label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shunil_gongopaddhay
থেকে কত দূরে চলে এসেছে ভরত। সে হেসে উঠল আপন মনে। বালিকা বধূটিকে কোন স্কুলে পাঠানো হবে, তাই নিয়ে সরলা ও বিবির মধ্যে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। সরলা পড়ে বেথুন স্কুলে, বিবি লোরেটা হাউজে। দু’জনেরই ধারণা, যার যার নিজের স্কুলটিই বেশি ভালো। বেথুন স্কুল বাঙালি পাড়ায় বাংলা-মাধ্যম, আর লোরেটো হাউজ সাহেব পাড়ার ইংরেজি স্কুল, সেখানে বাঙালি ছাত্রীর তুলনায় ফিরিঙ্গি ছাত্রীই বেশি। বেথুনের অনেক ছাত্রী এখন সমাজের নাম-করা মহিলা। এই তো গত বছরেই বেথুনের একটি ছাত্রীকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে অবলা দাস নামে মেয়েটি ঠিক করেছিল ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রীদের নেয়া হয় না। কিন্তু অবলার দাবি, কেনো সে ডাক্তারি পড়তে পারবে না? শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মাদ্রাজের মেডিকেল কলেজে। অবলার জেদ দেখে বাঙলা সরকার তার জন্য কুড়ি টাকার মাসিক বৃত্তিরও অনুমোদন করেছে। দেশের কোথায় কি আন্দোলন হয়, বেথুন কলেজে তার প্রভাব পড়ে। ইলবার্ট বিলের সময় সাহেবরা যখন এ দেশীয় মানুষদের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে যা-তা করা প্রচার করতে লাগল, তখন কামিনী সেন নামে একটি তেজস্বিনী ছাত্রীর নেতৃত্বে বেথুনের মেয়েরা বিক্ষোভ জানিয়েছিল। সুরেন বাড়ুজ্যের যেদিন জেল হল, সেদিন বেথুনের সব ছাত্রী হাতে কালো ফিতে বেধে এসেছিল স্কুলে। লোরেটো হাউজে এসব কিছুই হয় না। সেখানে স্বদেশিয়ানা নিষিদ্ধ। প্রভু যিশুর জয়গান করে নিয়মিত প্রার্থনা করতে হয়। ছাত্রীরা ভালো ইংরেজি শেখে। বিলিতি আদব-কায়দায় রপ্ত হয়, পাস করার পর তারা বড় বড় ব্যারিস্টারের পত্নী হিসেবে বেশ মানিয়ে যায়। বিবির বয়েস এখন দশ বছর, সরলার এগারো। এই মামাতো-পিসতুতো দুই বোনের মধ্যে যেমন বেশ ভাব, তেমন মাঝে মাঝে তর্কও হয় খুব। এই বয়েসেই সরলার মনে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে রাগ-রাগ ভাব এসেছে। প্রায়ই সে আবৃত্তি করে, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়। নতুন বউ ওদেরই বয়েসী, কিন্তু এই পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী তাকে কাকিমা বা মামী বলতে হবে। এক এক সময় বিবি আর সরলা তার কাছে ছুটে গিয়ে দু’জনে দুই হাত ধরে বলে, তুমি কার ইকুলে ভর্তি হবে বলো! আমারটা ভালো নয়। নতুন বউয়ের আড়ষ্টতা এখনও কাটেনি। এমনকি তার বিবাহ-উত্তর নাম যে মৃণালিনী তাও মনে থাকে না, এখনও যেন সে যশোরের গ্রাম মেয়ে ভবতারিণী। এত বড় একটা প্রাসাদ, এত মানুষজন, এত দাস-দাসী, এর মধ্যে তার দিশেহারা অবস্থা। ঠিক যেন রূপকথার মতন, কুঁড়েঘর থেকে সে রাজবাড়ির বধূ হয়ে চলে এসেছে। রাজপুত্রেরই মতন রূপবান তার স্বামী, তবু তার সঙ্গে এখনও ভালো করে ভাবই হল না। হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীর কাছে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, নীপময়ী তাকে এ বাড়ির রীতিনীতি শেখাচ্ছেন। বিয়ের দিনের পরেও কয়েকদিন উৎসবের রেশ থাকার কথা, কিন্তু বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। রবির বিবাহের রাত্রেই শিলাইদহে তার বড় সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলির হঠাৎ হৃদরোগে মৃত্যু হয়। বড় দিদি সৌদামিনী রবির প্রায় মায়ের মতন, তিনিই এই সংসারের কর্ত্রী। তিনি আবার এই সময়টায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে, খবর পেয়ে তিন দিন আগে পৌঁছেছেন। মূৰ্ছা যাচ্ছেন ঘন ঘন। বাড়িতে সবাই এখন ফিসফিস করে কথা বলে। একমাত্র বাচ্চারাই-এ নিয়ম মানে না। রবির স্ত্রী কোথায় শিক্ষা গ্ৰহণ করবে, তা নিয়ে বিবি-সরলার তর্কের তো কোনও মূল্যই নেই। আসল সিদ্ধান্ত নেবেন। জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি নিয়েও ফেলেছেন। এবারে তাদের জন্য সার্কুলার রোডে আরও বড় একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, মৃণালিনী সেখানেই তাঁর কাছে থাকবে। সে বাড়ি থেকে লোরেটো হাউজ বেশি দূর নয়, বিবির সঙ্গেই যেতে পারবে এক গাড়িতে। শাড়ি-টাড়ি চলবে না, উত্তম বিলিতি কাপড় কিনে স্কার্ট বানানো হতে লাগল তার জন্য। এ ব্যবস্থা অনেকেরই মনঃপূত হল না। কাদম্বরীর বড় সাধ ছিল স্ত্রী তার সঙ্গিনী হবে। তিনি তাঁর মনের মতন করে মেয়েটিকে গড়ে তুলবেন। রবির জন্য আলাদা একটি মহল নির্দিষ্ট হয়েছে। সাজানো-গোছানোও হয়েছে বেশ সুন্দরভাবে, নতুন বউ সেখানে না থেকে অন্য বাড়িতে চলে যাবে কেন? বেথুন স্কুল এ বাড়ির আরও তিনটি মেয়ে পড়তে যায়, এখানে থেকে ওই স্কুলে পাঠানোর তো কোনও অসুবিধে ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনীর নিজের ছেলে-মেয়ে আছে, কাদম্বরীর যে আর কেউ নেই, রবির বউকেও কেড়ে নেবেন জ্ঞানদানন্দিনী? বাড়ি ভর্তি মানুষ এখন গমগম করছে, রবির সঙ্গে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ নেই। অন্যদের সামনেই কাদম্বরী রবিকে সহজভাবে জিজ্ঞেস করলেন, রবি, ছোট বউকে বেথুনে পড়ালেই ভালো হত না? তুমি বাংলার কবি, তোমার বউ যাবে ইস্কুলে? রবি বিব্রতভাবে বললে, মেজ বউঠান যে ঠিক করলেন… নীপময়ীও সেখানে উপস্থিত। তিনি বললেন, ও রবি, তোর বউ যে একটি অক্ষরও ইংরেজি জানে না। আমি কথা বলে দেখছি তো, প্রাইমারী ইকুলে বাংলা একটু-আধটু শিখেছে বটে, ইংরেজির অক্ষরজ্ঞানও নেই। ও লোরেটোর ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে বসে পড়াশুনো করতে পারবে? এক্ষুনি ইস্কুলে পাঠাবারই বা দরকার কী? আমাদের কাছেই থাক না, আমরাই প্রথমটা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেব। রবি বলল, তোমরা একটু মেজ বউঠানকে বুঝিয়ে বলো না। এ কথা? নীপাময়ী ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, তোর বউয়ের ব্যাপারে আমরা বলতে যাব কেন রে? তুই নিজের বলতে পারিস नां। রবির মুখ দেখেই বোঝা গেল, জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে এরকম প্রস্তাব তোলার সাহস সে সঞ্চয় করতে পারবে না। কাদম্বরী নিঃশব্দে একটা ছায়ার মতন সরে গেলেন সেখান থেকে। বেথুন ইস্কুল বাংলার গর্ব। কত বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ও এদেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিদ্যাসাগর
false
humayun_ahmed
এতে ভয় কমে যায়। বল একটা গল্প।’ ‘তুমি বল।’ আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী ও তিনটি ইহুদি ও তিনটি মেয়ের গল্প বলল। গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়–পাদ্রী তখন কী বলল? এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না রানু। সে কি শুনছে না? আনিস ডাকল, ‘এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল না। বাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল। আনিস বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি যেও না। খবরদার, যেও না!’ ‘কী আশ্চর্য, কেন?’ ‘একটা-কিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।’ ‘কী যে বল!’ ‘প্লীজ, প্লীজ।’ রানু কেদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’ ‘কীসের গন্ধ?’ ‘কর্পূরের গন্ধের মতো গন্ধ।’ এটা কি মনের ভুল? সু্‌ক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে। ঝনঝন করে আরেকটা কাঁচ ভাঙল। রানু বলল, ‘ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?’ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না। ‘তুমি বস তো। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।’ ‘না তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।’ আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তো!’ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, ‘কোনো দোয়া-টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি। আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’ রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়-বড় হয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে-টেনে। ‘এই রানু, এই।’ কোনোই সাড়া নেই। আনিস হ্যারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইঁদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালো লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব।’ রহমান সাহেব বোধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন। ‘কী ব্যাপার?’ ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ ‘কী হয়েছে?’ ‘বুঝতে পারছি না।’ ‘হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?’ ‘বুঝতে পারছি না।’ ‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।’ আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলো সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রোগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, ‘রানু।’ রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?’ ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘এখন কেমন অবস্থা?’ রানু অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?’ রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?’ ‘ভালো।’ রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন আমি ভালো।’ রহমান সাহেব তবু মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, ‘আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?’ ‘সে তো রোজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত।’ ‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’ ‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।’ ‘তাই নাকি?’ ‘জ্বি। নতুন এসেছেন তো! কয়েক দিন যাক টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।’ ‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন না কি এক কাপ?’ ‘আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবেন।’ ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, ‘এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!’ ‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্র লোককে ডাকলাম।’ ‘কী করেছিলাম আমি?’ ‘অনেক কান্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল।’ ‘ভালো।’ ‘কী রকম ভালো? ‘বেশ ভালো।’ ‘ভয় লাগছে না আর?’ ‘নাহ।’ রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবসা করছে। ‘সকালে যা করার করবে। এখন এসব রাখ তো।’ ‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না!’ ‘হোক, এস তো এদিকে।’ রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল। ‘এখন আর তোমার ভয় লাগছে না?’ ‘না।’ ‘জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?’ ‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।’ আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?’ ‘চা, এত রাতে!’ ‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।’ রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?’ রানু জবাব দিল না। আনিস বলল, ‘এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।’ ‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।’ ‘দেখি পাই কি না।’ ‘চায়ে চিনি হয়েছে তোমার?’ ‘হয়েছে। তুমি নিলে না?’ ‘নাহ, রাত-দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না।’ রানু হাই তুলল। আনিস বলল, ‘এখন বল তো তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত।’ ‘কোন স্বপ্নের কথা?’ ‘ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লোক।’ ‘কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!’ আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত-শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে
false
shomresh
হবে। ওই দেখুন ওর এক চোখ কানা। ডান দিকটা দিয়ে দেখতে পায় না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কানা কাক? অর্জুনের মনে পড়ে গেল। খোঁড়া শকুন, কালো বেড়াল সংগ্রহে এসে গেছে কিন্তু গোরক্ষনাথ এখনও কানা কাক খুঁজে পায়নি। মেজরকে ব্যাপারটা বোঝাতে হল। প্রথমে তিনি বললেন, যতসব গ্যাঁজাখোরের কাণ্ড তারপর বললেন, একে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমেরিকাতেও এখন দিন দিন গেঁজেল বেড়ে যাচ্ছে। যাকগে, কাকটাকে ধরতে চাও? গোরক্ষনাথ সবেগে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু। তা হলে ভাত নিয়ে এসো। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনই কাক ধরতেও সুবিধে হয়। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে ইগমি নামের একটি উপজাতি থাকে। খুব কম লোকই তাদের দেখা পায়। আমি ওদের কাছ থেকে পাখিরা শিখেছিলাম। আফ্রিকা একটি বিশাল মহাদেশ। তার কিছুটা নাকি এখনও অনাবিষ্কৃত, সেখানে ইগমি নামের উপজাতি থাকতেই পারে। সন্দেহ প্রকাশ করে কোনও লাভ নেই। হাবুকে বলে কিছুটা শুকনো ভাত জোগাড় করা হল। কিন্তু মেজর যে কায়দাটা করল তা পশ্চিমবাংলার শিশুরাও জানে। একটা বড় ঝুড়ি খাড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। ভাত রাখা হল ঝুড়ির সামনে। দড়িটা লম্বা। সেটার প্রান্ত ধরে মেজর আড়ালে চলে গেলেন। কাকটা অনেকক্ষণ একচোখে যাচাই করল। কোনও কাককে অতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখেনি অর্জুন। শেষ পর্যন্ত লোভ প্রবল হওয়াতে কাকটা উঁচু কার্নিস থেকে নেমে এল ঝুড়ির সামনে। এক পা দু পা করে ভাতের কাছে পৌঁছে গিয়ে খপ করে কিছুটা তুলে লাফিয়ে সরে এল ঝুড়ির আওতা থেকে। ঝুড়ি পড়ল না, কোনও বিপদ ঘটল না দেখে বোধহয় কাকটার সাহস বাড়ল। এগিয়ে গিয়ে গপগপ করে ভাত খেতেই মেজরের দড়ির টানে ঝুড়িটা পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। কাকটা ধরা পড়ে গেছে। গোরানসাহেব কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেউ টের পায়নি। এবার তিনি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী? অর্জুন তাঁকে গোরক্ষনাথের সাধনার জন্যে যেসব সামগ্রীর প্রয়োজন, সেটা ব্যাখ্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোরানসাহেবের। ঝুড়ির পাশে উবু হয়ে বসে লক্ষ করছিল গোরক্ষনাথ, তিনি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তুমি সত্যি বলছ? গোরক্ষনাথ মুখ তুলে সাহেবকে দেখে দু হাত নাড়ল, নো ইংরেজি। মেজর বাংলায় অনুবাদ করলে সে দ্রুত মাথা নাড়ল, ইয়েস ইয়েস। দেন হি উইল গো উইদ আস। মেজরের কাছে বাংলা শুনে গোরক্ষনাথের মুখ চুপসে গেল, আমাকে ছেড়ে দিন সাহেব। এত কষ্টে কাকটাকে পেয়েছি, এখন এখানে আমার ডিম্যান্ড বেড়ে যাবে। কত টাকা রোজগার করো দিনে? প্রতিদিন তো হয় না। তেমন খদ্দের পেলে সেটা হয়। গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, ও বাবু, ওঁদের একটু বুঝিয়ে বলুন না! অর্জুন বলল, কিন্তু গোরক্ষনাথ, আপনার এখানে থেকে কোনও লাভ হবে না। কেন? পুলিশ তো বেড়ালটাকে নিয়ে যাবে। আর একটা বেড়াল জোগাড় না করা পর্যন্ত! তার চেয়ে এঁরা যা বলছে শুনুন। পুলিশের চোখের সামনে থেকে চলে গেলে তারাও হয়তো আপনাকে ভুলে যাবে। কদিন বাদে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ফিরে আসবেন। অর্জুনের কথাটা বোধহয় মনে ধরল গোরক্ষনাথের। তারপর একটু ভেবে বলল, আমার মুশকিল হল ওই বুড়িটাকে নিয়ে। আমি চলে গেলে কে ওকে দেখবে? কে ওর বাজার করে এনে দেবে? আচ্ছা, কদ্দূর যেতে হবে? হাসিমারার কাছে। অ। ঠিক আছে, পাড়ার একটা ছেলেকে বলে দেখি। কিছু পয়সা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। গোরানসাহেব বুঝলেন গোরক্ষনাথ খুশি হয়েছে। উনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে গোরক্ষনাথের হাতে গুঁজে দিলেন। এবার অর্জুন এগিয়ে এল ঝুড়িটার দিকে, কিন্তু গোরক্ষনাথ, মানলাম এই কাকটা কানা। কিন্তু আপনি বলেছিলেন ওকে জন্মাতে হবে কানা হয়ে। এই কাকটা যে সেই শ্রেণীর তা বুঝলেন কী করে? দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। গোরক্ষনাথ তার জামাটা খুলে ফেলল। ডান হাত জামার ভেতর ঢুকিয়ে ঝুড়িটাকে সামান্য তুলে খানিকটা চেষ্টার পর কাকটাকে ধরে ফেলল। তারপর ঝুড়ি সরিয়ে ওটা বের করতে কাকটা আর্তনাদ শুরু করল। বাঁ হাতে ওর মুখ চেপে ধরে কানা চোখটাকে অর্জুনের সামনে নিয়ে এল সে, দেখুন বাবু, চোখটা একদম সাদা। কোনও খোঁচা খেয়ে কানা হলে আশেপাশের জায়গা ফুলে থাকত। চোখের মণিও অন্যরকম দেখাত। এ একেবারে আমার জন্যই এখানে বসে অপেক্ষা করছিল। তা হলে আমি যাই? অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ঠিক করলেন? আজই যাবেন, না কাল ভোরে রওনা হবেন? মেজর গোরানসাহেবকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, এখানে খামোকা সময় নষ্ট করে কী লাভ? অর্জুন জানাল, কিন্তু তৈরি হয়ে হাসিমারায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। বরং শহরে থেকে আর একটু প্রস্তুতি নিয়ে গেলে ভাল হয়। সেই সিদ্ধান্ত হল। গোরক্ষনাথ তার সাধনার সামগ্রী নিয়ে সকাল সাতটার সময় জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। গোরক্ষনাথ চলে গেলে অর্জুন মালপত্রগুলো ভাল করে দেখল। মেজর এখান থেকেই চাল ডাল নুন কিনে নিয়ে যেতে চান। যদি জঙ্গলের গভীরে থাকতে হয় টেন্ট পেতে, তখন দরকার হবে। অর্জুন জানতে চাইল, রাঁধবে কে? কেন? আমি কি মরে গেছি? বছর তিনেক আগে উত্তরমেরুর একটা ইলুতে বসে সিল দ্য মাঞ্চুরিয়ান রান্না করেছিলাম। ওঃ, তোমাকে কী বলব অর্জুন, তাই খেতে এত এস্কিমো জড়ো হয়েছিল যে, ইগলুতে বসে ঘামতে হয়েছিল আমাকে। মনে হয়েছিল ফ্যান থাকলে ভাল হত। মেজর স্বর্গীয় হাসি হাসলেন, যেটা তাঁর গোঁফদাড়ির জঙ্গল ছাপিয়েও দেখা গেল। ঘামতে হয়েছিল কেন? বেশি
false
humayun_ahmed
বললাম, আপনি ওর গায়ে হাত দিলেন কেন? ষণ্ডাগণ্ডা টাইপের লোক। লাল চোখ। গরিলাদের মতো লোম ভরতি হাত। সে এমন ভাব করল যে আমার কথাই শুনতে পায় নি। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল—দেখি একটা লেবু চা। তখন আমি খপ করে তার হাত ধরে ফেললাম। সে ঝটিকা দিয়ে তার হাত ছড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই আমি তার হাত কামড়ে ধরলাম। যাকে বলে কচ্ছপের কামড়। কচ্ছপের কামড় কী তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। কচ্ছপ একবার কামড়ে ধরলে আর ছাড়ে না, আমিও ছাড়লাম না। আমার মুখ রক্তে ভরে গেল। লোকটা বিকট চিৎকার শুরু করল। ব্যাপারস্যাপার দেখে বোরকাওয়ালী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এর পর থেকে আমার টাইটেল হয়েছে সাদা বাঘিনী। গল্প শেষ করে সায়রা বানু খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি মেয়েটির হাসির মাঝখানেই বললেন, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? গল্প করার জন্যে এসেছি। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি বিখ্যাত মানুষ? অবশ্যই বিখ্যাত। আপনাকে নিয়ে কত বই লেখা হয়েছে। আমি অবিশ্যি একটা মাত্র বই পড়েছি। ওই যে সুধাকান্ত বাবুর গল্প। একটা মেয়ে খুন হল আর আপনি কেমন শার্লক হোমসের মতো বের করে ফেললেন–সুধাকান্ত বাবুই খুনটা করেছেন। বই পড়ে মনে হচ্ছিল। আপনার খুব বুদ্ধি কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। আমাকে দেখে কেমন মনে হচ্ছে? খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। আপনার মধ্যে একটা গৃহশিক্ষক গৃহশিক্ষক ব্যাপার আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি নিয়মিত বেতন পান মা এমন একজন অংকের স্যার। আপনি রোজ ভাবেন আজ বেতনের কথাটা বলবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারেন না। আচ্ছা। আপনি এমন গভীর মুখে বসে আছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে মজা তো পাচ্ছেনই না উল্টো বিরক্ত হচ্ছেন! সত্যি করে বলুন আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? কিছুটা হচ্ছি। মাছিটা তো এখন আর বিরক্ত করছে না। কেমন শান্ত হয়ে টেবিলে বসে আছে। তারপরেও আপনি এত বিরক্ত কেন বলুন তো? তুমি অকারণে কথা বলছ এই জন্যে বিরক্ত হচ্ছি। অকারণ কথা আমি নিজেও বলতে পারি না অন্যের অকারণ কথা শুনতেও ভালো লাগে না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে হলে সব সময় একটা কারণ লাগবে? তা হলে তো আপনি খুবই বোরিং একটা মানুষ। এত কারণ আমি পাব কোথায় যে আমি রোজ রোজ আপনার সঙ্গে কথা বলব? মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি রোজ রোজ আমার সঙ্গে কথা বলবে? হুঁ। সে কী, কেন? সায়রা বানু খুব সহজ ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, এক বাড়িতে থাকতে হলে কথা বলতে হবে না? এক বাড়িতে থাকবে মানে? আমি বুঝতে পারছি না। আমি আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকব। কদিন এখনো বলতে পারছি না। দু দিনও হতে পারে আবার দু মাসও হতে পারে। আবার দু বছরও হতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার উপর। মিসির আলি চেয়ার থেকে পা নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। হচ্ছেটা কী? এই যুগের টিনএজার মেয়েদের ভাবভঙ্গি, কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। তারা যে কোনো উদ্ভট কিছু হাসিমুখে করে ফেলতে পারে। মেয়েটি হয়তো অতি তুচ্ছ কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিংবা তাকে ভড়কে দেবার জন্যে গল্প ফেঁদেছে। পরে কলেজে বন্ধুদের কাছে এই গল্প করবে। বন্ধুরা মজা পেয়ে একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে।–ও মাগো বুড়োটাকে কী বোকা বানিয়েছি! সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে আমি থাকতে এসেছি। মিসির আলি নিজের বিস্ময় গোপন করে সহজভাবে বললেন, তুমি এ বাড়িতে থাকবে? জি। বিছানা বালিশ নিয়ে এসেছ? বিছানা বালিশ আনি নি। আজকাল তো আর বিছানা বালিশ নিয়ে কেউ অন্যের বাড়িতে থাকতে যায় না। শুধু একটা সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ এনেছি। আর একটা পানির বোতল। সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ কোথায়? বারান্দায় রেখে এসেছি। শুরুতেই আপনি আমার সুটকেস দেখে ফেললে ঢুকতে দিতেন না। যাই হোক আমি এখন আমার সুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আসছি। আচ্ছা! আপনি এমন ভাব করছেন যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু হয় নি। বিপদগ্ৰস্ত একজন তরুণীকে কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেয়া এমন কোনো বড় অন্যায় না। আমি নিশ্চিত এরচে অনেক বড় বড় অন্যায় আপনি করেছেন। তুমি সত্যি সত্যি আমার এখানে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছ? জি। মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। এই মুহুর্তে তাঁর ঠিক কী করা উচিত তা মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেয়েটির কোণ্ডকারখানা, দৈখাই মনে হয়। সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। এই পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন বা করতে পারেন। সেই সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সে নিশ্চয়ই করেছে। নিজেকে সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্যে সে প্রস্তুত করে রেখেছে। মিসির আলির এমন কিছু করতে হবে যার সম্পর্কে মেয়েটির প্রস্তুতি নেই। সে কেন বাড়ি ছেড়ে এসেছে এই মুহুর্তে তা তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কারণ এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক এবং সঙ্গত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তৈরি করে রেখেছে। তাঁর বিস্মিত হওয়াও ঠিক হবে না। তাঁকে খুব সহজ এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে। যেন এমন ঘটনা প্রতি সপ্তাহেই দুটা-একটা করে ঘটছে। সায়রা বানু সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন সে গুনগুন করে কী একটা গানের সুরও যেন ভাজছে। কত সহজ স্বাভাবিক তার আচরণ। কেক খাবেন? কেক? হুঁ। আমার নিজের
false
humayun_ahmed
হত! আবার চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। যেন বাইরের উথালপাথাল চাঁদের আলোর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে-শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জামগাছের পাতায় সরাসরি শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা-হা করে ওঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষন্নতাই না অনুভব করি! জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি। *শঙ্খনীল কারাগার রফিক কায়সারের একটি কবিতার নাম। কবির অনুমতিক্রমে নামটি পুনর্ব্যবহৃত হল। পূর্বকথা আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মোহনগঞ্জে, আমার নানার বাড়িতে। ছায়াময় একটি বাড়ি, পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর সারদেয়াল–পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। সব কিছুই রহস্যময়। সন্ধ্যাবেলায় সারদেয়ালে ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটাহাঁটি করে। গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ভূতে ঢিল মারে। কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। অশরীরী কিছু যন্ত্রণা তো করবেই। এদেরকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। মূলবাড়ি থেকে অনেক দূরে বিশাল এক তেঁতুলগাছের পাশে টাট্টিখানা। সন্ধ্যার পর যারা টাট্টিখানায় যায় তারা না-কি প্রায়ই তেঁতুলগাছে পা বুলিয়ে পেততুনি বসে থাকতে দেখে। দিনমানে অন্য দৃশ্য। বাড়ির কাছেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠভর্তি বক। আমার নানাজান আবুল হােসেন শেখ দোনলা বন্দুক হাতে বক শিকারে বের হন। আমি তাঁর সঙ্গী। ছররা বন্দুকের গুলি হলো। অনেকগুলি বিক একসঙ্গে মারা পড়ল। তাদের গায়ের ধবধবে পালক রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে–আমি চোখ বড় বড় করে দেখছি। মাথার উপর মৃত বকদের সঙ্গীরা ট্যা ট্যা শব্দে ঘুরছে, অদ্ভুত সব দৃশ্য। নানার বাড়ির স্মৃতি মাথায় রেখেই লীলাবতী উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই সময়ের রহস্যময়তাকে ধরার চেষ্টা। লেখাটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল অন্যদিন পত্রিকায়। কোনো ধারাবাহিক লেখাই আমি শেষ করতে পারি না। খেই হারিয়ে ফেলি। আগ্রহ কমে যায়। লীলাবতীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। একসময় লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, ভালো লেখা যত্ব নিয়ে লিখতে হয়, তাড়াহুড়া করা যায় না। তুমি মন খারাপ করো না। একসময় এই লেখা আমি শেষ করব। আমি আমার কথা রেখেছি। বইমেলায় লীলাবতী বের করতে পেরে মাজহার নিশ্চয়ই খুশি। আমিও খুশি। লেখাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন ঘাড়ে চেপে ছিল— এখন নেমে গেছে। লীলাবতী উপন্যাসের সব চরিত্ররা ভালো থাকুক। তাদের প্রতি এই আমার শুভকামনা। হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লী, গাজীপুর ০১. রেললাইনের উপর একটা বক বসে আছে। মেছো বাঁক। এ ধরনের বক বিলের উপর উড়াউড়ি করে। অল্প পানিতে এক ঠ্যাঙ ড়ুবিয়ে মাছের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ডাঙায় আসার কথা না। আর যদি আসেও গম্ভীর ভঙ্গিতে রেললাইনে বসে থাকার কথা না। সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে বকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর ঘটনাটা কী? এ কী চায়? বকটা ধবধবে সাদা। পানির বকের পালক সাদাই হয়। সারাক্ষণই পানিতে ডোবাড়ুবি করছে। পালকে ময়লা লেগে থাকা? কোনো কারণ নেই। ডাঙার বকের পালক এত সাদা না— বাদামি রঙ। মেছো।ক পানিতে যেমন এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনের উপরও এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাথ, নড়াচ্ছে না, শরীর নড়াচ্ছে না, স্থির দৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমানের বিস্ময় আরো প্রবল হলো, বকটা কী দেখছে? বিলের পানিতে এভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অর্থ আছে— মাছের গতিবিধি লক্ষ করা। এখানে বকটার একদৃষ্টিতে রেললাইনের পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী? সে কি রেললাইনের পাথর দেখছে? ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেন চলে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। ঘন জংলায় আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেন দেখা যাবে। বকটা এখনো নড়ছে না। রেললাইনের কম্পন তার অনুভব করার কথা। ধ্যান ভঙ্গ হবার সময় এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান বুকের ভেতর সামান্য চাপ অনুভব করলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার এরকম হয়। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। রেলের ইঞ্জিনটা এখন দেখা যাচ্ছে। কয়লার ইঞ্জিন। বুনকা বুনকা ধোঁয়া ছাড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! বকটাকেও দেখা যাচ্ছে। বক আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সিদ্দিকুর রহমান অস্থির বোধ করলেন। হুশ! হুশ! শব্দ করে বকটাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু গলা কেমন যেন আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ ব্যথা। তিনি তাকালেন রেলের ইঞ্জিনের দিকে। ভালো স্পিড দিয়েছে। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে বকটার দিকে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। গাঢ় ঘুমে তার চোখের পাতা নেমে এসেছে। চারদিকে অদ্ভুত এক শান্তি-শান্তি নীরবতা। বাতাস মধুর ও শীতল। বুকের ব্যথাটা নেই। নিঃশ্বাসের কষ্ট নেই। একসময় তিনি চোখ মেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাঠের উপর তিনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। তার বাঁ-দিকে প্ৰকাণ্ড শিমুল গাছ। গাছটার ছায়া পড়েছে তাঁর শরীরে। ছায়াটা এমনভাবে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি একটা ছায়ার চাঁদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখের সামনে আশ্বিন মাসের মেঘশূন্য আকাশ। আকাশে দুটা চিল উড়ছে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়ছে। তাদের দেখাচ্ছে বিন্দুর মতো। তিনি উঠে বসলেন। ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও না। রেললাইনের উপর বকটা দাঁড়িয়ে নেই। সে ট্রেনের নিচে চাপাও পড়ে নি। চাপা পড়লে তার রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমান দুই হাতে ভর দিয়ে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছে। রেললাইনের ওপাশের জলে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা ক্যাচ ক্যাচি পাখি তার পায়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে।
false
humayun_ahmed
বললাম, না। শেষটা দেখব। তোমার লজ্জা বোধ করার কোন কারণ নেই মা। ভেবে নাও রাস্তার কোনো নগ্ন পাগল। তাছাড়া ফরহাদ সাহেব নগ্ন হবার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা হবে। কী ব্যবস্থা হবে? কী ব্যবস্থা হবে আমি জানি না, কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা হবে। ফরহাদ সাহেব টান দিয়ে জিপার পুরোপুরি খুলে ফেলেছেন। জিপারের ফাঁক দিয়ে তার লাল আন্ডারওয়ার দেখা যাচ্ছে। ছেলেরা এমন লাল টুকটুক আন্ডার ওয়ার পরে আমি জানতাম না। আমি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকালাম। ঘটনাটা তিনি অনেক দূর এগুতে দিয়েছেন। এতদূর এগুতে দেয়া ঠিক হয় নি। আমি হলে দিতাম না। ডিরেক্টর সাহেব সিগারেট ধরালেন। তারপর সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে মওলানা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন–মওলানা সাহেব একটু শুনুন তো। কাছে আসুন। মওলানা সাহেব এগিয়ে গেলেন। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আপনি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে পারবেন? মওলানা বললেন, অবশ্যই পারব জনাব। ফরহাদ নামের এই বদ মানুষটাকে আমি এমন এক শাস্তি দিতে চাই যা তার দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আপনি এর কানে ধরে পুরো মাঠের চারদিকে একবার চক্কর দেয়াবেন। এই দৃশ্যটা আমরা ক্যামেরায় ধরে রাখব। পারবেন না? জনাব, আপনি হুকুম দিলে পারব। ইনশাল্লাহ। ফরহাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিছু বলতে গেলেন— বলতে পারলেন। আমি তাকালাম ডিরেক্টর সাহেবের দিকে–তাঁর মুখ হাসিহাসি। তার চোখ কঠিন হয়ে আছে। এমন কঠিন চোখ সচরাচর দেখা যায় না। মা আমার হাত খামচে ধরে বললেন, কী হবে রে? আমি জবাব দিলাম না। লক্ষ্য করলাম সোহরাব চাচা এগিয়ে এসে ফরহাদ সাহেবের কানে-কানে কী যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরহাদ সাহেবের মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। জোঁকের মুখে নুন পড়ার অবস্থা। এতক্ষণ যে মানুষটা হৈচৈ চিৎকার করছিল সে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। বেঁটেখাটো মেরাজ মাস্টার এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি কি এই মানুষটাকে কান ধরে মাঠের চারপাশে চক্কর খাওয়ানো হবে? ফরহাদ সাহেব তার প্যান্টের খোলা জিপার টান দিয়ে তুলে বিড়বিড় করে বললেন–মঈন ভাই, আমার ভুল হয়েছে। মাফ করে দেন। সকাল থেকে বিয়ার খাচ্ছি যা করেছি নেশার ঝেকে করেছি। ডিরেক্টর সাহেব গলা উঁচিয়ে বললেন–স্টিল ক্যামেরাম্যান কোথায়? কানে ধরে দৌড়ানোর ছবি তুলে রাখ। ক্যামেরা ইউনিট কি কাশবনে চলে গেছে? সোহরাব চাচা বললেন, জ্বি স্যার। আর্টিস্ট? আর্টিস্ট গিয়েছে? বলেই তিনি আমাকে দেখলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন–চল যাই, দেরি হয়ে গেল তো। মেকাপম্যান কোথায়? তাকেও যেতে হবে। ফরহাদ সাহেবের সামনে এসে মেরাজ মাস্টার দাঁড়িয়েছেন। কানে হাত দেবেন কি দেবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। তিনি আবারো তাকালেন ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব বাদ দিন। একে এই জংলা মাঠের চারদিকে কানে ধরে ঘোরালে কিছু হবে না। একে ঘোরাতে হবে এফডিসির চারদিকে। এই কাজটা আমি ঢাকায় গিয়ে করব। মেরাজ মাস্টার বললেন, স্যার, আমি কি শুটিং দেখার জন্যে আপনাদের সঙ্গে আসব? ডিরেক্টর সাহেব বললেন, অবশ্যই আসবেন। আপনি বিসমিল্লাহ বলে ক্যামেরায় ফু দিয়ে দেবেন, তারপর ক্যামেরা ওপেন হবে। তার আগে না। চারপাশের পরিবেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শুধু ফরহাদ সাহেব ঘামছেন। খুব ঘামছেন। তিনি যে হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে। সোহরাব চাচা কানে-কানে কথা বলার পর থেকে পরিবর্তনটা হয়েছে। কানে-কানে বলা কথাগুলি কী? সোহরাব চাচা কি আমাকে বলবেন? মনে হয় না। তিনি হড়বড় করে সারাক্ষণ কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু গোপন কথা গোপনই রাখেন। মানুষটাকে হয়তো এই কারণেই সবার ভাল লাগে। যে কথাগুলি ম্যাজিকের মত কাজ করল, সেই কথা সোহরাব চাচা আগে কেন বললেন না! আমরা কাশবনের দিকে রওনা হয়েছি। মা যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। তার এমন অসুস্থ শরীর — আমি জানি আজ শুটিং শেষে তিনি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হবেন। না গেলে চলত, কিন্তু তিনি যাবেনই। মা লেফট রাইটের ভঙ্গিতে দ্রুত পা ফেলছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা যে তিনি মোটেই অসুস্থ না। খুব সুস্থ। তিনি হাঁটছেন ডিরেক্টর সাহেবের পাশে পাশে। আমি পিছিয়ে পড়েছি। আমার পাশে পাশে আসছেন মেরাজ মাস্টার। ভদ্রলোক আজ সেজেগুজে এসেছেন। চোখে সুরমা। পায়জামা ইস্ত্রি করা। আমাদের সঙ্গে দুজন ছত্রধর যাচ্ছে। একজনের হাতে সবুজ রঙের বিশাল ছাতি। এই ছাতি ডিরেক্টর সাহেবের মাথায় ধরার কথা। ডিরেক্টর সাহেব ইশারায় নিষেধ করেছেন বলে ছাতা ধরা হয় নি। ছাতাটা ধরলে ভাল হত, মা খানিকটা ছায়া পেতেন। আমার মাথায় উপর ছাতা ধরা আছে। আমি ভদ্রতা করে নিষেধ করি নি। ছায়া আমার প্রয়োজন। কড়া রোদে মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্যি আমার ধারণা মেকাপ নষ্ট হলেও ক্ষতি নেই। পুরো দৃশ্যটা লং শটে ধরা থাকবে। এতদূর থেকে পরিষ্কার কিছু দেখতে পাওয়ার কথা না। মা, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? জ্বি চিনেছি। আপনি মেরাজ মাস্টার। আপনাদের সঙ্গে যে যাচ্ছি খুবই ভাল লাগছে। সবাই কেমন হৈচৈ করতে করতে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে থাকার মজাই আলাদা। জ্বি। আপনাদের ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কয়েকবার আলাপ হয়েছে— বিশিষ্ট ভদ্রলোক। এরকম বিশিষ্ট ভদ্রলোক সচরাচর দেখা যায় না। অতি অমায়িক। জ্বি। এ স্যারের সঙ্গে কফি খেয়েছি। নানান বিষয় নিয়ে আলাপও হয়েছে। ধর্ম বিষয়েও স্যারের জ্ঞান অতি উচ্চ শ্রেণীর। ধর্ম নিয়ে আপনারা আলাপ করলেন? উনিই আলাপ করলেন, আমি শুধু শুনলাম, আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও কম, পড়াশোনাও কম। ও আচ্ছা। শৈশবকালে হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। পাক কোরান মুখস্থ করেছিলাম। করেছিলাম বলছেন কেন? এখন মুখস্থ নাই? জ্বি না। স্মৃতি শক্তির
false
shordindu
হইয়া উঠিল। মনে যথেষ্ট কৌতূহল, কিন্তু সন্ন্যাসীর সম্মুখে হস্ত প্রসারিত করিতে লজ্জা করিতেছে। বীরশ্রী তখন জোর করিয়া তাঁহার বাঁ হাতখানি সাধুর সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিলেন। সাধু যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের দিকে একবার কটাক্ষপাত করিলেন, তারপর সম্মুখে ঝুঁকিয়া অভিনিবেশ সহকারে দেখিলেন। তাঁহার মুখে আবার ছাই-ঢাকা হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি যৌবনশ্রীর মুখের পানে মিটিমিটি চাহিয়া বলিলেন—রাজনন্দিনি, তোমার প্রিয়-সমাগমের আর বিলম্ব নেই। অদ্যই তুমি ভাবী পতির সাক্ষাৎ পাবে। যৌবনশ্রী অবাক হইয়া সন্ন্যাসীর মুখের পানে চোখ তুলিলেন। বীরশ্রী সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন—অ্যা—কি বললেন প্রভু? এই সময় বাধা পড়িল। সহসা পিছন হইতে একটি হাত আসিয়া যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের উপর ন্যস্ত হইল, একটি মন্দ্র-মন্থর পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল—সাধুবাবা, আমার হাতটা একবার দেখুন তো! চমকিয়া যৌবনশ্রী ঘাড় ফিরাইলেন। রাজকন্যার হাতের উপর হাত রাখে কোন্ ধৃষ্ট! যে মুখখানি যৌবনশ্রী দেখিতে পাইলেন তাহাতে একটু দুষ্টামিভরা হাসি লাগিয়া আছে, আরও কত কি আছে। চোখে চোখে দৃষ্টি বিনিময় হইল। যৌবনশ্রীর দেহ একবার বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত কাঁপিয়া উঠিল, সবেগে নিশ্বাস টানিয়া তিনি একেবারে রুদ্ধশ্বাস হইয়া গেলেন; তাঁহার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি নিজের প্রসারিত হাতখানি আগন্তুকের করতল হইতে সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেলেন। সন্ন্যাসী বিগ্রহপালের করকোষ্ঠী দেখিতেছিলেন, বলিলেন—বৎস, তুমি রাজকুলোদ্ভব– চুপ চুপ!—বিগ্রহপাল সচকিতে চারিদিকে চাহিলেন। ভাগ্যক্রমে কাছে পিঠে কেহ নাই। বীরশ্রী বিগ্রহপালের এই হঠকারিতায় চমৎকৃত হইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার ভয় হইল, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকিলে বিগ্রহ না জানি আরও কি প্রগতা করিয়া বসিবে। তিনি যৌবনশ্রীর হাত ধরিয়া টানিয়া লইলেন। বলিলেন—চল, যৌবনা, আমরা যাই। তন্দ্রাচ্ছন্নের মত যৌবনশ্রী সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। বীরশ্রী রথে উঠিয়া অশ্বের বৰ্গা হাতে লইলেন। যৌবনশ্রী রথে উঠিবার আগে আপনার অবশে একবার পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। প্রগম্ভ যুবক দুষ্টামিভরা মুখে তাঁহার পানেই চাহিয়া আছে। তিনি বিহ্বলভাবে রথে উঠিয়া পড়িলেন। রথ চলিতে আরম্ভ করিল। বীরশ্রী বলিলেন—আশ্চর্য সন্ন্যাসী! বোধহয় তান্ত্রিক। যৌবনশ্রী উত্তর দিলেন না। রথের গতি ক্রমশ দ্রুত হইল। আরও কিছুক্ষণ চলিবার পর যৌবনশ্রী প্রথম কথা বলিলেন। সম্মুখ দিকে চক্ষু রাখিয়া ঈষৎ স্খলিতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন—দিদি, ও কে? বীরশ্রী ভগিনীর প্রতি একটি তির্যক দৃষ্টি হানিলেন; তাঁহার অধরপ্রান্ত একটু স্ফুরিত হইল। যেন কিছুই বুঝিতে পারেন নাই এমনিভাবে বলিলেন—কার কথা বলছিস? সন্ন্যাসী ঠাকুরের? যৌবনশ্রী একবার দিদির পানে ভৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি ফিরাইলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন—বল না। কি বলব? বীরশ্রী মুখ টিপিয়া হাসি গোপন করিলেন—ও! যে তোর হাতে হাত রেখেছিল তার কথা বলছিস? তা—সে কে আমি কি জানি। আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া যৌবনশ্রী বলিলেন—বল না। বীরশ্রী হাসিয়া ফেলিলেন—বণিক। পাটলিপুত্র থেকে ব্যবসা করতে এসেছে। এবার যৌবনশ্রী অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। বীরশ্রী রথ চালাইতে চালাইতে একবার ঘাড় ফিরাইলেন, যৌবনশ্রীর চক্ষু দুটি বাষ্পকুল, অধর কাঁপিতেছে। বীরশ্রী অনুতপ্ত হইয়া বলিলেন—আচ্ছা আচ্ছা, বণিক নয় রাজপুত্র। এবার হল তো? ধন্যি মেয়ে তুই! কোথায় ভেবেছিলাম তোকে অনেক বোঝাতে পড়াতে হবে, অনেক কষ্টে রাজী করাতে হবে। তা নয়, একবার দেখেই মূছা! যৌবনশ্রী চক্ষু দুটি কিছুক্ষণ মুদিয়া রহিলেন; চোখের বাষ্প গলিয়া দুই বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িল। একবার দেখিয়া নিজেকে হারাইয়া ফেলা সকলের জীবনে ঘটে না। মানুষের সহিত মানুষের প্রীতি বড়ই বিচিত্র বস্তু। কখনও দেখা যায়, দীর্ঘ পরিচয়ের পর হঠাৎ একদিন মানুষ বুঝিতে পারিল—ওই মানুষটি না থাকিলে জীবন অন্ধকার। কখনও মনের মানুষ চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবার পর বুঝিতে পারে সে কী হারাইয়াছে। আবার কখনও মেঘমালার ভিতর হইতে তড়িল্লতার মত অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষ হৃদয়ে শেল হানিয়া দিয়া চলিয়া যায়, অন্তলোকে অলৌকিক ইন্দ্রজাল ঘটিয়া যায়। যাহারা যৌবনেন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়ের কথা চিন্তা করে, প্রেম লইয়া মনে মনে জল্পনা করে, তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেমের আবির্ভাব তেমন মারাত্মক নয়। কিন্তু যাহাদের মনের কৌমার্য ভঙ্গ হয় নাই তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই দারুণ; দুঃসহ জ্যোতিরুম্ফসে চক্ষু অন্ধ হইয়া যায়। রাজকুমারী যৌবনশ্রীর তাহাই হইয়াছিল। দুই রাজকুমারীরা রথে চড়িয়া চলিয়া গেলেন; অন্য রথটি এবং বাকি রক্ষীর দল তাঁহাদের পিছনে গেল। ঘাটের অঙ্গন শূন্য হইল। কেবল লম্বোদর অঙ্গনের অন্য প্রান্তে একটি ঘোড়ার রাশ ধরিয়া দাঁড়াইয়া অনঙ্গ ও বিগ্রহপালের উপর নজর রাখিল। অনঙ্গ এতক্ষণ সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসে নাই, একটু দূরে অপেক্ষা করিতেছিল; এখন বিগ্রহপালের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। বিগ্রহপাল তখনও বিলীয়মান রথের পানে চাহিয়া আছেন। অনঙ্গ বলিল—কি হল তোর? ধন্দ লেগে গেল নাকি? চমক ভাঙিয়া বিগ্রহপাল হাসিলেন। বন্ধুর পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন—দেখলি? অনঙ্গ বলিল—দেখলাম। অপরূপ সুন্দরী—না? হুঁ। কিন্তু এখন ত্রিপুরী যাবার উপায় কি? এই সময় সন্ন্যাসী ঠাকুর গলা খাঁকারি দিলেন। বিগ্রহপাল সন্ন্যাসীর কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এখন তাঁহার দিকে একবার চাহিয়া অনঙ্গকে বলিলেন—জানিস অনঙ্গ, সাধুবাবা একেবারে ত্রিকালদর্শী পুরুষ। আমার হাত দেখে বলে দিলেন, আমি রাজকুলোদ্ভব! অনঙ্গ সাধুবাবাকে ভাল করিয়া পরিদর্শন করিল, তারপর নিজের হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিল—বলুন তো সাধুবাবা, আমি কে? সাধুবাবা অনঙ্গের হাতের দিকে দৃকপাত করিলেন না, বলিলেন—তুমি অনঙ্গপাল। অনঙ্গ চমকিত হইল, আর একবার সাধুবাবাকে উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিল; তাহার মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটিয়া উঠিল—ও—আপনি জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেব। বিগ্রহপাল সবিস্ময়ে বলিলেন—অ্যাাঁ! আর্য যোগদেবের ভ্রাতা রন্তিদেব? সাধুবাবা ব্যগ্রস্বরে বলিলেন—চুপ চুপ, কেউ শুনতে পাবে।—তোমাদের জন্যে কাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। চারিদিকে লক্ষ্মীকর্ণের গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই ছদ্মবেশে এসেছি। কে জানতো যে লক্ষ্মীকর্ণ স্বয়ং এসে উপস্থিত হবে। যা হোক, আমি সঙ্গে দুটো ঘোড়া এনেছি, আর একটা গো-শকট। তোমরা
false
tarashonkor
উঠানে ধপ করে ফেলে পাখী তাড়াতাড়ি ঘর পূলে একটা নতুন কাঠের চৌকো টুল বার করে দিলে—বস মামা। বা-বাবা! এ যে টুল রে! বলিহারি বলিহারি! ভদ্রজনের কারবার করে ফেলাল করালী! পাখী ঘর থেকে একটা নতুন হারিকেন, একখানা নতুন সস্তা দামের শতরঞ্জি, একটা রঙচঙে তালপাতার পাখা এনে সামনে নামিয়ে দিয়ে বললে—এই দেখ, মানা করলে শোনে না; আজেবাজে জিনিস কিনে টাকা-পয়সার ছেরাদ্দ করছে। হা-হা করে হেসে বনওয়ারী বললেওরে বাবা, নতুন বিয়ের এই বটে। তার ওপরে বউ যদি মনে ধরে, তবে তো আর কথাই নাই। তা তোকে মনে ধরা তো ধরা—দুজনাতে মনের মানুষ। পাখী মুখে আঁচলটা দিয়ে হাসতে লাগল আমার কথা শুনে। বনওয়ারী উঠল, বললে—আসছিলাম তো বাড়িতেই। পথে পাড়াটাও ঘুরলাম, সব চাল দেখে এলাম। একটা পেচণ্ড ঝড়জল হবে লাগছে কিনা! তা তোদের ঘরে এসে দাঁড়ালাম, এমন ঝকমকে ঘরদোর দেখে দাঁড়াতে হল। যাই, এখন দেখিকার চালে খড় আছে কার চালে নাই। মাতব্বর হওয়ার অনেক ঝক্কি মা। পাখী বললে—ঝক্কি নিলেই ঝক্কি, না নিলেই ক্যা কি করবে? ওই তো আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বর অয়েছে পরম, সে ঝক্কি নেয়? এত সব খোঁজ করে? কার চালে খড় নাই, কার ঘরে খেতে নাই—দেখে বেড়ায়? কারও দোষ-গুণ বিচার করে? তুমি এই যে আমার ঘর করে দিলে, লইলে আমি চলে যেয়েছিলাম চন্ননপুরে ওর সঙ্গে। তা’পরেতে নিকনে কি ঘটত কে জানে? হয়ত আবারও কারুর সঙ্গে চলে যেতাম বিদ্যাশ বিভুয়ে। তোমার দয়াতেই আমার সব। তুমি ধার্মিক লোক, মা-লক্ষ্মীর দয়া অয়েছেন তোমার পরে। কত্তাঠাকুরতলায় ধূপ দাও, পিদিম দাও, তোমার ধরমবুদ্ধি হবে না তো হবে কার? পাখী হঠাৎ হেঁট হয়ে তার পায়ের ধুলে নিলে। বনওয়ারীর বড় ভাল লাগল পাখীকে আজ। বড় ভাল মেয়ে পাখী। বসনের কন্যে, ‘অক্তে’ চৌধুরী মোয়দের ‘অক্তের মিশাল আছে, হবে না ভাল কথা! আনন্দে তৃপ্তিতে তার মন জুড়িয়ে গেল, হিয়েখানি যেন ভরে উঠল গরমকালে মা-কোপাইয়ের শেতল জলে-ভরা ‘আঙা মাটির কলসের মত। মনে মনে সে কত্তাঠাকুরকে প্রণাম করলে, বললে—বাবাঠাকুর, এসব তোমার দয়া। তুমি মাতব্বর করেছ, তুমিই দিয়েছ এমন মন, মতি। তুমি অক্ষে করবে কাহারদের ঘরবাড়ি ঝড়ঝাপটা থেকে। বনওয়ারী তোমার অনুগত দাস, তোমার হুকুমেই সে কাহারপাড়ার চাল দেখছে। লাঙল টানে গরু, তার কি বুদ্ধি আছে, না সে জানে কোন দিকে ঘুরতে হবে, ফিরতে হবে? পিছনে থাকে লাঙলের মুঠো ধরে চাষী, তাকে গরু দেখতে পায় না; কিন্তু হালের মুঠোর চাপের ইশারায় গরু ঠিক চলে। বনওয়ারী সেই গরু! বাবাঠাকুর, কত্তাবাবা, তুমি হলে সেই চাষী। তা নইলে করালীর মতিগতি ফেরে! চন্ননপুরে কারখানায় পাকা মেঝের কোয়ার্টার ছেড়ে কাহারপাড়ার বাড়িতে রঙ ধরিয়ে ফিরে আসে! কথাবার্তা মিষ্টি হয়! না, করালী অনেকটা সোজা হয়েছে। এই তো সেদিন নিজে থেকে তেরপল দিয়ে এল গুড়ের শালে। কোনো রকমে ওকে ঘরবশ করে চন্ননপুর ছাড়িয়ে কাহারদের কুলকর্মের কাজে লাগাতে হবে; ধরমের পথ ধরিয়ে দিতে হবে। সে এক দিনে হবে না। কেমে-কেমে’ ‘ধেয়ো-ধেয়ো’ বাকা বাঁশকে যেমন তাতিয়ে চাপ দিয়ে সোজা করতে হয় তেমনই ভাবে। পাড়ার লোকে ক্ষেপে উঠেছিল করালীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তার তো দশের মত হট করে মাথা গরম করলে চলে না! ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে তাকে। ঘোড়ার একটা দোষ হল, ‘লবাবী’ করা। অ্যাই টেরি, অ্যাই জামা, অ্যাই কাপড়, অ্যাই একটা ‘টরচ’ আলো, একটা বশি, যেন বাবুর বেটা বাবু বেড়াচ্ছে, কে বলবে কাহারদের ছেলে! মুখে লম্বা লম্বা কথা। লোকে এসব সহ্য করতে পারে না। তাও অনেক করেছে—অনেক। তবে। নাকি শোনা যাচ্ছে, ছোঁড়া আজকাল বেআইনি চোলাই মদের কারবার করছে চন্ননপুরে। কাহারপাড়াতেও আনছে। রাত্রে মজলিস করে এই মদ খায়। সাবধান করতে হবে। শাসন করতে হবে। বনওয়ারীর মনের মধ্যে একটি সাধ হয়। করালীকে নিয়ে সাধ। সে জেনেছে, বেশ বুঝেছে, এই ছোঁড়া থেকে হয় সর্বনাশ হবে কাহারপাড়ার, নয় চরম মঙ্গল হবে। সর্বনাশের পথে যদি ঝোকে তবে কাহারপাড়ার অন্য সবাই থাকবে পেছনে—লাগতে লাগবে তার সঙ্গে। সে পথে করালী গেলে বনওয়ারী তাকে ক্ষমা করবে না। তাই তার ইচ্ছা তাকে কোলগত করে নেয়; তার পুত্র সন্তান নাই। ডান হাত থেকে বঞ্চিত করেছেন ভগবান। বনওয়ারীর ইচ্ছে, বিধাতা যা তাকে দেন নাই—নিজের কর্মফলের জন্যে—সে তা এই পিথিমীতে অর্জন করে। পুণ্য তার আছে। বাবার চরণে মতি রেখেছে, নিত্য দুবেলা প্রণাম করে, বাবার থান আগলে রাখে। আঁধার পক্ষের পনের দিন সনজেতে পিদিম দেয়। জ্ঞানমত বুদ্ধিমত ন্যায্য বিচারই করে সে। নয়ানের বউ পাখীকে করালীকে দিয়ে অন্যায় একটু করেছে, নয়ানের মা চোখের জল ফেলেছে—তাকে শাপ-শাপান্ত করেছে। তা করুক, বনওয়ারী নিজের কর্তব্য করবে। নয়ানের একটি সাঙা দেবে সে, কনে এর মধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে। মেয়েটির রীতকরণ একটুকুন চনমনে, কালোমুখী বদনাম একটু আছে তার বাপের গায়ের সমাজে। তা থাক, নয়ানের মায়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই এমন মেয়ে সে ঠিক করেছে। নয়ান যদি সেরে না ওঠে, তবে ওই মেয়েই রোজকার করে নয়ানের মাকে খাওয়াবে। লোকে না ভেবে কথা বলে। ভদ্রলোকে বেশি বলে। তারা বলে—ছোটলোকের জাতের ওই করণ। তারা হলেন টাকার মানুষ, জমির মালিক, রাজার জাত। তাদের কথাই আলাদা। কথাতেই আছে, ‘আজার মায়ের সাজার কথা’। নয়ান যদি তাদের জাতের হত তবে নয়ান মরে গেলেও থাকত তার টাকা, জমি, তাই থেকে নয়ানের মা একদিকে কাদত, একদিকে খেত। আর কাহারের জাত? না জমি, না টাকা, নয়ান মরে গেলে নয়ানের
false
shottojit_roy
কেউ জানে না। বছর খানেক হল ওই ফ্ল্যাটে এসেছে। আর রূপচাঁদ সিং? সে এখানে এসেছে গতকাল সকালে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ছিল। ভাড়া চুকোয়নি। কাল রাত্রে নাকি একটা ফোন করতে চেয়েছিল হোটেল থেকে, ফোন খারাপ ছিল। শেষে একটা ডাক্তারি দাকান থেকে কাজ সারে। কম্পাউন্ডার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু খদ্দের ছিল বলে কী কথা হয়েছে তা শোনেনি! এগারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। ঘরে একটা সুটকেস পাওয়া গেছে, তাতে জামা-কাপড় রয়েছে কিছু। দুটো টেরিলিনের শার্ট দেখে মনে হয় লোকটা বেশ শৌখিন ছিল। সেটা কিছুই আশ্চর্য না, বলল ফেলুদা, আজকাল ড্রাইভারের মাইনে আপিসের কেরানির চেয়ে অনেক বেশি। কথাই ছিল রেলওয়ে হোটেল থেকে বিলাসবাবুকে আমরা তুলে নেব; ছটা বাজতে পনেরো মিনিটে আমরা হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। ব্রিটিশ আমলের হোটেল, এখন রং ফেরানো হলেও চেহারায় পুরনো যুগের ছাপটা রয়ে গেছে। সামনে বাগান, সেখানে রঙিন ছাতার তলায় বেতের চেয়ারে বসে হোটেলের বাসিন্দারা চা খাচ্ছে। তারই একটা থেকে উঠে পাশের চেয়ারে বসা দুজন সাহেবকে এক্সকিউজ মি বলে বিলাসবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। চলুন, কপালে কী আছে দেখা যাক? আজ লালমোহনবাবু আমাদের গাইড, তাই তাঁর হাবভাব একেবারে পালটে গেছে। দিব্যি গটগটিয়ে সাগরিকার গেট দিয়ে ঢুকে বাগানের মধ্যিখানের নুড়ি ফেলা পথ দিয়ে সটান গিয়ে বারান্দায় উঠে কাউকে না দেখে একটু থতমত খেয়ে তৎক্ষণাৎ আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সাহেবি মেজাজে কোই হ্যায় বলতেই বাঁ দিকে একটা দরজা খুলে গেল। স্বাগতম! বুঝলাম ইনিই লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। পরনে সিঙ্কের লুঙ্গি আর চিকনের কাজ করা সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। মাঝারি হাইটের চেহারার বিশেষত্ব হল সরু গোঁফটা, যেটা ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে প্ৰায় আধা ইঞ্চি নেমে এসেছে নীচের দিকে। লালমোহনবাবু আলাপ করাতে যাচ্ছিলেন, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ওটা ভিতরে গিয়ে হবে। আসুন। লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বৈঠকখানার বেশির ভাগটা দখল করে আছে একটা তক্তপোশ; বুঝলাম ওটার উপরে বসেই ভাগ্যগণনা হয়। এ ছাড়া আছে দুটো কাঠের চেয়ার, একটা মোড়া, একটা নিচু টেবিলের উপর ওড়িশা হ্যাঁন্ডিক্রাফটসের একটা অ্যাশট্রে, আর পিছনে একটা দেয়ালের আলমারিতে দুটো কাঠের বাক্স, কিছু বই, কিছু শিশি-বোতল-বয়াম ইত্যাদি ওষুধ রাখার পাত্র, আর একটা ওয়েস্ট এন্ড অ্যালার্ম ঘড়ি। আপনি বসুন। এইখেনটায়—তক্তপোশের একটা অংশ দেখিয়ে বিলাসবাবুকে বললেন গণৎকার। —আর আপনারা এইখেনে। চেয়ার আর মোড়া দখল হয়ে গেল। লালমোহনবাবু এইবারে আমাদের সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিলেন। ফেলুদার বিষয় বললেন, ইনিই আমার সেই বন্ধু, আর বিলাস মজুমদারের নামটা বলে ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত ওয়াই–বলেই জিভ কেটে চুপ করে গেলেন। আমি জানি উনি বলতে গিয়েছিলেন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটাগ্রাফার; নিজের বুদ্ধিতেই যে নিজেকে সামলে নিয়েছেন সেটা আশ্চর্য বলতে হবে। ফেলুদা বোধহয় কেলেঙ্কারিটা চাপা দেবার জন্যই বলল, আমরা দুজন অতিরিক্ত লোক এসে পড়েছি বলে আশা করি আপনি বিরক্ত হননি। মোটেই না বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —আমার আপত্তি যেটাতে সেটা হচ্ছে স্টেজে উঠে ডিমনষ্ট্রেশন দেওয়ায়। সে অনুরোধ অনেকেই করেছে। আমি যে যাদুকর নই সেটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। এই যেমন- ভদ্রলোকের কথা থেমে গেল। তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে বিলাস মজুমদারের দিকে। —কী আশ্চর্য! বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচাৰ্য্য—আপনার কপালে ঠিক থার্ড আই-এর জায়গায় দেখছি একটি উপমাংস! উপমাংস মানে যে আঁচিল সেটা জানতাম না। ঠিক ওইখানে খুলির আবরণের তলায় কী থাকে জানেন তো? ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন। পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কথা বলছেন? ফেলুদা বলল। হ্যাঁ—পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। মানুষের মগজের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ। অন্তত পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা তাই বলেন। আমরা যদিও জানি যে ওটা আসলে প্রমাণ করে যে আদিম যুগে প্রাণীদের তিনটি করে চোখ ছিল, দুটি নয়। ওই থার্ড আইটাই এখন হয়ে গেছে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। নিউগিনিতে একরকম সরীসৃপ আছে, নাম টারটুয়া, যার মধ্যে এখনও এই থার্ড আই দেখতে পাওয়া যায়। ফেলুদা বলল, আপনার কপালে আঙুল রাখার উদ্দেশ্য কি এই পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের সঙ্গে যোগস্থাপন করা? তা একরকম তাই বলতে পারেন? বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —অবিশ্যি যখন প্রথম শুরু করি। তখন পিনিয়াল গ্র্যান্ডের নামও শুনিনি। জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। এক রবিবার আমার জ্যাঠামশাইয়ের মাথা ধরল। বললেন, লখনা, আমার মাথাটা একটু টিপে দিবি? আমি তোকে আইসক্রিমের পয়সা দেব। কপাল টনটন করছে, কপালের মধ্যিখানে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে টিপছি, এমন সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। চোখের সামনে বায়স্কোপের ছবির মতো পরপর দেখতে লাগলাম—জ্যাঠার পৈতে হচ্ছে, জ্যাঠা পুলিশের ভ্যানে উঠছেন—মুখে বন্দেমাতরম স্লোগান, জ্যাঠার বিয়ে, জেঠিমার মৃত্যু, এমনকী জ্যাঠার নিজের মৃত্যু পর্যন্ত, কীসে মরছেন, কোন খাটে শুয়ে মরছেন, খাটের পাশে কে কে রয়েছেন, সব।..তখন কিছু বলিনি, কিন্তু এই মৃত্যুর ব্যাপারটা যখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল, তখন…বুঝতেই পারছেন— লালমোহনবাবুকে দেখে বেশ বুঝছিলাম যে ওঁর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। বিলাসবাবু দেখলাম একদৃষ্টি চেয়ে রয়েছেন গণৎকারের দিকে। ফেলুদা বলল, আপনি তো শুনেছি। ডাক্তারিও করেন, আর তার চিহ্নও দেখছি ঘরে। নিজেকে কী বলেন—ডাক্তার, না গণৎকার? দেখুন, গণনার ব্যাপারটা আমি শিখিনি। আয়ুর্বেদটা শিখেছি। অ্যালোপ্যাথিও যে একেবারে জানি না তা নয়। পেশা কী জিজ্ঞেস করলে ডাক্তারিই বলব। আসুন, এগিয়ে আসুন, কাছে এসে বসুন। শেষের কথাগুলো অবিশ্যি বিলাসবাবুকে বলা হল। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তক্তপোশে পা তুলে বাবু হয়ে বসে বললেন, দেখুন, কপালের ব্ল্যাক স্পটটি যদি ইনফরমেশনের সহায়ক হয়। লক্ষ্মণবাবুর পাশেই যে একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটি রাখা ছিল সেটা এতক্ষণ লক্ষ করিনি। তার
false
humayun_ahmed
যে বলার না। কোনো প্যান্ট এখন পরতে পারেন না। ঢিলা হয়ে গেছে। বেল্ট লাগে। বাবাকে আজ দেখে খুবই মায়া লাগল। কথাবার্তাও এখন ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথা আটকে যায়। তোমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন। এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন না। তার ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন। বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেশের বাইরে নিতে হবে। টাকা কোথায়? বাবা তার সারা জীবনে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন সব ঐ ফ্ল্যাট কিনতে শেষ করছেন। যেই মুহূর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, আমরা হয়ে যাব পথের মানুষ—জাগ্রত জনতা। আসমানী আবারো হাসছে। ফরহাদ মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। আসমানী আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি হাসছে। বেশি কথা বলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরহাদের কি বলা উচিত—এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি চুপ করে থাক। আসমানী শাড়ির আঁচলে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল–একজন ভালো মেয়ে হিসেবে আমার বাবাকে বলা উচিত ফ্ল্যাট বিক্রি করার কোন দরকার নেই। চিকিৎসা করে লাভ যা হবে তা হচ্ছে মনের সান্তনা। তোমরা বলতে পারবে মেয়ের চিকিৎসার জটি হয় নি। এই মনের সান্তনার জন্যে পথের ফকির হবে কেন? কিন্তু এরকম কোনো কথা আমি বলি নি। আমি খুব স্বার্থপর তো এই জন্যে বলিনি। এই শোন তোমাকে আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। ছাই রঙা সার্টেও লাগছে। তোমাকে বলেছিলাম না ছাই রঙা সার্টটা পুড়িয়ে ফেলবে। পুড়াও নি কেন? গরিব মানুষ তো, সার্ট পুড়াতে মায়া লাগে। সার্ট গা থেকে খুলে দাও। আমি পুড়াব। আমিও গরিব তবে আমার এত মায়া নেই। কই খুলছ না কেন? সার্ট সত্যি খুলব? অবশ্যই খুলবে। আসমানী মিটি মিটি হাসছে। মনে হয় তার মনে কোনো দুষ্ট বুদ্ধি খেলা করছে। আমার সামনে সার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে। হ্যাঁ। তাহলে একটা কাজ কর–টেবিলের উপর দেখ একটা প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়। মনে নেই, তোমার জন্যে সাতটা সার্ট কিনে ছিলাম? কোন বারে কোন সার্ট পরবে কাগজে লিখে রেখেছি। আজ বুধবার। আজ তোমার কপালে হালকা সবুজ রঙের সার্ট। চিরুনীটা নিয়ে যাও। মাথা আঁচড়াবে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে। তারপর স্ট্রেইট দরজা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বক বক করে আমার মাথা ধরেছে এবং মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। তোমাকে একা ফেলে চলে যাব? হ্যাঁ চলে যাবে। আমি একা থাকব না—বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। ও আরেকটা কথা প্রতিটি সার্টের বুক পকেটে একটা করে চিঠি আছে। যে দিন যে সার্ট পরবে সেদিন চিঠিটাও পড়বে। আচ্ছা। আগামী সাতদিনে সাতটা চিঠি পড়া হয়ে যাবে। ইন্টারেস্টিং না। হুঁ। আমি কি ভেবে রেখেছিলাম জান—আমি ভেবে রেখেছিলাম সারা জীবন তোমাকে এরকম করে চিঠি লিখব। সার্ট গায়ে দিয়ে অফিসে যাচ্ছ। সার্টের বুক পকেটে একটা চিঠি। যত রাগ হোক, ঝগড়া হোক তুমি চিঠি পাবেই। আচ্ছা শোন তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না আমার মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। আর শোন বাথরুম থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখ আমি ঘুমিয়ে পরেছি— খবরদার আমার ঘুম ভাঙ্গাবে না। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন ঘুমটা আমার জন্যে খুবই দরকার। ফরহাদ সার্ট বদলে মাথার চুল আঁচড়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করল। হাসপাতালের সব আয়না হাসপাতালের রুগীদের মতোই অসুস্থ। আয়নায় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না তারপরেও ফরহাদের মনে হলো সবুজ রঙের সার্টটায় তাকে খুব মানিয়েছে। বুধবারের সার্টের পকেটে শুধু যে চিঠি তাই না। একটা বলপয়েন্ট কলম। কলমটা কেন দিয়েছে কে জানে। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করলেও এখন পড়া যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। এখন পড়লে আসমানী বুঝে ফেলবে। এইসব ক্ষেত্রে আসমানীর সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল। ফরহাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল আসমানী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার ঘুম ভাঙ্গানোর কোনো মানে হয় না। ফরহাদ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিশা এবং তার বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নিশার হাতে একটা প্যাকেট। নিশার বাবার হাতে কিছু বইপত্র। তিনি দূর থেকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এটা ফরহাদের কল্পনাও হতে পারে। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর এখন কিছু নেই। কেউ কাউকে দেখতে পায় নি এমন ভাব করলে কেমন হয়। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। মনে হয় এটাই সবচে ভালো বুদ্ধি। তাছাড়া আসমানীর চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করছে। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়া যাবে। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সিড়ি বা লিফট আছে। তার পুরানো ছাই রঙের সার্টটা হাসপাতালে রয়ে গেছে। সার্ট দেখে নিশা এবং তার বাবা নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। যার যা ইচ্ছা করুক। তাকে এই মুহূর্তে আসমানীর চিঠি পড়তে হবে। চিঠি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত—যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ আঁকিবুকি টানা সামান্য এক টুকরা কাগজ। পড়তে শুরু করলেই সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষের মতোই সে রাগ করে। অভিমান করে। বাবু সাহেব, প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে আপনার জন্যে আজ চিঠি লিখলাম। সব মিলিয়ে সাতটা চিঠি লেখা সহজ ব্যাপার না। শুধু এই চিঠিটাই সামান্য বড়। বাকি সবগুলি এক লাইন দুলাইনের। এই চিঠি লিখতে লিখতে আমি মজার একটা
false
shottojit_roy
শঙ্কু! আমার নাম ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ। আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু— দুম—দুম—দুম–! সামারভিলের রিভলভার তিন বার গৰ্জিয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিন বার কাঠ। ফাটার শব্দ। ওকে পালাতে দিয়ে না।–সামারভিল চিৎকার করে উঠল—কারণ গ্রোপিয়াস গোরস্থানের পিছন দিক লক্ষ্য করে ছুট দিয়েছে। একজন পুলিশের লোক হাতে রিভলভার নিয়ে তার দিকে তিরবেগে ধাওয়া করে গেল। ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ চেঁচিয়ে উঠলেন, যে পালাবে, তাকেই গুলি করা হবে। এদিকে আমার বিস্ফারিত দৃষ্টি চলে গেছে। কফিনের দিকে। তিনটের একটা গুলি তার পাশের দেয়াল ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে। অন্য দুটো ঢাকনার কানায় লেগে সেটাকে দ্বিখণ্ডিত করে স্থানচ্যুত করেছে। কফিনের ভিতর বিশাল দুটি নিষ্পলক পাথরের চোখ নিয়ে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি হলেন আমারই ভুপ্লিকেট-শঙ্কু নাম্বার টু। এবারে সমবেত সকলের রক্ত হিম করে, ডিট্রিখের হাত থেকে রিভলভার খসিয়ে দিয়ে, পুলিশের বগলদাবা গ্রোপিয়াসকে অজ্ঞান করে দিয়ে, কফিনবদ্ধ দ্বিতীয় শঙ্কু ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। বুঝলাম, তাঁর পাঁজরা দিয়ে গুলি প্রবেশ করে তাঁর দেহের ভিতরের যন্ত্র বিকল করে দিয়েছে; কারণ ওই বসা অবস্থাতেই গ্রোপিয়াস-সৃষ্ট জাল শঙ্কু তাঁর শরীরের ভিতরে রেকর্ড করা একটি পুরনো বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন— ভদ্রমহোদয়গণ!–আজ। আমি যে কথাগুলো বলতে এই সভায় উপস্থিত হয়েছি, সেগুলো আপনাদের মনঃপূত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু— আমি আমার অ্যানাইহিলিন বন্দুকটি পকেট থেকে বার করলাম। আমার এই পৈশাচিক জোড়াটিকে পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারলে তবেই আমার মুক্তি। আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৮৩ শঙ্কুর সুবৰ্ণ সুযোগ ২৪শে জুন ইংলন্ডের সলসবেরি প্লেনে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে তৈরি বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জের ধারে বসে আমার ডায়রি লিখছি। আজ মিড-সামার ডে, অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি। যে সময় স্টোনহেঞ্জ তৈরি হয়, তখন এ দেশে প্রস্তরযুগ শেষ হয়ে ব্ৰঞ্জ যুগ সবে শুরু হয়েছে। মানুষ ধাতুর ব্যবহার শিখে দেখতে দেখতে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিশর, ভারত, মেসোপটেমিয়া, পারস্য ইত্যাদির তুলনায় অবিশ্যি ইউরোপে সভ্যতা এসেছে অনেক পরে। কিন্তু চার হাজার বছর আগে এই ইংলন্ডেই যারা স্টোনহেঞ্জ তৈরি করতে পেরেছে, তাদের অসভ্য বলতে দ্বিধা হয়। বহু দূর থেকে আনা বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ দাঁড় করানো মাটির উপর, প্রতি দুটো পাশাপাশি স্তম্ভের উপর আবার আড়াআড়ি ভাবে রাখা হয়েছে আরেকটা পাথর। এই পাশাপাশি তোরণগুলো আবার একটা বিরাট বৃত্ত রচনা করেছে। অ্যাদ্দিন লোকের ধারণা ছিল, এই স্টোনহেঞ্জ ছিল কেল্টদের ধমনুষ্ঠানের জায়গা। এই কিছুদিন হল প্রত্নতাত্ত্বিকরা বুঝেছে যে এটা আসলে ছিল একটা মানমন্দির। পৃথিবীর প্রাচীনতম মানমন্দিরের অন্যতম—কারণ পাথরগুলোর অবস্থানের সঙ্গে সূর্যের গতিবিধির একটা পরিষ্কার সম্বন্ধ পাওয়া গেছে, যেটা বিশেষ করে আজকে, অর্থাৎ ২৪শে জুন কর্কটক্রাস্তিতে, সবচেয়ে পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়ে। ভাবতে অবাক লাগে যে আজকের দিনে আধুনিক এঞ্জিনিয়ারিং বলতে আমরা যা বুঝি, তার অভাবে সে কালে কী করে এই পাথরগুলোকে এমনভাবে হিসেব করে বসানো হয়েছিল। আমার বন্ধু ক্রোল অবিশ্যি অন্য কথা বলে। তার ধারণা প্রাচীনকালে মানুষ এমন কোনও রাসায়নিক উপায় জানত, যার ফলে সাময়িকভাবে পাথরের ওজন কমিয়ে ফেলা যেত। সেই কারণে নাকি পিরামিড বা স্টোনহেঞ্জের মতো জিনিস তৈরি করা আজকের চেয়ে সে কালে অনেক বেশি সহজ ছিল। উইলহেলম ক্রোল চিরকালই আদিম মানুষের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। প্রাচীন জাদুবিদ্যা, প্রেততত্ত্ব, উইচক্রাফট ইত্যাদি নিয়ে তার অগাধ পড়াশুনা। সে আমার সঙ্গে তিব্বতে গিয়েছিল একশৃঙ্গ-অভিযানে। এখন সে স্টোনহেঞ্জেরই একটা পাথরে হেলান দিয়ে ঘাসের উপর বসে একটা বিশেষ রকমের বাঁশি বাজাচ্ছে, যেটা সে তিব্বতের একটা গুমফা থেকে সংগ্রহ করেছিল। এ বাঁশি মানুষের পায়ের হাড় দিয়ে তৈরি। এ থেকে যে এমন আশ্চর্য সুন্দর জামান লোকসংগীতের সুর বেরোতে পারে, তা কে জানত? ক্রোল ছাড়া তিব্বত অভিযানে আমার আর এক সঙ্গীও কাছেই বসে। ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে কফি খাচ্ছে। সে হল আমার বিশিষ্ট বন্ধু ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স। সন্ডার্সের আমন্ত্রণেই এবার আমার লন্ডনে আসা। হ্যাম্পস্টেডে ওর বাড়িতে ক্রোল আর আমি অতিথি হয়ে আছি। আরও দিন সাতেক থাকার কথা। এবার ইংলন্ডে গ্ৰীষ্মকালটা ভারী উপভোগ্য মনে হচ্ছে। বৃষ্টি নেই। নীল আকাশে সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মানুষের মন ও শরীরকে তাজা করে দিচ্ছে। এবারে লেখা শেষ করি। ক্রোলের বাঁশি থেমেছে। তার সঙ্গে লন্ডনের এক নিলামঘরে যেতে হবে। সেখানে নাকি অ্যালকেমি সম্বন্ধে স্প্যানিশ ভাষায় ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর একটা পাণ্ডুলিপি বিক্রি আছে। ক্রোলের ধারণা, সেটা সে সস্তায় হাত করতে পারবে, কারণ অ্যালকেমি সম্বন্ধে আজকাল আর লোকের তেমন উৎসাহ নেই। আণবিক যুগে কৃত্রিম উপায়ে সোনা তৈরি করা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও আর অসম্ভব নয়। ২৪শে জুন, রাত সাড়ে দশটা নিলামে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বাভারিয়ার অধিবাসী ক্রোল স্বভাবত হাসিখুশি দিলাদরিয়া মানুষ, তাকে এভাবে উত্তেজিত হতে বড় একটা দেখিনি। অ্যালকেমি সম্বন্ধে যে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটা সে পঞ্চাশ পাউন্ডের মধ্যে পাবে বলে আশা করেছিল, তার জন্য শেষপর্যন্ত তাকে দিতে হল দেড় হাজার পাউন্ড। অর্থাৎ আমাদের হিসাবে প্রায় পাঁচিশ হাজার টাকা। এতটা দাম চড়ার কারণ একটি মাত্র ব্যক্তি, যিনি ক্রোলের সঙ্গে যেন মরিয়া হয়ে পাল্লা দিয়ে সাতশো বছরের পুরনো জীৰ্ণ কাগজের বান্ডিলটাকে জলের দর থেকে দেখতে দেখতে আগুনের দরে চড়িয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের পোশাক ও কথার উচ্চারণ থেকে তাঁকে আমেরিকান বলে মনে হচ্ছিল। ক্রোলের কাছে শেষপর্যন্ত হেরে যাওয়াতে তিনি যে আদৌ খুশি হননি সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। এর পরে যতক্ষণ ছিলেন নিলামে, ততক্ষণ তাঁর কপালে ভুকুটি দেখেছি। ক্রোল অবিশ্যি বাড়ি
false
shirshendu
নিয়ম। মাথার পিছনে ছোট্ট একটা চাটি। তারপর তুমি অনেকক্ষণ ঘুমোবে। নাঃ! প্লিজ। ববি মৃদু একটু হাসলেন। নিয়ম মানে না এ কেমন খেলোয়াড়? মাথার খুলিতে মারা একটা আর্ট। অপটিমামের একটু বেশি হলেই কংকাশন। মারতে হয় ওজন কবে, খুব মেপে, খুব সাবধানে। বস স্থির দৃষ্টিতে ববিকে দেখছিল। লক্ষ করছিল ববির সমস্ত নড়াচড়া। মৃদু স্বরে সে হঠাৎ বলল, লাভ নেই মিটার রায়। আমাকে মাবলেও আমাদের জাল কেটে বেরোনো অসম্ভব। ববি অত্যন্ত সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি। শুধু জানি না তোমরা কিসের কোড আমার কাছে চাও। বস অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে উঠে একটা সোফায় বসল। তারপর বলল, আমেরিকা থেকে তুমি একটা যন্ত্র চুরি করেছিলে। ববি রায় অবাক হয়ে বললেন, কিসের যন্ত্র? ক্রাইটন। ববি মাথা নাড়লেন, খবরটা ভুল। বস স্থির দৃষ্টিতে ববিকে নিরীক্ষণ করে বলল, খবরটা ভুল ঠিকই। তুমি যন্ত্রটা চুরি করোনি, কিন্তু তার নো-হাউ জেনে নিয়েছিলে। ববি উদাস গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ক্রাইটনের মতো সফিস্টিকেটেড জিনিস তৈরি করতে কত সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি লাগে জানো? আর কতজন হাইলি-কোয়ালিফায়েড লোক? বস মাথা নাড়ল, আমি বিজ্ঞানের লোক নই। জানি। বিজ্ঞানের লোকেরা ওরকম বোকার মতো কথা বলে না। কিন্তু তোমার কাছে আলট্রাসোনিক ক্রাইটন যে আছে তা আমরা ঠিকই জানি। ভুল জানো। ভারতবর্ষে এমন কোনও কারখানা নেই যেখানে ক্রাইটন তৈরি করা যায়। আর শোনো বোকা, ক্রাইটনের বিশেষণ হিসেবে কখনও আলট্রাসোনিক কথাটা ব্যবহার করা যায় না। বস গনগনে চোখে চেয়ে বলল, তুমি কি আমার পরীক্ষা নিচ্ছ? মা, তোমার মতো গাড়লেরা কতটা বিজ্ঞান জানে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তোমার প্রভু বা প্রভুৱা বোধকরি তোমার মতোই গাড়ল, যদি না তারা আমেরিকান বা ফরাসি হয়ে থাকে। সেটা যা-ই হোক, আমরা শুধু জানঙে চাই, ক্রাইটনটা কোথায় আছে। প্রথম কথা, ক্রাইটন নেই। দ্বিতীয় কথা, থাকলেও জেনে তোমাদের লাভ নেই। বাঁদরের কাছে টাইপরাইটার যা, তোমাদের কাছে ক্রাইটনও তাই। শোনো বায়, তোমার সেক্রেটারি মিস ভট্টাচারিয়া আমাদের নজরবন্দি। চব্বিশ ঘণ্টা তার ওপর নজব রাখা হচ্ছে। আমরা একদিন না একদিন তাকে ক্র্যাক করবই। ববি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লাথিত গলায় বললেন, তাকে নজরবন্দি করে কী হবে? তোমরা কি ভালো ববি রায় সামান্য বেতনভুক তার এক কর্মচারীর কাছে ক্রাইটনের খবর দেবে? ববি রায় তার সেক্রেটারিদের তত বিশ্বাস করে না। তবু আমরা তাকে ক্র্যাক করবই, যদি তোমাকে না পারি। ববি এবার ঘড়ি দেখে বললেন, তোমাকে অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। আর নয়। এবার তোমাকে আমি ঘুম পাড়াব। তারপর আমার কয়েকটা কাজ আছে। বস এই সময়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। ববি খুব হিসেব-নিকেশ করে তার অপটিমাম শক্তিতে রিভলভারের বঁটটা বসিয়ে দিলেন বস-এর মাথায়। বস যথারীতি কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল মেঝেয়। ববি দ্রুত পকেট সার্চ করলেন। কোনও কাগজপত্র নেই। তার স্যাঙাতের পকেটও পরিষ্কার। ববি গিয়ে চিকার ঘরের দরজা খুললেন। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে। ববি ঘরটা ভাল করে দেখলেন। কোনও ইন্টিরিয়র ডেকরেটারকে দিয়ে সাজানো হয়েছে। ছবির মতো ঘর। ওয়ার্ডরোবটা খুলে ববি দেখলেন, ভিতরে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশটা দামি ড্রেস হ্যাঙারে ঝুলছে। দরজার ওপরে একটা ডার্টবোর্ডে লক্ষ করলেন ববি, মাঝখানের বৃত্তে অন্তত পাচটি ডার্ট বিধে আছে। চিকা যে চমৎকার লক্ষ্যভেদী তাতে সন্দেহ নেই। একটা ওয়াইন ক্যাবিনেটে বিদেশি মদের এলাহি আয়োজন। এমনকী এক বোতল রয়্যাল স্যালুট অবধি রয়েছে। ববি ওয়াইন ক্যাবিনেটের ঢাকনাটা বন্ধ করলেন। আর ঠিক সেই সময়েই বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। ববি চোখ বুজে ফেললেন। একেবারে নগ্ন মেয়েমানুষ দেখতে তার অ্যালার্জি আছে। চিকা গুনগুন করে গান গাইছিল। কী গান তা বুঝলেন না ববি। বোধহয় কোনও উষ্ণ বিদেশি পপ গান। চিকা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল তখনও সে ঘরের অতিশয় মৃদু আলোয় ববি রায়কে লক্ষ করেনি। সুতরাং ববিকেই জানান দিতে হল। মৃদু স্বরে ববি বললেন, পুট অন সামথিং মাই ডিয়ার। চিকা আতঙ্কিত আর্তনাদ করে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে দুঃস্বপ্নের অবিশ্বাস। মুখ হাঁ। ববি ফের ইংরেজিতে বললেন, যা তোক একটা কিছু পরো হে সুন্দরী। আমাদের মেলা কথা আছে। মেলা কাজ। চিকা চোখের পলকে একটা রোব পরে নিল। তারপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এটা কী করে সম্ভব? তোমার তো এতক্ষণে– ববি মৃদু হেসে বললেন, বলো। থামলে কেন? বিস্ময়টা আস্তে আস্তে মুছে গেল চিকার চোখ থেকে। একটু মদির হাসল সে। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, সুপারম্যান। ববি রায় দেখছিলেন, মেয়েটি কী দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল। তার হাততালি দিতে ইচ্ছে করছিল। চিকা তার বিছানায় বসে অগোছালো চুল দু’হাতে পাট করতে করতে বলল, আমি জানতাম তুমি ওদের হারিয়ে দিলেও দিতে পারো। ওরা কারা? চিকা ঠোঁট উলটে বলল, রাফিয়ানস। তোমার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কী? চিকা তার রোবটা খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে ঈষৎ উন্মােচিত করে দিয়ে বলল, কিছু না। এইসব গুন্ডা বদমাশরা মাঝে মাঝে আমাদের কাজে লাগায় মাত্র। তুমি ওদের চেনো? চিকা তার বক্ষদেশ এবং পায়ের অনেকখানি অনাবৃত করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল, শুধু একজনকে। বস। বস আসলে কে? গ্যাং লিডার। বোম্বাইয়ের দক্ষিণ অঞ্চল বস শাসন করে। তুমি যদি ওকে মেরে ফেলে থাকো তাহলে তোমার লাশ সমুদ্রে ভাসবে। আমি অকারণে খুন করি না। ওরা আমার কাছে কী চায়? আমি জানি না। ওরা একটা কোড-এর কথা বলছিল। আর কিছু নয়? চিকা মৃদু হাসল।
false
toslima_nasrin
চাঁদের মনোরম আলো বলে ভুল করতে করতে, জাফর ইকবালের সঙ্গে নির্জন সমুদ্রতীরে হাত ধরে মনে মনে হাঁটতে হাঁটতে। এর পরেই আমাকে অবাক করে জাফর ইকবাল বলে, না। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড় না। আমি জানি। ধরায় ফিরে এসে জিজ্ঞেস করি, কি করে? কি করে তা না বলে ভারি গলায় বলে, বন্ধুর সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে হয় না। আমাকে গ্রাস করে রাখে মিথ্যে বলার লজ্জা। ফোন রেখে বিছানায় লেপের তলায় মুখ লুকোই গিয়ে। এরপর চন্দনার সঙ্গে দেখা হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি বলি, সব্বনাশ করছি, বয়সে বড় হইতে গিয়া একটা মিছা কথা কইয়া ফেলছি। জাফর ইকবাল জানে যে চন্দনা আমার বান্ধবী। একজন মিথ্যুক হলে আরেকজনও হতে পারে! চন্দনা অনেকক্ষণ দুঃখগ্রস্ত বসে থেকে হঠাৎ দুঃখ ঝেড়ে বলে ঠিকই তো কইছস তুই, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি না? পড়িই তো। মনে মনে পড়ি। বাবা পরদিনই ড্রয়ার খুলে টেলিফোনটি বগলতলায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি একরকম। ফোনের ছেঁড়া তার অনেকদিন ঝুলে থাকে। ছোটদা কোত্থেকে যেন একটি পুরোনো টেলিফোন এনে ঝুলে থাকা তারে জোড়া দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন শব্দ টব্দ নেই কোনও। এদিকে লজ্জায় জাফরের চিঠির আর কোনও উত্তর দিই না আমি। চন্দনা চিঠি পেতে থাকে জাফরের। সেসব চিঠিতে বন্ধুত্ব পেরিয়ে প্রেম উঁকি দিচ্ছে দিচ্ছে। চন্দনার চিঠিতেও। আমি দুপক্ষের চিঠিরই শ্রোতা। শ্রোতা হওয়াই আমাকে মানায়। এ ছাড়া আমি টের পাই আমার সাধ্য নেই অন্য কোনও ভূমিকা গ্রহণ করার। ছোটদা চিপাচসের অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেন আবার। ঢাকা থেকে আসবেন শাহনাজ রহমুতল্লাহ, বিখ্যাত গায়িকা, আর তাঁরই ভাই আমাদের সবেধন প্রেমিকপ্রবর জাফর ইকবাল। অনুষ্ঠান হবে টাউন হলে,শনিবার সন্ধেবেলা। চন্দনা আর আমি কলেজের শিমুল তলায় দোদুলদোলায় দুলি, যাবো কি যাবো না জাফর ইকবালকে দেখতে। শনিবার সারাদিন দুলি, সন্ধের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না আমার, ওই মিথ্যেটির কারণেই আমি গুটিয়ে থাকি, চন্দনা যাবে বলেও শেষ অবদি যায় না। অনুষ্ঠান শেষে জাফর ইকবালের আকুল আবদারে ছোটদা তাকে চন্দনার সবুজ টিনের বাড়িতে নিয়ে যান। ওখানে চা বিস্কুট খেতে খেতে চন্দনার সঙ্গে কথা বলে জাফর। চন্দনা ওই মাথা নুয়ে যতক্ষণ জাফর ছিল, ছিল। কিছু হ্যাঁ, না, কিছু অপ্রতিভ হাসিই ছিল ওর সম্বল। ঢাকা ফিরে জাফর কোনওদিন আর ওকে চিঠি লিখবে না এ ব্যাপারে ও একশ ভাগ নিশ্চিত ছিল, কিন্তু জাফরের পরের চিঠিতে থৈ থৈ করে প্রেম। এই থৈ থৈ প্রেম শেষে বিয়ের প্রস্তাবে গড়ায়। চন্দনা প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ। অন্ধকার উতল সমুদ্র পাড় থেকে দেখতে ভাল লাগে, কিন্তু ঝাপঁ দেবার মত দুঃসাহস চন্দনার নেই। চন্দনা এর মধ্যে নাকচ করে দিয়েছে বেশ কটি প্রেমের আবেদন। পাশের বাড়ির ম্যাজিস্ট্রেট আখতার হোসেনকে বুড়ো ধামড়া বলে গাল দিয়ে, গান গায় ছেলে অন্টুকে একদিন খালি গায়ে ছাদে হাঁটতে দেখে ওয়াক থু বলে, আর সন্দিপন চাকমা নামের যে ছেলেটি পেয়িং গেস্ট ছিল ওদের বাড়িতে ক’মাস, ওকে খেতে দেখে। ছেলেদের খালি গা দেখলে বা খাবার চিবোনো দেখলে চন্দনার বিচ্ছিজ্ঞর লাগে, রোমান্স বাপ বাপ করে পালায়। চন্দনা মাঝে মাঝে বলেওছে তুই কি জানিস মানুষকে সবসময় বিশ্রি দেখায় কখন? কখন? তারা যখন খায়। মুখ নামের একখানা ছিদ্র আছে শরীরে, মানুষ ওতে নানা কিছু ঢুকিয়ে কী অশ্লীল ভাবে দুদাঁতের পাটি ঘষতে থাকে…. ছি!! আমি যার সঙ্গে প্রেম করব, আমার সামনে সে যেন না খায়, যেন গায়ের জামা না খোলে, যেন পেশাব পায়খানায় না যায়। ব্যস সোজা হিশেব। ছুটিতে একবার রাঙামাটি বেড়াতে গেল চন্দনা। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তখন তার বিয়ের জন্য পাষনী খুঁজছে। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে চন্দনাকে দেখার পর হাঁ হয়ে গেল, এমন যোগ্য পাষনী আর সে কোথায় পাবে! এরকম সুন্দরী বুদ্ধিমতী রাঙামাটিতে আর আছে কে!চন্দনাকে তার চাই। চাই তো চাইই। চন্দনার এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে দেবাশীষ রায়ের বন্ধুত্ব ছিল, সেই দাদাকে ধরে চন্দনার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়ার সুযোগ চাইল দেবাশীষ। সুব্রত চাকমার আনন্দ আর ধরে না, মেয়ে তাঁর রাণী হতে যাচ্ছে। খুড়তুতো দাদার অনুরোধে চন্দনা গেল দেবাশীষের সঙ্গে ঝিলের পাড়ে বেড়াতে। য়চ্ছ জলে শাদা মসৃণ গ্রীবা উঁচু করে ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস সাঁতার কাটছে, পাশে ঘাসে বসে দেবাশীষ প্রেমিকের মত তার চটচটে ঘামে ভেজা হাতটি চন্দনার দিকে বাড়িয়ে গলা গম্ভীর করে প্রেমের কথা যখনই বলতে শুরু করেছে, চন্দনা ফক করে হেসে ফেলল। বাড়ি ফিরে ও উৎসাহী দাদাকে বলে দিল, রাজা হোক আর যেই হোক দেবাশীষ প্রেম করতেই জানে না, তার সঙ্গে হবে না। সুব্রত চাকমা প্রথম নরম স্বরে, তারপর কড়া স্বরে দেবাশীষের বিয়ের প্রস্তাবে চন্দনাকে রাজি হওয়ার জন্য বলেন, ও রাজি হয়নি। চড় থাপড় লাগিয়েও কাজ হয়নি। বিয়েতে চন্দনার ভীষণ আপত্তি, ওর পক্ষে এ কল্পনা করা অসম্ভব যে একটি লোক খালি গায়ে ওর বিছানায় এসে শোবে, তারপর কী কী সব করবে, কী কী সব করায় আর যে মেয়েই রাজি হোক, চন্দনা রাজি নয়। দিব্যি রাজার প্রস্তাবে গুল্লি মেরে ছুটি শেষে চলে এল ময়মনসিংহে। ওর এমনিতেও ভাল লাগে না নাক বোঁচা কোনও চাকমা লোক, সে যত বড় রাজাই হোক। চন্দনার এরকম পটাপট প্রেমে পড়া আর হুটহাট ফিরিয়ে দেওয়া সবকিছুই আমাকে মগ্ধু করে। আমার কাউকে ফিরিয়ে দেওয়ার নেই, কারও সঙ্গে প্রেমও
false
shirshendu
বারান্দার বুঝকো অন্ধকারে লোকটার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সে যতদূর জানে, লোকটা পাগল নয়, বায়ুগ্রস্ত নয়। লোকটা একজন বিশেষজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরিসংখ্যানের জোরে কথা বলছে। তবু সে স্বগতোক্তির মতো বলল, অতটাই কি হবে! বিজ্ঞানীরা যখন উঠে পড়ে লেগেছে তখন একটা কিছু সমাধান তো হবেই। তাই না? বিজ্ঞানীরা মুষ্টিমেয়। পৃথিবীর যে সংকট আসছে সে সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষেরই ধারণা ভাসা ভাসা। আর অশিক্ষিতরা তো সম্পূর্ণ নির্বিকার। কয়েকদিন আগেই একজন সেন্ট্রাল মিনিস্টার আমাকে ডেকে বলেছেন, আমি যে কলকারখানা কমাতে বলছি তাতে নাকি উৎপাদন ও উন্নয়ন মার খাবে। তাকে আমি বোঝাতে পারিনি, আগে অস্তিত্বকে রক্ষা করা দরকার, নইলে উন্নয়ন আর উৎপাদন কার কাজে লাগবে? আমি পৃথিবীর লোককে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সবগুলো রাষ্ট্রের উচিত অন্যসব ইস্যুকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহমণ্ডলকে রক্ষা করার জন্য সব রিসোর্সেস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু কে শুনছে বলুন! রাজনীতিকরা তাঁদের কূটকচালিতে বন্দী হয়ে আছেন, আমলারা ব্যস্ত প্রশাসনিক কাজে। সাধারণ মানুষ অন্নবস্ত্রের বাইরে কিছুই ভাবতে চায় না। এই পৃথিবীর জন্য, মাটির জন্য, গাছের জন্য, প্রকৃতির জন্য তাদের যেন কিছুই করার নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এই উদাসীনতা। নেগলিজেন্স। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি কী করতাম জানেন! কেউ গাছ কাটলে তার ফঁাসির ব্যবস্থা করতাম। সন্তান সংখ্যা যার বেশী হবে তাকে জেল-এ পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম। জল বা বায়ু দূষিত হয় এমন কলকারখানার মালিকদের দেউলিয়া করে ছেড়ে দিতাম। হেমাঙ্গ সামান্য সপ্রশংস গলায় বলে, আপনাকে দেখে বোঝা যায় না বটে, কিন্তু ইউ আর এ টাফ ম্যান। কৃষ্ণজীবন একটুও হাসল না। মাথা নেড়ে বলল, না। আমি বড় অসহায় আর দুর্বল। আমি কিছু করতে পারছি না। এ বিটন ওল্ড ম্যান। ওল্ড কোথায়! আপনি তো দারুণ ইয়ং লুকিং। বাইরেটা। ভিতরে ভিতরে আমি বুড়িয়ে যাচ্ছি দুশ্চিন্তায়, টেনশনে। অবস্থাটা কি ততটাই খারাপ? আপনি যতদূর ভাবতে পারছেন তার চেয়েও বোধ হয় বেশী। আমাদের আর একদম সময় নেই। তাহলে বৈজ্ঞানিকরা এতদিন কী করল মশাই? তাদের দিয়ে যা করানো হয়েছে তারা তাই করেছে। তারাও রাজনীতি আর প্রশাসনের শিকার। তাদের মস্তিষ্ক আছে, চরিত্র নেই। তাই তারা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, মারণাস্ত্র, দূষিত কেমিক্যালস তৈরি করে যাচ্ছে। তাদের লাগানো হচ্ছে কসমেটিক জিনিসপত্র তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে লোককে চমকে দেওয়ার জন্য নানা ম্যাজিক আইটেম বানানোর কাজে। লোককে বোঝানো হচ্ছে, এটা বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানীরা ঈশ্বরের বিকল্প। বিজ্ঞান দুনিয়ার সব রহস্য ভেদ করতে চলেছে। কিন্তু যারা বিজ্ঞান জানে তারা এ কথা শুনে লজ্জায় জিব কাটে। বিজ্ঞান কোথায় পড়ে আছে তা কি জানেন? লোকে আকাশে রকেট পাঠানো দেখে, স্যাটেলাইটে টিভি দেখে ভাবছে, বিজ্ঞান বুঝি কেল্লা মেরে দিল। কিন্তু আসলে কি তাই! বিজ্ঞানের ঘরে পচা ইঁদুরও কি নেই? মহাকাশের কথা বাদ দিয়ে শুধু এই সোলার সিস্টেমের কথাই ধরুন। এরই এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে কত সময় লাগছে বলুন তো একটা রকেট বা প্রজেক্টাইলের? কত ফুয়েল খরচ হচ্ছে! কত কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে! দুনিয়ার মানুষকে উপোস, অশিক্ষা আর রোগেভোগ রেখে এই গবেষণা কী দিচ্ছে আমাদের? প্রায় কিছুই নয়। আমাদের নিকটতম নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে চার লাইট ইয়ার দূরে। যদি মানুষ কখনও আলোর গতি অর্জন করতে পারে তাহলেও সেখানে মহাকাশযান পাঠাতে লাগবে চার বছর। যদি না মাঝপথে অ্যাস্টেরয়েডরা সেই মহাকাশযান ধ্বংস করে দেয়। আলোর গতি অর্জন করাও আইনস্টাইনের মতে প্রায় অসম্ভব। সেই ফুয়েল আমাদের নেই এবং ওই গতি কোনও ম্যাটারের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব, বস্তুগত রূপান্তর ছাড়া। আলোর গতি পেলে ম্যাটার হয়ে যাবে এনার্জি, আমি কি একটু বেশী টেকনিক্যাল হয়ে পড়ছি। আমি বুঝতে পারছি। আজকাল সবাই এসব বোঝে। কৃষ্ণজীবন হতাশ গলায় বলে, বুঝছে কই? বৈজ্ঞানিকরা আমাদের খেলনা দিয়ে, চুষিকাঠি দিয়ে, রূপকথার গল্প বলে ভুলিয়ে রাখছে। কিন্তু আমরা পচা ইঁদুরের গন্ধ পেতে শুরু করেছি। আমি হিউস্টনে এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, আমেরিকা যদি তার একটা বা দুটো রকেট উৎক্ষেপন বন্ধ রেখে টাকাটা ইথিওপিয়ার মরু-প্রকৃতিকে বশে আনতে ব্যয় করে তাহলে পৃথিবীর অনেক বেশী উপকার হবে। আমেরিকানরা তুমুল হাততালি দিল, বাহবা দিল, কিন্তু প্রস্তাবটা কার্যকর করল না। আপনি কি মহাকাশ গবেষণা বন্ধ করার পক্ষে। না, আমি ততটা গাধা নই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, মহাকাশ গবেষণার কলমে কিছু মানুষ বড়লোক হয়ে যাচ্ছে এবং চলছে ওয়াইল্ড গুজ চেজ। আমি বাড়াবাড়ির বিপক্ষে। আমেরিকা যখন চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল তখন সেটা কত বড় হাই রিস্ক ভেনচার ছিল তা কি জানেন? তখনও ফুল-প্রুফ টেকনোলজি ছিল না, শুধু বাহবা পাওয়ার জন্য ওই সাতিক ঝুঁকি নিয়েছিল। এইসব ইউজলেস কাজ তো বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য মানুষের মঙ্গল। কিন্তু সে কথাটা মানুষ বুঝছে কই! বিজ্ঞান-পাগল মানুষ বিজ্ঞানকে মাথায় তুলেছে, ঈশ্বরের বিকল্প করে তুলছে, অথচ বাস্তবুদ্ধি থাকলে মানুষের বোঝা উচিত ছিল, বিজ্ঞানের ভূমিকা হল মানুষের ভৃত্যের। যার চাকর হওয়ার কথা তাকে মনিব করে তোলা কি উচিত? আপনি নিজে বৈজ্ঞানিক, তবে বিজ্ঞানের ওপর ক্ষেপে আছেন কেন? বিজ্ঞানের ওপর ক্ষেপব কেন! আমার রাগ আহাম্মক মানুষের ওপর। অস্ত্র গবেষণায় কত কোটি কোটি ডলার খরচ হয় তা কি জানেন? এক একটা যুদ্ধে কত কোটি ডলার খরচ বলুন তো! এক একটা ক্ষেপণাস্ত্রের দাম কত, একটা পুওর ম্যান অ্যাটম বোমার? প্রতি মিনিটে কত মিলিয়ন ডলার ছারখার হয়ে যায়? মাটির নিচে
false
zahir_rayhan
বলতে হবে সব। তুমি যা ভেবেছো তার সবটুকু মিথ্যে জাহানারা। শিউলির সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যদি কিছু থেকে থাকে সেতো তোমার সঙ্গে। আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা। না। তা হয় না। মাস্টার সাহেবের সঙ্গে আমাদের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে। জাহানারা অটল। না জাহানারা। একবার চেয়ে দেখো তোমাকে ভালবেসে আমি যে নিঃশেষ হয়ে গেলাম। আমি একটি মেয়ে, ক’জনকে ভালবাসবো বলুন তো? জাহানারার চোখে মুখে কৌতুক। শুধু আমাকে। শুধু আমাকে জাহানারা। কাসেদের গলার স্বর কাঁপছে। বুকের নিচে যন্ত্রণা। বাইরে কাক ডাকছে। বোধ হয় ভোর হয়ে এলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো কাসেদ। চোখজোড়া জ্বালা করছে। মাথা ঘুরছে। সারা দেহে ঘাম করছে। ওর। মা আর নাহার চাপাস্বরে কথা বলছে পাশের ঘরে। ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে। ওরা। সাংসারিক আলাপ আলোচনাগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ সময়ে সেরে নেয়। কলতলায় গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় জল ঢাললো কাসেদ। মাথা তুলতে দেখে, নাহার তোয়ালে হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে তোয়ালেখানা ওকে দিলো নাহার। আস্তে করে বললো, সাবান এনে দেবো? তোয়ালেখানা হাতে নিয়ে কাসেদ বললো, না। নাহার আর দাঁড়ালো না, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। সে। ঘরে এলে মা শুধালেন, কিরে আজ এত সকাল-সকাল উঠলি যে? কাসেদ সংক্ষেপে বললো, এমনি। বেলা ন’টার সময় অফিসে যাবার জন্যে বেরুচ্ছে, মা কাছে ডাকলেন, পাশে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলালেন ওর। বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসবি বাবা, আমার কেমন যেন লাগছে। কাসেদ বললো, ভেবো না মা, তুমি খুব শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে। মা স্নান হাসলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছে, একখানা রিক্সা এসে থামলো সামনে। শিউলি বসে, মিটমিটি হাসছে সে। মুহুর্তে বিগত বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলো কাসেদের। বাহ্‌, বেশ তো! রিক্সা থেকে দ্রুত নেমে এসে শিউলি বললো, আমি এলাম বাসায় আর আপনি চলে যাচ্ছেন? আপনার কোন বাঁধন নেই, আমাকে অফিসে চাকুরি করে খেতে হয়।–যথাসম্ভব গভীর হবার চেষ্টা করলো কাসেদ। শিউলি বললো, সে আমি জানি। আর এও জানি আপনি একজন অনুগত কেরানী। কাজ ফেলে বসে থাকেন না। মিষ্টি করে কথাটা বললো সে, বলে হেসে উঠলো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে। কাসেদ তেমনি গম্ভীর স্বরে বললো, বাসায় মা আছেন, নাহার আছে, যান না, ওদের সঙ্গে গল্প করে বেশ কিছুটা সময় কাটবে আপনার। আমি ওদের কাছে আসি নি তা আপনি জানেন, শিউলির কণ্ঠস্বর সহসা পাল্টে গেলো। কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তাহলে কার কাছে এসেছেন? তাও আমাকে বলতে হবে? ভ্রূজোড়া বিস্তারিত করে অপূর্ব ভঙ্গীতে হাসলো শিউলি, তাহলে শুনুন, আমি আপনার কাছে এসেছি এবং আপনার কাছেই আসি। কিন্তু কেন? উত্তেজিত গলায় কাসেদ শুধালো, আপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই যার জন্যে আপনি আমার কাছে আসতে পারেন। সারা মুখ কালো হয়ে গেলো শিউলির। ঠোঁটের কোণে একসূতো হাসি জেগে উঠলো ধীরে ধীরে, তারপর সে হাসি অতি সুক্ষ্ম ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়লো তার সম্পূর্ণ ঠোঁটে, চিবুকে, চােখে, সারা মুখে। শিউলি মৃদু গলায় বললো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া না করে, আসুন রিক্সায় উঠুন। ভয় নেই আপনাকে নিয়ে আমি কোথাও পালিয়ে যাবো না, অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমার হোস্টেলে ফিরে যাবো। কাসেদ বললো, আমি রোজ হেঁটে যাই, আজও যেতে পারবো। শিউলি বললো, দেখুন মেয়েমানুষের মত রাগ করবেন না, উঠন, রিক্সায় উঠুন। শিউলির চোখের দিকে তাকিয়ে এবার আর না করতে পারলো না কাসেদ, নীরবে উঠে বসলো সে। রিক্সাওয়ালাকে যাবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে শিউলিও উঠে বসলো পাশে। আজ একটু ছোট হয়ে বসতে চেষ্টা করলো কাসেদ। শিউলির গায়ে গা লাগতে পারে সেই ভয়ে। শিউলি আড়চোখে এক পলক দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, আপনারা পুরুষ মানুষগুলো এত সহজে বদলে যেতে পারেন যে কি বলবো! কাসেদ চুপ করে থাকবে ভেবেছিলো, কিন্তু জবাব না দিয়ে পারলো না। অন্য পুরুষের কথা আমি বলতে পারবো না। নিজে আমি সহসা বদলাই নে। আমি যা ছিলাম। তাই আছি, তাই থাকবো। তাই নাকি? চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো শিউলি। শুনে বড় খুশি হলাম। কিন্তু জনাব, একটা কথা যদি জিজ্ঞেস করি তাহলে রাগ করবেন না তো? মুখ টিপে হাসছে শিউলি। কাসেদ বললো, বলুন। ক্ষণকাল চুপ করে থেকে শিউলি ধীরে ধীরে বললো, সেদিন বিকেলে সেই একসঙ্গে রিক্সায় চড়ে হাতে হাত রেখে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে একটা কি দুটো কথা বলা এর সবটুকুই কি মিথ্যা। মুখখানা নুইয়ে ওর চোখে চােখে তাকাতে চেষ্টা করলো শিউলি। সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না সে। একটু পরে কি ভেবে বললো, আপনি যা ভাবছেন সে অর্থে মিথ্যে। আমি কি ভেবেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে? কারণ আমি শুনেছি সব। কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো : জাহানারা এসেছিলো বাসায়, কাল বিকেলে। শিউলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ চুপচাপ কি যেন ভাবলো সে। রিক্সাটা কাসেদের অফিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। শিউলি আস্তে করে বললো, সেদিন আপনি একটা অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম। আজ আমার একটা কথা। আপনি রাখবেন? ওর কণ্ঠস্বরে আশ্চৰ্য আবেগ। নড়েচড়ে বসে কাসেদ শুধালো, কি কথা বলুন? শিউলি ধীর গলায় বললো, আজ বিকেলে আমি নিউ মার্কেটের মোড়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, আপনি আসবেন, কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। আসবেন তো? রিক্সা থেকে নেমে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো
false
shottojit_roy
যাচ্ছিলাম, সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁ দিক দিয়ে নেমেছে ঢাল, আর ডান দিক দিয়ে পাহাড় খাড়াই উপরে উঠে গেছে। এই পাহাড়ের গা দিয়েই পাথর গড়িয়ে পড়ে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল। সেই পাথরকে ভেঙে টুকরো করে এখন রাস্তার ধারে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোকে দেখে আর অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভেবে পেটের ভিতরটা কেমন জানি করে উঠল। ফেলুদা প্রথমে চটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল, তারপর রাস্তার বাঁ পাশটায় গিয়ে নীচের দিকে দেখে কয়েকবার খালি ইহঁ বলল। তারপর ক্যামেরাটা কাঁধ থেকে খুলে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই ঢাল দিয়ে হ্যাঁচোড় পাঁচোড় করে কিছুদূর নেমে যাওয়া বোধহয় খুব কঠিন হবে না। তুই এখানেই থাক। আমার মিনিট পনেরোর মামলা৷’ আমি যে উত্তরে কিছু বলব, ওকে বাধা দেবার কোনও চেষ্টা করব, তার আর সুযোগই হল না; ও চোখের নিমেষে। এবড়ো-খেবড়ো পাথর আর গাছগাছড়া লতাপাত খামচাতে খামচাতে তািরতরিয়ে নীচের দিকে নেমে গেল। আমার কাছে কাজটা বেশ দুঃসাহসিক বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু ফেলুদা দেখি তারই মধ্যে শিস দিয়ে চলেছে। ক্ৰমে ফেলুদার শিস মিলিয়ে গেল। আমি ভরসা করে নীচের দিকে চাইতে পারছিলাম না, কিন্তু এবার একবার না দেখলেই নয় মনে করে রাস্তার কিনারে গিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে দিলাম। যা দেখলাম তাতে বুকটা কেঁপে উঠল। ফেলুদা পুতুল হয়ে গেছে; না জানলে তাকে দেখে চিনতেই পারতাম না। ড্রাইভার বলল, ‘বাবু ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছেন। ওইখানেই গিয়ে পড়েছিল। জিপটা৷’ ফেলুদার আন্দাজ অব্যর্থ। ঠিক পনেরো মিনিট পরে খচমচ খড়মড় শব্দ শুনে আবার এগিয়ে গিয়ে দেখি ফেলুদা যেভাবে নেমেছিল সেইভাবেই আবার এটা-ওটা খামচে ধরে উঠে আসছে। হাতটা বাড়িয়ে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে রাস্তায় তুলেই জিজ্ঞেস করলাম—‘কী পেলে?’ ‘গাড়ির কিছু ভাঙা পার্টস, নাট-বোল্ট, কিছু ভাঙা কাচ, একটা তেলচিটে ন্যাকড়া। নো যমন্তক।‘ মূর্তিটা যে পাবে না সেটা আমারও মনে হয়েছিল। ‘আর কিছু না?’ ফেলুদা তার প্যান্ট আর কোটটা ঝেড়ে নিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট জিনিস বার করে আমাকে দেখাল। সেটা আর কিছুই না—একটা ঝিনুকের কিংবা প্লাস্টিকের তৈরি সাদা বোতাম–মনে হয় শার্টের। আমাকে দেখিয়েই বোতামটা আবার পকেটে রেখে ফেলুদা উলটোদিকে খাড়াই পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।’পাথর…পাথর…পাথর’ আপন মনে বিড়বিড় করে চলেছে সে। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, ‘আরেকটু তেনজিঙ্গি না করলে চলছে না। ‘ এবারে আর ফেলুদাকে একা ছাড়লাম না, কারণ খাড়াই খুব বেশি না, আর মাঝে মাঝে এমন এক-একটা জায়গা আছে যেখানে ইচ্ছে করলে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। ফেলুদা আগেই বলে নিয়েছিল—তুই আগে ওঠ, তোর পিছনে আমি। তার মানে হচ্ছে। আমি যদি পা হড়কে পড়ি, তা হলে ও আমাকে ধরবে। খানিক দূরে ওঠার পরেই ফেলুদা হঠাৎ পিছন থেকে বলল—’থাম।’ একটা খোলা সমতল জায়গায় এসে পড়েছি। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝেড়ে চারদিকটা একবার দেখলাম। ফেলুদা আবার গুনগুন গান ধরেছে, আর দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে পায়চারি করছে। ‘হুঁ!’ শব্দটা এল প্রায় মিনিট খানেক পায়চারির পর। ফ্ল্যাট জায়গাটা যেখানে ঢালু হযে নীচে নেমেছে, তারই একটা অংশের দিকে ফেলুদা একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। আশেপাশে ঘাস থাকলেও এই বিশেষ অংশটা নেড়া। মাটি আর দু-একটা নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছু নেই। ‘এখান থেকেই পাথরবাবাজি গড়িয়েছেন৷ লক্ষ করে দাখ–এইখান থেকে শুরু করে ঢাল বেয়ে গাছপালা ভেঙে চলেছে নীচে অবধি। ও ঝোপড়াটা দ্যাখ-ওই ফার্নের গোছাটা দ্যাখ–কীভাবে থেতলেছে। এগুলো সব পরিষ্কার ইনডিকেশন৷’ আমি বললাম, ‘কত বড় পাথর বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা বলল, ‘নীচে তো টুকরোগুলো দেখলি। কত বড় আর হবে? আর এ হাইট থেকে গড়িয়ে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা সৃষ্টি করার জন্য একটা ছোটখাটো ধোপার পুঁটুলির সাইজের পাথরই যথেষ্ট।’ ‘তাই বুঝি?’ ‘তা ছাড়া আর কী? এ হল মোমেন্টামের ব্যাপার। ম্যাস ইনটু ভেলোসিটি। ধর, তুই যদি মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে থাকিস, আর মনুমেন্টের উপর থেকে কেউ যদি তাগ করে একটা পায়রার ডিমের সাইজের নুড়িপাথরও তোর মাথায় ফেলে, তা হলে তার চোটেই তোর মাথা ফুটি-ফাটা হয়ে যাবে। একটা ক্রিকেট বল যত বেশি হাইটে ছোড়া যায়, সেটাকে লুফতে তত বেশি চোট লাগে হাতে। লোফার সময় কায়দা করে হাতে টেনে নিতে না পারলে অনেক সময় তেলো ফেটে যায়। অথচ বল তো সেই একই থাকছে, বদলাচ্ছে কেবল হাইট, আর তার ফলে মোমেন্টাম।‘ ফেলুদা এবার নেড়া জায়গাটোৱ পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ে বলল, ‘পাথরটা কীভাবে পড়েছিল জানিস?’ ‘কীভাবে?’ আমি ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘এই দ্যাখ।‘ ফেলুদা নেড়া অংশটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল। আমি ঝুকে পড়ে দেখলাম সেখানে একটা ছোট্ট গর্ত রয়েছে। সাপের গর্ত নাকি? ‘যদ্দূর মনে হয়, ফেলুদা বলে চলল, ‘প্রায় পঁচাত্তর পার্সেন্ট সিওর হয়ে বলা চলে যে একটা লম্বা লোহার ডান্ডা বা ওই জাতীয় একটা কিছু মাটিতে ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে পাথরটাকে ফেলা হয়েছিল। তা না হলে এখানে এ রকম একটা গর্ত থাকার কোনও মানে হয় না। অর্থাৎ–‘ অর্থাৎ যে কী আমিও বুঝে নিয়েছিলাম। তবুও মুখে কিছু না বলে আমি ফেলুদাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম। ‘অর্থাৎ মিস্টার শিবকুমার শেলভাঙ্কারের অ্যাক্সিডেন্টটা প্রকৃতির নয়, মানুষের কীর্তি। অর্থাৎ অত্যন্ত ক্রুর ও শয়তানি পদ্ধতিতে কেহ বা কাহারা তাহাকে হত্যা করিয়াছিল। অর্থাৎ-এক কথায়-গণ্ডগোল, বিস্তর গণ্ডগোল…’ খুনের জায়গা খুনের জায়গা (এখন থেকে আর অ্যাক্সিডেন্ট বলব না) থেকে হোটেলে ফিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল ওর একটু কাজ আছে–একটু পরে ফিরবে। আমি জানি যে যদি জিজ্ঞেস
false
toslima_nasrin
রেজাউল করিম কামালের তত্ত্বাবধানে থাকবে, তাঁকে টাকা তোলার সব রকম অধিকার দেওয়া হল। কাগজটি ছোটদার হাতে দিই। ছোটদা পড়ে বলেন, —আমারে সব অথরাইজ কইরা দিলি যে! তুই কি বাঁচবি না নাকি! —কথা কইও না। কাগজটা রাখো পকেটে। আমি বলি। ছোটদা কাগজ পকেটে রেখে বলেন—এত বেশি ভাবিস না তো! সব ঠিক হইয়া যাইব, দেখিস। বাবা হাত বুলিয়েই যাচ্ছেন আমার মাথায়, পিঠে, বাহুতে। ছোটদা বললেন, বাবারে তো মারছে মোল্লারা। মাইরা ধাককা দিয়া ফালাইয়া দিছে ড্রেনে। —কি কও? আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠি। —হ। মোল্লাগোর মিটিং হইতাছিল বড়বাজারে। বাবা শুনতে গেছিল। বাবা অপ্রস্তুত হেসে বললেন— না মা, তেমন কিছু না। চিন্তা কইর না। তেমন কিছু হয় নাই। প্রসঙ্গটি তিনি চাননা উঠুক। কিন্তু আমি শুনবই। বললেন—ওই একটু গেছিলাম শুনতে। —কেন? —কী ওদের প্রোগ্রাম, কি করতাছে .. মিটিংএর ভিতরে যাই নাই। দূরে দাঁড়াইয়া ছিলাম। —তারপর? —তারপর আর কী! দুইটা লোক চিনে ফেলছে আমারে যে আমি তোমার বাবা.. ছোটদা পেছন থেকে বললেন—তারপর তো ধইরা দিল মাইর। −ড্রনএ পইড়া গেছিল। পরে দৌড়াইয়া একটা চেনা লোকের ফার্মেসিতে ঢুইকা পইড়া বাচছে। নাইলে কি হইত কে জানে। আমি চোখ বুজি। দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে আসে। বাবা বলেন— বিদেশ থেইকা এত বলা হইতাছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তো চেষ্টা করতাছে। তাতে কি বেইল হইব না! আমি ঠোট উল্টে বলি—জানি না। বাবা বলেন—যদি বেইলটা হইয়া যায়, তাইলে তো বাসায় ফিরতে পারবা। সরকার যদিপুলিশ প্রটেকশানের ব্যবস্থা করে তাইলে তো তোমার আর ভয়ের কিছু নাই। ঘরে বইসা বইসা লিখবা। বিদেশের মন্ত্রীরা তো বলতাছে তোমারে প্রটেকশান দিতে। আমি আবারও মাথা নেড়ে বলি—যদি যদি যদি। এইটা যদি হয়, তাইলে ওইটা হইব। জানি না কি হইব। এই সরকার আর মৌলবাদীদের মধ্যে তো কোনও পার্থক্য দেখতাছি না। কী হয় শেষ পর্যন্ত কে জানে। ঝ ছোটদাকে ইঙ্গিত করেন ওঠার জন্য। এই ইঙ্গিতটি আমাদের বুকে তীরের মত বেঁধে। ইচ্ছে না থাকলেও ছোটদা ওঠেন। বাবাকে উঠতে বলেন। —আরেকটু বসুক আরেকটু। ঝর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলি। —না। খামাকা রিস্ক নেয়ার দরকার নেই। তোমার ফ্যামিলির লোকজন কোথায় কে যায় তার খবর রাখা হয় না মনে কর? ছোটদা বললেন—উরে বাবা, সারাক্ষণই তো সবার পেছনে এসবির লোক থাকে। আমি যেইখানেই যাই সেইখানেই যায়। আজকে ত সন্ধ্যার সময় বাসা থেইকা বার হইছি, সারা ঢাকা শহর চককর দিছি, এসবির গাড়িও ফলো করল তিন ঘন্টা। এমন অলি গলির মধ্যে ঘুরপাক খাইলাম , একসময় ওরা হাল ছাইড়া দিছে অথবা মিস করছে। তারপরে তো এইখানে আইলাম। বাবা ঝকে বললেন—আপনি যে কি ঝুঁকি নিয়ে আমার মেয়েটাকে এইরকম আশ্রয় দিয়েছেন, আপনার কাছে আমরা খুব কৃতজ্ঞ। ঝ বললেন—না না না কৃতজ্ঞতা জানাবেন না। আমি যা করেছি, এটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছি। কেবল আমি তো না, আরও অনেকেই ওকে সাহায্য করছে। আমি অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। আধঘণ্টা সময়ও কি কাটানো যেত না! আমার সাধ মেটে না। ঘুমের মধ্যে সুখের একটি স্বপ্ন যেন মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সাহস রাখো মা, সাহস রাখো। সাহস হারাইও না। তুমি যেই কথা লেখছ, তাতে তুমি যদি সত্যিই বিশ্বাস কইরা থাকো, তাইলে যতদিন বাঁচো, মাথা উঁচা কইরা বাঁচো। তবে এখন সাবধানে থাকতে হবে। তোমার বন্ধুরা আছে। আমরা আছি। চিন্তা কইর না। ছোটদা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। দরজার কাছে আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেবল মনে হতে থাকে এ দেখাই বুঝি শেষ দেখা। বাকি রাত ছবি আঁকি। আমার নিজের ছবি। নতুন নিউজ ইউক ম্যাগাজিনে আমার যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটি দেখেই আঁকি। আমার ছবিটির চারপাশে অনেকগুলো সাপ আঁকি, সাপগুলো ফণা তুলে আছে আমার দিকে। সাপের মাথায় সাদা টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ঝ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমার আঁকা দেখেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। এঘরেই তিনি আরেকটি তোশক পেতে বিছানা করে নিয়েছেন। সাতাশ জুলাই, বুধবার সরকার ও বিরোধী দলকে এই দায় সুদে আসলে শুধতে হবে। আবদুল মান্নান লিখেছেন ইনকিলাবে — জানতে পারলাম, তসলিমা নাসরিনের লজ্জার ইংরেজি ভার্সান একদিনেই ২০,০০০ (বিশ হাজার) কপি বিক্রি হয়ে গেছে। তসলিমাকে নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে যে ক্রেজ এর সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে হয়, তসলিমার বই ইংরেজি ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হবে এবং মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই সর্বৈব মিথ্যা কথাটিই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে, বাংলাদেশ উগ্র ফতোয়াবাজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের দেশ। বাংলাদেশের এই যে ইমেজ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, এটা কি কারও জন্যই কল্যাণকর? এই মিথ্যার প্রতিষ্ঠা থেকে কী কল্যাণলাভ করবেন প্রগতিবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা? কী কল্যাণ লাভ করবে সরকার? কী কল্যাণ লাভ করবে বিরোধী দল, বিশেষত আওয়ামী লীগ? আগামী নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায়ও যায়, তারা কেমন করে মুছবে এই মিথ্যা ইমেজ? তাদেরও কি এর দায় বহন করতে হবে না? অথচ দেশ ও রাজনীতির যাঁরা হর্তাকর্তা তাঁদের কারও মধ্যে কোন সুবুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে হয় না। যে সরকার ইসলামের দোহাই পেড়েই ক্ষমতায় গেছেন, সেই সরকারও পরম নির্বিকারচিত্তে তসলিমা নাসরিনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও ঔদ্ধত্য অবলোকন করলেন এবং ওর মিশন নির্বিবাদে সম্পন্ন হওয়ার পর একটি কার্যকারিতাহীন
false
humayun_ahmed
উঁহু, বেশি হলে নান্দনিক দিক ক্ষুন্ন হবে। কিন্তুক মামা, হাসি যেমন হঠাৎ আইছে তেমন হঠাৎ গেলে ভাল হইত। এই হাসি হঠাৎ যায় না, ঠোঁটের মইধ্যে লাইগ্যা থাকে। ফরিদ সত্যি সত্যি চমৎকৃত হল। এ রকম প্রতিভা, বাজার করে আর ঘর বাট দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই খারাপ লাগে। মামা কি করছ? কিছু করছি নারে মিলি। আয়। মিলি ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, তোমাদের ছবি এখনো শুরু হয় নি? না। আজ কি ছবি? স্পটাকার্স। স্পটাকার্স না একবার দেখলে। একবার কেন হবে, এ পর্যন্ত পাঁচবার হল। ভাল জিনিস অনেবার দেখা যায়। আচছা মামা এই যে তুমি কিছুই কর না, খাও দাও ঘুমাও, ছবি দেখ, তোমার খারাপ লাগে না? না তো। খারাপ লাগবে কেন? তুই যদি পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করিস তালে জানতে পারবি পৃথিবীর জনগষ্ঠির একটা বড় অংশ এভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়। জনগষ্ঠির ইকুইলিব্রিয়াম বজায় রাখার জন্যেই এটা দরকার। জনতা এই অকৰ্মক অংশের কাজ হচ্ছে কর্মক অংশগুলোর টেনশন এ্যাবজাৰ্ভ করা। অর্থাৎ শত এ্যাবজাৰ্ভারের মত কাজ করা। সব ব্যাপারেই তোমার একটা থিওরী আছে, তাই না মামা? থিওরী বলা ঠিক হবে না, বলতে পারিস হাইপোথিসিস। থিওরী আর হাইপোথিসিস কিন্তু এক না— চুপ করতো মামা। তুই দেখি তোর বাবার মত হয়ে যাচ্ছিস। সব কিছুতে চুপ কর, চুপ কর। মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আজ তোমার থিওরী শুনতে আসিনি মামা। আজ এসেছি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে। আমি কি করলাম? তুমি খুব অন্যায় করেছ মামা। অন্যায় করেছি? হ্যাঁ করেছ। বাবার স্বভাব চরিত্র তুমি খুব ভাল করেই জান। তুমি জান বাবা কত অল্পতে আপসেট হয়। সব জেনেশুনে তুমি তাকে আপসেট কর। মাছের সমস্যাটা নিয়ে বাবা একদিন ধরে ভাবছে, হতে পারে তার ভাবনাটা ঠিক না। কিন্তু কেউ যেখানে ভাবছে না। বাবাতো সেখানে ভাবছে। তা ভাবছে। তাকে আমরা সাহায্য না করতে পারি–ডিসকারেজ করব কেন? এসব উদ্ভট আইডিয়াকে তুই সাপোর্ট করতে বলছিস? হাঁ বলছি। এতে বাবা শান্তি পাবে, সে বুঝবে যে সে একা না। তুই এমন চমৎকার করে কথা বলা কোথেকে শিখলি? সিনেমা দেখে দেখে শিখিনি —এইটুকু বলতে পারি। তোর কথা বলার ধরন দেখে অবাকই হচ্ছি–ছোটবেলায় তো হাবলার মত ছিলি। কি যে তোমার কথা মামা। আমি আবার কবে হাবলার মত ছিলাম? মিলি উঠে দাঁড়াল। ফরিদ বলল, আচ্ছা যা তোর কথা রাখলাম। স্ট্রং সাপোর্ট দেব। মিলি বলল, সবকিছুতেই তুমি বাড়াবাড়ি কর মামা, স্ট্রং সাপোর্টের দরকার নেই। তুই দেখ না কি করি। মিলি চিন্তায় পড়ে গেল। মামার কাজ কর্মের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কি করে বসবে কে জানে। মামাকে কিছু না বলা বোধ হয় ভাল ছিল। মিলি নিজের ঘরে চলে গেল। মনটা কেন জানি খারাপ লাগছে। মন খারাপ লাগার যদিও কোন কারণ নেই। ইদানিং ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটছে। অকারণে মন খারাপ হচ্ছে। আফা ঘুমাইছেন? মিলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রহিমার মা দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার রহিমার মা? একটা সমস্যা হইছে আফা। কি সমস্যা। চশমা দেওনের পর থাইক্যা সব জিনিস দুইটা করে দেখি। বল কি? হ আফা। এই যে আফনে চেয়ারে বইয়া আছেন মনে হইতাছে দুইখান আফা। একজন ডাইনের আফা একজন বায়ের আফা। মিলি অবাক হয় তাকিয়ে রইল। রহিমার মা বলল, টেবিলের উপরে একখান গেলাস থাকে তখন আমি দেখি দুইখান গেলাস, এই দুই গেলাসের মাঝামাঝি হাত দিলে আসল গেলাস পাওয়া যায়। কি সর্বনাশের কথা। চশমা পরা বাদ দাও না কেন? অত দাম দিয়া একখান জিনিস কিনছি বাদ দিমু ক্যান? সমিস্যা একটু হইতাছে, তা কি আর করা কন আফা, সমিস্যা ছাড়া এই দুনিয়ায় কোন জিনিস আছে? সব ভাল জিনিসের মইদ্যে আল্লাহতালা মন্দ জিনিস ঢুকাইয়া দিছে। এইটা হইল আল্লাহতালার খুদরত। যাই আফা। রহিমার মা চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে খুব সাবধানে, কারণ সে শুধু যে প্রতিটি জিনিস দুটা করে দেখছে তাই না ঘরের মেঝেও উঁচুনিচু দেখেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে চারদিকে অসংখ্য গর্ত। এসব গর্ত বাঁচিয়ে তাকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। চশমা পড়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। মিলির পড়ায় মন বসছে না। সে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এস। দাঁড়াল। উপর থেকে টগর এবং নিশির খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এত রাতেও বাচ্চা দুটি জেগে আছে। এদের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোনদিন সন্ধ্যা না মিলতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার কোনোদিন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। আনিস সাহেব বাচ্চা দুটিকে ঠিকমত মানুষ করতে পারছেন না। সারাদিন কোথায় কোথায় নিয়ে ঘুরেন। আগের স্কুল অনেক দূরে কাজেই তারা এখন স্কুলেও যাচ্ছে না। ভদ্রলোকের উচিত আশেপাশের কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া। তিনি তাও করছেন না। বাচ্চাদের হাসির সঙ্গে সঙ্গে একবার তাদের বাবার হাসি শোনা গেল। কি নিয়ে তাদের হাসাহাসি হচ্ছে জানতে ইচ্ছ করছে— নিশ্চয়ই কোন তুচ্ছ ব্যাপার। এমন নির্মল হাসি সাধারণত তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়েই হয়। মিলির ধারণা সত্যি। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েই হাসােহাসি হচ্ছে। আনিস তার ছেলেবেলার গল্প করছে, তাই শুনে একেকজন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আনিসের ছেলেবেলা সিরিজের প্রতিটি গল্পই এদের শোনা, তবু কোন এক বিচিত্র কারণে গল্পগুলো এদের কাছে পুরানো হচ্ছে না। নিশা বলল, তুমি খুবই দুষ্ট ছিলে তাই না বাবা? না দুষ্ট ছিলাম না। আমার বয়েসী ছিলেদের মধ্যে আমি ছিলাম। সবচে শান্ত। তবু কেন জানি সাবই
false
nihar_ronjon_gupta
ও সহকারী।– কিরীটীর কথায় বুঝলাম বক্তাই কুমারসাহেব। কুমারসাহেবের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলাম। নীতি-দীর্ঘ সবল দেহাবয়ব; মাথায় লম্বা কঁচা-পাকা চুল, মাঝখানে সিঁথি কাটা, পরিধানে দামী সার্জের সুট, চোখে একজোড়া রঙিন কাচের চশমা। তাছাড়া মুখের ভাব অত্যন্ত শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। এই সময় দ্বিতীয় প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা তিনজনে সোফার ওপর কুমারসাহেবের নির্দেশক্রমে উপবেশন করলাম। ইনিই আমাদের কুমারসাহেব দীপেন্দ্রনারায়ণ, সুব্রত। কিরীটী বললে আমার দিকে এবারে তাকিয়ে। একজন বেয়ারা ট্রেতে করে কাপ-ভর্তি ধূমায়িত চা ও প্লেটে করে কিছু প্লাম-কেক দিয়ে গেল। ট্রের ওপর হতে একটা ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কাপে মৃদু চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বলল, জানিস, ভারী বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ এর জীবন-কথা সুব্ৰত! এমন সময় দামী সুট-পরা একজন বৃদ্ধ গোছের ভদ্রলোক পর্দা তুলে এসে সেখানে শু বেশ করলেন। হ্যালো ডাঃ চট্টরাজ। কলকাতায় কবে ফিরলেন? কিরীটী সোল্লাসে বলে উঠল। এই তো কদিন হল। তারপর রায়, তোমার সংবাদ কী বল? ডাঃ চট্টরাজ কিরীটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন এবং সহাস্যমুখে বললেন, দাও। হে রহস্যভেদী, একটা বিমর্ণ সিগার দও তোমার। অনেক দিন খাই না। খেয়ে দেখি! কিরীটী মৃদু হেসে তার পকেট থেকে সুদৃশ্য হাতাঁর দাঁতের সিগার কেন্সটা বের করে ডাক্তারকে একটা সিগার দিল। কুমারসাহব বললেন, মিঃ রায়, আপনারা ততক্ষণ আলাপ করুন, আমি ওদিকটা একটু দেখে আসি। কুমারসাহেব চলে গেলেন। তারপর ডাক্তার, আপনি এক সময় স্যার দিগেন্দ্রর চিকিৎসা করেছিলেন, না? কিরীটী প্রশ্ন করলে ডাঃ চট্টরাজের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হ্যাঁ, সে প্রায় বছর তিন সাড়ে তিন আগেকার কথা। কিন্তু তাহলেও তার সম্পর্কে সব কিছুই আমার আজও বেশ স্পষ্ট মনে আছে। একটা কথা আপনাকে আজ জিজ্ঞাসা করব ডাঃ চট্টরাজ? বলুন! আচ্ছা, স্যার দিগেন্দ্রর কি সত্যি সত্যিই মাথার কোন গোলমাল হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়? ডাঃ চট্টরাজ যেন অল্পক্ষণ কি একটু ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন। আমার যতদূর মনে হয়, ভদ্রলোকের — ছিল। তাঁর মধ্যে প্রায়ই একটা খুনোখুনি করবার যে জেগে উঠেছিল তাতে ও ধরনের ব্যাপারকে বলা যায়, অর্থাৎ যাকে সহজ ভাষায় খুন করবার একটা ইচ্ছা বলা চলে এবং স্যার দিগেন্দ্রর মত ঠিক ঐ ধরনের ‘কেস’ আমার ডাক্তারী-জীবনে চোখে বড় একটা পড়েনি। ডাক্তারী শাস্ত্র ও নানা প্রকারের নজির থেকে বলা যায়, এধরনের মনের বিকৃতি যাদের হয় তারা প্রিয়জনের বড় একটা ক্ষতি করে না। অথচ আশ্চর্য, স্যার দিগেন্দ্র তার অতি প্রিয় ভাইপোকেই শেষটায় খুন করতে গিয়েছিলেন। ভাগ্যে বেচারা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে; তা ছাড়া কুমারসাহেবের গায়েও অসীম ক্ষমতা ছিল। ভদ্রলোককে আমন হাবাগবা বোকাটে ধরনের দেখতে হলে হবে কি, গায়ে শুনেছি নাকি অসুরের মতই ক্ষমতা রাখেন। ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন, আমি তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পুরী বেড়াতে গেছি, সেই সময় হঠাৎ একদিন সকালে কুমারসাহেবের বাড়ি থেকে পেয়ে স্যার দিগেন্দ্রকে দেখতে যাই। সেও আজ বছর কয়েক আগেকার কথা। সকালবেলা রোগী দেখতে গেলাম, পুরীতে সমুদ্রের ধারেই ওঁদের সুন্দর একখানা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি আছে। স্যার দিগেন্দ্র তখন বারান্দায় একটা ডেকচেয়ারে বসে শেকস্পীয়র পড়ছিলেন; কুমারসাহেবও তাঁর কাকার পাশেই বসেছিলেন, আলাপ পরিচয় হবার পর স্যার দিগেন্দ্ৰ আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দীপু আমার জন্য বডড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ডাক্তার চট্টরাজ। আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন? স্যার দিগেন্দ্ৰ জবাবে বললেন, ওর ধারণা আমার কিছুদিন থেকে রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না বলে শীঘ্রই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ব। বলতে গেলে অতঃপর কুমারসাহেবের বিশেষ অনুরোধেই স্যার দিগেন্দ্রকে আমি পরীক্ষা করি এবং আশ্চর্য আমি স্যার দিগেন্দ্রকে খুব ভাল ভাবেই পরীক্ষা তো করলামই এবং অনেকক্ষণ ধরে সে রাত্রে তার সঙ্গে কথাবার্তাও বললাম, দেখলাম মাথার কোন গোলমাল নেই, চিন্তাশক্তিও স্বাভাবিক শান্ত ও ধীর; মস্তিষ্কের কোন রোগের লক্ষণই পাওয়া গোল না। তবে পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানতে গিয়ে একটা জিনিস পাওয়া গেল। কী? কিরীটী সাগ্রহে প্রশ্ন করল। ডাক্তার বলতে লাগলেন, ওদের ফ্যামিলিতে নাকি কবে কোন এক পূর্বপুরুষের ‘এপিলেপিসি’ (অনেকটা ফিটের মত ব্যারাম) ছিল। যাহোক স্যার দিগেন্দ্রকে পরীক্ষা করে। দেখলাম, দেহ তার বেশ সুস্থ ও সবল এবং রোগের কোন লক্ষণমাত্রও নেই। তবে চোখের দৃষ্টি-শক্তি একটু কম ছিল। সম্ভবত অতিরিক্ত পড়াশুনার জন্যই সেটা হয়ে থাকবে। লোকটি উঁচু, লম্বা, বলিষ্ঠ গঠন। চোখের তারা দুটো অন্তৰ্ভেদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ভদ্রলোক বহু ভাষায় সুপণ্ডিত। কথায় কথায় একসময় স্যার দিগেন্দ্র বললেন, বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে একটিবার আসবেন ডাক্তার, আপনাকে আরও গোটাকতক কথা বলব। জবাবে বললাম, বেশ তো। এবং কথামত বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে স্যার দিগেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হল। খানিকটা ঘুরে বেড়াবার পরই সন্ধ্যা হয়ে এল। সমুদ্রের ধারে একটু অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থান দেখে নিয়ে বালুবেলার ওপরেই দুজনে পাশাপাশি বসলাম। নানা মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন ডাক্তার, দীপু যাই বলুক না কেন, আমার নিজের ব্যাপারটা আমি নিজেই আপনাকে বুঝিয়ে বলছি, শুনুন। শান্ত গভীর কণ্ঠে স্যার দিগেন্দ্র বলতে লাগলেন, সত্যি বলতে কি, আমার মনে সত্যি সত্যি কোন বা বা কোন কুৎসিত ভয়ঙ্কর গোপন ইচ্ছা লুকিয়ে আছে কিনা আমি নিজেই তা জানি না বা আজ পর্যন্ত ঘৃণাক্ষরেও কোনদিন টেরও পাইনি। আর এও আমি মনে করি না, যদি বা অমন কুৎসিত ভয়ঙ্কর কোন গোপন ইচ্ছা আমার মনের কোথাও থাকেই, সেটা আমার পুরুষানুক্রমে পাওয়া। আমার নিজের যতদূর মনে হয়, ছেলেবেলা হতেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব বই পড়ে পড়ে
false
shottojit_roy
থেমে গেল। মাটির দিকে চেয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে ব্যস্তভাবে এগিয়ে আসছেন। আমাদেরই পথ ধরে মিঃ হিঙ্গোরানি। ভদ্রলোক আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন; তারপর ফেলুদার দিকে আঙুল নেড়ে বেশ ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ইউ বেঙ্গলিজ আর ভেরি স্টাবর্ন, ভেরি স্টাবর্ন! হঠাৎ এই আক্রোশ কেন? ফেলুদা হালকা হেসে ইংরিজিতে প্রশ্ন করল। ভদ্রলোক বললেন, আই অফার্‌ড হিম টোয়েন্টি ফাইভ থাউজ্যাণ্ড, অ্যান্ড হি স্টিল সেড নো! পঁচিশ হাজারের লোভ সামলাতে পারে এমন লোক তা হলে আছে বিশ্বসংসারে? আরে মশাই, ভদ্রলোক যে পুথি সংগ্রহ করেন সেটা আগে জানতাম। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে গেলাম। বললাম তোমার সবচেয়ে ভালুয়েবল পিস কী আছে সেটা দেখাও। তৎক্ষণাৎ আলমারি খুলে দেখালেন—দ্বাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত পুঁথি। অসাধারণ জিনিস। চোরাই মাল কি না জানি না। আমার তো মনে হয়। গত বছর ভাতগাঁওয়ের প্যালেস মিউজিয়াম থেকে তিনটে পুঁথি চুরি গিয়েছিল, এটা তারই একটা। দুটো উদ্ধার হয়েছিল, একটা হয়নি। আর সেটাও ছিল প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি। হায়ার ইজ ভাতগাঁও? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু। জায়গাটার নাম আমিও শুনিনি। কাঠমাণ্ডু থেকে দশ কিলোমিটার। প্রাচীন শহর, আগে নাম ছিল ভক্তপুর। কিন্তু চোরাই মাল কি কেউ চট করে দেখায়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল—আর আমি যতদূর জানি প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি একটা নয়, বিস্তর আছে। আই নো, আই নো, অসহিষ্ণুভাবে বললেন মিঃ হিঙ্গোরানি। উনি বললেন এটা দালাই লামার সঙ্গে এসেছিল, উনি নাকি ধরমশালা গিয়ে কিনে এনেছিলেন। কত দিয়ে কিনেছিলেন জানেন? পাঁচশো টাকা। আর আমি দিচ্ছি পঁচিশ হাজার—ভেবে দেখুন! তার মানে কি বলছেন। পুরী আসাটা আপনার পক্ষে ব্যর্থ হল। ওয়েল, আই ডোন্ট গিভ আপ সো ইজিলি। মহেশ হিঙ্গোরানিকে তো চেনেন না মিস্টার সেন! ওঁর আরেকটা ভাল পুঁথি আছে, ফিফটিনথ সেনচুরি। আমাকে দেখালেন। আরও দুটো দিন সময় আছে হাতে। দেখা যাক ক’দিন ওর গোঁ টেকে। ভদ্রলোক সংক্ষেপে গুডিনাইট জানিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন হোটেলের দিকে। একটু সাসপিশাস্‌ লাগছে না? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। ফেলুদা বলল, কার বা কীসের কথা বলছেন সেটা না জানলে বলা সম্ভব নয়। পাঁচশো টাকা দিয়ে কেনা জিনিস পঁচিশ হাজায়ে ছাড়ছে না? কেন, মানুষ নির্লোভ হতে পারে এটা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? সিধুজ্যাঠা দুর্গাগতিবাবুকে পুঁথি বিক্রি করতে রিফিউজ করেছেন সেটা আপনি জানেন? কই, সেটা তো মিঃ সেন বললেন না। সেটা তো আমার কাছে আরও স্যাসপিশাস। ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র এক বছর আগে। আমার মনে হল দুর্গাগতিবাবু শুধু পিকিউলিয়ার নন, বেশ রহস্যজনক চরিত্র। আর বিলাসবাবু যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়… সাসিপিশন কিন্তু একজনের উপর পড়ে নেই বলল ফেলুদা, নিউক্লিয়ার ফল-আউটের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কাকে বাদ দেবেন বলুন। আপনার গণৎকার যে তৃতীয়-চক্ষু-সম্পন্ন সরীসৃপের কথা বললেন, সেটার নাম টারটুয়া নয়, টুয়াটারা। আর তার বাসস্থান নিউ গিনি নয়, নিউজিল্যান্ড। এ ধরনের ভুল জটায়ুর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য যদি তাঁর জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে লোককে ইমপ্রেস করতে চান, তা হলে তাঁকে আরও অ্যাকুরেট হতে হবে। তারপর ধরুন নিশীথবাবু। আড়িপাতার অভ্যাস আছে ভদ্রলোকের; সেটা মোটেই ভাল নয়। তারপর দুর্গাগতিবাবু বললেন ওঁর গাউট হয়েছে কিন্তু ওঁর টেবিলের ওষুধগুলো গাউটের নয়। তবে কীসের? একটা ওষুধ তো সবে গত বছর বেরিয়েছে, টাইম ম্যাগাজিনে পড়ছিলাম ওটার কথা। কীসের ওষুধ ঠিক মনে পড়ছে না, কিন্তু গাউটের নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, ভদ্রলোককে এত অন্যমনস্ক কেন মনে হয় বলে তো? আর তা ছাড়া বললেন, ওঁর ছেলেকে চেনেন না… সেটারও তো কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না। লালমোহনবাবু বললেন, ধরুন যদি উনি সত্যিই বিলাস মজুমদারকে খুব করার চেষ্টা করে থাকেন, তা হলে সেটাই একটা অন্যমনস্কতার কারণ হতে পারে। এখানে অবিশ্যি অন্যমনস্কতা ইজ ইকুয়াল টু নার্ভাসনেস। এখানে আমাদের কথা থেমে গেল। শুধু কথা না, হাঁটাও। বালির উপরে জুতোর ছাপ, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বা পাশে লাঠির ছাপ। ছাপটা হয়েছে গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে বিলাসবাবু লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে সোজা হোটেলে ফিরে গিয়ে স্নান-টান সেরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এর মধ্যে আর নীচে আসেননি। তা হলে এ ছাপ কার? আর কে বাঁ হাতে লাঠি নিয়ে হেঁটে বেড়ায় পুরীর বিচে? পরদিন সকালে আমরা চা খেয়ে বেরোব বেরোবি ভাবছি, এমন সময় লালমোহনবাবুর গাড়ি চলে এল। ড্রাইভার হরিপদবাবু বললেন যে যদিও সকাল সকাল রওনা হয়েছিলেন, বাল্যাসোরের ৩০ কিলোমিটার আগে নাকি প্রচণ্ড বৃষ্টি নামে, ফলে ওঁকে ঘণ্টা চারেক বাল্যাসোরেই থাকতে হয়েছিল। গাড়ি নাকি দিব্যি এসেছে, কোনও ট্রাবল দেয়নি। হরিপদবাবুর জন্য আমাদের হোটেলের কাছেই নিউ হোটেলে একটা ঘর বুক করে রাখা হয়েছিল, কারণ নীলাচলে জায়গা ছিল না। গাড়িটা নীলাচলে রেখে ভদ্রলোক চলে গেলেন নিজের হোটেলে। আমরা বলে দিলাম দিন ভাল থাকলে দুপুরের দিকে ভুবনেশ্বরটা সেরে আসতে পারি। একটার মধ্যে মন্দির-টন্দির সব দেখে ঘুরে আসা যায়। ফেলুদা বলেই রেখেছিল। সকালে একবার স্টেশনে যাবে। ওর আবার স্টেটসম্যান না পড়লে চলে না, হোটেলে দেয় শুধু বাংলা কাগজ। হাঁটা পথে হোটেল থেকে স্টেশনে যেতে লাগে আধা ঘণ্টা। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন পৌনে নটা। কলকাতা থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেস এসে গেছে সাতটায়; পুরী এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা লেট, এই এল বলে। কোথাও যাবার না থাকলেও স্টেশনে আসতে দারুণ লাগে। বিশেষ করে কোনও বড় ট্রেন আসামাত্র ঠাণ্ডা স্টেশন কী রকম টগবগিয়ে ফুটে ওঠে, সে জিনিস
false
humayun_ahmed
আদে সাহেব কেমন আছেন? জি ভালো। আজ কি একা এসেছেন? না। দুলাভাই সঙ্গে এসেছেন, তিনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। আপনাকে তো বলেছি, একা আসার অভ্যাস করুন। দুলাভাই আমাকে একা ছাড়তে চান না। যেখানেই যাই, তিনি সঙ্গে আপনার ছবি আঁকা কেমন চলছে? ভালো চলছে। শেষ কী ছবি এঁকেছেন? ছবি আঁকা এখনো শুরু করিনি। রঙ মেশানো শিখছি। একটা উপন্যাস শুরু করবেন বলেছিলেন। শুরু করেছেন? জি। মাত্র দুই লাইন লিখেছি। উপন্যাসের নাম কী দিয়েছেন? ঝিঁঝি। সুন্দর নাম। ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে? জি। অদ্ভুত কিছু কি দেখেছেন বা কোন কি রিসেন্টলি হয়েছে? জি না। তেমন কিছু হয়নি। ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি? সামান্য ভয় পেয়েছি। কী দেখে ভয় পেয়েছেন? কিছু দেখে ভয় পাইনি, শব্দ শুনে ভয় পেয়েছি। ফোঁসফোসানি শব্দ। কে ফোঁসফোঁস করছিল? একটা সাপ। কাবার্ডের ভেতর থেকে ফোঁসফোঁস করছিল। কাবার্ডে সাপ গেল কিভাবে? আমি রেখেছি। আপনি কাবার্ডে সাপ রেখেছেন? না, আমি রাখিনি। আমি একটা বাঁকানো বেতের লাঠি রেখেছিলাম। খাড়া করে রাখা ছিল। মনে হয় কোনো কারণে লাঠিটা পড়ে গিয়েছে। এই লাঠির বিশেষত্ব হচ্ছে, শোয়ানো অবস্থায় এটা সাপ হয়ে যায়। লাঠিটা আপনাকে কে দিয়েছে? গোলাম মওলা আংকেল দিয়েছেন। দিতে চাননি, আমি জোর করে নিয়েছি। এমন একটা ভয়ঙ্কর জিনিস জোর করে কেন নিলেন? ভয়ঙ্কর বলেই নিয়েছি। মানুষ সুন্দর যেমন ভালোবাসে, ভয়ঙ্করও ভালোবাসে। রু আদে সাহেব? জি বলুন। আপনি খুবই স্বাভাবিক একজন মানুষ। বুদ্ধিমান, ক্রিয়েটিভ। আপনার কবিতার বইয়ের সবকটা কবিতা আমি পড়েছি। বিশেষ করে অন্ধ উইপোকা কবিতাটা। আমি প্রচুর কবিতা পড়ি। ভালো কবিতা এবং মন্দ কবিতার তফাৎ ধরতে পারি। ধন্যবাদ। আপনার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ কি আপনার আঁকা? জি না। আমি বিশ্বাস করি, আপনি ছবিও আঁকবেন। নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ নিজে করবেন। ধন্যবাদ। এখন যে প্রচ্ছদ আঁকা আছে সেখানে ছোট্ট সমস্যা হয়েছে। কি সমস্যা বলুন তো? প্রচ্ছদে একটা পাখি আঁকা ছিল। পাখিটা সাইকেলের চাকায় বসা ছিল। এখন দেখি পাখিটা বসে আছে চায়ের কাপে। চা খাচ্ছে? খেতে চাচ্ছে। চা অতিরিক্ত গরম বলে খেতে পারছে না। রেণুবালা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার একটাই সমস্যা, আপনার বাস্তব জগতের পাশাপাশি একটি অবাস্তব জগৎও আছে। অবাস্তব জগৎটাও আপনার কাছে বাস্তব। কেন? চট করে এই কেনর জবাব দেওয়া যাবে না। ব্রেইনের নিওরোল কানেকশনে শর্টসার্কিট হলে এ রকম হয়। অনেকে ড্রাগ খেয়ে এই শর্টসার্কিট নিজেরা করে। সাইকাডেলিক ড্রাগ যেমন , ধুতরা। এদের কম্পেজিন এবং -এর মতো। এ দুটি কেমিক্যাল হলো নিউরোট্রান্সমিটার। ঘাগ নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যক্রম বদলে দেয় বলে ঘটনা ঘটে। আমি তো কোনো ড্রাগ থাই মা। জানি। কারো কারো ক্ষেত্রে ড্রাগ ছাড়াই এ রকম ঘটে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, কালজয়ী ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়োভস্কি। তার প্রায়ই সিজারের মতো হতো। ঘোর কেটে গেলে তিনি বলতেন, ঈশ্বর কী, মানুষ কী, জগতের সঙ্গে ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্ক কী, তা তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও জেনেছেন। ও আচ্ছা। রু আদে সাহেব, আপনি কি কফি খাবেন? আমার এখানে খুব ভালো কফি বানানো হয়। কফি খাব না। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এখন আবার বলছি–আপনাকেই আপনার চিকিৎসা করতে হবে। কিভাবে? কোনটা বাস্তব, কোনটা অবাস্তব এটা চিন্তা করে বের করতে হবে। আপনি কি কখনো দেখেছেন, কোনো লাঠি মেঝেতে পড়ে গেলে সাপ হয়ে যায়? না, দেখিনি। তবে হজরত মুসা আলায়েস সালামের লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হয়ে যেত। আপনার লাঠি কি সেই লাঠি? না। আপনি এক কাজ করবেন। আজ বাসায় গিয়েই লাঠিটা বের করে মেঝেতে ফেলবেন। ফেলার পর কী দেখবেন বলুন তো? দেখব লাঠি সাপ হয়নি। লাঠি লাঠিই আছে। আমার ধারণা, আপনি দেখবেন লাঠিটা সাপ হয়ে গেছে। আপনার ব্রেইন সে রকম সিগন্যাল দেবে। আপনি তখন আপনার সঙ্গে অন্য কাউকে রাখবেন। সে কিন্তু লাঠি দেখবে, সাপ দেখবে না। তখন তার কথা বিশ্বাস করবেন। এ কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে। আজ কি উঠব? হ্যাঁ, আজ বিদায়। আর দয়া করে যার লাঠি তাকে ফেরত দিয়ে বাড়ি থেকে ঝামেলা বিদায় করুন। আচ্ছা। আপনার এখানে যখনই আসি তখনই একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। যাওয়ার সময় মনে থাকে না। আজ কি মনে আছে? আছে। তাহলে জিজ্ঞেস করুন। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। তারপরেও জিজ্ঞেস করুন। প্রশ্ন চাপা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো কোনো কাজের কথা না। স্বামী বিবেকানন্দের পাশের ছবিটা কার? রামকৃষ্ণ পরমহংসের। তাঁকে বলা হয় কলির অবতার। আমি উনার পরমভক্ত। ও আচ্ছা। উনিও কিন্তু স্কিজিওফ্রেনিক ছিলেন। ভক্তরা বলত, প্রায়ই তাঁর ভাব সমাধি হতো। আসলে যেটা হতো তা হলো . ও আচ্ছা। রামকৃষ্ণ সুন্দর সুন্দর কথা বলে গেছেন। আমার কাছে একটা বই আছে, নাম রামকৃষ্ণ কথামালা। বইটা কি পড়বেন? দেব আপনাকে? না। রুস্তম দুলাভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে ফিরছে। তাদের গাড়ি পেছনে পেছনে আসছে। গাড়িতে চড়লেই রুস্তমের দম বন্ধ হয়ে আসে বলে এই ব্যবস্থা। রুস্তম বলল, দুলাভাই! এবারে মায়ের মৃত্যুদিবসে আপনি কি ফকির খাইয়েছিলেন? অবশ্যই। পাঁচজন ফকির খাইয়েছি। এতিমখানায় এক বেলা খাবার দিয়েছি। শুধু মিলাদ পড়ানো হয় নাই। কেন বলো তো? বুবুর ধারণা, আপনি এইবার কিছু করেননি। তার এ রকম ধারণা হলো কেন? বুবু ভেবেছে, আপনি এসব করতেন শুধু বুবুকে খুশি করার জন্য। খুবই ভুল ধারণা। আমার শাশুড়ি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ফেরেশতা পর্যায়ে অতি
false
tarashonkor
পাব। বেহালাদার বলিল—তুমি বিবাগী হবে ওস্তাদ? নিতাই ও প্রশ্নের জবাবে তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। তাই তো। বসন্তের সঙ্গে যে গাটছড়া ও গিঁট সে বাঁধিয়াছিল, সে গিঁট খুলিয়া গিয়াছে। বসন্ত আজ তাহাকে মুক্তি দিয়াছে। এবার একটা নতুন ডাক যেন সে শুনিয়াছে। পথে পথে চলো মুসাকের। বেহালাদারের প্রশ্নে তাহার মনে অকস্মাৎ সুরটি বাজিয়া উঠিল।—বিবাগী? বৈরাগ্যই তাহার ভাল লাগিল। টা পথ ধরিল। কাটোয়া হইতে ছোট লাইন ধরিয়া ইহারা চলিল মল্লারপুরের দিকে। নিতাই বড় লাইন ধরিয়া উত্তর মুখে চলিল। শেষ মুহূর্তে ঠিক করিয়া ফেলিল সে কাশী যাইবে। নির্মলা অনেকখানি কাঁদিল। মেয়েটা তাহকে দাদা বলিত। দাদা বলিয়া নিতাইয়ের জন্য কাঁদিতে তাহার সঙ্কোচের কোন কারণ ছিল না। শেষ মুহূর্তে ললিতাও কাঁদিল। বলিল—জামাই, সত্যিই ছাড়লে! প্রৌঢ়া বর্তমানের আশা ছাড়িয়াও কিন্তু ভবিষ্যতের আশা ছাড়ে নাই। সে বলিল—চিরকাল তো মামুষের মন বিবাগী হয়ে থাকে না বাবা। মন একদিন ফিরবে, আবার চোখে রঙ ধরবে। ফিরেও আসবে। তখন যেন মাসীকে ভুলো না। আমার দলেই এসো। বেহালাদার স্নান হাসি হাসিয়া বলিল—আচ্ছা। মহিষের মত লোকটাও কথা বলিল—চললে? তা— খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল—সন্নাসী হওয়ার কষ্ট অনেক হে। ভিখ্‌ করে পেট ভরে না—তা নইলে—বেশ, এস তা হ’লে। তাহারা যাইবে ছোট লাইনের ট্রেনে—যে লাইনের উপর নিতাইয়ের নিজের বাড়ী। ওই লাইনের ট্রেনেই নিতাই আসিয়াছিল—গ্রাম ছাড়িয়া। সেই ছোট গাড়ীতেই চড়িয়া মাসী বলিল—এস বাবা, এই গাড়ীতেই চড়। এই নাইনেই তো বাড়ী ৷ মন খারাপ হয়েছে—বাড়ী ফিরে চল বাবা। বাড়ী! নিতাই চমকিয়া উঠিল। বাড়ী! স্টেশন! সেই কৃষ্ণচূড়ার গাছ! সেই রেল লাইনের বাঁক! সেই স্বর্ণশীর্ষবিন্দু কাশফুল! সোনার বরণ ঝকঝকে ঘটি মাথায় ক্ষার-ধোওয়া মোট খাটো কাপড় পরা অতি কোমল কালো মেয়েটি! সেই তাহার ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝি। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িয়া গেল সেই কতকালের পুরানো গান— “কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কঁদি কেনে? কালো চুলে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?” নিতাইয়ের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। অদ্ভুত হাসি। কত কথা মনে পড়িতেছে, কত কথা—কত পুরানো গান! তবুও নিতাই বার বার ঘাড় নাড়িয়া নীরবেই জানাইল—না। না। না। না। তাহার মনের মধ্যে সেই গানের কলি গুঞ্জন করিতেছিল—“চাঁদ তুমি আকাশে থাক।” মনে ঘুরিতেছিল—“তাই চলেছি দেশান্তরে—”—সে আবার একবার ঘাড় নাড়িয়া জানাইল— না। ঠাকুরঝি এতদিনে ভাল হইয়াছে, ঘরসংসার করিতেছে। সে গিয়া আর নূতন অশান্তির সৃষ্টি করিবে না। না। না সে যাইবে না। সে যাইবে না। নিতাই নীরবেই বিদায় লইল। এই বিদায় তাহার শোকাচ্ছন্ন মনকে আরও উদাস করিয়া তুলিল। দলের প্রত্যেক জনটির মুখ তাহার চোখের সম্মুখে ক্ষণে ক্ষণে জাগিয়া উঠিতেছিল— বিদায়-ব্যথা-কাতর ম্লান মুখ। কাহারও সহিত কোনদিন তাহার ঝগড়া হয় নাই কিন্তু তাহারা যে এত ভাল—এ কথা আজিকার দিনের এই মুহূর্তটির আগে কোনদিন কোন একটিবারের জন্যও মনে হয় নাই। বরং সে সময় তাহদের দোষগুলাই অনেক বড় হইয়া তাহার চোথে পড়িয়াছে। মাসীকে দেখিয়া মনে হইত মুখে মিষ্টি কথা বলিলেও সমস্ত অন্তরটা বিষে ভরা, মিথ্যা ছাড়া সত্য বলিতে জানে না। পৃথিবীতে খাদ্য এবং অর্থ ছাড়া আর কিছুকে ভালবাসে না মাসী। আজ মনে হইল—না, না, মাসী—মাসীরই মত, ময়েরই মত ভালবাসিত তাহাকে। তাহার চোখের ওই কয় ফোঁটা জল বসন্তের মরণকালের ভগবানের নামের মতই সত্য। নির্মলা চিরদিন ভাল। মায়ের পেটের বোনের মতই ভাল। ললিতার চোখা চোখা ঠাট্টাগুলি—শ্যালিকার মুখের ঠাট্টার মতই মিষ্ট ছিল। বেহালাদারের কথা মনে করিয়া তাহার চোখে জল আসিল। কানের কাছে বাজিয়া উঠিল সেই সুর। সেই সুরটাই ভাঁজিতে ভাঁজিতে সে ফিরিয়া বসিল গঙ্গার ঘাটে। গঙ্গায় স্নান করিয়া সে মনে মনে একখানি গঙ্গা স্তব রচনা করিবার চেষ্টা করিল ৷ হইল না। ঘাটের উপরেই একটা গাছের তলায় আসিয়া সে বসিল। কিন্তু কোথায় সে যাইবে? পথে পথে ভিক্ষা করিয়া ফিরিবে বাউল দরবেশের মত? না। এ কল্পনা তাহার ভাল লাগিল না। তবে? কি বা করিবে— কোথায়ই বা যাইবে? হঠাৎ তাহার মনে হইল—হায় হায় হায়, হায় রে পোড়া মন! এই কথা কি ভাবিতে হয়? ঠাকুর, ঠাকুরের কাছেই যাইবে সে! গোবিন্দ। বিশ্বনাথ! প্রভু, প্রভুর কাছে যাইবে সে! মায়ের কাছে যাইবে! মা অন্নপূর্ণা। রাধারাণী রাধারাণী রাধারাণী! সে সেই সব দেবতার দরবারে বসিয়া গান গাহিবে—মহিমা কীর্তন করিবে—ভগবানকে গান শুনাইবে—শ্লোতারা শুনিয়া চোখের জল ফেলিবে—সঙ্গে সঙ্গে তাহাকেও কিছু কিছু দিয়া যাইবে—তাহাতেই তাহার দিন গুজরান হইবে। তাহার ভাবনা কি? হায় রে পোড়া মন—এতক্ষণ তুমি এই কথাটাই ভাবিয়া পাইতেছিলে না? এখান হইতে কাশী, বাবা বিশ্বনাথ—মা অন্নপূর্ণা। কাশী হইতে অযোধ্যা, সীতারাম–সীতারাম! সীতারামের রাজ্য হইতে রাধাগোবিন্দ, রাধরাণী—রাধারাণীর রাজ্য বৃন্দাবন। তারপর মথুরা—না, না, মথুরা সে যাইবে না। রাধারাণীকে কাঁদাইয়া রাজ্যলোভী শ্যাম রাজা হইয়াছে সেখানে, সে রাজ্যে নিতাই যাইবে না। মধুরা হইতে বরং কুরুক্ষেত্র–হরিদ্বার। হরিদ্বারের পরেই হিমালয়—পাহাড় আর পাহাড়। ছেলেবেলায় পড়া ভূগোল মনে পড়িল— পৃথিবীর মধ্যে এত উচু পাহাড় আর নাই—হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গৌরীশঙ্কর। হিমালয়ের মধ্যেই মানস-সরোবর। সেখান পর্যন্তও নাকি মানুষ যায়। নিতাই মানস-সরোবরে স্নান করিবে। তারপর জনশূন্য হিমালয়ের কোখাও একটা আশ্রয় বানাইয়া সেইখানেই থাকিয়া যাইবে। নিত্য নূতন গান রচনা করিবে—গাহিবে, পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া খুদিয়া লিথিয় রাখিবে। সে মরিয়া যাইবে—তাহার পর যাহার সে-পথ দিয়া যাইবে তাহারা সে গান পড়িবে আর মনে মনে নিতাই-কবিকে নমস্কার করিবে। শেষ বৈশাখের দ্বিপ্রহর। আগুনের মত তপ্ত ঝড়োহাওয়া গঙ্গার বালি উড়াইয়া হু হু করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। দুই পায়ের শস্যহীন চরভূমি ধূসরবর্ণ-যেন ধুধু
false
shottojit_roy
পায়চারি শুরু করে আপন মনেই বলে উঠল, ঠিক এই রকম একটা কম্পার্টমেন্টেই ছিলেন ওঁরা চারজন… কখন যে কোন জিনিসটা ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সেটা বলা শক্ত। অনেক সময় কেন যে করে সেটা বলা আরও শক্ত। যেমন জলের গেলাসগুলো। কামরার দেয়ালে জানালা ও দরজার দুদিকে আংটা লাগানো আছে, আর তার মধ্যে বসানো আছে চারটে জলের গেলাস। ফেলুদা একদৃষ্টে চেয়ে আছে তারই একটা গেলাসের দিকে। ট্ৰেনে উঠলে আপনার ঘুম হয়, না হয় না? হঠাৎ ফেলুদা প্রশ্ন করুল জটায়ুকে। জটায়ু একটা জলহস্তীর মতো বিশাল হাই তুলতে গিয়ে মাঝপথে থেমে হেসে বললেন, ঝাঁকুনিটা মন্দ লাগে না। ফেলুদা বলল, জানি। কিন্তু সকলের পক্ষেই এই ঝাঁকুনিটা ঘুমপাড়ানির কাজ করে না। আমার এক মেসোমশাই সারারাত জেগে বসে থাকতেন। ট্রেনে। অথচ বাড়িতে খেয়েদেয়ে বালিশে মাথা দিলেই অঘোর নিদ্ৰা। হঠাৎ দেখি ফেলুদা এক লাফে বাঙ্কে উঠে গেছে। উঠেই প্রথমে রিডিং লাইটটা জ্বালল। তারপর সেটার সামনে এলেরি কুইনের বইটা (যেটা দিল্লি স্টেশন থেকে ধমীজার বাক্সে রাখার জন্য কিনতে হয়েছে) খুলে ধরে কিছুক্ষণ পাতা উলটে দেখল। তারপর কিছুক্ষণ একেবারে চুপ৷ করে শবাসনের ভঙ্গিতে শুয়ে সিলিংয়ের আলোর দিকে চেয়ে রইল। ট্রেন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে, বাইরে মাঝে মাঝে দু-একটা বাতি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, তিনি যে অস্ত্রটার কথা বলেছিলেন সেটা কখন আমাদের দেখাবেন, এমন সময় ভদ্রলোক বললেন, একটা ভুল হয়ে গেছে। ডাইনিং কারের লোকটাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে ওদের কাছে সুপুরি আছে কি না। না থাকলে কোনও স্টেশন থেকে কিনে নিতে হবে। ধমীজার কীটোর মাল মাত্র একটিতে এসে ঠেকেছে। লালমোহনবাবু পকেট থেকে কোডাকের কোটোটা বার করে ঢাকনা খুলে হাতের উপর কাত করলেন। কিন্তু তা থেকে সুপুরি বেরোল না। আচ্ছা আপদ তো! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভেতরে রয়েছে, অথচ বেরোচ্ছে না। এবার লালমোহনবাবু কৌটোটা হাতের তেলোর উপর ঝাঁকাতে শুরু করলেন, আর প্রত্যেক ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে একটা করে শালা বলতে লাগলেন। কিন্তু তাও সুপুরি বেরোল না। দিন তো মশাই! কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা এক লাফে বাঙ্ক থেকে নেমে এক ছোবলে লালমোহনবাবুর হাত থেকে হুলদে কৌটোটা ছিনিয়ে নিলা জটায়ু এই আচমকা আক্রমণে থ। ফেলুদা নিজে কৌটোটাকে একবার ঝাঁকিয়ে কোনও ফল হল না দেখে তার ডান হাতের কড়ে আঙুলটা কোটার ভিতরে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই একটা খচ শব্দ করে সুপুরিটা আলগা হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। এবার ফেলুদা কোটার মুখে নাক লাগিয়ে বলল—কীটের তলায় আঠা লাগানো ছিল। সম্ভবত অ্যারালডাইট। বাইরে করিডরে পায়ের আওয়াজ। তাপসে, শাট দ্য ডোর! আমি দরজাটা এক পাশে ঠেলে বন্ধ করার সময় এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম আমাদের দরজার সামনে দিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। যন্তর মন্তরের সেই কালো চশমা পরা আর কানে তুলো গোঁজা বুড়ো। স স স স… ফেলুদার মুখ দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ বেরোল। সে সুপুরিটা হাতের তেলোয় নিয়ে একদৃষ্টে সেটার দিকে চেয়ে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম ফেলুদার দিকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা আসলে সুপুরি নয়। একটা অন্য কিছুর গায়ে ব্ৰাউন রং লাগিয়ে তাকে কতকটা সুপুরির মতো দেখতে করা হয়েছে। বাঝা উচিত ছিল রে তোপসে! ফেলুদা চাপা গলায় বলে উঠল। আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। আই হ্যাঁভ বিন এ ফুল! এবার ফেলুদা তার হাতের কাছের জলের গেলাসটা আংটা থেকে বার করে নিয়ে তার মধ্যে সুপুরিটাকে ডুবিয়ে আঙুল দিয়ে ঘষতে লাগল। দেখতে দেখতে জলের রং খয়েরি হয়ে গেল। ধোয়া শেষ হলে পর জিনিসটাকে জল থেকে তুলে রুমাল দিয়ে মুছে ফেলুদা সেটাকে আবার হাতের উপর রাখল। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, যেটাকে সুপুরি বলে মনে হচ্ছিল সেটা আসলে একটা নিখুঁতভাবে পলকাটা ঝলমলে পাথর। চলন্ত ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সেটা ফেলুদার ডান হাতের উপর এপাশ ওপাশ করছে, আর তার ফলে কামরার এই আধা আলোতেই তার থেকে যা ঝালকানি বেরোচ্ছে, তাতে মনে হয় বুঝি হিরে। আর সত্যিই যদি তাই হয়, তা হলে বলব এত বড় হিরে আমি জীবনে কখনও দেখিনি, আর লালমোহনবাবুও দেখেননি, আর ফেলুদাও দেখেছে কি না সন্দেহ। এ-এটা কি ডা-ডাই-ডাই… লালমোহনবাবুর মাথাটা যে গণ্ডগোল হয়ে গেছে সেটা তাঁর কথা বলার ঢং থেকেই বুঝতে পারলাম। ফেলুদা পাথরটা হাতের মুঠোয় নিয়ে এক লাফে উঠে গিয়ে দরজাটা লক করে দিয়ে আবার জায়গায় ফিরে এসে চাপা গলায় বলল, এমনিতেই তো মৃত্যুভয় দেখাচ্ছে আপনি আবার তার মধ্যে ডাই ডাই করছেন? না—মানে– যে রেটে এই বাক্সের পিছনে লোক লেগেছে, তাতে হিরে হওয়া কিছুই আশ্চর্য না। তবে আমি তো আর জহুরি নই। তা হলে এর ভ্যা-ভ্যা— হিরের ভ্যালু সম্বন্ধে আমার খুব পরিষ্কার জ্ঞান নেই। ক্যারেটের একটা আন্দাজ আছে— কোহিনুরের ছবি অ্যাকচুয়েল সাইজে দেখেছি। আন্দাজে মনে হয় এটা পঞ্চাশ ক্যারেটের কাছাকাছি হবে। দাম লাখ-টাখ ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে যাবার কথা। ফেলুদা এখনও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাথরটাকে দেখছে। আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ধমীজার কাছে এ জিনিস গেল কী করে? ফেলুদা বলল, লোকটা আপেলের চাষ করে, আর ট্রেনে ডিটেকটিভ বই পড়ে-এ ছাড়া যখন আর বিশেষ কিছুই জানা যায়নি, তখন প্রশ্নটার জবাব আর কী করে দিই বল। এতক্ষণে লালমোহনবাবু মোটামুটি গুছিয়ে কথা বলতে পারলেন—তা হলে এই পাথর কি সেই ধমীজার কাছেই ফেরত চলে যাবে? যদি মনে হয় এটা তারই পাথর,
false
robindronath
দেখিয়া ভাবিলেন লোকটা নিতান্ত নির্জীব, একেবারে কোনো তেজ নাই। বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক্‌, তেজ থাকাটা দোষের, অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন। শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না। পণ সম্বন্ধে দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই অভিমান করিয়া থাকেন। কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁক রাখেন নাই। টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলই, তার পরে গহনা কত ভরির এবং সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল। আমি নিজে এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না; জানিতাম না, দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম, এই স্থূল অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, এবং সে অংশের ভার যাঁর উপরে তিনি এক কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্রী। যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতিবেন, এ একেবারে ধরা কথা। এইজন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের সংসারের এই জেদ— ইহাতে যে বাঁচুক আর যে মরুক। গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদমসুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে, সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তর হাসিলেন। ব্যাণ্ড, বাঁশি, শখের কন্সর্ট্ প্রভৃতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্তহস্তী দ্বারা সংগীতসরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া উঠিলাম। আংটিতে হারেতে জরি-জহরাতে আমার শরীর যেন গহনার দোকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম। মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহার পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠাণ্ডা। তাঁর বিনয়টা অজস্র নয়। মুখে তো কথাই নাই। কোমরে চাদর বাঁধা, গলাভাঙা, টাকপড়া, মিসকালো এবং বিপুলশরীর তাঁর একটি উকিলবন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া, নম্রতার স্মিতহাস্যে ও গদ্‌গদ বচনে কন্সর্ট্ পার্টির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই একটা এস্‌পার-ওসপার হইত। আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।” ব্যাপারখানা এই।– সকলের না হউক, কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয়, তাঁর বেহাই তাঁকে গহনায় ফাঁকি দিতে পারেন— বিবাহকার্য শেষ হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া, সওগাদ, লোকবিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন, দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য বাড়ির স্যাক্‌রাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং স্যাক্‌রা তাহার দাঁড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে। শম্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন, “তোমার মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন, ইহাতে তুমি কী বল।” আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। মামা বলিলেন, “ও আবার কী বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।” শম্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই? ” আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এ-সব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার। “আচ্ছা তবে বোসো, মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।” শম্ভুনাথ বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।” কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই তাঁহার পিতামহীদের আমলের গহনা— হাল ফ্যাশানের সূক্ষ্ম কাজ নয়— যেমন মোটা, তেমনি ভারী। স্যাক্‌রা গহনা হাতে তুলিয়া লইয়া বলিল, “এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাই— এমন সোনা এখনকার দিনে ব্যবহারই হয় না।” এই বলিয়া সে মকরমুখা মোটা একখানা বালায় একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়। মামা তখনি তাঁর নোটবইয়ে গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায় দরে এবং ভারে তার অনেক বেশি। গহনাগুলির মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে স্যাক্‌রার হাতে দিয়া বলিলেন, “এইটে একবার পরখ করিয়া দেখো।” স্যাক্‌রা কহিল, “ইহা বিলাতি মাল, ইহাতে সোনার ভাগ সামান্যই আছে।” শম্ভুবাবু এয়ারিংজোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন, “এটা আপনারাই রাখিয়া দিন।” মামা সেটা হাতে লইয়া দেখিলেন, এই এয়ারিং দিয়াই কন্যাকে তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। মামার মুখ লাল হইয়া উঠিল। দরিদ্র তাঁহাকে ঠকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরেও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল। অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন, “অনুপম, যাও তুমি সভায় গিয়া বোসো গে।” শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “না, এখন সভায় বসিতে হইবে না। চলুন, আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।”
false
shorotchandra
বার মুখ বাহির করিয়া একবার সম্মুখে একবার পশ্চাতে অন্ধকারের মধ্যে কি যে দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল তাহা সে-ই জানে, কিন্তু এ কথা তাহার মন কিছুতেই স্বীকার করিতে চাহিল না যে, এ গাড়িতে তাহার স্বামী নাই—সে একেবারে অনন্যনির্ভর, একান্ত ও একাকী সুরেশের সহিত কোন এক দিগ্বিহীন নিরুদ্দেশ-যাত্রার পথে বাহির হইয়াছে। এমন হইতে পারে না! এই গাড়িতেই তিনি কোথাও না কোথাও আছেনই আছেন। সুরেশ যাই হোক, এবং সে যাই করুক, একজন নিরপরাধা রমণীকে তাহার সমাজ হইতে, ধর্ম হইতে, নারীর সমস্ত গৌরব হইতে ভুলাইয়া এই অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যে ঠেলিয়া দিবে, এতবড় উন্মাদ সে নয়। বিশেষতঃ ইহাতে তাহার লাভ কি? অচলার যে দেহটার প্রতি তাহার এত লোভ সেই দেহটাকে একটা গণিকার দেহে পরিণত দেখিতে অচলা যে বাঁচিয়া থাকিবে না, এ সোজা কথাটুকু যদি সে না বুঝিয়া থাকে ত ভালবাসার কথা মুখে আনিয়াছিল কোন্‌ মুখে? না না, ইহা হইতেই পারে না! ইঞ্জিনের দিকে কোথাও তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়াছেন, সে দেখিতে পায় নাই। সহসা একটা প্রবল ঝাপটা তাহার চোখে-মুখে আসিয়া পড়িতেই সে সঙ্কুচিত হইয়া কোণের দিকে সরিয়া আসিল এবং ততক্ষণে নিজের প্রতি চাহিয়া দেখিল, সর্বাঙ্গে শুষ্ক বস্ত্র কোথাও আর এতটুকু অবশিষ্ট নাই। বৃষ্টির জলে এমন করিয়াই ভিজিয়াছে যে, অঞ্চল হইতে, জামার হাতা হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। এই শীতের রাতে সে না জানিয়া যাহা সহিয়াছিল, জানিয়া আর পারিল না এবং কিছু কিছু পরিবর্তন করিবার মানসে কম্পিতহস্তে ব্যাগটা টানিয়া লইয়া যখন চাবি খুলিবার আয়োজন করিতেছে, এমন সময় গাড়ির গতি অতি মন্দ হইয়া আসিল এবং অনতিবিলম্বে তাহা স্টেশনে আসিয়া থামিল। জল সমানে পড়িতেছে, কোন্‌ স্টেশন জানিবার উপায় নাই। তবুও ব্যাগ খোলাই পড়িয়া রহিল, সে ভিতরের অদম্য উদ্বেগের তাড়নায় একেবারে দ্বার খুলিয়া বাহিরে নামিয়া অন্ধকারে আন্দাজ করিয়া ভিজিতে ভিজিতে দ্রুতপদে সুরেশের জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। চিৎকার করিয়া ডাকিল, সুরেশবাবু! এই কামরায় জন-দুই বাঙালী ও একজন ইংরাজ ভদ্রলোক ছিলেন। সুরেশ একটা কোণে জড়সড়ভাবে দেওয়ালে ঠেস দিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়াছিল। অচলার বোধ করি ভয় ছিল, হয়ত তাহার গলা দিয়া সহজে শব্দ ফুটিবে না। তাই তাহার প্রবল উদ্যমের কণ্ঠস্বর ঠিক যেন আহত জন্তুর তীব্র আর্তনাদের মত শুধু সুরেশকেই নয়, উপস্থিত সকলকেই একেবারে চমকিত করিয়া দিল। অভিভূত সুরেশ চোখ মেলিয়া দেখিল, দ্বারে দাঁড়াইয়া অচলা; তাহার অনাবৃত মুখের উপর একই কালে অজস্র জলধারা এবং গাড়ির উজ্জ্বল আলোক পড়িয়া এমনিই একটা রূপের ইন্দ্রজাল রচনা করিয়াছে যে, সমস্ত লোকের মুগ্ধদৃষ্টি বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গিয়াছে। সে ছুটিয়া আসিয়া কাছে দাঁড়াইতেই অচলা প্রশ্ন করিল, তাঁকে দেখচি নে—কৈ তিনি? কোন্‌ গাড়িতে তাঁকে তুলেচ? চল দেখিয়ে দিচ্চি, বলিয়া সুরেশ বৃষ্টির মধ্যেই নামিয়া পড়িল এবং যেদিক হইতে অচলা আসিয়াছিল, সেইদিক পানেই তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়া গেল। বাঙালী দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিয়া একটু হাসিল। ইংরাজ কিছুই বুঝে নাই, কিন্তু নারী-কণ্ঠের আকুল প্রশ্ন তাহার মর্ম স্পর্শ করিয়াছিল; সে ভূলুণ্ঠিত কম্বলটা পায়ের উপর টানিয়া লইয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল এবং স্তব্ধমুখে বাহিরের অন্ধকারের প্রতি চাহিয়া রহিল। অচলার কামরার সম্মুখে আসিয়া সুরেশ থমকিয়া দাঁড়াইল, ভিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সভয়ে প্রশ্ন করিল, তোমার ব্যাগ খোলা কেন? এবং প্রত্যুত্তরের জন্য এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করিয়া দরজাটা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া অচলাকে বলপূর্বক আকর্ষণ করিয়া ভিতরে তুলিয়াই দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। সুরেশ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিল, এটা খুললে কে? অচলা কহিল, আমি। কিন্তু ও থাক—তিনি কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও—না হয়, শুধু বলে দাও কোন্‌ দিকে, আমি নিজে খুঁজে নিচ্ছি; বলিতে বলিতে সে দ্বারের দিকে পা বাড়াতেই সুরেশ তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, অত ব্যস্ত কেন? গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে দেখতে পাচ্চো? অচলা বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়াই বুঝিল, কথাটা সত্য। গাড়ি চলিতে শুরু করিয়াছে। তাহার দুই চক্ষে নিরাশা যেন মূর্তি ধরিয়া দেখা দিল। সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া সেই দৃষ্টি দিয়া শুধু পলকের জন্য সুরেশের একান্ত পাণ্ডুর শ্রীহীন মুখের প্রতি চাহিল এবং পরক্ষণেই ছিন্নমূল তরুর ন্যায় সশব্দে মেঝেয় লুটাইয়া পড়িয়া দুই বাহু দিয়া সুরেশের পা জড়াইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কোথায় তিনি? তাঁকে কি তুমি ঘুমন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েচ? রোগা মানুষকে খুন করে তোমার— এতবড় ভীষণ অভিযোগের শেষটা কিন্তু তখনও শেষ হইতে পাইল না। অকস্মাৎ তাহার বুক-ফাটা কান্না যেন শতধারে ফাটিয়া সুরেশকে একেবারে পাষাণ করিয়া দিয়া চতুর্দিকে ইহারই মত ভয়াবহ এক উন্মত্ত যামিনীর অভ্যন্তরে গিয়া বিলীন হইয়া গেল এবং সেইখানে, সেই গদি-আঁটা বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়া সুরেশ অসহ্য বিস্ময়ে শুধু স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তাহার পদতলে কি যে ঘটিতেছিল, কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাহা যেন উপলব্ধি করিতেই পারিল না। অনেকক্ষণ পরে সে পা-দুটা টানিয়া লইবার চেষ্টা করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, এ কাজ আমি পারি বলে তোমার বিশ্বাস হয়? অচলা তেমনি কাঁদিতে কাঁদিতে জবাব দিল, তুমি সব পারো। আমাদের ঘরে আগুন দিয়ে তুমি তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলে। তুমি কোথায় কি করেচ, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বল; বলিয়া সে আর একবার তাহার পা-দুটা ধরিয়া তাহারই পরে সজোরে মাথা কুটিতে লাগিল। কিন্তু পা-দুটা যাহার, সে কিন্তু একেবারে অবশ অচেতনের ন্যায় কেবল নিঃশব্দে চোখ মেলিয়া চাহিল। বাহিরে মত্ত রাত্রি তেমনি দাপাদাপি করিতে লাগিল, আকাশের বিদ্যুৎ তেমনি বারংবার অন্ধকার চিরিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে লাগিল, উচ্ছৃঙ্খল ঝড়-জল
false
manik_bandhopaddhay
সে নিজেই খুঁজিয়া দেখিবে। খুঁজিতে খুঁজিতে দুজনে আবার ঘাটে ফিরিয়া যায়। মতি বলে, কোথায় পড়ে গেছে কে জানে ও আর পাওয়া যাবে না। না পেলে তোমায় মারবে, না? কে মারবে? কে মারিবে মতি তাহার কী জানে? একজন কেউ নিশ্চয়। তবে তো মুশকিল। কুমুদ চিন্তিত হইয়া বলে। বলে, তোমার আর একটা মাকড়ি কই? দেখি, কী রকম? অন্য মাকড়িটি মতি আঁচলে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল। খুলিয়া দেয়। খুবই সাদাসিধে মাকড়ি, একটুকরা চাঁদের কোলে একরত্তি একটা তারা। তারার তলে চাঁদটা দোলে। মাকড়ি হারিয়েছে কাউকে বোলো না খুকী। কেউ টের না পাইলে মতি আপনা হইতে অবশ্যই বলিবে না। কিন্তু কেন? কাল তোমাকে একটা মাকড়ি এনে দেব। মতি অবাক হইয়া যায়। পাবেন কোথায়? কেন, গায়ে তোমাদের গয়নার দোকান নেই? কিনে আনবেন!–মতির মনে হয় মাকড়ি কেনার আগে প্রবীর তাকেই কিনিয়া ফেলিয়াছে। তাহার মাকড়িটা পকেটে ভরিয়া কুমুদ চলিয়ে গেলে, পুকুরঘাটে বসিয়া বসিয়া সে এই কথাটাই ভাবে। তাহাকে একটা মাকড়ি দেওয়া প্রবীরের কাছে কিছুই নয়। আর কত মেয়েকে হয়তো সে অমল কত দিয়াছে। বেশি না থাক, যাত্রার দলে দুটো একটা মেয়েও কি নাই? তবু তাহাকেই মাকড়ি দিতে চাওয়ার জন্য প্রবীর কী ভয়ানক ভালো। আজ তাহাদের যাত্রা শুনিতে যাওয়া বারণ। পরাণ নিষেধ করিয়া দিয়াছে। রোজ রোজ যাত্রা শোনা কী? একদিন শুনিয়া আসিয়াছে, আজ বাদ যাক, কাল আবার শুনিবে। পরাণ ওদের যাত্রা শুনিতে যাওয়া পছন্দ করে না। কেন করে না তার কোনো কারণ নাই। ওরা যাত্রা শুনিয়া বেলা দশটা পর্যন্ত পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাক আর না ঘুমক, পরাণের কিছুই আসিয়া যায় না। প্রতিদিন প্রদোষের আধো-অন্ধকারে সে যখন বাহির হইয়া যায়, এ বাড়িতে কারো ঘুম ভাঙে না। তাহার সুখ-সুবিধার দিকে তাকানোর অভ্যাস এ বাড়িতে কাহারো নাই। এক বেলা ভাতের বদলে মুড়ি খাইয়া থাকিতে হইলে নালিশ করা পরাণকে দিয়া হইয়া উঠে না। তবু সে চায় না বাড়ির মেয়েরা যাত্রা শুনিতে যায়। পর পর দুদিন যাত্রা শুনিতে যায়। তুমি যাবে না? না, নিজের বেলা ভিন্ন নিয়ম? কুসুম বলিল। সে রাগিয়াছে। আমার সঙ্গে তোমার কথা কী? ব্যাটাছেলে নাকি? তুমি গেলে আমিও যাব। আমি যাব না তবে পরাণও মাঝে মাঝে গোঁ ধরতে জানে। কুসুম বলে, তুমি যাও না যাও আমি কিন্তু যাব। চুলোয় যাও। মুখে যাই বলুক, কুসুম যাত্রা শুনিতে যাওয়ার কোনো আয়োজনই করিল না। পাড়ার অনেক বাড়ির মেয়েরা যাইবে। কুসুমও তাদের সঙ্গে যাইতে পারে। কিন্তু যাওয়ার চেয়ে না-যাওয়ার মধ্যেই এখন রাগ ও অভিমান বেশি প্রকাশ পায়, জিদও তাহাতেই বজায় থাকে বেশি। কুসুম তাই সারাটা দুপুর ঘুমাইয়া কাটাইয়া দিল। সন্ধ্যার সময় বাজনার শব্দ শুনিয়া অস্থির হইয়া উঠিল মতি। প্রবীর আজ লক্ষ্মণ সাজিবে। কীরকম না জানি আজ দেখাইবে তাহাকো পারিলে মতি একাই চলিয়া যাইত। দু বছর আগেও এমন সে গিয়াছে। এখন আর সেটা সম্ভব নয়। দুবছরের মধ্যে সে যে কী ভয়ানক বড় হইয়া গিয়াছে ভাবিলেও মতির চমক লাগে। কিন্তু কী করা যায়। অমন করিয়া বাজনা বাজিতে থাকিলে ঘরেও টেকা অসম্ভব। একসময় কুসুমকে সে বলিল, যাত্রা নাই শুনি, ঠাকুর দেখে আসি চল না বউ? পরাণ দাওয়ায় বসিয়া অর্থসমস্যার কথা ভাবিতেছিল। সে ডাকিয়া বলিল, এদিকে শোন মতি, শুনে যা। মতি কাছে আসিল কী বলছিলি? ঠাকুর দেখতে যাব। ঠাকুর দেখতে যাবি? আচ্ছা, চল। একটু যাত্ৰাও শুনে আসবি অমনি। । পরাণ অমনিভাবে একরকম স্পষ্টই হার স্বীকার করিল। কিন্তু কুসুম আর যাইতে রাজি নয়। এখন খাওয়াদাওয়া সারিয়া পান সাজিয়া যাইতে যাইতে পালা শেষ হইয়া যাইবে না। ঠাকুরপূজার বাদ্য বাজছে। পালা শুরু হতে ঢের দেরি।–পরাণ উদাসভাবে বলিল। মতি বলিল, চল না বউ? অমন করিস কেন? কুসুম বলিল, গিয়ে বসবি কোথায়? তোর জন্যে জায়গা ঘুমোচ্ছে সৰ্ব্বাইয়ের পেছনে বসে যাত্রা শোনার চেয়ে ঘরে শুয়ে ঘুমানো ঢের ভালো। পরাণ বলিল, ছোটোবাবুকে বললে— ছোটোবাবুর নামোল্লেখে কুসুম আরও রাগিয়া কহিল, ছোটোবাবু কী করবে? জায়গা গড়িয়ে দেবে? পরাণ বলিল, ছোটোবাবুর বাড়ির সবাই বাবুদের বাড়ির মেয়েদের জায়গায় বসে। নেটের পর্দা টাঙানো, দেখিসনি মতি? বাবুদের বাড়ি ছোটোবাবুর খাতির কত। ছোটোবাবুকে বললে তোদের ওইখানে বসিয়ে দেবে। কুসুম হঠাৎ শান্ত হইয়া বলে, আমি যাব না। তাহাকে আর কোনোমতেই টলানো যায় না। বাবুরা জমিদার, শশীরা বড়লোক। ওদের বাড়ির মেয়েদের কত ভালো-ভালো কাপড়, কত দামি দামি গয়না। একটা জবরজঙ্গ লেস-লাগানো জ্যাকেট গায়ে দিয়া তাতিবাড়ির কোরা কাপড় পরিয়া ওদের মাঝখানে (মাঝখানে তাহাকে বসিতে দিবে না ছাই, এককোণে ঝির মতো বসিতে হইবে) গিয়া বসিলে দম আটকাইয়া যাইবে কুসুমের। শেষপর্যন্ত পরাণের সঙ্গে মতি একাই গেল। শশীকে খুঁজিতে হইল না। সে বাড়িতেই ছিল। সে বলিল, তোর তো কম শখ নয় মতি! কিন্তু সঙ্গে গিয়া মতির বসিবার একটা ভালো ব্যবস্থা করিয়া দিতে সে আপত্তি করিল না। বরং নেটের পর্দার আড়ালে, যেখানে বাবুদের বাড়ির মেয়েরা বসে, মতিকে সেখানে বসাইতে পারিয়া সে বিশেষ গর্বই বোধ করিতে লাগিল। শীতলবাবুদের বাড়ির মেয়েরা গায়ে সিল্কের ব্লাউজ দেয়, বোম্বাই শাড়ি পরে। শীতলবাবুর ভাই কলিকাতা-প্রবাসী বিমলবাবুর স্ত্রী-কন্যারা পায়ে জুতাও দিয়া থাকে। দু’ভায়ের পরিবারের নারীর সংখ্যাও কি কম! সংসারে যেখানে যত টাকা সেখানে তত নারী, সেখানে তত পাপ। মতি সংসারের এ নিয়ম জানিত না সংসারে কোন নিয়মটাই বা সে জানে? কাঁচা মেয়ে সে, বোকা মেয়ে। প্রায় কুড়ি বগফিট পরিমাণ পরিষ্কার
false
nazrul
সংস্কারে একটু বাধিলেও সে আর আপত্তি করিল না। একটু কৌতূহল ও যে হইল না, এমন নয়! হারুণ হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘আশা করি গো-জাতির প্রতি তোমার মানবত্ববোদ আজও প্রবল হয়ে ওঠেনি!’ জাহাঙ্গীরও হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘না বন্ধু! বাঙালির বুদ্ধি আজও সেরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি। ওরা হনুমান ও গোরুর পূজা করেনি কখনও! ওই দুটো জীব বাংলার বাইরেরই দেবতা হয়ে আছেন!…’ গোরুর গাড়িতে চড়িয়া ক্রোশ-খানেক যাইবার পর জাহাঙ্গীরের কৌতূহল ও উৎসাহ একেবারে জল হইয়া গেল। অসমান গ্রাম্যপথে ঘন্টায় প্রায় এক মাইল গতিতে সনাতন গো-যান যে বিচিত্র শব্দ করিয়া ধূলি-পটল উড়াইয়া চলিতেছিল, তাহাতে জাহাঙ্গীরের ধৈর্য ধরিয়া বসিয়া থাকা একপ্রকার অসহ্য হইয়া উঠিল। অনবরত ঝাঁকুনি খাইতে খাইতে তাহার মনে পড়িল বহু পূর্বে তাহার একবার ডেঙ্গু জ্বর হইয়াছিল, তাহাতে যে গা-হাত-পায়ের ব্যথা হইয়াছিল, সে বোধ হয় ইহার কাছে কিছুই নয়। সে আর থাকিতে না পারিয়া নামিয়া পড়াতে বেচারা গাড়োয়ান বিনয়-নম্রস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘জি, নামলেন কেনে?’ জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘তোমার “জি” সাধ করে নামলেন না বাপু, তোমার গাড়ি তাকে নামিয়ে তবে ছাড়লে।’ গাড়োয়ান গাড়ি থামাইয়া বলিল, ‘জি, গাড়িতে উঠে বসুন, আমি একুটুকু চাঁওড় করে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এই শালার গোরু হুজুর একটু বেয়াড়া, তাইতে ভয় করে – কোথায় গোবোদে ফেলিয়ে দিবে। নইলে দাঁদাড়ে নিয়ে যেতুম!’ জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তুমি “দাঁদাড়ে” নিয়ে চলো বাপু, আমি খানিকটা হেঁটে যাই!’ বলিয়াই গাড়ির পিছনে পিছনে আস্তে আস্তে হাঁটিয়া চলিল। ধূলিধূসরিত জনবিরল গ্রাম্যপথ। দুই পাশে মাঠ ধু ধু করিতেছে। যেন উদাসিনী বিরহিণী। দূরে ছায়ানিবিড়পল্লি – ঝিল্লির ঘুমপাড়ানিয়া গানে যেন মায়ের কোলে শিশুর মতো ঘুমাইতেছে। জাহাঙ্গীরের মন কেমন যেন উদাস হইয়া গেল। পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, সে যেন উদাস বাউল , না-জানার সন্ধানে এই পথে পথে গান গাহিয়া ফিরিতে আসিয়াছে। যাহারা তাহার পথে আসিতেছে পরিচিতের রূপে তাহারা তাহার কেহ নয়। যে উদাসিনীর অভিসারে সে চলিয়াছে, সে এই পল্লিবাটের না-জানা উদাসিনী। তাহাকে অনুভব করা যায়, রূপের সীমায় সে অসীমা ধরা দেয় না… এমন সময় গাড়ির গো-বেচারি গো-যুগলকে গাড়োয়ান এমন ভাষায় সম্ভাষণ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল যাহাতে জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন এক নিমিষে টুটিয়া গেল। হাসিতে হাসিতে সে পথের ধারেই ধুলার উপর বসিয়া পড়িল। একটু পরে পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, কেন এ দেশে এত বাউল এত চারণ এত কবির সৃষ্টি হইল। এই উদাস, তপস্বীর ধ্যানলোকের মতো শান্ত নির্জন ঘাটমাঠ যেন মানুষকে কেবলই তাহার আপন অতলতার মাঝে ডুব দিতে ইঙ্গিত করে। এ তেপান্তরে পথের মায়া যেন কেবলই ঘর ভুলায়, একটানা পুরবি সুরের মতো করুণ বিচ্ছেদ-ব্যথায় মনকে ভরিয়া তোলে, গৃহীর উত্তরীয় বাউলের গৈরিকে রাঙিয়া উঠে!… এতক্ষণ যতবার তাহার ভূণীকে মনে পড়িয়াছে, ততবারই তাহার মন অবিশ্বাসের কালিতে কালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এই জনবিরল উদাস প্রান্তরে আসন্ন সন্ধ্যায় চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, এমনই একটি শান্ত পল্লিপ্রান্তে ছায়া-সুশীতল কুটির রচনা করিয়া তাহাকে লইয়া সে স্বর্গ রচনা করিতে পারে। কিন্তু তাহা হইতে পারে না! তাহার পিতার পাপ তাহার রক্তকে কলুষিত করিয়াছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে তাহার পিতার মতোই ব্যভিচারী হইয়া উঠিতে পারে! সে জানে, তাহার রক্তের চঞ্চলতাকে, তাহার ভীষণ উদ্দাম প্রবৃত্তিকে সংযত করিতে তাহার কত বেগ পাইতে হইয়াছে। তাহার স্বর, তাহার অবয়ব, তাহার রক্ত সমস্তই ফররোখ সাহেবের। উহার মধ্যে যেটুকু জাহাঙ্গীর, তাহা এই পশুর কাছে টিকিতে পারে না। পাপই যদি করিতে হয়, পশুর কবলেই যদি আত্মাহুতি দিতে হয়, তবে সে একাই দিবে, এ পাপের সাথি অন্যকে করিবে না! তাহার পিতার কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মাথায় যেন খুন চাপিয়া গেল। বুকের কাছে লুকানো রিভলভারটা একটানে বাহির করিয়া নিজের ললাটের কাছে ধরিল। আবার কী মনে করিয়া সেটাকে যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া গোরুর গাড়িকে পিছনে ফেলিয়া দৃপ্তপদে পথ চলিতে লাগিল। যাইবার সময় গাড়োয়ানের দিকে রোষ-কষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিয়া গেল, ‘শালা, তুমি যদি তাড়াতাড়ি গাড়ি না চালাও, তাহলে এই বনের মধ্যে তোমায় মেরে পুঁতে ফেলব!’ গাড়োয়ান বেচারা ভয়ে অভিভূত হইয়া প্রাণপণে জাহাঙ্গীরের সাথে গাড়ি চালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল! জাহাঙ্গীরের রক্তবর্ণ চোখ-মুখ দেখিয়া মনে হইল, সে ইচ্ছা করিলে সত্যসত্যই তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারে!… শিউড়ি যখন তাহারা আসিয়া পৌঁছিল, তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়া গিয়াছে। গাড়োয়ান কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলিল, ‘হুজুর, বলদ দুটো আর বাঁচবে না, মর মর হয়ে গিয়েছে হুজুর! সারা রাস্তা আমি মেরে দৌড়িয়ে নিয়ে এসেছি হুজুর!’ জাহাঙ্গীর একটিও কথা না বলিয়া একটা পাঁচ টাকার নোট গাড়োয়ানের হাতে দিয়া গাড়ি হইতে সমস্ত জিনিস নিজে বহিয়া প্ল্যাটফর্মে আনিল। গাড়োয়ান এই আশ্চর্য লোকটির কোনো কিছুই যেন বুঝিতে পারিতেছিল না। সে আর গোলমাল না করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জাহাঙ্গীর তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘এই, শোন!’ বলিয়াই সে ল্যাম্পপোস্টের কাছে দাঁড়াইয়া চিঠি লিখিতে লাগিল। চিঠি লেখা শেষ করিয়া গাড়োয়ানকে বলিল, ‘দেখ, এই চিঠি যদি ভূণীকে লুকিয়ে দিতে পারিস – তোকে দশ টাকা বকশিশ দেব। পারবি?’ গাড়োয়ান হতভম্ব লইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। জাহাঙ্গীর তাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘শালা হাঁদারাম! হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কী? ভূণীকে চিনিস? হারুণের বোন?’ গাড়োয়ান কম্পিতকণ্ঠে বলিল, ‘হুজুর উয়াকে চিনব না? এই তো সেদিন আমাদের কাছে ড্যাংডিঙিয়ে বড়ো হয়ে উঠল!’ জাহাঙ্গীর তাহার কাছে গিয়া কণ্ঠস্বর কমাইয়া বলিল, ‘তাকেই পৌঁছে দিতে হবে এই চিঠিটা, বুঝলি? তোর
false
robindronath
মুগার চাদর কাঁধে, একলা বসে আছি ফাস্ট ক্লাস ডেক-এ বেতের কেদারায়। ফেলে-দেওয়া খবরের কাগজের পাতাগুলো ফরফর করে এধারে ওধারে উড়ে বেড়াচ্ছিল, মজা লাগছিল দেখতে, মনে হচ্ছিল মূর্তিমতী জনশ্রুতির এলোমেলো নৃত্য। তুমি জনসাধারণের দলে, কোমর বেঁধে ডেক-প্যাসেঞ্জার। হঠাৎ আমার পশ্চাদ্বর্তী অগোচরতার থেকে দ্রুতবেগে এসে পড়লে আমার সামনে। আজও চোখের উপর দেখতে পাচ্ছি তোমার সেই ব্রাউন রঙের শাড়ি; খোঁপার সঙ্গে কাঁটায় বেঁধা তোমার মাথার কাপড় মুখের দুইধারে হাওয়ায় ফুলে উঠেছে। চেষ্টাকৃত অসংকোচের ভান করেই প্রশ্ন করলে, আপনি খদ্দর পরেন না কেন?– মনে পড়ছে?” “খুব স্পষ্ট। তোমার মনের ছবিকে তুমি কথা কওয়াতে পার, আমার ছবি বোবা।” “আমি আজ সেদিনের পুনরুক্তি করে যাব, তোমাকে শুনতে হবে।” “শুনব না তো কী। সেদিন যেখানে আমার নূতন জীবনের ধুয়ো, পুনঃ পুনঃ সেখানে আমরা মন ফিরে আসতে চায়।” “তোমার গলার সুরটি শুনেই আমার সর্বশরীর চমকে উঠল, সেই সুর আমার মনের মধ্যে এসে লাগল হঠাৎ আলোর ছটার মতো; যেন আকাশ থেকে কোন্‌ এক অপরূপ পাখি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল আমার চিরদিনটাকে। অপরিচিতা মেয়েটির অভাবনীয় স্পর্ধায় যদি রাগ করতে পারতুম তাহলে সেদিনকার খেয়াতরী এতবড়ো আঘাটায় পৌঁছিয়ে দিত না– ভদ্রপাড়াতেই শেষ পর্যন্ত দিন কাটত চলতি রাস্তায়। মনটা আর্দ্র দেশলাইকাঠির মতো, রাগের আগুন জ্বলল না। অহংকার আমার স্বভাবের সর্বপ্রধান সদ্‌গুণ, তাই ধাঁ করে মনে হল, মেয়েটি যদি আমাকে বিশেষভাবে পছন্দ না করত তাহলে এমন বিশেষভাবে ধমক দিতে আসত না, খদ্দরপ্রচার– ও একটা ছুতো, সত্যি কিনা বলো।” “ওগো, কতবার বলেছি– অনেকক্ষণ ধরে ডেকের কোণে বসে তোমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম আর-কেউ সেটা লক্ষ্য করছে কি না। জীবনে সেই আমার সব-চেয়ে আশ্চর্য একচমকের চিরপরিচয়। মন বললে, কোথা থেকে এল এই অতিদূর জাতের মানুষটি, চারদিকের পরিমাপে তৈরি নয়, শেওলার মধ্যে শতদল পদ্ম। তখনই মনে মনে পণ করলুম এই দুর্লভ মানুষটিকে টেনে আনতে হবে, কেবল আমার নিজের কাছে নয়, আমাদের সকলের কাছে।” “আমার কপালে তোমার একবচনের চাওয়াটা চাপা পড়ল বহুবচনের চাওয়ার তলায়।” “আমার উপায় ছিল না অন্তু। দ্রৌপদীকে দেখবার আগেই কুন্তী বলেছিলেন, তোমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিয়ো। তুমি আসবার আগেই শপথ করে দেশের আদেশ স্বীকার করেছি, বলেছি আমার একলার জন্যে কিছুই রাখব না। দেশের কাছে আমি বাগ্‌দত্তা।” “অধার্মিক তোমার পণগ্রহণ, এ পণকে রক্ষা করাও প্রতিদিন তোমার স্বধর্মবিদ্রোহ। পণ যদি ভাঙতে তবে সত্যরক্ষা হত। যে লোভ পবিত্র যা অন্তর্যামীর আদেশবাণী, তাকে দলের পায়ে দলিত করেছ, এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।” “অন্তু, শাস্তির সীমা নেই, দিনরাত মারছে আমাকে। যে আশ্চর্য সৌভাগ্য সকল সাধনার অতীত, যা দৈবের অযাচিত দান তা এল আমার সামনে, তবু নিতে পারলুম না। হৃদয়ে হৃদয়ে গাঁঠ বাঁধা, তৎসত্ত্বেও এতবড়ো দুঃসহ বৈধব্য কোনো মেয়ের ভাগ্যে যেন না ঘটে। একটা মন্ত্রপড়া বেড়ার মধ্যে ছিলুম, কিন্তু তোমাকে দেখবামাত্র মন উৎসুক হয়ে উঠল, বললে, ভাঙুক সব বেড়া। এমন বিপ্লব ঘটতে পারে সে-কথা কোনোদিন ভাবতে পারি নি। এর আগে কখনো মন বিচলিত হয় নি বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু চঞ্চলতা জয় করে খুশি হয়েছি নিজের শক্তির গর্বে। জয় করবার সেই গর্ব আজ নেই, ইচ্ছে হারিয়েছি–বাহিরের কথা ছেড়ে দাও, অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখো, হেরেছি আমি। তুমি বীর, আমি তোমার বন্দিনী।” “আমিও হেরেছি আমার সেই বন্দিনীর কাছে। হার শেষ হয় নি, প্রতি মুহূর্তের যুদ্ধে প্রতি মুহূর্তেই হারছি।” “অন্তু, ফার্স্ট ক্লাস ডেক-এ যখন অপূর্ব আবির্ভাবের মতো আমাকে দূর থেকে দেখা দিয়েছিলে তখনও জানতুম থার্ড ক্লাসের টিকিটটা আমাদের আধুনিক আভিজাত্যের একটা উজ্জ্বল নিদর্শন। অবশেষে তুমি চড়লে রেলগাড়িতে সেকেণ্ড ক্লাসে। আমার দেহমনকে প্রবল টান দিলে সেই ক্লাসের দিকে। এমন-কি, মনে একটা চাতুরীর কল্পনা এসেছিল, ভেবেছিলুম, ট্রেন ছাড়বার শেষমুহূর্তে উঠে পড়ব তোমার গাড়িতে, বলব,–তাড়াতাড়িতে ভুলে উঠেছি। কাব্যশাস্ত্রে মেয়েরাই অভিসার করে এসেছে, সংসারবিধিতে বাধা আছে বলেই কবিদের এই করুণা। উসখুস-করা মনের যত সব এলোমেলো ইচ্ছে ভিতরের আঁধার কোঠায় ঘুর খেয়ে খেয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বেড়ায়। এদের কথা মেয়েরা পর্দার বাইরে কিছুতে স্বীকার করতে চায় না। তুমি আমাকে স্বীকার করিয়েছ।” “কেন স্বীকার করলে?” “নারীজাতির গুমর ভেঙে কেবল ওই স্বীকারটুকুই তোমাকে দিতে পেরেছি, আর তো কিছু পারি নি।” হঠাৎ অতীন এলার হাত চেপে ধরে বলে উঠল, “কেন পারলে না? কিসের বাধা ছিল আমাকে গ্রহণ করতে? সমাজ? জাতিভেদ?” “ছি, ছি, এমন কথা মনেও করো না। বাইরে বাধা নয়, বাধা অন্তরে।” “যথেষ্ট ভালোবাস নি?” “ওই যথেষ্ট কথাটার কোনো মানে নেই অন্তু। যে শক্তি হাত দিয়ে পর্বতকে ঠেলতে পারে নি তাকে দুর্বল বলে অপবাদ দিয়ো না। শপথ করে সত্য গ্রহণ করেছিলুম, বিয়ে করব না। না করলেও হয়তো বিয়ে সম্ভব হত না।” “কেন হত না?” “রাগ করো না অন্তু, ভালোবাসি বলেই সংকোচ। আমি নিঃস্ব, কতটুকুই বা তোমাকে দিতে পারি!” “স্পষ্ট করেই বলো।” “অনেকবার বলেছি।” “আবার বলো, আজ সব বলা-কওয়া শেষ করে নিতে চাই, এর পরে আর জিজ্ঞাসা করব না।” বাইরে থেকে ডাক এল, “দিদিমণি।” “কী রে অখিল, আয় না ভিতরে।” ছেলেটার বয়স ষোলো কিংবা আঠারো হবে। জেদালো দুষ্টুমি-ভরা প্রিয়দর্শন চেহারা। কোঁকড়া চুল ঝাঁকড়ামাকড়া, কচি শামলা রঙ, চঞ্চল চোখদুটি জ্বলজ্বল করছে। খাকি রঙের শর্টপরা, কোমর পর্যন্ত ছাঁটা সেই রঙেরই একটা বোতাম-খোলা জামা বুক বের করা; শর্টের দুইদিককার পকেট নানা বাজে সম্পত্তিতে
false
tarashonkor
তিনকড়ি আস্ফালন করিয়া নির্মম নিষ্ঠুরভাবে তাহাদিগকে গালাগালি দিল—থান্ থান্ দুমুখখা সাপের দল, থাম্ তো। নেড়ী কুত্তার মতন যার কাছে যখন যাবে—তারই পা চাটবে আর ন্যাজ নাড়বে। দেবার প্রশংসা করবার তোরা কে? যা ছিরে পালের কাছে যা দল পাকিয়ে পতিত কগে দেবুকে। যা বেটারা, বল্ গিয়ে তোদের ডিরেকে—গেজেটে কি লিখেছে দেবুর নামে। তিনকড়ির গালিগালাজ লোকে চুপ করিয়া শুনিল—মাথা পাতিয়া লইল। একজন শুধু বলিলমোড়ল, পেট হয়েছে দুশমনকি করব বল? তুমি যা বলছ তা ঠিক বটে। —পেট আমার নাই? আমার ইস্তিরি-পুত্তু-কন্যে নাই? এ কথার উত্তর তাহারা দিতে পারিল না। তিনকড়ি পেট-দুশমনকে ভয় করে না, তাহাকে সে জয় করিয়াছে—এ কথা তাহারা স্বীকার করে; এজন্য তাহাকে তাহারা প্রশংসা করে। আবার সময়বিশেষে নিজেদের অক্ষমতার লজ্জা ঢাকিতে তিনকড়ির এই যুদ্ধকে বাস্তববোধহীনতা বলিয়া নিন্দা করিয়া আত্মগ্লানি হইতে বাঁচিতে চায়। কতবার মনে করে তাহারাও তিনকড়ির মত পেটের কাছে মাথা নিচু করিবে না। অনেক চেষ্টাও করে; কিন্তু পেট-দুশমনের নাগপাশের এমনি বন্ধন যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার পেষণে এবং বিষনিশ্বাসে জর্জরিত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িতে হয়। তাই আর সাহস হয় না। বাপ, পিতামহ, তাহাদেরও পূর্বপুরুষ ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা হইতে সন্তান-সন্ততিকে বারবার সাবধান করিয়া দিয়া গিয়াছে—পাথরের চেয়ে মাথা শক্ত নয়, মাথা ঠুকিয়ো না। পেটের চেয়ে বড় কিছু নাই, অনাহারের যাতনার চেয়ে অধিকতর যাতনা কিছু নাই; উদরের অন্নকে বিপন্ন কোরো নাতাহাদের শিরায় শিরায় প্রবহমান। শ্ৰীহরির ঘরেই যে তাহাদের পেটের অন্ন, কেমন করিয়া তাহারা শ্রীহরিকে অমান্য করিবে? তবুও মধ্যে মধ্যে তাহারা লড়াই করিতে চায়। বুকের ভিতর কোথায় আছে আর একটা গোপন ইচ্ছা-অন্তরতম কামনা, সে মধ্যে মধ্যে ঠেলিয়া উঠিয়া বলে না আর নয়, এর চেয়ে মৃত্যুই ভাল! এবার ধর্মঘটের সময়—সেই ইচ্ছা একবার জাগিয়া উঠিয়ছিল। তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাহারা ভাঙিয়া পড়িয়াছে। যেটুকু সময় দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিত, পারিবার কথা—তাহার চেয়েও অল্প সময়ের মধ্যে তাহারা ভাঙিয়া পড়িয়াছে। কেমন করিয়া কোথা দিয়া শেখেদের সঙ্গে দাঙ্গা বাঁধিবার উপক্রম হইল; সদর হইতে আসিল সরকারি ফৌজ। পুরুষানুক্রমে সঞ্চয়-করা ভয়ে তাহারা বিহ্বল হইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীহরি দেখাইল দানার লোভ। আর তাহারা থাকিতে পারিল না। থাকিয়াই বা কি হইত? কি করি? এই বন্যার পর যে শ্ৰীহরি ভিন্ন তাহাদের বাঁচিবার উপায় নাই। কি করিবে তাহারা? শ্ৰীহরির কথায় সাদাকে কালো-কালোকে সাদা না বলিয়া তাহাদের উপায় কি? পেট-দুশমনের ভার কেহ নাও, পেট পুরিয়া খাইতে পাইবার ব্যবস্থা কর,দেখ তাহারা কি না পারে! তিনকড়ির গালিগালাজের আর শেষ হয় না।—ভিতু শেয়াল, লোভী গরু, বোকা ভেড়া পেটে ছোরা মার্ গিয়ে! মরে যা তোরা! মরে যা! তেঁাড়া সাপ—এক ফোঁটা বিষ নেই! মরে যা তোরা মরে যা! দেখুড়িয়ার অধিবাসী তিনকড়ির এক জ্ঞাতি-ভাই হাসিয়া বলিল—মরে গেলে তো ভালই হয় ভাই তিনু। কিন্তু মরণ হোক বললেই তো হয় না—আর নিজেও মরতে পারি না! তেজের কথা—বিষের কথা বলছিস? তেজ, বিষ কি শুধুই থাকে রে ভাই? বিষয় না থাকলে বিষও থাকে না, তেজও থাকে না। তিনকড়ি মুখ খিঁচিয়া উঠিল—বিষয়! আমার বিষয় কি আছে? কত আছে? বিষয়—টাকা–! সে বলিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনু-দাদা বিষয়–টাকা। তেজ-বিষ আমারও একদিন ছিল। মনে আছে—তুমি আর আমি কঙ্কণার নিতাইবাবুকে ঠেঙিয়েছিলাম? রাত্রে আসত–দেঁতো গোবিন্দের বোনের বাড়ি! তাতে আমিই তোমাকে ডেকেছিলাম। আগে ছিলাম আমি। নিতাইবাবু মার খেয়ে ছমাস ভুগে শেষটা মরেই গেল—মনে আছে? সে করেছিলাম গায়ের ইজ্জতের লেগে। তখন তেজ ছিল—বিষ ছিল। তখন আমাদের জমজমাট সংসার। বাবার পঞ্চাশ বিঘে জমির চাষ, তিনখানা হাল; বাড়িতে আমরা পাঁচ ভাই–পাঁচটা মুনিষ; তখন তেজ ছিল—বিষ ছিল। তারপর পাঁচ ভাইয়ে ভিন্ন হলাম; জমি পেলাম দশ বিঘে, পাঁচটা ছেলেমেয়ে; নিজেরাই বা কি খাইছেলেমেয়েদিগের মুখেই বা কি দিই? শ্ৰীহরি ঘোষের দোরে হাত না পেতে করি কি বল? আর তেজ-বিষ থাকে? আবার একটু হাসিয়া বলিল—তুমি বলবেতোমারই বা কি ছিল? ছিল কিনা তুমিই বল? আর জমিও তোমার আমাদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। তোমার তেজ-বিষ মরে নাই, আছে। তাও তো তেজের দণ্ড অনেক দিলে গো। সবই তো গেল। রাগ কোরো না, সত্যি কথা বলছি। ঠিক আগেকার তেজ কি তোমারই আছে? তিনকড়ি এতক্ষণে শান্ত হইল। কথাটা নেহাত মিথ্যা বলে নাই। আগেকার তেজ কি তাহারই আছে? আজকাল সে চিৎকার করিলে লোকে হাসে। আর ওই ছিল—ছিরে, আগে চিৎকার করিলে লোকে সকলেই তো তাহার উত্তর করিত সামনাসামনি দাঁড়াইত। কিন্তু আজ ছিরে শ্ৰীহরি হইয়াছে। তাহার তেজের সম্মুখে মানুষ আগুনের সামনে কুটার মত কাপে; কুটা কাঁচা হইলে শুকাইয়া যায়, শুকনা হইলে জ্বলিয়া ওঠে। লোকটি এবার বলিল—তিনু-দাদা, শুনলাম নাকি গেজেটে নিকেছে—দেবুর কাছে টাকা আসবে—সেইসব টাকা-কাপড় বিলি হবে? তিনকড়ি এতটা বুঝিয়া দেখে নাই; সে এতক্ষণ আস্ফালন করিতেছিল—গেজেটে শ্রীহরিকে বাদ দিয়া কেবল দেবুর নাম প্রকাশিত হইয়াছে—এই গৌরবে। সে যে-কথাটা শ্ৰীহরিকে বারবার বলে—সেই কথাটা গেজেটেও বলিয়াছে—সেই জন্য। সে বলে—তুই বড়লোক আছিস আপনার ঘরে আছি, তার জন্যে তোকে খাতির করব কেন? খাতির করব তাকেই যে খাতিরের লোক। স্বর্ণের পাঠ্যপুস্তক হইতে কয়েকটা লাইন পর্যন্ত সে মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে– আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার, সংসারে সে বড় হয় বড় গুণ যার। ধনী শ্ৰীহরিকে বাদ দিয়া গেজেট গুণী দেবুর জয়জয়কার ঘোষণা করিয়াছে—সেই আনন্দেই সে আস্ফালন করিতেছিল। হঠাৎ এই কথাটা শুনিয়া তাহারও মনে হইল, হ্যাঁ,
false
robindronath
ওর আদালতে এদের সংসারের প্রতিকূলে ও রায় দিতে বসেছে। মানুষ করেছে নীরজাকে, সমস্ত দরদ তার ‘পরেই। তার কাছাকাছি যারা যায় আসে, এমন-কি, নীরজার স্বামী পর্যন্ত, তাদের সকলেরই সম্বন্ধে ওর একটা সতর্ক বিরুদ্ধতা। ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “জল এনে দেব খোঁখী?” “না, বোস।” মেঝের উপর হাঁটু উঁচু করে বসল আয়া। নীরজার দরকার কথা কওয়া, তাই আয়াকে চাই। আয়া ওর স্বগত উক্তির বাহন। নীরজা বললে, “আজ ভোরবেলায় দরজা খোলার শব্দ শুনলুম।” আয়া কিছু বললে না; কিন্তু তার বিরক্ত মুখভাবের অর্থ এই যে, “কবে না শোনা যায়।” নীরজা অনাবশ্যক প্রশ্ন করল, “সরলাকে নিয়ে বুঝি বাগানে গিয়েছিলেন?” কথাটা নিশ্চিত জানা, তবু রোজই একই প্রশ্ন। একবার হাত উলটিয়ে মুখ বাঁকিয়ে আয়া চুপ করে বসে রইল। নীরজা বাইরের দিকে চেয়ে আপন মনে বলতে লাগল, “আমাকেও ভোরে জাগাতেন, আমিও যেতুম বাগানের কাজে, ঠিক ঐ সময়েই। সে তো বেশিদিনের কথা নয়।” এই আলোচনায় যোগ দেওয়া কেউ তার কাছে আশা করে না, তবু আয়া থাকতে পারলে না। বললে, “ওঁকে না নিলে বাগান বুঝি যেত শুকিয়ে?” নীরজা আপন মনে বলে চলল, “নিয়ু মার্কেটে ভোরবেলাকার ফুলের চালান না পাঠিয়ে আমার একদিনও কাটত না। সেইরকম ফুলের চালান আজও গিয়েছিল, গাড়ির শব্দ শুনেছি। আজকাল চালান কে দেখে দেয় রোশনি।” এই জানা কথার কোনো উত্তর করল না আয়া, ঠোঁট চেপে রইল বসে। নীরজা আয়াকে বললে, “আর যাই হোক, আমি যতদিন ছিলুম মালীরা ফাঁকি দিতে পারে নি।” আয়া উঠল গুমরিয়ে, বললে, “সেদিন নেই, এখন লুঠ চলছে দু হাতে।” “সত্যি নাকি।” “আমি কি মিথ্যা বলছি। কলকাতার নতুন বাজারে ক’টা ফুলই বা পৌঁছয়। জামাইবাবু বেরিয়ে গেলেই খিড়কির দরজায় মালীদের ফুলের বাজার বসে যায়।” “এরা কেউ দেখে না?” “দেখবার গরজ এত কার।” “জামাইবাবুকে বলিস নে কেন।” “আমি বলবার কে। মান বাঁচিয়ে চলতে হবে তো? তুমি বল না কেন। তোমারই তো সব।” “হোক না, হোক না, বেশ তো। চলুক না এমনই কিছুদিন, তার পরে যখন ছারখার হয়ে আসবে আপনি পড়বে ধরা। একদিন বোঝবার সময় আসবে, মায়ের চেয়ে সৎমায়ের ভালোবাসা বড়ো নয়। চুপ করে থাক না।” “কিন্তু তাও বলি খোঁখী, তোমার ওই হলা মালীটাকে দিয়ে কোনো কাজ পাওয়া যায় না।” হলার কাজে ঔদাসীন্যই যে আয়ার একমাত্র বিরক্তির কারণ তা নয়, ওর উপরে নীরজার স্নেহ অসংগতরূপে বেড়ে উঠছে এই কারণটাই সব চেয়ে গুরুতর। নীরজা বললে, “মালীকে দোষ দিই নে। নতুন মনিবকে সইতে পারবে কেন। ওদের হল সাতপুরুষে মালীগিরি, আর তোমার দিদিমণির বইপড়া বিদ্যে, হুকুম করতে এলে সে কি মানায়। হলা ছিষ্টিছাড়া আইন মানতে চায় না, আমার কাছে এসে নালিশ করে। আমি বলি কানে আনিস নে কথা, চুপ করে থাক্‌।” “সেদিন জামাইবাবু ওকে ছাড়িয়ে দিতে গিয়েছিল।” “কেন, কী জন্যে।” “ও বসে বসে বিড়ি টানছে, আর ওর সামনে বাইরের গোরু এসে গাছ খাচ্ছে। জামাইবাবু বললে, “গোরু তাড়াস নে কেন।” ও মুখের উপর জবাব করলে, “আমি তাড়াব গোরু! গোরুই তো তাড়া করে আমাকে। আমার প্রাণের ভয় নেই।” শুনে হাসলে নীরজা, বললে, “ওর ঐরকম কথা। তা যাই হোক, ও আমার আপন হাতে তৈরী।” “জামাইবাবু তোমার খাতিরেই তো ওকে সয়ে যায়, তা গোরুই ঢুকুক আর গণ্ডারই তাড়া করুক। এতটা আবদার ভালো নয়, তাও বলি।” “চুপ কর রোশনি। কী দুঃখে ও গোরু তাড়ায় নি সে কি আমি বুঝি নে। ওর আগুন জ্বলছে বুকে। ঐ যে হলা মাথায় গামছা দিয়ে কোথায় চলেছে। ডাক্‌ তো ওকে।” আয়ার ডাকে হলধর মালী এল ঘরে। নীরজা জিজ্ঞাসা করলে, “কী রে, আজকাল নতুন ফরমাশ কিছু আছে?” হলা বললে, “আছে বৈকি। শুনে হাসিও পায়, চোখে জলও আসে।” “কী রকম, শুনি।” “ঐ-যে সামনে মল্লিকদের পুরোনো বাড়ি ভাঙা হচ্ছে ঐখান থেকে ইটপাটকেল নিয়ে এসে গাছের তলায় বিছিয়ে দিতে হবে। এই হল ওঁর হুকুম। আমি বললুম, রোদের বেলায় গরম লাগবে গাছের। কান দেয় না আমার কথায়।” “বাবুকে বলিস নে কেন।” “বাবুকে বলেছিলেম। বাবু ধমক দিয়ে বলে, চুপ করে থাক্‌। বউদিদি, ছুটি দাও আমাকে, সহ্য হয় না আমার।”“দেশ থেকে চিঠি এসেছে বড়ো হালের গোরুটা মারা গেছে।” ব’লে মাথা চুলকোতে লাগল। নীরজা বললে, “না, মারা যায় নি, দিব্যি বেঁচে আছে। নে দুটো টাকা, আর বেশি বকিস নে।” এই বলে টিপাইয়ের উপরকার পিতলের বাক্স থেকে টাকা বের করে দিলে। “আবার কি।” “বউয়ের জন্যে একখানা পুরোনো কাপড়। জয়জয়কার হবে তোমার।” এই বলে পানের ছোপে কালো-বর্ণ মুখ প্রসারিত করে হাসলে। নীরজা বললে, “রোশনি, দে তো ওকে আলনার ঐ কাপড়খানা।” রোশনি সবলে মাথা নেড়ে বললে, “সে কি কথা, ও যে তোমার ঢাকাই শাড়ি!” “হোক-না ঢাকাই শাড়ি। আমার কাছে আজ সব শাড়িই সমান। কবেই বা আর পরব।” রোশনি দৃঢ়মুখ করে বললে, “না, সে হবে না। ওকে তোমার সেই লালপেড়ে কলের কাপড়টা দেব। দেখ্‌ হলা, খোঁখীকে যদি এমনি জ্বালাতন করিস বাবুকে বলে তোকে দূর করে তাড়িয়ে দেব।” হলা নীরজার পা ধরে কান্নার সুরে বললে, “আমার কপাল ভেঙেছে বউদিদি।” “কেন রে, কী হয়েছে তোর।” “আয়াজিকে মাসি বলি আমি। আমার মা নেই, এতদিন জানতেম হতভাগা হলাকে আয়াজি ভালোবাসেন। আজ বউদিদি, তোমার যদি দয়া হল উনি কেন দেন বাগড়া। কোরো দোষ নয় আমারই কপালের দোষ। নইলে তোমার হলাকে
false
tarashonkor
বনওয়ারী, আর মেজ ঘোষ মারলেন পিঠে চটাচট চটিজুতোর পাটি। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই। মেজ ঘোষের এক। খদ্দের পাঠিয়েছিল এক ঝুড়ি খাস আম। সেই আমের ঝুড়ি করালী আনতে গিয়েছিল চন্ননপুর ইস্টিশান থেকে। মাস্টার মশায়ের মত এমন ভাল লোক আর হয় না। এত জিনিস আসে ইস্টিশানে, রাজ্যের সামগ্রী; সব মাস্টারই তার থেকে কিছু কিছু নিয়ে থাকে। কিন্তু সে মাস্টার কখনও কারুর জিনিসে হাত দিতেন না। শুধু মালের রসিদপিছু তার যে পার্বণীটি পাওনা সেইটেই নিতেন। ঘোষের আমের ঝুড়ি বেশ করে চট দিয়ে মুড়ে সেলাই করাই ছিল। কিন্তু উৎকৃষ্ট জাতের ল্যাংড়া আমের সুগন্ধে মালের ঘরখানা একেবারে মউ মউ করছিল। ঢুকলেই সে গন্ধে মানুষের নাক থেকে বুক পর্যন্ত ভরে উঠেছিল, জিভের তলা থেকে জল বেরিয়ে মুখটাকে সপপে সরস করে তুলছিল। মাস্টারের একটি ছোট মেয়ে সেই গন্ধে লুব্ধ হয়ে আম খাওয়ার জন্য বায়না ধরে শেষ পর্যন্ত কান্না জুড়ে দিয়েছিল। মাস্টার তবু একটি আমও বার করে নেন নি। কিন্তু করালী থাকতে পারে নি। সে নিজে দুটি আম বার করে মেয়েটির হাতে দিয়েছিল। বলেছিল—আমার মুনিব তেমন লয়, মাস্টার মশায়। তারপর ইস্টিশান থেকে বেরিয়ে আসতেই জমাদার ধরেছিল করালীকে। সে দুটো আম না নিয়ে ছাড়লে না। শুধু ছাড়লে না নয়, পকেট থেকে ছুরি বার করে একটা আম কেটে খেয়ে আমের প্রশংসায় শতমুখ হয়ে এক চাকা আম করালীকে আস্বাদন করিয়ে তবে ছাড়লে। তাই তার অপরাধ। চারটে আম কম-বেশিতে ঘোষ। করালীকে ধরতে পারত না, ধরলে করালীর হাতের ও মুখের গন্ধ থেকে। আমের ঝুড়িটা মেজ ঘোষই ধরে তার মাথা থেকে নামাচ্ছিল। নামিয়েই সে করালীর ডান হাতখানা খপ করে ধরে নাকের কাছে টেনে নিয়ে কলে, তারপর বনওয়ারীকে ডেকে বললে মুখটা শোক তো বনওয়ারী। হারামজাদা ঝুড়ি থেকে আম বের করে খেয়েছে পথে। বনওয়ারী লজ্জায় মাথা হেঁট করে রইল প্রথমটা। এ লজ্জা সে রাখবে কোথায়? করালী তার জাত-জ্ঞাতের ছেলে, সেই তাকে এনে এ বাড়িতে চাকরি করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে পাড়ার সে মাতব্বর, সে-ই পাড়ার ছেলে করালী। প্রজার পাপ জমিদার-রাজাকে অর্সায়, সেই জন্যই তো জমিদার-রাজার প্রজাকে শাসনের অধিকার। সমাজের পাপ মণ্ডলকে মাতব্বরকে অসায়, সেই জন্যই মণ্ডল মাতব্বরের কাজ হল—অধর্মের পথে পুরুষ-মেয়েকে যেতে নেবারণ করা। ছিছিছি। দেবতা আছেন, ব্রাহ্মণ আছেন, বাড়ির মালিক আছেন—তারা তোর মনিব, তারা খেয়ে তবে না তোকে প্রসাদ দেবেন। বনওয়ারীর ইচ্ছা হয়েছিল, একটা লোহার শিক আগুনে পুড়িয়ে তার। জিভে হেঁকা দেয়। কিন্তু মেজ ঘোষ নিজেই তাকে সাজা দিলেন। তাকে বললেন—ধ, বেটার ঘাড় ধরে মাটিতে মাথাটা নুইয়ে ধর। তাই ধরলে বনওয়ারী। মেজ ঘোষ নিজেই পায়ের চটি খুলে পেচণ্ড পেহার দিলেন। এবং কালীকে তাড়িয়ে দিলেন মেজবাবু। মাইনে কিছু পাওনা। ছিল, সেও দিলেন না। কথাটা কানে গিয়েছিল স্টেশন মাস্টারের। তিনি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেলেন, এবং তিনিই করালীকে ডেকে দিলেন ইস্টিশানের গুদামে কুলির কাজ। কিন্তু ছোট স্টেশনে এ কাজে উপাৰ্জন নাই। কায়ক্লেশে একটা লোকের পেট চলে। তাই লাইন-ইন্সপেক্টরকে বলে শেষে ঢুকিয়ে দিলেন কুলি-গ্যাঙের মধ্যে। সেই জন্যই-না করালী আজ এই করালী, এবং এই সবের জন্যই সে অন্য দশজনের মত বনওয়ারীকে খাতির করতে চায় না এবং ঘোষ বাড়ির ছায়াও মাড়াতে চায় না। হোক না কেন এসব অনেক দিনের কথা, এবং দশে বিচার করে বলুক-না কেন অন্যায় তারই, তবু করালী সে কথা ভুলতেও পারে না, এবং অন্যায় তার বলে মানতেও পারে না। মেজ ঘোষকে দেখে করালীর চোখ দুটো জ্বলে উঠল প্রথমে; কিন্তু পরক্ষণেই মনটা নেচে উঠল। বনওয়ারী তার ঘাড় ধরেছিল, মেজ ঘোষ তাকে মেরেছিল। আজ বনওয়ারী তাকে তারিফ করছে, মেজবাবু এসেছে তার মারা সাপটা দেখতে। মেজ ঘোষ কি বলে, কি রকম ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে প্ৰশংসা-ভরা দৃষ্টিতে, সে আজ তা একবার দেখবে। উঠানে নেমে সে সত্যই বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাপটার কাছেই। বনওয়ারী সামনের ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলে। করালী কিন্তু এগিয়েও এল না, প্ৰণামও করলে না। সে লটবরের সঙ্গে কি একটা কথা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিলে। বনওয়ারী বারকয়েক চোখের ইশারায় তাকে এগিয়ে এসে ঘোষ মহাশয়ের চরণে দণ্ডবৎ করতে ইঙ্গিত করলে। করালী দেখলে, কিন্তু দেখেও যেন দেখতে পেলে না, এই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কান কিন্তু তার খুব সজাগ ছিল, কে কি বলছে, তার প্রতিটি কথা সে শুনছিল। অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছিল মেজ ঘোষের মুখে কি কথা বার হয়—সেইটুকু শুনবার জন্য। সকলেই খুব বিস্ময় প্রকাশ করলে, করালীর বীরত্বের তারিফ করলে। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখেশুনে একটু হেসে মেজ ঘোষ বললেন, নাঃ, খুব বড় না। এর চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ে চিতি চিড়িয়াখানাতেই আছে। আসামের জঙ্গলে তো কথাই নাই। সেখানে এত বড় সাপ আছে যে, বাঘের সঙ্গে লড়াই হলে বাঘ মেরে ফেলে। রেললাইনের উপর যদি কোনো ট্রেন যাবার সময় পড়ে তো ট্রেন আটকে যায়। বনওয়ারী সায় দিলে কথাটায়, বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। মাঝারি সাপ। করালী এবার উদ্ধতভাবেই এগিয়ে এল। সাপটাকে এখনই এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে সে। নিয়ে যাবে চন্ননপুর স্টেশনে, সেখানে বাবুদের দেখাবে, সায়েবকে দেখাবে। তাদের কাছে ঘোষের দাম কানাকড়ি। জাঙলের একজন ভদ্রলোকের ছেলে বললে—কিন্তু এ তো পাহাড়ের চিতি নয়-এ হল চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়া এত বড় কিন্তু কেউ কখনও দেখে নি। আর সাপও ভীষণ সাপ। ঘোষ একটু হেসে বললেন–জাত ওই একই হে, চিতির
false
tarashonkor
দুঃখে দেবু একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। ভিক্ষা করিলেও এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোককে বাঁচানো কি তাহার সাধ্য! পরক্ষণেই মনে হইল—একজন পারিত, বিশু-ভাই হয়ত পারিত! সে-ই তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছে।… তাহার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল। কিসের ঢোল পড়িতেছে? ও কিসের ঢোল? ঢোল পড়ে সাধারণত জমি নিলামের ঘোষণায়—আজকাল অবশ্য ইউনিয়ন বোর্ডের হাকিমদের হুকুমজারি ঢেল সহযোগে হইয়া থাকে। ট্যাক্সের জন্য অস্থাবর ক্রোক, ট্যাক্স আদায়ের শেষ তারিখ, ট্যাক্স বৃদ্ধি প্রভৃতির ঘোষণা—হরেক রকমের হুকুম। এ ঢোল কিসের? দেবু দ্রুতপদে অগ্রসর হইল। চিরপরিচিত ভূপাল একজন মুচিকে লইয়া ঢোল সহরত করিয়া চলিয়াছে! –কিসের ঢোল, ভূপাল? –আজ্ঞে, ট্যাক্স। –ট্যাক্স? এই সময় ট্যাক্স? –আজ্ঞে হ্যাঁ। আর খাজনাও বটে। দেবুর সমস্ত শরীর যেন কেমন করিয়া উঠিল। এই দুঃসময়—তবু ট্যাক্স চাই, খাজনা চাই। কিন্তু সে কথা ভূপালকে বলিয়া লাভ নাই। সে দীর্ঘ দ্রুত পদক্ষেপে ভূপালদের পিছনে ফেলিয়া অগ্রসর হইয়া গেল। দুঃখে নয়—এবার ক্ষোভে ক্রোধে তাহার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করিয়া উঠিল। কোনো উপায় কি নাই? বাঁচিবার কি কোনো উপায়ই নাই? চণ্ডীমণ্ডপে শ্ৰীহরির সেরেস্তা পড়িয়াছে। গোমস্তা দাসজী বসিয়া আছে। কালু শেখ কাঠের ধুনি হইতে একটা বিড়ি ধরাইতেছে। ভবেশ ও হরিশ বসিয়া আছে, তাহাদের হাতে হুঁকা। মহাজন ফেলারাম ও শ্রীহরি বকুলগাছের তলায় দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে—কোনো গোপন কথা, কাহারও সর্বনাশের পরামর্শ চলিতেছে বোধহয়। গতিবেগ আরও দ্রুততর করিল দেবু। বাড়ির দাওয়ার উপর গৌর চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ওই একটি ছেলে। বড় ভাল ছেলে। একেবারে বাড়ির সম্মুখে আসিয়া সে বিস্মিত হইয়া গেল। একটা লোক তাহার তক্তপোশের উপর শুইয়া ঘুমাইতেছে। লোকটার পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে সস্তাদরের কামিজ ও কোট; পায়ে হেঁড়া মোজা; জুতাজোড়াটা নূতন হইলেও দেখিলে বুঝা যায় কমদামি। হ্যাটও আছে, হ্যাটটা মুখের উপর চাপা দিয়া দিব্য আরামে ঘুমাইতেছে, মুখ দেখা যায় না। পাশে টিনের একটা সুটকেস। দেবু গৌরকে প্রশ্ন করিল–কে গৌর? গৌর বলিলতা তো জানি না। আমি এখুনি এলাম; দেখলাম, এমনিভাবেই শুয়ে ঘুমুচ্ছে। দেবু সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে আবার লোকটার দিকে চাহিল। গৌর ডাকিল দেবু-দা! –কি? –ভিক্ষের বাক্সগুলো নিয়ে এসেছি। চাবি খুলে পয়সাগুলো নেন। আরও পাঁচ-ছটা বাক্স দিতে হবে। আমাদের আরও পাঁচ-ছজন ছেলে কাজ করবে। দেবু মনে অদ্ভুত একটা সান্ত্বনা অনুভব করিল। তালাবদ্ধ ছোট ছোট টিনের বাক্স লইয়া গৌরের দল জংশন-স্টেশনে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা করে। সেই বাক্সগুলি পূর্ণ করিয়া সে পয়সা লইয়া আসিয়াছে। সংবাদ আনিয়াছে—তাহার দলে আরও ছেলে বাড়িয়াছে; আরও ভিক্ষার বাক্স চাই। পাত্রে ভিক্ষা ধরিতেছে না। আরও পাত্র চাই। সে সস্নেহে গৌরের মাথায় হাত বুলাইয়া দিল। গৌর বলিল-আজ একবার আমাদের বাড়ি যাবেন? সন্ধের সময়? –কেন? দরকার আছে কিছুঃ কাকা ডেকেছেন নাকি? —না, স্বন্ন এবার পরীক্ষা দেবে কিনা। তাই দরখাস্ত লিখে দেবেন। আর স্বন্ন তার পড়ার কতকগুলো জায়গা জেনে নেবে। –আচ্ছা, যাব। গভীর স্নেহের সঙ্গে দেবু সম্মতি জানাইল। গৌর আর স্বর্ণ-ছেলেটি আর মেয়েটির কথা ভাবিয়া পরম সান্ত্বনা অনুভব করিল দেবু। আর ইহারা বড় হইলে এ অঞ্চলের। অবস্থা আর এক রকম হইয়া যাইবে। বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা, সে ঝঙ্কার দিয়া বুলিল—যাক, ফিরতে পারলে? খাবেদাবে কখন? তাহার শাসনে দেবু না হাসিয়া পারিল না; বলিল—এই যে! চল। দুর্গা একটু হাসিয়া বলিল-লাও, আবার কুটুম এসেছে! –কুটুম? –ওই যে! দুৰ্গা ঘুমন্ত লোকটিকে দেখাইয়া দিল। দেবুর কথাটা নূতন করিয়া মনে হইল। সবিস্ময়ে সে বলিল—তাই বটে! ও কে রে? –কর্মকার! –কর্মকার? –অনিরুদ্ধ গো! চাকরি করে সায়েব সেজে ফিরে এসেছে। মরণ আর কি! –অনিরুদ্ধ? অনি-ভাই? –হ্যাঁ। কথাবার্তার সাড়াতেই, বিশেষ করিয়া বার বার অনিরুদ্ধ শব্দটার উচ্চারণে অনিরুদ্ধ জাগিয়া উঠিল। প্রথমে মুখের টুপিটা সরাইয়া দেবুর দিকে চাহিল, তার পর উঠিয়া বসিয়া বলিল—দেবু–ভাই! রামরাম। দেবু অনিরুদ্ধকে বলিল—এতদিন কোথায় ছিলে অনি-ভাই? উত্তরে অনিরুদ্ধ দেবুকে বলিল—কেয়া, পদ্ম ঘর ছোড়কে চলা গেয়া দেবু-ভাই? দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মাথা হেঁট করিল। কোনো কথা সে বলিতে পারি না, পদ্মকে সে রক্ষা করিতে পারে নাই। গৃহত্যাগিনী কন্যার পিতা, পত্নীর স্বামী, ভগ্নীর ভাই সেই গৃহত্যাগের প্রসঙ্গ উঠিলে যে ভাবে মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া থাকে, তেমনিভাবেই সে চুপ করিয়া রহিল। অনিরুদ্ধ হাসিল; বলিল—সরম কাহে? তুমারা কেয়া কসুর ভাই? কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, ঘাড় নাড়িয়া যেন মনে মনে অনেক বিবেচনা করিয়া বলিল—উকা ভি কুছ কসুর নেহি! কুছ না! যানে দেও। শেষে আপনার বুকে হাত দিয়া নিজেকে দেখাইয়া বলিল—কসুর হামারা; হ্যাঁ, হামারা কসুর। দেবু এতক্ষণে বলিল—একখানা চিঠিও যদি দিতে অনি-ভাই! অনিরুদ্ধ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল—আর কোনো কথা বলিল না। দুর্গা দেবুকে তাগিদ দিল-জামাই, বেলা দুপুর যে গড়িয়ে গেল। রান্না কর! … তারপর অনিরুদ্ধের দিকে চাহিয়া বলিল-মিতেও তো এইখানে খাবে? না কি হে? দেবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল—হ্যাঁ, এইখানে খাবে বৈকি। তুই কথাবার্তা বলতে শিখলি না দুগ্‌গা! দুর্গা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; বলিল–ও যে আমার মিতে! ওকে আবার কুটুম্বিতে কিসের? কি হে মিতে, বল না? অনিরুদ্ধ অট্টহাসি হাসিয়া উঠিল—সছ বোলা হ্যায় মিতেনী। তাহার এই হাসিতে দেবু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিল। বলিল তুমি মুখ-হাত ধোও অনি-ভাই। তেল-গামছা নাও, চান কর। আমি রান্না করে ফেলি। বাড়ির ভিতর আসিয়া সে রান্নার উদ্যোগ আরম্ভ করিল! … অনিরুদ্ধ! হতভাগ্য অনিরুদ্ধ! দীর্ঘকাল পরে ফিরিলকিন্তু পদ্ম আজ নাই। থাকিলে কি সুখের কথাই না হইত। আজ অনিরুদ্ধের হাতে তাহাকে সে সমৰ্পণ করিত মেয়ের বাপের মত—বোনের বড় ভাইয়ের মত। হতভাগিনী পদ্ম!
false
shottojit_roy
সন্দেহ হয়েছিল, কারণ হামানদিস্তায় পান থাকলে শব্দটা হয় একটু অন্যরকম; এটা ছিল ফাঁকা শব্দ। সবই বুঝলাম, মিঃ মিত্তির, বললেন জয়ন্তবাবু, কিন্তু তারপর? তারপর চাবি দিয়ে সিন্দুক খোলা। আপনি কোন অপরাধে আমাদের অভিযুক্ত করছেন, মিঃ মিত্তির? অজ্ঞান হবার ভান করা? আমার মাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া? রাত্তিরে ফিরে এসে ডুপলিকেট চাবি বার করে সিন্দুক খোলা? তার মানে এর সবগুলোই করেছেন স্বীকার করছেন তো? এর কোনওটার জন্য শাস্তি হয় না সেটা আপনি জানেন? আসল ব্যাপারটায় আসছেন না। কেন আপনি? ঘটনা যে দুটো জয়ন্তবাবু, একটা তো নয়। আগে প্রথম ঘটনাটা সেরে নিই-এক বছর আগের চুরি। সেটা আপনি সারবেন কী করে, মিঃ মিত্তির? আপনি কি অন্তর্যামী? আপনি তখন কোথায়? আমি ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু অন্য লোক তো ছিল। যিনি চুরি করেছিলেন তাঁর ঠিক পাশেই লোক ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত একজন কি টের পেয়ে থাকতে পারেন না? এবারে শঙ্করবাবু কথা বললেন। তিনি বেশ উত্তেজিত। এটা আপনি কী বলছেন, মিঃ মিত্তির? চুরি হয়েছে সেটা জানবে অথচ আমায় বলবে না, আমার এত কাছের লোক হয়ে? ফেলুদা এবার ম্যাজিশিয়ান কালীনাথবাবুর দিকে ঘুরল। আপনি কাল রাত্তিরে কী বিপদের কথা ভেবে আমাকে তদন্ত বন্ধ করতে বলছিলেন সেটা বলবেন, কালীনাথবাবু? কালীনাথবাবু হেসে বললেন, আপ্রিয় সত্য প্রকাশ করায় বিপদ নেই? শঙ্করের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখুন তো! না, নেই বিপদ, দৃঢ়স্বরে বললেন শঙ্করবাবু! অনেক’দিন ব্যাপারটা ধামা চাপা রয়েছে। এবার প্রকাশ হওয়াই ভাল। তুমি যদি কিছু জেনে থাক তো বলে ফেলো, কালীনাথ। সেটা বোধহয় ওঁর পক্ষে সহজে নয়, মিঃ চৌধুরী, বলল ফেলুদা, কারণ তদন্তে চোর ধরা পড়লে যে ওঁরাও বিপদ হত। এই একটা বছর যে উনি চোরকে নিংড়ে শেষ করেছেন। ব্ল্যাকমেল? ব্ল্যাকমেল, শঙ্করবাবু। সেটা উনিও স্বীকার করবেন না, চারও স্বীকার করবেন না। অবিশ্যি চোরের যে দোসর আছে সেটা সম্ভবত কালীনাথবাবু জানতেন না, উনি একজনকেই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা এই অনবরত ব্ল্যাকমেলিং-এর ঠেলায় দ্বিতীয় চুরিটার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর তাই— ভুল! ভুল? তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন জয়ন্তবাবু।সিন্দুক থেকে যা নেবার তা আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। বনোয়ারিলালের আর একটি জিনিসও তাতে নেই! সিন্দুক খালি! তার মানে আমার বাকি অভিযোগ সবই সত্যিই? কিন্তু, কাল রাত্তিরে কুকীর্তিটা কে করেছে সেটা বলছেন না কেন? সেটাও বলছি, কিন্তু তার আগে আপনার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিটা চাই। আপনি বলুন জয়ন্তবাবু–ডাঃ সরকার আর আপনি মিলে গতবছর বারোটার মধ্যে থেকে একটি স্বর্ণমুদ্রা সরিয়েছিলেন কি না। জয়ন্তবাবুর মাথা হেঁট হয়ে গেছে; ডাঃ সরকার দুহাতে রগ টিপে বসে আছেন। আমি স্বীকার করছি, বললেন জয়ন্তবাবু। ফেলুদা পকেট থেকে টেপ রেকর্ডারটা বার করে চালু করে আমার হাতে দিয়ে দিল। আমি দাদার কাছে ক্ষমা চাইছি। সে স্বর্ণমুদ্রা ডাঃ সরকারের কাছেই আছে, সেটা ফেরত দেওয়া হবে। আমাদের দুজনেরই অর্থাভাব হয়েছিল। একটার জায়গায় বারোটার পুরো সেটটা বিক্রি করলে প্রায় একশো গুণ বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছিল, তাই… তাই বাকি এগারোটা নেবার কথা ভাবছিলেন। স্বীকার করছি, কিন্তু চোর আরও আছে, মিঃ মিত্তির। যে লোক ব্ল্যাকমেল করতে পারে– –সে লোক চুরি করতে পারে, বলল ফেলুদা। কিন্তু তিনি চুরি করেননি। তা হলে? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু। ওগুলো সরিয়েছেন প্রদোষ মিত্ৰ। ফেলুদা ঘর থেকে বাকি মাল এনে টেবিলের উপর রাখল। সকলের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। এই হল বনোয়ারিলালের বাকি সম্পত্তি, বলল ফেলুদা, মেঝেতে চাবি না পেয়ে, এবং রক্তের বদলে হিমোগ্লোবিন দেখে মনে ঘোর সন্দেহ উপস্থিত হয়। তাই যখন আপনাকে ধরাধরি করে নীচে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে পিকপকেটের ভূমিকা অবলম্বন করতে হয়েছিল। ভাগ্য ভাল যে চাবিটা ছিল আপনার প্যান্টের ডান পকেটে। বাঁ পকেটে থাকলে পেতাম না। আপনাকে নিয়ে যাবার পর বৈঠকখানায় এসে বসি। তখনই এক ফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে আমি সিন্দুক খুলে জিনিসগুলো বার করে আমার ঘরে রেখে দিই। আমি জানতাম যে বিপদের আশঙ্কা আছে।–এই নিন। আপনার চাবি, মিঃ চৌধুরী। এরপর কী করা হবে সেটা আপনিই স্থির করুন; আমার কাজ এখানেই শেষ। ফেরার পথে লালমোহনবাবুর মুখে আর একটা আবৃত্তি শুনতে হল। এটাও বৈকুণ্ঠ মল্লিকের লেখা। নাম হল জিনিয়াস– অবাক প্রতিভা কিছু জন্মেছে এ ভবে এদের মগজে কী যে ছিল তা কে কবে? দ্য ভিঞ্চি আইনস্টাইন খনা লীলাবতী সবারেই স্মরি আমি, সবারে প্রণতি। রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, রামমোহন রায়ের নাতির সার্কাস ছিল সেটা জানতেন? ফেলুদার মুখের উপর রুমাল চাপা, তাই সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিল। প্রায় দশ মিনিট ধরে পর্বতপ্রমাণ খড়বোঝাই লরি আমাদের যে শুধু পাশ দিচ্ছে না। তা নয়, সমানে পিছন থেকে রেলগাড়ির মতো কালো ধোঁয়া ছেড়ে প্রাণ অতিষ্ঠা করে তুলেছে। লালমোহনবাবুর গাড়ির ড্রাইভার হরিপদবাবু বার বার হর্ন দিয়েও কোনও ফল হয়নি। লরির পিছনের ফুলের নকশা, নদীতে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য, হর্ন প্লিজ, টা-টা গুডবাই, থ্যাঙ্ক ইউ সব মুখস্থ হয়ে গেছে। লালমোহনবাবু সাকার্স সম্বন্ধে বইটা কিছুদিন হল জোগাড় করেছেন; অনেক দিন আগের লেখা বই, নাম বাঙালির সাকাস। বইটা ওঁর ঝোলার মধ্যে ছিল, লরির জ্বালায় সামনে কিছু দেখবার জো নেই বলে সেটা বার করে পড়তে শুরু করেছেন। ইচ্ছে আছে সার্কাস নিয়ে একটা রহস্য উপন্যাস লেখার তাই ফেলুদার পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টা নিয়ে একটু পড়াশুনা করে রাখছেন। সকাসের কথা
false
shottojit_roy
চাকর কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এল। থামস আপ। মিঃ দস্তুর ফেলুদার পরিচয় আগেই পেয়েছেন, এবার গলাটা নামিয়ে বললেন, মিঃ মিটার, আমার ঘরে মূল্যবান জিনিস নেই ঠিকই, কিন্তু একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না। আমার প্রতিবেশীটি কিন্তু খুব সিধে লোক নন। তার ঘরে নানারকম গোপন কারবার চলে। গৰ্হিত ব্যাপার। আপনি জানলেন। কী করে? আমার স্নানের ঘর আর ওর স্নানের ঘর লাগোয়া। দুটোর মাঝখানে একটা বন্ধ দরজা আছে। সে দরজায় কান লাগালে মাঝে মাঝে ওর শোবার ঘর থেকে কথাবার্তা শোনা যায়। ফেলুদা গলা খাকরিয়ে বলল, এই ভাবে কান লাগানোও একটা গৰ্হিত ব্যাপার নয় কি? মিঃ দস্তর একটুও অপ্ৰস্তুত না হয়ে বললেন, সেটা করতাম না! যখন দেখলাম যে আমার চিঠি ভুল করে ওর হাতে পড়লে ও জল দিয়ে খাম খুলে তারপর আবার আঠা দিয়ে সেঁটে ফেরত দেয়, তখন একটা পালটা দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি নির্বাঞ্চাট মানুষ। কিন্তু উনি যদি আমার পিছনে লাগেন তা হলে আমিও ওকে ছাড়ব না, এই বলে দিলাম। কোল্ড ড্রিঙ্কসের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। গেটের কাছে এসে ফেলুদা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল। গত আধা ঘণ্টার মধ্যে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে কি না। সে বলল সুখওয়ানি আর দস্তুরকে ছাড়া কাউকে দেখেনি। এটা আশ্চর্য না। সাতের এক বালিগঞ্জ পার্কের কম্পাউন্ড ওয়াল রয়েছে বাড়ির চারদিক ঘিরে। পিছন দিকের একটা বাড়ি নাকি খালি পড়ে আছে আজ। কয়েক মাস যাবৎ। জোয়ান চোর হলে পাঁচিল টপকে আসায় কোনও অসুবিধা নেই—যদিও আমাদের সকলেরই মন বলছে। এ কাজ বাড়ির লোকেই করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার বলছে—ভেতরের লোকই যে বাইরের লোককে দিয়ে কাজটা করায়নি তারই বা বিশ্বাস কী? আমাদের গাড়ি নেই। সুবীরবাবু বলেছিলেন তাঁর গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা, কিন্তু ফেলুদা বলল হেঁটে গিয়ে ট্যাক্সি পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। পুলিশে একটা খবর দিলে ভাল করতেন। কিন্তু। ফেলুদার এ প্রস্তাবটা আমার কাছে একেবারই অপ্রত্যাশিত। সুবীরবাবুও বেশ একটু অবাক হলেন। বললেন, কেন বলছেন বলুন তো! পুলিশ সম্বন্ধে আপনার দাদার ধারণা। যাই হোক না কেন, পলাতক চার ধরার যে সব উপায় পুলিশের জানা আছে কোনও প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের তা নেই। বিশেষ করে যখন এতগুলো টাকা, তখন পুলিশকে বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নোটের নম্বর লেখা আছে বলছেন। কাজটা এমনিতেই অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। সুবীরবাবু বললেন, আপনাকে যখন আসতে বলেছি, এবং দুর্ঘটনা যখন একটা ঘটেছে, তখন আপনাকে বাদ দেবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। পুলিশ আসুক, কিন্তু তার পাশে আপনিও থাকলে শুধু আমিই নিশ্চিন্ত হব না, দাদাও হবেন! অবিশ্যি, সত্যি বলতে কী, চার কে সেটা কারুর সাহায্য ছাড়াই আমি বলতে পারি। আপনার ছেলের কথা বলছেন কি? সুবীরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।—এ শঙ্কর ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সে জানে এ পাড়ায় ছাঁটায় বাতি নিভে যায়। ডানপিটে ছেলে, পাঁচিল টপকানা তার কাছে কিছুই নয়। তার পর পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে জ্যাঠার ঘরে ঢুকে আলমারি খোলা—এ সবই তো তার কাছে নাস্যি! কিন্তু নীহারবাবুর গবেষণার কাগজপত্র নিয়ে সে কী করবে? বৈজ্ঞানিক মহলে কি তার খুব যাতায়াত আছে? সেটার দরকার কী বলুন! সে তো সেই কাগজপত্রের বিনিময়ে তার জ্যাঠার কাছ থেকেই টাকা আদায় করতে পারে। এই কাগজপত্রের দাম যে দাদার কাছে কতখানি সেটা তো সে খুব ভালভাবেই জানে! এই অল্প সময়ের মধ্যে এত রকম ঘটনা ঘটার ফলে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল। তার পরেও একই দিনে যে আরও কিছু ঘটতে পারে সেটা ভাবতেই পারিনি। অবিশ্যি সেটার কথা বলার আগে বাড়ি ফিরে এসে ফেলুদা আর আমার মধ্যে যে কথা হয়েছিল সেটা বলা দরকার। রাত্রে খাবার পরে ফেলুদার ঘরে গিয়ে দেখি সে খাটে চিত হয়ে শুয়ে সিলিং-এর দিকে চেয়ে পান চিবোচ্ছে আর চারমিনার ফুকছে। আমিও গিয়ে খাটে বসলাম। সে প্রশ্নটা গোলোকধাম থেকেই মনে খোঁচা দিচ্ছিল সেটা না বলে পারলাম না। তুমি কেসটা ছেড়ে দিতে চাইছিলে কেন ফেলুদা? ফেলুদা পর পর দুটো মোক্ষম রিং ছেড়ে বলল, কারণ আছে রে, কারণ আছে। কারণ তো বললেই তুমি—পালানো চোর ধরা পুলিশের পক্ষে আরও সহজ— বিশেষ করে যদি অনেক টাকা নিয়ে পালায়। সুবীরবাবুর ছেলেই নিয়েছে বলে তোর মনে হয়? আর কে নেবে বল। বাড়ির লোক নিয়েছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। দস্তুর তো ছিলেনই না। সুখওয়ানি চুরি করে দিব্যি ঘরে বসে থাকবেন সেটাও যেন কেমন কেমন লাগে। রণজিৎবাবুও এলেন চুরির পরে। আর আছে চাকরবাকার… কিন্তু ধরা যদি মক্কেল নিজেই কিছু করে থাকেন? আমি অবাক হয়ে চাইলাম ফেলুদার দিকে। সুবীরবাবু! একটু মাথা ঠাণ্ডা করে চুরি আবিষ্কারের ঠিক আগের ঘটনাগুলো ভেবে দেখা। আমি চোখ বুজে কল্পনা করলাম আমরা চারজনে বৈঠকখানায় বসে আছি। চা এল। আমরা চা খাচ্ছি। ফেলুদার হাতে কাপ। ঘরের বাতি নিভল। তারপর— ধাঁ করে একটা জিনিস মনে পড়ে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। লোড শেডিং-এর সঙ্গে সঙ্গে সুবীরবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, ফেলুদা—চাকরকে ডাকতে। তবে!—ভেবে দেখ আমার পোজিশনটা কী হবে। যদি বেরোয় যে সুবীরবাবুই আলমারি খুলেছিলেন। এটা অসম্ভব নয়। এই কারণেই যে ওই একটি লোক সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না। চাকরের কথা যেটা বলেছেন সেটা অবিশ্যি অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ধুর যদি শেয়ার বাজারে
false
shunil_gongopaddhay
তাকে পীড়া দেয়। মমতাও সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছেন, তাঁর কৃষ্ণুতার পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই, তবু তিনি বেশ মানিয়ে নিতে পারছেন। প্রতাপ অসহিষ্ণু। জসিডি পেঁৗছোতে রাত ভোর হয়ে যাবে। প্ৰতাপ দাড়িয়ে থাকলে মমতার চোখেও ঘুম আসবে ना। বাবাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে বাবলুও অবাক হয়ে গেছে। তার এখন যা বয়েস তাতে আরও দাও, আরও চাই, এই ভাবটাই বেশি থাকে, কারু জন্য কিছু ছেড়ে দেবার কথা মানে আসে না। সে ফিস ফিস করে কানুকে জিজ্ঞেস করলো, ছোটকা, বাবা কি ওপরে আসবে? কানুও তার সেজদাকে খানিকটা চেনে। সে জানে যে এখন কিছু বলতে গেলেই ধমক খাবে। ঐ বিহারী মেয়েলোকটির কোলে যে বাচ্চাটা, তার একটা পা বুলিছিল, সেই পা বোধ হয় ওপর তো রাগ করতে পারে না। কানুর শুধু একটাই মুশকিল হলো, সেজদা দাঁড়িয়ে থেকে ওপরটা দেখতে পাচ্ছে। এই অবস্থায় সে সিগারেট টানতে পারবে না। কানু প্ৰতাপের বৈমাত্রেয় ভাই। অনেকদিন পর্যন্ত সে তার মামাদের কাছেই ছিল। বড় মামার মৃত্যু হবার পর তাকে প্রতাপের কাছেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। আই এ পরীক্ষায় একবার ফেল করার পর তার আর পড়াশুনো হয়নি, তারপর থেকে সে একটানা চাকরি খুঁজে যাচ্ছিল। পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলেও কানুর এক ধরনের বুদ্ধি বেশ তীক্ষ। সে জানে, বেশিদিন বেকার থাকলে তার পথের কুকুরের মতন অবস্থা হবে। স্বাধীনতার পর শুধু ছীটাই। আর ছাঁটাইয়ের রবই শোনা গেছে, নতুন চাকরি একটাও তৈরি হয় নি। তার পাড়ার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে, শ্মাশান ঘাটে গিয়ে বসে থাক, দ্যাখ রিটায়ার করার আগে কে কে মলো। সেই সেই অফিসে ছুটে যাবি। কানু নিজস্ব-উপায় বার করে মাঝে মাঝেই পঁচিশ-তিরিশ টাকা উপার্জন করে আনতে লাগলো। লম্বা, পাতলা চেহারা তার, চোখ দুটি ঝকঝকে। প্রতাপের মতন তার মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ নেই, তাতে তার সুবিধেই হয়েছে, সে অনায়াসে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকতে পারে। জন্য সে মাঝে মাঝে কয়লা, আটা কিংবা মাছ কিনে আনে। প্রতাপ অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর এই ছোট ভাইটির উপার্জনের ব্যাপারটা টের পাননি, একদিন জানতে পেরে চেপে ধরলেন। চাকরি করে না, টিউশনি করে না, তবু কানু টাকা পায় কোথা থেকে? চুরি বা জোঙ্গুরি ছাড়া তো কলকাতা শহরে ५भगि यनि ाका •|&ग्रा याग्र ना । কানুর উপার্জনের পথটি পুরোপুরি অবৈধ নয়। বরং বলা যেতে পারে এক ধরনের ব্যবসায়ের উদ্যোগ। সে কন্ট্রোলের শাড়ী কিনে এনে বাজারের সামনের ফুটপাথের দোকানে বেচে দেয়। কানুর সময়ের অভাব নেই। কস্ট্রোলের শাড়ীর দোকানের সামনে লম্বা লম্বা লাইন পড়ে, কানু সারা দিন সেই লাইনে দাঁড়ায়। প্রতি শাড়ীতে দুটাকা তিন টাকা মুনাফা। শাড়ী যখন সহজে পাওয়া যেতে লাগলো, তখন কানু চলে এলো কয়লায়। কয়লারও রেশন | এখন দেশে প্রায়ই কোনো না কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সরকার তখন সেগুলো কট্রোল দরে দেবার চেষ্টা করে। সেটা একটা নিয়ম রক্ষা মাত্র, অতি অল্প লোকেই তা পায়। যারা পায়, তাদের মধ্যেও আবার কানুর মতন মানুষই বেশি। প্রতাপ এই বৃত্তান্তটি শুনে তার বাইশ বছর বয়সী ভাইয়ের গালে ঠাস ঠাস করে দুটি থাপ্পড়ু মেরে বলেছিলেন, হারামজাদা, তোর লজ্জা করে না? তুই কোন বংশের ছেলে তা তোর খেয়াল নেই? ফের যদি এরকম নোংরা কথা শুনি তা হলে আমার বাড়িতে তোর স্থান হবে না। বস্তিতে গিয়ে থাকবি! সেই ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় কানু নিজের গালে একবার হাত বোলালো। দাদার ওপর তার রাগ নেই, বরং একটা করুণার ভাব আছে। সেজদা সব সময় সততার গর্ব করে, অশেষ দুঃখ আছুে সেজদার কপালে। এই যুগটাই যে অন্যরকম। গত বছরের গোড়ার দিকে প্রতাপ অবশ্য বহু চেষ্টা করে কানুর জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। সাধারণ চাকরি, তবু যা হােক, সরকারি, বাধা মাইনে। চাকরিটা কানুর খুব পছন্দ। কারণ এরই মধ্যে সে ঐ সাধারণ চাকরির দেয়াল ফুটাে করে উপরে রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছে। চলতে শুরু করেছে। ট্রেন। বাতাস চলাচল করতেই আর আগের মতন অন্ত ভিড় বোধ হয় না। চলন্ত ট্রেনের বাঁকুনিতে কিছুটা জায়গা বেরিয়ে আসে। দাঁড়ানো মানুষগুলো কেউ কেউ এদিক সেদিকে একটুখানি করে নিতম্ব ছোয়ানোর ব্যবস্থা করে নেয়। প্রতাপ দাঁড়িয়েই রইলেন। তাঁর মুখখানি বিমৰ্য, তিনি কারু দিকে চেয়ে নেই, শূন্য দৃষ্টি। তার হাতে একটি সিগারেট, কিন্তু আগুন জ্বালানো হয় নি, সেটাই মাঝে মাঝে ঠোঁটে ছোয়াচ্ছেন। বাবলু এখনও বুঝতে পারছে না, বাঙ্কের ওপরে বসা আর নীচে বসার মধ্যে কোনটা বেশী ভালো। সে ভেবেছিল, ওপরে বসার মধ্যে একটা বড় বড় ভােব আছে। তা চাড়া বাবা যখন তখন বকুনি সেন বলে সে বাবার কাছাকাছি থাকতে চায় নি। কিন্তু দাদাটা মায়ের পাশে বসেছে জানলা দিয়ে বাইরের কত কিছু দেখছে। ওপর থেকে শুধু মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ট্রেন ছাড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝিমোতে শুরু করেছে অনেকে। কানু ফিসফিস করে বললো, দেখছিস বাবলু, তোর বাবার খুব মন খারাপ। আমরা এত কষ্ট করে ট্রেনে জায়গা করলুম, তবু জায়গা ছেড়ে দিলেন। কেন বল তো? বাবলু মন খারাপ-টারাপ তেমন বোঝে না। সে শেষ প্রশ্নটির জের টেনে পাল্টা প্রশ্ন করলো, কেন? কিসের জন্য মন খারাপ। \ე. কানু মুচকি হেসে বললো, আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি যে! বাবলু। তবু বুঝতে পারলো না -তবে কি তারা দেওঘরে ঠান্মার কাছে যাচ্ছে না, রেলগাড়িটা ভুল দিকে ছুটে যাচ্ছে? কানু
false
humayun_ahmed
টুকু জবাব দিল না। কথা না-বলা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। হীরু বলল, বাসার সবাই একটা গ্রেট চিন্তার মধ্যে ছিল; আমি অবশ্যি চিন্তা করছিলাম না। পীর সাহেব চিন্তা করতে নিষেধ করেছিলেন। কলতা বাজারের পার। তোকে এক’দিন নিয়ে যাব। হেভি পাওয়ার লোকটার। আমার ধারণা শ খানেক জ্বীন তার হাতে আছে। বেশিও হতে পারে। টুকুকে ফিরতে দেখে বাসার কেউ কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। মিনু একটি কথাও বললেন না। সকালে খিচুড়ি নাশতা হল। সেই খিচুড়ির এক থালা টুকুর সামনে রেখে তিনি কঠিন গলায় বললেন খা। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। টুকুর সঙ্গে এই হল তার প্রথম কথা। তিথি ভাইকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না, হাসল। সেই হাসি চিন্তা দূর হবার হাসি। যা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় টুকু ফিরে আসায্য সে খুশি হয়েছে। জালালুদ্দিন রাগী গলায় খানিক ক্ষণ বকাঝকা করলেন; বকাঝকার ফাকে ফাকে উপদেশ দিলেন বাড়ি পালানো হচ্ছে একটা অসুখ। সরল অসুখের চিকিৎসা আছে কিন্তু বাড়ি পালানো অসুখ এবং ক্যানসার এই দুয়ের কোনো চিকিৎসা নেই। একবার যার বাড়ি পালানো রোগ হয়েছে সে দু’দিন পর পর পালাবে। এটা জানা কথা। তিনি বেশিক্ষণ উপদেশ দিতে পারলেন না। তার প্লেটের খিচুড়ি শেষ হয়ে গেছে। শূন্য থালা সামনে নিয়ে কথা বলতে তার ভাল লাগে না। তিনি নিচু গলায় বললেন, ও মিনু খিচুড়িটা তো আসাধারণ হয়েছে। আতপ চাল ছিল তাই না? আতপ চাল ছাড়া এই জিনিস হয় না। আছে নাকি আরো? মিনু বললেন না। এক হাতা দাও দেখি। মুখের ক্ষিধেটা যাচ্ছে না। পেট অবশ্যি ভর্তি। তবু মুখের ক্ষিধের ব্যাপার আছে বললাম তো নাই। ও আচ্ছা, ঠিক আছে। না থাকলে কী আর করা। আজ দুপুরেও খিচুড়ি করলে কেমন হয়? আতপ চাল কী আরো আছে? চুপ কর তো। খাওয়া, খাওয়া আর খাওয়া। খাওয়া ছাড়াও তো আরো জিনিস আছে। সেই জিনিসটা কী? চুপ কর। জালালুদ্দিন চুপ করতে পারলেন না। টুকুকে আবার উপদেশ দিতে শুরু করলেন বুঝলি টুকু, ঘর হচ্ছে মানুষের মা। শিশু থাকে মায়ের পেটের ভেতর। আমরা থাকি ঘরের পেটের ভেতর। সেই জন্যে ঘর হচ্ছে আমাদের মা! ঘর থেকে পালান মাকে অপমান করা। এই কাজ খবরদার করবি না। মায়ের পেট থেকে যে বের হয়ে যায় সে আর মায়ের পেটে ঢুকতে পারে না। তেমনি ঘর থেকে যে বের হয়ে যায় সে আর ঘরে ঢুকতে পারে না। বুঝলি? টুকু মাথা নাড়ল। যেন সে এই জটিল ফিলসফি বুঝে ফেলেছে। তার মাথা নাড়া জালালুদ্দিন দেখতে পেলেন না। তবে টুকু যখন নিজের থালার খিচুড়ি বাবার থালায় ঢেলে দিল তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। চিকন গলায় বললেন, তুই খাবি না? না। না কেন? জিনিসটা তো ভাল হয়েছে। ক্ষিধে নেই। এইটুকু খিচুড়ি খেতে ক্ষিধে লাগে নাকি? এ তো দেখি পাগলের প্রলাপ।৷ ও মিনু একটা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে এনে দাও তো। টুকু বসে বসে বাবার খাওয়া দেখল। তার বড় ভাল লাগল। দুপুরে গেল বজলু ভাইয়ের খোঁজে। বজলু তাকে দেকে আঁৎকে উঠে বলল, কী সর্বনাশ তোর একি অবস্থা! কোথায় ছিলি? টুকু সহজ গলায় বলল, এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেড়াতে যাবি, বলে যাবি না? তোর বড় ভাইকে এক’দিন জিজ্ঞেস করলাম–টুকু কোথায়? সে বলল, আমি কী করে বলব কোথায়? আমি কী ডিটেকটিভ? কী কথার কী উত্তর। তা তোর স্বাস্থ্যের এই অবস্থা কেন? জ্বর হয়েছিল। কাজের সময় জ্বরজারি বঁধিয়ে দিস, আশ্চর্য। তোর জন্যে শ্রাবণ সংখ্যা দেয়াল পত্রিকা বের হল না। শিল্প-সাহিত্য এইসব তো ছেলেখেলা না। এক’দিন করবি দশদিন করবি না তা তো হবে না। কমিটমেন্ট দরকার। দুপুর থেকেই টুকু কাজে লেগে গেল। এবারে শ্রাবণ সংখ্যা দেয়াল পত্রিকা নতুন আঙ্গিকে বেরুচ্ছে। পুরো দেয়াল পত্রিকা পলিথিনের কাগজে মুড়ে বৃষ্টির মধ্যে রেখে দেয়া হবে। শ্রাবণ ংখ্যা পড়তে হলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পড়তে হবে। এই অসাধারণ আইডিয়া বজলুর মাথাতে এসেছে। এরকম আইডিয়া তার প্রায়ই আসে। সন্ধ্যা না মেলানো পর্যন্ত টুকু দেয়াল পত্রিকার কাজ করল। সন্ধ্যা মেলাবার পরপর কাউকে কিছু না বলে চলে গেল বস্তির ঐ ঘরে। বুড়ো লোকটি বারান্দায় বসে কাঠের চেয়ারে বেতের কাজ করছিল সে টুকুকে দেখে গলা ফাটিয়ে চোঁচাতে লাগল–ও মতির মা, ও মতির মা! ঐ পুলা আবার আসছে। জবান বন্ধ পুল। ঐ হারামজাদা তুই কৈ গেছিলি? আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির! ঐ পুলা দেহি এদিকে আয়। শুধু মতির মা না, ঘরের সবাই বের হয়ে এল। টুকু এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মতির মা বলল, নয়া বৌ এই পুলাডার খাওন দাও। এ না খাইয়া সারাদিন কই কই যেন ঘুরছে। নতুন বৌ তৎক্ষণাৎ ভাত বেড়ে ফেলল। ভাত এবং ডাটা দিয়ে রান্না করা ছোট মাছের তরকারি। তরকারিতে এমন ঝাল দেয়া হয়েছে যে মুখে দিলেই চোখে পানি এসে যায়। টুকু সেই আগুন ঝাল তরকারি তৃপ্তি করে খেল। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তার ঘুমের জন্যে জায়গাও করে দেয়া হয়েছে। তবে সে ঘুমুচ্ছে না, অনেক কষ্টে জেগে আছে। তার এখানে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে–শাড়ি দিয়ে ঘেরা অংশে নতুন বৌ এবং তার স্বামীর অভিনীত অংশটা দেখা। টুকু মনে মনে আশা করছে আজো যেন কুপী নিভাতে ওরা ভুলে যায়। হীরু বলল, মনটা খুবই ব্যাড হয়ে আছে। এ্যানা হেসে ফেলল। হীরু রাগী
false
bongkim
ন্যায়, ইঁহার রূপরাশি টলটল করিতেছিল – উছলিয়া পড়িতেছিল। বর্ণাপেক্ষা, নয়নাপেক্ষা, সর্ব্বাপেক্ষা সেই সৌন্দর্য্যের পরিপ্লব মুগ্ধকর। পূর্ণযৌবনভরে সর্ব্বশরীর সতত ঈষচ্চঞ্চল, বিনা বায়ুতে শরতের নদী ঈষচ্চঞ্চল, তেমনি চঞ্চল; সে চাঞ্চল্য মুহুর্মুহুঃ নূতন নূতন শোভাবিকাশের কারণ। নবকুমার নিমেষশূন্যচক্ষে সেই নূতন নূতন শোভা দেখিতেছিলেন। সুন্দরী, নবকুমারের চক্ষু নিমেষশূন্য দেখিয়া কহিলেন, “আপনি কি দেখিতেছেন, আমার রূপ?” নবকুমার ভদ্রলোক; অপ্রতিভ হইয়া মুখাবনত করিলেন। নবকুমারকে নিরুত্তর দেখিয়া অপরিচিতা পুনরপি হাসিয়া কহিলেন, “আপনি কখনও কি স্ত্রীলোক দেখেন নাই, না আপনি আমাকে বড় সুন্দরী মনে করিতেছেন?” সহজে এ কথা কহিলে, তিরস্কারস্বরূপ বোধ হইত, কিন্তু রমণী যে হাসির সহিত বলিলেন, তাহাতে ব্যঙ্গ ব্যতীত আর কিছুই বোধ হইল না। নবকুমার দেখিলেন, এ অতি মুখরা, মুখরার কথায় কেন না উত্তর করিবেন? কহিলেন, “আমি স্ত্রীলোক দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ সুন্দরী দেখি নাই।” রমণী সগর্ব্বে জিজ্ঞাসা করিলেন, “একটিও না?” নবকুমারের হৃদয়ে কপালকুণ্ডলার রূপ জাগিতেছিল; তিনিও সগর্ব্বে উত্তর করিলেন, “একটিও না, এমত বলিতে পারি না।” উত্তরাধিকারিণী কহিলেন, “তবুও ভাল। সেটি কি আপনার গৃহিণী?” নব । কেন? গৃহিণী কেন মনে ভাবিতেছেন? স্ত্রী । বাঙ্গালীরা আপন গৃহিণীকে সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দরী দেখে। নব । আমি বাঙ্গালী, আপনিও ত বাঙ্গালীর ন্যায় কথা বলিতেছেন, আপনি তবে কোন দেশীয়? যুবতী আপন পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “অভাগিনী বাঙ্গালী নহে; পশ্চিমপ্রদেশীয়া মুসলমানী।” নবকুমার পর্য্যবেক্ষণ করিয়া দেখিলেন, পরিচ্ছদ পশ্চিমদেশীয়া মুসলমানীর ন্যায় বটে। কিন্তু বাঙ্গালা ত ঠিক ঠিক বাঙ্গালীর ন্যায় বলিতেছে। ক্ষণপরে তরুণী বলিতে লাগিলেন, “মহাশয় বাগ্‌বৈদগ্ধে আমার পরিচয় লইলেন; – আপন পরিচয় দিয়া চরিতার্থ করুন। যে গৃহে সেই অদ্বিতীয়া রূপসী গৃহিণী, সে গৃহ কোথায়?” নবকুমার কহিলেন, “আমার নিবাস সপ্তগ্রাম।” বিদেশিনী কোন উত্তর করিলেন না। সহসা তিনি মুখাবনত করিয়া, প্রদীপ উজ্জ্বল করিতে লাগিলেন। ক্ষণেক পরে মুখ না তুলিয়া বলিলেন, “দাসীর নাম মতি। মহাশয়ের নাম কি শুনিতে পাই না?” নবকুমার বলিলেন, “নবকুমার শর্ম্মা।” প্রদীপ নিবিয়া গেল। তৃতীয় পরিচ্ছেদ : সুন্দরীসন্দর্শনে “ – ধর দেবি মোহন মূরতি দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বরবপু আনি নানা আভরণে!” মেঘনাদবধ নবকুমার গৃহস্বামীকে ডাকিয়া অন্য প্রদীপ আনিতে বলিলেন। অন্য প্রদীপ আনিবার পূর্ব্বে একটি দীর্ঘনিশ্বাসশব্দ শুনিতে পাইলেন। প্রদীপ আনিবার ক্ষণেক পরে ভৃত্যবেশী একজন মুসলমান আসিয়া উপস্থিত হইল। বিদেশিনী তাহাকে দেখিয়া কহিলেন, “সে কি, তোমাদিগের এত বিলম্ব হইল কেন? আর সকলে কোথায়?” ভৃত্য কহিল, “বাহকেরা সকল মাতোয়ারা হইয়াছিল, তাহাদের গুছাইয়া আনিতে আমরা পাল্কীর পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। পরে ভগ্ন শিবিকা দেখিয়া এবং আপনাকে না দেখিয়া আমরা একেবারে অজ্ঞান হইয়াছিলাম। কেহ কেহ সেই স্থানে আছে; কেহ কেহ অন্যান্য দিকে আপনার সন্ধানে গিয়াছে। আমি এদিকে সন্ধানে আসিয়াছি।” মতি কহিলেন, “তাহাদিগকে লইয়া আইস।” নফর সেলাম করিয়া চলিয়া গেল, বিদেশিনী কিয়ৎকাল করলগ্নকপোলা বসিয়া রহিলেন। নবকুমার বিদায় চাহিলেন। তখন মতি স্বপ্নোত্থিতার ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া পূর্ব্ববৎভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথায় অবস্থিতি করিবেন?” নব । ইহার পরের ঘরে। মতি । আপনার সে ঘরের কাছে এখানি পাল্কী দেখিলাম, আপনার কি কেহ সঙ্গী আছেন? “আমার স্ত্রী সঙ্গে।” মতিবিবি আবার ব্যঙ্গের অবকাশ পাইলেন। কহিলেন, “তিনিই কি অদ্বিতীয়া রূপসী?” নব । দেখিলে বুঝিতে পারিবেন। মতি । দেখি কি পাওয়া যায়? নব । (চিন্তা করিয়া) ক্ষতি কি? “তবে একটি অনুগ্রহ করুন। অদ্বিতীয়া রূপসীকে দেখিতে বড় কৌতূহল হইতেছে। আগ্রা গিয়া বলিতে চাহি, কিন্তু এখনই নহে – আপনি এখন যান। ক্ষণেক পরে আমি আপনাকে সংবাদ দিব।” নবকুমার চলিয়া গেলেন। ক্ষণেক পরে অনেক লোকজন, দাসদাসী ও বাহক সিন্দুক ইত্যাদি লইয়া উপস্থিত হইল। একখানি শিবিকাও আসিল; তাহাতে একজন দাসী। পরে নবকুমারের নিকট সংবাদ আসিল, “বিবি স্মরণ করিয়াছেন।” নবকুমার মতিবিবির নিকট পুনরাগমন করিলেন। দেখিলেন, এবার আবার রূপান্তর। মতিবিবি, পূর্ব্বপরিচ্ছদ ত্যাগ করিয়া সুবর্ণমুক্তাদিশোভিত কারুকার্য্যযুক্ত বেশভূষা ধারণ করিয়াছেন; নিরলঙ্কার দেহ অলঙ্কারে খচিত করিয়াছেন। যেখানে যাহা ধরে – কুন্তলে, কবরীতে, কপালে, নয়নপার্শ্বে, কর্ণে, কণ্ঠে, হৃদয়ে, বাহুযুগে, সর্ব্বত্র সুবর্ণমধ্য হইতে হীরকাদি রত্ন ঝলসিতেছে। নবকুমারের চক্ষু অস্থির হইল। প্রভূতনক্ষত্রমালাভূষিত আকাশের ন্যায় – মধুরায়ত শরীর সহিত অলঙ্কারবাহুল্য সুসঙ্গত বোধ হইল, এবং তাহাতে আরও সৌন্দর্য্যপ্রভা বর্দ্ধিত হইল। মতিবিবি কহিলেন, “মহাশয়, চলুন, আপনার পত্নীর নিকট পরিচিত হইয়া আসি।” নবকুমার বলিলেন, “সে জন্য অলঙ্কার পরিবার প্রয়োজন ছিল না। আমার পরিবারের কোন গহনাই নাই।” মতিবিবি । গহনাগুলি না হয় দেখাইবার জন্যই পরিয়াছি। স্ত্রীলোকের গহনা থাকিলে, সে না দেখাইয়া বাঁচে না। এখন, চলুন। নবকুমার মতিবিবিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিলেন। যে দাসী শিবিকারোহণে আসিয়াছিল, সেও সঙ্গে চলিল। ইহার নাম পেষমন্‌। কপালকুণ্ডলা দোকানঘরের আর্দ্র মৃত্তিকায় একাকিনী বসিয়া ছিলেন। একটি ক্ষীণালোক প্রদীপ জ্বলিতেছে মাত্র – অবদ্ধ নিবিড় কেশরাশি পশ্চাদ্ভাগ অন্ধকার করিয়া রহিয়াছিল। মতিবিবি প্রথম যখন তাঁহাকে দেখিলেন, তখন অধরপার্শ্বে ও নয়নপ্রান্তে ঈষৎ হাসি ব্যক্ত হইল। ভাল করিয়া দেখিবার জন্য প্রদীপটি তুলিয়া কপালকুণ্ডলার মুখের প্রতি আনিলেন। তখন সে হাসি হাসি ভাব দূর হইল; মতির মুখ গম্ভীর হইল; – অনিমিষলোচনে দেখিতে লাগিলেন। কেহ কোন কথা কহেন না; – মতি মুগ্ধা, কপালকুণ্ডলা কিছু বিস্মিতা। ক্ষণেক পরে মতি আপন অঙ্গ হইতে অলঙ্কাররাশি মোচন করিতে লাগিলেন। মতি আত্মশরীর হইতে অলঙ্কাররাশি মুক্ত করিয়া একে একে কপালকুণ্ডলাকে পরাইতে লাগিলেন। কপালকুণ্ডলা কিছু বলিলেন না। নবকুমার কহিতে লাগিলেন, “ও কি হইতেছে?” মতি তাহার কোন উত্তর করিলেন না। অলঙ্কারসমাবেশ সমাপ্ত হইলে, মতি নবকুমারকে কহিলেন, “আপনি সত্যই বলিয়াছিলেন। এ ফুল রাজোদ্যানেও ফুটে না। পরিতাপ এই যে, রাজধানীতে এ রূপরাশি
false
shunil_gongopaddhay
কাকাবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সিদ্ধার্থদা কাকাবাবুর সুটকেসটা তুলে নিয়ে বললেন, চলুন কাকাবাবু বাড়িতে গিয়ে সব গল্প শুনব। আমার বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়, আপনার পছন্দ হবে। কাকাবাবু বললেন, তোমার বাড়ি? না, সেখানে তো আমরা যাচ্ছি না? সিদ্ধাৰ্থদা নিরাশ হয়ে বললেন, সে কী? আমার বাড়িতে যাবেন না? কেন? কাকাবাবু বললেন, কিছু মনে কোরো না। আমি হোটেল বুক করেই এসেছি। আমি যে ব্যাপারে এসেছি, তাতে তোমার জড়িয়ে না পড়াই ভাল। তুমি তো সরকারি কাজ করো! তারপর তিনি সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, সন্তু, তুই গিয়ে ওদের সঙ্গে থাকতে পারিস। বিদেশে এসে কোনও চেনা লোকের কাছে তোর থাকতে ভাল লাগবে। সন্তু মুখের এমন ভাব করল যেন সে প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষত রিনি ওরকম কথা বলার পর সে আর রিনির সঙ্গে একটা মিনিটও কাটাতে চায় না। স্নিগ্ধাদি অনুযোগের সুরে বলল, কাকাবাবু, আপনি যাবেন না? আমি আপনাদের জন্য চিংড়ির মালাইকারি রান্না করে রেখেছি। কত কষ্টে জোগাড় করলুম চিংড়ি… কাকাবাবু এবারে হালকা গলায় বললেন, তুমি কী করে জানলে ঐ জিনিসটা আমার সবচেয়ে ফেভারিট? ঠিক আছে, সন্ধেবেলা গিয়ে খেয়ে আসব! কিন্তু উঠতে হবে হোটেলেই। ওয়েসিস হোটেলটি বিশেষ বড় নয়। শহর ছড়িয়ে একটু বাইরের দিকে। গরমকাল বলে এই সময়ে টুরিস্টদের ভিড় নেই, হোটেল প্রায় ফাঁকা। সিদ্ধার্থ স্নিগ্ধা আর রিনি সন্তুদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে একটু পরে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কথা হল যে, সন্ধেবোলা সিদ্ধার্থ আবার এসে ওদের নিয়ে যাবে বাড়িতে। কাকাবাবু ঘর থেকেই দুতিনটে টেলিফোন করলেন। তারপর তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সন্তুকে বললেন, তুই চান-টান করে নে। আজ দুপুরে আমরা ঘরেই খেয়ে নেব। দুপুরে যা চড়া রোদ ওঠে, বাইরে বেরুনোই যায় না। গরমে সন্তুর গা চ্যাটচ্যাট করছিল, সে ঢুকে গেল বাথরুমে। সেখানকার জানলা দিয়ে দেখল, রাস্তা দিয়ে ট্রলি বাস চলছে। ঐটাই যা নতুনত্ব, নইলে কায়রো শহরটাকে বিদেশ বিদেশ মনে হয় না, ভারতবর্ষের যে-কোনও বড় শহরেরই মতন। ইজিপ্ট দেশটা যদিও আফ্রিকার মধ্যে, কিন্তু এখানে কোনও মানুষ নেই। বর্তমান ইজিপ্টের অধিবাসীরা জাতিতে আরব। স্নান সেরে বেরিয়ে এসে সন্তু দেখল, কাকাবাবু তাঁর নোটবুকে কী সব লিখছেন। সন্তু চুল আচড়াতে শুরু করতেই জরজায় ঠক ঠক শব্দ হল। কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন। সন্তু দরজা খুলতেই একজন মাঝারি চেহারার লোক জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ রাজজা রায়চৌধারি হিয়ার? কাকাবাবু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মান্টো? কাম ইন! কাম ইন? লম্বা লোকটি প্রায় ছুটে এসে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন। একেবারে দৃঢ় আলিঙ্গন। তারপর কোলাকুলির ভঙ্গি করে তিনি সরে দাঁড়ালেন। এই গরমেও ভদ্রলোক একটা আলখাল্লার মতন পোশাক পরে আছেন। মাথায় ফেজ টুপি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। দাড়ি-গোঁপ কামানো। কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন আলি সাদাত মান্টো, কায়রো মিউজিয়ামের কিউরেটর, আমার পুরনো বন্ধু। মান্টো ইংরিজিতে বললেন, রায়চৌধারি, তুমি যে এই সময় কায়রোতে এসেছ, তা শুনে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। প্রথমে। তুমি কী কাণ্ড করেছ? জানো, এখানকার সব কাগজে তোমার কথা বেরিয়েছে? কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? তা হলে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছি বলো! কী লিখেছে কাগজে আমার সম্পর্কে? মান্টো একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন, খুব গুরুতর অভিযোগ। এখানকার এক বিখ্যাত নেতা মুফতি মহম্মদ চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। সেখানে তিনি কয়েকদিন আগে হঠাৎ মারা যান। শেষ মুহূর্তে তিনি যে উইল করে যান, তুমি নাকি সেটা চুরি করেছ। কাকাবাবু অট্টহাসি করে উঠে বললেন, ওরে বাবা রে, একেবারে চোর বানিয়ে দিয়েছে? মান্টোর মুখ গভীর। তিনি বললেন, হাসির ব্যাপার নয়, রায়চৌধারি! এখানে হানি আলকাদি নামে একজন জঙ্গি নেতা আছে। সে দাবি জানিয়েছে। যে, ভারত সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তোমাকে এখানে ধরে আনাতে হবে। আর তুমি নিজেই এখানে চলে এসেছ? তোমার কতটা বিপদ তা বুঝতে পারছ না? কাকাবাবু তবু হালকা চালে বললেন, উইল যদি আমি চুরি করেই থাকি, তা হলে ভারতবর্ষে বসে থেকে লাভ কী? মুফতি মহম্মদের বিষয়-সম্পত্তি সব কিছু তো। এদেশেই। তাই না? রায়চৌধারি, তুমি গুরুত্ব বুঝতে পারছি না। হানি আলকাদি অতি সাঙ্ঘাতিক লোক। তার দলের ছেলেরা খুব গোঁড়া, নেতার হুকুমে তারা যা খুশি করতে পারে। মান্টো, তুমি বিশ্বাস করো যে, আমি কারুর উইল চুরি করতে পারি? না, না, না, আমি সে-কথা ভাবব কেন? তোমাকে তো আমি চিনি! তা ছাড়া মুফতি মহম্মদের উইল নিয়ে তুমি কী করবে? আসলে কী হয়েছে বলো তো? তার আগে তুমি আমার দুএকটা প্রশ্নের উত্তর দাও! মুফতি মহম্মদ লেখাপড়া জানতেন না, একথা ঠিক তো? হ্যাঁ, তা ঠিক। উনি কোনওদিন স্কুল-কলেজে যাননি, পড়তে বা লিখতে জানতেন না। তবে জ্ঞানী লোক ছিলেন। উইল লেখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। অনেকদিন ধরে ওঁর গলার আওয়াজও একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে উইল তৈরি হল কী করে? তাও তো বটে? এ সম্পর্কে তোমাদের কাগজে কিছু লেখেনি? না, কিছু লেখেনি। তবে হানি আলকাদি অভিযোগ করেছে যে, আল মামুন নামে এক ব্যবসায়ী তোমার সঙ্গে মুফতি মহম্মদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তারপর তুমি ঐ কাণ্ডটা করেছ! মান্টো, তোমাকে আমি আসল ঘটনোটা পরে বলব। তার আগে তুমি মৃত্যুঃ মুহম্মদ সম্পর্কে কী জানো আমাদের বলে তো। তুমি কি ওঁকে চিনতে? হ্যাঁ, ইজিপ্টে তাঁকে কে না চেনে। ওঁর বয়েস হয়েছিল একশো বছর। আমি শুনেছি সাতানব্বই। তা হতে
false
toslima_nasrin
ধুম আড্ডা হচ্ছে। ঘন ঘন চা পান হচ্ছে। দুপুর বা রাতের খাবার সময় হলে খাবার দেওয়া হচ্ছে টেবিলে। যার যখন ইচ্ছে খেয়ে নিচ্ছে। অতিথি আপ্যায়নেও আমি মার স্বভাব পেয়েছি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন, শরৎ মুখোপাধ্যায় আর বিজয়া মুখোপাধ্যায় ঢাকায় বেড়াতে এসে দেখা করে গেলেন। যে কারুকে আমি আপ্যায়ন করতে পারি, বন্ধুদের যে কেউ আমার বাড়িতে যে কদিন ইচ্ছে কাটাতে পারে, এমনই সুস্থ সুন্দর মুক্ত একটি পরিবেশ আমি ধীরে ধীরে তৈরি করে নিয়েছি। ঠিক যেরকম আমি চাই, সেরকম করে আমার সংসার, আমার জগত এবং জীবন সাজিয়েছি। আত্মীয় স্বজনের চেয়ে বন্ধুরাই আমার কাছে বেশি বড়, বেশি আপন। অবসর বলে যদি কিছু থেকে থাকে আমার, বন্ধুদের জন্যই রাখি। কালো পাহাড়ের মত মানুষটি যার মুখে কখনও হাসি ফুটতে দেখিনি সেই বাদল বসু এলেন আনন্দ থেকে নতুন প্রকাশিত বই নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য নিয়ে। বাদল বসুকে কাছ থেকে জানলে তিনি যে মোটেও বেরসিক মানুষ নন, তা বোঝা যায়। তাঁর মুখে হাসি তো ফোটেই, খুব ভাল ফোটে। ফুটলে কি হবে, আমার মুখের হাসিটি নিবে গেল যখন নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্যের পাতায় পাতায় মারাত্মক মারাত্মক ভুল দেখলাম। ‘এ কি! বইটির কি প্রুফ দেখা হয়নি!’ বাদল বসু বই ঘেঁটে বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘সব্বনাশ হয়ে গেছে, প্রুফ দেখা হয়নি।’ ‘বই বিক্রি করা তাহলে বন্ধ করুন।’ বাদল বসুর মত ডাকসাইটে লোকের মুখের ওপর বলে দিতে পারি ছাপা হওয়া পাঁচ হাজার বইয়ের বিক্রি বন্ধ করে দিতে। একটি ঝকঝকে সুন্দর পঈচ্ছদের নতুন বই হাতে নিয়ে মন ভালর বদলে মন খারাপ হয়ে থাকে। বাদল বসু বললেন ‘ছাপা যখন হয়ে গেছে তখন বিক্রি হয়ে যাক। এর পরের সংস্করণে ভুল সংশোধন করা যাবে।’ কিন্তু যে পাঠকেরা এই বইটি কিনবে তারা তো ঠকে যাচ্ছে, একটি শুদ্ধ বাক্যও পাবে না বইটিতে! ভাববে আমিই বুঝি এরকম ভুল ভাল লিখেছি। এত বড় প্রকাশনীটি নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করেনি, লেখকের অনুরোধের পরও বই বিক্রি বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে অনেক ছোট। কিন্তু আমি যদি ছোট প্রকাশনীর ছোট প্রকাশকদের বলতাম প্রুফ না দেখা বই বাজারে না ছাড়তে, আমার বিশ্বাস তারা আমার কথা রাখতেন। আনন্দ আমাকে দীর্ঘদিন বিষাদে ভরিয়ে রাখে। কিন্তু কতদিন আর বিষাদ পুষে রাখা যায়! জীবনে মনস্তাপ, সন্তাপ, বিষাদ, বিধুর, পীড়া পরিতাপের তো শেষ নেই। বিষাদকে একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন কাজে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। চারদিকের কুৎসা রটনা, নিগ্রহ নৃশংসতা, ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতার থিকথিকে কাদার ওপর আমি জানি আমাকে মেরুদণ্ড শক্ত করে চলতে হবে, না চললে যে কোনও মুহূর্তেই আমি হোঁচট খাবো। ভেঙে যাবো। আমাকে ভেঙে ফেলার জন্য হাতে হাতে হাতুড়ি। জনপ্রিয়তার যত ভাল দিক আছে, তত মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকগুলোর মধ্যে আমাকে আর পত্রিকা আপিসে যেতে হয় না লেখা দিতে, পত্রিকা থেকেই লেখা নিয়ে যেতে লোক পাঠানো হয়। যাই লিখি না কেন, যেমনই লিখি না কেন, ছাপা হয়। প্রকাশকরা টাকা রেখে যান বাড়িতে। জীবনে যে টাকা নিজের জন্য কখনও কল্পনা করতে পারিনি, সে সব অংকের টাকা আমার টেবিলে যে কোনও ঠোঙার কাগজের মত পড়ে থাকে। মন্দ দিক অনেক আছে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। একাধিক বিয়ে করেছি এর অর্থ একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি (আমার স্বামী তালিকায় এমন অনেক লোকের নাম আছে, যাদের নাম আমি জীবনে শুনিনি)। আমি বেলাজ, বেহায়া, চরিত্রহীন। সুনীলের সঙ্গে খাতির ছিল তাই সুনীল আমাকে আনন্দ পুরস্কার দিয়েছেন (আনন্দ পুরস্কার কমিটিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন, শুনেছি তিনিই একমাত্র কমিটির সদস্য যিনি আমার পুরস্কার পাওয়ায় আপত্তি করেছিলেন)। আমি পুরুষ বিদ্বেষী। আমি ধর্ম বিদ্বেষী। আমি র এর এজেন্ট। আমার লেখা লেখা নয়, পিওর পর্নোগ্রাফি। ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধু যত বাড়ে, আমার শত্রু বাড়ে দ্বিগুণ। শত্রু বাড়ে, কতরকম মানুষ যে তবু আমার কাছে আসে! নানা বয়সের মেয়ে নানা রকম সমস্যার কথা শোনাতে আসে। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে তার পরিবারের লোকেরা যে ছেলেকে তার পছন্দ নয়। স্বামীর সঙ্গে অন্য মেয়ের সম্পর্ক। স্বামী মারধোর করে। স্বামী তালাক দিয়েছে। বাবা লেখাপড়া করতে দেয় না। স্বামী চাকরি করতে দেয় না। আপিসের বস শরীর চায়। যে কথা আর কাউকে বলতে পারে না, আমার কাছে বলে, দেখেছি, তারা ভারমুক্ত হয়। নিমন্ত্রণ নামে একটি উপন্যাস বেরোলো। গল্পটি ছোট, শীলা নামের এক ষোল সতেরো বছর বয়সের মেয়ে একটি সুদর্শনের যুবকের প্রেমে পড়ে। কিন্তু প্রেমে পড়লে কী হবে, সুদর্শনের মনে তো কোনও প্রেম নেই। যুবকটি একদিন নিমন্ত্রণ করে শীলাকে, শীলা ভেবেছিল যুবকটি তাকে ভালবাসে। শীলা নিমন্ত্রণে যায়, নিমন্ত্রণ না ছাই, শীলাকে একটি খালি বাড়িতে নিয়ে কয়েকটি বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে সেই যুবক। এমন মর্মান্তিক করুণ কাহিনীটিকে লোকে বলতে লাগল অশ্লীল অশ্লীল। পড়া যায় না। ছোঁয়া যায় না। যেহেতু ধর্ষণের নৃশংস বর্ণনা দিয়েছি বইটিতে, তাই এটি অশ্লীল, তাই এটি পর্নোগ্রাফি। সমাজে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু লেখা যাবে না। লিখলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সমাজচ্যূত হব, একঘরে হব। লোকে আমাকে থুতু ছিটোবে। ছিটোয় থুতু। থুতু ছিটোনো যখন চলছে, এক বিকেলে অচেনা এক ভদ্রমহিলা এলেন আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ বইটি সম্পর্কে বলতে। বইটি তিনি একাধিকবার পড়েছেন এবং তাঁর দুই মেয়েকে পড়িয়েছেন। যে বইটি এমন নোংরা যে স্পর্শ করলে গা ধুতে
false
shottojit_roy
দৃষ্টিশক্তি কেমন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। খুবই কম, বললেন জীবনবাবু, এবং তার সঙ্গে মানানসই শ্রবণশক্তি! বাগান এমনিতে তেমন দেখাশোনা হয় না? ওই ভোলানাথবাবুই যা দেখেন। রাত্রে লোক থাকে। এদিকে? রাত্রে? মাথা খারাপ! রাত জেগে বাগানে টহল দেবে এরা? সদর দরজায় তালা দেওয়া থাকে আশা করি? ওটা ভোলানাথবাবুর ডিউটি! তবে আমি থাকলে আমিই চাবি বন্ধ করি, চাবি আমার কাছেই থাকে। ভোলানাথবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়নি; তাঁকে একবার ডাকতে পারেন! ভোলানাথবাবুকে দিনের আলোয় দেখে মনে হল তিনি শহুরে লোকের মতো ধুতি শার্ট পরলেও তাঁর চেহারায় এখনও অনেকখানি তাঁর পূর্বপুরুষের ছাপ রয়ে গেছে। খালি গা করে মাঠে নিয়ে, হাতে লাঙল ধরিয়ে দিলে খুব বেমানান হবে না। আমরা বাড়ির সামনে বাঁধানো পুকুরের ঘাটে বসে কথা বললাম। বর্ষার জলে পুকুর প্রায় কানায় কানায় ভরে আছে আর সারা পুকুর ছেয়ে আছে। শালুকে। নবীন বলে একটি চাকরকে লেবুর সরবত আনতে বললেন জীবনবাবু! চারিদিক অদ্ভুত রকম নিস্তব্ধ, কেবল দূরে কেখেকে জানি চি চি করে শোনা যাচ্ছে ট্রানজিস্টারে গান। ওটা না হলে সত্যিই যেন মনে হত আমরা কোন আদ্যিকালে ফিরে গেছি। মৃগাঙ্কবাবু আপনাদের বাড়িতে একবারই এসেছেন? ভোলানাথবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। সম্প্রতি একবারই এসেছেন। আমার আগে? আগেও এসেছেন। কয়েকবার। কাটোয়া থেকে আষাঢ় মাসে মদন গোসাঁইর দল এল, তখন মৃগাঙ্কবাবুই তাদের নিয়ে এসে কতাঁকে কোত্তন শুনিয়ে যান। এমনিতেও বার কয়েক একা আসতে দেখেছি; মনে হয়। কিন্তর্গ একটা কুষ্ঠি ছকে দেবার কথা বলেছিলেন। সে কুষ্ঠি হয়েছে? আজ্ঞে তা বলতে পারব না। এবার যে এলেন, তার ব্যবস্থা কে করল? আজ্ঞে কর্তার নিজেরই ইচ্ছা ছিল, আর কবিরেজ মশাইও বললেন, আর-আজ্ঞে, আমিও বলেছিলাম। আপনার তো যাতায়াত আছে ভটচায বাড়িতে? আজ্ঞে হ্যাঁ। ভক্তি হয়? ভোলানাথবাবুর মাথা হেঁট হয়ে গেল। আজ্ঞে কী আর বলব বলুন। আমার মেয়ের নাম ছিল লক্ষ্মী, যেমন নাম তেমনি মেয়ে, এগারোয় পড়তে না পড়তে ওলাউঠেীয় চলে গেল। মৃগাঙ্কবাবু শুনে বললেন, সে কেমন আছে জানতে চাও তার নিজের কথায়? ভোলানাথবাবু অন্ধকারে ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, সেই মেয়েকে নামিয়ে আনলেন ভট্টচাষ মশাই! মেয়ে বললে ভগবানের কোলে সে সুখে আছে, তার কোনও কষ্ট নাই! মুখে বললে না। অবিশ্যি, কাগজে লেখা হল। সেই থেকে… ভোলানাথবাবুর গলা আবার ধরে গেল। ফেলুদা ব্যাপারটাকে আর না বাড়িয়ে বলল, এ বাড়িতে আত্মা নামানোর সময় আপনি ছিলেন? ছিলাম, তবে ঘরের মধ্যে ছিলাম না, দরজার বাইরে। ভেতরে কেবল কতামশাই আর ভটচাষ মশাই আর নিত্যানন্দ ছাড়া কেউ ছিলেন না। মা ঠাকরুন যেন জানতে না পারেন। এইটে বলে দিয়েছিলেন কর্তামশাই, তাই দরজায় পাহারা থাকতে হল। তা হলে আপনি কিছুই শোনেননি? আজ্ঞে দশ মিনিট খানেক চুপচাপের পর মধু সরকারের বাঁশ বনের দিক থেকে যখন শেয়াল ডেকে উঠল। সেই সময় যেন কতামশাইয়ের গলায় শুনলাম।–কেউ এলেন, কেউ এলেন? তারপর আর কিছু শুনিনি। সব হয়ে যাবার পর ভটচার্য মশাইকে নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। সরবত খাওয়া শেষ করে একটা চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা বলল, দুর্লভ মল্লিকের লোক আপনাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল সে কথা মনে পড়ে? ভোলানাথবাবুর উত্তর এল ছোট্ট দুটো কথায়। তা পড়ে। আপনার মনে আক্রোশ নেই? ফেলুদাকে এ ধরনের ধাক্কা-মারা প্রশ্ন করতে আগেও দেখেছি। ও বলে এই ধরনের প্রশ্নের রিঅ্যাকশন থেকে নাকি অনেক কিছু জানা যায়। ভোলানাথবাবু জিভ কেটে মাথা হেঁট করলেন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, এখন মাথাটা ঠিক নেই। তাই, নইলে কতাৰ্মশাইয়ের মতো মানুষ কজন হয়? ফেলুদা আর কোনও প্রশ্ন করল না। ভোলানাথবাবু একটুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, যদি অনুমতি দেন-আমি একটু ভটচার্য মশাইয়ের বাড়ি যাব। ফেলুদা বা জীবনবাবুর কোনও আপত্তি নেই জেনে ভদ্রলোক চলে গেলেন। জীবনবাবু একটু উস্‌খুস্‌ করছেন দেখে ফেলুদা বলল, কিছু বলবেন কি? আপনি কিছুটা অগ্রসর হলেন কি না জানার আগ্রহ হচ্ছে। বুঝলাম ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তিত। ফেলুদা বলল, ভোলানাথবাবুকে বেশ ভাল লাগল। জীবনবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। তার মানে আপনি বলতে চান— আমি নিশ্চয়ই বলতে চাই না আপনাকে আমার ভাল লাগে না। আমি বলতে চাই শুধু দু-একটা খটকার উপর নির্ভর করে তো খুব বেশি দূর এগোনো যায় না-বিশেষ করে সেই খটকাগুলোর সঙ্গে যখন মূল ব্যাপারটার কোনও সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যেটা দরকার সেটা হল কোনও একটা ঘটনা যেটা— কে রে, কে ওখানে? ফেলুদার কথা থেমে গেল, কারণ ঠাকুমা চেঁচিয়ে উঠেছেন। আওয়াজটা এসেছে বাড়ির পিছন দিক থেকে। চারদিক নিস্তব্ধ বলে গলা এত পরিষ্কার শোনা গেল। ফেলুদা দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে সোজা বাগানের দিকে ছুটছে। আমরাও তার পিছু নিলাম; লালমোহনবাবু এতক্ষণ পুকুরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছিলেন। তিনিও দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে দিলেন ছুট। তিনটে টর্চের আলোর সাহায্যে আমরা বাগানে গিয়ে পৌঁছলাম! ফেলুদা এগিয়ে গেছে, সে পশ্চিমের পাঁচিলের গায়ে একটা ধসে যাওয়া অংশের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে টর্চ ফেলে রয়েছে।কাউকে দেখলেন? জীবনবাবু প্রশ্ন করলেন। দেখলাম, কিন্তু চেনার মতো স্পষ্ট নয়। আধঘণ্টা ধরে মশার বিনবিনুনি আর কামড় আর বিঝির কান ফাটানো শব্দের মধ্যে সারা বাগান চষে যেটা পাওয়া গেল সেটা একটা চরম রহস্য। সেটা হল বাগানের উত্তর দিকের শেষ মাথায় একটা গাছের গুড়ির পাশে একটা সদখোঁড়া গর্ত। তার মধ্যে যে কী ছিল বা কী থাকতে পারে সে ব্যাপারে জীবনবাবু কোনওরকম আলোকপাত করতে পারলেন
false
humayun_ahmed
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাকের বলল শালা মদনা। হারামজাদার সবগুলি দাঁত আমি খুলে ফেলব। বকুল খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসির কি হল? এর মধ্যে হাসির কি হল? কেউ একটা মোমবাতি আনো না। আরো ব্যাপার কি? হ্যারিকেন, মোমবাতি, কুপী কিছুই পাওয়া গেল না। এ রকম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় শওকত সাহেব মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ওরা জিজ্ঞেস করবে মিষ্টি কি জানো? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। মুনা এক টুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল বাসি সন্দেশ। কোথেকে আনলে মামা? শওকত সাহেব রাত আটটায় সন্দোশের দোকানে রওনা হলেন ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা নিয়ে আসতে। বয়স হয়েছে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুনার কাছ থেকে চেয়ে রিকশা ভাড়াটা নিয়ে এলে হত। ঠাণ্ডাও লাগছে। এবার কি আগেভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? গরম চাদরটা সঙ্গে আনলে হত। টিনা বিরক্ত হয়ে বলল দুঘণ্টা আগে আসবার জন্যে খবর পাঠালাম না? কাজ ছিল ভাবী। টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, অল্পের জন্যে মিস কবলি, তোর ডাক্তার এসেছিল। বকুল বড় লজ্জা পেল। ইদানীং টিনা ভাবী কথায় কথায় বলছে তোর ডাক্তার। কি লজ্জার ব্যাপার, কারো কানে গেলে কি হবে কে জানে। বাচ্চাদের গা গরম, ডাক্তার ডাকতে হয়। কোন ডাক্তারকে আর ডাকি, তোর ভাইকে বললাম বকুলের ডাক্তারকেই ডাক। বকুল লাল হয়ে বলল কি যে তুমি কর ভাবী। টিনা বকুলের কোলে একটা বাচ্চা তুলে দিল। গা সত্যি গরম, মুখে লাল লাল কি দেখা যাচ্ছে। ওর কি হয়েছে ভাবী? কিছু না, মাসি-পিসি। সব বাচ্চাদের হয়। তোকে একটা বিশেষ কাজে ডেকেছি। বকুল। একটা না দু’টা বিশেষ কাজ। প্রথমটা হচ্ছে নাম ঠিক করেছিস? উঁহু। আজকেই নাম চাই। খুব জরুরি। কেন এত জরুরি কেন? টিনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলিল বাচ্চাদের দাদা চিঠি দিয়েছে। নাতীদের নাম যেন ফজলুর সঙ্গে মিল রেখে বজলু আর মজনু রাখা হয়। তোর ভাই বলছে, বাবা যা চান তাই রাখ। আমি মরে গেলেও ছেলেদের নাম বজলু মজনু রাখব না। এখন ছেলেদে বা কত সুন্দর সুন্দর নাম হয়, আর আমার দুটোর নাম হবে বজলু আর মজনু? বকুল হেসে ফেলল। টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসির কি হল? সুন্দর সুন্দর নাম দশ মিনিটের ভেতর বের কবি; ঠিক আছে করব, এখন দ্বিতীয় জরুরি কথাটি বল? তোর ডাক্তারকে আজ বললাম তোর কথ। তার মানে। খোলাখুলি বললাম। প্রথমে চা-টা খাইয়ে ভাই সম্পর্ক পাতালাম, তাপ প<ং পল পাম তুমি বয়সে আমার ছোট হবারই কথা, কাজেই তুমি বলছি। বকুল বলল, থাক ভাবী আমি আর শুনতে চাই না। শুনতে না চাইলে উঠে চলে যা, আমার যেটা বলার সেটা বলে যাচ্ছি। তারপর আমি বললাম তুমি কি ভাই বকুল নামের কোনো মেয়েকে চোন? সে দেখি লজ্জায টমেটোর মত হয়ে গেল। আমি বললাম। ওকে আমি ছোটবেলা থেকে চিলি। এ রকম মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম জন্মায়। তুমি যদি চাও এই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়েব ব্যবস্থা করি। বকুল ভেবেছিল সে কোনো জবাব দেবে না, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে বলল, উনি কি বললেন? কি বললেন সেটা শোনাল দরকার নেই। শুনলে পায়া ভাবী হয়ে যাবে। তোর মুনা। আপা বাসায়। আছে? তার সঙ্গে আমার কথা আছে। আছে বাসায়? না। কোথায় গেছে? জানি না। মামুন ভাইয়ের কাছে বোধ হয়। কখন আসবে? সন্ধ্যার পর চলে আসবে। ঠিক আছে সন্ধ্যার পর আমি যাব তোদের বাসায়। বকুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পানি চলে এসেছে। সে টিনা ভাবীর কাছে তা গোপন করতে চায়। টিনা হেসে বলল, কেঁদে গাল ভাসাচ্ছিস কেন বোকা মেয়ে? যা, বাসায় চলে যা। তোর আপাকে বলিস মনে করে আমি আসব। জরুরি কথা আছে তার সাথে। টিনা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বকুল দীর্ঘ সময় বসে বসে কাঁদল। দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। মামুন তাকিয়ে আছে। রাগী চোখে। এমন রাগী চোখে তাকিয়ে থাকার মত তো কিছু হয়নি। মুনার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছিল। সে বলল–চল যাই, কথা তো শেষ হল। না শেষ হয়নি, আরো কথা আছে। মামুন একটা সিগারেট ধরাল। মুনা ঘড়ি দেখল আটটা প্রায় বাজে বাজে। কল্যাণপুরের হাজি সাহেবের বাসায় আসতে অনেকখানি সময় লেগেছে। এখানে না এলেও চলত। এমন কোনো জরুরি কথা মামুনের ছিল না। যা শোনার জন্যে তাকে কল্যাণপুরের এই বাসায় আসতে হবে। মুনার নিজের হাতের কেনা জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ান। থালা বাটি চায়ের কাপ। কাটা চামচ। বসার মোড়া। দেখতে এমন মায়া লাগে। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। দিনের অবস্থা ভাল না। আকাশে মেঘ করেছে। বাড়ি ফেরা দরকার। মামুন হাতে সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল। তুমি তাহলে আমাকে বিয়ে করবে না? করব না এমন কথা তো বলিনি। বলেছি এখন না। একই কথা। এখন না মানে কখনো না। মুনা চুপ করে রইল। মামুন ধমকে উঠল–কথা বলছ না কেন? কি বলব? তোমার মনে কি আছে সেটা বল? তোমাকে বলার মত তেমন কিছু আমার নেই। তুমি একজন স্বার্থপর মানুষ। আমার ভাল লাগে না। মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল আমার মাথা ধরেছে। বাসায় যাব। মামুন হঠাৎ উঠে দরজার ছিটিকিনি তুলে দিল। মুনা বলল কি করছ? তেমন কিছু না। মামুন বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাতি নিভিয়ে জড়িয়ে ধরল। মুনাকে। মুনা একবার ভাবল আকাশ ফাটিয়ে
false
shunil_gongopaddhay
যে বড় হয়ে গেছে, মনেই থাকে না। ইয়াং লেডি বলা উচিত। এই ইয়াং লেডির নাম শ্রীমতী রাণু অধিকারী, আর এই তরুণ ইংরেজটি লিওনার্ড এন্মহার্স্ট, রাণু এস্রাজ বাজায় আর আমার লেখায় বিঘ্ন ঘটায়, আর এই সাহেবটি গ্রাম বাংলা সুজলা সুফলা করে দেবে। রাণু বলল, এঁকে আমি অনেকবার দেখেছি। এল্‌মহার্স্ট করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে নিয়েও তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নিয়ে যুক্তকরে বলল, নমস্কার। রাণুও নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, আপনি বাংলা জানেন? এল্‌মহার্স্ট বলল, একটু একটু। রাণু বলল, আমিও একটু একটু ইংরিজি জানি। কবি বললেন, একজন এক ঝুড়ি ভাল আম দিয়ে গেছে। লিওনার্ড, তুমি আম খাও? তক্ষুনি ঘরে ঢুকলেন অ্যান্ড্রুজ। কবি বললেন, স্যার চার্লস তো ওসব ছুঁয়েও দেখেন না। অ্যান্ড্রুজকে কবি মাঝে মাঝে কৌতুক করে স্যার চার্লস বলে সমোধন করেন। উনি পেটরোগা মানুষ, খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে খুব খুতখুতে। তিনি দু’হাত নাড়লেন। এমহার্স্ট বলল, আম তো অতি উপাদেয় আর স্বাস্থ্যকর ফল। রাণু একটা পাকা আম দিল এল্‌মহার্স্টের হাতে। এল্‌মহার্স্ট সেটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। ছুরি দিয়ে খোসা না ছাড়িয়ে খাবে কী করে। রাণু আর একটা আম নিয়ে বলল, এই দেখুন। প্রথমে দু’হাতে আমটাকে একটু পাকিয়ে তুলতুলে করতে হয়। তারপর– রাণু সেই প্রক্রিয়াটি দেখাতে দেখাতে তার শুভ্র দাঁতে আমটার তলার দিকের খোসা খানিকটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চুষতে চুষতে এল্‌মহার্স্টের দিকে চোখের ইঙ্গিতে বলল, এরকম করুন। এল্‌মহার্স্ট কবির দিকে তাকিয়ে বললেন, কত কিছু শেখার আছে। অ্যান্ড্রুজের সব সময় অতি ব্যস্ততার ভঙ্গি। তিনি বললেন, গুরুদেব, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। তারপর তিনি অপর দু’জনের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন এরা থাকলে সেই গোপন কথা বলা চলবে না। রাণু ওঁর পেছন থেকে এমন একটা মুখভঙ্গি করল, যা দেখে এল্‌মহার্স্ট হাসি চাপল অতি কষ্টে। রাণুই বেরিয়ে গেল আগে। অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কবি একবার জানলা দিয়ে দেখলেন, আম্রকুঞ্জ দিয়ে এল্‌মহার্স্ট আর রাণু হেঁটে যাচ্ছে পাশাপাশি। রাণুর সম্প্রতি এক বিশেষ জ্বালা হয়েছে। সবাই তাকে দেখলেই বলে, তুমি কী সুন্দর, তুমি কী সুন্দর! সমবয়সী থেকে বুড়োরা পর্যন্ত। রাণু বুঝতেই পারে না, সে কীসের সুন্দর। তার দিদিরা আরও বেশি। সুন্দর। সবাই তো সুন্দর। যে যার মতন। আর সুন্দর হলেই বা কী, তা সর্বক্ষণ বলতে হবে কেন? এক একটা গাছ, কত ফুল, কত প্রজাপতি সুন্দর। ফাল্গুন মাসের বাতাস সুন্দর, নদীর ওপর বৃষ্টি পড়া সুন্দর, মাটিতে লুটোনো জ্যোৎস্না সুন্দর, পৃথিবীতে কত কিছু সুন্দর আছে, তা বলে কি লোকেরা সব সময় সে সব দেখে সুন্দর সুন্দর বলে লাফাচ্ছে? কাশীর রাস্তায় আজকাল মাঝে মাঝেই এক একটা ছেলে তার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায়। সে চিঠির প্রথম লাইন, বাংলা বা হিন্দিতে হবেই, তুমি কী সুন্দর! বাকিটা আর পড়ে না রাণু, ছিঁড়ে ফেলে দেয়। শান্তিনিকেতনেও অনেক বয়স্ক ব্যক্তির রাণুকে একলা দেখলেই গলার আওয়াজ বদলে যায়। কেমন যেন গদো গদো ভাব। রাণুর ভাল লাগে না। এই তো সেদিন তপনদাদা সন্ধেবেলা একটা ছাতিম গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, রাণুকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। প্রথমে কিছুই বললেন না, রাণুর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ছাতিম গাছে অনেক ফুল এসেছে। সেই ফুলে কেমন যেন মশলা মশলা গন্ধ, সেই গন্ধে মাদকতা আসে। রাণুর অস্থিরতা দেখে একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ রাণু? এই কথাটা অনেক রকম ভাবে বলা যায়, এক এক রকম উচ্চারণে বদলে যায় অর্থ। আগে থেকে উত্তর জেনেও এরকম প্রশ্ন কেন করে মানুষ? কাছেই কবির নতুন মাটির বাড়ি। জানলায় জ্বলছে আলো, রাণু আঙুল দিয়ে সেই দিকে দেখাল।। তপনদাদা বললেন, কী সুন্দর হয়েছ তুমি। তোমাকে দেখে কালিদাসের সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব’র কথা মনে হচ্ছে। রাণু বলল, ওসব বলবেন না তপনদাদা। তপনদাদা বললেন, কেন, কেন, কেন? মহান কবির কাব্যে যেমন লেখা হয়েছে, তা যদি চোখের সামনে দেখতে পাই, তখন যে বিস্ময়ের চমক লাগে। কালিদাস বুঝি আমাকে দেখে লিখেছেন? কবিদের সুদুর দৃষ্টি থাকে। তিনি এক সময় কল্পনায় যে রূপ দেখেছিলেন, তা তোমার মধ্যে জীবন্ত হয়েছে! আমি এখন যাই? আর একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাও না। রোজই ভাবি, তোমাকে একটা কথা বলব। বলুন না। অমন করে কি ঝট করে বলা যায়? এ তো কাজের কথা নয়, মনের কথা। তুমি এত সুন্দর রাণু, তোমাকে দেখতে দেখতেই– তা হলে আমি এখন আর দাঁড়াতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে রাণু ছুট লাগাল। তার বলতে ইচ্ছে হল, সুন্দর হয়েছি তো বেশ করেছি, তাতে আপনার কী? একমাত্র তার ভানুদাদা কখনও তাকে তুমি কি সুন্দর, তুমি কি সুন্দর বলেন না। ভানুদাদা তো তার বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে কখনও খুব ভাব, কখনও আড়িও হয়। কখনও অভিমানে কথা বন্ধ হয়ে যায়, আবার এক ঘণ্টার মধ্যে গলা জড়িয়ে কত কথা। কখনও হাসি, কখনও কান্না। রাণু তত কাঁদেই, সে যেদিন কাশীতে ফিরে যায়, সেদিন ভানুদাদার চোখও চিকচিক করতে দেখেছে। ভানুদাদার ঘরে বেশি মানুষজনের ভিড় দেখলে রাগ হয় রাণুর। সে তো আর সর্বক্ষণ এখানে থাকে না, ছুটি পেলেই চলে আসে। সেই কটা দিন সে ভানুদাদাকে আপন করে পেতে চায়। যদিও সে মনে মনে জানে, তা সম্ভব নয়। তোকজন তো আসবেই। ভানুদাদা যে বিরাট মানুষ, তিনি কত রকম কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। এত রকম কাজ করতে ভালও বাসেন, আবার কাজ থেকে যখন তখন ছুটি
false
shirshendu
ও বিলেত যেতে চাইছে না কেন এবং বিয়েটাই বা কেন পিছোতে চাইছে। পারবেন না জেনে আসতে? চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমাকে উনি হয়তো গুরুত্বই দেবেন না। আপনাকেও খুব ভোলমানুষ বলে জানে। তা ছাড়া আপনি ইনোসেন্ট থার্ড পার্টি। আপনাকে বলতে ওর আপত্তি হবে না। শুধু মনে রাখবেন, আমি পাঠিয়েছি বলে যেন টের না পায়। মানুষ তো আত্মহত্যাও করে, চয়নের এই অভিযান না হয় সেরকমই একটা কিছু হবে। মরিয়া হয়ে সে ঘাড় কাত করে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। চারুশীলা উজ্জ্বল হয়ে বলল, বাঁচালেন। কি ভাবে যাবেন বলুন তো? আপনি বরং আমাদের গাড়িটা নিয়ে শনিবার সকালে ক্যানিং চলে যান। সেখান থেকে বোধ হয় লঞ্চ ছাড়ে। জিজ্ঞেস করে করে চলে যাবেন। গাড়িটা ওখানেই থাকবে। কাজ সেরে ফিরে আসবেন। চয়ন ম্লান একটু হেসে বলে, গাড়ি! গাড়ির কোনও দরকার নেই। ক্যানিং-এ অজস্র ট্রেন যায়। ভ্রূ কুঁচকে চারুশীলা বলে, আপনি আমার কাজে যাচ্ছেন! আমার দায়িত্ব। চয়ন বিনীতভাবে বলল, গাড়িতে সময় বেশি লাগবে। অকারণ অপচয়। কোনও দরকার নেই। ঠিক আছে, তা হলে যাতায়াতের জন্য আমি আপনাকে এক হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি। চয়ন আতঙ্কিত হয়ে বলে, দশ বিশ টাকার বেশি লাগবে না। আপনি কি ভিখিরির মতো যাবেন নাকি? রাস্তায় খেতেও তো হবে। খেতে ধরুন আর দশ টাকা লাগতে পারে। তবু রাখুন। পথে বেরোতে সব সময়ে বেশি টাকা সঙ্গে রাখতে হয়। আপত্তি করা সত্ত্বেও চারুশীলা হাজার টাকাই গছিয়ে ছাড়ল। বলল, সবটাই খরচ করবেন। কৃপণের মতো হিসেব করবেন না। ট্রেনে অবশ্যই ফাস্ট ক্লাসে যাবেন। লোকাল ট্রেনে ফাস্ট ক্লাস নেই যে। ট্যাক্সি করে যাবেন তা হলে। যা খুশি করবেন, কিন্তু কিছু ফেরত দিতে পারবেন না। শনিবারের তো এখনও দেরি আছে। দেরি! কোথায় দেরি? মাঝখানে তো মোটে দুটো দিন! চয়ন উদ্বেগের সঙ্গে একটা শ্বাস ছাড়ল। চারুশীলা আরও কিছু একটা গুরুতর এবং পাগুলে প্রস্তাব করতে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে বলল, মাসি, আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি যে! এখানে বসে আছ! ওঃ ঝুমকি! আমার যে কী বিপদ যাচ্ছে! চলো, ও ঘরে গিয়ে বসি। ঝুমকিকেও চেনে চয়ন। তার দিকে চেয়ে চমৎকার দাঁতে ঝলমল করে হেসে বলল, ভাল আছেন চয়নবাবু? সয়ন তটস্থ হয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওরা উঠে যাওয়ার পর খানিকটা স্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। এই খ্যাপাটে মহিলার সঙ্গ যদিও উদ্বেগজনক, তবু চারুশীলাকে কখনও অপছন্দও করতে পারে না চয়ন। অনেকটা এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতোই এসে সব ওলট-পালট শনিবার সকালে খুব উদ্বেগের সঙ্গেই রওনা হল চয়ন। কলকাতার বাইরে সে কমই গেছে। সুন্দরবণ তার সম্পূর্ণ অচেনা রাজ্য। প্রথম প্রথম ভয়-ভয় করছিল। তারপর ট্রেনে হাজারো রকমের লোক দেখে তার মনে হল, মানুষ কত কাজে কত দিকে যায়, ভয়ের কী! ভয় শুধু একটা। যদি হঠাৎ মাঝপথে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার মৃগী রোগের তো কোনও সৌজন্য বোধ বা লজ্জা নেই। যেখানে সেখানে প্রকাশ ঘটে। এবারে অনেকদিন ঘাপটি মেরে আছে। হঠাৎ কখন যে লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে তার ঠিক নেই। ক্যানিং পৌঁছে সে খোঁজ নিল। তারপর মজার নৌকো ভটভটিতে চেপে বসল। সাতার জানে না, তবু খুব একটা ভয় হচ্ছিল না তার। ভয় আসলে বসে আছে সামনের কোনও তীরবতী গ্রামে, হেমাঙ্গ সেজে। লোকটা এমনিতে ভদ্র ও সুজন। কিন্তু আজকের পর থেকে হেমাঙ্গ আর সুজন থাকবে না। তার কাছে। একটা লোকের সঙ্গে তার চিরবিচ্ছেদ ঘটবেই ঘটবে। খুবই সাফল্যের সঙ্গে সে উদ্দিষ্ট গায়ের ঘাটে ভটভটি থেকে নামল। তারপর সামান্য খোঁজ নিতেই হেমাঙ্গর ঘরখানা খুঁজে পেল। নদীর ধারেই ঘর। একটু গাছপালা আছে। ফাঁকা ও সুন্দর জায়গায় ঘরখানা দেখেই ভাল লাগল। তার। বাঃ, বেশ তো! এরকম জায়গায় এসে থাকতে ভালই লাগার কথা। উঠোনে ঢুকে চয়ন একটু গলাখীকারি দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, হেমাঙ্গবাবু! কেউ সাড়া দিল না। ঘরের দরজা বন্ধ। হেমাঙ্গীবাবু কি আছেন? আরও কয়েকবার ডাকার পর দরজাটা খুলে হেমাঙ্গ বেরিয়ে এল। তবে প্রথম দর্শনেই যেন চিনতে পারল না। কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল, আরে! চয়নের পালানোর বা পিছোনোর উপায় নেই। সুতরাং সে দুপা এগিয়ে বলল, আমি চয়ন। হেমাঙ্গ হঠাৎ হাসল। সমস্ত মুখটা উদ্ভাসিত হল সেই হাসিতে। বলল, ইটস এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! আপনি এখানে কি করে এলেন? চয়ন আমতা আমতা করে বলল, এদিকটা দেখা ছিল না। তাই— সে তো বটেই। এটা বেড়ানোর মতো জায়গাও নয়। শহুরে মানুষের কাছে। কিন্তু আমি এখানে থাকি কে বলল তাপনাকে? শুনলাম। আসুন, আসুন। ঘরে তেমন আসবাব কিছু নেই। বেশ নাড়া। একখানা তক্তপোশ, একখানা মোড়া এবং খুবই পলকা ধরনের একখানা টেবিল আর চেয়ার। চেয়ারে তাকে বসতে দিয়ে হেমাঙ্গ বিছানায় বসল। বলল, কিছু খাবেন? না। একটু জল খেলেই হবে। জলটা দিয়ে হেমাঙ্গ খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, চারুদি আপনাকে পাঠিয়েছে, না? বিষম খেয়ে সামলে নিয়ে চয়ন বলে, কথাটা কবুল করা বারণ। হেমাঙ্গ হাসল, কবুল করতে হবে না। আমি জানি। চয়ন গেলাসটা রেখে বলল, আমি আসতে চাইনি। উনি জোর করে বুঝতে পারছি। তবু মন্দের ভাল। আপনার বদলে চারুদি এলে অবস্থাটা খারাপ হত। উনি কিছু জানতে চান! হেমাঙ্গ একটু মাথা নেড়ে বলে, তাও জানি। চারুদি অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু কি জানাবো তাই যে আমি জানি! চয়ন সভয়ে বলল, উনি খুব ইনসিস্ট্যান্ট।
false
shottojit_roy
কোনও কারণ আছে। ফেলুদা বলল, ঠিক আছে। আপনি নিশ্চিন্তু থাকলেই হল। ফেলুদা আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে প্রথম ডিটেকটিভ ঔপন্যাসিকের লেখা বই চারখানা তার ঝোলার মধ্যে পুরে নিল। তোমরা চা খেয়েছ তো? কালীকিঙ্করবাবু জিজ্ঞেস করলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ ড্রাইভারকে বলা আছে। গাড়ি ঝর করেই রেখেছে। তামাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। বিশ্বনাথ খুব ভোরে বেরিয়ে গেছে। বলল ওর দশটার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছতে পারলে সুবিধে হয়। রাজেন গেছে বাজারে। গোকুল তোমাদের জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দেবে।..তোমরা কি স্টেশনে যাবার আগে একটু আশেপাশে ঘুরে দেখতে চাও? ফেলুদা বলল, আমি ভাবছিলাম সাড়ে দশটার ট্রেনটার জন্য অপেক্ষা না করে এখনই বেরিয়ে পড়লে হয়তো ৩৭২ ডাউনটা ধরতে পারব। তা বেশ তো, তোমাদের মতো শহুরে লোকেদের পল্লীগ্রামে বন্দি করে রাখতে চাই না আমি। তবে তুমি আসাতে আমি যে খুবই খুশি হয়েছি—সেটা আমার একেবারে অন্তরের কথা। কাল রাত্তিরের বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে পলাশী স্টেশনের দিকে যেতে আমি সকাল বেলার রোদে ভেজা ধান ক্ষেতের দৃশ্য দেখছি, এমন সময় শুনলাম ফেলুদা ড্রাইভারকে একটা প্রশ্ন করল। স্টেশনে যাবার কি এ ছাড়া আর অন্য কোনও রাস্তা আছে? আজ্ঞে না বাবু, বলল মণিলাল ড্রাইভার। ফেলুদার মুখ গম্ভীর। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি ও কী ভাবছে, কোনও সন্দেহের কারণ ঘটেছে কি না; কিন্তু সাহস হল না। রাস্তায় কাদা ছিল বলে দশ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট লাগল স্টেশনে পৌঁছতে। মাল নামিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। ফেলুদা কিন্তু টিকিট ঘরের দিকে গেল না। মালগুলো স্টেশনমাস্টারের জিন্মায় রেখে আবার বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে এল। রাস্তায় সাইকেল রিকশার লাইন। সবচেয়ে সামনের রিকশার মালিকের কাছে গিয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, এখানকার থানাটা কোথায় জানেন? জানি, বাবু। চলুন তো। তাড়া আছে। প্রচণ্ডভাবে প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন দিতে দিতে ভিড় কাটিয়ে কলিশন বাঁচিয়ে আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে থানায় পৌঁছে গেলাম। ফেলুদার খ্যাতি যে এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সেটা বুঝলাম যখন সাব-ইন্সপেক্টর মিস্টার সরকার ওর পরিচয় দিতে চিনে ফেললেন। ফেলুদা বলল, ঘুরঘুটিয়ার কালীকিঙ্কত মজুমদার সম্বন্ধে কী জানেন বলুন তো। কালীকিঙ্কর মজুমদার? সরকার ভুরু কুঁচকোলেন। তিনি তো ভাল লোক বলেই জানি মশাই। সাতেও নেই পাঁচেও নেই। তাঁর সম্বন্ধে তো কোনওদিন কোনও বদনাম শুনিনি। আর তাঁর ছেলে বিশ্বনাথ? তিনি কি এখানেই থাকেন? সম্ভবত কলকাতায়। কেন, কী ব্যাপার, মিস্টার মিত্তির? আপনার জিপটা নিয়ে একবার আমার সঙ্গে আসতে পারবেন? ঘোরতর গোলমাল বলে মনে হচ্ছে। কাদা রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে জিপ ছুটে চলল। ঘুরাঘুটিয়ার দিকে। ফেলুদা প্ৰচণ্ড চাপা উত্তেজনার মধ্যে শুধু একটিবার মুখ খুলল, যদিও তার কথা আমি ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। আরথ্রিাইটিস, সিন্দুকে দাগ, ডিনারে বিলম্ব, রাজেনবাবুর গলা ধরা, ন্যাফথ্যালিন–সর্ব ছকে পড়ে গেছে রে তোপ্‌সে। ফেলুমিত্তির ছাড়াও যে অনেক লোকে অনেক বুদ্ধি রাখে। সেটা সব সময় খেয়াল থাকে না। মজুমদার-বাড়ি পৌঁছে প্রথম যে জিনিসটা দেখে অবাক লাগল সেটা হল একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। ফটকের বাইরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে এটাই নিঃসন্দেহে বিশ্বনাথবাবুর গাড়ি। জিপ থেকে নামতে নামতে ফেলুদা বলল, লক্ষ কর গাড়িটাতে কাদাই লাগেনি। এ গাড়ি সবেমাত্র রাস্তায় বেরোল। বিশ্বনাথবাবুর ড্রাইভারই বোধহয়—কারণ এ লোকটাকে আগে দেখিনি—আমাদের দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে মুখ ফ্যাকাসে করে গেটের ধারে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তুমি এ গাড়ির ড্রাইভার? ফেলুদা প্রশ্ন করল। আ-আজ্ঞে হ্যাঁ— বিশ্বনাথবাবু আছেন? লোকটা ইতস্তত করছে দেখে ফেলুদা আর অপেক্ষা না করে সোজা গিয়ে ঢুকল বাড়ির ভিতর–তার পিছনে দারোগা, আমি আর একজন কনস্টেবল। আবার সেই প্যাসেজ দিয়ে গিয়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে ফেলুদা এবং আমরা তিনজন সোজা ঢুকলাম কালীকিঙ্করবাবুর ঘরে। ঘর খালি। বিছানায় কম্বলটা পড়ে আছে। আর যা ছিল সব ঠিক তেমনিই আছে, কিন্তু মালিক নেই। সর্বনাশ। বলে উঠল ফেলুদা। সে সিন্দুকটির দিকে চেয়ে আছে। সেটা হা করে খোলা। বেশ বোঝা যাচ্ছে তার থেকে অনেক কিছু বার করে নেওয়া হয়েছে। দরজার বাইরে গোকুল এসে দাঁড়িয়েছে। সে থরথর করে কাঁপছে। তার চোখে জল। দেখে মনে হয় যেন তার শেষ অবস্থা। তার উপর হুমড়ি দিয়ে পড়ে ফেলুদা বলল, বিশ্বনাথবাবু কোথায়? তিনি পিছনের দরজা দিয়া পালিয়েছেন। দেখুন তো মিস্টার সরকার! দারোগা আর কনস্টেবল অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে গেল। শোনো গোকুল—ফেলুদা দুহাত দিয়ে গোকুলের কাঁধ দুটোকে শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল—একটিও মিথ্যে কথা বললে তোমায় হাজতে যেতে হবে। —কালীকিঙ্করবাবু কোথায়? গোকুলের চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। আজ্ঞে—আজ্ঞে—তাঁকে খুন করেছেন। কে? ছোটবাবু। কবে? যেদিন ছাটবাবু এলেন সেদিনই। রাত্তির বেলা। বাপ-বেটায় কথা কাটাকাটি হল। ছোটবাবু সিন্দুকের নম্বর চাইলেন, কর্তাবাবু বললেন—আমার টিয়া জানে, তার কাছ থেকে জেনে নিয়ো, আমি বলব না। তারপরে-তারপরে—তার কিছুক্ষণ পরে—ছোটবাবু আর তেনার গাড়ির ডেরাইভারবাবু, দুজনে মিলে— গোকুলের গলা ধরে এল। বাকিটা তাকে খুব কষ্ট করে বলতে হল— দুজনে মিলে কর্তাবাবুর লাশ নিয়ে গিয়ে ফেলল ওই পিছনের দিঘির জলে—গলায় পাথর বেঁধে। আমার মুখ বন্ধ করেছেন ছোটবাবু-–প্ৰাণের ভয় দেখিয়ে! বুঝেছি। —আর রাজেনবাবু বলে তো কোনও লোকই নেই, তাই না? ছিলেন, তবে তিনি মারা গেছেন। আজ দুবছর হয়ে গেল। আমি আর ফেলুদা এবার ছুটলাম নীচে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁইয়ে ঘুরলেই পিছনের বাগানে যাবার দরজা। বাইরে বেরোনো মাত্র মিস্টার সরকারের চিৎকার শুনলাম—- পালাবার চেষ্টা করবেন না মিস্টার মজুমদার—আমার হাতে অস্ত্র রয়েছে! ঠিক সেই মুহূর্তেই শোনা গেল একটা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার
false
shomresh
ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। বসার জায়গা থাকলে খামোখা দাঁড়িয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দেখল ভদ্রলোক ছাড়া দুজন বাজবংশ মহিলা বসে আছেন বেঞ্চিতে। তাঁদের ভাবভঙ্গিতে নিজেদের গুটিয়ে নেবাব চেষ্টা আছে। ভদ্রলোক ঈষৎ ডান দিকে সরে গিয়ে বললেন, মহিলাদের পাশেই বসুন। ওরা স্বস্তি পারে, আপনিও। দীপা বসল। ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। উল্টো পিঠে চারজন বাঙালি ভদ্রলোক একবার দীপাকে দেখছেন আর একবার এই ভদ্রলোকের দিকে তাকাচ্ছেন। দীপা দেখল। চারজোড়া চোখেই একধরনের মজা পাওয়ার উৎসাহ। হঠাৎ খুব চাপা গলায় পাশের ভদ্রলোক বললেন, ওদিকে নজর দেবেন না। বাঙালি থিয়েটার দেখতে ভালবাসে। আপনি এমন ভান করুন যেন আমার সঙ্গে আগেই আলাপ আছে। দীপা অবাক হয়ে তাকাল। তারপরে এক ঝটিকায় উঠে দাঁড়িয়ে চলে এল দরজার পাশে সেই দেওয়ালের কাছে যেখানে সে কামরায় উঠেই দাঁড়িয়েছিল। তার চলে আসার সময় পাশের লোকটা একবারও মুখ ফিরিয়ে তাকায়নি। কিন্তু উল্টোদিকের চরিজোড়া চোখ ঘুরেছিল। দীপার সমস্ত অনুভূতি বলছিল ওই লোকটি ভাল নয়। কিন্তু সামনের চারজনও কি ভাল? লোকটা যদি আবার উঠে আসে? শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। কিন্তু লোকটা আর এদিকে এল না। ট্রেন থামল পরের স্টেশনে। দীপা দ্রুত নেমে পড়ল কামরা থেকে। পর পর তিনটে কামরা ছেড়ে আবার উঠে পড়ল সে। জানলার পাশে একটি একক আসন পেয়ে সে চটপট বসে পড়ল। ট্রেন চলতেই চোখের সামনে সবুজ মাঠ চাষের ক্ষেত এবং নীল আকাশ ভেসে উঠল। দীপার এত ভাল লাগছিল যে একটু আগের ঘটনা তার মন থেকে হারিযে গেল। শিলিগুড়ি স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই সে প্ল্যাটফর্মে নামল। একটা স্টেশন এত বড় হয়। তার ধারণাই ছিল না। এত হকার এত মানুষ। ও পাশেও একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন থেকে নাম যাত্রীদের অনুসরণ করে বাইরে আসতেই রিক্সা দেখতে পেল সে। রিক্সা চেপে শিলিগুড়ির রাস্তায় চুপচাপ যাচ্ছিল দীপা। একটা নদী পড়ল। খুব চওড়া নয়, তিস্তার মত নয়। এই নদীটার নাম কি? রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে সামলে নিল সে। নিশ্চয়ই লোকটা বুঝতে পারবে সে এই শহরে নতুন এসেছে। শিলিগুড়ির রিক্সাওয়ালারা কেমন তা কে জানে। রাস্তায় প্রচুর সাইকেল, অনেক রিক্সা। কান ঝালাপালা হবার যোগোড তাদের ঘণ্টার শব্দে। সেসব ছাডিয়ে শেষপর্যন্ত বা দিকের একটা রাস্তায় নামল রিক্সাটা। ছোট ছোট বাড়ি, কাঠের বাড়িও নজরে পড়ছে, একসময় রিক্সাওয়ালা বলল, এসে গেছি দিদি। দীপা ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে কয়েক পা হাঁটল। রমলা সেনের ঠিকানাটা তার মুখস্থ। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা না করে বাড়িতে পৌঁছানো যাবে না। এখন বেশ রোদ। সকাল শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রাস্তায় লোকজন কম। একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। দীপা দাঁড়িয়ে পড়তেই ছেলেটি এ ত বিস্মিত হল যে একটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট করত। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, প্রফেসর রমলা সেনের বাড়িটা কোথায় বলুন তো? ছেলেটির মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। দীপা অবাক হয়ে গেল। তারপরেই মনে হল হয়তো ছেলেটা বোবা। চা-বাগানে একটি মদেশিয়া ছেলে বোবা ছিল। তাকে দেখে বোঝাই যেত না সে কথা বলতে পারে না। দীপা কি করবে: বুঝতে পারছিল না। এইসময় ছেলেটি কথা বলল। বলল না বলে, বলতে চাইল বলা ভাল। ইয়ে, মানে, রমলা সেন–। দীপা দেখল ছেলেটি ঢ়েীক গিলিল; সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওঁর বাড়ি চেনেন? আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন? প্ৰথম প্রশ্নের সময়েই ঘাড় নেড়েছে ছেলেটি। এবার সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিল। দীপা দেখল ওর মুখে বেশ ঘাম জমে গেছে। ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যে নার্ভাস হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে হঠাৎ তার মজা করার ইচ্ছে হল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি নিশ্চয়ই এই পাড়ায় থাকেন? ছেলেটা দুবার মাথা নেড়ে হ্যা বলল। দীপা হাসল, আপনি জবাব দিচ্ছিলেন না বলে–আমি কিন্তু ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম। আপনি বোবা। ছেলেটা প্ৰতিবাদ করে উঠল, না না। আসলে, আপনার মত—। ছেলেটি কথা শেষ হাঁটতে হাঁটতে দীপা জিজ্ঞাসা করল, আমার মত মানে? সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার অভ্যোস নেই তো, তাই। ছেলেটি সরল গলায় বলতে পারল। দীপা আড়চোখে তাকল, আপনার কোন বোন নেই? ছেলেটি মাথা নাড়ল, না। আমরা তিন ভাই। আমি কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বল পারি না। মানে মেয়েরাত আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। কেন? কথা বললে লোকে আজেবাজে কথা বলবে। তাহলে এই যে আমার সঙ্গে কথা বলছেন! হুম। আপনি না বললে বলতাম না। আপনি কি শিলিগুড়িতে থাকেন? না। জলপাইগুড়ি। সেকি! জলপাইগুড়ি থেকে একা এসেছেন? হ্যাঁ। আপনার সাহস তো খুব। ওই যে, ওই বাড়ি। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিন। কাঠের গেটের ওপাশে একটা গ্যারেজ, বাগান এবং একতালা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। দেখতে বেশ সুন্দর। দীপা বলল, আপনি আমার খুব উপকার করলেন। আসুন না? কোথায়? ছেলেটি চোখ বড় করল। ওঁর বাড়িতে। না না। উনি খুব কড়া মহিলা। আপনি কি ওঁর আত্মীয়? না, না। ওঁর এখানে থাকবেন? না। আজই চলে যাব। ছেলেটি মাথা নেড়ে সাইকেলে উঠে বেরিয়ে গেল আচমকা। যাওয়ার সময় কোন কথা বলল না। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দরজায় রমলা সেনের নাম চোখে পড়ল। তাহলে ঠিক জায়গায় এসেছে। ও। এবং এতক্ষণ ধরে যে উদ্বেগ চাপা ছিল তা ঝটি করে চলে গেল। দীপা মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে আর দেখতে পেল না। এই ছেলেটার সঙ্গে ট্রেনের লোকগুলোর
false
shirshendu
হবে ঘাঁটি ছাড়ার সময় হয়েছে। তুমি বাপু, একটু কেমন যেন আছো। বড্ড ঠোঁট-কাটা। তোমাকে ছাড়া আর কাকে এসব বলব বলো তো! আমি যে ভয় পাই। সংসার-টংসার নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে আছি, এই বেশ আছি। ওসব কথা তুললে কেমন ঘাবড়ে যাই। হ্যাঁ গো, একটু তীৰ্থ করতে যাবে? মনটা ভাল করে আসি চলো। ও বাবা, সে তো মস্ত খরচের ব্যাপার! দূরে নয় গো। কাছেপিঠেই কোথাও যাই চলো। রামজীবনকে বললে খরচ দিয়ে দেবে। বিষ্ণুপদ বলল, ওর এখন অনেক খরচ। ঘর শেষ করতে পারছে না বলে মাথাটাও গরম। বলতে যেও না। গেলে ভাল হত। কিন্তু। তারকেশ্বর বা ওরকম কাছেপিঠে গেলেও কি অনেক খরচ? কাশী-বৃন্দাবন তো যেতে চাইছি না। এক জায়গায় থেকে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। তীর্থেই বা কোন শ্বাস ফেলার জায়গা আছে বলো তো! সব জায়গাতেই ভিড়। আচ্ছা, তোমার কি ভগবানে ভক্তি নেই? সত্যি করে বলো তো! এতকাল ধরে তোমাকে দেখছি, কোনওদিন মুখ ফুটে ভুবন্ধু কথাটা বললে না। কত ব্রত করেছি, পুজাে করেছি, তোমার তাতে কখনও যেন গা ছিল না। ইয়া গো, তুমি কি নাস্তিক? বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে করুণ গলায় বলে, তাও ঠিক বুঝতে পারি না। সত্যি কথাটা বলেই ফেল না। বিষ্ণুপদ দুর্বল গলায় বলে, যা ভাবছো তা নয়। কিন্তু তোমাদের মতো করে নয়। তা হলে কার মতো করে? আমার নিজের একটা রকম আছে। তোমরা যে পুজো-আচ্চা করো তার মধ্যে একটু ব্যবসা-বুদ্ধি আছে। ফুল বাতাসা দিয়ে ভগবানের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নেওয়া। দমাদম বাজনা, ট্যাঙস ট্যাঙস। কাঁসি বাজিয়ে দুর্গাপুজো হয়, ও আমার কেন যেন ভাল লাগে না। আমার মনে হয়, ভগবান ঠাণ্ডা সুস্থির একজন মানুষ। তাকে বুঝতে হলে নিজেকেও একটু ঠাণ্ডা বা সুস্থির হতে হয়। তুমি কত জানো। আমার হল মেয়েলি বুদ্ধি। আমি যে একটা জান বুফওলা মানুষ এ কেবল তোমার মতো বোকার কাছে। আমি কীই বা জানি? কতটুকুই বা বুঝি! বিদ্যের জাহাজ না হলেও তুমি বাপু অনেক জিনিস স্পষ্ট টের পাও। অনেক বিদ্বানেরও সেই ক্ষমতা নেই। এই না হলে নয়নতারা। তা ভাল, এরকমই বোকাসোকা থেকো। সংসারে বোকা আর ভালদের দাম না থাক, তাদের ওপর ভগবান সন্তুষ্ট থাকেন। বাকি রাতটুকু আর দুজনের কারোই ঘুম হল না। কথা কয়ে, জল খেয়ে আর এপোশ ওপাশ করে কেটে গেল। রোদ উঠবার অনেক আগেই তারা উঠে পড়ে। তখন অন্ধকার থাকে, চারদিকটা থাকে ঘুমন্ত। একটা দুটো পাখি সবে ডাকতে শুরু করে। একটা সময় আছে, ইরফানের মোরগাটা যখন জানান দেয়। সকালে নয়নতারার মেলা কাজ থাকে। ঘরদের সারা, লেপাপোছা, আরও অনেক কিছু। বিষ্ণুপদর কোনও কাজ থাকে না। জলচৌকিতে বসে আজ সে শরতের একটু হিম মাখানো ভোরবেলাটিকে বড় ভালবাসল। ডেকে বলল, কয়েকটা শিউলি তুলিব নাকি গো? তোমার ঠাকুর পুজোয় লাগবে। তা তোলো। বাসি কাপড় ছেড়ে হাত পা একটু ধুয়ে নাও। বাঁশের সাজিটা নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে পড়ল বিষ্ণুপদ। এই ফুল তোলাটা তার একটা দৈনন্দিন কাজ করে নিলে কেমন হয়? গাছ দুটো ঝোপে কী ফুল! কী ফুল! মাটিতে ঘাসে কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। ফুলে ফুলে ছয়লাপ হয়ে আছে। বিষ্ণুপদ হাঁক দিল, হ্যাঁ গো, মাটিতে পড়া ফুল কি পুজোয় লাগে? নয়নতারা উঠোনের এক প্রান্ত ঝাঁট দিতে দিতে বলল, শিউলিতে দোষ হয় না, যেটা পায়ে লাগবে সেটা কুড়িও না। গাছেও মেলা আছে। তবে গাছেরগুলোও তোলো। গাছের পাতায় পাতায় বেঁটা আলগা হয়ে কত শিউলি ঢলে পড়ে আছে। একটু নাড়া খেলেই টুপ করে খসে পড়ে। শিউলির বেঁটা কেন এরকম তা বুঝতে পারে না বিষ্ণুপদ। দুনিয়ায় একঢালা নিয়ম কিছু নেই। শিউলির ধর্ম শিউলির, বেল ফুলের ধর্ম কেবল বেল ফুলেরই। একই মাটির একই রস টেনে কত নানারকম হচ্ছে। আশ্চর্য লাগে বিষ্ণুপদর। সাজি ভরে উঠতে সময় লাগল না মোটেই। বিষ্ণুপদ ওপচানো সাজি নয়নতারার ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে রেখে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, আরও কিছু কাজ দেবে নাকি? ওমা! এ যে ভূতের মুখে রাম নাম! কেন, কাল রাতেই তো বললে আজ থেকে আমাকে দিয়ে মেলা কাজ করাবে। তাই লক্ষ্মী মানুষটির মতো কাজ চাইছো? মরে যাই! দোষটা কি আমার? তুমিই তো কিছু করতে দাও না। আমাকে। একটা জীবন কম খেটেছো নাকি? কম কষ্ট করেছো? তখন এ জায়গার কী অবস্থা! হাট নেই, বাজার নেই, পথঘাট নেই! হেঁটে হেঁটে পায়ে কড়া পড়েছে। সাইকেলে কত মাইল যেতে হত যেন! উরেব্বাস, যখন ফিরে আসতে তখন মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যেত। আহা, তখন যৌবন-বয়স। ও বয়সে কষ্ট করাই ভাল। গায়ে লাগে না। বরং ভালই হয় তাতে। সেই জন্যই বুড়ো বয়সে কষ্ট করতে দিই না। তা একটু-আধটু করতে চাও তো করো। এই তো বলছিলে, কাজ করতে গিয়ে মনে হয়। ছাইভস্ম করছি। হঠাৎ মন পাল্টালে কেন? এই দেখ, ওকালতি পাশ করে এলে নাকি? তখন বলেছিলাম, তখন একরকম মনে হয়েছিল বলে। এখন মনে হচ্ছে, তুমি কথাটা খারাপ বলনি। তা হলে যাও, বাগানে বসে একটু গাছপালার সেবা দাও। কাজটা বিষ্ণুপদর খুব পছন্দের। এবার ভারী বর্ষায় গাছ বেড়েছে খুব। বাগান দেখার কেউ নেই বলে আগাছায় একেবারে বনবিবির থান হয়ে আছে। দা আর কোদাল নিয়ে লেগে গেল বিষ্ণুপদ। লেগে গিয়ে বুঝল, শরীরের সেই ক্ষমতা আর নেই। হাত পায়ে যেন জরা
false
shordindu
সঙ্গে সঙ্গে ব্যোমকেশের টর্চ গদার মত তার চোয়ালে লাগল, অক্ষয় মণ্ডল ছাদের ওপর চিতিয়ে পড়ল। রাখালবাবু নীচে থেকে উঠে এসেছিলেন, তিনি অক্ষয় মণ্ডলের বুকের ওপর বসে বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, এর পকেটে পিস্তল আছে, বের করে নিন।’ ব্যোমকেশ অক্ষয় মণ্ডলের পকেট থেকে পিস্তল বার করে নিজের পকেটে রাখল। রাখালবাবু আসামীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে বললেন, ‘অক্ষয় মণ্ডল, হরিহর সিংকে খুন করার অপরাধে তোমাকে গ্রেপ্তার করলাম।’ ব্যোমকেশ অক্ষয় মণ্ডলের থলি থেকে কয়েকটা ভিজে লোহার প্যাকেট বার করে তার ওপর টর্চের আলো ফেলল। ‘বাঃ! এই যে, যা ভেবেছিলাম তাই। লোহার মোড়কের মধ্যে চকচকে বিদেশী সোনার বিস্কুট।’ পরদিন সকালবেলা সত্যবতী ব্যোমকেশকে বলল, ‘ভাল চাও তো বল, কোথায় রাত কাটালে?’ ব্যোমকেশ কাতর স্বরে বলল, ‘দোহার ধর্মাবতার, রাখাল সাক্ষী–আমি কোনো কুকার্য করিনি।’ ‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। গল্পটা বলবে?’ ‘বলব, বলব। কিন্তু আগে আর এক পেয়ালা চা দিতে হবে। এক পেয়ালা চা খেয়ে রাত জাগার গ্লানি কাটেনি।’ সত্যবতী আর এক পেয়ালা কড়া চা এনে ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসল, ‘এবার বল, টর্চটা ভাঙলে কি করে? মারামারি করেছিলে?’ ব্যোমকেশ বলল, ‘মারামারি নয়, শুধু মারা।’ চায়ে একটি চুমুক দিয়ে সে বলতে আরম্ভ করল: ‘অক্ষয় মণ্ডল সোনার চোরাকারবার করে অনেক টাকা করেছিল। নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ভদ্র পাড়ায় একটি বাড়ি করেছিল, বাড়ির ছাদ লোহার ডাণ্ডা-ছত্রী দিয়ে এমনভাবে মুড়ে রেখেছিল যে ওদিক দিয়ে বাড়িতে চোর ঢোকার উপায় ছিল না। ছাদটাকে নিরাপদ করা তার বিশেষ দরকার ছিল। ‘অক্ষয় মণ্ডলের পেশা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে যেসব চোরাই সোনা আসে তাই সংগ্রহ করা এবং সুযোগ মত বাজারে ছাড়া। সে বাড়িতেই সোনা রাখত, কিন্তু লোহার সিন্দুকে নয়। সোনা লুকিয়ে রাখার এক বিচিত্র কৌশল সে বার করেছিল। ‘অক্ষয় মণ্ডল বাড়িতে একলা থাকত; তার স্ত্রী আছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি। সে পাড়ার লোকের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করত না, কিন্তু পাছে পড়শীরা কিছু সন্দেহ করে, তাই কমল দাস নামে একটা ভদ্রলোককে নীচের তলায় একটি ঘর ভাড়া দিয়েছিল। বাজারে সোনা ছাড়বার জন্য সে কয়েকজন লোক রেখেছিল, তাদের মধ্যে একজনের নাম হরিহর সিং। ‘হরিহর সিং বোধহয় অক্ষয় মণ্ডলকে ফাঁকি দিচ্ছিল। একদিন দু’জনের ঝগড়া হল, রাগের মাথায় অক্ষয় মণ্ডল হরিহর সিংকে খুন করল। তারপর মাথা ঠাণ্ডা হলে তার ভাবনা হল, মড়াটা নিয়ে সে কি করবে। একলা মানুষ, ভদ্র পাড়া থেকে মড়া পাচার করা সহজ নয়। সে স্থির করল, মড়া থাক, বাড়িতে যা সোনা আছে, তাই নিয়ে সে নিজে ডুব মারবে। ‘কিন্তু সব সোনা সে নিয়ে যেতে পারল না। সোনা ধাতুটাও বিলক্ষণ ভারি, লোহার চেয়েও ভারি। তোমরা স্ত্রী-জাতি সারা গায়ে সোনার গয়না বয়ে বেড়াও, কিন্তু সোনার ভার কত বুঝতে পারো না। দশ হাত কাপড়ে কাছে নেই।’ সত্যবতী বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, তারপর বল।’ ‘অক্ষয় মণ্ডল ডুব মারবার কয়েকদিন পরে লাশ বেরুল; পুলিস এল, কিন্তু খুনের কিনারা হল না। অক্ষয় মণ্ডল খুন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে নিরুদ্দেশ। কমলবাবু সারা বাড়িটা দখল করে বসলেন। ‘অক্ষয় মণ্ডল নিশ্চয় কলকাতাতেই কোথাও লুকিয়ে ছিল, কয়েক মাস চুপচাপ রইল। কিন্তু বাড়িতে যে-সোনা লুকোনো আছে–যেগুলো সে সরাতে পারেনি, সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কমলবাবুর স্ত্রী এবং মেয়ে সর্বদা বাড়িতে থাকে, তাছাড়া একটি ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুর আছে। অক্ষয় মণ্ডল ভেবে-চিন্তে এক ফন্দি বার করল। ‘একটি স্ত্রীলোককে বউ সাজিয়ে এবং একটা পেটোয়া লোককে তার ভাই সাজিয়ে অক্ষয় মণ্ডল কমলবাবুর কাছে পাঠাল। বউকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। অক্ষয় মণ্ডল ফেরারী খুনী হতে পারে, কিন্তু তার বউ তো কোনো অপরাধ করেনি। কমলবাবু কিন্তু শুনলেন না, তাদের হাঁকিয়ে দিলেন। অক্ষয় মণ্ডল তখন বেনামে চিঠি লিখে ভয় দেখাল, কিন্তু তাতেও কোনো ফল হল না। কমলবাবু নড়লেন না। ‘অক্ষয় মণ্ডল তখন অন্য রাস্তা ধরল। ‘আমার বিশ্বাস ব্যাঙ্কের যে সহকর্মিটি কমলবাবুকে তীর্থে যাবার জন্য ভজাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে অক্ষয় মণ্ডলের যোগাযোগ আছে। দু’-চার দিনের জন্যও যদি কমলবাবুকে সপরিবারে বাড়ি থেকে তফাৎ করা যায়, তাহলেই অক্ষয় মণ্ডলের কার্যসিদ্ধি। কাজটা সে বেশ গুছিয়ে এনেছিল, কিন্তু একটা কারণে কমলবাবুর মনে খটকা লাগল; বাড়ি যদি বেদখল হয়ে যায়! তিনি আমার কাছে পরামর্শ নিতে এলেন। ‘তার গল্প শুনে আমার সন্দেহ হল বাড়িটা ওপর, আমি বাড়ি দেখতে গেলাম। দেখাই যাক না। অকুস্থলে গেলে অনেক ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘গেলাম বাড়িতে। কড়া রোদ ছিল, তাই ছাতা নিয়ে গিয়েছিলাম। দোতলায় উঠে দেখলাম, দোরের মাথায় ঘোড়ার নাল তিনটে পেরেকের মাঝখানে আলগাভাবে আটকানো রয়েছে। ঘোড়ার নালটা এক নজর দেখলে ঘোড়ার নাল বলেই মনে হয় বটে, কিন্তু ঠিক যেন ঘোড়ার নাল নয়। আমি ছাতাটা সেইদিকে বাড়িয়ে দিলাম, অমনি ছাতাটা আপনা থেকেই গিয়ে ঘোড়ার নালে জুড়ে গেল। ‘বুঝলাম, ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, ঘোড়ার নাল নয়, একটি বেশ শক্তিমান চুম্বক–ছাতার লোহার বাঁট পেয়ে টেনে নিয়েছে। প্রশ্ন করে জানলাম চুম্বকটা অক্ষয় মণ্ডলের। মাথার মধ্যে চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল–কেন? অক্ষয় মণ্ডল চুম্বক নিয়ে কি করে? দোরের মাথায় টাঙিয়েই বা রেখেছে কেন, যাতে মনে হয় ওটা ঘোড়ার নাল? মনে পড়ে গেল, পুলিসের খানাতল্লাশে দেরাজের মধ্যে কয়েকটা লোহার মোড়ক পাওয়া গিয়েছিল। রহস্যটা ক্রমশ পরিষ্কার হতে লাগল। ‘তারপর যখন ঘেরাটোপ লাগানো ছাদে গিয়ে জলের ট্যাঙ্ক দেখলাম, তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। চুম্বক যত জোরালোই হোক, সোনাকে টানবার ক্ষমতা
false
shorotchandra
অনেকের সঙ্গেই অনেকের একটা রফা হইয়া গেছে। চেষ্টা করিয়া, আলোচনা করিয়া, মধ্যস্থ মানিয়া নয়—যেন আপনিই হইয়াছে। আজও যাহারা বাঁচিয়া আছে, এখনও ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হয় নাই, তাহারা সকলেই যেন সকলের পরমাত্মীয়; বহুদিন ধরিয়া যেখানে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল, সহসা পথে দেখা হইতে উভয়ের চোখেই জল ছলছল করিয়া আসিয়াছে—কাহারও ভাই, কাহারও পুত্র-কন্যা, কাহারও বা স্ত্রী ইতিমধ্যেই মরিয়াছে—রাগ করিয়া মুখ ফিরাইবার মত জোর আর মনে নাই,—কখনও কথা হইয়াছে, কখনও তাহাও হয় নাই—নিঃশব্দে পরস্পরের কল্যাণ-কামনা করিয়া বিদায় লইয়াছে। মুচীদের পাড়ায় লোক আর বেশী নাই। যত বা মরিয়াছে, তত বা পলাইয়াছে। অবশিষ্টদের জন্য রাজেন একাই যথেষ্ট। তাহাদের গতি-মুক্তির ভার সে-ই গ্রহণ করিয়াছে। সহকারিণী হিসাবে কমল যোগ দিতে আসিয়াছিল। ছেলেবয়সে চা-বাগানে সে পীড়িত কুলীদের সেবা করিয়াছিল, সেই ছিল তার ভরসা। কিন্তু দিন দুই-তিনেই বুঝিল সে সম্বল এখানে চলে না। মুচীদের সে কি অবস্থা ! ভাষায় বর্ণনা করিয়া বিবরণ দিতে যাওয়া বৃথা। কুটীরে পা দেওয়া অবধি সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিত, কোথাও বসিবার দাঁড়াইবার স্থান নাই, এবং আবর্জনা যে কিরূপ ভয়াবহ হইয়া উঠিতে পারে এখানে আসিবার পূর্বে কমল জানিত না। অথচ, এই সকলেরই মাঝখানে অহরহ থাকিয়া আপনাকে সাবধানে রাখিয়া কি করিয়া যে রোগীর সেবা করা সম্ভব এ কল্পনা সে মনে স্থান দিতেও পারিল না। অনেক দর্প করিয়া সে রাজেনের সঙ্গে আসিয়াছিল, দুঃসাহসিকতায় সে কাহারও ন্যূন নয়, জগতে কোনকিছুকেই সে ভয় করে না, মৃত্যুকেও না। নিতান্ত মিথ্যা সে বলে নাই, কিন্তু আসিয়া বুঝিল, ইহারও সীমা আছে। দিন-কয়েকেই ভয়ে তাহার দেহের রক্ত শুকাইয়া উঠিবার উপক্রম করিল। তথাপি সম্পূর্ণ দেউলিয়া হইয়া ঘরে ফিরিবার প্রাক্কালে রাজেন্দ্র তাহাকে আশ্বাস দিয়া বার বার বলিতে লাগিল, এমন নির্ভীকতা আমি জন্মে দেখিনি। আসল ঝড়ের মুখটাই আপনি সামলে দিয়ে গেলেন ! কিন্তু আর আবশ্যক নেই,—আপনি দিন কতক বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন গে। এদের যা করে গেলেন সে ঋণ এরা জীবনে শুধতে পারবে না। আর তুমি? রাজেন বলিল, এই ক’টাকে যাত্রা করিয়ে দিয়ে আমিও পালাব। নইলে কি মরব বলতে চান? কমল জবাব খুঁজিয়া পাইল না, ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া নিঃশব্দে চলিয়া আসিল। কিন্তু তাই বলিয়া এমন নয় যে সে এ কয়দিন একেবারে বাসায় আসিতে পারে নাই। রাঁধিয়া সঙ্গে করিয়া খাবার লইয়া যাইতে প্রত্যহ একবার করিয়া তাহাকে বাসায় আসিতেই হইত। কিন্তু আজ আর সেই ভয়ানক জায়গায় ফিরিতে হইবে না মনে করিয়া একদিকে যেমন স্বস্তি অনুভব করিল, আর একদিকে তেমনি অব্যক্ত উদ্বেগে তাহার সমস্ত মন পূর্ণ হইয়া রহিল। কমল রাজেন্দ্রর খাবার কথাটা জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে ভুলিয়াছিল। কিন্তু এই ত্রুটি যতই হোক, যেখানে তাহাকে সে ফেলিয়া রাখিয়া আসিল তাহার সমতুল্য কিছুই তাহার মনে পড়িল না। স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার সময় হইতে হরেন্দ্রর ব্রহ্মচর্যাশ্রমও বন্ধ হইয়াছে। ব্রহ্মচারী-বালকদিগকে কোন নিরাপদ স্থানে পৌঁছাইয়া দিয়া তাহাদের তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া সতীশ সঙ্গে গিয়াছে। হরেন নিজে যাইতে পারে নাই অবিনাশের অসুখের জন্য। আজ সে আসিয়া উপস্থিত হইল। নমস্কার করিয়া কহিল, পাঁচ-ছ’ দিন রোজ আসচি, আপনাকে ধরতে পারিনে। কোথায় ছিলেন? কমল মুচীদের পল্লীর নাম করিলে হরেন্দ্র অতিশয় বিস্মিত হইয়া কহিল, যেখানে? সেখানে ত ভয়ানক লোক মরচে শুনতে পাই। এ মতলব আপনাকে দিলে কে? যে-ই দিয়ে থাক কাজটা ভাল করেনি। কেন? কেন কি? সেখানে যাওয়া মানে ত প্রায় আত্মহত্যা করা। বরঞ্চ, আমরা ত ভেবেছিলাম শিবনাথবাবু আগ্রা থেকে চলে যাবার পরে আপনিও নিশ্চয় অন্যত্র গেছেন। অবশ্য দিন কয়েকের জন্যে—নইলে বাসাটা রেখে যেতেন না,—আচ্ছা রাজেনের খবর কিছু জানেন? সে কি শহরে আছে, না আর কোথাও চলে গেছে? হঠাৎ এমন ডুব মেরেছে যে কোন সন্ধান পাবার জো নেই। তাঁকে কি আপনার বিশেষ প্রয়োজন? না, প্রয়োজন বলতে সচরাচর লোকে যা বোঝে তা নেই। তবুও প্রয়োজনই বটে। কারণ আমিও যদি তার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করি ত একা পুলিশ ছাড়া আর তার আত্মীয় থাকে না। আমার বিশ্বাস আপনি জানেন সে কোথায় আছে। কমল বলিল, জানি। কিন্তু আপনাকে জানিয়ে লাভ নেই। বাড়ি থেকে যাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বেরিয়ে গিয়ে সে কোথায় আছে সন্ধান নেওয়া শুধু অন্যায় কৌতূহল। হরেন্দ্র ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু সে আমার বাড়ি নয়, আমাদের আশ্রম সেখানে স্থান দিতে তাকে পারিনি, কিন্তু তাই বলে সে নালিশ আর একজনের মুখ থেকেও আমার সয় না। বেশ, আমি চললাম। তাকে পূর্বেও অনেকবার খুঁজে বার করেচি, এবারও বার করতে পারব, আপনি ঢেকে রাখতে পারবেন না। তাহার কথা শুনিয়া কমল হাসিয়া কহিল, তাঁকে ঢেকে যে রাখব হরেনবাবু, রাখতে পারলে কি আমার দুঃখ ঘুচবে আপনি মনে করেন? হরেন নিজেও হাসিল, কিন্তু সে হাসির আশেপাশে অনেকখানি ফাঁক রহিল। কহিল, আমি ছাড়া এ প্রশ্নের জবাব দেবার লোক আগ্রায় অনেকে আছেন। তাঁরা কি বলবেন জানেন? বলবেন, কমল, মানুষের দুঃখ ত একটাই নয়, বহুপ্রকারের। তার প্রকৃতিও আলাদা, ঘোচাবার পন্থাও বিভিন্ন। সুতরাং তাঁদের সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ হয়, আলোচনার দ্বারা একটা মোকাবিলা করে নেবেন। এই বলিয়া সে একটুখানি থামিয়া কহিল, কিন্তু আসলেই আপনার ভুল হচ্চে। আমি সে দলের নই। অযথা উত্যক্ত করতে আমি আসিনি, কারণ, সংসারে যত লোকে আপনাকে যথার্থ শ্রদ্ধা করে আমি তাদেরই একজন। কমল তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে যথার্থ শ্রদ্ধা করেন আপনি কোন্ নীতিতে? আমার মত বা আচরণ কোনটার
false
humayun_ahmed
নিষেধ আছে। আমার কাছে মনে হল তিনি ইচ্ছা করে আমাকে অপমান করলেন। সেদিন সন্ধ্যায়। মা তালের পিঠা করেছেন। ইরাকে বললেন, মাস্টার সাহেবকে কয়েকটা পিঠা দিয়ে আয়তো ইরা। বেচারা একা একা থাকে। কি খায় না খায় কে জানে? ইরা বলল, আমি পারব না। আপাকে পিঠা নিয়ে যেতে বল। ওর কলেজের স্যার। ওরই নিয়ে যাওয়া উচিত। আমি আপত্তি করলাম না। স্যারকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে ইচ্ছা করছিল। পিঠা দিতে গিয়ে সেই কথাগুলো শুনিয়ে আসা যাবে। স্যার আমাকে দেখে এতাই অবাক হলেন যে বলার কথা নয়। যেন এ রকম অস্বাভাবিক ঘটনা। এর আগে তাঁর জীবনে কখনো ঘটে নি। আমি বললাম, স্যার মা আপনার জন্যে কিছু তালের পিঠা পাঠিয়েছেন। তিনি হড়বড় করে বললেন, শুকরিয়া। শুকরিয়া। তোমার মাকে হাজার শুকরিয়া। স্যার আমাকে বসতে বলছেন না। আমি যে কথাগুলো বলব বলে ভেবে এসেছি সেগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে চলে যাওয়া যায় না। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বসতে হবে। আমি বললাম, স্যার আমি কি কিছুক্ষণের জন্যে আপনার এখানে বসতে পারি? অবশ্যই পার। বোস। বোস। তিনি অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয় পড়লেন। নিজেই ছুটে গিয়ে বারান্দা থেকে চেয়ার নিয়ে এলেন। আমি বসলাম না। কঠিন গলায় বললাম, স্যার বসতে ভয় লাগছে। আমারতো বোরকা পরা নেই। এইভাবে আপনার সামনে আসাই হয়ত ঠিক হয় নি। মা পিঠা দিয়ে যেতে বললেন বলেই এসেছি। নয়ত আসতাম না। আপনাকে বিব্রত করার আমার কোন ইচ্ছা নেই। আমি বিব্রত হচ্ছি না। অবশ্যই হচ্ছেন। বিব্রত না হলে বারান্দায় চাটাইয়ের বেড়া দিতেন না। এই কাণ্ডটা করেছেন কারণ চাটাইয়ের বেড়াটা না দিলে বোরকা নেই এমন একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে আপনার দেখতে হয়। বিরাট একটা পাপ হয়। এত বড় পাপের শাস্তি হল দোজখ। আমাকে দেখার কারণে আপনি দোজখে যাবেন তা-কি হয়? দোজখে সুন্দর সুন্দর পরী অপেক্ষা করছে। আমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করলাম। কঠিন কিছু কথা বলার ছিল বলতে পারলাম না, কারণ আমি দেখলাম। তিনি খুবই দুঃখিত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, স্যার যাই। তিনি বললেন, একটু বোস। এক মিনিট। আমার উপর এরকম রাগ করে চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে। একটু বসে যাও। আমি বসলাম। তিনি বললেন–চাটাইয়ের বেড়াটা আমি আমার জন্যে দেই নি। তোমার জন্যে দিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল–তোমার একা একা ছাদে হাঁটার অভ্যাস— আমার জন্যে স্বাধীনভাবে তা করতে পারছ না। তোমাকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই এটা করেছি। তুমি যে এমন রেগে যাবে বুঝতে পারি নি। তোমর রাগ কি একটু কমেছে? আমি কিছু বললাম না। তিনি যেন নিজের মনে কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন–বোরকা নিয়ে তোমার মনে বড় ধরনের ক্ষোভ আছে বলে মনে হয়। এরকম থাকা উচিত না। আমাদের প্রফেটের সময়ের যুগটা ছিল আলমে জাহিলিয়াতে যুগ। মানুষের প্রবৃত্তি ছিল পশুদের কাছাকাছি। মেয়েরা রাস্তায় বের হলে মানুষেরা নানাভাবে তাদের উত্যক্ত করত। মেয়েরাও যে ছেলেদের চেয়ে আলাদা ছিল তা না। তারাও এতে মজা পেত। তারাও চাইতো যেন পুরুষরা তাদের উত্যক্ত করে, তাদেরকে দেখে অশ্ৰীল অঙ্গ ভঙ্গি করে। কারণ যুগটাই হচ্ছে পশুত্বের যুগ। কাজেই আমাদের নবী এমন একটা ব্যবস্থা করলেন যাতে সবাই বুঝতে পারে— মুসলমান মেয়েরা অন্যদের মত না। তারা পবিত্র। তারা আলাদা। তাদেরকে নিয়ে এসব করা যাবে না। তারা তা চায়ও না। কাজেই নবী আদেশ দিলেন মেয়েরা যেন চাদরে তাদের শরীর ঢেকে নিজেদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। চাদরে ঢাকা একটা মেয়ে দেখলে সবাই যেন বোঝে এই মেয়ে আর দশটা মেয়ের মত না। এর সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছি নবনী? আমি কিছু বললাম না। স্যার বললেন, বেহেশতে পরী পাওয়া সম্পর্কে তুমি যা বললে সেটা নিয়েও কথা আছে। তুমি যেমন স্থূলভাবে বললে তা কিন্তু না। পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব। আমাকে বুঝিয়ে বলার কোন দরকার নেই। আপনি বুঝলেই হল। আমি দাঁড়ালাম। স্যার হেসে ফেললেন। এত সুন্দর করে আমি বোধহয় কাউকে হাসতে দেখি নি। আমার সারা শরীর ঝনঝনি করে উঠল। ঘণ্টা বেজে উঠার মত শব্দ। এই ঘণ্টা সর্বনাশের ঘণ্টা। আমি প্ৰায় ছুটে চলে এলাম। মেয়েরা ঠিক কিভাবে ছেলেদের প্রেমে পড়ে? একজনের প্রতি অন্যজনের তীব্র আকর্ষণটা কিভাবে তৈরি হয়। গল্প উপন্যাসের ব্যাপার। আর বাস্তবের ব্যাপার কি এক রকম না আলাদা? প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তার ভালবাসও কি আলাদা? একজন আরেকজনকে দেখেই পাগলের মত হয়ে গেল এমনকি সত্যি কখনো হয়েছে? না-কি এগুলি শুধু কথার কথা? আমার কি হয়েছে? আমি কি এই মানুষটির প্রেমে পড়ে গেছি? প্রেমের মত কি আছে। এই মানুষটার? মানুষটি যদি বিবাহিত হত, তার কয়েকটা ছেলেমেয়ে থাকতো তাহলেও কি আমি ঠিক এইভাবেই আকৰ্ষিত হতাম। সারারাত আমার ঘুম হল না। জীবনে এই প্রথম আমার ঘুমহীন রাত্রি যাপন। কি যে এক ভয়ঙ্কর কষ্ট। বিছানায় এপাশ ও পাশ করছি আর ভাবছি ভোর হচ্ছে না কেন? ভোর হোক। মনে হচ্ছে ভোর হলে আমার কষ্টটা কমবে। সূৰ্য উঠার আগে আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি মা ফজরের নামাযের জন্যে অজু করছেন। আমাকে দেখে বললেন, কিরে আজ এত সকালে ঘুম ভাঙলো যে। একবার ভোরবেলা উঠে দেখলাম কেমন লাগে। রোজ ভোরে উঠে ছাদে ঘোরাঘুরি করবি দেখবি শরীরটা কেমন ভাল লাগে। তুমি তাই
false
humayun_ahmed
রাত দশটার গাড়িতেই যাই। এই সময়ে তোমার যদি মন বদলায় সেটাও দেখে যাই! এমনও তো হতে পারে রাত দশটার সময় তুমি ঠিক করলে আমার সঙ্গে চলে যাবে। তখন তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। লীনা বলল, আমি যাচ্ছি। কোনো কিছুর দরকার হলে হোসেনকে বলবে। ও ব্যবস্থা করবে। ফিরোজ বলল, তোমাদের এখানে নাপিত আছে? সময়ের অভাবে সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে পারছি না। এখন যখন কিছু ফ্রি টাইম পাওয়া গেছে-~~ ফ্রি টাইমটা কাজে লাগাই। হেয়ার কাট পাস মাখা ম্যাসাজ। নাপিত আছে? লীনা বলল, নাপিত নেই। তবে হোসেনকে বললে সে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে। ফিরোজ বলল, তুমি হোসেনকে বলে যাও আমার সঙ্গে যেন দেখা করে। নাপিত খবর দিয়ে আনার জন্যে ফিরোজের হোসেনকে দরকার নেই। হোসেনকে দিয়ে সে স্যারের কাছে বীনার চিঠিটা পাঠাবে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল বীনার চিঠির প্রয়োজন পড়বে না। কী লেখা বীনার চিঠিতে? জানতে ইচ্ছা করছে, আবার জানতে ইচ্ছাও করছে না। হোসেনের হাতে চিঠিটা পাঠানো কি ঠিক হবে? সবচে ভালো হত সে নিজে যদি চিঠিটা নিয়ে যেত। সেটাও সম্ভব না। ফিরোজ পুরোদিন একা কাটাল। লীনা দুপুরে খেতে এল না। সে নাকি সাইটে খাবে। হোসেন আলি তাঁবুর ভেতর ফিরোজের খাবার দিয়ে গেল। ফিরোজ বলল, হোসেন–চিঠি দিয়েছিলে? হোসেন বলল, জ্বি। ফিরোজ বলল, স্যার কি চিঠিটা পড়েছেন? জানিনা। আমি উনার হাতে চিঠি দিয়া চইল্যা আসছি। লীনার জন্যে তার মা একবাটি তরকারি পাঠিয়েছিলেন। তরকারিটা গরম করে লীনাকে দিতে হবে। জ্বি আচ্ছা। দুপুরের খাওয়ার শেষে ফিরোজ ঘুমুতে গেল। চারদিকের হৈহল্লার মধ্যে ঘুমানো মুশকিল। তবে দীর্ঘ সময় শব্দের ভেতরে বাস করছে বলে শব্দ এখন আর কানে লাগছে না। সে কোথায় যেন পড়েছিল— পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতায় ঘুম ভালো হয় না। ফিরোজ ঘুমাল মরার মতো। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা। তাঁবুর ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। হোসেন আলি টি-পটে করে চা নিয়ে এসেছে। হোসেন বিনীত গলায় বলল, এর আগেও দুইবার আসছি। ঘুমে ছিলেন, ডাক দেই নাই। ফিরোজ বলল, ভালো করেছ। লীনা সাইট থেকে এখনো ফিরে নি? হোসেন বলল, জি ফিরছেন। স্যারের তাঁবুতে আছেন। চা খাইতেছেন। আমার এখানে কি এসেছিল? বলতে পারি না। বিকেল পাঁচটার গাড়ি কি চলে গিয়েছে? অনেক আগে গেছে। অখন বাজে ছয়টা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা দেখি তো হোসেন মিয়া—তোমার কেমন বুদ্ধি—এই ধাঁধার উত্তর কি হবে বল। সংসারে এমন জিনিস কিবা আছে বল লইতে না চাহে তারে মানব সকল। কিন্তু তাহা সবে পাবে অতি আশ্চর্য, বল দেখি বুঝি তব বুদ্ধির তাৎপর্য! হোসেন তাকিয়ে আছে। মনে হল তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফিরোজ বলল, সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সংসারে একটা জিনিস আছে যা কেউ চায় না। পিতা চায় না, মাতা চায় না, পুত্র-কন্যা চায় না। না চাইলেও সবাইকে সেই জিনিস গ্রহণ করতে হয়। কেউ বাদ যায় না। বলতে পারব না। ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা যাও। বলতে না পারলে কী আর করা। ফিরোজ অন্ধকারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার মাথায় আরো ধাঁধা আসছে। লীনা যখন ছোট ছিল-সেভেন এইটে পড়ত, তখন ফিরোজ তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। লীনা প্রাণপণ চেষ্টা করত ধাঁধার জবাব দিতে। যখন দিতে পারত না তখন কেঁদে ফেলত। নিঃশব্দ কান্না না, ভেউ ভেউ করে বাড়িঘর ঝাঁপিয়ে কান্না। লীনার বড়ভাই সাব্বির ফিরোজের উপর রাগ করত। বিরক্তগলায় বলত, তুই সবসময় ওকে কাঁদাস কেন? জানিস ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে সে কাঁদে। জেনেশুনে কঠিন কঠিন ধাঁধা। ফিরোজ বলত, ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে কাঁদবে কেন? লীনা অন্য সবার মতো না। নরম স্বভাবের মেয়ে। এটা মাথায় রাখবি। যেসব ধাঁধার জবাব সে জানে সেসব জিজ্ঞেস করবি। দেখবি জবাব দিয়ে সে কত খুশি হয়। মানুষকে খুশি করার মধ্যে কি কোনো দোষ আছে? না, দোষ নেই। কথা দে, তুই কখনো লীনাকে কঠিন কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি না। আচ্ছা যা কথা দিলাম। মনে থাকে যেন। মনে থাকবে। ফিরোজের মনে আছে। লীনাকে সে কখনোই কোনো কঠিন ধাঁধা জিজ্ঞেস করেনি। সমস্যা হচ্ছে যে মেয়ে কঠিন ধাঁধা পছন্দ করে না, সে নিজে ঝাপ দিয়ে কঠিন এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এই ধাঁধার জবাব ফিরোজ ইচ্ছা করলে দিয়ে দিতে পারে। দেয়া ঠিক হবে না। কিছু কিছু ধাঁধার জবাব নিজেকে খুঁজে বের করতে হয়। এমনও হয় যে, খুব সহজ ধাঁধা কিন্তু জবাব খুঁজতে এক জীবন চলে যায়। লীনা হাসানের সামনে বসে আছে। হাসান কাপে কফি ঢালছে। এই কাজটা করা উচিত লীনার, কিন্তু সে করতে পারছে না। স্যার কফির পট হাতে নিয়ে নিয়ে কফি ঢালা শুরু করেছেন। সে তো এখন কেড়ে স্যারের হাত থেকে কফিপট নিয়ে নিতে পারে না। লীনা খুব অস্বস্তি বোধ করছে। লীনা কেমন আছ বলো। লীনা নড়েচড়ে বসল। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আজ সারাদিন তো সে স্যারের সঙ্গেই ছিল। ডায়নোসরে কীভাবে রঙ করা হয় দেখছিল। তাঁবুতে সে স্যারের সঙ্গেই এসেছে। স্যার বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো লীনা। কিছুক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি। তখন থেকেই লীনার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। স্যার তার সাথে কি কথা বলবেন? সে ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। এখন বললেন, লীনা কেমন আছ বলো। লীনা কি বলবে সে ভালো আছে? নাকি চুপ
false
nihar_ronjon_gupta
বুকের মধ্যে নিয়ে। মঙ্গলা আঁতুড় ঘরে ঢুকে আবার দরজায় খিল তুলে দিল। এবার সে যেন নিশ্চিন্ত। বিভাবতীর একটি কন্যা হয়েছে সকলে জানল। নবজাত শিশুর কল্যাণে দান ধ্যান-যাগ যজ্ঞ কত কি হলো। কত মিষ্টান্ন জনে জনে বিতরণ করা হলো। সব ব্যাপারে বেশী উৎসাহী যেন মৃগাঙ্কমোহনই। দিন যায়-মাস যায়-বছর ঘুরে আসে। মৃগাঙ্কমোহনই শিশুর নামকরণ করল-শ্ৰীলেখা। ক্ৰ মে মেয়ে আরো বড় হয়—লেখা পড়া শুরু করে— মৃগাঙ্কমোহনের বড় আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী। চৌধুরী বংশের দুলালী–আদরিণী—শ্ৰীলেখা। হারিয়ে যাওয়া ছেলে হরিঘোষ স্ত্রীটের একটা মেস বাড়ি। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা হবে, মধ্যবয়সী একজন লোক সেদিনকার দৈনিকটা খুলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন পড়ছে। বিজ্ঞাপনের নিরুদ্দেশের পৃষ্ঠায় একটা বিজ্ঞাপন বের হয়েছে। “হারিয়ে যাওয়া ছেলে। হারিয়ে যাওয়া ছেলে।” ছেলেটিচুরি হয়ে গিয়েছিল, যেদিন সে জন্মায় সেইদিনই। তারপর ঘটনাচক্রে সে মানুষ হয় এক অনাথ আশ্রমে। এগার বছর যখন তার বয়স তখন সে নিরুদেশ হয়ে যায় আবার সেই অনাথ আশ্রম থেকে আশ্রমের নাম ‘হরমোহিনী আশ্রম”। ছেলেটি দেখতে ক’লো—দোহারা চেহারা—প্রকৃতি চঞ্চল-তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে এবং ছেলেটির ডান ক্রর নীচে একটা জরুল আছে। যদি কেউ নিম্নলিখিত ঠিকানায় ছেলেটির সংবাদ দিতে পারে তবে সে বিশেষ পুরস্কার পাবে। এস. রায় নং আমহাস্ট স্ট্রীট, কলিকাতা রোগা লিকলিকে একজন লোক এসে ঘরে প্রবেশ করল। লোকটার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একমাথা রুক্ষ চুল। ময়লা ধূতি পরিধানে, গায়ে একটা ময়লা তালি দেওয়া ডোরাকাটা সিস্কের সার্ট। কিশোরী-রোগা লোকটি ডাকে। উঁ। বলি কি ব্যাপার? উঁ। বলছি হঠাৎ খবরের কাগজ এমন কি গোপন হীরার সন্ধান পেলি? এতক্ষণে কিশোরী আগন্তুকের দিকে সংবাদপত্র থেকে মুখ তুলে তাকায়। কে? জগন্নাথ, আয়। আজকের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বের হয়েছে দেখকিসের বিজ্ঞাপন? একটী ছেলের? ছেলের? হ্যাঁ, হারানো ছেলের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার। কত দেবে? তা-কিছু লেখেনি। তবে– কি তবে– ব্যাপারটা শাঁসালো মনে হচ্ছে। কিসে বুঝলি? বুঝেছি। দেখি বিজ্ঞাপনটিা। কিশোরী দৈনিকটা এগিয়ে দিল জগন্নাথের দিকে। কই? কোথায়?– এই যে। কিশোরী আঙ্গুল দিয়ে ছেলে হারানোর বিজ্ঞাপনটা দেখায় জগন্নাথাকে। জগন্নাথ বিজ্ঞাপনটারি উপরে বুকে পড়ল।… একটা বিড়ি ধরিয়ে কিশোরী ঘন ঘন টান দিতে লাগল পাশে বসে। জগন্নাথ বিজ্ঞাপনটা আগাগোড়া পড়ে চোখ তুলল। পড়লি? হুঁ—আমার মনে হচ্ছে তোর অনুমানটা হয়ত মিথ্যে নয় কিশোরী–তাহলে? বল কি করতে হবে? শোন, আজই হরমোহিনী আশ্রমে গিয়ে একটা খোঁজ খবর নিতে হবে। আর এদিকে বাকী-কথাটা কিশোরী জগন্নাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বললে। আনন্দে জগন্নাথের চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতায় ঝাক ঝক করে উঠল। কিন্তু ভায়া একটা কথা আছে। জগন্নাথ বললে। কী? বুঝতে পারছে না? না। কি বলতে চাস খুলে বল। মানে, ঐ বিজ্ঞাপন হচ্ছে ফেউ, ওর পিছনে বাঘ আছে। বাঘ। হুঁ। বুঝতে পারছে না এখনো। ঠিকানাটা কোথাকার? আমহাস্ট স্ট্রীট থেকে দেওয়া হয়েছে না? তা হয়েছে– নম্বরটা মনে হচ্ছে সুব্রত রায়ের বাড়ি। বলিস কি? তাই-অতএব ঐ বিজ্ঞাপনের পশ্চাতে নিৰ্ঘাৎ তিনি আছেন। কে? কে আবার। শ্ৰীল শ্ৰীকিরীটী রায়– কোন কিরীটী? রহস্যভেদী কিরীটী রায়। আবার কোন কিরীটী রায়– তা হোক। যা জানাবার আছে তা আজই দুপুরে ঐ লোকটার কাছ থেকে সব জেনে আসবি। দিন পাঁচেক পরে দুপুরের দিকে বাইরের রোদটা বেশ চড়চড়ে হয়ে উঠেছে। অসহ্য গরমে বাইরের তপ্ত হওয়া গায়ে জ্বালা ধরায়। দরজা জানালা আটকে সুব্রত দ্বিপ্রহরে একটা সুখনিদ্রা দেবার চেষ্টা করছে, এমন সময় ভৃত্য এসে জানাল কে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওর সঙ্গে একটা জরুরী কাজের জন্য একটিবার দেখা করতে চান। ভদ্রলোককে বাইরের ঘরে বসা, আমি যাচ্ছি। সুব্রত বলে। তৃত্য চলে গেল। সুব্রত বাইরের ঘরে এসে দেখে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ একটা সোফা অধিকার করে দরজার দিকে উদগ্ৰীব হয়ে চেয়ে আছেন। নমস্কার। নমস্কার, সুব্রত একটা সোফা অধিকার করে বসল। ভদ্রলোক জামার বুক পকেট থেকে সেদিনকার খবরের কাগজের কাটিংটা বের করলেন, এই বিজ্ঞাপনটা আপনিই দিয়েছেন? মানে আপনার নামই তো এস, রায়? হ্যা, কিন্তু আপনি? মানে, আমি বোধহয় আপনাদের সেই হারানো ছেলেটির খোঁজ দিতে পারব।– আপনার নাম? কোথা থেকে আসছেন? শ্ৰীীরঘুনাথ ঘোষাল। অবিশ্যি এখানেই এই শহরেই থাকি-মানে চেতলায়। যে ছেলেটির কথা বলছেন সে ছেলেটি কোথায় আছে? আমার কাছেই আছে। আপনার কাছে। হ্যাঁ– তা এই যে সেই ছেলে তা আপনি বুঝলেন কি করে? সে বলতে পারব না-তবে এই ছেলেটির ডান ভ্রূর নীচে একটা জরুল আছে আর– আর? আর ছেলেটি আমার কেউ নয়-বছর চারেক ধরে প্রতিপালন করছি মাত্র– প্ৰতিপালন করছেন! তাই-রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখে আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে আমার বাড়িতে স্থান দিই। সেই থেকে আমার কাছেই আছে। এবং ছেলেটিকে দেখলে সহজেই বোঝা যায়। সাধারণ ঘরের ছেলে সে নয়-কোন ধনীর সন্তানই হবে। সুন্দর চেহারা– ছেলেটিকে যখন আপনি পান। তখন তার বয়স কত হবে? তা ধরুন দশ-এগার তো হবেই– নাম কি বলেছিল! সুধীর— এখুনি আপনার ওখানে গেলে ছেলেটিকে কি একবার দেখা যেতে পারে! কেন যাবে না-তবে একটা কথা আছে। কি বলুন! আপাততঃ সে কলকাতায় নেই– কোথায় আছে? ছেলেটি এখন মীরাটে আমার স্ত্রীর কাছে আছে। কবে তাক এনে দেখাতে পারবেন। ছেলেটিকে তা মনে করুন দিন দশেক তো লাগবেই। বেশ-তবে সেই ব্যবস্থাই করুন। আচ্ছা। একটা কথা। বলুন। ছেলেটির কোন ফটো আপনাদের কাছে আছে? সুব্ৰত ঘাড় নেড়ে বলে, না– তবে! তবে ছেলেকে সনাক্ত করবেন কি করে? সে ব্যবস্থা হবে–
false
shordindu
ভাবতাম তার স্বভাবই ওই রকম‌, নিজেকে জাহির করতে চায় না।’ ‘তার কোনও ফটোগ্রাফ আছে কি?’ ‘একটা গ্রুপ-ফটো ছিল‌, সহ্যাদ্রি হোটেলের অফিসে টাঙানো থাকত। সে রাত্রে আমি মুর্ছা ভেঙে দেখলুম দেয়ালে ছবিটা নেই।’ ‘সে রাত্রে হোটেলের লোহার সিন্দুকে কত টাকা ছিল?’ ‘ঠিক জানি না। আন্দাজ দেড় লাখ!’ অতঃপর আর কি প্রশ্ন করব ভেবে পেলাম না। আমি উঠি-উঠি করছি‌, হৈমবতী আমাকে প্রশ্ন করলেন‌, ‘আমি এখানে আছি আপনার বন্ধু জানলেন কি করে? আমি তো কাউকে জানাইনি।’ উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেলাম। মহিলাটির বর্তমান মানসিক অবস্থায় ভূতপ্রেতের অবতারণা না করাই ভাল। বললাম‌, ‘তা জানি না‌, ব্যোমকেশ কিছু লেখেনি। আপনি উপস্থিত এখানেই আছেন তো?’ হৈমবতী বললেন‌, ‘বোধ হয় আছি। আমার স্বামীর এক বন্ধু তাঁর এই বাড়িতে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন। —আসুন‌, নমস্কার।’ বাইরে এসে দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে গাছের তলায় বিড়ির মুখে আগুন জ্বলছে‌, তাই দেখে বিকাশের কাছে গেলাম। তারপর দু’জনে ফিরে চললাম। ভাগ্যক্রমে খানিক দূর যাবার পর একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বিকাশ বলল‌, ‘কাজ হল?’ এই কথা আমিও ভাবছিলাম। হৈমবতীর দেখা পেয়েছি বটে‌, তাঁকে প্রশ্নও করেছি; কিন্তু কাজ হল কি? মানেক মেহতা এখন কোথায় তার কিছুমাত্র ইঙ্গিত পাওয়া গেল কি? বললাম‌, ‘কতকটা হল।’ বিকাশ খানিক চুপ করে থেকে বলল‌, ‘আপনি যখন ব্যোমকেশবাবুকে চিঠি লিখবেন‌, তখন তাঁকে জানাবেন যে‌, শোবার ঘরে দুটো খাট আছে।’ অবাক হয়ে বললাম‌, ‘তুমি জানলে কি করে?’ বিকাশ বলল‌, ‘আপনি যখন মহিলাটির সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি তখন বাড়ির সব জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি।’ ‘তাই নাকি! আর কি দেখলে?’ ‘যা কিছু দেখলাম‌, শোবার ঘরেই দেখলাম। অন্য ঘরে কিছু নেই।’ ‘কী দেখলে?’ ‘একটা মাঝারি গোছের লোহার সিন্দুক আছে। আমি যখন কাচের ভেতর দিয়ে উঁকি মারলাম, তখন চাকরটা সিন্দুকের হাত ধরে ঘোরাবার চেষ্টা করছিল।’ ‘চাকরিটা! ঠিক দেখেছ?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সে যখন সদর দরজা খুলেছিল তখন আমি তাকে দেখেছিলাম। সে ছাড়া বাড়িতে অন্য পুরুষ নেই।’— তারপর লেকের কাছাকাছি এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। বিকাশ নিজের রাস্তা ধরল‌, আমি বাসায় ফিরে এলাম। রাত্রে বসে চিঠি লিখছি‌, কাল সকালে ডাকে দেব। তুমি কেমন আছ? সত্যবতী আর খোকা ভাল আছে। আমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছি। –তোমার অজিত আমি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কাহিনীর শেষাংশ লিখিতেছি। ব্যোমকেশের নামে সহ্যাদ্রি হোটেলের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়া ডাকে দিয়াছিলাম ৯ তারিখের সকালে। ১২ তারিখের বিকালবেলা অনুমান তিনটার সময় ব্যোমকেশ আসিয়া উপস্থিত। সবিস্ময়ে বলিলাম‌, ‘একি! আমার চিঠি পেয়েছিলে?’ ‘চিঠি পেয়েই এলাম। প্লেনে এসেছি। —তুমি চটপট তৈরি হয়ে নাও‌, এখুনি বেরুতে হবে।’–বলিয়া ব্যোমকেশ ভিতর দিকে চলিয়া গেল। আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি হইতে বাহির হইলাম। রাস্তায় বাড়ির সামনে পুলিসের ভ্যান দাঁড়াইয়া আছে‌, তাহাতে একজন ইন্সপেক্টর ও কয়েকজন কনস্টেবল। আমরাও ভ্যানে উঠিয়া বসিলাম। কয়েকদিন আগে যে সময় হৈমবতীর নির্জন গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিলাম‌, প্রায় সেই সময় আবার গিয়া পৌঁছিলাম। আজ কিন্তু ভৃত্য মহেশ দরজা খুলিয়া দিতে আসিল না। দরজা খোলাই ছিল। আমরা সদলবলে প্রবেশ করিলাম। বাড়িতে কেহ নাই; হৈমবতী নাই‌, মহেশ নাই। কেবল আসবাবগুলি পড়িয়া আছে; বাহিরের ঘরে চেয়ার-টেবিল‌, শয়নকক্ষে দু’টি খাট ও লোহার সিন্দুক‌, রান্নাঘরে হাঁড়ি কলসী। লোহার সিন্দুকের কপাট খোলা, তাহার অভ্যন্তর শূন্য। ব্যোমকেশ করুণ হাসিয়া ইন্সপেক্টরের পানে চাহিল,–‘চিড়িয়া উড়েছে।’– সে রাত্রে নৈশ ভোজন সম্পন্ন করিয়া ব্যোমকেশ ও আমি তক্তপোশের উপর গায়ে আলোয়ান জড়াইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী খোকাকে ঘুম পাড়াইয়া আসিয়া ব্যোমকেশের গা ঘেঁষিয়া বসিল। একটা শীতের হাওয়া উঠিয়াছে‌, হাওয়ার জোর ক্রমেই বাড়িতেছে। আমাদের ঘরের দরজা জানোলা সব বন্ধ‌, তবু কোন অদৃশ্য ছিদ্রপথে খুঁচের মত বাতাস প্রবেশ করিয়া গায়ে বিঁধিতেছে। বলিলাম‌, ‘মহাবলেশ্বরের শীত তুমি খানিকটা সঙ্গে এনেছ দেখছি। আশা করি বিজয় বিশ্বাসের প্রেতটিকেও সঙ্গে আনোনি।’ সত্যবতী ব্যোমকেশের কাছে আর একটু ঘেঁষিয়া বসিল। ব্যোমকেশ আমার পানে একটি সকৌতুক দৃষ্টি হানিয়া বলিল‌, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে তোমার ভুল ধারণা এখনও যায়নি।’ বলিলাম‌, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে আমার ভুল ধারণা থাকা বিচিত্র নয়‌, কারণ প্রেতের সঙ্গে আমি কখনও রাত্রিবাস করিনি। আচ্ছা ব্যোমকেশ‌, সত্যিই তুমি ভুত বিশ্বাস করা?’ ‘যা প্রত্যক্ষ করেছি তা বিশ্বাস করা-না-করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তুমি ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?’ ‘ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। কারণ তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভূত তো চোখে দেখিনি‌, বিশ্বাস করি কি করে?’ ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু আমি যদি বিশ্বাস করি‌, তুমি আপত্তি করবে কেন?’ কিছুক্ষণ নীরবে ধূমপান করিলাম। ‘আচ্ছা‌, ওকথা যাক। বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ‌, তর্কে বহু দূর। কিন্তু তোমার ভূতের এত চেষ্টা সত্ত্বেও কার্যসিদ্ধি হল না।’ ‘কে বলে কার্যসিদ্ধি হয়নি? ভূত চেয়েছিল মস্ত একটা ধোঁকার টাটি ভেঙে দিতে। তা সে দিয়েছে।’ ‘তার মানে?’ ‘মানে কি এখনও কিছুই বোঝোনি?’ ‘কেন বুঝব না? প্রথমে অবশ্য আমি হৈমবতীর চরিত্র ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝেছি হৈমবতী আর মানেক মেহতা মিলে বিজয় বিশ্বাসকে খুন করেছিল। হৈমবতী একটি সাংঘাতিক মেয়েমানুষ।’ ‘হৈমবতীর চরিত্র ঠিকই বুঝেছ। কিন্তু ভুতকে এখনও চেনোনি। ভূতের রহস্য আরও সাংঘাতিক।’ সত্যবতী ব্যোমকেশের আরও কাছে সরিয়া গেল‌, হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিয়া বলিল‌, ‘আমার শীত করছে।’ ‘শীত করছে‌, না ভয় করছে।’ ব্যোমকেশ হাসিয়া নিজের আলোয়ানের অর্ধেকটা তাহার গায়ে জড়াইয়া দিল। বলিলাম‌, ‘এস এস বঁধু এস‌, আধা আঁচরে বসো। বুড়ো বয়সে লজ্জা করে না!’
false
humayun_ahmed
বলল, আপনি বসুন, চা খেয়ে যান। আমি বসলাম। মেয়েটা চা এনে দিল। নিজেই এনে দিল। উনিই কি আমার দাদীজান? ইরতাজুদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ। তারপর? মেয়েটাকে বিয়ে করলাম। বাবা খুব বিরক্ত হলেন। সামান্য পেশকারের মেয়েকে তাঁর ছেলে বিয়ে করবে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে উঠলাম। বাবা মূল বাড়ির থেকে দূরে–এখানে যে কাঁঠালগাছটা আছে সেখানে ঘর বানিয়ে দিলেন। জোহরার থাকার জায়গা হল ঐ ঘরে। উনার নাম জোহরা? হুঁ। আপনিও ঐ ঘরে থাকতে? না। বাবা আমাকে বিলেত পাঠিয়ে দিলেন। ও একাই থাকত। বিলেত থাকার সময়ই খবর পাই ছেলে হতে গিয়ে ও মারা গেছে। ডাক্তার ছিল না, ওষুধপত্র ছিল না। অনাদর অবহেলায় তোর বাবার জন্ম হয়। তোর বাবা কি কখনো এইসব নিয়ে তোদের সঙ্গে গল্প করেছে? না, তবে বাবা বলেছেন তিনি মানুষ হয়েছেন তার বড় মামা-মামীর কাছে। এই বাড়িটা ছিল তোর বাবার কাছে এক দুঃস্বপ্নের বাড়ি। এখনো তাই আছে। সে কখনো আসে না–তার মেয়েদেরও আসতে দেয় না। এই বাড়িটা তার কাছে বন্দিশিবির। আসলেই তো বন্দিশিবির। বুবলি রে নীতু, এই বন্দিশিবিরে আমি সারা জীবন একা একা কাটিয়েছি। আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করিনি। ইচ্ছা করলেই বিয়ে করতে পারত ইচ্ছে হয়নি। এই ব্যাপারটা তোর বাবার চোখে পড়ল না। তোর বাবার শুধু চোখে পড়ল–আমার কারণে তার মা বন্দি হলেন রাজবাড়িতে। আমার কারণে তাঁর মৃত্যু হল। আমার দাদীজান কি সত্যি সত্যি এই রাজবাড়িতে বন্দি হয়ে ছিলেন? হ্যাঁ। আমার বাবা তাকে ঐ ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। জোহরার মা বাবাভাই-বোন কারো সঙ্গে তাকে দেখা করতেও দেননি। বিলেত থাকার সময় আমি যেসব চিঠিপত্র তাকে লিখেছি সেসবও তাকে দেয়া হয়নি। তার কোন চিঠিও আমার কাছে পাঠানো হয়নি। উনি কি খুব সুন্দরী ছিলেন দাদাজান? হ্যাঁ। উনার কোন ছবি আছে? একটা আছে। দেখবি? হ্যাঁ দেখব। ইরতাজুদ্দিন খাট থেকে নামলেন। চাবি দিয়ে আলমারি খুলে ছবি বের করে। নীতুর হাতে দিলেন। কালো মেহগনি কাঠের ফ্রেমে বাধা ছবি। নীতু ছবি হাতে নিয়ে হতভম্ব গলায় বলল, এ তো অবিকল আপার ছবি! ইরতাজুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ, শাহানার সঙ্গে ওর সাংঘাতিক মিল। ছবিটা আপনি সরিয়ে রাখেননি কেন দাদাজান? লুকিয়ে রেখেছেন কেন? ইরতাজুদ্দিন জবাব দিলেন না। নীতু বলল, দাদীজানের কথা আরো বলুন, আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। উনি কি খুব হাসিখুশি মহিলা ছিলেন? না। চুপচাপ থাকত। তবে ভয়ঙ্কর জেদ ছিল। যা বলবে তাই। আমার মত? হুঁ। খানিকটা তোর মত; যা নীতু, ঘুমুতে যা–রাত অনেক হয়েছে। নীতু বলল, আজ আমি আপনার সঙ্গে ঘুমুব দাদাজান। যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে। ইরতাজুদ্দিনের পাশে নীতু শুয়ে আছে। এক সময় তার মনে হল তার দাদাজান কাঁদছেন। নীতু ভয়ে ভয়ে একটা হাত তার দাদাজানের গায়ের উপর রাখল। ইরতাজুদ্দিন কাঁদছেন। তার শরীর কাপছে, সেই সঙ্গে কাঁপছে নীতুর ছোট্ট হাত। যে হাত একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতি মমতায় আর্দ্র। সুরুজ আলি অনেক রাতে খেতে বসেছে। অন্দরবাড়িতেই তাকে খেতে দেয়া হয়। আজ বাংলাঘরে খাচ্ছে। পুষ্প ভাত-তরকারি এগিয়ে দিচ্ছে। দরজার বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কুসুম। মনোয়ারার ব্যথা ওঠেছে। ব্যথায় কাটা মুরগির মত ছটফট করছেন। মনোয়ারার বড় বোন আনোয়ারা বোনের পাশে আছেন। আজ তার চলে যাবার কথা ছিল। মনোয়ারার ব্যথা ওঠার কারণে যেতে পারছেন না। আনোয়ারা এসেছিলেন কুসুমের বিয়ের ব্যাপারটা ফয়সালা করতে। তিনি মোটামুটিভাবে করেছেন। ছেলে তার খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি কুসুমকে বলেছেন–অনাথ ছেলে হলেও সে যে উঁচু বংশের তা বোঝা যায়। কারণ ভাত খাওয়ার সময় এই ছেলে ছোট ছোট ভাতের নলা করে মুখে দেয়। ভাতের নলা যার যত ছোট তার বংশ তত উঁচু। কুসুম তার উত্তরে বলেছে, তাহলে তো খালাজান মুরগির বংশ সবচাইতে উঁচা। মুরগি একটা একটা কইরা ভাত খায়। কুসুমের কথায় তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছেন। তার ধারণা হয়েছিল, কুসুম বোধূয় এই বিয়েটা চাচ্ছে না। তিনি কুসুমকে আড়ালে ডেকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিন্ত হলেন যে, কুসুমের কোন আপত্তি নেই। ছেলে কুসুমেরও পছন্দ। তিনি কুসুমকে আশ্বস্ত করে বলেছেন–ছেলে কাজকাম করে না এইটা নিয়া তুই চিন্তা করিস না। রুটি-রুজির মালিক মানুষ না, আল্লাহপাক। আর পুরুষ মাইনষের ভাগ্য থাকে ইস্তিরির শাড়ির অঞ্চলে বান্দা। আমার শাড়ির অঞ্চলে তো খালাজান কিছুই নাই। আছে কি নাই এইটা তোর জানার কথা না। জাঞ্জেল্লাহপাক। আর আমরা তো আছি। বানে ভাইস্যা যাই নাই। কুসুমের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তার খালুজনই অবস্থাসম্পন্ন। কুসুমের বিয়ের খরচপাতির বেশিরভাগই তিনি করবেন কাজে তার কথাবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়। আড়াল থেকে কুসুম মানুষটার খাওয়া দেখছে। ভিতরবাড়িতে সে সামনে যায় কিন্তু বাংলাঘরে পুরুষের সামনে যাওয়া যায় না। সুম মনে মনে হাসছে। খালা এই মানুষটাকে যত বড় ঘরের মনে করছেন সে তত বড় ঘরের না। এই তো বিরাট বিরাট নলা করে মুখে দিচ্ছে। খিদে মনে হয় খুব লেগেছে। খাওয়া দিতে অনেক দেরি হল। এক সময় কুসুম বলল, আফনের পেট ভরছে? লোকটা ধড়মড় করে উঠল। কুসুম যে এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়েছিল সে বুঝতে পারেনি। অযত্ন হইলে ক্ষমা দিবেন। মার শইলডা ভালা না। অযত্ন হয় নাই। পুষ্প, যা পান বানাইয়া আন। পুষ্প পান আনতে গেল। কুসুম ঘরে ঢুকল। গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে বাড়ি, তার উপর বলতে গেলে নিশুতি রাত। সে কি
false
manik_bandhopaddhay
খারাপ হয় নাই, আবার যখন দেখা হইয়াছে, তখনো হয় নাই আনন্দ। কয়েকটা দিনরাত্রি কেবল তখন একসঙ্গে কাটিয়া গিয়াছে—পরস্পরের মধ্যে মশগুল হইয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলিয়া আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করিয়া থাকিয়া। সদানন্দ ঘাড়ে হাত রাখিবামাত্র বিপিন ঘাড় ফিরাইয়া অন্যদিকে তাকায়, একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হয় বিপিনের এই ভাবপ্রবণতা, তার ক্রোধে অভিমানের এতখানি ভেজাল। তুই যা ভেবেছিলি, তা ঠিক নয় সদা, মেয়েটা সত্যি ভালো। ওকে না জানিয়ে নারাণবাবু চলে গেছে বলে সেই থেকে খালি কাঁদছে। নারাণ আর আসবে না? আসবে–বেলা, নয় তো কাল সকালে। চার-পাচদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে মাধবীকে নিয়ে চলে যাবে, এ কটা দিন একটু রয়ে-সয়ে কাটিয়ে দে সদা, দোহাই তোর। আর কেউ হলে কি আশ্রমে উঠতে দিতাম? রাজাসায়েবের ছেলে, দুদিন পরে নিজে সবকিছুর মালিক হবে, ওকে তো চটানো যায় না, তুই বল, যায়? সদানন্দ গম্ভীরমুখে বলিল, বড়লোকের পা-চাটা আর টাকা রোজগারের ফন্দি আঁটবার জন্য আশ্রম করেছিলি, বিপিন? তা হলে ব্যবসা করলেই হত? বিপিন তর্ক করিল না, হাতজোড় করিয়া হাসিয়া বলিল, এ ব্যবসা মন্দ কি প্ৰভু? সদানন্দ মাথা নাড়িয়া বলিল, তামাশা রাখ, ভালো লাগে না। দিন দিন তুই যে কি ব্যাপার করে তুলছিস, বুঝতে পারি না বিপিন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আশ্রম করা হয়েছিল, সব চুলোয় গেছে, তোর খালি টাকা টাকা! টাকা ছাড়া কিছু হয় না বলেছিলি, টাকা তো অনেক হয়েছে, আবার কেন? এবার আসল কাজে মন দে না ভাই—এ সব ছেড়ে দে। আর টাকাই যদি তোর বড় হয়, তুই থাক তোর আশ্ৰম নিয়ে, আমি চলে যাই। দিন দিন আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমার আর সয় না। নালিশটা নতুন নয়, সদানন্দের বলিবার সকরুণ ভঙ্গিতে বিপিন আশ্চর্য হইয়া গেল। একটু ভাবিয়া সে একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিল জোরে, যতদূর সম্ভব মর্মাহত হওয়ার ভঙ্গিতে বলিতে লাগিল, টাকা? টাকা দিয়ে আমি করব কি? তুই কি ভাবিস টাকার লোভে আমি টাকা রোজগারের ফন্দি আঁটি? কতবার তোকে বলেছি সদা, তুই বুঝবি না কিছুতে, টাকা ছাড়া কিছু হয় না। কত • লোক আশ্রমে এসে থাকতে চায়, থাকবার ঘর নেই, ঘর তুলবার টাকা নেই। দক্ষিণের আমবাগানটা কিনে ফেলা দরকার, টাকা আছে কিনবার? এবার যদি নারাণবাবু কিনে দ্যান। তুই আদর্শ জানিস সদা, কিসে কি হয় জানিস না। বড় কাজ করতে চাইলেই কি করা যায়? করতে জানা চাই। ভেবে দ্যাখ, এই যে আশ্রমটা হয়েছে, এতগুলি লোক আশ্রমে বাস করছে, দলে দলে লোক এসে তোর উপদেশ শুনে যাচ্ছে, আমি ফন্দি না আঁটলে এটুকুও কি হত? রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কেউ তোর কথা শুনত না। ভালো উদ্দেশ্যে দুটো মিথ্যা কথা, একটু ভড়ং, এ সবে দোষ হয় না। নারাণবাবু একটা মেয়েকে বার করে এনেছে তো আমাদের কি? আমরা আশ্রমে উঠতে দিলেও বার করে আনত মেয়েটাকে, না দিলেও বার করে আনত। আমরা শুধু এই সুযোগে আশ্রমের একটু উন্নতি করে নিচ্ছি। এ সব কথা নিয়ে মাথা ঘামাস না, তোর কাজ তুই করে যা, আমার কাজ আমি করে যাই, একদিন দেখবি আমাদের এই আশ্রমের নাম সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। বিপিনের মতো বড় বক্তৃতার জবাবে সদানন্দ শুধু বলিল, আশ্রমের নাম সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবার জন্য আমার তো ঘুম আসছে না। ঘুম তোর খুব আসে, মোষের মতো ঘুমোস সারারাত। তোর মতো শুয়ে-বসে আরামে দিন কাটাতে পারলে আমারও ঘুম আসত।–বলিয়া বিপিন রাগ করিয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে সদানন্দ ভিতরে গেল। ছোট ঘরের চৌকিতে সেই ময়ূরআঁকা মাদুরে মাধবীলতা চুপ করিয়া বসিয়াছিল। বিপিন বোধহয় তাকে চা আর খাবার আনিয়া দিয়াছে, কিন্তু সে খায় নাই। কথা বলিতে গিয়া প্রথমে সদানন্দের গলায় শব্দ আটকাইয়া গেল, তারপর এমন কথা বলিল যার কোনো মানে হয় না। এখানে একা বসে আছ? একটু ইতস্তত করিয়া চৌকিতেই একপাশে বসিল। মুখখানা তার অস্বাভাবিক রকম। গম্ভীর ও ম্লান হইয়া গিয়াছে। মাধবীলতা একবার চোখ তুলিয়া চাহিল, সরিয়াও বসিল না, কথাও বলিল না। সদানন্দের ইচ্ছা হইতেছিল অতি সন্তৰ্পণে ধীরে ধীরে তার গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া দেয় আর কিছুক্ষণের জন্য তার আঙুলগুলি যেন হইয়া যায় পাখির পালকের চেয়ে কোমল। খাবার খাও নি কেন? খিদে পায় নি। কাল রাত্রে খেয়েছিলে কিছু? মাধবী মাথা নাঢ়িল। তাহলে খেয়ে নাও কিছু। চাটা বোধহয় জুড়িয়ে গেছে, গরম করে দিতে বলব? না, কিছু খাব না। বমি হয়ে যাবে। মাধবীলতা যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গে সদানন্দের মুখের ভাব দেখিতে থাকে। সদানন্দের মনে হয়, তুচ্ছ খাওয়ার কথা লইয়া এত বেশি মাথা ঘামানোর জন্য বিরক্ত হইয়া চোখের দৃষ্টি দিয়া সে তাকে ভৎসনা করিতেছে। সদানন্দ কাঠের পুতুলের মতো বসিয়া রহিল। মাধবীলতাকে তার কি বলার আছে? ভাবিতে গিয়া মনে পড়িল, একটা কথা বলা যায়, মাধবীলতার ভুলের কথা। এমন কাজ কেন করলে মাধবী, কেন বাড়ি ছেড়ে এলে? দুদিন পরে নারাণ যখন তোমাকে ফেলে পালাবে, কি করবে তখন তুমি? সমস্ত জীবনটা নষ্ট করে ফেলছ নিজের, একটু ভুলের জন্য। এমন ছেলেমানুষি করে! শুনিতে শুনিতে মাধবীলতার দুচোখ জ্বলজ্বল করিতে থাকে, মুখ আরক্ত হইয়া যায়। ইতিমধ্যে সে কখন স্নান করিয়াছে, ভালো করিয়া মোছা হয় নাই বলিয়া চুল এখনো ভেজা। ভেজা চুলের জলপটি থাকা সত্ত্বেও এমন মাথা গরম হইয়া যায় মাধবীলতার যে, প্রথমে সে খাবারের
false
robindronath
বলিতে পারি না। অথচ নিরীহ বৎসলস্বভাব রাইচরণকে সকল ছাত্রই বড়ো ভালোবাসিত; এবং ফেল্‌নাও ভালোবাসিত, কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, ঠিক বাপের মতো নহে, তাহাতে কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ মিশ্রিত ছিল। রাইচরণ বৃদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। তাহার প্রভু কাজকর্মে সর্বদাই দোষ ধরে। বাস্তবিক তাহার শরীরও শিথিল হইয়া আসিয়াছে, কাজেও তেমন মন দিতে পারে না, কেবলই ভুলিয়া যায় – কিন্তু যে ব্যক্তি পুরা বেতন দেয় বার্ধক্যের ওজর সে মানিতে চাহে না। এদিকে রাইচরণ বিষয় বিক্রয় করিয়া যে নগদ টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল তাহাও নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। ফেল্‌না আজকাল বসনভূষণের অভাব লইয়া সর্বদাই খুঁতখুঁত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদ একদিন রাইচরণ হঠাৎ কর্মে জবাব দিল এবং ফেল্‌নাকে কিছু টাকা দিয়া বলিল, “আবশ্যক পড়িয়াছে, আমি কিছুদিনের মতো দেশে যাইতেছি।” এই বলিয়া বারাসতে গিয়া উপস্থিত হইল। অনুকূলবাবু তখন সেখানে মুন্সেফ ছিলেন। অনুকূলের আর দ্বিতীয় সন্তান হয় নাই, গৃহিণী এখনো সেই পুত্রশোক বরে মধ্যে লালন করিতেছিলেন। একদিন সন্ধ্যার সময় বাবু কাছারি হইতে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন এবং কর্ত্রী একটি সন্ন্যাসীর নিকট হইতে সন্তানকামনায় বহুমূল্যে একটি শিকড় ও আশীর্বাদ কিনিতেছেন – এমন সময় প্রাঙ্গণে শব্দ উঠিল, “জয় হোক, মা।” বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে।” রাইচরণ আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, “আমি রাইচরণ।” বৃদ্ধকে দেখিয়া অনুকূলের হৃদয় আর্দ্র হইয়া উঠিল। তাহার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সহস্র প্রশ্ন এবং আবার তাহাকে কর্মে নিয়োগ করিবার প্রস্তাব করিলেন। রাইচরণ ম্লান হাস্য করিয়া কহিল, “মাঠাকরুনকে একবার প্রণাম করিতে চাই।” অনুকূল তাহাকে সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে লইয়া গেলেন। মাঠাকরুন রাইচরণকে তেমন প্রসন্নভাবে সমাদর করিলেন না- রাইচরণ তৎপ্রতি লক্ষ না করিয়া জোড়হস্তে কহিল, “প্রভু, মা, আমিই তোমাদের ছেলেকে চুরি করিয়া লইয়াছিলাম। পদ্মাও নয়, আর কেহও নয়, কৃতঘ্ন অধম এই আমি-” অনুকূল বলিয়া উঠিলেন, “বলিস কী রে। কোথায় সে।” “আজ্ঞা, আমার কাছেই আছে, আমি পরশ্বঃ আনিয়া দিব।” সেদিন রবিবার, কাছারি নাই। প্রাতঃকাল হইতে স্ত্রীপুরুষ দুইজনে উন্মুখভাবে পথ চাহিয়া বসিয়া আছেন। দশটার সময় ফেল্‌নাকে সঙ্গে লইয়া রাইচরণ আসিয়া উপস্থিত হইল। অনুকূলের স্ত্রী কোনো প্রশ্ন কোনো বিচার না করিয়া তাহাকে কোলে বসাইয়া, তাহাকে স্পর্শ করিয়া, তাহার আঘ্রাণ লইয়া, অতৃপ্তনয়নে তাহার মুখ নিরীণ করিয়া, কাঁদিয়া হাসিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বাস্তবিক ছেলেটি দেখিতে বেশ – বেশভূষা আকার প্রকারে দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণ নাই। মুখে অত্যন্ত প্রিয়দর্শন বিনীত সলজ্জ ভাব। দেখিয়া অনুকূলের হৃদয়েও সহসাøস্নেহ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। তথাপি তিনি অবিচলিত ভাব ধারণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো প্রমাণ আছে?” রাইচরণ কহিল, “এমন কাজের প্রমাণ কী করিয়া থাকিবে। আমি যে তোমার ছেলে চুরি করিয়াছিলাম সে কেবল ভগবান জানেন, পৃথিবীতে আর কেহ জানে না।” অনুকূল ভাবিয়া স্থির করিলেন যে, ছেলেটিকে পাইবামাত্র তাঁহার স্ত্রী যেরূপ আগ্রহের সহিত তাহাকে আগলাইয়া ধরিয়াছেন এখন প্রমাণসংগ্রহের চেষ্টা করা সুযুক্তি নহে ; যেমনই হউক, বিশ্বাস করাই ভালো। তা ছাড়া রাইচরণ এমন ছেলেই বা কোথায় পাইবে। এবং বৃদ্ধ ভৃত্য তাঁহাকে অকারণে প্রতারণাই বা কেন করিবে। ছেলেটির সহিতও কথোপকথন করিয়া জানিলেন যে, সে শিশুকাল হইতে রাইচরণের সহিত আছে এবং রাইচরণকে সে পিতা বলিয়া জানিত, কিন্তু রাইচরণ কখনো তাহার প্রতি পিতার ন্যায় ব্যবহার করে নাই, অনেকটা ভৃত্যের ভাব ছিল। অনুকূল মন হইতে সন্দেহ দূর করিয়া বলিলেন, “কিন্তু রাইচরণ, তুই আর আমাদের ছায়া মাড়াইতে পাইবি না।” রাইচরণ করজোড়ে গদ্গদ্ কণ্ঠে বলিল, “প্রভু, বৃদ্ধবয়সে কোথায় যাইব।” কর্ত্রী বলিলেন, “আহা, থাক্। আমার বাছার কল্যাণ হউক। ওকে আমি মাপ করিলাম।” ন্যায়পরায়ণ অনুকূল কহিলেন, “যে কাজ করিয়াছে উহাকে মাপ করা যায় না।” রাইচরণ অনুকূলের পা জড়াইয়া কহিল, “আমি করি নাই, ঈশ্বর করিয়াছেন।” নিজের পাপ ঈশ্বরের স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা দেখিয়া অনুকূল আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “যে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিয়াছে তাহাকে আর বিশ্বাস করা কর্তব্য নয়।” রাইচরণ প্রভুর পা ছাড়িয়া কহিল, “সে আমি নয়, প্রভু।” “তবে কে।” “আমার অদৃষ্ট।” কিন্তু এরূপ কৈফিয়তে কোনো শিক্ষিত লোকের সন্তোষ হইতে পারে না। রাইচরণ বলিল, “পৃথিবীতে আমার আর কেহ নাই।” ফেল্‌না যখন দেখিল, সে মুন্সেফের সন্তান, রাইচরণ তাহাকে এতদিন চুরি করিয়া নিজের ছেলে বলিয়া অপমানিত করিয়াছে, তখন তাহার মনে মনে কিছু রাগ হইল। কিন্তু তথাপি উদারভাবে পিতাকে বলিল, “বাবা, উহাকে মাপ করো। বাড়িতে থাকিতে না দাও, উহার মাসিক কিছু টাকা বরাদ্দ করিয়া দাও।” ইহার পর রাইচরণ কোনো কথা না বলিয়া একবার পুত্রের মুখ নিরীক্ষণ করিল, সকলকে প্রণাম করিল; তাহার পর দ্বারের বাহির হইয়া পৃথিবীর অগণ্য লোকের মধ্যে মিশিয়া গেল। মাসান্তে অনুকূল যখন তাহার দেশের ঠিকানায় কিঞ্চিৎ বৃত্তি পাঠাইলেন তখন সে টাকা ফিরিয়া আসিল। সেখানে কোনো লোক নাই। (অগ্রহায়ণ, ১২৯৮ বঃ) ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের দুই-তিন শ্রেণী নীচে আমাদের পণ্ডিত ছিলেন শিবনাথ। তাঁহার গোঁফদাড়ি কামানো, চুল ছাঁটা এবং টিকিটি হ্রস্ব। তাঁহাকে দেখিলেই বালকদের অন্তরাত্মা শুকাইয়া যাইত। প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়, যাহাদের হুল আছে তাহাদের দাঁত নাই। আমাদের পণ্ডিতমহাশয়ের দুই একত্রে ছিল। এ দিকে কিল চড় চাপড় চারাগাছের বাগানের উপর শিলাবৃষ্টির মতো অজস্র বর্ষিত হইত, ও দিকে তীব্র বাক্যজ্বালায় প্রাণ বাহির হইয়া যাইত। ইনি আক্ষেপ করিতেন, পুরাকালের মতো গুরুশিষ্যের সম্বন্ধ এখন আর নাই ; ছাত্রেরা গুরুকে আর দেবতার মতো ভক্তি করে না। এই বলিয়া আপনার উপেতি দেবমহিমা বালকদের মস্তকে সবেগে নিপে করিতেন, এবং মাঝে মাঝে হুংকার দিয়া উঠিতেন, কিন্তু তাহার মধ্যে এত ইতর কথা মিশ্রিত থাকিত
false
shirshendu
তুলে চেয়ে আছে। তাকাতেই বলল, একটা পাগল আমাকে ডাকছিল। বিলু সামান্য একটু লজ্জা পেল কি? লাবু ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। বাবা কাত হয়ে শুয়ে আছে। বালিশ থেকে মাথাটা নীচে পড়ে গেছে। বাবার শরীরের ওপর মস্ত পাতা খোলা খবরের কাগজটা পড়ে আছে। মা বাথরুমে ঢুকে যেতেই খুব আস্তে আস্তে হেঁটে বাবার বিছানার কাছে আসে লাবু। সে জানে, মানুষ মরে গেলে শ্বাস ফেলে না। লাবু বাবার নাকের কাছে ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে দিল। খুব জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে বাবার। সন্তর্পণে খবরের কাগজটা টেনে আনে লাবু। ছোট হাতে অত বড় বড় পাতা ভাজ করতে পারে না। কোনও রকমে ঘুচুমুচু করে দলা পাকিয়ে টেবিলে সরিয়ে রেখে দেয়। একটু ছোঁবে বাবাকে? ভয় করে। কত রোগা না লোকটা! এত রোগা কেন? এত অসুখ কেন? প্রীতমের একটা রোগা হাত খাট থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে। লাবু খুব ভয়ে ভয়ে একবার হাতটা ছোয়। ভয় করে। হাতটা ঠান্ডা। কত বড় বড় নখ বাবার হাতে! ভয় করে। বাবা চুল কাটে না কেন মা?–ভাত খেতে বসে লাবু মাকে জিজ্ঞেস করে। বিলুর খেয়াল হয়, তাই তো। অনেকদিন প্রীতমের চুল ছাঁটানো হয়নি। সে লাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ও মেয়ে। বাবার দিকে তো খুব নজর তোমার! দীপের ঘুম ভাঙল কানের কাছে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ কথাটা শুনে। তার বিছানা ঘেঁষেই জানালা এবং জানালার পাশেই রাস্তা। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। একেই শীতকাল, তার ওপর বাইরে কিছু কুয়াশা থাকতে পারে। শীতকালে ঘরের জানালা বন্ধ থাকে, মাথার জানালাটা কিছু তফাতে বলে ভোলা। কিন্তু কোনওটা দিয়েই আলো বা হাওয়া আসে না তেমন। অতিশয় ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এই ঘর। এখান থেকে সব সময়ে মনে হয়, বাইরে মেঘ করে আছে কিংবা সন্ধে হয়ে এল। ঘুম ভাঙলেই রোজ আঁশটে, কটু একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। জানালার ধারেই পাড়ার রাজ্যের তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, এঁটোকাটা জমা হয়ে থাকে। করপোরেশনের টিনের ঠেলাগাড়ি একটু বেলায় এসে নিয়ে যায়। ততক্ষণ গন্ধটা বেশ তীব্র। তারপরও গন্ধ একটা থাকেই। একতলার ঘর বলে এইসব অস্বস্তি। তবে এখন আর অতটা টের পায় না দীপ। সয়ে গেছে। শুধু এই সকাল বেলায় ঘুম ভাঙলে এখন কয়েকটা শ্বাসে গন্ধ পায়। দীপনাথ বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ে। আজও গা থেকে কম্বলটা একটু আলসেমিভরে সরিয়ে উঠে পড়ল। কাজ আছে। সাতসকালে রাস্তায় কে কাকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলল সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু কথাটা শুনে ঘুম ভাঙল বলে দীপনাথের মন থেকে সহজে গেল না সেটা। কম্বলটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে দীপনাথের একটু কষ্ট হল মনে। দাদা মল্লিনাথ তাকে এই বিলিতি কম্বলটা দিয়েছিল। ওয়াড় কবে ছিড়ে গেছে, উদ্যোগহীন মল্লিনাথ আর ওয়াড় করায়নি। অযত্নের ব্যবহারে গায়ের ঘষটানিতে রোয়া উঠে ভিতরের বুনোট বেরিয়ে পড়েছে কয়েক জায়গায়, তেলচিটে ময়লা ধরায় সবুজ আর হলুদ চৌখুপিগুলোও আবছা হয়ে এসেছে। আর একটা বা দুটো শীতের পরই ভিখিরি-কম্বল হয়ে যাবে। কেন কোনও জিনিসেই তার যত্ন নেই? এ কথা ভাবতে ভাবতে দীপনাথ নিজের ওপর বিরক্ত হয়। শিয়ালদার মোড় থেকে কিনে আনা তেতো ও রসাল নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করতে করতে কলঘরে যাওয়ার আগে সে দু’জন চিত ও কাত হয়ে পড়ে থাকা রুমমেটকে দেখে নেয়। একটি নিতান্তই বাচ্চা ছেলে, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। অন্যজন ফুড ডিপার্টমেন্টের মধ্যবয়সি ইন্সপেক্টর। দীপনাথের সঙ্গে কারওরই খুব একটা ভাব নেই। লেপের তলায় দু’জনেই এখন নিথর। ছাত্রটি উঠবে সাতটা নাগাদ, ইন্সপেক্টর আরও পরে। এখন বাজে পৌনে ছ’টা মাত্র। ভিতরে একটু দরদালান মতো। দরদালানের শেষে একটু চৌখুপি কাটা একধাপ নিচু করে বাঁধানো চৌবাচ্চার চাতাল। জলের চাপ কম বলে সকলেই আজকাল গ্রাউন্ড-লেভেলের নীচে ঢৌবাচ্চা বানায়। চৌবাচ্চার ধারে অবশ্য যেতে পারল না দীপ। সেখানে ম্যানেজারের বউ তার ছোট ছেলেকে বড়-বাইরে করাতে বসেছে। দীপ সুতরাং দরজায় দাঁড়িয়ে দাতন চিবোতে থাকে। ম্যানেজারের বউয়ের মুখখানা কোনওদিনই দেখেনি দীপ। বউটি লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকে। কিন্তু আন্দাজ করা যায় বউটি তরুণী এবং দেখতে ভালই। গায়ের রং বেশ ফর্সা। তবে এর মতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলাও হয় না। দু’ঘরের মাত্র ছ’জনকে নিয়ে এই ছোট্ট বোর্ডিং-এর লোকদের ম্যানেজার এমনিতেই যাচ্ছেতাই খাবার দেয়, তার ওপর এই বউটি ইচ্ছে করেই এত খারাপ রাধে যে মুখে দেওয়া যায় না। ফলে কেউই পুরোপেট খেতে পারে না। প্রতিদিনই থাকে রসুন দেওয়া শাক, কলাইয়ের ডাল আর তেলাপিয়া মাছের একটি গাদার টুকরো। দীপনাথ খাওয়ার সময় প্রতিদিনই বমি-বমি ভাব টের পায়। এ দিয়েও হয়তো খাওয়া যেত কিন্তু এই বউটি তা হতে দেয় না। কলাইয়ের ডাল ফোড়ন ছাড়া বেঁধে দেয়, যা খাওয়া সম্ভবই নয়। সর্ষেবাটা আর গুঁড়োমশলা দিয়ে রাঁধা মাছটিও গলা দিয়ে নামানো শক্ত। দীপনাথ প্রায়দিনই বাইরে খেয়ে নেয়। বউটির ঘোমটার আবরু আছে বটে কিন্তু মানবিক লজ্জাবোধটুকু নেই। দীপনাথ দাঁতন করতে করতে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কঠোর দৃষ্টিতে বউটিকে দেখছিল। সে যে অপেক্ষা করছে তা টের পেয়েছে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে চকিতে দেখে নিল তাকে, তারপর ন্যাংটো এবং ভেজা ছেলেটাকে দুহাতে আলগা করে শূন্যে তুলে হরিণের পায়ে। পালাল। প্রাতঃকৃত্যের পর, রুমমেটরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দীপনাথ তার ব্যায়াম সেরে নেয়। নিজেকে ফিট রাখতে হলে এটুকু অবশ্যই দরকার। গোটা ষাটেক বৈঠক আর ত্রিশটা বুকডন, কয়েকটা যোগাসন এবং বুলওয়ার্কার নিয়ে একটু পেশি খেলানো। চল্লিশ মিনিট থেকে এক
false
tarashonkor
এই যাওয়ার কথাটা শিবনাথ বাড়িতে বলিয়া না গেলেও কথাটা গোপন ছিল না। শুনিয়া গৌরীর সর্বাঙ্গ যেত শাণিত দীপ্তিতে ঝলকাইয়া উঠিল। নগণ্য চাষী-প্রজার কাছে স্বয়ং গিয়া খাজনা দিতে বলাটা তার কাছে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছু মনে হইল না। সে মনে মনে ছি। ছি করিয়া সারা হইল, শিবনাথের এই উদ্ভু-প্রবৃত্তিতে তাহার প্রতি ঘৃণায় তাহার অন্তরটা ভরিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে রাগেও সে হইয়া উঠিল প্রখর। ওই নগণ্য তুচ্ছ চাষী-প্রজার চেয়েও সে হেয়, তাহাদের চেয়েও সে শিবনাথের পর? কই, একবারও তো মিষ্ট কথায় অনুনয় করিয়া সে তাহাকে বলিল না, গৌরী, এ বিপদে তুমি মুখ তুলিয়া না চাহিলে যে আর উপায় নাই। ঘূণায় ক্রোধে জর্জর হইয়া গৌরী নীরবে শিবনাথের প্রতীক্ষায় বসিয়া ছিল। শিবনাথ ফিরিতেই সে বলিল, হাগা, তুমি নাকি প্রজাদের কাছে ভিক্ষে চাইতে গিয়েছিলে? মুহূর্তে শিবনাথের মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, সে কঠিনভাবেই জবাব দিল, হ্যাঁ। বাঁকানো ছুরির মত ঠোঁট বাঁকাইয়া হাসিয়া গৌরী বলিল, কত টাকা নিয়ে এলে, দাও, আমি আঁচল পেতে বসে আছি। শিবনাথ রূঢ় দৃষ্টিতে গৌরীর দিকে চাহিয়া রহিল, এ কথার কোনো জবাব ছিল না। উত্তর না পাইয়া গৌরী আবার বলিল, কী ভাবছ? হাজার দরুনে টাকা এ শাড়ির অ্যাঁচলে মানাবে না, নাকি? বল তো বেনারসী শাড়িখানাই না হয় পরি। শিবনাথ এবার বলিল, শাড়ির কথা ভাবছি না গৌরী, ভাবছি তোমার পুণ্যের কথা। যে ধন আমি এনেছি, সে ধন গ্রহণ করবার মত পুণ্যবল তোমার এখনও হয় নি। হলে দিতাম। গৌরী বলিল, কেন, তোমার পুণ্যের অদ্ধেক তো আমার পাবার কথা গো; তবে কুলুবে না। কেন শুনি? পাবার কথাও বটে, আমি দিতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি নিতে পারলে কই গৌরী? সে হলে তোমায় বলতে হত না, আমি এসেই তোমাকে সব ঢেলে দিতাম। গৌরী এবার জ্বলিয়া উঠিল, অন্তরের জ্বালায় উপরের ভদ্রতার আবরণটুকুও খসাইয়া দিয়া সে নির্মমভাবে বলিয়া উঠিল, ছি ছি, তুমি এত হীন হয়েছে, ছি! আমি যে ছি ছি করে মরে। গেলাম! শিবনাথ আর সহ্য করতে পারিতেছিল না, সেও এ কথার উত্তরে নির্মমভাবেই গৌরীকে আঘাত করিত, কিন্তু নায়েব রাখাল সিংয়ের আকস্মিক আবির্ভাবে সেটুকু আর ঘটিতে পারিল না। রাখাল সিং ব্যস্ত হইয়া আসিয়া বলিলেন, সদর থেকে সায়েব-সুবো, উকিল-মোক্তার সব দুর্ভিক্ষের জন্যে ভিক্ষে করতে এসেছেন। আমাদের কাছারির দোরে এসে দাঁড়িয়েছেন, শিগগির আসুন। অন্দর হইতে কাছারি-বাড়ি যাইবার অর্ধপথে আসিয়াই শিবনাথ অনুভব কলিল, মূল্যবান। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে বায়ুস্তর যেন মোহময় হইয়া উঠিয়াছে। কাছারিতে আসিয়া দেখিল, গোটা বাড়িটাই উজ্জ্বল আলোয় আলোময় হইয়া গিয়াছে। একটা লোকের মাথায় একটা পেট্রোম্যাক্স আলো জ্বলিতেছে, তাহার পিছনে ভিক্ষার্থী বিশিষ্ট ব্যক্তির দল। ভিক্ষার কাপড়টার এক প্রান্ত ধরিয়াছেন জেলার উচ্চপদস্থ এক রাজকর্মচারী, অন্য প্রান্ত ধরিয়াছেন জেলার এক লক্ষপতি ধনী; তাঁহাদের পশ্চাতে উকিল মোক্তার ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর দল। হাতে হাতে প্রায় দশ-বারটা সিগারেট হইতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খাইয়া খাইয়া বাতাসে মিশিয়া যাইতেছে। পঞ্চাননকে মনে মনে শত শত ধন্যবাদ দিয়া শিবনাথ সেই পয়সা, আনি, দুয়ানির মুষ্টি ভিক্ষাপাত্রে ঢালিয়া দিয়া বাড়ি ফিরিল। গভীর চিন্তায় আচ্ছনের মত সে বাড়িতে প্রবেশ করিল। কিন্তু গৌরীর তীক্ষ্ণ কঠোর কণ্ঠস্বরে তাহার সে চিন্তার একাগ্ৰতা ভাঙিয়া গেল। গৌরী নিত্যকে বলিতেছিল, খবরদার, ওকে আর বাড়ি ঢুকতে দিবি না। বলছি, বসে খা, তা না, অ্যাঁচলে বেঁধে নিয়ে যাবে, যুগিয়ে রাখবে। নিত্যি দুবেলা ওকে আচার দিতে হবে। শিবনাথ দেখিল, ওদিকের দুয়ারে দাঁড়াইয়া সেই খোনা মেয়েটা। মেয়েটা আবার মুড়ি ও আচার চাহিতে আসিয়াছে! ধমক খাইয়াও মেয়েটা কিন্তু নড়িল না, তেমনিভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল, না লইয়া সে এক পা নড়িবে না। মধ্যে মধ্যে আপনার দাবিটা সে মনে পড়াইয়া দিতেছিল, এঁই এঁতটুকুন আঁঙুলের উঁগায় কঁরে দাঁও ঠাঁকরুন। এঁকটুঁকুন। শিবনাথ উপরে উঠিয়া গেল। কোনো উপায় আর নাই। পৈতৃক সম্পত্তি চলিয়াই যাইবে। গভীর রাত্রিতেও শিবনাথ বিনিদ্র হইয়া বসিয়া ওই কথাই ভাবিতেছিল। ওদিকে খাটের উপর গৌরী ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। প্রথম কিছুক্ষণ সেও জাগিয়া ছিল, তাহারই মধ্যে কয়েকটা বঁকা কথাও হইয়া গিয়াছে। শিবনাথ বরাবর নিরুত্তর থাকিবারই চেষ্টা করিয়াছে, ফলে অল্পেই পালাটা শেষ হইয়াছে। তারপর কখন গৌরী ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। গৌরীর ঘুমটা একটু বেশি, সেজন্য শিবনাথ ভাগ্যদেবতার নিকট কৃতজ্ঞ। ঘুম কম হইলে শিবনাথ রাত্রির কথা ভাবিয়া শিহরিয়া ওঠে। অনেক চিন্তা করিয়া করিয়া সে যেন ক্রমে নিশ্চিন্ত হইয়া আসিতেছে। উপায় যেখানে নাই, সেখানে চিন্তা করিয়া কী করিবে? উপায় ছিল—গৌরী যদি তাহার জীবনে নিজের জীবন দুইটি নদীর জলধারার মত মিশাইয়া দিতে পারি, তবে উপায় ছিল। গৌরীর টাকার কথা মনে করিয়াই শুধু এ কথা সে ভাবে নাই। সে যদি শিবনাথের আদর্শকে গ্রহণ করিতে পারি, তবে যে সে প্রপার্টি ইজ থে—এ কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিয়া গৌরীর হাত ধরিয়া এ সমস্ত বর্জন করিতে পারিত। জীবিকা? এতবড় বিস্তীর্ণ দেশমা-ধরিত্রীর প্রসারিত বক্ষ, তাহারই মধ্যে তাহারা স্বামী-স্ত্রীতে স্তন্যপায়ী শিশুর মত মায়ের বুক হইতে রস সগ্ৰহ করিত। গৌরীর দিকে চাহিয়া সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। এ কী! গৌরীর গায়ের গহনা কী হইল? এ যে হাতে কয়গাছা চুড়ি ও গলায় সরু একগাছি বিছাহার ভিন্ন আর কিছুই নাই! গহনাগুলি গৌরী খুলিয়া রাখিয়াছে। বোধ করি তাহার দৃষ্টিপথ হইতে সরাইবার জন্যই খুলিয়া রাখিয়াছে, হয়ত বা নিরাপদ করিবার জন্য আমাদের বাড়িতে ম্যানেজারের জিন্মায় রাখিয়া আসিয়াছে। সহসা সে চমকিয়া উঠিল। নিচে কোথায় যেন একটা শব্দ উঠিতেছে-পাখির পাখা ঝটপট করার
false
shorotchandra
কখনো না। তবু ত তাকে চলে যেতে হচ্চে? আমাকেও যেতে হবে গোঁসাই। নির্দোষীকে দূর করে যদি নিজে থাকি, তবে মিথ্যেই এ পথে এসেছিলাম, মিথ্যেই এতদিন তাঁর নাম নিয়েছি। তবে কেনই বা তাকে যেতে হবে? মঠের কর্তা ত তুমি—তুমি ত তাকে রাখতে পার? গুরু! গুরু! গুরু! বলিয়া দ্বারিকাদাস অধোমুখে বসিয়া রহিলেন। বুঝিলাম গুরুর আদেশ—ইহার অন্যথা নাই। আজ আমি চলে যাচ্চি গোঁসাই, বলিয়া ঘর হইতে বাহিরে আসিবার কালে তিনি মুখ তুলিয়া চাহিলেন; দেখি চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, আমাকে হাত’ তুলিয়া নমস্কার করিলেন, আমিও প্রতিনমস্কার করিয়া চলিয়া আসিলাম। ক্রমে অপরাহ্নবেলা সায়াহ্নে গড়াইয়া পড়িল, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া রাত্রি আসিল, কিন্তু কমললতার দেখা নাই। নবীনের লোক আসিয়া উপস্থিত, আমাকে স্টেশনে পৌঁছাইয়া দিবে, ব্যাগ মাথায় লইয়া কিষণ ছটফট করিতেছে—সময় আর নাই—কিন্তু কমললতা ফিরিল না। পদ্মার বিশ্বাস সে আর একটু পরেই আসিবে, কিন্তু আমার সন্দেহ ক্রমশঃ প্রত্যয়ে দাঁড়াইল—সে আসিবে না। শেষবিদায়ের কঠোর পরীক্ষায় পরাঙ্মুখ হইয়া সে পূর্বাহ্ণেই পলায়ন করিয়াছে, দ্বিতীয় বস্ত্রটুকুও সঙ্গে লয় নাই। কাল আত্মপরিচয় দিয়াছিল ভিক্ষুক বৈরাগিণী বলিয়া, আজ সেই পরিচয়ই সে অক্ষুণ্ণ রাখিল। যাবার সময় পদ্মা কাঁদিতে লাগিল। আমার ঠিকানা দিয়া বলিলাম, দিদি বলেছে আমাকে চিঠি লিখতে—তোমার যা ইচ্ছে তাই আমাকে লিখে জানিও পদ্মা। কিন্তু আমি ত ভালো লিখতে জানিনে, গোঁসাই। তুমি যা লিখবে আমি তাই পড়ে নেব। দিদির সঙ্গে দেখা করে যাবে না? আবার দেখা হবে পদ্মা, আজ আমি যাই, বলিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। চৌদ্দ সমস্ত পথ চোখ যাহাকে অন্ধকারেও খুঁজিতেছিল, তাহার দেখা পাইলাম রেলওয়ে স্টেশনে। লোকের ভিড় হইতে দূরে দাঁড়াইয়া আছে, আমাকে দেখিয়া কাছে আসিয়া বলিল, একখানি টিকিট কিনে দিতে হবে গোঁসাই— সত্যিই কি তবে সকলকে ছেড়ে চললে? এ-ছাড়া ত আর উপায় নেই। কষ্ট হয় না কমললতা? এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করো গোঁসাই, জানো ত সব। কোথায় যাবে? যাব বৃন্দাবনে। কিন্তু অত দুরের টিকিট চাইনে—তুমি কাছাকাছি কোন-একটা জায়গার কিনে দাও। অর্থাৎ আমার ঋণ যত কম হয়। তার পরে শুধু হবে পরের কাছে ভিক্ষে, যতদিন না পথ শেষ হয়। এই ত? ভিক্ষে কি এই প্রথম শুরু হবে গোঁসাই? আর কি কখনো করিনি? চুপ করিয়া রহিলাম। সে আমার পানে চাহিয়াই চোখ ফিরাইয়া লইল, কহিল, দাও বৃন্দাবনেরই টিকিট কিনে। তবে চল একসঙ্গে যাই। তোমারো কি ঐ এক পথ নাকি? বলিলাম, না, এক নয়, তবু যতটুকু এক করে নিতে পারি। গাড়ি আসিলে দু’জনে উঠিয়া বসিলাম। পাশের বেঞ্চে নিজের হাতে তাহার বিছানা করিয়া দিলাম। কমললতা ব্যস্ত হইয়া উঠিল—ও কি করচ গোঁসাই? করচি যা কখনো কারো জন্যে করিনি—চিরদিন মনে থাকবে বলে। সত্যিই কি মনে রাখতে চাও? সত্যিই মনে রাখতে চাই কমললতা। তুমি ছাড়া যে-কথা আর কেউ জানবে না। কিন্তু আমার যে অপরাধ হবে, গোঁসাই। না, অপরাধ হবে না—তুমি স্বচ্ছন্দে ব’সো। কমললতা বসিল, কিন্তু বড় সঙ্কোচের সহিত। গাড়ি চলিতে লাগিল কত গ্রাম, কত নগর, কত প্রান্তর পার হইয়া—অদূরে বসিয়া সে ধীরে ধীরে তাহার জীবনের কত কাহিনীই বলিতে লাগিল। তাহার পথে বেড়ানর কথা, তাহার মথুরা, বৃন্দাবন, গোবর্ধন, রাধাকুণ্ডবাসের কথা, কত তীর্থভ্রমণের গল্প, শেষে দ্বারিকাদাসের আশ্রমে, মুরারিপুর আশ্রমে আসা। আমার মনে পড়িয়া গেল ঐ লোকটির বিদায়কালের কথাগুলি; বলিলাম, জানো কমললতা, বড়গোঁসাই তোমার কলঙ্ক বিশ্বাস করেন না। করেন না? একেবারে না। আমার আসবার সময়ে তাঁর চোখে জল পড়তে লাগল, বললেন, নির্দোষীকে দূর করে যদি নিজে থাকি নতুনগোঁসাই, মিথ্যে তাঁর নাম নেওয়া, মিথ্যে আমার এ-পথে আসা। মঠে তিনিও থাকবেন না কমললতা, এমন নিষ্পাপ মধুর আশ্রমটি একেবারে ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে যাবে। না, যাবে না, একটা কোন পথ ঠাকুর নিশ্চয় দেখিয়ে দেবেন। যদি কখনো তোমার ডাক পড়ে, ফিরে যাবে সেখানে? না। তাঁরা যদি অনুতপ্ত হয়ে তোমাকে ফিরে চান? তবুও না। একটু পরে কি ভাবিয়া কহিল, শুধু যাব যদি তুমি যেতে বল। আর কারো কথায় না। কিন্তু কোথায় তোমার দেখা পাব? এ প্রশ্নের সে উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিলে ডাকিলাম, কমললতা? সাড়া আসিল না, চাহিয়া দেখিলাম সে গাড়ির এককোণে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিয়াছে। সারাদিনের শ্রান্তিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে ভাবিয়া তুলিতে ইচ্ছা হইল না। তারপরে নিজেও যে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম জানি না। হঠাৎ একসময়ে কানে গেল—নতুনগোঁসাই? চাহিয়া দেখি সে আমার গায়ে হাত দিয়া ডাকিতেছে। কহিল, ওঠ, তোমার সাঁইথিয়ায় গাড়ি দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিলাম, পাশের কামরায় কিষণ ছিল, ডাকিয়া তুলিতে সে আসিয়া ব্যাগ নামাইল, বিছানা বাঁধিতে গিয়া দেখা গেল যে দু-একখানায় তাহার শয্যা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম সে তাহা ইতিপূর্বেই ভাঁজ করিয়া আমার বেঞ্চের একধারে রাখিয়াছে। কহিলাম, এটুকুও তুমি ফিরিয়ে দিলে?—নিলে না? কতবার ওঠানামা করতে হবে, এ বোঝা বইবে কে? দ্বিতীয় বস্ত্রটিও সঙ্গে আনোনি—সেও কি বোঝা? দেব দু-একটা বার করে? বেশ যা হোক তুমি। তোমার কাপড় ভিখিরির গায়ে মানাবে কেন? বলিলাম, কাপড় মানাবে না, কিন্তু ভিখারিকেও খেতে হয়। পৌঁছতে আরও দু’দিন লাগবে, গাড়িতে খাবে কি? যে খাবারগুলো আমার সঙ্গে আছে তাও কি ফেলে দিয়ে যাব—তুমি ছোঁবে না? কমললতা এবার হাসিয়া বলিল, ইস্‌, রাগ দ্যাখো। ওগো, ছোঁব গো ছোঁব, থাক ও-সব, তুমি চলে গেলে আমি পেটভরে গিলবো। সময় শেষ হইতেছে, আমার নামিবার মুখে কহিল, একটু দাঁড়াও ত গোঁসাই; কেউ নেই, আজ লুকিয়ে তোমায় একটা প্রণাম করে নিই।
false
toslima_nasrin
কোটি মুসলিম নর নারীর সাধ্য আছে তাদের পবিত্র ধর্মকে নাস্তিক্যবাদী শয়তানের গোটা কয়েক সন্তানের বিদ্রূপ এবং অবহেলা থেকে বাঁচাবার। কেবল বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদী শক্তিকে ঠেকানো যাবে না, পথে নেমেছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গতকাল বিকেল চারটায় নির্মূল কমিটির সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি যে উদ্দেশ্যে একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল সেই একই উদ্দেশ্যে আজ তারা আমাদের মুক্তবুদ্ধির সংবাদপত্রগুলোর ওপর হামলা করছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারাই পরাজিত শষনুকে মাথা তুলতে দিয়েছি। এই শক্তি এখন দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত বদল করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে জেহাদে নামতে হবে। সমাবেশে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেবার জোর দাবি জানানো হয়। ডঃ কামাল হোসেন গতকাল বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলে গণফোরাম আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করেছেন, বলেছেন, ধর্মের নামে যারা বিভিন্ন ব্যক্তির ফাঁসি চায় তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন। বর্তমান সংসদ কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এ সংসদ দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারেনি। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, সবাই ব্যর্থ। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাকে রক্ষা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়নি। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইসলামকে বিপন্ন করেছে। আফ্রিকার নেলসন ম্যাণ্ডেলা শ্বেতাঙ্গদের সাথে আলোচনায় বসতে পারেন। আরাফাত ইজরাইলের সাথে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু আমাদের দুই নেষনী দেশের উন্নয়নের জন্য আলোচনায় বসতে পারেন না। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে এখনও পৃথক করা হয়নি। .. সরকার সংবাদপষেনর স্বাধীনতার নামে পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার ও সাংবাদিকদের হয়রানি করছে। জনগণকে উপেক্ষা করে দেশ চালাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাথার মূল্য ধার্য করার প্রতিবাদ করেছে সেই সাজু, সেই জাহেদা, সেই লাভলী এবং তাদের দল। এছাড়া আজকের পত্রিকায় আমার মাথা নিয়ে আর কারও মাথা ব্যথা দেখা যায়নি। তবে মাথা নিয়ে বিবিসি একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। খবরটি এভাবে বেরিয়েছে। খুলনায় মৌলবাদীদের একটি জনসভায় লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য ১ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রসচিব আজিমউদ্দিন আহমেদ গতকাল শনিবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যে মাওলানা ওই ঘোষণা দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ঠিক কি বলেছিলেন এবং খুলনাতে ঠিক কি ঘটেছিল সরকার তা জানার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, এটা যদি সত্যি হয় তাহলে যার বিরুদ্ধে এই কথা বলা হয়েছে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তসলিমা এখন আত্মগোপন করে আছেন এমন অবস্থায় তিনি কি করে নিরাপত্তার জন্য অনুরোধ করবেন? সচিব বলেন, তসলিমার উচিত সরকারের কাছে অথবা আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মৌলবাদীরা সংবাদপষেনর ওপর আর তসলিমার বাড়িতে হামলা করেছে, এতে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কি কোনও তদন্ত করছে? এটা একটা সাধারণ অপরাধ নয়, এটা কোনও সাধারণ ভাঙচুর বা গুণ্ডামির অপরাধ নয়। এটা অন্য কিছু। কিন্তু কেউ যদি কোনও সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, অন্য কাউকে আহত করে, অথবা অন্য যে কোনও কাজ করে যা আইনের চোখে অপরাধ তাহলে ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। এটুকু সংবাদ দেওয়ার পর বিবিসির সাংবাদিক জানান, আমি তাঁকে বাংলায় সাক্ষাৎকার দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, জবাবে তিনি জানান, তাঁর মাতৃভাষা বাংলা নয়, তাঁর মাতৃভাষা উর্দু। আজ সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল গেল কোনও খবর নেই ক বা ঙর। আমার যে যাবার কথা ছিল হাইকোর্টে! কেন আজকের এই যাওয়া বাদ দিতে হল, কিছুই আমি বুঝতে পারি না। চ আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের খাবার খেলেন। খাওয়ায় রুচি নেই আমার, অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়ি। চ যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ব্যস্ত থাকেন তাঁর কন্যা নিয়ে। আজ রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি আমার কাছে এসে বসলেন কিছুক্ষণের জন্য। কিছু পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন যে আজ আপিসে এক মহিলার সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, মহিলাই তুলেছিল প্রসঙ্গ,বলল লজ্জা একটা বাজে বই, লজ্জা বইটি লিখে আমি খুব ভুল করেছি। আমি চুপ হয়ে থাকি, মনে মনে ভাবি চ নিশ্চয়ই ওই মহিলার মতের সঙ্গে একমত হননি। কিন্তু চ এরপরেই বললেন, আপনার সব বইই আমি পড়েছি, লজ্জাটা আমারও ভাল লাগেনি। খুব একপেশে লেখা। একপেশে? হ্যাঁ একপেশে। অনেক কিছু তো সত্য নয়। এ দেশে হিন্দু পলিটিশিয়ান আছে, হিন্দু আর্টিস্ট আছে, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিন্দু আছে, হিন্দু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আছে, হিন্দু সাইন্টিস্ট আছে। লজ্জায় তো এদের কথা লেখেননি। কত বড় বড় মুভমেন্ট হল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, এসব কিছুই লেখা নেই লজ্জায়। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। মাথা নিচু করে বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে থাকি। চর মুখের দিকে ভয়ে তাকাই না। যদি চ এখন ঘ এর মত বলেন যে এ বাড়িতে আমার আর থাকা হচ্ছে না! তেরো জুন, সোমবার গভীর রাতে ক আর খ এসে আমাকে একটি গাড়ির পেছনে শুইয়ে নিয়ে গেলেন একটি দেয়ালঘেরা মাঠ অলা বাড়িতে। বাড়ির ভেতর বৈঠকঘরে বড় এক সোফা জুড়ে বসেছিলেন একজন রাশভারী মহিলা। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। এটি এমন এক দৃষ্টি যে দেখলে গা ছমছম করে। আমাকে বসতে বললেন গমগমে গলায়। গা ছমছম করলেও তিনিই আমার রক্ষক। তিনি আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন। জীবনে অনেক মেয়ের উপকার করেছেন তিনি, আমারও করছেন। আসলে চর বাড়ি ছাড়ার কারণটি হল, ক যা বলেছেন, যে, এক বাড়িতে বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। আত্মগোপনেরও পদ্ধতি আছে, আমার জানা ছিল না এতসব। এক জায়গায়, জায়গাটি নিরাপদ
false
MZI
দ্বিতীয় দিনে ছোটাচ্চু সুমনের কাছ থেকে উত্তর পেলো। ই-মেইল ঠিকানা বা চিঠির শেষে কোথাও সুমনের নাম লেখা নেই কিন্তু ছোটাচ্চুর বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না এটা সুমন। কারণ এখানে লেখা এই দশটা প্রশ্ন দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি কারণ এই প্রশ্নগুলো আমারও প্রশ্ন। আমি কয়েকটার উত্তর চিন্তা করে বের করেছি। অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করছি। তুমি বের করতে পারলে আমাকে জানিও। চিঠিটা পেয়ে ছোটাচ্চুর উত্তেজনার শেষ নেই। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে উত্তর পাঠালো তুমি যে প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করেছ, সেগুলো কি আমাকে পাঠাবে? উত্তরে সুমন লিখল পাঠালাম। ছোটাচ্চু লিখল ফ্যান্টাস্টিক। তুমি কী কর? কলেজ ইউনিভার্সিটির মাস্টার? সুমন লিখল হা হা হা। আমি কলেজ ইউনিভার্সিটির মাস্টার না। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকব। ছোটাচ্চু অবশ্যি শুধু ই-মেইল চালাচালি করে বসে রইল না, ইউনিভার্সিটির কয়েকজনের সাথে কথা বলে দুইটা প্রশ্নের উত্তর বের করে নিয়ে এসে সুমনকে লিখল আমি আরো দুইটা প্রশ্নের উত্তর বের করেছি। তুমি কি দেখতে চাও? সুমন লিখল অবশ্যই। ছোটাচ্চু তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে লিখল হাতে লেখা উত্তর। ই-মেইলে কেমন করে পাঠাব? সুমন লিখল স্ক্যান করে পাঠাতে পার। ছোটাচ্চু লিখল ধারে কাছে স্ক্যানার নাই। তোমার বাসা কোথায়? ধারে কাছে হলে হাতে হাতে দিতে পারি। সুমন পুরো একদিন এর উত্তর দিল না। তারপরে লিখল তুমি কে? কী কর? ছোটাচ্চু তখন বিপদে পড়ে গেল। সে এখন কী লিখবে? যখন চিন্তা করতে করতে ঘেমে গেল তখন টুনি তাকে সাহায্য করল। বলল, লিখ তুমি বিজ্ঞানের একটা বই লেখার চেষ্টা করছ। সেইজন্যে বিজ্ঞানের মজার মজার প্রশ্ন আর তার উত্তর খুঁজে বের করছ। ছোটাচ্চু চিন্তিত মুখে বলল, যদি আমাকে বিজ্ঞানের কোনো একটা প্রশ্ন করে বসে? সামনা সামনি তো তোমাকে পাচ্ছে না! কেমন করে প্রশ্ন করবে? ছোটাচ্চু বলল, তা ঠিক। তারপর সুমনকে লিখল আমি একটা বিজ্ঞানের বই লিখছি। বই মেলায় বের করার ইচ্ছা। সেই জন্যে মজার মজার প্রশ্ন আর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। সুমন লিখল আমার কাছে আরো মজার প্রশ্ন আছে। ছোটাচ্চু লিখল আমাকে দিবে? সুমন লিখল হাতে লেখা প্রশ্ন। আমার কাছেও স্ক্যানার নাই। হা হা হা। ছোটাচ্চু আবার তার বাসা বের করার চেষ্টা করল। তোমার বাসা কোথায়? কাছাকাছি হলে হাতে হাতে দিতে পার। সুমন যেখানেই তার বাসা লিখুক না কেন ছোটাচ্চু লিখবে তার বাসা ঠিক সেখানেই। তারপর সেখানে চলে যাবে। কিন্তু সুমন তাকে বিপদে ফেলে দিল, পাল্টা প্রশ্ন করল। তোমার বাসা কোথায়? এখন তার বাসা যদি কাছাকাছি না হয় তাহলে তো বিপদ হয়ে যাবে। টুনি আবার তাকে সাহায্য করল, বলল, ছোটাচ্চু, তুমি তোমার বাসাটা কোথায় লিখ। যদি তার বাসা থেকে দূরে হয় তখন ভান করবে ঠিক সেখানে একটা কাজে গিয়েছ! ছোটাচ্চু লিখল আমার বাসা মিরপুর। সুমন লিখল আমার বাসা উত্তরা। সরি। ছোটাচ্চু হাতে কিল দিয়ে বলল, অন্তত বাসাটা কোথায় বের করে ফেলেছি! সুমন উত্তরাতে আছে! টুনি বলল, এখন তুমি লিখ কাল পরশু তুমি উত্তরা যেতে পার। তখন ইচ্ছে করলে তুমি তাকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পার, তার প্রশ্নগুলো নিতে পার। বেশি উৎসাহ দেখিও না, তাহলে সন্দেহ করবে। ছোটাচ্চু লিখল উত্তরাতে আমার ডেন্টিস্ট এপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি কাল উত্তরা যাব। তুমি চাইলে তখন দিতে পারি। টুনি জিজ্ঞেস করল, এতো কিছু থাকতে ডেন্টিস্ট এপয়ন্টমেন্টের কথা কেন বলছ? ছোটাচ্চু হা হা করে হেসে বলল, বুঝলি না? ভান করব দাঁতে ব্যথা, কথা বলতে পারছি না। বিজ্ঞানের প্রশ্ন যদি করে ফেলে ধরা পড়ে যাব না? সুমনকে শেষ পর্যন্ত টোপ খাওয়ানো গেল। সে উত্তরার একটা ফাস্ট ফুডের দোকানের ঠিকানা দিয়ে বলল, সন্ধ্যেবেলা সেখানে গেলে সে তার মজার প্রশ্নগুলো দিয়ে যাবে। সেই ই-মেইলটি পেয়ে সুমন একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল এবং সেই চিৎকার শুনে ছোটদের সাথে সাথে বড়রাও চলে এল! বড়রা যখন বুঝল কোনো বিপদ আপদ হয়নি তখন যে যার মতো চলে গেল শুধু বাচ্চারা থেকে গেল। একজন জিজ্ঞেস করল, পালিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছ? ছোটাচ্চু বুকে থাবা দিয়ে বলল, ইয়েস। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে! আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কেমন করে খুঁজে বের করলে ছোটাচ্চু? ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে বলল, এটা একই সাথে বুদ্ধি, মেধা, বিশ্লেষণ, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং কঠোর পরিশ্রমের ফসল। ছোটাচ্চুর গম্ভীর মুখ দেখে বাচ্চারাও মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়ল। শুধু টুনি মুখ টিপে হাসল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, কালকে যখন দেখা হবে, তখন তুমি কী করবে? ছোটাচ্চু বলল, আমি তখন তার বাবাকে জানাব। বাবা সেই ফাস্ট ফুডের দোকানে অপেক্ষা করবে, আমি যখন সুমনের সাথে কথা বলব তখন তার বাবা এসে ক্যাঁক করে ধরে ফেলবে। ছোটাচ্চু আনন্দে হা হা করে হাসল। বাচ্চারা কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না। টুনি বলল, কালকে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কেন? যদি কোনো কারণে সুমন না আসে তাহলে তুমি লজ্জা পাবে। তুমি যদি তার ঠিকানাটা বের করে আনতে পার, তাহলে সেই ঠিকানাটা পরে যে কোনো সময়ে তার আন্ধুকে দিতে পারবে। ছোটাচ্চু বলল, ঠিকই বলেছিস। কালকে কোথায় থাকে দেখে আসি। যখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হব, তখন জানাব। সবাই চলে গেলে টুনি বলল, ছোটাচ্চু। কী হল? কালকে তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যেয়ো। তোকে? কেন? তুমি যদি সুমনের পিছনে পিছনে যাওয়ার চেষ্টা কর,
false
MZI
তাই তখন টাইয়ের নটটা প্রথমে একটু ঢিলে করল তারপর খুলেই ফেলল। আকবর হোসেন তখন এক পায়ের উপর তুলে রাখা অন্য পাটা সরিয়ে বসল, ছোটাচ্চুও তার পাটা সরিয়ে নিল। ছোটাচ্চুর তখন মনে হল সবকিছু মনে হয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে তখন জিরো পাওয়ারের চশমাটাও খুলে ফেলল। তার চশমা চোখে দেওয়ার অভ্যাস নেই তাই চশমাটা খুলতেই কানের উপর আর নাকের উপর থেকে চাপটা কমে গেল বলে মনে হল। আকবর হোসেন একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, বললেন, ডলি যা যা বলেছে সব সত্যি? ছোটাচ্চু কী বলবে একটু চিন্তা করল, তারপর বলল, অনেক কিছু সত্যি কিন্তু যেভাবে বলেছেন সেভাবে সত্যি না। যদি সত্যি হয় তাহলে আমি তোমাকে দায়িত্বটা দিতে চাই। ছোটাচ্চুর মনে হল সে কথাটা ঠিক করে শুনেনি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন? বলেছি যে ডলির কথা সত্যি হলে আমি তোমাকে দায়িত্বটা দিতে চাই। তুমি করে বলছি দেখে কিছু মনে করোনি তো। তোমার টাই আর চশমা খোলার পর তোমাকে একটা বাচ্চা মানুষের মতোই লাগছে। ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, না, না, কিছু মনে করি নাই। তুমি করেই তো বলবেন। আসলে ছোটাচ্চুকে অপরিচিত কোনো মানুয তুমি করে বললে সে খুব বিরক্ত হয়, এখন অবশ্যি অন্য ব্যাপার। আকবর হোসেন আবার তার একটা পায়ের উপর আরেকটা পা তুলে বললেন, ডলির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার এই ডিটেকটিভ এজেন্সি এখন একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আমি আসলে ঠিক এরকমই চাচ্ছিলাম, যে একটু সময় দেবে। আমার মনে হয় একটু সময় দিয়ে ঠিকভাবে খোঁজাখুঁজি করলেই সুমনকে বের করে ফেলা যাবে। হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর ভেতরে হুড় হুড় করে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করল। হাতে কিল দিয়ে বলল, অবশ্যই বের করে ফেলব। আকবর হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পাগল ছেলেটা কেমন যে আছে! আমার মতন হয়েছে, ছেলেটার মাথায় কিছু একটা ঢুকে গেলে আর বের করা যায় না। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা—মানে আমি বের করে ফেলব। থ্যাংক ইউ শাহরিয়ার। তুমি কেমন করে অগ্রসর হতে চাও? প্রথম ঘটনাটা আরেকটু বিস্তারিত বলেন, তারপর তার ঘরটা একটু দেখতে চাই। তার খাতাপত্র ডাইরি যদি থাকে সেগুলো একটা দেখতে চাই। তার বন্ধু বান্ধব যাদের আপনারা চিনেন, তাদের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর যদি থাকে সেগুলো নিতে চাই। আপনাদের আত্মীয় স্বজন যাদের কাছে সে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে তাদের নাম ঠিকানা চাই। মোটামুটি এগুলো হলেই কাজ শুরু করে দিতে পারব। গুড! আকবর হোসেন সোফায় হেলান দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমি তাহলে শুরু করি। আকবর হোসেন তখন সবকিছু বলতে শুরু করলেন। ছোটা খুবই গম্ভীর ভাবে তার নোট বইয়ে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাবার্তা টুকে নিতে লাগল। ছোটাচ্চু যখন বাসায় ফিরে এল তখন বাসার সব বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরল, জিজ্ঞেস করতে লাগল, কী হয়েছে ছোটাচ্চু? কী হয়েছে বল। ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, তোরা না আমাকে ত্যাজ্য ঢাঢ় করে দিয়েছিস—এখন আবার আমার সাথে কথা বলতে এসেছিস, তোদের লজ্জা করে না? একজন বলল, আমরা তোমাকে মাফ করে দিয়ে আবার টাচু হিসেবে নিয়ে নিয়েছি। তোরা নিলেই তো হবে না আমাকেও তো নিতে হবে। আমি এখনো নেই নাই। ছোটাচ্চু তার মুখটা শক্ত করে দাড়িয়ে রই। বাচ্চারা তখন ছোট ছোট লাফ দিতে দিতে বলতে লাগল, প্লিজ ছোটাচ্চু! প্লিজ। আগে বল আর কোনোদিন আমাকে গোলাম আযমের ভাতিজা বলে গালি দিবি? দিব না। কানে ধর। সবাই কানে ধরে ফেলল, ছোটাচ্চুর কাছ থেকে এই ধরনের শাস্তি তাদের জন্যে কোনো বিষয়ই না। শুধু একজন মিনমিন করে বলল, আমরা এইগুলো করি তোমাকে লাইনে রাখার জন্যে। এইভাবে তোমাকে শাসন না করলে তুমি বেলাইনে চলে যাও তো—সেইজন্যে। ছোটাচ্চু হুংকার দিল, আমি বেলাইনে যাই? সবাই হিহি করে হাসতে লাগল বলে ছোটাচ্চু আর বেশিক্ষণ রেগে থাকার ভান করতে পারল না। ছোটাচ্চু তখন আকবর হোসেনের বাসায় কী হয়েছে সেটা বাচ্চাদের বলল। যেটুকু বলল তার থেকে বেশি অভিনয় করে দেখালো। ডলি খালার নাকি কান্নার অভিনয়টা এতো ভালো হল যে, বাচ্চাদের অনুরোধে সেটা কয়েকবার করে দেখাতে হল। সব বাচ্চারা চলে যাবার পর টুনি বলল, ছোটাচ্চু। বল। তুমি কি ছেলেটার বাসায় দরকারি কিছু পেয়েছ? কিছু খাতাপত্র পেয়েছি। ডাইরি কি আছে? একটা ডাইরি আছে কিন্তু সেটা কোনো কাজে লাগবে না। কেন? ডাইরির মাঝে নিজের কোনো কথা নাই, শুধু বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞানের কথা? ছোটাচ্চু বলল, হ্যাঁ। পড়ে আমি কিছু বুঝিও না। টুনি বলল, তোমার বোবার কথা না। বিত্তানের কি দেখলে তোমার জুর উঠে যায়। ছোটাচ্চু বলল, শুধু জ্বর না, কেমন যেন এলার্জির মতো হয়। চামড়ার মাঝে লাল র‍্যাশ বের হয়। মাথা ঘোরায়। টুনি বলল, ঐ ছেলেটার খাতাটা আমাকে একটু দেখাবে? তুই দেখে কী করবি? তুই কি কিছু বুঝবি? তোমার থেকে বেশি বুঝব। ছোটাচ্চু খাতাটা বের করে টুনিকে দিল, টুনি তখন পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার ডাইরিটা খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ল। ভিতরে নানারকম বিজ্ঞানের প্রশ্ন, যেমন এক জায়গায় লেখা, প্রোটন আর ইলেকট্রন একটা আরেকটাকে আকর্ষণ করে, তাহলে ইলেকট্রন কেন প্রোটনের ভিতরে পড়ে যায় না, কেন চার্জ বিহীন কিছু একটা তৈরি হয় না? কেন হাইড্রোজেন পরমাণু হয়ে থাকে? কেন? আরেক জায়গায় লেখা, গতিশীল বস্তুর কাছে দৈর্ঘ্যকে সংকুচিত মনে হয়। তাহলে কি আলোর কাছে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
false
shunil_gongopaddhay
শোনা! যাদুগোপাল আবার গাইল : কী মজা আছে রে লাল জলে জানেন ঠাকুর কোম্পানি মদের গুণাগুন আমরা কী জানি জানেন ঠাকুর কোম্পানি… দ্বারিকা চোখ বড় বড় করে, জিভ কেটে বলল, এই রে, দারুণ ভুল হয়ে গেছে। লাল জলের তো ব্যবস্থা করা হয়নি! দু’পাত্তর না টানলে মাংস খাওয়া জমবে কী করে? ভরত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, ভাই, ওসব এখানে চলবে না। কাছেই রাস্তা দিয়ে লোক যাওয়া-আসা করছে, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যাদুগোপাল ভরতকেই সমর্থন করে সহাস্যে বলল, ওসব কি আর দিনের বেলা জমে। সূর্য ডুবুক আগে! ইরফান বলল, আর একখানা গান শোনাও, যাদু! যাদুগোপাল বলল, এই গানটা তোরা শুনেছিস? আজব শহর কলকেতা রাড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কী কেতা! হেথা ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে, বলিহারি ঐক্যতা আজব শহর কলকেতা যাদুগোপাল হঠাৎ থেমে যেতেই দ্বারিকা অট্টহাসি করে উঠল। খুন্তি হাতে নিয়ে নাচের ভঙ্গি করে বলল, থামলি কেন, থামলি কেন, পরের টুকু গা। যাদুগোপাল বলল, পরের দিকে বড় অশ্লীল! দ্বারিকা বলল, পরের লাইনে তোদের বেহ্মদের খোঁচা আছে, তা বুঝি জানি না? তাই চেপে যাচ্ছিস শালা। যাদুগোপাল বলল, তোদের হিন্দুদেরও ছাড়েনি হুতোম প্যাঁচা। ভরত বলল, আমরা আগে শুনিনি। শোনাও ভাই, সবটা শোনাও। যাদুগোপাল গাইল : – হেথা ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা যত বক বিড়ালে ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদা পাতা। পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, গুঁড়ি সোনার বেনের কড়ি খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা হদ্দ হেরি হিন্দুয়ানি, ভিতর ভাঙা ভড়ং খানি পথে হেগে চোকরাঙ্গানি, লুকোচুরির ফের গাঁতা… ইরফান বলল, মোছলমানদের নিয়ে কিছু লেখেনি? যাদুগোপাল বলল, হিন্দুরা মোছলমানদের ধর্ম নিয়ে খোঁচা মারতে ভয় পায়। তোদের মোছলমানদের মধ্যে কেউ নিজেদের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে গান বাঁধেনি? ইরফান বলল, ওই একটা ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার সাহস কোনও মোছলমানের নেই। আমি অন্তত সেরকম কিছু কখনও শুনিনি। যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, তোদের মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক আছে? দ্বারিকা বলল, মোছলমান আবার নাস্তিক? এ যে বাবা কাঁঠালের আমসত্ত্ব! ভরত বলল, দ্বারিকা, আঁচ নিভে গেল যে! দ্বারিকা আবার উনুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। বসন্তের বাতাস। এমন বাতাসে খোলা জায়গায় উনুন জ্বলিয়ে রান্না করা খুবই কষ্টকর। মাঝে মাঝেই আঁচ কমে যাচ্ছে। এখনও মাংস সেদ্ধ হয়নি, ভাত-ডাল বাঁকি। মধ্যাহ্ন পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দ্বারিকা মাটিতে শুয়ে পড়ে ফু দেয়। নতুন কাঠ গোঁজে, তবু আঁচ চাঙ্গা হতে চায় না। দ্বারিকার রন্ধনকুশলতা সম্পর্কে যাদুগোপালের কোনও ভরসা নেই। সে টিপ্পনি কেটে বলল, আজ কি খাওয়ার কোনও আশা আছে? পেটে যে ছুঁচোয় ডন মারছে। দ্বারিকা বলল, হবে, হবে। গান গাইছিলি, গান গেয়ে যা। যাদুগোপাল বলল, অন্নচিন্তা চমৎকারা, এই সময় আর গান-কবিতা আসে না। দ্বারিকা নানা রকম চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু আগুন ক্রমশই ঝিমিয়ে আসছে। ভরত বলল, একটা চাদর এনে এদিকটায় বুলিয়ে দেব। তাতে যদি বাতাস আটকায়। যাদুগোপাল হাসতে হাসতে বলল, চাদর টাঙিয়ে কি আর বসন্তের বাতাস আটকানো যায়? আজ যা বুঝছি, দখিনা পবনেই পেট ভরাতে হবে। এই সময় কাছেই একটা ঝোপে খচর মচর শব্দ হল। সকলেই চমকে উঠে তাকাল সেদিকে। যাদুগোপাল বলল, ওখানে আবার কী, শেয়াল নাকি? এবার শেয়ালের পাল ধেয়ে এলেই সোনায় সোহাগা হবে। আর একবার শব্দ হতেই ভরত এগিয়ে গেল ঝোপের দিকে। তাকে দেখেও লুকোল না, ঝোপের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী। অনেকক্ষণ ধরেই সে এদের দেখছে। ভরত ভুরু কুঞ্চিত করে বলল, তুমি? তুমি এখানে কেন এসেছ? ভূমিসূতা এগিয়ে এল সামনের দিকে। ভরত আবার ধমক দিয়ে বলল, তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে? যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, কে এই মেয়েটি? দাসী কথাটা উচ্চারণ করতে পারল না ভরত। সে বলল, আমি যে বাড়িতে থাকি, সেই বাড়িতেই ও থাকে। ভূমিসূতা কোনও কথাবার্তা না বলে বসে পড়ল উনুনের সামনে। যাদুগোপাল বলল, হ্যাঁ উনুনটা ধরিয়ে দাও তো বাছা। এসব কাজ ওরাই ভালো পারে, এ কি পুরুষ মানুষের কম্মো! ভূমিসূতা ক্ষিপ্ৰ হাতে কয়েকটি চ্যালা বার করে নিল। দ্বারিকা বেশি বেশি কাঠ গুঁজেছিল। ভূমিসূতা চালাগুলি আবার সাজিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগল জোরে জোরে। একটু পরেই ফিরে এল আগুন। যাদুগোপাল বলল, বা বা বা বা! বলেছি না, ওরাই ভালো পারে। ভূমিসূতা হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখছে, ভরত বলল, ঠিক আছে, এবার তুমি বাড়ি যাও! যাদুগোপাল বলল, কেন, ও থাকুক না। দ্বারিকাকে সাহায্য করুক। দারিকা বলল, এই সেই মেয়েটি, যে ভালো গান জানে? নাচ জানে? যাদুগোপাল মহা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, নাচ? এ মেয়ে নাচতে জানে? ভরত বলল, ও ঠিক বাঙালি নয়। ওর বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়। একটু আধটু লেখাপড়াও জানে। ওর কথা তোমাদের পরে বলব, এখন ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। যাদুগোপাল বলল, কেন? আমরা পিকনিক করছি, এ মেয়েটিও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে ক্ষতি কী? দ্বারিকা বলল, রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটছে। এবার এদিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। যাদুগোপাল বলল, তা থাক না, তাতে আমাদের ভারি বয়েই গেল। দেখ ভাই, আমাদের সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজে পুরুষের সঙ্গে নারীদেরও সমান অধিকার। পুরুষরা যা পারে, নারীরাও তা পারে। অন্দরমহল থেকে মেয়েদের মুক্তি না দিয়ে আর কতদিন আমরা তাদের অন্ধকারে আটকে রাখব? দ্বারিকা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, রাখো তোমার ওই সব বড় বড় কথা! তোমাদের ওই সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের নীতি
false
robindronath
বলিয়া বোধ হইল। অবশেষে অশ্ব যখন অন্তঃপুরপ্রাসাদের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল তখন মুহূর্তের জন্য সেনাপতি তাঁহার বল্গা আকর্ষণ করিলেন; অশ্ব মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইল; মুহূর্তের জন্য ললিতসিংহ একবার প্রাসাদবাতায়নে তৃষিত দৃষ্টি নিপে করিলেন; মুহূর্তের জন্য দেখিতে পাইলেন, দুইটি লজ্জানত নেত্র একবার চকিতের মতো তাঁহার মুখের উপর পড়িল এবং দুইটি অনিন্দিত বাহু হইতে একটি পুষ্পমালা খসিয়া তাঁহার ভূতলে পতিত হইল। তৎক্ষণাৎ অশ্ব হইতে নামিয়া সেই মালা কিরীটচূড়ায় তুলিয়া লইলেন এবং আর-একবার কৃতার্থ দৃষ্টিতে ঊর্ধ্বে চাহিলেন। তখন দ্বার রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, দীপ নির্বাপিত। তৃতীয় পরিচ্ছেদ সহস্র শত্রুর নিকট যে অবিচলিত, দুইটি চকিত হরিণনেত্রের নিকট সে পরাভূত। সেনাপতি বহুকাল ধৈর্যকে পাষাণদুর্গের মতো হৃদয়ে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন, গতকল্য সন্ধ্যাকালে দুটি কালো চোখের সলজ্জ সসম্ভ্রম দৃষ্টি সেই দুর্গের ভিত্তিতে গিয়া আঘাত করিয়াছে এবং এতকালের ধৈর্য মুহূর্তে ভূমিসাৎ হইয়া গেছে। কিন্তু, ছি ছি, সেনাপতি, তাই বলিয়া কি সন্ধ্যার অন্ধকারে চোরের মতো রাজান্তঃপুরের উদ্যানপ্রাচীর লঙঘন করিতে হয়! তুমিই না ভুবনবিজয়ী বীরপুরুষ! কিন্তু, যে উপন্যাস লেখে তাহার কোথাও বাধা নাই; দ্বারীরাও দ্বাররোধ করে না, অসূর্যম্পশ্যরূপা রমণীরাও আপত্তি প্রকাশ করে না, অতএব এই সুরম্য বসন্ত-সন্ধ্যায় দণিবায়ুবীজিত রাজান্তঃপুরের নিভৃত উদ্যানে একবার প্রবেশ করা যাক। হে পাঠিকা, তোমরাও আইস, এবং পাঠকগণ, ইচ্ছা করিলে তোমরাও অনুবর্তী হইতে পার – আমি অভয়দান করিতেছি। একবার চাহিয়া দেখো, বকুলতলের তৃণশয্যায় সন্ধ্যাতারার প্রতিমার মতো ঐ রমণী কে। হে পাঠক, হে পাঠিকা, তোমরা উঁহাকে জান কি। অমন রূপ কোথাও দেখিয়াছ? রূপের কি কখনো বর্ণনা করা যায়। ভাষা কি কখনো কোনো মন্ত্রবলে এমন জীবন যৌবন এবং লাবণ্যে ভরিয়া উঠিতে পারে। হে পাঠক, তোমার যদি দ্বিতীয় পরে বিবাহ হয় তবে স্ত্রীর মুখ স্মরণ করো; হে রূপসী পাঠিকা, যে যুবতীকে দেখিয়া তুমি সঙ্গিনীকে বলিয়াছ ‘ইহাকে কী এমন ভালো দেখিতে, ভাই। হউক সুন্দরী, কিন্তু ভাই, তেমন শ্রী নাই’ তাহার মুখ মনে করো – ঐ তরুতলবর্তিনী রাজকুমারীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য উপলব্ধি করিবে। পাঠক এবং পাঠিকা, এবার চিনিলে কি। উনিই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা। রাজকুমারী কোলের উপর ফুল রাখিয়া নতমুখে মালা গাঁথিতেছেন, সহচরী কেহই নাই। গাঁথিতে গাঁথিতে এক-একবার অঙ্গুলি আপনার সুকুমার কার্যে শৈথিল্য করিতেছে; উদাসীন দৃষ্টি কোন্-এক অতিদূরবর্তী চিন্তারাজ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। রাজকুমারী কী ভাবিতেছেন। কিন্তু, হে পাঠক, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না। কুমারীর নিভৃত হৃদয়মন্দিরের মধ্যে আজি এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কোন মর্তদেবতার আরতি হইতেছে, অপবিত্র কৌতূহল লইয়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারিব না। ঐ দেখো, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পূজার সুগন্ধি ধূপধূমের ন্যায় সন্ধ্যার বাতাসে মিশাইয়া গেল এবং দুইফোঁটা অশ্রুজল দুটি সুকোমল কুসুমকোরকের মতো অজ্ঞাত দেবতার চরণের উদ্দেশে খসিয়া পড়িল। এমন সময় পশ্চাৎ হইতে একটি পুরুষের কণ্ঠ গভীর আবেগ-ভরে কম্পিত রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, “রাজকুমারী!” রাজকন্যা সহসা ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন। চারি দিক হইতে প্রহরী ছুটিয়া আসিয়া অপরাধীকে বন্দী করিল। রাজকন্যা তখন পুনরায় সসংজ্ঞ হইয়া দেখিলেন, সেনাপতি বন্দী হইয়াছেন। চতুর্থ পরিচ্ছেদ এ অপরাধে প্রাণদণ্ডই বিধান। কিন্তু পূর্বোপকার স্মরণ করিয়া রাজা তাঁহাকে নির্বাসিত করিয়া দিলেন। সেনাপতি মনে মনে কহিলেন, ‘দেবী, তোমার নেত্রও যখন প্রতারণা করিতে পারে তখন সত্য পৃথিবীতে কোথাও নাই। আজ হইতে আমি মানবের শত্রু।’ একটি বৃহৎ দস্যুদলের অধিপতি হইয়া ললিতসিংহ অরণ্যে বাস করিতে লাগিলেন। হে পাঠক, তোমার আমার মতো লোক এইরূপ ঘটনায় কী করিত। নিশ্চয় যেখানে নির্বাসিত হইত সেখানে আর-একটা চাকরির চেষ্টা দেখিত, কিংবা একটা নূতন খবরের কাগজ বাহির করিত। কিছু কষ্ট হইত সন্দেহ নাই – সে অন্নাভাবে। কিন্তু, সেনাপতির মতো মহৎ লোক, যাহারা উপন্যাসে সুলভ এবং পৃথিবীতে দুর্লভ, তাহারা চাকরিও করে না, খবরের কাগজও চালায় না। তাহারা যখন সুখে থাকে তখন এক নিশ্বাসে নিখিল জগতের উপকার করে এবং মনোবাঞ্ছা তিলমাত্র ব্যর্থ হইলেই আরক্তলোচনে বলে, “রাসী পৃথিবী, পিশাচ সমাজ, তোদের বুকে পা দিয়া আমি ইহার প্রতিশোধ লইব।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ দস্যুব্যবসায় আরম্ভ করে। এইরূপ ইংরাজি কাব্যে পড়া যায় এবং অবশ্যই এ প্রথা রাজপুতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। দস্যুর উপদ্রবে দেশের লোক ত্রস্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু, এই অসামান্য দস্যুরা অনাথের সহায়, দরিদ্রের বন্ধু, দুর্বলের আশ্রয়; কেবল, ধনী উচ্চকুলজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং রাজকর্মচারীদের পক্ষে কালান্তক যম। ঘোর অরণ্য, সূর্য অস্তপ্রায়। কিন্তু, বনচ্ছায়ায় অকালরাত্রির আবির্ভাব হইয়াছে। তরুণ যুবক অপরিচিত পথে একাকী চলিতেছে। সুকুমার শরীর পথশ্রমে ক্লান্ত, কিন্তু তথাপি অধ্যবসায়ের বিরাম নাই। কটিদেশে যে তরবারি বদ্ধ রহিয়াছে, তাহারই ভার দুঃসহ বোধ হইতেছে। অরণ্যে লেশমাত্র শব্দ হইলেই ভয়প্রবণ হৃদয় হরিণের মতো চকিত হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু, তথাপি এই আসন্ন রাত্রি এবং অজ্ঞাত অরণ্যের মধ্যে দৃঢ় সংকল্পের সহিত অগ্রসর হইতেছে। দস্যুরা আসিয়া দস্যুপতিকে সংবাদ দিল, “মহারাজ, বৃহৎ শিকার মিলিয়াছে। মাথায় মুকুট, রাজবেশ, কটিদেশে তরবারি।” দস্যুপতি কহিলেন, “তবে এ শিকার আমার। তোরা এখানেই থাক।” পথিক চলিতে চলিতে সহসা একবার শুষ্ক পত্রের খস্‌খস্ শব্দ শুনিতে পাইল। উৎকণ্ঠিত হইয়া চারি দিকে চাহিয়া দেখিল। সহসা বুকের মাঝখানে তীর আসিয়া বিঁধিল, পান্থ ‘মা’ বলিয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। দস্যুপতি নিকটে আসিয়া জানু পাতিয়া নত হইয়া আহতের মুখের দিকে নিরীক্ষণ করিলেন। ভূতলশায়ী পথিক দস্যুর হাত ধরিয়া কেবল একবার মৃদুস্বরে কহিল “ললিত!” মুহূর্তে দস্যুর হৃদয় যেন সহস্র খণ্ডে ভাঙিয়া এক চীৎকারশব্দ বাহির হইল, “রাজকুমারী!” দস্যুরা আসিয়া দেখিল, শিকার এবং শিকারী উভয়েই অন্তিম আলিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া মৃত পড়িয়া আছে। রাজকুমারী একদিন সন্ধ্যাকালে তাঁহার
false
humayun_ahmed
চোখে পানি এসে গেছে। বিস্মিত হয়ে দেখছে এনারেবিক রোবট। ইরিনা। বল। আমরা হ্যাম্পটন কোর্টের গোলকধাঁধার মতো একটা গোলকধাঁধা। এখানে তৈরি করেছি। তাই নাকি? হ্যাঁ। তবে আমাদের এই গোলকধাঁধা তার চেয়ে কিছু জটিল। ভেতরে ঢুকলে হ্যারিসের মতো আটকে যাব? বেরুতে পারব না? মনে হচ্ছে তাই, তবে যদি বুদ্ধিমান হও, তাহালে নিশ্চয়ই বেরুতে পারবে। ভালো কথা, এখন তুমি চলে যাও। আমি এই বইটা পড়ব। এই জাতীয় বই তুমি আমাকে আরো জোগাড় করে দেবে। তোমার ধারণা এটা খুব একটা মজার বই? ধারণা নয়। আসলেই এটা একটা মজার বই। ইরিনা। বল। আমরা পরিকল্পনা করেছি। তোমাকে আমাদের তৈরি গোলকধাঁধায় ছেড়ে দেব। তার মানে? আমি দেখতে চাই তুমি কী করা। তোমার মানসিক অবস্থাটা আমরা পরীক্ষা করব। ঐ পরিস্থিতিতে তুমি কী কর আমরা দেখব। বেরুবার পথ খুঁজে না পেলে তোমার মানসিক অবস্থাটা কী হয়, তাই আমাদের দেখার ইচ্ছা। ইরিনা তাকিয়ে আছে। এনারোবিক রোবটটি বলল, এক দিকের প্রবেশপথ দিয়ে তোমাকে ড়ুকিয়ে দেব, অন্য দিকের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব মীরকে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তো একবার দিয়েছি। ক্ষুদ্র একটা পরীক্ষা আমরা করছি। আমরা মনে করি মানবিক আবেগ বোঝার জন্যে এই পরীক্ষাটি কাজে দেবে। আমরা অনেক নতুন নতুন তথ্য পাব। এই জাতীয় পরীক্ষা কি তোমরা আগেও করেছ? হ্যাঁ, করা হয়েছে। তুমি তো ইতোমধ্যেই জেনেছ, প্রথম শহরের কিছু নাগরিককে এখানে আনা হয়। অমর মানুষরা তাদের সঙ্গে কথা-টথা বলেন। তাদের দীর্ঘ জীবনের এক ঘেয়েমি কাটানোর এটা একটা উপায়। যখন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন আমরা ওদের নিয়ে নিই। মানবিক আবেগের প্রকৃতি বোঝার জন্যে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করি। গোলকধাঁধার পরীক্ষা হচ্ছে তার একটি। কেউ কি সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরুতে পেরেছে? না পারে নি। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের গোলকধাঁধাটি যথেষ্ট জটিল। ইরিনা রুদ্ধ। গলায় বলল, তুমি আমাকে বলেছিলে যদি আমি তোমাকে সাহায্য করি, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। এই তোমার সাহায্যের নমুনা? তুমি বুঝতে পারছি না। আমি কিন্তু তোমাকে সাহায্যই করছি। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। কীভাবে সাহায্য করছ আমাকে? গোলকধাঁধার কথা আগেই তোমাকে বলে দিলাম, এতে তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার একটা সুযোগ পাচ্ছ, যা তোমার সঙ্গী পাচ্ছে না। বাহ তোমার মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। কী বিশাল তোমার হৃদয়! তুমি মনে হচ্ছে আমার ওপর রাগ করলে? ইরিনা উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, নিয়ে চল আমাকে গোলকধাঁধায়। তুমি ভয় পাচ্ছ না? না, পাচ্ছি না। তাহলে চল যাওয়া যাক। ইরিনা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, যদি আমরা বেরুতে না পারি, তখন কী হবে? বেরুতে না পারলে যা হবার তাই হবে। তার মানে? তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে, মানে বুঝতে না পারার কোনো কারণ দেখছি না। তুমি বলেছিলে, অমর মানুষদের জন্য আমাদের আনা হয়েছে। আমাদের কি তাদের এখন আর প্রয়োজন নেই? না। তাঁরা এখন এক জনকে নিয়ে ব্যস্ত। তাকে তুমি চেন। তার নাম অরচ লীওন। তাঁর মন খুবই খারাপ। প্ৰায় এক ঘণ্টা তিনি তার ঘরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হাঁটলেন। তার স্বভাব হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর সিডিসিকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলা। এই এক ঘণ্টায় তিনি এক বার সিডিসিকে ডাকেন নি। দুপুরের খাবার খান নি। সবচে বড় কথা, একবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুগ্ধ চোখে দেখেন নি। এইবার দাঁড়ালেন। নিজের চেহারা দেখে তেমন কোনো মুগ্ধতা তার চোখে ফুটল না। বরং ভুরু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলেন। যেন খুব বিরক্ত হচ্ছেন। সিডিসি। বলুন শুনছি। আমাকে কি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, হচ্ছে। তুমি কি জান, আমি কী নিয়ে উত্তেজিত? জানি না, তবে অনুমান করতে পারি। তোমার অনুমান কী? আপনি অরচ লীওনের ব্যাপারে চিন্তিত। মোটেই না। ওকে নিয়ে চিন্তিত হবার কী আছে? কিছুই কি নেই? না, কিছুই নেই। আমি আমার জন্যে নতুন একটা নাম ভাবছি। কোনোটাই মনে ধরছে না। আপনি এই নিয়ে চিন্তিত? এমন একটা নাম হতে হবে, যা ছোট, সুন্দর এবং কিছু পরিমাণে কাব্যিক। আবার বেশি কাব্যিক হলে চলবে না। আমি কি নামের ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করব? না। তিনি আয়নার সমানে থেকে সরে দাড়ালেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি চমৎকার একটি নাম খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। এবার হাত মুঠো করছেন, একবার খুলছেন। খুশি হলে তিনি এমন করেন। সিডিসি। জি বলুন। তোমাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম, তুমি কর নি। ভুলে গেছ। আমি কিছুই ভুলি না। কুৎসিত রাজপুত্রদের নাম চেয়েছিলেন। নাম এবং অন্যান্য তথ্য জোগাড় করা হয়েছে। আপনাকে কি এখন দেব? না, এখন দিতে হবে না। তুমি বরং অরচ লীওনেকে পর্দায় নিয়ে এস, ওর সঙ্গে কথা বলব। ঘরের যে অংশে আয়না ছিল, সেই অংশটি অদৃশ্য হল। বিশাল এক পর্দায় অরচ লীওনের ছবি ভেসে উঠল। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। সে তার সামনে রাখা পর্দায় অসম্ভব রূপবান এক যুবকের ছবি দেখছে। সিডিসির কথা শোনা যাচ্ছে– অরচ লীওন, উঠে দাড়াও এবং অভিবাদন কর মহান গণিতজ্ঞ অমর বিজ্ঞানীকে। অরচ লীওন, উঠে দাঁড়াল। তার মুখে কোনো কথা নেই। সে এই দৃশ্যের জন্যে তৈরি ছিল না। তার ধারণা ছিল অত্যন্ত বয়স্ক এক বৃদ্ধকে দেখবে— যার মাথার সমস্ত চুল পাকা। চোখে ঘোলাটে। যে বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার অভিবাদন গ্ৰহণ করুন। গ্রহণ
false
humayun_ahmed
সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস আছে না? জামাল বলল, আছে। আনিকা বলল, আমি ঠিকানা দিচ্ছি, ড্রাইভারকে পাঠাও আমার বড়খালা আর ছোটখালাকে নিয়ে আসবে। জামাল বলল, আমি সঙ্গে যাই? উনারা মুরুব্বি মানুষ। ড্রাইভার দিয়ে উনাদের আনানো ঠিক হবে না। আনিকা বলল, তোমার যেতে হবে না। তোমার এখানে কাজ আছে। ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিয়ে দাও, এক লিটারের ছয়টা কোক আনবে, তিনটা সেভেন আপ আনবে। ঠাণ্ডা হয় যেন। আর কিছু? আর কিছু লাগবে না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস। ঘামে মুখ তেলতেলা হয়ে আছে। জামাল শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি গল্পটা বলব। আমাকে শুধু ধরিয়ে দিতে হবে। যেখানে শেষ করেছি, সেখান থেকে শুরু করব। কোথায় শেষ করেছি মনে আছে তো? শওকত বলল, মনে আছে। একসময় আপনার কাছে মনে হলো পানিতে অক্সিজেন কমে আসছে। কারণ মাছের পোনাগুলি ঘনঘন পানিতে ভেসে উঠছে। জামাল বলল, এটা সমস্যার মাত্র শুরু। সবটা না শুনলে বুঝবেন না। এক্ষুণি আসছি। জামাল অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হলো। শওকত বলল, তোমরা এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছ দেখে ভালো লাগছে। আনিকা বলল, ও একটু বোকা। এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলাটা যে খুবই অস্বাভাবিক বোকা বলেই সে তা ধরতে পারছে না। তুমি অতি বুদ্ধিমতী হয়েও কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ করছ। আনিকা বলল, মেয়ে হলো পানির মতো। বর্ণহীন। যে পাত্রে তাকে রাখা হবে সে সেই পাত্রের রঙ তার গায়ে মাখবে। বোকার সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হবে, তার হাভভাব হয়ে যাবে বোকার মতো। আর সেটাই ভালো। তোমার আনন্দিত মুখ দেখতে ভালো লাগছে। আনিকা বলল, ভালো লাগলেই ভালো। কিছুক্ষণ আগে আপনার পুত্রের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাকে আমি আমার বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে আসছে। তার মা গাড়ি দিয়ে তাকে পাঠাচ্ছেন। শওকত বিস্মিত হয়ে বলল, তাই না-কি! আনিকা বলল, আমিও খুব অবাক হয়েছি। আপনার ছেলে বলেছে তাকে দশ-পনেরো মিনিট সময় দিলেই সে মুক্তার মালা বানিয়ে দেবে। আলপিন গরম করে মুক্তোর গায়ে ফুটো করতে হবে। আপনি চা খাবেন? শওকত বলল, না। আমার খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে। আপনি যদি খান, আমি আপনার সঙ্গে এক কাপ চা খাব। বাকি জীবনে আর হয়তো আপনার সঙ্গে চা খাওয়া হবে না। আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। পড়ে থাকব গ্রামে। চাকরি? তোমার চাকরির কী হবে? আনিকা বলল, চাকরি করব না। স্বামীর খামার দেখব। হাঁস-মুরগি পালব। স্বামীর সেবা করব। ভাগ্য ভালো হলে ইমনের মতো সুন্দর বুদ্ধিমান দুএকটা ছেলেমেয়ে হয়তো আমাদের হবে। তাদেরকে আদর-মমতা-ভালোবাসায় বড় করব। আপনার কি মনে হয় আমি পারব না? শওকত বলল, অবশ্যই পারবে। তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি পারবে। থ্যাংক য়্যু। আমি পারতে চাই। ইমনের মুক্তার মালা তৈরি হয়েছে। সময় বেশি লেগেছে, কারণ পুরনো মুক্তা ফেলে দিয়ে মোম গলিয়ে নতুন মুক্তা বানানো হয়েছে। কাজটা ইমন একা করে নি, শওকত তাকে সাহায্য করেছে। যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দুজন কাজ করেছে সেই মনোযোগ দেখার মতো। শেষপর্যায়ে জামাল এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। দেখা গেল মুক্তা বানানোর ব্যাপারে তার স্বাভাবিক দক্ষতা আছে। হাত না কাপিয়ে সে গলন্ত মোম ফেলতে পারে। একটা মুক্তা আরেকটা মুক্তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে না। মুক্তার মালা গলায় দিয়ে আনিকা ইমনকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিল। তারপর নিচু হয়ে শওকতকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। তখনো ইমন তার কোলে। চুমু খাওয়ায় ইমন যতটুকু লজ্জা পেয়েছিল, সালাম করায় শওকত ঠিক ততটুকুই লজ্জা পেল। আনিকা বলল, শওকত ভাই! আমি আপনার ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আপনি আমাদের দুজনের একটা পোট্রেট করে দিন। কাগজ আর গাদাখানিক পেন্সিল আমি আনিয়ে রেখেছি। আজ সারা দুপুর বসে বসে পেন্সিল কেটেছি। ব্লেড দিয়ে পেন্সিল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছি। এই দেখেন কাটা আঙুল। শওকত বলল, ছবি আঁকা ভুলে গেছি আনিকা। চেষ্টা করে দেখুন। তাকান আমাদের দিকে। আমাদের দেখতে সুন্দর লাগছে না? শওকত তাকাল। সে অবাক হয়ে দেখল, আনিকার চোখ জলে টলমল করছে। শুধু তাই না, ইমনেরও চোখভর্তি জল। আহারে কী সুন্দর কম্পােজিশান। কী সুন্দর! কী সুন্দর! চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লেই এই কম্পােজিশান নষ্ট হয়ে যাবে। শওকতকে যা করতে হবে তা হচ্ছে এই দৃশ্যটা মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাদের দিকে আর তাকানো যাবে না। পোট্রেট করতে হবে স্মৃতি থেকে। শওকত হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি কাগজ দেখি। অতি দ্রুত সে পেন্সিল টানছে। কোনোদিকেই তাকাচ্ছে না। অন্যদিকে তাকানোর সময় তার নেই। অনেক অনেক দিন পর তার মাথায় পুরনো ঝড় উঠেছে। কী ভয়ঙ্কর অথচ কী মধুর সেই ঝড়! ইমন এক গাদা পেন্সিল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাতের পেন্সিল ভেঙে যেতেই সে পেন্সিল এগিয়ে দিচ্ছে। তার খুব ইচ্ছা করছে পোট্রেটটা কেমন হচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে না দেখেও ইমন বুঝতে পারছে বাবা অসাধারণ একটা পোট্রেট আঁকছেন। নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই শওকতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চোখে কৌতুহল এবং বিস্ময়। একটু দূরে আনিকা দাঁড়িয়ে। সে ক্রমাগত কাদছে। আনিকার পাশে জামাল ব্রিত মুখে দাঁড়িয়ে। আনিকা তার দিকে তাকিয়ে বলল, এইভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি কাঁদছি দেখছ না? আমার হাত ধর। না-কি হাত ধরতে লজ্জা লাগছে? জামাল হাত ধরল। নিচু গলায় বলল, এত কাঁদছ কেন? আনিকা ধরা
false
robindronath
ডাকতে পারি কি। আমাদের মতো অশুচির ঘরে খাবেন তো? ” “অশুচি! না খায় তো ওকে আছড়ে আছড়ে এমনি শুচি করে নেব যে বামনাইয়ের দাগ থাকবে না ওর মজ্জায়। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার নাকি একটি সুন্দরী মেয়ে আছে? ” “আছে। পোড়াকপালী সুন্দরীও বটে। তা কী করব বলুন।” “না না, আমাকে ভুল কোরো না। আমার কথা যদি বল, সুন্দরী মেয়ে আমি পছন্দই করি। ওটা আমার একটা রোগ বললেই হয়। কিন্তু আত্মীয়েরা বেরসিক, ভয় পেয়ে যাবে।” “ভয় নেই, আমি নিজের জাতেই মেয়ের বিয়ে দেব ঠিক করেছি।” এটা একেবারে বানানো কথা। “তুমি নিজে তো বেজাতে বিয়ে করেছ।” “নাকাল হয়েছি কম নয়। বিষয়ের দখল নিয়ে মামলা করতে হয়েছে বিস্তর। যে করে জিতেছি সেটা বলবার কথা নয়।” “শুনেছি কিছু কিছু। বিপক্ষ পক্ষের আর্টিকেল্‌ড্‌ ক্লার্ক্‌‍কে নিয়ে তোমার নামে গুজব রটেছিল। মকদ্দমায় জিতে তুমি তো সরে পড়লে, সে লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যায় আর কি! ” “এত যুগ ধরে মেয়েমানুষ টিকে আছে কী ক’রে। ছল করার কম কৌশল লাগে না, লড়াইয়ের তাগবাগের সমানই সে, তবে কিনা তাতে মধুও কিছু খরচ করতে হয়। এ হল নারীর স্বভাবদত্ত লড়াইয়ের রীতি।” “ঐ দেখো, আবার তুমি আমাকে ভুল করছ। আমরা বিজ্ঞানী, আমরা বিচারক নই, স্বভাবের খেলা আমরা নিষ্কাম ভাবে দেখে যাই। সে খেলায় যা ফল হবার তা ফলতে থাকে। তোমার বেলায় ফলটা বেশ হিসেবমতই ফলেছিল, বলেছিলুম, ধন্য মেয়ে তুমি। এ কথাটাও ভেবেছি, আমি যে তখন প্রোফেসর ছিলুম, আর্টিকেল্‌ড্‌ ক্লার্ক ছিলুম না, সেটা আমার বাঁচোয়া। মার্করি সূর্যের কাছ থেকে যতটুকু দূরে আছে ততটুকু দূরে থেকেই বেঁচে গেল। ওটা গণিতের হিসাবের কথা, ওতে ভালো নেই মন্দ নেই। এ-সব কথা বোধ হয় তুমি বুঝতে শিখেছ।” “তা শিখেছি। গ্রহগুলো টান মেনে চলে আবার টান এড়িয়ে চলে— এটা একটা শিখে নেবার তত্ত্ব বৈকি।” “আর-একটা কথা কবুল করছি। এইমাত্র তোমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে একটা হিসেব মনে মনে কষছিলুম, সেও অঙ্কের হিসেব। ভেবে দেখো, বয়সটা যদি অন্তত দশটা বছর কম হত তা হলে খামকা আজ একটা বিপদ ঘটত। কোলিশন ঐটুকু পাশ কাটিয়ে গেল আর কি! তবু বাষ্পের জোয়ার উঠছে বুকের মধ্যে। ভেবে দেখো, সৃষ্টিটা আগাগোড়াই কেবল অঙ্ককষার খেলা।” এই ব’লে চৌধুরী দুই হাঁটু চাপড়িয়ে হাহা করে হেসে উঠলেন। একটা কথা তাঁর হুঁশ ছিল না যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার আগে সোহিনী দুঘন্টা ধরে রঙে চঙে এমন করে বয়স বদল করেছে যে সৃষ্টিকর্তাকে আগাগোড়াই দিয়েছে ঠকিয়ে। ৪ পরের দিন অধ্যাপক এসে দেখলেন সোহিনী রোঁয়া ওঠা হাড়-বের করা একটা কুকুরকে স্নান করিয়ে তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছিয়ে দিচ্ছে। চৌধুরী জিগ্‌গেসা করলেন, “এই অপয়মন্তটাকে এত সম্মান কেন।” “ওকে বাঁচিয়েছি ব’লে। পা ভেঙেছিল মোটরের তলায় পড়ে, আমি সারিয়ে তুলেছি ব্যাণ্ডেজ বেঁধে। এখন ওর প্রাণটার মধ্যে আমারও শেয়ার আছে।” “রোজ রোজ ঐ অলুক্ষুনের চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে যাবে না? ” “চেহারা দেখবার জন্যে ওকে তো রাখি নি। মরতে মরতে এই যে ও সেরে উঠছে, এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। ঐ প্রাণীর বেঁচে থাকবার দরকারটা যখন দিনে দিনে মিটিয়ে দিই, তখন ধর্মকর্ম করতে ছাগলছানার গলায় দড়ি বেঁধে আমাকে কালীতলায় দৌড়তে হয় না। তোমাদের বায়োলজির ল্যাবরেটরির কানাখোঁড়া কুকুর-খরগোশগুলোর জন্যে আমি একটা হাসপাতাল বানাব স্থির করেছি।” “মিসেস মল্লিক, তোমাকে যতই দেখছি তাক লাগছে।” “আরো বেশি দেখলে ওটার উপশম হবে। রেবতীবাবুর খবর দেবেন বলেছিলেন, সেটা আরম্ভ করে দিন।” “আমার সঙ্গে দূর সম্পর্কে ওদের যোগ আছে। তাই ওদের ঘরের খবর জানি। রেবতীকে জন্ম দিয়েই ওর মা যান মারা। বরাবর ও পিসির হাতে মানুষ। ওর পিসির আচারনিষ্ঠা একেবারে নিরেট। এতটুকু খুঁত নিয়ে ওঁর খুঁতখুঁতুনি সংসারকে অতিষ্ঠ করে তুলত। তাঁকে ভয় না করত এমন লোক ছিল না পরিবারে। ওঁর হাতে রেবতীর পৌরুষ গেল ছাতু হয়ে। স্কুল থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে পঁচিশ মিনিট লাগত তার জবাবদিহি করতে।” সেহিনী বললে, “আমি তো জানি পুরুষরা করবে শাসন, মেয়েরা দেবে আদর, তবেই ওজন ঠিক থাকে।” অধ্যাপক বললেন, “ওজন ঠিক রেখে চলা মরালগামিনীদের ধাতে নেই। ওরা এদিকে ঝুঁকবে ওদিকে ঝুঁকবে। কিছু মনে কোরো না মিসেস মল্লিক, ওদের মধ্যেও দৈবাৎ মেলে যারা খাড়া রাখে মাথা, চলে সোজা চালে। যেমন—” “আর বলতে হবে না। কিন্তু আমার মধ্যেও শিকড়ের দিকে মেয়েমানুষ যথেষ্ট আছে। কী ঝোঁকে পেয়েছে দেখছেন না। ছেলে-ধরা ঝোঁক। নইলে আপনাকে বিরক্ত করতেম কি।” “দেখো, বার বার ঐ কথাটা বোলো না। জেনে রেখো আজ ক্লাসের জন্যে তৈরি না হয়েই চলে এসেছি। কর্তব্যের গাফেলি এতই ভালো লাগছে।” “বোধ হয় মেয়ে-জাতটার ’পরেই আপনার বিশেষ একটু কৃপা আছে।” “একটুও অসম্ভব নয়। কিন্তু তার মধ্যেও তো ইতরবিশেষ আছে। যা হোক, সে কথাটা পরে হবে।” সোহিনী হেসে বললে, “পরে না হলেও চলবে। আপাতত যে কথাটা উঠেছে শেষ করে দিন। রেবতীবাবুর এত উন্নতি হল কী করে।” “যা হতে পারত তার তুলনায় কিছুই হয় নি। একটা রিসর্চের কাজে ওর বিশেষ দরকার হয়েছিল উঁচু পাহাড়ে যাবার। ঠিক করেছিল যাবে বদরিকাশ্রমে। আরে সর্বনাশ! পিসিরও ছিল এক পিসি, সে বুড়ি মরবে তো মরুক ঐ বদরিকারই রাস্তায়। পিসি বললে, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি, পাহাড়পর্বত চলবে না’। কাজেই তখন থেকে একমনে যা কামনা করছি
false
shordindu
প্রাণ বাঁচাইতে সমর্থ হইয়াছে। পরিস্থিতি অতিশয় ভয়াবহ। শুনিয়া প্রদ্যুম্ন চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, মহারাজ, অনুমতি দিন শ্যালকদের ঢিট করিয়া আসি। মঘবা কিন্তু রাজী হইলেন না, বলিলেন, তাহা হয় না। ঢিট করিতে হয় আমি করিব। সৈন্য সাজাইয়া আবার মঘবা বাহির হইলেন। কিছু দূর গিয়া ফিরিয়া আসিয়া প্রদ্যুম্নকে বলিলেন, ইতিমধ্যে মেয়েটাকে তুই আর্যভাষা শেখাস্‌। মনের ক্ষুব্ধতা গোপন করিয়া প্রদ্যুন্ম বলিলেন, আচ্ছা। দু-এক দিনের মধ্যেই প্রদ্যুম্ন বুঝিতে পারিলেন, অনার্য মেয়েটি অতিশয় মেধাবিনী। অষ্টাহমধ্যে সে ভাঙা ভাঙা কথা কহিতে আরম্ভ করিল। _ তাহার নাম এলা। অনার্য নাম বটে, কিন্তু শুনিতে ও বলিতে বড় মিষ্ট। প্রদ্যুম্ন কয়েক বার উচ্চারণ করিলেন, এলা! এলা! বাঃ! বেশ তো। কথা কহিতে শিখিয়াই এলা প্রথম প্রশ্ন করিল, ও লোকটা কে? যে আমাকে ধরিয়া আনিয়াছে? প্রদ্যুম্ন বলিলেন, আমার বন্ধু। বন্ধু শব্দের ভাবার্থ বুঝিতে এলার কিছু বিলম্ব হইল। অবশেষে বুঝিতে পারিয়া সে নাক সিঁটকাইল; তীব্র অবজ্ঞার কণ্ঠে বলিল, তোমরা বর্বর। প্রদ্যুম্ন অবাক হইয়া গেলেন; ভাবিলেন, কি আশ্চর্য! আমরা বর্বর! ক্রমশ এলা আর্যভাষায় কথা কহিতে লাগিল—কোনও কথা বলিতে বা বুঝিতে তাহার বাধে না। একদিন জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে এখানে ধরিয়া রাখিয়াছ কেন? প্রদ্যুম্ন ঢোক গিলিয়া বলিলেন, আর্যভাষা শিখাইবার জন্য। এলা বলিল ছাই ভাষা। ইহা শিখিয়া কি হইবে? প্রদ্যুম্ন একটু রসিকতা করিয়া বলিলেন, প্রেমালাপ করিবার সুবিধা হইবে। মহারাজ মঘবা তোমাকে বিবাহ করিবেন স্থির করিয়াছেন। এলা বসিয়া ছিল, ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল, কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে প্রদ্যুম্নের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর আবার বসিয়া পড়িয়া নিশ্চিন্ত স্বরে বলিল, উহাকে আমি বিবাহ করিব না। বর্বর! প্রদ্যুম্ন স্তোক দিবার জন্য বলিলেন, মঘবা দাড়ি রাখে বটে, কিন্তু তোক খারাপ নয়— এলা শুধু বলিল, বর্বর! এমনি ভাবে দিন কাটিতে লাগিল। কিন্তু মঘবার দেখা নাই—তিনি কোদণ্ডদের ঢিট করিলেন অথবা কোদণ্ডেরা তাঁহাকে ঢিট করিল, কোনও সংবাদ নাই! প্রদ্যুম্ন উতলা হইয়া উঠিলেন। দেখিতে দেখিতে তিন মাস অতীত হইয়া গেল। একদিন প্রাতঃকালে প্রদ্যুম্ন এলার কূটগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এলা বাতায়ন-পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বেণী উন্মোচন করিতেছে। প্রদ্যুম্নকে দেখিয়া সে একবার ঘাড় ফিরাইল, তারপর আবার বাহিরের দূর দৃশ্যের পানে তাকাইয়া বেণীর বিসর্পিল বয়ন মোচন করিতে লাগিল। প্রদ্যুম্ন গলা ঝাড়া দিলেন, কিন্তু কোনও ফল হইল না। তখন তিনি বাতায়নসম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন; আকাশের দিকে তাকাইলেন, নিম্নে উঁকিঝুঁকি মারিলেন, তারপর পুনশ্চ গলাখাঁকারি দিয়া বলিলেন, শীত আর নাই; দিব্য গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। এলা বলিল, হুঁ। উৎসাহ পাইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, আজকাল দক্ষিণ হইতে যে হাওয়া বহিতেছে, তাহাকেই বুঝি তোমরা মলয় সমীরণ বলিয়া থাক? আর্যাবর্তে এ হাওয়া নাই। এলা তাঁহার দিকে গম্ভীর চক্ষু তুলিয়া প্রশ্ন করিল, দু-দিন আসা হয় নাই কেন? প্রদ্যুম্ন থতমত খাইয়া বলিলেন, ব্যস্ত ছিলাম,–একটু থামিয়া—তোমার তো আর আর্যভাষা শিখিবার প্রয়োজন নাই। যাহা শিখিয়াছ তাহাতেই আমাদের সকলের কান কাটিয়া লইতে পার। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না; এলা নতনেত্রে মুক্ত বেণী আবার বিনাইতে লাগিল। শেষে প্রদ্যুম্ন পূর্ব কথার জের টানিয়া বলিতে লাগিলেন, মঘবা আসিয়া পড়িলে বাঁচা যায়। অনেক দিন হইয়া গেল, এখনও তাহার কোন খবর নাই।—দুর্ভাবনা হইতেছে। এলা তিলমাত্র সহানুভূতি না দেখাইয়া নির্দয়ভাবে হাসিল, বলিল, তোমার মঘবা আর ফিরিবে না, আমার স্বজাতিরা তাহাকে শেষ করিয়াছে। ক্রুদ্ধ চক্ষে চাহিয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, মঘবাকে শেষ করিতে পারে এমন মানুষ দাক্ষিণাত্যে নাই। সে মহাবীর! তাচ্ছিল্যভরে এলা বলিল, বর্বর। অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ঐ বর্বরকেই তোমাকে বিবাহ করিতে হইবে। ভঙ্গি করিয়া এলা বলিল, তাই নাকি! আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে? তুমি তো বন্দিনী। তোমার আবার ইচ্ছা কি? প্রত্যেকটি শব্দ কাটিয়া কাটিয়া এলা উত্তর দিল, ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বিবাহ করিতে পারে এমন পুরুষ তোমাদের আর্যাবর্তে জন্মে নাই—এই বীজের মালা দেখিতেছ? এলা দুই আঙুলে নিজ কণ্ঠের বীজমালা তুলিয়া দেখাইল, একটি বীজ দাঁতে চিবাইতে যেটুকু দেরি—আর আমাকে পাইবে না। প্রদ্যুম্ন সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, কি সর্বনাশ—বিষ!–দাও, শীঘ্র মালা আমায় দাও। এলা দূরে সরিয়া গিয়া বলিল, এত দিন তোমাদের বন্দিনী হইয়া আছি, ভাবিয়াছ আমি অসহায়া? তোমাদের খেলার পুতুল? তাহা নহে। যখন ইচ্ছা আমি মুক্তি লইতে পারি। প্রদ্যুম্ন মূঢ়ের মতো তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, তবে লও নাই কেন? এলা ক্ষণেক চুপ করিয়া রহিল; তারপর গর্বিত স্বরে বলিল, সে আমার ইচ্ছা। এই সময় বাতায়নের বাহিরে দূর উপত্যকায় শঙ্খের গভীর নির্ঘোষ হইল। চমকিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সীমান্তের বনানীর ভিতর হইতে ধ্বজকেতনধারী আর্যসেনা ফিরিয়া আসিতেছে। ললাটের উপর করতলের আচ্ছাদন দিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে চাহিয়া রহিলেন, তারপর গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, যাক, বাঁচা গেল—মঘবা ফিরিয়াছে? প্রদ্যুম্ন তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। পিছন হইতে এলার শান্ত কণ্ঠস্বর আসিল, আমিও বাঁচিলাম, মুক্তির আর দেরি নাই। প্রদ্যুম্ন চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, এলা তেমনি দাঁড়াইয়া বেণী বয়ন করিতেছে, তাহার মুখে সূচীবিদ্ধ মৃত প্রজাপতির মতো একটুখানি হাসি। প্রদ্যুম্ন তাহার কাছে ফিরিয়া গিয়া অনুনয়ের কণ্ঠে বলিলেন, এলা, ছেলেমানুষি করিও না। মঘবাকে বুঝিতে সময় লাগে, বিবাহের পর বুঝিতে পারিবে তাহার মতো মানুষ হয় না—মিনতি করিতেছি, ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ একটা কিছু করিয়া বসিও না। এলা বলিল, হঠাৎ কোনও কাজ করা আমার অভ্যাস নয়; আমি কোদণ্ড-কন্যা, বর্বর নহি। যদি মঘবা বলপূর্বক আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করে, বিবাহের সভায় আমি মুক্তি লইব। মঘবা বলিলেন, কোদণ্ডদের ভাল রকম কাবু করিতে পারিলাম না। ক্ষেপিয়া গেলে ব্যাটারা ভীষণ লড়ে। যা হোক,
false
humayun_ahmed
মাতালের কান্না নয়, জগৎ সংসার ছারখার হয়ে যাওয়া একজন মানুষের কান্না। রিকশাওয়ালা পর্যন্ত অভিভূত হয়ে বলল, ভাইজান কাইন্দেন না-আল্লারে ডাকেন। আল্লা ছাড়া আমরার আর কে আছে। সুন্দর ডায়েরিতে মেয়েরা খুব যত্ন করে অনেক কিছু লেখে। এই লেখা মোটেই এরকম নয়। মোটা লাইন টানা একটা খাতা। শুরুতে বায়োলজির নোট নেবার জন্যে হয়ত কেনা হয়েছিল। বায়োলজির নানান প্রসঙ্গে খাতা ভর্তি। তার ফাঁকে-ফাঁকে অন্য সব কথা। হয়ত ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে দীর্ঘ একটা লেখার ফাঁকে চার লাইনের সম্পূর্ণ অন্য একটা লেখা। জহির সারারাত জেগে লেখাগুলি পড়ল— ** জহির ভাইকে নিয়ে আজ মার সঙ্গে ঝগড়া হল। ঝগড়া হবার মতো কোনো ঘটনা ছিল না তবু হল। আসলে অন্য একটা ব্যাপারে আমি মার ওপর রেগে ছিলাম। সুযোগ পেয়ে রাগ ঝাড়লাম। মা খুব অবাক হলেন আমি জহির ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে এত কথা বলছি কেন? মাঝখান থেকে বেচারা জহির ভাই খুব সজ্জা পেলেন। আমার মনে হচ্ছে বেচারা আর অনেকদিন আমাদের বাসায় আসবেন না। এরকম ছোটখাট একটা ঘটনা ঘটে আর জহির ভাই সপ্তাহখানেক এ বাসায় আসা ছেড়ে দেন। আজকের সমস্যার সূত্রপাত হল এইভাবে-জহির ভাইকে বাজারে পাঠানো হয়েছিল, তিনি বাইম মাছ নিয়ে এসেছেন। সেই বাইম মাছ দেখে মা তাঁর স্বভাব মতো অগ্ন্যুৎপাত শুরু করলেন সাপের মতো দেখতে একটা মাছ তুমি কি মনে করে আনলে? কে খাবে এই মাছ? আমি তখন বললাম, ওমাবাইম মাছ! আমার খুব ফেভারিট মাছ। জহির ভাই আনন্দিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে আমার বড় ভালো লাগল। আহা বেচারা! মা হতভম্ব। তিনি বললেন, বাইম মাছ তোর পছন্দ? তুই কবে খেয়েছিস? আমি কখনো খাই নি তবু বুঝতে পারছি এ মাছ খেতে অসাধারণ হবে। জহির ভাই বিব্রত গলায় বললেন, আমি বদলে নিয়ে আসছি। আমি বললাম—অসম্ভব। আমি আজ বাইম মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খাবই না। ** তরু জহির ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন কথা বলছিল। ওরা বারান্দায় বসে কথা বলছিল। অবাক হয়ে দেখি তরুর গাল পাল, মাথা নিচু হয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়েই তরু থেমে গেল এবং চোখমুখ কেমন করে যেন তাকাল। তাকানোর এই দৃষ্টি আমি চিনি। আমি কেন, সবাই চেনে। শুধু গাধার গাধা জহির ভাই চেনেন না। কোনোদিন চিনবেনও না। আমি তরুকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। বললাম, জহির ভাইয়ের সঙ্গে কী কথা বলছিলি? কোনো কথা বলছিলাম না তো। কোনো কথা বলছিলি না? ক্লাসের একটা মেয়ের কথা বলছিলাম। কি কথা? মেয়েটার নাম তৃষ্ণাও একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে—ছেলেটা ওদের আত্মীয়—ঐ গল্পটা বলছিলাম। কেন? কথায় কথায় চলে আসল–ওর কথা তোমাকেও তো বলেছি। আমি হঠাৎ রুর গালে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলাম। এই কাজটা আমি কেন করলাম তরু কি তা বুঝতে পারল? অবশ্যই পারল। আমি যেমন মেয়ে তরুও তো তেমনি মেয়ে। ও কেন পারবে না? ওকে চড়টা দিয়েই আমি দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলাম। তরু আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতে লাগল। আহা রে, এত ভালো কেন আমার বোনটা। ** জহির ভাইকে আমার এত ভালো লাগে কেন তা বুঝতে চেষ্টা করছি। কারণ নেই। কোনো কারণ নেই। এই মানুষটা একটা অকাট গাধা, একটা ছাগল। একবারের কথা, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ঢাকায় ফিরছি। আমি বললাম, জহির ভাই আসুন আমরা ডেকের বেঞ্চিতে বসে চাঁদের আলো দেখতে-দেখতে যাই। গাধাটা বলল, ঠাণ্ডা লাগবে না। আমি বললাম, লাওক। আমি একা-একা বসে আছি, গাধাটা কোত্থেকে একটা কম্বল না কী-যেন এনে আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। যখন কম্বলটা জড়িয়ে দিচ্ছে তখন হঠাৎ কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। এর নামই কি ভালবাসা? এই ভালবাসা কোথায় লুকিয়ে থাকে? কোন অচেনা জগতে? কোন অচেনা ভূবনে? কি করে সে আসে? কেন সে আসে? কেন সে আমাদের অভিভূত করে? জহির ভাই আমার পাশে বসলেন। জড়সড় হয়ে বসলেন। একটু সরে বসলেন, যেন গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। আমি বললাম, এমন দূরে সরে বসেছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমার গার সঙ্গে গা লাগলে আপনার পাপ হবে? জহির ভাই বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। আমি বললাম, আসুন তত আপনি আমার আরো কাছে সরে আসুন। তিনি কাছে এলেন, আমি মনে-মনে বললাম, জনম জনম তব তরে কাঁদিব। কি আশ্চর্য! কেন কাঁদব? কী আছে এই মানুষটির? হে ঈশর, ভালবাসা কী আমাকে বুঝিয়ে দাও। ** রাত কত হবে? দুটা? তিনটা? না তার চেয়েও বেশি। আমি দরজা খুলে বের হলাম। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে। কী জোছনা। জোছনায় মন এমন করে কেন? অনেকক্ষণ বসে রইলাম বারান্দায় আমার মাথাটা হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমি বসার ঘরে ঢুকলাম। ওখানে একটা খাটে জহির ভাই কদিন ধরে আছেন। আমি ঘরে ঢুকলাম খুব সাবধানে। আমি একটা ঘরের মধ্যে আছি। কি করছি বুঝতে পারছি না। জহির ভাইয়ের টের পাশে বসলাম। আমার ধারণা ছিল তিনি ঘুমাচ্ছেন। আসলে তিনি ঘুমুচ্ছিলেন না। আমি পাশে বসা মাত্র জহির ভাই বললেন, অরু—তুমি ঘুমাতে যাও। আমি একটা কথা না বলে উঠে চলে এলাম। এর পরে কতবার দেখা হল, আমরা দুজনে এমন ভাব করলাম যেন এমন একটি ঘটনা কোনো দিন ঘটে নি। কিংবা কে জানে, হয়ত সত্যি এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। হয়ত এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য। করিম সাহেব জহিরকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বেয়ারা দিয়ে স্লিপ
false
shordindu
ব্যস্ত হইয়া ডাকিল—ওরে কে আছিস কঙ্ক ড়ুভ-শীঘ্র কম্বোজ দুটিকে মন্দুরায় লইয়া যা, যব-শত্রু শালি-প্রিয়ঙ্গু দিয়া সেবা কর। দুইজন কিঙ্কর আসিয়া অশ্ব দুটির বা ধরিয়া ভিতরে লইয়া গেল। রট্টা জিজ্ঞাসা করিলেন–আমার রক্ষীরা কি চলিয়া গিয়াছে? পান্থপাল বলিল—আজ্ঞা হাঁ। নকুল মহাশয়ের ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু কুমার ভট্টারিকার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। তাঁহারা দ্বিপ্রহরেই চলিয়া গিয়াছেন। পান্থপাল মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি; স্থূলকায় কিন্তু নিরেট। বচনবিন্যাসে বেশ পটু। চিত্ৰক তাহাকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল—এখানে দেবদুহিতা রাত্রিযাপন করিলে ভয়ের কোনও কারণ নাই? ভয়! আমার পান্থশালার দ্বার বন্ধ হইলে মূষিকেরও সাধ্য নাই ভিতরে প্রবেশ করে। পান্থপাল কণ্ঠস্বর হ্রস্ব করিয়া বলিল—তবে ভিতরে কয়েকটি পান্থ আছে। তাহারা বিদেশী বণিক, পারস্যদেশ হইতে আসিতেছে; মগধে যাইবে— তাহারা কি বিশ্বাসযোগ্য নয়? বিশ্বাসের অযোগ্য বলিতে পারি না। ইহারা বহু বৎসর ধরিয়া এই পথে গতায়াত করিতেছে। মেষরোমের আস্তরণ গাত্রাবরণ প্রভৃতি লইয়া আর্যাবর্তের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্য করিয়া বেড়ায়। তবে উহারা অগ্নি-উপাসক, ম্লেচ্ছ। সাবধানের নাশ নাই। কিরূপ সাবধানতা অবলম্বন কর্তব্য? পান্থপাল বলিলেন—ইনি দেবদুহিতা একথা প্রকাশ না করিলেই চলিবে। ইনি আসিতেছেন তাহা আমি ভিন্ন আর কেহ জানে না। চিত্ৰক দেখিল পান্থপাল লোকটি চতুর ও প্রত্যুৎপন্নমতি; সে বলিল—ভাল।—পান্থপাল, তোমার নাম কি? পান্থপাল সবিনয়ে বলিল—দেবদ্বিজের কৃপায় এ দাসের নাম জয়কন্তু। কিন্তু আর্যভাষা সকলের মুখে উচ্চারণ হয় না, কেহ কেহ জম্বুক বলিয়া ডাকে। চিত্ৰক হাসিয়া বলিল—ভাল। জম্বুক, আমাদের ভিতরে লইয়া চল। আমরা শ্রান্ত হইয়াছি। জম্বুক বলিল—আসুন, মহাভাগ, আসুন দেবি। আপনাদের জন্য শ্রেষ্ঠ দুটি কক্ষ সজ্জিত করিয়া রাখিয়াছি। এদিকে স্নিগ্ধ অম্লসীধু প্রস্তুত আছে, অনুমতি হইলেই চিত্রক ও রট্টা প্রকারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। সূর্য তখনও অস্তাচল স্পর্শ করে নাই, কিন্তু জম্বুকের আদেশে দুইজন দ্বারী দ্বার বন্ধ করিয়া ইন্দ্ৰকীলক আঁটিয়া দিল। কাল সূর্যোদয় পর্যন্ত আর কেহ প্রবেশ করিতে পারিবে না। রট্টা পূর্বে কখনও পান্থশালা দেখেন নাই, তিনি পরম কৌতূহলের সহিত চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে চলিলেন। প্রাচীর দ্বারা পরিবৃত স্থানটি চতুষ্কোণ; তিনটি প্রাচীরের গাত্রে সারি সারি প্রকোষ্ঠ; প্রকোষ্ঠগুলির সম্মুখে একটানা অপ্রশস্ত অলিন্দ। মধ্যস্থলে শিলাপট্টাবৃত সুপরিসর উন্মুক্ত অঙ্গন। অঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে চক্ৰাকৃতি বৃহৎ জলকুণ্ড। অঙ্গনের এক কোণে কয়েকটি উষ্ট্র ও গর্দভ রহিয়াছে; তাহারা পারসিক পণ্যবাহক। পারসিকেরা নিকটেই আস্তরণ বিছাইয়া বসিয়া আছে এবং নিজেদের মধ্যে রহস্যালাপ করিতেছে। তাহাদের মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত; বর্ণ পক্ক দাড়িম্বের ন্যায়; চক্ষু ও কেশ ঘনকৃষ্ণ। রট্টা যখন চিত্ৰক ও জম্বুকের সহিত তাহাদের নিকট দিয়া চলিয়া গেলেন তখন তাহারা একবার চক্ষু তুলিয়া দেখিল, তারপর আবার পরম্পর বাক্যালাপ করিতে লাগিল। ইহারা নিতান্ত নিরীহ বণিক, ছদ্মবেশী দস্যু তস্কর নয়; কিন্তু চিত্রকের মন সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল। নারী লইয়া পথ চলা যে কিরূপ উদ্বেগজনক কাজ এ অভিজ্ঞতা পূর্বে তাহার ছিল না। চিত্ৰক নিম্নস্বরে জম্বুককে প্রশ্ন করিল—ইহারা কয়জন? জম্বুক বলিল—পাঁচজন। সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে? আছে। অস্ত্র না লইয়া এদেশে কেহ পথ চলে না। তোমার ভৃত্য অনুচর কয়জন? আমরা পুরুষ আটজন আছি। স্ত্রীলোকও আছে নাকি? জম্বুক প্রাঙ্গণের বিপরীত প্রান্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল—আমাদের চারিজন অন্তঃপুরিকা আছে। চিত্ৰক অনেকটা আশ্বস্ত হইল। অঙ্গনের অন্য প্রান্তে চারিজন নারী বসিয়া গৃহকর্ম করিতেছিল। রট্টা সেখানে গিয়া স্মিতমুখে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন। চত্বরের কিয়দংশ পরিষ্কৃত করিয়া নারীগণ নৈশ ভোজনের আয়োজন করিতেছে। একজন ঘরট্ট ঘুরাইয়া গোধূম চূর্ণ করিতেছে; নবচূর্ণিত গোধূম হইতে রোটিকা প্রস্তুত হইবে। দ্বিতীয়া শাক বাছিতেছে; তৃতীয়া প্রস্তরের উদ্খলে সুগন্ধি বেশার কুট্টন করিতেছে; চতুর্থী মেমাংস ছুরিকা দিয়া কাটিয়া কাটিয়া পৃথক করিয়া রাখিতেছে। তাহারা মাঝে মাঝে সম্রম-কৌতূহলপূর্ণ চক্ষু তুলিয়া এই পুরুষবেশিনী সুন্দরীকে দেখিল, কিন্তু তাহাদের ক্ষিপ্র নিপুণ হস্তের কার্য শিথিল হইল না। রট্টা কিছুক্ষণ ইহাদের মসৃণ কর্মদক্ষতা নিরীক্ষণ করিলেন। তারপর একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া জম্বুকের দিকে ফিরিলেন—জম্বুক, তোমাকে একটা কাজ করিতে হইবে। জম্বুক তৎক্ষণাৎ যুক্তপাণি হইল—আজ্ঞা করুন। কপোতকূটের পথে পর্বতের উপর একটি বৌদ্ধবিহার আছে জান কি? আজ্ঞা জানি। চিল্লকূট বিহার। সেখানে ভিক্ষুদের জন্য দুই আঢ়ক উত্তম গোধূম পাঠাইতে হইবে। আজ্ঞা পাঠাইব। কল্য প্রাতেই গর্দভপৃষ্ঠে গোধূম পাঠাইয়া দিব। ভিক্ষুরা সূর্যাস্তের পূর্বেই পাইবেন। ভাল। আমি মূল্য দিব। চিত্রক ও রট্টার জন্য যে দুইটি কক্ষ নির্দিষ্ট হইয়াছিল তাহা আকার ও আয়তনে অন্যান্য কক্ষের মতই, কিন্তু কক্ষের কুট্টিমে উষ্ট্ররোমের আস্তরণ বিস্তৃত হইয়াছিল, তদুপরি কোমল শয্যা। কোণে পিত্তলের দীপদণ্ডে বর্তি জ্বলিতেছে। রাজকুমারীর পক্ষে ইহা তুচ্ছ আয়োজন; কিন্তু দেখিয়া রট্টা প্রীত হইলেন। অশ্লসীধু সহযোগে কিছু ক্ষীরের মণ্ড ভক্ষণ করিয়া উভয়ে আপাতত ক্ষুৎপিপাসার নিবৃত্তি করিলেন। রাত্রির আহার বাকি রহিল। আহারান্তে চিত্ৰক গাত্রোত্থান করিয়া রট্টাকে বলিল—আপনি এখন কিয়ৎকাল বিশ্রাম করুন। বলিয়া রট্টার কক্ষের দ্বার ভেজাইয়া দিয়া বাহিরে আসিল। আকাশে তখন নক্ষত্র ফুটিয়াছে; রাত্রি অন্ধকার, এখনও চন্দ্রোদয় হয় নাই। পান্থশালার প্রাঙ্গণের স্থানে স্থানে অগ্নি জ্বলিতেছে। ওদিকে পারসিকেরা অঙ্গার কুণ্ড প্রস্তুত করিয়া শূল্য মাংস রন্ধন করিতেছে; দগ্ধ মাংসের বেশার-মিশ্র সুগন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে লুব্ধ করিয়া তুলিতেছে। চিত্ৰক বলিল—হিঙ্গু-পলা-ভোজী ম্লেচ্ছগুলা রাঁধে ভাল। জম্বুক, রাত্রে আমাদের ভোজনের কি ব্যবস্থা? জম্বুক ভোজ্য বস্তুর দীর্ঘ তালিকা দিল। প্রথমেই মিষ্টান্ন : মধু পিষ্টক লড়ু ও ক্ষীর; তারপর শাক ঘৃত-তণ্ডুল মুগ্ন-সূপ, ময়ূর ডিম্ব; সর্বশেষে রোটিকা পুরোডাশ ও তিন প্রকার অবদংশ সহ উখ্য মাংস শূল্য মাংস ও দধি। চিত্ৰক সন্তুষ্ট হইয়া বলিল—উত্তম। দেবদুহিতার কষ্ট না হয়। আর শুন, শূল্য মাংস আমি রন্ধন করিব। জম্বুক চক্ষু বিস্ফারিত করিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল—যেরূপ আপনার অভিরুচি। চিত্রক কক্ষের সম্মুখে অঙ্গনের উপর একটা স্থান
false
shirshendu
মোটেই ফেলনা জিনিস নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই পেটুক তা জানি। কিন্তু ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোকে কেউ হাত করে ফেললে সেটা আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে। তোকে যা বলে দিয়েছিলাম সেটা খোঁজ করেছিলি? কী বলেছিলি? ওরা বামুন না। কায়েত? ওই নিয়েই থাক। বামুন-কায়েত জেনে কী হবে? চোরের মন কেবল বেঁচেকার দিকে। রশ্মি আমার একজন ভাল বন্ধু। আর কিছু নয়। কবে দেখাবি? দেখাবো মানে? দেখানোর কী আছে? তোর যা অবস্থা দেখছি তাতে মনে হয়, গতিক সুবিধের নয়। ছাইক্লোন হতি পারে। শ্ৰীকান্ত থেকে কোট করলি নাকি? একটু-আধটু বই-টই পড়ছিস তাহলে? আমি তো পড়িই! তুই যে কিছুই পড়িস না। এই পিসটা বোধ হয় তোর পাঠ্য বইতে ছিল, তাই ধরতে পারলি। গল্প উপন্যাস পড়ে আকাজের লোকেরা। আমার আত ফালতু সময় নেই। আর ওইসব গল্প উপন্যাস পড়েই তো তোর মাথাটা গেছে। সব জায়গায় প্রেমের গন্ধ পাচ্ছিস। তুই একটা যা-তা। গল্প উপন্যাস পড়লে তোর নিরেট মগজেও বুঝতে পারতিস যে, তুই অলরেড রশ্মি রায়ের জালে আটকা পড়ে গেছিস। গল্প উপন্যাস মানুষকে অনেক বেশী কনশাস করে তোলে। যাক গে, আসল কথাটা বল। মেয়েটাকে কবে দেখাবি? দেখানোর কিছু নেই, বললাম তো। আচ্ছা ছোটলোক বটে তুই, কেল্পনাও ভীষণ। তোকে যে এত খাওয়াল, তোর কি উচিত নয়। ওকেও নেমন্তন্ন করে একদিন খাওয়ানো? এ কথায় হেমাঙ্গ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, কেন, আমি খাওয়াতে যাবো কেন? ওটাই যে ভদ্রতা। দুনিয়াটা চলছে। লেনদেনের ওপর। শুধু একতরফা খেয়ে এলেই হল? পার্টি দিতে হবে বলছিস? হবে না? তুই কী রে! ঠিক আছে, কোনও ভাল হোটেলে নিয়ে গিয়ে একদিন খাইয়ে দিলেই হবে। এই না হলে তোকে দুনিয়ার পয়লা নম্বর গবেট বলা হয় কেন? কেন, প্ৰস্তাবটা কি খারাপ? ও তোকে বাড়িতে ডেকে যত্ন করে রোধে খাওয়াল, আর তুই ওকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবি? এটা কি বিলেত? না কি তুই মস্ত বড় সাহেব হয়েছিস? হেমাঙ্গ অসহায়ভাবে বলল, তাহলে কি করব? বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলে হাজারটা কথা উঠবে। কুমারী সুন্দরী মেয়ে বলে কথা! জবাবদিহি করতে জেরবার হবে আমার। আর এ বাড়ির রাঁধুনী হল ফটিক, সেই রান্না আমার মতো সহনশীল মানুষ খেতে পারে, কিন্তু রশ্মি পারবে কি? তোকে আর বোকা-বুদ্ধি খাটাতে হবে না। রশ্মিকে নেমন্তন্ন করবি আমার বাড়িতে। তোর বাড়ি? অ, বুঝেছি। এই ফাঁকে দেখে নিতে চাস তো? দেখলে কি তোর ভাগে কম পড়বে? নেমন্তন্ন যদি নিতে না চায়? যদি না আসে? তোর বলার ভাগ বলবি, তারপর আমি বুঝব। ওর ফোন নম্বরটা আমাকে দে। তুই আগে নেমভন্ন করব, তারপর আমিও বলব। তুই কিন্তু ব্যাপারটা পাকিয়ে তুলছিস। আমি ব্যাচেলর মানুষ, আমি ওকে নেমস্তন্ন না করলেও কিছু যায় আসে না। এই পাল্টা নেমন্তন্ন মানেই সম্পর্কটাকে আরও ঘুলিয়ে তোলা। তোর মাথা! এ যুগে কেউ অত সহজে আছাড় খায় না। বিলেত-ঘোরা মেয়ে, খুব সোজা পাত্রী নয়। আর তুই বোকা হলেও সেয়ানা। আরও একটা প্রবলেম আছে। তুই যা রাঁধিস তা কি ও খেতে পারবে? চাটবে। তবে ভয় নেই, আমার রান্নার লোক আছে। তা জানি। তার রান্না খাওয়াবি? তার হাতে হাজা নেই তো? মুকুন্দ সদাচারী মানুষ, তোর মতো স্লেচ্ছ নয়। সাহেবী রান্নাও জানে। আমিও ওকে হেলপ করব। তোর ভয় নেই। এ পর্যন্ত হয়ে ছিল। কিন্তু কঠিন হল, রশ্মিকে নেমন্তন্ন করাটা। একটা আচমকা লজ্জা আর সংকোচ বাধা দিচ্ছিল হেমাঙ্গকে পাল্টা নেমন্তন্নটা কি ঠিক হচ্ছে? চারুদি একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলছে না তো! শেষ অবধি অবশ্য সে দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফোনটা করে ফেলেছিল। আশ্চর্যের বিষয় রশ্মি এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। সামনের রবিবার সন্ধেবেলায় চারুশীলার বাড়িতে সে সানন্দে যাবে। পৃথিবীর সব ঘটনার রাশ তার হাতে নেই। অনেক সময়ে ঘটনা ঘটে যায়, মানুষকে তা মেনে নিতে হয় মাত্র। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী এবং অভ্যাসবশে হেমাঙ্গ ভগবান মানে, কিন্তু তার জীবনে কোনও ধর্মাচরণ নেই। মাঝেমধ্যে সে ভগবানের ওপর নির্ভরও করে। এখনও তার জীবনে এক সং। ভগবানের ওপর ভর করা ছাড়া তার আর উপায় নেই। পোড়া মাংসের স্বাদ তাকে পেড়ে ফেলেছে বটে, কিন্তু সে সেই সম্মোহন কেটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ঘটনার গতিক তার সুবিধের ঠেকছে না। আজ কিছু কেনাকাটা করলে কেমন হয়? জিনিসপত্র কিনলে তার মনটা ভাল হয়ে যায়। অফিস থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে সে প্রায় হাজার টাকা দামের এক জোড়া জুতো কিনল। জুতো কিনতে তার যে কেন এখনও এত ভাল লাগে! জুতোর মধ্যে কোন আনন্দ লুকিয়ে থাকে কে জানে বাবা! দামটা একটু বেশী পড়ে গেল, কিন্তু জুতো জোড়া এতই ভাল যে পায়ে দিয়েই একটা চমৎকার আরাম বোধ করল সে। জুতো তৈরির কলাকৌশলও এত অত্যাধুনিক হয়ে যাচ্ছে যে, সূক্ষ্ম সাইকোলজির সঙ্গেও জুতোর যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে গেল বুঝি। পায়ে দিলেই মন অবধি ভাল হয়ে যায়। নতুন জিনিস কিনে এনে সে সেটা প্রথম দেখায় ফটিককেই। ফটিক বুঝদার সমঝদার মানুষ নয়। তবে সে-যাই দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়, অবাক হয়। তারিফ করার ধরনটাও তার আলাদা রকমের। আজ জুতো দেখে ফটিক বলল, এ খুব জস্পেশ জিনিস বলেই মনে হচ্ছে। হোসে-খেলে পাঁচ-সাতটা বছর চলে যাবে। আহা, টেকার কথা হচ্ছে না, জিনিসটা কেমন বলো। এ তো জুতো বলে চেনাই যায় না, যেন এক জোড়া জাহাজ।
false
tarashonkor
দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাচ্ছেন;—এক নির্জন গহনের মৌন একাকিত্বে মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন। বর্ষার এই দিগন্তজোড়া বর্ষপণানুখ মেঘমণ্ডলের মতই গম্ভীর ম্লান এবং ভারী হয়ে উঠছেন। জীবনের জ্যোতি যেন কোনো বিরাট গম্ভীর প্রশ্নের অনিবার্য আবির্ভাবে ঢাকা পড়ে গেছে। অবশ্য জ্ঞানেন্দ্রনাথের জীবনে এ নূতন নয়। ঋতুপর‍্যায়ের মত এ তাঁর জীবনে এসেছে বার বার। বার বার কত পরিবর্তন হল মানুষটির জীবনে। উঃ! কিন্তু এমন আচ্ছন্নতা, এমন মৌন মগ্নতা কখনও দেখেন নি। সবচেয়ে তাঁর ভয় হচ্ছে। সুমতির ছবিকে! সে কোন প্রশ্ন নিয়ে এল? কী প্রশ্ন? সে প্রশ্ন যাই হোক তার সঙ্গে তিনি যে জড়িয়ে আছেন তাতে তো সন্দেহ নেই। তার অন্তর যে তার আভাস পাচ্ছে। আকুল হয়ে উঠেছে। তার মা তাঁকে বারণ করেছিলেন। কানে বাজছে। মনে পড়েছে। নিজেও তিনি দূরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। টেনিস ফাইন্যালে জেতার পর তোলানো ফটোগ্রাফ কখানা পেয়েই সংকল্প করেছিলেন সুমতি জ্ঞানেন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে যাবেন। অনেক দূরে। পরদিন সকালেই কলকাতা চলে যাবেন, সেখান থেকে বাবাকে লিখবেন অন্যত্র ট্রান্সফারের জন্য; অথবা জ্ঞানেন্দ্রনাথকে ট্রান্সফার করাতে। বাবাকে জানাতে তার সংকোচ ছিল না। কিন্তু বিচিত্র ঘটনাচক্র। পরদিন ভোরবেলাতেই শুনেছিলেন মুনসেফবাবুর বাসা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। মুনসেফবাবুর স্ত্রী পুড়ে মারা গেছেন। মুনসেফবাবু হাসপাতালে, অজ্ঞান, বুকটা পিঠটা অনেকটা পুড়ে গেছে, বাঁচবেন কি না সন্দেহ! সব বাঁধ তাঁর ভেঙে গিয়েছিল। যে-প্রেমকে কখনও জীবনে প্রকাশ করবেন না সংকল্প করেছিলেন সে-প্রেম সেই সংকটময় মুহূর্তে তারস্বরে কেঁদে উঠে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তিনি জ্ঞানেন্দ্রনাথের শিয়রে গিয়ে। বসেছিলেন। উঠবেন না, তিনি উঠবেন না। মাকে বলেছিলেন—আমাকে উঠতে বোলোনা, আমি যাব না, যেতে পারব না। কাতর দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়েছিলেন বাবার দিকে। বাবা বলেছিলেন–বেশ, থাক তুমি। মা বলেছিলেন—এ দুই কী করছিস ভেবে দেখ। যে-লোক স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে এমনভাবে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে তার মনে অন্যের ঠাঁই কোথায়? লোকে যে দেখেছিল, চকিতের মত দেখেছিল সুমতির হাত ধরে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে বেরিয়ে আসতে। চাল চাপা পড়ার মুহূর্তে সুমতির নাম ধরে তার আর্তচিৎকার শুনেছিল—সুমতি! বলে, সে নাকি এক প্রাণফাটানো আর্তনাদ! জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভাল হয়ে উঠবার পর একদা এক নিভৃত অবসরে সুরমা বলেছিলেন—তোমার জীবন আমি সর্বস্বান্ত করে দিয়েছি। আমার জন্যই তোমার এ সৰ্বনাশ হয়ে গেল। আমাকে তুমি নাও! সুমতির অভাব জ্ঞানেন্দ্রনাথ আশ্চর্য। সুরমার কথায় বাধা দিয়ে বলেছিলেন—অভাববোধের সব জায়গাটাই যে অগ্নিজিহ্বা লেহন করে তার রূপ রস স্বাদ গন্ধ সব নিঃশেষে নিয়ে গেছে সুরমা। আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন নিজের পুড়ে-যাওয়া বুক এবং পিঠটাকে। —আমার চা-টা—শুধু চা, এখানে পাঠিয়ে দাও! –প্লিজ! জ্ঞানেন্দ্রনাথের মৃদু গম্ভীর কণ্ঠস্বর; চমকে উঠলেন সুরমা। ফিরে এলেন নিষ্ঠুরতম বাস্তব অবস্থায়। জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন সুমতির অয়েল-পেন্টিঙের সামনে। —না। আর্ত মিনতিতে সুরমা তার হাত ধরতে গেলেন। –প্লিজ! সুরমার উদ্যত হাতখানি আপনি দুর্বল হয়ে নেমে এল। আদেশ নয়, আকুতিভরা কণ্ঠস্বর। বিদ্রোহ করার পথ নেই। লঙ্ঘন করাও যায় না। নিঃশব্দেই বেরিয়ে গেলেন সুরমা। ক. স্থির দৃষ্টিতে ছবিখানির দিকে তাকিয়ে ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। ক্ষীণতম ভাষার স্পন্দন তাতে থাকলে তাকে শুনবার চেষ্টা করছিলেন, ইঙ্গিত থাকলে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। সুমতির মিষ্ট কোমল প্রতিমূর্তির মধ্যে কোথাও ফুটে রয়েছে অসন্তোষ অভিযোগের ছায়া? —তুমি আজ কোর্টের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে? জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফিরে তাকালেন। চা নিয়ে সুরমা এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজেই নিয়ে এসেছেন বেয়ারাকে আনেন নি সঙ্গে। —অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে? মাথা ঘুরে গিয়েছিল? –কে বললে? –আরদালি বললে। পাবলিক প্রসিকিউটারের সওয়ালের সময় তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল; তুমি উঠে খাস কামরায় গিয়ে মাথা ধুয়েছ–? –হ্যাঁ। একটু হাসলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। বিচিত্র সে হাসি। বিষণ্ণতার মধ্যে যে এমন প্রসন্নতা থাকতে পারে, এ সুরমা কখনও দেখেন নি। অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পাবলিক প্রসিকিউটার আসামির উকিলের সওয়ালের পর তার জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি গভীর আত্মমগ্নতার মধ্যে ড়ুবে ছিলেন। নিস্পন্দ পাথরের মূর্তির মত বসে ছিলেন তিনি, চোখের তারা দুটি পর্যন্ত স্থির; কাচের চোখের মত মনে হচ্ছিল। ইলেকট্রিক ফ্যানের বাতাসে শুধু তাঁর গাউনের প্রান্তগুলি কাঁপছিল, দুলছিল। তিনি মনে মনে অনুভব করছিলেন ওই শ্বাসরোধী অবস্থার স্বরূপ। আঙ্কিক নিয়মে অন্ধ বস্তুশক্তির নিপীড়ন। অঙ্কের নিয়মে একদিকে তার শক্তি ঘনীভূত হয়, অন্যদিকে জীবনের সগ্রাম-শক্তি সহ্যশক্তি ক্ষীণ ক্ষীণতর হয়ে আসে। তার শেষ মুহূর্তের অব্যবহিত পূর্বে সে চরম মুহূর্ত—শেষ চেষ্টা তখন তার, পুঞ্জ পুঞ্জ শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, নির্মল প্ৰাণদায়িনী বায়ুর অভাবে হৃৎপিণ্ড ফেটে যায়। সকল স্মৃতি, ধারণা, বিচারবুদ্ধি অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে আসে। অকস্মাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে যেমন আলোর শিখা বেড়ে উঠে লণ্ঠনের ফানুসে কালির প্রলেপ লেপে দেয়, তার জ্যোতির চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে নিজেও নিভে যায়—ঠিক তেমনি। ঠিক সেই মুহূর্তে খসে পড়ে জ্বলন্ত খড়ের রাশি, একসঙ্গে শত বন্ধনে বাঁধা একটা নিরেট অগ্নিপ্রাচীরের মত। আসামি ঠিক বলেছে, সেসময়ের মনের কথা স্মরণ করা যায় না। প্রকৃতির নিয়ম। হতভাগ্য আসামি জলের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিল, নিষ্ঠুর বন্ধনে বেঁধেছিল তার ভাই। ঘন জলের মধ্যে গভীরে নেমে যাচ্ছিল, শ্বাসবায়ু রুদ্ধ হয়ে ফেটে যাচ্ছিল বুক, সে সেই যন্ত্রণার মধ্যে চলছিল পিছনের দিকে আদিমতম জীবন-চেতনার দিকে। অকস্মাৎ তাঁর কানে এল অবিনাশবাবুর কথা। খ. পাবলিক প্রসিকিউটার বলছিলেন সেকশন এইট্টি-ওয়ানের অনুল্লিখিত অংশটির কথা। আমি খগেনের গলা টিপে ধরে তাকে আঘাত করেছে, শ্বাস রোধ করে মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে, খগেনকে মেরে নিজেই বেঁচেছে, খগেনকে বাঁচবার অবকাশ দেয় নি। ইয়োর অনার, তা ছাড়া আরও একটি কথা আছে। আমার পণ্ডিত বন্ধু সেকশন এইট্টিওয়ানের একটি নজিরের
false
tarashonkor
আর সাহায্য-সমিতিতে আসবে না, বিশু-ভাই! —আসবে। বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিলনা আসে তোমাকে বুঝিয়ে আনতে হবে। তুমি পারবে। টাকা-পয়সা তো জাত মেনে হাত ঘোরে না, ভাই! চণ্ডালের ঘরের টাকা বামুনের হাতে এলেই শুদ্ধ হয়ে যায়। কাটার খোঁচার মত একটু তীক্ষ্ণ আঘাত দেবু অনুভব করিল; সে বিশ্বনাথের মুখের দিকে চাহিল। অদ্ভুত বিশু-ভাইয়ের মুখখানিকোনোখানে এক বিন্দু এমন কিছু নাই—যাহা দেখিয়া অপ্রীতি জন্মে, রাগ করা যায়। বিশ্বনাথের হাত ধরিয়া সে বলিল—কেন তুমি এমন কাজ করলে, বিশু-ভাই? বিশ্বনাথ কথার উত্তর দিল না, অভ্যাসমত নীরবে হাসিল। দেবু বলিল কঙ্কণার বাবুরা ব্রাহ্মণ হলেও সায়েবদের সঙ্গে এক-টেবিলে বসে খানা খায়-অখাদ্য খায়, মদ খায়, অজাত-কুজাতের মেয়েদের নিয়ে ব্যভিচার করে তাদের আমরা ঘেন্না করি। হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, পথের ভিখিরিরা পর্যন্ত ঘেন্না করে। ভয়ে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঘেন্না করে। ওরা বামুনও নয়, ধর্মও ওদের নাই। কিন্তু রোগে, শোকে দুঃখে, বিশু-ভাই, মরণে পর্যন্ত আমাদের ভরসা ছিলে—তোমরা। ঠাকুর মশায়ের পায়ের ধুলো নিলে মনে হত সব পাপ আমাদের ধুয়ে গেল, সব দুঃখু আমাদের মুছে গেল। মনে মনে যখন ভাবতাম, একদিন ভগবান আসবেন, পৃথিবীর পাপীকে বিনাশ করে আবার সত্যযুগ প্রতিষ্ঠা করবেন—তখন মনে পড়ত ঠাকুর মশায়ের মুখ। আজ আমরা কি করে বাঁচব বলতে পার? কার ভরসায় আমরা বুক বাঁধব? বিশ্বনাথ বলিল—নিজের ভরসায় বুক বাঁধ, দেবু-ভাই! যেসব কথা তুমি বললে, সেসব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। সে তোমার ভাল লাগবে না। শুধু একটা কথা বলে যাই। যে-কালে দাদুর মত ব্রাহ্মণেরা রাজার অন্যায়ের বিচার করতে পারত, চোখ রাঙালে বড়লোকে। ভয়ে মাটিতে বসে যেত সে-কাল চলে গেছে। এ-কালে অভাব হলে—হয় নিজেরাই দল বেঁধে অভাব ঘুচোবার চেষ্টা কর, নয় যারা আজ দেশরক্ষার ভার নিয়ে বসে আছে—তাদের কাছে দাবি জানাও। রোগ হলে ওষুধের জন্যে চিকিৎসার জন্যে তাদেরই চেপে ধর। অকালমৃত্যুতে তাদেরই চোখ রাঙিয়ে গিয়ে বলকেন তোমাদের বন্দোবস্তের মধ্যে এমন অকালমৃত্যু? গভীর দুঃখে শোকে অভিভূত যখন হবে তখন ভগবানকে যদি ডাকতে ইচ্ছে হয়—নিজেরা ডেকো। ঠাকুর মশায়দের কাজ আজ ফুরিয়ে গিয়েছে; তাই সেই বংশের ছেলে হয়েও আমি অন্য রকম হয়ে গিয়েছি। দাদু আমার মন্ত্র-বিসর্জনের পর মাটির প্রতিমার মত বসে ছিলেন, তাই তিনি চলে গেলেন। দেবু একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—বিশু-ভাই, তুমি অনেক লেখাপড়া করেছ, তুমি আমাদের ঠাকুর মশায়ের বংশধর—তুমি আমাদের বাঁচাবে—এইটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল। কিন্তু হাসিয়া বিশ্বনাথ বলিলবলেছি তো, অন্যে তোমাদের আশীর্বাদের জোরে বাঁচাবে, এ ভরসা ভুল ভরসা, দেবু-ভাই! সে ভুল যদি আমা থেকে তোমাদের ভেঙে গিয়েই থাকে, তবে সে ভালই হয়েছে। আমি ভালই করেছি। আচ্ছা, আমি এখন চলি দেবু! –কিন্তু বিশু-ভাই। –যেদিন সত্যি ডাকবে, সেইদিন আবার আসব, দেবু-ভাই। হয়ত বা নিজেই আসব। বিশ্বনাথ দ্রুতপদে পথ অতিক্ৰম করিয়া, খানিকটা আগে পথের বাঁকে মোড় ফিরিয়া মিলাইয়া গেল। পথে যাইতে যাইতে হঠাৎ বিশ্বনাথ দাঁড়াইয়া গেল। কেহ যেন তাহার পথরোধ করিল। তাহার চোখে পড়িল—অদূরবর্তী মহাগ্রাম। ওই যে তাহাদের বাড়ির কোঠাঘরের মাথা দেখা যাইতেছে। ওই যে ঘনশ্যাম কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছটি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে দেখিয়া সে আবার মাথা নিচু করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। কোন আকর্ষণে সে যে দাদু-জয়া-অজয়কে ছাড়িয়া, ঘরদুয়ার ফেলিয়া, এমনভাবে জীবনের পথে চলিয়াছে—সে কথা ভাবিয়া মধ্যে মধ্যে সে নিজেই বিস্মিত হইয়া যায়। অদ্ভুত অপরিমেয় উত্তেজনা এই পথ চলায়। –ছোট-ঠাকুর মশায়! –কে? চকিত হইয়া বিশ্বনাথ চারিপাশে চাহিয়া দেখিল। পথের বাঁ দিকে মাঠের মধ্যে একটা পুকুরের পাড়ের আমবাগানের মধ্যে দাঁড়াইয়া একটি মেয়ে। বিশ্বনাথ আবার প্রশ্ন করিলকে? বহুকালের প্রাচীন গাছগুলি বাগানটার নিচের দিকটা ঘন ছায়ায় প্রায় অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। তাহার উপর একটা নিচু গাছের ডালের আড়ালে মেয়েটির মুখের আধখানা আড়াল পড়িয়া গিয়াছে, চেনা যাইতেছে না। বাগানের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা। বিশ্বনাথ বলিল-দুৰ্গা! –আজ্ঞে। –এখানে? –এসেছিলাম মাঠের পানে। দেখলাম আপনি যাচ্ছেন। –হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। —একবারে দেশ-ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আপুনি? বিশ্বনাথ দুর্গার মুখের দিকে চাহিল। দুর্গার মুখে বিষণ্ণতার ছায়া পড়িয়াছে। বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিল–দরকার হলেই আসব আবার। দুর্গা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হাসিল। বলিল এব টা পেনাম করে নিই আপনাকে। আপনি তো এখানকার বিপদ-আপদ ছাড়া আসবেন না। তার আগে যদি মরেই যাই আমি! সে আজ অনেকদিন পর খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে প্রণাম করিল খানিকটা সমপূর্ণ দূরত্ব রাখিয়া। বিশ্বনাথ হাসিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া আশীৰ্বাদ জানাইয়া বলিল-আমি জাতটাত মানি না রে! আমার পায়ে হাত দিতে তোর এত ভয় কেন? দুর্গা এবার বিশ্বনাথের পায়ে হাত দিল। প্রণাম সারিয়া উঠিয়া হাসিয়া বলিলজাত ক্যানে মানেন না ঠাকুর মশায়? এখানে এক নজরবন্দি বাবু ছিলেন তিনিও মানতেন না। বলতেন আমার খাবার জলটা না-হয় তুমিই এনে দিয়ো দুগ্‌গা। বিশ্বনাথও হাসিল, বলিল—আমার তো এখন পায় নি দুর্গা। নাহলে তোকেই বলতাম আমি এইখানে দাঁড়াই তুই এক গেলাস জল এনে দে আমায়! দুর্গা আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল—তবে না-হয় আমাকে নিয়ে চলেন। আপনার সঙ্গে। আপনার ঝিয়ের কাজ করব। ঘরদোর পরিষ্কার করব, আপনার সেবা করব। বিশ্বনাথ বলিল-আমার যে ঘরদোর নেই। এখানকার ঘরই পড়ে থাকল। তার চেয়ে এখানেই থাক্ তুই। আবার যখন আসবতোর কাছে জল চেয়ে খেয়ে যাব। বিশ্বনাথ চলিয়া গেল; দুর্গা একটু বিষণ্ণ হাসি মুখে মাখিয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। দেবু চুপ করিয়া বসিয়া আছে। বিশ্বনাথ চলিয়া যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ সে পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তারপর একটা
false
MZI
হলে সেটা বিশেষ বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে লিখতে হতো। সেই চিহ্নগুলো মানুষ মনে রাখত, সেটা দেখে তারা বলতে পারত কী লেখা আছে। সব শিশুকেই তার জীবনের শুরুতে লেখা আর পড়া ব্যাপারটা শিখতে হতো। সেটা শেখার পর তারা জ্ঞান অর্জন শুরু করতে পারত। কী আশ্চর্য! রুহান অবাক হয়ে বলল, কী জটিল একটা প্রক্রিয়া। হ্যাঁ। এখন ক্রিস্টাল রিডারে চাপ দিলেই কথা! ছবি ও ভিডিও বের হয়ে আসে। আগে সেটা ছিল না। আগে যে চিহ্নগুলো দেখে মানুষ পড়তো, সেই চিহ্নগুলোর নাম ছিল বর্ণমালা বা এলফাবেট। কী আশ্চর্য! রুহান মাথা নেড়ে বলল, তুমি এত কিছু কেমন করে জান? বৃদ্ধ কুরু হেসে বলল, আমি বুড়ো মানুষ। আমার তো কোনো কাজকর্ম নেই, আমি তাই বসে বসে আমার ক্রিস্টালগুলো দেখি! প্রাচীন কালে মানুষ কী করত তা আমার জানতে বড় ভালো লাগে। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও এগুলো খুব জানার ইচ্ছে করে। এক সময় এসে তোমার ক্রিস্টালগুলো দেখে যাব এসব জানার অনেক সময় পাবে রুহান। এখন গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এসব শেখ। চিকিৎসা বিজ্ঞান শেখ-যখন আমার মতো বুড়ো হবে তখন অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি বুড়ো হতে হতে যদি সব ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হয়ে যায়, তখন? বৃদ্ধ কুরু হাত দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে বলল, দোহাই তোমার! এন্ড্রোমিডার দোহাই, এরকম ভয়ঙ্কর কথা বলো না। আমার ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হবার আগে যেন আমার মৃত্যু ঘটে। তোমার মৃত্যু হলে তুমি বেঁচে যাবে। কিন্তু আমাদের কী হবে? বৃদ্ধ কুরু মাথা নেড়ে বলল, এই মন খারাপ আলোচনা থাকুক রুহান। তার চাইতে বলো তুমি কী খাবে? আমার কাছে খুব ভালো স্নায়ু উত্তেজক একটা পানীয় আছে। রুহান হেসে বলল, আমার স্নায়ু এমনিতেই অনেক উত্তেজিত। স্নায়ু শীতল করার কোনো পানীয় থাকলে আমাকে দাও। বৃদ্ধ কুরু রান্নাঘরের শীতল কক্ষ থেকে একটা পানীয়ের বোতল বের করে দুটি স্বচ্ছ গ্লাসে সেটা ঢালতে ঢালতে বলল, স্নায়ুকে শীতল করে লাভ নেই। জোয়ান বয়সের ছেলে-মেয়ের স্নায়ু বুড়োদের মতো শীতল হবে কেন? তোমাদের স্নায়ুতে সবসময়েই থাকবে উত্তেজনা। একেবারে টান টান উত্তেজনা! রুহান তার গ্লাসটি হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিতেই সারা শরীরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বুকের ভেতর চেপে থাকা দুর্ভাবনাগুলো কেটে মাথার ভেতরে ফুরফুরে এক ধরনের আনন্দ এসে ভর করে। সে জিব দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, চমক্কার পানীয় কুরু। হ্যাঁ। খুব চমৎকার! এই পানীয় এমনি এমনি খেতে হয় না। চমক্কার একটা সঙ্গীত শুনতে শুনতে এটি খেতে হয়। প্রাচীন একটা সঙ্গীত। রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, শোনাবে কুরু? কেন শোনাব না? তুমি হাট্টা কাট্টা জোয়ান একটা মানুষ, এই বুড়ো মানুষের ঘরে এসেছ, বুড়ো মানুষের প্রাচীন একটা সঙ্গীত তোমাকে তো শুনতেই হবে। বৃদ্ধ কুরু উঠে গিয়ে শেলফে রাখা ক্রিস্টাল রিডারের কাছে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় একটা নির্দেশ দিতেই ঘরের ভেতরে হালকা নীল আলোর একটা বিচ্ছুরণ হলো এবং পর মুহূর্তে ঘরের কোণায় ত্রিমাত্রিক একটা কিশোরী মেয়েকে দেখা গেল। হলোগ্রাফিতে মেয়েটিকে একটি জীবন্ত রূপ দেয়া হয়েছে, সেই রূপটি এত নিখুঁত যে দেখে মনে হয় মেয়েটিকে বুঝি স্পর্শ করা যাবে। কিশোরী মেয়েটি এদিক সেদিক তাকিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলে, শরতের এই সন্ধ্যেবেলায় তুমি কেমন আছ কুরু? মেয়েটি সত্যি নয়, এটি শুধুমাত্র একটি হলোগ্রাফিক ছবি, কিন্তু সেটি এত জীবন্ত যে তার সাথে সত্যিকারের মানুষের মতো কথা না বলে উপায় নেই। বৃদ্ধ কুরু তাই নরম গলায় বলল, আমি ভালোই আছি মেয়ে। আমাকে একটা প্রাচীন গান শোনাতে পারবে? প্রাচীন? কত প্রাচীন? এবারে রুহান উত্তর দিল। বলল, প্রাচীন। অনেক প্রাচীন। মানুষ যখন যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে নি, একে অন্যকে মারা শুরু করে নি সেই সময়কার গান। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, সেরকম গান তো একটি দুটি নয়, অসংখ্য। তোমাকে আরো নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। রুহান বলল, ঠিক আছে, বলছি। সেই গানে নদী আর নদীর ঢেউয়ের কথা থাকতে হবে। আকাশ ভরা কালো মেঘের কথা থাকতে হবে। একটা মেয়ে আর একটা ছেলের ভালোবাসার কথা থাকতে হবে। বিরহের কথা থাকতে হবে- আরো কিছু? হ্যাঁ। যে গান শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকবে সেরকম একটা গান। মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলল, চমৎকার! প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ঢোকাতে হবে। কুরু শেলফের ডালা খুলে প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরে হলোগ্রাফের কিশোরী মেয়েটি আবছা হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে আর প্রায় সাথে সাথে সারা ঘরে বিষণ্ণ একটা সুর বেজে ওঠে। বহুদূর থেকে কোনো একজন একাকী নারীর করুণ কণ্ঠ শোনা যায়। সেই কণ্ঠে একই সাথে ভালোবাসা এবং বেদনা। আনন্দ এবং যন্ত্রণা। রুহান তার হাতের পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। রুহান যখন বৃদ্ধ কুরুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো তখন বেশ রাত। আকাশে একটা ভাঙ্গা চাঁদ, চারিদিকে তার নরম জ্যোৎস্নার আলো। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে এবং মাঝে মাঝে দূর বনাঞ্চল থেকে রাত জাগা পশুর ডাক শোনা যাচ্ছে। রুহান হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করে শরতের শুরুতেই বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। জ্যাকেটের কলার একটু উপরে তুলে সে হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। একটু আগে শুনে আসা প্রাচীন
false
humayun_ahmed
‘হ্যাঁ।’ ‘কী আশ্চার্য, কখন জাগলে?’ ‘অনেকক্ষণ। তুমি বাথরুমে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে।’ ‘আমাকে ডাকলে কেন?’ আনিস সিগারেট টানতে লাগল। রানু বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে কেন?’ ‘গরম কোথায়? বেশ ঠাণ্ডা তো!’ ‘আমার গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড় না।’ ‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্যান ছাড়ব কি, কী যে বল!’ রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি যখন বাথরুমে ছিলে তখন কি নূপুরের শব্দ শুনেছ?’ আনিস ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘না তো কেন?’ ‘না, এমনি। আমি শুয়ে-শুয়ে শুনছিলাম।’ ‘ঘুমাও রানু।’ ‘আমার ঘুম আসছে না।’ ‘ঘুম না এলে উঠে বস, গল্প করি। চা খাওয়া যেতে পারে, কি বল?’ রানু উঠে বসল, কিন্তু জবাব দিল না। আনিস দেখল রানু কোন ফাঁকে গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। তুমি আমার দিকে তাকিও না, প্লীজ।’ ‘এইসব কী রানু? ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে আছে।’ ‘কী করব, বড্ড গরম লাগছে। তুমি বরং রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে সব অন্ধকার করে দাও।’ ‘না, বাতি জ্বালানো থাক।’ ‘আনিস দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। রানু বলল, ‘আমাদের গ্রামে একটা মন্দির আছে, তার গল্প এখন শুনব না।’ ‘আহ্‌, মন্দির-ফন্দিরের গল্প এখন শুনব না।’ ‘আহ্‌, শোন না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন খুব ছোট, তখন একা-একা যেতাম সেখানে।’ ‘কি মন্দির? কালীমন্দির?’ ‘নাহ্‌, বিষ্ণূমন্দির বলত ওরা।তবে কোনো বিষ্ণূমুর্তি ছিল না। একটি দেবী ছিল। হিন্দুরা বলত রুকমিনী দেবী।’ ‘তুমি মন্দিরে যেতে কী জন্যে?’ ‘এমনি যেতাম। ছোট বাচ্চা পুতুল খেলে না?’ ‘কী করতে সেখানে?’ ‘দেবীমূর্তির সাথে গল্পগুজব করতাম। ছেলেমানুষি খেলা আর কি!’ বলতে-বলতে রানু খিলখিল করে হেসে উঠল। আনিস স্পষ্ট শুনল সঙ্গে-সঙ্গে ঝমঝম করে কোথাও নুপুর বাজছে। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’ ‘কী শুনব?’ ‘নূপুরের শব্দ শুনছ না?’ আনিস দৃঢ় স্বরে বলল, ‘না। তুমি ঘুমাও রানু।’ ‘আমার ঘুম আসছে না।’ ‘শুয়ে থাক। তুমি অসুস্থ।’ ‘রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি অসুস্থ।’ ‘তোমাকে খুব বড় ডাক্তার দেখাব আমি।’ ‘আচ্ছা।’ ‘এখন শুয়ে থাক।’ রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি ঐ দেবীকে গান গেয়ে শোনাতাম।’ ‘ঐ সব অন্য দিন শুনব।’ ‘আজ রাতে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।’ আনিস এসে রানুর হাত ধরল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আনিস অবাক হয়ে বলর, ‘তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে!’ ‘হুঁ, বড্ড গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড়বে?’ আনিস উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। ঘর ভর্তি হয়ে গেল ফুলের গন্ধে। আর তখনি রানু অত্যন্ত নিচু গলায় গুনগুন করে কী যেন গাইতে লাগল। অদ্ভুত অপার্থিব কোনো-একটা সুর-যা এ জগতের কিছু নয়। অন্য কোনো ভূবনের। রান্নাঘর থেকে জিতু ডাকতে লাগল, ‘ও ভাইজান, ভাইজান।’ আনিস রানুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল। জিতুকে বলল, এ ঘরে যেন না আসে। তারপর নেমে গেল নিচে, বাড়িঅলার মেয়েটিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে। নীলু এল সঙ্গে সঙ্গে। আনিস দেখল রানু শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে। জিতু মিয়া শুধু জেগে আছে। কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে। নীলুর সঙ্গে তার বাবাও আসছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হয়েছেটা কি?’ আনিস ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না, কেমন যেন করছে।’ ‘কী করছে?‘ আনিস জবাব দিল না। নীলু বলল, ‘বাবা, তুমি শুয়ে থাক গিয়ে, আমি এখানে থাকি। রাত তো বেশি নেই।’ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন,‘হাসপাতালে নিতে হলে বলবেন, ড্রাইভারকে ডেকে তুলব।’ ‘জি আচ্ছা।’ রানু বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। একবারও জাগল না। নীলু সারাক্ষণ তার পাশে রইল। আনিসের সঙ্গে তার কথাবার্তা কিছু হলো না। আনিস বসার ঘরের সোফায় বসে ঝিমুতে লাগল। ১৩ মিসির আলি লোকটির ধের্য প্রায় সীমাহীন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি দ্বিতীয় দফায় রানুদের গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে প্রত্নতও্ব বিভাগের এক ভদ্রলোক, জয়নাল সাহেব। উদ্দেশ্য রুকমিনী দেবীর মন্দির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। জয়নাল সাহেব মন্দির দেখে বিশেষ উল্লসিত হলেন না। তিন শ’ বৎসরের বেশি এর বয়স হবে না। এরকম ভগ্নস্তূপ এ দেশে অসংখ্য আছে। মিসির আলি বললেন, ‘তেমন পুরোনো নয় বলেছেন?’ ‘না রে ভাই। ইটের সাইজ দেখলেন বুঝবেন। ভেঙে-টেঙে কী অবস্থা হয়েছে দেখেন!’ ‘যত্ন হয় নি। মন্দির যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি হয়তো মারা গেছেন কিংবা তাঁর উৎসাহ মিইয়ে গেছে।’ গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া গেল-পালবাবুদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। পালরা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরপরই তাদের ভাগ্য-বিপর্যয় শুরু হয়। তিন-চার বছরের মধ্যে পালরা নির্বংশ হয়ে পড়ে। দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তখন এক রাতে কুমারীকন্যাকে অমাবস্যা রাত্রিতে মন্দিরের সামনে বলি দেয়া হয়। দেবীর তুষ্টি হয় না তাতেও। পাথরের মূর্তি এত সহজে বোধহয় তুষ্ট হয় না। তবে গ্রামের মানুষেরা নাকি বলি দেয়া মেয়েটিকে এর পর থেকে গ্রামময় ছুটোছুটি করতে দেখে। ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজ পুলিশ সুপার এসে মন্দির তালাবন্ধ করে পালদের দুই ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। পালরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিল। কাজেই ছাড়া পেয়ে এক সময় আবার গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু মন্দির তালাবন্ধই পড়ে থাকে। ইতিহাস এইটুকুই। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুই-এক ঘর নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা ছিল, তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। হরিশ মণ্ডল বলল, ‘বাবু, আমার কেউ ঐ দিকে যাই না। ঐ মন্দিরে গেলে নির্বংশ হতে হয়, কে যাবে বলেন?’ ‘আপনি তো শিক্ষক
false
humayun_ahmed
আছি? ঠাট্টা তামাশা একটুও পারি না এখন। টাকাটা আমি তোকে দিলাম খোকা। আমার আর দেবার মতো কী আছে বল? তোর খুব ধনী হওয়ার শখ ছিল। সেই শখ মেটাতে পারছি বলে ভারি আনন্দ হচ্ছে। খুব যখন ছোট ছিল, তখন এক বার ফুটবল কেনার শখ হল তোর। মার কাছে সাহস করে তো কিছু চাইতি না। আমাকে এসে বললি কানে কানে। আমি টাকা পাব কোথায়? যা কষ্ট লাগল। এখন পর্যন্ত বাচ্চা ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখলে বুক ব্যথায় টনটন করে। তোর নিশ্চয়ই মনে নেই সে-সব। সোনা ভাই আমার, এ টাকাটা সমস্তই তোর, যে ভাবে ইচ্ছে খরচ কারিস। নিনু, ঝুনু, মন্টু আর বাবাকে ভাগ করে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু তাদেরকে দেওয়া আর তোকে দেওয়া একই—ভেবে দিই নি। কোত্থেকে পেয়েছি? তুই কি ভাবছিস আগে বল। না রে, চুরি করি নি। আমাকে কেউ ভিক্ষেও দেয় নি। এ আমার নিজের টাকা। মীর কথা সময় হলে তোকে বলব বলেছিলাম না? এখন বলছি, তাহলেই বুঝাবি কী করে কী হয়েছে। বাবার সঙ্গে বিয়ের আগে তাঁর আবিদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের একটি মেয়েও হয়েছিল। ছাড়াছড়ি হয়ে যায়। কী জন্যে, তা তোর জানার দরকার নেই। বাবা মাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন পরপরই। বুঝতেই পারছিস আমি হচ্ছি। সেই মেয়ে। খুব অবাক, না? আমার সেই বাবা ভদ্রলোক এত দিন ঢাকাতেই ছিলেন। সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে কিছুদিন হল বাইরে চলে গেছেন। যাবার আগে এই টাকাটা দিয়ে গেছেন। আমাকে। সেই লোকটিও ভালো ছিল রে। আসত। প্রায়ই আমাদের বাসায়। দেখিস নি কোনো দিন? নীল রঙের কোট পরীত, গলায় টকটকে লাল রঙা টাই। আমাকে ডাকত ইমা বলে। গল্পের মতো লাগে, না? এগার বছর বয়স থেকেই আমি জানি সব। কেমন লাগে। তখন বলা তো? তোদের যিনি বাবা, আমি নিজে তাঁকে বাবা বলেই ভেবেছি, আর তিনি একটুও বুঝতে দেন নি কিছু। সেই যে একবার কলেজে আমাকে মা কালী ডাকল। তোরা সবাই দুঃখিত হলি। বাবা কী করলেন বল তো? তিনি রাতের বেলা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন বারান্দায়। ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে মা, রখ তো এটা। কি বাবা? না ইয়ে, একটা ক্ৰীম, খুব ভালো, বিশ টাকা দাম। তাকিয়ে দেখি চ্যাপ্টা মুখের বোতল একটা মুখের উপর লেখা . চোখে পানি এসে গেল আমার। সেই কৌটাটা এখনো আছে আমার কাছে, ভারি মূল্যবান সেটি। যেন বাবা বিশ টাকায় এক কৌটা। ভালোবাসা কিনে এনেছেন। জন্মে জন্মে এমন লোককেই বাবা হিসেবে পেতে চাই আমি। মানুষ তো কখনো খুব বেশি কিছু চায় না, আমি নিজেও চাই নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, না চাইতেই তো অনেক পেয়েছি। কিটকি ভুল করল। কী করবি বল? ভুলে যেতে বলি না। ভুলবি কেন? রুনুকে কি আমরা ভুলতে পারি, না ভোলা উচিত? কিটকি ভারি ভালোমানুষ। মেয়েটি যেন সুখী হয়। এখনো তো তার বয়স হয় নি, বুঝতেও শেখে নি কিছু। কষ্ট লাগে ভেবে। মার কথা তোর মনে পড়ে খোকা? চেহারা মনে করতে পারিস? আমি কিন্তু পারি না। স্বপ্নেও দেখি না বহু দিন। খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। জানি, মারি প্রতি তোদের সবার একটা অভিমান আছে। তোদের ধারণা, মা কাউকে ভালোবাসতে পারে নি। হয়তো সত্যি, হয়তো সত্যি নয়। ছোটখালা এক দিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, শিরিন, তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের একটুও দেখতে পার না! মা জবাবে হেসে বলেছেন, এদের এমন করে তৈরি করে দিচ্ছি, যাতে ভালোবাসার অভাবে কখনো কষ্ট না পায়। মা বড় দুঃখী ছিল রে খোকা মেয়েমানুষের দুঃখ তো বলে বেড়াবার নয়, ঢেকে রাখবার, চিরদিন তিনি তাই রেখে গেছেন। তোরা জানতেও পারিস নি। এত গানপাগল মা তেইশ বছরে একটি গানও গাইল না। প্রথম স্বামীকে ভুলতে পারে নি। যদি পারত, তবে জানত সুখের স্বাদ কত তীব্র। যাই হোক, যা চলে গেছে তা গেছে। যারা বেচে আছে তাদের কথাই ভাবি। কিছুক্ষণ আগে নিচে ঘণ্টা দিয়েছে, খেতে যাবার সংকেত। আমার খাবার ঘরেই দিয়ে যায়। তবু নিচে গিয়ে এক বার দেখে আসি। আজ আর খাব না। শরীরটা ভালো নেই। একটু যেন জ্বরঙ্গুল লাগছে। মাঝে মাঝে অসুখ হলে মন্দ লাগে না। অসুখ হলেই অনেক ধরনের চিন্তা আসে, যেগুলি অন্য সময় আসে না। হোস্টেলের খুব কাছ দিয়ে নদী বয়ে থিয়েছে। সুন্দর নাম। এই মুহুর্তে মনে আসছে না। রাতের বেলা সার্চলাইট ফেলে ফেলে লঞ্চ যায়, বেশ লাগে দেখতে। দেখতে পাচ্ছি লঞ্চ যাচ্ছে আলো ফেলে। তোরা ঢাকায় থেকে তো এ-সব দেখবি না। আজ এই পর্যন্ত থাকে। শরীরের দিকে লক্ষ রাখিস। বাজে সিগারেট টানবি না। কম খাবি, কিন্তু দামী হতে হবে। টাকার ভাবনা তো নেই। ছোটবেলা চুমু খেতাম তোর কপালে, এখন তো বড়ো হয়ে গেছিস। তবু দূর থেকে চুমু খাচ্ছি। তোর, রাবেয়া আপা। ঠিকানাঃ সুপারিনটেনডেন্ট, গার্লস হোস্ট্রেল আদর্শ হাইকুল পোঃ আঃ কলসহাটি জেলা-ময়মনসিংহ। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় প্রায়ই। ছাড়া ছাড়া অর্থহীন স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ জেগে উঠি। পরিচিত বিছানায় শুয়ে আছি, এই ধারণা মনে আসতেও সময় লাগে। মাথার কাছের জানালা মনে হয় সরে গিয়েছে পায়ের কাছে। তৃষ্ণা বোধ হয়। টেবিলে ঢাকা-দেওয়া পানির গ্লাস। হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেই হয়, অথচ ইচ্ছে হয় না! কোনো কোনো রাতে অপূর্ব জোছনা হয়। সারা ঘর নরম আলোয় ভাসতে থাকে। ভাবি, একা একা বেড়ালে
false
shordindu
করবেন‌, আপনার স্ত্রী‌, মানে সদানন্দবাবুর ভগ্নী কি এখানে আছেন?’ দেখিলাম আমার প্রশ্নের উত্তর দিবার আগে প্রাণকেষ্টবাবুর চক্ষু দু’টি আমার মুখ ছাড়িয়া আমার পিছন দিকে চলিয়া গেল এবং তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিল। ‘হ্যাঁ–আছেন।’ আমি পিছনে ঘাড় ফিরাইলাম। অন্দরের পর্দা একটু ফাঁক হইয়া ছিল‌, চকিতে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট হইল। বুঝিতে বাকি রহিল না‌, পর্দার আড়ালে আছেন পত্নী সুশীলা এবং নেপথ্য হইতে প্রাণকেষ্টবাবুকে পরিচালিত করিতেছেন। ‘আপনার স্ত্রী নিশ্চয় খুব শোক পেয়েছেন?’ আবার প্রাণকেষ্টবাবুর চকিতচক্ষু পিছন দিকে গিয়া ফিরিয়া আসিল। ‘হ্যাঁ‌, হ্যাঁ‌, নিশ্চয়‌, খুব শোক পেয়েছেন।’ ‘আপনার স্ত্রী সদানন্দবাবুর উত্তরাধিকারিণী? ‘তা–তা তো জানি না। মানে–’ ‘সদানন্দবাবুর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’ ‘হ্যাঁ‌, হ্যাঁ‌, খুব সদ্ভাব ছিল।’ ‘যাওয়া-আসা ছিল?’ ‘তা ছিল বৈকি! মানে–’ তাঁহার চক্ষু আবার পদার পানে ধাবিত হইল‌, ‘অ্যা-মানে—বেশি যাওয়া-আসা ছিল না। কালেভদ্ৰে—’ ‘শেষ কবে দেখা হয়েছে?’ ‘শেষ? অ্যাঁ–ঠিক মনে পড়ছে না–’ ‘দশ-বারো দিন আগে তিনি আপনার বাসায় আসেননি?’ প্রাণকেষ্টবাবুর চক্ষু দু’টি ভয়ার্ত হইয়া উঠিল‌, ‘কৈ না তো! ‘ ‘তিনি কলকাতা যাবার আগে আপনার কাছে একটা স্টীলের ট্রাঙ্ক রেখে যাননি? প্রাণকেষ্টবাবুর দেহ কাঁপিয়া উঠিল‌, ‘না‌, না‌, স্টীলের ট্রাঙ্ক-না না‌, কৈ আমি তো কিছু—’ আমি কড়া সুরে বলিলাম‌, আপনি এত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কেন? ‘নার্ভাস! না না।–’ পর্দা সরাইয়া প্রাণকেষ্টবাবুর স্ত্রী প্রবেশ করিলেন। স্বামীর চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, ‘আমার স্বামী নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ, অচেনা লোক দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে পড়েন। আপনি কি জানতে চান আমাকে বলুন।’ মহিলাকে দেখিলাম। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, দৃঢ়গঠিত দেহ, চোয়ালের হাড় মজবুত, চোখের দৃষ্টি প্রখর। মুখমণ্ডলে ভ্ৰাতৃশোকের কোনও চিহ্নই নাই। তিনি যে অতি জবরদস্ত মহিলা তাহা বুঝিতে তিলার্ধ বিলম্ব হইল না। আমি উঠিয়া পড়িলাম‌, ‘আমার যা জানবার ছিল জেনেছি‌, আর কিছু জানবার নেই। নমস্কার।’ শ্ৰীমতী সুশীলাকে জেরা করা আমার কর্ম নয়। স্টেশনে গিয়া জানিতে পারিলাম‌, ন’টার আগে ফিরিবার ট্রেন নাই। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা কাটাইবার জন্য স্টেশনের স্টলে চা খাইলাম‌, অসংখ্য সিগারেট পোড়াইয়া প্ল্যাটফর্মে পাদচারণ করিলাম‌, এবং সস্ত্রীক প্রাণকেষ্টবাবুর কথা চিন্তা করিলাম। প্ৰাণকেষ্ট পাল নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ হইতে পারেন; কিন্তু তিনি যে আমাকে দেখিয়া এত বেশি নার্ভাস হইয়া পড়িয়াছিলেন তাহা কেবল ধাতুগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা নয়‌, অন্য কারণও আছে। কী সে কারণ? প্ৰাণকেষ্ট পত্নীর ইশারায় আমার কাছে অনেকগুলা মিথ্যাকথা বলিয়াছিলেন। কী সে মিথ্যাকথা? সদানন্দ সুরের সহিত বেশি সম্প্ৰীতি না থাক‌, সদানন্দ সুর তাঁহার বাড়িতে যাতায়াত করিতেন। দশ-বারো দিন আগে কলিকাতায় যাইবার মুখে তিনি স্টীলের ট্রাঙ্কটি নিশ্চয় ভগিনীপতির গৃহে রাখিয়া গিয়াছিলেন। ট্রাঙ্কে নিশ্চয় কোনও মূল্যবান দ্রব্য ছিল। কী মূল্যবান দ্রব্য ছিল? টাকাকড়ি? গহনা? বোমাবারুদ? আন্দাজ করা শক্ত। কিন্তু শ্ৰীমতী সুশীলা বাক্সে কী আছে জানিবার কৌতুহল সংবরণ করিতে পারেন নাই‌, হয়তো তালা ভাঙিয়াছিলেন। তাঁহার মত জবরদস্ত মহিলার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তারপর? তারপর হয়তো ট্রাঙ্কে এমন কিছু পাওয়া গেল যে সদানন্দ সুরকে খুন করা প্রয়োজন হইল। হয়তো ট্রাঙ্কে হ্যান্ড-গ্রিনেড ছিল‌, সেই হ্যান্ড-গ্রিনেড দিয়াই সদানন্দকে– কিন্তু না। শ্ৰীমতী সুশীলা যত দুর্ধর্ষ মহিলাই হোন‌, নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে খুন করিবেন? আর প্রাণকেষ্ট পালের পক্ষে এরূপ দুঃসাহসিক কার্যে লিপ্ত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। …কিন্তু স্টেশনমাস্টার হরিবিলাসবাবু বন্ধুকে অশুভ সংবাদটা সাত-তাড়াতাড়ি দিতে গেলেন কেন? বন্ধুসুলভ সহানুভূতি?… সাড়ে ন’টার সময় সান্তালগোলায় ফিরিলাম। আকাশে চাঁদ আছে‌, শহর-বাজার নিযুতি হইয়া গিয়াছে। ভাবিয়ছিলাম বিশ্রান্তি গৃহে আসিয়া দেখিব ব্যোমকেশ ফিরিয়াছে। কিন্তু তাহার দেখা নাই। কোথায় গেল সে? বিশ্রান্তিগৃহের চাকরটা রন্ধন শেষ করিয়া বারান্দায় বসিয়া ঢুলিতেছিল‌, তাহাকে খাবার ঢাকা দিয়া গৃহে ফিরিয়া যাইতে বলিলাম। সে চলিয়া গেল। কেরোসিনের বাতি কমাইয়া দিয়া বিছানায় অঙ্গ প্রসারিত করিলাম। পিছনের জানোলা দিয়া চাঁদের আলো আসিতেছে। …কোথায় গেল ব্যোমকেশ? বলা নাই কহা নাই ট্রেন হইতে নামিয়া চলিয়া গেল। বাঘামারি গ্রামে তার কী কাজ? এতক্ষণ সেখানে কী করিতেছে? ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলাম; ঘুম ভাঙিল। কানের কাছে ব্যোমকেশের ফিসফিস গলার শব্দে‌, ‘অজিত‌, ওঠে‌, একটা জিনিস দেখবে এস।’ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম‌, ‘কী-?’ ‘চুপ! আস্তে!’ ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া আমাকে বিছানা হইতে নামাইল‌, তারপর পিছনের জানালার দিকে টানিয়া লইয়া গেল; বাহিরের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল‌, ‘দেখছ?’ ঘুমের ঘোর তখনও ভালো করিয়া কাটে নাই‌, ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী দেখিয়া মনে হইয়াছিল না জানি কী দেখিব! কিন্তু যাহা দেখিলাম তাহাতে বোকার মত চাহিয়া রহিলাম। জানালা হইতে পনেরো-কুড়ি হাত দূরে ঝোপঝাড় আগাছার মাঝখানে খানিকটা মুক্ত স্থান‌, সেইখানে ছয়-সাতটা কৃষ্ণবৰ্ণ জন্তু অর্ধবৃত্তাকারে বসিয়া ঘাড় উচু করিয়া চাঁদের পানে চাহিয়া আছে। প্রথম দর্শনে মনে হইল কৃষ্ণকায় কয়েকটা কুকুর। বলিলাম‌, ‘কালো কুকুর।’ কিন্তু পরীক্ষণেই যখন তাহারা সমস্বরে হুক্কা-হুয়া করিয়া উঠিল‌, তখন আর সংশয় রহিল না। স্থানীয় শৃগালের দল চন্দ্রালোকে সঙ্গীত-সভা আহ্বান করিয়াছে। আমার মুখের ভাব দেখিয়া ব্যোমকেশ হো-হো শব্দে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। শৃগালের দল চমকিয়া পলায়ন করিল। আমি বলিলাম‌, ‘এর মানে? দুপুর রাত্রে আমাকে শেয়াল দেখাবার কী দরকার ছিল?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আগে কখনও চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখেছ?’ ‘চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখলে কী হয়?’ ‘পুণ্য হয়‌, অজ্ঞান তিমির নাশ হয়! আমার মনে যেটুকু সংশয় ছিল তা এবার দূর হয়েছে। চলো এখন খাওয়া যাক‌, পেট চুঁই-চুঁই করছে।’ আলো বাড়াইয়া দিয়া টেবিলে খাইতে বসিলাম। লক্ষ্য করিলাম‌, ব্যোমকেশ ক্ষুধার্তভাবে অন্নগ্ৰাস মুখে পুরিতেছে বটে‌, কিন্তু তাহার মুখ হযোৎফুল্ল। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘এত ফুর্তি কিসের? দুপুর রাত পর্যন্ত ছিলে কোথায়? বাঘমারিতে? সে বলিল‌, ‘বাঘমারির
false
MZI
সকল শক্তি নিয়োগ করেছে তাকে অপমান করার জন্যে। হিলারী ক্লিনটন ঘুরে যাবার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রফেসর ইউনুস সম্পর্কে যে ভাষায় কথাগুলো বলেছেন সেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে আতঙ্ক অনুভব করেছি। সম্মানী মানুষ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বললে তার সম্মানের ক্ষতি হয় না। কিন্তু কথাগুলো বলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তার নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন সেটা দেখে কী দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আতংক হতে পারে না? প্রফেসর ইউনুস আসলেই “রক্তচোষা” “মহাজন” কী না আমি সেই কুতর্ক শুরু করতে চাই না- শুধু বলতে চাই এই দেশে তার তৈরী করা গ্রামীন ব্যাংকের প্রায় এক কোটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয় স্বজন মিলে কয়েক ককোটি মানুষ আছে যাদের সবাই ভোটার। এই দেশের প্রায় সত্তুর আশি লক্ষ মানুষ বিদেশে থাকে তারাও ভোটার (ভোটের সময় তারা আসলে ভোট দিতে পারেন কী না সেটি আবশ্যি ভিন্ন প্রশ্ন)। এই দেশের তরুণেরা প্রায় কয়েক কোটি- তাদের একটা বড় অংশ ভোটার! আমি যে তিনটি দলের মানুষের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকে প্রফেসর ইউনুসকে পছন্দ করেন এবং যখন তাদের অসম্মান করা হয়েছে তারা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছে। যে দল ভোটের রাজনীতি করে সেই দল এক সাথে এতো ভোটারকে এতো দক্ষতার সাথে অন্য কোনোভাবে বিরক্ত করেছে বলে আমার জানা নেই- কী কারণে সেটা করেছে তার কারণটা আমি এখনো জানি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনুসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা না করে তাঁকে যদি তার অফিসে সুধুমাত্র একবার চা খেতে ডাকতেন তাহলেই এদেশের কতো মানুষের বুকের ভার যে লাঘব হতো সেটা কী তারা জানেন? বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লক্ষ আদিবাসী রয়েছে (মতান্তরে ৪০ লক্ষ)। তবে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার হঠাৎ করে একদিন ঠিক করেছে তাদেরকে আর আদিবাসী বলা যাবে না, তাদেরকে উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠী বা এই ধরণের আরো কঠিন এবং অসম্মানজনক কিছূ বলতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সিদ্বান্ত নিয়েছে সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। লোকমুখে শুনেছি এই সিদ্বান্তের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একটা চাপ রয়েছে, জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরীতে সেনাবাহিনী যেতে পারবে কী পারবে না এই নামকরেণের সাথে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের মানুষজনের সাথে এ ব্যাপারে নিরিবিলি কথা বলার ষেষ্টা করলে তার ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক শুরু করে দেন- কিন্তু এতোদিন কেন তাহলে তাদের আদিবাসী বলা হল, হঠাৎ করে কেন আর তাদের আদিবাসী বলা যাবে না সেটা ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। কেনো একটা কিছু বোঝাতে যখন একটা শব্দ ব্যবহার করা রেওয়াজ হয়ে যায় তখন সেটাই যে প্রচলিত হয়ে যায় এই সোজা কথাটা কে বোঝাবে? কিছুদিন আগে আমার চোখে একটা সরকারী সার্কুলারের অনুলিপি চোখে পড়েছে যেখানে বলা হয়েছে আগস্ট মাসকে শোকের মাস দেখিয়ে আদিবাসী দিবসকে উদযাপন করতে যেন সব মহলকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডকে এরকম কূটকৌশলে একটা হীন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! যাই হোক, যে সরকারকে ভোটে জিতে আসতে হবে তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে, চল্লিশ লক্ষ আদিবাসী অন্ততপক্ষে বিশ লক্ষ ভোটার! এতোগুলো ভোটারকে এতো অবলীলায় ক্ষুব্ধ করে তোলার উদাহরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে? একসাথে দেশের অনেক মানুষকে ক্ষুদ্ধ করে তোলার আরেকটা সহজ উপায় কী হতে পারে? সেটা হচ্ছে ঈদে যেন মানুষজন তাদের বাড়ীতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দেয়া। এই সরকারের আমলে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ঈদের আগে আগে দেখা গেল রাস্তাঘাটের অবস্থা এতো খারাপ যে সেই পথে কোনো বাস যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পাই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে নানা ধরণের উড়াল সেতু ফ্লাইওভার তৈরী হচ্ছে, একটি নয় দুই দুইটি পদ্মা সেতু তৈরী নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আলোচনা হচ্ছে (তার প্রস্তুতির জন্যে নিশ্চয়ই এর মাঝে কয়েকশত কোটি টাকা খরচ পর্যন্ত হয়ে গেছে) কিন্তু সাধারণ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ী যেতে পারছে না- এর চাইতে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন কাজেই রসিক বাঙ্গালী এখন ভাঙ্গাচোরা বেহাল রাস্তাঘাট বোঝানোর জন্যে বলে “আবুলী রাস্তা”! ডিকশনারীতে একটা নূতন শব্দ যোগ করে আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো একটু সমৃদ্ধ হল কিন্তু ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হল কী? বিষয়টা আরো গুরুতর হয়ে গেল যখন দেখা গেল রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্যে টাকার বরাদ্দ আছে কিন্তু সেই টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্যে কারো গরজ নেই। কারণটা বোঝার জন্যে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না- দেশের ভেতরকার রাস্তাঘাট তৈরীতে পয়সা কড়ি নেই, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, বড় বড় পদ্মা সেতুতে অনেক টাকা পয়সা। কাজেই উৎসাহটা সেখানেই বেশী। সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ অনেকদিন থেকে আলোচনার মাঝে রয়েছেন। আমাদের দেশের দূর্নীতির খবর সাধারণত দেশের ভেতরেই থাকে। আমাদের এই মন্ত্রীর কারণে দূর্নীতির খবরটি মোটামুটিভাবে একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দেশের সরকারের সাথে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হইচই, উইকিলিকস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অত্যন্ত অসম্মানজনক বক্তব্য বের হয়ে আসছে, কানাডার কোর্টে মামলা হয়ে রায়ে বের হচ্ছে যেখানে মন্ত্রী মহোদয়ের ফার্মের সাথে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে, সব মিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ লেজে গোবরে অবস্থা। পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গিয়েছে- যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেংকারীতে এখন তাদের মুখে
false
humayun_ahmed
হলে ভালো হয়। গামাল হাসিম শীতল গলায় বললেন, .-7.62 এবং লাইট মেশিনগান—এ দুয়ের মিলন ভালোই হবে। এদের সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে, দুটিতে একই গুলি ব্যবহার করা যায়। ঠিক আছে, তাই করুন। অ্যামুনিশান কী পরিমাণ চাই? যাদের কাছে থাকবে .-7.62 তারা প্রত্যেকেই দশটি করে ম্যাগজিন পাবে। এ ছাড়াও থাকবে বাড়তি এক শ রাউন্ড গুলি। সেগুলি থাকবে বেনজডালিয়ায় বেন্টে। বেশ, এবার বলুন লাইট মেশিনগানের জন্যে কী পরিমাণ গুলি চান? প্রতিটি সাব-মেশিনগানের সঙ্গে পাঁচ রাউন্ডের চারটি কনটেইনার। এ ছাড়া তিন জন কমান্ডো যে পরিমাণ গুলির বেল্ট নিতে পারে, সে-পরিমাণ বেল্ট। আমার মনে হয় আপনার দলে অন্তত কয়েকটি রকেট লঞ্চার থাকা দরকার। ঠিকই বলেছেন। তিনটি -2 রকেট লঞ্চার। প্রতিটির সঙ্গে চারটি রকেটের একটি প্যাকেট। গ্রেনেড কী পরিমাণ চান? সবার সঙ্গে থাকবে চারটি করে গ্রেনেড। এবং আটচল্লিশ ঘন্টার রসদ। আমেরিকান হেলমেট। আমেরিকান -10 প্যারাশুট। দেওয়া যাবে? নিশ্চয়ই দেওয়া যাবে। আমার মনে হয় অন্তত একটি ভারি অস্ত্র আপনাদের থাকা উচিত। যেমন ধরুন, জার্মানির তৈরি -301. চমৎকার জিনিস! কিংবা ফ্রেঞ্চদের তৈরি ম্যাট মাইন মিলিমিটার। ভারি কিছুই নেওয়া যাবে না। এটা ভারি নয়, ওজন বার পাউন্ড। বিপদে কাজে লাগবে। দুটি অন্তত নিন। ঠিক আছে, দুটি -301. আরেকটি মডেল আছে -308, এর থ্রাস্ট খুব বেশি, তবে ওজনও বেশি। আপনি 301-ই দিন। ঠিক আছে। ফকনার সিগারেট ধরাল মৃদুস্বরে বলল, আপনি ধূমপান করবেন কি? না। কোনো রকম পানীয়? ভালো হুইস্কি আছে। আমি মদ্যপান করি না। আপনার আর কী প্রয়োজন, বলুন। আমার কিছু কেমিক্যাল উইপন্‌স্‌ দরকার। কী জাতীয়? যেমন ধরুন, এমন কোনো বাষ্প, যা অল্প জায়গায় কাজ করে। কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয় বা ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এনিথল জাতীয় বোমা দেওয়া যাবে। বোমা ফাটার পর কাজ শুরু হতে কতক্ষণ লাগবে? পাঁচ থেকে দশ মিনিট। এত সময় নেই আমার হাতে। আরো দ্রুত কাজ করে, এমন কিছু বলুন। সে-সব কেমিক্যাল উইপনস্ ভয়াবহ হবে। নার্ভাস সিস্টেমে কাজ করবে। ঘুম পাড়িয়ে দেবে, কিন্তু সে-ঘুম ভাঙবে না। রাজি আছেন? রাজি আছি। ফকনার বলল, কাগজে লিখে নিলে হত না? আপনার হয়তো মনে থাকবে না। গামাল হাসিম মৃদুস্বরে বললেন, আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ভালো, আপনি ইচ্ছা করলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। পরীক্ষা করে দেখতে চান? না। আমি বিশ্বাস করছি। ফকনার চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগল। গামাল হাসিম বললেন, এখন বলুন, কতদিনের ভেতর চান? দশ দিন। কী বললেন? দশ দিন। অস্ত্ৰগুলি আমাদের ব্যবহার করতে হবে। ওদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। দশ দিনে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার কোনো গুদামঘর নেই। আমাকে সব জিনিস জোগাড় করতে হয়। কত দিনের ভেতর দিতে পারবেন? আমাকে দুমাস সময় দিতে হবে। এর কমে সম্ভব নয়। আমি তো যাদুকর নই মিঃ ফকনার। ফকনার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। গামাল হাসিম বললেন, আমি কি উঠতে পারি? ফকনার বলল, অস্ত্রের জন্যে আপনার যেটাকা পাওনা হবে, আমি তার তিন গুণ টাকা দেব। তিন গুণ কেন, দশ গুণ দিলেও লাভ হবে না। আমি তো আপনাকে বলেছি মিঃ ফকনার, আমি যাদুকর নই। আমি এখন উঠব। এক মিনিট দাঁড়ান। আপনি কি জেনারেল সিমসনকে চেনেন? ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, কিন্তু তাঁকে না-চেনার কোনো কারণ নেই। তাঁকে ভালোই চিনি। তিনি যদি আপনাকে বলেন, দশ দিনের ভেতর মালামাল পৌঁছে দিতে, আপনি কী করবেন? না বলবেন? গামাল হাসিম চুপ করে থাকলেন। ফকনার বলল, জেনারেল সিমসন আজ রাতের মধ্যেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। গামাল হাসিম শীতল স্বরে বললেন, আপনাদের কবে দরকার? দশ দিনের ভেতর দরকার। আগে বেশ কয়েক বার বলেছি। ঠিক আছে, পৌঁছানো হবে। তিন গুণ দাম দিতে হবে। পৌঁছানোর খরচ দিতে হবে। দেওয়া হবে। সব টাকাই দিতে হবে অগ্রিম। দেওয়া হবে। কাল ভোরে কি আপনি একবার আসতে পারবেন? কটায়? ভোর ছটায়। অস্ত্রের তালিকাটি সম্পূর্ণ করব। আপনাকে রাশিয়ান ব্যানানা রাইফেলের নমুনা দেখাব। ঠিক আছে, দেখা হবে ভোর ছটায়। শুভরাত্রি। শুভরাত্রি। পঞ্চাশ জনকে রিক্রুট করার দায়িত্ব পড়েছে বেন ওয়াটসনের ওপর। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল—পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে এবং বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভেতর হতে হবে। কিন্তু উৎসাহীদের বয়সের সীমা দেখা গেল সতের থেকে ষাটের মধ্যে এবং অনেকেরই কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। মাত্র একুশ দিনে এদের তৈরি করাও প্রায় অসম্ভব। জগতের অসম্ভব কাজগুলির প্রতি বেন ওয়াটসনের একটা ঝোঁক আছে। রিক্রুটমেন্ট শুরু হল সকাল থেকে। একেক জন এসে ঢেকে আর বেন তার দিকে প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন কিছুই নয়। শুধু তাকিয়ে থাকা। যাদের পছন্দ হয়, তাদেরকে নিয়ে যায় মাঠে। সেখানে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয় এবং ড্রিল হয়। দ্বিতীয় বাছাইপর্বটি হয় সেখানে। সেটিই চূড়ান্ত বাছাই। নমুনা দেয়া যাক। কী নাম? রিক ব্রেগার। বয়স? তেত্রিশ। মিশনে কেন যেতে চাও? টাকার জন্যে। শুধুই টাকার জন্যে? হ্যাঁ। অ্যাটেনশন। লেফট রাইট, লেফট। লেফট রাইট, লেফট। কুইক মার্চ। লেফট, লেফট। লেফট, লেফট। হল্ট। অ্যাবাউট টার্ন। স্ট্যান্ড এট ইজ। শুধুই টাকার জন্যে যেতে চাও? হ্যাঁ। টাকার এত প্রয়োজন কেন? ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, স্ত্রী আছে। পছন্দমতো কাজকর্ম পাচ্ছি না। নগদ কিছু টাকা। হলে ভালো হবে। গুড। কোন সেকশন? আর্টিলারি। সিলেক্টেড। রাত আটটার মধ্যে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিপোর্ট করবে। ঠিক আছে, স্যার। যাবার আগে কন্ট্রাক্ট ফর্ম সই করবে। মারা গেলে টাকা কে
false
nihar_ronjon_gupta
দশরথের চোখে। যা হোক, সেই কারণেই। কেতু পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার কোন সন্ধানই আর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কারণ কেতু বলে কেউ সত্যই ছিল না সেদিন আর আজও নেই। কিন্তু কে-কে সেই কেতু? অধীরভাবে আবার মধুসূদন সরকারই প্রশ্ন করলেন। বলছি-সবই বলব একে একে। এবারে আমি আসছি হতভাগ্য বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারে। বিজনবাবুকে হত্যাকারী সরিয়েছে তার সম্পত্তিটা হাত করবার জন্য। আর বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারটাই হচ্ছে হত্যাকারীর চরম নৃশংসতা। একটু আগেই আপনাদের আমি বলেছি, ঐ বিজনবাবুর হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী ক্রমশঃ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু কেন? কি ভাবে? এ ধরনের হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছতে হলে প্রধানতঃ তিনটি কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক প্রত্যেকেরই। মোটিভ, প্রবাবিলিটি ও চান্স। প্রথমেই ধরা যাক প্রবাবিলিটি-বিজনবাবু নিহত হবার পরই সর্বপ্রথম যে কথা আমার মনে উদয় হয়েছিল সেটা হচ্ছে বিজনবাবু সিমপ্লি বাই অফ মিসটেক নিহত হয়েছেন কিনা। যে কথাটা সেদিনও কিছুটা আপনাদের সামনে আমি আলোচনা করেছিলাম। অর্থাৎ কোন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশতঃ বিজনবাবুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কিনা। কিন্তু অনেক ভেবেও কোন কূল-কিনারা না পেয়ে শেষে স্থির করলাম, না, ভুল নয়-ইচ্ছা করেই এবং খুনীর প্রয়োজনেই তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিজনবাবু এক চুমুক চা পান করার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলেন। আগেই অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছি আমি, কি ভাবে নিকোটিন বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষ একমাত্র সেক্ষেত্রে মেশাতে পারে কে এবং কার পক্ষে সর্বাপেক্ষা সেটা সম্ভব ছিল তা পরে বিবেচ্য, কিন্তু বর্তমানে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যেভাবে মারা গেলেন সেভাবে আমাদের মধ্যে অন্য কেউই সে সন্ধ্যায় মারা যেতে পারত কিনা। হ্যাঁ, পারত। কিন্তু খুনী এখানে প্রবাবিলিটির উপরে একটা স্রেফ চান্স নিয়েছিল মাত্র সে সন্ধ্যায়। সৌভাগ্যবশতঃ খুনীর সে চান্স ফলে গেল। হি ওয়াজ সাকসেসফুল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিজনবাবুর মৃত্যুর পর-পরের দিন মধুবাবুকে নিয়ে যখন আমি তার আগের সন্ধ্যার অভিনয়টা করি সে সময়ও যদি একবারও ডাঃ অধিকারী—আপনি—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি আমার অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ না বন্ধ করে থাকতেন তো পুওর গোকুলকে ঐভাবে সে রাত্রে প্রাণ দিতে হত না হয়ত। না, না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? আমি-আমি সত্যিই কিছু জানি না। ব্যাকুল কন্ঠে প্রতিবাদ জানালেন ডাঃ অধিকারী। এখনো আপনি সত্যকে ঢাকবার চেষ্টা করছেন ডাঃ অধিকারী—সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী বলে ওঠে কঠিন কণ্ঠে। সেদিন মধুবাবুর অভিনয়কালে ব্যাপারটা সত্য ভেবে যে উদ্বেগ আপনার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, সেটা আর কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখকে ফাকি দিতে পারেনি। শুনুন ডাক্তার-অর্থের লোভই সেদিন আপনার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। বলুন-বুকে হাত দিয়ে আপনি বলুন তো একটা কথা—আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মৃত সারদাবাবুর সঙ্গে তার মৃত্যুর তিনদিন আগে যখন দেখা করতে এই সরকার ভিলাতে এক বেলার জন্য আপনি এসেছিলেন সে সময় ছদ্মবেশী কেতুকে কি আপনি চিনতে পারেন নি? আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারেননি আসলে সে কে? আমি–আমি– হ্যাঁ, কেতুই যে ছদ্মবেশে আমাদের মধুসূদনবাবু তা কি বুঝতে পারেননি আপনি সেদিন, বলুন? ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। বৃন্দাবন চিৎকার করে উঠলেন, কেতুই দাদা? হ্যাঁ–কেতুই ছদ্মবেশী আপনার দাদা মধুসূদনবাবু। আপনি-আপনিও বোধ হয় সন্দেহ করেছিলেন বৃন্দাবনবাবু? কিন্তু কেন আমাকে সে কথা বলেননি-তাহলে তো হতভাগ্য বিজনবাবু ও গোকুলকে ঐভাবে ঐ শয়তানের হাতে নিষ্ঠুরভাবে মরতে হত না! ঘরের সব কটি প্রাণীই যেন বিমূঢ়। মধুসূদনবাবু তখন ধীরে ধীরে বোধ হয় সোফাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার আর উঠে দাঁড়ানো হল না। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণকণ্ঠে কিরীটী মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য বললে, উঁহু মিঃ সরকার, উঠবার চেষ্টা করবেন না কারণ আজ আমরা প্রস্তুত হয়েই এসেছি। সকলকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে আরও শান্ত ও একান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে মধুসূদন এবারে কথা বললেন, ওঠবার চেষ্টা আমি করিনি মিঃ রায়—আর তার প্রয়োজনও নেই। তবে এটা ঠিকই, আপনার উর্বর কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করেও আমি পারছি না। মিঃ সুশান্ত ঘোষালের কথায় সেদিন এখন দেখছি আপনাকে একটু ওভার-এস্টিমেট করে ভুলই করেছিলাম। ভুল করেছিলেন বৈকি! ভেবেছিলেন আপনার চাতুরী বুঝি কেউ ধরতে পারবে না। মধুবাবু, আমাদের দেশে একটা চলতি প্রবাদ আছে-অধিক লোভে তাঁতি নষ্ট। সারদাবাবু যে উইল করে গিয়েছিলেন সেটা যদি মাস-চারেক আগে আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু আমাদের সলিসিটার মিঃ শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে না জানতে পারতেন শচীবিলাস বললেন, আশ্চর্য! আপনি-আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়? অনুমান–নিছক সেটা অনুমান মাত্র শচীবিলাসবাবু। অনুমান? হ্যাঁ। মধুসূদনবাবু বর্মা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এসেছেন দু-সপ্তাহকাল আগে নয়—চার মাস পূর্বে। এবং তিনি যে এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেকথা প্রথম আমি মাত্র পরশু জানতে পারি আপনার ফার্মের পার্টনার রথীন বোসের কাছ থেকেই। তারপর বাকিটা অনুমান করে নিতে আমার কষ্ট হয়নি। চুপ কর শচী, ওর দৌড়টা একবার শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখতে দাও। লেট হিম স্পিক। বললেন আবার মধুসূদন সরকার। কিন্তু সব কথা আমার বলবার আগে–বিমলবাবু, আমার অনুরোধ, সরকার সাহেবের রক্তাক্ত হাত দুটি আপনি লৌহবলয়াকৃত করুন! বললে কিরীটী। নিশ্চয়ই। উঠে দাঁড়াল বিমল সেন এবং মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন মিঃ সরকার, আইআই মাস্ট নট আলাউ দিস ইনসাল্ট! কিন্তু তার কোন প্রতিবাদই কাজে লাগল না। মধুসূদন সরকারের হাতে বিমল সেন হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, এবার সব কিছুই এক্সপ্লেন করে আপনাদের বলব। কিরীটী নিশ্চিন্ত কণ্ঠে আবার শুরু করল, অবশ্যই এই
false
MZI
বলল, আমি দুঃখিত য়ুহা। তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই মিটিয়া। যাই হোক, আমি যেটা বলছিলাম, এই পোশাকটা যদিও অত্যন্ত বিদঘুটে কিন্তু এটি একটি অসাধারণ পোশাক। একজন মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে যা যা দরকার তার সবকিছু এর ভেতরে আছে। একবার চার্জ করিয়ে নিলে এটা একজন মানুষকে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারে! এর ভেতরে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে, অস্ত্র আছে অস্ত্র আছে? য়ুহা চমকে উঠে বলল, আমাদের হাতে তোমরা অস্ত্র তুলে দিচ্ছ? হ্যাঁ, দিচ্ছি তার কারণ তোমরা এখন সেটা ব্যবহার করতে পারবে। নিচের অন্ধকার গ্রহটাতে পৌঁছানোর পর সেটাকে চালু করা হবে। নিচের গ্রহ সম্পর্কে তুমি কিছু জান মিটিয়া? না। আমি বিশেষ কিছু জানি না। তোমাকে এই মুহূর্তে বলা হয়তো ঠিক হবে না কিন্তু গ্রহটি অত্যন্ত কুৎসিত। এর মাঝে এক ধরনের অশুভ ব্যাপার লুকিয়ে আছে। য়ুহা কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে রইল। মহাকাশযান থেকে স্কাউটশিপটা উড়ে গেল কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে একবার পেছন দিকে তাকিয়ে মহাকাশযানটিকে দেখার চেষ্টা করল, ঠিক কী কারণ জানা নেই সেটিকে একটা বিধ্বস্ত জাহাজের মতো দেখাচ্ছে। সে আর কখনো এখানে ফিরে আসতে পারবে কী জানে না। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনার দিকে তাকালো, রায়ীনা। বল। তোমার কী মনে হয়? এই গ্রহটার প্রাণীগুলো কী রকম? আমার এখনো কোনো ধারণা নেই। তবে প্রাণীগুলো বুদ্ধিমান সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তারা কী আমাদের থেকে বুদ্ধিমান? রায়ীনা শব্দ করে হেসে বলল, আমরা বুদ্ধিমান তোমাকে কে বলেছে? আমরা যদি বুদ্ধিমান হতাম তাহলে কি নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করি? নিজেদের গ্রহটাকে ধ্বংস করে মহাজগতের এখানে-সেখানে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি? মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে হত্যা করি? জোর করে অপছন্দের মানুষদের কালো কুৎসিত অন্ধকার একটা গ্রহে ঠেলে পাঠিয়ে দিই? তার পরও আমরা তো একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছি তুলিনি— এটাকে সভ্যতা বলে না। য়ুহা সভ্যতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ করে তার মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছে, হালকা এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে কোথা থেকে। সে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, রায়ীলা— হ্যাঁ। রায়ীনা মাথা নাড়ে, আমাদের অচেতন করে দিচ্ছে। কে অচেতন করছে? কেন করছে? ক্যাপ্টেন জব নিশ্চিত করতে চাইছে যেন আমরা এই স্কাউটশিপটা ব্যবহার করে অন্য কিছু করতে না পারি। রায়ীনা ঘুমঘুম গলায় বলল, য়ুহা, আমি জানি না এই স্কাউটশিপটা আমাদের ঠিকভাবে গ্রহটাতে পৌঁছাতে পারবে কী না। যদি না পারে তাহলে বিদায়! তোমার সাথে পরিচয় হওয়াটা আমার জন্যে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিল। য়ুহা কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু বলার আগেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। য়ুহা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে একটি গহিন বনে হারিয়ে গেছে, যেদিকেই যায় সে দেখতে পায় শুধু গাছ আর গাছ। কৃত্রিম গাছ নয়, সত্যিকারের গাছ। সেই গাছের ডাল, গাছের পাতায় তার শরীর আটকে যাচ্ছে, লতাগুলোতে সে জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন শুনতে পেল বহুদূর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে, য়ুহা। য়ুহা এদিকে সেদিকে তাকালো, কাউকে দেখতে পেল না। শুধু মনে হলো কণ্ঠস্বরটি বুঝি আরো কাছে এগিয়ে এসেছে—আবার ডাকছে, য়ুহা। এ রকম সময় সে ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল, তার ওপর ঝুঁকে পড়ে আছে রায়ীনা, তাকে ধাক্কা দিতে দিতে সে ডাকছে। য়ুহা এসে বসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়? আমরা গ্ৰহটাতে নেমে এসেছি। আমরা তো বেঁচে আছি তাই না? মনে হচ্ছে বেঁচে আছি। তবে এটাকে তুমি যদি বেঁচে থাকা না বলতে চাও তাহলে অন্য ব্যাপার। য়ুহা স্কাউটশিপের গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ, কী বিদঘুটে গ্রহ! রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ এটা খুব বিদঘুটে একটা গ্রহ। য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি কখনো চিন্তা করিনি, আমার জীবনের শেষ সময়টা কাটাব এ রকম একটা বিদঘুটে অন্ধকার গ্রহে। তোমার জীবনের শেষ সময়টা কোথায় কাটানোর কথা ছিল? আমি ভেবেছিলাম আমার নিজের পরিচিত মানুষের সাথে। সাধারণ মানুষ। সাদামাটা মানুষ। রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, বিষয়টা নিয়ে আমারও এক ধরনের কৌতূহল! তুমি তো সামরিক কমান্ডের কেউ নও-তুমি কেমন করে এই মহাকাশযানে আছ? আমি একজন কবি! আমি একাডেমির কাছে আবেদন করেছিলাম যে আমি মহাকাশ ভ্রমণে যেতে চাই। একাডেমি এদের সাথে আমাকে যেতে দিয়েছে। রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি এখন নিশ্চয়ই খুব আফসোস করছ যে কেন এসেছিলে? না, আসলে করছি না। সবকিছুই তো অভিজ্ঞতা, এটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। একটা জীবন তো নানারকম অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু না। রায়ী অন্যমনস্কভাবে বলল, তা ঠিক। য়ুহা বলল, এখান থেকে বের হয়ে যদি আবার নিজের পরিচিত মানুষদের কাছে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে অভিজ্ঞতার গুরুত্বটুকু আরো অনেক বাড়ত। রায়ীনা আবার অন্যমনস্কভাবে বলল, তা ঠিক। য়ুহ্য জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব? রায়ীনা বলল, আমি প্রথম ছত্রিশ ঘণ্টা বিশেষ কিছু করতে চাই না। য়ুহা একটু অবাক হয়ে বলল, প্রথম ছত্রিশ ঘণ্টা? হ্যাঁ। ছত্রিশ ঘণ্টার পর আমি মহাকাশযান থেকে আরো কয়েকটি স্কাউটশিপ আশা করছি। আমাদের সাহায্য করার জন্যে তখন আরো কিছু মানুষ আসবে। যন্ত্রপাতি আসবে! অস্ত্র আসবে! তখন যদি কিছু করা যায় করব। য়ুহা হতচকিত হয়ে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ছত্রিশ ঘণ্টা পর মহাকাশযান থেকে স্কাউটশিপ কেন আসবে? তার কারণ ছত্রিশ ঘণ্টা
false
humayun_ahmed
সত্যি চলে যাব স্যার? মিথ্যা চলে যাওয়া বলে কিছু আছে? গাধার মতো কথা। , ম্যাডামকে গিয়ে বলবে, স্যার আজ আসবে না। ভীত মানুষটা সাবধানে দরজা বন্ধ করল। বন্ধ করার আগে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। হারুন মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, সব গাধা। মিসির আলি বললেন, আমি কি আপনাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করব? আপনি বাসায় চলে যান। আপনার স্ত্রী একা। উনার নিশ্চয় মনটা খারাপ আজ। আপনাদের একটা বিশেষ দিন। ম্যারেজ ডে। কে বলেছে আপনাকে? অনুমান করছি। হারুন রাগী গলায় বললেন, আমি মিথ্যা পছন্দ করি না। আপনাকে কেউ নিশ্চয় বলেছে। অনুমান বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। মিসির আলি বললেন, আপনার অফিসে আপনার এবং আপনার স্ত্রীর ছবি আছে। বাচ্চাকাচার ছবি নেই। যিনি অফিসে স্ত্রীর ছবি রাখেন। তিনি বাচ্চাকাচার ছবিও অবশ্যই রাখেন। সেই থেকে অনুমান করছি, আপনাদের ছেলেমেয়ে নেই। আপনার স্ত্রী বাসায় একা। আজ আমাদের ম্যারেজ ডে এটা বুঝলেন কীভাবে? আজ ছয় তারিখ। দেয়ালে যে ক্যালেন্ডার ঝুলছে সেখান ছয় তারিখটা লাল কালি দিয়ে গোল করা। আমার স্ত্রী বা আমার জন্মদিনও তো হতে পারে। মিসির আলি বললেন, আপনার জন্মদিন হবে না, কারণ নিজের জন্মদিন মনে থাকে। আপনার স্ত্রীর জন্মদিনও হবে না। স্ত্রীরা জন্মদিনে স্বামী দেরি করে বাড়ি ফিরলে তেমন রাগ করে না। ম্যারেজ ডে ভুলে গেলে বা সেই দিনে দেরি করে স্বামী ঘরে ফিরলে রাগ করে। তা ছাড়া গোল চিহ্নের ভেতর লেখা . এটা ম্যারেজ ডের আদ্যক্ষর হওয়ার কথা। হারুন বললেন, আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক। মিসির আলি বললেন, খুব বুদ্ধিমান না। তবে কাৰ্যকারণ নিয়ে চিন্তা করতে আমার ভালো লাগে। আপনি করেন কী? আমি কিছুই করি না। অবসরে আছি। আগে কী করতেন? সাইকোলজি পড়াতাম। আপনার কি কোনো কার্ড আছে? জি না। হারুন বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আমি আপনাকে চিনেছি। আপনাকে নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। আমার স্ত্রী আপনার বিশেষ ভক্ত। দিয়ে আপনার নাম, মেহের আলি বা এই জাতীয় কিছু। আপনার নামটা কী বলুন তো। আগে একবার বলেছিলেন। ভুলে গেছি। সরি ফর দ্যাট। আমার নাম মিসির আলি। আপনার কি টেলিফোন আছে? সেল ফোন একটা আছে। হারুন আগ্রহ নিয়ে বললেন, নাম্বারটা লিখুন তো। শয়লাকে দিব। সে খুবই খুশি হবে। আচ্ছা আপনি নাকি যে কোনো সমস্যার সমাধান চোখের নিমিষে করে ফেলেন, এটা কি সত্যি? সত্যি না। যে কোনো মানুষকে দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব বলে দিতে পারেন, এটা কি সত্যি? সত্যি না। শায়লা আপনার বিষয়ে যা জানে সবই তো দেখি ভুল। মগভর্তি চা চলে এসেছে। আগের লোকই চা এনেছে। ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন, ফজলু, তোমাকে না চলে যেতে বললাম? তুমি ঘুরঘুর করছ, কেন? . যাও সামনে থেকে। গাড়িতে বসে থাক। স্যার কি বাসায় যাবেন? যেতে পারি। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। চা খেয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিব। এখন . ফজলু চলে গেল। মিসির আলি লক্ষ করলেন ফজলুর মুখ থেকে ভয়ের ছাপ কমেছে। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। হারুন মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, চা ভালো হয়েছে। খান। বিস্কিট আছে। বিস্কিট দেব? ভালো বিস্কিট। বিস্কিট লাগবে না। হারুন সামান্য ঝুঁকে এসে খানিকটা গলা নামিয়ে বললেন, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন? মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, না। হারুন আনন্দিত গলায় বললেন, আমিও না। মিসির আলি বললেন, ভূতের প্রসঙ্গ এল কেন? হারুন জবাব দিলেন না। তাঁকে এখন বিব্রত মনে হচ্ছে। মিথ্যা কথা ধরা পড়ে গেলে মানুষ যেমন বিব্রত হয় সেরকম। মিসির আলি বললেন, আপনি কি কখনো ভূত দেখেছেন? হারুন ক্ষীণস্বরে বললেন, হুঁ। মিসির আলি বললেন, একটু আগেই বলেছেন, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন না। হারুন বললেন, ভূত দেখি নি। আত্মা দেখেছি। আত্মা। আমার মায়ের আত্মা। সেটাও তো এক ধরনের ভূত। তাই না? ও আচ্ছা। আমার সামনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, তখন আমার মায়ের আত্মা এসে আমাকে সাবধান করে। তাই নাকি? জি! আত্মার গায়ে যে গন্ধ থাকে এটা জানেন? মিসির আলি বললেন, জানি না। হারুন চাপা গলায় বললেন, গন্ধ থাকে। কেম্ফফরের গন্ধ। বেশ কড়া গন্ধ। সব আত্মার গান্ধই কি ফেম্ফফরের? নাকি একেক আত্মার গন্ধ একেক রকম? হারুন বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তো আত্মা শুঁকে শুঁকে বেড়াই না যে বলব কোন আত্মার গন্ধ কী? আমি শুধু আমার মার আত্মাকেই দেখি। তাও সব সময় না। যখন আমি বিপদে পড়ি তখন দেখি। তিনি আমাকে সাবধান করে দেন। মিসির আলি বললেন, উনি শেষ কবে আপনাকে সাবধান করেছেন? হারুন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চট কবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, যাই। বলেই অপেক্ষা করলেন না। অ্যাপ্রন পর অবস্থাতেই দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। মিসির আলির কাপের চা এখনো শেষ হয় নি। চা-টা খেতে অসাধারণ হয়েছে। তার কি উচিত চা শেষ না করেই উঠে যাওয়া? এক এক ডাক্তারের চেম্বারে বসে চুকচুক করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়াও তো অস্বস্তিকর। হঠাৎ করে বাইরে থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেও তো বিরাট সমস্যা। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও সম্ভাবনা থেকে যায়। প্রবাবিলিটির একটা বইয়ে পড়েছিলেন যে কোনো মানুষের হঠাৎ করে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। মিসির আলি চা শেষ করলেন। তাড়াহুড়া করলেন না, ধীরেসুস্থেই শেষ
false
bongkim
করে।” সুভাষিণী হাসিয়া উঠিল। বলিল, “মরণ আর কি তোমার! এই বুঝি বুঝিয়াছ? তুমি বড় মানুষের মেয়ে বলে বুঝি তোমার আদর করেছেন?” আমি বলিলাম, “তবে কি?” সু। ওঁর ছেলে পেট ভরে খাবে, তাই তোমার এত আদর। এখন যদি তুমি একটু কোট কর, তবে তোমার মাহিনা ডবল হইয়া যায়। আমি বলিলাম, “আমি মাহিনা চাই না। না লইলে যদি কোন গোলযোগ উপস্থিত হয়, এজন্য হাত পাতিয়া মাহিয়ানা লইব। লইয়া তোমার নিকট রাখিব, তুমি কাঙ্গাল গরীবকে দিও। আমি আশ্রয় পাইয়াছি, এই আমার পক্ষে যথেষ্ট।” নবম পরিচ্ছেদ : পাকাচুলের সুখ দু:খ আমি আশ্রয় পাইলাম। আর একটি অমূল্য রত্ন পাইলাম—একটি হিতৈষিণী সখী। দেখিতে লাগিলাম যে, সুভাষিণী আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতে লাগিল–আপনার ভগিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করিতে হয়, আমার সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করিত। তাঁর শাসনে দাস-দাসীরাও আমাকে অমান্য করিত না। এদিকে রান্নাবান্না সম্বন্ধেও সুখ হইল। সেই বুড়ী ব্রাহ্মণ—ঠাকুরাণী,-সোণার মা তিনি বাড়ী গেলেন না। মনে করিলেন, তিনি গেলে আর চাকরিটি পাইবেন না, আমি কায়েমী হইব। তিনি এই ভাবিয়া নানা ছুতা করিয়া বাড়ী গেলেন না। সুভাষিণীর সুপারিসে আমরা দুই জনেই রহিলাম। তিনি শাশুড়ীকে বুঝাইলেন যে, কুমুদিনী ভদ্রলোকের মেয়ে, একা সব রান্না পারিয়া উঠিবে না—আর সোণার মা বুড়া মানুষই বা কোথায় যায়? শাশুড়ী বলিল, “দুইজনকেই কি রাখিতে পারি? এত টাকা যোগায় কে?” বধূ বলিল, “তা একজনকে রাখিতে গেলে সোণার মাকে রাখিতে হয়। কুমু এত পারবে না।” গৃহিণী বলিলেন, “না না। সোণার মার রান্না আমার ছেলে খেতে পারে না। তবে দুইজনেই থাক।” আমার কষ্টনিবারণ জন্য সুভাষিণী এই কৌশলটুকু করিল। গিন্নী তার হাতে কলের পুতুল; কেন না, সে রমণের বৌ—রমণের বৌর কথা ঠেলে কার সাধ্য? তাতে আবার সুভাষিণীর বুদ্ধি যেমন প্রখরা, স্বভাবও তেমনই সুন্দর। এমন বন্ধু পাইয়া, আমার এ দু:খের দিনে একটু সুখ হইল। আমি মাছমাংস রাঁধি, বা দুই একখানা ভাল ব্যঞ্জন রাঁধি—বাকি সময়টুকু সুভাষিণীর সঙ্গে গল্প করি—তার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি; হলো বা স্বয়ং গৃহিণীর সঙ্গে একটু ইয়ারকি করি। কিন্তু শেষ কাজটায় একটা বড় গোলে পড়িয়া গেলাম। গৃহিণীর বিশ্বাস তাঁর বয়স কাঁচা, কেবল অদৃষ্টদোষে গাছকতক চুল পাকিয়াছে, তাহা তুলিয়া দিলেই তিনি আবার যুবতী হইতে পারেন। এই জন্য তিনি লোক পাইলেই এবং অবসর পাইলেই পাকা চুল তুলাইতে বসিতেন। এক দিন আমাকে এই কাজে বেগার ধরিলেন। আমি কিছু ক্ষিপ্রহস্ত, শীঘ্র শীঘ্রই ভাদ্র মাসের উলু ক্ষেত সাফ করিতেছিলাম। দূর হইতে দেখিতে পাইয়া সুভাষিণী আমাকে অঙ্গুলির ইঙ্গিতে ডাকিল। আমি গৃহিণীর কাছ হইতে ছুটি লইয়া বধূর কাছে গেলাম। সুভাষিণী বলিল, “ও কি কাণ্ড! আমার শাশুড়ীকে নেড়া মুড়া করিয়া দিতেছ কেন?” আমি বলিলাম, “ও পাপ একদিনে চুকানই ভাল।” সু। তা হলে কি টেঁকতে পারবে? যাবে কোথায়? আমি। আমার হাত থামে না যে। সু। মরণ আর কি! দুই একগাছি তুলে চলে আসতে পার না! আমি। তোমার শাশুড়ী যে ছাড়ে না। সু। বল গে যে, কই, পাকা চুল ত বেশী দেখিতে পাই না—এই বলে চলে এসো। আমি হাসিয়া বলিলাম, “এমন দিনেডাকাতি কি করা যায়? লোকে বলবে কি? এ যে আমার কালাদীঘির ডাকাতি।” সু। কালাদীঘির ডাকাতি কি? সুভাষিণীর সঙ্গে কথা কহিতে আমি একটু আত্মবিস্মৃত হইতাম—হঠাৎ কালাদীঘির কথা অসাবধানে মুখ দিয়া বাহির হইয়াছিল। কথাটা চাপিয়া গেলাম। বলিলাম, “সে গল্প আর একদিন করিব।” সু। আমি যা বলিলাম, তা একবার বলিয়াই দেখ না? আমার অনুরোধে। হাসিতে হাসিতে আমি গিন্নীর কাছে গিয়া আবার পাকা চুল তুলিতে বসিলাম। দুই চারি গাছা তুলিয়া বলিলাম, “কৈ আর বড় পাকা দেখিতে পাই না। দুই এক গাছা রহিল, কাল তুলে দিব।” মাগী এক গাল হাসিল। বলিল, “আবার বেটীরা বলে সব চুলই পাকা।” সে দিন আমার আদর বাড়িল। কিন্তু যাহাতে দিন দিন বসিয়া বসিয়া পাকা চুল তুলিতে না হয়, সে ব্যবস্থা করিব মনে মনে স্থির করিলাম। বেতনের টাকা পাইয়াছিলাম, তাহা হইতে এক টাকা হারাণীর হাতে দিলাম। বলিলাম, “একটা টাকার এক শিশি কলপ কারও হাত দিয়া কিনিয়া আনিয়া দে।” হারাণী হাসিয়া কুটপাট। হাসি থামিলে বলিল, “কলপ নিয়ে কি করবে গা? কার চুলে দেবে?” আমি। বামন ঠাকুরাণীর। এবার হারাণী হাসিতে হাসিতে বসিয়া পড়িল। এমন সময়ে বামন ঠাকুরাণী সেখানে আসিয়া পড়িল। তখন সে, হাসি থামাইবার জন্য মুখে কাপড় গুঁজিয়া দিতে লাগিল। কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া সেখান হইতে পলাইয়া গেল। বামন ঠাকুরাণী বলিলেন, “ও অত হাসিতেছে কেন?” আমি বলিলাম, “ওর অন্য কাজ ত দেখি না। এখন আমি বলিয়াছিলাম যে, বামন ঠাকুরাণীর চুলে কলপ দিয়া দিলে হয় না? তাই অমন করছিল।” বামন ঠা। তা অত হাসি কিসের? দিলেই বা ক্ষতি কি? শোণের নুড়ি শোনের নুড়ি ব’লে ছেলেগুলা খেপায়, তা সে দায়ে ত বাঁচব!” সুভাষিণীর মেয়ে হেমা অমনই আরম্ভ করিল, চলে বুড়ী, শোণের নুড়ী, খোঁপায় ঘেঁটু ফুল। হাতে নড়ি, গলায় দড়ী, কাণে জোড়া দুল। হেমার ভাই বলিল, “জোলা দুম!” তখন কাহারও উপর জোলা দুম পড়িবে আশঙ্কায় সুভাষিণী তাহাকে সরাইয়া লইয়া গেল। বুঝিলাম, বামনীর কলপে বড় ইচ্ছা। বলিলাম, “আচ্ছা, আমি কলপ দিয়া দিব।” বামনী বলিল, “আচ্ছা, তাই দিও। তুমি বেঁচে থাক, তোমার সোণার গহনা হোক। তুমি খুব রাঁধতে শেখ।” হারাণী হাসে, কিন্তু কাজের লোক। শীঘ্র এক শিশি উত্তম কলপ আনিয়া দিল। আমি তাহা হাতে করিয়া গিন্নীর পাকা চুল
false
shunil_gongopaddhay
নামকরা নায়িকা, সে পুরুষের ভূমিকাতেও এত ভালো অভিনয় করতে পারে? বিনোদিনী আর বনবিহারিণী দু’জনেই ঘন ঘন ক্ল্যাপ পাচ্ছে। সব নাটকেই নাচ থাকে। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, দর্শকেরা নাচ দেখতে চায়। নাটকের শুরুতে এবং ইন্টারভ্যালের পর সখীর দল খানিকক্ষণ নেচে যায়। এই নাটকে অবশ্য উত্তরার তো নাচেরই ভূমিকা, বৃহন্নলাবেশী অৰ্জ্জুন তাকে নাচ শেখাবে। কিন্তু উত্তরা সেজেছে ভূষণকুমারী, তার নাচ মোটেই সুবিধের নয়, শরীর একেবারে শক্ত। নাটক দেখতে দেখতে হঠাৎ ভূমিসূতার কথা মনে পড়ল ভরতের। মেয়েটি নাচতে জানে, গাইতে জানে, কিছু লেখাপড়াও শিখেছে, কিন্তু বিশ্বসংসারে ওর আপনি কেউ নেই ওকে ঝি-গিরি করেই কাটাতে হবে সারাজীবন। ওর এই গুণগুলো বৃথা যাবে। একমাত্র থিয়েটারে যোগ দিলে ওর ভাগ্য খুলে যেতে পারে। মেয়েটি দেখতে শুনতেও ভালো, নাচ জানা, গান জানা এমন মেয়ে পেলে লুফে নেবে যে-কোনও নাটুকে দল। থিয়েটারের মেয়েদের অবশ্য কেউ ভালো বলে না, সমাজে তাদের স্থান নেই, কিন্তু বাড়ির ঝিদেরও কি গ্রাহ্য করে সমাজ? অভিনেত্রীরা তবু তো হাততালি পায়, বাড়ির ঝি সারাদিন মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করলেও কি পায় কিছু? ভরতের বন্ধু নীলমাধনের সঙ্গে অর্ধেন্দুশেখরের আত্মীয়তা আছে, তাকে ধরে ভূমিসূতাকে কোনও নাটকের দলে ঢুকিয়ে দেওয়া শক্ত হবে না, তার আগে জানাতে হবে ভূমিসূতা এই জীবন চায় কি না! সে রাত্রে বাড়ি ফিরে ভরত দেখল, কে যেন তার ঘরখানি সুচারু ভাবে গুছিয়ে দিয়েছে। তার বইপত্র এলোমেলো হয়েছিল, জামা-কাপড় যেখানে সেখানে ছড়ানো থাকে, সব এখন সুবিন্যস্ত। টেবিলের ওপর অনেকখানি কালির দাগ ছিল, মোহা হয়নি, কেউ সযত্নে সেই দাগ তুলে দিয়েছে। টেবিলের ঠিক মাঝখানে রয়েছে রুপোর তৈরি সেই পলার আংটি। ছ’নম্বর বিডন স্ট্রিটে ন্যাশনাল থিয়েটারের সামনে এসে থামল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফিটন গাড়ি। থিয়েটার ভবনটি প্রায় কাঠের তৈরি, চতুর্দিকে তক্তার বেড়া আর করোগেটের ছাদ। আজ অভিনয়ের দিন নয়, তাই জন সমাগম নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গায়ে পাতলা জামার ওপর সিন্ধের মেরজাই, কাঁধে উড়নি, ধুতির কেঁচা বা হাতে ধরে তিনি নামলেন গাড়ি থেকে। গেটের কাছে টুলে বসে একজন দারোয়ান গাজা টানছিল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখে তাড়াতাড়ি কল্কেটা লুকিয়ে ফেলল। থিয়েটারের দারোয়ানেরা যণ্ডামার্কা ধরনের হয়, মাতাল ও উচ্ছৃঙ্খল দর্শকদের ঠ্যাঙবার জন্য তৈরি থাকে। এই দারোয়ান ভুজবল সিংও সেই প্রকৃতির, চক্ষু সব সময় রক্তবর্ণ, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত তাকে খাতির করে, সেও একমাত্র এই মঞ্চের মালিক প্রতাপ জহুরী ছাড়া আর কারুকে তোয়াক্কা করে না। তবু যে ভুজবল সিং এখন গাজা কন্ধে সরিয়ে রেখে সম্ভ্রম দেখাল, তার কারণ এই বাবুর কথা আলাদা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শুধু চেহারা কিংবা সাজপোশাকের জন্যই নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বেই এমন কিছু মহিমা আছে, যার জন্য সাধারণ মানুষ তাঁর সামনে এসে এমনিতেই মাথা নিচু করে। অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গম্ভীর স্বভাবের নন, সদা হাস্যময়। দারোয়ান লম্বা সেলাম ঠুকলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাত তুলে বললেন, আচ্ছা হ্যাঁয়? অডিটোরিয়ামের পাশের টানা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। ভেতরে কোনও বাতি নেই, গ্রিনরুমের দিকে যাবার সিঁড়ির কাছে শুধু একটা গ্যাসের বাতি জ্বলছে। ডান ধারের ফাঁকা জায়গায় খাবারের দোকানটি আজ বন্ধ, পানের দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে গজল্লা করছে কয়েককজন, হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে এদিকে তাকিয়ে তারা ফিসফিস করে বললেন, জ্যোতিবাবু, জ্যোতিবাবু! জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আজ কিছুটা ভারাক্রান্ত। এখানে আসবেন কি আসবেন না, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেকদিনের। এই মঞ্চে নাট্যকার হিসেবে তাঁর সার্থকতা প্রমাণিত হয়েছে। নিজেদের বাড়ির মঞ্চে পরিবারের লোকজনের নিয়ে অভিনয় করা এক কথা, সেখানে দর্শকরা সব আমন্ত্রিত, আর এখানে সাধারণ দর্শকরা টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে, তাদের পছন্দ না হলে আসনগুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। এখানে তাঁর ‘পুরুবিক্ৰম’ নাটক, কিঞ্চিৎ জলযোগ, ‘সরোজিনী’ বা চিতোর আক্রমণ নাটক জনপ্রিয় হয়েছে। সরোজিনী তো দারুণ ভাবে সার্থক, অন্য কারুর নাটক দর্শক মনোরঞ্জনে সমর্থ না হলেই সরোজিনী আবার মঞ্চস্থ হয়েছে। ন্যাশনাল থিয়েটারে তিনি বিশেষ সম্মানিত নাট্যকার। কিন্তু অবস্থাটা বদলে গেছে সম্প্রতি। এই ন্যাশনাল থিয়েটারে গিরিশ ঘোষের ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ জমজমাটভাবে চলছিল, হঠাৎ মালিকের সঙ্গে পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কলহ হল। গিরিশবাবু সদলবলে বেরিয়ে গেলেন, এই বিডন স্ট্রিটের খুব কাছে স্টার নামে নতুন থিয়েটার খোলা হয়েছে। গিরিশবাবু সঙ্গে নিয়ে গেছেন অমৃতলাল, বিনোদিনী, কাদম্বিনীদের, ‘দক্ষযজ্ঞ’ পালা নামিয়ে বিপুলভাবে দর্শক টানছেন। ন্যাশনালের অবস্থা এখন শোচনীয়, কোনও নাটকই জমছে না, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এর নাট্যরূপ দিয়েও কোনও সুফল হল না। দর্শকরা আনন্দমঠ একেবারেই পছন্দ করেনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুধু নাট্যকারী নন, নাট্যসমালোচকও, ‘ভারতী’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাধারণ মঞ্চের নাটক বিষয়ে লেখেন। সেই জন্যই যখন নিজের নাটক মঞ্চস্থ হয় না, তখনও থিয়েটারের লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। ‘আনন্দমঠ’ মঞ্চে তাঁরও পছন্দ হয়নি। মূল উপন্যাসটি অবশ্য এখনও পড়া হয়নি তার। রবি পড়েছে, রবির ভালো লাগেনি, রবির মতে উপদেশের ঠেলায় চারিত্রগুলো রক্ত-মাংস পায়ানি, চরিত্রগুলি যেন এক একটি সংখ্যা, আর শান্তিকে নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ন্যাশনালের এই দুর্দশার সময়ে এখানকার মালিক জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ধরেছেন নতুন নাটক লিখে দেবার জন্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথমে রাজি হননি। ন্যাশনাল নাটক দেওয়া মানে স্টারের গিরিশবাবুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা। গিরিশবাবু বন্ধু মানুষ, এতকাল গিরিশ-অমৃতলাল-বিনোদিনীরাই তাঁর নাটকে অভিনয় করেছে, ‘সরোজিনী’-র জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বিনোদিনীর অসাধারণ অভিনয়। এখন তিনি ওদের বিপক্ষে যাবেন কীভাবে? স্বপ্নময়ী নামে একটি নাটক তিনি এমনিই লিখেছিলেন, ন্যাশনালের মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরী সেখানা পাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দ্বিধার কথা জানতে পেরে গিরিশবাবু একজন
false
shomresh
এগিয়ে গেল। তখনই জুতোর শব্দ উঠল। প্রতুলবাবু এলেন, ভাল করে জিজ্ঞাসা করেছ? ডাক্তাব কিন্তু অন্য রিপোর্ট দিয়েছে। ওর শাশুড়ি সকালে যা বলেছে তা ঠিক নয়। তুমি যাচাই কর। আমার হাতে বেশী সময় নেই। যেমন করেই হোক আমি উত্তরাধিকারী চাই। প্রতুলবাবু একটু থেমে বললেন, আমি আবার হাসপাতালে চললাম আনা। সন্ধের পর ফিবব। জুতোর শব্দ মিলিয়ে গেল। গাড়ি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আনা মুখে আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই অবস্থায় বলল, তোমার মাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, কথাটা তিনি কানেই নিলেন না। নিজের মেয়ে হলে ঠিক নিতেন। এই সময় আলুথালু অবস্থায় নলিনী এসে দাঁড়ালেন, আনা, ওকে বুঝিয়ে দে কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছে ওর। ওর মুখে চোখে তার কোন ছাপ নেই রে। বুঝতেই পারছে না বেচারা। বুঝতে পারছে না? হুম। রাত্রে বুঝেছিল কি করে? রাত্রে কিছুই বোঝেনি। ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিল আনা। অ্যাঁ! চোখ বড় হয়ে গেল নলিনীর। ও এখন ও কুমারী আছে। টলতে টলতে ছেলের ফুলশয্যার বিছানায় বসে পড়লেন নলিনী। আনা বলল, খোকা এখনও বেঁচে আছে। তিনি বলে গেলেন উত্তরাধিকারী চাই। তোমার কি মত? নলিনী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কেঁদে উঠলেন। আনা বলল, যা বলার তা চটপট বলে ফেল। মতলব একটা কিছু করতে হবে। তুই বল। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। ফ্যাসফেসে গলায় বললেন নলিনী। মেয়েটাকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। এক্ষুনি। সে কি? উনি জানলে, মানে ওকে না বলে—। উনি জানলে অন্তত আজ রাত্রে পাঠাতে দেবেন না। মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করবে? সর্বনাশ? সৰ্ব্বনাশ নয়? খোকার পরে তোমার গৰ্ভ নষ্ট হয়েছিল। আর কোনদিন পারোনি মা হতে। কিন্তু আমি তো তোমার ম্যখ চেয়ে নিজের সর্বনাশ সহ্য করে যাচ্ছি এতদিন। আজ তাই মুখে খুলছি। তুমি মুখ বন্ধ করে থাকবে? আনাকে হঠাৎ খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে নলিনী বললেন, বেশ! তাই কর। স্যুটকেসটা এক হাতে তুলে নিয়ে দীপার হাত ধরে টেনে ভেতরের বারান্দায় নিয়ে এল আনা। কিছু লোক এপাশে ওপাশে কাজ করছে। বারান্দা থেকে এপাশে সরে এল আনা। তার হাতের মুঠো দীপাকে ছাড়েনি। এদিকটায় বড় বড় নারিকেল সুপারির গাছ। তার ভেতর দিয়ে সে প্ৰায় ছুটে চলল দীপাকে নিয়ে। ঘুরে ঘু্রে পেছনের একটা ছোট দরজা খুলে সে পাচিলের বাইরে চলে এল। এপাশা ওপাশ দেখে বলল, তুমি একা বাপের বাড়িতে যেতে পাববে? কিছু না বুঝেই দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আনা তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হাত নেড়ে দূরে দাঁড়ানো একটা রিকশাকে ডেকে জামার ভেতর থেকে একটা দু-টাকার নোট বের করে দীপার হাতে দিল, এই নাও গাড়িভাডা। এই রিকশাওয়ালা, জলদি একে ঘাটে নিয়ে যাও! ওঠ। বাড়িতে গিয়ে যা দেখলে সব বলো। যাও। রিকশায় উঠে পেছন দিকে যখন তাকাল দীপা তখন ছোট দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনা নেই। তিন চাকার রিকশায় আড়ষ্ট হয়ে বসে হঠাৎ দীপার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিল। কোনদিন সে একা যাওয়া-আসা করেনি। কবে শেষ জলপাইগুড়িতে এসেছিল তাও তার মনে নেই। যদি সে হারিয়ে যায়? শহরে নাকি আজেবাজে লোক থাকে অনেক, তারা যদি তাকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে কোনদিন কাউকে দেখতে পারে না। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না আনা কেন তাকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিল। কেন নলিনীও তাতে সম্মতি দিলেন। সে স্যুটকেসটা সিটের পাশে চেপে ধরে কাঁটা হয়ে বসে রইল যতক্ষণ না রিকশাওয়ালা বলল, দিদি ঘাট আ গিয়া। কখন শহবটাকে পার হয়ে এসেছে তা টের পায়নি দীপা। রিকশা থেকে নেমে সে বুঝতে পারছিল না কি করবে। রিকশাওয়ালা বলল, ঘাট ওহি দিকে আছে দিদি। হামাকে এক সিকি দিন। দুটো টাকা এগিয়ে দিল দীপা। লোকটা সেটাকে ভাঙিয়ে এক টাকা বাবে আনা ফেরত দিল। স্যুটকেসটা তুলতে গিয়ে দীপার মনে হচ্ছিল হাত ছিঁড়ে যাবে। ঘাটের দিকে কোনমতে এগিয়ে গেল সে। এর মধ্যে অনেকেরই নজর পড়ছে তার ওপর। যে-কেউ এক-নজরে ভেবে নিতে পারছে তার সবে বিয়ে হয়েছে এবং সঙ্গে কেউ নেই বুঝে বিস্মিত হচ্ছে। দীপা দেখল সবাই একটা ছোট কাঠের ঘর থেকে টিকিট কিনে নৌকায় উঠছে। স্যুটকেস রেখে সে দু আনা দিয়ে টিকিট কিনে আনল। বিয়ের রাত্রে দু-দুটো নদী পার হতে হয়েছিল তাদের। প্ৰায় হিচড়ে হিচড়ে স্যুটকেসটাকে টেনে নৌকোয় উঠল সে। প্রচুর লোকজন উঠেছে। তারা সবাই এখন দীপাকে দেখছে। দীপা জলের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। সে ঠিক যাচ্ছে তো? তার পাশে দাঁড়ানো একজন গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছ দিদি ভাই? দীপা জবাব দিল না। নৌকো ওপারে পৌঁছাল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। এখন বিরাট চর পার হতে হবে। পঙ্খীরাজ ট্যাক্সিগুলো চিৎকার করে লোক ডাকছে। যারা এই পয়সা খরচ করতে চায় না তারা হণ্টন দিয়েছে। কাশ গাছ আর বালিয়াডি ভেঙ্গে বার্নিশের কাছে পৌঁছে আবার নৌকোয় চাপবে তারা। দেখতে দেখতে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। দীপার খুব কান্না পাচ্ছিল। সে এখন কি করবে? স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যেতে পাররে না সে। শেষ পাখীরাজটা দাঁড়িয়েছিল। মোট দশ জন প্যাসেঞ্জার নেয় ওরা, কিন্তু পাঁচ জন জুটেছে তার। ওপারের যাত্রী নিয়ে নৌকো ফিরে গিয়েছে। কোথায় যাবে খুকী? বার্নিশে? দীপা মুখ তুলে দেখল ময়লা সার্ট প্যান্ট পরা একটা আধ-বুড়ো লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটা জিজ্ঞাসা করল, তোমার কাছে একটা টাকা আছে? তাহলে
false
shunil_gongopaddhay
আমি কোন ট্যাক্সিটা নেব, তা তোমরা বুঝলে কী করে? আমি তো অন্য ট্যাক্সিও নিতে পারতাম! তুমি কখন এয়ারপোর্টের ভিতর থেকে বেরোচ্ছ, তা একজন জানিয়ে দিয়েছে মোবাইল ফোনে। সেই অনুযায়ী এ-ট্যাক্সিটা এগিয়ে আনা হয়েছে। এটা ছাড়াও ওখানে আমাদের সাতখানা ট্যাক্সির সঙ্গে ব্যবস্থা করা ছিল। একটা না-একটায় তো তোমাকে উঠতেই হত। এয়ারপোর্টের মধ্যেও তোমাদের লোক আছে? শুধু কি তাই? কলকাতা থেকেও তো একজন এই প্লেনেই এসেছে তোমার সঙ্গে। ওরে বাবা, অনেক পয়সা খরচ করো তো তোমরা! কিন্তু জানলে কী করে যে, আজই এই প্লেনে আমি ভোপাল আসব? তুমি দশ দিন আগে টিকিট কেটেছ। কোথাকার টিকিট কাটছ, সেটা জানা কি খুব শক্ত? কাকাবাবু বললেন, হুঃ, তোমাদের দারুণ নেটওয়ার্ক। টাকাপয়সাও অনেক। আমার সেসব কিছুই নেই। এবার আমার লাস্ট কোয়েশ্চেন। তোমাদের ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, আমাদের লড়াই হবে সামনাসামনি। কিন্তু এটা কী হচ্ছে? আমার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, চোখ আর হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছ মেরে ফেলার জন্য। এটাই কি খেলার নিয়ম? লায়লা বলল, হবে, হবে, সামনাসামনি লড়াই হবে। সেই জন্যই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাতে তুমি পুলিশের সাহায্য নিতে না পারো। শঙ্করপুরে তো তুমি পুলিশের সাহায্য নিয়েই বেঁচে গেলে। শঙ্করপুরে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারিনি বলে আমি কর্নেলের কাছে ধমক খেয়েছি। তাই এবারে আর আমি কোনও চান্স নিইনি। কাকাবাবু বললেন, শঙ্করপুরে আমি পুলিশের সাহায্য নিইনি। গাড়িটা হঠাৎ এসে পড়ল। লায়লা ধমক দিয়ে বলল, ওসব বাজে কথা ছাড়ো। এখানেও তুমি পুলিশের সাহায্য নিতে, সে সুযোগই আমরা দিইনি। তোমাকে বলা হয়েছিল, তুমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখতে পারো। তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্ডেড, তা আমরা কী করতে পারি। কর্নেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমি তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। কাকাবাবু একটুখানি হেসে বললেন, আমাকে ধমক দিতে পারে, এমন মেয়েও আছে! ভাল, ভাল, সার্কাসে তুমি কী খেলা দেখাতে? লায়লা বলল, তোমার কোয়েশ্চেন শেষ হয়ে গিয়েছে। নাউ স্টপ! কাকাবাবু বললেন, মাঝে মাঝে আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে। গান গাইলে মন ভাল হয়ে যায়। একটা গাইব? ইংলিশ অর বেঙ্গলি? বেঙ্গলি হলে তো তুমি বুঝবে না। ঠিক আছে, ইংলিশই গাইছি। একটুক্ষণ চুপ করে কাকাবাবু একটা গান বানালেন। তারপর নিজস্ব সুরে ধরলেন সেই গান : আ গার্ল প্লেজ উইথ আ টাইগার ইন আ সার্কাস বাট ইটস নট অ্যালাইভ, ইটস আ কা-কাস! লায়লা জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ কা-কাস? কাকাবাবু বললেন, কথাটার বানান হচ্ছে , কিন্তু আর-টা উচ্চারণ হয় না। কা-কাস মানে, মরা পশু। লায়লা ঝুঁকে এসে কাকাবাবুর গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, ঠাট্টা হচ্ছে আমার সঙ্গে? স্টপ ইট। মরবে তো কিছুক্ষণ পরেই। এখনও গানের শখ! কাকাবাবু বললেন, আর যদি না মরি? তা হলে তোমারও যে একটা থাপ্পড় পাওনা রইল আমার কাছে। যদি না মরি, তা হলে এটা শোধ দেব কী করে? আমি যে মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না। লায়লা ভেংচাতে ভেংচাতে বলল, তুমি আর ছেলে বা মেয়ে, কারও গায়েই হাত তুলতে পারবে না, রাজা রায়চৌধুরী। দিস ইজ দ্য লাস্ট ডে অফ ইয়োর লাইফ। গাড়িটা বড় রাস্তা ছেড়ে একটা অন্য রাস্তায় ঢুকল বোঝা গেল। এ রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। গাড়িটা লাফাচ্ছে। তবে বেশিক্ষণ নয়। এক জায়গায় গাড়িটা থেমে গেল। কেউ একজন দরজা খুলে বলল, রায়চৌধুরীকে আনতে পেরেছ? গুড। এবার ওর চোখ খুলে দাও। গলার আওয়াজ শুনেই কাকাবাবু বুঝলেন, এ সেই ধ্যানচাঁদ অর্থাৎ কর্নেল। চোখ খোলার পর কাকাবাবু দেখলেন, এসে পড়েছেন একটা জঙ্গলের মধ্যে। খানিকটা ফাঁকা জায়গায় একটা মরা গাছের গুঁড়িতে বসে আছে দুজন লোক। কর্নেল ধ্যানচাঁদ যথারীতি পরে আছে প্যান্ট-কোর্ট। একটা বড় মাংসের টুকরো থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সে বলল, ওয়েলকাম, মিস্টার রায়চৌধুরী। আজই আমাদের খেলা শেষ হয়ে যাবে। তার আগে আমরা একটু কিছু খেয়ে নিচ্ছি। সরি, তোমাকেও দেওয়া উচিত। তুমি কিছু খাবে? একটুও চক্ষুলজ্জা না দেখিয়ে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খেতে পারি, আমার খিদে পেয়েছে। ধ্যানচাঁদ বলল, অ্যাই, রায়চৌধুরীকেও মটন রোস্ট দাও। লায়লা, তুমিও খেয়ে নিতে পারো। কাকাবাবু চেন দিয়ে বাঁধা হাত দুটো তুলে দেখালেন। ধ্যানচাঁদ বলল, না, না, হাত-বাঁধা অবস্থায় খাবে কী করে? লায়লা, ওর বাঁধন খুলে দাও। ওর কাছে অস্ত্রস্ত্র নেই তো? লায়লা কাকাবাবুর বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, নেই। তবে, ওই ক্রাচ দুটো দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। ডেঞ্জারাস জিনিস। ধ্যানচাঁদ বলল, হ্যাঁ, শুনেছি, ওগুলো থেকে ছুরিটুরি বেরিয়ে আসে। গুলিও করা যায় নাকি? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, গুলিও করা যায়। ধ্যানচাঁদ বলল, এ যে দেখছি জেমস বন্ডের অস্ত্রের মতো। ইন্ডিয়ায় তৈরি? কাকাবাবু বললেন, না। সুইডেনে। ধ্যানচাঁদ বলল, এ দুটো আমার নিজের কালেকশনে রেখে দেব। তোমার তো আর লাগবে না। কাকাবাবুকে এক টুকরো মাংস দেওয়া হল। আর-একটা রুটি। তিনি বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে বললেন, বাঃ, ভাল মাংস। এবার একটু জল চাই। লায়লা এগিয়ে দিল একটা জলের বোতল। ধ্যানচাঁদ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সিগারেট কিংবা চুরুট খাও? তোমার শেষ যা-যা ইচ্ছে আছে, তা মিটিয়ে নিতে পারো। কাকাবাবু বললেন, না, আমি ওসব খাই না। আমার আর কিছু চাই না। আই অ্যাম ফাইন। ধ্যানচাঁদও খাওয়া শেষ করে হাতটাত ধুয়ে বলল, শোনো রাজা রায়চৌধুরী, আমি খেলাটা আজই মিটিয়ে ফেলতে চাই। আমি ছমাস সময়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। তা ছাড়া আমার অন্য কাজ আছে। কাকাবাবু বললেন, আমাকে ধরেবেঁধে
false
toslima_nasrin
আর সাতটা হিন্দুর বাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে। গঙ্গাপুর গ্রামে যত হিন্দু বাড়ি ছিল, প্রথম লুট করেছে, পরে পুড়িয়ে দিয়েছে। সোনাপুরের শিব-কালী মন্দির আর বিনোদপুর আখড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনির কালীমন্দির, দুৰ্গাপুরের দুৰ্গর্বিাড়ি মন্দির, কুতুবপুর আর গোপালপুরের মন্দির ভেঙেছে। ডাঃ পি কে সিংহের ওষুধের ফ্যাক্টরি, আখন্দ আশ্রম, ছয়আনি এলাকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনি বাবুপুর, তেতুইয়া, মেহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গিরপাড়, কাজিরহাট, রসুলপুর, জমিদারহাট, পোতাবাড়ির দশটি মন্দির আর আঠারোটি হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটি দোকান, একটি গাড়ি, একটি মহিলাও পুড়েছে। ভাবর্দির সতেরোটি বাড়ির মধ্যে তেরোটি বাড়িই পুড়ে গেছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়ির মেয়েরা নিৰ্য্যতিত হয়েছে। বিপ্লব ভৌমিক স্টেবডি। গতকাল বিরাহিমপুরের সবকটি বাড়ি এবং মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, চরহাজারি গ্রামের তিনটি দোকান, ক্লাব লুট করেছে, ভেঙেছে। চরপার্বতী গ্রামের দুটো বাড়ি, দাসের হাটের একটি বাড়ি, চরকুকরি আর মুছাপুরের দুটো মন্দির, জয়কালী মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। পিরোজপুরের প্রতিটি মানুষ মার খেয়েছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়িগুলো শেষে পোড়ানোও হয়েছে। –ও। সুরঞ্জন আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে চায় না। ছোটবেলার মত রাস্তার যে কোনও ইট বা পাথরের টুকরো পায়ে ছুড়ে ছুড়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। কায়সার আরও কী কী সব বলে, আরও মন্দির পোড়ানো, আরও বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সুরঞ্জন সব শোনেও না। তার শুনতে ইচ্ছেও করে না। প্রেস ক্লাবের সামনে দুজনই দাঁড়ায়। সাংবাদিকদের জটলা, গুঞ্জন দু চোখ ভরে দেখে সে। শোনেও কিছু। কেউ বলছে-ভারতে এ পর্যন্ত দুশর ওপর লোক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। আর এস এস, শিবসেনাসহ মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ, লোকসভায় বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানি পদত্যাগ করেছে। কেউ বলছে-চট্টগ্রামে, নন্দনকানন তুলসীধামের এক সেবক দীপক ঘোষ পালিয়ে যাবার সময় জামাতিরা তাকে ধরে জ্বলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। পাশে কয়েকজন দারোয়ান ছিল, ওরা দীপককে মুসলমান পরিচয় দিলে জামাতিরা দীপককে মারধোর করে ছেড়ে দেয়। সুরঞ্জনকে পরিচিত যারাই দেখে চমকে ওঠে। বলে—কী ব্যাপার তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে! বিপদ হতে পারে। বাড়ি চলে যাও। সুরঞ্জন কোনও উত্তর করে না। বড় অপ্রতিভা লাগে নিজেকে। তার নাম সুরঞ্জন দত্ত বলে তাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আর কায়সার, লতিফ, বেলাল, শাহীন এরা বাইরে বেরোবে, কোথায় কী হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিলও করবে। কিন্তু সুরঞ্জনকে বলবে বাড়ি চলে যাও, এ কেমন কথা? সুরঞ্জন কি ওদের মতই বিবেকবান, মুক্তবুদ্ধির, যুক্তিবাদী মনের মানুষ নয়? দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে উদাসীন, সিগারেটের দোকান থেকে এক কাঠি বাংলা ফাইভ কেনে, আগুনমুখো দড়ি থেকে সিগারেট ধরায়। নিজেকে বড় বিচ্ছিন্ন বোধ করে সুরঞ্জন। এত লোক চারদিকে, অনেকেই চেনা, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠও, তবু এক লাগে তাঁর। যেন এই যে এত মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা আর সেইসূত্রে এ দেশের মন্দির ভাঙা নিয়ে উত্তপ্ত কথাবাত চলছে, এসব সুরঞ্জনের বিষয় নয়। সে মিশে যেতে চাইলেও পারছে না। কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করছে সে। সুরঞ্জন বুঝতে পারছে তাকে সকলেই আড়াল করছে, করুণা করছে, তাকে দলে টানছে না। সুরঞ্জন গাল ভরে ধোঁয়া নিয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা আর সে তার অলস শরীরের ভার দেওয়ালে ছেড়ে দেয়। অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সুরঞ্জনকে। বিস্মিত হয়। কারণ একটি ‘হিন্দু ও আজ ঘরের বার হয়নি। ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়েছে সব। আর সুরঞ্জনের সাহস বা স্পধর্ম দেখে লোকে অবাক হবেই বা না কেন! কায়সার একটি দলে ভিড়ে যায়। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকরা কাঁধে ঝোলা বা ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এদের মধ্যে লুৎফরকে দেখেও সুরঞ্জন ডাকে না। ও একসময় নিজেই এগিয়ে আসে। চোখ কপালে তুলে বলে-দাদা, আপনি এখানে কেন? —কেন থাকতে নেই? লুৎফরের চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা। জিজ্ঞেস করে–বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? লুৎফরের কথায় এবং বলবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অভিভাবকত্ব আছে। সুরঞ্জন টের পায়। এই ছেলেটি মুখচোরা স্বভাবের ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলেনি এমনই বিনত, লাজুক, ভদ্র। ছেলেটিকে সুরঞ্জনই ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদককে বলে-কয়ে চাকরি নিয়ে দিয়েছিল। লুৎফর একটি বেনসন ধরায়। সুরঞ্জনের খুব কাছে সরে এসে বলে—সুরঞ্জনদা, অসুবিধে হয়েছে কোনও? সুরঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করে–কি অসুবিধে? লুৎফর একটু অপ্রস্তুত হয়। বলে—কী আর বলব দাদা। দেশের যা অবস্থা… সুরঞ্জন তার সিগারেটটির ফিল্টারটুকু নীচে ফেলে পায়ে পিষতে থাকে। লুৎফর তার সঙ্গে সব সময় নীচু কণ্ঠে কথা বলত, আজি কণ্ঠটা তার উঁচুই মনে হয়। ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, বলে—দাদা, আজ বরং আপনি অন্য কোথাও থাকুন। বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। আচ্ছা আশেপাশের কোনও মুসলমানের বাড়িতে অন্তত দুটো রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যায় না? সুরঞ্জনের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে দোকানের আগুনমুখে দড়িটির দিকে তাকিয়ে বলে—না। —না? লুৎফর চিন্তিত হয়। ওর ভাববার ভঙ্গিতেও অভিভাবকত্ব টের পায় সুরঞ্জন। সে বুঝে যায়, যে কেউই এখন এ ধরনের অভিভাবকত্ব দেখাবে। না চাইতেই আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেবে। বাড়িতে থাকা ঠিক নয়, লুকিয়ে থাকে। ক’দিন বাড়ি থেকে বেরিও না। নাম পরিচয় বলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে না হয় বেরোও, এসব। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে আরও একটি সিগারেট ধরাতে। কিন্তু লুৎফরের গুরুগম্ভীর উপদেশ তার ইচ্ছেটিকে নষ্ট করে দেয়। শীত নেমেছে বেশ। সে হাতদুটো ভাঁজ করে -বুকের ওপর রেখে গাছের পাতার
false
shunil_gongopaddhay
ব্যবস্থা এখনো হলো না! সাহেব মেমরা এর আগে যে-কয়েকটা স্কুল খুলেছে, সে সব জায়গাতেই শুধু কচি কচি মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে খৃষ্টান করে নেওয়া হয়েছে। যীশু-ভজনা না করলে নাকি লেখাপড়া হয় না। কলকাতায় প্রথম অ-খৃষ্টানী বিদ্যালয় স্থাপনের কৃতিত্ব জগমোহন নিতে চান। জগমোহন সরকার বারাঙ্গনা গৃহে কখনো ইয়ার-বক্সিদের নিয়ে আসেন না। এসব জায়গায় তিনি গোপনে একা আসাই পছন্দ করেন। তাঁর ধারণা, তাঁর নিজস্ব কোচম্যান এবং এক অতি বিশ্বস্ত ভৃত্য ছাড়া তাঁর এই অভিযানের কথা আর কেউ জানে না। জগমোহন বললেন, বুজলি হীরে, এতখানি জন্মো আমার ব্ৰেথাই গেল, কিচুই করতে পারলুম। নিকো…ওফ…ওফ। লাল মখমলে মোড়া জাজিমের ওপর হীরেমণি বসে আছে জগমোহনের মুখোমুখি। জগমোহনের এমন স্বভাবের কথা সে ভালোভাবেই জানে। এই বিশালবপু বাবুটির দুটি বিচিত্র অভ্যোস আছে। প্রথমে ঘরে ঢুকেই তিনি বেশ জোরে একটি উদগার তুলবেন। এইটিই যেন তাঁর তৃপ্তির লক্ষণ। তারপর সুরা পান শুরু করার পরও এইরকম উদগার চলতেই থাকবে। সুরাপানের সময় এমন অ্যাও অ্যাও শব্দে ঢেঁকুর তুলতে আর কারুকে দেখেনি। হীরেমণি। আর শেষের দিকে এই কান্না। জগমোহন সরকারের কান্না শুনলেই হীরেমণি বুঝতে পারে যে আর আধঘণ্টার বেশী ওঁর চৈতন্য থাকবে না। হীরেমণি ছোট্ট একটি হাই গোপন করে বললো, আপনি অ্যাত কিচু করেচেন, অ্যাত বাড়ি, গাড়ি, বিষয় সম্পত্তি— জগমোহন হীরেমণির হাত চেপে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ওরে তাতে কী হয়, তাতে কী হয়…এই তো গ্যালো মাসেই আর একটা বাড়ি কিনলুম, কিন্তু বিষয় সম্পত্তি সবই তো মায়া প্ৰপঞ্চ…কিচুই সঙ্গে যাবে না। হীরেমণি বললো, আপনি দানধ্যানও কম করেননি— জগমোহন হীরেমণিকে আরও কাছে টেনে এনে বললেন, কাপণ্য করিনি, যে যা চেয়েচে দিয়িচি…তোকে দিইনি, বল? দিইনি? —তা দিয়েচেন বইকি! সে কতা স্বীকার না করলে আমার পাপ হবে। —গ্যালো হস্তাতেই তোকে এক জোড়া কঙ্কণ দিলুম, আমাদের বাড়ির সুরো দাসীকে একটা আংটি দিয়িচি, কমলাকে দিয়িচি একছড়া চন্দ্ৰহার— —এখন বুঝি কমলার ওপর খুব মন মজেচে? —ওরে সে মাগী বড় দেমাকী। বড় দেমাকী! তোকে কী বলবো! রামকমল সিংগী মরে ভূত হয়ে গোল কবে, আর এখনও সে মাগী বেধবা সেজে ঢং করে আচে। নাক নেই তার নিথ, বেশ্য আবার বেধবা! হুঁ! কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে হীরেমণি নিজেকে জগমোহনের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বললো, কমলার ওপরেই যখন এত টান, তবে আর আমার কাচে আসা কেন? জগমোহন তাকে নিবিড় করে টেনে এনে বললেন, ওরে কমলি আলায়দা আর তুই আলায়দা। তোর মতন গান কমলি গাইতে পারবে? কমলির গায়ের রং কালো আর তোরা যেন দুধে আলতা। আমি তো পেয়ার করি তোকেই। তবু কমলিকে কেন চাই জানিস? সে ছেল রামকমল সিংগীর মতন একজন বড়মানুষের বাঁধা মেয়েমানুষ, রামকমল সিংগী মারা গ্যাচে, এখন তার মেয়েমানুষকে কে নেবে এই নিয়ে যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গ্যাচে শহরে। বুজলি নে, রামকমল সিংগীর মেয়েমানুষকে যে নিতে পারবে তার কতটা মান বাড়বে? আমি ওর বাড়িতে প্ৰথমে একছড়া চন্দ্ৰহারি পটালুম, তা বেশ নিয়ে নিলে। ওমা, তারপর আর আসেই না, আসেই না। দুটো অন্য মাগীকে জুতে দিলে আমার সঙ্গে। সে দুটো যেন আশশ্যাওড়া গাচের পেত্নী! আমি বললুম, কমলাকে ডাকে, তার সঙ্গে দুটো কতা কইবো, তা সে পেত্নীরা বলে কিনা। উনি তো আসবেন না, আজ যে ওনার একাদশী!–শোন কতা! এমন কতা শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায় না? এতক্ষণ একটু কান্নাটা থেমেছিল,আবার ফুঁপিয়ে উঠে হীরেমণির বুকে মুখ গুঁজে জগমোহন বলতে লাগলেন, তুই বল হীরে, এটা কী ওরা উচিত কাজ হয়েচে? আমার মতন একটা মানী লোককে ফিরিয়ে দিলে? উফ উফ! হীরেমণি আদর করে জগমোহনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আহা গো, মনে বড় নেগেচে, দুঃখু করো না, দুঃখু করো না, ঐ গতরখাগী শতেক খোয়ারি কমলি ঠিক একদিন তোমার পায়ে এসে লুটোবে —ওর থেতামুখ যদি ভোঁতা করে না দিতে পারি, তাহলে আমার নাম জগমোহন সরকার নয়। আমি জানি ব্যাচা মল্লিকও ঐ কমলির কাছে ঘুরঘুর কচ্চে! ব্যাচা মল্লিক। আমার ওপর টেক্কা দেবে! —ব্যাচা মল্লিক তোমার নখের যুগ্য নয়! —তুই বল হীরে, তুই বল, ব্যাচা মল্লিকের নাম কজনা জানে? সাহেবদের কাচে সুদ খাঁটিয়ে ওর বড় টাকার গরমই হয়েচে! আমি কাগচে আটিকেল লিকি, দেশের জন্য এত কাজ কচ্চি, আর ঐ কমল ষ্টুড়ি আমায় না পুঁচে ব্যাচা মল্লিককে পুঁচবে! –কক্ষণো না। —তুই দেকিস কমলি, আহা কমলি কি বললুম, হীরে, তুই তো আমার আসল হীরেমণি, আর ঐ কমলিটা ঝুটো মুক্তো! তুই দেকিস, আমি বালিকা বিদ্যালয় খুলে দেশে অক্ষয় কীর্তি রেকে যাবো। -কী খুলবেন? –ইস্কুল, মেয়েদের জন্য ইস্কুল— —ইস্কুল? তাহলে সেখেনে আমার ছেলেটাকে ভর্তি করে নিন গো! জগমোহন সরকার ধড়ফড় করে উঠে বসে বিস্ময় বিস্ফারিত চক্ষে বললেন, ছেলে? তোর আবার ছেলে হলো কবে? হীরেমণির মুখ থেকে কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। বারাঙ্গনাদের পুত্রসন্তান থাকতে নেই, থাকলেও বাবুদের সামনে তার কথা উচ্চারণ করা চলে না। কিন্তু হীরেমণির মনের মধ্যে দিন দিন মাতৃভাবটিই যেন প্রবল হয়ে উঠছে। যখন তখন ছেলের কথা মনে পড়ে, এমনকি কোনো বাবুর অঙ্গশায়িনী অবস্থাতেও চোখে ভাসতে থাকে তার সন্তানের মুখ। আর হীরেমণির ছেলেটিও দিন দিন হয়ে উঠছে বড় সুন্দর। যেমন তার রূপ, তেমনি তার গুণ। বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ তার ছেলের, এর মধ্যেই পড়াশুনোয় তার বেশ মেধা দেখা যাচ্ছে। রাইমোহন কোথা
false
shunil_gongopaddhay
না! তারপর সে হন।হন করে হেঁটে চলে গেল অন্যদিকে। মদ-রাক্ষসীর মূর্তিটা পুড়ে শেষ হয়ে যাবার পর যখন ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, শশিভূষণ ভরতকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল? সব বুঝলি? গরল মানে জানিস? ভরত বলল, জানি। শশিভূষণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, মদ চেখে দেখেছিস কখনও? ভরত এবার সবেগে দুদিকে ঘাড় নাড়ল। শশিভূষণ চলতে চলতে বললেন, আমার বাবা বেশি মদ্যপান করে অকালে গেছেন। আমার বড় দাদার সঙ্গে পরিচয় ছিল চোরবাগানের কালী সিঙ্গির, অত বড় একটা তেজী পুরুষ, অথচ মাত্র তিরিশ বছরেই, আর মাইকেল মধুসূদনের নাম শুনেছিস তো, তিনিও, এ রকম আরও কত, সেই জন্য আমি মদ ছুঁই না, জীবনে কখনও, তুইও প্রতিজ্ঞা কর, কোনওদিন মদ স্পর্শ করবি না! ঈশ্বরের নামে বল… ভরত রাস্তার বাঁকের একটি শিবমন্দিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, এখানে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করি? শশিভূষণ বিরক্ত হয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন, তোকে কতবার বলেছি না, মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায় ঈশ্বর থাকেন না! ঈশ্বরকে নিজের মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা কর। নিজের ভাবের ঘরে যে চুরি করে, সে মন্দির-মসজিদ-গির্জেয় গিয়ে যতই ভড়ং দেখাক, সে সব মিথ্যে। ভরত। এতসব বড় বড় কথা বুঝল না। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে বলল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি! শশিভূষণ বললেন, চল, এবার একটু ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ঘুরে যাই। কাছেই ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বার। শশিভূষণ এখন প্রায় সুস্থই বলা যায়, শুধু দু’একটি উপসর্গ আছে। তিনি ত্রিপুরায় ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আজই ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে শেষ ওষুধ নিয়ে তিনি কয়েকদিনের মধ্যে রওনা হবেন মনস্থ করেছেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বারে তখনও কয়েকটি রোগী রয়েছে। শশিভূষণ ভরতকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন বাইরে।মহেন্দ্রলালের চেহারা অনুপাতে গলাটিও বাজখাই। ডাক্তারদের গুপ্তিমন্ত্রের শপথ অনুযায়ী তিনি রোগীদের রোগ বিষয়ে আলোচনা করেন নিম্নস্বরে। যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা যেন তাঁর চেম্বার ছাড়িয়ে গড়ের ময়দান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যেমন, শেষ রোগীটি দেখার পর তিনি চিৎকার করে তাঁর সহকারির উদ্দেশে বললেন, শওকত, এনার কাছ থেকে ষোলো টাকা ভিজিট নিয়ে রশিদ লিখে দাও! রোগীটি হাতজোড় করে বলল, ডাক্তারবাবু, আপনি অতি মহানুভব, আপনার নাম শুনে এসেছি, কিন্তু আমি অতি দরিদ্র, দু’বেলা অন্ন জোটে না, আপনার ফিস দেবার ক্ষমতা নেই। আপনি যদি দয়া করেন… মহেন্দ্রলাল বললেন, দয়া? ডাক্তার-রুগীর সম্পর্কের মধ্যে আবার দয়া আসে কী করে? ফেল কড়ি মাখ তেল! ডাক্তারকে পয়সা না দিলে, ওষুধের দাম না দিলে সে চিকিৎসায় ফল হয় না, তা জান না? ষোলো টাকা দিতে না পার, কত দিতে পারবে? লোকটি বলল, আজ্ঞে, আমার সামর্থ কিছুই নেই। আমি গরিব চাষী। এ বছর আষাঢ় মাসেও বিষ্টি হয়নি, হাতে একটা আধরাও নেই। এবারকার মতন যদি মাপ করেন, শরীরের তাগত ফিরে পেলে মহেন্দ্রলাল দু কোমরে হাত দিয়ে লোকটির সামনে পাহাড়ের মতন দাঁড়িয়ে বললেন, বাটে! একটি আধলাও নেই! তোমার কষ্ট শুনে আমার চোখে জল আসছে। হে! তোমার একটি আধলাও না থাকলে আমি তোমায় হাজার আধলা দেব। তোমার বাড়ি তো গুসকরা। এক আধলাও না থাকলে ফিরবে। কী করে? তোমার রাহা খরচা, খাই খরচা সব আমি দেব। তার আগে একটু সার্চ করে দেখতে হবে যে! শওকত, লোকটার ট্যাঁক খুলে দেখে নাও তো! মহেন্দ্রলালের সহকারি শওকত মিঞা একজন রোগা-পাতলা মাঝবয়েসী মানুষ, মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ, ঠোঁটে সব সময় মৃদু হাসি। তিনি এসে প্রথমে মহেন্দ্রলালকে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যার! তারপর লোকটি ধুতি ধরে টান দিতেই সে কোমরে বাধা-বেশ মোটাসোটা একটি পুটলি চেপে ধরল দুহাতে। মহেন্দ্রলাল প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, হাত সরাও, খুলে দেখব ক’ত আছে! শওকত বলল, আটচল্লিশ টাকা, আর একটা আধুলি! মহেন্দ্রলাল রোগীটিকে বললেন, ওহে, তোমার তো কিছু নেই। আমি এক হাজার আধলা দেব বলেছিলাম, সাত টাকা তের আনা নিয়ে বাড়ি যাও। বাকি সব আমার! লোকটি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, গোস্তাকি হয়ে গেছে হুজুর, এবারকার মতন ক্ষমা করে দ্যান হুজুর। মহেন্দ্রলাল বললেন, লোকটা অনেক সময় নষ্ট করেছে। শওকত, আমার ফি ষোলো টাকা আর আমাদের বিজ্ঞান কেন্দ্রের জন্য কুড়ি টাকা চাঁদা কেটে নিয়ে ওর বাকি পয়সা ফেরত দাও! লোকটি মহেন্দ্রলালের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, অত টাকা নেবেন না হুজুর, মহাবিপদে পড়ে যাব, কালীঘাটে পাঠা মানত করেছি, বউদের জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে যাব, একখান বেড়াজাল.এই টাকাতেও কুলোবে না… পা সরিয়ে নিয়ে অসহিষ্ণুভাবে মহেন্দ্রলাল বললেন, ওফ, আর পারি না। এদের নিয়ে। সবার জন্য কত কিছু কেনার ফর্দ, শুধু ডাক্তারের ফি দেবে না। ডাক্তাররা কি সব নিরাহারী সন্ন্যোসী! অন্তত দশটা টাকা তো দেবে। তাও দেবে না? ওহে শওকত, পুঁটুলিটা ফেরত দিয়ে একে তাড়াতাড়ি বিদেয় করো। লোকটি তৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে ধুতি গুছিয়ে সরে পড়ল। শওকত বলল, লোকটার পাটের ব্যবসা আছে স্যার। অনেক টাকা। আপনি কিছু না নিয়ে ছেড়ে দিলেন? মহেন্দ্রলাল বললেন, আমি কান্নাকাটি সহ্য করতে পারি না। আপদ বিদায় হয়েছে বাঁচা গেছে। তারপর তিনি গুনগুন করে একটা গান ধরলেন : “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে…” চেম্বারের পর্দা সরিয়ে বাইরে পা দিয়েই শশিভূষণকে দেখতে পেয়ে গান থামিয়ে দিলেন। নিশ্চয়ই ভাবলে, আমি চশমখোর। রুগীদের ট্যাঁক খুলে দেখি! ব্যাপার কী জানি না তো, আমি কিছু গরিব-গুর্বো মাগনায় দেখি, তাদের ওষুধপথ্য কিনো দিই, যাদের সামর্থ্য নেই,
false
shunil_gongopaddhay
রাগ জিনিসটা কিন্তু মানুষের খুব ক্ষতি করে। কাকাবাবু বললেন, মাঝে-মাঝে রেগে ওঠা ভাল। সব সময় ভাল নয়। সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও রাগ করতেন? কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই করতেন। হয়তো রেগে চঁচামেচি করতেন না। ভেতরে-ভেতরে ফুঁসতেন। ওঁর একটা কবিতা আছে, নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস … সেটা পড়লেই মনে হয়, লেখার সময় উনি খুব রেগে ছিলেন। অনির্বাণ বলল, আর তো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড়বড় ঝোপ ঠেলে গাড়ি চালানো মুশকিল। কাকাবাবু ঝুঁকে দুপাশ দেখে বললেন, এখানেও কিছু কিছু গাছের ডাল কাটা হয়েছে। আলোটা এদিকেই আসে। তুমি যতদূর পারো চালাও। তারপর নেমে পড়তে হবে। অনির্বাণ বলল, জঙ্গলে আর কিছুই তো দেখা গেল না এ পর্যন্ত। এদিকে আলো ফেলে কী দেখাতে চায় টোবি দত্ত? কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, হয়তো শেষপর্যন্ত দেখা যাবে কিছুই নেই। তখন যেন আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ো না। ভুল তো হতেই পারে। এটা আমার একটা থিয়োরি। একটু বাদে জিপটা থেমে গেল। জল-কাদায় চাকা পিছলে যাচ্ছে, সামনে বড়বড় ঝোপ। অনির্বাণ বলল, আর বোধ হয় সামনে এগিয়ে লাভ নেই। আজকের মতন এখান থেকেই ফেরা যাক। কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, নেমে পড়ো, নেমে পড়ো! তিনিই প্রথম নেমে একটা পেন্সিল টর্চ জ্বাললেন। কাছেই একটা গাছের সদ্য কাটা ডাল পড়ে আছে। ডালটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, হ্যাঁ, এইদিকেই এগোতে হবে। ঝোপঝাড় ঠেলে-ঠেলে যেতে কাকাবাবুরই অসুবিধে হচ্ছে বেশি। তবু তিনি যাচ্ছেন আগে-আগে। অনির্বাণ বলল, এই সময় যদি একটা হাতির পাল এসে পড়ে? সন্তু বলল, তা হলে আমাদের খুঁড়ে তুলে লোফালুফি খেলবে! কাকাবাবু বললেন, কোনওক্রমে যদি একটা হাতির পিঠে চেপে বসতে পারিস, তা হলে হাতিটা আর তোকে নামাতে পারবে না। অনির্বাণ বলল, অত সহজ নয়। হাতিটা তখন একটা বড় গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঘষবে। তাতেই চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাব! সন্তু বলল, সামনে একটা আলো! কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে টর্চ নিভিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ, কেউ শব্দ কোরো না। ঝোপঝাড়ের আড়ালে, বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে মিটমিটে আলো। সেই আলোর আশেপাশে কী আছে, তা দেখা যাচ্ছে না। কোনও শব্দও নেই। একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা টিপে টিপে এগোতে লাগল। কাকাবাবু মাঝে-মাঝে মাটির দিকে টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখে নিচ্ছেন। আরও খানিকটা যাওয়ার পর চোখে পড়ল একটা ভাঙা বাড়ি। প্রায় ধ্বংসস্তৃপই বলা যায়। কোনও এক সময় হয়তো কোচবিহারের রাজারা এখানে এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে শখের বিশ্রাম ভবন বানিয়েছিলেন। এখন ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কেউ খবরও রাখে না। বাড়িটার একটা কোণ থেকে আলোটা আসছে। কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্ত তা হলে এই বাড়িটাকেই দেখায়। অনির্বাণ বলল, এইরকম একটা ভাঙা বাড়ি দেখাবে কী জন্য? আলো জ্বলছে যখন, সাধারণ চোর-ডাকাতদের আখড়া হতে পারে। তার জন্য ওর এত আলোটালো ফেলার কী দরকার? কাকাবাবু বললেন, ধরো, যদি তোমাদের ইউ এফ ও কিংবা উড়ন্ত চাকির অদ্ভুত প্রাণীরা এখানে বাসা বেঁধে থাকে? অনির্বাণ বলল, উড়ন্ত চাকি যে আসেনি, তা তো প্রমাণ হয়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, কিছুই প্রমাণ হয়নি। কারা এই ভাঙা বাড়িতে আলো জ্বেলেছে, তা না দেখা পর্যন্ত সবটা বোঝা যাবে না। কাকাবাবু আবার এগোতে যেতেই অনির্বাণ তাঁকে বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়ান। ওর ভেতরে ঠিক কতজন আছে তার ঠিক নেই। আমরা মাত্র তিনজন। এক কাজ করা যাক, আমরা এখন ফিরে যাই। তারপর পুলিশ ফোর্স নিয়ে আবার এসে পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলব। কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ফিরে যাব? ভেতরটা দেখার এত ইচ্ছে হচ্ছে, ফিরে এসে যদি কিছুই না পাই! ততক্ষণে যদি সব ভোঁ-ভাঁ হয়ে যায়? তুমি বরং ফিরে যাও অনির্বাণ। আরও পুলিশ ডেকে আনন। আমি আর সন্তু এই দিকটা সামলাই ততক্ষণ। অনির্বাণ বলল, অসম্ভব! আপনাদের দুজনকে ফেলে রেখে আমি চলে যেতে পারি? আমিও তা হলে এখানে থাকব। দুপুরবেলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল খানিকক্ষণ। তারপর আকাশ একেবারে পরিষ্কার। বেশ কয়েকদিন পর ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা গেল। হেডমাস্টারমশাই ইস্কুল থেকে ফেরার পর সবাই মিলে বারান্দায় চা খেতে বসলেন। কথায়-কথায় হেডমাস্টারমশাই বললেন, দিনহাটার একটা ইস্কুলে কে একজন লোক দু লক্ষ টাকা দান করেছে। হঠাৎ এত টাকা পেয়ে সবাই অবাক! টাকাটা কে দিয়েছে, তা জানা যাচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, ত্যাপা নামে একটি গরিবের ছেলে একসময় ওই ইস্কুলে পড়ত। বিদেশে গিয়ে সে খুব বড়লোক হয়েছে। খুব সম্ভবত টাকাটা সে-ই দান করেছে! হেডমাস্টারমশাই বললেন, আমাদের গ্রামের টোবি দত্তও তো খুব বড়লোক। তার মামাদের অত বড় বাড়িটা কিনেছে। আমাদের ইস্কুলের বাড়িটা সারানো দরকার, সে কিছু টাকা দিলে পারত! দিয়েছে মোটে পাঁচ হাজার টাকা! মণিকা গরম-গরম বেগুনি আর পেঁয়াজি ভেজে এনেছে মুড়ির সঙ্গে। তোফা খাওয়া হল। মণিকা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু আজ সন্ধেবেলা কী করা হবে? মিলিটারির সেই সাহেব আসবেন? কাকাবাবু বললেন, ঠিক জানি না। কোনও খবর পাইনি। মণিকা বলল, আজ কিন্তু আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। সকালে আপনারা কোচবিহার শহরে গিয়েছিলেন, তখন আমাকে ইস্কুলে যেতে হল! কাকাবাবু হাসলেন। একটু বাদে হেডমাস্টারমশাই বেরিয়ে গেলেন এক জায়গায় ছাত্র পড়াতে। মণিকা বাথরুমে গা ধুতে গেল। কাকাবাবু সন্তুকে ফিসফিস করে বললেন, আজ সন্ধের সময় আমরা এক জায়গায় যাব। সেখানে মণিকাকে কিছুতেই নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ও ছাড়তে চাইবে না। কী করা যায় বল তো? সন্তু বলল, আমরা
false
shomresh
করেন। মিসেস ম্যাকফার্সন লিখেছিলেন তোমার গ্রান্ডসন যখন এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে আসবে তখন সব খরচ আমার। সরিৎশেখর অনিমেষকে বিলেতে পাঠাবেন বলে যখন ঘোষণা করেন তখন সময়ের হিসাব তার হারিয়ে যায়। পেনশন পাবার পর চলে যাচ্ছে একরকম। তিনটে তো প্রাণী, এতবড় বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মহীতোষ তাকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রতি মাসে, রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন তা হলে ছেলেকে হোস্টেলে রাখে। আর কথা বাড়াননি মহীতোষ। টাকার দরকার হলে বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন সরিৎশেখর। এটা তার একধরনের আনন্দ। কেউ ভাড়া চাইতে চলে তাকে মুখের ওপর না, বলে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে বলেন, বুঝলে হেম, এই যে বাড়িটা দেখছ-এই হল আমার আসল ছেলে, শেষ বয়সে এই আমাকে দেখবে। এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যার জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চলে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলে, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না। এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যা জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সুযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চরে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শতো শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলেটা, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না। আজ অবধি কারোর কাছ থেকে কোনোরকম নালিশ শুনতে হয়নি ওর বিরুদ্ধে। কিন্তু ভীষণ লাজুক অথবা গতর হয়ে থাকে ছেলেটা। এই বয়সে ওরকম মানায় না। জোর করে বিকেলে স্কুলের মাঠ পাঠালে ওকে, খেলাধুলা না করলে শরীর ঠিক থাকবে কী করে! ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে ওর শরীর, এই সময় ব্যায়াম দরকার। অনিমেষ শুনেছিল দাদু সেকালে ফাষ্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন। কলেজে যাননি কোনোদিন। কিন্তু এত ভালো ইংরেজি বুঝিয়ে দিতে পারেন যে ওদের স্কুলের রজনীবাবু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একবার প্রতিশব্দ লিখতে বলেছিলেন রজনীবাবু। অনিমেষ বাড়িতে এসে দাদুকে জিজ্ঞাসা করতে একটা শব্দের পাঁচটা প্রতিশব্দ পেয়ে গেল। রজনীবাবুর মুখ দেকে ক্লাসে বসে পরদিন অনিমেষ বুঝতে পেরেছিল তিনি নিজেও অতগুলো জানতেন না। ছোট ডিকশনারিতে অতগুলো না পেয়ে রজনীবাবু ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোত্থেকে ও এসব লিখেছে। অনিষের মুখ থেকে শুনে রজনীবাবু বিকেলে এসে দাদুর সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছিলেন। ম্যাকফার্সন সাহেব দাদুকে একটা ডিকশনারি দিয়েছিলেন যার ওজন প্রায় দশ সের হবে, অনিমেষ দুহাতে কোনোক্রমে এখন সেটাকে তুলতে পারে। রজনীবাবু মাঝে-মাঝে এসে সেটা দেখে যান। শেষ পর্যন্ত কিছুই চোপে রাখা গেল না। সরিৎশেখর যতই আড়াল করুন মহীতোষের বিয়ের আঁচ এ-বাড়িতে লাগতে আরম্ভ করল। মহীতোষ নিজে আসছেন না বটে, কিন্তু তার হবু স্বত্তবাড়ির লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলতে সরিৎশেখরের কাছে না এসে পারছেন না। সরিৎশেখর সকালে বাজারে গিয়ে একগাদা মিষ্টি নিয়ে আসেন, কখন কে আসে বলা যায় না। হেমলতা তা দিয়ে অতিথি আপ্যয়ন করেন। মেয়ের বাড়ি থেকে যারা আসেন তারা অনিকে দেখে একটু অস্বস্তির মধ্যে থাকেন সেটা অনি বেশ টের পায়। দাদু পিসিমা ওকে মুখে কিছু না বললেও ও যে ব্যাপার জেনে গেছে সেটা বুঝতে পেরে গেছেন। অনির ধারণা ছিল বিয়ে হলে খুব ধুমধাম হয়, অনেক আত্মীয়স্বজন আসে, কিন্তু ওদের বাড়িতে কেউ এল না। শুধু এক বিকেলে সাধুচরণ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে সরিৎশেখরের কাছে এলেন। ওদের সাজগোজ দেখে কেমন সন্দেহ হল অনিমেষের, পা টিপে ও দাদুর ঘরের জানলার কাছে এসে কান পাতল। সাধুচরণ বলেছিলেন, সব ঠিকঠাক আছে, এবার আপনাকে যেতে হয়। সরিৎশেখর বললেন, সন্ধে-সন্ধে বিয়েটা হয়ে যাবে আশা করি, আমি আবার আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, যা, সন্ধেবেলাতেই বিয়ে;, আপনি খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন। সরিৎশেখর বললেন, খাওয়াদাওয়া
false
humayun_ahmed
খুকী! জ্বি মামা। ছেলে দরিদ্র তবে ছেলে খারাপ না। আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। তোমাদের যে আমি মুক্তি দিতে পারলাম এতেই আমি খুশি। আমি নিজে খাস দিলে আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেছি। তুই সুখী হবি। সুখটাই বড় কথা। তবে সুখী হবার জেন্য চেষ্টা করতে হয়রে মা। খুব চেষ্টা চালাতে হয়। আমি চেষ্টা চালাব। তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোর উপর আমার ভরসা আছে। তোর বরও বুদ্ধিমান। তোদের অসুবিধা হবে না। মামা তুমি কি আমার সমস্যার কথা তাদের বলেছ? পরিষ্কার করে বলি নি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছি। পরিষ্কার করে বল নি কেন? মামা আবার কাশতে লাগলেন। টর্চের আলো এদিক ওদিকে ফেলতে লাগলেন। আমি বললাম, মামা আমি কি বলব। উনাকে? এখন বলাবলির দরকার নাই। তোদের দুজনের মধ্যে ভাব ভালবাসা হোক। তারপর বলবি। তাছাড়া দেখবি বলার দরকারও পরবে না। চল নিচে যাই। সাবধানে নামিস-সিঁড়ি পিছল। ধরা আমার হাত ধর। আমি মামার হাত ধরে সাবধানে নিচে নামছি। সিঁড়ির গোড়ায় ইরা দাঁড়িয়ে আছে। তার সুন্দর সাদা শাড়ি কাদায় মাখামাখি হয়েছে। ইরা বলল, আপা যে কজন বরযাত্রী এসেছে তাদের সবাইকে কাদায় চুবিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন দৌড়ে পালাতে গিয়েছিল সে নিজেই খাদে পড়ে গেছে। আমাদের কিছু করতে হয় নি। তার অবস্থাই সবচে করুণ। হি-হি-হি। বড় মামা বললেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না ছোট খুকী। এরা সম্মানিত মেহমান। সম্মানিত মেহমানদের অবস্থাটা একটু দেখে আসুন মামা। সম্মানিত মেহমানরা এখন মনের আনন্দেই কাদায় গড়াগড়ি করছেন। হিহিহি। বাসরঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত দুটা বেজে গেল। এর মধ্যে কত সমস্যা যে হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বরযাত্রী একজনের মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। ইরার এক বান্ধবীর কানের দুল খুলে পড়ে গেল। কলেজে পড়ে মেয়ে অথচ আকাশ ফাটিয়ে কান্না। এটা তার মার দুল। মা না-কি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবে। আমার বড় মামার শুরু হল মাইগ্রেন পেইন। এই বিশেষ ধরনের মাথাব্যথা যে এমন পর্যায়ে যেতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বড় মামা মাথার যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করছেন, অন্তু প্ৰবল বেগে তাকে বাতাস করছে এই অবস্থায় আমি বাসর ঘরে ঢুকলাম। ইরার বান্ধবীরা খাট ভালমত সাজাতে পারে নি। কাগজের ফুল দিয়ে জবরজং কি বানিয়ে রেখেছে। মামা যে ভেলভেটের চাদর এনেছেন সেটা সাইজে ছোট হয়েছে। চারদিকে তোশক বের হয়ে আছে। চাদরে গোলাপ ফুল দিয়ে লিখেছে ভালবাসা। তাকালেই লজ্জা লাগে। খাটের পাশে একটা একটা বেতের চেয়ার। রাখলই যখন দুটা বেতের চেয়ার রাখলেই পারত। একটা কেন রেখেছে? সেই বেতের চেয়ারে সে বসে। আছে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নিজেই লজ্জা পেল। ধাপ করে বসে পড়ল। ইরার সব বান্ধবীরা জানালার পাশে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। ওরা হেসে উঠল খিলখিল করে। আমি খাটের উপর বসলাম। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমি বসলাম সহজভাবেই। লজ্জায় অভিভূত হলাম না। তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও আমার লজ্জা লাগল না। আমি তাকলাম আগ্রহ নিয়ে। এই জীবন যার সঙ্গে কাটাব তাকে ভাল করে দেখতে ইচ্ছা করল। ইচ্ছাটা কি অন্যায়? বিশেষত্বহীন চেহারার একজন মানুষ। মাথা খানিকটা নিচু করে বসে আছে। এরকম মানুষ পথে ঘাটে, ট্রেনে বাসে কত দেখি। আগ্রহ নিয়ে এদের দিকে কখনো কেউ তাকিয়ে থাকে না। যেহেতু কেউ তাকিয়ে থাকে না সেহেতু তারাও বেশ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটা তরমুজ কিনে সারামুখে রস মাখিয়ে খায়। রাস্তায় যেতে যেতে শব্দ করে নাক ঝাড়ে। ঘরে আলো কম। ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় এরা একটা হারিকেন এবং একটা মোমবাতি দিয়ে গেছে। বাতাসে মোমবাতি যেভাবে কাঁপছে তাতে মনে হয় যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। সে আমাকে দেখছে না। তার হয়তো লজ্জা লাগছে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। এক সময় মোমবাতি নিভে গেল। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মোমবাতি জ্বালালো। যেন বাতি জ্বালিয়ে রাখাই তার প্রধান কাজ। ইরার বান্ধবীরা আবারও হাসছে খিলখিল করে। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে। অসহায়ের মত তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি হোসে ফেললাম। কেন হাসলাম নিজেই জানি না। আমি হাসি শাড়ির আঁচলে লুকানোর চেষ্টা করলাম না। মনে হয় সহজভাবে হেসে আমি মানুষটাকে অভয় দিতে চেষ্টা করলাম। সে অন্যদিকে তাকিয়ে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমার মামার মাথাব্যথা কি খুব বেশি? আমার সঙ্গে এই তার প্রথম কথা। আমি বললাম, হ্যাঁ বেশি। সে তৎক্ষণাৎ বলল, আমার এক বন্ধুর স্ত্রীরও মাইগ্রেন আছে। ওর নাম অহনা। অকুপাংচারে চিকিৎসা করিয়েছিল, এতে কমেছে। মানুষটা কথা বলে সহজ হবার চেষ্টা করছে। আমি তাকে সুযোগ করে দেবার জন্যেই বললাম, অকুপাংচার কি? যদিও আমি খুব ভাল করেই জানি অকুপাংচার কি। সে নড়েচড়ে বসল। খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল, অকুপাংচার হল এক ধরনের চায়নীজ চিকিৎসা। সুচ ফুটিয়ে দেয়। ব্যথা লাগে না? লাগে, খুব অল্প। তার কথা ফুরিয়ে গেল। সে এখন আবার তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। বোধহয় মনে-প্ৰাণে চাচ্ছে মোমবাতিটা নিভে যাক, তাহলে সে একটা কাজ পাবে, ছুটে গিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে পারবে। আমার বলতে ইচ্ছা করছে—তুমি মোমবাতি নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি আমার দিকে তাকাও। আমাকে এত লজ্জা পাবার কিছু নেই। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আসলেই মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। সে ইরার নায়ক শুভ্ৰ নয়। সে সাধারণ একজন মানুষ। অস্বস্তি, দ্বিধা এবং খানিকটা লজ্জা নিয়ে সে বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা পাচ্ছে না বলেই অকুপাংচার নিয়ে এসেছে।
false
humayun_ahmed
এটি মনে হচ্ছে তিনি ঠিকই করেছেন। কলিং-বেল খুঁজে পাওয়া গেল না! মিসির আলি দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা খুলে গেল প্ৰায় সঙ্গে-সঙ্গেই। কাকে চান? এটা কি আকন্দ সাহেবের বাড়ি? এস. আকন্দ? জ্বি। উনি কি আছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। উনি খুবই ব্যস্ত। আজ রাত দুটার ফ্লাইটে লণ্ডন চলে যাচ্ছেন। আপনার কী দরকার, বলুন? আমার খুবই দরকার। আমাকে বলুন। আমি তাঁকেই চাই। বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মিনিট সময় নেব। ঠিক আছে, বসুন, আমি দেখি। মিসির আলি সাহেব বসার ঘরে এক-এক দীর্ঘ সময় পৰ্যন্ত বসে রইলেন। বসার ঘরটি সুন্দর। অসংখ্য দর্শনীয় জিনিসপত্র দিয়ে জবড়াজং করা হয় নি। ঘাস রঙের একটা কার্পেট, নিচু-নিচু বসার চেয়ার। দেয়ালে একটিমাত্র পেইনটিং—চার-পাঁচ জন গ্রামের ছেলেমেয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমেছে। অপূর্ব ছবি। ছবিটির জন্যেই বসবার ঘরে একটি মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। মিসির আলি মনে-মনে ঠিক করলেন, তাঁর কোনো দিন টাকা পয়সা হলে এ-রকম করে একটি ড্রইংরুম সাজাবেন। সে-রকম টাকা পয়সা অবশ্যি তার হবে না। সবার সব জিনিস হয় না। আপনি কি আমার কাছে এসেছেন? আমি সাবির আকন্দ। মিসির আলি ভদ্রলোককে দেখলেন। বেশ লম্বা। শ্যামলা গায়ের রঙ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে একটি কঠিন ভাব আছে। তবে চোখ দুটি বড়-বড়, যা মুখের কঠিন দুভাবের সঙ্গে মানাচ্ছে না। আমি আপনাকে কোনো সময় দিতে পারব না। আমি আজ একটীয় চলে যাচ্ছি। আমি আপনার বেশি সময় নেব না। আপনি পত্রিকার এই কাটিংটি একটু দেখুন। আকন্দ সাহেব দেখলেন। কাটিংটি ফিরিয়ে দিয়ে মিসির আলির পাশে বসে ক্লান্ত স্বরে বললেন, এটা আপনি আমাকে কেন দেখাচ্ছেন? কিছু-কিছু জিনিস। আমি মনে করতে চাই না। এটা হচ্ছে তার একটি। মিসির আলি বললেন, আমার সঙ্গে একটি মেয়ে থাকে। আমার ধারণা, ও ইমা। ভদ্রলোক কোনো কথা বললেন না। তাঁর মুখের একটি পেশিও বদলাল না। আপনার এই মেয়ের কি খুব ছোটবেলোয় ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল? হ্যাঁ, ইংল্যাণ্ডে। ওর বয়স তখন দু বছর। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আপনার পরিচয়টি জানতে পারি? পারেন। আমার নাম মিসির আলি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন পার্ট টাইম শিক্ষক। আকন্দ সাহেব সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টানতে লাগলেন। মিসির আলি বললেন, আমি বুঝতে পারছি, ঘটনার আকস্মিকতা আপনাকে কনফিউজ করে ফেলেছে এবং এটা যে আপনারই মেয়ে, তা আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভদ্রলোক কিছু বললেন না। মিসির আলি বললেন, একবার এই মেয়েটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে-—মামি ইট হার্টস, মামি ইট হার্টস–তখনই আমার প্রথম মনে হল–। মিসির আলি কথা বন্ধ করে আকন্দ সাহেবের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের মুখ রক্তশূন্য! মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। তারপর আনন্দ আর যন্ত্রণা একসঙ্গে মেশান গলায় আকন্দ সাহেব থেমে-থেমে বললেন, খুব ছোটবেলায় হার্টের অসুখে কষ্ট পেত, তখন বলত, মামি ইট হার্টস। ওর নাভিতে একটি কালো জন্মদাগ আছে? আমি বলতে পারছি না। তবে এই মেয়ে আপনারই মেয়ে কি না, তা বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে টেষ্ট। আপনার এবং এই মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করে সেটা বলে দেয়া সম্ভব। এটা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা। জানি। তার দরকার হবে না। আমি আমার মেয়েকে দেখলেই চিনতে পারব। আমি কি এখনই যেতে পারি আপনার সঙ্গে? হ্যাঁ, পারেন। আমি আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিতে চাই। নিশ্চয়ই সঙ্গে নেবেন। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তিনি বললেন, আপনি কী করেন? এই প্রশ্ন আগে একবার করা হয়েছে এবং তার জবাবও দেয়া হয়েছে। তবু মিসির আলি দ্বিতীয় বার জবাব দিলেন। আকন্দ সাহেব কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমার মেয়েটি কী করে আপনার ওখানে। মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ও আছে কাজের মেয়ে হিসেবে। ভাতটাত রেঁধে দেয়। বিনিময়ে খেতে পায় এবং থাকতে পায়। ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন, যেন তিনি মিসির আলির কথা বুঝতে পারছেন না। তিনি ফিসফিস করে নিজের মনেই কয়েক বার বললেন, কাজের মেয়ে! কাজের মেয়ে! বুধবার। সময় রাত আটটা একুশ। মিসির আলি ভেবেছিলেন পিতা, কন্যা এবং মাতার মিলানদৃশ্যটি চিরদিন মনে রাখার মতো একটি দৃশ্য হবে। কিন্তু বাস্তবে সে-রকম হল না। কোনো হৈচৈ, কোনো কান্নাকাটি–কিছুই না। ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন হানিফার দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু ছিল না। হানিফা দেখতে অবিকল তার মার মতো। নাকের ডগায় তার মার মতো একটি তিল পর্যন্ত আছে। ভদ্রলোক বললেন, আমরা তোমার বাবা-মা, তুমি খুব ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আমরা তোমাকে নিতে এসেছি। হানিফ ফ্যালফ্যাল করে তোকাল মিসির আলি দিকে। মিসির আলি হাসলেন। সাহস দিতে চেষ্টা করলেন। এ-রকম একটি নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে তিনি হানিফাকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তাকে বলেছিলেন যে, তার বাবা-মার খোঁজ করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং খোঁজ পাওয়া যাবে। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে হানিফার হাত ধরলেন। মিসির আলি ভেবেছিলেন, এই মহিলাটি হয়তো কিছুটা আবেগ দেখাবেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। হয়তো আবেগকে সংযত করলেন। ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভারি মিষ্টি। তিনি মিষ্টি গলায় বললেন, মা, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখ, আয়নায় তাকিয়ে দেখ–আমি অবিকল তোমার মতো দেখতে। মিসির আলি ওদের সামনে থেকে সরে গেলেন। বাইরের এক জনের উপস্থিতি হয়তো এদের কাছে ভালো লাগবে না। তাঁরা চলে গেলেন। পনের মিনিটের মধ্যে। যাবার
false
humayun_ahmed
. কিডনী : দুটাই অকেজো। প্রেসার : নরমাল। ডায়াবেটিস : নাই। কোলেক্টরেল : বিপদসীমার নিচে। অর্থনৈতিক প্রোফাইল নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকেন। এ ছাড়াও কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। সঠিক সংখ্যা জানা যায় নি। ব্যাংকে প্রচুর টাকা। তিনি চেক কেটে টাকা তুলতে পারেন না, কারণ সিগনেচার মিলে না। পল্টু স্যার যে সিগনেচারে একাউন্ড খুলেছেন সেটা ভুলে গেছেন। বাড়ি ভাড়ার নগদ টাকা যা আসে তাতেই সংসার চলে। বাসায় বড় একটা লকার আছে। লকারের কম্বিনেশন নাম্বার স্যার ভুলে গেছেন বলে লকার খোলা যাচ্ছে না। স্যার প্রতি শুক্রবারে আধঘণ্টা সময় বিভিন্ন নাম্বারে চেষ্টা করেন। তাতে লাভ হচ্ছে না। কক কক ধর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল। কিছু কিছু বই পড়ার সময় তিনি কক কক জাতীয় শব্দ করেন। পছন্দের বই হলে এ ধরনের শব্দ করেন, না-কি অপছন্দের বই হলে করেনতা এখনো বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কক কিক শব্দটার সঙ্গে মুরগির ডাকের সাদৃশ্য আছে। গৃহভৃত্য বিষয়ে আমার বাবার কিছু উপদেশবাণী ছিল। উপদেশবাণীর সার অংশ হচ্ছে— মহাপুরুষদের কিছুকাল গৃহতৃত্য হিসেবে থাকতে হবে। তিনি ডায়েরিতে কি লিখে গেছেন হুবহু তুলে দিচ্ছি। এই অংশটি তিনি মৃত্যুর আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। হাতের লেখা জড়ানো এবং অস্পষ্ট। মানুষের মানসিক অবস্থার ছাপ পড়ে হাতের লেখায়। আমার ধারণা তখন তাঁর মানসিক অবস্থাও ছিল এলোমেলো। লেখার শিরোনাম–হিজ মাস্টার্স ভয়েস। তিনি সব লেখাই সাধু ভাষায় লেখেন। এই প্রথম সাধু ভাষা বাদ দিয়ে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েস হিমু, তুমি নিশ্চয় রেকর্ড কোম্পানি— হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড দেখেছি। তাদের মনোগ্রামে একটি কুকুরের ছবি আছে। কুকুরটা থাবা গেড়ে তার মনিবের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রভুর প্রতি আনুগত্য ঝরে ঝরে পড়ছে। সব মহাপুরুষদের কিছু দিন কুকুর জীবন যাপন করা বাধ্যতামূলক। সে একজন প্রভুর অধীনে থাকবে। প্রভুর কথাই হবে তার কথা। প্রভুর আদেশ পালনেই তার জীবনের সার্থকতা। প্রভুর ভাবনাই হবে তার ভাবনা। প্ৰভু মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাই সে সত্য বলে ধরে নিবে। কুকুর ট্রেনিং-এ উপকার যা হবে তা নিম্নরূপ : ক. জীবনে বিনয় আসবে। বিনয় নামক এই মহৎ গুণটি আয়ত্ত করা প্ৰায় অসম্ভব। আমি অতি বিনয়ী মানুষকেও দেখেছি অহংকারের গুদাম। সেই গুদাম তালাবদ্ধ থাকে বলে কেউ তার অহংকার প্রত্যক্ষ করতে পারে না। খ. আনুগত্য কি তা শেখা যাবে। প্রতিটি মানুষ নিজের প্রতিই শুধু অনুগত। অন্যের প্রতি নয়। নিজের প্রতি আনুগত্য যে সৰ্ব্বজনে ছড়িয়ে দিতে পারবে সেইতো মহামানব। গ. মানুষকে সেবা করার প্রথম পাঠের শুরু। কুকুর ট্রেনিং কিংবা গৃহভৃত্য ট্রেনিং তোমাকে সেবা নামক আরেকটি মহৎ গুণের সংস্পর্শে আনবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল না, তোমাকে সত্যি সেবা শিখতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অসুস্থ মানুষদের সেবা করতেন। তারা এমনিতেই সেবার দাবিদার। তোমাকে সুস্থ মানুষকে সেবা করতে হবে। আমি নিজে এখন অসুস্থ। সময় ঘনিয়ে আসছে। এরূপ মনে হয়। তোমাকে পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং দিয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। যেসব শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব না, আমার আদেশ, সেসব শিক্ষা নিজে নিজে গ্ৰহণ করবে। এখন অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলি—-গত পরশু দুপুরে আমি তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্ন মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। মানুষ যখন নিদ্ৰা যায় তখন মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে, তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিষ্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে। ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন, সব স্বপ্নের মূলে আছে যৌনতা। এই ধারণা যে কতটা ভুল তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। যাই হোক, এখন স্বপ্নের কথা বলি। আমি তোমার কিশোরী মাকে স্বপ্নে দেখলাম। এটা কীভাবে সম্ভব হল জানি না। কারণ তাকে আমি কিশোরী অবস্থায় কখনো দেখি নাই। যখন তাকে বিবাহ করি তখন তার বয়স বাইশ। সে একজন তরুণী। আমি দেখলাম। সে তার গ্রামের বাড়িতে। কুয়ার পাড়ে বসে আছে। তার সামনে এক বালতি পানি। সে চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। তোমার মা অতি রূপবতীদের একজন— এই তথ্য মনে হয় তুমি জান না। কারণ, তার মৃত্যুর পর আমি তার সমস্ত ফটোগ্রাফ নষ্ট করে দিয়েছি। তার স্মৃতি জড়িত সব কিছুই ফেলে দেয়া হয়েছে। কারণ স্মৃতি মানুষকে পিছনে টেনে ধরে। মহাপুরুষদের পিছুটান থেকে মুক্ত থাকতে হয়। স্বপ্নের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমার মা চোখেমুখে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তোমার মা অত্যন্ত আনন্দিত গলায় বলল, তুমি একা এসেছ, আমার ছেলে কই? আমি বললাম, তাকে ঢাকা শহরে রেখে এসেছি। সে করুণ গলায় বলল, আহারে, কত দিন তাকে দেখি না! সে না-কি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। এটা কি সত্যি? হ্যাঁ সত্যি। তুমি তাকে সুন্দর একটা শার্ট কিনে দিও। একটা প্যান্ট কিনে দিও। এক জোড়া জুতা কিনে দিও। আচ্ছা দিব। তোমার মা তখন কাঁদতে শুরু করে এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওরা কি কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে? কোনো মেয়ে কি ভালোবেসে তার হাত ধরেছে? আমি বললাম, না। সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে। তার জন্যে নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ। তোমার মা চোখের পানি মুছে রাগী ব্লাগী গলায় বলল, সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে, না কিছু করছে। তাকে তুমি আমার কাছে নিয়ে আস। আমি থাবড়ায়ে তাঁর মহাপুরুষগিরি ছুটায়ে দিব। স্বপ্নের এই জায়গায় আমার ঘুম ভেঙে
false
shorotchandra
করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই। তাহার জবাব শুনিয়া উভয়েই আশ্চর্য হইয়া উঠিল। রাসবিহারী কহিলেন, কে আবার তোমাকে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেল? কার কথা তুমি বলছ? বিলাস ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, জগদীশবাবুর সু-পুত্র নরেনবাবুর কথাই বলছি বাবা। তিনিই একদিন ঠিক এই ঘরে বসেই আমাকে অপমান করে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে চিনতুম না তাই—বলিয়া ইঙ্গিতে বিজয়াকে দেখাইয়া কহিল, নইলে ওঁকেও অপমান করে যেতে সে কসুর করেনি—তোমরা জান সে কথা? বিজয়া চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া চাইতেই, বিলাস তাহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিল, পূর্ণবাবুর ভাগ্নে বলে পরিচয় দিয়ে যে তোমাকে পর্যন্ত অপমান করে গিয়েছিল, সে কে? তখন যে তাকে ভারি প্রশ্রয় দিলে। সে-ই নরেনবাবু! তখন নিজের যথার্থ পরিচয় দিতে যদি সে সাহস করতো তবেই বলতে পারতুম, সে পুরুষমানুষ! ভণ্ড কোথাকার! সহসা পিতাপুত্র উভয়েই সবিস্ময়ে দেখিল, বিজয়ার সমস্ত মুখ বেদনায় একেবারে শুষ্ক বিবর্ণ হইয়া গেছে। দশম পরিচ্ছেদ বড়দিনের ছুটির আর বিলম্ব নাই। সুতরাং জগদীশের বাটীর প্রকাণ্ড হলঘরটা মন্দিরের জন্য, এবং অপরাপর কক্ষগুলি কলিকাতার মান্য অতিথিদের নিমিত্ত সজ্জিত করা হইতেছে। স্বয়ং বিলাসবিহারী তাহার তত্ত্বাবধান করিতেছেন। সাধারণ নিমন্ত্রিতের সংখ্যাও অল্প নয়। যাঁহারা বিলাসেরই বন্ধু, স্থির হইয়াছিল তাঁহারা রাসবিহারীর বাটীতে এবং অবশিষ্ট বিজয়ার এখানে থাকিবেন। মহিলা যাঁহারা আসিবেন তাঁহারাও এইখানেই আশ্রয় লইবেন। বন্দোবস্তও সেইরূপ হইয়াছিল। সেদিন সকালবেলায় বিজয়া স্নান সারিয়া নীচে বসিবার ঘরে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখিল, প্রাঙ্গণের একধারে দাঁড়াইয়া পরেশ একহাতে মায়ের কোঁচড় হইতে মুড়ি লইয়া চিবাইতেছে, অপরহস্তে রজ্জুবদ্ধ একটা গরুর গলায় হাত বুলাইয়া অনির্বচনীয় তৃপ্তি লাভ করিতেছে। গরুটাও আরামে চোখ বুজিয়া গলা উঁচু করিয়া ছেলেটার সেবা গ্রহণ করিতেছে। এই দুটি বিজাতীয় জীবের সৌহৃদ্যের সহিত তাহার মনের পুঞ্জীভূত বেদনার কি যে সংযোগ ছিল বলা কঠিন; কিন্তু চাহিয়া চাহিয়া অজ্ঞাতসারে তাহার চক্ষু দুটি অশ্রুপ্লাবিত হইয়া গেল। এ বাটীতে এ ছেলেটি তাহার ভারী অনুগত। সে চোখ মুছিয়া তাহাকে কাছে ডাকিয়া সস্নেহে কৌতুকের সহিত কহিল, হাঁ রে পরেশ, তোর মা বুঝি তোকে এই কাপড় কিনে দিয়েছে? ছিঃ—এ কি আবার একটা পাড় রে? পরেশ ঘাড় বাঁকাইয়া, আড়চোখে চাহিয়া নিজের পাড়ের সঙ্গে বিজয়ার শাড়ীর চমৎকার চওড়া পাড়টা মনে মনে মিলাইয়া দেখিয়া অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তাহার ভাব বুঝিয়া বিজয়া নিজের পাড়টা দেখাইয়া কহিল, এম্‌‌নি না হলে কি তোকে মানায়! কি বলিস রে? পরেশ তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল, মা কিচ্ছু কিনতে জানে না যে। বিজয়া কহিল, আমি কিন্তু তোকে এমনি একখানা কাপড় কিনে দিতে পারি, যদি তুই—কিন্তু ‘যদি’তে পরেশের প্রয়োজন ছিল না। সে সলজ্জ হাস্যে মুখখানা আকর্ণ-প্রসারিত করিয়া প্রশ্ন করিল, কখন দেবে? দিই, যদি তুই আমার একটা কথা শুনিস। কি কথা? বিজয়া একটু চিন্তা করিয়া বলিল, কিন্তু তোর মা কি আর কেউ শুনলে তোকে পরতে দেবে না। এ সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রতিবন্ধক গ্রাহ্য করিবার মত মনের অবস্থা পরেশের নয়। সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মা জানবে ক্যাম্‌নে? তুমি বল না, আমি এক্ষুণি শুনব। বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুই দিঘ্‌ড়া-গাঁ চিনিস? পরেশ হাত তুলিয়া বলিল, ওই ত হো‌থ্‌থা। গুটিপোকা খুঁজতে কতদিন দিঘ্‌ড়ে যাই। বিজয়া প্রশ্ন করিল, ওখানে সবচেয়ে বড় কাদের বাড়ি, তুই জানিস? পরেশ বলিল, হিঁ—বামুনদের গো। সেই যে আর বছর রস খেয়ে তিনি ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ্যালো। এই যেন হেথায় গোবিন্দের মুড়কি-বাতাসার দোকান, আর ওই হোত্থায় তেনাদের দালান।গোবিন্দ কি বলে জানো মাঠান? বলে, সব মাগ্যি-গোণ্ডা, আধ পয়সায় আর আড়াই গোণ্ডা বাতাসা মিলবে না, এখন মোটে দু’ গোণ্ডা। কিন্তু তুমি যদি একসঙ্গে গোটা পয়সার আনতে দাও মাঠান, আমি তা হলে সাড়ে-পাঁচ গোণ্ডা নিয়ে আসতে পারি। বিজয়া কহিল, তুই দু’পয়সার বাতাসা কিনে আনতে পারবি? পরেশ কহিল, হিঁ—এ হাতে এক পয়সার সাড়ে পাঁচ গোণ্ডা গুণে নিয়ে বলব, দোকানী, এ হাতে আরো সাড়ে-পাঁচ গোণ্ডা গুণে দাও। দিলে বলব, মাঠান বলে দেছে দুটো ফাউ—নাঃ? তবে পয়সা দুটো হাতে দেব, নাঃ? বিজয়া হাসিয়া কহিল, হাঁ, তবে পয়সা দিবি। আর অমনি দোকানীকে জিজ্ঞেস করে নিবি, ওই যে বড় বাড়িতে নরেনবাবু থাকত, সে কোথায় গেছে! বলবি—যে বাড়িতে তিনি আছেন, সেটা আমাকে চিনিয়ে দিতে পার দোকানী? কি রে পারবি ত? পরেশ মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিল, হিঁ—পয়সা দুটো দাও না তুমি। আমি ছুট্টে গে নে আসি। আমি যা জিজ্ঞেসা করতে বললুম? পরেশ কহিল, হিঁ—তা-ও। বাতাসা হাতে পেয়ে ভুলে যাবিনে তো? পরেশ হাত বাড়াইয়া বলিল, তুমি পয়সা আগে দাও না! আমি ছুট্টে যাই। আর তোর মা যদি জিজ্ঞেস করে, পরেশ, গিয়েছিলি কোথায়, কি বলবি? পরেশ অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত হাস্য করিয়া কহিল, সে আমি খুব বলতে পারব। বাতাসার ঠোঙা এমনি কোরে কোঁচড়ে নুকিয়ে বলব, মাঠান পাঠিয়ে ছ্যালো—ঐ হোত্থা বামুনদের নরেনবাবুর খবর জানতে গেছলাম। তুমি দাও না শিগ্‌‌গির পয়সা। বিজয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, তুই কি বোকা ছেলে রে পরেশ, মায়ের কাছে কি মিছে কথা বলতে আছে? বাতাসা কিনতে গিয়েছিলি, জিজ্ঞেস করলে তাই বলবি। কিন্তু দোকানীর কাছে সে খবরটা জেনে আসতে ভুলিস নে যেন। নইলে কাপড় পাবিনে, তা বলে দিচ্ছি। আচ্ছা, বলিয়া পরেশ পয়সা লইয়া দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলে, বিজয়া শূন্যদৃষ্টিতে সেই দিকেই চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যে সংবাদ জানিবার কৌতূহলের মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নাই, যাহা সে যে-কোন লোক পাঠাইয়া অনেকদিন পূর্বেই স্বচ্ছন্দে জানিতে পারিত, তাহাই যে কেন এখন তাহার কাছে এতবড়
false
toslima_nasrin
কেবল হৃদয় খুলে যদি দেখাতে পারিতাম। কাকে দেখাবো! কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না। কষ্টগুলো আড়াল করে রাখি। সংগোপনে কেবল নিজের জন্য রাখি। রুদ্রই যদি নেই, দেখে আর কার কী লাভ! ইসহাক খান নামে রুদ্রর এক বন্ধু লিখছেন বলছেন খিস্তি ছুঁড়ছেন আমার বিরুদ্ধে, আমি নাকি রুদ্রর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমিই রুদ্রকে হত্যা করেছি। কী করে হত্যা করেছি, তা অবশ্য তিনি বলেননি। তাঁর লেখা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ইসহাককে আমি চিনি দীর্ঘদিন। রুদ্রর কাছে প্রায়ই আসতেন। সংসারে অভাব ছিল তাঁর, রুদ্রর উদার হস্ত, বন্ধুকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করত। ইসহাকের সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে আমার, অন্তর ঢেলে আপ্যায়ন করেছি। ইসহাক খান গল্প লেখেন, গল্পকার হিসেবে তেমন টাকা রোজগার করতে পারেননি, এখন কুৎসা রটিয়ে রোজগার করছেন। তসলিমা বিষয়ে যে কোনও লেখাই এখন পত্রিকাগুলো লুফে নেয়। কিছু ছাপাতে তাঁর এখন আর অসুবিধে হয় না। ইসহাকের লেখা পড়ে, আমি নিশ্চিত, পাঠকেরা চুক চুক করে দুঃখ করেছে রুদ্রর জন্য আর আমাকে ছিনাল পিশাচ খানকি বলে গাল দিয়েছে। রুদ্রর এক বন্ধু একদিন হেসে বলল, ‘রুদ্র না থাকায় মাগনা মদ খেতে পাচ্ছেন না বলে ইসহাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’ রুদ্রকে নিয়ে বাণিজ্য করার ধুম পড়েছে চারদিকে। একদিন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নামের এক কবি আসে, আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠিগুলো যেন তাকে দিই, ছাপবে সে। আমি না বলে দিই। এই দুলালই রুদ্রর ট্রাক থেকে পেছনে রিক্সায় বসা আমার দিকে দলা দলা ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিল। যে কাজটি সবচেয়ে জরুরি সে কাজটি করি। রুদ্রর সমগ্রটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। রুদ্রর খুব ইচ্ছে ছিল তার সমগ্র প্রকাশ হোক। বেঁচে থাকলে কেউ প্রকাশ করেনি। রুদ্র কি তাই মরে গেল! মরে গিয়ে তার সমগ্র করার সুযোগ দিয়ে গেল! যা কিছু জীবনে সে লিখেছিল, সব নিয়ে সমগ্র। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। খোকা এবার আর রুদ্রর সমগ্র বের করতে অনিচ্ছ! প্রকাশ করেননি। বইয়ের রয়্যালটি চলে যাবে রুদ্রর ভাই বোনদের কাছে। সম্পাদনার দায়িত্ব অসীম সাহার। আমার দায়িত্ব প্রুফ দেখা। ইত্যাদি প্রেসে ছাপা হতে থাকা রুদ্রর লেখাগুলোর প্রুফ যখন দেখি ঘরে বসে, যেন প্রুফ দেখি না, দেখি রুদ্রকে। যেন বসে আছে পাশে, শুনছে সে, আমি তার কবিতাগুলো পড়ছি, বার বার পড়ছি। প্রতিটি শব্দ পড়ছি, প্রতিটি অক্ষর। মেঝের ওপর একরাশ কাগজের মধ্যে সারা সারা রাত প্রুফ দেখতে দেখতে কোনও কোনও সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি ওই কাগজের ওপরই মাথা রেখে। স্বপ্নে রুদ্র আর আমি দুজন আমরা হাতে হাত রেখে হাঁটি আর কবিতার কথা বলি। রুদ্র কমিটি গঠন করে অসীম সাহা এবং আরও কয়েকজন রুদ্রর নামে মেলার আয়োজন করেন। মেলায় বই বিক্রি হয়, কুটির শিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। এই মেলাই অকাল প্রয়াত এক প্রতিভাবান কবিকে প্রতিবছর স্মরণ করার দায়িত্ব নিয়েছে। রুদ্রকে নিয়ে অনুষ্ঠানে এখন অনেক বড় বড় লেখকরাই বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রকে স্মরণ করেন, যাঁরা ইচ্ছে করলেই পারতেন রুদ্রকে ঢাকায় একটি চাকরি যোগাড় করে দিতে। রুদ্র তো দ্বারে দ্বারে কম ঘোরেনি। সেই গানটি, ভাল আছি, ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো টেলিভিশনের একটি নাটকে ব্যবহার হওয়ার পর লোকের মুখে মুখে ফেরে। বেঁচে থাকলে কী বিষম আনন্দ পেত রুদ্র। বেঁচে থাকলে তার গান কি টেলিভিশনের কেউ ব্যবহার করতে চাইত! কে জানে! আকাশের ঠিকানায় আমি প্রতিদিন চিঠি লিখি রুদ্রকে। চিঠি সে পাক বা না পাক, লিখি। অবকাশ থেকে আমার সব জিনিসপত্র, আরমানিটোলা থেকে যেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল, মাকে বলেছিলাম নিয়ে আসতে, বৈঠকঘরের বইয়ের আলমারিতে রাখা আমার বইগুলো তো আনবেনই, আলমারিটিও যেন আনেন। ময়মনসিংহে ট্রাক ভাড়া করে মা জিনিসপত্র ট্রাকে তুলে নিয়ে এলেন শান্তিবাগের বাড়িতে। তখন রাত অনেক হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ঘরে ওঠানো হলে দেখি সব আছে, কেবল বইয়ের আলমারিটিই নেই। মা ক্লান্তিতে নুয়ে আছেন। ঘামছিলেন। মাকে ধমকে আরও ঘামিয়ে দিই। ‘বুকশেল্ফ আনো নাই কেন?’ মা বললেন, ‘কত চাইছি, তর বাপে দিল না। বইয়ের আলমারিটি আমার নিজের না হলেও বাপের।’ কিন্তু মেয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, দেওয়া কি যেত না আলমারিটি! মা কেঁদে ফেলেন, ‘আমি কি করতাম! তর বাপেরে এত কইলাম। তর বাপে কিছুতেই দিল না।’ আমি চেঁচিয়ে বলি, ‘দিল না কেন? বুকশেলফে তো আমার বই ই ছিল। এহন খালি বুক শেলফের মধ্যে কী ঘোড়ার ডিম সাজাইব? সব বই তো নিয়া ‌আইছি। অবকাশে কেউ বই পড়ে? কি করব আলমারি দিয়া? খাইব?’ মা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমি কইছি তর বাপেরে যে এইডা দেইন, মেয়েডা কইয়া দিছে, বই রাখব। ভ্যাংচাইয়া উডে। কয় এইডা আমি বানাইছি। তার দরকার লাগলে সে কিন্যা নিব নে।’ আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ‘সে দিল না তো তুমি জোর কইরা নিয়া আইলা না কেন! ট্রাকে যখন উডাইছো আমার জিনিসপত্র, কেন ওইডাও তুইল্যা লইলা না। এহন বই যে সব আনছো, বই আমি রাখবো কই? বুকশেল্ফটাই তো সবচেয়ে দরকার ছিল। কি রকম বাপ হইছে যে একটা বুকশেল্ফ দিতে পারে না নিজের মেয়েরে!’ বাবার ওপর রাগ আমার গিয়ে পড়ে মার ওপর। মা আমার গাল খেয়ে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। কারও কান্না আমার সহ্য হয় না। দুপাশে সাইডটেবিল সহ নরম স্পঞ্জের গদিঅলা নতুন একটি বড় খাট, লেখার টেবিল, চেয়ার, কাঠের সোফা কেনার
false
MZI
ডেঞ্জারাস। কোনো কিছু ধরলে ছাড়ে না। আমরা ভেবেছিলাম, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা আছে। এই পদ্ধতি ভালো না। তখন সবাই আরও বেশি জানতে চায়। মুখ বন্ধ করার রেট দেখতে দেখতে আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। মানুষগুলো নিচু গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলতে থাকে। আপাতত কিছুক্ষণের জন্য তাদের থামানো গেছে। ঈশিতা এবার একটু বেশি সাহসী হয়ে উঠল। বলল, আমি তোমাদের কাজে ডিস্টার্ব করব না—যে জন্য এসেছি, সেটা শেষ করে চলে যাই। কী জন্য এসেছ? আমি বাচ্চাটার একটা ছবি নিতে এসেছি। মানুষগুলো চমকে উঠল, ছবি? ছবি নেবে কেন? দেখব, এটা মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? আমরা একটা বাচ্চার ব্রেনে ইমপ্ল্যান্ট লাগিয়ে স্টিমুলেশান দিচ্ছি, সেই ছবি তুমি মিডিয়াকে দেবে? ঈশিতা সহৃদয়ভাবে হাসল। বলল, তোমার ভয় নেই। আমি মোটেও বলিনি মিডিয়াকে দেব। আমি বলেছি মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না, সেটা দেখব। নীল চোখের মানুষটি বলল, এই পুরো প্রজেক্টের গোড়ার কথা হচ্ছে গোপনীয়তা, আর তুমি বলছ, এর ছবি মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না, ভাবছ? হুবহু এই ছবি দেওয়া হবে না। এটাকে টাচআপ করা হবে—ফটোশপ দিয়ে মাথার টিউব সরানো হবে, মোটেও বলা হবে না যে আমরা তার ব্রেনে ইমপ্ল্যান্ট বসিয়েছি। আমরা বলব, এই ছেলেটিকে আমরা বাঁচানোর চেষ্টা করছি। একজন মানুষ বলল, না, না। এই আইডিয়াটা ভালো না। ঈশিতা তার মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলল, এই আইডিয়াটা ভালো না খারাপ, সেটা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তার জন্য প্রফেশনালরা আছে। স্পর্শকাতর বিষয় কীভাবে পাবলিককে খাওয়াতে হয়, তার জন্য সোশ্যাল সাইকোলজি নামে নতুনু ডিসিপ্লিন তৈরি হয়েছে। মানুষগুলো কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে বিছানায় শুয়ে থাকা অসহায় শিশুটির কয়েকটা ছবি তোলে। ছবি তোলা শেষ করে সে ক্যামেরাটা বন্ধ না করে ভিডিও মোডে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখে। এখন সে যে দিকেই ঘুরবে, ক্যামেরা ভিডিও করে নেবে। এই মানুষগুলোর ভেতরে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে সে যতটুকু সম্ভব তাদের ছবি তুলে নিতে চায়। ঈশিতা মানুষগুলোর দিকে ঘুরে বলল, তোমরা তোমাদের কাজ করো। কী মনে হয়, তোমরা কি আরেকটা মাইলফলক দিতে পারবে? এটা কী বলছ, আমরা আরও দুইটা মাইলফলক করে ফেলেছি, সেগুলো কাউকে জানাতে পারছি না। ছেলেটা বেঁচে থাকবে? সেটাই তো মুশকিল। শরীরের সব মেজর অর্গান ফেল করতে শুরু করেছে। কোনোভাবে আর চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আরও একটা বড় ব্রেক থ্রু হবে। ঈশিতার ভেতরটা কেমন যেন শিউরে উঠল, বাইরে সে প্রকাশ করল। সহজ গলায় বলল, আমার সব সময়ই একটা জিনিস নিয়ে কৌতূহল, আমি সাইকোলজি পড়েছি, কিন্তু টেক্সট বুকে এগুলো থাকে না। যখন তোমরা ছেলেটার ব্রেনটাকে হাই স্টিমুলেশান দিয়ে ব্যবহার করো, তখন ছেলেটা কী কিছু অনুভব করে? নীল চোখের মানুষটি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা জানি না। মনে হয়, তার অনুভূতিটা হয় কোনো একটা স্বপ্ন দেখার মতো। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি যে মানুষটি, সে মোটা গলায় বলল, স্বপ্ন নয়, বলা উচিত, দুঃস্বপ্ন। বাচ্চাটা কী রকম ছটফট করে, দেখেছ? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওর কষ্ট হয়। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি হাত নাড়িয়ে বলল, আমরা ওসব নিয়ে কথা না বললাম। ঈশিতা বলল, হ্যাঁ, কথা না বললাম। সে দরজার দিকে এগোতে এগোতে থেমে গিয়ে বলল, তোমাদের যদি আমার কাছে কোনো প্রশ্ন থাকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। আমি সিস্টেমে আছি। দাড়ি-গোঁফওয়ালা মানুষটি বলল, এক সেকেন্ড রাইসা, আমি একটু দেখে নিই। তুমি কিছু মনে কোরো না, এই ঘরে তোমার উপস্থিতি আমাদের জন্য খুব বড় একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। ঈশিতা সহৃদয়ভাবে হাসল। বলল, আমি কিছু মনে করব না। তুমি সিস্টেমে আমার প্রোফাইল দেখে নিশ্চিত হয়ে নাও যে আমি তোমাদের একজন। আমি পুলিশ বাহিনীর একজন সিক্রেট এজেন্ট না। মানুষটা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ঈশিতার ছবি, নাম-পরিচয় বের করে এনে একনজর দেখে মাথা নাড়ল। বলল, থ্যাংকু রাইসা। তুমি তোমার কাজ করো। ঈশিতা ঘর থেকে বের হয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার ক্যামেরায় যেটুকু তথ্য আছে, সেটা এদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ছেলেটির ছবি থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই মানুষগুলোর ভিডিও। ঘরের ভেতর যথেষ্ট আলো ছিল, ভিডিওটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। যন্ত্রপাতির একটা শব্দ থাকলেও কথাবার্তা ভালোভাবে রেকর্ড হয়ে যাওয়ার কথা। এখন তাকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। সিড়ি দিয়ে নেমে করিডর ধরে ডান দিকে। ঈশিতা দ্রুত হাঁটতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে করিডর ধরে হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছায়। ঢোকার সময় আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনা স্ক্যান করে ঢুকতে হয়েছিল। বের হওয়া খুব সহজ, দরজার নব ঘোরালেই দরজা খুলে যাবে। ঈশিতা নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতেই চমকে উঠল। দরজার অন্য পাশে বব লাস্কি দাঁড়িয়ে আছে। ঈশিতা বব লাস্কিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যাচ্ছিল। বব লাস্কি তাকে থামাল, এই যে তুমি, শোনো। ঈশিতা দাঁড়াল। বব লাস্কি বলল, তুমি কে? আমি রাইসা সুলতানা। একজন নতুন এমপ্লয়ি। সেটা অবশ্যি দেখতে পাচ্ছি। এনডেভার থেকে বের হতে চাইলে আগে সেখানে ঢুকতে হয়। আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম এমপ্লয়ি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেবে না। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের এমপ্লয়ি। ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। আমি কি এখন যেতে পারি? ছোট একটা ইমার্জেন্সি ছিল। তুমি অবশ্যই যাবে
false
shorotchandra
একটা আশীর্বাদও করলে না? চন্দ্রনাথ উপর দিকে চাহিয়া বলিল, এখন নয়। যখন চলে যাবে, যখন মৃতদেহ পুড়ে ছাই হবে, তখন আশীর্বাদ করব। সরযূ পা ছাড়িয়া দিয়া বলিল, তাই করো। চন্দ্রনাথ চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই সে আর একবার উঠিয়া গিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি বিষ খেলে কোন বিপদ তোমাকে স্পর্শ করবে না ত? কিছু না। কেউ কোন রকম সন্দেহ করবে না ত? নিশ্চয় করবে। কিন্তু টাকা দিয়ে লোকের মুখ বন্ধ করব। সরযূ বলিল, বিছানার তলায় একখানা চিঠি লিখে রেখে যাব, সেইখানা দেখিয়ো। চন্দ্রনাথ কাছে আসিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিল, তাই করো। বেশ ক’রে লিখে নীচে নিজের নাম স্পষ্ট ক’রে লিখে রেখো—কেউ যেন না বুঝতে পারে, আমি তোমাকে খুন করেচি। আর একটা কথা, ঘরের দোর-জানালা বেশ ক’রে বন্ধ ক’রে দিয়ো—একবিন্দু শব্দ যেন বাইরে না যায়। আমি যেন শুনতে না পাই— সরযূ দ্বার ছাড়িয়া দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া আর একবার প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তবে যাও—বলিয়াই তাহার কি যেন সন্দেহ হইল—হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, রোসো আর একটু দাঁড়াও। সে প্রদীপ কাছে আনিয়া স্বামীর মুখের দিকে বেশ করিয়া চাহিয়া দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। চন্দ্রনাথ দুই চোখে একটা অমানুষিক তীব্র-দ্যুতি—ক্ষিপ্তের দৃষ্টির মত তাহা ঝকঝক করিয়া উঠিল। চন্দ্রনাথ বলিল, চোখে কি দেখচ সরযূ? সরযূ এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিছু না, আচ্ছা যাও। চন্দনাথ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল-বিড়বিড় করিয়া বলিতে বলিতে গেল—সেই ভাল—সেই ভাল—আজই। দশম পরিচ্ছেদ সেই রাত্রে সরযূ নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া মনে মনে কহিল, আমি বিষ খেতে কিছুতেই পারব না। একা হ’লে মরতে পারতাম কিন্তু আমি ত আর একা নই—আমি যে মা। মা হয়ে সন্তান বধ করব কেমন ক’রে। তাই সে মরিতে পারিল না। কিন্তু তাহার সুখের দিন যে নিঃশেষ হইয়াছে, তাহাতেও তাহার লেশমাত্র সংশয় ছিল না। গভীর রাত্রে চন্দ্রনাথ সহসা তাহার স্ত্রীর ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল এবং সমস্ত শুনিয়া উন্মত্ত-আবেগে তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া স্থির হইয়া রহিল। অস্ফুটে বারংবার কহিতে লাগিল, এমন কাজ কখনো করো না সরযূ, কখনো না। কিন্তু ইহার অধিক সে ত আর কোন ভরসাই দিতে পারিল না। তাহার এই বৃহৎ ভবনে এই হতভাগিনীর জন্য এতটুকু কোণের সন্ধানও ত সে খুঁজিয়া পাইল না, যেখানে সরযূ তাহার লজ্জাহত পাংশু মুখখানি লুকাইয়া রাখিতে পারে। সমস্ত গ্রামের মধ্যে কোথাও একবিন্দু মমতাও সে কল্পনা করিতে পারিল না, যাহার আশ্রয়ে সে তপ্ত অশ্রুরাশির একটি কণাও মুছিতে পারে। কাঁদিয়া কাটিয়া সে সাত দিনের সময় ভিক্ষা করিয়া লইয়াছে। ভাদ্র মাসের এই শেষ সাতটি দিন সে স্বামীর আশ্রয়ে থাকিয়া চিরদিনের মত নিরাশ্রিতা পথের ভিখারিণী হইতে যাইবে। ভাদ্র মাসে ঘরের কুকুর বিড়াল তাড়াইতে নাই,—গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, তাই সরযূর এই আবেদন গ্রাহ্য হইয়াছে। একদিন সে স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, আমার দুরদৃষ্ট আমি ভোগ করব, সে জন্য তুমি দুঃখ করো না। আমার মত দুর্ভাগিনীকে ঘরে এনে অনেক সহ্য করেছ, আর করো না। বিদায় দিয়ে আবার সংসারী হও, আমার এমন সংসার যেন ভেঙ্গে ফেলো না। চন্দ্রনাথ হেঁটমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকে। ভালমন্দ কোন জবাবই খুঁজিয়া পায় না। তবে, এই কথাটা তাহার মনে হইতেছে, আজকাল সরযূ যেন মুখরা হইয়াছে। বেশি কিছু কথা কহিতেছে। এতদিন তাহার মনের মধ্যে যে ভয়টা ছিল, এখন তাহা নাই। দু’দিন পূর্বেও সে মুখ ঢাকিয়া, মুখোশ পরিয়া এ সংসারে বাস করিতেছিল; তখন সামান্য বাতাসেও ভয় পাইত, পাছে তাহার ছদ্ম আবরণ খসিয়া পড়ে, পাছে তাহার সত্য পরিচয় জানাজানি হইয়া যায়। এখন তাহার সে ভয় গিয়াছে। তাই এখন নির্ভয়ে কথা কহিতেছে। এ জীবনে তাহার যাহা-কিছু ছিল, সেই স্বামী, তাহার সর্বস্ব, সমাজের আদালত ডিক্রি জারি করিয়া নিলাম করিয়া লইয়াছে। এখন সে মুক্তঋণ, সর্বস্বহীন সন্ন্যাসিনী। তাই সে স্বামীর সহিত স্বচ্ছন্দে কথা কহে, বন্ধুর মত, শিক্ষকের মত উপদেশ দিয়া নির্ভীক মতামত প্রকাশ করে। আর সেদিনের রাত্রে দুইজন দুইজনকে ক্ষমা করিয়াছে। চন্দ্রনাথ বিষ খাইতে প্রলুব্ধ করিয়াছিল, তাহার এ আত্মগ্লানি সরযূর সব দোষ ঢাকিয়া দিয়াছে। পরদিন প্রাতঃকাল হইতে হরকালী একখন্ড কাগজে টিকিট আঁটিয়া স্বামীকে দিয়া মাথামুণ্ডু কত-কি লিখাইতেছিলেন। ব্রজকিশোর একবার জিজ্ঞাসা করিলেন, এত লিখে কি হবে? হরকালী তাড়া দিয়া বলিলেন, তোমার যদি একটুও বুদ্ধি থাকত, তা’হলে জিজ্ঞেস করতে না। একবার আমার কথা না শুনে এইটি ঘটেছে, আর কোন বিষয়ে নিজের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না। হরকালী যাহা বলিলেন, সুবোধ শিশুর মত ব্রজকিশোর তাহা লিখিয়া লইলেন। শেষ হইলে হরকালী স্বয়ং তাহা আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ঠিক হয়েছে। নির্বোধ ব্রজকিশোর চুপ করিয়া রহিলেন। অপরাহ্ণে হরকালী কাগজখানি হাতে লইয়া সরযূর কাছে আসিয়া কহিলেন, বউমা, এই কাগজখানিতে তোমার নামটি লিখে দাও। কাগজ হাতে লইয়া সরযূ মুখপানে চাহিয়া কহিল, কেন মামীমা? যা বলচি, তাই কর না বউমা! কিসে নাম লিখে দেব, তাও কি শুনতে পাব না? হরকালী মুখখানা ভারী করিয়া কহিলেন, এটা বাছা তোমারই ভালর জন্য। তুমি এখানে যখন থাকবে না, তখন কোথায় কিভাবে থাকবে, তাও কিছু আমরা আর সন্ধান নিতে যাবো না। তা বাছা, যেমন করেই থাক না কেন, মাসে পাঁচ টাকা ক’রে খোরাকি পাবে। একি মন্দ? ভাল-মন্দ সরযূ বুঝিত। এবং এই হিতাকাঙ্ক্ষিণীর বুকের ভিতর যতটুকু হিত
false
humayun_ahmed
হাঁটছে তাতে মনে হয়। পিঠে কুজ গজিয়ে যাবে। জোবেদ আলি বাকেরকে না দেখার ভান করে সরে পড়তে চাইছিল। বাকের সে সুযোগ দিল না। এগিয়ে গেল এই যে ব্রাদার, পালাচ্ছেন নাকি? জোবেদ আলি আমতা আমতা করে বলল–কে? চিনতে পারছেন না? ভাল করে দেখেন। মাথাটা কামিয়ে ফেলেছি। বাকি সব ঠিকই আছে। আমার কিছু মনে থাকে না। সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে চারপাশে নিয়ে থাকেন মনে না থাকারই তো কথা। আমার নাম বাকের। ও আচ্ছা বাকের সাহেব। চিনতে পারছেন তাহলে? জি। অনেক’দিন আপনাকে দেখি নাই। দেখবেন কি করে–আমি হাজতে ছিলাম। আপনাদের দোয়ায় আজ ছাড়া পেয়েছি। জোবেদ আলির চোখ সরু হয়ে গেল। চশমা ঝুলে পড়ল। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এখন যাই। কাজ আছে। আরে ভাই এই চৈত্র মাসের দুপুরে কিসের কাজ? দাঁড়ান একটু গল্পগুজব করি। মেয়ে কি আপনাদের এখনো তিনটাই না। আরো বাড়িয়েছেন? আপনার কথা বুঝলাম না। বিজনেস আরো বড় করেছেন না। আগের মত ছোটখাটো আছে? আপনি খুব বেতালা কথা বলেন। তাই নাকি? বেতালা কথা বেশি বলা ভাল না। জোবেদ আলি হাঁটা শুরু করল। মাথা নিচু করে চোরের মতো ভঙ্গিতে হাঁটা। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরল। বাকের তাকিয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। কিছুক্ষণ আগে যে বিরক্তি তাকে ঘিরে ছিল এখন আর তা নেই। তার বেশ মজা লাগছে। ইয়াদের বাসায় যাবার ব্যাপারে এখন বেশ আগ্রহ বোধ করছে। ইয়াদ বাসায় ছিল না। দরজা খুলল তার বৌ। ছোটখাটো একটা মেয়ে মাত্র গোসল করে এসেছে। চুলে গামছা জড়ানো গায়ের শাড়িও ভালমত পরা নেই। সে ভেবেছে ইয়াদ। কড়া নাড়া মাত্র দরজা খুলে এমন হকচাকিয়ে গেছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, উনি বাসায় নেই। কোথায় গেছে? অফিসে। আমার নাম বাকের। আজ হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছি। মেয়েটি কিছুই বলল না। সে শাড়ি দিয়ে নিজেকে ভালমত ঢাকতেই ব্যস্ত। ইয়াদ আসবে কখন? সন্ধ্যার পর আসবে। আপনি সন্ধ্যার পর আসুন। মেয়েটি এমন ভাবে দরজা বন্ধ করল যেন সে একজন ভিখিরিকে পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দিচ্ছে। বাকেরের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বলতে পারত। আপনি বসূন। বসুন বললেই তো সে খালি বাড়িতে হুঁট করে ঢুকে যেত না। মেয়েটি তাহলে এ রকম করল কেন? কোথায় যাওয়া যায়? সারা গায়ে প্রচুর ফেনা তুলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল কবার জন্যে মন কেমন করছে। গোসলের পর গরম এক কাপ চা। একটা ফাইভ ফাইভ কিংবা বেনসন। বাকের আবার রাস্তায় নামল। সূর্য হেলে পড়েছে। কিন্তু এখনো তার কী প্রচণ্ড তেজ। রাস্তায় পিচ গলে যাচ্ছে। জুতার সঙ্গে লেগে সমান মোটা হলে একটা কথা ছিল … একটা বেশি উঁচু অন্যটা। কম। যার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। বাকের ভাই না? কবে ছাড়া পেয়েছেন? অচেনা একটা ছেলে। দাঁত বের করে আছে। ইয়ারকি দিতে চায় সম্ভবত। কিংবা তাকে দেখে যে কোন কারণেই হোক মজা পাচ্ছে। আপনাকে অবিকল কোজাকের মতো লাগছে। তাই নাকি? ছেলেটি মাথা ঝাকাল। বাকের একবার ভাবল ব্যাপারটা গুরুত্ব দেবে না। চেংড়া ছেলে।পুলের সব কথা ধরতে নেই। তবু শেষ সময়ে মাথায় কি যেন হল বাকের প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটি ছিটকে পড়ল। রাস্তায়–সেখান থেকে গড়িয়ে গেল আরো কিছু দূর। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। বাকের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। জলিল মিয়ার স্টলে গিয়ে এক কাপ চা খেলে হয়। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছে। সারা শরীরে ঘামের কটু গন্ধ। আশ্চর্য কোথাও গিয়ে সে কি শান্তিমত একটা গোসল ও করতে পারবে না? মুনার কাছে গেলে কেমন হয়? ঠিক এই অবস্থায় মুনার সামনে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না। তাছাড়া মুনাকে এখন নিশ্চয়ই পাওয়াও যাবে না। অফিস করছে। সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। অফিস করা মেয়েগুলি আবার অফিস ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরতে পারে না। সাজানো-গোছানো দোকান দেখলেই তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে; ঘণ্টা খানিক চলে যায়। বাকের সন্ধ্যর পর পর মুনাদের বাসার দিকে রওনা হল। ইতিমধ্যে তার বেশভূষা পাল্টে গেছে। গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি (ইয়াদ দিয়েছে), নতুন স্যান্ডেল (কেনা হয়েছে), পকেটে নতুন রুমাল (কেনা)। গালে আফটার শেভ দেয়ায় ভুরিভুর করে গন্ধ বেরুচ্ছে। এটা একটু অস্বস্তিকর। আফটার শেভ না দিলেই হত। মুনাদের বাসায় বিরাট এক তালা ঝুলছে। বাকের তালা ধরেই খানিকক্ষণ ঝাকাঝাকি করল। অফিস থেকে এখনো ফিরেনি তা কি করে হয়? আটটা বাজে। রাত আটটা পর্যন্ত মুনা বাইরে ঘুরবে: নাকি? তালার সাইজ দেখে মন হয় মুনা বেশ কিছু দিন ধরেই বাইরে। অফিসিযাত্রীরা এত বড় তালা লাগায় না। রাত নটার দিকে বাকের আবার গেল। এখনো তালা ঝুলছে। ঘর অন্ধকার। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জানা গেল দিন দশেক আগে মুনা তাকে বলেছে সে কিছু দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কবে ফিরবে কিছু বলে যায়নি। বাকের থমথমে গলায় বলল, কোথায় গেল জিজ্ঞেস করলেন না? বাড়িওয়ালা বিরক্ত স্বরে বলল, আমার এত ঠেকা কিসের? কথার ধরনে বাকেরের রাগ উঠে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সে রাগ থামাল। মনে মনে কয়েকবার বলল, লাশা, লাশা। উল্টো করে শালা বললে রাগ নাকি কমে যায়। এই জিনিসটা সে হাজতে শিখে এসেছে। ব্যাপারটা সত্যি না। বাকেরের রাগ কমল না। তবুও সে কয়েকবার বলল–লাশা লাশা। বাড়িওয়ালা হারামজাদা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে
false
shorotchandra
বদনামটা বোধ করি খাটে না! আত্মীয়ই হোক আর অনাত্মীয়ই হোক, পুরুষমানুষের খাওয়া হয়নি শুনলে বাঙালীর মেয়ে মরতে বসলেও একবার উঠে দাঁড়ায়। তা জানো? উপেন্দ্র এবার হাসিয়া কহিল, জানি বৈ কি বৌঠান, বেশ জানি। স্বীকার করছি অপরাধ হয়েচে—আর না। ক্ষিদেও পেয়েছে, চলুন কি খেতে দেবেন। এসো, বলিয়া কিরণময়ী পথ দেখাইয়া রান্নাঘরের অভিমুখে চলিল। শাশুড়ীর ঘরের সুমুখে আসিয়া দোর ঠেলিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল, তিনি অকাতরে ঘুমাইতেছেন। রান্নাঘরে আসিয়া সতীশকে যেমন পিঁড়ি পাতিয়া বসাইত, তেমনি করিয়া উপেন্দ্রকে বসাইল। ঝি উনুন জ্বালিয়া দিয়া অন্যান্য আয়োজন করিতে বাহির হইয়া গেলে কিরণময়ী তাহার এই নূতন অতিথিটির প্রতি চাহিয়া কহিল, আচ্ছা ঠাকুরপো, আমার কষ্ট হবে বলে না খেয়ে চলে যাবার এই যে প্রস্তাবটি করেছিলে, সেটি যদি আর কোথাও আর কারো সামনে করে বসতে, আজ তা হলে তোমাকে কি শাস্তি ভোগ করতে হতো জানো? উপেন্দ্র বলিল, জানি। কিন্তু এখানে ত আর সে শাস্তিভোগের ভয় ছিল না বৌঠান! ঝি ময়দার থালাটা রাখিয়া চলিয়া গেল। কিরণময়ী সুমুখে টানিয়া লইয়া নতমুখে মৃদুস্বরে কহিল, বলা যায় না ঠাকুরপো, কপালে শাস্তি লেখা থাকলে কিসে যে কি ঘটে, কোথায় এসে কোন্‌ ভোগ ভুগতে হয়, আগে থাকতে তার কোন হিসেবই পাওয়া যায় না। অদৃষ্টের লেখা কি এড়ান যায়? যায় না ঠাকুরপো, তারা আপনি এসে ঘাড়ে পড়ে। উপেন্দ্র রহস্যটা ঠিক বুঝিতে পারিল না। শুধু কহিল, তা বটে। কিরণময়ীও তখনিই আর কোন কথা কহিল না। একবার শুধু উপেন্দ্রর মুখপানে চাহিয়াই চোখ নত করিয়া ময়দা মাখিতে লাগিল। বোধ হইল, সে যেন চুপি চুপি হাসিতেছে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাজ করিতে করিতে হঠাৎ এক সময়ে চোখ না তুলিয়াই কহিল, আচ্ছা, আজ এত ঘটা করে বৌ দেখাতে নিয়ে যাবার অভিপ্রায়টা কি ছিল এখন বল দেখি? উপেন্দ্র একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, ঘটা-পটা ত কিছুই করিনি বৌঠান। কিরণময়ী বলিল, তবে বুঝি আমার বলতে ভুল হয়েচে। বলি, এত রকমের ছল-চাতুরী করে যাওয়া হলো কেন? উপেন্দ্র কহিল, ছল-চাতুরীই বা কি করলুম? কিরণময়ী কহিল, এই যেমন বোকা-টোকা নানারকম কথার বাঁধুনি করে। কিন্তু মিছে কতকগুলো কথা – কাটাকাটি করে আর কি হবে ঠাকুরপো? সে বৌটিকে বোকা বলেই যদি জানতে পেরে থাক, এ বৌঠানটিরও ত কতক পরিচয় পেয়েচ? অত সহজে ভোলাতে পারবে বলেই কি মনে কর? না, তা করি না। কিরণময়ী মুখ তুলিয়া চাহিল। কারণ, যেমন লঘু করিয়া উপেন্দ্র জবাব দিতে চাহিয়াছিল, তেমনি করিয়া পারে নাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহার কণ্ঠস্বর গম্ভীর হইয়াই বাহির হইয়াছিল, কিন্তু কিরণময়ী তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল কি না, জানিতে দিল না। তেমনি সহজ পরিহাসের স্বরে কহিল, তবে? উপেন্দ্র নিজের কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য অনুভব করিয়া মনে মনে লজ্জা পাইয়াছিল, এই অবকাশে সেও নিজেকে সামলাইয়া ফেলিল। হাসিয়া বলিল, বৌঠান, আপনাকে ফাঁকি দেওয়া কি সহজ কাজ? কিন্তু ছল-চাতুরী না করলে ত আপনি যেতেন না। আমি যে কতবড় নির্বোধকে নিয়ে ঘর করি সে ত দেখতে পেতেন না। কিরণময়ী কহিল, সে দেখে আমার লাভ? উপেন্দ্র বলিল, লাভ আপনার নয়, লাভ আমার। সবাই নিজের দুঃখ জানিয়ে দুঃখটা কম করে ফেলতে চায়। মানুষের স্বভাবই এই। তাই ছল-চাতুরী করে যদি কিছু ক্লেশ দিয়েই থাকি ত সে আপনার দয়া পাবার জন্যেই। আর কোন কারণে নয়। কিরণময়ী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তার পরে কথা কহিল, কিন্তু মুখ তুলিয়া চাহিল না, কহিল, আর যে পারিনে ঠাকুরপো, এই ব্যাজস্তুতির পালাটা এইবার বন্ধ কর না। তোমার নির্বোধটিকে নির্বোধ বলে যদি কিছু কম ভালবাসতে, তা হলেও না হয় আর কিছুক্ষণ শোনা যেতে পারত। একটু দয়াও হয়ত পেতে। কিন্তু সতীশ-ঠাকুরপোর কাছে যে আমি সব শুনেচি। বেশ ত, ভাল না হয় তাকেই খুবই বাসো, কিন্তু তাই বলে কি এমন করে ঢাক পিটে বেড়াতে হয়? একটু বাধ-বাধও কি করে না? কথা শুনিয়া উপেন্দ্র যে কি বলবে, কি ভাবিবে, ঠাহর করিতেই পারিল না। এ কি বলিবার ভঙ্গী! এ কি কণ্ঠস্বর! পরিহাস ত ইহা কিছুতেই নয়, কিন্তু কি এ? বিদ্রূপ? ঈর্ষা? বিদ্বেষ? এ কিসের আভাস, এই বিধবা রমণী এই রাত্রে, এই নির্জন ঘরের মধ্যে আজ তাহার সাক্ষাতে ব্যক্ত করিবার প্রয়াস করিয়া বসিল! আর কাহারও মুখে কথা নাই। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল। ঝি দরজার বাহির হইতে একবার কাসিল। তার পরে একটুখানি মুখ বাড়াইয়া কহিল, আর ত আমি থাকতে পারিনে বৌমা। সদরটা একটু বন্ধ না করে দিলেও ত যেতে পারচি নে। কিরণময়ী মুখ তুলিয়া কহিল, যাবি? তবে একটুখানি বসো ঠাকুরপো, আমি সদরটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। বলিয়া সে চলিয়া যাইবামাত্রই এই ঘরের মধ্যে একাকী বসিয়া উপেন্দ্রর অন্তঃকরণ এমন এক অভাবনীয় বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল যাহা জীবনে কখনো সে অনুভব করে নাই। তাহার উন্মুক্ত চরিত্র চিরদিন স্ফটিকস্বচ্ছ প্রবাহের মত বহিয়া গিয়াছে। কোথাও কখনও বাধা পায় নাই। কোথাও কোনদিন বিন্দুমাত্র কলঙ্কের বাষ্প আসিয়াও তাহাতে ছায়া ফেলিয়া যায় নাই। কিন্তু আজ এই নির্জন কক্ষের মধ্যে সেই একান্ত নির্মলতা যেন মলিন হইয়া উঠিল। সাতাশ দাসীকে বিদায় দিয়া কিরণময়ী স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া যখন বসিল, উপেন্দ্র ঘাড় তুলিয়া একবার চাহিতে পর্যন্ত পারিল না। কিরণময়ীর তাহা দৃষ্টি এড়াইল না, কিন্তু, সেও কোন কথা না কহিয়া নীরবে কাজ করিয়া যাইতে লাগিল। মিনিট-দশেক এইভাবে যখন গেল, তখন কিরণময়ী ধীরে ধীরে কহিল, আচ্ছা ঠাকুরপো, আড়াল থেকে কেউ
false
humayun_ahmed
দেখেন তাঁর বাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে তার স্ত্রী ধস্তাধস্তি করছেন। তাঁর স্ত্রীর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি স্ত্রীকে রক্ষার জন্যে ছুটে যান। তারপর কী হয় তা তার মনে নেই। ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরের সামনে একজন পুলিশও দেখলাম ঘোরাঘুরি করছে। চশমা পরা গুরুগম্ভীর একজনকে দেখা গেল। চৈত্রমাসের এই গরমেও তার গায়ে উলের কোট। শুনলাম। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট। ডেথ বেড় ষ্টেটমেন্ট নিতে এসেছেন। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হল। তিনি তার মতই আরেক গুরু গম্ভীর মানুষকে ভুরু টুরু কুঁচকে হাত পা নেড়ে কী সব বলছেন। আমি কাছে গিয়ে শুনি.ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলছেনআমি তো সারাদিন এখানে বসে থাকব না। রোগীর যদি জ্ঞান ফেরে আমাকে খবর দিলে আমি চলে আসব। আর ধরেন ইন কেইস যদি জ্ঞান না ফেরে— ডাক্তারের কাছে রোগী যে কথা বলেছে সেটাকেই স্টেটমেন্ট হিসেবে নেয়া হবে। রোগী ডাক্তারকে কী বলেছে তা একটা কাগজে লিখে সই করে দিতে বলুন। যাকে এই কথা বলা হল তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, আমি বলব কেন? আপনি বলুন। এটা আপনার জুরিসডিকশান। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার জুরিসডিকশান হবে কেন? আচ্ছা ফাইন, আপনার জুরিসডিকশান না। আপনি চিৎকার করছেন কেন? . ভয়েস আমি রেইজ করছি না আপনি করছেন? আপনি শুধু যে ভয়েস রেইজ করছেন তা না, আপনি মুখ দিয়ে থুথুও ছিটাচ্ছেন। দুজনের কথা কাটাকাটি শুনতে অনেকেই জুটে গেল। সবাই মজা পাচ্ছে। আমিও পাচ্ছি, অপেক্ষা করছি ঝগড়াটা কোথায় থামে সেটা দেখার জন্যে। ঝগড়া থামতে হলে একজনকে পরাজয় স্বীকার করতে হবে। পরাজয়টা কে স্বীকার করে সেটাই দেখার ইচ্ছ। আমার ধারণা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব পরাজয় স্বীকার করবেন। চিৎকার উনিই বেশি করছেন। দম ফুরিয়ে যাবার কথা। পেছন থেকে আমার পাঞ্জাবি ধরে কে যেন টানল। আমি ফিরে দেখি চন্দ্র চাচী। অনেক দূরের লতায় পাতায় চাচী। বিবাহ এবং মৃত্যু এই দুই বিশেষ দিনে লতা–পাতা আত্মীয়দের দেখা যায়। সামাজিক মেলামেশা হয়। আন্তরিক আলাপ আলোচনা হয়। চন্দ্রা চাচী বিস্মিত হয়ে বললেন–তুই এখানে কেন? আরেফিন সাহেব তোর কে হয়? আমি বললাম, আরেফিন সাহেব আমার কেউ হন না তার স্ত্রী আমার খালা হন। ও আচ্ছা। আমি জানতামই না। কী রকম দুঃখের ব্যাপার দেখেছিস। দিনে দুপুরে জোড়া খুন। জোড়াখুন বলতে পার না— একজন তো এখনো ঝুলছে। চাচী দুঃখিত গলায় বললেন–একটা মানুষ মারা যাচ্ছে আর তুই তার সম্পর্কে এমন ডিসরেসপেক্ট নিয়ে কথা বলছিস। এটা ঠিক না। স্বভাবটা বদলা হিমু। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, জ্বি আচ্ছা বদলাব। কেমন যেন মেকানিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। রোবট টাইপ। মানুষের মৃত্যু, রোগ ব্যাধি এই সব কিছুই আর কাউকে স্পর্শ করছে না। ঠিক বলছি না? অবশ্যই ঠিক বলেছেন। চন্দ্ৰা চাচী হাত ব্যাগ থেকে পান বের করে মুখে দিতে দিতে চট করে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন— আমার ছোট মেয়ে ঝুমুর বিয়ে দিয়েছি। সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠান করেছি— গেস্ট ছিল একহাজার। বল কী? তাও তো সবাইকে বলতে পারিনি। তোকে অবশ্যই কার্ড পাঠাতাম। তুই কোথায় থাকিস জানি না। বিয়ে ভাল হয়েছে কি না বল। ছেলে কেমন হীরের টুকরা না গোবরের টুকরা? চন্দ্ৰা চাচী চোখ মুখ শক্ত করে বললেন— ছেলে গোবরের টুকরা হবে কেন? এই সব কী ধরনের কথা? ছেলে কেমিক্যাল ইনজিনিয়ারিং–এ পি, এইচ. ডি. করেছে। আমেরিকায় থাকে। ছেলের আপনি চাচা ষ্টেট মিনিস্টার। বলো কি? মিনিস্টারের ভাতিজা? ছেলের ফ্যামিলি খুবই পলিটিক্যাল। এবং খানদানী পলিটিক্স করে। এখনকার কাদা ছোড়াছড়ি পলিটিক্স না। ছেলের বড় দাদা বৃটিশ আমলের এম. এল.এ ছিলেন। আশ্চর্য তো। চন্দ্র চাচী আনন্দিত গলায় বললেন, ঝুমুর বিয়েতে মন্ত্রীই এসেছিল চারজন। বাংলাদেশের অনেক ইম্পটেন্ট কবি সাহিত্যিকেরা এসেছিলেন। শো বিজনেসের অনেকেই ছিল। ফিল্মের দুই নায়িকা এসেছিল। তারপর টিভির নায়িকারাও ছিল। অটোগ্রাফের জন্যে এমন হুড়াহুড়ি শুরু হল। সব ভিডিও করা আছে। বাসায় আসিস দেখাব। আচ্ছা যাব একদিন। আজই চল না। টোটাল চার ঘন্টা ভিডিও ছিল কেটে কুটে দুঘন্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে আবার বাইরে থেকে মিউজিক পাঞ্চ করা হয়েছে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই জায়গামত বসানো হয়েছে। মিউজিকটা সামান্য হয়েছে। তবে তুই দেখে খুবই মজা পাবি। শুনেই আমার মজা লাগছে। বিয়ের দিন ঝুমুকে কী সুন্দর যে লাগছিল। না দেখলে বিশ্বাস করবি না। এর কারণও আছে— ঝুমুরের মেকাপ দেয়ার জন্যে আমি ফিল্ম লাইন থেকে মেকাপম্যান নিয়ে এসেছি। দীপক কুমার শুর, দুবার মেকাপে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মেকাপম্যান। সে তিনঘন্টা লাগিয়ে মেকাপ দিয়েছে। ফিল্ম লাইনের মেকাপম্যানরা মুখের কাটা ভাঙতে পারে। ঝুমুরের থুতনী সামান্য উঁচু ছিল না? এটা এমন করেছে… দাবিয়ে দিয়েছে? হুঁ। আয়নায় ঝুমু নিজেকে দেখে চিনতে পারেনি। দাঁতের কী করেছে? চন্দ্রা চাচী বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আমি বললাম, ঝুমুর সামনে কোদাল সাইজের যে দুটা দাঁত ছিল তার কী করা হয়েছে? সেগুলিও কি দাবিয়ে দেয়া হয়েছে? চন্দ্ৰা চাচী থমথমে গলায় বললেন, ঝুমুর কোদাল সাইজ দাঁত? আমি হাই চাপতে–চাপতে বললাম, ভুলে গেছ না-কি, ঝুমুকে স্কুলের বন্ধুরা মিকি মাউস বলে ক্ষেপাত। সে বাসায় ফিরে কাঁদত। ঐ দাঁত দুটার কি হল? ফিল্ম লাইনে মেকাপ দিয়ে বড় দাঁত ছোট করার ব্যবস্থা-কি কিছু আছে? চন্দ্ৰা চাচী যে ভাবে তাকাচ্ছেন তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়বেন। তাকে এই সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। চলে যেতে হবে। যাবার আগে আরেফিন খালু সাহেবকে একটা কথা বলে যাওয়া দরকার। যে ডীপ
false