label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shorotchandra
আমার এখানে আপনি সুখে ছিলেন না, সে আমি জানি সুরেশবাবু। নিজের গৃহে এবার এইটেই যেন দূর হয়, আমি কায়মনে আশীর্বাদ করি। সুরেশ কোন কথাই কহিল না, কেবল আর-একবার হেঁট করিয়া প্রণাম করিয়া গাড়িতে গিয়া বসিল। রামবাবু আর একদফা আশীর্বাদ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে জানাইয়া দিলেন যে, তিনিও একখানা এক্কা আনিতে বলিয়া দিয়াছেন। হয়ত বা বেলা পড়িতে না পড়িতেই গিয়া হাজির হইবেন, কিন্তু তখন রাগ করিলে চলিবে না। এই বলিয়া পরিহাস করিতে গিয়া শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া মৌন হইলেন। গাড়ি চলিয়া গেলে তিনি মনে মনে বলিতে লাগিলেন, এ ভালই হইল যে, ইহারা সময় থাকিতে চলিয়া গেল। এখানে শুধু যে স্থানাভাব, তাই নয়, তাঁহার বিধবা ভগিনীটির স্বভাবটিও তিনি ভাল করিয়াই জানিতেন। অপরের নাড়ীর খবর জানিতে তাহার কৌতূহলের অবধি নাই। সে আসিয়াই সুরমাকে কঠিন পরীক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইবে, এবং তাহার ফল আর যাহাই হোক, আহ্লাদ করিবার বস্তু হইবে না। এই মেয়েটির কিছুই না জানিয়াও তিনি জানিয়াছিলেন যে সত্য সত্যই ভদ্রমহিলা। কোন একটা সুবিধার খাতিরে সে কিছুতেই মিথ্যা বলিতে পারিবে না; সে যে ব্রাহ্ম-পিতার কন্যা, সে যে নিজেও ছোঁয়াছুঁয়ি ঠাকুরদেবতা মানে না, ইহার কোনটাই গোপন করিবে না। তখন এ বাটীতে যে বিপ্লব বাধিয়া যাইবে তাহা কল্পনা করিতেও হৃদ্‌কম্প হয়। কিন্তু ইহা ত গেল তাঁহার নিজের সুখ-সুবিধার কথা। আরও একটা ব্যাপার ছিল, যাহাকে তিনি নিজের কাছেও স্পষ্ট করিয়া লইতে চাহিতেন না। তাঁহার মেয়ে ছিল না, কিন্তু প্রথম সন্তান তাঁহার কন্যা হইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। আজ সে বাঁচিয়া থাকিলে অচলার জননী হইতে পারিত, সুতরাং বয়স বা চেহারার সাদৃশ্য কিছুই ছিল না। কিন্তু সেই ক্ষুধাটা যে তাঁহার কত বড় ছিল, তাহা সেই অচেনা মেয়েটিকে যেদিন পথে পথে কাঁদিয়া চিকিৎসকের অনুসন্ধান করিতে দেখিয়াছিলেন সেইদিনই টের পাইয়াছিলেন। সেদিন মনে হইয়াছিল, সেই বহুদিনের হারানো সন্তানটিকে যেন হঠাৎ খুঁজিয়া পাইয়াছেন; এবং তখন হইতে সে ক্ষুধাটা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং অন্তরেও অনুভব করিতেন সত্য, কিন্তু কি যেন একটা গভীর রহস্য এই মেয়েটিকে ঘেরিয়া তাঁহাদের অগোচরে আছে; তাই থাক—যাহা চোখের আড়ালে আছে, তাহা আড়ালেই থাকুক, চেষ্টা করিয়া তাহাকে বাহিরে টানিয়া আনিয়া আর কাজ নাই। একদিন রাক্ষুসী একটুমাত্র আভাস দিয়াছিল যে, বোধ হয় ভিতরে একটা পারিবারিক বিবাদ আছে—বোধ হয় কলহ করিয়া সুরেশবাবু স্ত্রী লইয়া গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন, হঠাৎ যেদিন অচলা আপনাকে ব্রাহ্মমহিলা বলিয়া প্রকাশ করিয়াছিল, অথচ সুরেশের কণ্ঠে ইতিপূর্বেই যজ্ঞোপবীত দেখা গিয়াছিল, সেদিন বৃদ্ধ চমকিত হইয়াছিলেন, আঘাত পাইয়াছিলেন, কিন্তু মনে মনে এই গুপ্ত রহস্যের যেন একটা হেতু খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন; সেদিন নিশ্চয়ই মনে হইয়াছিল, সুরেশ ব্রাহ্মঘরে বিবাহ করিয়াই এই বিপত্তি ঘটাইয়াছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। ক্রমশঃ এই বিশ্বাসই তাঁহার মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল। এই বৃদ্ধলোকটি সত্যই হিন্দু ছিলেন, তাই হিন্দুধর্মের নিষ্ঠাকেই তিনি পাইয়াছিলেন, ইহার নিষ্ঠুরতাকে পান নাই। ব্রাহ্ম-সন্তান সুরেশের এই দুর্গতি না ঘটিলেই তিনি খুশি হইতেন, কিন্তু এই যে ভালবাসার বিবাহ, এই যে আত্মীয়স্বজনের বিচ্ছেদ, এই যে লুকোচুরি, ইহার সৌন্দর্য, ইহার মাধুর্য ভিতরে ভিতরে তাঁহাকে ভারী মুগ্ধ করিত। ইহাকে না জানিয়া প্রশ্রয় দিতে যেন সমস্ত মন তাঁহার রসে ডুবিয়া যাইত। তাই যখনই এই দুটি বিদ্রোহী প্রণয়-অভিমান তাঁহার কাছে মাঝে মাঝে মনোমালিন্যের আকারে প্রকাশ পাইত, তখন অতিশয় ব্যথার সহিত তাঁহার এই কথাটাই মনে হইত, পরগৃহের অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ সঙ্কুচিত গণ্ডির মধ্যে যে মিলন কেবল ঠোকাঠুকি খাইতেছে, তাহাই হয়ত নিজের বাটির স্বাধীন ও প্রশস্ত অবকাশে সংসারের অসংখ্য কাজে ও অকাজে শান্তি ও সামঞ্জস্যে স্থিতিলাভ করিবে। তাঁহার স্নানের সময় হইয়াছিল, গামছাটা কাঁধে ফেলিয়া নদীর পথে অগ্রসর হইয়া চলিতে চলিতে মনে মনে হাসিয়া বার বার বলিতে লাগিলেন, মা, যাবার সময় এই বুড়োটার উপর বড় অভিমান করেই গেলে। ভাবলে, আপনার লোকের খাতিরে জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়িতে জায়গা দিলে না; কিন্তু দু-চারদিন পরে যেদিন গিয়ে দেখতে পাবো, চোখে-মুখে হাসি আর আঁটচে না, সেদিন এর শোধ নেব। সেদিন বলব, এই বুড়োটার মাথার দিব্যি রইল মা, সত্যি করে বল দেখি, আগেকার রাগের মাত্রাটা এখন কতখানি আছে? দেখব বেটি কি জবাব দেয়। বলিয়া প্রশান্ত নির্মল হাস্যে তাঁহার সমস্ত মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি মনে মনে স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, সুরমা মুখ টিপিয়া হাসিয়া কাজের ছুতা করিয়া চলিয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই থালায় সন্দেশ লইয়া ফিরিয়া আসিয়া মুখ অসম্ভব গম্ভীর করিয়া বলিতে লাগিল, আমার হাতের তৈরি এই মিষ্টি যদি না খান জ্যাঠামশাই ত সত্যি সত্যিই ভারী ঝগড়া হয়ে যাবে! স্নানান্তে জলে দাঁড়াইয়া গঙ্গাস্তোত্র আবৃত্তি করার মাঝে মাঝেও মেয়েটার সেই লুকাইবার চেষ্টাকে শাক দিয়া মাছ ঢাকার সঙ্গে তুলনা করিয়া বুড়োর ভারী হাসি পাইতে লাগিল এবং অন্তরের মধ্যে যে ক্ষোভ গতরাত্রি হইতে নিরন্তর বাড়িয়াই চলিয়াছিল, তাহা সন্ধ্যাহ্নিক সারিয়া ফিরিবার পথেই কল্পনার স্নিগ্ধ বর্ষণে জুড়াইয়া জল হইয়া গেল। কাল সকালেই সকলে পৌঁছিবেন, তার আসিয়াছে। সঙ্গে রাজকুমার নাতি এবং রাজবধূ ভাগিনেয়ীর সংস্রবে সম্ভবতঃ লোকজন কিছু বেশি আসিবে। আজ তাঁহার বাটিতে কাজ কম ছিল না। উপরন্তু আকাশের গতিকও ভাল ছিল না। কিন্তু পাছে জল আসিয়া পড়ে, পাছে যাওয়ার বিঘ্ন ঘটে, এই ভয়ে রামবাবু বেলা পড়িতে না পড়িতে এক্কা ভাড়া করিয়া, বকশিশের আশা দিয়া দ্রুত হাঁকাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু পথেই জলো হাওয়ার সাক্ষাৎ মিলিল এবং এ বাটীতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইলেন, তখন কিছু কিছু বর্ষণও শুরু হইয়াছে।
false
humayun_ahmed
রাতে নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে, যার জন্যে আজ ফিহার গলায় এরকম নরম সুর। নিকি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কী হয়েছিল ফিহা! ভূতটা কি আপনাকে ভয় দেখিয়েছিল? না, ভয় দেখায় নি। বরং খুব সম্মান করে কথা বলেছে। বলেছে, এই যে চারিদিকে রব উঠেছে মহাসংকট, মহাসংকট–এসব কিছু নয়। শুধুমাত্র পৃথিবীর ডাইমেনশন বদলে যাবে, আর নতুন ডাইমেনশনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুবর্ণ সুযোগ! এবং সেখানে নাকি আমার মতো বিজ্ঞানীর মহা সুযোগ-সুবিধা। কাজেই আমি যেন এমন কিছু না করি যাতে এই মহাসংকট কেটে যায়। এই সব। আপনি তার কথা শুনে কী করলেন? প্রথমে কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মেরেছি। তার দিকে। তারপর ছুঁড়ে মেরেছি এ্যাসট্রেটা। এতেও যখন কিছু হল না, তখন বাতি জ্বলিয়ে দিয়েছি। নিকি অবাক হয়ে বলল, আমার যেন কেমন কেমন লাগছে। সত্যি কি কেউ এসেছিল? আরে না। আসবে আবার কি? ত্রিমাত্রিক জগৎকে চতুর্মাত্রিক জগতে পরিণত করবার জন্যে আমি এক সময় কতকগুলি ইকোয়েশন সমাধান করেছিলাম, জান বোধ হয়? গত কয়েক দিন ধরেই কেন জানি বারবার সে কথা মনে হচ্ছে। তাই থেকে এসব দেখছি। মাথা গরম হলে যা হয়। বাদ দাও ওসব। তুমি কি চা দেবে এক কাপ? আনছি, এক্ষুণি নিয়ে আসছি। রাত্রি জাগরণের ফলে ফিহা সত্যি সত্যি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আগে ভেবে রেখেছিলেন, আজ সমস্ত দিন কাজ করবেন এবং সমস্ত দিন কোনো খাবার খাবেন না। ফিহো সব সময় দেখেছেন যখন তাঁর পেটে এক কণা খাবার থাকে শ1, ক্ষুধায় সমস্ত শরীর অবসান হয়ে আসে, তখন তাঁর চিন্তাশক্তি অসম্ভব রকম বেড়ে যায়। বিস্ময়কর যে কয়টি আবিষ্কার তিনি করেছেন, তা ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই করেছেন। আজ অবশ্যি কিছু করা গেল না। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিকি সকালের খাবার দিয়ে যায় নি। গত রাতে যদি এই জাতীয় আধিভৌতিক ব্যাপার গুলি না। ২৩ তাহলে এতক্ষণে কাজে লেগে পড়তেন। এই নিন চা। আমি সঙ্গে কিছু বিস্কিটও নিয়ে এসেছি। খুব ভালো করেছ। নিকি একটু ইতস্তত করে বলল, ফিহা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। বল, বল। আগে বলুন আপনি হাসবেন না? হাসির কথা হলেও হাসব না? হাসির কথা নয়। আমি–মানে আমার মনে কদিন ধরেই একটা ভাবনা হচ্ছে, আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। ফিহা বললেন, বলেই ফেল। কোনো প্রেমের ব্যাপার নাকি? না না, কী যে বলেন! আমার মনে হয় আমরা যদি পৃথিবীটাকে সরিয়ে দিতে পারি তার কক্ষপথ থেকে, তাহলে বিপদ থেকে বেচে যেতে পারি। নয় কি? ফিহা হো হো করে হেসে ফেললেন। নিকি বলল, কেন, পৃথিবীটাকে কি সরান যায় না? নিশ্চয়ই যায়। তুমি যদি মঙ্গল গ্রহটা পরম পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাহায্যে গুড়িয়ে দাও, তাহলেই সৌরমন্ডলে মধ্যাকর্ষণজনিত সমতা ব্যাহত হবে। এবং পৃথিবী ছিটকে সরে যাবে। তা হলেই তো হয়। পৃথিবীকে নিরাপদ জায়গায় এই করে সরিয়ে নিলেই হয়। কিন্তু একটা গ্রহ উড়িয়ে দিলে যে প্রচন্ড বিস্ফোরণ হবে তাতে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে। আর পৃথিবীকে অল্প একটু সরালেই তো জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠবে। ধর, পৃথিবী যদি সূর্যের একটু কাছে এগিয়ে আসে, তাহলেই উত্তাপে সুমেরু-কুমেরুর যাবতীয় বরফ গলে মহাপ্লাবন। আর সূর্য থেকে একটু দূরে সরে গেলে শীতে আমাদের শরীরের প্রোটোপ্লাজম পর্যন্ত জমে যাবে। বুঝলে? নিকির চেহারা দেখে মনে হল সে ভীষণ। হতাশ হয়েছে। ফিহা চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। অনিদ্রাজনিত ক্লান্তি এখন আর তার নেই! নিকির সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি নিজেও একটু উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। নিকির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি, প্রতিটি মেয়ে পৃথিবী রক্ষার জন্যে একএকটি পরিকল্পনা বের করে ফেলেছে। ট্রেনে আসবার পথে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা, সেও নাকি কী বই পেয়েছে কুড়িয়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো বই–তাতেও নাকি পৃথিবী কী করে রক্ষা করা যায় তা লেখা আছে। হা-হা-হা। নিকি চুপ করে রইল। বেচারী বেশ লজ্জা পেয়েছে। লাল হয়ে উঠেছে চোখমুখ। ফিহা বললেন, নিকি, তুমি কি আমার কথায় লজ্জা পেয়েছে? না। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে যে, তোমরা সবাই কিছু-না-কিছু ভাবছ। আমার ভেতর কোনো রকম ভাবালুত নেই। তবু তোমাদের এসব কান্ডকারখানা দেখে মনে হয়, যে পৃথিবীর জন্যে সবার এত ভালোবাসা–তা নষ্ট হয় কী করে! নিকি বলল, আপনি কিছু ভাবছেন ফিহা? নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ঠান্ডা মাথায় ভাববার জন্যেই তো এমন নির্জন জায়গায় এসেছি। আমি প্ৰাণপণে বের শরতে চেষ্টা করছি কী জন্যে এমন হচ্ছে। সেই বিশেষ কারণটি কী হতে পারে, যার জন্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে কিছুই হচ্ছে না। যেই মুহুর্তে কারণ জানা যাবে, সেই মুহূর্তে পৃথিবী রক্ষার উপায় একটা কিছু হবেই। আমার বয়স হয়েছে, আগের মতো খাটতে পারি না, তবু মাথার ধার একটুও ভোঁতা হয় নি। তুমি বিশ্বাস কর আমাকে। আবেগে নিকির চোখে পানি এল। ফিহার চোখে পড়লে তিনি রেগে যাবেন, তাই সে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু আসছি। ফিহা ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। হাতে সিগারেট জ্বলিছে। হেটে বেড়াচ্ছেন ঘরের ভেতর। মনে মনে বলছেন, কিছু একটা করা প্রয়োজন। কিন্তু কী করে সেই কিছু একটা হবে, তাই ভেবে পাচ্ছেন না। অন্ধকারে হাতড়ানর কোনো মানে হয় না। ফিাহা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, নিকি। নিকি দৌড়ে এল ফিহা বললেন, আমি মাথুরের সঙ্গে একটু আলাপ করি,
false
toslima_nasrin
খুন করবে ঠাত্তা মাথায়। মৌলবাদী যৌগবাদী দু জাতের পুরুষই করবে, করবে এবং করবেই। তারা করেছে অতীতে, এখনও করছে, এবং ভবিষ্যতেও করবে। ততদিন অবধি করবে যতদিন না পুরুষদের পায়ের তলায় পিষে মারা না হয়। যতদিন না তাদের দম্ভকে গুঁড়া করা না হয়। তাদের পৌরুষকে ছিঁড়ে টুকরো করে ঘৃণায় এবং অবত্তায় ছুড়ে ফেলা না হয় দুর্গন্ধ ডোবায়। হাসিনা নারী। যে কেউ এখন বলবে। হাসিনা নারী, কিন্তু তিনি পুরুষের প্রতিনিধি। তিনি মৌলবাদের দোসর। তিনি ধর্মের দোসর। পুরুষতন্ত্রের দোসর। হাসিনার মতো পুরুষ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। হাসিনা এখন পুরুষের মতো পুরুষ। নারীরা পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, এ কথা জানি। কিন্তু কোনও নারী যে এত জঘন্যভাবে এমন ভয়াবহ নারীবিরোধী পুরুষ হয়ে উঠতে পারে, তা এত তীব্র করে আমার জানা ছিল না। নারী হয়ে নারীর ক্ষতি অনেকে করে। না বুঝেই করে। কিন্তু হাসিনা, আমি মানি যে জেনে বুঝেই নারীর এই ক্ষতি করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন মৌলবাদীরা আজ ক্ষমতার চুড়োয় উঠে নারীর সর্বনাশ সবার আগে করবে। তিনি জানেন শরিয়তি আইনের আগুন, ফতোয়ার আগুন, ধর্মীয় আইনের বর্বরতা, অসভ্যতা সবই নারীকে গিলে খাবে, তারপরও তিনি এই ভয়ংকর সিদ্ধান্তটি নিলেন। অনেকে হাসিনার এই সিদ্ধান্তকে কৌশল বলে ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু আমি একে বলবো আগুন নিয়ে খেলা। এর পরিণাম কখনও ভালো হয় না। হবে না। আজ যেদিকে তাকাই, দেখি নারীদের চরিত্রহীনতা। পুরুষের সুখের জন্য ভোগের জন্য নিজের অধিকার বিসর্জন দেওয়া, পুরুষের দাসীত্ব করা, পুরুষের প্রতিনিধি হওয়া কি নারীর চরিত্রহীনতা নয়? এর চেয়ে বেশি চরিত্রহীন নারী আর অন্য কোনও কারণে হতে পারে না। হাসিনার চরিত্রহীনতা থেকে যেন কোনও নারী শিক্ষা না নেয়। যেন সকল নারী একযোগে ধিক বলতে পারে হাসিনার মতো চরিত্রহীনকে। ধিক বলতে পারার সাহস এবং শক্তি এবং সততা অর্জন করুক সকল নারী। ছোটবেলায় আমিও ছেলে হয়ে যেতে চাইতাম। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেখবো আমি ছেলে হয়ে গেছি। আমি তখন বাবা মার আদর পাবো বেশি, যত্ন পাবো বেশি, যা চাই তাই আমাকে দেওয়া হবে। দামি খেলনা চাই, পাবো। ফ্যাশনের জামা জুতো, পাবো। আমাকে খেতেও দেওয়া হবে সবচেয়ে ভালো খাবার। যেখানে খুশি যেতে পারবো, শহরের বড় মাঠগুলোয় খেলতে পারবো। কেউ আমাকে বাধা দেবে না। আমার সাধ আহ্লাদ সব মেটানোর জন্য একশ একজন দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি রাজা, আমি বাদশাহ, আমি পুত্র, আমি জগত, আমি ভগবান। যত বড় হতে থাকি, ততই দুর্ভোগ বাড়ে। মেয়ে বলে মুখ ঝামটা, গালাগালি। কথায় কথায় চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান। ঘরের কোণে বসে বসে চোখের জল ফেলি আর ভাবি ‘ছেলে তো কত কেউ হঠাৎ হয়ে যায়, আমি কেন হতে পারি না!’ স্তনের দিকে পুরুষের লোলুপ চোখ, সুযোগ পেলেই থাবা দিচ্ছে। ঋতুবতী হওয়ার পরই শুনি আমি অপবিত্ত। এটা ছোঁয়া যাবে না, ওটা করা যাবে না। মেয়ে বলে আমাকে দিন রাত তটস্থ থাকতে হত, এই বুঝি কেউ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ধর্ষণ করবে নয়তো গলা টিপে মেরে ফেলবে। এই বুঝি অ্যাসিড ছুড়বে মুখে, এই বুঝি সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, ঠাত্তা মাথায় কুপিয়ে মারবে। ছেলে হয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম। ভয় যেত। আরামে বাঁচতাম। পরিবার থেকে সমাজ থেকে আইন থেকে রাষ্ট্র থেকে সবসরকম সহযোগিতা পেতাম। মন দিতে পারতাম লেখাপড়ায়, গবেষণায়, অর্জনে, উপার্জনে, জীবন যাপনে। কিন্তু মেয়ে হয়েছি বলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যায় নিজের নিরাপত্তা রক্ষায়। কাজে মন দিতে হয়, একই সঙ্গে অগুনতি থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কোনওদিনই নিশ্চিন্তে রাস্তায় একা হাঁটতে পারিনি, পার্কে বেড়াতে পারিনি, নদীর ধারে বসে থাকতে পারিনি, সমুদ্রের সামনে দুদণ্ড দাঁড়াতে পারিনি। পুরুষের জগত এটি, এই জগতে আর কোনও কিছু, আর কেউ, কোনও প্রাণী এত নিরাপত্তাহীন নয়, যত নিরাপত্তাহীন নারী। শহরে, বন্দরে, গ্রামে, গজ্ঞে রাস্তায় ঘাটে মাঠে ক্ষেতে কখনও একা আমি নিরাপদ ছিলাম না, এখনও নই। নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাকে চিরকালই রক্ষী নিয়ে চলতে হয়েছে। কেউ না কেউ সঙ্গে থাকে আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য, আমি একা আমার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নই বলে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন, সমাজ, সমাজের রীতি নীতি কিছুই যথেষ্ট নয় একটি মেয়েকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। অনেকে এসময় ফোঁস করে উঠে বলবে, ‘পুরুষেরও তো অভাব নিরাপত্তার।’ তা ঠিক। পুরুষেরও অভাব। একটি পুরুষের নিরাপত্তার যে অভাব, সেই অভাব তো মেয়েদের আছেই, তার লক্ষগুণ বেশি অভাব মেয়েদের, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে। এই সমস্যা কোনও পুরুষের নেই। প্রাণীজগতে অন্য কারওর নেই। এই সমাজ নারী পুরুষ উভয়কে জন্মের পর থেকে শিখিয়ে আসছে যে পুরুষ একটু বেশি-মানুষ, নারী একটু কম-মানুষ। অনেক কিছু নারীর করতে নেই, বলতে নেই, চাইতে নেই, ভাবতে নেই। নারীর শরীর দুর্বল, মন দুর্বল। নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। এই শিক্ষা পেতে পেতে নারীর ‘আত্মবিশ্বাস’ ভেঙে গুঁড়ো হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। মেয়েরা তাই একত্র হয় না, প্রতিবাদ করে না। রুখে ওঠে না। লাঙ্গি দেয় না। নারীবিরোধী সমাজের বিরুদ্ধে নারীরা কোনও টুঁ শব্দ তো করেই না, বরং আদরে আহ্লাদে আস্কারা দিয়ে একে মাথায় তুলে রাখে। পুরুষেরা মনে করে সমাজে নারী পুরুষে যে বৈষম্য আছে, তা নারীর সমস্যা, তাদের নয়, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার দায়িত্ব নারীর, তাদের নয়। এই বৈষম্য বিলুপ্ত করার দায় নারীর একার। পুরুষেরা দায়দায়িত্বহীনের
false
humayun_ahmed
চলুন যাই। চলুন যাই বলেও কালাম সাহেব বসে রইলেন। আমি বললাম, আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? কোন সমস্যা নাই। আমার ধারণা। আপনি দুই লাখ টাকাটা ফিরত দিতে চান। এবং আপনি টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ধারণাটা কি ঠিক? জি ধারণা ঠিক। টাকা সঙ্গে আছে? আছে। তিন শ টাকা শুধু খরচ করেছি। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, চলুন চা খাবার পর আপনাকে থানায় দিয়ে আসি। টাকাটাও ওসি সাহেবের কাছে জমা রাখি। আপনি যা ভালো মনে করেন। টাকাটা আমি কেন ফেরত দিচ্ছি জানতে চান হিমু ভাই? না। জানতে চাইলেও বলতে পারতাম না। আমি নিজেও জানি না। এই কাজটা কেন করলাম। ওসি সাহেব। আবার মারধোর করেন। কিনা কে জানে। মনে হয়। করবে না। টাকা পেয়ে গেছে এখন আর মেরে কি হবে? তিনশ টাকা কম আছে। এই জন্যে মারতে পারে। মারতে চাইলে অজুহাত তৈরি করতে কতক্ষণ। ঈশপের ওই গল্পটা জানেন না— এক ছাগলের বাচ্চা পানি খাচ্ছিল। সিংহ এসে বলল, কিরে চেংড়া হারামজাদা। তুই পানি নোংরা করছিস কোন সাহসে। আবার দাড়িও নাড়ছিস। তোর সাহস তো কম না। গল্পটা জানি না। না জানলেও ক্ষতি নেই। এই যুগে ঈশপের গল্প অচল। উঠুন তো— চেয়ারে যেভাবে বসে আছেন মনে হচ্ছে শিকড় গজিয়ে গিয়েছে। কালাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, ফুলের মালাটা গলায় পরে নিন। মালা পরিয়ে হাজত থেকে বের করেছি— আবার মালা পরিয়েই হাজতে ঢুকিয়ে দেব। গুনগুন করে গানও গাইতে পারেন— মালা পরা ছিল মোদের এই মালা পরা ছল। মালা পরেই মালা মোরা করবো যে বিকল। গানটা জানেন? জি না। ওসি সাহেব তাকিয়ে আছেন কিছু বলছেন না। তিনি যে বিস্মিত হয়েছেন সে রকমও মনে হচ্ছে না। ভাবলেশ হীন দৃষ্টি। এমনভাবে বসে আছেন যেন তিনি জানেন আমি কামাল সাহেবকে নিয়ে উপস্থিত হব। আমি বললাম, স্যার টাকাটা গুনে নিন। দুই লাখের চেয়ে তিন শ কম আছে। তিন শ টাকা আপনার আসামি খরচ করে ফেলেছেন। কোন কোন খাতে খরচ করেছেন সেটাও লেখা আছে। এই যে স্যার খরচের ভাউচার। পেন্সিলে লেখা ভাউচারটায় ওসি সাহেব চোখ বুলালেন। কালাম সাহেব সব বেশ গুছিয়েই লিখেছেন। জমা দুই লক্ষ টাকা মাত্র। খরচ- বিরিয়ানি ফুল প্লেট ৪০ টাকা হাফ খাসিয় রেজালা ২০ টাকা দুই প্যাকেট সিগারেট ১০০ টাকা দই মিষ্টি ৩০ টাকা বেবি টেক্সি ভাড়া ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া ৬০ টাকা মোট খরচ ৩০০ টাকা। ব্যালেন্স এক লক্ষ নিরানব্বই হাজার সাতশত টাকা মাত্র। পুলিশের লোক চোখের ইশারায় খুব ভালো কথা বলতে পারে। ওসি সাহেব মুখে কিছু বললেন না, চোখে ইশারা করলেন এতেই কাজ হল। একজন এসে টাকা গুনতে শুরু করল। অন্য আরেকজন কালাম সাহেবকে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দিল। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, স্যার আমি যাই। ওসি সাহেব বললেন, যাবেন কোথায় বসুন। টাকা জমা দিয়েছেন। রশিদ নিয়ে যান। চা খাবেন? জি না। সিগারেট? জি না। ওসি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিতে দিতে বললেন, আপনি কি মিথ্যা কথা বলেন? আমি বললাম, বলি। ওসি সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, যাক বাঁচা গেল। যারা সব সময় সতি্যু কথা বলে— আমরা পুলিশরা তাদের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকি। দু ধরনের মানুষ সব সময় সত্যি কথা বলে— সাধু সন্ত মানুষ। আর ভয়ঙ্কর যারা ক্রিমিনাল। মাঝখানের মানুষরা সত্যমিথ্যা মিশিয়ে বলে। এদেরকে নিয়ে পুলিশ দুঃশ্চিন্তাগ্ৰস্ত না। টাকা শুনা শেষ হয়েছে। ওসি সাহেব আমাকে রশিদ দিলেন। আমি বললাম, স্যার যাই। ওসি সাহেব বললেন, না। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। অসুবিধা আছে? জি না। ওসি সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন–আবুল কামালের গলায় ফুলের মালা দিয়ে তাকে বের করে আপনি নিয়ে গেলেন– সেই দৃশ্য কি মনে আছে? জি স্যার আছে। সেদিন সঙ্গত কারণেই আপনাকে অত্যন্ত সন্দেহজনক মানুষ বলে আমার মনে হয়েছিল। মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমি সন্দেহজনক মানুষ তো বটেই। আমি তৎক্ষণাৎ আপনার পেছনে প্লেইন ক্লথ পুলিশ লাগিয়ে দিলাম। যাতে সে আপনার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতে পারে। তার দায়িত্ব ছিল আপনার প্রতিটি মুভমেন্ট ফলো করা। আপনার কথা শুনে নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে স্যার। আমরা জানি আপনি কি কি করেছেন। এম্বুলেন্স ডেকেছেন। রোগী নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। রাত দুটায় ধানমন্ডির এক বাসায় গেছেন। আবার হাসপাতালে গেছেন। ভোর সাতটায় গনিমিয়া টি স্টলে নাশতা খেয়েছেন। আমি সবই জানি। আপনি তো স্যার মোটামুটি ইশ্বরের কাছাকাছি চলে গেছেন। ইশ্বর যেমন সব জানেন, আপনিও সব জানেন। আমি বাইরের কর্মকাণ্ড জানি। আপনার মনের ভেতর কি কাণ্ডকারখানা হচ্ছে সেটা জানি না। সেটা স্যার আমিও জানি না। আপনার রোগীর কি অবস্থা সেটা জানেন? জি না। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আমি ভোরবেলা খবর নিয়েছি। রাত সাড়ে তিনটার সময় হার্ট থেমে গিয়েছিল। ডাক্তাররা ইলেকট্ৰিক শক দিয়ে চালু করেছেন। ও। রোগী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আপনি নাকি তাকে কথা দিয়েছেন। তার মেয়েকে এনে দেবেন। তিনি মেয়েকে দেখতে চান। মেয়েটা কোথায় থাকে বলুন–আমি আনিয়ে দিচ্ছি। পুলিশ চলে যাবে। প্রয়োজনে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবে। বলেন কী। এই মেয়েকে আপনি আনাবেন কীভাবে? আমি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললাম, দেখি চেষ্টা করে। স্যার আপনার টেলিফোনটা একটু ব্যবহার করি? ওসি সাহেব টেলিফোন এগিয়ে দিলেন। আমি আশাকে টেলিফোন ধরলাম। আশা তুমি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করবে?
false
humayun_ahmed
কি চলে যাব? চলে যাওয়াটাই তো উচিত। নাকি আরো কিছু বলতে চান? জ্বি না। প্রেসক্রিপশানে লেখা আপনার শ্বাসকষ্টটা রাতে হয়, যে রাতে কষ্টটা হয় সেই রাতে কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়? কিংবা সেই দিন অফিসে বসের সঙ্গে ঝগড়া? মনে করে দেখুন তো? তৌহিদ বলল, আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। আরে ভাই স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া তো আমার রোজই হয়, তাই বলে আমার শ্বাসকষ্ট হয় না। শোবার সময় দশ মিলিগ্ৰাম ফ্রিজিয়াম খাই, মরার মতো ঘুমাই। আপনাদের ঝগড়া কি খুব বেশি হয়? জ্বি না। তাহলে এই অবস্থা কেন? আপনি এক কাজ করুন। স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে কোথাও যান। ঘুরে-টুরে আসুন। তাতে মনের ওপর থেকে চাপ কমবে। কক্সবাজার চলে যান না। শুধু স্বামী-স্ত্রী। আণ্ডাবাচ্চা নিবেন না। হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পারে হাঁটবেন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। আচ্ছা দেখি। দেখি-দেখি করে বাঙালি জাতি শেষ হয়ে গেল। কোনো ডিসিশান নিতে পারে না-বলে দেখি। এত দেখাদেখির কী আছে? রিমি খুবই গোছানো মেয়ে। আজ অনেকগুলো ঝামেলা ছিল। সবই সে সুন্দর করে সামলাল। মেয়ের জুর অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। গা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুছে দিল। তাপ অনেকটা নাম। বাকিটা নামল এ্যানালজেসিক সিরাপ খাইয়ে। রিমির ঘরে গৃহ চিকিৎসা বলে একটা চটি বই আছে। এই বই রিমির প্রায় মুখস্থ। ছোটখাট চিকিৎসা এখান থেকেই করে। জুর নেমে যাবার পরপরই অনি ঘুমিয়ে পড়ল। এই ফাঁকে রিমি রান্না সেরে ফেলল। ঘরে নদশ বছর বয়সী একটি কাজের ছেলে আছে। সে ঘুমানো ছাড়া কোনো কাজই ভালোমলত পারে না। তবু তাকে রিমি রেখেছে কারণ অসংখ্যবার দোকানে এটা-ওটা আনতে যেতে হয়। এই লবণ ফুরিয়ে গেল, এই তেল ফুরিয়ে গেল। ছেলেটির নাম জিতু। ও জিতু মিয়া। জ্বি আম্মা। বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। তোর স্যারের ছাত্ররা এলে বলবি আজ পড়াবে না। স্যার ডাক্তার দেখাতে গেছে। জ্বি আচ্ছা আম্মা। ওদের কাল আসতে বলবি। জ্বি আচ্ছা। আরেকটা কথা জিতু মিয়া, তোকে কতবার বলেছি আমাকে আম্মা ডাকবি না—আপা ডাকবি। জিতু মিয়া দাঁত বের করে হাসল। রান্না শেষ করে রিমি শোবার ঘরের পর্দাগুলোও ধুয়ে দিল। চারদিক ঝকঝকে পরিষ্কার থাকার আলাদা আনন্দ। এটা কেউ বুঝতে চায় না। জোবেদা খানম বারান্দার ইজিচেয়ারে কাত হয়ে বসে আছেন। আজ তাঁর শরীরটাও ভালো না। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। রিমিকে কয়েকবার বলেছেন, রিমি তেমন গা করে নি। শান্ত মুখে বলেছে, প্রেসার বোধ হয় বেড়েছে, চুপচাপ শুয়ে থাকুন। একজন ডাক্তার খবর দাও মা। এই বয়সে হুট করে প্রেসার বাড়া কোনো কাজের কথা না। প্রেসার থেকে স্ট্রোক হয়। কথায় কথায় ডাক্তার ডাকার অবস্থাতো মা সংসারের না। অনির যে এক শ তিন জ্বর উঠল—আমি কি ডাক্তার ডেকেছি? ওর বয়স আর আমার বয়স কি এক হল মা? ও যা সহ্য করতে পারবে আমি তা পারব? ঠিক আছে ও আসুক। ও এসে ডাক্তার ডেকে আনবে। জোবেদা খানম চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, কিছু-কিছু কাজ মা ইচ্ছা না থাকলেও করতে হয়, যেমন বুড়ো শাশুড়ির চিকিৎসা। বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে তোমরা লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। লোকে তোমাকে দেখিয়ে বলবে, শাশুড়িমারা বেী। রিমি কঠিন কন্ঠে বলল, বলুক। এখনই বলে, বুঝ না বৌ, এখনই বলে। তোমার নিজের মেয়েই বলে। তোমারে বলে কাচকচানি। সারাদিন যে কাচৰ্কাচ কর এই জন্যে বলে। অনি কিছু বলে না। অনিকে আপনি শিখিয়ে দেন। ক্ৰমাগত আজেবাজে সব কথা আমার সম্পর্কে বলেন। একটা কথাও মিথ্যা বলি না বৌমা। এইটা মিথ্যা বলার বয়স না। রিমির এর উত্তরে কঠিন-কঠিন কথা তৈরি ছিল। বলা হল না। জিতু এসে বলল, একজন ভদ্রলোক না-কি আসছে। চোখে কালো চশমা। চোখে কালো চশমা থাকলে চেনা লোককেও অচেনা মনে হয়। এই লোকটি বোধহয় আসলেই অচেনা। রিমি চিনতে পারল না। লোকটির গায়ে একটা গোলাপি রঙের গেঞ্জি। ত্রিশ বত্রিশ বছরের কোনো মানুষ কি গোলাপি গেঞ্জি গায়ে দেয়। পরনের প্যান্টের রঙ ঘন নীল। পায়ের জুতো সাদা। সাদা-নীল-গোলাপি এই তিনটি রঙের আলাদা কি কোন প্রভাব আছে? এত চমৎকার লাগছে তাকিয়ে থাকতে। লোকটি রিমিকে দেখেও উঠে দাঁড়াল না। যে ভাবে বসা ছিল সেই ভাবেই বসে রইল। একটা পায়ের ওপর অন্য পা-টা রাখা। সেই পা অল্প-অল্প দুলছে। রিমি বলল, কে? লোকটি বলল, আন্দাজ কর তো কে? রিমি সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পারল। তার সারা গা বেয়ে শীতল সম্রাত বয়ে গেল। কেন সে প্রথম দেখাতেই চিনল না? নাকি প্রথম দেখাতেই চিনেছিল—শুধু ভান করেছিল যে চিনতে পারে নি? এই লোকটিকে কি এখন ভালো করে চেনা উচিত? বা চিনতে পারলেও কি বেশি সময় তার সামনে থাকা উচিত? রিমি, চিনতে পেরেছ তো? রিমি জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তুমি কি দাঁড়িয়ে থাকবে না বসবে? তোমার নিজের ঘরে তো আর তোমাকে আমি বসতে বলতে পারি না। আমি নিজেই তোমার অনুমতি ছাড়া বসে আছি। রিমি বসল। আমি যে আজই প্রথম এসেছি তা না, আগেও একদিন এসেছিলাম। তোমাদের কারো সঙ্গে দেখা হয় নি। তুমি, তোমার স্বামীকেউ ছিলে না। তোমার ছোট মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওর নাম বোধহয় অনি, তাই না? হুঁ। অনি বলে নি আমার কথা? বলেছে—সেটা যে তুমি বুঝতে পারি নি। রিমি বুঝতে পারছে তার কপাল ঘামছে। বুক ধকধক করছে। তার পরিষ্কার মনে পড়ছে সেদিন অনির হাতে ছিল বিশাল
false
robindronath
মধ্যে এত বয়সের তারতম্য কোনো হৃদয়সম্পন্ন মনুষ্য সহ্য করিতে পারে না—বিশেষতঃ সমাজসংস্কারই যাহাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য, হৃদয়ের প্রধান আশা, অবকাশের প্রধান ভাবনা, কার্যক্ষেত্রের প্রধান কার্য, তাহারা সমাজের এ-সকল অন্যায় অবিচার কোনো মতেই সহ্য করিতে পারে না। ইহা সংশোধনের জন্য, এ প্রকার অন্যায়রূপে বিবাহিত স্ত্রীলোকদিগের কষ্ট নিবারণের জন্য সংস্কারকদিগের সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করা কর্তব্য, এবং আমাদের কাত্যায়নী দেবীর উদ্ধারের জন্য গদাধর সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতেই প্রস্তুত আছেন। আর, যখন স্বরূপবাবু তাঁহার ক্ষুদ্র কবিতাবলী পুস্তকাকারে মুদ্রিত করেন, তাহার মধ্যে ‘রাহুগ্রাসে চন্দ্র’ নামে একটি কবিতা পাঠ করিয়াছিলাম। তাহাতে, যে বিধাতা কুসুমে কীট, চন্দ্রে কলঙ্ক, কোকিলে কুরূপ দিয়াছেন, তাঁহাকে যথেষ্ট নিন্দা করিয়া একটি বিবাহবর্ণনা লিখিত ছিল; আমরা গোপনে সন্ধান লইয়া শুনিয়াছিলাম যে, তাহা কাত্যায়নী ঠাকুরানীকেই লক্ষ্য করিয়া লিখিত হয়। অনেক সমালোচক নাকি তাহাতে অশ্রুসংবরণ করিতে পারেন নাই। একাদশ পরিচ্ছেদ সমস্তদিন মেঘ-মেঘ করিয়া আছে, বিন্দু-বিন্দু বৃষ্টি পড়িতেছে, বাদলার আর্দ্র বাতাস বহিতেছে। আজ করুণা মন্দিরে মহাদেবের পূজা করিতে গিয়াছে। কাঁদিয়া-কাটিয়া প্রার্থনা করিল—যেন তাহাকে আর অধিক দিন এরূপ কষ্টভোগ করিতে না হয়; এবার তাহার যে সন্তান হইবে সে যেন পুত্র হয়, কন্যা না হয়; নারীজন্মের যন্ত্রণা যেন আর কেহ ভোগ না করে। করুণা প্রার্থনা করিল—তাহার মরণ হউক, তাহা হইলে নরেন্দ্র স্বেচ্ছামতে অকণ্টকে সুখ ভোগ করিতে পাইবে। এই দুঃখের সময় নরেন্দ্রের এক পুত্র জন্মিল। অর্থের অনটনে সমস্ত খরচপত্র চলিবে কী করিয়া তাহার ঠিক নাই। নরেন্দ্রের পূর্বকার চাল কিছুমাত্র বিগড়ায় নাই। সেই সন্ধ্যাকালে গদাধর ও স্বরূপের সহিত বসিয়া তেমনি মদটি খাওয়া আছে—তেমনি ঘড়িটি, ঘড়ির চেনটি, ফিন্ফিনে ধুতিটি, এসেন্সটুকু, আতরটুকু, সমস্তই আছে—কেবল নাই অর্থ। করুণার গার্হস্থ্যপটুতা কিছুমাত্র নাই; তাহার সকলই উল্টাপাল্টা, গোলমাল। গুছাইয়া কী করিয়া খরচপত্র করিতে হয় তাহার কিছুই জানে না, হিসাবপত্রের কোনো সম্পর্কই নাই, কী করিতে যে কী করে তাহার ঠিক নাই। করুণা যে কী গোলে পড়িয়াছে তাহা সেই জানে। নরেন্দ্র তাহাকে কোনো সাহায্য করে না, কেবল মাঝে মাঝে গালাগালি দেয় মাত্র—নিজে যে কী দরকার, কী অদরকার, কী করিতে হইবে, কী না করিতে হইবে, তাহার কিছুই ভাবিয়া পায় না। করুণা রাত দিন ছেলেটি লইয়া থাকে বটে, কিন্তু কী করিয়া সন্তান পালন করিতে হয় তাহার কিছু যদি জানে। ভবি বলিয়া বাড়ির যে পুরাতন দাসী ছিল সে করুণার এই দুর্দশায় বড়ো কষ্ট পাইতেছে। করুণাকে সে নিজহস্তে মানুষ করিয়াছে, এই জন্য তাহাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে। নরেন্দ্রের অন্যায়াচরণ দেখিয়া সে মাঝে মাঝে নরেন্দ্রকে খুব মুখনাড়া দিয়া আসিত, হাত মুখ নাড়িয়া যাহা না বলিবার তাহা বলিয়া আসিত। নরেন্দ্র মহা রুষ্ট হইয়া কহিত, “তুই বাড়ি হইতে দূর হইয়া যা! ” সে কহিত, “তোমার মতো পিশাচের হস্তে করুণাকে সমর্পণ করিয়া কোন্ প্রাণে চলিয়া যাই? ” অবশেষে নরেন্দ্র উঠিয়া দুই-চারিটি পদাঘাত করিলে পরে সে গর্ গর্ করিয়া বকিতে বকিতে কখনো বা কাঁদিতে কাঁদিতে সেখান হইতে চলিয়া যাইত। ভবিই বাড়ির গিন্নি, সেই বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করিত, করুণাকে কোনো কাজ করিতে দিত না। করুণার এই অসময়ে সে যাহা করিবার তাহা করিয়াছে। ভবির আর কেহ ছিল না। যাহা-কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিল, সমস্ত করুণার জন্য ব্যয় করিত। করুণা যখন একলা পড়িয়া পড়িয়া কাঁদিত তখন সে তাহাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিত। করুণাও ভবিকে বড়ো ভালোবাসিত; যখন মনের কষ্টের উচ্ছ্বাস চাপিয়া রাখিতে পারিত না, তখন দুই হস্তে ভবির গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া এমন কাঁদিয়া উঠিত যে, ভবিও আর অশ্রুসংবরণ করিতে পারিত না, সে শিশুর মতো কাঁদিয়া একাকার করিয়া দিত। ভবি না থাকিলে করুণা ও নরেন্দ্রের কী হইত বলিতে পারি না। দ্বাদশ পরিচ্ছেদ স্বরূপবাবু কহেন যে, পৃথিবী তাঁহাকে ক্রমাগতই জ্বালাতন করিয়া আসিয়াছে, এই নিমিত্ত মানুষকে তিনি পিশাচ জ্ঞান করেন। কিন্তু আমরা যতদূর জানি তাহাতে তিনিই দেশের লোককে জ্বালাতন করিয়া আসিতেছেন। তিনি যাহার সহিত কোনো সংশ্রবে আসিয়াছেন তাহাকেই অবশেষে এমন গোলে ফেলিয়াছেন যে, কী বলিব। স্বরূপবাবু সর্বদা এমন কবিত্বচিন্তায় মগ্ন থাকেন যে, অনেক ডাকাডাকিতেও তাঁহার উত্তর পাওয়া যায় না ও সহসা ‘অ্যাঁ’ বলিয়া চমকিয়া উঠেন। হয়তো অনেক সময়ে কোনো পুষ্করিণীর বাঁধা ঘাটে বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া আছেন, অথচ যে সম্মুখে পশ্চাতে পার্শ্বে মানুষ আছে তাহা টেরও পান নাই, অথবা যাহারা দাঁড়াইয়া আছে তাহারা টের পায় নাই যে তিনি টের পাইতেছেন। ঘরে বসিয়া আছেন এমন সময়ে হয়তো থাকিয়া বাহিরে চলিয়া যান। জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, জানালার ভিতর দিয়া তিনি এক খণ্ড মেঘ দেখিতে পাইয়াছিলেন, তেমন সুন্দর মেঘ কখনো দেখেন নাই। কখনো কখনো তিনি যেখানে বসিয়া থাকেন, ভুলিয়া দুই-এক খণ্ড তাঁহার কবিতা-লিখা কাগজ ফেলিয়া যান, নিকটস্থ কেহ সে কাগজ তাঁহার হাতে তুলিয়া দিলে তিনি‘ও! এ কিছুই নহে’ বলিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলেন। বোধ হয় তাহার কাছে তাহার আর একখানা নকল থাকে। কিন্তু লোকে বলে যে, না, অনেক বড়ো বড়ো কবির ঐরূপ অভ্যাস আছে। মনের ভুল এমন আর কাহারও দেখি নাই। কাগজপত্র কোথায় যে কী ফেলেন তাহার ঠিক নাই, এইরূপ কাগজপত্র যে কত হারাইয়া ফেলিয়াছেন তাহা কে বলিতে পারে। কিন্তু সুখের বিষয়, ঘড়ি টাকা বা অন্য কোনো বহুমূল্য দ্রব্য কখনো হারান নাই। স্বরূপবাবুর আর-একটি রোগ আছে, তিনি যে-কোনো কবিতা লিখেন তাহার উপরে বন্ধনীচিহ্নের মধ্যে ‘বিজন কাননে’ বা ‘গভীর নিশীথে লিখিত’
false
humayun_ahmed
আমি তাকে ফুটপাতে শুইয়ে দিলাম। মাথার নিচে ইটজাতীয় কিছু দিতে পারলে ভালো হতো । ইট দেখছি না । ‘হিমু ভাই।’ ‘জি?’ ‘রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষদের কষ্ট দিতে এতো ভালোবাসে কী জন্যে? তারা রজনীতি করেন— আমরা কষ্ট পাই । এর কারণ কী?’ ‘রাজনীতি হলো রাজাদের ব্যাপার—বোধহয় এজন্যেই । রাজনীতি বাদ দিয়ে তাঁরা যখন জননীতি করবেন তখন আর আমাদের কষ্ট হবে না ।’ ‘এরকম কি কখনো হবে?’ ‘বুঝতে পারছি না। হবার তো কথা। মেঘের আড়ালে সূর্য থাকে।’ ‘সূর্য কি আছে? ‘সূর্য নিশ্চয়ই আছে। মেঘ সরে গেলেই দেখা যাবে,’ ‘মেঘ যদি অনেক বেশি সময় থাকে তাহলে কিন্তু একসময় সুর্য ডুবে যায়। তখন মেঘ কেটে গেলেও সূর্যকে আর পাওয়া যায় না।’ আমি শঙ্কিত বোধ করছি। ভয়াবহ ধরনের অসুস্থ মানুষেরা হঠাৎ দার্শনিক হয়ে ওঠে। ব্ৰেইনে অক্সিজেনের অভাব হয়। অক্সিজেন ডিপ্রাইভেশনঘটিত সমস্যা দেখা দিতে থাকে। উচ্চস্তরের ফিলসফি আসলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন ঘাটতিজনিত সমস্যা। আসগর সাহেবকে দ্রুত হাসপাতাল নেবার ব্যবস্থা করতে হবে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি কিছুই দেখছি না। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হলো। মাটি-কাটা কুলি একজন পাওয়া গেল। সে কাঁধে করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তাকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে। আসগর সাহেব মানুষের কাঁধে চড়তে লজ্জা পাচ্ছেন। আমি বললাম, লজ্জার কিছু নেই। হাসিমুখে কাঁধে চেপে বসুন। চিরকালই মানুষ মানুষের কাঁধে চেপেছে। একটা ঘোড়া আরেকটা ঘোড়াকে কাঁধে নিয়ে চলে না- মানুষ চলে। সৃষ্টির সেরা জীবদের কাণ্ডকারখানাও সেরা । গল্প-উপন্যাসে “পাখি-ডাকা ভোর” বাক্যটা প্রায়ই পাওয়া যায় । যারা ভোরবেলা পাখির ডাক শোনেন না তাদের কাছে ‘পাখি-ডাকা ভোরের” রোমান্টিক আবেদন আছে। লেখকরা কিন্তু পাঠকদের বিভ্রান্ত করেন- তারা পাখি-ডাকা ভোর বাক্যটায় পাখির নাম বলেন না। ভোরবেলা যে-পাখি ডাকে তার নাম কাক । ‘কাক-ডাকা ভোর’ লিখলে ভোরবেলার দৃশ্যটি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যেত। কাকের কা-কা শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। খুব একটা খারাপ লাগল তা না। কা-কা শব্দ যত কৰ্কশই হোক, শব্দটা আসছে পাখির গলা থেকেই। প্রকৃতি অসুন্দর কিছু সৃষ্টি করে না—কাকের মধ্যেও সুন্দর কিছু নিশ্চয়ই আছে। সেই সুন্দরটা বের করতে হবেএই ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নামলাম। তার পরই মনে হলো—এত ভোরে বিছানা থেকে শুধু শুধু কেন নামছি? আমার সামনে কোনো পরীক্ষা নেই যে হাতমুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসতে হবে। ভোরে ট্রেন ধরার জন্যে স্টেশনে ছুটতে হবে না। চলছে অসহযোগের ছুটি । শুধু একবার ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে। আসগর সাহেবের খোজ নিতে হবে। খোজ না নিলেও চলবে। আমার তো কিছু করার নেই। আমি কোনো চিকিৎসক না। আমি অতি সাধারণ হিমু। কাজেই আরও খানিকক্ষণ শুয়ে থাকা যায়। চৈত্রমাসের শুরুর ভোরবেলাগুলিতে হিম-হিম ভাব থাকে। হাত-পা গুটিয়ে পাতলা চাদরে শরীর ঢেকে রাখলে মন্দ লাগে না | অনেকে ভোর হওয়া দেখার জন্যে রাত কাটার আগেই জেগে ওঠেন। তাদের ধারণা, রাত কেটে ভোর হওয়া একটা অসাধারণ দৃশ্য। সেই দৃশ্য না দেখলে মানবজন্ম বৃথা। তাদের সঙ্গে আমার মত মেলে না। আমার কাছে মনে হয় সব দৃশ্যই অসাধারণ। এই যে পাতলা একটা কথা-গায়ে মাথা ঢেকে শুয়ে আছি এই দৃশ্যেরই কি তুলনা আছে? কাঁথার ছেড়া ফুটো দিয়ে আলো আসছে। একটা মশাও সেই ফুটো দিয়েই ভেতরে ঢুকেছে। বেচার খনিকটা হকচকিয়ে গিয়েছে- কী করবে বুঝতে পারছে না। সূর্য উঠে যাবার পর মশাদের রক্ত খাবার নিয়ম নেই। সূর্য উঠে গেছে। বেচারার বুকে রক্তের তৃষ্ণা। চোখের সামনে খালি গায়ের এক লোক শুয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই তার গায়ের রক্ত খাওয়া যায়—কিন্তু দিনের হয়ে হিমু নামক মানুষটার কানের কাছে ভনভন করছে। মনে হচ্ছে অনুমতি প্রার্থনা করছে। মশাদের ভাষায় বলছে—স্যার, আপনার শরীর থেকে এক ফোটার পাঁচ ভাগের এক ভাগ রক্ত কি খেতে পারি? আপনারা মুমূর্ষ রোগীর জন্যে রক্ত দান করেন, ওদের প্রাণরক্ষা করেন। আমাদের প্রাণও তো প্রাণ—মুদ্র হলেও প্রাণ। সেই প্রাণরক্ষা করতে সামান্য রক্ত দিতে আপনাদের এত আপত্তি কেন স্যার? কবি বলেছেন—“যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে ।” এইসব দৃশ্যও কি অসাধারণ না? তার পরেও আমরা আলাদা করে কিছু মুহূর্ত চিহ্নিত করি। এদের নাম দিই অসাধারণ মুহুর্ত। সাংবাদিকরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রশ্ন করেন—আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কী? বিখ্যাত ব্যক্তিরা আবার ইনিয়ে বিনিয়ে স্মরণীয় ঘটনার কথা বলেন (বেশিরভাগই বানোয়াট)। সমগ্র জীবনটাই কি স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে পড়ে না? এই যে মশাটা কানের কাছে ভনভন করতে করতে উড়ছে, আবহ সংগীত হিসেবে ভেসে আসছে কাকদের কা-কা— এই ঘটনাও কি স্মরণীয় না? আমি হাই তুলতে তুলতে মশাটাকে বললাম, খা ব্যাটা, রক্ত খা! আমি কিছু বলব না। ভরপেট রক্ত খেয়ে ঘুমুতে যা—আমাকেও ঘুমুতে দে। মশার সঙ্গে কথোপকথন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কড়া নড়ল। সূর্য-ওঠা সকালে কে আসবে আমার কাছে? মশাটার কথা বলা এবং বোঝার ক্ষমতা থাকলে বলতাম—যা ব্যাটা, দেখে আয় কে এসেছে। দেখে এসে আমাকে কানেকানে বলে যা । যেহেতু মশাদের সেই ক্ষমতা নেই সেহেতু আমাকে উঠতে হলো। দরজা খুলতে হলো । দরজা ধরে যে দাড়িয়ে আছে তার নাম মারিয়া। এই ভোরবেলায় কালো সানগ্লাসে তার চোখ ঢাকা । ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক । চকলেট রঙের সিল্কের শাড়িতে কালো রঙের ফুল ফুটে আছে। কানে পাথর-বসানো দুল, খুব সম্ভব চুনি। লাল রঙ ঝিকমিক করে জুলছে। এরকম রূপবতী একজন তরুণীর সামনে আমি ছেড়া কাথা গায়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছি। যে-কোনো সময় কাঁথা গা
false
shordindu
নিম্নে বক্তার বেদী সহজেই দেখা যায়। বৈতালিকের গান শেষ হইল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোর রবে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিয়া সভাগৃহ-মধ্যে তুমুল ধ্বনি-তরঙ্গের সৃষ্টি করিল। তারপর— সভা একেবারে শান্ত হইয়া গিয়াছে, পাতা নড়িলে শব্দ শোনা যায়। কালিদাস বেদীর উপর বসিয়াছেন, সম্মুখে উন্মুক্ত পুঁথি। তিনি একবার প্রশান্ত চক্ষে সভার চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, তারপর মন্দ্রকণ্ঠে পাঠ আরম্ভ করিলেন— অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ। মহিলামঞ্চের মধ্যস্থলে কুন্তলকুমারী নির্নির্মষ নেত্রে নিম্নে কালিদাসের পানে চাহিয়া আছেন। এ কে? সেই মূর্তি—সেই কণ্ঠস্বর! তবে কি—তবে কি–? কালিদাস পাঠ করিয়া চলিয়াছেন। শ্রোতাদের মনশ্চক্ষে ধীরে ধীরে একটি দৃশ্য ফুটিয়া উঠিতেছে-তুষারমৌলি হিমালয়। দূরে একটি অধিত্যকা, তথায় একটি ক্ষুদ্র কুটির ও লতাবিতান। পতিনিন্দা শুনিয়া দক্ষদুহিতা সতী প্রাণবিসর্জন দিবার পর মহেশ্বর এই নির্জন স্থানে উগ্র তপস্যায় রত আছেন। কালিদাস শ্লোকের পর শ্লোক পড়িয়া চলিয়াছেন। বিশাল সভা চিত্রার্পিতবৎ বসিয়া আছে; কালিদাসের কণ্ঠস্বর এই নিঃশব্দ একাগ্রতার মধ্যে মৃদঙ্গের ন্যায় মন্দ্রিত হইতেছে। মহিলামঞ্চে কুন্তলকুমারী তন্দ্রাহতার ন্যায় বসিয়া শুনিতেছেন। বাহ্যজ্ঞান নাই, চক্ষু নিষ্পলক; কখন বক্ষ ভেদ করিয়া নিশ্বাস বাহির হইতেছে, কখন গণ্ড বহিয়া অশ্রুর ধারা নামিতেছে তাহা জানিতেও পারিতেছেন না। মহাকাব্যের ছন্দে ছন্দে চিত্র রচিত হইতেছে। হিমালয়ের অধিত্যকায় মহেশ্বরের লতাগৃহ। দ্বারে নন্দী প্রকোষ্ঠে হেমবেত্র লইয়া দণ্ডায়মান। বেদীর উপর যোগাসনে বসিয়া মহেশ্বর ধ্যানমগ্ন। বনপথ দিয়া গিরিকন্যা উমা কুটিরের পানে আসিতেছেন। হস্তে ফুল জল সমিধপূর্ণ পাত্র। বেদীপ্রান্তে পৌঁছিয়া উমা নতজানু হইয়া মহেশ্বরকে প্রণাম করিলেন। শঙ্কর ধ্যানমগ্ন। প্রথম সর্গ সমাপ্ত হইলে কালিদাস ক্ষণেক ব্রিাম দিয়া দ্বিতীয় সর্গ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। মেঘলোকে ইন্দ্রসভা। ইন্দ্র ও দেবগণ মুহ্যমানভাবে বসিয়া আছেন; মদন ও বসন্ত প্রবেশ করিল। মদনের কণ্ঠে পুষ্পধনু, বসন্তের হস্তে চূত-মঞ্জরী। ইন্দ্র সাদরে মদনের হাত ধরিয়া বলিলেন—এস বন্ধু, আমাদের দারুণ বিপদে তুমিই একমাত্র সহায়। কৈতববাদে স্ফীত হইয়া মদন সদর্পে বলিল—আদেশ করুন দেবরাজ। আপনার প্রসাদে আমি কেবলমাত্র বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাৎ পিণাকপাণির ধ্যানভঙ্গ করতে পারি। দেবগণ সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। মদন ঈষৎ ত্রস্ত ও চকিত হইয়া সকলের মুখের পানে চাহিল। সত্যই মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করিতে হইবে নাকি?– কালিদাস কাব্যপাঠ করিয়া চলিয়াছেন। সকলে রুদ্ধশ্বাসে শুনিতেছে। মহিলামঞ্চে হৈমশ্রীর অবস্থা পূর্ববৎ বাহ্যজ্ঞানশূন্য। ভানুমতী তাহা লক্ষ্য করিলেন, কিন্তু কিছু না বলিয়া কাব্যশ্রবণে মন দিলেন। হিমালয়। সমস্ত প্রকৃতি শীতজর্জর, তুষার কঠিন। বৃক্ষ নিষ্পত্র, প্রাণীদের প্রাণচঞ্চলতা নাই। তপোবনের সন্নিকটে একটি শাখাসর্বস্ব বৃক্ষ দাঁড়াইয়া আছে। মদন ও বসন্তের সূক্ষ্ম দেহ এই বৃক্ষের উপর দিয়া ভাসিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষটি পুষ্প পল্লবে ভরিয়া উঠিল। দূরে সহসা কোকিলকাকলি শুনা গেল। হিমালয়ে অকাল বসন্তের আবির্ভাব হইয়াছে। সহসা হরিতায়িত বনভূমির উপর কিন্নর মিথুন নৃত্যগীত আরম্ভ করিল, পশুপক্ষী ব্যাকুল বিস্ময়ে ছুটাছুটি ও কলকূজন করিয়া বেড়াইতে লাগিল। প্রমথগণ প্রমত্ত উদ্দাম হইয়া উঠিল। নন্দী প্রকৃতির এই আকস্মিক রূপান্তরে বিব্রত হইয়া চারিদিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, তারপর ওষ্ঠে অঙ্গুলি রাখিয়া প্রমথদের নীরবে শাসন করিল—চপলতা করিও না, মহেশ্বর ধ্যানমগ্ন। বেদীর উপর মহেশ্বর যোগাসনে উপবিষ্ট। চক্ষু ভূমধ্যে স্থির, শ্বাস নাসাভ্যন্তরচারী, নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় দেহ নিশ্চল। রুমঝুম মঞ্জীরের শব্দ কাছে আসিতেছে; উমা যথানিয়ত পূজার উপকরণ লইয়া আসিতেছেন। নন্দী সসম্রমে পথ ছাড়িয়া দিল। মহেশ্বরের ধ্যানসমাধি ক্রমে তরল হইয়া আসিতেছে; তাঁহার নয়নপল্লব ঈষৎ ফুরিত হইল। লতাবিতানের এক কোণে দাঁড়াইয়া মদন ধনুর্বাণ হস্তে অপেক্ষা করিতেছে। পার্বতী আসিতেছেন, এই উপর্যুক্ত সময়। পার্বতী আসিয়া বেদীমূলে প্রণাম করিলেন, তারপর নতজানু অবস্থায় স্মিতসলজ্জ চক্ষু দুটি মহেশ্বরের মুখের পানে তুলিলেন। মদনের অলক্ষিত উপস্থিতি উভয়ের মনেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছিল; মহাদেবের অরুণায়ত নেত্র পার্বতীর মুখের উপর পড়িল। মদন এই অবসরের প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিল, সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিয়া সম্মোহন বাণ নিক্ষেপ করিল। মহেশ্বরের তৃতীয় নয়ন খুলিয়া গিয়া ধৰ্ধক্ করিয়া ললাট বহ্নি নির্গত হইল—কে রে তপোবিঘ্নকারী! তিনি মদনের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। হরনেত্ৰজন্মা বহ্নিতে মদন ভস্মীভূত হইল। ভয়ব্যাকুলা উমা বেদীমূলে নতজানু হইয়া আছেন। মহেশ্বর বেদীর উপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চতুর্দিকে একবার রুদ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। তারপর তাঁহার প্রলয়ঙ্কর মূর্তি সহসা শূন্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। কালিদাস মদনভস্ম নামক সর্গ শেষ করিয়া ক্ষণেকের জন্য নীরব হইলেন, সভাও নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। এতগুলি মানুষ যে সভাগৃহে বসিয়া আছে, শব্দ শুনিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। কালিদাস পুঁথির পাতা উল্টাইলেন, তারপর আবার নূতন সর্গ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। রতিবিলাপ শুনিয়া কুন্তলকুমারীর নয়নে অশ্রুধারা বহিল। ভানুমতীও আবার নূতন করিয়া কাঁদিলেন। দ্বার পার্শ্বে বসিয়া মালিনী কাঁদিল। প্রিয়-বিয়োগ ব্যথা কাহাকে বলে এতদিনে মালিনী বুঝিতে শিখিয়াছে। কবি ক্রমে উমার তপস্যা অধ্যায়ে পৌঁছিলেন। হিমালয়ের গহন গিরিসঙ্কটের মধ্যে কুটির রচনা করিয়া গিরিরাজসুতা উমা কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন। পতি লাভার্থ তপস্যা। স্বয়ং বিশীর্ণ দ্রুমপর্ণ, অর্থাৎ আপনা হইতে খসিয়া পড়া গাছের পাতা—তাহাও পার্বতী আর আহার করেন না। তাই তাঁহার নাম হইয়াছে—অপর্ণা। কৃচ্ছ্রসাধন বহু প্রকার। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে তপঃকৃশা পার্বতী চারি কোণে অগ্নি জ্বালিয়া মধ্যস্থ আসনে বসিয়া প্রচণ্ড সূর্যের পানে নিষ্পলক চাহিয়া থাকেন। ইহা পঞ্চাগ্নি তপস্যা। আবার শীতের হিমকঠিন রাত্রে যখন জলের উপর তুষারের আস্তরণ পড়ে তখন সেই আস্তরণ ছিন্ন করিয়া উমা জলমধ্যে প্রবেশ করেন; আকণ্ঠ জলে ড়ুবিয়া শীতের রাত্রি অতিবাহিত হয়। সারা রাত্রি চন্দ্রের পানে চাহিয়া উমা চন্দ্রশেখরের মুখচ্ছবি ধ্যান করেন। এইভাবে কল্প কাটিয়া যায়। তারপর— একদিন উমার কুটির দ্বারে এক তরুণ সন্ন্যাসী দেখা দিলেন। ডাক দিলেন—অয়মহং ভোঃ! উমা কুটিরে ছিলেন, তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া সন্ন্যাসীকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিলেন। সন্ন্যাসীর চোখের দৃষ্টি ভাল নয়;
false
humayun_ahmed
ক্ষুধার কারণে অনেক সময় মাথা ধরে। পরী বলল, আমি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দুটা কথা বলব। মাসুদের সঙ্গে কথা বলতে চাও? জি। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তুমি তো জানোই বাবা কেমন রাগী মানুষ, উনি মাসুদকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন। বাবার রাগ কমার সময় দিতে হবে। উনার রাগ কমবে? নিজ থেকে কমবে না। কমাবার চেষ্টা করতে হবে। আমি চেষ্টা করব। তুমিও চেষ্টা করবে। আমি কীভাবে চেষ্টা করব? সেটা ভেবে ঠিক করা হবে। লীলা পরীবানুর সঙ্গে কথা বলে অবাক হয়েছে। মেয়েটা গ্রামের মেয়েদের মতো কথা বলছে না। মোটামুটি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করছে। মেয়েটিকে লীলার বুদ্ধিমতী বলেও মনে হচ্ছে। মেয়েটা এই বাড়ির ব্যাপারগুলি বোঝার চেষ্টা করছে। যে-পরিস্থিতিতে মেয়েটা এসেছে সেই পরিস্থিতিতে পড়লে সব মেয়েই হাল ছেড়ে দেবে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে। কোনোকিছু বোঝার চেষ্টা করবে লীলা বলল, তুমি কি শহরে কিছুদিন ছিলে? পরী বলল, জি। আমি ময়মনসিংহে থাকি। বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়ি। ছুটিতে বাড়িতে আসি। কোন ক্লাসে পড়ো? এবার ম্যাট্রিক দিব। তোমার সঙ্গে মাসুদের পরিচয় কোথায় হয়েছে? ময়মনসিংহে? জি না। আমাদের বাড়িতে। উনি বাবার কাছে গান শুনতে আসতেন। তুমি গান জানো? জি না। লীলা বলল, তুমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো। রান্না হয়ে গেলেই আমি তোমাকে নিয়ে খেতে বসব। পরী কিছু বলল না। তবে লীলার কথামতো কুণ্ডলি পাকিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে নতুন বউ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখল তার দাদিকে। দাদি খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ হাসি-হাসি। তিনি বললেন, তোর শ্বশুরবাড়ি দেখতে আসছি। খুশি হয়েছি। এদের বিরাট শান-শওকত। তবে মানুষজন নাই। ঘরবাড়ি জিনিসপত্র দিয়া শান-শওকত হয় না। শান-শওকত হয় মানুষজন দিয়া। তুই একলা শুয়ে আছিস। তোর জামাই কই? পরী হাসতে হাসতে বলল, তারে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। কী জন্যে? জানি না। তালাবদ্ধ কে করছে? আমার শ্বশুর সাহেব করেছেন। এই লোকের দেখি স্বভাব ভালো না! সবেরে তালাবদ্ধ করে রাখে। নিজের স্ত্রীকেও শুনেছি তালাবন্ধ করে রেখেছে। বেশিক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকবা না দাদি। শেষে তোমারেও তালাবন্ধ করবে। আমারে তালাবন্ধ করে করুক, তোর জামাইরে কেন করবে? যা তারে ছুটিয়ে নিয়ে আয়। কীভাবে ছুটায়ে আনব? আমার কাছে চাবি নাই। চাবি আমি নিয়া আসছি। এই নে। বৃদ্ধ বড় একটা পিতলের চাবি পরীর হাতে দিলেন। পরী সেই চাবি সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলল। তখনি তার ঘুম ভাঙল। স্বপ্নটা এত বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পরী শাড়ির আঁচল ঘুরেফিরে দেখল। রাত কত হয়েছে পরা বুঝতে পারছে না। কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই। মনে হচ্ছে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িটাও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের নিজেদের বাড়ির অবস্থা অন্যরকম। সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন আসতে থাকে। রাত একটু বাড়ার পর ঢোলের বাড়ি পড়তে শুরু করে। মাঝরাতে শুরু হয়। গানের আসার। বন্দনা দিয়ে শুরু হয়– পশ্চিমে বন্দনা করি সোনার মদিনা ঝলমল ঝলমল ঝলমল ঝলমল সোনার মদিনা… লীলা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পরীকে চমকে গিয়ে বলল, ঘুম ভেঙেছে? পরী বলল, জি। রান্না হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ঘুম ভাঙাই নি। এসো খেতে বসি। মাথা ধরা এখনো আছে? না। বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য মনখারাপ লাগছে? না। মনখারাপ লাগছে না কেন? জানি না। খাওয়ার আয়োজন ভেতরের বারান্দায়। পোলাও-কোরমা, মাছভাজি–অনেক আয়োজন। পরী কিছুই খেতে পারছে না। হাত দিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে। লীলা বলল, খেতে পারছ না? পরী বলল, না। আপনি খান। আমি বসে থাকি। লীলা কিছুক্ষণ পরীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, পরী, তোমার কি সন্তান হবে? পরী বলল, হ্যাঁ। বিয়েটা কি এইজন্যই তাড়াহুড়া করে গোপনে করে ফেলেছ? পরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লীলা বলল, কয় মাস কী, এইসব হিসাব কি তোমার আছে? পরী বলল, হিসাব আছে। তিন মাস। লীলা বলল, তোমরা দু’জন যে বিরাট একটা অন্যায় করেছ, এটা কি জানো? আমি কোনো অন্যায় করি নাই। আপনি কাউকে বলেন, শুকনা মরিচের ভর্তা বানিয়ে আমাকে দিতে। মরিচভর্তা ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে আমি ভাত খেতে পারি না। লীলা পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরী বসে আছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তাকিয়ে আছে লীলার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো অস্বস্তি নেই। রাতের খাবারের পরপরই সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। লোকমান হুক্কার নল তার হাতে ধরিয়ে দিল। তিনি ঘুমের ঘোরে। দুটা টান দিলেন। তার মনে হলো নল-হাতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। এই লক্ষণ ভালো না। এই লক্ষণ বার্ধক্য এবং স্থবিরতার লক্ষণ। স্থবির মানুষরাই মুখভর্তি পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হুঙ্কার নল হাতে ঘুমিয়ে পড়ে। সিদ্দিকুর রহমান ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করলেন। ঘুমটা যাচ্ছে না। আবারো যেন চেপে আসছে। জটিল কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করলে কিংবা কারো সঙ্গে জটিল আলোচনা করলে ঘুমটা হয়তো কাটবে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান! লোকমান তার ইজিচেয়ারের পেছনে বসেছিল। সেখান থেকে জবাব দিল— জি চাচাজি? মাস্টারের খবর কী? উনি ভালো আছেন। আজ সারাদিনে জ্বর আসে নাই। উনারে ডেকে নিয়ে আসো। জি আচ্ছা। সিদ্দিকুর রহমান ঘুমিয়ে পড়তে চান না। এখন ঘুমিয়ে পড়া মানে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা। খাটে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা। সাপে-কাটা রোগীকে কিছুতেই ঘুমাতে দেয়া হয় না। তিনি কল্পনা করছেন চার-পাঁচ হাত লম্বা কালো একটা চন্দ্ৰবোড়া সাপ তার পায়ে ছোবল দিয়েছে। ওঝা এসে বিষ ঝাড়বে। বিষ না নামানো পর্যন্ত তাকে জেগে
false
humayun_ahmed
পেন্সিল কামড়াতেই থাকবে। একটা অংকও করতে পারবে না! অংক মিস একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন– কত? মোটা-মিঠু বলেছিল–. লুতপাইন থাকলে কী করত? সেও পেন্সিল কামড়াতে, তবে সব অংক শেষ করে তারপর। মেয়েটার অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সব অংক শেষ হলেও সে কখনো হাত তুলে বলবে না মিস আমি অংক সবগুলি করে ফেলেছি। তার নাকি ম্যাডামদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। শাহানা মিস বললেন, কী ব্যাপার, আজ কি নুতপা আসে নি? তিনি বিশেষ কাউকে প্রশ্ন করেন নি, কিন্তু যথারীতি জবাব দিল মিঠু। মিস, লুতপা আজ আসেনি। সে গত সোমবারেও আসেনি। মিস বললেন, লুতপা না এলে তো অংকের হজ কেউ পাবে না। রনির মনে হলো মিসের কথা খুবই সত্যি। লুতপা থাকলে এতক্ষণে সব অংক শেষ করে সে পেন্সিল কামড়াতে কামড়াতে রনির সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করত। মোটা মিঠু বলল, মিস আপনি কি প্রাইজটা টেবিলের উপর রাখবেন? তাহলে প্রাইজটা দেখে দেখে আমরা অংক করতাম। মিস তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে গিফট র্যাপে মোড়া একটা প্যাকেট টেবিলে রাখলেন। প্যাকেটের সাইজ দেখে রনির কাছে মনে হচ্ছে চকলেট। লুতপা চকলেট পেলে খুবই খুশি হতো। মেয়েটা এমন চকলেট খেতে পারে! তার ব্যাগে সবসময় চকলেট থাকে। পাঁচটা অংকের ভেতর রনি চারটা করে ফেলেছে, আর একটা শুধু বাকি। যে চারটা করেছে রনির ধারণা সেগুলি শুদ্ধ হয়েছে। পাঁচ নম্বরটা ঠিকমতো করে ফেলতে পারলে চকলেটের প্যাকেটটা সে-ই পাবে। রনি চকলেট পছন্দ করে না। সে ঠিক করে রাখল যদি প্রাইজটা সে পায় তাহলে লুতপাইনকে দিয়ে দেবে। তবে নিজের হাতে দেবে না। লুতপাইনের চেয়ারে রেখে দেবে, সঙ্গে একটা নোট থাকবে। নোটে লেখা– . লুতপাইন খুবই অবাক হবে। ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করবে–কে দিল চকলেটের প্যাকেট। রনি। হ্যালো রনি। রনি পাঁচ নাম্বার অংকটা মাত্র শুরু করেছে। তার ধারণা এই অংকটাও সে পারবে, ঠিক তখনি মিস ডাকলেন। রনি উঠে দাঁড়াল। মিস বললেন, রনি, তুমি প্রিন্সিপ্যাল আপার ঘরে যাও। তোমার বাবা টেলিফোন করেছেন। জরুরি। অংক খাতা আমার কাছে দিয়ে যাও। রনির মোটেও যেতে ইচ্ছা করছে না, কারণ সে জানে এমন কোনো জরুরি ব্যাপার না। তারপরেও সে গেল। তার মনটা খারাপ হয়েছে, কারণ তার মনে হচ্ছে পাঁচ নাম্বার অংকটাও সে পারবে। কে, রনি? হুঁ। হুঁ কী? বলো জি। জি। শোনো, আজ টিফিন টাইমে তুমি স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হবে না। আচ্ছা। প্রাইভেট অ্যারেঞ্জমেন্টে আমি তোমার জন্যে একজন সিকিউরিটির লোক রেখেছি। সে সবসময় তোমাকে চোখে চোখে রাখবে। আচ্ছা। সে ডিউটি শুরু করবে আজ বিকাল তিনটা থেকে। অর্থাৎ তোমার স্কুল ছুটির পর থেকে। হুঁ। আবার হুঁ বলছ কেন? বলো জি কিংবা . তোমার দাদাজান খুবই ঝামেলা করছেন। তিনি আমার নামে ফৌজদারি মামলা করেছেন। তার ধারণা আমিই লোক দিয়ে বিভিন্ন সময়ে তোমাকে কিডন্যাপ করাচ্ছি। বদ্ধ উম্মাদ না হলে এমন আইডিয়া তার মাথায় কী করে আসে কে জানে! এই উন্মাদ আজ বিকালে বাড়িতে আসবে। তুমি তার সঙ্গে কথা বলবে না। কেন কথা বলবো না? একজন উন্মাদের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না। এইজন্যে কথা বলবে না। . টেলিফোন শেষ করে ক্লাসে ফিরে রনি দেখে, অংক মিসের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রাইজটা পেয়েছে সে। কেউ চারটা অংক শুদ্ধ করতে পারে নি। শুধু রনিই পেরেছে। শাহানা মিস বললেন, আমার কথা ছিল পাঁচটা অংক শুদ্ধ করতে হবে। তুমি পঞ্চমটা করতে পার নি। এই ফল্ট তোমার না। তোমাকে আমিই প্রিন্সিপ্যাল আপার ঘরে পাঠিয়েছিলাম। কাজেই তোমাকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। মোটা-মিঠু বলল, মিস এটা ফেয়ার না। আমি প্রটেষ্ট করছি। মিঠু, তুমি কি চুপ করে বসবে? না মিস, আমি বসব না। ঠিক আছে, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে পেন্সিল কামড়াও। মিস, আমি বাজি রাখতে পারি রনি পাঁচ নম্বর অংকটা পারবে না। লুতপা থাকলে পারত। ও পারবে না। ওকে প্রাইজ দেয়া যাবে না মিস, আমি প্রটেষ্ট করছি। মোটা-মিঠু প্রটেস্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অংক ক্লাস শেষ হলো। পরের ক্লাস সায়েন্সের। সায়েন্স মিস ক্লাসে ঢুকেই বললেন, রনি কোথায়? রনি উঠে দাঁড়াল। মিস বললেন, প্রিন্সিপ্যাল আপার ঘরে যাও। তোমার জরুরি টেলিফোন এসেছে। মোটা-মিঠু বলল, প্রতি ক্লাসেই রনির একটা করে জরুরি টেলিফোন আসছে আর সে ক্লাস ফাকি দিয়ে ঘুরছে। এই প্রটেস্ট। রনির ইচ্ছা করছে বলে, আমি টেলিফোন ধরব না। আমি নিজেও প্রটেস্ট করছি। সেটা বলা সম্ভব না। রনি প্রিন্সিপ্যাল আপার ঘরের দিকে রওনা হলো। এখন কে টেলিফোন করেছে কে জানে! বাবা কি আবার করেছেন? নতুন আরেকজন সিকিউরিটি গার্ডের কথা বলবেন? নাকি মা করেছেন? নাকি অন্য কেউ? হ্যালো রনি? হুঁ। এই গাধা, আমাকে চিনতে পারছিস না? না, আপনি কে? আমি তোর দাদাজান। ও আচ্ছা। ও আচ্ছা কী? বল স্লামালিকুম। স্লামালিকুম। তোর ফলস বাবা তোকে নিয়ে যে সব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে, সেটা তো আর সহ্য করা যায় না। ওর নামে শিশু নির্যাতন আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছি। মজা টের পাবে। মজা কত প্রকার ও কী কী এক ধাক্কায় বুঝে ফেলবে। ও আচ্ছা। ও আচ্ছা ও আচ্ছা করিস না। মন দিয়ে শোন কী বলছি। তোর স্কুল ছুটি হবে কয়টায়? তিনটায়। তিনটার আগেই আমার গাড়ি তোর স্কুল গেটের সামনে থাকবে। সঙ্গে আমার লোকজনও থাকবে। তুই আমার গাড়িতে
false
shomresh
এখানে ঢুকতে পারবে না, শুধু বাথরুমের ওই জানলাটা ছাড়া। বড্ড পলকা, জোরে ধাক্কা দিলেই ভেঙে যাবে। অর্জুন সেদিকে উঁকি মেরে দেখল অনেক নীচে রাস্তা। অর্থাৎ এদিক দিয়ে ওপরে উঠে আসার কোনও পথ নেই। মিস্টার আলাম্বাকে আশ্বস্ত করল সে। বাইরের ঘরের সোফায় শুয়ে পড়া পছন্দ করল অর্জুন। মিস্টার আলাম্বার এতে আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত তর্ক না করে বালিশ চাদর এনে ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর গুডনাইট বলার আগে পিস্তল ফেরত চাইলেন, আসলে ওটা বালিশের নীচে না নিয়ে আমি ঘুমোতে পারছি না। আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে মিস্টার আলাম্বা ফিরে গেলেন। এই ফ্ল্যাটের সর্বত্র আফ্রিকার শিল্পনিদর্শন ছড়ানো। অন্ধকারেও মনে হচ্ছিল সে আজ আফ্রিকাতেই আছে। অর্জুনের খেয়াল হল মিস্টার আলাম্বা অনেকক্ষণ আর লকেট নিয়ে কোনও কথা বলছেন না। এটা চাইবার সময় ওঁর মধ্যে যে আকৃতি দেখতে পেয়েছিল তা উধাও হয়ে যাবে এত সহজে? হয়তো এই ভয় পাওয়ার কারণে তাকে এখানে শুতে বলা এটার পেছনে ওই লকেট-প্রাপ্তির আকাঙক্ষা কাজ করছে? কোনও বিশেষ কিছু সংগ্রহ করা যাদের নেশা তারা খুব খ্যাপাটে হয়। না-হলে রাজার চারমাথাওয়ালা একটা কয়েন ভুল করে মিন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আর সেটির দর উঠেছিল এক কোটি পাউন্ড? অর্জুন লকেটটাকে গলা থেকে খুলে বের করল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের একপাশে দাঁড় করানো কাঠখোদাই করা একটি আফ্রিকান কলসির মধ্যে সেটা ঢুকিয়ে রাখল। গলা থেকে সেটাকে খুলতেই কীরকম অস্বস্তি আরম্ভ হল। অর্জুন হেসে ফেলল, তার মধ্যেও ওই আদিম ভাবনাচিন্তা ঢুকে পড়েছে নাকি লকেট পরার পর? সোফায় শুয়ে তার মনে পড়ল জিমের কথা। লোকটা মরে গেল নাকি? এত তাড়াতাড়ি ওকে বিশ্বাসঘাতক চিহ্নিত করে খুঁজে পেয়ে গেল ওরা? কী এফিশিয়েন্ট অর্গানাইজেশন। জিম এই লকেটটাকে প্রবল ভক্তি করেছে। ওর বান্ধবী সাদা মেয়ে, তার মধ্যে ওসব ভক্তিটক্তি দেখা যায়নি। কিন্তু এই আমেরিকার কিছু মানুষ যে লকেটটার ব্যাপারে ক্রমশ উন্মাদ হয়ে উঠছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন কী করা যায়? সুধামাসিকে পোঁছে দিতে এসেছিল সে। এখনও হাসপাতালে গিয়ে ওঁর জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। খুব অভদ্রতা হয়েছে এটা। সুধামাসিকে সময় না দিয়ে এসব গোলমালে না জড়িয়ে পড়ে লকেটটাকে নিউ ইয়র্কে মিউজিয়ামে জমা দিয়ে দেওয়াই ভাল। হঠাৎ নিশ্বাসের কষ্ট হতে আরম্ভ করল। বাতাস ভারী হয়ে গেছে খুব। এ-ঘরের ভেন্টিলেশন কি এত খারাপ? অর্জুন ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। তীব্র একটা গন্ধ নাকে ঢুকছে। কীসের গন্ধ। তার মাথা ঘুরতে লাগল। অন্ধকারে চারপাশে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পেল না। এবং এই দেখার সক্রিয় ভাবনাটাও আচমকা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। অর্জুন শুয়ে পড়ল। সোফায়। তার জ্ঞান ছিল না। টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। ভাঙল বটে, কিন্তু সমস্ত শরীরে তীব্র আলস্য এবং মাথায় টিপটিপে যন্ত্রণা অর্জুনকে কাহিল করে দিচ্ছিল। সে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলতেই অজানা অচেনা ভাষায় একটি নারীকণ্ঠ কিছু বলল। একবর্ণ না বুঝতে পেরে অর্জুন ইংরেজিতে বলল, আপনি কাকে চাইছেন? এবার মেয়েটি জানতে চাইল, এটা মিস্টার আলাম্বার ফ্ল্যাট, আশা করি। হ্যাঁ। ওঁকে বলুন সিম্বা এসেছে। অর্জুন টেলিফোন রেখে ভেতরের ঘরে গেল। দুটো ঘর। একটি ঘরে শিল্পসংগ্রহের প্রদর্শনী, অন্যটিতে মিস্টার আলাদা থাকেন। তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে সে বলল, মিস্টার আলাম্বা, ফোন আছে আপনার? ফোন? অসম্ভব। আমাকে কেউ ফোন করবে না। মেয়েটি বলছে ওর নাম সিম্বা। ও, সিম্বা। সিম্বা আমার মেয়ে। ও বোধহয় নীচ থেকে ফোন করছে। দেখছি আমি। মিস্টার আলাম্বাকে খুশি-খুশি দেখাল। কেউ নীচের গেটে এসে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের বোতাম টিপলেই রিসিভার আওয়াজ করে। তখন ফোনে নিজের পরিচয় দিলে যার কাছে এসেছে সে রিমোট টিপলে নীচের দরজা খুলে যায়। লিফট চালু হয়। দ্বিতীয়বার বোতাম টিপলে যে-ফ্লোরে লিফট দাঁড়াবে তার দরজা খোলে। কত সহজে ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারছে ওরা। আমাদের দেশে হলে বলতে হত, দ্যাখ তো কে বেল বাজাচ্ছে। অর্জুন ভাবল, বেশিদিন নেই, এব্যবস্থা চালু হল বলে! মিস্টার আলাম্বাই দরজা খুললেন। প্রায় অর্জুনের মাথায় লম্বা ছিপছিপে একটি কালো মেয়ে ঘরে ঢুকল। তার কাঁধে দুটো স্ট্র্যাপ দেওয়া ব্যাগ, পরনে জি। বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। মেয়ে ঘুরে তাকাল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন? অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। মিস্টার আলাম্বা মেয়ের সঙ্গে অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সিম্বা জিজ্ঞেস করল, কীরকম লাগল বাবার ফ্ল্যাট? ভাল। বেশ ভাল। রাত্রে ঘুম হয়েছিল? হ্যাঁ। কিন্তু–! কিন্তু? মনে হয়নি ওইসব আফ্রিকান মূর্তিগুলো জীবন্ত হয়ে আপনাকে ঘিরে ফেলছে। বিশেষ করে ওই সাপটা—? সিম্বা চোখ বড় করল। না। তা হয়নি। কারণ শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই একটা তীব্র গন্ধে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। অর্জুন হাসল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন? সিম্বা অবাক, গন্ধে? হ্যাঁ। তা হলে এটা বাবার কীর্তি। আফ্রিকার জঙ্গলের অনেক কিছু বাবার সংগ্রহে আছে, মাঝে-মাঝে বাবা সেগুলো ঠিক আছে কিনা যাচাই করেন। আমি হস্টেলে থাকি। এখানে থাকলে পাগল হয়ে যেতাম। ব্যাগ টেবিলে রেখে ভেতরে চলে গেল সিম্বা। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তা হলে আপনি পরীক্ষা করেছিলেন কাল রাত্রে? ঠিক পরীক্ষা নয়। একটা গাঙ্কে কাঠ কিছুক্ষণ ঘষলে গন্ধ বের হয়। অনেকটা চন্দনের মতো গন্ধ, কিন্তু হাতিকেও অজ্ঞান করে ফেলে। কেনিয়াতে পাওয়া যেত আগে। কাল ভাবলাম দেখি, ওগুলো কেমন আছে? আপনি নাকে মাস্ক পরে নিয়েছিলেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ! আর আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তো? একদম ঠিক। আর তারপর যখন দেখলেন আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি তখন
false
MZI
এগারোটা মাকড়শা, সাত শ’ তেরোটা চিনে জোক, নয় শ” উনিশটা গুবরে পোকা— খুলে দেয়ার পর আমি জায়গাটা চিনতে পারলাম। স্কুলের পিছনে গাছপালা ঢাকা জঙ্গলের মতো জায়গাটা। সাপখোপের ভয়ে কেউ কখনো এখানে আসে না, টুকুনজিল যে কী ভাবে এখানে আমাকে রেখেছে কে জানে। তারিক বলল, তোকে কে এখানে এনে ফেলে রেখে গেছে? আমি বললাম, সব বলব তোদের, চল। তোরা আজকে এখানে কী করছিস? ব্ল্যাক মার্ডারের মিটিং না? ও, আচ্ছা। আমার উপর দিয়ে কত রকম ঝড় বয়ে গেছে যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজকে স্কুলে ব্ল্যাক মার্ডারের গোপন মিটিং; আমার রক্ত-শপথ করে ব্ল্যাক মার্ডারের মেম্বার হওয়ার কথা। আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে আসছিলাম, নান্টু দাঁড়িয়ে বলল, চেয়ারটা দেখেছিস? ইস! কী দারুণ চেয়ার! হ্যাঁ। একেবারে রকেটের চেয়ার। আয় চেয়ারটা নিয়ে যাই। আমি বললাম, এখন চল্। পরে নিলেই হবে। কেউ যদি নিয়ে যায়? কে নেবে এখান থেকে? তোর মাথা খারাপ হয়েছে? নান্টু তবু খুঁতখুঁত করতে থাকে। আমরা জঙ্গলের মতো জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসি। সবাই এখনো একটা ঘোরের মতো অবস্থায় আছে, একটু পরপর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মাহবুব বলল, খালিপায়ে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো, বিলু? আমি হেসে বললাম, আমি সারাজীবন খালিপায়ে হেঁটেছি, আমার কোনো অসুবিধে হয় না। সুব্রত জিজ্ঞেস করল, তোর কি খিদে পেয়েছে? আমার হঠাৎ খিদে চাগিয়ে উঠল। সত্যি খিদে পেয়েছে ভীষণ। বললাম, হ্যাঁ, খুব খিদে পেয়েছে। তারিক বলল, তুই চিন্তা করিস না, আমরা খাবার নিয়ে আসব তোর জন্যে। সুব্রত বলল, হ্যাঁ, তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোকে আমরা এখন থেকে রক্ষা করব। আর কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না। আমার শুনে বড় ভালো লাগল। ব্ল্যাক মার্ডারের গোপন মিটিং আধা ঘন্টার জন্যে পিছিয়ে দেয়া হল। পন্টু গেল আমার জন্যে কিছু খাবার কিনে আনতে। সে সম্ভবত ব্ল্যাক মার্ডারের ক্যাশিয়ার। মাহবুব গেল তার বাসা থেকে আমার জন্যে এক জোড়া জুতা আনতে। আমি কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে আমি খালিপায়ে যতক্ষণ খুশি হাঁটাহাঁটি করতে পারি, আমার কোনো অসুবিধে হয় না। সুব্রত আর তারিক গেল অন্য মেম্বারদের ডেকে আনতে। একা স্কুলের বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকলাম। গত চব্বিশ ঘন্টায় এত কিছু ঘটেছে যে মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেছে। এই স্কুলে সবসময় এত ছাত্র গমগম করতে থাকে যে এখন কেউ কোথাও নেই দেখে কেমন জানি লাগে। আমি টুকনজিলকে ডাকলাম কয়েকবার সাড়া পেলাম না। কোথায় গেছে কে জানে হয়তো। আবার চট করে মঙ্গল গ্রহ থেকে ঘুরে আসতে গেছে। কী বিচিত্র একটা ব্যাপার! কে জানে কখনো আমাকে নিয়ে যেতে পারবে কি না? নানান কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি স্কুলের গেট খুলে লিটন এসে ঢুকল, তার সাথে আরো তিনজন ছেলে। এই তিনজনের একজনকেও আমি চিনি না, লিটনের বন্ধু। আমাকে দেখেই লিটনের মুখে কেমন—একটা হাসি ফুটে উঠল, খারাপ রকমের হাসি, এরকম হাসিকে আমি খুব ভয় পাই। কাছে এগিয়ে এসে তার বন্ধুদের বলল, বলেছিলাম না আজকে পেয়ে যাব? আমি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রাখলাম। বললাম, আমাকে খুঁজছ তুমি? লিটন আমার কথার উত্তর দিল না, বন্ধুদের বলল, একটা দল আছে ওদের, নাম দিয়েছে ব্ল্যাক মার্ডার। হাঃ—ব্ল্যাক মার্ডার। হেসে মরে যাই। আজকে নাকি মিটিং। লিটন এবার আমার দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তোর আর সাগরেদরা কই? ক্লাসের অনেকের সাথে আজকাল আমি তুই তুই করে বলি। ভালো বন্ধু, তাই। লিটনের সাথে বলতে গেলে আমার কথাই হয় না, তার সাথে তুই তুই করে কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাকে তুই তুই করে বলছে বদমাইশি করে। আমি বেশি গা করলাম না, বললাম, এখানে কেউ কারো সাগরেদ না। লিটন মুখ বাঁকা করে বলল, ভালোই হল, তোকে একা পেলাম। কেন? তোকে একটা জিনিস বলতে এসেছি। কি জিনিস? তুই যে-জঙ্গল থেকে এসেছিস সেই জঙ্গলে ফিরে যা। কি বলতে চাইছে বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না, কিন্তু আমি তবু না বোঝার ভান করে বললাম, মানে? বলছি, তুই তোর নীলাঞ্জনা স্কুলে ফিরে যা। কেন? বলেছি ফিরে যেতে ফিরে যা বাজে তর্ক করিস না। আস্তে আস্তে আমার মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল, বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, আমি থাকলে ফাস্ট হতে পারবি না? মুহূর্তে লিটনের মুখ লাল হয়ে যায়। কিছু বোঝার আগে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দিল নিচে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম, প্রথম দিন স্কুলে আমাকে অসম্ভব মেরেছিল লিটন। আজকেও মারবে? লিটনের তিনজন বন্ধু এবারে হাত গুটিয়ে এগিয়ে এল। লিটন একগাল হেসে বলল, এরা আমার কারাটে স্কুলের বন্ধু। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ব্ল্যাক বেল্ট—ব্লাক বেল্ট আর রেড বেল্ট। মারামারি করবি? তুই করবি? তোরা চারজন আর আমি একা? কেন, ভয় করে? কাপড়ে পেচ্ছাব হয়ে যাবে? আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, বললাম, লিটন, চারজন মিলে এক জনকে মারতে এসেছিস, লজ্জা করে না? বাপের ব্যাটা হলে একা আয়। একা তো তোকে কিমা বানিয়েছিলাম। আজকে কিমা না, একেবারে কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব। জনের মতো সিধে হয়ে যাবি। এই বলে রাখলাম। স্কুল ছেড়ে যদি না যাস তোর জান শেষ। আগেরবার লক্ষ করেছি, মারপিট করার সময় লিটন হাত ব্যবহার না করে পা ব্যবহার করে, কে জানে কারাটের সেটাই হয়তো
false
shirshendu
শচীন জানে, হেমকান্ত আপনভোলা লোক। বিষয়-আশয়ে মন নেই। তার ছেলেরা জমিদারিতে আগ্রহী নয়। জমিদারি হল ভাগের মা। হেমকান্তর সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যে হিস্যা তারা পাবে তা লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই তারা অন্যান্য কাজ কারবারে নেমে পড়েছে। শচীন আর-একটা ব্যাপারও বুঝতে পারছে। হেমকান্ত তাকে জামাই করতে চান সম্ভবত এই জমিদারি দেখাশোনা করার জন্যই। এ বাড়ির জামাই হয়ে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করতে শচীনের আপত্তি নেই। বিশাখাকে সে বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে। ভারী সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে। মুখখানা মনে পড়লেই বুক তোলপাড় করে। শচীন অবশ্য খুব ভাবালু নয়। বরং বাস্তববাদী। কিন্তু পুরুষ তো! সুন্দরী মেয়ে দেখে কোন পুরুষের না বুক তোলপাড় হয়? শচীন তাই খুব আগ্রহ আর নিষ্ঠার সঙ্গে হেমকান্তর জমিদারি জরিপ করছে। টাকার জন্য নয়, বিশাখার মুখ চেয়েই। এ বাড়ির মান-সম্মান রাখা তাবও কর্তব্য। বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা দুনিয়াতেই একটা মন্দা চলছে। এ দেশের লোকের হাতে বিশেষ টাকা নই। নগদ টাকার টানাটানি থেকেই বোধহয় খাজনা আদায়েও মন্দা চলছে। উপরন্তু হেমকান্ত পাওনা আদায়ে পটু নন। গত বছর দুয়েকের মধ্যে কম করেও তিনটে মহাল হেমকান্ত প্রায় জলের পরে ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কোনও বন্দোবস্তও হয়নি। কয়েকটা মোকদ্দমা হেরে গেছেন তদবিরের অভাবে। শচীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুহুরি রাখাল বলল, শচীনবাবু, এখনও কিছু মুখে দিলেন না। দিচ্ছি।–শচীন হাসিমুখেই বলে। তারপর আবার কাগজপত্রে ড়ুব দেয়। হেমকান্তর নায়েবমশাই বুড়ো মানুষ। রাতে চোখে ভাল দেখেন না বলে এ সময়টায় আসেনও না। একটা ছুটির দিনে এসে তার সঙ্গে সকালের দিকে বসা দরকার। শচীন কাজ রেখে খাবারের ঢাকনা খুলল। বিশাল আকারের গোটা আষ্টেক মিষ্টি, কমলালেবু, ক্ষীর, নাড়ু, এক বাটি পায়েস। এত খেতে পারে নাকি কেউ! রোজই সে অর্ধেকের ওপর পাতে ফেলে রেখে যায়। কমিয়ে আনতে বললে কেউ গা করে না। অপচয় এদের গায়ে লাগে না বোধহয়। কিন্তু সে গরিব ঘরের ছেলে, তার লাগে। বড় কষ্টে মানুষ হয়েছে তারা। শচীনের বাবার আইনের ব্যাবসা জমতে সময় লেগেছিল অনেক। সে যে বাড়ির জামাই হতে চলেছে সেই বাড়ির অনেক দাক্ষিণ্য তাদের এক সময় হাত পেতে নিতে হয়েছে। শচীন সেসব ভোলনি। খাওয়া শেষ করে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে বলে শচীন ওঠে। রাখাল বলে, একবার মনুদিদির সঙ্গে দেখা করে যাবেন। ঠাকুরবাডিতে আপনার জন্যই বসে আছেন। শচীন অবাক হল না। মনুদিদি অর্থাৎ রঙ্গময়ির সঙ্গে তার বেশ সহজ সম্পর্ক। ইদানীং বিয়ের সম্বন্ধ হওয়াতে মনুদিদি প্রায়ই যায় তাদের বাড়িতে। বয়সে তার চেয়ে বেশি বড় নয়, তাই তাদের মধ্যে কিছু ঠাট্টা-ইয়ার্কিও হয়। শচীন ঠাকুরমণ্ডপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একবার বাড়ির দিকে চাইল। মস্ত বাড়ি। অনেক জানালা দরজা, বহু ঘর। কোথায় বিশাখা আছে কে জানে! বুকের মধ্যে একটা উদ্বেল রহস্যময় আনন্দ সে টের পায়। বিশাখা কি তাকে লক্ষ করে? আরতি হয়ে গেছে। ঠাকুর মণ্ডপ জনশূন্য। সামনের বিশাল বারান্দায় একা রঙ্গময়ি বসে আছে। মুখখানা গম্ভীর। শচীনকে দেখে অবশ্য মুখে হাসি ফুটল। বলল, এসো। শচীন জুতো খুলে বারান্দায় উঠে সিঁড়িতে পা রেখে বসল। দু-চারজন এ সময়ে চরণামৃত আর ঠাকুরের আশীর্বাদি ফুল নিতে আসে। রঙ্গময়ি পাশে তামার কোষাকুষি আর পরাত নিয়ে বসা। অভ্যাসবশে একটু চরণামৃত দিল শচীনকে। তারপর বলল, এস্টেটের অবস্থা কি খুব খারাপ? খুব নয়। তবে খারাপই। ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে না। রঙ্গময়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এরকমই তো হওয়ার কথা। কৃষ্ণর বাপের তো বিষয়ে মন নেই। তা জানি। এখন তুমি ভরসা। যদি একটু সামলে দিতে পারো। শচীন হেসে বলল, আমি উকিল মানুষ। জমিদারির কী বুঝি? এসব সামলানোর জন্য পাকা লোক দরকার। সে আর কোথায় পাওয়া যাবে? কৃষ্ণর বাপ তোমার ওপরেই নির্ভর করে আছে। শচীন মাথা নিচু করে বলে, আমি যতটুকু সাধ্য করব। কোরো। কৃষ্ণর বাপের পক্ষে কিছুই সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এমন মানুষ কাছা দিতে কোঁচা খুলে পড়ে। দায়-দায়িত্বও কিছু কম নয় মাথার ওপর। মেয়ের বিয়ে বাকি, একটা ছেলে এখনও মানুষ হয়নি। ঠাটবাটও তো রাখতে হয়। তা তো ঠিকই। তবে এখনই খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আদায়টা ঠিকমতো করতে হবে। মাঝে মধ্যে ওঁর একটু মহালে যাওয়া উচিত। প্রজারা এতে খুশি হয়। সে কি আর উনি যাবেন? যেতে পারলে ভাল। তুমি বুঝিয়ে বোলো। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। শচীন পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে দেখে নিল। রাত হয়েছে। রঙ্গময়ি বলল, একটু বোসো। তোমার সঙ্গে আমার দু-একটা কথা আছে। বলুন। এখানে যদি তোমার বিয়ে হয় তা হলে কি রাজেনবাবু খুব বেশি দাবি-দাওয়া করবেন? শচীন একটু অবাক হয়। এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা তার নয়। মাথাটা নামিয়ে বলল, বাবার সঙ্গেই এ নিয়ে কথা বলবেন। সে তত বলবই। তবে তুমি নিজে তো এস্টেটের অবস্থা দেখতেই পাচ্ছো। উনি কতটা খরচ করতে পারবেন তার একটা আন্দাজও নিশ্চয়ই হয়েছে। শচীন একটু হেসে মাথা নেড়ে বলে, মনুদি, এসব নিয়ে কথা বলতে আমি পারব না। রঙ্গময়ি একটু চুপ করে থেকে বলে, আমার ভয় কী জানো? দাবি-দাওয়া বেশি হলে না আবার বিয়েটাই ভেঙে যায়। শচীন খুব গম্ভীর মুখে নিজের হাতের তেলো দেখতে লাগল। রঙ্গময়ি হঠাৎ বলে, কোকাবাবুর এক নাতি আছে। শরৎ। তাকে চেনো? শরৎকে চিনব না কেন? আমার চেয়ে বয়সে কিছু ছোট। খুব চিনি। কেমন ছেলে? ভালই তো। শুনি, ছেলেটার স্বভাব তেমন ভাল নয়। কেন, খারাপ কীসের? শুনেছি,
false
humayun_ahmed
দিবি? আয়, পাল্লা দিলে আয়। প্রথম থাইকা শুরু করি. হি-হিঁ-হি ভয় পাইছস? ভয় পাওনেরই কথা। বেশি ভয় পাওনের দরকার নাই। তোরে আমি কিছু বলব না! তোর বাচ্চাটারে শেষ করব। তুই মৌলানা মানুষ, তুই বাচ্চা দিয়া কী করবি? তুই থাকিবি মসজিদে। মসজিদে বইস্যা তুই তোর আল্লাহরে ডাকবি। পুলাপান না-থাকাই তোর জন্য ভােলা। হি-হি-হি। একটা ভয়ংকর রাত পার করলাম ভাইসাব। সকালে দেখি সব ঠিকঠাক। লতিফ ঘরের কাজকর্ম করছে। এইভাবে দিন পার করতে লাগিলাম। কখনো ভালো কখনো মন্দ। লতিফ যখন আট মাসের পোয়াতি, তখন আমি হাতে-পায়ে ধরে আমার শাশুড়িকে এই বাড়িতে নিয়া আসলাম। লতিফা খানিকটা শান্ত হল। তবে আগের মতো সহজ-স্বাভাবিক হল না। চমকে-চমকে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। ছটফট করে। মাঝে-মাঝে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নে কফিল এসে উপস্থিত হয়। কফিল চুপা গলায় বলে, দেরি নাই—আরদেরি নাই। পুত্রসন্তান আসতেছে। সাতদিনের মধ্যে নিয়ে যাব। কান্দােকাটি যা করার কইরা নেও। ঘুম ভেঙে লতিফা জেগে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদে। আমি চোখে দেখি অন্ধকার। কী করব কিছুই বুঝি না। শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্রসন্তান হল। কী সুন্দর যে ছেলেটা হল ভাইসাহেব, না-দেখলে বিশ্বাস করবেন না। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ। টানাটানা চোখ। আমি এক শ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমল না। আঁতুড়ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ি আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন। পালা করে কেউ-না-কেউ সারা রাত জেগে থাকি। লতিফার চোখে এক ফোটাও ঘুম নাই। সন্তানের মা। সারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না। আমার শাশুড়ি যখন বাচ্চা কোলে নেন। তখনো লতিফ বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে, যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে। ছয় দিনের দিন কি হল শুনেন। ঘোর বর্ষ। সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। এ-রকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই। লতিফা আমাকে বললো, আইজরাইতটা আপনে জাগনা থাকবেন। আমার কেমন জানি লাগতেছে। আমি বললাম, কেমন লাগতেছে? জানি না। একটু পরে-পরে শরীর কাঁপতেছে। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাক। আমি সারা রাইত জগনা থাকব। আপনে একটু বলরামরেও খবর দেন। সেও যেন জগন্না থাকে। আমি বলরামকে খবর দিলাম। লতিফ বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছে। আমি একমনে আল্লাহপাকেরে ডাকতেছি। জীবন দেওয়ার মালিক তিনি। জীবন নেওয়ার মালিকও তিনি। রাত তখন কত আমি জানি না ভাইসাহেব। ঘুমায়ে পড়েছিলাম। লতিফার চিৎকারে ঘুম ভাঙিল। সে আসমান ফাটাইয়া চিৎকার করতেছে। আমার বাচ্চা কই গেল-আমার বাচ্চা কই। হারিকেন জ্বালানো ছিল, নিভানো! পুরা বাড়ি অন্ধকার। কাঁপতে-কাঁপতে হারিকেন জ্বালালাম। দেখি সত্যি বাচ্চা নাই। আমার শাশুড়ি ফিট হয়ে পড়ে গেলেন। লতিফা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল কুয়ার কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিল। তাকায়ে দেখি টিন সরানো। লতিফা চিৎকার করে বলছে—আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছে। আমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরে। লতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইল। আমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম। ইমাম সাহের চুপ করে গেলেন। কপালের ঘাম মুছলেন। আমি বললাম, বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিল? জ্বি। আর দ্বিতীয় বাচ্চা? সে-ও কি এইভাবে মারা যায়? জ্বি-না জনাব। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা শ্বশুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করে। সিদ্দিক সাহেবের ঐ বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন? জ্বি। তাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে না। দ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারে। জন্মের চারদিনের দিন– আমি আৎকে উঠে বললাম, থাক ভাই, আমি শুনতে চাই না। গল্পগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না। ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহপাক আরেকটা সন্তান দিতেছেন। কিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারব না। মনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেব। বড়ই খারাপ। আমি কত বার চিৎকার করে বলেছি-কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেল। আমার সন্তানরে মের না। এই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও। ইমাম সাহেব কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হল! ইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। সেইদিন ভোরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সফিকের আরো কিছুদিন থেকে কালু খাঁর রহস্য ভেদ করে আসার ইচ্ছা ছিল। আমি তা হতে দিলাম না। ইমাম সাহেবের সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ০৩. সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে—ইমাম সাহেরের এই গল্প তাঁকে বলা হল না! ঢাকায় ফেরার তিন দিনের মাথায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা নানান কথাবার্তা হল-এটা বাদ পড়ে গেল। দু, মাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন। রাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। তিনি প্রায় দু ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন—ইমাম সাহেবের গল্প বলা হল না। তিনি চলে যাবার পর মনে হল–ইমাম সাহেবের গল্পটা তো তাঁকে শোনানো হল না। আমি আমার মেয়েকে বলে রাখলাম যে এর পরে যদি কখনো মিসির আলি সাহেব আমাদের বাসায় আসেন, সে যেন আমার কানের কাছে ইমাম বলে একটা চিৎকার দেয়। আমার এই মেয়ের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। সে যে যথাসময়ে ইমাম বলে চিৎকার দেবে, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। হলও তাই। অনেকদিন পর মিসির আলি সাহেব এসেছেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করছি।—আমার মেয়ে কানের কাছে এসে বিকট চিৎকার দিল। এমন চিৎকার যে মেজাজ
false
shunil_gongopaddhay
কাছে অবশ্য এখনও অনেক লোক আছে। কিছু কিছু দোকান খোলা রেখেছে হ্যাজাক জ্বালিয়ে। বাজারের বাইরের রাস্তায় বসা তরকারিওয়ালারা চেঁচাচ্ছে, নিয়ে যান, শস্তায় পটল! শস্তায় ঝিঙে! দেড় টাকায় একটা লাউ, নিয়ে যান, নিয়ে যান! বাজার পেরিয়ে আরও খানিকটা যাওয়ার পর গগন সাহার বাড়ি। নতুন বাড়ি, দোতলা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সামনে লোহার গেট। একতলা অন্ধকার, দোতলায় আলো জ্বলছে, অর্থাৎ এদের নিজস্ব জেনারেটার আছে। গ্রামে সেটাই বড়লোকদের চিহ্ন। লোহার গেটে তালাবন্ধ। ছোটমামা কয়েকবার ঘটাঘট শব্দ করলেন, কেউ এল। তখন হাঁক দিলেন, গগন, গগন! এবারে ভেতর থেকে একজন বলল, দাদা নেই! ছোটমামা বললেন, একবার গেটটা খোলো। আমি চাঁদুবাবু বলছি! ভেতর থেকে আবার উত্তর এল, বলছি তো দাদা বাড়ি নেই। কোথায় গেছে? তা জানি না। একবার গেটটা খুলতে পারছ না? কী মুশকিল! দাদা বাড়ি নেই। গেটে তালা পড়ে গেছে, এখন খোলা বারণ! ওপরে তো আলো জ্বলছে দেখছি! আলো জ্বালা কি নিষেধ নাকি? গগন বাড়িতে নেই বলছ! বাড়িতে নেই, তবু কি আছেন বলব? দাদার জ্যাঠাবাবু এসে এখানে রয়েছেন, তাই তেনার ইচ্ছেতে আলো জ্বালিয়েছেন! কাকাবাবু বললেন, এরপর একমাত্র পুলিশই জোর করে বাড়িতে ঢুকতে পারে। আমরা তা পারি না। জোজো বলল, অন্যভাবেও ঢোকা যায়। পেছনের জলের পাইপ বেয়ে সন্তু অনায়াসে ছাদে উঠে যেতে পারে। সন্তু বলল, আমি তো পারবই। তুই পারবি না? জোজো বলল, আমিও পারি। কতবার দশতলা-বারোতলা উঠে গেছি, এ তো মোটে দোতলা। আমার শুধু একটাই মুশকিল। যদি কুকুর থাকে? আমি কুকুর ম্যানেজ করতে পারি না। কাকাবাবু বললেন, থাক, অতটা দরকার নেই। সন্তু বলল, ভেতর থেকে যে-লোকটা কথা বলল, তার দাড়ি আছে, আর একটা চোখ ট্যারা। জোজো বলল, তুই কী করে জানলি? সন্তু বলল, তুই গিয়ে দেখে আয় মেলে কিনা! জোজো বলল, শার্লক হোমস হলে এখান থেকেই প্রমাণ করে দিত। ছোটমামা বললেন, আমার মনে হয়, গগন সত্যিই বাড়ি নেই। এতটা বাড়াবাড়ি সে করবে না। তবে, আজ বিকেলেও আমি তাকে দেখেছি। কাকাবাবু বললেন, ভেতরের লোকটি তো বলল, রাত্তিরে আর সে ফিরবে না। ছোটমামা বললেন, এক হতে পারে, গগনের গ্রামেও একটা বাড়ি আছে। এখন সে শহরে থেকে ব্যবসা করলেও গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সেখানকার বাড়িটা আরও বড় করে, সুন্দর করে সাজিয়েছে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকে দু-একদিন। কাকাবাবু বললেন, চলো, সেই বাড়িতে। ছোটমামা প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, এখন? অসম্ভব! কাকাবাবু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, অসম্ভব কেন? অনেক দূর! ছোটমামা বললেন, না, অনেক দূর নয়। কিন্তু রাস্তা খারাপ। বর্ষাকালে কাদায় ভরা। সাইকেল রিকশা যেতে পারবে না। কাকাবাবু বললেন, গগন যায় কী করে? ছোটমামা বললেন, মোটরসাইকেল যেতে পারে। জিপগাড়িও যেতে পারে। এমনিতে রাস্তা চওড়া, তবে— কাকাবাবু বললেন, একটা জিপগাড়ি জোগাড় করো! ছোটমামা বললেন, তুমি কী বলছ রাজাদা? এত রাতে আমি জিপ জোগাড় করব কোথা থেকে? কাকাবাবু এবার প্রচণ্ড রেগে উঠে বললেন, দ্যাখো চাঁদু, তুমি এত বছর ধরে গ্রামে আছ। জিপ কোথা থেকে জোগাড় করবে, তা কি আমাকে বলে দিতে হবে? যেখান থেকে পারো একটা জিপ নিয়ে এসো! কাকাবাবুর ধমক খেয়ে ছোটমামা কুঁকড়ে গেলেন। খানিকটা কাজও হল। সবাইকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ছোটমামা একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে গেলেন বাজারের দিকে। জোজো বলল, সন্তু, বাজি ধরবি, ছোটমামা জিপ আনতে পারবেন কিনা। সন্তু বলল, ঠিক পঁয়তিরিশ মিনিটের মধ্যে জিপ নিয়ে এসে পড়বেন। কাকাবাবু বললেন তোমরা বরং আর একটা বাজি ধরো। গগন সাহা এবাড়িতেই লুকিয়ে আছে, না গ্রামের বাড়িতে আছে? জোজো বলল, এ-বাড়িতেই আছে। সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি? জোজো বলল, তুই যেভাবে তখন বুঝলি যে, ভেতরে লোকটার দাড়ি আর এক চোখ ট্যারা। সন্তু বলল, এত সাততাড়াতাড়ি গেটে তালা দেওয়ার কী মানে হয়? মোটে তো নটা বাজে! কাকাবাবু বললেন, তোদের কী মত? এই রাত্তিরেই গ্রামের বাড়িটা একবার দেখে আসা উচিত। দুজনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, নিশ্চয়ই! কাকাবাবু বললেন, কিছু না পাওয়া গেলেও রাত্তিরবেলা গ্রাম তো ঘুরে আসা হবে। তাই বা মন্দ কী? দূরে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ শোনা গেল। তীব্র হেডলাইট জ্বেলে সেটা এদিকেই আসছে। জোজো বলল, এইবার গগন সাহা ধরা পড়বে! ওর কাছে যদি বোমা থাকে? কাকাবাবু বললেন, তোমরা একটু দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকো। অন্য সাইকেল রিকশাটা এর মধ্যে চলে গেছে। কাকাবাবু একলা দাঁড়িয়ে রইলেন মাঝরাস্তায়। মোটরসাইকেলটা গর্জন করতে করতে এসে থামল এই বাড়ির সামনে। যে চালাচ্ছে, তার মাথায় হেলমেট। এবার সেটা খুলতেই, অল্প আলোয় বোঝা গেল, তার বয়েস মাত্র তেইশ-চব্বিশের বেশি নয়। অর্থাৎ সে গগন সাহা হতেই পারে না। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল বাড়িটার ভেতরের দরজা, বেরিয়ে এল দুজন। তাদের মধ্যে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক, আর একজন মেয়ে। উনিশ-কুড়ির মতন বয়েস। গেটও খোলার পর মেয়েটি এসে বসল মোটরবাইকের পেছনের সিটে। যে-চালাচ্ছে, সে চেঁচিয়ে বলল, সব ঠিক আছে তো নিবারণদা? অন্য লোকটি কী বলল তা শোনা গেল না। মোটরসাইকেলটি আবার বেরিয়ে গেল হুস করে। এবার সে বাড়ির দোতলার আলোও নিভে গেল। সন্তু আর জোজো কাছে চলে আসার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, কী বুঝলি? জোজো বলল, যাকে বলে, রহস্য ঘনীভূত! এই কি সেই মোটরসাইকেলের লোকটা, যে বোমা ছুড়েছে? ও আসতেই গেট খুলে গেল কেন? কাকাবাবু বললেন, অনেক সময়
false
shottojit_roy
পাই। কোথায়? আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তার ঠিক বাইরেই প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়বার জায়গা। মনে পড়ছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বলে উঠলাম। লালমোহনবাবু চুপ। লোকটা একটা নীল অ্যাম্বাসাডারে ওঠে। ড্রাইভার ছিল। পাঁচ-সাত মিনিট চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট নেয় না। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এসে ড্রাইভারের উপর তম্বি করে। কথা না শুনলেও, ভাবভঙ্গিতে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তারপর লোকটা গাড়ির আশা ছেড়ে চলে যায়। ট্যাক্সি নিতে —এবার লালমোহনবাবু। এগজাক্টলি-তাতে কী বোঝা যায়? লোকটা ব্যস্ত-ইয়ে, ব্যতিব্যস্ত-ইয়ে, মানে, লোকটার তাড়া ছিল। গুড। দৃষ্টি আর মস্তিষ্ক—এই দুটোকে সজাগ রাখলে অনেক কিছুই অনুমান করা যায়, লালমোহনবাবু। কাজেই আমি যে ট্যাক্সিটাকে ফলো করেছিলাম তাঁর পিছনে একটা কারণ ছিল। কী মনে হচ্ছে বলুন তো আপনার? লালমোহনবাবু সোজা হয়ে বসে কনুই দুটো টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নটা করলেন। এখনও কিছুই মনে হচ্ছে না, বলল ফেলুদা, শুধু একটা খটকা। এর পরে আমরা এ ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনও কথা বলিনি। পাঁচটা নাগাত বিশ্রাম-টিশ্রাম করে লালমোহনবাবু আমাদের ঘরে এলেন। তিনজনে বসে চা আনিয়ে খাচ্ছি, এমন সময় দরজায় টাকা। যিনি ঢুকলেন তার বয়স পঁয়ত্ৰিশের বেশি। কিছুতেই নয়, কিন্তু মাথা ভরতি ঢেউ খেলানো চুলে আশ্চর্য বেশি রকম পাক ধরে গেছে। এই যে লালুদা—কেমন, এভরিথিং অলরাইট? লালুদা!–লালমোহনবাবুকে যে কেউ লালুদা ডাকতে পারে সেটা কেন জানি মাথাতেই আসেনি। বুঝলাম-ইনিই হচ্ছেন পুলক ঘোষাল। ফেলুদা আগেই লালমোহনবাবুকে শাসিয়ে রেখেছিল যে, ওর আসল পরিচয়টা যেন চেপে রাখা হয়। তাই পুলকবাবুর কাছে ও হয়ে গেল। লালমোহনবাবুর বন্ধু। পুলকবাবু আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, দেখুন তো, আপনি লালুদার বন্ধু, এত কাছের মানুষ, আর আমরা হিরোর অভাবে হিমসিম খাচ্ছি। আপনার হিন্দি আসে? ফেলুদা একটা খোলা হাসি হেসে বলল, হিন্দি তো আসেই না, অভিনয়টা আরওই আসে না। কিন্তু হিরোর অভাব কী রকম? আপনাদের তো শুটিং আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে শুনলাম। অর্জুন মেরহোত্রা করছে না? তা তো করছে, কিন্তু অর্জুন কি আর সে-অর্জুন আছে? এখন তার হাজার বায়নাক্কা। এদের আমি হিরো বলি না মশাই। আসলে এরা চোরা ভিলেন, পদায় যাই হন না কেন। নাই দিয়ে দিয়ে এদের মাথাটি খেয়ে ফেলেছে। এখানকার প্রোডিউসাররা। —যাক গে, পরশু আপনাদের ইনভাইট করে যাচ্ছি। এখান থেকে মাইল সত্তর দূরে শুটিং ৭ ড্রাইভার জায়গা চেনে। সঙ্কাল সঙ্কল বেরিয়ে সোজা চলে আসবেন। মিস্টার গোরে-মানে আমার প্রোডিউসার—এখানে, নেই; ছবি বিক্রির ব্যাপারে দিন সাতেকের জন্য দিল্লি মাদ্রাজ কলকাতা ঘুরতে গেছেন। তবে উনি বলে গেছেন আপনাদের আতিথেয়তার যেন কোনও ত্রুটি না হয়। কোথায় শুটিং? ফেলুদা প্রশ্ন করল। বিটউইন খাণ্ডালা অ্যান্ড লোনাউলি। ট্রেনের সিন। প্যাসেঞ্জারের অভাব হলে আপনাদের বসিয়ে দেব কিন্তু। ভাল কথা, লালমোহনবাবু বললেন, আমরা শিবাজী কাসল দেখে এলুম। কথাটা শুনে পুলকবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। সেকী, কখন? এই তো, আসার পথে। ধরুন, এই দুটো নাগাদ। ও। তা হলে ব্যাপারটা আরও পরে হয়েছে। কী ব্যাপার মশাই? খুন। সে কী।—আমরা তিনজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম। খ-য়ে হ্রস্বউ আর ন—এই দুটো পর পর জুড়লে আপনা থেকেই যেন শিউরে উঠতে হয়। আমি খবর পাই এই আধঘণ্টা আগে, বললেন পুলকবাবু।ও বাড়িতে তো আমার রেগুলার যাতায়াত মশাই! মিস্টার গোরেও শিবাজী কাসলেই থাকেন—বারো নম্বর ফ্লোরে। সাধে কি আপনার গপ্লে বাড়ির নাম চেঞ্জ করতে হয়েছে। অবিশ্যি উনি নিজে খুব মাই-ডিয়ার লোক। –আপনারা বাড়ির ভেতরে গেসলেন নাকি? আমি গিয়েছিলাম, বলল ফেলুদা, লিফটের দরজা অবধি। ওরেব্বাবা! লিফটের ভেতরেই তো খুন। লাশ সনাক্ত হয়নি এখনও। দেখতে গুণ্ডা টাইপ। তিনটে নাগাত ত্যাগরাজন বলে ওখানকারই এক বাসিন্দা তিন তলা থেকে লিফটের জন্য বেল টেপে। লিফুট ওপর থেকে নীচে নেমে আসে। ভদ্রলোক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েই দেখেন এই কাণ্ড। পেটে ছোরা মেরেছে মশাই। হরিবল ব্যাপার। ওই সময়টায় লিফটে কাউকে উঠতে-টুঠতে দেখেনি। কেউ? প্রশ্ন করল ফেলুদা। লিফটের আশেপাশে কেউ ছিল না। তবে বিল্ডিং-এর বাইরে দুজন ড্রাইভার ছিল, তারা ওই সময়টায় পাঁচ-ছজনকে ঢুকতে দেখেছে। তার মধ্যে একজনের গায়ে লাল শার্ট, একজনের কাঁধে ব্যাগ আর গায়ে খয়েরি রঙের- ফেলুদা হাত তুলে পুলকবাবুকে থামিয়ে বলল, ওই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি স্বয়ং আমি, কাজেই আর বেশি বলার দরকার নেই। আমার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠেছে। সর্বনাশ!—ফেলুদা কি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়বে নাকি? এনিওয়ে, আশ্বাসের সুরে বললেন পুলক ঘোষাল, ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনিও না লালুদা। আপনার গল্পে শিবাজী কাসলে স্মাগলার থাকে লিখেছেন, তাতে আর ভয়ের কী আছে বলুন! বম্বের কোন অ্যাপার্টমেন্টে স্মাগলার থাকে না? মিসায় আর কটাকে ধরেছে? এ তো সবে খোসা ছাড়ানো চলছে এখন, শাঁসে পৌছুতে অনেক দেরি। সারা শহরটাই তো স্মাগলিং-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। ফেলুদাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। তবে সে ভাবটা কেটে গেল আর একজন লোকের আবির্ভাবে। দ্বিতীয় টাকার শব্দ হতে পুলকবাবুই চেয়ার ছেড়ে এই বোধহয় ভিক্টর বলে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। চাবুকের মতো শরীরওয়ালা মাঝারি হাইটের একজন লোক ঘরে ঢুকল। পরিচয় করিয়ে দিই লালুদা–ইনি হলেন ভিক্টর পেরুমল—হংকং-ট্রেনড কুং-ফু এক্সপার্ট। ভদ্রলোক দিব্যি খোলতাই হেসে আমাদের সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলেন, পুলকবাবু বললেন, আর হিন্দি তো বটেই, যদিও ইনি দক্ষিণ ভারতের লোক। আর ইনি শুধু কুং-ফু শেখান না, এঁর স্টান্টেরও জবাব নেই। ঘোড়া থেকে চলন্ত ট্রেনের উপর লাফিয়ে পড়ার ব্যাপারটা হিরোর ভাইয়ের মেক-আপ নিয়ে ইনিই করবেন। আমার ভদ্রলোককে দেখে কেন জানি
false
shorotchandra
এতবড় সম্মানিত গরীয়সী নারী এ প্রদেশে আর কেহ নাই। সে সামান্য একজন রমণীর অত্যন্ত সাধারণ গৃহস্থালীর অতি তুচ্ছ আলোচনায় মুহূর্তের জন্যও আপনাকে বিহ্বল করিয়াছে মনে করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল। ঘরে আর কেহ নাই, ক্ষণকালের এতটুকু দুর্বলতা জগতে কেহ কখনো জানিবেও না, শুধু কেবল যে দেবীর সেবিকা সে, সেই চণ্ডীর উদ্দেশ্যে আর একবার যুক্তকরে নতশিরে কহিল, মা, বৃথা চিন্তায় সময় বয়ে গেল, তুমি ক্ষমা করো। রাত্রি কত হইয়াছে ঠিক জানিবার জো নাই, কিন্তু অনুমান করিল অনেক হইয়াছে। তাই শয্যাটুকু আরও একটু বিস্তৃত করিয়া এবং প্রদীপে আরও খানিকটা তেল ঢালিয়া দিয়া সে শুইয়া পড়িল। শ্রান্তচক্ষে ঘুম আসিতেও বোধ করি বিলম্ব ঘটিত না; কিন্তু বাহিরে দ্বারের কাছেই একটা শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া বসিল। বাতাসেও একটু জোর ধরিয়াছিল, শিয়াল-কুকুর হওয়াও অসম্ভব নয়, তবুও ক্ষণকাল কান পাতিয়া থাকিয়া সভয়ে কহিল, কে? বাহির হইতে সাড়া আসিল, ভয় নেই, মা, তুমি ঘুমোও – আমি সাগর। কিন্তু এত রাত্তিরে তুই কেন রে? সাগর কহিল, হরখুড়ো বলে দিলে, জমিদার এয়েচে, রাতটাও বড় ভাল নয়——মা একলা রয়েচে, যা সাগর, লাঠিটা হাতে নিয়ে একবার বস্‌ গে। তুমি শুয়ে পড় মা, ভোর না দেখে আমি নড়ব না। ষোড়শী বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তাই যদি হয় সাগর, একা তুই কি করবি, বাবা? বাহিরের লোকটি একটু হাসিয়া কহিল, একা কেন, মা, খুড়োকে একটা হাঁক দেব। খুড়ো-ভাইপোয় লাঠি ধরলে জান ত, মা, সব। সেদিনকার লজ্জাতেই মরে আছি, একটিবার যদি হুকুম দিয়ে পাঠাতে মা। এই দুইটি খুড়া ও ভাইপো—হরিহর ও সাগর ডাকাতি অপবাদে একবার বছর-দুই করিয়া জেল খাটিয়াছিল। জেলের মধ্যে বরঞ্চ ছিল ভাল, কিন্তু অব্যাহতি পাইয়া ইহাদের প্রতি বহুকাল যাবৎ একদিকে জমিদার ও অন্যদিকে পুলিশ কর্মচারীর দৌরাত্ম্যের অবধি ছিল না। কোথাও কিছু একটা ঘটিলে দুইদিকের টানাটানিতে ইহাদের প্রাণান্ত হইত। স্ত্রীপুত্র লইয়া না পাইত ইহারা নির্বিঘ্নে বাস করিতে, না পাইত দেশ ছাড়িয়া কোথাও উঠিয়া যাইতে। এই অযথা পীড়ন ও অহেতুক যন্ত্রণা হইতে ষোড়শী ইহাদের যৎকিঞ্চিৎ উদ্ধার করিয়াছিল। বীজগাঁর জমিদারি হইতে বাস উঠাইয়া আনিয়া নিজের মধ্যে স্থান দিয়া এবং নানা উপায়ে পুলিশকে প্রসন্ন করিয়া জীবনযাত্রার ব্যাপারটা ইহাদের অনেকখানি সুসহ করিয়া দিয়াছিল। সেই অবধি দস্যু অপবাদগ্রস্ত এই দুইটি পরম ভক্ত ষোড়শীর সকল সম্পদে বিপদে একান্ত সহায়। শুধু কেবল নীচ জাতীয় ও অস্পৃশ্য বলিয়াই সঙ্কোচে তাহারা দূরে দূরে থাকিত, এবং ষোড়শী নিজেও কখনো কোনদিন তাহাদের কাছে ডাকিয়া ঘনিষ্ঠতা করিবার চেষ্টা করে নাই। অনুগ্রহ কেবল দিয়াই আসিয়াছে, ফিরিয়া কখনো গ্রহণ করে নাই, বোধ করি প্রয়োজনও হয় নাই। আজ এই নির্জন নিশীথে সংশয় ও সঙ্কটের মাঝে তাহাদের আড়ম্বরহীন এই স্নেহ ও নিঃশব্দ সেবার চেষ্টায় ষোড়শীর দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। মুছিয়া ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর, তোদের জাতের মধ্যেও বোধ হয় আমার সম্বন্ধে কথাবার্তা হয়, না রে? কে কি বলে? বাহির হইতে সাগর আস্ফালন করিয়া জবাব দিল, ইস্‌! আমাদের সামনে! দুই তাড়ায় কে কোথায় পালাবে ঠিক পায় না মা! ষোড়শী তৎক্ষণাৎ সলজ্জে অনুভব করিল, ইহার কাছে এরূপ প্রশ্ন করাই তাহার উচিত হয় নাই। অতএব কথাটাকে আর না বাড়াইয়া মৌন হইয়া রহিল। অথচ চোখেও তাহার ঘুম ছিল না। বাহিরে আসন্ন ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া তাহারি খবরদারিতে একজন জাগিয়া বসিয়া আছে জানিলেই যে নিদ্রার সুবিধা হয় তাহা নয়, তাই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আবার সে এই কথাই পাড়িল, কহিল, যদি জল আসে তোর যে ভারী কষ্ট হবে সাগর, এখানে ত কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। সাগর কহিল, নাই থাকল মা। রাত বেশী নেই, প্রহর-দুই জলে ভিজলে আমাদের অসুখ করে না। বাস্তবিক ইহার কোন প্রতিকারও ছিল না, তাই আবার কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া ষোড়শী অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিল। কহিল, আচ্ছা, তোরা কি সব সত্যিই মনে করেচিস জমিদারের পিয়াদারা আমাকে সেদিন বাড়ি থেকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল? সাগর অনুতপ্ত স্বরে কহিল, কি করবে মা, তুমি যে একলা মেয়েমানুষ! এ পাড়ায় মানুষ বলতেও কেউ নেই, আমরা খুড়ো-ভাইপোও সেদিন হাটে গিয়ে তখনও ফিরতে পারিনি। নইলে সাধ্য কি মা, তোমার গায়ে কেউ হাত দেয়! ষোড়শী মনে মনে বুঝিল এ আলোচনাও ঠিক হইতেছে না, কথায় কথায় হয়ত কি একটা শুনিতে হইবে; কিন্তু থামিতেও পারিল না, কহিল, তাদের কত লোকজন, তোরা দুটিতে থাকলেই কি আটকাতে পারতিস? বাহির হইতে সাগর মুখে অস্ফুট ধ্বনি করিয়া বলিল, কি হবে, মা, আর মনের দুঃখ বাড়িয়ে! হুজুরও এয়েছেন, আমরাও জানি সব। মায়ের কৃপায় আবার যদি কখনো দিন আসে, তখন তার জবাব দেব। তুমি মনে করো না, মা, হরখুড়ো বুড়ো হয়েছে বলে মরে গেছে। তাকে জানতো মাতু ভৈরবী, তাকে জানে শিরোমণিঠাকুর। জমিদারের পাইক-পিয়াদা বহুৎ আছে তাও জানি, গরীব বলে আমাদের দুঃখও তারা কম দেয়নি, সেও মনে আছে—ছোটলোক আমরা নিজেদের জন্যে ভাবিনে, কিন্তু তোমার হুকুম হলে মা ভৈরবীর গায়ে হাত দেবার শোধ দিতে পারি। গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ওই হুজুরকেই রাতারাতি মায়ের স্থানে বলি দিতে পারি মা, কোন শালা আটকাবে না! ষোড়শী মনে মনে শিহরিয়া কহিল, বলিস কি সাগর, তোরা এমন নিষ্ঠুর, এমন ভয়ঙ্কর হতে পারিস? এইটুকুর জন্যে একটা মানুষ খুন করবার ইচ্ছে হয় তোদের! সাগর কহিল, এইটুকু! কেবল এইটুকুর জন্যেই কি আজ তোমার এই দশা! জমিদার এসেছে শুনে খুড়ো
false
toslima_nasrin
হয়ে পায়ের ওপর, যেন সেজদা করছেন, ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলে হওয়ার শর্তে তিনি মাঝরাত কেন, সারারাতই জিকির করবেন। আমিরুল্লাহ দাড়ি থেকে হাত সরিয়ে আলেয়ার পিঠে রাখেন, কড়িকাঠ থেকে নামিয়ে আলেয়ার ঘোমটা খসে বেরিয়ে আসা চুলে চোখ রেখে বলেন আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, সর্বশক্তিমান। তার আদি নেই, অন্ত নেই। তার পিতামাতা পুত্রকন্যা নেই। তিনিই সবকিছু দেখেন অথচ তার আমাদের মত চক্ষু নেই। তিনি সবই শোনেন, অথচ তার কর্ণ নেই। তিনি সবকিছুই করতে পারেন অথচ আমাদের মত তার হাত নেই। তিনি সর্বত্র সর্বদা বিরাজিত। তিনি আহার করেন না, নিদ্রা যান না। তার কোনও আকৃতি নেই। তার তুলনা দেওয়া যেতে পারে এমন কোনও বস্তু নেই। তিনি চিরদিনই আছেন এবং চিরদিনই থাকবেন। তিনি সকলের অভাব পূরণ করেন, তার নিজের কোনও অভাব নেই। তিনি চিরজীবিত, তার মৃত্যু নেই, ধ্বংসও নেই। তিনি পরম দাতা, অসীম দয়ালু। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ইজ্জতের মালিক, মানুষকে তিনি ইজ্জত দান করেন। তুমি তার দরবারে হাত ওঠাও, তোমার নিশ্চয় ছেলে হবে, সমাজে তোমার ইজ্জত রক্ষা হবে। মা’র পেছনে জড়সড় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিরাকার শরীরটির কথা ভাবি। ‌এ অনেকটা আমাদের ইস্কুলে যাদু দেখাতে আসা লোকটির মত, কালো কাপড় দিয়ে তাঁকে ঢেকে ফেলা হল, পরে কাপড় সরালে যাদুকর আর নেই ওতে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। আমারও যদি নিরাকার শরীর থাকত, সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একা একা চলে যেতাম, কেউ আমার ঘাড় খুঁজে পেত না ঘরে ঠেলার। নতজানু আলেয়ার উপুড় হওয়া শরীরের তল থেকে পীরসাব পা সরিয়ে নেন। যুবতীদের ভিড় থেকে হুমায়রা ছুটে এসে আলেয়াকে ধরে উঠোনে নিয়ে যায়। জবা গাছ তলে দাঁড়িয়ে আঁচলের গিঁট খুলে ভাঁজ করা নোট বার করে হুমায়রার হাতে দেন আলেয়া। হুমায়রা মুঠোর ভেতর নোটটি নিয়ে পীরসাবের হাতে গুঁজে দেয়, অভিজ্ঞ হাত। টাকা এক হাত থেকে আরেক হাতে যায়। অনেকটা রিলে রেসের মত। পীরসাব তাঁর আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে দেন টাকার হাতটি, ওটিই আপাতত চলমান ক্যাশবাক্স। পকেটে ঢোকানো হাতটির ওপর চোখ গেঁথে থাকে আমার। আমার চোখের পাতায় তীক্ষ্ণ চোখ রেখে–হামিমা, সঙ্গে কে তোমার, মেয়ে নাকি! পীর বলেন। মা আমার বাহু টেনে সামনে এনে বলেন–জ্বি হুজুর। এই মেয়ে জন্মাইছে বারই রবিউল আওয়ালে। মেয়ে আমার সাথে দাড়ায়া নামাজ পড়ে। কায়দা সিফারা পইড়া সাইরা কোরান শরিফ ধরছে। এরে এট্টু দুয়া কইরা দিবেন হুজুর, যেন মেয়ে আমার ঈমানদার হয়। মা আমার পিঠ ঠেলে বলেন–যা হুজুরকে কদমবুসি কর। আমি গা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। কদমবুসি করার জন্য এক পাও এগোতে ইচ্ছে করে না আমার। মা গা ঠেলেন আমার, আবারও। আমি এক পা দু’পা করে পেছোতে থাকি। মুখে শাদা লম্বা দাড়ি, পায়ের গোড়ালি অবদি আলখাল্লা, মাথায় আল্লাহু লেখা গোল টুপি লাগানো পীর থাবা বাড়িয়ে খপ করে ধরেন আমাকে, যেন গাছ থেকে টুপ করে পড়া একটি চালতা ধরছেন মুঠোয়। আমাকে তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে ফেলেন এত যে আলখাল্লার ভেতর হারিয়ে যায় আমার শরীর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে কিছু বলে পীরসাব ফুঁ দেন আমার সারা মুখে। ফুঁএর সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ে মুখে আমার। আলখাল্লা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মোহাবিষ্ট মা’র পেছনে। জামার হাতায় থুতু মুছতে মুছতে শুনি পীর বলছেন–তুমার মেয়ে কি দুনিয়াদারির পড়া পড়ছে নাকি! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–হ। আমার ত কোনও হাত নাই হুজুর ছেলেমেয়ের ওপর। এর বাপে সেই পড়াই পড়াইতেছে। এই মেয়ের আবার আল্লাহ রসুল সম্পর্কে খুব জানার ইচ্ছা। তাই ভাবছি এহানে নিয়া আসলে ওর ভাল লাগবে। মনটা ফিরবে আল্লাহর দিকে আরও। হুজুর চুক চুক দুঃখ করেন জিহবায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে বলেন–মুশকিল কি জানো! দুনিয়াদারির লেখাপড়ায় মনে শয়তান ঢুকে যায়, পরে শয়তানের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যে দেখ নাজিয়া, নাফিসা, মুনাজ্জেবা, মতিয়া এরা সবাই কলেজে পড়ত, সবাই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে এখন আল্লাহর পথের পড়াশুনা করছে। আখেরাতের সম্বল করছে। ওরা এখন বুঝতে পারে, ওইসব পড়ালেখা আসলে মিথ্যা। ওরা ঢাকা ছিল ভয়ংকর অন্ধকারে। সত্যিকার জ্ঞানের আলো ওরা পায়নি। মা আমাকে ইঙ্গিতে উঠোনে যেতে বলে হুজুরকে তালপাতার পাখায় বাতাস করেন। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে যেই না উঠোনে পা দেব, চিলের মত ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নেয় হুমায়রা, নিয়ে সোজা উত্তরের ঘরে। এ ঘরটির তোষকগুলো গুটোনো থাকে দিনের বেলা, চৌকির ওপর বিছানো থাকে কেবল শীতল পাটি। পাটির ওপর বসে ফজলিখালার মেয়েরা তসবিহ জপে, নামাজ পড়ে। তারা কেউ ইস্কুলে যায় না, তারা আল্লাহর পথের লেখাপড়া করে বাড়িতে। হুমায়রা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। মুখখানা গোল চালতার মত ওর। — তুমি বড় খালার মেয়ে, তুমি আমার খালাতো বোন হও, তা জানো! হুমায়রা আমার কাঁধে টোকা মেরে বলেন। — দুনিয়াদারির লেখাপড়া কর কেন? এই লেখাপড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ অনেক গুনাহ দেবেন তোমাকে। বলে আমাকে পাটির ওপর বসিয়ে হুমায়রা পাশে বসে আমার। — তোমার বাবা হচ্ছে একটা কাফের। কাফেরের কথা শুনলে তোমাকেও দোযখে পাঠাবেন আল্লাহতায়ালা। চোখ বুজে দোযখের কল্পনা করতে গিয়ে গায়ে কাঁপুনি ওঠে হুমায়রার। আমার হাতদু’খানা হঠাৎ চেপে ধরে সে কি কারণে, ঠিক বুঝতে পারি না। গা হিম হতে থাকে আমার। বড় একটি গর্তে আগুন জ্বলছে, ফুটন্ত
false
shunil_gongopaddhay
একে তোলো, স্পিডবোটে নিয়ে চলো! রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এই, তুই হারু দফাদারের দলে ছিল না? তাকে কে মেরেছে? লোকটি এবারে খানিকটা দম নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, তারে মেরেছি আমি। সেই কুত্তার বাচ্চা নিমকহারাম, সে ছিল আমার প্রাণের বন্ধু, এক সাথে কত কাজ করেছি, আর সেই হারু দফাদার কিনা আচমকা আমার পেটে গুলি চালালে! আমিও তারে ছাড়ি নাই, বাবু! বদলা নিয়েছি। ছুরির এক কোপে তার কলজে ফাঁসিয়ে দিয়েছি। লোকটা এর পর দারুণভাবে হাঁপাতে লাগল। কাকাবাবু আঙুল দিয়ে তার থুতনিটা উঁচু করে ধরে তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবারে সত্যি কথা বলে তো? সেই সাহেবকে কে মেরেছে? তুমি না হারু দফাদার? লোকটা আস্তে আস্তে বলল, মা কালীর কিরে, বনবিবির কিরে, আমি তারে মারিনি! হারুও তারে মারেনি। কালু শেখ তারে জড়িয়ে ধরেছিল, কিন্তু ছুরি মারবার আগেই সাহেব জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে! এর পরে যা ঘটল তাকে অসম্ভব বা অলৌকিক বলা যেতে পারে। ঠিক যেন একটা রূপকথা। ইংগামার স্মেন্ট মারা যাননি, জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, একথা জানিবার পর পুরো পাঁচ ঘন্টা ধরে পুরো এলাকাটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখা হল। নদীর দুধারে প্রতিটি ইঞ্চিও দেখা বাকি রইল না। কিন্তু জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল না ইংগামার স্মেল্টকে। এর মধ্যে স্পিডবোটের ডিজেল ফুরিয়ে গিয়েছিল, পুলিশের লঞ্চ থেকে নেওয়া হয়েছিল ডিজেল। ভাড়া করা লঞ্চটাকেও খোঁজার কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। বেলা দুটোর সময় রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, নাঃ! লেটুস কল ইট এ ডে! আর খুঁজে লাভ নেই! বিমান বলল, জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেও, এত স্রোত, তাছাড়া এই নদীতে কামঠ আছে। সাহেবের প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। সাহেবের বয়েসও তো হয়েছিল অনেক, তাই না কাকাবাবু? কাকাবাবু ক্লান্তভাবে বললেন, হ্যাঁ। প্রায় চুয়াত্তর! চলো, তাহলে ফেরা যাক! সাহেব জলে মরতে চেয়েছিলেন, জলেই প্ৰাণ গেছে। স্পিডবোটটা তখন প্রায় সমুদ্রের মোহনার কাছে। ফেরার জন্য স্পিডবোটের চালক কাশেম এমনই ব্যস্ত হয়ে গেল যে, প্রচণ্ড স্পিড তুলে দিল। আর মোটরের আওয়াজ হতে লাগল। এত জোরে যে, কারুর কোনও কথা বলার উপায় নেই। সবাই নিস্তব্ধ। কিন্তু রণবীর ভট্টাচার্য বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। তিনি বুকে পড়ে কাশেমের পিঠে হাত রেখে বললেন, ওহে, একটু আস্তে চালাও! আমাদের মেরে ফেলতে চাও নাকি? কাশেম মুখ ফিরিয়ে বলল, অ্যাঁ? কী বলছেন স্যার? অ্যাঁ? একটু আস্তে চালাও! অ্যাঁ? অ্যাঁ? তার পরেই কিসে প্ৰচণ্ড এক ধাক্কা লেগে উল্টে গেল স্পিডবোটটা। সবাই ছিটকে পড়ে গেল জলে। কামঠের ভয়ের চেয়েও সন্তুর বেশি ভয় হল কাকাবাবুর জন্য। কাকাবাবু বলেছিলেন, তিনি সাঁতার কাটতে পারবেন না। সে এদিক-ওদিক চেয়ে কাকাবাবুকে খুঁজতে লাগল। ওদের মহা সৌভাগ্য এই যে, স্রোতের টান নেই একেবারে। সময়টা জোয়ার আর ভাটার ঠিক মাঝখানে। এই সময়ে জল প্ৰায় স্থির থাকে, কোথাও অবশ্য ঘূর্ণি হয়। একটা বড় গাছ ভেসে আসছিল, কাশেম অন্যমনস্ক হওয়ায় সেই গাছেই ধাক্কা লেগে উল্টে গেছে স্পিডবোটটা। একটু দূরে কাকাবাবুর মাথাটা একবার দেখতে পেয়ে সন্তু ড়ুবসাঁতারে কাছে চলে গিয়ে কাকাবাবুকে ধরতে গেল। কাকাবাবু মুখ উঁচু করে বললেন, আমি ঠিক আছি। আমি পেরে যাচ্ছি। পুলিশের লঞ্চটা কাছেই ছিল। তারা স্পিডবোটটা উল্টে যাওয়া দেখতে পেয়েছে। তারা অমনি আসতে লাগল। এদিকে। লঞ্চের ঢেউয়ে কাকাবাবু আরও সহজে ভেসে যেতে লাগলেন পাড়ের দিকে। তীর থেকে বোটটা খুব বেশি দূরে ডোবেনি। একটুক্ষণের মধ্যেই সবাই পৌঁছে গিয়ে গাছের শিকড় ধরল। রণবীর ভট্টাচার্য হেসে বললেন, কেলেংকারি ব্যাপার! আমিই বোধহয় ডোবালাম বোটটাকে, তাই না? আমি যদি কাশেমকে না ডাকতুম— কাশেম এবারে আর পুলিশের বড়সাহেবকে খাতির করল না। বেশ রাগতভাবে বলল, আপনিই তো স্যার আমায় অন্যমনস্ক করে দিলেন। আমি ঠিকই চালাচ্ছিলুম! রণবীর ভট্টাচার্য সেইরকম হাসিমুখে বললেন, যাক, এ যাত্রায় অনেক কিছুই তো হল, জলে ডোবাটাই বা বাকি থাকে কেন? সবই হয়ে গেল! আমরা সবাই তো বেঁচে গেছি। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি পুলিশের লঞ্চের উদ্দেশে খুব জোরে চেঁচিয়ে বললেন, আমরা সবাই ঠিক আছি। তোমরা স্পিডবোটটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করো? স্পিডবোটটা উল্টো হয়ে ভেসে চলেছে দুলতে দুলতে। কাশেম কাকাবাবুকে দেখিয়ে বলল, ভাগ্য ভাল, নদীর জলে এখন টান ছিল না। নইলে এই বাবুর খুব অসুবিধে হত। কাকাবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হুঁ! তারপরই উৎকৰ্ণভাবে বললেন, ওটা কিসের শব্দ? জঙ্গলের মধ্যে তোমরা একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছ? সবাই একসঙ্গে মনোযোগ দিল। একটা ক্ষীণ আওয়াজ সত্যিই শোনা যাচ্ছে। গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ? তার চেয়ে যেন কিছুটা অন্যরকম। তীক্ষ্ণ শিসের মতন। কিন্তু একটানা আর সুরেলা। কাশেম বলল, ওটা স্যার সাপের ডাক। মাঝে-মাঝে জঙ্গলে শোনা যায়। গোখরো সাপে ওরকম ডাকে। কাকাবাবু খাড়া হয়ে বসে বললেন, সাপের ডাক? যতসব গাঁজাখুরি কথা। সাপ কখনও ডাকে নাকি? আমার ক্রাচ দুটো ভেসে গেছে। এখন আমি কী করে যাব? বিমান বলল, কোথায় যাবেন? এখন? কাকাবাবু বললেন, ওটা কিসের আওয়াজ দেখতে হবে না? আমার মনে হচ্ছে, রুমানিয়ান বাঁশির আওয়াজ। আমি রুমানিয়ায় গিয়ে এই বাঁশি শুনেছি। দেখতে ছোট হারমোনিকার মতন, কিন্তু ঠিক বাঁশির সুর বেরোয়। রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সুন্দরবনে রুমানিয়ান বাঁশি? কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সন্তু আর বিমান, আমার দুদিকে দাঁড়া তো। তোদের কাঁধে ভর দিয়ে চল যাই, একটু দেখে আসি। কাশেম কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে ভয়ার্তা গলায় বলল, যাবেন না, বাবু! এ জঙ্গল
false
shomresh
ও হাত বাড়িয়ে দিল, অনি! নিজের নামটা রেতিমার গলায় শুনে অদ্ভুত সুখে অনিমেষের সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি এসে গেল। ও চট করে রেতিয়ার বাড়ানো হাত দুটো ধরতেই বুকের গভীরে দ্রুত-হয়ে-ওঠা মোড়টা ঝরঝর করে দুচোখ থেকে কান্না হয়ে ঝরে পড়ল। ও কোনো কথা বলতে পারছিল না। নেতিয়া যেন এরকমটা আশা করেনি, ও অনিমেষের হাত ধরেই জিজ্ঞাসা করল, অনি। এবার হাতটা ছাড়িয়ে নিল অনিমেষ, তারপর দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, হ্যাঁ। ক্যা হুয়া তুমহারা? রোতা হ্যায় কাহে। কেন কান্না এল? রেতিয়ার এই প্রশ্নটার জবাব ও সত্যিই চট করে নিজেই খুঁজে পেল না। এই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে এই বোধটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বুক চেপে ধরেছিল। তারপর সীতাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কী যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেতিয়ার মুখে নিজের নামটা শুনতে পেয়েই ওর মধ্যে চট করে কান্নাটা এসে গেল। অনিমেষ বলল, এইসেই। বেতিয়া হাম কলকাতামে যায়েগা। বেতিয়া যেন চিন্তিত হল, উতো বহু দূর-জলপাই সে ভি-না? অনিমেষ একথার জবাব দিল না। সে জলপাইগুড়িতে থাকুক কিংবা কলকাতায়-স্বৰ্গছেঁড়ার সঙ্গে যে-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তা কোনোদিন কমবে না। শুধু এই রেতিয়ার মতো কেউ যখন এত বছর পরও তার গলা মনে রেখে নাম ধরে ডেকে ওঠে, তখন মনটা কেমন হয়ে যায়। বাজারের দিকে যাবার ইচ্ছে ছিল ওর। কাল হয়তো-দুপুরের আগেই ওকে চলে যেতে হবে। তাই আজ স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার-এলাকায় ঘুরে আসার ইচ্ছা ছিল ওর। বিশু কিংবা বাপীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ভালো লাগত। কিন্তু এই সন্ধে-হয়ে-যাওয়া সময়টা.ওর মনে রেতিয়ার সঙ্গে হেঁটে ওকে লাইনে পৌঁছে দিলেই বোধহয় ভালো লাগবে। এখন আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ওর একটুও ইচ্ছে করছিল না। হঠাৎ ওর মনে হল, স্বৰ্গছেঁড়ার গাপালা মাটি মাঠ আংরাভা নদীর মতো রেতিয়া যেন প্রকৃতির একটা অদ। ও রেতিমার হাত ধরে রাখার পাশ ধরে হাঁটতে লাগল। কমশ অন্ধকার সমস্ত চরাচর ছেয়ে যেতে লাগল। মাথার ওপর পাখিরা এখন গাছে-গাছে জায়গা পেয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুম ক্যায়সা হ্যায় রেতিয়া? রেতিয়া সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল কিছুটা, তারপর বলল, আজ হাম কুছ নেহি খায়-হামকো কই খানে নেহি দিয়া। সে কী, কেন? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। বেচারা রেতিয়া অন্ধ বলে কাজ করতে পারে না এবং ওর বাপ মা দাদার কাছে থাকে। তা হলে তারা ওকে খেতে দেয়নি কেন? বিমর্ষমুখে রেতিয়া বলল, আজ সুবেরে সব হরতাল পরব কিয়া। কই, ঘমে নেহি হ্যায়। সামনে সব হাড়িয়া পিকে বেহুঁশ হো গিয়া। বাজারে গিয়ে চা খাসনি? কেন দেয়নি জিজ্ঞাসা করল না অনিমেষ, শুধু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশকিছু খুচরো পয়সা বের করে না শুনে রেতিয়ার হতের মুঠোয় গুঁজে দিল। রেতিয়া চমকে গিয়ে হাতটা ওপরে তুলতেই পয়াসগুলো আঙুলের ফাঁক গলে টুংটাং করে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল। যাঃ, গির গিয়া পয়সা। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে রেতিয়া মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে হাতড়ে পয়সা খুঁজতে লাগল। এখন এখানে ঘন অন্ধকার। সাদাচোখে কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে ছুটে-যাওয়া এক-টকেটা গাড়ি অন্ধকারকে ছুড়ে ফেলে মুহূর্তের জন্য চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। এইরকম একঝলক আলোয় অনিমেষ দেখল অনেক দূরে রেতিয়ার নাগালের বাইরে একটা এক আনা পড়ে আছে। ও চট করে এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলতেই জায়গাটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। তীব্র আলোর পর অন্ধকার আরও গাঢ়তর হয়। ছড়িয়ে-থাকা পয়সাগুলো খুঁজতে ওকে এখন হাতড়াতে হচ্ছে। অনিমেষ আবিষ্কার করল, ওর সঙ্গে রেতিয়ার এই মুহূর্তে কোনো পার্থক্য নেই-দুজনেই এই মুহূর্তে অন্ধ। ছোটমা বোধহয় আগে থেকেই বিছানাপত্র ঠিক করে রেখেছিলেন। মহীতোষের একটা পুরনো হোন্ডল ছিল, সেটাই পরিস্কার করে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। ঝাড়িকাকু সেটাকে মাথায় নিয়ে ওর সঙ্গে চলল। সকালে মহীতোষ তাঁর বন্ধু দেব্রতবাবুর ঠিকানা-লেখা একটা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন অনিমেষকে। টেগ্রিাম করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি অবশ্যই স্টেশনে আসেন। প্রিয়তোষকে তিনি পরে জানাবেন, যদি ভরতি হতে অসুবিধে হয় তবেই যেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মহীতোষ ভাই-এর সাহায্য নেওয়া ঠিক পছন্দ করছেন না। টাকাপয়সা যত্ন করে ওর সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল। ছোটমা বারবার করে এ-ব্যাপারে সজাগ হতে বললেন ওকে। যাবার সময় যখন অনিমেষ ওদের প্রণাম করল, তখন, মহীতোষ অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, যখন যা দরকার হবে আমাকে জানিও, সঙ্কোচ করবে না। কুচবিহার থেকে আসা বাসে জিনিসপত্র তুলে ও যখন উঠতে যাচ্ছে হঠাৎই ঝাড়িকাকু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল অনিমেষ, কিন্তু কান্না বড় ছোঁয়াচে রোগ। তবু সে কোনোরকমে ঝাড়িকাকুকে বলল, এই, তুমি কাঁদছ কেন? সমস্ত বাসের লোক অবাক হয়ে দেখল, ঝাড়িকাকু কান্না গিলতে গিলতে বলল, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে, তোকে আর আমি দেখতে পাব না-তুই ফিরে এসে দেখবি আমি নেই, মরে গেছি। দাঁড়াতে পারল না অনিমেষ, ঠোঁট কামড়ে দ্রুত বাসে উঠে পড়ল। বাসসুদ্ধ লোক এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝাড়িকাকু সরে রাস্তার পাশে যেতেই বাসটা ছেড়ে দিল। দুহাতে নিজের গাল চেপে সেই বেঁটেখাটো প্রৌঢ় মানুষটাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল সে। হঠাৎ ওর সমস্ত শরীরে টা দিয়ে উঠল, সত্যি যদি তার ঝড়িকাকুকে না দেখতে পায়? চোখ বন্ধ করে ফেলল অনিমেষ। হুহু করে বাসটা ছুটে যাচ্ছে। সেই ইউক্যালিপটাস
false
shomresh
পাবলিককে বুঝিয়ে বোকা বানাতে চাইছে। আমার তা মনে হয় না। মনে হয় না? না। পুলিশ সত্যি মনে করছে আকাশলালের মৃতদেহ চুরি হয়ে গেছে। পুলিশের পক্ষে সবার নজর এড়িয়ে রাস্তার নীচে দিনের পর দিন ধরে সুড়ঙ্গ খোড়া সম্ভব নয়। তাহলে তুমি কাকে দেখে এলে? আমার কি দেখতে ভুল হয়েছে? বিড়বিড় করল স্বজন, শুয়ে থাকলে মানুষের চেহারা অবশ্য একটু অন্যরকম দেখায়। নাঃ, এত বড় ভুল হবে না। আশ্চর্য ডেডবডি কবর থেকে উঠে এখানে শুয়ে থাকবে কী করে? যদি ডেডবডি না হয়? যদি জীবিত অবস্থায় ওকে কবর দেওয়া হয়? তুমি কি পাগল? পুলিশ ওকে জীবিত অবস্থায় কবর দেবে কেন? পুলিশ যদি মৃত বলে ভুল করে থাকে? উল্টোপাল্টা বলছ। পুলিশের ডাক্তার নেই। ডাক্তার মৃত বাঁ জীবিত বুঝবে! নিশ্চয়ই বুঝবে। কিন্তু বুঝে সুঝেই যদি করে থাকে। পুলিশের ডাক্তার তো। এদের লোক হতে পারে। পারে না? আকাশলাল জানত এভাবেই বেরিয়ে আসবে, তাই আগে থেকে সুড়ঙ্গ খুজিয়ে রেখেছিল। মৃত্যুটা একটা ভাওতা। ওপরে যে লোকটা শুয়ে আছে তার ওপর দু-তিন দিন আগে একটা বড় অপারেশন হয়েছে। আমাকে বলা হল হাটের ব্যাপার। যা অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখলাম তা বড় নাসিংহোমের ভাল অপারেশন থিয়েটারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আমি বুঝতে পারছি না। পৃথা। মৃত বাঁ অর্ধমৃত কোনও মানুষকে শুইয়ে আবার তুলে এনে বাঁচানো আমার জ্ঞানে সম্ভব নয়। অথচ লোকটা বেঁচে আছে। পৃথা স্বামী পাশে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখল, তুমি এ নিয়ে ভাবছ কেন? পরশুর পর তো আমরা এখানে থাকছি না। কাল তোমার কাজটুকু ঠিকঠাক করে দাও। টেলিফোন বাজল। ভার্গিস রিসিভার তুলে শুরলেন, স্যার প্রধান বাস টার্মিনালে একটু আগে বোমা ফেটেছে। আমাদের একটা জিপ আর দুজন কনস্টেবল প্রচন্ড আহত হয়েছে। বোমাটা ছুড়ল কে? ধরতে পারা যায়নি। একটু আগে কারফিউ শিথিল হওয়ায় রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল। সার্চ পাটি পৌঁছে গিয়েছে? হ্যাঁ। এর এক মিনিট বাদেই ভিক্টোরিয়া সিনেমা হলের সামনে আর একটি পুলিশের ভ্যান আক্রান্ত হয়। সেখানেও আড়াল থেকে বোমা ছোড়া হয়েছে। কর্তব্যরত সার্জেন্ট গুলি চালালে একজন পথচারী নিহত হয়েছেন। পথচারী বলবেন না, টেররিস্ট বলে ঘোষণা করুন। এইমাত্র আর একটি ইনসিডেন্টের খবর এসেছে স্যার। বারো নম্বর রাস্তার মোড়ে এবার গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। হ্যাঁ স্যার, গ্রেনেড। একটা পুলিশ ভ্যান বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ছজন পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলস স্পট ডেড। দাঁতে দাঁত চাপলেন ভার্গিস, ওরা হঠাৎ এটা শুরু করল কেন? স্যার, দুজন লোক টেলিফোন করে বলেছে। ওরা ডেভিডের হত্যার বদলা নিচ্ছে। কারফিউ ইমপোজ করুন। ইমিডিয়েটলি। নো মোর রিল্যাক্সসেসন। রাস্তায় যাকে দেখা যাবে তাকেই গুলি করে মারা হবে। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ভার্গিস। তাকে খুব উত্তেজিত দেখছিল। লোকগুলো এবার মরিয়া হয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। ভয় দেখিয়ে কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ডেভিডের হত্যার বদলা? দরকার হলে ওর মৃতদেহ মেলার মাঠে ঝুলিয়ে রাখবেন তিনি। পচে পচে খসে না যাওয়া পর্যন্ত পাবলিক দেখুক। হঠাৎ সেই মেয়ে রিপোর্টারের কথা মনে পড়ল ভার্গিসের। ইন্টারকমে আদেশ দিলেন তাকে তার ঘরে নিয়ে আসার জন্য। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভার্গিস অনীকাকে তার সামনে দেখতে পেলেন। ততক্ষণে চুরুট ধরিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেই অবস্থায় বললেন, আপনার বন্ধুরা বোমা ছুড়ছে, গ্রেনেড ছুড়ছে। এর বদলে আমাকে কিছু তো করতে হয়। আমার কোনও বন্ধু এখানে নেই। আলবত আছে। তারাই আপনাকে পাঠিয়েছিল। ডেভিডের সৎকারের জন্যে। আমি সেটা অ্যালাউ না করতে ওরা পুলিশ মারছে। এসব কথা অনর্থক আমাকে বলছেন! শুনুন মিস, বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই। কে আপনাকে পাঠিয়েছে? যে লোকটি আমাকে অনুরোধ করেছিল তাকে আমি চিনি না। আমি এখনও আপনার সম্মান বজায় রেখেছি। আমি যদি হুকুম দিই তাহলে আমার লোকজন আপনাকে মার্সিলেসলি রেপ করতে পারলে খুশি হবে। আমি জানি না কোনও রেপ মার্সি-সহকারে করা সম্ভব কিনা। ওঃ, আপনার কি ভয় বলে কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি, আপনি আপনার লোকদের দিয়ে ওই কাজটা করাবেন কেন? আমি কি এতই সাবস্ট্যান্ডার্ড? এমন সংলাপ জীবনে কখনও শোনেননি ভার্গিস। তার চোয়াল বুলে গেল। তিনি কোনও মতে বলতে পারলেন, বসুন। অনীকা বসলো। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এক কাপ ভাল কফি পেতে পারি? ভার্গিস মাথা নাড়লেন, না। আপনি কিছুই পেতে পারেন না। ডেভিডের সৎকারের অধিকার যদি আপনাকে দিই তাহলে শহরে গোলমাল থেমে যাবে? বলতে পারছি না। কারণ করা গোলমাল করছে। আমি জানি না। ওয়েল! আপনি প্ৰথমবার কবরখানায় কেন গিয়েছিলেন? আকাশলালের মৃত্যুর খবর আমাকে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল ওর পারিবারিক কবরখানায় আগাম গিয়ে সৎকারের খবর নিয়ে আসি। হুম। দ্বিতীয়বার গেলেন কেন? আমার সন্দেহ হয়েছিল কোথাও গোলমাল হয়েছে। কী গোলমাল? ওর মৃত্যুটা আমার কাছে স্বাভাবিক নয়। ডাক্তার সেই সার্টিফিকেট দিয়েছে। হতে পারে। কিন্তু আমি একজন মানুষকে মাটিতে কান পেতে কিছু শুনতে দেখেছিলাম। পরে সুড়ঙ্গের খবরটা পাই। সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল আকাশলালের শরীর কবর থেকে তোলা হবে বলেই। অর্থাৎ আকাশলাল জীবিত অবস্থায় সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরিকল্পনা করেছিল। কারণ সে জানতে আপনার এখান পৌঁছে সে মারা যাবে অথবা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হবে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। ঠিক তখনই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলতেই ডেস্ক থেকে তাকে জানানো হল মিনিস্টার তাকে এখনই দেখা করতে বলেছেন। এই প্ৰথম মিনিস্টার তার সঙ্গে সরাসরি কথা
false
nihar_ronjon_gupta
ঘুরতেই ও দেখতে পেল, উপরে উঠবার সিঁড়ি। আর কালবিলম্ব না করে টর্চটা নিভিয়ে অন্ধকারেই টিপে টিপে নিঃশব্দে ও উপরে উঠতে লাগল। উপরের তলাতেও ঠিক এমনি একটা বারান্দা। কোণের একটা ঘরের আধ-ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এসে বারান্দায় পড়েছে। সুব্রত পা টিপে টিপে দরজাটা দিকে এগিয়ে গেল। কাদের কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে যেন। সুব্রত যে ঘরটা থেকে আলো আসছিল, তার পাশের ঘরটাতে গিয়ে প্রবেশ করল। ঘরটার এক কোণে একটা সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। ঘরটা খালি! কেউ নেই ঘরে। ভাগ্যক্রমে ও দেখলে, যে-ঘরে লোকগুলো কথাবার্তা বলছিল, সেই ঘর থেকে এই ঘরে আসা-যাওয়ার একটা প্রবেশদ্বার আছে। সেখানে ভারী একটা পর্দা টাঙানো। সর্বাগ্রে সুব্রত চট্‌ করে ঘরটার চারপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। একপাশে একটা লোহার খাটে শয্যা বিছানো। একটা কাঠের আলমারি এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। এককোণে একটা কুঁজো। কুঁজোর মুখে একটা গ্লাস উপুড় করা। আর এক কোণে একটা লোহার সিন্দুক। একটা আলনায় গোটাকতক কাপড়ও ঝুলছে। সুব্রত আস্তে আস্তে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার ঝুলন্ত পর্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পাশের ঘরের লোকগুলো বেশ জোরে-জোরেই কথা বলছে। একজনের গলা শোনা গেল, একটু কর্কশ গলার স্বর, তাহলে তোমরা চিঠিটা সত্যি উদ্ধার করে এনেছ? হ্যাঁ, সর্দার। কিন্তু বেটা গোয়েন্দাটা আর একটু হলেই পিস্তলের গুলি চালিয়ে মানকের প্রাণটা নিয়েছিল আর কি! আগের লোকটি ঐ কথায় কর্কশ গলায় হেসে উঠল। চিঠিটা যদি আজ তোরা না আনতে পারতিস—লোকটা বলতে লাগল, তবে আজ বহু টাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। সাবাস! খুব বাহাদুর! গোবরা জবাব দিলে, তাতে আর সন্দেহ কি সর্দার। তা চিঠির মালিক সেই টাকা দেনেওয়ালা আজ এখানে এসেছিল কি? না, আমিই সন্ধ্যার সময় তাজ হোটেলে দেখা করেছি। বলেছে, চিঠিটা উদ্ধার হলে কাল এসে সে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেনাপাওনার কি হবে সর্দার? কুছ পরোয়া নেই। টাকা সে আগাম দিয়ে গেছে। এমন সময় সেই লম্বা লোকটার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তবে এদের টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও সর্দার। হ্যাঁ, টাকা পাশের ঘরের সিন্দুকে আছে। এখুনি এনে দিচ্ছি। ব্যস্ত কেন? সুব্রত বুঝলে, এখুনি হয়তো সর্দার এ ঘরে আসবে। ও চটপট বড় আলমারিটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং লুকাবার আগেই সে দেখে রেখেছিল ঘরের আলোর সুইচটা কোথায়। যেখানে লুকিয়েছে তারই পাশে, অনায়াসেই হাত বাড়িয়ে সুইচটা পাওয়া যায়। আর আলমারির পাশেই সিন্দুকটা। একটু পরেই কে যেন এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রত আলমারির পিছনে দাঁড়িয়ে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। আগন্তুক এসে সবে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলতে যাবে, সহসা সুব্রত এসে তার সামনে দাঁড়াল। হাতে তার উদ্যত পিস্তল। লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মোটাসোটা গড়ন। মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল। নাকটা চ্যাপটা। চোখ দুটো ছোট ঘোট কুতকুতে। মুখে বিশ্রী বসন্তের দাগ। কুৎসিত। লোকটা হঠাৎ সুব্রতকে সামনে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যেন। কিন্তু যেমন সে দাঁড়িয়েছিল তেমনই নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। টু শব্দটি করেছ কী পিস্তলের গুলি তোমার বুকে গিয়ে তোমাকে যমের বাড়ি পাঠাবে। একটা কুৎসিত হাসির রেখা লোকটার মুখে যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই খেলে গেল। সুব্রত জানত না যে, যার সামনে সে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই লোকটা কত বড় দুঃসাহসী, নৃশংস ও ভয়ংকর! এর চাইতেও সংকটাপন্ন ভয়ংকর মুহূর্তেও সে তার উপস্থিত বিবেচনা, শক্তি ও সাহস হারায়নি। লোকটা তার কুকুতে ভয়ংকর ধারাল ছুরির ফলার মত দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ হ্যাঁ হ্যাঁ করে কর্কশ হাসি হেসে উঠল! সুব্রত চমকে উঠল, চুপ! লোকটার কিন্তু ভ্রূক্ষেপও নেই। তেমনিই হা হা করে হাসছে। সুব্রত আলোটার ওপরে লক্ষ্য করে একটা গুলি চালাল। ঝন্‌ঝন্ শব্দ করে মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র আঁধারে ভরে গেল। ইতিমধ্যে ওর হাসি শুনে পাশের ঘরের লোকগুলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছুটে এসেছে, সর্দার—সর্দার কী হল? একটা লোক ঘরের মধ্যে! লোক ঘরের মধ্যে? কোথা থেকে এল? মানকের গলা। হ্যাঁ, আলমারির দিকে… সুব্রত ততক্ষণে আলমারির দিক থেকে অন্ধকারে শিকারী বিড়ালের মত দেওয়াল ঘেঁষে এগুচ্ছে দরজার দিকে। মানকে গম্ভীর গলায় বললে, ওরে শয়তান, শীঘ্র বের হয়ে আয়! সিংহের গুহায় পা দিয়েছিস! বলতে বলতে অন্ধকার তা করে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারল মানকে! ছুরিটা এসে সাঁ করে সুব্রতর ডান হাতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা ওর হাত থেকে ঠন্‌ করে মাটিতে পড়ে গেল। সুব্রত পিস্তলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নেবার আগেই কে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঘাড়ের উপর। সুব্রত এক ঝাকানি দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিতেই লোকটা অন্ধকারে সুব্রতর পা চেপে ধরল। সুব্রত আবার পড়ে গেল। ততক্ষণে আরও একজন এসে সুব্রতর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল সেই অন্ধকারেই। সুব্রত একজনের পেটে একটা প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল। লোকটা গ্যাক করে শব্দ করে ছিটকে পড়ল। সুব্রত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে, সহসা কে তার মাথার ওপরে অন্ধকারেই একটা প্রচণ্ড আঘাত হানল। সুব্রত চোখে অন্ধকার দেখে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কতক্ষণ যে সুব্রত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তা ও বলতে পারে না। ক্রমে এক সময় একটু একটু করে ওর জ্ঞান ফিরে এল। মাথাটা তখনও বেশ ভারী। ঝিমঝিম্ একটা ভাব। শরীরটা বরফের মত জমাট বেঁধে গেছে। রক্ত চলাচল একেবারে বন্ধ। চোখের পাতা দুটো খুলতে তখনও বেশ কষ্ট হয়। কোথায় আছে সে? কী অন্ধকার!
false
shomresh
গাড়ি আর দাঁড়ায়নি। এখনও রাস্তা সুনসান। জলপাইগুড়ির ঘুম ভাঙতে একটু দেরি। রিকশাগুলো পথে নামেনি। চায়ের দোকানদার থানার বড়বাবুকে দেখে তৎপর হল। চায়ে চুমুক দিয়ে অর্জুন বলল, আঃ। প্রথম চা বেশ ভাল করে। অবনীবাবু চুমুক দিয়ে বললেন, কাল মাঝরাত পর্যন্ত সন্দীপ এবং ওর বন্ধুদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছি। কিন্তু কোনও প্রমাণ পাইনি। এস. পি. সাহেবের অনুমতি নিয়েছিলাম। কিছু না পাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাকে এমন ভাষায় তিরস্কার করলেন যে, লজ্জায় মরে যাচ্ছি। সন্দেহ হওয়ায় আমরা যে-কোনও বাড়িতে তল্লাশি করতে পারি কিন্তু— অবনীবাবুর মন যে ভাল নেই তা বোঝা গেল। আপনি কী খুঁজতে গিয়েছিলেন? এতদিন ধরে যেসব টাকা ওরা লুঠ করছিল তা নিশ্চয়ই ওদের হেফাজতে পাওয়া যাবে বলে ভেবেছিলাম। অল্পবয়সী ছেলেরা অত টাকা কোত্থেকে পেল এই কৈফিয়ত দিতে পারত না। থানায় এনে চাপ দিলে ভেঙে পড়ত। কিন্তু হিসেবে কিছু মিলল না। ওরা কিছু বলেছে? হ্যাঁ। আজ ওরা কোর্টে যেতে পারে। অবনীবাবু নিশ্বাস ফেললেন, হয়তো এর জন্যে খুব বাজে জায়গায় ট্রান্সফার করে দেবে ওপরওয়ালা। কী করা যাবে? চায়ের দোকানদার দাম নিচ্ছিল না। অবনীবাবু জোর করে দিতে সে নমস্কার করল। অর্জুন বলল, আমার মনে হচ্ছে একটা রাস্তা আছে। রাস্তা? হ্যাঁ। অবশ্য একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা না নিয়ে কোনও উপায় নেই। আপনার থানায় এখন কজন সেপাই আছে? কেন? একটু আদরপাড়ায় চলুন। আদরপাড়া? খোলসা করে বলুন মশাই। আমার মাথা কাজ করছে না। থানার দিকে যেতে যেতে অর্জুন অবনীবাবুকে ব্যাপারটা বলতে লাগল। দুজন লাঠিধারী সেপাই পেছনে বসে ছিল, অবনীবাবু জিপ চালাচ্ছিলেন। পাশে অর্জুন। জিপটা চলে এল আদরপাড়ায়। এখন দু-একজন রাস্তায়। এই ভোরে পুলিশের জিপ দেখে তারা অবাক হয়ে তাকাল। অবনীবাবু বললেন, জিজ্ঞেস না করলে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্জুন বলল, জিজ্ঞেস করলেই ভিড় বাড়বে। দাঁড়ান। জিপটা দাড়াল। এক ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিলেন। অর্জুন জিপ থেকে নেমে বলল, শুনুন, আপনি এ-পাড়ায় থাকেন? হ্যাঁ। ভদ্রলোক পুলিশের জিপ দেখে থমকে গেলেন। আমরা একটু সমস্যায় পড়েছি। একজন ডাক্তারের কলকাতা থেকে এ পাড়ায় আসার কথা। ওঁর আত্মীয় বামাচরণ দত্তের বাড়িতে উঠবেন। বাড়িটা কোথায় বলবেন? বামাচরণ দত্ত! ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না তো। ওপাশে দুজন দাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা এগিয়ে এল বামাচরণ দত্ত? কী করেন? ব্যবসা। না। চিনতে পারছি না। আর কিছু বলেছে? অর্জুন মনে করার ভান করল, হ্যাঁ। উনি কয়েকটি অর্থোপেডিক পেশেন্টকে দেখবেন। তার মধ্যে বামাচরণবাবুর পাশের বাড়ির একটি ছেলে আছে। কী নাম যেন, কাবুল, হাঁ কাবুল। তিনজনে একটু আলোচনা করে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কাবুল নামের একটি ছেলে আছে। প্রতিবন্ধী। সে থাকে সোজা গিয়ে বাঁ দিকের মোড়ে লাল বাড়িতে। কিন্তু তার আশপাশে বামাচরণ দত্ত বলে কেউ থাকে বলে মনে হয় না। আনারা একটু বেলায় আসুন। পাড়ার মুদির দোকানে খোঁজ করলে জানতে পারবেন। অশেষ ধন্যবাদ। অর্জুন গাড়িতে ওঠায় ওঁরা যে-যার মতন চলে গেলেন। অবনীবাবু অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য অভিনয় করলেন তো! অর্জুন বলল, সোজা চলুন। বাঁ দিকের মোড়ে লাল বাড়ি কাবুলদের। বাড়ির সামনে গাড়ি রাখার দরকার নেই। আগে কোথাও পার্ক করুন। হেঁটেই যাওয়া যাবে। বাড়িটা চিনতে অসুবিধে হল না৷ বেল বাজালেন অবনীবাবু। দ্বিতীয়বারের পর একটি কাজের লোক দরজা খুলল। অবনীবাবু বললেন, কাবুল আছে? হ্যাঁ। ঘুমোচ্ছ। ওঁর বাবা বাড়িতে থাকলে ডেকে দাও। কাবুলের বাবা মধ্যবয়সী মানুষ। লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গ্রায়েই বিছানা থেকে উঠে এলেন, কী ব্যাপার? কী চাই? অবনীবাবু বললেন, আমি থানার অফিসার-ইন-চার্জ। ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন, ও। কী ব্যাপার? মানে! আমরা আপনার ছেলে কাবুলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কেন বলুন তো? ওর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। অভিযোগ? সে কী? আপনি কি জানেন দুবছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্ট করায় ওর দুটো পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে? আমরা জানি। আপনার উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা রুটিন কিছু প্রশ্ন করে চলে যাব। ওকে ঘুম থেকে তুলুন। কিন্তু ওর পক্ষে তো নীচে নামা সম্ভব নয়। তা হলে আমরাই ওর কাছে যাচ্ছি। বুঝতেই পারছি আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেলছি কিন্তু ওর সঙ্গে কথা না বলে চলে যেতে পারছি না। অবনীবাবু হাসলেন, চলুন। ভদ্রলোককে অনুসরণ করে দোতলায় এল ওরা। ঘরের দরজা খোলা। পরদা ঝুলছে। বাইরে থেকে ভদ্রলোক ডাকলেন, কাবুল! বলো। সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া এল। তোমার মুখ ধোয়া হয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ। দুজন ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন? কে? কারা? কাবুলের বাবা জবাব দেওয়ার আগে অবনীবাবু পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। বছর বাইশের এক যুবক হুইল চেয়ারে বসে আছে। সামনে খোলা জানলা। ভোরের রোদ পড়ছে ঘরে। কাবুল অবাক হয়ে তাকাল, কী চাই? অবনীবাবু বললেন, তোমার নাম তো কাবুল। আমি থানা থেকে আসছি। কাবুল অবনীবাবুকে দেখল। তারপর অর্জুনের দিকে তাকাল। হঠাৎ তার মুখের চেহারা বদলাল। বলল, আপনি তো অৰ্জুন। অর্জুন কোনও কথা বলল না। অবনীবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। তোমার কোন-কোন বন্ধুর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রয়েছে? সবার সঙ্গেই আছে। ওরা আসে। ফোন করে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন খুব বই পড়ো? ওর বাবা জবাবটা দিলেন, চিরদিনই পড়ে। ফার্স্ট ডিভিশন ওর বাঁধা ছিল। ওই মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে—। ভদ্রলোক কথা শেষ করতে পারল না। অনীবাবু বললেন, এখন তো কত আধুনিক সরঞ্জাম বেরিয়েছে, প্রতিবন্ধীরা প্রায় স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারে। কাবুলের বাবা বলল, সেগুলোর সাহায্য ও
false
humayun_ahmed
ভালো। হঠাৎ করে চলে গেলে! আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। রাগ করেন নি তো স্যার? আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা উচিত ছিল। উচিত অনুচিত বিচার করে তো মানুষ সব সময় কাজ করতে পারে না। তোমার সেই মুহূর্তে চলে যেতে ইচ্ছা করেছে। তুমি চলে গিয়েছ। ভালো করেছ। আপনার কাছে তো টাকা ছিল না। ফুচকাওয়ালাকে কী বলেছেন? ঐটা কোনো সমস্যা হয় নি। যে ছেলেটি তোমাকে ফলো করে তার নাম কী? নাম জানি না। জিজ্ঞেস করো নি? না জিজ্ঞেস করি নি। ছেলেটা কে, কী করে? ঠিক জানি না। তার সঙ্গে তোমার কী কথা হয়েছে? স্যার আমার বলতে ইচ্ছা করছে না। বলতে ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না। তুমি কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে বলতে পারো। আমি খুব ভালো কাউন্সেলর। সব সমস্যার সমাধান আপনার কাছে আছে? সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবেই। সমাধান আছে অথচ সমস্যা নেই তা কি হয়? না, তা হয় না। তোমাদের ওদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে না-কি? আমি বৃষ্টির শব্দ শুনছি। বৃষ্টি হচ্ছে না। আমার একটা ঝড় বৃষ্টির সিডি আছে। ঐ সিডিটা শুনছি। আমার মন যখন খুব ভালো থাকে তখন এই সিডি শুনি। আবার মন যখন খুব খারাপ থাকে তখনও এই সিডি শুনি। এখন তোমার মনের অবস্থা কী? খুব ভালো, না খুব খারাপ? সেটা আপনাকে বলব না। সহজভাবে কিছুক্ষণ কথা বলো প্লিজ। আমি সহজভাবেই কথা বলছি। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গল্প করুন। কোন বিষয় নিয়ে তোমার গল্প করতে ভালো লাগে? সে বিষয়টা বলে। যে-কোনো বিষয় নিয়ে গল্প করতে পারেন? পৃথিবীর সব বিষয় আপনি জানেন? গল্প চালিয়ে যাবার জন্যে গভীর জ্ঞান লাগে না। যারা ভাসা ভাসা জানে তারাই সুন্দর গল্প করতে পারে। জ্ঞানীরা ঝিম ধরে বসে থাকেন, তারা গল্প। করতে পারেন না। আমি জ্ঞানী না। নিজের বিষয় কিছুটা জানি। এর বাইরে প্রায় কিছুই জানি না। জানি না বলেই ভালো গল্প করতে পারি। আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে না আমি ভালো গল্প করি। হ্যাঁ মনে হচ্ছে। তুমি কি আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাও? না তো! জানতে চাইলে বলতে পারি। আমার বাবা মা, ভাই বোন—তারা কোথায় থাকে। তারা পড়াশোনা কোথায় করেছে। জানতে চাও না? না। আমার নিজের থেকেই তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। আমার এমন কিছু বিষয় আছে যা শুনলে তুমি চমকে উঠবে। মানুষকে আপনি খুব চমকাতে পছন্দ করেন তাই না? তা করি। তবে আমার নিজের সম্পর্কে জেনে তুমি যে চমকটা খাবে সেটা রিয়েল। বাকিগুলি ফেব্রিকেটেড চমক। কষ্ট করে তৈরি করা। চমকে দেব? দিন। আমি রং নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম মনে আছে তো? আমি যখন স্থাপত্য বিষয়ের আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট তখন রঙের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ঢুকে। আমাদের একজন টিচার ছিলেন, নাম জন রে জুনিয়র, উনিই ঢুকিয়ে দেন। ক্লাসে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, সাতটা রঙের বাইরেও যে আরো অসংখ্য রং আছে তা বুঝতে পারার কিছু পদ্ধতি আছে। ড্রাগ নেয়া হলো তার একটি। কিছু কিছু ড্রাগ আছে যা রক্তে মিশলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়, যে সব রং পৃথিবীতে নেই সেইসব রং দেখা যায়। তিনি কিছু কিছু ড্রাগের নামও বললেন–তার একটি হচ্ছে . তুমি -এর নাম শুনেছ? হ্যাঁ শুনেছি। স্যারের কথা কতটুকু সত্যি তা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি নিলাম। রং দেখতে পেলেন। হ্যাঁ পেলাম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার ভুবন রঙে রঙময় হয়ে গেল। রঙের কোনো শেড না— . আমি বর্ণনা করতে পারব না, বা এঁকেও দেখাতে পারব না কারণ এই রঙগুলি পৃথিবীতে নেই। মৃন্ময়ী তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ? হ্যাঁ শুনছি। অভিজ্ঞতাটা আমার জন্যে এতই অসাধারণ ছিল যে আমার নিজের ভুবন এলোমেলো হয়ে গেল। একের পর এক নিতে থাকলাম। এক সময় পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করে সুস্থ হতে হলো। এখন আপনি সুস্থ? না এখনো ঠিক সুস্থ না। হঠাৎ হঠাৎ মাথার ভেতর রঙগুলি উঠে আসে। আমার চারপাশের পৃথিবী হয়ে যায়। আমি প্রবল ঘোরের মধ্যে চলে যাই। উদাহরণ দিয়ে বলি– মনে করে আমি কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। লাল ফুল। পেছনে ঘন নীল আকাশ। হঠাৎ ফুলের লাল রঙটা কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে গেল। আকাশের নীল রঙও বদলে গেল। রঙগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো। ওরা হয়ে গেল জীবন্ত। ওরা নিঃশ্বাস নিচ্ছে, নিঃশ্বাস ফেলছে, ছটফট করছে। কখনো কাঁদছে, কখনো রং হাসছে। বুঝতে পারছ কী বলছি? মনে হয় পারছি। এই ব্যাপারগুলি ঘটে যখন খুব পছন্দের কেউ আশেপাশে থাকে। কেউ। আমি যখন ফুচকা খাচ্ছিলাম তুমি ছেলেটার সঙ্গে গল্প করতে গেলে। আমি তাকালাম কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে, তখন ব্যাপারটা ঘটল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আপনি কি এখনো নেন? না। এখন আর নেয়ার দরকার পড়ে না। আপনার কাছে কি আছে? হ্যাঁ আছে। কেন, তুমি কি একটা ট্রিপ নিয়ে দেখতে চাও– রং ব্যাপারটা আসলে কী? আমি বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। অভিজ্ঞতার জন্যে একবার নিয়ে দেখতে পারো। তবে না নেয়াই ভালো। রঙের আসল রূপ দেখে ফেললে সাধারণ পৃথিবীর রং আর ভালো লাগবে না। পৃথিবীটাকে খুবই সাধারণ খুবই পাশে মনে হবে। প্রায়ই মনে হবে দূর ছাই এই পৃথিবীতে থেকে কী হবে? যারা নেয় তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এই
false
shunil_gongopaddhay
যাবে সবচেয়ে আগে, মাঝখানে কাকাবাবু, সবশেষে সন্তু। ডাগো একটা মোটা দড়ি আলগা করে জড়িয়ে দিল তিনজনের কোমরে। এখানে ক্রাচ নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই বলে কাকাবাবু সে-দুটো রেখে গেলেন বাইরে। সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। দুদিকের দেওয়ালে দুহাতের ভর দিয়ে বসে-বসে নামতে হয়। হাতের বেশ জোর লাগে। সন্তু ভাবল, নীচে নামবার কী অদ্ভুত ব্যবস্থা। অবশ্য হাজার হাজার বছর আগে এই ব্যবস্থাটাই বোধহয় সবচেয়ে সুবিধেজনক ছিল। কাকাবাবুর যে দারুণ কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারছে সন্তু। ওঁর ভাঙা পাটার ওপরেও জোর পড়ছে। কিনা। মাঝে-মাঝে কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, তুই ঠিক আছিস তো, সন্তু? কাকাবাবুর মুখ ভর্তি চন্দনের ফোঁটার মতন ঘাম। ওপরের আলো খানিকটা মাত্র ভেতরে ঢোকে, তারপরেই ঘুরঘুটি অন্ধকার। ডাগো কী কায়দায় যেন একটা টর্চ জেলে বগলে চেপে আছে। আর মাঝে-মাঝে আরবি ভাষায় কী যেন বলে উঠছে। হয়তো কোনও প্রার্থনামন্ত্ৰ! মিনিট দশেক পরে ওরা পৌঁছে গেল সমতল জায়গায়। ঘড়িতে দশ মিনিট কাটলেও মনে হয় যেন কয়েক ঘণ্টা লেগে গেছে। তিনটে টর্চের আলোয় দেখা গেল সেখানে একটি চৌকো ছোট ঘর। ঘরটা একেবারে খালি। দেওয়ালেও কোনও ছবি নেই। ঘরের একটা দেওয়ালে, নীচের দিকে একটা চৌকো গর্ত। তার মধ্য দিয়ে একটা সরু পথ। সেই পথে খানিকটা যাবার পর আর-একটি দেওয়াল, সেই দেওয়ালের গায়ে একটি লোহার দরজা। দেখলেই বোঝা যায়, সেই দরজাটা নতুন বসানো হয়েছে, আগে অন্যকিছু ছিল। দরজাটা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। তারপরই একটি বিশাল হলঘর। এখানকার দেওয়ালে বড়-বড় ছবি আঁকা। কিন্তু জিনিসপত্তর কিছু নেই। কাকাবাবু বললেন, সব নিয়ে গেছে। আগেরবার এসেও অনেক কিছু দেখেছিলাম। তাই না, ডাগো? ডাগো বলল, হ্যাঁ, এফেন্দি। কিছুই থাকে না। চোরেরা সব নিয়ে নেয় বলে গভর্নমেন্ট এখন নিজেই তুলে নিয়ে গিয়ে মিউজিয়ামে রাখে। কাকাবাবু বললেন, বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। ডাগো, সেই ল্যাবিরিন্থটা কোথায়? ডাগো বিস্মিতভাবে বলল, সেটাতেও যাবেন? আপনার আরও কষ্ট হবে। এক কাজ করি, এফেন্দি। আমি আপনাকে পিঠে করে নিয়ে যেতে পারি। তার দরকার হবে না। তুমি পথটা খুঁজে বার করে। আমার জায়গাটা ঠিক মনে পড়ছে না। হলঘরটা পার হয়ে এক জায়গায় এসে ডাগো একটা চৌকো পাথরের স্ল্যাব সরাল। তার মতন শক্তিশালী লোক ছাড়া অতবড় পাথর সরাতে যে-সে পারবে না। তারপর একটা ছোট গোল জায়গা। সেখানে মেঝেতে শুয়ে পড়ে সে আবার একটা পাথরের পাটাতন সরিয়ে ফেলল। এখানে আবার আর-একটা সুড়ঙ্গ। কাকাবাবু বললেন, এইখানে আমাদের যেতে হবে, সন্তু। তারপর তিনি ডাগোকে বললেন, আর তোমাকে যেতে হবে না। তুমি ফিরে যাও! দারুণ চমকে উঠে ডাগো বলল, কী বলছেন, এফেন্দি? আমি যাব না? আমাকে বাদ দিয়ে আপনি এই বাচ্চাকে নিয়ে যাবেন কী করে? ঠিক পেরে যাব। তুমি বড় হলটায় অপেক্ষা করে, কিংবা ওপরেও উঠে যেতে পারো। আমরা ফেরার সময় তোমাকে ডাকব? না, না, না, তা হয় না! আপনাকে এখানে ফেলে রেখে গেলে হানি আলকাদি আমায় আস্ত রাখবে না? হানি আলকাদির সঙ্গে আমার এই রকমই কথা আছে। আমি যা দেখতে পাচ্ছি, তা আমি দেখার আগে, অন্য কেউ জানতে পারবে না। মুফতি মহম্মদের এটা আদেশ। এই আদেশ তো সকলকে মানতেই হবে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, ডাগো। তুমি আমাদের যা উপকার করলে, তার কোনও তুলনা নেই। তোমাকে ছাড়া আর কারুকে বিশ্বাস করে আমি এখানে আসতে পারতুম না। ডাগো মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে কাকাবাবু ঢুকে পড়লেন সেই ল্যাবিরিন্থের মধ্যে। কাকাবাবু বললেন, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, সন্তু। ভেতরটা খুব আঁকাবাঁকা। একটু অন্যমনস্ক হলেই মুখে গুতো লাগবে। আগেরবার আমার নাক থেতলে গিয়েছিল। এখন কি বুঝতে পারছিস যে, আমাদের মাথার ওপরে রয়েছে একটা বিরাট পিরামিড? সন্তুর বুক টিপটপ করছে। মাটির কত নীচে, জমাট অন্ধকার ভরা এক সুড়ঙ্গ। আর কি ওপরে ওঠা যাবে? যদি হঠাৎ একটা পাথর ভেঙে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়? ডাগে সঙ্গে থাকায় তবু খানিকটা ভরসা ছিল। সন্তুর কাঁধ ধরে কাকাবাবুকে লাফিয়ে-লাফিয়ে আসতে হচ্ছে। সন্তু টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছে খুব সাবধানে। একটুখানি অন্তর-অন্তরই সুড়ঙ্গটা বাঁক কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ভয় পাচ্ছিস নাকি রে, সন্তু? সন্তু শুকনো গলায় বলল, না। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা বুঝতে পারছিস? না। এক-একটা সমাধিস্থান খুব গোপন রাখা হত। কেন যে এত গোপনীয়তা তা জানা যায় না। হয়তো দামি জিনিসপত্র অনেক বেশি রাখা হত। সেখানে। এটা সেইরকম একটা গোপন সমাধিতে যাবার পথ; কত কষ্ট করে এরকম সুড়ঙ্গ বানিয়েছে। হয়তো এই সমাধিতে যাবার আরও কোনও রাস্তা আছে, যা আমরা এখনও জানি না। রাজা-রানিরা কি এত কষ্ট করে যেতেন? আমরা কোন সমাধিতে যাচ্ছি? রানি হেটেফেরিসের গল্প তোকে বলেছিলুম, মনে আছে? হ্যাঁ, সেই যে কফিনের মধ্যে যাঁর মমি খুঁজে পাওয়া যায়নি? হ্যাঁ, হ্যাঁ। লোকের ধারণা, এই জায়গাটা ভুতুড়ে। সেই মমিটাকে মাঝে-মাঝে দেখতে পাওয়া গেছে, আবার মাঝে-মাঝে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। তোর ভূতের ভয় নেই তো? অ্যাঁ? না! মুফতি মহম্মদ নামে একজন বৃদ্ধ কী সব ছবি এঁকেছিলেন, তা দেখে আমাদের কি এত কষ্ট করে এত দূরে আসার কোনও দরকার ছিল, বল? সন্তু এ-কথার কী উত্তর দেবে! সে কিছুই বলল না। কাকাবাবু আবার বললেন, আমি এলুম কেন জানিস? ঐ যে মুফতি মহম্মদ নির্দেশ দিলেন, তুমি আগে নিজে যাচাই করে দেখো, সেইজন্যই আমার
false
toslima_nasrin
মধ্যে বাক্যের পর বাক্য টুকে নিয়েছি। বইটি আমাকে এমনই প্রভাবিত করেছে যে আমি পারিনি নিজেকে সুকুমারী থেকে মুক্ত করে নিজের আলাদা কোনও মত প্রকাশ করতে। সুকুমারী থেকে বেদের অনুবাদটুকুই নিতে পারতাম, কিন্তু তাঁর মন্তব্যও চুরি করতে গেলাম কেন! চুরি করতে গেলাম এই জন্য যে তাঁর মতের সঙ্গে আমার মত হুবুহু মিলে যায়। এমন সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি বেদএর শ্লোকের যে বইটি না পড়লেও ঠিক এমনই ব্যাখ্যা আমার মনে উদয় হত। আমার কথাই যেন তিনি আমার বলার আগে বলে দিয়েছেন। কলাম দুটো পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর ক্ষীণ একটি গ্লানি আমাকে নিস্তার দেয়নি। ব্যপারটি এক বালতি খাঁটি দুধের মধ্যে দুফোঁটা চোনা মিশিয়ে পুরো দুধকেই নষ্ট করে দেওয়ার মত। আনন্দ পুরস্কারের খবর পেয়ে প্রথম আমার মনে পড়েনি আমার এই চুরির কথা। হঠাৎ যখন মনে পড়ে, গ্লানি আর লজ্জা আমাকে কেঁচোর মত নিজের গর্তে ঢুকিয়ে রাখে। ঘৃণায় নিজের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সে রাতেই বেরিয়ে পড়ি টেলিফোন আপিসে গিয়ে কলকাতায় জরুরি একটি ফোন করার জন্য। নিখিল সরকারকে ফোনে জানাই যে আমার এই নির্বাচিত কলাম পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নয়, কারণ বইটির ভেতরে দুটো কলাম আছে, যেখানে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বই থেকে অনেক কিছু নেওয়া হয়েছে। আমার এই স্বীকারোক্তি শোনার পর যদি তিনি বলতেন যে তিনি পুরস্কার কমিটিকে ব্যপারটি অবগত করে আনন্দ পুরস্কারটি আমাকে যেন না দেওয়া হয় তার জন্য তদবির করবেন, হালকা হতে পারতাম। তাঁকে মনে হল না তিনি আদৌ আমার এই চুরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। জানি চুরি অনেকেই করে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখাটি, তিনি নিজেই বলেছেন, চুরি করে লেখা। দাঁড়ি কমাও বাদ দেননি চুরিতে। কিন্তু আমার তো এটি প্রথম লেখা নয়। রীতিমত যখন নাম করে ফেলেছি লিখে, তখন চুরি করা। আমাকে আমিই ক্ষমা করতে পারছি না, অন্যরা কি করে করবে! পুরস্কার পেলে মানুষের আনন্দ হয়, আমার হচ্ছে লজ্জা। নিখিল সরকারকে সুকুমারী-তথ্যটি জানিয়ে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখে লজ্জার ওপর ভয় এসে ভর করে। তবে কি পুরস্কারটি আমাকে নিতেই হবে! কী করে মুখ দেখাবো আমি! কী করে এই লজ্জা আমি ঢাকবো! চেতনার জানালা দরজায় শব্দ হতে থাকে প্রচণ্ড, আমি কী এমন লেখক যে এত বড় একটি পুরস্কার পাবো! এতকাল যাঁরা আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা আমার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ ভাল সাহিত্যিক। তাঁরা জ্ঞানের সমুদ্র, আমার জ্ঞান নেই, গুণ নেই, তুলনায় আমি এক বিন্দু জল। বাংলাদেশের কাউকে যদি পুরস্কার দিতে হয়, তবে আর যাকেই হোক, আমাকে তো দেওয়ার প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। এত বড় মাপের সাহিত্যিক এ দেশে আছেন, এত বড় কবি আছেন, তাঁদের সাহিত্যের সঙ্গে আমার কোনও গদ্য পদ্যের কোনও তুলনা করাও হাস্যকর। শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, রাহাত খান, বশীর আল হেলাল —-এঁদের পায়ের ধূলার যোগ্য নই আমি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার ধারে কাছে কি আমার কবিতা স্থান পেতে পারে! নিঃসন্দেহে বলতে পারি, না। তবে আমি কেন নির্বাচিত হলাম! পুরস্কার কমিটির মাথাটি নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গেছে, অথবা বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, তা না হলে পুরস্কারের জন্য আমাকে নির্বাচন করতেন না। কমিটিতে খুব বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী আছেন, এ কেমন বুদ্ধির নমুনা! জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদের মত বড় প্রাবন্ধিক যদি এই পুরস্কার না পান, তবে কী যোগ্যতা বলে আমি এই পুরস্কার পাই! কিছু শখের কবিতা লিখেছি, পত্র পত্রিকায় কিছু কলাম লিখেছি, এরকম তো কত কেউ লেখে, সাহিত্যিক জগতের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে আমার, তাই বলে তো আমি সাহিত্যিক হয়ে যাইনি! সে স্পর্ধাও আমি করি না। কলকাতার কত বড় বড় লেখকও এখন পুরস্কারের মুখ দেখেন নি, আর আমাকে কি না নিজে উপস্থিত থেকে নিজে হাতে নিতে হবে পুরস্কার! পুরস্কারের ঘোষণাটি আমাকে হঠাৎ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কত ক্ষুদ্র আমি, কত অযোগ্য আমি, লেখক হিসেবে কত তুচ্ছ আমি, কত অপাংক্তেয় আমি! মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য লিখি, কিন্তু আমি তো নতুন লিখছি না, অনেকেই মেয়েদের অধিকারের পক্ষে লিখেছেন, লিখছেন। আমাকে তো কোনও স্বার্থত্যাগ করতে হয়নি, আমাকে ভুগতে হয়নি, পথে নামতে হয়নি, সংগ্রাম করতে হয়নি, অনেকে তো কত রকম সংগঠন করেছেন নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্য করার জন্য। এনজিও খুলেছেন, ইশকুল বানিয়েছেন, নিজের যা কিছু আছে সবই বিসর্জন দিয়েছেন নারী উন্নয়নের জন্য। আমি কিছুই করিনি। এখনও পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে শেখা বাড়ির কাজের মেয়েদের গালে চড় কষানোর, পিঠে ধুমাধুম কিল দেওয়ার বদভ্যাস ছাড়তে পারিনি। সুফির দেড়বছর বয়সী মেয়েটি প্যানপ্যান করে কাঁদত বলে, চতুর হাসি হাসত বলে সুফির আড়ালে আমি একদিন তার হাতদুটো মুচড়ে দিয়েছিলাম। আমার এই হাত কলুষিত হাত, এই হাতে এত বড় সম্মানের প্রতীক ওঠা মানায় না। যে সব আদর্শের কথা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি বার বার, সেইসব আদর্শের কতটুকু জীবনে চর্চা করেছি! সমাজতন্ত্রের রূপরেখা পড়ে আমি উৎসাহিত হই, কিন্তু নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করার উৎসাহ কোনওদিন পাইনি। দেশের আশি ভাগ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে জেনেও নিজের আরাম আয়েশের কিছু ছাড় দিই না। হাজার হাজার মানুষ ফুটপাতে বা তক্তপোষে
false
tarashonkor
ন্যায়রত্ন বলিলেন—গৃহস্থকে আতিথ্য-ধর্ম পালনে ব্যাঘাত দিতে নাই। তারপর বিশ্বনাথকে বলিলেন—যাও ভাই, পণ্ডিতের বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। বড় শ্ৰান্ত-ক্লান্ত ও… কিছুক্ষণ পরে ন্যায়রত্ন বলিলেন আমি সব শুনেছি পণ্ডিত। দেবু তাহার পায়ে হাত দিয়াই বসিয়াছিল; সে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-আমি কি করব বলুন। ন্যায়রত্ন স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। বিশ্বনাথ পাশেই চুপ করিয়া বসিয়া ছিল—জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিল। দেবু আবার প্রশ্ন করিল—বলুন আমি কি করব? ন্যায়রত্ব বলিলেন—বলবার অধিকার নিজ থেকেই অনেকদিন ত্যাগ করেছি। শশীর মৃত্যুর দিন উপলব্ধি করেছিলাম কাল পরিবর্তিত হয়েছে, পাত্রেরাও পূর্বকাল থেকে স্বতন্ত্র হয়েছে; দৈবক্রমে আমি ভূতকালের মন এবং কায়া সত্ত্বেও ছায়ার মত বর্তমানে পড়ে রয়েছি। সেদিন থেকে আমি শুধু দেখে যাই। বিশ্বনাথকে পর্যন্ত কোনো কথা বলি না। তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইলেন। দেবু চুপ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া যেমন বসিয়া ছিল—তেমনি বসিয়া রহিল। ন্যায়রত্ন আবার বলিলেনদেখ, বলবার অধিকার আমার আর সত্যিই নাই। শশীর কালেও যাদের দেখেছি, একালের মানুষ তাদের চেয়েও স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছে। মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। বিশ্বনাথ এবার বলিল—তাদের যে সত্যিই দেহের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে দাদু, নৈতিক মেরুদণ্ড সোজা থাকবে কি করে! অভাব যে অনিয়ম; নিয়ম না থাকলে নীতি থাকবে কোন অবলম্বনে বলুন? চুরিতে লুটতরাজে যার সব যায়, সে বড়জোর নীতি মেনে চুরি না করতে পারে, কিন্তু ভিক্ষে না করে তার উপায় কি বলুনঃ ভিক্ষার সঙ্গে হীনতার বড় নিকট সম্বন্ধ, আর হীনতার সঙ্গে নীতির বিরোধকে চিরন্তন বলা চলে। ন্যায়রত্ন হাসিলেন, বলিলেন—তাই-ই কালক্রমে সত্য হয়ে দাঁড়াল বটে। হয়ত মহাকালের তাই অভিপ্রায়। নইলে দীনতা—সে হোক না কেন নিষ্ঠুরতম দীনতা–তার মধ্যে। থেকেও হীনতার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার সাধনাই তো ছিল মহদ্ধর্ম। কৃচ্ছ্বসাধনায়, সর্বস্ব ত্যাগে ভগবানকে পাওয়া যা না-যাক পার্থিব দৈন্য এবং অভাবকে মালিন্যমুক্ত করে মনুষ্যত্ব একদিন জয়যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বনাথ বলিল—যে শিক্ষায় আপনার পূর্ববর্তীরা এটা সম্ভবপর করেছিলেন—সে শিক্ষা যে তারাই সর্বজনীন হতে দেয় নি দাদু। এ তারই প্রতিফল। মণি পেয়ে মণি ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু মণি যে পায় নি—সে মণি ফেলে দেবে কি করে? লোভই বা সংবরণ করবে কি করে? ন্যায়রত্ন পৌত্রের মুখের দিকে চাহিলেন, বলিলেনকথা তুমি বেশ চিন্তা করে বলে থাক দাদু। অসংযত বা অর্থহীনভাবে কথা তো বল না তুমি! বিশ্বনাথ দেখিল—পিতামহের দৃষ্টিকোণে প্রখরতা অতি ক্ষীণ আভায় চমকিয়া উঠিতেছে। দেবুও লক্ষ্য করিয়াছিল, সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বিশ্বনাথের কোন কথায় ন্যায়রত্ন এমন হইয়া উঠিয়াছেন—অনুমান করিতে পারিল না। বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিল—আমার পূর্ববর্তী সম্মুখে বর্তমান; আমি এখন রঙ্গমঞ্চে নেপথ্যে অবস্থান করছি। সেইজন্যই বললাম—আপনার পূর্বগামী। ন্যায়রত্বও হাসিলেন নিঃশব্দ বাঁকা হাসি; বলিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের দিব্যাস্ত্রের সম্মুখে পার্থসারথি রথের ঘোড়া দুটোকে নতজানু করে রথীর মান বাঁচিয়েছিলেন। অর্জুনকে পেছন। ফিরতেও হয় নি, কর্ণের মহাস্ত্রও ব্যর্থ হয়েছিল। বাগযুদ্ধে তুমি কৌশলী বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথ এবার খানিকটা শঙ্কিত হইয়া উঠিল; ইহার পর ন্যায়রত্ন যাহা বলিবেন, সে হয়ত বজ্রের মত নিষ্ঠুর অথবা ইচ্ছামৃত্যুশীল শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের অন্তিম মৃত্যু-ইচ্ছার মত সকরুণ মর্মান্তিক কিছু। ন্যায়রত্ব কিন্তু তেমন কোনো কিছুই বলিলেন না, ঘাড় নিচু করিয়া তবু আপনার ইষ্টদেবতাকে ডাকিলেন নারায়ণ! নারায়ণ! পরমুহূর্তে তিনি সোজা হইয়া বসিলেন—যেন আপনার সুপ্ত শক্তিকে টানিয়া সোজা করিয়া জাগ্রত করিয়া তুলিলেন। তারপর দেবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন বিবেচনা করে দেখ পণ্ডিত। আমার উপদেশ নেবে অথবা তোমাদের এই নবীন ঠাকুরমশায়ের উপদেশ নেবে? বিশ্বনাথও সোজা হইয়া বসিল, বলিল—আমি যে সমাজের ঠাকুরমশায় হব দাদু, সে সমাজে আপনার দেবু পণ্ডিত হবে আপনাদেরই মত পূর্বগামী। সে সমাজের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই হয় দেবু কাশীবাস করবে অথবা আপনার মত দ্রষ্টা হয়ে বসে থাকবে। ন্যায়রত্ন হাসিয়া বলিলেন—তা হলে আমার পাজি-পুঁথি এবং শাস্ত্রগ্রন্থ ফেলে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে ফেলি, বল? আমার ঠাকুরের তা হলে মহাভাগ্য! পাকা নাটমন্দির হবে। তুমিই সেদিন বলেছিলে-যুগটা বণিকের এবং ধনিকের যুগ; কথাটা মহাসত্য। এ অঞ্চলের নব সমাজপতি—মুখুয্যেদের প্রতিষ্ঠা তার জ্বলন্ত প্ৰমাণ। বিশ্বনাথ হাসিয়া বাধা দিয়া বলিল-আপনি রেখে গেছেন দাদু কথাগুলো আপনার যুক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে; সেদিন আরও কথা বলেছিলাম সেগুলো আপনি ভুলে গেছেন। ন্যায়রত্ন চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন ভুলি নাই। তোমার সেই ধর্মহীন ইহলোকসর্বস্ব সাম্যবাদ। –ধর্মহীন নয়। তবে আপনারা যাকে ধর্ম বলে মেনে এসেছেন সে ধর্ম নয়। সে আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়, ন্যায়নিষ্ঠ সত্যময় জীবনধারা। আপনাদের বাহ্যানুষ্ঠান ও ধ্যানযোগের পরিবর্তে বিজ্ঞানযোগে পরম রহস্যের অনুসন্ধান করব আমরা। তাকে শ্রদ্ধা করব কিন্তু পূজা করব। না। ন্যায়রত্ন গম্ভীরস্বরে ডাকিলেন–বিশ্বনাথ! –দাদু! –তা হলে আমার অন্তে তুমি আমার ভগবানকে অৰ্চনা করবে না। বিশ্বনাথ বলিল–আগে আপনি দেবু পণ্ডিতের সঙ্গে কথা শেষ করুন। ন্যায়রত্ন দেবুর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। দেবুর মুখ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাহাকে উপলক্ষ করিয়া ন্যায়রত্নের জীবনে আবার এ কি আগুন জ্বলিয়া উঠিল? কুড়ি-বাইশ বৎসর পূর্বে নীতির বিতর্কে এক বিরোধবহ্নি জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে সংসারটা ঝলসিয়া গিয়াছে; ন্যায়রত্নের একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথের পিতা ক্ষোভে অভিমানে আত্মহত্যা করিয়াছে। দেবুকে নীরব দেখিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন—পণ্ডিত। দেবু বলিল—আমি আজ যাই ঠাকুর মশায়! —যাবে? কেন? –অন্যদিন আসব। —আমার এবং বিশ্বনাথের কথা শুনে শঙ্কিত হয়েছ? ন্যায়রত্ব হাসিলেন। না না, ওর জন্যে তুমি চিন্তিত হয়ো না। বল, তুমি কি জানতে চাও! বল? দেবু বলিল—আমি কি করব? শ্ৰীহরি পঞ্চায়েত ডেকে আমাকে পতিত করতে চায়। অন্যায় অপবাদ দিয়ে –হ্যাঁ, এইবার মনে হয়েছে। ভাল, পঞ্চায়েত তোমাকে ডাকলে তুমি যাবে, সবিনয়ে বলবে আমি অন্যায় কিছু করি নি।
false
shordindu
ভ্রাতা কুমার কম্পনদেবকে প্রতিভূস্বরূপ পাঠাইয়াছেন। কুমার কম্পন রাজা অপেক্ষা বয়সে অনেক ছোট, সবেমাত্র যৌবনপ্রাপ্ত হইয়াছেন, অতি সুন্দরকান্তি নবযুবক। রাজা এই ভ্রাতাটিকে অত্যধিক স্নেহ করেন, তাই তিনি বধূ-সম্ভাষণের জন্য নিজে না আসিয়া ভ্রাতাকে পাঠাইয়াছেন। কিল্লাঘাটের উচ্চতম সোপানে কুমার কম্পন অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া নৌকার দিকে চাহিয়া আছেন। তাঁহার পিছনে পাঁচটি চিত্রিতাঙ্গ হস্তী, হস্তীদের দুই পাশে ভল্লধারী অশ্বারোহীর সারি। তাহাদের পশ্চাতে নববেশপরিহিত ধনুর্ধর পদাতি সৈন্যের দল। সর্বশেষ ঘাটের প্রবেশমুখে নানা বর্ণাঢ্য বস্তুনির্মিত দ্বিভূমক তোরণ, তোরণের দুই স্তম্ভাগ্রে বসিয়া দুই দল যন্ত্রবাদক পালা করিয়া মুরমুরলী বাজাইতেছে। বড় মিঠা মন-গলানো আগমনীর সুর। ওদিকে অগ্রসারী নৌকা তিনটিতেও প্রবল ঔৎসুক্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল। আরোহীরা নৌকার কিনারায় কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া ঘাটের দৃশ্য দেখিতেছিল। ময়ূরপঙ্খী নৌকার ছাদের উপর বিদ্যুন্মালা মণিকঙ্কণা মন্দোদরী ও মাতুল চিপিটকমূর্তি উপস্থিত ছিলেন। সকলের দৃষ্টি ঘাটের দিকে। তোরণশীর্ষে নানা বর্ণের কেতন উড়িতেছে; ঘাটের সম্মুখে জলের উপর কয়েকটি গোলাকৃতি ক্ষুদ্র নৌকা অকারণ আনন্দে ছুটাছুটি করিতেছে। ঘাটের অস্ত্রধারী মানুষগুলা দাঁড়াইয়া আছে চিত্রার্পিতের ন্যায়। সর্বাগ্রে অশ্বারূঢ় পুরুষটি কে? দূর হইতে মুখাবয়ব ভাল দেখা যায় না। উনিই কি মহারাজ দেবরায়? নৌকাগুলি যত কাছে যাইতেছে মুরমুরলীর সুর ততই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। দুই দলের দৃষ্টি পরস্পরের উপর। আকাশের দিকে কাহারও দৃষ্টি নাই। নৌকা তিনটি ঘাটের দশ রঞ্জুর মধ্যে আসিয়া পড়িল। তখন মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালা ছাদ হইতে নামিয়া রইঘরে গেলেন। ঘাটে নামিবার পূর্বে বেশবাস পরিবর্তন, যথোপযুক্ত অলঙ্কার ধারণ ও প্রসাধন করিতে হইবে। মন্দোদরীকে ডাকিলে সে তাঁহাদের সাহায্য করিতে পারিত; কিন্তু মন্দোদরী ঘাটের দৃশ্য দেখিতে মগ্ন, রাজকন্যারা তাহাকে ডাকিলেন না। দুই ভগিনী গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে মহার্ঘ স্বর্ণতন্তুরচিত শাড়ি ও কঙুলী পরিধান করিলেন, পরস্পরকে রত্নদ্যুতিখচিত অলঙ্কার পরাইয়া দিলেন। তারপর বিদ্যুম্মালা গমনোম্মুখী হইলেন। মণিকঙ্কণা জিজ্ঞাসা করিল—আলতা কাজল পরবি না? বিদ্যুন্মালা বলিলেন—না, থাক। তিনি উপরে চলিয়া গেলেন। মণিকঙ্কণা ক্ষণেক ইতস্তত করিল, তারপর কাজললতা লাক্ষারসের করঙ্ক ও সোনার দর্পণ লইয়া বসিল। বিদ্যুন্মালা পটপত্তনের উপর আসিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহার মনে হইল এই অল্পক্ষণের মধ্যে আকাশের আলো অনেক কমিয়া গিয়াছে। তিনি চকিতে ঊর্ধ্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। দক্ষিণ হইতে একটা ধূম্রবর্ণ রাক্ষস ছুটিয়া আসিতেছিল, বিদ্যুন্মালার নেত্রাঘাতে যেন উন্মত্ত ক্রোধে বিকট চিৎকার করিয়া নদীর বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িল। নিমেষমধ্যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল। দাক্ষিণাত্যের শৈলবন্ধুর মালভূমিতে গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে এমনি অতর্কিত ঝড় আসে। দিনের পর দিন তাপ সঞ্চিত হইতে হইতে একদিন হঠাৎ বিস্ফোরকের ন্যায় ফাটিয়া পড়ে। ঝড় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বড় জোর দুই-তিন দণ্ড; কিন্তু তাহার যাত্রাপথে যাহা কিছু পায় সমস্ত ছারখার করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। এই ঝড়ের আবির্ভাব এতই আকস্মিক যে চিন্তা করিবার অবকাশ থাকে না, সতর্ক হইবার শক্তিও লুপ্ত হইয়া যায়। নৌকা তিনটি পরস্পরের কাছাকাছি চলিতেছিল, ঘাট হইতে তাহাদের দূরত্ব পাঁচ-ছয় রঞ্জুর বেশি নয়, হঠাৎ ঝড়ের ধাক্কা খাইয়া তাহারা কাত হইয়া পড়িল। ময়ূরপঙ্খী নৌকার ছাদে মন্দোদরী ও চিপিটকমূর্তি ছিলেন, ছিটকাইয়া নদীতে পড়িলেন। পাটাতনের উপর বিদ্যুন্মালা শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হইয়া মত্ত জলরাশির মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। মকরমুখী নৌকা হইতেও কয়েকজন নাবিক ও সৈনিক জলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে অর্জুনবর্মা একজন। যখন ঝড়ের ধাক্কা নৌকায় লাগিল তখন সে মকরমুখী নৌকার কিনারায় দাঁড়াইয়া ময়ূরপঙ্খী নৌকার দিকে চাহিয়া ছিল; নিজে জলে পড়িতে পড়িতে দেখিল রাজকুমারী ড়ুবিয়া গেলেন। সে জলে পড়িবামাত্র তীরবেগে সাঁতার কাটিয়া চলিল। আকাশের আলো নিভিয়া গিয়াছে, নৌকাগুলি ঝড়ের দাপটে কে কোথায় গিয়াছে কিছুই দেখা যায় না। কেবল নদীর উন্মত্ত তরঙ্গরাশি চারিদিকে উথল-পাথার হইতেছে। তারপর প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি নামিল। চরাচর আকাশ-পাতাল একাকার হইয়া গেল। বিদ্যুন্মালা তলাইয়া গিয়াছিলেন, জলতলে তরঙ্গের আকর্ষণ-বিকর্ষণে আবার ভাসিয়া উঠিলেন। কিছুক্ষণ তরঙ্গশীর্ষে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইবার পর তাঁহার অর্ধচেতন দেহ আবার ড়ুবিয়া যাইতে লাগিল। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ঝড়ের মাতন চলিয়াছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক, মেঘের হুঙ্কার; তারপর শোঁ শোঁ ক শব্দ। জল ও বাতাসের মরণাত্মক সংগ্রাম। বিদ্যুন্মালা জলতলে নামিয়া যাইতে যাইতে অস্পষ্টভাবে অনুভব করিলেন, কে যেন তাঁহাকে আকর্ষণ করিয়া আবার উপর দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট রহিলেন; শরীর অবশ, বাঁচিয়া থাকার যে দুরন্ত প্রয়াস জীবমাত্রেরই স্বাভাবিক তাহা আর নাই। জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান ঘুচিয়া গিয়াছে। ক্রমে তাঁহার যেটুকু সংজ্ঞা অবশিষ্ট ছিল তাহাও লুপ্ত হইয়া গেল। দশ ঝড় থামিয়াছে। মেঘের অন্ধকার অপসারিত হইবার পূর্বেই রাত্রির অন্ধকার নামিয়াছে। বর্ষণধৌত আকাশে তারাগুলি উজ্জ্বল; তুঙ্গভদ্রার স্রোত আবার শান্ত হইয়াছে। তীরবর্তী প্রাসাদগুলির দীপরশ্মি নদীর জলে প্রতিফলিত হইয়া কাঁপিতেছে। কেবল হেমকূট শিখরে এখনও অগ্নিস্তম্ভ জ্বলে নাই। এই অবকাশে ঝক্কাহত মানুষগুলির হিসাব লওয়া যাইতে পারে। কিল্লাঘাটে যাহারা অতিথি সংবর্ধনার জন্য উপস্থিত ছিল তাহারাও ঝড়ের প্রকোপে বিপর্যস্ত হইয়াছিল। বস্তুতোরণ উড়িয়া গিয়া নদীর জলে পড়িয়াছিল; হাতিগুলা ভয় পাইয়া একটু দাপাদাপি করিয়াছিল, তাহার ফলে কয়েকজন সৈনিকের হাত-পা ভাঙ্গিয়াছিল; আর বিশেষ কোনো অনিষ্ট হয় নাই। ঝড় অপগত হইলে কুমার কম্পন নৌকা তিনটির নিরাপত্তা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু রাত্রি অন্ধকার, তীরস্থ গোলাকৃতি ছোট নৌকাগুলি কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে। কুমার কম্পন কোনো সন্ধানই পাইলেন না। তখন তিনি সৈন্যদের ঘাটে রাখিয়া অশ্বপৃষ্ঠে রাজভবনে ফিরিয়া গেলেন। রাজাকে সংবাদ দিয়া কাল প্রত্যুষে তিনি আবার ফিরিয়া আসিবেন। নৌকা তিনটি ঝড়ের আঘাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ড়ুবিয়া যায় নাই; অগভীর জলে বা নদীমধ্যস্থ দ্বীপের শিলাসৈকতে আটকাইয়া গিয়াছিল। নাবিক ও সৈন্যদের মধ্যে যাহারা ছিটকাইয়া জলে পড়িয়াছিল
false
shomresh
কিন্তু একই সঙ্গে আমি যে আপনার মনের কথাও জেনে যাব। সেটা কি আপনার ভাল লাগবে? না। লাগবে না। মাথা নাড়তে লাগলেন রামগোপালবাবু। তা হলে? আচ্ছা বাবা, এই বিদ্যে তুমি কোথায় আয়ত্ত করলে? স্বপ্নে। মাটি থেকে এক হাত ওপরে শরীরটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারলেই দেখবেন মানুষের মনের কথা শুনতে পাচ্ছেন। সে তো শুনেছি যোগী-ঋষিরা পারেন। হ্যাঁ। আপনার শরীর ভারী হয়ে গেছে, বাস্তবে পারবেন না। আপনি স্বপ্নে চেষ্টা করে দেখুন। পেয়ে যাবেন। রামগোপালবাবু চলে গেলেন বিষন্ন মুখে। এখন হয়তো কয়েক রাত তিনি ওরকম স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করবেন। সফল না হলে জলপাইগুড়ি শহরে প্রচার করবেন অর্জুনের ক্ষমতার কথা। একলা ঘরে বসে অর্জুন রুদ্রাক্ষর মালাটাকে দেখল। এটা পরলে মানুষ অদ্ভুত ক্ষমতা পায়। ঠিক কথা। কিন্তু সেইসঙ্গে দুঃখকে ডেকে আনা হয়। এই যে বুড়িদি তার সম্পর্কে এরকম ভাবে তা রুদ্রাক্ষ পরার আগে সে জানত না। পরিচিত প্রিয় মানুষের মনের খারাপ দিকটা জেনে ফেললে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে। যাকে আমি খুব ভালবাসি সে আমার সম্পর্কে মনে এক আর মুখে আর-এক বলে সেটা জানার পর সম্পর্ক রাখা কি সম্ভব? অর্জুনের মনে হল, এই মালা তার ভাবার ক্ষমতাকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। সত্যসন্ধান করতে যদি তাকে এই মালার ওপর নির্ভর করতে হয়, অ হলে তার স্বকীয়তা কোথায় রইল। বরং খুব প্রয়োজনে যেমন রিভলভার বের করতে হয় তেমনই কোনও উপায় না থাকলে এটাকে পরবে সে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে মনে হল অমল সোমের সঙ্গে দেখা করে এলে হয়। এই রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না সে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকে অর্জুন দেখল বাইরের ঘরের দরজা বন্ধ। অমল সোম দুপুরে ঘুমোন না। নির্দ্বিধায় দরজায় শব্দ করল সে। কোনও সাড়া নেই। বেশ কয়েকবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর খিড়কি দরজায় পোঁছে ফাঁক দিয়ে আঙুল গলিয়ে শেকল খুলল সে। এখন দুপুরের শেষ। ভেতরের বারান্দায় ছায়া পড়েছে। অর্জুন দেখল অমল সোমের থাকার ঘর দুটোর ভেতরদিকের দরজায় তালা ঝুলছে। বুকের ভেতরটায় ছ্যাঁত করে উঠল। তালা কেন? অমলদা কি চলে গেছেন। সে হাবুর ঘরের দিকে তাকাল। দরজা খোলা। সেখানে গিয়ে দেখল হাবু ভেতরে নেই। অতএব বাগানে চলে এল অর্জুন। এবং তখনই হাবুকে দেখতে পেল। পেয়ারা গাছের নীচে মাদুর পেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে হাবু। না, ঘুমোচ্ছে না। ওর চোখ গাছের ডালে বসে থাকা একটা নীলকণ্ঠ পাখির দিকে স্থির। অর্জুনকে দেখে পাখিটা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। পাখির উড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে মুখ ফেরাতে হাবু তাকে দেখতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। অর্জুন হাতের ইশারার সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইল অমল সোম কোথায়? হাবুর মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ। পাটি মাটি থেকে তুলে ভাঁজ করছিল সে, কিন্তু অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, ঘর থেকে যার মন উঠে গেছে তাকে আর ঘরে পাবে কী করে? হাবুর গলার স্বর কোনওদিন শোনেনি অর্জুন, কারণ সে কথা বলতে পারে না। এখন যে কণ্ঠস্বর কানে এল সেটা বেশ ঘষঘষে, অমার্জিত অর্জুন চমকৃত। সে হাবুর মনের কথা শুনতে পাচ্ছে? বাঃ। পাশ কাটিয়ে হাবু চলে গেল তার ঘরে। যাওয়ার সময় অর্জুনের কানে এল, আর আমার এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। আমিও চলে যাব। হাবু ফিরে এল একটা খাম নিয়ে। সেটা খুলতেই চিঠি দেখতে পেল অর্জুন। কল্যাণবরেষু, আশা করি আজ বিকেলের মধ্যে তুমি এই বাড়িতে একবার আসবে। গতকাল আমি নিউ বঙ্গাইগাঁও যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলাম। পথে কয়েকটা রেলডাকাতের জন্যে যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছিল। তাই আজ আবার রওনা হচ্ছি। এখানে এসে বুঝলাম একা থেকে-থেকে শ্রীমান হাবু খুব কাহিল হয়ে পড়েছেন। তার নার্ভ এই একাকিত্ব সহ্য করতে পারছে না। তার ওপর বিনা কারণে তার কপালে গত রাতে প্রহার জুটেছে। ওকে আর এভাবে একা ফেলে রাখা উচিত নয়। আমি দিন সাতেকের মধ্যে নিউ বাইগাঁও থেকে ফিরে আসব। তারপর যা হোক একটা ব্যবস্থা করব। তোমার মা সম্ভবত দিন সাতেকের মধ্যে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসছেন না। খুব যদি অসুবিধে না হয় তা হলে তুমি কি হাবুকে একটু সঙ্গ দিতে পারবে? -তোমার মঙ্গলাকাঙক্ষী, অমল সোম। তার নীচে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন, রুদ্রাক্ষের মালাটি যদি কোনও সমস্যা তৈরি করে তা হলে হাবুর কাছে রেখে দিও।–অমল সোম। এইটুকু? যেন রুদ্রাক্ষের মালার কোনও ভূমিকা নেই যে তাকে নিয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে! সমস্যা হয় বলতে কী বোঝাচ্ছেন? অমলদা কি জানেন না এই মালার মাহাত্ম্য কী? অর্জুন শুনল, কী লিখেছে কে জানে! অর্জুন ইশারা করে বোঝাল অমল সোম সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসবেন এবং ততদিন তাকে এবাড়িতে থাকতে বলেছেন। হাবুর মুখে হাসি ফুটল। অর্জুন শুনল, বাঃ, খুব ভাল কথা। তা হলে আজ রাত্রে মাংস রাঁধতে হয়। অর্জুন পকেট থেকে টাকা বের করে হাবুর হাতে দিতে হাবু খুব অবাক হয়ে তাকাল। অর্জুন বলল, একটু পরে মাংস কিনে এনো। ঠোঁট নাড়া দেখে কথা বোঝার ক্ষমতা আছে হাবুর। অর্জুন তাকে মাংস আনতে বলছে বুঝতে পেরে তার চোখ বড় হয়ে গেল। অর্জুন শুনল, শুধু মাংস না, সঙ্গে মিষ্টি দই আনব। অর্জুন মাথা নাড়ল, রাত্রে মিষ্টি দই খেতে নেই। ঠোঁট নাড়া দেখে কথাটাকে বুঝতে পেরে হাবু মাটিতে বসে পড়ল। সে একদৃষ্টিতে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আজ পর্যন্ত অমল সোম ছাড়া কেউ
false
humayun_ahmed
অবশ্যই আপনি শুনতেন। মিসির আলি বললেন, তুমি তো যথেষ্ট আবেগ দিয়েই কথাটা বলেছ। এরচেয়ে বেশি আবেগ দিয়ে কীভাবে বলতে? সায়রা বলল, শৈশবের ঈদের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে যদি টপটপ করে চোখের পানি পড়ত তা হলে আপনি আমার কথায় রাজি হয়ে যেতেন। আপনি কাজ করেন। লজিক নিয়ে কিন্তু আপনার মধ্যে আবেগ অনেক বেশি। কথা বলতে—বলতে সায়রার হঠাৎ গলা ধরে গেল। সে তার মাথা সামান্য নিচু করল। মিসির আলি সায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন! সায়রার চেখভর্তি পানি টলমল করছে। বোরকার একটা অংশ সে দু চোখের উপর চেপে ধরল। তার শরীর সামান্য কঁপিল। মিসির আলি বললেন, তুমি আরেক কাপ চা খাও। চা খেতে খেতে আমি গোসল সেরে চলে আসব। আমার জন্য কী পাঞ্জাবি এনেছ দাও পরে ফেলি। সায়রা চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে হেসে ফেলে বলল, আমার যে চোখের পানি আপনি দেখেছেন সেটা আসল না, নকল। চোখের পানি দিয়ে যে আপনার সিদ্ধান্ত পাস্টানো যায় সেটা দেখাবার জন্য কাজটা করেছি। আমি আগেও আপনাকে একবার বলেছি যে আমি দ্রুত চোখের পানি আনতে পারি। বলি নি? হুঁ বলেছ। আমি যে একজন এক্সপার্ট অভিনেত্রী এটা বুঝতে পারছেন? হুঁ। ইথেন ছিল আমার চেয়েও এক্সপার্ট। সে যে কোনো মানুষের গলা নকল করতে পারত। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে আপনি খুব মজা পেতেন। মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। গোসল সারবেন ভেবেই উঠে দাঁড়ানো। সায়রা বলল, আপনাকে গোসল করতে হবে না। নতুন পাঞ্জাবিও পরতে হবে না। আপনার অভ্যস্ত জীবন থেকে আমি আপনাকে সরাব না। তবে ঈদ উপলক্ষে আপনাকে নিয়ে চা অবশ্যই খাব। নাসরিনকে চা দিতে বলি? বলো। আমি আজ যাওয়ার সময় নাসরিনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ঈদ উপলক্ষে আমার বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ হইচই করবে। দরিদ্র মানুষের জন্য ঈদের উৎসব অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। চাচা আমি কি ঠিক বলেছি? বুঝতে পারছি না ঠিক কি না। তবে তোমার লজিক ভালো। তুমি যা বলবে ভেবেচিন্তেই বলবে এটা ধরে নেওয়া যায়। নাসরিন চা নিয়ে এসেছে। সায়রা মাথা নিচু করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলি সিগারেট ধরিয়েছেন। একটা ছোট্ট প্রশ্ন তাঁর মাথায় এসেছে প্রশ্নটা করবেন কি না। বুঝতে পারছেন না। আজকের উৎসবের দিন কঠিন প্রশ্নের জন্য হয়তো উপযুক্ত না। প্রশ্নটা দুই বোনের ইবলিশ শয়তান দেখা নিয়ে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এরা ইবলিশকে দেখেছে। অথচ সময় মিলছে না। পুরো লেখাতেই সময়ের গণ্ডগোল থেকেই যাচ্ছে। সায়রা খাতায় লিখছে সে শ্রাবণ মাসের রাতে ইবলিশ শয়তানের দেখা পায় কিংবা স্বপ্নে দেখে। তার কয়েকদিন পরেই ছাদে দুই বোনের চা খাওয়ার বর্ণনা আছে। তখন বাগান বিলাসের রঙিন ঝলমলে পাতার কথা আছে। শ্রাবণ মাসে বাগান বিলাসের রঙিন পাতা থাকবে না। বেলি ফুলের গাছে বেলি ফুল থাকবে। অথচ সায়রা পরিষ্কার লিখল বেলি ফুলের সিজন না। ইবলিশ শয়তানের দেখা যদি তারা পেয়েও থাকে কে আগে পেয়েছে? সায়রা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান। আপনার চোখে প্রশ্ন প্রশ্ন ভাব আছে। প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারেন। কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না। আপনি আমার লেখা কতটুকু পড়েছেন? সেকেন্ড চ্যাপ্টার শেষ করেছি। প্ৰথম চ্যাপ্টার শেষ করার পরে আপনার মধ্যে অনেক খটকা তৈরি হয়েছিল। সেকেন্ড চ্যাপ্টারে হয় নি? তেমন বড় কোনো খটকা তৈরি হয় নি। ছোটখাটো কিছু সমস্যা আছে সেগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। সেকেন্ড চ্যাপ্টার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই পান নি? মিসির আলি বললেন, একটা পেয়েছি তোমাদের ইবলিশ শয়তান বিরাট মিথ্যাবাদী। সে সত্যির সঙ্গে মিথ্যা মিশাচ্ছে না। মিথ্যার সঙ্গেই মিথ্যা মিশাচ্ছে। তোমার মা মোটেই হিন্দু মহিলা ছিলেন না। তার নাম রহিমা বেগম। তোমার বাবা সংক্ষেপ করে রমা ডাকতেন। সায়রা শান্ত গলায় বলল, এই তথ্য আমি আমার খাতার কোথাও লিখি নি। আপনি কোথায় পেয়েছেন? মিসির আলি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এক ছাত্র বগুড়া আযিযুল হক কলেজে অধ্যাপনা করে। তাকে চিঠি লিখে বিষয়টা জানাতে বলেছিলাম। সে চিঠিতে জানিয়েছে। সায়রা বলল, আমি কি চিঠিটা পড়তে পারি? মিসির আলি বললেন, অবশ্যই পার। তিনি চিঠি এনে দিলেন। চিঠিতে লেখা— শ্রদ্ধেয় স্যার, আসসালাম। আমি আপনার চিঠি পেয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। আপনি যে আমার নাম মনে রেখেছেন এই আনন্দই আমার রাখার জায়গা নাই। আমার কথাটা আপনি বাড়াবাড়ি হিসাবে নেবেন না। আপনার সকল ছাত্রছাত্রী যে আপনাকে কোন চোখে দেখে তা আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। যাই হোক এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। আপনার চিঠি যেদিন পাই সেদিনই আমি সারিয়াকান্দি রওনা হই। বগুড়া জেলায় তিনটি সারিয়াকান্দি আছে। ভাগ্যগুণে প্রথম গ্রামটিতেই কেমিস্ট্রির টিচার হাবিবুর রহমান সাহেবের স্ত্রীর কবরের সন্ধান পাই। মহিলার নাম রহিমা বেগম। তাঁর পিতা সারিয়াকান্দি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন মৃত। মেয়ের কবরের পাশেই তাঁর কবর হয়েছে। স্যার, এর বাইরেও যদি আপনি কিছু জানতে চান আমাকে জানাবেন। আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। আপনার শরীরের যত্ন নেবেন। যদি অনুমতি পাই তা হলে ঢাকায় এসে আপনাকে কদমবুসি করে যাব। ইতি আপনার স্নেহধন্য ফজলুল করিম বগুড়া আফিফুল হক কলেজ, বগুড়া। সায়রা চিঠি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনার অনুসন্ধানের এই প্যাটার্নটা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার লেখা পড়ে চিন্তা করতে করতে মূল সমস্যার সমাধানে যাবেন! আপনি যে আবার চিঠিপত্র লিখে অন্যখান থেকেও
false
shordindu
হতে লাগিল। সন্তোষবাবু তখন মীনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন‌, তিনি নিজের দলের অতিবড় গুপ্তকথাগুলিও মীনার কাছে প্রকাশ করে ফেলতে লাগলেন। মীনা রঙ্গিণী মেয়ে হলেও নিজের দলের স্বার্থচিস্তা তার মনে ছিল‌, সে গুপ্ত সংবাদগুলি যথাস্থানে পৌঁছে দিতে লাগল। অবস্থাটা ভেবে দেখ‌, রাজনৈতিক কূটযুদ্ধ চলছে‌, ওদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় আমরা কিছুই জানি না‌, ওরা আমাদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় সমস্ত জানে। ফল অনিবাৰ্য। ‘সন্তোষবাবুর তখন এমন মোহমত্ত অবস্থা যে‌, তিনি মীনাকে কেবল মৌখিক গুপ্তকথা জানিয়ে নিরস্ত হননি‌, যখন কলকাতায় থাকতেন তখন চিঠি লিখে তাকে গুপ্ত সংবাদ জানাতেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণ কী আমি জানি না‌, সম্ভবত অন্য কোন দেশনেতার প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষা। কিন্তু তিনি যে জেনেশুনে মীনাকে খবর পাঠাতেন‌, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম বইয়ের উপহার পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন—মীনা মাতাহারি। তিনি জানতেন মীনা বিপক্ষ দলের গুপ্তচর। যাহোক‌, দেশ-ভাগাভাগির লড়াই একদিন শেষ হল। তারপর কয়েক বছর কেটে গেল। মীনা সন্তোষবাবুর চিঠিগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল‌, নষ্ট করেনি। তার কি মতলব ছিল বলতে পারি না‌, হয়তো ভেবেছিল কোনদিন সন্তোষবাবু যদি বাঁধন ছেঁড়বার চেষ্টা করেন তখন চিঠিগুলো কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন মীনা মারা গেল। বোধহয় অ্যাকসিডেন্টেই মারা গিয়েছিল। ‘মীনার একটি মেয়ে ছিল–হেনা। মা যখন মারা গেল তখন সে সাবালিকা হয়েছে। সে মায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সন্তোষবাবুর চিঠিগুলো খুঁজে পেল। হেনার নিশ্চয় দু-চারজন উমেদার ছিল‌, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ওমর শিরাজি। শিরাজি বিমান কোম্পানিতে কাজ করত‌, এরোপ্লেনের ন্যাভিগেটর। দেশে দেশে উড়ে বেড়াতো‌, তার প্লেনের দৌড় সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো। দশ-বারো দিন অন্তর তার প্লেন দমদমে নামতো। ‘হেনা ওমর শিরাজিকে চিঠির কথা বলল‌, দু’জনে পরামর্শ করল সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। তারা কলকাতায় এসে সোজাসুজি তাদের মতলব সন্তোষবাবুকে জানালো। হেনা এসে তাঁর বাড়িতে জাঁকিয়ে বসল। ওরা ভেবে দেখেছিল সন্তোষবাবুর বাড়িই হেনার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে গেলেন। ইচ্ছে থাকলেও হেনাকে খুন করতে পারেন না‌, তাহলেই ওমর শিরাজি তাঁর গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবে। তিনি ব্ল্যাকমেলের টাকা শুনতে লাগলেন। মারাত্মক চিঠিগুলো হেনা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সন্তোষবাবু আবিষ্কার করতে পারেননি, তবে সন্দেহ করেছিলেন যে হেনা তাঁর বাড়িতে নিজের ঘরে চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিজের বাড়ি বলেই সেখানে তল্লাশ করবার সুবিধা নেই। হেন সর্বদা নিজের ঘরে থাকে‌, কেবল সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়বার জন্যে একবার ছাদে যায়। তাও দোরে তালা লাগিয়ে। ‘ওমর শিরাজি ইন্দো-পাক হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। সেই ঘরে ওদের সাক্ষী প্রমাণ যাবতীয় চিঠিপত্র ওরা লুকিয়ে রেখেছিল। বোধহয় ব্যবস্থা ছিল‌, সন্তোষবাবু হেনাকে হগুয় হগুপ্তায় টাকা দেবেন। কত টাকা দিতেন জানি না‌, সন্তোষবাবুর ব্যাঙ্কের হিসেব পরীক্ষা করলে জানা যাবে। যাহোক‌, টাকা নিয়ে হেনা ওমর শিরাজির অপেক্ষা করত। যথাসময়ে শিরাজি এসে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে তাকে সঙ্কেত জানাতো‌, তারপর দু’জনে ইন্দো-পাক হোটেলে যেত। সেখানে হেনা শিরাজিকে টাকা দিত‌, শিরাজি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে চলে যেত। এই ছিল তাদের মোটামুটি কর্মপদ্ধতি।’ বলিলাম, ‘ভারতীয় টাকা নিয়ে যেত?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘টাকা নিয়ে যেত‌, কিংবা সোনা কিনে নিয়ে যেত‌, কিংবা কলকাতার কোন ব্যাঙ্কে টাকা জমা রেখে যেত। আমার বিশ্বাস টাকা নিয়ে যেত।’ ‘তারপর বলো।’ ‘হেনা যে সন্তোষবাবুর অনাথ বন্ধু-কন্যা নয়‌, সে তাঁর রক্ত-শোষণ করছে‌, একথা কেবল একজনই সন্দেহ করেছিল। রবিবর্মা। সে সন্তোষবাবুর সেক্রেটারি‌, তার ওপর ভীষণ ধূর্ত ধড়িবাজ লোক। হেনাকে সে আগে থাকতে চিনত কিনা বলা যায় না‌, কিন্তু কোন সময় সে হেনার পিছু নিয়ে ইন্দো-পাক হোটেলের সন্ধান পেয়েছিল‌, বুঝেছিল যে ৭ নম্বর ঘরে মারাত্মক দলিল আছে। সে এক গোছা চাবি যোগাড় করে তাক বুঝে ৭ নম্বর ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দরজা খুলতে পারেনি। তার বোধহয় মতলব ছিল দলিলগুলো হস্তগত করতে পারলে সে-ই সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। হেনার মৃত্যুর পর সে একবার চেষ্টা করেছিল। বিকাশ তার পিছনে লেগেছিল‌, সে দেখে ফেলল। বিকাশ যদি তাকে ইন্দো-পাক হোটেলের ৭ নম্বর ঘরের সামনে দেখতে না পেত‌, তাহলে সন্তোষবাবুকে ধরা যেত না।’ আমি বলিলাম‌, ‘একটা কথা। এমন কি হতে পারে না যে‌, সন্তোষবাবুই রবিবর্মাকে নিযুক্ত করেছিলেন দলিলগুলো উদ্ধার করার জন্যে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না। সন্তোষবাবু এর মধ্যে থাকলে ছিঁচকে চোরের মত কাজ করতেন না। ম্যানেজারকে মোটা ঘুষ দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতেন। যাহোক‌, পরের কথা আগে বলব না। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে যন্ত্রণা ভোগ করছেন‌, ছ-মাস কেটে গেছে‌, আরো কতদিন চলবে ঠিক নেই‌, এমন সময় এক ব্যাপার ঘটল। একদিন সকালবেলা খবরের কাগজ খুলে সন্তোষবাবু দেখলেন একটি পাকিস্তানী বিমান সমুদ্রে ডুবেছে‌, মৃতদের মধ্যে নাম পেলেন-ওমর শিরাজি। ‘ব্যাস‌, সন্তোষবাবু উদ্ধারের পথ দেখতে পেলেন। হেনা খবরের কাগজ পড়ে না‌, সে এখনো জানতে পারেনি; সে খবর পাবার আগেই তাকে শেষ করতে হবে। তিনি জানতেন‌, হেনা রোজ সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়তে ছাদে যায়। বর্তমানে বাড়ি মেরামত হচ্ছে‌, ভারা বেয়ে বাইরে থেকে ছাদে ওঠা সহজ। তিনি ঠিক করে ফেললেন কী করে হেনাকে মারবেন। এমনভাবে মারবেন যাতে অপঘাত মৃত্যু বলে মনে হয়। ‘দিনটা ছিল শনিবার। বিকেলবেলা তিনি সুকুমারীর কাছে গেলেন‌, সুকুমারীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের অ্যালিবাই তৈরি করলেন। আট-ঘাট বেঁধে কাজ করতে হবে।’ আমি বলিলাম‌, ‘সুকুমারী যে আমাদের কাছে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল তা বুঝতে পারিনি।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ। সন্তোষবাবুর প্রতি সুকুমারীর প্রাণের টান ছিল‌, নইলে সে তাঁর জন্যে নিজেকে খুনের মামলায় জড়িয়ে ফেলত
false
shirshendu
খেলিতেছে। একটি প্রাচীন বাটির অভ্যন্তরে বহু বৎসরের পুরাতন কালদুষ্ট আবহাওয়ায় আমার আত্মা প্রতিপালিত হইয়াছে। ইহাই আমার পৃথিবী। কাছারিঘরের পিছনে অযত্নলালিত উদ্যানটির মধ্যে আমি প্রকৃতির লীলা প্রত্যক্ষ করিতাম। চাহিদা আমার বিশেষ নাই। পুত্রকন্যারা কেহ প্রতিষ্ঠিত, কেহ বিবাহিত। তাহাদের প্রতি দায়দায়িত্ব তেমন কিছু ছিল না, সম্পর্কও নিতান্তই আলগা। একমাত্র কৃষ্ণকান্ত আমাকে কিছু মায়ায় বাঁধিয়াছিল। এখনও সেই মায়াই আমাকে বিহুল করিতেছে। ইহা ছাড়া আর একটি বন্ধনের কথা স্বীকার করিব। পুরোহিত-কন্যার বালিকাহৃদয় যে-খাতে বহিতে শুরু করিয়াছিল আজও যৌবনপ্রান্তে আসিয়া সে খাতেই বহিতেছে। এই নারীকে সাধ্বী বলিব না তো কাহাকে বলিব? তাহার সেই সাধ্বী অনুরাগকে অবহেলা করার অনেক চেষ্টা করিয়াছি। পারি নাই। আজ বুঝিতেছি একটি ক্ষীণ বন্ধনে সেও আমাকে বাঁধিয়াছে। কুল ভাসায় নাই, সৌজন্য ভাঙে নাই, দেহস্পর্শে আবিল করে নাই। কিন্তু একমুখী লক্ষে বহিয়াছে ঠিকই। আমি তাহার সংযম, তাহার নিষ্ঠা ও সেবাপরায়ণতার প্রশংসা করি। আমি রূপমুগ্ধ নহি, হইলে বলিতাম আমি তাহার রূপানলেও ঝাঁপ দিয়াছি। কিন্তু তবু এই বয়সে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার মতো উদ্যম এবং উৎসাহ আমার ছিল না। “কৃষ্ণকান্তের জন্য উদ্বেগে আমার অভ্যন্তর শুকাইতেছে। জীবনীশক্তি হ্রাস পাইতেছে। বীর পুত্রের জন্য গৌরবের চেয়ে তাহার বিরহ আমাকে কাতর করিয়াছে অনেক বেশি। অপাপবিদ্ধ তাহার কিশোর মুখের শ্রী আমার ভিতরে এক কোমল অভিভূতির সৃষ্টি করিত। কতকাল যেন তাহাকে দেখি না। কৃষ্ণকান্তের ভিতর দিয়াই প্রথম বুঝিলাম, পুত্র কেমন হয়। পুত্রস্নেহ কাহাকে বলে। আমার সেই পরম প্রিয় পুত্র পুলিশের তাড়া খাইয়া, প্রতি মুহূর্তে লাঠি গুলির বিপদের মধ্যে অভুক্ত, অক্ষত, নিরাশ্রয় হাটে মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আর আমি? আমি মহাসুখে অট্টালিকার নিরাপদ আশ্রয়ে চর্বচোষ্য ভোগ করিয়া গদির বিছানায় দেহ এলাইয়া দিবাস্বপ্ন দেখিতেছি। তাহাও একরূপ সহনীয় ছিল, কিন্তু এই অবস্থায় বিবাহের টোপরটি পরিব কোন মুখে? “সত্য বটে বিবাহের অনুকুলেও যুক্তি আছে। পুরোহিত-কন্যার জীবন লইয়া আর ছিনিমিনি খেলিবার সময় নাই। এও সত্য দুর্জনের মুখ বন্ধ করিবার নিমিত্ত বিশাখা ও শচীনের বিবাহের আগেই এই কর্মটি চুকাইয়া ফেলা অভিপ্রেত। তবু মন সায় দেয় না। মনে হয়, কী যেন একটি কুকর্ম, পাপকাজ করিতে চলিয়াছি। ইহার ফল বহুকাল ধরিয়া ভোগ করিতে হইবে। “বিবাহ আজই। বিশ্বাস হয় না। সুনয়নী কবে মরিয়াছে, সেই শূন্য স্থান পূরণ করিতে যাইতেছি, সুনয়নীর আত্মা ব্যথিত হইবে না তো! পুত্রকন্যারা সকলেই কি এই বিবাহ স্বীকার করিবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আজ এই পরিণত বয়সে বিবাহ করিয়া আমরা পরস্পরকে কীই বা দিতে পারিব? কেমন যেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগিতেছে। মনে কাটার মতো কী যেন বিধিতেছে। “অবশ্য বিবাহের কোনও আয়োজন নাই, উপকরণ নাই, নিমন্ত্রিত কেহই আসিবেন না। ঠাকুরদালানে পুরোহিত একান্তে শুধু দুই হাত এক করিয়া দিবেন। সাক্ষী থাকিবেন শালগ্রাম শিলা, অগ্নি, গৃহদেবতা। তবু বড় চঞ্চল বোধ করিতেছি। “একটু আগে বিশাখা আসিয়া আমার মুখের দিকে ক্ষণমাত্র দৃষ্টিক্ষেপ করিয়াছিল। তাহার চোখে বিস্ময়। আমি সভয়ে চোখ নামাইয়া লইলাম। আমাকে চমকিত করিয়া বিশাখা কহিল, বাবা, আপনার গরদের পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। “আমি কহিলাম, গরদের পাঞ্জাবি কী হবে? আজ পরতে হবে না? আজ! আজ কী ব্যাপার? “বিশাখা নতমুখে কহিল, আমি জানি না। পিসি বলল তাই। কিন্তু বিস্ময়ের কথা তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল না যে সে আমাকে ঘৃণা করিতেছে রাগ করিয়া আছে। অথচ সেটাই তো স্বাভাবিক! “যাহার এত বড় বিবাহযোগ্য কন্যা আছে তাহার বিবাহ কীরূপ হইবে? “অনেক ভাবিলাম। ভাবিতে ভাবিতে বেলা কাটিতে লাগিল। একবার মনে হইল নিরুদ্দেশ হইয়া যাই না কেন? গিয়া স্বদেশিদের দলে ভিড়িয়া পড়ি বা সন্ন্যাস গ্রহণ করি। আমাদের বংশে তো ইহা নূতন নহে। “আবার ভাবিলাম এই সময়ে চপলতা মানায় না। স্থির থাকিতে হইবে। সংযত থাকিতে হইবে। “পড়ন্ত বেলায় সদাশয়-হাস্য মুখে মাখিয়া ধুতি পাঞ্জাবিতে সাজিয়া রাজেনবাবু আসিয়া হাজির। কহিলেন, এ কী, এখনও যে প্রস্তুত হননি। কীসের প্রস্তুত? “রাজেনবাবু আমার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। কহিলেন, দেখুন, আপনার মতো ভাগ্যবান খুব কম লোকই আছে। লোকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলে তার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ বড় একটা খুশি হয় না। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ঘটেছে উলটো। কীরকম? স্বয়ং আপনার মেয়েই চায় আপনি বিয়েটা করুন। আমি আপনার হবু বেয়াই, আমিও চাই করুন। কারণ বিশাখার বিয়ের পর আপনি একদম একা হয়ে যাবেন। আমরা আপনাকে এক অসহায় অবস্থায় ফেলতে পারি না। অনেক আলোচনা, গবেষণার পরই আমরা সর্বান্তঃকরণে এই বিয়ে অনুমোদন করেছি। এবার আপনি অনুমোদন করলেই হয়। “বুঝিলাম মনু সব দিক দিয়া আঁট বাঁধিয়া লইয়াছে। সে কিছুতেই আমার মুখে চুনকালি লেপন হইতে দিবে না। তবু বিশাখা কেন অনুমোদন করিল তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। কিন্তু কৃতজ্ঞ বোধ করিলাম। “রাজেনবাবু তাড়া দিলেন, উঠুন, উঠুন, লগ্নের বেশি দেরি নেই। আমার গিন্নিও আসছেন।” আমি ব্যথিত হইয়া কহিলাম, এই তামাশায় আবার তাকে কেন? রাজেনবাবু সহাস্যে কহিলেন, তামাশা হবে কেন? তিনি এয়োর কাজ করতে আসবেন। ব্যাপারটা আমাদের কাছে তামাশা নয়। আমরা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। “বিশ্বাস হইল না। মনে হইল ইহারা রঙ্গ দেখিতেই আসিয়াছেন। আমাকে লইয়া পরে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা বিদ্রুপ করিবেন। শেষ অবধি জল কোথায় গড়াইবে? “এক এক সময়ে মানুষের স্বীয় বুদ্ধি লোপ পায়। ভাবিয়া কূল করা যায় না। আমারও আজ সেই অবস্থা। মস্তিষ্ক অসাড়, মন জড়বৎ, দেহ শক্তিহীন। আমার যেন এক কঠিন অসুখে বিকারের মতো অবস্থা। চারদিকে যাহা সব দেখিতেছি তাহা যেন স্বপ্নবৎ এবং অপ্রাকৃত।
false
humayun_ahmed
দেখা যাচ্ছে। পিপি পিপ শব্দ হচ্ছে। আমি জয়নাল সাহেবের কপালে হাত রাখতেই তিনি জেগে উঠলেন। চোখ মেলে ক্লান্ত গলায় বললেন, হিমু ভাই আপনাকে বিরাট তকলিফ দিলাম। আপনার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী। দয়া করে ক্ষমা করুন। ক্ষমা করলাম। আপনার মনে হয় কথা বলা নিষেধ। কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমি বরং কিছুক্ষণ আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। আপনার কাছে শেখা বিদ্যা কাজে লাগাই। জয়নাল সাহেব আমার হাত ধরে ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন, আমার কথা বলা নিষেধ আমি জানি। কিন্তু আমার সময় শেষ হয়ে গেছে! কথা বলার সুযোগ আর পাব না। সময় শেষ কে বলল? কেউ বলে নাই। এইসব জিনিস বোঝা যায়। যতবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আমি আমার মৃত আত্মীয়স্বজনদের দেখি। এরা বিছানার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। এরা আমাকে নিতে এসেছে। এখনো বসে আছে–আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আমি আবছা আবছা দেখছি। ও। আমার বাবার পাশে আমার বড় মা বসে আছেন। আপনাকে বলতে ভুলে গেছি। আমার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের দুই মাসের মাথায় তার প্রথম স্ত্রী মারা যায়। উনাকে আমি কখনো দেখি নি। কিন্তু আজ বাবার পাশে দেখেই চিনেছি। আমার নিজের মা বসে আছেন উলটো দিকে। আপনি কি দয়া করে কথা বলা বন্ধ করবেন? হিমু ভাই কয়েকটা জরুরি কথা আপনাকে বলব। না বললে আর বলা হবে না। যদি ইজাজত দেন। বলুন। আমার মেয়েটার সঙ্গে একবার দেখা হওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। তাকে একটা কথা বললে মনটা শান্ত হত। কী কথা? বেচারী নিশ্চয়ই ধারণা করে আছে তার বাবা ভয়ঙ্কর একটা মানুষ। তার মার মুখে এসিড মারার জন্যে এসিড কিনে লুকিয়ে রেখেছিল। আমার সম্পর্কে এত বড় একটা খারাপ ধারণা তার থাকবে ভাবলেই অস্থির লাগে। মেয়েটাকে যদি বলতে পারতাম— সমস্ত ঘটনাটা সাজানো। মন শান্ত হত। মেয়েটাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললে অন্য একটা সমস্যা হবে। মেয়েটা সারাজীবন তার মার সম্পর্কে ভয়ঙ্কর খারাপ ধারণা নিয়ে থাকবে। এটা কি ঠিক হবে? জয়নাল সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বললেন, না ভাই সাহেব এটাও ঠিক হবে না। বাবার সম্পর্কে খারাপ ধারণা থাকলে তেমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু মার সম্পর্কে খারাপ ধারণা থাকলে কোনো ছেলে মেয়ে বড় হতে পারে না। আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ধরে দিয়েছেন। এই জন্যেই আপনাকে এত পছন্দ করি। লোকে যে বলে— আপনার পাওয়ার আছে। এটা ঠিক? আসলেই আপনার পাওয়ার আছে। আপনি ঘুমান আমি চলে যাই। আমি থাকলে আপনি ঘুমুতে পারবেন না। ভাই সাহেব। জি। একটা শেষ কথা বলি মনে কিছু নিবেন না। বলুন। আপনার পাওয়ার আছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতা দিয়ে আপনি মেয়েটার সঙ্গে আমার শেষ দেখা করিয়ে দিন। স্বয়সে আমি আপনার অনেক বড় তবুও করজোড়ে ভিক্ষা চাচ্ছি। ভাই আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আমার একমাত্র ক্ষমতা হল খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটা। বিভ্ৰান্তিকর কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্ৰান্ত করে দেওয়া। হিমু ভাই আমি জানি আপনি ইচ্ছা করলেই পারবেন। হাত জোড় করছি ভাই সাহেব। মৃত্যুপথ যাত্রীর শেষ অনুরোধ। জয়নাল সাহেবের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি হাত জোড় করে আছেন। একটা মিথ্যা আশ্বাস কি জয়নাল সাহেবকে দেব? সেটা কি ঠিক হবে? আমার বাবা তার পুত্রের জন্যে কিছু কঠিন উপদেশ লিখিতভাবে দিয়ে গিয়েছিলেন। মিথ্যা সম্পর্কে তিনি বলেছেন– হে আমার প্রিয় পুত্ৰ, মিথ্যার কিছু কিছু উপকার আছে। কিছু মিথ্যা সমাজের এবং ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে কল্যাণকর ভূমিকা নেয়। কিন্তু মিথ্যা মিথ্যাই। সত্য আলো, মিথ্যা অন্ধকার। তোমার যাত্রা আলোর দিকে। মিথ্যা ছলনাময়ী নানান ছলনায় তোমাকে ভুলাইবে। তুমি ভুলিও না; কখনো না, কোন অবস্থাতেই না। ইহা আমার আদেশ। ভোর চারটার মেসে ফিরে দেখি— আবুল কালাম সাহেব আমার ঘরে বাসা। চেয়ারে পা তুলে বসেছেন। মনে হচ্ছে মানুষ না কাপড়ের পুঁটলি। কতক্ষণ ধরে বসে আছেন কে জানে। মানুষটা ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্তা লাগছে। গলায় ফুলের মালা নেই। ফুলের মালা পাঞ্জাবির পকেটে রাখা হয়েছে। মালার একটা অংশ পকেটের বাইরে। গাদা ফুলের জীবনী শক্তি ভালো। এতক্ষণেও ফুল চুপসে যায় নি। আমি হালকা গলায় বললাম, কালাম সাহেবের খবর কী? কালাম সাহেব ফিসফিস করে বললেন, খবর ভালো না। খবর অত্যধিক খারাপ। শরীর খারাপ? জি শরীর খারাপ, মন খারাপ, ভাগ্য খারাপ। আমার সবই খারাপ। আপনি চাঁদপুরে যান নি? না। যান নি কেন? জানি না কেন। যাই নি। লঞ্চ টার্মিনেল পৰ্যন্ত গিয়ে ফেরত এসেছি। ঘণ্টা খানিক শহরে খামাখা ঘুরেছি। তারপর আপনার ঘরে এসে বসে আছি। সারারাত আপনি কোথায় ছিলেন? এক রোগী নিয়ে ছোটাছুটি করেছি। আমি যে আপনার এই চেয়ারটায় বসে আছি, বসেই আছি। চেয়ারে বসেই ঘুমায়েছি। ভাগ্য ভালো আপনার ঘর সব সময় খোলা থাকে। দরজা বন্ধ থাকলে ঘরে ঢুকতে পারতাম না। খাওয়াদাওয়া করেছেন? না। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে— এই জন্যে ঘর থেকে বের হইনি। মারাত্মক পিসাব ধরেছে। পিসাব করতেও যাই নি। এখন যেতে পারেন। কেউ দেখবে না। ভোর চারটায় চোর পর্যন্ত ঘুমায়। তোয়ালে দিয়ে মাথা দেড়কে চলে যান। কালাম সাহেব নড়লেন না। যেখানে বসেছিলেন সেখানেই বসে রইলেন। বরং আরো গুটিসুটি মেরে গেলেন। আমি বললাম, বাথরুম সেরে আসুন, কোন একটা চায়ের দোকানে বসে গরম পরোটা চায়ে চুবিয়ে খাই। আমারো ক্ষিধে লেগেছে। এত ভোরে চায়ের দোকান
false
shirshendu
বসে থাকতে পারি না। তাই বুঝি? আজ আমি কেবল ঝগড়া করলাম। না। তা নয়। আপনার দুঃখ আমি বুঝি। ধন্যবাদ। কিন্তু বেশি বুঝতে যাবেন না। তাতে বিপদ বাড়বে। তার মানে? বোস সাহেবকে ঘাটানোর দরকার নেই। ও আমাকে চায় না। আমি বরং চলেই যাব। আপনি শুধু কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিন ওকে বলে। আমার তো একটু ফুটিং চাই। সেই দোকানের কথা এখনও মাথা থেকে যায়নি? অন্য কোনও আইডিয়া আসছে না যে! দোকান করাটা আমার পছন্দ নয় মিসেস বোস। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, তবে কী পছন্দ? ভেবে দেখি। বলব। কিন্তু যা বলব শুনবেন তো? মণিদীপা মাথা নাড়ে, শুনব। আমাকে কেউ তো গাইডেন্স দেয়নি এতকাল। আমি ভারী একা হয়ে গেছি। এত একা সহ্য হয় না। আমি আপনার ভাল চাই। ভীষণভাবে চাই। মণিদীপা সত্যিকারের লজ্জায় মাথা নত করে বলে, জানি। খুব জানি। আজ যাই। আসুন।–বলে একটু থেমে মণিদীপা আরও মৃদু স্বরে বলে, এবার ফোন করলে কথা বলব। দীপনাথ বোস সাহেবকে এতটাই জানে যে, খুব বেশি খোঁজ-খবর না করেই সে মেয়েটির পাত্তা লাগিয়ে ফেলতে পারল পরদিন। বোস সাহেব বোকা নয়। সন্ধের মুখে দীপনাথ হঠাৎ বিনা এত্তেলায় তার খুপরিতে ঢুকলে দীপনাথের মুখের দিকে চেয়েই বোস সাহেব বুঝতে পারে, সামথিং রং। বসুন চ্যাটার্জি। দীপনাথ বসে এবং বিনা ভূমিকায় বলে, মহুয়া আপনার কাজিন? বোস স্তব্ধ ও স্থির হয়ে বসে থাকে। চোখ টেবিলে। বোস সাহেবের শরীরের যন্ত্রপাতি খুব ভাল নয়, দীপনাথ জানে। তাই ওই স্তব্ধতায় একটু ভয় পেল সে। কিন্তু তবু নীরবতা ভাঙল না। ব্যক্তিত্বের লড়াইতে প্রথম রাউন্ডটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বোস সাহেব ঠিক এক মিনিট দশ সেকেন্ড বাদে বাঁ হাতের তর্জনীর ধার দিয়ে থুতনিটা ঘষে নিয়ে নড়ে বসল। তারপর খসখসে ভাঙা গলায় বলে, দরজাটা লক করে দিয়ে আসুন। দরকার নেই। অফিস ফাঁকা। বোস মাথা নাড়ল। মুখটা ফ্যাকাসে, অসহায়, ভিতু কেমন এক ধরনের হয়ে গেছে। হাতে একটা কাগজচাপা নিয়ে নাড়তে নাড়তে তেমনি অদ্ভুত গলায় বলে, দীপা কতটা জানে? সামান্যই। অন্তত মহুয়ার কথা জানে না। শুধু জানে সামথিং ইজ কুকিং। মহুয়া আমার ডিসট্যান্ট কাজিন। তা যোক বোস সাহেব। ইট ইজ এ রং চয়েস। উই হ্যাভ অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফ্রম অলমোস্ট চাইল্ডহুড। কিন্তু পারিবারিক বাধায় বিয়ে হতে পারেনি। ওর বাবা ছিল ভীষণ কনজারভেটিভ। বাট ইট ইজ নাউ এ ডেড কেস। বোস মাথা নাড়ে, না, রিলেশন না থাক, উই অলওয়েজ হ্যাড দ্যাট ফিলিং ফর ইচ আদার। বোস সাহেব!–দীপনাথের গলাটা ধমকের মতো শোনায়, ব্যাপারটা ইনএভিটেবল নয়, আমি জানি। আমি তা বলিনি। তবে? আপনি অতীতকে খুঁড়ে বের করছেন। দীপার সঙ্গে আমার রিলেশন তো আপনি জানেন। অথচ আই নিড সামওয়ান। যাকে বিশ্বাস করা যায়, যার ওপর নির্ভব করা যায়। বোস সাহেব, আপনার এক ভাই এই অফিসে কাজ করে। বোস অবাক হয়ে বলে, ও কিছু বলেছে? না। তবে ও শুনেছে। ওর মুখে ঘেন্নার ভাব দেখলেই তা বোঝা যায়। বোস সাহেব পিছনে মাথা হেলিয়ে বলে, দীপা অলসো উইল হেট মি। চ্যাটার্জি, আই অ্যাম সরি। কিছু করার নেই। দীপনাথ বিদায় নেওয়ার একটা নাটকীয় এবং জুতসই ক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। একটা সাইকোলজিক্যাল মোমেন্ট। এই কথার পরই তা পেয়ে গেল সে। আচমকা উঠে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। নিজের টেবিলে এসে অপেক্ষা করছিল দীপনাথ। একটু বাদেই বোস তার লম্বা মেদবহুল চেহারাটা নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। মুখ ভীষণ ভাবালু, গম্ভীর। চোখে অনির্দিষ্ট দৃষ্টি। বোস একটু ইতস্তত করে দীপনাথের টেবিলের কাছে আসে, চ্যাটার্জি, উঠবেন না? এই যাব। চলুন। কোথায়? চলুন, কোথাও যাওয়া যাক। দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আজ আমার ঘোট বোনের বাড়িতে যাওয়ার কথা। আজ ক্যানসেল করুন। দীপনাথ একটু দম ধরে থেকে বলে, মিস্টার বোস, আমি আপনাকে হেলপ করতে চাই, কিন্তু এখন দেখছি সব ব্যাপারেই আপনাকে হেলপ করা সম্ভব নয়। আই কানট হেলপ ইউ টু বি আনহ্যাপি। বোস একটু হাসে, ইংরেজিটা আপনি মাঝে মাঝে ভালই বলেন। কিন্তু এখন আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বাসায় চলুন। খুব জরুরি কথা কি? খুব জরুরি। দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা তুলে বিলুদের পাশের ফ্ল্যাটের নম্বর ডায়াল করল। বিলুকে ডাকিয়ে বলে দিল, আজ নয়। কাল যাচ্ছি। কত কথা জমে আছে তোমার সঙ্গে। আজ একটু কাজ পড়ে গেল রে। প্রীতম ঠিকই বলত, ভীষণ কাজের লোক হয়েছ তুমি আজকাল। আমি যে তোমার জন্যই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে খাবার তৈরি করাতে বসেছি। একটু রাতের দিকে গেলে যেতে পারি। তবে ঠিক নেই। দূর। থাকগে আজ। কবে আসবে? কাল। ঠিক তো? ঠিক। কাল অফিস থেকে একবার ফোন করিস। বোস সাহেব নীচে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে। সামনে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছে। দু’জনে উঠল। গাড়ি নিউ আলিপুর রওনা হতেই বোস সাহেব বলে, আপনি আমার ওপর স্পাইং করছিলেন? একথা কেন? নইলে এত খবর আপনার জানার কথা নয়। খবর নেওয়াটা দোষের, না খবর হওয়াটা? বোস সাহেব মৃদু হাসে। বুঝদারের মতো খুব সামান্য একটু মাথা নেড়ে বলে, আমি অবশ্য ব্যাপারটা গোপন রেখেছি, কিন্তু সেটা পাপবোধ থেকে নয়। ডিসেন্সির জন্য। সময় হলেই মণিকে জানাতাম। আমি কিন্তু মিসেস বোসকে খবর দিইনি। উনি আগে থেকেই জানতেন। কতটা জানে? খুব বেশি নয়। জানে, একটা মেয়ের সঙ্গে মিশছেন। মেয়েদের
false
shirshendu
তুমি আমাকে আপনজন ভাবোনি। এ কথার জবাব দিলে বোধহয় ঝগড়া হবে। কিন্তু প্রীতম কোনওদিন ঝগড়া করেনি। তার সারাজীবনেই ঝগড়া বলে কিছু নেই। যদিও বা দু-চারবার সে কারও সঙ্গে ঝগড়া করেছে, প্রতিবারই গো-হারা হেরেছে। উত্তেজিত হলে তার মুখে কথা ফোটে না, মাথা গুলিয়ে যায়, শরীর ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। সে ভারী করুণ অবস্থা! প্রীতম তাই চুপ করে থাকে। বিলু বলে, ওরা তোমাকে কেন নিয়ে যেতে চায় তা বলেছে? নিয়ে যেতে চায় এমনিই। আমি তো ওই পরিবারেরই ছেলে। তা কি জানি না। কিন্তু ভাবছি আমার কোনও ত্রুটি হল কি না। না, তুমি যথেষ্ট করেছ। একটা কথা বলবে? তুমি বাড়িতে চিঠি লিখে কিছু জানাওনি তো? কী জানাব? তোমার কোনও অসুবিধের কথা? না বিলু। আমার তো কোনও অসুবিধে নেই। আমি কখনও কারও কাছে তোমার নামে নালিশ করিনি। ওটা আমার আসে না। আমিও তাই জানতাম এতদিন। আজ কি বিশ্বাস করছ না আমায় বিলু? বিশ্বাস করছি। আমি শুধু ভাবছি আমার দোষটা কোথায়। এটা দোষগুণের ব্যাপার নয়। আমার মা, ভাই, বাড়ির লোক সবাই চায় আমাকে তাদের কাছে কিছুদিন নিয়ে রাখতে। তোমার দোষের কথা ওঠেই না। কথা বলতে বলতে প্রীতম গভীরভাবে বিলুকে দেখছিল, অনুভব করছিল। কাল এই বিলু ছিল তার। আজ যেন তার নয় আর। এই সত্য প্রীতমের ভিতরে মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। বেঁচে থাকা নিরর্থক। তার লড়াই শেষ হয়েছে। এবার শিলিগুড়ি চলে যাবে। জানালা দিয়ে দেখবে সারাদিন, উত্তরের পাহাড়। শৈশব ফিরে আসবে। নিবিড় হয়ে উঠবে মায়ের আঁচলের সেই অদ্ভুত গন্ধ। বড় নেই-আঁকড়া ছেলে ছিল সে। আবার তাই হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে লাবুর জন্য কষ্ট হবে খুব। বিলুর কথা বড় মনে পড়বে। কিন্তু বেশিদিন নয়, রোগ-জীবাণুরা ঘোড়সওয়ারের মতো উঠে আসবে মাথায়। সব ভুলিয়ে দেবে। সব ভুলে যাবে প্রীতম। বিলু আবার নিচু গলায় বলে, তোমার শিলিগুড়িতে যাওয়ার অর্থ আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, তা-ই বিলু। অস্বীকার করে লাভ নেই। তুমি তো শিলিগুড়িতে যাবে না। ও কথা থাক। কেন যাব না, কেন যেতে চাই না, তা তো তুমি জানো। জানি। তবে ছাড়াছাড়ির জন্য দুঃখ নেই বিলু। এখানে থাকলেও খুব শিগগিরই একদিন ছাড়াছাড়ি তো হতই। বিলু খুব অবাক হয়ে প্রীতমের দিকে তাকিয়ে বলে, তার মানে? ওসব কী বলছ তুমি? কেন, তুমি জানো না যে, আমার আয়ু বেশিদিন নয়? এটা কি নতুন কথা বিলু? বিলুর চোখ-মুখ তবু বিস্ময়ে টানটান হয়ে থাকে। অস্ফুট গলায় সে বলে, তুমি তো কোনওদিন এসব বলোনি প্রীতম! আজ কেন বলছ? ভারী অপ্রস্তুত বোধ করে প্রীতম। মুখে কথা আসে না। বিলু তার দু’হাত দিয়ে প্রীতমের একখানা হাত ধরে বলে, কেন বললে? তুমি তো কখনও মরার কথা বলো না। আজ কেন বললে? প্রীতম হাতটা আস্তে টানে। কিন্তু দুর্বল হাতখানা বিলুর হাত থেকে খসে এল না। সে বলল, একটু আস্তে বিলু। শতম শুনবে, অচলা শুনবে। শুনুক। তোমাকে বলতে হবে প্রীতম। কী বলব! আমি কিছু ভেবেচিন্তে বলিনি। মনে হল, তাই বললাম। তোমার মনের সেই জোর কোথায় গেল? একটু শ্লেষের হাসি অজ্ঞাতেই ফুটে ওঠে প্রীতমের মুখে। বলে, মনের জোরে তুমি তো বিশ্বাস করো না। আমি না করলেও তুমি তো করতে? আমার মনের জোর আর নেই। হাল ছেড়ে দিয়েছি। এবার ভেসে যাব। বিলু তার হাতটা আর-একটু নিবিড়ভাবে চেপে ধরে, কী হয়েছে তোমার বলবে? আমার কিছু হয়নি। তুমি কেমন আছ বিলু? এ কথায় বিলু যেন চমকে ওঠে, আমি কেমন আছি? তার মানে? প্রীতম ঠেস দিয়ে কথা বলতে প্রায় জানেই না। বলতে লজ্জাও করে তার। তবু আজ বলল, এখন তো তোমার একটা আলাদা বাইরের জীবন হয়েছে বিলু। সে জীবনটার কথা তো আমি জানি না! তাই জিজ্ঞেস করছি, কেমন আছ? বিলুর মুখ থমথম করছে। একটু কঠিন গলায় সে বলে, আলাদা জীবন? চাকরি করলেই কি একটা আলাদা জীবন হয় মানুষের! আজ তুমি অদ্ভুত সব কথা বলছ প্রীতম। চাকরি কেন করতে গেলে বিলু? সে কি টাকার জন্য? না তো কী? এমন তো নয় যে, সারাদিন একজন রুগির সঙ্গ করে করে ঘঁফিয়ে উঠেছিলে বলে, সব সময়ে মৃত্যুর সঙ্গে ঘর করতে হচ্ছে বলে, একটু মুক্তির জন্য, ডানা মেলবার জন্যই চাকরি করতে গেছ? বিলুর সেই পুরনো কাঠিন্য ফিরে এল মুখশ্রীতে। বহুকাল ওই বরফ-শীতল ভাবটা দেখেনি প্রীতম। মাঝখানে কিছুদিন একটু প্রগ হয়েছিল বিলু। শীতল মুখশ্রীর সঙ্গে ঠান্ডা গলার মিশেল দিয়ে বিলু বলে, তোমার যদি তা-ই মনে হয়েছিল তবে আগে বলোনি কেন? আমি তো তোমার কোনও কাজে বাধা দিই না। সব মানুষেরই ইচ্ছে মতো চলার স্বাধীনতা আছে। তবু কেন বলছি জানো? মনে হয় বলে। কেন মনে হবে? এ প্রশ্নের জবাব হয় না। মনে হয়, তাই বললাম। চাকরি করে কিছু অন্যায়ও করোনি। আমি যদি বাঁচি তবে এ চাকরিটা তোমার দরকার হবে। বিলু মাথা নিচু করে বসে থাকে। সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রীতমের বড় ইচ্ছে হল, নতমুখী এই শীতল মেয়েটিকে একটা চরম আঘাত দিতে। কোনওদিন শত অপরাধেও যা করেনি প্রীতম। কিন্তু এখন সে শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে। হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। ওকে একটু আঘাত দিয়ে যাওয়া ভাল। তাতে হয়তো ও মনে রাখবে। প্রীতম গলা ঝাড়ল। অনেক ইতস্তত ভাব, দ্বিধা কাটিয়ে
false
zahir_rayhan
আমেনাকে ওর নিজের চেয়ে বড় মনে হলো আজ। শাহাদাত মৃদু গলায় বললো, দেখলে তো, কী যে স্বভাব পেয়েছে ও বুঝি না। দূরের কেউ তো নয়, আপন মায়ের পেটের ভাই, দরকার পড়েছে তাই হাত পাতবে। ভিক্ষে তো চাইছি না, ধার চাইছি। এতে অসম্মানের কি হলো? মাহমুদ চুপ করে রইলো। ওকে নীরব থাকতে দেখে শাহাদত আবার বললো, আরে ভাই, ওদের হচ্ছে হারামীর টাকা। কন্ট্রাকটারী করে, রাস্তায় রাস্তায় রোজগার করছে। দিতে একটু গায়ে লাগবে না। মাহমুদ আস্তে করে বললো, ওই হারামী টাকাগুলো এনে তোমার অনেক শ্রমে গড়া প্রেসটাকে কলুষিত করো না শাহাদাত। তারচেয়ে বিক্রি করে দাও ওটা। ওর কাছ থেকে কোন রকম সমর্থন না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লো শাহাদাত। সবার ইচ্ছে প্রেসটা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু বিক্রির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মন থেকে সত্যিকার কোন সাড়া পায় না সে। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। কত কষ্টে গড়া ওই প্রেস। বার কয়েক উসখুস করে ধরা গলায় হঠাৎ শাহাদাত বললো, তোমরা কি আমার কথা একবার ভাবো না? ওই প্রেসটার পেছনে সর্বস্ব দিয়েছি আমি, ওটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে কি করে বাঁচবো, বলো। মাহমুদ নীরব। পর পর কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিলো শাহাদাত। তারপর অনেকক্ষণ অভিমানেভরা কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, তাই হবে বলে চুপ করে গেলো সে। এ সময়ে আবার এ ঘরে এলো আমেনা। মরিয়মের বিয়ে প্রসঙ্গে মাহমুদকে দুচারটে প্রশ্ন করলো সে। কোথায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে দেখতে শুনতে কেমন, কি করে। পানদানটা সামনে রেখে একটা পান বানিয়ে খেলো আমেনা। তারপর আবার চলে গেলো। অনেকক্ষণ পর মাহমুদ বললো, প্রেসটা বিক্রি করে দেবার পর কি করবে? চাকরি-বাকরি–! কথাটা শেষ করতে পারলো না। শাহাদাত বাধা দিয়ে বললো, কি যে বলো তুমি? আমি চাকরি করবো? আমেনা তাহলে গলায় দড়ি দেবে। বলে হেসে উঠলো সে। হাসতে গিয়ে চিবুকে অনেকগুলো ভাঁজ পড়লো তার। মাহমুদ কিছু বলবে ভাবছিলো। আমেনা আবার এলো সেখানে–কী হলো অমন হাসছে যে। বলতে গিয়ে খুকখুক করে বার কয়েক কাশলো সে। আবার কাশলো। শাহাদাত শঙ্কিত চোখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, তোমার কাশটা দেখছি আরো বাড়লো। আমেনা পরক্ষণে বললো, না কিছু না। শাহাদাত বললো, কিছু না নয়, তুমি ভীষণ ঠাণ্ডা লাগাও আজকাল। এ কথার কোন জবাব দিলো না আমেনা। খানিকক্ষণ কেশে নিয়ে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসলো সে। ওদের এই দাম্পত্য আলাপের মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো মাহমুদ। কাল বিকেলে এতক্ষণে বর এসে গেছে মরিয়মের। আজ সে শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে খোকনও আছে। হাসিনা ফিরেছে স্কুল থেকে। বাসায় এখন বাবা, মা, দুলু আর সে হয়তো বসে বসে বিয়ের গল্প করছে। কাল স্বামীসহ আবার ফিরে আসবে মরিয়ম। হাসিনার ঘরে ওদের থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। হাসিনা থাকবে মায়ের সঙ্গে। আর বাবার জন্যে মাহমুদের ঘরে একটা নতুন বিছানা পাতা হবে। মা হয়তো এতক্ষণে সে বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন বাসায় সবার সঙ্গে। মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো। শাহাদাত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ওকি উঠলে কেন? মাহমুদ আস্তে করে বললো, না, এবার যাই। যাবে আর কি বসো না। না, আর বসবো না। কোথায় যাবে? টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা হাই তুললো শাহাদাত। মাহমুদ বললো, প্রেসে, দেখি কোন কাজ আছে কি না। শরীরটা আজ বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাবো। আমেনা পেছন থেকে শুধালো, মরিয়ম ফিরছে কখন? মাহমুদ সংক্ষেপে বললো, কাল। আমেনা বললো, আবার এসো তুমি, খাওয়ার দাওয়াত রইলো। মাহমুদ আস্তে বললো, আসবো। তারপর শাহাদাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো মরিয়ম। বিয়ের পর তিনটে মাস কেটে গেছে। দিনগুলো যেন বাদাম তোলা নৌকোর মতো দেখতে না দেখতে চলে গেলো। প্রথম প্রথম মনসুর তো ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো। সারাদিন ঘরে থাকতো। সারাক্ষণ মরিয়মের পাশে। মরিয়ম রাগ করে বলতো ব্যবসাটা কি ডোবাবে নাকি? মনসুর বলতো, তোমার জন্যে ডোবে যদি ডুবুক। ক্ষতি নেই। রোজ বিকেলে সাজপোশাক পরে, চকোলেট রঙের গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছে ওরা। যেখানে যেতে চেয়েছে মরিয়ম, সেখানে নিয়ে গেছে মনসুর। মাঝে বারকয়েক বাবার বাড়িতেও এসেছিলো মরিয়ম। দিন দুতিনেক করে থেকে গেছে। আরো থাকতো। মনসুরের পীড়াপীড়িতে থাকতে পারে নি। নিজের স্বচ্ছল জীবনের পাশে বাবা মা-ভাইবোনের দীনতা মনে আঘাত দিয়েছে মরিয়মকে। যখন যা পেরেছে, টাকা-পয়সা দিয়ে ওদের সাহায্য করছে সে। মনসুর কথা দিয়েছে, একটা ভালো বাড়ি দেখে সেখানে নিয়ে আসবে ওদের। ভাড়াটাও নিজেই দেবে, আর হাসিনা ও খোকনের পড়ার খরচটা চালাবে মনসুর। শুনে প্রসন্ন হয়েছে মরিয়ম। মাবাবারও খুশির অন্ত নেই। যখন হাত পেতেছেন কিছু না কিছু পেয়েছেন মনসুরের কাছে। জীবনটা বেশ চলছিলো। কিন্তু দুমাস না যেতে, অকস্মাৎ একদিন প্রথম জোয়ারের উচ্ছাসে ভাটা এলো। খাওয়ার টেবিলে সেদিন বড় উন্মনা মনে হচ্ছিল মনসুরকে। শোবার ঘরে এসে প্রথম বললো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ম্যারি, উত্তর দেবে? শঙ্কিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে মরিয়ম জবাব দিলো, কি কথা, বলো। জাহেদ নামে কোন ছেলেকে তুমি চিনতে? ওর দৃষ্টি মরিয়মের চোখের উপর। বুকটা বহুদিন পর কেঁপে উঠেছে মরিয়মের। ইতস্তত করে বললো, চিনতাম। মনসুরের মুখখানা কাল হয়ে এলো। ক্ষণকাল পরে সে আবার বললো, তার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিলো তোমার? মুখখানা মাটির দিকে নামিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো মরিয়ম। তারপর মুখ তুলে
false
tarashonkor
নজরবন্দি ছেলেটি বড় ভাল, বাপু। কামার-বউকে মা বলে। গায়ের ছেলেরাও ওর কাছে ভিড় জমিয়ে বসে থাকে। —বস তুমি। আমি আসি একবার যতীনবাবুর সঙ্গেই দেখা করে। পথে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ডাকিল শ্ৰীহরি। সেখানেও চারপাশে একটি ছোটখাটো ভিড় জমিয়া রহিয়াছে। দেবু অনুমানে বুঝিল, খাজনা আদায়ের পর্ব চলিতেছে। চৈত্র মাসের বারই-তেরই, ইংরাজি আটাশে মার্চ সরকার-দপ্তরে রাজস্ব দাখিলের শেষ দিন। তা ছাড়া চৈত্র-কিস্তি, আখেরি। দেবু বলিল–ওবেলা আসব ভাইপো। শ্ৰীহরি বলিল—সঁচ মিনিট। গ্রামের ব্যাপারটা দেখে যাও। যেন অরাজক হয়েছে। দেবু উঠিয়া আসিল। দেখিল বৈরাগীদের নেলো অর্থাৎ নলিন হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ও-পাশে তাহার মা কাঁদিতেছে। শ্ৰীহরি বলিলই দেখ, ছোঁড়ার কাও দেখ। আঙুল দিয়া সে দেখাইয়া দিল চণ্ডীমণ্ডপের চুনকাম-করা একটি থাম। সেই চুনকাম-করা থামের সাদা জমির উপর কয়লা দিয়া অ্যাঁকা এক বিচিত্র ছবি। মা-কালীর এক মূর্তি। দেবু নেলোকে জিজ্ঞাসা করিলা রে, তুই এঁকেছিস? নেলো ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া উত্তর দিল—হ্যাঁ। —চুনকাম-করা চণ্ডীমণ্ডপের উপর কি করেছে একবার দেখ দেখি? –পট এঁকেছেন। ইহার পর নেলোকেই সে বলিল—চুনকামের খরচা দে, দিয়ে উঠে যা! দেবু তখনও ছবিখানি দেখিতেছিল—বেশ অ্যাঁকিয়াছিল নেলো। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলকার কাছে অ্যাঁকতে শিখলি তুই? নেলো রুদ্ধস্বরে কোনোমতে উত্তর দিল—আপুনি আপুনি, আজ্ঞে। –নিজে নিজে শিখেছিস? শ্ৰীহরি এই প্রশ্নের উত্তর দিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ছোঁড়ার ওই কাজ হয়েছে, বুঝলে কিনা! লোকের দেওয়ালে, সিমেন্টের উঠানে, এমনকি বড় বড় গাছের গায়ে পর্যন্ত কয়লা দিয়ে ছবি অ্যাঁকবে। তারপর ওই নজরবন্দি ছোকরা ওর মাথা খেল! অনিরুদ্ধের বাইরের ঘরে ছোকরা থাকে, দেখো না একবার তার দেওয়ালটা একেবারে চিত্ৰি-বিচিত্রে ভর্তি। এখন চণ্ডীমণ্ডপের উপর লেগেছে। কাল দুপুরবেলায় কাজটি করেছে। দেবু হাসিয়া বলিল—নেলো অন্যায় করেছে বটে, কিন্তু এঁকেছে ভাল, কালীমূর্তিটি খাসা হয়েছে। –নমস্কার, ঘোষমশায়! ওদিকের সিঁড়ি দিয়া পথ হইতে উঠিয়া আসিল ডেটিনিউ যতীন। দেবুকে দেখিয়া সে বলিল এই যে আপনিও রয়েছেন দেখছি! আপনার ওখানেই যাচ্ছিলাম। —আমিও যাচ্ছিলাম আপনার কাছেই। –দাঁড়ান, কাজটা সেরে নি। ঘোষমশায়, ওই মাথাট য় কলি ফেরাতে কত খরচ হবে? শ্ৰীহরি বলিলখরচ সামান্য কিছু হবে বৈকি। কিন্তু কথা তো তা নয়, কথা হচ্ছে নেলোকে শাসন করা। হাসিয়া যতীন বলিল—আমি দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বললেন—চুন চার আনা, একটা রাজমিস্ত্রির আরোজের মজুরি চার আনা, একটা মজুরের আধরোজ দু আনা। মোট এই দশ আনা, কেমন? –হ্যাঁ। তবে পাটও কিছু লাগবে পোচড়ার জন্যে। —বেশ, সেও ধরুন দু আনা। এই বার আনা। একটি টাকা বাহির করিয়া যতীন শ্রীহরির সম্মুখে নামাইয়া দিয়া বলিলবাকিটা আমায় পাঠিয়ে দেবেন। সে উঠিয়া পড়িল। দেবুও সঙ্গে সঙ্গে উঠিল। যতীন হাসিয়া বলিল-আমার ওখানেই আসুন, দেবুবাবু। নলিনের অ্যাঁকা অনেক ছবি আছে, দেখবেন। এস নলিন—এস। শ্ৰীহরি ডাকিল—খুড়ো, একটা কথা! দেবু ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–বল। –একটু এধারে এস বাবা। সব কথা কি সবার সামনে বলা চলে? শ্ৰীহরি হাসিল। ষষ্ঠীতলার কাছে নির্জনে আসিয়া শ্ৰীহরি বলিলগতবার চোত-কিস্তি থেকেই তোমার খাজনা বাকি রয়েছে, খুড়ো। এবার সমবৎসর। কিস্তির আগেই একটা ব্যবস্থা কোরো বাবা। দেবুর মুখ মুহুর্তে অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল! গতকালের কথা তাহার মনে পড়িল! বোধ হইল, শ্ৰীহরি তাহাকে শাসাইতেছে। সে সংযত স্বরে বলিল-আচ্ছা, দেব। কিস্তির মধ্যেই দোব। *** উনিশ শো চব্বিশ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ ক্ষমতাবলে ইংরেজ সরকারের প্রণয়ন করা আইন আটক-আইন। নানা গণ্ডিবন্ধনে আবদ্ধ করিয়া বিশেষ থানার নিকটবর্তী পল্লীতে রাজনৈতিক অপরাধ-সন্দেহে বাঙালি তরুণদের আটক রাখার ব্যবস্থা হইয়াছিল। বাংলা সরকারের সেই আটক-আইনের বন্দি যতীন। যতীনের বয়স বেশি নয়, সতের-আঠার বৎসরের কিশোর, যৌবনে সবে পদার্পণ করিয়াছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ রঙ, রুক্ষ বড় বড় চুল, ছিপছিপে লম্বা, সর্বাঙ্গে একটি কমনীয় লাবণ্য; চোখ দুটি ঝকঝকে, চশমার আবরণের মধ্যে সে দুটিকে আরও আশ্চর্য দেখায়। অনিরুদ্ধের বাহিরের ঘরের বারান্দায় একখানা তক্তপোশ পাতিয়া সেইখানে যতীন আসর করিয়া বসে। গ্রামের ছেলের দল তো এইখানেই পড়িয়া থাকে। বয়স্কেরাও সকলেই আসে তারা নাপিত, গিরিশ ছুতার, গাঁজাখোর গদাই পাল, বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরীও আসেন। সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করিয়া বৃন্দাবন দত্তও আসে; মজুর খাঁটিয়া কোনোরূপে বাঁচিয়া আছে তারিণী পাল—সেও আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কোনো কোনো দিন শ্রীহরিও পথে যাইতেআসিতে এক-আধবার বসে। বাউরিপাড়া-বায়েনপাড়ার লোকেরাও আসে। গ্রাম্যবধূ ও ঝিউড়ি মেয়েগুলি দূর হইতে তাহাকে দেখে। বুড়ি রাঙাদিদি মধ্যে মধ্যে যতীনের সঙ্গে কথা বলে। কোনোদিন নাড়ু, কোনোদিন কলা, কোনোদিন অন্য কিছু দিয়া সে যতীনকে দেখিয়া আপন মনেই পঁচালির একটি কলি আবৃত্তি করে– অঙ্কুর পাষাণ হিয়া, সোনার গোপালে নিয়া শূন্য কৈল যশোদার কোল। যতীনও মধ্যে মধ্যে আপনার মনে গুনগুন করিয়া আবৃত্তি করে–রবীন্দ্রনাথের কবিতা। দুইটা লাইন এই পল্লীর মধ্যে তাহার অন্তরীণ জীবনে অহরহ গুঞ্জন করিয়া ফেরে– সব ঠাঁই মোর ঘর আছে… ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়… সমগ্র বাংলাদেশ যেন এই পল্লীটির ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে রূপায়িত হইয়া ধরা দিয়াছে তাহার কাছে। এখানে পদার্পণমাত্র গ্রামখানি এক মুহুর্তে তাহার আপন ঘরে পরিণত হইয়া উঠিয়াছে। এখানকার প্রতিটি মানুষ তাহার ঘনিষ্ঠতম প্রিয়জন, পরমাত্মীয়। কেমন করিয়া যে এমন হইল—এ সত্য তাহার কাছে এক পরমাশ্চর্য। শহরের ছেলে সে, কলিকাতায় তাহার বাড়ি। জীবনে পল্লীগ্রাম এমন করিয়া কখনও দেখে নাই। আটক-আইনে গ্রেপ্তার হইয়া প্রথমে কিছুদিন ছিল জেলে। তারপর কিছুদিন ছিল বিভিন্ন জেলার সদরে মহকুমা শহরে। এই মহকুমা শহরগুলি অদ্ভুত। সেখানে পল্লীর আভাস কিছু আছে, কিছু কিছু মাঠঘাট আছে, কৃষি এখনও সেখানকার জীবিকার একটা মুখ্য বা গৌণ অংশ; ক্ষুদ্ৰ ক্ষুদ্ৰ সমাজও আছে। ঠিক সমাজ নয়–দল। সমাজ ভাঙিয়া
false
bongkim
জিজ্ঞাসা করিল, “বড় কাকা, কবে এলেন?” হরলাল বলিল, “কাল এসেছি। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে |” রোহিণী শিহরিল; বলিল, “আজি এখানে খাবেন? সরু চালের ভাত চড়াব কি?” হ। চড়াও চড়াও। কিন্তু সে কথা নয়। তোমার এক দিনের কথা মনে পড়ে কি? রোহিণী চুপ করিয়া মাটি পানে চাহিয়া রহিল। হরলাল বলিল, “সেই দিন যে দিন তুমি গঙ্গাস্নান করিয়া আসিতে, যাত্রীদিগের দলছাড়া হইয়া পিছাইয়া পড়িয়াছিলে? মনে পড়ে?” রো। (বাঁ হাতের চারিটি আঙ্গুল দাইন হাতে ধরিয়া অধোবদনে) মনে পড়ে। হ। যে দিন তুমি পথ হারাইয়া মাঠে পড়িয়াছিলে, মনে পড়ে? রো। পড়ে। হ। যে দিন মাঠে তোমার রাত্রি হইল, তুমি একা; জনকত বদমাস তোমার সঙ্গ নিল– মনে পড়ে? রো। পড়ে। হ। সে দিন কে তোমায় রক্ষা করিয়াছিল? রো। তুমি। তুমি ঘোড়ার উপরে সেই মাঠ দিয়া কোথায় যাইতেছিলে– হ। শালীর বাড়ী। রো। তুমি দেখিতে পাইয়া আমায় রক্ষা করিলে–আমায় পাল্কী বেহারা করিয়া বাড়ী পাঠাইয়া দিলে। মনে পড়ে বই কি। সে ঋণ আমি কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না। হ। আজ সে ঋণ পরিশোধ করিতে পার–তার উপর আমায় জন্মের মত কিনিয়া রাখিতে পার, করিবে? রো। কি বলুন–আমি প্রাণ দিয়াও আপনার উপকার করিব। হ। কর না কর, এ কথা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিও না। রো। প্রাণ থাকিতে নয়। হ। দিব্য কর। রোহিণী দিব্য করিল। তখন হরলাল কৃষ্ণকান্তের উইল ও জাল উইলের কথা বুঝাইয়া বলিল। শেষে বলিল, “সেই আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল তাহার বদলে রাখিয়া আসিতে হইবে। আমাদের বাড়ীতে তোমার যাতায়াত আছে। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি অনায়াসে পার। আমার জন্য ইহা করিবে?” রোহিণী শিহরিল। বলিল, “চুরি! আমাকে কাটিয়া ফেলিলেও আমি পারিব না |” হ। স্ত্রীলোক এমন অসারই বটে–কথার রাশি মাত্র। এই বুঝি এ জন্মে তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবে না! রো। আর যা বলুন, সব পারিব। মরিতে বলেন, মরিব। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকের কাজ পারিব না। হরলাল কিছুতেই রোহিণীকে সম্মত করিতে না পারিয়া, সেই হাজার টাকার নোট রোহিণীর হাতে দিতে গেল। বলিল, “এই হাজার টাকা পুরস্কার আগাম নাও। এ কাজ তোমার করিতে হইবে|” রোহিণী নোট লইল না। বলিল, “টাকার প্রত্যাশা করি না। কর্তার সমস্ত বিষয় দিলেও পারিব না। করিবার হইত ত আপনার কথাতেই করিতাম | ” হরলাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বলিল, “মনে করিয়াছিলাম, রোহিণী, তুমি আমার হিতৈষী। পর কখনও আপন হয়? দেখ, আজ যদি আমার স্ত্রী থাকিত, আমি তোমার খোশামোদ করিতাম না। সেই আমার এ কাজ করিত |” এবার রোহিণী একটু হাসিল। হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিলে যে?” রো। আপনার স্ত্রীর নামে সেই বিধবাবিবাহের কথা মনে পড়িল। আপনি না কি বিধবাবিবাহ করিবেন? হ। ইচ্ছা ত আছে–কিন্তু মনের মত বিধবা পাই কই? রো। তা বিধবাই হৌক, সধবাই হৌক–বলি বিধবাই হৌক, কুমারীই হৌক–একটা বিবাহ করিয়া সংসারী হইলেই ভাল হয়। আমরা আত্মীয়স্বজন সকলেরই তাহলে আহ্লাদ হয়। হ। দেখ, রোহিণী, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। রো। তা ত এখন লোকে বলিতেছে। হ। দেখ, তুমিও একটি বিবাহ করিতে পার— কেন করিবে না? রোহিণী মাথার কাপড় একটু টানিয়া মুখ ফিরাইল। হরলাল বলিতে লাগিল,–“দেখ তোমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রাম সুবাদ মাত্র–সম্পর্কে বাধে না |” এবার রোহিণী লম্বা করিয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া, উনুন গোড়ায় বসিয়া যান, দালে কাটি দিতে আরম্ভ করিল। দেখিযা বিষণ্ণ হইয়া হরলাল ফিরিয়া চলিল। হরলাল দ্বার পর্যন্ত গেলে, রোহিণী বলিল, “কাগজখানা না হয় রাখিয়া যান, দেখি, কি করিতে পারি |” হরলাল আহ্লাদিত হইয়া জাল উইল ও নোট রোহিণীর নিকটে রাখিল। দেখিয়া রোহিণী বলিল, “নোট না। শুধু উইলখানা রাখুন |” হরলাল তখন জাল উইল রাখিয়া নোট লইয়া গেল। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ঐ দিবস রাত্রি আটটার সময়ে কৃষ্ণকান্ত রায় আপন শয়নমন্দিরে পর্যঙ্কে বসিয়া উপাধানে পৃষ্ঠ রক্ষা করিয়া, সটকায় তামাক টানিতেছিলেন এবং সংসারে একমাত্র ঔষধ–মাদকমধ্যে শ্রেষ্ঠ–অহিফেন ওরফে আফিমের নেশায় মিঠে রকম ঝিমাইতেছিলেন। যেন হরলাল তিন টাকা তের আনা দু কড়া দু ক্রান্তি মূল্যে তাঁহার সমুদয় সম্পত্তি কিনিয়া লইয়াছে। আবার যেন কে বলিয়া দিল যে, না, এ দানপত্র নহে, এ তমসুক। তখনই যেন দেখলেন যে, ব্রহ্মার বেটা বিষ্ণু আসিয়া বৃষভারূঢ় মহাদেবের কাছে এক কৌটা আফিম কর্জ লইয়া, এই দলিল লিখিয়া দিয়া, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বন্ধক রাখিয়াছেন–মহাদেব গাঁজার ঝোঁকে ফোরক্লোজ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। এমত সময়ে, রোহিণী ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা কি ঘুমাইয়াছ?” কৃষ্ণকান্ত ঝিমাইতে ঝিমাইতে কহিলেন, “কে নন্দী? ঠাকুরকে এই বেলা ফোরক্লোজ করিতে বল |” রোহিণী বুঝিল যে, কৃষ্ণকান্তের আফিমের আমল হইয়াছে। হাসিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা, নন্দী কে?” কৃষ্ণকান্ত ঘাড় না তুলিয়া বলিলেন, “হুম্ ঠিক বলেছ। বৃন্দাবনে গোয়ালাবাড়ী মাখন খেয়েছে–আজও তার কড়ি দেয় নাই|” রোহিণী খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। তখন কৃষ্ণকান্তের চমক হইল, মাথা তুলিয়া দেখিয়া বলিলেন, “কে ও, অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা রোহিণী?” রোহিণী উত্তর করিল, “মৃগশিরা আর্দ্রা পুনর্বসু পুষ্যা |” কৃষ্ণ। অশ্লেষা মঘা পূর্বফাল্গুনী। রো। ঠাকুরদাদা, আমি কি তোমার কাছে জ্যোতিষ শিখ‍‍তে এয়েছি! কৃষ্ণ। তাই ত! তবে কি মনে করিয়া? আফিঙ্গ চাই না ত? রো। যে সামগ্রী প্রাণ ধ‍‍র্যে দিতে পারবে না, তার জন্যে কি আমি এসেছি! আমাকে কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাই এসেছি। কৃ। এই এই। তবে আফিঙ্গের জন্য! রো। না, ঠাকুরদাদা না। তোমার দিব্য, আফিঙ্গ চাই না। কাকা বল‍লেন যে, যে
false
shorotchandra
কিন্তু এ-ও কি কপালের লেখা? তার মানে আপনি কখনো চেষ্টা করেন নি। তারকবাবু বলছিলেন, চেষ্টায় সমস্ত হয়, সব-কিছু সংসারে মেলে। এ কথায় রাখাল হাসিয়া বলিল, কিন্তু সেই চেষ্টাটাই যে কোন্‌ চেষ্টায় মেলে তাকে জিজ্ঞেসা করলে না কেন? তার জবাবটা হয়তো আমার কাজে লাগতো। শুনিয়া সারদাও হাসিল, বলিল, বেশ জিজ্ঞেসা করবো; কিন্তু এ কেবল আপনার কথার ঘোর-ফের,—আসলে সত্যিও নয়, তাঁর জবাবও আপনার কোন কাজে লাগবে না। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর ওপর আপনি রাগ করে আছেন—না? রাখাল সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, আমি রাগ করে আছি তারকের ওপর? এ সন্দেহ তোমার হলো কি করে? কি জানি কি করে হলো, কিন্তু হয়েচে তাই বললুম। রাখাল চুপ করিয়া রহিল, আর প্রতিবাদ করিল না। সারদা বলিতে লাগিল, তাঁর ইচ্ছে নয় আর গ্রামে থাকা। একটা ছোট্ট জায়গার ছোট্ট ইস্কুলে ছেলে পড়িয়ে জীবন ক্ষয় করতে তিনি নারাজ। সেখানে বড় হবার সুযোগ নেই, সেখানে শক্তি হয়েচে সঙ্কুচিত, বুদ্ধি রয়েচে মাথা হেঁট করে, তাই শহরে ফিরে আসতে চান। এখানে উঁচু হয়ে দাঁড়ানো তাঁর কাছে কিছুই শক্ত নয়। রাখাল আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কথাগুলো কি তোমার, না তার সারদা? না আমার নয়, তাঁরই মুখের কথা। মাকে বলছিলেন আমি শুনেচি। শুনে নতুন-মা কি বললেন? শুনে মা খুশিই হলেন। বললেন, তার মতো ছেলের গ্রামে পড়ে থাকা অন্যায়। থাকতে যেন না হয় এ তিনি করবেন। করবেন কি করে? সারদা বলিল, শক্ত নয় ত দেব্‌তা। মা বিমলবাবুকে বললে না হতে পারে এমন ত কিছু নেই। শুনিয়া রাখাল তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। অর্থাৎ, জিজ্ঞাসা করিতে চাহিল ইহার তাৎপর্য কি? সারদা বুঝিল আজও রাখাল কিছুই জানে না। বলিল, খাওয়া হয়ে গেছে, হাত ধুয়ে এসে বসুন আমি বলচি মিনিট-কয়েক পরে হাতমুখ ধুইয়া সে বিছানায় আসিয়া বসিল। সারদা তাহাকে জল দিল, পান দিল, তার পরে অদূরে মেঝের উপরে বসিয়া বলিল, রমণীবাবু চলে গেছেন আপনি জানেন? চলে গেছেন? কৈ না! কোথায় গেছেন? কোথায় গেছেন সে তিনিই জানেন, কিন্তু এখানে আর আসেন না। যেতে তাঁকে হতোই—এ ভার বইবার আর তাঁর জোর ছিল না—কিন্তু গেলেন মিথ্যে ছল করে। এতখানি ছোট হয়ে বোধ করি আমার কাছে থেকে জীবনবাবুও যায়নি। এই বলিয়া সে সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিল, এ ঘটতোই, কিন্তু উপলক্ষ হলেন আপনি। সেই যে রেণুর অসুখে পরের নামে টাকা ভিক্ষে চাইতে এলেন, আর না পেয়ে অভুক্ত চলে গেলেন, এ অন্যায় মাকে ভেঙ্গে গড়লো, এ ব্যথা তিনি আজও ভুলতে পারলেন না। আমাকে ডেকে বললেন, সারদা, রাজুকে আজ আমার চাই-ই, নইলে বাঁচবো না। এসো তুমি আমার সঙ্গে। যা-কিছু মায়ের ছিল পুঁটুলিতে বেঁধে নিয়ে আমরা লুকিয়ে গেলুম আপনার বাসায়, তার পরে গেলুম ব্রজবাবুর বাড়ি, কিন্তু সব খালি, সব শূন্য! নোটিশ ঝুলছে বাড়ি ভাড়া দেবার। জানা গেল না কিছুই, বুঝা গেল শুধু কোথায় কোন্‌ অজানা গৃহে মেয়ে তাঁর পীড়িত, অর্থ নেই ওষুধ দেবার, লোক নেই সেবা করার। হয়তো বেঁচে আছে, হয়তো বা নেই। অথচ উপায় নেই সেখানে যাবার—পথের চিহ্ন গেছে নিঃশেষে মুছে। মাকে নিয়ে ফিরে এলুম। তখন বাইরের ঘরে চলেছে খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান আনন্দ-কলরব। করবার কিছু নেই, কেবল বিছানায় শুয়ে দু’চোখ বেয়ে তাঁর অবিরল জল পড়তে লাগলো। শিয়রে বসে নিঃশব্দে শুধু মাথায় হাত বুলোতে লাগলুম—এ-ছাড়া সান্ত্বনা দেবার তাঁকে ছিলই বা আমার কি! সেদিন বিমলবাবু ছিলেন সামান্য-পরিচিত আমন্ত্রিত অতিথি, তাঁরই সম্মাননার উদ্দেশ্যে ছিল আনন্দ-অনুষ্ঠান। রমণীবাবু এলেন ঘরের মধ্যে তেড়ে, বললেন, চলো সভায়। মা বললেন, না, আমি অসুস্থ। তিনি বললেন, বিমলবাবু কোটিপতি ধনী, তিনি আমার মনিব, নিজে আসবেন এই ঘরে দেখা করতে। মা বললেন, না, সে হবে না। এতে অতিথির কত যে অসম্মান সে কথা মা না জানতেন তা নয়, কিন্তু অনুশোচনায়, ব্যথায়, অন্তরের গোপন ধিক্কারে তখন মুখ-দেখানো ছিল বোধ করি অসম্ভব। কিন্তু দেখাতে হলো। বিমলবাবু নিজে এসে ঢুকলেন ঘরে। প্রশান্ত সৌম্য মূর্তি, কথাগুলি মৃদু বললেন, অনধিকার-প্রবেশের অন্যায় হলো বুঝি, কিন্তু যাবার আগে না এসেও পারলাম না। কেমন আছেন বলুন? মা বললেন, ভালো আছি। তিনি বললেন, ওটা রাগের কথা, ভালো আপনি নেই। কিছুকাল আগে ছবি আপনার দেখেচি আর আজ দেখচি সশরীরে। কত যে প্রভেদ সে আমিই বুঝি। এ চলতে পারে না, শরীর ভালো আপনাকে করতেই হবে। যাবেন একবার সিঙ্গাপুরে? সেখানে আমি থাকি—সমুদ্রের কাছাকাছি একটা বাড়ি আছে আমার। হাওয়ারও শেষ নেই, আলোরও সীমা নেই। পূর্বের দেহ আবার ফিরে আসবে,—চলুন। মা শুধু জবাব দিলেন, না। না কেন? প্রার্থনা আমার রাখবেন না? মা চুপ করে রইলেন। যাবার উপায় ত নেই, মেয়ে যে পীড়িত, স্বামী যে গৃহহীন। সেদিন রমণীবাবু ছিলেন মদ খেয়ে অপ্রকৃতিস্থ, জ্বলে উঠে বললেন, যেতেই হবে। আমি হুকুম করচি যেতে হবে তোমাকে। না, আমি যেতে পারবো না। তার পরে শুরু হলো অপমান আর কটু কথার ঝড়। সে যে কত কটু আমি বলতে পারবো না দেব্‌তা। ঘূর্ণি হাওয়ায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জড়ো করে তুললে যেখানে যত ছিল নোংরামির আবর্জনা—প্রকাশ পেতে দেরি হলো না যে, মা ও-লোকটার স্ত্রী নয়—রক্ষিতা। সতীর মুখোশ পরে ছদ্মবেশে রয়েচে শুধু একটা গণিকা। তখন আমি একপাশে দাঁড়িয়ে, নিজের কথা মনে করে ভাবলুম, পৃথিবী দ্বিধা হও। মেয়েদের এ-যে এতবড় দুর্গতি তার আগে কে জানতো দেব্‌তা? রাখাল
false
humayun_ahmed
লাগল। তিথি বলল, কেন বিরক্ত করছিস? তুই আমাকে থ্রি থাউজেন্ড টাকা জোগাড় করে দিতে পারবি? না। এর জন্যে তুই আমাকে তোর পা ধরতে বলিস। আমি তোর পা ধরে বসে থাকব। টাকাটা আমার খুবই দরকার। দরকার হলে চুরি কর। ছিনতাই কর। কানে দুল পরে মেয়েরা যায়। ঐ দুল টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যা। তুই পাগল হয়ে গেলি তিথি? আমি ভদ্রলোকের ছেলে না? হ্যাঁ, ভদ্রলোকের ছেলে। তুই ভদ্রলোকের ছেলে, আমি ভদ্রলোকের মেয়ে। আমি টাকা কিভাবে আনি তুই জানিস? নাকি তোর জানা নেই? হীরু চুপ করে গেল। তিথি বলল, আমি কিভাবে টাকা আনি সেটা কেউ জানে না, আবার সবাই জানে। মজার একটা খেলা। তুই আমার পেছন পেছন আসবি না। যদি আসিস তাহলে ধাক্কা দিয়ে নর্দমায় ফেলে দেব। হীরু দাঁড়িয়ে পড়ল। তিথিকে বিশ্বাস নেই। এই কাণ্ড সে সত্যি সত্যি করে বসতে পারে। একবার নর্দমায় পড়ে গেলে চৌদবার গোসল করলেও গন্ধ উঠবে না। হীরুর মন খারাপ হয়ে গেল। তিথির কাছ থেকে সে টাকা পাবে না এটা জানত। টাকা চাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন। হীরুর ধারণা ছিল টাকার কথা শুনেই তিথি বলবে এত টাকা দিয়ে তুই কি করবি? তখন হীরু কারণটা ব্যাখ্যা করবে। কারণটা বেশ অদ্ভুত। আজ হাঁটতে হাঁটতে সে পীর সাহেবের কাছে গিয়েছে। খালি হাতে গিয়েছে, এই জন্যে সে আর তার সঙ্গে দেখা করল না। উঠোনে মাথা কামানো এক লোকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। মাথা কামানো লোকটির নাম সবুর। তার বাড়ি কালিয়াকৈর। মাস তিনেক আগে বিয়ে করেছে। গত সপ্তাহে তার বৌ হঠাৎ পালিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খোঁজখবর করেও সে কোনো সন্ধান না পেয়ে পীর সাহেবের কাছে এসেছে। পীর সাহেবের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নি। হীরু বলল, ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন ভাইজান। মোটেই চিন্তা করবেন না, এক মিনিটের মামলা। পীর সাহেব ফড়ফড় করে সব বলে দেবেন। সত্যি? সত্যি মানে? আমার নিজের ইয়ং ব্রাদার মিসিং হয়ে গেল। তার নাম টুকু। পীর সাহেবকে বললাম। উনি বললেন–চিন্তা করিস না। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরবে। ফিরল এক সপ্তাহের মধ্যে? ফিরবে না মানে? পীর সাহেবের সঙ্গে ইয়ার্কি চলে না। ডাইরেক্ট অ্যাকশান। আপনি খালি হাতে আসেননি তো? একশ টাকা এনেছি, গরিব মানুষ। টাকা-পয়সা পীর সাহেব নিবেন না। টাকা-পয়সা উনার কাছে তেজপাতা। সিগারেট দিতে হবে, বিদেশী সিগারেট। বিদেশী কি সিগারেট? ধরেন ডানাহিল, বেনসন। মোড়ের দোকানে গিয়ে বললেই হবে–পীর সাহেবের সিগ্রেট। ওরা জানে। বাজারের চেয়ে কম রেইটে পাবেন। যান সিগ্রেট নিয়ে আসেন। পীর সাহেবকে কদমবুসি করে সিগ্রেটের প্যাকেটটা বাম দিকে রাখবেন। সবুর মিয়া সিগ্রেট আনতে গেল আর তখনি বাড়ির ভেতর থেকে পীর সাহেব খালি পায়ে বের হয়ে এলেন। বারান্দায় এবং উঠোনে এতগুলি লোক বসা, কাউকে কিছু না বলে হীরুকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। হতভম্ব হীরু ছুটে গেল। পীর সাহেব বললেন, তুই বিসমিল্লাহ বলে একটা ব্যবসা শুরু কর। ব্যবসা তোর তরক্কি হবে। স্বয়ং নবী করিম ব্যবসা করতেন। হীরু কাঁপা গলায় বলল, কিসের ব্যবসা করব? পীর সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, তোর ব্যবসা হবে গরম জিনিসের। একটা চায়ের দোকান দিয়ে দে। এই বলেই পীর সাহেব। আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। আর কি আশ্চর্য যোগাযোগ তার পরদিনই যে কল্যাণপুরের বশীর মোল্লার চায়ের দোকানে চা খেতে গেছে, বশীর মোল্লা বলল, দোকান বেচে দিব। হীরু ভাই। খদ্দের যদি পান একটু বলবেন। হীরু গম্ভীর হয়ে বলল, বেচবেন কেন? চালু দোকান। চালু কোথায় দেখলেন? দিনে পঞ্চাশ কাপ চা বেচতে পারি না। বিশ-পাঁচিশ কাপ পাড়ার ছেলেরা খায়। দাম চাইলে বলে খাতায় লিখে রাখেন। দাম কত চান দোকানের? দশ হাজার পাইলে রাখমু না। দশ হাজার? দোকানে আপনার আছে কি? দুইটা কেতলী, পনের-বিশটা কাপ। হাজার তিনেক হলে আমাকে বলবেন ক্যাশ দিয়ে নিয়ে যাব। নো প্রবলেম। বশীর মোল্লা আর কিছু বলল না। চিন্তিত মুখে দাঁত খুঁচাতে লাগল। এই সবই হচ্ছে যোগাযোগ। এরকম যোগাযোগ আপনা-আপনি হয় না। উপরের নির্দেশ লাগে। পীর সাহেবের দোয়ায় অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। এরা হচ্ছেন অলি মানুষ এদের দোয়া কোরামিন ইনজেকশনের মত। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন। হীরুর ইচ্ছা ছিল টাকা চাওয়ার উপলক্ষে পুরো ঘটনাটা তিথিকে বলবে। তিথি সেই সুযোগ দিল না। পীর সাহেবের দোয়ার ফল তো সে একা ভোগ করবে না। সবাই মিলে ভোগ করবে। তার টাকা-পয়সা হলে সে কি ভাই বোন ফেলে দিবে? অবশ্যই না। ভাই-বোন, ফাদার-মাদার এরা থাকবে মাথার উপরে। ফরিদার চোখ দু’টি আজ যেন উজ্জ্বল আরো তীক্ষ্ণ। চুলার গানগনে কয়লার মত ঝকঝকি করছে। তার পরনের শাড়িটাও লাল। মাথার চুলগুলিও কেন জানি লালচে দেখাচ্ছে। শুধু মুখের চামড়া আরো হলুদ হয়েছে। এমন হলুদ যে মনে হয় হাত দিয়ে ছুঁলে হাতে হলুদ রঙ লেগে যাবে। ফরিদা বললেন, বস তিথি। চেয়ার টেনে বস। তিথি বলল, আপনি আমাকে ডেকেছেন? ফরিদা চুপ করে রইলেন তবে খুব আগ্রহ নিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের মণিতে এক ধরনের কৌতুক। এক সময় হাসিমুখে বললেন, তুমি কি চোখে কাজল দিয়েছ না-কি? তিথি শান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ দিয়েছি। কেন, আমার মত মেয়ের কি চোখে কাজল দেয়া নিষেধ? ফরিদা তিথির প্রশ্নের প্রতি মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। নিজের মনে বললেন, বিয়ের আগে আমারও চোখে কাজল দেয়ার সখ ছিল। খুব কাজল দিতাম। এক’দিন আমার মামা আমাকে
false
humayun_ahmed
কি হইয়া যায়, সে বুঝিতে পারে না; তবে হইয়া যায়। প্রথম দিনের কথা তাহার মনে পড়িয়া যায়। বুড়া শিবতলার সম্মুখেই দুর্গাসায়রের বাঁধাঘাটের ভাঙা রাণার উপর সে দাঁড়াইয়া ছিল—জলের তলে তাহার ছবি উল্টা দিকে মাথা করিয়া দাঁড়াইয়া জলের ঢেউয়ে আঁকিয়া-বাঁকিয়া লম্বা হইয়া যাইতেছিল—জল স্থির হইলে লম্বা ছবিটি অবিকল তাহার মত দশ-এগারো বৎসরের মেয়েটি হইয়া তাহারই দিকে চাহিয়া হাসিতেছিল। হঠাৎ বামুন-বাড়ির হারু সরকার আসিয়া তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া টানিয়া সানবাঁধানো সিঁড়ির উপর তাহাকে আছাড় দিয়া ফেলিয়া দিয়াছিল। তাহার সে রূঢ় কণ্ঠস্বর সে এখনও শুনিতে পায় হারামজাদী ডাইনী, তুমি আমার ছেলেকে নজর দিয়েছ? তোমার এত বড় বাড়? খুন করে ফেলব হারামজাদীকে। হারু সরকারের সে ভয়ঙ্কর মূর্তি যেন স্পষ্ট চোখের উপর ভাসিতেছে। সে ভয়ে বিহ্বল হইয়া চীকার করিয়া কাঁদিয়াছিল—ওগো বাবু গো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি গো! —আম দিয়ে মুড়ি খেতে দেখে যদি তোর লোভই হয়েছিল, তবে সে-কথা বললি না কেন হারামজাদী? হ্যাঁ, লোভ তো তাহার হইয়াছিল, সত্যই হইয়াছিল, মুখের ভিতরটা জলে ভরিয়া পরিপূর্ণ হইয়াছিল! -হারামজাদী, আমার ছেলে যে পেট-বেদনায় ছটফট করছে। সে আজও অবাক হইয়া যায়, কেমন করিয়া এমন হইয়াছিল—কেমন করিয়া এমন হয়! কিন্তু এ যে সত্য তাহাতে তো আর সন্দেহ নাই। তাহার স্পষ্ট মনে পড়িতেছে, সে হারু সরকারের বাড়ি গিয়া অঝোরঝরে কাদিয়াছিল, আর বার বার মনে মনে বলিয়াছিল—হে ঠাকুর, ভালো করে দাও, ওকে ভালো করে দাও। কতবার সে মনে মনে বলিয়াছিল—দৃষ্টি আমার ফিরাইয়া লইতেছি, এই লইলাম। আশ্চর্যের কথা, কিছুক্ষণ পরে বার-দুই বমি করিয়া ছেলেটি সুস্থ হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। সরকার বলিয়াছিল, ওকে একটা আমি আর দুটি মুড়ি দাও দেখি। সরকার-গিন্নী একটা ঝাঁটা তুলিয়াছিল, বলিয়াছিল, ছাই দেব হারামজাদীর মুখে। মা-বাবা-মরা অনাথা মেয়ে বলে দয়া করি—যেদিন হারামজাদী আসে সেই দিনই আমি ওকে খেতে দিই। আর ও কিনা আমার ছেলেকে নজর দেয়! আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে দেখ। ওর ঐ চোখের দৃষ্টি দেখে বরাবর আমার সন্দেহ ছিল, কখনও আমি ওর সাক্ষাতে ছেলেপুলেকে খেতে দিই নি। আজ আমি খোকাকে খেতে দিয়ে ঘাটে গিয়েছি, আর ও কখন এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছে। সে কি দৃষ্টি ওর! লজ্জায় ভয়ে সে পালাইয়া গিয়াছিল। সেদিন রাত্রে সে গ্রামের মধ্যে কাহারও বাড়ির দাওয়ায় শুইতে পারে নাই; ইয়াছিল গ্রামের প্রান্তে ঐ বুড়াশিবতলায়। অঝেরঝরে সে সমস্ত রাত্রি কাদিয়াছিল আর বলিয়াছিল—হে ঠাকুর, আমার দৃষ্টিকে ভালো করে দাও, না-হয় আমাকে কানা করে দাও। গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস মাটির মূর্তির মত নিস্পন্দ বৃদ্ধার অবয়বের মধ্যে এতক্ষণে ক্ষীণ একটি চাঞ্চল্যের সঞ্চার করিল। ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাশিতে লাগিল। পূর্বজন্মের পাপের যে খণ্ডন নাই—দেবতার দোষই বা কি, আর সাধ্যই বা কি? বেশ মনে আছে, গৃহস্থের বাড়িতে সে আর ঢুকিবে না ঠিক করিয়াছিল। বাহির-দুয়ার হইতেই সে ভিক্ষা চাহিত—গলা দিয়া কা যেন বাহির হইতে চাহিত না, কোনওমতে বহুকষ্টে বলিত, দুটি ভিক্ষে পাই মা! হরিবোল। —কে রে? তুই বুঝি? খবরদার ঘরে ঢুকবি নে! খবরদার! —না মা, ঘরে ঢুকব না মা। কিন্তু পরক্ষণেই মনের মধ্যে কি যেন একটা কিলবিল করিয়া উঠিত, এখনও উঠে। কি সুন্দর মাছভাজার গন্ধ, আহা-হা! বেশ খুব বড় পাকা-মাছের খানা বোধ হয়। —এই—এই! হারামজাদী বেহায়া! উঁকি মারছে দেখ! সাপের মত! ছি ছি ছি! সত্যিই তো সে উঁকি মারিতেছে—রান্নাশালার সমস্ত আয়োজন তাহার নরুণ-চেরা ক্ষুদ্র চোখের এক দৃষ্টিতে দেখা হইয়া গিয়াছে। মুখের ভিতর জিবের তলা হইতে ঝরনার মত জল উঠিতেছে। বহুকালের গড়া জীর্ণ-বিবর্ণ মূর্তি যেন কোথায় একটা নাড়া পাইয়া দুলিয়া উঠিল; ফাট-ধরা শিলিগ্রন্থি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শৃঙ্খলাহীন অসমগতিতে চঞ্চল হইয়া পড়িল; অস্থিরভাবে বৃদ্ধা এবার নড়িয়া-চড়িয়া বসিল বা হাতে শীর্ণ দীর্ঘ আঙুলগুলির নখাঘ দাওয়ার মাটির উপর বিদ্ধ হইয়া গেল। কেন এমন হয়, কেমন করিয়া এমন হয়, সে-কথা সারাজীবন ধরিয়াও যে বুঝিতে পারা গেল না। অস্থির চিন্তায় দিশাহারা চিত্তের নিকট সমস্ত পৃথিবীই যেন হারাইয়া যায়। কিন্তু সে তার কি করিবে? কেহ কি বলিয়া দিতে পারে, তার কি করিবে, কি করিতে পারে? প্রহৃত পশু যেমন মরীয়া হইয়া অকস্মাৎ আঁ-আঁ গর্জন করিয়া উঠে, ঠিক তেমনই ই-ই শব্দ করিয়া অকস্মাৎ বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া শণের মত চুলগুলাকে বিশৃঙ্খল করিয়া তুলিয়া খাড়া সোজা হইয়া বসিল। ফোকলা মাড়ির উপর মাড়ি চাপিয়া, ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে নরুণ-চেরা চোখে চিলের মত দৃষ্টি হানিয়া হাঁপাইতে আরম্ভ করিল।। ছাতি-ফাটার মাঠটা যেন ধোঁয়ায় ভরিয়া ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। চৈত্র মাস, বেলা প্রথম প্রহর শেষ হইয়া গিয়াছে। মাঠ-ভরা ধােয়ার মধ্যে ঝিকিমিকি ঝিলিমিলির মত কি একটা যেন ছুটিয়া চলিয়াছে। একটা ফুকার যদি সে দেয়, তবে মাঠের ধূলার রাশি উড়িয়া আকাশময় হইয়া যাইবে। ঐ ধোঁয়ার মধ্যে জমাট সাদার মত ওটা কি নড়িতেছে যেন! মানুষ? হ্যাঁ, মানুষই তো! মনের ভিতরটা তাহার কেমন করিয়া উঠে। ফুঁ দিয়া ধূলা উড়াইয়া, দিবে মানুষটাকে উড়াইয়া? হি-হি-হি করিয়া পাগলের মত হাসিয়া একটা অবোধ নিষ্ঠুর কৌতুক তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছিল। দুই হাতের মুঠি প্রাণপণ শক্তিতে শক্ত করিয়া সে আপনার উচ্ছল মনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিল–না-না-না। ছাতি-ফাটার মাঠে মানুষটা ধূলার গরমে শ্বাসরোধী ঘনত্বে মরিয়া যাইবে। নাঃ, ওদিকে আর সে চাহিবেই না। তাহার চেয়ে বরং উঠানটায় আর একবার বঁটা বুলাইয়া, ছড়াইয়া-পড়া পাতা ও কাঠকুটাগুলাকে সাজাইয়া রাখিলে কেমন হয়? বসিয়া বসিয়াই সে ভাঙ্গিয়া-পড়া দেহখানাকে টানিয়া উঠানে ঝাঁটা বুলাইতে শুরু করিল। জড়ো-করা পাতাগুলা ফরফর করিয়া অকস্মাৎ সর্পিল
false
MZI
ধ্বংস” ট্যাবলেটটা না থাকলে খেতে পারতাম কি না সন্দেহ। একটা ছোট ট্যাবলেট মাছের ঝোলে ছেড়ে দিতেই সে সব ঝাল শুষে নিল, সত্যি বলতে কি, স্বাদও খানিকটা শুষে নিয়ে স্বাদটা কেমন জানি পানসে করে দিল। পেটে খিদে ছিল, তাই খেতে বিশেষ অসুবিধে হয় নি। খেয়ে বের হয়েছি, একটু হাঁটতেই মনে হল যেন একটা মাছের বাজার। মাছের আশটে গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। বেশ রাত হয়েছে, কিন্তু অনেক লোকজন। খাওয়ার ঠিক পরপরই এরকম আশটে গন্ধ ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু সফদর আলী গো ধরলেন তিনি বাজারটা দেখবেন। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনা হয়েছে, বড় বড় কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে পাইকারি বেচাকেনা হচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব মাছ, দেখে তাক লেগে যায়। ভিড়ে এক জায়গায় মাঝারি একটা হাঙরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সফদর আলী হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, সাবধান! কী হল? এক জন লোক অনেকক্ষণ থেকে আমাদের পিছু পিছু ঘুরছে। সফদর আলী আগেও অনেক বার দাবি করেছেন, তাঁকে নাকি সি, আই এ এবং কে জি বি-র লোকেরা অনুসরণ করে বেড়ায়, কখনো বিশ্বাস করি নি। এবারেও আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সফদর সাহেব ভুরু কুঁচকে চিন্তিত মুখে গোঁফ টানতে লাগলেন। আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, কোন লোকটা? আসেন, দেখাচ্ছি। বাজার থেকে বের হয়ে একটু হেঁটে এগিয়ে যেতেই দেখি সত্যি তাই। আমরা একটু এগুতেই একটা লোক এগোয়, আমরা দাঁড়াতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে কালঘাম ছুটে যাবার মতো অবস্থা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না, বাজারে ভিড়ের মধ্যেই ভালো ছিলাম, রাস্তাটা এদিকে আবার বেশ নির্জন। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাজারে ফিরে যাব কি না ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি লোকটার হাতে একটা টর্চলাইট জ্বলে উঠল, আলো ফেলে ফেলে লোকটা এগিয়ে আসতে থাকে সোজা আমার দিকে। কাছে এসে আমার মুখে আলোটা ফেলে মেঘস্বরে বলল, দাঁড়ান এখানে। ভয়ে আমার কাপড় জামা-নষ্ট হবার অবস্থা, তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললাম, আমি? আমার ধারণা ছিল লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে সফদর আলী বলে ভুল করেছে; কিন্তু দেখা গেল তা নয়। লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো কুচকুচে পিস্তল বের করে আনে, আমার দিকে তাক করে বলে, হ্যাঁ, আপনি। একটা টু শব্দ করলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে ঘিলু বের করে দেব। আমি মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে দেখি সফদর আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী একটা জিনিস বের করে লোকটার দিকে তাক করেছেন। কিছু বোঝার আগেই তিনি হঠাৎ সুইচ টিপে দিলেন। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা নীল আলো বের হল। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, লোকটা আর্তনাদ করে দশ হাত দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। হাত থেকে টর্চ আর পিস্তল ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। তার মাঝে সফদর আলী দৌড়ে লোকটার বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হুঁঙ্কার দিয়ে বলছেন, একটু নড়বে না, নড়লেই আরেকটা দেব, ডাবল করে দেব পাওয়া। আমি বললাম, কথা বলছেন কি? আরেকটা দিয়ে দিন আগে, নড়ছে যে এখনো। লোকটার নড়ার আর কোনো ইচ্ছা নেই, কাতর স্বরে বলল, ইকবাল, আমাকে বাঁচা। আমি মতিন, ঠাকুরপাড়ার মতিন। আমার সম্বিত ফিরে আসে, দৌড়ে টর্চলাইটটা তুলে লোকটার দিকে এগিয়ে যাই, সত্যিই মতিন, চোখে আলো ফেলে আমার চোখ ধাঁধিয়ে রেখেছিল বলে দেখতে পাই নি, না হয় মতিনকে না চেনার কোনো কারণ নেই, ও আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমার মুখে কথা সরে না, তোতলাতে তোতলাতে বলি, তু-তু-তু-তুই– সফদর আলী ততক্ষণে মতিনের বুক থেকে পা সরিয়ে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা কছেন। সে উঠে হাতড়ে হাতড়ে পিস্তলটা তুলে নেয়, বার কয়েক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, বাজারে দেখলাম তোকে। ভাবলাম, তুই যেরকম ভীতু, একটু মজা করি তোর সাথে। সর্বনাশ আরেকটু হলে তো মরেই গিয়েছিলাম! আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম, ইনি সফদর আলী, আমার বন্ধু। মতিন তখনো হাঁপাচ্ছে, কোনোমতে বলল, খালি গল্প শুনেছিলাম স্টান্টগানের, আজ দেখলাম। স্টান্টগান? হ্যাঁ, যেটা দিয়ে মারলেন আমাকে। ও! সফদর আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট হাতলওয়ালা জিনিসটা বের করলেন, এটাকে স্টান্টগান বলে নাকি? জানতাম না তো! জানতেন না মানে? মতিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, লাইসেন্স করান নি? লাইসেন্স? বন্দুক লাইসেন্স করাতে হয় জানেন না? কে বিক্রি করেছে আপনাকে? আমাকে কেউ বিক্রি করে নি, আমি নিজেই তৈরি করেছি। মতিন খানিকক্ষণ অবাক হয়ে সফদর আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম, সফদর আলী হচ্ছেন বিজ্ঞানী মানুষ, অনেক কিছু ইনি তৈরি করেছেন। সফদর আলী বিরস মুখে স্টান্টগানটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, খানিকক্ষণ পর আস্তে-আস্তে বললেন, জন্ম নিতে-নিতে একটু দেরি হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? একটু ঝাজিয়ে উত্তর দিলেন, দেখছেন না, যেটাই তৈরি করি সেটাই আগে আবিষ্কার হয়ে গেছে! বাকি আছে কী? মতিন কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললাম, কাছাকাছি কোনো বাথরুম আছে? তুই যখন বন্দুকটা ধরলি, ভয়ে পেটটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, এখন মনে হচ্ছে— হ্যাঁ, আছে। ঐ তো ওদিকে হঠাৎ করে পেট খারাপ নাকি? সফদর আলী বললেন, নার্ভাস ডাইরিয়া। ভয় পেলে হয়, হঠাৎ করে ইনটেস্টাইনে— ব্যাখ্যাটা শোনার সময় ছিল না, মতিনের সাথে আমি দৌড়ালাম। মতিন কী কাজ করে বলা মুশকিল। পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের লোক। পরিষ্কার করে কখনো বলে না, কে জানে হয়তো বলা নিষেধ। একসাথে দু’জন কলেজে গেছি, কিন্তু এখন
false
humayun_ahmed
শহরের কাউকে খুঁজতে পারে, আইনের বাধা আছে না? তাছাড়া সে নিজেই হচ্ছে আইনের লোক। আইনের লোক বলেই তো আইন ভাঙা সহজ। তা ঠিক। সে আইন ভেঙেছে। আমার কার্ডে তেতাল্লিশটি দাগ পড়ার পরও কিন্তু আমি বেঁচে আছি। চল্লিশটি দাগ পড়ার পর সরকারি নিয়মে দোষী লোকটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। অবাঞ্ছিত কেউ বেঁচে থাকে না, অথচ আমি আছি। হা হা হা। মীর এত শব্দ করে হেসে উঠল যে লীওন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখলেন। তিনি বিরক্ত হয়েছেন। কিনা তা বোঝা গেল না। তার গ্রাসের পানীয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, সুইচ টিপে তিনি আরো পানীয় আনতে বললেন। ট্রেনের গতি আবার বাড়তে শুরু করেছে। বাইরে রীতিমতো ঝড় হচ্ছে। মুষল-ধারে বৃষ্টি পড়ছে। ঘনঘন বাজ পড়ছে। বজপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। ইরিনা লক্ষ করল। মীর চোখ বন্ধ করে আছে। হয়তো ঘুমুচ্ছে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভাবছে। কি ভাবছে কে জানে। ইরিনার এখন আর কেন জানি লোকটির চেহারা খারাপ লাগছে না। হয়তো চোখে সয়ে গেছে। ইরিনারও ঘুম পেয়ে গেল। চমৎকার সকাল। সূর্যের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। আকাশের রঙ ঘন নীল। ছবির মতো সুন্দর একটি শহরে ট্রেন এসে থেমেছে। ট্রেন থেকে নেমে তারা একটি ছোট্ট কাচের ঘরে ঢুকল। এখান থেকে চারদিক দেখা যায়। ইরিনা মুগ্ধ হয়ে গেল। কেউ তাকে বলে দেয় নি, কিন্তু সে বুঝতে পারছে এটা হচ্ছে তৃতীয় শহর। সুখের শহর, দুঃখ এখান থেকে নির্বাসিত। এর আকাশ-বাতাস পর্যন্ত অন্য রকম। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, কী সুন্দর, কী সুন্দর! মীর তার পাশেই, সে কিছু বলল না। হাই তুলল। রাতে তার ঘুম ভালো হয় নি। ঘুম ঘুম লাগছে। তৃতীয় নগরীর সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করছে না। ইরিনা বলল, এখন আমরা কোথায় যাব? মীর হাই চাপতে চাপতে বলল, তুমি এত ব্যস্ত হলে কেন? ওরা ব্যবস্থা করে রেখেছে। যথাসময়ে কোথাও চাপাবে। যথাসময়ে পৌঁছবে। হাতে কিছু সময় থাকলে শহরটা ঘুরে দেখতাম। আমি দেখাদেখির মধ্যে নেই, তোমাকে যেতে হবে একা। আমি ঘুমুবার চেষ্টা করছি। কোথাও যেতে চাইলে যাবে আমাকে জাগাবে না। মীর সত্যি সত্যি ঘুমুবার আয়োজন করল। তারা বসে আছে ছোট্ট একটা ঘরে। এত ছোট যে হাত বাড়ালে দেয়াল এবং ছাদ দুই-ই ছোয়া যায়। এতটুকু ঘরেও চার-পাঁচটা চেয়ার সাজানো। তেমন কোনো আরামদায়ক কিছু নয়। ঘরের দেয়াল অতি স্বচ্ছ কাচ জাতীয় পদার্থের তৈরি। বাইরের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। অরচ লীওন তাদের এখানে বসিয়ে রেখে উধাও হয়েছেন, আর কোনো খোজ নেই। ইরিনা একবার বেরুতে চেষ্টা করল। বেরুবার পথ পেল না। দরজা-টিরজা এখন কিছুই নেই বলে মনে হচ্ছে। অথচ এই ঘরে ঢোকার সময় কোনো বাধা পাওয়া যায় নি। মীর, আপনি কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? চেষ্টা করছি। এটাকে কেমন যেন খাঁচার মতো মনে হচ্ছে। বেরুতে পারছি না। বেরুবার দরকারটা কি? ইরিনার অস্বস্তি লাগছে, এমন নির্জন জায়গা। আশেপাশে একটিও মানুষ নেই, অথচ বাইরের কত চমৎকার সব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মীর, আপনি এরকম চোখ বন্ধ করে থাকবেন? আমার ভয় ভয় লাগছে। ভয় ভয় লাগার কারণ কি? মানুষজন কিচ্ছু নেই। মানুষজন ঠিকই আছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না। কাচের এই ঘরটায় বসে তুমি বাইরের যেসব দৃশ্য দেখছ, তা সত্যি নয়। বানান, মেকি। তার মানে! তার মানে আমি জানি না। টেলিভিশনে যেমন ছবি দেখ, এখানেও তাই দেখছ। একটাও সত্যি নয়। কি করে বুঝলেন? খুব সহজেই বুঝলাম। আমরা ট্রেন থেকে নেমেছি ভোর হবার ঠিক আগে আগে। রোবটটি আমাকে বলল সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে ট্রেন পৌঁছবে। অথচ এই ঘরে বসে আমরা দেখছি সূর্য মাথার ওপরে। তই তো। ইরিনা পরিষ্কার চোখে দেখার চেষ্টা কর এবং আমার মনে হয় এখন থেকে যা দেখবে তাই বিশ্বাস করার অভ্যাসটা ত্যাগ করলে ভালো হবে। এই দেখ আমাদের চারপাশে দৃশ্য এখন বদলে গেল। ইরিনা মুগ্ধ হয়ে দেখল সত্যি সত্যি সব বদলে গেছে। তাদের চারপাশে এখন ঘন নীল সমুদ্র, ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সমুদ্রসারস উড়ছে। সমুদ্রের নীল পানিতে সূৰ্য প্রায় ড়ুবু ড়ুবু। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, অপূর্ব! মীর বলল, আমার মনে হচ্ছে এটা যাত্রীদের বিশ্রামের কোনো জায়গা। অনেকক্ষণ যাদের অপেক্ষা করতে হয় তারা যাতে বিরক্ত না হয় সেই ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। সুন্দর ব্যবস্থা। আপনার কাছে সুন্দর লাগছে না? না। এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আমি দেখি। এটা তো আর স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন নয় তোমাকে বলল কে? পুরোটাই স্বপ্ন। সুন্দর সুন্দর ছবি দেখছ, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘরের চারপাশের দৃশ্য আবার বদলে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে চারপাশেই উচু উচু পাহাড়। পাহরে চূড়ায় বরফ জমেছে। সূর্যের আলোয় সেই বরফ ঝিকমিক করছে। ইরিনা মুগ্ধ গলায় বলল, এবারের দৃশ্য আরো সুন্দর! বলতে বলতেই ছবি কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল। ইরিনার মনে হল ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। কানে ঝিঝি শব্দ। সে কোনোমতে বলল, এসব কী হচ্ছে? মীর ক্লান্ত গলায় বলল, আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদের যেখানে নেবার, সেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় নেবে। যেন… গভীর গাঢ় ঘুমে দুজনেই তলিয়ে যাচ্ছে। ইরিনা প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে জেগে থাকতে। কিছুতেই পারছে না, চোখের সামনের আলো কমে কমে প্ৰায় অন্ধকার হয়ে এল। দূরে তীক্ষ্ম বাঁশির আওয়াজের মতো আওয়াজ। ইরিনা তার মাকে ডাকতে চেষ্টা করল। পারল
false
bongkim
উহারা আমার কাছে রজনীর বৃত্তান্ত সবিশেষ শুনিয়া বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল। পরে রাজচন্দ্রকে আমি নিভৃতে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার কন্যা গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিল কেন জান?” রাজচন্দ্র বলিল, “না। আমি তাহা সর্বদাই ভাবি, কিন্তু কিছুই ঠিকানা করিতে পারি নাই |” আমি বলিলাম, “রজনী জলে ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিল কি দু:খে জান?” রাজচন্দ্র বিস্মিত হইল। বলিল, “রজনীর এমন কি দু:খ, কিছুই ত ভাবিয়া পাই না। সে অন্ধ, এটি বড় দু:খ বটে, কিন্তু তার জন্য এত দিনের পর ডুবিয়া মরিতে যাইবে কেন? তবে, এত বড় মেয়ে, আজিও তাহার বিবাহ হয় নাই। কিন্তু তাহার জন্যও নয়। তাহার ত সম্বন্ধ করিয়া বিবাহ দিতেছিলাম। বিবাহের আগের রাত্রেই পলাইয়াছিল |” আমি নূতন কথা পাইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে পলাইয়াছিল?” রা। হাঁ। আমি। তোমাদিগকে না বলিয়া? রা। কাহাকেও না বলিয়া। আমি। কাহার সহিত সম্বন্ধ করিয়াছিলে? রা। গোপাল বাবুর সঙ্গে। আমি। কে গোপাল বাবু? চাঁপার স্বামী? রা। আপনি সবই ত জানেন। সেই বটে। আমি একটু আলো দেখিলাম। তবে চাঁপা সপত্নীযন্ত্রণাভয়ে রজনীকে প্রবঞ্চনা করিয়া ভ্রাতৃসঙ্গে হুগলী পাঠাইয়াছিল। বোধ হয়, তাহারই পরামর্শে হীরালাল উহার বিনাশে উদ্যোগ পাইয়াছিল। সে কথা কিছু না বলিয়া রাজচন্দ্রকে বলিলাম, “আমি সবই জানি। আমি আরও জানি, তোমায় বলিতেছি। তুমি কিছু লুকাইও না |” রা। কি-আজ্ঞা করুন। আমি। রজনী তোমার কন্যা নহে। রাজচন্দ্র বিস্মিত হইল। বলিল, “সে কি! আমার মেয়ে নয় ত কাহার?” “হরেকৃষ্ণ দাসের |” রাজচন্দ্র কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। শেষে বলিল, “আপনি কে, তাহা জানি না। কিন্তু আপনার পায়ে পড়ি, এ কথা রজনীকে বলিবেন না |” আমি। এখন বলিব না। কিন্তু বলিতে হইবে। আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার সত্য উত্তর দাও। যখন হরেকৃষ্ণ মরিয়া যায়, তখন রজনীর কিছু অলঙ্কার ছিল? রাজচন্দ্র ভীত হইল। বলিল, “আমি ত তাহার অলঙ্কারের কথা কিছু জানি না। অলঙ্কার কিছুই পাই নাই |” আমি। হরেকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তুমি তাহার ত্যক্ত সম্পত্তির সন্ধানে সে দেশে আর গিয়াছিলে? রা। হাঁ, গিয়াছিলাম। গিয়া শুনিলাম, হরেকৃষ্ণের যাহা কিছু ছিল, তাহা পুলিসে লইয়া গিয়াছে। আমি। তাহাতে তুমি কি করিলে? রা। আমি আর কি করিব? আমি পুলিসকে বড় ভয় করি, রজনীর বালাচুরি মোকদ্দমায় বড় ভুগিয়াছিলাম। আমি পুলিসের নাম শুনিয়া আর কিছু বলিলাম না। আমি। রজনীর বালাচুরি মোকদ্দমা কিরূপ? রা। রজনীর অন্নপ্রাশনের সময় তাহার বালা চুরি গিয়াছিল। চোর ধরা পড়িয়াছিল। বর্ধমানে তাহার মোকদ্দমা হইয়াছিল। এই কলিকাতা হইতে বর্ধমানে আমাকে সাক্ষ্য দিতে যাইতে হইয়াছিল। বড় ভুগিয়াছিলাম। আমি পথ দেখিতে পাইলাম। তৃতীয় খণ্ড শচীন্দ্র বক্তা প্রথম পরিচ্ছেদ এ ভার আমার প্রতি হইয়াছে-রজনীর জীবনচরিত্রের এ অংশ আমাকে লিখিতে হইবে। লিখিব। আমি রজনীর বিবাহের সকল উদ্যোগ করিয়াছিলাম-বিবাহের দিন প্রাতে শুনিলাম যে, রজনী পলাইয়াছে, তাহাকে আর পাওয়া যায় না। তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম, পাইলাম না। কেহ বলিল, সে ভ্রষ্টা। আমি বিশ্বাস করিলাম না। আমি তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছিলাম-শপথ করিতে পারি, সে কখন ভ্রষ্টা হইতে পারে না। তবে ইহা হইতে পারে যে, সে কুমারী, কৌমার্যাবস্থাতেই কাহারও প্রণয়াসক্ত হইয়া বিবাহশঙ্কায় গৃহত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু ইহাতেও দুইটি আপত্তি ; প্রথম, সে অন্ধ, সে কি প্রকারে সাহস করিয়া আশ্রয় ত্যাগ করিয়া যাইবে? দ্বিতীয়ত:, যে অন্ধ, সে কি প্রণয়াসক্ত হইতে পারে? মনে করিলাম, কদাচ না। কেহ হাসিও না, আমার মত গণ্ডমূর্খ অনেক আছে। আমরা খান দুই তিন বহি পড়িয়া, মনে করি, জগতের চেতনাচেতনের গূঢ়াদপি গূঢ় তত্ত্ব সকলই নখদর্পণ করিয়া ফেলিয়াছি, যাহা আমাদের বুদ্ধিতে ধরে না, তাহা বিশ্বাস করি না। ঈশ্বর মানি না, কেন না, আমাদের ক্ষুদ্র বিচারশক্তিতে সে বৃহত্তত্ত্বের মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারি না। অন্ধের রূপোন্মাদ কি প্রকারে বুঝিব? সন্ধান করিতে করিতে জানিলাম যে, যে রাত্রি হইতে রজনী অদৃশ্য হইয়াছে, সেই রাত্রি হইতে হীরালালও অদৃশ্য হইয়াছে। সকলে বলিতে লাগিল, হীরালালের সঙ্গে সে কুলত্যাগ করিয়া গিয়াছে। অগত্যা আমি এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, হীরালাল রজনীকে ফাঁকি দিয়া লইয়া গিয়াছে। রজনী পরমা সুন্দরী ; কাণা হউক, এমন লোক নাই, যে তাহার রূপে মুগ্ধ হইবে না। হীরালাল তাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া, তাহাকে বঞ্চনা করিয়া লইয়া গিয়াছে। অন্ধকে বঞ্চনা করা বড় সুসাধ্য। কিছুদিন পরে হীরালাল দেখা দিল। আমি তাহাকে বলিলাম, “তুমি রজনীর সম্বাদ জান?”-সে বলিল-“না |” কি করিব। নালিশ, ফরিয়াদ হইতে পারে না। আমার জ্যেষ্ঠকে বলিলাম। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “রাস্কালকে মার |” কিন্তু মারিয়া কি হইবে? আমি সম্বাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে আরম্ভ করিলাম। যে রজনীর সন্ধান দিবে, তাহাকে অর্থ পুরস্কার দিব, ঘোষণা করিলাম। কিছু ফল ফলিল না। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ রজনী জন্মান্ধ, কিন্তু তাহার চক্ষু দেখিলে অন্ধ বলিয়া বোধ হয় না। চক্ষে দেখিতে কোন দোষ নাই। চক্ষু বৃহৎ, সুনীল, ভ্রমরকৃষ্ণতারাবিশিষ্ট। অতি সুন্দর চক্ষু- কিন্তু কটাক্ষ নাই। চাক্ষুষ স্নায়ুর দোষে অন্ধ। স্নায়ুর নিশ্চেষ্টতাবশত: রেটিনাস্থিত প্রতিবিম্ব মস্তিষ্কে গৃহীত হয় না। রজনী সর্বাঙ্গসুন্দরী; বর্ণ উদ্ভেদ-প্রমুখ নিতান্ত নবীন কদলীপত্রের ন্যায় গৌর, গঠন বর্ষাজলপূর্ণ তরঙ্গিণীর ন্যায় সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত; মুখকান্তি গম্ভীর ; গতি, অঙ্গভঙ্গী সকল মৃদু, স্থির এবং অন্ধতাবশত: সর্বদা সঙ্কোচজ্ঞাপক ; হাস্য দু:খময়। সচরাচর এই স্থিরপ্রকৃতি সুন্দর শরীরে সেই কটাক্ষহীন দৃষ্টি দেখিয়া কোন ভাস্কর্যপটু শিল্পকরের যত্ননির্মিত প্রস্তরময়ী স্ত্রীমূর্তি বলিয়া বোধ হইত। রজনীকে প্রথম দেখিয়াই আমার বিশ্বাস হইয়াছিল যে, এই সৌন্দর্য অনিন্দনীয় হইলেও মুগ্ধকর নহে। রজনী রূপবতী, কিন্তু তাহার রূপ দেখিয়া কেহ কখন পাগল হইবে না। তাহার
false
shordindu
সহজ? আপনি পারেন?’ ‘সব খবর পেলে হয়তো পারি।’ ‘বাইরের লোককে সব খবর জানানো যদিও আমাদের রীতি বিরুদ্ধ, তবু যতটুকু জানি আপনাকে বলতে পারি।’ ‘বেশ‌, বলুন! নটবর নস্করের আত্মীয়-স্বজনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে?’ ‘না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে‌, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।’ ‘ময়না তদন্তের ফলাফল কি রকম?’ ‘বুকের হাড় ফুটো করে গুলি হৃদযন্ত্রে ঢুকেছে। পিস্তলের সঙ্গে গুলি মিলিয়ে দেখা গেছে‌, গুলি ওই পিস্তল থেকেই বেরিয়েছে।’ ‘আর কিছু?’ শিরীর সুস্থই ছিল‌, কিন্তু চোখে ছানি পড়বার উপক্রম হয়েছিল।’ ‘পিস্তলের মালিক কে?’ ‘মার্কিন ফৌজি পিস্তল‌, কালোবাজারে কিনতে পাওয়া যায়। মালিকের নাম জানার উপায় নেই।’ ‘ঘর তল্লাশ করে কিছু পেয়েছেন?’ ‘দরকারী জিনিস যা পেয়েছি তা ওই টেবিলের ওপর আছে। একটা ডায়েরি‌, গোটা পাঁচেক টাকা‌, ব্যাঙ্কের পাস-বুক‌, আর একটা আদালতের রায়ের বাজাপ্ত নকল। আপনি ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন।’ ঘরের কোণে একটা টেবিল ছিল‌, ব্যোমকেশ উঠিয়া সেইদিকে গেল‌, আমি গোলাম না। প্রণব দারোগা লোক ভাল নয়‌, তিনি যদি আপত্তি করেন একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হইবে। বসিয়া বসিয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ ব্যাঙ্কের খাতা পরীক্ষা করিল, ডায়েরির পাতা উল্টাইল, স্ট্যাম্প কাগজে লেখা আদালতী দলিল মন দিয়া পড়িল। তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, ‘দেখা হয়েছে।’ প্রণব দারোগার দুষ্টবুদ্ধি এতক্ষণে আবার চাড়া দিয়াছে‌, তিনি মিটমিটি চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আমি যা-যা দেখেছি আপনিও তাই দেখলেন। আসামীর নাম-ধাম সব জানতে পেরে গেছেন?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, পেরেছি।’ ভ্রূ আকাশে তুলিয়া প্রণববাবু বলিলেন‌, ‘বলেন কি! এরি মধ্যে! আপনার তো ভারি বুদ্ধি! তা দয়া করে আসামীর নামটা আমায় বলুন‌, আমি তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলি?’ ব্যোমকেশ চোয়াল শক্ত করিয়া বলিল‌, ‘আসামীর নাম আপনাকে বলব না দারোগাবাবু; ওটা আমার নিজস্ব আবিষ্কার। আপনি এই কাজের জন্যে মাইনে খান‌, আপনাকে নিজে থেকে খুঁজে বার করতে হবে। তবে একটু সাহায্য করতে পারি। মেসের পাশের গলিটা খুঁজে দেখবেন।’ ‘সেখানে আসামী তার পদচিহ্ন রেখে গেছে নাকি! খিক্‌ খিক্‌।’ ‘না‌, পদচিহ্নের চেয়েও গুরুতর চিহ্ন রেখে গেছে।—আর একটা কথা জানিয়ে যাই। দুচার দিনের মধ্যেই আমি অজিতকে নিয়ে কটকে চলে যাব। আপনার যদি সাহস থাকে তাকে আটকে রাখুন।–চল অজিত।’ থানা হইতে বাহির হইয়া আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলাম‌, ‘কে আসামী‌, ধরতে পেরেছ?’ ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল‌, ‘থানায় আসার আগেই জানতে পেরেছি‌, কিন্তু প্রণব দরোগা একটা ইয়ে। বুদ্ধি নেই তা নয়‌, বিপরীত বুদ্ধি। ও কোনো কালে নটবর নস্করের খুনীকে ধরতে পারবে না।’ প্রশ্ন করিলাম‌, নটবর নস্করের খুনী কে? চেনা লোক?’ ‘পরে বলব। আপাতত এইটুকু জেনে রাখো যে‌, নটবর নস্করের পেশা ছিল ব্ল্যাকমেল করা। তুমি বাসায় ফিরে যাও‌, আমি অফিস-পাড়ায় যাচ্ছি। কলকাতাতেও গডফ্রে ব্রাউনের প্রকাণ্ড ব্যবসা আছে‌, তাদের অফিসে কিছু খোঁজ-খবর পাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা‌, আমার ফিরতে দেরি হবে।’ হাত নাড়িয়া সে চলিয়া গেল। আমি একাকী বাসায় ফিরিলাম। ব্যোমকেশ ফিরিল বেলা তখন দেড়টা। স্নানাহারের পর সে বলিল‌, ‘একটা কাজ করতে হবে; বিকেলবেলা তুমি গিয়ে রামবাবুকে‌, বনমালীবাবুকে এবং ভূপেশবাবুকে চায়ের নেমন্তন্ন করে আসবে। সন্ধ্যের পর এই ঘরে সভা বসবে।’ ‘তথাস্তু। কিন্তু ব্যাপার কি! গডফ্রে ব্রাউনের অফিসে গিয়েছিলে কেন?’ ‘থানায় নটবর নস্করের জিনিসগুলোর মধ্যে একটা আদালতের রায় ছিল। সেটা পড়ে দেখলাম রাসবিহারী বিশ্বাস এবং বনবিহারী বিশ্বাস নামে দুই ভাই গডফ্রে ব্ৰাউন কোম্পানির ঢাকা ব্ৰাঞ্চে যথাক্রমে খাজাঞ্চী ও তস্য সহকারী ছিল। সাত বছর আগে তারা অফিসের টাকা চুরির অপরাধে ধরা পড়ে। মামলা হয় এবং বনবিহারীর দু’বছর ও রাসবিহারীর তিন বছর জেল হয়। সেই মোকদ্দমার রায় নটবর নস্কর যোগাড় করেছিল। তারপর তার ডায়েরি খুলে দেখলাম‌, প্রতি মাসে সে রাসবিহারী ও বনবিহারী বিশ্বাসের কাছ থেকে আশি টাকা পায়। গডফ্রে ব্রাউনের অফিসে গিয়ে চুরি-ঘটিত মামলার কথা যাচাই করে এলাম। সত্যি ঘটনা। সন্দেহ রইল না‌, নটবর তাদের ব্ল্যাকমেলা করছিল।’ ‘কিন্তু–রাসবিহারী বনবিহারী–এরা কারা? এদের কোথায় খুঁজে পাবে?’ ‘বেশি দূর খুঁজতে হবে না‌, এই মেসের তিন নম্বর ঘরে তাঁদের পাওয়া যাবে।’ ‘অ্যাঁ। রামবাবু আর বনমালীবাবু!’ ‘হ্যাঁ। তুমি কাছাকাছি আন্দাজ করেছিলে। ওরা মাসতুত ভাই নয়‌, সাক্ষাৎ সহোদর ভাই। তবে যদি চোরে চোরে মাসতুত ভাই এই প্রবাদ-বাক্যের মর্যাদা রাখতে চাও তাহলে মাসতুত ভাই বলতে পার।’ ‘কিন্তু–কিন্তু–এরা তো নটবর নস্করকে খুন করতে পারে না। নটবর যখন খুন হয় তখন তো ওরা—‘ হাত তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ধৈর্য ধারণ কর। আগাগোড়া কাহিনী আজ চায়ের সময় শুনতে পাবে।’ মাড়োয়ারীর দোকানের রকমারি ভাজা ভুজি ও চা দিয়া অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হইয়াছে। প্রথমে দেখা দিলেন ভূপেশবাবু। ধুতি পাঞ্জাবির উপর কাঁধে পাট-করা ধূসর রঙের শাল‌, মুখে উৎসুক হাসি। বলিলেন‌, ‘ব্রিজ খেলার ব্যবস্থা আছে নাকি।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনারা যদি খেলতে চান ব্যবস্থা করা যাবে।’ কিছুক্ষণ পরে রামবাবু ও বনমালীবাবু আসিলেন। গায়ে গলাবন্ধ কোট‌, চোখে সতর্ক দৃষ্টি। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আসুন আসুন।’ পানাহারের সঙ্গে ব্যোমকেশ সরস বাক্যালাপ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করিলাম‌, রামবাবু ও বনমালীবাবুর আড়ষ্ট ভােব শিথিল হইয়াছে। তাঁহারা সহজভাবে কথাবাতায় যোগ দিতেছেন। মিনিট কুড়ি পরে জলযোগ সমাপ্ত করিয়া রামবাবু চুরুট ধরাইলেন; ব্যোমকেশ ভূপেশবাবুকে সিগারেট দিয়া সিগারেটের টিন বনমালীবাবুর সামনে ধরিল‌, ‘আপনি একটা নিন‌, বনবিহারীবাবু।’ বনমালীবাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি সিগারেট খাই না–বলিয়া একেবারে ফ্যাকাসে হইয়া গেলেন—‘আজ্ঞে—আমার নাম—‘ ‘আপনাদের দুই ভায়েরই প্রকৃত নাম আমি জানি-রাসবিহারী এবং বনবিহারী বিশ্বাস।’–ব্যোমকেশ নিজের চেয়ারে গিয়া বসিল‌, ‘নটবর নস্কর আপনাদের ব্ল্যাকমেল করছিল। আপনারা মাসে মাসে তাকে আশি
false
humayun_ahmed
দেখভালও করছি। স্যার, আমি জানি। কিন্তু বলব না। মিলিটারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস তুমি জানো। এই খবর না দিলে কিন্তু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে। স্যার, আমি কিছুই বলব না! আরে ব্যাটা নিজের জীবন বাঁচা। এখন ইয়া নফসি সময়। বলে দে তারা কোথায় আছে? আমি কোনোদিন ও বলব না। রশিদকে সেই দিনই সন্ধ্যায় হুলারহাট লঞ্চঘাটে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ————- *মূল নাম ব্যবহার করছি না। এই মানুষটির নিদায়তা ও নিষ্ঠুরতার অপরাধ আমার মা ক্ষমা করেছেন। বলে অ্যামিও ক্ষমা করলাম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন–পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া পাকিস্তান সরকারের অন্য কোনো উপায় ছিল না। তিনি বলেন, মার্চের প্রথম দিকে যখন ধারণা করা হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন, তখন তিনি ঢাকায় গিয়ে তার মরহুম পিতার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের মারাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার স্বীকার করে ৩০ হাজার পুলিশ বাহিনী সদস্য, ১৪ হাজার নিয়মিত বাহিনী সদস্য, ৪ হাজার ইপিআর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান রাজাকার অর্ডিনেন্স জারি করেন। রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাহায্যকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। তারা প্রধানত গেরিলাদের খুঁজে বের করা, তাদের আশ্রয়দাতাদের খবর সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া, রেললাইন, ব্রীজ পাহারা দেবে।* রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে খুবই বিনম্র সহানুভূতিশীল আচরণ পাচ্ছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে প্রদেশের জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না এবং নেই।* ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আমাদের প্রিয় ভূমি পাকিস্তানকে খণ্ড করার অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা করছি। রাজনৈতিক চরমপন্থীদের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় আমরা দুঃখ পেয়েছি ও হতাশ হয়েছি।* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক কাজে যোগ দেন। তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছেন এই মর্মে বিবৃতি দেন। ————— * আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিতে আগেও পছন্দ করতেন। এখনো করেন।–লেখক জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বললেন, মানব ইতিহাসের সবচে বিষাদময় ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। ভ্যাটিকান সিটি থেকে জন পোপ পল পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।* ————- * বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মুসলিম দেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কোনো নেতা মুখ খোলেন নি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের লেনিন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্ৰখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ডন পত্রিকায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের নৃশংসতার প্রতিবাদ করে একটি রচনা লিখেন। তিনি সংগ্রামী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ করে একটি কবিতাও রচনা করেন যার শিরোনাম।–পাও সে লাহুকো ধো ডালো– পা থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলো। গভর্নর টিক্কা খান সকল বাঙালি দোষীদের জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। দেশত্যাগীদের ফিরে আসার জন্যে অভ্যর্থনা শিবির খোলার কথা বলা হয়। এক ইস্তাহারে বলা হয়–খাঁটি পাকিস্তানিরা নিৰ্ভয়ে দেশে ফিরতে পারবেন। তাদের ফিরে আসার সুবিধার জন্যে তিনি অভ্যর্থনা শিবির খোলার নির্দেশ দেন।* কবি শামসুর রাহমান ভেতরের দিকের একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছেন। গ্রামের নাম পাড়াতলী। নরসিংদীর পাড়াতলীর যে বাড়িতে তিনি বাস করছেন সেটা মাটির। তার জানালা আছে। গ্রামের মানুষ বড় জানালা পছন্দ করে না। রেলের টিকিটঘরের জানালার মতো ছোট্ট জানালা। সেই জানালায় ঘরের ভেতর আলো-বাতাস কিছুই আসে না। তবুও তো জানালা। কবি জানালার পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছেন। বেতের মোড়াটা এই বাড়ির সবচে আরামদায়ক। একটাই সমস্যা–হেলান দেয়া যায় না। সবসময় ঋজু অবস্থানের কথা মনে রাখতে হয়। অবশ্যি এখন যে সময় সেই সময়ে ঋজু থাকারই কথা। তিনি উঠোনের দুটো বেগুন গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেগুন গাছে বেগুন হয়েছে–অদ্ভুত বেগুন। হাঁসের ডিমের মতো ধবধবে সাদা রঙ। এই জিনিস তিনি আগে দেখেন নি। মনে হচ্ছে গাছে ডিম ফলে আছে। তিনি নাগরিক মানুষ। এখন গ্রামে পড়ে আছেন। গ্রামগঞ্জের অনেক খুঁটিনাটি তাকে আকৃষ্ট করছে। কোনো একটি বিশেষ দৃশ্যে যখন তাঁর চোখ আটকাচ্ছে তিনি মনে মনে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আবৃত্তি করছেন— . কবি সাহেব কি আছেন? কবি সাহেব! কেউ কি তাঁকে খুঁজছে? নাকি তিনি ভুল শুনছেন? মেয়েলি ধরনের এই পুরুষগলা তিনি কি আগেও শুনেছেন? যেখানে তিনি অজ্ঞাত বাস করছেন সেখানে কবি সাহেব হিসেবে কেউ তাকে চেনার কথা না! অপরিচিত কেউ ডাকছে? কবি চমকালেন। এখন দুঃসময়। দুঃসময় অপরিচিত আহ্বানের জন্যে ভালো না। কবি খালি গায়ে আছেন। কড়া সবুজ রঙের লুঙ্গি নাভির উপর পরেছেন। অন্ধকারে তাঁর ফর্সা দুধসাদা শরীর জ্বলজ্বল করছে। এই অবস্থাতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে কিছু দেবার কথা তাঁর মনে হলো না। এই গণ্ড গ্রামে নাগরিক সভ্যতা ভব্যতা দেখাবার কিছু নেই। সুরুচি? দুঃসময়ে সুরুচি প্রথম নির্বাসনে যায়। কবি কি আমাকে চিনেছেন? আমি শাহ কলিম। আপনার খাদেম। আমার খাদেম মানে কী? আমি কি পীর সাহেব? আমার পীর তো অবশ্যই। কলিমুল্লাহ কদমবুসি করার জন্যে নিচু হলো। কবি চমকে সরে গিয়েও কদমবুসির হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। কলিমউল্লাহ হাসিমুখে বলল, আপনাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে লিভিংস্টোনের সাক্ষাৎ পেলাম। তার মানে? আমাজানের জঙ্গলে লিভিংস্টোন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে কমিশন করে একজনকে আমাজানে পাঠানো হলো। তিনি অনেক ঝামেলা করে লিভিংস্টোনের খোঁজে উপস্থিত হলেন। গভীর অরণ্যে একদল কালো মানুষের মধ্যে একজন সাদা মানুষ
false
shunil_gongopaddhay
সময় অঙ্কের মাস্টারমশাই একদিন আমার কান মলে দিয়েছিলেন। তারপর এত বছরে আর কেউ আমার কানে হাত দেয়নি। লোকটি বলল, একবার কান মলে দিলেই তক্ষুনি একেবারে ঘুম ভেঙে যায়। সামনে থেকে ড্রাইভারটি বলল, আমাদের মতন ড্রাইভারদের যখন গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুম আসে, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের কান মলে দিই ভাল করে। টবি হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। নিশ্চয়ই রাস্তায় কোনও কুকুর দেখেছে। পাশের লোকটি বলতে লাগল, টবি, টবি, নো, নো। ঝনঝন শব্দ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, টবির গলায় চেন বাঁধা। কুকুরটা তবু হিংস্রভাবে ডেকেই চলেছে। কাকাবাবুর ইচ্ছে হল, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে। কিন্তু তাঁর হাত যে বাঁধা। ড্রাইভার আর অন্য দুজন লোকের গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, শঙ্খচূড় নিজে আসেনি। এদের মধ্যে রিমোট কন্ট্রোলটা কার কাছে? গাড়িটা চলছে, কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। একটু পরে ড্রাইভার বলল, এই রে, সামনের রাস্তায় জল জমে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। সামনের সিটের লোকটি বলল, থামাও, থামাও, গাড়ি থামাও! ড্রাইভার বলল, বেশি জল নয়, ওপর দিয়ে চলে যেতে পারব। সামনের লোকটি বলল, না, না, না, জলের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানো নিষেধ। আছে। ব্যাক করো, ব্যাক করো। ড্রাইভারটি বলল, অন্য গাড়ি তো যাচ্ছে, অসুবিধে হবে না। এবারে সামনের লোকটি কঠোরভাবে বলল, বললাম না, জলের ওপর দিয়ে যাওয়ার অর্ডার নেই। খানিকটা ব্যাক করো, বাঁ দিক দিয়ে একটা সরু রাস্তা আছে। এর মধ্যে পেছনে অন্য গাড়ি এসে গেছে। একজন লোক নেমে গিয়ে সেইসব গাড়ি সরিয়ে এ-গাড়িটাকে ব্যাক করানো হল। তারপর ঢুকে পড়ল একটা গলিতে। যে নীচে নেমেছিল সে গাড়িতে উঠে পড়ে বলল, এই জ্যামের মধ্যে গাড়ি ব্যাক করানোর কত ঝামেলা। ওইটুকু জলের ওপর দিয়ে চলে গেলে কী হত? অন্যজন বলল, শাট আপ! সারের অর্ডারের ওপর কোনও কথা নয়। কাকাবাবু বললেন, আমাদের পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে? অন্য লোকটি আবার বলল, শাট আপ! কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না! গাড়িটা আস্তে চলছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, মনে হয় রাস্তায় কিছুটা জ্যাম আছে। এক জায়গায় গাড়িটা কয়েক মিনিট থামার পর কাকাবাবু একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলেন। তার মানে, এ-জায়গাটা লেভেল ক্রসিং। আবার কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামল। দরজা খুলে নেমে গেল ওদের একজন। টবিও আবার ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে। গাড়ির দরজা খোলা বন্ধের শব্দ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, লোকটি ফিরে এসেছে। তারপর ওরা কী যেন খেতে শুরু করল। একজন বলল, টবিকে একটা দে। টবি মিষ্টি খেতে ভালবাসে। অন্যজন বলল, রায়চৌধুরীকেও একটা দিবি নাকি? তার সঙ্গী বলল, এ-ব্যাপারে কোনও অর্ডার নেই। তবে, সার তো নিজেই ওকে খাবার খাইয়েছেন। অন্যজন কাকাবাবুকে একটু ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই যে, একটা মিষ্টি খাবেন? কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না। সে বলল, খেয়ে দেখুন না, ভাল মিষ্টি। সে জোর করে কাকাবাবুর মুখে কিছু একটা চেপে ধরল। কাকাবাবু বাধ্য হয়ে একটুখানি খেলেন। তাঁর ভালই লাগল, খেয়ে নিলেন সবটা। এরপর গাড়ি চলতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে, না থেমে। কাকাবাবুর সত্যিই ঘুম এসে যাচ্ছে। কিন্তু হেলান দেওয়ার উপায় নেই। পিঠে যে জিনিসটা বাঁধা, সেটা মনে হচ্ছে ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। একবার তিনি সামনের দিকে ঢুলে পড়তেই পাশের লোকটি তার একটা কান চেপে ধরল। কাকাবাবু বললেন, দাও, ভাল করে কানটা মলেই দাও, আমি ঘুমোতে চাই না। সামনের লোকটি বলল, আর-একটা মিষ্টি খাবেন? কাকাবাবু এবারে আর আপত্তি না করে বললেন, দাও। সেটা খেয়ে তিনি একটু জল চাইলেন। লোকটি বলল, গাড়িতে জলের বোতল নেই, এখন আর থামাও যাবে না, দেরি হয়ে যাবে। ক্রমশ রাস্তায় অন্য গাড়ির হর্নের আওয়াজ বাড়তে লাগল। তারপর ট্রামের আওয়াজ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা কলকাতা শহরে এসে পড়েছে। এবারে পাশের লোকটি তার চোখের বাঁধন আর হাতের শিকল খুলে দিল। দুপাশে কালো কাচ, সামনের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা ছুটছে ময়দানের মধ্য দিয়ে। পাশ দিয়ে যাচ্ছে আলিপুরের ট্রাম। গাড়িটা লালদিঘি ঘুরে এসে থামল রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে। পাশের লোকটি দরজা খুলে বলল, নামুন। কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ কোথায়? ক্রাচ না পেলে আমি হাঁটতে পারব না। লোকটি বলল, ক্রাচ আনা হয়েছে। আধঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই ফিরবেন, আমি এখানে অপেক্ষা করব। আমাদের সার কী বলে দিয়েছেন শুনুন। আপনাকে শেষবারের মতন সাবধান করে দিচ্ছি। আপনি মুখে যা বলবেন, সব আমরা শুনতে পাব। আপনি লিখেলিখে কিছু জানাবার চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হবে। আপনার পিঠ থেকে ওই জিনিসটা খোলার চেষ্টা করলে আপনি কিছুতেই বাঁচবেন না। সঙ্গে সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল চালু হয়ে যাবে। আপনি ছাতু হয়ে যাবেন! আধঘণ্টার বেশি দেরি হলেও তাই হবে। কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি যদি এখন ঘরে না থাকেন? লোকটি বলল, তা হলে ফিরে আসবেন সঙ্গে সঙ্গে। পরে আবার চেষ্টা করা হবে। কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এরা সবদিক ভেবে রেখেছে। হোম সেক্রেটারিকে লিখে জানাবার কথাটা তাঁরও মনে এসেছিল। জানালেও এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সময় মিলবে না। একতলার অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে কাকাবাবু হোম সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সেখানকার একজন বলল, আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? নেই? তা হলে আজ দেখা হবে না। উনি সারাদিন ব্যস্ত থাকবেন। কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি মৃগাঙ্ক আমার ভাই। আমি বিশেষ দরকারে এসেছি। ওকে আমার নামটা শুধু বলুন, তাতেই কাজ হবে। কর্মচারীটি টেলিফোনে হোম সেক্রেটারির সঙ্গে
false
bongkim
নাই। এক্ষণে মার্জ্জারসুন্দরী, নির্জ্জাল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, “মেও!” বলিতে পারি না, বুঝি, তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল; বুঝি, মার্জ্জার মনে মনে হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া ভাবিতেছিল, “কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।” বুঝি সে “মেও!” শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব, “তোমার দুধ ত খাইয়া বসিয়া আছি-এখন বল কি?” বলি কি? আমি ত ঠিক করিতে পারিলাম না। দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়ালে দুধ খাইয়া গেলে, তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে যাইতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকুলে কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কি জানি, এই মার্জ্জারী যদি স্বজাতি-মণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া, সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগর্ব্বে মার্জ্জারী প্রতি ধাবমান হইলাম। মার্জ্জারী কমলাকান্তকে চিনিত; সে যষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল, “মেও!” প্রশ্ন বুঝিতে পারিয়া যষ্টি ত্যাগ করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া হুঁকা লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জ্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম যে, বিড়াল বলিতেছে, “মারপিট কেন? স্থির হইয়া হুঁকা হাতে করিয়া, একটু বিচার করিয়া দেখ দেখি? এ সংসারে ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস, সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন? তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কি? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে-আমাদের কি নাই? তোমরা খাও, আমাদের আপত্তি নাই; কিন্তু আমরা খাইলেই তোমরা কোন্ শাস্ত্রানুসারে ঠেঙ্গা লাঠি লইয়া মারিতে আইস, তাহা আমি বহু অনুসন্ধানে পাইলাম না। তোমরা আমার কাছে কিছু উপদেশ গ্রহণ কর। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না। তোমাদের বিদ্যালয়সকল দেখিয়া আমার বোধ হয়, তোমরা এত দিনে এ কথাটি বুঝিতে পারিয়াছ। “দেখ, শয্যাশায়ী মনুষ্য! ধর্ম্ম কি? পরোপকারই পরম ধর্ম্ম। এই দুগ্ধটুকু পান করিয়া আমার পরম উপকার হইয়াছে। তোমার আহরিত দুগ্ধে এই পরোপকার সিদ্ধ হইল-অতএব তুমি সেই পরম ধর্ম্মের ফলভাগী-আমি চুরিই করি, আর যাই করি, আমি তোমার ধর্ম্মসঞ্চয়ের মূলীভূত কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া, আমার প্রশংসা কর। আমি তোমার ধর্ম্মের সহায়। “দেখ, আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেক চোর অপেক্ষাও অধার্ম্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে। অধর্ম্ম চোরের নহে-চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়; চুরির মূল যে কৃপণ, তাহার দণ্ড হয় না কেন? “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নর্দমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা, ফাঁপরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না-সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে? “দেখ, যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালঙ্কার আসিয়া তোমার দুধটুকু খাইয়া যাইতেন, তবে তুমি কি তাঁহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে? বরং যোড়হাত করিয়া বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব? তবে আমার বেলা লাঠি কেন? তুমি বলিবে, তাঁহারা অতি পণ্ডিত, বড় মান্য লোক। পণ্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা তাঁহাদের ক্ষুধা বেশী? তা ত নয়-তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ-দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয়, তাহার জন্য ভোজের আয়োজন কর-আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দণ্ড কর-ছি! ছি! “দেখ, আমাদিগের দশা দেখ, দেখ প্রাচীরে প্রাচীরে, প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে, প্রাসাদে, প্রাসাদে, মেও মেও করিয়া আমরা চারি দিক্ দৃষ্টি করিতেছি-কেহ আমাদিগকে মাছের কাঁটাখানা ফেলিয়া দেয় না। যদি কেহ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হইতে পারিল-গৃহমার্জ্জার হইয়া বৃদ্ধের নিকট যুবতী ভার্য্যার সহোদর, বা মূর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্চ খেলওয়ারের স্থানীয় হইয়া থাকিতে পারিল-তবেই তাহার পুষ্টি। তাহার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয়, এবং তাহাদের রূপের ছটা দেখিয়া, অনেক মার্জ্জার কবি হইয়া পড়ে। “আর, আমাদিগের দশা দেখ-আহারাভাবে উদর কৃশ, অস্থি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত, দাঁত বাহির হইয়াছে-জিহ্বা ঝুলিয়া পড়িয়াছে-অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, ‘মেও! মেও! খাইতে পাই না!’- আমাদের কালো চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না! এ পৃথিবীর মৎস্য মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও-নহিলে চুরি করিব। আমাদের কৃষ্ণ চর্ম্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয় না? চোরের দণ্ড আছে, নির্দ্দয়তার কি দণ্ড নাই? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দণ্ড
false
humayun_ahmed
যাই। জোবেদ আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে আমি ভালই আছি। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কাজে কর্মে ব্যস্ত আছি। তবে মাঝে মধ্যে পুরানো দিনের কথা মনে হয়। তখন মনটা খুব খারাপ হয়। পুরানো কোন কথা? তুই যখন চাকরি করতি। ঢাকার বাইরে থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরতি। বাপ ব্যাটা এক সঙ্গে ভাত খেতাম। মনে নেই ঔ যে কাতল মাছের বিরাট এক মাথা তুই আমার পাতে তুলে দিলি। তবে এইসব ভেবে মন খারাপ করি না। মন খারাপ করলেতো কোন লাভ নেই। শুধু শুধু মন খারাপ করব কেন? নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন। পোলাও এবং মুরগির কোরমা। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে কারণ অর্ণব খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আজ রাতে সে। বাবার সঙ্গে থাকবে। অর্ণব গভীর আগ্রহে বাবার কর্মকান্ড দেখছে। নান্টু ভাই। ছেলের আগ্রহ দেখেও মজা পাচ্ছেন। তিনি ফরহাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ফরহাদ এলে তাকে ডিম আনতে পাঠাবেন। ফার্মের ডিম না, দেশী ডিম। ডিমের পুডিং বানাতে হবে। ডিমের পুডিং ছেলের খুব পছন্দ। রান্না শেষ করেই ভিডিওর দোকানে যেতে হবে। মিকি মাউসের ক্যাসেট আনতে হবে। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা বেটা মিলে ক্যাসেট দেখা হবে। যে ভাবেই হোক ছেলেকে আনন্দে রাখতে হবে। আজ অর্ণবের দুঃখের দিন। কারণ আজ সন্ধ্যায় তার মার বিয়ে। মা-বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে ছেলে মেয়ের উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ। সেই জন্যেই বোধ হয় শর্মিলা এত সহজে ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে। নান্টু বলল, মনটা খারাপ না-কি রে ব্যাটা? অর্ণব বলল, না। কখনোই কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ করবি না। সব সময় ফুর্তি। অর্ণব পা দুলাতে দুলাতে বলল, আচ্ছা। আর এই যে আমি এক জায়গায় থাকছি, তোর মা অন্য জায়গায় থাকছে। এটাও কোন ব্যাপার না। তোর জন্যে বরং লাভ। তুই একটা জায়গার বদলে দুটা জায়গা পাচ্ছিস। হুঁ। অর্ণবকে এখন কেন জানি অবোধ শিশু মনে হচ্ছে না। সে কেমন বয়স্ক মানুষের মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। নান্টুর মনে হচ্ছে অর্ণবের সঙ্গে জটিল সংসারিক বিষয় নিয়ে আলাপ করা যায়, এবং আলাপ করাই উচিত। এই পৃথিবীতে সবচে বড় বান্ধবী হয় মা এবং কন্যা, এবং সবচে বড় বন্ধু পিতা ও পুত্র। দুই বন্ধু জটিল আলাপ যদি না করে, কে করবে? অর্ণব। হুঁ। তোর মার আজ যে বিয়ে হচ্ছে সেই লোকটা কেমন? হুঁ। তোকে আদর করে? হুঁ। বেশি? হুঁ। আমার চেয়েও বেশি? একটু বেশি। ছেলের শেষ উত্তরটা নান্টুর ভাল লাগল না। নিজেকে সে এই ভেবে সান্তনা দিল যে ছেলে মানুষ, না ভেবে চিন্তে কথা বলছে। সে ঠিক করে রাখল যে ছেলেকে সত্যি ভালবাসা এবং নকল ভালবাসার মধ্যে প্রভেদটা বুঝতে হবে। তবে এখন না, একটু বড় হলেই বুঝতে হবে। সব কিছুরই একটা সময় আছে। তোর মা আমার সম্পর্কে তোকে কিছু বলে? না। ভাল মন্দ কিছুই বলে না? অর্ণব বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে বলল–পেপসি খাব। নান্টু বলল, একটু ধৈর্য ধরে বস বাপধন। তোর ফরহাদ চাচু চলে আসবে। সে এলেই তাকে পেপসি আর ডিম আনতে পাঠাব। ডিমের পুডিং বানাব। ডিমের পুডিং কি তোর পছন্দ? হুঁ। ফরহাদ চাচুকে কি পছন্দ? হুঁ। ফরহাদ খুবই ভাল ছেলে। এরকম ভাল ছেলে বাংলাদেশে নাই। ভাল ছেলেদের কপালে দুঃখ থাকে। এই জন্যে তার কপালেও দুঃখ। নান্টু আশা করেছিল ছেলে বলবে, কেন দুঃখ? অর্ণব তা করল না। সে আগের মতই পা দুলাতে লাগল। নান্টুর ইচ্ছা করছে ফরহাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে। অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে ধারণা হওয়া দরকার। তাহলে বয়স কালে দুঃখী মানুষের প্রতি মমতা হয়। নান্টু গরম ঘিয়ে চাল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, যে মেয়েটির সঙ্গে ফরহাদ চাচুর বিয়ের কথা হয়েছিল তার একটা ভয়ংকর অসুখ করেছে। খুবই ভয়ংকর অসুখ। সে চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে গেছে। বুঝতে পারছিস? হুঁ। তোর ফরহাদ চাচুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও সঙ্গে যাবে। টাকা নেই যাবে কি ভাবে? এখন সে পাগলের মত রাস্তায় হাঁটে। রাতে ঘুমায় না। যতবারই আমার ঘুম ভাঙ্গে আমি দেখি সে চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। আমার চোখে পানি এসে যায়। অর্ণব বলল, বাবা পেপসি খাব। ধৈর্য ধর বাবা। একটু ধৈর্য ধর। জীবনে বড় হতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্য ইংরেজি কি জানিস? পেশেন্স। আমার ধৈর্য ছিল না বলে—আজ এই দশা। টিভি দেখবি। টিভি ছেড়ে দেব? না। এটা ভাল। দিনরাত টিভি দেখা কোন কাজের কথা না। চোখের ক্ষতি হয়। নান্টু পোলাও এ পানি দিয়ে পাতিলের মুখে ঢাকনা দিয়ে ছেলের কাছে এসে বসল। সে সামান্য উদ্বিগ্ন। কারণ ভাজা চালে গরম পানি দেয়ার কথা, সে দিয়েছে ঠাণ্ডা পানি। পোলাও হয়ত বা নরম হয়ে যাবে। অর্ণব। হুঁ। তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আজ একটা সুসংবাদ আছে। সে মেসে এলেই সুসংবাদটা দেব তারপর দেখব সে কত খুশি হয়। সুসংবাদটা কি জানতে চাস? না। এটাতো বাবা ঠিক না। মানুষের সুখের সংবাদ, দুঃখের সংবাদ সব জানার আগ্রহ থাকতে হবে। সুসংবাদটা হল তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আমি টাকা জোগাড় করেছি। এখন শুধু একটা পাসপোর্ট করিয়ে প্লেনে তুলে দেয়া। পাসপোর্ট বের করা একদিনের মামলা। ইনশাল্লাহ আগামী পরশুর ফ্লাইটে তাকে তুলে দেব। বাবা কাজটা ভাল করেছি না? জানি না। খবরটা যখন তাকে দেব সে
false
toslima_nasrin
সাকের নাম-টাম রাখতে হত। রত্না হেসেছিল শুনে। বলেছিল–বিয়ে না করাই ভাল, ক’দিনের মাত্র জীবন। বন্ধনহীন কাটিয়ে দেওয়াই তো ভাল। —তাই বুঝি আপনিও ওপথ মাড়াচ্ছেন না। —ঠিক তাই। —ঐ অবশ্য একদিক থেকে ভালই। —ঐকই সিদ্ধান্ত হলে আপনার আমার বন্ধুত্ব জামবে ভাল। —বন্ধুত্বের খুব বড় অর্থকরি আমি। দু-একটা সিদ্ধান্ত মিললেই বন্ধু হওয়া যায় নাকি! —আপনার বন্ধু হতে গেলে বুঝি খুব সাধনা করতে হবে? সূরঞ্জন জোরে হেসে উঠে বলেছিল—আমার কি এত সৌভাগ্য হবে নাকি? –আত্মবিশ্বাস খুব কম বুঝি আপনার? –না সে কথা না। নিজেকে বিশ্বাস আছে। অন্যকে বিশ্বাস নেই। —আমাকে বিশ্বাস করে দেখুন তো। সূরঞ্জনের সেদিন সারাদিন মন ভাল ছিল। আজ আবার রত্নার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে তার, সম্ভবত মন ভাল করবার জন্য। ইদানীং সে তাই করে, কিছুতে মন খারাপ হলে রত্নাকে স্মরণ করে। রত্না আছে কেমন? একবার যাবে নাকি আজিমপুরে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে–কেমন আছেন রত্না মিত্ৰ?’ প্রত্না কি সামান্য অপ্রস্তুত হবে তাকে দেখে? সুরঞ্জন স্থির করতে পারে না তার কি করা উচিত। সাম্প্রদায়িক সম্রাসের কারণে এক ধরনের হিন্দু পুনর্মিলনী হচ্ছে, তা সে অনুমান করে। আর রত্না নিশ্চয় অবাক হবে না, ভাববে। এ সময় হিন্দুরা হিন্দুদের খোঁজ নিচ্ছে, দুঃসময়ে যখন পাশেই দাঁড়াচ্ছে সবাই, তখন, হঠাৎ, কোনও নিমন্ত্রণ ছাড়াই সুরঞ্জন নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারে রত্নার সামনে। রিক্সাকে আজিমপুরের দিকে ঘুরতে বলে সে। রত্না তেমন লম্বা নয়, সুরঞ্জনের কাঁধের নীচে পড়ে, ফসর্ণ গোল মুখ, কিন্তু ওর চোখে কী যে অতল বিষন্নতা, সুরঞ্জন থাই পায় না। সে বুক পকেট থেকে টেলিফোন ইনডেক্সে লিখে রাখা ঠিকানাটি বের করে বাড়িটি খোঁজে। চাইলে খুঁজে পাবে না এমন কী হয়! রত্না বাড়িতে নেই। দরজা সামান্য ফাঁক করে বুড়োমত এক লোক বললেন–আপনার নাম কি? —সুরঞ্জন। —ও তো ঢাকার বাইরে গেছে। —কবে? কোথায়? সুরঞ্জন নিজেই তার কণ্ঠস্বরে আবেগ বা আকুলতা টের পেয়ে সামান্য লজা পায়। —সিলেট। –কবে ফিরবে জানেন কিছু? —না। সিলেটে কি অফিসের কাজে গেছে রত্না নাকি বেড়াতে, নাকি পালিয়েছে? নাকি আদৌ সিলেট যায়নি, বলা হচ্ছে সিলেট। কিন্তু সুরঞ্জন নাম শুনে, যেহেতু এটি ‘হিন্দু নাম’, লুকোবার তো কিছু নেই—এরকম ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জন আজিমপুরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এখানে কেউ তাকে হিন্দু বলে চিনতে পারছে না। টুপি মাথার পথচারী, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তপ্ত যুবকেরা, রাস্তার টোকাই কিশোরেরা কেউ যে তাকে চিনতে পারছে না। এ বেশ মজার ব্যাপার বটে। যদি ওরা চিনতে পারে, যদি ওদের ইচ্ছে করে চ্যাংদোলা করে কবরস্থানে ফেলে আসবে তাকে, সুরঞ্জনের কি একার শক্তি হবে নিজেকে বাঁচায়! তার বুকের ভেতর ঢিপিটিপ শব্দটি আবার শুরু হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখে সে ঘািমছে। পরনে কোনও গরম জামা নেই তার, পাতলা একটি শার্ট, শার্টের ভেতর সূচের মত হাওয়া ঢুকছে, অথচ তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে হাঁটতে পলাশি পৌঁছে যায় সুরঞ্জন। পলাশি যখন এসেছেই, একবার নির্মলেন্দু গুণের খবর নেওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়িদের জন্য কলোনি আছে পলাশিতে। কলোনির মালির ঘরটি ভাড়া নিয়ে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ। সত্যভাষী এই মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা সুরঞ্জনের। দরজায় টোকা পড়লেই পাল্লা হাট করে খুলে দেয় দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে। নির্মলেন্দু গুণ বিছানায় পা তুলে বসে মন দিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। সুরঞ্জনকে দেখেই সুর করে বলে উঠলেন—‘এস এস এস আমার ঘরে এস, আমার ঘরে…।‘ —টিভিতে দেখার কি আছে? —বিজ্ঞাপন দেখি। সানলাইট ব্যাটারি, জিয়া সিল্ক শাড়ি, পেপসি জেল টুথপেস্ট-এর বিজ্ঞাপন। হামদ নাত দেখি। কোরানের বাণী দেখি। সুরঞ্জন হেসে ওঠে। বলে—সারাদিন এই করেই কাটে আপনার? বাইরে বের-টের হননি নিশ্চয়? —আমার বাড়িতে চার বছরের এক মুসলমান ছেলে থাকে। ওর ভরসায় তো বেঁচে আছি। কাল অসীমের বাড়ি গেলাম, ও আগে আগে গেল, আমি পেছন পেছন। সুরঞ্জন হেসে ওঠে আবার। বলে—এই যে না দেখে দরজা খুলে দিলেন। যদি অন্য কেউ হত? গুণ হেসে বলেন–কাল রাত দুটোর সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মিছিল করবার প্ল্যান করছিল, হিন্দুদের গাল দিয়ে কী কী শ্লোগান দেওয়া যায়, আলোচনা চলছিল। হঠাৎ হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে, গেলি?’ ওরা সরে গেল। আর আমার চুল দাড়ি দেখে অনেকে তো ভাবে আমি মুসলমান, মৌলভি। —কবিতা লেখেন না? —না। ওসব লিখে কি হবে। ছেড়ে দিয়েছি। –রাতে নাকি আজিমপুর বাজারে জুয়ো খেলেন? –হ্যাঁ। সময় কাটাই। তবে ক’দিন তো যাচ্ছি না। –কেন? –বিছানা থেকেই নামি না, ভয়ে। মনে হয় নামলেই বুঝি ওরা ধরে ফেলবে। —টিভিতে কিছু বলছে, মন্দির ভাঙা-টাঙা কিছু দেখাচ্ছে? —আরে না। টিভি দেখলে মনে হবে এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে দাঙ্গা-টাঙ্গা কিছু ঘটছে না। যা কিছু ঘটছে ভারতে। —সেদিন একজন বলল, ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার দাঙ্গা হয়েছে। তবু তো ভারতের মুসলমান দেশ ত্যাগ করছে না। কিন্তু এখানকার হিন্দুদের এক পা থাকে বাংলাদেশে, আরেক পা ভারতে। অৰ্থাৎ ভারতের মুসলমানরা লড়াই করছে, আর বাংলাদেশের হিন্দুরা পালাচ্ছে। গুণ গভীর হয়ে বলেন-ওখানকার মুসলমানরা লড়াই করতেই পারে। ভারত সেকুলার রাষ্ট্র। আর এখানে ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্ষমতায়। এখানে আবার লড়াই কিসের। এখানে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের কি লড়াই করবার জোর থাকে? —এসব নিয়ে কিছু লেখেন না কেন? —লিখতে তো ইচ্ছে করেই। লিখলে আবার ভারতের দালাল বলে গাল দেবে। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করেই লিখি
false
shomresh
নয়। আপনি আজকের রাতটা এখানকার হোটেলে থাকুন। থানার কাছে রুবি বোর্ডিং নামে একটা সাধারণ হোটেল পাবেন। কাল সকালে আসুন। আমি ভেবে দেখি। হরিপদ সেনের মুখে হাসি ফুটল, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। শিলিগুড়ির দিল্লি হোটেল আমার পরিচিত। ওখান থেকে আসতে ঘণ্টাখানেকও লাগবে না। জিনিসপত্র সেখানেই রেখে এসেছি। কাল তা হলে আসব? বেশ। আপনার গাড়িতে কাগজপত্র আছে দিয়ে যান। নিশ্চয়ই। আপনাকে দক্ষিণা বাবদ কত দিতে হবে এখন? দক্ষিণা পরে। আপাতত খরচ বাবদ হাজার তিনেক দেবেন। যদি কেস হাতে না নিই তা হলে আগামীকাল টাকা ফেরত পাবেন। হরিপদ সেন তৈরি হয়েই এসেছিলেন। পকেট থেকে একটা মোটা বান্ডিল বের করে গুনে-গুনে তিন হাজার টেবিলে রাখলেন। রেখে বললেন, কেসটা রিফিউজ করবেন না মিস্টার সোম। প্লিজ। অমলদা কোনও কথা না বলে অর্জুনকে ইঙ্গিত করলেন হরিপদ সেনের সঙ্গে যেতে। বাগান পেরিয়ে গাড়ির পেছনের সিটের নীচে ফেলে রাখা একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে মোটা চওড়া খাম বের করে ভদ্রলোক অর্জুনের হাতে। দিলেন। অর্জুন বললেন, এগুলো এভাবে ফেলে রেখেছেন? ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে হরিপদ জবাব দিলেন, বাজারের ব্যাগে রেখেছি বলে কেউ সন্দেহ করবে না। আচ্ছা, আসি। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে অর্জুন ভেতরে এসে অমল সোমের হাতে প্যাকেটটা দিল। তিনি সেটা নিয়ে বললেন, বেশির ভাগ অপরাধের পেছনে কাজ করে মানুষের লোভ। ও হ্যাঁ, বিষ্ণুসাহেব এখানে আসছেন। তখন খবরটা বলা হয়নি। কাল চিঠি পেয়েছি। বিষ্টুসাহেব? চিৎকার করে উঠল অর্জুন। আনন্দে। কালিম্পং-এর বিষ্টুসাহেব। এখন আমেরিকায় আছেন। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। সে কিছু বলার আগেই অমলদা ভাঁজ করা কাগজটা এগিয়ে দিলেন, এটা পড়ো আগে। কাগজটা খুলল অর্জুন। সুন্দর হাতের লেখা : হরিপদ সেন। যা করছ তাই করে খাও। নন্দলালের সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ালে হাত খসে যাবে : কালাপাহাড়। নেতাজির স্ট্যাচুটাকে বাঁ দিকে রেখে করলা সেতুর ওপর উঠে বাইকটাকে থামাল অর্জুন। একপাশে সেটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রেলিঙে ভর করে নদীর দিকে তাকাল। এখন নদীর জল কচুরিপানায় ছাওয়া। আর একটু দূরে যেখানে করলা গিয়ে তিস্তায় পড়েছে, সেখানে জল স্থির হয়ে গেছে চড়া ওঠায়। এই জায়গাটা বড় ছিমছাম, নির্জন। অর্জুন একটা সিগারেট ধরাল। গত বছর ভোট দিয়েছে সে। এখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহরের মানুষেরা এখনও কিছু ব্যাপার মেনে চলে। অর্ধ-পরিচিত বয়স্ক মানুষ দেখে অনেকেই সিগারেট লুকোয়। পরিচিতি বেড়ে যাওয়ায় অর্জুনের পক্ষে অচেনা মানুষকে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে এইরকম নির্জন জায়গা বেছে নিতে হয় সেই কারণে। পুরো ব্যাপারটাকেই তার অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব মনে হচ্ছে। অথচ অমল সোম বললেন, ইন্টারেস্টিং। কয়েকশো বছর আগে একটি অত্যাচারী সেনাপতি কোথায় কী লুকিয়ে রেখেছিল তাই খোঁজার দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে এসেছেন হরিপদ সেন। এ যেন হিমালয়ের বরফের মধ্যে থেকে একটা সঁচ খুঁজে নিয়ে আসার মতো ব্যাপার। লোকটাকে স্বচ্ছন্দে পাগল বলা যেত, যদি না ওই চিঠিটা তিনি দেখাতেন। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, এই চিঠি হরিপদবাবু নিজেই লিখে নিয়ে আসতে পারেন ঘটনার গুরুত্ব বাড়াতে। অমলদা এটা ভাবলেন না কেন? এমন চিঠি অন্য কাউকে দিয়ে লেখানোর বোকামি কেউ করে না, নিশ্চয়ই হরিপদ সেনও নির্বোধ নন। ভদ্রলোকের হাতের লেখার নমুনা যদি পাওয়া যেত। কিন্তু মুশকিল হল কোনও সমস্যারই এত সহজে সমাধান হয় না। জীবিত মানুষকে খুঁজে পেতেই হিমশিম খেতে হয়, আর এ তো মৃত মানুষ। পনেরশো আশি খ্রিস্টাব্দে যে মানুষটি মারা গিয়েছে সে কোথায় কিছু সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে তা খুঁজে পাওয়া। অর্জুন হেসে ফেলল। এই তো, কুড়ি বছরেই জলপাইগুড়ির চেহারা কত বদলে গেল। আটষট্টির বন্যার আগে শহরটার চেহারা নাকি অন্যরকম ছিল। অমলদা বলেন, তিস্তায় বাঁধ হওয়ার আগে চরে অদ্ভুত চেহারার ট্যাক্সি চলত। এসব এখন কি তারা ভাবতে পারে? অত কথা কী, জলপাইগুড়ির খেলাধুলোর জগতে যাঁর দান সবচেয়ে বেশি সেই রায়সাহেব তো মারা গিয়েছেন কয়েক বছর হল। এখন যদি তাঁকে বলা হয় রায়সাহেব, কখন কোথায় গিয়েছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা আবিষ্কার কর, তা হলে কি সে সক্ষম হবে? অথচ অমলদা বলে দিলেন কাল সকালের মধ্যে কালাপাহাড় লোকটা, মানে ইতিহাসের সেই সেনাপতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি করে এস। কালাপাহাড় সম্পর্কে চালু ইতিহান্স বইয়ে নাকি দু-চার লাইনের বেশি জানতে পারা যায় না। এখন লাইব্রেরি খোলার সময় নয়। তা হলে বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে দেখা যেত কালাপাহাড়ের ওপর কোনও বই পাওয়া যায় কি না! সিগারেটটা শেষ হল তবু অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না অমল সোম এরকম কেস নিলেন কেন! আগামীকাল সকালে যদিও দেখা করতে বলেছেন, আর সেটাই তো নেওয়ার লক্ষণ। এই সময় ওর গৌরহরিবাবুর মনে পড়ল। স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন। খুব পণ্ডিত মানুষ। দুবছর আগে অবসর নিয়ে সেনপাড়ায় আছেন। অনেককাল ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়নি। অবসর নেওয়ার কথাটা সে শুনেছিল। খুব রাগী মানুষ, পড়া না করে এলে ক্ষেপে যেতেন। অর্জুন বাইক ঘোরাল। সেনপাড়ায় গৌরহরিবাবুর বাড়িতে সে ছাত্রাবস্থায় একবার এসেছিল। আজ খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। টিনের ছাদ, গাছপালা আছে। রাস্তার দিকটা টিনের দেওয়াল তুলে একটু আব্রু রাখার চেষ্টা। গরিব মাস্টারমশাইয়ের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। অর্জুন বাইরের দরজায় তিনবার শব্দ করার পর একটি মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো, কে? সার আছেন? আমি অর্জুন। তিরিশ সেকেন্ড বাদে দরজাটা খুললেন এক প্রৌঢ়া, ওঁর শরীর ভাল নেই। ও, ঠিক আছে তা হলে। অর্জুন ফেরার জন্য ঘুরছিল, এই সময়
false
toslima_nasrin
যাইতে হইব। আর যদি ঢাকায় না পাও তাইলে লন্ডন গিয়া হইলেও কিন্যা নিয়া আসতে হইব। সুহৃদ সাইকেল পাওয়ার পর শুভকে ঠিক এরকম সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য হাসিনা দাদাকে আবার ধরল। দাদা সারা শহর খুঁজে একটি তিন চাকার সাইকেল কিনে নিয়ে বাড়ি এলে হাসিনা সাইকেলটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, রাস্তা থেইকা টুকাইয়া আনছ নাকি? এর চেয়ে ভাল সাইকেল আর নাই বাজারে। পারলে গিয়া দেইখা আসো। মা বলেন, সুহৃদের সাইকেলটা নাকি কামাল সিঙ্গাপুর থেইকা আনছে। এইরম সাইকেল তো দেশেই পাওয়া যাবে না। সমস্যার সমাধান সুহৃদই করে। সে নতুন আনা সাইকেলটির ওপর আকর্ষণে নতুন সাইকেলটি চালাতে থাকে। শুভ চালায় সিঙ্গাপুরি। হাসিনার দেখে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হয় না। তার মুখে হাসি মোটেও ফুটতে চায় না। হাসি ফোটানোর জন্য মা পরিশ্রম করেন। মা তাকে ছোটদার আনা আপেল আঙুল কমলালেবু দিতে থাকেন। মাছ মাংস রান্না হলে হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভাল টুকরোগুলো দেওয়া হয়। হাতে টাকা পয়সা এলে হাসিনা আর শুভর জন্য বাজার থেকে কিছু না কিছু উপহার কিনে নিয়ে আসেন। হাসিনার হাসি নেই তবু। দাদাকে তিনি অহর্নিশি বলতে থাকেন, কি নড়ো না কেন! মরার মত শুইয়া থাকলেই হবে? ফকিরের মত টিনের ঘরে আর কতদিন পইড়া থাকবা। আলদা বাসা নেও। আমার ছেলেরে তোমার এই গুষ্ঠি থেকে দূরে সরাইতে হবে। সুহৃদ সংসারের কোনও কুটকচাল বোঝে না, শুভর জন্য সুহৃদের মমতা অনেক। শুভকে পারলে সে তার নিজের যা কিছু সম্পদ সব দিয়ে দেয়। কিল চড় আঁচড় এগুলো সুহৃদের শরীরে বসাতে শুভ সবচেয়ে বেশি পারদর্শী। একবার ধাক্কা দিয়ে সুহৃদকে ফেলে দিয়েছিল খাটের রেলিং থেকে, মাথায় চোট পেয়ে সুহৃদ পুরো চব্বিশঘন্টা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মা পাগল মত হয়ে গিয়েছিলেন। মার ভয় কখন না আবার কি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তিনি ছোটদাকে বলেছেন, এই পরিবেশে সুহৃদরে মানুষ করা যাবে না। তুই ওরে ঢাকায় নিয়া যা। ছোটদা মার এই প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মুখ শুকনো করে বলেন, হ নিয়া যাইতে হইব। ঢাকায় নিয়া ইশকুলে ভর্তি করাইতে হবে। সুহৃদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলও এরপর। মা গেলেন সঙ্গে। দু সপ্তাহ পর মা ফিরে এসে সুহৃদের জন্য চোখের জল ফেলতে থাকেন। কেবল চোখের জলই নয়। হাঁউমাউ কান্না। কেঁদে কেটে নিজেই তিনি উন্মাদিনীর মত ঢাকা চলে যান, সুহৃদকে ফের অবকাশে ফেরত আনেন। সুহৃদ মহাসুখে অবকাশে দিন যাপন করতে থাকে। ওকে নিয়ে প্রায় বিকেলেই বেড়াতে বেরোই। রিক্সা করে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। কখনও কখনও বান্ধবীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। ওর আবদারের খেলনা কিনে দেওয়া। আজ চাবিঅলা গাড়ি কিনে দিলাম তো কাল চাবিঅলা উড়োজাহাজ লাগবে। নিজের জন্যও রেডিমেড টু পিস থ্রি পিস কিনি। দুটো জামা, একটি ধোব, আরেকটি পরব, বাবার এই নিয়ম ভেঙে আমার জামা পাজামার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় দশাধিক। শখ করে নীল জিনসের কাপড় কিনে দরজি দিয়ে একটি প্যান্টও বানাই। এবার দরজিকে বলি, সামনের দিকে বোতাম বা চেইন দিবেন, কিনারে না। লপু দিবেন। যদি বেল্ট পরতে ইচ্ছে হয়, পরব। রেডিমেড ছাড়া কখনও যদি কাপড় কিনে জামা বানাই, দরজির ফিতে নিজের হাতে নিয়ে বুকের মাপ দিই। ইয়াসমিনকে বলে দিই, এখন থেইকা নিজে মাপ দিবি। ইয়াসমিনকে বলা হয় না কেন ওর নিজের এ কাজটি করা দরকার, কেন দরজির নয়। সম্ভবত ও বুঝে নেয়। হাসপাতাল থেকে ফিরেই ওর সঙ্গ চাই আমার। জগতের সকল কথাই হয় ওর সঙ্গে, কেবল শরীরের কোনও গোপন কিছু নিয়ে কোনও কথা নয়। আমরা দুজন যেন আজও শিশু। আমরা হাসি আনন্দ করি, কবিতা পড়ি গান গাই। ঘুরে বেড়াই। যেদিন জিনস প্যান্ট পরেছি, বাবা দেখে বলেন, এইডা কি পরছস। এক্ষুনিখোল। খুইলা পায়জামা পর। আমি বলি, জিনস প্যান্ট সবাই পরে। মেয়েরাও পরে। না মেয়েরা পরে না। এইসব ছেলেদের পোশাক। বাবার প্রতিবাদ করি না আমি, সরে আসি সামনে থেকে। কিন্তু জিনস খুলে রাখি না, পরে থাকি। পরদিনও পরি। আমার কাপড় চোপড় ইয়াসমিনের গায়ে আঁটে। সে নিজেও আমার জামা কাপড় অবলীলায় ব্যবহার করতে থাকে। আমি না করি না। বাবা ইয়াসমিনকেও জিনস পরতে দেখে দাঁত খিচোন, কি হইছে এইগুলা? বড়টার শয়তানি তো ছোটটারেও ধরছে। যেইদিন ধরব আমি, সেইদিন কিন্তু পিটাইয়া হাড্ডিা গুড়া কইরা দিয়াম। হাড্ডি গুঁড়ো হোক, ইয়াসমিনকে বলি খুলবি না। খুলবি না বলি, কারণ আমি কোনও যুক্তি দেখি না জিনস পরা মেয়েদের জন্য অনুচিত হওয়ার। এটি পরলে আমি যে ছেলে বনে যাবো, তা তো নয়। এর ভেতরে যে শরীর, সে তো ঠিকই থাকছে। সেটি ঠিক রাখার জন্যই যদি বাবার আদেশ হয়ে থাকে। ইয়াসমিনকে ছোট বাজারের সুর তরঙ্গ থেকে একটি পুরোনো হারমোনিয়াম কিনে দিই। গানের মাস্টারও রেখে দিই। একটিই শতর্ আমার, ও যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ঈশান চক্রবর্তী রোডের একটি দেয়াল ফুঁড়ে বটগাছের চারা ওঠা পুরোনো বাড়িতে ময়মনসিংহ সঙ্গীত বিদ্যালয়, ওতে ভর্তি করিয়ে দিই ওকে। গেল, কিন্তু সাতদিনের মাথায় বলে দিল ওর ভাল লাগছে না ওখানে। ঠিক আছে ইশকুলে যদি ভাল না লাগে বাড়িতে এসে মাস্টার গান শেখাবে, এই ভেবে সুনীল ধরের কাছে নাকি মিথুন দের কাছে! কার কাছে যাবো! শেষ অব্দি ঠিক হল, বাদল চন্দ্র। সঙ্গীত বিদ্যালয়ের গানের মাস্টার বাদল চন্দ্রর বাড়ি কোথায় খোঁজ নিয়ে জেনে ইয়াসমিনকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে
false
shorotchandra
করিতে লাগিল।নারীর এমন রূপ অরুণ আর কখনো দেখে নাই, সে যেন একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল। সন্ধ্যা কহিল, অরুণদা, আমি পিঁড়ি থেকে পালিয়ে এসেচি তোমাকে নিয়ে যেতে। আর আমার লজ্জা নেই, ভয় নেই, মান-অপমানের জ্ঞান নেই—তুমি ছাড়া আজ আর আমার পৃথিবীতে কেউ নেই—তুমি চল। কোথায় যাব? যেখান থেকে এইমাত্র একজন উঠে চলে গেল—সেই আসনের উপরে। অরুণ মনে মনে অত্যন্ত আহত হইল। কাণ্ডটা কি ঘটিয়াছে সে বুঝিল। কিছু একটা কলহের পর বর-পক্ষীয়েরা জোর করিয়া পাত্র তুলিয়া লইয়া গেছে। হিন্দুসমাজে এরূপ দুর্ঘটনা বিরল নহে, তাই সেই অপরের পরিত্যক্ত আসনে অকস্মাৎ তাহার ডাক পড়িয়াছে। যেমন করিয়াই হউক, আজ সন্ধ্যার বিবাহ হওয়া চাই-ই। কিন্তু নিজে আঘাত খাইলেও অরুণ প্রতিঘাত করিতে পারিল না, বরঞ্চ সস্নেহ ভর্ৎসনার কণ্ঠে কহিল, ছিঃ—তোমার নিজে আসা উচিত হয়নি সন্ধ্যা। এমন ত প্রায়ই ঘটে—তোমার বাবা কিংবা আর কেউ ত আসতে পারতেন? বাবা? বাবা ভয়ে কোথায় লুকিয়েচেন! মা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন, তাঁকে ধরাধরি করে তুলেচে। আমি সেইসময়ে তোমার কাছে ছুটে এসে পড়েচি। উঃ—এত বড় সর্বনাশ কি পৃথিবীতে আর কারও হয়েচে? আমরা বাঁচব কি করে? তাহার শেষ কথাটায় অরুণ পুনরায় ঘা খাইল। কহিল, কিন্তু আমাকে দিয়ে ত তোমাদের কুল রক্ষা হবে না সন্ধ্যা, আমি যে ভারী ছোট বামুন! কিন্তু দেশে আরও অনেক কুলীন আছে—তোমার বাবা হয়ত এতক্ষণ সেই সন্ধানেই গেছেন। সন্ধ্যা কাঁদিয়া বলিল, না, না, না অরুণদা—বাবা কোথাও যাননি, তিনি ভয়ে পালিয়ে গেছেন। আমাকে আর কেউ নেবে না—কেউ বিয়ে করবে না। কেবল তুমি ভালোবাসো,—কেবল তুমিই আমার চিরদিন মান রাখো। তাহার ভয়ানক উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় অরুণ ক্লেশ বোধ করিল, হাত ধরিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে সন্ধ্যা বাধা দিয়া বলিল, না আমি উঠব না—যতক্ষণ পারি তোমার পায়ের কাছেই পড়ে থাকব। কুলরক্ষা হবে না বলছিলে? কার কুল অরুণদা? আমি ত বামুনের মেয়ে নই—আমি নাপিতের মেয়ে! তাও ভাল মেয়ে নই। আজ আমার ছোঁয়া জল কেউ খাবে না! উঃ! এত বড় শাস্তি আমাকে তুমি কেন দিলে ভগবান! আমি তোমার কি করেছিলাম! অরুণ চমকাইয়া উঠিল। তাহার হঠাৎ মনে হইল বুঝি বা সন্ধ্যা প্রকৃতিস্থা নয়। হয়ত এ-সমস্তই তাহার উষ্ণমস্তিষ্কের উদ্ভট বিকৃত কল্পনা। হয়ত বা এ-সকল কিছুই ঘটে নাই—সে পলাইয়া আসিয়াছে—বাড়িতে তাহাদের এতক্ষণ হুলস্থূল বাধিয়া গিয়াছে। তাহাকে শান্ত করিয়া বাড়ি পাঠাইবার অভিপ্রায়ে সস্নেহে মাথায় হাত রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আচ্ছা, চল সন্ধ্যা, তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাই। সন্ধ্যা গড় হইয়া প্রণাম করিয়া তাহার পায়ের ধুলো মাথায় লইয়া বলিল, চল। তুমি যে যাবে সে আমি জানতুম। কিন্তু আমার সমস্ত কথা শুনে তবে চল—নইলে কি জানি, তুমিও হয়ত—কি বলেছিলুম তোমাকে একদিন? ছোট বামুন, না? আজ বোধ হয় সেই পাপেই কেবল প্রমাণ হয়ে গেল আমি বামুনের মেয়ে নই। উঃ—আমরা বেঁচে থাকব কি করে অরুণদা? তাহার মানসিক যাতনার পরিমাণ দেখিয়া অরুণের মন আবার দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া উঠিল, তাহার মনে হইল হয়ত বা যথার্থই কি একটা ঘটিয়াছে—হয়ত বা সে সত্য ঘটনাই বিবৃত করিতেছে। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কে এ কথা প্রমাণ করলে? কে? গোলোক চাটুয্যে। হাঁ, সেই। কি আমাকে সে বলেছিল জানো? জানো না? আচ্ছা, থাক তবে সে কথা। মা আমাকে সম্প্রদান করতে বসেছিলেন, আমার ঠাকুরমা চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনি সময়ে মৃত্যুঞ্জয় ঘটক দু’জন লোক সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো। একজন তাঁকে ডেকে বললে, তারাদিদি, আমাদের চিনতে পার? একজন আমার মাকে দেখিয়ে বললে, তুমি ছেলের বিয়ে দিয়ে এই বামুনের মেয়ের জাত মেরেচ—আবার কেন নাতনীর বিয়ে দিয়ে এদের জাত মারচ? তারপরে, বাবাকে আঙুল দেখিয়ে সবাইকে ডেকে বললে, তোমরা সবাই শোন, এই যাকে তোমরা পরম কুলীন প্রিয় মুখুয্যে বলে জানো—সে বামুন নয়, সে হিরু নাপ্‌তের ছেলে। অরুণ বলিয়া উঠিল, এ-সমস্ত তুমি কি বকে যাচ্ছ সন্ধ্যা? কিন্তু সন্ধ্যা বোধ করি এ প্রশ্ন শুনিতেই পাইল না—নিজের কথার সূত্র ধরিয়া বলিতে লাগিল, মৃত্যুঞ্জয় ঘটক গঙ্গাজলের ঘটটা ঠাকুরমার সামনে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, বলুন সত্যি কিনা? বলুন ও কার ছেলে? মুকুন্দ মুখুয্যের, না হিরু নাপিতের? বলুন? অরুণদা, আমার সন্ন্যাসিনী ঠাকুরমা মাথা হেঁট করে রইলেন, কিছুতেই মিথ্যা বলতে পারলেন না। ওগো! এ সত্যি, এ সত্যি, এ ভয়ঙ্কর সত্যি! সত্যিই আমাদের তোমরা যা বলে জানতে তা আমি নই। তোমার সন্ধ্যা বামুনের মেয়ে নয়! অরুণের মনের মধ্যে সংশয়ের আর লেশমাত্র অবকাশ রহিল না, শুধু বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সন্ধ্যা কহিল, একজন তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললে, সে তাদের গ্রামের লোক। বললে, আট বছর বয়সে ঠাকুরমার বিয়ে হয়, তারপরে চোদ্দ-পনর বছর পরে একজন এসে জামাই বলে—মুকুন্দ মুখুয্যে বলে পরিচয় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। পাঁচ টাকা আর একখানা কাপড় নিয়ে সে দু’দিন বাস করে চলে যায়।—ওঃ—ভগবান! অরুণ তেমনি নির্বাক্‌ নিশ্চল হইয়া রহিল। সন্ধ্যা কহিল, কি বলছিলাম অরুণদা? হাঁ, হাঁ—মনে পড়েচে। তারপর থেকে লোকটা প্রায়ই আসত। ঠাকুরমা বড় সুন্দরী ছিলেন—আর সে টাকা নিত না। তারপরে একদিন যখন সে হঠাৎ ধরা পড়ে গেল, তখন বাবা জন্মেছেন। উঃ—আমি মা হলে গলা টিপে মেরে ফেলতাম, বড় হতে দিতাম না।—কি বলছিলাম? অরুণ অস্ফুট-স্বরে বলিল, লোকটা ধরা পড়ে গেল? সন্ধ্যা বলিল, হাঁ হাঁ, তাই। ধরা পড়ে গেল। তখন সে কি কথা স্বীকার করলে জানো? বললে, এ কুকাজ সে নিজের ইচ্ছেয় করেনি, তার মনিব মুকুন্দ মুখুয্যের আদেশেই করেচে।
false
shunil_gongopaddhay
পড়ে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা আজ দেখে আসি। কাকাবাবু বললেন, এখন আর পাখি দেখা যাবে না। আগুন জ্বালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গাটা সুন্দর, নদীর ধার দিয়ে দিয়ে রাস্তা, বেড়াতে ভাল লাগবে। তোমরা দুজনে ঘুরে আসতে পারো। জোজো বলল, কী করে যাব? আপনি পুলিশকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিন। কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা যখন ওখানে গিয়েছিলাম তখন বিশেষ কিছুই ছিল না। এখন একটা ভাল হোটেল হয়েছে। তোমরা সেই হোটেলে গিয়ে উঠতে পারো। শুনেছি, সেই হোটেলের মালিক হিম্মত রাও। এই নামটা শুনেই সন্তু সচকিত হয়ে উঠল। কাকাবাবু বললেন, আমি গেলে আমার এই খোঁড়া পা আর গোঁফ দেখে চিনে ফেলতে পারে। তোমাদের হয়তো চিনবে না। তোমরা ভাব দেখাবে যেন পাহাড়ে বেড়াতে গেছ। গাড়ির বদলে ট্রেনে করে চলে যাও কাল ভোরে ফিরে আসবে। জোজো বলল, আমি চোখে সান গ্লাস আর মাথায় একটা টুপি পরে নেব, কেউ চিনতে পারবে না। কাকাবাবু বললেন, তোমাদের বিশেষ কিছু করতে হবে না। ভাল করে খাবে, কাছাকাছি স্টেশনে, বাজারে ঘোরাঘুরি করবে। শুধু কান খোলা রেখে শুনবে। কেউ টিকেন্দ্রজিৎ সম্পর্কে কিছু বলে কি না। খবরদার, তোমরা নিজে থেকে টিকেন্দ্রজিতের নাম একবারও উচ্চারণ করবে না, কোনও আগ্রহ দেখাবে না। অন্যরা কেউ কিছু বললে শুনে আসবে। কাল সকাল নটার মধ্যে ফিরে আসা চাই। ভোর পাঁচটায় ফেরার ট্রেন আছে। মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে সন্তু আর জোজো কাঁধে দুটো ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এই ট্রেনটা বেশ মজার। সরু লাইন, তার ওপর ছোট ট্রেন। দূর থেকে মনে হয় খেলনা গাড়ি। কিন্তু দিব্যি কু-ঝিক-ঝিক শব্দ করতে করতে চলে। কামরার মধ্যে শুধু মুখোমুখি দুটি বেঞ্চ। এদিককার ট্রেনে নানা জাতের মানুষ দেখা যায়। কত রকম পোশাক, কত রকম ভাষা। টুকটুকে ফরসা দু-তিনটে বাচ্চা ছোটাছুটি করছে, ঠিক যেন জ্যান্ত পুতুল। জানলার ধারে মুখোমুখি বসেছে দুজনে। পাহাড়ের পর পাহাড় চলেছে। নদীটাকে মাঝে-মাঝে দেখা যায়, শীতকাল বলে জল খুব কম। বর্ষার সময় এই নদী দেখে চেনাই যাবে না। জোজো বলল, শোন সন্তু, কাকাবাবু না থাকলে আমি দলের লিডার। কারণ তোর থেকে আমি দু মাস দশ দিনের বড়। আমার কথা শুনে চলবি। দ্যাখ না ওই ব্যাটা বদমাশ টিকেন্দ্রজিৎটা সম্পর্কে কত খবর জোগাড় করে আনব। সন্তু ঝুঁকে জোজোর হাঁটুতে জোরে একটা চিমটি কাটল। জোজো অবাক হয়ে তাকাতেই সন্তু বলল, কাকাবাবু ওই নামটা উচ্চারণ করতে বারণ করে দিয়েছেন না? তুই এর মধ্যেই শুরু করলি? জোজো বলল, ও, স্যরি, স্যরি। ঠিক আছে, এখন থেকে বলব শুধু টি, তা হলে কেউ বুঝতে পারবে না। ওই টি ব্যাটা কাকাবাবুকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সন্তু বলল, আমার মনে হয় কাকাবাবু শব্দটাও আমাদের উচ্চারণ করা ঠিক নয়। ওই নামটাও অনেকে চিনে গেছে। জোজো বলল, আমরা তো বাংলায় বলছি, কে বুঝবে? সন্তু বলল, এখানে অনেকেই বাংলা বোঝে। জোজোর পাশেই বসে আছে মাথায় পাগড়ি ও মুখভর্তি দাড়ি গোঁফওয়ালা এক মাঝবয়েসী সর্দারজি। তিনি গোঁফের ফাঁক দিয়ে হেসে বলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি! জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ও, আপনি বাংলা বুঝতে পারেন? আসলে কি হয়েছিল জানেন, আমাদের কাকাবাবুর খাবারের থালায় একটা টিকটিকি পড়ে গিয়েছিল, উনি দেখতে পাননি। সেই খাবার খেয়ে ওঁর অসুখ হয়ে গেল, একেবারে মরো-মরো অবস্থা। যাই হোক বেঁচে গেছেন শেষপর্যন্ত। সেই থেকে টিকটিকিদের ওপর আমাদের খুব রাগ। সদারজি হাসিটাকে চওড়া করে বলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি। আমি বাংলা বুঝতে পারি! আই নো ওনলি দিস সেন্টেন্স ইন বেঙ্গলি। এবার সন্তুও হাসতে লাগল। নদীর নাম জাটিঙ্গা, সেই নামেই স্টেশন। তার আগে একটা স্টেশনের নাম হারাংগাজাও। নামগুলো শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ হয়। সন্তু এদিকে আগে এসেছে, তার সব চেনা। এখান থেকে হাফলং পাহাড়ের ওপরের শহরটায় যাওয়া যায়। আগের বার সেখানে কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ডই না হয়েছিল! স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটা নতুন দোতলা বাড়ি। সেটাই হোটেল। বাইরে সাইনবোর্ড লেখা আছে রিভারভিউ হোটেল। ফুডিং অ্যান্ড লজিং। সন্তু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ইস, ইংরেজি ভুল। ফুডিং আবার হয় নাকি? ফুড অ্যান্ড লজিং! জোজো বলল, তোকে মাস্টারি করতে হবে না। ইন্ডিয়ান ইংরেজিতে ওসব চলে! গেট দিয়ে ঢুকেই অফিস ঘর। কাউন্টারে একটি লোক বসে আছে, তার পেছনের দেওয়ালে একজন বিশাল চেহারার লোকের ছবি বাঁধানো। হিম্মত রাও। এই হোটেলের মালিক কে, তা আর বলে দিতে হবে না। ওরা দুটো বিছানাওয়ালা একটা ঘর নিল দেড়শো টাকায়। দোতলার ওপর ঘর। সামনে একটা গোল বারান্দা। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে প্রায় একেবারে নীচেই দেখা যায় নদীটাকে। তার ও পাশে পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে একটা গাড়ি চলার রাস্তা চলে গেছে। জায়গাটা সত্যি সুন্দর! জোজো বলল, কাকাবাবু আমাদের ভাল করে খেতে বলেছেন। এখন দুপুর সাড়ে বারোটা, তা হলে খাবারের অর্ডার দেওয়া যাক। সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই চান করবি না? বেশ পরিষ্কার বাথরুম আছে। জোজো বলল, এই শীতের মধ্যে প্রত্যেক দিন চান করতে হবে তার কোনও মানে নেই। দু-তিন বার বেল টিপতে একজন বেয়ারা এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। খাটের ওপর বসে জুতো খুলতে-খুলতে জোজো জিজ্ঞেস করল, হাঁ ভাই, দুপুরের খাবার কী পাওয়া যাবে? বেয়ারাটি বলল, কী খাবেন বলুন? চিকেন, মটন, এগ কারি। জোজো বলল, মাছ পাওয়া যাবে না? বেয়ারাটি বলল, না, এখানে বোজ
false
shordindu
সুবিধা‌, পাড়াপাড়শী কেউ কারুর খবর রাখে না। কিন্তু সে লক্ষ্য করল। আপনি সারাক্ষণ জানালার কাছে বসে থাকেন‌, আপনার বাইনোকুলার আছে। তাকে সাবধান থাকতে হবে। ‘সে-রত্রে আপনি শুয়ে পড়বার পর সে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি দখল করতে এল। কেউ জানতে পারল না যে মাত্র একজন লোক এসেছে‌, দু’জন নয়। তার সঙ্গে একটা ছোট্ট লোহার সিন্দুক ছিল‌, সেটা সে শোবার ঘরে রাখল। ‘তারপর তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আরম্ভ হল। সকালবেলা সে স্কুলে পড়বার নাম করে বেরিয়ে যায়‌, দুপুরবেলা ‘দুপুর ডাকাতি করার মতলবে ঘুরে বেড়ায়‌, বিকেলবেলা ফিরে আসে। আবার সন্ধ্যের পর পুরুষ সেজে বেরোয় আপনাকে ধাপ্পা দেবার জন্যে। ঘরের বিদ্যুৎবাতি নিবিয়ে পিদিম জ্বেলে রেখে বেরোয়; তেল ফুরোলে পিদিম নিবে যায়‌, আপনি ভাকেন শান্তা আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনি কেবল একটা ভুল করেছিলেন; ইলেকট্রিক বাতি যে তপন বাড়ি থেকে বেরুবার আগে নেবে সেটা লক্ষ্য করেননি। আপনার মনে সন্দেহ ছিল না। তাই লক্ষ্য করেননি। ‘যাক‌, আপনি শুয়ে পড়বার পর সে আবার বাড়িতে ফিরে আসে এবং ঘুমোয়। একটা আলোয়ান সে সম্ভবত ওভারকেটের নীচে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে বেরুতো‌, ফেরবার সময় সেটা গায়ে জড়িয়ে নিত। তাই প্রথম যে-রাত্রে আপনি খড়খড়ি তুলে তাকে ফিরতে দেখলেন‌, আপনি ভাবলেন সে শান্তার গুপ্ত প্রণয়ী। ‘এইভাবে চলছিল। তারপর প্রমীলার হঠাৎ ভীষণ বিপদ উপস্থিত হল। বিধুভুষণ আইচ পুলিসের কর্মচারী‌, প্রমীলাকে আগে দেখেছিল‌, ছুটিতে কলকাতায় এসে সে প্রমীলাকে দেখতে পেল এবং পুরুষের ছদ্মবেশ সত্ত্বেও চিনতে পারল। সে প্রমীলার পিছু নিল। হয়তো কোনো হোটেলে দু’জনের দেখা হয়েছিল। প্রমীলা নিশ্চয় তাকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করেছিল‌, কিন্তু যখন পারল না‌, তখন–’ বাক্য অসমাপ্ত রাখিয়া ব্যোমকেশ থামিল‌, সিগারেট বাহির করিয়া ধরাইল। আমি বলিলাম‌, ‘একটা কথা। বিধুভুষণকে খুন করে প্রমীলা বাড়ি ছেড়ে পালাল না কেন? ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পালাবার সময় পেল না। সে তো জানত না যে চিন্তামণিবাবু খড়খড়ি তুলে হত্যাকাণ্ডটা দেখে নিয়েছেন। তাই তার বিশেষ তাড়া ছিল না; ভেবেছিল দামী জিনিসপত্র গয়নাগটি নিয়ে ধীরে সুস্থে পালাবে। কারণ ও বাড়িতে থাকা আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়; বাড়ির সামনে লাশ পড়ে আছে‌, পুলিস নিশ্চয় তাকে জেরা করতে আসবে। প্রমীলা পাল জেল-ভাঙা খুনী আসামী‌, যদি পুলিসের মধ্যে কেউ তাকে চিনতে পারে? সুতরাং নিশ্চয় সে পালাতো। কিন্তু হঠাৎ পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিস এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। তখন আর পালাবার রাস্তা নেই, প্রমাঈলা তাড়াতাড়ি পরচুলোটা পরে নিয়ে মেয়ে সাজল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে গালের তিলটা আঁকতে ভুলে গেল।’ ‘গালে তিল আঁকতো কেন?’ ‘দুটো চেহারায় রকমফের আনবার জন্যে। পুরুষবেশে নাকের নীচে গোঁফ লাগাতো‌, আর স্ত্রীবেশে পারচুলো ছাড়াও গালে তিল আঁকত। বুঝেছি?—আজ তাহলে উঠি‌, চিন্তামণিবাবু।’ চিন্তামণিবাবু গদগদ ধন্যবাদ সহ একটি দুইশত টাকার চেক লিখিয়া দিলেন। আমরা ফিরিয়া চলিলাম। বেলা দুটা বাজিতে বিলম্ব নাই। পুলিস আসামীকে লইয়া অন্তৰ্হিত হইয়াছে। এখানে তাহাদের আর প্রয়োজন নাই। শ্ৰীযুক্ত বিজয় ভাদুড়ী মহাশয় খুনী আসামীকে গ্রেপ্তার করিয়া নিশ্চয় প্রচুর প্রশংসা অর্জন করিবেন। বাসায় পৌঁছিয়া দেখি সত্যবতী দরজার কাছে উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া আছে‌, আমাদের দেখিয়া ভ্রূ তুলিয়া সপ্রশ্ন নেত্ৰে চাহিল। অর্থাৎ-এত দেরি যে! ব্যোমকেশ হঠাৎ হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। তারপর হাত বাড়াইয়া সত্যবতীর চিবুক একটু নাড়িয়া দিয়া বলিল‌, ‘তোমরাও কম যাও না।’ রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে ব্যোমকেশের পরিচয় প্রায় পনেরো বছরের। কিন্তু এই পনেরো বছরের মধ্যে তাঁহাকে পনেরো বার দেখিয়াছি কিনা সন্দেহ। শেষের পাঁচ-ছয় বছর একেবারেই দেখি নাই। কিন্তু তিনি যে আমাদের ভোলেন নাই তাহার প্রমাণ বছরে দুইবার পাইতাম। প্রতি বৎসর পয়লা বৈশাখ ও বিজয়ার দিন তিনি ব্যোমকেশকে নিয়মিত পত্ৰাঘাত করিতেন। রামেশ্বরবাবু বড়মানুষ ছিলেন। কলিকাতায় তাঁহার আট-দশখানা বাড়ি ছিল‌, তাছাড়া নগদ টাকাও ছিল অপব্যাপ্ত; বাড়িগুলির ভাড়া হইতে যে আয় হইত। তাহার অধিকাংশই জমা হইত। সংসারে তাঁহার আপনার জন ছিল দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুমুদিনী‌, প্রথম পক্ষের পুত্র কুশেশ্বর ও কন্যা নলিনী। সবোপরি ছিল তাঁহার অফুরন্ত হাস্যরসের প্রবাহ। রামেশ্বরবাবু হাস্যরসিক ছিলেন। তিনি যেমন প্ৰাণ খুলিয়া হাসিতে পারিতেন তেমনি হাসাইতেও পারিতেন। আমি জীবনব্যাপী বহুদর্শনের ফলে একটি প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিয়াছিলাম যে‌, যাহাদের প্রাণে হাস্যরস আছে তাহারা কখনও বড়লোক হইতে পারে না‌, মা লক্ষ্মী কেবল প্যাঁচাদেরই ভালোবাসেন। রামেশ্বরবাবু আমার আবিষ্কৃত এই নিয়মটিকে ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছিলেন। অন্তত নিয়মটি যে সার্বজনীন নয় তাহা অনুভব করিয়াছিলাম। রামেশ্বরবাবুর আর একটি মহৎ গুণ ছিল‌, তিনি একবার যাহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইতেন তাহাকে কখনও মন হইতে সরাইয়া দিতেন না। ব্যোমকেশের সহিত তাঁহার পরিচয় ঘটিয়াছিল তাঁহার বাড়িতে চৌর্য ঘটিত সামান্য একটি ব্যাপার লইয়া। ব্যাপারটি কৌতুকপ্রদ প্রহসনে সমাপ্ত হইয়াছিল‌, কিন্তু তদবধি তিনি ব্যোমকেশকে সস্নেহে স্মরণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। কয়েকবার তাঁহার গৃহে নিমন্ত্রণও খাইয়াছি। তিনি আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন‌, শেষ বরাবর তাঁহার শরীর ভাঙিয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু হাস্যরস যে তিলমাত্র প্রশমিত হয় নাই তাহা তাঁহার ষান্মাসিক পত্র হইতে জানিতে পারিতাম। আজ রামেশ্বরবাবুর অন্তিম রসিকতার কাহিনী লিপিবদ্ধ করিতেছি। ঘটনাটি ঘটিয়াছিল। কয়েক বছর আগে; তখন আইন করিয়া পিতৃ-সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার স্বীকৃত হয় নাই। সেবার পয়লা বৈশাখ অপরাহ্রের ডাকে রামেশ্বরবাবুর চিঠি আসিল। পুরু অ্যান্টিক কাগজের খাম‌, পরিচ্ছন্ন অক্ষরে নাম-ধাম লেখা; খামটি হাতে লইতেই ব্যোমকেশের মুখে হাসি ফুটিল। লক্ষ্য করিয়াছি রামেশ্বরবাবুকে মনে পড়িলেই মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়া ওঠে। ব্যোমকেশ সস্নেহে খামটি নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘অজিত‌, রামেশ্বরবাবুর বয়স কত আন্দাজ করতে পারো?’ বলিলাম‌, নবাবুই হবে।’
false
humayun_ahmed
ক্লিনিকে দুই ধরনের কেবিন আছে। নরমাল কেবিন এবং ডিলাক্স কেবিন। নরমাল কেবিনের ভাড়া প্রতিদিন পাঁচশ টাকা। ডিলাক্স কেবিন এক হাজার টাকা। ডিলাক্স কেবিনে এসি আছে, রঙিন টিভি আছে। তৌহিদাকে কেবিনে ভর্তি করাবেন কি-না এটা নিয়েও মতিনের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। সে গেছে কোথায়? মতিন কোথাও যায় নি। ঢাকাতেই আছে। দিন দশেক হলো সে বাস করছে। নিশুর সঙ্গে। বাড়িওয়ালার সেজো ছেলে নিশুকে খুবই বিরক্ত করছে। রাত বিরাতে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ছেলেটা নেশাখোর। গাঁজা ফেনসিডিল নিয়ে আছে। তার বন্ধু-বান্ধবরাও তার মতোই। বন্ধু-বান্ধবরাও যন্ত্রণা করছে। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছিল। পুলিশ এসেওছিল। বাড়িওয়ালা পুলিশকে বলেছেন–নিশু মেয়েটা খারাপ। নানান ধরনের ছেলে তার কাছে আসে। রাতে থাকে। ভদ্রপাড়ায় থেকে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলে খারাপ এটা জানি। খারাপ যায় খারাপের কাছে। এখন বুঝেছেন ঘটনা? পুলিশ হয়তো ঘটনা বুঝেছে। তারা কিছুই করে নি। ঢাকা শহরে একা একটি অল্পবয়েসি মেয়ের ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা প্রায়। অসম্ভব ব্যাপার। নিশু মেয়েদের কোনো হোস্টেলে চলে যেতে চাচ্ছে। তেমন কিছু পাচ্ছে না। পল্লবীতে নিশুর আপন মামা থাকেন। নিশু তার কাছেও গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, তিন বেডের এক বাড়িতে থাকি, আমাদেরই থাকার জায়গা নাই। তুই কই থাকবি? নিশু বলেছে, আমি ড্রয়িংরুমে শুয়ে থাকব। নিশুর মামা বলেছেন, ড্রয়িংরুমে আমার অফিসের পিয়ন ঘুমায়, তুই তার সঙ্গে ঘুমাবি? নিশু বলেছে, হ্যাঁ। নিশুর মামা বিরক্ত হয়ে বলেছেন, তোর বাবা যেমন পাগল ছিল তুইও পাগল। তোর যা করা উচিত তা হলো বিয়ে করে ফেলা। নিশু বলল, আমি রাজি আছি, আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। আমি আজই বিয়ে করব। গুণ্ডাপাণ্ডাদের যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না। নিশু ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছে। এখন তার প্রধান কাজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লেডিস হোস্টেলে সিট খোজা। সে ডাবলিং ট্রিপলিং সবকিছুতেই রাজি আছে। মেঝেতে শুয়ে থাকতেও তার আপত্তি নেই। সে মতিনকে আলটিমেটাম দিয়েছে। মতিন যদি সন্ধ্যার মধ্যে তার জন্যে থাকার ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। বাড়িওয়ালার ছেলে রাতে এলে নিশু বটি দিয়ে তাকে খুন করবে। আলটিমেটাম নিয়ে মতিন কিছু ভাবছে সেরকম মনে হচ্ছে না। সে ভোরের স্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সামনে লাজুক লাজুক মুখ করে বসে আছে। আজহার উল্লাহ সাহেব রাগে ছটফট করছেন। মতিন তাঁর রাগ কমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আজহার উল্লাহ সাহেবের রাগের কারণ বর্তমান কালের এক তরুণ কবির পাঠানো কবিতা। কবিতার নাম জনৈক রমণীর পায়ুপথ। তিনি কবিতা হাতে নিয়ে চিড়বিড় করছেন এই নামে কবিতা হতে পারে? মতিন, তুমি বলো, এই নামে কবিতা হতে পারে? মতিন বলল, ইউরোপ আমেরিকার কিছু কবি এ ধরনের অ্যাক্সপেরিমেন্টাল কবিতা লিখছেন। আজহার উল্লাহ বললেন, অ্যাক্সপেরিমেন্ট! এর নাম অ্যাক্সপেরিমেন্ট? পায়ুপথ নিয়ে অ্যাক্সপেরিমেন্ট? মতিন বলল, ঠিক এধরনের একটি কবিতা ইংরেজিতে আছে– . কবিতার মধ্যে রুচি ও অরুচির মিশ্রণ। হচ্ছে রুচির প্রতীক, অরুচির প্রতীক। চুপ কর। জি আচ্ছা স্যার চুপ করলাম। চা খাবে? চা খাব না, কফি খাব। আজহার উল্লাহ সিগারেট ধরালেন। তার রাগ সামান্য কমল। তিনি মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার গল্পগুলি ভালো হয়েছে। মতিন বলল, আমার গল্প না স্যার। নদ্দিউ নতিম সাহেবের গল্প। আজহার উল্লাহ বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না। আমি তোমার ইয়ার দোস্ত না, তোমার দুলাভাইও না। তুমি গল্পগুলি ভালো লিখেছ, তবে লাভ নাই। লাভ নাই কেন স্যার? লাভ নাই, কারণ বাঙালি মুসলমান লেখক জন্মে জাত সাপ হয়ে, মারা যায় হেলে সাপ হিসাবে। মতিন বলল, নদ্দিউ নতিম সাহেব মুসলমান এটা ঠিক আছে; তবে উনি বাঙালি না, উজবেক। আমার কাছ থেকে থাপ্পড় খেতে চাও? থাপ্পড় দিয়ে চাপার লুজ দাঁত ফেলে দেব। মতিন হেসে ফেলল। আজহার উল্লাহ বললেন, কোনো নতুন লেখা এনেছ? মতিন বলল, নদ্দিউ নতিম সাহেবের একটা অ্যাক্সপেরিমেন্টাল কবিতার অনুবাদ এনেছি। চায়নিজরা যেমন উপর থেকে নিচে লেখে তিনি এইভাবে কিছু কবিতা লিখেছেন। পক্ষীবিষয়ক রচনা। মতিন টেবিলের উপর লেখা রাখল! আজহার উল্লাহ সাহেব লেখা হাতে নিলেন– এ কি না পা ক ং ও খি টি বা * কে পা শ্যা পা মা খি মা রে না * * * য় ছি কা ব না। ল ঠ লা * হ ঠো ক জা য় ক ঠি নি * রা ন * কা হ বে না ক তে শ * কি পা ক কে ং রে ঠি ন? বা * ন। চ আ কা ড়ু বা ঠি ই র ন্য আজহার উল্লাহ বেশ কিছুক্ষণ মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আর আমার এখানে আসবে না। বিদায় হও। কফি খেয়ে যাই স্যার? আজহার উল্লাহ বললেন, না। মতিন উঠে দাঁড়াল। ভোরের স্বদেশ পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে মতিন ঘড়ি দেখল, এগারোটা পঁচিশ। তার মনে হলো, বিজ্ঞান এখনো যথেষ্ট অগ্রসর হয় নি। এখনো মানুষকে ঘড়ি দেখতে হয়। সার্টের হাতা গুটিয়ে রিস্টওয়াচ চোখের সামনে ধরতে হয়। রাতে আরো সমস্যা, বাতি জ্বালাতে হয়। বিজ্ঞান এত কিছু করেছে কিন্তু মানুষকে ঘড়ি দেখার ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে পারছে না কেন? মানুষের শরীরের ভেতর বিজ্ঞানীরা একটা ঘড়ি ঢুকিয়ে দেবেন। সেই ঘড়ি মানুষকে সময় দিতে থাকবে। ঘড়ি বন্ধ হবে মৃত্যুর সময়। আকাশ নীল। কড়া রোদ উঠেছে। এই রোদের নাম ছাতা-রোদ। ছাতা ছাড়া এই রোদে যাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা মানুষকে এখনো
false
humayun_ahmed
যাচ্ছে না বলে বিয়ের তারিখ করা যাচ্ছে না। যুথী বলল, সফিক ভাই কি চলে এসেছেন? হুঁ। ছাদে বসে আছে। আজ ছাদে তার ছবির প্রদর্শনী হবে। পাঁচটা ছবি নিয়ে এসেছে। পর্দা দিয়ে ঢাকা আছে। কক্লিম অ্যাঙ্কেল ফিতা কেটে প্রদর্শনী উদ্বোধন করবেন। চল ছাদে যাই। ছাদে উঠে যুথী হতভম্ব। এককোনায় চেয়ারে শুকনা মুখে শুভ্র বসে আছে। যুথী রাগী ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। যুথীর সঙ্গে নীপাও এগোলো। কী ব্যাপার! আপনি যান নি? ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে নেয় নি। নামিয়ে রেখে চলে গেছে। ভাড়া না নিয়ে চলে গেছে? এই বাড়ির একজন কে যেন ভাড়া দিয়েছেন। তিনিই আমাকে বললেন, ছাদে চলে যেতে। কালো একজন মানুষ। রোগা লম্ব। চোখে চশমা। যুথী বলল, আপনার বাসার টেলিফোন নাম্বার দিন। টেলিফোন করে দিচ্ছি, বাসা থেকে লোক এসে নিয়ে যাবে। শুভ্র বলল, বাসার টেলিফোন নাম্বর আমার মনে নেই। আমার টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। নীপা বলল, সমস্যাটা কী? যুথী বলল, সমস্যা টমস্যা এখন বলতে পারব না। এই লোক চশমা ছাড়া চোখে দেখে না। শাহবাগ থেকে আমি একে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি। তুই কি একে তার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারবি? অবশ্যই পারব। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলছি। আপনার নাম কী? শুভ্ৰ। শুনুন, আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে এখানে পার্টি হচ্ছে। আপনি ইচ্ছা করলে পার্টিতে জয়েন করতে পারেন। তবে গাড়ি রেডি আছে। এখনই যদি যেতে চান যেতে পারেন। একটু চিন্তা করে তারপর বলি? কোনো সমস্যা নেই। চিন্তা করে বলুন। পার্টির লোকজন আসতে শুরু করেছে। নীপা ছাদের দরজার পাশে দাঁড়াল। যুথী অবাক হয়ে লক্ষ করল, তার বান্ধবীরা কেউ কথা রাখে নি। কারও হাতেই চকলেটের প্যাকেট এবং ফুল নেই। অতিথিরা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। সবাই কথা বলছে। সবার গলার স্বরই স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু। করিম আঙ্কেল চলে এসেছেন। মেয়েরা তাকে ঘিরে ভিড় করেছে। করিম আঙ্কেলের বয়স ষাট। তিনি বিপত্নীক। তিনি তার রূপবতী প্রাইভেট সেক্রেটারি যমুনাকে নিয়ে এসেছেন। যমুনার বয়স ২৩/২৪। সে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করেছে ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটি থেকে। যমুনার সঙ্গে তিনি এখন লিভ টুগেদার করছেন। করিম আঙ্কেল অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করেন। মেয়েরাও তার সঙ্গ পছন্দ করে। নীপা ডায়াসে উঠে হাত নেড়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাসিমুখে বলল, সৌভাগ্যক্রমে আজ পূর্ণিমা। যারা চাঁদের আলোয় সুইমিংপুলে নামতে চাও তারা নামতে পার। আমি বেশ কয়েক সেট সুইমিং কষ্টিউম আনিয়ে রেখেছি। সুইমিংএর সময় ছাদের সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হবে। পুরুষরা কেউ সুইমিং করতে পারবে না। আমরা যখন সুইমিং করব, তখন পুরুষদের চলে যেতে হবে ছাদের দক্ষিণ দিকে। খাবার সেখানেই দেওয়া হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হবে। করিম আঙ্কেল বললেন, নীপা! মা, তুমি তো অত্যন্ত গৰ্হিত কথা বলছি। তালেবান টাইপ কথা। তোমরা মেয়েরা জলকেলি করবে। আয় আমরা চোখ বন্ধ করে দক্ষিণের ছাদে বসে থাকব তা তো হবে না। আমরা পুরুষরা সুইমিংপুলের চারপাশে থাকব। তোমাদের উৎসাহ দেব। তোমরা ড়ুবর্সাতার দিবে, আমি হব। তার জাজ! নারীদের দৈহিক সৌন্দৰ্য স্থলে একরকম, জলে আরেক রকম। আজ শ্রেষ্ঠ জলনারী নির্বাচিত হবে। আমরা প্রত্যেকেই তার গায়ে জল ছিটিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাব। নীপা বলল, আঙ্কেল চুপ করুন তো। বার ওপেন হয়েছে। আপনি বরং বারে গিয়ে বসুন। করিম আঙ্কেল বললেন, রাত আটটার আগে আমি মদ্যপান করি না। রাত আটটা থেকে সাড়ে নটা হলো আমার . তবে আজ বিশেষ দিন হিসেবে নিয়মের ব্যতিক্রম করা যেতে পারে। তিনি যমুনার হাত ধরে বারের দিকে এগুলেন। নিজের জন্যে এক পেগ রয়েল স্যালুট নিলেন। যমুনার জন্যে টাকিলা। সফিক এসে বলল, চিক্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করে তারপর গ্লাস নিয়ে বসুন। করিম আঙ্কেল বললেন, গ্লাসের সঙ্গে চিত্রকলার কোনো বিরোধ নেই। সফিক। চিত্রকলার গ্রান্ডমাস্টাররা সবাই পাড়ামাতাল ছিলেন। ভালো কথা, তোমার পেইন্টিং কি বিক্রি হবে? সফিক বলল, বিক্রির কথা ভাবি নি। কেউ কিনতে চাইলে ভাববো। তোমার ওখানে কি কোনো ছবি আছে? যদি থাকে। আমি কিনব। আছে? भाँछि। ভেরি গুড। পৃথিবীর সৌন্দর্য মাত্র দুটি জায়গায়। আলোছায়ার খেলাতে এবং নারীদেহে। কার কথা জানো? মনে হচ্ছে। আপনার নিজের কথা। না। এর কথা। তাঁর আঁকা ছবি দেখার মতো চিত্রকর্ম। মনেটের ভাবশিষ্য আমেরিকান মহিলা পেইন্টার . ইম্প্রেশনিস্ট ধারার শিল্পী। তিনি কিন্তু কোনো ছবি আঁকেন নি। মহিলা শিল্পীরা মনে হয় কোনো বিচিত্র কারণে তাঁদের শরীর নিয়ে বিব্রত থাকেন বলে শরীর আঁকেন না। যাই হোক, চলো চিত্ৰপ্ৰদৰ্শনীর উদ্বোধন করা যাক। করিম আঙ্কেল চিত্ৰপ্ৰদৰ্শনীর উদ্বোধন করতে গিয়ে চিত্রকলার ইতিহাস বিষয়ে ছোট্ট ভাষণ দিলেন, ভাষণ শেষ হলো -এর ওপর। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন , যিনি জীবনে কখনো ছবি আঁকেন নি। তিনি একজন আর্ট ক্রিটিক মাত্র।—এই ছিল করিম আঙ্কেলের শেষ কথা। তিনি প্রদর্শনীর ছবিগুলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বারে ফিরে গেলেন। বারের পাশেই শুভ্র বসে আছে। তিনি শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো ইয়াং ম্যান! সবাই আগ্রহ করে ছবি দেখছে আর তুমি ঝিম ধরে বসে আছ, ব্যাপার কী? শুভ্র বলল, আমি চশমা ছাড়া দূরের কিছু দেখি না। এইজন্যে বসে আছি। আপনার বক্তৃতা আগ্রহ করে শুনলাম। আপনি অনেক জানেন। ইয়াং ম্যান! আমি অনেক বিষয় সম্পর্কেই জানি। তাতে কিছু যায় আসে না। মদ্যপানের অভ্যাস আছে? জি-না। বিয়ার খাও। বিয়ার মদের মধ্যে পড়ে না। অনেক দেশেই কুলকুচরি কাজে ব্যবহার করা হয়। দিতে বলব
false
bongkim
কি–আমরা স্ত্রীলোক সহজেই বুঝিতে পারি। আর একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের যহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে? এখন বৈঠকখানায় ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিলে সেই গ্রন্থ লইয়া বড় তর্ক বিতর্ক হয়। সে দিন ন্যায়-কচকচি ঠাকুর, মা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপু্ত্র, বিধবাবিবাহের পক্ষে তর্ক করিয়া বাবুর নিকট হইতে টোল মেরামতের জন্য দশটি টাকা লইয়া যায়। তাহার পরদিন সার্বভৌম ঠাকুর বিধবাবিবাহের প্রতিবাদ করেন। তাঁহার কন্যার বিবাহের জন্য আমি পাঁচ ভরির সোণার বালা গড়াইয়া দিয়াছি। আর কেহ বড় বিধবাবিবাহের দিকে নয়। আপনার দু:খের কথা লইয়া তোমাকে অনেকক্ষণ জ্বালাতন করিয়াছি। তুমি না জানি কত বিরক্ত হইবে? কিন্তু কি করি ভাই–তোমাকে মনের দু:খ না বলিয়া কাহাকে বলিব? আমার কথা এখনও ফুরায় নাই–কিন্তু তোমার মুখ চেয়ে আজ ক্ষান্ত হইলাম। এ সকল কথা কাহাকেও বলিও না। আমার মাথার দিব্য, জামাই বাবুকেও এ পত্র দেখাইও না। তুমি কি আমাদিগকে দেখিতে আসিবে না? এই সময় একবার আসিও, তোমাকে পাইলে অনেক ক্লেশ নিবারণ হইবে। তোমার ছেলের সংবাদ ও জামাই বাবুর সংবাদ শীঘ্র লিখিবে। ইতি। সূর্যমুখী। পুনশ্চ। আর এক কথা–পাপ বিদায় করিতে পারিলেই বাঁচি। কোথায় বিদায় করি? তুমি নিতে পার? না ভয় করে?” কমল প্রত্যুত্তরে লিখিলেন,- “তুমি পাগল হইয়াছ। নচেৎ তুমি স্বামীর হৃদয়প্রতি অবিশ্বাসিনী হইবে কেন? স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারাইও না। আর যদি নিতান্তই সে বিশ্বাস না রাখিতে পার–তবে দীঘির জলে ডুবিয়া মর। আমি কমলমণি তর্কসিদ্ধান্ত ব্যবস্থা দিতেছি, তুমি দড়ি কলসী লইয়া জলে ডুবিয়া মরিতে পার। স্বামীর প্রতি যাহার বিশ্বাস রহিল না–তাহার মরাই মঙ্গল |” দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : অঙ্কুর দিন কয় মধ্যে, ক্রমে ক্রমে নগেন্দ্রের সকল চরিত্র পরিবর্তিত হইতে লাগিল। নির্মল আকাশে মেঘ দেখা দিল–নিদাঘকালের প্রদোষাকাশের মত, অকস্মাৎ সে চরিত্র মেঘাবৃত হইতে লাগিল। দেখিয়া সূর্যমুখী গোপনে আপনার অঞ্চলে চক্ষু মুছিলেন। সূর্যমুখী ভাবিলেন, “আমি কমলের কথা শুনিব। স্বামীর চিত্তপ্রতি কেন অবিশ্বাসিনী হইব? তাঁহার চিত্ত অচলপর্বত–আমিই ভ্রান্ত বোধ হয়। তাঁহার কোন ব্যামোহ হইয়া থাকিবে |” সূর্যমুখী বালির বাঁধ বাঁধিল। বাড়ীতে একটি ছোট রকম ডাক্তার ছিল। সূর্যমুখী গৃহিণী। অন্তরালে থাকিয়া সকলের সঙ্গেই কথা কহিতেন। বারেণ্ডার পাশে এক চিক থাকিত; চিকের পশ্চাতে সূর্যমুখী থাকিতেন। বারেণ্ডায় সম্বোধিত ব্যক্তি থাকিত, মধ্যে এক দাসী থাকিত; তাহার মুখে সূর্যমুখী কথা কহিতেন। এইরূপে সূর্যমুখী ডাক্তারের সঙ্গে কথা কহিতেন। সূর্যমুখী তাহাকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবুর অসুখ হইয়াছে, ঔষধ দাও না কেন?” ডাক্তার। কি অসুখ, তাহা ত আমি জানি না। আমি ত অসুখের কোন কথা শুনি নাই। সূ। বাবু কিছু বলেন নাই? ডা। না–কি অসুখ? সূ। কি অসুখ, তাহা তুমি ডাক্তার, তুমি জান না –আমি জানি? ডাক্তার সুতরাং অপ্রতিভ হইল। “আমি গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি,” এই বলিয়া ডাক্তার প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেছিল, সূর্যমুখী তাহাকে ফিরাইলেন, বলিলেন, “বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না–ঔষধ দাও।” ডাক্তার ভাবিল, মন্দ চিকিৎসা নহে। “যে আজ্ঞা, ঔষধের ভাবনা কি,” বলিয়া ডাক্তার পলায়ন করিল। পরে ডিস্পেন্সরিতে গিয়া একটু সোডা, একটু পোর্ট ওয়াইন, একটু সিরপফেরিমিউরেটিস, একটু মাথা মুণ্ড মিশাইয়া, শিশি পুরিয়া, টিকিট মারিয়া প্রত্যহ দুই বার সেবনের ব্যবস্থা লিখিয়া দিল। সূর্যমুখী ঔষধ খাওয়াইতে গেলেন; নগেন্দ্র শিশি হাতে লইয়া পড়িয় দেখিয়া বিড়ালকে ছুঁড়িয়া মারিলেন–বিড়াল পলাইয়া গেল–ঔষধ তাহার ল্যাজ দিয়া গড়িয়া পড়িতে পড়িতে গেল। সূর্যমুখী বলিলেন “ঔষধ না খাও–তোমার কি অসুখ, আমাকে বল |” নগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি অসুখ?” সূর্যমুখী বলিলেন, “তোমার শরীর দেখ দেখি কি হইয়াছে?” এই বলিয়া সূর্যমুখী একখানি দর্পণ আনিয়া নিকটে ধরিলেন। নগেন্দ্র তাঁহার হাত হইতে দর্পণ লইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিলেন। দর্পণ চূর্ণ হইয়া গেল। সূর্যমুখীর চক্ষু দিয়া জল পড়িল। দেখিয়া নগেন্দ্র চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া উঠিয়া গেলেন। বহির্বাটী গিয়া একজন ভৃত্যকে বিনাপরাধে প্রহার করিলেন। সে প্রহার সূর্যমুখীর অঙ্গে বাজিল। ইতিপূর্বে নগেন্দ্র অত্যন্ত শীতলস্বভাব ছিলেন। এখন কথায় কথায় রাগ। শুধু রাগ নয়। একদিন, রাত্রে আহারের সময় অতীত হইয়া গেল, তথাপি নগেন্দ্র অন্ত:পুরে আসিলেন না। সূর্যমুখী প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছেন। অনেক রাত্রি হইল। অনেক রাত্রে নগেন্দ্র আসিলেন ; সূর্যমুখী দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। নগেন্দ্রের মুখ আরক্ত, চক্ষু আরক্ত নগেন্দ্র মদ্যপান করিয়াছেন। নগেন্দ্র কখন মদ্যপান করিতেন না। দেখিয়া সূর্যমুখী বিস্মিতা হইলেন। সেই অবধি প্রত্যহ এইরূপ হইতে লাগিল। একদিন সূর্যমুখী, নগেন্দ্রের দুইটি চরণে হাত দিয়া গলদশ্রু কোনরূপে রুদ্ধ করিয়া, অনেক অনুনয় করিলেন ; বলিলেন, “কেবল আমার অনুরোধে ইহা ত্যাগ কর |” নগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, কি দোষ?” জিজ্ঞাসার ভাবেই উত্তর নিবারণ হইল। তথাপি সূর্যমুখী উত্তর করিলেন, “দোষ কি, তাহা ত আমি জানি না। তুমি যাহা জান না, তাহা আমিও জানি না। কেবল আমার অনুরোধ |” নগেন্দ্র প্রত্যুত্তর করিলেন, “সূর্যমুখী, আমি মাতাল, মাতালকে শ্রদ্ধা হয়, আমাকে শ্রদ্ধা করিও। নচেৎ আবশ্যক করে না |” সূর্যমুখী ঘরের বাহিরে গেলেন। ভৃত্যের প্রহার পর্যন্ত নগেন্দ্রের সম্মুখে আর চক্ষের জল ফেলিবেন না, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন। দেওয়ানজী বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “মা ঠাকুরাণীকে বলিও–বিষয় গেল, আর থাকে না |” “কেন?” “বাবু কিছু দেখেন না। সদর মফস্বলের আমলারা যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেছে। কর্তার অমনোযোগে আমাকে কেহ মানে না |” শুনিয়া সূর্যমুখী বলিলেন, “যাঁহার বিষয়, তিনি রাখেন, থাকিবে। না হয়, গেল গেলই |” ইতিপূর্বে নগেন্দ্র সকলই স্বয়ং তত্ত্বাবধান করিতেন। একদিন তিন চারি
false
humayun_ahmed
দিন পর আবার তিনি লিখতে বসলেন। আগের মত কলম আটকে গেল না। কিন্তু যে গল্প লেখা হচ্ছে তা অরণ্যের গল্প নয়। শহরের গল্প। শহব গ্ৰাস করছে অরণ্যকে। তিনি দ্রুত গতিতে লিখছে সন্ধ্যার পর থেকে নীলুর কেমন যেন লাগতে লাগল। এক ধবনের অস্বস্তি, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যে বকম লাগে। সে রকম। সমস্ত শশীবাব বিষম ধবে আছে। মাথার ভেতবটা ফাকা ফাকা। নীলু। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এ বাড়ির বাবান্দাটা সুন্দাব। কল্যাণপুবের দিকে শহব তেমন বাড়তে শুরু করেনি। গ্রাম গ্রাম একটা ভাব আছে। বারান্দায্য দাঁড়ালে ঝিলের মত খানিকটা জায়গা চোখে পড়ে। গত শীতের আগের শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস নেমেছিল। কী অদ্ভুত দৃশ্য। এ বৎসর নামবে কী না কে জানে। বোধ হয় না। শাহব এগিযে আসছে। পাখিরা শহর পছন্দ কবে না। অনেক রাতে রানু এসে দাঁড়াল দরজার পাশে। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন বানুকে চিনতে পারছেন না। এ যেন অচেনা কেউ। রানু বলল, কেমন আছে? ভাল। তুমি ভাল আছ রানু? হ্যাঁ। কী করছ! লিখছ? তিনি মাথা নাড়লেন। বানু বলল, লেখা এগুচ্ছে? হ্যাঁ। অনেক দিন পর লিখতে বসলে তাই না? হ্যাঁ, অনেক দিন পর। ভেতরে এসে বস বানু। সে কয়ক মুহূর্ত ইতস্তত করে ভেতরে এসে দাঁড়াল। বসল খাটে। কেমন কোমল দেখাচ্ছে রানুর মুখ। কেননা দুঃখি দুঃখি চেহারা। তাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন? মিলির একটি চিঠি আমার কাছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তুমি পড়বে? হ্যাঁ পড়ব। রানু চিঠিটা এগিয়ে দিল। চিঠি পড়তে গিযে তিনি লক্ষ্য করলেন তার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তিনি কিছু পড়তে পারলেন না। রানু মৃদু স্বরে বলল, মিলির খবরটা পেয়ে তোমার জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তোমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে। খুব বড় রকমের মিল। অনেক ভেবেছি বের করতে পারি না। তুমি চিঠিটা আমার কাছে দাও আমি পড়ে শুনাচ্ছি। তুমি পড়তে পারছ না। রানু চিঠি পড়তে শুরু করল। তিনি তাকিয়ে আছেন রানুর দিকে। চশমার ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে খুব কাছের মানুষও অস্পষ্ট হয়ে যায়। টগর পা বুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার মা চলে এসেছে এটি তার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বারবার মনে হচ্ছে তার মা বোধ হয আসেনি। এই যে মা চলে গেল পাশের ঘরে, সত্যি কী গেল? হয়ত সে ঘরে উঁকি দিলে মাকে সে দেখবে না। দেখা যাবে করুণ মুখ করে বাবা বসে আছে। টগর, খাট থেকে নামল। তাকাল অপলার দিকে। অপলা শীতল গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে? ঐ ঘরে। ঐ ঘরে এখন যে ও না। কেন যাব না? একটু পরে যাও। আসি আমরা দু’জন গল্প করি। শিশুরা অনেক জিনিস চট করে বুঝে ফেলে। টগরও হয়তবা কিছু বুঝল। আবার উঠে বসল খাটে। পা দুলাতে দুলাতে ভয়ে ভয়ে বলল, মা কী এখন থেকে বাবার সঙ্গে থাকবে? অপলা গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ থাকবে। টগর ছোট্ট করে হাসল। ছেলেমানুষি হাসি। দেখতে এত ভাল লাগে। খালামণি। বল। সত্যি থাকবে? হ্যাঁ থাকবে। তুমি কী করে জান? আমি জানি। টগর, আর কিছু বলল না। পা দুলাতে লাগল। তার মনে হল খালামনি কাঁদছে। খালামণি এখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু টগর বুঝতে পারছে। তুমি কাঁদছ কেন খালামণি? কাঁদছি না তো। কিন্তু খালামণি কাঁদছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বড়দের কত অদ্ভুত দুঃখ-কষ্ট থাকে। টগরের নিজেরও খুব কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে নেই। সে প্রাণপণে নিজের কান্না সামলাবার চেষ্টা করতে লাগল। অপলা ধরা গলায় বলল, টগর তুমি শান্ত হয়ে বসে থাকবে এখানে, বাবার ঘরে যাবে না। কেমন? আচ্ছা। আমি একটু নিচে যাব। একা একা হাঁটব। কেন? অপলা চোখ মুছে শান্ত গলায় বলল, বড়দের মাঝে মাঝে একা একা থাকতে ইচ্ছে করে। রাত অনেক হয়েছে। ওসমান সাহেব মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছেন। টগর ঘুমিয়ে পড়েছে। রানু রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কী অপূর্ব জোছনার রাত উঠোনে একা একা দাঁড়িয়ে আছে অপলা। কী দেখছে সে? রানু একবার ভাবল নিচে নেমে যাবে, অপলার হাত ধরে বলবে, কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু সে তা করল না। তাকিয়ে রইল মাঠের দিকে। রানু ডাকল, অপলা! অপলা ফিরে তাকাল। চাঁদের আলোয় ভেজা কী সুন্দর একটি মুখ। তাকে ঘিরে জোছনা কেমন থর থর করে কাঁপছে। অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে রানুর। সে আবার ডাকল, অপলা, অপলা! ভূমিকা আমি প্রায়ই কিছু অদ্ভুত চরিত্র নিয়ে ভাবি। এমন কিছু চরিত্র যাদের কখনো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্যি এ ধরনের চরিত্র নিয়ে কিছু লিখতে ভরসা হয় না। কারণ আমি জানি লেখা মাত্র আমাকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। পাঠক পাঠিকা জানতে চাইবেন, লোকটা কে? সে কোত্থেকে এসেছে? ব্যাপারটা কি? কি হচ্ছে? আমি এসব প্রশ্নের জবাব জানি না। অবশ্যি সব প্রশ্নের জবাব যে জানতেই হবে তারও তো কোনো কথা নেই। এই ভেবেই শেষ পর্যন্ত লিখে ফেললাম। লেখার খসড়া একটি ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তকাকারে পরিপূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হলো। কেউ গুরুত্বের সঙ্গে এই লেখাটি বিবেচনা না করলেই খুশী হবে। হুমায়ূন আহমেদ ১লা বৈশাখ ১৩৯৮ ০১. মতিন সাহেব গাড়ির একসিলেটর আরো খানিকটা নামিয়ে দিলেন। স্পীডোমিটারের কাঁটা সত্তর থেকে আশিতে চলে এল। ময়মনসিংহ-ঢাকা
false
shunil_gongopaddhay
লিতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। নবাবের অঙ্গে সাদা রেশমের আঙরাখা, তার তলায় হালকা নীল রঙের শালুকা (ছোট জামা)। প্রখর গ্ৰীষ্মে তাঁর ললাট ঘর্মসিক্ত। আগা আলীর কথা শোনার পর তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন মুসী আমীর আলীর দিকে। এত রকম উত্তেজনার মধ্যে মুন্সী আমীর আলী গলায় রুমাল এবং মাথায় টুপী খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি সেগুলি খুলে বারবার কুর্নিশ করতে লাগলেন। নবাব দণ্ডায়মান দুই আগন্তুকের উদ্দেশে বললেন, বয়ঠো! আগা আলী বললেন, হে বাদশা, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটি অতি জরুরি ও গোপন কথা আছে, সেগুলি আমি আপনাকে নিভৃতে বলতে চাই। নবাব এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না এবং তাঁর সঙ্গীদেরও যেতে বললেন না। আগা আলী নিজেই গরম চক্ষে লোকগুলির দিকে তাকালেন। সেই লোকগুলি সম্ভবত আগা আলীকে চিনতে পেরেছে, তাই তারা বিনা বাক্যব্যয়ে নিজেরাই উঠে গেল। আগা আলী নবাবের উদ্দেশে বললেন, হুজুরে আলম নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পেরেছেন? যে মসীহউদ্দীন খাঁ-কে আপনি মুখতার-এ আম দিয়ে বিলায়েতে পাঠিয়েছেন মামলা দাখিল করবার জন্য, আমি সেই মসীহউদ্দিন খাঁ-এর ভ্রাতুষ্পুত্র। হুজুরে আলম অনেকবার আমাকে দেখেছেন। নবাব নীরব রইলেন। তারপর আগা আলী শোনালেন বর্তমান লক্ষীয়ের অবস্থা। ওয়াজীদ আলীর সন্তান বিরজীস কদু এখন লক্ষ্মেীয়ের সিংহাসনে আসীন, তার নামে মুদ্রাও বার করা হয়েছে, প্ৰজারা আবার কর দিচ্ছে। এখন সকলেরই ইচ্ছা বাদশাহ আবার লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসুন। বাঙ্গালায় মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। হুজুরে আলম একবার ডাক দিলেই সকলে তাঁর অধীনে জমায়েত হবে, তখন সহজেই কলকাতা দখল করা যাবে। মুন্সী আমীর আলী এবার শোনালেন ফরাজী এবং ওয়াহাবীদের প্রস্তুতির কথা। চট্টগ্রাম, ঢাকা, মেদিনীপুরে সিপাহী ব্যারাকেও উত্তেজনা চলছে, যে-কোনো দিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করতে পারে। শুধু শাহী বংশের কারুর নেতৃত্বের অপেক্ষা। নবাব সম্পূর্ণ নীরব রইলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি দুই বক্তার মুখের ওপর দৃষ্টি স্থাপন করতে লাগলেন, কিন্তু একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। আগা আলী আরও বিশদভাবে ফুটিয়ে তুললেন বিদ্রোহের চিত্র। দিল্লিতে সিপাহীদের জয়লাভের কাহিনী। লক্ষ্মৌতে এখন বইছে খুশীর জোয়ার। নবাবেরই বেগম হযরত মহলের নামে প্রজারা দিচ্ছে জয়ধ্বনি। মুন্সী আমীর আলী বললেন, নবাব যদি এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গোপনে কোথাও অবস্থান করতে চান, তাহলে সে ব্যবস্থাও করা আছে। নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ সময় বিশেষে বাকসংযমী হিসেবে বিখ্যাত। এখন তিনি একেবারে পাথরের মূর্তির মতন নীরব নিথর হয়ে গেছেন। তাঁর মুখে কোনো ভাবের রেখাই ফুটলো না। আগা আলী কাতরভাবে বললেন, হুজুরে আলম, কিছু বলুন! কোনো উত্তর না দিয়ে নবাব উঠে দাঁড়ালেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি চলে গেলেন পাশের কক্ষে। তারপর সেখানে একেবারে সাদা একটি দেয়ালের কাছে চলে গিয়ে, দেয়ালে নাসিক ঠেকিয়ে তিনি কেঁদে উঠলেন উচ্চস্বরে। নবাবের কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর অনেক সহচর-অনুচর ভিড় করে দাঁড়ালো সেই কক্ষের কাছে। আগা আলী এবং মুন্সী আমীর আলীও অপ্ৰস্তুত। বেশ খানিকক্ষণ ধরে দেয়ালের দিকে মুখ করে ক্ৰন্দন করলেন নবাব। তারপর মুখ ফেরালেন এক সময়। তাঁর বস্ত্র ভিজে গেছে অশ্রুধারায়। নবাব অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, খোআব থা। জো কুছভী দেখা, জো সুনা আফসানা থা। যা কিছু দেখেছি, সবই স্বপ্ন, যা কিছু শুনেছি, সবই কাহিনী। তারপরই তিনি ডাক পাঠালেন কলমচীর উদ্দেশে। সে হাজির হতে তৎক্ষণাৎ মুসাবিদ করা হলো একটি পত্রের। নবাব কোম্পানির সরকারকে জানিয়ে দিলেন যে বিদ্রোহীরা এসে তাঁকে উস্কানি দিচ্ছে, তিনি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চান না একটুও। ইংরেজের বিরুদ্ধে আগেও লড়াই করেননি, এখনো লড়াই করবেন না। এবং এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে বাইরে থাকাও নিরাপদ নয়, সরকার বাহাদুর যেন তাঁকে কেল্লার মধ্যে স্থান দেন। পত্রপাঠ ইংরেজ সরকার নবাবকে নিয়ে গেল ফোর্ট উইলিয়ামে। আগা আলী এবং মুন্সী আমীর আলীও বন্দী হলেন, তাঁদের রাখা হলো ফৌজি গারদে। কেল্লায় নিরাপদে অবস্থানের জন্য নবাবের নিজস্ব জিনিসপত্রের সঙ্গে এলো সতেরোটি বালিশ। দুদিকে পাশ ফিরে শোবার সময় নবাবের দুই কানের জন্যও ছোট দুটি কান-বালিশ লাগে। সেই বালিশের স্তুপের মধ্যে নিশ্চিন্তে শুয়ে থেকে নবাব আবার মন দিলেন কবিতা রচনায়। গভর্নর জুড়ে কানিয়ের মহানুভবতার জন্য তাঁর প্রতি প্রশস্তিমূলক এক দীর্ঘ কবিতা রচনা করে পাঠিয়ে দিলেন। হীরা বুলবুলের তীর্থ দর্শনের সাধ দিন দিন বেড়েই চলছিল। রাইমোহন নানারূপ ওজর আপত্তি তুলে টালবাহনা করছিল বলে এক সময় জেদ ধরল যে রাইমোহনকে বাদ দিয়ে সে নিজেই সব ব্যবস্থা করবে। এখনো তার অর্থের অকুলান নেই। দেহ-ব্যবসায় এবং সংগীত-বৃত্তি পরিত্যাগ করার পর এখন সে তার বেশভুষার প্রতি কোনো মনোযোগ দেয় না, সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে বাড়িতে থাকে। কলকাতার মাথা মাথা বাবুদের দেওয়া বেশ কিছু স্বৰ্ণালঙ্কার তার কাছে রয়ে গেছে। রাইমোহনের অগোচরেই একদিন সে তার অনেকগুলি বিক্রয় করে দিয়ে এলো গুপী স্যাকরার দোকানে। এই অর্থ দিয়ে সে এবার বজরা ও লোক-লস্কর ভাড়া করবে। সে মনস্থ করেছে, সে যাবে জগন্নাথধামে। পতিতপাবন সকলকেই আশ্রয় দেন, তার মতন পতিতাকেও কি তিনি উদ্ধার করবেন না! যথাসময়ে সব জানতে পেরে রাইমোহন একেবারে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। হীরা বুলবুলকে সে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলো যে এই সময় কি কেউ বিদেশ বির্ভূয়ে যায়! সেপাইদের হেঙ্গামা চলছে। চতুর্দিকে নানা রকম উৎপাত, দেশে একেবারে যেন অরাজক অবস্থা। এই সময় পথে-ঘাটে পদে পদে বিপদের ভয়। কিন্তু হীরা বুলবুল এসব কিছুই বুঝবে না। সে অনাথিনী, তীর্থযাত্ৰিণী, তার আবার ভয় কি! এই পড়ন্ত যৌবনেও যে তার শরীরে মোহ উদ্রেককারী রূপ
false
shorotchandra
দিলেন না—কেবল তাহার একটা হাত ধরিয়া আরো কাছে টানিয়া আনিয়া গভীর স্নেহে তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া দিলেন। সারদা আড়াল হইতে বোধ হয় শুনিতেছিল, সুমুখে আসিয়া বলিল, দেব্‌তাকে খেয়ে যেতে বলুন না মা, সেই ত বাসায় গিয়ে ওঁকে নিজেই রাঁধতে হবে। নতুন-মা বলিলেন, আমি কেন সারদা, তুমি নিজেই ত বলতে পারো মা। তার পরে স্মিতহাস্যে কহিলেন, এই কথাটি ও প্রায় বলে রাজু। তোমাকে যে আপনি রাঁধতে হয় এ যেন ও সইতে পারে না—ওর বুকে বাজে। ওকে বাঁচিয়েছিলে একদিন এ কথা সারদা একটি দিন ভোলে না। পলকের জন্য রাখাল লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল, তিনি বলিতে লাগিলেন, এমন স্ত্রীকে যে কি করে তার স্বামী ফেলে দিয়ে গেলো আমি তাই শুধু ভাবি। যত অঘটন কি বিধাতা মেয়েদের ভাগ্যেই লিখে দেন! এবং বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার মুখ দিয়া দীর্ঘশ্বাস পড়িল। সারদা কহিল, এইবার ওঁকে একটি বিয়ে করতে বলুন মা। আপনার আদেশকে উনি কখনো না বলতে পারবেন না। সবিতা কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু রাখাল তাড়াতাড়ি বাধা দিল। বলিল, তুমি আমাকে মোটে দু-চারদিন দেখচো, কিন্তু উনি করেচেন আমাকে মানুষ—আমার ধাত চেনেন। বেশ জানেন, ওর না আছে বাড়িঘর, না আছে আত্মীয়-স্বজন, না আছে উপার্জন করার শক্তি-সামর্থ্য। ও বড় অক্ষম, কোনমতে ছেলে পড়িয়ে দু’বেলা দুটো অন্নের উপায় করে। ওকে মেয়ে দেওয়া শুধু মেয়েটাকে জবাই করা। এমন অন্যায় আদেশ মা কখনো দেবেন না। সারদা বলিল, কিন্তু, দিলে? রাখাল বলিল, দিলে বুঝবো এ আমার নিয়তি। ঠাকুর আসিয়া খবর দিল খাবার তৈরি হইয়াছে। রাখাল বুঝিল, এ আয়োজন সারদা উপরে আসিয়াই করিয়াছে। বহুকালের পরে সবিতা তাহাকে খাওয়াইতে বসিলেন। বলিলেন, রাজু, তারক যেখানে চাকরি করে সে গ্রামটি নাকি একেবারে দামোদরের তীরে। আমাকে ধরেছে দিন-কয়েক গিয়ে তার ওখানে থাকি। স্থির করেচি যাবো। প্রস্তাব করে সে চিঠি লিখেচে নাকি? চিঠিতে নয়, দিন-দুয়েক ছুটি নিয়ে সে নিজে এসেছিল বলতে। বড় ভালো ছেলে। যেমন বিনয়ী তেমনি বিদ্বান। সংসারে ও উন্নতি করবেই। রাখাল সবিস্ময় মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, তারক এসেছিলো কলকাতায়? কৈ আমি ত জানিনে! সবিতা বলিলেন, জানো না? তবে বোধ করি দেখা করার সময় করতে পারেনি। শুধু দুটো দিনের ছুটি কিনা! রাখাল আর কিছু বলিল না, মাথা হেঁট করিয়া অন্নের গ্রাস মাখিতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল অসুখের পূর্বের দিনই সে তারককে একখানা পত্র লিখিয়াছে; তাহাতে বলিয়াছে, ইদানীং শরীরটা কিছু মন্দ চলিতেছে, তাহার সাধ হয় দিন-কয়েকের ছুটি লইয়া পল্লীগ্রামে গিয়া বন্ধুর বাড়িতে কাটাইয়া আসে। সে চিঠির জবাব এখনো আসে নাই। তের সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরে বাসায় ফিরিবার সময়ে সারদা সঙ্গে সঙ্গে নীচে নামিয়া আসিয়াছিল, ভারী অনুরোধ করিয়া বলিয়াছিল, আমার বড় ইচ্ছে আপনাকে একদিন নিজে রেঁধে খাওয়াই। খাবেন একদিন দেব্‌তা? খাবো বৈ কি। যেদিন বলবে। তবে পরশু। এমনি সময়ে। চুপি চুপি আমার ঘরে আসবেন, চুপি চুপি খেয়ে চলে যাবেন। কেউ জানবে না, কেউ শুনবে না। রাখাল সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, চুপি চুপি কেন? তুমি আমাকে খাওয়াবে এতে দোষ কি? সারদাও হাসিয়া জবাব দিয়াছিল, দোষ ত খাওয়ার মধ্যে নেই দেব্‌তা, দোষ আছে চুপিচুপি খাওয়ানোর মধ্যে। অথচ নিজে ছাড়া আর কাউকে না জানতে দেবার লোভ যে ছাড়তে পারিনি। সত্যি পারো না, না বলতে হয় তাই বলচো? অত জেরার জবাব আমি দিতে পারবো না, বলিয়া সারদা হাসিয়া মুখ ফিরাইল। রাখালের বুকের কাছটা শিহরিয়া উঠিল, বলিল, বেশ, তাই হবে—পরশুই আসবো বলিয়াই দ্রুতপদে বাহির হইয়া পড়িল। সেই পরশু আজ আসিয়াছে। রাত্রি বেশী নয়, বোধ হয় আটটা বাজিয়াছে। সকলেই কাজে ব্যস্ত, রাখালকে বোধ হয় কেহ লক্ষ্য করিল না। রান্নার কাজ শেষ করিয়া সারদা চুপ করিয়া বসিয়া ছিল, রাখালকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া বিছানায় বসিতে দিল, বলিল, আমি ভেবেছিলুম হয়তো আপনার রাত হবে, কিংবা হয়তো ভুলেই যাবেন, আসবেন না। ভুলে যাবো এ তুমি কখনো ভাবোনি সারদা, এ তোমার মিছে কথা। সারদা হাসিমুখে মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আমার মিছে কথা। একবারও ভাবিনি আপনি ভুলে যাবেন। খেতে দিই? দাও। হাতের কাছে সমস্ত প্রস্তুত ছিল, আসন পাতিয়া সে খাইতে দিল। পরিমিত আয়োজন, বাহুল্য কিছুতে নাই। রাখাল খুশী হইয়া বলিল, ঠিক এমনই আমি মনে মনে চেয়েছিলুম সারদা, কিন্তু আশা করিনি। ভেবেছিলুম আরও পাঁচজনের মতো যত্ন দেখানোর আতিশয্যে কত বাড়াবাড়িই না করবে। কত জিনিস হয়তো ফেলা যাবে। কিন্তু সে চেষ্টা তুমি করোনি। সারদা কহিল, জিনিস ত আমার নয় দেব্‌তা, আপনার। নিজের হলে বাড়াবাড়ি করতে ভয় হোতো না, হয়তো করতুমও—নষ্টও হোতো। ভাল বুদ্ধি তোমার! ভালোই ত! নইলে আপনি ভাবতেন মেয়েটার অন্যায় ত কম নয়! দেনা শোধ করে না, আবার পরের টাকায় বাবুয়ানি করে। রাখাল হাসিয়া বলিল, টাকার দাবী আমি ছেড়ে দিলুম সারদা, আর তোমাকে শোধ করতে হবে না, ভাবতেও হবে না। কেবল খাতাটা দাও, আমি ফিরে নিয়ে যাই। সারদা কৃত্রিম গাম্ভীর্যে মুখ গম্ভীর করিয়া বলিল, তা হলে ছাড়-রফা হয়ে গেল বলুন? এর পরে আপনিও টাকা চাইতে পাবেন না, আমিও না। অভাবে যদি মরি তবুও না। কেমন? রাখাল বলিল, তুমি ভারী দুষ্টু সারদা। ভাবি, জীবন তোমাকে ফেলে গেল কি করে? সে কি চিনতে পারলে না? সারদা মাথা নাড়িয়া বলিল, না। এ আমার ভাগ্যের লেখা দেব্‌তা। স্বামী না, যিনি ভুলিয়ে আনলেন
false
nihar_ronjon_gupta
আমি খাইয়ে দেবখন, তুই যা, ওপরে চলে যা, শিখেন্দু বলল। তারপর? সঞ্জীব শুধাল। নির্বাণী ওপরে চলে যায়। তারপর? আর পৌনে বারোটা নাগাদ দীপা ওপরে গিয়েছিল, তারপরেই ব্যাপারটা জানা গেল! শিখেন্দু বলল। ওঃ! নির্মল বলল। তাহলে মনে হচ্ছে পৌনে এগারটা থেকে রাত পৌনে বারোটা, ঐ একঘন্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় নির্বাণীকে কেউ খুন করে গিয়েছে। সঞ্জীব বলল। ইতিমধ্যে পরেশও এসে ঘরে ঢুকেছিল এবং সব শুনেছিল, ওরা তিনজন কেউ লক্ষ্য করেনি; হঠাৎ ঐ সময় পরেশ বলল, নির্মল তো অনেক রাত্রে ফিরেছিস, রাত বোধ হয়। তখন সাড়ে বারোটারও বেশী হবে, আমি পৌনে বারোটায় প্রায় শুয়েছি, কিন্তু ঘুমোই নি। দশটার পরই যদি তুই নির্বাণীদের বাড়ি থেকে চলে এসে থাকিস তো তোর ফিরতে এত দেরি হল কেন রে? বাসে যা ভিড়! নির্মল বলল। অত রাত্রে বাসে ভিড়! পরেশ কথাটা বলে নির্মলের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, দেখ বাবা, চালাকি করো না, অতক্ষণ কোথায় ছিলে বল। পরেশ চিরদিনই ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা। ইংরাজী বাংলা কোন ডিটেকটিভ বই-ই সে বাদ দেয় না এবং সুযোগ পেলেই ডিটেকটিভগিরি করে। নির্মল কিন্তু চটে যায়। বললে, কি ইয়ার্কি হচ্ছে, এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপার– সেইজন্যই তো সিরিয়াসলি আমি প্রশ্নটা করেছি। পরেশ গম্ভীর হয়ে বলে। শিখেন্দু এবারে বললে, নিবার্ণীর বাবা কিরীটী রায়কে ডেকেছেন তদন্ত করবার জন্য। বলিস কি! পরেশ বললে। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক তিনি জানবেনই কে তাঁর ছেলেকে অমন করে খুন করে গেল। ও আর দেখতে হবে না শিখেন্দু, কিরীটী রায়ের যখন আবির্ভাব ঘটেছে, আততায়ীর আর নিস্তার নেই। ইস, কাল রাত্রে অমন একটা ব্যাপার ঘটবে যদি জানতাম, তাহলে এত তাড়াতাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে ওখান থেকে চলে আসি! শিখেন্দু উঠে পড়ল, স্নান সেরেই তাকে বেরুতে হবে। জামা কাপড় খুলে মাথায় তেল মেখে তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে শিখেন্দু একতলার দিকে চলে গেল। নির্মল আর সঞ্জীব দুজনই চুপচাপ বসে। কারও মুখে কোন কথা নেই। পরেশ একবার ওদের মুখের দিকে তাকাল, তারপর পকেট থেকে চারমিনারের প্যাকেটটা। বের করে একটা সিগারেট ধরালো নিঃশব্দে। সিগারেটে গোটা-দুই টান দিয়ে পরেশ বললে, ব্যাপারটা তোদের কি মনে হয় সঞ্জীব, নির্মল? ওরা দুজনেই যুগপৎ পরেশের মুখের দিকে তাকাল। কেউ কোন কথা বললে না। পরেশ আবার বললে, নির্বাণীকে কে অমন করে খুন করতে পারে বলে মনে হয় তোদের? নির্মল ক্ষীণ গলায় বললে, কি করে বলব? দেখ বাবা, সত্যি কথা বলি, আমরা সবাই অথাৎ তুই নির্মল সঞ্জীব শিখেন্দু আমি শ্রীমান পরেশ ইন্টারেসটেড পার্টি ছিলাম মানে! নির্মল বললে। মানে, সবাই আমরা মনে মনে চেয়েছি দীপাকে, কিন্তু মাঝখান থেকে দীপা হয়ে গেল নির্বাণীর। দীপা নির্বাণীর গলাতেই শেষ পর্যন্ত মালা দিল। নির্মল চেচিয়ে ওঠে, হোয়াট ননসেন্স! বোকার মত কি সব যা-তা বলছিস পরেশ! বোকা নয় বন্ধু। গোপন প্রেম, প্রেম থেকেই লালসা, লালসা থেকেই হিংসা এবং হিংসা থেকেই আক্রোশ ও তার পরিণতি হত্যা, দীপাকে না পাওয়ার জন্য– তুই থামবি পরেশ! নির্মল আবার খিঁচিয়ে ওঠে। আমি থামলেও কিরীটী রায় থামবে না বন্ধু। পরেশ বললে। সঞ্জীব বললে, এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তোর ওই সব ভণ্ডামি আমার একটুও ভাল লাগছে না পরেশ, সত্যি! কিন্তু তবু এটা সত্যি সঞ্জীব, তুই আমি নির্মল শিখে সবাই নির্বাণীর মত দীপাকে মনে মনে কামনা করেছি। দোষ নেই অবিশ্যি তাতে। একটি সুন্দরী আকর্ষণীয়া তরুণীর প্রতি আমাদের মত তরুণদের আকর্ষণ জাগাটা এমন কিছু দোষের নয়, র্যাদার ন্যাচারাল। তাছাড়া আমার কথাটা যে মিথ্যে নয়, সেটা নিশ্চয়ই তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সঞ্জীব বললে, তার মানে পরেশ তুই কি বলতে চাস! সঞ্জীবের গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে গেল। বলতে চাই যা একটু আগেই তা তোদের বললাম। ঐ সময় শিখেন্দু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে পুনরায় প্রবেশ করে বললে, কি বললি রে পরেশ! বলছিলাম, পরেশ বললে, তুই আমি নির্মল সঞ্জীব আমরা এই চারজনের মধ্যে— কি? হাতে চিরুনিটা নিয়ে পরেশের মুখের দিকে তাকাল শিখেন্দু। যে কেউ একজন, পরেশ বললে, কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করতে পারি। হাতের চিরুনি থেমে যায় শিখেন্দুর, সে যেন বজ্রাহত, পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ বোজা গলায় প্রশ্ন করলে, আমরাই কেউ কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করেছি? করেছি তা তো আমি বলিনি শিখেন্দু, তবে করতে পারতাম। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! শিখেন্দু বললে। মাথা আদৌ খারাপ হয়নি, আমরা সকলেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, নির্বাণীও চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই পেল দীপাকে—তাতে করে নির্বাণীর ওপরে একটা আক্রোশ আমাদের হওয়া স্বাভাবিক, যে আক্রোশের বশে হত্যাও করা যায়। শিখেন্দু চুপ। একেবারে যেন বোবা। হাতের চিরুনি হাতেই ধরা আছে তখন তার, সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পরেশের মুখের দিকে, পরেশ যেন হিংস্র নখর দিয়ে ওদের প্রত্যেকের মনের উপর থেকে একটা পদা ছিড়ে ওদের প্রত্যেককে নিজেদের মুখখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পরেশ বলতে থাকে, দেখ, একমাত্র সঞ্জীব ছাড়া আমরা সকলেই কাল রাত্রে উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। আমরা সকলেই ছিলাম নির্বাণীর বন্ধু, কাজেই আমাদের দ্বার ঐ বাড়িতে অবারিত ছিল। আমরা যদি ইচ্ছা করতাম, অনায়াসেই আমরা যে কেউ একজন আমাদের মধ্যে কোন এক ফাঁকে তিনতলায় গিয়ে বাথরুমের মধ্যে সুযোগর অপেক্ষায় আত্মগোপন করে থাকতে পারতাম। তারপর? ক্ষীণ গলায় বলে উঠল সঞ্জীব ও শিখেন্দু। তারপর কাজ শেষ করে, অনায়াসেই বাড়ি
false
robindronath
পেতেছি।” “দোষ কী, হলে তো ভালোই হত। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, বেজাতে মেয়ের বিয়ে দেবে না।” “তখনো আপনার মন জানতুম না, তাই মিথ্যে কথা বলেছিলুম। খুবই চেয়েছিলুম। কিন্তু ছেড়েছি সেই মতলব।” “কেন।” “বুঝতে পেরেছি, ও ভাঙন ধরানো মেয়ে। ওর হাতে যা পড়বে তা আস্ত থাকবে না।” “কিন্তু ও তো তোমারই মেয়ে।” “আমারই মেয়ে তো বটে, তাই তো ওকে আঁতের ভিতর থেকেই চিনি।” অধ্যাপক বললেন, “কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে কেন যে, মেয়েরা পুরুষের ইন্‌‌‍স্পিরেশন জাগাতে পারে।” “আমার সবই জানা আছে। পুরুষের খোরাকে আমিষ পর্যন্ত ভালোই চলে কিন্তু মদ ধরালেই সর্বনাশ। আমার মেয়েটি মদের পাত্র, কানায় কানায় ভরা।” “তা হলে কী করতে চাও বলো।” “আমার ল্যাবরেটরি দান করতে চাই পাবলিককে।” “তোমার একমাত্র মেয়েকে এড়িয়ে দিয়ে? ” “মেয়েকে? ওকে দান করলে সে দান পৌঁছবে কোন্‌ রসাতলে কী করে জানব। আমার ট্রাস্ট সম্পত্তির প্রেসিডেন্ট করে দেব রেবতীকে। তাতে তো পিসির আপত্তি হতে পারবে না? ” “মেয়েদের আপত্তির যুক্তি যদি ধরতেই পারব তা হলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে গেলুম কেন। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি নে, ওকে যদি জামাই না করবে তা হলে প্রেসিডেন্ট করতে চাও কেন।” “শুধু যন্ত্রগুলো নিয়ে কী হবে। মানুষ চাই ওদের প্রাণ দিতে। আর-একটা কথা এই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটাও নতুন যন্ত্র আনা হয় নি। টাকার অভাবে নয়। কিনতে হলে একটা লক্ষ্য ধরে কিনতে হয়। খবর জেনেছি, রেবতী ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ নিয়ে কাজ করেছেন। সেই পথে সংগ্রহ এগিয়ে চলুক, যত দাম লাগে লাগুক্‌-না।” “কী আর বলব, পুরুষমানুষ যদি হতে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে নেচে বেড়াতুম। তোমার স্বামী রেল-কোম্পানির টাকা চুরি করেছিলেন, তুমি চুরি করে নিয়েছ তাঁর পুরুষের মনখানা। এমন অদ্ভুত কলমের জোড়-লাগানো বুদ্ধি আমি কখনো দেখি নি। আমারও পরামর্শ নেওয়া তুমি যে দরকার বোধ কর, এই আশ্চর্য।” “তার কারণ আপনি যে খুব খাঁটি, ঠিক কথা বলতে জানেন।” “হাসালে তুমি। তোমাকে বেঠিক কথা ব’লে ধরা পড়ব, এত বড়ো নিরেট বোকা আমি নই। তা হলে লাগা যাক এবার, জিনিসপত্র ফর্দ করা, দর যাচাই করা, ভালো উকিল ডেকে তোমার স্বত্ব বিচার করা, আইনকানুন বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি অনেক হাঙ্গামা আছে।” “এ-সব দায় কিন্তু আপনারই।” “সেটা হবে নামমাত্র। বেশ ভালো করেই জান, যা তুমি বলাবে তাই বলব, যা করাবে তাই করব। আমার লাভটা এই দুবেলা দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে যে কী চক্ষে দেখেছি তুমি তো জান না।” সোহিনী চৌকি থেকে উঠে এসে ধাঁ করে এক হাতে চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেয়ে চট্‌ করে সরে গেল, ভালোমানুষের মতো বসল গিয়ে চৌকিতে। “ঐ রে সর্বনাশের শুরু হল দেখছি।” “সে ভয় যদি একটুও থাকত তা হলে কাছেও এগতুম না। এ বরাদ্দ আপনার জুটবে মাঝে মাঝে।” “ঠিক বলছ? ” “ঠিকই বলছি। আমার এতে খরচ নেই, আপনারও যে বেশি কিছু পাওনা আছে, মুখের ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছে না।” “অর্থাৎ বলতে চাও, এ হচ্ছে মরা কাঠে কাঠঠোকরার ঠোকর দেওয়া। — চললুম উকিলবাড়িতে।” “কাল একবার আসবেন এ পাড়াতে।” “কেন, কী করতে।” “রেবতীর মনে দম দিতে।” “আর নিজের মনটা খুইয়ে বসতে।” “মন কি আপনার একলারই আছে।” “তোমার মনের কিছু বাকি আছে নাকি।” “উচ্ছিষ্ট অনেক পড়ে আছে।” “তাতে এখনো অনেক বাঁদর নাচানো চলবে।” ৭ তার পরদিনে রেবতী ল্যাবরেটরিতে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত বিশ মিনিট আগে এসেই উপস্থিত। সোহিনী প্রস্তুত ছিল না, আটপৌরে কাপড়েই তাড়াতাড়ি চলে এল ঘরে। রেবতী বুঝতে পারলে গলদ হয়েছে। বললে, “আমার ঘড়িটা ঠিক চলছে না দেখছি।” সোহিনী সংক্ষেপে বললে, “নিশ্চয়।” একসময় একটু কী শব্দ শুনে রেবতী মনে মনে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালে। সুখন বেহারাটা গ্লাসকেসের চাবি নিয়ে এল ঘরে। সোহিনী জিগ্‌গেসা করলে, “এক পেয়ালা চা আনিয়ে দেব কি।” রেবতী ভাবলে বলা উচিত, হাঁ। বললে, “দোষ কী।” ও বেচারার চা অভ্যাস নেই, সর্দির আভাস দিলে বেলপাতাসিদ্ধ গরম জল খেয়ে থাকে। মনে মনে বিশ্বাস ছিল স্বয়ং নীলা আসবে পেয়ালা হাতে। সোহিনী জিগ্‌গেসা করলে, “তুমি কি কড়া চা খাও।” ও ফস্‌ করে বলে বসল, “হাঁ।” ভাবলে এ ক্ষেত্রে হাঁ বলাটাই পাকা দস্তুর। এল চা, সেটা কড়া সন্দেহ নেই। কালির মতো রঙ, নিমের মতো তিতো। চা আনলে মুসলমান খানসামা। এটাও ওকে পরীক্ষা করবার জন্যে। আপত্তি করতে ওর মুখে কথা সরল না। এই সংকোচ ভালো লাগল না সোহিনীর। খানসামাকে বললে, “চা-টা ঢেলে দাও-না মোবারক, ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।” খানসামার হাতের পরিবেশন-প্রত্যাশায় রেবতী বিশ মিনিট আগে এখানে আসে নি। কী দুঃখে যে মুখে চামচ উঠছিল অন্তর্যামীই জানছিলেন, আর জানছিল সোহিনী। হাজার হোক মেয়েমানুষ, দুর্গতি দেখে বললে, “ও পেয়ালাটা থাক্‌। দুধ ঢেলে দিচ্ছি, তার সঙ্গে কিছু ফল খেয়ে নাও। সকাল সকাল এসেছ, বোধ হয় কিছু খেয়ে আসা হয় নি।” কথাটা সত্য। রেবতী ভেবেছিল আজও সেই বোটানিকালের পুনরাবৃত্তি হবে। কাছ দিয়েও গেল না, মুখে রয়ে গেল কড়া চায়ের তিতো স্বাদ আর মনে রয়েছে আশাভঙ্গের তিতো অভিজ্ঞতা। এমন সময়ে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক; ঘরে ঢুকেই রেবতীর পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, “কী রে হল কী, সব যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। খুকুর মতো বসে বসে দুধ খাচ্ছিস ঢকে ঢক। চার দিকে যা দেখছিস একি খোকাবাবুর খেলনার দোকান। যাদের চোখ আছে তারা
false
toslima_nasrin
নেওয়া ছাড়া। আমি জেলের মৃত্যুকে বেছে নিলাম। ক আর ঙ চুপ হয়ে থাকেন। চ শব্দহীন পায়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকেন। ক আর ঙর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। সবকটি প্রাণী চুপ। নৈঃশব্দ্য ভেঙে চ বলেন, কিছু খাবেন আপনি? মাথা নেড়ে না বলি। দুপুরে খাইনি, রাতেও না। ক্ষিধে বলতে কোনও কিছু আমি বোধ করছি না। ক এবং ঙ দুজনে আমাকে দুটো চিরকুট দেন। ঙ দেন শামসুর রাহমানের লেখা একটি চিরকুট। তসলিমা, মানসিক ভাবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। ক দেন ছোটদার লেখা একটি চিরকুট। নাসরিন, আমরা সবাই তোর কথা ভাবছি। তুই ভেঙে পড়িস না। সত্যের জয় একদিন হবেই। চিরকুটটি আমার হাতে দিয়ে ক বলেছেন, আপনার ভাই কামাল আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনও খবর আমি জানি কি না জানার জন্য। আমি কিছু বলিনি তাকে। আমাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে, যদি কখনও আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়, যেন দিয়ে দিই। বলেছে, ময়মনসিংহ থেকে আপনার বাবা নাকি জানিয়েছেন, আপনার কোনও খোঁজ পেলে বলতে যে আপনি যেন মনের জোর রাখেন, যেন ভেঙে না পড়েন। কামাল তার বউ বাচ্চা নিয়ে এখন আপনার বাড়িতে থাকছে। আপনার উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে সে। ক আর ঙ কতক্ষণ ছিলেন বসে আমার মনে নেই। কারও সঙ্গে আমার আর কোনও বাক্য বিনিময় হয়েছে কি না মনে নেই। মনে নেই সে রাতে আমার ঘুম পেয়েছিল কি না, আমি ঘুমিয়েছিলাম কি না। নয় জুন, বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরের এমন কোনও রাস্তা নেই যেখানে মৌলবাদীদের জমায়েত হচ্ছে না বা মিছিল হচ্ছে না। গতকাল দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে জামাতে ইসলামির জনসভায় হাজার হাজার লোক জমেছিল। জামাতে ইসলামির মহাসচিব, জাতীয় সংসদ সদস্য মতিউর রহমান নিজামী জনসভায় বলেন, তসলিমা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। স্বাধীনতার চেতনার দাবিদার যে সমস্ত নেতা ও দল ওই লেখিকাকে সমর্থন করছেন তাঁরাও মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে থেকে যাচ্ছেন। বাইবেল বা যীশু-খ্রীস্টের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য বা কটূক্তি করলে বৃটেনসহ পশ্চিমাদেশগুলোতে যে শাস্তির বিধান রয়েছে, কোরান শরিফ সম্পর্কে দুঃসাহসিক বক্তব্যের কারণে তসলিমারও একই শাস্তি প্রাপ্য। বিজেপি, আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা যারা তসলিমাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তারা ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইনের দাবি। জামাতে ইসলামির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী বক্তা হিসেবে জনপ্রিয় বেশ। তাঁর বক্তৃতার ক্যাসেট হাটে ঘাটে মাঠে ঝালমুড়ির মত বিক্রি হয়। তিনি অগুনতি জনতার সামনে বলেছেন, সমাজতন্ত্রের ধ্বস নামার পর নাস্তিক মুশরিক ও ইহুদিবাদীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। দেশ আজ তৌহিদী জনতা ও মুরতাদ এই দুই ভাগে বিভক্ত। মুরতাদ দলের নেষনী হচ্ছে তসলিমা। সুতরাং তসলিমাকে ফাঁসি দেওয়া হলে দেশ মুরতাদ মুক্ত হবে। শায়খুল হাদিসও তাঁর বাহিনী নিয়ে পথে নেমেছেন। আর অনেকের মত তিনিও এখন সরকারকে দোষ দিচ্ছেন, আমাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে। বলেছেন, জনতার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচাবার জন্য সরকার তসলিমাকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছে। ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা ওবায়দুল হক তাঁর সভায় বলেছেন, জনমতের চাপে সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে না পারায় সরকারের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। আজ সব পত্রিকায় স্পীকারের কাছে লেখা আমার চিঠিটি ছাপা হয়েছে। ভাল কথা। খুব ভাল কথা। যে কথা আগেই জানিয়েছিলাম, সে কথা আবার জানালাম যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। এতে কী উপকার হবে আমার? এখন কি মৌলবাদীরা বলবে, যে, দুঃখিত আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছিল, তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, কারণ ও তো বলেনি কোরান সংশোধনের কথা–সুতরাং আমরা সরে দাঁড়াচ্ছি ওর ফাঁসি চাওয়া থেকে! সরকার কি বলবে, ইসরে কি মিথ্যে মামলা ঠুকে দিয়েছি। এখন ক্ষমা চেয়ে মামলা তুলে নিই! কেউ বলবে না। বলবে না কারণ সংশোধনের কথাটির জন্য মৌলবাদীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত নয়, কোরান সংশোধনের কথা শুনে সরকারের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতও লাগেনি। মৌলবাদীদের ইচ্ছে কোনও একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মাঠে নামা, নিজেদের তেজ দেখানো, রাগ দেখানো আর লোকদের ভয় দেখানো। ইচ্ছে, শক্তিমান হওয়া। এ তো মৌলবাদীদের ইচ্ছে। সরকারের ইচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মাঝখান থেকে কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে? আমি। ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দল বা বিরোধী দল আওয়ামী লীগ (এই দুটো দলই আকারে আকৃতিতে প্রতিশ্রুতিতে সন্ত্রাসে সবার ওপরে) কারও বুকের পাটা নেই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত শক্ত কথা বলে, কারণ দুই বড় দলেরই সময় সময় এই মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। সম্ভবত সরকারি দলের ধারণা ছিল না, উসকে দিলে মৌলবাদীরা এত বিকট শক্তি ধারণ করতে পারে। অথবা ধারণা ছিল, সরকারের অন্তঃস্থলে যথেষ্টই ধর্মান্ধ বিরাজ করে। আজ সব পত্রিকায় বিবৃতি বেরিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছেন দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবীগণ। দেশের যত রাজনৈতিক দল আছে ( বিএনপি এবং মৌলবাদী দল ছাড়া), দেশের যত প্রগতিশীল সংগঠন, সংস্থা, সমিতি, পরিষদ আছে, খুব বড়, বড়, মাঝারি, ছোট, সবার, দেশের যত নারী সংগঠন আছে, যত সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আছে, লেখকদের, কবিদের, নাট্যকারদের, শিল্পীদের, সাংবাদিকদের যত রকম সংস্থা আছে সবার, আবৃত্তির দলের, গানের দলের, নাচের দলের, খেলার দলের, হ্যাঁ সবারই বিবৃতি আজকের পত্রিকায়, প্রতিবাদে মুখর আজ
false
shomresh
দিয়েছি। কি ব্যাপার মশাই? নানারকম ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম। শুনুন, এ যা সম্পত্তি তার তুলনায় কোন ঝামেলাই ইমপটেন্ট হতে পারে না! আচ্ছা, এই আনা মহিলাটিকে অংশ দিতেই হবে? অমরনাথ অসহায় ভাবে মাথা নাড়লেন। বুঝুন, বাড়ির ঝি সেবা করে মাথায় উঠছে। কাটানো যায় না? কি ভাবে? কাটাতে চান? তাহলে আমার ওপর ছেড়ে দিন। অমরনাথ দ্বিধায় পড়লেন। আনাকে প্রতারিত করে পুরো সম্পত্তির দখল নিলে লাভ হয় নিশ্চয়ই কিন্তু মন সায্য দিচ্ছে না। তা ছাড়া সইসাবুদ তো আনাই প্রতুলবাবুকে দিয়ে করাবে। ব্যাপারটা জানতে পারলে সে অনর্থ করে ছাডবে। না, কারণ অভিশাপ থাকলে সম্পত্তি থেকে সুখ পারেন না তিনি। অমরনাথ মাথা নাড়লেন, দাবকার নেই, যেমন বলেছি তেমন করুন। উকিলবাবু হাসলেন, আপনার যেমন ইচ্ছে। কাগজপত্র সব তৈরী করেই রেখেছি। তিনি উঠে আলমারির দরজা খুলে একটা ফাইল টেনে আনলেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন পেন্সিলে টিক দেওয়া জায়গাগুলোয় সই করিয়ে আনুন। বাকি কাজটা আমি করে দেব। অমরনাথ স্ট্যাম্প পেপারগুলো নিয়ে মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক আছে। উকিলবাবু টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিলেন। পড়া শেষ হলে আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনি হরদেব ঘোষালকে চেনেন? আপনার বেয়াই মশাই-এর বন্ধু! চমকে উঠলেন অমরনাথ। পরীক্ষণেই মনে পড়ল কোর্ট কাছারিতে ঘোরাঘুরি করা হরদেবের নেশা। একই শহরের লোক সেই সূত্রে পরিচিত হতেই পারে। তিনি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। ভদ্রলোকের কাছে প্রতুলবাবুর কাহিনী শুনলাম। ওই আনা মেয়েটা তো মুঠোয় করে রেখেছে তাকে। খুব সুন্দরী নাকি? না। তেমন নয়। তাহলে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য ভাল। হা হা শব্দ করে হাসলেন উকিলবাবু, হরদেব বাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি রকম? আলাপ আছে। উঁহ, মনে হল আরও বেশী কিছু। যাক, আর দেরি করবেন না। একটু ইতস্তত করে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি হরদেবকে এই উইলের কথা কিছু বলেছেন? না মশাই। সেই বুদ্ধি না থাকলে ওকালতি করে খেতে পারতাম না। লোকটা একটা শেয়াল, খ্যাক শেয়াল বললেও কম বলা হয়। আমার মক্কেল আপনি, সে নয়। অমরনাথ খুশী হলেন, কত দিতে হবে? আমাকে? দুলে দুলে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন উকিলবাবু, রাজার সম্পত্তি পেতে চলেছেন। এখনই কিছু দেওয়ার দরকার নেই। তবে পাওয়ার আগে আঙুলগুলো আর মুঠো করবেন না, তাহলেই হবে। পারলে আজই সই করিয়ে আনুন। তবু যদি একটা আন্দাজ দেন। আরে মশাই, এখন আপনার পকেটে যা আছে তাতে আমার কোন আসক্তি নেই। আমি আমারটা ঠিক সময়মত আপনার কাছে চেয়ে নেব। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোর্টে চলে আসবেন। উকিলরা যেখানে বসে সেখানে খোঁজ করলে পেয়ে যাবেন। ঝোলনা ব্রিজ পেরিয়ে হাকিমপাড়ায় ঢুকলেন অমরনাথ। এত শান্ত এলাকা যে মনেই হয় না শহরে এসেছি। চারপাশে নজর রেখে তিনি এগোচ্ছিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছিল পথে হরদেবের সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়। কিন্তু প্ৰতুল বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ির গেট পর্যন্ত আসতে কোন বিঘ্ন ঘটল না। বাগানের ভেতরে পা দিতেই গন্ধটা নাকে এল। বাঁ দিকে একটা স্বাস্থ্যবান মাঝারি উচ্চতার গাছে পদ্মের মত সুন্দর ফুল ফুটেছে। একটু চিন্তা করে নামটা মনে করতে পারলেন তিনি, গ্ল্যান্ডিফ্লোরা। গন্ধে বুক ভরে যায়। ফুল ফোটে তার সময়মত শুধু মানুষের সময়টায় কোন হিসেব থাকে না। সদর দরজা যথারীতি বন্ধ। চট করে মনে হয় কেউ বাস করে না। অমরনাথ দরজায় শব্দ করলেন কয়েকবার কিন্তু সাড়া মিলল না। প্রতুলবাবু নিশ্চয়ই মারা যাননি। এই ছোট্ট শহরে প্রতুলবাবুর মত মানুষ মারা গেলে মুখে মুখে খবর ছড়াতো। হঠাৎ অমরনাথের মনে হল উইলটুইল করার আগেই যদি প্রতুলবাবু চলে যান তাহলে আনাকে এক পয়সাও দিতে হবে না। সমস্ত সম্পত্তি আইনমোতাবেক দীপাই পারে। মরে গেল নাকি? পরীক্ষণেই মাথা নাড়লেন তিনি। কিছু বিশ্বাস নেই, কোথেকে একটা উইল বেরিয়ে পড়বে আর চোখে ধুতরো ফুল দেখতে হবে। যত যাই হোক, কোন মানুষেব মৃত্যু কামনা করা ঠিক নয়। শেষ পর্যন্ত মনে পড়ল! গলাটা শুনেই চমকে ফিরে তাকালেন অমরনাথ। বাগানের রাস্তান্য দাঁড়িয়ে আছে আনা। কে বলবে বাড়ির বি। শরীর স্বাস্থ্য যেন আরও ঝকমকে। স্নান করেছে বলে আরও টাটকা দেখাচ্ছে। হাতে ফুলের সাজি। ফুল তুলতে বেরিয়েছিল। পেছনের দরজা দিয়ে। অমরনাথ আমতা আমতা করলেন, সব কিছু তৈরী করতে দেরি হয়ে গেল! আমি হনুমান নাকি যে সূর্যকে বগলে আটকে রাখব? এই সময়ে তিনি যদি স্বৰ্গে চলে যেতেন তাহলে ওই তৈরী করা কাগজ আমার কোন কাজে লাগত? অমরনাথ হাসলেন, শেষ ভাল যার সব ভাল। এখন সব তৈরী। আসুন। এদিক দিয়ে। সদর খোলা নেই। কথাগুলো বলে আনা বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। ওকে অনুসরণ করে প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি অমরনাথ হঠাৎ শিহরিত হলেন। আজকাল অঞ্জলির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক দৈবাৎ হয়। তাঁর বাসনা অঞ্জলির নির্লিপ্তির কাছে চাপা পড়ে যায়। কোথায় যেন পড়েছিলেন, বাঙালি মেয়েদের মন পয়ত্ৰিশের এপাশে চলে এলেই শরীর নিবিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অথচ আনার বয়স চল্লিশের এদিকে তো নয়ই। কিন্তু হাঁটার ধমকে সমস্ত শরীরে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার। নিজেকে সংযত করতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করছিলেন অমরনাথ। দেশটা বিলেত আমেরিকা নয়। বাঙালি পুরুষ যদি বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা হয় তাহলে মনের মধ্যে এক সন্ন্যাসীকে ধরে রাখা অবশ্য কর্তব্য। পেছনের বারান্দায় পৌঁছে একটা মোড়া এগিয়ে দিল আনা, বসুন। অমরনাথ বসলেন। সাজিটা রেখে দিয়ে এসে আনা বলল, ওমা, আপনার কি শরীর খারাপ মুখচোখ অমন হয়ে গিয়েছে কেন? অমরনাথ দ্রুত মাথা নাড়লেন, না, না। কিছু হয়নি। আনার
false
humayun_ahmed
বসে থাকব। কেন? মন ভাল করার জন্যে বারান্দায় কিছু আছে নাকি? ঘুম আসছে না। তাই বসে আছি। ঘুম আসছে না কেন? কী মুশকিল, ঘুম আসছে না কেন সেটা আমি কী করে বলব? আমি কী ডাক্তার? দুপুর বারোটার দিকে বারু মগবাজার চৌরাস্তায় উপস্থিত হল। আর হাঁটতে ভাল লাগছে না। এখন আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া যেতে পারে। যে পথে এসেছে সেই পথেই যাবে না। অন্য কোনো পথ ধরবে এটা ঠিক করতে বাবুর কিছু সময় কাটল। চেনা পথ ধরে ফেরাই ভাল। কিন্তু নান্টু সব সময় বলে যে পথে আসা হয়েছে সে পথে ফিরে যেতে নেই। সে পথে ফিরলে বিপদ হয়। বাবু কী করবে বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন সে একটি অবিশ্বাসা দৃশ্য দেখল। তার বাবা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম কিনছেন। নিজের জন্যেই কিনছেন নাকি? বাবুর উচিত পালিয়ে যাওয়া, কিন্তু সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল। বাবা একবার তাকালেন তার দিকে। তার চোখে-মুখে চিনতে পারার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠল না। তিনি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মত লাল রঙের আইসক্রিমটি কামড়ে কামড়ে খেতে লাগলেন। তার বগলে একটি ছাতা। প্রচণ্ড রোদেও ছাতা না খুলে নিশ্চয়ই প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেছেন। ঘামে ভেজা মুখ হয়েছে আয়নার মত চকচকে। তিনি আইসক্রিম হাতে রাস্তা পার হলেন। রাস্তা পার হওয়াও শিশুদের মত। কোনো দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ ছুটলেন। একজন বয়স্ক মানুষ শিশুদের মত এতগুলো কাণ্ড একসঙ্গে কিভাবে করে? বাবু নিজের অজান্তেই ডাকল, বাবা। শওকত সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। সামনেই দাঁড়িয়ে, তবু তিনি যেন তাকে চিনতে পারছেন তুই এখানে! বাবু জবাব দিল না। শওকত সাহেব জবাবের জন্য অপেক্ষাও করলেন না। সহজ ভাবে বললেন, আইসক্রিম খাবি? না। হঠাৎ তৃষ্ণা লেগে গেল। যেন তিনি ছেলের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন। খা একটা আইসক্রিম। এ্যাই, এ্যাই আইসক্রিমওয়ালা। বাবুকে আইসক্রিম নিতে হল। আমাদের সময় লালগুলি দুপয়সা দাম ছিল, দুধ মালাই একটা ছিল এক আনা করে। চল বাসায় যাই। হেঁটে যেতে পারবি, না রিকশা নেব? হাঁটতে পারব। রিকশার চেয়ে হাঁটাটাই আরাম। রিকশায় অ্যাকসিডেন্টের ভয়। পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিলে অবস্থা কাহিল। বাবু সারাক্ষণই ভাবছিল এই বুঝি বাবা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন, এইখানে কী করছিলি? স্কুলে যাসনি কেন? কিন্তু শওকত সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বরং তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল ছেলেকে হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে তিনি বেশ খুশি। রোদ লাগছে নাকি বাবু? না! রোদ লাগলে বলিস, সঙ্গে ছাতা আছে। তবে শরীরে রোদ লোগা ভাল। ভিটামিন ডি আছে। এতে শরীরের হাডিডর খুব পুষ্টি হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এই যে ভিখারিগুলো দেখছিস? সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ অসুখ-বিসুখ হয় না। বাবু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল, এমন অদ্ভুত ভাবে কথাবার্তা বলছেন কেন? আমি সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়েই হাঁটা শুরু করি। দুপুর পর্যন্ত হাঁটি আর শরীরে রোদ লাগাই। খুব উপকারী। বাবু কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। শওকত সাহেব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, জেলে কত দিনের জন্যে নিয়ে রাখে কোনো ঠিক আছে? তখন রোদও পাওয়া যাবে না, হাঁটাহাঁটিও করা যাবে না। শওকত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বাবুর হঠাৎ মনে হল বাবা শুধু কথাবার্তাতেই না দেখতেও কেমন যেন অচেনা মানুষের মত হয়ে গেছেন। হাঁটছেন কেমন কঁজো হয়ে। অস্বাভাবিক লম্বা লম্বা পা ফেলছেন। অনেক দিন পর জলিল মিয়ার চায়ের দোকানে বাকের এসে ঢুকল। আগে রোজ সন্ধ্যায় তাদের একটা আড্ডা বসত। তিন-চার বছর ধরে ভাঙন ধরেছে। একজন একজন করে খসে পড়তে শুরু করেছে। আশফাকের মত ছেলেও বিয়ে করে মদন বলে এক জায়গায় পড়ে আছে। শ্বশুরের সঙ্গে নাকি কাঠের বিজনেস করে। এক বছরের ওপর হয়েছে তার কোনো খোঁজ নেই। নিৰ্ঘাৎ বাচ্চা বাধিয়ে ফেলেছে বাই দিস টাইম। শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল ইয়াদ। তারও দিন শেষ। সকাল-বিকাল চাকরি করছে। ব্রিফকেস নিয়ে টু্যরে যাচ্ছে। শালা। পুরোপুরি ভেডুয়া হয়ে গেছে। দেখা হলেই আই.এ. পাস মেয়ের কথা শুরু হয়। নানান ধরনের গল্প। পরশুদিন একটি শুনল এ রকম, ইয়াদ নিউ মাকেটে গিয়ে দেখে তার সেই আই.এ. পাস একজন বান্ধবীকে নিয়ে শাড়ির দোকানে ঘুরছে। তারা যাতে ইয়াদকে চিনতে না পারে সে জন্যে সে চট করে সানগ্লাস পরে ফেলল। কিন্তু মেয়েটি ঠিকই চিনল। কী সব বলল তার বান্ধবীকে। সেই বান্ধবী তার দিকে চোখ ড্যাবি করে তাকাতে লাগল। অসহ্য। গল্প শুনলেই ইচ্ছা করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। ড্যাবি ড্যাবি করে তাকাচ্ছিল। ড্যাব ড্যাবি করে তাকানোর মাল হচ্ছে তুমি। শালা। ফকিরামির জায়গা পায় না। জলিল মিয়ার চায়ের সন্টলে ইয়াদ বসে ছিল। তার গায়ে কালো কোট। গলায় লাল রঙের টাই। ক্লিন শেভড। মুখে ক্রিম ঘষেছে বোধ হয়। ভুরতুর করে গন্ধ বেরুছে। বাকেরকে দেখে সে হকচাকিয়ে গেল। বাকের অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, তুই এখানে। আসলাম। দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। সাজ-পোশাক তো মাশাআল্লাহ ভালই চড়িয়েছিস। আর বলিস কেন। ওদের বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে আসবে। ওর এক দূর সম্পর্কের চাচারও আসার কথা। এক্স মিনিস্টার এল রহমান। দেখতে আসবে তো তুই এখানে কেন? চায়ের দোকানে দেখতে আসবে নাকি? বাসায় তো আর সেজোগুজে বসে থাকা যায় না। মনে করবে। ইচ্ছে করে সেজে বসে আছি। ওরা এলে রঞ্জু এসে এখান থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। ভাবটা এ রকম যেন বাইরে ছিলাম, বাসায় এসেছি।
false
humayun_ahmed
বলেই মুনা তার সঙ্গে কথা বলছে না। মেয়েরা আড়াল পছন্দ করে। কিন্তু সঞ্জু তো কাল রাতেই চলে গেছে। এর পরেও মুনা কথা বলবে না কেন? বল্টু নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে আজ ভোরবেলা কথা বলার চেষ্টা করেছে। মুনাকে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছে–মুনা, চা খেতে যাবি? একটা দোকানে দেখলাম গুড়ের চা বানাচ্ছে। মুনা বলল, গুড়ের চা খাবার জন্যে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে আছি আপনাকে কে বলল? চিনির চা-ই খাই না, তো গুড়ের চা। চা না খেলে না খাবি-চিল, হেঁটে আসি। আপনার সঙ্গে হাঁটতে যাব? হ্যাঁ। অসুবিধা আছে? অবশ্যই অসুবিধা আছে। বাঁটকু লোকের সঙ্গে আমি হাঁটি না। লোকজন দেখে ফিক ফিক করে হাসে। তারা মনে মনে বলে-লম্বা মেয়েটা এই বাঁটকুটার সঙ্গে হাঁটছে কেন? বল্টুর মন এই কথায় অত্যন্ত খারাপ হলো। এই জাতীয় কথা কি কেউ বলতে পারে? বলতে পারা কি উচিত? মুনার দেয়া স্যুয়েটার সে এখন পরে আছে। ইচ্ছা! করছে স্যুয়েটারটা খুলে টেকনাফের নদীতে ফেলে দিতে। দরকার নেই শালার স্যুয়েটারের! রানা বিরক্ত গলায় বলল, তোরা সব হাবার মতো তীরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাদের কি রওনা দেয়া লাগবে না? জোয়ার-ভাটার ব্যাপার আছে। যাকে বলে সমুদ্রযাত্রা। এক্ষুনি রওনা দিতে হবে। নো ডিলে। নীরা নিচু গলায় বলল, আমি যাচ্ছি না। রানা হতভম্ব হয়ে বলল, আমি যাচ্ছি না মানে? আমি সাঁতার জানি না। আমরা তো সাঁতরে যাচ্ছি না। নৌকায় কয়ে যাচ্ছি। আমার ভয় লাগছে। আমি যাব না। রানা অনেক কস্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করল–ঢেউ যা একটু নদীতেই দেখা যাচ্ছে–নৌকা সমুদ্রে পড়লেই সব শান্ত। তাই না মাঝি? মাঝি হাসিমুখে বলল, উল্টা কথা ন-কাইও। সাগরে ডাঙ্গর ডাঙ্গর গইর ঢেউ। তুঁই ন-জানো? নীরা বলল, অসম্ভব, আমি যাব না। আমাকে বঁটি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেললেও যাব না। আনুশকা বলল, শোন নীরা, তীৰ্থস্থানে সবার যাবার সৌভাগ্য হয় না। অনেকেই খুব কাছ থেকে ফিরে যায়…. নীরা আনুশকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যারি, এক সময় আমি এরকম কথা বলেছিলাম। আমি সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি যাব না। প্লিজ, না। নীরার গলায় এমন কিছু ছিল যে সবাই বুঝল নীরা যাবে না। কেউ কিছু বলল না। দীর্ঘ সময় সবাই চুপচাপ। রানার চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। জরী বলল, নীরা, সত্যি যাবে না? না জরী। আমি যাব না। নৌকায় উঠলেই আমি ভয়ে মরে যাব। আমি পানি অসম্ভব ভয় পাই। তোদের সঙ্গে ঠিক করেছি। কিন্তু আসল কথাটাই কখনো মনে আসে নি। মুনা বলল, তাহলে কী হবে? আমাকে নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। আমি একটা বাস ধরে কক্সবাজার চলে যাব। সেখান থেকে ঢাকা। আনুশকা বলল, এটা একটা কথা হল? আমি যা করছি খুব অন্যায় করছি। আমি সেটা জানি। ভয়কে জয় করতে হয় নীরা। সব ভয় জয় করা যায় না। রানা বলল, এখন তাহলে কী করা? নীরাকে একা একা যেতে দেয়া যায় না। একজন-কাউকে নীরার সঙ্গে যেতে হবে। কে যাবে? বল্টু বলল, আমি। আমি নিয়ে যাব। মুনা অবাক হয়ে বল্টুর য় আছে। কী বলছে এই মানুষটা? সে কি মুনার ওপর রাগ করে বলছে? এত রাগ কেন? মুনার সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল—অয়ন ভাই, আপনি যাবেন না। প্লিজ, প্লিজ। আমি নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ে। আপনিও হতদরিদ্র একজন মানুষ। কোনোদিন যে আবার আমরা সমুদ্রের কাছে আসতে পারব—আমার মনে হয় না। কী সুন্দর একটা সুযোগ্য! আমার ওপর রাগ করে আপনি এই সুযোগটা নষ্ট করবেন। না। আমি জানি, আমি নানাভাবে আপনাকে কষ্ট দিই। আপনাকে আহত করি। কেন করি আমি নিজেও জানি না। প্রতিবার কষ্ট পেয়ে আপনি যখন মুখ কালো করেন তখন আমার ইচ্ছা করে খুব উচু একটা বিল্ডিং-এ উঠে সেখান থেকে লাফিয়ে রাস্তার পড়ে যেতে। অয়ন ভাই, বলুন তো আমার স্বভাবটা উলটো হলো কেন? কেন আমি আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলাম না? আমার ধারণা, আমি খুব বাজে ধরনের একটা মেয়ে। আপনার এই ধারণা সত্যি নয়। খুব ভুল ধারণা। আমি যে কত ভালো একটা মেয়ে সে জানে শুধু আমার মা। একদিন আপনিও জানবেন। সেই দিনটির জন্যে আমি কত যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি! অয়ন ভাই, আমাদের আর্থিক অবস্থাটা যে কত খারাপ সেটা তো আপনি জানেন—তার পরেও মার সংসার-খরচের টাকা চুরি করে আপনার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনলাম। আপনার একটাই স্যুয়েটার। সেটাও অনেকখানি ছেড়া। ছেড়া ঢাকার জন্যে আপনি সবসময় স্যুয়েটারের উপর একটা শার্ট পরেন। একদিন আমাকে বললেন-মানুষ কেন যে শার্টের উপর স্যুয়েটার পরে আমি জানি না। কী বিশ্ৰী লাগে দেখতে! মনে হয় শার্টের উপর একটা ভারি গেঞ্জি পরে আছে। আপনার কথা শুনে আমি সেদিন কী কষ্ট যে পেয়েছিলাম! সারা রাত কেঁদেছি আর বলেছি, কেন একজন মানুষ আপনার মতো দরিদ্র হয়—আর কেন আরেকজন হয় শুভ্ৰ ভাইয়ার মতো ধনী? নানা ধরনের কস্টের মধ্যে আমি বড় হচ্ছি। একধরনের আশা নিয়ে বড় হচ্ছি-গভীর রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ মনে হয়—হয়তো সামনের দিনগুলি অন্যরকম হবে। অয়ন ভাই, আমি একটা ঘোরের মধ্যে আপনার সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। সবাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল। আমি কিন্তু একটুও লজ্জা পেলাম না। মনে মনে বললাম—এই ব্যাপারটা নিয়তি সাজিয়ে রেখেছে।
false
MZI
যে তোমার সাথে এত দুর্ব্যবহার করেছি। এস জীবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্ত আমরা ভুলে যাই তুমি নীলমানব এবং আমি মানুষ। দুজনে একসাথে বসে বসে খেতে খেতে কথা বলি। কিন্তু রিরা নীলমানবের কাছে গেল না, ক্যাপ্টেনের সুদৃশ্য ঘরে একা একা খাবারের ট্রে সামনে নিয়ে বসে রইল। রিরা মনিটরের সামনে নিঃশব্দে বসে আছে। মহাকাশযানটি একটা নিউট্রন স্টারের গা ঘেঁষে যেতে যেতে গতি সঞ্চয় করছে—দূরে একটা গ্রহাণুপুঞ্জ, তার ভেতর দিয়ে যাবার কথা। রিরা গ্রহাণুপুঞ্জটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মহাকাশযানের মূল প্রসেসরকে জিজ্ঞেস করল, এই গ্রহাণুপুঞ্জের সব গ্রহ-উপগ্রহ কি নিখুঁতভাবে ক্যাটালগ করা আছে? আছে। এটা আমাদের নিয়মিত রুটের মাঝে পড়ে। তা হলে আমরা এখানকার ভালো দেখে একটা গ্রহে নেমে পড়ি না কেন? মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এটি একটি অত্যন্ত অবাস্তব পরিকল্পনা। রিরা একটু রেগে উঠে বলল, কেন? অবাস্তব পরিকল্পনা কেন? এই মহাকাশযানটি খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—কোনো গ্রহে নামা বা সেখান থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। নামতে গেলে বিধ্বস্ত হবার আশঙ্কা শতকরা নব্বই ভাগ থেকে বেশি। রিরা কাঠকাঠ স্বরে হেসে উঠে বলল, মহাকাশে যেতে থাকলে এমনিতেই মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে যাবে—তা হলে নামার চেষ্টা করে বিধ্বস্ত হওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ না? যদি বেঁচে যাই, তা হলে কী লাভ হবে বুঝতে পারছ? না, বুঝতে পারছি না। তা হলে হয়তো ভবিষ্যতে কখনো কোনো মহাকাশযান এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে। তার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য চার ভাগ। রিরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি তোমার সম্ভাবনা হিসাব করে বের করা একটু বন্ধ করবে? আমি দুঃখিত রিরা। মূল প্রসেসর তার শুক ধাতবস্বরে বলল, আমি তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করছিলাম। তোমার যেখানে সাহায্য করার কথা, সেখানে সাহায্য করলেই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে না। ঠিক আছে। এখন ক্যাটালগ দেখে আমাকে জানাও কোন গ্ৰহটাতে নামা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি সবগুলো গ্রহ পরীক্ষা করে দেখলাম। এর কোনোটাই দীর্ঘ সময় থাকার উপযোগী নয়। রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে খুব সহজ একটা জিনিল বোঝানো যাচ্ছে! আমি আমার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এই গ্রহে যাচ্ছি না। আমি এই গ্রহে যাচ্ছি কোনো উপায় না দেখে হয়তো এই গ্রহে কিছুদিন থাকা যাবে—যে সময়ের ভেতরে কোনো উদ্ধারকারী মহাকাশযান আমাদের খুঁজতে আসবে। বুঝেছ? বুঝেছি। তা হলে আমাকে বলে কোন গ্রহটা সবচেয়ে কম বিপজ্জনক। মহাকাশযানের মূল প্রসেসর বলল, প্রথম প্রহটা ছোট–বায়ুমণ্ডল নেই, প্রতিমুহূর্তে উল্কাপাত হচ্ছে–খুব বিপজ্জনক। দ্বিতীয় গ্রহটা এখনো শীতল হয় নি, অসংখ্য আগ্নেয়গিরি ক্রমাগত লাভা বের হচ্ছে, এটাও বিপজ্জনক। তৃতীয় গ্ৰহটাতে একটা বায়ুমণ্ডল আছে, তাপমাত্রাও মোটামুটি আরামদায়ক–তবে গ্রহটা পুরোপুরি অন্ধকার। রিরা মাথা নেড়ে বলল, উহুঁ, অন্ধকার গ্রহে যাওয়া যাবে না। মহাকাশযানের প্রসেসর বলল, চতুর্থ গ্রহটাকে মনে করা যায় বাসযোগ্য, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এর মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ জি-এর কাছাকাছি। গ্রহটি মোটামুটি আলোকিত, একটা কাজ চালানোর মতো বায়ুমণ্ডল আছে, তবে অক্সিজেন সাপ্লাই না নিয়ে তুমি বের হতে পারবে লা। রিরা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার! আগেই চমৎকার বলো না। মানুষ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এখানে কলোনি করেছিল, কিন্তু– কিন্তু কী? কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে কলোনির সবাই মারা পড়েছিল। কারণটা বের করতে পারে নি মানুষ আর কখনো ফিরে আসে নি। রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ? না রিরা। আমি ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখছি। অনেক ধন্যবাদ সেজন্য। রির অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে কয়েকবার শব্দ করে বলল, এই গ্রহের সব মানুষ কেন মারা পড়েছিল, সেটা নিয়ে কোনো তথ্য আছে? না নেই। মহাকাশযানের প্রসেসর তার শুকণ্ঠে বলল, তবে অসমর্থিত একটা তথ্য আছে। সেটা কী? এই গ্রহে কোনো এক ধরনের প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধিহীন, ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী। রিরা একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, আমার জীবনে যেন যথেষ্ট উত্তেজনা নেই—এখন। বুদ্ধিহীন ভয়ংকর নৃশংস প্রাণীর সাথে সময় কাটাতে হবে! কপালটা দেখেছ? এর চাইতে ভালো কোনো গ্রহ আছে? না। অন্য গ্রহগুলো বড় এবং অস্থিতিশীল। জি-এর মান এত বেশি যে নিজের শরীরের ওজনেই মারা পড়বে। বেশ, তা হলে বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণীর গ্রহটাতেই নামার ব্যবস্থা কর। কাজটি জটিল এবং বিপজ্জনক। আমি জানি। রিরা হাসার চেষ্টা করে বলল, বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। তবুও কি আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি না? মহাকাশযানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়েছে—অবতরণ করাটি প্রায় দুঃসাধ্য। তুমি কিছু চিন্তা করো না রিরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? হ্যাঁ। এত অবাক হচ্ছ কেন? মূল প্রসেসর শুষ্ক এবং ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, আমি অবাক হচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে কী, অবাক বা রাগ হওয়ার মতো মানবিক ক্ষমতাগুলো আমাদের নেই। তবে ঘোর অবাস্তব পরিকল্পনা আমরা নিরুৎসাহিত করি। আমরা করি না। রিরা গলায় খানিকটা উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে বলল, মহাকাশ একাডেমিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে মহাকাশযান অবতরণের ওপরে আমার একটি কোর্স ছিল। দেখা যাক যেসব বিষয় শিখিয়েছে সেটা সত্যি কি না! মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কোনো কথা না বলে শুধুমাত্র একটা যান্ত্রিক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল। প্রথমে মহাকাশযানটিকে গ্রহের কক্ষপথে আটকে নিতে হল, পুরো কাজটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময় এটি যে বিশাল গতিবেগ সঞ্চয় করেছে, তার
false
shomresh
বিকেলে আপনারা আমার দোকানে দয়া করে পায়ের ধুলো দিয়েছেন। আপনার দোকানে? আজ্ঞে। শেঠ বাবুলাল অ্যান্ড সন্স আমারই দোকান। শেঠ বাবুলাল আমার বাবা। তিনি গত হয়েছেন বছরপাঁচেক হল। কিন্তু এখানকার মানুষের মুখে তিনি এখনও বেঁচে আছেন। আমি যা কিছু করছি সবই তাঁর আশীর্বাদে। ভদ্রলোক দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে পিতৃদেবকে শ্রদ্ধা জানালেন। অর্জুন কল্পনাই করেনি তার খেলাচ্ছলে ঘুরে আসা এতটা কার্যকর হবে। সে গম্ভীর গলায় বলল, বলুন। আমার ছোট্ট দোকান আপনি দেখে এসেছেন। এখানেই জন্ম, কর্ম আমার। কাঠমণ্ডুতে কোথায় কী হচ্ছে, কী পাওয়া যাচ্ছে তার খবর রাখতে হয় এই ব্যবসা বানাতে গেলে। মিস্টার জন বেইলির নেতৃত্বে একটা অভিযান হচ্ছে এই খবরটা জানতাম। এরকম তো কতই হয়! মাথা ঘামাইনি তাই। আপনি চলে আসার পর খবর নিয়ে জানলাম অভিযানটা হচ্ছে ইয়েতিদের ছবি তুলতে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন হিলারিসাহেব পাহাড় থেকে ঘুরে এসে বলেছিলেন ইয়েতি বলে কিছু নেই। নীল রঙের একধরনের ভালুককেই লোকে ইয়েতি বলে ভুল করছে। কিন্তু একথা পাহাড়ের মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে ইয়েতি আছে। আপনিও তাই মনে করেন জেনে ভাল লাগল। প্রবীণলাল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরলেন। অর্জুন মাথা নেড়ে না বলে, কী করে মনে হল? আরে, ইয়েতি আছে বিশ্বাস না করলে আপনি দোকানে খোঁজ করবেন কেন? প্রবীণলাল বললেন, এই দলে আপনিই একমাত্র ভারতীয়। আরে আমিও তাই। এখানে পড়ে আছি পেটের দায়ে। আপনার সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চাই। কীরকম? যদি সত্যি ইয়েতির কোনও নিদর্শন খুঁজে পান তা হলে আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিক্রি করবেন না। দামের জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না। প্রস্তাবটা আপনি আমাদের নেতা জনসাহেবকে দিচ্ছেন না কেন? সাহেবদের আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি দলের সঙ্গে যাচ্ছি। নেতা যা বলবেন তাই করতে হবে। আপনি বলছেন ওগুলোর ভাল দাম হবে। তা হলে লোক পাঠিয়ে নিজেরাই নিয়ে আসছেন না কেন? সম্ভব না। নেপাল সরকারের অনুমতি ছাড়া ওখানে যাওয়া যায় না। কিন্তু বরফের ওপরের গ্রাম থেকে লোকজন এখানে আসে বলে শুনেছি। ওখানকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে ওই আইন চালু নেই। আরে মশাই, সেই চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়। কিন্তু কাজ হয়নি। আর আপনি যদি সাহায্য করতে চান তা হলে নেতাকে না জানালেই হল। এখন পর্যন্ত কেউ আনতে পারেনি? না। বাজারে একটা খবর চালু হয়েছে যে, ইয়েতির মাথা নাকি কাঠমণ্ডুতে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি না। মাথা নাড়লেন প্রবীণলাল। আর কেউ কি এসবের ব্যবসা করেন এখানে? বলেই যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে অর্জুন বলল, হ্যাঁ, কী নাম যেন, এস, কে, গুপ্তা, তাই না? আচমকা প্রবীণলালের চোখ ছোট হয়ে গেল, ওকে আপনি চেনেন? না। টিভিতে নাম শুনলাম। অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন। তখন পরিচয় দেওয়ার সময় বলা হল উনি কিউরিও নিয়ে ব্যবসা করতেন। অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল অর্জুন। প্রবীণলালের টানটান মুখ আস্তে-আস্তে সহজ হল। হাসি ফুটল মুখে। মাথা নেড়ে বললেন, তাই বলুন। আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আরে মশাই, অন্যায় করলে ভগবান ঠিক শাস্তি দিয়ে দেন। ওকে আপনি চিনতেন? বিলক্ষণ। কেউ মারা গেলে দুনাম করতে নেই, কিন্তু যা সত্যি তা চিরকালই সত্যি। হিটলার যে খুনি ছিলেন তা মারা গেছেন বলে কি বলব না? ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার ছিল মশাই। ওই ইয়েতির মাথার গল্পটা ওই চালু করেছিল। যাক গে, আপনার সঙ্গে সব কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত। উঠে দাঁড়ালেন প্রবীণলাল। তারপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে সামনে ধরলেন, এটা নিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করুন। এটা অ্যাডভান্স। কী এটা? সামান্য টাকা। রাস্তায় খরচ করবেন। আপনি হয়তো জানেন না আমরা এখান থেকে হেলিকপ্টারে যাচ্ছি। যেখানে নামব সেখানে বরফ আর ফাঁকা পাহাড়। মানুষ যেখানে হাতে গোনা। সেখানে দোকান কোথায় পাব খরচ করার! ইয়েতিরা নিশ্চয়ই দোকান খোলেনি? অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আপনাকে তো আগেই বলেছি আমাদের দলনেতার সঙ্গে কথা বলতে। ঠিক আছে, যদি ইয়েতিদের কিছু খুঁজে পাই তা হলে কাঠমণ্ডুতে ফিরে আপনাকে ফোন করব। আপনার সঙ্গে কার্ড আছে? ভদ্রলোক মাথা নেড়ে পার্স থেকে কার্ড বের করে দিলেন। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কয়েক সেকেন্ড বাদে অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এল। ওপর থেকে দেখতে পেল প্রবীণলাল হেঁটে গাড়িতে উঠলেন। দুজন লোক গাড়ির সামনের সিটে উঠে পড়ল। তার মানে ভদ্রলোক দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। একজন কিউরিও ব্যবসায়ীর দেহরক্ষীর কখন প্রয়োজন হয়? সকালে জন বেইলির ঘরে সবাই জিনিসপত্র রাখার পর তিনি একটা ম্যাপ দেখিয়ে বোঝাতে লাগলেন ঠিক কোন জায়গায় আজ হেলিকপটার নামছে। দলের অন্য সবাই এর আগেই মাপের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা একবার নজর বুলিয়ে মাথা নেড়ে সরে যাচ্ছিলেন। এধরনের ম্যাপ অর্জুন আগে কখনও দ্যাখেনি। তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। পাশে দাঁড়ানো ডানা যখন হেসে বলল, ম্যাপ দেখে আমি কী করব। আপনি যখন যেমন বলবেন তাই করব। জন মাথা নাড়লেন, নো। নট অ্যাট অল। ধরো, তুমি ওখানে গিয়ে পথ হারালে। কাউকে খুঁজে পাচ্ছ না। তখন এই ম্যাপ, কম্পাস তোমার জীবন বাঁচাবে। বুঝলে মাই লিটল লেডি! পর্বত অভিযানের কাহিনী অনেক পড়েছে অর্জুন। পাহাড়ে ওঠার আগে যে প্রস্তুতি নিতে হয় তা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রচুর মালপত্র, খাবার, এলাহি ব্যাপার। কুলির মাথায় চাপিয়ে সেসব নিয়ে আসা হয় বেসক্যাম্পে। সেখান থেকে মূল অভিযান শুরু হয়।
false
humayun_ahmed
পাওয়া গেল। শুভ্ৰ খাতা নিয়ে উবু হয়ে বসেছে। লেখা শুরু করেছে। মোবারক যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে শুভ্রর কাণ্ডকারখানা দেখছে। কী লেখা হচ্ছে তা সে শুভ্রর ঘাড়ের ওপর উঁকি দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। শুভ্ৰ লিখছে— যুথী, রাশিয়ান পাগলা সাধু রাসপুটিন কীভাবে মারা গেছেন জানো? তিনি মারা যান পেট্রোগ্রাডে, যার বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৯১৬ সনে। তাঁকে প্রথমে প্রচুর সায়ানাইড মেশানো মদ এবং কেক খাওয়ানো হয়। তাতে তাঁর কিছুই হয় না। প্রিন্স ০ তখন তাঁর বুকে পিস্তল দিয়ে কয়েকটি গুলি করেন তাতেও রাসপুটিনের কিছু হয় না। বরং রাসপুটিন প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন। মৃত্যুর কোনো লক্ষণ না দেখে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। তাঁর মৃত্যু হয় পানিতে ড়ুবে। বলতে ভুলে গেছি, তাঁকে চটের থলিতে ভরে পানিতে ফেলা হয়েছিল। আমার নিজেকে এই মুহূর্তে রাসপুটিনের মতো লাগছে। কারণটা বলছি। এই পর্যন্ত লিখে শুভ্ৰ মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এক কাপ চ্যা খাওয়াতে পারবেন? মোবারক বলল, অবশ্যই। দুধ চা না রঙ চা? শুভ্র বলল, দুধ চা। আপনি একটু দূরে বসতে পারবেন? ঘাড়ের ওপর দিয়ে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি লিখতে পারি না। ভালো কথা, যে বস্তায় ভরে আমাকে পানিতে ফেলা হবে সেটা কি আনা হয়েছে? সব রেডি। বস্তা, ইট, সব। যে আমাকে পানিতে ফেলবে তাকে আমার দেখার ইচ্ছা ছিল। তার নাম কী? তার নাম বলা যাবে না। তবে আপনেরে বলতে বাধা নাই। আপনে তো আর কাউরে গিয়া বলবেন না। সেই সুযোগ নাই। তারে আমরা হায়ার করে এনেছি। তার নাম কানা ছালামত। একটা চোখ কি নষ্ট? চোখ ঠিকই আছে, তারপরেও নাম কানা। শুভ্ৰ বলল, কানা নাম হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। কলেজে সবাই আমাকে কানা বাবা ডাকত। কারণ আমি চোখে কম দেখি। কানা ছালামতের নামের পেছনের গল্পটা কী? এত কথা বলতে পারব না। চিঠি শেষ করেন। হাতে সময় নাই। শুভ্র বলল, চা আসুক। চায়ে চুমুক দিয়ে লেখা শুরু করি। যুথী হেকমতের চায়ের দোকানে বসে আছে। হেকমত তাকে বলল, যার জন্যে এসেছেন তার আশা ছেড়ে দেন। সে ধরা খেয়েছে কানা ছালামতের হাতে। এতক্ষণে বস্তায় ভাইরা তারে পানিতে নামায়ে দিয়েছে। খেল খতম কইরা সে পয়সা হজম কইরা ফেলছে। যুথী বলল, ভ্যাজর ভ্যাজার করবেন না প্লিজ। আপনার পরিচয় কী? আপনি তার কে হন? আমি তার কেউ হই না। তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে এসেছি। মজিনা মেয়েটার ঘর কোথায়? জানি না কোথায়। চর তো ছোট না। বিশাল চর। কোন চিপায় ঘর তুলছে খুঁইজা বাইর করেন। শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এই ব্যাপারটা যুথীর কাছে এখন পরিষ্কার। বিপদের ধরনটা বুঝতে পারছে না। সে কার কাছে সাহায্যের জন্যে যাবে তাও জানে না। চরে নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ নেই। কানা ছালামত নামের একজন কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কানা ছালামতটা কে? কোথায় তাকে নিয়ে গেছে? সত্যি মেরে ফেলবে? মানুষ মারা এত সহজ? যুথী হেকমতের দোকান থেকে বের হয়ে মর্জিনার বাড়ি খুঁজে বের করল। চরের সবাই জড়ো হয়েছে সেখানে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যুথীর নিজেকে অসহায় লাগিছিল, এখন ততটা লাগছে না। চারের মানুষজন শুভ্রর নিখোঁজ হবার খবর পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাদের ব্যাকুলতা অবাক হয়ে দেখার মতো। একজন রোগামতো মানুষ যুথীকে বলল, আফা শুনেন, শুভ্ৰ ভাইজানের ক্ষতি যদি কেউ করে তারে আমরা চাবায়া খায়া ফেলব। সে যত বড় নবাবের পুতই হউক। সবাই সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, অবশ্যই! একজন বলল, কানা ছালামন্তরে আমরা যদি চাবায়া না খাই তাইলে আমরা পিতামাতার জারজ সন্তান। আবার হুঙ্কার উঠল, অবশ্যই! মর্জিনা কোনো আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না। সে বাবার কবরের পাশে পাকুরগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি অপ্ৰকৃতস্থের দৃষ্টি। তার হাত মুঠি করা। সেখানে নীল রঙের একটা ডিম। ডিমটা পাখির। শুভ্ৰ ভাইজানের সঙ্গে মজা করার জন্যে সে বলেছিল সাপের ডিম। ভাইজান তা-ই বিশ্বাস করে ডিমটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মিথ্যা কথাটা বলার জন্যে মর্জিনার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। ভেতরে ভেতরে মর্জিনা অনেক শান্ত। তার সবকিছু ঠিক করা আছে। নাইলনের দড়ি পর্যন্ত কেনা আছে। শুভ্ৰ ভাইজানের খারাপ খবর পাওয়া মাত্র সে ঝুলে পড়বে। যুথীর সঙ্গে একটা মোবাইল টেলিফোন সেট আছে। মেরাজউদ্দিন দিয়ে দিয়েছেন। চরে মোবাইল সেটটা কাজ করছে না। কোনো সিগন্যাল নেই। যুথী ঢাকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না। তবে সে জানে না যে মেরাজউদ্দিন হেলিকপ্টার নিয়ে রওনা হয়েছেন। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় হেলিকপ্টার চরে নামবে। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আসছেন। রেহানা স্বামীর পাশে মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টিও অপ্রকৃতস্থ। কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। মেরাজউদ্দিন বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তোমার ছেলেকে দেখবে। রেহানা বললেন, আচ্ছা। তাকে প্রথম কথা কী বলবে ঠিক করেছ? না। আমি শিখিয়ে দিব? দাও। মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি তাকে বলবে ইউ নিটি বয়। রেহানা বিড়বিড় করে বললেন, ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়। শুভ্ৰকে লঞ্চের ছাদে আনা হয়েছে। সেখানে কানা ছালামত তার দুই সঙ্গী নিয়ে বসা। তাদের সামনে ইটভর্তি চটের বস্তা! কানা ছালামত বলল, আপনি যে চিঠি লিখেছেন সেটা পড়লাম। চিঠি সুন্দর লিখেছেন। এই অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় একটা চিঠি লিখতে পেরেছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার। শুভ্র বলল, অন্যকে
false
humayun_ahmed
এ-দোকান ও-দোকান করছে। ছোট চাচা বললেন, টুকু, একটা সমস্যা হয়েছে। তোকে বলা দরকার। আমি বললাম, কী সমস্যা? তিনি বেশ সহজ গলায় বললেন, এই সমিতা মেয়েটাকে আমি বিয়ে করব বলে ভাবছি। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, কবে? সেটা এখনো ফাইনাল করি নি। কবে বিয়ে করব সেটা ইম্পৰ্টেন্ট নয়। বিয়ে করব সেটাই ইম্পৰ্টেন্ট। বলেই ছোট চাচা গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কারণ কুদ্দুস টাকার ভাংতি পেয়েছে। সে সিগারেট নিয়ে ফিরছে। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, বাড়ির কেউ জানে? না। আমি বলব সবাইকে। লুকিয়ে রাখার মতো তো কিছু না। ছোট চাচার গাড়ি উড়ে চলল। তিনি আস্তে গাড়ি চালাতে পারেন না। গাড়ি হু হু করে ছুটছে। আমি বসে বসে ঘামছি। কী সর্বনাশের কথা। মেজো খালুরা একটি দুতলা বাড়ির একতলায় থাকেন। বাড়ির নাম নীল কুঠির। অবশ্যি কুটির বানানটা ভুল করে লেখা কুঠীর। ভুল নামের বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় এই বাড়িতে ঝামেলা আছে। নীল কুঠির মেজো খালুর নিজের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি। উত্তর শাহজাহানপুরে তিনি চমৎকার একতলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন। এ মাসের শেষ শুক্রবারে তাঁদের নিজ বাড়িতে উঠার কথা ছিল। মেজো খালু সে সুযোগ পেলেন না। তাঁদের বাড়ির সবাই দীর্ঘদিন এই নিয়ে বলাবলি করবে। মেজো খালুর প্রসঙ্গ উঠলেই বলবে, আহা, বেচারা নিজের বাড়িতে একরাত কাটাতে পারল না। কী ক্ষতি হতত কয়েকটা দিন পরে মারা গেলো যেন আর কটা দিন পরে মারা গেলে এই মৃত্যু সহনীয় হত। আমি লক্ষ করেছি সব মৃত মানুষকে নিয়ে একটানা-একটা অতৃপ্তির গল্প চালু থাকে। কেউ হয়তো মৃত্যুর আগের দিন বলেছিল, মা। খুব ঝাল দিয়ে পাবদা মাছ রাধ তো। খেতে ইচ্ছা করছে। মা রাঁধেন নি। এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। আজ তিনি শুধু পাবদা মাছ না, কোনো মাছই খেতে পারেন না। মৃত লোকের চেয়ে তার অতৃপ্তির ব্যাপারটি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। মৃত মানুষটির কথা কেউ বলে না। তার অপূর্ণ সাধের গল্প করে। আচ্ছা, এমন কেউ কি আছে মৃত্যু। মুহূর্তে যার কোনো অপূর্ণ সাধ ছিল না? যে যাত্রা শুরু করে একজন পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত এবং সুখি মানুষ হিসেবে? আমি দাঁড়িয়ে আছি নীল কুঠিরের গেটের বাইরে। আমার মনে উচ্চ শ্রেণীর সব ভাব আসছে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। সকালের সিগারেটটি খাওয়া হয় নি। সিগারেট ধরাবার একটা চমৎকার জায়গা। সিগারেট ধরালাম। এবং সুখ কী এই নিয়ে চিন্তা শুরু করলাম। এইসব চিন্তা-ভাবনার বুদ্ধি বড় চাচার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি আমাদের আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে এ জাতীয় ট্রেনিং ছেলেবেলায় দিয়েছেন—বুঝলি, যখন কিছু করার থাকবে না তখন চিন্তা শুরু করবি। ধর, সুন্দর একটা গাছ দেখলি, তখন কী করবি? নিজেকে প্রশ্ন করবি-গাছটা সুন্দর লাগছে কেন? সৌন্দর্য ব্যাপারটা কী? বড় চাচার ট্রেনিঙে আমাদের আত্মার শক্তির কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে কি-না আমি জানি না তবে খানিকটা ভ্যাবার মতো যে হয়েছি তাতে সন্দেহ নেই। কে, টুকু না? ফিলসফিক চিন্তা-ভাবনা থেকে সরাসরি ধুলা-কাদার পৃথিবীতে চলে এলাম। প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। যিনি প্রশ্ন করছেন তিনি মেজো খালুর বড় ভাই। পর্যটনের বড় অফিসার। পর্যটনের অফিসাররা সব সময় খানিকটা সেজেগুজে থাকেন। তাঁদের দেখলেই মনে হয় এই বুঝি বেড়াতে যাচ্ছে। হয় পিকনিকে, নয় বিয়েবাড়িতে। এই ভদ্রলোক নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও লাল টকটকে একটা টাই পরে এসেছেন। জুতা যেমন চকচক করছে, তাতে মনে হয় বুট পালিশওয়ালাকে দিয়ে পালিশ করানো। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা। এঁর সঙ্গে আমার এমন কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই যে তিনি আমাকে তুই তুই করে বলবেন। আমি লক্ষ করেছি, আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজন (নিকট কি দূরের) আমাকে তুই তুই করে বলেন এবং দেখা হওয়ামাত্র কোন একটা ফরমায়েস দিয়ে বসেন। সম্ভবত আমার চেহারায় চাকর চাকর একটা ভাব আছে। মেজো খালুর বড় ভাই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, তিনি এখন বলবেন—চট করে এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে আয় তো দেখবি যেন ড্যাম্প না হয়। সত্যি সত্যি ভদ্রলোক একটা এক শ টাকার নোট বের করে ইতস্তত করতে লাগলেন। আমি বললাম, কিছু আনতে হবে? তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, তিন কেজি চিনি নিয়ে আয় তো। ঘরে এক দানা চিনি নেই, এদিকে লোকজন যারা আসছে, তাদের এটলিস্ট এককাপ চা তো অফার করা দরকার। এর নাম সামাজিকতা। মরেও রক্ষা নেই, সামাজিকতা চালিয়ে যেতে হবে। হোয়াট এ সোসাইটি। তিন কেজি চিনি কিনলাম। পঁয়ত্রিশ টাকা করে তিন কেজির দাম নিল এক শ পাঁচ টাকা। আমি দোকানদারকে বললাম, আমার কাছে এক শ টাকাই আছে। আপনি কি পাঁচটা টাকা কম রাখতে পারেন? দোকানদার বলল, একদাম। এমনভাবে বলল যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পাঁচ টাকা কমানোর প্রস্তাবে সে খুবই অপমানিত বোধ করছে। আমি বললাম, আপনি এক কাজ করুন, এখান থেকে পাঁচ টাকার চিনি কমিয়ে ফেলুন। দুই খাবলা চিনি নিয়ে নিন। দোকানদার মনে হল এতে আরো অপমানিত বোধ করল। এক ধরনের মানুষই আছে যারা কথায় কথায় অপমানিত বোধ করে। এদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—ভাই কেমন আছেন? এরা অপমানে নীল হয়ে যায়। মনে করে, তাদের দারুণ অপমান করা হল। এই দোকানদার বোধহয় সেই পদের। সে চিনি কমাল না। প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে মুখঝামটার মতো
false
shunil_gongopaddhay
না, নদীর জল চঞ্চল, তাই মাটির পাত্রে জল ধরে রাখা হয়, দু-তিন দিন থিতিয়ে ওপরের জল পরিষ্কার হলে দুপুরের রোদে মেয়েরা সেই জলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। নারী জাতি রূপ-সচেতন। পুরুষদের মধ্যে এরকম রীতি নেই। কিছু কিছু ব্যবহার মেয়েদের মানায়, পুরুষদের পক্ষে তা অনুকরণ করতে যাওয়া মানহানিকর। কোনও কৌতূহলী কিশোর কখনও বাড়িতে এরকম মাটির পাত্রে ধরা জলের সামনে মুখ নিয়ে এলে তার পিতা তাকে প্রচণ্ড শাসন করেন। মাটিতে তার মুখ ঘষে দেন। সেইসব কিশোর-যুবকেরা কখনও কোনও ঝর্ণায় কিংবা দিঘিতে উবু হয়ে চুমুক দিয়ে জল খেতে গিয়ে দেখতে পায় একটি মুখের ছায়া। সবিস্ময়ে ভাবে, এই কি আমি? প্ৰজারা জানতে পারবে না, মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য প্রাসাদের অলিন্দ থেকে আজ ছবি তুলবেন। আজ তাঁর রাজ্যের সমস্ত অঞ্চল থেকে সমস্ত উপজাতীয় প্রজারা আসবে, আজই সুবর্ণ সুযোগ। ব্যাভেরিয়া থেকে সদ্য নতুন একটি ক্যামেরা আনিয়েছেন, তাতে নাকি দূর থেকে স্পষ্ট ছবি তোলা যায়, আজ সেই ক্যামেরারও পরীক্ষা হবে। কয়েকটি দল এসে গেছে এরই মধ্যে। সামনের বিশাল চত্বরে প্রত্যেকটি উপজাতীয়দের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে স্থান। এক একটি মিছিল এসে অলিন্দের নীচে দাঁড়িয়ে মহারাজের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে চলে যাচ্ছে নিজেদের জায়গায়। এ সময় স্বয়ং মহারাজের দর্শন দেবার প্রথা নেই, প্রজারা আনুগত্য জানাচ্ছে রাজপ্রাসাদকে। সূর্যাস্তের পর যখন দশমীর চাঁদ উঠবে, তখন চন্দ্ৰবংশীয় এই রাজা গিয়ে দাঁড়াবেন সব প্রজাদের মাঝখানে একটি অনুচ্চ বেদীতে, বিভিন্ন দলপতি এসে উপহার দ্রব্য এনে রাখবে তাঁর সামনে। আজকের দিনে নজরানা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। রাজকোষ থেকেই এত বিশাল ভোজের ব্যবস্থা, কিন্তু এই সরল আদিবাসীরা যতই দরিদ্র হাকে, রাজদর্শনে আসার সময় কিছু-না-কিছু ভেট আনবেই। এই পর্ব শেষ হবার পর মহারাজ প্রজাদের সঙ্গে অন্ন গ্ৰহণ করবেন মাটিতে এক পঙক্তিতে বসে। এই প্রথা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। বিজয়া দশমীর দিনে হাসাম ভোজন। কেউ কেউ একটু শুদ্ধ করে বলে অসম ভোজন। এতগুলি উপজাতির মধ্যে রয়েছে অনেক রকম ভেদাভেদ। প্রায় সকলেই অতি দরিদ্র ও অর্ধ নগ্ন, তবু এর মধ্যে কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় নিজেদের মনে করে উঁচু জাত। এক উপজাতির সঙ্গে অন্য উপজাতির বিবাহ সম্পর্ক হয় না। মাত্র কিছুদিন আগেই চাকমাদের এক তরুণী একটি হালাম তরুণকে পছন্দ করে তার গলায় মালা দিয়েছিল বলে চাকমারা ক্রুদ্ধ হয়ে দল বেঁধে তাড়া করে দু’জনকেই ধরে ফেলে এবং হত্যা করে তদ্দণ্ডেই। হালাম সম্প্রদায় অনেকের চোখে ঘৃণ্য, কারণ তারা দাসশ্রেণীর, তাদের স্বাধীন জীবিকা নেই। আবার হালামরা গর্ব করে বলে বিজয়া দশমীর এই হাসাম ভোজ আসলে হালাম ভোজ। এক সময় ত্রিপুরারাজের সৈন্যবাহিনীতে হালামরাই ছিল প্রধান, তারা দাস নয়, তারা যোদ্ধা হিসেবে মহারাজার সেবা করত, সেই জন্যই আগের কালের মহারাজারা বছরে একদিন সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একাসনে ভোজন করতেন। সে যাই হোক, আগেকার দিনে যে-নিয়মই থাকুক, মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য এই একটি দিন সকল উপজাতীয়দের এক জায়গায় মেলাতে চান এবং সকলের মাঝখানে আহার করতে বসে বুঝিয়ে দিতে চান যে তার চক্ষে প্রজাদের মধ্যে কোনও জাতিবৈষম্য নেই। সামনের চত্বরের এক পাশে হোগলার ছাউনি দিয়ে বাঁধা হয়েছে আটচালা। সেখানে দশটি উনুনে প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড হাঁড়িতে রান্না চড়েছে। খিচুড়ি আর পায়সান্ন, এই দুটি মাত্র পদ, সবাই পেট চুক্তি খাবে, সকলের খাওয়া শেষ হতে হতে রাত ভোর হয়ে যাবে। একেক জন সন্ধেবেলা খেতে বসে ভোর হবার আগে ওঠেই না। রাজার আদেশ আছে। যে যতবার যতখানি চাইবে তাকে তত দিতেই হবে। কেউ কেউ যেন সারা বছরের ক্ষুধা এই একদিনে মিটিয়ে নিতে চায়। সকালবেলা দেখা যায় উচ্ছিষ্ট পাতের সামনেই অনেকে ঘুমে ঢলে পড়ে আছে। কালো চাদরে শরীর ঢেকে ছবি তুলছেন মহারাজ। কাছাকাছি যে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের একজনের নাম শশিভূষণ সিংহ। ত্রিপুরার রাজকার্যে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকতা প্রবর্তনের জন্য মহারাজ কলকাতা থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তিদের আনিয়েছেন, তাদের মধ্যে শশিভূষণ সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত। ইনি বি এ পাস ও ব্ৰাহ্ম, কিছুদিন দেবেন ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনি রাজকুমারদের গৃহশিক্ষক। শশিভূষণ মাঝে মাঝে মহারাজের সামনেও এমন কথা উচ্চারণ করেন যা শুনে অন্যদের প্লীহা পর্যন্ত চমকিত হয়, কিন্তু এঁর সম্পর্কে মহারাজের একটা প্রশ্ৰয়ের ভাব আছে। শশিভূষণ গৌরবর্ণ, সুপুরুষ, তীক্ষ্ণ নাশা। পোশাকের ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন, চুনটি করা ধুতি ও বেনিয়ান সব সময় শুভ্রবর্ণ, মাথায় বাবরি চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। হাতে একটা দূরবীন নিয়ে শশিভূষণ চত্বরের জনসমাগম দেখতে দেখতে পাশের এক ব্যক্তির কাঁধে হাত রাখলেন। এর নাম যদুনাথ ভট্টাচাৰ্য, বিষ্ণুপুর ঘরানার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, মহারাজের দরবারের নবরত্ন সভার অন্যতম। শশিভূষণ এঁকে বললেন, ভট্ট মশাই, অনেকদিন তো এ দেশে রইলেন, ট্রাইবগুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে চিনতে পারেন? বলুন দেখি, নোয়াতিয়া আর ওরাংদের মধ্যে পার্থক্য কী? যদুনাথ নিরীহ ধরনের মানুষ, গানবাজনা ছাড়া অন্য কিছু বিশেষ বোঝেন না। তিনি বললেন, আমার চোখে তো সকলে একই রকম লাগে! শশিভূষণ বললেন, ভালো করে দেখুন, মনোযোগ দিয়ে দেখুন। যদুনাথ বললেন, শুধু যে দেখি পিল পিল করে মানুষের মাথা। ব্যাটাছেলে মেয়েছেলেরও তফাত করা যায় না। শশিভূষণ নিজের দূরবীনটি যদুনাথের চোখের সামনে ধরে বললেন, এই বার ভালো করে দেখুন। কিন্তু দূরবীন ব্যবহার করা যাদের অভ্যেস নেই তাদের পক্ষে দৃষ্টি-সংযোগ সহজ নয়। যদুনাথ বিকৃতভাবে বললেন, এ যে দেখি আকাশ! এবার? এখনও আকাশ! না, না, দেখতে পাচ্ছি, অনেকগুলি গাছ।
false
humayun_ahmed
ঠিক হয়েছে ‘শের খাতেমুন’, যার অর্থ-শেরের শেষ। শের খাঁকে বন্দি করতে কতদিন লাগবে এটা বোঝা যাচ্ছে না। সে সরাসরি সম্মুখ সমরে আসে না। চোরাগোপ্তা হামলা করে। তার যুদ্ধ কাপুরুষের যুদ্ধ। মোঘল বাহিনী কাপুরুষ যুদ্ধে অভ্যস্ত না বলেই সমস্যা। সম্রাট বাংলা মুলুক কখনো দেখেন নি। শের খাঁকে পরাস্ত করে তিনি বাংলা মুলুকে কিছুদিন বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলা মুলুকের বর্ষার অনেক গল্প শুনেছেন। সেই বর্ষা দেখবেন। বর্ষায় সেখানকার সব নদী নাকি সমুদ্রের মতো হয়ে যায়। এক কুল থেকে আরেক কুল দেখা যায় না। তাঁর নদী দেখার শখ আছে। বাংলা মুলুকের হিজড়ারা নাকি নৃত্যগীতে বিশেষ পারদর্শী। তাদের নৃত্যগীত সাধারণ নৃত্যগীতের চেয়ে আলাদা। কতটা আলাদা সেটাও সম্রাটের দেখার ইচ্ছা। (*সম্রাটের ভাই আসকারি মীর্জা বঙ্গ বিজয়ের পর সম্রাটের কাছে উপহার হিসেবে কয়েকজন হিজড়া চেয়েছিলেন।) মোঘল সম্রাটদের যুদ্ধযাত্রা বিশাল ব্যাপার। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। যুদ্ধযাত্রার খরচ হিসেবে আমীররা সঞ্চিত ধনরত্ন জমা দিতে শুরু করলেন। শুধু ধনরত্ন না, তাদেরকে ঘোড়াও দিতে হলো। যে এক হাজারি আমীর সে দেবে এক হাজার ঘোড়া। পাঁচ হাজারি আমীর দেবে পাঁচ হাজার ঘোড়া। করদ রাজ্যের রাজাদের বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য এবং স্বর্ণমুদ্রা পাঠাতে হলো। যুদ্ধযাত্রার জন্যে একটা বরগা তাঁবু রওনা হয়ে গেছে। বরগী তাঁবুতে একসঙ্গে দশ হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারে। এই তাঁবু খাটাতে এক হাজার তাঁবুর কারিগরকে সাত দিন খাটতে হয়। সম্রাটের জন্যে যাচ্ছে ডুরসানা-মঞ্জেল তাঁবু। এটি দোতলা। উপরের তলায় সম্রাট নামাজ পড়বেন। নিচতলায় বেগমরা থাকবেন। সম্রাট রাতে ঘুমাবেন চৌবিলরৌতি তাঁবুতে। এই তাঁবুর চালের নিচে খসখসের সিলিং দেওয়া। নিচেও থাকে খসখস। খসখসের উপর কিংখাব ও মলমল। তাঁবু খাটাবার দড়ি রেশমের। সম্রাট হুমায়ূন আনন্দের সঙ্গে যুদ্ধপ্ৰস্তৃতি লক্ষ করতে লাগলেন। তাঁর আনন্দ কিছু বাধাগ্রস্ত হলো বৈরাম খাঁ’র কারণে। বৈরাম খাঁ বললেন, দিল্লী ত্যাগ করা মোটেই ঠিক হবে না। সম্রাট বললেন, সমস্যা কী ? বৈরাম খাঁ বললেন, সমস্যা আপনার তিন ভাই। আপনার অনুপস্থিতিতে তারা দিল্লীর সিংহাসন দখলের চেষ্টা চালাবে। হুমায়ূন বললেন, আমি আমার ভাইদের নিজের প্রাণের মতোই ভালোবাসি। তারা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে। তারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে না। তুমি আমার সঙ্গে বাজি রাখতে চাও ? সম্রাটের সঙ্গে বাজি রাখার স্পর্ধা এই নফরের নেই। আমার এই তিন ভাইয়ের কারণেই কি তুমি যুদ্ধযাত্রা করতে চাচ্ছ না, নাকি আরও কারণ আছে ? বাংলা মুলুকে বর্ষা এসে যাবে। মোঘল সেনাবাহিনী বর্ষার সঙ্গে পরিচিত না। এখন পরিচয় হবে। আমিও পরিচিত হব। কলমচিকে খবর দাও, আমি তিনভাইকে পত্ৰ লিখব। এখনই লিখব। সম্রাট পত্র লিখলেন। তিনজনকে আলাদা আলাদা চিঠি। মীর্জা কামরানকে লেখা চিঠির নমুনা– আমার প্রাণপ্রিয় ভ্ৰাতা কামরান মীর্জা। আমার হৃদয়ের পাখি। বাগিচার সৌরভময় গোলাপ। প্রিয় ভ্রাতা, বাংলা মুলুকের শের খাঁ নামের দুষ্টকে শায়েস্তা করতে বিশাল মোঘল বাহিনী অতি শীঘ্ৰ যাত্রা শুরু করবে। তুমি তোমার সৈন্যবাহিনী নিয়ে লাহোর থেকে চলে এসো। বড়ভাইয়ের দক্ষিণ বাহু হও। আমার তিন ভাই পাশে থাকলে আমি বিশ্ব জয় করতে পারি। যেমন করেছিলেন জুলকারলাইন। (*আলেকজান্ডার দি গ্রেট) আমার বহরের সঙ্গে তোমার অতি আদরের ভগ্নি গুলবদন থাকবে। সে তোমার সাক্ষাতের জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে। প্রিয় ভ্রাতা, তোমার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে আমি একটি নীলা এবং একটি পোখরাজ পাঠালাম। তুমি রত্ন দু’টিকে প্রতিদিন দুগ্ধমান করাবে। এর অন্যথা হলে রত্নের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হবে। এখন তাৎক্ষণিকভাবে তোমার উদ্দেশে রচিত পঞ্চপদী– কামরান চন্দ্ৰ প্ৰস্ফুটিত তার দু’নয়ন। হৃদয় আর্দ্র আবেগে যার কেন্দ্ৰে তার ভাই মীর্জা হুমায়ূন। কামরান মীর্জা পত্রের জবাব দিলেন না। তার দরবারের এক আমীরকে সম্রাটের কাছে পাঠালেন। আমীর সম্রাট হুমায়ূনকে জানালেন, পাঁচটি কারণে কামরান মীর্জা তাঁর সঙ্গে যেতে পারছেন না। ১. তিনি অসুস্থ। পেটের পীড়ায় ভুগছেন। ২. তাঁর প্রধান গণক গণনা করে পেয়েছে, যুদ্ধযাত্রায় তার প্ৰাণনাশের সম্ভাবনা। ৩. লাহোর অরক্ষিত রেখে রওনা হওয়ার অর্থ শত্রুর হাতে লাহোর তুলে দেওয়া। ৪. স্বপ্লে তিনি তাঁর পিতা সম্রাট বাবরকে দেখেছেন। সম্রাট বাবর তাকে লাহোর ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছেন। ৫. তাঁর প্রিয় ঘোড়া লালী মারা গিয়েছে। তিনি ভালো ঘোড়ার সন্ধানে আছেন। শিক্ষিত এবং পরিচিত ঘোড়া ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া যায় না। আমার সঙ্গে না যাওয়ার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে। একটি কারণই যথেষ্ট ছিল। পাঁচটি কারণের একটিতে সে আমার মহান পিতাকে টেনে এনেছে। তার প্রয়োজন ছিল না। আপনি আমার ভাইকে বলবেন, যা ঘটবে আল্লাহ্‌পাকের হুকুমেই ঘটবে। আমি কামরান মীর্জার জন্যে একটি শিক্ষিত আরবি ঘোড়া আপনার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। পেটের পীড়া একটি নোংরা ব্যাধি। আমি দ্রুত তার আরোগ্য কামনা করছি। সম্রাটের নির্দেশে আমীরকে একপ্রস্থ পোশাক, একটি রত্নখচিত তরবারি, দশটা আশরাফি দেওয়া হলো। ভাইয়ের পাঠানো দূতের প্রতি সম্মান দেখানো হলো। এই আমীরের নাম মীর হামজা। মীর হামজা লাহোর ফিরছেন। তার সঙ্গে বিশজন অশ্বারোহীর একটি ক্ষুদ্র দল। রসদ বহনকারী একটা ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ির সঙ্গেই কামরান মীর্জাকে দেওয়া সম্রাট হুমায়ূনের আরবি ঘোড়া বাধা। ঘোড়ার রঙ সাদা। তার নাম ফাতিন। ফাতিন শব্দের অর্থ সুন্দর। বিশ ক্রোশ অতিক্রম করার পর মীর হামজাকে থামতে হলো। অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে বৈরাম খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন। বৈরাম খাঁ বললেন, সম্মানিত আমীর মীর হামজা! আপনার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। মীর হামজা বললেন, অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে একান্তে কথা? আমরা
false
humayun_ahmed
যেভাবে পারি জোগাড় করব। আপনার ভাবি সাবের রূপ বেহেশতের হুর বরাবর। তাকে দেখলে বেহেশতের হুর কেমন হবে এই বিষয়ে আন্দাজ পাবেন। আমি তাকে বলব, সে যেন আপনার সামনে পর্দা না করে। নবিজির স্ত্রীদের জন্যে পর্দা বাধ্যতামূলক। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের স্ত্রীদের জন্যে পর্দা বাধ্যতামূলক না। ইদরিসের বাড়িতে পা দিয়ে উকিল মুনসি মুগ্ধ গলায় গান ধরলেন— আমি না বুঝিয়া কার ঘরে আসিলাম কারে করলাম আমার নাওয়ের সাথি। উকিল মুনসির স্ত্রী তাঁর পেছনেই ঘোমটা পরে দাড়িয়ে ছিলেন। উকিল মুনসি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘোমটা খুইলা দেখ— কী সুন্দর বাড়ি! কী সুন্দর জংলা! আহারে কী সৌন্দর্য! আমি স্বপ্নে দেখেছি বেহেশত এই রকম হবে। প্রত্যেকের জন্য থাকবে বেহেশতি জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কাঠের বাড়ি। বাড়ির পাশে পানির নাহর। গাছে গাছে মনোহর পাখপাখালি। মাওলানা ইদরিস রিঠা মাছের সন্ধানে মাছবাজারে গেলেন। আজ হাটবার। বাজারে প্রচুর মাছ থাকার কথা। রিাঠা মাছ পাওয়া গেল না, তবে বড় বড় বাছা মাছ পাওয়া গেল। এই অঞ্চলের বাছা মাছ বিখ্যাত। মাছের বাজারে দেখা হলো। হরিচরণের সঙ্গে। তিনি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তবে নিয়ম করে হাটের দিন তিনি মাছবাজারে আসেন। তাজা বড় বড় মাছ দেখতে তার ভালো লাগে। জমিদার মানুষ, পাইক বীরকন্দাজ নিয়ে চলাফেলা করার কথা। তিনি চলাফেরা করেন একা। চামড়ার এক জোড়া চটি, ধুতি হাঁটু পর্যন্ত তোলা। গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর। হরিচরণ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম বিখ্যাত গাতক বাউল সাধক উকিল মুনসি আপনার বাড়িতে এসেছেন? ইদরিস বললেন, জি এসেছেন। কয়েক দিন কি থাকবেন? বলেছেন তো থাকবেন। তবে এরা ভাবের মানুষ। হুট করে যদি বলেন চলে যাব, তাহলে চলে যাবেন। উনার স্বকণ্ঠে গান শোনার বাসনা ছিল। বিখ্যাত বিচ্ছেদি গান। সম্ভব কি হবে? নিমন্ত্রণ করলে আমার বাড়িতে কি উনি যাবেন? হাতির পিঠে করে উনাকে নিয়ে যেতাম। বলে দেখব। নিরহঙ্কারী মানুষ। বললেই রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি উনার জন্যে একটা মাছ কিনে দেই। কী মাছ উনার পছন্দ জানেন? রিঠা মাছ পছন্দ। আজ বাজারে রিঠা মাছ উঠে নাই। হরিচরণ বললেন, রিঠা মাছের ব্যবস্থা আমি করব। আজ আমার পছন্দের মাছ নিয়ে যান। হরিচরণ বাজারের সবচে’ বড় রুই মাছটা কিনলেন। প্ৰকাণ্ড লাল মুখের জ্যান্ত রুই। জীবনের আনন্দে ছটফট করছে। এমন এক মাছ যাকে দেখতেও আনন্দ। ইদরিস বললেন, এত বড় মাছ কে খাবে? মাছ কুটাও তো মুশকিল। কোনো মুশকিল না। মাছ কুটার লোক আমি পাঠাব। মাছ কুটে দিয়ে আসবে। আস্ত মাছ দেখে উকিল মুনসি সাহেব হয়তো খুশি হবেন। বড় মাছ দেখে খুশি হয় না। এমন মানুষ কম। আপনি নিয়ে যান। উকিল মুনসি মাছ দেখে মুগ্ধ। তিনি নিজেই মাছ কুটিতে বসলেন। ইদরিস বললেন, আপনার জন্যে মাছটা হরিচরণ বাবু পাঠিয়েছেন। অতি বিশিষ্ট মানুষ। লোকে তাঁর নাম দিয়েছে ঋষি হরিচরণ। উকিল মুনসি বললেন, মানুষের মুখে জয়, মানুষের মুখে ক্ষয়। অনেক মানুষ যাকে জয় বলে, তার অবশ্যই জয়। এত বড় মাছ উনি পাঠিয়েছেন। তাকে দাওয়াত দেন। তার সঙ্গে খাই। উনি মাছ-মাংস খান না। নিরামিষ আহার করেন। ভালো, খুবই ভালো। উনার খুব ইচ্ছা স্বকণ্ঠে আপনার বিচ্ছেদি গান শুনেন। আপনি রাজি হলে আপনার জন্যে হাতি পাঠায়ে দিবেন। উনার হাতি আছে না-কি? জি আছে। শশাংক পালের সাত আনি জমিদারি খরিদ করেছেন। সইন্ধ্যাকালে উনারে হাতি পাঠাইতে বলেন। লাবুসের মারে নিয়া হাতির পিঠে চড়ব। এই বলেই উকিল মুনসি গান ধরলেন– মাছ কুটিতে কুটিতে গান। বারান্দায় ঘোমটা দেয়া লাবুসের মা হাসছেন। স্বামীর আনন্দ দেখে উনি আনন্দিত। উকিল মুনসি হাতির পিঠে লইড়া চইরা বসে। সেই হাতি কদম ফেলে লিলুয়া বাতাসে ঘোমটা পরা লারুসের মা ঘোমটার ফাঁকে চায় তাহারে পাগল করছে উকিলের মায়ায়।। লাবুসের মা’র সঙ্গে মাওলানা ইদরিসের কথাবার্তা হলো। মাওলানা কখনোই সরাসরি তাকালেন না। যে-কোনো তরুণীর দিকে দৃষ্টি ফেলা অপরাধ। অথচ লাবুসের মা’র মধ্যে কোনো সঙ্কোচ নেই। যেন মাওলানা তার অনেক দিনের চেনা। লাবুসের মা বললেন, আমার সাথে ধর্মের ভাইন পাতাইবেন। ও মাওলানা, আমার দিকে চায়া কথা বলেন। ভাই ভইনের দিকে তাকাইতে পারে। আপন ভাই ভইনের দিকে তাকাতে পারে। আপন ভাবলেই আপনা। আপন ভাইব্যা। আমার সঙ্গে কথা বলেন। কী কথা বলব? বয়স হইছে, শাদি করেন না কেন? আপনে মাওলানা মানুষ, শাদি যে ফরজ এইটা জানেন না? জানি। কইন্যা দেখব? আমার সন্ধানে ভালো পাত্রী আছে। ওমা, মাওলানা দেখি লইজ্যা পায়। নাক-মুখ হইছে লাল। উকিল মুনসি এসেছেন। হরিচরণের বাড়িতে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মাওলানা ইদরিস আসেন নি। লাবুসের মা স্বামীর সঙ্গে এলেও হরিচরণের বাড়িতে ঢুকে আলাদা হয়ে পড়েছেন। পুরুষদের গানের আসরে তিনি কখনো থাকেন না। লাবুসের মা হরিচরণের বাড়িঘর ঘুরে ঘুরে দেখছেন। বাগান দেখছেন। দিঘি দেখছেন। হরিচরণ দামি কার্পেটে উকিল মুনসিকে বসতে দিয়েছেন। রুপার পানদানিতে পান দেয়া হয়েছে। ইকো প্রস্তুত। আম্বরী তামাকের সুগন্ধ বাতাসে। ইকোর নল হাতে অপেক্ষা করছে জহির। সে মাওলানার বাড়ি ছেড়ে হরিচরণের বাড়িতে চলে এসেছে। কোথাও থিতু হতে পারছে না। উকিল মুনসি বললেন, এই ছেলে কে? হরিচরণ বললেন, এর নাম জহির। আমার এখানে থাকে। মুসলমান ছেলে? জি। অতি লাবণ্যময় চেহারা। সে কি ঘাটুগানের ছেলে? হরিচরণ বললেন, না। সে আমার পুত্ৰসম। উকিল মুনসি বললেন, গোস্তাকি মাপ হয়। আমি খারাপ কিছু ভেবেছিলেম। বড় মানুষদের এইসব দোষ থাকে। আমি কিশোর
false
nazrul
তো আমাদের জিশু প্রেরণ করেছেন। আপনায় ঢন্যবাড, আমরা খ্রিস্টান হওয়ার আগে ঠেকেই হেলেনকে বালো বালো কাজ শেকাচ্ছে।” মেজোবউ হঠাৎ অশ্রু-সিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল “আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি – যদি কোনোদিন ইচ্ছে হয়?” –– বলেই সে তার অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি পূজারিনির ফুলের মতো আনসারের পানে তুলে ধরল। আনসারের বুক কেন যেন দোল খেয়ে উঠল! এ কোন মায়াবিনী? সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “নিশ্চয়ই, যখন ইচ্ছা দেখা করবেন। আমাকে আপনার কোনো ভয় নাই। আপনার এই ধর্ম-পরিবর্তনে আমি অন্তত এতটুকু দুঃখিত নই। আপনার মতো মেয়েকে তার যোগ্যস্থান দেওয়ার মতো জায়গা আমাদের এই অবরোধ-ঘেরা সমাজে নেই। – এ আমি আপনাকে দেখে এবং দুটি কথা শুনেই বুঝেছি!” –বলেই একটু থেমে আবার বললে, “আপনি যে ধর্মে থেকে শান্তিলাভ করেন। –করুন, আমার শুধু একটি প্রার্থনা, আপনারই চারপাশের এই হতভাগ্যদের ভুলবেন না –আপনার হাত দিয়ে যদি ওদের একজনেরও একদিনের দুঃখও দূর হয় – তবে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। আপনার মতো সাহসী মেয়ে পেলে যে কত কাজই করা যায়?” মেজোবউ তার চোখমুখ মুছে ভরা কণ্ঠে বলে, উঠল, “আমায় দিয়ে আপনার কোনো কাজের সাহায্য যদি হয় জানাবেন, আমি সব করতে পারব আপনার জন্য!” –কিন্তু ওই ‘আপনার জন্য’কথাটা বুঝি তার বেরিয়ে এসেছে। ওই কতাটা বলবার পরই তার চোখমুখ লজ্জায় রাঙা টকটকে হয়ে উঠল। আনসারের মনে হল, সে যেন কোন নদী আর সাগরের মোহনাট উত্তাল তরঙ্গ-মধ্যে এসে পড়েছে! সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললে, “আমায় হয়তো আপনি ভালো করে চেনেন না, লতিফা আমারই বোন। যদি ওখানে কোনোদিন যান, আমার সব কথা শুনবেন। আর দেখাও ওখানেই করতে পারেন – ইচ্ছা করলে।” মেজোবউ ঠোঁটে হাসি চেপে বলে উঠল, “আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি। আমি ওখানেই দেখা করব গিয়ে। কিন্তু যেতে দিবেন তো ওখানে খ্রিস্টাননিকে?” আনসার কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই মেজোবউয়ের ছেলেমেয়ে দুটি কোথা থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “মা, তুই ইখেনে এয়েছিস আর আমরা খুঁজে খুঁজে মরছি!” মেজোবউ তাদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভারি গলায় বলে উঠল, “এই দুটোই আমার শত্রু। এখানে এসে তবু দু বেলা দুটো খেতে পাচ্ছে! ওদের উপোস করা সহ্য করতে না পেরেই আমি এখানে এসেছি।” আনসার তার বলিষ্ট বাহু দিয়ে মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েকে একেবারে তার বুকে তুলে চুমো খেতে খেতে বললে, “তোরা কী খেতে ভালোবাসিস বল তো!” দুই শিশুতে মিলে তারস্বরে যে-সব ভালো জিনিসের লিস্টি দিলে, তা শুনে ঘরের সকলেই হেসে উঠল। কিন্তু হাসলেও আনসারের এই ব্যবহার সকলের বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। অতি সামান্য ঘরের ছেলেমেয়েদের কোলে তুলে সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত যুবকের এই এত সহজভাবে চুমো খাওয়া তারা যেন দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। জাদুকরি মেজোবউয়ের মনে হতে লাগল, তার এতদিনের এত অহংকার আজ ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। তাকে শ্রদ্ধা করবার মতো মানুষও আছে জগতে! সে তার চেয়েও বড়ো জাদুকর। তার কেবলই ইচ্ছা করতে লাগল, দু হাত দিয়ে, এই পাগলের পায়ের ধুলো নিয়ে চোখে-মুখে মেখে ধন্য হয়, কিন্তু লজ্জায় পারল না। আর কেউ না থাকলে হয়তো সে সত্যি-সত্যিই তা করে ফেলত। শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং তারও অতিরিক্ত কিছু সুন্দর চক্ষুকে সুন্দরতর করে তুলেছিল। তার সারা মুখে যেন কীসের আভা ঝলমল করছিল। আনসারের দুই চক্ষুর পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে মাধুরী যেন বুভুক্ষুর মতো পান করতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই সে সচকিত হয়ে মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েদের হাতে দুটো টাকা গুঁজে বললে, “এখন আসি!” বলে সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এল। আশ্চর্য, এবার মেজোবউও সলজ্জ হাসি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল! আনসারের উষ্ণ করস্পর্শে তার সমস্ত শরীরে যেন তড়িৎ-প্রবাহ বয়ে গেল। মনে হল, এই নিমিষের স্পর্শ বিনিময়ে সে আজ ভিখারিনি হয়ে গেল! সে তার সর্বস্ব লুটিয়ে দিল! মিস জোন্স এবং পাদরি সাহেব এ সবই লক্ষ করছিল। এইবার পাদরি সাহেব একটু অসহিষ্ণু হয়েই মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েকে আদেশের স্বরে বলে উঠল, “এই! টোমরা ও টাকা এখনই ফিরিয়ে ডিয়ে এসো।” সঙ্গে সঙ্গে মেজোবউ বলে উঠল, “না, তোরা চলে আয়। তোদের ফিরিয়ে দিতে হবে না।” – বলেই ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সেও বেরিয়ে গেল। পাদরি সাহেব বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মিস জোন্সকে ইঙ্গিতে ডেকে বহু পরামর্শের পর স্থির হল, মেজোবউকে শিগগিরই অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। মেজোবউ রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দেখল, একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে আনসার বিস্কুট কিনছে সামনের দোকান থেকে। সে একটু হাসল, সেই জাদুভরা হাসি। তারপর যেতে যেতে বলল, “কাল সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবেন, আমি যেমন করে পারি যাব।” আনসার হেসে বললে, “ধন্যবাদ, মিসেস হেলেন!” মেজোবউ তিরস্কার-ভরা চাউনি হেনে চলে গেল। আনসারের আজ পথ চলতে চলতে মনে হল, এই ধরণির দুঃখ-বেদনা-অভাব – সব যেন সুন্দর সুমধুর! এই পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছুই নেই, ও-যেন আনন্দেরই একটা দিক। সুরার মতো এর আনন্দ তিক্ত জ্বালাময়। এ সুরা যারা পান করেছে, তাদের আনন্দ সুখী মানব কল্পনাও করতে পারে না। তার পকেট উজাড় করে সে আজ রাস্তার ছেলেমেয়েদের বিস্কুট বিলাতে বিলাতে এল। ওই ময়লা কৃষ্ণকায় ছেলেমেয়ে – ওরা ওদের সুন্দর মায়ের সন্তান। ওই যে মেয়েটা তাকে দেখে ঘোমটা দিয়ে চলে গেল, কী অপরূপ সুন্দরী সে। এই পৃথিবী যেন সুন্দরের মেলা! মনে পড়ল অমনই সুন্দর – তারও চেয়ে সুন্দর রুবিকে –
false
shorotchandra
নিয়েচে চিরদিনই তার শত্রু-সংখ্যা বেড়ে উঠেছে। সেই ভয়ে যারা পেছিয়ে দাঁড়ায় তুইও তাদের দলে গিয়ে যদি মিশিস্‌, তা হলে ত চলবে না বাবা! এ গুরুভার ভগবান তোকেই বইতে দিয়েছেন, তোকেই বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু হাঁ রে রমেশ, তুই নাকি ওদের হাতে জল খাস? রমেশ হাসিয়া কহিল, ঐ দ্যাখ জ্যাঠাইমা, এর মধ্যেই তোমার কানে উঠেচে। এখনো খাইনি বটে, কিন্তু খেতে ত আমি কোন দোষ দেখিনি। আমি তোমাদের জাতিভেদ মানিনে। জ্যাঠাইমা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, মানিস নে কি রে? এ কি মিছে কথা, না জাতিভেদ নেই যে তুই মানবি নে? রমেশ কহিল, ঠিক ওই কথাটাই জিজ্ঞাসা করতে আজ তোমার কাছে এসেছিলাম জ্যাঠাইমা। জাতিভেদ আছে তা মানি, কিন্তু একে ভাল বলে মানিনে। কেন? রমেশ হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া কহিল, কেন সে তোমাকে বলতে হবে? এর থেকেই যত মনোমালিন্য, যত বাদাবাদি, এ কি তোমার জানা নেই? সমাজে যাকে ছোটজাত করে রাখা হয়েচে, সে যে বড়কে হিংসা করবে, এই ছোট হয়ে থাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, এর থেকে মুক্ত হতে চাইবে—সে ত খুব স্বাভাবিক। হিন্দুরা সংগ্রহ করতে চায় না, জানে না—জানে শুধু অপচয় করতে। নিজেকে এবং নিজের জাতকে রক্ষা করবার এবং বাড়িয়ে তোলবার যে একটা সাংসারিক নিয়ম আছে, আমরা তাকেই স্বীকার করি না বলেই প্রতিদিন ক্ষয় পেয়ে যাচ্ছি। এই যে মানুষ গণনা করার একটা নিয়ম আছে, তার ফলাফলটা যদি পড়ে দেখতে জ্যাঠাইমা, তা হলে ভয় পেয়ে যেতে। মানুষকে ছোট করে অপমান করবার ফল হাতে হাতে টের পেতে! দেখতে পেতে কেমন করে হিন্দুরা প্রতিদিন কমে আসচে এবং মুসলমানেরা সংখ্যায় বেড়ে উঠেচে। তবু ত হিন্দুর হুঁশ হয় না! বিশ্বেশ্বরী হাসিয়া বলিলেন, তোর এত কথা শুনে এখনো ত আমার হুঁশ হচ্ছে না রমেশ! যারা তোদের মানুষ গুণে বেড়ায়, তারা যদি গুণে বলতে পারে, এতগুলো ছোটজাত শুধুমাত্র ছোট থাকার ভয়েই জাত দিয়েচে, তা হলে হয়ত আমার হুঁশ হতেও পারে। হিন্দু যে কমে আসচে সে কথা মানি; কিন্তু তার অন্য কারণ আছে। সেটাও সমাজের ত্রুটি নিশ্চয়; কিন্তু ছোটজাতের জাত দেওয়া-দেওয়ি তার কারণ নয়। শুধু ছোট বলে কোন হিন্দুই কোনদিন জাত দেয় না। রমেশ সন্দিগ্ধকণ্ঠে কহিল, কিন্তু পণ্ডিতেরা তাই ত অনুমান করেন জ্যাঠাইমা ! জ্যাঠাইমা বলিলেন, অনুমানের বিরুদ্ধে ত তর্ক চলে না বাবা। কেউ যদি এমন খবর দিতে পারে, অমুক গাঁয়ের এতগুলো ছোটজাত এই জন্যেই এ বৎসর জাত দিয়েচে, তা হলেও না হয় পণ্ডিতের কথায় কান দিতে পারি। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, এ সংবাদ কেউ দিতে পারবে না। রমেশ তথাপি তর্ক করিয়া কহিল, কিন্তু যারা ছোটজাত তারা যে অন্যান্য বড় জাতকে হিংসা করে চলবে, এ ত আমার কাছে ঠিক কথা বলেই মনে হয় জ্যাঠাইমা! রমেশের তীব্র উত্তেজনায় বিশ্বেশ্বরী আবার হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, ঠিক কথা নয় বাবা, একটুকুও ঠিক কথা নয়। এ তোদের শহর নয়। পাড়াগাঁয়ে জাত ছোট কি বড়, সেজন্যে কারো এতটুকুও মাথাব্যথা নেই। ছোটভাই যেমন ছোট বলে বড়ভাইকে হিংসা করে না, দু-এক বছর পরে জন্মাবার জন্যে যেমন তার মনে এতটুকু ক্ষোভ নেই, পাড়াগাঁয়েও ঠিক তেমনি। এখানে কায়েত বামুন হয়নি বলে একটুও দুঃখ করে না, কৈবর্তও কায়েতের সমান হবার জন্য একটুও চেষ্টা করে না। বড়ভাইকে একটা প্রণাম করতে ছোটভাইয়ের যেমন লজ্জায় মাথা কাটা যায় না, তেমন কায়েতও বামুনের একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে একটুও কুণ্ঠিত হয় না। সে নয় বাবা, জাতিভেদ-টেদ হিংসে-বিদ্বেষের হেতুই নয়। অন্ততঃ বাঙ্গালীর যা মেরুদণ্ড—সেই পল্লীগ্রামে নয়। রমেশ মনে মনে আশ্চর্য হইয়া কহিল, তবে কেন এমন হয় জ্যাঠাইমা? ও-গাঁয়ে ত এত ঘর মুসলমান আছে, তাদের মধ্যে ত এমন বিবাদ নেই। একজন আর একজনকে বিপদের দিনে এমন করে ত চেপে ধরে না। সেদিন অর্থাভাবে দ্বারিক ঠাকুরের প্রায়শ্চিত্ত হয়নি বলে কেউ তার মৃতদেহটাকে ছুঁতে পর্যন্ত যায়নি, সে ত তুমি জান! বিশ্বেশ্বরী কহিলেন, জানি বাবা, সব জানি। কিন্তু জাতিভেদ তার কারণ নয়। কারণ এই যে, মুসলমানদের মধ্যে এখনো সত্যকার একটা ধর্ম আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে তা নেই। যাকে যথার্থ ধর্ম বলে, পল্লীগ্রাম থেকে সে একেবারে লোপ পেয়েচে। আছে শুধু কতকগুলো আচার-বিচারের কুসংস্কার, আর তার থেকে নিরর্থক দলাদলি। রমেশ হতাশভাবে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, এর কি প্রতিকারের কোন উপায় নেই জ্যাঠাইমা? বিশ্বেশ্বরী বলিলেন, আছে বৈ কি বাবা! প্রতিকার আছে শুধু জ্ঞানে। যে পথে তুই পা দিয়েচিস শুধু সেই পথে। তাই ত তোকে কেবলি বলি, তুই তোর এই জন্মভূমিকে কিছুতে ছেড়ে যাসনে। প্রত্যুত্তরে রমেশ কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, বিশ্বেশ্বরী বাধা দিয়া বলিলেন, তুই বলবি মুসলমানদের মধ্যেও ত অজ্ঞান অত্যন্ত বেশি। কিন্তু তাদের সজীব ধর্মই তাদের সব দিকে শুধরে রেখেচে। একটা কথা বলি রমেশ, পিরপুরে খবর নিলে শুনতে পাবি, জাফর বলে একটা বড়লোককে তারা সবাই একঘরে করে রেখেছে। সে তার বিধবা সৎমাকে খেতে দেয় না বলে। কিন্তু আমাদের এই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সেদিন তার বিধবা বড়ভাজকে নিজের হাতে মেরে আধমরা করে দিলে, কিন্তু সমাজ থেকে তার শাস্তি হওয়া চুলোয় যাক, সে নিজেই একটা সমাজের মাথা হয়ে বসে আছে। এ-সব অপরাধ আমাদের মধ্যে শুধু ব্যক্তিগত পাপ-পুণ্য; এর সাজা ভগবান ইচ্ছা হয় দেবেন, না হয় না দেবেন, কিন্তু পল্লী-সমাজ তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না। এই নূতন তথ্য শুনিয়া একদিকে রমেশ
false
toslima_nasrin
যে হাওয়া লেগেছিল, ফতোয়া জারির পর সরকারের নিষিক্রয়তা যেমন উসকে দিয়েছিল আগুন, সে হাওয়ার জোর, সে আগুনের তাপ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমেওছিল কিছু। পুলিশ পাহারাও অনেকটা আছে আছে নেই নেই রকম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া ক্ষিপ্ত, তপ্ত, নতুন করে দ্বিগুণ তেজে ত্রিগুণ বেগে ধাবিত হচ্ছে! আমার কত বড় স্পর্ধা যে আমি পবিত্র কোরান শরীফে কাঁটাছেড়া করতে চাইছি, স্বয়ং আল্লাহর বাণী সংশোধন করতে চাইছি! এর মানে এই যে আমি মনে করছি আল্লাহ সঠিক কথা বলেননি, আল্লাহ ভুল বলেছেন, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি, আমি আল্লাহর চেয়ে নিজেকে বেশি ক্ষমতাবান মনে করছি। মৌলবাদীদের কাছে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী থাকতে পারে! দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আদৌ কি আমি বলেছিলাম কোরান সংশোধনের কথা? আমি কি পাগল হয়েছি যে কোরান সংশোধন করতে চাইব! ধরুন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বই লিখেছেন। সেটির আমি সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু সেটি আমি সংশোধন করতে পারি না। আমার বইয়ের কথাই বলছি, আমার বই সংশোধন করার অধিকার একমাত্র আমার আছে, অন্য কারওরই নেই। আমার মৃত্যু হলেও আমার বই যে সব ভুল ষনুটি নিয়ে আছে, সেভাবেই থাকবে। এরকমই তো নিয়ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে লিখেছিলেন, আমরা কেউ কি চাইব ভেঙে মোর ঘরের চাবির বদলে ভেঙে মোর ঘরের তালা করে দিতে? না। চাইব না। প্রশ্নই ওঠে না। কোরানে তো লেখাই আছে যে এর কোনও শব্দও পরিবর্তন করা যাবে না। কোরান একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ, আমি কোন ছার যে এটি সংশোধনের দাবি করব! এ ব্রহ্মাণ্ডের কেউ এ দাবি করতে পারে না। আমি আর যে সব বইয়ের উদাহরণ দিলাম, তা মানুষের লেখা, কিন্তু কোরান তো আল্লাহ তায়লার লেখা। আমি তুলনা করি কি করে কোরানের সঙ্গে মানুষের লেখা বইয়ের? তুলনা করি এই জন্য যে কোরানও মানুষেরই লেখা। ক্ষমতালোভী, স্বার্থা−ন্বষী, নারীবিদ্বেষী,নিষ্ঠুর নির্দয় পুরুষের লেখা। এ মানুষের নির্বুদ্ধিতা যে মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ জিবরাইলকে পাঠিয়েছেন মুহম্মদের কাছে তাঁর কথাগুলো পৌঁছে দিতে। মুহম্মদ জিবরাইলকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আওয়াজ শুনতেন জিবরাইলের গমগমে কণ্ঠস্বরের। তিনি যা শুনতেন, তা লিখে নিতেন। নিজে তো লিখতে পড়তে জানতেন না, অন্যকে লিখতে বলতেন। সে যুগে, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে অন্ধতা, অজ্ঞানতা, মূর্খতা চারদিক ছেয়ে ছিল, তখন অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত লোকে, এ কোনও অবাক করা ব্যাপার নয়। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, এই বিজ্ঞানের যুগে, যখন মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যুক্তি চিন্তা অনেক অগ্রসর, মানুষ কী করে বিশ্বাস করে এসব রূপকথা? তবে কিসের সংশোধনের দাবি করছেন? শরিয়া নামের বর্বর আইনকে বিদেয় করার দাবি করছি। এই আইনের সংশোধন এ যাবৎ অনেক হয়েছে, কোনও সংশোধনই নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করেনি। নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শরিয়া আইনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং এর উল্টো। কোনও সংশোধনই মূল লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না। যদি আমরা রাষ্ট্রের সংবিধানটি অক্ষত রাখি, যে সংবিধান বলে যে সব মানুষের অধিকার সমান, তবে আইনটি রক্ষা করার কোনও যুক্তি নেই। সব পত্রিকায় আমার বিবৃতি ছাপা হয়েছে যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি তারপরও তাণ্ডব থামার কোনও লক্ষণ নেই। মৌলবাদীরা আর্তনাদ করছে, ইসলাম ভেসে গেল, কোরান ধ্বংস হয়ে গেল। কে ভাসাচ্ছে, কে ধ্বংস করছে? তসলিমা। সুতরাং জ্বালাও পোড়াও, ফাঁসি চাও, আন্দোলনে নামো। মুসলমান তোমরা যে যেখানে আছো বেরিয়ে পড়ো, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দাও, তসলিমার ফাঁসি চাই। তসলিমার মৃত্যু চাই। হ্যাঁ, আমার মৃত্যু চাওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। মিছিলে লোক আগের চেয়ে অনেক বেশি। সময় গেলে বেশির ভাগ আন্দোলনের তেজ এ দেশে কমে আসে জানতাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, তত বাড়ছে তেজ। চারদিকে কেবল একটিই হুংকার, তসলিমাকে হত্যা কর, ইসলাম বাঁচাও। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক যত ইসলামী সংস্থা সংগঠন আছে দেশে, সবখানেই ফুঁসে ওঠা লোকের ভিড়, জোট বাঁধো, পথে নামো, ইসলাম বাঁচাও। প্রতিদিন আমার ফাঁসি চেয়ে জঙ্গী মিছিল বেরোচ্ছে। প্রতিদিন। লিফলেট বিলি হচ্ছে, হাজার হাজার লিফলেট — কেন তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন? সম্মানিত দেশবাসী! আসসালামু আলায়কুম, কেন তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন? তসলিমার এজেন্ট এবং ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এ প্রশ্ন তুলছে। এদেশের সর্বস্তরের জনগণ তার মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে। স্মরণাতীতকালের সর্বত্মক হরতাল পালিত হয়েছে এ দাবীতে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রয়েছে। বিশ্ব ইহুদি-খ্রিস্টান চক্রের আশ্রয়ে দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে সে ইসলামের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়েছে। সম্প্রতি আবার ফিরে আসায় স্বাভাবিকভাবেই দেশপ্রেমিক ইসলামী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এবারে দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী চক্রটি তাকে কেন্দ্র করে মাথা চারা দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্য তাদের ইসলাম ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের বৈধতা ও উৎসাহ যুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তসলিমার বিরোধিতাকারীরা বাড়াবাড়ি করছে। অথচ তসলিমা আল্লাহ রাসুল ও কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, বাংলাদেশের মানচিত্রকে অন্য দেশের সাথে মিশিয়ে না দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না। সে অবাধ যৌন সংসর্গের প্রকাশ্য ইন্ধন যোগাচ্ছে, বিয়ের শৃঙ্খল ভাঙবার জন্যে নারীদের আহবান জানাচ্ছে আর অকথ্য, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছে আলেম উলামা পীর মাশায়েখ ও মসজিদের ইমামকে। মসজিদকে বলছে বৈষম্যের প্রতীক। শেখ হাসিনা কেন মাথায় ঘোমটা দেয় এজন্যে যার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয় —- এই দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহীর জন্যে একটি চিহ্নিত মহলের উকালতি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক।
false
toslima_nasrin
খায়। তেমন সম্পত্তিও পুরুষ অংশীদাররা নিয়ে টিয়ে তলাঝাড়া যা থাকে, নারী পায়। স্ত্রী, কন্যা, মা, বোন, বৈপিত্রেয় বোন, সকলেই সম্পত্তির অবশিষ্টাংশ পায়। কেউই অংশীদার নয়। কেউই প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকারী নয়। এই অবশিষ্টাংশ ভোগ করবার বেলায়ও সমাজের সাত রকম বাধা, বলা হয়, মেয়েরা সম্পত্তি নিলে সম্পত্তি সয় না। সম্পত্তি সওয়াবার ব্যবস্থা করতে হবে। সয় না বলে সেগুলো পুরুষের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা চলবে না। পিতার সমান মাতাকে, পুত্রের সমান কন্যাকে, স্বামীর সমান স্ত্রীকে সমান উত্তরাধিকার দেবার ব্যবস্থা করা হলে সব সইবে। আর তা না হলে যে সরকার আমাদের আইনের মাথা, তাঁকে কিন্তু আমরা বেশিদিন সইব না। হিন্দুর উত্তরাধিকার আইনটি আরও ভয়াবহ। কোনও নারীর চিহ্ন নেই উত্তরাধিকার তালিকায়। নারী কিছু পাবার বেলায় নেই, কেবল দেবার বেলায় আছে। লোকে ভাবে, নারীর আর কী দরকার সম্পদ সম্পত্তির! তাকে পিতা স্বামী ও পুত্রের অধীনে বেঁচে থাকতে হয়। তাকে পরাশ্রয়ী লতার মত আঁকড়ে থাকতে হয় পুরুষের শরীর। নারীকে স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে দিতে সমাজ বড় নারাজ। সমাজ তাকে নিঃস্ব করেছে সর্বার্থে, তাকে অচল করেছে, অনাথ করেছে। হিন্দুরা এ দেশে আজও শাস্ত্র মতো চলে। মুসলমানরা খুব যে শাস্ত্রের বাইরে চলে তা কিন্তু নয়। . আসলে আইন কখনও হিন্দু মুসলমান বিচার করে হওয়া উচিত নয়। ধর্মের সঙ্গে সভ্যতার বিরোধ চিরকালীন। আইন যদি সভ্য না হয়, মানুষ সভ্য হবে না। আইনের হিন্দুত্ব আর মুসলমানিত্ব মানা অসভ্যতা ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে সভ্য করতে হলে একটি আধুনিক সভ্য আইনের প্রয়োজন। আর এদেশের অসভ্য, অসংস্কৃত, অনাধুনিক, অধম মানুষদের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব কঠোর কঠিন আইন করা প্রয়োজন যে উত্তরাধিকার হোক, বিবাহ হোক, তালাক হোক, সন্তানের অধিকার হোক কোথাও নারী পুরুষে কোনও বৈষম্য থাকবে না। মানুষ হিসেবে সকলেই সমান হবে, সে বিশ্বাসে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমানের উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আমার লেখাগুলো পড়ে অনেকে বলেছে আমি নাকি খুব কঠিন জিনিস নিয়ে লিখছি। কঠিন কেন জিজ্ঞেস করলে কিছু মেয়ে বলল এসব বুঝিটুঝি না। বললাম, তা বুঝবে কেন, বুঝলে কি আর সব পেয়েছির হাসি ঝোলে ঠোঁটে! এত তৃপ্ত থাকে হৃদয়! ওরা আমার তিরস্কারও বুঝল কি না জানি না তবে ওরা অনুরোধ করে গেল উত্তরাধিকারের কাঠখোট্টা আলোচনা বাদ দিয়ে পুরুষদের কি করে পেটানো যায় তা যেন লিখি। উত্তরাধিকারের ঝামেলায় কেউ যেতে চায় না। এটি ঝামেলা ছাড়া আর কী! গজ ফিতে নিয়ে শতাংশ মাপা, আর নিজের ভাইদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করা ঠিক শোভন মনে হয় না। আপন ভাই ই তো, না হয় নিলই সব। আর বাপের বাড়ির জমি, এটির ভাগ চাইলে লোকে লোভী ভাববে। বাপ তো বিয়ের আগ অবধি খাওয়ালো পরালো, এখন স্বামী খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে, অসুবিধে তো কিছুতে নেই। খামোকা অসভ্যের মত বাপের দুকানি জমির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে কেন! এই হল আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের মানসিকতা। আর নিম্নবিত্তের তো জমিই নেই, যদিও বা থাকে তার ভাগ চাইতে এলে ভাইয়েরা ঠেঙিয়ে বিদেয় করে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আর কদিন ঘটবে? কদিন আমাদের নিরীহ, নির্বোধ, প্রতারিত মেয়েরা ভাববে যে পিতার সম্পত্তি কেবল পুত্রদের জন্য, কন্যাদের জন্য নয়, আর কন্যাদের জন্য হলেও তা ছিটেফোঁটা। কবে তাদের বোধ হবে যে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমান অধিকার থাকা উচিত! কারণ কন্যা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, সে পুত্রের তুলনায় কিছু কম সন্তান নয়, কিছু কম মূল্যবান নয়, কিছু কম মেধাবী নয়। এই বোধ যখন হবে তখন সে নিজে উত্তরাধিকার আইনের মা বাপের হাতে গজফিতে দেবে এবং বলবে আমার যা কিছু প্রাপ্য তার সবই দাও, আমি কড়ায় গণ্ডায় সব হিসেব চাই। আমি এই জগতে একে ওকে দান দক্ষিণা করতে আসিনি। আমার যা, আমি তা একশ ভাগ চাই। আর পুত্র তৈরিতে একটি শুক্রাণু আর ডিম্বাণু যেখানে লাগে, কন্যা তৈরিতে সেখানে আধা শুক্রাণু বা আধা ডিম্বাণু লাগে না। তবে সম্পত্তির বেলায় আধা কেন! পুরুষ প্রগতিবাদীরা নানারকম আন্দোলন করে। কিন্তু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে তারা কখনও রা শব্দ করে না। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তাদের একদম অপছন্দ। আমি অনেক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিককে জানি যারা মেপে মেপে জমি নিয়েছে বোনদের অর্ধেক দিয়ে অর্থাৎ ঠকিয়ে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনও হেরফের দেখলে তারা উত্তেজিত হন, কিন্তু জমি বন্টনে কোনও হেরফের বা বৈষম্য দেখলে তারা খুব শান্ত থাকেন, মোটেও উত্তেজিত হন না। যেন শরিয়ত মত আর কিছু না চলুক, উত্তরাধিকার আইন চলছে চলুক। বিয়ের ব্যবস্থাও চলুক। যেহেতু বহুবিবাহের সুবিধাদি আছে। যা করবার তা নারীকেই করতে হবে। নারীর জন্য সুযোগ সুবিধা তৈরি করতে হবে নারীকেই। প্রতিবন্ধক সরাতে হবে তাকেই, তার পথ মসৃণ করবার দায়িত্ব তারই। আমাদের সমাজে সহজেই গোলাম আযম জন্মায়, ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর জন্মায় না। তাই বহুবিবাহও দূর হয় না। সম্পত্তির সমান অধিকারও জোটে না। মেয়েদেরই তাই এক একজন প্রীতিলতা, লীলা নাগ, বেগম রোকেয়া হতে হবে। মেয়েদের জলের মত হৃদয় শত বারুদে এবার দাউ দাউ জ্বলে ওঠা প্রয়োজন। নতুন একটি কথা উঠছে যে পুরুষের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ বিবাহ করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে। আগে স্ত্রীর অনুমতি লাগত আর এখন আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। এতে নারীর কী লাভ হল শুনি! পুরুষের জন্য কি আদালত থেকে অনুমতি নেওয়া খুব
false
shordindu
ইহার পর আর চুপ করিয়া থাকা যায় না। মোবারক আরক্ত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল, ছিপটা হাতে তুলিয়া পাড় বাহিয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ঘোড়ার সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সুজার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর অধাবরুদ্ধ ক্রোধের স্বরে বলিল, বাঁদীর বাচ্চা তুমি। তোমার শরীরে ভদ্র রক্ত থাকলে ভদ্রভাবে কথা বলতে। আলিবর্দি একেবারে হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, বেয়াদব যুবক! তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ জানো? উনি সুলতান সুজা। নাম শুনিয়া মোবারকের বুকে মুগুরের ঘা পড়িল। সে বুঝিল তাহার জীবনে এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু তবু এখন ভয়ে পিছাইয়া যাইতে সে ঘৃণাবোধ করিল। অকারণ লাঞ্ছনার গ্লানি তাহার আরও বাড়িয়া গেল; নীচ শ্রেণীর লোকের মুখে ইতর ভাষা বরং সহ্য হয় কিন্তু বড়র মুখে ছোট কথা দ্বিগুণ পীড়াদায়ক। মোবারকের মুখে একটা ব্যঙ্গ বঙ্কিম বিকৃতি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, সুলতান সুজা ছোট ভাইয়ের কাছে যুদ্ধে মার খেয়ে এখন নিরস্ত্রের ওপর বাহাদুরী দেখাচ্ছেন! সুজার অন্তরে যে-গ্লানি প্রচ্ছন্ন ছিল, যাহার ইঙ্গিত পর্যন্ত করিতে ওমরাহেরা সাহস করিতেন না, তাহাই যেন শ্লেষের চাবুক হইয়া তাঁহার মুখে পড়িল। আর তাঁহার দিগবিদিক জ্ঞান রহিল না, উন্মত্ত রোষে তরবারি বাহির করিয়া তিনি মোবারকের পানে ঘোড়া চালাইলেন। গোস্তাক। বদ্‌বখ্‌ত—। ইতিমধ্যে ভোজবাজির মতো কোথা হইতে অনেকগুলি লোক আসিয়া জুটিয়াছিল, তাহারা সমস্বরে হৈ হৈ করিয়া উঠিল। কেহ বা মোবারককে পলায়ন করিবার উপদেশ দিল; মোবারক কিন্তু এক পা পিছু হটিল না। ঘোড়া যখন প্রায় তাহার বুকের উপর আসিয়া পড়িয়াছে তখন সে একবার সজোরে ছিপ চালাইল। ছিপের আঘাত শপাৎ করিয়া সুজার গালে লাগিল। সুজাও বেগে তরবারি চালাইলেন। মোবারকের গলদেশে তরবারির ফলা বসিয়া গেল। সে বাঙনিষ্পত্তি না করিয়া মাটিতে পড়িল। কয়েক মুহূর্ত পূর্বে যাহা চিন্তার অতীত ছিল, অতি তুচ্ছ কারণে অকস্মাৎ তাহাই ঘটিয়া গেল। দিন শেষ হইয়া আসিতেছে। খ্বাজা নজর বোখারী তাঁহার কারখানা ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দুনীচ বেনিয়ার সহিত হাসিমুখে কথা বলিতেছিলেন। দুনীচন্দের পুত্র আরোগ্যলাভ করিয়াছে, তাই সে মিঞা সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছে। সহসা রাজপথের উপর অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। খ্বাজা নজর চোখ তুলিয়া দেখিলেন একদল লোক একটি মৃতদেহ বহন করিয়া আনিতেছে, তাহাদের পশ্চাতে দুইজন সওয়ার। খ্বাজা নজর শঙ্কিত হইয়া ঈশ্বরের নাম স্মরণ করিলেন। মৃতদেহ বাহকগণ খ্বাজা নজরের অঙ্গনে প্রবেশ করিল। খ্বাজা নজর নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। বাহকেরা মোবারকের রক্তাক্ত মৃতদেহ আনিয়া খ্বাজা নজরের সম্মুখে একটি পাথরের পাটার উপর শোয়াইয়া দিল। কেহ কথা কহিল না। খ্বাজা নজর নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন; তাঁহার রক্তহীন অধর একটু নড়িল, মোবারক— যাহারা বহন করিয়া আনিয়াছিল তাহারা নিঃশব্দে অশুমোচন করিয়া সরিয়া গেল। কেবল অশ্বারোহী দুইজন গেল না। সুজার মুখে ক্রোধের অন্ধকার এখনও দূর হয় নাই, চোখে জিঘাংসা ধিকিধিকি জ্বলিতেছিল। তাঁহার গালে ছিপের আঘাত চিহ্নটা ক্রমে বেগুনী বর্ণ ধারণ করিতেছে। তিনি মাঝে মাঝে তাহাতে হাত বুলাইতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু হিংস্রভাবে জ্বলিয়া উঠিতেছে। সহসা সুজা খ্বাজা নজরকে উদ্দেশ করিয়া কঠোর কণ্ঠে বলিলেন, তুমি এর বাপ? খ্বাজা নজর সুজার দিকে শূন্য দৃষ্টি তুলিলেন, কথা কহিলেন না। মোবারক তো বক্সী তালাওয়ে মাছ ধরিতে গিয়াছিল…! উত্তর না পাইয়া আলিবর্দি খাঁ বলিলেন, ইনি মালিক উলমুল্ক সুলতান সুজা। তোমার ছেলে এর অমর্যাদা করেছিল তাই তার এই দশা হয়েছে। খ্বাজা নজর এবারও উত্তর দিলেন না, ভাবহীন নিস্তেজ চক্ষু অশ্বারোহীদের উপর হইতে সরাইয়া মোবারকের উপর ন্যস্ত করিলেন। দেখিলেন পাথরের পাটা মোবারকের কণ্ঠ-ক্ষরিত রক্তে ভিজিয়া উঠিয়াছে। মোবারক বাঁচিয়া নাই….ইহারা তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে— সুজা মুখের একটা বিকৃত ভঙ্গি করিলেন। এই সামান্য প্রস্তর-শিল্পীর পুত্রকে হত্যা করিবার পর ইহার অধিক কৈফিয়ৎ বা দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন নাই। সুজা আলিবর্দিকে ইঙ্গিত করিলেন; উভয়ে ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া প্রস্থাননাদ্যত হইলেন। এই সময় বাড়ির ভিতর হইতে তীব্র আতোক্তি আসিল, সঙ্গে সঙ্গে পরীবানু ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। তাহার কেশ বিস্রস্ত, বোধকরি ভয়ঙ্কর সংবাদ শুনিবার সময় সে কেশ প্রসাধন করিতেছিল; অঙ্গে ওড়নি নাই, কেবল চোলি ও ঘাঘরি। সে ছুটিয়া আসিয়া মোবারকের মৃতদেহের পাশে ক্ষণেক দাঁড়াইল, ব্যাকুল বিস্ফারিত নেত্রে মোবারকের মৃত্যুস্থির মুখের পানে চাহিল, তারপর ছিন্নলতার মতো তাহার বুকের উপর আছড়াইয়া পড়িল। খ্বাজা নজর মোহগ্রস্ত মূকের মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন। সুজা ঘোড়ার পৃষ্ঠ হইতে ঘাড় ফিরাইয়া এই দৃশ্য দেখিলেন; কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে পরীবানুর পানে চাহিয়া রহিলেন। সামান্য মানুষের গৃহেও এমন স্ত্রীলোক পাওয়া যায়? পানাপুকুরে মরালী বাস করে? সুজার সমসাময়িক ইতিকার লিখিয়াছেন, চামেলির মতো ক্ষুদ্র বস্তু সুজার চোখে পড়িত না। আজ কিন্তু এই শিশির-সিক্ত চামেলি ফুলটি ভাল করিয়াই তাঁহার চোখে পড়িল। সন্ধ্যার ছায়ালোকে তিনি যখন দুর্গের দিকে ফিরিয়া চলিলেন, তখনও ঐ শোক-নিপীড়িতার যৌবনোচ্ছল লাবণ্য তাঁহার চিত্তপটে ফুটিয়া রহিল। দুর্গের সিংহদ্বারে প্রবেশ করিতে সুজা বলিলেন, বুড়ো বান্দাটা পাথরের কারিগর মনে হল। আলিবর্দি বলিলেন, হাঁ হজরৎ, আমারও তাই মনে হল। বলিয়া সুজার পানে অপাঙ্গে চাহিলেন। সুজা চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া গণ্ডের স্ফীত কৃষ্ণবর্ণ আঘাত চিহ্নটার উপর অঙ্গুলি বুলাইলেন। তাঁহার দৃষ্টি ছুরির নখাগ্রের মতো ঝিলিক দিয়া উঠিল। পরদিন সন্ধ্যাকালে খ্বাজা নজরের গৃহে অনৈসর্গিক নীরবতা বিরাজ করিতেছিল। অন্তঃপুরে শব্দমাত্র নাই, যেন সেখানে মানুষ বাস করে না; পরীবানু শশাকের কোন্ নিগূঢ় গর্ভগৃহে আশ্রয় লইয়াছে। বাহিরের অঙ্গনও শূন্য নিস্তব্ধ; কেবল মোবারকের রক্তচর্চিত প্রস্তরপট্টের পানে চাহিয়া খ্বাজা নজর একাকী বসিয়া আছেন। মোবারকের কফন দফন আজ প্রভাতেই হইয়া গিয়াছে। খ্বাজা নজর ভাবিতেছেন মোবারক
false
robindronath
সূর্য আপনার শেষ স্পর্শ ঠেকিয়ে নেমে গেল। অতি সুকুমার সবুজের আভা আস্তে আস্তে সুকোমল নীলে গেল মিলিয়ে। দুজনে থেমে সেই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। লাবণ্য আস্তে আস্তে বললে, “একদিন একজনকে যে আংটি পরিয়েছিলে, আমাকে দিয়ে আজ সে আংটি খোলালে কেন।” অমিত ব্যথিত হয়ে বললে, “তোমাকে সব কথা বোঝাব কেমন করে বন্যা। সেদিন যাকে আংটি পরিয়েছিলুম, আর যে আজ সেটা খুলে দিলে, তারা দুজনে কি একই মানুষ।” লাবণ্য বললে, “তাদের মধ্যে একজন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরি, আর একজন তোমার অনাদরে গড়া।” অমিত বললে, “কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। যে আঘাতে আজকের কেটি তৈরি তার দায়িত্ব কেবল আমার একলার নয়।” “কিন্তু মিতা, নিজেকে যে একদিন সম্পূর্ণ তোমার হাতে উৎসর্গ করেছিল তাকে তুমি আপনার করে রাখলে না কেন। যে কারণেই হোক, আগে তোমার মুঠো আলগা হয়েছে, তার পরে দশের মুঠোর চাপ পড়েছে ওর উপরে, ওর মূর্তি গেছে বদলে। তোমার মন একদিন হারিয়েছে বলেই দশের মনের মতো করে নিজেকে সাজাতে বসল। আজ তো দেখি, ও বিলিতি দোকানের পুতুলের মতো; সেটা সম্ভব হত না, যদি ওর হৃদয় বেঁচে থাকত। থাক্‌ গে ও সব কথা। তোমার কাছে আমার একটা প্রার্থনা আছে। রাখতে হবে।” “বলো, নিশ্চয় রাখব।” “অন্তত হপ্তাখানেকের জন্যে তোমার দলকে নিয়ে তুমি চেরাপুঞ্জিতে বেরিয়ে এসো। ওকে আনন্দ দিতে নাও যদি পার, ওকে আমোদ দিতে পারবে।” অমিত একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, “আচ্ছা।” তার পরে লাবণ্য অমিতর বুকে মাথা রেখে বললে, “একটা কথা তোমাকে বলি মিতা, আর কোনোদিন বলব না। তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আংটি দিয়ো না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক্‌ নিরঞ্জন; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।” এই বলে নিজের আঙুলের থেকে আংটি খুলে অমিতর আঙুলে আস্তে আস্তে পরিয়ে দিলে। অমিত তাতে কোনো বাধা দিলে না। সায়াহ্নের এই পৃথিবী যেমন অস্তরশ্মি উদ্‌ভাসিত আকাশের দিকে নিঃশব্দে আপন মুখ তুলে ধরেছে, তেমনি নীরবে, তেমনি শান্ত দীপ্তিতে লাবণ্য আপন মুখ তুলে ধরলে অমিতর নত মুখের দিকে। সাত দিন যেতেই অমিত ফিরে যোগমায়ার সেই বাসায় গেল। ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে। কোথায় গেছে তার কোনো ঠিকানা রেখে যায় নি। সেই য়ুক্যালিপ্‌টাস গাছের তলায় অমিত এসে দাঁড়াল, খানিকক্ষণ ধরে শূন্যমনে সেইখানে ঘুরে বেড়ালে। পরিচিত মালী এসে সেলাম করে জিজ্ঞাসা করলে, “ঘর খুলে দেব কি। ভিতরে বসবেন?” অমিত একটু দ্বিধা করে বললে, “হাঁ।” ভিতরে গিয়ে লাবণ্যর বসবার ঘরে গেল। চৌকি টেবিল শেল্‌ফ্‌ আছে, সেই বইগুলি নেই। মেজের উপর দুই-একটা ছেঁড়া শূন্য লেফাফা, তার উপরে অজানা হাতের অক্ষরে লাবণ্যর নাম ও ঠিকানা লেখা; দু-চারটে ব্যবহার করা পরিত্যক্ত নিব এবং ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অতি ছোটো পেন্‌সিল টেবিলের উপরে। পেন্‌সিলটি পকেটে নিলে। এর পাশেই শোবার ঘর। লোহার খাটে কেবল একটা গদি, আর আয়নার টেবিলে একটা শূন্য তেলের শিশি। দুই হাতে মাথা রেখে অমিত সেই গদির উপর শুয়ে পড়ল, লোহার খাটটা শব্দ করে উঠল। সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূর্ছা, যে মূর্ছা কোনোদিনই আর ভাঙবে না। তার পরে শরীরমনের উপর একটা নিরুদ্যমের বোঝা বহন করে অমিত গেল নিজের কুটিরে। যা যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনিই সব আছে। এমন-কি, যোগমায়া তাঁর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যান নি। বুঝলে, তিনি স্নেহ করেই এই চৌকিটি তাকে দিয়ে গেছেন, মনে হল যেন শুনতে পেলে শান্ত মধুর স্বরে তাঁর সেই আহ্বান–বাছা! সেই চৌকির সামনে মাথা লুটিয়ে অমিত প্রণাম করলে। সমস্ত শিলঙ পাহাড়ের শ্রী আজ চলে গেছে। অমিত কোথাও আর সান্ত্বনা পেল না। শেষের কবিতা কলকাতার কলেজে পড়ে যতিশংকর। থাকে কলুটোলা প্রেসিডেন্সি কলেজের মেসে। অমিত তাকে প্রায় বাড়িতে নিয়ে আসে, খাওয়ায়, তার সঙ্গে নানা বই পড়ে, নানা অদ্ভুত কথায় তার মনটাকে চমকিয়ে দেয়, মোটরে করে তাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসে। তার পর কিছুকাল যতিশংকর অমিতর কোনো নিশ্চিত খবর পায় না। কখনো শোনে সে নৈনিতালে, কখনো উটকামণ্ডে। একদিন শুনলে, অমিতর এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলছে, সে আজকাল কেটি মিত্তিরের বাইরেকার রঙটা ঘোচাতে উঠে-পড়ে লেগেছে। কাজ পেয়েছে মনের মতো, বর্ণান্তর করা। এতদিন অমিত মূর্তি গড়বার শখ মেটাত কথা দিয়ে, আজ পেয়েছে সজীব মানুষ। সে মানুষটিও একে একে আপন উপরকার রঙিন পাপড়িগুলো খসাতে রাজি, চরমে ফল ধরবে আশা করে। অমিতর বোন লিসি নাকি বলছে যে, কেটিকে একেবারে চেনাই যায় না, অর্থাৎ তাকে নাকি বড্‌ডো বেশি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। বন্ধুদের সে বলে দিয়েছে তাকে কেতকী বলে ডাকতে; এটা তার পক্ষে নির্লজ্জতা, যে মেয়ে একদা ফিন্‌ফিনে শান্তিপুরে শাড়ি পরত সেই লজ্জাবতীর পক্ষে জামা শেমিজ পরারই মতো। অমিত তাকে নাকি নিভৃতে ডাকে “কেয়া” বলে। এ কথাও লোকে কানাকানি করছে যে, নৈনিতালের সরোবরে নৌকো ভাসিয়ে কেটি তার হাল ধরেছে আর অমিত তাকে পড়ে শোনাচ্ছে রবি ঠাকুরের “নিরুদ্দেশ যাত্রা।” কিন্তু লোকে কী না বলে। যতিশংকর বুঝে নিলে, অমিতর মনটা পাল তুলে চলে গেছে ছুটিতত্ত্বের মাঝদরিয়ায়। অবশেষে অমিত ফিরে এল। শহরে রাষ্ট্র কেতকীর সঙ্গে তার বিয়ে। অথচ অমিতর নিজ মুখে একদিনও যতী এ প্রসঙ্গ শোনে নি। অমিতর ব্যবহারেরও অনেকখানি
false
shunil_gongopaddhay
আপনার নয়। আপনার তো পাহাড়-জঙ্গলে গিয়ে ভূত তাড়া করার কথা। কাকাবাবু বললেন, আমি পুলিশের লোক নই, কিন্তু আমি মানুষ। তোমাদের মতন অমানুষ নই। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাচ্ছে শুনলে আমার কষ্ট হয়। শুধু কষ্ট নয়, মাথা গরম হয়ে ওঠে। আংটি-পরা লোকটি বলল, উঁহু, মাথা গরম করা মোটেই ভাল নয়। মাথা গরম করেই তুমি হুট করে এখানে চলে এসেছ! কাজটা মোটেই ভাল করোনি। এখান থেকে কী করে ফিরে যাবে, সে চিন্তা করোনি! পাশের লোকটি এবারে বলে উঠল, আরে ওস্তাদ, এর সঙ্গে তুমি এত ধানাইপানাই করছ কেন? সাফ-সাফ কথা বলে দাও। ময়নার ছেলেটাকে ফেরত না দিলে ওর ওই মেয়েটার একটা হাত কেটে ফেলা হবে! কাকাবাবু বললেন, দেবলীনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করলে ময়নার ছেলেকে কোনওদিনই ফেরত পাবে না। আমি যা বলছি আগে শোনো, তা হলে সব গণ্ডগোল মিটে যাবে। সে লোকটি উঠে এসে কাকাবাবুর গলায় হাত দিয়ে বলল, চোপ! তুই আবার কী বলবি রে? আমরা যা বলব তা তোকে শুনতে হবে। কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, গলা থেকে হাত সরাও! আমার গায়ে কারও হাত ছোঁয়ানো আমি পছন্দ করি না। লোকটি এবারে আরও জ্বলে উঠে বলল, চোপ, হারামজাদা, ল্যাংড়া! যদি এক্ষুনি তোর গলা টিপে মেরে রেললাইনে ফেলে দিয়ে আসি, তুই কী করবি? কাকাবাবু বললেন, কাউকে মেরে রেললাইনে ফেলে দিয়ে আসাই তোমাদের কায়দা? সে লোকটি আরও কিছু বলার আগে আংটি-পরা লোকটি হাত তুলে বলল, দাঁড়া দাঁড়া, ডাবু, যা বলার আমি বলছি! ডাবু বলল, ওস্তাদ, এ-ল্যাংড়াটা আমারই ঘরে বসে আমাকে ধমকাবে, তা আমি সহ্য করব? ওস্তাদ বলল, এরা লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোক তো, প্রথম-প্রথম এরকম চোটপাট করে। দু-চারটে পুলিশের সঙ্গে চেনাশোনা আছে বলে মনে করে, ওদের সবাই ভয় পাবে। পেটে দু-চারটে কোঁৎকা মারলেই দেখবি, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। পা জড়িয়ে ধরবে। ওসব ভদ্দরলোক আমার ঢের দেখা আছে। কাকাবাবুর ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। ওস্তাদ বলল, ঠিক আছে, রায়চৌধুরীবাবু, তুমি কী বলতে চাও, আগে শুনি। তারপর আমাদের কাজ শুরু হবে। কাকাবাবু বললেন, আমার একটাই শর্ত আছে। তোমরা দেবলীনা দত্ত নামে মেয়েটিকে ছেড়ে দেবে, যে বাচ্চা ছেলেগুলোকে চুরি করে এনেছ, তাদেরও ছেড়ে দেবে আমার সামনে, তারপরই ময়নার ছেলেকে ফেরত পাবে। ওস্তাদ ভুরু তুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমরা ছেলে চুরি করি, তোমায় কে বলল? না, না, ওসব আমাদের কাজ নয়। আমরা জিনিস সাপ্লাই করি। বর্ডারের ওপার থেকে যেসব জিনিস পাঠায়, তা আমরা এক-এক জায়গায় পৌঁছে দিই। কখন কী জিনিস পাঠাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। কাকাবাবু বললেন, তোমরা আর কী-কী চোরাই জিনিস সাপ্লাই করো, তা নিয়ে আমিও মাথা ঘামাতে চাই না। সেসব আটকানো পুলিশের কাজ। কিন্তু বাচ্চা শিশুদের বিদেশে চালান করা আমি সহ্য করব না কিছুতেই। বারোটি দুধের বাচ্চাকে তোমরা আটকে রেখেছ, আমি জানি! ওস্তাদ হো-হো করে হেসে উঠে বলল, তুমি সহ্য করতে পারবে কি না, তাতে আমাদের কী আসে যায়? তুমি তো ভারী মজার কথা বলো! কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার আর কিছু বলার নেই। বাচ্চাগুলোকে আর মেয়েটিকে ছেড়ে না দিলে তোমরা ময়নার ছেলেকে ফেরত পাবে না। ওস্তাদ বলল, আরে, আরে, যাচ্ছ কোথায়? ডাবু নামের লোকটি এক লাফে উঠে এসে কাকাবাবুকে জাপটে ধরতে গেল। কাকাবাবু এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিলেন মাটিতে। ডাবু লোকটি বেশ শক্তিশালী, কিন্তু কাকাবাবুর হাতে যে এতটা জোর, তা সে ভাবতেই পারেনি। মাটিতে পড়ে গিয়ে সে চেঁচিয়ে ডাকল, অনন্ত, দিনু– ওস্তাদ পকেট থেকে রিভলভার বার করল। বাইরে থেকে দুজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল কাকাবাবুকে, তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রিভলভার বার করলেন না, কাউকে ঘুসি-টুসিও মারলেন না। একবার ওদের হাত ছাড়িয়ে চলে এলেন দরজার কাছে, আবার ওরা চারজন মিলে চেপে ধরল, একজন একটা মিষ্টি গন্ধমাখা রুমাল ঠেসে দিল তাঁর নাকে। তাতেই তাঁর হাত-পা অবশ হয়ে গেল, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। ওস্তাদ বলল, ডাবু, দ্যাখ তো, লোকটার কাছে নিশ্চয়ই অস্তর আছে। ডাবু কাকাবাবুর কোটের পকেট চাপড়ে রিভলভারটা খুঁজে পেয়ে গেল। ওস্তাদ বলল, এটা বার করার সময় পায়নি। আমারটা দেখেছে তো, তাই বুঝে গেছে যে আর কোনও লাভ নেই। ডাবু জিজ্ঞেস করল, অনন্ত, বাইরে পুলিশের গাড়ি আছে? অনন্ত বলল, কাছাকাছি নেই, দেখে এসেছি। ওস্তাদ বলল, গন্ধ শুঁকে-শুঁকে ঠিক আসবে। এখন হোটেলটা বন্ধ রাখতে হবে কিছুদিন। এখানে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। এ লোকটাকে আমাদের আসল ডেরায় নিয়ে চল। ময়নাকেও এখান থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার। ময়না চলুক আমার সঙ্গে। ওদের দুজন কাকাবাবুকে চ্যাংদোলা করে নামিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই সন্তু তড়াক করে খাট থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে এল দোতলায়। কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে দেখল, বিছানার চাদরে একটুও ভাঁজ পড়েনি। দেখলেই বোঝা যায়, রাত্তিরে ফেরেননি কাকাবাবু। সন্তু ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। এরকম তো হয় না। কাকাবাবু কাল ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন, সন্তুকে কিছুই বললেন না। না খেয়েদেয়ে কোথায় চলে গেলেন অত রাত্রে? সে টেবিলটা খুঁজে দেখল, যদি তার প্রতি কোনও নির্দেশ লিখে রাখা থাকে। তাও নেই। আর দুদিন বাদেই কাকাবাবুর সঙ্গে তার ইজিপ্ট যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে, তা আর যাওয়া হবে না। বাচ্চা ছেলেগুলোকে উদ্ধারের চিন্তায় কাকাবাবু এখন অন্য সবকিছু ভুলে গেছেন। কাল তিনি
false
MZI
খবর ছড়িয়ে গেল দ্রুত। আজিজ খায়ের মতো লোকেরও নিজের পীর আছে। শুধু তাই নয়, সেই পীর নাকি হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরীর দাড়ি দিয়ে পা পর্যন্ত মোছেন না। লোকজন খবর নিতে আসে। স্বল্পভাষী আজিজ খাঁ বলবেন না বলবেন না করেও একটা দুটো কথা বলে ফেলেন। শুনে সবার ভিরমি লেগে যায়। একটি গল্প এরকম : আঠার বছরের মেয়েকে নিয়ে মা এসেছেন পীরের কাছে। দুই বছর থেকে সেই মেয়ের ওপর জিনের আছর। মেয়ে পীরকে দেখে আর এগুতে চায় না, কারণ সহজ, মেয়ে তো আসলে মেয়ে নয়, তাকে চালাচ্ছে এক কাফির জিন, জিনদের ভেতরেও নামাজী এবং কাফির জিন আছে। পীর খালি একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর এক হাত সুতা নিয়ে বসলেন। একটা করে সুরা পড়েন আর সুতায় একটা করে গিট দেন, সাথে সাথে জিনের সে কী চিল্কার! বলে, বাবাগো, মাগো, ছেড়ে দাও, সুলায়মান পয়গম্বরের কসম আমাকে ছেড়ে দাও। পীর বললেন, শালার ব্যাটা, তুই এখনি দূর হয়ে যা। তখন জিন আর যেতে চায় না, হুঁজুরের সাথে তখন কী ভয়ংকর ঝগড়া! কিন্তু হুঁজুরের সাথে পারবে সে সাধ্যি কার আছে? শেষ পর্যন্ত জিন যেতে রাজি হল। হুঁজুর বললেন, যাওয়ার আগে একটা চিহ্ন দিয়ে যা। জিন জিজ্ঞেস করল, কী চিহ্ন দিয়ে যাব? হুঁজুর বললেন, দরবারের সামনে আমগাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে দিয়ে যা। মুহূর্তে মেয়ে চোখ খুলে তাকায়, আর ঝড় নেই বৃষ্টি নেই মড়মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। আজিজ খাঁ শুধু গল্প বলেই ক্ষান্ত হলেন না, ঘোষণা করলেন যারা যারা ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চায় সামনের শুক্রবার তাদের নিয়ে যাবেন, নিজের চোখে সেই আমগাছের ভাঙা ডাল দেখে আসবে। পরের সপ্তাহে বেশ কয়জন আজিজ খাঁর সাথে পীরের দরবার থেকে ঘুরে এলেন। আজিজ খায়ের গল্পে কোনো মিথ্যা নেই। সত্যি সত্যি দরবারের সামনে আমগাছের ভাঙা ডাল। তখন-তখনি কয়েকজন সেই পীরের মুরীদ হয়ে গেল। এরপর অফিস দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরীর মুরীদেরা এবং হযরত মাওলানা নূরে নাওয়াজ নকশবন্দীর মুরীদেরা। আমরা কয়েকজন কোনো দলেই নেই এবং আমাদের হল সবচেয়ে বিপদ। দু’দলের ওয়াজ-নসীহত, উরশ এবং মিলাদের চাঁদা দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাবার মতো অবস্থা। এক দলকে পাঁচ টাকা চাঁদা দিলে আরেক দল দশ টাকা না নিয়ে ছাড়ে না, তখন আবার প্রথম দল এসে আরো পাঁচ টাকা নিয়ে সমান সমান করে দেয়। চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই। এক দুই মিনিট অনুরোধ করেই হুঁমকি দেয়া শুরু হয়ে যায়। দেখে-শুনে মনে হল সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজেই পীর হয়ে যাই। পীর যদি হতে না পারি, অন্তত ধর্মটা পাল্টে ফেলি। অফিসে এক জন বৌদ্ধ কেরানি আছে, দিলীপকুমার বড় ময়া, তাকে কেউ কখনো বিরক্ত করে না। সেদিন সফদর আলীর সাথে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে পীরের উপদ্রব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কী ভাবে দুই পীরের ভক্তেরা দলাদলি শুরু করেছেন এবং দুই দলের টানাটানিতে আমাদের কী ভাবে দম বের হয়ে যাচ্ছে, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। সব শুনেটুনেও সফদর আলী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, পীরদের কি কোনো পরীক্ষা পাস করতে হয়? আমি হাসি গোপন করে বললাম, না। তাহলে আপনি বুঝবেন কেমন করে যে সে পীর? ব্যাপারটা হচ্ছে বিশ্বাস। তাহলে আপনি কেন একজনকে বিশ্বাস করবেন, আরেকজনকে অবিশ্বাস করবেন? আমাকে তখন সফদর আলীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে হয়। বিশ্বাস অর্জনের জন্যে সবসময়েই পীরদের সম্পর্কে অলৌকিক কাহিনী ছড়ানো হয়। সাধারণ মানুষের অনেক সমস্যা থাকে, অলৌকিক জিনিস বিশ্বাস করতে তাদের এতটুকু দেরি হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অলৌকিক ঘটনাগুলো কখনো কেউ যাচাই করার চেষ্টা করে না। আমি এখন পর্যন্ত একটি মানুষকেও পাই নি যে বলেছে সে নিজে একটি অলৌকিক ঘটনা দেখেছে। সবসময়েই শোনা ঘটনা, ওমুকের বড় ভাইয়ের শালা বলেছেন, ওমুকের ভায়রা ভাই নিজের চোখে দেখেছেন। ওমুক অফিসের বড় সাহেব করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এক জন দু’জন যে নিজের চোখে দেখেছেন বলে দাবি করেন নি তা নয়। কিন্তু চেপে ধরার পর সবসময়েই দেখা গেছে হয় মিথ্যে না হয় অতিরঞ্জন। একবার দুবার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আমি পীরদের কাছে গিয়েছি। কিন্তু সময় এবং পয়সা নষ্ট করা ছাড়া আর কোনো লাভ হয় নি। সফদর আলীর তখনো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না, মাথা চুলকে বললেন, তাহলে এক জন মানুষ কেন পীর হয়ে যায়? পীরদের বাড়ি দেখেছেন কখনো? না। দেখলে আপনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন, পাকা দালান, ফ্রিজ, টেলিভিশন ছাড়া পীর নেই। পীরদের চেহারা দেখলে আপনি বোকা বনে যাবেন, দুধ-ঘি খেয়ে একেকজনের অন্তত আড়াই মণ ওজন এবং গায়ের রঙ গোলাপি। এই বাজারে এত আরামে কয়জন থাকতে পারে? একবার একটা ভালো পীর যদি হয়ে যেতে পারেন, কয়জন বড় পুলিশ, আর্মি অফিসারকে মুরীদ করে নিতে পারেন, আর কোনো চিন্তা নেই। সফদর আলী চিন্তিত মুখে চুপ করে খানিকক্ষণ কী একটা ভাবলেন, তারপর বললেন, তার মানে যত পীর দেখা যায় সবাই আসলে দুষ্টু লোক? তা নির্ভর করে আপনি দুষ্টু লোক বলতে কী বোঝান তার ওপর। তবে হ্যাঁ, যারা লোক ঠকায় তারা দুষ্টু লোক ছাড়া আবার কী? সবাই লোক ঠকায়? আপনি কোনো গরিব পীর দেখেছেন? দেখেন নি—কারণ গরিব পীর নেই। যে-পীরের যত নামডাক সেই পীরের তত বেশি টাকাপয়সা, টাকাপয়সাটা আসে
false
shorotchandra
করেছিলুম, এই একটা মাসের মধ্যেই আর কোথাও পাত্রী স্থির করে মহিমের বিয়ে দেব। যেমন করেই হোক তাকে আটকাতে হবে। আমার বন্ধু হয়ে সে যে একটা নারীর মোহে নিজেদের সমাজ ছেড়ে চলে যাবে, এ যেন কিছুতেই না ঘটতে পায়। অচলা রুদ্ধ-নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, তার পরে? তাহার পাংশু মুখের পানে চাহিয়া সুরেশ একটুখানি হাসিল; কহিল, তার পরে আর ভয় নেই। এ পাপ-সঙ্কল্প ত্যাগ করেছি, আজ সেই কথাই আমি স্বীকার করে যাব। আপনাকে দেখা দেবার জন্যে কাল রাত্রে তাকে অনেক অনুরোধ করেচি। একদিন আমার অনুরোধটা সে রেখেছিল, কিন্তু কালকের অনুরোধটা রাখলে না—আপনাকে দেখা না দিয়েই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল। অচলা জিজ্ঞাসা করিল, যাবার কোন কারণ দেখিয়েছিলেন? সুরেশ কহিল, না। দরকার আছে—এই মাত্র। অচলা আর একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া যেন আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল—দরকার! দরকার! চিরকাল তাঁর মুখে এই কথাই শুনে আসছি—চিরদিন প্রয়োজনই তাঁর সর্বস্ব! সুরেশ কহিল, একটা চিঠি লিখেও ত সে আপনাকে জানাতে পারত। অচলা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিল, না। চিঠি তিনি লেখেন না। সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল; বলিল, কি প্রয়োজন, তাও কখনো বলে না। তার সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ সমস্তই তার একার। স্বার্থপর! কখনো কাউকে তার ভাগ দিলে না। এই নিয়ে কত দুঃখ সে যে ছেলেবেলা থেকে আমাকে দিয়ে এসেছে, বোধ করি, তার সীমা নেই। নিষ্ঠুর! দিনের পর দিন নিজে উপোস করে, আমার প্রতিদিনের খাওয়া-পরা তিক্ত বিষাক্ত করেচে—কিন্তু কখনো কোনদিন আমার মুখ চেয়েও আমার হাত থেকে কিছু নেয়নি। আমার ভয় হয়, যে পাষাণকে নিয়ে আমি কখনো সুখ পাইনি, তাকে নিয়ে আপনিই কি সুখী হতে পারবেন? বলিতে বলিতেই অকস্মাৎ তাহার চোখ-দুটো অশ্রুজলে ঝকঝক করিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া, জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, দেখুন, আমার বাইরেটা ভারী শক্ত দেখতে, কিন্তু ভিতরটা তেমনি দুর্বল। মহিমের ঠিক তার উলটো—তবু আমাদের মত বন্ধুত্ব সংসারে বোধ করি খুব কমই ছিল। অচলা নতমুখে মৃদুকণ্ঠে বলিল, সে আমি জানি সুরেশবাবু, এবং আরও জানি যে, সে বন্ধুত্ব আজও তেমনি অক্ষয় হয়ে আছে। শৈশবের সমস্ত পূর্বস্মৃতি সুরেশের বুকের ভিতর আলোড়িত হইয়া উঠিল, সে অশ্রু-রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, যখন জানেনই, তখন এই ভিক্ষা আজ আমাকে দিন যে, অজ্ঞানে যে শত্রুতা আপনাদের করেচি, সে অপরাধ আর যেন আমার বুকে না বেঁধে। তাহার কণ্ঠস্বর আবেগে পুনরায় রুদ্ধ হইয়া আসিল এবং এই একান্ত ব্যাকুলতায় অচলার নিজের অন্তরটাও যেন দুলিয়া দুলিয়া উঠিল। সে উদ্গত অশ্রু গোপন করিতে অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়াই দেখিল, তাহার পিতা দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। কেদারবাবু সুরেশকে দেখিয়া খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই যে সুরেশবাবু! সুরেশ দাঁড়াইয়া নমস্কার করিল। কেদারবাবু আসন গ্রহণ না করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, মহিমের খবর কি? তাকে ত দেখচি নে! সুরেশ বলিল, মহিম অত্যন্ত প্রয়োজনে সকালের গাড়িতেই বাড়ি চলে গেল—এই খবর জানাবার জন্যেই আমি এলুম। কেদারবাবু বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, বাড়ি চলে গেল। বলিয়াই সহসা জ্বলিয়া উঠিয়া কহিতে লাগিলেন, সে বাড়ি যাক, থাক, আমাদের তাতে আর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তুমি বাবা সুরেশ যখন সময় পাবে বাড়ির ছেলের মত এখানে এসো, যেয়ো—আমার বড় আনন্দ হবে—কিন্তু তোমার সেই মিথ্যাচারী বন্ধুরত্নটি যেন আর কখন এ বাড়িতে মুখ না দেখায়। দেখা হলে বলে দিও তার আর কোন লজ্জা না থাকে—অন্ততঃ অপমানের ভয়টা যেন থাকে। সুরেশ ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার মনের ভাব অনুমান করিবার চেষ্টা করিয়া কেদারবাবু সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, না, না, সুরেশ তোমার লজ্জা বোধ করবার ত এতে কোনই কারণ নেই। বরঞ্চ কর্তব্য করবার গৌরব আছে। তুমি বুঝতে পারছ না যে, কি বিপদ থেকে আমাদের পরিত্রাণ করেছ এবং কতদূর পর্যন্ত আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। মেয়ের দিকে চাহিয়া কহিলেন, আমি কাল থেকে এই বড় আশ্চর্য হচ্ছি অচলা, সে লোকটা সুরেশের মত ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল কি করে, আর কি করেই বা এতদিন ধরে সেটা বজায় রেখেছিল। একটুখানি থামিয়া বলিলেন, যে এ পারে, সে যে আমাদের মত দুটি নিরীহ মানুষকে ভুলিয়ে রাখবে, এ বেশি কথা নয়, মানি, কিন্তু এও বড় অদ্ভুত যে এই লোকটা বাস্তবিক কি, কেমন—এটুকু অনুসন্ধান করার কথাও আমার মত প্রবীণ বয়সের লোকের মনেও একটা দিন ওঠেনি। আশ্চর্য! সুরেশ কথা কহিল না, কেদারবাবুর মুখের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহিতে পর্যন্ত পারিল না। কেদারবাবু ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া নিজের পোশাকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, আমার অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে বাবা; একটু বসো, আমি এইগুলো ছেড়ে আসি; বলিয়া প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেই সুরেশ কহিল, আমার বেলা হয়ে গেছে। আজ যাই, আর একদিন আসব, বলিয়া ব্যস্ত হইয়াই উঠিয়া পড়িল এবং কোনমতে একটা নমস্কার সারিয়া লইয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল। কিন্তু পরদিন সকালেই আবার তাহাকে দেখিতে পাওয়া গেল এবং পরদিনও ঠিক এই সময়েই তাহার গাড়ির শব্দ আসিয়া থামিল। কিন্তু ইহার পরদিনও আবার যখন তাহার গাড়ির শব্দ শুনা গেল, তখন বেলা হইয়াছে। পিতাকে স্নানাহারের তাগিদ দিয়া অচলা উঠিবার চেষ্টা করিতেছে—কিন্তু তাঁহার আর উঠা হইল না, তিনি সুরেশকে সানন্দে আহ্বান করিয়া লইয়া গল্প শুরু করিয়া দিলেন। সুরেশ ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল বলিয়াই দুই-চারিটা সাধারণ কথাবার্তার পরে যখন উঠিতে গেল, তখন তাহার শুষ্ক রুক্ষ মাথার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া আজ অকস্মাৎ একনিমেষেই কেদারবাবু ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। বলিলেন, এখনো
false
humayun_ahmed
না। চুলায় পানি দিয়ে কেতলি বসাও। কেন? আজহার বললেন, কেতলির মুখ দিয়ে ষ্টিম বের হবে। খামটা স্টিমে ধরলে পাম নরম হবে। তখন ব্লেড় দিয়ে খুলব। চিঠি পড়া শেষ হলে আগের মতো লাগিয়ে রাখা হবে। ক্লিয়ার? আজহার চিঠি খুলে পড়লেন। চিঠিতে লেখা—— যুথী, আমার ছেলে শুভ্ৰ বিপদে পড়েছিল। তাকে তুমি সাহায্য করেছি। তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। সামান্য কিছু ফল পাঠালাম। গ্রহণ করলে খুশি হব। ইতি শুভ্রর মা। আজহার বললেন, শুভ্ৰটা কে? সালমা বললেন, জানি না কে। তুমি তার মা। তুমি কিছুই জানো না? আমাকে না বললে জানব কীভাবে? তুমি অতি মুর্থ একজন মহিলা। মূর্থিশ্রেষ্ঠ। মেয়ের সঙ্গে মায়ের থাকবে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক। যেন মেয়ে পেটে কথা রাখতে না পারে। রাতে এক বিছানায় মা-মেয়ে শোবে। মেয়ে গুনগুন করে সব কথা বলবে। তুমি সময়মতো আমাকে জানাবে। তা-না, সন্ধ্যা হতেই ঘুম। বুদ্ধির কোনো নাড়াচাড়া আমি তোমার মধ্যে দেখলাম না। অপদার্থ মেয়েছেলে! গালাগালি করছি কেন? গালাগালি করছি কারণ গালাগালি তোমার প্রাপ্য। চিঠি পড়ে তো আমার গায়ের রক্ত পানি হবার উপক্রম হয়েছে। শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এমনই বিপদ যে উদ্ধারের পর তার মা একগাদা ফল পাঠিয়েছে। আর উদ্ধার কে করেছে? তোমার মেয়ে। আমি নিশ্চিত ড্রাগঘটিত কিছু! শুভ্র ড্রাগ চালাচালিতে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিল। তোমার মেয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে হাতে-পায়ে ধরে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। তোমার মেয়ে তো কথার রানি। ও কি তার ঘর তালা দিয়ে গেছে? হুঁ। এইটাও তো একটা কথা, যখনই বাইরে যাবে ঘর তালা দিয়ে যাবে কেন? এমন কী আছে ঘরে যা কেউ দেখতে পারবে না? আমি তালা খোলার লোক নিয়ে আসছি। তালা খুলে আজ তার ঘর চেক করা হবে। তোমার শরীরটা খারাপ! শুয়ে থাকে। অন্য কোনোদিন তালা খোলা হবে। আজহার শার্ট পরতে পরতে বললেন, এইসব জিনিস দেরি করতে নাই। কুইক অ্যাকশানে যেতে হয়। শরীর খারাপের আমি কেঁথা পুড়ি। ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারণত বেশ কয়েকজন থাকেন। এখানে বোর্ডে একজনই আছেন। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। সুন্ট-টাই পরা না। হালকা সবুজ রঙের টিশার্চ পরা। ভদ্রলোকের চুল কোঁকড়ানো। চেহারা সুন্দর। তাঁর সামনে কোনো ফাইলপত্র নেই। আছে কোনো একটা গল্পের বই। ইন্টারভিউ নেওয়ার চেয়ে গল্পের বই পড়ার ব্যাপারে তার আগ্ৰহ বেশি দেখা যাচ্ছে। কথাবাতাঁর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বইও পড়ছেন। তাঁর নাম আহসান। তিনি চিকেন ফেদার কোম্পানির সৰ্বেসৰ্ব্ব। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরটাও খুব সুন্দর। দেয়ালে তিনটা পেইনটিং। প্রতিটাই সুন্দর। একটা পেইনটিং-এ গ্রামের মেয়ে ঘোমটা দিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা এত সুন্দর যে যুথীর চোখ বারবার সেখানে চলে যাচ্ছে। আহসান বললেন, বিএসসি অনার্স পাশ করেছেন। রেজাল্টও বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণী। এমএসসি শেষ করলেন না কেন? কারণটা কি আর্থিক? জি। অনার্সে সাবজেক্ট কী ছিল? ম্যাথমেটিকস। ইন্টারেস্ট্রিং। ইন্টারেস্টিং কেন? মেয়েরা সাধারণত অঙ্কের দিকে যায় না। তারা সাইকোলজি, সাহিত্য, এইসব পড়ে। মেয়েদের ছোট করার জন্যে বলছি না। এটাই জেনারেল ট্রেন্ড। ভুল বললে সরি। যুথী বলল, স্যার ভুল বলেন নি। ভদ্রলোক বললেন, বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল ছিলেন অঙ্কের ছাত্র। তাঁর নাম জানেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভেরি গুড। তাঁর কোনো বই পড়েছেন? দুটা বই পড়েছি—পুতুল নাচের ইতিকথা আর জননী। আমার এক বান্ধবী আছে, তার নাম নীপা। সে খুব বই পড়ে। নীপা যেসব বই আমাকে পড়তে দেয়, আমি তা-ই পড়ি। আপনি যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম বলতে পারেন, আমি আপনাকে চাকরি দিয়ে দেব। বলতে পারবেন? নাম বলতে না পারলে চাকরি পাব না? যুথী বলল, এই চাকরির সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কী? কোনো সম্পর্ক নেই। এই মুহূর্তে আমি উনার একটা বই পড়ছি বলে এরকম সিদ্ধান্ত নিলাম। যুথী বলল, উনার আসল নাম প্ৰবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। কনগ্রাচুলেশনস। ভদ্রলোক বোতাম টিপলেন। এবার সুন্ট-টাই পরা একজন ঢুকলেন। আহসান বই থেকে মুখ না তুলে বললেন, জহির, এই মেয়েটির নাম যুথী। সে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করছে। অফিস এক্সিকিউটিভ। অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করার ব্যবস্থা করুন। জয়েনিং ডেট কবে স্যার? সামনের মাসের এক তারিখ। জহির যুথীর দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম আসুন আমার সঙ্গে। যুথীর সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। এটা কেমন চাকরির ইন্টারভিউ? এত বড় একটা কোম্পানি চলবে খামখেয়ালিভাবে? যুথী কী জানে বা জানে না। এই সম্পর্কে এরা তো কিছুই জানে না। বর্তমান সময়ের কাজের প্রধান যে বিষয় কম্পিউটার জানা তাও সে জানে না। ইংরেজিতে সে খুবই কাঁচা। কারও সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো তার জন্যে অসম্ভব ব্যাপার। জহির বলল, ম্যাডাম! এইটা আপনার রুম। একটু অগোছালো আছে। আজ দিনের মধ্যেই গুছিয়ে দেওয়া হবে। আপনার পার্সেনাল অ্যাসিসটেন্টের নাম গফুর। সে বিরাট ফাঁকিবাজ। তাকে সবসময় ধমকের ওপর রাখবেন। আমার আগে এখানে কে বসতেন? শর্মি ম্যাডাম বসতেন। উনি ছিলেন কম্পিউটারের জাদুকর। যে-কোনো প্রবলেম নিমিষে করতে পারতেন। উনার চাকরি কি নেই? গত মাস থেকে তাকে অফ করা হয়েছে। কেন? ম্যাডাম জানি না কেন! চা খান, চা দিতে বলি? বলুন। আমি দশ মিনিট পর কাগজপত্র রেডি করে নিয়ে আসব। যুথী তার ঘরে বসে আছে। ঠান্ডা ঘর। এসি চলছে। বিজবিজ করে এসির শব্দটা এমন অদ্ভুত লাগছে। যুথীর এখন মনে হচ্ছে, এটা কোনো স্বপ্ন। মাঝে মাঝে সে নিখুঁত স্বপ্ন দেখে। একবার স্বপ্নে দেখল, বাসে করে যাচ্ছে। তার পাশেই বুড়োমতো এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কোলে পাঁচ-ছয় বছরের একটা মানসিক প্রতিবন্ধী ধরনের মেয়ে। সে হা করে
false
shomresh
গাড়িতে উঠতে পার। পাঁচ জন আছে, ছয় জন হলেই ছাড়ব। দীপা হাতের মুঠো খুলে এক টাকা দশ আনা দেখাল। লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে বলা তো? দীপা চা বাগানের নাম বলল। তার হাত তখনও বাড়ানো। লোকটা সেখান থেকে একটা আধুলি নিয়ে স্যুটকেস তুলে নিল, এসো। গাড়িতে আড়ষ্ট হয়ে বসল দীপা। কোন গদি নেই। স্প্রীংগুলোর ওপর দুটো বস্তা পেতে দেওয়া হয়েছে। বসামাত্র লাগছিল। গাড়ি চলা শুরু করলে অসহ্য হয়ে উঠল। দীপার পাশে বসা লোকটা বলল, একটু রবার লাগাতে পাবো না ভাই। পাছা গেল! গাড়িটা থেমে গিয়েছিল। স্টার্ট নিচ্ছিল না। ড্রাইভার লাফিয়ে নেমে একটা কাশগাছ ছিঁড়ে বনেট খুলে ইঞ্জিনের একটা জায়গায় ঢুকিয়ে দিল। ফিরে এসে একবার চেষ্টা করতেই স্টার্ট নিল গাড়ি। একমুখ থুতু বাইরে ফেলে লোকটা বলল, এক টাকায় বস্তাই হয়। রবার চাইলে দেড় টাকা দিতে হবে। ঘাটে নামিয়ে দিতেই সবাই ছুটল দাঁড়িয়ে থাকা নৌকে ধরতে। লোকটা দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, যাচ্ছ যেখানে সেখানে কে থাকে? বাবা-মা। ভাই। ঠাকুমা। শ্বশুরবাড়ি থেকে পালাচ্ছ মনে হচ্ছে। আমার কি! বাসুদেব বলে বাসটায় উঠবে। চল। লোকটা স্যুটকেস তুলে দিল নৌকোয়। শীত শীত করছিল দীপার। এখন রোদ ছড়ানো রয়েছে আকাশে। কিন্তু চওড়া নদীর ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। দুটো হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখেও কনকনানি থামাতে পারছিল না। সাবাটা দিনের অস্নাত অভুক্ত শরীরটা টলছিল। নৌকোয় যাত্রীরা নিঃশব্দে ছিল শুধু মাঝিবা চিৎকার করে গুণ টানছে। হাওয়ার বিপরীতে যাওয়ায় ঠাণ্ডাটা লাগছে জব্বর। পাশে বসা এক মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, গরম জামা আনোনি সঙ্গে? দীপা মাথা নেড়ে না বলল। মহিলা বললেন, সঙ্গে তো দেখছি কেউ নেই। যােচ্ছ কোথায়? বাপের বাড়ি না শ্বশুর বাড়ি? দীপা গম্ভীর মুখে জবাব দিল, বাপের বাড়ি। কবে বিয়ে হয়েছে? তরশু। ইয়ার্কি মারছ? এটুকুনি মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বের হবে, ইয়ার্কি মারছ? দীপা জবাব দিল না। সে কঠিন মুখে বসে রইল। মহিলা তাঁর পাশের সঙ্গীর সঙ্গে ফিসফিস করে কিছু বললেন। দীপা শুনল লোকটা বলছে, পুলিশে ধরিযে দেওয়া উচিত। মহিলা ধমকালেন, তোমার কি! পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। যে পালাচ্ছে তাকে পালাতে দাও। থাক, ওদিকে আর তাকিও না তুমি। মাঝি হত না লাগালে টলায়মান নৌকো থেকে স্যুটকেস নিয়ে নামতে পারত না দীপা। ঘাটের দোকানগুলোতে খদ্দেরদের ঢোকার জন্যে হাঁকাহকি চলছে। পরশু রাত্রে এই ঘাটেই ওরা জোড়া-নৌকোতে উঠেছিল। তখন অন্ধকারে কিছুই নজরে আসেনি। এখন দেখল গোটা পাঁচেক বাস দাঁড়িয়ে। কন্ডাক্টার খালাসিরা চিৎকার করে যাত্রী ডাকছে। শহরে যাওয়ার যাত্রীতে ভরে গেল নৌকো। বাসুদেব বাসটা কোথায়। কোয়ার্টার্সের সামনে দাঁড়িয়ে বা স্কুলে যাওয়ার সময় ওই নামের বাসটাকে দেখেছে। পেটের কাছে বড় করে লেখা থাকে বাসুদেব। দীপা স্যুটকেসটা তুলল। একটানে যতটা সম্ভব হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল সে! একটা কুলি ছুটে এল তার কাছে, কোথায় যাবেন দিদি? কোন বাস? দীপা জবাব দিল, বাসুদেব। দ্যান আমারে। দু আনা দিবেন। আসেন। জলদি। বাস ছাড়বার টাইম হইছে। দীপা দেখল লোকটা অবলীলায় স্যুটকেস তুলে দৌড়াতে লাগল। বালির ওপর দিয়ে শাড়ি পরে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল। চটিতে বালি ঢুকে যাচ্ছে, কাপড়ে টান পড়ছে। সে দেখল চারপাশের লোকজন, মায় খাবারের দোকানের বেঞ্চিতে বসেও সবাই তার দিকে হাঁ করে দেখছে। এবং তখনই তার খেয়াল হল বাঁ হাতের মুঠোয় ঘোমটার আঁচল ধরা আছে। সেই যে ফুলশয্যার ঘরে ঘোমটা দিয়ে আঁচল ধরেছিল আর তা খোলা হয়নি। এতক্ষণ মনেও ছিল না। সে চট করে হাত নামাতেই ঘোমটা সরল এবং কানো ঠাণ্ডা হাওয়া লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘোমটাব প্ৰান্ত মুঠোয় ধরল দীপা। যে যাই ভাবুক, এতে তার ঠাণ্ডা কম লাগবে। খালাসিটা স্যুটকেস বাসের মাথায় তুলে দিচ্ছে। দীপা বাসুদের লেখাটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ যে উদ্বেগ বুকের পাঁজরায় ভার বাড়াচ্ছিল সেটা উধাও হয়ে গেল। এই বাস রোজ তাদের কোয়ার্টার্সের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করে যখন তখন সে ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে। লোকটাকে দু আনা দেওয়ার পর তার হাতে একটা টাকা রইল। গাড়ি ভাড়া কত? দীপার গলা শুকিয়ে গেল। এক টাকায় হয়ে যাবে? মনে পড়ল ট্যাক্সিওয়ালা ভাডা চেয়েছিল একটা টাকা কিন্তু তার হাত থেকে নিয়েছিল আট আনা। ওপর থেকে নেমে এসে খালাসিটা ধমকাল, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? গাড়িতে উঠুন। কোথায় যাবেন? দীপা চা-বাগানের নাম বলল। খালাসি বলল, উঠুন। জলদি। লেডিস সিটে বসে পড়ন। গাড়ি এখনই ছাডবে। শাড়ি সামলে বাসের সিঁড়ি ভাঙ্গতে বেশ কসরত করতে হল। খুব ভিড় নেই। লেডিস লেখা একটা খালি সিটে বসে পড়ল সে। এবং তার কিছুক্ষণ বাদেই ঝিমুনি এল। বাস যখন চলতে শুরু করল, যখন ঠাণ্ডার কামড় আরও বাড়ল, যখন রোদ্দুর টুপ করে সরে গিয়েই অন্ধকার নামল ময়নাগুড়ির ওপর, তখন কণ্ডাক্টার এসে দীপার পাশে বা জানলা বন্ধ করে দিল। দীপা চোখ মেলল। তার খুব কাঁপুনি আসছিল। ঠোঁট শুকনো। গলার ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার দুটো হাঁটু কাঁপছিল। সে ঝাপসা দেখল। কন্ডাক্টার একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবেন? দীপার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কি আশ্চর্য। আজ সবাই তাকে আপনি বলছে কেন? সে কি দুদিনেই এত বড় হয়ে গেল! দীপা হঠাৎ কন্ডাক্টারকে ঝাপসা দেখল। কন্ডাক্টার বলল, আরে, সঙ্গে কেউ নেই নাকি! চোখ দেখে মনে হচ্ছে জ্বর হয়েছে খুব। যাবেন কোথায়? দীপা কোনমতে চা-বাগানের নামটা উচ্চারণ করল। গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা মনে হল!
false
humayun_ahmed
আমার চিঠি পড়বি? বেশ আর পড়ব না। পড়বি না। শুধু না, তুই আমার ঘরেও কোনোদিন ঢুকবি না। বেশ ঢুকব না। আর আমার সঙ্গে কথাও বলবি না। ঠিক আছে বলব না। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। সন্ধ্যাবেল বাবা প্রেস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে নালিশ করল, বাবা বিলু আমার সব চিঠিপত্র পড়ে ফেলে। তাই নাকি? হ্যাঁ। তুমি ওকে ডেকে নিষেধ করে দাও। ঠিক আছে করব। না এখনই কর। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। শান্তস্বরে বললেন, একজনের কাছে লেখা চিঠি অন্যের পড়াটা ঠিক না মা। আমি লজ্জায় বাঁচি না। নীলুটা এমন হচ্ছে কেন কে জানে। আগে এ রকম ছিল না। তার কাছে চিঠি এলেই আমাকে সে চিঠি পড়তে হত। একবার সে পেনফ্রেন্ডশিপ করল বুলগেরিয়ার কি একটা ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলেটা সবুজ রঙের কাগজে লম্বা লম্বা চিঠি লিখিত ভুল ইংরেজিতে। চিঠির শেষে একটা ঠোঁটের ছবি একে লিখিত । নীলু আমাকে সেই চিঠি পড়তে দিয়ে বলত, মা গো কি অসভ্য! নীলুর সেই সব চিঠির জবাবও লিখে দিতাম। আমি। একদিন সে লজ্জায় লাল হয়ে বলল, বিলু চিঠির শেষে তুইও লিখে দে । ঐ বাঁদরটার সাথে তো আর দেখা হচ্ছে না। কি বলিস? আমি লিখলাম । নীলু বহু যত্নে একটা ঠোঁটের ছবিও আঁকল। তারপর ঐ ছেলে তার ছবি পাঠাল। মাথায় চুল নেই একটিও। গালে এত বড় একটা আঁচিল। হাতির কানের মত বড় বড় কান। ছবি দেখে দারুণ রেগে গেল নীলু। ছেলেটি লিখেছিল সুযোগ পেলেই সে তার বাংলাদেশী পেনফ্রেন্ড নীলুর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। নীলু বলল, লিখে দে হাঁদারাম তুমি বাংলাদেশে এলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেব। বাঁদর কোথাকার। নীলু চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলেও আমি চালিয়ে যেতে লাগলাম। মজাই লাগত। আমার। বানিয়ে বানিয়ে কত কিছু যে লিখছি। যেমন একবার লিখলাম, কাল আমরা সমুদ্রে নৌকা নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর সমুদ্র আমাদের। খুব মজা হয়েছে। একবার সে লিখল, তোমার কি কোনো ছেলেবন্ধু আছে? আমি লিখলাম, হ্যাঁ আছে। আমার ছেলে-বন্ধুটি একজন কবি। সে আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। ছেলেটা সত্যি সত্যি হাঁদারাম। যা লিখতাম তাই বিশ্বাস করত। তারপর একদিন সে হঠাৎ লিখে বসিল, আসছে সামারে আমি বাংলাদেশে আসব। কী সর্বনাশ! ভয়ে আমি এবং নীলু দু’জনই অস্থির। একি ঝামেলা হল। কি যে ভয়ে ভয়ে কেটেছে সেই সময়টা। রাতে ভাল ঘুম পর্যন্ত হত না। নীলু অবশ্যি খুব একটা ভয় পায়নি। ও বলত, খামোকা ভয় পাচ্ছিস, আসবে-টাসবে না। আর যদি এসেও পড়ে তাহলে বলব নীলু নামের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি অবশ্যি আসেনি। এবং চিঠিপত্রও দেয়নি। আর। হয়তো অন্য কোনো দেশের কোনো মেয়ে পেনফ্রেন্ডশিপ করেছে। নীলুর যন্ত্রণায় আরো সব চিঠি লিখতে হয়েছে আমাকে। একবার সে বলল, খুব ভাষা-টাষা দিয়ে একটা চিঠি লিখে দে তো বিলু। কার কাছে, কী–কিছুই বলবে না। লিখলাম একটা চিঠি। সেটা তার পছন্দ হল না। আবার একটা লিখলাম। কত কাণ্ড হল সে চিঠি নিয়ে। ক্লাসের মেয়েরা সেই চিঠির লাইন বলে বলে নীলুকে খ্যাপাতে লাগল। কোথায় পেয়েছে তারা সেই চিঠি কে জানে! নীলু। যে ছেলেকে লিখেছিল সে-ই হয়ত বলে দিয়েছে। নীলু বাসায় এসে কেঁদে-টেদে অস্থির। সেই সময় নীলুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল আমার। নীলু হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে গেল। আমার কোনো বন্ধুটন্ধু নেই। নীলু দূরে সরে যেতেই আমি একা হয়ে গেলাম। এরকম একটি অদ্ভুত সুন্দর সকালে একা থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি নীলুর খোজে বাগানের পেছনের দিকে এসে দেখি নীলু কাঁদছে। কী আশ্চর্য! আমি বললাম, কি হয়েছে রে? কিছু হয়নি। কাঁদছিস কেন? তোর কাছে সব কিছু বলতে হবে নাকি? বললে দোষ কি? নীলু। কোনো জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে বাগান ছেড়ে চলে গেল। সকালটা হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। লোকজন সবাই জেগে উঠেছে। রমজান ভাই ঘটং ঘটং করে টিউবওয়েলের পানি তুলছে। আকবরের মা ময়লা থালা-বাসন এনে জমা করছে টিউবওয়েলের পাশে। এক সময় ঝগড়া লেগে গেল দুজনের মধ্যে। এরা দু’জন দু’জনকে সহ্যই করতে পারে না। তবু কেমন করে থাকে এক সঙ্গে? এদের চেঁচামেচিতেই বোধ হয় বাবার ঘুম ভাঙল। বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চারদিক আবার চুপচাপ। বাবা বললেন, আমাকে চা দাও এক কাপ। এরা দুজনে কেউ কোনো উত্তর করল না। আকবরের মা বেড়ালের মতো ফ্যাসফ্যাস করে কি বলতেই আবার বেঁধে গোল রমজান ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আজকাল কেউ আর বাবাকে তেমন গ্রাহ্য করে না। আমি এগিয়ে এসে বললাম, আমি বানিয়ে আনছি। বাবা। তুই আবার চা বানাতেও জানিস নাকি? জানিব না কেন? বাবা অবাক হয়ে বললেন, কার কাছে শিখলি? কী আশ্চর্য কাণ্ড, চা বানানো আবার শিখতে হয় নাকি? বাবা এরকম ভান করতে লাগলেন যেন খুব অবাক হয়েছেন। আর কি জানিস, রান্নাবান্না করতে পারিস? ভাত-মাছ এইসব? নাহ। এইগুলিও শিখে ফেল। একদিন বিয়েটিয়ে হবে। রান্নাবান্না না জানলে বিয়ে দেয়াই যাবে না, হা হা হা। অনেক দিন পর বাবা হাসলেন। মানুষের হাসির মতো সুন্দর কি কিছু আছে? বাবার হাসির সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠল। মা একটা কথা সব সময় বলতেন, মানুষ যখন হাসে তখন তার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী হাসে। কিন্তু সে যখন কাঁদে, তার সঙ্গে আর কেউ কাঁদে না। কাঁদতে হয়
false
toslima_nasrin
বন্দর মানুষের সামনে আমি হু হু করে কেঁদে উঠি। ওঁদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমার যে এমন ঝড় বইবে বুকে, এমন যে উথলে উঠবে কষ্ট, তা আমি তখন বুঝিনি। কাচের ঘরের মত ভেঙে গেল আমার স্বপ্নের দালানকোঠা। পুরো বন্দর শুনল সেই ভাঙনের শব্দ, পুরো বন্দর শুনল আমার বুক ছেঁড়া আর্তনাদ। আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হল না। হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হল, ‘এই কাগজটি দেখিয়ে এসবি অফিস থেকে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে নেবেন।’ ‘কখন দেবে পাসপোর্ট?’ ‘আজকে বিকালে গেলে বিকালেই পাবেন। যদি না হয়, কালকে সকালে তো পাবেনই।’ উড়োজাহাজের পেটের ভেতর থেকে ফেরত এসেছে নম্বর সাঁটা আমার দুটো সুটকেস। সুটকেসদুটো সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ অবশ বসে থাকি। হঠাৎ কি করে কি হয়ে গেল, পুরোটাই যেন আস্ত একটি দুঃস্বপ্ন। এখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না সত্যি সত্যিই ঘটে গেছে এমন মর্মান্তিক একটি ব্যপার। কায়সার প্রায় সকালে বিজয়নগরে তার এক বন্ধুর আপিসে গিয়ে বসে। সেখানে ফোন করে কায়সারকে পেয়ে তাকে বিমান বন্দরে আসতে বলি। কায়সার এলে বাড়িতে না গিয়ে সোজা সচিবালয়ে যাই ইমরান নূরের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে আলাদা ঘরে নিয়ে মুখোমুখি বসে বললেন তাঁর কোনও ক্ষমতাই নেই আমার জন্য কিছু করার। কেন তাঁর ক্ষমতা নেই তা তিনি বলতে চাইলেন না। বহির্বাংলাদেশ ছুটির জন্য আবেদন করার উপদেশ দিলেন কলকাতা যেতে হলে আমার বর্হিবাংলাদেশ ছুটি চাই। এরকম যে একটি ছুটি নেবার নিয়ম আছে তা আমার জানা ছিল না। হরদম দেখছি ডাক্তাররা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, কাউকে এরকম ছুটি নিতে হয়নি। আমার বেলায় আইনের সাত রকম মারপ্যাঁচ। আইন মানতে আমার তো কোনও অসুবিধে নেই। সচিবালয় থেকে ছুটে যাই হাসপাতালে। দরখাস্ত লিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অগ্রায়ন নিয়ে সোজা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দরখাস্তটি দেওয়ার পর তিনি দেখলেন, পড়লেন, বললেন আমি যেন কাল আসি। কাল কেন? আজই সই দিয়ে দিন। না, আজ সই হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এটি আমার আজই দরকার। আজই দরকার হোক, কিন্তু হচ্ছে না। বাড়ি ফিরে আসি। সৌমিত্র মিত্র ফোন করছেন বিকেলের ফ্লাইটে আসা হচ্ছে কি না আমার জানতে। বলে দিই হচ্ছে না। ‘কাল হবে?’ ‘চেষ্টা করবো।’ পরদিন সকালে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে পাসপোর্ট আনতে যাই। পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় না আমকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বহির্বাংলাদেশ ছুটির কি হল দেখতে যাই, কিছুই হয়নি জেনে আবার ক্লান্ত বিপর্যস্ত আশাহত আমি ফিরে আসি। কলকাতা থেকে সৌমিত্র মিত্র বার বারই ফোন করে জানতে চাইছেন কতদূর এগিয়েছে যাওয়ার ব্যপারটি। বলছেন আমার জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষা করছেন, আমি না গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেলেঙ্কারি হবে তো আমি কি করব, আমাকে তো পাসপোর্টই ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। তার পরদিনও দেখি, তার পরদিনও। আমাকে কিছুই দেওয়া হয়না। না পাসপোর্ট। না ছুটি। আমার কলকাতা যাওয়া হয় না। কবিরা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করি, কেমন হল সম্মেলন, কারা কারা কবিতা পড়ল, কেমন আছে কলকাতা, নন্দনে কী চলছে, রবীন্দ্রসদনে কী হচ্ছে, শিশির মঞ্চেই বা কী.. । ওঁরা বলেন, যতটুকু বলেন, শুনে আমার সাধ মেটে না। বইমেলা এসে যায়। এর আগের বছরের মেলায় তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটির মিছিল বেরিয়েছে, মেলায় আমার বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মেলা কর্তৃপক্ষ আমাকে মেলায় যেতে নিষেধ করেছেন। এ বছরের মেলায় অন্য সব কবি লেখকরা যাচ্ছেন, আমিই কেবল বসে আছি ঘরে। ঘরে মন বসে না। মন খেলায় মেতে ভেলায় ভেসে মেলায় যায়। একদিন আমার দুর্দমনীয় ইচ্ছে আমাকে খাঁচা ভেঙে বের করে আনে, যে করেই হোক যাবই আমি মেলায়। কিসের ভয় আমার! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি। যে কোনও মানুষেরই অধিকার আছে মেলায় যাওয়ার। আমার কেন থাকবে না! আমি কেন নিজের ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকু কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশে বিসর্জন দেব! মেলায় যাওয়ার সিদ্ধান্তটি খসরুকে জানালে তিনি তাঁর দুজন বন্ধু সঙ্গে নেবেন বললেন। একা যাওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না, যেতে হবে সদলবলে। টাক-মাথা ছিপছিপে চশমা চোখের দার্শনিক চেহারার শহিদুল হক খান আমার নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে এগিয়ে এলেন। শহিদুল হক খান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন, প্রচুর কথা বলেন কিন্তু সুন্দর কথা বলেন। তাঁর অনুষ্ঠানে আমাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম কিন্তু তাঁর দেওয়া নাট্যসভা পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে একরকম বন্ধুতা গড়ে ওঠে আমার। আমার বাড়িতে দেখা হতে হতে খসরু আর শহিদুলের মধ্যেও জমে ওঠে। খসরু দেখতে যেমনই হোক, খুব হৃদয়বান মানুষ তিনি। বন্ধুদের জন্য যতটুকু করা উচিত তার চেয়েও বেশি করেন। ইত্তেফাকের সাংবাদিক আলমগীরের সঙ্গে পরিচয় হল আমার বাড়িতে, কদিন পরই তিনি আলমগীরকে তাঁর ব্যবসার অংশীদার করে নিলেন। আমার কখনও গাড়ি প্রয়োজন হলে তিনি নিজে যদি ব্যস্ত থাকেন, তাঁর গাড়িটি পাঠিয়ে দেন। হঠাৎ একদিন আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য আস্ত একটি নতুন কমপিউটার নিয়ে এসে। খসরু ধনী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দেশের আর ধনীদের মত তাঁর আচরণ নয়। কত মুক্তিযোদ্ধাকেই দেখেছি নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে আরাম করছেন, দেশকে শকুনে ঠোকরাচ্ছে কি শেয়ালে খাচ্ছে এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা করেন না। খসরু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁর আদর্শ তিনি কারও কাছে বিক্রি করেননি। মুক্তিযদ্ধের পক্ষের শক্তিকে তিনি সাধ্যাতীত সাহায্য করেন। আওয়ামি লীগের নেতারা তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকেন দলের চাঁদার জন্য, কাউকে তিনি ফিরিয়ে
false
nihar_ronjon_gupta
তো বন্ধ ছিল, আর সিঁড়ি দিয়ে পালালে সবার চোখে পড়ে যেত তখন। পাশের ঘরের সংলগ্ন বাথরুম নেই? কিরীটী যেন কৃষ্ণার কথায় চমকে উঠে বললে, ঠিক বলেছ! সে ঘরটা তো দেখিনি! বলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে কিরীটী শিবতোষের বাড়িতে ফোন করল। শিবতোষ বাড়িতে ছিলেন না। ফোন ধরল তাঁর ছোট মেয়ে স্বাতী, কে? আমি কিরীটী রায়, আপনি কে? স্বাতী। স্বাতী দেবী, আমাকে একটা সংবাদ দিতে পারেন? কি বলুন? আপনার দাদা তিনতলায় যে পাশাপাশি দুটি ঘর ব্যবহার করতেন, তার দুটো ঘরেই কি সংলগ্ন বাথরুম আছে? আছে। ওপরের সব ঘরেই সংলগ্ন বাথরুম আছে, একটা ঘর বাদে। সে বাথরুমেও নিশ্চয়ই মেথরদের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে? পেছনের দিকে একটা সরু ফালি বারান্দা আছে, সেই বারান্দা দিয়েই প্রত্যেকে বাথরুমে ঢোকে, মেথরের সিঁড়িটা লোহার ঘোরানো। ওপরে গিয়ে চট্ করে একবার দেখে আসবেন, সেই পাশের ঘরের বাথরুমের দরজাটা খোলা মা বন্ধ? ধরুন, দেখে এসে বলছি। মিনিট দশেক বাদেই স্বাতী এসে বলল, দরজাটা বন্ধ আছে। আর একটা কথা, সে রাতের পর কেউ কি তিনতলায় আর গিয়েছে? না। কেউ যায় না আর ওপরে। মেথররাও না? না। কেন? বাবা বারণ করে দিয়েছেন। ওপরের সব ঘরেই এখন তালা দেওয়া। বৌদি কেমন আছেন? সেই রকম। কিছুই মনে করতে পারছেন না? না। ধন্যবাদ। কিরীটী ফোনটা রেখে দিল। উঃ কৃষ্ণা, তোমার জন্যই রহস্যের রীতিমত শক্ত জট খুলে গেল। কেবল সেদিন থেকে অন্ধকারে হাতড়ে মরছিলাম, অথচ একবারও দ্বিতীয় ঘটনার কথা মনে হয়নি, আশ্চর্য! এতবড় একটা ভুল হল লে আমার? মাথার বস্তুগুলো বোধ হয় সব ফসিল হয়ে গিয়েছে আমার কৃষ্ণা , কিরীটীর ছুটি এবারে— না, কিছুই হয়নি—সব ঠিক আছে। তবে কথাটা মনে পড়ল না কেন? বুড়ো হয়ে গিয়েছি কৃষ্ণা-বুড়ো হয়ে গিয়েছি, সকলকে প্রণাম জানিয়ে এবারে ছুটি নেব। হয়ত পরে মনে পড়ত, কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে। স্বামীকে স্তোক দিচ্ছ? না গো না। কিরীটী রায় তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিরীটী রায়ই থাকবে, কিন্তু কফিটা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! যাক। জটটাও খুলেছে, আর সেই সঙ্গে এখন যেন অন্ধকারে একটু একটু করে আলোও ফুটে উঠেছে।। ঐদিনই বিকেলের দিকে। খোলা জানলাপথে মৃদু মৃদু প্রথম বসন্তের হাওয়া আসছে। কৃষ্ণা আর কিরীটী তাদের বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী! কিরে? একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কোথা থেকে এসেছে? নাম কি? বলতে বললেন শিবতোষবাবুর মেয়ে। যা, এই ঘরে নিয়ে আয়। একটু পরে ঢুকল স্বাতী ও দামী সিল্কের সুট-পরিহিত সুদর্শন এক ভদ্রলোক, বয়স আটাশ-ঊনত্রিশ হবে। আসুন। নমস্কার। আমার নাম পরেশভৌমিক, স্বাতী আমার স্ত্রী,কলকাতা হাইকোর্টে আমি প্র্যাকটিস করি। বার-এট-এল। আপনিই তো মিঃ রায়! হ্যাঁ বসুন, নমস্কার। ওঁরা দুজন বসলেন। তারপর পরেশ ভৌমিক বললেন, দেখুন মিঃ রায়, আপনি হয়ত আমাদের দুজনের এভাবে আসায় একটু অবাকই হয়েছে, ভাবছেন কেন এলাম— না না, তা কেন— এসেছি এইজন্য যে, আমার স্ত্রী স্বাতী সেদিন আপনার কাছে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল তার মধ্যে একটা মিথ্যা ছিল, শুনে আমি ওকে নিয়ে এলাম, মিথ্যাটা সংশোধন করে নেবার জন্য। মিথ্যা স্টেটমেন্ট! কিরীটী তাকাল পরেশ ভৌমিকের মুখের দিকে। হ্যাঁ, স্বাতীয়ে বলেছিল, ওদের বৈমাত্রেয় ভাই, ঐদিন উৎসবের রাত্রে— কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন ওঁদের বৈমাত্রেয় ভাই আশু মল্লিককে কখনও উনি বেলতলার বাড়িতে আসতে দেখেননি। উনি যে সত্য গোপন করেছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি পরে। পেরেছেন বুঝতে? হ্যাঁ, আগের কথা বলতে পারি না, তবে উৎসবের রাত্রে যে আশু মল্লিক এসেছিলেন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর এও বুঝেছিলাম, অন্য কোনদিন না দেখলেও সে রাত্রে উনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐ অচেনা আগন্তুকই ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই। আপনার যদি আপত্তি না থাকে স্বাতীদেবী, এবার বলুন সে-রাত্রে কখন কোথায় দেখেছিলেন তাঁকে আর চিনতেই বা পারলেন কি করে তাঁকে যে তিনি আপনাদের বৈমাত্রেয় ভাই? বল স্বাতী, আমাকে যা বলেছ তা ওঁকে বল। ব্যাপারটা একটা জঘন্য মাডার কেস, প্রত্যেক সমাজ-সচেতন ব্যক্তিরই কর্তব্য দেশের আইনকানুনকে সাহায্য করা নিজ নিজ সাধ্যমত। ইট ইজ ইওর ডিউটি, স্পিক আউট! স্বাতী তখন যা বললে— রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে একবার উপরে গিয়েছিল, দু-চার-পাঁচ মিনিট হয়ত আগেই। দীপিকার চশমাটা আনতে ওপরের ঘর থেকে। বৌ সাজাবার পর দীপিকা চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিল। পরে তাকে ঘরে এনে বসিয়ে দেবার ঘন্টা-তিনেক পরে কষ্ট হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত স্বাতীকে বলে ওপরে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসার জন্য। সেই চশমাটা আনতেই স্বাতী ওপরে গিয়েছিল। ঘরের দরজা খোলা এবং ঘরে আলো জ্বলতে দেখে স্বাতী একটু অবাকই হয়। হঠাৎ ওর কানে আসে ঘরের মধ্যে তার দাদা যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। দাদার কথা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন। হ্যাঁ, দাদা যেন কাকে বলছিল, নিশ্চয়ই দেব দাদা, তোমার আশীর্বাদ দীপাকে আমি নিজেই পরিয়ে দেব। কিন্তু তুমিও তো নিজের হাতে তাকে দিতে পার, সে সব জানে—তাকে ডেকে আনব নীচে থেকে? তারপর? জবাব এল ভারী গম্ভীর গলায়, না না—তার কোন দরকার নেই ভাই। তুমি তাকে দিও আমার নাম করে। এ বাড়িতে কোনদিনই আমি আসতাম না, আসব না-ই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার চিঠি পেয়ে আসতেই হল। এবার আমি যাব। বড়দা বললেন শুনতে পেলাম। দাদা? বল? বড়দার গলা। বাবাকে তুমি ত্যাগ করেছ বড়মার ওপরে অন্যায় করেছিলেন বলে। সে
false
humayun_ahmed
ক্যামনে সৃষ্টি হইল? বাপজান সঙ্গে সঙ্গে বলল, (জুলেখা এই অংশে গান শুরু করল) ওরে গুন ধান! প্রশ্নের কী বিবরণ! সভার মাঝে করিব বর্ণন। ধৈর্য ধরে শুনো ওরে শ্রোতাবন্ধুগণ। দুই দিনে হয় মাটির জনম চারদিনে আল্লাহ সব করিলেন সৃজন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, হঠাৎ হঠাৎ অম্বিকাচরণ উপস্থিত হন। তিনি প্রতিবারই সমাজ থেকে পতিত হবার পর উদ্ধারের একেকটা উপায় নিয়ে আসেন। পুকুরঘাটে বসে গলা উঁচিয়ে ডাকেন- হরি! আছো? খোজ নিতে আসলাম। আছো কেমন? ভালো আছি। তোমার উপর কাজটা অন্যায্য হয়েছে। আমি খোজ নিয়েছি, একটা সোনার চামচে গোবর নিয়া চামচের হাতলে তিনবার দাঁতে কামড় দিলেই শরীর শুদ্ধ হয়। তারপর সেই চামচ কোনো এক সৎ ব্রাহ্মণকে দান করে দিতে হয়। কাশির এক পণ্ডিতের বিধান। কেমন পণ্ডিত? বিরাট পণ্ডিত। চার-পাঁচটা ন্যায়রত্ব রামনিধি পানিতে গুলে খেয়ে ফেলতে পারে। তোমার শরীর শুদ্ধির ব্যবস্থা কি করব? যাক আরো কিছু দিন। তাছাড়া আপনি শরীর শুদ্ধি করলে তো হবে না। কেউ মানবে না। কাশির পণ্ডিতদের লাগবে। তাও কথা। একটা কাজ করি, কোনো শুভদিন দেখে দু’জনে কাশি চলে যাই। তোমার তো অর্থের অভাব নাই। আমারে খরচ দিয়া নিয়া গেলা। পুণ্যধাম কাশি কোনোদিন দেখি নাই। দেখার শখ আছে। নিয়ে যাব আপনাকে। কথা দিলাম। আমি উদ্ধার পাই বা না পাই— আপনার শখ মেটাব। অম্বিকাচরণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন, হরিচরণের জন্যে তার সত্যি খারাপ লাগে। হরিচরণের জন্যে আরেকজন মানুষের খুবই খারাপ লাগে, তার নাম ধনু শেখ। সে লঞ্চঘাটের টিকেট বাবু। মাঝে মাঝে টুকটাক ব্যবসা করে। কোলকাতা থেকে এক ড্রাম লাল কেরোসিন নিয়ে এসে বান্ধবপুরে বিক্রি করে। লঞ্চে পাঠিয়ে দেয় শুকনা মরিচ। এতে বাড়তি আয় যা হয় তা সে ব্যয় করে নতুন বিয়ে করা স্ত্রীর পেছনে। পাউডার, স্নো, শাড়ি, রুপার গয়না। লঞ্চঘাটের কাছেই টিনের এক চালায় তার সংসার। স্ত্রীর নাম কমলা। ধনু শেখ স্ত্রীর খুবই ভক্ত। তার একমাত্র স্বপ্ন একদিন সে একটা লঞ্চ কিনবে। সেই লঞ্চ নারায়ণগঞ্জ সোহাগগঞ্জ চলাচল করবে। লঞ্চের নাম এমএল কমলা। এমএল হলো মোটর লঞ্চ। সেই লঞ্চে কমলা নামের যে-কোনো যাত্রী যদি উঠে সে যাবে ফ্রি। তার টিকেট লাগবে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ লঞ্চের টিকেট কাটতে এলেই ধনু শেখ কোনো না কোনো প্রসঙ্গ তুলে হরিচরণের জাত নষ্টের কথা তুলবে। বাবু, আপনে বলেন- মনে করেন সুন্দর একটা কুত্তার বাচ্চা রাস্তায় হাঁটতেছে। আপনে ‘আয় তু তু’ বললেন, সে লাফ দিয়া আপনের কোলে উঠল। আপনের জাইত কিন্তু গেল না। মুসলমানের এক বাচ্চা কোলে নিছেন— জাইত গেল। এখন মীমাংসা দেন— মুসলমানের বাচ্চা কি কুত্তার চাইতে অধম? যে সব বাবুদের এ ধরনের প্রশ্ন করা হয় তারা বিব্রত হন না। বিরক্ত হন। কেউ কেউ বলেন, তুমি টিকেট বাবু। তুমি টিকেট বেচবা। এত কথা কী? জাইত জিনিসটা কী বুঝায় বলেন। শরীরের কোন জায়গায় এই জিনিস থাকে, ক্যামনে যায়? জিনিসটা কি ধুয়াশা? তুমি বড়ই বেয়াদব। তোমার মালিকের কাছে বিচার দিব। চাকরি চাইলে। যাবে। না খায়া মরবা। মরলে মরব। তয় জাইতের মীমাংসা কইরা দিয়া মরব। তুমি জাইতের মীমাংসা করার কে? জাইতের তুমি কী বুঝ? আমি না বুঝলেও আপনেরা তো বোঝেন। আপনেরা মীমাংসা দেন। বেয়াদবির কারণেই, ধনু শেখের টিকেট বাবুর চাকরি চলে গেল। লঞ্চ কোম্পানির মালিক নিবারণ চক্রবর্তী তাকে ধর্মপাশা অফিসে ডেকে পাঠালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ধনু, উইপোকা চেন? ধনু শেখ ভীত গলায় বলল, চিনি। উইপোকার পাখা কেন উঠে জানো? উড়াল দিবার জন্যে। না। উইপোকার পাখা উঠে মরিবার তরে। তুমি উইপোকা ছাড়া কিছু না। তোমার পাখা উঠেছে। তুমি সবেরে জাইত পাইত শিখাইতেছ? ধনু শেখ বলল, কর্তা ভুল হইছে। ভুল স্বীকার পাইলে কানো ধরা। কানে ধইরা একশ’বার উঠবোস করা। ধনু দেরি করল না। কানে ধরে উঠবোস শুরু করল। সে ধরেই নিয়েছিল চাকরি চলে যাবে। কানে ধরে উঠবোসের মতো অল্প শাস্তিতে পার পেয়ে যাচ্ছে দেখে সে আনন্দ। তার হাঁটুতে ব্যথা, উঠবোস করতে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট কোনো কষ্টই না। নিবারণ চক্রবর্তী খাতা দেখছিলেন। খাতা থেকে মাথা তুলে বললেন, একশ’বার কি হইছে? জে কর্তা হইছে। এখন বিদায় হও। তোমার চাকরি শেষ। লঞ্চঘাটায় নতুন টিকেট বাবু যাবে। আইজ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়বা। নতুন টিকেট বাবু পরিবার নিয়া উঠবে। আমার চাকরি শেষ? এতক্ষণ কী বললাম? ধনু শেখ বলল, চাকরি। যদি শেষই করবেন কান ধইরা উঠবোস করাইলেন। কী জন্যে? নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, আগেই যদি বলতাম চাকরি শেষ তাহলে কি কানে ধরে উঠবোস করতা? এই জন্যে আগে বলি নাই। ধনু শেখ বলল, এইটা আপনের ভালো বিবেচনা। তোমার ছয়দিনের বেতন পাওনা আছে। নতুন টিকেট বাবুর কাছে থাইকা নিয়া নিবা। তার নাম পরিমল। যাও, এখন বিদায়। জটিল হিসাবের মধ্যে আছি। ধনু শেখ অতি দ্রুত গভীর জলে পড়ে গেল। স্ত্রীকে নিয়ে উঠার কোনো জায়গা নেই। নিজের খরুচে স্বভাবের কারণে সঞ্চয়ও নেই। সে কিছুদিন বাজে মালের দোকান চালাবার চেষ্টা করল। স্ত্রীর জায়গা হলো নৌকায়। ছাইওয়ালা নৌকার দু’পাশ শাড়ি দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে সংসার। ধনু শেখের দোকান চলল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ তার দোকান থেকে কিছু কেনে না। আশ্চর্যের ব্যাপার, মুসলমানওরাও না। রাতে নৌকায় ঘুমাতে গিয়ে ধনু শেখ হতাশ গলায় বলে, বউ কী করি বলো তো। নতুন কোনো ব্যবসা দেখবেন? কী ব্যবসা? ঘোড়াতে কইরা ধর্মপাশা থাইকা
false
nazrul
তো এ প্রাণপোড়ানো অতীতটা জগদ্দল শিলার মতো এসে বুকটা চেপে ধরে না! সেই সে কোন্-ভুলে-যাওয়া দিনের কুলিশ-কঠোর স্মৃতিটা তপ্ত শলাকার মতো এসে এই ক্ষত বক্ষটায় ছ্যাঁকা দেয় না! ‘জোবেহ্’ করা জানোয়ারের মতো আর কতদিন নিদারুণ জ্বালায় ছটফট করে মরব? কেন মৃত্যুর মাধুরী মায়ের আশিসধারার মতো আমার উপর নেমে আসে না? এ হতভাগিনিকে জ্বালিয়ে কার মঙ্গল সাধন করছেন মঙ্গলময়? তাই ভাবি – আর ভাবি – কোনো কূলকিনারা পাই না, এর যেন আগাও নেই, গোড়াও নেই। কী ছিল – কী হল – এ শুধু একটা বিরাট গোলমাল! সেদিন সকালে ওই পাশের চারাধানের খেতের আলের উপর দিয়ে কাঁচা আম খেতে খেতে একটি রাখাল বালক কোথা হতে শেখা একটা করুণ গান গেয়ে যাচ্ছিল। গানটা আমার মনে নেই, তবে তার ভাবার্থটা এই রকম, ‘কত নিশিদিন সকাল সন্ধ্যা বয়ে গেল, কত বারোমাস কত যুগ-যুগান্তরের অতীতে ঢলে পড়ল, কত নদনদী সাগরে গিয়ে মিশল, আবার কত সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল, কত নদী পথ ভুলে গেল, আর সে কত গিরিই না গলে গেল, তবু ওগো বাঞ্ছিত, তুমি তো এলে না!’ গানটা শুনছিলুম আর ভাবছিলুম, কী করে আমার প্রাণের ব্যাকুল কান্না এমন করে ভাষায় মূর্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল? ওগো, ঠিক এই রকমই যে একটা মস্ত অসীম কাল আমার আঁখির পলকে পলকে যেন কোথা দিয়ে কোথায় চলেছে, আর আমি কাকে পাওয়ার – কী পাওয়ার জন্যে শুধু আকুলি-বিকুলি মিনতি করে ডাকছি, কিন্তু কই তিনি তো এলেন না – একটু সাড়াও দিলেন না। তবে দুপুর রোদ্দুরে ঘুনঘুনে মাছির মুখে ওই যে খুব মিহি করুণ ‘গুন গুন’ সুর শুনি এই গোরস্থানে, ও কি তাঁরই কান্না? দিনরাত ধরে সমস্ত গোরস্থান ব্যেপে প্রবল বায়ুর ওই যে একটানা হু হু শব্দ, ও কি তাঁরই দীর্ঘশ্বাস? রাত্তিরে শিরীষ ফুলের পরাগমাখা ওই যে ভেসে আসে ভারী গন্ধ, ও কি তাঁরই বর-অঙ্গের সুবাস? গোরস্থানের সমস্ত শিরীষ, শেফালি আর হেনার গাছগুলো ভিজিয়ে, সবুজ দুর্বা আর নীল ভুঁই-কদমের গাছগুলোকে আর্দ্র করে ওই যে সন্ধে হতে সকাল পর্যন্ত শিশির ক্ষরে, ও কি তাঁরই গলিত বেদনা? বিজুলির চমকে ওই যে তীব্র আলোকচ্ছটা চোখ ঝলসিয়ে দেয়, ও কি তাঁরই বিচ্ছেদ-উন্মাদ হাসি? সৌদামিনী-স্ফুরণের একটু পরেই ওই যে মেঘের গম্ভীর গুরু গুরু ডাক শুনতে পাই, ও কি তাঁর পাষাণ বক্ষের স্পন্দন? প্রবল ঝঞ্ঝার মতো এসে সময় সময় ওই যে দমকা বাতাস আমাকে ঘিরে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকে, ও কি তাঁরই অশরীরী ব্যাকুল আলিঙ্গন? গোরস্থানের পাশ দিয়ে ওই যে ‘কুনুর’ নদী বয়ে যাচ্ছে, আর তার চরের উপর প্রস্ফুটিত শুভ্র কাশফুলের বনে বনে দোল-দোলা দিয়ে ঘন বাতাস শন শন করে ডেকে যাচ্ছে, ও কি তাঁরই কম্পিত কণ্ঠের আহ্বান? আমি কেন ওঁরই মতো অমনই অসীম, অমনই বিরাট-ব্যাপ্ত হয়ে ওঁকে পাই না? আমি কেন অমনই সবারই মাঝে থেকে ওই অ-পাওয়াকে অন্তরে অন্তরে অনুভব করি না? এ সীমার মাঝে অসীমের সুর বেজে উঠবে সে আর কখন? এখন যে দিন শেষ হয়ে এল, ওই শুন নদীপারের বিদায়-গীত শুনা যাচ্ছে খেয়াপারের ক্লান্ত মাঝির মুখে – দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি, ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে, – এবার তবে গভীর করে ফেলোগো মোরে ঢাকি অতি নিবিড় ঘন তিমির তলে! [ খ ] এই যে গোরস্থান, যেখানে আমার জীবনসর্বস্ব দেবতা শুয়ে রয়েছেন, শৈশব হতে এই জায়গাটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। ওই যে অদূরে ছোটো ছোটো তিনটি কবর দেখতে পাচ্ছ প্রায়ই মাটির সঙ্গে মিশে সমান হয়ে গেছে, আর উপরটা কচি দূর্বা ঘাসে ছেয়ে ফেলেছে, ওগুলি আমার ছোটো ভাই বোনদের কবর! ওরা খুব ছোটোতেই মারা গিয়েছিল – আমের কচি বৌল ফাগুনের নিষ্ঠুর করকাস্পর্শে ঝরে পড়েছিল। ওই যে ওদের শিয়রে বকম ফুলের গাছগুলি দেখতে পাচ্ছ, ওগুলি আমিই লাগিয়েছিলুম আমি তখন খুবই ছোটো। এখন অযতনে রোয়ানো ঝোপ আর আলগা লতায় ও জায়গাটা ভরে উঠেছে। আগে ওদের কবরের উপর ওদেরই মতো কোমল আর পবিত্র বকম ও শিরীষ ফুলের হলদে রেণু ঝরে পড়ত সারা বসন্ত আর শরৎকালটা ধরে, আর তার চেয়ে বেশি ঝরে পড়ত ওই তিনটি ক্ষুদ্র সঙ্গীদের বিচ্ছেদ-ব্যথিত অন্তর-দরিয়া মথিত করে আকুল অশ্রুর পাগল-ঝোরা! বাবা আমার মাকে ধরে ধরে নিদাঘের বিষাদ-গভীর সন্ধ্যায় এই সরু পথ বেয়ে নিয়ে যেতেন, আর আমাদের ‘টুনু’র, ‘তাহেবা’র আর ‘আবুলে’র ঘাসে চাপা ছোটো কবরগুলি দেখিয়ে বলতেন, ‘এইখানে তারা ঘুমিয়ে আছে, তারা আর উঠে আসতে পারে না। অনেক দিন বাদে আমরাও সব এসে ওদেরই পাশে শুব, – আমাদেরও অমনি মাটির ঘর তৈরি করে দেবে গাঁয়ের লোকে।’ সেই সময় সেই বেদনাপ্লুত বিয়োগ-বিধুর সন্ধ্যায় কী একটা আবছায়া-আবেশ করুণ সুরে যে আমার সারা বক্ষ ছেয়ে ফেলত, তা প্রকাশ করতে পারতুম না, তাই বাবার মুখের দিকে চেয়ে কী জানি কেন ডুকরে কেঁদে উঠতুম। বাবা অপ্রতিভ হয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁর স্নিগ্ধ-কোমল স্পর্শে সান্ত্বনা দিতেন। সেই থেকে জায়গাটার উপর আমার এত মায়া জন্মে গেছিল যে, আমি রোজ মাকে লুকিয়ে এখানে পালিয়ে এসে আমার ভাই বোনদের ওই ছোট্ট তিনটি কবরের দিকে ব্যাকুল বেদনায় চেয়ে থাকতুম! – আচ্ছা ভাই, রক্তের টান কী এত বেশি? যেখানে আমার কচি ভাই-বোনগুলির ফুলের দেহ মাটির সঙ্গে মিশে মাটি হয়ে গেছে, সেই ভীষণ
false
humayun_ahmed
হয়েছে, এটা সে জানল কীভাবে? জানল, কারণ সে নিজেই ফেলেছে। এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, হচ্ছে? আপনাকে কি আরো যুক্তি দিতে হবে? আমার কাছে আরো ছোটখাটো যুক্তি আছে। আর লাগবে না। শুধু বলুন-কুয়ার ওপরের টিনে ঝন ঝন শব্দ হত কেন? যে-শব্দ ইমাম সাহব নিজেও শুনেছেন? কুয়ার টিনটা না-দেখে বলতে পারব না। আমার ধারণা বাতাসে টিনটা কাঁপে, ঝন ঝন শব্দ হয়। দিনের বেলায় এই শব্দ শোনা যায় না, কারণ আশেপাশে অনেক ধরনের শব্দ হতে থাকে। রাত যতই গভীর হয় চারপাশ নীরব হতে থাকে। সামান্য শব্দই বড় হয়ে কানে আসে। আপনার এই যুক্তিও গ্রহণ করলাম, এখন বলুন, লতিফা এমন ভয়ংকর কাণ্ড কেন করছে? মেয়েটা অসুস্থ। মনোবিকার ঘটেছে। ইমাম সাহেব লোকটি তাদের আশ্রিত। তাদের পরিবারে চাকরিবাকাররা যে-কাজ করে, সে তাই করত। মেয়েটি ভাগ্যের পরিহাসে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। পরিবারের সবার কাছে ছোট হয়, অপমানিত হয়। এত প্রচণ্ড চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। তার মনোবিকার ঘটে। পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের হরমোনাল ব্যালান্স এদিক-ওদিক হয়। সেই সময় মনোবিকার তীব্র হয়। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। একই সঙ্গে সে লোকটিকে প্রচণ্ড ভালবাসে, আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করে। কী ভয়াবহ অবস্থা। মেয়েটি ইমামকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে, এটা কেন বলছেন? ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়। পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে-ইমাম আসছে। অজুর পানি দে, জয়নামাজ দে, কেবলা কোন দিকে বলে দে। একধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে। মনোবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিল কেন? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন? বড়ো ধরনের বিকারে এ-রকম হয়। সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছে। নিজের সন্তানহত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছারই অংশবিশেষ পূর্ণ হচ্ছে। আরো কিছু থাকতে পারে। না দেখে বলতে পারব না। ০8. ধুন্দুল নাড়া গ্রামে সন্ধ্যার পর পৌঁছলাম। পৌঁছেই খবর পেলাম পাঁচ দিন হয় ইমাম সাহেবের একটি কন্যা হয়েছে। কন্যাটি ভালো আছে। বড় ধরনের স্বস্তি বোধ করলাম। ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম মসজিদে। তিনি আমাদের দেখে বড়ই অবাক হলেন। আমি বললাম, আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ভালো না। খুব খারাপ। কফিল তার সঙ্গে-সঙ্গে আছে। কফিল বলেছে, সাতদিনের মাথায় মেয়েটিকে মেরে ফেলবে। খুব কষ্টে আছি ভাইসাহেব। আল্লাহপাকের কাছে আমার জন্য খাস দিলে একটু দোয়া করবেন। আমি বললাম, আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলবেন। ইমাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? যাতে আপনার বাচ্চাটা ভালো থাকে, সুস্থ থাকে। উনি খুব বড় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অনেক কিছু বুঝতে পারেন, যা আমরা বুঝতে পারি না। ওনার কথা শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবে। এই জন্যেই ওনাকে এনেছি। অবশ্যই আমি ওনার কথা শুনব। অবশ্যই শুনব। ইমাম সাহেব আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে অনেক লোকজন ছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া হল। মিসির আলি বললেন, আমি কিছু কথা বলব যা শুনতে ভালো লাগবে না, তবু দয়া করে শুনুন। লতিফা চাপা গলায় বলল, আমার সাথে কী কথা? আপনার বাচ্চাটির বিষয়ে কথা। বাচ্চাটি যাতে বেঁচে থাকে, ভালো থাকে, সেজন্যেই আমার কথাগুলি আপনাকে শুনতে হবে। লতিফা তার স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বলেন, কী বলবেন। মিসির আলি খুবই নিরাসক্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার সময় একবারও লতিফার দিকে তাকালেন না। লতিফা তার শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় লম্বা ঘোমটা। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মাঝে-মাঝে তার তীব্র চোখের দৃষ্টি নজরে আসছে। ইমাম সাহেব তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে আছেন। মিসির আলির ব্যাখ্যা যতই শুনছেন ততই তাঁর চেহারা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি কথা শেষ করে লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করলেন? লতিফা জবাব দিল না। মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিল। কী সুন্দর শান্ত মুখ! চোখের তীব্রতা এখন আর নেই। মনে হচ্ছে অশ্রু টলমল করছে। মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, আমার ব্যাখ্যা আপনি বিশ্বাস না-করলেও শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মঙ্গলের জন্যে শিশুটিকে আপনি অন্যের কাছে দিন। সে যেন কিছুতেই আপনার সঙ্গে না থাকে। আমার যা বলবার বললাম, বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। আচ্ছা, আজ তাহলে যাই। আমরা রাতেই রওনা হব। নৌকা ঠিক করা আছে। আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব, আপনার কি মনে হয় মেয়েটি আপনার কথা বিশ্বাস করেছে? মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, হ্যাঁ, করেছে। এবং বিশ্বাস করার কারণেই তার দ্রুত রোগমুক্তি ঘটবে। আমার ধারণা, মেয়েটি নিজেও খানিকটা হলেও এই সন্দেহই করছিল। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। চলুন, রওনা দেওয়া যাক। এই গ্রামে রাত কাটাতে চাই না। আমি বললাম, ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যাবেন না? না। আমার কাজ শেষ, বাকিটা ওরা দেখবে। রওনা হবার আগে ইমাম সাহেব। ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। শিশুটি তাঁর কোলে। তিনি বললেন, লতিফা মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছে। সে খুব কাঁদতেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেহেরবানি করে একটু আসেন। আমরা আবার ঢুকলাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, লতিফা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন? লতিফা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, আল্লাহ আপনার ভালো করবে। আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে। আপনি কোনো
false
bongkim
বয়স পনের বৎসর। সতের বৎসর বয়সে, বলিতে লজ্জা করে, সধবাবস্থাতেই-আর একটা বিবাহ ঘটিয়া গেল। আমাদের বাড়ীর কাছে, কালীচরণ বসু নামে একজন কায়স্থ ছিল। চীনাবাজারে তাহার একখানি খেলানার দোকান ছিল। সে কায়স্থ-আমরাও কায়স্থ-এজন্য একটু আত্মীয়তা হইয়াছিল। কালী বসুর একটি চারি বৎসরের শিশুপুত্র ছিল। তাহার নাম বামাচরণ। বামাচরণ সর্বদা আমাদের বাড়ীতে আসিত। একদিন একটা বর বাজনা বাজাইয়া মন্দগামী ঝড়ের মত আমাদিগের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া যায়। দেখিয়া বামাচরণ জিজ্ঞাসা করিল,- “ও কেও?” আমি বলিলাম, “ও বর |” বামাচরণ তখন কান্না আরম্ভ করিল-“আমি বল হব |” তাহাকে কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া বলিলাম, “কাঁদিস না-তুই আমার বর |” এই বলিয়া একটা সন্দেশ তাহার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন, তুই আমার বর হবি?” শিশু সন্দেশ হাতে পাইয়া, রোদন সম্বরণ করিয়া বলিল, “হব |” সন্দেশ সমাপ্ত হইলে, বালক ক্ষণেককাল পরে বলিল, “হাঁ গা, বলে কি কলে গা?” বোধ হয়, তাহার ধ্রুব বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, বরে বুঝি কেবল সন্দেশই খায়। যদি তা হয়, তবে সে আর একটা আরম্ভ করিতে প্রস্তুত। ভাব বুঝিয়া আমি বলিলাম, “বরে ফুলগুলি গুছিয়ে দেয় |” বামাচরণ স্বামীর কর্তব্যাকর্তব্য বুঝিয়া লইয়া, ফুলগুলি আমার হাতে গুছাইয়া তুলিয়া দিতে লাগিল। সেই অবধি আমি তাহাকে বর বলি-সে আমাকে ফুল গুছাইয়া দেয়। আমার এই দুই বিবাহ-এখন এ কালের জটিলা-কুটিলাদিগকে আমার জিজ্ঞাস্য-আমি সতী বলাইতে পারি কি? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ বড়বাড়ীতে ফুল যোগান বড় দায়। সে কালের মালিনী মাসী রাজবাটীতে ফুল যোগাইয়া মশানে গিয়াছিল। ফুলের মধু খেলে বিদ্যাসুন্দর, কিল খেলে হীরা মালিনী-কেন না, সে বড়বাড়ীতে ফুল যোগাইত। সুন্দরের সেই রামরাজ্য হইল-কিন্তু মালিনীর কিল আর ফিরিল না। বাবা ত “বেলফুল” হাঁকিয়া, রসিক মহলে ফুল বেচিতেন, মা দুই একটা অরসিক মহলে ফুল নিত্য যোগাইতেন। তাহার মধ্যে রামসদয় মিত্রের বাড়ীই প্রধান। রামসদয় মিত্রের সাড়ে চারিটা ঘোড়া ছিল।-(নাতিদের একটা পণি, আর আদত চারিটা) সাড়ে চারিটা ঘোড়া-আর দেড়খানা গৃহিণী। একজন আদত-একজন চিররুগ্না এবং প্রাচীনা। তাঁহার নাম ভুবনেশ্বরী-কিন্তু তাঁর গলার সাঁই সাঁই শব্দ শুনিয়া রামমণি ভিন্ন অন্য নাম আমার মনে আসিত না। আর যিনি পুরা একখানি গৃহিণী, তাঁহার নাম লবঙ্গলতা। লবঙ্গলতা লোকে বলিত, কিন্তু তাঁহার পিতা নাম রাখিয়াছিলেন ললিতলবঙ্গলতা, এবং রামসদয় বাবু আদর করিয়া বলিতেন-ললিত-লবঙ্গলতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে। রামসদয় বাবু প্রাচীন, বয়:ক্রম ৬৩ বৎসর। ললিতলবঙ্গলতা নবীনা, বয়স ১৯ বৎসর, দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-আদরের আদরিণী, গৌরবের গৌরবিণী, মানের মানিনী, নয়নের মণি, ষোলআনা গৃহিণী। তিনি রামসদয়ের সিন্দুকের চাবি, বিছানার চাদর, পানের চূণ, গেলাসের জল। তিনি রামসদয়ের জ্বরে কুইনাইন, কাসিতে ইপিকা, বাতে ফ্লানেল এবং আরোগ্যে সুরুয়া। নয়ন নাই-ললিত-লবঙ্গ-লতাকে কখন দেখিতে পাইলাম না-কিন্তু শুনিয়াছি, তিনি রূপসী। রূপ যাউক, গুণ শুনিয়াছি। লবঙ্গ বাস্তবিক গুণবতী। গৃহকার্যে নিপুণা, দানে মুক্তহস্তা, হৃদয়ে সরলা, কেবল বাক্যে বিষময়ী। লবঙ্গলতার অশেষ গুণের মধ্যে, একটি এই যে, তিনি বাস্তবিক পিতামহের তুল্য সেই স্বামীকে ভালবাসিতেন-কোন নবীনা নবীন স্বামীকে সেরূপ ভালবাসেন কি না সন্দেহ। ভালবাসিতেন বলিয়া, তাঁহাকে নবীন সাজাইতেন-সে সজ্জার রস কাহাকে বলি? আপন হস্তে নিত্য শুভ্র কেশে কলপ মাখাইয়া কেশগুলি রঞ্জিত করিতেন। যদি রামসদয় লজ্জার অনুরোধে কোন দিন মলমলের ধুতি পরিত, স্বহস্তে তাহা ত্যাগ করাইয়া কোকিলপেড়ে, ফিতেপেড়ে, কল্কাপেড়ে পরাইয়া দিতেন-মলমলের ধুতিখানি তৎক্ষণাৎ বিধবা দরিদ্রগণকে বিতরণ করিতেন। রামসদয় প্রাচীন বয়সে, আতরের শিশি দেখিলে ভয়ে পলাইত-লবঙ্গলতা, তাহার নিদ্রিতাবস্থায় সর্বাঙ্গে আতর মাখাইয়া দিতেন। রামসদয়ের চশমাগুলি লবঙ্গ প্রায় চুরি করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিত, সোণাটুকু লইয়া, যাহার কন্যার বিবাহের সম্ভাবনা, তাহাকে দিত। রামসদয়ের নাক ডাকিলে, লবঙ্গ ছয়গাছা মল বাহির করিয়া, পরিয়া ঘরময় ঝম‍ঝম করিয়া, রামসদয়ের নিদ্রা ভাঙ্গিয়া দিত। লবঙ্গলতা আমাদের ফুল কিনিত-চারি আনার ফুল লইয়া দুই টাকা মূল্য দিত। তাহার কারণ, আমি কাণা। মালা পাইলে, লবঙ্গ গালি দিত, বলিত, এমন কদর্য মালা আমাকে দিস কেন? কিন্তু মূল্য দিবার সময় ডবল পয়সার সঙ্গে ভুল করিয়া টাকা দিত। ফিরাইয়া দিতে গেলে বলিত-ও আমার টাকা নয়-দুই বার বলিতে গেলে গালি দিয়া তাড়াইয়া দিত। তাহার দানের কথা মুখে আনিলে মারিতে আসিত। বাস্তবিক, রামসদয় বাবুর ঘর না থাকিলে, আমাদিগের দিনপাত হইত না; তবে যাহা রয় সয়, তাই ভাল বলিয়া, মাতা, লবঙ্গের কাছে অধিক লইতেন না। দিনপাত হইলেই আমরা সন্তুষ্ট থাকিতাম। লবঙ্গলতা আমাদিগের নিকট রাশি রাশি ফুল কিনিয়া রামসদয়কে সাজাইত। সাজাইয়া বলিত-দেখ, রতিপতি। রামসদয় বলিত-দেখ, সাক্ষাৎ-অঞ্জনানন্দন। সেই প্রাচীনে নবীনে মনের মিল ছিল-দর্পণের মত দুইজনে দুইজনের মন দেখিতে পাইত। তাহাদের প্রেমের পদ্ধতিটা এইরূপ- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ রামসদয় বলিত, “ললিতলবঙ্গলতাপরিশী-?” ল। আজ্ঞে ঠাকুরদাদামহাশয়, দাসী হাজির। রা। আমি যদি মরি? ল। আমি তোমার বিষয় খাইব | লবঙ্গ মনে মনে বলিত,“আমি বিষ খাইব |” রামসদয় তাহা মনে মনে জানিত। লবঙ্গ এত টাকা দিত, তবে বড়বাড়ীতে ফুল যোগান দু:খ কেন? শুন। একদিন মার জ্বর। অন্ত:পুরে বাবা যাইতে পারিবেন না-তবে আমি বৈ আর কে লবঙ্গলতাকে ফুল দিতে যাইবে? আমি লবঙ্গের জন্য ফুল লইয়া চলিলাম। অন্ধ হই, যাই হই-কলিকাতার রাস্তা সকল আমার নখদর্পণে ছিল। বেত্রহস্তে সর্বত্র যাইতে পারিতাম, তখন গাড়ি ঘোড়ার সম্মুখে পড়ি নাই। অনেক বার পদচারীর ঘাড়ে পড়িয়াছি বটে-তাহার কারণ, কেহ কেহ অন্ধ যুবতী দেখিয়া সাড়া দেয় না, বরং বলে, “আ মলো! দেখতে পাসনে? কাণা না কি?” আমি ভাবিতাম, “উভয়ত:|” ফুল লইয়া গিয়া লবঙ্গের কাছে গেলাম। দেখিয়া লবঙ্গ বলিলেন, “কি লো কাণি-আবার ফুল লইয়া মরতে এয়েছিস কেন?” কাণী বলিলে আমার হাড় জ্বলিয়া যাইত-আমি কি
false
shottojit_roy
চশমা পরা?… ছেলেদের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল। মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক, প্যান্ট শার্ট পরা, রোগাও না মোটাও না ফরাসাও না কলোও না, বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে; আমরা এসে পৌঁছানোর আধা ঘণ্টা আগে এসে একে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে পানুর কাছ থেকে সামান্য কিছু বকশিশ দিয়ে একটা লাল পাথরের তৈরি মানুষের মাথা উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন। তার নীল রঙের গাড়ি। আমরা যখন গ্রামের পথ দিয়ে গাড়িতে করে আসছিলাম তখন উলটো দিক থেকে একটা নীল রঙের অ্যাম্বাসাডরকে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম। চল তোপসে—আসুন বলরামবাবু! খবরটা শুনে ফেলুদা যদি হতাশও হয়ে থাকে, সে ভাবটা যে সে এর মধ্যে কাটিয়ে উঠে আবার নতুন এনার্জি পেয়ে গেছে সেটা তার ট্যাক্সির উদ্দেশে দৌড় দেখেই বুঝলাম। আমরাও দুজনে ছুটলাম তাঁর পিছনে। কী আছে কপালে কে জানে! যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার ফিরে চলেছি। দেড়টা বেজে গেছে, কিন্তু খাওয়ার কথা মনেই নেই। যশোহর রোডে পড়ে বলরামবাবু একবার বলেছিলেন, চা খাবেন নাকি স্যার? গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলে…. ফেলুদা সে কথায় কান দেয়নি। বলরামবাবুও বোধহয় ব্যাপারটায় একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে আর চায়ের কথা বলেননি। গাড়ি পঁচাত্তর কিলোমিটার স্পিডে ছুটে চলেছে, আর আমি ভাবছি কী অল্পের জন্যেই না মাথাটা ফসকে গেল। সকালে যদি লোডশেডিংটা না হত, আর রেডিয়োর খবরটা যদি ঠিক সময়ে শুনতে পেতাম, তা হলে এতক্ষণে হয়তো আমরা মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের আপিসে ছুটে চলেছি। কিংবা হয়তো সোজা ভুবনেশ্বর। মন্দিরের গায়ে ভাঙা মূর্তি আবার জোড়া লেগে যেত, আর ফেলুদা তার জোরে হয়তো পদ্মশ্ৰী-টদ্মশ্ৰী হয়ে যেত। এই এক ঘণ্টার রোদেই রাস্তা অনেকটা শুকিয়ে গেছে, মনে মনে ভাবছি। বলরামবাবু আরেকটু স্পিড তুললে পারেন, এমন সময় হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ায় পালস রেট-টা ধাঁ করে বেড়ে গেল। একটা গাড়ি-মেরামতের দোকানের সামনে একটা নীল অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে আছে। বলরামবাবু যে সিদিকপুরের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনেছিলেন সেটা তার প্রশ্ন থেকে বুঝতে পারলাম। —গাড়ি থামাব স্যার? সামনের চায়ের দোকানটায়, ফেলুদা চাপা গলায় জবাব দিল। বলরামবাবু স্টাইলের মাথায় মেরামতির দাকানের দুটো দোকানের পরে ট্যাক্সিটাকে রাস্তার ডান দিকে নিয়ে গিয়ে ঘৰ্য্য-ষ করে ব্রেক কষলেন। ফেলুদা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তিন কাপ চা অডার দিল। কাপ তো নয়, কাচের গেলাস। আর কী আছে ভাই? বিস্কুট খাবেন? ভাল বিস্কুট আছে। কাচের বায়ামের মধ্যে গাল গাল নানখাটাই টাইপের বিস্কুট, ফেলুদা তারই দুটো করে দিতে বলল। আমার চোখ নীল অ্যাম্বাসাডারের দিকে। পাংচার সারানো হচ্ছে। একটি ভদ্রলোক, মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, বয়স চল্লিশ-টল্লিশ, ঘন ভুরু, ঘন হাতের লোম, কনের পাশ দিয়েও বোধহয় লোম বেরিয়েছে, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। গাড়ির পাশে ছটফট ভাব করে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন টান দিচ্ছেন আধপোড়া সিগারেটে। বাঙালি কি? কথা না বললে বোঝার উপায় নেই। চা তৈরি হচ্ছে। ফেলুদা চারমিনার বার করে একটা মুখে পুরে পকেট চাপড়ে দেশলাই না-পাওয়ার ভান করে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেল। আমি আমাদের ট্যাক্সির কাছেই রয়ে গেলাম। দুই গাড়ির মধ্যে তফাত বিশ-পঁচিশ হাত। বলরামবাবুর আড়াচোখ নীল গাড়ির দিকে। এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে কি… ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা লাইটার বার করে জ্বলিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। থ্যাঙ্কস। ফেলুদা ধোঁয়া ছাড়ল। টেরিবল ব্যাপার! ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন। আপনি তো ক্র্যাশের ওখানে গিয়েছিলেন, ফেলুদা বলল। —আপনার গাড়িটা যেন আসতে দেখলাম…? ক্র্যাশ? আপনি জানেন না? কাঠমাণ্ডুর প্লেন…সিদিকপুরে… আমি টাকি থেকে আসছি। টাকি হল হাসনাবাদের কাছেই একটা শহর। আমরা কি তা হলে ভুল করলাম? গাড়ির নম্বরটা যদি দেখে রাখতাম তা হলে খুব ভাল হত। আর কতক্ষণ লাগবে হে? ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন মেরামতির লোকটাকে। এই হয়ে গেল স্যার। পাঁচ মিনিট। চায়ের দোকান থেকে বলরামবাবু হাঁক দিয়ে জানালেন চা রেডি। ফেলুদা নীল গাড়ি ছেড়ে আমাদের হলদে গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। হাতে গেলাস নিয়ে তিনজনে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসার পর ফেলুদা চাপা গলায় বলল, ডিনাই করছে। ডাহা মিথ্যেবাদী। আমি বললাম, কিন্তু নীল অ্যাম্বাসাডর তো আরও অনেক আছে। এ রংটা তো খুব কমন, ফেলুদা। লোকটার জুতোয় এখনও কালো ছাইয়ের দাগ লেগে আছে। তোর নিজের স্যান্ড্যালটার দিকে চেয়ে দেখেছিস একবার? সত্যিই তো! স্যান্ড্যালের রংটাই বদলে গেছে। ক্র্যাশের জায়গায় গিয়ে। আর ওই ভদ্রলোকেরও তাই। ব্ৰাউন জুতোয় কালোর ছোপ। ফেলুদা যে ইচ্ছে করেই ধীরে সুস্থে বিস্কুট খাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট পরে অন্য গাড়িটা সুস্থ অবস্থায় মেরামতির দোকান থেকে বেরিয়ে যশোহর রোড দিয়ে কলকাতার দিকে রওনা দিল। আর তার পরমুহূর্তেই আমাদের গাড়িও ধাওয়া করল তার পিছনে। দুটোর মাঝখানে বেশ অনেকখানি ফাঁক, কিন্তু ফেলুদা বলল সেই ভাল; লোকটার সন্দেহ উদ্রেক করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। দমদমের কাছে এসে হঠাৎ আরেক পশলা বৃষ্টি নামল। সামনে সব ধোঁয়াটে হয়ে গেছে, ভাল দেখা যাচ্ছে না, তাই বলরামবাবুকে বাধ্য হয়েই স্পিড বাড়িয়ে নীল গাড়ির আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে পড়তে হল। ভদ্রলোক বেশ রসিক; বললেন, হিন্দি ফিল্মের মতন মনে হচ্ছে স্যার। সেদিন শত্ৰুঘনের একটা বইয়ে দেখলুম। এইভাবে গাড়ির পেছনে গাড়ি ফলো করছে। অবিশ্যি সেখানে পেছনের গাড়িটা একটা পাহাড়ের গায়ে ক্র্যাশ করল। ফেলুদা বলল, এক’দিনে একটা ক্র্যাশই যথেষ্ট। আপনি স্টেডি থাকুন। কলকাতায় পাহাড় না থাকলেও— কী বলচেন স্যার!
false
bongkim
শ্রবণ-পথে মধুর বাজে, রাধে রাধে রাধে রাধে বিপিন মাঝে; যব শুনন লাগি সই, সো মধু বোলি, জীবন না গেলো? ধায়নু পিয় সই, সোহি উপকূলে, লুটায়নু কাঁদি সই শ্যামপদমূলে, সোহি পদমূলে রই, কাহে লো হামারি, মরণ না ভেল?” গিরিজায়া গায়িতে গায়িতে দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে চন্দ্রের কিরণোপরি, মনুষ্যের ছায়া পড়িয়াছে। ফিরিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী কাঁদিতেছেন। গিরিজায়া দেখিয়া হর্ষান্বিত হইলেন – তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, যখন মৃণালিনীর চক্ষুতে জল আসিয়াছে – তখন তাঁহার ক্লেশের কিছু শমতা হইয়াছে। ইহা সকলে বুঝে না – মনে করে, “কই, ইহার চক্ষুতে ত জল দেখিলাম না, তবে ইহার কিসের দু:খ?” যদি ইহা সকলে বুঝিত, সংসারের কত মর্মপীড়াই না জানি নিবারণ হইত। কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী কিছু বলিতে পারেন না; গিরিজায়াও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে না। পরে মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, আর একবার তোমাকে যাইতে হইবে |” গি। আবার সে পাষণ্ডের নিকট যাইব কেন? মৃ। পাষণ্ড বলিও না। হেমচন্দ্র ভ্রান্ত হইয়া থাকিবেন-এ সংসারে অভ্রান্ত কে? কিন্তু হেমচন্দ্র পাষণ্ড নহেন। আমি স্বয়ং তাঁহার নিকট এখনই যাইব-তুমি সঙ্গে চল। তুমি আমাকে ভগিনীর অধিক স্নেহ কর-তুমি আমার জন্য না করিয়াছ কি? তুমি কখনও আমাকে অকারণে মন:পীড়া দিবে না-কখনও আমার নিকট এ সকল কথা মিথ্যা করিয়া বলিবে না, ইহা আমি নিশ্চিত জানি। কিন্তু তাই বলিয়া, আমার হেমচন্দ্র আমাকে বিনাপরাধে ত্যাগ করিলেন, ইহা তাঁহার মুখে না শুনিয়া কি প্রকারে অন্ত:করণকে স্থির করিতে পারি? যদি তাঁহার নিজ মুখে শুনি যে, তিনি মৃণালিনীকে কুলটা ভাবিয়া ত্যাগ করিলেন, তবে এ প্রাণ বিসর্জন করিতে পারিব। গি। প্রাণবিসর্জন! সে কি মৃণালিনী? মৃণালিনী কোন উত্তর করিলেন না। গিরিজায়ার স্কন্ধে বাহুস্থাপন করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। গিরিজায়াও রোদন করিল। নবম পরিচ্ছেদ : অমৃতে গরল-গরলামৃত হেমচন্দ্রের আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া মৃণালিনীকে দুশ্চরিত্রা বিবেচনা করিয়াছিলেন; মৃণালিনীর পত্র পাঠ না করিয়া তাহা ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছিলেন, তাঁহার দূতীকে বেত্রাঘাত করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইহা বলিয়া তিনি মৃণালিনীকে ভালবাসিতেন না, তাহা নহে। মৃণালিনীর জন্য তিনি রাজ্যত্যাগ করিয়া মথুরাবাসী হইয়াছিলেন। এই মৃণালিনীর জন্য গুরুর প্রতি শরসন্ধান করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন, মৃণালিনীর জন্য গৌড়ে নিজ ব্রত বিস্মৃত হইয়া ভিখারিণীর তোষামোদ করিয়াছিলেন। আর এখন? এখন হেমচন্দ্র মাধবাচার্যকে শূল দেখাইয়া বলিয়াছিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব!” কিন্তু তাই বলিয়া কি, এখন তাঁহার স্নেহ একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল? স্নেহ কি একদিনে ধ্বংস হইয়া থাকে? বহুদিন অবধি পার্বতীয় বারি পৃথিবী-হৃদয়ে বিচরণ করিয়া আপন গতিপথ নিখাত করে, একদিনের সূর্যোত্তাপে কি সে নদী শুকায়? জলের যে পথ নিখাত হইয়াছে, জল সেই পথেই যাইবে, সে পথ রোধ কর, পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। হেমচন্দ্র সেই রাত্রিতে নিজ শয়নকক্ষে, শয্যোপরি শয়ন করিয়া সেই মুক্ত বাতায়নসন্নিধানে মস্তক রাখিয়া, বাতায়ন-পথে দৃষ্টি করিতেছিলেন-তিনি কি নৈশ শোভা দৃষ্টি করিতেছিলেন? যদি তাঁহাকে সে সময় কেহ জিজ্ঞাসা করিত যে, রাত্রি সজ্যোৎস্না কি অন্ধকার, তাহা তিনি তখন সহসা বলিতে পারিতেন না। তাঁহার হৃদয়মধ্যে যে রজনীর উদয় হইয়াছিল, তিনি কেবল তাহাই দেখিতেছিলেন। সে রাত্রি ত তখনও সজ্যোৎস্না! নহিলে তাঁহার উপাধান আর্দ্র কেন? কেবল মেঘোদয় মাত্র। যাহার হৃদয়-আকাশে অন্ধকার বিরাজ করে, সে রোদন করে না। যে কখনও রোদন করে নাই, সে মনুষ্যমধ্যে অধম। তাহাকে কখনও বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও, সে পৃথিবীর সুখ কখনও ভোগ করে নাই-পরের সুখও কখনও তাহার সহ্য হয় না। এমন হইতে পারে যে, কোন আত্মচিত্তবিজয়ী মহাত্মা বিনা বাষ্পমোচনে গুরুতর মন:পীড়া সকল সহ্য করিতেছেন, এবং করিয়া থাকেন; কিন্তু তিনি যদি কস্মিন্‌কালে, একদিন বিরলে একবিন্দু অশ্রুজলে পৃথিবী সিক্ত না করিয়া থাকেন, তবে তিনি চিত্তজয়ী মহাত্মা হইলে হইতে পারেন, কিন্তু আমি বরং চোরের সহিত প্রণয় করিব, তথাপি তাঁহার সঙ্গে নহে। হেমচন্দ্র রোদন করিতেছিলেন – যাহাকে পাপিষ্ঠা, মনে স্থান দিবার অযোগ্যা বলিয়া জানিয়াছিলেন, তাঁহার জন্য রোদন করিতেছিলেন। মৃণালিনীর কি তিনি দোষ আলোচনা করিতেছিলেন? তাহা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু কেবল তাহাই নহে। এক একবার মৃণালিনীর প্রেমপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, প্রেমপরিপূর্ণ কথা, প্রেমপরিপূর্ণ কার্যসকল মনে করিতেছিলেন। সেই মৃণালিনী কি অবিশ্বাসিনী? একদিন মথুরায় হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নিকট একখানি লিপি প্রেরণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন, উপযুক্ত বাহক পাইলেন না; কিন্তু মৃণালিনীকে গবাক্ষপথে দেখিতে পাইলেন। তখন হেমচন্দ্র একটি আম্রফলের উপরে আবশ্যক কথা লিখিয়া মৃণালিনীর ক্রোড় লক্ষ্য করিয়া বাতায়নপথে প্রেরণ করিলেন; আম্র ধরিবার জন্য মৃণালিনী কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া আসাতে আম্র মৃণালিনীর ক্রোড়ে না পড়িয়া তাঁহার কর্ণে লাগিল, অমনি তদাঘাতে কর্ণবিলম্বী রত্নকুণ্ডল কর্ণ ছিন্নভিন্ন করিয়া কাটিয়া পড়িল; কর্ণস্রুত রুধিরে মৃণালিনীর গ্রীবা ভাসিয়া গেল। মৃণালিনী ভ্রূক্ষেপও করিলেন না; কর্ণে হস্তও দিলেন না; হাসিয়া আম্র তুলিয়া লিপি পাঠপূর্বক, তখনই তৎপৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর লিখিয়া আম্র প্রতিপ্রেরণ করিলেন। এবং যতক্ষণ হেমচন্দ্র দৃষ্টিপথে রহিলেন, ততক্ষণ বাতায়নে থাকিয়া হাস্যমুখে দেখিতে লাগিলেন। হেমচন্দ্রের তাহা মনে পড়িল। সেই মৃণালিনী কি অবিশ্বাসিনী? ইহা সম্ভব নহে। আর একদিন মৃণালিনীকে বৃশ্চিক দংশন করিয়াছিল। তাহার যন্ত্রণায় মৃণালিনী মূমূর্ষুবৎ কাতর হইয়াছিলেন। তাঁহার একজন পরিচারিকা তাহার উত্তম ঔষধ জানিত; তৎপ্রয়োগ মাত্র যন্ত্রণা একেবারে শীতল হয়; দাসী শীঘ্র ঔষধ আনিতে গেল। ইত্যবসরে হেমচন্দ্রের দূতী গিয়া কহিল যে, হেমচন্দ্র উপবনে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। মুহূর্তমধ্যে ঔষধ আসিত, কিন্তু মৃণালিনী তাহার অপেক্ষা করেন নাই; অমনি সেই মরণাধিক যন্ত্রণা বিস্মৃত হইয়া উপবনে উপস্থিত হইলেন। আর ঔষধ প্রয়োগ হইল না। হেমচন্দ্রের তাহা স্মরণ হইল। সেই
false
MZI
আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। আপনি চাইলেও পারবেন না। কেন? আমি এখানে এসেছি প্রায় সাত মিনিটের মতো হয়ে গেছে। তার মানে জানেন? কি? পৃথিবীতে আরো পঞ্চাশ বছর সময় পার হয়ে গেছে। প্রফেসর ত্রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, তাতে কী হয়েছে? আমি এখানে এসেছি গোপনে, কেউ জানে না। কিন্তু আমার ডাইরিটা আমি রেখে এসেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভন্টে। সেটা এতদিনে পৃথিবীর মানুষ পেয়েছে। পেলে কী হবে? তারা জানবে আমি এই ল্যাবরেটরির সবগুলো দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছি, আপনারা এখন ইচ্ছে করলে বের হয়ে যেতে পারবেন। পৃথিবীর মানুষ সময়ের অপবলয়ের সূত্রের সমাধান করেছে, তারাও জানে দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি। তারাও এখন জেনে গেছে এই ছোট ঘরে আমরা তিনজন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমরা বের হয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা সেটা হতে দেবে না। কিছুতেই হতে দেবে না। কী করবে তারা? কাউকে পাঠাবে এখানে। যারা আমাদের তিনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পৃথিবীকে রক্ষা করবে। কাকে পাঠাবে? প্রফেসর ত্রিনির গলা কেঁপে গেল হঠাৎ। আমার ধারণা, সেগুরি-৪৯ ধরনের রবোটকে। অত্যন্ত নিঁখুত রবোট, অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করতে সক্ষম। আমার ধারণা যে-কোনো মুহূর্তে তারা এসে ঢুকবে এখানে। বিশ্বাস করি না তোমার কথা। বিশ্বাস করি না– রিগা কী-একটা বলতে চাইছিল, তার আগেই হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়। দরজায় চারটি ধাতবমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মূর্তিগুলো মাথা ঘুরিয়ে তাদের তিনজনকে একনজর দেখে নেয়। তারপর খুব ধীরে ধীরে হাতের অস্ত্র তাদের দিকে উদ্যত করে। রিগা চিনতে পারে—সেঞ্চুরি-৪১ রবোট। ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিগা। তার অনুমান তাহলে ভুল হয় নি। কখনো হয় না। বিষ ক্রায়োজেনিক পাম্পটি চালিয়ে দিয়ে কিম জিবান কাচের ছোট অ্যাম্পুলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনো একটা ক্ষুদ্রাইভার হাতে একটা স্কু ঘুরিয়েছেন মনে পড়ে না, অথচ গত এক সপ্তাহ থেকে তাঁর ঘরে একটা ছোট কিন্তু জটিল ল্যাবরেটরি বসানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের দশজন সদস্যের একজন হিসেবে তাঁর ক্ষমতার আক্ষরিক অর্থেই কোনো সীমা নেই। মূল কম্পিউটার তাঁর মুখের কথায় এই ল্যাবরেটরির প্রতিটি জিনিস এনে হাজির করেছে। কিন্তু কাচের অ্যাম্পুলটিতে তিনি যে তরল পদার্থটি রাখতে চাইছেন, সেটি কী ভাবে তৈরি করতে হয় সেই তথ্যটি তিনি মুখের কথায় বের করতে পারেন নি। সেজন্যে তাঁকে নিজের হাতে তাঁর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের গোপন সংখ্যাটি মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাতে হয়েছে। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কেউ সেটি করেছে বলে জানা নেই। এজন্যে তাঁকে সামনের কাউন্সিলে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেয়ার কথা। জিন স্থির দৃষ্টিতে কাচের অ্যালটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। হালকা লাল রঙের একটা তরল একফোঁটা একফোঁটা করে কাচের অ্যাম্পলটিতে জমা হচ্ছে। পুরোটুকু ভরে যাওয়ার পর অ্যাম্পুলটির মুখ লেজারের একঝলক আলোতে গলিয়ে বন্ধ করে ফেলার কথা। তিনি কখনো আগে এ ধরনের কাজ করেন নি, তাই নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান। অ্যাম্পুলটির মুখ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি সেটা হাতে নেয়ার জন্যে ক্রায়োজেনিক পাম্পটা বন্ধ করে দেন। ভিতরে বাতাসের চাপ স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা খোলার জন্যে হাতল স্পর্শ করামাত্র মূল কম্পিউটারটি আপত্তি জানাল। পৃথিবীতে মাত্র দশজন মানুষকে এই ঢাকনা খোলার অধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি সেই দশজন মানুষের একজন। কিম জিবানকে দ্বিতীয়বার তাঁর নিজের হাতে গোপন সংখ্যাটি প্রবেশ করিয়ে কম্পিউটারকে জানাতে হল। বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা এবার সহজেই খুলে আয়) জিবানের হাত অল্প অল্প কাঁপতে থাকে, তিনি সে অবস্থাতেই সাবধানে অ্যালতি তুলে নেন। তিনি এখন তাঁর জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করবেন। তাঁর হাতে কাচের অ্যাম্পুলটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে এই তরল পদার্থটি বাতাসে মিশে গিয়ে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মেরে ফেলবে। মাত্র তিন ধরনের ভাইরাস এই বোনাসিয়াস থেকে রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ লন। কিম জিবান হেঁটে ঘরের মাঝখানে আসেন, তাঁর হাত তখনো অল্প অল্প কাঁপছে, তিনি ভালো করে অ্যাম্পুলটি ধরে রাখতে পারছেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রাণ তিনি এখন হাতে ধরে রেখেছেন, কিম জিবান অবাক হয়ে ভাবলেন, এত বড় ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ কি কখনো অর্জন করেছিল? নীষ কিম জিবানের ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করেন, ঘরাট অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করতেই অন্ধকারে এক কোনা থেকে জিবান বললেন, নীষ, বাতি জ্বালিও না। একটু পরেই দেখবে চোখ অন্ধকারে সয়ে যাবে। বাজে কথা বলো না—নীষ বাতি জ্বালালেন, আমার অন্ধকার ভালো লাগে না। জিবান চোখ কুঁচকে নীষের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর মুখে আশ্চর্য একটা হাসি। নীষ বেশি অবাক হলেন না। কিম জিবান বরাবরই খেয়ালি মানুষ, এরকম একজন খেয়ালি মানুষকে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য করা হয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! নীষ বললেন, কী ব্যাপার জিবান, আমাকে ডেকেছ কেন? জিন কথা না বলে ঘরের কোনায় তাঁর ছোট ল্যাবরেটরি দেখালেন, নীষ বিস্মিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যান, কী ব্যাপার জিবান, তুমি ডিষ্টিলেশান কমপ্লেক্স দিয়ে কী করছ? জিবান মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, তুমি পৃথিবীর প্রথম পাঁচজন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন– কথাটি সত্যি তাই নীষ প্রতিবাদ না করে পরের অংশটক শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। জিবান বললেন, তুমিই বল আমি কী করছিলাম। নীষ মিনিট
false
tarashonkor
না। ইতি– শ্ৰীসেতাবচন্দ্র মণ্ডল পড়িয়া দেখিয়া চিঠিখানি মুড়িয়া নোটনের হাতে দিয়া বলিল, চলে যা। কাল মণিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। খবরদার, কোনো কথা ভাবি না। নোটন চিঠিখানা লইতে হাত বাড়াইল। রাখাল বলিল, সেতাব! —ফ্যাচফাচ করিস না রাখাল। পিছু ডাকিস না। বাড়ি যা। –ওহে, চাঁপাডাঙার বউমাকে– –রাখাল, তু বাড়ি যা। রাখাল থামিয়া গেল। ভয় পাইল। সেতাব চিঠিখানা নোটনের হাতে দিয়া বলিল—তু সব বলবি। যা ঘটেছে মুখে বলবি। বুঝলি? রাখাল চলিয়া গেল এবার। সেতাব আবার বলিল—যাবার পথে ঘোঁতনকে ঘোঁতনকে বলবি, আমি ডেকেছি। আমি ডেকেছি। নোটন তবু চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সেতাব বলিল—কি? দাঁড়িয়ে রইলি যে? ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে সানাই ঢোল ঢাক বাজিয়া উঠিল। সপ্তমী পূজার ঘট আনিবার সময় হইয়াছে। সেতাব আবার বলিল, নোটন! এবারে নোটন বলিল, ওই শোন, পূজার ঢাক বাজছে। ঘট আসছে মোড়ল। সে সব বুঝিয়াছে। সেতাব রূঢ়কণ্ঠে বলিল, নোটন। নোটন পুরনো লোক, এই ঘরের সুখদুঃখের সঙ্গে তাহার জীবনটা জড়াইয়া গিয়াছে শত পাকে সহস্ৰ বয়নে। সে বলিল, যা করবে পূজার পরে কোরো। মোড়ল, আজ সপ্তমী পুজোর দিন; ঠাকুরুনের ঘট আসবে, সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী পাতবে, আজ ঘর ভাঙার ধুয়ে তুলো না। বেসজ্জনের বাজনা বাজিও না। সেতাব তাহার হাতের চিঠিটা লইতে উদ্যত হইল। বলিল, তুই যাবি কি না বল? নোটন তাহার হাতখানা সরাইয়া লইয়া বলিল, যাব। তুমি মনিব। কথা শুনতে হবে আমাকে। চললাম আমি। কিন্তু মাঠে ধান মরছে, শো-শে ডাক ধরেছে মাটিতে। জল নাই। জল হবে না। আকাশের জল হবে না। এ আমি বললাম তোমাকে। যা হয় কোরো। সে চলিয়া গেল। পথে একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়াইয়া তখন বহুবল্লভ বাউল একতারা এবং বায়া বাজাইয়া গান ধরিয়াছিল– কমল-মুখ শুকায়ে গেছে, আয় মা আয় মুছায়ে দি, মায়ের কোলে শয়ন কর মা, শীতলপাটি বিছায়ে দি।। বল বল মা কানে কানে কি দুঃখ পেলি কোমল প্ৰাণে শ্মশান-তাপে জ্বলছে দেহ, আঁচল-বায়ে ঘুচায়ে দি। আয় মা মুখ মুছায়ে দি। আগমনী গানের বাৎসল্য রস অনাবৃষ্টি—শুষ্ক শরতের আকাশের উত্তপ্ত নীলিমাকে সকরুণ করিয়া তুলিয়াছিল। বড় বউয়ের কানে ওই গানের সুর ভাসিয়া আসিতেছিল। এ গান যেন দূর চাঁপাডাঙায় বসিয়া তাহারই মা গাহিতেছে। সে তো যাইবে। এ বাড়ির মেয়াদ তাহার ফুরাইয়াছে। সে কথা সে জানিয়াছে। তাহার নিজের চিত্তের সকল মায়া সব মমতাই কাটিয়াছে। তাহার স্বামীরও কাটিয়াছে। সব ভালবাসা মায়ানদীর মত শুকাইয়া গিয়া মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে। সেই মরুভূমির বুকের মধ্যে সেতাবের অন্তরের রূপটা ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে চায় নূতন ঘর, নূতন সংসার, নূতন– হাসি ফুটিয়া উঠিল তাহার মুখে। তাহার প্রতি এই কদর্য সন্দেহ একান্তভাবেই মিথ্যা। এতকাল এইভাবেই তো ঘর করিয়া আসিল সে। এমনিভাবেই তো সে মহাতাপকে স্নেহ করিয়াছে, এমনিভাবেই তো মহাতাপ আবদার করিয়াছে। কই, এতকালের মধ্যে এমন সন্দেহ তো হয় নাই? হঠাৎ আজ, আজ কেন হইল? ওই তাহার নূতন গোপন সাধটা তাহার চোখে ফুলি পরাইয়া দিয়া সংসারটাকে কালো করিয়া দেখাইয়া তাহাকে জোর দিতেছে। ঠিক এই সময়েই কে ডাকিল, বউমা! চমকিয়া উঠিল চাঁপাডাঙার বউ। সে সবিস্ময়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে চাহিয়া রহিল। সিঁড়ির নিচে হইতে আগন্তুক কথা বলিল, আমি মা, রাখাল। চাঁপাডাঙার বউ ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। রাখাল উঠিয়া আসিল; সে একা নয়, তাহার সঙ্গে একটি আট-নয় বছরের মেয়ে। তাহার হাতে এক বাটি দুধ। রাখাল বলিল, তোমার জন্যে দুটুকু নিয়ে এলাম মা। খাও তুমি। দে মা দেী, খুড়ীমাকে দুধের বাটিটা দে। চাঁপাডাঙার বউ মাথার ঘোমটাটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, পূজার ঘট আসছে। আমাকে লক্ষ্মী পাততে হবে। তার আগে তো খাব না! –মা, এই দেহে তুমি মাথা ঘুরে আবার পড়ে যাবে। –না! পারব আমি। খুব পারব। সে ধীরে ধীরে দেওয়াল ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, তুই রাষ্য দেী, আমি লক্ষ্মী পেতে এসে খাব। রাখাল বলিল, খেঁদী, তুই সঙ্গে যা। বুঝলি, সঙ্গে যা। ওদিকে ঢাক ঢোল সানাই কঁসির শব্দ উচ্চ হইয়া উঠিল। চণ্ডীমণ্ডপে ঘট আসিল। শাঁখ বাজিল, উলু পড়িল। চণ্ডীমণ্ডপে এবার পূজার আয়োজন সবই হইয়াছে; কিন্তু তাহাতে প্ৰাণ নাই, সমারোহ জমিয়া উঠিতেছে না। সব যেন বিষণ্ণ চিন্তাভারক্লিষ্ট। আকাশে জল নাই, চাষীর দৃষ্টি আকাশের দূর-দিগন্তে, চিত্ত উদ্বেগকাতর। তাহার উপর সেতাবদের এই কলহটাও একটা বেদনাতুর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। ছেলেরা শুধু ছুটাছুটি করিতেছে। তাহার মধ্যে মানিকও রহিয়াছে। তাহাকে আনিয়াছে গোবিন্দ। খালি গা, জামাও কেহ একটা পরাইয়া দেয় নাই। সে একটা রঙিন বাঁশি লইয়াই খুশি আছে। সেইটাই সে বাজাইতেছে–পু-পু! পু-পু! বাজাইতেছে আর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মণ্ডলেরা বসিয়া আছে, তামাক টানিতেছে, কিন্তু আসর ঝিমাইয়া গিয়াছে। কেহ বড় একটা কথা বলে না। চেঁচাইতেছে শুধু টিকুরীর খুড়ী। —অবিশ্বেস, অনাচার, অবিচার-বলি এর চেয়ে পাপ আর কি হবে? বলি ইয়েতে কি ধৰ্ম থাকে, না দেবতা তুষ্ট হয়। মোড়লেরা কি সব ধর্মজ্ঞান চিবিয়ে খেয়েছে নাকি? বলি পূজা করা কেনে? বিপিন মণ্ডল সোজা হইয়া বসিল। বলিল—টিকুরীর বউ, তুমি এমন করে ফেঁচাও ক্যানে গো? বলি এমন করে চেঁচাও ক্যানে গো? —চেঁচাবে না? বলি মোড়লেরা যে চোখ-কানের মাথা খেয়েছে। বলি সেতাবের থেকে এখনও পুজো এল না, সেদিকে নজর আছে? পাঁচ আনার অংশীদার সেতাব চণ্ডীমণ্ডপের সম্মুখে রাস্তার উপর ঘোঁতনের সঙ্গে কথা বলিতেছিল। বিপিন মণ্ডল বিস্মিত এবং ব্যস্ত হইয়া উঠিল। প্রতি বৎসর পূজায় চাঁপাডাঙার বউ ষষ্ঠীর সন্ধ্যা হইতে দশমী পর্যন্ত চণ্ডীমণ্ডপে সারাক্ষণ হাজির থাকিয়া সকল অনুষ্ঠান নিখুঁত করিয়া দেয়।
false
shordindu
হতে পারে না, এ ধারণা তার মনে ততই দৃঢ় হচ্ছে। তাছাড়া অন্যের বাগদত্তা মেয়ে কেউ জেনেশুনে বিয়ে করতে চায় না, দু-চারটে ঘরানা ঘরে সম্বন্ধ করতে গিয়ে লজ্জা পেয়ে লিখুজীকে ফিরে আসতে হল। শেষ পর্যন্ত তিনি দেখলেন শাহু ছাড়া জিজার গতি নেই। এইভাবে ন-দশ বছর কেটে গেছে। মালোজী কপালের জোরে এবং বুদ্ধিবলে খুব উন্নতি করেছেন, বিষয়-সম্পত্তিও হয়েছে। লখুজীর বিদ্বেষ ও অনিচ্ছা ক্রমেই কমে আসতে লাগিল। তারপর একদিন মালোজীকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভাই, আমারই ভুল; জিন্জাকে তুমি তোমার ছেলের জন্যে নিয়ে যাও। ব্যাস, আর কি! এইখানেই গল্প শেষ। মালোজীর মতলব সিদ্ধ হল, মহা ধুমধাম করে তোমার বাপের সঙ্গে তোমার মায়ের বিয়ে হয়ে গেল। তখন তোমার মার বয়স তেরো বৎসর, আর শাহুর পনেরো। বিয়ের রাত্রে তোমার মার গবোজ্জ্বল হাসি ভরা মুখ আমার আজও মনে আছে। তবে একথা ঠিক যে জন্মান্তরের সম্বন্ধ না হলে এত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, এতবড় সামাজিক পার্থক্য লঙঘন করে এ বিয়ে কখনই হতে পারত না। তোমার মা-বাবা পূৰ্ব্বজন্মেও স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। বৃদ্ধ দাদো মৌন হইলেন। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না, দুইজনে নীরবে চলিলেন। অন্ধকার তখন বেশ গাঢ় হইয়াছে, পাশের লোকও স্পষ্ট দেখা যায় না। দাদো লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, বালক দুই কর যুক্ত করিয়া ললাটে ঠেকাইয়া বারংবার কাহার উদ্দেশে নমস্কার করিতেছে। দান্দাে কথা কহিলেন না, অপূর্ব আবেগভরে তাঁহার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কিয়ৎকাল পরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অর্ধস্ফুটস্বরে বালক বলিল, কি সুন্দর গল্প! আমার মার মতো এমন মা পৃথিবীর আর কারো নেই—না দাদো? দাদো সংযতকণ্ঠে বলিলেন, না। তোমার মায়ের মতো এমন অসামান্য নারী আর কোথাও নেই। সেই তিন বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত দেখে আসছি, এমনটি আর দেখিনি। পূর্ণ হৃদয় লইয়া দুইজনে নীরব রহিলেন। ক্রমে পুণার আলোক নিকটবতী হইতে লাগিল, পুত্র সমতল ও অনুস্থত হইল। অস্বয় আশু গৃহে পৌঁছবার আশয় দ্রুতবেগে চলতে আরম্ভ করিল। পুণা পৌঁছিতে যখন পাদক্ৰোশ মাত্র বাকি আছে, তখন কে একজন সম্মুখের অন্ধকার হইতে উচ্চকণ্ঠে হাকিল, হে শিব্বা হো! হে দাদোজী! বালক শিব্বা চমকিয়া উঠিয়া সানন্দে চিৎকার করিয়া উঠিল, তানা! তানা! তারপর তীরবেগে সম্মুখে ঘোড়া ছুটাইয়া দিল। অন্ধকারে তানাজী মালেশ্বর ঘোড়ার উপর বসিয়া ছিল, শিব্বা প্ৰায় তাহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। তানাজি তিরস্কারের সুরে বলিল, আজ কি আর বাড়ি ফিরতে হাওবে না? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মা কত ভাবছেন, শেষে আর থাকতে না পেরে আমাকে পাঠালেন? শিব্বা ঘোড়ার উপর হইতেই তানাজীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, মা কোথায় রে, তানা? তানাজি বলিল, কোথায় আবার—বাড়িতে! দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পথের পানে চেয়ে আছেন। তোমার এত দেরি হল কেন? গলা খাটো করিয়া বলিল, দেওরামের সঙ্গে দেখা হল নাকি? ওদিকের কি খবর? কবে? শিব্বা অন্যমনস্কভাবে বলিল, খবর ভালো। অমাবস্যর রাত্রে সব ঠিক হয়েছে — চল তানা, শীগগির বাড়ি যাই। মাকে সমস্ত দিন দেখিনি— ভারী মন-কেমন করছে। দুই কিশোর বন্ধু তখন নীড়-প্রতিগামী পাখির মতো দ্রুতবেগে গৃহের দিকে অগ্রসর হইল। বৃদ্ধ দাদোদী কোণ্ডু বহুদূর পশ্চাতে পড়িয়া রহিলেন। ১৩৩৮ আর্য দ্রাবিড় হূণ মোঙ্গল—প্রত্যেক মৌলিক জাতির জীবনেই একটা সময় আসে যেটাকে তাহার নবীন যৌবন বলা চলে; যখন তপ্ত যৌবনের দুর্দমনীয় অপরিণামদর্শিতায় তাহারা বহু অসম্ভব ও হাস্যকর প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে এবং শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিজ্ঞা পালন করিয়া ছাড়ে। যাহাদের আমরা আর্যজাতি বলিয়া জানি, তাহাদের জীবনে এই নবীন যৌবন আসিয়াছিল বোধ হয় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধেরও আগে। পাঁজিপুঁথি তখনও জন্মগ্রহণ করে নাই; আকাশের গ্রহ নক্ষত্র চন্দ্র সূর্য স্বেচ্ছামত নিশ্চিন্ত মনে স্ব-স্ব কক্ষায় পরিভ্রমণ করিত—মানুষ তাহাদের গতিবিধি ও কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখিতে আরম্ভ করে নাই। আর্য বীরপুরুষগণ ভারতভূমিতে পদার্পণ করিয়া আদিম অনার্যদিগকে বিন্ধ্যাচলের পরপারে খেদাইয়া দিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, উপরন্তু তাহাদের রাক্ষস পিশাচ দস্যু প্রভৃতি নাম দিয়া কটুক্তি করিতেছিলেন। মনে হয়, সে-যুগেও শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাইবার প্রথা পুরাদস্তুর প্রচলিত ছিল। তারপর একদা অগস্ত্য মুনি কতিপয় সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া দক্ষিণাপথে অগস্ত্যযাত্রা করিলেন, আর ফিরিলেন না। রাক্ষস ও পিশাচগণ তাঁহাকে কাঁচা ভক্ষণ করিল কি না পুরাণে তাহার উল্লেখ নাই। যা হোক, তদবধি অন্যান্য আর্য বীরগণও বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণ দিকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিলেন। দুইজন নবীন আর্য যোদ্ধা সৈন্যসামন্ত লইয়া দক্ষিণাপথে বহুদূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছিলেন। এবং দেখিয়া-শুনিয়া খানিকটা উর্বর ভূভাগ হইতে কৃষ্ণকায় দস্যু-তস্করদের তাড়াইয়া স্বরাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। এই আর্য বীরপুরুষ দুটির নাম—প্রদ্যুম্ন এবং মঘবা। উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বন্ধুত্ব। আজকাল বন্ধুত্ব বস্তুটার তেমন তেজ নাই; ইয়ারকি দিবার জন্যই বন্ধুকে প্রয়োজন হয়। সেকালে দস্যু ও রাক্ষস দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া বন্ধুত্ব পুরামাত্রায় বিস্ফুরিত হইবার অবকাশ পাইত। দুই বন্ধুর যৌথ বাহুবলে রাজ্য স্থাপিত হইল। কিন্তু প্রশ্ন উঠিল–রাজা হইবে কে? প্রদ্যুম্ন কহিলেন, মঘবা, তুই রাজা হ, আমি সেনাপতি হইব। মঘবা কহিলেন, উঁহু, তুই রাজা হ—আমি সেনাপতি। সমস্যার সমাধান হইল না; বন্ধুকে বঞ্চিত করিয়া রাজা হইতে কেহই ব্যর্থ নয়। এদিকে নবলব্ধ রাজ্যটি এতই ক্ষুদ্র যে ভাগাভাগি করিতে গেলে কিছুই থাকে না, চটকস্য মাংসং হইয়া যায়। প্রজা ভাগাভাগি করিলেও শক্তিক্ষয় অনিবার্য—চারিদিকে শত্রু ওৎ পাতিয়া আছে। বন্ধুযুগল বড়ই ভাবিত হইয়া পড়িলেন। একদিন রাত্রিকালে আকাশে গোলাকৃতি চন্দ্র শোভা পাইতেছিল—অথাৎ পূর্ণিমার রাত্রি। প্রস্তরনির্মিত উচ্চ দুর্গের চূড়ায় দুই বন্ধু চিন্তাকুঞ্চিত ললাটে অবস্থান করিতেছিলেন। দুর্গা অবশ্য বিতাড়িত অনার্য দস্যুদের নির্মিত; আর্যেরা আদৌ দুর্গ নির্মাণ করিতে জানিতেন না।
false
shunil_gongopaddhay
মাতা হেঁট হয়ে যায়। হাতি দিয়ে পড়লেও হাতি। নবাব দিয়ে পড়েচোন বটে। কিন্তু নবাবী মেজাজ একটুও নষ্ট হয়নিকো! রাহিসী কায়দা পুরোপুরি বজায় রেকেচেন। —তবু বাপু তুমি একটু খপর নেও না! শুনলে কেমন ভয় ভয় করে। নবাব ডেকেচোন, সে ডাক উপিক্ষেও কত্তে পারি না, আবার চাল-চলন-সহবতে যদি কিচু ভুল হয়, নবাব যদি হাতে মাতা কাটার হুকুম দেন— — যেতে হবে তো শনিবার? এখনো চারদিন রয়েচে। আমি সব খোঁজ এনে দিচ্চি তোমায়। লক্ষীয়ের নবাব কলকাতায় এসে আর কারুকে ডাকেনি, শুধু তোমায় এত্তেলা দিয়েচেন, তার মানে বুঝলে, কমলা, এক ডাকে তোমায় সবাই চেনে! ঐ ফুটে মল্লিকটার হিংসেয় বুক ফাটচে! দুদিন বাদে ছোট নুটু সব খোঁজখবর নিয়ে এলো। কথা বলার বদলে সে ক্ৰন্দন করতে শুরু করলো কমলাসুন্দরীর হাত চেপে ধরে। কমলাসুন্দরী হতভম্ব হয়ে বললো, ও মা, এ কী? এ কী? ছোট নুটু হাপুসা নয়নে থেমে থেমে বললো, কমলা, কত দাও, তুমি কিচুতেই মেটেবুরুজে যাবে না! নবাব তোমায় যতই হীরে-মোতির মালার লোভ দেখাক! —কেন গো? সত্যিই কি নবাব বাহাদুর মেয়েমানুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলেন নাকি? —না গো, তা নয়! ব্যাপার আরও ভয়ংকর। নবাবী প্রাসাদে কেউ ঢুকলে আর বেরুতে পারে না। নবাব সবাইকে শাদী করে ফেলেন! -অ্যাঁ? –হ্যাঁ গো, আমি সব খপর এনিচি! —এসব কত কে শোনালে তোমায়! —মেটেবুরুজে। সব্বাই বলাবলি কচ্চে যে! সেখেনে কত মানুষের ভিড়, যত সব ফড়ে আর দালাল, গুড়ের লোভে লোভে যেমন পিঁপড়ে আসে। আর জুটেচে যত রাজ্যের পাখিওলা। নবাবের খুব পাখি কেনার শক, আর ঐ শক বিয়ে করার। —কী বললে গো তুমি? কতা নেই, বাত্রা নেই, যাকে দেকবে, তাকেই ধরে ধরে বে করবে? এ কি অলুক্ষ্মণে লখনৌয়ের আইন? —নবাব ধন্মে হলেন গে শিয়া! ওরা যত খুশী মুত-আ কত্তে পারে। —মুত্-আ কী গো? —ঐ যে বললুম, বিয়ে বল, শাদী বল, নিকে বল, সবই ঐ মুত-আ। নবাবের যাকে পছন্দ হয়, অমনি তাকে মুতু-আ করে ফেলেন। একজন কী বললে জানো? এক কম বয়েসী ভিশতিনী মাগী অন্দর মহলে জল দিতে যেত, তাকে হঠাৎ নবাবের চোখে লেগে গেল। আর অমনি তাকে মুত-আ করে ফেললেন নবাব। সে ভিশতিনী এখন বেগম! ছোট নুটুর গলা কাঁদো কাঁদো, কিন্তু কমলাসুন্দরী হেসে গড়িয়ে পড়লো একেবারে। এ যেন রূপকথা, নবাবের নেক নজরে পড়ে এক ভিশতিনী রাতারাতি হয়ে গেল বেগম সাহেব! ছোট নুটু বললো, শুধু কি ভিশতিনী নাকি, এক ঝাড়ুদারনীকেও অমনি মুত্-আ করে বেগম বানিয়েচেন নবাব। তার নাম আবার মুসফফা বেগম। —তার মানে কী? —কে জানে? শুনাচি নবাব রোজই একটা করে শাদী কচ্চেন, অ্যাদিনে প্ৰায় শখানেক বেগম হয়ে গ্যাচে। আগে আরও কত ছেল কে জানে! তোমার মতন আগুনের খাপরাকে দোকলে নবাব কী আর ছাড়বেন! জোরজার করে অমনি মুত-আ করে নেবেন! কমলাসুন্দরী ঠোঁট টিপে হেসে বললো, তা একবার নবাবের বেগম হয়ে দেকালে মন্দ হয় না! ছোট নুটু হাত জোড় করে বললো, কমলা, তুমি এমন কতা বললে? জাত ধম্মো বিসজন দেবে? —আমাদের আবার জাত কী? —ওঃ, এই তোমার মনে ছেল? তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে চাও? আমরা কি তোমার পায়ে পড়ে থাকিনি? এখুন তোমার পায়ে মাতা কুটবো, কমল। —আরে, আরে, করে কী, করে কী, মিনসেটা! সত্যি সত্যি কি আমি ধেই ধেই করে নবাবের বেগম হতে যাচ্চি নাকি? আর গেলেই বা কি। অমনি জোর করে মুত-আ করবে? এ কি মগের মুলুক নাকি রে। বাবা! —হাঁ, সেই কতাই তো সবাই বলচে। নিজের রাজ্য রক্ষা কত্তে পাল্লেন না, নবাব এখন মেয়েমানুষ জয় কচ্চেন! সুন্দরপানা কোনো মাগ নবাবের প্রাসাদে একবার ঢুকলে আর বেরুতে পারে না। মুত্-আ করার পর বেগম বানাবে। সে ঐ নামেই বেগম, সে আর কোনোদিন দেকতে পাবে না বাইরের আলো-বাতাস, বুঝলে? কমলাসুন্দরী ডাকলো চপলা, তরঙ্গিনী আর চন্দনবিলাসীকে। সব বৃত্তান্ত শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী লো, তোরা কেউ নবাবের বেগম হতে চাস নাকি? এমন সুযোগ আর কখুনো পাবিনি! তিনজনেই সমস্বরে বলে উঠলো, ও মা গো, রক্ষে করো! ছোট, নুটু বললো, ঠিক বলিচিস। কেন নবাব মহলে গিয়ে বন্দিনী হবি? আমরা কি তোদের কম খাতির করি? কমলাসুন্দরী বললো, তা হলেও বেগম বলে কতা! চপলা বললো, ওফ, ভাবতেও বুক কাঁপে! প্যাঁজ রসুনের গন্ধ, আর নবাবের নাকি হুমন্দো হুমন্দো কাফ্রি খোজা রয়েচে। নবাব সম্পর্কে এই সব চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর গল্প চলতে লাগলো। দু-তিনদিন ধরে। আমন্ত্রণ পেয়েও কমলাসুন্দরী যাবে না বলে নবাব যদি রাগ করেন এবং জোর করে ধরে নিয়ে যান, সেই ভয়ে ছোট নুটু একটা বজরা ভাড়া করে ওদের সকলকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য গঙ্গাবক্ষে বিহারের প্রস্তাব দিল। অতি উত্তম কথা, কমলাসুন্দরী সানন্দে রাজি। কিন্তু যাত্রার আগের দিন সন্ধে থেকে তরঙ্গিনীকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। পরদিনও সন্ধান মিললো না তার। কমলাসুন্দরীর বজরা ভ্ৰমণে বেরিয়ে গেল। এবং ফিরে আসার পর শুনতে পেল, তরঙ্গিনী ঝাড়ুদারনীর ছদ্মবেশে নবাবের মহলে ঢুকেছিল এবং নবাবও তাকে মুতু-আ করে বেগম বানিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য এটা ঘটনা না রটনা, তার সত্য মিথ্যে জানার কোনো উপায় নেই। বিধুশেখরের নাতি প্ৰাণগোপালের উপনয়ন উপলক্ষে নবীনকুমার অনেকদিন পর এলো এ বাড়িতে। অতি শৈশবে সে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গঙ্গানারায়ণের হাত ধরে এখানে অনেকবার এসেছে। তখন তাকে আদর করার জন্য নারীগণের মধ্যে কাড়াকড়ি পড়ে যেত। পারিবারিক গণ্ডি ছাড়িয়ে নবীনকুমার এখন
false
shirshendu
হয়ে পড়বেন যে! বাবার একটু ভাল খবর না পেলে খাবো কি করে? গলা দিয়ে নামবেই না। তাই কি হয়? এরকম করতে নেই। আমি ওদের বুঝিয়ে বলছি। গমনোদ্যত হেমাঙ্গর পথ আটকাল ঝুমকি, প্লিজ! কেউ কিছু খেতে পারবে না এখন। ডাক্তার এখনই আসবে খবর দিতে। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে গেছে। খবর! বলে হেমাঙ্গ ঝুমকির দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আবার লবিতে এসে বসল। তারা। চারজন মহিলা একসঙ্গে। একটু তফাতে হেমাঙ্গ। সে চুপ করে চোখ বুজে বসা। মাথার পিছনে জড়ো করা দুটো হাত। মন অস্থির। মাথা পাগল পাগল। পাশে কেউ এসে বসল। একটা পারফিউমের গন্ধ। হেমাঙ্গদা! হেমাঙ্গ চোখ খুলল। অনু। আপনার কী হয়েছে? এত আপসেট কেন? ও কিছু নয়। ভীষণ আপসেট। আমাদের চেয়েও বেশি। হেমাঙ্গ একটু হাসল। আই অ্যাম ভেরি সরি। মাই অ্যাপোলজি। কেন বলো তো! পরশু আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। হেমাঙ্গ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভালই করেছিলে। তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাকটা নিশিপুরে হলে কী বিপদ হত বলো তো! ওখানে ডাক্তার নেই, না? না। ওখানে কিছু নেই। কিছু নেই। ডাক্তার না, নার্সিংহোম না, অ্যাম্বুলেন্স না, গাড়ি না। তা হলে কারও অসুখ করলে কী করে লোকেরা? ভটভটিতে চাপিয়ে শহরে আনে। যদি না আনা যায় তা হলে ভগবানকে ডাকে। তোমার বাবা লাকি। তুমি রাগ করে চলে এসে ভালই করেছে। আপনি সেই জন্য আপসেট? না। তা হলে? হেমাঙ্গ একটু হাসল। দিদিকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কী বললেন? বললাম তোমাদের কিছু খাওয়া উচিত। মাত্র এই কথা? হেমাঙ্গ হাসল, আর কী বলব? অনু চুপ করে রইল। কী ভাবছো অনু? আপনার ভীষণ ইগো। তাই বুঝি? অথচ আপনি ভীষণ ভালও তো! ভাল? হ্যাঁ, ভাল। কে জানে কী! আমি জানি আপনি ভীষণ ভাল। যদিও ইউ আর নট মাই টাইপ অফ এ যান। তবু আপনি আপনার মতো করে ভীষণ ভাল। তোমার ফেভারিট টাইপ কেমন? স্মার্ট, প্র্যাক্টিক্যাল, ড্যাশিং। ওই যে, ডাক্তার ভট্টাচাৰ্য আসছে। সুদৰ্শন ডাক্তারটি এসেই ঝুমকিকে ডেকে নিয়ে গেল। হেমাঙ্গর অন্তরাত্মা বলে উঠল, যেও নাকো অই যুবকের কাচের দরজাটা ঠেলে ওরা ভিতরে চলে গেল। খনিক দূর দেখা গেল ওদের। তারপর চোখের আড়ালে। হেমাঙ্গ হতাশায় কেমন স্থবির হয়ে যাচ্ছে এখন। তার মনে হচ্ছে সে একটা ভুল করছে। এখনই তার যা করা উচিত তা সে করছে না। বয়ে যাচ্ছে একটা জরুরি সময়। এর পর দেরি হয়ে যাবে। অনু বলল, আজ আপনি সত্যিই খুব রেস্টলেস। তাই না? হেমাঙ্গ স্তিমিত গলায় বলল, মানুষ তো ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু কী হয়েছে? কথাটার জবাব দেওয়ার আগেই ঝুমকিকে দেখা গেল, ফিরে আসছে। বাবাকে দেখে এলাম মা! অপর্ণা চমকে উঠে বলল, কী দেখলি? ব্যথাটা কমেছে একটু। কথা বলল? ডাক্তার বলতে দিল না। বাবা আমার হাতটা একটু ধরল। কিছু বলল না? একটু হাসল। এখন আমরা কী করব? ডাক্তারবাবু বলল, ভয় নেই। আপনারা বাড়ি চলে যান। অনেকগুলো টেস্ট করা হচ্ছে। কাল-পরশুর মধ্যেই অবস্থাটা বোঝা যাবে। হয়তো সিরিয়াস কিছু নয়। বলল? হ্যাঁ তো। ঠিক শুনেছিস? হ্যাঁ মা। চলো আমরা বাড়ি যাই। ঝুমকিদের বাড়িতে নয়, চারুশীলা তাদের নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। বলল, তোমাদের তো আজ রান্নাই হয়নি, বাড়ি গিয়ে রোধে খেতে হবে। আমার বাড়িতে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা আছে, চলো। বিপর্যন্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত একটি পরিবার জড়ো হল চারুশীলার বাড়িতে। আজ কারও মন ভাল নেই। হেমাঙ্গ চুপ করে ওদের পাশাপাশি বসে রইল সোফায়। একজোড়া চোখ তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার চোখও ছয়ে আসছে। ওকে। মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছে চোখে চোখ। হেমাঙ্গর ভিতরে একটা জ্বালা। ওই ডাক্তারকে সে ভুলতে পারছে না। তিন দিন বাদে ছাড়া পেল মণীশ। জানা গেছে তার হার্টে কিছু হয়নি, পেটে গ্যাস জমে চাপ ধরেছিল বুকে। আপাতত ভয় নেই। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে বিষ্ণুপদ বলে দিয়েছিল, পূর্বপুরুষের ভিটোটা একটু দেখে আসিস বাবা। আমার তো আর যাওয়া হবে না। তুই দেখে এলেই আমারও এক রকম দেখাই হবে। ঢাকায় নেমে নানা কনফারেন্সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কৃষ্ণজীবন। তারপর একদিন বাংলাদেশেরই একটি অমায়িক ছেলে আনোয়ার তাকে একখানা টিয়োটা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল তার গায়ে। যেতে যেতে বলল, কিছু চিনতে পারবেন না। সব পাল্টে গেছে। কৃষ্ণজীবন হেসে বলল, চিনিব কি? আমার তো কিছু মনেই নেই। দুবার ফেরী পেরিয়ে বেশ একটু ধকলের পর যখন গায়ে পৌঁছালো কৃষ্ণজীবন তখন দুপুর। সেই খাড়া শারদীয় রোদে সে দেখল, কিছু আহামারি গ্রাম নয়। একটু ছন্নছাড়া। ক্ষেতে ফসল আছে। গাছপালা বিশেষ রকমের সতেজ। আনোয়ার দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করে একটা বাড়ি খুঁজে বের করল। বলল, দাদা, এইটেই আপনাদের বাড়ি ছিল। কৃষ্ণজীবন নির্বিকার চোখে চারখানা টিনের ঘর আর একটা কোঠাবাড়ি আর উঠোন সমেত বাড়িটা নিরীক্ষণ করল। এই তাদের বাড়ি। এ বাড়ির স্মৃতিমেদুর মায়ায় বিষ্টুপুরে এক বৃদ্ধ নৃত্যুজ হয়ে বসে থাকে আজও। কৃষ্ণজীবন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। সামনে আনোয়ার। খবর পেয়ে বাড়ির মালিক বেরিয়ে এল। মধ্যবয়স্ক একজন রোগা মানুষ। আসেন, আসেন। বলে নিয়ে গেল ভিতরে। কোঠাবাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। বসাল। দেখতে আসছেন? দেখেন, ভাল করে দেখেন। কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, এ বাড়ি কি হাতবদল হয়েছে, নাকি আপনারাই প্রথম থেকে আছেন? বিশ্বাসবাবুদের কাছ থেকে আমার আব্ববাজান কিনেছিলেন। তারপর থেকে আমরাই আছি। এই কোঠাবাড়িটা ছিল না, আর ওই পশ্চিমের ঘরটা
false
shunil_gongopaddhay
থেমে যায়। তাতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, এর পর কী করব! চতুর্থ বাসটার দরজার কাছে আসতেই টিক টিক শব্দটা খুব জোর হয়ে গেল। তারপর যা হল। তুই হয়তো শুনলে বিশ্বাস করবি না, কিন্তু একেবারে খাঁটি সত্যি কথা। বাসে তিন-চারজন লোক মোটে বসে ছিল। আমি উঠতেই কোণ থেকে একজন লোক হাউমাউ করে বলে উঠল, আমি ঘড়ি দিয়ে দিচ্ছি, সব দিয়ে দিচ্ছি, আমাকে দয়া করে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন না! সন্তু অম্লান মুখে বলল, বিশ্বাস করব না কেন? পুরোটা বিশ্বাস করেছি। কাকাবাবু বললেন, সেই জাদুকম্পাস থাকলে তো সব ঝামেলাই মিটে যেত বুঝতে পারছি। সেটা যখন নেই, তখন এ চোরদের ধরার কোনও উপায় তোমরা বলতে পারো? আমার বুদ্ধিতে কুলোবে না বুঝতে পারছি! সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি চোরদের বলছ কেন? একটা চোরও তো হতে পারে? কাকাবাবু বললেন, এই ধরনের চুরির পেছনে সাধারণত একটা দল থাকে। তা ছাড়া, ওই পাথরটা আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি, একজন লোকের পক্ষে ওটা বয়ে আনা সম্ভব নয়। জোজো ফস করে জিজ্ঞেস করল, দুপুরে আমরা কী খাব? সন্তু ভুরু তুলে বলল, হঠাৎ খাবার কথা? এর মধ্যে তোর খিদে পেয়ে গেল? জোজো বলল, খিদে পাবে না? দুপুর আড়াইটে বাজে। না খেয়েদেয়ে আমরা চোরের পেছনে ছুটতে যাব কেন? কাকাবাবু বললেন, তা অবশ্য ঠিক। এখানে অপেক্ষা করেও কোনও লাভ নেই। সন্ধেবেলা পুরুত দুজন জেগে উঠলে ওদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। জোজো বলল, তার মধ্যে নরেন্দ্র ভার্মা এসে পড়বেন। তাঁকে বুঝিয়ে বলুন। চোর ধরার মতন সামান্য কাজ আপনাকে মানাবে না। কাকাবাবু বললেন, চলো, বাংলোতে ফেরা যাক। ফেরার পথে অন্য একটা সেতুর কাছে এসে গাড়িটা থেমে গেল। এই সেতুটা পুরনো। একসঙ্গে দুদিকের গাড়ি যেতে পারে না। দুদিকে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে, তারা এক-একবার এক একদিকের গাড়ি ছাড়ে। উলটোদিক থেকে একটা গাড়ি আসছে, তাতে ড্রাইভার ছাড়া আর কোনও লোক নেই। ড্রাইভারটির দিকে তাকিয়ে কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি সন্তদের জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এই লোকটিকে চিনিস? এখানকার স্থানীয় লোকদের মতন লোকটির মাথায় সাদা রঙের মস্ত পাগড়ি। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, ডান হাতে একটা লোহার বালা। সন্তু বলল, না, একে কখনও দেখেছি বলে তো মনে হয় না! কাকাবাবু বললেন, আমার যেন মনে হচ্ছে, কোথাও একে দেখেছি আগে। জোজো বলল, মনে হচ্ছে, মোহন সিং-এর কোনও চ্যালা। কালিকটে যখন আমাদের আটকে রেখেছিল, তখন এই লোকটাই খাবার দিতে আসত না? সন্তু বলল, যাঃ, সে-লোকটার তো মাথায় টাক ছিল। মুখে দাড়ি-গোঁফও ছিল না। জোজো বলল, এক বছরে দাড়ি-গোঁফ গজানো যায়। টাকও ঢাকা যায় পরচুলা দিয়ে। সন্তু বলল, এক বছরে কি বেঁটে মানুষকে লম্বা করা যায়? সেই লোকটা ডেফিনিটলি এর চেয়ে বেঁটে ছিল। জোজো বলল, হ্যাঁ, লম্বা হওয়াও যায়। আমার বাবার কাছে তিব্বতি ওষুধ আছে। তিব্বতের লোকরা সবাই কীরকম লম্বা হয় দেখিসনি? বাবা সেই ওষুধ অবশ্য যাকে তাকে দেন না। সন্তু বলল, তা হলে তুই সেই ওষুধ খেয়ে লম্বা হচ্ছিস না কেন? জোজো বলল, আমার একুশ বছর বয়েস হোক, দেখবি আমি তোর চেয়ে অন্তত ছ সেন্টিমিটার বেশি লম্বা হয়ে গেছি। কাকাবাবু চিন্তিত মুখে বসে রইলেন চুপ করে। বাংলোতে এখন আর কোনও পুলিশ নেই। একজন চৌকিদারকে দেখে জোজো চেঁচিয়ে বলল, খানা দিজিয়ে জলদি! বহুৎ ভুখ লাগ গিয়া। কাকাবাবু বললেন, আমি স্নানটা সেরে আসি চট করে। তোমরা স্নান করবে না? দুটো বাথরুম আছে। জোজো বলল, আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘলা দিনে স্নান করলে আমার গলায় ব্যথা হয়। কাকাবাবু বললেন, গরম জল তো পেতে পারো। জোজো বলল, গরম জলে স্নান করতে হয় ভোরবেলা। দুপুরবেলা আমার ঠিক সহ্য হয় না। কাকাবাবু স্নান সেরে এসে দেখলেন, সন্তুর তখনও হয়নি, জোজো একলাই খাবার টেবিলে বসে আছে। টেবিলে তিনটে প্লেট ও জলের গেলাস সাজানো, খাবার তখনও দেয়নি। শুধু একটা প্লেট-ভর্তি স্যালাড। জোজো তার থেকেই পেঁয়াজ আর শসা খেতে শুরু করেছে। বেচারির খুবই খিদে পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। একজন পরিচারক এসে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সার, আপনারা কি ঝিঙে-পোস্ত খান? আপনাদের জন্য রান্না করেছি। ঝিঙে এখানে সহজে পাওয়া যায় না। লোকটির মুখে বাংলা কথা শুনে কাকাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাঙালি নাকি? লোকটি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ সার, আমার নাম নৃপেন হালদার। কাকাবাবু বললেন, আপনার বাড়ি এখানেই? নৃপেন বলল, না সার, আমার বাড়ি হুগলি জেলায়। চাকরিবাকরি পাইনি, তাই ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। আমি এই বাংলোর ইনচার্জ, রান্নাও করি। কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বাঙালির ছেলে এতদূরে এসে চাকরি করছেন, এ তো বেশ ভাল কথা। তা এখানে আপনার ভাল লাগছে তো? নৃপেন বলল, এমনিতে তো সবই ভাল। লোজনেরাও ভাল, তবে কী জানেন সার। দিনের পর দিন বাংলায় কথা না বলতে পারলে বুকটা যেন শুকিয়ে যায়! কাকাবাবু বললেন, এখানে আর বাঙালি নেই বুঝি? নৃপেন বলল, শুনেছি, আছে আরও পাঁচ-ছ জন। দেখা তো হয় না। এখানকার কমিশনার সাহেবই তো বাঙালি, মিস্টার সুদৃপ্ত রায়, মস্ত বড় অফিসার, তিনি অবশ্য এখন এখানে নেই, দিল্লিতে কী কাজে গেছেন শুনেছি। জোজো অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা ঝিঙে-পোস্ত খাই, সব খাই। ভাত-রুটি কী আছে আগে আনুন তো! নৃপেন টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে দিল। অনেকরকম খাবার। ভাত-রুটি, ডাল, ঝিঙে-পোস্ত, মাছভাজা, মুরগির ঝোল। সন্তু এর
false