label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
humayun_ahmed
ভালোও লাগে না। ভালো লাগে না কী করে বললেন? আগে কি কখনো প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলেছেন? আপনার সঙ্গে বলছি। বাহ্‌, আপনি মানুষ হিসেবেও তো রসিক। একবার আসুন। আসবেন? আসতেও পারি। দেরি না করে চলে আসুন। আজ রাতেই চলে আসুন। আপনার বাড়ির ঠিকানা কী? রশিদ মোল্লাকে জিজ্ঞেস করুন। ও আপনাকে ঠিকানা বলে দেবে। আপনি ওর বাসা থেকেই তো টেলিফোন করছেন। তাই না? জি। কিংবা এক কাজ করতে পারেন। ওকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসতে পারেন। ও দারুণ ভীতু ওকে একটা ধমক দিলেই ও আপনার সঙ্গে আসবে এবং দূর থেকে বাসা দেখিয়ে দেবে। কাছে আসবে না। সন্ধ্যার পর বাসার কাছে আসতে সে ভয় পায়? আজ আসতে পারছি না। তবে হয়তো শিগগিরই আসব। শুনুন মিসির আলি সাহেব, আজ আসাই ভালো। জোছনা রাত আছে। জোছনা আপনার ভালো লাগে নিশ্চয়ই। ভালো লাগে না। জোছনা অনেক রহস্য তৈরি করে। রহস্য আমি পছন্দ করি না। বলেই দিনের আলো জোছনার চেয়ে বেশি ভালো লাগে। রহস্য আপনি পছন্দ করেন না? জি না। এই জন্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। চলে আসুন। আসব আসব, এত ব্যস্ত হবেন না। আমি মোটেই ব্যস্ত নই। আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এই জন্যেই বলছি। ও আরেকটা কথা-আগের ম্যানেজারের মেয়েটির ঠিকানা রশিদ মোল্লা জানে না। বের করার চেষ্টা করেছে। পারে নি। তবে আমি আপনাকে ঠিকানা দিতে পারি। ওরা মায়ায়ণগঞ্জে থাকে। আপনার কাছে কি কাগজ-কলম আছে? থাকলে লিখে নিন… মিসির আলি বললেন, থাক, ঠিকানার প্রয়োজন নেই। আমি যে এতকিছু জানি আপনি কি এতে অবাক হচ্ছেন না। আমি এত সহজে অবাক হই না। আপনার নাম তো জানা হল না। দেখা হলেই নাম বলব। এত তাড়া কিসের? মিসির আলি টেলিফোন নামিয়ে রেখে রশিদ মোল্লাকে বললেন, চলি রশিদ সাহেব। অনেক রাতে আপনাকে বিরক্ত করেছি। কিছু মনে করবেন না। রশিদ মোল্লা কিছু বলল না। জবুথবু হয়ে বসে রইল। এই শীতের রাতেও তার কপালে ঘাম। সে খুব ভয় পেয়েছে। আগের বার রশিদ মোল্লা গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। এবার এল না। দরজা বন্ধ করতেও উঠল না। রশিদ মোল্লার মেয়েটি দরজা বন্ধ করার জন্যে উঠে এসেছে। সে খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। তার বাবার মতো মেয়েটিও ভয় পেয়েছে। অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে! বুদ্ধি করে মাফলার এনেছেন বলে রক্ষা। মাফলার ভেদ করে শীতল হাওয়া ঢুকছে। নাক জ্বালা করা শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডা মনে হয় লেগে যাবে। নিউমোনিয়ায় না ধরলে হয়। শরীর দুর্বল। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি গেছে। ছোট অসুখই দেখতে দেখতে ভয়াবহ হয়ে যায়। আজকের রাতের ঘটনায় তিনি তেমন বিস্মিত বোধ করছেন না। বড় ধরনের রহস্যময় ঘটনায় তিনি তেমন বিস্মিত হন না। ছোটখাটো ঘটনাগুলো বরং তাঁকে অনেক বেশি অভিভূত করে। একবার এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে ছটাকা ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠলেন। নামার সময় তাকে একটা পঁচি টাকা এবং একটা দুটাকার নোট দিলেন। দুটাকার নোটটা ছিল পঁচি টাকার নোটের ভেতর। রিকশাওয়ালার তা দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। সে টাকাটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল এবং লুঙ্গির খুঁট থেকে একটা এক টাকার নোট ফেরত দিল। মিসির আলি বিষ্ময়ে অভিভূত হলেন। একবার ভাবলেন, রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কী করে ঘুঝল পাঁচ টাকার নোটের আঁজে একটা দুটাকার নোট আছে? তিনি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেন নি। থাক না কিছু রহস্য! সব রহস্য ভেঙে দেওয়ার দরকার কি? পৃথিবীতে কিছু কিছু রহস্য আছে যা ভাঙতে ইচ্ছে করে, আবার কিছু রহস্য আছে ভাঙতে ইচ্ছা করে না। তন্ময় নামের ছেলেটির রহস্য ভেদ করার ইচ্ছা তার আছে। ঘ্যাপারটা খুব সহজ হবে কিনা তা তিনি এখনো জানেন না। রশিদ মোল্লার বাসা থেকে তিনি টেলিফোন করলেন। অন্য একজন ধরল। তা ধরতেই পারে। হয়তো তন্ময়ের বাড়িতে আরো একজন থাকে। যে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে মাস্টার সাহেব হিসেবে। সে চট করে বলে দিল, আপনি রশিদ মোল্লার বাড়ি থেকে টেলিফোন করছেন? আপাতদৃষ্টিতে খুব আশ্চর্যজনক ঘটনা মনে হলেও হয়তো তেমন আশ্চর্যজনক নয়। রশিদ মোল্লাই আগেভাগে জানিয়েছে। মিসির আলি অপেক্ষা করছিলেন-রশিদ মোল্লা টেলিফোন সেটা আনতে গেল। চট করে আনল না। দেরি হল। এই ফাঁকে রশিদ মোল্লা হয়তো জানিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া ঐ লোকটি প্রাণপণ চেষ্টা করছিল মিসির আলিকে বিস্মিত করতে। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল, আমি যে এতকিছু জানি আপনি এতে অবাক হচ্ছেন না? একজন প্রেতাত্মা মানুষকে বিস্মিত করার এত চেষ্টা করবে না। মানুষই করবে। তন্ময়ের মৃত শিক্ষক টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলবে এই হাস্যকর ধারণা নিয়ে মাথা ঘামাবার মানুষ মিসির আলি নন। তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। তবে চিন্তিত বোধ করছেন। কেন চিন্তিত বোধ করছেন তাও তার কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বিপদ আঁচ করছেন। তাঁর মনের একটি অংশ ভয় পাচ্ছে। ভয় পাবার পেছনের কারণটি তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। শুধু যে ভয় পাচ্ছেন তা না-পুরো ব্যাপারটা তাঁর মনের ওপর এক ধরনের চাপও সৃষ্টি করছে। কে যেন খুব অস্পষ্টভাবে তাঁকে বলছে—তুমি সরে এস। তুমি দূরে সরে এস। টুং-টুং ঘণ্টা বাজিয়ে রিকশা আসছে। ভিড়ের সময় রিকশাওয়ালারা কখনো ঘণ্টা বাজায় না। ফাঁকা রাস্তা বলেই হয়তো ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে আসছে। এই রিকশা ভাড়া যাবে বলে মনে হয় না। যাচ্ছে উল্টো দিকে। তবু মিসির আলি বললেন, ভাড়া যাবে? মিসির আলিকে
false
shorotchandra
মহারাজ নিজে ইহা করিতেন না, আমরা তাঁহার সেবকেরা পালা করিয়া করিতাম। সন্ন্যাসীর অপরাপর কর্তব্যে আমি তাঁহার অন্য দুই চেলাকে অতি সত্বর ডিঙ্গাইয়া গেলাম; শুধু এইটাতেই বরাবর খোঁড়াইতে লাগিলাম। এটা কোনদিনই নিজের কাছে সহজ এবং রুচিকর করিয়া তুলিতে পারিলাম না। তবে এই একটা সুবিধা ছিল—সেটা হিন্দুস্থানীদের দেশ। আমি ভাল-মন্দর কথা বলিতেছি না, আমি বলিতেছি, বাঙ্গলা দেশের মত সেখানকার মেয়েরা ‘হাতজোড়া—আর এক বাড়ি এগিয়ে দেখ’ বলিয়া উপদেশ দিত না, এবং পুরুষেরাও চাকরি না করিয়া ভিক্ষা করি কেন, তাহার কৈফিয়ত তলব করিত না। ধনীদরিদ্র-নির্বিশেষে প্রতি গৃহস্থই সেখানে ভিক্ষা দিত—কেহই বিমুখ করিত না। এম্‌নি দিন যায়। দিন-পনর ত সেই আম-বাগানের মধ্যেই কাটিয়া গেল। দিনের বেলা কোন বালাই নাই, শুধু রাত্রে মশার কামড়ের জ্বালায় মনে হইত—থাক্‌ মোক্ষসাধন। গায়ের চামড়া আর একটু মোটা করিতে না পারিলে ত আর বাঁচি না! অন্যান্য বিষয়ে বাঙ্গালী যত সেরাই হোক, এ বিষয়ে বাঙ্গালীর চেয়ে হিন্দুস্থানী-চামড়া যে সন্ন্যাসের পক্ষে ঢের বেশি অনুকূল, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। সেদিন প্রাতঃস্নান করিয়া সাত্ত্বিক ভোজনের চেষ্টায় বহির্গত হইতেছি, গুরুমহারাজ ডাকিয়া বলিলেন— ৫৪৪ “ভরদ্বাজ মুনি বসহিঁ প্রয়াগা যিনহি রামপদ অতি অনুরাগা—” অর্থাৎ স্ট্রাইক্‌ দি টেণ্ট—প্রয়াগ যাত্রা করিতে হইবে। কিন্তু কাজ ত সহজ নয়! সন্ন্যাসীর যাত্রা কিনা! পা-বাঁধা টাট্টু খুঁজিয়া আনিয়া বোঝাই দিতে, উটের উপরে মহারাজের জিন কষিয়া দিতে, গরু-ছাগল সঙ্গে লইতে, পোঁটলা-পুঁটলি বাঁধিতে গুছাইতে একবেলা গেল। তার পরে রওনা হইয়া ক্রোশ-দুই দূরে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বিঠৌরা গ্রামপ্রান্তে এক বিরাট বটমূলে আস্তানা ফেলা হইল। জায়গাটি মনোরম, গুরুমহারাজের দিব্য পছন্দ হইল। তা ত হইল, কিন্তু সেই ভরদ্বাজ মুনির আস্তানায় পৌঁছিতে যে কয় মাস লাগিবে, সে ত অনুমান করিতেই পারিলাম না। এই বিঠৌরা গ্রামের নামটা কেন আমার মনে আছে, তাহা এইখানে বলিব। সে দিনটা পূর্ণিমা তিথি। অতএব গুরু-আদেশে আমরা তিন জনেই তিন দিকে ভিক্ষার জন্য বাহির হইয়া পড়িয়াছিলাম। একা হইলে উদরপূর্তির জন্য চেষ্টাচরিত্র মন্দ করিতাম না। কিন্তু আজ আমার সে চাড় ছিল না বলিয়া অনেকটা নিরর্থক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম। একটা বাড়ির খোলা দরজার ভিতর দিয়া হঠাৎ একটা বাঙ্গালী মেয়ের চেহারা চোখে পড়িয়া গেল। তার কাপড়খানা যদিচ দেশী তাঁতে-বোনা গুণচটের মতই ছিল, কিন্তু পরিবার বিশেষ ভঙ্গিটাই আমার কৌতূহল উদ্রেক করিয়াছিল। ভাবিলাম, পাঁচ-ছয়দিন এই গ্রামে আছি, প্রায় সব ঘরেই গিয়াছি, কিন্তু বাঙ্গালী মেয়ে ত দূরের কথা—একটা পুরুষের চেহারাও ত চোখে পড়ে নাই। সাধু-সন্ন্যাসীর অবারিত দ্বার। ভিতরে প্রবেশ করিতেই, মেয়েটি আমার পানে চাহিয়া রহিল। তাহার মুখখানি আমি আজও মনে করিতে পারি। তাহার কারণ এই যে, দশ-এগার বছরের মেয়ের চোখে এমন করুণ, এমন মলিন উদাস চাহনি, আমি আর কখনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। তাহার মুখে, তাহার ঠোঁটে, তাহার চোখে, তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া দুঃখ এবং হতাশা যেন ফাটিয়া পড়িতেছিল। আমি একেবারেই বাঙ্গলা করিয়া বলিলাম, চাট্টি ভিক্ষে আনো দেখি মা। প্রথমটা সে কিছুই বলিল না। তার পরে তার ঠোঁট-দুটি বার-দুই কাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিল; তার পরে সে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। আমি মনে মনে একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। কারণ সন্মুখে কেহ না থাকিলেও, পাশের ঘর হইতে বেহারী মেয়েদের কথাবার্তা শুনা যাইতেছিল। তাহাদের কেহ হঠাৎ বাহির হইয়া এ অবস্থায় উভয়কে দেখিয়া কি ভাবিবে, কি বলিবে, তাহা ভাবিয়া না পাইয়া—দাঁড়াইব, কি প্রস্থান করিব, স্থির করিবার পূর্বেই মেয়েটি কাঁদিতে কাঁদিতে এক নিশ্বাসে সহস্র প্রশ্ন করিয়া ফেলিল,—তুমি কোথা থেকে আসচ? তুমি কোথায় থাক? তোমার বাড়ি কি বর্ধমান জেলায়? কবে সেখানে যাবে? তুমি রাজপুর জানো? সেখানকার গৌরী তেওয়ারীকে চেন? আমি কহিলাম, তোমার বাড়ি কি বর্ধমানের রাজপুরে? মেয়েটি হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া বলিল, হাঁ। আমার বাবার নাম গৌরী তেওয়ারী, আমার দাদার নাম রামলাল তেওয়ারী। তাঁদের তুমি চেনো? আমি তিনমাস শ্বশুরবাড়ি এসেছি—একখানি চিঠিও পাইনে। বাবা, দাদা, মা, গিরিবালা, খোকা কেমন আছে কিছু জানিনে। ঐ যে অশ্বত্থ গাছ—ওর তলায় আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি। ও-সোমবারে দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে—এরা বলে, না—সে কলেরায় মরেছে। আমি বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। ব্যাপার কি? এরা ত দেখ্‌ছি পুরা হিন্দুস্থানী, অথচ মেয়েটি একেবারে খাঁটি বাঙ্গালীর মেয়ে। এতদূরে এ-বাড়িতে এদের শ্বশুরবাড়িটিই বা কি করিয়া হইল, আর ইহাদের স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ীই বা এখানে কি করিতে আসিল? জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার দিদি গলায় দড়ি দিল কেন? সে কহিল, দিদি রাজপুরে যাবার জন্য দিনরাত কাঁদত, খেত না, শুত না। তাই তার চুল আড়ায় বেঁধে তাকে সারা দিনরাত দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তাই দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মরেচে। প্রশ্ন করিলাম, তোমারও শ্বশুর-শাশুড়ী কি হিন্দুস্থানী? মেয়েটি আর একবার কাঁদিয়া ফেলিয়া কহিল, হাঁ। আমি তাদের কথা কিছু বুঝতে পারিনে, তাদের রান্না মুখে দিতে পারিনে—আমি ত দিনরাত কাঁদি; কিন্তু বাবা আমাকে চিঠিও লেখে না, নিয়েও যায় না। জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, তোমার বাবা এতদূরে তোমার বিয়ে দিলেন কেন? মেয়েটি কহিল, আমরা যে তেওয়ারী। আমাদের ঘর ও-দেশে ত পাওয়া যায় না। তোমাকে কি এরা মারধোর করে? করে না? এই দেখ না, বলিয়া মেয়েটি বাহুতে, পিঠের উপর, গালের উপর দাগ দেখাইয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, আমিও দিদির মত গলায় দড়ি দিয়ে মরব। তাহার কান্না দেখিয়া আমার নিজের চক্ষুও সজল হইয়া উঠিল। আর প্রশ্নোত্তর বা ভিক্ষার অপেক্ষা না কারিয়াই বাহির হইয়া পড়িলাম। মেয়েটি কিন্তু আমার পিছনে পিছনে আসিয়া বলিতে লাগিল, আমার বাবাকে গিয়ে তুমি
false
tarashonkor
উহার আগে আগে চলিবার শক্তি চৌধুরীর নাই। পাতু কিন্তু নিজেই পথ করিয়া লইল, সে পাশের জমিতে নামিয়া পড়িয়া ধানের মধ্য দিয়া যাইবার জন্য উদ্যত হইল। সহসা সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া চৌধুরীকে একটা প্রণাম করিয়া বলিল দ্যাখেন চৌধুরী মশাই দ্যাখেন। চৌধুরী পাতুর মুখের দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠিল। কপালে একটা সদ্য আঘাতচিহ্ন হইতে রক্ত ঝরিয়া মুখখানাকে রক্তাক্ত করিয়া দিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রী ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল। –ওগো, বাবুমশায় গো! খুন করলে গো! –এ্যাঁও! পাতু গর্জন করিয়া উঠিল। আবার চেঁচাতে লাগিলি মাগী? সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর নামিয়া গেল; সে গুনগুন করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল–গরিবের কি দশা করেছে দেখেন গো, আপনারা বিচার করেন গো! পাতু পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পিঠ দেখাইয়া বলিল—দেখেন, পিঠ দেখেন। এবার চৌধুরী দেখিল পাতুর পিঠে লম্বা দড়ির মত নির্মম প্রহার-চিহ্ন রক্তমুখী হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। দাগ একটা-দুইটা নয়—দাগে দাগে পিঠটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত। চৌধুরী অকপট মমতা ও সহানুভূতিতে বিচলিত হইয়া উঠিল, আবেগবিগলিত স্বরেই বলিল—আ-হা-হা! কে এমন কল্লে রে পাতু? –আজ্ঞে, ওই ছিরু পাল। রাগে গগন্ করিতে করিতে প্রশ্ন শেষ হইবার পূর্বেই পাতু উত্তর দিল-–কথা নাই, বার্তা নাই, এসেই এক গাছা দড়ির বাড়িতে দেখেন কি করে দিলে দেখেন। আবার সে পিছন ফিরিয়া ক্ষতবিক্ষত পিঠখানা চৌধুরীর চোখের সামনে ধরিল। তারপর আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-দড়িখানা চেপে ধরলাম তো একগাছা বখারির ঘায়ে কপালটাকে একেবারে দিল ফাটিয়ে। ছিরু পাল—শ্ৰীহরি ঘোষ? অবিশ্বাস করিবার কিছু নাই। উঃ, নির্মমভাবে প্রহার করিয়াছে। চৌধুরীর চোখে অকস্মাৎ জল আসিয়া গেল। এক এক সময় অপরের দুঃখ-দুর্দশায় মানুষ এমন বিচলিত হয় যে, তখন নিজের সকল সুখ-দুঃখকে অতিক্ৰম করিয়া নির্যাতিতের দুঃখ যেন আপন দেহমন দিয়া প্ৰত্যক্ষভাবে অনুভব করে। চৌধুরী এমনই একটি অবস্থায় উপনীত হইয়া সজল চক্ষে পাতুর দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার দন্তহীন মুখের শিথিল ঠোঁট অত্যন্ত বিশ্রী ভঙ্গিতে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। পাতু বলিল—মোড়লদের ফিজনার কাছে গেলাম। তা কেউ রা কাড়লে না মশায়। শক্তর সব দুয়োর মুক্ত। পাতুর বউ অনুচ্চ কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলিতেছিল—সর্বনাশী কালামুখীর লেগে গো— পাতু একটা ধমক করিয়া বলিল—অ্যাই—অ্যাই, আবার ঘ্যানঘ্যান করে। চৌধুরী একটু আত্মসংবরণ করিয়া বলিল—কেন অমন করে মারলে? কি এমন দোষ করেছ তুমি যে– অভিযোগ করিয়া পাতু কহিল—সেদিন চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে বলতে গেলাম–তো আপনি শুনলেন না, চলে গেলেন। গোটা গেরামের লোকের আঙোটজুতি আমাকে সারা বছর যোগাতে হয়, অথচ আমি কিছুই পাই না। তা কর্মকার যখন রব তুললে, তখন আমিও বলেছিলাম যে, আমি আর আঙোটজুতি যোগাতে লারব। কাল সানঝেতে পালের মুনিষ আঙোটজুতি চাইতে এসেছিল—আমি বলেছিলাম-পয়সা আন গিয়ে! তা আমার বলা বটে আজ সকালে উঠে এসেই কথা নাই বাৰ্ত্তা নাই-আথালি-পাথালি দড়ি দিয়ে মার! চৌধুরী চুপ করিয়া রহিল। পাতুর বউ বার বার ঘাড় নাড়িয়া মৃদু বিলাপের সুরে সেই বলিয়াই চলিল না গো বাবুমশায়— পাতু তাহার কথা ঢাকিয়া দিয়া বুলিল-আমার পেট চলে কি করেসেটা আপনারা বিচার করবেন না, আর এমনি করে মারবেন? চৌধুরী কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল—শ্ৰীহরি তোমাকে এমন করে মেরেছে—মহা অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, হাজার বার লক্ষ বার, সে কথা সত্যি; কিন্তু আঙোটজুতির কথাটা তুমি জান না বাবা পাতু! গায়ের ভাগাড় তোমরা যে দখল করতার। জন্যেই তোমাদিগে গায়ের আঙোটজুতি যোগাতে হয়। এই নিয়ম। ভাগাড়ে মড়ি পড়লে তোমরা চামড়া নাও, হাড় বিক্রি কর, তারই দরুন তোমরা ওই আঙোটজুতিমাংস কাটিয়া লইয়া যাওয়ার কথাটা আর চৌধুরী ঘূণাবশে উচ্চারণ করিতে পারিল না। পাতু অবাক হইয়া গেল; সে বলিলভাগাড়ের দরুন! –হ্যাঁ। তোমাদের প্রবীণেরা তো কেউ নাই, তারা সব জানত। —শুধু তাই নয়, মশায়; ওই পোড়ামুখী কলঙ্কিনী গো? এই ফাঁকে পাতুর বউ আবার সুর তুলিল। পাতু এবার সঙ্গে সঙ্গে বলিল–আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু তো আঙোটজুতিও লয়; আপনারা ভদ্রনোকরা যদি আমাদের ঘরের মেয়েদের পানে তাকান—তবে আমরা যাই কোথা বলুন? প্রৌঢ় প্রবীণ ধর্মপরায়ণ চৌধুরী বলিয়া উঠিল—রাম! রাম! রাম! রাধাকৃষ্ণ! রাধাকৃষ্ণ! পাতু বলিল–আজ্ঞে রাম রাম লয়, চৌধুরী মশায়। আমার ভগ্নী দুর্গা একটু বজ্জাত বটে; বিয়ে দেলাম তো পালিয়ে এল শ্বশুরঘর থেকে। সেই তারই সঙ্গে মশায় ছিরু পাল ফষ্টিনষ্টি করবে। যখন তখন পাড়ায় এসে ছুতোনাতা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে বসবে। আমার মা হারামজাদীকে তো জানেন? চিরকাল একভাবে গেল; ছিরু পালকে বসতে মোড়া দেবেতার সঙ্গে ফুসফাস করবে। ঘরে মশায়, আমার বউ রয়েছে। তাকে, মাকে আর দুর্গাকে আমি ঘা-কতক করে দিয়েছিলাম। মোড়লকেও বলেছিলাম, ভাল করেই বলেছিলাম চৌধুরী মশাই,–আমাদের জাতজ্ঞেতে নিন্দে করে—আর আপনি আসবেন না মশায়। এ আক্কোশটাও আছে মশাই। লাঠি ও ছাতায় চৌধুরীর দুই হাত ছিল আবদ্ধ, কানে আঙুল দিবার উপায় ছিল না; সে ঘৃণাভরে থুতু ফেলিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিলরাধাকৃষ্ণ হে! থাক পাতু, থাক বাবা-সক্কালবেলা ওসব কথা আমাকে আর শুনিও না। এতে আর আমার কি হাত আছে বল? রাধাকৃষ্ণ! পাতু কিন্তু ইহাতে তুষ্ট হইল না। সে কোনো কথা না বলিয়া চৌধুরীকে পাশ কাটাইয়া। হনহন করিয়া অগ্রসর হইল। তাহার পিছন পিছন তাহার স্ত্রী আবার ছুটিতে আরম্ভ করিল–স্বামীর নীরবতার সুযোগ পাইয়া সে আবার কান্নার সুরে সুর করিল-হারামজাদী আবার ঢং করে। ভাইয়ের দুঃখে ঘটা করে কানতে বসেছে গো! ওগো আমি কি করব গো! পাতু বিদ্যুৎগতিতে ফিরিল; সঙ্গে সঙ্গে বউটি আতঙ্কে অস্ফুট চিৎকার করিয়া উঠিল—অ্যাঁ— পাতু মুখ খিঁচাইয়া বলিল—চেন্নাস না বাপু। তোকে কিছু বলি নাই… তু থাম। ধাক্কা দিয়া স্ত্রীকে সরাইয়া
false
robindronath
৬ মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, বুড়ো কর্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে। দেশটাকে সে নাড়েও না, অথচ ছাড়েও না। দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ, যারা দিনের বেলা নায়েবের ভয়ে কথা কয় না, তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে বলে, ‘কর্তা, এখনো কি ছাড়বার সময় হয় নি।’ কর্তা বলেন, ‘ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।’ তারা বলে, ‘ভয় করে যে, কর্তা।’ কর্তা বলেন, ‘সেইখানেই তো ভূত।’ শ্রাবণ ১৩২৬ ভোরবেলায় সে বিদায় নিলে। আমার মন আমাকে বোঝাতে বসল, “সবই মায়া।” আমি রাগ করে বললেম, “এই তো টেবিলে সেলাইয়ের বাক্স, ছাতে ফুলগাছের টব, খাটের উপর নাম-লেখা হাতপাখাখানি— সবই তো সত্য।” মন বললে, “তবু ভেবো দেখো—” আমি বললেম, “থামো তুমি। ঐ দেখো-না গল্পের বইখানি,মাঝের পাতায় একটি চুলের কাঁটা, সবটা পড়া শেষ হয় নি; এও যদি মায়া হয়, সে এর চেয়েও বেশি মায়া হল কেন।” মন চুপ করলে। বন্ধু এসে বললেন, “যা ভালো তা সত্য, তা কখনো যায় না; সমস্ত জগৎ তাকে রত্নের মতো বুকের হারে গেঁথে রাখে।” আমি রাগ করে বললেম, “কী করে জানলে। দেহ কি ভালো নয়। সে দেহ গেল কোন্‌খানে।” ছোটো ছেলে যেমন রাগ করে মাকে মারে তেমনি করেই বিশ্বে আমার যা-কিছু আশ্রয় সমস্তকেই মারতে লাগলেম। বললেম, “সংসার বিশ্বাসঘাতক।” হঠাৎ চমকে উঠলেম। মনে হল কে বললে, “অকৃতজ্ঞ! ” জানলার বাইরে দেখি ঝাউগাছের আড়ালে তৃতীয়ার চাঁদ উঠছে, যে গেছে যেন তারই হাসির লুকোচুরি। তারা-ছিটিয়ে-দেওয়া অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি ভর্ৎসনা এল, “ধরা দিয়েছিলেম সেটাই কি ফাঁকি, আর আড়াল পড়েছে, এইটেকেই এত জোরে বিশ্বাস? ” আমাদের এই শানবাঁধানো গলি, বারে বারে ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে একদিন কী যেন খুঁজতে বেরিয়েছিল। কিন্তু, সে যে দিকেই যায় ঠেকে যায়। এ দিকে বাড়ি, ও দিকে বাড়ি, সামনে বাড়ি। উপরের দিকে যেটুকু নজর চলে তাতে সে একখানি আকাশের রেখা দেখতে পায়— ঠিক তার নিজেরই মতো সরু, তার নিজেরই মতো বাঁকা। সেই ছাঁটা আকাশটাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বলো তো দিদি, তুমি কোন্ নীল শহরের গলি।’ দুপুরবেলায় কেবল একটুখনের জন্যে সে সূর্যকে দেখে আর মনে মনে বলে, ‘কিচ্ছুই বোঝা গেল না।’ বর্ষামেঘের ছায়া দুইসার বাড়ির মধ্যে ঘন হয়ে ওঠে, কে যেন গলির খাতা থেকে তার আলোটাকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দিয়েছে। বৃষ্টির ধারা শানের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, বর্ষা ডমরু বাজিয়ে যেন সাপ খেলাতে থাকে। পিছল হয়, পথিকদের ছাতায় ছাতায় বেধে যায়, ছাদের উপর থেকে ছাতার উপরে হঠাৎ নালার জল লাফিয়ে প’ড়ে চমকিয়ে দিতে থাকে। গলিটা অভিভূত হয়ে বলে, ‘ছিল খট্‌‍খটে শুকনো, কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু, কেন অকারণে এই ধারাবাহী উৎপাত?’ ফাল্গুনে দক্ষিণের হাওয়াকে গলির মধ্যে লক্ষ্ণীছাড়ার মতো দেখতে হয়; ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো এলোমেলো উড়তে থাকে। গলি হতবুদ্ধি হয়ে বলে, ‘এ কোন্ পাগলা দেবতার মাৎলামি!’ তার ধারে ধারে প্রতিদিন যে-সব আবর্জনা এসে জমে— মাছের আঁশ, চুলোর ছাই, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর, সে জানে এই-সব হচ্ছে বাস্তব। কোনোদিন ভুলেও ভাবে না, ‘এ সমস্ত কেন।’ অথচ, শরতের রোদ্‌‍দুর যখন উপরের বারান্দায় আড় হয়ে পড়ে, যখন পুজোর নহবত ভৈরবীতে বাজে, তখন ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, ‘এই শানবাঁধা লাইনের বাইরে মস্ত একটা-কিছু আছে বা!’ এ দিকে বেলা বেড়ে যায়; ব্যস্ত গৃহিণীর আঁচলটার মতো বাড়িগুলোর কাঁধের উপর থেকে রোদ্‌‍দুরখানা গলির ধারে খসে পড়ে; ঘড়িতে ন’টা বাজে; ঝি কোমরে ঝুড়ি করে বাজার নিয়ে আসে; রান্নার গন্ধে আর ধোঁয়ায় গলি ভরে যায়; যারা আপিসে যায় তারা ব্যস্ত হতে থাকে। গলি তখন আবার ভাবে, ‘এই শানবাঁধা লাইনের মধ্যেই সব সত্য। আর, যাকে মনে ভাবছি মস্ত একটা-কিছু সে মস্ত একটা স্বপ্ন।’ অগ্রহায়ণ ১৩২৬ ছেলেটির যেমনি কথা ফুটল অমনি সে বললে, ‘গল্প বলো।’ দিদিমা বলতে শুরু করলেন, ‘এক রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সদাগরের পুত্তুর—’ গুরুমশায় হেঁকে বললেন, ‘তিন-চারে বারো।’ কিন্তু তখন তার চেয়ে বড়ো হাঁক দিয়েছে রাক্ষসটা ‘হাঁউ মাউ খাঁউ’—নামতার হুংকার ছেলেটার কানে পৌঁছয় না। যারা হিতৈষী তারা ছেলেকে ঘরে বন্ধ ক’রে গম্ভীর স্বরে বললে, ‘তিন-চারে বারো এটা হল সত্য; আর রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সওদাগরের পুত্তুর—ওটা হল মিথ্যে, অতএব—’ ছেলেটির মন তখন সেই মানসচিত্রের সমুদ্র পেরিয়ে গেছে মানচিত্রে যার ঠিকানা মেলে না; তিন-চারে বারো তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে যায়, কিন্তু সেখানে ধারাপাতের হালে পানি পায় না। হিতৈষী মনে করে, নিছক দুষ্টমি, বেতের চোটে শোধন করা চাই। দিদিমা গুরুমশায়ের গতিক দেখে চুপ। কিন্তু আপদ বিদায় হতে চায় না, এক যায় তো আর আসে। কথক এসে আসন জুড়ে বসলেন। তিনি শুরু করে দিলেন এক রাজপুত্রের বনবাসের কথা। যখন রাক্ষসীর নাক কাটা চলছে তখন হিতৈষী বললেন, ‘ইতিহাসে এর কোনো প্রমাণ নেই; যার প্রমাণ পথে ঘাটে সে হচ্ছে, তিন-চারে বারো।’ ততক্ষণে হনুমান লাফ দিয়েছে আকাশে, অত ঊর্ধ্বে ইতিহাস তার সঙ্গে কিছুতেই পাল্লা দিতে পারে না। পাঠশালা থেকে ইস্কুলে, ইস্কুল থেকে কলেজে ছেলের মনকে পুটপাকে শোধন করা চলতে লাগল। কিন্তু যতই চোলাই করা যাক, ঐ কথাটুকু কিছুতেই মরতে চায় না ‘গল্প বলো’। ২ এর থেকে দেখা যায়, শুধু শিশুবয়সে নয়, সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব। তাই পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে, যুগে যুগে, মুখে মুখে, লেখায় লেখায়, গল্প যা
false
humayun_ahmed
এই সমস্যা–জ্ঞানের কথা বলতে ইচ্ছা করে। উদাহরণ দিয়ে কোনো জ্ঞানের কথা বলতে পারলে ভালো লাগে। বাবা তার চেহারায় ভালো লাগা ভাব নিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী ইদানীং টগর কী করছে না-করছে সে সম্পর্কে কিছু জানি। আমি বললাম, না। কম্পিউটারের কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, সেটা তো যতদূর জানি সে করছে। না। ভাইয়ার চোখে সমস্যা। সে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না। চোখে সমস্যা এইসব ভুয়া কথা। কোনো কিছু করার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। সে ধরেই নিয়েছে বাবার মৃত্যুর পর বিরাট বিষয়সম্পত্তির মালিক হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে যাবে। তার চিন্তাটা ঠিক না। যে অপদার্থ তাকে আমি কিছু দিয়ে যাব না। তাকে পথে পথে ঘুরতে হবে। এই কথাটা তাকে বুঝিয়ে বলিস তো। তুমি বুঝিয়ে বলো। তুমি শিক্ষক মানুষ। উদাহরণ দিয়ে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে পারো। আমি পারি না। এই তো একটু আগে গ্যাস নিয়ে কথা বললে। জানালা খুললে গ্যাস বের হয়ে যাবে – এইসব উদাহরণ তো আমি জানি না। বাবা আহত চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি মন খারাপ করেছেন। যে মানুষটার মন খারাপ সে তার মন খারাপটা ছড়িয়ে দিতে চায় অন্যদের ভেতর। যার মন উফুল্ল সে চায় তার ফুল্ল ভাব ছড়িয়ে দিতে। আমি ঠিক এই কাজটাই করছি। জেনে শুনে করছি তা না। নিজের অজান্তেই করছি। যে মস্তিস্ক আমাদের পরিচালনা করছে সে করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। মানুষ স্বাধীন না, সে তার মস্তিষ্কের অধীনে বাস করে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ভাইয়ার ঘরে ঊকি দিলাম। জানালা দিয়ে উকি। এটা আমার নিয়মিত রুটিনে পড়ে না। কাজটা কেন করলাম? ঘুমোনার আগে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে। তা তো না। ভাইয়া গল্প করতে পারে না। কিছু বললে ঠোট চেপে হাসে। মাঝে মধ্যে মাথা দোলায়। তাহলে কি আমার অবচেতন মন এই ঘরে কিছু খুঁজছে? ভাইয়ার বন্ধুকে আমি খুঁজছি? ভাইয়ার ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতরটা যথারীতি অন্ধকার। ঘরের ভেতর ভাইয়া ছাড়া দ্বিতীয় কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ভাইয়া বড় বড় করে শ্বাস ফেলছে এটা শোনা যাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে। ভাইয়া হয়তো ঘুমুচ্ছে। মৃ! জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিস কেন? আমি ভাইয়ার কথা শুনে জানালা থেকে সরে এসে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, তোমার ঘরে কেউ লুকিয়ে আছে কি-না দেখতে এসেছি। বাবা পাঠিয়েছেন? কেউ পাঠায় নি, আমি নিজেই এসেছি। অন্ধকার ঘরে দেখবি কী? বাতি জ্বালিয়ে দেখ। খাটের নিচে উঁকি দে। তোমার ঐ বন্ধু আর আসে নি? কোন বন্ধু? নাম তো আমি জানি না। মাথায় কোঁকড়া চুল। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির ছাদে ঘুমায়। যাকে পুলিশ খুঁজছে। ও আচ্ছা! তার নাম কী? ভাইয়া হাসল। নাম বলতে তার বোধহয় কোনো সমস্যা আছে। আমি তো ভাইয়া পুলিশের কোনো ইনফরমার না। নাম বলতে তোমার সমস্যা কী? কোনো সমস্যা নেই। বোস, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর ডান দিকেই চেয়ায় দেখতে পাচ্ছিস নাকি বাতি জ্বালতে হবে? দেখতে পাচ্ছি। ভাইয়া, তোমার ঐ কোঁকড়া চুলের বন্ধু ও কি খুবই ভয়ঙ্কর? হ্যাঁ ভয়ঙ্কর। ও করে কী? এমনিতে কিছু করে না। দিন রাত মন খারাপ করে থাকে। কেউ মজার কোনো কথা বললে খুব মজা পায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ করে ফেলে। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এসএসসি-তে ঢাকা বোর্ডে ফিফথ প্লেস পেয়েছিল। কলেজে ওঠার পর আর পড়াশোনা হয় নি। এটা তো তার কোনো পরিচয় হলো না ভাইয়া। আমি জানতে চাচ্ছি ও করে কী? কেন ভয়ঙ্কর? ও ভাড়া খাটে। ভাড়া খাটে মানে? যে কেউ তাকে ভাড়া করতে পারে। মনে কর, কেউ খারাপ কিছু কাজ করতে চায়, নিজে করতে পারছে না ওকে ভাড়া করে নিয়ে গেল। খারাপ কাজটা কী রকম? মানুষ খুন? হ্যাঁ। টাকা দিলেই সে মানুষ খুন করবে। হ্যাঁ করবে। মানুষ খুন করতে সে কত টাকা নেয়? জানি না। আমি জিজ্ঞেস করি নি। তোমার এত প্রিয় বন্ধু, রাতে তোমার সঙ্গে থাকতে আসে আর তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি? ভাইয়া হাসল। মজার কোনো কথা শুনলে মানুষ যেভাবে হাসে ঠিক সেরকম হাসি। আমি বললাম, ভাইয়া আমি যদি তোমার ঐ বন্ধুকে বলি– এই নিন টাকা, আমি অমুক লোকটাকে খুন করতে চাই। সে করবে? করার তো কথা। এরকম বন্ধু তোমার কজন আছে? ভাইয়া আবারও হাসল। যেন আবারও আমি মজার কোনো কথা বলেছি। ওদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে তোমার ওদের মতো হতে ইচ্ছে করে না? না। ওরা আমার মতো হয় না। আমিও ওদের মতো হই না। যা, ঘুমুতে যা। কেউ কি আসবে তোমার কাছে? ভাইয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম, তুমি কিন্তু এখনো ঐ ছেলের নাম বলো নি। ভাইয়া আবারও বলল, যা ঘুমুতে যা। আমি ঘুমুতে গেলাম এবং আশ্চর্যের কথা খুবই সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম কাওসার স্যার মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন। আমি মোটর সাইকেলের পেছনে বসে আছি। হাওয়ায় আমার মাথার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। মোটর সাইকেল প্রায় উড়ে যাচ্ছে। আমার মোটেই ভয় লাগছে না। তার পরেও কপট ভয়ের অভিনয় করে বলছি এই তুমি কি একটু আস্তে চালাতে পারে না? স্যার বললেন, না, পারি না। আমি বললাম, ছিটকে পড়ে যাব তো। স্যার বললেন, পড়বে না। আমার কোমর জড়িয়ে ধরে
false
robindronath
ক্ষুদ্র বুকটির মধ্যে কী হৃৎকম্পই উপস্থিত হইয়াছিল। গল্প ফুরাইলে পর রামমোহন কহিল, “মা, তোমার জন্য চারগাছি শাঁখা আনিয়াছি, তোমাকে ঐ হাতে পরিতে হইবে, আমি দেখিব।” বিভা তাহার চারগাছি সোনার চুড়ি খুলিয়া শাঁখা পরিল ও হাসিতে হাসিতে মায়ের কাছে গিয়া কহিল, “মা, মোহন তোমার চুড়ি খুলিয়া আমাকে চারগাছি শাঁখা পরাইয়া দিয়াছে।” মহিষী কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট না হইয়া হাসিয়া কহিলেন, “তা বেশ তো সাজিয়াছে, বেশ তো মানাইয়াছে।” রামমোহন অত্যন্ত উৎসাহিত ও গর্বিত হইয়া উঠিল। মহিষী তাহাকে ডাকাইয়া লইয়া গেলেন, নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাহাকে আহার করাইলেন। সে তৃপ্তিপূর্বক ভোজন করিলে পর তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “মোহন, এইবারে তোর সেই আগমনীর গানটি গা।” রামমোহন বিভার দিকে চাহিয়া গাহিল, “সারা বরষ দেখি নে মা, মা তুই আমার কেমনধারা, নয়নতারা হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা। এলি কি পাষাণী ওরে দেখব তোরে আঁখি ভরে কিছুতেই থামে না যে মা, পোড়া এ নয়নের ধারা।” রামমোহনের চোখে জল আসিল, মহিষীও বিভার মুখের দিকে চাহিয়া চোখের জল মুছিলেন। আগমনীর গানে তাঁহার বিজয়ার কথা মনে পড়িল। ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। পুরমহিলাদের জনতা বাড়িতে লাগিল। প্রতিবেশিনীরা জামাই দেখিবার জন্য ও সম্পর্ক অনুসারে জামাইকে উপহাস করিবার জন্য অন্তঃপুরে সমাগত হইল। আনন্দ, লজ্জা, আশঙ্কা, একটা অনিশ্চিত অনির্দেশ্য না-জানি-কী-হইবে ভাবে বিভার হৃদয় তোলপাড় করিতেছে, তাহার মুখ-কান লাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত-পা শীতল হইয়া গিয়াছে। ইহা কষ্ট কি সুখ কে জানে! জামাই অন্তঃপুরে আসিয়াছেন। হুলবিশিষ্ট সৌন্দর্যের ঝাঁকের ন্যায় রমণীগণ চারিদিক হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছে। চারিদিকে হাসির কোলাহল উঠিল। চারিদিক হইতে কোকিল-কণ্ঠের তীব্র উপহাস, মৃণাল-বাহুর কঠোর তাড়ন, চম্পক-অঙ্গুলির চন্দ্র-নখরের তীক্ষ্ণ পীড়ন চলিতে লাগিল। রামচন্দ্র রায় যখন নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একজন প্রৌঢ়া রমণী আসিয়া তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া বসিল। সে কঠোর কণ্ঠে এমনি কাটা কাটা কথা কহিতে লাগিল ও ক্রমেই তাহার মুখ দিয়া এমনি সকল রুচির বিকার বাহির হইতে লাগিল যে পুররমণীদের মুখ একপ্রকার বন্ধ হইয়া আসিল। তাহার মুখের কাছে থাকোদিদিও চুপ করিয়া গেলেন। বিমলাদিদি ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। কেবল ভুতোর মা তাহাকে খুব এক কথা শুনাইয়াছিল। যখন উল্লিখিত ভুতোর মার মুখ খুব চলিতেছিল, তখন সেই প্রৌঢ়া তাহাকে বলিয়াছিল, “মাগো মা, তোমার মুখ নয় তো, একগাছা ঝাঁটা।” ভুতোর মা তৎক্ষণাৎ কহিল, “আর মাগি, তোর মুখটা আঁস্তাকুড়, এত ঝাঁটাইলাম তবুও সাফ হইল না।” বলিয়া গস গস করিয়া চলিয়া গেল। একে একে ঘর খালি হইল, রামচন্দ্র রায় বিরাম পাইলেন। তখন সেই প্রৌঢ়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া মহিষীর কক্ষে উপস্থিত হইল। সেখানে মহিষী দাসদাসীদিগকে খাওয়াইতেছিলেন। রামমোহনও একপার্শ্বে বসিয়া খাইতেছিল। সেই প্রৌঢ়া মহিষীর কাছে আসিয়া তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, “এই যে নিকষা জননী।” শুনিবামাত্র রামমোহন চমকিয়া উঠিল, প্রৌঢ়ার মুখের দিকে চাহিল। তৎক্ষণাৎ আহার পরিত্যাগ করিয়া শার্দূলের ন্যায় লম্ফ দিয়া তাহার দুই হস্ত বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া বজ্রস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমি যে ঠাকুর তোমায় চিনি।” বলিয়া তাহার মস্তকের বস্ত্র উন্মোচন করিয়া ফেলিল। আর কেহ নহে, রমাই ঠাকুর। রামমোহন ক্রোধে কাঁপিতে লাগিল, গাত্র হইতে চাদর খুলিয়া ফেলিল; দুই হস্তে অবলীলাক্রমে রমাইকে আকাশে তুলিল, কহিল, “আজ আমার হাতে তোর মরণ আছে।” বলিয়া তাহাকে দুই-এক পাক আকাশে ঘুরাইল। মহিষী ছুটিয়া আসিয়া কহিলেন, “রামমোহন তুই করিস কী?” রমাই কাতর স্বরে কহিল, “দোহাই বাবা, ব্রহ্মহত্যা করিস না।” চারিদিক হইতে বিষম একটা গোলযোগ উঠিল। তখন রামমোহন রমাইকে ভূমিতে নামাইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “হতভাগা, তোর কি আর মরিবার জায়গা ছিল না?” রমাই কহিল, “মহারাজ আমাকে আদেশ করিয়াছেন।” রামমোহন বলিয়া উঠিল, “কী বলিলি, নিমকহারাম? ফের অমন কথা বলিবি তো এই শানের পাথরে তোর মুখ ঘষিয়া দিব।” বলিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিল। রমাই আর্তনাদ করিয়া উঠিল। তখন রামমোহন খর্বকায় রমাইকে চাদর দিয়া বাঁধিয়া বস্তার মতন করিয়া ঝুলাইয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে কথাটা অনেকটা রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে। রাত্রি তখন দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। রাজার শ্যালক আসিয়া সেই রাত্রে প্রতাপাদিত্যকে সংবাদ দিলেন যে, জামাতা রমাই ভাঁড়কে রমণীবেশে অন্তঃপুরে লইয়া গেছেন। সেখানে সে পুররমণীদের সহিত, এমন কি, মহিষীর সহিত বিদ্রূপ করিয়াছে। তখন প্রতাপাদিত্যের মূর্তি অতিশয় ভয়ংকর হইয়া উঠিল। রোষে তাঁহার সর্বাঙ্গ আলোড়িত হইয়া উঠিল। স্ফীতজটা সিংহের ন্যায় শয্যা হইতে উঠিয়া বসিলেন। কহিলেন, “লছমন সর্দারকে ডাকো।” লছমন সর্দারকে কহিলেন, “আজ রাত্রে আমি রামচন্দ্র রায়ের ছিন্ন মুণ্ড দেখিতে চাই।” সে তৎক্ষণাৎ সেলাম করিয়া কহিল, “যো হুকুম মহারাজ।” তৎক্ষণাৎ তাঁহার শ্যালক তাঁহার পদতলে পড়িল, কহিল, “মহারাজ, মার্জনা করুন, বিভার কথা একবার মনে করুন। অমন কাজ করিবেন না।” প্রতাপাদিত্য পুনরায় দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “আজ রাত্রের মধ্যেই আমি রামচন্দ্র রায়ের মুণ্ড চাই।” তাঁহার শ্যালক তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “মহারাজ, আজ তাঁহারা অন্তঃপুরে শয়ন করিয়াছেন, মার্জনা করুন, মহারাজ, মার্জনা করুন।” তখন প্রতাপাদিত্য কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিলেন, “লছমন, শুন, কাল প্রভাতে যখন রামচন্দ্র রায় অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবে তখন তাহাকে বধ করিবে, তোমার উপর আদেশ রহিল।” শ্যালক দেখিলেন, তিনি যত-দূর মনে করিয়াছিলেন তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইয়া গিয়াছে। তিনি সেই রাত্রে চুপি চুপি আসিয়া বিভার শয়নকক্ষের দ্বারে আঘাত করিলেন। তখন দূর হইতে দুই প্রহরের নহবত বাজিতেছে। নিস্তব্ধ রাত্রে নেই নহবতের শব্দ জ্যোৎস্নার সহিত দক্ষিণা বাতাসের সহিত মিশিয়া ঘুমন্ত প্রাণের মধ্যে স্বপ্ন সৃষ্টি করিতেছে। বিভার শয়নকক্ষের মুক্ত বাতায়ন
false
nihar_ronjon_gupta
দোহাই হুজুরের, মা-বাপ—আমি কিছু জানি না, আমার দেবতার মত মুনিব—হায় হায়, এ কি হল ঈশ্বর– বাড়িতে তোর কে কে আছে? ছেলে মেয়ে পরিবোর—সবাই আছে হুজুর। কাল কত রাত্রে ঘুমিয়েছিলি? বাবু দশটা নাগাদ খেয়ে নিতেই, আমিও খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। বাবু কাল অফিস থেকে কখন ফিরেছিলেন? বাবু কাল অফিসেই যাননি।–কেবল বেলা বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ একবার বের হয়েছিলেন, কিন্ত একটু পরেই ফিরে আসেন—আর বের হননি। কাল নীচের তলায় যে খুন হয়েছে জানিস? জা-জানি হুজুর। জানিস? হ্যাঁ, আমরা তো তখন উপরে যখন পুলিস আসে—আমি, বাবু— তুই আর তোর বাবু তখন উপরেই ছিলি? আজ্ঞে হুজুর। বাবু ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কেন? ভয় পেয়েছিলেন কেন? কে জানে হুজুর—দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে ছিলেন। হুঁ। তা নীচে কাল দুপুরে কোন চিৎকার বা চেঁচামেচির শব্দ শুনেছিলি? না বাবু। সত্যি কথা বল? মা কালীর দিব্বি বাবু-কিছু শুনিনি। তবে জানতে পারলি কি করে যে খুন হয়েছে। নীচের ফ্ল্যাটে —পুলিস এসেছে? আজ্ঞে বাবু বললেন— বাবু বললেন! হ্যাঁ, বাবু ঐ সময় আবার জামাকাপড় পরে কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন—সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পুলিস দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। তা খুন হয়েছেন নীচে জানলেন কি করে? তা জানি না বাবু— তারপর কি হল? বাবু উপরে উঠে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জামা কাপড় খুলে ফেললেন। দাশু? আজ্ঞে হুজুর— তুই নেশা-টেশা করিস কিছু? আজ্ঞে! নিশা-টেশা করিস? আজ্ঞে এই যৎসামান্য– তা কিসের নেশা করিস? দামী নেশা কোথায় পাব হুজুর—সামান্য একটু-আধটু বড় কলকে— হুঁ। কাল বড় কলকে হয়েছিল? আজ্ঞে। যা বলছি তার জবাব দে। আজ্ঞে– কাল একটু বেশী নেশা তোর হয়েছিল, তাই না? আজ্ঞে। কখন বড় কলকে টেনেছিলি? সন্ধ্যায়? আজ্ঞে না-বাবু তাহলে জেনে ফেলবেন-রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর— তারপর? তারপর তো কিছু জানি না হুজুর— নীচের বাবুর সঙ্গে তোর আলাপ ছিল? তা ছিল বৈকি হুজুর। তোর বাবুর? বাবুর! হ্যাঁ ছিল বৈকি। নীচের চাকরিটা-মানে ঐ শম্ভুকে চিনিস না? হ্যাঁ-একটি ঘুঘু, বয়েস ওর অনেক হুজুর। ও মিথ্যা বলে ওর বয়েস। তাই নাকি? আজ্ঞে। তা বুঝলি কি করে শম্ভু একটি ঘুঘু? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে। ও আমরা দেখলেই চিনতে পারি।–দাশু বললে। হুঁ। তা তুই আজ কখন জানতে পারিস যে তোর বাবু খুন হয়েছেন? বাবুর ঘুম ভাঙার পরই এক কাপ চায়ের দরকার হয়, সেই চা নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি—শোবার ঘরে বাবু নেই, তখন ভাবলাম বাবু বোধ হয়। বাথরুমে, কিন্তু কেউ নেই— ঐ সময় দুধওয়ালা দুধ নিয়ে আসে—কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিতে গিয়েই দেখি— সদর দরজা খোলা ছিল, না বন্ধ? আজ্ঞে, বন্ধ। ভিতর থেকে খিল দেওয়া ছিল? না। বিকাশ ঐ সময় বলে, দরজায় গডরেজের অটোমেটিক ডোরলক লাগানো স্যার। তাই নাকি! হ্যাঁ স্যার, আমার মনে হয়। হত্যাকারী হত্যা করার পর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে হয়তো আবার লক করে দিয়ে গিয়েছিল। বিকাশ বললে। তারপর তুই কি করলি দাণ্ড? আজ্ঞে প্রথমটায় কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর দোতলায় ছুটে গিয়ে যে সেপাইজী পাহারায় ছিল তাকে ডেকে আনি। লালবাজারে কে খবর দিয়েছিল বিকাশ? কারণ সিং— সে-ই তো নীচের ফ্ল্যাটের সামনে পাহারায় ছিল? হ্যাঁ স্যার— সে কোন শব্দটব্দ উপরে শোনেনি? না। স্যার। আরো আধঘণ্টা পরে সুদৰ্শন ফিরে এল লালবাজারে, বিকাশের উপরেই বাকি কাজের ভার দিয়ে। নিজের ঘরে ঢুকেই একজন সার্জেণ্টকে বললে সমীরণকে তার অফিস-কামরায় নিয়ে আসবার জন্য। একটু পরে সমীরণ সার্জেণ্টর সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকল। এক রাত্রেই তার চেহারা যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ শুকনো-সমস্ত মুখে যেন একটা ক্লান্তি ও অবসন্নতা। বসুন সমীরণবাবু। সমীরণ বসল সুদর্শনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে। চা বোধ হয় খাননি—বলে সুদৰ্শন একজন সেপাইকে ডেকে সমীরণকে চা দেবার জন্য বললে। কাল ঘুমোতে পারেন নি মনে হচ্ছে! সুদৰ্শনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না সমীরণ। সমীরণবাবু! সমীরণ মুখ তুলে তাকাল। বিজিতা দেবীকে আপনি তো অনেক দিন থেকেই চিনতেন? চিনতাম। আপনি তাকে ভালবাসতেন, তাই না? সমীরণ মাথাটা নীচু করল, তারপর মৃদু গলায় বললে, সে সব কথার আজ আর কাজ কি মিঃ মল্লিক। বুঝতে পারছি ভালবাসতেন। আর এও বুঝেছি সত্যিই কত গভীর ভালবাসা ছিল তার প্রতি আপনার। আশ্চর্য, তা ভালই যদি বাসতেন তো তাকে বিয়ে করলেন না কেন? বিজিত বলুন। কিন্তু সে সব কথা শুনে আপনার কি লাভ মিঃ মল্লিক। বিজিতা দেবীর হত্যাকারীকে ধরতে হলে তাঁর সম্পর্কে সব কথাই জানা প্রয়োজন আমাদের সমীরণবাবু। আপনিও নিশ্চয়ই চান তাঁর হত্যাকারী ধরা পড়ুক— কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন। মিঃ মল্লিক, সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকল, তার দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে, বিজিতাকে আমি হত্যা করিনি। ও কথা থাক। আপনি মধ্যে মধ্যে ওঁদের ওখানে যেতেন? আগে আগে যেতাম—তবে ইদানীং কয়েক মাস যাইনি। কেন? মণি পছন্দ করত না জানতে পেরেই যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। মণিবাবু কিছু আপনাদের কোনদিন বলে ছিলেন? না। তবে আপনি বুঝতে পারলেন কি করে? বুঝতে পেরেছিলাম— কি করে? ঐ সময় একজন বেয়ারা এক কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল। চা-টা খেয়ে নিন। চায়ের পিপাসা আমার নেই। তবু খান না। সকালবেলাতে চা খাননি। নিন, কাপটা তুলে নিন। সমীরণ কাপটা হাতে নিয়ে একটা ছোট চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা আবার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে দিল। খেলেন না। ভাল লাগছে না। তবে থাক। যা বলছিলাম-মণিবাবু
false
humayun_ahmed
ঘুম ভেঙে যাবে। চুপচাপ শুয়ে রইলেন। বাথরুমের ট্যাপ বোধহয় ভালোমতো বন্ধ করা হয় নি। কিছুক্ষণ পর পর ‘টপ’ করে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ আসতে লাগল। এক মিনিট নীরবতা–তারপর ‘টপ’ করে একটা শব্দ। আবার নীরবতা আবার শব্দ। তিনি সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। বাথরুমের ট্যাপ ভালো করে বন্ধ করলেন। তখন ঘড়ির শব্দ শোনা যেতে লাগল। টক টক করে সেকেন্ডের কাঁটা নড়ছে। তিনি আবার উঠলেন। দেয়াল থেকে চেয়ারে দাঁড়িয়ে ঘড়ি নামানোর কোনো অর্থ হয় না। তিনি খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সামনের রাস্তা ফাঁকা। কোনো লোক চলাচল নেই। শীতের রাতে এই সময় লোক চলাচল থাকেও না। সে রাতে শীত খুব তীব্ৰ ছিল। কিন্তু তার শীত লাগিছিল না। তাঁর গায়ে ফ্লানেলের স্লিপিং স্যুট। বারান্দায় খোলা বাতাস দিচ্ছে। শীতে তাঁর জমে যাওয়ার কথা। তিনি রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। তার একটু গরম লাগতে লাগল। সেই সঙ্গে ক্ষীণ ইচ্ছা হতে লাগল। লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে। তাঁর মনে হলো পড়াটা খুব ইন্টারেস্টিং হবে। তিনতলা থেকে নিচে পড়ার সময় মাথাটা যদি আগে পড়ে তাহলে মাথা থ্যাতলানোর টাস করে একটা শব্দ হবে। সেই শব্দটাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা। এই জাতীয় চিন্তা সব মানুষের ভেতর কখনো না কখনো আসে, কিন্তু চিন্তাটা স্থায়ী হয় না। মুহূর্তের মধ্যে আসে আবার মুহুর্তের মধ্যে চলে যায়। তাঁর গেল না। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে লাফিয়ে নিচে পড়বেন। পড়ার জন্যে ভালো জায়গা রেব করতে হবে। নরম কোনো জায়গায় পড়লে হবে না। শানবাধানো জায়গায় পড়তে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবেন এই চিন্তাটা তাঁর এত ভালো লাগতে লাগিল যে আনন্দে গায়ে কাটা দিল। তার মনে হলো-অনেক অনেক দিন তিনি এই আনন্দ পাননি। তিনি রেলিঙের ওপর উঠতে যাচ্ছেন তখন শোবার ঘরের থেকে রেহানা বলল, এই তুমি একা একা এখানে কী করছ? তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এত বিরক্তি এবং এত রাগ নিয়ে তিনি তার নীর এর আগে তাকান নি। পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছ, তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না? আমি তো শীতে মরে যাচ্ছি। ঘুম আসছে না? না। ঘুমের ওষুধ খাবে? না খাওয়াই ভালো–একবার খেলে অভ্যাস হয়ে যায়। আমাকে দু’তিনটা সিডাকসিন না খেলে তন্দ্রা পর্যন্ত আসে না। এস, ভেতরে এল। ইস্‌রে কী ঠাণ্ডা! তিনি ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় ঘুমুতে গেলেন এবং বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি বোকা নন, তিনি বুদ্ধিমান মানুষ, যা ঘটেছে তা যে আবারো ঘটবে তা তিনি জানেন। তিনি যদি বেঁচে থাকতে চান সেই পথ তাঁকে খুঁজতে হবে। এখানে সাহায্য করার আসলে কেউ নেই। বিলেতে তিনি এক নামি সাইকিয়াট্রিন্টের কাছে গিয়েছিলেন। এক এক সিটিঙে। এই ভদ্রলোক পঁচাত্তর পাউন্ড করে নেন। রঙচঙে পোশাক পরা এক বুড়ো, যে ফুর্তিবাজের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা করছে। অভিনয় ভালো হচ্ছে না। মোবারক সাহেব চট করে সেই অভিনয় ধরে ফেললেন এবং বুড়োর জন্যে একটু মায়াও লাগল। বুড়ো বলল, তোমার সমস্যাটা কী? মোবারক সাহেব বললেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার কাছে এসেছে কেন? গল্প করতে এসেছি। বোস। বোস। আরাম করে বোস এবং গল্প কর। গল্প তুমি করবে, না। আমি করব? মোবারক সাহেব বললেন, দু’জনে মিলেই করব। প্ৰথমে তুমি শুরু করা–দেখি তোমার গল্পটা ইন্টারেস্টিং কিনা। তুমি নিশ্চিত তোমার কোনো সমস্যা নেই? আমি নিশ্চিত। তাহলে তো তুমি মানুষ না, তুমি ফার্নিচার গোত্রীয়–টেবিল বা চেয়ার। মানুষ হলে সমস্যা থাকতেই হবে। তোমাদের বিদ্যা তাই বলে? হ্যাঁ, তাই বলে। প্রচুর সমস্যা থাকবে–তোমরা আমাদের কাছে আসবে। আমরা খেয়ে পরে বঁচিব, তোমরাও পাউন্ড খরচের একটা জায়গা পাবে–হা-হা-হা। মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন, বুড়ো নকল হাসি হাসছে। এদের কাছে আসা অর্থহীন। তারপরেও কিছু কথাবার্তা হলো। তিনি এক সময় জানতে চাইলেন–মানুষ মরতে চায় কেন? বুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, অসংখ্য কারণে মানুষ মরতে চায়, তুমি কী জন্যে চাচ্ছ সেটা তুমি জান। মোবারক সাহেব মনে মনে বুড়োর বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। একটা সিটিঙে যে পঁচাত্তর পাউন্ড নেয়। তার কিছু বুদ্ধি তো থাকতেই হবে। বুড়োর সঙ্গে আলাপ করে মোবারক সাহেবের কোনো লাভ হয় নি। তার সমস্যা তিনি জানেন। তিনি বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলেছেন। তাঁকে বেঁচে থাকতে হলে বিস্মিত হবার ক্ষমতা ফিরে পেতে হবে। কিংবা এমন কাউকে পাশে লাগবে যার বিস্মিত হবার ক্ষমতা প্ৰবল। বইয়ের দোকান থেকে তিনি স্বপ্নের উপর দু’টা বই কিনলেন। সেলস গার্ল হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝি খুব স্বপ্ন দেখ? মেয়েটার কথা তাঁর ভালো লাগল। এই মেয়েটি রোবট হয়ে যায় নি। তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা আছে। দু’টা স্বপ্নের বই কিনতে দেখে সে বিস্মিত হয়েছে। তুমি কি আর কোনো বই নেবে? সুইসাইডের উপর কোনো বই আছে? হ্যাঁ আছে। . পাঁচ শ পৃষ্ঠার বিরাট একটা বই। তিনি ডলার দিচ্ছেন। মেয়েটা কৌতুহলী হয়ে তাকে দেখছে। রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে। এফডিসির ক্যান্টিনে এই সময় জায়গা পাওয়া মুশকিল-আজ ফাঁকা। শুধু যে ক্যান্টিন ফাঁকা তাই না–পুরো এফডিসিই ফাঁকা। সবার শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে–ফাইটার গ্রুপের একটা ছেলে মারা গেছে। শুটিং এই কারণে বন্ধ। ক্যান্টিনের ম্যানেজার বিরস মুখে বসে আছে। এক কোণায় দিলদার খাঁ বৃদ্ধা একজন এক্সট্রার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে–নানি নানি করে ডাকছে। নানির সঙ্গে ঝলমলে পোশাক পরা এক কিশোরী। চোখ বড় বড় করে সে গল্প
false
shottojit_roy
যে হরফে ওগুলো ছাপা, সেটা হয়েছে, মাত্র পনের-বিশ বছর। …আর যে আঠা দিয়ে আটকানো হয়েছে সেটা সম্বন্ধে কোন ধারনা করেছ?’ ‘গন্ধটা গ্রিপেক্স আঠার মতো।’ ‘চমৎকার ধরেছ।’ ‘কিন্তু আপনিও তো ধরার ব্যাপারে কম যান না দেখছি।’ তিনকড়িবাবু হেসে বললেন, ‘কিন্তু তোমার বয়সে আমি ডিটেকটিভ কথাটার মানে জানতুম কিনা সন্দেহ!’ বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদা বলল, ‘রাজেনবাবুর মিস্ট্রি সল্‌ভ করতে পারব কিনা জানি না— কিন্তু সেই সূত্রে তিনকড়িবাবুর সঙ্গে আলাপটা বেশ ফাউ পাওয়া গেল।’ আমি বললাম, তা হলে উনিই ব্যাপারটা তদন্ত করুন না। তুমি আর মিথ্যে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?’ ‘আহা— বাঙলা হরফের ব্যাপারটা জানা আছে বলে কি সবই জানবেন নাকি?’ ফেলুদার কথাটা শুনে ভালোই লাগল। ওর মতো বুদ্ধি আশা করি তিনকড়িবাবুর নেই। মাঝে মাঝে ফোড়ন দিলে আপত্তি নেই, কিন্তু আসল কাজটা যেন ফেলুদাই করে। ‘কাকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে ফেলুদা?’ ‘অপরা—’ কথাটার মাঝখানেই ফেলুদা থেমে গেল। তার দৃষ্টি দেখলাম একজন লোককে ফলো করে পিছন দিকে ঘুরছে। ‘লোকটাকে দেখলি?’ ‘কই, না তো। মুখ দেখিনি তো।’ ‘ল্যাম্পের আলোটা পড়ল, আর ঠিক মনে হল’— ফেলুদা আবার থেমে গেল। ‘কী মনে হল ফেলুদা?’ ‘নাঃ, বোধহয় চোখের ভুল। চ’ পা চালিয়ে চ’, খিদে পেয়েছে।’ ফেলুদা হল আমার মাসতুতো দাদা। ও আর আমি আমার বাবার সঙ্গে দার্জিলিং-এ বেড়াতে এসে শহরের নীচের দিকে স্যানাটোরিয়ামে উঠেছি। স্যানোটোরিয়াম ভর্তি বাঙালি; বাবা তাদেরই মধ্য থেকে সমবয়সী বন্ধু জুটিয়ে নিয়ে তাসটাস খেলে গল্পটল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। আমি আর ফেল্যদা কোথায় যাই, কী করি, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। আজ সকালে আমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়েছে। উঠে দেখি বাবা রয়েছেন, কিন্তু ফেলুদার বিছানা খালি। কী ব্যাপার? বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘ও এসে অবধি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেনি। আজ দিনটা পরিষ্কার দেখে বোধহয় আগেভাগে বেড়িয়েছে।’ আমি কিন্তু মনে মনে আন্দাজ করেছিলুম যে ফেলুদা তদন্তের কাজ শুরু করে দিয়েছে, আর সেই কাজেই বেরিয়েছে। কথাটা ভেবে ভারী রাগ হল। আমাকে বাদ দিয়ে কিছু করার কথা তো ফেলুদার নয়। যাই হোক্‌, আমিও মুখটুখ ধুয়ে চা-টা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লেডেন লা রোডে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটার কাছাকাছি এসে ফেলুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘বা-রে, তুমি আমায় ফেলে বেরিয়েছ কেন?’ ‘শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল–তাই ডাক্তার দেখাতে গেস্‌লাম।’ ‘ফণী ডাক্তার?’ ‘তোরও একটু একটু বুদ্ধি খুলেছে দেখছি।’ ‘দেখলে?’ ‘চার টাকা ভিজিট নিল, আর একটা ওষুধ লিখে দিল।’ ‘ভাল ডাক্তার?’ অসুখ নেই তাও পরীক্ষা করে ওষুধ দিচ্ছে–কেমন ডাক্তার বুঝে দ্যাখ; তার পর বাড়ির যা চেহারা দেখলাম, তাতে পসার যে খুব বেশি তাও মনে হয় না।’ ‘তা হলে উনি কখনওই চিঠিটা লেখেননি।’ ‘কেন?’ ‘গরিব লোকের অত সাহস হয়?’ ‘তা টাকার দরকার হলে হয় বইকী।’ ‘কিন্তু চিঠিতে তো টাকা চায়নি।’ ‘ওই ভাবে খোলাখুলি বুঝি কেউ টাকা চায়?’ ‘তবে?’ ‘রাজেনবাবুর অবস্থা কাল কী রকম দেখলি বল তো?’ ‘কেমন যেন ভিতু ভিতু।’ ‘ভয় পেয়ে মনের অসুখ হতে পারে, জানিস?’ ‘তা তো পারেই।’ ‘আর মনের অসুখ থেকে শরীরের অসুখ?’ ‘তাও হয় বুঝি?’ ‘ইয়েস। আর শরীরের অসুখ হলে ডাক্তার ডাকতে হবে, সেটা আশা করি তোর মতো ক্যাবলারও জানা আছে।’ ফেলুদার বুদ্ধি দেখে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। অবিশ্যি ফণী ডাক্তার যদি সত্যই এত সব ভেবে-টেবে চিঠিটা লিখে থাকে, তা হলে ওরও বুদ্ধি সাংঘাতিক বলতে হবে। ম্যালের মুখে ফোয়ারার কাছাকাছি যখন এসেছি তখন ফেলুদা বলল, ‘কিউরিও সম্বন্ধে একটা কিউরিয়সিটি বোধ করছি।’ ‘কিউরিও’র মানে আগেই শিখেছিলাম, আর কিউরিয়সিটি মানে যে কৌতূহল, সেটা ইস্কুলেই শিখেছি। আমাদের ঠিক পাশেই ‘নেপাল কিউরিও সপ’। রাজেনবাবু আর অবনীবাবু এখানেই আসেন। ফেলুদা সটান দোকানের ভেতর গিয়ে ঢুকল। দোকানদারের গায়ে ছাই রঙের কোট, গলায় মাফলার আর মাথায় সোনালি কাজ করা কালো টুপি। ফেলুদাকে দেখে হাসি হাসি মুখে করে গিয়ে এল। দোকানের ভেতরটা পুরনো জিনিসপত্রে গিজগিজ করছে, আলোও বেশি নেই, আর গন্ধটাও যেন সেকেলে। ফেলুদা এদিও-ওদিক দেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভাল পুরনো থাঙ্কা আছে?’ ‘এই পাশের ঘরে আসুন। ভাল জিনিস বিক্রি হয়ে গেছে সব। তবে নতুন মাল আবার কিছু আসছে।’ পাশের ঘরের যাবার সময় আমি ফেলুদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, থাঙ্কা কী জিনিস?’ ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘দেখতেই তো পাবি।’ পাশের ঘরটা আরও ছোট–যাকে বলে একেবারে ঘুপ্‌চি। দোকানদার দেওয়ালে ঝোলানো সিল্কের উপর আঁকা একটা বুদ্ধের ছবি দেখিয়ে বলল, ‘এই একটাই ভালো জিনিস আছে–তবে একটু ড্যামেজড্‌।’ একেই বলে থাঙ্কা? এ জিনিস তো রাজেনবাবুর বাড়িতে অনেক আছে। ফেলুদা ভীষণ বিজ্ঞের মত থাঙ্কাটার গায়ের উপর চোখ ঠেকিয়ে উপর থেকে নীচে অবধি প্রায় তিনি মিনিট ধরে দেখে বলল, ‘এটার বয়স তো সত্তর বছরের বেশি বলে মনে হচ্ছে না। আমি অন্তত তিনশো বছরের পুরনো জিনিস চাইছি।’ দোকানদার বলল, ‘আমরা আজ বিকেলে কিন্তু এক লট মাল পাচ্ছি। তার মধ্যে ভাল থ্যাঙ্কা পাবেন।’ ‘আজই পাচ্ছেন?’ ‘আজই।’ ‘এ খবরটা তাহলে রাজেনবাবুকে জানাতে হয়।’ ‘মিস্টার মজুমদার? ওনার তো জানা আছে। রেগুলার খদ্দের যে দু-তিন জন আছেন, তাঁরা সকলেই নতুন মাল দেখতে বিকেলে আসছেন।’ ‘অবনীবাবুও খবরটা পেয়ে গেছেন? মিস্টার ঘোষাল?’ ‘জরুর!’ ‘আর বড় খদ্দের কে আছে আপনাদের?’ ‘আর আছেন মিস্টার গিলমোর–চা বাগানের ম্যানেজার। সপ্তাহে দু দিন বাগান থেকে আসেন। আর মিস্টার নাওলাখা। উনি এখন সিকিমে।’ ‘বাঙালি
false
shunil_gongopaddhay
এর শোধ নেয়। এবার কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে আসা যাক। ঐ কুশারী বংশেরই এক সন্তান পঞ্চানন এবং তাঁর খুল্লতাত শুকদেব আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাদ করে স্বগ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্যান্বেষণে। ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এসে পৌঁছেলেন গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কাছে। খাটো জাতের ব্ৰাহ্মণ হলেও তাঁদের সাজ-পোশাকের কোনো ত্রুটি ছিল না। পরিধানে পট্টবস্ত্ৰ, মাথায় স্কুল শিখা এবং ললাটে চন্দন, গাত্রবর্ণ অতিশয় গৌর। দেখলেই ব্ৰাহ্মণ বলে চেনা যায়। গোবিন্দপুরের খাঁড়ির পাশে তখন শুধু কয়েক ঘর জেলে, মালো, কৈবর্তের বাস। ব্ৰাহ্মণ দেখে তারা ষষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করলো এবং সেখানেই অধিষ্ঠিত হবার অনুরোধ জানালো। গ্রামের মধ্যে ব্ৰাহ্মণদের আশ্রয় দেওয়া একটি বড় পুণ্যকর্ম। সেই গোবিন্দপুরের খাঁড়ির নামই ইদানীং আদি গঙ্গা বা টালির নালা। গোবিন্দপুর, সুতানটি এবং কলকাতা নামে তিনটি গ্রাম জুড়ে ইংরেজরা তখন নতুন একটি শহরের পত্তন করছে। এই খাঁড়ি দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য এটিকে কেটে প্রশস্ত করা হচ্ছে এবং গ্রামের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য সাহেবরা যখন আসে তখন গ্রামের জেলেরা নিজেরা কথা বলার সাহস না পেয়ে ব্ৰাহ্মণ দুজনকে এগিয়ে দেয়। ব্ৰাহ্মণ দেবতুল্য, তাই গ্রামের মানুষ তাঁদের ঠাকুর বলে ডাকে। সাহেবরা সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না বলে, তারা বলে টেগোর। কুশারী ও পিরালী পরিচয় মুছে ফেলে পঞ্চানন ও শুকদেব ঠাকুর হয়ে গেলেন। এই ঠাকুররাই কলকাতার আদিযুগের স্টিভেডর এবং কন্ট্রাক্টর। প্রথম প্রথম পঞ্চানন ও শুকদেব সাহেবদের জাহাজে মালপত্র সরবরাহ করতেন। তারপর সাহেবদের সঙ্গে ভালোমতন পরিচয় হয়ে যাওয়ার ফলে আরও নানারকম কাজের ভার পেতে লাগলেন তাঁরা। নতুন শহরে তখন অনেক প্রকার কর্মোদ্যম চলছে। বর্গীর হাঙ্গামা থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাটা হলো মারহাট্টা ডিচ। সিরাজউদৌল্লা হঠাৎ এসে কলকাতার কেল্লা গুড়িয়ে দেবার পর ইংরেজরা ময়দানের ফাঁকা জায়গায় মজবুত করে তৈরি করে নতুন কেল্লা বা ফোর্ট উইলিয়াম। এইসব কাজের ঠিকাদারির ভার পায় ঐ দুই ঠাকুরের পুত্ৰ ও পৌত্রেরা। ঠাকুরদের তখন এতই ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, শোনা যায় দুৰ্গম বন জঙ্গল সাফ করে তাঁরা যেখানে একটি বাগানবাটি প্রস্তুত করেন, পরে সেখানেই তৈরি হয়েছিল ঐ নতুন কেল্লা। পরবর্তীকালে এই বংশের আর দুই উল্লেখযোগ্য ভ্রাতার নাম নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ। দুজনেই যথেষ্ট ধনাঢ্য, তবে নীলমণি অনেক বেশী কর্মবীর। গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কিনারা ছেড়ে ঠাকুরেরা এখন চলে এসেছেন মেছোবাজারের পাথুরিয়াঘাটা নামের অভিজাত পল্লীতে। ছোট ভাইকে সংসার দেখাশুনোর ভার দিয়ে নীলমণি প্রায়ই বাইরে বাইরে কাটান। ইংরেজ কোম্পানীর সঙ্গে তিনি চাকুরিসূত্রে আবদ্ধ। কখনো তিনি যান চট্টগ্রামে, কখনো উড়িষ্যায়। অথোপার্জনের উদ্দেশ্য ছাড়াও তাঁর চরিত্রে দুঃসাহস ছিল যথেষ্ট। দেওয়ানি কাজে সেকালে অথাগম হতো বিস্তর। সমস্ত টাকা নীলমণি পাঠিয়ে দিতেন ছোট ভাইয়ের কাছে। এক সময় চাকরি ত্যাগ করে নীলমণি গৃহে ফিরলেন। সেখানে তাঁর জন্য এক বিরাট অশান্তি অপেক্ষা করে ছিল। তাঁদের গৃহে তখন অতুল বৈভব। কিন্তু ছোটভাই দর্পনারায়ণ দাবী করলেন যে এর অধিকাংশই তাঁর নিজের উদ্যোগ ও বিচারবুদ্ধির ফল, এর মধ্যে নীলমণির অংশ সামান্যই। নীলমণি বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছেন বটে, কিন্তু দর্পনারায়ণই নিজ কৃতিত্বে সম্পত্তি বহুগুণ করেছেন। ভ্ৰাতৃবিরোধ এক সময় এমনই চরমে উঠলো যে এক বিষরি রাতে নীলমণি তাঁর স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার হাত ধরে এবং গৃহদেবতা নারায়ণশিলা সঙ্গে নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আর কোনোদিন ফিরবেন না। দর্পনারায়ণ তাঁর দাদার হাতে নগদ এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছেন এবং তাঁকে দিয়ে স্বীকার করে নিইয়েছেন যে বসতবাটি এবং ভুসম্পত্তির ওপর নীলমণির আর কোনো অধিকার রইলো না। বৃষ্টিময় অন্ধকার রাতে নীলমণিকে অবশ্য সপরিবারে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হলো না। ব্ৰাহ্মণকে ভূমিদানের পুণ্য অর্জনের জন্য তাঁদের আশ্রয় দিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত ধনপতি। এর নাম শেঠ বৈষ্ণবচরণ। এ বৈষ্ণবচরণ ধনী হয়েছিলেন গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে। হিন্দুদের বিবাহ থেকে শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত, এবং প্রতিদিনের পুজোআচ্চায় গঙ্গাজলের প্রয়োজন, এমনকি আদালতেও শপথ নেবার সময় গঙ্গাজল স্পর্শ করতে হয়। মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি ভর্তি গঙ্গাজল চালান যেত গঙ্গাবর্জিত অঞ্চলে। দুধে ভেজাল মিশ্রণের চল না হলেও তখনই নিশ্চিত গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে নানারকম কারচুপি ছিল, যে-কারণে অন্যান্য গঙ্গাজল ব্যবসায়ীদের তুলনায় শেঠ বৈষ্ণবচরণের নামাঙ্কিত শিলমোহর করা গঙ্গাজলই ছিল বেশী বিশ্বাসযোগ্য। এমন কি সুদূর তেলেঙ্গানার রাজাও গঙ্গাজল নিতেন এঁর কাছ থেকে। জোড়াসাঁকো অঞ্চলে শেঠ বৈষ্ণবচরণ প্রদত্ত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ঠাকুর বংশের দ্বিতীয় শাখাঁটি। নিজে আরও জমি কিনে ক্রমে ক্রমে নীলমণি সেখানে তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব প্ৰাসাদ। নীলমণির তিনটি সন্তান। জ্যেষ্ঠের নাম রামলোচন। পিতার মৃত্যুর পর রামলোচনের ওপর পড়লো সংসারের ভার এবং তিনি দক্ষতার সঙ্গেই সে কার্য সম্পন্ন করতে লাগলেন। ছোট দু ভাইয়ের পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণও করেন তিনি। এবং কিছু কিছু জমিদারি কিনে তিনি আস্তে আস্তে কলকাতার ধনী সমাজে নিজের স্থান করে নেন। রামলোচন ছিলেন শৌখিন এবং বিলাসী পুরুষ। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও অপরাহ্নে তিনি একবার, হাওয়া খেতে বের হবেনই। পরনে লম্বা কোতা দোপাট্টা ও তাজ, অর্থাৎ মুকুটের মতন পাগড়ি। গৃহের সামনে নিজস্ব তাঞ্জাম প্রস্তুত, সেই তাঞ্জামে চড়ে তিনি ময়দানের দিকে যান বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করার জন্য। পরিচিত আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবরাখবর নেওয়াও ছিল তাঁর অভ্যোস। ততদিনে দুই ঠাকুর পরিবারের বিবাদ মিটে গেছে, রামলোচন প্রায়ই যান পাথুরিয়াঘাটের বাড়িতে, পিতৃপুরুষের ভদ্রাসন দেখে আসেন। আসা-যাওয়ার পথে যতগুলি দেবালয় পড়ে, সব জায়গাতেই নেমে তিনি ভক্তিভরে প্রণামী দেন। মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে বসে মজলিশ। রামলোচন ঠাকুরের সাংস্কৃতিক রুচি সমসাময়িক ধনীদের চেয়ে অনেক উন্নত। শুধু বাঈ-নাচ দেখে প্ৰমোদ করার
false
shunil_gongopaddhay
মেরে দেবার চেষ্টা কোরো না। কাল রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর হিসেব করা হয়েছিল, কে কতগুলো ইংরেজি বলে ফেলেছে। রিঙ্কু আর রঞ্জন প্রায় সমান-সমান, রিঙ্কু আঠাশ টাকা আর রঞ্জনের সাতাশ। রঞ্জন আবার সন্তুকে বলল, কী, আমার সঙ্গে সুইমিং কমপিটিশানে নামতে রাজি আছ? তুঙ্গভদ্রা এপার-ওপার, একশো টাকা বাজি। চ্যালেঞ্জ! রিঙ্কু বলল, রাজি হয়ে যা, সন্তু! একশো টাকা পেয়ে যাবি। রঞ্জন সাঁতারই। জানে না? রঞ্জন আকাশ থেকে পড়ার মতন অবাক হয়ে বলল, আমি সাঁতার জানি না? আমি একটা জেনুইন বাঙাল, আমাদের সাতপুরুষ পূর্ববাংলার নদী-নালার দেশে…তুমি জানো, ওখানে চার বছরের বাচ্চারাও পুকুরে ড়ুব-সাঁতার দিতে। শিখে যায়। রিঙ্কু বলল, তুমি তো আর কোনওদিন পূর্ববাংলায় ছিলে না! তোমায় আমি কোনওদিন সাঁতার কাটতে দেখিনি। রঞ্জন বলল, দেখোনি, আজ দেখিয়ে দিচ্ছি! আমি কলকাতার গঙ্গা কতবার এপার-ওপার করেছি! ও হ্যাঁ, জোজো কোথায়? সে নিশ্চয়ই আমার থেকেও বড় চ্যাম্পিয়ান? জোজো খুব সম্ভব কোনও সমুদ্র এপার-ওপার করেছে। সন্তু বলল, জোজো এখনও জাগেনি। কাকাবাবু বললেন, তোমাদের সাঁতারের কেরামতি এখন দেখতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোমরা যদি স্নান করেই বেরোতে চাও তো বাথরুমেই স্নান করে নাও। আমার মনে হয়, মপি দেখতে হলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভাল। রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, আপনার আর সন্তুর চা খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি। আমরাও এই বাগানে বসেই বেড-টি খাব! অ্যাই সন্তু, একটু চায়ের কথা বলে দে না ভাইটি! সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠল। কাকাবাবু বললেন, সন্তু চা খায়নি আমার সঙ্গে। অন্য একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি চা খেতে-খেতে গল্প করছিলেন আমার সঙ্গে। গেস্ট হাউসের একজন বেয়ারা এদিকেই আসছিল কাপগুলো নিতে, তাকেই বলে দেওয়া হল চায়ের কথা। দোতলার বারান্দায় দেখা গেল জোজোকে। সন্তু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমরা যে হামপি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে আসলে কী দেখার আছে একটু বুঝিয়ে বলুন তো! কাকাবাবু বললেন, হামপি এখানকার একটি গ্রামের নাম। এককালে ওইখানেই ছিল বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানী। বিজয়নগরের কথা ইতিহাসে পড়েছ নিশ্চয়ই। রঞ্জন বলল, আমি অঙ্কে খুব ভাল তো, সেইজন্য ইতিহাস আর ভূগোলে খুব কাঁচা। তা ছাড়া ইস্কুল ছাড়বার পর তো আর ইতিহাস পড়িনি! বিজয়নগর নামে একটা রাজ্য ছিল বুঝি? রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই রঞ্জন, তুমি বিজয়নগরের কথা জানো না! বিজয়নগর আর বাহমনি, এই দুটো রাজ্যের মধ্যে সবসময় লড়াই হত! সন্তু বলল, হরিহর আর বুক নামে দুই ভাই বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল দক্ষিণ ভারতে। দিল্লিতে তখন পাগলা রাজা মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল। সেটা ফোরটিনথ সেঞ্চুরির মাঝামাঝি। রঞ্জন সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, বাহ্, তোর তো বেশ ইতিহাসে মাথা। সেঞ্চুরি পর্যন্ত মনে আছে। হ্যাঁ বুঝলাম, বিজয়নগর নামে একটি রাজ্য ছিল, তার রাজারা সবসময় মারপিট করত। তারপর? কাকাবাবু বললেন, হামপিতে সেই এককালের বিরাট শহর বিজয়নগরের রুইনস আছে। সেইগুলোই দেখতে যাচ্ছি। রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, ওঃ, হিস্টোরিক্যাল রুইনস? তার মানে তো দু-চারটে ভাঙা দেওয়াল আর আধখানা মন্দির, আর-একটা লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা গেট। যে-জায়গাটায় হাতি থাকত সেই জায়গাটাই দেখিয়ে গাইডরা বলবে, এটাই ছিল মহারানির প্রাসাদ। এই তো? এ-আর দেখতে কতক্ষণ লাগবে? বড়জোর একঘন্টা! এই হিস্টোরিক্যাল রুইনস-টুইনসগুলো সাধারণত খুব বোরিং হয়। রিঙ্কু বলল, মোটেই না! আমার এসবগুলো দেখতে খুব ভাল লাগে। রঞ্জন বলল, ঠিক আছে, আমি গাছতলায় শুয়ে থাকব। তোমরা যত খুশি পেট ভরে দেখো দুঘন্টা, তিনঘন্টা, তার বেশি তো লাগবে না! লাঞ্চের আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি বলি কী, এই গেস্ট হাউস ছাড়ার দরকার নেই, আমরা এখানেই ফিরে আসব আবার। রাত্তিরটা জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। জোজো বাগানে এসে সন্তুর পাশে দাঁড়িয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, হামপিতে যদি ভাঙাচোরা জিনিস ছাড়া আর কিছুই দেখবার না থাকে, তা হলে ওই মোহন সিং সেখানে যেতে আমাদের বারণ করল কেন? কাকাবাবুকে শাসালই বা কেন? রঞ্জন বলল, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। আমিও ঠিক সেই কথাই ভাবছিলুম। আমরা হামপি বেড়াতে গেলে ওর অসুবিধের কী আছে? তা ছাড়া ওই গণ্ডারটা কাকাবাবুকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা কাজ দিতে চেয়েছিল। কাকাবাবু বললেন, এখন একটু-একটু মনে পড়ছে, ওই মোহন সিং-এর ভাই। সুরয সিংকে আমি একবার জব্দ করেছিলুম। সুরয সিং এখন জেল খাটছে। সেইজন্যেই আমার ওপর মোহন সিং-এর রাগ থাকতে পারে। পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভটা কেন দেখিয়েছিল বুঝতে পারছি না। আমাকে কোনও ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল বোধহয়। রিঙ্কু বলল, ওর কথায় আমরা ভয় পাব নাকি! আমরা হমপি দেখতে এসেছি, সেখানে যাবই। কাকাবাবুর সঙ্গে ওরকম একটা জায়গা দেখার চান্স আর কখনও পাব? কাকাবাবু সবকিছু ভাল বুঝিয়ে দিতে পারবেন। চলো, চলো, সবাই তৈরি হয়ে নাও! আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়া হল। গেস্ট হাউসটা না ছেড়ে সেখানে রেখে যাওয়া হল কিছু জিনিসপত্র। সবাই ওঠার পর রঞ্জন গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ওই মোহন সিং ব্যাটা সিনেমায় ডাকাতের পার্ট করে, ব্যবহারটাও ডাকাতের মতন। আবার ওদের দলে একজন আশি নব্বই বছরের থুথুরে বুড়ো, সে নাকি একজন নামকরা পণ্ডিত, এই অদ্ভুত কম্বিনেশনটা আমি বুঝতে পারছি না। রিঙ্কু বলল, ওরা দলবল মিলে সবাই হামপিতে গেছে নিশ্চয়ই। চলো,একটু পরেই সব বোঝা যাবে। ওদের দু জনের এই কথা শুনে কাকাবাবু একটু মুচকি হাসলেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না। কিছুদূর যাবার পর একটা ছোট্ট শহর মতন দেখা গেল। সেটার নাম হসপেট। কিছু দোকানপাট, হোটেল
false
shottojit_roy
আমি প্যারিসে যাই একটা আর্ট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। ওখানে কিছু বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বাংলা শেখার ইচ্ছে হয়। শেষে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ক্লাসে যোগ দিই। ভাষার উপর আমার দখল ছিল, কাজেই শিখতে মুশকিল হয়নি। বছর দু-এক হল চন্দ্ৰশেখরের জীবনী লেখা স্থির করি। রোমে যাই। ভেনিসেও গিয়ে ক্যাসিনি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করি। সেখানেই টিনটারেটার ছবিটার কথা জানতে পারি। তার মানে আপনিও একটি কপি করেছিলেন টিনটোরেটা ছবির। এবং সেই কপিই হীরালাল সোমানি নিয়ে গিয়েছিল। হংকং-এ? আজ্ঞে হ্যাঁ। তা হলে আসলটা কোথায়? চেঁচিয়ে উঠলেন নবকুমারবাবু। ওটা আমার কাছেই আছে, বললেন রবীনবাবু। কেন, আপনার কাছে কেন? ওটা আমার কাছে আছে বলেই এখনও আছে, না-হলে হংকং চলে যেত। এখানে এসেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে ওটাকে সরাবার মতলব করছেন জাল-বিরুদ্রশেখর। তাই ওটার একটা কঁপি করে, আসলটাকে আমার কাছে রেখে কপিটকে ফ্রেমে ভরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। ফেলুদা বলল, আসলটা তো আপনারই নেবার ইচ্ছে ছিল, তাই না? নিজের জন্য নয়। আমি ভেবেছিলাম। ওটা ইউরোপের কোনও মিউজিয়ামে গিয়ে দেব। পৃথিবীর যে-কোনও মিউজিয়াম ওটা পেলে লুফে নেবে। আপনি মিউজিয়ামে দেবেন। মানে? সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললেন নবকুমারবাবু।ওটা তো নিয়োগী পরিবারের সম্পত্তি। আপনি ঠিকই বলেছেন নবকুমারবাবু, বলল ফেলুদা, কিন্তু উনিও যে নিয়োগী পরিবারেরই একজন। মানে? আমার বিশ্বাস উনি রুদ্রশেখরের পুত্র ও চন্দ্ৰশেখরের নাতি–রাজশেখর নিয়োগী। অর্থাৎ আপনার আপনি খুড়তুতো ভাই। ওঁর পাসপোর্টও নিশ্চয়ই সেই কথাই বলছে। নবকুমারবাবুর মতো আমরা সকলেই থ। রবীন—থুড়ি, রাজশেখরবাবু বললেন, পাসপোর্টটা কোনওদিন দেখাতে হবে ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম ছদ্মনামে এখানে থেকে ঠাকুরদাদা সম্বন্ধে রিসার্চ করে চলে যাব, আর যেহেতু ছবিটা উত্তরাধিকারসূত্রে আমারই প্রাপ্য, ওটা নিয়ে যাব। কিন্তু ঘটনাচক্রে এবং প্রদোষবাবুর আশ্চর্য বুদ্ধির জন্য—আসল পরিচয়টা দিতেই হল। আশা করি আপনারা অপরাধ নেবেন না। ফেলুদা বলল, এখানে একটা কথা বলি রাজশেখরবাবু—পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত চন্দ্ৰশেখরের চিঠি পেয়েছেন ভূদেব সিং। কাজেই আইনত ছবিটা এখনও আপনার প্রাপ্য নয়। কিন্তু আমার মতে ছবি আপনার কাছেই থাকা উচিত। কারণ আপনিই সত্যি করে এটার কদর করবেন। কী বলেন নবকুমারবাবু? একশোবার। কিন্তু মিস্টার মিত্তির, আপনার সন্দেহটা হল কী করে বলুন তো? আমার কাছে তো সমস্ত ব্যাপারটা ভেলকির মতো। ফেলুদা বলল, উনি যে বাংলাদেশের বাঙালি নন। সেটা সন্দেহ হয় সেদিন দুপুরে ওঁর খাওয়া দেখে। সুক্তো কখন খেতে হয় সেটা বাংলার বাঙালিরা ভাল ভাবেই জানে। ইনি দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে প্রথমে খেলেন ডাল, তারপর মাছ, সব শেষে সুক্তো। তা ছাড়া, সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ হল— এবার ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল সেটা একেবারে ম্যাজিক। উত্তরের দেওয়ালের দিকে গিয়ে চন্দ্রশেখরের আঁকা তাঁর বাবা অনন্তনাথের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুটো হাত ছবির গোঁফে আর দাড়ির উপর চাপা দিতেই দেখা গেল মুখটা হয়ে গেছে রবীন চৌধুরীর! লালমোহনবাবু ক্ল্যাপ দিয়ে উঠলেন, আর আমি অ্যাদ্দিনে বুঝতে পারলাম রবীনবাবুকে দেখে কেন চেনা চেনা মনে হত। কিন্তু চমকের এখানেই শেষ না। একটি চাকর কিছুক্ষণ হল একটা টেলিগ্রাম নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার সেটা নবকুমারবাবুর হাতে এল! ভদ্রলোক সেটা খুলে পড়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, আশ্চর্য! নন্দ লিখেছে আজ। সকালের ফ্লাইটে কলকাতায় আসছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ফেলুদা বলল, ওটার জন্য আমিই দায়ী, মিস্টার নিয়োগী। আপনার নাম করে কাল আমিই ওঁকে টেলিগ্ৰাম করেছিলাম। আপনি? আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম সৌম্যশেখরবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। কাম ইমিডিয়েটলি। * নবকুমারবাবুর কাছ থেকে আরও টাকা নেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আপত্তি করেছিল ফেলুদা। বলল, দেখলেন তো, তদন্তর ফলে বেরিয়ে গেল আপনার নিজের ভাই হচ্ছেন অপরাধী। তাতে নবকুমারবাবু বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, ওসব কথা আমি শুনতে চাই না। আপনি আমাদের হয়ে তদন্ত করেছেন। ফলাফলের জন্য তো আপনি দায়ী নন। আপনার প্রাপ্য আপনি না নিলে আমরা অসন্তুষ্ট হব। সেটা নিশ্চয়ই আপনি চান না। নিজের ভাই অপরাধী প্রমাণ হলেও, সেই সঙ্গে যে খুড়তুতো ভাইটিকে পেলেন নবকুমারবাবু, তেমন ভাই সহজে মেলে না। টিনটারেটার যীশু যে এখন উপযুক্ত লোকের হাতেই গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ইউরোপের কোনও বিখ্যাত মিউজিয়ামের দেয়ালে শোভা পাবে। আমরা আর এক’দিন ছিলাম বৈকুণ্ঠপুরে। ফেরার পথে লালমোহনবাবুর অনুরোধে একবার ভবেশ ভট্টাচার্যের ওখানে ঢুঁ মারতে হল। সামনের বছর বৈশাখের জন্য জটায়ু যে উপন্যাসটা লিখবেন সেটার নাম হংকং-এ হিমসিম হলে সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে ঠিক হবে কিনা সেটা জানা দরকার। রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু প্লেট থেকে একটা চীনাবাদাম তুলে নিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তার পাশের আঙুল দিয়ে সেটার উপর একটা হালকা হুঁশিয়ার চাপ দিতেই ব্ৰাউন খোলসের মধ্যে থেকে মসৃণ ফরসা বাদামটা সুডুৎ করে বেরিয়ে তাঁর বাঁ হাতের তেলোর উপর পড়ল। সেটা মুখে পুরে খোসাটা সামনের টেবিলে রাখা অ্যাশ-ট্রেতে ফেলে দিয়ে হাত ঝেড়ে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, দেশাশ্বমেধ ঘাটে বিজয়া দশমী দেখেছেন কখনও? ফেলুদার সামনে দাঝার বোর্ড, তার উপরে একটা সাদা রাজা, একটা সাদা গজ আর একটা সাদা বোড়ে, আর একটা কালো রাজা আর দুটো কালো ঘোড়া। বোর্ডের পাশে গ্রেট গেমস অফ চেস বলে একটা বই খোলা; ফেলুদা তার মধ্যে থেকে একটা চ্যাম্পিয়নশিপ গেম বেছে নিয়ে তার চালগুলো বই দেখে দেখে চলিছিল। খেলার প্রায় মাঝামাঝি লালমোহনবাবু এসে পড়েন। আজকাল আর ওঁর সঙ্গে বাড়াবাড়ি রকম ভদ্রতা না করলেও চলে, তাই ফেলুদা
false
tarashonkor
কর দেয়, রাজার মতই রাজার প্রতিভূকে মান্য করে। সে বিধানকে ইহারা অমান্য করিয়াছিল বলিয়াই এতবড় বন্যার শাস্তি তিনিই বিধান করিয়াছেন। এখন তাহার পরীক্ষা। প্রজার বিপর্যয়ে রাজার কর্তব্য তাহাদিগকে রক্ষা করা। রাজার প্রতিভূ হিসাবে সে কর্তব্য তাহার উপর আসিয়া বৰ্তিয়াছে। সে যদি সে-কর্তব্য পালন না করে, তবে তিনি তাহাকেও রেহাই দিবেন না। সে তাহাদিগকে ধান দিবে। তাহার কর্তব্যে সে অবহেলা করিবে না। দুই হাত জোড় করিয়া সে ভগবানকে প্ৰণাম করিল। তিনি তাহার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। করিয়াছেন। দিতে বাকি রাখিয়াছেন কি? জমি, বাগান, পুকুর, বাড়ি; শেষ পর্যন্ত তাহার কল্পনাতীত বস্তু জমিদারি—সেই জমিদারিও তিনি তাহাকে দিয়াছেন। গোয়াল-ভরা গরু, খামার-ভরা মরাই, লোহার সিন্দুক-ভরা নোট, সোনা, টাকা—তাহাকে দুহাতে ঢালিয়া দিয়াছেন। তার জীবনের সকল কামনাই তিনি পরিপূর্ণ করিয়াছেন; পাপকামনা পূর্ণ করিয়াও অত্যাশ্চর্যভাবে সেই পাপ-প্রভাব হইতে তিনি তাহাকে র করিয়াছেন। অনিরুদ্ধের সঙ্গে যখন তাহার প্রথম বিরোধ বাধে, তখন হইতেই তাহার কামনা ছিল—অনিরুদ্ধের জমি কাড়িয়া লইয়া তাহাকে দেশান্তরী করিবে এবং তার স্ত্রীকে সে দাসী করিয়া রাখিবে। অনিরুদ্ধের জমি সে পাইয়াছে অনিরুদ্ধ দেশত্যাগী। অনিরুদ্ধের স্ত্রীও তাহার ঘরে স্বেচ্ছায় আসিয়া প্রবেশ করিয়াছিল। যাক্‌, সে পলাইয়া গিয়াছে-ভালই হইয়াছে, ভগবান তাহাকে রক্ষা করিয়াছেন। এইবার দেবু ঘোষকে শায়েস্তা করিতে হইবে। আরও কয়েকজন আছে,জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল, তিনকড়ি পাল, সতীশ বউরি, পাতু বায়েন, দুর্গা মুচিনী। তিনকড়ির ব্যবস্থা। হইয়াছে। সতীশ, পাতু ওগুলা পিঁপড়ে; তবে দুর্গাকে ভালমত সাজা দিতে হইবে। জগন, হরেনকে সে বিশেষ গ্রাহ্য করে না। কোনো মূল্যই নাই ও-দুটার। আর দেবুকে শায়েস্তা করিবার আয়োজনও আগে হইতেই হইয়া আছে। কেবল বন্যার জন্যই হয় নাই; পঞ্চগ্রামের সমাজের পঞ্চায়েতমণ্ডলীকে এইবার একদিন আহ্বান করিতে হইবে। দেবু অনেকটা সুস্থ হইয়াছে, আরও একটু সুস্থ হউক। দেখুড়িয়া হইতে বাড়িতে আসুক। চণ্ডীমণ্ডপে তাহাকে ডাকিয়া, পঞ্চগ্রামের লোকের সামনে তাহার বিচার হইবে। কালু শেখ আসিয়া সেলাম করিয়া একখানা চিঠি, গোটাদুয়েক প্যাকেট ও একখানা খবরের কাগজ আনিয়া নামাইয়া দিল। কঙ্কণার পোস্টাপিসে এখন শ্ৰীহরির লোক নিত্য যায় ডাক আনিতে। এটা সে কঙ্কণার বাবুদের দেখিয়া শিখিয়াছে। খবরের কাগজ দেখিয়া, সে চিঠি লিখিয়া ক্যাটালগ আনায়; চিঠিপত্রের কারবার সামান্যইউকিল মোক্তারের নিকট হইতে মামলার খবর আসে। আর আসে একখানা দৈনিক সংবাদপত্র। চিঠিখানায় একটা মামলার দিনের খবর ছিল, সেখানা দাসজীকে দিয়া শ্ৰীহরি খবরের কাগজটা খুলিয়া বসিল। কাগজটার মোটা মোটা অক্ষরের মাথার খবরের দিকে চোখ বুলাইতে গিয়া হঠাৎ সে একটা খবর দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। মোটা মোটা অক্ষরে লেখা ময়ূরাক্ষী নদীতে প্রবল বন্যা। … রুদ্ধনিশ্বাসে সে সংবাদটা পড়িয়া গেল।… দেবুও অবাক হইয়া গেল। সে অনেকটা সুস্থ হইয়াছে, তবে শরীর এখনও দুর্বল। কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তারের চিকিৎসায়, জগন ডাক্তারের তদবিরে এবং স্বর্ণের শুশ্রুষায়—সে সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে। গতকল্য সে অন্নপথ্য করিয়াছে। আজ সে বিছানার উপর ঠেস দিয়া বসিয়া ছিল। সে ভাবিতেছিল নিজের। কথা। একেবারে গেলেই ভাল হইত। আর সে পারিতেছে না। রোগশয্যায় দুর্বল ক্লান্ত শরীরে শুইয়া তাহার মনে হইতেছিল পৃথিবীর স্বাদগন্ধ-বৰ্ণ সব ফুরাইয়া গিয়াছে। কেন? কিসের জন্য তাহার বাঁচিয়া থাকা? বাঁচার কথা মনে হইলেই তাহার মনে পড়িতেছে তাহার নিজের ঘর। নিস্তব্ধ, জনহীন ধুলায় আচ্ছন্ন ঘর!… তিনকড়ির ছেলে গৌর হাঁপাইতে হাঁপাইতে ঘরে প্রবেশ করিল-পণ্ডিত-দাদা! –গৌর? দেবু বিস্মিত হইল—কি গৌর? স্কুল থেকে ফিরে এলে? গৌর জংশনের স্কুলে পড়ে; এখন স্কুলের ছুটির সময় নয়। গৌর একখানা খবরের কাগজ তাহার সামনে ধরিয়া বলিল—এই দেখুন। —কি? বলিয়াই সে সংবাদটার উপর ঝুঁকিয়া পড়িল। ময়ূরাক্ষী নদীতে ভীষণ বন্যা। সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা কেহ লিখিয়াছে। বন্যার ভীষণতা বৰ্ণনা করিয়া লিখিয়াছে : শিবকালীপুরের দেশপ্ৰাণ তরুণ কর্মী দেবনাথ ঘোষ বন্যার গতিরোধের জন্য বিপুল চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। উপরন্তু তিনি বন্যাস্রোতে ভাসিয়া যান। বহু কষ্টে তাহার প্রাণ রক্ষা পাইয়াছে। ইহার পরেই স্থানীয় ক্ষতির উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছে এখানকার অধিবাসীরা আজ সম্পূর্ণ রিক্ত ও গৃহহীন। শতকরা যাটখানি বাড়ি ধসিয়া পড়িয়াছে, সমস্ত খাদ্যশস্য বন্যার প্লাবনে ভাসিয়া গিয়াছে, সাংসারিক সকল সম্বল নিশ্চিহ্ন, ভবিষ্যতের আশা কৃষিক্ষেত্রের খাদ্যসম্পদ বন্যায় পচিয়া গিয়াছে; অনেকের গরু-বাছুরও ভাসিয়া গিয়াছে। এই শেষ নয়, সঙ্গে সঙ্গে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের চিরসঙ্গী মহামারীরও আশঙ্কা করা যাইতেছে। তাহাদের জন্য বর্তমানে খাদ্য ছাই, ভবিষ্যতে বাঁচিবার জন্য বীজধান চাই, মহামারী হইতে রক্ষার জন্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা চাই; নতুবা দেশের এই অংশ শুশ্মশানে পরিণত হইবে। এই বিপন্ন নরনারীগণেক রক্ষার দায়িত্ব দেশবাসীর উপর ন্যস্ত; সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে সকলকে আহ্বান জানাইতেছি। এই স্থানে অধিবাসীগণের সাহায্যকল্পে একটি স্থানীয় সাহায্য সমিতি গঠিত হইয়াছে। ঐ অঞ্চলের একনিষ্ঠ সেবক উপরোক্ত শ্রীদেবনাথ ঘোষ সম্পাদক হিসাবে সমিতির ভার গ্রহণ করিয়াছেন। দেশবাসীর যথাসাধ্য সাহায্য-বিধাতার আশীর্বাদের মতই গৃহীত হইবে। দেবু অবাক হইয়া গেল। এ কি ব্যাপার! খবরের কাগজে এ সব কে লিখিল? দেশপ্ৰাণ—দেশের একনিষ্ঠ সেবক! দেশময় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এ বার্তা কে ঘোষণা করিয়া দিল? খবরের কাগজটা এক পাশে সরাইয়া, সে খোলা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল। গৌর কাগজখানা লইয়া বহুজনকে পড়িয়া শুনাইল। যে শুনিল সে-ই অবাক হইল। দেশের গেজেট দেবু পণ্ডিতের নামে জয়জয়কার করিয়াছে ইহাতে তাহারা খুশি হইল। শ্ৰীহরি দেবুকে পতিত করিবার আয়োজন করিতেছে, দায়ে পড়িয়া শ্ৰীহরির মতেই তাহাদিগকে মত দিতে হইবে; তবুও তাহারা খুশি হইল। বারবার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করিলা, তা বটে। ঠিক কথাই লিখেছে। এর মধ্যে মিথ্যা কিছু নাই। দশের দুঃখে দুঃখী, দশের সুখে সুখী—দেবু তো আমাদের
false
shordindu
মিছে সময় নষ্ট করে লাভ কি?’ ছেলেমানুষ দু’টি বাঙ্‌নিষ্পত্তি করিল না‌, কামিনীকান্ত তাদের জবানীতে কাহিনী বিবৃত করিলেন। মোটামুটি কাহিনীটি এই— বছর দুই আগে অনাদি হালদার মহাশয় যখন কলিকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন তখন নিমাই নিতাই খবর পাইয়া কাকার কাছে ছুটিয়া আসে। তাহারা পিতৃহীন‌, কাকাই তাঁহাদের একমাত্র অভিভাবক‌, কাকাকে তাহারা সাবেক বাড়িতে লইয়া যাইবার জন্য নির্বন্ধ করে। অনাদি হালদার অতিশয় সজ্জন এবং ভালো মানুষ ছিলেন‌, ভাইপোদের প্রতি তাঁহার মেহের সীমা ছিল না। কিন্তু একদল দুষ্ট লোক তাঁহার ভালমানুষীর সুযোগ লইয়া ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছিল‌, তাঁহার কানে কুমন্ত্রণা দিতে লাগিল‌, ভাইপোদের উপর তাঁহার মন বিরূপ করিয়া তুলিল। তিনি নিতাই-নিমাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া দিলেন। নিমাই নিতাই ন্যায়তঃ ধৰ্মতঃ অনাদিবাবুর উত্তরাধিকারী। তাঁহাদের ভয় হইল‌, এই দুষ্ট লোকগুলো কাকাকে ঠকাইয়া সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবে‌, হয়তো তাঁহাকে খুন করিতেও পারে। নিমাই নিতাই তখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া শ্ৰীকান্ত হোটেলে ঘর ভাড়া করিল। এবং জানোলা দিয়া অনাদিবাবুর বাসার উপর নজর রাখিতে লাগিল। তাঁহাদের বাড়িতে একটাশ পুরনো আমলের দূরবীন আছে‌, সেই দূরবীন চোখে লাগাইয়া অনাদিবাবুর বাসার ভিতরকার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করিবার চেষ্টা করিত। এই দেখুন সেই দূরবীন। —নিমাইনিতাইয়ের একজন চাদরের ভিতর হইতে দূরবীন বাহির করিয়া দেখাইল। চামড়ার খাপের মধ্যে চোঙের মত দূরবীন‌, টানিলে লম্বা হয়; ব্যোমকেশ নাড়িয়া চাড়িয়া ফেরত দিল। কামিনীকান্ত আবার আরম্ভ করিলেন। — নিমাই নিতাই পালা করিয়া হোটেলে যাইত এবং চোখে দূরবীন লাগাইয়া জানালার কাছে বসিয়া থাকিত। অবশ্য ইহা নিতান্তাই ছেলেমানুষী কাণ্ড। কামিনীকান্ত কিছু জানিতেন না‌, জানিলে এমন হাস্যকর ব্যাপার ঘটিতে দিতেন না। যাহোক‌, এইভাবে কয়েকমাস কাটিবার পর কালীপূজার রাত্ৰি আসিয়া উপস্থিত হইল। রাত্রি দশটা আন্দাজ নিমাই হোটেলে গিয়া দূরবীন লাগাইয়া বসিল। অনাদিবাবু ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া বাজি পোড়ানো দেখিতেছিলেন। এগারোটার সময় এক ব্যাপার ঘটিল। অনাদিবাবু হঠাৎ পিছনের দরজার দিকে ফিরিলেন‌, যেন পিছনে কাহারও সাড়া পাইয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ হইল এবং বন্দুকের গুলি নিমাইয়ের কানের পাশ দিয়া চলিয়া গেল। ওদিকে ব্যালকনিতে অনাদিবাবু ধরাশায়ী হইলেন। কিন্তু ঘরের অন্ধকার হইতে কে গুলি চালাইয়াছে নিমাই তাহা দেখিতে পাইল না। নিমাই ব্যাপার বুঝিতে পারিল। বন্দুকের গুলি অনাদিবাবুর শরীর ভেদ করিয়া আর একটু হইলে নিমাইকেও বধ করিত; ভাগ্যক্রমে গুলিটা তাহার রগ ঘোষিয়া চলিয়া গিয়াছে। সে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরিয়া গেল এবং দুই ভাইয়ে পরামর্শ করিয়া সেই রাত্রেই কামিনীকান্তর কাছে উপস্থিত হইল। তারপর যাহা যাহা ঘটিয়াছে ব্যোমকেশবাবু তাহা ভালভাবেই জানেন। ইহাই সত্য পরিস্থিতি‌, ইহাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নাই। ব্যোমকেশবাবু বিবেচক ব্যক্তি‌, তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে পূজ্যপাদ খুল্লতাতকে বধ করা কোনও ভদ্রলোকের ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তিনি যেন পুলিসে খবর না দেন। পুলিস-বিশেষত বর্তমানকালের পুলিস-যদি এমন একটা ছুতা পায় তাহা হইলে নিতাই-নিমাইকে নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িবে‌, নিরাপরাধের প্রতি জুলুম করিবে। ইহা কদাচ বাঞ্ছনীয় নয়। একেই তো অবিচার অত্যাচারে দেশ ছাইয়া গিয়াছে। কামিনীকান্ত শেষ করিলে ব্যোমকেশ আড়মোড়া ভাঙিয়া হাই তুলিল‌, অলসকণ্ঠে বলিল‌, ‘এঁরা -এর জন্য দরখাস্ত করেছেন নিশ্চয়? তার কি হল?’ কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘দরখাস্ত করা হয়েছে। তবে আদালতের ব্যাপার‌, সময় লাগবে।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার বিশ্বাস প্রভাত কোনও আপত্তি তুলবে না। তবে বইয়ের দোকানটা তার নিজের নামে; আপনারা যদি সেদিকে হাত বাড়ন তাহলে সে লড়বে।’ ‘না না‌, অনাদিবাবু যা দান করে গেছেন তার ওপর ওদের লোভ নেই। —তাহলে ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি শ্ৰীকান্ত হোটেলের কথাটা প্ৰকাশ করবেন না। আশা করতে পারি কি?’ ‘এ বিষয়ে আমি বিবেচনা করে দেখব। নিমাইবাবু নিতাইবাবু যদি নির্দোষ হন তাহলে নিৰ্ভয়ে থাকতে পারেন। আচ্ছা‌, আজ আসুন তাহলে।’ তিনজনে গাত্ৰোত্থান করিয়া পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলেন‌, চোখে চোখে কথা হইল। তারপর কামিনীকান্ত একটু আমতা আমতা করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ আমরা আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ক্ষতিপূরণস্বরূপ সামান্য কিছু— বলিয়া পকেট হইতে পাঁচটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া বাড়াইয়া ধরিলেন। ব্যোমকেশের অধর ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হইয়া উঠিল—’আমার সময়ের দাম অত বেশি নয়। তাছাড়া‌, আমি ঘুষ নিই না।’ কামিনীকান্ত তাড়াতাড়ি বলিলেন‌, ‘না না‌, সে কি কথা। আপনি অনাদিবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্তু করছেন‌, তার তো একটা খরচ আছে। সে খরচ এদেরই দেবার কথা। আচ্ছা‌, আর আপনার সময় নষ্ট করব না। নমস্কার।’ নোটগুলি টেবিলে রাখিয়া তিনি মক্কেল সহ ক্ষিপ্ৰবেগে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। ব্যোমকেশ নোটগুলি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল‌, ‘ঘুষ কি করে দিতে হয় শিখলাম।’ তারপর ভ্রূ বাঁকাইয়া আমার পানে চাহিল—’কেমন গল্প শুনলে?’ বলিলাম‌, ‘আমার তো নেহাৎ অসম্ভব মনে হল না।’ ‘এরকম গল্প তুমি লিখতে পারো? সাহস আছে?’ ‘এমন অনেক সত্য ঘটনা আছে যা গল্পের আকারে লেখা যায় না‌, লিখলে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তবু যা সত্য তা সত্যই। .’ তর্ক বেশ জমিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিতেছে এমন সময় দ্বারে আবার অতিথি সমাগম হইল। দরজা ভেজানো ছিল; একজন দরজার ফাঁকে মুণ্ড প্রবিষ্ট করাইয়া বলিল, ‘আসতে পারি স্যার?’ বলিয়া দাঁত খিঁচাইয়া হাসিল। অবাক হইয়া দেখিলাম‌, বিকাশ দত্ত! বছরখানেক আগে চিড়িয়াখানা প্রসঙ্গে তাহার সহিত পরিচয় ঘটিয়াছিল। তাহার হাসিটি অটুট আছে। কিন্তু বেশভূষা দেখিয়া মনে হয় ধন-ভাগ্যে ভাঙন ধরিয়াছে। ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া বিকাশকে বসাইল‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘তারপর‌, খবর কি?’ বিকাশ বলিল‌, ‘খবর ভাল নয়। স্যার। চাকরি গেছে‌, এখন ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি।’ ব্যোমকেশের মুখ গভীর হইল–’চাকরি গেল কোন অপরাধে?’ বিকাশ বলিল‌, ‘অপরাধ করলে তো ফাঁসি যেতম স্যার। অপরাধ করিনি। তাই চাকরি গেছে।’
false
toslima_nasrin
কে কেমন আচরণ করবে, কি জিজ্ঞেস করলে কি বলতে হবে, কি কিই বা রান্না হবে ইত্যাদি নানা কিছ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সবাইকে। আমাদের বাড়ি এসেও বরবউকে নেমন্তন্ন করার কথা বলে গেছেন। রুনুখালা আর তাঁর বরিশালি স্বামীকে দেখতে নানিবাড়ি গিয়ে দেখি সবাই গলা নামিয়ে কথা বলছে, নানি নানা পদের রান্না করছেন, রুনুখালা এ ঘর ও ঘর ছুটোছুটি করছেন, আর নতুন চাদর পাতা বিছানায় নতুন কড়কড়ে লুঙ্গি আর শাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে মখু চুন করে বসে আছেন বরিশালি। বরিশালি অবকাশে যেদিন এলেন সেদিন মুখের চুনটি দূর হল। জুতোর মচমচ শব্দ তুলে হাঁটা বাবাকেও বেশ পছন্দ হল তাঁর। রুনুখালার বোনের স্বামী ডাক্তার, তাও আবার মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক-ডাক্তার, বরিশালি পলকহীন চোখে বাবাকে দেখেন আর বলেন, আত্মীয় বলতে তো আপনারাই। রুনুখালা চলে যাওয়ার পর মা বলেন, ঝুনু অত তোয়াজ করে কেন জামাইরে? নিজে সে এমএ পাশ করা মেয়ে। সে এখন বড় চাকরি বাকরি করবে। তার তো ঠেকা পড়ে নাই জামাইরে মানাইয়া চলার! মার সুযোগ নেই বলে লেখাপড়া করতে পারেননি। মাঝে মাঝে ভাবি, আবার সুযোগ থাকলেও কেউ হেলায় সে সুযোগ নষ্ট করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় রুদ্রর নাম আছে, ওটুকুই। ক্লাসও করে না, পরীক্ষাও দেয় না, আমি তাকে অন্তত মাস্টারডিগ্রিটা পাশ করতে বলি, তার নিজের জন্যই বলি। তার দ্বারা হবে না এসব, কারণ, স্পষ্ট বলে দেয়, এসব একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের সে থোড়াই কেয়ার করে। সে সারাজীবন কবিতা লিখবে, কবিতাই তার নেশা পেশা যা কিছু। রুদ্র ট্রেনে করে পাঁচ ঘন্টায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসে, বাসেও এলেও ওই একই সময়। একবার ভিড়ের ট্রেনে ঝুলতে থাকা নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে ঝুলে পড়ল গুণের ঘাড়ে। গুণের বাড়ি আমাদের দেখা করার নতুন একটা জায়গা হল। কিন্তু ঠায় কতক্ষণই বা বসে থাকা যায় অন্যের বাড়িতে! ওদেরও তো ঝগড়াঝাটি আছে, চিৎকার চেঁচামেচি আছে! সুতরাং রিক্সা করে চল ঘুরে বেড়াই! শহরের কেউ যেন না দেখে ফেলে আমাদের, শহরের ভেতর দুজন দুটো আলাদা রিক্সা নিই, শহর থেকে দূরে গিয়ে একটি রিক্সা ছেড়ে দিয়ে দুজন এক রিক্সায় পাশাপাশি বসি। রুদ্রর স্পর্শ বিষম পুলক জাগায় মনে! শহরের বাইরে যাবার মত জায়গা এক মুক্তাগাছা, নির্জন গ্রামের রাস্তায় রিক্সা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সারি বেঁধে দাঁড়ানো কড়ইগাছের তল দিলে, ছোট ছোট নদীর ওপর ছোট ছোট সেতু পার হয়ে চলে। আমার চোখ পড়ে থাকে সবুজ শস্যে, বিলের জলে ন্যাংটো ছেলেদের দাপাদাপিতে, শীণর্ গরুর নির্বিকার রাস্তা পারে, আর মন পড়ে থাকে রুদ্রে। রুদ্রর চুমু খাওয়ার নিরন্তর চেষ্টাকে শরমে সরিয়ে সরিয়ে মুক্তাগাছা পোঁছি। সাপে শ্যাওলায় আগাছায় পরগাছায় আর মাকড়শার জালে ছেয়ে থাকা জমিদারবাড়ির আঙিনা ঘুরি ফিরি, রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটলেও ভয় নেই, এ শহরে ঢিঢি ফেলার মত চেনা লোক নেই। রুদ্র সেবার ঢাকা ফিরে যাবার পর, কদিন পর আর, সাতদিন, ক্লাসে ঢুকতে যাব, ওপরের ক্লাসের এক মেয়ে এসে জানাল নীরা লাহিড়ী খবর পাঠিয়েছে, এক্ষুনি যেন তার বাড়ি যাই। ক্লাস ফেলে দৌড়োলাম গুণের বাড়ি। দেখি রুদ্র বসে আছে গুণের বসার ঘরে। ঘরে দুটো কাঠের চেয়ার, একটি চৌকি। চৌকিতে। দেখে মন নেচে ওঠে। রুদ্রকে দেখলে এই হয় আমার, মন নাচে। কী ব্যাপার হঠাৎ! হ্যাঁ হঠাৎ। চিঠিতে জানাবার সময় পাইনি। ও। এরপর মুখোমুখি বসে থাকা নৈঃশব্দের সঙ্গে দুজনের। নৈঃশব্দের নীলিমা জুড়ে রুদ্রর স্টার সিগারেটের ধোঁয়া। রুদ্র তার কাঁধের কালো ব্যাগ থেকে একখানা কাগজ বের করে বলল, এই কাগজে একটা সই করতে হবে তোমার। কিসের কাগজ এটা? পরে বলব। আগে সই কর। কেন? এত কথা বোলো না। কাগজটা কিসের? প্রশ্ন করি, কিন্তু আমি নিশ্চিত রুদ্র কোনও স্মারকলিপিতে অথবা নতুন কোনও কবিসংগঠন তৈরি করেছে, আমাকে সেই সংগঠনের সদস্য করতে সই চাইছে। আমার নিশ্চিত চোখদুটোয় ভোরের স্নিগ্ধ আলো। আমার নিদ্বির্ধ ঠোঁটে এক ঝাঁক পাখির ওড়াওড়ি। কাগজটি নিতে হাত বাড়ালে রুদ্র সরিয়ে নেয় কাগজ।দ্বন্দ্বে পড়ি, ধন্ধে পড়ি। কিসের কাগজ এটি? না পড়ে তো সই করব না! রুদ্রর শ্যাওলা পড়া চোখ স্থির হয়ে থাকে আমার চোখে। বিয়ের কাগজ। রুদ্রর ভারি কণ্ঠ, ভাঙা কণ্ঠ। কান ঝাঁ ঝাঁ করে। ঝাঁ ঝাঁর ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ঝরঝরে হই। বিয়ের কাগজ? হ্যাঁ বিয়ের কাগজ। কেন? কেন মানে? বিয়ের কাগজ কেন? কেন তা বোঝো না? না। সই করবে কি করবে না বল। আশ্চর্য, এভাবে, এরকম করে বিয়ে করব কেন? তাহলে তুমি সই করবে না? কী লেখা আছে দেখি! আমি কাগজটি হাতে নিতেই রুদ্র হাঁ হাঁ করে উঠল, বৌদি আসছে, লুকোও। লুকোবো কেন? বুঝে ফেলবে। কি বুঝবে? বুঝবে যে বিয়ের কাগজ। কি করে? আরে বুঝবে বললাম তো! বুঝলে কি ক্ষতি? ক্ষতি আছে। কি ক্ষতি, শুনি! রুদ্র টেনে নিল কাগজখানা হাত থেকে। পাথুরে গলায় বলল তুমি সই করবে কি না বল, হ্যাঁ বা না। এ কি আশ্চর্য! বিয়ের কথা উঠছে কেন হঠাৎ! উঠছে। কে উঠিয়েছে? আমি। আমি তো বলিনি আমি বিয়ে করব! আমি বলছি। এক হাতে তালি বাজে? সই করবে? না। কাগজটি ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র, বলল ঠিক আছে, চললাম। বিস্ময় আমার জগত ধোঁয়াটে করে আনে, কোথায়? ঢাকায়। এক্ষুনি? হ্যাঁ। কেন, কি হয়েছে? থাকার আর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই? রুদ্রর নিরুত্তাপ কন্ঠ। না। কাগজে সই করিনি বলে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল?
false
tarashonkor
কাজে সঁদার খাতায় তাঁহাদের নাম সর্বদাই উপরের দিকেই থাকে। তাহারা যে পথে চলিয়া থাকেন, সে পথটি বাহ্যত স্পষ্ট আইনের পথ। টাকা ধার দেন, সুদলন। খাজনা বাকি পড়িলে অমার্জনীয় কঠোরতার সঙ্গে সুদ আদায় করেন, নালিশ করেন। বৃদ্ধির ব্যাপারেও মুখুয্যেবাবুরা আদালতের মধ্য দিয়া চলিতেছেন! বেআইনী আদায় হয়ত কিছু আছে, কিন্তু সেও এমনভাবে আইনের গঙ্গাজল প্ৰক্ষেপে শুদ্ধ হইয়া যায় যে সে আদায়ের অসিদ্ধতা অশুদ্ধতার কথা কখনও উঠিতেও পায় না। যেমন দেবোত্তরের পার্বণী আদায়, খারিজফি বাবদ উদ্বৃত্ত আদায় ইত্যাদি; এই আদায়ের জন্য বাবুদের জবরদস্তি নাই। শুধু পার্বণী না দিলে টাকা আদায় লনও না, দেনও না। নালওয়া বা না-দেওয়াটা ইচ্ছাধীন, বেআইনী নয়। এবং পরিশেষে বাধ্য হইয়া আদালতে যান এবং অন্যকে যাইতে বাধ্য করেন; তাহাও বেআইনী নয়। সুতরাং আইনের ক্ষুরধারে যাহারা চলিয়া থাকেন—সঁহাদের নিকট মাথা কামাইতে আসিয়া দুই-এক বিন্দু রক্তপাত সকলে মানিয়া লইয়াছে। ইহার উপর সরকারের প্রতি বাবুদের ভক্তিশ্রদ্ধার কথা লর্ড কর্নওয়ালিসের আমল হইতে আজ পর্যন্ত এ জেলার প্রত্যেক সাহেব বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। সেইজন্যই রাজভক্ত বাবুদের অতিথি-নিকেতনে আতিথ্য স্বীকার করাকে তাহারা কিছু অন্যায় মনে করেন না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরশু তারিখে সার্কেল-অফিসার এখানে আসিয়াও বাবুদের অতিথি-নিকেতনে আতিথ্য স্বীকার করেন নাই। মুখুয্যেবাবু দুইটা কারণে সচকিত হইয়া উঠিলেন। দেশ-কালের কোথায় কি যেন পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে এবং তিনি জানিতে পারেন নাই। প্রজাদের টেলিগ্রামের মূল্য যেন অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। মামলার কূট-কৌশল প্রজাদের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির কাছে আজ যেন অত্যন্ত দুর্বল বলিয়া মনে হইতেছে। অথচ পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে এখান হইতে ছয় মাইল দূরবর্তী গ্রামের জমিদার প্রজাদের জনতার উপর গুলি চালাইয়া তৎক্ষণাৎ ঘোড়ায় করিয়া সদরে গিয়া সাহেবকে সেলাম দিয়া প্ৰমাণ করিলেন—তিনি ঘটনার সময় সদরে ছিলেন। প্রজাদের মামলা ফাঁসিয়া গিয়াছিল। ঘরে বসিয়া তিনি অনুভব করিলেন রাজশক্তি যেন এই সঙ্বদ্ধ প্রজাদের তার পাইয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও চঞ্চল হইয়া পড়িলেন। দেবুকে ইহাদের সঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াও বিশেষ ফল হয় নাই। একেবারে হয় নাই। তা নয়, তবে যেটুকু হইয়াছে তাহার মূল্য খুব বেশি নয়, অন্তত তাহার তাই মনে হইল। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি দৌলত শেখকে আহ্বান করিয়া পাঠাইলেন। শেখজীর বয়স ষাট বৎসর পার হইয়া গেলেও এখনও দেহ বেশ সমর্থ আছে। মাঝারি আকারের একটা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হইয়া এখনও যাওয়া-আসা করেন, সেই ঘোড়াটায়। চড়িয়া শেখজী বাবুদের কাছারিতে উঠিলেন। বাবু সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন। দৌলত শেখও রহম এবং ইরসাদকে ভাল চোখে দেখেন না। তিনি বলিলেন ভুল খানিকটা করেছেন কর্তা। চুরি করে তালগাছটা বেচলে একটা চুরির চার্জে নালিশ করে দিলেই ঠিক হত। কর্তা বলিলেনসে তো করবই—এখন তোমায় ডেকেছি, তুমি কুসুমপুরের মাতব্বর লোক, তুমি ওদের বুঝিয়ে দাও যে, ব্যাপারটা ভাল করছে না। আমার কিছুই হবে না এতে। সাহেব তদন্তে এলেও বিনা মামলায় কিছু করতে পারবে না। মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত চলে। মিথ্যে নালিশ হাইকোর্টে টিকবে না। তা ছাড়া হাইকোর্টের মামলা ধান বেচে হয় না। দাড়িতে হাল বুলাইয়া শেখ বলিল—দেখেন কর্তা, আমাকে বলা আপনার মিছা। রহম শেখ হল বদমাস বেতমিজ লোক; ইরসাদ দুকলম লিখাপড়া শিখে নামের আগে লিখে মৌলভী; ফরজ জানে না কলেমা জানে না নিজেরে বলে মোমেন। আমি হাজী হজ করে আসছি—বয়স হল। ষাট, আমাকে বলে—বুড়া সুদ খায়, লোকেরে ঠকায়-উ হাজী নয়, কাফের। আমি বললে উয়ারা শুনবেই না! কর্তা বলিলেন—ভাল। তুমি গ্রামের মাতব্বর লোক—আমাদের সঙ্গে অনেক দিনের সুবাদ তোমার, তাই তোমাকে বললাম। এর পর আমাকে তুমি দোষ দিয়ো না। রহম-ইরসাদ আর তার দলে যাবা আছে, এ অঞ্চল থেকে আমি তাদের বাস তুলে ছাড়ব। বলিয়াই মুখুয্যে-কর্তা উঠিয়া গেলেন। দৌলত শেখের সঙ্গে আর বাক্যালাপও করিলেন না। তাহার মনে হইল হাজী ইচ্ছা করিয়াই ব্যাপারটা হইতে সরিয়া থাকিতে চাহিতেছে। কঙ্কণার তাহার ছোটখাটো সমধর্মীদের মত শেখজীও বোধহয় তিনি বিব্রত হওয়ায় আনন্দ উপভোগ করিতেছে। দৌলত শেখ কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া উঠিল। অবহেলাটা তাহার গায়ে বড় লাগিল। বুড়া ঘোড়ায় চড়িয়া ফিরিবার পথে বারবার তাহার ইচ্ছা হইল সে-ও রহম এবং ইরসাদদের সঙ্গে যোগ দেয়। সে জীবনে নিতান্ত সামান্য অবস্থা হইতে বড় হইয়াছে। বহু পরিশ্রম করিয়াছে, বহু লোকের সহিত কারবার করিয়াছে, বহুজনের মন তাহাকে রাখিতে হইয়াছে। মানুষকে বুঝিবার একটা ক্ষমতা তাহার জন্মিয়া গিয়াছে। সে বেশ বুঝিল—আজ রহম এবং ইরসাদ তাহাকে মানে না—সে তাহাদিগকে মানাইতে পারে না।ওই সত্যটা জানিবার পর মুখুয্যেবাবু আর তাহাকে মান্য করিবার প্রয়োজন অনুভব করিলেন না। আজ একটা বিপাকের সৃষ্টি করিয়া সামান্য রহম। ও ইরসাদ বাবুর কাছে তাহার চেয়েও বড় হইয়া উঠিয়াছে। হঠাৎ তাহার মনে হইল-রহম এবং ইরসাদকে সে যদি বাগ মানাইয়া আপনার আয়ত্তে আনিতে পারে তবে এ অঞ্চলের ধুরন্ধর কর্তাটিকে ছিপে-গাথা হাঙ্গরের মত খেলাইয়া লইতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তাহার হাসি আসিল। মুখুয্যেবাবু শের ছিল, হঠাৎ যেন শিয়াল বনিয়া গিয়াছে। যখন তাহাকে বলিল রহম ইরসাদ। আর তার দলে যারা আছে এ অঞ্চল থেকে তাদের বাস তুলে ছাড়ববাবুর তখনকার গলার আওয়াজটা পর্যন্ত হালকা হইয়া গিয়াছিল। শাসনিটা নিতান্তই মৌখিক। মুখুয্যেবাবুর মুখখানা পর্যন্ত ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। আরে হায় রে, হায় রে মুখুয্যেবাবু! তুমি দেখিতেছি বাঘের খাল ( চামড়া) পরিয়া থাক—আসলে তুমি ভেড়া! রহম আর ইরসাদকে ভয় কর তুমি? ফুঃ ফুঃ! ঘোড়ার পিঠে বসিয়া আপন মনে হাজী সাহেব বারকয়েক ফুঃ ফুঃ শব্দ করিল। ইরসাদরহম? তাদের মুরদ কি? মুখুয্যেবাবুদের মত তাহার
false
humayun_ahmed
রাতে কিছু খাবেন না। তোমার না। আজ বন্ধুর বিয়েতে যাবার কথা ছিল–যাওনি? না। যাওনি কেন? শুভ্ৰ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব এই হাসির অর্থ জানেন। এই হাসির অর্থ হচ্ছে শুভ্ৰ এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলতে চায় না। ইয়াজউদ্দিন সাহেব এক চামচ ভাত নিলেন। তিন-চার রকমের তরকারি আছে। কোনটিই তাঁর মনে ধরছে না। তিনি ডালের বাটির দিকে হাত বাড়ালেন। ডাইনিং রুমে শুধু তিনি এবং শুভ্ৰ। মতি মিয়া চলে গেছে। এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে সব খাবার-দাবার টেবিলে সাজিয়ে কাজের লোকরা দূরে সরে যাবে। এই নিয়ম ইয়াজউদ্দিন সাহেবের করা। তিনি তাঁর জরুরি কথাবার্তা যা বলার তা খাবার টেবিলেই বলেন। তিনি চান না বাইরের কেউ এসব কথাবার্তা শুনুক। শুভ্র। জ্বি। তোমাদের রেজাল্ট কবে হবে–তুমি কিছু জান? খুব শিগগিরই হবার কথা। এখন কি করবে কিছু ভেবেছ? না। দেশের বাইরে গিয়ে যদি পড়াশোনা করতে চাও, করতে পার। আমার বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। কেন? শুভ্র আবারো হাসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, পড়াশোনা করার জন্য যেতে না চাও, বেড়াবার জন্যে যাও। এরপর আর সময় পাবে না। সময় পাব না কেন? আমি অবসর নেব বলে ভাবছি। এক জীবনে প্রচুর পরিশ্রম করেছি। এখন আর আগের মত পরিশ্রম করতে পারি না। পরিশ্রম করতে ভালও লাগে না। এক জীবনে সঞ্চয় যা করেছি তা আমার কাছে যথেষ্ট বলেই মনে হয়। তোমাকে এই সঞ্চয় আমি বাড়াতে বলছি না। তুমি যা আছে তা শুধু ঠিক রাখবে। শুভ্ৰ সহজভাবে বলল, তোমার কত টাকা আছে, বাবা? চট করে বলতে পারব না। তবে আমাকে দেখে বা আমার জীবনযাপন পদ্ধতি দেখে আমার অর্থ-বিত্ত সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব না। আমি খুব লো প্রোফাইল মেইনটেইন করি। তুমি বলতে চাচ্ছি। তোমার প্রচুর টাকা? হ্যাঁ। টাকা তোমার কাছে কখনো ঝামেলা বলে মনে হয় নি? টাকা ঝামেলা মনে হবে কেন? টাকার অভাবই ঝামেলা বলে মনে হয়েছে। শুভ্ৰ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। থেমে গেল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছি? না। বলতে চাইলে বলতে পার। আমি তোমার সঙ্গে ফ্রি ডিসকাশন করতে চাই। দেখ শুভ্ৰ, আমি কঠোর পরিশ্রম করে টাকা করেছি। আমি মদ খাই না। জুয়া খেলি না। রিল্যাক্স করার জন্যে বিদেশের নাইট ক্লাবে যাই না। কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলায় জীবনযাপন করেছি–কেন করেছি বলে তোমার ধারণা? কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করনি। তোমার স্বভাবই হচ্ছে এরকম। একেক মানুষ একেক রকম। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ দ্রু কঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। হালকা গলায় বললেন, তোমার মা তোমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। ঐদিন কি এক মেয়ের কথা বললেন। বিয়ের ব্যাপারে তুমি কি কিছু ভাবছ? না, কিছু ভাবছি না। তোমার পছন্দের কেউ কি আছে? থাকলে বলতে পার। শুভ্ৰ হাসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মতি মিয়া অপেক্ষা করছিল–টি কোজি ঢাকা চায়ের পট নিয়ে ঢুকল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব ডিনারের পর পর হালকা লিকারে এক কাপ চা খান। শুভ্র বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাত ধোয় হলে সে হাত ধুবো। শুভ্র বলল, তোমাকে একটা কথা বলা বোধহয় দরকার, বাবা, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। আমার টাকাপয়সার দরকার নেই। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তুমি কি এ বাড়িতে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছ? শুভ্ৰ চুপ করে রইল। ইয়াজউদ্দিন তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তোমার কি ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে? হ্যাঁ আছে। আমি কি জানতে পারি? অন্য আরেকদিন বলব, বাবা। আজ বলতে সমস্যা কি? আজ তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনবে না। যে কোন কারণেই হাক আজ তুমি উত্তেজিত। এসো চা খাই। দুজন নিঃশব্দে চায়ের পেয়ালা হাতে বসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব কোন একটা মজার কথা বলতে চাচ্ছেন। হালকা কোন রসিকতা। এনেকডোটস। চায়ার টেবিলে এই কাজটা তিনি প্রায়ই করেন। আশ্চর্য! কোন রসিকতা মনে পড়ছে না। তিনি আসলেই উত্তেজিত। মতি! মতি মিয়া! মতি এসে দাঁড়াল। মতিকে কি জন্যে ডেকেছেন ইয়াজউদ্দিন সাহেব মনে করতে পারলেন না। কটা বাজে মতি? মতি বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে। প্রশ্নটা অর্থহীন। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের হাতে ঘড়ি আছে, দেয়ালে ঘড়ি। এ বাড়ির এমন কোন ঘর নেই। যেখানে দেয়ালে ঘড়ি টিক টিক করছে না। স্যার, এগারোটা বাজে। আচ্ছা যাও। শুভ্ৰ বলল, বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তুমি ঘামছ। শরীর খারাপ লাগছে না। গরম লাগছে। তুমি কি আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ বারান্দায় বসবে? অবশ্যই বসব। অনেকদিন তোমার সঙ্গে কথা হয় না। আমি নিজে ব্যস্ত থাকি, তুমিও সম্ভবত ব্যস্ত থাক। আমি তো ব্যস্ত থাকি না। আমার আসলে কিছুই করার নেই। আমি শুনেছি। সারাদিন তুমি বাসায় থাক না। কি করা? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, বাবা। কেন? কারণ নেই কোন। এম্নি। কলাবাগানের এক বাসায় তুমি যাও। প্রায়ই যাও। কার বাসা? শুভ্র সহজ গলায় বলল, তুমি কি করে জানলে বাবা? ইয়াজউদ্দিন খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আমাকে খোঁজ-খবর রাখতে হয়। তুমি পৃথিবী সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। যে কোন সময় ঝামেলায় পড়তে পার। বাবা হিসেবে এইটুকু সাবধানতা নেয়া অন্যায় নয় নিশ্চয়ই। ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলছি না। আমার মজা লাগছে তাই জিজ্ঞেস করছি। তুমি কোথায় যাও না যাও সে সম্পর্কে একটা রিপোর্ট দেবার জন্যে আমি একজনকে বলেছিলাম। সে রিপোট দিয়েছে। পড়তে চাও? না। কলাবাগানে তুমি যে বাসায় যাও সেটা কার বাসা? রিপোটে কি লেখা নেই?
false
humayun_ahmed
হতে পারি। যাবেন কিসে? আমি সেনাবাহিনীর একটি বিমান নিয়ে এসেছি। একটা টু-সীটার। আপনি নিজেই চালাবেন? হ্যাঁ। আমি একজন বৈমানিক। এক সময় বিমানবাহিনীতে ছিলাম। বিষয়টি খুব জরুরি মনে হচ্ছে? খুবই জরুরি। টাকার ব্যাপারে সিআইএ কৃপণতা করবে না বলে আশা করতে পারি। টাকা কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি। মিঃ ফকনার, আপনি তৈরি হয়ে নিন। আমি তৈরিই আছি। শুধু একটা নোট লিখে দরজায় রেখে যাব। লিজা ব্রাউন পিজার প্যাকেট নিয়ে এসে দরজায় আটকানো নোটটি পড়ল। লিজা, তুমি খাবারের প্যাকেটটি দরজার বাইরে রেখে যাও। দেখা হল না বলে দুঃখিত। তারপর বল, তুমি কেমন আছ? ফকনার। পুনশ্চঃ খাবারের বিল আমি এসে মিটিয়ে দেব। লিজা ব্রাউন বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটির বয়স খুবই অল্প। সাদামাঠা চেহারা। মাথার চুল ছেলেদের মত কাটা বলেই হয়তো সমস্ত চেহারায় একধরনের মায়াকাড়া ভাব এসেছে। সে কি কিছুটা হতাশ হয়েছে? হয়তো-বা। অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়। ফকনার ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছিল। তাকে এক ঘন্টার ওপর এন্ট্রি-রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এন্ট্রি-রুমটি ছোট। আলো-বাতাস নেই। বসার জন্যে চামড়ার গদিওয়ালা চেয়ারগুলি নোংরা। সমস্ত মেঝেতে সিগারেটের ছাই। এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এন্ট্রি রুমের এই অবস্থা কেন? নাকি ইচ্ছা করেই এ-রকম রাখা হয়েছে মনের ওপর চাপ ফেলবার জন্যে। দেড় ঘন্টার মাথায় তাকে জানানো হল, জেনারেল সিমসন ব্যস্ত, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক পড়বে। তাকে একজন কে এসে এক কাপ কফি দিয়ে গেল। ইন্সট্যান্ট কফি—এমন একটা গন্ধ, নাকে গেলেই বমি-বমি ভাব হয়। জেনারেল সিমসনের অফিসের দরজা খুলল। অল্পবয়সী একটি তরুণ (সম্ভবত জেনারেলের পিএ) এসে বলল, মিঃ ফকনার, আপনি আসুন। সে ফকনারকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। প্ৰকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে যে-ছোটখাটো মানুষটি বসে আছেন, তাঁকে ফকনারের মোটেই পছন্দ হল না। জেনারেল সিমসনের বয়স ষাটের কোঠায়। শরীর অশক্ত। মাথায় একগাছিও চুল নেই। মাথা নিচু করে বসে-থাকা মানুষটিকে দেখেই মনে হয় অনেক ধরনের রোগ-ব্যাধি এঁকে ধরে আছে। পিঙ্গল বর্ণের চোখ। তাকানোর ভঙ্গিতে একধরনের অবহেলা আছে, যা অন্যদের মনে হীনমন্য দেয়। জেনারেল সিমসন ভারি স্বরে বললেন, আপনিই ফকনার। কর্নেল ফকনার? হ্যাঁ। বসুন। ফকনার বসল। সে আশা করেছিল জেনারেল সিমসন উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করবেন। তিনি তা করলেন না, যেন ফকনার একজন ছোট পদের অধস্তন কর্মচারী। তার সঙ্গে বাড়তি সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজন নেই। জেনারেল সিমস কিছুক্ষণের জন্যে একটা ফাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টেলিফোনে কাকে যেন কী-সব বললেন। এও একধরনের চাল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো—তুমি অত্যন্ত নগণ্য ব্যক্তি। বসে থাক চুপচাপ। আমার কাজ শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে। সেনাবাহিনী থেকে আপনাকে ডিসচার্জ করা হয়েছিল? হ্যাঁ। কেন? ফকনার ঠাণ্ডা স্বরে বলল, কেন করা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। যেপ্রশ্নের উত্তর জানেন, তার উত্তর আবার শোনাবার কারণ দেখি না। ফকনার সিগারেট ধরাল। সে তার বিরক্তি চেপে রাখতে পারছিল না। জেনারেল সিমসন বললেন, আমি নন-স্মকার, তামাকের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। দয়া করে। সিগারেটটি ফেলে দিন। আমি বরং পাশের ঘরে গিয়ে সিগারেট শেষ করে আসি। ইতোমধ্যে আপনার যা বলবার ঠিকঠাক করে রাখুন। লম্বা ধরনের আলাপ-পরিচয় আমার পছন্দ নয়। মিঃ ফকনার, লম্বা আলাপ আমারও পছন্দ নয়। আপনি সিগারেট নিয়েই বসুন। আপনাকে কী জন্যে ডাকা হয়েছে আপনি তা জানেন, আশা করতে পারি। কিছু জানি। জুলিয়াস নিশোকে ফোর্টনকে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁকে এ-মাসের ২৬ কিংবা ২৭ তারিখে হত্যা করা হবে। তার আগে নয় কেন? এ-মাস হচ্ছে জেনারেল ডোফার জন্মমাস। জন্মমাসে আফ্রিকানরা হত্যার মতো বড় অপরাধ করে না, ওদের অনেক রকম কুসংস্কার আছে। মাস তো শেষ হবে ত্রিশ তারিখে। ২৬/২৭ বলছেন কেন? চান্দ্রমাসের কথা বলছি। আফ্রিকানরা চান্দ্রমাস মেনে চলে। আপনি নিশ্চিত যে, ২৬/২৭ তারিখের আগে নিশোকে হত্যা করা হবে না? নব্বই ভাগ নিশ্চিত। দশ ভাগ আনসারটিনিটি সবসময়ই থাকে। এখন আপনিই বলুন, জুলিয়াস নিশোকে এই সময়ের ভেতর কি উদ্ধার করা সম্ভব? জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এটা একটা ছেলেমানুষি কথা, পৃথিবীতে অনেক কিছুই অসম্ভব। আমার সঙ্গে ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে কোনো কথা বলবেন না। আপনি আমাকে বলুন, এই মিশন গ্রহণ করতে আপনি রাজি আছেন? ফকনার লোকটিকে পছন্দ করতে শুরু করল। এ কাজের লোক। কথাবার্তার ধরন দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এবং এর সঙ্গে কথাবার্তা হওয়া উচিত সরাসরি। কথার মারপ্যাচ না-দেখালেও চলবে। বলুন, রাজি আছেন? হ্যাঁ বলবার আগে সব ভালোমতো জানতে চাই। আপনি সবকিছুই জানবেন। আপনার জন্যে কয়েকটি ফাইল তৈরি করা হয়েছে। এগুলি ভালো করে পড়ন। কাল সকাল নটায় আপনি হা কিংবা না বলবেন। ঠিক আছে, তা বলব। অবশ্যি আপনি যা বললেই যে আমরা মিশনটি আপনার হাতে দেব, তেমন। কোনো কথা নেই। আমরা অন্য লোকজনদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলছি। ভালো। বাজার যাচাই করে নেওয়াই ভালো। কর্নেল ফকনার, আপনাকে একটা কথা বলা…… আমাকে কর্নেল বলবেন না। সেনাবাহিনী আমি অনেক আগে ছেড়ে এসেছি। মিঃ ফকনার, আমি যে-জিনিসটি বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে…… ফাইলগুলো পড়ার আগে আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। ঠিক আছে। আমি এখন তাহলে উঠি। বেশ। দেখা হবে কাল নটায়। ফকনার ঘর থেকে বেরুবার আগ মুহূর্তে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, সিআইএ জুলিয়াস নিশোকে উদ্ধার করতে চাচ্ছে কেন? উনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদ্ধার করার মতো কোনো মহৎ আদর্শ তাদের
false
shunil_gongopaddhay
আজ সন্ধেবেলা কী করা হবে? মিলিটারির সেই সাহেব আসবেন? কাকাবাবু বললেন, ঠিক জানি না। কোনও খবর পাইনি। মণিকা বলল, আজ কিন্তু আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। সকালে আপনারা কোচবিহার শহরে গিয়েছিলেন, তখন আমাকে ইস্কুলে যেতে হল! কাকাবাবু হাসলেন। একটু বাদে হেডমাস্টারমশাই বেরিয়ে গেলেন এক জায়গায় ছাত্র পড়াতে। মণিকা বাথরুমে গা ধুতে গেল। কাকাবাবু সন্তুকে ফিসফিস করে বললেন, আজ সন্ধের সময় আমরা এক জায়গায় যাব। সেখানে মণিকাকে কিছুতেই নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ও ছাড়তে চাইবে না। কী করা যায় বল তো? সন্তু বলল, আমরা চুপিচুপি এখনই কেটে পরি? কাকাবাবু বললেন, আরও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। তা ছাড়া ওকে কিছু না বলে গেলে বেচারি খুব দুঃখ পাবে। একটা কাজ করা যায়। তুই বরং আজ থেকে যা এখানে। তুই ওর সঙ্গে গল্প করবি। আমি ঘুরে আসি। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল, না, আমি থাকব না। আমি যাব! কাকাবাবু বললেন, তা হলে এক কাজ কর। দুজনে একসঙ্গে বেরনো যাবে না। তুই আগেই সরে পড়। তুই গিয়ে নদীর ধারে লুকিয়ে বসে থাক। সেই প্রথমবার যেখানে বসেছিলাম, যেখানে তোকে কুকুরটা আক্রমণ করেছিল। ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে থাকবি, নদীর ওপারেও থাকতে পারিস, কেউ যেন তোকে দেখতে না পায়। সন্তু তক্ষুনি জুতো-মোজা পরে তৈরি হয়ে নিল। তারপর এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। কিছুক্ষণ পর কাকাবাবু ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে যেই ঘর থেকে বেরিয়েছেন, অমনই মণিকা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? কাকাবাবু বললেন, যাই, একটু বেড়িয়ে আসি। মণিকা বলল, সন্তু কোথায় গেল? কাকাবাবু অম্লানবদনে বললেন, ও তো পাঁচটার বাস ধরে কোচবিহার টাউনে চলে গেল! কেন? ও যে তোমাদের আগুন পাখির ছবিগুলো তুলেছিল, তার প্রিন্টগুলো দেখার জন্য ছটফট করছিল। তা ছাড়া, কলকাতায় একটা ফোন করতে হবে। রাত্তিরে ফিরবে কী করে? আর তো বাস নেই! অনির্বাণ যদি গাড়ি নিয়ে আসে, তা হলে তার সঙ্গে ফিরবে। না হলে থেকে যাবে। আমাকে না বলে চলে গেল, ভারী দুষ্টু তো! দাঁড়ান কাকাবাবু, আমি চটি পরে আসি, আমিও যাব আপনার সঙ্গে! কাকাবাবু অপলকভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মণিকার দিকে। এই মেয়েটির সাহস আছে। ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে যেতে চায়। এরকম মেয়ে বেশি দেখা যায় না। তবু আজ ওকে সঙ্গে নেওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। তিনি আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, না মণিকা, আজ আমি একাই। যাব। মণিকা ভুরু তুলে বলল, এই গ্রামের মধ্যে আপনি একা কোথায় বেড়াবেন? আমি আপনাকে সব চিনিয়ে দেব। কাকাবাবু নরম গলায় বললেন, চিনিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমি নদীর ধারে ঘুরব। তোমাকে সঙ্গে আসতে হবে না। শুধু তাই নয়, তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এর পরেও তুমি একা একা বেরিয়ে পড়বে না। আমি যতক্ষণ না ফিরি, তুমি বাড়িতে থাকবে। মণিকা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, কেন, আমি আপনার সঙ্গে গেলে কী হয়েছে? কেন নেবেন না আমাকে? কাকাবাবু বললেন, ফিরে এসে বলব। ফিরে এসে তোমাকে একটা অদ্ভুত গল্প শোনাব। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রইল, তুমি কিছুতেই আজ রাতে বাইরে বেরোবে না। কাকাবাবু মণিকার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে একটু আদর করলেন। তারপর মণিকাকে সেই অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন আস্তে-আস্তে। যেন তিনি অলসভাবে ভ্রমণ করছেন। টোবি দত্তর বাড়ির ধারেকাছে ঘেঁষলেন না। নদীর ধারে যখন পৌঁছলেন, তখন বিকেল প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের আকাশ। লাল। সন্তুকে কোথাও দেখা গেল না। কাকাবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটুক্ষণ সূর্যাস্তের শোভা দেখলেন। নদীর ওপর থেকে একটা শিসের শব্দ ভেসে এল। কাকাবাবু দুবার মাথা ঝোঁকালেন। তারপর নেমে পড়লেন নদীতে। নদীতে জল বেশি নেই, কিন্তু মাঝখানে বড় বড় পাথর। অন্য লোকেরা অনায়াসে বসে যেতে পারে। কিন্তু ক্রাচ নিয়ে যাওয়ার বেশ অসুবিধে। কাকাবাবু খোঁড়া পা-টা ঠিকমতন মাটিতে পাততে পারেন না, তবে সেই পায়েও একটা বিশেষ ধরনের জুতো পরে থাকেন। সেই জুতো খোলার অনেক ঝামেলা বলে তিনি প্যান্ট-জুতো ভিজিয়ে ফেললেন। অন্য পাড়ে ওঠার পর সন্তু একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আমি টোবি দত্তর বাড়ির দিকে নজর রেখেছি। ছাদে কাউকে দেখা যায়নি। কাকাবাবু সে-কথায় কোনও গুরুত্ব না দিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, দ্যাখ, কিছু কিছু গাছের ডাল কেউ হেঁটেছে বোঝা যাচ্ছে। সন্তু বলল, জঙ্গলের গাছ কাটা তো অপরাধ। কাকাবাবু বললেন, পুরো গাছ কাটেনি। ডালপালা ছাঁটা তেমন অপরাধ নয়। মনে হয়, জঙ্গলের মধ্যে কেউ একটা রাস্তা বানাতে চেয়েছে। কাকাবাবু ঘড়ি দেখলেন। তখনই নদীর এ-ধারে একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। একটা কালো রঙের জিপ গাড়ি থেকে নেমে এল অনির্বাণ। কাকাবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন দিকে যাব? কাকাবাবু বললেন, একটু দাঁড়াও। আগে ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে হবে। এবার তিনি টোবি দত্তর বাড়ির দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। আবছা অন্ধকারে বাড়িটাকে জনমনুষ্যহীন মনে হয়। কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্তর বাড়ির ছাদে গভীর রাতে একটা জোরালো আলো জ্বলে। কেন সে আলোটা জ্বালে, এর একটা সহজ উত্তর আমাদের মনে আসেনি। অনির্বাণ বলল, কাকাবাবু, আপনার কাছে উত্তরটা সহজ মনে হতে পারে, আমাদের কাছে কিন্তু খুবই জটিল। কাকাবাবু বললেন, জটিল কেন হবে? আলোটা সে জ্বালে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু কার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য? কাকাবাবু বললেন, তোমার! অনির্বাণ চমকে গিয়ে খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে
false
shunil_gongopaddhay
গরম পড়তে শুরু করেছে। বিকেলবেলায় আকাশে দেখা যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে বিদেশি হংস। কাদম্বরীর ঘরের দরজা খোলা। তিনি একটা জানলার পাশে বসে আছেন বাইরে তাকিয়ে। ঘর একটু একটু অন্ধকার, কিন্তু বাইরে এখনও শেষ সূর্যের আলো আছে। এই জানলা দিয়ে বাগানের অনেকখানি দেখা যায়। একেবারে কাছেই একটা বড় বকুল গাছ, সেখানে কিচির-মিচির করছে অসংখ্য পাখি, বাগানের অন্য গাছের তুলনায় এই গাছটাকে পাখিরা বেশি পছন্দ করে। রবি ডাকল, নতুন বউঠান! কাদম্বরী ফিরে তাকালেন। কিন্তু ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালেন না, ছুটে রবির হাত ধরলেন না, তার নামে কোনও অনুযোগ করলেন না, কিছুই না। শুধু একবার তাকালেন মাত্র। – রবি কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার শরীর ভালো আছে। কাদম্বরী মাথা হেলিয়ে বললেন, হ্যা। রবি আবার জিজ্ঞেস করল, ঘরে বাতি জ্বলোনি? কাদম্বরী উত্তর না দিয়ে এমনভাবে চেয়ে রইলেন, যাতে মনে হয়, বাতি জ্বালা না-জ্বালায় কিছু আসে যায় না। রবি বলল, নতুন বউঠান, এই আমার ছবি ও গান। কাদম্বরী হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন। অলসভাবে ওলটালেন কয়েকটি পৃষ্ঠা, উৎসর্গের লেখাটি পড়ে শুধু বললেন, গত বৎসর। তারপর রেখে দিলেন। বইটি এক পাশে। এর আগে রবির অন্য যে-কোনও বই পেলে তিনি উৎফুল্ল হয়ে প্রথমেই গন্ধ শুঁকতেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা দেখতেন, কেন কোন কবিতাটি আগে দেওয়া হয়েছে, কোনটি শেষে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতেন। এখন যেন তাঁর কোনও উৎসাহই নেই। কেন যে এই অনাসক্তি, তার কারণটা রবি জানে, সেইজন্যই প্রশ্ন করতে সাহস করল না। জ্ঞানদানন্দিনী যে এঁর কাছ থেকে জোর করে রবিকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এঁর স্বামীকে নিজের দিকে টেনেও নিরস্ত হননি, রবিকেও তার চাই। কাদম্বরীকে নিঃসঙ্গতার শাস্তি দিয়েই তাঁর আনন্দ। নতুন বউঠানেরও দোষ আছে, তিনি শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকেন কেন, স্বামীর সঙ্গে বেরুতে পারেন না? নতুন বউঠান দিনের পর দিন এই ঘরে একা বসে থাকবেন, প্রতিদিন এরকম বিকেল-সন্ধেবেলা রবি কি তাকে সঙ্গ দিতে পারে এখন? তার ইচ্ছে থাকলেও পারবে না। সারা বাড়িতে ফিসফাস শুরু হয়ে যাবে। তা ছাড়া রবিরও তো এখন বাইরে অনেক কাজ। আগের মতন, কাদম্বরীর অভিমান ভাঙাবার মতন অনন্ত অবসর যে তার নেইই। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়ির দিনগুলি এখন নিতান্তই এক সুখস্বপ্ন! রবি বলল, নতুন বউঠান, এখন স্বর্ণদিদির বাড়িতে রোজ কত মজা হয়, কত গান হয়, তুমি সেখানে আস না কেন? কাদম্বরী ক্লিষ্ট স্বরে বললেন, ওখানে আমার যেতে নেই। আমি যে অপয়া। রবি তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, যাঃ, এ কী বলছ, তুমি, ছিছিছি! কাদম্বরী বললেন, ঠাকুরঝি’র মেয়ে উৰ্মিলা, আমার কাছে আসত, আমার হাতে খেত, আমরা এখানেই শুয়ে থাকত। আমি তাকে মেরে ফেলেছি। সবাই বলে, আমি আঁটকুড়ী, তাই হিংসেয় আমি স্বর্ণদিদির মেয়েটাকেও খেয়ে ফেলেছি! রবি বলল, ইস, ছিছি, এমন কথা কক্ষনও আর উচ্চারণ করবে না। ওটা তো একটা দুর্ঘটনা। তোমার নামে অমন কথা কেউ কক্ষনও বলে না। কাদম্বরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বলে না বুঝি? কী জানি! আমি যেন সৰ্বক্ষণ শুনতে পাই, আমার আড়ালে এ বাড়ির সবাই গুজগুজ করে বলছে, অপয়া। অপয়া। ওই বউটা অপয়া! রবি কাতরভাবে বলল, ভুল, ওটা তোমার মনের ভুল! তুমি সৰ্বক্ষণ ঘরে বসে থাক. বাইরে বেরোও, সবার সঙ্গে মিশে দেখো, কতজন তোমাকে ভালোবাসে, স্বর্ণদিদির বাড়িতে গান-বাজনার মধ্যে গিয়ে পড়লে তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে! কাদম্বরী বললেন, যদি ওরা আমাকে… আমার যেতে ইচ্ছে করে না রবি, আমার মন চায় না। তুমি যাও— তিনি আবার জানলার বাইরে চোখ ফেরালেন। এখন বাইরেও প্রায়ান্ধকার। রবি কাছে এসে কাদম্বরীর কাঁধে হাত রেখে ব্যাকুল হয়ে বলল, নতুন বউঠান, চলো, আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে দেখলে সবাই খুশি হবে। রবিকে হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে কাদম্বরী ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তুমি যাও, রবি! তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। রবির পক্ষে সত্যি আর থাকার উপায় নেই। এখানে আর কাকুতিমিনতি করেও লাভ হবে না বোঝা যাচ্ছে। ওখানে দেরি হলে সে কী কৈফিয়ত দেবে? কাশিয়াবাগানের বাড়িতে সেই সন্ধ্যায় সবাই বিশেষ করে রবির জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের এক জায়গায় একটা মোচাড়ের জন্য, নায়িকাকে দেখে নায়কের মোহিত হয়ে যাওয়া বোঝাবার জন্য একটা গান দরকার। কোনও গানই পছন্দ হচ্ছে না। স্বর্ণকুমারী বা অক্ষয় চৌধুরী দু’-চার লাইন বলেছেন, তা বাতিল করে দিচ্ছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বসেছেন পিয়ানোতে। মেঝেতে কার্পেট পাতা, তাতে বসেছে। হিরণ্ময়ীর সমবয়েসী আট দশটি মেয়ে। স্বর্ণকুমারী ও অক্ষয়চন্দ্র বসেছেন দুটি সোফায়। সবার সামনে সামনে খাবারের প্লেট। রবি ঢুকতেই সবাই হইহই করে উঠল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কোথায় ছিলি, রবি? আমরা চাতক পাখির মতন তোর জন্য বসে আছি! জুতো-মোজা খুলে রবি কার্পেট এসে বসল। ছোটরা তাকে পছন্দ করে। তার গান বেশি ভালোবাসে, কারণ, রবির গান সহজ, সবাই বুঝতে পারে। অন্যদের গানের কথা বড় খটোমটো। স্বর্ণকুমারী অক্ষয়চন্দ্রকে আদেশ করলেন, ওকে সিচুয়েশানটা বুঝিয়ে দিন। জোড়াসাঁকো থেকে উল্টোডাঙ্গা পর্যন্ত আসতে আসতে রবির চোখের সামনে শুধু একটাই ছবি ভেসে আছে। মন ভরে গেছে বিষাদে। তার পক্ষে অন্য ভাব আনা এখন সম্ভব নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পিয়ানো ছেড়ে এস্রাজ নিয়ে বললেন, এই মিশ্র খাম্বাজের সুরাটা কেমন দেখ তো? রবি আচ্ছন্নের মতন বলল, ওই জানলার কাছে বসে আছে, করতলে রাখি মাথা…তারপর এস্রাজের সুরের সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে যেতে লাগল। : …চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়, উড়ে উড়ে যায় পাখি সারাদিন ধরে বকুলের
false
shunil_gongopaddhay
মানুষও সেইরকম মানুষ চায়। কিছুক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাফেরা করে ওরা আবার এলো সেই পাকা রাস্তায়, দুজনে কোনো যুক্তি করে নি-তবুওরা সেই মহুয়ার দোকানেরই পথ ধরলো। যাবার পথে চোখে পড়লো, সেই ভাঙা মিলিটারি ব্যারাক থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছে। অসীম বললো, ওখানে কারা রয়েছে চল তো দেখে আসি? নিৰন্ত উনুন থেকে তখনো ধোঁয়া বেরুচ্ছে, সেই আদিবাসী মেয়ে তিনটি শাল পাতায় ভাত বেড়ে সেখানে সদ্য খেতে বসেছে; ওদের দেখে অভিমানী চোখে তিনজনেই একবার তাকালো, তারপর আবার খাওয়ায় মনঃসংযোগ করলো; দেখেই শেখর বললো, চল! অসীম তবু দাঁড়িয়ে রইলো, একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলো। ওদের দিকে। তিনটি মেয়ে—তাদের বয়েন্স পনেরো থেকে পঁয়ত্ৰিশের মধ্যে যে-কোনো জায়গায়, কিন্তু শরীরে তারা ভরাট যুবতী, তাদের সামনে শাল পাতায় ঢালা শুধু ভাত আর ধুঁধুল সেদ্ধ, নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে। দুজন পুরুষ দাঁড়িয়ে সেই খাওয়া দেখলে—জঙ্গলের মধ্যে তখন আবছা অন্ধকার। শেখর অসীমের হাত ধরে টেনে বললো, চল! অসীম। তবু নড়লো না, অস্ফুটভাবে বললো, এখানে খাচ্ছে? এদের বাড়ি নেই? –থাকবে না কেন? কিছু দূরে বোধহয় এদের গ্রাম—সারাদিন কাজ খুঁজেছে আর ফিরে যায় নি।। অসীম পিছন ফিরে কিছুদূর হেঁটে তারপর বললো, দুপুরে তুই ওদের তাড়িয়ে দিলি কেন? তোর গোয়ার্তুমি ওরা দুটো খেতে পেতো অন্তত। –ওদের খাওয়ানের জন্য অত মাথাব্যথা কিসের রে? –দুপুরে আমাদের কতগুলো ভাত বেশি হয়েছিল—কুকুরকে খাওয়ালুম। তাতে ওদের তিনজনের অনায়াসে খাওয়া হয়ে যেতো! তুই শুধু এমন চোঁচামেচি আরম্ভ করলি! –ভালোই করেছি। –তার মানে? জঙ্গলের মধ্যে বিকেল পাঁচটার সময় ধুঁধুল সেদ্ধ দিয়ে ভাত গিলছে! আমরা ওদের দুটো খাওয়াতে পারতুম না? –দুদিন আগে আমরা এখানে ছিলুম না। দুদিন পরেও আমরা থাকবে না। ওদের খাওয়ানোর দায়িত্ব আমাদের নয়! –এটা তোর বাজে যুক্তি; যে কদিন আমরা থাকবো, সে কদিন তো খেতে পেতে, কাজের জন্য কিছু টাকাও দিতে পারতুম। –আমাদের ওখানে থাকলে ওদের দ্বারা কোনো কাজ হতো না। কি হতো, তুই ভালোভাবেই জানিস– –হলোই বা, তাতেই বাঁ আপত্তি কি? ওরা তো জেনেশুনেই এসেছিল–রবি ওদের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল-ওরা আপত্তি করে নি। খেতে না পেলে ওসব নীতি-ফিতির কোনো মানে হয় না! –সেই জন্যই তো আমি আপত্তি করছিলুম। কয়েকটা মেয়ে খেতে পাচ্ছে না বলেই সেই সুযোগ নিয়ে তাদের শরীর আমরা ছেঁড়াছিঁড়ি করবো? –করুভূমই যে তার কোনো মানে নেই। –তুই রবির চোখ-মুখ লক্ষ করিস নি? —রবির বুকের মধ্যে প্রচণ্ড অভিমান রয়েছে তপতীর জন্য। আমার তো তাই মনে হয় এদের নিয়ে কিছুটা ছেলেখেলা কাঞ্চলে রবির পক্ষে ভালোই হতো–কিছুদিন অন্তত তপতীর কথা ভুলে থাকতে পারতো। তুই দিন দিন এত মরালিস্ট হয়ে উঠেছিস কেন? –মরালিটির প্রশ্ন নয়। তোকে একটা কথা বলি অসীম, মেয়েদের সম্বন্ধে তোর চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা খানিকটা বেশি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একটা মেয়েকে ভোলার জন্য অন্য যেকোনো একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলে কিছু লাভ হয় না। তাতে অভিমান আরও বেড়ে যায়। –তোর নিজেরও ব্যথা আছে বুঝি সে রকম? –ব্যথা কার না আছে? আমার অন্য রকম ব্যথা। সে কথা থাক। –শেখর, তোকে তোর নিজের কথা জিজ্ঞেস করলেই হঠাৎ চেপে যাস কেন বল তো? আমি লক্ষ করেছি, তুই মাঝে মাঝে খুব গম্ভীর হয়ে যাস। কি ব্যাপার তোর? শেখর হা হা করে হেসে উঠে বললো, তুই যে দেখছি গোফ খাড়া করে আমার গোপন কথা শোনার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিস! আমার কিছু ব্যাপার নেই। মহুয়ার দোকানে আজ একটু বেশি ভিড়। তাছাড়া দৃশ্য প্রায় একই রকম, লাইন দিয়ে সবাই মাটিতে বসে গেছে। আশ্চৰ্য, সেই মেয়েটার মরদ আজও অজ্ঞান-মেয়োটা টানাটানি করছে তাকে। সাইকেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো লোক, এরা মহুয়া খেতে আসে নি, এদের অন্য মতলব! সমস্ত জায়গাটায় একটা অসহ্য ধরনের মিষ্টি গন্ধ। চাটের দোকানে আজ মেটুলির ঝোল রান্না হয়েছে, ওদের দেখেই দোকানদার হৈ-হৈ করে ডাকতে শুরু করে দিলো। এক বোতল মহুয়া কেনার পর অসীম আর শেখর মেটুলির ঝোল একটুখানি চোখ দেখলো। অসম্ভব ঝাল, শেখর শাল পাতাটা ছুঁড়ে দিয়ে উস্ উস্ করে হাওয়া টানতে টানতে বললো, ব্যাপস্! আগুন ঝাল, মেরে ফেললে একেবারে! উস্! দোকানদার হাসতে হাসতে বললো, ঝালই তো ভালো বাবু, মহুয়ার সঙ্গে। ঐ দেখেন না। সাঁওতালগুলো কি রকম কাঁচা লঙ্কা খেয়ে ল্যায়, দুটা চুমুক দিন আর ঝাল লাগবে নি। একবার ঝাল খেলে আরও খেতে ইচ্ছা করে। অসীম বেশি ঝাল খেতে পারে, তার তো আপত্তি নেই-ই। অসীম বললো, এখান থেকেই মেটের তরকারি আর আলুর দম কিনে নিয়ে গেলে হয়, রাত্তিরে তাহলে আর কিছু খাবার লাগবে না।। কিন্তু শেখর সঙ্গে কোনো টাকা আনেনি। অসীমের সঙ্গে মাত্র পাঁচ টাকা। তাহলে আর মহুয়া কেনাই হয় না। রবির জন্য কিছুটা নিয়ে যাওয়া উচিত। ভিড়ের মধ্যে এক কোণে লখাকে দেখতে পেয়ে অসীম বললো, লেখাকে পাঠালেই তো হয়। বাংলোয় গিয়ে সঞ্জয় বা রবির কাছ থেকে টাকা চেয়ে আনবে।–এই লখা লখা– ওরা এখানে এসে পৌঁছবার পর থেকেই লেখা ওদের সঙ্গে আঠার মতন লেগেছিল। লোকটা এমনিতে বেশ বাধ্য এবং বিনীত, সবরকম ফাই-ফরমাশ খাটতেই রাজি। কিন্তু একটু হাতটান আছে, জিনিসপত্র কিনতে পাঠালে ফিরে এসে খুচরো পয়সা সহজে ফেরত দিতে চায় না। দিলেও এমন হিসেব দেখায়-যাতে স্পষ্ট কারচুপি ধরা পড়ে। আর কেউ লক্ষ করে নি বিশেষ, কিন্তু রবি এই লখাকে ধমকেছে। এমনিতে রবি টাকা-পয়সার হিসেব গ্রাহ্য করে
false
MZI
মেমোরি ধ্বংস করে ফেলল। অন্ধকার নেমে এল সিসিয়ানে সাথে সাথে। ০৭ অনাহুত আগন্তুক কন্ট্রোলরুমে আবছা অন্ধকার, সিডিসি ধ্বংস করে দেয়ার পর সিসিয়ানে একটা বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। মহাকাশযানের জটিল কাজকর্মগুলি দূরে থাকুক, বাতাসের চাপ বা তাপমাত্রা ঠিক রাখার মতো ছোটখাট জিনিসগুলি করতে গিয়ে পর্যন্ত সই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবার পরেও কিছুতেই মূল দায়িত্বগুলিও পালন করা যাচ্ছে না। কন্ট্রোলরুমে সবাই যখন সিসিয়ানকে মূল কক্ষপথে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ দরজায় কার ছায়া পড়ে। সুশান আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, কে, কে ওখানে? ছায়ামূর্তি কোনো কথা না বলে আরো এক পা এগিয়ে আসে। সিসিয়ানে এখন। আলো খুব বেশি নেই, এগিয়ে আসার পরও তার চেহারা ভালো দেখা গেল না। সুশানের মনে হল, ট্রাইটনের বংশধর বুঝি মানুষের আকার নিয়ে চলে এসেছে। ভয়পাওয়া গলায় বলল, কে, কে ওখানে? ছায়ামূর্তি খসখসে গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি, কে ওখানে? লম্বা ছায়া ফেলে একজন মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসে, পরনে আধময়লা কাপড়, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লোকটা চোখ পিটপিট করে বলল, আমি কোথায়? এটি কোন জায়গা? লু হঠাৎ করে বুঝতে পারে লোকটা কে এবং হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়েছে। ডান হাতে একটা থ্রটল চেপে ধরে গলা উঁচিয়ে বলল, এটি মহাকাশযান সিসিয়ান। সত্যি যদি এটা একটা মহাকাশযান হয়, তা হলে এটা এত অন্ধকার কেন? এরকম এলোমেলোভাবে ঘুরছে কেন? তাপমাত্রা এত কম কেন? বাতাসের চাপ কি ঠিক করা হবে, নাকি এরকমভাবে রেখে একসময় ফুসফুসটাকে ফাটিয়ে দেওয়া হবে? কিম জিবান গলা নামিয়ে লুকে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে? নিশ্চয়ই শীতল-ঘরে ছিল। সিডিসি যাবার আগে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, সিডিসি ছাড়া তো আর জীবন্ত কাউকে শীতল রাখা যায় না। কোথায় যাবার কথা ছিল ভদ্রলোকের? জানি না, আমাদের জানার কথাও না। সিডিসি জানত। লোকটি আরো এক পা এগিয়ে এসে রুক্ষ স্বরে বলল, গুজগুজ করে ওখানে কী কথা হচ্ছে? আমাকে কি কেউ কিছু-একটা বলবে? লু কিম জিবানের হাতে টলটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। বলছি। আমার নাম লু, আমি এখানকার দলপতি। এটি কী জিনিস? এটি একটা মহাকাশযান, আসলে বলা উচিত এটি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একটা মহাকাশযান ছিল। এখন কী হয়েছে? লু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, একটা খুপরি, একটা ভাঙা ঘর, একটা উপগ্রহ, যা ইচ্ছে হয় বলা যায়। কেন?-এ অবস্থা হল কেমন করে? আমাদের মূল কম্পিউটারটি ধ্বংস হয়ে গেছে। লোকটি অবাক হয়ে বলল, ধ্বংস হয়ে গেছে? লু একটু ইতস্তত করে বলল, আসলে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। লোকটার খানিকক্ষণ সময় লাগে বিশ্বাস করতে, খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে বলল, ধ্বংস করে ফেলেছ? ইচ্ছে করে? হ্যাঁ। কেন? সেটা অনেক বড় ইতিহাস, এখন শুনে কাজ নেই। তা ছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এইমাত্র ফ্রিজিং ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ, বিশ্রাম নেয়া দরকার। আমাদের মূল কম্পিউটার নেই বলে ঠিক ঠিক সবকিছু করতে পারব না, সবাই কোনো-না-কোনো কাজে ব্যস্ত। আমাদের একজন সময় পেলেই– লোকটা বাধা দিয়ে বলল, তার আগে শুনি, কেন কম্পিউটারটাকে ধ্বংস করেছ। লু শান্ত গলায় বলল, শোনার অনেক সময় পাবে, এখন আমার কথা শুনে– লু, কিম জিবান উচ্চস্বরে ডাকল, তাড়াতাড়ি আস, আর সামলাতে পারছি না। লু কথার মাঝখানে থেমে প্রায় ছুটে কিম জিবানের পাশে গিয়ে থ্রটলটা চেপে ধরে। সময়ে-অসময়ে সে কম্পিউটারের কাজগুলি নিজে নিজে করার চেষ্টা করত বলে এসব ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। কখনো সেটা কোনো কাজে আসবে চিন্তা করে নি। লোকটা লুয়ের পিছু পিছু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, বলবে? লু মনিটর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, সত্যি এখনি শুনতে চাও? হ্যাঁ। নীষা, তুমি ভদ্রলোককে একটু গুছিয়ে বলবে? আমি খুব ব্যস্ত এখানে। নীষা নিজেও খুব ব্যস্ত, সিডিসির সাথে সাথে সিসিয়ানের প্রায় চার হাজার কম্পিউটারের সবগুলি অচল হয়ে গিয়েছে, সেগুলি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করার জন্যে তৈরি হয় নি। নীষা চেষ্টা করছে সে-রকম একটা দু’টা কম্পিউটারকে চালু করতে, ওদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে তা হলে। একটা কম্পিউটারের অসংখ্য ডাটা লাইনগুলি সাবধানে ধরে রেখে সে লোকটাকে অল্প কথায় ওদের অবস্থাটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ট্রাইটনের কথা শুনে লোকটি খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে সিডিসিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথাটি শুনল, সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে নিজের চুল খামচে ধরে বলল, কী বললে তুমি? তোমরা নিজের ইচ্ছায় ২১১২ নম্বরের তৃতীয় মাত্রার একটা কম্পিউটার ধ্বংস করে দিয়েছ? ২১১২ নম্বরের কম্পিউটারের কত বড় ক্ষমতা, তুমি জান? তাও তৃতীয় মাত্রার। পৃথিবীতে ফিরে গেলে তোমাদের নামে খুনের অপরাধ দেয়া হবে, খেয়াল আছে? তৃতীয় মাত্রার হলে দেয়া হত। আমি যে-কম্পিউটারের কথা বলছি, সেটা তার পরবর্তী পর্যায়ের, সেটি চতুর্থ পর্যায়ের। লোকটি কোনো কথা বলতে পারে না, খানিকক্ষণ লাগে তার ব্যাপারটা বুঝতে। একটু পরে সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, কী বললে? চতুর্থ পর্যায়? হ্যাঁ। কিন্তু চতুর্থ পর্যায় তো মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা রাখে, এটি একমাত্র কম্পিউটার, যেটাকে মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর জন্যে এটার মানুষ খুন করার অনুমতি আছে। জানি। তা হলে? তা হলে কী? কী ভাবে ধ্বংস করলে সেটাকে? তোমাকে একবার বলেছি, তুমি শোন নি। আবার বলছি, আমরা
false
nazrul
নিশি ভোর না হলেই ছিল ভালো। এ আলো আমি আর সইতে পারছি নে, – এ যে আমার চোখ ঝলসিয়ে দিলে! এ কী অকল্যাণময় প্রভাত আমার! ভোর হল। বনে বনে বিহগের ব্যাকুল কূজন বনান্তরে গিয়ে তার প্রতিধ্বনির রেশ রেখে এল! সবুজ শাখীর শাখায় শাখায় পাতার কোলে ফুল ফুটল। মলয় এল বুলবুলির সাথে শিস দিতে দিতে। ভ্রমর এল পরিমল আর পরাগ মেখে শ্যামার গজল গানের সাথে হাওয়ার দাদরা তালের তালে তালে নাচতে নাচতে। কোয়েল, দোয়েল, পাপিয়া সব মিলে সমস্বরে গান ধরলে, – ওহে সুন্দর মরি মরি! তোমায় কী দিয়ে বরণ করি! অচিন কার কণ্ঠ-ভরা ভৈরবীর মিড় মোচড় খেয়ে উঠল – ‘জাগো পুরবাসী।’ সুষুপ্ত বিশ্ব গা মোড়া দিয়ে তারই জাগরণের সাড়া দিলে! তুমি সুন্দর, তাই নিখিল বিশ্ব সুন্দর শোভাময়। পড়ে রইলুম কেবল আমি উদাস আনমনে, আমার এই অবসাদ-ভরা বিষণ্ণ দেহ ধরার বুকে নিতান্ত সংকুচিত গোপন করে, হাস্যমুখরা তরল উষার গালের একটেরে এককণা অশুষ্ক অশ্রুর মতো! অথচ এই যে এক বিন্দু অশ্রুর খবর, তা উষা-বালা নিজেই জানে না, গত নিশি খোওয়াবের খামখেয়ালিতে কখন সে কার বিচ্ছেদ-ব্যথা কল্পনা করে কেঁদেছে, আর তারই এক রতি স্মৃতি তার পাণ্ডুর কপোলে পূত ম্লানিমার ঈষৎ আঁচড় কেটে রেখেছে। ঘুমের ঘোর টুটলেই শোর ওঠে, –ওই গো ভোর হল! জোর বাতাসে সেই কথাই নিভৃত-সব কিছুর কানে কানে গুঞ্জরিত হয়। সবাই জাগে – ওঠে – কাজে লাগে। আমার কিন্তু ঘুমের ঘোর টুটেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। এখনও আপশোশের আঁসু আমার বইছে আর বইছে। সব দোরই খুলল, কিন্তু এ উপুড়-করা গোরের দোর খুলবে কী করে? – না, তা খোলাও অন্যায়, কারণ এ গোরের বুকে আছে শুধু গোরভরা কঙ্কাল আর বুকভরা বেদনা, যা শুধু গোরের বুকেই থেকেছে আর থাকবে! – দাও ভাই, তাকে পড়ে থাকতে দাও এমনি নীরবে মাটি কামড়ে, আর ওই পথ বেয়ে যেতে যেতে যদি ব্যথা পাও, তবে শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলো, আর কিচ্ছু না! * * * আচ্ছা, আমি এই যে আমার কথাগুলো লিখে রাখছি সবাইকে লুকিয়ে, এ কি আমার ভালো হচ্ছে? নাঃ, তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে, – এ ভালো, না মন্দ। হাঁ, আর এই যে আমার লেখার উপর কুয়াশার মতো তরল একটা আবরণ রেখে যাচ্ছি, এটাও ইচ্ছায়, না অনিচ্ছায়? তাই বলছি, এখন যেমন আমি অনেকেরই কাছে আশ্চর্য একটা প্রহেলিকা, আমি চাই চিরটা দিনই এমনি করে নিজেকে লুকিয়ে থাকতে – আমার সত্যিকারের ব্যথার উৎসে পাথর চাপা দিয়ে আর তারই চারি পাশে আবছায়ার জাল বুনে ছাপিয়ে থাকতে, বুকের বেদনা আমার গানের মুখর কলতানে ডুবিয়ে দিতে। –কেননা, যখন লোকে ভাববে আর হাসবে, যে, ছি! – সৈনিকেরও এমন একটা দুর্বলতা থাকতে পারে ! না না – এখন থেকে আমার বুক সে চিন্তাটার লজ্জায় ভরে উঠছে! – আমার এই ছোটো কথা ক-টি যদি এমনই এক করুণ আবছায়ার অন্তরালেই রেখে যাই, তাহলে হয়তো কারুর তা বুঝবার মাথা-ব্যথা হবে না। আর কোনো অকেজো লোক তা বুঝবার চেষ্টা করলেও আমায় তেমন দূষতে পারবে না। দূর ছাই, যতসব সৃষ্টিছাড়া চিন্তা। কারই বা গরজ পড়েছে আমার এ লেখা দেখবার? তবু যে লিখছি? মানুষ মাত্রেই চায় তার বেদনায় সহানুভূতি, তা নইলে তার জীবনভরা ব্যথার ভার নেহাৎ অসহ্য হয়ে পড়ে যে। দরদি বন্ধুর কাছে তার দুখের কথা কয়ে আর তার একটু সজল সহানুভূতি আকর্ষণ করে যেন তার ভারাক্রান্ত হৃদয় অনেকটা লঘু হয়। তাছাড়া, যতই চেষ্টা করুক, আগ্নেয়গিরি তার বুক-ভরা আগুনের তরঙ্গ যখন নিতান্ত সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে, তখন কী অত বড়ো শক্ত পাথরের পাহাড়ও তা চাপা দিয়ে আটকে রাখতে পারে? কখনই না। বরং সেটা আটকাতে যাবার প্রাণপণ আয়াসের দরুন পাহাড়ের বুকের পাষাণ-শিলাকে চুর-মার করে উড়িয়ে দিয়ে আগুনের যে হলকা ছোটে, সে দুর্নিবার স্রোতকে থামায় কে?… হাঁ, তবু ভাববার বিষয় যে, সে দুর্মদ দুর্বার বাষ্পোচ্ছ্বাসটা আগ্নেয়গিরির বুক থেকে নির্গম হয়ে যাবার পরই সে কেমন নিস্পন্দ শান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখলে বোধ হয়, মৌন এই পাষাণ-স্তূপের যেন বিশ্বের কারুর কাছে কারুর বিরুদ্ধে কিছু বলবার কইবার নেই। শুধু এক পাহাড় ধীর প্রশান্ত-নির্বিকার শান্তি! আঃ – সেই বেশ! আচ্ছা, বাইরে আমি এতটা নিষ্করুণ নির্মম হলেও আমার যে এই মরু-ময়দানের শুকনো বালির নীচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্যে করুণায় একটি আঁখিও কি সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আমার! হয়তো থাকতেও পারে। তবু চাই নে যে? – না ভাই, না, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রুপের ভয় ও বেদনা যে বড়ো নিদারুণ! তাই আমার অন্তরের ব্যথাকে আর লজ্জাতুর করতে চাই নে – চাই নে। হয়তো তাতে সে কোন্ এক পবিত্র স্মৃতির অবমাননা করা হবে। সে তো আমি সইতে পারব না। – অথচ একটু সান্ত্বনা যেন এ নিরাশ নীরস জীবনে খুবই কামনার জিনিস হয়ে পড়েছে। এখন আমার সান্ত্বনা হচ্ছে এই লিখেই – এমনি করে আমার এই গোপন খাতাটির সাদা বুকে তারই – সেই বেদনাতুর মূর্তিটিরই প্রতিচ্ছবি আবছায়ায় এঁকে। আমার সাদা খাতার এই কালো কথাগুলি আর গানের স্নিগ্ধ-কল্লোল এই দুটি জিনিসই আমার আগুন-ভরা জীবনে সান্ত্বনা-ক্ষীর ঢেলে দিচ্ছে আর দেবে!… আমার আজ দুনিয়ার কারুর উপর অভিমান নেই! আমার সমস্ত মান-অভিমান এখন তোমারই উপর খোদা! তুমিই তো
false
shunil_gongopaddhay
না। এখানকার ডিভিশনাল কমিশনার একজন বাঙালি, খুব কাজের লোক, তাঁর সঙ্গে আলাপ হলে আপনার ভাল লাগবে! কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ওখানে কী হয়েছে? অরুণ ভার্গব বললেন, গাড়িতে উঠুন। হোটেল থেকে আপনাদের জিনিসপত্রগুলো তুলে নিতে হবে। যেতে যেতে সব বলব। হোটেলে এসে জিনিসপত্র সব ভরা হল পুলিশের গাড়িতে। ম্যানেজার বিল বানাতে দেরি করছিল, অরুণ ভার্গব তাকে ধমক দিয়ে বললেন, শিগগির, শিগগির করুন। সময় নষ্ট করছেন কেন? টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়ে সবাই মিলে ওঠা হল এক গাড়িতে। নদীটার দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছিল। খুব ইচ্ছে ছিল, নিরিবিলিতে এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার। অরুণ ভার্গব বললেন, বুঝতেই পারছেন, খুবই একটা বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে বলেই আপনাকে বিরক্ত করা হচ্ছে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা এবার শোনা যাক। অরুণ ভার্গব বললেন, একটু খুলে বলতে হবে। তবে ব্যাপারটা খুবই গোপন, বাইরের কেউ এখনও কিছু জানে না। তিনি সন্তু আর জোজোর দিকে তাকালেন। কাকাবাবু বললেন, ওরা ঠিক আছে। আলাপ করিয়ে দিই, একজন আমার ভাইপো সন্তু, আর একজন তার বন্ধু জোজো। ওদের গুণপনা ক্রমশ জানতে পারবেন। জোজো বলল, কাকাবাবু, শুধু গুণপনা কেন বললেন? আমাদের কোনও দোষ নেই বুঝি? কাকাবাবু হাসলেন। সন্তু বলল, জোজো, আগে ঘটনাটা শুনতে দে! অরুণ ভার্গব বললেন, পরশুদিন শিবরাত্রির পুজো জানেন নিশ্চয়ই? কাকাবাবু বললেন, শিবরাত্রি? না, জানতাম না। অরুণ ভার্গব বললেন, শিবরাত্তিরে এখানে বিরাট মেলা হয়। সেই উপলক্ষে গ্রাম থেকে দেবতারা নেমে আসেন। দূর দূর পাহাড়ের ওপর যেসব গ্রাম, সেখান থেকেও দেবতারা আসেন। কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, দেবতারা নেমে আসেন মানে? জোজো বলল, দেবতারা কি উড়তে উড়তে আসেন? না, রথে চেপে? অরুণ ভার্গব বিরক্তভাবে তাকালেন জোজোর দিকে। সন্তু তার কাঁধে চিমটি কেটে বলল, চুপ করে শোন না! অরুণ ভার্গব বললেন, দেবতা মানে দেবতার মূর্তি। সব গ্রামেই মন্দির আছে, আলাদা আলাদা দেবতা আছেন। এখানে কেউ মূর্তি বলে না, শুধু দেবতাই বলে। মাণ্ডিতে সেই দেবতাদের নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। পুরুতরা কাঁধে করে দেবতার সিংহাসন বয়ে নিয়ে যান। অনেক দূর দূর থেকে আসতে হয়, বৃষ্টি হতে পারে, রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই শিবরাত্রির দু-তিনদিন আগেই অনেক দেবতা পৌঁছে যান। এখানকার মন্দিরে তাঁদের ভাগ ভাগ করে রাখা হয়। প্রায় তিনশোসাড়ে তিনশো দেবতা। এর মধ্যে লাল পাথুরে নামে একটা খুব বড় গ্রামের দেবতার নাম ভূতেশ্বর। খুব জাগ্রত। খুব নাম। সেই ভূতেশ্বর দেবতা চুরি হয়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, দেবতা চুরি? শুনতে কীরকম অদ্ভুত লাগে। অর্থাৎ দেবতার মূর্তি চুরি। খুব দামি বুঝি? ভার্গব বললেন, দামি মানে সোনা কিংবা রুপোর নয়। পঞ্চ ধাতুতে তৈরি। খুব বেশি দামি নয়, আবার শস্তাও নয়। সেজন্য কেউ চুরি করবে না। মূর্তিটা অন্তত আড়াইশো বছরের পুরনো, সেইদিক থেকে দাম আছে, যাকে বলে অ্যান্টিক ভ্যালু। অনেক সময় এইসব মূর্তি বিদেশে পাচার হয়ে যায়। তা ছাড়া, অন্য গ্রামের লোকও চুরি করতে পারে। জোজো বলল, ভূতেশ্বর মানে কি ভূতদের দেবতা? কাকাবাবু বললেন, এসব নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে নেই, জোজো। মানুষের বিশ্বাসের ব্যাপার। ভূতেশ্বর মানে শিব। শিবের আর-এক নাম ভূতনাথ। জোজো বলল, ও হ্যাঁ, তাই তো! আমার এক জ্যাঠামশাইয়ের নামও ভূতনাথ। আমরা বলি, ভুতুজ্যাঠা। খুব ভয় পাই তাঁকে। ভার্গব এমনভাবে জোজোর দিকে তাকালেন যে, মনে হল, কাকাবাবু না থাকলে এক্ষুনি তিনি জোজোকে একটা চড় কষাতেন। কাকাবাবু বললেন, দেবতার মূর্তি চুরি গেছে, তাতে আমি কী করব বলুন তো? চোর ধরা তো পুলিশের কাজ। আমি কোনও দিন পুলিশের চাকরি করিনি। চোর কী করে ধরতে হয়, তাও জানি না। ভার্গব বললেন, মূর্তিটা যে চুরি গেছে, এটাই এখনও কাউকে জানানো হয়নি। জানাজানি হয়ে গেলেই দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। পুলিশ খোঁজখবর নিতে গেলেই লোকের সন্দেহ হবে। সেইজন্য আমরা এগোতে পারছি না। মাপ করবেন, মিস্টার রায়চৌধুরী। আমি আপনার পরিচয় ঠিক জানি না। আমাদের ওপর অর্ডার এসেছে আপনার সাহায্য নেওয়ার জন্য। কাকাবাবু বললেন, দেখছেনই তোত আমি খোঁড়া মানুষ। চোরের পেছনে ছোটাছুটি করা কি আমার পক্ষে সম্ভব? জোজো বলল, কাকাবাবু, একটা কাজ করলে হয় না? এই কেসটা সন্তু আর আমাকে দিয়ে দিন। আমরা ঠিক ভূতেশ্বর ঠাকুরকে খুঁজে বের করে নেব। আমাদের কেউ সন্দেহও করবে না। ভার্গব চোখ দিয়ে জোজোকে ভস্ম করে দিতে চাইলেন। কাকাবাবু বললেন, এটা মন্দ প্রস্তাব নয়। তোমরাই চেষ্টা করে দ্যাখো। তোমরা ছোটাছুটিও করতে পারবে। ভার্গব খুবই অসন্তুষ্টভাবে বললেন, আপনারা প্লিজ ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবেন না। এটা সাধারণ চুরির ব্যাপার নয়। এখানকার মানুষ দেবতার মূর্তি ছুতেই সাহস করে না। চোরেরাও মন্দিরে ঢুকতে ভয় পায়। আজ পর্যন্ত এ রাজ্যে কখনও কোনও দেবতার মূর্তি কিংবা কোনও মূর্তির গায়ের গয়না চুরি যায়নি। কাকাবাবু বললেন, অন্য রাজ্যের লোক এসে চুরি করতে পারে। ভার্গব সাহেব, আপনি বললেন, মূর্তিচুরির কথা এখনও কেউ জানে না। যে পুরোহিতরা মূর্তিটি বয়ে এনেছে গ্রাম থেকে, তারা নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে? ভার্গব বললেন, দুজন পুরোহিত শুধু জানে। কিন্তু তারা আর কাউকে জানাতে পারবে না। দুজনকেই খুব কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু পরশুদিন শিব রাত্রির মিছিলে তো অন্য দেবতাদের সঙ্গে ভূতেশ্বরের মূর্তি বের করতেই হবে। হাতে মাত্র দু দিন সময়। কাকাবাবু বললেন, এই দু দিনের মধ্যে ওরকম আর-একটা মূর্তি বানিয়ে ফেলা যায় না? ভার্গব বললেন, আড়াই
false
shomresh
ফিরিয়ে দেব। দীপা উঠে দাঁড়াল। আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মা। বোঝার তো অসুবিধে নেই মামা। না অসুবিধে হচ্ছে। তুমি প্রতুলবাবুর সম্পত্তি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবে এমন কথা আছে। আমি শুধু আড়াইশো আর আড়াইশো পাঁচশো টাকাই পাব এ কেমন কথা? না, না, বুঝিয়ে বল আমাকে। অস্থির হলেন সুভাষচন্দ্ৰ। আপনাকে যে ওকালতনামা সই করে দিয়েছিলাম সেটা কোথায়? ওই যে, ওই কাগজের সঙ্গেই আছে। খুব ভাল হল। আমি স্থির করেছি। যেহেতু প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক আমি অস্বীকার করেছি। তাই তাঁর সম্পত্তি আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভাগ করে দেবার কোন অধিকার আমার নেই। আপনারা ভোগ করা মানে পরোক্ষভাবে আমারই ভোগ করা। সেটা আমি হতে দিতে পারি না। সম্পত্তির যে হিসেব আপনি এনে দিয়েছেন তা আমি কোন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিতে চাই। মানুষকে অপমান করে কষ্ট দিয়ে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় যে সম্পত্তি তৈরী করেছিলেন তার কিছুটা অন্তত সাধারণ মানুষের প্রকারে লাওক। এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। কাগজপত্রগুলো তুলে নিল দীপা স্মিতমুখে। সুভাষচন্দ্ৰ হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। কোন শব্দই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। তারপর একসঙ্গে হুড়মুড় করে যেসব কথা বলতে গেলেন তা জড়িয়ে গিয়ে অস্পষ্ট শব্দাবলী ছিটকে উঠল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, অসম্ভব, এ হতে পারে না। কিছুতেই না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ বলেই আমি এসব করেছি। আমাকে বঞ্চিত করতে পারো না তুমি। আমি কোন কথা শুনব না। সম্পত্তির ভাগ আমার চাই চাই। সুভাষচন্দ্রের গলার স্বর সপ্তমে ওঠায় দারোয়ান ছুটে এল দরজায়। ইশারায় তাকে চলে যেতে বলে দীপা ঘুরে দাঁড়াল, ওইভাবে চিৎকার করে কথা বলবেন না। এটা মেয়েদের হোস্টেটল। সুভাষচন্দ্ৰ সামান্য গলা নামালেন। কিন্তু তাঁর জ্বালা কমল না, হোস্টেল ফোস্টেল শুরু দেখাতে এসোনা। কলকাতার জল পেটে পড়ামাত্র খুব চাল চালতে শিখে গিয়েছ, অ্যাঁ। মামা, আপনি ভদ্রভাবে কথা বলুন। শক্ত গলায় বলল দীপা। ভদ্র। ভদ্রতা শেখাচ্ছ আমাকে? না, আমার টাকা চাই-ই! আমি আপনাকে কখনও বলিনি যে সম্পত্তির ভাগ দেব। তুমি বলনি? এত বড় মিথ্যে কথা? মামা, আবার বলছি ভালভাবে কথা বলুন। কেন, দারোয়ান ডেকে বের করে দেবে নাকি? এখনও সেটা চিন্তা করিনি। সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করতে আপনিই আমার কাছে এসেছেন। মনে আছে যেদিন আমি প্ৰথম জেনেছিলাম। বাবা আমার পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে টাকা নিয়েছেন সেদিন তাঁকে বলেছিলাম, ছিঃ তুমি এত লোভী। বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন, হয়তো সেই কারণে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমার বাধেনি সেদিন। আজ তো না বলার কোন কারণ নেই। আপনারা আমার জন্যে কিছুই করেননি, আমি কিভাবে কলকাতায় আছি তার খবরও নেননি। অথচ যখন জেনেছেন আমার বাতিল করা সম্পর্কের সূত্র বাঁচালে অনেক সম্পত্তি পাওয়া যাবে তখন ভাগ বসাতে ছুটে এসেছেন। সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, তুমি, তুমি একথা বললে! তোমাকে আমি কত স্নেহ করি। কথাটা আজ আপনাকে মুখে উচ্চারণ করে বোঝাতে হচ্ছে। মামা, কলকাতায় তো আমার অনেকদিন হয়ে গেল, এর মধ্যে আপনি আমাকে একবারও আপনার বাড়িতে নিয়ে গেছেন? সুভাষচন্দ্র মাথা নামালেন, না মানে, তোমার মামীমা, জানোই তো। আপনি লাখ টাকা পেলে মামী তা ভোগ করবেন না? আপনাদের আমি খুব ভাল করে চিনে গিয়েছি। যিনি আমার জন্মদাতা, যাঁকে আপনি একসময় যত্ন করে ধরে এনেছিলেন, অবশ্য এখন যাঁকে শত্ৰু ভাবছেন, তাঁর চরিত্র আপনার থেকে খুব আলাদা নয়। এত বছর পর তিনি শকুনের মত উড়ে এসেছেন ভাগাড় থেকে মাংস খেতে। অনেক হয়েছে, এবার আপনি আসুন। পাঁচশো টাকা আপনাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করব আমি। দীপা সরে দাঁড়াল। সুভাষচন্দ্ৰ হঠাৎ বুকের বাঁদিকে হাত রাখলেন। তাঁর মুখে ঘাম জন্মছিল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, না। তারপর চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমারই ভুল হয়েছিল। বিধবার গায়ে যখন রঙিন শাড়ি ওঠে তখন তাকে আর বিশ্বাস করতে নেই। অঞ্জলি ঠিক করেছে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে। ঠিক করেছে। সুভাষচন্দ্র চলে গেলেন। আর পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল দীপা। মুহূর্তেই তার শরীর অসাড়। ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল সে। সুভাষচন্দ্ৰ যে শেষ পর্যন্ত এমন কথা উচ্চারণ করতে পারবেন তা কল্পনাও করেনি সে। তাহলে কি চারপাশের মানুষজন যারা জানে তার অতীতের কথা এই মুহূর্তে আড়ালে একই ভাবনা ভাবছে? মনে এক আর মুখে আর এক কথা বলছে? অসীম মানতে পারেনি তার অতীত, এই হোস্টেলের অন্য মেয়েরা শুনলেই বড় চোখে তাকরে। সে যদি থান পরে কলেজে ক্লাস করতে যেত তাহলে কি বেশী সহানুভূতি পেত। কতক্ষণ ওভাবে বিম মেরে বসেছিল দীপা জানে না হঠাৎ দারোয়ান এসে দাঁড়াল দরজায়, দিদিমণি, এক ভদ্রমহিলা আপনাকে খুঁজছেন। সম্বিত এল কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ দারোয়ানের পেছন থেকে গলা ভেসে এল, ওমা, তুই এখানে বসে কি করছিস। আমি ভাবলাম হোস্টেলেই নেই। বলতে বলতে রমলা সেন একটা বই-এর প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই সব চিন্তা উধাও হয়ে বিস্ময় পাহাড়ের মত উঁচু হল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না দীপা। রমলা সেনের মাথায় একটা বড় কালো রুমাল বাঁধা। সে সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, এ কি হয়েছে। আপনার? কি হয়েছে? রমলা সেন অবাক হয়ে গেলেন। আপনার মাথায় ওটা কি? ওঃ, তাই বল।
false
humayun_ahmed
নানান হৈ চৈ শুরু হবে। সেই হৈ চৈও হবে মজার। কণা এমন মেয়ে যে সব কিছুতেই মজা খুঁজে পায়। কেউ মারা গিয়েছে কণা খবর পেয়ে গেল আর মরা বাড়িতেই কোন না কোন মজা না করে ফিরল না তা কখনো হবে না। কাল দুপুরে সে যখন কণাকে টেলিফোন করে বলল, এই কণা তুই আগামীকাল সকালে আমার বাসায় আসতে পারবি? কণা বলল, পারব। রাত পর্যন্ত থাকতে হবে কিন্তু। আচ্ছা থাকব। কি জন্যে আসতে বলছি বলতো? তোর বিয়ে এই জন্যে আসতে বলছিস। কি করে বুঝলি আমার বিয়ে? গলার স্বর থেকে বুঝলাম। কোন মেয়ে যখন বিয়ের দাওয়াত দেয় তখন তার গলা অন্য রকম হয়ে যায়। অন্য রকম মানে কি? পুরুষ পুরুষ গলা। আর যখন কোন ছেলে তার বিয়ের কথা বলে তখন তার গলা হয়ে যায় মেয়েলী। সে চিকন স্বরে কথা বলে। তুই কি সত্যি সত্যি আমার গলা শুনেই বুঝে ফেলেছিস আমার বিয়ে? হুঁ। আল্লাহর কসম গলা শুনেই টের পেয়েছি। বিয়ে কার সঙ্গে হচ্ছে? ফরহাদ নামের ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে? হুঁ। খুব ভাল। হাতের পাঁচ স্বামী। হাতের পাঁচ স্বামী মানে? হাতের পাঁচ স্বামী মানে এই স্বামী সব সময় হাতে থাকবে। হাত ছাড়া হবে। সব মিলিয়ে এই পৃথিবীতে ছয় রকম স্বামী আছেন মন দিয়ে শোন— হাতের শূন্য স্বামী, যে কখনো হাতে থাকবে না। হাতের এক স্বামী, হঠাৎ হঠাৎ হাতে থাকবে। বেশীর ভাগ সময় থাকবে না। হাতের দুই স্বামী, হাতের একের চেয়ে একটু বেশী থাকবে। হাতের পাঁচ হচ্ছে সারাক্ষণ হাতে থাকা স্বামী। তুই হাত ঝেড়ে ফেললেও দেখবি সে যাচ্ছে না, তোর কড়ে আংগুল ধরে ঝুলে আছে। তোর মাথায় কি সব সময় এ রকম মজার মজার কথা থাকে? হ্যাঁ থাকে। কারণ আমি হচ্ছি খুবই মজাদার একটা মেয়ে। ফানী লেডি। আচ্ছা শোন তোর বিয়েটা কি খুব শুকনা টাইপ হচ্ছে? শুকনা টাইপ মানে? শুকনা টাইপ মানে–ভেজা না। আগুন দিলে জ্বলবে না–শুধু ধোয়া বের হবে। যে সব বিয়ে হুট করে ঠিক হয় সে সব হয় শুকনা বিয়ে। এক টুকরা হলুদ মাথায় ঘষে আধ বালতি পানি দিয়ে গোসল। তারপরই কাজি সাহেবের পাঠানো খাতায় দুটা সিগনেচার। বিয়ে শেষ। রাত আটটায় স্বামীর কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে আনা মাইক্রোবাসে করে স্বামীর বাড়ি যাত্রা। রাত এগারোটার দিকে বাসর ঘর। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বিয়ের শাড়ি খুলে নগ্ন হয়ে যাওয়া। কণা চুপ কর প্লীজ। নগ্ন হবার কথা শুনে লজ্জা লাগছে! তাহলে বিয়ে করিস না। তোর পায়ে পড়ি প্লীজ এই লাইনের কথা বন্ধ কর। আমি বিয়ে করছি না কেন জানিস? রাত সাড়ে এগারোটার কথা ভেবে বিয়ে করছি না–কথায় আছে না— টকের ভয়ে দেশ ছাড়লাম তেতুল তলায় বাসা। আমার হবে এই দশা। যে টকের ভয়ে সব ছাড়লাম দেখা যাবে আমার জীবন কাটবে টকের মধ্যে। শেষমেষ হয়ত একটা হাউস খুলে বসব। পুরুষরা আসবে, টাকা দেবে, আর আমি টাকা গুনতে গুনতে শাড়ি খুলব…… প্লীজ কণা প্লীজ। আচ্ছা যা এবারকার মত চুপ করলাম। আমি কাল ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটার, মধ্যে চলে আসব। তুই কি তোর আর কোন বান্ধবীকে বলেছিস? না। কাউকে বলার দরকার নেই। আমি দলবল নিয়ে উপস্থিত হব। বিয়েটা-কি তোর বাসাতেই হচ্ছে না-কি কোন কমিউনিটি সেন্টারে? আমাদের বাসাতেই। আমাদের এ্যাপার্টমেন্টে একটা হলরুম আছে সেখানে। মনে হয় অল্প খরচে সব ছেড়ে দিচ্ছিস। আমরা গরীব মানুষ না, বেশী খরচ করব এমন টাকা পয়সা কি আমাদের আছে? যাকে বিয়ে করছিস সেতো আরো গরীব। স্বামী গরীব হওয়া ভাল। কেন? গরীব স্বামীরা অর্থের অভাব ভালবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তোর চমৎকার কথাটা শুনে ভাল লাগল। তুই কথাটা যত চমৎকার ভাবছিস—তত চমৎকার কিন্তু না। এই ভালবাসা মনের ভালবাসা না, শরীরের ভালবাসা। এই ভালবাসা রাত সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয়ে…… প্লীজ কণা। প্লীজ। আচ্ছা যা তোকে এখনকার মত ক্ষমা করে দিলাম। আসমানীর জ্বর কি আরো বাড়ছে? এখন কেমন যেন শরীর কাঁপছে। ম্যালেরিয়া নাতো? ম্যালেরিয়াতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। প্রতিবারই তার জ্বর শরীর কেঁপে আসূছে। ডাক্তারকে এই কথাটা কি বলা হয়েছে? ম্যালেরিয়ার জ্বরের রহস্য কে যেন বের করেন? রোনাল্ড রস। তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কারণে। আচ্ছা আলফ্রেড নোবেলের কি কখনো ম্যালেরিয়া হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের হয়েছিল? মনে হয় হয়নি। তার ম্যালেরিয়া হলে এই বিষয়ে কোন না কোন গান থাকতো। আচ্ছা তিনি কি প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কোন গান লিখেছিলেন? ঘোর লাগা মাথায় লেখা কোন গান? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হত। আসমানী প্রাণপণে চেষ্টা করছে গানের কথা না ভাবতে। জ্বরের মধ্যে কোন একটা গানের সুর মাথায় চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। সেই সুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। জাগ্রত অবস্থায় সেই গান বাজবে, ঘুমের মধ্যে বাজবে। প্রথমে বাজবে মাথায় তারপর সেই সুর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। ভক করে আসমানীর নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ ঢুকে পড়ল। আসমানী চোখ মেলে দেখল বড় মামা তার পাশে বসে আছেন। তিনি কখন ঘরে ঢুকেছেন। কখন বসেছেন সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, কটা বাজে মামা? সাড়ে সাতটা। মাত্র সাড়ে সাতটা, আমি ভাবলাম দুপুর হয়ে গেছে। তোর জ্বরটা ভয়াবহ। মাথায় পানি ঢালতে হবে। বিয়ের দিনে কি অসুখ বাধালি বলতো। সেরে যাবে। খুব বেশী
false
toslima_nasrin
না করে কাটিয়ে, বেরিয়ে মার কাছে এক গেলাস পানি চেয়ে খেয়ে, বাড়িতে আনাজপাতি কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করে চলে গেলেন। ঘরে কেঁচো হয়ে বসে ছিলাম। বুক ধড়ফড় করে, এই খোলা পদ্যের গোলা শেষ অবদি কতটা বিস্ফোরক হবে কে জানে! বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁচো কেটে বের করি কিংশুক। বাবা লিখে গেছেন, এবার জানালার বেগুনি কাচে। মরমে গিয়া আঘাত করিল আত্মজার ক্রন্দন পিতাই শুধু বোঝে কন্যার সহিত কতখানি তার আত্মার বন্ধন। পিতা আজ আছে, কাল যাবে মরে তাইতো কন্যাকে সে দিতে চায় ভরে শিক্ষা দীক্ষা আর দেখাইতে চায় সত্যের পথ যে পথে চললে সকলে ভাল বলে, এই তো পিতার মত। এই কথোপকথন আমাকে ভীষণ উৎসাহিত করে। বাড়ির সবাই এসে জানালার কাচে সাঁটা পদ্য পড়ে যায়। দাদার দেওয়া লাল ডায়রিতে কবিতা লেখা বাদ দিয়ে জানালায় সাঁটা এই পদ্য পদ্য খেলায় আমি মেতে উঠি। রবীন্দ্রনাথ পড়ে কি কোনও সত্য যায় না পাওয়া? কাজী নজরুলকে কার সাধ্য আছে করে হাওয়া! আর সুকান্ত সে তো দুর্দান্ত। কবিতা মানে কি মিথ্যের পথ? যদি হয়, তবে এই দিচ্ছি নাকে খত ওপথ মাড়াবো না, কারো দুঃখ বাড়াবো না। আমি অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র প্রাণী, কেবল এইটুকু জানি আমার কোনও তৃষ্ণা নেই মণি মুক্তা মালার, একটু শুধু তাগিদ আছে সন্ধ্যাদীপ জ্বালার। এক জানালা শেষ হলে আরেক জানালায় সাঁটা হচ্ছে। এটি পড়ে মা বললেন, আমি তুচ্ছ ক্ষুদ্র প্রাণীডা কাইট্টা দে। কাইট্টা দিলে কি দিয়া মিলাবো? লেইখা দে, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান প্রাণী। কাটা হয় না, কারণ বাবার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। বাবা আজকাল ঘন ঘন বাড়িতে ঢুঁ মারেন। পেচ্ছাব পায়খানা তো আছেই, এক গেলাস পানি খেতেও নতুন বাজার থেকে আমলাপাড়া পাড়ি দেন। উদ্দেশ্য অবশ্য কবিতা। কখনও এমন হয়েছে তিনি লিখে যাওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই খামোকা ফিরে এলেন বাড়ি। ঘরের জানালা দরজায় নতুন কিছু সাঁটা হয়েছে কি না দেখে যান। কারণ ছাড়াই আমার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখেন আছি কি না। চোখাচোখি হয় না, ও জিনিসটি তিনিও এড়িয়ে চলেন, আমিও। কথা বন্ধের কালে দৃষ্টিও সংযত করার নিয়ম, এ নিয়ম বাবারই শেখানো। রবিবাবু কবিতা লিখেছেন নির্ভাবনায় জমিদারদেরই এইসব মানায়। ছাত্রজীবনে কবিতা কি শোভা পায়? এই হতভাগা বড় কষ্টে সংসার চালায় এত কষ্টের ফল কি সে পায়? পিতার কথা কি তারা এতটুকু ভাবে? আমি তো দেখি না কোনো সম্মান হাবে ভাবে। কত বলি হইতে মানুষের মত মানুষ তবওু দেখি না তাহাদের কোনও হুঁশ। সময় গেলে সময় নাহি আসে পিতা মরে গেলে কেউ আর নাই পাশে। ছাত্রজীবনে অবসর বলে কিছু নাই এই কথা আমি বারবার বলি, আবারও বলে যাই হেলাফেলা করিলে জীবনটি হবে নষ্ট দেখে আর কেউ নয়, পিতাই পাইবে কষ্ট। বাবা এই পদ্যটি লিখতে সময় নিয়েছেন বেশ। সালামকে খুঁচিয়ে খবর জোটে, বাবা কাগজ কলম নিয়ে আজকাল আরোগ্য বিতানে বসে মাথা চুলকোন। রোগী বসে থাকে অপেক্ষা-ঘরে। তিনি চুলকোচ্ছেন, লিখছেন, ফেলছেন, আবার নতুন করে লিখছেন। পরে বেরিয়ে এসে রোগীদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে তিনি বাড়ি থেকে ঘুরে যান। ঘুরে যাওয়া মানে জানালায় পদ্য সেঁটে যাওয়া। এ পদ্যটি পড়ে মা বলেন, হুঃ! এই সংসার চালাইতে কষ্ট হয় নাকি কোনও? সাতদিনে একদিন বাজার করে। হেই বেডির বাড়িত ত প্রত্যেকদিন মাছ মাংস যায়। টাকা ত আর কম কামায় না। তোদেরে কি দেয়? শখের একটা জিনিস দিছে কোনওদিন? মার প্রেরণায় লিখি কি হয় এমন খরচ সংসারে! কাটাই তো অনেকটা অনাহারে। ঈদ এলে জামা পাই, সব ঈদেও জোটে না মনে কত কথা জমা, মুখে কিছু ফোটে না। চারিদিকে মেয়েরা কথা বলে চুটিয়ে আমরাই এ বাড়িতে ভয়ে থাকি গুটিয়ে। মনে তবু আশা থাকে লুকিয়ে, বাবার আদর পেলে ভুলগুলো চুকিয়ে বড় হব এত বড় আকাশ নাগাল পাবো দিগন্তের ওইপারে একদিন হারাবো। পদ্যটি পড়ে মা বলেন হারানোর কথা লেখছস কেন? দাদা শব্দ করে পড়ে বলেন, সুন্দর হইছে। বাবা এরপর আর কিছু লেখেন না। পদ্যের জীবন আর সত্যিকার জীবনে যে অনেক পার্থক্য তা একদিন বাবার নাসরিন ডাকের চিৎকারে অনুভূত হয়। বাবার সামনে আগের সেই নতমখু নতচোখ দাঁড়াই। তিনি আগের মতই দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, কি করা হইতাছে? আমি নিরুত্তর। সারাদিন আড্ডা মাইরা জীবন চলবে? নিরুত্তর। কোনও মেডিকেলে তর মত গাধার পক্ষে যে পাশ করা সম্ভব না, এইডা বুঝা যাইতাছে না? নিরুত্তর। কবিতা লেখস? কবিতা কি একলা তুইই লেখতে পারস? সবাই লেখতে পারে। কামের ছেড়ি মালেকারে জিজ্ঞাসা কর, সেও পারবে লেখতে। গাধা থেকে শব্দ বেরোয়, মালেকা তো লিখতে জানে না। না জানুক, মুখে ত কইতে পারব। লালন ফকির মুখে মুখে কবিতা বলে নাই? হাছন রাজা বলে নাই? নিরুত্তর। আমি শেষ ওয়ারনিং দিয়া দিলাম, মেডিকেলে ভর্তি হইতে না পারলে বাড়িত তর ভাত বন্ধ। খবর রাখছ কবে ঢাকা ইউনির্ভাসিটির ভর্তি পরীক্ষা শুরু হইব? নিরুত্তর। আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা সামনের মাসে। ঢাকায় গিয়া পরীক্ষা দিতে হইব। এক্ষুনি অঙ্ক করতে ব। পরীক্ষায় পাশ না করলে কপালে কি আছে তা নিজে বুঝতে চেষ্টা কর। বাবার উপদেশবাণী নীরবে হজম করে আমি নতমস্তকে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে অঙ্ক নয়, আনন্দ উৎসব শুরু করি। ঢাকা যাওয়ার আনন্দ। ঝিককির ঝিককির ময়মনসিং, ঢাকা যাইতে কত্তদিন
false
humayun_ahmed
ফেলব? হ্যাঁ। আপাতত পুরনো পতাকাই উড়ুক। নতুনটা না। জি আচ্ছা। আর পতাকার দাম বাবদ বারো টাকা আপনাকে স্কুল ফান্ড থেকে দেওয়া হবে না। পারচেজ কমিটির অনুমোদন ছাড়া আপনি পতাকা কিনেছেন। এটা আপনি পারেন না। সবকিছু নিয়মের ভিতর দিয়ে হতে হবে। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না। জি আচ্ছা। আর শুনুন, আমার স্ত্রীর জন্য একটু দোয়া করবেন। জি, অবশ্যই করব। জোহরের নামাজের পরেই দোয়া করব ইনশাআল্লাহ। ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে হেডমাস্টার সাহেবেব ঘর থেকে বের হলেন। স্বাধীন পূর্ববাংলা এই জাতীয় কথাবার্তা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এগুলি কোনো কাজের কথা না। আকাজের কথা। অখণ্ড হিন্দুস্তানে মুসলমানরা অনেক কষ্ট করেছে। জিন্নাহ সাহেব মহাপুরুষ মানুষ ছিলেন, তিনি অভাগা মুসলমানদের মুক্তি দিয়েছিলেন। অকৃতজ্ঞেব মতো সেইসব কথা ভুলে গেলে চলবে না। মুসলমানদের ভুলে গেলে চলবে না যে কোনো হিন্দুর বাড়িতে তারা ঢুকতে পারত না! হিন্দু বাড়িতে মুসলমান ঢুকলে সেই বাড়ি অপবিত্র হয়ে যেত। হিন্দু ময়রার মিষ্টির দোকানে বসে তারা মিষ্টি খেতে পারত না। মুসলমানরা নগদ পয়সা দিয়ে ভিখিরির মতো দুহাত বাড়িয়ে দিত। মিষ্টি ছুঁড়ে দেওয়া হতো সেই হাতে; এই অপমানের ভেতর দিয়ে তাকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। আজ যারা স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা করছে, তারা কি এই অপমানের ভেতর দিয়ে গিয়েছে? মাওলানা ভাসানী তো গিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন এই কাণ্ডটা করছেন? তার মতো বুদ্ধিমান লোক হিন্দুদের চাল বুঝতে পারবেন না তা কী করে হয়? ইন্ডিয়া যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র করছে–এ তো বোঝাই যাচ্ছে। পুরো জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুব সূক্ষ্মভাবে করছে। এটা আর কিছুই না, জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দাবাখেলায় হেরে যাবার শোধ তোলার চেষ্টা। এতদিন পর তাবা! একটা সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। জোহরের নামাজের পর মাওলানা ইরতাজউদ্দিন পাকিস্তানের সংহতি ও মঙ্গলের জন্য দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীর বিষয়ে দোয়া করার কথা ছিল। করতে ভুলে গেলেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি আবারো নফল নামাজে বসলেন। সেদিনই দুপুর একটায় রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। তারিখটা হলো রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ইয়াহিয়াকে উদ্ধৃত করে ঘোষণা প্রচার করা হলো– যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল দুটি প্ৰধান দলের মধ্যকার অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাধ্য হয়েছি ____ সালের ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করতে। তবে আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ মুলতবি দুই/তিন সপ্তাহের বেশি অতিক্রান্ত হবে না এবং এই স্বল্প পরিসর সময়ে আমি আমাদের দেশের দুই অঞ্চলের নির্বাচিত প্ৰতিনিধিদের মধ্যে সৌহার্দ্য আনয়নে সব ধরনের প্ৰচেষ্টাই করব। সন্ধ্যা পার হয়েছে। মাগরেবের নামাজ শেষ করে ইরতাজউদ্দিন রান্না বসিয়েছেন। আয়োজন সামান্য। ভাত, ডাল আর আলুভর্তা। বৈয়মে খাঁটি ঘি আছে। আলুভর্তার সঙ্গে দুচামচ ঘি দিয়ে দিবেন। ক্ষুধা পেটে অমৃতের মতো লাগবে। নবিজী দুটা খেজুর খেয়ে অনেক রাত পার করেছেন। সেই তুলনায় রাজ ভোগ। আলুভর্তা করা গেল না। তিনটা আলু ছিল। তিনটাই পচা। তাছাড়া আলুভতাঁর প্রধান উপকরণ কাঁচামরিচ বা শুকনামরিচ কোনোটাই নেই। ইরতাজউদ্দিন বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সবসময় সর্ব পরিস্থিতিতে শুকুরগুজার করতে হবে। আল্লাহপাক শুকুরগুজারি বান্দা পছন্দ করেন। হাঁড়িতে পানি ফুটছে— ইরতাজউদ্দিন ফুটন্ত পানিতে ডাল ছাড়বেন, তার ঠিক আগে আগে মধু এসে বলল, হেড স্যার ডাকে। রাতে তার সাথে আপনেরে খাইতে বলছেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, রান্না কী? মধু বলল, মৈরিলা মাছের ঝোল, টাকি ভর্তা, মাষকলাই-এর ডাইল। রেঁধেছে। কে? তুই? জে। ইরতাজউদ্দিন আবারো বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। মধু হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে থাকে। রান্নাবান্না করে। তার রান্নার হাত খুবই ভালো। মাছের কাটাকুটা, সামান্য লাউপাতা কুমড়াপাতা দিয়ে সে এমন জিনিস তৈরি করে যে মোহিত হয়ে খেতে হয়। তার রান্না মিষ্টি কুমড়ার ভর্তা যে খায় নি, সে জানেই না ভতাঁর স্বাদ কী। মধু! জি স্যার। দেশের অবস্থা তো ভালো না রে মধু। কী হয় কে জানে! মধু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, হউক গা। কপালের লিখন না হবে খণ্ডন।। মধুকে অতিরিক্ত আনন্দিত মনে হচ্ছে। কারণে অকারণে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, গাজা খেয়েছিস না-কি? মধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, খাইতেও পারি, আবার নাও খাইতে পারি। এই জিনিসটা না খেলে হয় না? হয়। খাইলেও হয়, না খাইলেও হয়। ইরতাজউদ্দিন ডাল পানিতে ভিজিয়ে ফেলেছেন। পানি থেকে তুলে কুলায় মেলে দিলেন। শুকিয়ে গেলে আবার ব্যবহার করা যাবে। কোনো কিছুই নষ্ট করা উচিত না। আল্লাহপাক অপচয়কারী পছন্দ করেন না। স্যার গো, দিনের অবস্থা কিন্তু ভালো না। ঝড় তুফান হইতে পারে। ইরতাজউদ্দিন সামান্য চিন্তিতঃ বোধ করলেন। তিনি যে চালাঘরে বাস করেন তার অবস্থা শোচনীয়; প্রধান খুঁটির সব কটাতে উইপোকা ধরেছে। ঝড়ের বড় ঝাপ্টা এই ঘর নিতে পারবে না। ঘর নতুন করে বাঁধতে হবে। ঠিক করে রেখেছিলেন, বর্ষার আগে আগে ঘরের কাজটা ধরবেন। মনে হয় না। এইবারও পারবেন। সব নির্ভর করছে আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর। উনি ইচ্ছা! করলে হবে। উনি ইচ্ছা না করলে হবে না। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই হবে না। তাহলে মানুষের চেষ্টার মূল্যাটা কী? মধু খিকখিক করে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কী হয়েছে? মধু বলল, কিছু হয় নাই। একটা শিলুক মনে আসছে। বলব? বল শুনি। গাই এ ভাঙ্গে নল খাখরী, বাছুর ভাঙ্গে আইল ছয় মাস হইল গাই বিয়াইছে বাছুর আইছে কাইল। কন দেহি জিনিসটা
false
humayun_ahmed
ছুঁয়ে বলুন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুনার অবস্থা খুব খারাপ হল। মনে হল লোকজন ঠিক চিনতে পারছে না। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই বলল, আপনি আমার আম্মিকে একটু ডেকে দেবেন? মতিন সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ডেকে দিন না। বেশিক্ষণ কথা বলব না, সত্যি বলছি। যাব। আপনি ওর কাছে বসে থাকুন। হাসপাতালে নিতে হবে। মতিন সাহেবের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সহজ সাধারণ মানুষের মতো কাপড় পরলেন। বাদশা অবাক হয়ে বলল, কার্ফুর মইধ্যে যাইবেন? হ্যাঁ। আমি বললাম, সত্যি সত্যি বেরুচ্ছেন মতিন মাহেব? হ্যাঁ। কাদের মুক্তিবাহিনীতে গেছে শুনেছেন? শুনেছি। বাদশা বলল–খুব নাকি কাঁদছিল। কাঁদার তো কিছু নেই, কী বলেন? মতিনউদ্দিন সাহেব জুতো পায়ে দিতে—দিতে বললেন, দেখবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বসে রইলাম মেয়েটির পাশে। জানালা দিয়ে দেখছি, শান্ত ভঙ্গিতে পা ফেলে মতিনউদ্দিন সাহেব এগোচ্ছেন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তাঁর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। এক দিন এই দুঃস্বপ্ন নিশ্চয়ই কাটবে। এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটি গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে হয়তো সত্যি সত্যি বেড়াতে আসবে এ বাড়িতে। বিলু নীলুরা ফিরে আসবে একতলায়। অকারণেই বিলু দোতলায় উঠে এসে চোখ ঘুরিয়ে বলবে, আচ্ছা বলুন দেখি, দুই এবং তিন যোগ করলে কখন সাত হয়? কনিষ্কও ফিরে এসে গর্বিত ভঙ্গিতে রেলিং-এ বসে ডাকবে কা-কা। কাদের মিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলবে–কী অলক্ষণ। যা-যা, ভাগ। গভীর রাত্রে মুষলধারে বর্ষণ হবে। সেই বর্ষণ অগ্রাহ্য করে পাড়ার বখাটে ছেলেরা সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখে শিস দিতে-দিতে বাড়ি ফিরবে। বৃষ্টির ছাটে আমার তোষক ভিজে যাবে, তবু আমি আলস্য করে উঠাব না। আমি বসেই রইলাম। বসেই রইলাম। লুনা ফিসফিস করে তার মাকে এক বার ডাকল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, মতিন সাহেব ঠিকই বলেছেন। মেয়েটির নাকের ডগায় ছোট একটি লাল রঙের তিল। বহু দূরে একসঙ্গে অনেকগুলি কুকুর ডাকতে লাগল। আমার ঘরের প্রাচীন তক্ষকটি বুক সেফফের কাছে থেকে মাথা ঘুরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। বাড়ির নাম আতর-বাড়ি। ঢাকা শহরে অদ্ভুত অদ্ভুত নামের অনেক বাড়ি আছে। আতর-বাড়িকে কি সেই তালিকায় ফেলা যায়? গাছপালায় ঘেরা বিশাল দোতলা বাড়ি। চারিদিকে উঁচু পাঁচিল বলে দিচ্ছে বাড়ির মালিকের প্রচুর পয়সা। ধনবান ব্যক্তিদের বাড়ির পাঁচিল উঁচু হয়। তাঁরা নিজেদের পাঁচিল দিয়ে আলাদা করে রাখতে পছন্দ করেন। তাদের বাড়ির গেট হয় নিচ্ছিদ্র লোহার। সেখানে কোন ফুটো-ফাটা থাকে না। ফুটোর ভেতর দিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরের কোন কিছুই দেখার উপায় নেই। শফিকুল করিম আতর-বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই সে বাড়িতে ঢুকতে পারে। ঢুকছে না। সিগারেট ধরিয়েছে, কে জানে ভেতরে হয়তো সিগারেট খাওয়া যাবে না। এমন হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে বাড়ির মালিক মবিনুর রহমান সিগারেটের ধোঁয়া পছন্দ করেন না। অতি ধনবানরা একটা পর্যায়ে এসে ডাক্তারদের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সিগারেট ছেড়ে দেন। নিরামিশি হয়ে যান। সকালে মর্নিং ওয়াক করেন। বাড়িতে ওয়াকার নামক যন্ত্র থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁটা। ধনবানদের জন্যে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। একটা সিগারেট শেষ করতে শফিকুল করিমের দুই মিনিট বার সেকেন্ড লাগে। স্টপওয়াচ দিয়ে হিসাব করা। আজকে মনে হয় সময় বেশি লাগছে। টেনশনের সময় অন্য সবাই সিগারেট দ্রুত টানে। তার বেলায় উল্টোটা হয়— সে সিগারেট আস্তে টানে। সময় বেড়ে যায়। শফিকুল করিমের কাছে মনে হচ্ছে সে দশ-পনেরো মিনিট ধরেই সিগারেট টানছে, তারপরও অর্ধেকের বেশি শেষ হয়নি। মনে হয় তার টেনশন বেশি হচ্ছে। অথচ টেনশনের কোনোই কারণ নেই। মবিনুর রহমান তাকে চাকরি দিয়েছেন। আজ সে জয়েন করবে। কি ধরনের চাকরি সে বুঝতে পারছে না। ওনার পিএ টাইপ কিছু? নাকি বাজার সর্দার? প্রতিদিন সকালে গাড়ি ভর্তি বাজার আনতে হবে। চাকরির শর্তে কিছুই বলা নেই। বেতনের অংকটা লেখা আছে মাসে বার হাজার এবং অন্যান্য সুবিধা। অন্যান্য সুবিধা কি কে জানে। একেক কাজে একেক ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। পত্রিকা অফিসে যখন কাজ করত তখন অন্যান্য সুবিধার মধ্যে ছিল ফ্রি চা। বেতনের কোনো ঠিকঠিকানা নেই; কিন্তু যখন ইচ্ছা তখন চা খাওয়া। রঙ চা, দুধ চা, মাঝে মধ্যে মালাই চা বলে এক বস্তু। দুধের সর দিয়ে বানানো। সে কিছুদিন ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেছে। সেখানের সুবিধা বিনা টিকিটে বিমান ভ্রমণ এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম চাকরি দেয়ার সময় শফিকুল করিমের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন—বিনা টিকেটে দেশ-বিদেশ ঘুরবেন। যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাবেন। জাপান-ইউরোপ-আমেরিকা কোনো ব্যাপারই না। অফ সিজনে যাবেন, এয়ারলাইন্স ফ্রি বিজনেস ক্লাসের টিকেট দেবে। আত্মীয়স্বজন বিদেশ যাচ্ছে? টেলিফোন করে বলে দেবেন তাদের নরমাল ইকোনমি ক্লাস টিকেট হয়ে যাবে বিজনেস ক্লাস। পায়ের ওপর পা তুলে ভ্রমণ। শফিকুল করিমের জীবনে একবারই ফ্রি টিকেট জুটেছিল। ঢাকা-কাঠমন্ডু ঢাকা। কাঠমন্ডু যাওয়া হয়নি, তার আগেই চাকরি চলে গেল। এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম তার পিঠে হাত রেখে বললেন, সরি ভাই। আপনাকে দিয়ে আমাদের পোযাচ্ছে না। আমাদের আরো স্মার্ট লোক দরকার। আপনি একটু স্লো আছেন। বজলুল আলমের অভ্যাস ছিল পিঠে হাত রেখে কথা বলা। বস শ্রেণীর মানুষদের কথা বলার অনেক প্যাটার্ন আছে। কেউ কথা বলে পিঠে হাত রেখে। কেউ কথা বলে চোখের দিকে না তাকিয়ে (প্রাইড পত্রিকার সম্পাদক হাসনাইন খান) আবার কেউ কথাই বলে না। যেমন বেগম রোকেয়া গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুল মুকিত খান। শফিকুল করিম সেই কলেজে এক বছর এগারো মাস কাজ করেছে। বেতন ভালো ছিল না তবে
false
toslima_nasrin
সিঁটকে বলল, জ্ঞনারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ। উফ! অসহ্য। নারীবাদ নিয়ে যারা লাফায়, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। এ হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। এও আরেক ধরনের মৌলবাদ। যে কোনও কিছুতেই আমরা নারী আমরা নারী। নারীর এই হয়নি সেই হয়নি। এই চাই সেই চাই। এই হতে হবে সেই হতে হবে। এ আবার কী! মানুষের কথা ভাব, মানুষের জন্য বল, মানুষের জন্য কর, নারী পুরুষ শিশু সবার কথা ভাব! কেবল নারীরই কি সব সমস্যা? শিশুদের নেই? পুরুষের নেই? হু!নারীবাদীদের উদ্দেশ্য নারী নিয়ে ব্যবসা করা, আর কিছু নয়।’ ক্রিশ্চান রাস্তার কিনারে গাড়ি রেখে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কদ্বীপে বাজার বসেছে, সেখানে যায়। বাজারটি এই দ্বীপে বুধবার আর শনিবারে বসে। দুপুরের মধ্যেই বাজারটি উঠে যাবে। আবার সব ঝকঝকে তকতকে আগের মত। বিকেলে দেখলে কারও বোঝার উপায় থাকবে না এখানে একটি জমজমাট বাজার ছিল সকালবেলা। আমাদের কাঁচা বাজারের মত নয় এটি। সবকিছুর এখানে নির্ধারিত দাম। আমাদের দেশের মত চিৎকার করে দরদাম করতে হয় না। ক্রিশ্চান ফুল কেনে। লিলি অব দ্য ভ্যালি। চমৎকার ঘ্রাণ ফুলের, ছোট শাদা ফুল। ক্রিশ্চানের বাড়িটি তিনতলায়। এমন সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে কমই দেখেছি। যেন বাড়ি নয়, আস্ত একটি মিউজিয়াম। সাতশ সিসি মেফেয়ার গাড়িটি দেখে মনেই হয়নি তাঁর বাড়িতে আছে খৃষ্টপূর্ব চারশ শতাব্দির প্রাচীন মূর্তি, ব্যাবিলিয়ন, সুমেরিয়ান সভ্যতার অমূল্য সব সম্পদ। প্রাচীন সব রঙিন পাথরের অলংকার। মিশরের গুহা থেকে তুলে আনা সেই আমলের জিনিসপত্র। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মূর্তিগুলোর সামনে, যেমন থ হয়ে ছিলাম ল্যুভরে। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে যত তেলচিত্র আছে, সবই বড় বড় শিল্পীর। সবই আসল, নকল বলতে কিছু নেই। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও শিল্পীর তৈরি। যে কাপে চা খেতে দিল, সেটিও কয়েকশ বছর আগের। অ্যান্টিকে বাড়িটি ভর্তি। একটি অ্যান্টিক ল্যাণ্ডও আছে। অমিতাভ ঘোষের অ্যান্টিক ল্যাণ্ড বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ক্রিশ্চান নিজে। বইটির নামে ইজিপ্ট দেখে আমি ধন্দে পড়ি। ক্রিশ্চান বললেন বাণিজ্যিক কারণে তিনি নামটি পাল্টে দিয়েছেন। বাণিজ্যিক শব্দটি উচ্চারণ করতে এখানে কারও কোনও গ্লানি নেই। আমার চা খাওয়া শেষ হয়নি। টেলিভিশনের লোকেরা এল। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারও এল। একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নিল ওরা। এরপর নিচে, খানিকটা হেঁটে গিয়ে মডার্ন মিউজিয়ামের বারান্দায় আরেক দফা সাক্ষাৎকার। হাঁটছি, কথা বলছি, ক্যামেরা আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি তুলে রাখছে। প্যারিস কেমন লাগছে? এত সৌন্দর্য প্যারিসের, তা আমি আগে কল্পনাও করিনি। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারকে অনুবাদক হিসেবে নিয়েছে টিভির লোকেরা। একসময় আমি মনিক আতলাঁকে, সাংবাদিক পরিচালক দুটোই তিনি, বলি যে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ হলে, আমি ইংরেজিতে একই প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছি, সেটির সঙ্গে যেন মিলিয়ে দেখে নেন বক্তব্য ঠিক আছে কি না। লক্ষ করিনি জ্যঁ শার্ল আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আপনি বিসওয়াস খরেন না? চমকে উঠি। তাকিয়ে বারথেয়ারের মুখ দেখি বিষণ্ন মুখ। বড় অপ্রস্তুত হই! বলি, ‘না না আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই আর কী! আপনার তো কিছু ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ যদি না বুঝতে পারেন, তাই।’ আমার এই সান্ত্বনায় বারথেয়ারের বিষণ্নতা দূর হয় না। মায়া হয় মানুষটির জন্য। এমন ভাবে বলাটা বোধহয় উচিত হয়নি। ক্রিশ্চান বেস আর মনিক আতলাঁ হাঁটছি কথা বলতে বলতে, ফাঁকে ফাঁকে আমার ব্যাগ আর চশমা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বারথেয়ারের বিষণ্ন মলিন মুখটি দেখছি। নীল চোখ তার, ঘাড় অবদি সোনালী চুল, পরনে জিনসের জ্যাকেট — খানিকটা গবেট গবেট মনে হয় তাকে, বারথেয়ারকে, এত স্পর্শকাতর হবে ভাবিনি। কোনও ফরাসি পুরুষ এমন অভিমান করে মলিনতার চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। ক্রিশ্চানের গাড়ির কাছে যেতে যেতে সবার থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে নিয়ে বারথেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে থাকি আমি। এমনি কথা। ছোটোখাটো কথা। এতদিন আসলে বারথেয়ারকে বিষম এড়িয়ে চলেছি। ক্রিশ্চান যখন আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে, বারথেয়ারকে বললাম, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছি, চলুন। বারথেয়ারের মুখটি মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রিশ্চান তাকে ফরাসিতে কিছু বলল, কি বলল জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বারথেয়ার আমাকে থতমত ঠাণ্ডা গলায় বলে দিল যে সে যেতে পারছে না, জরুরি কিছু কাজ আছে তার। তবে তিনি বারথেয়ার অপেরায় নিয়ে যাবেন আমাকে, অপেরার টিকিট কেটে এনেছিলেন। তিনি বললেন, সাতটায় হোটেলে যাবেন আমাকে অপেরায় নিয়ে যেতে। ক্রিশ্চান আমাকে লেবানিজ একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। মুরগির কাবাবমত, আর কাঁচা বাধাকপি, নানা রকম কাঁচা পাতা, যা কখনও কাঁচা খাওয়া যায় বলে আমার ধারণা ছিল না। খেতে খেতে ক্রিশ্চানের সঙ্গে কথা বলি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে। ফরাসি সাহিত্যিকরা কেমন লিখছেন, কী লিখছেন! ক্রিশ্চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বললেন, বাজে বাজে বাজে। নতুন প্রজন্মের সবাই আমবিলিকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে সবই তো আছে তাদের। তারাই তো জনক শিল্পের সাহিত্যের। সুতরাং নতুন কিছুর আর কী দরকার! ক্রিশ্চান খুবই হতাশ ফরাসি লেখকদের নিয়ে। বললেন, জ্ঞআমি অনেক পাণ্ডুলিপি পাই ফরাসি লেখকদের। সবই অখাদ্য। কেবল বর্ণনা। কিছুই নতুন নয়। নতুন ভাষা নেই। নতুন বক্তব্য নেই।’ ক্রিশ্চান জ্যঁ শার্লকে দিয়ে লজ্জা অনুবাদ করাচ্ছেন। এখন লজ্জা নিয়ে তিনি আর ভাবছেন না। ভাবছেন আমার অন্য বই নিয়ে। জ্যঁ শার্ল লন্ডন থেকে আমার বাংলা বই কিনে এনেছে। শোধ, নিমন্ত্রণ, ভ্রমর কইও
false
tarashonkor
কি করিবে? মহাতাপ হাত বাড়াইয়া শিবকেষ্টকে বলিল, ওঠ, আমাকে ধরে ওঠ। শিবকেষ্ট ধীরে ধীরে উঠিল। মহাতাপ তাহাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল। খুড়ী যেন কী কথাটা বলিয়া গেল! কি ভাজের মুখ! পরিবারের মুখ! কি সব বলিল। শিবকেষ্টর অবস্থা দেখিয়া সে তখন এমনই অভিভূত হইয়াছিল যে, কথাটা ঠিক শুনিয়াও বুঝিবার চেষ্টা করে নাই। এতক্ষণে কথাটা মনে হইল। কি বলিল? সে হাকিয়া ডাকিল—এই, এই খুড়ী, এই বিষমুখী টিকুরীর খুড়ী! বলি শুনছ? খুড়ী ঘরের ভিতর হইতে উত্তর দিল—কেন রেড্যাকরা? বলি বলছিস কি? —কি বললে কি তখন? আর একবার বল দিকিন? কি ভাজের–মুখ বউয়ের মুখ–কি বলছিলে? টিকুরীর খুড়ী হাসিয়া বলিল—তোমাদের বড় বউয়ের মুখখানি বড় সুন্দর রে, চাঁদের পারা। তাই বলছিলাম। তোর বউয়ের মুখ কিন্তু এত সুন্দর নয়, তাই বলছিলাম আমি। মহাতাপ খুশি হইয়া গেল। সে উচ্চকণ্ঠে সমর্থন করিয়া বলিল, হাজার বার লক্ষ বার। এ তুমি ঠিক বলেছ। আমি বলি কি বলছ! না, এ তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু এবার গরু সামলে রেখো। তা বলে গেলাম। সে হনহন করিয়া মাঠে চলিয়া গেল। স্তব্ধ দ্বিপ্রহর তখন। মাঠে ধান। ভরিয়া উঠিয়াছে। নিড়ান চলিয়াছে। নিদারুণ রৌদ্রের মধ্যে ধানের ক্ষেতে হামাগুড়ি দিয়া আগাছা তুলিয়া চলিয়াছে চাষীরা। দূরে তখনও মাটিওয়ালীদের হক শোনা যাইতেছে। মাটি, মাটি চাই গো! মাটি, লাল মাটি–খড়িমাটি! সেতাবের বাড়িতে সেদিন দুপুরে ঢেঁকিতে ভোলা কলাই কুটিয়া বেশম তৈয়ারি হইতেছিল। বেশম হইতে সেউই ভাজিয়া গুড়ে পাক করিয়া পূজার নাড় হইবে। দুই জন ভানাড়ী মেয়ে টেকিতে পাড় দিতেছিল, ঢেঁকির মুখে নাড়িয়া-চাড়িয়া দিতেছিল। স্তব্ধ দ্বিপ্রহর বেলা, বাড়িটা নির্জন। বড় বউকে দেখা যাইতেছে না। এই নির্জনতার মধ্যে তাহারা গান গাহিতেছে। মানদা গাহিতেছে মূল গান, মেয়েগুলি গাহিতেছে ধুয়া। মেয়েগুলি ধুয়া গাহিতেছিল– আমার বাজুবন্ধের ঝুমকো দোলায় বঁধুর মন তো দুলল না, ও-তার সিথিপাটির লালমানিকের ছটাতে চোখ খুলল না হায় সখি, লাজে মরি লাজে মরি গো। মানদা গাহিল— আমার মন যে দোলন খেলে ওতার বনমালার দোলাতে। আমার মন সেই গেল ভুলে, তারে এসে ভুলাতে। ভানাড়ী মেয়েগুলি আবার ধুয়া ধরিল— আমার বাজুবন্ধের ঝুমকো দোলায় বঁধুর মন তো দুলল না! হায় লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো! মানদা আবার গাহিল— মন কাড়িতে এসেছিলাম মন হারায়ে ঘর ফিরিলাম– লাজে গলার চিক মাদুলি পড়ল ছিঁড়ে ধুলাতে। সঙ্গে সঙ্গে ভানাড়ীরা ধরিল— হায় লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো। মানদা আবার গাহিল— খুলতে গেলাম বাজুবন্ধ বধন যে সেই খুলল না। ভুলতে গেলাম তারে সখি ভুল যে মোকে ভুলল না। কালনাগে ধরতে গেলাম– কালীয়ারে জড়াইলাম– মারতে গিয়ে অমর হলাম জ্বলতে জ্বলন জ্বালাতে! –লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো! রাধাকৃষ্ণের লীলার স্পর্শ জড়াইয়া এমন ধরনের প্রেমের গান বাংলার পল্লী অঞ্চলে কালে কালে কালোপযোগী ভাষায় ছন্দে উপমায় রচিত হইয়া আসিতেছে। এ ভাব পুরনো হয় না। নূতন ভাষায় নবীন হইয়া দেখা দেয়। সকল কালেই পুরবধূরা এ গান–বাউল বৈরাগী পঁচালি দল, যাত্রার দলের গায়কদের কাছে শুনিয়া শিখিয়া লয়। কালে কালে এইভাবে নির্জন দ্বিপ্রহরে গাহিতে থাকে। ঘরে গায়—ঢেঁকিশালে, ঘাটে গায়—জলে গলা ড়ুবাইয়া, সখিরা মিলিয়া জল আনিবার পথে গায়। গানের মধ্যেই দরজায় ধাক্কা পড়িল। কেহ শিকল বাজাইয়া দরজার ওপাশে সাড়া দিতেছে। মানদা সেদিকে তাকাইয়া বলিল, কে? মেয়েলি গলায় সাড়া আসিল, একবার দরজাটা খোল। মানদা ভানাড়ীদের একজনকে বলিল, দে তো লা খুলে। মেয়েটি দরজা খুলিয়াই বলিল, অ। পুঁটি মোল্যান! মানদার দিকে তাকাইয়া বলিল, ঘোঁতন ঘোষের বুন গো! বলিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। পুঁটি বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া বলিল, ওরে বাপরে। এ যে পুজোর ধুম পড়ে গিয়েছে যে! খুব কলাই কুটছ! খুব গান জুড়েছ! মানদা মুখ চমকাইয়া বলিল, তা কুটছি। কিন্তু তুমি কি মনে করে হে? এই ভত্তি দুপুরে? –বড় বউ কই? চাঁপাডাঙার দিদি? একটা কথা বলতে এসেছি। মানদা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কি কথা হে? –না ভাই, সে আমি তাকেই বলব। আমার মা বলে পাঠিয়েছে, অন্য কাউকে বলতে বারণ করেছে। –আমি জানি হে, আমি জানি। গয়না তো? টাকা? —তা জানবে বৈকি ভাই। তুমি অর্ধেকের মালিক। জানবে বৈকি। তবে আমি চাঁপাডাঙার দিদিকে বলে যাই; তুমি তার কাছে শুনো। কই, দিদি কোথায়? মানদা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, ধান সেদ্ধ করছে, ওদিকের চালায়। পুঁটি আগাইয়া গেল। মানদা হাতের কুঁচিগাছটা লইয়া বলিল, ললাটে তিন ঝাঁটা মারতে মন হয়—তিন ঝাঁটা। বাড়ির আর একদিকে খোভড়া চালায় উনান হাঁড়িতে ধান সিদ্ধ হইতেছিল। ছোট এক টুকরা উনান, সেখানে সিদ্ধ-করা ধান মেলা রহিয়াছে। একটি মজুর মেয়ে পায়ে পায়ে ধানগুলি টানিয়া ওলটপালট করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। চাঁপাডাঙার বউয়ের কাপড়খানা ময়লা, ধোঁয়ায় কালো। গাছকোমর বাঁধিয়া কাপড় পরা। মাথায় ঘোমটা নাই। চুলগুলি রুখু দেখাইতেছে। এখনও স্নান হয় নাই। মুখচোখ আগুনের অ্যাঁচে এবং এখনও অস্নাত অভুক্ত বলিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। একটু বেশি কালো দেখাইতেছে। পুঁটি গিয়া একটু অবাক হইয়াই বলিল, তোমার কি অসুখ করেছে নাকি দিদি? এ কি মুখ হয়েছে তোমার? যেন বড় অসুখ থেকে উঠেছ? সে সকরুণ বিস্মিত দৃষ্টিতে কাদুর দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। –পুঁটি? পুঁটিকে দেখিয়া বড় বউ একটু বিস্মিত হইয়া গেল।—এমন অসময়ে? –মা পাঠালে তোমার কাছে। কিন্তু– —সইমা? কেন রে? অসুখ শুনেছিলাম সইমায়ের—; শঙ্কিত হইয়া উঠিল সে। পুঁটি কি তবে টাকা-পয়সার জন্য আসিয়াছে। —উঠেছে
false
shomresh
বোঝা যাচ্ছে ওকে কেউ হত্যা করেছে। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল, অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে এখানে কোনো কথা বললে সেটা বিচ্ছিরি লাগবে, এটা অনুভব করতে পারল অনিমেষ। ও আস্তেআস্তে বাকি ধাপগুলো পেরিয়ে সুনীলদার খাটিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সুনিলদার বাবা ওকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক দুহাত বাড়িয়ে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরলেন, দ্যাখো, দ্যাখো, আমার সুনীলকে তোমরা দ্যাখো। চিৎকারটা শেষদিকে কান্নায় জড়িয়ে যেতে অনিমেষ এই প্রৌঢ়ের হাতে বাঁধনে দাঁড়িয়ে থেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল। কেউ-একজন পাশ থেকে এই প্রথম কথা বলল, মেলোমশাই, একটু শক্ত হন। শক্ত হব? কান্নাটা তখনও শব্দগুলোকে নিয়ে খেলা করছিল, আমি তো শক্ত আছি। আমার ছেলে কমিউনিস্ট পার্টি করে-আমি কিছু বলি না, কলকাতা থেকে বই আনায়-আমি টাকা দিই, দশবারো দিন কোথায় গিয়ে সংগঠন করে-আমি চুপ করে থাকি। আমার চেয়ে শক্ত আর কোন বাবা থাকবে? অনিমেষ ওঁর আলিঙ্গনে বন্দি হয়ে পাশে বসে পড়েছিল। সুনীলদার মুখ এখন ওর এক হাতের মধ্যে। সুনীলদা কোথায় গিয়েছিল? স্বৰ্গছেঁড়ায়? স্বৰ্গছেঁড়াতে কেউ সুনীলদাকে খুন করতে পারে? কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ওর। সুনীলদার কেউ শক্ত হতে পারে। পারে, সুনীলদা বলেছিলেন, শক্র চারধারে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তারাই আমাদের শত্রু। তা হলে স্বৰ্গছেঁড়ায় ক্ষমতা আগলে থাকবে এবং শত্রু হবে-এরকমটা শুধু বাগানের ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো পুলিশ আছে। ওই ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ স্পষ্ট শুনতে পেল, এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, মৃত পৃথিবী ভগ্ন ধ্বংসস্তুপ পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব, তবু দেহে যতক্ষণ আছে, প্রাণ, প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি। এই বারান্দায় এক সন্ধেবেলায় পায়চারি করতে করতে আবৃত্তি করেছিল সুনীলদা। এখন এই জ্যোৎস্নায়-ঘোয়া। সুনীলদার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল সুনীলদা হয়তো সামান্য বড় ছিল বয়সে, কিন্তু তার কোনো কথা ও স্পষ্ট বুঝতে পারেনি। ঠিক এই সময় একটা রিকশা এসে গেটের কাছে থামল। দু-তিনজন লোক সেদিকে এগিয়ে যেতে অনিমেষ দেখল রিকশা থেকে একটা বিরাট ফলের মালার নামিয়ে যিনি আসছেন তাঁকে সে চেনে। এক হাত কাটা অথচ কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। মালাটা নিয়ে দৃঢ় পায়ে নেমে এসে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে গেলেন তিনি। সুনীলদার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখে দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মালাটা সুনীলদার বুকের ওপর এমন আলতো করে নামিয়ে রাখলেন যাতে একটুও না লাগে। তারপর খুব মৃদুস্বরে বললেন, সুনীল, আমরা আছি, তুই ভাবিস না। অনিমেষ ওঁর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল, না, চিনতে পারেনি। সেই সন্ধ্যায় ছোটাকার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে সে যে গিয়েছিল নিশ্চয়ই খেয়াল করতে পারেননি। এই মানুষটির হাঁটাচলা এবং কথা বলা তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ছোটকাকা কী করে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ওর মুখের ওপর ধরেছিল, তা হরে ছোটকাকাও কি ওঁর শত্রু! যা, ছোটাকাক তো ক্ষমতাবান মানুষদের একজন-ক্রমশ ঘোলা জলটা থিতিয়ে আসছিল। প্রায় নিঃশব্দেই সুনীলদাকে ওরা ঠিকঠাক করে নিল। সুনীলদার বাবা হঠাৎ যেন একদম বোবা হয়ে গেছেন, কোনো কথা বলছেন না। সেই কান্নাটাও যেন আর ওঁর গলায় নেই। এতক্ষণের নাগাল পেল। না, স্বৰ্গছেঁড়ায় নয়, ড়ুয়ার্সের অন্য এক চা-বাগানে দুদল শ্রমিকের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ থামাতে সুনীলদা ছুটে গিয়েছিল। আসন্ন হরতাল বানচাল হয়ে যেত তাতে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে সংগঠনকে আরও মজবুত করে আজ সকালে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসছিল সে। তোরবেলায় বাসস্ট্যান্ডে আসবার সময় কেউ ওকে ভোজালি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে চা-বাগানের ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে গাড়িতে ময়নাগুড়ি হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। সুনীলদা ডাক্তারদের কাছে কিছু বলতে পারেনি বলে শোনা যাচ্ছে, যেটা এই জনতা বিশ্বাস করছে না। পুলিশ বিকেলবেলায় অনেক তদ্বির করার পর মৃতদেহ ছেড়েছে। কোনো ধরপাকড়ের কথা শোনা যায়নি এখনও। জনতার ধারণা হরতাল হোক এটা যারা চায়নি তারাই সুনীলদাকে মেরেছে। সুনীল রায়ের মৃত্যুতে আগামীকাল সেই চা-বাগানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। শেষ মুহূর্তে সুনীলদার বাবা ঘাড় নাড়লেন। না, তিনি শোনে যাবেন না। অনেকের অনুরোধে তার এক কথা, আমার স্ত্রীকে অমি দাহ করেছি, সুনীলকে আমার সঙ্গে সে রেখে গেছে বলে। সুনীলকে আমি দাহ করে কার জন্যে অপেক্ষা করব? শেষ পর্যন্ত সরিৎশেখর এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ দূরে বসে তিনি চুপচাপ সব দেখছিলেন। ভদ্রলোক শোনে যাবেন না শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন হেমলতা নিষেধ সত্ত্বেও, মিঃ রায়, আপনি গেলে যে ওর অমঙ্গল হবে। সুনীলদার বাবা বোধহয় এখনও মানুষ চিনছিলেন না, না, ও এখন মঙ্গল-অমঙ্গলের বাইরে। সরিৎশেখর বললেন, কিন্তু পিতা হিসেবে আপনার কর্তব্য তো শেষ হয়নি। আপনি ওকে জন্ম দিয়েছেন, পালন করেছেন, উপযুক্ত করেছেন, তাই তার শেষ যাওয়ার সময় আপনার উপস্থিতি ওকে মুক্তি দেবে। সঙ্গে সঙ্গে সজোরে ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি, হল না, হল না, ও বলত, মরে গেলেও আমি আবার কমিউনিস্ট হব। আচ্ছা, আপনার আঙ্গুল আগুনে পুড়ছে আপনি সহ্য করতে পারবেন? পারুন, আমি বড় দুর্বল, পারব না। প্রায় নিঃশব্দে সুনীলদাকে বাড়ির গেট খুলে বের করা হল। ওরা যখন যাত্রা শুরু করছিল, অনিমেষ তখন দৌড়ে পিসিমার কাছে গেল। দাদু নেই বারান্দায়। সুনীলদার বাবা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর লনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। অনিমেষ পিসিমাকে বলল, আমি
false
manik_bandhopaddhay
দিশেহারা হইয়া ছুটিয়া বাহিরে যাওযায় কী ভাবে গোপির উপব চালটা আসিয়া পড়িয়াছিল। ঘরে থাকিলে মেযেটার কিছু হইত না। ঝড়ের সময় যে বাহিরে যাইতে নাই, ঘরের মধ্যে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ, সেটুকু বৃদ্ধি তো মেয়ের নাই। শুনিতে শুনিতে কুবের ঢুলিতে থাকে। হ, কুবেরের ঘুম পাইয়াছে। উন্মুক্ত নদীতীরে বসিয়া সে কাটাইয়াছে ঝড়ের রাত্রি, সকালে হাঁটিয়া আসিয়াছে দেবীগঞ্জে, দুটি মুড়ি শুধু সে খাইয়াছে, বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত দুর্ভাবনায় টিপচিপ করিয়াছে বুকের মধ্যে। এখন পেট ভরিয়া খাইয়া উঠিয়া আর তাহার জাগিয়া থাকিবার ক্ষমতা নাই। মালার সব কথা তার কানে যায় না। গোপির মাথার কাছে সংকীর্ণ স্থানটুকুতে কোনোমতে কাত হইয়া সে একসময় ঘুমাইয়া পড়ে। সন্ধ্যার আগে জেলেপাড়ার সকলেই ফিরিয়া আসিল। পদ্মার গ্রাসে কেহ যায় নাই। পীতম মাঝির নৌকাটি শুধু মাঝ-নদীতে ঝড়ের মুখে পড়িয়া ডুবিয়া গিয়াছে। নৌকায় ছিল পীতমের ছেলে মাখন, কুবেরের প্রতিবেশী সিধু আব তার ভাই মুরারি,–অর্ধমৃত অবস্থায় একটা চরে উঠিয়া রাত কাটাইয়া তাহারা ফিরিয়া আসিয়াছে, আর বলিয়া বেড়াইতেছে তাহাদের বাহাদুরিব কাহিনি, পাহাড়-সমান ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করিয়া কী ভাবে তাহারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাইয়াছিল। কয়েকটা দিন বড়ো গোলমালের মধ্যে কাটিয়া গেল। ধীরে ধীরে ভাঙা ঘরগুলির সংস্কারের চেষ্টা চলিতে লাগিল। কেতুপুরের দু-চারখানা ঘরবাড়ি পড়িয়া গিয়াছিল, একদিন মেজোকর্তা অনস্ত তালুকদারের সভাপতিত্বে গ্রামবাসীর এক সভা হইয়া গেল। ক্ষতিগ্রস্ত আর দুঃস্থদের জন্য চাঁদা তোলার ব্যবস্থা হইল। অনন্তবাবু নিজে দান করিলেন দশ টাকা, গ্রাম হইতে আরও পনেরো টাকা উঠিল। তার মধ্যে সাত টাকা দেওয়া হইল কেতুপুরের নন্দ ভট্টাচার্যকে, আহা, ব্রাহ্মণের দুখানা ঘর পড়িয়া গিয়াছে। জেলেপাড়ার জন্য দেওয়া হইল দশ টাকা, দুটাকা করিয়া পাঁচজনকে। বাকি টাকাটা বোধ হয় ফান্ডে জমা রহিল। সুখের বিষয় দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর এই সময় হোসেন মিয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া সে চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া বেড়াইল, তারপর দাড়ি নাড়িয়া বলিল, না, টাকা কর্জ দিমু না, ছন দিমু, বাঁশ দিমু, নিজে খাড়াইয়া তোমাগো ঘর তুইল্যা দিমু-শ্যাষে নিকাশ নিয়া খত লিখুম, একটা কইবা টিপ দিবা। তাই সই। পুরাতন জীর্ণ ঘরের বদলে যদি নূতন ঘর ওঠে, খত লিখিয়া দিতে আর আপত্তি কী? ঘর যাহাদের পড়িয়া গিয়াছিল সকলে তাহারা খুশি হইয়া উঠিল। যাহাদের ঘর পড়ে নাই তাহারা দুঃখিত হইয়া ভাবিল, ঘরদুয়ার তাহাদেরও পড়িয়া গেলে মন্দ হইত না! সকলেই সাগ্রহে হোসেন মিয়ার সাহায্য গ্রহণ করিল, করিল না শুধু আমিনুদ্দি। সে মাথা নাড়িয়া বলিল, না মিয়া, ঘর দিয়া আমার কাম নাই। আমগাছের তলে তাহার ঘরখানা যেমন নিষ্পেষিত হইয়া পড়িয়াছিল তেমনিভাবে পড়িয়া রহিল। সত্যিই তো, ঘর দিয়া আমিনুদ্দি কী করিবে? কে আছে আমিনুদ্দির? কার জন্য আবার সে দুঃখের, দারিদ্র্যের নীড় বাঁধিবে? জেলেপাড়ার সকলেই আবার পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়াছে, আমিনুদ্দি কোথাও যায় না, কার জন্য পদ্মার অতল জলে সে জীবিকার সন্ধান করিবে? শুধু মেযেটা আছে,—মমীন। কেন আছে কে জানে! সারাদিন মমীন মৃদুস্বরে কাঁদে, আমিনুদ্দি চাহিয়াও দ্যাখে না, না ডাকে কাছে, না বলে মেয়ের সঙ্গে কথা। ক্ৰমে ক্ৰমে সকলের নূতন খুঁটি, নুতন বেড়া ও নূতন চালার ঘরগুলি সমাপ্ত হইল। হোসেন মিয়া মজুরদের কী ইঙ্গিত দিয়াছিল সেই জানে, কুবেরের ঘরটা উঠিল সকলের আগে। ঘর দেখিতে আসিয়া হোসেন মিয়া গোপির জন্য বড়ো দরদ দেখাইল। বলিল, হাসপাতালে নিয়া যাও কুবের বাই, জবর চোট পাইছে মালুম হয়। তারপর একখানা খত বাহির করিয়া বলিল, টিপ সই দেও কুবের—- একুশ টাহা দশ আনার খত লিখিছি—বাদ দিছি দুই টাহা। টিপ সই দিয়া রাখ, যখন পারবা দিবা,–না দিলি মামলা করুম না বাই! –হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিল, জান দিয়া তোমাগো দবদ কবি, খত কিসির? লিখা থুইলাম, হিসাব থাকবো—না-ত কিসির কাম খত দিয়া? কুবের বলিল, পুরানো বাঁশ পুরানো বেড়া দিলি খরচা কম হইত মিয়া বাই। ক্যান? পুরান বাঁশ দিয়া ক্যান? খরচার লাইগা ভাইবো না, খরচা তো দিছি আমি! না, দিই নাই? হ, মিয়াবাই দিছেন, আপনেই দিছেন। টিপসই দিয়া কুবের হোসেনের মুখের দিকে চাহিল। বড়ো ভয় করে কুবের হোসেন মিয়াকে, বড়ো টান তাহার হোসেন মিয়ার দিকে। কী যাদুমন্ত্রে তাহাকে বশ করিয়াছে লোকটা? গোপির পায়ের ব্যথাও কমে না, ফোলাও কমে না। মেয়েটাকে নিয়া মহা মুশকিলে পড়িয়াছে কুবের। মালার মতো গোপিও কি শেষ পর্যন্ত গোড়া হইয়া যাইবে? কী ব্যবস্থা করা দরকার কুবের বুঝিয়া উঠিতে পারে না। হোসেন মিয়ার কথামতো সদরের হাসপাতালে লইয়া যাইবে নাকি? সে তো কম হাঙ্গামার ব্যাপার নয়। অতখানি পথ গোপিকে কেমন করিয়া লইয়া যাইবে? ব্যথায় সে বিছানাতেই পাশ ফিবিতে পারে না, অত নাড়াচাড়া তাহার সহিবে কেন? অথচ পায়ের যা অবস্থা গোপির, শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা না করিলে নয়। ইতিমধ্যে পূজা আসিয়া পড়িল। চরডাঙ্গা হইতে একদিন আবার আবির্ভাব ঘটিল অধরের। আবার সে রাগারগি করিয়া সকলকে লইয়া যাইতে চাহিল। ছেলেমেয়েগুলি তার সঙ্গে ফিরিয়া গেল চরডাঙ্গায়, কপিলা গেল না। বলিল, কেন, ঘর পড়িয়া গিয়া টেঁকি ঘরটাতে যখন তাহারা সকলে একসঙ্গে মাথা গুজিয়া ছিল, অসুবিধার অন্ত ছিল না, তখন অধর আসিতে পারে নাই? এখন নতুন ঘর উঠিয়াছে, থাকিবার কোনো অসুবিধা নাই এখন সে যাইবে কেন এদের এই বিপদের মধ্যে ফেলিয়া? কুবেরও ইহাতে সায় দিয়া বলিল, হ কেন যাইবে কপিলা তাদের এই বিপদের সময়? কপিলা সত্যই প্রাণ দিয়া সকলের সেবা করিতেছিল, বড়ো কৃতজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছিল কুবের তাহার কাছে। বড়ো ভালো মেয়ে কপিলা। কেন যে
false
nihar_ronjon_gupta
উৎসবে, তাঁদের মধ্যে কেউ হতে পারেন। কিরীটী যেন কি ভাবছিল, অন্যমনস্কভাবে মৃদু কণ্ঠে বললে, তা অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু সে বৌটি যে-ই হোক, সে তিনতলায় গিয়েছিল কেন? তিনতলায় তো যাবার কথা নয় কারো! ঠিক আছে মিঃ মুখার্জী, অ্যাম সরি টু ডিসটাব ইউ, আপনি আপনার কাজ করুন। বীরেন মুখার্জী মধ্যখানে কিরীটীর প্রশ্নোত্তরে একটু বিরক্তই হয়েছিলেন, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না। আরও কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করে অন্য ভৃত্য রাজেনকে ডেকে দেবার জন্য গোকুলকে বললেন। গোকুল চলে গেল। রাজেন একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকল। গোকুলের চেহারাটা মোটাসোটা বেঁটে। একটু গোলগাল এবং রং কালো। রাজেন ঢ্যাঙা, লম্বা, রোগা। শুকনো পাকানো চেহারা। গোকুলের চোখের চাউনি ভাসা-ভাসা, একটু যেন বোকা-বোকা মনে হয় ওকে চোখের দিকে তাকালে, কিন্তু রাজেনের চোখের দৃষ্টিতেই বোঝ যায় লোকটা চালাক-চতুর। গোকুলের মত নিরীহ সরল হাবাগবা নয়। তোমার নাম রাজেন? বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন। আজ্ঞে–রাজেন সাধু। এ বাড়িতে কতদিন কাজ করছ? তা আজ্ঞে—দশ বছরের কিছু বেশি হবে। কিরীটী সোফার উপরে বসে পাইপে অগ্নিসংযোগ করে টানতে থাকে। তুমিও কি সন্ধ্যে থেকে ওপরেই ছিলে? আজ্ঞে না—আমি নিচের প্যাণ্ডালে ছিলাম। দাদাবাবু আমাকে সেখানেই থাকতে বলেছিলেন। রাজেন, নিমন্ত্রিত পুরুষ ও মহিলারা কি সব এক প্যাণ্ডালে বসেই খেয়েছেন? আজ্ঞে না। মেয়েদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। সামনের দিকের প্যাণ্ডালে পুরুষরা খেয়েছেন, পিছনের প্যাণ্ডালে মেয়েরা। তুমি কোন্ প্যাণ্ডালে ছিলে? দুপ্যাণ্ডালেই আমি ছুট ছুটে বেড়িয়েছি দাদাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে। দাদাবাবু তাহলে দুপ্যাণ্ডালেই যাতায়াত করছিলেন? আজ্ঞে। ওই সময় কিরীটী পাইপটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল, রাজেন, তুমি যখন দাদাবাবুর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলে, তখন নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে কখন দাদাবাবু প্যাণ্ডাল ছেড়ে চলে যান? বোধ হয় রাত এগারটায়, তাঁর বন্ধুদের শেষ ব্যাচ খেয়ে চলে যাবার পর,–রাজেন বললে। আর শিখেন্দুদাদাবাবু? আরও আধঘণ্টা পরে। শিখেন্দুবাবু তখন কোথায় ছিলেন? দাদাবাবুর পাশেই। রাজেন, নীল রঙের দামী শাড়ি পরা কোন অল্পবয়সী বৌকে দেখেছ? আজ্ঞে অনেকের পরনেই নীল শাড়ি ছিল, আর অল্পবয়সী বৌও অনেক এসেছিল। তোমার দাদাবাবুর মাথা ধরেছিল জান? আজ্ঞে না। তোমার দাদাবাবুর মাথা ধরেছিল বলেই তো শিখেন্দুদাদাবাবু তাঁকে ওপরে চলে যেতে বলেছিলেন! আমি বলতে পারব না বাবু। রাত্রি শেষ হয়ে এসেছিল ইতিমধ্যে। জানলাপথে প্রথম ভোরের আলো ঘরে এসে প্রবেশ করে। বীরেনবাবু, কিরীটী বললে, আমি এবার যাব। আমি ওপরে যাচ্ছি। শিবতোষবাবুকে একবার বলে আসি। কিরীটী উঠে পড়ল। বীরেন মুখার্জী কোন কথা বললেন না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শিখেন্দুর সঙ্গে মুখখামুখি হয়ে গেল কিরীটীর। শিখেন্দু নেমে আসছিল। আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম শিখেন্দুবাবু। কিরীটী বললে। আমার সঙ্গে! হ্যাঁ। কোথাও আমরা বসতে পারি? কিছু কথা ছিল আমার। কথা? হ্যাঁ। একটু নিরিবিলি হলেই ভাল হয়। কিরীটী বললে। নিচে কাকাবাবুর অফিসঘরে আমরা বসতে পারি। আর ওপরের কোন ঘরে যদি বসতে– না। ওপরে নয়। নিচেই চলুন। বেশ চলুন। শিখেন্দু বললে। নিচের তলায় একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে শিবতোষের অফিসঘর। কিন্তু দরজাটা আটকানো দেখা গেল। আপনি এখানে একটু দাঁড়ান কিরীটীবাবু, যতীশবাবুর কাছে বোধ হয় ঘরের চাবি আছে—তাঁকে বলছি ঘরটা খুলে দিতে। কিরীটী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল, শিখেন্দু পালারের দিকে চলে গেল। যতীশ সামন্ত তখনও পালারেই ছিল, শিখেন্দু তাকে ডেকে এনে শিবতোষের অফিসঘরটা খুলিয়ে নিল। আসুন! আগে শিখেন্দু, পশ্চাতে কিরীটী অফিসঘরে প্রবেশ করল এবং শিখেন্দু ঘরের আলোটা জ্বালাতে চাইলে, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বললে, ভোর হয়ে গিয়েছে শিখেন্দুবাবু, ঘরের জানলাগুলো খুলে দিন বা পদগুলো সরিয়ে দিন—আলো জ্বালাতে হবে না। শিখেন্দু আলো আর না জ্বালিয়ে ঘরের জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই জানলার কাঁচের সার্শিপথে দিনের আলো এসে ঘরে প্রবেশ করল। দেখা গেল কিরীটীর অনুমান মিথ্যে নয়। ঘরের মাঝখানে বিরাট একটি সেক্রেটারিয়াট টেবিল, গোটা দুই ফোন, কলমদানী, অ্যাশট্রে আর ছোট দামী একটা ফটোর ফ্রেমে এক মহাত্মার ফটো, শিবতোষের গুরুদেব। ঘরের চারপাশে গোটাচারেক স্টিলের আলমারি, দেয়ালে গাঁথা একটি আয়রন-সেফ। টেবিলের উপরে কিছু ফাইল-পত্র রয়েছে।গোটাসাতেকচেয়ার একদিকেছটাচেয়ার ও অন্যদিকে একটি রিভলবিং চেয়ার। বোঝা গেল, শিবতোষ ঐ চেয়ারটাতেই বসেন। ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। বাথরুমের দরজা বন্ধ। বসুন শিখেন্দুবাবু! শিখেন্দু বসল। কিরীটীও পাশেই একটা চেয়ারে বসল। পাইপটা কিরীটীর নিভে গিয়েছিল। লাইটারের সাহায্যে পুনরায় পাইপের মাথায় অগ্নিসংযোগ করে মৃদু একটা টান দিয়ে বললে, বুঝতেই পারছেন শিখেন্দুবাবু, ব্যাপারটা র্যাদার ডেলিকেট, তাই একটু নিরিবিলিতে আপনাকে নিয়ে এলুম। শিখেন্দু কোন জবাব দিল না। ক য়েকটি প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাই। বেশ তো করুন। কাল রাত্রে ফুলশয্যার ব্যবস্থা তিনতলায় নির্বাণীতোষবাবুর শোবার ঘরেহ য়েছিল দেখলাম— হ্যাঁ। ও তো তিনতলাতেই থাকত, তাই। তিনতলায় বুঝি কেউ থাকে না? পাঁচটা ঘরের তিনটে ঘর খালিই পড়ে থাকে তিনতলায়। দুটো ঘর পাশাপাশি নির্বাণীতোষ ব্যবহার করত বেল। বৌ বসানো হয়েছিল নিচের সামনে দোতলার একটি ঘরে? হ্যাঁ। তার মানে তিনতলায় কারো কোন দরকারই ছিল না যাবার? কারো বলে কোন কথা নয়, বরাবরই নির্বাণীতোষ তিনতলায় কারো যাওয়া পছন্দ করত। তাই কেউ বড় একটা যেত না। কেন? পছন্দ করত না কেন? ও চিরদিনই একটু নির্জনতাপ্রিয় ছিল। গোলমাল হৈচৈ পছন্দ করত না। তাহলে তো পছন্দ না হবারই কথা। বলেইহঠাৎ যেন প্রশ্নটা করল.কিরীটী, আপনি কাল রাত্রে তিনতলায় কবার গিয়েছিলেন? আমি—তিনতলায়? হ্যাঁ। একবার মাত্র গিয়েছিলাম। মনে করে দেখুন তো শিখেন্দুবাবু! একবার নয়, অন্ততঃ দুবার নিশ্চয়ই গিয়েছিলেন। কিরীটীর গলার স্বর যেন অদ্ভুত শান্ত, অদ্ভুত নির্লিপ্ত। প্রশ্নটা
false
shunil_gongopaddhay
খ্যাতি অর্জন করেছিল, এখন তার কণ্ঠে সপ্তসূর্য যেন আরও বণাঢ্য হয়ে ভর করেছে। অতি সূক্ষ্ম মীড় ও টপ্পার কাজ। হীরা বুলবুল যখন গান শুরু করে তখন রাইমোহনের বুকটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে। এমন মধুর গান। এমন সুরের মূর্চ্ছনা, অথচ অন্য কারুকে শোনানো যাবে না! হীরা বুলবুল এই গান গেয়ে তো কলকাতার বাবুসমাজকে মাতোয়ারা করে দিতে পারে আবার। কলকাতায় ফিরিয়ে আনার পর প্রথম কয়েকদিন রাইমোহন অনেক ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছে ওকে। এখন রাইমোহন শান্ত স্তব্ধ হীরা বুলবুলের সামনে গিয়ে যদি বা কিছু বলাবলি করেও, কিন্তু হীরা বুলবুল গান শুরু করার পর সে আর ভয়ে সামনে থাকে না। গান গাইতে গাইতে অকস্মাৎ এক জায়গায় থেমে গিয়ে হীরা বুলবুল তার দ্বিতীয় মূর্তি ধারণ করে। তখন তার চক্ষু দুটি থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোয়, মুখখানা হয়ে যায় কালী মূর্তির দু পাশের ডাকিনী যোগিনীর মতন, গলার আওয়াজও হয়ে যায় সানের মেঝেতে টিনের কৌটো ঘষার মতন। সামনাসামনি কেউ না দেখলে বা শুনলে বিশ্বাসই করবে না যে এই রমণীই একটু আগে এমন অপূর্ব সুরেলা গলায় গান গাইছিল। তখন সাংঘাতিক হিংস্র হয়ে ওঠে। সে, মুখ দিয়ে কুৎসিত কদৰ্য গালি-গালাজের ঝড় বইতে থাকে, চোখের সামনে যাকেই দেখতে পায় তাকেই মারতে ধেয়ে আসে। যে-কোনো কারণেই হোক তার সবচেয়ে বেশী আক্রোশ রাইমোহনের ওপর। হাতের সামনে যা পায়, তাই ছুঁড়ে মারে রাইমোহনের দিকে। একবার পান ছেচার পিতলের হামানদিস্তে সজোরে নিক্ষেপ করেছিল রাইমোহনের কপাল লক্ষ্য করে, সেটি ঠিক মতন লাগলে রাইমোহনকে আর পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস গ্রহণ করতে হতো না। সেই অবস্থায় হীরা বুলবুল কোনো ষণ্ডকায় পুরুষের মতন দুপদুপিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, খাদ্যদ্রব্য পেলে মুঠো মুঠো মুখে ভরে, দু দিকের কষ দিয়ে লালা গড়ায় এবং অকারণে হা-হা করে হেসে ওঠে। তখন তাকে দেখলে রাক্ষসী বলে মনে হয় অথবা অপ্রাকৃত কোনো ভীতিপ্ৰদ রমণী। দাস-দাসীরা পালিয়েছে এ গৃহ ছেড়ে। রাইমোহনের এক সহচর হারাণচন্দ্র এখনো রয়ে গেছে শুধু। দুজনে মিলে এ পাগলিনীকে কোনোক্রমে সামলায়। এখন সন্ধ্যার সময় অধিকাংশ ঘরেই আলো জ্বলে না। একতলার এক ছোট কুঠুরিতে হারাণচন্দ্র বসে বসে সুরা পান করে, রাইমোহন চুপ করে বসে থাকে সেখানে। সে যেন এখন আর সুরাপানেও স্বাদ পায় না। হঠাৎ একেবারে বিস্বাদ হয়ে গেল জীবনটা। আজ হারাণচন্দ্রের পীড়াপীড়িতে রাইমোহন সুরার পাত্রে দু-একটা চুমুক দিয়েছে। বাতাসে শীত শীত ভাব, তাই সুরার প্রভাবে শরীরে উত্তাপ সঞ্চারিত হলে বেশ আমেজ আসে। রাইমোহন আক্ষেপের সঙ্গে বললো, সব কেমুন ভেবলে গেল রে, হারাণে, সব ভেবলে গেল! হারাণচন্দ্রের আবার ছিলিমও চলে। চরসেই। সে বেশী টং হয়। কল্কেট রাইমোহনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বললো, দুটান দিয়ে দ্যাকো দাদা, রিদয়টা একদম খোলসা হবে। দিনরাত ভেবে ভেবে তুমি যে একেবারে কাহিল হয়ে গেলে! এই সময় ওপর থেকে ভেসে আসে হীরা বুলবুলের সুমিষ্ট কণ্ঠের গান। গত দেড়দিন যাবৎ সে টু শব্দটিও করেনি। এই সন্ধেবেলা আবার তার ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। গান শুনতে পেয়ে হারাণচন্দ্ৰ বলে উঠলো, আহা, আহা, দিদি আমার সাত্থক বুলবুল। রাইমোহন মন দিয়ে খানিকক্ষণ গানটা শুনলো। হীরা বুলবুল গাইছে : পাসরিতে চাই তারে না যায় পাসরা আমারে মজালে আমার নয়নেরি তারা বাসনা করিয়ে মনে চাব না তাহার পানে আঁখি নিষেধ না মানে বহে বারিধারা… রাইমোহন বললো, এ গান আমি শিকোচি ওকে। এ গান কার রচনা জানিস? কালী মীর্জার। নাম শুনিচিস? হারাণচন্দ্র মাথা নেড়ে জানালো যে ঐ নাম সে শোনেনি। রাইমোহন আফসোসের সুরে বললো, তা শুনবি কেন, তোরা তো সবাই নিধুবাবুর নামে নাচিস। কালী মীর্জাও কম বড় গায়ক ছেলেন না। লক্ষ্ণৌ, দিল্লি থেকে গান শিকে এয়েছিলেন। বর্ধমানের রাজা বাহাদুর প্রতাপচাঁদের সভায় গাইতেন। সেই যে রে, যাঁর নামে আর এক জাল প্ৰতাপচাঁদ বেইরেছেল। কালী মীর্জা কলকেতায় এসে গোপীমোহন ঠাকুরের আখড়াতেও গাইতেন। যেমন ভালো গান বাঁধতেন, তেমন ঢেউ খেলানো গলা, আর চ্যায়রা খানা ছেল কি, যেন নবাব আমীর কেউ হবে। হারাণচন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, তুমি ওনাকে দেকোচো, দাদা? রাইমোহন বললো, হ্যাঁ, দেকিচি, গান শুনিচি। খানাকুলের রামমোহন রায়, ঐ যে রে যিনি এখুনকার বোম্যজ্ঞানীদের গুরু ঠাকুর, সেই তিনিও কিছুদিন গান শেকার জন্য এই কালী মীর্জার কাচে নাড়া বেঁধেছিলেন। আমি যখন কালী মীর্জার গান শুনি, আমার বয়েস তখুন। অনেক কম, ধর চাঁদুর মতন বয়েস, আমি বাপ-মরা ছেলে, কেউ দোকবার নেই, ঘুরে ঘুরে বেড়াই-এই যা, কার নাম করলুম। –কার নাম করলে দাদা? —চাঁদুর নাম? হঠাৎ কেন মনে এলো? —বাদ দাও ওসব কতা। আর এক ছিলিম টানো, গান শোনো। হীরা বুলবুল তখন অন্য গান ধরেছে : ভালবাস, ভালবাসি, লোকে মন্দ বলে তাতে কাহারও নই প্রতিবাদী, তবু কেন মিছে তাতে। কি নৃপতি কি দীন সবে দেখি প্ৰেমাধীন কেউ ছাড়া নয় কোন দিন ভেবে দেখ যাতে-তাতে। হারাণচন্দ্ৰ বললো, আহা-হা, আহা-হা! রাইমোহন বললো, এ গানটা হীরে অনেকদিন পরে গাইলে। আমিও প্রায় ভুলেই গোসলাম। বড় খাসা গান। এটি কার বাঁধা বলতে পারিস? —এটা আর বলতে হবে না। টপ্পার টান শুনেই বুঝিচি! এ গান নিধুবাবু ছাড়া আর কার? রাইমোহন ক্ষেপে উঠে বললো, নিধুবাবু আর নিধুবাবু! সবই তোদের নিধুবাবু। সাধে কি আর দাশু রায় মশাই রেগে গিয়ে বলেচেন, জুতোর চোটে ঘুচাব তোর নিধুর টপ্পা গাওয়া! —দাদা, তবে এ গান কারি? —শ্রীধর কথকের। কত
false
bongkim
বীরেন্দ্রসিংহের পত্নী এক কন্যা প্রসব করিলেন। কিছু দিন পরে কন্যার প্রসূতির পরলোক প্রাপ্তি হইল। বীরেন্দ্র দিল্লীতে উপনীত হইয়া মোগল সম্রাটের আজ্ঞাকারী রাজপুতসেনা-মধ্যে যোদ্ধৃত্বে বৃত হইলেন; অল্পকালে নিজগুণে উচ্চপদস্থ হইতে পারিলেন। বীরেন্দ্রসিংহ কয়েক বৎসরে ধন ও যশ সঞ্চার করিয়া পিতার লোকান্তরসংবাদ পাইলেন। আর এক্ষণে বিদেশ পর্যটন বা পরাধীনবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। বীরেন্দ্রের সহিত দিল্লী হইতে অনেকানেক সহচর আসিয়াছিল। তন্মধ্যে জনৈক পরিচারিকা আর এক পরমহংস ছিলেন। এই আখ্যায়িকায় এই দুই জনের পরিচয় আবশ্যক হইবেক। পরিচারিকার নাম বিমলা, পরমহংসের নাম অভিরাম স্বামী। বিমলা গৃহমধ্যে গৃহকর্মে বিশেষত: বীরেন্দ্রের কন্যার লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত থাকিতেন, তদ্ব্যতীত দুর্গমধ্যে বিমলার অবস্থিতি করার অন্য কারণ লক্ষিত হইত না, সুতরাং তাঁহাকে দাসী বলিতে বাধ্য হইয়াছি; কিন্তু বিমলাতে দাসীর লক্ষণ কিছুই ছিল না। গৃহিণী যাদৃশী মান্যা, বিমলা পৌরগণের নিকটে প্রায় তাদৃশী মান্যা ছিলেন; পৌর-জন সকলেই তাঁহার বাধ্য ছিল। মুখশ্রী দেখিলে বোধ হইত যে, বিমলা যৌবনে পরমা সুন্দরী ছিলেন। প্রভাতে চন্দ্রাস্তের ন্যায় সে রূপের প্রতিভা এ বয়সেও ছিল। গজপতি বিদ্যাদিগ্‌গজ নামে অভিরাম স্বামীর একজন শিষ্য ছিলেন, তাঁহার অলঙ্কারশাস্ত্রে যত ব্যুৎপত্তি থাকুক বা না থাকুক, রসিকতা প্রকাশ করার তৃষ্ণাটা বড় প্রবল ছিল। তিনি বিমলাকে দেখিয়া বলিতেন, “দাই যেন ভাণ্ডস্থ ঘৃত; মদন-আগুন যত শীতল হইতেছে, দেহখানি ততই জমাট বাঁধিতেছে।” এইখানে বলা উচিত, যে দিন গজপতি বিদ্যাদগ্‌গজ এইরূপ রসিকতা করিয়া ফেলিলেন, সেদিন অবধি তাঁহার নাম রাখিলেন – “রসিকরাজ রসোপাধ্যায়।” আকারেঙ্গিত ব্যতীত বিমলার সভ্যতা ও বাগ্‌বৈদগ্ধ্য এমন প্রসিদ্ধ ছিল যে, তাহা সামান্যা পরিচারিকার সম্ভবে না। অনেকে এরূপ বলিতেন যে, বিমলা বহুকাল মোগল সম্রাটের পুরবাসিনী ছিলেন। এ কথা সত্য, কি মিথ্যা, তাহা বিমলাই জানিতেন, কিন্তু কখন সে বিষয়ের কোন প্রসঙ্গ করিতেন না। বিমলা বিধবা, কি সধবা? কে জানে? তিনি অলঙ্কার পরিতেন, একাদশী করিতেন না। সধবার ন্যায় সকল আচরণ করিতেন। দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমাকে বিমলা যে আন্তরিক স্নেহ করিতেন, তাহার পরিচয় মন্দিরমধ্যে দেওয়া গিয়াছে। তিলোত্তমাও বিমলার তদ্রূপ অনুরাগিণী ছিলেন। বীরেন্দ্রসিংহের অপর সমভিব্যাহারী অভিরাম স্বামী সর্বদা দুর্গমধ্যে থাকিতেন না। মধ্যে মধ্যে দেশপর্যটনে গমন করিতেন। দুই এক মাস গড় মান্দারণে, দুই এক মাস বিদেশ পরিভ্রমণে যাপন করিতেন। পুরবাসী ও অপরাপর লোকের এইরূপ প্রতীতি ছিল যে, অভিরাম স্বামী বীরেন্দ্রসিংহের দিক্ষাগুরু; বীরেন্দ্রসিংহ তাঁহাকে যেরূপ সম্মান এবং আদর করিতেন, তাহাতে সেইরূপই সম্ভাবনা। এমন কি, সাংসারিক যাবতীয় কার্য অভিরাম স্বামীর পরামর্শ ব্যতীত করিতেন না ও গুরুদত্ত পরামর্শও প্রায় সতত সফল হইত। বস্তুত: অভিরাম স্বামী বহুদর্শী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন; আরও নিজ ব্রতধর্মে, সাংসারিক অধিকাংশ বিষয়ে রিপু সংযত করা অভ্যাস করিয়াছিলেন; প্রয়োজন মতে রাগক্ষোভাদি দমন করিয়া স্থির চিত্তে বিষয়ালোচনা করিতে পারিতেন। সে স্থলে যে অধীর দাম্ভিক বীরেন্দ্রসিংহের অভিসন্ধি অপেক্ষা তাঁহার পরামর্শ ফলপ্রদ হইবে আশ্চর্য কি? বিমলা ও অভিরাম স্বামী ভিন্ন আশমানি নাম্নী একজন দাসী বীরেন্দ্রসিংহের সঙ্গে আসিয়াছিল। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : অভিরাম স্বামীর মন্ত্রণা তিলোত্তমা ও বিমলা শৈলেশ্বরের হইতে নির্বিঘ্নে দুর্গে প্রত্যাগমন করিলেন। প্রত্যাগমনের তিন চারি দিবস পরে বীরেন্দ্রসিংহ নিজ দেওয়ানখানায় মছনদে বসিয়া আছেন, এমন সময় অভিরাম স্বামী তথায় উপস্থিত হইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ গাত্রোত্থানপূর্বক দণ্ডবৎ হইলেন; অভিরাম স্বামী বীরেন্দ্রের হস্তদত্ত কুশাসনোপরি উপবিষ্ট হইলেন, অনুমতিক্রমে বীরেন্দ্র পুনরুপবেশন করিলেন। অভিরাম স্বামী কহিলেন, “বীরেন্দ্র! অদ্য তোমার সহিত কোন বিশেষ কথা আছে|” বীরেন্দ্রসিংহ কহিলেন, “আজ্ঞা করুন|” অভিরাম স্বামী কহিলেন, “এক্ষণে মোগল পাঠানের তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত।” বী। হাঁ; কোন বিশেষ গুরুতর ঘটনা উপস্থিত হওয়াই সম্ভব। অ। সম্ভব–এক্ষণে কি কর্তব্য স্থির করিয়াছ? বীরেন্দ্র সদর্পে উত্তর করিলেন, “শত্রু উপস্থিত হইলে বাহুবলে পরাঙ্মুখ করিব।” পরমহংস অধিকতর মৃদুভাবে কহিলেন, “বীরেন্দ্র! এ তোমার তুল্য বীরের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর; কিন্তু কথা এই যে, কেবল বীরত্বে জয়লাভ নাই; যথানীতি সন্ধিবিগ্রহ করিলেই জয়লাভ। তুমি নিজে বীরাগ্রগণ্য; কিন্তু তোমার সেনা সহস্রাধিক নহে; কোন্ যোদ্ধা সহস্রেক সেনা লইয়া শতগুণ সেনা বিমুখ করিতে পারে? মোগল পাঠান উভয় পক্ষেই সেনা-বলে তোমার অপেক্ষা শতগুণে বলবান্; এক পক্ষের সাহায্য ব্যতীত অপর পক্ষের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইতে পারিবে না। এ কথায় রুষ্ট হইও না, স্থিরচিত্তে বিবেচনা কর। আরও কথা এই যে, দুই পক্ষেরই সহিত শত্রুভাবে প্রয়োজন কি? শত্রু ত মন্দ; দুই শত্রুর অপেক্ষা এক শত্রু ভাল না? অতএব আমার বিবেচনায় পক্ষাবলম্বন করাই উচিত।” বীরেন্দ্র বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া কহিলেন, “কোন্ পক্ষ অবলম্বন করিতে অনুমতি করেন?” অভিরাম স্বামী উত্তর করিলেন, “যতো ধর্মস্ততো জয়:,-যে পক্ষ অবলম্বন করিলে অধর্ম নাই, সেই পক্ষে যাও, রাজবিদ্রোহিতা মহাপাপ, রাজপক্ষ অবলম্বন কর।” বীরেন্দ্র পুনর্বার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “রাজা কে? মোগল পাঠান উভয়েই রাজত্ব লইয়া বিবাদ।” অভিরাম স্বামী উত্তর করিলেন, “যিনি করগ্রাহী, তিনিই রাজা।” বী। আকবর শাহ? অ। অবশ্য। এই কথায় বীরেন্দ্রসিংহ অপ্রসন্ন মুখভঙ্গী করিলেন; ক্রমে চক্ষু আরক্তবর্ণ হইল; অভিরাম স্বামী আকারেঙ্গিত দেখিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্র! ক্রোধ সংবরণ কর, আমি তোমাকে দিল্লীশ্বরের অনুগত হইতে বলিয়াছি; মানসিংহের আনুগত্য করিতে বলি নাই।” বীরেন্দ্রসিংহ দক্ষিণ হস্ত প্রসারণ করিয়া পরমহংসকে দেখাইলেন; দক্ষিণ বাম হস্তের উপর বাম হস্তের অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন, “ও পাদপদ্মের আশীর্বাদে এই হস্ত মানসিংহের রক্তে প্লাবিত করিব।” অভিরাম স্বামী কহিলেন, “স্থির হও; রাগান্ধ হইয়া আত্মকার্য নষ্ট করিও না; মানসিংহের পূর্বকৃত অপরাধের অবশ্য দণ্ড করিও, কিন্তু আকবর শাহের সহিত যুদ্ধে কার্য কি?” বীরেন্দ্র সক্রোধে কহিতে লাগিলেন, “আকবর শাহের পক্ষ হইলে কোন্ সেনাপতির অধীন হইয়া যুদ্ধ করিতে হইবে? কোন্
false
tarashonkor
সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। কালের দ্বারে বলি ভাবিয়া দৃঢ়চিত্তে আজ কিন্তু এ সমস্ত সে দেখিতে পারিতেছে না। পদ্মের মত সমস্ত গ্রামখানাই কবে কখন তাহার সমস্ত অন্তরকে মমতায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে—সে বুঝিতে পারে নাই। গ্রামের এই বিপর্যয়ে—বিয়োগে-শোকে সে নিতান্ত আপনজনের মতই একান্ত বিষণ্ণ ও ব্যথিত হইয়া উঠিল। **** বৈশাখের প্রথম দিন। সেই মধ্যরাত্রে কিছু বৃষ্টি হইয়াছে, তারপর আর হয় নাই। হু-হু করিয়া গরম ধূলিকণাপূর্ণ বাতাস বহিতেছে ঝড়ের মত। সেই বাতাসে শরীরের রক্ত যেন শুকাইয়া যাইতেছে। মাটি তাতিয়া আগুন হইয়া উঠিয়াছে। চারিদিকে যেন একটা তৃষাতুর হা-হা-ধ্বনি উঠিয়াছে। কোথাও মানুষ দেখা যায় না। এক দিনেই এক বেলাতেই একটা মানুষের মৃত্যুতেই মানুষ ভয়ে ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়াছে, একটা মানুষও আর পথের উপরে নাই। শুধু বাহির হইয়াছে দেবু ও জগন। তাহারা এখনও ফেরে নাই। যতীনও একবার বাহির হইয়াছিল, অল্পক্ষণ পূর্বে ফিরিয়াছে। সে ফিরিতেই পদ্ম অঝোর-ঝরে কাঁদিয়া বলিল-আমাকে খুন কোরো না তুমি-তোমার পায়ে পড়ি। দোহাই একটু সাবধানে থাক তুমি। যতীন ভাবিয়া পায় না—এই অবোধ মা-মণিকে সে কি বুলিবে? দেবু গিয়াছে উপেনের সৎকারে। সকাল হইতে দেবু যেন একাই একশো হইয়া উঠিয়াছে। এই অর্ধ-শিক্ষিত পল্লী-যুবকটির কর্মক্ষমতা ও পরার্থপরতা দেখিয়া যতীন বিস্মিত হইয়া গিয়াছে। আরও একটা নূতন জিনিস সে দেখিয়াছে। ডাক্তারের অভিনব রূপ। চিকিৎসকের কর্তব্যে তাহার এতটুকু ক্ৰটি নাই। শৈথিল্য নাই। এই মহামারী ক্ষেত্রে নির্ভীক জগন-পরম যত্নের সহিত প্রতিটি জনকে আপনার বিদ্যাবুদ্ধি মত অকাতরে চিকিৎসা করিয়া চলিয়াছে। গ্রামে সে কখনও ফি লয় না; কিন্তু এমন ক্ষেত্রে, কলেরার মত ভয়াবহ মহামারীর সময় ডাক্তারদের উপার্জনের বিশেষ একটা সুযোগ পাইয়াও জগন আপনার প্রথা-রীতি ভাঙে নাই,এটা জগনের লুকাইয়া রাখা একটা আশ্চর্য মহত্ত্বের পরিচয়। মুখে আজ তাহার কর্কশ কথা পর্যন্ত নাই, মিষ্ট ভাষায় সকলকে অভয় দিয়া চলিয়াছে। দেবু ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়াছে। টেলিগ্রাম লইয়া জংশনে গিয়াছে দুর্গা। ইউনিয়ন বোর্ডেও দেবু সংবাদ পাঠাইয়াছে, পাতু সেখানে গিয়াছে। নিজে সে রোগাক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়াছে। যাহারা গ্রাম হইতে সরিয়া যাইতে চাহিয়াছে—তাহাদিগকে সাহায্য করিয়াছে। তারপর উপেন বায়েনের সৎকারের ব্যবস্থা করিতে বসিয়াছে। বায়েনদের মধ্যে এখানে সক্ষম পুরুষ মাত্র তিন জন। তাহাদের এক জন পলাইয়াছে। বাকি দুই জন রাজি থাকিলেও দুই জনে একটা শব লইয়া যাওয়া অসম্ভব কথা। পাশেই বাউরিপাড়ায় অনেক লোক আছে। বটে, কিন্তু বাউরিরা মুচির শব স্পর্শ করিবে না। তবে বাউরিদের মাতব্বর সতীশ তাহার সঙ্গে আছে। শ্মশানের পথও কম নয়, ময়ূরাক্ষীর গর্ভের উপর শ্মশান দূরত্ব দেড় মাইলের উপর। অনেক চিন্তা করিয়া শেষে বেলা এগারটার সময় আপনার গাড়ি গরু আনিয়া, দেবু গাড়িতে করিয়া উপেনের সকারের ব্যবস্থা করিল। সৎকারের ব্যবস্থা করিয়াই তাহার কর্তব্য শেষ হইল না; বাউরিবায়েনদের দায়িত্বজ্ঞান কম হয়ত গ্রামের কাছেই কোথাও ফেলিয়া দিবে আশঙ্কা করিয়া সে শবের সঙ্গে শ্মশান পর্যন্ত যাইতে প্রস্তুত হইল। তা ছাড়া পাতুও তাহার সঙ্গী—মাত্র দুই জনে এই কলেরারোগীর মৃতদেহ লইয়া শ্মশানে যাইতে তাহারা যেন ভয় পাইতেছিল। দেবু তাহা অনুভব করিল। এবং বলিল–ভয় করছে পাতু? শুকমুখে পাতু বলিল–আজ্ঞে? –ভয় করছে নিয়ে যেতে? –করছে একটুকু। ভয়ার্ত শিশুর মতই অপকটে সে স্বীকার করিল। –তবে চল, আমি তোমাদের সঙ্গে যাই। –আপুনি? –হ্যাঁ, আমি। চল যাই। পাতু ও তাহার সঙ্গীর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। পাতু বলিল—আপুনি বাঁধের ওপরটিতে শুধু দাঁড়াবেন তা হলেই হবে। –চল, আমি শ্মশান পর্যন্তই যাব। প্রচণ্ড উত্তাপে উত্তপ্ত বৈশাখী দ্বিপ্রহরে তাহারা গাড়ির উপর শবদেহ চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িল। মাঠ আজ জনশূন্য। রাখালেরা সকলেই প্ৰায় এই বাউরিবায়েনের ছেলে—তাহারা এমন আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছে যে, মাঠে গরু লইয়া আসে নাই। গ্রামের আশপাশেই গরু লইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বৈশাখী দ্বিপ্রহরে এই ধু-ধু করা প্রান্তরে আসিয়া যদি অকস্মাৎ তাহারা রোগাক্রান্ত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে কি হইবে? মাঠে আগুনের মত ধুলায় পড়িয়া তৃষ্ণায় ছটফট করিয়া মরিবে যে! এই আতঙ্কে তাহারা আতঙ্কিত। চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মাঠখানা খাখা করিতেছে। মধ্যে যে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, তাহার আর এক বিন্দুও কোথাও জমিয়া নাই। মাটির রস পর্যন্ত শুকাইয়া গিয়াছে। প্রাচীন কালের বড় বড় সিচের পুকুরগুলি এমনভাবে মজিয়া গিয়াছে, মোহনার বাঁধ এমনভাবে ভাঙিয়া গিয়াছে যে, বিন্দু বিন্দু করিয়া যে জল ভিতরে জমে, তাহাও নিঃশেষে বাহির হইয়া আসে। গ্রামের প্রান্ত হইতে ময়ূরাক্ষী পর্যন্ত কোথাও এক ফোঁটা জল নাই। ঝড়ের মত প্রবল বৈশাখী দ্বিপ্রহরের বাতাসে মাঠের ধুলা উড়িতেছে; তাহাতে যেন আগুনের স্পৰ্শ। ইহারই মধ্যে গাড়িটা ধীর গতিতে চলিয়াছিল। ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ -চাকার দীর্ঘ একটানা একঘেয়ে শব্দ উঠিতেছে। ক্যাঁ-ক্যাঁ– পাতু বলিল—এবার আর আমাদের রক্ষে নাই; কেউ বাঁচবে না পণ্ডিত মশায়। দেবু স্নেহসিক্ত স্বরে অভয় দিয়া বলিল–তুই পাগল পাতু! ভয় কি? –ভয়? পাতু হাসিল, বলিল—একেবারে পয়লা বোশেখ নামুনে ঢুকল গাঁয়ে। তা ছাড়া লোকে বলছে—এবার আমরা চণ্ডীমণ্ডপ ছাইয়ে দিলাম না-বাবা বুড়োশিবের রাগেই হয়ত– দেবুও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। সে দেবধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু বাবা কি এমনই অবিচার করিবেন? নিরপরাধের অপরাধটাই বড় হইবে তাঁহার কাছে? দেবোত্তর সম্পত্তি যাহারা আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছে, তাহাদের তো কিছু হয় নাই? সে দৃঢ়স্বরে বলিলনা পাতু, বাবার কাছে। কোনো অপরাধ তোমাদের হয় নাই। আমি বলছি। পাতু বলিল—তবে ইরকমটা ক্যানে হল পণ্ডিত মশাই? দেবু কলেরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আরম্ভ করিল। উঃ! এই ঠিক দুপুরে স্ত্রীলোক কে এদিকে আসিতেছে? বোধ হয় জংশন হইতে ফিরিতেছে। হ্যাঁ, তাই তো। এ যে দুৰ্গা! দুৰ্গা টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়া ফিরিতেছে। উপেনের শবের সঙ্গে
false
humayun_ahmed
বাড়ির অবস্থা কি বল। গেলেই দেখবেন। সে তো দেখবই। বলতে অসুবিধা আছে? তোর ছোট চাচা কি মেয়েটাকে বাড়িতে এনে তুলেছে? হ্যাঁ। বলিস কী। ছোট চাচী অর্থাৎ এক্স ছোট চাচী কোর্টে কেইস করে দিয়েছেন, মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন, সম্মানহানি এইসব কী যেন। ভালো ভালো উকিলও দেয়া হয়েছে। আমাদের অবস্থা কেরোসিন বলতে পারেন। ক্ৰমাগত কোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। চাচী এতবড় খবর শোনার পরও কোন শব্দ করলেন না। পেছনে ফিরে দেখি, তিনি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছেন। আমি নিশ্চিন্ত মনে একটা সিগারেট ধরালাম। গাড়ি বড় বড় কয়েকটা ঝাঁকুনি খেল। চাচীর ঘুমের তাতে উনিশ বিশ হল না। মোটা মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগে না। শরীরের মতো এদের ঘুমও ভারী হয়। বড় চাচীকে নিয়ে আমি পৌঁছলাম খুব খারাপ সময়ে। ঐ সন্ন্যাসী ব্যাটা ভোলাবাবু তখনই কী জন্যে যেন এসেছে, বড় চাচা গলা ফুলিয়ে তাকিয়ে তাকে ধমকাচ্ছেন। সন্ন্যাসী তার সন্ন্যাসীসুলভ নিৰ্লিপ্ততায় ঐসব ধমক হাসিমুখে সহ্য করছে। বড় চাচা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলছেন, ইউ আর এ ফ্ৰড নাম্বার ওয়ান। এ থিফ। খবদার, এখানে আর আসবি না। সন্যাসী বলছে, রাগারাগি করাটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে মঙ্গলজনক হবে না। তাছাড়া তুই-তোকারি ভালো শুনাচ্ছে না, সবার মুখে তো সবকিছু মানায় না। বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। যাচ্ছি, আপনি দয়া করে এত উত্তেজিত হবেন না। আবার কথা বলে। আপনি বলেন বলেই বলি। আপনি না বললে বলতাম না। ধ্বনি হলেই প্ৰতিধ্বনি হয়। খবৰ্দার ব্যাটা, বড় বড় কথা বলবি না। বড় বড় কথা তোরচে আমি বেশি বলতে পারি। সে তো খুবই আনন্দের কথা। আপনি বলুন, আমি শুনি। তোকে ধরে একটা আছাড় দেব ব্যাটা ফ্ৰড। আপনার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না। আমার ওজন অনেক। চুপ! চুপ। আপনি চুপ করলেই চুপ করব। আমি আগেই বলেছি ধ্বনি হলেই প্রতিধ্বনি হবে। চুপ! চুপ। কথোপকথনের পুরো অংশটি আমরা বসার ঘরে ঢোকার আগে আগে শুনলাম, চাচী হতভম্ব গলায় বললেন, তোর চাচা কার সঙ্গে এরকম চেঁচামেচি করছে? লোকটা কে? লোকটা এক জন সন্ন্যাসী-নাম ভোলাবাবু। তোর চাচা সন্ন্যাসী নিয়ে কী করছে? হচ্ছে কী এসব? আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। চাচী চোখে-মুখে হতভম্ব ভাব নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন এবং বড় চাচাকে বললেন, এই, তুমি চেচা কেন? বড় চাচা গলা আরো চড়িয়ে বললেন, তুমি ভেতরে যাও। চাচী আরো হকচকিয়ে গেলেন। তিনি আহত গলায় বললেন, তুমি ঝগড়া করছ কেন? চাচা থমথমে গলায় বললেন, ভূত দেখাবার নাম করে ব্যাটা সারারাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। এখন বড় বড় কথা বলে। আমি এত সহজে ছাড়ার লোক না। স্ক্র কী ভাবে টাইট দিতে হয়, আমি জানি। আমাকে ব্লাফ দেয়, কত বড় সাহস! চাচী বললেন, ভূত দেখাবার কথা তুমি কী বলছ? ভূত দেখা মানে? ভূত দেখা যায় না কি? কি মুশকিল। ভেতরে যেতে বললাম না? কানে শুনতে পাও না! চাচী আহত এবং অপমানিত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। অন্যবারের মতো এবার আর তাঁকে দেখে কেউ ছুটে এল না। মীরা-ইরা এসে জড়িয়ে ধরল না। চাচী বললেন, বাসায় কেউ নাই নাকি? আমি বললাম, থাকার তো কথা। সবাই বোধহয় দোতলায় আছে। চলুন দোতলায় চলে যাই। আমি এখন সিঁড়ি ভাঙতে পারব না। তুই সবাইকে ডেকে আন। আর তোর বড় চাচাকেও আসতে বল….। চাচীর কথা শেষ হবার আগেই সিঁড়ি দিয়ে সমিতাকে নামতে দেখা গেল। তার পিছু পিছু নামলেন ছোট চাচা। তিনি সিঁড়ি থেকে বললেন, ভাবী, ভালো আছেন? খুব একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি, পরে আপনার সাথে কথা বলব। চাচী অবাক হয়ে সমিতার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা চলে যাবার পর তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, এই কি সেই মেয়ে? হ্যাঁ। কদিন হল এ বাড়িতে আছে? দিন সাতেক। লজ্জা-শরম দেখি মেয়েটার একেবারেই নেই। এই বাড়িতে এসে উঠল? স্বামীর বাড়িতে উঠতে অসুবিধা কি? স্বামীর বাড়িতে উঠতে লজ্জা নেই। স্বামীর বাড়ি? স্বামীর বাড়ি মানে? বিয়ে হয়েছে নাকি? বিয়ের কথা তো কেউ কিছু লিখে নি। অনেক কিছুই কেউ আপনাকে জানায় নি। এখন জানবেন। আমি দোতলায় লোকজনের খোঁজে গেলাম। কাউকে পেলাম না। মীরা গেছে তার কোন ক্লাসফ্লেন্ডের কাছ থেকে নোট আনতে। ইরা গেছে তার সঙ্গে। বড় চাচীর মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কাঁদে কাঁদো গলায় বললেন, সবাই জানে আজ আমি আসছি। তারপরও কেউ বাসায় নেই। এ বাড়িতে হচ্ছে কী? আমি সহজ স্বরে বললাম, অনেক দিন আপনি এ বাড়িতে থাকেন না, কাজেই এ বাড়ির নিয়ম-কানুন এখন কী তা জানেন না। জানলে এত অবাক হতেন না। হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমি চা দিতে বলি। আগে তুই তোর বড় চাচাকে ডেকে আন। এক্ষুনি আন। বলবি খুব জরুরি। তাঁকে পাওয়া গেল না। জানা গেল সন্ন্যাসী ভোলাবাবুর সঙ্গে বের হয়ে গেছেন। এতদিন পর স্ত্রী বাইরে থেকে ফিরেছে অথচ তিনি একটা মুখের কথা বলার জন্যেও ভেতরে আসেন নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সত্যি সত্যি বড় চাচীর চোখে পানি এসে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, তোরা সব ইচ্ছে করে আমাকে অপমান করছিস, তাই না? কী কী করবি সব আগে থেকে ঠিক করা। যুক্তি করে মীরাইরা বাইরে চলে গেছে। একটা লোককে সন্ন্যাসী সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছিস যাতে আমি ঘরে ঢোকামাত্র তোরা একটা ঝগড়া শুরু করতে পারিস। তার চাচাও আমার সঙ্গে কথা
false
MZI
কোটি বছর আপুকুর একটি আশ্চর্য জিনিস পেয়েছিলেন আমাকে পেয়েছিলেন। এই টাইম মেশিনে বসে আছি, অবশ্যি বিধ্বস্ত অবস্থায়। মানে? হ্যাঁ, আমার কপোট্রন বিশ্লেষণ করে দেখা গেল। আমি কতকগুলি এককোষী প্রাণী নিয়ে গিয়েছিলাম। কেন? পৃথিবীতে প্ৰাণ সৃষ্টি করতে। পৃথিবী সৃষ্টির পরে এখানে প্রাণের জন্ম সম্বন্ধে আপনারা যা ভাবছেন, তা সত্যি নয়। মহাকাশ থেকে জটিল জৈবিক অণু থেকে নয়, মাটি পানির ক্রমাগত ঘর্ষণে স্বাভাবিক উপায়ে নয়, ঈশ্বরের কৃপাতেও নয়, আমিই অতীত প্ৰাণ নিয়ে গিয়েছি। শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, প্ৰাণ নিয়ে যাচ্ছি। মানে? আপনি বলতে চান সুদূর অতীতে এই এককোষী প্রাণী ছড়িয়ে দিলে পরেই প্রাণের জন্ম হবে, ক্রমবিবর্তনে গাছপালা, ডাইনোসর, বাঘ-ভালুক, মানুষ এসবের জন্ম হবে না? ঠিক ধরেছেন। কিন্তু যদি আপনি ব্যর্থ হন? আমি কঠোর গলায় বললাম, যদি আপনি অতীতে এককোষী প্ৰাণী নিয়ে প্রাণের সৃষ্টি করতে না পারেন তাহলে কি এই জীবন, সভ্যতা কিছুই সৃষ্টি হবে না? ব্যৰ্থ হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু আমাকে কয়েক শত কোটি বছর আগে পাওয়া গেছে, কাজেই আমি ব্যর্থ হলেও আমার অন্য কোনো অস্তিত্ব নিশ্চয়ই অতীতে প্ৰাণ রেখে আসবে। তবে তার প্রয়োজন হবে না। আমার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি পুরো অতীত পর্যবেক্ষণ করে দেখছি। কিন্তু তবু যদি আপনি ব্যর্থ হন? বললাম তো হব না। আমি আমার পুরো যাত্রাপথ ছকে এসেছি। কিন্তু যদি তবুও কোনোভাবে ব্যর্থ হন? আমি একগুয়ের মতো বললাম, কোনো দুৰ্ঘটনায় যদি আপনার মৃত্যু হয়? কিংবা আপনার টাইম মেশিন যদি ধ্বংস হয়? তা হলে বুঝতে হবে আমি অন্য এক জগতে ভুলে নেমে পড়েছি। সেটির ভবিষ্যৎ কি? কে বলতে পারে। তবে-রবোটটি মনে মনে কী হিসেবে করল, তারপর বলল, যদি আমি কোনো জগতে নামার দরুন অতীতে ফিরে যেতে ব্যর্থ হই, তবে সেজগতের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ, এখনও মানুষ খুঁকঠুক করে জ্ঞানসাধনা করছে। রবোটটি হা-হা করে হাসল, বলল, হয়তো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে একেবারে গোড়া থেকে সভ্যতা সৃষ্টি করছে। রবোটটি আবার দুলে দুলে হেসে উঠল। মানুষের প্রতি এর অবজ্ঞা প্রায় নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কিন্তু সে নিজে এটি বুঝতে পারছে না। আমি অনেক কষ্ট করে শান্ত থাকলাম। তারপর মৃদুস্বরে বললাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আরো আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, রবোটটি বলল, কিন্তু এই টাইম মেশিনটি একটু পরে নিজে থেকে চালু হয়ে উঠবে। আর সময় নেই। এক সেকেণ্ড। আমার টোপনের কথা মনে হল। বললাম, আমার ছেলে ভবিষ্যতের অধিবাসী দেখতে ভীষণ আগ্রহী। শুর আগ্রহেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে-ওকে একটু ডেকে আনি। বেশ, বেশ। তবে একটু তাড়াতাড়ি করুন। বুঝতেই পারছেন– আমি টোপনের ঘরে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে গেলাম, একটি জিনিস নিতে হবে। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, ড়ুয়ারে ছিল। সেটি শার্টের তলায় গুঁজে টোপনকে ডেকে তুললাম, টোপন, ওঠ, ভবিষ্যতের মানুষ এসেছে। এসেছে বাবা? এসেছে? কেমন দেখতে? দেখলেই বুঝতে পারবি, আয় আমার সাথে। আমি ওকে নিয়ে দ্রুত স্টেশনে হাজির হলাম। রবোটটি সুইচ প্যানেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওটিকে দেখে টোপন অবাক হয়ে বলল, মানুষ কই, এটি তো রবোট! ভবিষ্যতের মানুষ রবোটই হয়! আমি দাঁতে দাঁত চেপে হাসলাম। টোপন বিমর্ষ হয়ে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল, কথা বলার উৎসাহ পেল না। রবোটটি একটু অপ্ৰস্তুত হল মনে হল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এবারে বিদায় নিই, আমি অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। বেশ। আমি হাত নাড়লাম, আবার দেখা হবে। রবোটটি তার টাইম মেশিনের দরজায় উঠে দাঁড়াল। বিদায় নিয়ে হাত নেড়ে ওটি ঘুরে দাঁড়াল। টোপন—আমি চিবিয়ে কললাম, চোখ বন্ধ করা। না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবি না। কেন বাবা? কাজ আছে, বন্ধ করা চোখ। টোপন চোখ বন্ধ করল। আমি শার্টের তলা থেকে একটু আগে নিয়ে আসা রিভলবারটি বের করলাম। রবোটটি শেষ করে দিতে হবে। আমার বংশধরের ভবিষ্যৎ এই রবোটদের পদানত হতে দেয়া যাবে না। এটিকে শেষ করে দিলেই পুরো ভবিষ্যৎ পাল্টে যাবে। রিভলবারটি তুলে ধরলাম। একসময় ভালো হাতের টিপ ছিল। হে মহাকাল, একটিবার সেই টিপ ফিরিয়ে দাও। মনুষ্যত্বের দোহাই, পৃথিবীর দোহাই, একটি ধার হাতের নিশানা ঠিক করে দাও, … একটিবার… আমি রবোটের কপোট্রন লক্ষ্য করে গুলি করলাম, প্রচণ্ড শব্দ হল। টোপন চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আর রবোটটির চূৰ্ণ কপোট্রন টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। খুব ধীরে ধীরে রবোটটি কান্ত হয়ে টাইম মেশিনের ভিতর পড়ে গেল। খানিকক্ষণ থেকেই একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, এবার সেটা তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজের মতো হল। সাৎ করে হঠাৎ দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কানে তালা লাগানো শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল, তারপর কিছু বোঝার আগে ধূসর টাইম মেশিন অদৃশ্য হয়ে গেল। শূন্য জায়গাটা দেখে কে বলবে এখানে কখনো কিছু এসেছিল! চোখ খোল টোপন। টোপন চোখ খুলে চারদিক দেখল। তারপর, আমার দিকে তাকাল, কী হয়েছে। বাবা? কিছু না। রবোট কই? টাইম মেশিন কই? চলে গেছে। আর আসবে না? না। আর আসবে না। যদি আসে মানুষ আসবে। কবে? আজ হোক কাল হোক, আসবেই একদিন। মানুষ না এসে পারে? কপোট্রনিক প্রেরণা ডাক্তার বলেছিলেন রাত দশটার ভেতর যেন শুয়ে পড়ি। প্রতিদিন আমার পক্ষে এত সকাল সকাল শুয়ে পড়া সম্ভব নয়। টেকীওনের উপর দুটো প্ৰবন্ধ শেষ করতে এ সপ্তাহের প্রতি রাতেই ঘুমোতে দেরি হয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে
false
shunil_gongopaddhay
দুজনেই একটা ঝোপের আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোথাও কোনও শব্দ নেই, শুধু দুরের একটা ঝর্নার জলের শব্দ ছাড়া। তবু মনে হচ্ছে যেন খুব কাছাকাছি কেউ দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করছে। সব দিকে এমন ঘুটফুটে অন্ধকার যে, কিছুই দেখা যায় না। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। সন্তুর গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। জলতেষ্টায় মনে হচ্ছে যেন বুকটা ফেটে যাবে। ঘাড়ের কাছে অনবরত কটা মশা কামড়াচ্ছে। একবার সে চটাস করে মশা মারল। কাকাবাবু বললেন, উঁহু! শব্দ করো না। সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি জল খাব। কাকাবাবু বললেন, আমারও জলতেষ্টা পেয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও তো কিছু লাভ নেই। চলো, আমরা আস্তে আস্তে ঝর্নাটার দিকে এগোই। অন্ধকারে কোথায় পা পড়ছে, তা বোঝবার উপায় নেই। সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখে নিতে হচ্ছে সামনে কোনও বড় গাছ আছে কি না। তাও গাছে মাথা ঠুকে গেল। কয়েকবার। কাকাবাবুর ক্রাচটা প্রায়ই জড়িয়ে যাচ্ছে বুনো লতায়, সেগুলো টেনে-টেনে ছিড়তে হচ্ছে। বেশ খানিকটা যাবার পর ঝর্নাটা চোখে পড়ল। এখানে গাছপালা কিছু কম বলে চাঁদের আলো এসে জলে পড়েছে, তাই অন্ধকার এখানে পাতলা। বনটি বেশ চওড়া, জলে স্রোত আছে। এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে বিচ্ছিরি লাগছিল, তাই সন্তু দৌড়ে চলে গেল ঝর্নাটার কাছে। ঝর্নার ধারে বালি ছড়ানো, বেশ ঝকঝকে, পরিষ্কার। সন্তু জলের মধ্যে এক পা দিয়েই আবার উঠে এল তাড়াতাড়ি। এত জোর স্রোত যে, তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। সে উবু হয়ে মাথাটা কুঁকিয়ে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল খানিকটা। জলটা ঠাণ্ডা নয়, একটু-একটু গরম, আর স্বাদটাও কষা-কষা। তবু পেট ভরে জল খেয়ে নিল সন্তু। সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। এতক্ষণ খিদের কথা মনেই পড়েনি। কাকাবাবু ঝর্নার ধারে বসতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। জলের মধ্যে গিয়ে পড়ার আগেই সন্তু তাঁর পিঠের জামা টেনে ধরল। তাতে কাকাবাবু নিজেকে সামলে নিতে পারলেন বটে, কিন্তু একটা সাঙ্ঘাতিক বিপদ ঘটে গেল। হুমড়ি খাবার সময় কাকাবাবুর ডান হাতের ক্রাচটা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল জলে, আর অমনি স্রোতে সেটা ভেসে গেল। সন্তু বনের ধার দিয়ে খানিকটা দৌড়ে গেল তবু সেটাকে ধরতে পারল না, একটু পরেই একটা দপ্ত বড় পাথর, সেটা ডিঙানো যায় না। ডান পাশ দিয়ে ঘুরে যখন আবার ঝর্নাটার কাছে এল, তখন ক্রাচটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সন্তু ফিরে আসতেই কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, পেলি না? না। কাকাবাবু হতাশভাবে বললেন, যাঃ, কী হবে এখন? ক্রাচ ছাড়া কাকাবাবু এক পাও চলতে পারেন না। বাঁ হাতেরটা রয়েছে বটে, কিন্তু একটা নিয়ে হাঁটতে গেলে একটু বাদেই বগলে দারুণ ব্যথা হয়ে যায়। এমনিতেই বিপদে পড়লে কাকাবাবু দৌড়তে পারেন না, এরপর যদি হাঁটতেও না পারেন, তাহলে কী হবে? কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর আজিলা ভরে খানিকটা জল নিয়ে এলেন মুখের কাছে। প্রথমে একটু জিভ ঠেকিয়ে স্বাদ নিলেন, তারপর বললেন, এটা একটা হট ওয়াটার স্ক্রিপ্রং। কাছাকাছি কোনও জায়গায় পাহাড় ফুড়ে বেরিয়েছে। জলে অনেকটা গন্ধক আর লোহা মেশানো আছে। তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি হবে না, এ-জল খাওয়া যায়। সন্তুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন কাকাবাবু। তারপর সন্তুর কাঁধে ভর দিয়েই এগোতে লাগলেন ঝর্নার ধার দিয়ে। একটু পরে বললেন, কোনও গাছের ডাল ভেঙে একটা লাঠি বানিয়ে নিতে হবে অন্তত। সন্তু বলল, আমি এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। কাছেই একটা গাছের ডাল ধরে সে টান মারল। সেটা কিন্তু ভাঙল না। দারুণ শক্ত। সন্তু ডালটা ধরে ঝুলে পড়ল। সেটা নুয়ে পড়ছে, কিন্তু ভাঙছে না কিছুতেই। কাকাবাবু বললেন, ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। এখানকার বেশির ভাগ গাছই প্যাডোক কিংবা সিলভার উড, খুব ভাল কাঠ হয়। সন্তুর পকেটে একটা ছোট্ট ছুরি আছে। তাতে বেশি মোটা ডাল কাটা যাবে না। তবু সে চেষ্টা করতে গেল, সেই সময় শুনতে পেল একটা অদ্ভুত শব্দ। কেউ যেন খুব জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। অনেকখানি রাস্তা দৌড়ে এলে যে-রকম নিশ্বাস পড়ে। দুজনেই কান খাড়া করে শুনল আওয়াজটা। এক-একবার থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে। খুব কাছেই। শব্দটা লক্ষ করে এগিয়ে যেতেই দেখল একটা লোক শুয়ে আছে মাটিতে। তার দেহটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে, আর মুখটা বেরিয়ে আছে বাইরে। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঝর্নাটার দিকে আর ঐ রকম নিশ্বাস ফেলছে। এর চেহারাও আগের লোকটার মতন, কিন্তু জ্যোৎস্নার আলোয় বোঝা যায়, এর সারা গায়ে রক্ত মাখা। কাকাবাবু বললেন, এর গায়েও গুলি লেগেছে। কিন্তু লোকটা এখনও বেঁচে আছে। ওরা গিয়ে লোকটার কাছে দাঁড়াল। লোকটা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ওদের দিকে, সেই দৃষ্টিতে দারুণ ঘৃণা। কাকাবাবু বললেন, আহা রে, লোকটা গড়িয়ে গড়িয়ে এতটা এসেছে। জল খাবার জন্য। আর এগোতে পারেনি। সন্তু, ওকে একটু জল এনে দাও তো! সন্তু আজিলা করে খানিকটা জল নিয়ে এসে লোকটার মুখের ওপর ঢেলে দিল। লোকটা হাঁ করে আছে। যেটুকু জল মুখের বাইরে পড়েছে, তা জিভ দিয়ে চোটে নিচ্ছে। সন্তু তিন-চারবার ওকে জল এনে এনে দিল। কাকাবাবু ততক্ষণে লোকটার পাশে বসে পড়েছেন। লোকটার পেটে আর কাঁধে আর পায়ে তিনটে গুলি লেগেছে। এর মধ্যে পেটের জখমটাই সাঙ্ঘাতিক। কাকাবাবু বললেন, এখনও চেষ্টা করলে লোকটাকে বাঁচানো যায়। তিনি পকেট থেকে রুমাল বার করে তুলোর মতন পেটের ক্ষতটাতে গুঁজে দিলেন। তারপর দু পায়ের মোজা খুলে ফেলে সেগুলো ছিঁড়ে গিঁট বেঁধে সন্তু পাশে বসে আছে। হঠাৎ
false
shirshendu
লীনা। আর যাই হোক, এদের হাতে নোকটাকে মরতে দেওয়া যায় না। লীনা মাথা নেড়ে বলল, বলব না। মিস লীনা, তুমি ববি রায়ের প্রেমে পড়োনি তো? তোমাকে দেখে তত বোকা কিন্তু মনে হয় না। আবার ঝাঁ ঝা করে উঠল লীনার নাক মুখ কান। রক্তোচ্ছাসে ভেসে যেতে লাগল শরীর। সে চোখ বুজল। দাঁতে দাঁত চাপল। তারপর বলল, না। তা হলে ববির প্রতি তুমি এত দুর্বল কেন? আমি তো তোমাকে বলেছি যে, ববি একজন চোর, গুন্ডা, তার কোনও নীতিবোধ নেই, সে হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে পারে। লীনা মাথা নেড়ে বলল, জানি না কেন। তবে বলব না। মিস লীনা, আমি অকারণে কঠোর হতে চাই না। আমরা মরিয়া মানুষ, তোমার সাহায্য চাইছি। লীনা লোকটার দিকে তাকাল। দার্শনিকের মতো ভাবাল ও সুন্দর মুখশ্রী-বিশিষ্ট এই বিদেশিকে তার খারাপ লাগছিল না। ভদ্র, নম্র কণ্ঠস্বর, চোখের চাউনিতে কিছু ধূসরতা। কিন্তু এটাও ওর সত্য। পরিচয় নয়। ছদ্ম-দার্শনিকতার অভ্যন্তরে কোনো রয়েছে ভাড়াটে সৈন্যের উদাসীন হননেচ্ছা। মানুষ মারা বা মশা মারার মধ্যে কোনও তফাত নেই এর কাছে। লীনা মাথা নেড়ে বলল, না। মিস লীনা বিশ্বাস করো, আমাদের হাতে সত্যিই সময় নেই। আমি বলব না। মিস লীনা, আর একবার ভাবো। না, না, না— তা হলে দুঃখের সঙ্গে তোমাকে কিন্তু পশুর হাতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তারা পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছে। নারীমাংসলোভী, কামুক, বর্বর। লীনা আপাদমস্তক শিউরে উঠে বলল, না— উপায় নেই মিস লীনা। মুখ তোমাকে খুলতেই হবে। লোকটা একটা বেল টিপল। আর মুহূর্তের মধ্যে সেই লাল গেঞ্জি পরা লোকটা এসে লীনার পাশে দাঁড়াল। তারপর লীনা কিছু বুঝে উঠবার আগেই তাকে একটা ডল পুতুলের মতো তুলে নিল দু’হাতে। লীনা আর্ত চিৎকার করল বটে কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। এরকম প্রকাণ্ড মানুষ সে জীবনেও দেখেনি। কোনও মানুষের শরীরে যে এরকম সাংঘাতিক জোর থাকতে পারে তাও সে কখনও কল্পনা করেনি। লোকটা তাকে একটা ঘরে এনে ছেড়ে দিল। ঘরের মাঝখানে মেঝের ওপর একটা মাট পাতা। ছ’জন দানবীয় চেহারার লোক শুধুমাত্র খাটো প্যান্ট পরে অপেক্ষা করছে ছ’টা টিনের চেয়ারে। লোকটা লীনাকে কিছু বুঝতেই দিল না। চোখের পলকে তার কামিজ ছিঁড়ে ফেলল কাগজের মতো, ছিঁড়ে ফেলে দিল চুড়িদারের পায়জামা। শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরা লীনা উন্মাদের দৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে দেখল। কী হবে? আমার কী হবে? কী করবে এরা? ছ’টা লোক উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। লাল গেঞ্জিওয়ালা লোকটা লীনার কানের কাছে শাস ফেলে বলল, আমি হোমোসেক্সয়াল না হলে… পিঠে একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল লীনা। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু তার আগেই একটা প্রকাণ্ড হাঁটু চেপে বসল তার কোমরে। একটা হ্যাঁচকা টানে উড়ে গেল ব্রা। লীনা চেঁচিয়ে উঠল, বলছি! বলছি! প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দাও। হয়তো তবু ছাড়ত না। এদের মনুষ্যত্ব বলে কিছু তো নেই। কিন্তু ঠিক এই সময়ে দার্শনিক লোকটা এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। একটা হাত ওপরে তুলে বলল, ড্রেস হার। লোকগুলো কলের পুতুলের মতো সরে গেল আবার। ছেঁড়া পোশাকটাই কুড়িয়ে নিল লীনা। দু’চোখে অবিরল অশ্রু বিসর্জন করতে করতে, ফুঁসতে ফুঁসতে সে পোশাক পরল। চলো, মিস লীনা। সময় নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রকাণ্ড পন্টিয়াকটা লীনার নির্দেশমতো ছুটতে শুরু করল। উন্মাদের মতো গতিবেগ। লীনার দু’ধারে এবার দুজন। সেই দার্শনিক আর লাল গেঞ্জি। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে সেই দু’জন, যারা তাকে ধরে এনেছে। বোম্বে রোড ধরে কতটা যেতে হবে তা কম্পিউটারের বাণী উদ্ধৃত করে বলে গেল লীনা। পাকা ড্রাইভার সুনির্দিষ্ট একটা জায়গায় এসে বাঁ ধারে একটা ভাঙা রাস্তায় ঢুকে পড়ল। চারদিকে গাছপালা, লোকালয়হীন পোভড়া জায়গা। দার্শনিক খুনি হঠাৎ বলে উঠল, ওই তো! সামনে একটা বাগানঘেরা বাড়ি। চারদিকে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপর বৈদ্যুতিক তারের বেড়া। ফটকে অটো-লক। গাড়ি ফটকের সামনে থামতে দার্শনিক লোকটা নামল। ফটকটা দেখে নিয়ে একটু চিন্তিত মুখে গাড়িতে ফিরে এসে তার সঙ্গীদের উদ্দেশে অতিশয় দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু নির্দেশ দিল। লাল গেঞ্জি নেমে লাগেজ বুট খুলে একটা অ্যাটাচি কেস বের করে আনল। লীনা গাড়িতে বসেই দেখল, দার্শনিক লোকটা অ্যাটাচি খুলে ছোটখাটো নানা যন্ত্রপাতি বের করে ফটকের ওপর কী একটু কারসাজি করল। একটু বাদেই ফটক খুলে গেল হাঁ হয়ে। খুব ধীরে ধীরে গাড়িটা ঢুকে পড়ল বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে। ফটকটা আবার বন্ধ হয়ে গেল ধীরে ধীরে। তারপর যা ঘটল তা সাধারণত মিলিটারি অপারেশনেই দেখা যায়। অত্যন্ত তৎপর লোকগুলো চটপট কয়েকটা সাব-মেশিনগান নিয়ে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল প্রস্তুত হয়ে। দার্শনিক লোকটা গাড়ির দরজা খুলে বলল, এসো মিস লীনা। মানসিক বিপর্যয়টা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি লীনা। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। এই নারীজন্মকে সে ধিক্কার দিচ্ছিল মনে মনে। সে মরতে ভয় পেত না, কিন্তু যে শাস্তি তাকে দিতে চেয়েছিল তা যে মৃত্যুরও অধিক। শুধু মেয়ে বলেই এরা তাকে এভাবে ভেঙে ফেলতে পারল। নইলে পারত না। লীনা টলমলে পায়ে নামল। চারদিকে পরিষ্কার রোদ। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। শান্ত, নির্জন, নিরীহ পরিবেশ। কিন্তু একটু বাদেই এখানে ঘটবে রক্তপাত, বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে বারুদের গন্ধ.. বাড়ির সদর দরজাটাই বিচিত্র। একটি ইস্পাতের মোটা পাত আর তার গায়ে একটা স্লট। কয়েকটা অত্যন্ত খুদে আলপিনের মাথার মতো বোতাম রয়েছে স্লটের নীচে। মিস লীনা, এটা একটা ইলেকট্রনিক
false
humayun_ahmed
থাকল। আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে খুব সহ গলায় বললাম, এষা, মোরশেদ সাহেব এসেছেন। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ্নে। তোমার সঙ্গে একটা কথা বলেই চলে যাবেন। এষা ভূত দেখার মতো চমকে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, ভদ্রলোককে কী চলে যেতে বলব? ভেতরে এসে বসতে বলেছিলাম, উনি রাজি হলেন না। এষা কঠিন গলায় বলল, আপনি দয়া করে বসার ঘরে বসুন। আপনি হুট করে ঘরে ঢুকে গেলেন কী মনে করে? আমি নিতান্তই স্বাভাবিক গলায় বললাম, ভদ্রলোককে কি বসতে বলব? ‘তাঁকে যা বলার আমি বলব। প্লীজ, আপনি বসার ঘরে যান। আশ্চর্য, আপনি কী মনে করে ভেতরে চলে এলেন?’ আমি এষাকে হতচকিত অবস্থায় রেখে চলে এলাম। ভদ্রলোক বাইরে।সিগারেট ধরিয়েছেন। আমাকে দেখে আস্ত সিগারেট ফেলে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন।আমি বললাম, ভেতরে গিয়ে বসুন, এষা আসছে। ‘আমাকে বসতে বলেছে?’ ‘তা বলেনি, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি ভেতরে গিয়ে বসলে খুব রাগ করবে না।’ ‘আমি বরং এখানেই থাকি?’ ‘আচ্ছা, থাকুন।’ আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তায় চলে এলাম। আপাতত রাস্তার দোকানগুলির কোন-একটিতে বসে চা খাব। ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের সঙ্গে এষার কথাবার্তা শেষ হবে—আমি আবার ফিরে যাব। ফিরে নাও যেতে পারি। এই জগৎ সংসারে আগেভাগে কিছুই বলা যায় না। শীতের রাতে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবার অন্যরকম আনন্দ আছে। চা খেতে-খেতে মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের তারা দেখতে হয়। সারা শরীরে লাগবে কনকনে শীতের হাওয়া, হাতে থাকবে চায়ের কাপ। দৃষ্টি আকাশের তারার দিকে।তারাগুলিকে তখন মনে হবে সাদা বরফের ছোট-ছোট খণ্ড। হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। পরপর দু’কাপ চা খেয়ে তৃতীয় কাপের অর্ডার দিয়েছি, তখন দেখি মোরশেদ সাহেব হনহন করে ‍যাচ্ছেন। মাটির দিকে তাকিয়ে এত দ্রুত আমি কাউকে হাঁটতে দেখিনি। আমি ডাকলাম—এই যে ভাই মোরশেদ সাহেব! ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন। খুবই অবাক হয়ে তাকালেন। নিতান্তই অপরিচিত কেউ নাম ধরে ডাকলে আমরা যেরকম অবাক হই—সেরকম অবাক। ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পারছেন না। আশ্চর্য আত্মভোলা মানুষ তো! আমি বললাম, চা খাবেন মোরশেদ সাহেব? ‘আমাকে বলছেন?’ ‘হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?’ ‘জ্বি-না।’ ‘একটু আগেই দেখা হয়েছে।’ ভদ্রলোক আরো বিস্মিত হলেন। আমি বললাম, এখন কি চিনতে পেরেছেন? তিনি মাথা নেড়ে বললেন, জ্বি জ্বি। মাথা নাড়ার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছি তিনি মোটেই চেনেননি। আমি বললাম—এষার সঙ্গে কথা হয়েছে? ‘জ্বি, হয়েছে। এখন আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি এষার ছোটমামা। এষাকে ডেকে দিয়েছেন।’ ‘আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। আমি অবশ্যি এষার ছোটমামা না। সেটা কোনো বড় কথা না। এষা আপনার সঙ্গে কথা বলেছে। এটাই বড় কথা।’ ‘এষা কথা বলেনি।’ ‘কথা বলেনি?’ ‘জ্বি-না। আমাকে দেখে প্রচণ্ড রাগ করল। আপনি তো জানেন ও রাগ করলে কেঁদে ফেলে—কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, বের হয়ে যাও।এক্ষুণি বের হও। আমি চলে এসেছি।’ ‘ভাল করেছেন। আসুন চা খাওয়া যাক।’ ‘আমি চা খাই না। চা খেলে রাতে ঘুম হয় না।’ ‘তা হলে চা না খাওয়াই ভাল। এষা আপনার কে হয়?’ ‘ও আমার স্ত্রী।’ ‘আমি তাই আন্দাজ করছিলাম। চলুন যাওয়া যাক।’ ‘চলুন।’ বড় রাস্তায় ‍গিয়ে ভদ্রলোক রিকসা ‍নিলেন। খিলগাঁ যাবেন। রিকসাওয়ালাকে বললেন, ১৩২ নম্বর খিলগাঁ, একতলা বাড়ি। সামনে একটা বড় আমগাছ আছে। রিকসাওয়ালাকে এইভাবে বাড়ির ঠিকানা দিতে আমি কখনো শুনিনি। তিনি রিকসায় উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছোটমামা, আপনি কোনদিকে যাবেন? আসুন আপনাকে নামিয়ে দি। আমি এষার ছোট মামা নই। কিন্তু মনে হচ্ছে ভদ্রলোককে এইসব বলা অর্থহীন। তাঁর মাথায় ছোটমামার কাঁটা ঢুকে গেছে। সেই কাঁটা দূর করা এত সহজে সম্ভব না। আমি বললাম, মোরশেদ সাহেব আমি উল্টোদিকে যাব। ‘আপনি এষাকে একটু বলবেন যে আমি সরি। একটা ভুল হয়ে গেছে।এরকম ভুল আর হবে না।’ ‘যদি দেখা হয় বলব। অবশ্যই বলব।’ ‘যাই ছোটমামা?’ ‘আচ্ছা, আবার দেখা হবে।’ আমি উল্টোদিকে হাঁটা ধরলাম। এষাদের বাড়িতে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। কি করব এখনো ঠিক করিনি। ঘণ্টাখানিক রাস্তায় হেঁটে মেসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। রাতের খাওয়া এখনো হয়নি—কোথায় খাওয়া যায়? ‍কুড়ি টাকার একটা নোট পকেটে আছে।অনেক টাকা। কুড়ি কাপ চা পাওয়া যাবে। একজন ভিখিরির দু’দিনের রোজগার। ঢাকা শহরে ভিখিরিদের গড় রোজগার দশ টাকা। এই তথ্য ইয়াদের কাছ থেকে পাওয়া।সে হল আমার বোকা বন্ধুদের একজন। ইয়াদের অঢেল টাকা। টাকা বোকা মানুষকেও বুদ্ধিমান বানিয়ে দেয়। ইয়াদকে বুদ্ধিমান বানাতে পারেনি।ইয়াদদের পরিবারের যতই টাকা হচ্ছে, সে ততই বোকা হচ্ছে। ইয়াদ ভিখিরিদের উপর গবেষণা করছে। তার পিএইচি.ডি. ডি থিসিসের বিষয় হল‘ভাসমান জনগোষ্ঠীঃ আর্থ-সামাজিক নিরীক্ষার আলোকে’।ইয়াদকে অনেক ডাটা কালেক্ট করতে হচ্ছে। আমি তাকে সাহায্য করছি। সাহায্য করার মানে হল—তার একটা বিশাল পেটমোটা কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। তার কালো ব্যাগে পাওয়া যাবে না এমন জিনিস নেই। কাগজপত্র ছাড়াও ছোট একটা টাইপ রাইটার। বোতলে ভর্তি চিড়া-গুড়। ইনসটেন্ট কফি, চিনি, ফার্স্ট এইডের জিনিসপত্র। একগাদা লম্বা নাইলনের দড়িও আছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—দড়ি কি জন্যে রে ইয়াদ? সে মুখ শুকনো করে বলেছে—কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না। রেখে দিলাম। ভাল করিনি? ভাল করিনি—বলাটা ইয়াদের মুদ্রাদোষ! কিছু বলেই খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলবে—ভাল করিনি?’ রাত একটার দিকে মজনুর দোকানে ভাত খেতে গেলাম। ভাতের হোটেলের সাধারণত কোনো নাম থাকে না। এটার নাম আছে। নাম হল—‘‘মজনু মিয়ার ভাত মাছের হোটেল।’’ বিরাট
false
shirshendu
একটু কাঁপছিল। বাড়িটা এত ফাঁকা, এত ধু ধু ফাঁকা যে লীনার কাপ ডিশ ছুড়ে ভাঙতে ইচ্ছে করে। বেসিনে গিয়ে সে দু’হাত ভরে জল নিয়ে চোখে মুখে প্রবল ঝটকা দিচ্ছিল। মাথাটা ভোম হয়ে আছে, কান জ্বালা করছে, মনটা কাঁদো কাঁদো করছে। কোনও মানে হয় এর? লোকটা যে বিটকেল রকমের পাগল তাতে সন্দেহ আছে কোনও? লীনাকে ভয়-টয় খাইয়ে একটা ম্যাসকুলিন আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে না তো? না কি প্র্যাকটিক্যাল জোক? রঙ্গ-রসিকতার ধারে কাছে বাস করে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ববি রায় যে একটু চন্দ্রাহত তাতে সন্দেহ নেই। লীনাদের বাড়িটা দোতলা। গোটা আষ্টেক ঘর। একটু বাগান আছে। এ বাড়িতে প্রাণী বলতে তারা এখন তিনজন। মা, বাবা আর লীনা। দুপুরে কেউ বাড়ি থাকে না। শুধু রাখাল আর বৈষ্ণবী। তারাই কেয়ারটেকার, তারাই ঝি চাকর, রাঁধুনি। বয়স্কা স্বামী-স্ত্রী, নিঃসন্তান। একতলার পিছন দিকের একখানা ঘরে তারা নিঃশব্দে থাকে। ডাকলে আসে, নইলে আসে না। নিয়ম করে দেওয়া আছে। শরৎ শেষ হয়ে এল। দুপুরেও আজকাল গরম নেই। রাত্রে একটু শীত পড়ে আর উত্তর দিক থেকে হাওয়া দেয়। লীনা মস্ত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল, ঘাড় মুছল। ঠান্ডা জলের প্রতিক্রিয়ায় গা একটু শিরশির করছে। ঘড়িতে পৌনে চারটে। পাঁচটার সময় ববি রায়ের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। থিয়েটার শুরু হবে সাড়ে ছ’টায়। দেড় ঘণ্টা সময় হাতে থাকছে। তা হলে পাগলা ববি কেন তাকে থিয়েটার বাদ দিতে বলছে? কে জানে বাবা, লীনা কিছু বুঝতে পারছে না। দোলন এসে অ্যাকাডেমিতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে তার জন্য। দোলনের ফোন নেই। দোলনকে খবর দেওয়ার কোনও উপায় নেই। সিমলের মোড়ে গদাইয়ের চায়ের দোকানে খবর দিয়ে রাখলে সেই খবর দোলন পায়। কিন্তু এখন সেই সিমলে অবধি ঠ্যাঙাবে কে? একটা গাড়ি থাকলেও না হয় হত। গাড়ি যে নেই এমনও নয়। দু’-দুখানা গাড়ি তাদের। পুরনো অ্যাম্বাসাডারটা তো ছিলই। সম্প্রতি মারুতিটা এসেছে। কিন্তু সে দু’খানা তার মা আর বাবার। দুজনেই জবরদস্ত কাজের লোক। লীনার একদা বিপ্লবী দাদা বিপ্লব করতে না-পেরে টাকা রোজগারে মন দিয়েছিল। ভাল ইঞ্জিনিয়ার সে ছিলই। ব্যাবসা করতে নেমেই টুকটাক নানা যোগাযোগে এত দ্রুত বড়লোক হতে লাগল যে, এ বাড়িতে বাপ আর ছেলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল চাপা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সোরাব-রুস্তম। তারপর দাদা বিয়ে করল, বিশাল বাড়ি হাঁকড়াল এবং বাপ-মা-বোনকে টা-টা গুডবাই করে চলে গেল। দাদার বোধহয় তিন-চারখানা গাড়ি। একদা-বিপ্লবীকে এখন পেয়েছে এক সাংঘাতিক টাকার নেশা। হিংস্র, একবোখা, কাণ্ডজ্ঞানহীন অর্থোপার্জন। সেই ভয়ংকরী আকর্ষণের কাছে দুনিয়ার আর সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন তো দুরের কথা, নিজের বউ-বাচ্চার প্রতিও তার কোনও খেয়াল নেই। বিশাল বিশাল কনস্ট্রাকশনের কাজ নিয়ে কলকাতা থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত পাড়ি দিচ্ছে। দেশ-বিদেশ ঘুরছে পাগলের মতো। বিপ্লবী দাদাকে পাগলের মতো ভালবাসত লীনা, কিন্তু এই দাদাকে সে চেনেই না। দাদার কাছে গাড়ি চাইলেই পাওয়া যাবে। লীনা জানে। কিন্তু চাওয়ার উপায় নেই। বাবা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র করবে। কী করে যে দোলনকে একটা খবর দেওয়া যায়! ট্যাক্সির কোনও ভরসা নেই। আর উত্তর কলকাতায় যা জ্যাম! এখন বেরোলে পাঁচটার মধ্যে ফেরা যাবে কি না সন্দেহ। লীনা এক কাপ চা খেল। তারপর হলঘরের ডিভানে শুয়ে একখানা ইংরিজি থ্রিলার পড়ার চেষ্টা করল। হল না। বাড়িটা বড্ড খাঁ খাঁ করছে। যতদিন দাদা ছিল এত ফাঁকা লাগত না। এ বাড়ির লোকেরা শুধু টাকা চেনে। শুধু টাকা। তার বাবারও ওই এক নেশা। দিন রাত টাকা রোজগার করে যাচ্ছে। তারও মস্ত ব্যাবসা কেমিক্যালসের। মা পর্যন্ত বসে নেই। মেয়েদের জন্য একটা এক্সকুসিভ ইংরিজি ম্যাগাজিন বের করেছে। তাই নিয়ে ঘোরর ব্যস্ত। এদের কারও সঙ্গেই সম্পর্ক রচনা করে তুলতে পারেনি লীনা। ছেলেবেলা থেকেই সে এই ব্যস্ত মা বাবার কাছে অবহেলিত। নিজের মনে সে বড় হয়েছে। ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও যে কতখানি শুন্যতা একজনকে ঘিরে থাকতে পারে তা লীনার চেয়ে বেশি আর কে জানে? এমনকী ওই যে ভ্যাগাবন্ড দোলন, সেও এই শূন্যতাকে ভরে দিতে পারে না। গরিবের ছেলে বলে নানা কমপ্লেকস আছে। হয়তো মনে মনে লীনাকে একটু ভয়ও পায়। বেচারা! লীনা চাকরি নিয়েছে টাকার প্রয়োজনে তো নয়। এই আট ঘরের ফাঁকা বাড়ি তাকে হানাবাড়ির মতো তাড়া করে দিন রাত। সকাল-সন্ধে মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয় দেখা না-হওয়ার মতোই। দু’জনেই নিজের চিন্তায় আত্মমগ্ন, বিরক্ত, অ্যালুফ। সামান্য কিছু কথাবার্তা হয় ভদ্রতাবশে। যে যার নিজস্ব বলয়ের মধ্যে বাস করে। লীনা ইচ্ছে করলে বাবার কোম্পানিতে, দাদার কনসার্নে বা মায়ের ম্যাগাজিনে চাকরি করতে পারত। ইচ্ছে করেই করেনি। গোমড়ামুখো মা-বাবার সংশ্রবের চেয়ে অচেনা বস বরং ভাল। কপাল খারাপ। লীনা এমন একজনকে বস হিসেবে পেল, যে শুধু গোমড়ামুখোই নয়, পাগলও। ওয়ার্ডরোব খুলে লীনা ড্রেস পছন্দ করছিল। দেশি, বিদেশি অজস্র পোশাক তার। সে অবশ্য আজকাল তাঁতের শাড়িই বেশি পছন্দ করে। বেছে-গুছে আজ সে জিনস আর কামিজই বেশি পছন্দ করল। সাজতে লীনার বিশেষ সময় লাগে না। মোটামুটি সুন্দরী সে। রূপটান সে মোটেই ব্যবহার করে। মুখে একটু ঘাম-তেল ভাব থাকলে তার মুখশ্রী ভাল ফোটে, এটা সে জানে। পায়ে একজোড়া রবার সোলের সোয়েডের জুতো পরে নিল। গয়না সে কখনওই পরে না, ঘড়ি পরে শুধু। হাতে পনেরো মিনিট সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়বে লীনা। ওল্ড বালিগঞ্জ থেকে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগবে। সে একটু আস্তে হাঁটবে বরং।
false
shirshendu
খেলা করে রোদের বর্ণালি। চিকের ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখেন, শতভাগে ভাগ হয়ে গেছে বাইরের দৃশ্যাবলী। কী চমৎকার! এইসব শব্দ ও দৃশ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব ঘটনা হেমকান্তকে বার বার অবাক করে দেয়। বেঁচে থাকতে আজকাল তার দ্বিগুণ ভাল লাগে কেন? এই আলো ও ছায়া, এইসব অর্থহীন শব্দ, এসব মৃত্যুর পর কি পৌঁছাবে তার কাছে কোনওদিন? কে জানে কেমন সেই চির প্রদোষের জগৎ! কিংবা কে জানে মৃত্যুর পর হয়তো কোনও অস্তিত্বই থাকে না কারও। সে এক স্বপ্নহীন অনস্তিত্বের অন্তহীন ঘুম। কখন নিজের অজান্তে চলে আসেন দোতলার বারান্দা ঘুরে ছেলেমেয়েদের মহলে। এমনিতে আসেন না। স্নেহশীলা দাসী ও বিশ্বাসী যত্নশীল চাকরদের পরিচর্যায় ছেলেমেয়েরা ভালই আছে, তিনি জানেন। নিজের উপস্থিতির গুরুভার কখনও ওদের ওপর চাপিয়ে দিতে তার ইচ্ছে হয় না। একটু চমকে উঠে শোনেন, কৃষ্ণকান্ত বিশাখাকে বলছে, দেখ দিদি, আজ যদি দুপুরে ঘুমোই তো গোরু খাই। গোরুই তো খাস। কালও ঘুমিয়েছিস। টাস্ক করেছিলি মাস্টারমশাইয়ের? কাল? ওঃ, রাত জাগতে হয়েছিল না? তোকে কে রাত জাগতে বলেছে? কে আবার বলবে? তবে জাগিস কেন? মনুপিসি যে বলে শশীদা বাঁচবে না! তাতে তোর কী? আমি সেইজন্যই তো বসে থাকি। কেন বসে থাকিস? কম্পাউন্ডার কাকা বলে, মরার সময় আত্মাটা শরীরের কোন ফুটো দিয়ে বেরোবে তার ঠিক নেই। কারও নাক দিয়ে, কারও কান দিয়ে, কারও মুখ দিয়ে, কারও নাভি দিয়ে, আবার গুহ্যদ্বার দিয়েও বেরোয়। কী অসভ্য রে! ছিঃ ছিঃ ভাই! দাঁড়া, মনুপিসিকে বলব। বাঃ, কম্পাউন্ডার কাকা বলে যে আত্মাটা ধোঁয়ার মতো জিনিস। এক বিঘত লম্বা। সুট করে বেরিয়ে আসে। আমি সেইটে দেখার জন্য বসে থাকি। শশীদার আত্মা কোথা দিয়ে বেরোবে জানিস? আমি জানব কী করে? ব্ৰহ্মরন্ধ্র দিয়ে। মহাপুরুষের আত্মা ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে বেরোয়। তোর শশীদা কি মহাপুরুষ নাকি? শশীদা স্বদেশি না। তাতে কী? স্বদেশিরা তো আর যা তা লোক নয়। ইংরেজ মাবে। শশীদা এক পাদ্রিকে মেরেছে জানিস? বোমা দিয়ে। খুব বীরত্বের কাজ করেছে, না? বাবা শুনলে দেবেখন তোমাকে। স্বদেশিদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে নেই। কৃষ্ণকান্ত একটু যেন অবাক হয়ে বলে, বাবা স্বদেশিদের পছন্দ করে না? একদম না। আমরা ইংরেজদের পক্ষে। তবে বাবা শশীদাকে বাড়িতে থাকতে দিল কেন? মোটেই থাকতে দেয়নি। আটক রেখেছিল। পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে। তবে এখনও দেয়নি কেন? লোকটার অসুখ করল বলে। যদি শশীদা সেরে যায় তা হলে দেবে? নিশ্চয়ই দেবে। দেওয়াই উচিত। কৃষ্ণকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, তা হলে শশীদার মরাই ভাল। হেমকান্ত খুবই অবাক হলেন। তাঁকে ইংরেজের সমর্থক ও স্বদেশিদের বিরোধী বলে কবে চিহ্নিত করা হল এবং কেন, তা তিনি জানেন না। একটু কৌতুক বোধ করলেন তিনি। শশিভূষণকে ধরিয়ে দেবেন বলে আটক রাখা হয়েছে একথাই বা কে রটাল? বিশাখাই বা এসব কথা জানল কোথা থেকে? তিনি তো মেয়েকে এসব প্রসঙ্গে কখনও কিছু বলেননি। স্বদেশিদের প্রতি বিশাখার এই জাতক্রোধের কারণটাও তাঁর অজানা। বরং উলটোটাই হওয়া উচিত ছিল। রঙ্গময়ির শাসনে এবং ছায়ায় ওরা মানুষ। রঙ্গময়ির নিজের একটু স্বদেশিপ্রীতি আছে। কাজেই বিশাখার এরকম উলটো মত হওয়ার কারণ নেই। তবে? অনুচ্চ স্বরে তিনি ডাকলেন, কৃষ্ণ। বিশাখা। ভাইবোনের ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। হেমকান্ত ঘরে ঢুকলেন। কৃষ্ণ ও বিশাখা উঠে দাঁড়ায়। তটস্থ, সন্ত্রস্থ। মুখচোখে বিহ্বল ভাব। হেমকান্তর সামনে ওদের কেন যে এরকম একটা রূপান্তর হয়! তিনি তো শাসন তর্জন করেন না কখনও। দুদিকে দুটি প্রকাণ্ড খাট। জানালা ঘেঁষে মস্ত ডেস্ক। তার ওপর সাজানো বইখাতা, দোয়াতদান ও কলম। একটি বিলিতি মহার্ঘ টেবিল ল্যাম্প। দুই খাটের পাশেই শ্বেতপাথরের তেপায়া। দেয়াল আলমারি, আয়না বসানো বার্মা সেগুনের আলমারি, কাচের বাক্সে সাজানো বিদেশি পুতুল আর খেলনা। দেয়ালে এয়ারগান। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন হেমকান্ত। এ ঘরে তিনি কদাচিৎ আসেন। মেয়ের দিকে একটু সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। লোকচরিত্র অনুধাবনের অভ্যাস তাঁর নেই। মুখশ্রী দেখে চরিত্রের ঠিকানা পাওয়া তার পক্ষে কঠিন। কিন্তু তার মেয়েটি যে ভারী শ্রীময়ি তাতে সন্দেহ নেই। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়। কিন্তু মানুষের মুখশ্রীকে কি বিশ্বাস আছে? তার অন্য মেয়েরাও সুন্দরী। অপাপবিদ্ধ মুখশ্রী। কিন্তু তবু গোপনে মায়ের গয়না সরাতে তো তাদের বাধেনি। বিশাখা যে অন্যরকম হবে তা মনে করার কোনও কারণ নেই। হেমকান্ত মেয়ের দিকে চেয়ে সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, তুমি স্বদেশিদের পছন্দ করো না? বিশাখা খুবই ঘাবড়ে গেছে। কী বলবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ মাথা নত করে নখ দেখতে লাগল। ব্রীড়ার সেই ভঙ্গিটুকুও ভারী অপরূপ। মেয়েকে আর অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে ইচ্ছে হল না তার। মেয়েমাত্রই কিছুটা নির্বোধ, কুচুটে, পরশ্রীকাতর, ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের দোষও নেই। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব গঠনে কোনও চেষ্টাও যে সমাজে নেই। দেশে সম্প্রতি একটা নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেটা ভাল কি মন্দ এবং কাজ কতদূর এগিয়েছে তা হেমকান্ত জানেন না। তবে তার বিশ্বাস স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে কোনও লাভ নেই। তাদের মনের জানালাকপাট খুলে বাইরের উদার মুক্ত আলো-হাওয়ার পথটুকু অবারিত করে দিলেই যথেষ্ট। সি এ টি ক্যাট শেখার চেয়ে থানকুনিপাতার আরোগ্য গুণ জানাটা অনেক বেশি কার্যকরী শিক্ষা। লোকে বলে, এদেশের মেয়েরা ভারী সহনশীলা। কথাটা সত্যি বলে মনে হয় না হেমকান্তর। সহনশীলতা এক অনবদ্য গুণ, তা শিক্ষা করতে হয়। এদেশের মেয়েরা সয়। বটে, কিন্তু সে দায়ে পড়ে। ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের আগুন ফুঁসতে থাকে, আর সে আগুন বেরোবার
false
robindronath
অর্থই নেই। তাই আমার অভিমান ছিল সতীত্বের। সেখানে আমার স্বামীকেও হার মানতে হবে এটা আমার মনে ছিল। কিন্তু যখনই সংসারের কোনো খিটিমিটি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা কইতে গেছি তখনই বারবার এমন ছোটো হয়ে গেছি যে, সে আমাকে মেরেছে। তাই তখন আমি তাঁকেই উলটে ছোটো করতে চেয়েছি। মনে মনে বলেছি, তোমার এ-সব কথাকে ভালো বলে মানব না, এ কেবলমাত্র ভালোমানুষি। এ তো নিজেকে দেওয়া নয়, এ অন্যের কাছে ঠকা। আমার স্বামীর বড়ো ইচ্ছা ছিল আমাকে বাইরে বের করবেন। একদিন আমি তাঁকে বললুম, বাইরেতে আমার দরকার কী? তিনি বললেন, তোমাকে বাইরের দরকার থাকতে পারে। আমি বললুম, এতদিন যদি তার চলে গিয়ে থাকে আজও চলবে, সে গলায় দড়ি দিয়ে মরবে না। মরে তো মরুক-না, সেজন্য আমি ভাবছি নে– আমি আমার জন্যে ভাবছি। সত্যি নাকি, তোমার আবার ভাবনা কিসের? আমার স্বামী হাসিমুখে চুপ করে রইলেন। আমি তাঁর ধরন জানি, তাই বললুম, না, অমন চুপ করে ফাঁকি দিয়ে গেলে চলবে না, এ কথাটা তোমার শেষ করে যেতে হবে। তিনি বললেন, কথা কি মুখের কথাতেই শেষ হয়? সমস্ত জীবনের কত কথা শেষ হয় না। না, তুমি হেঁয়ালি রাখো, বলো। আমি চাই বাইরের মধ্যে তুমি আমাকে পাও, আমি তোমাকে পাই। ঐখানে আমাদের দেনাপাওনা বাকি আছে। কেন, ঘরের মধ্যে পাওয়ার কমতি হল কোথায়? এখানে আমাকে দিয়ে তোমার চোখ কান মুখ সমস্ত মুড়ে রাখা হয়েছে– তুমি যে কাকে চাও তাও জান না, কাকে পেয়েছ তাও জান না। খুব জানি গো খুব জানি। মনে করছ জানি, কিন্তু জান কি না তাও জান না। দেখো, তোমার এই কথাগুলো সইতে পারি নে। সেইজন্যেই তো বলতে চাই নি। তোমার চুপ করে থাকা আরো সইতে পারি নে। তাই তো আমার ইচ্ছে, আমি কথাও কইব না, চুপও করব না, তুমি একবার বিশ্বের মাঝখানে এসে সমস্ত আপনি বুঝে নাও। এই ঘরগড়া ফাঁকির মধ্যে কেবলমাত্র ঘরকর্নাটুকু করে যাওয়ার জন্যে তুমিও হও নি, আমিও হই নি। সত্যের মধ্যে আমাদের পরিচয় যদি পাকা হয় তবেই আমাদের ভালোবাসা সার্থক হবে। পরিচয় তোমার হয়তো বাকি থাকতে পারে, কিন্তু আমার কিছুই বাকি নেই। বেশ তো, আমারই যদি বাকি থাকে সেটুকু পূরণ করেই দাও-না কেন? এ কথা নানা রকম আকারে বারবার উঠেছে। তিনি বলতেন, যে পেটুক মাছের ঝোল ভালোবাসে সে মাছকে কেটেকুটে সাঁৎলে সিদ্ধ করে মসলা দিয়ে নিজের মনের মতোটি করে নেয়, কিন্তু যে লোক মাছকেই সত্য ভালোবাসে সে তাকে পিতলের হাঁড়িতে রেঁধে পাথরের বাটিতে ভর্তি করতে চায় না– সে তাকে ছাড়া জলের মধ্যেই বশ করতে পারে তো ভালো, না পারে তো ডাঙায় বসে অপেক্ষা করে– তার পরে যখন ঘরে ফেরে তখন এইটুকু তার সান্ত্বনা থাকে যে, যাকে চাই তাকে পাই নি, কিন্তু নিজের শখের বা সুবিধার জন্য তাকে ছেঁটে ফেলে নষ্ট করি নি। আস্ত পাওয়াটাই সব চেয়ে ভালো, নিতান্তই যদি তা সম্ভব না হয় তবে আস্ত হারানোটাও ভালো। এ-সব কথা আমার একেবারেই ভালো লাগত না, কিন্তু সেইজন্যেই যে তখন বের হই নি তা নয়। আমার দিদিশাশুড়ি তখন বেঁচে ছিলেন। তাঁর অমতে আমার স্বামী বিংশ শতাব্দীর প্রায় বিশ-আনা দিয়েই ঘর ভর্তি করে তুলেছিলেন, তিনিও সয়েছিলেন; রাজবাড়ির বউ যদি পর্দা ঘুচিয়ে বাইরে বেরোত তা হলেও তিনি সইতেন; তিনি নিশ্চয় জানতেন এটাও একদিন ঘটবে, কিন্তু আমি ভাবতুম এটা এতই কি জরুরি যে তাঁকে কষ্ট দিতে যাব। বইয়ে পড়েছি আমরা খাঁচার পাখি, কিন্তু অন্যের কথা জানি নে, এই খাঁচার মধ্যে আমার এত ধরেছে যে বিশ্বেও তা ধরে না। অন্তত তখন তো সেইরকমই ভাবতুম। আমার দিদিশাশুড়ি যে আমাকে এত ভালোবাসতেন তার গোড়ার কারণটা এই যে, তাঁর বিশ্বাস আমি আমার স্বামীর ভালোবাসা টানতে পেরেছিলুম সেটা যেন কেবল আমারই গুণ, কিম্বা আমার গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্ত। কেননা, পুরুষমানুষের ধর্মই হচ্ছে রসাতলে তলিয়ে যাওয়া। তাঁর অন্য কেনো নাতিকে তাঁর নাতবউরা সমস্ত রূপযৌবন নিয়েও ঘরের দিকে টানতে পারে নি, তাঁরা পাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন, কেউ তাঁদের বাঁচাতে পারলেন না। তাঁদের ঘরে পুরুষমানুষের এই মরণের আগুন আমিই নেবালুম এই ছিল তাঁর ধারণা। সেইজন্যেই তিনি আমাকে যেন বুকে করে রেখেছিলেন; আমার একটু অসুখবিসুখ হলে তিনি ভয়ে কাঁপতেন। আমার স্বামী সাহেবের দোকান থেকে যে-সমস্ত সজসজ্জা এনে সাজাতেন সে তাঁর পছন্দসই ছিল না। কিন্তু তিনি ভাবতেন পুরুষমানুষের এমন কতকগুলো শখ থাকবেই যা নিতান্ত বাজে, যাতে কেবলই লোকসান। তাকে ঠেকাতে গেলেও চলবে না, অথচ সে যদি সর্বনাশ পর্যন্ত না পৌঁছয় তবেই রক্ষে। আমার নিখিলেশ বউকে যদি না সাজাত আর-কাউকে সাজাতে যেত। এইজন্যে ফি বারে যখন আমার জন্যে কোনো নতুন কাপড় আসত তিনি তাই নিয়ে আমার স্বামীকে ডেকে কত ঠাট্টা কত আমোদ করতেন। হতে হতে শেষকালে তাঁরও পছন্দর রঙ ফিরেছিল। কলিযুগের কল্যাণে অবশেষে তাঁর এমন দশা হয়েছিল যে নাতবউ তাঁকে ইংরিজি বই থেকে গল্প না বললে তাঁর সন্ধ্যা কাটত না। দিদিশাশুড়ির মৃত্যুর পর আমার স্বামীর ইচ্ছা হল আমরা কলকাতায় গিয়ে থাকি। কিন্তু কিছুতেই আমার মন উঠল না। এ যে আমার শ্বশুরের ঘর, দিদিশাশুড়ি কত দুঃখ কত বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে কত যত্নে একে এতকাল আগলে এসেছেন, আমি সমস্ত দায় একেবারে ঘুচিয়ে দিয়ে যদি কলকাতায় চলে যাই তবে
false
humayun_ahmed
সারেঙের অ্যাসিসটেন্ট হাবলু মিয়ার সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ ভাব হয়েছে। সে-ই বলেছে। তিন নম্বর কেবিনের এক প্রফেসর সাহেবও এই চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছিলেন। তার ছাত্রী সঙ্গে যাবে। শেষ মুহুর্তে ছাত্রী আসে নি। প্রফেসর সাহেব মুখ ভোতা করে বসে আছেন। তার ভাড়ার টাকা পুরোটাই জলে গেছে। টাকা শুধু যে জলে গেছে তা না, তিনি নিজেও জলে যাবেন এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কালের চিৎকার পত্রিকার চলমান লঞ্চ সাংবাদিক হিসেবে কোথায় কী ঘটছে দেখা দরকার। আমি ভ্রমণে বের হলাম। তৃষ্ণা মেয়েটি ভয় পেতে থাকুক। ভয় ভাঙানোর জন্য যথাসময়ে তার কাছে যাওয়া যাবে। তৃষ্ণা ছাড়া লঞ্চের আর কাউকে উীত দেখলাম না। সবাই স্বাভাবিক অৰ্দ্ধাচরণ করছে। লঞ্চ মোহনায় ঘুরপাক খাচ্ছে—এটা যেন কোনো ব্যাপার না। এখন কালের চিৎকার প্রতিবেদকের প্রতিবেদন। আনসার বাহিনী আনসার বাহিনীর চার সদস্যের তিনজন টাকা নিয়ে পলাতক। একজন পাবলিকের কাছে ধরা খেয়েছে। তাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে তাকে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। যিনি তাকে পানিতে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন তার নাম রুস্তম। মধ্যমবয়সী গাটাগোট্টা মানুষ। কুৎকুতে চোখ। চিবুকে ছাগলা দাড়ি। রুস্তম বরিশাল ট্রাকচালক সমিতির কোষাধ্যক্ষ। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনলাম। প্ৰাণপ্রিয় ভাইয়েরা আমার। আনসার বাহিনী আমাদের রক্ষক হয়ে হয়েছে ভক্ষক। ছিনতাইয়ের টাকা উদ্ধার করে নিজেরা গাপ করে দিয়েছে। ভেবেছে পার পাবে? পার পাবে না। একজন ধরা খেয়েছে, তাকে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। সে যদি সাঁতার দিয়ে কুলে উঠতে পারে এটা তার ভাগ্য। যদি কুলে উঠতে না পারে, যদি সলিল সমাধি হয় সেটাও তার ভাগ্য। বলেন, আল্লাহু আকবার। দুর্বল ভঙ্গিতে কয়েকজন মিলে বলল, আল্লাহু আকবার। রুস্তম হুংকার দিয়ে বলল, তবে আপনারা যদি মনে করেন। আমি একা তাকে পানিতে ফেলব আপনারা ভুল করেছেন। আমরা সবাই মিলে পানিতে ফেলব। এই জন্যেই কবি বলেছেন, সবে মিলে করি কাজ হারিজিাতি নাহি লাজ। জনতার আদালত তৈরি হয়েছে। জনতার আদালতে সবার বিচার হবে। অপরাধী যে-ই হোক তাকে পানিতে ফেলা হবে। বলুন, আল্লাহু আকবার। আবার দুর্বল ধ্বনি, আল্লাহু আকবার। রুস্তম রণাহুংকার দিয়ে বলল, আপনাদের গলায় জোর নাই। মুরগির বাচ্চাও তো আপনাদের চেয়ে উঁচা গলায় কক কক করে। বুলন্দ আওয়াজ দেন, আল্লাহু আকবার। আগের চেয়েও ক্ষীণ আওয়াজ উঠল, আল্লাহু আকবার। অপরাধী ছিনতাইকারী শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। তবে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে মার খায় নি। এতেই খুশি। লঞ্চ-বাস-ট্রেনের কামরায় ধরা পড়া ছিনতাইকারীর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এরা পালিয়ে যেতে পারে না বলে মার খেতে খেতে শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে মারা যায়। কিছু আছে বিড়ালের মতো কঠিন প্রাণশক্তি, এরা লুল হয়ে বেঁচে থাকে। লুলা হওয়ার কারণে ভিক্ষার সুবিধা হয়। ভিক্ষুক শ্রেণীতে লুলা স্বামীর অনেক কদর। আর্মি অফিসার এবং ইঞ্জিনিয়াররা রূপবতী স্ত্রী পায়। লুলা ভিক্ষুকরাও রূপবতী ভিক্ষুক স্ত্রী পায়। চায়ের দোকানের মালিক এখনো ধরা খায় নি। সে চা বিক্রি করে যাচ্ছে। লাশের চায়ের ব্যাপারই মনে হয় চাপা পড়ে গেছে। তবে আমি নিশ্চিত যথাসময়ে বিষয়টা উঠবে। চা-ওয়ালা নিজের মনে বিড়বিড় করছে—পানিতে ফেলব। তর বাপের পানি! রুস্তম বলল, ব্রাদার কিছু বলেছেন? না কিছু বলি নাই। যা বলার আওয়াজে বলবেন। বিড়বিড়ানি বন্ধ। আপনার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে। আমার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত? পাবলিকেরে লাশের চা খিলাইছেন। পাবলিক আপনেরে ছাড়বে না। চা-ওয়ালা বলল, পাবলিকের মারে আমি.। রুস্তম বলল, হারামির পুত কী বলেছে আপনারা শুনছেন? জাগ্ৰত পাবলিক, আপনারা শুনছেন? হুনলাম। শুধু শুনবেন? ব্যবস্থা নিবেন না? অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। সামান্য হুটাপুটির পরেই চা-ওয়ালা ধরা খেয়ে গেল। তার স্থান হলো ছিনতাইকারীর পাশে। ছিনতাইকারী নিচু গলায় বলল, কিছুক্ষণ রঙতামাশা করে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওস্তাদ কোনো চিন্তা নাই। চা-ওয়ালা বলল, তুই চুপ থাক বদমাইশ। ওস্তাদ ডাকবি না, আমি তোর ওস্তাদ না। ছিনতাইকারী আসল এক ওস্তাদ লঞ্চে আছে। তার খোঁজ পাইলে রুস্তম যে আছে নতুন লিডার হইছে হে পিসাব করে লুঙ্গি ভিজায়ে দিবে। অসল ওস্তাদ কে? উনার নাম আতর। আতর মিয়া। নাম তো আগে শুনি নাই। ও আচ্ছা আচ্ছা শুনেছি। নাম শুনেছি। সে লঞ্চে কী জন্যে? আছে কোনো মতলব! আমি জিগাই নাই। দেখা হয়েছে, সালাম দিয়েছি। উনি বলেছেন, ভালো আছ? আমি বলেছি, জি ওস্তাদ। পীর সাহেব এবং পুলিশ বাহিনী পুলিশ বাহিনী আগের জায়গাতেই আছে। তাদের সামনে দুটা হারিকেন। একটায় তেল শেষ। দপদপ করছে, যে-কোনো সময় নিভবে। ওসি সাহেব দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকানো বন্ধ করেছেন। কোনো একটা ঘটনা মনে হয় ঘটেছে। ওসি সাহেবের মুখ পাংশুবর্ণ। আমি বললাম, স্যার কেমন আছেন? ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। বিরক্ত চোখে তাকালেন। পীর সাহেব বললেন, স্যারের অবস্থা কাহিল। জ্বিন কফিল উনার পিছে লাগছে। কী করছে সে? দেয়াশলাইয়ের মাথা ভাঙছে। ভাঙা মাথা এখন স্যারের কানের ভেতরে। জ্বিন কফিলারে আমার মতো ভালো কেউ চিনে না। সে এখন কী করব। শুনেন। ভাঙা মাথার মধ্যে ফায়ারিং করবে। ধুম কইরা আগুন জ্বলবে। তাহলে তো বেকায়দা অবস্থা। সাংবাদিক ভাই ধরেছেন ঠিক। অবস্থা বেগতিক। আমি সূরা বাকারা পড়ে ঞ্জিনরে এখনো সামলায়া রাখার চেষ্টা নিতেছি। কতক্ষণ পারব জানি না। দোয়া রাখবেন। অবশ্যই দোয়া রাখব। এদিকে জ্বিন খবর দিয়েছে বিরাট ঝড় উঠবে, লঞ্চভুবি হবে। জানমালের বেশুমার ক্ষতি হবে। দুটি হারিকেনের একটি দপ করে নিভে গেল। ওসি সাহেব চমকে উঠলেন। এতটা কেন চমকালেন বোঝা
false
shorotchandra
অধিকতর জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, মৃণালদিদিও সমস্তদিন না খেয়েই বাড়ি গেলেন ; কিন্তু তাঁর সঙ্গে হেসে কথা কইতে ত তোমার আপত্তি হয়নি! মহিম আশ্চর্য হইয়া বলিল, এ-সব তুমি কি বলচ অচলা? অচলা কহিল, আমি এই বলচি যে, কি এমন গুরুতর অপরাধ তোমার কাছে করেচি, যাতে এই অপমানটা আমাকে না করলে তোমার চলছিল না? মহিম হতবুদ্ধি হইয়া পুনরায় সেই প্রশ্নই করিল। কহিল, কি বলছ? এ-সব কথার মানে কি? অচলা অকস্মাৎ উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, মানে এই যে, কি অপরাধে আমাকে এই অপমান করলে তুমি? তোমার কি করেছি আমি? মহিম বিহ্বল হইয়া উঠিল, বলিল, আমি তোমাকে অপমান করেছি? অচলা বলিল, হাঁ, তুমি। মহিম প্রতিবাদ করিয়া বলিল, মিছে কথা। অচলা মুহূর্তকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া রহিল। তার পরে কণ্ঠস্বর মৃদু করিয়া বলিল, আমি কোনদিন মিছে কথা বলিনে। কিন্তু সে কথা যাক; এখন তোমার নিজের যদি সত্যবাদী বলে অভিমান থাকে, সত্য জবাব দেবে? মহিম উৎসুক-দৃষ্টিতে শুধু চাহিয়া রহিল। অচলা প্রশ্ন করিল, মৃণালদিদি যা করে আজ চলে গেলেন, তাকে কি তোমাদের পাড়াগাঁয়ের সমাজে অপমান করা বলে না? মহিম বলিল, কিন্তু তাতে আমাকে জড়াতে চাও কেন? অচলা কহিল, বলচি। আগে বল, তাতে কি বলা হয় এখানে? মহিম কহিল, বেশ, তাই যদি হয়— অচলা বাধা দিয়া কহিল, হয় নয়, ঠিক জবাব দাও। মহিম কহিল, হাঁ, পাড়াগাঁয়েও অপমান বলেই লোকে মনে করে। অচলা কহিল, করে ত? তবে তুমি সমস্ত জেনে শুনে এই অপমান করিয়েছ। তুমি নিশ্চয় জানতে, তিনি আমার ছোঁয়া রান্না খাবেন না। ঠিক কি না? বলিয়া সে নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া মহিমের বুকের ভিতর পর্যন্ত যেন তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল। মহিম তেমনি অভিভূতের মত শুধু চাহিয়া রহিল। তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না। ঠিক এমনি সময়ে বাহির হইতে সুরেশের চিৎকার আসিয়া পৌঁছিল—মহিম! কোথা হে? ষোড়শ পরিচ্ছেদ একি, সুরেশ যে! এস এস, বাড়ির ভেতরে এস। ভাল ত? মহিমের স্বাগত-সম্ভাষণ সমাপ্ত হইবার পূর্বে সুরেশ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাতের গ্লাডস্টোন ব্যাগটা নামাইয়া রাখিয়া কহিল, হ্যাঁ, ভাল। কিন্তু কি রকম, একা দাঁড়িয়ে যে? অচলা বধূঠাকুরানী একমুহূর্তে সচলা হয়ে অন্তর্ধান হলেন কিরূপে? তাঁর প্রবল বিশ্রম্ভালাপ মোড়ের ওপর থেকে যে আমাকে এ বাড়ির পাত্তা দিলে। বস্তুতঃ অচলার শেষ কথাটা রাগের মাথায় একটু জোরে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক দ্বারের বাহিরেই তাহা সুরেশের কানে গিয়াছিল। সুরেশ কহিল, দেখলে মহিম, বিদুষী স্ত্রী-লাভের সুবিধে কত? ক’দিনই বা এসেছেন, কিন্তু এর মধ্যেই পাড়াগাঁয়ের প্রেমালাপের ধরনটা পর্যন্ত এমনি আয়ত্ত করে নিয়েছেন যে, খুঁত বের করে দেয়, পাড়াগেঁয়ে মেয়েরও তা সাধ্য নেই। মহিম লজ্জায় আকর্ণ রাঙ্গা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ ঘরের দিকে চাহিয়া অচলাকে উদ্দেশ করিয়া পুনরায় কহিল, অত্যন্ত অসময়ে এসে রসভঙ্গ করে দিলুম বৌঠান, মাপ কর। মহিম, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসবার কিছু থাকে ত নিয়ে চল, একটু বসি। হাঁটতে হাঁটতে ত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে—ভাল জায়গায় বাড়ি করেছিলে ভাই—চল, চল, কলকাতায় চল। চল, বলিয়া মহিম তাহাকে বাহিরের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল। সুরেশ কহিল, বৌঠান কি আমার সামনে বের হবেন না নাকি? পর্দানশীন? মহিম জবাব দিবার পূর্বেই পাশের দরজা ঠেলিয়া অচলা প্রবেশ করিল। তাহার মুখে কলহের চিহ্নমাত্র নাই, নমস্কার করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, এ যে আশাতীত সৌভাগ্য! কিন্তু এমন অকস্মাৎ যে? তাহার প্রফুল্ল হাসিমুখ সুখ-সৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করিয়া সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় যেন জ্বলিয়া উঠিল। হাত তুলিয়া প্রতি-নমস্কার করিয়া বলিল, এখন দেখচি বটে, এমন অকস্মাৎ এসে পড়া উচিত হয়নি। কিন্তু কাণ্ডটা কি হচ্চিল? না,—আসা পর্যন্ত এইভাবে মতভেদ চলচে? কোন্‌টা? অচলা তেমনি হাসিমুখে কহিল, কোন্‌টা শুনলে আপনি বেশ খুশি হন বলুন? শেষেরটা ত? তা হলে আমার তাই বলা উচিত—অতিথিকে মনঃক্ষুণ্ণ করতে নেই। সুরেশের মুখ গম্ভীর হইল; কহিল, কে বললে নেই? বাড়ির গৃহিণীর সেই ত হল আসল কাজ—সেই ত তার পাকা পরিচয়। অচলা হাসিতে হাসিতে কহিল, গৃহই নেই, তার আবার গৃহিণী! এই দুঃখীদের কুঁড়ের মধ্যে কি করে যে আজ আপনার রাত্রি কাটবে, সেই হয়েছে আমার ভাবনা। কিন্তু ধন্য আপনাকে, জেনে শুনে এ দুঃখ সইতে এসেছেন। স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আচ্ছা, নয়নবাবুকে ধরে চন্দ্রবাবুর বাড়িতে আজ রাতটার মত ওঁর শোবার ব্যবস্থা করা যায় না? তাঁদের পাকা বাড়ি—বসবার ঘরটাও আছে, ওঁর কষ্ট হতো না! সৌজন্যের আবরণে উভয়ের শ্লেষের এই-সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মহিম মনে মনে অধীর হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু কি করিয়া থামাইবে, ভাবিয়া পাইতেছিল না, এমনি অবস্থায় সুরেশ নিজেই তাহার প্রতিকার করিল; সহসা হাতজোড় করিয়া বলিল, আমার ঘাট হয়েচে বৌঠান, বরং একটু চা-টা দাও, খেয়ে গায়ে জোর করে নিয়ে তার পরে নয়নবাবুকে বল, শ্রবণবাবুকে বল—চন্দ্রবাবুর পাকা ঘরে শোবার জন্যে সুপারিশ ধরতে রাজি আছি। কিন্তু যাই বল মহিম, এর ওপর এত টান সত্যি হলে, খুশি হবার কথা বটে। মহিমের হইয়া অচলাই তাহার উত্তর দিল; সহাস্যে কহিল, খুশি হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের হাতে; কিন্তু এ আমার শ্বশুরের ভিটে, এর ওপর টান না জন্মে বড়লাটের রাজপ্রাসাদের ওপর টান পড়লে সেইটে ত হত মিথ্যে। যাক, আগে গায়ে জোর হোক, তার পর কথা হবে। আমি চায়ের জল চড়াতে বলে এসেচি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এনে হাজির করে দিচ্চি—ততক্ষণ মুখ বুজে একটু বিশ্রাম করুন; বলিয়া অচলা হাসিয়া প্রস্থান করিল। সে চলিয়া
false
shordindu
কি তিনি হরিনাথের অন্তধনের গুঢ় রহস্য কিছু জানেন? তিনি কি জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আড়াল করিবার চেষ্টা করিতেছেন? ভীত-দৃষ্টি রুগ্নকায় অনাদি সরকারের কথা মনে পড়িল। সে কাল প্রভুর পায়ে ধরিয়া কাঁদিতেছিল কি জন্য? ‘ও মহাপাপ করিনি।-কোন মহাপাপ হইতে নিজেকে ক্ষালন করিবার চেষ্টা করিতেছিল! বেবি আজ আবার একটা নূতন খবর দিল—হিমাংশুবাবু ও তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলিতেছে। ঝগড়া। এতদূর গড়াইয়াছে যে স্ত্রী তিনদিন আহার করেন নাই। কি লইয়া ঝগড়া? হরিনাথ মাস্টার কি এই কলহ-রহস্যের অন্তরালে লুকাইয়া আছে! ‘তুমি ছবি আঁকতে জানো?’ বেবির প্রশ্নে চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া গেল। অন্যমনস্কভাবে বলিলাম‌, ‘জানি।’ ঝামর চুল উড়াইয়া বেবি ছুটিয়া গেল। কোথায় গেল ভাবিতেছি এমন সময় সে একটা খাতা ও পেন্সিল লইয়া ফিরিয়া আসিল। খাতা ও পেন্সিল আমার হাতে দিয়া বলিল‌, ‘একটা ছবি এঁকে দাও না। খু–ব ভাল ছবি।’ খাতাটি বেবির অঙ্কের খাতা। তাহার প্রথম পাতায় পাকা হাতে লেখা রহিয়াছে‌, শ্ৰীমতী বেবিরাণী দেবী। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘একি তোমার মাস্টারমশায়ের হাতের লেখা?’ বেবি বলিল, ‘হ্যাঁ।‘ খাতার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে আশ্চর্য হইয়া গেলাম। বেশির ভাগই উচ্চ গণিতের অঙ্ক; বেবির হাতে লেখা যোগ‌, বিয়োগ খুব অল্পই আছে। আবার জিজ্ঞাসা করিলাম ‘এসব অঙ্ক কে করেছে?’ বেবি বলিল‌, ‘মাস্টারমশাই। তিনি খালি আমার খাতায় অঙ্ক করতেন।’ দেখিলাম‌, মিথ্যা নয়। খাতার অধিকাংশ পাতাই মাস্টারের কঠিন দীর্ঘ অঙ্কের অক্ষরে পূর্ণ হইয়া আছে। কি ব্যাপার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। একটি ছোট মেয়েকে গণিতের গোড়ার কথা শিখাইতে গিয়া কলেজের শিক্ষিতব্য উচ্চ গণিতের অবতারণার সার্থকতা কি? খাতার পাতাগুলা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে একস্থানে দৃষ্টি পড়িল—একটা পাতার আধখানা কাগজ কে ছিড়িয়া লইয়াছে। একটু অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করিতে মনে হইল যেন পেন্সিল দিয়া খাতার উপর কিছু লিখিয়া পরে কাগজটা ছিড়িয়া লওয়া হইয়াছে। কারণ‌, খাতার পরের পৃষ্ঠায় পেন্সিলের চাপ-দাগ অস্পষ্টভাবে ফুটিয়া রহিয়াছে। আলোর সম্মুখে ধরিয়া নখচিহ্নের মত দাগগুলি পড়িবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু পড়িতে পারিলাম না। বেবি অধীরভাবে বলিল‌, ‘ও কি করছ। ছবি এঁকে দেখাও না!’ ছেলেবেলায় যখন ইস্কুলে পড়িতাম তখন এই ধরনের বর্ণহীন চিহ্ন কাগজের উপর ফুটাইয়া তুলিবার কৌশল শিখিয়াছিলাম‌, এখন তাহা মনে পড়িয়া গেল। বেবিকে বলিলাম‌, ‘একটা ম্যাজিক দেখবে? বেবি খুব উৎসাহিত হইয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ–দেখব।’ তখন খাতা হইতে এক টুকরা কাগজ ছিড়িয়া লইয়া তাহার উপর পেন্সিলের শিষ ঘষিতে লাগিলাম; কাগজটা যখন কালো হইয়া গেল তখন তাহা সন্তৰ্পণে সেই অদৃশ্য লেখার উপর বুলাইতে লাগিলাম। ফটোগ্রাফের নেগেটিভ যেমন রাসায়নিক জলে ধৌত করিতে করিতে তাহার ভিতর হইতে ছবি পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে্‌্‌, আমার মৃদু ঘর্ষণের ফলেও তেমনি কাগজের উপর ধীরে ধীরে অক্ষর ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সবগুলি অক্ষর ফুটিল না‌, কেবল পেন্সিলের চাপে যে অক্ষরগুলি কাগজের উপর গভীরভাবে দাগ কাটিয়াছিল সেইগুলি স্পষ্ট ইয়া উঠিল। ওঁ হ্রীং… ক্লীং… রাত্ৰি ১১…৫….অম…পড়িবে। অসম্পূর্ণ দুর্বোধ অক্ষরগুলার অর্থ বুঝিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু বিশেষ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। ওঁ হ্রীং ক্লীং–বোধহয় কোনো মন্ত্র হইবে। কিন্তু সে যাহাঁই হোক‌, হস্তাক্ষর যে হরিনাথ মাস্টারের তাহাতে সন্দেহ রহিল না। প্রথম পৃষ্ঠার লেখার সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলাম‌, অক্ষরের ছাঁদ একই প্রকারের। বেবি ম্যাজিক দেখিয়া বিশেষ পরিতৃপ্ত হয় নাই; সে ছবি আঁকিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। তখন তাহার খাতায় কুকুর বাঘ রাক্ষস প্রভৃতি বিবিধ জন্তুর চিত্তাকর্ষক ছবি আকিয়া তাহাকে খুশি করিলাম। মন্ত্র-লেখা কাগজটা আমি ছিড়িয়া লইয়া নিজের কাছে রাখিয়া দিলাম। বেলা সাড়ে তিনটার সময় হিমাংশুবাবু ফিরিয়া আসিলেন। মোটর তেমনি নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া বাড়ির পশ্চাতে গ্যারাজের দিকে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে হিমাংশুবাবুর গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম; তিনি ভুবন বেয়ারাকে ডাকিয়া চায়ের বন্দোবস্ত করিবার হুকুম দিতেছেন। ব্যোমকেশ যখন ফিরিল তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। কুমার গাড়ি হইতে নামিলেন না; ব্যোমকেশকে নামাইয়া দিয়া শরীরটা তেমন ভাল ঠেকিতেছে না বলিয়া চলিয়া গেলেন। তখন ব্যোমকেশের অনারে আর একবার চা আসিল। চা পান করিতে করিতে কথাবাত আরম্ভ হইল। দেওয়ানজীও আসিয়া বসিলেন। ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কি হল?’ ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল‌, ‘বিশেষ কিছু হল না। পুলিসের ধারণা হরিনাথ মাস্টারকে প্রজারা কেউ নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে।’ দেওয়ানজী বলিলেন‌, ‘আপনার তা মনে হয় না?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না। আমার ধারণা অন্যরকম।’ ‘আপনার ধারণা হরিনাথ বেঁচে নেই?’ ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতভাবে বলিল‌, ‘আপনি ‘কি করে বুঝলেন? ও‌, অজিত বলেছে। হঁহা-আমার তাই ধারণা বটে। তবে আমি ভুলও করে থাকতে পারি।’ কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া এমন কিছু বোধ হইল না যে সে আমার উপর চটিয়াছে; কিন্তু মুখ দেখিয়া সকল সময় তাহার মনের ভাব বোঝা যায় না। কে জানে‌, হয়তো কথাটা ইহাদের কাছে প্রকাশ করিয়া অন্যায় করিয়াছি‌, ব্যোমকেশ নির্জনে পাইলেই আমার মুণ্ড চিবাইবে।‌ কালীগতি হঠাৎ বলিলেন‌, ‘আমার বোধ হয় আপনি ভুলই করেছেন ব্যোমকেশবাবু। হরিনাথ সম্ভবত মরেনি।’ ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ কালীগতির পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘আপনি নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?’ কালীগতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, না-তাকে ঠিক জানা বলা চলে না; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে ঐ বনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।’ ব্যোমকেশ চমকিত হইয়া বলিল‌, ‘বনের মধ্যে? এই দারুণ শীতে?’ ‘হ্যাঁ। বনের মধ্যে কাপালিকের ঘর বলে একটা কুঁড়ে ঘর আছে–রাত্রে বাঘ ভালুকের ভয়ে সম্ভবত সেই ঘরটায় লুকিয়ে থাকে।’ ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘স্পষ্ট কোনো প্ৰমাণ পেয়েছেন কি?’ ‘না। তবে আমার স্থির বিশ্বাস সে ঐখানেই
false
shorotchandra
আমারও ত সে ভাইয়ের মত। সতীশ কহিল, একটা কথা ভেবে দেখবার যে, তারা আমাকে বিনা-দোষে লাঞ্ছনা করেচে সত্যি, কিন্তু ছেড়েও দিয়েছে। হরেন বলিল, বিনা-দোষে লাঞ্ছনা করাটাও ত আইন নয়। যারা তা পারে, তারা এ-ই বা পারবে না কেন? এই বলিয়া সে তখনকার মত কলেজে চলিয়া গেল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার ভারী অশান্তি লাগিয়া রহিল। শুধু কেবল রাজেনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়াই নয়, দেশের কাজে দেশের ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করিয়া তুলিতে এই যে সে আয়োজন করিয়াছে, পাছে, তাহা অকারণে নষ্ট হইয়া যায়। হরেন স্থির করিল, ব্যাপারটা সত্যই হউক, বা মিথ্যাই হউক, পুলিশের চক্ষু অকারণে আশ্রমের প্রতি আকর্ষণ করিয়া আনা কোনমতেই সমীচীন নয়। বিশেষতঃ সে যখন স্পষ্টই এখানকার নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া চলিতেছে, তখন কোথাও চাকরি করিয়া দিয়া হোক বা যে-কোন অজুহাতে হোক, তাহাকে অন্যতর সরাইয়া দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইহার দিন-কয়েক পরেই মুসলমানদের কি একটা পর্বোপলক্ষে দু’দিনের ছুটি ছিল। সতীশ কাশী যাইবার অনুমতি চাহিতে আসিল। আগ্রা আশ্রমের অনুরূপ আদর্শে ভারতের সর্বত্র প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার বিরাট কল্পনা হরেন্দ্রর মনের মধ্যে ছিল এবং এই উদ্দেশ্যেই সতীশের কাশী যাওয়া। শুনিয়া রাজেন আসিয়া কহিল, হরেনদা, ওর সঙ্গে আমিও দিনকতক বেড়িয়ে আসি গে। হরেন বলিল, তার কাজ আছে বলে সে যাচ্ছে। রাজেন বলিল, আমার কাজ নেই বলেই যেতে চাচ্চি। যাবার গাড়িভাড়ার টাকাটা আমার কাছে আছে। হরেন জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু ফিরে আসবার? রাজেন চুপ করিয়া রহিল। হরেন বলিল, রাজেন, কিছুদিন থেকে তোমাকে একটা কথা বলি-বলি করেও বলতে পারিনি। রাজেন একটুখানি হাসিয়া কহিল, বলবার প্রয়োজন নেই, হরেনদা, সে আমি জানি। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল। রাত্রির গাড়িতে তাহাদের যাইবার কথা। বাসা হইতে বাহির হইবার কালে হরেন্দ্র দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হঠাৎ তাহার হাতের মধ্যে একটা কাগজের মোড়ক গুঁজিয়া দিয়া চুপি চুপি বলিল, ফিরে না এলে বড় দুঃখ পাবো রাজেন। এবং বলিয়াই চক্ষের পলকে নিজের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। ইহার দিন-দশেক পরে দুজনেই ফিরিয়া আসিল। হরেনকে নিভৃতে ডাকিয়া সতীশ প্রফুল্ল মুখে কহিল, আপনার সেদিনের ঐটুকু বলাতেই কাজ হয়েছে হরেনবাবু। কাশীতে আশ্রম স্থাপনের জন্যে এ কদিন রাজেন অমানুষিক পরিশ্রম করেচে। হরেন কহিল, পরিশ্রম করলে ত সে অমানুষিক পরিশ্রমই করে সতীশ। হাঁ, তাই সে করেছে। কিন্তু এর সিকি ভাগ পরিশ্রমও যদি সে আমাদের এই নিজেদের আশ্রমটুকুর জন্যে করত! হরেন আশান্বিত হইয়া বলিল, করবে হে সতীশ, করবে। এতদিন বোধ করি ও ঠিক জিনিসটি ধরতে পারেনি। আমি নিশ্চয় বলচি, তুমি দেখতে পাবে এখন থেকে ওর কর্মের আর অবধি থাকবে না। সতীশ নিজেও সেই ভরসাই করিল। হরেন বলিল, তোমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় একটা কাজ স্থগিত আছে। আমি মনে মনে কি স্থির করেছি জানো? আমাদের আশ্রমের অস্তিত্ব এবং উদ্দেশ্য গোপন রাখলে আর চলবে না। দেশের এবং দশের সহানুভূতি পাওয়া আমাদের প্রয়োজন। এর বিশিষ্ট কর্মপদ্ধতি সাধারণ্যে প্রচার করা আবশ্যক। সতীশ সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে কহিল, কিন্তু তাতে কি কাজে বাধা পাবে না? হরেন বলিল, না। এই রবিবারে আমি কয়েকজনকে আহ্বান করেচি। তাঁরা দেখতে আসবেন। আশ্রমের শিক্ষা, সাধনা, সংযম ও বিশুদ্ধতার পরিচয়ে সেদিন যেন তাঁদের আমরা মুগ্ধ করে দিতে পারি। তোমার উপরেই সমস্ত দায়িত্ব। সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, কে কে আসবেন? হরেন বলিল, অজিতবাবু, অবিনাশদা, বৌঠাকরুন। শিবনাথবাবু সম্প্রতি এখানে নেই,—শুনলাম জয়পুরে গেছেন কার্যোপলক্ষে, কিন্তু তাঁর স্ত্রী কমলের নাম বোধ করি শুনেছ—তিনিও আসবেন; এবং শরীর সুস্থ থাকলে হয়ত আশুবাবুকেও ধরে আনতে পারব। জান ত, কেউ এঁরা যে-সে লোক নন। সেদিন এঁদের কাছ থেকে যেন আমরা সত্যিকার শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারি। সে ভার তোমার। সতীশ সবিনয়ে মাথা নত করিয়া কহিল, আশীর্বাদ করুন, তাই হবে। রবিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে অভ্যাগতেরা আসিয়া উপস্থিত হইলেন,—আসিলেন না শুধু আশুবাবু। হরেন্দ্র দ্বার হইতে তাঁহাদের সসম্মানে অভ্যর্থনা করিয়া আনিলেন। ছেলেরা তখন আশ্রমের নিত্যপ্রয়োজনীয় কর্মে ব্যাপৃত। কেহ আলো জ্বালিতেছে, কেহ ঝাঁট দিতেছে, কেহ উনান ধরাইতেছে, কেহ জল তুলিতেছে, কেহ রান্নার আয়োজন করিতেছে। হরেন্দ্র অবিনাশকে লক্ষ্য করিয়া সহাস্যে কহিল, সেজদা, এরাই সব আমাদের আশ্রমের ছেলে। আপনি যাঁদের লক্ষ্মীছাড়ার দল বলেন। আমাদের চাকর-বামুন নেই, সমস্ত কাজ এদের নিজেদের করতে হয়। বৌদি, আসুন আমাদের রান্নাশালায়। আজ আমাদের পর্বদিন, সেখানকার আয়োজন একবার দেখে আসবেন চলুন। নীলিমার পিছনে পিছনে সবাই আসিয়া রান্নাঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়াইলেন। একটি বছর দশ-বারোর ছেলে উনান জ্বালিতেছিল এবং সেই বয়সের আর একটি ছেলে বঁটিতে আলু কুটিতেছিল, উভয়েই উঠিয়া দাঁড়াইয়া নমস্কার করিল। নীলিমা ছেলেটিকে স্নেহের কণ্ঠে সম্বোধন করিয়া প্রশ্ন করিল, আজ তোমাদের কি রান্না হবে বাবা? ছেলেটি প্রফুল্লমুখে কহিল, আজ রবিবারে আমাদের আলুর-দম হয়। আর কি হয়? আর কিছু না। নীলিমা ব্যাকুল হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, শুধু আলুর-দম? ডাল কিংবা ঝোল, কিংবা আর কিছু— ছেলেটি শুধু কহিল, ডাল আমাদের কাল হয়েছিল। সতীশ পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, বুঝাইয়া বলিল, আমাদের আশ্রমে একটার বেশী হবার নিয়ম নেই। হরেন হাসিয়া কহিল, হবার জো নেই বৌদি, হবে কোথা থেকে? ভায়া এই ভাবেই পরের কাছে আশ্রমের গৌরব রক্ষা করেন। নীলিমা জিজ্ঞাসা করিল, দাসী-চাকরও নেই বুঝি? হরেন কহিল, না। তাদের আনলে আলুর-দমকে বিদায় দিতে হবে। ছেলেরা সেটা পছন্দ করবে না। নীলিমা আর প্রশ্ন করিল না, ছেলে-দুটির মুখের পানে চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু ছলছল করিতে লাগিল। কহিল, ঠাকুরপো, আর কোথাও চল। সকলেই এ কথার অর্থ
false
humayun_ahmed
গোন্ড মেডেল) মানুষটা ছোটখাটো। গায়ের রঙ ভয়াবহ ধরনের কালো। ছাত্ররা আড়ালে তাকে ডাকে অমাবস্যা স্যার। স্বভাবে-চরিত্রে অসম্ভব কঠিন। গত নবছর ধরে তিনি এই স্কুলের হেডমাস্টার। এ নবছরে শুধু একদিনই নাকি তাকে হাসতে দেখা গেছে। ১৯৬৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখে। সেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছিল এবং নেপালচন্দ্ৰ হাওলাদার নামের এই স্কুলের একজন ছাত্র ফোর্থ স্ট্যান্ড করেছিল। আবারো কোনো একদিন এই স্কুল থেকে কেউ স্ট্যান্ড করলে মনসুর সাহেব হয়তো হাসবেন। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। গ্রামের স্কুলে ভালো ছাত্র আসছে না। ইরতাজউদ্দিন বসেই আছেন। হেডমাস্টার সাহেবের লেখালেখির কাজ শেষ হচ্ছে না। ইরতাজউদিনের মনে হলো–হেডমাস্টার সাহেব আজ যেন অন্যদিনের চেয়েও গম্ভীর। মনে হয় তার শরীরটা ভালো না। কিংবা দেশ থেকে খারাপ কোনো চিঠি পেয়েছেন। প্রায়ই হেডমাস্টার সাহেব দেশ থেকে খারাপ চিঠি পান। মনসুর সাহেবের স্ত্রীর মাথা পুরোপুরি খারাপ। ভদ্রমহিলা থাকেন তার বাবার কাছে। সেখানে তার উপর নানান ধরনের চিকিৎসা চলে। চিকিৎসার কারণে কিংবা প্রাকৃতিক কারণে ভদ্রমহিলার মাথা মাঝে-মাঝে ঠিক হয়, তখন হেডমাস্টার সাহেব তাকে নীলগঞ্জ নিয়ে আসেন। সেই সময় হেডমাষ্টার সাহেবের মুখ ঝলমল করতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সুখী একজন মানুষ। গায়ের কালো রঙ তখন তেমন কালো লাগে না। সেই সময় প্রায় প্রতিদিনই তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সোহাগী নদীর পাড় ধরে হাঁটেন। তাদের বাড়ির কাছেই একটা বটগাছ–যার কয়েকটা ঝুরি নেমে গেছে সোহাগী নদীর পানিতে। সেই বটগাছের গুড়িতেও প্রায়ই হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীকে বসে থাকতে দেখা যায়। ঘোমটাটানা লাজুক ধরনের একটি মেয়ে। যার ভাব-ভঙ্গি এমন যেন নতুন বিয়ে হওয়া বউ, স্বামীর সঙ্গে যার এখনো তেমন করে পরিচয় হয় নি। মহিলা বসে থাকেন, তার আশপাশে হাঁটাহাঁটি করেন হেডমাস্টার সাহেব। বড়ই মধুর দৃশ্য। কিছুদিন পর ভদ্রমহিলার মাথা আবার যথানিয়মে খারাপ হয়। হেডমাস্টার সাহেব বিষণ্ণ মুখে তাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে আসেন। স্কুলে ফিরে কিছুদিন তার খুব মেজাজ খারাপ থাকে। অকারণে সবাইকে বকাঝকা করেন। তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। সোহাগী নদীর পাড়ে একা একা হাঁটেন। বটগাছের কুরিতে একা বসে থাকেন। হেডমাস্টার সাহেব লেখা বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালেন। প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, আমার বড় শ্যালককে একটা পত্র লিখলাম। আমার স্ত্রীর অবস্থা ভালো না। তারা তাকে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করতে চায়। কী হয়েছে? নতুন করে কিছু হয় নাই। পুরনো ব্যাধি। তবে এবার নাকি বাড়াবাড়ি। আমার বড় শ্যালকের স্ত্রীকে মাছ কাটা বটি দিয়ে কাটতে গিয়েছিল। সবাই এখন ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছে। খুব চিৎকার চেচামেচিও না-কি করে। ইরতাজউদ্দিন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। তার মনটা খারাপ হলো। আর তখনি ভুরু কুঁচকে হেডমাস্টার সাহেব কথা বলা শুরু করলেন। ইরতাজউদ্দিন সাহেব। জি। দেখলাম স্কুলে একটা পতাকা টানিয়েছেন। জি, ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছি। বারো টাকা দাম নিয়েছে। কাপড়টা সিস্কের। জাতীয় পতাকা আজকাল পাওয়াই মুশকিল। কেউ বিক্রি করতে চায় না। নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করেছেন। অপ্রয়োজনীয় খরচ করার মতো অবস্থা স্কুলের নেই। যেখানে মাস্টারদের বেতন দিতে পারি না… ইরতাজউদ্দিন নিচু গলায় বললেন, জাতীয় পতাকা অপ্রয়োজনীয় কোনো ব্যাপার না। পতাকা তো একটা আমাদের ছিল। সেটার রঙ জ্বলে গেছে। মনসুর সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, এই দেশের জন্যে রঙ জ্বলে যাওয়া পতাকাই ঠিক আছে, রঙ তো বাস্তবেও জ্বলে গেছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার কথা বুঝলাম না। হেডমাস্টার সাহেব বিরস গলায় বললেন, এক সময় এই পতাকাটাকে নিজের মনে হতো, এখন হয় না। সারা দেশে কী হচ্ছে খবর নিশ্চয়ই রাখেন, না রাখেন না? জি, খবর রাখি। লক্ষণ খুব খারাপ। পতাকা বদলে যেতে পারে। কাজেই আমার ধারণা, আপনি অকারণে দরিদ্র একটা স্কুলের বারোটা টাকা খরচ করিয়ে দিয়েছেন। ইরতাজউদ্দিন বিস্মিত গলায় বললেন, পতাকা বদল হয়ে যাবে? হ্যাঁ, যাবে। চট করে বদল হবে না। তবে হবে। লক্ষণ সে-রকমই। মাওলানা ভাসানী পল্টনের মাঠে কী বক্তৃতা দিয়েছেন জানেন? জি-না। না জানারই কথা, কোনো কাগজে আসে নাই। সব খবর তো কাগজে আসে না। কোনটা আসবে কোনটা আসবে না তা তারা ঠিক করে দেন। মাওলানা ভাসানী কী বলেছেন? তিনি বলেছেন–নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ। কী বলেন এসব? পতাকা বদল হয়ে যাবে। চানতারা পতাকা থাকবে না। মাওলানা সাহেব সুফি মানুষ। উনার জীন সাধনা আছে। জীনদের মারফতে তিনি আগে আগে খবর পান। চানতারা পতাকা থাকবে না। ইরতাজউদ্দিন চিন্তিত মুখে বললেন, যদি হয়ও সেটা ভালো হবে না। ভালো হবে না কেন? হিন্দুর গোলামি করতে হবে। মুসলমান হিন্দুর গোলামি করবে সেটা কি হয়? হেডমাস্টার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কপালে গোলামি লেখা থাকলে গোলামি করতে হবে, উপায় কী? তবে দেশ স্বাধীন হলেই হিন্দুর গোলামি করতে হবে–এ কী ধরনের চিন্তা? আপনি আধুনিক মানুষ। আপনি উন্নত চিন্তা করবেন, সেটা তো স্বাভাবিক। এখন তো আমরা গোলামিই করছি। অন্য কিছু তো করছি না। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের সার্ভিসে বাঙালির সংখ্যা কত জানেন? শতকরা দশেরও কম। সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা জানেন? না জানাই ভালো। পশ্চিমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাবার আমাদের উপায় আছে? কোনো উপায় নেই। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ইলেকশানে জিতে কি পেরেছেন এসেম্বলিতে বসতে? পারেন নি। কারণ তাকে বসতে দেওয়া হবে। না। কোনোদিনও না। এখন যা হচ্ছে তার নাম ধানাই। আর পানাই। কাজেই আমাদের সময় হয়ে আসছে। পতাকা খুলে ফেলে দেওয়ার। পতাকা
false
shomresh
কলি আর যেই আমি সুস্থ হলাম। নিজেকে গুটিয়ে নিলি। শমিত তোকে এই হোস্টেল ঠিক করে দিয়েছে। শমিতের কাছে চাকরির জন্যে গিয়েছিলি? মিথ্যে কথা? দীপাবলী হাসল, মায়া, তোর সম্পর্কে আমার অন্যরকম ধারণা ছিল। যারা রাজনীতি করে, পাঁচটা ছেলের সঙ্গে দলের প্রয়োজনে দিনরাত মেশে, যাদের পড়াশুনো আছে তাদের দেখার চোখ অনেক ব্যাপক বলে ভাবতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল। যে কোন ঘরকুনো মেয়ের সংকীর্ণতার সঙ্গে তোদর কোন পার্থক্য নেই, অন্তত ঘা খেলে যে মুখোটা খুলে যায় সেটা বুঝতে পারছি। তুই আমাকে অপমান করছিস দীপা। আমি সংকীর্ণ? সংকীর্ণ হলে নিজে এসে তোকে বলতাম না শমিতকে গ্রহণ কর। আমি কাকে গ্রহণ করব তা তুই ঠিক করে দিবি? আমার তো তাই মনে হয়েছিল। তুই শমিতকে আমার কথা বলেছিলি? বলেছিলাম। কারণ আমি বিশ্বাস করি তুই শমিতকে ভালবাসিস। না, মায়া, আমি শমিতের জন্যে মোটেই ব্যগ্ৰ নই। একথা ভাল লাগছে শমিত যা করেছে, তা তোকে বলেছে। লোকটা খুব ছোট হয়েছিল এতক্ষণ আমার কাছে, এখন সত্যি শ্ৰদ্ধা হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি তুই ওকে ভালবাসিস। তুই নিশ্চিন্ত থাক, শমিতের জন্যে আমার কোন আগ্রহ নেই। তুই একথা শমিতকে বলতে পারবি? নিশ্চয়ই। আমি তো বলেই এসেছি ওকে, বন্ধু হিসেবে সম্পর্ক রাখতে। হঠাৎ মায়া দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল, আমি এখন কি করব? দীপাবলী উঠল এক হাতে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, এবার তোকে আমার হিংসে হচ্ছে। ঠাট্টা করছিস? মুখ না তুলে বলল মায়া। নারে। তোর মত এমন ভালবাসা যদি কাউকে বাসতে পারতাম। কি হবে বেসে! শমিত আমাকে বুঝতে চায় না, বোঝে না। অপেক্ষা কর। দীপাবলী মায়ার মাথায় হাত বুলিয়েছিল, শমিত নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। আমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করিস না। এরও দিন সাতেক বাদে শমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হোস্টেলের সামনের রাস্তায়। একেবারে মুখোমুখি, তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। বলুন। তোমার চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের স্কুলের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি কাল সকাল ঠিক সাড়ে নটায় আমাদের বাড়িতে চলে এস। আমি স্কুলে নিয়ে যাব। মন স্থির করাই ছিল। দীপাবলী হাসল, আপনি অনেক করলেন আমার জন্যে। কিন্তু আমার পক্ষে আর আপনার স্কুলে চাকরি করা সম্ভব নয়। সে কি? কেন? অবাক হয়ে গেল শমিত। আর সম্ভব নয়। মাথা নেড়েছিল দীপাবলী। আমি কারণটা জানতে চাইছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। সব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমাকে আগামীকাল কৈফিয়ত দিতে হবে সেক্রেটারিকে। তুমি কি এই ব্যাপারটাকে ছেলেখেলা বলে মনে কর? আমি অসম্মানিত হব তুমি চাইছ? বেশ, তাহলে বলি। সেদিন আপনার ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারিনি। ও! থমকে গেল শমিত। আপনার খারাপ লাগতে পারে কিন্তু আমার পক্ষে এক স্কুলে কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ আপনাকে দেখলেই ওইসব মনে পড়বে। মায়া আপনাকে কিছু বলেনি? মায়া? না তো! ও। আপনি যে ব্যবহার করেছিলেন তা হৃদয়ের সম্পর্ক নিবিড় হলেই মানুষ করে থাকে। বলে শুনেছি। আপনাকে আমি ওই স্তরে ভাবতে পারছি না। অথচ আপনি যেহেতু প্রস্তাব। করেছেন তাই একসঙ্গে কাজ করলে মনে হবে আমি সমস্যা তৈরী করছি। এই অস্বস্তিতে আমি থাকতে চাই না। এটাই তাহলে তোমার শেষ কথা? হ্যাঁ। কিন্তু তুমি বলেছিলে বন্ধুত্ব থাকবে। বলেছিলাম। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বন্ধুত্বের মধ্যেও একটা ছোট্ট দেওয়াল থাকে। আপনি সেই দেওয়ালটাকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন। তবে দেখা হলে নিশ্চয়ই কথা বলব। আশা করব আপনিও সহজ হয়ে কথা বলবেন। সেই শেষ দেখা। চাকরি নেবার সময় মায়াদের বাড়িতে গিয়েছিল দীপাবলী। মায়া ছিল না। ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভদ্রমহিলা এসব ব্যাপারের কিছুই জানেন না। নিজের চাকরির বিস্তারিত ব্যাপার মহিলাকে জানিয়েছিল সেদিন। আর তারপর কলকাতা চোখের আড়ালে। খুব খারাপ লেগেছিল লাবণ্যর কাছ থেকে বিদায় নিতে। মেয়েটা এতদিনে যেন অনেক বুঝতে শিখেছে। সে বারংবার ওর দিদিমাকে বলেছিল লাবণ্যকে অন্তত গ্রাজুয়েট যেন করা হয়। শিক্ষিত একটি মেয়ে তার অতীত যা পূর্বনারীরা তাকে দিয়েছিল জেনে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরী করে নিক। ততদিন তার জন্যে সুস্থ পরিবেশ রাখা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাপস! এত রাত্রেও জল ঠাণ্ডা হয় না এখানে? চমকে মুখ তুলল দীপাবলী। পাজামা পাঞ্জাবি পরে মাথায় ভেজা গামছা ঘষতে ঘষতে ঘরে ঢুকল শমিত, পরনের গুলো বাথরুমের বালতিতে ভিজিয়ে দিয়েছি। ওগুলো আর গায়ে রাখা যাচ্ছিল না। ঠিক আছে তিরি কেচে দেবে। তোমার কাজের মেয়েটির নাম বুঝি তিরি? ফ্যানটাসটিক নাম তো? তিরি মানে কি? তিরতিরে থেকে এসেছে নাকি? শমিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে প্রশ্নটা করা মাত্র ভেতরের বারান্দা থেকে কৌতুক মেশানো হাসি ছিটকে উঠেই আচমকা থেমে গেল। সেদিকে তাকিয়ে শমিত বলল, বাঃ, চমৎকার বাংলা বোঝে তো! দীপাবলী ঠোঁট কামড়াল। বারান্দায় অন্ধকার। তিরি ওখানে যে ছিল বা আছে তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু নির্ঘাৎ সে কথা শোনার লোভই কাছাকাছি রয়েছে। শমিত আর কোন বিষয় পেল না বলবার। সমস্ত ব্যাপারটাই খুব বিশ্ৰী লাগছিল দীপাবলীর। খাট থেকে নেমে বলল, তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, রাতের খাবার পেতে সময় লাগবে। আপাতত এক কাপ চা হলেই চলবে, সঙ্গে বিস্কুট। শমিত পা বাড়াল। বারান্দার দিকে মুখ করে দীপাবলী গলা তুলল, তিরি, তোর কানে গিয়েছে নিশ্চয়ই। চা নিয়ে আয়। বাইরের ঘরে ঢুকে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, তাহলে তুমি একখনও নাটক করছ? মানে? তোমার দাড়ি আর কাঁধের ব্যাগ বলে দিচ্ছে শিল্পের জন্যে
false
manik_bandhopaddhay
এই নীরবতার সুযোগে তাকে সে কত দিক দিয়ে কতভাবে বুঝছে হেরম্বের মনে তার চুলচেরা হিসাব চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় হঠাৎ সে অনুভব করে এই প্রক্রিয়া তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আনন্দকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার চেষ্টায় তার মধ্যে কেমন একটা অনুত্তেজিত অবসন্ন জ্বালা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্মুখে পথ অফুরন্ত জেনে যাত্রার গোড়াতেই অশ্ৰান্ত পথিকের যেমন স্তিমিত হতাশা জাগে, একটা ভারবোধ তাকে দমিয়ে রাখে, সেও ভুটা বিমানো চেপে-ধর কক্টর অধীন হয়ে পড়েছে। আনন্দের অন্তরঙ্গ প্রয়ে তার ফেন সুখ নেই। হেরম্ব বিছানায় উঠে বসে। লন্ঠনের এত কাছে আনন্দ বসেছে যে তাকে মনে হচ্ছে জ্যোতির্ময়ী, আলো যেন লণ্ঠনের নয়। হেরম্ব অসহায় বিপনের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আরো একটি অভিনব আত্মচেতনা খুঁজে পায়। তার বিহ্বলতার সীমা থাকে না। সন্ধ্যা থেকে আনন্দকে সে যে কেন নানা দিক থেকে বুঝবার চেষ্টা করছে, এতক্ষণে হেরম্ব সে রহস্যের সন্ধান পেয়েছে। ঝড়ো রাক্রির উত্তাল সমুদ্রের মতো অশান্ত অসংযত হৃদয়কে এমনিভাবে সে সংযত করে রাখছে, আনন্দকে জািনবার ও বুঝবার এই অপ্ৰমত্ত ছলনা দিয়ে। আনন্দ যেমনি হোক কি তার এসে যায়? সে বিচার পড়ে আছে সেই জগতে, যে জগৎ আনন্দের জন্যই তাকে অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। জীবনে ওর যত অনিয়ম–যত অসঙ্গতিই থাক, কিসের সঙ্গে তুলনা করে সে তা যাচাই করবে? আনন্দকে সে যে স্তরে পেয়েছে সেখানে ওর অনিয়ম নিয়ম, ওর অসঙ্গতিই সঙ্গতি। ওর অনিবাৰ্য আকর্ষণ ছাড়া বিশ্বজগতে আজ আর দ্বিতীয় সত্য নেই, ওর হৃদয়মনের সহস্র পরিচয় সহস্রাবার আবিষ্কার করে তার লাভ কি হবে? তার মোহকে সে চরম পরিপূর্ণতার স্তরে তুলে দিয়েছে, তাকে আবার গোড়া থেকে শুরু করে বাস্তবতার ধাপে ধাপে চিনে গিয়ে তিল তিল করে মুগ্ধ হবার মানে কি হয়? এ তারই হৃদয়মনের দুর্বলতা। ঈশ্বরকে কৃপাময় বলে কল্পনা না করে যে দুর্বলতার জন্য মানুষ ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারে না, এ সেই দুর্বলতা? আনন্দকে আশ্রয় করে যে অপার্থিব অবোধ্য অনুভূতি নীহারিকালোকের রহস্যসম্পদে তার চেতনাকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে দিতে চায়, পৃথিবীর মাটিতে প্রোথিত সহস্র শিকড়ের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে উর্ধািয়ত জ্যোতিস্তরের মতো তাকে উক্তৃঙ্গ আত্মপ্রকাশে সমাহিত করে ফেলতে চায়, সেই অব্যক্ত অনুভূতি ধারণ করবার শক্তি হৃদয়ের নেই বলে অভিজ্ঞতার অসংখ্য অনভিব্যক্তি দিয়ে তাকেই সে আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছে! আকাশকুসুমকে আকাশে উঠে সে চয়ন করতে পারে না। তাই অসীম ধৈর্যের সঙ্গে বাগানের মাটিতে তার চাষ করছে। হৃদয়ের একটিমাত্র অবাস্তব বন্ধনের সমকক্ষ লক্ষ বাস্তব বন্ধন সৃষ্টি করে সে আনন্দকে বাঁধতে চায়। সুখ-দুঃখের অতীত উপভোগকে সে পরিণত করতে চায় তার পরিচিত পুলকবেদনায়। আজ সন্ধ্যা থেকে সে এই অসাধ্য সাধনে ব্ৰতী হয়েছে। আনন্দ পুরাতন প্রশ্ন করল। ‘কি ভাবছেন?’ ‘অনেক কথাই ভাবছি, আনন্দ। তার মধ্যে প্রধান কথাটা এই, আমার কি হয়েছে।’ ‘কি হয়েছে?’ ‘কি রকম একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে।’ আনন্দ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমারও হয়। নাচবার আগে আমার ওরকম হয়।’ হেরম্ব উৎসুক হয়ে বলল, ‘তোমার কি রকম লাগে?’ ‘কি রকম লাগে?’ আনন্দ একটু ভাবল, ‘তা বলতে পারব না। কি রকম যেন একটা অদ্ভুত—’ ‘আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, আনন্দ।’ ‘আমিও আপনারটা বুঝতে পারছি।‘ পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে তারা হেসে ফেলল। আনন্দ বলল, ‘আপনার খিদে পায় নি? কিছু খান।’ হেরম্ব বলল, ‘দাও। বেশি দিও না।’ একটি নিঃশব্দ সঙ্কেতের মতো আনন্দ যতবার ঘরে আনাগোনা করল, জানালার পাটগুলি ভালো করে খুলে দিতে গিয়ে যতক্ষণ সে জানালার সামনে দাঁড়াল, ঠিক সম্মুখে এসে যতবার সে চোখ তুলে সোজা তার চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল—তার প্রত্যেকটির মধ্যে হেরম্ব তাঁর আত্মার পরাজয়কে ভুলে যাবার প্রেরণা আবিষ্কার করল। তার ক্রমে ক্রমে মনে হল, হয়তো এ পরাজয়ের গ্লানি মিথ্যা। বিচারে হয়তো ভুল আছে। হয়তো জয়-পরাজয়ের প্রশ্নই ওঠে না। হেরম্বের মন যখন এই আশ্বাসকে খুঁজে পেয়েও সন্দিগ্ধ পরীক্ষকের মতো বিচার করে না দেখে। গ্ৰহণ করতে পারছে না, আনন্দ তার চিন্তায় বাধা দিল। আনন্দের হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে, সিঁড়িতে বসে হেরম্বকে একটা কথা বলবে, মনে করেও বলা হয় নি। কথাটা আর কিছুই নয়। প্রেম যে একটা অস্থায়ী জোরালো নেশ্যমাত্র হেরম্ব এ খবর পেল কোথায়! একটু আগেও এ কথা জিজ্ঞাসা করতে আনন্দের লজ্জা হচ্ছিল। কিন্তু কি আশ্চৰ্য, এখন তার একটুও লজ্জা করছে না। ‘আপনাকে সত্যি কথাটা বলি। সন্ধ্যার সময় আপনাকে যে বন্ধু বলেছিলাম, সেটা বানানো কথা। এতক্ষণে আপনাকে বন্ধু মনে হচ্ছে।’ ‘এখন কত রাত্রি?’ ‘কি জানি। দশটা সাড়ে-দশটা হবে। ঘড়ি দেখে আসব?’ ‘থাক। আমার কাছে ঘড়ি আছে। দশটা বাজতে এখনো তের মিনিট বাকি।’ আনন্দ বিস্মিতা হয়ে বলল, ‘ঘড়ি আছে, সময় জিজ্ঞেস করলেন যে?’ হেরম্ব হেসে বলল, ‘ঘড়ি দেখতে জান কিনা পরখ করছিলাম। মালতী—বৌদির সাড়াশব্দ যে না?’ আনন্দ হাসল। বলল, ‘অত বোকা নাই, বুঝলেন? এমনি করে আমার কথাটা এড়িয়ে যাবেন, তা হবে না। রোমিও জুলিয়েট বেঁচে থাকলে তাদের প্ৰেম অল্পদিনের মধ্যে মরে যেত, আপনি কি করে জানলেন বলুন।’ হেরম্ব এটা আশা করে নি। লজ্জা না করার অভিনয় করতে আনন্দের যে প্রাণান্ত হচ্ছে, এটুকু ধরতে না পারার মতো শিশুচোখ হেরম্বের নয়। একবার মরিয়া হয়ে সে প্রশ্ন করছে, তার সম্বন্ধে এই সুস্পষ্ট ব্যক্তিগত প্রশ্নটা। তার এ সাহস অতুলনীয়। কিন্তু প্রশ্নটা চাপা দিয়েও আনন্দের শরম-তিক্ত অনুসন্ধিৎসাকে চাপা দেওয়া গেল না দেখে হেরম্ব অবাক
false
humayun_ahmed
মুখে হ্যাঁ বলুন। আব্দুর রহমান বললেন, হ্যাঁ। আমি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার উনার যে অবস্থা। আপনি উনাকে যাই জিজ্ঞেস করুন। উনি মাথা নাড়বেন। হ্যাঁ বলতে বললে বলবেন–হ্যাঁ। আপনি উনাকে জিজ্ঞেস করুন— গরু কি আকাশে উড়তে পারে? উনি বলবেন–হ্যাঁ। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমার খালু সাহেবের মতো ইংরেজিতে আমাকে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো— আমি কী জিজ্ঞেস বাঁ করব না। সেই বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নেব। তোমার কাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার। আব্দুর রহমান সাহেবের আত্মীয়স্বজনরা এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। তাদের কারো চোখে ভয়, কারো চোখে ক্ৰোধ, কারো চোখে তীব্র ঘৃণা। শুধু একটা পাঁচ ছ বছরের বাচ্চা মেয়ের চোখে প্রবল বিস্ময়। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, খুঁকি তোমার কী নাম? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমার নাম উর্মি। আমি ক্লাস টুতে পড়ি। আমি বললাম, ক্লাস টু খায় গু। ঊর্মি ফিক করে হেসে ফেলল। বয়স্ক একজন মহিলা ধাক্কা দিয়ে ঊৰ্মিকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন। ওসি সাহেবের ঘরে আমি বসে আছি। আমার সামনে ফুলফুলিয়া। সে আমাকে দেখতে এসেছে। ওসি সাহেব ভদ্রতা করে ফুলফুলিয়াকে তাঁর ঘরে বসিয়েছেন। আমাকে হাজত থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন। আমরা দুজন যেন নিরিবিলি কথা বলতে পারি। তার জন্যে নিজে ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে গেছেন। আমার হাতে হাতকড়া নেই, কোমরে দড়ি নেই। সকালে দাড়ি শেভ করার জন্যে ওসি সাহেব ডিসপোজেবল শেভার এবং শোভিংক্রিম পাঠিয়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়া তাঁর বাসা থেকেই আসছে। আজ দুপুরের পর আমাকে থানা হাজত থেকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওসি সাহেবের সমস্যার সমাধান। বেচারা খুবই লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। কেইস সাজানো এত নিখুঁত হবে সেটা মনে হয়। ভবেন নি। তারপর ফুলফুলিয়া কেমন আছ? ফুলফুলিয়া জবাব দিল না। চেয়ারে বসা ছিল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর ব্যাপারটা তরুণী মেয়েদের মধ্যে নেই। আমি যে হাজতে আছি খোঁজ পেলে কী করে? সব পত্রিকায় আপনার ছবি ছাপা হয়েছে। আপনি ক্ষুর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার হাতে হাতকড়া পরানো। আপনার সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার। তার হাতে পিস্তল। ছবিটা সুন্দর হয়েছে? খুব ভালো হয়েছে। কোনো খুনি আসামি ক্ষুর হাতে এমন হাসিমুখে ছবি তুলে না। আপনার মুখ ভর্তি হাসি। এই ঝামেলায় আপনি ইচ্ছা করে জড়িয়েছেন, তাই না? মানুষ ইচ্ছা করে ঝামেলায় জড়াতে চায় না। ভুল বললেন। প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ইচ্ছা করে ঝামেলায় জড়ায়। মানুষ ঝামেলা পছন্দ করে। ফুলফুলিয়া দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস। ফুলফুলিয়া বসল। আমি বসলাম তার পাশে এবং মুগ্ধ হয়ে তাকালাম। ফুলফুলিয়াকে আজ ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। আজ যে তার সাজাগোজের পরিবর্তন হয়েছে তা না। তার বাবার বাজনা রেকর্ডিং-এর দিন যে শাড়ি পরা ছিল সেই শাড়িটিই সে পরেছে। চোখে কাজল দেয় নি বাঁ মুখে পাউডার দেয় নি। মেয়েদের এই একটি বিশেষ ব্যাপার আছে–দিনের কোনো কোনো সময়ে তাদের ইন্দ্রাণীর মতো লাগে। ফুলফুলিয়া বলল, বাবার সিডিটা বের হয়েছে। আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। সত্যি সত্যি সিডি বের করেছেন? কই দেখি কেমন হয়েছে। আমি আনি নি। বাবার ইচ্ছা সিডিটা উনি নিজে আপনার হাতে দেবেন। উনি কেমন আছেন? ভালো না। ভালো না মানে কি? তিনি কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না। ডাক্তাররা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। তাকে কি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে? জি। হাসপাতালের বেডে তিনি হাত-পা সোজা করে লম্বা হয়ে পড়ে থাকেন। কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দেন না। তোমার কথারও জবাব দেন না? না। শুধু গতকাল রাতে অতীশ দীপংকর রোডের রাধাচুড়া গাছটার কথা বললেন। গাছটা দেখে আসতে বললেন। তুমি নিশ্চয়ই গাছ দেখতে যাও নি? না, আমি যাই নি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খুব হাস্যকর লাগছে। একটা মানুষ তার নিজের জীবন গাছকে দিয়ে সে গাছ হয়ে যাবে। একজন উন্মাদও তো এভাবে চিন্তা করবে না। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তোমার বাবা গাছ হয়ে গেলে তোমার জন্যই তো সুবিধা। ফুলফুলিয়া অবাক হয়ে বলল, আমার জন্যে কী সুবিধা? তোমাকে আগলে আগলে রাখবেন না। তোমার সঙ্গে যাতে কোনো তরুণের পরিচয় না হয় তার জন্যে আগ বাড়িয়ে বলবেন না যে আমার মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী থাকে নাইক্ষ্যংছড়ি। ফুলফুলিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলকহীন মাছের দৃষ্টি। আমি বললাম, যতদিন তোমার বাবা বেঁচে থাকবেন ততদিন তোমার জীবন শুরু হবে না। একজন মানুষের মৃত্যুর ব্যাপার আপনি এত সহজে বলতে পারলেন? হ্যাঁ পারলাম। আপনি পাথরের মতো মানুষ, এটা জানেন? জানি। যদি আপনার ফাঁসি হয় আপনি কি হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় দিতে পারবেন? চেষ্টা অবশ্যই করব। পারব কি-না বুঝতে পারছি না। চেষ্টা কেন করবেন? আপনি আলাদা, আপনি অন্যদের মতো না, এটা প্ৰমাণ করার জন্যে? আমরা কেউ তো কারো মতো নাই। আমরা সবাই আলাদা। আমার বিয়ে হয় নি। বিয়ের কথা মিথ্যা করে বলা হচ্ছে –এই তথ্য আপনাকে কে দিল? বাবা দিয়েছেন? না। আমি নিজেই চিন্তা করে বের করেছি। কবে বের করেছেন? যেদিন তোমার সঙ্গে প্ৰথম দেখা হলো সেদিন। এতদিন বলেন নি কেন? তোমরা পিতা-কন্যা একটা খেলা খেলছ, আমি খেলাটা নষ্ট করি নি। আজ হঠাৎ খেলাটা নষ্ট করলেন কেন? খেলা নষ্ট করলাম। কারণ–জহির ঢাকায় আসছে। তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আমি
false
robindronath
সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত বাহির হইল। সেই শৈলশিখরের উপরে সেই বকুলতরুচ্ছায়ায় মর্মাহত অমর বসিয়া আছেন। এক-একটি করিয়া ছেলেবেলাকার সকল কথা মনে পড়িতে লাগিল। কত জ্যোৎস্নারাত্রি, কত অন্ধকার সন্ধ্যা, কত বিমল উষা, অস্ফুট স্বপ্নের মতো তাঁহার মনে একে একে জাগিতে লাগিল। সেই বাল্যকালের সহিত তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের অন্ধকারময় মরুভূমির তুলনা করিয়া দেখিলেন— সঙ্গী নাই, সহায় নাই, আশ্রয় নাই, কেহ ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিবে না, কেহ তাঁহার মর্মের দুঃখ শুনিয়া মমতা প্রকাশ করিবে না— অনন্ত আকাশে কক্ষচ্ছিন্ন জ্বলন্ত ধূমকেতুর ন্যায়, তরঙ্গাকুল অসীম সমুদ্রের মধ্যে ঝটিকাতাড়িত একটি ভগ্ন ক্ষুদ্র তরণীর ন্যায়, একাকী নীরব সংসারে উদাস হইয়া বেড়াইবেন। ক্রমে দূর গ্রামের কোলাহলের অস্ফুট ধ্বনি থামিয়া গেল, নিশীথের বায়ু আঁধার বকুলকুঞ্জের পত্র মর্মরিত করিয়া বিষাদের গম্ভীর গান গাহিল। অমর গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে, শৈলের সমুচ্চ শিখরে একাকী বসিয়া দূর নির্ঝরের মৃদু বিষণ্ন ধ্বনি, নিরাশ হৃদয়ের দীর্ঘনিঃশ্বাসের ন্যায় সমীরণের হূ—হু শব্দ, এবং নিশীথের মর্মভেদী একতানবাহী যে-একটি গম্ভীর ধ্বনি আছে, তাহাই শুনিতেছিলেন। তিনি দেখিতেছিলেন অন্ধকারের সমুদ্রতলে সমস্ত জগৎ ডুবিয়া গিয়াছে, দুরস্থ শ্মশানক্ষেত্রে দুই-একটি চিতানল জ্বলিতেছে, দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত নীরন্ধ্র স্তম্ভিত মেঘে আকাশ অন্ধকার। সহসা শুনিলেন উচ্ছ্বসিত স্বরে কে কহিল, “ভাই অমর” – এই অমৃতময়, স্নেহময়, স্বপ্নময় স্বর শুনিয়া তাঁহার স্মৃতির সমুদ্র আলোড়িত হইয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখিলেন—কমল। মুহূর্তের মধ্যে নিকটে আসিয়া বাহুপাশে তাঁহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া কহিল, “ভাই অমর” – অচলহৃদয় অমরও অন্ধকারে অশ্রু বিসর্জন করিলেন, আবার সহসা চকিতের ন্যায় দূরে সরিয়া গেলেন। কমল অমরকে কত কী কথা বলিল, অমর কমলকে দুই-একটি উত্তর দিলেন। সরলা আসিবার সময়ে যেরূপ উৎফুল্লহৃদয়ে হাসিতে হাসিতে আসিয়াছিল, যাইবার সময় সেইরূপ ম্রিয়মাণ হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল। কমল ভাবিয়াছিল সেই ছেলেবেলাকার অমর ফিরিয়া আসিয়াছে, আর আমি সেই ছেলেবেলাকার কমল কাল হইতে আবার খেলা করিতে আরম্ভ করিব। যদিও অমর মর্মের গভীরতলে সাংঘাতিক আহত হইয়াছিলেন, তথাপি তিনি কমলের উপর কিছুই ক্রুদ্ধ হন নাই বা অভিমান করেন নাই। তাঁহার জন্য বিবাহিত-বালিকার কর্তব্যকর্মে বাধা না পড়ে এই নিমিত্ত তিনি তাহার পরদিন কোথায় যে চলিয়া গেলেন তাহা কেহই স্থির করিতে পারিল না। বালিকার সুকুমার হৃদয়ে দারুণ বজ্র পড়িল। অভিমানিনী কতদিন ধরিয়া ভাবিয়াছে যে, এত দিনের পর সে বাল্যসখা অমরের কাছে ছুটিয়া গেল, অমর কেন তাহাকে উপেক্ষা করিল। কিছুই ভাবিয়া পায় নাই। একদিন তাহার মাতাকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, মাতা তাহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, কিছুকাল রাজসভার আড়ম্বররাশির মধ্যে থাকিয়া সেনাপতি অমরসিংহ পর্ণকুটিরবাসিনী ভিখারিনী ক্ষুদ্র বালিকাটিকে ভুলিয়া যাইবেন তাহাতে অসম্ভব কী আছে। এই কথায় দরিদ্র বালিকার অন্তরতম দেশে শেল বিঁধিয়াছিল। অমরসিংহ তাহার প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ করিল মনে করিয়া কমল কষ্ট পায় নাই। হতভাগিনী ভাবিত, ‘আমি দরিদ্র, আমার কিছুই নাই, আমার কেহই নাই, আমি বুদ্ধিহীনা ক্ষুদ্র বালিকা, তাঁহার চরণরেণুরও যোগ্য নহি, তবে তাঁহাকে ভাই বলিব কোন্‌ অধিকারে! তাঁহাকে ভালোবাসিব কোন্‌ অধিকারে! আমি দরিদ্র কমল, আমি কে যে তাঁহার স্নেহ প্রার্থনা করিব!’ সমস্ত রাত্রি কাঁদিয়া কাটিয়া যায়, প্রভাত হইলেই সেই শৈলশিখরে উঠিয়া ম্রিয়মাণ বালিকা কত কী ভাবিতে থাকে, তাহার মর্মের নিভৃত তলে যে বাণ বিদ্ধ হইয়াছিল তাহা যদিও সে মর্মেই লুকাইয়া রাখিয়াছিল— পৃথিবীর কাহাকেও দেখায় নাই— তথাপি ঐ মর্মে-লুক্কায়িত বাণ ধীরে ধীরে তাহার হৃদয়ের শোণিত ক্ষয় করিতে লাগিল। বালিকা আর কাহারও সহিত কথা কহিত না, মৌন হইয়া সমস্তদিন সমস্তরাত্রি ভাবিত। কাহারও সহিত মিশিত না। হাসিত না, কাঁদিত না। এক-একদিন সন্ধ্যা হইলেও দেখা যাইত পথপ্রান্তের বৃক্ষতলে মলিন ছিন্ন অঞ্চলে মুখ ঝাঁপিয়া দীনহীন কমল বসিয়া আছে। বালিকা ক্রমে দুর্বল ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল। আর উঠিতে পারে না— বাতায়নে একাকিনী বসিয়া থাকিত, দেখিত দূর শৈলশিখরের উপর বকুলপত্র বায়ুভরে কাঁপিতেছে। দেখিত রাখালেরা সন্ধ্যার সময় উদাস-ভাবোদ্দীপক সুরে মৃদু মৃদু গান করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া আসিতেছে। বিধবা অনেক চেষ্টা করিয়াও বালিকার কষ্টের কারণ বুঝিতে পারেন নাই এবং তাহার রোগের প্রতিকার করিতেও পারেন নাই। কমল নিজেই বুঝিতে পারিত যে, সে মৃত্যুর পথে অগ্রসর হইতেছে। তাহার আর কোনো বাসনা ছিল না, কেবল দেবতার কাছে প্রার্থনা করিত যে ‘মরিবার সময় যেন অমরকে দেখিতে পাই’। কমলের পীড়া গুরুতর হইল। মূর্ছার পর মূর্ছা হইতে লাগিল। শিয়রে বিধবা নীরব, কমলের গ্রাম্য সঙ্গিনী বালিকারা চারি ধার ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দরিদ্র বিধবার অর্থ নাই যে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করিতে পারেন। মোহন দেশে নাই এবং দেশে থাকিলেও তাহার নিকট হইতে কিছু আশা করিতে পারিতেন না। তিনি দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া সর্বস্ব বিক্রয় করিয়া কমলের পথ্যাদি যোগাইতেন। চিকিৎসকদের দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করিয়া ভিক্ষা চাহিতেন যে, তাহারা কমলকে একবার দেখিতে আসুক। অনেক মিনতিতে চিকিৎসক কমলকে আজ রাত্রে দেখিতে আসিবে বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। অন্ধকার রাত্রের তারাগুলি ঘোর নিবিড় মেঘে ডুবিয়া গিয়াছে, বজ্রের ঘোরতর গর্জন শৈলের প্রত্যেক গুহায় গুহায় প্রতিধ্বনিত হইতেছে এবং অবিরল বিদ্যুতের তীক্ষ্ম চকিতচ্ছটা শৈলের প্রত্যেক শৃঙ্গে শৃঙ্গে আঘাত করিতেছে। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। প্রচণ্ড বেগে ঝটিকা বহিতেছে। শৈলবাসীরা অনেক দিন এরূপ ঝড় দেখেন নাই। দরিদ্র বিধবার ক্ষুদ্র কটির টলমল করিতেছে, জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া বৃষ্টিধারা গৃহে প্রবাহিত হইতেছে এবং গৃহপার্শ্বে নিষ্প্রভ প্রদীপশিখা ইতস্তত কাঁপিতেছে। বিধবা এই ঝড়ে চিকিৎসকের আসিবার আশা পরিত্যাগ করিয়াছেন। হতভাগিনী নিরাশহৃদয়ে নিরাশাব্যঞ্জক স্থির দৃষ্টিতে কমলের মুখের পানে চাহিয়া আছেন ও প্রত্যেক শব্দে চিকিৎসকের আশায় চকিত হইয়া দ্বারের দিকে
false
shordindu
মধ্যে শিল্পী রসিক গুণিজনও আছে। একটি কোট-প্যান্ট পরা ছোকরা প্রেক্ষাভূমি থেকে উঠে এসে রবীন্দ্রনাথের গান ধরল–তোমরা সবাই ভাল‌, আমাদের এই আঁধার ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলো। ছোকরার গলা ভাল; গান শুনতে শুনতে শ্ৰোতাদের দন্ত বিকশিত হয়ে রইল। দীপার মুখেও একটি অরুণাভ হাসি আনাগোনা করতে লাগল। সে একবার আড়চোখে দেবাশিসের পানে তাকাল; দেখল‌, তার ঠোঁটে লোক-দেখানো নকল হাসি। দীপা এখন দেবাশিসের হাসি দেখে বুঝতে পারে আসল হাসি কি নকল হাসি। তার মন হোঁচটি খেয়ে শক্ত হয়ে বসল। গানের পালা শেষ হলে আর একটি যুবক এসে গম্ভীর মুখে একটি হাসির গল্প শোনাল। সকলে খুব খানিকটা হাসল। তারপর ডক্টর দত্ত উঠে ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। চা কেক দিয়ে সভা শেষ হল। দেবাশিস দীপাকে নিয়ে নিজের মোটরের কাছে এসে দেখল‌, মোটরের পিছনের সীট একরাশ গোলাপফুল এবং আরো অনেক উপহারদ্রব্যে ভরা। দেবাশিস স্নিগ্ধকণ্ঠে সকলকে ধন্যবাদ দিল‌, তারপর দীপকে পাশে বসিয়ে মোটর চালিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যে তখন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সাবধানে গাড়ি চালাতে চালাতে দেবাশিস বলল—’কেমন লাগল?’ পাশের আলো-আঁধারি থেকে দীপা বলল—’ভাল।’ গাড়ির দু’পাশের ফুটপাথ দিয়ে স্রোতের মত লোক চলেছে‌, তারা যেন অন্য জগতের মানুষ। গাড়ি চলতে চলতে কখনো চৌমাথার সামনে থামছে‌, আবার চলছে; এদিক ওদিক মোড় ঘুরে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। ‘ডক্টর দত্তকে কেমন মনে হল?’ এবার দীপার মনে একটু আলো ফুটল–’খুব ভালো লোক‌, এত চমৎকার কথা বলেন। উনি কি অনেক দিন। এখানে‌, মানে ফ্যাক্টরিতে আছেন?’ দেবাশিস বলল–’বাবা যখন ফ্যাক্টরি পত্তন করেন তখন থেকে উনি আছেন। আমি ফ্যাক্টরির মালিক বটে‌, কিন্তু উনিই কর্তা।’ গাড়ির অভ্যন্তর গোলাপের গন্ধে পূর্ণ হয়ে আছে। দীপা দীর্ঘ আন্ত্রাণ নিয়ে বলল—’ফ্যাক্টরির অন্য সব লোকেরাও ভাল।’ দেবাশিস মনে মনে ভাবল‌, ফ্যাক্টরির সবাই ভাল‌, কেবল মালিক ছাড়া। মুখে বলল—‘ওরা সবাই আমাকে ভালবাসে।’ একটু থেমে বলল–’ফ্যাক্টরি থেকে বার্ষিক যে লাভ হয় তার থেকে আমি নিজের জন্যে বারো হাজারা টাকা রেখে বাকি সব টাকা কর্মীদের মধ্যে মাইনের অনুপাতে ভাগ করে দিই।’ ‘ও—’ দীপার মনে একটা কৌতূহল উঁকি মারল‌, সে একবার একটু দ্বিধা করে শেষে প্রশ্ন করল–’ফ্যাক্টরি থেকে কত লাভ হয়?’ দেবাশিস উৎসুকভাবে একবার দীপার পানে চাইল‌, তারপর বলল–’খরচ-খরচা বাদ দিয়ে ইনকাম ট্যাক্স শোধ করে এ বছর আন্দাজ দেড় লাখ টাকা বেঁচেছে। আশা হচ্ছে‌, আসছে বছর আরো বেশি লাভ হবে।’ আর কোনো কথা হবার আগেই মোটর বাড়ির ফটকে প্রবেশ করল। বাড়ির সদরে মোটর দাঁড় করিয়ে দেবাশিস বলল-‘গোলাপফুলগুলোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’ দীপা বলল–’আমি করছি।’ নকুল এসে দাঁড়িয়েছিল‌, দীপা তাকে প্রশ্ন করল–’নকুল‌, বাড়িতে ফুলদানি আছে?’ নকুল বলল–’আছে। বইকি বউদি‌, ওপরের বসবার ঘরে দেয়াল-আলমারিতে আছে। চাবি তো তোমারই কাছে।’ ‘আচ্ছা। আমি ওপরে যাচ্ছি‌, তুমি গাড়ি থেকে ফুল আর যা যা আছে নিয়ে এস।’ দীপা ওপরে চলে গেল। ওপরের বসবার ঘরে কাবার্ডে অনেক শৌখিন বাসন-কোসন ছিল‌, তার মধ্যে কয়েকটা রূপের ফুলদানি। কিন্তু বহুকাল অব্যবহারে রূপোর গায়ে কলঙ্ক ধরেছে। দীপা ফুলদানিগুলোকে বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর নকুল এক বোঝা গোলাপ নিয়ে উপস্থিত হলে তাকে প্রশ্ন করল-নকুল‌, ব্ৰাসো আছে?’ নকুল বলল–’বাসন পরিষ্কার করার মলম? না বউদি‌, ছিল‌, শেষ হয়ে গেছে। কে আর রূপের বাসন মাজাঘষা করছে! আমি তেঁতুল দিয়েই কাজ চালিয়ে নিই।’ দীপা বলল—’তেঁতুল হলেও চলবে। এখন চল‌, ফুলগুলোকে বাথরুমের টবে রেখে ফুলদানি পরিষ্কার করতে হবে।’ দীপার শয়নঘরের সংলগ্ন বাথরুমে জলভরা টবে লম্বা ডাঁটিসুদ্ধ গোলাপ ফুলগুলোকে আপাতত রেখে দীপা তেঁতুল দিয়ে ফুলদানি সাফ করতে বসল। এতদিন পরে সে একটা কাজ পেয়েছে যাতে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও ভুলে থাকা যায়। দেবাশিস একবার নিঃশব্দে ওপরে এসে দেখল‌, দীপা ভারি ব্যস্ত। আচলটা গাছ-কোেমর করে। জড়িয়েছে‌, মাথার চুল একটু এলোমেলো হয়েছে; ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। দেবাশিস দোরের কাছে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট চোখে দেখল‌, কিন্তু দীপা তাকে লক্ষ্যই করল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেবাশিস আস্তে আস্তে নীচে নামল‌, তারপর নৃপতির বাড়িতে চলে গেল। কিন্তু আজ আর তার আড্ডায় মন বসল না! ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল। ওপরের বসবার ঘরে দীপা রেডিও চালিয়ে বসে ছিল‌, দেবাশিসকে দেখে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে রেডিও নিবিয়ে উঠে দাঁড়াল‌, বলল–’ফুলগুলোকে ফুলদানিতে সাজিয়ে ঘরে ঘরে রেখেছি। দেখবে?’ দেবাশিসের মনের ভিতর দিয়ে বিস্ময়ানন্দের বিদ্যুৎ খেলে গেল। দীপা এতদিন তাকে প্রকাশ্যে ‘তুমি এবং জনাস্তিকে ‘আপনি বলেছে‌, আজ হঠাৎ নিজের অজান্তে জনান্তিকেও ‘তুমি বলে ফেলেছে। দেবাশিস মুচকি হেসে বলল–’চল‌, দেখি।’ দীপা তার হাসি লক্ষ্য করল; হাসিটা যেন গোপন অর্থবহ। সে কিছু বুঝতে পারল না‌, বলল—‘এস।‘ নিজের শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে দীপা দেবাশিসের মুখের পানে চাইল; দেবাশিস দেখল‌, ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে ঝকঝকে রূপের ফুলদানিতে দীৰ্ঘবৃন্ত একগুচ্ছ গোলাপ শোভা পাচ্ছে। লাল‌, গোলাপী এবং সাদা‌, তিন রঙের গোলাপ‌, তার সঙ্গে মেডেন হেয়ার ফানের জালিদার পাতা। ফুলদানিতে ফুল সাজানোর কলাকৌশল আছে‌, যেমন-তেমন করে সাজালেই হয় না। দেবাশিস খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠল–’বাঃ‌, ভারি চমৎকার সাজিয়েছ! মনে হচ্ছে যেন ফুলের ফোয়ারা।’ ঘর থেকে বেরিয়ে বসবার ঘরে এসে দেবাশিসের নজর পড়ল রেডিওগ্রামের ওপরে একটা ফুলদানিতে গোলাপ সাজানো রয়েছে। এর সাজ অন্য রকম; চরকি ফুলঝুরির মত ফুলগুলি গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে দেবাশিস বলল–’এটাও ভারি সুন্দর। আগে চোখে পড়েনি।’ এই সময় নকুল নীচে থেকে হাঁক দিল—’বউদিদি‌,
false
shorotchandra
দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া গেল। সোজা বাহিরে চলিয়া যাইতেছিল, মহেশ্বরী ভাঁড়ার হইতে দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিলেন, খেয়ে গেলিনে রে? না—সময় নেই। মহেশ্বরী বলিলেন, তবে কলেজ থেকে একটু সকাল করে ফিরে আসিস—ও বামুনঠাকুর, দিবাবাবুর জন্যে যেন সমস্ত ঠিক থাকে। দিবাকর উত্তর না দিয়া চলিয়া গেল। তাহার বাহিরের ছোট ঘরটিতে ফিরিয়া আসিয়া কাপড় পরিতে পরিতে চোখে জল আসিয়া পড়িল। সামনের বৈঠকখানা হইতে তখনও পাশাখেলার হুঙ্কার শোনা যাইতেছিল। হঠাৎ দ্বারের কাছে শব্দ শুনিয়া দিবাকর পিছন ফিরিয়া দেখিল, ঝি দাঁড়াইয়া আছে। তাড়াতাড়ি জামার হাতায় চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি? ঝি কহিল, ছোটবৌমা একবার ডাকচেন। যাচ্ছি, তুমি যাও। ঝি চলিয়া গেলে দিবাকর ছোটো টাইমপিসটির পানে চাহিয়া মুহূর্তকাল ইতস্ততঃ করিয়া বাঁ হাতের বইগুলা টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া জামার হাতায় আর একবার ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া লইয়া ভিতরে ফিরিয়া গেল। দিবাকরকে ডাকিতে পাঠাইয়া সুরবালা নিজের ঘরের সুমুখেই অপেক্ষা করিতেছিল। দিবাকর কাছে আসিয়া বলিল, কি? সুরবালা প্রকাশ্যে কথা কহিত না, আড়ালে কহিত। মাথার কাপড়টা আরো একটু টানিয়া দিয়া বলিল, একবার ঘরে এস; বলিয়াই ঘরে ঢুকিয়া দেখাইয়া দিল—মেঝের উপর আসন পাতা, একবাটি দুধ এবং রেকাবিতে দুই-চারিটি সন্দেশ,—দেখাইয়া দিয়া বলিল, খেয়ে তবে ইস্কুলে যাও। দিবাকর কোন কথা না বলিয়া খাইতে বসিয়া গেল। অদূরে শয্যার উপর তাহার ছোটদাদা উপেন্দ্রনাথ তখনও নিদ্রিতের মত পড়িয়া ছিলেন, দিবাকর খাইয়া চলিয়া যাইতেই মাথা তুলিয়া স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, এ আবার কি? সুরবালা খাবার জায়গাটা পরিষ্কার করিয়া ফেলিতেছিল, চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি জেগে আছ নাকি? ঘণ্টা-দুই। এগারোটা পর্যন্ত মানুষে ঘুমুতে পারে? সুরবালা হাসিয়া কহিল, তুমি সব পার। নইলে মানুষে কি এগারোটা পর্যন্ত পড়ে থাকতে পারে? উপেন্দ্র কহিলেন, সকলে পারে না, কিন্তু আমি পারি। তার কারণ, শুয়ে থাকার মত ভাল জিনিস সংসারে আমি দেখতে পাইনে। সে যাই হোক, দিবাকরের— সুরবালা বলিল, ঠাকুরপো রাগ করে না খেয়ে কলেজে যাচ্ছিলেন, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলুম! হেতু? সুরবালা বলিল, রাগ সত্যিই হয়। ও বেচারার সকালে পড়বার জো নেই—বাজারে যেতে হবে, ফিরে এসে ঠাকুরপূজো করতে হবে। কোনদিন এগারোটা-বারোটা বেজে যায়। বল দেখি, কখনই বা খায়, কখনই বা পড়তে যায়? ঠিক বুঝলাম না। ভট্‌চায্যিমশায়ের জ্বর নাকি? সুরবালা কহিল, জ্বর হবে কেন? বাবার সঙ্গে পাশায় বসেছেন আর তাঁরই বা অপরাধ কি? বাবা ডেকে পাঠালে ত তিনি না বলতে পারেন না। উপেন্দ্র কহিল, তা ত পারেন না, কিন্তু আগে তিনি চাকরের সঙ্গে সকালে বাজারে যেতেন না? সুরবালা কহিল, দিন-কতক শখ করে গিয়েছিলেন মাত্র। না হলে ঠাকুরপোকেই বরাবর যেতে হয়। হুঁ, বলিয়া উপেন্দ্র পাশ ফিরিবার উপক্রম করিতেই সুরবালা সভয়ে বলিয়া উঠিল, কর কি, আবার পাশ ফেরো যে! উপেন্দ্র চুপ করিয়া আরো মিনিট-পাঁচেক পড়িয়া থাকিয়া উঠিয়া পড়িলেন, এবং নিঃশব্দে বাহিরে চলিয়া গেলেন। সেইদিন ঠাকুরপূজা হইল না, এই কথা ভাবিতে ভাবিতে দিবাকর অপ্রসন্ন মুখে ধীরে ধীরে কলেজে চলিয়াছিল। বাড়িতে এইমাত্র যে-সব ব্যাপার ঘটিয়া গেল, সে আলোচনা ভিন্ন ভাবিতেছিল ঠাকুরের পূজা হইল না। অনেকদিনের অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও এ কাজটিকে সে অবহেলা করে নাই, করিবার কথাও কোনদিন মনে উদয় হয় নাই। বিশেষ করিয়া এই কারণেই সে আজিকার কথা স্মরণ করিয়া পীড়া অনুভব করিতে লাগিল। যদিও যুক্তিতর্ক দ্বারা বারংবার মনকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল যে, ভগবান একটিমাত্র স্থানেই আবদ্ধ নহেন, সুতরাং একস্থানে ভোগ না জুটিলেও অন্যত্র জুটিয়াছে; তবু সেই যে তাহাদের অভুক্ত গৃহদেবতাটি তাঁহার নিত্যপূজা ও ভোগ হইতে বঞ্চিত হইয়া ক্রুদ্ধমুখে সিংহাসন বসিয়া রহিলেন, তাঁহার প্রতিহিংসার আশঙ্কা তাহার মন হইতে কিছুতেই ঘুচিতে চাহিল না। কলেজ গিয়া শুনিল, প্রফেসারের অসুখ হওয়ায় প্রথম ঘণ্টার ক্লাস বসে নাই—শুনিয়া দিবাকর প্রফুল্ল হইল। পরীক্ষা নিকট হইতেছে বলিয়া ছাত্রেরা হাজিরির হিসাবের নিমিত্ত কলেজের কেরানীকে ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। আজ অন্যান্য ছাত্রেরা যখন ওই উদ্দেশ্যে অফিস-ঘরের দিকে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিল তখন দিবাকরও প্রস্তুত হইল। কিন্তু অফিসের সম্মুখে আসিয়া ঠাকুরপূজা না করিবার কথা স্মরণ হইবামাত্র সে থামিয়া দাঁড়াইল। একজন জিজ্ঞাসা করিল, দাঁড়ালে যে? দিবাকর সংক্ষেপে উত্তর করিল, আজ থাক! থাকবে কেন, এস না, আজই দেখে নিই। না থাক, বলিয়া সে ফিরিয়া গেল। হাজিরি সম্বন্ধে মনে মনে তাহার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, সেই সন্দেহের মীমাংসা করিবার সাহস আজিকার দিনে তাহার কোনমতেই হইল না। খাইয়া না আসিলেও তাহার বাটী ফিরিবার তাড়া ছিল না। নানা কারণে আজ ক্ষুধা ছিল না। ছুটির পরে কলেজের ফটকের নিকটে আসিয়া দেখিল, তাহাদের বি. এ. ক্লাসের ছাত্রের দল দূরে দাঁড়াইয়া তর্ক-কোলাহল করিতেছে, দিবাকর অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া সরিয়া গেল এবং যে পথটা বরাবর গঙ্গায় গিয়া পড়িয়াছে, সেইদিকে চলিয়া গেল। ভাঙ্গা বাঁধানো-ঘাট মৃতের কঙ্কালের মত পড়িয়া আছে। একদিন যে ইহার দেহ ছিল, রূপ ছিল, প্রাণ ছিল, স্থানে স্থানে ইঁটের ভগ্নস্তূপ সেই কথাই বলে, আর কিছুই বলে না। কবে, কে বাঁধাইয়াছিল, কে আসিয়া বসিত, কাহারা স্নান করিত, কোথাও কোন সাক্ষ্য বিদ্যমান নাই। শীতের শীর্ণ গঙ্গা তাহারি এক প্রান্ত দিয়া অবিশ্রাম একটানা স্রোতে সমুদ্রে চলিয়াছে। তীরে পলির উপরে যবের শীষ মাথা তুলিয়া রৌদ্রের উত্তাপ ও গঙ্গার বায়ু গ্রহণ করিতেছে। তাহারি একধারে বালুময় সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া দিবাকর ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইল। একদিকে ছোট একখণ্ড ইষ্টকস্তূপের উপর জুতা খুলিয়া রাখিল, পিরান খুলিয়া ভারী বাঁধান বইগুলা চাপা দিল। তাহার পরে জলে নামিয়া হাতমুখ ধুইয়া মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া অভুক্ত
false
humayun_ahmed
কান্দাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি বিশেষ শকটে যাচ্ছেন হামিদা বানু। তার কোলে পারস্য-সম্রাটের শিশুপুত্র মুরাদ, যে কান্দাহারের সিংহাসনে বসবে। শিশুপুত্রের বয়স মাত্র তিন মাস। শিশুপুত্রকে দুধ খাওয়ানোর জন্যে তিনজন দুধ-মাও যাচ্ছেন। কান্দাহার দখল হলো বিনা যুদ্ধে। কামরানের সৈন্যদের বড় অংশ হুমায়ূনের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলো। কামরান পালিয়ে কাবুল দুর্গে আশ্রয় নিলেন। মীর্জা হিন্দালকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সেনাবাহিনীর একাংশের দায়িত্ব দেওয়া হলো। কান্দাহার দুর্গের পতনের ফলে মীর্জা কামরানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হুমায়ূনের দখলে চলে এসেছে। লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপির বিপুল সংগ্ৰহ দেখে হুমায়ূন মুগ্ধ। হুমায়ূন নির্দেশ জারি করলেন, এখন থেকে তিনি যেখানে যাবেন লাইব্রেরির প্রতিটি গ্রন্থ তাঁর সঙ্গে যাবে। শিশু মুরাদকে সিংহাসনে বসিয়ে হুমায়ূন ছুটলেন কাবুলের দিকে। কাবুল দুর্গ ঘেরাও করা হলো। হুমায়ূন কামান দাগার নির্দেশ দিলেন। দুৰ্গকে কামানের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য মীর্জা কামরান বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করলেন। তিন বছর বয়সী আকবরকে উঁচু খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দুর্গচূড়ায় খুঁটি লাগিয়ে দেওয়া হলো। কামানের গোলা ভেতরে পড়লেই শিশু আকবর নিহত হবে। হুমায়ূনের নির্দেশে গোলাবর্ষণ বন্ধ হলো। বৈরাম খাঁ হুমায়ূনকে বললেন, আপনি নিশ্চিত মনে তাঁবুতে অপেক্ষা করুন। আমার সঙ্গে অতি দক্ষ দুজন কামানচি আছে। এরা এমনভাবে কামান দাগবে যে, আপনার শিশুপুত্রের কোনো ক্ষতি হবে না। দ্রুত আমরা দুর্গের দখল নেব। হুমায়ূন তাঁবুর ভেতর ঢুকে অজু করে নামাজে বসলেন। কামানের গর্জনে তাঁবু কেঁপে কেঁপে উঠছে। হুমায়ূন নামাজে মন দিতে পারছেন না। নামাজের মাঝখানেই জওহর আবিতাবচি উত্তেজিত গলায় খবর দিল-জাহাঁপনা আমরা কাবুল দুর্গ দখল করেছি। বৈরাম খাঁ দুর্গে ঢুকে পড়েছেন। যুবরাজ আকবর সুস্থ আছেন। মীর্জা আসকারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিন বছর পর আকবর তার বাবা-মাকে সামনে দেখল। সে হুমায়ূনের দিকে আঙুল তুলে বলল, তুমি কে? হুমায়ূন বললেন, আমি কেউ না। আমি শুধু তোমার বাবা। শিশু আকবর বলল, আমার বাবা দিল্লীর সম্রাট বাদশাহ হুমায়ূন। তুমি না। হুমায়ূনের নির্দেশে হামিদা বানু এসে শিশুপুত্রকে কোলে তুললেন। আকবর বলল, তুমি কে? হামিদা বানু বললেন, আমি তোমার মা। যখন চারদিকে কামানের গোলা পড়ছিল তখন তুমি কি ভয় পাচ্ছিলে? হ্যাঁ। তোমাকে আর ভয় পেতে হবে না। তোমার বাবা চলে এসেছেন। হামিদা বানু স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, একটি ফরমান জারি করুন। লাইব্রেরির বই যেমন আপনার চোখের আড়াল হবে না, আপনার পুত্রও আপনার চোখের আড়াল হবে না। দলে দলে সৈন্য হুমায়ূনের পক্ষে যোগ দিচ্ছে। এদের বেতন দেওয়ার সামৰ্থ্য হুমায়ূনের নেই। সৈন্যরা বলল, এখন আমাদের কোনো বেতন দিতে হবে না। আপনি দিল্লীর সিংহাসনে বসার পর বেতন দেবেন। কামরান পালিয়ে লাহোর দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বৈরাম খাঁ দুৰ্গ দখল করলেন। কামরান মেয়েদের পোশাক পরে দুর্গ থেকে পালালেন। তাকে চেনার কোনো উপায় নেই। তিনি চুল-দাড়ি কামিয়ে সর্বহারা সন্ন্যাসীর ভেক ধরেছেন। তিনি রওনা হয়েছেন দিল্লীর দিকে। দিল্লীর সম্রাট ইসলাম শাহ’র কাছ থেকে যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। কাশির রাজপথে আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। তরুণী হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধের সামনে এসে দাঁড়াল। তরুণী বলল, আমি আপনাকে চিনি। আপনার নাম আমার মনে নেই, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। বৃদ্ধ বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে চিনতেও চাচ্ছি না। তরুণী বলল, হুমায়ূন-কন্যা আকিকা বেগম এবং তার বান্ধবী অম্বাকে কি আপনি চেনেন? আমি কাউকে চিনি না। এই দুজনকে আপনি আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন। বৃদ্ধ বলল, তুমি উন্মদিনী। উন্মদিনীর সঙ্গে আমি কথা বলি না। তরুণী আমাদের পরিচিত। তার নাম আসহারি। সম্রাট হুমায়ূন তাকে ‘আগ্রার বুলবুলি’ উপাধি দিয়েছিলেন। চৌসার যুদ্ধে সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাঁতরে তীরে উঠেছে। সম্রাট-কন্যার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটনার সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আসহারি অপেক্ষায় আছে কোনো একদিন সম্রাট হুমায়ূনকে ঘটনাটি জানাবে। শের শাহ কাজীর দুর্গ পরিদর্শনে গিয়েছেন। দুর্গপ্রাচীরের কামানগুলির অবস্থা কী দেখছেন। হঠাৎ একটি গোলাভরা কামান বিস্ফোরিত হলো। শের শাহ্ লুটিয়ে পড়লেন। মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর জ্ঞান ফিরল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমি মারা যাচ্ছি। দিল্লীর সিংহাসন আমি প্রথম পুত্ৰ জালাল খাঁ’র জন্যে নির্ধারণ করেছি। পুত্ৰ জালাল খাঁ সিংহের মতো সাহসী। একমাত্র সে-ই পারবে মোঘলদের হাত থেকে সিংহাসন রক্ষা করতে। আমার মন বলছে হুমায়ূন হারানো সিংহাসন পেতে ফিরে আসবেন। জালাল খাঁ ইসলাম শাহ নাম নিয়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন। ইসলাম শাহ্ কাব্যানুরাগী মানুষ ছিলেন। নিজে শের লিখতে পারতেন না, যারা পারত। তাদের প্রতি তার ভালোবাসার সীমা ছিল না। মানুষ হিসেবে তার অন্য গুণাবলিও ছিল। মদ্যপান বা কোনো নেশাজাতীয় বস্তুর প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। শের শাহ সম্পূর্ণ হিন্দুস্থানের রাস্তাঘাট বানানোর যে কাজ শুরু করেছিলেন, ইসলাম শাহ সেই কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন। দিল্লীর মানুষজন ইসলাম শাহকে পছন্দ করত। মুণ্ডিত মস্তক শ্মশ্রুবিহীন মীর্জা কামরান দিল্লীর সম্রাট ইসলাম শাহ’র সামনে বসে আছেন। কামরানকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইসলাম শাহ রসিকতা করে বললেন, আপনাদের মহিলারাও কি আপনার মতো মাথার চুল কামিয়ে ফেলে? কামরান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না। তারা আপনাদের মতো বিশাল গোফ রাখে। ইসলাম শাহহাসতে হাসতে বললেন, আপনার রসবোধ দেখে মুগ্ধ হলাম। আপনি চমৎকার শের লেখেন জানতাম। রসিকতা করতে পারেন জানতাম না। আপনার একটি শের শোনান। কামরান আবৃত্তি করলেন— গর্দিশে গরদূনে গরদ না রা দর্গ কর্দ বর সরে আহলে তমৗজা ওয়া নাকি সারা মর্দ কর্দ (ললাটের এমনই লিখন যে সে শ্রেষ্ঠ জনকে
false
shunil_gongopaddhay
খুনটুনের কী সম্পর্ক? অনির্বাণ বলল, যদি পৃথিবীর বাইরে থেকে কিছু এসে থাকে, তার মধ্যে কী ধরনের অদ্ভুত প্রাণী থাকবে তা আমরা জানি না। তারা খুব হিংস্র হতে পারে। কাকাবাবু হেসে বললেন, অনেক কমিক স্ট্রিপে গল্প আর ছবি থাকে, মহাকাশে ইদুরের মতন প্রাণী মানুষের চেয়েও অনেক শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান। সন্তু ওইসব গল্প খুব পড়ে। তুমিও পড়ো নাকি? সন্তু বলল, আজকাল ওগুলো সবাই পড়ে। কাকাবাবু বললেন, আমিও তো কয়েকখানা পড়েছি তোর ঘর থেকে নিয়ে। সায়েন্স ফিকশান হল একালের রূপকথা। পড়তে ভালই লাগে। কিন্তু অনির্বাণ, অন্য গ্রহের অদ্ভুত প্রাণীরা এসে তোমার এই কোচবিহারের সাধারণ মানুষদের মারবে কেন? অনির্বাণ বলল, তা ছাড়া যে আর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। ইউ এফ ওর প্রাণীরা হয়তো রাত্তিরে মাটিতে নেমে ঘুরে বেড়ায়। কোনও গ্রামের মানুষ দৈবাৎ তাদের দেখে ফেললেই সেই মানুষটাকে তারা মেরে ফেলছে গলা টিপে। যে কজন খুন হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই মুখে সাঙ্ঘাতিক ভয়ের ছাপ। একজন ভয়েই মারা গেছে, আর দুজনকে গলা মুচড়ে মেরেছে। কিন্তু আঙুলের ছাপ মানুষের মতন নয়! এই ব্যাপারটাতেই আমরা ধাঁধায় পড়েছি। কাকাবাবু বললেন, হুঁ, আচ্ছা, এই যে লোকগুলো খুন হয়েছে, এদের কারও সঙ্গে কারও কোনও সম্পর্ক আছে? অনির্বাণ বলল, এরা এক গ্রামের লোক নয়। কারও সঙ্গে কারও চেনা ছিল বলেও জানা যায়নি। শেষ যে লোকটা খুন হয়েছে, তার নাম ভবেন সিকদার। লেখাপড়া শেখেনি, বেকার, তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর বয়েস। পাড়ায় একটু মাস্তানি করত, কিন্তু এমন কিছু না, পুলিশের খাতায় নাম নেই। কাকাবাবু বললেন, বেকার ছেলে, স্বাস্থ্য ভাল, কিছু একটা কাজ করতে চায়, অথচ আমাদের দেশ এদের কোনও কাজ দিতে পারে না। এটাই তো আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। শেষ পর্যন্ত এই ছেলেদের কেউ-কেউ বদ লোকদের পাল্লায় পড়ে। এই ছেলেটা চোরা চালানিদের দলে যোগ দেয়নি তো? অনির্বাণ বলল, তা অসম্ভব কিছু নয়। সীমান্ত এলাকায় স্মাগলারদের উৎপাত তো আছেই। পুলিশ আর কতদিন সামলাবে! কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ আবার বললেন, টোবি দত্তকে যারা ছুরি মেরেছিল, তাদের কেউ ধরা পড়েছে? অনির্বাণ আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে, টোবি দত্ত থানায় কোনও অভিযোগ জানায়নি। ওখানকার থানাও আর বেশি দূর এগোয়নি, আরও অনেক কাজ থাকে তো! কাকাবাবু বললেন, বাঃ, একটা লোককে রাস্তার ওপর কয়েকজন লোক ঘিরে ধরে ছুরি মারল, পুলিশ তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেবে না? সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, টোবি দত্তর পিঠে ছুরি গেঁথে গিয়েছিল, তবু সে স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে? কাকাবাবু বললেন, তুই কি এখনও ভাবছিস, টোবি দত্তর অলৌকিক ক্ষমতা আছে? ছুরিটা বেশিদূর ঢোকেনি, তাই ক্ষতটা সেরে গেছে। অনির্বাণ বলল, টোবি দত্তর গায়েও বেশ জোর আছে। সে লোকগুলোকে ঘুসি চালিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। তাতে বোঝা যায়, সে সঙ্গে ছুরি, ছোরা, বন্দুক রাখে না। কাকাবাবু বললেন, তা বলে সে প্রতিশোধ নেবে না? প্রকাশ্য রাস্তায় কয়েকজন লোক তাকে খুন করতে গেল, তার মতন একজন তেজি লোক সেটা হজম করে যাবে? পুলিশ কিছু না করলেও সে নিশ্চয়ই ওই লোকগুলোকে খুঁজে বের করবে! অনির্বাণ বলল, তা বলে আপনি বলতে চান, টোবি দত্তই এই লোকগুলোকে খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছে? কিন্তু গলায় ওরকম অদ্ভুত আঙুলের ছাপ… সন্তু উত্তেজিতভাবে কিছু বলার জন্য ডাকল, কাকাবাবু… কাকাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেসব পরে দেখা যাবে। অনির্বাণ, তুমি আগে খোঁজ নাও। এই তিনজন লোকই এক দলের কি না! থানাগুলোতে চাপ দাও, ওরা গুণ্ডা-চোরাচালানিদের ঠিকই চেনে! অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে কোচবিহারের গ্রামের মানুষদের খুন করছে, একথা প্রকাশ্যে বোলো না, লোকে হাসবে!। অনির্বাণ বলল, খবরের কাগজেও এই ধরনের লিখছে! কাকাবাবু খানিকটা ধমকের সুরে বললেন, খবরের কাগজে লিখুক! আমাদের আপাতত ইউ এফ ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। তোমরা গ্রামের মানুষদের কথায় পাত্তা দাও না। ওদের কথাগুলো ভাল করে ভেবে দেখলে বুঝতে, ইউ এফ ওর ব্যাপারটা পুরো ধাপ্পা! সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, গ্রামের লোকরাই তো প্রথম থেকে বলছে, হেলিকপটার নয়, আগুনের পাখি, অন্য গ্রহের আকাশযান এসেছে পাঁচ-ছ বার! কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই কথাগুলোরই ঠিক-ঠিক মানে যদি আমরা বুঝতে না পারি, তা হলে আর আমরা শিক্ষিত কীসে? সন্তু তবু চোখ-মুখ খুচিয়ে রইল। কাকাবাবুর কথাগুলি তার ধাঁধার মতন মনে হচ্ছে। নাছোড়বান্দার মতন সে বলল, কাকাবাবু, আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি। আমাকে বুঝিয়ে দাও! কাকাবাবু হেসে বললেন, যথাসময়ে বলব। এর মধ্যে আরও ভেবে দ্যাখ নিজেই বুঝতে পারিস কি না! দুপুরবেলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল খানিকক্ষণ। তারপর আকাশ একেবারে পরিষ্কার। বেশ কয়েকদিন পর ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা গেল। হেডমাস্টারমশাই ইস্কুল থেকে ফেরার পর সবাই মিলে বারান্দায় চা খেতে বসলেন। কথায়-কথায় হেডমাস্টারমশাই বললেন, দিনহাটার একটা ইস্কুলে কে একজন লোক দু লক্ষ টাকা দান করেছে। হঠাৎ এত টাকা পেয়ে সবাই অবাক! টাকাটা কে দিয়েছে, তা জানা যাচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, ত্যাপা নামে একটি গরিবের ছেলে একসময় ওই ইস্কুলে পড়ত। বিদেশে গিয়ে সে খুব বড়লোক হয়েছে। খুব সম্ভবত টাকাটা সে-ই দান করেছে! হেডমাস্টারমশাই বললেন, আমাদের গ্রামের টোবি দত্তও তো খুব বড়লোক। তার মামাদের অত বড় বাড়িটা কিনেছে। আমাদের ইস্কুলের বাড়িটা সারানো দরকার, সে কিছু টাকা দিলে পারত! দিয়েছে মোটে পাঁচ হাজার টাকা! মণিকা গরম-গরম বেগুনি আর পেঁয়াজি ভেজে এনেছে মুড়ির সঙ্গে। তোফা খাওয়া হল। মণিকা জিজ্ঞেস করল,
false
robindronath
জাগিয়া দেখিলাম, আমাকে লইয়া তিনটি বালক অস্থিবিদ্যা শিখিতেছে! বুকের যেখানে সুখদুঃখ ধুক্ধুক্ করিত এবং যৌবনের পাপড়ি প্রতিদিন একটি একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইত, সেইখানে বেত্র নির্দেশ করিয়া কোন্ অস্থি’র কী নাম মাস্টার শিখাইতেছে। আর সেই যে অন্তিম হাসিটুকু ওষ্ঠের কাছে ফুটাইয়া তুলিয়াছিলাম, তাহার কোনো চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছিলে কি।” “গল্পটা কেমন লাগিল।” আমি বলিলাম, “গল্পটি বেশ প্রফুল্লকর।” এমন সময় প্রথম কাক ডাকিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখনো আছ কি।” কোনো উত্তর পাইলাম না। ঘরের মধ্যে ভোরের আলো প্রবেশ করিল। ফাল্গুন, ১২৯৮ বঃ ভূমিকা গ্রামের মধ্যে অনূপকুমারের ন্যায় ধনবান আর কেহই ছিল না। অতিথিশালানির্মাণ, দেবালয়প্রতিষ্ঠা, পুষ্করিণীখনন প্রভৃতি নানা সৎকর্মে তিনি ধনব্যয় করিতেন। তাঁহার সিন্ধুক-পূর্ণ টাকা ছিল, দেশবিখ্যাত যশ ছিল ও রূপবতী কন্যা ছিল। সমস্ত যৌবনকাল ধন উপার্জন করিয়া অনূপ বৃদ্ধ বয়সে বিশ্রাম করিতেছিলেন। এখন কেবল তাঁহার একমাত্র ভাবনা ছিল যে, কন্যার বিবাহ দিবেন কোথায়। সৎপাত্র পান নাই ও বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র আশ্রয়স্থল কন্যাকে পরগৃহে পাঠাইতে ইচ্ছা নাই—তজ্জন্যও আজ কাল করিয়া আর তাঁহার দুহিতার বিবাহ হইতেছে না। সঙ্গিনী-অভাবে করুণার কিছুমাত্র কষ্ট হইত না। সে এমন কাল্পনিক ছিল, কল্পনার স্বপ্নে সে সমস্ত দিন-রাত্রি এমন সুখে কাটাইয়া দিত যে, মুহূর্তমাত্রও তাহাকে কষ্ট অনুভব করিতে হয় নাই। তাহার একটি পাখি ছিল, সেই পাখিটি হাতে করিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর পাড়ে কল্পনার রাজ্য নির্মাণ করিত। কাঠবিড়ালির পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটাছুটি করিয়া, জলে ফুল ভাসাইয়া, মাটির শিব গড়িয়া, সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাইয়া দিত। এক-একটি গাছকে আপনার সঙ্গিনী ভগ্নী কন্যা বা পুত্র কল্পনা করিয়া তাহাদের সত্য-সত্যই সেইরূপ যত্ন করিত তাহাদিগকে খাবার আনিয়া দিত, মালা পরাইয়া দিত, নানা প্রকার আদর করিত এবং তাদের পাতা শুকাইলে, ফুল ঝরিয়া পড়িলে, অতিশয় ব্যথিত হইত। সন্ধ্যাবেলা পিতার নিকট যা-কিছু গল্প শুনিত, বাগানে পাখিটিকে তাহাই শুনানো হইত। এইরূপে করুণা তাহার জীবনের প্রত্যুষকাল অতিশয় সুখে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার পিতা ও প্রতিবাসীরা মনে করিতেন যে, চিরকালই বুঝি ইহার এইরূপে কাটিয়া যাইবে। কিছু দিন পরে করুণার একটি সঙ্গী মিলিল। অনূপের অনুগত কোনো একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মরিবার সময় তাঁহার অনাথ পুত্র নরেন্দ্রকে অনূপকুমারের হস্তে সঁপিয়া যান। নরেন্দ্র অনূপের বাটীতে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিত, পুত্রহীন অনূপ নরেন্দ্রকে অতিশয় স্নেহ করিতেন। নরেন্দ্রের মুখশ্রী বড়ো প্রীতিজনক ছিল না কিন্তু সে কাহারও সহিত মিশিত না, খেলিত না ও কথা কহিত না বলিয়া, ভালোমানুষ বলিয়া তাহার বড়োই সুখ্যাতি হইয়াছিল। পল্লীময় রাষ্ট্র হইয়াছিল যে, নরেন্দ্রের মতো শান্ত শিষ্ট সুবোধ বালক আর নাই এবং পাড়ায় এমন বৃদ্ধ ছিল না যে তাহার বাড়ির ছেলেদের প্রত্যেক কাজেই নরেন্দ্রের উদাহরণ উত্থাপন না করিত। কিন্তু আমি তখনই বলিয়াছিলাম যে, ‘নরেন্দ্র, তুমি বড়ো ভালো ছেলে নও।’ কে জানে নরেন্দ্রের মুখশ্রী আমার কোনোমতে ভালো লাগিত না। আসল কথা এই, অমন বাল্যবৃদ্ধ গম্ভীর সুবোধ শান্ত বালক আমার ভালো লাগে না। অনূপকুমারের স্থাপিত পাঠশালায় রঘুনাথ সার্বভৌম নামে এক গুরুমহাশয় ছিলেন। তিনি নরেন্দ্রকে অপরিমিত ভালোবাসিতেন, নরেন্দ্রকে প্রায় আপনার বাড়িতে লইয়া যাইতেন এবং অনূপের নিকট তাহার যথেষ্ট প্রশংসা করিতেন। এই নরেন্দ্রই করুণার সঙ্গী। করুণা নরেন্দ্রের সহিত সেই পুষ্করিণীর পাড়ে গিয়া কাদার ঘর নির্মাণ করিত, ফুলের মালা গাঁথিত এবং পিতার কাছে যে-সকল গল্প শুনিয়াছিল তাহাই নরেন্দ্রকে শুনাইত, কাল্পনিক বালিকার যত কল্পনা সব নরেন্দ্রের উপর ন্যস্ত হইল। করুণা নরেন্দ্রকে এত ভালোবাসিত যে কিছুক্ষণ তাহাকে না দেখিতে পাইলে ভালো থাকিত না, নরেন্দ্র পাঠশালে গেলে সে সেই পাখিটি হাতে করিয়া গৃহদ্বারে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিত, দূর হইতে নরেন্দ্রকে দেখিলে তাড়াতাড়ি তাহার হাত ধরিয়া সেই পুষ্করিণীর পাড়ে সেই নারিকেল গাছের তলায় আসিত, ও তাহার কল্পনারচিত কত কী অদ্ভুত কথা শুনাইত। নরেন্দ্র ক্রমে কিছু বড়ো হইলে কলিকাতায় ইংরাজি বিদ্যালয়ে প্রেরিত হইল। কলিকাতার বাতাস লাগিয়া পল্লীগ্রামের বালকের কতকগুলি উৎকট রোগ জন্মিল। শুনিয়াছি স্কুলের বেতন ও পুস্তকাদি ক্রয় করিবার ব্যয় যাহাকিছু পাইত তাহাতে নরেন্দ্রের তামাকের খরচটা বেশ চলিত। প্রতি শনিবারে দেশে যাইবার নিয়ম আছে। কিন্তু নরেন্দ্র তাহার সঙ্গীদের মুখে শুনিল যে, শনিবারে যদি কলিকাতা ছাড়িয়া যাওয়া হয় তবে গলায় দড়ি দিয়া মরাটাই বা কী মন্দ! বালক বাটীতে গিয়া অনূপকে বুঝাইয়া দিল যে, সপ্তাহের মধ্যে দুই দিন বাড়িতে থাকিলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিবে না। অনূপ নরেন্দ্রের বিদ্যাভ্যাসে অনুরাগ দেখিয়া মনে-মনে ঠিক দিয়া রাখিলেন যে, বড়ো হইলে সে ডিপুটি মাজিস্টর হইবে। তখন দুই-এক মাস অন্তর নরেন্দ্র বাড়িতে আসিত। কিন্তু এ আর সে নরেন্দ্র নহে। পানের পিকে ওষ্ঠাধর প্লাবিত করিয়া, মাথায় চাদর বাঁধিয়া, দুই পার্শ্বের দুই সঙ্গীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া, কন্স্টেবলদের ভীতিজনক যে নরেন্দ্র প্রদোষে কলিকাতার গলিতে গলিতে মারামারি খুঁজিয়া বেড়াইত, গাড়িতে ভদ্রলোক দেখিলে কদলীর অনুকরণে বৃদ্ধ অঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিত, নিরীহ পান্থ বেচারিদিগের দেহে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া নির্দোষীর মতো আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকিত, এ সে নরেন্দ্র নহে—অতি নিরীহ, আসিয়াই অনূপকে ঢীপ্ করিয়া প্রণাম করে। কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিলে মৃদুস্বরে, নতমুখে, অতি দীনভাবে উত্তর দেয় এবং যে পথে অনূপ সর্বদা যাতায়াত করেন সেইখানে একটি ওয়েব্স্টার ডিক্সনারী বা তৎসদৃশ অন্য কোনো দীর্ঘকায় পুস্তক খুলিয়া বসিয়া থাকে। নরেন্দ্র বহুদিনের পর বাড়ি আসিলে করুণা আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিত। নরেন্দ্রকে ডাকিয়া লইয়া কত কী গল্প শুনাইত। বালিকা গল্প শুনাইতে যত উৎসুক, শুনিতে তত নহে। কাহারো কাছে কোনো নূতন কথা শুনিলেই যতক্ষণ না নরেন্দ্রকে শুনাইতে পাইত, ততক্ষণ উহা তাহার
false
shomresh
ঝাড়িকাকু। পিসিমাকে বড়দি ঝাড়িকাকু। বাবা ছোটকাকরাও বড়দি বলে। এই সেদিন আগে পর্যন্ত শুনে শুনে অনিও বলত বড়দিপিসি। তখন কি ছোট ঠাকুমা ছিল না? না সেই কুমড়ো নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল বলে মরে গিয়েছিল। মা তখন ছিল না এটা বুঝতে পারছে অনি। পিসিমা বলেন, বিশ বছর বয়সে বাবার বিয়ে হয়েছিল। বাবা যখন কুল খেত তখন নিশ্চয় ছোট ছিল। অনি বলল, তারপর? কথা বলার সময় ঝাড়িকাকুর একটা পিতনে বাধানো দাত দেখতে পাওয়া যায়। রোজ ই দিয়ে দাঁত মাজে বলে চকচক করে। বাড়িকাকু বলল, বাসন মাজতে মাজতে হঠাৎ শুনতে পেলাম বুকফাটা চিল্কার। চমকে উঠে দাড়িয়ে দেখি হরিশ পড়ে যাচ্ছে। অত উঁচু ডাল ভেঙে পড়ে যাচ্ছে হরিশ, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। পড়ে গিয়ে কেমন দলা পাকিয়ে গেল ও। আমি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনলাম। ডাভারবার দুপুরে খেতে এসেছিলেন। চিৎকার শুনে ছুটে এলেন। সাহেবের গাড়ি করে, জলপাইগুড়ি নিয়ে গেল যদি বাঁচানো যায়, পাগলের মতো সবাই ছুটল ওকে নিয়ে। ভুডুয়ার জল বেড়েছে সকাল থেকে রাস্তার ওপরে জল, এত জল আগে কখনো হয়নি। সন্ধেবেলা মড়া নিয়ে ফিরে এল ওরা, যেতে পারেনি। তা হরিশ চলে যাবার তিনদিন পরই ঘটে গেল ব্যাপারটা। তখন কর্তাবাবু লোক দিয়ে এই ঘাটে খড়ের ছাউনি করে দিয়েছিলেন। বৃষ্টিবাদলায় ভিজতে হবে না বলে। সেদিন রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বাসনগুলো নিয়ে এসেছিলাম মেজে ফেলতে। চাঁদের রাত হলে রাত্রেই বাসন মাজতাম। রাত হয়ে গেলে নদীতে কেউ আসে না। কিন্তু আমার ভয়টয় করত না। বাসন মাজা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ শুনি মাথার উপর খড়ের চালে মচমচ শব্দ হচ্ছে। এঘাটের ওপর তো কোনো গাছপালা নেই, ব্যাপারটা কী দেখবার জন্য মুখ বাড়িয়েছে তো আমার শরীর ঠাণ্ডা। হরিশ বাঁশের চালায় পা ঝুলিয়ে বসে হাসছে। আমায় দেখে বলল, কী মাছের কাঁটা ফেললি রে নদীতে, কালবোস? আমায় দিবি? কেমন খোনা-খোনা শব্দ। কিন্তু একদম হরিশ। আমি একছুটে বাড়ি এসে বড়দিকে বললাম। বাসন-টাসন সব রইল নদীর পাড়ে। বড়দি তক্ষুনি এক প্লেট ভাজা মাছ আমাকে দিয়ে বলল ঘাটে রেখে আসতে। আমি রাম রাম বলতে বলতে মাছ নিয়ে আবার এসে এখানে রেখে দৌড়ে ফিলে গেলাম। বাসন নেবার কথা মনে নেই। আর চালার দিকেও তাকাইনি। পরদিন সকালে দেখি বাসনগুলো তেমনই আছে, প্লেটটাও, শুধু মাছগুলো নেই। তারপর থেকে যদ্দিন ডাক্তারবাবু পিণ্ডি দেননি ততদিন ওর মা ওর জন্যে এক প্লেট মাছ নদীর ধারে রেখে যেত। আমি অবশ্য আর সন্ধের পর এখানে আসিনি। অনেকে জড়িয়ে ধরে টর্চ জ্বেলে হাঁটতে লাগল ঝাড়িকাকু, নে চল।। এতক্ষণ হাওয়া দিচ্ছিল, এখন টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা পড়ল। তাড়াতাড়ি পা চালা। ঝাড়িকাকু বেশ দ্রুত হাঁটছিল। দুপাশে অন্ধকার রেখে ফ্যাকাশে আলোর বৃত্তে পা ফেলে ওরা এগিয়ে আসছিল। এখন চারপাশে শুধু বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। অবশ্য ঝাড়িকাকুর হাতে খাইতে বড় কাঁকড়াটা ভীষণ শব্দ করছে। ওরা গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে আসতে হঠাৎ কালীগাই-এর গম্ভীর গলার ডাক নতে পেল। যেন পরিচিত কেউ যাচ্ছে বুঝতে পেরেছে ও। জিভ দিয়ে একটা শব্দ করে সাড়া দিল কাড়িকাকু। অনির মনে হচ্ছিল, এখন যে-কোনো মুহূর্তেই হরিশ ওদের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে মাছ চাইতে পারে। আর ঠিক তখনি অন্ধকারে একটা আকন্দগাছের পাশে দুটো মূর্তিকে নড়ে উঠতে দেখে অনি দুহাতে শাড়িকাকুকে জড়িয়ে ধরল। ঝাড়িকাকুও দেখতে পেয়েছিল ওদের। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে মাথা দোলাল একবার। তারপর অনির হাত ধরে সোজা হেঁটে খিড়কিদরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, তোর যা ভয়, ও তো প্রিয়। চমকে গেল অনি। প্রিয়? মানে কাক কাকু এত রাত্রে ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করছে? সঙ্গে শাড়ি-পরা মেয়েটা কে? চট করে নদীর পাড়ে দেখা দুটো মূর্তির কথা মনে পড়ে গেল ওর। অন্ধকারে মনে হয়েছিল যাদের মাথা নেই। তাহলে ঝাড়িকাকু আর একটা মেয়ে নদীর পাড়ে গিয়েছিল মাছধরা দেখতে মেয়েটা কে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অনির। উঠোনে ওদের দেকেই মা আর পিসিমা একসঙ্গে বকাঝকা শুরু করলেন। পিসিমা বকছিলেন ঝাড়িকাকুকে, কেন এতক্ষণ ও অনিকে নিয়ে নদীতে ছিল, আর মা অনিকে। অনি যখন টিউবওয়েলের জলে পা ধুচ্ছে ঠিক তখন নদীর মধ্যে প্রচণ্ড শোরগোল হচ্ছে শুনতে পেল। কারা ভয় পেয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করছে। একবার ফিরে তাকিয়ে ঝাড়িকাকু আবার ছুটে গেল অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে। কী হয়েছে জানতে ওরা উঠোনে এসে দাঁড়াল। উঠোনের এখানটায় অন্ধকার তেন নেই। শিকে টাঙানো হারিকেনের আলো অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝাড়িকাকু চলে যেতে ওরা দেখল তিনচারটে লণ্ঠন গোয়ালঘরের পিছনদিকে ছুটে ডাক্তারবাবুরকোয়ার্টারের দিকে চলে গেল। এমন সময় প্রিয়তোষ খিড়িকিদরজা খুলে ভিতরে এল। পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে রে? কী জানি! প্রিয়তোষ হাঁটতে হাঁটতে বলল। তুই কোথায় ছিলি? পিসিমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন। চটপট পা চালিয়ে কাকু ততক্ষণে ভিতরে চলে গিয়েছে। অনি দেখল থমথমে-মুখে পিসিমা মায়ের দিকে তাকালেন। মা চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিলেন। পিসিমা মনে মনে বিড় বিড় করে বললেন, বড় বেড়ে যাচ্ছে, বাবা ওনলে রক্তে রাখবে না। একটু বাদেই ঝাড়িকাকু ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। ওর কাছে শোনা গেল ব্যাপারটা। মাছ ধরার নেশায় সবাই নেমে পড়েছে নদীতে। তা ঐ লাইনের বংশী, বয়স হয়েছে বলে চোখে ভালো করে দেখে না, পা দিয়ে দিয়ে কাদা সরিয়ে পাকাল মাছ খুঁজছিল। কয়েকটা মাছ ধরে নেশাটা বেশ জমে গিয়েছিল ওর। হাড়িয়া খেয়েছে আজ সন্ধে থেকে।
false
shirshendu
উচ্ছিষ্টের মতো পড়ে আছে এক ধারে। না, দিনটা আজ ভালই গেল। বুক চিতিয়ে সপাটে খানিক হাঁটার পরই বিনোদকুমার বুঝল, বুড়োবয়সকে খুব বেশি পিছনে ফেলতে পারেনি। পোষা কুকুরের মতো গা শুঁকতে শুঁকতে পিছন পিছন আসছে। টের পেল, যখন হাঁফ ধরে যাওয়ায় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দম নিতে হচ্ছিল। ওরে বাপু! যৌবনপ্রাপ্তি কি আর ছেলের হাতের মোয়া? বয়স তেমন ভাঁটিয়ে যায়নি, কিন্তু শরীরের জোয়ার নেমে গেছে। বয়সকালে নেশাভাঙও তো কম করেনি! তার ওপর এই ফুক ফুক রোজ ডজনখানেক সিগারেট ফোঁকা— এরও তো মাশুল আছে, নাকি? মাশুল মেলাই দিতে হচ্ছে বিনোদকে। কতক জানিত কর্মফল, কতক অজান। আটন গেট-এ তার এক জন মেয়েমানুষ ছিল, এক জন ছিল ফুলেশ্বরে। সব্বার নামও মনে নেই। পাপটাপ যখন করেছে, তখন পাপ জেনেই করেছে। তবে মনস্তাপ ছিল না। একটু আধটু তো ও রকম হবেই বাপু! তখন বিনোদের চেহারাখানা কী ছিল বলো! নদের নিমাই করে কত বুড়োবুড়ির চোখে জল এনে ফেলেছিল। কত বুড়ি পালার পর পায়ের ধুলো নিয়ে যেত। বিনোদ টের পেল, বয়সটা তার পায়ের গোছের কাছেই বসে আছে। তাড়ালেও যাবে না। অথচ হিসেবের বয়স তার হয়নি। —বিনোদ নাকি রে? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? বিনোদ দেখল, সামনে সফলরাম। তা সফলই বটে। গঙ্গারামপুরের সব ক’টা টাকাওলা লোককে পাল্লার এক ধারে, আর সফলরামকে অন্য ধারে চাপালে সফলের দিকেই পাল্লা মাটিতে ঠেকবে। —এই মেয়েটির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। —তা দাঁড়িয়ে থাকবি তো থাক না! বিড়বিড় করে কাকে গাল দিচ্ছিস? বিড়বিড় করছে নাকি সে? ওই এক মুশকিল হয়েছে আজকাল। সে টের পায় না, কিন্তু লোকে দেখতে পায়। সে নাকি একা একা বিড়বিড় করে। তা করে হয়তো, কিন্তু সেটা টের পায় না কেন সেটাই বুঝতে পারে না বিনোদ। —গাল দিচ্ছি না দাদা, নানা কথা ভাবছি আর কী! —পষ্ট দেখলুম হাত-পা নেড়ে কথা কইছিস! বলি লোককে শাপ-শাপান্ত করিস না তো? —কী যে বলেন দাদা! —বিচিত্র কী! ঘর-বসা লোকের মনে মেলা গাঁদ জমে থাকে তো! প্রকৃতির নিয়মেই বড়লোকদের সামনে বিনোদ ভারী দুর্বল বোধ করে। মনের জোরটা পায় না। টাকার জোরের কাছে কোন জোরটাই বা খাটে বাপু? সে একটু হেঃ হেঃ করে বলল, ঘর-বসা না হয়ে উপায়ই বা কী বলুন? শরীরটা জুত-এর নেই। —তাই থাকে রে পাজি? তুই তো চিরকালের নষ্ট! এইটুকুন বেলা থেকে দেখে আসছি। তবে তোর কপালটা বড্ড ভাল। সসম্ভ্রমে চুপ করে থাকে বিনোদ। সফলরাম নিজেই বলে, তুই নষ্ট হলেও ছেলেটা তোর ভাল। তোর মতো লপেটা-বাবু নয়। করে-কর্মে দাঁড়িয়ে গেছে। —তা আপনাদের আশীর্বাদে। —এটা কলিযুগ জানিস তো! এ যুগে আশীর্বাদও ফলে না, অভিশাপও ফলে না। এ হল নগদা-নগদির যুগ, যেমন করবি তেমনি পাবি। জুয়োর দান ধরে নেংটি-ঘটি সার করলি, এখনও চোখ খুলল না? আশীর্বাদ-টাশীর্বাদ সব বাজে কথা। ছেলেটা যে তোর মতো হয়নি সেইটেই তোর কপাল। তা বিনোদ এ সব কথাও বিস্তর শোনে। ঘরে, বাইরে, পথেঘাটে। বউ শোনায়, আত্মীয়স্বজন শোনায়, উটকো লোকও শোনায়। কিছু ভুলও শোনায় না। হ্যাঁ, তার ছেলেটা ভাল, আর সে খারাপ। তা বাপু, তাতে হলটা কী? কী একটা কথা বলছিল সফলরাম, ধরতাইটা ঠিকমতো শোনেনি। কানের দোষই হবে বোধহয়। শেষটা শুনতে পেল, আমি বাপু রাজি হইনি। —কথাটা কী হচ্ছিল দাদা? —তোর ছেলের কথাই হচ্ছিল। আমার বউমা বলছিল, ফুলির সঙ্গে ফুটুর সম্বন্ধ করলে কেমন হয়! আমি বলে দিয়েছি, ও লাইনে মোটেই চিন্তা কোরো না। ছেলে ভাল হলে কী হবে, বিনোদেরই তো রক্ত। রক্তে রক্তে কোন বিষ অর্শায় তার ঠিক কী! তোর কাছে বলেছে কিছু? ব্যাপারটা স্পর্ধারই সামিল। জিভ কেটে বিনোদ বলল, আজ্ঞে না, ও রকম কোনও কথা হয়নি মোটেই। —আর হবেও না। বারণ করে দিয়েছি। আগেভাগেই জানিয়ে রাখা ভাল, নইলে আবার একটা প্রত্যাশা থাকবে তো! না, বিনোদের কোনও প্রত্যাশা নেই। বউ মানেই একটা ফ্যাকড়া, একটা বাধক। বউ-বাচ্চার জন্যই না বিনোদের দুই নৌকোয় পা রেখে জীবন কাটল! ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে সে বলে, না, না, তা হয় না। ঘাড়ে দু-দুটো আইবুড়ো বোন, জুয়াড়ি বাপ, কে যে বউমাকে বুদ্ধিটা দিল কে জানে! সফলরাম ঠোঁটকাটা লোক সবাই জানে। বিনোদের মোটেই রাগ বা অপমান হল না। সে দিব্যি হাসি-হাসি মুখ করে বলে, সে তো বটেই। সফলরাম চলে যাওয়ার পরও খানিক দাঁড়িয়ে রইল বিনোদ। তার একটু ভয় হচ্ছে। ফুটু বিয়ে বসলে তার নতুন বিপদ দেখা দেবে। বউ এসে যদি বাড়ি-ছাড়া করে, তা হলে তাকে এই বাজারেই ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করতে হবে। —ও বাবা! চটকা ভেঙে বিনোদ দেখে, সামনে বিম্ববতী। —চল মা, বাড়ি চল। বাজার হয়েছে? —হ্যাঁ। —দে, একখানা ব্যাগ বরং আমাকে দে। —আমি পারব। তুমি চলো তো! বুকটা ধকধক করছে। এখনও হাঁফটা পুরোপুরি কাটেনি। বয়স হয়েছে কী হয়নি, তা ঠিক বুঝতে পারছে না বিনোদ। ডালের বস্তার ওপর টং-এ বসে এক্সারসাইজ খাতায় হিসেব করছিল প্রীতম। বাহ্যজ্ঞান নেই। হিসেব করতে তার বড় ভাল লাগে। আর ব্যবসার প্রাণই হল হিসেব। আগে হিসেবের কায়দাটা ভাল জানা ছিল না তার। মণিরাম শিখিয়েছে। বলেছে, হিসেবটা যদি ঠিকমত করতে পারিস তো ভিত বেঁধে ফেললি। ওইখানে ভুলচুক করলে দর ফেলতে গড়বড় হয়ে যাবে। তা হলেই সর্বনাশ। দোকান সামলাতে পরেশকে রেখেছে সে। মাইনে দিয়ে লোক রাখার মতো তালেবর
false
MZI
রাখবি। আমি বলতাম রাখব। বড় কিছু করতে হলে বড় কিছু স্বপ্ন দেখতে হয়। ও। তোকেও বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। বুঝেছিস? বুঝেছি। শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে। তোকে নিয়মিত খেলাধুলাও করতে হবে। ও। শুধু অংকে ভাল করলে হবে না। সব সাবজেক্টে ভাল করতে হবে। ও। সব সাবজেক্ট মন দিয়ে পড়তে হবে। আচ্ছা। দেরি করে ঘুমাবি না। ভাল শরীরের জন্যে ঘুম খুব দরকার। ও। আর তোর একা একা থাকার অভ্যাস ছাড়তে হবে। তাই নাকি? অবশ্যই। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এতো সুইট অথচ তোর কোন বন্ধু নেই। আমি বললাম, কে বলেছে বন্ধু নাই! তুই আছিস। আর কে আছে? আমার আরেকজন বন্ধুর নাম মিচকি। মিচকি? প্রিয়াংকা ভুরু কুঁচকে বলল, ফাজলামি করবি না। খোদার কসম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোর সাথে একদিন। পরিচয় করিয়ে দেবো। ভয় পাবি না তো? ভয় পাব কেন? অনেকে ইঁদুরকে ভয় পায় তো! ইঁদুর? প্রিয়াংকা মুখ বিকৃত করে বলল, ছিঃ! মাগো ঘেন্না! মিচকি মোটেও সেরকম ইঁদুর না। খুব লক্ষ্মী। প্রত্যেকদিন রাত দশটার সময় আমার কাছে বেড়াতে আসে। আমি প্রিয়াংকাকে মিচকি সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা বলি কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় না, প্রিয়াংকা মুখ বিকৃত করে বলে, ছিঃ! মাগো ঘেন্না! আমি টের পেলাম খুব ধীরে ধীরে আমার একটা পরিবর্তন হলো। আমি নিজেকে খুব খারাপ ভাবতে শুরু করেছিলাম সেটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে শুরু করল। আমি পড়াশোনা শেষ করে একজন বড় ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারব সেটাও আজকাল খুব অসম্ভব মনে হয় না। প্রিয়াংকা বড় মানুষের মতো অনেক উপদেশ দেয়, বেশিরভাগ উপদেশই হাস্যকর তবে একটা উপদেশ মনে হয় সত্যি। নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখা খুব জরুরি, খুব আস্তে আস্তে মনে হয় আমার নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে আসছে। যেমন সেদিন সকালে আমি প্রিয়াংকার গণিত বইটাতে একটা সিরিজ খুঁজে পেলাম যেটার যোগফল দুটো ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা হতে পারে। একভাবে যোগ করলে এক রকম অন্যভাবে যোগ করলে অন্য রকম, আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি তখন হঠাৎ ভাইয়া আমাকে ডাকতে শুরু করল। আমি উঠে ভাইয়ার ঘরে গেলাম। ভাইয়া কলেজে যাবার জন্যে কাপড় পরছে, আমাকে একটা প্যান্ট ছুড়ে দিয়ে বলল, তপু এই প্যান্টটা আমাকে ইস্ত্রি করে দে দেখি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, না? ইস্ত্রি করে দিবি না? না। কেন? আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না কিন্তু আজকে কী হলো কে জানে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে উত্তর দিলাম। একেবারে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, তিনটা কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে আমি ব্যস্ত, পড়াশোনা করছি। দ্বিতীয় কারণ প্যান্ট ইস্ত্রি করা এমন কিছু কঠিন না। তোমার নিজের শার্ট-প্যান্ট তুমি নিজে ইস্ত্রি করবে, অন্যকে করে দিতে বলবে না। তৃতীয় কারণ, আমি তোমার ছোট ভাই। তুমি আমাকে বেতন দিয়ে তোমার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করে দেয়ার জন্যে রাখ। নাই। ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রথমে অবাক হলো তারপর আস্তে আস্তে রেগে উঠতে লাগলো। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোর বেশি সাহস হয়েছে? আমি এবারেও একটা ফাটাফাটি উত্তর দিয়ে দিলাম, প্রিয়াংকার সাথে সাথে থেকে আমিও মনে হয় কথা বলা শিখে যাচ্ছি! বললাম, উঁহু। আমার বেশি সাহস হয় নাই, যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু হয়েছে। ভাইয়া তখন যেটা করবে বলে ভাবছিলাম সেটাই করল, গলা উঁচিয়ে আম্মুকে ডাকল। বলল, আম্মু! তপু আমার প্যান্ট ইস্ত্রি করে দিচ্ছে না! আম্মু অফিসে যাবার জন্যে রেডি হচ্ছিলেন সেইভাবে ভাইয়ার ঘরে এসে ঢুকলেন। কোন কথা না বলে আমার চুল ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে গালে একটা চড় দিলেন, তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মারার জন্যে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। আমার কপাল ভাল ভাইয়ার বেল্টগুলো কাছাকাছি কিছু নেই–টেবিলে তার রুলারটা পেয়ে গেলেন, শক্ত লোহার রুলার কিন্তু সাইজে ছোট বলে মারতে খুব অসুবিধে। সেটা দিয়েই মারতে লাগলেন। আমি সাবধানে থাকার চেষ্টা করলাম তারপরেও একটা মুখে লেগে গেলো এবং আমার ঠোঁটটা কেটে গেল, আম্মু হঠাৎ করে থেমে গেলেন দেখে বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই অনেকখানি কেটেছে। আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে বললেন, বেশি সাহস হয়েছে তোর? আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু বললেন, এই মুহূর্তে রাজীবের প্যান্ট ইস্ত্রি করে দে। আমি মাথা নেড়ে ভাইয়ার প্যান্টটা তুলে নিলাম। আম্মুর অফিসের গাড়ি চলে এসেছে বলে আম্মুকে চলে যেতে হলো। আমি খুব যত্ন করে ভাইয়ার প্যান্টটা ইস্ত্রি করলাম, আমার কাটা ঠোঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, সেগুলো যেন তার প্যান্টে না পড়ে সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকলাম। প্যান্টটা ইস্ত্রি করে আমি সেটা দুই হাতে ধরে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিলাম, ভাইয়া প্যান্টটা হাতে নিয়ে বলল, গাধা কোথাকার, আমার কথা শুনলে তোর এরকম মার খেতে হতো না! আমি রক্তমাখা মুখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, বললাম, কিন্তু তোমার কথা আমি শুনব না! যতবার তোমার প্যান্ট ইস্ত্রি করতে হবে ততবার তোমাকে আম্মুকে দিয়ে আমাকে পিটাতে হবে। বুঝেছ? ভাইয়া কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি একেবারে সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর কী আশ্চর্য শেষ পর্যন্ত ভাইয়া তার চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি দেখলাম তার চোখে আমার জন্যে ঘেন্না আছে সত্যি কিন্তু তার সাথে সাথে সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস যোগ হয়েছে, সেটা হচ্ছে ভয়। হঠাৎ করে ভাইয়া আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। কী আশ্চর্য! মুখে কাটাকাটি থাকলে, মারের
false
robindronath
হেমনলিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “কী বাবা?” অন্নদা। রমেশ বলিতেছেন, উঁহার কী-একটা বিশেষ কাজ পড়িয়াছে, এখন উঁহার বিবাহ করিবার অবকাশ হইবে না। হেমনলিনী একবার বিবর্ণমুখে রমেশের মুখের দিকে চাহিল। রমেশ অপরাধীর মতো নিরুত্তর বসিয়া রহিল। হেমনলিনীর কাছে এ খবরটা যে এমন করিয়া দেওয়া হইবে, রমেশ তাহা প্রত্যাশা করে নাই। অপ্রিয় বার্তা অকসমাৎ এইরূপ নিতান্ত রূঢ়ভাবে হেমনলিনীকে যে কিরূপ মর্মান্তিকরূপে আঘাত করিল, রমেশ তাহা নিজের ব্যথিত অন্তঃকরণের মধ্যেই সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারিল। কিন্তু যে তীর একবার নিক্ষিপ্ত হয়, তাহা আর ফেরে না–রমেশ যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল এই নিষ্ঠুর তীর হেমনলিনীর হৃদয়ের ঠিক মাঝখানে গিয়া বিঁধিয়া রহিল। এখন কথাটা আর কোনোমতে নরম করিয়া লইবার উপায় নাই। সবই সত্য–বিবাহ এখন স্থগিত রাখিতে হইবে, রমেশের বিশেষ প্রয়োজন আছে, কী প্রয়োজন তাহাও সে বলিতে ইচ্ছা করে না। ইহার উপরে এখন আর নূতন ব্যাখ্যা কী হইতে পারে? অন্নদাবাবু হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তোমাদেরই কাজ, এখন তোমরাই ইহার যা হয় একটা মীমাংসা করিয়া লও।” হেমনলিনী মুখ নত করিয়া বলিল, “বাবা, আমি ইহার কিছুই জানি না।” এই বলিয়া, ঝড়ের মেঘের মুখে সূর্যাস্তের মলান আভাটুকু যেমন মিলাইয়া যায় তেমনি করিয়া সে চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু খবরের কাগজ মুখের উপর তুলিয়া পড়িবার ভান করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। রমেশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। হঠাৎ রমেশ এক সময় চমকিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। বসিবার বড়ো ঘরে গিয়া দেখিল হেমনলিনী জানালার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহার দৃষ্টির সম্মুখে আসন্ন পূজার ছুটির কলিকাতা জোয়ারের নদীর মতো তাহার সমস্ত রাস্তা ও গলির মধ্যে স্ফীত জনপ্রবাহে চঞ্চল-মুখর হইয়া উঠিয়াছে। রমেশ একেবারে তাহার পার্শ্বে যাইতে কুণ্ঠিত হইল। পশ্চাৎ হইতে কিছুক্ষণের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতে লাগিল। শরতের অপরাহ্ন-আলোকে বাতায়নবর্তিনী এই স্তব্ধমূর্তিটি রমেশের মনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী ছবি আঁকিয়া দিল। ঐ সুকুমার কপোলের একটি অংশ, ঐ সযত্নরচিত কবরীর ভঙ্গি, ঐ গ্রীবার উপরে কোমলবিরল কেশগুলি, তাহারই নীচে সোনার হারের একটুখানি আভাস, বাম স্কন্ধ হইতে লম্বিত অঞ্চলের বঙ্কিম প্রান্ত, সমস্তই রেখায় রেখায় তাহার পীড়িত চিত্তের মধ্যে যেন কাটিয়া কাটিয়া বসিয়া গেল। রমেশ আস্তে আস্তে হেমনলিনীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হেমনলিনী রমেশের চেয়ে রাস্তার লোকদের জন্য যেন বেশি ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল। রমেশ বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “আপনার কাছে আমার একটি ভিক্ষা আছে।” রমেশের কণ্ঠস্বরে উদ্‌বেল বেদনার আঘাত অনুভব করিয়া মুহূর্তের মধ্যে হেমনলিনীর মুখ ফিরিয়া আসিল। রমেশ বলিয়া উঠিল, “তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিয়ো না।”–রমেশ এই প্রথম হেমনলিনীকে ‘তুমি’ বলিল।–“এই কথা আমাকে বলো যে, তুমি আমাকে কখনো অবিশ্বাস করিবে না। আমিও অন্তর্যামীকে অন্তরে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি তোমার কাছে আমি কখনো অবিশ্বাসী হইব না।” রমেশের আর কথা বাহির হইল না, তাহার চোখের প্রান্তে জল দেখা দিল। তখন হেমনলিনী তাহার সিনগ্ধকরুণ দুই চক্ষু তুলিয়া রমেশের মুখের দিকে স্থির করিয়া রাখিল। তাহার পরে সহসা বিগলিত অশ্রুধারা হেমনলিনীর দুই কপোল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই নিভৃত বাতায়নতলে দুই জনের মধ্যে একটি বাক্যবিহীন শান্তি ও সান্ত্বনার স্বর্গখণ্ড সৃজিত হইয়া গেল। কিছুক্ষণ এই অশ্রুজলপ্লাবিত সুগভীর মৌনের মধ্যে হৃদয়মন নিমগ্ন রাখিয়া একটি আরামের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রমেশ কহিল, “কেন আমি এখন সপ্তাহের জন্য বিবাহ স্থগিত রাখিবার প্রস্তাব করিয়াছি, তাহার কারণ কি তুমি জানিতে চাও?” হেমনলিনী নীরবে মাথা নাড়িল–সে জানিতে চায় না। রমেশ কহিল, “বিবাহের পরে আমি তোমাকে সব কথা খুলিয়া বলিব।” এই কথাটায় হেমনলিনীর কপোলের কাছটা একটুখানি রাঙা হইয়া উঠিল। আজ আহারান্তে হেমনলিনী যখন রমেশের সহিত মিলনপ্রত্যাশায় উৎসুকচিত্তে সাজ করিতেছিল, তখন সে অনেক হাসিগল্প, অনেক নিভৃত পরামর্শ, অনেক ছোটোখাটো সুখের ছবি কল্পনায় সৃজন করিয়া লইতেছিল। কিন্তু এই-যে অল্প কয় মুহূর্তে দুই হৃদয়ের মধ্যে বিশ্বাসের মালা-বদল হইয়া গেল–এই-যে চোখের জল ঝরিয়া পড়িল, কথাবার্তা কিছুই হইল না, কিছুক্ষণের জন্য দুইজনে পাশাপাশি দাঁড়াইয়া রহিল–ইহার নিবিড় আনন্দ, ইহার গভীর শান্তি, ইহার পরম আশ্বাস সে কল্পনাও করিতে পারে নাই। হেমনলিনী কহিল, “তুমি এক বার বাবার কাছে যাও, তিনি বিরক্ত হইয়া আছেন।” রমেশ প্রফুল্লচিত্তে সংসারের ছোটো-বড়ো আঘাত-সংঘাত বুক পাতিয়া লইবার জন্য চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু রমেশকে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া উদ্‌বিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। রমেশ কহিল, “নিমন্ত্রণের ফর্দটা যদি আমার হাতে দেন, তবে দিনপরিবর্তনের চিঠিগুলি আজই রওনা করিয়া দিতে পারি।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “তবে দিনপরিবর্তনই স্থির রহিল?” রমেশ কহিল, “হাঁ, অন্য উপায় আর কিছুই দেখি না।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো বাপু, তবে আমি ইহার মধ্যে নাই। যাহা-কিছু বন্দোবস্ত করিবার, সে তুমিই করিয়ো। আমি লোক হাসাইতে পারিব না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে যদি নিজের মর্জি অনুসারে ছেলেখেলা করিয়া তোল, তবে আমার মতো বয়সের লোকের ইহার মধ্যে না থাকাই ভালো। এই লও তোমার নিয়ন্ত্রণের ফর্দ। ইতিমধ্যে আমি কতকগুলা টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার অনেকটাই নষ্ট হইবে। এমনি করিয়া বার বার টাকা জলে ফেলিয়া দিতে পারি এমন সংগতি আমার নাই।” রমেশ সমস্ত ব্যয় ও ব্যবস্থার ভার নিজের স্কন্ধে লইতেই প্রস্তুত হইল। সে উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ, বিবাহের পরে তুমি কোথায় প্র্যাক্‌টিস করিবে, কিছু স্থির করিয়াছ? কলিকাতায় নয়?” রমেশ কহিল, “না। পশ্চিমে একটা ভালো জায়গার সন্ধান করিতেছি।” অন্নদা। সেই ভালো, পশ্চিমই ভালো। এটোয়া তো মন্দ জায়গা নয়। সেখানকার জল হজমের পক্ষে অতি উত্তম–আমি সেখানে মাসখানেক ছিলাম–সেই এক মাসে আমার আহারের পরিমাণ ডবল বাড়িয়া
false
MZI
যাচ্ছে। শোন বুলা, তুমি যদি এখনও এরকম কর—আমি তীব্র স্বরে বললাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলব। বুলা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে আমার দিকে তাকাল। হ্যাঁ। তোমাকে অজ্ঞান করে আবার তোমার মাথায় নূতন কপোট্রন বসাব, আবার নূতন করে তোমার মাঝে বুলাকে ফিরিয়ে আনব… বুলা বিশ্বফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তোমাকে আমার চাই-ই চাই। তোমার জন্যে শোন বুলা, শুধু তোমার জন্যে আমি তোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক বদলে নূতন কপোট্রন বসিয়েছি। তোমার ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ভালবাসা আছে। তোমার টোপন আছে, আমি আছি—তবু তুমি এরকম করছ? তুমি বুকে হাত দিয়ে বল, তোমার বুকে আমার জন্য ভালবাসা নেই? টোপন তোমার ছেলে না? থাকুক তোমার মাথায় কপোট্রন। মানুষ কৃত্রিম চোখ, কৃত্রিম হাতপা, ফুসফুস নিয়ে বেঁচে নেই? তবে কেন পাগলামি করছ? কথা বলতে বলতে আমার সব আবেগ স্রোতের মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। কে জানত আমার ভিতরে এত আবেগ লুকিয়ে ছিল। তোমার নিজেকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি বুলা কি না। বুলার চোখ, মুখ, হাতু, পা, চুল—সবকিছু বুলার, শুধু তোমার মস্তিষ্কটি কৃত্রিম, তাতে যে-অনুভূতি, সেটি পর্যন্ত বুলার, আমি নিজের হাতে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি। তবু তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ। আমার কী স্বাৰ্থ? তোমাকে প্ৰাণ দেয়ার আমার কী স্বাৰ্থ? রবোটের সাহায্যে তোমার মস্তিষ্ক বদলে মানবিক আবেগসম্পন্ন কপোট্রন তৈরি করে সেখানে বসানোতে আমার কী স্বাৰ্থ? শুধু তোমাকে পাওয়া-তোমাকে তোমাকে তোমাকে… আমি বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে বুলাকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে লাগলাম। বুলা আমার বুকে মাথা গুঁজে বলল, তাহলে আমিই বুলা? হ্যাঁ, তুমিই বুলা। পৃথিবীতে আর কোনো বুলা নেই। টোপনি আমার ছেলে? হ্যাঁ। টোপন তোমার ছেলে, তোমার আর আমার। তুমি আমার— আমি তোমার? বুলা উত্তর না দিয়ে হাসল। আমি ওর চুলে হাত বোলাতে লাগলাম। এই চুলের আড়ালে বুলার মাথায় একটি কপোট্রন লুকানো আছে। কিন্তু ক্ষতি কি? এই কপোট্রন আমাকে ভালবাসে, টোপনকে স্নেহ করে, আনন্দে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে। হলই-বা কপোট্রন! আমি বুলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। কপোট্রনিক ভবিষ্যৎ বিকেলে আমার হঠাৎ করে মনে হল আজ আমার কোথায় জানি যাবার কথা। ভোরে বারবার করে নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছি না। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, তবে বিশেষ চিন্তিত হলাম না। আমি ঠিক জানি, আমার মস্তিষ্কও কপোট্রনের মতো পুরানো স্মৃতি হাতড়ে দেখতে শুরু করেছে, মনে করার চেষ্টা না করলেও ঠিক মনে হয়ে যাবে। বৈকলিক চা খাওয়ার সময় আমার মনে পড়ল আজি সন্ধেয় একটি কপোট্রন প্ৰস্তুতকারক ফার্মে যাবার কথা। ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন করে বলেছিলেন, তাঁরা কতকগুলি নিরীক্ষামূলক কপোট্রন তৈরি করেছেন, আমি দেখলে আনন্দ পাব। কিছুদিন আগে এই ডিরেক্টরের সাথে কোনো—এক বিষয়ে পরিচয় ও অল্প কিছু হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নৃতন রবোট তৈরি করলে আমাকে ফোন করে যাবার আমন্ত্রণ জানান। ফার্মটি শহরের বাইরে, পৌঁছুতে একটু দেরি হয়ে গেল। লিফটে করে সাততলায় ডিরেক্টরের ঘরে হাজির হলাম। তিনি খানিকক্ষণ শিষ্টতামূলক আলাপ করে আমাকে তাঁদের রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম। সদ্যপ্ৰস্তুত ঝকঝকে কতকগুলি রবোট দেখব, কিন্তু সেরকম কিছু না। বিরাট হলঘরের মতো ল্যাবরেটরিতে ছোট ছোট কালো টেবিলের উপর কাচের গোলকে কপোট্রন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে একটি প্রিন্টিং মেশিন, অপর পাশে মাইক্রোফোন, প্রশ্ন করলে উত্তর বলে দেবে কিংবা লিখে দেবে। দেয়ালে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, চৌকোণা ট্রান্সফর্মার, দেখে মনে হল এখান থেকে উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেয়া হয়। কপোট্টনের সামনে লম্বাটে মাউথপীস। ঠিক একই রকম বেশ কয়টি কপোট্রন পাশাপাশি সাজানো। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, রবোটের শরীরের সাথে এখনও জুড়ে দিই নি,-দিতে হবেও না বোধহয়। কেন? এই কপোট্রনগুলি স্বাভাবিক নয়। সব কপোট্রনই কিছু কিছু যুক্তিতর্ক মেনে চলে। এগুলির সেরকম কিছু নেই। মানে? ওরা তাহলে আবোল-তাবোল বকে? অনেকটা সেরকমই। ভদ্রলোক হাসলেন। ওদের কল্পনাশক্তি অস্বাভাবিক। ঘোর অযৌক্তিক ব্যাপারও বিশ্বাস করে এবং সে নিয়ে রীতিমতো তর্ক করে। এগুলি তৈরি করে লাভ? এ তো দেখছি উন্মাদ কপোট্রন। তা, উন্মাদ বলতে পারেন। কিন্তু এদের দিয়ে কোনো লাভ হবে না জোর দিয়ে বলা যায় না। বলগা ছাড়া ভাবনা যদি না করা হত, পদার্থবিদ্যা কোনোদিন ক্লাসিক্যাল থেকে রিলেটিভিস্টিক স্তরে পৌঁছুত না। তা বটে। আমি মাথা নাড়ুলাম। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করে পাগল কপোট্রন তৈরি করবেন? আপনি আলাপ করে দেখুন না, আর কোনো লাভ হোক কি না-হোক, নির্ভেজাল আনন্দ তো পাবেন। আমি একটা কপোট্রনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি হে? নাম? নামের প্রয়োজন কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকলে নামের প্রয়োজন হয় না-যন্ত্রণা পিয়ে পরিচয় পাওয়া যায়। লাল নীল যন্ত্রণারা রক্তের ভিতর খেলা করতে থাকে… সাহিত্যিক ধাঁচের মনে হচ্ছে? আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকোলাম। হ্যাঁ। এটি সাহিত্যমান। একটা-কিছু জিজ্ঞেস করুন। আমি কপোট্রনটিকে জিজ্ঞেস করলাম, যন্ত্রণারা আবার লাল নীল হয় কেমন করে? যন্ত্রণারা সব রংয়ের হতে পারে, সব গন্ধের হতে পারে, এমনকি সবকিছুর মতো হতে পারে। যন্ত্রণার হাত-পা থাকে, চোখ থাকে-ফুরফুরে প্রজাপতির মতো পাখা থাকে। সেই পাখা নাড়িয়ে যন্ত্রণার আরো বড় যন্ত্রণায় উড়ে বেড়ায়। উড়ে উড়ে যখন ক্লান্তি নেমে আসে, তখন– তখন? তখন একটি একটি লাল ফুলের জন্ম হয়। সব নাইটিংগেল। তখন সবগুলো ফুলের কাঁটায় বুক লাগিয়ে রক্ত শুষে নেয়—লাল ফুল সাদা হয়ে যায়, সাদা ফুল লাল… বেশ
false
shunil_gongopaddhay
কিকুইউ, ইনি ফিলিপ কিকুইউ-এর ভাই। বড় বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী, পুলিশও এই দুই ভাইকে ভয় পায়। কাকাবাবু বললেন, বুঝেছি, এই দুই ভাই মিলেই চোরাশিকার, পশুচালানের কাজ করে বহু পশু মেরেছে, মানুষও খুন করেছে। হ্যারি ওটাংগোর মতো বিখ্যাত মানুষকে এরাই মেরেছে। রবার্ট কাকাবাবুর চুল ছেড়ে দিয়ে উলটো দিকের সোফায় বসল। সামনের পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমরা জন্তু-জানোয়ার মারি, বেশ করি। সিংহ, হাতি, গন্ডার, এরা মানুষের কী উপকার করে? পৃথিবী থেকে এদের শেষ করে দেওয়াই উচিত। কাকাবাবু বললেন, আমরা মানুষ, পৃথিবীর একটা প্রাণী। এখানে আরও কতরকম প্রাণী আছে। আমরা যেমন বাঁচতে চাই, তেমনি ওদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। রবার্ট ধমক দিয়ে বলল, মোটেই না। অন্য সব হিংস্র প্রাণীকে শেষ করে দিতে হবে। ওরা মানুষের ক্ষতি করে। কাকাবাবু বললেন, ওদের বিরক্ত না করলে ওরা মানুষের ধারেকাছে। আসে না। অন্য সব প্রাণীকে ধ্বংস করে দিলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। মানুষও বাঁচবে না। রবার্ট বলল, যত সব বাজে কথা। ওসব খবরের কাগজে লেখে। মুরগি, হাঁস, ভেড়া, গোরু, শূকরদের যে প্রতিদিন কত মারা হচ্ছে? মানুষ এদের খায়। তা বুঝি দয়ামায়ার প্রশ্ন নেই? সিংহ আর গন্ডারের মাংস যদি আমরা খেতাম, ওদেরও বাঁচিয়ে রাখতাম। অত বড় বড় হাতি বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার? শুধু গাছ ধ্বংস করে? বরং ওদের দাঁতগুলো মানুষের কাজে লাগে। সিংহের চামড়া দিয়ে ভাল জুতো হয়। কাকাবাবু বললেন, মানুষ ক্রমশ নিরামিষাশী হয়ে যাবে। খাওয়ার জন্য কোনও প্রাণীকেই মারবে না। আমাদের ইন্ডিয়ার অনেক লোক নিরামিষ খায়। রবার্ট বলল, যাক গে ওসব কথা। আসল কথাটা হল, আমার ভাই ফিলিপ এখন জেলে। লোহিয়া নামে ব্যবসায়ীটা অনেক টাকা খরচ করে ওর বিরুদ্ধে উকিল-ব্যারিস্টার লাগিয়েছে। সে নিজেও একজন প্রধান সাক্ষী। আর-একজন তুমি। তোমরা দুজন মিলে ওকে ফাঁসি দিতে চাও? অপরাধ প্রমাণ হলে ওর নির্ঘাত ফাঁসি! কাকাবাবু বললেন, না, আমি ফিলিপের ফাঁসি চাই না। কারওই ফাঁসি চাই না। যদিও সে আমার ভাইপোকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়েছিল। আমরা কোনওক্রমে বেঁচেছি। সে একজন অতি নিকৃষ্ট অপরাধী। তার অবশ্যই কিছু শাস্তি হওয়া উচিত। রবার্ট ঠোঁট বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, শাস্তি হবে না ছাই! আমরা আছি কী করতে? আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী দুজন, লোহিয়া আর তুমি। খতম হবে। আর-একটা মেয়ে আছে, তার স্বামীটা আমাদের দলে ছিল। তারপর বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরা পড়ায় তার মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বউটা যাতে সাক্ষী দিতে না পারে, তাই তাকেও গুম করার ব্যবস্থা করেছি। ব্যস, কোনও সাক্ষী না পেলে শাস্তি হবে কী করে? জজসাহেবকেও ঘুষ। খাওয়াব, বড়ভাই বেকসুর খালাস হয়ে যাবে! কাকাবাবু বললেন, সবটাই এত সোজা? রবার্ট বলল, তুমি যা ভাবছ, তার চেয়েও সোজা। বিল্‌ এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে বলল, মাস্টার, এবার আমার টাকাটা দিয়ে দাও। আমি চলে যাই। রবার্ট বলল, ও হ্যাঁ, তোমার টাকা? কত যেন ঠিক হয়েছিল? বিল্‌ বলল, তিরিশ হাজার ডলার। কাকাবাবু বললেন, আমার জীবনের দাম মাত্র তিরিশ হাজার ডলার? অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল! বিল্‌ আর রবার্ট দুজনেই কাকাবাবুর দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ কোনও মন্তব্য করল না। রবার্ট বিল্‌কে বলল, তিরিশ হাজার ঠিক হয়েছিল, তাই না? এখন তোমাকে যদি আমি এক পয়সাও না দিই? মাল তো ডেলিভারি পেয়ে গিয়েছিই। এখন তোমাকে টাকা দিতে অস্বীকার করলে তুমি কী করবে? পকেট থেকে সে একটা রিভলবার বের করল। বিল্‌-এর মুখটা পাংশু হয়ে গেল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, সে কী, টাকাটা দেবেন না? আমি এত কষ্ট করে নিয়ে এলাম? আমি গরিব মানুষ! রবার্ট বলল, আমি জিজ্ঞেস করছি, টাকাটা না দিলে তুমি কী করবে? বিল্‌ বলল, কী আর করব? আমার আর কতটুকু ক্ষমতা? রবার্ট বলল, পাবে। তোমাকে একেবারে বঞ্চিত করব না। দামটা বেশিই দেব। এসব কাজ পাঁচ-দশ হাজারেও হয়। ঠিক আছে, তোমাকে কুড়ি দিচ্ছি। বাকি দশ রইল। আবার কখনও যদি তোমাকে কাজে লাগাতে হয়, তখন পাবে। একটা ব্যাগ থেকে সে কয়েক তাড়া নোট বের করে ছুড়ে দিল বিলের দিকে। বিল্‌ বলল, অন্তত আরও পাঁচ বেশি দিন স্যার! রবার্ট প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, যাও! তারপর সে কাকাবাবুর দিকে ফিরে রিভলবারটা তুলে বলল, ওহে, আমি তোমাকে কতরকমভাবে মেরে ফেলতে পারি, শুনবে? এক নম্বর: এক্ষুনি দুটি গুলি চালিয়ে দিতে পারি তোমার বুকে। দুনম্বর: পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারি। তিন নম্বর: হাত-পা বেঁধে ফেলে দিতে পারি লেকে। ওখানে হিপোগুলো তোমাকে নিয়ে খেলা করবে। চার নম্বর: তোমাকে নিয়ে…! কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, অত কিছুর দরকার কী? তুমি আর আমি সামনাসামনি লড়াই করি কোনও অস্ত্র না নিয়ে। দেখা যাক কে জেতে? বিল্‌ এখনও যায়নি। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, খবরদার স্যার, ওতে রাজি হবেন না। এ লোকটি অতি ধুরন্ধর। নিশ্চয়ই কোনও কায়দা করবে! রবার্ট নীচের ঠোঁট উলটে বলল, ওসব কায়দাটায়দা আমি গ্রাহ্য করি। আমি ইচ্ছে করলে এক্ষুনি খালি হাতে ঘ্যাচাং করে ওর মুন্ডুটা ঘুরিয়ে ওর ঘাড়টা ভেঙে দিতে পারি। কিন্তু আমি কোনও খোঁড়া লোকের সঙ্গে লড়াই করি না। তারপর সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমায় আমি কী করে মারব জানো? তুমি জন্তু-জানোয়ারদের এত ভালবাসো। সেই জন্তুদের দিয়েই তোমাকে খাওয়াব। লেক মিগাইয়ের উলটো দিকটায় একটা স্পট আছে, তার নাম লায়ন্স ডেন। সেখানে
false
humayun_ahmed
এরা প্ৰতিভাধর সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গীত সংগ্রহ করে। দেশে বিদেশে প্রচার করে। এই একাডেমী শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসার চায়। একটা লোককে মিথ্যা কথা বলে নিয়ে আসবি? সত্য উদঘাটনের জন্যেই আমাদের মিথ্যার ভিতর দিয়ে যেতে হবে, উপায় কী? উনাকে বলব, মাজেদা সঙ্গীত একাডেমী আপনার একটা সিডি প্ৰকাশ করতে চায়। চা খেতে খেতে টার্মস এন্ড কন্ডিশন্স নিয়ে একাডেমীর ডিরেক্টর মিসেস মাজেদা কথা বলবেন। তারপর উনি যখন দেখবেন সবই ভুয়া, তখন কী হবে? সবই ভুয়া হবে কেন? প্রয়োজনে আমরা উনার একটা সিডি বের করব। কত টাকা আর লাগবে! খালু সাহেব তো বিপথে প্রচুর টাকা কামাচ্ছেন। সেই টাকা যত নষ্ট করা যায় ততই ভালো। খালা কী বলো, ভদ্রলোককে বলব। চা খেতে? সিডি বের করতে কত টাকা লাগে? আমি কিছুই জানি না। খোঁজ নেব। তার আগে আমরা মাজেদা সঙ্গীত একাডেমী গঠন করে ফেলি। ট্রেড লাইসেন্স বের করি। সিডি যদি ভালো চলে ঘরে বসে ব্যবসা। আমি দোকানে দোকানে সিডি দিয়ে আসব। মাসের শেষে টাকা নিয়ে আসব। তোর খালু শুনলে রাগ করবে। রাগ করার কিছু নেই। এটা তোমার বাতেনি ব্যবসা। বাতেনি মানে কী? বাতেনি মানে গোপন, অপ্ৰকাশ্য। সঙ্গীত হবে তোমার গোপন ব্যবসা। রাজি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা আউল লাগছে। তোর যা ভালো মনে হয়। করা। তোর খালুর সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। তুমি পরামর্শ করতে যেও না। পরামর্শ যা করার আমি করব। তুই কথা বলতে যাবি না। তোর ওপর সে ভয়ঙ্কর রেগে আছে। বললাম না, কেইস করেছে। তোর নামে ওয়ারেন্ট বের হয়ে গেছে। তোকে যে-কোনো দিন পুলিশ ধরবে। ধরলে ধরুক। আপাতত আমি খালু সাহেবকে ধরব। উনার গোপন মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দাও তো। ভয় নেই, আমি নাম্বার কোত্থেকে পেয়েছি বলব না। খালার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার নিয়ে আমি খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম। মাইডিয়ার টাইপ গলার আওয়াজে বললাম, খালু সাহেব কেমন আছেন? খালু সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, কে? আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, হিমু কথা বলছি। আপনার শরীর ভালো? তুমি কোথায়? খালু সাহেব, আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। শুনেছি আপনি আমার নামে কেইস করেছেন। পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে আমাকে খুঁজছে। পালিয়ে থাকা ছাড়া গতি কী? জহিরের খবর কিছু পেয়েছ? জ্বি না। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই? জ্বি না। মিথ্যা কথা বলছ কেন? তোমার সঙ্গে তার ভালোই যোগাযোগ আছে। আমি নিশ্চিত তোমরা দুজন। একই জায়গায় বাস করছি। কোনো বিষয়েই এত নিশ্চিত হওয়া ঠিক না খালু সাহেব। গ্যালিলিও যখন প্রথম বললেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তখনো তিনি আপনার মতো নিশ্চিত ছিলেন না। কিছুটা সন্দেহ তারও ছিল। হিমু তুমি বেশি জ্ঞানী হয়ে গেছ। তোমার জ্ঞান কমাবার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যথাসময়ে তা বুঝতে পারবে। জ্বি আচ্ছা খালু সাহেব। আপনাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। আপনার মুড কি এখন ভালো? কথাটা মুড ভালো হলেই জিজ্ঞেস করব। আমার মুড নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যা জিজ্ঞেস করতে চাও করা। ট্রেড লাইসেন্স করার ব্যাপারে কি আপনি সাহায্য করতে পারবেন? অতি দ্রুত আমাদের একটা ট্রেড লাইসেন্স বের করতে হবে। মাজেদা সঙ্গীত বিতানের নামে লাইসেন্স। লিমিটেড কোম্পানি হবে। মাজেদা খালা কোম্পানির ডিরেক্টর। কী বললে? মাজেদা সঙ্গীত বিতান শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসারের জন্যে কাজ করবে। কোম্পানির প্ৰথম অবদান ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁর ব্যাঞ্জোর সিডি। তোমার খালা সঙ্গীত বিতান করছে? সিডি বের করছে? জ্বি। তার একমাত্র ছেলে নেংটো হয়ে পথে পথে ঘোরার পরিকল্পনা করছে। আর সে কোম্পানি ফাঁদছে? গান বাজনা নিয়ে ব্যক্তিগত দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা। দেবদাস মদের বোতল নিয়ে দুঃখ ভুলার চেষ্টা করেছেন। খালার পক্ষে তো আর সেটা সম্ভব না। সিডি কোম্পানি ফাদার বুদ্ধি তুমি তার মাথায় ঢুকিয়েছ? ঢোকানো বলতে যা বোঝায় তা না। তবে আইডিয়াটা নিয়ে সামান্য আলোচনা করেছি। তুমি তার মাথায় সিডির আইডিয়া ঢুকিয়ে দিলে? তুমি যে কত বড় বদমাশ এটা জানো? . এই খেলা আমি বন্ধ করতে যাচ্ছি। তুমি . সোসাইটি থেকে দীর্ঘ দিনের জন্য তোমাকে দূরে রাখার ব্যবস্থা আমি করছি – . কথা শেকসপিয়রের তবে এই মুহূর্তে কথাটা আমারও। খালু সাহেব, শেকসপিয়র একটা ভুল কথা বললে সেই ভুল কথা নিয়ে মাতামাতি করতে হবে? হবার জন্যে হতে হবে কেন? দয়া সমুদ্রে আসতে হলে দয়ার নদী দিয়েই আসতে হবে। মনে করুন। আপনি দয়ার সমুদ্রে পৌছতে চাচ্ছেন। তা করতে হলে দয়ার নদী দিয়ে আপনাকে এগোতে হবে। নৃশংসতার নদী দিয়ে আপনি কখনো দয়ার সমুদ্রে পৌঁছতে পারবেন না। শেকসপিয়র বাবাজি বললেও পারবেন না। খালু সাহেব টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। টেলিফোনের দোকানের লোকটা হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার মুখে এক ধরনের সারল্য। মনে হচ্ছে টেলিফোনের দোকান দিয়ে সে সুখে আছে। কে কী কথা বলছে মন দিয়ে শুনছে। রাত এগারোটায় দোকান বন্ধ করে তার স্ত্রীর সঙ্গে সারা দিনে কী হলো গল্প করছে। আমি বললাম, ভাই আপনার কত হয়েছে? লোকটা হাসি মুখে বলল, হইছে অনেক। কিন্তুক আফনের কিছু দেওয়া লাগবে না। আপনে ফ্রি। এইসব ক্ষেত্রে আমার বলা উচিত— আমি ফ্রি কী জন্যে? আমি সে-সব কিছুই বললাম না। শান্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে চলে এলাম। আবার টেলিফোন করতে এই দোকানে আসব। দেখা যাক তখনো ফ্রি হয় কিনা। এখন কোথায় যাওয়া যায়? রাতে থাকার সমস্যা নেই। ফুলফুলিয়াদের বাসায় থাকি। আরামেই
false
nihar_ronjon_gupta
দুজনে ঢলাঢলি করছিল। আর কাল তো সারাটা দুপুর ও রাত্রের দিকে আমি হোটেলেই ছিলাম না—ওরাই ছিল। কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল সলিল দত্ত মজুদমারকে, হঠাৎ এবার বলল, আপনার সারা জুততা ও প্যান্টের নীচে অত বালি এল কোথা থেকে? সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে এসেছি তো, তাই বোধ করি— আপনি তো গাড়িতে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছেন কি সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে? না না, তা কেন! গাড়িতেই ফিরেছি, তবে হোটেলের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এলাম। কাল কখন ভুবনেশ্বর পৌঁছেছিলেন–কখন সেখান থেকে রওনা হয়েছেন? ভোরবেলা রওনা হয়েছি— এখানে আসতে কতক্ষণ সময় লাগল? তা ঘণ্টা দুই প্রায়। কিন্তু এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আর আপনি বা কে? সাহুই জবাব দিলেন সলিল দত্ত মজুমদারের কথাটার, বললেন, উনি আমাদের লোক। যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন ওঁকে। কিরীটী বললে, ওঁকে আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মিঃ সাহু। আপনার যদি কিছু জানবার থাকে— না, আমি আর কি জিজ্ঞাসা করব—হেমন্ত সাহু বললেন। ভবেশবাবু, ঘরের দরজায় তো দেখছি গডরেজের তালা লাগানো-কিরীটী বলল। হ্যাঁ, এই হোটেলের সব দরজাতেই গডরেজের তালা লাগানো–ভবেশ বললেন। দুটো করে নিশ্চয়ই চাবি আছে প্রত্যেক তালার? হ্যাঁ। একটা অফিসে থাকে, অন্যটা বোর্ডারকে দেওয়া হয়। একটা চাবি তো দেখছি তালায় লাগানো, অন্যটা— নীচে অফিসে আছে, কি বোর্ডে টাঙানো-আনব? নিয়ে আসুন। আর ঐ সঙ্গে সরিৎবাবুকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে যান। ভবেশ অধিকারী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। কিরীটী আবার সলিল দত্ত মজুমদারের দিকে তাকাল-মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনি অনুরাধা দেবীর প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন? মেয়েমানুষকে কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে কি? মেয়েমানুষ জাতটাই— অবিশ্বাসিনী হয়—তাই কি আপনার ধারণা? তাই। নচেৎ দেখুন না, হঠাৎ পুরানো প্রেমিককে দেখেই অনুরাধার পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠল— প্রফেসারকে কি আপনি সন্দেহ করেন? ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রথমে ভবেশ অধিকারী ও তার পশ্চাতে সরিৎশেখর ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে পা দিয়েই সরিৎশেখর অস্ফুট কণ্ঠে বললে, এ কি! অনুরাধা এভাবে—ওকে কে খুন করলে? উঃ, কি ভয়ানক। আপনি তো চেনেন সরিৎবাবু, ওঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল— হ্যাঁ, এক সময় ছিল ঠিকই, পরে অনুরাধা মিঃ দত্ত মজুমদারকে বিবাহ করেছিল। আপনি সেকথা কার কাছে শুনলেন—অনুরাধা দেবী বলেছিলেন নাকি? না, সলিল দত্ত মজুমদারই বলেছিলেন কাল। শুধান না ওঁকে! কিন্তু ওঁদের বিয়ে তো হয়নি। অনুরাধা দেবী ওঁর কিপিংয়ে ছিলেন— এখন মনে পড়ছে বটে, অনুরাধা ঐরকম কিছু একটা গতকাল আমাকে বলেছিল এবং এও বলেছিল ওঁর স্ত্রী আছেন— কি মিঃ দত্ত মজুমদার, কথাটা কি সত্যি? হ্যাঁ ছিল, বাট শি ইজ ডেড। অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছে মনে হয়। কথাটা ঠিক বুঝলাম না–কিরীটী বলল। মানে অনেক বছর সে নিরুদিষ্টা হঠাৎ প্রায় চার বছর আগে আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়, তারপর থেকে তার অনেক সন্ধান করেছি আমি কিন্তু কোন সন্ধান তার পাইনি। আচ্ছা তাঁকে আপনি কবে বিবাহ করেছিলেন? লন্ডন থেকে ফিরে এসে চাকরিতে ঢোকার পর। ঐ সময় সরিৎশেখর বললে, ওঁর পূর্বতন স্ত্রী, যাকে উনি লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিবাহ করেছিলেন বলছেন, সেই মহিলা অর্থাৎ মুকুল রায়কে উনি আদপে বিবাহই করেননি—উনি মিথ্যা বলছেন! চকিতে সলিল দত্ত মজুমদার সরিৎশেখরের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, নিশ্চয় আপনার প্রেমিকা অনুরাধা আপনাকে বলেছে কথাটা? যে-ই বলে থাকুক, কথাটা সত্যি কিনা? না, সত্য নয়। জীমূতবাহন রায়কে আপনি চেনেন–না তাঁকেও চেনেন না? সরিৎশেখর আবার প্রশ্ন করেন। কে জীমূতবাহন রায়? মুকুল রায়ের দাদা, এককালে যার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল। জীমূতবাহন বলেও কাউকে আমি চিনি না। অথচ ঐ জীমূতবাহনসরিৎশেখর বললে, একদিন ওঁর অফিসে ওঁকে করে গিয়েছিলেন-অনুরাধাই কথাটা আমাকে কাল বলেছিল। শি ওয়াজ এ র্যাম্পস্বৈরিণী! চাপা ক্রুদ্ধস্বরে সলিল দত্ত মজুমদার বললে। কিরীটী ওদের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার বললে, ডঃ সেন, আপনিও পুলিশের এনকোয়ারি-পর্ব সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কিন্তু আমি যে আজই চলে যাব। সরিৎশেখর বললে। সাহু বললেন, আপনি যেতে পারবেন না! কেন, আমাকে কি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন? সরিৎশেখর বললে। কিরীটী বললে, ঘটনা পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে কেউই আপনারা সম্ভাব্য সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। আপনি ও মিঃ দত্ত মজুমদার তো বটেই, ১৫নং ঘরে যিনি আছেন তিনিও না। ভবেশবাবু বললেন, হয়ে গেল। আমার হোটেলই এবার উঠে গেল। কিরীটী বললে, আপনি এ ঘরের ড়ুপলিকেট চাবিটা এনেছেন ভবেশবাবু? না। একটা ছোট্ট ঢোক গিলে হতাশার ভঙ্গিতে ভবেশ অধিকারী বললেন, চাবিটা কি-বোর্ডে নেই রায়মশাই। নেই মানে কি? খুঁজে পেলাম না। ভবেশ শুকনো গলায় বললেন, চাবিটা কাল সকালেও কি-বোর্ডে ছিল কিন্তু দেখতে পেলাম না– তবে চাবিটা গেল কোথায়? চাকরবাকরদের জিজ্ঞাসা করেছেন? না। কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, চলুন পাশের ঘরের ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলা যাক। ডঃ সেন, আপনি আপনার ঘরে যান। প্রথমে সাহু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে এল। সরিৎশেখর ও সলিল দত্ত মজুমদারও পিছনে পিছনে এল, সকলের পশ্চাতে ভবেশ অধিকারী। বাইরে আকাশ তখনও মেঘে কালো। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, তবে হাওয়াটা কিছুটা স্তিমিত। সূর্যের মুখ মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে আছে। ১৫নং ঘরের দরজা বন্ধ তখনও। সাহুই বন্ধ দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে চেঁচালেন, দরজাটা খুলুন, শুনছেন মশাই, দরজাটা খুলুন! কিন্তু সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাহু আবার
false
nazrul
কেঁদে পড়ল, “ওরে, পাঁচি যে আর বাঁচে না।” চা খেয়ে এসেও প্যাঁকালের উষ্মা তখনও কাটেনি। সে তেড়ি কাটতে কাটতে মুখ না তুলেই বলল, “মরুক! আমি তার কী করব? দাইয়ের টাকা দিতে পারবি?” সত্যিই তো, সে কী করবে! টাকাই বা কোথায় পাওয়া যায়! হঠাৎ পুত্র তুলে ঝাঁজের সঙ্গে বলে উঠল, “রোজ ঝগড়া করবি নুলোর মা-র সঙ্গে, নইলে সে-ই তো এতখন নিজে থেকে এসে সব করত!” নুলোর মা আর কেউ নয়, –আমাদের সেই ভীমা প্রখর-দশনা শ্রীমতী হিড়িম্বা! এবং সে শুধু ঝগড়া করতেই জানে না, একজন ভালো ধাত্রীও। ইতিমধ্যেই পাঁচি চিৎকার করে মূর্ছিতা হয়ে পড়ল। মায়ের প্রাণ, আর থাকতে পারল না। বউদের মেয়েকে দেখতে বলে সে তাড়াতাড়ি হিড়িম্বাকে ডাকতে বেরিয়ে পড়ল। হিড়িম্বা তখন তার বাড়ির কয়েকটা শশা হাতে নিয়ে বাবুদের বাড়ি বিক্রি করতে যাচ্ছিল। পথে গজালের মা-র সঙ্গে দেখা হতেই সে মুখটা কুঁচকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলে। কিন্তু গজালের মা-র তখন তা লক্ষ করবার মতো চোখ ছিল না। সে দৌড়ে হিড়িম্বার হাত দুটো ধরে বললে, “নুলোর মা, আমায় মাফ কর ভাই! একটু দৌড়ে আয়, আমার পাঁচি আর বাঁচে না!” হিড়িম্বা কথা কয়টা ঠিক বুঝতে না পেরে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। সে একটু জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললে, “এ কী ন্যাকামি লা? তুই কি আবার কাজিয়া করবি নাকি পাড়ার মাঝে পেয়ে?” গজালের মা কেঁদে ফেলে বললে, “না বোন সত্য বলছি, আল্লার কিরে! আমার পাঁচির কাল থেকে ব্যথা উঠেছে; ঝগড়া তোর গজালের মা-র সঙ্গেই হয়েছে, পাঁচির মার সঙ্গে তো হয়নি!” হিড়িম্বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে “অ! তা তোর পাঁচির ছেলে হবে বুঝি? তা আত (রাত) থেকে কষ্ট পাচ্ছে – আর আমায় খবর পাঠাসনি? আচ্ছা মা যাহোক বাবা তুই! আমরা হলে ধন্না দিয়ে পড়তাম গিয়ে। চ দেখি গিয়ে!” হিড়িম্বা যেতেই পাঁচি কেঁদে উঠল, “মাসি গো, আমি আর বাঁচব না।” হিড়িম্বা হেসে বললে, “ভয় কী তোর মা; এই তো এখনই সোনার চাঁদ ছেলে কোলে পাবি!” পাঁচি অনেকটা শান্ত হল। ধাত্রী আসার সান্ত্বনাই তার অর্ধেক যন্ত্রনা কমিয়ে দিল যেন। একটু তদবির করতেই পাঁচির বেশ নাদুস-নুদুস একটি পুত্র ভূমিষ্ঠ হল। সকলে চেঁচিয়ে উঠল, “ওলো, ছেলে হয়েছে লো! ছেলে হয়েছে যে!” ওদের খুশি যেন আর ধরে না! ওরা যেন ঈদের চাঁদ দেখেছে! হিড়িম্বা মূর্ছিতাপ্রায় পাঁচির কোলে ছেলে তুলে দিয়ে বললে, “নে, ছেলে কোলে কর। সব কষ্ট জুড়িয়ে যাবে!” পাঁচি আঝোর নয়নে কাঁদতে লাগল! নবশিশুর ললাটে প্রথম চুম্বন পড়ল না কারুর, পড়ল দুঃখিনী মায়ের অশ্রুজল! গজালের মা হিড়িম্বার হাত ধরে বলল, “দিদি, আমায় মাফ কর!” হিড়িম্বার চোখ ছলছল করে উঠল। সে কিছু না বলে সস্মেহে খোকার কপালে-পড়া তার মায়ের অশ্রুজল-লেখা মুছিয়ে দিলে। বাইরে তখন ক্রিশ্চান ছেলেদের দেখাদেখি মুসলমান ছেলেরাও গাচ্ছে – “আমরা জিশুর গুণ গাই।” মৃত্যুক্ষুধা – ০৩ এই সব ব্যাপারে কাজে যেতে সেদিন প্যাঁকালের বেশ একটু দেরি হয়ে গেল। তারই জুড়িদার আরও জন তিন-চার রাজমিস্তিরি এসে তাকে ডাকাডাকি আরম্ভ করে দিলে। প্যাঁকালে না খেয়েই তার যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে এল। সে জানত কাল থেকে চালের হাঁড়িতে ইঁদুরদের দুর্ভিক্ষনিবারণী সভা বসেচে। তাদের কিচিরমিচির বক্তৃতায় আর নেংটে ভলান্টিয়ারদের হুটোপুটির চোটে সারারাত তার ঘুম হয়নি। কিন্তু চাল যদিবা চারটে জোগাড় করা যেত ধারধুর করে, আজ আবার চুলোও নেই। উনুন-শালেই পাঁচির ছেলে হয়েছে। ও-ঘর নিকুতে সন্ধে হয়ে যাবে। ঘরে তাদের চালের হাঁড়িগুলো যেমন ফুটো, চালও তেমনই সমান ফুটো। সেখানেই বাসা বাঁধবার খড় না পেয়ে চড়াই পাখিগুলো অনেকদিন হল উড়ে চলে গেছে। কিন্তু অর্থের চেয়েও বেশি টানাটানি ছিল তাদের জায়গার। যেটা উনুন-শাল, সেইটেই ঢেঁকিশাল, সেইটেই রান্নাঘর এবং সেইটেই রাত্রে জনসাতেকের শোবার ঘর। তারই একপাশে দরমা বেঁধে গোটা বিশেক মুরগি এবং ছাগলের ডাক-বাংলো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। প্যাঁকালে না খেয়েই কাজে গেল, তার মা-ও তা দেখলে। কিন্তু ওই শুধু দেখলে মাত্র, মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন, চোখে কিন্তু তার জল দেখা গেল না। বরং দেখা গেল সে তার মায়ের আঁতুড়-ঘরে ঢুকে খোকাকে কোলে নিয়ে দোলা দিতে দিতে কী সব ছড়া-গান গাচ্ছে। একটি ছোট্ট শিশু তার জোয়ান রোজগেরে ছেলেদের অকালমৃত্যু ভুলিয়েছে। একটা দিনের জন্যও সে তার দুঃখ ভুলেছে। তার অনাহারী ছেলের কথা ভুলেছে। প্যাঁকালে যেতে যেতে তার মা-র খুশিমুখ দেখলে, বোনের ছেলেকে নিয়ে গানও শুনল। চোখ তার জলে ভরে এল। তাড়াতাড়ি কাঁধের গামছাটা দিয়ে চোখ দুটো মুছে সে হাসতে হাসতে বার হয়ে পড়ল! রাজমিস্ত্রিদলের মোনা প্যাঁকালের সুরকি-লাল কোটটার পকেটে ফস করে হাত ঢুকিয়ে বললে, “লে ভাই একটা ‘ছিকরেট’বের কর! বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ, শালা হয়তো এতক্ষন দাঁত খিঁচুচ্ছে।” প্যাঁকালে পথ চলতে চলতে বলল, “ও গুড়ে বালি রে মনা, ছিকরেট ফুরিয়ে গেছে।” আল্লারাখা তার কাছা খুলে কাছায়-বাঁধা বিড়ির বান্ডিলটা সাবধানে বের করে বললে, “এই নে, খাকি ছিকরেট আছে, খাবি?” কুড়চে বান্ডিল থেকে ফস করে একটি বিড়ি টেনে নিয়ে, সায়েবদের মতো করে বাম ওষ্ঠপার্শ্বে চেপে ধরে ঠোঁট-চাপা স্বরে বললে, “জিয়াশলাই আছে রে গুয়ে, জিয়াশলাই?” গুয়ে তার ‘নিমার’ভেতর-পকেট থেকে বারুদ-ক্ষয়ে-যাওয়া ছুরিমার্কো দেশলাইয়ের বাক্সটা বের করে কুড়চের হাতে দিয়ে বললে, “দেখিস, একটার বেশি কাঠি পোড়াসনে যেন। মাত্তর আড়াইটি কাঠি আছে।” কুড়চে কাঠির ও খোলার দুরবস্থা দেখে বললে, “তুই-ই জ্বালিয়ে দে ভাই,
false
shunil_gongopaddhay
হাত তুলে থামা। সেটা নয়, কিন্তু পরের গাড়িটা ট্যাক্সি। আগে জোজো আর রাধাকে তুলে দিয়ে কাকাবাবু পেছন ফিরে গোমেজকে বললেন, আমাদের ফলো করার চেষ্টা কোরো না। কোনও লাভ নেই। ট্যাক্সিতে উঠে কাকাবাবু ড্রাইভারকে বললেন, পিস্তল দেখে ঘাবড়িয়ো না ভাই। সিনেমার শুটিং হচ্ছে। তোমার গাড়িরও ছবি উঠে যাবে। এখন খুব জোরে চালাও তো! মাথা হেলান দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রাধা, ভয় পেয়েছিলে নাকি? রাধা জোরে-জোরে দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, না, একটুও না। জোজো বলল, আপনি যখন বললেন, সেটি ল্যাচ খোলা, তখন আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যদি অ্যাসিডেন্ট হয়ে যেত? কাকাবাবু রিভলভারটার মুখ জানলার বাইরে দিয়ে ট্রিগার টিপলেন। শুধু খটখট শব্দ হল। হাসতে-হাসতে তিনি বললেন, আমি গুলি ভরিইনি ওইজন্য! সাবধানের মার নেই। রাধার গায়ে গুলি লাগবার ঝুঁকি কি আমি নিতে পারি? জোজো বলল, উরি সর্বনাশ! গুলিই ভরেননি! যদি ওদের সঙ্গে শেষপর্যন্ত ফাইট করতে হত? আমি জানি, আপনি ইচ্ছে করলে ওদের তিনজনকেই আগে গুলি করতে পারতেন, অরণ্যদেবের মতন। কাকাবাবু বললেন, অরণ্যদেব প্রত্যেকবার পারেন, আমি মাঝে-মাঝে ফসকে যাই। দরকার কী ওসব ঝঞ্ঝাটের। ওদের ভয় দেখিয়েই তো কাজ আদায় করা গেল। জোজো বলল, পুলিশের গাড়ি কি সত্যি ছিল? না কি সেটাও ওদের ভয় দেখালেন মিথ্যে কথা বলে? কাকাবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, মাঝে-মাঝে ওরকম বলতে হয়। এটাকে বলতে পারিস সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। ওদের মনের জোরের। সঙ্গে আমার মনের জোরের যুদ্ধ। ক্রিমিনালদের সাধারণত মনের জোর কম হয়। ওরা আসলে ভিতু। ট্যাক্সিটাকে নানা রাস্তায় ঘুরিয়ে তারপর হোটেলের কাছে এনে ছেড়ে দিলেন। পেছনে কোনও গাড়ি আসেনি। এত রাত্তিরেও হোটেলের লবিতে কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন লম্বা লোক। পুরোদস্তুর সুট-টাই পরা, মাথায় টুপি। কাকাবাবুকে দেখে মাথা থেকে টুপিটা খুলে তিনি বললেন, নমস্তে রাজা রায়চৌধুরী। এত রাতে কোথায় বেরিয়েছিলেন? কাকাবাবু একটুও অবাক না হওয়ার ভান করে বললেন, নরেন্দ্র ভার্মা যে। তুমি এত রাতে, কোথা থেকে এলে? আমরা তিনজনে একটু সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কী চমৎকার হাওয়া! নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এত রাতে এই শহরে কেউ বেড়াতে যায় বলে শুনিনি। তা ছাড়া চতুর্দিকে তোমার সব বন্ধু ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কারুর সঙ্গে দেখা হল না? কাকাবাবু বললেন, নাঃ, কোনও বন্ধুর সঙ্গে তো দেখা হল না! এখানে এসে দেখা হল, তুমিই তো আমার একমাত্র বন্ধু! নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তোমার কী কাণ্ড বলো তো! আরাকু ভ্যালির গেস্ট হাউসে তুমি নেই। এখানকার পার্ক হটেলে তোমার জিনিসপত্র পড়ে আছে। সেখানেও ফেরোনি। অন্য হোটেলে উঠেছ, সেকথা পুলিশকে জানিয়ে রাখবে তো? আমরা খুঁজে-খুঁজে হয়রান! কাকাবাবু বললেন, পুলিশকে জানাব? তোমাকে বলেছিলাম না, সরষের মধ্যে ভূত থাকে অনেক সময়? কেন, আমাকে এত খোঁজাখুঁজি করার কী আছে? তোমারও তো বম্বে না কোথায় খুব কাজ ছিল, ফিরে এলে কেন? নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ফিরতে হল দিল্লির ঠেলা খেয়ে। রাজা, তোমার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। এই ছেলেমেয়ে দুটিকে ওপরে পাঠিয়ে দাও। কাকাবাবু বললেন, এত রাতে আবার কাজের কথা কীসের? কাজের সময় কাজ, খেলার সময় খেলা, আর ঘুমের সময় ঘুম, এই না হলে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়। তোমার জরুরি কথাটা চটপট সংক্ষেপে বলে ফেলো তো! নরেন্দ্র ভার্মা কাকাবাবুকে একপাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ভাইজাগের স্মাগলিং নিয়ে দিল্লি খুব চিন্তিত। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ব্যস্ত হয়ে গেছেন। এখান থেকে প্রচুর অস্ত্র, বিশেষত হাত-বোমা পাচার হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। এটা বন্ধ করতেই হবে, না হলে দু দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। সারা দেশের পুলিশকে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির কর্তারা তোমারও সাহায্য চান। তোমাকে সবরকম ক্ষমতা দেওয়া হবে। তুমি এখানকার চোরাচালান-বিরোধী অভিযানটা পরিচালনা করবে। কাকাবাবু কঠিন মুখ করে বললেন, দেখো নরেন্দ্র, তুমি জানো না বোধ হয় যে, ওরা সন্তুকে ধরে রেখেছে। সন্তুর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমি কোনও কিছুই। করতে পারব না। সন্তুকে উদ্ধার করা আমার প্রথম কাজ। তার আগে আমি স্মাগলিং-টাগলিং নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। আমার পক্ষে অসম্ভব! সন্তু কিছু বুঝবার আগেই অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন তার মুখ চেপে ধরল। আর একজন তার কাঁধ ধরে তুলে নিল সিট থেকে। টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সন্তু ছটফট করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না। টানেলটা শেষ হওয়ার একটু আগে লোক দুটো সন্তুকে নিয়ে ঝাঁপ দিল বাইরে। ট্রেনের গতি এখানে বেশি নয়, ওদের তেমন লাগল না। ঝোঁক সামলে উঠে দাঁড়াবার আগেই একজন সন্তুর হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর দুর্বোধ ভাষায় হুকুম দিল কী যেন। সন্তু এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ যে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, এরকম সে কল্পনাও করেনি একবারও। জোজো বারবার স্পাই-স্পাই করছিল বটে, ওটা তো জোজোর বাতিক। সব জায়গাতেই ও স্পাই দেখে। এখানে সন্তু আর জোজোকে কে চেনে? ওদের পেছনে স্পাই লাগবে কেন? সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, আমাকে কোথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছ? লোক দুটো ইংরেজি বা হিন্দি কিছু বোঝে না। ওরা কী যে উত্তর দিতে লাগল, তারও এক অক্ষর সন্তুর বোধগম্য হল না। খুব একটা লম্বা-চওড়া চেহারা নয় ওদের। সন্তু ক্যারাটে জানে। কিন্তু হাত দুটো পেছনে বেঁধে ফেললে খুব মুশকিল হয়। হাত দুটো সামনে বাঁধা থাকলেও তবু ব্যবহার করা যায়, অনেক কিছু আটকানো যেতে পারে। বাধা
false
robindronath
একবার কমলের মূর্ছা ভাঙিল, মূর্ছা ভাঙিয়া মাতার মুখের দিকে চাহিল। অনেক দিনের পর কমলের চক্ষে জল দেখা দিল— বিধবা কাঁদিতে লাগিলেন, বালিকারা কাঁদিয়া উঠিল। সহসা অশ্বের পদধ্বনি শুনা গেল, বিধবা শশব্যস্তে উঠিয়া কহিলেন চিকিৎসক আসিয়াছেন। দ্বার উদ্‌ঘাটিত হইলে চিকিৎসক গৃহে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার আপাদমস্তক বসনে আবৃত, বৃষ্টিধারায় সিক্ত বসন হইতে বারিবিন্দু ঝরিয়া পড়িতেছে। চিকিৎসক বালিকার তৃণশয্যার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। অবশ বিষাদময় নেত্র চিকিৎসকের মুখের পানে তুলিয়া কমল দেখিল সে চিকিৎসক নয়, সে সেই সৌম্যগম্ভীরমূর্তি অমরসিংহ। বিহ্বলা বালিকা প্রেমপূর্ণ স্থির দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, বিশাল নেত্র ভরিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল এবং প্রশান্ত হাস্যে কমলের বিবর্ণ মুখশ্রী উজ্জল হইয়া উঠিল। কিন্তু এই রুগ্‌ণ শরীরে অত আহ্লাদ সহিল না। ধীরে ধীরে অশ্রুসিক্ত নেত্র নিমীলিত হইয়া গেল, ধীরে ধীরে বক্ষের কম্পন থামিয়া গেল, ধীরে ধীরে প্রদীপ নিভিয়া গেল। শোকবিহ্বলা সঙ্গিনীরা বসনের উপর ফুল ছড়াইয়া দিল। অশ্রুহীন নেত্রে, দীর্ঘশ্বাসশূন্য বক্ষে, অন্ধকারময় হৃদয়ে, অমরসিংহ ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন। শোকবিহ্বলা বিধবা সেই দিন অবধি পাগলিনী হইয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতেন এবং সন্ধ্যা হইলে প্রত্যহ সেই ভগ্নাবশিষ্ট কুটিরে একাকিনী বসিয়া কাঁদিতেন। সেই জীর্ণপ্রায় বাঁধাঘাটের ধারে আমার বোট লাগানো ছিল। তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। বোটের ছাদের উপরে মাঝি নমাজ পড়িতেছে। পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশপটে তাহার নীরব উপাসনা ক্ষণে ক্ষণে ছবির মতো আঁকা পড়িতেছিল। স্থির রেখাহীন নদীর জলের উপর ভাষাতীত অসংখ্য বর্ণচ্ছটা দেখিতে দেখিতে ফিকা হইতে গাঢ় লেখায়, সোনার রঙ হইতে ইস্পাতের রঙে, এক আভা হইতে আর-এক আভায় মিলাইয়া আসিতেছিল। জানালা-ভাঙা বারান্দা-ঝুলিয়া-পড়া জরাগ্রস্ত বৃহৎ অট্টালিকার সম্মুখে অশ্বত্থমূল-বিদারিত ঘাটের উপরে ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাবেলায় একলা বসিয়া আমার শুষ্ক চক্ষুর কোণ ভিজিবে-ভিজিবে করিতেছে, এমন সময়ে মাথা হইতে পা পর্যন্ত হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া শুনিলাম, “মহাশয়ের কোথা হইতে আগমন।” দেখিলাম, ভদ্রলোকটি স্বল্পাহারশীর্ণ, ভাগ্যলক্ষ্মী কর্তৃক নিতান্ত অনাদৃত। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদেশী চাক্‌রের যেমন একরকম বহুকাল-জীর্ণসংস্কার-বিহীন চেহারা, ইঁহারও সেইরূপ। ধুতির উপরে একখানি মলিন তৈলাক্ত আসামী মটকার বোতাম খোলা চাপকান; কর্মক্ষেত্রে হইতে যেন অল্পক্ষণ হইল ফিরিতেছেন। এবং যেসময় কিঞ্চিৎ জলপান খাওয়া উচিত ছিল সে সময় হতভাগ্য নদীতীরে কেবল সন্ধ্যার হাওয়া খাইতে আসিয়াছেন। আগন্তুক সোপানপার্শ্বে আসনগ্রহণ করিলেন। আমি কহিলাম, “আমি রাঁচি হইতে আসিতেছি।” “কী করা হয়।” “ব্যাবসা করিয়া থাকি।” “কী ব্যাবসা।” “হরীতকী, রেশমের গুটি এবং কাঠের ব্যবসা।” “কী নাম।” ঈষৎ থামিয়া একটা নাম বলিলাম। কিন্তু সে আমার নিজের নাম নহে। ভদ্রলোকের কৌতুহলনিবৃত্তি হইল না। পুনরায় প্রশ্ন হইল, “এখানে কী করিতে আগমন।” আমি কহিলাম, “বায়ুপরিবর্তন।” লোকটি কিছু আশ্চর্য হইল। কহিল, “মহাশয়, আজ প্রায় ছয়বৎসর ধরিয়া এখানকার বায়ু এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যহ গড়ে পনেরো গ্রেন্‌ করিয়া কুইনাইন খাইতেছি কিন্তু কিছু তো ফল পাই নাই।” আমি কহিলাম, “এ কথা মানিতেই হইবে রাঁচি হইতে এখানে বায়ুর যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা যাইবে।” তিনি কহিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ, যথেষ্ট। এখানে কোথায় বাসা করিবেন।” আমি ঘাটের উপরকার জীর্ণবাড়ি দেখাইয়া কহিলাম, “এই বাড়িতে।” বোধকরি লোকটির মনে সন্দেহ হইল, আমি এই পোড়ো বাড়িতে কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পাইয়াছি। কিন্তু এ সম্বন্ধে আর কোনো তর্ক তুলিলেন না, কেবল আজ পনেরো বৎসর পূর্বে এই অভিশাপগ্রস্ত বাড়িতে যে ঘটনাটি ঘটিয়াছিল তাহারই বিস্তারিত বর্ণনা করিলেন। লোকটি এখানকার ইস্কুলমাস্টার। তাঁহার ক্ষুধা ও রোগ শীর্ণ মুখে মস্ত একটা টাকের নীচে একজোড়া বড়ো বড়ো চক্ষু আপন কোটরের ভিতর হইতে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় জ্বলিতেছিল। তাঁহাকে দেখিয়া ইংরাজ কবি কোল্‌রিজের সৃষ্ট প্রাচীন নাবিকের কথা আমার মনে পড়িল। মাঝি নমাজ পড়া সমাধা করিয়া রন্ধনকার্যে মন দিয়াছে। সন্ধ্যার শেষ আভাটুকু মিলাইয়া আসিয়া ঘাটের উপরকার জনশূন্য অন্ধকার বাড়ি আপন পূর্বাবস্থার প্রকাণ্ড প্রেতমূর্তির মতো নিস্তব্ধ দাঁড়াইয়া রহিল। ইস্কুলমাস্টার কহিলেন— আমি এই গ্রামে আসার প্রায় দশ বৎসর পূর্বে এই বাড়িতে ফণিভূষণ সাহা বাস করিতেন। তিনি তাঁহার অপুত্রক পিতৃব্য দুর্গামোহন সাহার বৃহৎ বিষয় এবং ব্যবসায়ের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন। কিন্তু , তাঁহাকে একালে ধরিয়াছিল। তিনি লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তিনি জুতাসমেত সাহেবের আপিসে ঢুকিয়া সম্পূর্ণ খাঁটি ইংরাজি বলিতেন। তাহাতে আবার দাড়ি রাখিয়াছিলেন, সুতরাং সাহেব-সওদাগরের নিকট তাঁহার উন্নতির সম্ভাবনামাত্র ছিল না। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই নব্যবঙ্গ বলিয়া ঠাহর হইত। আবার ঘরের মধ্যেও এক উপসর্গ জুটিয়াছিল। তাঁহার স্ত্রীটি ছিলেন সুন্দরী। একে কালেজে-পড়া তাহাতে সুন্দরী স্ত্রী, সুতরাং সেকালের চালচলন আর রহিল না। এমন-কি, ব্যামো হইলে অ্যাসিস্ট্যান্ট্-সার্জনকে ডাকা হইত। অশন বসন ভূষণও এই পরিমাণে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। মহাশয় নিশ্চয়ই বিবাহিত, অতএব এ কথা আপনাকে বলাই বাহুল্য যে, সাধারণত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে-যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নহে, সে নিতান্ত নিরীহ। যদি জিজ্ঞাসা করেন কেন এমন হইল, আমি এ সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবিয়া রাখিয়াছি। যাহার যা প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা সেটার চর্চা না করিলে সে সুখী হয় না। শিঙে শান দিবার জন্য হরিণ শক্ত গাছের গুঁড়ি খোঁজে, কলাগাছে তাহার শিং ঘষিবার সুখ হয় না। নরনারীর ভেদ হইয়া অবধি স্ত্রীলোক দুরন্ত পুরুষকে নানা কৌশলে ভুলাইয়া বশ করিবার বিদ্যা চর্চা করিয়া আসিতেছে। যে স্বামী আপনি বশ হইয়া বসিয়া থাকে তাহার স্ত্রী-বেচারা একেবারেই বেকার, সে তাহার মাতামহীদের নিকট হইতে শতলক্ষ বৎসরের শান-দেওয়া যে উজ্জ্বল বরুণাস্ত্র, অগ্নিবাণ ও নাগপাশবন্ধনগুলি পাইয়াছিল তাহা সমস্ত নিস্ফল হইয়া যায়। স্ত্রীলোক পুরুষকে ভুলাইয়া নিজের শক্তিতে ভালোবাসা আদায় করিয়া লইতে চায়, স্বামী যদি ভালোমানুষ হইয়া সে
false
humayun_ahmed
চলে যেতে পারে। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আপা নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যে নতুন ঝামেলা। এমনিতেই আপা যা করছেন, তার নিজের ভাই বা বোন তা করবে না। উকিল সাহেবের ফিসের টাকা পুরোটা উনি দিয়েছেন। অবশ্যি তাকে প্রথম বলেছিলেন, উকিল সাহেব প্রথম দফায় ন হাজার টাকা চেয়েছেন। দিতে পারবে পুষ্প? পুষ্প বলেছে, আমার কাছে চার হাজার টাকা আছে। আমি ওকে বলব। ও জোগাড় করবে। রকিব সব শুনে রাগী গলায় বলেছে, প্রথম বারেই নয় হাজার টাকা! এইটা কীরকম উকিল? একজন ব্যারিস্টারও তত পাঁচ শ টাকার বেশি নেয় না। ঐ উকিল বাদ দিতে বল, আমি দেখব। তুমি চেন কাউকে? চিনব না কেন? ভালেই চিনি। পুষ্প নিশাতকে বলল, ও নিজে একজন উকিল দিতে চায় আপা। ওর চেনা কে নাকি আছে। টাকা নেবে না। নিশাত বলেছে, আচ্ছা ঠিক আছে। দু-তিন দিন পর জিজ্ঞেস করল, রকিব। সাহেব কি কিছু করেছেন? না আপা। জিজ্ঞেস করেছিলে কিছু করেছেন কি না? জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল করবে। কেইসটার নাকি অনেক দেরি। খুব দেরি কিন্তু নেই পুষ্প। ও গা করছে না আপা। শুধু বলছে দেখি। ওর বোধহয় টাকাও নেই। আমার গলার একটা হার দিই আপা, দু ভরি সোনা আছে। নিশাত বলেছে, আমি পরে তোমার কাছ থেকে হার নিয়ে যাব। এখন আমি চালিয়ে নিই। তুমি চল, তোমার সঙ্গে উকিল সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিই। ওঁকে দেখে প্রথমে ভক্তি হবে না, কিন্তু উনি খুবই নামকরা। উনি যা বলবেন মন দিয়ে শুনবে। উকিল সাহেব প্রথমে সমস্ত ব্যাপারটা খুটিয়ে-খুটিয়ে শুনলেন। প্রথম মিজান কবে। এ-বাসায় এল, কখন এল, তার পরনে কী ছিল থেকে শুরু। তারপর কত রকম যে। প্রশ্ন। যেমন, মিজান সাহেবের ড্রাইভার কি কখনো বাসায় এসেছিল? মিজান সাহেব কি কখনো চিঠিপত্র লিখেছিলেন? বেশির ভাগ প্রশ্নেরই পুষ্প জবাব দিতে পারল না। এর মধ্যে একটি হচ্ছেআপনার স্বামী কি কখনো মিজান সাহেবের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নিয়েছেন। আপনি কিছু জানেন না? জ্বি-না। আপনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করবেন। জ্বি আচ্ছা। আপনার স্বামীকে বলবেন তিনি যেন অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করেন। জ্বি আচ্ছা। তাঁকে কিছু শিখিয়েপড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। কারণ মিজান সাহেবের উকিল তাঁকে কোর্টে তুলবে। আপনি আগামী পরশু আপনার স্বামীকে আসতে বলবেন। বিকেল পাঁচটায় আমি ফ্রী থাকব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকে লিখে রাখছি। জ্বি আচ্ছা। আপনাকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করবে। আপনি ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসবার জন্য উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। যা জানেন তাই বলবেন। উকিল আপনাকে প্রশ্ন করলে জবাব নিয়ে আপনি ধাঁধায় পড়ে গেছেন, তখন তাকাবেন আমার দিকে। যদি দেখেন আমি ডান হাত মুঠি করে আছি তা হলে বলবেন, আমার মনে নেই। আর যদি দেখেন আমি দুটি হাতই মুঠি পাকিয়েছি তা হলে বলবেন, এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার এসব মনে থাকবে না। বাজে কথা বলবেন না। অবশ্যই মনে থাকবে। পুষ্প রকিবকে টাকার কথাটা জিজ্ঞেস করল। রাতে ভাত খেতেখেতে বলল, তোমার বন্ধু কি তোমাকে কোনো টাকা ধার দিয়েছিল? রকিব চোখ কুঁচকে বলেছে, কেন? উকিল সাহেব জানতে চাচ্ছিলেন। দিয়েছিল? এর সাথে মামলার কী সম্পর্ক? জানি না কি সম্পর্ক। উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন বলেই বললাম। তোমাকে যেতে বলেছেন। কী মুশকিল, আমি কেন যাব? যেতে বলেছেন, যাও। রকিব গেল না। কেন গেল না কে জানে। নিশাত বলল, ঠিক আছে, যেতে না চাইলে কি আর করা। জোর করে তো আর নেওয়া যাবে না। আমি তোমার ল ইয়ারকে বলব। তিনি কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই বের করবেন। উনি বোধহয় চান না তোমার কেইস কোর্টে উঠুক, তাই না পুষ্প? আমি জানি না আপা। মাঝে-মাঝে মনে হয় চায়। আবার মাঝে-মাঝে মনে হয় চায় না। কী যে মুশকিলে পড়েছি আপা। কোনো মুশকিল নেই। আমি আছি তোমার পাশে। নিশাত আপার কথায় পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। যার কথায় ভরসা পাওয়া যেত সে আছে চুপ করে। মিজান আজ এসেছিল এই খবর শুনলে সে কী করবে কে জানে। হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে যাবে। তাকে এই খবর কিছুতেই বলা যাবে না। বরং একতলার বাড়িওয়ালার বাসা থেকে নিশাত আপাকে টেলিফোন করে বলা যায়। পুষ্প তাই করল। সুরমা দুপুরের খাবারের বিশাল এক আয়োজন করেছেন। ঢাকার সব আত্মীয়স্বজনদের বলেছেন। মেয়ে-জামাই চলে যাবে এই উপলক্ষে সবাই মিলে একটা উৎসব। আনন্দ-উৎসবের সুর এখানে বাজছে না, মীরু অনবরত কাঁদছে। দেশ থেকে যাবার দিন মীরু সবসময় এরকম করে কেঁদে-কেঁদে ভাসায়। তার কান্নাকাটি দেখে নিমন্ত্ৰিত অথিতিরাও অস্বস্তি বোধ করেন। সুস্বাদু সব খাবারও মুখে রোচে না। ইয়াকুব স্ত্রীকে কিছুক্ষণ সামলাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। সে এখন বসেছে। জহিরের পাশে। বারান্দার এক কোণায়। সাউথ ডেকোটার পেট্রোয়াড ফরেস্টের গল্প এমন ভঙ্গিতে করছে যে জহির মুগ্ধ। শুরুতে জহিরের মনে হয়েছিল মানুষটা অহঙ্কারী। সেই ভুল তার দ্বিতীয় দিনেই ভেঙেছে। মানুষটা মোটেই অহঙ্কারী নয়। দারুণ আমুদে এবং খুবই খরচে স্বভাবের। দু হাতে টাকা খরচ করে। মুখ শুকনো করে বলে, সাত দিনের জন্যে দেশে বেড়াতে এসে দেখি পথের ফকির হলাম রে ভাই! বলেই পর মুহুর্তে আরো বড় সংখ্যার টাকা খরচ করে বসে। খুব খরচে স্বভাবের মানুষও আমেরিকায় দীর্ঘ দিন থাকলে ধাতস্থ হয়ে যায়। খরচে স্বভাব নিয়মের ভেতর চলে আসে। এই লোকটির তা হয় নি।
false
MZI
পেটব্যথা করছে সার, বাসায় যেতে হবে এক্ষুণি। অঙ্ক-স্যার যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন জানতাম না। সকালে কি খেয়েছি, রাতে কি খেয়েছি, দাস্ত হয়েছে কি না, বাহ্যি হয়েছে কি না এইসব একগাদা প্রশ্ন করে দুই দানা আন্টিমনি সিক্স হানড্রেড খাইয়ে বেঞ্চে শুইয়ে রাখলেন। স্যার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন আর পকেটে নানারকম ওষুধ নিয়ে ঘুরে বেড়ান জানলে কখনোই সারকে পেটব্যথার কথা বলতাম না! শক্ত বেঞ্চে শুয়ে থাকা আরামের কিছু ব্যাপার নয়, তাই একটু পরে বললাম যে আমার পেটব্যথা কমে গেছে। শুনে অজ্ঞ স্যারের মুখে কী হাসি। বিকেলে বাসায় এসে আমি দৌড়ে আমার ঘরে গেলাম। বালিশের নিচে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে সেই পোকাটি রেখেছিলাম যেটা হয়তো আসলে মহাকাশের সেই রহস্যময় প্রাণী। আমি সাবধানে সেই শিশিটা হাতে নিলাম, এক কোনায় কালো বিন্দুর মতো সেই জিনিসটি। আমি আস্তে আস্তে শিশিতে একটা টোকা দিলাম, সাথে সাথে ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর ভিতর থেকে কে যেন ক্ষীণ স্বরে বলল, সাবধান। উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হল। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করে ভালো করে সেটাকে দেখার চেষ্টা করলাম, অবিশ্বাস্য রকম জটিল একটা যন্ত্র। তার ভিতর থেকে একটা ফুটো দিয়ে মাথা বের করে একটি অত্যন্ত ছোট। প্রাণী আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সত্যি সত্যি একটা বড় মাথা আর দুটি চোখ। বুদ্ধিমান প্রাণীর যে-রকম থাকার কথা। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? প্রাণীটি খানিকক্ষণ ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করল, তারপর বলল তুমি কে? আমি বিলু। বিলু। বিলু দায়িত্বহীন হোমাস্যাপিয়েন। হোমোস্যাপিয়েন মানে মানুষ, প্রাণীটি আমাকে দায়িত্বহীন মানুষ বলছে, আমি নিশ্চয়ই কিছু-একটা কাজ খুব ভুল করেছি। ঢোক গিলে বললাম, আমি আসলে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই নি, আমি তোমাকে সাহাযা করতে চাই ঠিক তখন ছোট খালা ঘরে উঁকি দিলেন, আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে কথা বলছিস রে, বিলু? আমি চট করে শিশিটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেললাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না, প্রাণীটা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন। দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন!! ছোট খালা প্রাণীটির কথা শুনতে পেলেন বলে মনে হল না, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে কথা বলছিলি? আমি আমতা আমতা করে বললাম, কারো সাথে না, ছোট খালা। প্রাণীটা তখনও চিৎকার করছে, দায়িত্বহীন হোমাস্যাপিয়েন। ছোট খালা মনে হল কিছু-একটা শুনলেন, ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন, ঘরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে? আমি ঢোক গিলে বললাম, হ্যাঁ। ছোট খালা খানিকক্ষণ ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি তখন আর শিশিটা বের করার সাহস পেলাম না। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হবে। খুব সাবধানে। রাতে খাবার টেবিলে আমি ছোট খালুকে জিজ্ঞেস করলাম, খালু, কেউ যদি মহাকাশের সেই প্রাণীকে দেখতে পায় তাহলে তার কী করা উচিত? খালু অবাক হয়ে বললেন, মহাকাশের কী প্রাণী? আমি বললাম, খবরের কাগজে যে উঠেছে। কী উঠেছে? আমি খবরটা বললাম, ছোট খালু খবরটাকে মোটেও গুরুত্ব দিলেন না। হাত নেড়ে বললেন, ধুর, সব লোকঠকানোর ফন্দি। খবরের কাগজ বিক্রি করার জন্যে যত সব গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু যদি সত্যি হয় তাহলে কার সাথে যোগাযোগ করবে? সত্যি হবে না। যদি হয়? ছোট খালু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর ইতস্তত করে বললেন, পুলিশকে নিশ্চয়ই। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি বালিশের নিচে থেকে ছোট শিশিটা বের করলাম, ভিতর থেকে একটা হালকা নীল আলো বের হচ্ছে। কাছে মুখ নিয়ে বললাম, হে মহাকাশের আগন্তুক। ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর শুনলাম সেটি বলল, বিলু। দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন। প্রাণীটা আবার আমাকে গালি দিচ্ছে, আমার এত খারাপ লাগল যে বলার নয়। ধতমত খেয়ে বললাম, আমি আসলে বুঝতে পারি নি, একেবারেই বুঝতে পারি নি– ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর একটা কাতর শব্দ করল প্রাণীটা, বলল, বিপদ, মহাবিপদ, আটানব্বই দশমিক তিন চার বিপদ– কার বিপদ? আমার। কী বিপদ? প্রাণীটা কোনো কথা না বলে বিবি পোকার মতো শব্দ করতে স্বাক। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী বিপদ? কী হয়েছে? প্রাণীটা কোনো উত্তর দিল না, ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করতে থাকল। আমার মনে হল শব্দটা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসছে। প্রাণীটা যদি মরে যায় তখন কী হবে? আমার তখন এই প্রাণীটার জন্যে এত মন-খারাপ হয়ে গেল, বলার নয়। আহা বেচারা, না-জানি কোন দূর-দূরান্তের এক গ্রহ থেকে এসে এখানে কী বিপদে পড়েছে। কি বিপদ বলতেও পারছে না। বাংলা যে বলতে পারে সেটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। মানুষের মতো কথা বলে না, অন্যরকমভাবে বলে, তাই সবাই শুনে বুঝতে পারে না। ছোট খালা যেরকম বোঝেন নি। এখন এত দুর্বল হয়ে গেছে যে আর কথাও বলতে পারছে না। কী করা যায় আমি চিন্তা করে পেলাম না। ছোট খালুকে কি ডেকে তুলে বলব? কিন্তু কী বলব? মহাকাশের প্রাণী একটা হোমিওপ্যাথিক শিশিতে অসুস্থ হয়ে আছে? একজন ডাক্তার ডাকা দরকার? হোট খালু তো বিশ্বাসই করবেন না। স্যারকে বলতে পারলে হত, কিন্তু এই মাঝরাতে স্যারকে আমি কোথায় পাব? আমি অনেকক্ষণ বসে বসে চিন্তা করলাম। প্রাণীটাকে যখন পেয়েছি তখন সেটাকে ঘির ছিল অসংখ্য পিঁপড়া। পিঁপড়াগুলো মনে হচ্ছিল প্রাণীটাকে কোনোভাবে সাহায্য করছিল। প্রাণীটা যদি আমার সাথে কথা বলতে পারে, নিশ্চয়ই তাহলে পিঁপড়াদের সাথেও
false
shomresh
পৌঁছে সে ডরোথিকে দেখতে পেল। এই সকালবেলায় নরম রোদে লনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পরনে হলদে ছোপ দেওয়া চমৎকার স্কার্ট। মাথায় রিবন। বয়স অনেক কম লাগছে। গুড মর্নিং। অর্জুন হাসল। গুড মর্নিং। সত্যি, সকালটা খুব সুন্দর! ওটা কী পাখি? অর্জুন দেখল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচু ডালে পাখিটা বসে আছে, আমি ইংরেজি নাম জানি না। বাংলায় বলে নীলকণ্ঠ। ডরোথি মনে-মনে নামটা উচ্চারণের চেষ্টা করল, কিন্তু পাখিটা উড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে তাকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছিল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে? হ্যাঁ। ডিম সেদ্ধ, টোস্ট আর চা। তোমার জন্যে একটা খবর আছে। ডরোথির মুখে হাসি ফুটল, তিন নম্বরের খবর পেয়েছ? কিছুটা। কিন্তু খবর হচ্ছে ওই তারিণী সেন সম্পর্কে তুমি ছাড়া আরও দু জন মানুষ ইন্টারেস্টেড। তাঁরা ওর ওপর সিনেমা তৈরি করবেন। ডরোথির মুখ শক্ত হয়ে গেল, কে বলল একথা? ওরাই। অবশ্য আমাকে নয়। গতকাল আমি যে ভদ্রলোকের কাছে তারিণী সেনের খবর আনতে গিয়েছিলাম, তাঁর কাছেই ওরা রাত বারোটার সময় গিয়েছিল। আমার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হচ্ছে না, ওরা সুধীরবাবুর কাছেই গেল কেন? জলপাইগুড়ি শহরে অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন যাঁরা পুরনো দিন নিয়ে কথা বলতে ভাল পারেন। তাঁদের কারও কাছে না গিয়ে ওরা! এটা কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে করি না। ডরোথি বলল, তোমাকে যিনি ওঁর কথা বলেছিলেন তেমনই আর-একজন ওদের একই নাম বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো আলাদা। হ্যাঁ। তবে সেটা একই সময়ে বলে অস্বস্তি হচ্ছে। বিশেষ করে লোকটার অতীত ভাল নয়। তারিণী সেন কুখ্যাত ডাকাত ছিল। অর্জুন তাকাল ডরোথির দিকে। মেয়েটা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা একটু সহজ করার জন্য সে বলল, আসলে সত্যসন্ধান করতে করতে এমন অভ্যেস তৈরি হয়েছে যে, কোনও কিছুকেই সহজ মনে গ্রহণ করতে পারি না। তারিণী সেন কি এখনও বেঁচে আছে? ডরোথি জিজ্ঞেস করল। জানি না। না থাকারই সম্ভাবনা। সময় তো কম বয়ে যায়নি। উনি কোথায় থাকতেন? ময়নাগুড়ি থেকে দোমহনির মধ্যে। আমরা নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে পারি। কত দূরে? বেশি দূর নয়। তিস্তা ব্রিজ পার হলেই দোমহনি। মিনিট কুড়ির পথ। তা হলে চলো। আমি বলি কি, তুমি গেস্ট হাউসেই থাকো; আমি ঘুরে আসি। না। একা থাকতে একঘেয়ে লাগছে। আমি যাব। অতএব ডরোথিকে পেছনের সিটে বসাতে হল। জলপাইগুড়ি শহরের রাস্তায় সাইকেল রিকশার ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে অর্জুন তিস্তা ব্রিজের পথ ধরল। রাস্তায় অধিকাংশ মানুষ ঘুরে-ঘুরে তাদের দেখছে। এটা যে ডরোথির কারণে, তা বলা বাহুল্য। ডরোথি এখন রোদচশমা পরে নিয়েছে। ফলে তার মনের ভাব বোঝা সম্ভব নয়। কী রকম নির্বিকার দেখাচ্ছে। এখন দুপাশে ফাঁকা মাঠ, নীল আকাশ মাথার ওপর, আর চমৎকার বাতাস শরীরে আলতো আঘাত করছে। পেছনে বসে ডরোথি বলল, কী আরাম। অর্জুন কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটার বয়স নিশ্চয়ই বেশি নয়, শরীরটাই বড় হয়েছে শুধু। নইলে ওই দুটো লোককে নিয়ে সে এবং সুধীরবাবু যতটা বিচলিত হয়েছে, তার বিন্দুমাত্র ও হচ্ছে না কেন? সহজ-সরল মানুষদের। সুবিধে হল দুশ্চিন্তা চট করে তাদের আঁকড়ে ধরে না, ফলে ভাল থাকে। তিস্তা ব্রিজে টোল ট্যাক্স দিতে থামতেই হল। টিকিট নিয়ে অর্জুন বলল, এটা হল তিস্তা নদী। এখন বেশি জল নেই বলে ভেবো না সারা বছর এইরকম চেহারা থাকে। ভরা বর্ষায় এপার-ওপার দেখা যায় না। ডরোথি নেমে পড়েছিল। কয়েক পা হেঁটে ব্রিজের ওপর রেলিং ধরে দাঁড়াল সে। হাওয়ায় তার পোশাক উড়ছে। বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে অর্জুন পাশে চলে গেল, যখন এই ব্রিজ তৈরি হয়নি তখন বর্ষাকালে নৌকোয় মানুষ এপার থেকে ওপারে যেত। প্রচুর সময় লাগত তখন। শীতকালে শুনেছি একপাশে নৌকো আর বাকিটা চরের ওপর ট্যাক্সি চলত। ওদিকটা হল বার্নিশ। কমলাকান্ত রায়কে ওখানে পাওয়া গিয়েছিল। ডরোথি অনেক দূরের গাছপালার দিকে তাকাল। এখান থেকে সেটা প্রায় অস্পষ্ট। ডরোথি জিজ্ঞেস করল, আমার ঠাকুর্দাও তা হলে নৌকো করে পার হতেন? নিশ্চয়ই। তখন মোটরবোট চালু হয়নি। আবার বাইক চালু করে অর্জুন ব্যাপারটা ভাবতে আরম্ভ করল। মায়ের কাছে সে শুনেছে তখন নদী পার হতে ঘণ্টা দেড়েক লেগে যেত। রিচার্ড অথবা ম্যাকসাহেব প্রায়ই তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট করে কোন কারণে বার্ণিশের দিকে যেতেন, সেটা বোধ হয় কখনও জানা যাবে না। মানুষ অকারণে এত কষ্ট করে না। দোমহনির মোড় জমজমাট। আগে এখানে রেল লাইন ছিল, আটষট্টির বন্যার পর ট্রেন চলে না। ডান দিকে বাইপাসের পথ ছেড়ে অর্জুন সোজা চলে এল ময়নাগুড়িতে। তেমাথার মোড়ে বাইক থামিয়ে সে জায়গাটার নাম বলল ডরোথিকে। বেশ হতশ্রী চেহারা। দোকানপাটগুলো যে সচ্ছল নয় বোঝা যায় সাজগোজ দেখে। বাইপাস হওয়ার পর থেকে ময়নাগুড়ির গুরুত্ব কমে গেছে। ওদের দাঁড়াতে দেখে ভিড় জমে গেল। মফস্বলের বেকার মানুষেরা গোল হয়ে ঘিরে ওদের দেখতে লাগল। কালো চামড়ার মানুষের পেছনে সাদা চামড়ার এক মেমসাহেব দেখে ওরা কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। অর্জুন এক জনকে জিজ্ঞেস করল, হরিদাস বর্মণকে চেনেন? সঙ্গে-সঙ্গে গুঞ্জন উঠল। এরা হরিদাস বর্মণের বাড়িতে এসেছে অতএব আর কোনও কৌতূহল থাকতে পারে না, এমন ভাব। একজন জবাব দিলেন, ওই যে রাস্তাটা, চারটে বাড়ি বাদ দিলেই ডানহাতি দোতলা বাড়ি। কোনও কাজ আছে বুঝি? মফস্বলের লোকেরা প্রশ্ন করার সময় ভাবে না করাটা ঠিক কিনা। মুখ আর মনের ফারাক নেই। অর্জুন বাইক ঘোরাতেই রাস্তা
false
shirshendu
করে না। তুমি করো? না। আপনাকে আমি শিশুবয়স থেকে দেখে আসছি। এই পরিবারের কোনও লোক কখনও ছোট কাজ করেনি। হেমকান্ত একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, না, আমরা ছোট কাজ সহজে করি না। শশীকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি জানি। বরিশাল মার্ডার কেস নিয়ে খুব তোলপাড় হচ্ছে। শশীর পক্ষে দলছুট হয়ে লুকিয়ে থাকা এমনিতেই সম্ভব ছিল না। তুমি অনেক জানো দেখছি। কিছু খবর রাখি। ওকে যারা প্রোটেকশন দিতে পারত তাদের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারেনি। তা ছাড়া আর-একটা নির্দেশ ছিল ওর ওপর। সেটাও ও মানেনি। কী সেটা? কথা ছিল, মার্ডারের পর সুইসাইড করবে। হেমকান্ত শিউরে ওঠেন, তাই নাকি? হ্যাঁ। তুমি কী করে জানলে? মনুদিদির কাছে ও নিজেই বলেছে। কই, মনু তো আমাকে বলেনি! আপনাকে আমোক বিরক্ত করতে চাননি। তোমাকে কবে বলল? পরশু মনুদিদি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনই বলেন। শশী সুইসাইড করল না কেন? সেটা বোঝা মুশকিল। হয়তো শেষ সময়ে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। পিস্তলের গুলিও ফুরিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। বাচ্চা ছেলে তো! হেমকান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু আমার সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটা যে ভাঙা দরকার। কী করব বলতে পারো? এখন কিছু করার দরকার নেই। আগে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি। মনু কি ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেছে? না, উনি চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। ঠিক আছে। আগে তুমিই দেখা করো। যে আজ্ঞে। মামলা কবে নাগাদ উঠবে? তা বলতে পারি না। তা ছাড়া মামলা তো এখানে হবে না। শশীকে বরিশালে চালান দেওয়া হবে। মামলা উঠবে সেখানে। এখানে হয় না? সেটা নরমাল প্রসিডিওর নয়। তুমি কি বরিশালে গিয়ে মামলা লড়তে পারবে? তা পারা যাবে না কেন? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আচ্ছা, তোমার ওপর অনেক দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম। তাতে কী? পারবে তো সব সামলাতে? চেষ্টা করব। শচীন চলে যাওয়ার পর হেমকান্ত অনেকক্ষণ শচীনের কথাই ভাবলেন। ছেলেটি অতি চমৎকার। এই ছেলেটিকে যদি জামাই করেন তবে সব দিক দিয়েই তার ভাল হয়। বিষয় আশয় এবং মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ভাববার মতো একজন লোক পেলে জীবনটা তিনি নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন। হেমকান্তর ঘরের বাইরেই ওত পেতে ছিল কৃষ্ণকান্ত। শচীন বেরিয়ে আসতেই ধরল, শচীনদা, কী কথা হল? শচীন একটু হেসে বলে, তা দিয়ে তোর কী দরকার? আমার দরকার আছে। তুমি শশীদাকে বাঁচাবে? আমি বাঁচাতে যাব কোন দুঃখে? বাবা তোমাকে শশীদার উকিল ঠিক করেনি? করলেই বা। উকিল কি ভগবান? সি আর দাশ কীরকম আরগুমেন্ট করেছিল জানো? খুব পেকেছিস দেখছি। শচীন নীচে এসে বার-বাড়িতে রাখা তার সাইকেলটা টেনে নিয়ে বলে, শশীকে নিয়ে তোকে অত ভাবতে হবে না। লেখাপড়া কর। করছি। আমি উকিল হব। তাই নাকি? উকিল হয়ে শুধু স্বদেশিদের হয়ে মামলা লড়ব। বলিস কী? শুধু স্বদেশিদের মামলা লড়লে যে পেট চলবে না। আমি তোমার সাইকেলের রডে একটু উঠি শচীনদা? ওঠ। কিন্তু তোর মতলবখানা কী? চলোই না, বলছি। শচীন সাইকেলের রডে কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এল। রাস্তা মোটেই ভাল নয়। ইটের রাস্তায় গর্ত, উঁচু-নিচু। সাইকেল চালাতে চালাতে শচীন বলল, এবার বল। ছোড়দিকে তোমার পছন্দ হয়? শচীন একটু থতমত খেয়ে হেসে ওঠে। বলে, আমার পছন্দ হলে তোর কী লাভ? তোমার সঙ্গে ছোড়দির বিয়ের কথা চলছে, জানো? শচীন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, না তো! তোকে কে বলল? মনুপিসি। বলেনি ঠিক। বাবাকে বলছিল, আমি শুনেছি। তাই নাকি? তুমি ছোড়দিকে বিয়ে করবে? দূর ফাজিল! ছোড়দি সুন্দর না? কে জানে! লোকে বলে, ছোড়দি নাকি খুব সুন্দর। তা হবে। কিন্তু ছোড়দির একটা দোষের কথা তোমাকে বলে দিই। রেগে গেলে কিন্তু ছোড়দির নাকের ডগা নড়ে। শচীন এত জোরে হেসে ফেলল যে, সাইকেল বেসামাল হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ফের সামলে নিয়ে সে বলল, আর কী দোষ আছে রে তোর ছোড়দির? ভীষণ হিংসুটে। খুব মিথ্যে কথা বলে। তাই নাকি? তা হলে ওকে তো বিয়ে করা উচিত নয়। না, না। করো। ছোড়দি এমনিতে ভালই। তোমাব সঙ্গে বিয়ে হলে ছোড়দি তো কাছাকাছিই থাকবে, তাই না? ও, সেইজন্যই আমাকে বিয়ে করতে বলছিস? শচীন আবার হাসতে থাকে। রঙ্গময়ি বিশাখার চুল বেঁধে দিল সেদিন বিকেলে। তারপর বলল, বাপ তো বোম ভোলানাথ, মেয়ের বয়সের দিকে লক্ষই নেই। কিন্তু এই বয়সে কি ঘরে রাখা যায়! কথাটা শুনল বিশাখা। কোনও মন্তব্য করল না। রঙ্গময়ি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীনকে তো দেখেছিস! বিশাখা একটু বিস্ময়ভরে চেয়ে বলে, দেখব না কেন? সুফলার দাদা তো! তার কথাই বলছি। তার কথা কেন? তোর বাবার খুব ইচ্ছে, ওর সঙ্গে তোর সম্বন্ধ করে। ওর সঙ্গে?–বলে বিশাখা যেন আকাশ থেকে পড়ে। কেন, ছেলেটা খারাপ নাকি? কী চমৎকার রাজপুত্রের মতো চেহারা! বিশাখা একটা ঝামটা মেরে বলে, হলেই বা! মোক্তারের ছেলেকে বিয়ে করতে যাব কেন? আর পাত্র জুটল না। রঙ্গময়ি বলে, মোক্তারের ছেলে তো কী! ও নিজে তো উকিল। ওরকম উকিল গন্ডায়-গন্ডায় আছে। তোর পছন্দ নয়? দুর! —বলে প্রস্তাবটা একদম উড়িয়ে দিল বিশাখা। রঙ্গময়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এমন পাত্র তোর পছন্দ নয়! সত্যিই পছন্দ নয়? বিশাখা বিরক্ত হয়ে বলে, আমি কি তোমাদের পথের কাঁটা পিসি যে, ধরে বেঁধে জলে ফেলে দিতে চাও? জলে ফেলে দেওয়া কি একে
false