label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shunil_gongopaddhay
থেকে কত দূরে চলে এসেছে ভরত। সে হেসে উঠল আপন মনে। বালিকা বধূটিকে কোন স্কুলে পাঠানো হবে, তাই নিয়ে সরলা ও বিবির মধ্যে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। সরলা পড়ে বেথুন স্কুলে, বিবি লোরেটা হাউজে। দু’জনেরই ধারণা, যার যার নিজের স্কুলটিই বেশি ভালো। বেথুন স্কুল বাঙালি পাড়ায় বাংলা-মাধ্যম, আর লোরেটো হাউজ সাহেব পাড়ার ইংরেজি স্কুল, সেখানে বাঙালি ছাত্রীর তুলনায় ফিরিঙ্গি ছাত্রীই বেশি। বেথুনের অনেক ছাত্রী এখন সমাজের নাম-করা মহিলা। এই তো গত বছরেই বেথুনের একটি ছাত্রীকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে অবলা দাস নামে মেয়েটি ঠিক করেছিল ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রীদের নেয়া হয় না। কিন্তু অবলার দাবি, কেনো সে ডাক্তারি পড়তে পারবে না? শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মাদ্রাজের মেডিকেল কলেজে। অবলার জেদ দেখে বাঙলা সরকার তার জন্য কুড়ি টাকার মাসিক বৃত্তিরও অনুমোদন করেছে। দেশের কোথায় কি আন্দোলন হয়, বেথুন কলেজে তার প্রভাব পড়ে। ইলবার্ট বিলের সময় সাহেবরা যখন এ দেশীয় মানুষদের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে যা-তা করা প্রচার করতে লাগল, তখন কামিনী সেন নামে একটি তেজস্বিনী ছাত্রীর নেতৃত্বে বেথুনের মেয়েরা বিক্ষোভ জানিয়েছিল। সুরেন বাড়ুজ্যের যেদিন জেল হল, সেদিন বেথুনের সব ছাত্রী হাতে কালো ফিতে বেধে এসেছিল স্কুলে। লোরেটো হাউজে এসব কিছুই হয় না। সেখানে স্বদেশিয়ানা নিষিদ্ধ। প্রভু যিশুর জয়গান করে নিয়মিত প্রার্থনা করতে হয়। ছাত্রীরা ভালো ইংরেজি শেখে। বিলিতি আদব-কায়দায় রপ্ত হয়, পাস করার পর তারা বড় বড় ব্যারিস্টারের পত্নী হিসেবে বেশ মানিয়ে যায়। বিবির বয়েস এখন দশ বছর, সরলার এগারো। এই মামাতো-পিসতুতো দুই বোনের মধ্যে যেমন বেশ ভাব, তেমন মাঝে মাঝে তর্কও হয় খুব। এই বয়েসেই সরলার মনে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে রাগ-রাগ ভাব এসেছে। প্রায়ই সে আবৃত্তি করে, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়। নতুন বউ ওদেরই বয়েসী, কিন্তু এই পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী তাকে কাকিমা বা মামী বলতে হবে। এক এক সময় বিবি আর সরলা তার কাছে ছুটে গিয়ে দু’জনে দুই হাত ধরে বলে, তুমি কার ইকুলে ভর্তি হবে বলো! আমারটা ভালো নয়। নতুন বউয়ের আড়ষ্টতা এখনও কাটেনি। এমনকি তার বিবাহ-উত্তর নাম যে মৃণালিনী তাও মনে থাকে না, এখনও যেন সে যশোরের গ্রাম মেয়ে ভবতারিণী। এত বড় একটা প্রাসাদ, এত মানুষজন, এত দাস-দাসী, এর মধ্যে তার দিশেহারা অবস্থা। ঠিক যেন রূপকথার মতন, কুঁড়েঘর থেকে সে রাজবাড়ির বধূ হয়ে চলে এসেছে। রাজপুত্রেরই মতন রূপবান তার স্বামী, তবু তার সঙ্গে এখনও ভালো করে ভাবই হল না। হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীর কাছে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, নীপময়ী তাকে এ বাড়ির রীতিনীতি শেখাচ্ছেন। বিয়ের দিনের পরেও কয়েকদিন উৎসবের রেশ থাকার কথা, কিন্তু বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। রবির বিবাহের রাত্রেই শিলাইদহে তার বড় সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলির হঠাৎ হৃদরোগে মৃত্যু হয়। বড় দিদি সৌদামিনী রবির প্রায় মায়ের মতন, তিনিই এই সংসারের কর্ত্রী। তিনি আবার এই সময়টায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে, খবর পেয়ে তিন দিন আগে পৌঁছেছেন। মূৰ্ছা যাচ্ছেন ঘন ঘন। বাড়িতে সবাই এখন ফিসফিস করে কথা বলে। একমাত্র বাচ্চারাই-এ নিয়ম মানে না। রবির স্ত্রী কোথায় শিক্ষা গ্ৰহণ করবে, তা নিয়ে বিবি-সরলার তর্কের তো কোনও মূল্যই নেই। আসল সিদ্ধান্ত নেবেন। জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি নিয়েও ফেলেছেন। এবারে তাদের জন্য সার্কুলার রোডে আরও বড় একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, মৃণালিনী সেখানেই তাঁর কাছে থাকবে। সে বাড়ি থেকে লোরেটো হাউজ বেশি দূর নয়, বিবির সঙ্গেই যেতে পারবে এক গাড়িতে। শাড়ি-টাড়ি চলবে না, উত্তম বিলিতি কাপড় কিনে স্কার্ট বানানো হতে লাগল তার জন্য। এ ব্যবস্থা অনেকেরই মনঃপূত হল না। কাদম্বরীর বড় সাধ ছিল স্ত্রী তার সঙ্গিনী হবে। তিনি তাঁর মনের মতন করে মেয়েটিকে গড়ে তুলবেন। রবির জন্য আলাদা একটি মহল নির্দিষ্ট হয়েছে। সাজানো-গোছানোও হয়েছে বেশ সুন্দরভাবে, নতুন বউ সেখানে না থেকে অন্য বাড়িতে চলে যাবে কেন? বেথুন স্কুল এ বাড়ির আরও তিনটি মেয়ে পড়তে যায়, এখানে থেকে ওই স্কুলে পাঠানোর তো কোনও অসুবিধে ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনীর নিজের ছেলে-মেয়ে আছে, কাদম্বরীর যে আর কেউ নেই, রবির বউকেও কেড়ে নেবেন জ্ঞানদানন্দিনী? বাড়ি ভর্তি মানুষ এখন গমগম করছে, রবির সঙ্গে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ নেই। অন্যদের সামনেই কাদম্বরী রবিকে সহজভাবে জিজ্ঞেস করলেন, রবি, ছোট বউকে বেথুনে পড়ালেই ভালো হত না? তুমি বাংলার কবি, তোমার বউ যাবে ইস্কুলে? রবি বিব্রতভাবে বললে, মেজ বউঠান যে ঠিক করলেন… নীপময়ীও সেখানে উপস্থিত। তিনি বললেন, ও রবি, তোর বউ যে একটি অক্ষরও ইংরেজি জানে না। আমি কথা বলে দেখছি তো, প্রাইমারী ইকুলে বাংলা একটু-আধটু শিখেছে বটে, ইংরেজির অক্ষরজ্ঞানও নেই। ও লোরেটোর ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে বসে পড়াশুনো করতে পারবে? এক্ষুনি ইস্কুলে পাঠাবারই বা দরকার কী? আমাদের কাছেই থাক না, আমরাই প্রথমটা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেব। রবি বলল, তোমরা একটু মেজ বউঠানকে বুঝিয়ে বলো না। এ কথা? নীপাময়ী ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, তোর বউয়ের ব্যাপারে আমরা বলতে যাব কেন রে? তুই নিজের বলতে পারিস नां। রবির মুখ দেখেই বোঝা গেল, জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে এরকম প্রস্তাব তোলার সাহস সে সঞ্চয় করতে পারবে না। কাদম্বরী নিঃশব্দে একটা ছায়ার মতন সরে গেলেন সেখান থেকে। বেথুন ইস্কুল বাংলার গর্ব। কত বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ও এদেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিদ্যাসাগর
false
humayun_ahmed
এতে ভয় কমে যায়। বল একটা গল্প।’ ‘তুমি বল।’ আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী ও তিনটি ইহুদি ও তিনটি মেয়ের গল্প বলল। গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়–পাদ্রী তখন কী বলল? এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না রানু। সে কি শুনছে না? আনিস ডাকল, ‘এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল না। বাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল। আনিস বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি যেও না। খবরদার, যেও না!’ ‘কী আশ্চর্য, কেন?’ ‘একটা-কিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।’ ‘কী যে বল!’ ‘প্লীজ, প্লীজ।’ রানু কেদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’ ‘কীসের গন্ধ?’ ‘কর্পূরের গন্ধের মতো গন্ধ।’ এটা কি মনের ভুল? সু্‌ক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে। ঝনঝন করে আরেকটা কাঁচ ভাঙল। রানু বলল, ‘ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?’ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না। ‘তুমি বস তো। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।’ ‘না তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।’ আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তো!’ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, ‘কোনো দোয়া-টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি। আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’ রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়-বড় হয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে-টেনে। ‘এই রানু, এই।’ কোনোই সাড়া নেই। আনিস হ্যারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইঁদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালো লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব।’ রহমান সাহেব বোধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন। ‘কী ব্যাপার?’ ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ ‘কী হয়েছে?’ ‘বুঝতে পারছি না।’ ‘হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?’ ‘বুঝতে পারছি না।’ ‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।’ আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলো সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রোগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, ‘রানু।’ রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?’ ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘এখন কেমন অবস্থা?’ রানু অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?’ রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?’ ‘ভালো।’ রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন আমি ভালো।’ রহমান সাহেব তবু মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, ‘আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?’ ‘সে তো রোজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত।’ ‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’ ‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।’ ‘তাই নাকি?’ ‘জ্বি। নতুন এসেছেন তো! কয়েক দিন যাক টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।’ ‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন না কি এক কাপ?’ ‘আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবেন।’ ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, ‘এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!’ ‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্র লোককে ডাকলাম।’ ‘কী করেছিলাম আমি?’ ‘অনেক কান্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল।’ ‘ভালো।’ ‘কী রকম ভালো? ‘বেশ ভালো।’ ‘ভয় লাগছে না আর?’ ‘নাহ।’ রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবসা করছে। ‘সকালে যা করার করবে। এখন এসব রাখ তো।’ ‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না!’ ‘হোক, এস তো এদিকে।’ রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল। ‘এখন আর তোমার ভয় লাগছে না?’ ‘না।’ ‘জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?’ ‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।’ আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?’ ‘চা, এত রাতে!’ ‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।’ রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?’ রানু জবাব দিল না। আনিস বলল, ‘এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।’ ‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।’ ‘দেখি পাই কি না।’ ‘চায়ে চিনি হয়েছে তোমার?’ ‘হয়েছে। তুমি নিলে না?’ ‘নাহ, রাত-দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না।’ রানু হাই তুলল। আনিস বলল, ‘এখন বল তো তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত।’ ‘কোন স্বপ্নের কথা?’ ‘ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লোক।’ ‘কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!’ আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত-শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে
false
shomresh
হবে। ওই দেখুন ওর এক চোখ কানা। ডান দিকটা দিয়ে দেখতে পায় না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কানা কাক? অর্জুনের মনে পড়ে গেল। খোঁড়া শকুন, কালো বেড়াল সংগ্রহে এসে গেছে কিন্তু গোরক্ষনাথ এখনও কানা কাক খুঁজে পায়নি। মেজরকে ব্যাপারটা বোঝাতে হল। প্রথমে তিনি বললেন, যতসব গ্যাঁজাখোরের কাণ্ড তারপর বললেন, একে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমেরিকাতেও এখন দিন দিন গেঁজেল বেড়ে যাচ্ছে। যাকগে, কাকটাকে ধরতে চাও? গোরক্ষনাথ সবেগে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু। তা হলে ভাত নিয়ে এসো। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনই কাক ধরতেও সুবিধে হয়। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে ইগমি নামের একটি উপজাতি থাকে। খুব কম লোকই তাদের দেখা পায়। আমি ওদের কাছ থেকে পাখিরা শিখেছিলাম। আফ্রিকা একটি বিশাল মহাদেশ। তার কিছুটা নাকি এখনও অনাবিষ্কৃত, সেখানে ইগমি নামের উপজাতি থাকতেই পারে। সন্দেহ প্রকাশ করে কোনও লাভ নেই। হাবুকে বলে কিছুটা শুকনো ভাত জোগাড় করা হল। কিন্তু মেজর যে কায়দাটা করল তা পশ্চিমবাংলার শিশুরাও জানে। একটা বড় ঝুড়ি খাড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। ভাত রাখা হল ঝুড়ির সামনে। দড়িটা লম্বা। সেটার প্রান্ত ধরে মেজর আড়ালে চলে গেলেন। কাকটা অনেকক্ষণ একচোখে যাচাই করল। কোনও কাককে অতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখেনি অর্জুন। শেষ পর্যন্ত লোভ প্রবল হওয়াতে কাকটা উঁচু কার্নিস থেকে নেমে এল ঝুড়ির সামনে। এক পা দু পা করে ভাতের কাছে পৌঁছে গিয়ে খপ করে কিছুটা তুলে লাফিয়ে সরে এল ঝুড়ির আওতা থেকে। ঝুড়ি পড়ল না, কোনও বিপদ ঘটল না দেখে বোধহয় কাকটার সাহস বাড়ল। এগিয়ে গিয়ে গপগপ করে ভাত খেতেই মেজরের দড়ির টানে ঝুড়িটা পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। কাকটা ধরা পড়ে গেছে। গোরানসাহেব কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেউ টের পায়নি। এবার তিনি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী? অর্জুন তাঁকে গোরক্ষনাথের সাধনার জন্যে যেসব সামগ্রীর প্রয়োজন, সেটা ব্যাখ্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোরানসাহেবের। ঝুড়ির পাশে উবু হয়ে বসে লক্ষ করছিল গোরক্ষনাথ, তিনি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তুমি সত্যি বলছ? গোরক্ষনাথ মুখ তুলে সাহেবকে দেখে দু হাত নাড়ল, নো ইংরেজি। মেজর বাংলায় অনুবাদ করলে সে দ্রুত মাথা নাড়ল, ইয়েস ইয়েস। দেন হি উইল গো উইদ আস। মেজরের কাছে বাংলা শুনে গোরক্ষনাথের মুখ চুপসে গেল, আমাকে ছেড়ে দিন সাহেব। এত কষ্টে কাকটাকে পেয়েছি, এখন এখানে আমার ডিম্যান্ড বেড়ে যাবে। কত টাকা রোজগার করো দিনে? প্রতিদিন তো হয় না। তেমন খদ্দের পেলে সেটা হয়। গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, ও বাবু, ওঁদের একটু বুঝিয়ে বলুন না! অর্জুন বলল, কিন্তু গোরক্ষনাথ, আপনার এখানে থেকে কোনও লাভ হবে না। কেন? পুলিশ তো বেড়ালটাকে নিয়ে যাবে। আর একটা বেড়াল জোগাড় না করা পর্যন্ত! তার চেয়ে এঁরা যা বলছে শুনুন। পুলিশের চোখের সামনে থেকে চলে গেলে তারাও হয়তো আপনাকে ভুলে যাবে। কদিন বাদে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ফিরে আসবেন। অর্জুনের কথাটা বোধহয় মনে ধরল গোরক্ষনাথের। তারপর একটু ভেবে বলল, আমার মুশকিল হল ওই বুড়িটাকে নিয়ে। আমি চলে গেলে কে ওকে দেখবে? কে ওর বাজার করে এনে দেবে? আচ্ছা, কদ্দূর যেতে হবে? হাসিমারার কাছে। অ। ঠিক আছে, পাড়ার একটা ছেলেকে বলে দেখি। কিছু পয়সা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। গোরানসাহেব বুঝলেন গোরক্ষনাথ খুশি হয়েছে। উনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে গোরক্ষনাথের হাতে গুঁজে দিলেন। এবার অর্জুন এগিয়ে এল ঝুড়িটার দিকে, কিন্তু গোরক্ষনাথ, মানলাম এই কাকটা কানা। কিন্তু আপনি বলেছিলেন ওকে জন্মাতে হবে কানা হয়ে। এই কাকটা যে সেই শ্রেণীর তা বুঝলেন কী করে? দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। গোরক্ষনাথ তার জামাটা খুলে ফেলল। ডান হাত জামার ভেতর ঢুকিয়ে ঝুড়িটাকে সামান্য তুলে খানিকটা চেষ্টার পর কাকটাকে ধরে ফেলল। তারপর ঝুড়ি সরিয়ে ওটা বের করতে কাকটা আর্তনাদ শুরু করল। বাঁ হাতে ওর মুখ চেপে ধরে কানা চোখটাকে অর্জুনের সামনে নিয়ে এল সে, দেখুন বাবু, চোখটা একদম সাদা। কোনও খোঁচা খেয়ে কানা হলে আশেপাশের জায়গা ফুলে থাকত। চোখের মণিও অন্যরকম দেখাত। এ একেবারে আমার জন্যই এখানে বসে অপেক্ষা করছিল। তা হলে আমি যাই? অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ঠিক করলেন? আজই যাবেন, না কাল ভোরে রওনা হবেন? মেজর গোরানসাহেবকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, এখানে খামোকা সময় নষ্ট করে কী লাভ? অর্জুন জানাল, কিন্তু তৈরি হয়ে হাসিমারায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। বরং শহরে থেকে আর একটু প্রস্তুতি নিয়ে গেলে ভাল হয়। সেই সিদ্ধান্ত হল। গোরক্ষনাথ তার সাধনার সামগ্রী নিয়ে সকাল সাতটার সময় জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। গোরক্ষনাথ চলে গেলে অর্জুন মালপত্রগুলো ভাল করে দেখল। মেজর এখান থেকেই চাল ডাল নুন কিনে নিয়ে যেতে চান। যদি জঙ্গলের গভীরে থাকতে হয় টেন্ট পেতে, তখন দরকার হবে। অর্জুন জানতে চাইল, রাঁধবে কে? কেন? আমি কি মরে গেছি? বছর তিনেক আগে উত্তরমেরুর একটা ইলুতে বসে সিল দ্য মাঞ্চুরিয়ান রান্না করেছিলাম। ওঃ, তোমাকে কী বলব অর্জুন, তাই খেতে এত এস্কিমো জড়ো হয়েছিল যে, ইগলুতে বসে ঘামতে হয়েছিল আমাকে। মনে হয়েছিল ফ্যান থাকলে ভাল হত। মেজর স্বর্গীয় হাসি হাসলেন, যেটা তাঁর গোঁফদাড়ির জঙ্গল ছাপিয়েও দেখা গেল। ঘামতে হয়েছিল কেন? বেশি
false
humayun_ahmed
বললাম, আপনি ওর গায়ে হাত দিলেন কেন? ষণ্ডাগণ্ডা টাইপের লোক। লাল চোখ। গরিলাদের মতো লোম ভরতি হাত। সে এমন ভাব করল যে আমার কথাই শুনতে পায় নি। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল—দেখি একটা লেবু চা। তখন আমি খপ করে তার হাত ধরে ফেললাম। সে ঝটিকা দিয়ে তার হাত ছড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই আমি তার হাত কামড়ে ধরলাম। যাকে বলে কচ্ছপের কামড়। কচ্ছপের কামড় কী তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। কচ্ছপ একবার কামড়ে ধরলে আর ছাড়ে না, আমিও ছাড়লাম না। আমার মুখ রক্তে ভরে গেল। লোকটা বিকট চিৎকার শুরু করল। ব্যাপারস্যাপার দেখে বোরকাওয়ালী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এর পর থেকে আমার টাইটেল হয়েছে সাদা বাঘিনী। গল্প শেষ করে সায়রা বানু খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি মেয়েটির হাসির মাঝখানেই বললেন, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? গল্প করার জন্যে এসেছি। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি বিখ্যাত মানুষ? অবশ্যই বিখ্যাত। আপনাকে নিয়ে কত বই লেখা হয়েছে। আমি অবিশ্যি একটা মাত্র বই পড়েছি। ওই যে সুধাকান্ত বাবুর গল্প। একটা মেয়ে খুন হল আর আপনি কেমন শার্লক হোমসের মতো বের করে ফেললেন–সুধাকান্ত বাবুই খুনটা করেছেন। বই পড়ে মনে হচ্ছিল। আপনার খুব বুদ্ধি কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। আমাকে দেখে কেমন মনে হচ্ছে? খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। আপনার মধ্যে একটা গৃহশিক্ষক গৃহশিক্ষক ব্যাপার আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি নিয়মিত বেতন পান মা এমন একজন অংকের স্যার। আপনি রোজ ভাবেন আজ বেতনের কথাটা বলবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারেন না। আচ্ছা। আপনি এমন গভীর মুখে বসে আছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে মজা তো পাচ্ছেনই না উল্টো বিরক্ত হচ্ছেন! সত্যি করে বলুন আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? কিছুটা হচ্ছি। মাছিটা তো এখন আর বিরক্ত করছে না। কেমন শান্ত হয়ে টেবিলে বসে আছে। তারপরেও আপনি এত বিরক্ত কেন বলুন তো? তুমি অকারণে কথা বলছ এই জন্যে বিরক্ত হচ্ছি। অকারণ কথা আমি নিজেও বলতে পারি না অন্যের অকারণ কথা শুনতেও ভালো লাগে না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে হলে সব সময় একটা কারণ লাগবে? তা হলে তো আপনি খুবই বোরিং একটা মানুষ। এত কারণ আমি পাব কোথায় যে আমি রোজ রোজ আপনার সঙ্গে কথা বলব? মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি রোজ রোজ আমার সঙ্গে কথা বলবে? হুঁ। সে কী, কেন? সায়রা বানু খুব সহজ ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, এক বাড়িতে থাকতে হলে কথা বলতে হবে না? এক বাড়িতে থাকবে মানে? আমি বুঝতে পারছি না। আমি আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকব। কদিন এখনো বলতে পারছি না। দু দিনও হতে পারে আবার দু মাসও হতে পারে। আবার দু বছরও হতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার উপর। মিসির আলি চেয়ার থেকে পা নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। হচ্ছেটা কী? এই যুগের টিনএজার মেয়েদের ভাবভঙ্গি, কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। তারা যে কোনো উদ্ভট কিছু হাসিমুখে করে ফেলতে পারে। মেয়েটি হয়তো অতি তুচ্ছ কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিংবা তাকে ভড়কে দেবার জন্যে গল্প ফেঁদেছে। পরে কলেজে বন্ধুদের কাছে এই গল্প করবে। বন্ধুরা মজা পেয়ে একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে।–ও মাগো বুড়োটাকে কী বোকা বানিয়েছি! সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে আমি থাকতে এসেছি। মিসির আলি নিজের বিস্ময় গোপন করে সহজভাবে বললেন, তুমি এ বাড়িতে থাকবে? জি। বিছানা বালিশ নিয়ে এসেছ? বিছানা বালিশ আনি নি। আজকাল তো আর বিছানা বালিশ নিয়ে কেউ অন্যের বাড়িতে থাকতে যায় না। শুধু একটা সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ এনেছি। আর একটা পানির বোতল। সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ কোথায়? বারান্দায় রেখে এসেছি। শুরুতেই আপনি আমার সুটকেস দেখে ফেললে ঢুকতে দিতেন না। যাই হোক আমি এখন আমার সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আসছি। আচ্ছা! আপনি এমন ভাব করছেন যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু হয় নি। বিপদগ্ৰস্ত একজন তরুণীকে কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেয়া এমন কোনো বড় অন্যায় না। আমি নিশ্চিত এরচে অনেক বড় বড় অন্যায় আপনি করেছেন। তুমি সত্যি সত্যি আমার এখানে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছ? জি। মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। এই মুহুর্তে তাঁর ঠিক কী করা উচিত তা মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেয়েটির কোণ্ডকারখানা, দৈখাই মনে হয়। সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। এই পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন বা করতে পারেন। সেই সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সে নিশ্চয়ই করেছে। নিজেকে সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্যে সে প্রস্তুত করে রেখেছে। মিসির আলির এমন কিছু করতে হবে যার সম্পর্কে মেয়েটির প্রস্তুতি নেই। সে কেন বাড়ি ছেড়ে এসেছে এই মুহুর্তে তা তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কারণ এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক এবং সঙ্গত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তৈরি করে রেখেছে। তাঁর বিস্মিত হওয়াও ঠিক হবে না। তাঁকে খুব সহজ এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে। যেন এমন ঘটনা প্রতি সপ্তাহেই দুটা-একটা করে ঘটছে। সায়রা বানু সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন সে গুনগুন করে কী একটা গানের সুরও যেন ভাজছে। কত সহজ স্বাভাবিক তার আচরণ। কেক খাবেন? কেক? হুঁ। আমার নিজের
false
humayun_ahmed
হত! আবার চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। যেন বাইরের উথালপাথাল চাঁদের আলোর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে-শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জামগাছের পাতায় সরাসরি শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা-হা করে ওঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষন্নতাই না অনুভব করি! জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি। *শঙ্খনীল কারাগার রফিক কায়সারের একটি কবিতার নাম। কবির অনুমতিক্রমে নামটি পুনর্ব্যবহৃত হল। পূর্বকথা আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মোহনগঞ্জে, আমার নানার বাড়িতে। ছায়াময় একটি বাড়ি, পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর সারদেয়াল–পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। সব কিছুই রহস্যময়। সন্ধ্যাবেলায় সারদেয়ালে ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটাহাঁটি করে। গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ভূতে ঢিল মারে। কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। অশরীরী কিছু যন্ত্রণা তো করবেই। এদেরকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। মূলবাড়ি থেকে অনেক দূরে বিশাল এক তেঁতুলগাছের পাশে টাট্টিখানা। সন্ধ্যার পর যারা টাট্টিখানায় যায় তারা না-কি প্রায়ই তেঁতুলগাছে পা বুলিয়ে পেততুনি বসে থাকতে দেখে। দিনমানে অন্য দৃশ্য। বাড়ির কাছেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠভর্তি বক। আমার নানাজান আবুল হােসেন শেখ দোনলা বন্দুক হাতে বক শিকারে বের হন। আমি তাঁর সঙ্গী। ছররা বন্দুকের গুলি হলো। অনেকগুলি বিক একসঙ্গে মারা পড়ল। তাদের গায়ের ধবধবে পালক রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে–আমি চোখ বড় বড় করে দেখছি। মাথার উপর মৃত বকদের সঙ্গীরা ট্যা ট্যা শব্দে ঘুরছে, অদ্ভুত সব দৃশ্য। নানার বাড়ির স্মৃতি মাথায় রেখেই লীলাবতী উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই সময়ের রহস্যময়তাকে ধরার চেষ্টা। লেখাটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল অন্যদিন পত্রিকায়। কোনো ধারাবাহিক লেখাই আমি শেষ করতে পারি না। খেই হারিয়ে ফেলি। আগ্রহ কমে যায়। লীলাবতীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। একসময় লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, ভালো লেখা যত্ব নিয়ে লিখতে হয়, তাড়াহুড়া করা যায় না। তুমি মন খারাপ করো না। একসময় এই লেখা আমি শেষ করব। আমি আমার কথা রেখেছি। বইমেলায় লীলাবতী বের করতে পেরে মাজহার নিশ্চয়ই খুশি। আমিও খুশি। লেখাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন ঘাড়ে চেপে ছিল— এখন নেমে গেছে। লীলাবতী উপন্যাসের সব চরিত্ররা ভালো থাকুক। তাদের প্রতি এই আমার শুভকামনা। হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লী, গাজীপুর ০১. রেললাইনের উপর একটা বক বসে আছে। মেছো বাঁক। এ ধরনের বক বিলের উপর উড়াউড়ি করে। অল্প পানিতে এক ঠ্যাঙ ড়ুবিয়ে মাছের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ডাঙায় আসার কথা না। আর যদি আসেও গম্ভীর ভঙ্গিতে রেললাইনে বসে থাকার কথা না। সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে বকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর ঘটনাটা কী? এ কী চায়? বকটা ধবধবে সাদা। পানির বকের পালক সাদাই হয়। সারাক্ষণই পানিতে ডোবাড়ুবি করছে। পালকে ময়লা লেগে থাকা? কোনো কারণ নেই। ডাঙার বকের পালক এত সাদা না— বাদামি রঙ। মেছো।ক পানিতে যেমন এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনের উপরও এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাথ, নড়াচ্ছে না, শরীর নড়াচ্ছে না, স্থির দৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমানের বিস্ময় আরো প্রবল হলো, বকটা কী দেখছে? বিলের পানিতে এভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অর্থ আছে— মাছের গতিবিধি লক্ষ করা। এখানে বকটার একদৃষ্টিতে রেললাইনের পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী? সে কি রেললাইনের পাথর দেখছে? ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেন চলে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। ঘন জংলায় আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেন দেখা যাবে। বকটা এখনো নড়ছে না। রেললাইনের কম্পন তার অনুভব করার কথা। ধ্যান ভঙ্গ হবার সময় এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান বুকের ভেতর সামান্য চাপ অনুভব করলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার এরকম হয়। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। রেলের ইঞ্জিনটা এখন দেখা যাচ্ছে। কয়লার ইঞ্জিন। বুনকা বুনকা ধোঁয়া ছাড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! বকটাকেও দেখা যাচ্ছে। বক আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সিদ্দিকুর রহমান অস্থির বোধ করলেন। হুশ! হুশ! শব্দ করে বকটাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু গলা কেমন যেন আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ ব্যথা। তিনি তাকালেন রেলের ইঞ্জিনের দিকে। ভালো স্পিড দিয়েছে। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে বকটার দিকে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। গাঢ় ঘুমে তার চোখের পাতা নেমে এসেছে। চারদিকে অদ্ভুত এক শান্তি-শান্তি নীরবতা। বাতাস মধুর ও শীতল। বুকের ব্যথাটা নেই। নিঃশ্বাসের কষ্ট নেই। একসময় তিনি চোখ মেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাঠের উপর তিনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। তার বাঁ-দিকে প্ৰকাণ্ড শিমুল গাছ। গাছটার ছায়া পড়েছে তাঁর শরীরে। ছায়াটা এমনভাবে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি একটা ছায়ার চাঁদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখের সামনে আশ্বিন মাসের মেঘশূন্য আকাশ। আকাশে দুটা চিল উড়ছে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়ছে। তাদের দেখাচ্ছে বিন্দুর মতো। তিনি উঠে বসলেন। ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও না। রেললাইনের উপর বকটা দাঁড়িয়ে নেই। সে ট্রেনের নিচে চাপাও পড়ে নি। চাপা পড়লে তার রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমান দুই হাতে ভর দিয়ে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছে। রেললাইনের ওপাশের জলে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা ক্যাচ ক্যাচি পাখি তার পায়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে।
false
humayun_ahmed
বললাম, না। শেষটা দেখব। তোমার লজ্জা বোধ করার কোন কারণ নেই মা। ভেবে নাও রাস্তার কোনো নগ্ন পাগল। তাছাড়া ফরহাদ সাহেব নগ্ন হবার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা হবে। কী ব্যবস্থা হবে? কী ব্যবস্থা হবে আমি জানি না, কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা হবে। ফরহাদ সাহেব টান দিয়ে জিপার পুরোপুরি খুলে ফেলেছেন। জিপারের ফাঁক দিয়ে তার লাল আন্ডারওয়ার দেখা যাচ্ছে। ছেলেরা এমন লাল টুকটুক আন্ডার ওয়ার পরে আমি জানতাম না। আমি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকালাম। ঘটনাটা তিনি অনেক দূর এগুতে দিয়েছেন। এতদূর এগুতে দেয়া ঠিক হয় নি। আমি হলে দিতাম না। ডিরেক্টর সাহেব সিগারেট ধরালেন। তারপর সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে মওলানা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন–মওলানা সাহেব একটু শুনুন তো। কাছে আসুন। মওলানা সাহেব এগিয়ে গেলেন। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আপনি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে পারবেন? মওলানা বললেন, অবশ্যই পারব জনাব। ফরহাদ নামের এই বদ মানুষটাকে আমি এমন এক শাস্তি দিতে চাই যা তার দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আপনি এর কানে ধরে পুরো মাঠের চারদিকে একবার চক্কর দেয়াবেন। এই দৃশ্যটা আমরা ক্যামেরায় ধরে রাখব। পারবেন না? জনাব, আপনি হুকুম দিলে পারব। ইনশাল্লাহ। ফরহাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিছু বলতে গেলেন— বলতে পারলেন। আমি তাকালাম ডিরেক্টর সাহেবের দিকে–তাঁর মুখ হাসিহাসি। তার চোখ কঠিন হয়ে আছে। এমন কঠিন চোখ সচরাচর দেখা যায় না। মা আমার হাত খামচে ধরে বললেন, কী হবে রে? আমি জবাব দিলাম না। লক্ষ্য করলাম সোহরাব চাচা এগিয়ে এসে ফরহাদ সাহেবের কানে-কানে কী যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরহাদ সাহেবের মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। জোঁকের মুখে নুন পড়ার অবস্থা। এতক্ষণ যে মানুষটা হৈচৈ চিৎকার করছিল সে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। বেঁটেখাটো মেরাজ মাস্টার এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি কি এই মানুষটাকে কান ধরে মাঠের চারপাশে চক্কর খাওয়ানো হবে? ফরহাদ সাহেব তার প্যান্টের খোলা জিপার টান দিয়ে তুলে বিড়বিড় করে বললেন–মঈন ভাই, আমার ভুল হয়েছে। মাফ করে দেন। সকাল থেকে বিয়ার খাচ্ছি যা করেছি নেশার ঝেকে করেছি। ডিরেক্টর সাহেব গলা উঁচিয়ে বললেন–স্টিল ক্যামেরাম্যান কোথায়? কানে ধরে দৌড়ানোর ছবি তুলে রাখ। ক্যামেরা ইউনিট কি কাশবনে চলে গেছে? সোহরাব চাচা বললেন, জ্বি স্যার। আর্টিস্ট? আর্টিস্ট গিয়েছে? বলেই তিনি আমাকে দেখলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন–চল যাই, দেরি হয়ে গেল তো। মেকাপম্যান কোথায়? তাকেও যেতে হবে। ফরহাদ সাহেবের সামনে এসে মেরাজ মাস্টার দাঁড়িয়েছেন। কানে হাত দেবেন কি দেবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। তিনি আবারো তাকালেন ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব বাদ দিন। একে এই জংলা মাঠের চারদিকে কানে ধরে ঘোরালে কিছু হবে না। একে ঘোরাতে হবে এফডিসির চারদিকে। এই কাজটা আমি ঢাকায় গিয়ে করব। মেরাজ মাস্টার বললেন, স্যার, আমি কি শুটিং দেখার জন্যে আপনাদের সঙ্গে আসব? ডিরেক্টর সাহেব বললেন, অবশ্যই আসবেন। আপনি বিসমিল্লাহ বলে ক্যামেরায় ফু দিয়ে দেবেন, তারপর ক্যামেরা ওপেন হবে। তার আগে না। চারপাশের পরিবেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শুধু ফরহাদ সাহেব ঘামছেন। খুব ঘামছেন। তিনি যে হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে। সোহরাব চাচা কানে-কানে কথা বলার পর থেকে পরিবর্তনটা হয়েছে। কানে-কানে বলা কথাগুলি কী? সোহরাব চাচা কি আমাকে বলবেন? মনে হয় না। তিনি হড়বড় করে সারাক্ষণ কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু গোপন কথা গোপনই রাখেন। মানুষটাকে হয়তো এই কারণেই সবার ভাল লাগে। যে কথাগুলি ম্যাজিকের মত কাজ করল, সেই কথা সোহরাব চাচা আগে কেন বললেন না! আমরা কাশবনের দিকে রওনা হয়েছি। মা যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। তার এমন অসুস্থ শরীর — আমি জানি আজ শুটিং শেষে তিনি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হবেন। না গেলে চলত, কিন্তু তিনি যাবেনই। মা লেফট রাইটের ভঙ্গিতে দ্রুত পা ফেলছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা যে তিনি মোটেই অসুস্থ না। খুব সুস্থ। তিনি হাঁটছেন ডিরেক্টর সাহেবের পাশে পাশে। আমি পিছিয়ে পড়েছি। আমার পাশে পাশে আসছেন মেরাজ মাস্টার। ভদ্রলোক আজ সেজেগুজে এসেছেন। চোখে সুরমা। পায়জামা ইস্ত্রি করা। আমাদের সঙ্গে দুজন ছত্রধর যাচ্ছে। একজনের হাতে সবুজ রঙের বিশাল ছাতি। এই ছাতি ডিরেক্টর সাহেবের মাথায় ধরার কথা। ডিরেক্টর সাহেব ইশারায় নিষেধ করেছেন বলে ছাতা ধরা হয় নি। ছাতাটা ধরলে ভাল হত, মা খানিকটা ছায়া পেতেন। আমার মাথায় উপর ছাতা ধরা আছে। আমি ভদ্রতা করে নিষেধ করি নি। ছায়া আমার প্রয়োজন। কড়া রোদে মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্যি আমার ধারণা মেকাপ নষ্ট হলেও ক্ষতি নেই। পুরো দৃশ্যটা লং শটে ধরা থাকবে। এতদূর থেকে পরিষ্কার কিছু দেখতে পাওয়ার কথা না। মা, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? জ্বি চিনেছি। আপনি মেরাজ মাস্টার। আপনাদের সঙ্গে যে যাচ্ছি খুবই ভাল লাগছে। সবাই কেমন হৈচৈ করতে করতে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে থাকার মজাই আলাদা। জ্বি। আপনাদের ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কয়েকবার আলাপ হয়েছে— বিশিষ্ট ভদ্রলোক। এরকম বিশিষ্ট ভদ্রলোক সচরাচর দেখা যায় না। অতি অমায়িক। জ্বি। এ স্যারের সঙ্গে কফি খেয়েছি। নানান বিষয় নিয়ে আলাপও হয়েছে। ধর্ম বিষয়েও স্যারের জ্ঞান অতি উচ্চ শ্রেণীর। ধর্ম নিয়ে আপনারা আলাপ করলেন? উনিই আলাপ করলেন, আমি শুধু শুনলাম, আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও কম, পড়াশোনাও কম। ও আচ্ছা। শৈশবকালে হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। পাক কোরান মুখস্থ করেছিলাম। করেছিলাম বলছেন কেন? এখন মুখস্থ নাই? জ্বি না। স্মৃতি শক্তির
false
shordindu
হইয়া উঠিল। মনে যথেষ্ট কৌতূহল, কিন্তু সন্ন্যাসীর সম্মুখে হস্ত প্রসারিত করিতে লজ্জা করিতেছে। বীরশ্রী তখন জোর করিয়া তাঁহার বাঁ হাতখানি সাধুর সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিলেন। সাধু যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের দিকে একবার কটাক্ষপাত করিলেন, তারপর সম্মুখে ঝুঁকিয়া অভিনিবেশ সহকারে দেখিলেন। তাঁহার মুখে আবার ছাই-ঢাকা হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি যৌবনশ্রীর মুখের পানে মিটিমিটি চাহিয়া বলিলেন—রাজনন্দিনি, তোমার প্রিয়-সমাগমের আর বিলম্ব নেই। অদ্যই তুমি ভাবী পতির সাক্ষাৎ পাবে। যৌবনশ্রী অবাক হইয়া সন্ন্যাসীর মুখের পানে চোখ তুলিলেন। বীরশ্রী সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন—অ্যা—কি বললেন প্রভু? এই সময় বাধা পড়িল। সহসা পিছন হইতে একটি হাত আসিয়া যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের উপর ন্যস্ত হইল, একটি মন্দ্র-মন্থর পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল—সাধুবাবা, আমার হাতটা একবার দেখুন তো! চমকিয়া যৌবনশ্রী ঘাড় ফিরাইলেন। রাজকন্যার হাতের উপর হাত রাখে কোন্ ধৃষ্ট! যে মুখখানি যৌবনশ্রী দেখিতে পাইলেন তাহাতে একটু দুষ্টামিভরা হাসি লাগিয়া আছে, আরও কত কি আছে। চোখে চোখে দৃষ্টি বিনিময় হইল। যৌবনশ্রীর দেহ একবার বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত কাঁপিয়া উঠিল, সবেগে নিশ্বাস টানিয়া তিনি একেবারে রুদ্ধশ্বাস হইয়া গেলেন; তাঁহার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি নিজের প্রসারিত হাতখানি আগন্তুকের করতল হইতে সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেলেন। সন্ন্যাসী বিগ্রহপালের করকোষ্ঠী দেখিতেছিলেন, বলিলেন—বৎস, তুমি রাজকুলোদ্ভব– চুপ চুপ!—বিগ্রহপাল সচকিতে চারিদিকে চাহিলেন। ভাগ্যক্রমে কাছে পিঠে কেহ নাই। বীরশ্রী বিগ্রহপালের এই হঠকারিতায় চমৎকৃত হইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার ভয় হইল, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকিলে বিগ্রহ না জানি আরও কি প্রগতা করিয়া বসিবে। তিনি যৌবনশ্রীর হাত ধরিয়া টানিয়া লইলেন। বলিলেন—চল, যৌবনা, আমরা যাই। তন্দ্রাচ্ছন্নের মত যৌবনশ্রী সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। বীরশ্রী রথে উঠিয়া অশ্বের বৰ্গা হাতে লইলেন। যৌবনশ্রী রথে উঠিবার আগে আপনার অবশে একবার পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। প্রগম্ভ যুবক দুষ্টামিভরা মুখে তাঁহার পানেই চাহিয়া আছে। তিনি বিহ্বলভাবে রথে উঠিয়া পড়িলেন। রথ চলিতে আরম্ভ করিল। বীরশ্রী বলিলেন—আশ্চর্য সন্ন্যাসী! বোধহয় তান্ত্রিক। যৌবনশ্রী উত্তর দিলেন না। রথের গতি ক্রমশ দ্রুত হইল। আরও কিছুক্ষণ চলিবার পর যৌবনশ্রী প্রথম কথা বলিলেন। সম্মুখ দিকে চক্ষু রাখিয়া ঈষৎ স্খলিতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন—দিদি, ও কে? বীরশ্রী ভগিনীর প্রতি একটি তির্যক দৃষ্টি হানিলেন; তাঁহার অধরপ্রান্ত একটু স্ফুরিত হইল। যেন কিছুই বুঝিতে পারেন নাই এমনিভাবে বলিলেন—কার কথা বলছিস? সন্ন্যাসী ঠাকুরের? যৌবনশ্রী একবার দিদির পানে ভৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি ফিরাইলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন—বল না। কি বলব? বীরশ্রী মুখ টিপিয়া হাসি গোপন করিলেন—ও! যে তোর হাতে হাত রেখেছিল তার কথা বলছিস? তা—সে কে আমি কি জানি। আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া যৌবনশ্রী বলিলেন—বল না। বীরশ্রী হাসিয়া ফেলিলেন—বণিক। পাটলিপুত্র থেকে ব্যবসা করতে এসেছে। এবার যৌবনশ্রী অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। বীরশ্রী রথ চালাইতে চালাইতে একবার ঘাড় ফিরাইলেন, যৌবনশ্রীর চক্ষু দুটি বাষ্পকুল, অধর কাঁপিতেছে। বীরশ্রী অনুতপ্ত হইয়া বলিলেন—আচ্ছা আচ্ছা, বণিক নয় রাজপুত্র। এবার হল তো? ধন্যি মেয়ে তুই! কোথায় ভেবেছিলাম তোকে অনেক বোঝাতে পড়াতে হবে, অনেক কষ্টে রাজী করাতে হবে। তা নয়, একবার দেখেই মূছা! যৌবনশ্রী চক্ষু দুটি কিছুক্ষণ মুদিয়া রহিলেন; চোখের বাষ্প গলিয়া দুই বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িল। একবার দেখিয়া নিজেকে হারাইয়া ফেলা সকলের জীবনে ঘটে না। মানুষের সহিত মানুষের প্রীতি বড়ই বিচিত্র বস্তু। কখনও দেখা যায়, দীর্ঘ পরিচয়ের পর হঠাৎ একদিন মানুষ বুঝিতে পারিল—ওই মানুষটি না থাকিলে জীবন অন্ধকার। কখনও মনের মানুষ চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবার পর বুঝিতে পারে সে কী হারাইয়াছে। আবার কখনও মেঘমালার ভিতর হইতে তড়িল্লতার মত অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষ হৃদয়ে শেল হানিয়া দিয়া চলিয়া যায়, অন্তলোকে অলৌকিক ইন্দ্রজাল ঘটিয়া যায়। যাহারা যৌবনেন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়ের কথা চিন্তা করে, প্রেম লইয়া মনে মনে জল্পনা করে, তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেমের আবির্ভাব তেমন মারাত্মক নয়। কিন্তু যাহাদের মনের কৌমার্য ভঙ্গ হয় নাই তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই দারুণ; দুঃসহ জ্যোতিরুম্ফসে চক্ষু অন্ধ হইয়া যায়। রাজকুমারী যৌবনশ্রীর তাহাই হইয়াছিল। দুই রাজকুমারীরা রথে চড়িয়া চলিয়া গেলেন; অন্য রথটি এবং বাকি রক্ষীর দল তাঁহাদের পিছনে গেল। ঘাটের অঙ্গন শূন্য হইল। কেবল লম্বোদর অঙ্গনের অন্য প্রান্তে একটি ঘোড়ার রাশ ধরিয়া দাঁড়াইয়া অনঙ্গ ও বিগ্রহপালের উপর নজর রাখিল। অনঙ্গ এতক্ষণ সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসে নাই, একটু দূরে অপেক্ষা করিতেছিল; এখন বিগ্রহপালের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। বিগ্রহপাল তখনও বিলীয়মান রথের পানে চাহিয়া আছেন। অনঙ্গ বলিল—কি হল তোর? ধন্দ লেগে গেল নাকি? চমক ভাঙিয়া বিগ্রহপাল হাসিলেন। বন্ধুর পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন—দেখলি? অনঙ্গ বলিল—দেখলাম। অপরূপ সুন্দরী—না? হুঁ। কিন্তু এখন ত্রিপুরী যাবার উপায় কি? এই সময় সন্ন্যাসী ঠাকুর গলা খাঁকারি দিলেন। বিগ্রহপাল সন্ন্যাসীর কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এখন তাঁহার দিকে একবার চাহিয়া অনঙ্গকে বলিলেন—জানিস অনঙ্গ, সাধুবাবা একেবারে ত্রিকালদর্শী পুরুষ। আমার হাত দেখে বলে দিলেন, আমি রাজকুলোদ্ভব! অনঙ্গ সাধুবাবাকে ভাল করিয়া পরিদর্শন করিল, তারপর নিজের হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিল—বলুন তো সাধুবাবা, আমি কে? সাধুবাবা অনঙ্গের হাতের দিকে দৃকপাত করিলেন না, বলিলেন—তুমি অনঙ্গপাল। অনঙ্গ চমকিত হইল, আর একবার সাধুবাবাকে উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিল; তাহার মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটিয়া উঠিল—ও—আপনি জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেব। বিগ্রহপাল সবিস্ময়ে বলিলেন—অ্যাাঁ! আর্য যোগদেবের ভ্রাতা রন্তিদেব? সাধুবাবা ব্যগ্রস্বরে বলিলেন—চুপ চুপ, কেউ শুনতে পাবে।—তোমাদের জন্যে কাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। চারিদিকে লক্ষ্মীকর্ণের গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই ছদ্মবেশে এসেছি। কে জানতো যে লক্ষ্মীকর্ণ স্বয়ং এসে উপস্থিত হবে। যা হোক, আমি সঙ্গে দুটো ঘোড়া এনেছি, আর একটা গো-শকট। তোমরা
false
tarashonkor
উঠানে ধপ করে ফেলে পাখী তাড়াতাড়ি ঘর পূলে একটা নতুন কাঠের চৌকো টুল বার করে দিলে—বস মামা। বা-বাবা! এ যে টুল রে! বলিহারি বলিহারি! ভদ্রজনের কারবার করে ফেলাল করালী! পাখী ঘর থেকে একটা নতুন হারিকেন, একখানা নতুন সস্তা দামের শতরঞ্জি, একটা রঙচঙে তালপাতার পাখা এনে সামনে নামিয়ে দিয়ে বললে—এই দেখ, মানা করলে শোনে না; আজেবাজে জিনিস কিনে টাকা-পয়সার ছেরাদ্দ করছে। হা-হা করে হেসে বনওয়ারী বললেওরে বাবা, নতুন বিয়ের এই বটে। তার ওপরে বউ যদি মনে ধরে, তবে তো আর কথাই নাই। তা তোকে মনে ধরা তো ধরা—দুজনাতে মনের মানুষ। পাখী মুখে আঁচলটা দিয়ে হাসতে লাগল আমার কথা শুনে। বনওয়ারী উঠল, বললে—আসছিলাম তো বাড়িতেই। পথে পাড়াটাও ঘুরলাম, সব চাল দেখে এলাম। একটা পেচণ্ড ঝড়জল হবে লাগছে কিনা! তা তোদের ঘরে এসে দাঁড়ালাম, এমন ঝকমকে ঘরদোর দেখে দাঁড়াতে হল। যাই, এখন দেখিকার চালে খড় আছে কার চালে নাই। মাতব্বর হওয়ার অনেক ঝক্কি মা। পাখী বললে—ঝক্কি নিলেই ঝক্কি, না নিলেই ক্যা কি করবে? ওই তো আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বর অয়েছে পরম, সে ঝক্কি নেয়? এত সব খোঁজ করে? কার চালে খড় নাই, কার ঘরে খেতে নাই—দেখে বেড়ায়? কারও দোষ-গুণ বিচার করে? তুমি এই যে আমার ঘর করে দিলে, লইলে আমি চলে যেয়েছিলাম চন্ননপুরে ওর সঙ্গে। তা’পরেতে নিকনে কি ঘটত কে জানে? হয়ত আবারও কারুর সঙ্গে চলে যেতাম বিদ্যাশ বিভুয়ে। তোমার দয়াতেই আমার সব। তুমি ধার্মিক লোক, মা-লক্ষ্মীর দয়া অয়েছেন তোমার পরে। কত্তাঠাকুরতলায় ধূপ দাও, পিদিম দাও, তোমার ধরমবুদ্ধি হবে না তো হবে কার? পাখী হঠাৎ হেঁট হয়ে তার পায়ের ধুলে নিলে। বনওয়ারীর বড় ভাল লাগল পাখীকে আজ। বড় ভাল মেয়ে পাখী। বসনের কন্যে, ‘অক্তে’ চৌধুরী মোয়দের ‘অক্তের মিশাল আছে, হবে না ভাল কথা! আনন্দে তৃপ্তিতে তার মন জুড়িয়ে গেল, হিয়েখানি যেন ভরে উঠল গরমকালে মা-কোপাইয়ের শেতল জলে-ভরা ‘আঙা মাটির কলসের মত। মনে মনে সে কত্তাঠাকুরকে প্রণাম করলে, বললে—বাবাঠাকুর, এসব তোমার দয়া। তুমি মাতব্বর করেছ, তুমিই দিয়েছ এমন মন, মতি। তুমি অক্ষে করবে কাহারদের ঘরবাড়ি ঝড়ঝাপটা থেকে। বনওয়ারী তোমার অনুগত দাস, তোমার হুকুমেই সে কাহারপাড়ার চাল দেখছে। লাঙল টানে গরু, তার কি বুদ্ধি আছে, না সে জানে কোন দিকে ঘুরতে হবে, ফিরতে হবে? পিছনে থাকে লাঙলের মুঠো ধরে চাষী, তাকে গরু দেখতে পায় না; কিন্তু হালের মুঠোর চাপের ইশারায় গরু ঠিক চলে। বনওয়ারী সেই গরু! বাবাঠাকুর, কত্তাবাবা, তুমি হলে সেই চাষী। তা নইলে করালীর মতিগতি ফেরে! চন্ননপুরে কারখানায় পাকা মেঝের কোয়ার্টার ছেড়ে কাহারপাড়ার বাড়িতে রঙ ধরিয়ে ফিরে আসে! কথাবার্তা মিষ্টি হয়! না, করালী অনেকটা সোজা হয়েছে। এই তো সেদিন নিজে থেকে তেরপল দিয়ে এল গুড়ের শালে। কোনো রকমে ওকে ঘরবশ করে চন্ননপুর ছাড়িয়ে কাহারদের কুলকর্মের কাজে লাগাতে হবে; ধরমের পথ ধরিয়ে দিতে হবে। সে এক দিনে হবে না। কেমে-কেমে’ ‘ধেয়ো-ধেয়ো’ বাকা বাঁশকে যেমন তাতিয়ে চাপ দিয়ে সোজা করতে হয় তেমনই ভাবে। পাড়ার লোকে ক্ষেপে উঠেছিল করালীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তার তো দশের মত হট করে মাথা গরম করলে চলে না! ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে তাকে। ঘোড়ার একটা দোষ হল, ‘লবাবী’ করা। অ্যাই টেরি, অ্যাই জামা, অ্যাই কাপড়, অ্যাই একটা ‘টরচ’ আলো, একটা বশি, যেন বাবুর বেটা বাবু বেড়াচ্ছে, কে বলবে কাহারদের ছেলে! মুখে লম্বা লম্বা কথা। লোকে এসব সহ্য করতে পারে না। তাও অনেক করেছে—অনেক। তবে। নাকি শোনা যাচ্ছে, ছোঁড়া আজকাল বেআইনি চোলাই মদের কারবার করছে চন্ননপুরে। কাহারপাড়াতেও আনছে। রাত্রে মজলিস করে এই মদ খায়। সাবধান করতে হবে। শাসন করতে হবে। বনওয়ারীর মনের মধ্যে একটি সাধ হয়। করালীকে নিয়ে সাধ। সে জেনেছে, বেশ বুঝেছে, এই ছোঁড়া থেকে হয় সর্বনাশ হবে কাহারপাড়ার, নয় চরম মঙ্গল হবে। সর্বনাশের পথে যদি ঝোকে তবে কাহারপাড়ার অন্য সবাই থাকবে পেছনে—লাগতে লাগবে তার সঙ্গে। সে পথে করালী গেলে বনওয়ারী তাকে ক্ষমা করবে না। তাই তার ইচ্ছা তাকে কোলগত করে নেয়; তার পুত্র সন্তান নাই। ডান হাত থেকে বঞ্চিত করেছেন ভগবান। বনওয়ারীর ইচ্ছে, বিধাতা যা তাকে দেন নাই—নিজের কর্মফলের জন্যে—সে তা এই পিথিমীতে অর্জন করে। পুণ্য তার আছে। বাবার চরণে মতি রেখেছে, নিত্য দুবেলা প্রণাম করে, বাবার থান আগলে রাখে। আঁধার পক্ষের পনের দিন সনজেতে পিদিম দেয়। জ্ঞানমত বুদ্ধিমত ন্যায্য বিচারই করে সে। নয়ানের বউ পাখীকে করালীকে দিয়ে অন্যায় একটু করেছে, নয়ানের মা চোখের জল ফেলেছে—তাকে শাপ-শাপান্ত করেছে। তা করুক, বনওয়ারী নিজের কর্তব্য করবে। নয়ানের একটি সাঙা দেবে সে, কনে এর মধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে। মেয়েটির রীতকরণ একটুকুন চনমনে, কালোমুখী বদনাম একটু আছে তার বাপের গায়ের সমাজে। তা থাক, নয়ানের মায়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই এমন মেয়ে সে ঠিক করেছে। নয়ান যদি সেরে না ওঠে, তবে ওই মেয়েই রোজকার করে নয়ানের মাকে খাওয়াবে। লোকে না ভেবে কথা বলে। ভদ্রলোকে বেশি বলে। তারা বলে—ছোটলোকের জাতের ওই করণ। তারা হলেন টাকার মানুষ, জমির মালিক, রাজার জাত। তাদের কথাই আলাদা। কথাতেই আছে, ‘আজার মায়ের সাজার কথা’। নয়ান যদি তাদের জাতের হত তবে নয়ান মরে গেলেও থাকত তার টাকা, জমি, তাই থেকে নয়ানের মা একদিকে কাদত, একদিকে খেত। আর কাহারের জাত? না জমি, না টাকা, নয়ান মরে গেলে নয়ানের
false
shottojit_roy
কেউ জানে না। বছর খানেক হল ওই ফ্ল্যাটে এসেছে। আর রূপচাঁদ সিং? সে এখানে এসেছে গতকাল সকালে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ছিল। ভাড়া চুকোয়নি। কাল রাত্রে নাকি একটা ফোন করতে চেয়েছিল হোটেল থেকে, ফোন খারাপ ছিল। শেষে একটা ডাক্তারি দাকান থেকে কাজ সারে। কম্পাউন্ডার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু খদ্দের ছিল বলে কী কথা হয়েছে তা শোনেনি! এগারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। ঘরে একটা সুটকেস পাওয়া গেছে, তাতে জামা-কাপড় রয়েছে কিছু। দুটো টেরিলিনের শার্ট দেখে মনে হয় লোকটা বেশ শৌখিন ছিল। সেটা কিছুই আশ্চর্য না, বলল ফেলুদা, আজকাল ড্রাইভারের মাইনে আপিসের কেরানির চেয়ে অনেক বেশি। কথাই ছিল রেলওয়ে হোটেল থেকে বিলাসবাবুকে আমরা তুলে নেব; ছটা বাজতে পনেরো মিনিটে আমরা হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। ব্রিটিশ আমলের হোটেল, এখন রং ফেরানো হলেও চেহারায় পুরনো যুগের ছাপটা রয়ে গেছে। সামনে বাগান, সেখানে রঙিন ছাতার তলায় বেতের চেয়ারে বসে হোটেলের বাসিন্দারা চা খাচ্ছে। তারই একটা থেকে উঠে পাশের চেয়ারে বসা দুজন সাহেবকে এক্সকিউজ মি বলে বিলাসবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। চলুন, কপালে কী আছে দেখা যাক? আজ লালমোহনবাবু আমাদের গাইড, তাই তাঁর হাবভাব একেবারে পালটে গেছে। দিব্যি গটগটিয়ে সাগরিকার গেট দিয়ে ঢুকে বাগানের মধ্যিখানের নুড়ি ফেলা পথ দিয়ে সটান গিয়ে বারান্দায় উঠে কাউকে না দেখে একটু থতমত খেয়ে তৎক্ষণাৎ আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সাহেবি মেজাজে কোই হ্যায় বলতেই বাঁ দিকে একটা দরজা খুলে গেল। স্বাগতম! বুঝলাম ইনিই লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। পরনে সিঙ্কের লুঙ্গি আর চিকনের কাজ করা সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। মাঝারি হাইটের চেহারার বিশেষত্ব হল সরু গোঁফটা, যেটা ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে প্ৰায় আধা ইঞ্চি নেমে এসেছে নীচের দিকে। লালমোহনবাবু আলাপ করাতে যাচ্ছিলেন, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ওটা ভিতরে গিয়ে হবে। আসুন। লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বৈঠকখানার বেশির ভাগটা দখল করে আছে একটা তক্তপোশ; বুঝলাম ওটার উপরে বসেই ভাগ্যগণনা হয়। এ ছাড়া আছে দুটো কাঠের চেয়ার, একটা মোড়া, একটা নিচু টেবিলের উপর ওড়িশা হ্যাঁন্ডিক্রাফটসের একটা অ্যাশট্রে, আর পিছনে একটা দেয়ালের আলমারিতে দুটো কাঠের বাক্স, কিছু বই, কিছু শিশি-বোতল-বয়াম ইত্যাদি ওষুধ রাখার পাত্র, আর একটা ওয়েস্ট এন্ড অ্যালার্ম ঘড়ি। আপনি বসুন। এইখেনটায়—তক্তপোশের একটা অংশ দেখিয়ে বিলাসবাবুকে বললেন গণৎকার। —আর আপনারা এইখেনে। চেয়ার আর মোড়া দখল হয়ে গেল। লালমোহনবাবু এইবারে আমাদের সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিলেন। ফেলুদার বিষয় বললেন, ইনিই আমার সেই বন্ধু, আর বিলাস মজুমদারের নামটা বলে ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত ওয়াই–বলেই জিভ কেটে চুপ করে গেলেন। আমি জানি উনি বলতে গিয়েছিলেন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটাগ্রাফার; নিজের বুদ্ধিতেই যে নিজেকে সামলে নিয়েছেন সেটা আশ্চর্য বলতে হবে। ফেলুদা বোধহয় কেলেঙ্কারিটা চাপা দেবার জন্যই বলল, আমরা দুজন অতিরিক্ত লোক এসে পড়েছি বলে আশা করি আপনি বিরক্ত হননি। মোটেই না বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —আমার আপত্তি যেটাতে সেটা হচ্ছে স্টেজে উঠে ডিমনষ্ট্রেশন দেওয়ায়। সে অনুরোধ অনেকেই করেছে। আমি যে যাদুকর নই সেটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। এই যেমন- ভদ্রলোকের কথা থেমে গেল। তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে বিলাস মজুমদারের দিকে। —কী আশ্চর্য! বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচাৰ্য্য—আপনার কপালে ঠিক থার্ড আই-এর জায়গায় দেখছি একটি উপমাংস! উপমাংস মানে যে আঁচিল সেটা জানতাম না। ঠিক ওইখানে খুলির আবরণের তলায় কী থাকে জানেন তো? ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন। পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কথা বলছেন? ফেলুদা বলল। হ্যাঁ—পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। মানুষের মগজের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ। অন্তত পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা তাই বলেন। আমরা যদিও জানি যে ওটা আসলে প্রমাণ করে যে আদিম যুগে প্রাণীদের তিনটি করে চোখ ছিল, দুটি নয়। ওই থার্ড আইটাই এখন হয়ে গেছে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। নিউগিনিতে একরকম সরীসৃপ আছে, নাম টারটুয়া, যার মধ্যে এখনও এই থার্ড আই দেখতে পাওয়া যায়। ফেলুদা বলল, আপনার কপালে আঙুল রাখার উদ্দেশ্য কি এই পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের সঙ্গে যোগস্থাপন করা? তা একরকম তাই বলতে পারেন? বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —অবিশ্যি যখন প্রথম শুরু করি। তখন পিনিয়াল গ্র্যান্ডের নামও শুনিনি। জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। এক রবিবার আমার জ্যাঠামশাইয়ের মাথা ধরল। বললেন, লখনা, আমার মাথাটা একটু টিপে দিবি? আমি তোকে আইসক্রিমের পয়সা দেব। কপাল টনটন করছে, কপালের মধ্যিখানে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে টিপছি, এমন সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। চোখের সামনে বায়স্কোপের ছবির মতো পরপর দেখতে লাগলাম—জ্যাঠার পৈতে হচ্ছে, জ্যাঠা পুলিশের ভ্যানে উঠছেন—মুখে বন্দেমাতরম স্লোগান, জ্যাঠার বিয়ে, জেঠিমার মৃত্যু, এমনকী জ্যাঠার নিজের মৃত্যু পর্যন্ত, কীসে মরছেন, কোন খাটে শুয়ে মরছেন, খাটের পাশে কে কে রয়েছেন, সব।..তখন কিছু বলিনি, কিন্তু এই মৃত্যুর ব্যাপারটা যখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল, তখন…বুঝতেই পারছেন— লালমোহনবাবুকে দেখে বেশ বুঝছিলাম যে ওঁর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। বিলাসবাবু দেখলাম একদৃষ্টি চেয়ে রয়েছেন গণৎকারের দিকে। ফেলুদা বলল, আপনি তো শুনেছি। ডাক্তারিও করেন, আর তার চিহ্নও দেখছি ঘরে। নিজেকে কী বলেন—ডাক্তার, না গণৎকার? দেখুন, গণনার ব্যাপারটা আমি শিখিনি। আয়ুর্বেদটা শিখেছি। অ্যালোপ্যাথিও যে একেবারে জানি না তা নয়। পেশা কী জিজ্ঞেস করলে ডাক্তারিই বলব। আসুন, এগিয়ে আসুন, কাছে এসে বসুন। শেষের কথাগুলো অবিশ্যি বিলাসবাবুকে বলা হল। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তক্তপোশে পা তুলে বাবু হয়ে বসে বললেন, দেখুন, কপালের ব্ল্যাক স্পটটি যদি ইনফরমেশনের সহায়ক হয়। লক্ষ্মণবাবুর পাশেই যে একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটি রাখা ছিল সেটা এতক্ষণ লক্ষ করিনি। তার
false
humayun_ahmed
যে বলার না। কোনো প্যান্ট এখন পরতে পারেন না। ঢিলা হয়ে গেছে। বেল্ট লাগে। বাবাকে আজ দেখে খুবই মায়া লাগল। কথাবার্তাও এখন ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথা আটকে যায়। তোমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন। এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন না। তার ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন। বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেশের বাইরে নিতে হবে। টাকা কোথায়? বাবা তার সারা জীবনে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন সব ঐ ফ্ল্যাট কিনতে শেষ করছেন। যেই মুহূর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, আমরা হয়ে যাব পথের মানুষ—জাগ্রত জনতা। আসমানী আবারো হাসছে। ফরহাদ মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। আসমানী আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি হাসছে। বেশি কথা বলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরহাদের কি বলা উচিত—এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি চুপ করে থাক। আসমানী শাড়ির আঁচলে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল–একজন ভালো মেয়ে হিসেবে আমার বাবাকে বলা উচিত ফ্ল্যাট বিক্রি করার কোন দরকার নেই। চিকিৎসা করে লাভ যা হবে তা হচ্ছে মনের সান্তনা। তোমরা বলতে পারবে মেয়ের চিকিৎসার জটি হয় নি। এই মনের সান্তনার জন্যে পথের ফকির হবে কেন? কিন্তু এরকম কোনো কথা আমি বলি নি। আমি খুব স্বার্থপর তো এই জন্যে বলিনি। এই শোন তোমাকে আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। ছাই রঙা সার্টেও লাগছে। তোমাকে বলেছিলাম না ছাই রঙা সার্টটা পুড়িয়ে ফেলবে। পুড়াও নি কেন? গরিব মানুষ তো, সার্ট পুড়াতে মায়া লাগে। সার্ট গা থেকে খুলে দাও। আমি পুড়াব। আমিও গরিব তবে আমার এত মায়া নেই। কই খুলছ না কেন? সার্ট সত্যি খুলব? অবশ্যই খুলবে। আসমানী মিটি মিটি হাসছে। মনে হয় তার মনে কোনো দুষ্ট বুদ্ধি খেলা করছে। আমার সামনে সার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে। হ্যাঁ। তাহলে একটা কাজ কর–টেবিলের উপর দেখ একটা প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়। মনে নেই, তোমার জন্যে সাতটা সার্ট কিনে ছিলাম? কোন বারে কোন সার্ট পরবে কাগজে লিখে রেখেছি। আজ বুধবার। আজ তোমার কপালে হালকা সবুজ রঙের সার্ট। চিরুনীটা নিয়ে যাও। মাথা আঁচড়াবে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে। তারপর স্ট্রেইট দরজা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বক বক করে আমার মাথা ধরেছে এবং মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। তোমাকে একা ফেলে চলে যাব? হ্যাঁ চলে যাবে। আমি একা থাকব না—বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। ও আরেকটা কথা প্রতিটি সার্টের বুক পকেটে একটা করে চিঠি আছে। যে দিন যে সার্ট পরবে সেদিন চিঠিটাও পড়বে। আচ্ছা। আগামী সাতদিনে সাতটা চিঠি পড়া হয়ে যাবে। ইন্টারেস্টিং না। হুঁ। আমি কি ভেবে রেখেছিলাম জান—আমি ভেবে রেখেছিলাম সারা জীবন তোমাকে এরকম করে চিঠি লিখব। সার্ট গায়ে দিয়ে অফিসে যাচ্ছ। সার্টের বুক পকেটে একটা চিঠি। যত রাগ হোক, ঝগড়া হোক তুমি চিঠি পাবেই। আচ্ছা শোন তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না আমার মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। আর শোন বাথরুম থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখ আমি ঘুমিয়ে পরেছি— খবরদার আমার ঘুম ভাঙ্গাবে না। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন ঘুমটা আমার জন্যে খুবই দরকার। ফরহাদ সার্ট বদলে মাথার চুল আঁচড়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করল। হাসপাতালের সব আয়না হাসপাতালের রুগীদের মতোই অসুস্থ। আয়নায় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না তারপরেও ফরহাদের মনে হলো সবুজ রঙের সার্টটায় তাকে খুব মানিয়েছে। বুধবারের সার্টের পকেটে শুধু যে চিঠি তাই না। একটা বলপয়েন্ট কলম। কলমটা কেন দিয়েছে কে জানে। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করলেও এখন পড়া যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। এখন পড়লে আসমানী বুঝে ফেলবে। এইসব ক্ষেত্রে আসমানীর সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল। ফরহাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল আসমানী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার ঘুম ভাঙ্গানোর কোনো মানে হয় না। ফরহাদ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিশা এবং তার বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নিশার হাতে একটা প্যাকেট। নিশার বাবার হাতে কিছু বইপত্র। তিনি দূর থেকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এটা ফরহাদের কল্পনাও হতে পারে। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর এখন কিছু নেই। কেউ কাউকে দেখতে পায় নি এমন ভাব করলে কেমন হয়। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। মনে হয় এটাই সবচে ভালো বুদ্ধি। তাছাড়া আসমানীর চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করছে। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়া যাবে। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সিড়ি বা লিফট আছে। তার পুরানো ছাই রঙের সার্টটা হাসপাতালে রয়ে গেছে। সার্ট দেখে নিশা এবং তার বাবা নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। যার যা ইচ্ছা করুক। তাকে এই মুহূর্তে আসমানীর চিঠি পড়তে হবে। চিঠি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত—যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ আঁকিবুকি টানা সামান্য এক টুকরা কাগজ। পড়তে শুরু করলেই সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষের মতোই সে রাগ করে। অভিমান করে। বাবু সাহেব, প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে আপনার জন্যে আজ চিঠি লিখলাম। সব মিলিয়ে সাতটা চিঠি লেখা সহজ ব্যাপার না। শুধু এই চিঠিটাই সামান্য বড়। বাকি সবগুলি এক লাইন দুলাইনের। এই চিঠি লিখতে লিখতে আমি মজার একটা
false
shottojit_roy
শঙ্কু! আমার নাম ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ। আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু— দুম—দুম—দুম–! সামারভিলের রিভলভার তিন বার গৰ্জিয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিন বার কাঠ। ফাটার শব্দ। ওকে পালাতে দিয়ে না।–সামারভিল চিৎকার করে উঠল—কারণ গ্রোপিয়াস গোরস্থানের পিছন দিক লক্ষ্য করে ছুট দিয়েছে। একজন পুলিশের লোক হাতে রিভলভার নিয়ে তার দিকে তিরবেগে ধাওয়া করে গেল। ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ চেঁচিয়ে উঠলেন, যে পালাবে, তাকেই গুলি করা হবে। এদিকে আমার বিস্ফারিত দৃষ্টি চলে গেছে। কফিনের দিকে। তিনটের একটা গুলি তার পাশের দেয়াল ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে। অন্য দুটো ঢাকনার কানায় লেগে সেটাকে দ্বিখণ্ডিত করে স্থানচ্যুত করেছে। কফিনের ভিতর বিশাল দুটি নিষ্পলক পাথরের চোখ নিয়ে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি হলেন আমারই ভুপ্লিকেট-শঙ্কু নাম্বার টু। এবারে সমবেত সকলের রক্ত হিম করে, ডিট্রিখের হাত থেকে রিভলভার খসিয়ে দিয়ে, পুলিশের বগলদাবা গ্রোপিয়াসকে অজ্ঞান করে দিয়ে, কফিনবদ্ধ দ্বিতীয় শঙ্কু ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। বুঝলাম, তাঁর পাঁজরা দিয়ে গুলি প্রবেশ করে তাঁর দেহের ভিতরের যন্ত্র বিকল করে দিয়েছে; কারণ ওই বসা অবস্থাতেই গ্রোপিয়াস-সৃষ্ট জাল শঙ্কু তাঁর শরীরের ভিতরে রেকর্ড করা একটি পুরনো বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন— ভদ্রমহোদয়গণ!–আজ। আমি যে কথাগুলো বলতে এই সভায় উপস্থিত হয়েছি, সেগুলো আপনাদের মনঃপূত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু— আমি আমার অ্যানাইহিলিন বন্দুকটি পকেট থেকে বার করলাম। আমার এই পৈশাচিক জোড়াটিকে পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারলে তবেই আমার মুক্তি। আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৮৩ শঙ্কুর সুবৰ্ণ সুযোগ ২৪শে জুন ইংলন্ডের সলসবেরি প্লেনে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে তৈরি বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জের ধারে বসে আমার ডায়রি লিখছি। আজ মিড-সামার ডে, অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি। যে সময় স্টোনহেঞ্জ তৈরি হয়, তখন এ দেশে প্রস্তরযুগ শেষ হয়ে ব্ৰঞ্জ যুগ সবে শুরু হয়েছে। মানুষ ধাতুর ব্যবহার শিখে দেখতে দেখতে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিশর, ভারত, মেসোপটেমিয়া, পারস্য ইত্যাদির তুলনায় অবিশ্যি ইউরোপে সভ্যতা এসেছে অনেক পরে। কিন্তু চার হাজার বছর আগে এই ইংলন্ডেই যারা স্টোনহেঞ্জ তৈরি করতে পেরেছে, তাদের অসভ্য বলতে দ্বিধা হয়। বহু দূর থেকে আনা বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ দাঁড় করানো মাটির উপর, প্রতি দুটো পাশাপাশি স্তম্ভের উপর আবার আড়াআড়ি ভাবে রাখা হয়েছে আরেকটা পাথর। এই পাশাপাশি তোরণগুলো আবার একটা বিরাট বৃত্ত রচনা করেছে। অ্যাদ্দিন লোকের ধারণা ছিল, এই স্টোনহেঞ্জ ছিল কেল্টদের ধমনুষ্ঠানের জায়গা। এই কিছুদিন হল প্রত্নতাত্ত্বিকরা বুঝেছে যে এটা আসলে ছিল একটা মানমন্দির। পৃথিবীর প্রাচীনতম মানমন্দিরের অন্যতম—কারণ পাথরগুলোর অবস্থানের সঙ্গে সূর্যের গতিবিধির একটা পরিষ্কার সম্বন্ধ পাওয়া গেছে, যেটা বিশেষ করে আজকে, অর্থাৎ ২৪শে জুন কর্কটক্রাস্তিতে, সবচেয়ে পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়ে। ভাবতে অবাক লাগে যে আজকের দিনে আধুনিক এঞ্জিনিয়ারিং বলতে আমরা যা বুঝি, তার অভাবে সে কালে কী করে এই পাথরগুলোকে এমনভাবে হিসেব করে বসানো হয়েছিল। আমার বন্ধু ক্রোল অবিশ্যি অন্য কথা বলে। তার ধারণা প্রাচীনকালে মানুষ এমন কোনও রাসায়নিক উপায় জানত, যার ফলে সাময়িকভাবে পাথরের ওজন কমিয়ে ফেলা যেত। সেই কারণে নাকি পিরামিড বা স্টোনহেঞ্জের মতো জিনিস তৈরি করা আজকের চেয়ে সে কালে অনেক বেশি সহজ ছিল। উইলহেলম ক্রোল চিরকালই আদিম মানুষের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। প্রাচীন জাদুবিদ্যা, প্রেততত্ত্ব, উইচক্রাফট ইত্যাদি নিয়ে তার অগাধ পড়াশুনা। সে আমার সঙ্গে তিব্বতে গিয়েছিল একশৃঙ্গ-অভিযানে। এখন সে স্টোনহেঞ্জেরই একটা পাথরে হেলান দিয়ে ঘাসের উপর বসে একটা বিশেষ রকমের বাঁশি বাজাচ্ছে, যেটা সে তিব্বতের একটা গুমফা থেকে সংগ্রহ করেছিল। এ বাঁশি মানুষের পায়ের হাড় দিয়ে তৈরি। এ থেকে যে এমন আশ্চর্য সুন্দর জামান লোকসংগীতের সুর বেরোতে পারে, তা কে জানত? ক্রোল ছাড়া তিব্বত অভিযানে আমার আর এক সঙ্গীও কাছেই বসে। ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে কফি খাচ্ছে। সে হল আমার বিশিষ্ট বন্ধু ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স। সন্ডার্সের আমন্ত্রণেই এবার আমার লন্ডনে আসা। হ্যাম্পস্টেডে ওর বাড়িতে ক্রোল আর আমি অতিথি হয়ে আছি। আরও দিন সাতেক থাকার কথা। এবার ইংলন্ডে গ্ৰীষ্মকালটা ভারী উপভোগ্য মনে হচ্ছে। বৃষ্টি নেই। নীল আকাশে সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মানুষের মন ও শরীরকে তাজা করে দিচ্ছে। এবারে লেখা শেষ করি। ক্রোলের বাঁশি থেমেছে। তার সঙ্গে লন্ডনের এক নিলামঘরে যেতে হবে। সেখানে নাকি অ্যালকেমি সম্বন্ধে স্প্যানিশ ভাষায় ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর একটা পাণ্ডুলিপি বিক্রি আছে। ক্রোলের ধারণা, সেটা সে সস্তায় হাত করতে পারবে, কারণ অ্যালকেমি সম্বন্ধে আজকাল আর লোকের তেমন উৎসাহ নেই। আণবিক যুগে কৃত্রিম উপায়ে সোনা তৈরি করা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও আর অসম্ভব নয়। ২৪শে জুন, রাত সাড়ে দশটা নিলামে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বাভারিয়ার অধিবাসী ক্রোল স্বভাবত হাসিখুশি দিলাদরিয়া মানুষ, তাকে এভাবে উত্তেজিত হতে বড় একটা দেখিনি। অ্যালকেমি সম্বন্ধে যে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটা সে পঞ্চাশ পাউন্ডের মধ্যে পাবে বলে আশা করেছিল, তার জন্য শেষপর্যন্ত তাকে দিতে হল দেড় হাজার পাউন্ড। অর্থাৎ আমাদের হিসাবে প্রায় পাঁচিশ হাজার টাকা। এতটা দাম চড়ার কারণ একটি মাত্র ব্যক্তি, যিনি ক্রোলের সঙ্গে যেন মরিয়া হয়ে পাল্লা দিয়ে সাতশো বছরের পুরনো জীৰ্ণ কাগজের বান্ডিলটাকে জলের দর থেকে দেখতে দেখতে আগুনের দরে চড়িয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের পোশাক ও কথার উচ্চারণ থেকে তাঁকে আমেরিকান বলে মনে হচ্ছিল। ক্রোলের কাছে শেষপর্যন্ত হেরে যাওয়াতে তিনি যে আদৌ খুশি হননি সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। এর পরে যতক্ষণ ছিলেন নিলামে, ততক্ষণ তাঁর কপালে ভুকুটি দেখেছি। ক্রোল অবিশ্যি বাড়ি
false
shirshendu
নিয়ম। মাথার পিছনে ছোট্ট একটা চাটি। তারপর তুমি অনেকক্ষণ ঘুমোবে। নাঃ! প্লিজ। ববি মৃদু একটু হাসলেন। নিয়ম মানে না এ কেমন খেলোয়াড়? মাথার খুলিতে মারা একটা আর্ট। অপটিমামের একটু বেশি হলেই কংকাশন। মারতে হয় ওজন কবে, খুব মেপে, খুব সাবধানে। বস স্থির দৃষ্টিতে ববিকে দেখছিল। লক্ষ করছিল ববির সমস্ত নড়াচড়া। মৃদু স্বরে সে হঠাৎ বলল, লাভ নেই মিটার রায়। আমাকে মাবলেও আমাদের জাল কেটে বেরোনো অসম্ভব। ববি অত্যন্ত সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি। শুধু জানি না তোমরা কিসের কোড আমার কাছে চাও। বস অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে উঠে একটা সোফায় বসল। তারপর বলল, আমেরিকা থেকে তুমি একটা যন্ত্র চুরি করেছিলে। ববি রায় অবাক হয়ে বললেন, কিসের যন্ত্র? ক্রাইটন। ববি মাথা নাড়লেন, খবরটা ভুল। বস স্থির দৃষ্টিতে ববিকে নিরীক্ষণ করে বলল, খবরটা ভুল ঠিকই। তুমি যন্ত্রটা চুরি করোনি, কিন্তু তার নো-হাউ জেনে নিয়েছিলে। ববি উদাস গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ক্রাইটনের মতো সফিস্টিকেটেড জিনিস তৈরি করতে কত সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি লাগে জানো? আর কতজন হাইলি-কোয়ালিফায়েড লোক? বস মাথা নাড়ল, আমি বিজ্ঞানের লোক নই। জানি। বিজ্ঞানের লোকেরা ওরকম বোকার মতো কথা বলে না। কিন্তু তোমার কাছে আলট্রাসোনিক ক্রাইটন যে আছে তা আমরা ঠিকই জানি। ভুল জানো। ভারতবর্ষে এমন কোনও কারখানা নেই যেখানে ক্রাইটন তৈরি করা যায়। আর শোনো বোকা, ক্রাইটনের বিশেষণ হিসেবে কখনও আলট্রাসোনিক কথাটা ব্যবহার করা যায় না। বস গনগনে চোখে চেয়ে বলল, তুমি কি আমার পরীক্ষা নিচ্ছ? মা, তোমার মতো গাড়লেরা কতটা বিজ্ঞান জানে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তোমার প্রভু বা প্রভুৱা বোধকরি তোমার মতোই গাড়ল, যদি না তারা আমেরিকান বা ফরাসি হয়ে থাকে। সেটা যা-ই হোক, আমরা শুধু জানঙে চাই, ক্রাইটনটা কোথায় আছে। প্রথম কথা, ক্রাইটন নেই। দ্বিতীয় কথা, থাকলেও জেনে তোমাদের লাভ নেই। বাঁদরের কাছে টাইপরাইটার যা, তোমাদের কাছে ক্রাইটনও তাই। শোনো বায়, তোমার সেক্রেটারি মিস ভট্টাচারিয়া আমাদের নজরবন্দি। চব্বিশ ঘণ্টা তার ওপর নজব রাখা হচ্ছে। আমরা একদিন না একদিন তাকে ক্র্যাক করবই। ববি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লাথিত গলায় বললেন, তাকে নজরবন্দি করে কী হবে? তোমরা কি ভালো ববি রায় সামান্য বেতনভুক তার এক কর্মচারীর কাছে ক্রাইটনের খবর দেবে? ববি রায় তার সেক্রেটারিদের তত বিশ্বাস করে না। তবু আমরা তাকে ক্র্যাক করবই, যদি তোমাকে না পারি। ববি এবার ঘড়ি দেখে বললেন, তোমাকে অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। আর নয়। এবার তোমাকে আমি ঘুম পাড়াব। তারপর আমার কয়েকটা কাজ আছে। বস এই সময়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। ববি খুব হিসেব-নিকেশ করে তার অপটিমাম শক্তিতে রিভলভারের বঁটটা বসিয়ে দিলেন বস-এর মাথায়। বস যথারীতি কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল মেঝেয়। ববি দ্রুত পকেট সার্চ করলেন। কোনও কাগজপত্র নেই। তার স্যাঙাতের পকেটও পরিষ্কার। ববি গিয়ে চিকার ঘরের দরজা খুললেন। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে। ববি ঘরটা ভাল করে দেখলেন। কোনও ইন্টিরিয়র ডেকরেটারকে দিয়ে সাজানো হয়েছে। ছবির মতো ঘর। ওয়ার্ডরোবটা খুলে ববি দেখলেন, ভিতরে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশটা দামি ড্রেস হ্যাঙারে ঝুলছে। দরজার ওপরে একটা ডার্টবোর্ডে লক্ষ করলেন ববি, মাঝখানের বৃত্তে অন্তত পাচটি ডার্ট বিধে আছে। চিকা যে চমৎকার লক্ষ্যভেদী তাতে সন্দেহ নেই। একটা ওয়াইন ক্যাবিনেটে বিদেশি মদের এলাহি আয়োজন। এমনকী এক বোতল রয়্যাল স্যালুট অবধি রয়েছে। ববি ওয়াইন ক্যাবিনেটের ঢাকনাটা বন্ধ করলেন। আর ঠিক সেই সময়েই বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। ববি চোখ বুজে ফেললেন। একেবারে নগ্ন মেয়েমানুষ দেখতে তার অ্যালার্জি আছে। চিকা গুনগুন করে গান গাইছিল। কী গান তা বুঝলেন না ববি। বোধহয় কোনও উষ্ণ বিদেশি পপ গান। চিকা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল তখনও সে ঘরের অতিশয় মৃদু আলোয় ববি রায়কে লক্ষ করেনি। সুতরাং ববিকেই জানান দিতে হল। মৃদু স্বরে ববি বললেন, পুট অন সামথিং মাই ডিয়ার। চিকা আতঙ্কিত আর্তনাদ করে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে দুঃস্বপ্নের অবিশ্বাস। মুখ হাঁ। ববি ফের ইংরেজিতে বললেন, যা তোক একটা কিছু পরো হে সুন্দরী। আমাদের মেলা কথা আছে। মেলা কাজ। চিকা চোখের পলকে একটা রোব পরে নিল। তারপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এটা কী করে সম্ভব? তোমার তো এতক্ষণে– ববি মৃদু হেসে বললেন, বলো। থামলে কেন? বিস্ময়টা আস্তে আস্তে মুছে গেল চিকার চোখ থেকে। একটু মদির হাসল সে। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, সুপারম্যান। ববি রায় দেখছিলেন, মেয়েটি কী দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল। তার হাততালি দিতে ইচ্ছে করছিল। চিকা তার বিছানায় বসে অগোছালো চুল দু’হাতে পাট করতে করতে বলল, আমি জানতাম তুমি ওদের হারিয়ে দিলেও দিতে পারো। ওরা কারা? চিকা ঠোঁট উলটে বলল, রাফিয়ানস। তোমার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কী? চিকা তার রোবটা খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে ঈষৎ উন্মােচিত করে দিয়ে বলল, কিছু না। এইসব গুন্ডা বদমাশরা মাঝে মাঝে আমাদের কাজে লাগায় মাত্র। তুমি ওদের চেনো? চিকা তার বক্ষদেশ এবং পায়ের অনেকখানি অনাবৃত করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল, শুধু একজনকে। বস। বস আসলে কে? গ্যাং লিডার। বোম্বাইয়ের দক্ষিণ অঞ্চল বস শাসন করে। তুমি যদি ওকে মেরে ফেলে থাকো তাহলে তোমার লাশ সমুদ্রে ভাসবে। আমি অকারণে খুন করি না। ওরা আমার কাছে কী চায়? আমি জানি না। ওরা একটা কোড-এর কথা বলছিল। আর কিছু নয়? চিকা মৃদু হাসল।
false
toslima_nasrin
চাঁদের মনোরম আলো বলে ভুল করতে করতে, জাফর ইকবালের সঙ্গে নির্জন সমুদ্রতীরে হাত ধরে মনে মনে হাঁটতে হাঁটতে। এর পরেই আমাকে অবাক করে জাফর ইকবাল বলে, না। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড় না। আমি জানি। ধরায় ফিরে এসে জিজ্ঞেস করি, কি করে? কি করে তা না বলে ভারি গলায় বলে, বন্ধুর সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে হয় না। আমাকে গ্রাস করে রাখে মিথ্যে বলার লজ্জা। ফোন রেখে বিছানায় লেপের তলায় মুখ লুকোই গিয়ে। এরপর চন্দনার সঙ্গে দেখা হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি বলি, সব্বনাশ করছি, বয়সে বড় হইতে গিয়া একটা মিছা কথা কইয়া ফেলছি। জাফর ইকবাল জানে যে চন্দনা আমার বান্ধবী। একজন মিথ্যুক হলে আরেকজনও হতে পারে! চন্দনা অনেকক্ষণ দুঃখগ্রস্ত বসে থেকে হঠাৎ দুঃখ ঝেড়ে বলে ঠিকই তো কইছস তুই, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি না? পড়িই তো। মনে মনে পড়ি। বাবা পরদিনই ড্রয়ার খুলে টেলিফোনটি বগলতলায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি একরকম। ফোনের ছেঁড়া তার অনেকদিন ঝুলে থাকে। ছোটদা কোত্থেকে যেন একটি পুরোনো টেলিফোন এনে ঝুলে থাকা তারে জোড়া দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন শব্দ টব্দ নেই কোনও। এদিকে লজ্জায় জাফরের চিঠির আর কোনও উত্তর দিই না আমি। চন্দনা চিঠি পেতে থাকে জাফরের। সেসব চিঠিতে বন্ধুত্ব পেরিয়ে প্রেম উঁকি দিচ্ছে দিচ্ছে। চন্দনার চিঠিতেও। আমি দুপক্ষের চিঠিরই শ্রোতা। শ্রোতা হওয়াই আমাকে মানায়। এ ছাড়া আমি টের পাই আমার সাধ্য নেই অন্য কোনও ভূমিকা গ্রহণ করার। ছোটদা চিপাচসের অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেন আবার। ঢাকা থেকে আসবেন শাহনাজ রহমুতল্লাহ, বিখ্যাত গায়িকা, আর তাঁরই ভাই আমাদের সবেধন প্রেমিকপ্রবর জাফর ইকবাল। অনুষ্ঠান হবে টাউন হলে,শনিবার সন্ধেবেলা। চন্দনা আর আমি কলেজের শিমুল তলায় দোদুলদোলায় দুলি, যাবো কি যাবো না জাফর ইকবালকে দেখতে। শনিবার সারাদিন দুলি, সন্ধের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না আমার, ওই মিথ্যেটির কারণেই আমি গুটিয়ে থাকি, চন্দনা যাবে বলেও শেষ অবদি যায় না। অনুষ্ঠান শেষে জাফর ইকবালের আকুল আবদারে ছোটদা তাকে চন্দনার সবুজ টিনের বাড়িতে নিয়ে যান। ওখানে চা বিস্কুট খেতে খেতে চন্দনার সঙ্গে কথা বলে জাফর। চন্দনা ওই মাথা নুয়ে যতক্ষণ জাফর ছিল, ছিল। কিছু হ্যাঁ, না, কিছু অপ্রতিভ হাসিই ছিল ওর সম্বল। ঢাকা ফিরে জাফর কোনওদিন আর ওকে চিঠি লিখবে না এ ব্যাপারে ও একশ ভাগ নিশ্চিত ছিল, কিন্তু জাফরের পরের চিঠিতে থৈ থৈ করে প্রেম। এই থৈ থৈ প্রেম শেষে বিয়ের প্রস্তাবে গড়ায়। চন্দনা প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ। অন্ধকার উতল সমুদ্র পাড় থেকে দেখতে ভাল লাগে, কিন্তু ঝাপঁ দেবার মত দুঃসাহস চন্দনার নেই। চন্দনা এর মধ্যে নাকচ করে দিয়েছে বেশ কটি প্রেমের আবেদন। পাশের বাড়ির ম্যাজিস্ট্রেট আখতার হোসেনকে বুড়ো ধামড়া বলে গাল দিয়ে, গান গায় ছেলে অন্টুকে একদিন খালি গায়ে ছাদে হাঁটতে দেখে ওয়াক থু বলে, আর সন্দিপন চাকমা নামের যে ছেলেটি পেয়িং গেস্ট ছিল ওদের বাড়িতে ক’মাস, ওকে খেতে দেখে। ছেলেদের খালি গা দেখলে বা খাবার চিবোনো দেখলে চন্দনার বিচ্ছিজ্ঞর লাগে, রোমান্স বাপ বাপ করে পালায়। চন্দনা মাঝে মাঝে বলেওছে তুই কি জানিস মানুষকে সবসময় বিশ্রি দেখায় কখন? কখন? তারা যখন খায়। মুখ নামের একখানা ছিদ্র আছে শরীরে, মানুষ ওতে নানা কিছু ঢুকিয়ে কী অশ্লীল ভাবে দুদাঁতের পাটি ঘষতে থাকে…. ছি!! আমি যার সঙ্গে প্রেম করব, আমার সামনে সে যেন না খায়, যেন গায়ের জামা না খোলে, যেন পেশাব পায়খানায় না যায়। ব্যস সোজা হিশেব। ছুটিতে একবার রাঙামাটি বেড়াতে গেল চন্দনা। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তখন তার বিয়ের জন্য পাষনী খুঁজছে। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে চন্দনাকে দেখার পর হাঁ হয়ে গেল, এমন যোগ্য পাষনী আর সে কোথায় পাবে! এরকম সুন্দরী বুদ্ধিমতী রাঙামাটিতে আর আছে কে!চন্দনাকে তার চাই। চাই তো চাইই। চন্দনার এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে দেবাশীষ রায়ের বন্ধুত্ব ছিল, সেই দাদাকে ধরে চন্দনার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়ার সুযোগ চাইল দেবাশীষ। সুব্রত চাকমার আনন্দ আর ধরে না, মেয়ে তাঁর রাণী হতে যাচ্ছে। খুড়তুতো দাদার অনুরোধে চন্দনা গেল দেবাশীষের সঙ্গে ঝিলের পাড়ে বেড়াতে। য়চ্ছ জলে শাদা মসৃণ গ্রীবা উঁচু করে ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস সাঁতার কাটছে, পাশে ঘাসে বসে দেবাশীষ প্রেমিকের মত তার চটচটে ঘামে ভেজা হাতটি চন্দনার দিকে বাড়িয়ে গলা গম্ভীর করে প্রেমের কথা যখনই বলতে শুরু করেছে, চন্দনা ফক করে হেসে ফেলল। বাড়ি ফিরে ও উৎসাহী দাদাকে বলে দিল, রাজা হোক আর যেই হোক দেবাশীষ প্রেম করতেই জানে না, তার সঙ্গে হবে না। সুব্রত চাকমা প্রথম নরম স্বরে, তারপর কড়া স্বরে দেবাশীষের বিয়ের প্রস্তাবে চন্দনাকে রাজি হওয়ার জন্য বলেন, ও রাজি হয়নি। চড় থাপড় লাগিয়েও কাজ হয়নি। বিয়েতে চন্দনার ভীষণ আপত্তি, ওর পক্ষে এ কল্পনা করা অসম্ভব যে একটি লোক খালি গায়ে ওর বিছানায় এসে শোবে, তারপর কী কী সব করবে, কী কী সব করায় আর যে মেয়েই রাজি হোক, চন্দনা রাজি নয়। দিব্যি রাজার প্রস্তাবে গুল্লি মেরে ছুটি শেষে চলে এল ময়মনসিংহে। ওর এমনিতেও ভাল লাগে না নাক বোঁচা কোনও চাকমা লোক, সে যত বড় রাজাই হোক। চন্দনার এরকম পটাপট প্রেমে পড়া আর হুটহাট ফিরিয়ে দেওয়া সবকিছুই আমাকে মগ্ধু করে। আমার কাউকে ফিরিয়ে দেওয়ার নেই, কারও সঙ্গে প্রেমও
false
shirshendu
বারান্দার বুঝকো অন্ধকারে লোকটার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সে যতদূর জানে, লোকটা পাগল নয়, বায়ুগ্রস্ত নয়। লোকটা একজন বিশেষজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরিসংখ্যানের জোরে কথা বলছে। তবু সে স্বগতোক্তির মতো বলল, অতটাই কি হবে! বিজ্ঞানীরা যখন উঠে পড়ে লেগেছে তখন একটা কিছু সমাধান তো হবেই। তাই না? বিজ্ঞানীরা মুষ্টিমেয়। পৃথিবীর যে সংকট আসছে সে সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষেরই ধারণা ভাসা ভাসা। আর অশিক্ষিতরা তো সম্পূর্ণ নির্বিকার। কয়েকদিন আগেই একজন সেন্ট্রাল মিনিস্টার আমাকে ডেকে বলেছেন, আমি যে কলকারখানা কমাতে বলছি তাতে নাকি উৎপাদন ও উন্নয়ন মার খাবে। তাকে আমি বোঝাতে পারিনি, আগে অস্তিত্বকে রক্ষা করা দরকার, নইলে উন্নয়ন আর উৎপাদন কার কাজে লাগবে? আমি পৃথিবীর লোককে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সবগুলো রাষ্ট্রের উচিত অন্যসব ইস্যুকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহমণ্ডলকে রক্ষা করার জন্য সব রিসোর্সেস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু কে শুনছে বলুন! রাজনীতিকরা তাঁদের কূটকচালিতে বন্দী হয়ে আছেন, আমলারা ব্যস্ত প্রশাসনিক কাজে। সাধারণ মানুষ অন্নবস্ত্রের বাইরে কিছুই ভাবতে চায় না। এই পৃথিবীর জন্য, মাটির জন্য, গাছের জন্য, প্রকৃতির জন্য তাদের যেন কিছুই করার নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এই উদাসীনতা। নেগলিজেন্স। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি কী করতাম জানেন! কেউ গাছ কাটলে তার ফঁাসির ব্যবস্থা করতাম। সন্তান সংখ্যা যার বেশী হবে তাকে জেল-এ পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম। জল বা বায়ু দূষিত হয় এমন কলকারখানার মালিকদের দেউলিয়া করে ছেড়ে দিতাম। হেমাঙ্গ সামান্য সপ্রশংস গলায় বলে, আপনাকে দেখে বোঝা যায় না বটে, কিন্তু ইউ আর এ টাফ ম্যান। কৃষ্ণজীবন একটুও হাসল না। মাথা নেড়ে বলল, না। আমি বড় অসহায় আর দুর্বল। আমি কিছু করতে পারছি না। এ বিটন ওল্ড ম্যান। ওল্ড কোথায়! আপনি তো দারুণ ইয়ং লুকিং। বাইরেটা। ভিতরে ভিতরে আমি বুড়িয়ে যাচ্ছি দুশ্চিন্তায়, টেনশনে। অবস্থাটা কি ততটাই খারাপ? আপনি যতদূর ভাবতে পারছেন তার চেয়েও বোধ হয় বেশী। আমাদের আর একদম সময় নেই। তাহলে বৈজ্ঞানিকরা এতদিন কী করল মশাই? তাদের দিয়ে যা করানো হয়েছে তারা তাই করেছে। তারাও রাজনীতি আর প্রশাসনের শিকার। তাদের মস্তিষ্ক আছে, চরিত্র নেই। তাই তারা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, মারণাস্ত্র, দূষিত কেমিক্যালস তৈরি করে যাচ্ছে। তাদের লাগানো হচ্ছে কসমেটিক জিনিসপত্র তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে লোককে চমকে দেওয়ার জন্য নানা ম্যাজিক আইটেম বানানোর কাজে। লোককে বোঝানো হচ্ছে, এটা বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানীরা ঈশ্বরের বিকল্প। বিজ্ঞান দুনিয়ার সব রহস্য ভেদ করতে চলেছে। কিন্তু যারা বিজ্ঞান জানে তারা এ কথা শুনে লজ্জায় জিব কাটে। বিজ্ঞান কোথায় পড়ে আছে তা কি জানেন? লোকে আকাশে রকেট পাঠানো দেখে, স্যাটেলাইটে টিভি দেখে ভাবছে, বিজ্ঞান বুঝি কেল্লা মেরে দিল। কিন্তু আসলে কি তাই! বিজ্ঞানের ঘরে পচা ইঁদুরও কি নেই? মহাকাশের কথা বাদ দিয়ে শুধু এই সোলার সিস্টেমের কথাই ধরুন। এরই এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে কত সময় লাগছে বলুন তো একটা রকেট বা প্রজেক্টাইলের? কত ফুয়েল খরচ হচ্ছে! কত কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে! দুনিয়ার মানুষকে উপোস, অশিক্ষা আর রোগেভোগ রেখে এই গবেষণা কী দিচ্ছে আমাদের? প্রায় কিছুই নয়। আমাদের নিকটতম নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে চার লাইট ইয়ার দূরে। যদি মানুষ কখনও আলোর গতি অর্জন করতে পারে তাহলেও সেখানে মহাকাশযান পাঠাতে লাগবে চার বছর। যদি না মাঝপথে অ্যাস্টেরয়েডরা সেই মহাকাশযান ধ্বংস করে দেয়। আলোর গতি অর্জন করাও আইনস্টাইনের মতে প্রায় অসম্ভব। সেই ফুয়েল আমাদের নেই এবং ওই গতি কোনও ম্যাটারের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব, বস্তুগত রূপান্তর ছাড়া। আলোর গতি পেলে ম্যাটার হয়ে যাবে এনার্জি, আমি কি একটু বেশী টেকনিক্যাল হয়ে পড়ছি। আমি বুঝতে পারছি। আজকাল সবাই এসব বোঝে। কৃষ্ণজীবন হতাশ গলায় বলে, বুঝছে কই? বৈজ্ঞানিকরা আমাদের খেলনা দিয়ে, চুষিকাঠি দিয়ে, রূপকথার গল্প বলে ভুলিয়ে রাখছে। কিন্তু আমরা পচা ইঁদুরের গন্ধ পেতে শুরু করেছি। আমি হিউস্টনে এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, আমেরিকা যদি তার একটা বা দুটো রকেট উৎক্ষেপন বন্ধ রেখে টাকাটা ইথিওপিয়ার মরু-প্রকৃতিকে বশে আনতে ব্যয় করে তাহলে পৃথিবীর অনেক বেশী উপকার হবে। আমেরিকানরা তুমুল হাততালি দিল, বাহবা দিল, কিন্তু প্রস্তাবটা কার্যকর করল না। আপনি কি মহাকাশ গবেষণা বন্ধ করার পক্ষে। না, আমি ততটা গাধা নই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, মহাকাশ গবেষণার কলমে কিছু মানুষ বড়লোক হয়ে যাচ্ছে এবং চলছে ওয়াইল্ড গুজ চেজ। আমি বাড়াবাড়ির বিপক্ষে। আমেরিকা যখন চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল তখন সেটা কত বড় হাই রিস্ক ভেনচার ছিল তা কি জানেন? তখনও ফুল-প্রুফ টেকনোলজি ছিল না, শুধু বাহবা পাওয়ার জন্য ওই সাতিক ঝুঁকি নিয়েছিল। এইসব ইউজলেস কাজ তো বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য মানুষের মঙ্গল। কিন্তু সে কথাটা মানুষ বুঝছে কই! বিজ্ঞান-পাগল মানুষ বিজ্ঞানকে মাথায় তুলেছে, ঈশ্বরের বিকল্প করে তুলছে, অথচ বাস্তবুদ্ধি থাকলে মানুষের বোঝা উচিত ছিল, বিজ্ঞানের ভূমিকা হল মানুষের ভৃত্যের। যার চাকর হওয়ার কথা তাকে মনিব করে তোলা কি উচিত? আপনি নিজে বৈজ্ঞানিক, তবে বিজ্ঞানের ওপর ক্ষেপে আছেন কেন? বিজ্ঞানের ওপর ক্ষেপব কেন! আমার রাগ আহাম্মক মানুষের ওপর। অস্ত্র গবেষণায় কত কোটি কোটি ডলার খরচ হয় তা কি জানেন? এক একটা যুদ্ধে কত কোটি ডলার খরচ বলুন তো! এক একটা ক্ষেপণাস্ত্রের দাম কত, একটা পুওর ম্যান অ্যাটম বোমার? প্রতি মিনিটে কত মিলিয়ন ডলার ছারখার হয়ে যায়? মাটির নিচে
false
zahir_rayhan
বলতে হবে সব। তুমি যা ভেবেছো তার সবটুকু মিথ্যে জাহানারা। শিউলির সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যদি কিছু থেকে থাকে সেতো তোমার সঙ্গে। আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা। না। তা হয় না। মাস্টার সাহেবের সঙ্গে আমাদের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে। জাহানারা অটল। না জাহানারা। একবার চেয়ে দেখো তোমাকে ভালবেসে আমি যে নিঃশেষ হয়ে গেলাম। আমি একটি মেয়ে, ক’জনকে ভালবাসবো বলুন তো? জাহানারার চোখে মুখে কৌতুক। শুধু আমাকে। শুধু আমাকে জাহানারা। কাসেদের গলার স্বর কাঁপছে। বুকের নিচে যন্ত্রণা। বাইরে কাক ডাকছে। বোধ হয় ভোর হয়ে এলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো কাসেদ। চোখজোড়া জ্বালা করছে। মাথা ঘুরছে। সারা দেহে ঘাম করছে। ওর। মা আর নাহার চাপাস্বরে কথা বলছে পাশের ঘরে। ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে। ওরা। সাংসারিক আলাপ আলোচনাগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ সময়ে সেরে নেয়। কলতলায় গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় জল ঢাললো কাসেদ। মাথা তুলতে দেখে, নাহার তোয়ালে হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে তোয়ালেখানা ওকে দিলো নাহার। আস্তে করে বললো, সাবান এনে দেবো? তোয়ালেখানা হাতে নিয়ে কাসেদ বললো, না। নাহার আর দাঁড়ালো না, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। সে। ঘরে এলে মা শুধালেন, কিরে আজ এত সকাল-সকাল উঠলি যে? কাসেদ সংক্ষেপে বললো, এমনি। বেলা ন’টার সময় অফিসে যাবার জন্যে বেরুচ্ছে, মা কাছে ডাকলেন, পাশে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলালেন ওর। বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসবি বাবা, আমার কেমন যেন লাগছে। কাসেদ বললো, ভেবো না মা, তুমি খুব শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে। মা স্নান হাসলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছে, একখানা রিক্সা এসে থামলো সামনে। শিউলি বসে, মিটমিটি হাসছে সে। মুহুর্তে বিগত বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলো কাসেদের। বাহ্‌, বেশ তো! রিক্সা থেকে দ্রুত নেমে এসে শিউলি বললো, আমি এলাম বাসায় আর আপনি চলে যাচ্ছেন? আপনার কোন বাঁধন নেই, আমাকে অফিসে চাকুরি করে খেতে হয়।–যথাসম্ভব গভীর হবার চেষ্টা করলো কাসেদ। শিউলি বললো, সে আমি জানি। আর এও জানি আপনি একজন অনুগত কেরানী। কাজ ফেলে বসে থাকেন না। মিষ্টি করে কথাটা বললো সে, বলে হেসে উঠলো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে। কাসেদ তেমনি গম্ভীর স্বরে বললো, বাসায় মা আছেন, নাহার আছে, যান না, ওদের সঙ্গে গল্প করে বেশ কিছুটা সময় কাটবে আপনার। আমি ওদের কাছে আসি নি তা আপনি জানেন, শিউলির কণ্ঠস্বর সহসা পাল্টে গেলো। কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তাহলে কার কাছে এসেছেন? তাও আমাকে বলতে হবে? ভ্রূজোড়া বিস্তারিত করে অপূর্ব ভঙ্গীতে হাসলো শিউলি, তাহলে শুনুন, আমি আপনার কাছে এসেছি এবং আপনার কাছেই আসি। কিন্তু কেন? উত্তেজিত গলায় কাসেদ শুধালো, আপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই যার জন্যে আপনি আমার কাছে আসতে পারেন। সারা মুখ কালো হয়ে গেলো শিউলির। ঠোঁটের কোণে একসূতো হাসি জেগে উঠলো ধীরে ধীরে, তারপর সে হাসি অতি সুক্ষ্ম ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়লো তার সম্পূর্ণ ঠোঁটে, চিবুকে, চােখে, সারা মুখে। শিউলি মৃদু গলায় বললো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া না করে, আসুন রিক্সায় উঠুন। ভয় নেই আপনাকে নিয়ে আমি কোথাও পালিয়ে যাবো না, অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমার হোস্টেলে ফিরে যাবো। কাসেদ বললো, আমি রোজ হেঁটে যাই, আজও যেতে পারবো। শিউলি বললো, দেখুন মেয়েমানুষের মত রাগ করবেন না, উঠন, রিক্সায় উঠুন। শিউলির চোখের দিকে তাকিয়ে এবার আর না করতে পারলো না কাসেদ, নীরবে উঠে বসলো সে। রিক্সাওয়ালাকে যাবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে শিউলিও উঠে বসলো পাশে। আজ একটু ছোট হয়ে বসতে চেষ্টা করলো কাসেদ। শিউলির গায়ে গা লাগতে পারে সেই ভয়ে। শিউলি আড়চোখে এক পলক দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, আপনারা পুরুষ মানুষগুলো এত সহজে বদলে যেতে পারেন যে কি বলবো! কাসেদ চুপ করে থাকবে ভেবেছিলো, কিন্তু জবাব না দিয়ে পারলো না। অন্য পুরুষের কথা আমি বলতে পারবো না। নিজে আমি সহসা বদলাই নে। আমি যা ছিলাম। তাই আছি, তাই থাকবো। তাই নাকি? চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো শিউলি। শুনে বড় খুশি হলাম। কিন্তু জনাব, একটা কথা যদি জিজ্ঞেস করি তাহলে রাগ করবেন না তো? মুখ টিপে হাসছে শিউলি। কাসেদ বললো, বলুন। ক্ষণকাল চুপ করে থেকে শিউলি ধীরে ধীরে বললো, সেদিন বিকেলে সেই একসঙ্গে রিক্সায় চড়ে হাতে হাত রেখে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে একটা কি দুটো কথা বলা এর সবটুকুই কি মিথ্যা। মুখখানা নুইয়ে ওর চোখে চােখে তাকাতে চেষ্টা করলো শিউলি। সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না সে। একটু পরে কি ভেবে বললো, আপনি যা ভাবছেন সে অর্থে মিথ্যে। আমি কি ভেবেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে? কারণ আমি শুনেছি সব। কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো : জাহানারা এসেছিলো বাসায়, কাল বিকেলে। শিউলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ চুপচাপ কি যেন ভাবলো সে। রিক্সাটা কাসেদের অফিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। শিউলি আস্তে করে বললো, সেদিন আপনি একটা অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম। আজ আমার একটা কথা। আপনি রাখবেন? ওর কণ্ঠস্বরে আশ্চৰ্য আবেগ। নড়েচড়ে বসে কাসেদ শুধালো, কি কথা বলুন? শিউলি ধীর গলায় বললো, আজ বিকেলে আমি নিউ মার্কেটের মোড়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, আপনি আসবেন, কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। আসবেন তো? রিক্সা থেকে নেমে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো
false
shottojit_roy
যাচ্ছিলাম, সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁ দিক দিয়ে নেমেছে ঢাল, আর ডান দিক দিয়ে পাহাড় খাড়াই উপরে উঠে গেছে। এই পাহাড়ের গা দিয়েই পাথর গড়িয়ে পড়ে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল। সেই পাথরকে ভেঙে টুকরো করে এখন রাস্তার ধারে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোকে দেখে আর অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভেবে পেটের ভিতরটা কেমন জানি করে উঠল। ফেলুদা প্রথমে চটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল, তারপর রাস্তার বাঁ পাশটায় গিয়ে নীচের দিকে দেখে কয়েকবার খালি ইহঁ বলল। তারপর ক্যামেরাটা কাঁধ থেকে খুলে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই ঢাল দিয়ে হ্যাঁচোড় পাঁচোড় করে কিছুদূর নেমে যাওয়া বোধহয় খুব কঠিন হবে না। তুই এখানেই থাক। আমার মিনিট পনেরোর মামলা৷’ আমি যে উত্তরে কিছু বলব, ওকে বাধা দেবার কোনও চেষ্টা করব, তার আর সুযোগই হল না; ও চোখের নিমেষে। এবড়ো-খেবড়ো পাথর আর গাছগাছড়া লতাপাত খামচাতে খামচাতে তািরতরিয়ে নীচের দিকে নেমে গেল। আমার কাছে কাজটা বেশ দুঃসাহসিক বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু ফেলুদা দেখি তারই মধ্যে শিস দিয়ে চলেছে। ক্ৰমে ফেলুদার শিস মিলিয়ে গেল। আমি ভরসা করে নীচের দিকে চাইতে পারছিলাম না, কিন্তু এবার একবার না দেখলেই নয় মনে করে রাস্তার কিনারে গিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে দিলাম। যা দেখলাম তাতে বুকটা কেঁপে উঠল। ফেলুদা পুতুল হয়ে গেছে; না জানলে তাকে দেখে চিনতেই পারতাম না। ড্রাইভার বলল, ‘বাবু ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছেন। ওইখানেই গিয়ে পড়েছিল। জিপটা৷’ ফেলুদার আন্দাজ অব্যর্থ। ঠিক পনেরো মিনিট পরে খচমচ খড়মড় শব্দ শুনে আবার এগিয়ে গিয়ে দেখি ফেলুদা যেভাবে নেমেছিল সেইভাবেই আবার এটা-ওটা খামচে ধরে উঠে আসছে। হাতটা বাড়িয়ে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে রাস্তায় তুলেই জিজ্ঞেস করলাম—‘কী পেলে?’ ‘গাড়ির কিছু ভাঙা পার্টস, নাট-বোল্ট, কিছু ভাঙা কাচ, একটা তেলচিটে ন্যাকড়া। নো যমন্তক।‘ মূর্তিটা যে পাবে না সেটা আমারও মনে হয়েছিল। ‘আর কিছু না?’ ফেলুদা তার প্যান্ট আর কোটটা ঝেড়ে নিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট জিনিস বার করে আমাকে দেখাল। সেটা আর কিছুই না—একটা ঝিনুকের কিংবা প্লাস্টিকের তৈরি সাদা বোতাম–মনে হয় শার্টের। আমাকে দেখিয়েই বোতামটা আবার পকেটে রেখে ফেলুদা উলটোদিকে খাড়াই পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।’পাথর…পাথর…পাথর’ আপন মনে বিড়বিড় করে চলেছে সে। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, ‘আরেকটু তেনজিঙ্গি না করলে চলছে না। ‘ এবারে আর ফেলুদাকে একা ছাড়লাম না, কারণ খাড়াই খুব বেশি না, আর মাঝে মাঝে এমন এক-একটা জায়গা আছে যেখানে ইচ্ছে করলে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। ফেলুদা আগেই বলে নিয়েছিল—তুই আগে ওঠ, তোর পিছনে আমি। তার মানে হচ্ছে। আমি যদি পা হড়কে পড়ি, তা হলে ও আমাকে ধরবে। খানিক দূরে ওঠার পরেই ফেলুদা হঠাৎ পিছন থেকে বলল—’থাম।’ একটা খোলা সমতল জায়গায় এসে পড়েছি। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝেড়ে চারদিকটা একবার দেখলাম। ফেলুদা আবার গুনগুন গান ধরেছে, আর দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে পায়চারি করছে। ‘হুঁ!’ শব্দটা এল প্রায় মিনিট খানেক পায়চারির পর। ফ্ল্যাট জায়গাটা যেখানে ঢালু হযে নীচে নেমেছে, তারই একটা অংশের দিকে ফেলুদা একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। আশেপাশে ঘাস থাকলেও এই বিশেষ অংশটা নেড়া। মাটি আর দু-একটা নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছু নেই। ‘এখান থেকেই পাথরবাবাজি গড়িয়েছেন৷ লক্ষ করে দাখ–এইখান থেকে শুরু করে ঢাল বেয়ে গাছপালা ভেঙে চলেছে নীচে অবধি। ও ঝোপড়াটা দ্যাখ-ওই ফার্নের গোছাটা দ্যাখ–কীভাবে থেতলেছে। এগুলো সব পরিষ্কার ইনডিকেশন৷’ আমি বললাম, ‘কত বড় পাথর বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা বলল, ‘নীচে তো টুকরোগুলো দেখলি। কত বড় আর হবে? আর এ হাইট থেকে গড়িয়ে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা সৃষ্টি করার জন্য একটা ছোটখাটো ধোপার পুঁটুলির সাইজের পাথরই যথেষ্ট।’ ‘তাই বুঝি?’ ‘তা ছাড়া আর কী? এ হল মোমেন্টামের ব্যাপার। ম্যাস ইনটু ভেলোসিটি। ধর, তুই যদি মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে থাকিস, আর মনুমেন্টের উপর থেকে কেউ যদি তাগ করে একটা পায়রার ডিমের সাইজের নুড়িপাথরও তোর মাথায় ফেলে, তা হলে তার চোটেই তোর মাথা ফুটি-ফাটা হয়ে যাবে। একটা ক্রিকেট বল যত বেশি হাইটে ছোড়া যায়, সেটাকে লুফতে তত বেশি চোট লাগে হাতে। লোফার সময় কায়দা করে হাতে টেনে নিতে না পারলে অনেক সময় তেলো ফেটে যায়। অথচ বল তো সেই একই থাকছে, বদলাচ্ছে কেবল হাইট, আর তার ফলে মোমেন্টাম।‘ ফেলুদা এবার নেড়া জায়গাটোৱ পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ে বলল, ‘পাথরটা কীভাবে পড়েছিল জানিস?’ ‘কীভাবে?’ আমি ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘এই দ্যাখ।‘ ফেলুদা নেড়া অংশটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল। আমি ঝুকে পড়ে দেখলাম সেখানে একটা ছোট্ট গর্ত রয়েছে। সাপের গর্ত নাকি? ‘যদ্দূর মনে হয়, ফেলুদা বলে চলল, ‘প্রায় পঁচাত্তর পার্সেন্ট সিওর হয়ে বলা চলে যে একটা লম্বা লোহার ডান্ডা বা ওই জাতীয় একটা কিছু মাটিতে ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে পাথরটাকে ফেলা হয়েছিল। তা না হলে এখানে এ রকম একটা গর্ত থাকার কোনও মানে হয় না। অর্থাৎ–‘ অর্থাৎ যে কী আমিও বুঝে নিয়েছিলাম। তবুও মুখে কিছু না বলে আমি ফেলুদাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম। ‘অর্থাৎ মিস্টার শিবকুমার শেলভাঙ্কারের অ্যাক্সিডেন্টটা প্রকৃতির নয়, মানুষের কীর্তি। অর্থাৎ অত্যন্ত ক্রুর ও শয়তানি পদ্ধতিতে কেহ বা কাহারা তাহাকে হত্যা করিয়াছিল। অর্থাৎ-এক কথায়-গণ্ডগোল, বিস্তর গণ্ডগোল…’ খুনের জায়গা খুনের জায়গা (এখন থেকে আর অ্যাক্সিডেন্ট বলব না) থেকে হোটেলে ফিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল ওর একটু কাজ আছে–একটু পরে ফিরবে। আমি জানি যে যদি জিজ্ঞেস
false
toslima_nasrin
রেজাউল করিম কামালের তত্ত্বাবধানে থাকবে, তাঁকে টাকা তোলার সব রকম অধিকার দেওয়া হল। কাগজটি ছোটদার হাতে দিই। ছোটদা পড়ে বলেন, —আমারে সব অথরাইজ কইরা দিলি যে! তুই কি বাঁচবি না নাকি! —কথা কইও না। কাগজটা রাখো পকেটে। আমি বলি। ছোটদা কাগজ পকেটে রেখে বলেন—এত বেশি ভাবিস না তো! সব ঠিক হইয়া যাইব, দেখিস। বাবা হাত বুলিয়েই যাচ্ছেন আমার মাথায়, পিঠে, বাহুতে। ছোটদা বললেন, বাবারে তো মারছে মোল্লারা। মাইরা ধাককা দিয়া ফালাইয়া দিছে ড্রেনে। —কি কও? আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠি। —হ। মোল্লাগোর মিটিং হইতাছিল বড়বাজারে। বাবা শুনতে গেছিল। বাবা অপ্রস্তুত হেসে বললেন— না মা, তেমন কিছু না। চিন্তা কইর না। তেমন কিছু হয় নাই। প্রসঙ্গটি তিনি চাননা উঠুক। কিন্তু আমি শুনবই। বললেন—ওই একটু গেছিলাম শুনতে। —কেন? —কী ওদের প্রোগ্রাম, কি করতাছে .. মিটিংএর ভিতরে যাই নাই। দূরে দাঁড়াইয়া ছিলাম। —তারপর? —তারপর আর কী! দুইটা লোক চিনে ফেলছে আমারে যে আমি তোমার বাবা.. ছোটদা পেছন থেকে বললেন—তারপর তো ধইরা দিল মাইর। −ড্রনএ পইড়া গেছিল। পরে দৌড়াইয়া একটা চেনা লোকের ফার্মেসিতে ঢুইকা পইড়া বাচছে। নাইলে কি হইত কে জানে। আমি চোখ বুজি। দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে আসে। বাবা বলেন— বিদেশ থেইকা এত বলা হইতাছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তো চেষ্টা করতাছে। তাতে কি বেইল হইব না! আমি ঠোট উল্টে বলি—জানি না। বাবা বলেন—যদি বেইলটা হইয়া যায়, তাইলে তো বাসায় ফিরতে পারবা। সরকার যদিপুলিশ প্রটেকশানের ব্যবস্থা করে তাইলে তো তোমার আর ভয়ের কিছু নাই। ঘরে বইসা বইসা লিখবা। বিদেশের মন্ত্রীরা তো বলতাছে তোমারে প্রটেকশান দিতে। আমি আবারও মাথা নেড়ে বলি—যদি যদি যদি। এইটা যদি হয়, তাইলে ওইটা হইব। জানি না কি হইব। এই সরকার আর মৌলবাদীদের মধ্যে তো কোনও পার্থক্য দেখতাছি না। কী হয় শেষ পর্যন্ত কে জানে। ঝ ছোটদাকে ইঙ্গিত করেন ওঠার জন্য। এই ইঙ্গিতটি আমাদের বুকে তীরের মত বেঁধে। ইচ্ছে না থাকলেও ছোটদা ওঠেন। বাবাকে উঠতে বলেন। —আরেকটু বসুক আরেকটু। ঝর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলি। —না। খামাকা রিস্ক নেয়ার দরকার নেই। তোমার ফ্যামিলির লোকজন কোথায় কে যায় তার খবর রাখা হয় না মনে কর? ছোটদা বললেন—উরে বাবা, সারাক্ষণই তো সবার পেছনে এসবির লোক থাকে। আমি যেইখানেই যাই সেইখানেই যায়। আজকে ত সন্ধ্যার সময় বাসা থেইকা বার হইছি, সারা ঢাকা শহর চককর দিছি, এসবির গাড়িও ফলো করল তিন ঘন্টা। এমন অলি গলির মধ্যে ঘুরপাক খাইলাম , একসময় ওরা হাল ছাইড়া দিছে অথবা মিস করছে। তারপরে তো এইখানে আইলাম। বাবা ঝকে বললেন—আপনি যে কি ঝুঁকি নিয়ে আমার মেয়েটাকে এইরকম আশ্রয় দিয়েছেন, আপনার কাছে আমরা খুব কৃতজ্ঞ। ঝ বললেন—না না না কৃতজ্ঞতা জানাবেন না। আমি যা করেছি, এটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছি। কেবল আমি তো না, আরও অনেকেই ওকে সাহায্য করছে। আমি অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। আধঘণ্টা সময়ও কি কাটানো যেত না! আমার সাধ মেটে না। ঘুমের মধ্যে সুখের একটি স্বপ্ন যেন মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সাহস রাখো মা, সাহস রাখো। সাহস হারাইও না। তুমি যেই কথা লেখছ, তাতে তুমি যদি সত্যিই বিশ্বাস কইরা থাকো, তাইলে যতদিন বাঁচো, মাথা উঁচা কইরা বাঁচো। তবে এখন সাবধানে থাকতে হবে। তোমার বন্ধুরা আছে। আমরা আছি। চিন্তা কইর না। ছোটদা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। দরজার কাছে আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেবল মনে হতে থাকে এ দেখাই বুঝি শেষ দেখা। বাকি রাত ছবি আঁকি। আমার নিজের ছবি। নতুন নিউজ ইউক ম্যাগাজিনে আমার যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটি দেখেই আঁকি। আমার ছবিটির চারপাশে অনেকগুলো সাপ আঁকি, সাপগুলো ফণা তুলে আছে আমার দিকে। সাপের মাথায় সাদা টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ঝ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমার আঁকা দেখেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। এঘরেই তিনি আরেকটি তোশক পেতে বিছানা করে নিয়েছেন। সাতাশ জুলাই, বুধবার সরকার ও বিরোধী দলকে এই দায় সুদে আসলে শুধতে হবে। আবদুল মান্নান লিখেছেন ইনকিলাবে — জানতে পারলাম, তসলিমা নাসরিনের লজ্জার ইংরেজি ভার্সান একদিনেই ২০,০০০ (বিশ হাজার) কপি বিক্রি হয়ে গেছে। তসলিমাকে নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে যে ক্রেজ এর সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে হয়, তসলিমার বই ইংরেজি ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হবে এবং মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই সর্বৈব মিথ্যা কথাটিই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে, বাংলাদেশ উগ্র ফতোয়াবাজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের দেশ। বাংলাদেশের এই যে ইমেজ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, এটা কি কারও জন্যই কল্যাণকর? এই মিথ্যার প্রতিষ্ঠা থেকে কী কল্যাণলাভ করবেন প্রগতিবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা? কী কল্যাণ লাভ করবে সরকার? কী কল্যাণ লাভ করবে বিরোধী দল, বিশেষত আওয়ামী লীগ? আগামী নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায়ও যায়, তারা কেমন করে মুছবে এই মিথ্যা ইমেজ? তাদেরও কি এর দায় বহন করতে হবে না? অথচ দেশ ও রাজনীতির যাঁরা হর্তাকর্তা তাঁদের কারও মধ্যে কোন সুবুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে হয় না। যে সরকার ইসলামের দোহাই পেড়েই ক্ষমতায় গেছেন, সেই সরকারও পরম নির্বিকারচিত্তে তসলিমা নাসরিনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও ঔদ্ধত্য অবলোকন করলেন এবং ওর মিশন নির্বিবাদে সম্পন্ন হওয়ার পর একটি কার্যকারিতাহীন
false

Description

BAAD16 is an Authorship Attribution dataset for Bengali Literature. It was collected and analyzed by the authors of this paper. It was created by scraping text from an online Bangla e-library using custom web crawler and contains literary works of various famous Bangla writers. It contains novels, stories, series, and other works of 16 authors. Each sample document is created with 750 words. The dataset is imbalanced and resembles real-world scenarios more closely, where not all the authors will have a large number of sample texts. The following table gives more details about the dataset.

Author Name Number of Samples Word Count Unique Word
zahir rayhan 185 138k 20k
nazrul 223 167k 33k
manik bandhopaddhay 469 351k 44k
nihar ronjon gupta 476 357k 43k
bongkim 562 421k 62k
tarashonkor 775 581k 84k
shottojit roy 849 636k 67k
shordindu 888 666k 84k
toslima nasrin 931 698k 76k
shirshendu 1048 786k 69k
zafar iqbal 1100 825k 53k
robindronath 1259 944k 89k
shorotchandra 1312 984k 78k
shomresh 1408 1056k 69k
shunil gongopaddhay 1963 1472k 109k
humayun ahmed 4518 3388k 161k
Total 17,966 13,474,500 590,660
Average 1,122.875 842,156.25 71,822.25

Citation

If you use this dataset, please cite the paper Authorship Attribution in Bangla literature using Character-level CNN. Archive link.

 @inproceedings{BAAD16Dataset,
  title={Authorship Attribution in Bangla literature using Character-level CNN},
  author={Khatun, Aisha and Rahman, Anisur and Islam, Md Saiful and others},
  booktitle={2019 22nd International Conference on Computer and Information Technology (ICCIT)},
  pages={1--5},
  year={2019},
  organization={IEEE}
  doi={10.1109/ICCIT48885.2019.9038560}
}

This dataset is also available in Mendeley: BAAD16 dataset. Always make sure to use the latest version of the dataset. Cite the dataset directly by:

@misc{BAAD6Dataset,
  author = {Khatun, Aisha and Rahman, Anisur and Islam, Md. Saiful},
  title = {BAAD16: Bangla Authorship Attribution Dataset},
  year={2019},
  doi = {10.17632/6d9jrkgtvv.4},
  howpublished= {\url{https://data.mendeley.com/datasets/6d9jrkgtvv/4}}
  } 
Downloads last month
138
Edit dataset card