label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shunil_gongopaddhay
পাগলা ছাগলা মনিষ্যি, আমি কী গান জানি! গান শোনবেন তো বেগুনবেড়েতে ঝান না ক্যান! অপরকে প্ৰসন্ন করার জন্য মানুষ যেমন কণ্ঠস্বরে একটা কৃত্ৰিম অতিরিক্ত মিষ্টতা আনে, সেইভাবে গঙ্গানারায়ণ বললো, তুমি পাগল কেন হবে? বেশ তো গান গাইচিলে। তোরাপ বললো, হ, পাগল হইছি, নীলির ঘায়ে পাগল হইছি। তারপর সে সম্পূর্ণ ফিরে বললো, আগে জমিদারে মারছে, অহন মারে নীলির সাহেব। আমাগো ঝা জেবন, তায়ের আর বাচা আর মরা। পাগল হওনই সবঝে ভালো, খাই না খাই বগোল বাজাই। গান শোনবেন কইলেন, শোনেন তয়– ঘর ভাঙ্গিলে জমিদারে জাত মাল্লে পাদরি ধরে ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে। গঙ্গানারায়ণের মুখে একটু অপ্ৰস্তুত ভাব ফুটে উঠলো। সে যে জমিদার বংশের সন্তান একথা কেউ তাকে ভুলতে দেবে না। সে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো, জমিদার তোমার ঘর ভেঙেছেল? কবে? তোরাপ এবার হা হা করে হেসে বললো, আমার তো ঘরই নাই, তা ভাঙবে কী? এ গানডা রচেছে আমার নানা বচোরদ্দি শ্যাখ। মোর ছ্যালো মোটে পাঁচ বিঘা জমি, তাও সাহেবরা নীলির জন্য দেগে দিয়েলো। হাল গরু ব্যাচে দেয়েছি, চাষই করমু না, তাও সুমুন্দির পো-র ছাড়ে না। এবার গঙ্গানারায়ণ উৎসাহের সঙ্গে বললো, শোনো, তোরাপ, তোমার জমিতে যদি তুমি নীল রুইতে না চাও, ধান রুইতে চাও, আমি তোমায় সাহায্য করবো। কিন্তু এ আলোচনা আর বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলো না। গ্রামে একটা হই হই রব উঠলো। দাবানলের তাড়া খাওয়া জন্তুজানোয়ারদের মতন উদভ্ৰান্ত ভাবে ছুটতে লাগলো মেয়ে-পুরুষ-শিশুরা। কুঠিয়াল সাহেবরা দলবল নিয়ে আসছে, সব জমি নীল চাষের জন্য দাগিয়ে দেবে। এবারে নাকি সাহেবরা এক ছটাক জমিও ছাড়বে না। এমনকি পাগল তোরাপও বুঝলো যে এই সময় গঙ্গানারায়ণ সাহেবদের নজরে পড়লে বিপদ ঘটবে। সে বললো, ও বাবু, যদি পরানে বাচতি চাও তো হুই পগারের পানে দৌড়ি পলাও! তুমি ভদ্দরনোক, তোমারে আগে বান্‌ধবে! গঙ্গানারায়ণ তবু দাঁড়িয়ে রইলো। সে পালাবে কেন? ব্রিটিশ রাজত্বে মহারানীর সমস্ত প্ৰজারই সমান অধিকার। লোভে উন্মত্ত কিছু ব্যবসায়ী যদি আইন ভাঙতে চায়, তা হলে তাদের শাস্তিরও ব্যবস্থা আছে। এরা রুল অব ল মানতে বাধ্য। যেমন প্রথা, সেই মত তিনজন সাহেব অশ্বপুষ্ঠে এবং তাদের দেওয়ান-গোমস্তা ও লাঠিয়ালের দলবল পিছন পিছন দৌড়ে দৌড়ে আসছে। অশ্বত্থ গাছের তলায় দণ্ডায়মান গঙ্গানারায়ণকে তারা দেখতেও পেল না, সোজা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। গঙ্গানারায়ণ দেখলো, তার পাশ থেকে তোরাপ যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সাহেবরা সব কাজই অতি দ্রুত সারে। তাদের দলটি অবিলম্বেই বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন দিকে। একটু পরেই গঙ্গানারায়ণ শুনতে পেল কান্নার রোল। খুব বেশী দূরে নয়। সামনের আম বাগানটির ওপার থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। গঙ্গানারায়ণ আর থাকতে পারলো না, এগিয়ে গেল সেদিকে। সেখানে একজন সাহেব, একজন আমীন ও তিনজন লাঠিয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন চাষী সাহেবের জানু ধরে কেঁদে কেঁদে বলছে, ও সাহেব, এ জমিডা ছেড়ে দেও, এড মোগো পুকুর ধাইর্যা জমি, গেরামের মাইয়া মানষেরা এহানে গোছল করতে আসে, ও সাহেব! সাহেব বারবার লাথি দিয়ে লোকটিকে ফেলে দিচ্ছে, সে আবার উঠে আসছে মিনতি জানাতে। গঙ্গানারায়ণ হন হন করে এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, স্টপ দিস! লিসন, ড়ু ইউ নো দি রিসেন্ট পরোয়ানা অব দি গবরমেণ্ট? কুঠিয়াল ম্যাকগ্রেগর বেশ কয়েক বৎসর এই অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তার বাংলা ভাষায় যথেষ্ট বুৎপত্তি হয়েছে। গঙ্গানারায়ণের ইংরেজীর উত্তরে সে বললো, এ বাঞ্চৎ কোন আছে? গঙ্গানারায়ণ মুখ তুলে ভালো করে দেখলো সাহেবটিকে। স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে ক্রমশ মুখখানি স্পষ্ট হলো। এই সেই ম্যাকগ্রেগর। এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই গঙ্গানারায়ণ চুড়ান্ত অপমানিত হয়েছিল। কোনো উত্তরই দিতে পারেনি সেদিন। হঠাৎ রক্ত উঠে এলো তার মাথায়। কয়েকজন চাষী চিৎকার করে উত্তর দিল, সাহেব, ইনি আমাগো জমিদার! ম্যাকগ্রেগর হেসে বললো, এ না-লায়েক বেটা কোন জমিন্দার! শ্যামচাঁদ খেলেই জমিন্দার ভাগবে! দেকো, তুমলোগ সব দেকো। হাতের চাবুকটি শূন্যে ঘুরিয়ে ম্যাকগ্রেগর সজোরে এক ঘা কষালে গঙ্গানারায়ণের শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের পিঠ দিয়ে রক্ত ফুটে বেরিয়ে এলো। সে তবু অবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মেঘমন্দ্র স্বরে বললো, নতুন আইন হয়েচে, তোমরা জানো না, এই অত্যাচারের জন্য তোমায় গারদে পাঠাবো। এই আমি এখেনে সকলের সামনে শপথ নিলুম। তুমি এই চাষীর জমিতে ট্রেসপাস করেচো– ম্যাকগ্রেগর বললো, বজ্জাত, নিগার। তুই আমায় আইন ডেখাইটে চাস? এই ড্যাখ তবে আমার আইন। ম্যাকগ্রেগর আবার চাবুক কষাতেই গঙ্গানারায়ণ সেটা ধরে ফেললো। অতিরিক্ত মদ্যপ ও ভোগী ম্যাকগ্রেগরের চেয়ে সে অনেক বেশি শক্তিমান পুরুষ। হ্যাঁচকা টান দিয়ে চাবুকটা কেড়ে নেবার পর সে আর ক্ৰোধ দমন করতে পারলো না। পর পর কয়েক ঘা চাবুক সজোরে মেরে সে প্রতিদান দিল ম্যাকগ্রেগরকে। ম্যাকগ্রেগর পড়ে গেল ঘোড়া থেকে। তারপর একটি ছোটখাটো বিদ্রোহের ব্যাপারই ঘটে গেল সেখানে। লাঠিয়ালরা এগিয়ে আসতেই অনেক চাষী একত্রে গর্জন করে উঠলো, খবর্দার, ওনার গায়ে কেউ হাত লোগাবি না। একজন অত্যাচারী সহেবকে ভূপাতিত হতে দেখে তাদের আনন্দ ও সাহস যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। কোথা থেকে একটা প্ৰকাণ্ড লাঠি নিয়ে এসে পড়লো তোরাপ। সকলে মিলে লাঠিয়াল তিনজনকে ঘায়েল করে ফেলল এবং অন্য সাহেবদের কাছ থেকে সাহায্য আসার আগেই ওরা গঙ্গানারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে দূরে পালিয়ে গেল। সেইদিন মধ্যরাত্রে গ্রামের কয়েক স্থানে লক লক করে উঠলো অগ্নির লেলিহান শিখা। সবচেয়ে প্রথমে ভস্মসাৎ হলো জমিদার সিংহবাবুদের কুঠিবাড়িটি। বিরাহিমপুর
false
bongkim
কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত না হয়, ততদিন তাহাকে গ্রহণ করিও না। তোমাদিগের হাতের কাজ সমাপ্ত হইলে তোমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উহার অনুসরণ করিও, সময় দেখিলে উহাকে শ্রীবিষ্ণুমণ্ডপে উপস্থিত করিও। আর সময়ে হউক, অসময়ে হউক, উহাদিগের প্রাণরক্ষা করিও। কেন না, যেমন দুষ্টের শাসন সন্তানের ধর্ম, শিষ্টের রক্ষাও সেইরূপ ধর্ম |” দ্বাদশ পরিচ্ছেদ অনেক দু:খের পর মহেন্দ্র আর কল্যাণীতে সাক্ষাৎ হইল। কল্যাণী কাঁদিয়া লুটাইয়া পড়িল। মহেন্দ্র আরও কাঁদিল। কাঁদাকাটার পর চোখ মুছার ধুম পড়িয়া গেল। যত বার চোখ মুছা যায়, ততবার আবার জল পড়ে। জলপড়া বন্ধ করিবার জন্য কল্যাণী খবার কথা পাড়িল। ব্রহ্মচারীর অনুচর যে খাবার রাখিয়া গিয়াছে, কল্যাণী মহেন্দ্রকে তাহা খাইতে বলিল। দুর্ভিক্ষের দিন অন্ন-ব্যঞ্জন পাইবার কোন সম্ভাবনা নাই, কিন্তু দেশে যাহা আছে, সন্তানের কাছে তাহা সুলভ। সেই কানন সাধারণ মনুষ্যের অগম্য। যেখানে যে গাছে, যে ফল হয়, উপবাসী মনুষ্যগণ তাহা পাড়িয়া খায়। কিন্তু এই অগম্য অরণ্যের গাছের ফল আর কেহ পায় না। এই জন্য ব্রহ্মচারীর অনুচর বহুতর বন্য ফল ও কিছু দুগ্ধ আনিয়া রাখিয়া যাইতে পারিয়াছিল। সন্ন্যাসী ঠাকুরদের সম্পত্তির মধ্যে কতকগুলি গাই ছিল। কল্যাণীর অনুরোধে মহেন্দ্র প্রথমে কিছু ভোজন করিলেন। তাহার পর ভুক্তাবশেষ কল্যাণী বিরলে বসিয়া কিছু খাইল। দুগ্ধ কন্যাকে কিছু খাওয়াইল, কিছু সঞ্চিত করিয়া রাখিল আবার খাওয়াইবে। তার পর নিদ্রায় উভয়ে পীড়িত হইলে, উভয়ে শ্রম দূর করিলেন। পরে নিদ্রাভঙ্গের পর উভয়ে আলোচনা করিতে লাগিলেন, এখন কোথায় যাই। কল্যাণী বলিল, “বাড়ীতে বিপদ বিবেচনা করিয়া গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, বাড়ীর অপেক্ষা বাহিরে বিপদ অধিক। তবে চল, বাড়ীতেই ফিরিয়া যাই |” মহেন্দ্ররও তাহা অভিপ্রেত। মহেন্দ্রর ইচ্ছা, কল্যাণীকে গৃহে রাখিয়া, কোন প্রকারে এক জন অভিভাবক নিযুক্ত করিয়া দিয়া, এই পরম রমণীয় অপার্থিব পবিত্রতাযুক্ত মাতৃসেবাব্রত গ্রহণ করেন। অতএব তিনি সহজেই সম্মত হইলেন। তখন দুই জন গতক্লম হইয়া, কন্যা কোলে তুলিয়া পদচিহ্নাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কিন্তু পদচিহ্নে কোন্ পথে যাইতে হইবে, সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যানীমধ্যে কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তাঁহারা বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, বন হইতে বাহির হইতে পারিলেই পথ পাইবেন। কিন্তু বন হইতে ত বাহির হইবার পথ পাওয়া যায় না। অনেক্ষণ বনের ভিতর ঘুরিতে লাগিলেন, ঘুরিয়া ঘুরিয়া সেই মঠেই ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন, নির্গমের পথ পাওয়া যায় না। সম্মুখে এক জন বৈষ্ণববেশধারী অপরিচিত ব্রহ্মচারী দাঁড়াইয়া হাসিতেছিল। দেখিয়া মহেন্দ্র রুষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “গোঁসাই, হাস কেন?” গোঁসাই বলিল, “তোমরা এ বনে প্রবেশ করিলে কি প্রকারে?” ম। যে প্রকারে হউক, প্রবেশ করিয়াছি। গোঁসাই। প্রবেশ করিয়াছ ত বাহির হইতে পারিতেছ না কেন? এই বলিয়া বৈষ্ণব আবার হাসিতে লাগিল। রুষ্ট হইয়া মহেন্দ্র বলিলেন, “তুমি হাসিতেছ, তুমি বাহির হইতে পার?” বৈষ্ণব বলিল, “আমার সঙ্গে আইস, আমি পথ দেখাইয়া দিতেছি। তোমরা অবশ্য কোন সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীর সঙ্গে প্রবেশ করিয়া থাকিবে। নচেৎ এ মঠে আসিবার বা বাহির হইবার পথ আর কেহই জানে না |” শুনিয়া মহেন্দ্র বলিলেন, “আপনি সন্তান?” বৈষ্ণব বলিল, হাঁ, আমিও সন্তান, আমার সঙ্গে আইস। তোমাকে পথ দেখাইয়া দিবার জন্যই আমি এখানে দাঁড়াইয়া আছি |” মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার নাম কি?” বৈষ্ণব বলিল, “আমার নাম ধীরানন্দ গোস্বামী |” এই বলিয়া ধীরানন্দ অগ্রে অগ্রে চলিল; মহেন্দ্র, কল্যাণী পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। ধীরানন্দ অতি দুর্গম পথ দিয়া তাঁহাদিগকে বাহির করিয়া দিয়া, একা বনমধ্যে পুন:প্রবেশ করিল। ম। কি করিব, তাহাই ভাবি – স্বপ্ন কেবল বিভীষিকামাত্র, আপনার মনে জন্মিয়া আপনি লয় পায়, জীবনের জলবিম্ব – চল গৃহে যাই। ক। যেখানে দেবতা তোমাকে যাইতে বলেন, তুমি সেইখানে যাও – এই বলিয়া কল্যাণী কন্যাকে স্বামীর কোলে দিলেন। মহেন্দ্র কন্যা কোলে লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর তুমি – তুমি কোথায় যাইবে?” কল্যাণী দুই হাতে দুই চোখ ঢাকিয়া মাথা টিপিয়া ধরিয়া বলিলনে, “আমাকেও দেবতা যেখানে যাইতে বলিয়াছেন, আমিও সেইখানে যাইব |” মহেন্দ্র চমকিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “সে কোথা, কি প্রকারে যাইবে?” কল্যাণী বিষের কৌটা দেখাইলেন। মহেন্দ্র বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “সে কি? বিষ খাইবে?” “খাইব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু—” কল্যাণী নীরব হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। মহেন্দ্র তাঁহার মুখ চাহিয়া রহিলেন। প্রতি পলকে বৎসর বোধ হইতে লাগিল। কল্যাণী আর কথা শেষ করিলেন না দেখিয়া মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু বলিয়া কি বলিতেছিলে?” ক। খাইব মনে করিয়াছিলাম – কিন্তু তোমাকে রাখিয়া – সুকুমারীকে রাখিয়া বৈকুণ্ঠেও আমার যাইতে ইচ্ছা করে না। আমি মরিব না। এই কথা বলিয়া কল্যাণী বিষের কৌটা মাটিতে রাখিলেন। তখন দুই জনে ভূত ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কথোপকথন করিতে লাগিলেন। কথায় কথায় উভয়েই অন্যমনষ্ক হইলেন। এই অবকাশে মেয়েটি খেলা করিতে করিতে বিষের কৌটা তুলিয়া লইল। কেহই তাহা দেখিলেন না। সুকুমারী মনে করিল, এটি বেশ খেলিবার জিনিস। কৌটাটি একবার বাঁ হাতে ধরিয়া দাহিন হাতে বেশ করিয়া তাহাকে চাপড়াইল। তার পর দুই হাতে ধরিয়া টানাটানি করিল। সুতরাং কৌটাটি খুলিয়া গেল–বড়িটি পড়িয়া গেল। বাপের কাপড়ের উপর ছোট গুলিটি পড়িয়া গেল – সুকুমারী তাহা দেখিল, মনে করিল, এও আর একটা খেলিবার জিনিস। কৌটা ফেলিয়া দিয়া থাবা মারিয়া বড়িটি তুলিয়া লইল। কৌটাটি সুকুমারী কেন গালে দেয় নাই বলিতে পারি না – কিন্তু বড়িটি সম্বন্ধে কালবিলম্ব হইল না। প্রাপ্তিমাত্রেণ ভোক্তব্য – সুকুমারী বড়িটি মুখে পুরিল। সেই সময় তাহার উপর মার নজরে পড়িল। “কি খাইল! কি খাইল! সর্বনাশ!” কল্যাণী ইহা বলিয়া, কন্যার মুখের ভিতর আঙ্গুল পুরিলেন। তখন
false
humayun_ahmed
হয়েছে। তাকে এবং তার বান্ধবীকে গুলি করে হত্যার পর পায়ে দড়ি বেঁধে লরেটা স্কয়ারে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে ইটালির মানুষ এদের গায়ে থুথু দিতে পারে। * ————- * অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি– ১৯৩০ সনের দিকে ইউরোপ ভ্রমণের সময় বেনিতো মুসোলিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা হয়। মুসোলিনীর লেখা উপন্যাস ‘দ্য কার্ডিনালস মিসট্রেস’ (ইংরেজি অনুবাদ) পড়েও খুশি হন। মুসোলিনীর আতিথেয়তা এবং ভদ্রতায় রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হন। মুসোলিনী বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সাহায্যও করেন। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেন, মুসোলিনী একজন অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক এবং আঁর অতি পছন্দের। বড় মানুষদের ভুলগুলিও সাধারণত বড় হয়ে থাকে। ১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস। রুশ সৈন্যরা এগিয়ে আসছে বার্লিনের দিকে। তাদের দলপতি মার্শাল জর্জি ঝুকভ’। তার প্রধান দুই সহকারীর একজন জেনারেল আইভান কোনোভ। অন্যজন জেনারেল ভাসিল চুইকভ। তাদের সৈন্যসংখ্যা ২৫ লাখ। ট্রাকের ওপর বসানো কাতুশা রকেটের সংখ্যা ৩ হাজার ২৫৫, ট্যাংকের ংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। দূরপাল্লার কামান আছে ৪১ হাজার। বুকভের বাহিনীকে সাহায্যকারী বিমানের সংখ্যা ৭ হাজার। চলে এসেছে বার্লিনের কাছাকাছি। এরা যে-কোনো সময় বার্লিনে ঢুকে পড়বে। তাদের দূরপাল্লার কামানের আওয়াজ বার্লিনবাসী সারাক্ষণ শুনছে। হিটলার নিজেও শুনছেন। তিনি সেই শব্দ শুনতে শুনতে বললেন, যে-কোনো মূল্যে বার্লিন রক্ষা করতে হবে। রুশরা বার্লিনে ঢুকে পড়লে একদিক দিয়ে ভালো হবে, ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা এটা পছন্দ করবে না। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করবে। রাজধানীর কমান্ডান্ট মেজর জেনারেল হেলমুট রোম্যান। তিনি হিটলারের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছিলেন। হিটলার বললেন, আমার বিমানবাহিনী কোথায়? হেলমুট বললেন, বিমান আকাশে উড়তে পারছে না। জ্বালানি নেই। হিটলার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, জ্বালানি নেই কেন? জেনারেল গথার্ড হেইনরিচকে টেলিফোনে ধর। সে বলুক বিমানবাহিনীর জন্যে জ্বালানি কেন নেই। জেনারেল হেইনরিচকে টেলিফোনে ধরা গেল না। জেনারেল উইলহেম। মোনবিককে পাওয়া গেল। জেনারেল মোনকি বললেন, আপনি যাতে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে পারেন তার জন্যে আমি বিশেষ ব্যবস্থায় দুটি বিমান প্ৰস্তুত রেখেছি। হতভম্ব হিটলার বললেন, আমি পালিয়ে যাব? জার্মান জাতিকে রক্ষার জন্যে আপনার বেঁচে থাকা জরুরি। হিটলার কঠিন গলায় বললেন, আমাকে পালিয়ে যেতে হবে? আমাকে রক্ষা করার জন্যে অমর জেনারেলরা কোথায়? জেনারেলের বক্তব্য শোনা গেল না, কারণ কাতুশা রকেট, যার আরেক নাম স্টালিন অরগান্স, বৃষ্টির মতো বার্লিনে আসতে শুরু করেছে। ২০ এপ্রিল হিটলারের জন্মদিন। হিটলার তাঁর বান্ধবীকে পাশে নিয়ে বাঙ্কারে বসে ছিলেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল আলফ্রেড জোডল। তিনি শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, জার্মান জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমাণ করবে। অবশ্যই আমরা বার্লিন রক্ষা করব। হিটলার শ্যাস্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিয়মমাফিক গ্লাস ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, আজ কি অন্যদিনের চেয়ে বেশি গোলাবর্ষণ হচ্ছে? ইভা ব্ৰাউন বললেন, যুদ্ধের আলাপ কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ থাকুক। আসুন আমরা আনন্দময় কোনোকিছু নিয়ে আলাপ করি। কেউ কোনো জবাব দিল না। হিটলার ইভা ব্ৰাউনের দিকে সামান্য ঝুকে এসে বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করব। ইভা ব্ৰাউন বললেন, হঠাৎ বিয়ের কথা আসছে কেন? হিটলার বললেন, আমার ধারণা আমরা পরাজিত হতে যাচ্ছি। যদি সত্যি তাই ঘটে আমি আত্মসমৰ্পণ করব না। নিজেকে হত্যা করব। আমার মৃত্যুর পর ইতিহাসে লেখা হবে। আমার একজন রক্ষিতা ছিল, তা আমি চাই না। হিটলার দ্বিতীয় দফায় শ্যাস্পেন নিলেন। টোস্ট করলেন তার বান্ধবীর সঙ্গে। নরম গলায় বললেন, আমার সুখ এবং দুঃখের চিরসঙ্গী ইভা ব্ৰাউন। হিটলার এবং ইভা ব্ৰাউন মাটির অনেক গভীরে বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের বান্ধবপুরের একজন (হাদিস উদ্দিন) বাঙ্কারের মতোই একটি জায়গায় বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে। হরিচরণের মাটির নিচের গুপ্তঘর। যে ঘরে যাবার একটাই পথ, সিন্দুকের ভেতর দিয়ে। হাদিস উদ্দিনের গুপ্তঘরে সময় কাটানোর পেছনে কারণ আছে। সে নানান জিনিসপত্র গুপ্তঘরে রাখছে। এর মধ্যে রেশমি রুমালে মোড়া একান্নটা স্বর্ণমুদ্রাও আছে। হাদিস উদ্দিন যতবারই গুপ্তঘরে যায় স্বর্ণমুদ্রা গুনে দেখে। দুভাবে গুনে। প্রথমে এক থেকে একান্ন, তারপর শুরু হয় উল্টোদিকে গুনা। ৫১-৫০-৪৯-৪৮… গুপ্তঘর সে ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। সেখানে পাটি বিছানো আছে। বালিশ আছে। কলসিভর্তি পানি আছে। মোমবাতি, দেয়াশলাই আছে। একটা টর্চাও আছে। হাদিস উদ্দিন পাটিতে শুয়ে গুনগুন করে মাঝে মধ্যে গান গায়। গান তার নিজের রচনা। সুরও তার নিজের। বদ্ধঘরের কারণে গানের শব্দ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে। হাদিস উদ্দিনের বড় ভালো লাগে। ভরদুপুর। গুপ্তঘর অন্ধকার। পাটিতে শুয়ে হাদিস উদ্দিন নিচুগলায় গান করছে– ও আমার সোনার মোহররে মোহররে মোহররে মোহররে তোর মনে দুঃখ? দুঃখ? দুঃখ? আমার মনে সুখ। ও আমার সোনার মোহররে মোহররে মোহররে মোহররে… অনেকবার করে ফিরে আসছে। হাদিস উদ্দিনের মনে হচ্ছে ‘ঘরভর্তি মানুষ একসঙ্গে ‘মোহররে’ বলে গান করছে। এই সময় হঠাৎ করে বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দের মতো শব্দ হলো। রিনারিনে গলায় কে যেন হাসল। হাদিস উদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘর অন্ধকার, তবে সিন্দুকের খোলা ডালা দিয়ে কিছু আলো আসছে। গুপ্তঘরের ভেতরটা আবছা! আবছা চোখে আসে। হাদিস উদ্দিনের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা সে কী দেখছে? ঘরের এক কোণে দেয়ালের দিকে মুখ করে দশ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে বসে আছে। নিজের মনে খেলছে। এমন কি হতে পারে কোনো বিচিত্র উপায়ে মীরা নেমে এসেছে? না, তা কখনোই না। মেয়েটা মীরার চেয়ে অনেক বড়। হদিস উদ্দিন বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহপাক রক্ষা কর।
false
shunil_gongopaddhay
হলেও বোধ হয় পুলিশ ওকে ছাড়বে না! আমতা-আমতা করে সন্তু বলল, কাকাবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, কী রে, তোর কী হয়েছে? কী জিজ্ঞেস করবি? তার জন্য ঘাড় চুলকোচ্ছিস কেন? সন্তু বলল, আমার বন্ধু জোজোকে তো তুমি চেনো? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, চিনব না কেন? সেই যে আমাদের সঙ্গে একবার মধ্যপ্রদেশে গেল, যেবারে আদিবাসীদের গ্রাম থেকে আমরা একটা অপূর্ব সুন্দর নীল মূর্তি উদ্ধার করলাম! জোজো কাল আমাদের একটা চাঁদের পাথর দেখিয়েছে! তাই নাকি? কী করে বুঝলি সেটা চাঁদের পাথর? জোজো বলল, ওটা নীল আর্মস্ট্রং নিজে ওকে দিয়েছেন। কাকাবাবু হা-হা করে খুব জোরে হেসে উঠলেন। দু-তিনবার নীল আর্মস্ট্রং-এর নাম উচ্চারণ করে বললেন, নীল আর্মস্ট্রং যাকে তাকে চাঁদের পাথর বিলি করে বেড়ায়, এমন তো শুনিনি! আমি সেবারেই লক্ষ করেছি, তোর ওই বন্ধুটির কল্পনাশক্তি খুব প্রবল! জোজো তা হলে মিথ্যে কথা বলেছে? উচ্চ কল্পনাশক্তি আর মিথ্যে কথা ঠিক এক নয়। মিথ্যে অনেক রকম। পয়লা এপ্রিল কেউ যদি এপ্রিল ফুল করার জন্য কিছু বলে, তাকে ঠিক মিথ্যে বলা যায় না। অনেকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। যাকে আমরা বলতুম গুল মারা। তোরাও কি তাই বলিস? হ্যাঁ। গুলবাজরা খুব মজার নোক হয়, সাধারণ মিথ্যুকদের সঙ্গে তাদের তফাত আছে। মিউজিয়াম থেকে কাল সকালে চাঁদের পাথরটা চুরি গেছে। আর দুপুরবেলা জোজো আমাদের চাঁদের পাথর বলে একটা পাথর দেখাল। এটা জানতে পারলে পুলিশ ওকে সন্দেহ করবে না? তা করতে পারে অবশ্য। পুলিশ তো আর আসল চোরকে সহজে ধরতে পারবে না, ওকে নিয়েই টানাটানি করবে। জোজোর বাবা এখন ইণ্ডিয়াতে নেই। পুলিশ যদি জোজোকে জেলে ভরে দেয়— তুই এক কাজ কর, সন্তু। জোজোকে গিয়ে বল, ওটা নিয়ে এক্ষুনি এখানে চলে আসতে। আমি পাথরটা একবার দেখতে চাই। ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে কাকাবাবু বাথরুমে চলে গেলেন। এই ঘরেই টেলিফোন। সন্তু চট করে জোজোদের বাড়ির নম্বর ঘোরাল। জোজোই ওদিক থেকে প্রথম হ্যালো বলল। সন্তু উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল, এই জোজো, আজকের খবরের কাগজ পড়েছিস? জোজো বলল, না। কেন? সক্কালবেলাতেই ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ বাবাকে ফোন করেছিলেন একটা ব্যাপার জানতে। বাবা তো কলকাতায় নেই। কুইন তখন আমায় বললেন, মাস্টার জোজো, তুমি তো তোমার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছ। তুমি এটা বলতে পারবে না? আমি যত বলি, ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমি অতটা শিখিনি, তবু তিনি বলতে লাগলেন, তুমি একবার পুজোয় বসে চেষ্টা করে দ্যাখো না! ইংল্যান্ডের রানি তোর কাছে কী জানতে চাইলেন? সেটা টপ সিক্রেট। তোকে বলা যাবে না। এই সন্তু; টেলিফোনটা বেশিক্ষণ আটকে রাখিস না। একটু বাদেই নরওয়ের রাজার ফোন করার কথা আছে। ওঁর জিনিসটা অবশ্য আমি রেডি করে রেখেছি। ওসব রাজারানির কথা ছাড় তো, জোজো। আজকের কাগজ পড়ে দ্যাখ। সব কাগজেই ফার্স্ট পেজে বেরিয়েছে। কী বেরিয়েছে তাই বল না! এখানে কাগজ নেই হাতের কাছে। কলকাতার মিউজিয়াম থেকে চাঁদের পাথর কাল সকালে চুরি গেছে। জোজো একটুক্ষণ থমকে গেল যেন। তারপর নীরস গলায় বলল, ও, চুরি গেছে। সেই খবরের জন্য তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমিই বা কী করব? তুই কাল যেটা দেখালি, সেটা সত্যিই চাঁদের পাথর? রজত ভট্টাচারিয়া কখনও এলেবেলে কথা বলে না। যদি এলেবেলে কথা না হয়, তা হলে, তা হলে, ওই পাথর কলকাতা শহরে, শুধু কলকাতা কেন ইণ্ডিয়াতেই আর কারও কাছে নেই। এর মানে বুঝতে পারছিস না? না। পারছি না। পুলিশ তোকে সন্দেহ করবেই। সন্দেহ করলেই হল? কোথাকার কী চুরি গেছে, তার জন্য আমি দায়ী হব কেন? তোকে যে ওই পাথরটা নীল আর্মস্ট্রং দিয়েছেন তার কোনও প্রমাণ আছে? প্রমাণ, মানে, প্রমাণ আবার কী? কেউ যদি কাউকে কোনও জিনিস দেয়, তার সঙ্গে কি কোনও প্রমাণের সার্টিফিকেট লিখে দেয়? তুই যে সেবারে ইজিপ্টে গেলি, সেখান থেকে আমাকে একটা পিরামিডের পাথরের মূর্তি এনে দিলি, সেটার কি কোনও প্রমাণ রাখতে হয়েছে? সেটা তো একটা সাধারণ জিনিস। তার সঙ্গে কি এটার তুলনা হয়? তুই এক কাজ কর জোজো, পাথরটা নিয়ে চট করে আমাদের এখানে চলে আয়। কাকাবাবু পাথরটা দেখতে চেয়েছেন। বিকেলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করব। এখন তো পারব না। নরওয়ের রাজার জরুরি কাজ আছে। দূর ছাই তোর নরওয়ে-ফরওয়ে! শোন জোজো, তোর কাছে যে-কোনও সময় পুলিশ যেতে পারে। কাকাবাবু তোকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। কাকাবাবুর কাছে থাকলে তুই বেঁচে যাবি। এখন তোর যা ইচ্ছে কর! রাগ করে সন্তু টেলিফোনটা রেখে দিল। একতলা থেকে মা চা-জলখাবারের জন্য ডাকছেন, তাই নেমে যেতে হল একতলায়। মনে-মনে সে গুমরোচ্ছে। জোজোটা এক-এক সময় সীমা ছাড়িয়ে যায়! সন্তু যেন কল্পনায় দেখতে পেল পুলিশ জোজোদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তারপর হাতে হাতকড়া দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জোজোকে। তারপর থানায় নিয়ে গিয়ে ওর আঙুলের ডগায় আলপিন ফুটিয়ে-ফুটিয়ে তিন-চারজন পুলিশ অফিসার জেরা করছে, বল, ছোকরা, তুই এই চাঁদের পাথর কোথায় পেয়েছিস? পরশু রাতে মিউজিয়ামের কাছে কেন গিয়েছিলি? ঠিক সতেরো মিনিটের মধ্যে সাঁ সাঁ করে সাইকেল চালিয়ে জোজো এসে উপস্থিত হল। সাদা প্যান্ট আর নীল রঙের একটা গেঞ্জি পরা। চেহারা দেখলে মনে হয়, কী সরল, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না! ভেতরে ঢুকেই সন্তুর মাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, মাসিমা, এই সাতসকালে কেন ছুটে এলুম জানেন?
false
tarashonkor
–তিন সত্য করছি আপনার চরণ ছুঁয়ে। –তবে দিনতিনেক পরে আসি। আমি সব খোঁজখবর করে দেখি। –খোঁজ করবেন? কি খোঁজ করবেন? –আর কোথাও বন্ধক-টক দিয়েছিস কি না। –আপনার চরণ ছুঁয়ে বলছি চৌধুরী বলিল—এইবার চরণ দুটিকে আমাকে সিকেয় তুলতে হবে বাবা। তাতে তোরই। খারাপ হবে। রেজেষ্ট্রি অফিসে যাওয়া হবে না, তুইও টাকা পাবি না। খোঁজ না করে আমি টাকা কাউকে দিই না, দোবও না। অনিরুদ্ধ তবু উঠিল না। শ্ৰান্ত ক্লান্ত দেশান্তরী উদাসীনের অকস্মাৎ প্রিয়জনকে মনে পড়িয়া যেমন বাড়ি ফিরিবার জন্য ব্যাকুল আগ্ৰহ জাগে, অনিরুদ্ধের আজ তেমনি ব্যাকুল আগ্রহ জাগিয়া উঠিয়াছে আবার সেই পূর্বের সংযত সচ্ছল জীবনে ফিরিবার জন্য। সেই ফিরিবার পথের পাথেয় চাই তাহার। চার বছরের বাকি খাজনা সালিয়ানা পঁচিশ টাকা দশ আনা হিসাবে একশত আড়াই টাকা; সিকি সুদ পঁচিশ টাকা দশ আনা—একুনে একশো আটাশ টাকা দু আনা, খরচা লইয়া একশো চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ, দেড়শো টাকাই ধরিয়া রাখা ভাল। আরও একশো চাই। সে বলদ এক জোড়া কিনিবে। জমি ভাগে না দিয়া, একটি কৃষাণ রাখিয়া সে বাপঠাকুরদার মতই ঘরে চাষ করিবে। তাহার নিজের জমি তের বিঘা। তাহার সঙ্গে অন্য কাহারও বিঘাপাঁচেক জমি সে ভাগে লইতেও পারিবে। সঙ্গে সঙ্গে জংশন শহরের ধানকলে বা তেলকলে একটা চাকরিও লইবে। রাজি থাকিতে সে উঠিবে, গরু দুটাকে আপন হাতে খাইতে দিবে। কৃষাণ হাল লইয়া যাইবে, সেইসঙ্গে সে-ও বাহির হইবে একেবারে সারাদিনের মত সাজিয়া গুছাইয়া। জমিগুলি দেখিয়া-শুনিয়া ওই পথেই চলিয়া যাইবে সে জংশনে কলের কাজে। ফিরিবার পথে আবার একবার মাঠ ঘুরিয়া বাড়ি আসিবে। মদ খাইতে হয়—একটু না খাইলে সে বাঁচিবে না—বোতল কিনিয়া আনিয়া বাড়িতে রাখিবে, পদ্ম মাপিয়া ঢালিয়া দিবে–ব্যস! কলের মাইনে দৈনিক আট আনা হিসাবে চারিটা রবিবার বাদ দিয়া তের টাকা—বৎসরে একশো ছাপ্পান্ন টাকা নগদ আয়। ধান, কলাই, গুড়, গম, যব, তিসি, সরিষা হইবে চাষে। নজরবন্দির বাড়িভাড়া আছে মাসিক দশ টাকা। ওটা অবশ্য স্থায়ী আয় নয়। এ ছাড়াও সে বাড়িতে আবার কামারশালা খুলিবে। রাত্রে যাহা পারে, যতটুকু পারে করিবে; দৈনিক দু গণ্ডা পয়সা রোজগার হইলেও তাহাতেই তাহার দৈনিক নুন-তেলের খরচা তো চলিয়া যাইবে। ঋণ শোধ দিতে তাহার কয় দিন! ঋণ শোধ দিয়া সে আরম্ভ করিবে সঞ্চয়; সঞ্চয় হইতে সুদি কারবার। খৎ-তমসুকে নয়, জিনিস-বন্ধকী কারবার। ঘাটতি নাই পড়তি নাই, বৎসরে একটি টাকা দুটাকায় পরিণত হইবে। ইহার ওপর তাহার বাকুড়ির আরো আধ হাত মাটি তুলিয়া সে যদি গর্ত করিতে পারে—তবে বাকুড়িতে হাজাশুকা থাকিবে না। মাটি তুলিয়া গাড়ি-গাড়ি সার এবং মরা পুকুরের পাক ঢালিয়া দিবে। উনো ফসল দুনো হইবে। চৌধুরী বলিল–বসে থাকলে তো টাকা মিলবে না, অনিরুদ্ধ। আমি খোঁজখবর করি, তারপর এদিকে বেলাও যে দশটা হল। আমার আবার ইস্কুল আছে। অনিরুদ্ধ বলিল, আজই চলুন কঙ্কণা, রেজেস্টারি আপিসে খোঁজ করুন। হাসিয়া চৌধুরী বলিল-আজই? তোর অশ্বতর যে পক্ষীরাজের চেয়েও জিন্দে দেখছি, থামতে চায় না। বেশ বস্তুই। আমি চান করে দুটো খেয়ে নি। চল্ আমার সঙ্গে। টিফিনের সময় খোঁজ করব। টিফিনেও খোঁজ শেষ হইল না। চৌধুরী বলিল—আবার সেই শেষ ঘণ্টা, তিনটে দশের পর আবার অবসর। তুই তা হলে বস। শেষ ঘণ্টায় হেডপণ্ডিত চৌধুরীর ধর্ম-সম্বন্ধীয় বক্তৃতার ক্লাস। এ ক্লাসটার সময় চৌধুরী প্রায়ই ছেলেদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অবকাশ দিয়া রেজিস্ট্রি অফিসের কাজগুলি সারিয়া থাকে। দলিলদস্তাবেজ বাহির করে, কে কোথায় কি নিল, কি বেচিল, কে কি বন্ধক দিল ইত্যাদি সংবাদগুলি সংগ্রহ করিয়া রাখে। অনিরুদ্ধ সেই অপেক্ষা করিয়া রহিল। সমস্ত দিন খাওয়া হয় নাই। সে খানকয়েক বাতাসা কি দুই টুকরা পাটালির প্রত্যাশায় পরাণ ময়রার দোকানে বসিয়া পরাণের তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিল। পাটালি-বাতাসা মিলিল না, কিন্তু ক্ষুধাতৃষ্ণা সে ভুলিয়া গেল; পরাণের বিধবা ভাগ্নী দোকান করে, তাহার সঙ্গে বেশ আলাপ জমাইয়া ফেলিল। একটা হইতে তিনটা দুই ঘণ্টা সময় যেন মেয়েটার হাসির ছুঁয়ে উড়িয়া গেল! চৌধুরী আসিয়া বলিল—দেখা আমার হয়ে গেল অনিরুদ্ধ, বুঝলি? হয়ে গেল আজ্ঞে। হ্যাঁ। তোকে আর ডাকি নাই। দেখলাম গল্পেতে খুব জমে গিয়েছিস, রসভঙ্গ করা পাপ, শাস্ত্রনিষিদ্ধ। বলিয়া চৌধুরী হাসিল। অনিরুদ্ধ একটু লজ্জিত হইল। –টাকা আমি দোব। –দেবেন! উৎসাহে অনিরুদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইল। –হ্যাঁ। কিন্তু তোর তো আজ সারাদিন খাওয়া হল না রে! –তা এই বাড়ি গিয়ে এই তো কোশখানেক পথ আজ্ঞে। আনন্দের আবেগে অনিরুদ্ধ কোনো কথাই শেষ করিতে পারিল না। –আচ্ছা, পরশু আসি। তা হলে শিগগির বাড়ি যা। মেঘ উঠেছে। ঝড়-জল হবে মনে। হচ্ছে। চৌধুরী চলিয়া গেল। মেয়েটি বলিল—তুমি খাও নাই এখনও? —তা হোক। এই কতক্ষণ! বো বে করে চলে যাব। –এই বাতাসা কখানা ভিজিয়ে জল খাও। খাও নাই—বলতে হয়! বাতাসা ভিজাইয়া জল খাইয়া অনিরুদ্ধ যেন বাঁচিল। টাঙিটা হাতে করিয়া সে পথে নামিয়া হনহন করিয়া বাড়ি চলিল। কিন্তু কঙ্কণার প্রান্তে আসিয়া পৌঁছিতে-না-পৌঁছিতে ঝড় উঠিয়া পড়িল। পৌষের পর হইতে বৃষ্টি হয় নাই। চারিদিক রুক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতেই যেন বৈশাখের চেহারা দেখা দিয়াছে। অকালেই উঠিয়া পড়িয়াছে কালবৈশাখীর ঝড়। দেখিতে দেখিতে চারিদিক অন্ধকার হইয়া গেল; দুর্দান্ত ঝড়ের তাড়নায় পৃথিবী হইতে আকাশ পর্যন্ত পিঙ্গল ধুলায় ধূসর হইয়া উঠিল, তাহার ওপর ঘনাইয়া আসিল—দ্রুত আবর্তনে আবর্তিত পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ঘন ছায়া দুয়ে মিলিয়া সে এক বিচিত্র পিঙ্গলাভ অন্ধকার। গো গোঁ শব্দ করিয়া ঝড়ের সে কি দুৰ্দান্তপনা! অনিরুদ্ধ আশ্ৰয় লইল একটা গাছতলায়। শিলাবৃষ্টি বজ্ৰপাতও হইতে
false
humayun_ahmed
জ্বর আছে সে বুঝতে পারছে–সব কেমন হলুদ হলুদ লাগছে। রহমান সাহেব বললেন, কাল তোমার ওখানে যাব বলে ভেবেছিলাম–বৃষ্টি-টৃষ্টি দেখে আর যাইনি। তোমার স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছ তো? জ্বি স্যার। ওর বড় চাচার বাসায় দিয়ে এসেছি। গুড। ভেরী গুড। একা একা থাকতে খারাপ লাগে তো, এই জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। অন্যায় হয়েছিল। কিছু মনে করবেন না স্যার। নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে রাখবে এতে অন্যায় কি? কমপ্লেইন হচ্ছিল। স্যারের কানে গেলে স্যার রাগ করতে পারেন এই জন্যেই, অন্য কিছু না। আমি বুঝতে পারছি স্যার। ঠিক আছে, তুমি যাও। ও আচ্ছা শোন, কি একটা জরুরী কথা বলতে চাচ্ছিলাম–ভুলে গেলাম। ঠিক আছে মনে হলে বলব। আমি কি স্যার ঘন্টাখানিক পরে আসব? কেন? কথা যেটা ভুলে গিয়েছিলেন সেটা যদি মনে পড়ে! আসতে হবে না। এমন কিছু জরুরী কথা না। জরুরী কথা হলে মনে থাকত। চলে যাব স্যার? হ্যাঁ। বাড়ি-ঘর ঠিক-ঠাক রাখবে। অবশ্যই স্যার। এর মধ্যে কি আপনি একবার আসবেন? আসব। বাড়িটা রঙ করাতে হবে। র মিস্ত্রীকে নিয়ে এসে এস্টিমেট করাতে হবে। কবে আসবেন স্যার? দিন-তারিখের দরকার কি, চলে যাব এক সময়। ও আচ্ছা, কথাটা মনে পড়েছে–কামরুলের খবর কি? তাহেরের বুক ধ্বক করে উঠল–মনে হল সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কামরুলের খবর কি? এই প্রশ্নের উত্তরে সে কি বলবে? তাহেরকে কিছু বলতে হল না। রহমান সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, কুকুর তিনটাকে ইনজেকশন দেয়ার জন্যে তার নিয়ে যাবার কথা–আমি ইনজেকশন আনিয়ে রেখেছি–সে আসছে না কেন? সব সময় এ রকম করে। একবারের জায়গায় দশবার বলতে হয়। ওকে খবর দেবে। জ্বি আচ্ছা। স্যার চিঠিতে জানতে চেয়েছেন ইনজেকশন দেয়া হয়েছে কি না। এক সপ্তাহ আগে তাকে বলেছি, আশ্চর্য, এমন গাফিলতি। তুমি তাকে কালই আসতে বলবে। জ্বি বলব। তবে কাল বোধহয় আসতে পারবে না। জ্বর হয়েছে। বিছানায় শুয়ে আছে দেখলাম। কাছে অবশ্যি যেতে পারি নাই। কুকুরগুলির কারণে কাছে যেতে ভয় লাগে। কোন দিন এরা আমাকে মেরে ফেলে কে জানে। রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও। তাহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বের হয়ে এল। জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে। মাথা ঘুরছে। সকালে সে নাশতা না খেয়ে বের হয়েছে। পারুল নাশতা বানিয়েছিল–রুটি, আলু ভাজা। তার খেতে ইচ্ছে করেনি। তার ঘর থেকে বেরুতেও ইচ্ছা করেনি। পারুলই তাকে প্রায় জোর করে বাইরে পাঠিয়েছে। সহজ গলায় বলেছে–এই বাড়িতে থাকলেই তোমার আরো খারাপ লাগবে। গত রাতের কথা মনে পড়বে। তুমি বরং ঘুরে টুরে আস। সন্ধ্যাবেলা যখন ঘরে ফিরবে দেখবে আগের মত খারাপ লাগছে না। কোথায় ঘুরব? অফিসে যাও। সবার সঙ্গে গল্প-টল কর। যত গল্প করবে তত দ্রুত তুমি সহজ হবে। তাতে মাথা থেকে রাতের ব্যাপারটা চলে যাবে। তুমি একা থাকবে? একা কোথায়? আমার কুকুর তিনটা আছে না? আমি ভালই থাকব, আমার কোন সমস্যা হবে না–তুমি আসার সময় কিছু চা-পাতা নিয়ে এসো। চা-পাতা, আরেকটা বই–শিশুদের নামের বই। বাচ্চাদের নাম রাখার এখন সুন্দর সুন্দর বই পাওয়া যায়। এলফাবেটিকেলী সাজানো। বই-এ নাম, নামের অর্থ সব দেয়া থাকে। মনে থাকবে? হুঁ, থাকবে। চা-পাতা আনতে যদি ভুলেও যাও–বই আনার কথাটা কিন্তু ভুললে চলবে না। তাহের ভুলেনি–তার মনে আছে। তার শরীর খারাপ, মাথা ঘুরছে, গায়ে জ্বর, তারপরে সবকিছুই তার মনে আছে। সে ম্যানেজার রহমান সাহেবের ঘর থেকে লবীতে চলে এল। রিসেপসনিস্ট মেয়েটি আজও সবুজ শাড়ি পরেছে। সম্ভবত তার অনেকগুলি সবুজ শাড়ি। মেয়ে শাড়ির রঙ মিশিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়–সবুজ রঙের লিপস্টিক কি পাওয়া যায়? নিশ্চয়ই যায়। সে তো আর খোঁজ-খবর করে না। খোঁজ-খবর করলে দেখত দোকান ভর্তি সবুজ বরে লিপস্টিক। আজ যখন বইমের দোকানে যাবে তখন সে লিপস্টিকের দোকানে খোঁজ করবে। কিনতে পারবে না, টাকা নেই। দামটা শুধু জানবে। দোকানদার বিরক্ত হবে। ওরা আবার চট করে ধরে ফেলে কে কিনতে এসেছে আর কে শুধু দরদাম করতে এসেছে। হঠাৎ তাহেরের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল–তার মনে পড়ল এখন পর্যন্ত সে পারুলকে কোন উপহার দেয়নি। কোন কিছুই না। এর মধ্যে তার একবার জন্মদিন গেল। তারা তখন সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় থাকে। সকালবেলা পারুল বলল, বুঝলেন জনাব, আজ আমার জন্মদিন। আজ অবশ্যই আমার জন্যে কয়েকটা গোলাপ ফুল কিনে আনবেন। বেশি আনার দরকার নেই–যা দাম। দুটা আনলেই হবে। খবর্দার, উপহার-টুপহার আবার আনতে যাবেন না। তাহের উপহার আনেনি, ফুলও আনেনি। ভুলে গিয়েছিল। জন্মদিনের সেই উপহার আজ কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কিছু টাকা সঙ্গে আছে। লিপস্টিকের দাম কত সে জানে না–চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ টাকায় হলে কিনে ফেলা যায়। রিসেপসনিস্ট মেয়েটাকে কি সে জিজ্ঞেস করবে লিপস্টিকের দাম কত? রাগ করবে না তো আবার সুন্দরী মেয়েরা সব সময় রেগে থাকে। ব্যতিক্রম অবশ্যি আছে। যেমন পারুল কখনো রাগে না। সে রূপবতী এ কথাটা বোধহয় তার জানা নেই। জানলে সেও সারাক্ষণ রেগে থাকত। রিসেপসনিস্ট মেয়েটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই শুনুন। তাহের তার দিকেই তাকিয়েছিল–সে চমকে উঠল। আপনি কিছু বলবেন? জ্বি-না। কিছু বললেন না, তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মেয়েদের দিকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যে অভদ্রতা এটা কি আপনার জানা নেই? আজ তো নতুন না, আপনাকে আগেও বলেছি। তাহের নিজের অজান্তেই বলল, আপনার কি অনেকগুলি সবুজ রঙের শাড়ি? মেয়েটি হকচকিয়ে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তার মুখে কোন
false
humayun_ahmed
কফিনের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি। অ্যানি তার সোনার মাছি সঙ্গে নিয়ে গেছে। অ্যানির ছবি দেখবে? দেয়ালে তাকাও। বাসকেট বল হাতে নিয়ে হাসছে। ছবিটা আমার তোলা। ছবিটা প্রায়ই দেখি এবং অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের সবার বয়স বাড়বে। আমরা জরাগ্রস্ত হব। কিন্তু ছবির এই মেয়েটি তার যৌবন নিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। জরা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। প্রফেসর চুরুট হাতে উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুত ঘর থেকে বের হলেন। তাঁর চোখে পানি চলে এসেছে। তিনি সেই পানি তাঁর ছাত্রকে দেখাতে চান না। হামা–ভূত বাংলাদেশে। কত ধরনের ভূত আছে জানেন? আমি বললাম, জানি না। মিসির আলি বললেন, আটত্রিশ ধরনের ভূত আছে- ব্ৰহ্মদৈত্য, পেত্নি, শাকচুন্নি, কন্ধকাটা, মামদো, পানি ভূত, কুয়া ভূত, কুনি ভূত, বুনি ভূত। কুনি ভূতটা কি রকম? মিসির আলি বললেন, ঘরের কোনায় থাকে বলে এদের বলে কুনি ভূত। আরেক ধরনের ভূত আছে। এরা কোনো শরীর ধারণ করতে পারে না। শুধুই শব্দ করে। নিশি রাতে মানুষের নাম ধরে ডাকে। আরেক ধরনের ভূত আছে নাম ‘ভুলাইয়া। এরা পথিককে পথ ভুলিয়ে নিয়ে যায়। শেষ সময় বিলের পানিতে ড়ুবিয়ে মারে। আমি বললাম, ভূত নিয়ে আপনার স্টকে কোনো গল্প আছে? মিসির আলির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো গল্প আছে। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। হামা-ভূতের নাম শুনেছেন? না তো। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে বলেই এই ভূতের নাম হামা-ভূত। আট-ন বছর বয়েসি বালকের মতো শরীর। চিতা বাঘের মতো গাছে উঠতে পারে। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। শো শো শব্দ করে। আপনি কখনো হামা-ভূত দেখেছেন? আমি বললাম, সাধারণ কোনো ভুতই এখনো দেখিনি। হামা-ভূত দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি দেখেছেন? মিসির আলি বললেন, শুধু যে দেখেছি তা না। হামা-ভূতকে পাউরুটি খাইয়েছি। ভূত পাউরুটি খায়? অন্য ভূত খায় কি-না জানি না, হামা-ভূত খায় এবং বেশ আগ্রহ করেই খায়। গল্প শুনতে চান? অবশ্যই চাই। হামা-ভূতের গল্পটা হলো প্রস্তাবনা। তবলার টুকটাক। মূল গল্প অসাধারণ, আমার ক্যাটাগরির। হামা-ভূত না দেখলে মূল গল্পের সন্ধান পেতাম না। যাই হোক শুরু করি— পত্রিকায় পড়লাম নেত্রকোনার সান্ধিকোনা অঞ্চলে হামা-ভূতের উপদ্ৰব হয়েছে। যারা এই ভূত দেখেছে তারা সবাই অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে আছে। অঞ্চলের লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে কেউ বের হয় না। হামা-ভূতের বিশেষত্ব হচ্ছে- সে মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে গাছে ওঠে। যেসব বাড়িতে নবজাতক শিশু আছে সেই সব বাড়ির চারপাশে বেশি ঘোরাঘুরি করে। আমার তখন বয়স কম, আদিভৌতিক বিষয়ে খুব আগ্ৰহ। হামা-ভূত দেখার জন্যে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। বাংলাদেশের গ্রামে অজানা জন্তুর আক্রমণের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। ভূতের আক্রমণের খবর তেমনভাবে আসে না। সান্ধিকোনা গ্রামে সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছলাম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্ভেজাল গ্রাম। একটা স্কুল আছে, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ানো হয়। স্কুলের দু’জন শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে একজন চলে গেছেন। যিনি টিকে আছেন তার নাম প্ৰকাশ ভট্টাচাৰ্য। আমি হামা-ভূত দেখতে এসেছি। এই খবর রুটে গেল। দলে দলে লোকজন আমাকে দেখতে এলো। যেন আমি ফিলোর কোনো বড় তারকা, পথ ভুলে এখানে চলে এসেছি। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রধান সমস্যা একই ধরনের প্রশ্নের জবাব বারবার দিতে হয়। আপনার নাম? দেশের বাড়ি? সার্ভিস করেন? বেতন কত পান? শাদি করেছেন? নতুন যেই আসছে সে-ই এসব প্রশ্ন করছে। রাত কোথায় কটাব এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা নিচু গলায় চলতে লাগল। সাধারণত গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাড়িতে বিদেশি মেহমান রাখা হয়। সম্ভবত এই গ্রামে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নাই। আক্কাস আলি নামের একজনের কথা কয়েকবার শোনা গেল। তবে তার বাড়িতে আজ অসুবিধা। শ্বশুরবাড়ির অনেক মেহমান হঠাৎ করে চলে এসেছে। সুরুজ মিয়ার নাম উচ্চারিত হলো। তাঁর বাড়িতেও সমস্যা। তার ছোটমেয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। আমি বললাম, আমার রাতে থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সঙ্গে করে সিপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছি। গাছতলায় থাকব। গাছতলায় থাকবেন! কি কন? গ্রামের ইজ্জত আছে না। আপনি বিদেশি মেহমান। আমি বললাম, ভাই ভূত দেখতে এসেছি। রাতে যদি কোনো বাড়িতে ঘুমিয়েই থাকি ভূতটা দেখব কি ভাবে? সারারাত আমি জেগেই থাকিব, হাঁটাহাঁটি করব। গ্রামের এক মুরব্বি বললেন, সাথে কি তিন-চাইরজন জোয়ান পুলাপান দিব? অলঙ্গ নিয়া আপনার সাথে থাকব। অলঙ্গা জিনিসটা কি? ব্ররশা। তালগাছ দিয়া বানায়। আমি বললাম, একগাদা লোক সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে তো ভূত দেখা দিবে না। বর্শা দিয়ে ভূত গাথাও যাবে না। আমাকে একই ঘুরতে হবে। আর আমার রাতের খাবার নিয়েও চিন্তা করবেন না। আমি রাতের খাবার, পানি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। মুরুব্বি বললেন, এইটা কেমন কথা! চাইরটা ডাল-ভাত আমাদের সাথে খাবেন না? আমি বললাম, আবার যদি কোনোদিন আসি তখন খাব। আমার কাছে মনে হলো মুরুব্বি এবং মুরুব্বির সঙ্গে অন্যরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। প্ৰশান্ত ভট্টাচাৰ্য বললেন, কোনো কারণে ভয় পেলে আমার বাড়িতে উঠবেন। ঐ যে টিনের বাড়ি। আমি বলতে গেলে সারারাত জগন্নাই থাকি। রাতে ঘুম হয় না। ভূতের ভয়ে ঘুম হয় না? তা না। এমিতেই ঘুম হয় না। ভগবানের নাম জপে রাত পার করি। অনেক আগে থেকেই করি। গ্রামের লোকজন হামা-ভূতকে যথেষ্টই ভয় পেয়েছে বুঝা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়ল। গল্প-উপন্যাসে শাশানপুরীর উল্লেখ থাকে। সান্ধিকোেনা শশানপুরী হয়ে গেল। আমি একা একা ঘুরছি। চমৎকার লাগছে! ভাদ্র মাস। এই সময়ে যতটা গরম হবার কথা ছিল তত গরম
false
tarashonkor
লাগে। ছিরু কে সে এখন ঘৃণা করে, সেই আগুন লাগানোর সংবাদ সে কাহাকেও বলে নাই; ঘৃণায় তাহার সহিত সংস্রব ত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু ছিরু র সহিত যখন তাহার ঘনিষ্ঠতা ছিল—তখনও তাহার পণ্ডিতকে ভাল লাগিত; ছিরু অপেক্ষা অনেক বেশি ভাল লাগিত। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, এই দুই ভাল লাগার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আজ পণ্ডিতকে পূর্বাপেক্ষা যেন আরও বেশি ভাল লাগিল। পণ্ডিতের সহিত তাহার একটা সম্বন্ধও আছে। রক্তের সম্বন্ধ নয়, পাতানো সম্বন্ধ। দেবুর বউ বিলুকে তাহার মা এককালে কোলেপিঠে করিত। সেই কারণে সে বিলুকে দিদি বলে। দেবু পণ্ডিত তাহার বিলু দিদির বর। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে ইতুলক্ষ্মী পর্ব আসিয়া গেল। অন্যান্য প্রদেশে-বাংলাদেশে বিশেষ অঞ্চলে কার্তিক-সংক্রান্তি হইতেই ইতু বা মিত্র-ব্ৰত আরম্ভ হয়, শেষ হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। রবিশস্যের কল্যাণ কামনা করিয়া সূর্য-দেবতার উপাসনা হইতেই নাকি ইহার উদ্ভব। দেবুদের দেশে কিন্তু সম মাস ধরিয়া সূর্য-দেবতার আরাধনার প্রচলন নাই। এদেশে রবিশস্যের চাষেরও বিশেষ প্রকার নাই, ধান-চাষ এখানকার প্রধান কৃষিকৰ্ম। ইতু-পর্বকে এখানে ইলক্ষ্মী বা ইতু-সংক্রান্তি পর্ব বলা হয়। হৈমন্তী-ধান মাড়াই ও ঝাড়াই করিবার শুভ প্রারম্ভের পর্ব এটি এবং রবিশস্যের আবাহনও বটে। চাষীদের আপন খামারে ইহার অনুষ্ঠান হয়। খামারের ঠিক মধ্যস্থলে শক্ত একটি বাঁশের খুঁটি পুতিয়া সেই খুঁটির তলায় আল্পনা দিয়া সেইখানে লক্ষ্মীর পূজা ভোগ হয়। ধান মাড়াইয়ের সময়ে ওই খুঁটিটির চারদিকেই ধানসুদ্ধ পোয়াল বিছাইয়া দেওয়া হইবে এবং গরু মহিষগুলি ওই খুঁটাতে আবদ্ধ থাকিয়া বৃত্তাকারে পোয়ালের উপর পাক দিয়া ফিরিবে। তাহাদের পায়ের খুরের মাড়াইয়ে খড় হইতে ধান ঝাড়াই হইয়া যাইবে। এ পর্বের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের সম্বন্ধ বিশেষ নাই। তবে মেয়েরা প্রাতঃকালে স্নান করিয়া চণ্ডীমণ্ডপে প্রণাম না করিয়া লক্ষ্মী পাতিবে না। পূর্বকালে আরও খানিকটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। দেবুর মনে আছে, পনের বৎসর পূর্বেও লক্ষ্মীপূজার শেষে সমস্ত গ্রামের মেয়েরা আসিয়া এইখানে সমবেত হইয়া সুপারি হাতে ব্ৰত-কথা শুনিতে বসিত। গ্রামের প্রবীণা কেহ ব্ৰতকথা। বলিতেন। অপর সকলে শুনিত। আজকাল সে রেওয়াজ উঠিয়া গিয়াছে। এখন দুই-তিন বাড়ির মেয়েরা কোনো এক বাড়িতে একত্রিত হইয়া ব্ৰত-কথা শুনিয়া লয়। দেবুর বাড়িতেও এই ব্ৰতকথার আসর বসে। আজ দেবু পাঠশালায় পড়াইতে পড়াইতে ওইসব কথাই ভাবিতেছিল। তাহার মনে সেদিন হইতে সমস্ত প্রেরণা ও শক্তি ক্ষুব্ধ ও আহত হইয়া অহরহ তাহাকে পীড়িত করিতেছে। যে কোনো সুযোগ পাইলেই তাহা অবলম্বন করিয়া আবার সে খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে চায়। জগন ডাক্তারের সহিত যোগাযোগ আবার স্বাভাবিক নিয়মের বসে শিথিল হইয়া আসিয়াছে। জগন ডাক্তারের ঐ দরখাস্ত করার পন্থাটাকে সে অন্তরের সহিত গ্রহণ করিতে পারে না। দরখাস্তের কথায় তাহার হাসি আসে। অন্তর জ্বলিয়া ওঠে। সে সাহিত্য পড়াইতেছিল— অট্টালিকা নাহি মোর নাহি দাস-দাসী ক্ষতি নাই, নহি আমি সে সুখ-প্রয়াসী। আমি চাই ছোট ঘরে বড় মন লয়ে, নিজের দুঃখের অন্ন খাই সুখী হয়ে! পরের সঞ্চিত ধনে হয়ে ধনবান, আমি কি থাকিতে পারি পশুর সমান? সহসা তাহার নজরে পড়িল—একটি দীর্ঘাঙ্গী অবগুণ্ঠনবতী মেয়ে পথের ধার হইতেই চণ্ডীমণ্ডপের দেবতার উদ্দেশে প্রণাম করিল। চণ্ডীমণ্ডপে সে বোধহয় ইচ্ছা করিয়াই উঠিল না; কারণ তাহার পদক্ষেপে কোনো ব্যস্ততার লক্ষণ দেখা গেল না। দেবু তাহাকে চিনিল–অনিরুদ্ধের স্ত্রী। বুঝিল নবান্নের দিনের সেই ঘটনার জন্য অনিরুদ্ধের স্ত্রী চণ্ডীমণ্ডপের উপরে উঠিল না। মুহুর্তে দেবুর মন খারাপ হইয়া গেল। অনিরুদ্ধের স্ত্রী ওই যে নীরবে পথের উপর হইতে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল, তাহার প্রতিটি ভঙ্গি যেন রুদ্ধ-বেদনায় ব্যথিত বিষণ্ণ বলিয়া। তাহার মনে হইল। একা আসিয়া একা চলিয়া গেল, যেন বলিয়া গেল—একা আমিই কি দোষী? দেবু অনিরুদ্ধের স্ত্রীর গমনপথের দিকেই চাহিয়া রহিল, মেয়েটির ধীরপদক্ষেপ যেন ক্লান্ত। বলিয়া তাহার মনে হইল। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। কাজটা সত্যই অন্যায়। হইয়া গিয়াছে। এই মুহূর্তটিতে তাহার বিচারবুদ্ধির ত্রুটি স্বীকার না করিয়া পারিল না। অনিরুদ্ধের অন্যায়ের চেয়ে গ্রামের লোক যে অনিরুদ্ধের প্রতি অন্যায় করিয়াছে বেশি! ধান না দেওয়ার জন্যই অনিরুদ্ধ কাজ বন্ধ করিয়াছে। মজলিসে ছিরু আগে অপমান করিয়াছে, তবে অনিরুদ্ধ উঠিয়াছিল। অনিরুদ্ধের দুই বিঘা বাকুড়ির ধান কাটিয়া লওয়ার প্রতিকার যখন কেহ করিতে পারে নাই, তখন অনিরুদ্ধকে শাস্তি দিবার অধিকারই বা কাহার আছে? অকস্মাৎ সে বিস্ময়ে চকিত হইয়া উঠিল, মনের চিন্তাধারায় একটা ছেদ পড়িয়া গেল-একি! অনিরুদ্ধের স্ত্রী তাহার বাড়ির দিকে যাইতেছে কেন?– পাঠশালার ছেলেগুলো পণ্ডিতের স্তব্ধতার অবকাশ পাইয়া উসখুস করিতে শুরু করিয়াছিল। একটি ছেলে বলিল-আজ ইতুলক্ষ্মী, মাস্টার মশায় আজ আমাদের হাপ-ইস্কুল হয়। নটা বেজে গিয়েছে ঘড়িতে। দেবুর সম্মুখেই থাকে একটা টাইমপি। দেবু ঘড়িটার দিকে চাহিয়া আবার পড়াইতে শুরু করিল– শৈশব না যেতে ক্ষেতে শিখিয়াছি কাজ, সেই তো গৌরব মোর তাতে কিবা লাজ? ধীরে ধীরে সমস্ত কবিতাটি শেষ করিয়া দেবু বলিল—কালকে এই পদ্যটির মানে লিখে আনবে সবাই। মানে বলতে কথার মানে নয়, কে কি বুঝেছ লিখে আনবে। পাঠশালার ছুটি দিয়া সে আজ সঙ্গে সঙ্গেই আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। বাড়ির উঠানে তখন তাহার স্ত্রীর সম্মুখে বসিয়া আছে পদ্ম, অদূরে বসিয়া আছে দুর্গা; তাহার স্ত্রী ইতুলক্ষ্মীর ব্ৰতকথা বলিতেছে। দেবুর স্ত্রী বড় ভাল উপকথা বলিতে পারে, এ পাড়ায় ব্রত-কথার আসর তাহার ঘরেই বসে। সে আসর শেষ হইয়া গিয়াছে। এ বোধহয় দ্বিতীয় দফা। দেবুর শিশু-পুত্রটিকে কোলে লইয়া পদ্ম বসিয়াছিল, দেবুকে দেখিয়া সে অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল। দেবুর স্ত্রীও ঘোমটা অল্প একটু টানিয়া হাসিল। দুর্গা কাপড়চোপড় সামলাইয়া গুছাইয়া বেশ একটু বিন্যাস করিয়া বসিল। তাহারও
false
robindronath
যাঁদের কথা বলছ আমি তাঁদের ভক্তি করি, তাঁদের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সে যখন তুমি কোনো-মতেই ঠিকভাবে বুঝবে না তখন আমার আর কোনো উপায় নেই, আমি এখনই এখান থেকে চললুম–যখন তুমি শান্ত হবে এবং বাড়িতে তোমার সঙ্গে একলা এসে বাস করতে পারব তখন আমি ফিরে আসব।” হরিমোহিনী কহিলেন, “গৌরমোহনের প্রতিই যদি তোর মন নেই, যদি তার সঙ্গে তোর বিয়ে হবেই না এমন কথা থাকে, তবে এই পাত্রটি দোষ করেছে কী? তুমি তো আইবুড়ো থাকবে না?” সুচরিতা কহিল, “কেন থাকব না! আমি বিবাহ করব না।” হরিমোহিনী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “বুড়োবয়স পর্যন্ত এমনি–” সুচরিতা কহিল, “হাঁ, মৃত্যু পর্যন্ত।” ৭১ এই আঘাতে গোরার মনে একটা পরিবর্তন আসিল। সুচরিতার দ্বারা গোরার মন যে আক্রান্ত হইয়াছে তাহার কারণ সে ভাবিয়া দেখিল–সে ইহাদের সঙ্গে মিশিয়াছে, কখন্‌ নিজের অগোচরে সে ইহাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিয়া ফেলিয়াছে। যেখানে নিষেধের সীমা টানা ছিল সেই সীমা গোরা দম্ভভরে লঙ্ঘন করিয়াছে। ইহা আমাদের দেশের পদ্ধতি নহে। প্রত্যেকে নিজের সীমা রক্ষা করিতে না পারিলে সে যে কেবল জানিয়া এবং না জানিয়া নিজেরই অনিষ্ট করিয়া ফেলে তাহা নহে, অন্যেরও হিত করিবার বিশুদ্ধ শক্তি তাহার চলিয়া যায়। সংসর্গের দ্বার নানাপ্রকার হৃদয়বৃত্তি প্রবল হইয়া উঠিয়া জ্ঞানকে নিষ্ঠাকে শক্তিকে আবিল করিয়া তুলিতে থাকে। কেবল ব্রাহ্মঘরের মেয়েদের সঙ্গে মিশিতে গিয়াই সে এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছে তাহা নহে। গোরা জনসাধারণের সঙ্গে যে মিলিতে গিয়াছিল সেখানেও একটা যেন আবর্তের মধ্যে পড়িয়া নিজেকে নিজে হারাইবার উপক্রম করিয়াছিল। কেননা, তাহার পদে পদে দয়া জন্মিতেছিল; এই দয়ার বশে সে কেবলই ভাবিতেছিল এটা মন্দ, এটা অন্যায়, এটাকে দূর করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু এই দয়াবৃত্তিই কি ভালো-মন্দ-সুবিচারের ক্ষমতাকে বিকৃত করিয়া দেয় না? দয়া করিবার ঝোঁকটা আমাদের যতই বাড়িয়া উঠে নির্বিকারভাবে সত্যকে দেখিবার শক্তি আমাদের ততই চলিয়া যায়–প্রধূমিত করুণার কালিমা মাখাইয়া যাহা নিতান্ত ফিকা তাহাকে অত্যন্ত গাঢ় করিয়া দেখি। গোরা কহিল–এইজন্যই, যাহার প্রতি সমগ্রের হিতের ভার তাহার নির্লিপ্ত থাকিবার বিধি আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে। প্রজার সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিলে তবেই যে প্রজাপালন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হয় এ কথা সম্পূর্ণ অমূলক। প্রজাদের সম্বন্ধে রাজার যেরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন সংস্রবের দ্বারা তাহার কলুষিত হয়। এই কারণে, প্রজারা নিজেই ইচ্ছা করিয়া তাহাদের রাজাকে দূরত্বের দ্বারা বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। রাজা তাহাদের সহচর হইলেই রাজার প্রয়োজন চলিয়া যাইবে। ব্রাহ্মণও সেইরূপ সুদূরস্থ, সেইরূপ নির্লিপ্ত। ব্রাহ্মণকে অনেকের মঙ্গল করিতে হইবে, এইজন্যই অনেকের সংসর্গ হইতে ব্রাহ্মণ বঞ্চিত। গোরা কহিল, “আমি ভারতবর্ষের সেই ব্রাহ্মণ।’ দশজনের সঙ্গে জড়িত হইয়া, ব্যবসায়ের পঙ্কে লুণ্ঠিত হইয়া, অর্থের প্রলোভনে লুব্ধ হইয়া, যে ব্রাহ্মণ শূদ্রত্বের ফাঁস গলায় বাঁধিয়া উদ্‌বন্ধনে মরিতেছে গোরা তাহাদিগকে তাহার স্বদেশের সজীব পদার্থের মধ্যে গণ্য করিল না; তাহাদিগকে শূদ্রের অধম করিয়া দেখিল, কারণ, শূদ্র আপন শূদ্রত্বের দ্বারাই বাঁচিয়া আছে, কিন্তু ইহারা ব্রাহ্মণত্বের অভাবে মৃত, সুতরাং ইহারা অপবিত্র। ভারতবর্ষ ইহাদের জন্য আজ এমন দীনভাবে অশৌচ যাপন করিতেছে। গোরা নিজের মধ্যে সেই ব্রাহ্মণের সঞ্জীবন-মন্ত্র সাধনা করিবে বলিয়া মনকে আজ প্রস্তুত করিল। কহিল, “আমাকে নিরতিশয় শুচি হইতে হইবে। আমি সকলের সঙ্গে সমান ভূমিতে দাঁড়াইয়া নাই। বন্ধুত্ব আমার পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নহে, নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয় আমি সেই সামান্যশ্রেণীর মানুষ নই, এবং দেশের ইতরসাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বর্জনীয়। পৃথিবী সুদূর আকাশের দিকে বৃষ্টির জন্য যেমন তাকাইয়া আছে ব্রাহ্মণের দিকে ইহারা তেমনি করিয়া তাকাইয়া আছে, আমি কাছে আসিয়া পড়িলে ইহাদিগকে বাঁচাইবে কে?” ইতিপূর্বে দেবপূজায় গোরা কোনোদিন মন দেয় নাই। যখন হইতে তাহার হৃদয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে, কিছুতেই সে আপনাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না, কাজ তাহার কাছে শূন্য বোধ হইতেছে এবং জীবনটা যেন আধখানা হইয়া কাঁদিয়া মরিতেছে, তখন হইতে গোরা পূজায় মন দিতে চেষ্টা করিতেছে। প্রতিমার সম্মুখে স্থির হইয়া বসিয়া সেই মূর্তির মধ্যে গোরা নিজের মনকে একেবারে নিবিষ্ট করিয়া দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উপায়েই সে আপনার ভক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিতে পারে না। দেবতাকে সে বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করে, তাহাকে রূপক করিয়া না তুলিয়া কোনোমতেই গ্রহণ করিতে পারে না। কিন্তু রূপককে হৃদয়ের ভক্তি দেওয়া যায় না। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে পূজা করা যায় না। বরঞ্চ মন্দিরে বসিয়া পূজার চেষ্টা না করিয়া ঘরে বসিয়া নিজের মনে অথবা কাহারো সঙ্গে তর্কোপলক্ষে যখন ভাবের স্রোতে মনকে ও বাক্যকে ভাসাইয়া দিত তখন তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দ ও ভক্তিরসের সঞ্চার হইত। তবু গোরা ছাড়িল না– সে যথানিয়মে প্রতিদিন পূজায় বসিতে লাগিল, ইহাকে সে নিয়মস্বরূপেই গ্রহণ করিল। মনকে এই বলিয়া বুঝাইল, যেখানে ভাবের সূত্রে সকলের সঙ্গে মিলিবার শক্তি না থাকে সেখানে নিয়মসূত্রেই সর্বত্র মিলন রক্ষা করে। গোরা যখনই গ্রামে গেছে সেখানকার দেবমন্দিরে প্রবেশ করিয়া মনে মনে গভীরভাবে ধ্যান করিয়া বলিয়াছে, এইখানেই আমার বিশেষ স্থান– এক দিকে দেবতা ও এক দিকে ভক্ত–তাহারই মাঝখানে ব্রাহ্মণ সেতুস্বরূপ উভয়ের যোগ রক্ষা করিয়া আছে। ক্রমে গোরার মনে হইল, ব্রাহ্মণের পক্ষে ভক্তির প্রয়োজন নাই। ভক্তি জনসাধারণেরই বিশেষ সামগ্রী। এই ভক্ত ও ভক্তির বিষয়ের মাঝখানে যে সেতু তাহার জ্ঞানেরই সেতু। এই সেতু যেমন উভয়ের যোগ রক্ষা করে তেমনি উভয়ের সীমারক্ষাও করে। ভক্ত এবং দেবতার মাঝখানে যদি বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যবধানের মতো না থাকে তবে সমস্তই বিকৃত হইয়া যায়। এইজন্য ভক্তিবিহ্বলতা ব্রাহ্মণের সম্ভোগের সামগ্রী
false
shordindu
চলে যায়‌, দ্বিতীয় শুখা আসে। দশটার সময়। বিশু পাল আন্দাজ ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরুলো‌, বোধ হয়। র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে বেরিয়েছিল‌, হাতে ছিল শুনাৰ্ছচের মত একটা অস্ত্র। গত তিন মাসে সে অভয় ঘোষালের চাল-চলন সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে একটা ঝি ছাড়া আর কেউ থাকে না; অভয় ঘোষাল নটর সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে যায়; সদর দরজা ভেজানো থাকে‌, চাকরানী বোধ হয় দশটার পর রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে সদর দরজা বন্ধ করে। ‘সুতরাং বিশু পালের কোনই অসুবিধা হল না। অভয় ঘোষালকে খুন করে সে দশটার আগেই নিজের বাড়িতে ফিরে এল; কেউ জানতে পারল না। যদি কেউ তাকে দেখে ফেলত। তাহলেও বিশু পালের অ্যালিবাই ভাঙা শক্ত হতো। যে লোক তিন মাস পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী সে খুন করতে যাবে কি করে? খুন করার মোটিভ কোথায়? ‘আজ ভোরবেল বিশু পাল আর একটা ইনজেকশন নিল। সাবধানের মার নেই। তারপর পুলিস-ডাক্তারকে নিয়ে আমরা গেলাম। পুলিস-ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন পক্ষাঘাতাই বটে। ‘আমার মনটা গোড়া থেকেই খুঁৎখুঁৎ করছিল। একটা সুদখোর মহাজন কেবল আমাকে তার দুঃখের কাহিনী শোনাবার জন্য একশো টাকা খরচ করবে? ওইখানেই বিশু পাল একটু ভুল করে ফেলেছিল। তারপর আজ সকালে যখন কাগজে অভয় ঘোষালের মৃত্যু-সংবাদ পড়লাম‌, তখন আর সন্দেহ রইল না যে বিশু পোলই অভয় ঘোষালের মৃত্যু ঘটিয়েছে। কিন্তু কী করে? ‘তিনজন লোক আছে : বিশু পাল নিজে‌, তার স্ত্রী এবং ডাক্তার রক্ষিত। ডাক্তার রক্ষিত খুবই প্যাঁচে পড়েছে‌, সে বিশু পালকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে পারে‌, কিন্তু নিজের হাতে খুন করবে: কি? বিশ্বাস হয় না। বিশু পালের স্ত্রী মেয়েমানুষ‌, স্বামীকে বাঁচাবার জন্যে সে অভয় ঘোষালকে হাতের কাছে পেলে বিষ খাওয়াতে পারে। কিন্তু অত দূরে গিয়ে ছুরি চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুরি মেয়েমানুষের অস্ত্র নয়। বাকি রইল বিশু পাল। কিন্তু সে তো পক্ষাঘাতে পঙ্গু– ‘গুর্খা দুটোকে গোড়াতেই বাদ দিয়েছি। প্ৰাণীহত্যায় তাদের অরুচি নেই‌, তারা কুকরি চালাতেও জানে। কিন্তু বিশু পাল নিজের গু্ররখা দারোয়ানকে দিয়ে খুন করাবে এত কাঁচা ছেলে সে নয়। গুর্খাদের মাথায় প্যাঁচালো বুদ্ধি নেই‌, তারা সরল এবং গোঁয়ার। ধরা পড়লেই সত্যি কথা বলে ফেলবে। ‘তবে?’ ‘হঠাৎ আসল কারসাজিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ডাক্তারি শাস্ত্ৰে জ্ঞান থাকলে অনেক আগেই বুঝতে পারতাম। বিশু পালের পক্ষাঘাত সত্যিকারের পক্ষাঘাত নয়‌, পক্ষাঘাতের অস্থায়ী বিকল্প‌, ডাক্তারি প্রক্রিয়ার দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। ‘ডাক্তার অসীম সেনকে ফোন করলাম। তিনি প্রবীণ ডাক্তার‌, এক কথায় বুঝিয়ে দিলেন। ‘আমার দুঃখ এই যে বিশু পালের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রক্ষিতও ছাড়া পেয়ে গেল। ডাক্তার হয়ে সে যে কাজ করেছে‌, তার ক্ষমা নেই। — যাহোক‌, প্রতিরক্ষা তহবিলে এক লক্ষ টাকাই বা মন্দ কি?’ স্বাধীনতা লাভের পর পনেরো বছর অতীত হইয়াছে। সনাতন ভারতীয় আইন অনুসারে আমাদের স্বাধীনতা দেবী সাবালিকা হইয়াছেন‌, পলায়নী মনোবৃত্তি ত্যাগ করিয়া কঠিন সত্যের সম্মুখীন হওয়ার সময় উপস্থিত। সুতরাং এ কাহিনী বলা যাইতে পারে। নেংটি দত্ত নামধারী অকালপক্ক বালককে লইয়া কাহিনী আরম্ভ করিতেছি‌, কারণ সে না থাকিলে এই ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটিত না। নেংটি একরকম জোর করিয়াই আমাদের বাসায় আসিয়া ব্যোমকেশের সহিত আলাপ জমাইয়াছিল। অত্যন্ত সংপ্রতিভ ছেলে‌, নাকে-মুখে কথা‌, বয়স সতেরো কি আঠারো‌, কিন্তু চেহারা রোগা-পাটকা বলিয়া আরো কম বয়স মনে হইত। এই বয়সে সে যথেষ্ট বুদ্ধি সংগ্রহ করিয়াছিল‌, অথচ সেই সঙ্গে একটু ন্যাকা-বোকাও ছিল; একাধারে ছেলেমানুষ এবং এঁচড়ে-পাকা। অল্প পরিচয়ে অত্যন্ত ফাজিল ও ডেপো মনে হইলেও আসলে সে যে মন্দ ছিল না। তাহার পরিচয় আমরা পাইয়াছিলাম। ব্যোমকেশকে সে মনে মনে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করিত‌, কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া মনে হইত। ব্যোমকেশের সমস্ত চালাকি সে ধরিয়া ফেলিয়াছে‌, ব্যোমকেশের চেয়ে তাহার বুদ্ধি অনেক বেশি। যখনই সে আমাদের বাসায় আসিত‌, ব্যোমকেশের সঙ্গে অপরাধ-বিজ্ঞান লইয়া পরম বিজ্ঞের মত আলোচনা করিত। ছেলেটা লেখাপড়ায় বহুদিন ইস্তফা দিয়াছে কিন্তু একেবারে অজ্ঞ নয়‌, ব্যোমকেশ হাসি মুখে তাহাকে আস্কারা দিত। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে প্রীতি-কৌতুক মিশ্রিত একটা সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। দুচার দিন আনাগোনা করার পর নেংটি হঠাৎ একদিন হাত বাড়াইয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, একটা সিগারেট দিন না।’ ব্যোমকেশ বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল‌, তারপর ধমক দিয়া বলিল‌, ‘এতটুকু ছেলে‌, তুমি সিগারেট খাও।‘ নেংটি বলিল‌, ‘পাব কোথায় যে খাব? মাসিমা একটি পয়সা উপুড়-হস্ত করে না‌, মাঝে-মধ্যে মেসোমশাইয়ের টিন থেকে দুএকটা চুরি করে খাই। তাছাড়া বাড়িতে কি সিগারেট খাওয়ার জো আছে? ধোঁয়ার গন্ধ পেলেই মাসিমা মারমার করে তেড়ে আসে। দিন না একটা।’ ব্যোমকেশ তাহাকে একটা সিগারেট দিল‌, সে তাহা পরম যত্নে সেবন করিয়া শীঘ্র আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া প্রস্থান করিল। অতঃপর সে যখনই আসিত তাহাকে একটা সিগারেট দিতে হইত। একদিন নেংটি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে আসিয়া বলিল, ‘জানেন ব্যোমকেশদা, আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে‌, ঠিক বিলিতি মেমের মত দেখতে।’ ব্যোমকেশ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি।’ নেংটি বলিল‌, ‘হ্যাঁ, এত সুন্দর মেয়ে আমি আর কখনো দেখিনি। আপনি যদি দেখেন ট্যারা হয়ে যাবেন।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে দেখব না। কে তিনি?’ নেংটি বলিল‌, ‘মেসোমশাইয়ের বন্ধুর মেয়ে। পূর্ববঙ্গে থাকত‌, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় বাপ-মা মরে গেছে; মেয়েটা কোন মতে প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। মেসোমশাই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন‌, বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমারই মত অবস্থা।’ মনে মনে নেংটির মেসোমশাই সন্তোষ সমাদ্দারকে সাধুবাদ করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকিলেও
false
shirshendu
যায়। তা যাক। দীপনাথ জানে, শরীরকে সক্ষম রাখতে গেলে ব্যায়াম ছাড়া পথ নেই। বসিয়ে রাখলেই শরীরে ঘুণ ধরে, আজ গ্যাস অম্বল, কাল রক্তচাপ, হার্টের ব্যামো দেখা দেবেই। শরীরের যত্ন নিতে দীপনাথ ঠেকে শিখেছে। এর আগে মেস বোর্ডিং-এ বার দুয়েক সে শক্ত টাইফয়েড আর হাইপার-অ্যাসিডিটিতে ভুগে বিছানা নিয়েছিল। ফলে শৌখিন শরীর হলে তার চলবে না। দুর্ভাগ্যবশত তার আপনজন বলতে কেউই নেই। দাদা, ভাই বা বোন আছে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠেনি বলে সম্পর্ক তেমন গাঢ় হয়নি। ফলে অসুখ বা বিপদ ঘটলে ভাই-বোনদের কাছে ধরনা দিতে তার লজ্জা করে। নিজের দায়িত্ব তার একেবারেই নিজের। অসুখ হয়ে পড়ে থাকা তার পোষায় না। ব্যায়ামের পর কাচের গেলাসে ভেজানো কাবলি ছোলা খেয়ে স্টেটসম্যানটা খুলে বসে দীপ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এবং আড়চোখে ঘড়ি দেখে। অফিস টাইমের আগেই বোসের ফাইবার গ্লাসের সুটকেসটা সারাতে চাদনি চক যেতে হবে। সুটকেস সারিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। অফিসে তার বাঁধাধরা কাজ নেই। গেলেই হয়। আসলে সে বোস সাহেবের চব্বিশ ঘণ্টার চাকর। পৃথিবীর খবর খুব ভাল নয়। খবরের কাগজওলারা সেই নিরানন্দ ছবিই তুলে ধরে বারবার। এনার্জি ক্রাইসিস, ইনফ্লেশন, পৃথিবী জুড়ে উগ্রপন্থীদের উৎপাত, দুর্ঘটনা। খবরের কাগজ ভাজ করে রেখে দীপ উঠে পোশাক পরে নেয়। চৌকির তলা থেকে সুটকেসটা বের করে টেনে। ওজনে হালকা হলেও বেশ বড়সড় জিনিস। বাসে-ট্রামে নেওয়া কষ্টকর। বোস এটার জন্য ট্যাক্সির ভাড়া দেয়নি। কৌতূহলবশে সুটকেসটা খুলল দীপ। ভিতরটা ভেলভেটের মতো নরম কাপড় দিয়ে ঢাকা, গভীর বেগুনি তার রং, অনেকগুলো পকেট রয়েছে নানা মাপের। দীপনাথ লোভী নয়, চোর নয়। তবু তার আঙুল প্রতিটি পকেটের ভিতর খুঁজতে লাগল। কী খুঁজছে তা সে জানে না। একেবারে সামনের দিকে লম্বা পকেটটাতে তার আঙুল একটুকরো কাগজ চিমটি দিয়ে তুলে আনল। একটু অবাক হয়ে দীপনাথ দেখে মিসেস বোসের সই করা একটা বেয়ারার চেক। টাকার অঙ্ক লেখা আছে আড়াই হাজার। কে একজন স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে লেখা হয়েছে। চেকটা অবশ্য ব্যাংক থেকে ফেরত দিয়েছে। লাল কালি দিয়ে আগাগোড়া চেকটাকে আক্রোশভরে কেটে দিয়েছে কেউ। দীপনাথ চেকটা পকেটে রেখে দিল। সকালের দিকে বোস সাহেবকে তার বাড়িতে রোজ একটা ফোন করার নিয়ম আছে। কোনও কাজ থাকলে বোস সাহেব তা ফোনেই বলে দেন। আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে দীপ ফোন করতেই মিসেস বোসের গলা পাওয়া গেল। গলাটি মিষ্টি বটে, কিন্তু বেশ ঝাঁঝালো। দীপনাথ সবিনয়ে বলে, আমি দীপ। বুঝেছি। মিস্টার বোস এইমাত্র বাথরুমে গেলেন। দীপনাথ আড়চোখে ঘড়ি দেখে। এ সময়ে বোস সাহেবের বাথরুমে যাওয়ার কথা নয়। ঘড়ির কাঁটায় চলা মানুষ। বাথরুমে থাকেন আটটা থেকে সওয়া আটটা। এখন সাড়ে আটটা বাজছে প্রায়। দীপ মৃদু স্বরে বলে, আজ যেন একটু ইররেগুলার হলেন মিস্টার বোস। ওপাশে মিসেস বোস থমথমে গলায় বললেন, হ্যাঁ। কয়েকজন ভিজিটর এসে পড়েছিল বলে দেরি। আপনি কি একটু ধরবেন? দীপনাথ সংকোচের সঙ্গে বলে, আমি ডাকঘর থেকে ফোন করছি। এখানে তো বেশিক্ষণ লাইন আটকে রাখতে দেবে না। উঃ, আপনার যে কত প্রবলেম দীপনাথবাবু! ঠিক আছে, আপনি না হয় পরে ফোন করবেন। শুনুন মিসেস বোস, আপনাদের সুটকেসটার মধ্যে একটা জিনিস ছিল। কী জিনিস? দামি কিছু? না। স্ক্র্যাপ একটা চেক। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে দেওয়া আপনার সই করা চেক। হঠাৎ খুব কঠিন হয়ে গেল মিসেস বোসের কণ্ঠস্বর। বললেন, আপনি সুটকেসটা খুলেছিলেন কেন? দীপনাথ একটু হাসল আপনমনে। বলল, সারাতে হলে মিস্ত্রিরাও তো খুলবে। তাই আমি আগেভাগে দেখে নিচ্ছিলাম, ভিতরে কিছু রয়ে গেছে কি না। ও। ঠিক আছে। চেকটা কী করব? স্ক্র্যাপ চেক যখন, ফেলে দিন। বলেই পরমুহূর্তেই মিসেস বোস হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, না, না। শুনুন, চেকটা আপনি নিজে নিয়ে এসে আমাকে দেবেন। প্লিজ, হারিয়ে ফেলবেন না। আচ্ছা। ফোন রেখে রাস্তার মোড়ের কাছে স্টার সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিতে বসে নিমীলিত চোখে আয়নায় নিজের সাবানের ফেনায় অর্ধেক ঢাকা মুখের দিকে চেয়ে দীপ ভাবে, মিসেস বোস খুব সাবধানি মেয়ে। চেকটা দীপ নষ্ট করে নাও ফেলতে পারে এবং সেটা দিয়ে কোনওদিন মিসেস বোসকে ব্ল্যাকমেল করতেও পারে, এই ভয়েই না ফেরত চাইল! আজকাল মানুষ মানুষকে একদম বিশ্বাস করে না। দীপ স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির একটা কাল্পনিক চেহারা ভাবতে চেষ্টা করল। নামটাই এমন মোলায়েম এবং দেবত্বে ভরা যে, যতবার চোখ বুজল ততবার শিবনে এক জটাধারী পুরুষকে দেখতে পেল। নিশ্চয়ই ওরকম নয় আসল স্নিগ্ধদেব। সম্ভবত পায়জামা পাঞ্জাবি পরা দাড়িওলা, রোগা ও রগচটা এবং ভীষণ পড়াশুনো জানা কোনও উগ্রপন্থী যুবাই হবে। মিসেস বোসের একটা পলিটিক্যাল লাইন আছে, সে জানে। কিন্তু কিছুতেই স্নিগ্ধদেবকে মিসেস বোসের গোপন প্রেমিক বা জার বলে মনে হয় না। কারণ, মিসেস বোস ওরকম নয়। গোপনতার ধারও ধারে না। যা চায় তা মুখ ফুটে চাইতে জানে। দরকার মতো স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট হিম্মত আছে। না, মিসেস বোসের চরিত্রের সঙ্গে গুপ্তপ্রেম ব্যাপারটা একদম খাটে না। তবু কোথাও একটা গোপনীয়তা আছেও। নইলে শেষ মুহূর্তে চেকটা অত আকুলভাবে ফেরত চাইত না। দীপ যখন চাঁদনি চওকে পৌঁছোল তখন বেলা সাড়ে ন’টা। নানু মিয়ার দোকানে সুটকেসটা জমা করে বেরোল আবার ফোন করতে। মিস্টার বোস এতক্ষণে অফিসে এসে গেছেন। ফোন ধরেই মিস্টার বোস বলেন, আজ শনিবার খেয়াল আছে তো? হ্যাঁ। আপনি বেলা একটার মধ্যে রেসের মাঠে
false
shomresh
লালন করতে পারে না। কবে কোন যৌবনে বকুর প্রতি ওর যে অভিমান ঘৃণা বা অহংকারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, এখন এতদিন পরে নেশার চুড়ান্ত মুহূর্তে সেগুলো ফিরে পেল সেরা-পেয়ে বোধহয় আজ সারারাত বুদ হয়ে থাকবে। ভরবিকেলে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় না এই সবে সকাল হয়েছে। নিজের মনে হেসে আবার হাঁটতে লাগলেন সরিৎশেখর। পেছনে বকু সর্দার। সেরা তখনও টলছে। ওরা যে চলে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। সাদা নুড়ি-বিছানো বাগানের পথ দিয়ে ওরা হাঁটতে লাগল। ফ্যাক্টরির আলো ফুরিয়ে যেতেই টর্চ জ্বাললেন তিনি। পাঁচ-ব্যাটারির জোরালো আলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চমকে চমকে সামনের পথটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। দুপাশে ছোট শুকনো নালার ধারে থরে থরে চা-গাছ। রাস্তাটার বাকে দাড়িয়ে পেছনে তাকালেন উনি। দূরে ঝিম হয়ে থাকা ফ্যাক্টরির হলদে-মেরে-যাওয়া আলোয় ডিসপেনসারি-বাড়িটা আনাড়ি হাতের তোলা ছবির মতো মনে হচ্ছে। আর তার সামনে একা রোগাটে শাড়ি জড়ানো শরীর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছে। সরিৎশেখর লক্ষ করলেন, বকু পেছন ফিরে দেখল না। মাথা নিচু করে পেছন পেছন আসছে তাঁর। দুপাশের চা-গাছের মধ্যে দিয়ে চলে-যাওয়া অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে যেতে-যেতে সরিৎশেখর লক্ষ করলেন, বকু পেছন ফিরে দেখল না। মাথা নিচু করে যেতে-যেতে সরিৎশেখর হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘ্রাণ পেলেন। ছোটবউ কবে চলে গেছে। তখন তো তার মধ্যযৌবন। এই এতদিন ধরে তিনি কী ভীষণ একা! আর আশ্চর্য, কথাটা এমন করে কই কখনো মনে পড়েনি তাঁর। এই স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে তার শিকড়গুলো কত গভীরে নেমে গেছে-নিজের কথা মনে পড়ার সুযোগই দেয়নি। এখন ছেলেরা বড় হয়ে গিয়েছে। দুটো সরল কথা বলার মতো সম্পর্ক নেই আর। বড় মেয়ে বিধবা হয়ে তার কাছেই আছে। ওঁর দেখাশুনা সেই করে। কিন্তু তাকেও তো সহজ হয়ে কিছু বলতে পারেন না তিনি। এই বয়সে নিজের চারদিকে এত রকমের দেওয়াল নিজেই খাড়া করে রেখেছেন দিনদিন-আজ বর কষ্ট হল সরিৎশেখরের। ভারী পা টেনে টেনে চা-বাগানের রাস্তা ছেড়ে কোয়ার্টারের সামনে মাঠে এলেন উনি। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চেয়ে দেখলেন, এটা ছোট্ট শরীর সারা গায়ে তার টর্চের আলো মেখে দুর্গাঠাকুরের পায়ে ছুঁড়ে দেওয়া অঞ্জলির মতো ছুটে আসছে। হঠাৎ আলো নিবিয়ে ফেললেন এবার। এই ঘন অন্ধকারে দাড়িয়ে তার শরীরে লক্ষ কদম ফুটে আসছে। হঠাৎ আলো নিবিয়ে ফেললেন তার শীত বোধ হল যেন। দুহাত বাড়িয়ে নিজের বিশাল দেহে নরম শরীরটাকে প্রায় লুফে নিয়ে কী গাঢ় মমতায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দাদু? এখন তাঁর চারপাশে কোনো দেওয়াল নেই। আকাশ হাতের কাছে, বুকের ওপরে। ক্লাবঘরে মাঝে-মাঝে শোরগোল উঠছে। পটাপট তাস ফেলার শব্দ, এর ওর ভুল বুঝিয়ে দেবার চেষ্টায় কান পাতা দায় ওখানে। যাজাকে পূর্ণ আলো দরজা-জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়েছে বাইরের অন্ধকারে। মহীতোষ ওখানে আছেন। তাস-পাগল লোক। ব্রিজ টুর্নামেন্টে আশেপাশের চা-বাগান থেকে অনেক ট্রফি জিতে এনেছেন মালবাবুকে পার্টনার করে। সরিৎশেখরের যৌবনকালে কোনো ক্লাবঘর ছিল না স্বৰ্গছেঁড়ায়। মহীতোষরা খালি-পড়ে-থাকা খড়ের ছাদ দেওয়া ঘরটাকে ক্লাবঘর বানিয়ে নিয়েছেন মেরামত করে। অবশ্য স্বৰ্গছেঁড়া বাজারে এখন বিরাট ক্লাবঘর হয়েছে। টিম্বার মার্টেন্টস আর কন্ট্রাক্টররা এসে আঁকিয়ে বসেছে চা-বাগানের পাশে স্বৰ্গছেঁড়া বাজারে। ওটা খাসমহলের এলাকা। মাঝে-মাঝে মহীতোষরা ঐ ক্লাবে তাস খেলতে যান। শুধু ব্রিজ নয়, পয়সা বাজি রেখে রামি, এমনকি কালীপূজার রাত্রে তিনতাস খেলাও হয়ে থাকে ওখানে। সরিৎশেখর ব্যাপারটা একদম পছন্দ করেন না। ফলে মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হলেও রামি বা তিনতাস নিজেদের ক্লাবে খেলেন না মহীতোষরা। অনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাবঘরের দিকে একবার তাকাল। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, মালবাবুকে কল ভুল দেবার জন্য বকছেন। এখন যদি অনিকে দেখতে পান, চিৎকার করে উঠবেন, কী চাই এখানে-যাও! অথচ মহীতোযকে বলার দরকার ছিল। সরিৎশেখর অনুমতি দিয়েছেন শুনে মা বলেছেন, বেশ যাও, বাবাকে বলে যেও। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু বাবাকে বলার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি অনির। ক্লাবঘরে যাওয়া নিষেধ ওর। ও আবার ভিতরের ঘরে ফিরে এল। এটা সরিৎশেখরের ঘর। একপাশে খাটে বিছানা সাজানো। লম্বা ইজিচেয়ারে উনি বসে আছে। বিরাট পেটমোটা হারিকেনটা একটা স্ট্যান্ডের ওপর জ্বলছে। সামনে-রাখা টিপয়ের ওপর একটা দাবার বোর্ড।কালো গুটি খুব পছন্দ সরিৎশেখরের। বা হাতের তালুতে মুখ রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বোর্ডের দিকে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে খেলা চলতে চলতে ওর প্রতিদ্বন্দী একটু উঠে গেছে। কিন্তু অনি জানে এটা দাদুর অভ্যেস। এই একা একা দাবা খেলা। হোটবাবু মারা যাবার পর থেকে দাদু একাই দাবা খেলেন। আগে ফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ছোটবাবু চলে আসতেন এখানে। জখাবার খেতে দাদুর সঙ্গে। তারপর দাবাখেলার বোর্ড পাতা হত। প্রায় দাদুর বয়সি মানুষ মাথা জুড়ে টাক, সন্ধের পর আর বাঁধানো দাঁত পরতেন না বলে মুখটা বিশ্রী দেখাত। দাদুর সঙ্গে অনেকদিন এই চা-বাগানে কাটিয়েছিলেন উনি। বলতে গেলে দাদুর বন্ধু বলতে উনিই ছিলেন। খেলতে খেলতে কাশি হত ওর, আর চট করে উঠে-আসা কফ গিলে ফেলে দাদুর দিকে অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাতেন ছোটবাবু। সঙ্গে সঙ্গে ঝের্ড থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নাড়তেন সরিৎশেখর, নিজেই নিজের মৃত্যু ডাকছ হে, আমার , শুধু সন্ধের পর এই খেলাটা বন্ধ হবে এই যা। যেদিন ছোৰু মারা গেলেন অনির মনে পড়েছিল ঐ কফগেলার কথাটা। নিশ্চয়ই কক্ষগুলো জমে জমে ছোটবাবুর পেটটা ভরতি হয়ে গিয়েছিল। সেদিন চা-বাগানের লোকজন ছোটবার বাড়িতে ভেঙে পড়েছিল। অনেকদিনের মানুষ। কিন্তু সরিৎশেখর যাননি। অনিদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন হোটবাবুকে
false
humayun_ahmed
সে মোটর সাইকেল নিয়ে এসে প্রায়ই নায়লাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। তার প্রধান কাজ ছিল ঘুরে বেড়ানো। মোটর সাইকেল নিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেত। একবার নিয়ে গেল জয়দেবপুরে ফরেস্টের এক বাংলোতে। নির্জন বাংলো। শুধু একজন কেয়ারটেকার এবং দারোয়ান। কেয়ারটেকার ঘর খুলে দিল। কাঠের বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। এত নির্জন চারদিক, নায়লার ভয় ভয় করছিল। রফিকুল ইসলাম চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল, বলল, কি খুকী, ভয় লাগছে (লোকটা তাকে মজা করে খুকী ডাকত)? না। ভয় করার কোন কারণ নেই। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসেছ! তাই না? হুঁ। আমরা এখানে রাত দশটা পর্যন্ত থাকব। তোমার বাবা-মাকে বলে এসেছি, কাজেই ওরা চিন্তা করবে না। ডাকবাংলোয় রাত দশটা পর্যন্ত থাকব এটা বলে এসেছেন? আরে না, পাগল হয়েছ? বাংলাদেশী বাবা মা ডাকবাংলো শুনলেই আঁৎকে উঠবেন। তাঁদেরকে বলেছি, তোমাকে নিয়ে আমার এক অসুস্থ খালাকে দেখতে যাব। ফিরতে দেরি হতে পারে, নস্টা-দশটা বাজবে। তাঁরা খুশি মনে বলেছেন, আচ্ছা। সেই ডাকবাংলোয় তারা রাত দশটা না, রাত এগারোটা পর্যন্ত ছিল। নায়লা ডাকবাংলোয় তার অভিজ্ঞতার গল্প কাউকে বলেনি। বলা সম্ভবও নয়, এবং উচিতও নয়। তবে রফিকুল ইসলাম নামের সানগ্লাস পরা ঐ লোক ডাকবাংলোর গল্প নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে করেছে। ছেলেরা এই জাতীয় গল্প বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে করতে ভালবাসে। অনেকে স্ত্রীদের সঙ্গেও করে। কিছু কিছু স্ত্রী আছে স্বামীর মুখে এ জাতীয় গল্প শুনতে ভালবাসে। নায়লার দূর সম্পর্কের এক মামী আছেন–রাঙ্গামামী–তিনি সুযোগ পেলেই তাঁর স্বামীর এই ধরনের একটা গল্প শুনিয়ে দেবেন–বুঝলি নায়লা, বিয়ের আগে তোর মামা ছিল ভয়াবহ এক চীজ। মেয়েদের পটানোর সে এক হাজার একটা কৌশল জানে। কোন মেয়েকে তার মনে ধরেছে তো আর দেখতে হবে না। ঐ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে। তোর মামা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিছানাতে নেবেই। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল–একবার বিছানায় নেবার পর তোর মামার সব আগ্রহ শেষ। এই চ্যাপ্টার ক্লাজ–নতুন আরেক চ্যাপ্টার …। রফিকুল ইসলাম নামের লোকটাও কি তার স্ত্রীর কাছে ইন্টারেস্টিং গল্প হিসেবে নায়লার গল্প করেছে? করেছে বলেই মনে হয়। গল্প করার মত অনেক কিছুই সেই ডাকবাংলোয় ঘটেছিল। রফিকুল ইসলাম মজা করে ঐ গল্প করলেও নায়লা কোনদিনও কারো সঙ্গে এই গল্প করবে না। যদিও প্রায়ই তার মনে হয় জামানকে ঘটনাটা বলে! হয়ত বলবে। এখন না হলেও কোন একদিন। যখন তারা দুজনই বুড়ো হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারা চলে যাবে দূরে দূরে। যখন নায়লার জামান ছাড়া কোন আশ্রয় থাকবে না। জামানেরও নায়লা ছোড়া কেউ থাকবে না–তখন। এই গল্প আপাতত বাক্সবন্দী থাকুক। সাভার স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাবার গল্পটাও চাপা থাকুক। এমন কিছু না যে আগ বাড়িয়ে বলে বেড়াতে হবে। নায়লার কি জ্বর আসছে? গা জ্বালা করছে–মাথায় শিরা দপদপ করছে . . .। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বাবুর জন্যে কেনা থার্মোমিটার আছে। জ্বরটা দেখলে হয়। ইচ্ছা করছে না। সামনের সোমবারে বাবুর জন্মদিন। দুবছর হবে। ঠিক দুবছরে তার দুধ ছাড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্রী ঝামেলা করে–বাতিস দুদু, কোলা দুদু। লজ্জায় পড়তে হয়। আচ্ছা, বাবুর জন্মদিনে ছোটখাট ঘরোয়া ধরনের একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? একটা কেক কেনা হল। বাসায় সে পোলাও-কোরমা রান্না করল। কয়েকজনকে খেতে বলল। তার মা-বাবা, আলম। এই সূঙ্গে অরুণাকেও বলা যেতে পারে। তাহলে জন্মদিনের আসরেই দুজনের দেখা হয়ে যায়। ঝামেলা চুকে যায়। আলমকে অবশ্যি জন্মদিনের কথা বলা যাবে না। বললেই দামী একটা কিছু কিনে নিয়ে এসে সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলবে। অলিমকে বললে–খাবার-দাবার আরেকটু ভাল করতে হবে। বড় মাছের একটা পেট কিনে আনতে পারলে মাছের আইটেম করা যায়। বড় মাছ কি সে পছন্দ করে? ঐ দিন ছোট মাছ খুব আগ্রহ করে খেল। মাকে নিয়ে গিয়ে মেথি দিয়ে গোশত রান্না করালে কেমন হয়? আচ্ছা, সে শুধু আলমের কথা ভাবছে কেন? তার কি অন্য চিন্তা-ভাবনা কিছু নেই? ঘর কি ময়লা হয়ে আছে। ফিরুর মা নিশ্চয়ই আজ ঘর ঝাঁট দেয়নি। এই মহিলা আছেই শুধু ফাঁকিবাজিতে। বাবুর জন্মদিন উপলক্ষে ফিরুর মাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার। বাবুর জন্যে দরকার হাফহাতা একটা স্যুয়েটার…। লাল রঙের হাফহাতা সুয়েটার বাবুকে খুব মানায়। এ বছর প্রচুর সুয়েটার এসেছে–একদিন সময় করে সুয়েটার দেখে আসতে হবে। যেদিন তাড়া থাকে সেদিনই একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। আজ জামানের সকাল সকাল অফিসে যাবার কথা। বছর শেষের এই দিনটি জামানদের অফিসের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এইদিন অফিসে কাজকর্ম তেমন কিছু হয় না। কয়েকটা মিটিং হয়। মিটিংএর বিষয়বস্তু হল–বিগত বছরে কোম্পানী কি করেছে তার পর্যালোচনা। সামনের বছরে কোম্পানী কি করবে তার আভাস। পদোন্নতির ব্যাপারগুলিও এই দিনই জানা যায়। দুপুরে কোম্পানীর খরচে লাঞ্চ দেয়া হয়। ফুল রোস্ট, রেজালা, দৈ, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংকস …। ঠিকমত অফিসে পৌঁছার জন্যে জামান আজ অন্যদিনের চেয়ে আগেই রওনা হয়েছিল। বাসে করে যাচ্ছে–শাহবাগের মোড়ে বাসের ভেতর প্রচণ্ড হৈ চৈ। বাস নাকি বেবীটেক্সির উপর উঠে গেছে। চারদিক থেকে ধর ধর শব্দ। নিমেষের মধ্যে বাসের ড্রাইভার দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়ল। সে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ছুটছে, তার পেছনে ছুটছে রাজ্যের মানুষ। কণ্ডাক্টার পালাতে পারেনি। বাসের যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেছে। শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মার। এই লোকটার দোষ কি? একসিডেন্টের সময় যে যাত্রীদের ভাড়া আদায় করছিল। বেবীটেক্সির উপর বাস তুলে দেয়াতে তার কোন ভূমিকা ছিল না। লোকটাকে কি মেরেই ফেলবে?
false
shorotchandra
জানে এতবড় দুর্ভোগ, এতবড় ফাঁকি আর নেই, কিন্তু একদিন এ বিড়ম্বনা যখন ধরা পড়ে, তখন প্রতিকারের সময় বয়ে যায়। হরেন্দ্র কহিল, তার পরে? কমল বলিল, পরের খবর জানিনে, হরেনবাবু, লক্ষ্মীর সার্থকতার শেষ দেখে আসতে পারিনি, আগেই চলে আসতে হয়েছিল; কিন্তু ঐ যে আমার গাড়ি এসে দাঁড়াল। চলুন, পথে যেতে যেতে বলব। নমস্কার। এই বলিয়া সে একমুহূর্তে উঠিয়া দাঁড়াইল। নীলিমা নিঃশব্দে নমস্কার করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার দুই চক্ষের তারকা যেন অঙ্গারের মত জ্বলিতে লাগিল। চোদ্দ ‘আশ্রম’ শব্দটা কমলের সম্মুখে হরেন্দ্রর মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গিয়াছিল। শুনিয়া অবিনাশ যে-ঠাট্টা করিয়াছিলেন সে অন্যায় হয় নাই। জনকয়েক দরিদ্র ছাত্র ওখানে থাকিয়া বিনা-খরচায় স্কুলে পড়াশুনা করিতে পায়—ইহাই লোকে জানে। বস্তুতঃ, নিজের এই বাসস্থানটাকে বাহিরের লোকের কাছে অতবড় একটা গৌরবের পদবীতে তুলিয়া ধরার সঙ্কল্প হরেন্দ্রর ছিল না। ও নিতান্তই একটা সাধারণ ব্যাপার এবং প্রথমে আরম্ভও হইয়াছিল সামান্যভাবে। কিন্তু এ-সকল জিনিসের স্বভাবই এই যে, দাতার দুর্বলতায় একবার জন্মগ্রহণ করিলে আর ইহাদের গতির বিরাম থাকে না। কঠিন আগাছার ন্যায় মৃত্তিকার সমস্ত রস নিঃশেষে আকর্ষণ করিয়া ডালে-মূলে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতে ইহাদের বিলম্ব হয় না। হইলও তাই। এ বিবরণটাই প্রকাশ করিয়া বলি। হরেন্দ্রর ভাই-বোন ছিল না। পিতা ওকালতি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে সংসারে অবশিষ্ট ছিলেন শুধু হরেনের বিধবা মা। তিনিও পরলোক গমন করিলেন। ছেলের তখন লেখাপড়া সাঙ্গ হইল। অতএব, আপনার বলিতে এমন কেহই আর রহিল না যে তাহাকে বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করে, কিংবা উদ্যোগ ও আয়োজন করিয়া পায়ে শৃঙ্খল পরায়। অতএব, পড়া যখন সমাপ্ত হইল তখন নিতান্ত কাজের অভাবেই হরেন্দ্র দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করিল। সাধুসঙ্গ বিস্তর করিল, ব্যাঙ্কের জমানো সুদ বাহির করিয়া দুর্ভিক্ষ-নিবারণী-সমিতি গঠন করিল, বন্যাপ্লাবনে আচার্যদেবের দলে ভিড়িল, মুক্তি-সঙ্ঘে মিলিয়া কানা-খোঁড়া-নুলো-হাবা-বোবা ধরিয়া আনিয়া সেবা করিল,—নাম জাহির হইতেই দলে দলে ভালো লোকেরা আসিয়া তাহাকে বলিতে লাগিল, টাকা দাও, পরোপকার করি। বাড়তি টাকা শেষ হইয়াছে, পুঁজিতে হাত না দিলে আর চলে না,—এমনি যখন অবস্থা, তখন হঠাৎ একদিন অবিনাশের সঙ্গে তাহার পরিচয়। সম্বন্ধ যত দূরের হউক, পৃথিবীতে একটা লোকও যে তখনো বাকী আছে যাহাকে আত্মীয় বলা চলে, এ খবর সেইদিন সে প্রথম পাইল।অবিনাশদের কলেজে তখন মাস্টারি একটা খালি ছিল; চেষ্টা করিয়া সেই কর্মে তাহাকে নিযুক্ত করাইয়া সঙ্গে করিয়া আগ্রায় আনিলেন। এ দেশে আসিবার ইহাই তাহার ইতিহাস। পশ্চিমের মুসলমানী আমলের প্রাচীন শহরগুলার সাবেককালের অনেক বড় বড় বাড়ি এখনও অল্প ভাড়ায় পাওয়া যায়, ইহারই একটা হরেন্দ্র যোগাড় করিয়া লইল। এই তাহার আশ্রম। কিন্তু এখানে আসিয়া যে-কয়দিন সে অবিনাশের গৃহে অতিবাহিত করিল—তাহারই অবকাশে নীলিমার সহিত তাহার পরিচয়। এই মেয়েটি অচেনা লোক বলিয়া একটা দিনের জন্যও আড়ালে থাকিয়া দাসী-চাকরের হাত দিয়া আত্মীয়তা করিবার চেষ্টা করিল না—একেবারে প্রথম দিনটিতেই সম্মুখে বাহির হইল। কহিল, তোমার কখন কি চাই, ঠাকুরপো, আমাকে জানাতে লজ্জা করো না। আমি বাড়ির গিন্নী নই—অথচ গিন্নীপনার ভার পড়েছে আমার ওপর। তোমার দাদা বলছিলেন, ভায়ার অযত্ন হলে মাইনে কাটা যাবে। গরীব মানুষের লোকসান করে দিয়ো না ভাই। দরকারগুলো যেন জানতে পারি। হরেন কি যে জবাব দিবে খুঁজিয়া পাইল না। লজ্জায় সে এমনি জড়সড় হইয়া উঠিল যে, এই মিষ্ট কথাগুলি যিনি অবলীলাক্রমে বলিয়া গেলেন তাঁহার মুখের দিকেও চাহিতে পারিল না। কিন্তু লজ্জা কাটিতেও তাহার দিন-দুয়ের বেশী লাগিল না। ঠিক যেন না কাটিয়া উপায় নাই,—এমনি। এই রমণীর যেমন স্বচ্ছন্দ অনাড়ম্বর প্রীতি, তেমনি সহজ সেবা। তিনি যে বিধবা, সংসারে তাঁহার যে সত্যকার আশ্রয় কোথাও নাই—তিনিও যে এ বাড়িতে পর—এই কথাটাও একদিকে যেমন তাঁহার মুখের চেহারায়, তাঁহার সাজসজ্জায়, তাঁহার রহস্য-মধুর আলাপ-আলোচনায় ধরিবার জো নেই, তেমনি এইগুলাই যে তাঁহার সবটুকু নহে এ কথাটাও না বুঝিয়া উপায়ান্তর নাই। বয়স নিতান্ত কম নহে, বোধ করি বা ত্রিশের কাছাকাছি গিয়া পৌঁছিয়াছে। এই বয়সের সমুচিত গাম্ভীর্য হঠাৎ খুঁজিয়া পাওয়া দায়,—এমনি হালকা তাঁহার হাসি-খুশির মেলা, অথচ একটুখানি মনোনিবেশ করিলেই স্পষ্ট বুঝা যায়—এমন একটা অদৃশ্য আবেষ্টন তাঁহাকে অহর্নিশি ঘিরিয়া আছে যাহার ভিতরে প্রবেশের পথ নাই। বাটীর দাসী-চাকরেরও না, বাটীর মনিবেরও না। এই গৃহে, এই আবহাওয়ার মাঝখানেই হরেন্দ্রর সপ্তাহ-দুই কাটিয়া গেল। হঠাৎ একদিন সে আলাদা বাসা ভাড়া করিয়াছে শুনিয়া নীলিমা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, এত তাড়াতাড়ি করতে গেলে কেন ঠাকুরপো, এখানে কি এমন তোমার আটকাচ্ছিল? হরেন্দ্র সলজ্জে কহিল, একদিন ত যেতেই হত বৌদি। নীলিমা জবাব দিল, তা হয়ত হত। কিন্তু দেশসেবার নেশার ঘোর তোমার এখনো চোখ থেকে কাটেনি ঠাকুরপো, আরও দিন-কতক না হয় বৌদির হেপাজতেই থাকতে। হরেন্দ্র বলিল, তাই থাকব বৌদি। এই ত মিনিট-দশেকের পথ—আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যাব কোথায়? অবিনাশ ঘরের মধ্যে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন; সেইখান হইতেই কহিলেন, যাবে জাহান্নমে। অনেক বারণ করেছিলাম, হরেন, যাসনে আর কোথাও, এইখানে থাক। কিন্তু সে কি হয়? ইজ্জত বড়—না দাদার কথা বড়! যাও, নতুন আড্ডায় গিয়ে দরিদ্র-নারায়ণের সেবা চড়াও গে। ছোটগিন্নী, ওকে বলা বৃথা। ও হল চড়কের সন্ন্যাসী—পিট ফুঁড়ে ঘুরতে না পেলে ওদের বাঁচাই মিথ্যে। নূতন বাসায় আসিয়া হরেন্দ্র চাকর-বামুন রাখিয়া অতিশয় শান্তশিষ্ট নিরীহ মাস্টারের ন্যায় কলেজের কাজে মন দিল। প্রকাণ্ড বাড়িতে অনেক ঘর। গোটা-দুই ঘর ছাড়া বাকী সমস্তই পড়িয়া রহিল। মাস-খানেক পরেই এই শূন্য ঘরগুলা তাহাকে পীড়া দিতে লাগিল। ভাড়া দিতে হয়, অথচ কাজে লাগে
false
humayun_ahmed
তোমার খুবই সাহস। আতর বলল, ঠিকই বলেছেন, আমার অনেক সাহস। তোমার বাবা এই ঘটনা জানেন না? না। আর জানলেই কী? উনি আমারে কি শাস্তি দিবে? আমারে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা উনার নাই! বাপজান আমারে ভয় পায়। ভয় পায়? হুঁ। বাপজান ভাব দেখায় সে খুব সাহসী। আসলে ভীতু। বেজায় ভীতু। শরিফা ইতস্তত করে বলল, রঙিলা বাড়িতে কী দেখলা? আতর বলল, দিনের বেলা গিয়েছিলাম। কিছুই দেখি নাই। সুন্দর সুন্দর মেয়ে— হাসতেছে, গল্প করতেছে। একৃজুন আরেকজনের চুল বানতেছে। ইমাম ইদরিস সাহেবের স্ত্রী জুলেখা না-কি রঙিলা বাড়িতে থাকেন? উনার সঙ্গে দেখা হয়েছে? না। উনি রঙিলা বাড়িতে থাকেন না। উনি কলিকাতা থাকেন। তাঁর গানের নতুন রেকর্ড হবে, এইজনে গিয়েছেন। আপনি কি রেকর্ডে উনার গান শুনেছেন? শুনি নাই। শুনতে ইচ্ছা করে। আতর বলল, শুনতে ইচ্ছা করলে আমি শুনাব। তোমার কাছে কি কলের গান আছে? কলিকাতার বাড়িতে আছে। আমি আনাব। কবে আনাবা? খুব শিগগির আনাব। এখুন্টু আমি যাই। আচ্ছা যাও, আবার আসবা। আতর উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করব। যদি মনে কিছু না নেন। শরিফা বলল, মনে কিছু নিব না। যা ইচ্ছা জিজ্ঞাস করা। আপনার স্বামী আপনাকে তালাক দিয়েছেন। তারপরেও আপনি স্বামীর ঘরে বাস করেন। এটা কেমন কথা। শরিফা বলল, আমি আমার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাই আমারে সুখে নাই। আমার কোনোখানে যাওয়ার জায়গা নাই। ইমাম সাব আমারে আবার বিবাহ করতে রাজি হয়েছেন। উনি দয়া করেছেন। বিবাহ কবে? ধর্মে নিয়ম আছে। উনি বিবাহ করার আগে আমারে অন্য জায়গায় বিবাহ করতে হবে। এরে বলে হিল্লা’ বিবাহ। আমারে কেউ হিল্লা বিবাহ করতে রাজি না বইলা দেরি হইতেছে। তবে আমি একঘরে থাকলেও আলাদা থাকি। উনার সঙ্গে কথা বলি না। পর্দার মধ্যে থাকি। ভইন, আর কিছু জিজ্ঞাস করবা? না। আতরের মন খারাপ হয়ে গেল। শরিফা হাসিখুশি মেয়ে, এখন কেমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। আতরের নিজেরও কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এরকম তার প্রায়ই হয়। নিজের দুঃখে না, অন্যের দুঃখে তার কাঁদতে ইচ্ছা করে। যে সময়ের কথা বলছি সে-সময়ে হিল্লা বিবাহ কঠিন বিষয় ছিল। ইসলাম ধর্ম প্রচারের যুগে ভারতবর্ষের মুসলমানরা কঠোরভাবে ধর্মের নিয়মকানুন পালন করতেন না। ধর্মকর্মে চিলাঢ়ালা ভাব ছিল। অনেক হিন্দুয়ানী ছিল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ভক্তিভরে দেবদেবীকে নমস্কার করতেন। তাদের কাছে পারলৌকিক এবং ইহলৌকিক মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা জানাতেন। দেবদেবীদের নাম দিয়ে ছেলেমেয়েদের নামও রাখতেন। যেমন– নারায়ণ শেখ গোকুল মোল্লা কালী বানু। মুসলমান মেয়েরা শাঁখা পরতেন, কপালে সিঁদুর দিতেন। মুসলমান বাড়িতে থাকত তুলসি মঞ্চ। সেখানে সান্ধ্যপ্ৰদীপ জ্বালানো হতো। ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি মৌলানা এনায়েত আলী এবং মৌলানা কেরামত আলি ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। তাদের ধর্ম প্রচার আন্দোলনের নাম ‘তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া’। এই নামের অর্থ – মোহাম্মদের পথ। তরিকায়ে মোহম্মদীয়া আন্দোলনের পাশাপাশী চলছিল ফরায়েজী আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূচনা করেন শরীয়তুল্লাহ। ফরায়েজী আন্দোলন মোহাম্মদ (দঃ)-এর শিক্ষার চেয়ে কোরানের শিক্ষাকে প্রাধান্য দিল। তাদের মতে মুসলমানদের সব বাদ দিয়ে কোরানের ফরজ আঁকড়ে ধরতে হবে। ফরায়েজী আন্দোলন এবং তার পরে পরে হানাফি মোস্তাহাবের কট্টরপন্থী আন্দোলনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সহজিয়া ভাব দূর হয়ে গেল। তালাক দেয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহের ব্যাপারে কোরান শরীফ ‘হিল্লা বিবাহ’ উল্লেখ করেছে, কাজেই হিল্লা বিবাহ হতে হবে। এর মধ্যেও মনগড়া অনেক নিয়মকানুন তৈরি হয়ে গেল। যেমন, যিনি তার তালাকপ্ৰাপ্ত স্ত্রীকে আবার বিবাহ করতে চান। তিনি তার ইচ্ছার কথা জুমার নামাজের পর সমস্ত মুসল্লিদের জানাবেন। যাতে মুসল্লিদের মধ্যে যিনি ইচ্ছা করেন। তিনিই বিয়েতে আগ্ৰহ প্ৰকাশ করতে পারেন। গোপনে কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়া যাবে না। পবিত্র কোরান শরীফে এ জাতীয় কোনো নিয়মকানুন নেই। সূরা বাকারায় (আয়াত ২৩০) আল্লাহপাক বলছেন— ( ), . ( ) . অনুবাদ: তারপর যদি সে ঐ স্ত্রীকে তালাক দেয়। তবে যে পর্যন্ত না। ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করেছে তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। তারপর যদি সে (দ্বিতীয় স্বামী) তাকে তালাক দেয় তবে তাদের আবার মিলনে কারও কোনো দোষ নেই, যদি দুজনে ভাবে যে তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রেখে চলতে পারবে। অনুবাদ : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এক জুম্মার নামাজে খুৎবা পাঠের পর ইমাম করিম শরিফার হিল্লা বিবাহের কথা বললেন। মুসল্লিদের মাঝে গুঞ্জন দেখা গেল। এ ধরনের ঘটনা বান্ধবপুরে এর আগে ঘটে নি। করিম বললেন, তালাক দেয়া স্ত্রীকে নিজের বাড়িতেই আমি রেখেছি। বাধ্য হয়ে রেখেছি। তবে তার মুখ দর্শন করি না। সে আলাদা ঘরে থাকে। তার হিল্লা বিবাহের পর আমি ইনশাল্লাহ আবার তাকে বিবাহ করব। আমি একটা ভুল করেছি। আল্লাহপাকের কাছে ভুলের জন্যে ক্ষমা চাই। আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালো পাই। সে ভালো মেয়ে। এখন তার জন্যে আমার মন কান্দে। কথা বলতে গিয়ে ইমাম করিমের গলা ভারী হয়ে গেল। তার চোখে পানিও এসে গেল। পাগড়ির কোণা দিয়ে তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, যদিও আল্লাহপাক তালাক বৈধ করেছেন, তারপরেও তার কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ। অপছন্দের কাজ বলেই তিনি যেসব দম্পতি তালাকের পর পুনর্বিবাহ করতে চায় তাদের জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। হিল্লা বিবাহ এইরকম এক শাস্তি। জুম্মাবার উপলক্ষে একজন মসজিদে খিচুড়ি সিন্নি দিয়েছিল। করিম সেই খিচুড়ি খানিকটা খেয়ে মসজিদে শুয়ে থাকলেন। বাড়িতে গেলেন না। ঠিক করলেন আছর, মাগরিব এবং এশার নামাজ
false
shorotchandra
করিল, ভিতরে বুঝি ধর্মদাস-গিন্নী এসেচে? খবরদার, খবরদার, অমন কাজটি ক’রো না বাবা! বিট্‌লে বামুন যতই ফোসলাক্‌, ধর্মদাস-গিন্নীর হাতে ভাঁড়ারের চাবি-টাবি দিও না বাবা, কিছুতে দিও না—ঘি, ময়দা, তেল, নুন অর্ধেক সরিয়ে ফেলবে। তোমার ভাবনা কি বাবা? আমি গিয়ে তোমার মামীকে পাঠিয়ে দেব। সে এসে ভাঁড়ারের ভার নেবে, তোমার একগাছি কুটো পর্যন্ত লোকসান হবে না। রমেশ ঘাড় নাড়িয়া ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া মৌন হইয়া রহিল। তাহার বিস্ময়ের অবধি নাই। ধর্মদাস যে তাহার গৃহিণীকে ভাঁড়ারের ভার লইবার জন্য পাঠাইয়া দিবার কথা এত গোপনে কহিয়াছিল, গোবিন্দ ঠিক তাহাই আন্দাজ করিয়াছিল কিরূপে? উলঙ্গ শিশু-দুটা ছুটিয়া আসিয়া দীনুদার কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল—বাবা, সন্দেশ খাব। দীনু একবার রমেশের প্রতি একবার গোবিন্দের প্রতি চাহিয়া কহিল, সন্দেশ কোথায় পাব রে? কেন, ঐ যে হচ্চে, বলিয়া তাহারা ওদিকের ময়রাদের দেখাইয়া দিল। আঁমরাও দাঁদামশাই, বলিয়া নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে আরও তিন-চারটি ছেলেমেয়ে ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ ধর্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল। বেশ ত, বেশ ত, বলিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল—ও আচায্যিমশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েচে, খেয়ে ত আসেনি—ওহে ও, কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে। ময়রা সন্দেশের থালা লইয়া আসিবামাত্র ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল; বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল—ওরে ও খেঁদি, খাচ্ছিস ত, সন্দেশ হয়েচে কেমন বল্‌ দেখি? বেশ বাবা, বলিয়া খেঁদি চিবাইতে লাগিল। দীনু মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হ’ল। হাঁ হে কারিগর, এ কড়াটা কেমন নামালে—কি বল গোবিন্দভায়া, এখনও একটু রোদ আছে বলে মনে হচ্ছে না? ময়রা কোন দিকে না চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ কহিল, আজ্ঞে আছে বৈ কি! এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে-আহ্নিকের— তবে কৈ দাও দেখি একটা গোবিন্দভায়াকে, চেখে দেখুক কেমন কলকাতার কারিগর তোমরা! না, না, আমাকে আবার কেন? তবে আধখানা—আধখানার বেশী নয়। ওরে ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন্‌ দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি— রমেশ ডাকিয়া বলিয়া দিল, অমনি বাড়ির ভিতর থেকে গোটা-চারেক থালাও নিয়ে আসিস ষষ্ঠীচরণ। প্রভুর আদেশ মত ভিতর হইতে গোটা-তিনেক রেকাবি ও জলের গেলাস আসিল এবং দেখিতে দেখিতে এই বৃহৎ থালার অর্ধেক মিষ্টান্ন এই তিন প্রাচীন ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট সদ্‌ব্রাহ্মণের জলযোগে নিঃশেষিত হইয়া গেল। হাঁ, কলকাতার কারিগর বটে! কি বল ধর্মদাসদা? বলিয়া দীননাথ রুদ্ধনিশ্বাস ত্যাগ করিল। ধর্মদাসদার তখনও শেষ হয় নাই, এবং যদিচ তাঁহার অব্যক্ত কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া সহজে মুখ দিয়া বাহির হইতে পারিল না, তথাপি বোঝা গেল এ বিষয়ে তাহার মতভেদ নাই। হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে! বলিয়া গোবিন্দ সকলের শেষে হাত ধুইবার উপক্রম করিতেই ময়রা সবিনয়ে অনুরোধ করিল, যদি কষ্টই করলেন ঠাকুরমশাই, তবে মিহিদানাটা একটু পরখ করে দিন। মিহিদানা? কই আনো দেখি বাপু? মিহিদানা আসিল এবং এতগুলি সন্দেশের পরে এই নূতন বস্তুটির সদ্ব্যবহার দেখিয়া রমেশ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল! দীননাথ মেয়ের প্রতি হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিল, ওরে ও খেঁদি, ধর্‌ দিকি মা এই দুটো মিহিদানা। আমি আর খেতে পারব না বাবা। পারবি, পারবি। এক ঢোক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত নয়! না পারিস্‌ আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ্‌, কাল সকালে খাস্‌, হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে! যেন অমৃত! তা বেশ হয়েচে। মিষ্টি বুঝি দুরকম করলে বাবাজী! রমেশকে বলিতে হইল না। ময়রা সোৎসাহে কহিল, আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন— অ্যাঁ ক্ষীরমোহন! কৈ সে ত বার করলে না বাপু? বিস্মিত রমেশের মুখের পানে চাহিয়া দীননাথ কহিল, খেয়েছিলুম বটে রাধানগরের বোসেদের বাড়িতে। আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালোবাসি। রমেশ হাসিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল। কথাটা বিশ্বাস করা তাহার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইল না। রাখাল কি কাজে বাহিরে যাইতেছিল, রমেশ তাহাকে ডাকিয়া কহিল, ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন; যা ত রাখাল, কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আনতে বলে আয় দেখি। সন্ধ্যা বোধ করি উত্তীর্ণ হইয়াছে। তথাপি ব্রাহ্মণেরা ক্ষীরমোহনের আশায় উৎসুক হইয়া বসিয়া আছেন। রাখাল ফিরিয়া বলিল, আজ আর ভাঁড়ারের চাবি খোলা হবে না বাবু। রমেশ মনে মনে বিরক্ত হইল। কহিল, বল গে, আমি আনতে বলচি। গোবিন্দ গাঙ্গুলী রমেশের অসন্তোষ লক্ষ্য করিয়া চোখ ঘুরাইয়া কহিল, দেখলে দীনুদা, ভৈরবের আক্কেল? এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসির বেশি দরদ। সেই জন্যই আমি বলি— সে কি বলে তাহা না শুনিয়া রাখাল বলিয়া উঠিল, আচায্যিমশাই কি করবেন? ও-বাড়ি থেকে গিন্নীমা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করেছেন যে! ধর্মদাস এবং গোবিন্দ উভয়ে চমকিয়া উঠিল, কে, বড়গিন্নী? রমেশ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, জ্যাঠাইমা এসেছেন? আজ্ঞে হাঁ, তিনি এসেই ছোট-বড় দুই ভাঁড়ারই তালাবন্ধ করে ফেলেছেন। বিস্ময়ে আনন্দে রমেশ দ্বিতীয় কথাটি না বলিয়া দ্রুতপদে ভিতরে চলিয়া গেল। তিন জ্যাঠাইমা! ডাক শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী ভাঁড়ার ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। বেণীর বয়সের সঙ্গে তুলনা করিলে তাহার জননীর বয়স পঞ্চাশের কম হওয়া উচিত নয়, কিন্তু দেখিলে কিছুতেই চল্লিশের বেশি বলিয়া মনে হয় না। রমেশ নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল। আজও সেই কাঁচা সোনার বর্ণ। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজও সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, সুমুখেই
false
bongkim
রাত্রিকাল–কেবল নক্ষত্রালোকে পথ দেখা যাইতেছে। সুতরাং তাহাদের অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। বেহারারা দেখিল, যেন কালান্তর যমের মত দুই মূর্ত্তি আসিতেছে। একজন বেহারা অপরদিগকে বলিল, “মানুষ দুটোকে সন্দেহ হয়!” অপর আর একজন বলিল, “রাত্রে যখন বেড়াচ্চে, তখন কি আর ভাল মানুষ?” তৃতীয় বাহক বলিল, “মানুষ দুটো ভারি জোয়ান।” ৪র্থ। হাতে লাঠি দেখ্ছি না? ১ম। চক্রবর্ত্তী মহাশয় কি বলেন? আর তো এগোনো যায় না–ডাকাতের হাতে প্রাণটা যাবে। চক্রবর্তী মহাশয় বলিলেন, “তাই ত বড় বিপদ্ দেখি যে! যা ভেবেছিলেম, তাই হলো!” এমন সময়ে, যে দুই ব্যক্তি আসিতেছিল, তাহারা পথে লোক দেখিয়া হাঁকিল, “কোন্ হ্যায় রে?” বেহারারা অমনি পাল্কী মাটিতে ফলিয়া দিয়া “বাবা গো” শব্দ করিয়া একেবারে জঙ্গলের ভিতর পলাইল। দেখিয়া দুর্লভ চক্রবর্তী মহাশয়ও সেই পথাবলম্বী হইলেন। তখন ফুলমণি “আমায় ফেলে কোথা যাও?” বলিয়া তাঁর পাছু পাছু ছুটিল। যে দুই জন আসিতেছিল–যাহারা এই দশ জন মনুষ্যের ভয়ের কারণ–তাহারা পথিক মাত্র। দুই জন হিন্দুস্থানী দিনাজপুরের রাজসরকারে চাকরির চেষ্টায় যাইতেছে। রাত্রিপ্রভাত নিকট দেখিয়া সকালে সকালে পথ চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। বেহারারা পলাইল দেখিয়া তাহারা একবার খুব হাসিল। তাহার পর আপনাদের গন্তব্য পথে চলিয়া গেল। কিন্তু বেহারারা, আর ফুলমণি ও চক্রবর্তী মহাশয় আর পাছু ফিরিয়া চাহিল না। প্রফুল্ল পাল্কীতে উঠিয়াই মুখের বাঁধন স্বহস্তে খুলিয়া ফেলিয়াছিল। রাত্রি দুই প্রহরে চীৎকার করিয়া কি হইবে বলিয়া চীৎকার করে নাই; চীৎকার শুনিতে পাইলেই বা কে ডাকাতের সম্মুখে আসিবে! প্রথমে ভয়ে প্রফুল্ল কিছু আত্মবিস্মৃত হইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রফুল্ল স্পষ্ট বুঝিল যে, সাহস না করিলে মুক্তির কোন উপায় নাই। যখন বেহারারা পাল্কী ফেলিয়া পলাইল, তখন প্রফুল্ল বুঝিল–আর একটা কি নূতন বিপদ্। ধীরে ধীরে পাল্কীর কপাট খুলিল। অল্প মুখ বাড়াইয়া দেখিল, দুই জন মনুষ্য আসিতেছে। তখন প্রফুল্ল ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিল; যে অল্প ফাঁক রহিল, তাহা দিয়া প্রফুল্ল দেখিল, মনুষ্য দুই জন চলিয়া গেল। তখন প্রফুল্ল পাল্কী হইতে বাহির হইল–দেখিল, কেহ কোথাও নাই। প্রফুল্ল ভাবিল, যাহারা আমাকে চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছিল, তাহারা অবশ্য ফিরিবে। অতএব যদি পথ ধরিয়া যাই, তবে ধরা পড়িতে পারি। তার চেয়ে এখন জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া থাকি। তার পর, দিন হইলে যা হয় করিব। এই ভাবিয়া প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল। ভাগ্যক্রমে যে দিকে বেহারারা পলাইয়াছিল, সে দিকে যায় নাই। সুতরাং কাহারও সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইল না। প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অল্পক্ষণ পরেই প্রভাত হইল। প্রভাত হইলে প্রফুল্ল বনের ভিতর এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিল। পথে বাহির হইতে এখনও সাহস হয় না। দেখিল, এক জায়গায় একটা পথের অস্পষ্ট রেখা বনের ভিতরের দিকে গিয়াছে। যখন পথের রেখা এদিকে গিয়াছে, তখন অবশ্য এদিকে মানুষের বাস আছে। প্রফুল্ল সেই পথে চলিল। বাড়ী ফিরিয়া যাইতে ভয়, পাছে বাড়ী হইতে আবার তাকে ডাকাইতে ধরিয়া আনে। বাঘ-ভালুকে খায়, সেও ভাল, আর ডাকাইতের হাতে না পড়িতে হয়। পথের রেখা ধরিয়া প্রফুল্ল অনেক দূর গেল–বেলা দশ দণ্ড হইল, তবু গ্রাম পাইল না। শেষে পথের রেখা বিলুপ্ত হইল–আর পথ পায় না। কিন্তু দুই এক‎খানা পুরাতন ইট দেখিতে পাইল। ভরসা পাইল। মনে করিল, যদি ইট আছে, তবে অবশ্য নিকটে মনুষ্যালয় আছে। যাইতে যাইতে ইটের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। জঙ্গল দুর্ভেদ্য হইয়া উঠিল। শেষে প্রফুল্ল দেখিল নিবিড় জঙ্গলের মধযে এক বৃহৎ অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। প্রফুল্ল ইষ্টকস্তূপের উপর আরোহণ করিয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিল। দেখিল, এখনও দুই চারিটা ঘর অভগ্ন আছে। মনে করিল, এখানে মানুষ থাকিলেও থাকিতে পারে। প্রফুল্ল সেই সকল ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে লাগিল। দেখিল, সকল ঘরের দ্বার খোলা–মনুষ্য নাই। অথচ মনুষ্য-বাসের চিহ্নও কিছু কিছু আছে। ক্ষণপরে প্রফুল্ল কোন বুড়া মানুষের কাতরানি শুনিতে পাইল। শব্দ লক্ষ্য করিয়া প্রফুল্ল এক কুঠরীমধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, সেখানে এক বুড়া শুইয়া কাতরাইতেছে। বুড়ার শীর্ণ দেহ, শুষ্ক ওষ্ঠ, চক্ষু কোটরগত, ঘন শ্বাস। প্রফুল্ল বুঝিল, ইহার মৃত্যু নিকট। প্রফুল্ল তাহার শয্যার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। বুড়া প্রায় শুষ্ককণ্ঠে বলিল, “মা, তুমি কে? তুমি কি কোন দেবতা, মৃত্যুকালে আমার উদ্ধারের জন্য আসিলে?” প্রফুল্ল বলিল, “আমি অনাথা। পথ ভুলিয়া এখানে আসিয়াছি। তুমিও দেখিতেছি অনাথ–তোমার কোন উপকার করিতে পারি?” বুড়া বলিল, “অনেক উপকার এ সময়ে করিতে পার। জয় নন্দদুলাল! এ সময়ে মনুষ্যের মুখ দেখিতে পাইলাম। পিপাসায় প্রাণ যায়–একটু জল দাও।” প্রফুল্ল দেখিল, বুড়ার ঘরে জল-কলসী আছে, কলসীতে জল আছে, জলপাত্র আছে; কেবল দিবার লোক নাই। প্রফুল্ল জল আনিয়া বুড়াকে খাওয়াইল। বুড়া জল পান করিয়া কিছু সুস্থির হইল। প্রফুল্ল এই অরণ্যমধ্যে মুমূর্ষু বৃদ্ধকে একাকী এই অবস্থায় দেখিয়া বড় কৌতূহলী হইল। কিন্তু বুড়া তখন অধিক কথা কহিতে পারে না। প্রফুল্ল সুতরাং তাহার সবিশেষ পরিচয় পাইল না। বুড়া কয়টি কথা বলিল, তাহার মর্ম্মার্থ এই;- বুড়া বৈষ্ণব। তাহার কেহ নাই, কেবল এক বৈষ্ণবী ছিল। বৈষ্ণবী বুড়াকে মুমূর্ষু দেখিয়া তাহার দ্রব্যসামগ্রী যাহা ছিল, তাহা লইয়া পলাইয়াছে। বুড়া বৈষ্ণব–তাহার দাহ হইবে না। বুড়ার কবর হয়–এই ইচ্ছা। বুড়ার কথামত, বৈষ্ণবী বাড়ীর উঠানে তাহার একটি কবর কাটিয়া রাখিয়া গিয়াছে। হয়ত শাবল কোদালি সেইখানে পড়িয়া আছে। বুড়া এখন প্রফুল্লের কাছে এই ভিক্ষা চাহিল যে, “আমি মরিলে সেই কবরে আমাকে টানিয়া ফেলিয়া দিয়া মাটি চাপা দিও।” প্রফুল্ল স্বীকৃত হইল। তার পর বুড়া বলিতে লাগিল, “আমার কিছু টাকা পোঁতা আছে। বৈষ্ণবী
false
bongkim
যায় না। বোধ করি, পণ্ডিতবর মক্ষমূলর মনোযোগ করিলে এ বিষয়ে মীমাংসা করিতে পারেন। যে পণ্ডিত মীমাংসা করিয়াছেন যে, অশোকের পূর্ব্বে আর্য্যেরা লিখিতে জানিত না, সেই পণ্ডিতই এ কথার মীমাংসায় সক্ষম। আর একটি কথা আছে। সর উইলিয়ম জোন্স হইতে মক্ষমূলর পর্য্যন্ত প্রাচ্যবিৎ পণ্ডিতেরা বলেন যে, এদেশে সংস্কৃত নামে আর একটি ভাষা আছে। কিন্তু এদেশে আসিয়া আমি কাহাকেও সংস্কৃত কহিতে বা লিখিতে দেখি নাই। সুতরাং এদেশে সংস্কৃত ভাষা থাকার বিষয়ে আমার বিশ্বাস নাই। বোধ হয় এটি সর উইলিয়ম জোন্স প্রভৃতির কারসাজি। তাঁহারা পশারের জন্য এ ভাষাটি সৃষ্টি করিয়াছেন।4 যাহা হৌক, উহাদিগের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বলিব। তোমরা শুনিয়াছ যে, হিন্দুরা চারিটি জাতিতে বিভক্ত; কিন্তু তাহা নহে। ইহাদিগের মধ্যে অনেকগুলি জাতি আছে, তাহাদের নাম নিম্নে লিখিতেছি। ১। ব্রাহ্মণ, ২। কায়স্থ, ৩। শূদ্র, ৪। কুলীন, ৫। বংশজ, ৬। বৈষ্ণব, ৭। শাক্ত, ৮। রায়, ৯। ঘোষাল, ১০। টেগোর, ১১। মোল্লা, ১২। ফরাজি, ১৩। রামায়ণ, ১৪। মহাভারত, ১৫। আসাম গোয়ালপাড়া, ১৬। পারিয়া ডগ্‌স। বাঙ্গালিদিগের চরিত্র অত্যন্ত মন্দ। তাহারা অত্যন্ত মিথ্যাবাদী, বিনা কারণেও মিথ্যা কথা বলে। শুনিয়াছি, বাঙ্গালিদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র। আমি অনেকগুলিন বাঙ্গালিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, তিনি কোন্ জাতি? সকলেই বলিল, তিনি কায়স্থ। কিন্তু তাহারা আমাকে ঠকাইতে পারিল না; কেন না, আমি সেই পণ্ডিতবর মক্ষমূলরের গ্রন্থে 5 পড়িয়াছি যে, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র ব্রাহ্মণ। দেখা যাইতেছে যে, “” শব্দ “” শব্দের অপভ্রংশ, অতএব মিত্র মহাশয়কে পুরোহিতজাতীয়ই বুঝায়। বাঙ্গালিদিগের একটি বিশেষ গুণ এই যে, তাহারা অত্যন্ত রাজভক্ত। যেরূপ লাখে লাখে তাহারা যুবরাজকে দেখিতে আসিয়াছিল, তাহাতে বোধ হইল যে, ঈদৃশ রাজভক্ত জাতি আর পৃথিবীতে কোথাও জন্মগ্রহণ করে নাই। ঈশ্বর আমাদিগের মঙ্গল করুন, তাহা হইলে তাহাদিগেরও কিছু মঙ্গল হইতে পারে। বাঙ্গালিরা স্ত্রীলোকদিগকে পরদানশীন করিয়া রাখে শুনা আছে। ইহা সত্য বটে, তবে সর্ব্বত্র নয়।6 যখন কোন লাভের কথা না থাকে, তখন স্ত্রীলোকদিগকে অন্তঃপুরে রাখে, লাভের সূচনা দেখিলেই বাহির করিয়া আনে। আমরা যেরূপ ফৌলিংপিস লইয়া ব্যবহার করি, বাঙ্গালিরা পৌরাঙ্গনা লইয়াও সেরূপ করে; যখন প্রয়োজন নাই, তখন বাক্সবন্দি করিয়া রাখে, শিকার দেখিলেই বাহির করিয়া তাহাতে বারুদ পোরে। বন্দুকের সিসের গুলিতে ছার পক্ষিজাতির পক্ষচ্ছেদ হয়, বাঙ্গালির মেয়ের নয়নবাণে কাহার পক্ষচ্ছেদের আশা করে বলিতে পারি না। আমি বাঙ্গালির কন্যার অঙ্গাভরণের যেরূপ গুণ দেখিয়াছি, তাহাতে আমার ইচ্ছা করে, আমারও ফৌলিংপিসটিকে দুই একখানা সোণার গহনা পরাইব-দেখি, পাখী ঘুরিয়া আসিয়া বন্দুকের উপর পড়ে কি না। তবু নয়নবাণে কেন, শুনিয়াছি বাঙ্গালির মেয়ে নাকি পুষ্পবাণ প্রয়োগেও বড় সুপটু। হিন্দু সাহিত্যোক্ত পুষ্পশরে, আর এই বঙ্গকামিনীগণের পরিত্যক্ত পুষ্পশরে কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা আমি জানি না; যদি থাকে, তবে বাঙ্গালির মেয়েকে দুরাকাঙ্ক্ষিণী বলিতে হইবে। শুনিয়াছি, কোন বাঙ্গালি কবি নাকি লিখিয়াছিলেন “কি ছার মিছার ধনু, ধরে ফুলবাণ”; এখন কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিতে হইবে, “কি ছার মিছার ফুল, মারে ফুলবান”। যাহা হউক, ফুলবাণ সচরাচর প্রচলিত না হইয়া উঠে। বাঙ্গালায় ইংরেজ টেঁকা ভার হইবে-আমার সর্ব্বদা ভয় করে, আমি এই গরিব দোকানদারের ছেলে, দু টাকার লোভে সমুদ্র পার হইয়া আসিয়াছি-কে জানে, কখন বঙ্গকুলকামিনী-প্রেরিত কুসুমশর আসিয়া, এই ছেঁড়া তাম্বু ফুটা করিয়া, আমার হৃদয়ে আঘাত করিবে, আমি অমনি ধপাস্ করিয়া চিতপাত হইয়া পড়িয়া যাইব! হায়! তখন আমার কি হইবে! কে মুখে জল দিবে! আমি এমত বলি না যে, সকল বাঙ্গালির মেয়ে এরূপ ফৌলিংপিস, অথবা সকলেই এরূপ পুষ্পক্ষেপণী প্রেরণে সচতুরা। তবে কেহ কেহ বটে, ইহা আমি জনরবে অবগত হইয়াছি। শুনিয়াছি, তাঁহারা নাকি ভর্ত্তৃনিয়োগানুসারেই এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত। এই ভর্ত্তৃগণ দেশীয় শাস্ত্রানুসারেই এই পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন। হিন্দুদিগের যে চারিটি বেদ আছে-তাহার মধ্যে চাণক্যশ্লোক নামক বেদে (আমি এই সকল শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হইয়াছি) লেখা আছে যে, আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি। ইহার অর্থ এই, হে পদ্মপলাশলোচনে শ্রীকৃষ্ণ! আমি আপনার উন্নতির জন্য তোমাকে এই বনফুলের মালা দিতেছি, তুমি গলায় পর। ————————- 3 & 4 সাবধান, কেহ হাসিবেন না। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত ডুগাল্‌ড ষ্টুয়ার্ট যথার্থই এই মতাবলম্বী ছিলেন। 5 6 বাঙ্গালি স্ত্রীলোকেরা কেহ কেহ অন্তঃপুর পরিত্যাগ করিয়া রাজপুত্রকে অভ্যর্থনা করিয়াছিল। 7 জন ডিক্‌সন সাহেবকে ফৌজদারী আদালতে ধরিয়া আনিয়াছে। সাহেব বড় কালো, তা হলে হয় কি, সাহেব ত বটে-পাড়াগেঁয়ে কাছারিতে বিচার দেখিতে অনেক রঙ্গদার লোক ছুটিয়া গেল। বিচার একটা দেশী ডিপুটির কাছে হইবে। তাহাতে সাহেবের কিছু কষ্ট; তবে মনে মনে ভরসা আছে যে, বাঙ্গালিটা ভয়ে আমাকে ছাড়িয়া দিবে। ডিপুটি মহাশয়ের রকম দেখিয়াও তাই বোধ হয়, একটা তেকেলে বুড়ো-নিরীহ রকম ভাল মানুষ; জড়সড় হইয়া বসিয়া আছে। এদিকে কনষ্টেবল মহাশয়েরা কতকটা ভয়ে ভয়ে সাহেব মহাশয়কে ডকস্থ করিলেন। সাহেব ডকস্থ হইয়াই একটু গরম হইয়া হাকিমের পানে চাহিয়া চোখ ঘুরাইয়া একটু বাঁকা বাঁকা বুলিতে বলিলেন, “সে হামাকে টোমরা হেখানে কেন আনিলো?” হাকিম বলিল, “কি জানি সাহেব! কেন আনিলো-তুমি কি করেছ?” সাহেব। যা করে না কেন, টোমার সাতে হামার কোন বাট হোবে না। হাকিম । কেন সাহেব? সাহেব। টুমি কালা বাঙ্গালি আছে। হাকিম । তার পর? সাহেব। হামি সাহেব আছে। হাকিম । তা ত দেখ্‌ছি-তাতে কি হলো? সাহেব। তোমার-কি বলে? সেটা লেই। হাকিম । তবু ভাল-মাতৃভাষা ধরেছ, এতক্ষণ বাঁকা বাঁকা বুলি ধরেছিলে কেন? কি নেই? সাহেব। সেই ঝাতে মোকদ্দমা করে-সে তুমি জানে না? হাকিম । সাহেব, আমি
false
shorotchandra
যে আত্মপ্রকাশ করিয়া বসে, তাহা কিছুতেই অনুমান করা যায় না। ইতিপূর্বে কত অসংখ্য গুরুতর কারণ ঘটিয়া গিয়াছে, আমি কোনদিন আপনাকে ধরা দিই নাই; কিন্তু আজ তাহার মুখের এই অত্যন্ত সোজা কথাটা সহ্য করিতে পারিলাম না। মুখ দিয়া সহসা বাহির হইয়া গেল—সকলের মনের কথা ত জানিনে রাজলক্ষ্মী, কিন্তু একজনের জানি। যদি কোনদিন ফিরে আসি ত শুধুই তোমার জন্যই আসব। তোমার মাথার দিব্যি আমি অবহেলা করব না। পিয়ারী আমার পায়ের উপর একেবারে ভাঙ্গিয়া উপুড় হইয়া পড়িল। আমি ইচ্ছা করিয়াই পা টানিয়া লইলাম না। কিন্তু মিনিট-দশেক কাটিয়া গেলেও যখন সে মুখ তুলিল না, তখন তাহার মাথার উপর আমার ডান হাতখানা রাখিতেই, সে একবার শিহরিয়া কাঁপিয়া উঠিল; কিন্তু তেমনি পড়িয়া রহিল। মুখও তুলিল না, কথাও কহিল না। বলিলাম, উঠে বস, এ অবস্থায় কেউ দেখলে সে ভারি আশ্চর্য হয়ে যাবে। কিন্তু পিয়ারী একটা জবাব পর্যন্ত যখন দিল না, তখন জোর করিয়া তুলিতে গিয়া দেখিলাম, তাহার নীরব অশ্রুতে সেখানকার সমস্ত চাদরটা একেবারে ভিজিয়া গেছে। টানাটানি করিতে, সে রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, আগে আমার দু-তিনটে কথার জবাব দাও, তবে আমি উঠব। কি কথা বল? আগে বল, ও লোকটা এখানে থাকাতে তুমি আমাকে কোন মন্দ মনে করনি? না। পিয়ারী আবার একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু আমি যে ভাল নই, সে ত তুমি জানো! তবে কেন সন্দেহ হয় না? প্রশ্নটা অত্যন্ত কঠিন। সে যে ভাল নয়, তাও জানি; সে যে মন্দ এও ভাবিতে পারি না। চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। হঠাৎ সে চোখ মুছিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, আচ্ছা, জিজ্ঞেস করি তোমাকে, পুরুষমানুষ যত মন্দই হয়ে যাক, ভাল হতে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না; কিন্তু আমাদের বেলাই সব পথ বন্ধ কেন? অজ্ঞানে, অভাবে পড়ে একদিন যা করেচি, চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন? কেন আমাদের তোমরা ভাল হতে দেবে না? আমি বলিলাম, আমরা কোনদিন মানা করিনে। আর করলেও সংসারে ভাল হবার পথ কেউ কারো আটকে রাখতে পারে না। পিয়ারী অনেকক্ষণ পর্যন্ত চুপ করিয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিল, বেশ। তা হলে তুমিও আটকাতে পারবে না। আমি জবাব দিবার পূর্বেই রতনের কাসির শব্দ দ্বারের কাছে শুনিতে পাওয়া গেল। পিয়ারী ডাকিয়া কহিল, কি রে রতন? রতন মুখ বাড়াইয়া বলিল, মা, রাত্রি ত অনেক হল—বাবুর খাবার নিয়ে আসবে না? বামুনঠাকুর ঢুলে ঢুলে রান্নাঘরেই ঘুমিয়ে পড়েচে। তাইত, তোদের কারুর যে এখনো খাওয়া হয়নি, বলিয়া পিয়ারী ব্যস্ত এবং লজ্জিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আমার খাবারটা সে বরাবর নিজের হাতেই লইয়া আসিত; আজও আনিবার জন্য দ্রুতপদে চলিয়া গেল। আহার শেষ করিয়া যখন বিছানায় শুইয়া পড়িলাম, তখন রাত্রি একটা বাজিয়া গেছে। পিয়ারী আসিয়া আবার আমার পায়ের কাছে বসিল। বলিল, তোমার জন্যে অনেক রাত্রি একলা জেগে কাটিয়েচি—আজ তোমাকেও জাগিয়ে রাখব। বলিয়া সম্মতির জন্যে অপেক্ষামাত্র না করিয়া আমার পায়ের বালিশটা টানিয়া লইয়া বাঁ হাতটা মাথায় দিয়া আড় হইয়া পড়িয়া বলিল, আমি অনেক ভেবে দেখলুম, তোমার অত দূরদেশে যাওয়া কিছুতেই হতে পারে না। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হতে পারে তা হলে? এমনি করে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো? পিয়ারী তাহার জবাব না দিয়া বলিল, তা ছাড়া কিসের জন্যে বর্মায় যেতে চাচ্চ শুনি? চাকরি করতে, ঘুরে বেড়াতে নয়। আমার কথা শুনিয়া পিয়ারী উত্তেজনায় সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, দেখ, অপরকে যা বল, তা বল; কিন্তু আমাকে ঠকিও না। আমাকে ঠকালে তোমার ইহকালও নেই, পরকালও নেই—তা জানো? সেটা বিলক্ষণ জানি; এবং কি করতে বল তুমি? আমার স্বীকারোক্তিতে পিয়ারী খুশি হইল; হাসিমুখে বলিল, মেয়েমানুষে চিরকাল যা বলে থাকে, আমিও তাই বলি। একটা বিয়ে করে সংসারী হও—সংসারধর্ম প্রতিপালন কর। প্রশ্ন করলাম, সত্যি খুশি হবে তাতে? সে মাথা নাড়িয়া, কানের দুল দুলাইয়া সোৎসাহে কহিল, নিশ্চয়! একশ’ বার। এতে আমি সুখী হব না ত সংসারে কে হবে শুনি? বলিলাম, তা জানিনে, কিন্তু এ আমার একটা দুর্ভাবনা গেল! বাস্তবিক এই সংবাদ দেবার জন্যেই আমি এসেছিলাম যে বিয়ে না করে আমার আর উপায় নেই। পিয়ারী আর একবার তাহার কানের স্বর্ণাভরণ দুলাইয়া মহা আনন্দে বলিয়া উঠিল, আমি ত তা হলে কালীঘাটে গিয়ে পুজো দিয়ে আসব। কিন্তু মেয়ে আমি দেখে পছন্দ করব, তা বলে দিচ্চি। আমি বলিলাম, তার আর সময় নেই—পাত্রী স্থির হয়ে গেছে। আমার গম্ভীর কণ্ঠস্বর বোধ করি পিয়ারী লক্ষ্য করিল। সহসা তাহার হাসিমুখে একটা ম্লান ছায়া পড়িল, কহিল, বেশ ত, ভালই ত! স্থির হয়ে গেলে ত পরম সুখের কথা। বলিলাম, সুখ-দুঃখ জানিনে রাজলক্ষ্মী; যা স্থির হয়ে গেছে, তাই তোমাকে জানাচ্চি। পিয়ারী হঠাৎ রাগিয়া উঠিয়া বলিল, যাও—চালাকি করতে হবে না—সব মিছে কথা। একটা কথাও মিথ্যে নয়; চিঠি দেখলেই বুঝতে পারবে। বলিয়া জামার পকেট হইতে দুখানা পত্রই বাহির করিলাম। কৈ দেখি চিঠি, বলিয়া হাত বাড়াইয়া পিয়ারী চিঠি দুখানা হাতে লইতেই, তাহার সমস্ত মুখখানা যেন অন্ধকার হইয়া গেল। হাতের মধ্যে পত্র দুখানা ধরিয়া রাখিয়াই বলিল, পরের চিঠি পড়বার আমার দরকারই বা কি! তা কোথায় স্থির হল? পড়ে দেখ। আমি পরের চিঠি পড়িনে। তা হলে পরের খবর তোমার জেনেও কাজ নেই। আমি জানতেও চাইনে, বলিয়া সে ঝুপ করিয়া আবার শুইয়া পড়িল। চিঠি দুটা কিন্তু তাহার মুঠার মধ্যেই রহিল। বহুক্ষণ
false
shomresh
কোনো ট্রেন ছাড়ছে না। শুধু দূরপাল্লার মেলট্রেনগুলো এসে যাত্রী নামিয়ে চুপচাপ শেডে ফিরে গিয়েছে। টিয়ার গ্যাসের জ্বলুনি কমলে আটক যাত্রীদের গুঞ্জন মিলিয়ে গেল, কেউ বেশি কথা বলছে না। জিনিসপত্র নিচে নামিয়ে অনিমেষ বসে পড়েছিল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন। এখান থেকে তার বাড়ি হেঁটে গেলে মাত্র দশ মিনিটের পথ, অথচ সারারাত এই প্ল্যাটফর্মে আটকে থাকতে হবে এটা যেন তিনি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। অনিমেষের কাছে জিনিসপত্র রেখে তিনি খবরাখবর নেবার জন্য অন্য প্ল্যাটফর্মে চলে গেলেন। শুরুতেই এ ধরনের ব্যাপার হয়ে গেল, অনিমেষের ভালো লাগছিল না। কলকাতা শহরকে দেখবার জন্য ওর মন ছটফট করছিল, এখন এই পরিবেশে নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে। কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বামপন্থিদের যুদ্ধ হচ্ছে এখানে, কিসের যুদ্ধ খাবার যদি কারণ হয়, তা হলে সে-যুদ্ধে তো ও যে-বাংলাদেশ নয়। তা হলে বামপন্থিদের এই যুদ্ধ কতটা সাফল্যলাভ করবে। কংগ্রেস সরকারের হাতে মিলিটারি আছে, তাদের অস্ত্র আছে-এভাবে কি খাবার আদায় করা যায়? একে কি গৃহযুদ্ধ বলে? আর কংগ্রেস সরকারই বা নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাচ্ছে কেন? তারা খাবার চেয়েছে অল্প দামে, সরকার সেটা দিয়ে দিলেই তো পারে! তা হলে দেশের মানুষ কংগ্রেসের ওপর খুশি হবে-আর বেশি বোট পাবে নির্বাচনে। সেটা নিশ্চয়ই কংগ্রেস সরকার জানে এবং জেনেশুনে। এরকম উপায়ে মোকাবিলা করছে! অনিমেষ অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত এইরকম একটা সিদ্ধান্তে এল যে, আজ যে-ঘটনাটা কলকাতা শহরে ঘটছে তা খুব সরল নয়। নিশ্চয়ই তার পেছনে অন্য কোনো কারণ আঁছে যা ও বুঝতে পারছে না। এখন আর টিয়ার গ্যাসের সেই জ্বলুনিটা নেই, পরিষ্কার মেখে চারধারে অনেক সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখতে পেল। এখন আলোগুলো কেমন হলুদ-হলুদ দেখাচ্ছে। রাত যত বাড়ে তত কি আলোগুলোর চেহারা পালটে যায়? অনিমেষ দেখল একটা কালোমতন রাত মাঝবয়সি মেয়েছেলে সামনে সতরঞ্জি পেতে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে সে ফিক কর দোক্তা-খাওয়া-ইতাসি হাসল। চোখ ফিরিয়ে নিল অনিমেষ, কে না জানে কলকাতায় খারাপ মেয়ে এবং পুরুষ সবসময় শিকার ধরতে ঘুরে বেড়ায়। এদের থেকে সতর্ক না থাকলে এই শহরে একদিনও বাস করতে পারা যাবে না। ও অলসভাবে নিজের কোমরে হাত বুলিয়ে দেখে নিল, টাকগুলো ঠিকই আছে। খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে। এখানে কাছেপিঠে জলের কল কোথায় আছে। অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে। গিয়ে হাল ছেড়ে দিল। এত জিনিসপত্র এখানে রেখেসে জল খেতে যাবে কী করে? নিজেরটা হলে বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু বৃদ্ধা ভদ্রলোকের ব্যাগও রয়েছে। উনি যে কোথায় গেলেন! মাঝবয়সি মেয়েছেলেটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল আবার, এক হাত কনুই থেকে ভাজ করে মুখের ওপর আড়াল দিয়েছে। কালো দাঁত বের করে বলল, শুয়ে পড়ে খোকা, ঘুমিয়ে গেলে সকাল হয়ে যাবেখন। অনিমেষ বলতে চাইল, আমি এইরকম পায়ে-চলা জায়গায় জীবনে শুইনি, অতএব আজ বসেই রাত কাটাব, কিন্তু বলতে গিয়েও থমকে গেল সে। তার এই ষোল-সতেরো বছরের জীবনে অনেক কিছু সে করেনি, এখন তো করছে। যেমন কোনোদিন সে কলকাতায় আসেনি, এর আগে কখনো দাদু-পিসিমাকে ছেড়ে একা একা থাকেনি, এইভাবে টিয়ার গ্যাসে কখনো তার চোখ জ্বলেনি-এগুলো সব এখন ঘটছে। তাই কোনোদিন করিনি বলে করব না বলা বোধহয় টিক নয়। সে ঘাড় নেড়ে বলল, না, ঘুম আসছে না। কোত্থেকে আসা হল? কথা বলল মেয়েছেলেটা। জলপাইগুড়ি। সে কোথায়-আসামে? না, তবে ওইদিকেই। সেখানে পাহাড় আছে। হেসে ফেলল অনিমেষ। জলপাইগুড়ি শহরে বা জেলায় পাহাড় বলতে তেমন-কিছু নেই। জঙ্গল, আছে, পাহাড়ি আবহাওয়া আছে। সে বলল, নেই। যেন হতাশ হল মেয়েছেলেটা, আসামে পাহাড় আছে, সেখানে আমার দেওর কাজ করে। তবে লোক ভালো নয়, মাতাল। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। কী মতলব কে জানে, নাহলে যেচে যেচে নিজের পরিবারের খবর ওকে দিতে যাবে কেন? মেয়েছেলেটা অবশ্য একা নেই, ওর পাশে একটা ফ্ৰকপরা মেয়ে উলটোদিকে মুখ করে শুয়ে আছে। তাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না অনিমেষ। এই সময় মাইকে আবার ঘোষণা করা হল, যাত্রীসাধারণের কাছে আবেদন, সমগ্র কলকাতা শহরে শান্তিবিম্নের আশঙ্কায় কারফু জারি হওয়ায় আগামীকাল ভোর ছটার আগে কেউ স্টেশন-চত্বরের বাইরে যাবেন না। এতে আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত হবে। বেশ কয়েকবার এই কথাগুলো আওড়ে মাইকটা থেমে গেল। এই সময় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে হন্তদন্ত হয়ে ফিরতে দেখল অনিমেষ। এক হাতে বাদামের ঠোঙা একটা, কাছে এসে বললেন, খিদে পায়নি? অনিমেষ ঘাড় নাড়তে তিনি বললেন, একটু আগে ট্রেনেই তো খেয়ে নিলে তুমি! ওঁর বাদাম-চিবানো মুখটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী দেখলেন? বুঝতে পারছি না। কোনোরকমে এই সার্কুলার রোডটা পেরিয়ে যেতে পারলেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। কী যে করি! বৃদ্ধের চোয়াল নাচছিল। তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা চলো তো, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাই। কেন? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। ওখান থেকে সার্কুলার রোড পাঁচ পা রাস্তা। কিন্তু বাইরে দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। গুড, চলে এসো এদিকে। নিজের জিনিস হাতে নিয়ে বৃদ্ধ আগে-আগে চললেন, পেছনে অনিমেষ। ওরা যাত্রীদের মধ্যে দিয়ে প্ল্যাটফর্মের পেছনদিকে ফিরে যাচ্ছিল। এদিক দিয়ে কীভাবে বের হওয়া যাবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে জায়গটা ঢালু হয়ে মাটিতে মিশে গিয়েছে। শেষ আলোটা ছাড়িয়ে ওরা নিচে নামল। তারপর কয়েক পা হেঁটে বাঁদিকে ঘুরে অনেকগুলো রেললাইন পেরিয় একদম শেষপ্রান্তে চলে এল। এখন কোনো ট্রেন আসা-যাওয়া করছে না। মাথার
false
humayun_ahmed
নাচ করে শরীর এবং মন দুটাই ঠিক রাখে। আমাদের এই বাড়িটাও মন্দির। যেসব পুরুষ এই বাড়িতে আনন্দের খোজে আসে তারা দেবতা। কখনো নিলাজ হবে না। পুরুষমানুষ। নটি বেটির কাছেও লজ্জা আশা করে। কোনো যক্ষ্মারোগীকে ঘরে নিবে না। যত টাকাই সে দিক তাকে ঘিরে নেয়া যাবে না। যক্ষ্মীরোগী চেনার উপায় আছে। আমি তোমাকে শিখায়ে দেব। তোমার স্বামী, স্বামীর দিকের আত্মীয় কাউকে ঘরে নিবে না। স্বামীকে কোনো অবস্থাতেই না। খদেরদের কারো কারো স্ত্রীরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তাদের সঙ্গে কখনো কোনো অবস্থায় দেখা করবে না। খদের আমাদের দেবতা। খন্দেরের স্ত্রীরা উপদেবতা। উপদেবতারা ভয়ঙ্কর। তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। যদি কখনো মনে কর এই জায়গা, এই জীবন তোমার পছন্দ না, তুমি চলে যেতে চাও, তাহলে চলে যাবে। কেউ তোমাকে আটকাবে না। আমি জেলখানা খুলে বসি নাই। দুঃখী মানুষের জন্যে আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করেছি। মানুষকে আনন্দ দেয়ার মধ্যে পুণ্য আছে। তুমি নিজেও আনন্দে থাকার চেষ্টা করবে। চান বিবি আনন্দে থাকার চেষ্টা ছাড়াই আনন্দে আছে। নতুন জীবনের শুরুতে প্রথম পুরুষটিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভাটি অঞ্চলের বোকাসোকা চেহারার একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। ফর্সা, লম্বা। চোখেমুখে দিশাহারা ভাব। সে খুব ভয়ে ভয়ে বিছানায় পেতে রাখা শীতলপাটিতে বসল। পকেট থেকে ফুলতোলা ময়লা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব । চান বিবি ঝকঝকে কাসার গ্রাসে পানি এনে দিল। লোকটা এক চুমুক পানি খেয়েই গ্রাস নামিয়ে রাখতে রাখতে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুবই গরম। চান বিবি বলল, বাতাস করব? না, বাতাস লাগবে না। দরজার আড়ালে হাছুন উকিঝুকি দিচ্ছিল। চান বিবি তাকে ইশারা করতেই সে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস শুরু করল। লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার মেয়ে? চান বিবি বলল, আমার মেয়ে না। তবে মেয়ের মতোই। আমাকে আপনি আপনি বলতেছেন কী কারণে? আমি বয়সে আপনার ছোট। লোকটি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাই। চান বিবি বলল, চলে যাবেন? কিছুক্ষণ জিরান। বাতাস খান। শরীর ঠাণ্ড। করেন। মন ঠাণ্ডা করেন। আসেন, গল্প করি। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বসল। আবার পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। তবে এবার রুমালটা পকেটে ঢুকাল না। হাতে নিয়ে বসে রইল। চান বিবি বলল, রুমালে সুন্দর ফুলের কাজ। কে করেছে? আপনার স্ত্রী? হুঁ। আপনার ছেলেমেয়ে আছে? দুই মেয়ে। তারা দেখতে সুন্দর? হুঁ। আপনার স্ত্রীর চেহারা কেমন? সুন্দর? হুঁ। আমার চেয়েও সুন্দর? না আপনি কি কিছু খাবেন? শরবত বানায়ে দিব? না। ঘরে মিষ্টি আছে। মিষ্টি দিব? বেগমগঞ্জের লাড্ডু। না। আপনার স্ত্রীর নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন। তার নাম বলব না। মেয়ে দুটার নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন। বড় মেয়ের নাম শরিফা। ছোট মেয়ের নাম তুলা। তুলা নাম রেখেছেন কেন? জন্মের সময় খুব হালকা ছিল? হুঁ। সাত মাসে হয়েছে। বাঁচার আশা ছিল না। হালিমা তাকে শিমুল তুলার বস্তায় ভরে বাঁচায়ে রেখেছিল। এখন তুলার স্বাস্থ্য খুবই ভালো। সারাদিন মারামারি করে। কামড় দেয়া শিখেছে। কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দেয়। আপনার স্ত্রীর নাম হালিমা? হুঁ। নাম বলে ফেলেছেন, এখন কি আপনার খারাপ লাগছে? লোকটা চুপ করে রইল। প্রসঙ্গ পাল্টে জুলেখা বলল, আপনার মেয়ে তুলা আপনাকে কামড়ায়? অনেকবার। আমার সারা গায়ে তার কামড়ের দাগ। সে শুধু তার মারে কামড়ায় না। চান বিবি বলল, আপনার মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল। কয়েকবার টোক গিলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কালো কাপড়ের ছোট্ট থলি বের করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, এখানে দশটা রুপার টাকা আছে। টাকার পরিমাণ কি ঠিক আছে? চান বিবি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লোকটা উঠে দাঁড়াল। চান বিবি বলল, চলে যাবেন? হুঁ। বিশ্রাম করেন। রাতটা থাকেন, সকালে যান। न। তাহলে আরেকদিন আসেন। সেদিন টাকা ছাড়াই আসেন। আমি আর আসব না। আমার উপর কোনো কারণে কি আপনি নারাজ হয়েছেন? না। তুমি ভালো মেয়ে। আপনার স্ত্রীর চেয়েও কি ভালো? লোকটার চেহারা সামান্যক্ষণের জন্যে কঠিন হয়ে গেল। চান বিবি আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কঠিন মুখভঙ্গি সহজ হলো। লোকটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না। রুপার টাকার থলেটা চান বিবি সরাজুবালার কাছে পাঠিয়ে দিল। এটাই নিয়ম। সরাজুবালা সেখান থেকে নিজের অংশ রেখে ফেরত পাঠাবেন। চান বিবির পুরো টাকাই সরাজুবালা ফেরত পাঠালেন। প্রথম রোজগারে ভাগ বসালেন না। চান বিবি প্রথম রোজগারের টাকায় তার ছেলে জহিরের জন্যে জামা, জুতা কিনল। বান্ধবপুর জুম্মা মসজিদের ইমাম সাহেবের জন্যে একটা তুর্কি ফেজ টুপি কিনল। শশী মাস্টারের জন্যে কিনল নকশি করা সিলেটের শীতলপাটি। জিনিসগুলি হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ কাঁদল। ভদ্রঘরের একটি মেয়ের স্থান হয়েছে। রঙিলা বাড়িতে— এই ঘটনা বান্ধবপুরে কোনো আলোড়ন তুলল না। অনেক দিন এই বিষয়টা কেউ জানলও না। সুলেমান সবাইকে বলল, স্ত্রীকে সে তালাক দিয়েছে। স্ত্রী চলে গেছে তার বাপ ভাইয়ের কাছে। মুসলমান সমাজে স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং স্ত্রীর বাপ-ভাইয়ের কাছে চলে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এক স্ত্রী চলে যাবে অন্য স্ত্রী আসবে। স্ত্রী একা আসবে না, সঙ্গে দাসী নিয়ে আসবে। স্ত্রীর গর্ভে যেমন সন্তান হবে, দাসীর গর্ভেও হবে। স্ত্রীর গর্ভের সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পাবে। বান্দির গর্ভের সন্তানরা পাবে না। তারা
false
toslima_nasrin
নারীবিদ্বেষী সমাজে মেয়েদের মুখে মুখে থাকার কথা, কিন্তু শহুরে শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ের মুখ থেকেও এত ঋদ্ধ বাণী উচ্চারিত হয় না, যা হয়েছে আলুন্দা গ্রামের এক দরিদ্র রিত্তাওয়ালার মেয়ে সানেরার মুখ থেকে। সানেরা মানে যে বিয়ে না করেও সে দিব্যি ভালো বেঁচে থাকতে পারে। বলছে, ‘আমি সেলাই জানি, কাপড়ে সেলাইয়ের আলপনা তুলবো। খেটে বাকি জীবনটা কাটাবো।’ এমন আত্মবিশ্বাস যদি আজ নারীদের থাকতো, পৃথিবী বদলে যেত। নারী যদি অত্যাচারী পুরুষের সঙ্গে জীবন আর যাপন করবে না বলে মনস্থির করে যেমন সানেরা করেছে, যদি বোঝে যে দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো, অথবা কোনও বদমাশের সঙ্গে থাকার চেয়ে একা থাকাই ঢের ভালো, এবং নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কোনও কাজ খুঁজে নেয়, এবং নিজের আত্মসম্মান নিয়ে চলার সংকল্প করে, তবে সত্যিই, পৃথিবী বদলে যেতে বাধ্য। কিন্তু, সানেরার মতো মেয়ে কি খুব বেশি আছে? কিছু বিয়েতে লগ্নের কুসংস্কার থাকে। লগ্নের একটু এদিক ওদিক হলে সব্বনাশ। পুরুষের কোনও সব্বনাশ হয় না, হয় নারীর। যার সঙ্গে বিয়ে হয় নারীর, ভেবেই নেওয়া হয়, সারাজীবনের সঙ্গেী সে। সারাজীবন সংসারদাহে পুরুক কী পুরুষাবর্জনায় পচুক, সঙ্গেীকে ত্যাগ করা চলবে না। কত যে যন্ত্রণাকাতর নারীর মুখ দেখেছি আমি এই ভারতীয় উপমহাদেশে, তারা না পারে যন্ত্রণা বইতে, না পারে সইতে। এভাবেই কেটে যায় তাদের জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো, মাসগুলো। কাটে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর আর যুগ। সানেরা হওয়ার স্বপ্ন কি গোপনে গোপনে সবার মধ্যে নেই! থাকলেও সে স্বপ্ন বাস্তব করার সাহস এবং শক্তি অধিকাংশ নারীর নেই। নারীর স্বপ্ন স্বপ্নই দেখে যায়। ভয় আর লজ্জা তাদের স্বপ্নকে চিরকাল স্বপ্ন করেই রেখে দেয়। একটা বিশ্বাস খুব জনপ্রিয় যে মেয়েরা শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হলে গৃহনিগ্রহের শিকার তারা আর হয় না। এই বিশ্বাসকে মিথ্যে প্রমাণ করে প্রতিদিনই মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে গৃহে। তারা ডাক্তার ইঙ্গিনিয়ার, আইনজীবী, গায়িকা, নায়িকা, ব্যবসায়ী কী নয়! ইস্কুল কলেজ না পাশ করা গৃহবধূকে যেমন গৃহনিগ্রহ সইতে হয়, পাশ করা মেয়েদেরও সইতে হয় একই রকম গৃহনিগ্রহ। এর পিছনের কারণ, দুজনই নারী। দুজনই শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, এই সমাজের চোখে দুর্বল, দুজনই দ্বিতীয়লিঙ্গ। সানেরা পুরুষতান্ত্রিকতার অত শত তত্ত্ব বোঝেনি। কেবল তার ইচ্ছের কথাটি সে বুঝেছে। এবং ইচ্ছেটাকে মূল্য দিয়েছে। সে চেঁচিয়েছে। অপদার্থের সঙ্গে বিয়ে ভেঙেছে। সানেরা শিক্ষিতও নিশ্চয়ই ছিল না, স্বনির্ভরও সে নয়। কিন্তু তার যে স্বনির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই সে জোর গলায় বললো। পুরুষনির্ভর পরজীবী মেয়েদের পা কাঁপে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বললে। এদের মধ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা মেয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এরকম একটি চল আছে, যে, বিয়ের রাতে পুরুষদের বেড়াল মারতে হয়। ওই বেড়াল মারা দেখেই নতুন স্ত্রী বুঝে যাবে যে তার কপালেও এই মার আছে। সুতরাং সে নত হবে নম্র হবে, আদেশ নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, এবং স্বামী-সেবায় জীবন উৎসর্গ করবে। বিয়ের দিন বেড়াল না মেরে বরপক্ষের লোকেরা মেয়ের বাবাকে মেরে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল, ‘তোর বাবাকেই আমরা কেয়ার করি না, তোকে কী করবো!’ এখানে সানেরার বাবা পুরুষের প্রতিনিধি নয়, প্রতিনিধি তার মেয়ের, সানেরার। তাই সে অত সহজে মার খেতে পেরেছে। সানেরার বাবা যদি সেদিন তার ছেলের বিয়ে দিত, কার শক্তি ছিল তার গায়ে হাত তোলে! যা কোনও বড় শহরে ঘটে না, ছোট কোনও গ্রামে, ছোট কোনও পরিবারে নিভৃতে ঘটে যায়। ওইসব ছোট ছোট গ্রামেই দেখেছি হঠাৎ কোনও এক মেয়ে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে নেয় বা ভিন্ন গোজ্ঞের ভিন্ন ধর্মের প্রেমিককে নিয়ে নির্দ্বিধায় পালিয়ে যায়। পুরুষতন্ত্রের বিদ্যেটা যত সুন্দর করে ইতিহাস ভূগোল পদার্থ বিজ্ঞান আর রসায়নজ্ঞান শেখার মতো মেয়েরা শিখে নেয়, তত কিন্তু ‘লেখাপড়া না জানা’ সানেরারা শিখতে পারে না। তাদের তাই বিয়ের আসরে একথা বলতে বাধে না যে ‘এই বিয়ে আমি মানি না।’ অনড় দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ের মালা খুলে ফেলতে তাদের একটুও সংকোচ হয় না। পুরুষতন্ত্রের নিয়ম কানুন অন্তস্থ থাকলে সংকোচ হত। বিয়ের দিন বর এবং বরের বাড়ির লোকেরা আরও বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটালেও, মেয়ের বাবাকে কেবল পেটানো নয়, মেরে ফেললেও পুরুষতন্ত্রের বিদ্যে শেখা মেয়েরা বিয়ে ভাঙার মতো দুঃসাহস করতো না। কলঙ্ক বলে কথা। কিন্তু সানেরা জানে না কী করলে কলঙ্কের কীর্তিকাহিনী রচিত হয়। জানে না বলেই সে অমন কঠিন এবং জরুরি একটি সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেনি। এখন কী হবে সানেরার? হয়তো তার বাবা আবার পাত্রস্থ করতে চাইবে সানেরাকে। সানেরা এবার বোধহয় চোখ কান বুজে রাজি হবে। কারণ আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শি আর তাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। সানেরা এখন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির সবার সেবা করবে আর প্রতিদিন মার খাবে। এরকম, অথবা সত্যিই সানেরা যা বলেছিল, তাই করবে, বিয়ে সে করবে না আর, নিজের উপার্জনের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবে। সে কারও খায় না, পরে না। সে কোনও নিয়মনীতির ধারও ধারে না। এই দুটো পরিণতির কথাই আপাতত ভাবছি। দ্বিতীয় পরিণতিটি যদিও আমি সমর্থন করি, কিন্তু এই সমাজে তা ঘটানো খুব দুরূহ । যে চাপ সানেরার ওপর আসবে সমাজের অনুশাসন মেনে চলার, যে নিন্দা সানেরাকে করা হবে সে তার ইচ্ছের মূল্য দিয়েছে বলে, তা কি সানেরার একার পক্ষে বহন করা সম্ভব! মানুষ যদি চারদিক থেকে সানেরাকে সমর্থন করতো, সহযোগিতা করতো, মনে সে জোর পেত। তবে, জনসমক্ষে না
false
robindronath
ভুলও তো হয়। বিধু। না, ভুল নয় সতীশ, এবার তোর ভাই হবে। সতীশ। কী যে বল মা, তার ঠিক নেই— ভাই হবেই কে বললে! বোন হতে পারে না বুঝি! বিধু। দিদির চেহারা যেরকম হয়ে গেছে নিশ্চয় তাঁর মেয়ে হবে না, ছেলেই হবে। তা ছাড়া ছেলেই হোক, মেয়েই হোক, আমাদের পক্ষে সমানই। সতীশ। এত বয়সের প্রথম ছেলে, ইতিমধ্যে অনেক বিঘ্ন ঘটতে পারে। বিধু। সতীশ, তুই চাকরির চেষ্টা কর্। সতীশ। অসম্ভব। পাস করতে পারি নি। তা ছাড়া চাকরি করবার অভ্যাস আমার একেবারে গেছে। কিন্তু, যাই বল মা, এ ভারি অন্যায়। আমি তো এতদিনে বাবার সম্পত্তি পেতেম, তার থেকে বঞ্চিত হলেম, তার পরে যদি আবার— বিধু। অন্যায় নয় তো কী,সতীশ। এ দিকে তোকে ঘরে এনেছেন, ও দিকে আবার ডাক্তার ডাকিয়ে ওষুধও খাওয়া চলছে। নিজের বোনপোর সঙ্গে এ কিরকম ব্যবহার। শেষকালে দয়াল ডাক্তারের ওষুধ তো খেটে গেল। অস্থির হোস নে সতীশ। একমনে ভগবানকে ডাক— তাঁর কাছে কোনো ডাক্তারই লাগে না। তিনি যদি— সতীশ। আহা, তিনি যদি এখনো— এখনো সময় আছে। মা, এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কিন্তু যেরকম অন্যায় হল, সে ভাব রক্ষা করা শক্ত হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের কাছে এঁদের একটা দুর্ঘটনা না প্রার্থনা করে থাকতে পারছি নে— তিনি দয়া করে যেন— বিধু। আহা তাই হোক, নইলে তোর উপায় কী হবে সতীশ, আমি তাই ভাবি। হে ভগবান, তুমি যেন— সতীশ। এ যদি না হয় তবে ঈশ্বরকে আমি আর মানব না। কাগজে নাস্তিকতা প্রচার করব। বিধু। আরে চুপ চুপ, এখন এমন কথা মুখে আনতে নেই। তিনি দয়াময়, তাঁর দয়া হলে কী না ঘটতে পারে। সতীশ, তুই আজ এত ফিট্ফাট্ সাজ করে কোথায় চলেছিস। উঁচু কলার পরে মাথা যে আকাশে গিয়ে ঠেকল! ঘাড় হেঁট করবি কী করে। সতীশ। এমনি করে কলারের জোরে যতদিন মাথা তুলে চলতে পারি চলব, তার পরে ঘাড় হেঁট করবার দিন যখন আসবে তখন এগুলো ফেলে দিলেই চলবে। বিশেষ কাজ আছে মা, কথাবার্তা পরে হবে। [প্রস্থান] বিধু। কাজ কোথায় আছে তা জানি। মাগো, ছেলের আর তর সয় না। এ বিবাহটা ঘটবেই। আমি জানি, আমার সতীশের অদৃষ্ট খারাপ নয়; প্রথমে বিঘ্ন যতই ঘটুক, শেষকালটায় ওর ভালো হয়ই, এ আমি বরাবর দেখে আসছি। না হবেই বা কেন। আমি তো জ্ঞাতসারে কোনো পাপ করি নি— আমি তো সতী স্ত্রী ছিলাম, সেইজন্যে আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে দিদির এবারে— দ্বাদশ পরিচ্ছেদ সুকুমারী। সতীশ । সতীশ। কী মাসিমা । সুকুমারী। কাল যে তোমাকে খোকার কাপড় কিনে আনবার জন্য এত করে বললেম,অপমান বোধ হল বুঝি। সতীশ। অপমান কিসের মাসিমা। কাল ভাদুড়ি-সাহেবের ওখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল তাই— সুকুমারী। ভাদুড়ি-সাহেবের ওখানে তোমার এত ঘন ঘন যাতায়াতের দরকার কী, তা তো ভেবে পাই নে। তারা সাহেব মানুষ, তোমার মতো অবস্থার লোকের কি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সাজে। আমি তো শুনলেম, তোমাকে তারা আজকাল পোঁছে না,তবু বুঝি ঐ রঙিন টাইয়ের উপর টাইরিং পরে বিলাতি কার্তিক সেজে তাদের ওখানে আনাগোনা করতেই হবে। তোমার কি একটুও সম্মান বোধ নেই তাই যদি থাকবে তবে কি কাজকর্মের কোনো চেষ্টা না করে এখানে এমন করে পড়ে থাকতে। তার উপরে আবার একটা কাজ করতে করতে বললে মনে মনে রাগ করা হয়, পাছে ওঁকে কেউ বাড়ির সরকার মনে করে ভুল ক’রে । কিন্তু, সরকারও তো ভালো— সে খেটে উপার্জন করে খায় । সতীশ। মাসিমা, আমিও হয়তো তা পারতেম, কিন্তু তুমিই তো— সুকুমারী। তাই বটে। জানি শেষকালে আমারই দোষ হবে। এখন বুঝছি তোমার বাপ তোমাকে ঠিক চিনতেন। তাই তোমাকে এমন করে শাসনে রেখেছিলেন। আমি আরো ছেলেমানুষ বলে দয়া করে তোমাকে ঘরে স্থান দিলেম, জেল থেকে বাঁচালেম, শেষকালে আমারই দোষ হল। একেই বলে কৃতজ্ঞতা! আচ্ছা, আমারই নাহয় দোষ হল, তবু যে কদিন এখানে আমাদের অন্ন খাচ্ছ, দরকারমত দুটো কাজই না হয় করে দিলে। এমন কি কেউ করে না। এতে কি অত্যন্ত অপমান বোধ হয়। সতীশ। কিছু না, কিছু না। কী করতে হবে বলো, আমি এখনই করছি। সুকুমারী। খোকার জন্য সাড়ে সাত গজ রেন্বো সিল্ক চাই— আর একটা সেলার সুট- সতীশের প্রস্থানোদ্যম শোনো শোনো, ওর মাপটা নিয়ে যেয়ো, জুতো চাই। সতীশ প্রস্থানোন্মুখ অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন— সবগুলো ভালো করে শুনেই যাও। আজও বুঝি ভাদুড়ি-সাহেবের রুটি বিস্কুট খেতে যাবার জন্য প্রাণ ছট্ফট্ করছে। খোকার জন্যে স্ট্র-হ্যাট এনো— আর তার রুমালও এক ডজন চাই । সতীশের প্রস্থান। তাহাকে পুনরায় ডাকিয়া শোনো সতীশ, আর একটা কথা আছে। শুনলাম, তোমার মেসোর কাছ হতে তুমি নূতন সুট কেনবার জন্য আমাকে না বলে টাকা চেয়ে নিয়েছ । যখন নিজের সামর্থ্য হবে তখন যত খুশি সাহেবিয়ানা কোরো, কিন্তু পরের পয়সায় ভাদুড়ি-সাহেবদের তাক লাগিয়ে দেবার জন্য মেসোকে ফতুর করে দিয়ো না। সে টাকাটা আমাকে ফেরত দিয়ো। আজকাল আমাদের বড়ো টানাটানির সময়। সতীশ। আচ্ছা , এনে দিচ্ছি। সুকুমারী। এখন তুমি দোকানে যাও, সেই টাকা দিয়ে কিনে বাকিটা ফেরত দিয়ো। একটা হিসাব রাখতে ভুলো না যেন। সতীশের প্রস্থানোদ্যম শোনো সতীশ, এই কটা জিনিস কিনতে আবার যেন আড়াই টাকা গাড়িভাড়া লাগিয়ে বোসো না। ঐ জন্যে তোমাকে কিছু আনতে বলতে ভয় করে। দু পা হেঁটে
false
humayun_ahmed
যায় না। রেশনের ব্যবস্থা নেই। যার যা প্রয়োজন, বাজার থেকে কিনে আনবে। কাজ করতে হবে মাত্র ছয় ঘণ্টা। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি এখানে নেই। বড় রকমের অপরাধের শাস্তি জরিমানা। বছরে এক মাস দেয়া হয়। ভ্ৰমণ, পাস। সেই পাস নিয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ান যায়। একটি টাকাও খরচ হয় না। আর উৎসব তো লেগেই আছে। দ্বিতীয় শহরের জীবনে ক্লান্তি বা অবসাদ বলে কিছু নেই। এই শহরের নাগরিকরা দুঃখ ব্যাপারটা কি জানেই না, এরা শুধু স্বপ্ন দেখে তৃতীয় শহরের। কুড়ি বছর দ্বিতীয় শহরে বাস করতে পারলেই তৃতীয় শহরে যাবার যোগ্যতা হয়। কিন্তু সবাই যেতে পারে না। ভাগ্যবানদের ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। লটারিটা হয় বছরের শেষ দিনে। প্ৰচণ্ড আনন্দ ও উত্তেজনার একটি দিন। এক দল নির্বাচিত হন তৃতীয় শহরের জন্যে, তাদের ঘিরে সারারাত আনন্দ-উল্লাস চলে। যাঁরা নির্বাচিত হন না, তারাও খুব একটা মন খারাপ করেন না। পরের বছর আবার লটারি হবে। সেই আশায় বুক বাঁধেন। তৃতীয় শহরের সুখ-সুবিধা কেমন, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দ্বিতীয় শহরের নাগরিকদেরও নেই। তাঁরা শুধু জানেন, তৃতীয় শহর হচ্ছে স্বৰ্গপুরী। চির অবসর ও চির আনন্দের স্থান। সবাই ভাবেন— মৃত্যুর আগে একবার যেন তৃতীয় শহরে ঢুকতে পারি। ইরিনা ছয় নম্বর কামরার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল থাকা সত্ত্বেও সে দরজায় মৃদু টােকা দিল। ভেতর থেকে একজন কে শিশুর মতো গলায় বলল, কে? আমি ইরিনা। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই। এখন তো কথা বলতে পারব না। আমি এখন ঘুমুব। প্লীজ, একটু দরজা খুলুন। আমার খুব দরকার। দরজা খুলে গেল। অসম্ভব রোগা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। লোকটি রুক্ষ গলায় বলল, তুমি কী চাও? ইরিনা তার জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লোকটি অবাক হয়ে তাকে দেখছে। ট্রেনের গতিবেগ ক্রমেই বাড়ছে। বাতাসে শিসের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন প্ৰচণ্ড গতি, যেন এই ট্রেন এক্ষুণি মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যাবে। ইরিনা বলল, আমি কি বসতে পারি? ছেলেটি হাবাগোবার মতো। কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ আছে, যাদের দেখলেই মনে হয় এরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা হাস্যকর কিছু করবে। এবং এটা যে হাস্যকর, তা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকাবে। একেও সে রকম লাগছে। মোটা ফ্রেমের চশমা। সেই চশমা নাকের ডগায় চলে এসেছে। দেখতে অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে চশমা এই বুঝি খুলে পড়ল। আমি কি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? ছেলেটি বিরক্তি স্বরে বলল, একবার তো বললাম। আমি ঘুমুব। আপনার ঘুম এতই জরুরি? ঘুম জরুরি না! ঠিক সময়ে ঘুমুতে যাওয়া উচিত এবং ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা উচিত। আজি না হয় একটু ব্যতিক্রম হল। বসব? আমি না বললে কি তুমি শুনবে? ছেলেটির মুখে তুমি শব্দটি খুব স্বাভাবিক শোনাল। খট করে কানে বাজল না। যেন এ অনেকদিন থেকেই ইরিনাকে চেনে, তুমি করে ডাকে। জরুরী কথাটি কি? আপনি যেখানে যাচ্ছেন আমিও সেখানে যাচ্ছি। আমি নিষিদ্ধ নগরীতে যাচ্ছি। ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, এটা এমন কি জরুরি কথা! আপনার কাছে খুব জরুরি মনে হচ্ছে না? না তো! আপনি খুবই বোকা। তা ঠিক না। আমি বোকা হব কেন? আমার অনেক বুদ্ধি। এই জন্যেই তো আমাকে নিষিদ্ধ নগরীতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বোকা হলে আমাকে নিয়ে যেত? ইরিনার ইচ্ছে হল উঠে চলে যেতে। যাবার আগে এই হাঁদারামের গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতে। ছেলেটি বেশ অবাক হয়েই বলল, একি খুকী, আমার যে বুদ্ধি আছে, এটা তুমি বিশ্বাস করছ না কেন? কোনো বুদ্ধিমান লোক কখনো বলে না, আমার খুব বুদ্ধি। শুধুমাত্র হাদারাই সে রকম বলে। একজন বুদ্ধিমান লোক যদি বলে আমার খুব বুদ্ধি, তাতে দোষের কি? না, কোনো দোষ নেই, আপনি যত ইচ্ছা বলুন। আর দয়া করে আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। ইরিনা সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়াল। ছেলেটি দুঃখিত স্বরে বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করে চলে যােচ্ছ, এই জন্যে আমার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর নি। আমি প্রমাণ করে দেব যে আমার বুদ্ধি আছে? আপনাকে কিছু প্ৰমাণ করতে হবে না। না না শোন, শুনে যাও। আমার সম্পর্কে তোমার একটা ভুল ধারণা থাকবে, এটা ঠিক না। আমি এই ঘণ্টাখানেক আগে কী করে একটা বুদ্ধিমান রোবটকে বোকা বানালাম এটা শোন। ইরিনা কৌতূহল হয়ে তাকাচ্ছে। ছেলেটি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছে, ট্রেনে একটা রোবট আছে দেখ নি? ব্যাটা আমার সাথে রসিকতা করবার চেষ্টা করছিল, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করল। আর আপনি চট করে জবাব দিয়ে দিলেন? না। আমি উল্টো তাকে একটা এমন ধাঁধা দিলাম ব্যাটার প্রায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়। কি ধাঁধা? আমি বললাম, একটা সাপ হঠাৎ তার নিজের লেজটা গিলতে শুরু করল। পুরোপুরি যখন গিলে ফেলবে, তখন কী হবে? রোবটটার আক্কেল গুড়ুম। ভেবে পাচ্ছে না। কী হবে। একবার বলছে সাপটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। পরীক্ষণেই মাথা নেড়ে বলছে, তা কি করে হয়? এই আপনার বুদ্ধির নমুনা? হ্যাঁ। দ্বৈত সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছি মাথায়। একটা রোবটকে বোকা বানানোর এই বুদ্ধি কি তোমার মাথায় আসত? না, আসত না। তাহলে তোমার কি মনে হয়, আমি বুদ্ধিমান? ইরিনা হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছা হল বলে, আপনি এর কোনোটাই না,
false
shunil_gongopaddhay
দেবের মনোভাব অনেকটা যেন এই যে, বিধবা-বিবাহের পক্ষে বিপক্ষে তাত্ত্বিক আলোচনা চলছে চলুক না, ভালোই তো, এতে দু পক্ষের কাছ থেকেই অনেক শাস্ত্রবচন জানা যাচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্ৰ শুধু বিদ্যা জাহির করবার জন্য বিধবা-বিবাহের পক্ষে কলম ধরেননি। একে কার্যোনা পরিণত করে ছাড়বেন না। এক সময় তিনি ঠিক করলেন, ধনীরা যতই বাধা দেবার চেষ্টা করুক, বিধবা-বিবাহের প্রচলনের জন্য আইন পাস করাতে হবে। ইয়ং বেঙ্গল এবং ব্ৰাহ্মীরাও চায় সরকারের কাছে এই মর্মে আবেদন করা হোক। আবেদনপত্র রচনা করে ঈশ্বরচন্দ্ৰ এবার ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করতে লাগলেন। এবার দপ করে জ্বলে উঠলেন রাধাকান্ত দেব। তক্যািতর্কি করা এক ব্যাপার, আর বিদেশী রাজশক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের ওপর একটি আইন চাপিয়ে দেওয়া অন্য ব্যাপার। সতীদাহ বন্ধ করার সময় রাধাকান্ত দেব যে কারণে বিরোধিতা করেছিলেন, বিধবা-বিবাহের ব্যাপারেও তিনি সেই কারণেই উগ্র হয়ে উঠলেন। সমাজের পরিবর্তন যদি আসে, তবে তা আসবে জনমানসের ক্ৰম-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, এতে রাজশক্তির হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ রাজশক্তি একবার নাসিক গলাতে শুরু করলে তার আর কোনো শেষ থাকবে না। বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতীদের মত এই যে দেশের আইন-কানুন রক্ষার দায়িত্ব রাজশক্তির। বিধবা-বিবাহ যদি আইনসম্মত না হয়, তবে সাধারণ মানুষ এই বিবাহে সম্মত হবে না। কিংবা হলেও, বিধবার পুনর্বিবাহের পর তার সন্তান সম্পত্তির অধিকার পাবে না। সন্তান যদি পিতামাতার সম্পত্তির বৈধ অধিকারী না হতে পারে, তাহলে সেই বিবাহ যে অসিদ্ধ হিসেবে গণ্য এই সরল কথাটি রাজা রাধাকান্ত দেবের দল বুঝেও বুঝলেন না। তাঁরাও দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিবাদী স্বাক্ষর জোগাড় করতে শুরু করলেন। বিধবা-বিবাহের সমর্থনে আবেদনটিই আগে পেশ করার ব্যবস্থা হলো সরকার সমীপে। এতে স্বাক্ষর করলেন নয়শো বত্ৰিশ জন ব্যক্তি, একেবারে শেষ স্বাক্ষরকারীর নাম ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর। আবেদনপত্র জমা দেবার আগের দিন ঈশ্বরচন্দ্র সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছেন, তিনি গাড়ি-পাল্কির তোয়াক্কা করেন না, তাঁর দুই পা দুই অশ্বশক্তি, হাঁটাহাঁটি করতে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। পথঘাট নির্জন, ঈশ্বরচন্দ্ৰ ঠনঠনের কাছাকাছি এসেছেন, দেখলেন। কিয়ৎদূরে কয়কজন লোক দাঁড়িয়ে আছে পথজুড়ে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, তারা অপেক্ষা করছে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য। ঈশ্বরচন্দ্র একবার পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, ছিরো আছিস তো? লাঠিয়াল শ্ৰীমন্ত বললো, হ্যাঁ, তুমি থেমে না, এগিয়ে যাও। তোমার চাকর তৈরি আছে, সম্বুন্ধির ভাইদের সে দেখবে। শ্ৰীমস্তের তাড়া খেয়ে লোকগুলো ভয়ে দৌড় লাগাল। ওদের মধ্যে একটি লোককে যেন ঈশ্বরচন্দ্ৰ চিনতে পারলেন। কিছুদিন আগেই তিনি ঐ লোকটিকে কোনো এক বাবুর পার্শ্বচর হিসেবে দেখেছেন। তিনি হনহন করে এগিয়ে গেলেন সিমুলিয়ার দিকে। জগমোহন সরকারের গৃহের সামনে গিয়ে তিনি শ্ৰীমন্তকে বললেন, ছিরে, তুই বাইরে দাঁড়া! তিনি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে সোজা উপস্থিত হলেন জগমোহন সরকারের সামনে, জগমোহন সরকার আঁতকে উঠলেন একেবারে। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, আপনি আমাকে মারতে লোক পাঠিয়েছিলেন না? অতি কষ্ট করার দরকার কী? এই তো আমি এসেছি, মারতে হয় মারুন দেখি? শীতের এক সকালে বেণ্টিঙ্ক নামক একটি জাহাজ এসে ভিড়লো কলকাতার পোতাশ্রয়ে। জাহাজটি এসেছে মান্দ্ৰাজ প্রেসিডেন্সি থেকে। অন্যান্য অনেকের সঙ্গে সেই জাহাজ থেকে নামলেন এক কালো রঙের পাক্কা সাহেব। হ্যাট, কোট, প্যান্ট, বুট জুতো পরিহিত। এঁর ওষ্ঠে সাদা লম্বা একটি পদার্থ, যার এক প্রান্ত থেকে ধূম উদগীরিত হচ্ছে। কাগজের মখ্যে তামাক পাকানো এই জিনিসটির নাম সিগারেট, কলকাতাবাসীর চক্ষে এ বস্তুটি নতুন। এই কৃষ্ণকায় সাহেবটিই স্বৰ্গত উকিল রাজনারায়ণ দত্তের একমাত্র পুত্ৰ মধুসূদন। তবে মধু নামে যে উচ্ছঙ্খল, প্রতিভাবান, কোমল, হঠকারী, উদ্ধত যুবকটি এক সময় কলকাতা শহর মাতিয়ে তুলেছিল, সে আর নেই, তার বদলে ইনি একজন স্থূলকায়, মধ্যবয়সী, ক্লান্ত চেহারার পুরুষ। মধুসূদনের বয়েস এখন বত্ৰিশ, কিন্তু তাঁর চেহারায় যৌবনের দীপ্তি নেই, বরং এরই মধ্যে যেন প্রৌঢ়ত্বের ছাপা পড়েছে। সুদীর্ঘ আট বৎসরকাল মধুসূদন মান্দ্রাজে প্রবাসী ছিলেন। একদা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন কারুকে কোনো সংবাদ না দিয়ে গোপনে তিনি কলকাতা পরিত্যাগ করেছিলেন, তখন বুকে কত আশা ছিল, ভবিষ্যতের কত পরিকল্পনা ছিল। তার কিছুই ফলেনি। আজ কলকাতার অনেকের চোখেই তিনি মৃত, জাহাজঘাটায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য একজনও দাঁড়িয়ে নেই। তবু মধুসূদন এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন, যদি একটিও চেনা মুখ চোখে পড়ে। কেউ নেই। ইতোমধ্যে কলকাতার অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মধুসূদন এখন কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, তারও ঠিক নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধুসূদন মালপত্র একটি ছ্যাকরা গাড়িতে তুলে বললেন, চলো ফেরীঘাট, বিশপস কলেজ মে যায়ে গা! মান্দ্রাজে মধুসূদনের ভাগ্যে জুটেছে ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা। খৃষ্টান হয়েছিলেন বিলাত যাবার লোভে, কিন্তু অদ্যাপি সে সুযোগ ঘটেনি। মান্দ্রাজে গিয়ে ভেবেছিলেন, ইওরোপীয় সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়ে উচ্চ কোনো পদে নিযুক্ত হবেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর নেটিভ আখ্যা ঘোচেনি, জীবিকার্জনের জন্য তাঁকে গ্ৰহণ করতে হয়েছিল সামান্য স্কুল মাস্টারি। কবি খ্যাতির মোহে রচনা করেছিলেন মিল্টনের অনুকরণে গাথা-কাব্য, তাঁর সেই ইংরেজি কাব্যের সমাদর হয়নি। কেউ কেউ পিঠ চাপড়ানি দিয়েছে মাত্র, কলকাতার সংবাদপত্র তাঁর রচনারীতি নিয়ে পরিহাস করেছে। মধুসূদন মনে করতেন বাঙালী মেয়েদের তুলনায় ইওরোপীয় রমণীরা শতগুণে শ্রেষ্ঠা, সেই মোহে মান্দ্রাজে যাবার অত্যন্নকালের মধ্যেই তাঁর ছাত্রীস্থানীয়া এক নীলকর সাহেবের কন্যা রেবেকাকে বিবাহ করেছিলেন। চারটি পুত্ৰ-কন্যার জন্ম দিয়েও সে বিবাহ সুখের হলো না, স্থায়ী হলো না। পুত্ৰ-কন্যা সমেত রেবেকাকে পরিত্যাগ করে আবার এক ফরাসী যুবতীর সঙ্গে পত্নীভাবে বসবাস করছিলেন। কবি হতে গেলে পিতামাতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে
false
shunil_gongopaddhay
এল, তারা সব মুর্খ ছিল? শশিভূষণ খুব নিচু গলায় বললেন, মহারাজ, এ বিষয়টা তো আমি ভালো জানি না। তবে যতদূর যা পড়েছি, আমাদের উপনিষদে তো ঈশ্বরের কোনও রূপের কথা নেই। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব এই তিন প্রধান দেবতাও কখনও কখনও ধ্যানে বসেন। এঁরা যার ধ্যান করেন, তিনিই পরমেশ্বর, তার তো কোনও শরীর বা মূর্তির কথা কোথাও পাওয়া যায় না। মহারাজ বললেন, বেশ! হিন্দুর পরমেশ্বর নিরাকার। মোছলমান আর খ্রিস্টানরাও তো নিরাকারের ভজনা করে, তাই না? এই তিন নিরাকার কি আলাদা আলাদা, না এঁরাও এক? যদি এক হয়, তা হলে আলাদা আলাদা এতগুলি ধৰ্ম থাকার মানে কী? শশিভূষণ বললেন, সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, কোনও মানে নেই। মানুষ মাত্রেই ঈশ্বরের সন্তান, তা হলে সব মানুষেরই এক ঈশ্বর। ধর্মও এক হওয়া উচিত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কি, তাহলে পুরুত, মোল্লা, পাদ্রিদের ব্যবসার খুব অসুবিধে হয়। তাই তারা মানুষের মধ্যে এত বিভেদ তৈরি করে রাখে। মহারাজ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সেই মেয়েটি কোথায়? শশিভূষণের মধ্যে বক্তৃতার আবেগ এসে গিয়েছিল, থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন। মহারাজ আবার বললেন, সেই যে সুতো না দড়ি, কী নাম যেন মেয়েটির? তাকে ডাকো, আজ রাতে সে আমার শিয়রে বসে গান শোনাবে। দিব্যি ওর গানের গলা। শশিভূষণ ইতস্তত করে বললেন, মহারাজ, সে তো অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। মহারাজ বললেন, সে কী! এখনও অসুস্থ! ডাক্তার-কোবরেজ দেখাওনি? অমন গুণী ছুকরিটাকে মেরে ফেলবে নাকি? কী রোগ হয়েছে তার? শশিভূষণ বললেন, জ্বর। মাঝে মাঝে ছাড়ে, মাঝে মাঝে বেড়ে যায়। মহারাজ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, এতদিন ধরে জ্বর! উহু, মোটেই ভালো নয়, মোটেই ভালো নয়! মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তাকে দেখে আসি। শশিভূষণের মুখখানি বিবৰ্ণ হয়ে গেল। ভূমিসূতার অসুখের ব্যাপারে তাঁকে মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে অনেক। মহারাজ নিজে গিয়ে দেখলেই সব বুঝে যাবেন। মরিয়া হয়ে তিনি বললেন, মহারাজ, আপনি কেন যাবেন? আমি বরং দেখি তাকে এখানে আনা যায় কি না। মহারাজ বললেন, না, না, জ্বর গায়ে তাকে আসতে হবে না। আমি তার রোগটা একটু দেখে নিই, কিছু ওষুধও দিতে পারি। শশিভূষণের ঘরের পাশ দিয়ে নীচে নামবার সিঁড়ি। মহারাজ জুতো খটখটিয়ে বারান্দা পার হয়ে সেই সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়ালেন। নীচের ভৃত্যমহল অন্ধকার, ওপর থেকে কিছুই দেখা যায় না। শশিভূষণ বললেন, আমি একটা বাতি নিয়ে আসি বরং মহারাজ হেসে বললেন, বয়েস! তিন দিন পর এই প্রথম মহারাজের ওষ্ঠে একটু হাসির রেখা দেখা গেল। তিনি শশিভূষণের পিঠে একটা হাত রেখে হাসতে হাসতে বললেন, নিজের বয়েসটার কথা এখনও মাঝে মাঝে ভুলে যাই বুঝলে মাস্টার, যৌবনকালে আমার খুব দৌরাত্ম্য ছিল, ভৃত্যমহলে গিয়ে প্রায়ই উঁকিঝুঁকি মারতাম। তেমন তেমন রূপসী দাসী দেখলে নিয়ে আসতাম ওপরে। কিন্তু যে-বয়েসে যা মানায়। এখন বুড়ো হচ্ছি, এখন একটা দাসীর ঘরে যাওয়াটা কি আমার পক্ষে শোভা পায়! ঝোঁকের মাথায় যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু তুমি আমায় নিষেধ করোনি কেন! যে-সে লোক তো নাই, আমি একজন মহারাজ তো বটে, তোমার মনিব, আমি একটা ভুল করে ফেললে তোমার কি বাধা দেওয়া উচিত ছিল না? এই বয়েসে মান-সম্মানের ব্যাপারটা বড় হয়ে ওঠে হে! কোনও উত্তর দেবার বদলে এখানে নীরব থাকাই শ্ৰেয়, শশিভূষণ ঘাড় হেট করে রইলেন। মহারাজ তর্জনী তুলে বললেন, তিনদিনরে মধ্যে মেয়েটিকে সারিয়ে তোল। ভালো চিকিৎসক দেখাও, পয়সাকড়ির ব্যাপারে কার্পণ্য করো না। অমন একটি রত্ন কেন ছাইগাদায় পড়ে থাকবে। ওকে সুস্থ করে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও! মহারাজ নিজের মহলে ফিরে যাবার পর শশিভূষণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সাময়িকভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু রীতিমতন একটা সংকট সৃষ্টি করে ফেলেছে। মহারাজ বীরচন্দ্ৰও ভূমিসূতার কথা ভুলে যাচ্ছেন না, ভূমি-সূতাও মহারাজের কাছে যাবে না। প্ৰথমে সে বলেছিল, বৈঠকখানা ঘরে সে গান শোনাতে যাবে না, এখন সে পুরোপুরি বেঁকে বসেছে। এখন সে বলছে, মহারাজের সামনেই সে আর যাবে না। কখনও। এর মধ্যে সে নিশ্চয়ই মহারাজ অনেক কিছু জেনেছে। কিন্তু মিথ্যে অসুখের কথা বলে আর কতদিন চালানো যাবে? অন্য দাস-দাসীরা জানে। এমনকি মনোমোহিনীও জানে যে ভূমিসূতা অসুস্থ নয়। এ খবরটা কানে গেলে মহারাজ তো শশিভূষণের ওপরেই খড়গহস্ত হবেন। মিথ্যে ভাষণের জন্য দায়ী করবেন শশিভূষণকে। ভূমিসূতা মেয়েটিও দারুণ জেদি। শশিভূষণ তাকে কিছু বোঝাতে গেলেই সে বলে, আমাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন। কিন্তু কোথায় পাঠানো যাবে ওকে! শশিভূষণের পৈতৃক বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসার অন্য কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু মহারাজের নেকনজরে পড়ে গেছে, মহারাজ ওর খবর জানতে চাইলে কী উত্তর দেওয়া যাবে এর মধ্যে মহারাজ একদিন শশিভূষণদের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। মেজ বউঠানের অনুরোধে রানী মনোমোহিনীকে একদিন ও বাড়িতে পাঠাবার কথা আছে। ওখানে ভূমিসূতাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। ভূমিসূতা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, এ কথাটা বলা যেতে পারে, কিন্তু শশিভূষণের বাড়িতে তাকে আশ্ৰয় দেওয়া হয়েছে, এত বড় মিথ্যেটা ধর্মে সইবে না। এই চিন্তাটা শশিভূষণের মনে সব সময় দংশন করে। ভূমিসূতা, ভূমিসূতা, সামান্য এক দাসী, তার কথা সারাদিন মনে রাখতে হবে কেন। শশিভূষণ অনেকগুলি বছর কোনও রমণীর চিন্তাই মনে স্থান দেননি। সুহাসিনী চলে গেছে সাড়ে ছ’বছর আগে। মাত্র পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন। কিন্তু সেই পাঁচ বছরেই নারী সম্পর্কে ধারণার বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে শশিভূষণের জীবনে। সুহাসিনী রূপ-লাবণ্যময়ী, কিছু কিছু লেখাপড়াও জানত,
false
humayun_ahmed
কাজেই বিষাদগ্রস্ত হই কি হই না তা কী করে বলি। তুমি আরো প্রশ্ন কর। তোমার প্রশ্ন বড়ই আনন্দ বোধ হচ্ছে। আমি : আনন্দ কী? মহাপুরুষ : বৎস আনন্দ কি তা আমি জানি না। আমি : আপনি জানেন এমন কিছু কী আছে? মহাপুরুষ : না। আমি কিছুই জানি না। বৎস তুমি প্রশ্ন কর। আমি : আমার প্রশ্ন করার কিছুই নেই। আপনি বিদেয় হোন। মহাপুরুষ : চলে যেতে বলছ? আমি : অবশ্যই – ব্যাটা তুই ভাগ। মহাপুরুষ : তুমি কী আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ? আমি : হ্যাঁ। মহাপুরুষ : তাতে লাভ হবে না বৎস। তুমি বোধহয় জানো না আমাদের মান অপমান বোধ নেই। কথোপকথন আরো চালানোর ইচ্ছা ছিল। চালানো গেল না। ফুপু এসে বললেন, এই তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিস কেন? আমি বললাম, কথা বলছি। কার সঙ্গে বলছিস? মহাপুরুষদের সঙ্গে। ফুপু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই সবসময় এমন রহস্য করিস কেন? তুই আমাকে পেয়েছিস কী? আমাকেও কি বাদলের মতো পাগল ভাবিস? তুই কি ভাবিস বাদলের মতো আমিও তোর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করব। আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। ফুপু আমার সেই হাসি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, তু্‌ই একটা বিয়ে কর। বিয়ে করলে সব রোগ সেরে যাবে। বিয়ে করাটা ঠিক হবে না ফুপু। ঠিক হবে না কেন? যেসব রোগের কথা তুমি বলছ সেইসব রোগ কখনো সারাতে নেই। যে কারণে মহাপুরুষেরা বিয়ে করেন না। আজীবন চিরকুমার থাকেন । বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন তাঁরা স্ত্রী- সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধদেব। ফুপু হতচকিত গলায় বললেন, তুই আমাকে আপনি না বলে তুমি তুমি করে বলছিস কেন? আমি তো সবসময় তাই বলি। সে কি ! আমার তো ধারণা ছিল আপনি করে বলিস। জি না ফুপু আপনি ভুল করছেন। আমার খুব প্রিয়জনদের আমি তুমি করে বলি। আপনি যদিও খুব কঠিন প্রকৃতির মহিলা তুব আপনি আমার প্রিয়জন। সেই কারণে আপনাকে আমি তুমি করে বলি। এই তো এখন আপনি করে বলছি। কই না তো। তুমি করেই তো বলছি। ফুপু খুবই বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন । মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আমার খুব ভালো লাগে। সম্ভবত আমি মহাপুরুষের পর্যাযে পৌঁছে যাচ্ছি। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছি। রূপার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রও হচ্ছে বিভ্রান্তি। তাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলো শীতকালে– পৌষমাস কিংবা মাঘমাস। কিংবা অন্যকোনো মাসও হতে পারে। তবে শীতকাল এইটুকু মনে আছে, কারণ আমার গায়ে ছিল গেরুয়া রঙের চাদর। রূপার গায়ে হালকা লাল কার্ডিগান। প্রথমে অবশ্য কার্ডিগানের দিকে আমার চোখ পড়ল না । আমার চোখ পড়ল তার মাথায় জড়ানো স্কার্ফের দিকে। স্কার্ফের রঙ গাঢ় সোনালি । কাপড়ে সোনালি এবং রূপালি এই দুটি রঙ সচরাচর চোখ পড়ে না। হয়তো এই দুটি রঙ কাগজে খুব ভালো ধরে, কাপড়ে ধরে না । সোনালি রঙের স্কার্ফ মাথায় জড়ানো বলে দূর থেকে তার চুলগুলো মনে হচ্ছিল সোনালি। দেখলাম সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি বসে আছি ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির বারান্দায় । বসেছি ছায়ার দিকে। শীতকালে সবাই রোদে বসতে ভালোবাসে। আমিও বাসি, তবু ছায়াময় কোণ বেছে নিয়েছি কারণ ঐ দিকটায় ভিড় কম। আমি লক্ষ্য করছি রূপা আসছে। আমি তাকে চিনি, তার নাম জানি, সে যে ধবধবে শাদা গাড়িটাতে করে আসে তার নম্বরও জানি , ঢাকা ভ-৮৭৮২। শুধু আমি একা নই আমাদের ক্লাসের সব ছেলেই জানে। সবাই কোনো-না-কোনো ছলে রূপার সঙ্গে কথা বলেছে, অনেকেই তার বাসায় গেছে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ তার জন্যে নোট এবং বইপত্র জোগাড় করেছে। রূপার জন্মদিনে সব ছেলারা মিলে একটা জলরঙ ছবি উপহার দিল। ছবিটার নাম বর্ষা । ছবির বিষয়বস্তু হচ্ছে একটি মেয়ে কদমগাছের একটু নিচু ডালে হাত দিয়ে মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চমৎকার ছবি। ছবিটা পাওয়া গিয়েছিল বিনা পয়সায়, তবে বাঁধাতে খরচ হলো পাঁচশ টাকা । সেই টাকা আমরা সবাই চাঁদা তুলে দিলাম। রূপা হচ্ছে সেই ধরনের মেয়ে যার জন্যে চাঁদা তুলে কিছু একটা করতে কারোর আপত্তি থাকে না। ছেলেরা গভীর আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে এদের সঙ্গে মেশে এবং জানে এই জাতীয় মেয়েদের সঙ্গে তারা কখনোই খুব ঘনিষ্ঠ হতে পারবে না। এরা যথাসময়ে বাবা-মার পছন্দ-করা একটি ছেলেকে বিয়ে করবে, যে ছেলে সাধারণত থাকে বিদেশে। রূপা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মাথার স্কার্ফ খুলে ফেলে বলল, কেমন আছ? রূপাকে যেমন সবাই তুমি করে বলে, রূপাও তেমনি সবাইকে তুমি করে বলে। তার সঙ্গে দীর্ঘ দু বছরে আমার কোনো কথা হয় নি। আজ হচ্ছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আন্তরিক সুরে বললাম, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? রূপা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। আমি আপনি করে বলব তো সে আশা করে নি। তাকে অপ্রস্তুত এবং লজ্জিত মনে হলো । সে এখন কী করে তাই আমারে দেখার ইচ্ছা । তুমি করেই চালিয়ে যায় , না আপনি ব্যবহার করে। বাংলা ভাষাটা বড়ই গোলমেলে। মাঝে মাঝেই তরুণ-তরুণীদের বিভ্রান্ত করে। রূপা নিজেকে সামলে নিল। সহজ গলায় বলল, আপনি আপনি করছেন কেন? আমাকে অস্বস্তিতে ফেলবার জন্যে? আমি এত সহজে অস্বস্তিতে পড়ি না । আমি বললাম, বস রূপা । রূপা বসতে বসতে বলল, অনেকদিন থেকেই আপনার সঙ্গে আমার কথা বলার ইচ্ছা্‌
false
shunil_gongopaddhay
মহাদেবী তাতেও কোনও সন্দেহ নেই, অন্দরমহলের সকলেই তাকে সমীহ করে। কিন্তু একটা ব্যাপারে ভানুমতী তাঁর সপত্নী রাজেশ্বরীর কাছে হেরে গেছেন। বহুদিন পর্যন্ত ভানুমতীর কোনও পুত্রসন্তান হয়নি। এমনকি ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ভানুমতী বাঁজা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। যে স্ত্রী স্বামীর বংশে কোনও পুত্রসন্তান উপহার দিতে পারে না, সে তো অচল পয়সায় মতন পরিত্যাজ্য। সাধারণ ঘরে ঘরেই এই নিয়ম, আর রাজ পরিবারে পুত্রহীন রানী তো রক্ষিতার সমতুল্য। মহারাজ বীরচন্দ্র নিতান্ত স্নেহবশতই ভানুমতীকে বাতিল করে দেননি। শেষ পর্যন্ত ভানুমতী একটি পুত্রের জন্ম দিয়ে নারীত্বের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বটে, কিন্তু ততদিনে রাজেশ্বরীর তিনটি পুত্র জন্মে গেছে। তার ফলে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিল ৰিপত্তি। যুবরাজ হবেন কে, পাটরানীর সন্তান, না রাজার জ্যেষ্ঠ সন্তান? বড় কূট এই প্রশ্ন! এই বংশে প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র লেগেই আছে, সিংহাসনের অধিকার নিয়ে মারামারি-কাটকাটি ও আদালতের মামলা হয়েছে অনেকবার। স্বয়ং বীরচন্দ্রকেও অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। বীরচন্দ্র সিংহাসনে বলেছিলেন তার বড় ভাই ঈশানচদ্রের সহসা মৃত্যুর পর। তার ফলে ঈশানচন্দ্রের পুত্ররা এবং বীরচন্দ্রের অন্য ভাইরা নিজেদের দাবি উত্থাপন করে চক্রান্তে মেতে ওঠে। সুযোগ সন্ধানীরা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে উস্কানি দেয়। চট্টগ্রামের কমিশনার, বাংলা লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে পর্বত মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল। সিংহাসন আঁকড়ে থেকে বীরচন্দ্র অন্য দাবিদারদের প্রতি নির্মম হতে বাধ্য হয়েছিলেন, পথের কাঁটা নির্মূল করতে তিনি দ্বিধা করেননি। আবার যাতে সেই রকম পারিবারিক বিদ্রোহ না ঘটে সেই জন্য বীরচন্দ্র আগেই মনঃস্থির করে রাজেশ্বরীর গর্ভজাত তাঁর প্রথম সন্তান রাধাকিশোরকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। বীরচন্দ্র জানেন, ভানুমতীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে তিনি ভানুমতীর সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্রকে যৌবরাজ্য দিলে শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তো বটেই, আদালতের বিচারে ও চতুর্থ রাজকুমার সমরেন্দ্রচন্দ্রের দাবি টিকবে না। ইংরেজের আদালত জ্যেষ্ঠ সন্তানকেই মর্যাদা দেয়। তবু তো খানিকটা রীতিবিরোধী হয়ে তিনি সমরেন্দ্রচন্দ্রকে বড় ঠাকুরের পদ দিতে চাইছেন, এ রাজ্যে যুবরাজের পরেই বড় ঠাকুরের প্রাধান্য! ভানুমতী তাতেও খুশি নন, অথচ দ্বিতীয় পুত্র দেবেন্দ্রকেও বঞ্চিত করা হল! অন্যান্য জুতাগুলি বাতিল করে বীরচন্দ্র সাদাসিধে এক জোড়া খড়ম পায়ে দিলেন। তারপর সেই কক্ষ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়ে একবার চিন্তা করলেন, রাজেশ্বরীর সঙ্গে দেখা করে যাবেন কিনা। ভানুমতীর চর আছে সর্বত্র, ভানুমতী ঠিক জেনে যাবেন সে কথা। থাক তা হলে। বীরচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক করলেন, আজ রাতে আর ভানুমতীর কাছে ফিরে আসা হবে না। ও কথা তিনি বলে ফেলেছেন ঝোঁকের মাথায়। ভোজ পর্বের পর আজ গান বাজনার ব্যবস্থা আছে। বীণা বাদক নিসার হোসেন, রবাব বাদক কাসেম আলি খাঁ, পাখোয়াজ বাদক পঞ্চানন মিত্রকে খবর দেওয়া আছে, তারা আসর সাজিয়ে বসবেন, গায়ক যদু ভট্ট মশাই তো রয়েছেনই। কত রাত হবে তার ঠিক নেই। ভানুমতীর কাছে গেলে শুধু অভিযোগের ঘ্যানঘ্যানানি আর প্যানপ্যানানি শুনতে হবে। তাতে মেজাজ নষ্ট হয়ে শুধু। না, ফেরা হবে না! ভানুমতীর কাছে তিন সত্যি করা হয়ে গেল? তাতেও কিছু আসে না। স্ত্রীলোকের কাছে প্রতিশ্রুতির কোনও দাম আছে নাকি? ওরা তো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুনতেই ভালৰাসে। রণে ও রমণে মিথ্যেই বেশি শক্তিশালী। দুটো তিনটে দিন কেটে যাক, এর মধ্যে আর ভানুমতীর কাছ ঘেঁষা হবে না, তারপর ভানুমতীর নিভৃত সংসর্গে আরও কিছু মিথ্যে সোহাগ দিয়ে তাকে ভোলালেই চলবে। পারিষদরা অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মহারাজ বীরচন্দ্র আবার গুনগুন করে গান ধরলেন, কী হেরিলাম রাই কিশোরী মরি, মরি। চন্দ্রকলায় কী বা শোভা… মহারাজ বীরচন্দ্রের এক পাশে হুঁকো-বরাদর, অন্য পাশে সুসজ্জিত ও সশস্ত্ৰ কৰ্ণেল সুখদেব ঠাকুর। পেছনে ন’জন পারিষদ। বিভিন্ন উপলক্ষে এই পারিষদদের মুখ বদল হয়। এই পারিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে মহারাজ একটি নীরব প্রথা অনুসরণ করেন সব সময়। রাজকর্মচারী, সভাসদ ও প্রাসাদ-বাসিন্দা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেকেই যার যার স্বার্থে মহারাজের কাছাকাছি ঘুরে ঘুর করতে চায়, চাটুকারিতায় মহারাজকে খুশি করতে পারলে জীবন-সার্থক বোধ করে। কিন্তু মহারাজ তাঁর মর্জিমতন এক এক সময় এক একটি দল বেছে নেন, যারা কাছাকাছি সমবেত হয় মহারাজ তাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার দৃষ্টি ন্যস্ত করেন, এক একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর তাঁর ভুরু কুঁচকে যায়, তখন সেই ব্যক্তি পায়ে পায়ে পিছু হটে আড়ালে চলে যেতে বাধ্য। মহারাজ কখন যে কেন কাকে অপছন্দ করেন, তা বোঝা অতি দুষ্কর। একদিন যার প্রতি ভ্রূকুটি করে দূরে পাঠিয়ে দেন, পরদিনই হয়তো সাগ্রহে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বিশ্রম্ভালাপ শুরু করে দেন। রাজা-রাজড়াদের ব্যবহারের ব্যাখ্যা কেউ দাবি করে না। কৰ্ণেল সুখদেব ঠাকুর মহারাজের পরামর্শদাতা এবং প্রধান দেহরক্ষী, তিনি এবং একান্ত সচিব রাধারমণ ঘোষ তার নিত্য সঙ্গী; গৃহশিক্ষক শশিভূষণ কিন্তু কখনও স্বেচ্ছায় রাজ সন্নিধানে আসার চেষ্টা করেন না। মহারাজ নিজেই কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে, ওই মানুষটিকে না ডাকলে কখনও দেখা পাওয়া যায় না। ছবি তোলার ব্যাপারে মহারাজ প্রায়ই ওঁর কাছ থেকে সাহায্য নেন। আগে বীরচন্দ্ৰ দাগেরোটাইপ ছবি তুলতেন, সেই সঙ্গে কলোডিয়ান ওয়েট প্লেট ফটোগ্রাফিরও চর্চা করেছেন। সিলভার নাইট্রেট-এ ডোবানো কাচের প্লেট সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় ভরে ছবি তোলার ঝঞাট অনেক। শশিভূষণই তাঁকে ড্রাই প্লেটের সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু শশিভূষণ মহারাজের কাছ থেকে কখনও অতিরিক্ত পারিতোষিক নিতে চান না। মনে হয় শশিভূষণের অর্থাভাব নেই, হয়তো তাঁর যথেষ্ট পৈতৃক সম্পত্তি আছে, তা হলে কেন তিনি কলকাতার চাকচিক্যময় পরিবেশ ছেড়ে এই জঙ্গলের দেশে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে এসেছেন, কে জানে। গড়গড়ার
false
tarashonkor
ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দিলে। করালী অট্টহাসি হেসে উঠল। বললে—যত সব ভয়তরাসের দলভয়েই মরবে, ভয়েই মরবে। তারপর বললে-পালাও সব, পালাও বলছি। নইলে ভাল হবে না। পালাও। পাখী, বার কর। অর্থাৎ মদের বোতল। বিজয়ী বীর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মদ্যপান করবে। কাহারপাড়ায় তরুণদের নিয়ে তার একটি দল আছে, যে দল বাইরে বনওয়ারীর মাতব্বরি মেনে চললেও অন্তরে অন্তরে করালীই তাদের দলপতি। এদের মধ্যে রতনের ছেলে নটবরই প্রধান। নটবর একবার বীরদৰ্পে সাপটার চারদিক ঘুরে বললে—কই, একটি করে পয়সা আন দেখি নি।–বাবা, তার বেলাতে লবডঙ্কা! একটি মেয়ে বললে—মরণ! সাপ মেরে গিদেরে যেন কি করছে! অর্থাৎ অহঙ্কারে। করালী বললে—ধর্‌ ওকে নটবরে, আমরা গান করব, ওকে লাচতে হবে। ধর্‌। মেয়ের দল এইবার পালাল। চ্যাঙড়ার দলকে বিশ্বাস নাই, তার উপর মদের বোতল বেরিয়েছে। কয়েক ঢোক পেটে পড়লে হয়! নটবর বললে—আঃ, নদিদি নাই রে আজ! করালী ইতোমধ্যে খানিকটা খেয়েছে। সে বললেওঃ, সে থাকলে মাতন লাগিয়ে দিত। হারামজাদীর কুটুম্বিতে লেগেই আছে। নসুবালা করালীর পিসতুতো ভাই। আসল নাম সুরাম। অদ্ভুত চরিত্র নসুরামের। ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় একেবারে মেয়েদের মত। মাথায় মেয়েদের মত চুল, তাতে সে খোপা বঁধে, নাকে নাকছবি পরে, কানে মাকড়ি পরে, হাতে পরে কাচের চুড়ি লাল রুলি, মেয়েদের মত শাড়ি পরে। মেয়েদের সঙ্গে গোবর কুড়ায়, কাঠ ভাঙে, ঘর নিকায়, চন্ননপুরে দুধের যোগান দিতে যায়, মজুরনী খাটতে যায়। কণ্ঠস্বরটি অতি মিষ্ট গান গায়, নাচে। গান আর নাচ এই তার সবচেয়ে বড় নেশা। ঘেঁটুর দলে নাচে, ভাঁজোর নাচনে সে-ই মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা নাচিয়ে। মেয়েদের সঙ্গেই সে ব্ৰতপার্বণ করে। করালীর ঘরে সে-ই গৃহিণী। করালী বিয়ে করে বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, বউ তার পছন্দ হয় নি, আবার বিয়ে করবে। নসুরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নসুও বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, সে আর বিয়ে করবে না। করালীর ঘরে বোন হয়ে, করালীর বউয়ের ননদ হয়ে থাকবে—এই তার বাসনা। পাড়ার বিয়েতে নসুবালাই বাসরে নাচে, গান গায়। শুধু পাড়ায় নয়, গ্রামে গ্রামান্তরে যে কোনো ঘরে ধুমধামের বিয়ে হলেই নসুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খবর দেয়। নসু খোপা বেঁধে, আলতা পরে, রঙিন শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর ঠেকিয়ে অর্থাৎ টিপ পরে রওনা হয়, আবার উৎসব মিটলে ফেরে। করালীর জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে আসে। এই নসুবালার অভাবই করালী সবচেয়ে বেশি অনুভব করলে আজ। —নসুদিদি নাই তো পাখী নাচুক কেনে? কথাটা বললে করালীর অপর অনুগত শিষ্য মাথলা। মাথলার আসল নাম রাখাল বা আখাল, কিন্তু দেহের অনুপাতে মাথাটা মোটা বলে কাহারেরা তাদের নিজস্ব ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্ভবত ওয়ালা প্রত্যয় করে করেছে মাথলা। কথাটা মন্দ বলে নাই মাথলা। কিন্তু তবু ভ্ৰ কুঁচকে উঠল করালীর। পাখী তাকে ভালবাসে, একদিন হয়ত তাকেই সে সাঙা করবে। সে নাচবে এই এদের সামনে? পাখির চোখেও রঙ ধরেছে, সেও খানিকটা পাকী মদ খেয়েছে, করালীর গৌরবে তারও নাচতে মন যাচ্ছে; তবু সে করালীর মুখের দিকে চাইলে। চেয়েই সে বুঝতে পারলে করালীর মন, সে তৎক্ষণাৎ বললে–না। তোর বউকে ডাক্ কেনে? ঠিক এই সময়েই কাছাকাছি কোথাও সুচাঁদের কর্কশ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, মুহূর্তে সমস্ত পাড়াটা চকিত হয়ে উঠল। —ওরে বাবা রে! ওরে মা রে! আমি কোথায় যাব রে! করালী হা-হা করে হেসে উঠল, বললে—বিত্যেব দেখ বুড়ির! অর্থাৎ ভয়ে চেঁচানি দেখ বুড়ির। তারপর সকৌতুকে বলে উঠল—নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, ও-ই বুড়িকে নিয়ে আয়ওই নাচবে। তুর্কি নাচন নাচাব বুড়িকে। ব্যাঙ দেখে নাচে, সাপ দেখে নাচবে না? ডাকতে হল না, এক-গা কাদা মেখে খাটো-কাপড়-পরা সুচাঁদ এসে দাঁড়াল করালীর উঠানে। তার পিছনে আরও কয়েকজন প্রৌঢ়া মেয়ে। স্থির দৃষ্টিতে সে মরা সাপটাকে কিছুক্ষণ দেখে হঠাৎ বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। শঙ্কাতুর অমঙ্গল ঘোষণার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বরে। —ওগো বাবাঠাকুর গো! ওরে, আমার বাবার বাহন রে! ওরে, কি হবে রে! হায় মা রে! বলতে বলতে সে থরথর করে কেঁপে মাটির উপরে বসে পড়ল। সমস্ত কাহারপাড়ার আকাশে একটা আশঙ্কার আর্তবাণী হায় হায় করে ছড়িয়ে পড়ল। করালী পাখী নটবর মাথলা সকলেই বেরিয়ে এল—কি হল? হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে-ঘেরা আলো-আঁধারির মধ্যে গ্রামখানি। সে গ্রামের উপকথায় এ দেশের কতকাল আগের ব্রত-কথায় আছে, গায়ে ছিল এক নিঃসন্তান বুড়ি, ব্রত করত, ধর্মকর্ম করত, গাঁয়ের দুঃখে দুঃখ করেই তার ছিল সুখ। কারও দুঃখে কাঁদতে না পেলে বুড়ি পশু-পক্ষীর দুঃখ খুঁজে বেড়াত। এমন দিনের সকালে বসে ভাবতে ভাবতে আপন মনেই বলত—কাদি কাঁদি মন করছে, কেঁদে না আত্মি মিটছে, মহাবনে হাতি মেরেছে, যাই; তার গলা ধরে কেঁদে আসি। হাঁসুলী বাঁকে সুচাঁদ বুড়ি বোধহয় সেকালের সেই বুড়ি। সাপটা যখন মরে তখন বুড়ি বাড়ি ছিল না। থাকলে যে কি করত, সে কথা বলা যায় না। সে গিয়েছিল ঘাস কাটতে। বাঁশবাঁদির কাহার-বুড়িরা, প্ৰবীণরা, যারা মজুরনী খাটতে পারে না, তারাও বসে খায় না—পিতিপুরুষের নিয়ম এই, যেমন গতর তেমনই খাটতে হবে। তারা দুপুরবেলা গরু-বাছুর-ছাগলের জন্য ঘাস। কাটতে যায়। কাখে ঝুড়ি নিয়ে, কাস্তে নিয়ে চলে যায় হাঁসুলীর বাঁকের ওপারে—কোপাইয়ের অপর পারে গোপের পাড়ায় মোষদহরীর বিলে ঘাস কাটতে। মস্ত বিলটার চারিপাশে প্রচুর ঘাস জন্মায়। তার সঙ্গে পানিফল তুলে আনে, কলমি শুনি শাক সংগ্রহ করে, আর দু-চারটে পাকাল মাছ—তাও ধরে আনে। তাই বুড়ি গিয়েছিল ওই মিেষদহরীর বিলে। ফিরে এসে সমস্ত কথা শুনে ছুটে এসেছে সাপটাকে দেখতে। দেখে চিৎকার করে পাড়াটাকে শঙ্কায় সচকিত করে দিলে। সাপটার
false
bongkim
সংস্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন, “মা, দেখ দেবী অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছেন; বিল্বপত্র পড়ে নাই। যে মানস করিয়া অর্ঘ্য দিয়াছিলাম, তাহাতে অবশ্য মঙ্গল। তুমি এই পথিকের সঙ্গে সচ্ছন্দে গমন কর; কিন্তু আমি বিষয়ী লোকের রীতি চরিত্র জানি। তুমি যদি গলগ্রহ হইয়া যাও, তবে এ ব্যক্তি অপরিচিত যুবতী সঙ্গে লইয়া লোকালয়ে লজ্জা পাইবে। তোমাকেও লোকে ঘৃণা করিবে। তুমি বলিতেছ এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণসন্তান; গলাতেও যজ্ঞোপবীত দেখিতেছি। এ যদি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইয়া যায়, তবে সকল মঙ্গল। নচেৎ আমিও তোমাকে ইহার সহিত যাইতে বলিতে পারি না।” “বি–বা–হ”! এই কথাটি কপালকুণ্ডলা অতি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করিলেন। বলিতে লাগিলেন, “বিবাহের নাম ত তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি, কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানি না। কি করিতে হইবে?” অধিকারী ঈষন্মাত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “বিবাহ স্ত্রীলোকের একমাত্র ধর্ম্মের সোপান; এই জন্য স্ত্রীকে সহধর্ম্মিণী বলে; জগন্মাতাও শিবের বিবাহিতা।” অধিকারী মনে করিলেন সকলই বুঝাইলেন। কপালকুণ্ডলা মনে করিলেন, সকলই বুঝিলেন। বলিলেন, “তাহা হউক। কিন্তু তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে আমার মন সরিতেছে না। তিনি যে এতদিন আমাকে প্রতিপালন করিয়াছেন।” অধি । কি জন্য প্রতিপালন করিয়াছেন, তাহা জান না। এই বলিয়া অধিকারী তান্ত্রিক সাধনে স্ত্রীলোকের যে সম্বন্ধ, তাহা অস্পষ্ট রকম কপালকুণ্ডলাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। কপালকুণ্ডলা তাহা কিছু বুঝিল না, কিন্তু তাহার বড় ভয় হইল। বলিল, “তবে বিবাহই হউক।” এই বলিয়া উভয়ে মন্দির হইতে বহির্গত হইলেন। এক কক্ষমধ্যে কপালকুণ্ডলাকে বসাইয়া, অধিকারী নবকুমারের শয্যাসান্নিধ্যে গিয়া তাঁহার শিয়রে বসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! নিদ্রিত কি?” নবকুমারের নিদ্রা যাইবার অবস্থা নহে; নিজ দশা ভাবিতেছিলেন। বলিলেন, “আজ্ঞা না।” অধিকারী কহিলেন, “মহাশয়! পরিচয়টা লইতে একবার আসিলাম, আপনি ব্রাহ্মণ?” অধি । কোন্‌ শ্রেণী। নব । রাঢ়ীয় শ্রেণী। অধি । আমরাও রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ – উৎকল ব্রাহ্মণ বিবেচনা করিবেন না। বংশে কুলাচার্য্য, তবে এক্ষণে মায়ের পদাশ্রয়ে আছি। মহাশয়ের নাম? নব । নবকুমার শর্ম্মা। অধি । নিবাস? নব । সপ্তগ্রাম অধি । আপনারা কোন্‌ গাঁই? নব । বন্দ্যঘটী। অধি । কয় সংসার করিয়াছেন। নব । এক সংসার মাত্র। নবকুমার সকল কথা খুলিয়া বলিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁহার এক সংসারও ছিল না। তিনি রামগোবিন্দ ঘোষালের কন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। বিবাহের পর পদ্মাবতী কিছু দিন পিত্রালয়ে রহিলেন। মধ্যে মধ্যে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করিতেন। যখন তাঁহার বয়স ত্রয়োদশ বৎসর, তখন তাঁহার পিতা সপরিবারে পুরুষোত্তম দর্শনে গিয়াছিলেন। এই সময়ে পাঠানেরা আকবর শাহ কর্ত্তৃক বঙ্গদেশ হইতে দূরীভূত হইয়া উড়িষ্যায় সদলে বসতি করিতেছিল। তাহাদিগের দমনের জন্য আকবর শাহ বিধিমতে যত্ন পাইতে লাগিলেন। যখন রামগোবিন্দ ঘোষাল উড়িষ্যা হইতে প্রত্যাগমন করেন, তখন মোগল পাঠানের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। আগমনকালে তিনি পথিমধ্যে পাঠানসেনার হস্তে পতিত হয়েন। পাঠানেরা তৎকালে ভদ্রভদ্র বিচারশূন্য; তাহার নিরপরাধী পথিকের প্রতি অর্থের জন্য বলপ্রকাশের চেষ্টা করিতে লাগিল। রামগোবিন্দ কিছু উগ্রস্বভাব; পাঠানদিগকে কটু কহিতে লাগিলেন। ইহার ফল এই হইল যে, সপরিবারে অবরুদ্ধ হইলেন; পরিশেষে জাতীয় ধর্ম্ম বিসর্জ্জনপূর্ব্বক সপরিবারে মুসলমান হইয়া নিষ্কৃতি পাইলেন। রামগোবিন্দ ঘোষাল সপরিবারে প্রাণ লইয়া বাটী আসিলেন বটে, কিন্তু মুসলমান বলিয়া আত্মীয় জনসমাজে এককালীন পরিত্যক্ত হইলেন। এ সময়ে নবকুমারের পিতা বর্তমান ছিলেন, তাঁহাকে সুতরাং জাতিভ্রষ্ট বৈবাহিকের সহিত জাতিভ্রষ্টা পুত্রবধূকে ত্যাগ করিতে হইল। আর নবকুমারের সহিত তাঁহার স্ত্রীর সাক্ষাৎ হইল না। স্বজনত্যক্ত ও সমাজচ্যুত হইয়া রামগোবিন্দ ঘোষাল অধিক দিন স্বদেশে বাস করিতে পারিলেন না। এই কারণেও বটে, এবং রাজপ্রসাদে উচ্চপদস্থ হইবার আকাঙ্ক্ষায়ও বটে, তিনি সপরিবারে রাজধানী রাজমহলে গিয়া বসতি স্থাপন করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মান্তর গ্রহণ করিয়া তিনি সপরিবারে মহম্মদীয় নাম ধারণ করিয়াছিলেন। রাজমহলে যাওয়ার পরে শ্বশুরের বা বনিতার কি অবস্থা হইল, তাহা নবকুমারের জানিতে পারিবার উপায় রহিল না এবং এ পর্য্যন্ত কখনও কিছু জানিতেও পারিলেন না। নবকুমার বিরাগবশতঃ আর দারপরিগ্রহ করিলেন না। এই জন্য বলিতেছি, নবকুমারের “এক সংসারও” নহে। অধিকারী এ সকল বৃত্তান্ত অবগত ছিলেন না। তিনি বিবেচনা করিলেন, “কুলীনের সন্তানের দুই সংসারে আপত্তি কি?” প্রকাশ্যে কহিলেন, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলাম। এই যে কন্যা আপনার প্রাণরক্ষা করিয়াছে – পরহিতার্থ আত্মপ্রাণ নষ্ট করিয়াছে। যে মহাপুরুষের আশ্রয়ে ইহার বাস, তিনি অতি ভয়ঙ্করস্বভাব। তাঁহার নিকট প্রত্যাগমন করিলে, আপনার যে দশা ঘটিতেছিল, ইহার সেই দশা ঘটিবে। ইহার কোন উপায় বিবেচনা করিতে পারেন কি না?” নবকুমার উঠিয়া বসিলেন। কহিলেন, “আমিও সেই আশঙ্কা করিতেছিলাম। আপনি সকল অবগত আছেন – ইহার উপায় করুন। আমার প্রাণদান করিলে যদি কোন প্রত্যুপকার হয় – তবে তাহাতেও প্রস্তুত আছি। আমি এমন সঙ্কল্প করিতেছি যে, আমি সেই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্মসমর্পণ করি। তাহা হইলে ইহার রক্ষা হইবে।” অধিকারী হাস্য করিয়া কহিলেন, “তুমি বাতুল। ইহাতে কি ফল দর্শিবে? তোমারও প্রাণসংহার হইবে – অথচ ইহার প্রতি মহাপুরুষের ক্রোধোপশম হইবে না। ইহার একমাত্র উপায় আছে।” নব । সে কি উপায়? অধি । আপনার সহিত ইহার পলায়ন। কিন্তু সে অতি দুর্ঘট। আমার এখানে থাকিলে দুই এক দিনের মধ্যে ধৃত হইবে। এ দেবালয়ে মহাপুরুষের সর্ব্বদা যাতায়াত। সুতরাং কপালকুণ্ডলার অদৃষ্টে অশুভ দেখিতেছি। নবকুমার আগ্রহসহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার সহিত পলায়ন দুর্ঘট কেন?” অধি । এ কাহার কন্যা, – কোন্‌ কুলে জন্ম, তাহা আপননি কিছুই জানেন না। কাহার পত্নী, – কি চরিত্রা, তাহা কিছুই জানেন না! আপনি ইহাকে কি সঙ্গিনী করিবেন? সঙ্গিনী করিয়া লইয়া গেলেও কি আপনি ইহাকে
false
nihar_ronjon_gupta
মত কঠিন। প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ ধুলো পুরু হয়ে জমে আছে। ধুলো সরিয়ে সরিয়ে সুব্রত মেঝে ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় ওর নজরে পড়ল, একটা লোহার উঁচু বন্টুর মত কী যেন মেঝে থেকে উঁচু হয়ে আছে। সুব্রত তখন সেটাতে নিয়ে প্রবল উৎসাহে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। কিন্তু সেটা মেঝের সিমেন্টের সঙ্গে একেবারে গাঁথা। সুব্রত ভাবলে এটা যখন মেঝেতে আছে, এর একটা উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ই আছে। হঠাৎ মেঝেতে একটা লোহার বন্টুর মতই থাকতে যাবে কেন? সুব্রত আবার আলো ফেলে ফেলে ঘরের মেঝের সর্বত্র খুঁজে দেখলে। কিন্তু আর কোথাও ও রকম লোহার বন্টু তার নজরে পড়ল না। সুব্রত যখন অনেক চেষ্টা করে ও গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেটাকে এতটুকু নড়াতে পারল না, তখন সে তার ছুরিটা দিয়ে বন্টুর চারপাশে কুরে কুরে ফেলতে লাগল। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বল্টুটা আরও একটু সজাগ হয়ে উঠল। এবার হঠাৎ কী ভেবে সুব্রত বন্টুটার ওপরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড একটা চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘড়ঘড় শব্দ। চোখের। নিমেষে বন্টুটার ঠিক হাতখানেক দূরে মেঝের পাথর সরে গিয়ে একটা গোলাকার গর্ত দেখা গেল। সুব্রত এক লাফ দিয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। বুকটার মধ্যে তখনও তার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। সুব্রত এগিয়ে এসে গর্তটার মুখে আলো ফেলল। দেখল মেঝেতে যেখানে পাথর সরে গিয়ে ফাঁক হয়ে গেছে, সেখানে একটা গোলাকার সিমেন্টের ঢাকনা মত নিচের দিকে ঝুলছে। গর্তের মুখে ও আবার আলো ফেলল। ধাপে ধাপে অপ্রশস্ত সিঁড়ি নীচে কোন্ অন্ধকার গহ্বরে নেমে গেছে কে জানে! ও এতক্ষণে বুঝতে পারলে এটা একটা গোপন সুড়ঙ্গ পথ। কোন স্প্রিং বা ওই জাতীয় কিছুর সাহায্যে কাজ করে। সুব্রত মনে মনে ভাবলে, আশ্চর্য! জানি না এই সিঁড়ি কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সিঁড়ি ধরে এগোলে শেষ পর্যন্ত কোথায় যেতে হবে কে জানে? হয়তো বা সাক্ষাৎ মৃত্যুর গহ্বর বরাবর। চলে গেছে। এখন এই পথ ধরে অগ্রসর হওয়া উচিত কিনা? কিন্তু অগ্রসর না হয়েই বা লাভ কী? এইখানে এই ঘরের মধ্যে বসে থাকলেও তো মুক্তির কোনই উপায় হবে না। এখানে তাকে এইভাবে বন্দী করে রেখেছে শত্রুপক্ষ, তারা নিশ্চয়ই আরামে বসে থাকবে না। তারা যদি দলে ভারী হয় এবং তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকে, তবে মুক্তির পথ আরও দুরূহ হওয়াই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বিবেচনা করে দেখতে গেলে অগ্রসর হওয়াই উচিত। হয়তো বা এই পথের শেষে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে। চান্স একটা নেওয়া দরকার। সুব্রত উঠে দাঁড়াল। হ্যাঁ, সে এই পথ ধরেই অগ্রসর হবে। সুব্রত গর্তের ভিতরে নামল এবং সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। উঃ, কী অন্ধকার। গাঢ় কালির মতই শ্বাসরোধকারী জমাট-বাঁধা অন্ধকার। সুব্রত সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একবার থমকে দাঁড়াল। কোন শব্দ শোনা যায় কিনা? না, কিছুই শোনা যায় না। সুব্রত আবার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। এক, দুই। এমনি করে প্রায় বারোটা সিঁড়ির ওপরে ওর পা সমতলভূমিতে ঠেকল। ও দাঁড়াল। হাতের টর্চটা জ্বেলে ও চট করে একবার তার আশপাশ আলোতে দেখে নিল। সরু অপ্রশস্ত গলিপথ। কিন্তু কোথায় গিয়ে যে ঐ পথ শেষ হয়েছে কিছুই তার বোঝবার উপায়। নেই। যেন বিরাট একটা কালো অজগর মুখব্যাদান করে আছে। সুব্রত আবার অগ্রসর হল। বোধ হয় দশ পাও সে অগ্রসর হয়নি, সহসা কার তীব্র কণ্ঠস্বর নির্ঘোষে ওর কানে এসে। বাজল, থাম! তারপরেই একটা তীব্র আলোর রশ্মি ওর চোখেমুখে এসে সুতীব্র ঝাপটা দিল। কিহে মাস্টার, চলেছ কোথায়? বিস্ময়ে ও ঘটনার আকস্মিকতার সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ও দেখলে গলিপথ কখন প্রশস্ত হয়ে গেছে, সামনে যমদূতের মত দুজন লোক তাদের দুজনেরই হাতে উদ্যত পিস্তল। সুব্রত তার হাতের টর্চটা জ্বাললে এবং নিঃশব্দে লোক দুটোর মুখের ওপরে প্রতিফলিত করল। শান্ত অবহেলার ভঙ্গিতে লোক দুটি দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তাদের কঠোর সংকল্পের নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি। সুব্রত নিরস্ত্র। সম্বল মাত্র জাপানী ছুরিটা! দুটো পিস্তলের কাছে ওটা কিছুই নয়। সুব্রত চকিতে তার আশেপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিল। সামনের গলিপথটা প্রশস্ত হয়ে গেছে। সামনেই দেখা যায় দুদিককার দেওয়ালে দুটো দরজা। একটার কবাট বন্ধ, অন্যটার খোলা। খোলা কবাটের সামনেই লোক দুটো দাঁড়িয়ে। তিনজনেই নিস্তব্ধ, নিঝুম। কারও মুখে কোন কথা নেই। যেন একটা বরফের মত ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা—অন্ধকারে কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। সহসা আবার সুব্রত তার টর্চের আলো একজনের মুখের ওপরে প্রতিফলিত করলে। লোকটা হঠাৎ চোখটা বুজে ফেললে মুহূর্তের জন্য। আর সেই মুহূর্তের অবকাশে সুব্রত চোখের পলকে মরিয়া হয়ে বিড়ালের মত নীচু হয়ে বসে পড়ে লোকটার পায়ে এক লাথি মারলে। লোকটার হাতে টর্চ ছিল। সে হঠাৎ ঐভাবে আক্রান্ত হয়ে একপাশে ছিটকে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চীৎকার করে উঠল। লোকটার হাত থেকে টর্চ ও পিস্তলটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। অন্য লোকটা ততক্ষণে সুব্রতর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুব্রত তাকে জাপানী যুযুৎসুর প্যাচে মুহূর্তে ধরাশায়ী করল। অন্য লোকটার পায়ে বেশ চোট লেগেছিল। কিন্তু তবু সে উঠে বসেছে। সুব্রত তাকে আক্রমণ করবার সুযোগমাত্র না দিয়ে আবার যুযুৎসুর পাঁচে ধরাশয়ী করলে এবং পরক্ষণেই সে আলো জ্বেলে প্রথমেই পিস্তল দুটো করায়ত্ত করে নিল। একটা পিস্তলের লোহার বাঁট দিয়ে উঠে বসা লোটারই মাথায় প্রচণ্ড এক আঘাত করতেই লোকটা অস্ফুট কাতর শব্দ করে তখুনি আবার জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়ে গেল। দ্বিতীয় লোকটা তখন
false
humayun_ahmed
যাবে। বাবার স্ট্রোক না হলেই হয়। ‘কি লিখেছ চিঠিতে?‘ ‘তিন লাইনের চিঠি – আজ বিয়ে করছি তাই লেখা -‘ ‘কিভাবে লেখা – ল্যাংগুয়েজটা কি?‘ ‘তিস লাইনে তো খুব কাব্যিক ল্যাংগুয়েজ হয় না। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।‘ ‘কাকে বিয়ে করছ এইসব কিছু লেখনি তো?‘ ‘না। শুধু লিখলাম – একটি বেকার এবং আপাতদৃষ্টিতে অপদার্থ যুবককে বিয়ে করছি। আমার মনে হচ্ছে না আমি কোন অপরাধ করছি। তার পরেও ক্ষমা প্রার্থনা করছি – আপা, তুমি বাবা-মা‘কে শান্ত করবে এবং বুঝিয়ে বলবে।‘ মুহিব শুকনো গলায় বলল, তোমার বাবা-মা‘র রিএ্যকশান কি হবে? ‘কি করে বলব কি হবে! তাদের কোন মেয়েতো এর আগে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নি। এই প্রথম এবং এই শেষ। চল রওনা হওয়া যাক।‘ তারা রিকশায় উঠল। মুহিব বলল, হুড তুলে দেব? ‘না।‘ ‘খারাপ লাগছে অরু?‘ ‘খারাপও লাগছে না আবার ভালও লাগছে না। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। জ্বর জ্বর লাগছে। দেখ তো জ্বর কি-না?‘ ‘না জ্বর নেই।‘ অরু হাসতে হাসতে বলল, জ্বর নেই বলে হাত সরিয়ে নিলে কেন? লজ্জা লাগছে? ‘হু, আজ কেন জানি অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লজ্জা লাগছে। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।‘ ‘তাকিয়ে আছে তো বটেই। তাকিয়ে আছে তোমার হলুদ পাঞ্জাবীর জন্যে। তুমি দয়া করে আজ রাতেই এই পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ফেলবে।‘ ‘আচ্ছা।‘ অরু হালকা গলায় বলল, বিয়ের পর আমরা যাব কোথায়? ‘বাসর কোথায় হবে এই কথা জিজ্ঞেস করছ?‘ অরু অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ। ‘বজলুর বাসায়।‘ ‘বজলু কে?‘ ‘আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, অতি ভাল ছেলে। গত বৎসর বিয়ে করেছে। তার বৌটা তার চেয়েও ভাল। ওরা একটা ঘর আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে হুলস্থুল করেছে।‘ ‘অপরিচিত কারো বাসায় উঠতে আমার ইচ্ছে করছে না।‘ ‘ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তোমার মনে হবে এরা অপরিচিত না। খুবই পরিচিত। তা ছাড়া আমার আর কোন জায়গাও নেই যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।‘ ‘তুমি তোমার আপাকে সব খুলে বলবে বলেছিলে – বলেছ?‘ ‘না।‘ ‘বলনি কেন?‘ ‘কাল বলব। আপাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।‘ ‘উনি রাগ করবেন না?‘ ‘পাগল, আপার রাগ করার ক্ষমতাই নেই।‘ ‘আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছ, একটু আগেই না একটা খেলে।‘ ‘টেনশন বোধ করছি।‘ অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই যে তোমার পাশে বসেছি – শেষবারের মত বন্ধুর পাশে বসেছি। এরপর বসব – স্বামীর পাশে। ‘স্বামী কি বন্ধু না?‘ ‘গল্প উপন্যাসে বন্ধু। বাস-বে না। বাস-বের স্বামীরা যতটা না বন্ধু তার চেয়েও বেশী অভিভাবক।‘ মুহিব গম্ভীর গলায় বলল, তুমি ভুল করছ অরু। আমি তোমার বন্ধুই থাকব। অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাকলে তো ভালই। ‘তোমার মনে কোন সন্দেহ আছে?‘ ‘আছে। হুডটা তুলে দাও। আসলেই সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি তাকাচ্ছে আমাদের রিকশাওয়ালা। যেভাবে সে পেছন ফিরে ফিরে রিকশা চালাচ্ছে মনে হয় এ্যাকসিডেন্ট করবে।‘ মুহিব হুড তুলে দিল। অরু বলল, আজ কত তারিখ বল তো? ‘এগারোই ডিসেম্বর।‘ ‘বাংলা কত?‘ ‘জানি না বাংলা কত।‘ অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজ আমাদের বিয়ে আর আজকের বাংলা তারিখটা তোমার জানার ইচ্ছা হল না? আজ ২৬শে অগ্রায়ণ। ‘ও আচ্ছা ২৬শে অগ্রায়ণ।‘ ‘আর আমাদের রিকশাওয়ালার নাম হচ্ছে সুরুজ মিয়া। তার নামটাও মনে রাখা দরকার। তার রিকশায় করে বিয়ে করতে যাচ্ছি।‘ মুহিব কিছু বলল না। অরু বলল, ভাল করে দেখ তো জ্বর কি-না। এত খারাপ লাগছে কেন? মাথা ঘুরছে। ভুলে জরদা দিয়ে পান খেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে। ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ধর আর আধ ঘণ্টা।‘ অরু ঘড়িতে দেখল তাদের বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান শেষ হতে মাত্র ১৬ মিনিট লাগল। কাজী সাহেবের কাছে অনুষ্ঠানটা হয়ত খুব ‘বোরিং‘ লাগছে। তিনি কয়েকবার হাই তুললেন এবং যন্ত্রের মত বললেন, এইখানে সই করেন। তারিখ দেন। অরু গোটা গোটা করে লিখল, অরুণা চৌধুরী। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ। কি আশ্চর্য! কটকটে হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন তার স্বামী। এই জীবনের সবচে‘ কাছে মানুষ। কোন ভুল হয়নি তো? প্রচণ্ড বড় কোন ভুল! যে ভুল এই জীবনে আর শোধরানো যাবে না। অরুর পানির পিপাসা পেয়ে গেল। কাজী সাহেবকে সে কি বলবে পানির কথা? না-কি মুহিবকে বলবে? মুহিবের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগছে। মুহিবের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। বজলু এগিয়ে এসে বলল, ভাবী, চলুন যাওয়া যাক। ভাবী ডাকটা কি অদ্ভূত শোনাচ্ছে! গা শির শির করে। অরু নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরুল। মুহিবের অন্য বন্ধুরা এখনো কেউ তাকে কিছু বলেনি। একজন শুধু তাকে বলেছে – কনগ্র্যাচুলেশনস ভাবী, বলে হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়েছে। ফুলটার দিকে তাকাতেও কেন জানি লজ্জা লাগছে। মুহিবকেও অন্য রকম লাগছে। ও আচ্ছা এখন বোঝা গেল – বাবু চুল কেটেছেন। নতুন হেয়ার স্টাইল। গোলাপ ফুল দেয়া মানুষটা বলল, কোথাও বসে এক কাপ চা কিংবা কোল্ড ড্রিংস খাওয়া যাক। কাছেই একটা ভালো কনফেকশনারী দোকান আছে। যাবে? বজলু বলল, না না – স্ট্রেইট আমার বাসায় চল। কেক কেনা আছে। কেক কাটা হবে। রেনুকে চা রেডি রাখতে বলেছি। গাড়িতে উঠ সবাই। গাড়িতে উঠ। মুহিব তুই ভাবীকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বস। আমরা সবাই পেছনে আছি। অরুর প্রচণ্ড পানির পিপাসা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক গ্লাস পানি
false
humayun_ahmed
চেয়েছিলেন। মিসির আলি বললেন, এখন আপনার অনুমান কী? আমি স্যার আমার অনুমানের কথা আপনাকে বলব না। আমি আমার অনুমানের কথা বলে আপনাকে প্রভাবিত করব না। বেশ, আপনি বলতে থাকুন। আমার জীবন কাটতে লাগল বাড়ির পেছনে কুয়োতলায়। বাঁধানো কুয়োতলা আমি চক দিয়ে ছবি এঁকে ভরিয়ে ফেলতাম। সন্ধ্যাকেলা সর্দার চাচা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতেন–ভালো হইছে। সৌন্দৰ্য হইছে। তারপর কুয়ো থেকে বালতি বালতি পানি তুলে কুয়োতলা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতেন, যাতে পরদিন আমি ছবি আঁকতে পারি। যে মাস্টার সাহেব আমাকে পড়াতে এলেন তাকে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। হাসিখুশি। পড়াতেন খুব ভালো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতেন। মানুষটা খুব রোগা। অনেকখানি লম্বা। অতিরিক্ত লম্বার কারণেই বোধহয় কুঁজো হয়ে থাকতেন। চাইনিজদের মতো তার থুতনিতে দাড়ি ছিল। প্রচুর সিগারেট খেতেন। সস্তা দামের সিগারেট। সিগারেটের কড়া গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যেত। বমি আসত। যখন গল্প শুরু করতেন তখন আর কিছু মনে থাকত না। তামাকের গন্ধও পেতাম না। কী গল্প করতেন? নানান ধরনের গল্প। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের পুরো গল্পটা তিনি আমাকে বলেন, কাঁদতে কাঁদতে আমি এই গল্প শুনি। আজ পর্যন্ত আমি কাউকে এত সুন্দর গল্প বলতে শুনি নি। অল্প কিছুদিন স্যার আমাকে পড়ালেন। তারপর তার চাকরি চলে গেল। কেন? আপনাকে পরে বলব। ব্যাখ্যা করে বলব। স্যারের প্রসঙ্গ এখন থাক। যে কথা বলছিলাম–উনার চাকরি চলে গেলেও উনি কিন্তু প্রায়ই আসতেন। চুপিচুপি আসতেন, বেছে বেছে এমন সময় আসতেন যখন বাবা থাকতেন না। গলা নিচু করে বলতেন, তোমাকে দেখতে আসলাম। ভালো আছ? তোমার বাবা বাসায় নাই তো? আমি যদি বলতাম, না। তিনি অসম্ভব আনন্দিত হয়ে তৎক্ষণাৎ সিগারেট ধরাতেন। একদিন ঠিক দুপুর বেলায় এসে গলা নিচু করে বললেন, তন্ময়, বাবা একটা কথা শোন–তোমার মা তোমাকে একটু দেখতে চায়। শুধু একপলক দেখবে। তোমার মার খুব শরীর খারাপ। হয়তো বাঁচিবে না। তোমাকে খুব দেখার ইচ্ছা! তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? দুপুর বেলা তো তোমার বাবা বাসায় বেশিক্ষণ থাকেন না। তখন নিয়ে যাব। দেখা করিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। যাবে? এই দেখ, তোমার মা একটা চিঠিও দিয়ে দিয়েছেন। চিঠিটা পড়। আমি চিঠিটা না পড়েই তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ। তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে কিছু বললে তোমাকে নিতে দেবে না। আমি কাউকে কিছু বলব না। আমি তোমাকে নিতে আসব না-বুঝলে? তুমি করবে কি-দুপুর বেলায় সুযোগ বুঝে গেট দিয়ে বাইরে চলে আসবে। এক দৌড়ে সদর রাস্তায় চলে আসবে। একটা বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে না-ঐখানে আমি থাকব। তুমি আসামাত্র তোমাকে নিয়ে চলে যাব। আসতে পারবে না? পারব। দেখো, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। জানতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোমার বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন না। উনি সেই মানুষই না। আমি একজন দরিদ্র মানুষ… আমি যাব। কবে আসবে? আপনি বলুন। আগামীকাল পারবো? হুঁ। পারব। উনাকে খুব চিন্তিত মনে হলেও আমি মোটেই চিন্তিত হলাম না। আমার মনে হলকেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই আমি চলে আসব। তা ছাড়া শীতের দুপুরে সর্দার চাচা পাকা বারান্দায় পাটি পেতে রোদে ঘুমায়। বাবা বাসায় থাকেন না। তিনি ফেরেন। সন্ধ্যায়। গেটে যে থাকে সেও ঝিমুতে থাকে। এক ফাঁকে ঘর থেকে চলে গেলেই হল! তাই করলাম। সবাইকে ফাকি দিয়ে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বেবিট্যাক্সি স্ট্র্যান্ডের কাছে মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। তাঁকে দেখে দারুণ চিন্তিত মনে হল। ভীত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে দেখে তার উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। তিনি বললেন, কেউ দেখে নি তো? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, চল একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে নি। উনি যখন বেবিট্যাক্সি দরদাম করছেন তখনই সর্দার চাচা উপস্থিত হলেন। আমাদের দুজনকেই বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাবা আসলেন সন্ধ্যাবেলা। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু স্যারের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। সেই শাস্তি ভয়াবহ শাস্তি। একতলার দারোয়ানের ঘরে দরজা বন্ধ করে মার! সেই ঘরের ভেতর আমিও আছি। বাবা চাচ্ছিলেন যেন শাস্তির ব্যাপারটা আমিও দেখি। স্যারকে মারছিল সর্দার চাচা। আমি একটা খাটের উপর দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্য থরথর করে কাপতে কাঁপিতে দেখছি। স্যার একসময় রক্তবমি করতে লাগলেন এবং একসময় কাতর গলায় বললেন, আমারে জানে মারবেন না। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে। সর্দার চাচা হিসহিস করে বললেন,-চুপ। শব্দ করলে কইলজা টান দিয়া বাইর কইরা ফেলামু। চুপ। এরপর কী হল আমার মনে নেই। কারণ, আমার জ্ঞান ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। সর্দার চাচা আমার মাথায় পানি ঢালছেন। আমি বললাম, উনি কি মারা গেছেন? সর্দার চাচা বললেন, আরে দূর বোকা! মানুষ অত সহজে মরে না। মানুষ মারা বড়ই কঠিন। তারে রিকশায় তুল্যা বাসায় পাঠায়ে দিছি। রক্তবমি করছিল? পেটে আলসার থাকলে অল্প মাইর দিলেই নাকে-মুখে রক্ত ছোটে। ও কিছু না। উনি তা হলে মরেন নাই? না না। আইচ্ছা ঠিক আছে-তোমারে একদিন তার বাসায় নিয়া যাব নে! আমি উনার বাসায় যাব না। এইটাই ভালো। কী দরকার? সর্দার চাচা আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। স্যারকে ঐরাতে ভয়ংকরীভাবে মারা হয়েছিল। অচেতন অবস্থায় তাঁকে গভীর রাতে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়। সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তাঁর
false
humayun_ahmed
করছেন না। শখের বসে আকাশ দেখছেন। সেটা তো একবার দেখলেই হয়। রাতের পর রাত হী করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন কী? রূপা হেসে ফেলল। তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছ কেন? আপনি কেমন রাগ করছেন তাই দেখে হাসছি। যে মানুষটিকে আপনি এখনো দেখেন নি। তার উপর রাগ করছেন কেন? তার উপর রাগ করছি না। তোমার বিচার-বিবেচনা দেখে রাগ করছি। তোমাদের মতো ব য়েসী মেয়েদের এই সমস্যা। তারা অতি অল্পতেই অভিভূত। একজন হয়তো কবিতা লেখে। তার মাথাভর্তি লম্বা চুল। ময়লা পাঞ্জাবি পরে উদাস মুখে ঘুরে বেড়ায়। তার একটি কবিতা না পড়ে শুধুমাত্র তাকে দেখেই তোমরা অভিভূত হয়ে যাবে। চোখ বড় বড় করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলবে, কবি, কবি! রূপা খিলখিল করে হেসে ফেলল। তানভিরও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, লর্ড বায়রনের কথা তুমি জানো কি-না জানি না। বড় কবি। ইংল্যান্ডের সব তরুণী কবিতা না পড়েই এই মানুষটার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অথচ মানুষটা ছিলেন খোড়া, তিরিক্ষি মেজাজ। কেউ তাঁর দিকে তাকালেই রেগে যেতেন। তিনি বিয়ের দুঘণ্টা পর নববধূকে কাছে ডেকে বললেন, এই শোন, তোমাকে আমি কেন বিয়ে করেছি। জানো? তোমাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি বলেই বিয়ে করেছি। রূপা বলল, বায়রনের কোনো কবিতা কি আপনার জানা আছে? না। তুমি পড়তে চাইলে জোগাড় করে দেব। অনেক দূর এসে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আব কতক্ষণ? ঐ যে ভাঙা বাড়িটা দেখছেন–ঐ টা। তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, এ বাড়ি তো যে-কোনো মুহুর্তে ভেঙে মাথার উপর পড়বে। কোনো বুদ্ধিমান প্ৰাণী এই বাড়িতে বাস করতে পারে না। অসম্ভব! তানভিাবের কথা ভুল প্রমাণ করে ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে মবিনুর রহমান বের হয়ে এলেন এবং নিতান্তই সহজ গলায় বললেন, রূপা আসা। যেন তিনি রূপার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। রূপা বলল, স্যার ইনি মেজো ভাইয়ের বন্ধু। আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন। গ্রাম দেখতে বের হয়েছেন। মবিনুর রহমান বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন। তানভির কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বইলি। রূপা বলল, স্যার আপনার নৌকাটা কি ঘাটে আছে? হ্যাঁ আছে। আমরা আপনার নৌকান্য বসে চা খাব। ঘরে চা পাতা আছে স্যার? আছে, চা পাতা আছে। তবে চিনি নেই। গুড় দিয়ে চা খেতে হবে। তোমরা নৌকায় গিয়ে বাস, আমি চা বানিয়ে আনছি। আপনাকে চা বানাতে হবে না স্যার। আমি বানাব। কোনটা কোথায় আছে আপনি শুধু দেখিয়ে দেবেন। রূপা চা বানাতে বসল। তানভির মবিনুর রহমানের পাশে একটা চৌকিতে বসল। সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে বাড়ির ছাদ ভেঙে মাথায় পড়বে। তবে আরো আগে যে চৌকিতে বসেছে সেই টোকিও ভেঙে টুকরো টুকরো হবে। মটমট শব্দ করছে। তানভির বলল, রূপা বলছিল। আপী-। না-কি টেলিস্কোপ দিয়ে সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন? মবিনুর রহমান নিচু গলায় বললেন, এটা আমার একটা শখ। তবে সবদিন দুরবিন নিয়ে বসি না। আকাশ যখন পরিষ্কার থাকে তখন বসি। কী দেখেন। তারা দেখি? একই তারা বারবার দেখতে ভালো লাগে? জি লাগে। তারা দেখি আর ভাবি। কী ভাবেন? বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কী করে তৈরি হলো তাই ভাবি। আপনার এই ভাবনা তো পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভেবে রেখেছেন। বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্সের সৃষ্টি। এটা নিয়েই ভাবি। বিগ বেংগের আগে কী ছিল? অনন্ত শূন্য ছিল? যদি তাই থাকে তাহলে তো বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্স সৃষ্টি হতে পারে না। অসুবিধা কোথায়? তাহলে ধরে নিতে হবে থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র কাজ করছে না। তা তো হয় না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম কখনো ভঙ্গ করে না। আপনি তা কী করে জানেন? কেন জানব না? আমিও তো প্রকৃতিরই অংশ। আপনার দুরবিনটা কি খুব ভালো দুরবিন? জি। শনি গ্রহের বলয় পরিষ্কার দেখা যায়। এক রাতে সময় করে আসুন। আপনাকে 6थींद। এখানে আসতে খুব ভরসা পাচ্ছি না। বাড়ির যা অবস্থা। যে কোনো মুহৰ্তে ছাদ মাথার উপর ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে–তাছাড়া আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে বিষাক্ত সাপ আছে। ভাঙা বাড়ি সাপদের খুব প্রিয়। মবিনুর রহমান সহজ গলায় বললেন, সাপ আছে ঠিকই। দুটো চন্দ্রবোড়া সাপ পাশের ঘরে থাকে। সাপ আপনি টেনেন? চন্দ্ৰবোড়া বুঝলেন কী করে? অনুমানে বলছি। সব সাপ ডিম দেয়। এই সাপটা সরাসরি বাচ্চা দিয়েছে। একমাত্র চন্দ্রবোড়াই সরাসরি বাচ্চা দেয়। একত্ৰিশটা বাচ্চা দিয়েছে। বসে বসে গুনেছেন? জি না। একদিন বারান্দায় বসে ছিলাম। দেখলাম, সাপটা বাচ্চাগুলি নিয়ে বের হয়েছে। তখন গুনলাম। একত্ৰিশটা সাপের বাচ্চা এবং দুটা সাপ নিয়ে বাস করতে আপনার ভয় লাগে না? একটু লাগে। রাতে আমি ঘরে থাকি না। নৌকায় ঘুমাই। তবে আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আমরা সহাবস্থান নীতি গ্ৰহণ করেছি। আমি ওদের কিছু বলি না। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। ওরা আমার গায়ের গন্ধ চেনে। আমিও ওদের গায়ের গন্ধ চিনি। আগেভাগেই সাবধান হয়ে যাই। চা তৈরি হয়ে গেছে। মবিনুর রহমান ফ্রাঙ্ক এনে দিলেন। ফ্লাঙ্ক-ভর্তি চা নিয়ে তিনি নৌকায় রাত্রিযাপন করেন। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, খাবার-দাবার তো কিছু নেই রূপা। মুড়ি আছে। মুড়ি নিয়ে যাবে? হ্যাঁ নিয়ে যাব। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। রূপা, তানভিরকে নিয়ে নৌকায় উঠে খুশি খুশি গলায় বলল, সুন্দর না? তানভির বলল, অবশ্যই সুন্দর। নৌকায় বসে চা খাওয়ার এই আইডিয়া অসাধারণ আইডিয়া। আমরা রোজ এখানে
false
humayun_ahmed
উপার্জন করতে পারে না। আমাদের প্রফেট আদর্শ মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। আচ্ছা, শুভ্ৰ কি আদর্শ মানুষ হবে? যদি হয় একদিন তারও তো তাহলে দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা হবে। তিনি কি তা সহ্য করতে পারবেন? কিন্তু তিনি চান শুভ্র আদর্শ মানুষ হোক। শুভ্রর যে রাতে জন্ম হলো সে রাতে তিনি বড় ধরনের একটা অন্যায় করে বিশাল অঙ্কের টাকা গেলেন। ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে হাসপাতালে গেলেন ছেলেকে দেখতে–আহা, কী সুন্দর, কী ফুটফুটে ছেলে। নবজাতক শিশু হাসতে পারে না, কিন্তু তিনি পরিষ্কার দেখলেন যে, ফুলের মতো শিশু তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। হয়তো তার চোখের ভুল। হয়তো তাঁর কল্পনা। কিন্তু তিনি দেখলেন। নার্স বলল, বাচ্চা কোলে নেবেন? তাঁর হাত অশুচি হয়ে আছে। এই অশুচি হাতে বেহেশতের ফুল স্পর্শ করা যায় না। তবু তিনি দুহাত বাড়িয়ে বললেন–দিন। আমার কোলে দিন। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তিনি তার নাম রাখলেন-শুভ্ৰ। তিনি মনে মনে বললেন-আমার এই ছেলেকে যেন পৃথিবীর কোনো মালিন্য, কোনো নোংরামি কখনো স্পর্শ না করে-সে যেন তার নামের মতোই হয়। আচ্ছা, শুভ্ৰ কি পারবে? নিশ্চয়ই পারবে। কেন পারবে না? সৎ প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষ জন্মায়। চারপাশের মানুষ তাকে অসৎ করে। তিনি শুভ্রকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছেন। পৃথিবীর কোনো মালিন্য শুভ্রের কাছে ভিড়তে দেন নি। তিনি কোটি কোটি টাকা শুভ্রের জন্যে রেখে যাচ্ছেন। টাকার পরিমাণ কল্পনার উপরে। এই অর্থ সৎ অর্থ নয়। শুভ্ৰ এই অৰ্থ দিয়ে কী করে তা তার দেখার ইচ্ছা। মৃত্যুর পর কোনো—একটা জগৎ যদি সত্যি থাকে তাহলে সেখান থেকে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখবেন। ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ি বের করতে বলে স্ত্রীর খোঁজে গেলেন। নিশিরাতে হাইওয়েতে ছুটে বেড়ানো রাহেলার পছন্দের কর্মকাণ্ডের একটি নয়। তিনি হয়তো যেতে চাইবেন না। রাহেলার ঘর অন্ধকার। তিনি বাতি জ্বালালেন। অন্ধকার ঘরে খাটের ঠিক মাঝখানে জবুথবু হয়ে রাহেলা বসে আছেন। কী হয়েছে? রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, কিছু না। ঘর অন্ধকার করে এভাবে বসে আছ কেন? আমার শুভ্রের জন্যে খুব খারাপ লাগছে। আবার দুশ্চিন্তা করছ? রাহেলা ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, একদিন তুমি, আমি আমরা কেউ থাকব না। আমার এই ছেলের চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। কে তখন দেখবে আমাদের শুভ্ৰকে? ইয়াজউদ্দিন সাহেব স্ত্রীর কাধে হাত রেখে বললেন, চলো, ঘুরে আসি। ১০০ কিমি স্পিডে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাব। আমি চালাব, তুমি বসে থাকবে পাশে। আর শোনো রাহেলা—যা হবার তাই হবে—কে সারা সারা। আমরা কোথায় যাচ্ছি? এখনো জানি না কোথায়। আগে চলো গাড়িতে উঠি। আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। তোমার শরীর ঠিকই আছে। আসলে তোমার মন ভালো নেই। গাড়িতে উঠলেই তোমার মন ভালো হতে শুরু করবে। মন ভালো হয়ে গেলেই শরীর ভালো লাগতে শুরু হবে। ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব এক্সিলেটারের চাপ ক্রমেই বাড়াচ্ছেন। রাহেলা বসে আছেন মূর্তির মতো। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, তোমার কি ভয় লাগছে রাহেলা? রাহেলা যন্ত্রের মতো বললেন, না। গুড। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদটাও ছুটছে আমাদের সঙ্গে। দেখছ? হুঁ। তোমার কি মনে হয়। হাত বাড়ালেই চাঁদটাকে ছোঁয়া যায়? রাহেলা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে? ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ির স্পিড আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিলে বললেন, আমি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলি নি। তাহলে বলো, শুভ্ৰ আর কতদিন পরে চোখে দেখতে পাবে? ডাক্তারের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে। তুমি এটা জানো। আমাকে বলো। ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ির গতি কমিয়ে একসময় গাড়ি থামিয়ে ফেললেন। যতদূর দৃষ্টি যায়—ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের মাথার উপর বিশাল চাঁদ। ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, রাহেলা, তুমিও নামো। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি। জবাব দাও। ইয়াজউদ্দিন সাহেব চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে প্রশ্নটা শুনতে পান নি। রাহেলা গাড়ির ড্যাসবোর্ডে মাথা রেখে কাঁদছেন। দারুচিনি দ্বীপে জোছনার ফিনিক ফুটেছে। দ্বীপের চারপাশের জলরাশিতে প্রতিফলিত হচ্ছে চাঁদের আলো! এই আলো স্থলভূমির আলোর চেয়েও অনেক রহস্যময়। তীব্ৰ অথচ শান্ত। এই আলো কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সরাসরি হৃদয়ের অন্ধকার কুঠরিতে চলে যায়। মানুষের মনে তীব্র এক হাহাকার জেগে ওঠে। সেই হাহাকারের কারণ মানুষ জানে না। প্রকৃতি তার সব রহস্য মানুষের কাছে প্ৰকাশ করে না। শুভ্র বসেছে একেবারে জরীর গা ঘেষে। জরীর অন্য পাশে আনুশকা। তাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সমুদ্রের কাছাকাছি মুনা আছে। মোতালেব এবং রানা অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। তাদের দৃষ্টি বড় একটা প্রবাল খণ্ডের উপর বসে থাকা পাগলী মেয়েটির দিকে। মেয়ের ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক নেই কখন কি করে বসে। হয়তো ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেল। আনুশকা শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে শুভ্র? খুব খারাপ লাগছে। আনুশকা বিস্মিত হয়ে বলল, খারাপ লাগছে কেন? শুভ্র সহজ গলায় বলল, এত সুন্দর পৃথিবী। কিন্তু আমি এই সুন্দর বেশিদিন দেখব না। আমার চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর অল্প কিছুদিন, তারপর আমি সত্যি সত্যি কানা-বাবা হয়ে যাব। জরী বলল, কি বলছ তুমি? সত্যি কথা বলছি। আমি তো কখনো মিথ্যা বলি না। যার নাম শুভ্র সে মিথ্যা বলবে কি করে? আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। আনুশকা বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলা যাক।
false
humayun_ahmed
গেছে–এ খবর ফিহাকে খুব আলোড়িত করল। দু-তিন বার পড়লেন খবরটি। নিজের মনেই বললেন, সত্যিই কি মহাবিপদ? সমস্ত-নিয়ম কানুন ভেঙে পড়ছে এভাবে। না—তা কেন হবে– যারা কোনো দিন পৃথিবীকে চোখেও দেখল না, তাদের কথা কি কখনও ভেবেছেন ফিহি? নিকি চা নিয়ে কখন যে ফিহার সামনে এসে বসেছে এবং চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, ফিহা তা লক্ষই করেন নি। কাদের কথা বলছ নিকি? মানুষদের কথা, যাদের জন্ম হয়েছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে মহাকাশযানে কিংবা অন্য উপগ্রহে। জানেন ফিহা, পৃথিবীতে ফিরে এসে একবার শুধু পৃথিবীকে দেখবে, এই আশায় তারা পাগলের মতো।– নিকি, তুমি জান আমি কবি নই। এসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমার ভালো লাগে ! আমি দুঃখিত। চায়ে চিনি হয়েছে? হয়েছে। আপনার আর কিছু লাগবে, কোনো সহকারী? না, তার প্রয়োজন নেই। তুমি একটা কাজ করবে নিকি? বলুন কি কাজ। আমার বাবা-মা শীতলকক্ষ থেকে বেরিয়ে হয়তো আমাকে খুজছেন। তাদের এখানে নিয়ে আসব? না না। তাঁরা যেন আমার খোঁজ না পান। আমি একটা জটিল হিসাব করব। খুব জটিল! ঠিক আছে। রাতে বাতি নিভিয়ে ফিহা সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন। মাথার কাছে মোমবাতি রেখে দিলেন। রাত-বিরেতে ঘুম ভেঙে গেলে আলো জ্বালিয়ে পড়তে ভালোবাসেন, এই জন্যে। চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে, এমন সময় একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল। ফিহার মনে হল ঘরের ভিতর কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে আবছা মতো একটা মূর্তি দেখতে পেলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, কে? আমি। আমিটি কে? বলছি। দয়া করে বাতি জ্বালাবেন না। ফিহা নিঃশব্দে বাতি জ্বালালেন। আশ্চর্য। ঘরে কেউ নেই। তিনি বাতি হাতে বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালেন। চাঁদ উঠেছে আকাশে। চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে। কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাব। আমি অসুস্থ, আরোল-তাবোল দেখছি। জটিল একটা অঙ্ক করতে হবে। আমাকে। এ সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। ফিহা মনে মনে বললেন। বাকি রাতটা তাঁর বারান্দায় পায়চারি করে কাটল। মাথুর ঘরের উজ্জ্বল আলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। সমস্ত বইটা পড়তে আমার এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না। মনে মনে এই ভাবলেন। আসন্ন বিপদের হয়তো তাতে কোনো স্রুরাহা হবে না, তবু তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। ড়ুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। সে তুলনায় এ তো অনেক বড় অবলম্বন। স্বয়ং ফিহা বলে পাঠিয়েছেন যেখানে। রাত জেগে জেগে মাথুরের মাথা ধরেছিল। চোখ কার্যকর করছিল। তবু তিনি পড়তে শুরু করলেন। বাইরে অনেক রাত। বারান্দায় খ্যাপার মতো হাঁটছেন স্রুরা। খটখট শব্দ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকক্ষে। সমস্ত অগ্রাহ্য করে মাথুর পড়ে চললেন। মাঝে মাঝে অস্পষ্টভাবে বলতে লাগলেন, আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! তা কী করে হয়? না না অসম্ভব। –আমি নিশ্চিত বলতে পারি যিনি এই বই পড়ছেন, রূপকথার গল্প ভেবেই পড়ছেন। অথচ এখানে যা যা লিখেছি একদিন আমি নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছি। মাঝে মাঝে আমারো সমস্ত ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। মনে হয়, হয়তো আমার মাথার দোষ হয়েছিল, বিকারের ঘোরে কত কী দেখেছি। কিন্তু আমি জানি মস্তিষ্ক বিকৃতিকালীন স্মৃতি পরবর্তী সময়ে এত স্পষ্ট মনে পড়ে না। তখনি সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্য বলে মনে হয়। বড় রকমের হতাশা জাগে। ইচ্ছে করে মরে যাই! ঘুমুতে পারি না, খেতে পারি না, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। এই জাতীয় অস্থিরতা ও হতাশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমি লিখতে শুরু করলাম এই আশায়, যে, কেউ একদিন আমার লেখা পড়ে সমস্তই ব্যাখ্যা করতে পারবে। অনেক সময়ই তো দেখা গেছে আজ যা রহস্য, কাল তা সহজ স্বাভাবিক সত্য। আজ যা বুদ্ধির অগম্য, কাল তা-ই সহজ সীমান্য ঘটনা। আমার সে রাতে ঘুম আসছিল না। বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছি। ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। আনা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার মার কাছে বেড়াতে গেছে। বিশেষ কাজ ছিল বলে আমি যেতে পারি নি। ফাঁকা বাড়ি বলেই হয়তো আমার বিষন্ন লািগছিল। সকাল সকাল শুয়েও পড়েছিলাম। ঘুম এল না–মাথা দপদপ করতে লাগল। এক সময় দুর ছাই বলে বাগানে চেয়ার টেনে বসলাম। এপ্রিল মাসের রাত। বিরবির করে বাতাস বইছে, খুব সুন্দর জ্যোৎস্না হয়েছে। এত পরিষ্কার আলো যে মনে হতে লাগল অনায়াসে এই আলোতে বই পড়া যাবে। মাঝে মাঝে মানুষের ভিতরে যে রকম ছেলেমানুষি জেগে ওঠে, আমারো তেমনি জেগে। উঠল। খুব ইচ্ছা হতে লাগল একটা বই এনে দেখেই ফেলি না পড়া যায়। কিনা। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নির্জনতায় কেমন ভয়ভয় লাগে, আবার ভালোও লাগে। চুপচাপ বসে আরোল-তাবোল কত কি ভাবছি, এমন সময় একটা হালকা গন্ধ নাকে এল, মিষ্টি গন্ধ। কিছু ভালো লাগে না, অস্বস্তি বোধ হয়। কিসের গন্ধ এটি? বের করতে চেষ্টা করতে লাগলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, গন্ধের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। হাত-পা অসাড় হয়ে উঠতে লাগল। যতই ভাবছি। এইবার উঠে দৌড়ে পালাব, ততই সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় হল আমার। সেই সময় ঘুম পেতে লাগল। কিছুতেই ঘুমাব না, নিশ্চয়ই কোনো বিষাক্ত গ্যাসের খপ্পরে পড়েছি, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ছাড়া ছাড়া কাটা কাটা ঘুম। চোখ মেলতে পারছিলাম না, তবে মিষ্টি গন্ধটা নাকে আসছিল তখনও। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মনে নেই। ঘুম ভাঙাল মাথায় তীর যন্ত্রণা নিয়ে। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ। চোখ মেলে। আমি দিন কি রাত বুঝতে পারলাম না। কোথায় আছি, আশেপাশে কাদের ফিসফিস
false
MZI
সুযোগ করে দেওয়া যাক। এবার যখন ক্রাইম করবে, তখন হাতেনাতে ধরা হবে। বড় মামা এতক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে যাচিছল, এবার বলল, এটা অনৈতিক কাজ। একজন মানুষকে অপরাধ করতে প্ররোচনা দেওয়া অপরাধ করার মতোই অন্যায়- বড় মামি বলল, রাখো তোমার নীতিকথা! আমাদের সোনা গয়না মোবাইল মানিব্যাগ হাওয়া হয়ে যাচ্ছে আর তোমার বড় বড় কথা। এই বাসায় যখনই বড়রা কথা বলে তখন সব সময়ই আশপাশে বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা থাকে। এখানেও তারা আছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছে। সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে টুনি। এখানে যে বাচ্চাকাচ্চা আছে তারা সবাই ঝুমু খালার ভক্ত, কেউ চিন্তাই করতে পারে না যে ঝুমু খালার মতো মানুষ এ রকম কাজ করতে পারে। হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর খেয়াল হলো বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা তার কথা শুনছে, সাথে সাথে খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাচ্চু সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিল, বলল, যা ভাগ। ভাগ এখান থেকে। একজন আপত্তি করে বলল, কেন? ভাগতে হবে কেন? ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, আবার মুখে মুখে তর্ক করে? বের হ বলছি। কাজেই বাচ্চাকাচ্চাদের বের হয়ে আসতে হলো, তারা খুব মনমরা হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন একজন বলল, ঝুমু খালাকে সাবধান করে দিতে হবে। টুনি বলল, কোনো দরকার নাই। সবাই একসাথে টুনির দিকে তাকাল, বলল, কেন? ঝুমু খালা মোটেও এইগুলো চুরি করে নাই। তাহলে কে করেছে? টুনি উত্তরটা জানে না, তাই চুপ করে রইল। ত্যাঁদড় টাইপ জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন করে জানিস ঝুমু খালা চুরি করে নাই। ঝুমু খালার অনেক বুদ্ধি। বুদ্ধিমান মানুষ বোকার মতো চুরি করে না। তাহলে কে চুরি করেছে? চুরি করেছে বাইরের কেউ। বাইরের কেউ বাসার ভেতরে কেমন করে ঢুকেছে? টুনি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। বাইরের কেউ বাসার ভেতরে কেমন করে ঢুকেছে সে জানে না। হয়তো ঢোকেনি। বাসার ভেতরে ঢুকেই কীভাবে বাসার ভেতরের জিনিস চুরি করে নেওয়া যায়, টুনি সেটা এখনো চিন্তা করে বের করতে পারল না। সে অবশ্য চিন্তা করা থামাল না, চিন্তা করতে লাগল। টুনি জানে ছোটাচ্চু এটা বের করতে পারবে না, তাকেই এটা বের করতে হবে। ছোটাচ্চু চোরকে হাতেনাতে ধরার জন্য খুব গোপনে একটা ব্যবস্থা নিল। তার মোটা কলমের মতো ভিডিও ক্যামেরাটা নানির ঘরের জানালার সাথে বেঁধে দিল। বাঁধল অনেক উঁচুতে যেন ঘরের ভেতরে কেউ থাকলে সেটা সহজে চোখে না পড়ে। নানির বিছানার কাছে টেবিলে বেশ কিছু লোভনীয় জিনিস ছড়িয়ে রাখা হলো। লোভনীয় জিনিসগুলো হলো কিছু টাকা, একটা মোবাইল ফোন এবং একটা গলার হার। হারটা দেখে সোনার মনে হলেও এটা আসলে ইমিটেশন, চোরের পক্ষে সেটা জানার কোনো উপায় নেই। ছোটাচ্চু তার ডিটেকটিভ এজেন্সির পুরো কাজটা করল খুব গোপনে, যেন কেউ সেটা টের না পায়। কিন্তু বাচ্চারা সবাই সেটা জেনে গেল কিন্তু সবাই ভান করল তারা জানে না। বাসার বড় মানুষদের শান্ত রাখার জন্য তাদের সবারই মাঝে মাঝে এ রকম কিছু করতে হয়। বড় মানুষদের নানা কাজকর্ম দেখেও না দেখার ভান করতে হয়, বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয়। ছোটাচ্চু মোটামুটি নিঃসন্দেহ ছিল পরদিন ভোরের মধ্যে চোরের সব কাজকর্ম ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাবে। এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর চোরকে শায়েস্তা করার কাজটা হবে পানির মতো সোজা। ছোটাচ্চু কখনোই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে পারে না কিন্তু পরদিন সে অ্যালার্ম ছাড়াই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। ঘুম থেকে উঠেই সে নানির ঘরে ছুটে এল, বিছানার কাছে টেবিলে টাকা, মোবাইল ফোন কিংবা ইমিটেশন সোনার হার কেউ ধরে দেখেনি, সেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানেই আছে। ঘরের মাঝখানে টুনি দাঁড়িয়েছিল, সে আঙুল দিয়ে জানালার ওপরে দেখিয়ে বলল, নিয়ে গেছে। কী নিয়ে গেছে? তোমার ভিডিও ক্যামেরা। ছোটাচ্চু চমকে উঠল, জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, কে নিয়েছে? মনে হয় চোর। ছোটাচ্চু প্রায় হাহাকার করে বলল, আ-আ-আমার এত দামি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে গেছে? টুনি কোনো কথা বলল না, সে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না। ছোটাচ্চু তখন আরও জোরে হাহাকার করে বলল, কেমন করে নিল? টুনি এবার উত্তর দিল, বলল, তুমি চেয়ারের ওপর একটা মোড়া রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে তোমার ভিডিও ক্যামেরা ফিট করেছিলে। তু-তুই কেমন করে জানিস? সবাই জানে। তোমরা মনে করো তোমরা কী কর সেটা ছোটরা জানে। ছোটরা সবকিছু জানে। এই বাসার বড় মানুষেরা একটু হাবা টাইপের। হ-হাবা টাইপের? টুনি এই প্রশ্নের উত্তর দিল না, বলল, তুমি অনেক উঁচুতে ভিডিও ক্যামেরাটা লাগিয়েছ, সেটা খুলে নিতে হলে চোরটাকে অন্তত আট ফুট লম্বা হতে হবে। এই বাসায় আট ফুট লম্বা কোনো মানুষ নাই, বাইরে থেকে এই বাসায় কোনো মানুষ ঢুকে নাই। তাহলে? টুনি বলল, তুমি ডিটেকটিভ, তুমি বের করো। এ রকম সময় নানি ঘরে ঢুকলেন, তার ঘরে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। নানি এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছ, মা। আমার পানের বাটা। নানিকে একজন খুব ছোট—প্রায় সিগারেটের বাক্সের সাইজের একটা পানের বাটা এনে দিয়েছিল। নানি বাইরে কোথাও গেলে সেটাতে পান সুপারি ভরে ব্যাগে করে নিয়ে যান। মনে হলো নানি সেটা খুঁজে পাচ্ছেন না। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কোথায় রেখেছিলে? নানি বললেন, এই তো।
false
shunil_gongopaddhay
ওরা চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতন এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করেও কোনও লাভ নেই। একজন লোক কাছে এসে পড়ে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে তাকে মারতে যেতেই সে শুয়ে পড়ল মাটিতে। আগুনের সঙ্গে সে লড়াই করতে পারবে না। একজন তার পিঠের ওপর পা রেখে বলল, এবার বাঁধ এটাকে। আর-একজন নিচু হয়ে সন্তুর হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল, এটার ওপর আমাদের বাবুর খুব রাগ। এটার জন্য ভাল টাকা পাওয়া যাবে। শুধু হাত নয়, সন্তুর সারা শরীরে দড়ি বাঁধা হল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে সে আছাড় খেয়ে পড়ছে, ওরাই তার চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করাচ্ছে। নদীর ধারে একটা গাছতলায় হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। একজনের হাতে রাইফেল। তার পায়ের কাছে ফেলে দেওয়া হল সন্তুকে। রাইফেলধারী লোকটি বেশ লম্বা-চওড়া। গম্ভীর গলায় সে বলল, ধরেছিস বিচ্ছুটাকে? বাঃ! গলার আওয়াজ শুনে দারুণ চমকে উঠল সন্তু। এ তো গগন সাহা। সে তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করল, সেই পুলিশটার কী হল? একজন বলল, সে পড়ে আছে রাস্তায়। গগন বলল, ওখানেই থাক। ওকে জানে মারিস না। তার দরকার নেই। ও আর কিছু করতে পারবে না। গাধা আর কাকে বলে, একখানা মোটে অস্তর নিয়ে এসেছে ছেলেকে উদ্ধার করতে! সন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এই গগন সাহার ছেলে তাদের সঙ্গে থিয়েটারের রিহার্সাল দিচ্ছিল। এই লোকটা সেই থিয়েটার নষ্ট করে অন্যের ছেলেকে চুরি করেছে! গগন সন্তুকে জুতো দিয়ে একটা ঠোক্কর মেরে বলল, কী রে শয়তানের বাচ্চা, নকল টাকা দিয়ে আমাদের ঠকাবি ভেবেছিলি? আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? ওই ছেলেকে ফেরত পেতে হলে এখন পাঁচের বদলে দশ লাখ দিতে হবে! একজনকে এক তাড়া নোট দিয়ে সে বলল, কাশেম, এটা তোরা ভাগ করে নে। এ-ছেলেটাকে তুলে দে আমার ভটভটিতে। সন্তুকে দাঁড় করাবার পর গগন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কী রে, সেদিন তো খুব নদীতে সাঁতারের কেরানি দেখিয়েছিলি। আজ তোকে এইরকমভাবে বেঁধে জলে ফেলে দিলে বাঁচতে পারবি? চল, দেখি! একজন বলল, একেবারে তলিয়ে যাবে, হাঙরে-কুমিরে খেয়ে নেবে। আর-একজন বলল, কিংবা জোয়ারের টান এলে টেনে নিয়ে যাবে একেবারে সুমুদুরে। সন্তকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেওয়া হল ভটভটিতে। গগন হাল ধরে বসল। তার সঙ্গী জিজ্ঞেস করল, আমি যাব না? গগন বলল, না, আমি একাই পারব। তোরা কদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাক। হ্যাজাকটা আমার সঙ্গে দে। ভটভটিটা চালু হওয়ার পর একজন চেঁচিয়ে বলল, একেবারে মাঝগাঙে ফেলে দেবেন সার। কম পানিতে ফেললে কিনারায় এসে ঠেকে যেতে পারে। ভটভটিটা চলল মাঝনদীর দিকে। এই অবস্থাতেও সন্তু ভাবল, কাকাবাবু কোথায়? তিনি কোনও খবরও দিলেন না। তা হলে তিনিও কি বন্দি? কাকাবাবুকে কেউ বন্দি করে বেশিদিন রাখতে পারে? হাত-বাঁধা অবস্থায় সাঁতার কাটা সম্ভব নয়। আজই তার জীবনের শেষ? মাবাবা, কাকাবাবুর সঙ্গে, জোজোর সঙ্গে, দেবলীনার সঙ্গেও আর দেখা হবে না। অনেকখানি দূরে এসে মাঝনদীতে ভটভটিটা থেমে গেল। তারপর আবার একটা চমক লাগল সন্তুর। গগন সাহা হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর বেশ জোরে, ওঃ আঃ শব্দ করে। যেন তার বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। সেইরকম কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল, আমি আর বাঁচতে চাই না সন্তু। আমি মহাপাপী। আজ এইখানে আমি মরব। সন্তু কিছু না বুঝতে পেরে বলল, কী হয়েছে? গগন বলল, দাঁড়াও, আগে তোমার বাঁধন খুলে দিই। পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করে কচকচ করে কেটে ফেলল সব দড়ি। তারপর বলল, সন্তু, তুমি ভটভটি চালাতে পারবে? শক্ত কিছু নয়। এখানে এসে মোটর চালু করে হাল ধরে থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হবে, কিন্তু ওলটাবে না। আমি তোমার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিচ্ছি। সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনার? গগন বলল, আমি মহাপাপী। তোমাদের রিহার্সাল শুরুর অনেক আগেই ওই পুলিশের ছেলেকে চুরি করার প্ল্যান করা হয়েছিল। আমার ছেলেও যে তোমাদের সঙ্গে থিয়েটার করতে যাবে, তা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। তবে বিশ্বাস করো, মানুষ চুরি করে টাকা রোজগার করা আমার পেশা নয়। আগে কখনও একাজ করিনি। ওই শঙ্খচূড় মহা শয়তান। সে আমাকে ভয় দেখিয়ে জোর করে এর মধ্যে জড়িয়েছে। আমার বউ বা ছেলে কিছুই জানে না। রাইফেলটা তুলে নিয়ে গলার কাছে ঠেকিয়ে সে বলল, ওই যে দূরে দেখছ একটা মিটিমিটি আলো, ওটা একটা দ্বীপ। ওখানে আমার একটা খামারবাড়ি আছে। সুকোমল ওইখানে আছে। আরও তিনজন মানুষকে ওখানে আটকে রাখা হয়েছে। তুমি একা যেয়ো না, অনেক পুলিশ সঙ্গে নিয়ে যেয়ো। আমি চললাম। সন্তু বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, এটা কী করছেন? গগন বলল, শঙ্খচূড় আমাকে দিয়ে এই জঘন্য কাজ করিয়েছে। আমার বউছেলে যদি কখনও টের পায়, তাদের কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে? তাই আমি মরতে চাই। আর দেরি করে লাভ নেই। সন্তু বলল, দাঁড়ান, আর-একটা কথা। শঙ্খচূড় জোর করে ভয় দেখিয়ে আপনাকে দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়েছে। সেজন্য শঙ্খচুড়কে তো শাস্তি দিতে হবে। আপনি সেই শাস্তি দিতে সাহায্য করুন, তা হলেই আপনার দোষ কেটে যাবে। গগন বলল, শঙ্খচূড়ের যে কী সাঙ্ঘাতিক শক্তি, তা তুমি ধারণাও করতে পারবে না। এই ছেলে চুরি, মানুষ চুরি এগুলো তার আসল কাজ নয়। অন্য লোকদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে অনেক টাকা তুলছে। সেই টাকায় আবার অনেক
false
humayun_ahmed
গেলেন। রেস্টুরেন্টের মালিক খুবই অবাক হয়ে বলল, আপনে ময়না ভাইয়ের লোক, আপনার কাছে থাইক্যা চায়ের দাম নিব এইটা কেমন কথা! ময়না ভাই এই মানুষটার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেন গুরুত্বপূর্ণ কে জানে। জানতে ইচ্ছা করছে না। কোনো সমস্যা মাথার ভেতর ঘুরপাক থাক তা চাচ্ছেন না। তাঁর নিজেরই শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে ভালো হতো। রাত প্ৰায় আটটা। মিসির আলি তাঁর ঘরে। ঘরের কোনো বাতি জ্বালানো হয় নি। এতক্ষণ অন্ধকারেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়া, রান্নাঘর থেকে আবার বসার ঘর। জায়গাটা খুব ভালো করে চেনা। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারে কেন হাঁটাহাঁটি করছেন তা তিনি জানেন না। অস্থিরতা কাটানোর কোনো চেষ্টা হতে পারে। অস্থিরতা কাটানোর এই প্রক্রিয়া মিসির আলির চরিত্রের সঙ্গে মানাচ্ছে না। খুব অস্থির অবস্থায় তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। আঁখিতারাকে নিয়ে তিনি হঠাৎ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মনে হচ্ছে মনসুরের কথা ঠিক। মেয়েটা বাঁচবে না। অথচ হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিয়েছেন ভয়ের কিছু নেই। এশিয়া জোনে ভাইরাসের নতুন কিছু ষ্ট্রেইন দেখা দিয়েছে। এতে হাই ফিভার হয়। ডেঙ্গু তার মধ্যে একটা। মিসির আলি ডাক্তারকে বললেন, মেয়েটার কি ডেঙ্গু হয়েছে? ডাক্তার সাহেব ভরসা দেয়ার মতো গলায় বললেন, হতে পারে। তবে চার-পাঁচদিন পার না হলে কিছুই বলা যাবে না। আমরা সিস্টেমেটিক চিকিৎসা চালিয়ে যাব। আপনি নিশ্চিত থাকুন। ডাক্তারের কথায় তাঁর ভরসা পাওয়া উচিত। ভরসা পাচ্ছেন না। ভরসা না পাওয়ার কারণ কি মনসুর? সে পীর-দরবেশের মতো বলে বসিল মেয়েটা বাঁচবে না। সে কোনো পীর-দরবেশ না। পীর-দরবেশদেরও মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকে বলে তিনি মনে করেন না। তারপরেও কি কোনো কারণে মনসুরের কথা তার মনের গভীরে ঢুকে গেছে। হিপনোটিক সাজেশান? আচ্ছা বাড়িওয়ালার পীর ভাই-এর এখানে কোনো ভূমিকা আছে! এই মানুষটিও তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন–মহাবিপদ আসছে। জীবন সংশয় হবার মতো বিপদ। তাই তো হয়েছে। শুধু জীবন সংশয়টা তার না হয়ে আঁখিতারার হয়েছে। মিসির আলি হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে খাটে উঠে বসলেন। এখনো বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। একটা ছোট্ট হিসাব মিলছে না। তিনি ঠিক করলেন ছোট্ট হিসাবটা না মেলা পর্যন্ত তিনি বাতি জ্বালাবেন না। হিসাব মেলানোর জন্য তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এখন মনে হচ্ছে ফেরা ঠিক হয় নি। হাসপাতালে মেয়েটার পাশে থাকা উচিত ছিল। মেয়েটার মা-বাবা মেয়েটাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে আসতে পারত না। তার বিছানার পাশে সারা রাত জেগে বসে থাকত। বেচারি আঁখিতারা প্রবল জুরের ঘোরে আশপাশে অপরিচিত মানুষজন দেখবে, নার্স দেখবে, ডাক্তার দেখবে। কাউকেই সে চিনতে পারবে না। কী প্ৰচণ্ড ভয়ই না সে পাবে। কী করে তিনি মেয়েটাকে ফেলে চলে এলেন? মিসির আলি ঠিক করলেন রাতের খাবার খেয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যাবেন। থাকবেন মেয়েটার পাশে। যত বার সে চোখ মেলবে তত বার তিনি বলবেন, ভয় পেও না, আমি আছি। ভালো হয়ে যাও। এক ধরনের হিপনোটিক সাজেশান দেওয়া হবে। মেয়েটা এই সাজেশানের মর্ম বুঝতে পারবে না। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন কেন? মিসির আলি চমকে উঠে বললেন, কে? কী আশ্চৰ্য, আমার গলা চিনতে পারছেন না। আমি রেবু। আপনার সুইচবোর্ড কোনদিকে বলুন তো। আমি বাতি জ্বেলে দেই। মিসির আলি খাটে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার হাতের কাছেই সুইচবোর্ড। তিনি সুইচ টিপলেন। রেবু বলল, আপনার দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার। আমি ভাবলাম চোর এসে দরজা খুলে সবকিছু নিয়ে গেছে। কি কি নিয়েছে তা দেখার জন্যে এসেছিলাম। আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলেন কেন? আপনি কি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলেন। মিসির আলি জবাব দিলেন না। জবাব দেবার কিছু নেই। তিনি কি বলবেন, না, আমি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলাম না। রেবু বলল, আমি একবার পরীক্ষার হলে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জিওগ্রাফি ফাইনাল পরীক্ষার দিন। সারারাত জেগে পড়েছি। হলে বসার পর লক্ষ করলাম। এমন ঘুম ধরেছে, চোখ মেলে রাখতে পারছি না। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইনভিজিলেটর আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে গেল ঘুম রাবেয়া। আমাদের ক্লাসে দু’জন রাবেয়া ছিল। একজন খুব নামাজ পড়ত। বোরকা পরে স্কুলে আসত। তাকে সবাই ডাকত তাপসী রাবেয়া, আমাকে ডাকত ঘুম রাবেয়া। মিসির আলি বললেন, তোমার নাম রাবেয়া? হুঁ। শুধু রাবেয়া না। ঘুম রাবেয়া। তোমার ভালো নাম শেফালী না? না তো! আমি কি কখনো আপনাকে বলেছি আমার নাম শেফালী? তবে আপনার যদি আমাকে শেফালী ডাকতে ভালো লাগে আপনি ডাকতে পারেন। আমি রাগ করব না। আপনার কোনো কিছুতেই আমি রাগ করব না। রেবু আজ শাড়ি পরে আসে নি। সালোয়ার-কামিজ পরেছে। পোশাকের জন্যই হয়তো তাকে কিশোরীদের মতো লাগছে। শাড়ি না পরার কারণে তার মধ্যে এখন তরুণী ভাব একেবারেই নেই। শাড়ি অদ্ভুত একটা পোশাক। ছেলেদের এমন কোনো পোশাক নেই। যা পরলে একটা কিশোরকে যুবক মনে হবে। মিসির আলির মনে হলো শাড়ি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বারো-তেরো হাত লম্বা একটা কাপড় কেন একজন কিশোরীকে তরুণী বানিয়ে দেবে? রেবু বলল, আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কীভাবে তাকিয়ে আছি? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুবই অবাক হচ্ছেন। তোমার ভালো নাম রাবেয়া এটা শুনে অবাক হচ্ছি। কেন? মানুষের ভালো নাম
false
manik_bandhopaddhay
প্রভুর চরণ দর্শন করে– সদানন্দের ধারণা, জ্বালা তারও আছে। সে বলে, তোমায় না আশ্রমে আসতে বারণ করে দিয়েছি? না এসে পারি না প্রভু। বটে? বেশ, বেশ। তোমার মতো আর দু-একটি ভক্ত জুটলেই আশ্রম ছেড়ে আমায় বনে-জঙ্গলে পালাতে হবে। তা তোমার আসল মতলবটা কি বল তো শুনি? চরণে ঠাঁই চাই প্ৰভু–মনে শান্তি চাই। পাগল? মাথা খারাপ মহেশ চৌধুরীর? এ রকম অন্ধ ভক্ত সদানন্দের আরো আছে, কিন্তু এমন নাছোড়বান্দা কেউই নাই। বাড়াবাড়ির জন্য ধমক দিলে, ভাবপ্রবণ ভক্ত সমিয়া যায়, মুখ হইয়া আসে কালো, ভক্তিও যেন উবিয়া যায় খানিকটা। কিন্তু মহেশ চৌধুরী কিছুতেই দমে না, কিছুতেই হাল ছাড়ে না। সদানন্দের অবজ্ঞা, অবহেলা, কড়া কথা, এ সবও যেন তার কাছে পরম উপভোগ্য। বড় রাগ হয় সদানন্দের–বড় আনন্দ হয়। মনে হয়, আসলে মহাপুরুষ সে কেবল এই একজন মানুষের কাছে, প্রায় দেবতার সমান। আর সকলে তাকে ঠকায়, শুধু দাম দেয়, শুধু তার দাবি মেটায়। তারই বলিয়া দেওয়া মন্ত্রে পূজা করে তার। কিন্তু মহেশ চৌধুরী কিছু জানে না, কিছু মানে না, নিজের রচিত একটিমাত্র মন্ত্র বলিয়া সে পূজা করে–তুমি আমায় চাওবা না চাও দেবতা, আমি তোমায় চাই। একটু ভয়ও করে সদানন্দের মহেশ চৌধুরীর কাছে দাঁড়াইয়া থাকিতে, তার সঙ্গে কথা বলিতে। বাস্তব অভিজ্ঞতার মালমসলায় জীবনের যে আদর্শ সে সৃষ্টি করিয়া গিয়াছে নিজের জন্য, সে আদর্শ অবাস্তব কল্পনা কিনা, অর্থহীন স্বপ্ন কিনা, আজো এ বিষয়ে সদানন্দের সন্দেহ মেটে নাই। যে আত্মপ্রত্যয়ের নিচে এ সন্দেহ চাপা থাকে, মহেশ চৌধুরীর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, চোখের দৃষ্টিতে, মুখের কথায় তা যেন উবিয়া যাইতে থাকে দেবতার সামনে পূজারীর মতো মহেশ চৌধুরী দাঁড়াইয়া থাকে, পোষা কুকুরের মতো তাকায়, স্তব করার মতত কথা বলে–তবু। মনে হয়, আর যত ভক্ত তার আছে, যাদের মধ্যে অনেকে মনে মনে তার সমালোচনাও করে কম। বেশি, তাদের ভুলাইতে কোনোদিন তার কষ্ট হইবে না, ভুলিবার জন্য শিশুর মতো তারা উদগ্রীব হইয়া আছে, কিন্তু এই অন্ধ ভক্তটিকে ভুলানোর ক্ষমতা তার নাই। মহেশ চৌধুরীর পূজা গ্রহণ করিলে বর দিবার সময় ফাঁকি চলিবে না, ভেজাল চলিবে না। অবাস্তব পাগলামির পুরস্কারকে করিয়া তুলিতে হইবে বাস্তব। কাব্যের জন্য কবিকে যেমন নারীকে দিতে হয় খাঁটি রক্তমাংসের দেহটি। তোমার ছেলে ছাড়া পেয়েছে মহেশ? আজ্ঞে না। ও কি আর ছাড়া পাবে! এ্যাঁ? সে কি কথা–ছাড়া পাবে বৈকি, দুদিন পরেই ছাড়া পাবে। ভেবো না। এই কি বাস্তব পুরস্কারের নমুনা? ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুটি মিষ্টি কথা বলা, একটু অনিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া, হিসাব করিলে যার দাম কানাকড়িও হয় না, কিন্তু মহেশ চৌধুরীর কাছে যা অমূল্য? কোনোদিন সদানন্দ কথা না বলিয়া পাশ কাটিয়া চলিয়া যায়, মহেশ চৌধুরী ঠায় দাঁড়াইয়া যতক্ষণ দেখা যায় তাকে দেখে, তারপর আবার আপন মনে তপোবনে ঘুরিয়া বেড়ায় আর সদানন্দের সম্মুখে পড়ে না। এখানে সে অনাহুত, অবাঞ্ছিত, আগন্তুক, বিপিনের শাসনে আশ্রমের কেউ তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না, মাঝে মাঝে রীতিমতো অপমানও জোটে, তবু মোহাচ্ছনের মতো সে আশ্রমের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়, ধীরে ধীরে আশ্রমের জাগরণ লক্ষ্য করে। সদানন্দের অজ্ঞাতবাসের খবরটা মহেশ চৌধুরী পাইল সাতুনার শ্রীধরের বাড়িতে। বাগবাদায় নিজের বাড়ি হইতে আশ্রমে যাওয়ার পথে শ্রীধরের বাড়ি পড়ে, মহেশ চৌধুরী এখানে কিছুক্ষণ বসিয়া যায়। বিশ্রামও হয়, জানাশোনা অনেকের সঙ্গে কথা বলাও হয়, অনেকের খবর পাওয়া যায়। আজ শ্রীধরের সদরের বড় ঘরটার দাওয়ায় তোক জুটিয়াছে অনেক। যারা অপরাজ্ৰে যাইবে ভাবিয়াছিল, সদানন্দ সাতদিন দর্শন দিবে না শুনিয়া তাদের মধ্যে অনেকেই শ্রীধরের এখানে আসিয়া জুটিয়াছে। শ্ৰীধর একটি নূতন বই সংগ্রহ করিয়াছে কোথা হইতে, কামরূপের এক রোমাঞ্চকর প্রামাণ্য উপন্যাস। কাল চারটি পরিচ্ছেদ পাঠ করা হইয়াছিল, আজ সকলে আসিয়া জুটিলেই বাকি অংশটুকু পড়া আরম্ভ হইতে পারিবে। মহেশ চৌধুরী বলিল, কেউ দর্শন পাবে না? শ্ৰীধর বলিল, বিপিনবাবু তাই বললেন চৌধুরী মশাই। প্ৰকৃত ভক্ত ছাড়া কেউ দর্শন পাবে না–প্রভুর জন্য যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে, জীবন বিসর্জন দিতে পারে, কেবল সেই দর্শন পাবে। প্রভুর জন্য তোমরা সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পার না, জীবন বিসর্জন দিতে পার না শ্ৰীধর? উৎসুক দৃষ্টিতে মহেশ চৌধুরী সকলের মুখের দিকে চাহিতে থাকে, সকলে স্বস্তিবোধ করে, চোখ নামাইয়া নেয়। বৃদ্ধ শ্রীধরের স্তিমিত চোখ দুটি বোধহয় তামাকের ধোঁয়াতেই বুজিয়া যায়। আমি প্রভুর চরণদর্শন করতে যাব শ্রীধর। সকলে স্তব্ধ হইয়া থাকে। অহংকারের কথা নয়, মহেশ চৌধুরীর অহংকার আছে কিনা সন্দেহ। সকলে তা জানে। কিন্তু একটা কথা প্ৰায় সকলের মনেই খচখচ করিয়া বিধিতে থাকে, কঠিন একটা সমস্যা। সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পারে, জীবন বিসর্জন দিতে পারে, এত বড় ভক্তই যদি মহেশ চৌধুরী হয়, সদানন্দ তাকে আমল দেয় না কেন, কেন তাকে শিষ্য করে না? এই সমস্যা আজ বহুদিন সকলকে পীড়া দিতেছে, এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে তারা অনেক আলোচনা করিয়াছে, মনে মনে অনেক মাথা ঘামাইয়াছে। কারো মনে এ সন্দেহও জাগিয়াছে যে, মানুষটা মহেশ চৌধুরী কি আসলে তবে ভালো নয়, তার নীতি, ধর্ম, ভক্তি, নিষ্ঠা সব লোকদেখানো ভালোমানুষি? মহেশ চৌধুরী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলে, যাই, একবার ঘুরে আসি আশ্রম থেকে। কয়েকজন কৌতূহলভরে তার সঙ্গ নিলে সে তাদের ফিরাইয়া দেয়, বলে, না, আজ আর তোমাদের গিয়ে কাজ নেই ভাই। প্রভু যখন বারণ করে দিয়েছেন, মিছিমিছি গোলমাল না করাই ভালো। আশ্রমে গিয়া মহেশ চৌধুরী যাকে সামনে পাইল তাকেই
false
shorotchandra
গঙ্গার রুচিকর হাওয়ায় বাবুর ক্ষুধার উদ্রেক হইল এবং দেখিতে দেখিতে সে ক্ষুধা অবিশ্রান্ত বকুনির চোটে একেবারে ভীষণ হইয়া উঠিল। এদিকে চলিতে চলিতে রাত্রিও প্রায় দশটা হইয়া গেছে—থিয়েটারে পৌঁছিতে রাত্রি দুটা বাজিয়া যাইবে শুনিয়া, বাবু প্রায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। রাত্রি যখন এগারোটা, তখন কলিকাতার বাবু কাবু হইয়া বলিলেন, হ্যাঁ রে ইন্দ্র, এদিকে খোট্টামোট্টাদের বস্তি-টস্তি নেই? মুড়ি-টুড়ি পাওয়া যায় না? ইন্দ্র কহিল, সামনেই একটা বেশ বড় বস্তি নতুনদা। সব জিনিস পাওয়া যায়। তবে লাগা লাগা—ওরে ছোঁড়া—ঐ—টান্‌ না একটু জোরে—ভাত খাসনে? ইন্দ্র বল না তোর ওই ওটাকে, একটু জোর ক’রে টেনে নিয়ে চলুক ইন্দ্র কিংবা আমি কেহই জবাব দিলাম না। যেমন চলিতেছিলাম, তেমনি ভাবেই অনতিকাল পরে একটা গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। এখানে পাড়টা ঢালু ও বিস্তৃত হইয়া জলে মিশিয়াছিল। ডিঙি জোর করিয়া ধাক্কা দিয়া সঙ্কীর্ণ জলে তুলিয়া দিয়া আমরা দুজনে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। বাবু কহিলেন, হাত-পা একটু খেলানো চাই। নাবা দরকার। অতএব ইন্দ্র তাঁহাকে কাঁধে করিয়া নামাইয়া আনিল। তিনি জ্যোৎস্নার আলোকে গঙ্গার শুভ্র সৈকতে পদচারণা করিতে লাগিলেন। আমরা দুজনে তাঁহার ক্ষুধাশান্তির উদ্দেশে গ্রামের ভিতরে যাত্রা করিলাম। যদিচ বুঝিয়াছিলাম, এতরাত্রে এই দরিদ্র ক্ষুদ্র পল্লীতে আহার্য সংগ্রহ করা সহজ ব্যাপার নয়, তথাপি চেষ্টা না করিয়াও ত নিস্তার ছিল না। অথচ তাঁর একাকী থাকিতেও ইচ্ছা নাই, সে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেই, ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ আহ্বান করিয়া কহিল, চল না নতুনদা, একলা তোমার ভয় করবে—আমাদের সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসবে। এখানে চোর-টোর নেই, ডিঙি কেউ নেবে না—চল। নতুনদা মুখখানা বিকৃত করিয়া বলিলেন, ভয়! আমরা দর্জিপাড়ার ছেলে, যমকে ভয় করিনে তা জানিস্‌! কিন্তু তা ব’লে ছোটলোকদের পাড়ার মধ্যেও আমরা যাইনে। ব্যাটাদের গায়ের গন্ধ নাকে গেলেও আমাদের ব্যামো হয়। অথচ তাঁহার মনোগত অভিপ্রায়—আমি তাঁহার পাহারায় নিযুক্ত থাকি এবং তামাক সাজি। কিন্তু আমি তাঁর ব্যবহারে মনে মনে এত বিরক্ত হইয়াছিলাম যে, ইন্দ্র আভাস দিলেও, আমি কিছুতেই একাকী এই লোকটার সংসর্গে থাকিতে রাজি হইলাম না। ইন্দ্রর সঙ্গেই প্রস্থান করিলাম। দর্জিপাড়ার বাবু হাততালি দিয়া গান ধরিয়া দিলেন, ঠুন্‌-ঠু‌ন্‌ পেয়ালা— আমরা অনেক দূর পর্যন্ত তাঁহার সেই মেয়েলি নাকীসুরে সঙ্গীতচর্চা শুনিতে শুনিতে গেলাম। ইন্দ্র নিজেও তাহার ভ্রাতার ব্যবহারে মনে মনে অতিশয় লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হইয়াছিল। ধীরে ধীরে কহিল, এরা কলকাতার লোক কিনা, জল-হাওয়া আমাদের মত সহ্য করতে পারে না—বুঝলি না শ্রীকান্ত! আমি বলিলাম, হুঁ। ইন্দ্র তখন তাঁহার অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয়—বোধ করি আমার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিবার জন্যই—দিতে দিতে চলিল। তিনি অচিরেই বি․ এ․ পাশ করিয়া ডেপুটি হইবেন, কথা-প্রসঙ্গে তাহাও কহিল। যাই হোক্‌, এতদিন পরে, এখন তিনি কোথাকার ডেপুটি কিংবা আদৌ সে কাজ পাইয়াছেন কি না, সে সংবাদ জানি না। কিন্তু মনে হয় যেন পাইয়াছেন; না হইলে বাঙ্গালী ডেপুটির মাঝে মাঝে এত সুখ্যাতি শুনতে পাই কি করিয়া? তখন তাঁহার প্রথম যৌবন। শুনি, জীবনের এই সময়টায় নাকি হৃদয়ের প্রশস্ততা, সমবেদনার ব্যাপকতা যেমন বৃদ্ধি পায়, এমন, আর কোন কালে নয়। অথচ ঘণ্টাকয়েকের সংসর্গেই যে নমুনা তিনি দেখাইয়াছিলেন, এতকালের ব্যবধানেও তাহা ভুলিতে পারা গেল না, তবে ভাগ্যে এমন-সব নমুনা কদাচিৎ চোখে পড়ে; না হইলে বহু পূর্বেই সংসারটা রীতিমত একটা পুলিশ থানায় পরিণত হইয়া যাইত। কিন্তু যাক্‌ সে কথা। কিন্তু ভগবানও যে তাঁহার উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, সে খবরটা পাঠককে দেওয়া আবশ্যক। এ অঞ্চলে পথঘাট, দোকান-পত্র সমস্তই ইন্দ্রর জানা ছিল। সে গিয়া মুদির দোকানে উপস্থিত হইল। কিন্তু দোকান বন্ধ এবং দোকানী শীতের ভয়ে দরজা-জানালা রুদ্ধ করিয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এই গভীরতা যে কিরূপ অতলস্পর্শী সে কথা যাহার জানা নাই, তাহাকে লিখিয়া বুঝানো যায় না। ইহারা অম্লরোগী নিষ্কর্মা জমিদারও নয়, বহুভারাক্রান্ত কন্যাদায়গ্রস্ত বাঙ্গালী গৃহস্থও নয়। সুতরাং ঘুমাইতে জানে। দিনের বেলা খাটিয়া-খুটিয়া রাত্রিতে একবার ‘চারপাই’ আশ্রয় করিলে, ঘরে আগুন না দিয়া, শুধুমাত্র চেঁচামেচি ও দোর নাড়ানাড়ি করিয়া জাগাইয়া দিব, এমন প্রতিজ্ঞা যদি স্বয়ং সত্যবাদী অর্জুন জয়দ্রথ-বধের পরিবর্তে করিয়া বসিতেন, তবে তাঁহাকেও মিথ্যা-প্রতিজ্ঞা-পাপে দগ্ধ হইয়া মরিতে হইত তাহা শপথ করিয়া বলিতে পারা যায়। তখন উভয়ে বাহিরে দাঁড়াইয়া তারস্বরে চিৎকার করিয়া, এবং যত প্রকার ফন্দি মানুষের মাথায় আসিতে পারে, তাহার সবগুলি একে একে চেষ্টা করিয়া, আধঘণ্টা পরে রিক্তহস্তে ফিরিয়া আসিলাম। কিন্তু ঘাট যে জনশূন্য! জ্যোৎস্নালোকে যতদূর দৃষ্টি চলে, ততদূরই যে শূন্য! ‘দর্জিপাড়া’র চিহ্নমাত্র কোথাও নাই। ডিঙি-যেমন ছিল, তেমনি রহিয়াছে—ইনি গেলেন কোথায়? দু’জনে প্রাণপণে চিৎকার করিলাম—নতুনদা, ও নতুনদা! কিন্তু কোথায় কে! ব্যাকুল আহ্বান শুধু বাম ও দক্ষিণের সু-উচ্চ পাড়ে ধাক্কা খাইয়া অস্পষ্ট হইয়া বারংবার ফিরিয়া আসিল। এ অঞ্চলে মাঝে মাঝে শীতকালে বাঘের জনশ্রুতিও শোনা যাইত। গৃহস্থ কৃষকেরা দলবদ্ধ ‘হুড়ারে’র জ্বালায় সময়ে সময়ে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিত। সহসা ইন্দ্র সেই কথাই বলিয়া বসিল, বাঘে নিলে না ত রে! ভয়ে সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া উঠিল—সে কি কথা! ইতিপূর্বে তাঁহার নিরতিশয় অভদ্র ব্যবহারে আমি অত্যন্ত কুপিত হইয়া উঠিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু এতবড় অভিশাপ ত দিই নাই! সহসা উভয়েরই চোখে পড়িল, কিছু দূরে বালুর উপরে কি একটা বস্তু চাঁদের আলোয় চক্‌চক্‌ করিতেছে। কাছে গিয়া দেখি, তাঁরই সেই বহুমূল্য পাম্প-সু’র একপাটি। ইন্দ্র সেই ভিজা বালির উপরেই একেবারে শুইয়া পড়িল—শ্রীকান্ত রে! আমার মাসিমাও এসেছেন যে! আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। তখন ধীরে ধীরে সমস্ত বিষয়টাই পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। আমরা যখন মুদীর দোকানে দাঁড়াইয়া তাহাকে জাগ্রত করিবার
false
bongkim
আজ লেখাপড়া আছে, তাতে তোমার দস্তখত হয় নাই। কৃ। সে কি! আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমি দস্তখত করিয়াছি। রো। না, কাকা কহিলেন যে, তাঁহার যেন স্মরণ হচ্ছে, তুমি তাতে দস্তখত কর নাই; ভাল সন্দেহ রাখায় দরকার কি? তুমি কেন সেখানা খুলে একবার দেখ না। কৃ। বটে–তবে আলোটা ধর দেখি। বলিয়া কৃষ্ণকান্ত উঠিয়া উপাধানের নিম্ন হইতে চাবি লইলেন। রোহিণী নিকটস্থ দীপ হস্তে লইল। কৃষ্ণকান্ত প্রথমে একটি ক্ষুদ্র হাতবাক্স খুলিয়া একটি বিচিত্র চাবি লইয়া, পরে একটা চেষ্টড্রয়ারের একটি দেরাজ খুলিলেন এবং অনুসন্ধান করিয়া ঐ উইল বাহির করিলেন।পরে বাক্স হইতে চশমা বাহির করিয়া নাসিকার উপর সংস্হাপনের উদ্যোগ দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু চশমা লাগাইতে লাগাইতে দুই চারি বার আফিঙ্গের ঝিমকিনি আসিল–সুতরাং তাহাতে কিছুকাল বিলম্ব হইল। পরিশেষে চশমা সুস্থির হইলে কৃষ্ণকান্ত উইলে নেত্রপাত করিয়া দেখিয়া হাস্য করিয়া বলিলেন, “রোহিণিী আমি কি বুড় হইয়া বিহ্বল হইয়াছি? এই দেখ, আমার দস্তখত | রোহিণী বলিল, “বালাই, বুড়ো হবে কেন? আমাদের কেবল জোর করিয়া নাতিনী বল বই ত না। তা ভাল, আমি এখন যাই, কাকাকে বলি গিয়া |” রোহিণী তখন কৃষ্ণকান্তের শয়নমন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। গভীর নিশাতে কৃষ্ণকান্ত নিদ্রা যাইতেছিলেন, অকস্মাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলেন যে, তাঁহার শয়নগৃহে দীপ জ্বলিতেছে না। সচরাচর সমস্ত রাত্রি দীপ জ্বলিত, কিন্তু সে রাত্রে দীপ নির্বণ হইয়াছে দেখিলেন, নিদ্রাভঙ্গকালে এমতও শব্দ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল যে, যেন কে একটা চাবি কলে ফিরাইল। এমত বোধ হইল, যেন ঘরে কে মানুষ বেড়াইতেছে। মানুষ তাঁর পর্যঙ্কের শিরোদেশ পর্যন্ত আসিল–তাঁহার বালিশে হাত দিল। কৃষ্ণকান্ত আফিঙ্গের নেশায় বিভোর; না নিদ্রিত, না জাগরিত, বড় কিছু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না। ঘরে যে আলো নাই–তাহাও ঠিক বুঝেন নাই, কখন অর্ধনিদ্রিত–কখন অর্ধসচেতন–সচেতনও চক্ষু খুলে না। একবার দৈবাৎ চক্ষু খুলিবায় কতকটা অন্ধকার বোধ হইল বটে, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখন মনে করিতেছিলেন যে, তিনি হরি ঘোষের মোকদ্দামায় জাল দলিল দাখিল করায়, জেলখানায় গিয়াছেন।জেলখানা ঘোরান্ধকার। কিছু পরে হঠাৎ যেন চাবি খোলার শব্দ অল্প কানে গেল–এ কি জেলের চাবি পড়িল? হঠাৎ একটু চমক হইল। কৃষ্ণকান্ত সটকা হাতড়াইলেন, পাইলেন না–অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, “হরি!” কৃষ্ণকান্ত অন্তঃপুরে শয়ন করিতেন না–বহির্বাটীতেও শয়ন করিতেন না। উভয়ের মধ্যে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে শয়ন করিতেন। সেখানে হরি নামক একজন খানসামা তাঁহার প্রহরী স্বরূপ শয়ন করিত। আর কেহ না। কৃষ্ণকান্ত তাহাকেই ডাকিলেন, “হরি!” কৃষ্ণকান্ত বারেক মাত্র হরিকে ডাকিয়া, আবার আফিমে ভোর হইয়া ঝিমাইতে লাগিলেন। আসল উইল, তাঁহার গৃহ হইতে সেই অবসরে অন্তর্হিত হইল। জাল উইল তৎপরিবর্তে স্থাপিত হইল। পঞ্চম পরিচ্ছেদ পরদিন প্রাতে রোহিণী আবার রাঁধিতে বসিয়াছে, আবার সেখানে হরলাল উঁকি মারিতেছে। ভাগ্যশঃ ব্রহ্মানন্দ বাড়ী ছিল না–নহিলে কি একটা মনে করিতে পারিত। হরলাল ধীরে ধীরে রোহিণীর কাছে গেল–রোহিণী বড় চাহিয়া দেখে না। হরলাল বলিল, “চাহিয়া দেখ, হাঁড়ি ফাটিবে না |” রোহিণী চাহিয়া দেখিয়া হাসিল। হরলাল বলিল, “কি করিয়াছ?” রোহিণী অপহৃত উইল আনিয়া হরলালকে দেখিতে দিল। হরলাল পড়িয়া দেখিল–আসল উইল বটে। তখন সে দুষ্টের মুখে হাসি ধরে না। উইল হাতে করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি প্রকারে আনিলে?” রোহিণী সে গল্প আরম্ভ করিল। প্রকৃত কিছুই বলিল না। একটি মিথ্যা উপন্যাস বলিতে লাগিল–বলিতে বলিতে সে হরলালের হাত হইতে উইলখানি লইয়া দেখাইল, কি প্রকারে কাগজখানা একটা কলমদানের ভিতর পড়িয়া ছিল। উইল চুরির কথা শেষ হইলে রোহিণী হঠাৎ উইলখানা হাতে করিয়া উঠিয়া গেল। যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার হাতে উইল নাই দেখিয়া হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “উইল কোথায় রাখিয়া আসিলে?” রো। তুলিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। হ। আর তুলিয়া রাখিয়া কি হইবে? আমি এখনই যাইব। রো। এখনই যাবে? এত তাড়াতাড়ি কেন? হ। আমার থাকিবার যো নাই। রো। তা যাও। হ। উইল? রো। আমার কাছে থাক। হ। সে কি? উইল আমায় দিবে না? রো। তোমার কাছে থাকাও যে, আমার কাছে থাকাও সে। হ। যদি আমাকে উইল দিবে না, তবে ইহা চুরি করিলে কেন? রো। আপনারই জন্য। আপনারই জন্য ইহা রহিল। যখন আপনি বিধবাবিবাহ করিবেন, আপনার স্ত্রীকে এ উইল দিব। আপনি লইয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবেন। হরলাল বুঝিল, বলিল, “তা হবে না–রোহিণী! টাকা যাহা চাও, দিব |” রো। লক্ষ টাকা দিলেও নয়। যাহা দিবে বলিয়াছিলে, তাই চাই। হ। তা হয় না। আমি জাল করি, চুরি করি, আপনারই হকের জন্য। তুমি চুরি করিয়াছ, কার হকের জন্য? রোহিণীর মুখ শুকাইল। রোহিণী অধোবদনে রহিল। হরলাল বলিতে লাগিল, “আমি যাই হই–কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র। যে চুরি করিয়াছে, তাহাকে কখনও গৃহিণী করিতে পারিব না |” রোহিণী সহসা দাঁড়াইয়া উঠিয়া, মাথার কাপড় উঁচু করিয়া তুলিয়া, হরলালের মুখপানে চাহিল; বলিল, “আমি চোর! তুমি সাধু! কে আমাকে চুরি করিতে বলিয়াছিল? কে আমাকে বড় লোভ দেখাইল? সরলা স্ত্রীলোক দেখিয়া কে প্রবঞ্চনা করিল? যে শঠতার চেয়ে আর শঠতা নাই, যে মিথ্যার চেয়ে আর মিথ্যা নাই, যা ইতরে বর্বরে মুখেও আনিতে পারে না, তুমি কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র হইয়া তাই করিলে? হায়! হায়! আমি তোমার অযোগ্য? তোমার মত নীচ শঠকে গ্রহণ করে, এমন হতভাগী কেহ নাই। তুমি যদি মেয়ে মানুষ হইতে, তোমাকে আজ, যা দিয়া ঘর ঝাঁট দিই, তাই দেখাইতাম। তুমি পুরুষ মানুষ, মানে মানে দূর হও |” হরলাল বুঝিল, উপযুক্ত হইয়াছে। মানে মানে বিদায় হইল–যাইবার সময় একটু টিপি টিপি হাসিয়া
false
shordindu
একটি নক্সা পাঠকদের সম্মুখে স্থাপন করিতে চাই। নক্সা থাকিলে দীর্ঘ বর্ণনার প্রয়োজন হইবে না। — ১। নিশানাথ গৃহ; ২। বিজয়ের ঘর; ৩। বনলক্ষ্মীর ঘর; ৪। ভুজঙ্গাধরের ঘর ও ঔষধালয়; ৫। ব্ৰজদাসের ঘর; ৬। রসিকের ঘর; ৭। কৃপা; ৮। আস্তাবল ও মুস্কিলের ঘর; ৯। গোশালা ও পানুর ঘর; ১০। মুকুল ও নেপালের ঘর; ১১। ভোজনকক্ষ ও পাকশালা; ১২। অব্যবহৃত হাঁটু-হাউস; ১৩। সামরিক মোটরের সমাধিক্ষেত্ৰ। বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আমরা বাঁ দিকের পথ ধরিলাম। সুরকি-ঢাকা পথ সঙ্কীর্ণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন‌, আকিয়া বাঁকিয়া কলোনীর সমস্ত গৃহগুলিকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে। প্রথমেই পড়িল ফটকের পাশে লম্বা টানা একটা ঘর। মাথার উপর টালির ফাঁকে ফাঁকে কাচ বসানো‌, দেওয়ালেও বড় বড় কাচের জানালা! কিন্তু ঘরটি অনাদৃত‌, কাচগুলি অধিকাংশই ভাঙিয়া গিয়াছে; অন্ধের চক্ষুর মত ভাঙা ফোকরের ভিতর দিয়া কেবল অন্ধকার দেখা যায়। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’এটা কি?’ নিশানাথ বলিলেন,–’হট্‌-হাউস করেছিলাম‌, এখন পড়ে আছে। বেশি শীত বা গরম পড়লে কচি চারাগাছ এনে রাখা হয়।’ পাশ দিয়া যাইবার সময় ভাঙা দরজা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম‌, ভিতরে কয়েকটা ধূলিধূসর বেঞ্চি পড়িয়া আছে। মেঝের উপর কতকগুলি মাটিভরা চ্যাঙারি রহিয়াছে‌, তাহাতে নবাকুরিত গাছের চারা। এখান হইতে সম্মুখের সীমানার সমান্তরাল খানিক দূর অগ্রসর হইবার পর গোেহালের কাছে উপস্থিত হইলাম। চেঁচারির বেড়া দিয়া ঘেরা অনেকখানি জমি‌, তাহার পিছন দিকে লম্বা খড়ের চালা; চালার মধ্যে অনেকগুলি গরু-বাছুর বাঁধা রহিয়াছে। খোলা বাথানে খড়ের আটটি ডাঁই করা। গোহালের ঠিক গায়ে একটি ক্ষুদ্র টালি-ছাওয়া কুঠি। আমরা গোহালের সম্মুখে উপস্থিত হইলে একটি লম্বা-চওড়া যুবক কুঠির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিল। গায়ে গেঞ্জি, হাঁটু পর্যন্ত কাপড়; দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। যুবকের দেহ বেশ বলিষ্ঠ কিন্তু মুখখানি বোকাটে ধরনের। আমাদের কাছে আসিয়া সে দুই কানের ভিতর হইতে খানিকটা তুলা বাহির করিয়া ফেলিল এবং আমাদের পানে চাহিয়া হাবলার মত হাসিতে লাগিল। হাসি কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব হাসি‌, গলা হইতে কোনও আওয়াজ বাহির হইতে শুনিলাম না। নিশানাথ বলিলেন,–’এর নাম পানু। গো-পালন করে তাই ওকে পানুগোপাল বলা হয়। কানে কম শোনে।’ পানুগোপাল পূর্ববৎ হাসিতে লাগিল‌, সে নিশানাথবাবুর কথা শুনিতে পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। নিশানাথবাবু একটু গলা চড়াইয়া বলিলেন,–’পানুগোপাল‌, তোমার গরু-বাছুরের খবর কি? সব ভাল তো?’ প্ৰত্যুত্তরে পানুগোপালের কণ্ঠ হইতে ছাগলের মত কম্পিত মিহি আওয়াজ বাহির হইল। চমকিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া দেখিলাম সে প্ৰাণপণে কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে‌, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না। নিশানাথবাবু হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিলেন‌, খাটো গলায় বলিলেন,–’পানু যে একেবারে কথা বলতে পারে না তা নয়‌, কিন্তু একটু উত্তেজিত হলেই কথা আটকে যায়। ছেলেটা ভাল‌, কিন্তু ভগবান মেরেছেন।’ অতঃপর আমরা আবার অগ্রসর হইলাম‌, পানুগোপাল দাঁড়াইয়া রহিল। কিছু দূর গিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম পানুগোপাল আবার কানে তুলা গুঁজিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম,–’পানুগোপাল কানে তুলো গোঁজে কেন?’ নিশানাথ বলিলেন,–’কানে পুঁজ হয়।’ কিছুদূর চলিবার পর বাঁ দিকে রাস্তার একটা শাখা গিয়াছে দেখিলাম; রাস্তাটি নিশানাথবাবুর বাড়ির পিছন দিক দিয়া গিয়াছে‌, মাঝে পাতা—বাহার ক্রোটন গাছে ভরা জমির ব্যবধান। এই রাস্তার মাঝামাঝি একটি লম্বাটে গোছের বাড়ি। নিশানাথবাবু সেই দিকে মোড় লইয়া বলিলেন,–’চলুন‌, আমাদের রান্নাঘর খাবারঘর দেখবেন।’ পূর্বে শুনিয়াছি মুকুল নামে একটি মেয়ে কলোনীর রান্নাবান্না করে। অনুমান করিলাম মুকুলকে দেখাইবার জন্যই নিশানাথবাবু আমাদের এদিকে লইয়া যাইতেছেন। ভোজনালয়ে উপস্থিত হইয়া দেখা গেল‌, একটি লম্বা ঘরকে তিন ভাগ করা হইয়াছে; একপাশে রান্নাঘর‌, মাঝখানে আহারের ঘর এবং অপর পাশে স্নানাদির ব্যবস্থা। রান্নাঘর হইতে ছ্যাকছোঁক শব্দ আসিতেছিল‌, নিশানাথবাবু সে দিকে চলিলেন। আমাদের সাড়া পাইয়া দয়মন্তী দেবী রান্নাঘরের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন; কোমরে আঁচল জড়ানো‌, হাতে খুন্তি। তাঁহাকে এই নূতন পারিবেশের মধ্যে দেখিয়া মনে হইল‌, আগে যাঁহাকে দেখিয়াছিলাম ইনি সে-মানুষ নন‌, সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। প্রথমে দূর হইতে দেখিয়া একরকম মনে হইয়াছিল‌, তারপর সরবতের ট্রে হাতে তাঁহার অন্যরূপ আকৃতি দেখিয়াছিলাম‌, এখন আবার আর এক রূপ। কিন্তু তিনটি রূপই প্ৰীতিকর। দময়ন্তী দেবী একটু উৎকণ্ঠিতভাবে স্বামীর মুখের পানে চাহিলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’তুমি রান্না করছি? মুকুল কোথায়?’ দময়ন্তী দেবী বলিলেন,–’মুকুলের বড় মাথা ধরেছে‌, সে রান্না করতে পারবে না। শুয়ে আছে।’ নিশানাথ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, —’তাহলে বনলক্ষ্মীকে ডেকে পাঠাওনি কেন? সে তোমাকে যোগান দিতে পারত।’ দময়ন্তী বলিলেন,–’দরকার নেই‌, আমি একলাই সামলে নেব।’ নিশানাথের ভ্রূকুঞ্চিত হইয়া রহিল‌, তিনি আর কিছু না বলিয়া ফিরিলেন। এই সময় স্নানঘরের ভিতর হইতে একটি যুবক তোয়ালে দিয়া মাথা মুছতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল,–’কাকিমা‌, শীগগির শীগগির-এখনি কলকাতা যেতে হবে–এই পর্যন্ত বলিবার পর সে তোয়ালে হইতে মুখ বাহির করিয়া আমাদের দেখিয়া থামিয়া গেল। দময়ন্তী বলিলেন,–’আসন‌, পেতে বোসো‌, ভাত দিচ্ছি। সব রান্না কিন্তু হয়নি এখনও।’ তিনি রান্নাঘরের মধ্যে অদৃশ্য হইলেন। আমাদের সম্মুখে যুবক মানসিক্ত নগ্নদেহে বিশেষ অপ্ৰস্তুত হইয়া পড়িয়াছিল‌, সে তোয়ালে গায়ে জড়াইয়া আসন পাতিতে প্ৰবৃত্ত হইল। তাহার বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ-সাতাশ‌, বলবান সুদৰ্শন চেহারা। নিশানাথ অপ্ৰসন্নভাবে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন,–’বিজয়‌, তুমি এখনও কাজে যাওনি? বিজয় কাঁচুমাচু হইয়া বলিল,–’আজ দেরি হয়ে গেছে কাকা।–হিসেবটা তৈরি করছিলাম– নিশানাথ জিজ্ঞাসা করিলেন,–’হিসেব কতদূর?’ ‘আর দু’তিন দিন লাগবে।’ ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া নিশানাথ দ্বারের দিকে চলিলেন‌, আমরা অনুবর্তী হইলাম। হিসাব লইয়া গোলাপ কলোনীতে একটা গোলযোগ পাকাইয়া উঠিতেছে মনে হইল। দ্বারের নিকট হইতে পিছন ফিরিয়া দেখি, বিজয় বিস্ময়-কুতূহলী চক্ষে আমাদের পানে তাকাইয়া আছে।
false
MZI
কখনো জানে কখনো বামে কখনো সামনে পিছে। দেখতে দেখতে হার্টবিট বেড়ে যাবে, শরীরের ব্যায়াম হতে থাকবে। সত্যি? দৃশ্যটা কল্পনা করেই আনন্দে আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। হ্যাঁ। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝে আশা সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ভেরি গুড। আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, এখনি দাও আমার ব্যায়াম মিক্সচার? অনিক ভেতরে ঢুকে গেল, খানিকক্ষণ কিছু জিনিস ঘাটাঘাটি করে একটা খাবার পানির শাষ্টিকের বোতলে করে সেই বিখ্যাত আবিষ্কার নিয়ে এল। আমি বললাম, কী হল? তুমি না বলেছিলে এটাকে লাল রঙ করে দেবে? অনিক হাত নেড়ে পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি একজন বয়স্ক মানুষ, লাল রঙ গোলাপি রঙ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? রঙটা তো ইম্পরট্যান্ট না। আমার মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল কিন্তু এখন আর তাকে চাপ দিলাম না। বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে ওঁকে দেখলাম, ভেবেছিলাম তীব্র একটা ঋজ্জালো গন্ধ হবে কিন্তু সেরকম কিছু নয়। আমার আরো একটু আশাভঙ্গ হল, এরকম সাংঘাতিক একটা জিনিস যদি টকটকে লাল না হয়, ভয়ংকর ঝুঁজালো গন্ধ না থাকে, মুখে দিলে টক-টক মিষ্টি একটা স্বাদ না হয় তা হলে কেমন করে হয়? বিজ্ঞানীরা মনে হয় কখনোই একটা জিনিসের সত্যিকারের গুরুত্বটা ধরতে পারে না। আমি প্লাস্টিকের বোতলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, যাই। কোথায় যাচ্ছ? বাসায়। গিয়ে আজকেই টেস্ট করতে চাই। কী হল আমাকে জানিও। জানাব। অনিকের বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে মাত্র অল্প কিছু দূর গিয়েছি তখন দেখি রাস্তার পাশে একটা ফাস্টফুডের দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে বিশাল একটা হ্যামবার্গারের ছবি, টলটলে রসালো একটা হ্যামবার্গার, নিশ্চয়ই মাত্র তৈরি করা হয়েছে, গরম একটা ভাপ বের হচ্ছে। ছবি দেখেই আমার খিদে পেয়ে গেল। আমি রিকশা থামিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে নেমে গেলাম। হ্যামবার্গারটা খেতে ভালো, প্রথমটা খাবার পর মনে হল খিদেটা আরো চাগিয়ে উঠল, একটা খাবার দোকানে এসে তো আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় উঠে যেতে পারি না তাই দ্বিতীয় হ্যামবার্গাবটা অর্ডার দিতে হল। যখন সেটা আধাআধি খেয়েছি তখন হঠাৎ আমার বিলু-মিলুর কথা মনে পড়ল। কবি কিংকর চৌধুরীর উৎপাতে এখন তাদের মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া বন্ধ, ঘাস-লতাপাতা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। তাদেরকে নিয়ে এলে এখানে আমার সাথে হ্যামবার্গার খেতে পারত! নিয়ে যখন আসি নি তখন আর দুঃখ করে কী হবে ভেবে চিন্তাটা মাথা থেকে প্রায় দূর করে দিচ্ছিলাম তখন মনে হল এখান থেকে তাদের জন্য দুটি হ্যামবার্গার কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সাথে কিছু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই? আমি আর দেরি করলাম না, কাউন্টারে গিয়ে বললাম, আরো দুটি হ্যামবার্গার। কাউন্টারে কমবয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ কপালে তুলে বলল, আরো দুটি হামবার্গার খাবেন? আমি বললাম, আমি খাব না। সাথে নিয়ে যাব। মেয়েটা খুব সাবধানে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে আমার জন্য হ্যামবার্গার আনতে গেল। শিউলির বাসায় গিয়ে দরজার বেল টিপতেই মিলু দরজা খুলে দিল। তার মুখ শুকনো, আমাকে দেখেও খুব উজ্জ্বল হল না। আমি বললাম, কী রে মিলু, কী খবর? মিলু একটা নিশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, খবর ভালো না। কেন? কী হয়েছে? কবি কাকু এখানে চলে এসেছে। এখানে চলে এসেছে মানে? এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, বলিস কী তুই? মিলু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শিউলিকে দেখে থেমে গেল। শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া। কখন এসেছ? তোমার হাতে কিসের প্যাকেট? হ্যামবার্গার। মিলু-বিলুর জন্য এনেছি। শিউলি বলল, আমাদের বাসায় মাছ-মাংস বন্ধ রাখার চেষ্টা করছি। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে হলে মাছ-মাংস কেন লবণ-পানি এসবও বন্ধ রাখ। দরকার হলে নিশ্বাস নেওয়াও বন্ধ রাখ। কিন্তু এই ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিতে পারবি না। কষ্ট কেন হবে? অভ্যাস হয়ে গেলে– তোদের ইচ্ছে হলে যা কিছু অভ্যাস করে নে। লোহার শিক গরম করে তালুতে ছ্যাকা দেওয়া শুরু কর। দেখবি কয়দিন পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমার কথা শুনে বিলুপ্ত বের হয়ে আসছে, তার মুখও শুকনো। আমি হ্যামবার্গারের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, নে খা। মিলু আর বিলু হামবার্গারের প্যাকেটটা নিয়ে ছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেল। আহা বেচারারা! কতদিন না জানি ভালোমন্দ কিছু খায় নি। আমি শিউলিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কবি নাকি এই বাসায় উঠে এসেছে? মনে আছে আমি তোকে কী বলেছিলাম? কবিসাহিত্যিক থেকে এক শ হাত দূরে থাকবি। সুযোগ পেলেই এরা বাড়িতে উঠে আসে! আর একবার উঠলে তখন কিছুতেই সরানো যায় না! শিউলি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স আস্তে ভাইয়া, কিংকর ভাই শুনবেন। শুনুক না! আমি তো শোনার জনাই বলছি। কোথায় তোর কিংকর ভাই? বলে আমি শিউলির জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই তাকে খুঁজতে লাগলাম। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না, তাকে ড্রয়িংরুমে পেয়ে গেলাম, ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সোফায় পা তুলে বসে আছে। এক হাতে একটা কাগজ আরেক হাতে একটা কলম, চোখে-মুখে গভীর এক ধরনের ভাব। আমাকে দেখে মনে হল একটু চমকে উঠল। আমি তার পাশে বসলাম, হাতে অনিকের আবিষ্কারের বোতলটা ছিল, সেটা টেবিলে রাখলাম। কবি কিংকর চৌধুরী বলল, আঁ-আঁ–আঁপনি? হ্যাঁ। আমি। এঁত রাঁতে এঁখানে কীঁ মঁনে কঁরে? শিউলি আমার বোন। নিজের বোনের বাসায় আমি যখন খুশি আসতে পারি! আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি এখানে এত রাতে কী মনে করে? কবি কিংকর চৌধুরী আমার কথা
false
shorotchandra
চলিতে পারিবে। বৃন্দাবন খুশি হইয়া সম্মত হইল এবং সেই উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধের দিন, দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যতীত সমুদয় সম্পত্তি রেজেস্ট্রী করিয়া কেশবের হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, কেশব, এই করো ভাই, বিষাক্ত জল খেয়ে আমার চরণের বন্ধুবান্ধবেরা যেন আর না মরে। আর আমার সকল সম্পত্তির বড় সম্পত্তি এই পাঠশালা। এর ভারও যখন নিলে, তখন আর আমার কোন চিন্তা নাই। যদি কোনদিন এদিকে ফিরে আসি, যেন দেখতে পাই, আমার পাঠশালার একটি ছাত্রও মানুষ হয়েচে। আমি সেইদিনে শুধু চরণের দুঃখ ভুলব। দুর্গাদাসবাবু এ-কয়দিন সর্বদাই উপস্থিত থাকিতেন। নিরতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া বলিলেন, বৃন্দাবন, তোমাকে সান্ত্বনা দেবার কথা খুঁজে পাইনে বাবা! কিন্তু দুঃখ যত বড়ই হোক, সহ্য করাই ত মনুষ্যত্ব। অক্ষম অপারগ হয়ে সংসার ত্যাগ করা কখনই ভগবানের অভিপ্রায় নয়। বৃন্দাবন মুখ তুলিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, সংসার ত্যাগ করার কোন সঙ্কল্প ত আমার নেই মাস্টারমশাই। বরং সে ত একেবারে অসম্ভব। ছেলেদের মুখ না দেখতে পেলে আমি একটা দিনও বাঁচব না। আপনার দয়ায় আমি পণ্ডিতমশাই বলে সকলের পরিচিত, আমার এ সম্মান আমি কিছুতেই হাতছাড়া করব না, আবার কোথাও গিয়ে এই ব্যবসাই আরম্ভ করে দেব। দুর্গাদাসবাবু বলিলেন, কিন্তু তোমার সর্বস্ব ত জলকষ্ট-মোচনের জন্য দান করে গেলে, তোমাদের ভরণপোষণ হবে কি করে? বৃন্দাবন সলজ্জ হাস্যে দেয়ালে টাঙ্গানো ভিক্ষার ঝুলি দেখাইয়া বলিল, বৈষ্ণবের ছেলের কোথাও মুষ্টিভিক্ষার অভাব হবে না মাস্টারমশাই, এইতেই আমার বাকি দিনগুলো স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে। তা ছাড়া সম্পত্তি আমার চরণের, আমি তারই সঙ্গী-সাথীদের জন্য দিয়ে গেলাম। দুর্গাদাস ব্রাহ্মণ এবং প্রবীণ হইলেও শ্রাদ্ধের দিন উপস্থিত থাকিয়া সমস্ত তত্ত্বাবধান করিয়াছেন, তাই তিনিও কুসুমের যথার্থ পরিচয় জানিতে পারিয়াছিলেন। এখন তাহাই স্মরণ করিয়া বলিলেন, সেটা ভাল হবে না বাবা, তোমার কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু বৌমার পক্ষে সেটা বড় লজ্জার কথা। এমন হতেই পারে না বৃন্দাবন। বৃন্দাবন মুখ নিচু করিয়া কহিল, তিনি তাঁর ভায়ের কাছেই যাবেন। দুর্গাদাস বৃন্দাবনকে ছেলের মত স্নেহ করিতেন, তাহার বিপদে এবং সর্বোপরি এই গৃহত্যাগের সঙ্কল্পে যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হইয়া নিবৃত্ত করিবার শেষ চেষ্টা করিয়া বলিলেন, বৃন্দাবন, জন্মভূমি ত্যাগ করবার আবশ্যকতা কি? এখানে বাস করেও ত পূর্বের মত সমস্ত হতে পারে। বৃন্দাবনের চোখ ছলছল করিয়া উঠিল, বলিল, ভিক্ষা ছাড়া আমার আর উপায় নেই, কিন্তু সে আমি এখানে পারব না। তা ছাড়া, এ বাড়িতে যেদিকেই চোখ পড়ছে, সেইদিকেই তার ছোট হাত-দুখানির চিহ্ন দেখতে পাচ্চি। আমাকে ক্ষমা করুন মাস্টারমশাই, আমি মানুষ, মানুষের মাথা এ গুরুভারে গুঁড়ো হয়ে যাবে। দুর্গাদাস বিমর্ষমুখে মৌন রহিলেন। যে ডাক্তার চরণের শেষ-চিকিৎসা করিয়াছিলেন, সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা, তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল। ইহার শেষ দেখিবার কৌতূহল ও বৃন্দাবনের প্রতি অদম্য আকর্ষণ তাঁহাকে সেইদিন সকালে বিনা-আহ্বানে আবার কলিকাতা হইতে টানিয়া আনিয়াছিল। এতক্ষণ তিনি নিঃশব্দে সমস্ত শুনিতেছিলেন; বৃন্দাবনের এতটা বৈরাগ্যের হেতু কোনমতে বুঝা যায়, কিন্তু কেশব কিসের জন্য সমস্ত উন্নতি জলাঞ্জলি দিয়া এই অতি তুচ্ছ পাঠশালার ভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিতেছে, ইহাই বুঝিতে না পারিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া বন্ধুকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, কেশব, সত্যই কি তুমি এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে পাঠশালা নিয়ে সারাজীবন থাকবে? কেশব সংক্ষেপে কহিল, শিক্ষা দেওয়াই ত আমার ব্যবসা। ডাক্তার ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, তা জানি, কিন্তু কলেজের প্রফেসারি এবং এই পাঠশালার পণ্ডিতি কি এক? এতে কি উন্নতি আশা কর শুনি? কেশব সহজভাবে বলিল, সমস্তই। টাকা রোজকার—আর উন্নতি এক নয় অবিনাশ। নয় মানি। কিন্তু এমন গ্রামে বাস করলেও যে মহাপাতক হয়! উঃ—মনে হলেও গা শিউরে ওঠে রে! বৃন্দাবন হাসিল এবং কেশবের জবাব দিবার পূর্বেই কহিল, সে কি শুধু গ্রামেরই অপরাধ ডাক্তারবাবু, আপনাদের নয়? আজ আমার দুর্দশা দেখে শিউরে উঠেছেন, এমনি দুর্দশায় প্রতি বৎসর কত শিশু, কত নরনারী-হত্যা হয়, সে কি কারো কোনদিন চোখে পড়ে? আপনারা সবাই আমাদের এমন নির্মমভাবে ত্যাগ করে চলে না গেলে, আমরা ত এত নিরুপায় হয়ে মরি না! রাগ করবেন না ডাক্তারবাবু, কিন্তু যারা আপনাদের মুখের অন্ন, পরনের বসন যোগায়, সেই হতভাগ্য দরিদ্রের এইসব গ্রামেই বাস। তাদিকেই দু’পায়ে মাড়িয়ে থেঁত্‌লে থেঁত্‌লে আপনাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি হয়। সেই উন্নতির পথ থেকে কেশব এম. এ. পাশ করেও স্বেচ্ছায় মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েচে। কেশব আনন্দে উৎসাহে সহসা বৃন্দাবনকে আলিঙ্গন করিয়া বলিয়া উঠিল, বৃন্দাবন, মানুষ হবার কত বড় সুযোগই না আমাকে দিয়ে গেলে! দশ বছর পরে একবার দয়া করে ফিরে এসো, দেখে যেয়ো তোমার জন্মভূমিতে লক্ষ্মী-সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি না। দুর্গাদাস ও অবিনাশ ডাক্তার উভয়েই এই দুই বন্ধুর মুখের দিকে শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া চাহিয়া রহিলেন। পরদিন বৃন্দাবন ভিক্ষার ঝুলিমাত্র সম্বল করিয়া বাড়ল ত্যাগ করিয়া যাইবে এবং ঘুরিতে ঘুরিতে যে-কোনস্থানে নিজের কর্মক্ষেত্র নির্বাচিত করিয়া লইবে। কেশব তাহাকে তাহাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়া কিছুকাল অবস্থান করিতে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়াছিল, কিন্তু বৃন্দাবন সম্মত হয় নাই। কারণ, সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধাকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতে চাহে। যাত্রার উদ্যোগ করিয়া সে দেবসেবার ভার পুরোহিত ও কেশবের উপর দিয়া দাসদাসী প্রভৃতি সকলের কথাই চিন্তা করিয়াছিল। মায়ের সিন্দুকের সঞ্চিত অর্থ তাহাদিগকে দিয়া বিদায় করিয়াছিল। শুধু কুসুমের কথাই চিন্তা করিয়া দেখে নাই। প্রবৃত্তিও হয় নাই, আবশ্যক বিবেচনাও করে নাই। যেদিন সে চরণকে আশ্রয় দেয় নাই, সেইদিন হইতে তাহার প্রতি একটা বিতৃষ্ণার ভাব জমিয়া উঠিতেছিল, সেই বিতৃষ্ণা তাহার মৃত্যর পরে অনিচ্ছা-সত্ত্বেও বিদ্বেষে রূপান্তরিত হইয়া উঠিতেছিল।
false
humayun_ahmed
দেয়া ঠিক হবে কি-না। আমি বুঝতে পারছি না। ঝড়ের দ্বিতীয় ঝাপ্টা শুরু হয়েছে। সমস্যা হল, এই ঝাপ্টা প্রথমটার মতই শক্তিশালী। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। বড় ধরনের বিপদে প্রকৃতি নিজে হাল ধরে। এখানেও তাই হল। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে গেল। বড়লোকদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও সমস্যা হয় না। তাদের নানান ব্যবস্থা থাকে–জেনারেটার চালু হয়ে যায়, আই পি এস চালু হয়। এক সঙ্গে অনেকগুলি চার্জ লাইট জ্বলে উঠে। এখানে তা হচ্ছে না। অন্ধকার বাড়ি, অন্ধকারই হয়ে আছে। একজন অতি বিরক্ত গলায় বলল, রাত একটার সময় কিসের লোড শেডিং? কল কারখানা সবই তো এখন বন্ধ। স্যার আপনার বাড়িতে আই পি এস নেই? জুঁই-এর বাবা বললেন, আছে। ইলেকট্রিক্যাল লাইনে কী যেন সমস্যা হয়েছে। এই রহমত! মোমবাতি জ্বালাও। অন্ধকার ঘরে ছোটাছুটি হচ্ছে। মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পকেট থেকে মোমবাতি বের করলাম–দেয়াশলাই দিয়ে মোমবাতি জ্বালালাম। খাকি পোষাক পরা ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি পকেটে মোমবাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ান? আমি বললাম, জ্বি স্যার। কখন দরকার পড়ে যায়। পরিস্থিতি এখন সামান্য হলেও আমার দিকে। সবাইকে সামান্য হলেও হকচাকিয়ে দিয়েছি। এখন আমি যা বলব সবাই তা শুনবে। সামান্য একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে এই অসামান্য ব্যাপারটা করা হয়েছে। আমি জুঁই-এর বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার জুঁই কোথায় আমি জানি না। রাত দশটায় এই বাড়িতে এসে আমার কফি খাবার কথা। আসতে সামান্য দেরি হয়েছে। জুঁই এত রাতেও বাড়িতে ফেরেনি শুনে আমি অবাক হচ্ছি। তুমি বলতে চোচ্ছ তুমি তার জান না? জ্বি না। তোমার সঙ্গে মোবাইল আছে না? জ্বি আছে। অন করা আছে? জ্বি আছে। সে মোবাইলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি? জ্বি না। আমি লক্ষ করলাম। জুঁই-এর বাবার সঙ্গে খাকি পোষাক পরা ভদ্রলোকের চোখের ইশারায় কিছু কথা হচ্ছে। মোমবাতির অল্প আলোয় চোখের ভাষা ঠিক পড়া যাচ্ছে না। অবশ্যি আলো বেশি থাকলেও লাভ হত না। চোখের ভাষা একেক শ্রেণীর জন্যে একেক রকম। অফিসের কেরাণীদের চোখের ভাষা, এবং পুলিশের চোখের ভাষা এক না। আমি শুধু রাস্তায় যারা হাঁটাহাটি করে তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারি। অন্যদেরটা পারি না। হিমু! জ্বি স্যার। জুঁই আজ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এখন রাত বাজছে একটা কুড়ি। এখনো ফিরছে না। কোনো বান্ধবীর বাড়িতে বসে আডিডা দিচ্ছে। আডিডা দিতে গিয়ে এত রাত হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। ওদের আবার টেলিফোনও নষ্ট। খবর দিতে পারছে না। হিমু শোনো, তোমার এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি যেখানে থাক সেখানে চলে যাও। জুঁই খুব সম্ভব তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এবং যোগাযোগ করা মাত্র আমাকে জানাবে। জ্বি আচ্ছা। আমি কি এখনই চলে যাব? হ্যাঁ। গাড়ি তোমাকে নামিয়ে দেবে। কোনো দরকার নেই স্যার। তোমার দরকার না থাকতে পারে। আমার আছে। আমি ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে মোমবাতিটা আবার পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মোমবাতি আমি নিয়ে যাব এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে খুব স্বাভাবিক কাজও আশেপাশের সবার চোখে অস্বাভাবিক মনে হয়। যে পাঁচজন বৈঠক করছেন তাদের কাছে আমার আচরণ খুবই অস্বাভাবিক লাগছে তা বুঝতে পারছি। লাগুক অস্বাভাবিক। মানুষকে সব সময় স্বাভাবিক লাগবে এটা কোনো কাজের কথা না। প্রাণী হিসেবে মানুষ অস্বাভাবিক। সে স্বাভাবিকের ভঙ্গি করে পৃথিবীতে বাস করে। আমি পুলিশের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, জুঁই-এর বাবা বের হয়ে এলেন এবং গম্ভীর গলায় বললেন, এক কাজ করো তুমি তোমার মোবাইলটা রেখে যাও। আমি মোবাইল তার হাতে দিলাম। তিনি বললেন, পুলিশের গাড়িতে করে তোমাকে পৌঁছে দেয়া ঠিক হবে না। তুমি হেঁটে চলে যাও। আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার। খবরটা ছাপা হয়েছে। পত্রিকার প্রথম পাতায়। ছবি সহ বক্স নিউজ। এখনকার পত্রিকাগুলি অন্যরকম হয়ে গেছে, গুরুত্বহীন খবরগুলি প্রথমপাতায় ছাপা হয়। মিথ্যা খবর দিয়ে লিড নিউজ আসে। আগে ধর্ষণ সংক্রান্ত খবরগুলি ছাপা হত ম্যাগাজিনে। দৈনিক পত্রিকাওয়ালারা দেখল–এমন একটা মজাদার আইটেম তাদের হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে–তারাও শুরু করল ধারাবাহিক ধর্ষণ প্রতিবেদন। ধর্ষণের পরের আইটেম ধারাবাহিক গালাগালি প্রতিবেদন। সরকার প্রধান বিরোধীদলকে গালি দিয়ে কী বললেন, আবার বিরোধীদলের প্রধান সরকারকে গালাগালি দিয়ে কী বললেন তার বিশদ বর্ণনা। রাজনীতির খেলা যত জমে পত্রিকাওয়ালাদের ততই রমরমা। রাজনীতিবিদরা তাদের খেলা খেলেন, পত্রিকাওয়ালারা খেলেন তাদের খেলা। তারা যে নিরপেক্ষ ভাবে খেলেন, তা না। প্রতিটি পত্রিকামালিক কোনো–না–কোনো রাজনীতিবিদের থলেতে বসে খেলেন। এই সিনড্রমের একটা নাম ক্যাঙ্গারু সিনড্রম। ক্যাঙ্গারুর ছানার মত থলোয় বসে খেলাধুলা। আজকের প্রথম পাতায় বক্স করে ছাপা সংবাদটার সঙ্গে রাজনীতি জড়িত না, হিমুনীতি খানিকটা জড়িত বলে খবরটা দুবার পড়লাম। পত্রিকা পড়া আমার কাজ না। আজকের কাগজটা কিনিয়েছি। জুঁই এর কোন খবর পত্রিকায় উঠেছে কি-না দেখার জন্যে। পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা নিখোজ এই শিরোনামে পত্রিকাওয়ালারা কিছু লিখেছে কি? কিন্যা নিখোজ আইটেম ধর্ষণের মত ইন্টারেষ্টিং না হলেও খারাপ না। এ জাতীয় কোনো খবর নেই। তবে অন্য খবর আছে। প্রথম পাতায় সেই খবর পেয়ে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল– তপ্ত নগরীতে প্রথম বৃষ্টিধারা এক দল নগ্ন মানুষের উল্লাস নৃত্য (নিজস্ব প্রতিবেদন) দীর্ঘ দাবীদাহের পর গতকাল রাজধানীতে শান্তির বারিধারা হয়েছে। রাত একটার দিকে হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তুমুল ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষল ধারে বর্ষণ শুরু হয়। দাবীদাহে অতিষ্ট মানুষের মনে নেমে আসে
false
shirshendu
না। ছাত্রীর পরীক্ষা চলছে। অনিন্দিতা গম্ভীর হয়ে বলে, আসলে আপনি আমাকে অ্যাভয়েড করতে চান। তা নয়। বিশ্বাস করুন। অনিন্দিতা বিশ্বাস করল না। একটু ম্লান হেসে বলল, এ যুগে এত লজ্জা সংকোচ আর ভয় থাকলে চলে না। এসব ঝেড়ে না ফেললে বাঁচবেন কি করে? চয়ন চুপ করে রইল। অনিন্দিতা কি একটু সেজে এসেছে? ঘরের আলোর আভায় তাই যেন মনে হল চয়নের। চুল পরিপাটি করে বাঁধা, মুখে একটু পাউডার এবং হয়তো বা কাজলও। কপালে একটা বড় আর একটা ছোেট টিপ। কে জানে কেন, ব্যাপারটা লক্ষ করে সে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। আসুন, একটু গল্প করি। এ প্রস্তাবের মধ্যে প্রত্যাখ্যানের কিছু নেই। অনিচ্ছুক চয়ন তাই বাধ্য হয়ে রেলিঙের ধারে অনিন্দিতার পাশে দাঁড়াল। বেশ একটা সুগন্ধ আসছে অনিন্দিতার গা থেকে। খুব দুঃখ পেলাম জানেন, একটু ইনসাল্টেড ফিল করছি। তটস্থ হয়ে চয়ন বলল, কেন? আপনি রিফিউজ করলেন বলে। ইচ্ছে করলেই যেতে পারতেন। কী এমন টিউশনি করেন শুনি! তারা তো আর মাথা কিনে নেয়নি। চয়ন কি বলবে তা ভেবেই পেল না। সে কাউকে তোয়াজটাও করতে শেখেনি। অনিন্দিতা একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, আপনার কথা ভেবেই দুটো টিকিট চেয়েছিলাম। অবশ্য আপনার মতটা আগেই জেনে নেওয়া উচিত ছিল। চয়ন মেয়েটাকে খুশি করতেই বলল, আচ্ছা, আর একদিন যাবো। অনিন্দিতা মাথা নেড়ে বলে, আপনি যে কখনও যাবেন না তা আমি জানি। আপনার অনেক অজুহাত বেরোবে। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে তো কোনওদিন টিউশনি ছাড়া আর কিছু করতে দেখি না। বড্ড ড্রাই জীবন কাটাচ্ছেন। তাই ভাবলাম, একটা নাটক দেখাই আপনাকে। হয়তো ভাল লাগবে। চয়ন এ কথায় যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করল। একটা মেয়ের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যাওয়া দোষেরও কিছু নয়। কিন্তু এই ঘটনা থেকে নানা রকম ব্যাখ্যা বেরোতে পারে। ভয়ের সেইটাই। একটা কথা বলবেন? আপনি সব ব্যাপারেই এত ভয় পান কেন? আমি ভীষণ ভিতু। থিয়েটারে যাওয়ার মধ্যে ভয়ের কী আছে? কেউ খারাপ ভাববে? আজকাল আর ওসব কেউ ভাবে নাকি? সে কথা নয়। অথচ আপনার কত ফ্রিডম দেখুন। একে তো আপনি পুরুষমানুষ। মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের ফ্রিডম অনেক বেশী। আপনার মাথার ওপর কোনও গার্জিয়ান নেই; কেউ শাসন করবে না। এত ফ্রিডম থাকা সত্ত্বেও কেন যে লজ্জা সংকোচ ভয়ে এমন কুঁকড়ে থাকেন। খুব নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল চয়ন। তারপর বলল, আমার জীবনটা ঠিক আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়। অনিন্দিতা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। বলল, কেন বলুন তো। আপনার এপিলেপসি আছে বলে? ওটা তো অনেকের থাকে! তা বলে সব বিসর্জন দিয়ে বিধবার মতো থাকতে হবে নাকি? চয়ন বিষণ্ণ নরম গলায় বলল, এই অসুখটা আমার মনের জোর নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময়ে একটা অস্বস্তি থাকে মনে। তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন? চয়ন মাথা নেড়ে বলল, তাই। হয়তো ওটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। অসুখের চিন্তা করেন কেন? এপিলেপসি একটা পাজি অসুখ। কিন্তু ফ্যাটাল তো নয়। আপনার কতদিন পর পর ওটা হয়? তার কিছু ঠিক নেই। গত তিন মাস হয়নি। আবার হয়তো পর পর তিন চারদিন হবে। দিনে দু-তিনবারও হয়েছে। রাস্তাঘাটে বিপদে পড়তে হয় মাঝে মাঝে। গত তিন মাস হয়নি বলছেন! এটা তো ভাল লক্ষণ। হয়তো সেরেই গেছে। চয়ন হঠাৎ একটু যেন সচকিত হয়ে বলল, সারেনি। কি করে বুঝলেন? চয়ন হঠাৎ নাটকীয়ভাবে টের পেল তার চারদিকে একটা কুয়াশার ঘেরাটোপ তৈরি হচ্ছে। চোখে একটা অস্পষ্ট সিগন্যাল দেখতে পায় সে। কুয়াশা ভেদ করে একটা রেলগাড়ি ঝিকঝিক করে এগিয়ে আসছে। তার বুড়ো আঙুল কেঁপে উঠল হঠাৎ। অস্ফুট গলায় চয়ন বলল, ওই যে! কী ওই যে! কী হল আপনার? প্লিজ! বলেই চয়ন দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে কোনওরকমে ছুঁড়ে দিল নিজেকে বিছানায়। অনিন্দিতা ঘাবড়ে গেল না। দ্রুত পায়ে এসে তার কাছে দাঁড়াল। চয়নের হাত কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আঙুল। সে প্রাণপণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, কাউকে ডাকবেন না কিন্তু, প্লিজ! অনিন্দিতা ঘরে রাখা ছোটো প্লাস্টিকের বালতিটা থেকে আঁজলায় জল তুলে নিয়ে চয়নের চোখে ঝাঁপটা দিল একবার। এটুকু চয়ন টের পেল। তারপরই তলিয়ে গেল তার নিজের ভিতরে এক অন্ধকারে। যখন চোখ মেলল তখন তার বুক, মুখ, জামা সব জলে ভেজা। খুব শীত করছে। শরীর অসম্ভব দুর্বল। বিছানার পাশে অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাকে সে কয়েক সেকেন্ড চিনতেই পারল না। কেমন লাগছে এখন? চয়ন শুধু চেয়ে রইল। মাথা এত সাদা যে কথাটা ভাল করে বুঝতেই পারল না। জবাব দেওয়ার ভাষাটাও খুঁজে পেল না কিছুক্ষণ। অবোধ চোখে শুধু চেয়ে থাকল। চয়নবাবু! কেমন লাগছে? চয়নের মাথার অস্পষ্টতা সরছে। মনে পড়ছে। সৌজন্যবোধ তার বড়ই বেশী। মৃদু একটু আসার চেষ্টা করে সে বলল, ভাল। করুণা আর মায়ায় নরম হয়ে আছে অনিন্দিতার মুখখানা। ছলোমলো চোখে সে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে? চয়ন তার ঠাণ্ডা দুর্বল শরীর আর ভারী মাথা নিয়ে পাথরের মতো শুয়ে থেকেও মৃদু একটু হেসে বলল, আমার অভ্যাস আছে। এ তো আমার পুরনো বন্ধু। একটু দুধ এনে দিই? গরম দুধ? চয়ন আত্মধিক্কার এবং নিজের ওপর ঘেন্নায় মুখখানা সামান্য বিকৃত করল। তারপর খুব মৃদুস্বরে বলল, না। দুধ আমার সহ্য হয় না। অনিন্দিতা তার মুখের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এ সময়ে দুধ খেতে হয়। আমি নিয়ে আসছি। অনিন্দিতা চলে
false
shorotchandra
চেহারায় দিনান্তের সূচনা দেখিয়া বিজয়ার বুক দমিয়া গেল। কাল যে লোক চিরদিনের মত দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে, আজ সে যদি এতদূরে আসিতে এতখানি সময় নষ্ট করিতে না পারে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে! তাহার শেষ সম্বলটুকু যদি অপর কাহাকেও বেশি দামে বিক্রয় করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহাকেই বা কি দোষ দিবে কে? তাহাদের শেষ কথাবার্তাগুলি সে বার বার তোলাপাড়া করিয়া নিরতিশয় অনুশোচনার সহিত মনে করিতে লাগিল যে মনের মধ্যে তাহার যাহাই থাক, মুখে সে এ সম্বন্ধে আগ্রহাতিশয্য একেবারেই প্রকাশ করে নাই। ইহাকে অনিচ্ছা কল্পনা করিয়া সে যদি শেষ পর্যন্ত পিছাইয়া গিয়া থাকে ত দর্পিতার উচিত শাস্তিই হইয়াছে বলিয়া হৃদয়ের ভিতর হইতে যে কঠিন তিরস্কার বারংবার ধ্বনিত হইয়া উঠিতে লাগিল, তাহার জবাব সে কোনদিকে চাহিয়াই খুঁজিয়া পাইল না। কিন্তু পরেশকে কিংবা আর কাহাকেও কোন ছলে তাঁহার কাছে পাঠান যায় কিনা, পাঠাইলেও তাহারা খুঁজিয়া পাইবে কিনা, তিনি আসিতে স্বীকার করিবেন কিনা, এমনি তর্ক-বিতর্ক করিয়া ছটফট করিয়া ঘড়ির পানে চাহিয়া ঘর-বাহির করিয়া যখন কোনমতেই তাহার সময় কাটিতেছিল না, এমনি সময়ে পরেশ ঘরে ঢুকিয়া সংবাদ দিল, মাঠান, নীচে এসো, বাবু এসেছে। বিজয়ার মুখ পাংশু হইয়া গেল—কে বাবু রে? পরেশ কহিল, কাল যে এসেছ্যালো—তেনার হাতে মস্ত একটা চামড়ার বাক্স রয়েছে মাঠান। আচ্ছা, তুই বাবুকে বসতে বল গে, আমি যাচ্ছি। মিনিট দুই-তিন পরে বিজয়া ঘরে ঢুকিয়া নমস্কার করিল। আজ তাহার পরনের কাপড়ে, মাথার ঈষৎ রুক্ষ এলোচুলে এমন একটা বিশেষত্ব ও পারিপাট্য ছিল যাহা কাহারও দৃষ্টি এড়াইবার কথা নহে। গতকল্যের সঙ্গে আজকের এই প্রভেদটায় ক্ষণকালের জন্য নরেনের মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তাহার বিস্মিত-দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া বিজয়ার নিজের দৃষ্টি যখন নিজের প্রতি ফিরিয়া আসিল, তখন লজ্জায়-শরমে সে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়া গেল। মাইক্রস্কোপের ব্যাগটা এতক্ষণ তাহার হাতেই ছিল, সেটা টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া সে ধীরে ধীরে কহিল, নমস্কার। আমি বিলেতে থাকতে ছবি আঁকতে শিখেছিলাম। আপনাকে ত আমি আরও কয়েকবার দেখেছি, কিন্তু আজ আপনি ঘরে ঢুকতেই আমার চোখ খুলে গেল। আমি নিশ্চয় বলতে পারি, যে ছবি আঁকতে জানে, তারই আপনাকে দেখে আজ লোভ হবে। বাঃ কি সুন্দর! বিজয়া মনে মনে বুঝিল, ইহা সৌন্দর্যের পদমূলে অকপট ভক্তের স্বার্থগন্ধহীন নিষ্কলুষ স্তোত্র অজ্ঞাতসারে উচ্ছ্বসিত হইয়াছে; এবং এ কথা একমাত্র ইহার মুখ দিয়াই বাহির হইতে পারে। কিন্তু তথাপি নিজের আরক্ত মুখখানা যে সে কোথায় লুকাইবে, এই দেহটাকে তাহার সমস্ত সাজসজ্জার সহিত যে কি করিয়া বিলুপ্ত করিবে, তাহা ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া মুখ তুলিয়া গম্ভীরস্বরে কহিল, আমাকে এ রকম অপ্রতিভ করা কি আপনার উচিত—তা ছাড়া, একটি জিনিস কিনব বলেই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, ছবি আঁকবার জন্যে ত ডাকিনি। জবাব শুনিয়া নরেনের মুখ শুকাইল। সে লজ্জায় একান্ত সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত হইয়া অস্ফুটকণ্ঠে এই বলিয়া ক্ষমা চাহিতে লাগিল যে, সে কিছুই ভাবিয়া বলে নাই—তাহার অত্যন্ত অন্যায় হইয়া গিয়াছে—আর কখনো সে—ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহার অনুতাপের পরিমাণ দেখিয়া বিজয়া হাসিল। স্নিগ্ধহাস্যে মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিল, কৈ দেখি আপনার যন্ত্র। নরেন বাঁচিয়া গেল। এই যে দেখাই, বলিয়া সে তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া বাক্স খুলিতে প্রবৃত্ত হইল। এই বসিবার ঘরটায় আলো কম হইয়া আসিতেছিল দেখিয়া বিজয়া পাশের ঘরটা দেখাইয়া কহিল, ও-ঘরে এখনো আলো আছে, চলুন, ঐখানে যাই। তাই চলুন, বলিয়া সে বাক্স হাতে লইয়া গৃহস্বামিনীর পিছনে পিছনে পাশের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। একটি ছোট টিপয়ের উপর যন্ত্রটি স্থাপিত করিয়া উভয়ে দুই দিকে দুখানা চেয়ার লইয়া বসিল। নরেন কহিল, এইবার দেখুন। কি করে ব্যবহার করতে হয়, তার পরে আমি শিখিয়ে দেব। এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রটির সহিত যাহাদের সাক্ষাৎ পরিচয় নাই তাহারা ভাবিতেও পারে না কত বড় বিস্ময় এই ছোট জিনিসটির ভিতর দিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। বাহিরের অসীম ব্রহ্মাণ্ডের মত এমনি সীমাহীন ব্রহ্মাণ্ডও যে মানুষের একটি ক্ষুদ্র মুঠার ভিতর ধরিতে পারে, সে আভাস শুধু এই যন্ত্রটির সাহায্যেই পাওয়া যায়। এইটুকুমাত্র ভূমিকা করিয়াই সে বিজয়ার মনোযোগ আহ্বান করিল। বিলাতে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করার পরে তাহার জ্ঞানের পিপাসা এই জীবাণুতত্ত্বের দিকেই গিয়াছিল। তাই একদিকে যেমন ইহার সহিত তাহার পরিচয়ও একান্ত ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার সংগ্রহও তেমনি অপর্যাপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সে-সমস্তই সে তাহার এই প্রাণাধিক যন্ত্রটির সহিত বিজয়াকে দিবার জন্য সঙ্গে আনিয়াছিল। সে ভাবিয়াছিল এ-সকল না দিলে শুধু শুধু যন্ত্রটা লইয়া আর একজনের কি লাভ হইবে। প্রথমে ত বিজয়া কিছু দেখিতে পায় না—শুধু ঝাপসা আর ধোঁয়া। নরেন যতই আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে সে কি দেখিতেছে ততই তাহার হাসি পায়। সেদিকে তাহার চেষ্টাও নাই মনোযোগও নাই। দেখিবার কৌশলটা নরেন প্রাণপণে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছে; প্রত্যেক কলকবজা নানাভাবে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া দেখাটা সহজ করিয়া তুলিবার বিধিমতে প্রয়াস পাইতেছে; কিন্তু দেখিবে কে? যে বুঝাইতেছে, তাহার কণ্ঠস্বরে আর একজনের বুকের ভিতরটা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে, প্রবল নিশ্বাসে তাহার এলোচুল উড়িয়া সর্বাঙ্গ কণ্ঠকিত করিতেছে, হাত হাতে ঠেকিয়া দেহ অবশ করিয়া আনিতেছে—তাহার কি আসে-যায় জীবাণুর স্বচ্ছদেহের অভ্যন্তরে কি আছে, না আছে, দেখিয়া? কে ম্যালেরিয়ায় গ্রাম উজাড় করিতেছে, আর কে যক্ষ্মায় গৃহ শূন্য করিতেছে চিনিয়া রাখিয়া তাহার লাভ কি? করিলেও ত সে তাহাদের নিবারণ করিতে পারিবে না! সে ত আর ডাক্তার নয়! মিনিট-দশেক ধস্তাধস্তি করিয়া নরেন অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া সোজা উঠিয়া বসিল; কহিল, যান,
false
robindronath
বেড়াইতে যাইবার সময় হইয়াছে। খানিকটা না বেড়াইয়া আসিলে আবার রাত্রে তোমার ক্ষুধা হইবে না।” বেড়াইতে যাওয়ার অর্থ ডাক্তারের বাড়ি যাওয়া। আমিই তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলাম, ক্ষুধাসঞ্চারের পক্ষে খানিকটা বেড়াইয়া আসা বিশেষ আবশ্যক। এখন নিশ্চয় বলিতে পারি, তিনি প্রতিদিনই আমার এই ছলনাটুকু বুঝিতেন। আমি নির্বোধ, মনে করিতাম তিনি নির্বোধ। এই বলিয়া দক্ষিণাচরণবাবু অনেকক্ষণ করতলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। অবশেষে কহিলেন, “আমাকে একগ্লাস জল আনিয়া দাও।” জল খাইয়া বলিতে লাগিলেন— একদিন ডাক্তারবাবুর কন্যা মনোরমা আমার স্ত্রীকে দেখিতে আসিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। জানি না, কী কারণে তাঁহার সে প্রস্তাব আমার ভালো লাগিল না। কিন্তু, প্রতিবাদ করিবার কোনো হেতু ছিল না। তিনি একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেদিন আমার স্ত্রীর বেদনা অন্য দিনের অপেক্ষা কিছু বাড়িয়া উঠিয়াছিল। যেদিন তাঁহার ব্যথা বাড়ে সেদিন তিনি অত্যন্ত স্থির নিস্তব্ধ হইয়া থাকেন; কেবল মাঝে মাঝে মুষ্টি বদ্ধ হইতে থাকে এবং মুখ নীল হইয়া আসে, তাহাতেই তাঁহার যন্ত্রণা বুঝা যায়। ঘরে কোনো সাড়া ছিল না, আমি শয্যাপ্রান্তে চুপ করিয়া বসিয়া ছিলাম; সেদিন আমাকে বেড়াইতে যাইতে অনুরোধ করেন এমন সামর্থ্য তাঁহার ছিল না, কিংবা হয়তো বড়ো কষ্টের সময় আমি কাছে থাকি এমন ইচ্ছা তাঁহার মনে মনে ছিল। চোখে লাগিবে বলিয়া কেরোসিনের আলোটা দ্বারের পার্শ্বে ছিল। ঘর অন্ধকার এবং নিস্তব্ধ। কেবল এক-একবার যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশমে আমার স্ত্রীর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস শুনা যাইতেছিল। এমন সময়ে মনোরমা ঘরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়াইলেন। বিপরীত দিক হইতে কেরোসিনের আলো আসিয়া তাঁহার মুখের উপর পড়িল। আলো-আঁধারে লাগিয়া তিনি কিছুক্ষণ ঘরের কিছুই দেখিতে না পাইয়া দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিতে লাগিলেন। আমার স্ত্রী চমকিয়া আমার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কে। ”— তাঁহার সেই দুর্বল অবস্থায় হঠাৎ অচেনা লোক দেখিয়া ভয় পাইয়া আমাকে দুই-তিনবার অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করিলেন, “ও কে ! ও কে গো! ” আমার কেমন দুর্বুদ্ধি হইল প্রথমেই বলিয়া ফেলিলাম, “আমি চিনি না।” বলিবামাত্রই কে যেন আমাকে কশাঘাত করিল। পরের মুহূর্তেই বলিলাম, “ওঃ, আমাদের ডাক্তারবাবুর কন্যা! ” স্ত্রী একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন; আমি তাঁহার মুখের দিকে চাহিতে পারিলাম না। পরক্ষণেই তিনি ক্ষীণস্বরে অভ্যাগতকে বলিলেন, “আপনি আসুন।” আমাকে বলিলেন, “আলোটা ধরো।” মনোরমা ঘরে আসিয়া বসিলেন। তাঁহার সহিত রোগিণীর অল্পস্বল্প আলাপ চলিতে লাগিল। এমন সময় ডাক্তারবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি তাঁহার ডাক্তারখানা হইতে দুই শিশি ওষুধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। সেই দুটি শিশি বাহির করিয়া আমার স্ত্রীকে বলিলেন, “এই নীল শিশিটা মালিশ করিবার,আর এইটি খাইবার। দেখিবেন, দুইটাতে মিলাইবেন না, এ ওষুধটা ভারি বিষ।” আমাকেও একবার সতর্ক করিয়া দিয়া ঔষধ দুটি শয্যাপার্শ্ববর্তী টেবিলে রাখিয়া দিলেন। বিদায় লইবার সময় ডাক্তার তাঁহার কন্যাকে ডাকিলেন। মনোরমা কহিলেন, “বাবা, আমি থাকি না কেন। সঙ্গে স্ত্রীলোক কেহ নাই, ইঁহাকে সেবা করিবে কে। ” আমার স্ত্রী ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন; বলিলেন, “না,না, আপনি কষ্ট করিবেন না। পুরানো ঝি আছে, সে আমাকে মায়ের মতো যত্ন করে।” ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “উনি মা-লক্ষ্মী, চিরকাল পরের সেবা করিয়া আসিয়াছেন, অন্যের সেবা সহিতে পারেন না।” কন্যাকে লইয়া ডাক্তার গমনের উদ্‌যোগ করিতেছেন এমন সময় আমার স্ত্রী বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, ইনি এই বদ্ধ ঘরে অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন, ইঁহাকে একবার বাহিরে বেড়াইয়া লইয়া আসিতে পারেন? ” ডাক্তারবাবু আমাকে কহিলেন, “আসুন-না, আপনাকে নদীর ধার হইয়া একবার বেড়াইয়া আনি।” আমি ঈষৎ আপত্তি দেখাইয়া অনতিবিলম্বে সম্মত হইলাম। ডাক্তারবাবু যাইবার সময় দুই শিশি ঔষধ সম্বন্ধে আবার আমার স্ত্রীকে সতর্ক করিয়া দিলেন। সেদিন ডাক্তারের বাড়িতেই আহার করিলাম। ফিরিয়া আসিতে রাত হইল। আসিয়া দেখি আমার স্ত্রী ছট্‌ফট্‌ করিতেছেন। অনুতাপে বিদ্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার কি ব্যথা বাড়িয়াছে।” তিনি উত্তর করিতে পারিলেন না, নীরবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তখন তাঁহার কণ্ঠরোধ হইয়াছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই রাত্রেই ডাক্তারকে ডাকাইয়া আনিলাম। ডাক্তার প্রথমটা আসিয়া অনেকক্ষণ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। অবশেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই ব্যথাটা কি বাড়িয়া উঠিয়াছে। ঔষধটা একবার মালিশ করিলে হয় না? ” বলিয়া শিশিটা টেবিল হইতে লইয়া দেখিলেন, সেটা খালি। আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি ভুল করিয়া এই ওষুধটা খাইয়াছেন? ” আমার স্ত্রী ঘাড় নাড়িয়া নীরবে জানাইলেন, “হাঁ।” ডাক্তার তৎক্ষণাৎ গাড়ি করিয়া তাঁহার বাড়ি হইতে পাম্প্‌ আনিতে ছুটিলেন। আমি অর্ধমূর্ছিতের ন্যায় আমার স্ত্রীর বিছানার উপর গিয়া পড়িলাম। তখন, মাতা তাহার পীড়িত শিশুকে যেমন করিয়া সান্ত্বনা করে তেমনি করিয়া তিনি আমার মাথা তাঁহার বক্ষের কাছে টানিয়া লইয়া দুই হস্তের স্পর্শে আমাকে তাহার মনের কথা বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। কেবল তাঁহার সেই করুণ স্পর্শের দ্বারাই আমাকে বারংবার করিয়া বলিতে লাগিলেন, “শোক করিয়ো না, ভালোই হইয়াছে, তুমি সুখী হইবে, এবং সেই মনে করিয়া আমি সুখে মরিলাম।” ডাক্তার যখন ফিরিলেন, তখন জীবনের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীর সকল যন্ত্রণার অবসান হইয়াছে। দক্ষিণাচরণ আর-একবার জল খাইয়া বলিলেন, “উঃ, বড়ো গরম! ” বলিয়া দ্রুত বাহির হইয়া বারকয়েক বারান্দায় পায়চারি করিয়া বসিলেন। বেশ বোঝা গেল, তিনি বলিতে চাহেন না কিন্তু আমি যেন জাদু করিয়া তাঁহার নিকট হইতে কথা কাড়িয়া লইতেছি। আবার আরম্ভ করিলেন— মনোরমাকে বিবাহ করিয়া দেশে ফিরিলাম। মনোরমা তাহার পিতার সম্মতিক্রমে আমাকে বিবাহ করিল; কিন্তু আমি যখন তাহাকে আদরের কথা বলিতাম, প্রেমালাপ করিয়া তাহার হৃদয় অধিকার করিবার চেষ্টা করিতাম, সে হাসিত না, গম্ভীর হইয়া থাকিত। তাহার মনের কোথায় কোন্‌খানে কী খটকা
false
robindronath
“কুমু, আমার কাছে খুলে বল্‌, কী রকম চলছে তোদের।” তখনই কুমু কিছু বলতে পারলে না। মাথা নিচু করে বসে রইল, দেখতে দেখতে মুখ হল লাল, শিশুকালের মতো করে বিপ্রদাসের প্রশস্ত বুকের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল; বললে, “দাদা, আমি সবই ভুল বুঝেছি, আমি কিছুই জানতুম না।” বিপ্রদাস আস্তে আস্তে কুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিক বাদে বললে, “আমি তোকে ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারি নি। মা থাকলে তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যে প্রস্তুত করে দিতে পারতেন।” কুমু বললে, “আমি বরাবর কেবল তোমাদেরই জানি, এখান থেকে অন্য জায়গা যে এত বেশি তফাত তা আমি মনে করতে পারতুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি যা-কিছু কল্পনা করেছি সব তোমাদেরই ছাঁচে। তাই মনে একটুও ভয় হয় নি। মাকে অনেক সময়ে বাবা কষ্ট দিয়েছেন জানি, কিন্তু সে ছিল দুরন্তপনা, তার আঘাত বাইরে, ভিতরে নয়। এখানে সমস্তটাই অন্তরে অন্তরে আমার যেন অপমান।” বিপ্রদাস কোনো কথা না বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। মধুসূদন যে ওদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক জগতের মানুষ, তা সেই বিবাহ-অনুষ্ঠানের আরম্ভ থেকেই বুঝতে পেরেছে। তারই বিষম উদ্‌বেগে ওর শরীর যেন কোনোমতেই সুস্থ হয়ে উঠছে না। এই দিঙ্‌নাগের স্থূলহস্তাবলেপ থেকে কুমুকে উদ্ধার করবার তো কোনো উপায় নেই। সকলের চেয়ে মুশকিল এই যে, এই মানুষের কাছে ঋণে ওর সমস্ত সম্পত্তি বাঁধা। এই অপমানিত সম্বন্ধের ধাক্কা যে কুমুকেও লাগছে। এতদিন রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বিপ্রদাস কেবলই ভেবেছে মধুসূদনের এই ঋণের বন্ধন থেকে কেমন করে সে নিষ্কৃতি পাবে। ওর কলকাতায় আসবার ইচ্ছে ছিল না, পাছে কুমুর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওদের সহজ ব্যবহার অসম্ভব হয়। কুমুর উপর ওর যে স্বাভাবিক স্নেহের অধিকার আছে, পাছে তা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে থাকে, তাই ঠিক করেছিল নুরনগরেই বাস করবে। কলকাতায় আসতে বাধ্য হয়েছে অন্য কোনো মহাজনের কাছ থেকে ধার নেবার ব্যবস্থা করবে বলে। জানে যে এটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য, তাই এর দুশ্চিন্তার বোঝা ওর বুকের উপর চেপে বসে আছে। খানিক বাদে কুমু বিপ্রদাসের থেকে অন্য দিকে ঘাড় একটু বেঁকিয়ে বললে, “আচ্ছা দাদা, স্বামীর ‘পরে কোনোমতে মন প্রসন্ন করতে পারছি নে, এটা কি আমার পাপ?” “কুমু তুই তো জানিস, পাপপুণ্য সম্বন্ধে আমার মতামত শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে না।” অন্যমনস্কভাবে কুমু একটা ছবিওয়ালা ইংরেজি মাসিক পত্রের পাতা ওলটাতে লাগল। বিপ্রদাস বললে, “ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন তার ঘটনায় ও অবস্থায় এতই ভিন্ন হতে পারে যে, ভালোমন্দর সাধারণ নিয়ম অত্যন্ত পাকা করে বেঁধে দিলে অনেক সময়ে সেটা নিয়মই হয়, ধর্ম হয় না।” কুমু মাসিক পত্রটার দিকে চোখ নিচু করে বললে, “যেমন মীরাবাইএর জীবন।” নিজের মধ্যে কর্তব্য-অকর্তব্যের দ্বন্দ্ব যখনই কঠিন হয়ে উঠেছে, কুমু তখনই ভেবেছে মীরাবাইএর কথা। একান্ত মনে ইচ্ছা করেছে কেউ ওকে মীরাবাইএর আদর্শটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। কুমু একটু চেষ্টা করে সংকোচ কাটিয়ে বলতে লাগল, “মীরাবাই আপনার যথার্থ স্বামীকে অন্তরের মধ্যে পেয়েছিলেন বলেই সমাজের স্বামীকে মন থেকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু সংসারকে ছাড়বার সেই বড়ো অধিকার কি আমার আছে?” বিপ্রদাস বললে, “কুমু, তোর ঠাকুরকে তুই তো সমস্ত মন দিয়েই পেয়েছিস।” “এক সময়ে তাই মনে করেছিলুম। কিন্তু যখন সংকটে পড়লুম তখন দেখি প্রাণ আমার কেমন শুকিয়ে গেছে, এত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতে তাঁকে যেন আমার কাছে সত্য করে তুলতে পারছি নে! আমার সব চেয়ে দুঃখ সেই।” “কুমু, মনের মধ্যে জোয়ার-ভাঁটা খেলে। কিছু ভয় করিস নে, রাত্তির মাঝে মাঝে আসে, দিন তা বলে তো মরে না! যা পেয়েছিস তোর প্রাণের সঙ্গে তা এক হয়ে গেছে।” “সেই আশীর্বাদ করো, তাঁকে যেন না হারাই। নির্দয় তিনি দুঃখ দেন, নিজেকে দেবেন বলেই। দাদা, আমার জন্যে ভাবিয়ে আমি তোমাকে ক্লান্ত করছি।” “কুমু, তোর শিশুকাল থেকে তোর জন্যে ভাবা যে আমার অভ্যেস। আজ যদি তোর কথা জানা বন্ধ হয়ে যায়, তোর জন্যে ভাবতে না পাই, তা হলে শূন্য ঠেকে। সেই শূন্যতা হাতড়াতে গিয়ে তো মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।” কুমু বিপ্রদাসের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, “আমার জন্যে তুমি কিন্তু কিছু ভেবো না দাদা। আমাকে যিনি রক্ষা করবেন তিনি ভিতরেই আছেন, আমার বিপদ নেই।” “আচ্ছা, থাক্‌ ও-সব কথা। তোকে যেমন গান শেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তোকে শেখাই।” “ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বাঁচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও। আজ আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা গান শোনাই।” দাদার শিয়রের কাছে বসে কুমু আস্তে আস্তে গাইতে লাগল– পিয়া ঘর আয়ে, সোহী পীতম পিয় প্যার রে। মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, চরণকমল বলিহার রে। বিপ্রদাস চোখ বুজে শুনতে লাগল। গাইতে গাইতে কুমুর দুই চক্ষু ভরে উঠল এক অপরূপ দর্শনে। ভিতরের আকাশ আলো হয়ে উঠল। প্রিয়তম ঘরে এসেছেন, চরণকমল বুকের মধ্যে ছুঁতে পাচ্ছে। অত্যন্ত সত্য হয়ে উঠল অন্তরলোক, যেখানে মিলন ঘটে। গান গাইতে গাইতে ও সেইখানে পৌঁচেছে। “চরণকমল বলিহার রে”–সমস্ত জীবন ভরে দিলে সেই চরণকমল, অন্ত নেই তার–সংসারে দুঃখ-অপমানের জায়গা রইল কোথায়। “পিয়া ঘর আয়ে” তার বেশি আর কী চাই। এই গান কোনোদিন যদি শেষ না হয় তা হলে তো চিরকালের মতো রক্ষা পেয়ে গেল কুমু। কিছু রুটি-টোস্ট আর এক পেয়ালা বার্লি গোকুল টিপাই-এর উপর রেখে দিয়ে গেল। কুমু গান থামিয়ে বললে, “দাদা, কিছুদিন আগে মনে
false
shunil_gongopaddhay
কাকাবাবু বললেন, ওহে যতীন, আমাদের আরও একটু চা খাওয়াও। যতীন বলল, চা-চিনি-দুধ এনেছেন তো? আর চাল-ডাল? আমি রান্না করে দেব। কিন্তু আমার কাছে ওসব কিছু নেই। কাকাবাবু বললেন, রণবীর কীসব দিয়ে দিয়েছে, দ্যাখো তো। একটা প্যাকেটে রণবীর চা, চিনি, দুধ, পাউরুটি, মাখন, কেক, ডিম এইসব অনেক কিছুই দিয়ে দিয়েছে। সব দেখে গৌতমকাকু বললেন, আজ আমরা ডিম-পাউরুটি খেয়ে নেব। কাল সকালে বাজার করে আনব। শুনেছি তো দশ-বারো মাইল দূরেই একটা বাজার আছে। সেখানে সবকিছু পাওয়া যায়? যতীন বলল, হ্যাঁ স্যার। মাছ পাবেন, মুরগি পাবেন। মিলিকাকিমা জিজ্ঞেস করলেন, কুমড়ো ফুল পাওয়া যায় না? অনেকদিন কুমড়ো ফুল ভাজা খাইনি। যতীন বলল, তাও এক-একদিন পাওয়া যায়। ফুলকপি, বাঁধাকপি এসব পাবেন। গৌতমকাকু বললেন, না, না, ওসব চাই না। আমেরিকাতে ওসব খেতে খেতে মুখ পচে গেছে। এখানে খুঁজব ভাল পটল, ঝিঙে, কলমিশাক, আর মুরগির বদলে কচি পাঁঠার মাংস! কাকাবাবু বললেন, ওসব কলকাতায় গিয়ে খেয়ো। এখানে যা পাবে তাই-ই খেতে হবে। বাংলোর সামনে একটা উঁচুমতন বাঁধ, তার ওপাশে একটা পুকুর। ঠিক গোল বা চৌকো নয়, অনেকখানি ছড়ানো, মাঝখানে একটা ছোট দ্বীপের মতন। তারপর শুধু জঙ্গল। মিলিকাকিমা বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, ওই পুকুরে বুঝি সবাই চান করে? কাকাবাবু বলে উঠলেন, না, না, না, ওখানে যাওয়াই নিষেধ। তোমরা কেউ এই বাংলোর চৌহদ্দির বাইরে হেঁটে যাবে না। যে-কোনও সময় কোনও জন্তু-জানোয়ার এসে পড়তে পারে। সব সময় গাড়িতে যেতে হবে। যতীন বলল, ওই পুকুরে জন্তু-জানোয়াররা জল খেতে আসে। হাতিরা জলে নেমে অনেকক্ষণ খেলা করে। গৌতমকাকু বললেন, এই বারান্দায় বসেই হাতিদের জলক্রীড়া দেখা যাবে? যতীন বলল, হ্যাঁ, স্যার, হাতি তো দেখতে পাবেনই, তা ছাড়া বাইসন, লেপার্ড, বুনো শুয়োর, হঠাৎ কখনও কখনও টাইগারও চলে আসে। ওই দেখুন না, এখনই দুটো পি-কাক দেখা যাচ্ছে। গৌতমকাকু বললেন, পি-কাক? সেটা আবার কী ধরনের জন্তু? কাকাবাবু বললেন, ও বলতে চাইছে পিকক, ময়ূর। কোথায় ময়ূর? যতীন বলল, ওই যে ঝোপটার পাশে। সবাই ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এক মিনিট পরেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ময়ূর, মস্ত বড় লেজ, আর কী সুন্দর গায়ের রং। সন্তু পুরুকে জিজ্ঞেস করল, দেখতে পেয়েছ? পুরু মাথা নেড়ে বলল, এই প্রঠম আমি বনের ময়ূর ডেকলাম। কাকাবাবু বললেন, বাঃ, নিখুঁত বাংলা বলছে। সন্তু বলল, প্রঠম নয় প্রথম। ডেকলাম না, দেখলাম। যতীন বলল, পুকুরটার ওপারে দেখুন খানিকটা সাদা পাথরের মতন। ওটা সল্ট লিক। কাকাবাবু বললেন, ওখানে অনেকটা করে নুন দিয়ে আসতে হয় মাঝে-মাঝে। জন্তুরা ওই নুন চাটতে আসে। মানুষের মতন জন্তু-জানোয়ারদেরও নুন খাওয়ার দরকার হয়। মিলিকাকিমা বললেন, এত কাছে জন্তুরা আসে। ওরা এই বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে না? যতীন অম্লান বদনে বলল, হ্যাঁ মেমসাহেব, এই পরশুদিনই তো রাত্তিরে একটা লেপার্ড ঢুকে পড়েছিল। মিলিকাকিমা বললেন, আমি মোটেই মেমসাহেব নই। আমাকে দিদি কিংবা বউদি বলবে। তা লেপার্ডটা ঢুকে পড়ার পর কী করল? যতীন অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, কী আর করবে, কিছুক্ষণ হাউ হাউ করে ডেকে চলে গেল। ও আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, বেশিরভাগ জন্তুই সন্ধের পর বেরোয়। তখন এখানে দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখতে হয়। তা হলে তো ওরা আর কিছু করতে পারে না। ঘুরেটুরে চলে যায়। একমাত্র ভয় হাতির পালকে। ওরা ঘরবাড়ি ভেঙে দিতে পারে। মিলিকাকিমা বললেন, ওরে বাবা, তা হলে যদি হাতি এসে পড়ে? কাকাবাবু হেসে বললেন, ভাল করে দেখো, এই বাংলোর চার পাশে একটা পরিখা কাটা আছে। মিলিকাকিমা বললেন, পরিখা কী? কাকাবাবু বললেন, অনেকটা সরু খালের মতন। হাতি আর সব পারে, শুধু লাফাতে পারে না অত বড় শরীর নিয়ে। তাই হাতি ভেতরে আসতে পারে না। যতীন বলল, গেটের কাছেও কাঠের পাটাতন। রাত্তিরবেলা ওটা কপিকল দিয়ে টেনে তোলা যায়। ওখান দিয়েও হাতি ঢুকতে পারে না। পুরু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ওই দ্যাকো, ওই দ্যাকো, কতকগুলো বাফেলো। সন্তু বলল, বাফেলো নয়, বাইসন। বাফেলোর বাংলা মোষ। কিন্তু বাইসনের বাংলা নেই। কাকাবাবু বললেন, মোষের মতন দেখতে হলেও বাইসন আলাদা। লক্ষ করে দেখো, ওদের পায়ের তলাটা সাদা, ঠিক যেন সাদা মোজা পরে আছে। ওরা খুবই হিংস্র প্রাণী। দল বেঁধে থাকলে বাঘও ভয় পায়। ধারালো শিং দিয়ে পেট ফুটো করে দেয়। সন্তু বলল, এক, দুই..মোট সাতটা। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে বাইসন দেখতে লাগল। সন্তু আগে অনেক জঙ্গলে গেছে, কিন্তু পুরুর কাছে এসবই প্রথম, সবই নতুন। সন্তু ভাবল, ইস, জোজো এবার এল না। জোজো থাকলে এতক্ষণে কত মজার মজার কথা বলত। সন্ধে হতে-না-হতেই খুব তাড়াতাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। জঙ্গলের মতন এমন গাঢ় অন্ধকার শহরে দেখা যায় না। রাত্তির হলেই জঙ্গল রহস্যময় মনে হয়। কোনও শব্দ নেই, তবু যে-কোনও দিকে তাকালেই মনে হয় যেন কোনও হিংস্র জানোয়ার সেখানে লুকিয়ে আছে। মাঝে-মাঝে জোনাকি দেখা যাচ্ছে। সবগুলোই জোনাকি না কোনও পশুর চোখ, তা বোঝার উপায় নেই। সব পশুর চোখই রাত্তিরে জ্বলজ্বল করে। বারান্দা ছেড়ে কেউ আর ঘরে গেল না। রাত্তিরের খাওয়াদাওয়াও হল ওখানে বসে। মাঝে-মাঝে জঙ্গলে নানারকম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুটো বড়-বড় সার্চলাইট রয়েছে। সেগুলো জ্বাললে শুধু বাইসনদেরই দেখা যাচ্ছে, ওরা জায়গা ছেড়ে নড়ছে না। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে যেন তাণ্ডব শুরু হল।
false
zahir_rayhan
খালি পা কংক্রিটের পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনে। ঝরনা এখন নদী হয়ে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। সামনে বিশাল সমুদ্র। এ সমুদ্রের মতো জনতা। নগ্নপায়ে এগিয়ে চলেছে শহীদ মিনারের দিকে। অসংখ্য কালো পতাকা। পতপত করে উড়ছে। উড়ছে আকাশে। মানুষগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে সামনে। ইউক্যালিপ্টাসের পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে নিচে। মাটিতে। ঝরে। প্রতি বছর ঝরে। তবু ফুরোয় না। রাত দুপুরে সবাই যখন ঘুমে অচেতন তখন বৃটিশ মেরিনের সেপাহীরা এসে ছাউনি ফেলেছিলো এখানে। শহরের এ অংশটার তখন বসতি ছিলো না। ছিলো, সার সার উর্ধ্বমুখী গাছের ঘন অরণ্য। দিনের বেলা কাঠুরের দল এসে কাঠ কাটতো আর রাতে হিংস্র পশুরা চড়ে বেড়াতো। শহরে তখন গভীর উত্তেজনা। লালবাগে সেপাহীরা যে কোন মুহুর্তে বিদ্রোহ করবে। যে কটি ইংরেজ পরিবার ছিলো, তারা সভয়ে আশ্রয় নিলো বুড়িগঙ্গার ওপর গ্রিনবোট। খবর পেয়ে যথাসময়ে বৃটিশ মেরিনের সৈন্যরা এসে পৌঁছেছিলো আর শহরের এ অংশটা দখল করে তাঁবু ফেলেছিলো এখানে। সে থেকে এর নাম হয়েছিলো, আণ্ডার গোরা ময়দান। লোকে বলতো, আণ্ডা গোরার ময়দান। শেষতে লালবাগের নিরস্ত্র সেপাহীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করেছিলো তারা। মানুষের রক্তে লালবাগের মাটি লাল হয়ে ওঠে। কিছু সেপাহী মার্চ করে পালিয়ে যায় ময়মনসিংহের দিকে। যারা ধরা পড়ে তাদের ফাঁসি দেয়া হয় আণ্ডা গোরার ময়দানে। মৃতদেহগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছের ডালে ডালে। লোকে দেখুক। দেশদ্রোহীতার শাস্তি কত নির্মম হতে পারে, স্বচক্ষে দেখুক নেটিভরা। এসব ঘটেছিলো একশো বছর আগে। আঠারশো সাতান্ন সালে। আণ্ডা গোরার ময়দান এখনো আছে। শুধু নয় পালটেছে তার। লোকে বলে, ভিকটোরিয়া পার্ক। সে অরণ্য আজ নেই। মাঝে একটা প্রচণ্ড ঝড় হয়েছিলো। সে ঝড়ে কি আশ্চর্য, গাছের-ডালগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেলো, আর গুঁড়িশুদ্ধ গাছগুলো লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকে বলতো, গাছেরো প্রাণ আছে। পাপ সইবে কেন? তারপর থেকে আবাদ শুরু হয়ে এখানে। ঘর উঠলো। বাড়ি উঠলো। রাস্তা ঘাট তৈরি হলো। আর মহারানীর নামে গড়া হলো একটা পার্ক। আগে জনসভা হতো এখানে এখন হয় না। শুধু বিকেলে ছেলে বুড়োরা এসে ভিড় জমায়। ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ দেয়। বুড়োরা শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেয়, চিনে বাদামের খোসা ছড়ায়। এ হলো গ্রীষ্মে অথবা বসন্তে। শীতের মরশুমে লোক খুব কম আসে, সন্ধ্যার পরে কেউ থাকে না। এবারে শীত পড়েছিলো একটু বিদঘুটে ধরনের। দি নে ভয়ানক গরম। রাতে কনকনে শীত। সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিলো পুরো আকাশটা। আকাশের অনেক নিচু দিয়ে মন্থর গতিতে ভেসে চলেছিলো এক টুকরা মেঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণে। রঙ তার অনেকটা জমাট কুয়াশার মত দেখতে। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মত একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেলো নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তার একটা সদ্য ধোঁয়ান সাদা শার্ট। সাদা প্যান্ট। পা জোড়া খালি। জুতো নেই। রাস্তার দুপাশে দোকানীরা পসরা নিয়ে বসেছে। টাউন সার্ভিসের বাসগুলো চলতে শুরু করেছে সবে। ভিড় বাড়ছে। কর্মচঞ্চল লোকেরা গন্তব্যের দিকে ছুটছে রাস্তার দুধার ঘেঁষে। কিন্তু ওদের সঙ্গে এ ছেলেটির একটা আশ্চর্য অসামঞ্জস্য প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। সব আছে তার। ধবধবে জামা। প্যান্ট। পকেটে কলম। কব্জিতে বাঁধা ঘড়ি। হাতে একটা খাতা। মুখের দিকে তাকালে, ভদ্রলোকের সন্তান বলে মনে হয়। কিন্তু, পায়ে জুতো নেই কেন ওরা জুতো অবশ্য এ দেশের অনেকেই পরে না। পরে না, পরবার সমর্থ নেই বলে আর সামর্থ যে নেই ওদের জীর্ণ মলিন পোষাকের দিকে তাকালে বোঝা যায়। এ ছেলেটির পোষাকে কোন দৈন্য নেই। বরং আভিজাত্যের চমক আছে। তবে, এ পোষাক পরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কেন সে? এ দৃশ্য যাদের চোখে পড়লো, তারা একটু অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। তাদের চোখে হঠাৎ জাগা বিস্ময়। মনে ক্ষণিক প্রশ্ন। ছেলেটির মাথায় কোন ছিট নেই তো? পাগল নয় তো ছেলেটা? কেউ কেউ তাকে নিয়ে ইতস্তত মন্তব্য করলো। আরে না না, পাগল না। ছেলেটার বোধ হয় কেউ মারা গেছে। তাই শোক করছে খালি পায়ে হেঁটে। কেউ বললো, কে জানে এটা একটা ফ্যাশনও হতে পারে। আজকাল কত রকমের ফ্যাশন যে দেখি। কেউ বললো, মহররমের তো এখনো অনেক দেরি, তাই না? ছেলেটা তখনো হেঁটে চলেছে আপন মনে। মাঝে মাঝে সন্ধানী দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে সে। কি যেন তালাশ করছে। কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে তার চঞ্চল দুটো চোখ। আর যখন কোন লোকের দিকে তাকাচ্ছে সে, তখন তার মুখের দিকে না তাকিয়ে তার পায়ের দিকে দেখছে আগে। এমনি করে যখন বংশালের মোড় পেরিয়ে গেলো সে, তখন একজনের দিকে চোখ পড়তে সারামুখে আনন্দের আবীর ছড়িয়ে গেলো তার। পেছন থেকে সে তাকালে, মুনিম ভাই, এই যে, ওদিকে নয়, এদিকে। মুনিম পেছন ফিরে তাকালো। গায়ের রঙ তার রাতের আঁধারের মতো কালো। মসৃণ মুখ। খাড়া নাকের গোড়ায় পুরু ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা ধবধবে পায়জামা পা জোড়া কিন্তু তারও নগ্ন। জুতো নেই। মুখোমুখি হতে পরস্পরের দিকে স্নেহার্ড চোখে তাকালো ওরা। মৃদু হাসলো। হেসেই গম্ভীর হয়ে গেলো দুজনে। তারপর পথ চলতে চলতে মুনিম বললো, বাসা থেকে মা বেরুতেই দিচ্ছিলেন না। বুঝলে আসাদ। মায়ের আমার সব সময় ভয়, যদি কিছু ঘটে? আমার অবশ্য এসব বালাই নেই। আসাদ আস্তে করে বললো, মা মরে গিয়ে বোধহয় ভালই হয়েছে। থাকলে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করতো। বলতে গিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। ঠাটারী বাজার
false
shunil_gongopaddhay
আবার সে জেগে উঠলো। বেলা দশটায় সে হাঁক দিয়ে বলল, দুলাল! গাড়ি জুততে বল! দুলাল জানালো যে, এখনো পথঘাটে গাড়ি চালাবার কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি প্রশমিত হয়েছে বটে, কিন্তু সব পথই ভাঙা বাড়ি আর উৎপাটিত বৃক্ষে পরিপূর্ণ। সে নিজে অনেকখানি ঘুরে দেখে এসেছে। নবীনকুমার বললো, বেশ, আমি তবে পায়ে হেঁটেই বেরুবো। তুই তৈরি হয়ে নে! দুলাল সভয়ে জিজ্ঞেস করলো, এমন দিনে কোতায় যাবেন, ছোটবাবু? নবীনকুমার বললো, যাবো বরানগরে। কাজ কম্মো কত্তে হবে না? সব কিছু দিনের পর দিন ফেলে রাখলে চলবে? —বরানগর? পায়ে হেঁটে? —কেন? যাওয়া যাবে না? কেউ যাচ্ছে না? সবাই কি ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে বসে আচে? যাওয়া যাবে না কেন, অনেকেই যায়। কিন্তু এ বাড়ির কোনো মানুষ কোনোদিন দিবাকালে পায়ে হেঁটে বেরিয়োচে নাকি? জোড়াসাঁকো থেকে বরানগর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাবেন ত পথের লোকজন চক্ষু কপালে তুলে বলবে না, ঐ যাচ্চেন রামকমল সিংগীর ছেলে নবীনকুমার সিংগী! এই জলকাদা আর আদাড় পগারের মধ্য দিয়ে উনি হেঁটে হেঁটে যাচ্চেন কি গো, বৈরিগী হয়েচেন নাকি? কারুর নিষেধই গ্রাহ্য করলো না। নবীনকুমার। তার চোখ-মুখের চেহারাই সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সে আবার আগেকার মতন জেদী ও চঞ্চল যুবা। ধুতিতে মালকোঁচা মেরে নিল, তার ওপর সাধারণ একটি কুতা, হাতে ছড়ি, পায়ে কালো বানিস করা পাম্প শু। নিচে নেমে এসে সে দুলালকে বললে, চ! লোকের মুখে শোনা কিংবা সংবাদপত্রের বিবরণ পাঠের সঙ্গেও চাক্ষুষ দেখার অনেক তফাত! যতটা সে কল্পনা করেছিল, ধ্বংসের রূপটি তার চেয়েও ভয়াবহ। একটি গৃহও বুঝি অক্ষত নেই। একটি বৃক্ষও হয়তো পুরোপুরি অটুট নয়। পথ চলা সত্যিই দুষ্কর। অতি প্রয়োজনে কোনো কোনো ভদ্র গৃহস্থ পাল্কী নিয়ে বার হয়েছিল, এরকম পথ দিয়ে চলা পাল্কী বেহারাদেরও অসাধ্য, মাঝপথে তারা সওয়ারি নামিয়ে দিয়েছে। পথ পরিষ্কার করা কিংবা আর্ত বিপন্নদের সাহায্য করার কোনো উদ্যোগই নেই সরকারের। কিংবা কে জানে, যাবতীয় উদ্ধারকার্য বুঝি চলছে সাহেব-পল্লীগুলিতে, নেটিভ টাউন বিষয়ে চিন্তা করার এখনো সময় আসেনি। নবীনকুমারের মনে হলো সমস্ত নগরীটিই একটি ধ্বংসস্তুপ। তার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো অন্য একটি চিত্র। যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু ঠুনকো সব খসে গেছে। আবার গড়ে উঠেছে এক নতুন দেশ, সুন্দর উজ্জ্বল। মানুষের মনে নতুন আশা। সব কিছুর সঙ্গে মানানসই করে নিতে হলে জীবনটাকেও তো নতুন করে নিতে হবে! প্ৰলয়ঙ্কর ঝড়ে কলকাতা নগরীর অন্যান্য বহু অট্টালিকার মতন ব্ৰাহ্ম সমাজের উপাসনা ভবনটিরও প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত এই ভবনটির একাংশ কাত হয়ে পড়েছে। ছাদ ভেঙে কড়ি-বরগা এমন খুলে ঝুলছে যে উত্তমরূপে মেরামত করার আগে ওখানে প্রবেশ করাই বিপজ্জনক। ঝড়ে শুধু উপাসনা ভবনটিই ভাঙেনি, সেই ধাক্কায় ব্রাহ্ম সমাজও ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। প্ৰবীণ দেবেন্দ্ৰবাবুর সঙ্গে জ্বলন্ত তেজী যুবা কেশবের মিলনে ব্রাহ্ম সমাজ নতুনভাবে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে। গুসকরা গ্রামের এক আম্রকুঞ্জে তাঁবুর মধ্যে রাত্ৰিবাস কালে দেবেন্দ্ৰবাবুর মনে যে বিদ্যুৎ চমক হয়েছিল তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেশব এই ধর্ম আন্দোলনটিকে স্থানীয় গণ্ডি থেকে করে এসেছেন এই নতুন ধর্ম মত। এখন সারা ভারতে ব্ৰাহ্ম সমাজের শাখার সংখ্যা পঞ্চাশ। দীক্ষিত ব্রাহ্মের সংখ্যা দু হাজারের কিছু বেশী। যারা দীক্ষা নেয়নি এমনও অনেকে এই মুক্ত-চিন্তা ও কালোপযোগী ধর্ম-সংস্কারের প্রতি আকৃষ্ট। পারিবারিক বাধা অগ্রাহ্য করে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ্যে মাঘ উৎসবে যোগ দিয়েছেন কেশব, এই উপলক্ষে চিরকালের মতন গৃহত্যাগ করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। তখন দেবেন্দ্রবাবুর সনির্বন্ধ অনুরোধে সস্ত্রীক তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সকলের এমন আন্তরিক, আপন—করা ব্যবহার যে, এ যে পরের বাড়িতে বাস, তা একদিনের তরেও বোঝা যায় নি। কেশবের স্ত্রী জগন্মোহিনীর কী-ই বা বয়েস। এর আগে কখনো সে থাকে নি কোনো অনাত্মীয়ের গৃহে।। কিন্তু দেবেন্দ্ৰবাবুর কন্যা ও পুত্রবধুরা তাকে একেবারে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নিয়েছিলেন। সকলে মিলে অন্দরমহলে কত আনন্দ-ফুর্তি। জগন্মোহিনীর তবু মন কেমন করে তার একেবারে ছোট ভাইটির জন্য। সে দুঃখও তিনি ভুলে যান দেবেন্দ্ৰবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রবিকে দেখে। রবির মুখে সদ্য আধো আধো বোল ফুটেছে, জগন্মোহিনী প্রায়ই তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রবির বড় ভাই সোম আর দেবেন্দ্ৰবাবুর এক নাতি সত্যও তার পায়ে পায়ে ঘোরে, এই শিশুরা তাঁকে মাচি বলে ডাকে। কিছুদিন ঠাকুরবাড়িতে থাকার পর কেশবের শরীরে একটি বিষম ফোঁড়া হলো। কার্বঙ্কল জাতীয়। দেবেন্দ্রবাবু খ্যাতনামা চিকিৎসকদের ডাকিয়ে চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখলেন না। তবু বেশ কিছুকাল শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন কেশব। তখন কেশবের আত্মীয়-স্বজন অনুতপ্ত হয়ে কাকুতি-মিনতি করে আবার কেশব ও জগন্মোহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কলুটোলার বাড়িতে। সেরে ওঠবার পর কেশব আবার বিপুল বিক্রমে লাগলেন ব্ৰাহ্ম সমাজের কাজে। প্রথম যৌবনে বিষয়-কার্যের প্রতি দেবেন্দ্ৰবাবুর মনে একটা খুব বিরাগের ভাব ছিল। তাঁর মনে হতো, নিত্য তিরিশ দিন অর্থ সম্পদের চিন্তা মানুষের নৈতিক উন্নতি ও ধর্ম সাধনার অন্তরায়। বিশেষত তাঁর পিতা অত্যন্ত বৈষয়িক বিলাস-আড়ম্বরপ্রিয় এবং ভোগী দ্বারকানাথকে দেখেই দেবেন্দ্রবাবু তার বিপরীতমুখী হয়েছিলেন। প্রায়ই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সুদূর, নির্জন শৈলশিখরে সুমহান প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে তিনি বেশী সান্ত্বনা পেতেন। কিন্তু এখন তিনি মধ্যবয়স্ক এবং একটি সুবৃহৎ পরিবারের অধিপতি। সাংসারিক ব্যয় বিপুল তো বটেই, তা ছাড়া ব্ৰাহ্ম আন্দোলন পরিচালনার জন্যও তাঁকে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এবং ইণ্ডিয়ান মিরার নামে ইংরেজি পাক্ষিকও চলে তাঁর
false
MZI
ভাল, যদি আগ্রহ দেখাতো তাহলে দুলি খালাকে সেটা বোঝাতে পারতাম বলে মনে হয় না! নাচের কম্পিটিশন হয়, গানের কম্পিটিশন হয় এমন কী কবিতা আবৃত্তির কম্পিটিশন হয়। তাই বলে গণিতের কম্পিটিশন? স্টোররুমে আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে সার্টিফিকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। মেডেলটা হাতে নিয়ে দেখলাম, তারপর সেগুলো তোশকের নিচে রেখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আম্মু, ভাইয়া কিংবা আপু কিছুই জানে না। কালকে নিশ্চয়ই খবরের কাগজে খবরটা ছাপা হবে, সেই খবরটা পড়ে আম্মু কী করবে? ভাইয়া আর আপুইবা কী করবে? তাদের সবার ধারণা আমি একজন অপদার্থ খারাপ ছেলে। আমাকে দিয়ে কিছু হবে না! খবরের কাগজে যখন দেখবে বাংলাদেশে আমার মতো গণিত কেউ জানে না—আমি হচ্ছি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন তখন তারা কী করবে? আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে হলো। স্কুল থেকে ডিবেটের টিম গিয়েছে, আমিও আছি সেই টিমে! আম্মু আমাকে নিয়ে গেছেন, বসেছেন দর্শকদের সাথে। ডিবেটে যখন আমাদের টিম জিতে গেলো তখন আম্মুর সে কী হাততালি। মেডেলটা নিয়ে যখন এসেছি আম্মু আমাকে ধরে সবার সামনে দুই গালে চুমু খেয়ে ফেললেন! বাসায় যখনই কেউ এসেছে সাথে সাথে তাদের আমার সেই মেডেলটা দেখিয়েছেন, এখন আমি বাংলাদেশের গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, দেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা গোল্ড মেডেল দিয়েছে কিন্তু আমি সেটা আম্মুকে বলতে পারছি না। আম্মু আর আপু বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। এখন ভাইয়ার গলাও শুনতে পাচ্ছি, তিনজনে মিলে টেলিভিশনে খবর শুনছে। আজকে মনে হয় ক্রিকেট খেলা ছিল, ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাসার সবার খুব উৎসাহ। যখনই ক্রিকেট খেলা হয় তখন সবাই মিলে সেটা দেখে। আমি অন্যমনস্কভাবে বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের খবরের ছিটে ছোটা শুনছিলাম হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলাম। টেলিভিশনে আজকের গণিত প্রতিযোগিতার কথা বলছে! আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত চলে এলাম ভাল করে শোনার জন্যে। দুলি খালা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি ফিসফিস করে বললাম, দুলি খালা, টেলিভিশনে আমাদের খবর বলছে। দুলি খালা তখন চুলো থেকে ডেকচিটা নামিয়ে হাত মুছে তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গেলো খবর শুনতে। আমি দরজায় কান লাগিয়ে খবরটা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম। আবছা আবছা শুনতে পেলাম খবরে বলছে, এই গণিত প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, আজকের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। তারাই একদিন বড় বিজ্ঞানী। এবং গণিতবিদ হয়ে এই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এই গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পেয়েছে হয় বিকে হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরিফুল ইসলাম তপু। খবর এক মুহূর্তের জন্যে। থেমে যায় এবং অনেক মানুষের হাততালি শোনা যেতে থাকে, এখন নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে আমাকে গোল্ড মেডেলটি দেয়া হচ্ছে! ইস! আমি যদি একবার দেখতে পারতাম! আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, অনুষ্ঠান শেষে একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানান আমি তখন হঠাৎ করে আমার নিজের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমি বলছি, না মানে আমি কখনই ভাবি নাই আমি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হব। সবাই ছয়টা সাতটা করে অঙ্ক করেছে আমি করেছি মাত্র একটা! আমি বুঝি নাই আমি যেটা করেছি সেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তবে অঙ্কটা কঠিন হলেও খুব মজার অঙ্ক ছিল। আমার করতে খুব মজা লেগেছে। আমার কথা যখন বলেছে তখন টেলিভিশনে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়েছে–কেমন দেখাচ্ছিল কে জানে! ইস যদি একবার দেখতে পারতাম! টেলিভিশনে আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানিয়েছে সে বড় হয়ে একজন সত্যিকার গণিতবিদ হতে চায়। সে জানায় তার সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তার বন্ধুবান্ধব, তার স্কুলের শিক্ষক এবং অবশ্যই তার পরিবারের সদস্যরা। খবরের মানুষটি বলল, এবারে খেলার খবর। তখন একটা বাজনা বাজতে লাগলো। এখন মনে হয় বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবে। আমি কিছুক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম, বসার ঘর থেকে আম্মু ভাইয়া বা আপুর কোন কথা শোনা যায় কী না সেটা শুনতে। কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না। সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। এই মুহূর্তে কী ভবছে তারা? আমি নিঃশব্দে আবার স্টোররুমে আমার বিছানায় ফিরে এলাম। অন্যদিন খাবার টেবিলে আম্মু ভাইয়া আর আপু হালকা গলায় একটু কথাবার্তা বলে আজকে আমি এটা কথাও শুনতে পেলাম না, একেবারে নিঃশব্দে তারা খেয়ে উঠে গেলো। আমি শুনতে পেলাম সবাই নিজের নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। ঠিক আধাঘণ্টা পরে বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। আমাদের বাসায় খুব বেশি কেউ আসে না–আম্মুর অফিসের লোকজন, ভাইয়া বা আপুর দুই একজন বন্ধুবান্ধব মাঝে মাঝে আসে। তারা অবশ্যি আরো আগে আসে–এখন একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। কলিংবেল শুনে দুলি খালা দরজা খুলে দিয়েছে, আমি একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কে এসেছে, কার কাছে এসেছে। কিছু বোঝার আগেই আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, রান্নাঘর হয়ে স্টোররুমে যে এসে হাজির তাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। ম্যাডামের হাতে একটা বিশাল ফুলের তোড়া। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্টোররুমে এসে চালের বস্তাটা ঠেলে সরিয়ে একটু জায়গা করে নোংরা মেঝেতে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো স্টোররুমের ছোট ঘুপচিতে ময়লা তোষক বিছিয়ে গুটিশুটি মেরে একজনের ঘুমানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আর ফুলের তোড়া নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসা আরো স্বাভাবিক
false
robindronath
তাহার কথা অল্প ছিল, এবং তাহার সঙ্গে কথা কহিতেই ভয় হইত–পাছে সামান্য কিছুতেই সে অপরাধ লয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাহার আশ্চর্য পরিবর্তন হইয়াছে। তাহার পাংশুবর্ণ কপোলে লাবণ্যের মসৃণতা দেখা দিল। তাহার চক্ষু এখন কথায় কথায় হাস্যচ্ছটায় নাচিয়া উঠে। আগে সে বেশভূষায় মনোযোগ দেওয়াকে চাপল্য, এমন-কি, অন্যায় মনে করিত। এখন কারো সঙ্গে কোনো তর্ক না করিয়া কেমন করিয়া যে তাহার মত ফিরিয়া আসিতেছে, তাহা অন্তর্যামী ছাড়া আর কেহ বলিতে পারে না। কর্তব্যবোধের দ্বারা ভারাক্রান্ত রমেশও বড়ো কম গভীর ছিল না। বিচারশক্তির প্রাবল্যে তাহার শরীর মন যেন মন্থর হইয়া গিয়াছিল। আকাশের জ্যোতির্ময় গ্রহতারা চলিয়া ফিরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কিন্তু মানমন্দির আপনার যন্ত্রতন্ত্র লইয়া অত্যন্ত সাবধানে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকে–রমেশ সেইরূপ এই চলমান জগৎসংসারের মাঝখানে আপনার পুঁথিপত্র যুক্তিতর্কের আয়োজনভারে স্তম্ভিত হইয়া ছিল, তাহাকেও আজ এতটা হালকা করিয়া দিল কিসে? সেও আজকাল সব সময়ে পরিহাসের সদুত্তর দিতে না পারিলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠে। তাহার চুলে এখনো চিরুনি উঠে নাই বটে, কিন্তু তাহার চাদর আর পূর্বের মতো ময়লা নাই। তাহার দেহে মনে এখনও যেন একটা চলৎশক্তির আবির্ভাব হইয়াছে। প্রণয়ীদের জন্য কাব্যে যে-সকল আয়োজনের ব্যবস্থা আছে, কলিকাতা শহরে তাহা মেলে না। কোথায় প্রফুল্ল অশোক-বকুলের বীথিকা, কোথায় বিকশিত মাধবীর প্রচ্ছন্ন লতাবিতান, কোথায় চূতকষায়কণ্ঠ কোকিলের কুহুকাকলি? তবু এই শুষ্ককঠিন সৌন্দর্যহীন আধুনিক নগরে ভালোবাসার জাদুবিদ্যা প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া যায় না। এই গাড়িঘোড়ার বিষম ভিড়ে, এই লৌহনিগড়বদ্ধ ট্রামের রাস্তায় একটি চিরকিশোর প্রাচীন দেবতা তাঁহার ধনুকটি গোপন করিয়া লালপাগড়ি প্রহরীদের চক্ষের সম্মুখ দিয়া কত রাত্রে কত দিনে কত বার কত ঠিকানায় যে আনাগোনা করিতেছেন, তাহা কে বলিতে পারে। রমেশ ও হেমনলিনী চামড়ার দোকানের সামনে, মুদির দোকানের পাশে, কলুটোলায় ভাড়াটে বাড়িতে বাস করিতেছিল বলিয়া প্রণয়বিকাশ সম্বন্ধে কুঞ্জকুটিরচারীদের চেয়ে তাহারা যে কিছুমাত্র পিছাইয়া ছিল, এমন কথা কেহ বলিতে পারে না। অন্নদাবাবুদের চা-রস-চিহ্নিত মলিন ক্ষুদ্র টেবিলটি পদ্মসরোবর নহে বলিয়া রমেশ কিছুমাত্র অভাব অনুভব করে নাই। হেমনলিনীর পোষা বিড়ালটি কৃষ্ণসার মৃগশাবক না হইলেও রমেশ পরিপূর্ণ স্নেহে তাহার গলা চুলকাইয়া দিত–এবং সে যখন ধনুকের মতো পিঠ ফুলাইয়া আলস্যত্যাগপূর্বক গাত্রলেহন দ্বারা প্রসাধনে রত হইত তখন রমেশের মুগ্ধদৃষ্টিতে এই প্রাণীটি গৌরবে অন্য কোনো চতুষ্পদের চেয়ে ন্যূন বলিয়া প্রতিভাত হইত না। হেমনলিনী পরীক্ষা পাস করিবার ব্যগ্রতায় সেলাইশিক্ষায় বিশেষ পটুত্ব লাভ করিতে পারে নাই, কিছুদিন হইতে তাহার এক সীবনপটু সখীর কাছে একাগ্রমনে সে সেলাই শিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। সেলাই-ব্যাপারটাকে রমেশ অত্যন্ত অনাবশ্যক ও তুচ্ছ বলিয়া জ্ঞান করে। সাহিত্যে দর্শনে হেমনলিনীর সঙ্গে তাহার দেনাপাওনা চলে–কিন্তু সেলাই-ব্যাপারে রমেশকে দূরে পড়িয়া থাকিতে হয়। এইজন্য সে প্রায়ই কিছু অধীর হইয়া বলিত, “আজকাল সেলাইয়ের কাজ কেন আপনার এত ভালো লাগে? যাহাদের সময় কাটাইবার আর কোনো সদুপায় নাই, তাহাদের পক্ষেই ইহা ভালো।” হেমনলিনী কোনো উত্তর না দিয়া ঈষৎ হাস্যমুখে ছুঁচে রেশম পরাইতে থাকে। অক্ষয় তীব্রস্বরে বলে, “যে-সকল কাজ সংসারের কোনো প্রয়োজনে লাগে, রমেশবাবুর বিধানমতে সেসেমস্ত তুচ্ছ। মশায় যত-বড়োই তত্ত্বজ্ঞানী এবং কবি হোন-না কেন, তুচ্ছকে বাদ দিয়া একদিনও চলে না।” রমেশ উত্তেজিত হইয়া ইহার বিরুদ্ধে তর্ক করিবার জন্য কোমর বাঁধিয়া বসে; হেমনলিনী বাধা দিয়া বলে, “রমেশবাবু, আপনি সকল কথারই উত্তর দিবার জন্য এত ব্যস্ত হন কেন? ইহাতে সংসারে অনাবশ্যক কথা যে কত বাড়িয়া যায়, তাহার ঠিক নাই।” এই বলিয়া সে মাথা নিচু করিয়া ঘর গণিয়া সাবধানে রেশমসূত্র চালাইতে প্রবৃত্ত হয়। একদিন সকালে রমেশ তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া দেখে, টেবিলের উপর রেশমের ফুলকাটা মখমলে বাঁধানো একটি ব্লটিং-বহি সাজানো রহিয়াছে। তাহার একটি কোণে ‘র’ অক্ষর লেখা আছে, আর-এক কোণে সোনালি জরি দিয়া একটি পদ্ম আঁকা। বইখানির ইতিহাস ও তাৎপর্য বুঝিতে রমেশের ক্ষণমাত্রও বিলম্ব হইল না। তাহার বুক নাচিয়া উঠিল। সেলাই জিনিসটা তুচ্ছ নহে, তাহা তাহার অন্তরাত্মা বিনা তর্কে, বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইল। ব্লটিং-বইটা বুকে চাপিয়া ধরিয়া সে অক্ষয়ের কাছেও হার মানিতে রাজি হইল। সেই ব্লটিংবেই খুলিয়া তখনি তাহার উপরে একখানি চিঠির কাগজ রাখিয়া সে লিখিল- “আমি যদি কবি হইতাম, তবে কবিতা লিখিয়া প্রতিদান দিতাম, কিন্তু প্রতিভা হইতে আমি বঞ্চিত। ঈশ্বর আমাকে দিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু লইবার ক্ষমতাও একটা ক্ষমতা। আশাতীত উপহার আমি যে কেমন করিয়া গ্রহণ করিলাম, অন্তর্যামী ছাড়া তাহা আর কেহ জানিতে পারিবে না। দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো। ইতি। চিরঋণী।” এই লিখনটুকু হেমনলিনীর হাতে পড়িল। তাহার পরে এ সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে আর-কোনো কথাই হইল না। বর্ষাকাল ঘনাইয়া আসিল। বর্ষাঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্যসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে–ওটা আরণ্যপ্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী; শহরের বাড়িগুলা তাহার রুদ্ধ বাতায়ন ও ছাদ লইয়া, পথিক তাহার ছাতা লইয়া, ট্রামগাড়ি তাহার পর্দা লইয়া বর্ষাকে কেবল নিষেধ করিবার চেষ্টায় ক্লেদাক্ত পঙ্কিল হইয়া উঠিতেছে। নদী-পর্বত-অরণ্য-প্রান্তর বর্ষাকে সাদর কলরবে বন্ধু বলিয়া আহ্বান করে। সেইখানেই বর্ষার যথার্থ সমারোহ-সেখানে শ্রাবণে দ্যুলোক-ভূলোকের আনন্দসম্মিলনের মাঝখানে কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু নূতন ভালোবাসায় মানুষকে অরণ্যপর্বতের সঙ্গেই একশ্রেণীভুক্ত করিয়া দেয়। অবিশ্রাম বর্ষায় অন্নদাবাবুর পাকযন্ত্র দ্বিগুণ বিকল হইয়া গেল, কিন্তু রমেশ-হেমনলিনীর চিত্তস্ফূর্তির কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না। মেঘের ছায়া, বজ্রের গর্জন, বর্ষণের কলশব্দ তাহাদের দুই জনের মনকে যেন ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিল। বৃষ্টির উপলক্ষে রমেশের আদালতযাত্রার প্রায়ই বিঘ্ন ঘটিতে লাগিল। এক-এক দিন সকালে এমনি চাপিয়া বৃষ্টি আসে যে, হেমনলিনী উদ্‌বিগ্ন
false
shorotchandra
কহিলেন, অদ্ভুত মানুষ এই ছেলেটি। ওকে দু-তিনদিনের বেশী দেখিনি, কিছুই জানিনে, তবু মনে হয় কি যেন এক সৃষ্টিছাড়া ধাতুতে ও তৈরি। তাকে নিয়ে এলে না কেন, ব্যাপারগুলো জিজ্ঞাসা করতাম। খবরের কাগজ থেকে ত সব বোঝা যায় না। কমল বলিল, না। কিন্তু তাঁর ফিরতে এখনও দেরি আছে। কেন? পাড়াটা এখনো নিঃশেষ হয়নি। যারা অবশিষ্ট আছে তাদের রওনা না করে দিয়ে তিনি ছুটি নেবেন না, এই তাঁর পণ। আশুবাবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, তা হলে তোমারই বা কি করে ছুটি হলো? আবার কি সেখানে ফিরতে হবে? নিষেধ করতে পারিনে, কিন্তু সে যে বড় ভাবনার কথা কমল! কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, ভাবনার জন্যে নয় আশুবাবু, ভাবনা আর কোথায় নেই? কিন্তু আমার ঘড়িতে যেটুকু দম ছিল সমস্ত শেষ করে দিয়েই এসেচি। সেখানে ফিরে যাবার সাধ্য আমার নেই। শুধু রয়ে গেলেন রাজেন্দ্র। এক-একজনের দেহ-যন্ত্রে প্রকৃতি এমনি অফুরন্ত দম দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয় যে, সে না হয় কখনো শেষ, না যায় কখনো বিগড়ে। এই লোকটি তাদেরই একজন। প্রথম প্রথম মনে হতো এই ভয়ানক পল্লীর মাঝখানে এ বাঁচবে কি করে? ক’দিনই বা বাঁচবে? সেখান থেকে একলা যখন চলে এলাম কিছুতেই যেন আর ভাবনা ঘোচে না, কিন্তু আর আমার ভয় নেই। কেমন করে যেন নিশ্চয় বুঝতে পেরেচি প্রকৃতি আপনার গরজেই এদের বাঁচিয়ে রাখে। নইলে দুঃখীর কুটীরে বন্যার মত যখন মৃত্যু ঢোকে তখন তার ধ্বংসলীলার সাক্ষী থাকবে কে? আজই হরেন্দ্রবাবুর কাছে আমি এই গল্পই করছিলাম। শিবনাথবাবুর ঘর থেকে রাত্রিশেষে যখন লজ্জায় মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এলাম— আশুবাবু এ বৃত্তান্ত শুনিয়াছিলেন, বলিলেন, এতে তোমার লজ্জার কি আছে কমল? শুনেচি তাঁকে সেবা করার জন্যেই তুমি অযাচিত তাঁর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলে,— কমল কহিল, লজ্জা সেজন্য নয় আশুবাবু। যখন দেখতে পেলাম তাঁর কোন অসুখই নেই—সমস্তই ভান, কোন একটা ছলনায় আপনাদের দয়া পাওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য, কিন্তু তাও সফল হতে পায়নি, আপনি বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন—তখন কি যে আমার হলো সে আপনাকে বোঝাতে পারব না। যে সঙ্গে ছিল তাকেও এ কথা জানাতে পারিনি,—শুধু কোনমতে রাত্রির অন্ধকারে সেদিন নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। পথের মধ্যে বার বার করে কেবল এই একটা কথাই মনে হতে লাগল, এই অতি ক্ষুদ্র কাঙাল লোকটাকে রাগ করে শাস্তি দিতে যাওয়ার না আছে ধর্ম, না আছে সম্মান। আশুবাবু বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, বল কি কমল, শিবনাথের অসুখটা কি শুধু ছলনা? সত্যি নয়? কিন্তু জবাব দিবার পূর্বেই দ্বারের কাছে পদশব্দ শুনিয়া সবাই চাহিয়া দেখিল নীলিমা প্রবেশ করিয়াছে। তাহার হাতে দুধের বাটি। কমল হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। সে পাত্রটা শয্যার শিয়রে তেপায়ার উপরে রাখিয়া দিয়া প্রতিনমস্কার করিল, এবং অপরের কথার মাঝখানে বাধা দিয়াছে মনে করিয়া নিজে কোন কথা না কহিয়া অদূরে নীরবে উপবেশন করিল। আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু এ যে দুর্বলতা কমল! এ জিনিস ত তোমার স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। আমি বরাবর ভাবতাম, যা অন্যায়, যা মিথ্যাচার, তাকে তুমি মাপ কর না। হরেন্দ্র কহিল, ওঁর স্বভাবের খবর জানিনে, কিন্তু মুচীদের পাড়ায় মরণ দেখে ওঁর ধারনা বদলেছে, এ সংবাদ ওঁর কাছেই পেলাম। আগে মনের মধ্যে যে ইচ্ছাই থাক, এখন কারও বিরুদ্ধেই নালিশ করতে উনি নারাজ। আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু সে যে তোমার প্রতি এতখানি অত্যাচার করলে তার কি? কমল মুখ তুলিতেই দেখিল নীলিমা একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। জবাবটা শুনিবার জন্য সেই যেন সবচেয়ে উৎসুক। না হইলে হয়ত সে চুপ করিয়াই থাকিত, হরেন্দ্র যতটুকু বলিয়াছে তার বেশী একটা কথাও কহিত না। কহিল, এ প্রশ্ন আমার কাছে এখন অসংলগ্ন ঠেকে। যা নেই তা কেন নেই বলে চোখের জল ফেলতেও আজ আমার লজ্জা বোধ হয়; যেটুকু তিনি পেরেচেন, কেন তার বেশী পারলেন না বলে রাগারাগি করতেও আমার মাথা হেঁট হয়। আপনাদের কাছে প্রার্থনা শুধু এই যে, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে তাঁকে আর টানাটানি করবেন না। এই বলিয়া সে যেন হঠাৎ শ্রান্ত হইয়া চেয়ারের পিঠে মাথা ঠেকাইয়া চোখ বুজিল। ঘরের নীরবতা ভঙ্গ করিল নীলিমা, সে চোখের ইঙ্গিতে দুধের বাটিটা নির্দেশ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, ওটা যে একেবারে জুড়িয়ে গেল। দেখুন ত খেতে পারবেন, না আবার গরম করে আনতে বলব? আশুবাবু বাটিটা মুখে তুলিয়া খানিকটা খাইয়া রাখিয়া দিলেন। নীলিমা মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া কহিল, পড়ে থাকলে চলবে না—ডাক্তারের ব্যবস্থা ভাঙতে আমি দেবো না। আশুবাবু অবসন্নের মত মোটা তাকিয়াটায় হেলান দিয়া কহিলেন, তার চেয়েও বড় ব্যবস্থাপক নিজের দেহ। এ কথা তোমারও ভোলা উচিত নয়। আমি ভুলিনে, ভুলে যান আপনি নিজে। ওটা বয়সের দোষ নীলিমা—আমার নয়। নীলিমা হাসিয়া বলিল, তাই বৈ কি! দোষ চাপাবার মত বয়স পেতে এখনো আপনার অনেক—অনেক বাকী। আচ্ছা, কমলকে নিয়ে আমরা একটু ও-ঘরে গিয়ে গল্প করি গে, আপনি চোখ বুজে একটুখানি বিশ্রাম করুন, কেমন? যাই? আশুবাবুর এ ইচ্ছা বোধ হয় ছিল না, তথাপি সম্মতি দিতে হইল; কহিলেন, কিন্তু একেবারে তোমরা চলে যেও না, ডাকলে যেন পাই। আচ্ছা। চল ঠাকুরপো, আমরা পাশের ঘরে গিয়ে বসি গে। এই বলিয়া সকলকে লইয়া চলিয়া গেল। নীলিমার কথাগুলি স্বভাবতঃই মধুর, বলিবার ভঙ্গীটিতে এমন একটি বিশিষ্টতা আছে যে সহজেই চোখে পড়ে, কিন্তু তাহার আজিকার এই গুটি-কয়েক কথা যেন তাহাদেরও ছাড়াইয়া গেল। হরেন্দ্র লক্ষ্য করিল না, কিন্তু লক্ষ্য
false
bongkim
শোবেন?” শ্রীশচন্দ্র বলিলেন, “এসো, আমরা সব পরিষ্কার করি |” অমনি শ্রীশচন্দ্র, রাজ, মজুর, ফরাস, মালী, যেখানে যাহার প্রয়োজন, সেখানে তাহাকে নিযুক্ত করিলেন। এদিকে কমলমণির দৌরাত্ম্যে ছুঁচা, বাদুড়, চামচিকে মহলে বড় কিচি মিচি পড়িয়া গেল; পায়রাগুলা “বকম বকম” করিয়া এ কার্ণিশ ও কার্ণিশ করিয়া বেড়াইতে লাগিল, চড়ুইগুলা পলাইতে ব্যাকুল–যেখানে সার্সি বন্ধ, সেখানে দ্বার খোলা মনে করিয়া, ঠোঁটে কাচ লাগিয়া ঘুরিয়া পড়িতে লাগিল; পরিচারিকারা ঝাঁটা হাতে জনে জনে দিকে দিকে দিগ্বিজয়ে ছুটিল। অচিরাৎ অট্টালিকা আবার প্রসন্ন হইয়া হাসিতে লাগিল। পরিশেষে নগেন্দ্র আসিয়া পঁহুছিলেন। তখন সন্ধ্যাকাল। যেমন নদী, প্রথম জলোচ্ছ্বাসকালে অত্যন্ত বেগবতী, কিন্তু জোয়ার পূরিলে গভীর জল শান্তভাব ধারণ করে, তেমনি নগেন্দ্রের সম্পূর্ণ-শোক-প্রবাহ এক্ষণে গম্ভীর শান্তিরূপে পরিণত হইয়াছিল। যে দু:খ, তাহা কিছুই কমে নাই; কিন্তু অধৈর্যের হ্রাস হইয়া আসিয়াছিল। তিনি স্থিরভাবে পৌরবর্গের সঙ্গে কথাবার্তা কহিলেন, সকলকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন। কাহারও সাক্ষাতে তিনি সূর্যমুখীর প্রসঙ্গ করিলেন না–কিন্তু তাঁহার ধীরভাব দেখিয়া সকলেই তাঁহার দু:খে দু:খিত হইল। প্রাচীন ভৃত্যেরা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গিয়া আপনা আপনি রোদন করিল। নগেন্দ্র কেবল একজনকে মন:পীড়া দিলেন। চিরদু:খিনী কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না। চতুশ্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ : স্তিমিত প্রদীপে নগেন্দ্রনাথের আদেশমত পরিচারিকারা সূর্যমুখীর শয্যাগৃহে তাঁহার শয্যা প্রস্তুত করিয়াছিল। শুনিয়া কমলমণি ঘাড় নাড়িলেন। নিশীথকালে পৌরজন সকলে সুষুপ্ত হইলে নগেন্দ্র সূর্যমুখীর শয্যাগৃহে শয়ন করিতে গেলেন। শয়ন করিতে না–রোদন করিতে। সূর্যমুখীর শয্যাগৃহ অতি প্রশস্ত এবং মনোহর উহা নগেন্দ্রের সকল সুখের মন্দির, এই জন্য তাহা যত্ন করিয়া প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ঘরটি প্রশস্ত এবং উচ্চ, হর্ম্যতল শ্বেতকৃষ্ণ মর্মর-প্রস্তরে রচিত। কক্ষপ্রাচীরে নীল পিঙ্গল লোহিত লতা-পল্লব-ফল-পুষ্পাদি চিত্রিত; তদুপরি বসিয়া নানাবিধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিহঙ্গমসকল ফল ভক্ষণ করিতেছে, লেখা আছে। একপাশে বহুমূল্য দারুনির্মিত হস্তিদন্তখচিত কারুকার্যবিশিষ্ট পর্যঙ্ক, আর এক পাশে বিচিত্র বস্ত্রমণ্ডিত নানাবিধ কাষ্ঠাসন এবং বৃহদ্দর্পণ প্রভৃতি গৃহসজ্জার বস্তু বিস্তর ছিল। কয়খানি চিত্র কক্ষপ্রাচীর হইতে বিলম্বিত ছিল। চিত্রগুলি বিলাতী নহে। সূর্যমুখী নগেন্দ্র উভয়ে মিলিত হইয়া চিত্রের বিষয় মনোনীত করিয়া এক দেশী চিত্রকরের দ্বারা চিত্রিত করাইয়াছিলেন। দেশী চিত্রকর এক জন ইংরেজের শিষ্য; লিখিয়াছিল ভাল। নগেন্দ্র তাহা মহামূল্য ফ্রেম দিয়া শয্যাগৃহে রাখিয়াছিলেন। একখানি চিত্র কুমারসম্ভব হইতে নীত। মহাদেব পর্বতশিখরে বেদির উপর বসিয়া তপশ্চরণ করিতেছেন। লতাগৃহদ্বারে নন্দী, বামপ্রকোষ্ঠার্পিতহেমবেত্র–মুখে এক অঙ্গুলি দিয়া কাননশব্দ নিবারণ করিতেছেন। কানন স্থির–ভ্রমরেরা পাতার ভিতর লুকাইয়াছে–মৃগেরা শয়ন করিয়া আছে। সেই কালে হরধ্যানভঙ্গের জন্য মদনের অধিষ্ঠান। সঙ্গে সঙ্গে বসন্তের উদয়। অগ্রে বসন্তপুষ্পাভরণময়ী পার্বতী, মহাদেবকে প্রণাম করিতে আসিয়াছেন। উমা যখন শম্ভুসম্মুখে প্রণামজন্য নত হইতেছেন, এক জানু ভূমিস্পৃষ্ট করিয়াছেন, আর এক জানু ভূমিস্পর্শ করিতেছে, স্কন্ধসহিত মস্তক নমিত হইয়াছে, সেই অবস্থা চিত্রে চিত্রিতা। মস্তক নমিত হওয়াতে অলকবন্ধ হইতে দুই একটি কর্ণবিলম্বী কুরুবক কুসুম খসিয়া পড়িতেছে; বক্ষ হইতে বসন ঈষৎ স্রস্ত হইতেছে, দূর হইতে মন্মথ সেই সময়ে, বসন্তপ্রফুল্লবনমধ্যে অর্ধলুক্কায়িত হইয়া এক জানু ভূমিতে রাখিয়া, চারু ধনু চক্রাকার করিয়া, পুষ্পধনুতে পুষ্পশর সংযোজিত করিতেছেন। আর এক চিত্রে শ্রীরাম জানকী লইয়া লঙ্কা হইতে ফিরিয়া আসিতেছেন; উভয়ে এক রত্নমণ্ডিত বিমানে বসিয়া, শূন্যমার্গে চলিতেছেন। শ্রীরাম জানকীর স্কন্ধে এক হস্ত রাখিয়া, আর এক হস্তের অঙ্গুলির দ্বারা নিম্নে পৃথিবীর শোভা দেখাইতেছেন। বিমানচতুষ্পার্শে নানাবর্ণের মেঘ,-নীল, লোহিত, শ্বেত,-ধূমতরঙ্গোৎক্ষেপ করিয়া বেড়াইতেছে। নিম্নে আবার বিশাল নীল সমুদ্রে তরঙ্গভঙ্গ হইতেছে–সূর্যকরে তরঙ্গসকল হীরকরাশির মত জ্বলিতেছে। এক পারে অতিদূরে “সৌধকিরীটিনী লঙ্কা __” তাহার প্রাসাদাবলীর স্বর্ণমণ্ডিত চূড়া সকল সূর্যকরে জ্বলিতেছে। অপর পারে শ্যামশোভাময়ী “তমালতালীবনরাজিনীলা” সমুদ্রবেলা। মধ্যে শূন্যে হংসশ্রেণী সকল উড়িয়া যাইতেছে। আর এক চিত্রে, অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করিয়া, রথে তুলিয়াছেন। রথ শূন্যপথে মেঘমধ্যে পথ করিয়া চলিছে, পশ্চাৎ অগণিত যাদবী সেনা ধাবিত হইতেছে, দূরে তাহাদিগের পতাকাশ্রেণী এবং রজোজনিত মেঘ দেখা যাইতেছে। সুভদ্রা স্বয়ং সারথি হইয়া রথ চলাইতেছেন। অশ্বেরা মুখোমুখি করিয়া, পদক্ষেপে মেঘ সকল চূর্ণ করিতেছে; সুভদ্রা আপন সারথ্যনৈপুণ্যে প্রীতা হইয়া মুখ ফিরাইয়া অর্জুনের প্রতি বক্রদৃষ্টি করিতেছেন; কুন্দদন্তে আপন অধর দংশন করিয়া টিপি টিপি হাসিতেছেন; রথবেগজনিত পবনে তাঁহার অলক সকল উড়িতেছে–দুই এক গুচ্ছ কেশ স্বেদবিজড়িত হইয়া কপালে চক্রাকারে লিপ্ত হইয়া রহিয়াছে। আর একখানি চিত্রে, সাগরিকাবেশে রত্নাবলী, পরিষ্কার নক্ষত্রালোকে বালতমালতলে, উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিতে যাইতেছেন। তমালশাখা হইতে একটি উজ্জ্বল পুষ্পময়ী লতা বিলম্বিত হইয়াছে, রত্নাবলী এক হস্তে সেই লতার অগ্রভাগ লইয়া গলদেশে পরাইতেছেন, আর এক হস্তে চক্ষের জল মুছিতেছেন, লতাপুষ্প সকল তাঁহার কেশদামের উপর অপূর্ব শোভা করিয়া রহিয়াছে। আর একখানি চিত্রে, শকুন্তলা দুষ্মন্তকে দেখিবার জন্য চরণ হইতে কাল্পনিক কুশাঙ্কুর মুক্ত করিতেছেন–অনসূয়া প্রিয়ম্বদা হাসিতেছে–শকুন্তলা ক্রোধে ও লজ্জায় মুখ তুলিতেছেন না–দুষ্মন্তের দিকে চাহিতেও পারিতেছেন না–যাইতেও পারিতেছেন না। আর এক চিত্রে, রণসজ্জিত হইয়া সিংহশাবকতুল্য প্রতাপশালী কুমার অভিমন্যু উত্তরার নিকট যুদ্ধযাত্রার জন্য বিদায় লইতেছেন–উত্তরা যুদ্ধে যাইতে দিবেন না বলিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া আপনি দ্বারে দাঁড়াইয়াছেন। অভিমন্যু তাঁহার ভয় দেখিয়া হাসিতেছেন, আর কেমন করিয়া অবলীলাক্রমে ব্যুহভেদ করিবেন, তাহা মাটিতে তরবারির অগ্রভাগের দ্বারা অঙ্কিত করিয়া দেখাইতেছেন। উত্তরা তাহা কিছুই দেখিতেছেন না। চক্ষে দুই হস্ত দিয়া কাঁদিতেছেন। আর একখানি চিত্রে সত্যভামার তুলাব্রত চিত্রিত হইয়াছে। বিস্তৃত প্রস্তরনির্মিত প্রাঙ্গণ, তাহার পাশে উচ্চ সৌধপরিশোভিত রাজপুরী স্বর্ণচূড়ার সহিত দীপ্তি পাইতেছে। প্রাঙ্গণমধ্যে এক অত্যুচ্চ রজতনির্মিত তুলাযন্ত্র স্থাপিত হইয়াছে। তাহার এক দিকে ভর করিয়া, বিদ্যুদ্দীপ্ত নীরদখন্ডবৎ, নানালঙ্কারভূষিত প্রৌঢ়বয়স্ক দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণ বসিয়াছেন। তুলাযন্ত্রের সেই ভাগ ভূমিস্পর্শ করিতেছে; আর এক দিকে নানারত্নাদিসহিত সুবর্ণরাশি স্তূপীকৃত হইয়া রহিয়াছে, তথাপি তুলাযন্ত্রের সেই ভাগ ঊর্ধ্বোত্থিত হইতেছে না। তুলাপাশে সত্যভামা; সত্যভামা প্রৌঢ়বয়স্কা, সুন্দরী, উন্নতদেহবিশিষ্টা, পুষ্টকান্তিমতী, নানাভরণভূষিতা, পঙ্কজলোচনা; কিন্তু
false
shunil_gongopaddhay
আকৃতিই বিশেষ উপযোগী। সস্ত্রীক আসবেন মহারাজ, তার বসবাসের জন্য খোলামেলা বাড়ি, সামনে থেকে সব দেখা যায়, এমনটি মানাত না। একটা অন্দরমহল দরকার। এই বেশ হল, সামনের দিকে শশিভূষণ থাকবেন, তাঁকে পাকাপাকিই এখানে থাকতে হবে, এরকমই মহারাজের নির্দেশ, একতলায় ত্রিপুরা রাজ্য-সরকারের একটি দফতরও খোলা হবে। পিছনের দিকটি হবে মহারাজের অন্দরমহল। বাড়িটি পুরোপুরি পরিদর্শন করার পর ছাদে এলেন শশিভূষণ। এক দিকে দেখা যায় আগাছা ভরা প্রান্তর ও জলাভূমি, খানিক দূরেই বড় টানা জালে মাছ ধরছে কয়েকজন জেলে। তার কাছেই ধানের খেত। আর সার্কুলার রোডের অন্য পারে অগণ্য নতুন নতুন গৃহ, এক একটি তিনতলা বাড়ি যেন আকাশচুম্বী। দশ-পনেরো বছর আগেও কলকাতায় এত উঁচু বাড়ি ছিল না। ভরতের কাঁধে হাত রেখে শশিভূষণ বললেন, এবার তোর জন্য একটা থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। ভরত চমকে উঠে বলল, আমার জন্য? আমি এই বাড়িতে থাকিব? শশিভূষণ হেসে বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এ বাড়িতে তোর আর পা দেওয়া দূরে থাক, এখানকার ত্রিসীমানার মধ্যেও তুই কখনও আসবি না। ত্রিপুরা থেকে কিছু কর্মচারী এসে এখানে থাকবে। তারা তোকে দেখলে চিনে ফেলতে পারে। আর মহারাজের নজরে পড়লে তোর ভাগ্যে আবার কী ঘটবে কে জানে। ত্রিপুরায় সরকারি ভাবে তুই মৃত, তা জানিস তো। অন্যান্য রাজকুমারদের মুখে আমি সেরকমই শুনেছি। তোর নামটা এখানে এসে বদল করলেই ভালো হত। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমি আরও একটা কথা চিন্তা করছি, ভরত। আমার বাড়িতেও বোধ হয় তোর আর থাকাটা ঠিক হবে না। মহারাজ খামখেয়ালি মানুষ রাজকীয় রীতিনীতি অনেক সময়ই মানেন না। তিনি হয়তো-বা কিংবা নিশ্চিতই কখনও আমার পৈতৃক বাড়ি দেখতে যেতে চাইবেন। ভরত বলল, তখন আমি লুকিয়ে থাকব? শশিভূষণ বললেন, মহারাজ, কবে বা কখন যাবেন, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমার আমন্ত্রণের তোয়াক্কা না করে নিজেই যদি হঠাৎ কোনও সকালে উপস্থিত হন? তুই মহারাজের চোখে না পড়লেও আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক রয়েছে, এটা কোনওক্রমে জানাজানি হয়ে গেল তোর বা আমার পক্ষে তা সুখকর হবে না। তুই অনেক দূরে, বাগবাজার-শ্যামবাজারের দিকে বাসা-ভাড়া করে থাকতে পারবি? ভরত তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিতে পারল না। শশিভূষণ বললেন, তোকে অর্থচিন্তা করতে হবে না। যতদিন পড়াশুনো চালিয়ে যেতে চাস চালিয়ে যাবি। তার পরও যতদিন না তোর নিজস্ব জীবিকার ব্যবস্থা হয়, ততদিন তুই বৃত্তি পাবি। তোর বাসা ভাড়াও আমি দিয়ে দেব। স্বাধীনভাবে ভরত একটি নিজস্ব বাড়িতে থাকবে, এতে তার খুশি হওয়ারই কথা। মণিভূষণের সঙ্গে তার বনিবনা হবে না কোনও দিন, শশিভূষণ না থাকলেই আবার যখন-তখন সংঘর্ষ বাধবো। ভরতের নিজস্ব হলে বন্ধুরা আসতে পারবে বিনা বাধায়, ইচ্ছেমতন রান্না করে খেতে পারবে। বাড়ির কাজের জন্য একটি লোক রেখে দিলেই চলবে। তবু ভরতের মনটা দমে গেল। ভূমিসূতার কী হবে? ভরত কথা দিয়েছিল, সে ভূমিসূতাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু ভূমিসূতাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেই বা কী করে। তা যে অসম্ভব! পরদিন থেকেই ভরতের জন্য বাসার খোজ শুরু হল। ভরত নিজেই একবার প্রস্তাব দিয়েছিল, মুসলমান পাড়া লেনের মেস বাড়িতে সে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শশিভূষণের মেস বাড়ি পছন্দ নয়, তা ছাড়া শিয়ালদা অঞ্চলটি বেশ কাছাকাছি হয়ে যায়। একজন উত্তর কলকাতায় বিডন স্ট্রিটের কাছে হরি ঘোষের গলিতে একটি ছোট বাড়ির সন্ধান দিল। একতলায় মশলার গুদাম, সেখানে সন্ধের পর একজন দারোয়ান ছাড়া আর কেউ থাকে না, দোতলায় দুখানি ঘর, অল্প একটু খোলা ছাদ। অতিশয় ভদ্র পল্লী। কাছাকাছি। কয়েকটি স্কুল ও কলেজ, সুন্দর পরিবেশ। বাড়িটির ভাড়া তেমন বেশি নয়, আট টাকা। আগে যে পরিবারটি সেখানে ভাড়া থাকত, তাদের মহিম ভৃত্যটি বেকার, সে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। তাকেই কাজের জন্য নিযুক্ত করা হল। সব কিছুই ঘটে গেল খুব দ্রুত। দুদিনের মধ্যেই বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে চলে যেতে হবে ভরতকে। ভূমিসূতা এখনও কিছুই জানে না। কী করে জানাবে তাকে। অন্দরমহল থেকে ভূমিসূতাকে ডেকে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। শশিভূষণ সব সময় কাছাকাছি থাকেন বলে ভূমিসূতাও কাজের ছলে ভরতের সামনে আসে না। ভূমিসূতাকে কিছু না জানিয়েই সে চলে যবে। এই অসহায় মেয়েটার হাত ধরে ভরত বলেছিল, আমি তোমার পাশে থাকব। এখন কাপুরুষের মত ভরত দূরে সরে যাবে। বই খাতা-পত্র বাণ্ডিল করে ভরত দড়ি দিয়ে বাঁধেছে আর মনে মনে বলছে, এই সময় ভূমিসূতা তাকে সাহায্য করার জন্য এলেও তো পারত। ভূমিসূতা লেখাপড়া জানে, তাকে ঠিকানা দিয়ে গেলে সে চিঠি লিখতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ কেন এসে পড়ছে না ভূমিসূতা! শশিভূষণের পাশাপাশি খেতে বসেছে ভরত, কৃষ্ণভামিনী পরিবেশন করছেন। একটু দূর থেকে ব্যঞ্জনের পাত্রগুলি এগিয়ে দিচ্ছে ভূমিসূতা। ভরত মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে, চোখাচোখি হলেও ভূমিসূতা কয়েক মুহূর্তেই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে সাহস পায় না। এই বাঘের বাসার মধ্যে কি শুধু দৃষ্টি বিনিময়েও কথা বলা যায়। কৃষ্ণভামিনীর নজর অতি তীক্ষ্ণ আঁচাবার সময় ভূমিসূতা শশিভূষণের হাতে জল ঢেলে দিল। সেটাই স্বাভাবিক। ভরত নিজেই জল নিচ্ছে, সে দেখতে পাচ্ছে ভূমিসূতার মুখের একটা পাশ। অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারি করল ভরত, যদি ছাদের কার্নিশে দেখা যায় ভূমিসূতাকে। কিন্তু পাশের ঘরে মণিভূষণ তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করছেন, তাই ভূমিসূতা এদিক পানে আসতেই ভরসা পায় না। ভূমিসূতা আশা করে আছে, শশিভূষণ নতুন বাড়িতে চলে গেলেই ভরতের সঙ্গে তার নিশ্চিন্তে দেখা
false
MZI
তখন আমাকে খুঁজে পাবে না। স্কুলে গিয়ে দেখে তখনো সবাই আসেনি। স্কুলের সামনে খোলা জায়গাটাতে সবাই হা-ড়ু-ড়ু খেলছে। একজন বুলবুলকে ডাকল, এই কুঁজা বুলবুল! আয় হা-ড়ু-ড়ু খেলবি। বুলবুল রাজি হলো না। তার শরীর পাখির পালকের মতো হালকা, সে কাউকে ধরে রাখতে পারে না। কাউকে জাপটে ধরলে তাকেসহ টেনে নিয়ে যায়। তা ছাড়া খালা তাকে বলেছে সে যেন কখনো কারো সাথে ধাক্কাধাক্কি করে। তার যে রকম পাখা আছে সেটা কাউকে জানতে দেয়া যাবে না, ঠিক সে রকম তার শরীর যে পাখির পালকের মতো হালকা সেইটাও কাউকে জানতে দেয়া যাবে না। বুলবুল স্কুলের সামনে পা ছড়িয়ে বসে খেলা দেখতে লাগল, তখন লিপি তার ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে হাজির হলো। বুলবুলের মতো লিপিরও খুব লেখাপড়া করার ইচ্ছা। তার ছোট ভাইকে দেখেশুনে রাখতে হয়, তারপরেও সে স্কুলে চলে আসে। লিপি বুলবুলের পাশে পা ছড়িয়ে বসে ছোট ভাইটাকে ছেড়ে দিল। ছোট ভাইটা ধুলোর মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে ছোট ছোট পিঁপড়া খুঁজে বের করতে থাকে। লিপি জিজ্ঞেস করল, বুলবুল, তুই অঙ্কগুলো করেছিস? বুলবুল মাথা নাড়ল। স্কুলের সবাই তাকে কখনো না কখনো কুঁজা বুলবুল ডেকেছে—লিপি ছাড়া। লিপি তাকে কখনো কুঁজা বুলবুল ডাকেনি। সে জন্যে বুলবুল লিপিকে একটু পছন্দই করে। লিপি বলল, আমাকে অঙ্কগুলো দেখাবি? বুলবুল তার খাতা বের করে লিপিকে দেখাল। লিপি সেগুলো দেখে দেখে নিজের অঙ্কগুলো মিলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের স্কুলের মালবিকা আপা এসে ঘরের তালা খুলে দিল। বুলবুল আর লিপি ভেতরে ঢুকে স্কুলঘরের জানালাটা খুলে দেয়। হোগলাপাতার মাদুরটা বিছিয়ে তাকের ওপর রাখা বইগুলো নামিয়ে আনতে খাকে। ততক্ষণে মাঠে খেলতে থাকা ছেলেগুলোও ক্লাসের ভেতরে এসে যার যার জায়গায় বসে গেছে। রোদে ছোটাছুটি করার কারণে একেকজন দরদর করে ঘামছে! মালবিকা আপা ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে বলল, সবাই এখন শান্ত হয়ে বস। আমরা আমাদের ক্লাস শুরু করি। বাচ্চাগুলো শান্ত হওয়ার খুব একটা লক্ষণ দেখাল না। আপা খালি জায়গাগুলো দেখিয়ে বলল, জলিল, মাহতাব আর কামরুল কই? একজন বলল, কামরুল বাবার সাথে মাঠে কাম করে। আরেকজন বলল, জলিলের জ্বর। বুলবুলের ভাসা ভাসাভাবে মনে পড়ল সে মাহতাবকে নদীর পানিতে দাপাদাপি করতে দেখেছে, কিন্তু সেটা নিয়ে সে নালিশ করল না। আপা জিজ্ঞেস করল, জলি আর আমিনা? লিপি বলল, মনে হয় তারা লেখাপড়া করতে চায় না। আপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে সবাইকে বই খুলতে বলল। বাচ্চাগুলো। বই খুলতে থাকে, প্রথমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার উপকারিতা নিয়ে একটা গল্প। তারপর লালপরী নীলপরী নিয়ে একটা কবিতা। কবিতার প্রথম চার লাইন মুখস্থ করতে দিয়ে আপা সবার অঙ্ক খাতাগুলো দেখতে শুরু করে দিল। বুলবুল কবিতা মুখস্থ করতে করতে লালপরী নীলপরীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে আকাশে উড়ছে, তাদের পেছনে প্রজাপতির পাখার মতো পাখা। অঙ্ক খাতাগুলো বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিয়ে আপা তাদের পড়া ধরতে শুরু করল। নখ কেন কাটতে হয়, খাবার আগে কেন হাত ধুতে হয়—এসব শেষ। করে সবাইকে লালপরী নীলপরী কবিতার প্রথম চার লাইন জিজ্ঞেস করতে লাগল। সবারই মোটামুটি মুখস্থ হয়েছে তারপরেও একটা-দুইটা শব্দ তাদের বলে দিতে হলো। শুধু বুলবুলকে কিছু বলে দিতে হলো না, সে এক নিঃশ্বাসে পুরো চার লাইন কবিতা মুখস্থ বলে গেল। আপা খুশি হয়ে বলল, ভেরি গুড বুলবুল। দুষ্টু একটা মেয়ে ফিসফিস করে বলল, কুঁজা মিয়া গুডি গুড। বুলবুল কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে, লিপি তখন হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, আপা। বল লিপি। পরী কি আসলেই আছে? আপা উত্তর দেয়ার আগেই সব ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, আছে! আছে! আপা হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কেমন করে জান পরী আছে? একজন বলল, তার মা একদিন জোছনা রাতে বের হয়েছিল, তখন দেখেছে একটা গাছের ওপর থেকে পরী উড়ে উড়ে নেমে এসেছে। আরেকজন সেই গল্পটা সমর্থন করে বলল, পূর্ণিমার রাতে একটা বড় দিঘিতে সব পরী গোসল করতে আসে। কাপড়গুলো দিঘির ঘাটে খুলে রেখে তারা ন্যাংটা হয়ে দিঘিতে গোসল করে। এই সময় দুষ্ট কয়েকটা ছেলে একজন আরেকজনের দিকে অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে তাকিয়ে হি হি করে হাসতে থাকে। মালবিকা আপা দেখেও না দেখার ভান করল। লিপি জিজ্ঞেস করল, পরীরা শুধু জোছনা রাতে আসে কেন? এর কোনো সদুত্তর ছিল না, একজন বলল, আসলে পরীদের যখন খিদে লাগে তখন তারা জোছনার আলো খায়।। বুলবুল এইবারে একটু আপত্তি করল। বলল, জোছনা আবার কেমন করে খায়? যে বলেছে পরীরা জোছনার আলো খেয়ে বেঁচে থাকে সে গলা উঁচিয়ে বলল, তার নানি নিজের চোখে দেখেছে যে একদিন জোছনা রাতে অনেকগুলো পরী উঠানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কপকপ করে জোছনা খাচ্ছে। এ রকম অকাট্য প্রমাণ দেয়ার পর সেটা অবিশ্বাস করবে কেমন করে?। সবাই তখন মাথা নেড়ে সেটা মেনে নিল। আরেকজন বলল, পরীদের চামড়া হয় খুব নরম, সূর্যের আলো লাগলে চামড়া পুড়ে যায় তাই তারা কখনো দিনের বেলা বের হয় না। বুলবুল তখন মুখ শক্ত করে বলল, তাহলে দিনের বেলা পরীরা কোথায় থাকে? পরীদের দেশে। সেইটা কোথায়? আকাশের উপরে। অনেক দূরে। লিপি তখন হাত তুলে আবার জিজ্ঞেস করল, আপা। বল। ছেলে পরী কি আছে? কেউ কিছু বলার আগেই বুলবুল বলল, আছে। বুলবুলের কাছে বসে থাকা একজন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আছে। ছেলে পরীদের বলে জিন।
false
shunil_gongopaddhay
খাবার পাওয়া যাবে না, জলও পাওয়া যাবে না। অন্যরা সহ্য করতে পারলেও কয়েকটা বাচ্চা আছে। তারা কী করে সহ্য করবে? খবরের কাগজে কাকাবাবু অনেক হাইজ্যাকিং-এর ঘটনা পড়েছেন। কিন্তু নিজের কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তিনি বুঝতে পারছেন, এখানে প্রতিবাদ জানাবার উপায় নেই। মুখ বুজেই থাকতে হবে। দেখা যাক, এর পর কী হয়! কাকাবাবু আবার মহাভারত খুললেন। খানিক পর খেয়াল হল, তিনি বইয়ের দিকে তাকিয়েই আছেন শুধু, পড়ছেন না। এই সময় কি বইয়ে মন বসানো যায়? জানলা দিয়ে দেখলেন, মারাত্মক সব অস্ত্র নিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যরা। প্লেনটাকে ঘিরে ফেলেছে। ইচ্ছে করলে ওরা প্লেনটাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু তাতে এত যাত্রীরও প্রাণ যাবে। এই যাত্রীদের প্রাণ নিয়েই দরাদরি চলছে। এই হাইজ্যাকাররা যে কী চায়, সেটাই তো জানা যাচ্ছে না। সাধারণত ওরা ওদের দলের কিছু বন্দির মুক্তি চায়। তারপর প্লেনটা নিয়ে উড়ে যেতে চায় অন্য দেশে। কেটে গেল প্রায় একঘণ্টা। কেউ ফিসফিস করেও কথা বলছে না। আবার একটি লোক উঠে দাঁড়াল। লোকটি বেশ লম্বা আছে, সুন্দর চেহারা। মাথা নাড়তে নাড়তে সে পাগলের মতো বলতে লাগল, আমি আর পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। আমাকে নামতেই হবে। নামতে দাও! বন্দুকধারী ধমক দিয়ে বলল, সিট ডাউন! সিট ডাউন! লোকটি তবু বলল, না, বসব না। বসে থাকতে পারছি না। আই মাস্ট গো! বন্দুকধারী এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুমি যাবেই। বেশ, তোমাকে যাওয়াচ্ছি। কাছে এগিয়ে এসে সে লোকটির বুকে বন্দুকটি ঠেকিয়ে বলল, একটা গুলি! তাতেই তোমার প্রাণপাখিটা বেরিয়ে যাবে। তারপর উড়ে উড়ে বাইরে চলে যেয়ো! লোকটি বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে বলল, তাই করো। আমাকে গুলি করো। তবু আমি বসে থাকব না! বোঝাই যাচ্ছে, দুশ্চিন্তায় লোকটির মাথার গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে। অন্য একজন হাইজ্যাকার ওর পিছনে এসে নিজের দড়িটা দিয়ে চট করে ওই লোকটির গলায় ফাঁস পরিয়ে দিল। তারপর প্যাঁচাতে লাগল দড়িটা। লোকটি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল। হাইজ্যাকারটি দড়ির প্যাঁচ যত শক্ত করতে লাগল, ততই লোকটির চিৎকারও বাড়তে লাগল। তারপর একসময় ধপ করে পড়ে গেল মেঝেয়। মরে গেল? কিংবা অজ্ঞানও হতে পারে। এই দৃশ্য দেখে রাগে কাকাবাবুর শরীর জ্বলছে। তিনি উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, অতি কষ্টে দমন করলেন নিজেকে। প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকেও ওরকমভাবে মারবে। তিনজন এয়ার হোস্টেস দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো। বোধহয় তাদের চোখের পাতাও পড়ছে না একবারও। একটু পর ককপিট থেকে বেরিয়ে এলেন পাইলট আর কো-পাইলট। তাঁদের পিছনে রিভলবার উঁচিয়ে একজন হাইজ্যাকার। এবার প্লেনের দরজা খুলে গেল, পাইলট দুজনকে নামিয়ে দেওয়া হল। সিঁড়ি দিয়ে। দরজাটা খোলাই রইল। কী ব্যাপার হল, বোঝাই যাচ্ছে না। বাচ্চা দুটো কেঁদেই চলেছে, নিশ্চয়ই ওদের খিদে পেয়েছে। আজকাল প্লেনে জলের বোতল নিয়ে ওঠা যায় না। এখানেও জল দেওয়া হচ্ছে না। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে? দড়ি হাতে হাইজ্যাকার দুটো সিগারেট টেনেই চলেছে। আর যার হাতে এ কে ফর্টি সেভেনের মতো মারাত্মক বন্দুক, সে তার অস্ত্রটা এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে অনবরত। যেন যে-কোনও মুহূর্তে সে যাকে-তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। একসময় দড়িধারীদের একজনের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে কী সব কথা বলল দু-তিন মিনিট ধরে। তারপর সে ফোনটা নিয়ে গেল অস্ত্রধারীর কানের কাছে। সে-ও একটুক্ষণ শোনার পর বলল, ওকে, ওকে! এবার সে চেঁচিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশে বলল, হিয়ার ইজ অ্যান অ্যানাউন্সমেন্ট। সবাই মন দিয়ে শোনো। এখন আমরা যাত্রীদের মধ্যে থেকে কুড়িজনের মতো ব্যাচকে ছেড়ে দেব। আমরা যাদের বেছে নেব, তারা ছাড়া আর কেউ সিট ছেড়ে উঠবে না। কেউ কোনও কথা বলবে না! যাদের নামিয়ে দেব, তারাও লাইন বেঁধে যাবে, কেউ দৌড়োবে না। একটু এদিক-ওদিক হলেই আমরা গুলি চালাব। ক্লিয়ার? এবার সে এলোপাথাড়িভাবে এক-একজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, ইউ গেট আপ! ইউ! ইউ! একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ওয়াইফ, সে যাবে না? অস্ত্রধারী বলল, শাট আপ! নো ওয়াইফ! স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে একজন থাকলে আর-একজন যাবে, তা কি হয় নাকি? কিন্তু এরা যে কোনও কথাই শুনবে না। কাকাবাবু আশা করলেন, বাচ্চার মা দুজনকে নিশ্চয়ই এরা ছেড়ে দেবে! কী আশ্চর্য ব্যাপার, সেই মা দুজনের দিকে অস্ত্রধারী আঙুল দেখাল না, নম্বর গুনতে গুনতে কুড়ি নম্বরে এসে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, অ্যান্ড ইউ! কাম! কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে খুবই বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের একটা অনুরোধ করতে পারি? আমার বদলে যদি ওই বাচ্চাদের মায়েদের ছেড়ে দেন, খুব ভাল হয়। ওরা কষ্ট পাচ্ছে। আমি আরও অপেক্ষা করতে পারি, আমার কোনও অসুবিধে নেই। লোকটি প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, শাট আপ! বলেছি না, কেউ কোনও কথা বলবে না! কাকাবাবু তবু দাঁড়িয়ে রইলেন। দড়ি হাতে যে-দুজন কাকাবাবুর পাশে বসে ছিল, তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে বলল, কেন সময় নষ্ট করছিস! বেরিয়ে আয়। কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো পাশে রাখা ছিল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রাচ দুটো নেওয়ার চেষ্টা করতেই সে আবার দাঁত খিচিয়ে বলল, নো! ওসব নেওয়া চলবে না। কেউ হ্যান্ডব্যাগও নিতে পারবে না। লাইনে এসে দাঁড়াও! কাকাবাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন দরজার দিকে। কয়েকটা রো পরেই অরুণকান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। তাঁর মুখে একটা দারুণ অসহায় ভাব। কাকাবাবু আর বাকি উনিশজন যেন লটারি জিতেছেন। বাকি যাত্রীদের ভাগ্যে যে কী
false
MZI
হঠাৎ করে সবার কাছে সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছে। তখন রাতারাতি মহাকাশযানের বিচিত্র জটিল সেই নৃশংস অমানবিক জীবনটি পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে। মহাকাশচারীদের আবার শীতল ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ না করে স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে। মহাকাশযানটিতে আবার সেই ভুতুড়ে নৈঃশব্দ নেমে এসছে। পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আবার সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে, প্রাণচাঞ্চল্যে আবার ভরপুর হয়ে উঠবে এই বিশাল মহাকাশযান। পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ নিয়ে গ্রাউল সবার কাছে মিথ্যে তথ্য দিয়ে। আসছিল। পৃথিবীর মানুষ নিজেদের মাঝে হানাহানি করছে সেটি সত্যি নয়। হানাহানি করার জন্যে পৃথিবীতে এখন কোনো মানুষ নেই। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় সমস্ত পৃথিবী বাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, প্রায় দুই হাজার বছর আগে শেষ মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে গ্রহান্তরে পাড়ি দিয়েছে। এই দুই হাজার বছর প্রকৃতি নিজের হাতে পৃথিবীকে আবার মানুষের বাসের যোগ্য করে গড়ে তুলেছে। আবার সেখানে নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজ বনারণ্য গড়ে উঠেছে। আমরা সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে মানব জীবন শুরু করব। পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক ভাবে বাইরে তাকিয়েছিলাম, লেন এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম, তার ঝকঝকে খাপ খোলা চেহারা দেখে আবার আমার বুকের ভেতর এক ধরণের বেদনা বোধ হতে থাকে। লেন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ? না। কিছু না। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা বেঁচে আছি। আমি হেসে বললাম, আসলে আমরা বেঁচে নেই। এই পুরো ব্যাপারটা আসলে মহামতি গ্রাউলের অত্যাশ্বর্য মস্তিষ্কের একটা স্বপ্ন দৃশ্য। এক্ষুনি তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তখন– লেন আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, দোহাই তোমার। গ্রাউলের কথা বল না। সে কেমন আছে শুনবে না? না, শুনতে চাই না। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। পুরোপুরি উন্মাদ— লেন কাতর গলায় বলল,আমি শুনতে চাই না। আমি লেনকে নিজের কাছে টেনে এনে বললাম, কেন শুনতে চাও না? কী আশ্চর্য শক্তিতে তুমি তাকে পরাস্ত করে পুরো মহাকাশযান আর তার হাজার হাজার মহাকাশচারীকে রক্ষা করেছ সেটা শুনবে না? না। আমি শুনব না। আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই। ঠিক তখন পিছনে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হল এবং সাথে সাথে একাধিক শিশুর উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল। লেনের মুখে অধৈর্যের একটা ছায়া পড়ে, সে কাতর গলায় বলল, ঐ দেখ আবার শুরু করল ওরা! কী করি ওদের নিয়ে বল তো? আমি হেসে বললাম, মানুষের এক সাথে একটি করে সন্তান থাকার কথা। সেই একটি সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে বাবা মায়ের কালো ঘাম ছুটে যায়। তোমার সন্তান হচ্ছে আটটি। এই সমস্যার কোন সমাধান নেই লেন। এর আগে কথা জানত না তখন তবু সামলে দেয়া যেত। এখন ওরা কথা শিখেছে ওদেরকে আর কোনভাবে সামলে নেয়া যাবে না। তুমি কিছুদিনে পাগল হয়ে যাবে লেন! আমি একা কেন? তুমিও পাগল হয়ে যাবে। হ্যাঁ। আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাব– আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি হুঁটোপুটি করতে করতে আমাদের কাছে হাজির হল। তারা কয়েকজন মিলে একজনকে নিচে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, যারা ফেলছে এবং যাকে ফেলছে সবারই একধরনের বিচিত্র উল্লাস হচ্ছে বলে মনে হয়। লেন বৃথাই তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে? খেলছি। কী খেলছ? খেলছি আমরা পৃ’তে গিয়েছি। পু? হ্যাঁ। পৃ মানে পৃথিবী! আমি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এই শিশুরা আমাদের জন্যে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবে। ভালবাসাময় আনন্দের একটা পৃথিবী। নতুন পৃ। ———- একাকী কিশোর সুহান হাতের উপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের রং নীলাভ কিন্তু নীল নয়। স্বচ্ছ কাচের মতো। পৃথিবীর আকাশ নাকি নীল। গাঢ় নীল। সে কখনো পৃথিবী দেখে নি কিন্তু তবু সে জানে। তাকে ট্ৰিনি বলেছে। ট্ৰিনি তাকে আরো অনেক কিছু বলেছে। পৃথিবীর নীল আকাশে নাকি সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। কখনো কখনো সেই মেঘ নাকি পুঞ্জীভূত হয়ে আসে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যায়, তারপর নাকি আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি জন্ম দেয় গাছ। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর গাছ নাকি সবুজ। গাঢ় সবুজ। সেই গাছে নাকি ফুল হয়। বিচিত্র রঙিন সব ফুল। ট্ৰিনি সব জানে। ট্রিনিকে পৃথিবীতে তৈরি করা হয়েছিল, তার কপোট্রনের ক্রিস্টাল ডিস্কে পৃথিবীর সব খবর রাখা আছে। ট্ৰিনি একটু একটু করে সুহানকে সব বলেছে। সুহান জানতে চায় না, তবু সে বলেছে। সুহানকে নাকি জানতে হবে। সুহান মানুষ। মানুষের জন্মগ্রহ পৃথিবী। তাই সব মানুষকে নাকি পথবীর কথা জানতে হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর কথা ভাবতে হয়। সুহান তাই পাথরের উপর শুয়ে শুয়ে কখনো কখনো পৃথিবীর কথা ভাবে। ভাবতে চায় না, তবু সে ভাবে। ট্ৰিনি বলেছে, তাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে, মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে তাকে সত্যিকার মানুষের মতো হতে হবে। যদি কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হয় তারা যেন সুহানকে দেখে চমকে না ওঠে। ভয় পেয়ে চিৎকার না করে ওঠে। সুহান এক সময় ট্রিনির কথা বিশ্বাস করত। ভাবত, সত্যিই বুঝি তার একদিন মানুষের সাথে দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে সব ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু তার মানুষের সাথে দেখা হয় নি। সে জানে কোনোদিন মানুষের সাথে তার দেখা হবে না। স্বচ্ছ কাচের মতো নীলাভ আকাশের
false
humayun_ahmed
দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কপালের খানিকটা চোখে পড়ছে। সে একেবারেই নড়াচড়া করছে না। তৌহিদার পাশে হাবিবুর রহমান বসেছেন। তার কপাল ঘামছে। তিনি কেন জানি ভয়ে অস্থির হয়ে আছেন। ডাক্তারের এই ঝামেলা শেষ হলে বাঁচেন এমন অবস্থা। ডাক্তার এবং উকিলের কাছে কিছু লুকানো যায় না। তাদেরকে সব সত্যি কথা বলতে হয়। হাবিবুর রহমান বুঝতে পারছেন না সব সত্যি কথা তিনি বলতে পারবেন কি-না। ডাক্তার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে। মানুষটা কঠিন প্রকৃতির। রোগীদের সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। ভদ্রলোক সারাক্ষণই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে রেখেছেন। ডাক্তার তৌহিদার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, নাম কী? তৌহিদা সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট স্বরে বলল, বলব না। কেন বলবেন না? নাম বলতে ভালো লাগে না। কী করতে ভালো লাগে? পান খেতে ভালো লাগে। এই বলেই সে হাবিবুর রহমানের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ভাইজান, জর্দা দিয়ে পান খাব। হাবিবুর রহমান বিনীত ভঙ্গিতে ডাক্তারকে বললেন, স্যার, এর পান খাবার অভ্যাস ছিল না। অসুখের পর থেকে পান খায়। আর স্যার এর নাম তৌহিদা। তৌহিদা খানম। তৌহিদা বলল, মতিন ভাই শুধু ডাকেন তৌ। ডাক্তার বললেন, মতিন ভাই কে? হাবিবুর রহমান বললেন, আমার শ্যালক। ডাক্তার বললেন, আপনার বাসায় তার যাতায়ত আছে? জি আছে। তবে কম। মাসে দুই মাসে একবার। ডাক্তার তৌহিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, মতিন সাহেবকে কি আপনার ভালো লাগে? তৌহিদা বলল, আমি পান খাব। জর্দা দিয়ে পান খাব। আপনার এখানে পান নাই? ডাক্তার হাবিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি একটা কাজ করুন। জর্দা দেয়া পান কিনে আনুন। পান কিনে এনে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করবেন। আমি না ডাকা পর্যন্ত আসবেন না। আমি ততক্ষণ রোগীর সঙ্গে কথা বলব। হাবিবুর রহমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে ছিলেন কখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করে বসে রোগী কি বিবাহিত? কার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে? বিবাহ কবে হয়েছে? যখন শুনবে হাবিবুর রহমানের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে তখন হুট করে জিজ্ঞেস করবে আপনার সঙ্গে কি আপনার স্ত্রীর যৌন মিলন হয়েছে? মানসিক রোগের ডাক্তারদের মুখে কোনো পর্দা থাকে না। অশ্লীল কথা তারা হুটহাট করে জিজ্ঞেস করে। হাবিবুর রহমান চারটা জর্দা দেয়া পান কিনলেন। নিজে একটা মুখে দিলেন। বাকি তিনটা পকেটে রাখলেন। চারটা সিগারেট কিনে একটা ধরালেন। তিনি আগে সিগারেট খেতেন না। সিগারেট খেলে টেনশন কমে এই ভেবে সিগারেট ধরিয়েছিলেন। তার টেনশন কিছুমাত্র কমে নি। মাঝখান থেকে সিগারেটের অভ্যাস হয়ে গেছে। তৌহিদার মতো ভয়াবহ রোগী ঘরে থাকলে টেনশন কীভাবে কমে? তাকে দেখাশোনা করার তৃতীয় ব্যক্তি নেই। সালেহা পুরোপুরি শয্যাশায়ী। একটা ছুটা কাজের মেয়ে আছে, সকালে এসে হাঁড়ি বাসন মেজে ঘর ঝাট দিয়ে চলে যায়। তাকে চোখে চোখে রাখতে হয়। কারণ এই মেয়ের অভ্যাস যাবার সময় শাড়ির কোচড়ে করে চাল ডাল নিয়ে যাওয়া। গত সাতদিন থেকে হাবিবুর রহমানের ঘরে রান্নাবান্না হচ্ছে না। তৌহিদার এই অবস্থা, কে রাঁধবে? হাবিবুর রহমানের ব্যবসা-বাণিজ্য মাথায় উঠেছে। বেশির ভাগ সময় তাকে বাসায় থাকতে হয়। যখন বাইরে যান তখন তৌহিদাকে তার ঘরে তালাবন্ধ করে যান। তৌহিদা তাতে কোনো আপত্তি করে না। সে আগে যেমন শান্ত মেয়ে ছিল এখনো তাই আছে। যত শান্তই হোক মাথা খারাপ মানুষের কোনো ঠিক নেই। কোনো একদিন দেখা যাবে কাপড়চোপড় ছাড়া রাস্তায় বের হয়ে পড়েছে। রাস্তার মানুষজন মজা পাচ্ছে। ভ্যাকভ্যাক করে হাসছে। হাবিবুর রহমান দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেন। পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে মতিনের নাম্বার বের করে আবার চেষ্টা করলেন। রিং হলো না। গত পাঁচদিন ধরে তিনি মতিনের খোঁজ বের করার চেষ্টা করছেন। লাভ হচ্ছে না। একদিন তার বেঙ্গল মেসে গিয়ে দরজার নিচ দিয়ে চিরকুট ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছেন– বিরাট বিপদে আছি সাক্ষাতে কথা হবে। বাসায় এসো। জরুরি। তারপরেও মতিন আসে নি। বিপদের সময় আত্মীয়স্বজন না এলে কখন আসবে? জন্মদিনের অনুষ্ঠানে! মতিনের সন্ধান পাওয়া গেলে তাকে কিছুদিনের জন্যে স্থায়ীভাবে বাসায় এনে রাখা যেত। তার সঙ্গে পরামর্শ করা যেত। পরামর্শ করার জন্যে নিজের লোক লাগে। যার তার সঙ্গে পরামর্শ করা যায় না! পরামর্শ করার বিষয় অনেক আছে। হাবিবুর রহমান অনেক ঝামেলা করে লৌহজং-এর কবিরাজ হৃষিকেশ ভট্টাচার্য (ভৈষজ্য ধন্বন্তরী, সাহিত্য শ্রী) সাহেবের কাছ থেকে পাগলের তেল আনিয়েছেন। তেলের নাম উন্মাদ ভঞ্জন কনক তৈল। এই তেল তৌহিদার মাথায় দেয়া যাবে কি-না তা নিয়ে পরামর্শ। তেল মাথায় দেবার আগে মাথার সব চুল ফেলে দিতে হবে। এটা করা কি ঠিক হবে? তিনি সালেহার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। সালেহা বলেছেন, অসম্ভব। সালেহার পরামর্শ গ্রাহ্য না। কারণ মহাবিপদে নারীর পরামর্শ নিতে নাই। শাস্ত্রের কথা। কনক তেলের জন্যে যাওয়া আসা বাদেই তাকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এক ফাইল পাঁচশ টাকা। তিনি দুই ফাইল কিনেছেন। কবিরাজ সাহেব বলেছেন এক ফাইল। ওষুধেই কাজ হবে। তারপরেও তিনি দুই ফাইল কিনেছেন। যে কবিরাজ নিজ থেকেই এক ফাইল ওষুধ নিতে বলে তার মধ্যে সততা আছে। অসৎ কবিরাজ হলে তিন ফাইল গছিয়ে দেবার চেষ্টা করত। হাবিবুর রহমান সিএনজি ট্যাক্সি ক্যাবে করে তৌহিদাকে নিয়ে ফিরছেন। তৌহিদা পান চিবোচ্ছে। সে মুখ থেকে ঘোমটা খানিকটা সরিয়েছে। তাকে উৎফুল্ল এবং আনন্দিত মনে হচ্ছে। ডাক্তার সাহেব ওষুধপত্র কিছু দেন নি। তৌহিদাকে ক্লিনিকে ভর্তি করতে বলেছেন। ক্লিনিক মিরপুরে, নাম নিরাময়। ডাক্তার সাহেব নিজেই ক্লিনিক
false
manik_bandhopaddhay
তছনছ করিয়া ফেলিবার সাধ যায়। নিজেকে তখন বড় অসুখী মনে হয় শশীর। মনে হয়, অনেক কিছু চাহিয়া সে কিছুই পাইল না। ঘর গোছানোর নামে যেমন ঘরখানা জঞ্জালে ভরিয়াছে, জীবনটা তেমনি বাজে কাজে নষ্ট হইল। কী লাভ হইবে তার গ্রাম ছাড়িয়া গিয়া; চিরকাল যদি সে এমন কিছু চাহিয়া যায় যাহা অবিলম্বে পাওয়া যায় না, যার জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে মনের উপভোগ করিবার ক্ষমতা পর্যন্ত ক্ষীণ হইয়া আসে? শশীর সন্দেহ হয়, তার মাথায় বুঝি একধরনের গোলমাল আছে। ভবিষ্যতে যারা অন্যরকমভাবে বাঁচিতে চায় বর্তমানকে তারা এরকম নীরস, নিরর্থক মনে করে না। তার অভাব কিসের, দুঃখ কিসের? সুন্দর সুস্থ শরীর তার, অর্থ ও সম্মানের তার অভাব নাই এবং আর কারো না থাক তার জন্য অন্তত একজনের বুকভরা স্নেহ আছে। যতদিন এখানে আছে এসব তো সে অনায়াসে উপভোগ করিতে পারে, জীবনে বজায় রাখিতে পারে মৃদু একটু রোমাঞ্চ। পরের বাড়ি থাকার মতো এখানে দিনযাপন করিয়া তার লাভ কী? পরদিন সকালে সে পরানের বাড়ি গেল। না, পরান আজও বাড়ি নাই। মোক্ষদা দাওয়ায় বসিয়া ছিল, সে বলিল, গলায় ঘা দেখাইতে পরান বাজিতপুর গিয়াছে। হাসপাতাল, গলা দেখাইতে পরান গিয়াছে বাজিতপুর রাগে শশীর গা জ্বালা করিতে লাগিল। একদিন একটু কড়া কথা বলিয়াছে বলিয়া তাকে ডিঙাইয়া বাজিতপুর যাইবে চিকিৎসার জন্য, স্পর্ধা তো কম নয় পরানের! কুসুম রাধিতেছিল, আসিয়া জলচৌকি দিল। শশী বলিল, না, বসব না। মোক্ষদা বলিল, বোসো বাবা, বোসো-বাড়ি এসে না-বসে কি যেতে আছে। কত বললাম পরানকে-কাজে যাচ্ছিস বাজিতপুর যা, আমাদের শশী থাকতে আর কারোকে গলাটা দেখাসনি বাপু, শশীর কাছে নাকি সরকারি ডাক্তার তা ছেলে জবাব যা দিলে! মুখপোড়ার যত ছিষ্টেছাড়া কথা। বললে, ছোটোবাবু ব্যস্ত মানুষ, বিরক্ত হন, তাকে জ্বালাতন করে কী হবে মা? আগে সব কথায় কুসুম মুচকি-মুচকি হাসিত। আজ তার মুখে হাসি দেখা গেল না। বলিল, ছোটোবাবুর ওষুধে ঘা বেড়ে গেল কি-না, তাই তো গেল বাজিতপুর। মোক্ষদা চটিয়া বলিল, তাই তো গেল বাজিতপুর তোকে বলে গেছে, তাই গেল বাজিতপুর যা মুখে আসবে বানিয়ে বানিয়ে বলবি তুই? যা না মা রান্নাঘরে? শশী সত্যসত্যই উদ্‌বিগ্নভাবে কুসুমের হাসি দেখিবার প্রতীক্ষা করিতেছিল, এতক্ষণে সে হাসিল। বলিয়া গেল, বানিয়ে কেন বলব মা, তোমার ছেলেই তো আমাকে বলছিল। যা শুনেছি বললাম। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি লইয়া শশী বাড়ি ফিরিল। কী ভাবিয়াছে পরান? সেদিন যে ওষুধ দিয়াছিল তাতে পরানের গলার ঘা প্রথমে একটু বাড়িয়া যাওয়া আশ্চর্য নয়, তাতেই কি ভয় পাইয়া গেল পরান, আর তার চিকিৎসায় বিশ্বাস রহিল না? দিনরাত্রি কাটে, মনে মনে শশী ছটফট করে। পরানের গলায় ক্যানসার হইয়াছে মনে হইয়াছিল শশীর, সেটা ঠিক কি-না জানিতে না-পারিয়া তার স্বস্তি ছিল না। হয়তো না। হয়তো অবহেলা করিয়া সাধারণ ক্ষতকেই পরান অতখানি বাড়াইয়া ফেলিয়াছে। পরান আসে না, নিজে গিয়া তাকে যে শশী জিজ্ঞাসা করিবে বাজিতপুরের সরকারি ডাক্তার কী বলিল, তাও শশীর অভিমানে বাঁধে। কুসুমও যদি একদিন কোনো ছলে আচমকা আসিয়া হাজির হইত। কেন সে আসে না? সে যায় না বলিয়া? যাওয়া-আসার সপ্তাহ মাসের ফাঁক তো এমন সে কত ফেলিয়াছে, তবু প্রায় কুসুমের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হইবার বাঁধা তো হয় নাই কখনও! একদিন খুব ভোরে বাড়ির সামনে রাস্তায় নামিয়া দাঁড়াইতেই শশীর চোখে পড়িল কুসুমও নিজের বাড়ির সামনে পথে দাঁড়াইয়া আছে। কুসুমও যে শশীকে দেখিতে পাইয়াছে তা বোঝা গেল। কই, হাতছানি তো দিল না কুসুম, আগাইয়া তো সে আসিল না? শশী একটু দাঁড়াইয়া রহিল। খোলা মাঠে বিলীন কায়েতপাড়ার নির্জন রাস্তাটি আজও শশীর জীবনে রাজপথ হইয়া আছে, যে তাকে যতটুকু নাড়া দিয়াছে এই পথে তাদের সকলের পড়িয়াছে পদচিহ্ন। তাহদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে শুধু কুসুম, এ পথে আজ শুধু কুসুম হাঁটে। আস্তে আস্তে শশী কুসুমের কাছে আগাইয়া গেল। তোমায় দেখে দাঁড়িয়েছিলাম বউ, ভাবছিলাম কাছে যাবে। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি কাছে যাব? তাতে কিছু দোষ আছে নাকি! শশী হাসিল, কই, কথা শুধোবার জন্যে তালবনে আর তো আমায় ডাকো না বউ? কী আর শুধোব? নতুন কিছু কি ঘটেছে গাঁয়ে! ঘটেছে বইকী! অতবড় হাসপাতাল হল, কেমন চলছে হাসপাতাল, রোগীপত্র কেমন হচ্ছে, এসব তো শুধোতে পারো? আমার সম্বন্ধে তোমার কৌতুহল যেন কমে যাচ্ছে বউ। এবার কুসুম মিষ্টি করি হাসিল, ওমা, তাই নাকি? তা হবে হয়তো একটা কমে একটা বাড়ে, এই তো নিয়ম জগতের। আকাশের মেঘ কমে, নদীর জল বাড়ে,–নইলে কি জগৎ চলে ছোটোবাবু? বিবাদ হয় নাই, বিবাদ তাদের হইবার নয়, তবু কুসুমের সম্বন্ধে শশীর মনে ভয় ঢুকিয়াছিল যে ব্যবহার যেন তার কড়া হইয়া উঠিতেছে। তাতে ভয়ের কী আছে শশী জানে না, শুধু কষ্ট হইয়াছিল। এখন খুশি হইয়া শশী বলিল, কৌতুহল কমে কি বাড়ল? কী জানি কী বাড়ল, একটা কিছু অবশ্যি বেড়েছে। পরানের কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়া শশী এইসব কথা বলিল কুসুমের সঙ্গে। এই দরকারটাই তার যেন বেশি ছিল। তারপর চলিয়া আসিবার আগে সে পরানের খবর জানিতে চাহিল। গলায় ঘা কমিয়াছে পরানের। কমিয়াছে? ভালোই হইয়াছে। বাজিতপুরের ডাক্তারের ওষুধেই তবে গলার ঘা কমিল পরানের? শশীর ওষুধে বাড়িয়া গিয়াছিল। পরানের এতবড় অন্যায় ব্যবহারের কথা শশী ভাবিতে পারে না। বাড়াইবার সুযোগ দিয়া আর কমানোর সুযোগ দিল না, শশীর ওষুধে যে গলার ঘা বাড়িয়ছিল তাই হইয়া রহিল স্থায়ী সত্য
false
shordindu
চড়ে চলে যাও, আমি পরে গো-শকটে যাব। তোমাদের সঙ্গে যে তৈজসপত্র আছে তাও গো-শকটে যাবে। বিগ্রহপাল বলিলেন—ধন্য। কিন্তু নগরে গিয়ে আপনার গৃহ খুঁজে পাব কোথায়? রন্তিদেব বলিলেন—নগরে গিয়ে কাক কোকিলকে জিজ্ঞাসা করলে রন্তিদেব দৈবজ্ঞের গৃহ। দেখিয়ে দেবে। তবে, আমার ভৃত্য তোমাদের চেনে না। এই রুদ্রাক্ষ নাও, ভৃত্যকে দেখালে সে তোমাদের গৃহে স্থান দেবে, আদর যত্ন করবে। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে। রুদ্রাক্ষ লইয়া বিগ্রহপাল বলিলেন—আপনি সকল ব্যবস্থাই করেছেন দেখছি। অনঙ্গ, তুমি নৌকায় যাও, গরুড়কে বলে দাও আমাদের তৈজসপত্র যেন সাধুবাবার গো-শকটে তুলে দেয়। যাই—অনঙ্গ রন্তিদেবের দিকে ফিরিয়া বলিল—গ্রহাচার্য মহাশয়, একটি প্রশ্ন আছে। আমরা দুজন যে বিগ্রহপাল ও অনঙ্গপাল তা অবশ্য আর্য যোগদেবের পত্রে জানতে পেরেছেন। কিন্তু আমি যে অনঙ্গপাল আর ও যে বিগ্রহপাল তা চিনলেন কি করে? আগে কি আমাদের দেখেছেন? না, পঞ্চদশ বৎসর আমি ত্রিপুরীতে আছি। তবে? রন্তিদেব হাসিলেন—ও যদি অনঙ্গপাল হত তাহলে যৌবনশ্রীর হাতের ওপর হাত রাখত। শুধু সাজসজ্জা দিয়ে সকলের চোখে ধূলা দেওয়া যায় না। উত্তর শুনিয়া অনঙ্গ পরিতুষ্ট হইল এবং হাসিতে হাসিতে নৌকার দিকে চলিয়া গেল। একজন তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিকে সঙ্কটময় কার্যে সহকারীরূপে পাওয়া কম কথা নয়। লক্ষণ সবই ভাল। মনে হইতেছে। নৌকায় গিয়া অনঙ্গ গরুড়কে তৈজসপত্র সম্বন্ধে যথাযোগ্য উপদেশ দিল, তারপর বলিল—আমরা ত্রিপুরী চললাম, কবে ফিরব কিছু স্থির নেই। তোমরা সর্বদা নৌকায় থাকবে, সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। হয়তো এক নিমেষের মধ্যে নৌকা নিয়ে দেশে ফিরে যেতে হবে। মনে রেখো। গরুড় বলিল—আজ্ঞা। দ্বিপ্রহর অতীত প্রায়। রন্তিদেবের ঘোড়া দুটি চালা ঘরে বাঁধা ছিল, দুই বন্ধু তাহাদের বাহিরে আনিয়া রন্তিদেবের নিকট বিদায় লইলেন, ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া ত্রিপুরী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। লম্বোদর এতক্ষণ দূর হইতে সমস্ত দেখিতেছিল, কিন্তু কথাবার্তা কিছু শুনিতে পায় নাই। অনঙ্গ এবং বিগ্রহপাল যখন বাহির হইয়া পড়িলেন তখন সেও ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া তাঁহাদের অনুসরণ করিল। ঘাট হইতে যে পথটি নগরের দিকে গিয়াছে তাহা ঈষৎ আঁকাবাঁকাভাবে মেখল পর্বতকে বেষ্টন করিয়া গিয়াছে। মেখল পর্বত বিন্ধ্য গিরিশ্রেণীর নিতম্বদেশ। এই পর্বত হইতে দুইটি নদ-নদী শোণ ও নর্মদা উৎপন্ন হইয়া পূর্ব ও পশ্চিমে মেখলার মতই ভারতবর্ষের কটিদেশ অলঙ্কৃত করিয়া রাখিয়াছে। পথটি মেখল পর্বর্তকে যথাসম্ভব পাশ কাটাইয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছে, তবু সর্বত্র সমতল হইতে পারে নাই, ক্রমাগত উচ্চ হইতে হইতে আবার নিম্নাভিমুখে গড়াইয়া পড়িয়াছে। এই তরঙ্গায়িত নিরস্তপাদপ পথে দুই অশ্বারোহী ক্ষুরোদ্ধৃত ধূলিকে পশ্চাতে ফেলিয়া চলিয়াছেন। মধ্যাহ্নে সূর্যের তাপ কিছু প্রখর বটে কিন্তু গতিবেগের জন্য তাহা অনুভব হয় না। পাশাপাশি অশ্ব চালাইতে চালাইতে দুইজনের মধ্যে বিশ্রম্ভালাপ হইতেছিল। বিগ্রহপাল বলিলেন—এ পর্যন্ত যাত্রা বেশ ভালই হয়েছে বলতে হবে। যাত্রার সময় খঞ্জন দেখেছিলাম সে কি মিথ্যে হয়? তুই বললিকাদাখোঁচা। কাদাখোঁচা হলে কি যাত্রা এত ভাল হত? অনঙ্গ বলিল—যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু ওকথা যাক। এখানকার খঞ্জনটিকে কেমন মনে হল খুলে বল। বিগ্রহপালের চক্ষু রবিষ্ট হইয়া উঠিল, তিনি গাঢ়স্বরে বলিলেন—ভাই, ও খঞ্জন। নয় রাজহংসী। মানস সরোবরের রাজহংস। তুইও তো দেখেছিস। বল, সত্যি কিনা! অনঙ্গ ঢোক গিলিয়া বলিল—হাঁ, তা–সত্যি বৈকি। তোর চোখে যখন ভাল লেগেছে— বিগ্রহপাল মহা বিস্ময়ে বলিলেন—এ কি বলছিস! তোর চোখে ভাল লাগেনি? অনঙ্গ বলিল—না না, ভাল লেগেছে, খুবই সুন্দরী। তবে— তবে কি? ভাই একটু বেশি তন্বী। অত তন্বী হওয়া ভাল নয়। আমার বৌটা ছিল ভীষণ তন্বী, তাই টিকল না। গায়ে একটু মেদমাংস থাকলে হয়তো টিকত। বলিয়া অনঙ্গ গভীর নিশ্বাস মোচন করিল। বিগ্রহপাল উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন—তুই শিল্পী কিনা, তাই জগদ্দল পাথরের যক্ষিণীমূর্তি না হলে তোর মন ওঠে না। দাঁড়া, এবার, পাটলিপুত্রে ফিরে গিয়ে তোর জন্যে একটি হস্তিনী খুঁজে বার করব। অনঙ্গপাল বলিল—রোগা বৌয়ের অবশ্য একটা সুবিধা আছে, দরকার হলে কাঁধে তুলে নিয়ে পালাতে পারবি। রঙ্গ পরিহাসে দুই ক্রোশ পথ অতিক্রান্ত হইল। বিগ্রহ বলিলেন—এ পথে বেশি লোক। চলাচল নেই। এতদূর এলাম, একজন পথিকও চোখে পড়ল না। অনঙ্গ বলিল—পথিক যারা ছিল তারা সব এগিয়ে গেছে, পিছনে কেউ নেই। অলসভাবে পিছন দিকে ঘাড় ফিরাইয়া সে বলিয়া উঠিল—আছে আছে। একটা লোক পিছনে আসছে। বিগ্রহপাল পিছন ফিরিয়া দেখিলেন। প্রায় পাঁচ-ছয় রঞ্জু দূরে পথ যেখানে কুজ পৃষ্ঠের ন্যায় উঁচু হইয়াছে সেইখানে একজন অশ্বারোহী আসিতেছে। এতদূর হইতে মানুষটার চেহারা ভাল দেখা গেল না, পোশাক পরিচ্ছদেরও আড়ম্বর নাই। বিগ্রহ বলিলেন—লোকটা আসুক, ওর কাছ থেকে জানা যাবে ত্রিপুরী আর কত দূর। লোকটা কিন্তু আসিল না। ইহারা ঘোড়া থামাইয়াছেন দেখিয়া সেও ঘোড়া থামাইয়া অবতরণ করিল এবং ঘোড়ার পা তুলিয়া ক্ষুর পরীক্ষা করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া দুইজনে আবার মন্থরগতিতে অশ্ব চালাইলেন। পিছনের পথিকও ঘোড়ায় চড়িয়া মন্থরগতিতে আসিতে লাগিল। তাহাদের মাঝখানের ব্যবধান কমিল না। দুই বন্ধু জোরে ঘোড়া চালাইলেন; কিছুক্ষণ পরে পিছু ফিরিয়া দেখিলেন পিছনের অশ্বারোহী যত দূরে ছিল তত দূরেই আছে, ব্যবধান বাড়ে নাই। অনঙ্গ মাথা নাড়িয়া বলিল—গতিক সুবিধার নয়। বোধহয় মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ আমাদের পিছনে একটি গুপ্তচর জুড়ে দিয়েছেন। আচ্ছা দেখা যাক— বলিয়া বিগ্রহপাল আবার ঘোড়া থামাইলেন, ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া হাত তুলিয়া লোকটিকে আহ্বান করিলেন। লোকটি যেন দেখিতেই পায় নাই, এমনিভাবে ঘোড়া হইতে নামিয়া আবার ঘোড়ার ক্ষুর পরীক্ষা করিতে লাগিল। তখন আর সন্দেহ রহিল না। দুইজনে আবার সম্মুখ দিকে অশ্ব চালাইলেন। অনঙ্গ বলিল—গুপ্তচরই বটে। আমরা কোথায় যাই দেখতে চায়। বিগ্রহ বলিলেন—। কিন্তু গুপ্তচর লাগিয়েছে কেন? আমি কে তা কি
false
humayun_ahmed
বলছ। স্যার, আমি একটি যন্ত্রবিশেষ। যন্ত্রের মধ্যে আছে যুক্তি, হেঁয়ালি নয়। হেঁয়ালি আপনাদেরই একচেটিয়া। ক্যাপ্টেন সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে কাসেকশন কেটে দিলেন। তাঁর আর দাবা খেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মাথা ধরেছে। ঘুমানো দরকার। কিন্তু ঘুম এল না। দীর্ঘ সময় কাটল এপাশ-ওপাশ করে। কিছুক্ষণ কেবিনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পায়চারি করলেন। কেবিনের তাপমাত্রা নামিয়ে দিলেন দুডিগ্রি। তবু ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি সুইচ টিপে আবার ডাকলেন সিডিসিকে, হ্যালো সিডিসি। হ্যালো ক্যাপ্টেন। খেলাটা তাহলে শুরু করবেন? না, আমি তোমাকে ডেকেছি ভিন্ন কারণে। বলুন। তুমি যদি গ্যালাক্সি-ওয়ানের ক্যাপ্টেন হতে, তাহলে কী করতে? আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। ক্যাপ্টেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, প্রাণীগুলিকে নিয়ে কী করতে? ওদেরকে এই গ্রহে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেতাম। কেন? নামিয়ে দিতে কেন? যে সব প্রাণীদের ওমিক্রন রশি দিয়েও কাবু করা যায় না, তারা গ্যালাক্সি-ওয়ানের নিরাপত্তার এক বিরাট হুমকি। কিন্তু এরা বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধিমান প্রাণী বলেই এরা বিপজ্জনক। এদেরকে এই গ্রহে নামিয়ে দিতে চাইলে ওরা রাজি হবে? না, এরা রাজি হবে না। এই প্রান্তহীন গ্রহে এদের কিছু করার নেই। আমাদের সঙ্গে এসে এরা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে বলা চলে। প্রাণীগুলিকে তোমার কেমন লাগছে সিডিসি? চমৎকার! এদের দাবা খেলা শিখিয়ে আমি একবার বুদ্ধির শক্তি পরীক্ষা করিয়ে দেখতে চাই। সিডিসি। বলুন স্যার। তুমি এ জাহাজের ক্যাপ্টেন হলে কী করতে? আমি এদের মেরে ফেলতে চেষ্টা করতাম। এদের মেরে ফেলবার পেছনে তোমার কী কী যুক্তি আছে? আমার তিনটি যুক্তি আছে। কিন্তু আপনাকে একটি শুধু বলব। বল। স্যার, আপনি জানেন না যে আরো দুজায়গায় মানুষের সঙ্গে কল্পনাতীত বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা হয়েছে। সেখানেও নিওলিথি সভ্যতা ছিল। দুজায়গাতেই মহাকাশযানের নাবিকরা বুদ্ধিমান প্রাণীগুলিকে জাহাজে তুলে নিয়ে আসছিল। এবং দুটি ক্ষেত্রেই হাইপারডাইভের আগে আগে মহাকাশযান দুটি বিনষ্ট হয়েছে। আমাদের সঙ্গে ওদের মিল লক্ষ করেছেন? ঐ ক্ষেত্রেও প্রাণীগুলি মাকড়সা জাতীয় ছিল? না, তা ছিল না। নিওলিথি সভ্যতার সঙ্গে প্রাণীগুলির কী সম্পর্ক? আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো যথেষ্ট তথ্য আমার জানা নেই। সিডিসি। বলুন স্যার। নিওলিথি সভ্যতা সম্পর্কে আরো জানতে চাই। আমাদের লাইব্রেরিতে একটি মাইক্রোফিল্ম করা বই আছে–অজানা সভ্যতা—সেটি পড়ে দেখতে পারেন। তাছাড়া যা যা জানতে চান, আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ক্যাপ্টেন সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। বেরিয়ে এলেন হলঘরেলাইব্রেরি থেকে বইটি নিতে। লাইব্রেরি তৃতীয় স্তরে। অনেকখানি হাঁটতে হবে। তৃতীয় স্তরে ঢাকবার মুখেই তাঁর দেখা হল লীর সঙ্গে। তিনি সহজ স্বরে বললেন, হ্যালো। ক্যাপ্টেন। কিছু বলবেন? আপনি মনে হচ্ছে একটি বইয়ের খোঁজে যাচ্ছেন? ক্যাপ্টেন ইতস্তত করে বললেন, কোত্থেকে জানলেন। আপনার মস্তিষ্কের কম্পন থেকে। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমরা আপনাদের চিন্তার ধারা বেশ খানিকটা বুঝতে পারি। হ্যাঁ, তা অবশ্যি বলেছেন। আপনি যে বিষয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন, আমিও সে বিষয়ে জানতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই মাইক্রোফি পড়তে জানেন না। নাকি জানেন? না, জানি না। তবে আপনি যখন পড়বেন, তখন আমি যদি আশেপাশে থাকি, তাহলেই সব বুঝতে পারব। নিওলিথি সভ্যতা সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কারণ কি? আমরা কোত্থেকে এসেছি তা জানতে চাই। ক্যাপ্টেন, আমরা এই গ্রহের অধিবাসী নই। আমাদের অন্য কোনো জায়গা থেকে এনে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আমাদের গরণা, নিওলিথি সভ্যতার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। আপনি কি ঘরগুলির ভেতর কখনো গিয়েছেন? না, তবে নীম একবার গিয়েছিল। যান নি কেন? আমাদের উপর নিষেধ ছিল। আমাদের মা নিষেধ করেছিলেন, যেন কখনো তার আশপাশে না যাই। আপনার মায়ের কথা তো কখনো বলেন নি। বলবার সুযোগ হয় নি। ক্যাপ্টেন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। আমি লাইব্রেরিতে বসেই পড়ব। আপনি থাকুন আমার পাশে। ক্যাপ্টেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ বইটি ছাড়াও অন্য কোনো বই যদি আপনার পড়তে ইচ্ছা হয়, আপনি বলবেন, আমি ব্যবস্থা করব। অসংখ্য ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন। আপনার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি? ক্যাপ্টেন খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আছে, আমার একটি সমস্যা আছে। আমি যথাসময়ে আপনাকে সমাধান করতে দেব। আমরা তিন জন মিলে সে সমস্যার সমাধান করব। নিশ্চয়ই আমরা করব। অয়ুর পায়ের যন্ত্ৰণা অসম্ভব বেড়ে গেছে। সে কিছুক্ষণের জন্যে জেগেছিল, ব্যথার তীব্রতায় অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। নীম পরীক্ষা করে দেখল পা-টি-নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেটা তেমন ভয়াবহ নয়, কিন্তু ভয়াবহ হচ্ছে শরীরের অন্যান্য কোষগুলিও নষ্ট হতে শুরু করেছে। তার মায়েরও এ রকম হয়েছিল। এমন কিছু কি নেই, যা দিয়ে তীব্র ব্যাথার উপশম হয়? নীম অস্থির হয়ে উঠল। কিছু একটা করা প্রয়োজন, কিন্তু কিছু কি সত্যি করা যায়? তারা এখানে একা। অসাধারণ চিন্তাশক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা কিছুই করতে পারে নি। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী তারা একটি প্রাণহীন গ্রহে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুধু ঘুরে বেড়ানো। উফ, শক্তি ও ক্ষমতার কী নিদারুণ অপচয়। এর কি শরীর খুব খারাপ? নীম দেখল, স্রুরা। এই লোকটির সঙ্গে অয়ুর ভালো চেনাজানা হয়েছে। নীম বলল, ও মারা যাচ্ছে। সে কি! আমাদের মা নিজেও এভাবেই মারা গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এর চিকিৎসা আছে। থাকলেও আমাদের জানা নেই। আমি আমাদের মেডিকেল টিমকে বলছি, এসে দেখতে। আমার মনে হয় না, এতে কোন লাভ হবে। আমাদের শরীরের সঙ্গে তোমাদের কোনো মিল নেই। না থাকুক, আমি ওদের
false
shottojit_roy
সেই অবস্থায় হেঁটে শহরে ফিরে আসি। প্রথমে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করি, তারপর স্টেশনে গিয়ে মনমডের ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করি। মল্লিককে নামতে দেখে নিশ্চিন্তু হয়ে ওকে ফলো করে ওর পিছনের ট্যাক্সিটায় উঠি। আরেকজন আসছিল হোটেলে, তাকে সঙ্গে তুলে নিই ভাড়াটা শেয়ার করতে পারব বলে। … শুভঙ্কর বোস জিজ্ঞেস করলে বলিস দাদা একটা বিশেষ কাজে বম্বে চলে গেছে, কারণ এই মেক-আপ কেবল রাত্রে শোবার আগে ছাড়া খোলা যাবে না। তোতে আমাতে আলাপ আছে এটা জানলেও মুশকিল। তুই আর লালমোহনবাবু একসঙ্গে এসেছিস, আমি আলাদা! তোরা এক ঘরে থাকবি, আমি আলাদা ঘরে। তুমি বাঙালি তো?—আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদার সঙ্গে অন্য ভাষায় কথা বলতে হবে ভাবতে ভাল লাগছিল না। বাংলা জানি এটুকু বলে রাখছি। নাম জানার দরকার নেই; পেশা ফটোগ্রাফি; হংকং-এর এশিয়া ম্যাগাজিনের জন্য ছবি তুলতে এসেছি। আর আমরা? মামা-ভাগনে। উনি সিটি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। তুই সিটি স্কুলের ছাত্র। ছবি আঁকার শখ আছে। সামনের বছর কলেজে ঢুকবি। ইতিহাসে অনার্স নিবি। তোর পদবি মুখার্জি। লালমোহনবাবুর নাম চেঞ্জ হচ্ছে না। আপনি এলোরা সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করে নেবেন। মোটামুটি মনে রাখবেন যে, কৈলাসের মন্দির তৈরি হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকুট রাজবংশের রাজা কৃষ্ণের আমলে। লালমোহনবাবু কথাটা বিড়বিড় করে আওড়ে নিয়ে চলন্ত গাড়িতেই কোনওমতে তাঁর খাতায় নোট করে নিলেন। ভীষণ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে ফেলুদা আমাদের উপর। এখন বুঝতে পারছি ফেলুদা কোন নিজে গরজ করে লালমোহনবাবুকে সঙ্গে নিতে চাইছিল। ও জানত যে মল্লিকের সন্দেহ এড়াবার জন্য ওকে ছদ্মবেশ নিতে হবে, আমার থেকে আলাদা থাকতে হবে। লালমোহনবাবু থাকলে দলটা ভারীও হবে, আর আমার একজন অভিভাবকও হবে। লালমোহনবাবুকে মামা বলতে আপত্তি নেই, কিন্তু ফেলুদাকে ভাল করে চিনি না—এটা বোঝাতে গেলে সত্যিই অ্যাকটিং করতে হবে। কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী? আওরঙ্গাবাদ থেকে এলোরার রাস্তা চমৎকার; দূরে পাহাড়-যদিও বেশি উঁচু না-আর রাস্তার দু পাশে রুক্ষ জমি। একটা নতুন ধরনের মনসার ঝোপ দেখতে পাচ্ছি। যেটা ফণীমনসা নয়। রাজস্থানেও এরকম লম্বা লম্বা মনসার পাতা দেখেছি। এর এক একটা ঝোপ প্রায় দেড় মানুষ উঁচু। পিছনে কিছুক্ষণ থেকেই একটা গাড়ি হর্ন দিচ্ছিল, আমাদের ড্রাইভার সিগন্যাল করাতে সেটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। তাতে রয়েছে সেই টেকো সাহেব, আর ফেলুদার সঙ্গে যে ট্যাক্সি থেকে নেমেছিল সেই ঘাড়ে-গদর্শনে লোকটা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই একটা পাহাড় ক্ৰমে কাছে এগিয়ে এল। রাস্তা পাহাড়ের গা ঘেঁষে খানিকটা উপর দিকে উঠে, ডান দিকে পাহাড়টাকে রেখে এগোতে লাগল। বাঁ দিকে দূরে একটা ছোট্ট শহরের মতো দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার বলল সেটা খুলদাবাদ, আর খুলদাবাদেই নাকি এলোরার গুহা। আমরা ডাক বাংলোতে থাকব। অন্য সময় হলে হয়তো এত চট করে। জায়গা পাওয়া যেত না, কিন্তু আগেই বলেছি। এটা অফ-সিজন; তার মানে টুরিস্টদের সংখ্যা কম। আর সেই কারণেই অবিশ্যি মূর্তি-চোরদেরও সুবিধে। আরও খানিকটা যেতেই ডান দিকে পাহাড়ের গায়ে প্রথম গুহাগুলো দেখতে পেলাম। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, পহিলে কেভ দেখনা, ইয়া বাংলোমে যানা? ফেলুদা বলল, পহিলে বাংলো। বাঁ দিক দিয়ে একটা রাস্তা খুলদাবাদের দিকে চলে গেছে। গাড়ি সেই রাস্তা দিয়ে ঘুরে গেল। আমি তখনও অবাক হয়ে পাহাড়ের গা থেকে কেটে বার করা সারি সারি গুহাগুলোর দিকে দেখছি। এর মধ্যে কৈলাস কোনটা কে জানে। খুলদাবাদে দুটো থাকার জায়গা আছে—একটা টুরিস্ট গেস্ট হাউস—সেটা ভাড়া বেশি—আর একটা ডাক বাংলো। আমরা বাংলোতেই দুটো ঘর বুক করেছি। যাবার পথে আগে গেস্ট হাউসটা পড়ে। সেটার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম সামনের বাগানের পাশে সবুজ ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে? তার মানে জয়ন্ত মল্লিক এটাতেই উঠেছেন। গেস্ট হাউসের পরের বাড়িটাই বাংলো, দুটোর মাঝখানে বেড়া দিয়ে ভাগ করা। সাইজে বাংলোটা অনেক ছোট, বাহারও কম, কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফেলুদা ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বলল সে যেন মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে। আমরা জিনিসপত্র রেখে কৈলাসে যাব, ও আমাদের নামিয়ে দিয়ে আওরঙ্গাবাদ ফিরে যাবে। ডাক ব্যাংলোয় সবসুদ্ধ চারটি ঘর, প্রত্যেকটায় তিনটে করে খাট। ফেলুদা ইচ্ছে করলে আমাদের ঘরে থাকতে পারত, কিন্তু থাকলে না; ও নিজের ঘরে যাবার সময় চাপা গলায় বলে গেল, তোর পদবি মুখার্জি, লালমোহনবাবু তোর মেজোমামা, রাষ্ট্রকুট, সেভেনথ সেঞ্চুরি, রাজার নাম কৃষ্ণ…আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি। আমাদের ছেড়ে ফেলুদা তার নিজের ঘরে গিয়েই চৌকিদার বলে হাঁক দিল। এমন একটা গলায় যার সঙ্গে ওরা নিজের গলার কোনও মিল নেই। আমরা দুজনে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঝখানের ডাইনিং রুমটীয় এসে বুঝতে পারলাম যে আরেকজন লোক বাংলোয় এসে উঠেছেন। ইনিই ফেলুদার সঙ্গে স্টেশন থেকে এসেছিলেন, আর একেই আমরা একটু আগে ট্যাক্সিতে সেই সাহেবটার সঙ্গে দেখেছি। তখন দেখে বক্সার বা কুস্তিগির বলে মনে হয়েছিল, এখন দেখছি চোখের কোণে একটা বুদ্ধিভরা উজ্জ্বল হাসি হাসি ভাব রয়েছে, যাতে মনে হয়। ভদ্রলোক বেশ লেখাপড়া জানেন-এমনকী হয়তো কবি বা সাহিত্যিক বা শিল্পী-টিল্পীও হতে পারেন। আমাদের দুজনকে দেখে বললেন, বেঙ্গলি? ইয়েস স্যার, লালমোহনবাবু জবাব দিলেন। —ফ্রম ক্যালকাটা। আই অ্যাম দি কী বলে প্রোফেসার অফ হিস্ট্রি ইন দি সিটি কলেজ। অ্যান্ড দিস ইজ কী বলে মাই নেফিউ। কৈলাস দেখতে আসা হয়েছে?–পরিষ্কার বাংলায় বললেন ভদ্রলোক। হা হা-আপনিও বাঙালি? একশো বার। তবে কলকাতার নয়। এলাহাবাদের। ভদ্রলোকের বাংলায় একটা টান আছে। যেটা অনেক প্রবাসী বাঙালির মধ্যেই থাকে। আমাদের আর কিছু না বললেও
false
tarashonkor
শুয়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু তার মসৃণ ললাটে কয়েকটি রেখা। বিস্ময়ের বা প্রশ্নের কুঞ্চনে পুষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। চোখের কোণে কালো দাগ-জীবনে অমিতাচারের রথের চাকার দাগের মত। নাও, খেয়ে ফেলে। একটা পিল বের করে কৃষ্ণস্বামী ডাকলেন। বড়িটা খেয়ে মেয়েটি উঠে বসল। বললে, নো। নেভার। সে হতে পার না তুমি। নো। তারপর হাত বাড়িয়ে অফিসারকে বললে—এ স্মোক প্লিজ! নেলপলিশ লাগানো আঙুলের ডগায় নিকোটিনের দাগ। অফিসারটি সোৎসাহে বলে উঠল, নাট শি ইজ ও-কে। টেক ইট। গেট আপ মাই হনি। হিয়ার ইজ ফায়ার। সে সিগারেট দিল মেয়েটিকে। এবং লাইটারটা জ্বেলে ধরিয়ে দিল সিগারেটটা। তারপর কৃষ্ণস্বামীর দিকে চেয়ে বললে, ও ঠিক হয়ে গেছে, ডক, ও-কে। আমরা এবার যাব। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এই নাও। খান দুয়েক দশ টাকার নোট বের করে ধরলে। কৃষ্ণস্বামী বললেন, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু মাপ করা আমাকে। এই আমার ধৰ্ম। এই আমার ঈশ্বরোপাসনা। কায়েস্টের নামে তোমাকে অনুরোধ করছি। মেয়েটি স্থির বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবং অক্লান্তভাবে সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে। মুখ ফিরিয়ে নিলেন কৃষ্ণস্বামী। জীবনের বন্ধ-করা ঘরে যেন ভিতর থেকে ঘা পড়ছে। কে যেন মাথা ঠুকছে। গাড়িখানা গর্জন করে চলে গেল। বংশী বললে—মেয়াটা তাকায়ে রইছে দেখ বাবা! বাবাসাহেব উয়ার নেশাটো ছুঁটায়ে দিলেক কিনা! রেগেছে! কৃষ্ণস্বামী তাঁর আশ্রমে ফিরে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে ছিলেন। এটা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক। ঝুমকি এসে বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে লাল সিং আর সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললে, সিং বাবাসাহেবের কী হইছে? লাল সিং আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো দূরে গর্জমান উড়োজাহাজের সন্ধান করছিল। ঝুমকির কথায় সে ফিরে তাকালে, কী হয়েছে! বিড়বিড় করে কী বলছে, মন্তরটন্তর বুলছে শুনলাম আমি। ভয়ে পালিয়ে এলাম! চা দিতে পারলাম। তুরা দে গে যা। বাবা রে! মন্ত্রটন্ত্রের মত কিছু শুনলে ঝুমকির ভয় করে। মনে হয় হয়ত তাকেই ডাইনী ভেবে মন্ত্ৰ আওড়াচ্ছে। দিনের বেলা হলে সে পালিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে। চুপ করে বসে থাকে ঝোপের ভিতরে খরগোশ-শজারুর মত। অনেকক্ষণ কেটে গেলে ভয়টা ধীরে ধীরে কমে আসে। তখন গুনগুনিয়ে গান করে, তারপর উঠে আসে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে লাল সিং কৃষ্ণস্বামীর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সে জানে, মধ্যে মধ্যে বাবাসাহেব বাইবেলের সার্মন আপন মনে বলে যান। সে আপনার কপালে গায়ে প্রথামত আঙুল ঠেকিয়ে আমেন বলে। সত্যই বাবাসাহেব ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আপন মনে বাইবেল বলে যাচ্ছেন। বাইবেল নয়, কৃষ্ণস্বামী আবৃত্তি করছিলেন : – — , – . . . শেক্সপীয়রের ওথেলো থেকে আবৃত্তি করছেন কৃষ্ণস্বামী। আজ রামচরণের বাসা থেকেই ওথেলো মনে পড়ে গেছে। ওই মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যে তিনি ওথেলোর কথা কত ব্যবহার করেছেন। লেট মি লুক অ্যাট ইওর আইজ। লুক অ্যাট মাই ফেস। পিস অ্যান্ড বি স্টিল। ওই সবই ওথেলো নাটকের সংলাপ। পেশেন্স, ইউ ইয়ং রোজ-লিপ মেড– এরও অনেকটা অংশ তাই। আমেরিকান অফিসারটির এসব বুঝবার কথা নয়। খাদ্য-মদ্য-নারী–হুল্লোড়-যুদ্ধাস্ত্র, এ ছাড়া এ-সব বুঝলে যুদ্ধ চলে না। অবশ্য কিছু কিছু উচ্চস্তরের লোক আছে, হয়ত অনেক কবি কলম ছেড়ে কোমরে রিভলভার ঝুলিয়ে রাইফেল কাঁধে এসেছে, কিন্তু তারা ক-জন? তারা অন্তত এমনিভাবে মেয়েটিকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াত না। বেড়ালে বুঝতে হবে তাদের জীবন-সত্য হেসে নাও দুদিন বৈ তো নয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বাকি সব তারা মুছে দিয়েছে। হয়ত বা ভুলেই গেছে। রিনা ব্রাউনেরও তাই হয়েছে। অতীত বোধহয় মুছে গেছে। নইলে এমন কী করে হল? সেই রিনা ব্রাউন! আশ্চর্য ওথেলোর সেই অবিস্মরণীয় শব্দগুলি কানে ঢুকল কিন্তু তবু স্মৃতির ঘরের দরজা খুলল না? আশ্চর্য! না। আশ্চর্যই বা কিসে? মদের নেশায় প্ৰমত্ত রিনা ব্রাউনই–সকল বিস্ময়ের সীমা শেষ। মদের প্রভাব আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তার স্মৃতি, বুদ্ধি,–বোধহয় সমস্ত সত্তাকে। চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে লাল সিং সসম্ভ্ৰমে সশ্রদ্ধ পদক্ষেপে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ফাদার ঈশ্বরকে ডাকছেন। রিনা ব্রাউনের মূল্যের তুলনায় একদিন ঈশ্বরের মূল্যও তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণস্বামীর কাছে। তখন তিনি কৃষ্ণস্বামী ছিলেন না। তখন তিনি ছিলেন কালাচাঁদ গুপ্ত। অবশ্য তখন কালাচাঁদ ঠিক ঈশ্বর মানত না। এবং কালাচাঁদ নাম পালটে সদ্য তখন সে কৃষ্ণ ইন্দু-কৃষ্ণেন্দু হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। কালাচাঁদ কৃষ্ণের প্রথম নাম। পাহাড়ী নদীর মত বন্য। কালাচাঁদ ঈশ্বরে অবিশ্বাস করত না কিন্তু বিশ্বাস করত নিজের প্রাণশক্তিকে। বন্য পাহাড়ী নদীর মত শুধু প্রাণচঞ্চল বেগবানই নয়—খানিকটা বর্বরও বটে। মেডিক্যাল কলেজে ঢুকবারও আগে। পল্লীগ্রামের ছেলে। কালো হিলহিলে লম্বা, বড় বড় চোখ, কপাল পর্যন্ত পুরু ঘন চুল, মুখেচোখে পল্লীর সারল্য। পল্লীর কর্কশতায় ঈষৎ মলিন। কিন্তু আশ্চর্য প্রাণবন্ত, বুদ্ধিও তেমনি তীক্ষ। পল্লীগ্রামের নামকরা কামারের গড়া খ্ৰীটি ইস্পাতের দায়ের মত। ধারালো তীক্ষ্ণ অনমনীয় দৃঢ়; কিন্তু শান-যন্ত্রে ঘষামাজা পালিশ-করা ঝকঝকে নয়, একটু ময়লা। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান বৈদ্যবংশের সন্তান। কিন্তু সে-খ্যাতি তখন অস্তোনুখ। প্রপিতামহ। এবং পূর্বপুরুষ ছিলেন প্রসিদ্ধ ভিষগাচার্য। আয়ুর্বেদের প্রসার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার উৎসাহ কমে গিয়েছিল। তিনি আয়ুর্বেদে মন না দিয়ে মন দিয়েছিলেন চাষবাস ও ধর্মেকর্মে। একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন এই বাসনা। গ্ৰাম্য ইস্কুলে ম্যাট্রিক পাস করে কালাচাঁদ আই. এস. সি. পড়তে এল কলকাতার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে। আই. এস. সি. পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকবে। সামান্য কৌতুকে হা-হা করে হাসে, দুড়দুড় করে সিঁড়ি ভেঙে নামে, ক্লাসের শতকরা আশিটি ছেলের মাথার উপরে হিলহিলে লম্বা কালাচাঁদের মাথাটা প্রায় ছ ইঞ্চি উঁচু হয়ে উঠে
false
manik_bandhopaddhay
সে চোর। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, গণেশকে একবার ধরতে পারলে জেল খাঁটিয়ে ছাড়বে। এসব বলে ভড়কে দিতে হবে ওদের, যাতে কোনোরকম হাঙ্গামা করতে সাহস না পায়। দাশগুপ্তের অবশ্য ভয়-ভাবনার কিছু আর নেই, তবু সামান্য হাঙ্গামাও সে পোহাতে চায় না গণেশের বোকার মতো গুলি খেয়ে মরার ব্যাপার নিয়ে। এমনিতেই সর্বদা তাকে কত ঝঞাট নিয়ে থাকতে হয়। তার ওপর আবার গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর-তদন্তের জন্য দশটা মিনিট সময় দিতে হবে ভাবলেও তার বিরক্তি বোধ হয়। ফ্ল্যাটের সদর দরজার ঠিক সামনে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইকে কাখে নিয়ে রাণী দাঁড়িয়েছে বাকা ও পরিস্ফুট হয়ে। তার দিকে নজর পড়তেই দাশগুপ্তের চোখ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে কয়েকবার দেখে নেয়, রাণীর মুখে যে মৃদু বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে তাও তার চোখে ধরা পড়ে। চিন্তাধারা সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করে দাশগুপ্তের। তাই, গোড়াতেই প্ৰেষ্টিজ হারাতে না চেয়ে সে ইচ্ছে করে মস্ত হাই তুলে মুখ-চোখের ভাব বদলে নির্বিকার গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলে। গণেশকে খুঁজতে এসেছ? যাদব বলে, আজ্ঞা হ্যাঁ। আছে না গণেশ? এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে দাশগুপ্ত বলে, তুমি কে গণেশের? গণেশ চুরি করে পালিয়েছে বলে ওদের ভড়কে দিলে চলবে না, অন্য কিছু বলতে হবে। লাগসই কি বলা যায় দাশগুপ্ত ভাবতে থাকে। গণেশ আমার ছেলে বাবু। দেশ গাঁ থেকে আসছি আমরা। ও! দাশগুপ্ত বলে উদাসভাবে, এখন তো গণেশ এখানে নেই। কখন ফিরবে বাবু? গণেশ কি জান, ছুটি নিয়ে গেছে কদিনের। কোথায় যেন যাবে বলল, নামটা মনে পড়ছে। না। কারা সব সঙ্গী জুটেছে, তাদের সঙ্গে গেছে। তিন-চার দিনের মধ্যেই ফিরবে। হাসপাতালে অথবা মর্গে যার মৃতদেহটায় হয়তো এখন পচন ধরেছে, অনায়াসে দাশগুপ্ত তার বাপ-মা-ভাইবোনদের জানায় সে ফিরে আসবে তিন-চার দিনের মধ্যে, এতটুকু বাধে না। তার ভাবভঙ্গিটা শুধু রাণীর কাছে একটু কেমন কেমন লাগে। তবে তো মুশকিল। আমরা এখন যাই কোথা! যাদব বলে হতাশ হয়ে। কোনো খবর না দিয়ে কিছু ঠিক না করে এ ভাবে এলে কেন বোকার মতো? দাশগুপ্ত বলে রাগ আর বিরক্তি দেখিয়ে, কয়েক মুহূর্ত ভাববার ভান করে, তারপর যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, এইখানেই থাক এখনকার মতো, কি আর করা যাবে! বলে সংযম হারিয়ে রাণীর ওপর একবার নজর না দিয়ে পারে না। রাণী বলে, বাবা বদ্যি মশায়ের ছেলে তো আছেন। তাঁর কাছে গেলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। যাদব ইতস্তত করে। কেশব বদ্যির ছেলে থাকে হাওড়ায়, আবার সেখানে ছুটবে এত পথ হেঁটে! গিয়ে যদি তাকেও না পাওয়া যায়, কি উপায় হবে তখন। দাশগুপ্ত বলে, কোথায় যাবে আবার, এখানেই থাক। একটা ঘর ছেড়ে দিচ্ছি তোমাদের। রাণী বলে, বাবা, শোন। যাদব কাছে এলে চুপিচুপি বলে, না বাবা, এখানে থাকা চলবে না। বারু লোক ভালো না। মোর ভরসা হচ্ছে না মোটে। শেষকালে গোলমাল হবে, চাকরিটা যাবে দাদার। যাদব তখন বলে দাশগুপ্তকে, আজ্ঞে, দেশের এক ভদ্রলোক পত্র দিয়েছেন, আমরা তার ছেলের ওখানেই যাই। আপনার এখানে হাঙ্গামা করব না বাবু। যা খুশি তোমাদের! দাশগুপ্ত বলে। সময়টা তার খারাপ পড়েছে সত্যি দাশগুপ্ত ভাবে। ধীরে ধীরে আবার তারা পথে নেমে যায়। আবার দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। স্টেশন থেকে এতদূর হেঁটে এসেছে, এবার স্টেশন পার হয়ে অনেক দূরে যেতে হবে। যে পথে এসেছিল সেই পথেই আবার তারা লালদিঘির দিকে চলতে আরম্ভ করে। গণেশের মা বলে, ছুটি নিয়ে কোথায় বেড়াতে গেল গণেশ? মোদের জানাল না কিছু চিঠিতে, কিছু বুঝি না বাবু ব্যপার স্যাপার। শহরে এসে স্যাঙাৎ জুটেছে ছেলের। যাদব বলে ঝাঁঝের সঙ্গে। অমন কথা বোলো না গণশার নামে। সে আমার তেমন ছেলে নয়। লালদিঘির দিকে বাঁক ঘুরবার মোড়ের কাছাকাছি এলে দূরাগত জনতার কলরব তাদের কানে ভেসে আসে। লালদিঘির সামনাসামনি পৌঁছে তাদের থামতে হয়। চারিদিক লোকারণ্য, ভিড় ঠেলে এগোন অসম্ভব। বিরাট এক শোভাযাত্রার মাথা লালদিঘির ওদিকের মোড় ঘুরছে, সামনে তিনটি তিন রকম বড় পতাকা উড়ুরে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। শোভাযাত্রার শেষ এখনো দেখা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে ধ্বনি উঠছে হাজার কণ্ঠে। এবার যাদবের মনে হয়, বাঘ যেন ডাক দিচ্ছে মনের আনন্দে। সামনে তারা দেখতে পায় অজয়কে। মানুষ ঠেলে তারা অজয়ের কাছে যায়। যাদব ডাকে, বাবু! অজয় ফিরে তাকায় না। যাদব শুনতে পায় সে নিজের মনে বলছে : আমরা এগিয়েছি। ঠেকাতে পারে নি, আমরা এগিয়েছি! ঘাড় উঁচু হয়ে গেছে অজয়ের, দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে আনন্দে, উত্তেজনায়। যাদব চেয়ে দ্যাখে, সে হাসছে। মুখে যেন তার সূর্য উঠেছে মেঘ কেটে গিয়ে। বেলা তিনটার সময় রাজকুমার টের পাইল, তার মাথা ধরিয়াছে। এটা নূতন অভিজ্ঞতা নয়, মাঝে মাঝে তার ধরে। কেন ধরে সে নিজেও জানে না, তার ডাক্তার বন্ধু অজিতও জানে না। তার চোখ ঠিক আছে, দাঁত ঠিক আছে, ব্লডপ্রেসার ঠিক আছে, হজমশক্তি ঠিক আছে–শরীরের সমস্ত কলকজাগুলিই মোটামুটি এতখানি ঠিক আছে যে, মাঝে মাঝে মাথাধরার জন্য তাদের কোনোটিকেই দায়ী করা যায় না। তবু মাঝে মাঝে মাথা ধরে। অজিত অবশ্য এক জোড়া কারণের কথা বলিয়াছে : আলসেমি আর স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতিতে অবহেলা। রাজকুমার তার এই ভাসা ভাসা আবিষ্কারে বিশ্বাস করে না। প্রথম কারণটা একেবারেই অর্থহীন, সে অলস নয়, তাকে অনেক কাজ করিতে হয়। দ্বিতীয় কারণটা যুক্তিতে টেকে না, স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতি না মানিলে স্বাস্থ্য খারাপ হইতে পারে, মাথা
false
toslima_nasrin
ডাস্টবিনে গেছে, সকলে তাই শান্ত হয়েছে। এরপর আমি আর ইচ্ছে করেই মেয়েটির খোঁজ রাখিনি। সেদিন রাস্তায় বড় চেনা চেনা লাগে একটি মেয়েকে দেখে আমি দাঁড়াই। মেয়েটির নির্লিপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আবিষ্কার করি অন্য এক চোখ, এই চোখ চেনে মানুষের ভেতরের সব কদাকার মানুষ। শরীর নিয়ে ওর আড়ষ্টতা দেখে আমি বুঝতে পারি শরীরে সে সন্তান বহন করছে। জিজ্ঞেস করি—চাকরিটা করছিস তো ? না। আমি তখন বুঝতে পারি একটি কেরানির ঘরে কর্মকতার ব্যক্তিত্ব বড় বেমানান লাগে বলে গৃহকতার আদেশ এবং সামাজিক কটাক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের চাকরি ছেড়ে দাম্পত্য জীবনকে মেয়েটি মানানসই করেছে। আমার একবার ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি তোর যোগ্য কি এই দেশে কেউ ছিল না ? আসলে ছিল, ছিল না কে বলে, তারা এসেছে, চমৎকার সব ভালবাসার কথা বলেছে, কিন্তু কেউ বিয়ের কথা বলেনি। সংসার-ভাঙা একটি মেয়ে নিয়ে সারাদিন আড্ডা দেওয়া যায়, রেস্তোরায় চা-পান করা যায়, সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে বিকেল-সন্ধ্যা পার করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করলে যেন কেমন এঁটো এঁটো লাগে, তার চেয়ে শিক্ষা নেই, রুচিফুচির বালাই নেই এমন এক কুমারী কন্যা এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারলেই লোকে বাহবা দেয়। যোগ্য ছেলে নিয়ে তাই আমি আর প্রশ্ন করি না। মেয়েটি তার স্ফীত শরীরের লজ্জায় দ্রুত চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার আবারও বড় এক লাগে। শুরুতে মেয়েটির নাম আমি বলতে চাইনি, কেন বলতে চাইনি তা বলব বলেছি। বলতে চাইনি কারণ মেয়েটির নাম দিলরুবা, শাহানা, দিলারা, সুলতানা, নমিতা, পারভিন, মারিয়া, শ্যামলী, চন্দনা, ফরিদী, শিপ্রা, অর্চনা কী না হতে পারে ? মেয়েটিকে তাই কোনও নামে ডাকতে ইচ্ছে করেনি কারণ জুলেখা, সুফিয়া, মার্গারেট, আয়শা, হাসিনা, মমতা ও নাসিমা থেকে মেয়েটিকে আমি পৃথক দেখিনি। ১. বস্তির মেয়ে। বয়স, বয়সের চেয়ে বেশি মনে হয়। কী কারণে আমি জানি না, দ্বিগুণ বয়সের একটি লোক মেয়েটিকে প্রথম হ্যাঁচকা টান দিল। তারপরই দিল ঘাড় ধরে ধাক্কা, মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘরের বেড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে দুটো লাথি । চুলের মুঠি ধরে মেয়েটিকে এরপর ঘরে নিয়ে গেল লোকটি, তার স্বামী। ঘটনাটি দেখে আমি বিস্মিত হইনি। হইনি, কারণ আমিও, আমি একজন চিকিৎসক, দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, আমিও কি এভাবে অত্যাচারিত হই না? আমারও ঘাড় ধরে ধাক্কা দেওয়া হয়, আমিও উপুড় হয়ে পড়ি দেয়ালে, আমারও কপাল ফেটে রক্ত বেরোয়। সরকারী কাগজপত্রে আমি একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা, তাতে কী, আমি তো মেয়ে। বস্তির ওই মেয়েটির জন্য এবং একইভাবে আমার জন্যও বিবাহ আইন একই রকম। মেয়েটির স্বামী যেমন ইচ্ছে করলেই বলতে পারে তালাক তালাক তালাক, আমার স্বামীও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার স্বামীও এক এক করে এক ঘরে চার বউ তোলার ধর্মীয় আহ্লাদ দেখাতে পারে। আমি পারি না। বস্তির মেয়েটি যেমন কেবল একবেলা ভাত আর বছরে গা ঢাকার দুটো কাপড়ের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, সন্তানকে কেঁচো-কেন্নোর মত বড় হতে দেয়, আমিই বা এর চেয়ে আলাদা কিসে? আমার আছে সমাজের লজ্জা, আছে মধ্যবিত্ত সংস্কার। আমিও দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকি সংসার নামক কিছু থাল-বাসন আর খাট-আলনার মধ্যে। বস্তির ওই মেয়েটির ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমিও বেদনায় নীল হই, আমার কোমরেও এসে পড়ে পুরুষ তৈরি আইনের লাথি। বিত্তবান কোনও মেয়ে এবং বস্তির এই মেয়েটির মধ্যে, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। স্বামী অর্থ প্রভু। যে কোনও শ্রেণীর মেয়ের জন্য স্বামী তার প্রভু। সে তার অর্ধাঙ্গিনী হলেও স্বামী তার অর্ধাঙ্গ নয়। অভিধানে ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘সহধর্মিণী’ শব্দগুলোর কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। ইংল্যান্ডের একজন বুদ্ধিজীবী জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) তাঁর দি সাবজেকশান অভ ওম্যান (১৮৬৯) গ্রন্থে লিখেছেন–‘আজকের দিনে বিবাহই হল একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে আইনত দাসপ্রথা বজায় আছে। আমাদের বিবাহ-আইনের মাধ্যমে পুরুষেরা লাভ করে একটি মানুষের উপর সর্বময় অধিকার। লাভ করে প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, লাভ করে তালাক ও বহু বিবাহের অবাধ অশ্লীলতা।‘ ২ পিতৃকুলে জন্ম নিয়ে শ্বশুরকুলে যার জীবনযাপন, উত্তরাধিকার প্রশ্নে তারা যদি সম্পত্তির ভাগ পায় তবে উভয়দিকের অংশ পেয়ে তাদের প্রাপ্য যদি আবার বেশি হয়ে পড়ে তাই আপত্তি ওঠে। দুই স্থানে তাদের দাবি বলে কোনও দাবিই আর কোনও কুলে টেকে না। প্রবাদ আছে ধোপার যে কুকুর, সে না-ঘাটের, না-ঘরের। মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৬.৪) বলে—‘কন্যা জন্মিলে সবাই তুচ্ছ করে, সে ফেলনা। পুত্র তো ফেলনা নহে, তাই কন্যা উত্তরাধিকার পায় না, পুত্র পায়। কন্যা পরের ঘরে যায়, তাই সে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর।‘ তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬.৫.৮.২৭) আছে—‘নারীদের দ্বারা গৃহ্যমান হইতেছে ইহা সোম সহ্য করিতে পারিল না। তাই ঘৃতকে বজ্র করিয়া মারিল। যখন তাহা শক্তিহীন হইল তখন তাহারা গ্রহণ করিল। তাই নারীগণ নিরিন্দ্রিয় অর্থাৎ শক্তিহীনা, তাহারা নিচ-পুরুষ হইতেও নিচ, এজন্যই তাহারা আদায়াদী অর্থাৎ দায়প্রাপ্তির অযোগ্য।’ আচার্যদের মতে—‘কন্যাকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে, পুত্রকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে না, তাই পুরুষ দায়াদ, স্ত্রীলোক দায়াদ নহে।‘ বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ (যা ধর্মীয় বিধানের ওপর ভিত্তি করে রচিত) অনুযায়ী একটি মেয়ে পৈতৃক সম্পত্তির যে অংশ পায় তা একটি ছেলের অর্ধেক। একই পিতা-মাতার সন্তানের মধ্যে যদি আইনের এমন বৈষম্য থাকে, তবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ১/৮ অংশ, সন্তানের সম্পত্তিতে ১/৬ অংশ, পিতার সম্পত্তিতে কন্যা হিসেবে
false
toslima_nasrin
না, দুপুরের খাবার খেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হোক, তবু পুরুষ-ছেলেরা আমিষ-নিরামিষ খাবার পর যা থাকে, তা উঠোনের হাস-মুরগি পায় কিছু কিছু পায় ঘরের মেয়েরা, আর বাকি যদি কিছু থাকে, তা বাসি করে রাখা হয় পরদিনের জন্য (অবশ্য তা মেয়েদের জন্যই)–এই হচ্ছে সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র। ২. ছোটবেলা থেকেই আমার এক আত্মীয়ার মাথা ভর্তি উকুন ছিল। একবার ওষুধ দিয়ে তার মাথার উকুন সব মারা হল। উকুন মরে ভালর চেয়ে বরং খারাপ হয়েছিল সেই আত্মীয়ার। রাতে ঘুম হয় না, চোখে অন্ধকার দেখে, খাবারে রুচি নেই। শেষ অব্দি আত্মীয়াটি আবিষ্কার করল মাথায় উকুন নেই বলেই তার এই অবস্থা। দু’মাস চরম অস্থিরতায় ভোগার পর মাথায় নতুন করে উকুন ছাড়তে সে বাধ্য করল। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। আসলে উপদ্রব পোহাতে পোহাতে মেয়েদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উপদ্রব ছাড়া মেয়েরা বাঁচতে পারে না। প্রতি রাতে বউ না পিটিয়ে ঘুমোয় না এমন পুরুষ খুঁজে বের করলে সংখ্যায় খুব কম হবে না বলে আমার মনে হয় না। তো সেদিন এ ধরনের নির্যাতনে অভ্যস্ত এক বউকে বলেছিলাম–উল্টে আপনি ওকে মারুন, নয় ওই পাষণ্ডকে ত্যাগ করুন। শুনে আঁতকে উঠল ঘোমটা ঢাকা বউ। তাঁর শরীরের কালশিরাগুলোও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সম্ভবত মেয়েদের রক্তে-মাংসে গভীর এক বিশ্বাসের অঙ্কুরোদগম হয়েই গেছে যে মেয়েমানুষ জন্মই নিয়েছে লাঞ্ছিত হতে, যাবতীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ পোহাতে। তাই যথেচ্ছ নির্যাতিত হতে তাদের মোটেই অপমান লাগে না। ৩. শাস্ত্ৰে বলে—‘অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা তু রোহিনী/ দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা উর্ধ্বং রজঃস্বলা’ ইত্যাদি। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়–আট বছরের কন্যাকে গৌরী বল, নয় বছরের কন্যাকে রোহিনী, আর দশ বছরের কন্যাকে–কন্যা। দশের ওপর যাদের বয়স তাদের বলে রজঃস্বলা। বারো বছর হয়ে গেলেও যে পিতা কন্যাদান করেন না তাঁর পিতৃলোকের আয়ীয়রা মাসে মাসে সেই কন্যার ঋতুকালীন শোণিত পান করেন। কন্যাকে রজঃস্বলা দেখলে মা, বাবা এবং বড় ভাই নরকে যান। যে ব্রাহ্মণ অজ্ঞানতাবশত অন্ধ হয়ে সেই কন্যাকে বিয়ে করেন, তিনি সম্ভাষণের অযোগ্য, তাঁর সঙ্গে এক পাতে বসে ভোজন করতে নেই। সেকালে মেয়েরা মায়ের কোল থেকে নামতে না নামতে শুরু হয়ে যেত দৌড়াদৌড়ি–কার আগে কে মেয়েকে বলিদান করতে পারেন। একালে বলিদান কমেছে এই কথা গত এক মাসে দেশের পঁচিশটা গ্রাম ঘুরে না এলে আমিও হয়ত বিশ্বাস করতাম। একেবারে পাঁচ ছয় বছর না হােক বারো থেকে পনেরো বছরের অধিকাংশ মেয়েকেই আমি বিবাহিত দেখেছি। সতীদাহর চেয়ে এই বাল্যদাহ কম মারাত্মক নয়। সেকালে এবং একালে সময়ের শুধু দীর্ঘ ব্যবধানই দেখি, সংস্কারের এক তিল ব্যবধান দেখি না। ৪. নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজ তাকে নারীত্বের নানা কলাকৌশল শিখিয়েছে। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ যে সমাজে এই পুঁথিকাব্য রচিত হয়— পতিভক্তি কর সদা থাকিতে জীবন। পতিভক্তি সতী সাধণী করে প্রাণপণ।। সতী সাধ্বী অবলার এইত ধরম। পতিকে সেবিয়া করে সার্থক জীবন।। পতি সেবা রমণীর আদরের ধন। লভিয়ে সে ধন করে সার্থক জীবন।। সতীর লক্ষণ ইহা জানিতে একীনে। জানে না সে আর কিছু পতি সেবা বিনে।। শয়নে স্বপনে ধ্যানে আর জাগরণে। জীবন সার্থক করে পতির চরণে।। কেমনে উজ্জ্বল হবে পতির সংসার। দিবানিশি এ ভাবনা অন্তরে তাহার।। পতির আনন্দ ছাড়া শান্তি নাহি চায়। সতীর মরম ব্যথা পতির ব্যথায়।। পতির সুখেতে সুখী দুঃখেতে দুঃখিনী। পতির সোহাগে কাটে দিবস রজনী।। সাধ্যের অতীত চাপ পতিকে না দেয়। যাহা কিছু দেয় পতি খুশি মনে নেয়।। পতি-হিতে পতি স্বার্থে নশ্বর জীবন। বিলাইয়া দেয় সদা করি সম্ভাষণ।। এবং এ জাতীয় গাথাই ঘরে ঘরে তুমুল জনপ্রিয় হয়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজের নীতি ও নিয়মের কাঁধ খামচে ধরে তলপেটে কষে দুটো লাথি দিতে গেলে হই রই করে তেড়ে আসে সাত কোটি বুনো ষাঁড়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজে অতঃপর হাত-পা-মাথা গুটিয়ে তাকে শামুকের মত সামাজিক খোলসে আবৃত হতে হয়। আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু ১. কিছু বোকা আছে, ওরা বলে মেয়েরাই মেয়েদের শক্র, কারণ বাঙালির বউ-শাশুড়ি বিবাদ দীর্ঘদিনের। শাশুড়িরা বউদের অত্যাচার করে সুখ পায়। আমরা ভেবে দেখতে পারি, কোনও নারী—সে যখন ছেলের বউ-এর শাশুড়ি হয় তখন সে উচ্চকণ্ঠ নাকি সে যখন মেয়ের জামাইয়ের শাশুড়ি হয়, তখন? মেয়ের বেলায় অবশ্যই সে বিনম্র এবং আপসকামি, কিন্তু ছেলের বেলায় ঠিক তার বিপরীত। কারণ মেয়েমাত্রই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার; বিয়ের মাধ্যমে ছেলের হাতে মেয়েকে ন্যস্ত করা, এবং ছেলের সংসার ও বংশ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করা দ্বারাই একটি মেয়ে পুরুষতন্ত্রের জালে আটকা পড়ে। ছেলের বউ-এর শাশুড়ি যখন ছেলের বউ ছিল, একই নিগ্রহ সে ভোগ করেছে। ছেলেকে বিয়ে করানোর ফলে সে যদি ছেলে পক্ষের একজন প্রতিনিধি হয়, নিশ্চয় সে প্রতিনিধি, এবং ছেলে যেহেতু সঙ্গত কারণেই পুরুষতন্ত্রের ধারক, সে-ও অর্থাৎ ছেলের মাও পুরুষতন্ত্রের ধারক। এ কথা অনস্বীকার্য যে নারী নিজেই পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক। অপরদিকে নিজের মেয়েকে যখন সে বিয়ে দেয়, পুরুষতন্ত্রের কাছে মেয়েকে সে অর্পণ করে, সে তখন পুরুষতন্ত্রের ধারক নয়। সে তখন নারীপক্ষ, নির্যাতিত নারীর প্রতিনিধি; তাই সে বিনত, অনুদ্ধত, শ্লীল, সংযত ও বশংবদ। ওদিকে মেয়ের শাশুড়ি আবার তারই মত দাপুটে, অপ্রসন্ন, অমর্ষপরায়ণ ও খড়গহস্ত—সে তার ছেলের বউ-এর কাছে যে চরিত্রে উপস্থিত। তাই, নির্দ্বিধায় আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি
false
humayun_ahmed
অজুহাত। নাদিয়া এমন চমৎকার রেজাল্ট করেছে তাকে কনগ্রাচুলেট করা তার অবশ্যই কর্তব্য। যেদিন নাদিয়ার রেজাল্টের কথা জেনেছে সেদিনই সে নাদিয়ার জন্যে ভালো একটা কলম কিনেছে। কলমের বাক্সটা গিফট র‍্যাপে মুড়েছে। ছোট্ট একটা চিরকুট গিফট র‍্যাপে ঢোকাল। সেখানে লেখা– নাদিয়া, ফার্স্ট হওয়া ছেলেমেয়ে এতদিন শুধু পত্রিকায় দেখেছি। বাস্তবে এদের সত্যি সত্যি কোনো অস্তিত্ব আছে তা মনে হতো না। রেজাল্ট হবার পর তোমাকে বাস্তবের কেউ মনে হয় না। মনে হয়। তুমি অন্য কোনো গ্রহের। তুমি আমার অভিনন্দন নাও। ইতি হাসান ভাইয়া উপহারটা নাদিয়াকে এখনো দেয়া হয় নি। অনেকবারই সে তিতলীদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে। শেষ পর্যন্ত গেট খুলে ভেতরে ঢোকে নি। হয়তো বাড়িতে গল্প করছে। হাসান সেই আনন্দময় মুহুর্তে প্ৰবেশ করামাত্র ছন্দপতন হবে। আজ বোধহয় যাওয়া যায়। তিতলী মার বাড়িতে এলেও এত রাত পর্যন্ত নিশ্চয়ই থাকবে না। নববিবাহিতা তরুণীরা মার বাড়িতে এত সময় নষ্ট করে না। এরা দ্রুত অতীত ভুলতে চেষ্টা করে। মেয়েরা তাদের শরীরে সন্তান ধারণ করে। সন্তান ধারণ করে বলেই হয়তো প্রকৃতি তাদের ভবিষ্যৎমুখী করে রাখে। অতীত তাদের কাছে পুরনো গল্পের বইয়ের মতো। যে গল্প একবার পাঠ করা হয়েছে বলে কৌতুহল মরে গেছে। দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছা করে না। বইটি হারিয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। হাসান তিতলীদের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতটুকু মনের জোর দরকার এই মুহুর্তে ততটুকু মনের জোর তার নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে তিতলী তার মার বাড়িতে। কারণ ঘরে অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। বারান্দায়ও বাতি জ্বলছে। এতগুলো বাতি জ্বলার কথা না। বাইরে বারান্দার বাতি তো কখনোই জ্বালানো থাকে না। ঘটনা কী ঘটেছে হাসান তো অনুমান করার চেষ্টা করছে। তিতলী এসে কলিংবেল টিপৌঁছে। নাদিয়া বাইরে বারান্দায় বাতি জ্বলিয়ে দরজা খুলল। তারপর আপাকে দেখে এতই আনন্দিত হলো যে বাতি নেবাতে ভুলে গেল। তিতলী এ বাড়িতে এলে গেটের ভেতরে একটা গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি অবশ্যি নেই। তিতলীর স্বামী এসে হয়তো তিতলীকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। রাত এগারটার দিকে আবার এসে নিয়ে যাবেন। হাসান হাঁটা শুরু করল। আজ থাক আরেকদিন সে আসবে। নাদিয়ার উপহারটা মনে হয় দীর্ঘদিন পকেটে পকেটে ঘুরবে। গিফট র‍্যাপ কচুকে যাবে, ময়লা হয়ে যাবে উপহার আর দেয়া হবে না। সবচে’ ভালো হত হঠাৎ যদি রাস্তায় নাদিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। উপহারটা তার হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলা যেত। রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। নাদিয়া এমন মেয়ে যে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। ঘর থেকে বের হলেই তার নাকি কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। চান দেয়ালের ভেতরে সে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই নাকি তার শান্তি শান্তি লাগে। কী অদ্ভুত কথা! বাসায় ফিরতে হাসানের ইচ্ছা করছে না। আজ বাসার পরিস্থিতি খুব খারাপ থাকার কথা। তারেক একদিনের অফিস টুরের কথা বলে চিটাগাং গিয়েছিল। এক দিনের জায়গায় সাতদিন কাটিয়ে আজ দুপুরে ফিরেছে। টুরের ব্যাপারটা যে মিথ্যা রীনার কাছে তা প্ৰকাশ হয়ে পড়েছে। চারদিনের দিন অফিস থেকে তারেকের এক কলিগ এসেছিল খোঁজ নিতে–তারেকের অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে। কিনা, তার কাছেই রীনা জেনেছে। তারেক দুদিনের ক্যাজুয়েল লিভ নিয়েছে। রীনা খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে–দুইয়ে দুইয়ে চার করা তার জন্যে কোনো সমস্যাই না। হাসান এখনো জানে না ভাবি হিসাব মিলাতে বসেছে কি না। সব ঘটনা জানার পর রীনার প্রতিক্রিয়া কী হবে হাসান তাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে ধৈৰ্য হারালে সমস্যা হবে। তবে ভাবি সম্ভবত ধৈৰ্য হারাবে না। তারেক দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যায় গোসল করে পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে। দুবার চা চেয়ে নিয়ে খেয়েছে। তার চেহারা এবং কথাবার্তায় কোনোরকম উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নেই। বরং মুখটা হাসি হাসি। টগরের কথা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর টগর ঠিকই শব্দে কাশছে তারেক সেটা নিয়ে উদ্বেগও প্ৰকাশ করল। রীনাকে ডেকে বলল, টগরের বুকে কফ বসে গেছে। এক কাজ কর সরিষার তোলে রসুন দিয়ে তেলটা গরম করে বুকে মালিশ করে দাও। আর এক কাপ কুসুমগরম পানিতে এক চামচ মধু দিয়ে ওই পানিটা খাইয়ে দাও। কফ আরাম হবে। ঘরে মধু আছে? রীনা স্বাভাবিক গলায় বলল, না মধু নেই। তারেক বলল, এক শিশি মধু ঘরে সব সময় রাখবে। মেডিসিন বক্সে যেমন নানান ধরনের ওষুধপত্র থাকে তেমনি এক শিশি মধু থাকা উচিত। কোরান শরীফে কয়েকবার মধুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাসানকে বল মধু নিয়ে আসুক। হাসান বাসায় নেই। আচ্ছা ঠিক আছে-কাগজটা পড়ে দি। আমি এনে দেব। তারেক মধু এনে দিয়ে রাতের খাবার খেতে গেল। সে সাধারণত চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। আজ রানার সঙ্গে গল্প শুরু করল। রাজনৈতিক গল্প। তারেক বিএনপি সমর্থক ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর সে কিছুটা আওয়ামী লীগ ঘেসা হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা দেশ তো মনে হয় ভালোই চালাচ্ছে, কী বল? হুঁ। সাহস আছে। রাজনীতিতে সাহসটা অনেক বড় জিনিস। কর্নেল ফারুক গং-কে কেমন জেলে ঢুকিয়ে দিল দেখলে? হুঁ। ভালো কাজ করলে সাপোর্ট পাবে। তবে মূল সমস্যাটা কোথায় জান? না। মূল সমস্যা মানুষের ভেতর না। মূল সমস্যা সিংহাসনে। সিংহাসনে কিছুদিন বসলেই মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীকে দেখ–লোকে যে তাকে এখনো ভালো বলে কেন বলে? সিংহাসনে বসেন নি বলেই বলে। দু মাস সিংহাসনে বসতেন দেখতে
false
humayun_ahmed
বলে নাও। বৃদ্ধ তার মেয়ে এবং নাতনীর যে ইতিহাস শুরু করেছে তার সঙ্গে হাসানের কাজের সম্পর্ক কী? হাসান। জ্বি স্যার। জয়দেবপুরের শালবনে আমার দুশ বিঘার মতো জমি আছে। একটা কেমিকেল ইনডাস্ট্রি করার জন্যে জায়গাটা নিয়েছিলাম পরে আর ইন্ডাস্ট্রি করা হয়নি। জায়গাটা পতিত পরে আছে। আমি সেখানে একটা পার্কের মতো করতে চাই— শিশু পার্ক। পার্কে কী থাকবে? কী থাকবে সেটা তুমি ঠিক করবে। তোমার রুচি আছে, কল্পনাশক্তি আছে। আমার যেহেতু টাকাপয়সা আছে, তোমার লজিক অনুসারেই রুচি এবং কল্পনাশক্তি থাকার কথা না। আমি তোমার রুচি এবং তোমার কল্পনার উপর ভরসা করছি। হাসান ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার কথায় রাগ করবেন না। আপনি পার্ক নিয়ে কী ভাবছেন আমার জানা দরকার। ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি কিছুই ভাবছি না। আমি শুধু ভাবছি ছনম্বর জন্মদিন এলেন ঐ পার্কে করবে এবং সে মুগ্ধ হয়ে ভাববে— এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে আছে! সে যেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে মা আমি এখানেই থাকব। আমি স্টেটস-এ ফিরে যাব না। আমি আমার নিম্নমানের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি— সে নিজের মনে ছোটাছুটি করতে করছে— যাই দেখছে সে বিস্মিত হচ্ছে। সে ছুটে গেল জঙ্গলে সেখানে বিশাল সাইজের ডায়নোসর। এমনভাবে বানানো হয়েছে। যেন ডায়নোসরগুলি কংক্রিটের না, জীবন্তু। বুঝতে পারছ? জ্বি পারছি। এলেন মুগ্ধ হয়ে ছুটছে, হঠাৎ দেখল– রূপকথার জগৎ। রূপকথার রাজারানীদের প্রাসাদের মতো প্রাসাদ। এক জায়গায় দেখল— ডাইনীদের আস্তানা। ডাইনীরা বড় ডেগচিতে কী যেন রান্না বসিয়েছে। খুব সম্ভব নরমাংস। একটা লেক থাকবে। লেকের পানি তুবে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। লেক ভর্তি রঙিন মাছের ঝাঁক। লেকের উপর নৌকা থাকবে। ও আচ্ছা, নকল জলপ্রপাত থাকবে। একটা সুড়ং থাকতে পারে। সুড়ংঙের ভেতর দিয়ে এলেন যখন হাঁটবে, যে নানান বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে দেখতে এগুবে। সুড়ং যেখানে শেষ হবে সেখানে তার জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিস্ময়টা কী আমি জানি না। জানতেও চাই না। হাসান, এতবড় দায়িত্ব এককভাবে নেবার মতো সাহস কি তোমার আছে? হাসান বলল, আছে। আপনার বাজেট কত? ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার কত দরকার? হাসান বলল, কত দরকার আমি বুঝতে আপ্রছি না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি তোমার বানানো পানিতে ডুবে থাকা পরী দেখেছি। তুমি যদি সাহস করে বলো আমি পারব। তাহলে তুমি পারবে। বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। হাসান বলল, কাজ শুরুর সময় সবাই এরকম বলে— বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কাজ কিছুদূর আগাবার পরই বাজেট সমস্যা শুরু হয়। ইয়াকুব সাহেব বললেন, শখের কাজে কখনো বাজেট সমস্যা হয় না। শখের বাজেট সব সময় থাকে। হাসান বলল, শখের একটা সমস্যাও আছে স্যার। শখ বেশিদিন থাকে। আপনি কিছু বোঝার আগেই দেখবেন শখ চলে গেছে। ইয়াকুব সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, হাসান শোনো। প্রতিটি মানুষই আলাদা। সেই হিসেবে একেক জন মানুষের শখের স্থায়িত্ব একেক রকম। স্যার আপনি পুরো কাজটা করতে চাচ্ছেন— এলেন নামের পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে মুগ্ধ করার জন্যে। ধরুন কোনো কারণে মেয়েটি বলল—— সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারছে না, পরে কোনো এক সময় আসবে তখনো কি আপনার শখ থাকবে? এলেন আসবে। কারণ আমি তাকে দেখতে চেয়েছি। আমি অসুস্থ আমি একজন ডাইং পেসেন্ট। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন খুব বেশি হলে আমি দুবছর বাঁচব। এই অবস্থায় এলেন আসবে না তা হয় না। তারপরেও যদি না আসে কোনো ক্ষতি নেই। আমার মুখের কথার দাম অনেক বেশি। আমার সঙ্গে তোমার সেরকম পরিচয় নেই বলেই তুমি দ্বিধায় ভুগছু। ঠিকমত বলো তুমি কি কাজটা করতে পারবে? পারব— যদি মানি সাম্পাই ঠিক থাকে আমি পারব। কিছুদূর কাজ করার পর টাকার জন্যে হাতগুটিয়ে বসে থাকতে হলে আমি পারব না। জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে— পারবে? পারব। প্রশ্নটা আবার করছি : জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে। পারবে? পারব। ভালো। হাত বাড়াও আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক কর। হাসান বলল, আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার আগে আমার কিছু কথা আছে স্যার। বলো। আমি কাজটা আমার মতো করব। সেখানে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। আপনি বলতে পারবেন না–এই ডায়নোসরটা এরকম কেন? সাইজে ছোট কেন? কিংবা এই ডায়নোসরটার মুখ বাকা কেন? ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি এলেনের সঙ্গে জুন মাসের নয় তারিখেই প্রথম পার্কে যাব। আমি কোথায় কী করছি এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করব না। আলাপের প্রয়োজন দেখছি না। আপনি আমার কোম্পানির নামে প্রথম চেক আগামীকাল ব্যাংকে জমা দেবেন। চেকে কত টাকার অংক বসানো আছে সেটা দেখে আমি বুঝতে পারব আপনি আমার কাছে কি চাচ্ছেন। কাজ শুরু হবে আগামীকাল থেকে। এই টাকা যখন শেষ হবে তখন আপনাকে বলব— আপনি আরেকটা চেক দেবেন। তোমার রেমুনারেশন কী হবে? জুন মাসের নয় তারিখে পার্ক যেদিন খোলা হবে সেদিন আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমাকে রেমুনারেশন দেবেন। ইচ্ছা না করলে দিতে হবে না। তোমার কোম্পানির নাম, যে ব্যাংকে তোমার একাউন্ট আছে তার নাম এবং একাউন্ট নাম্বারটা পরিষ্কার করে এই কাগজে লিখে দাও। হাসান লিখল। লিখতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল তার হাত কাঁপছে— বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। মনে হচ্ছে অতিরিক্ত উত্তেজনায় জ্বর এসে যাচ্ছে। ইয়াকুব সাহেব বললেন, এখন কি আমরা হেন্ডশেক করতে পারি? হাসান হাত বাড়িয়ে দিল। ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমরা ওয়েটিংরুমে
false
humayun_ahmed
ঘরে থাকলেই ইয়াদের হাতে পড়তে হবে। সারা দিনের জন্যে আটকে যেতে হবে। আমার কাজ হবে তার পেটমোটা কালো ব্যাগ ‍নিয়ে ঘুরে বেড়ানো—এখন যেহেতু ভিডিও ক্যামেরা কেনা হয়েছে—ভিক্ষুকদের ইন্টারভ্যু হবে ভিডিওতে। এতদিন ক্যাসেট রেকর্ডারে হচ্ছিল। ইয়াদের কাজকর্ম পরিষ্কার। তৈরি প্রশ্নমালা আছে—ইন্টারভ্যুর সময় তৈরি প্রশ্নমালার বাইরে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্নের নমুনা হল— নাম? স্ত্রী না পুরুষ? বয়স? শিক্ষা? পিতার নাম? ঠিকানা ক) স্থায়ী? খ) অস্থায়ী? কতদিন ধরে ভিক্ষা করছেন? দৈনিক গড় আয় কত? পরিবারের সদস্য সংখ্যা? সদস্যদের মধ্যে কতজন ভিক্ষুক? খাবার রান্না করে খান, না ভিক্ষালব্ধ খাবার খান? এরকম মোট পঞ্চাশটা প্রশ্ন। একেকজনের উত্তর দিতে ঘণ্টাখানিক লাগে। এক ঘণ্টার জন্যে তাকে পাঁচ টাকা দেয়া হয়। পাঁচ টাকার চকচকে একটা নোট হাতে নিয়ে অধিকাংশ ভিক্ষুকই চোখ কপালে তুলে বলেন, অতক্ষণ খাটনি করাইয়া এইডা কী দিলেন? আফনের বিচার নাই? আমি ইয়াদকে বলার চেষ্টা করেছি, এ-জাতীয় প্রশ্ন অর্থহীন।ইয়াদ মানতে রাজি নয়। সে নাকি তিন মাস দিনরাত খেটে প্রশ্ন তৈরি করেছে। প্রশ্ন তৈরির আগে স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড়া করিয়েছে। কম্প্যুটার সফটওয়্যরে পরিবর্তন করেছে—ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তার বকবকানি শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছি, চুপ কর্ গাধা। সে খুবই অবাক হয়ে বলেছে—গাধা বলছিস কেন? আমাকে গাধা বলার পেছনে তোর কি কি যুক্তি আছে তুই পয়েন্ট ওয়াইজ কাগজে লিখে আমাকে দে। আমি ঠাণ্ডা মাথায় অ্যানালাইসিস করব। ‍যদি দেখি তোর যুক্তি ঠিক না, তা হলে আমাকে গাধা বলার জন্যে তোকে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এ-জাতীয় মানুষদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। আমি সবসময় দূরে থাকার চেষ্টাই করি। আমি পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াই।গাধাটা আমাকে খুঁজে খুঁজে বের করে। একধরণের চোর-পুলিশ খেলা। আমি চোর—সে পুলিশ। যেহেতু চোরের বুদ্ধি সবসময়ই পুলিশের বুদ্ধির চেয়ে বেশি, সেহেতু সে গত এক সপ্তাহ আমার দেখা পায় নি। আজো পাবে না। আমি আবার বের হয়ে পড়লাম। আমার কোনো রকম পরিকল্পনা নেই। প্রথমে রুপার কাছে যাওয়া যায়। ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। প্রিয় মুখ কিছুদিন পরপর দেখতে হয়। মানুষের মস্তিষ্ক অপ্রিয়জনদের ছবি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। প্রিয়জনদের ছবি কোনো এক বিচিত্র কারণে কখনো সাজায় না। যে জন্যে চোখ বন্ধ করে প্রিয়জনদের চেহারা কখনোই মনে করা যায় না। রুপাকে পাওয়া গেল না। রুপার বাবার সঙ্গে দেখা হল। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন —ও তো ঢাকায় নেই। এই ভদ্রলোক সহজ গলায় মিথ্যা বলেন। রুপা ঢাকায় আছে তা তাঁর কথা থেকেই আমি বুঝতে পারছি। আমি বললাম, কোথায় গেছে? ‘সেটা জানার কি খুব প্রয়োজন আছে?’ ‘না, জানার প্রয়োজন নেই—তবু জানতে ইচ্ছা করছে।’ ‘ও যশোর গিয়েছে।’ ‘ঠিকানাটা বলবেন?’ ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন, ঠিকানা দিতে চাচ্ছি না। ও অসুস্থ্। আমরা চাই না অসুস্থ অবস্থায় কেউ ওকে বিরক্ত করে। ‘অসুস্থ্ অবস্থায় মানুষের বন্ধুবান্ধবের প্রয়োজন পড়ে। আমি ওর খুব ভাল ব্ন্ধু। ‘ওর ঠিকানা দেয়া যাবে না।’ ‘ও কোথায় গেছে বললেন যেন?’ ‘যশোর।’ ‘খুব শিগ্‌গির ফেরার সম্ভাবনা নেই—তাই না?’ ‘দেরি হবে।’ আমি খুব চিন্তিত মুখে বললাম, একটা ঝামেলা হয়ে গেল যে! আজই প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় রুপার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল।সে-ই আমাকে বাসায় আসতে বলেছে। ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি বলছেন রুপা যশোরে। আপনার মত বয়স্ক, দায়িত্ববান একজন মানুষে আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই মিথ্যাকথা বলবেন না। তাহলে রুপার সঙ্গে দেখা হল কী ভাবে? ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন। কিছু বললেন না। তাঁকে মোক্ষম আঘাত করা হয়েছে। সামলে উঠতে সময় লাগবে। তাঁর মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখতে ভাল লাগছে। ‘তোমার নাম হিমু না?’ ‘জ্বি।’ ‘মিথ্যা যা বলার তুমি বলেছ। রুপার সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি, ও যশোরে আছে। আমার সঙ্গে তুমি যে ক্ষুদ্র রসিকতা করার চেষ্টা করলে তা আর করবে না। মনে থাকবে?’ ‘জ্বি স্যার, থাকবে।’ ‘গেট আউট।’ ‘থ্যাংক ইউ স্যার।’ আমি চলে এলাম। এমন কঠিন ধরণের একজন মানুষ রুপার মতো মেয়ের বাবা কী করে হলেন ভাবতে-ভাবতে আমি হাঁটছি—রুপার চিঠি এখনো পড়া হয়নি। পড়লে তো ফুরিয়ে গেল। চিঠির এই হল ম্যাজিক। যতক্ষণ পড়া হয় না, ততক্ষণ ম্যাজিক থাকে। পড়ামাত্রই ম্যাজিক ফু্রিয়ে যায়। কোথায় যাওয়া যায়? মেসে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ইয়াদ সেখানে নিশ্চয়ই বসে আছে। আমি মোরশেদ সাহেবের বাসার দিকে রওনা হলাম। খিলগাঁ—দূর আছে। অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে। কোনো-একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে হাঁটতে ভাল লাগে। যদিও জানি মোরশেদ সাহেব কে পাওয়া যাবে না। কোনো-কোনো দিন এমন যায় যে কাউকেই পাওয়া যায় না। আজ বোধহয় সেরকম একটা দিন। মোরশেদ সাহেব কে পাওয়া গেল না। দরজা তালাবন্ধ। তবে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। বাসার ঠিকানা বলার সমকয় তিনি বলেছিলেন—১৩২ নং খিলগাঁ, একতলা বাড়ি, সামনে বিরাট আমগাছ। সবই ঠিক আছে, শুধু আমগাছ নেই। শুধু এই বাড়ি না, আশেপাশের কোনো বাড়ির সামনেই আমগাছ নেই। মোরশেদ সাহেবের বাড়িতে দারোয়ান জাতীয় একজন কে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম—এখানে কি আমগাছ কখনো ছিল? সে বিরক্ত হয়ে বলল, আমগাছ কেন থাকবে? যেন আমগাছ থাকাটা অপরাধ। আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি এ বাড়িতে কতদিন ধরে আছেন? ‘ছোটবেলা থাইক্যা আছি।’ ‘এটা কি মোরশেদ সাহেবের কেনা বাড়ি?’ ‘জ্বে না, ভাড়া বাসা। তয় বেশিদিন থাকব না। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিছে।’ ‘আচ্ছা ভাই, যাই।’ ‘উনারে কিছু বলা লাগব?’ ‘না।’ আমি আবার হাঁটা ধরলাম।রাত
false
bongkim
তাহা প্রতাপসিংহ, আকব্বর শাহকেও শিখাইয়াছিল। দুনিয়ার বাদশাহকে কিল খাইয়া কিছু দিনের জন্য কিল চুরি করিতে হইল। কিন্তু ঔরঙ্গজেব কাহারও উপর রাগ সহ্য করিবার লোক নহেন। হিন্দুর অনিষ্ট করিতে তাঁহার জন্ম, হিন্দুর অপরাধ বিশেষ অসহ্য। একে হিন্দু মারহাট্টা পুন: পুন: অপমান করিয়াছে, আবার রাজপুত অপমান করিল। মারহাট্টার বড় কিছু করিতে পারেন নাই, রাজপুতের হঠাৎ কিছু করিতে পারিতেছেন না। অথচ বিষ উদ্গীরণ করিতে হইবে। অতএব রাজসিংহের অপরাধে সমস্ত হিন্দুজাতির পীড়নই অভিপ্রেত করিলেন। আমরা এখন ইন‍কাম্ টেক‍শকে অসহ্য মনে করি, তাহার অধিক অসহ্য একটা “টেক‍শ” মুসলমানি আমলে ছিল। তাহার অধিক অসহ্য–কেন না, এই “টেক‍শ” মুসলমানকে দিতে হইত না; কেবল হিন্দুকেই দিতে হইত। ইহার নাম জেজেয়া। পরম রাজনীতিজ্ঞ আকব্বর বাদশাহ; ইহার অনিষ্টকারিতা বুঝিয়া, ইহা উঠাইয়া দিয়াছিলেন। সেই অবধি উহা বন্ধ ছিল। এক্ষণে হিন্দুদ্বেষী ঔরঙ্গজেব তাহা পুনর্‍বার স্থাপন করিয়া হিন্দুর যন্ত্রণা বাড়াইতে প্রবৃত্ত হইলেন। ইতিপূর্‍বেই বাদশাহ জেজেয়ার পুনরাবির্ভাবের আজ্ঞা প্রচারিত করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ হইল। হিন্দুরা ভীত, অত্যাচারগ্রস্ত মর্‍মপীড়িত হইল। যুক্তকরে সহস্র সহস্র হিন্দু বাদশাহের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিল, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের ক্ষমা ছিল না। শুক্রবারে যখন বাদশাহ মসজিদে ঈশ্বরকে ডাকিতে যান, তখন লক্ষ লক্ষ হিন্দু সমবেত হইয়া তাঁহার নিকট রোদন করিতে লাগিল। দুনিয়ার বাদশাহ দ্বিতীয় হিরণ্যকশিপুর মত আজ্ঞা দিলেন, “হস্তীগুলা পদতলে ইহাদিগকে দলিত করুক |” সেই বিষম জনমর্‍দ হস্তি পদতলে দলিত হইয়া নিবারিত হইল। ঔরঙ্গজেবের অধীন ভারতবর্ষ জেজেয়া দিল। ব্রহ্মপুত্র হইতে সিন্ধুতীর পর্‍যন্ত হিন্দুর দেবপ্রতিমা চূর্ণীকৃত, বহুকালের গগনস্পর্শী দেবমন্দির সকল ভগ্ন ও বিলুপ্ত হইতে লাগিল, তাহার স্থানে মুসলমানের মসজিদ প্রস্তুত হইতে লাগিল। কাশীতে বিশ্বেশ্বরের মন্দির গেল; মথুরায় কেশবের মন্দির গেল; বাঙ্গালায় বাঙ্গালির যাহা কিছু স্থাপত্যকীর্‍তি ছিল, চিরকালের জন্য তাহা অন্তর্হিত হইল। ঔরঙ্গজেব এক্ষণে আজ্ঞা দিলেন যে, রাজপুতানায় রাজপুতেরাও জেজেয়া দিবে। রাজপুতানার প্রজা তাঁহার প্রজা নহে, তথাপি হিন্দু বলিয়া তাহাদের উপর এ দণ্ডাজ্ঞা প্রচারিত হইল। রাজপুতেরা প্রথমে অস্বীকৃত হইল; কিন্তু উদয়পুর ভিন্ন সর্‍বত্র রাজপুতানা কর্ণধারবিহীন নৌকার ন্যায় অচল। জয়পুরের জয়সিংহ–যাঁহার বাহুবল মোগল সাম্রাজ্যের একটি প্রধান অবলম্বন ছিল, তিনি এক্ষণে গতাসু;-বিশ্বাসঘাতক বন্ধুহন্তা ঔরঙ্গজেবের কৌশলে বিষপ্রয়োগ দ্বারা তাঁহার মৃত্যু সাধিত হইয়াছিল। তাঁহার বয়:প্রাপ্ত পুত্র দিল্লীতে আবদ্ধ। সুতরাং জয়পুর জেজেয়া দিল। যোধপুরের যশোবন্ত সিংহও লোকান্তরগত। তাঁহার রাণী এখন রাজপ্রতিনিধি। স্ত্রীলোক হইয়াও তিনি বাদশাহের কর্‍মচারীদিগকে হাঁকাইয়া দিলেন। ঔরঙ্গজেব তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে উদ্যত হইলেন। স্ত্রীলোক যুদ্ধের ধমকে ভয় পাইলেন। রাণী জেজেয়া দিলেন না, কিন্তু তৎপরিবর্‍তে রাজ্যের কিয়দংশ ছাড়িয়া দিলেন। রাজসিংহ জেজেয়া দিলেন না। কিছুতেই দিবেন না; সর্‍বস্ব পণ করিলেন। জেজেয়া সম্বন্ধে ঔরঙ্গজেবকে একখানি পত্র লিখিলেন। রাজপুতানার ইতিহাসবেত্তা সেই পত্রসম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “ , , , , - , , , ”6 পত্রখানি বাদশাহের ক্রোধানলে ঘৃতাহুতি দিল। বাদশাহ রাজসিংহের উপর আজ্ঞা প্রচার করিলেন, জেজেয়া ত দিতে হইবেই, তাহা ছাড়া রাজ্যে গোহত্যা করিতে দিতে হইবে, এবং দেবালয় সকল ভাঙ্গিতে হইবে। রাজসিংহ যুদ্ধের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। ঔরঙ্গজেবও যুদ্ধের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। এরূপ ভয়ানক যুদ্ধের উদ্যোগ করিলেন যে, তিনি কখন এমন আর করেন নাই। চীনের সম্রাট, কি পারস্যের রাজা তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইলে যে উদ্যোগ করিতেন না, এই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার বিরুদ্ধে সেই উদ্যোগ করিলেন। অর্‍ধেক আসিয়ার অধিপতি সের () যেমন ক্ষুদ্র গ্রীসরাজ্য জয় করিবার জন্য আয়োজন করিয়াছিলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর সের, ক্ষুদ্র রাজা রাণা রাজসিংহকে পরাজয় করিবার জন্য সেইরূপ উদ্যোগ করিয়াছিলেন। এই দুইটি ঘটনা পরস্পর তুলনীয়, ইহার তৃতীয় তুলনা আর নাই। আমরা গ্রীক ইতিহাস মুখস্থ করিয়া মরি–রাজসিংহের ইতিহাসের কিছুই জানি না। আধুনিক শিক্ষার সুফল! 6- ’ – , 381 ষষ্ঠ খণ্ড অগ্নির উৎপাদন প্রথম পরিচ্ছেদ : অরণিকাষ্ঠ–উর্‍বশী রাজসিংহ যে তীব্রঘাতী পত্র ঔরঙ্গজেবকে লিখিয়াছিলেন, তৎপ্রেরণ হইতে এই অগ্ন্যুৎপাদন খণ্ড আরম্ভ করিতে হইবে। সেই পত্র ঔরঙ্গজেবের কাছে কে লইয়া যাইবে, তাহার মীমাংসা কঠিন হইল। কেন না, যদিও দূত অবধ্য, তথাপি পাপে কুণ্ঠাশূন্য ঔরঙ্গজেব অনেক দূত বধ করিয়াছিলেন ইহা প্রসিদ্ধ। অতএব প্রাণের শঙ্কা রাখে, অন্তত: এমন সুচতুর নয় যে, আপনার প্রাণ বাঁচাইতে পারে, এমন লোককে পাঠাইতে রাজসিংহ ইচ্ছুক হইলেন না। তখন মাণিকলাল আসিয়া প্রার্থনা করিল যে, আমাকে এই কার্‍যে নিযুক্ত করা হউক। রাজসিংহ উপযুক্ত পাত্র পাইয়া তাহাকেই এই কার্‍যে নিযুক্ত করিলেন। এ সংবাদ শুনিয়া চঞ্চলকুমারী, নির্‍মলকুমারীকে ডাকিলেন। বলিলেন, “তুমিও কেন তোমার স্বামীর সঙ্গে যাও না?” নির্‍মল বিস্মিত হইয়া বলিল, “কোথায় যাব? দিল্লী? কেন?” চ। একবার বাদশাহের বঙ‍মহালটা বেড়াইয়া আসিবে। নি । শুনিয়াছি, সে না কি নরক। চ। নরকে কি কখন তোমায় যাইতে হইবে না? তুমি গরিব বেচারা মাণিকলালের উপর যে দৌরাত্ম্য কর, তাহাতে তোমার নরক হইতে নিস্তার নাই। নি । কেন, সুন্দর দেখে বিয়ে করেছিল কেন? চ। সে বুঝি তোমায় গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া থাকিতে সাধিয়াছিল? নি । আমি ত আর তাকে ডাকি নাই। এখন সে ভূতের বোঝা বহিয়া দিল্লী গিয়া কি করিব বলিয়া দাও। চ। উদিপুরীকে নিমন্ত্রণ-পত্র দিয়া আসিতে হইবে। নি । কিসের? চ। তামাকু সাজার। নি । বটে, কথাটা মনে ছিল না। পৃথিবীশ্বরী তোমার পরিচর্‍যা না করিলে, তোমারও ভূতের বোঝা মিলিবে না। চ। দূর হ পাপিষ্ঠা! আমিই এখন ভূতের বোঝা। হয়, বাদশাহের বেগম আমার দাসী হইবে–নহিলে আমাকে বিষ খাইতে হইবে। গণকের ত এই গণনা। নি । তা, পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণ করিলেই কি বেগম আসিবে? চ। না।
false
shirshendu
জানে। বুবকা তার বাবাকে যত ভালবাসে, যত বিশ্বাস করে, বাপের ওপর যত নির্ভর করে, তত আর কাউকে নয়, কারও ওপর নয়। মা! বলে এক গাল হাসল বুবকা। ইস ঘেমেছিস কেন? শীতে কেউ ঘামে? আমার যে ফ্যাট আছে। ফ্যাট! কে আবার ওকথা বলল? তুমি খাইয়ে খাইয়ে বোজ আমার ফ্যাট বাড়িয়ে দিচ্ছো। বলিস কি রে? কোথায় আবার ফ্যাট? আছে মা। রোজ এত এত খাচ্ছি, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? মোটেই তোর ফ্যাট নেই। স্কুলে আমাকে আজকাল কেউ কেউ ফ্যাটসো বলে ডাকে। তারা অন্ধ। বুবকা নিঃশব্দে হাসল, তারপর বলল, কী টিফিন খাওয়াবে বলে তো! আই অ্যাম হাংরি। হাত-মুখ ধুয়ে আয়। নুডলস্ করে রেখেছি, চিংড়ি দিয়ে। দ্যাটস্ ফাইন। সন্ধে অনেকটা গড়িয়ে মণীশ ফেরে। মুখখানা গম্ভীর। ছেলেমেয়েরা যে যার ঘরে পড়ছে। একা অপৰ্ণাই রিসিভ করে তাকে। গম্ভীর কেন গো? গম্ভীর! না তো! অপর্ণার আবার চোখে জল আসতে চায়। সে তো মণীশকে দুহাতে আগলে রেখেছে। তবু কোথায় যে ব্যবধান রচিত হয়ে যায়। সে কিছু করতে পারে না। নদীর ধারে বাস করতে হেমাঙ্গর কি নেশা ধরে গেল? গত শুক্রবার এসেছে। কলকাতায় বিস্তর বকেয়া কাজ পড়ে থাকা সত্ত্বেও আজ আর এক শুক্রবার অবধি রয়ে গেছে এখানে। কোনও খবরও দেয়নি কোথাও। না বাড়িতে, না অফিসে, না রশ্মিকে। দায়হীন জীবন কি এরকমই হয়? গত সাত দিন সে নৌকোয় নৌকোয়, হেঁটে হেঁটে নানা গায়ে ঘুরেছে, বাঁকা মিঞার সঙ্গে বাঘের জঙ্গল অবধি। দাড়ি কামায়নি, শহুরে পোশাক পারেনি। ধুতি আর শার্ট। তাও ময়লা হয়েছে যথেষ্ট। বাঁকা মিঞা না বলে পারল না, বাবু, কাণ্ডটা কী? এসব হচ্ছেটা কি? আপনি যে আর বাড়িমুখো হচ্ছেন না। একটু হেসে হেমাঙ্গ বলে, কী হবে বাড়িমুখখা হয়ে? কী আছে বলে তো সেখানে! এখানেই বা কোন মধুটা পাচ্ছেন আপনি? এখানে কী আছে? এখানে আর যাই হোক, দায় তো নেই। এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে বলে তো আর কেউ শাসাচ্ছে না। সেদিন যে লোকটা এসেছিল কী বলে গেল আপনাকে? চয়ন! সে তো চারুদিদির গুপ্তচর। ছেলেটা ভাল। জানতে এসেছিল। বাঁকা মিঞা মাথা নেড়ে বলে, কিছু একটা পাকিয়ে তুলেছেন বলে মনে হচ্ছে। একটু খোলসা হবেন কি? হেমাঙ্গ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, খোলসা হতে বলছো? কিন্তু নিজেই তো জানি না তোমাকে কী বলব! মাঝে মাঝে এমন এক একটা সংকটের সময় আসে যখন মানুষ সত্যিই বুঝতে পারে না, সে কী চায়। যেটা চায় না, সেটাই হয়তো চায়, যেটা চায় সেটা হয়তো তার সত্যিই প্রয়োজন নেই। এরকম সব সংকটের মুহূর্তে একজন প্রম্পটারের অভাব বড় বেশী বোধ করে হেমাঙ্গ। কে বুঝিয়ে দেবে, কে বলে দেবে। বাঁধ ধরে সকালে অনেক দূর হটে হেমাঙ্গ। সূর্যোদয় দেখে। মাঠঘাট, নদী নিয়ে বিশাল বিস্তার জেগে ওঠে চোখের সামনে। মনে হয়, কোনও পিছুটান আর নেই। নোঙর ছেড়ে সে এখন অনির্দিষ্ট বার রিয়ায়। যেন সে আর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নয়, যেন তাকে আর পয়সা রোজগার করতে হবে না, আর বিষয়-চিন্তা করতে হবে না, যেন তার কোনও দায়ভারই নেই পৃথিবীতে। কিন্তু তিষ্টোতে দেয় না বাঁকা মিঞা। প্রায়ই এসে তাড়া দেয়, একবার কলকাতা ঘুরে আসেন গিয়ে। কাজকর্ম যে সব রসাতলে যাবে। আমাকে চাষবাস শেখাবে বাঁকা। সে সব হবেখন। শখের শেখা শিখতে বেশী সময় লাগবে না। কিন্তু আপনার যা বিদ্যে তা তো এ কাজের জন্য নয়, সবাই চাষ করলে দুনিয়াটা চলবে কি করে? দিন দুয়েক আগে সে রশিকে একটা চিঠি দিয়েছে। তাতে লিখেছে, নিজের সঙ্গে কিছু বোঝাঁপড়া আছে। তাই কদিনের ছুটি নিয়েছে। তুমি কিছু মনে কোরো না। এই ছুটিটার বড় দরকার ছিল আমার। বোধ হয় মানসিক ক্লান্তিই হবে। আমার ঠিকানা চাদি জানে। সুতরাং নিরুদ্দেশ হইনি। তুমি বোধ হয় দিল্লি গেছ। সেরকমই শুনেছিলাম তোমার মুখে। এসে এ চিঠি পাবে। পাওয়ার পর একটু অপেক্ষা কোরো। আমি গিয়ে বুঝিয়ে বলব। এমনই কপাল, বাংলায় গুছিয়ে একটু চিঠিও লিখতে পারি না। লেখার দোষে ভুল বুঝে না। চিঠিটা পৌঁছে থাকবে। নাও পৌছোতে পারে। চিঠিটা দেওয়া উচিত হল কিনা তা বুঝতে পারে না হেমাঙ্গ। উচিত হল কি? এই অজ্ঞাতবাসের জবাবদিহিই বা সে কেন করল? গত চার দিন বাঁকা মিঞার ঘাড়ে আর খাচ্ছে না হেমাঙ্গ। সে আজকাল রান্না করছে। প্রথম প্রথম পুড়ে বা গলে যেত তরকারি বা ভাত। আজকাল মোটামুটি হয়। তবে এত খারাপ রান্না জীবনে খায়নি হেমাঙ্গ। খিদের মুখে খাওয়া যায়, এই মাত্র। বাঁকা মিঞা যথেষ্ট আপত্তি তুলে বলেছে, আমি যতদিন আছি ততদিন রাঁধবেন কেন? আমি মরণে না হয়– হেমাঙ্গ বলে, না বাকা, তোমার ঘাড়ে বসে খেলে আমার এই অজ্ঞাতবাসটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। কোনও মানে থাকবে না। নিজের ওপর নির্ভর না করলে মজাও থাকে না। সাত দিনে সে বুঝতে পারছে, ব্যাপারটা একটু বোরিং। সাতটা দিন কাটছে খুব ঢিমে তেতালে। সে হিসেব করে দেখেছে এখানে এক ঘণ্টা কাটে কলকাতার আড়াই ঘন্টার মাপে। এখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে অনেক বেশী সময় লেগে যায়। গত সাত দিনে এখানে সে যত হেঁটেছে, গত দশ বছরেও সে এত হাঁটেনি। হাঁটা জিনিসটাও তার কাছে ক্লান্তিকর। কারণ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পথ যেন ফুবোয় না। এসব না ধরলে তার কিছু খারাপ লাগছে না। গাঁয়ের অনেক মানুষজনের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে।
false
shirshendu
পড়ে গিয়ে চোট হল কপালে। প্রায় সারা রাত কাঁদল নিমাই। এক ফেঁটা ঝিমুনি এল না তার গুদামঘরের গুমটিতে পাহারা দিতে বসে। সারা রাত ভগবানকে ডাকল, সারা রাত মনস্তাপে হাহাকার করল বুক। না, তার একটুও লোভ নেই। তার যা আছে সব সে দিয়ে দেবে কাকাকে। তারপর কাকা হোরা বা গুলি যাই দিয়েই মারুক শান্তভাবেই মরবে নিমাই। কৰ্মফল ক্ষয় হোক। ওদিকে রাত নটা নাগাদ বনগাঁয়ে বীণার দরজায় ধাক্কা পড়ল, বীণা দরজা খোলো শিগগির। বিরক্ত হয়ে বীণা উঠে এল, এত রাতে জ্বালাতে এলেন বাবু। কী গো, কী চাই? সজলকে কিছু উদ্ভ্ৰান্ত দেখাচ্ছিল। বলল, বীণা, আমি ছুটতে ছুটতে আসছি। একটা কথা ছিল। বীণা মুখ টিপে হেসে বলল, রসের কথা তো! অনেক বলেছ। বীণা, কথাটা জরুরি। তোমার বিপদ! বিপদ! আপাতত একতলা। দোতলাটা পরে হবে, যদি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই প্রয়োজনটা নিয়েই আবার মণীশ আর অপর্ণার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে। মণীশ বলল, দোতলাটা একবারেই করে ফেলা দরকার। দোতলাটা হবে লিভিং কোয়ার্টার, একতলায় থাকবে বসবার ঘর, ডাইনিং রুম, রান্নাঘর। অপর্ণা মাথা নেড়ে বলে, দোতলার এখন কোনও দরকার নেই। দু কাঠা জমি নিয়ে বাড়ি হচ্ছে। একতলাতেই অনেক জায়গা। মণীশ আপত্তি করতে লাগল, একতলায় মশা বেশি। চোরের উৎপাত হবে খুব। জানালা দিয়ে লগি ঢুকিয়ে আলনার জিনিসপত্র টেনে নিয়ে যাবে। অত সোজা নয়। জানালায় জাল থাকবে। শোনো অপু, একতলায় আরও হ্যাজার্ড আছে। ক্ৰলিং ওয়ার্ম এসে ঢুকবে বর্ষাকালে। ব্যাঙ লাফাবে ঘরের মধ্যে, কেঁচো বেয়ে বেড়াবে, বিছে কিলবিল করবে। হ্যাঁ গো, এরপর আমাকে ভয় দেখানোর জন্য রাক্ষস-খোৰূসের গল্পও ফাঁদবে নাকি? একতলায় কি মানুষ থাকছে না? সব একতলাই কি সুন্দরবন! খুবই ব্যথিত হয়ে মণীশ বলল, একতলার হ্যাজার্ডস্ তুমি স্বীকার না করলেও, আছেই। বেশি বৃষ্টি হলে ড়ুবেও যেতে পারে ঘরদোর। অনেক কিছু হলে অনেক কিছুই হতে পারে। তা বলে সেসব ভেবে গুটিয়ে থাকতে হবে নাকি? তুমি ভীষণ অ্যাডামেন্ট অপু। মোটেই নয়। আমি প্র্যাকটিক্যাল। এক গাদা টাকা খরচ করে দোতলা বানাবে। থাকবে কে বলো তো? মোটে তো পাঁচটি প্রাণী। অনু আর ঝুমকির বিয়ে হয়ে যাবে, বুবকা হয়তো পড়তে চলে যাবে হোস্টেলে, তখন অত বড় বাড়ি হাঁ হাঁ করবে না? তুমি তো ভাড়াটেও বসাতে দেবে না। না, না, ভাড়াটের প্রশ্নই উঠছে না। কিন্তু দোতলা অনেক সেফ এটা তো মানো? সাবধান থাকলে একতলাও সেফ। অত ভয়ের কিছু নেই। আচ্ছা অপু, একটা কাজ করলে হয় না। আবার কী? ধরো, একতলাটা আমরা কমপ্লিট করলাম না, শুধু পিলার থাকল। শুধু পিলারের ওপর দোতলাটা করলাম। ডিজাইনটাও চমৎকার হবে আর দোতলায় থাকাও হবে। মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া এলেই তো হবে না। দোতলা মানেই দু দফা ছাদ ঢালাই। খরচ কাছাকাছিই পড়বে। মণীশ খুবই হতাশ মুখে বসে থাকে। মুখে থমথম করে বাচ্চা ছেলের মতো অভিমান। তারপর বলে, ঠিক আছে, ছেলেমেয়েদের মতও নেওয়া হোক। লেট আস পুট ইট টু ভোট। অপর্ণা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, কখনও নয়। তোমার ডেমোক্র্যাসির চালাকি আমার জানা আছে। ছেলেমেয়েরা সবাই তোমার দলে। তোমার মতোই ইমপ্র্যাকটিক্যাল। ওরা যখনই বুঝবে যে, তুমি দোতলা করতে চাও তখনই ওরা তোমার পক্ষ নেবে। আমি তোমার ভোটাভুটি মানি না। তুমি একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছো অপু। তাই চালাবো। তোমাদেরও মানতে হবে। আবার ভেবে দেখো অপু। তুমি বড় কৃপণ। আমাদের টাকা তো ছড় ফুড়ে আসে না! প্রচুর আপত্তি, বাদানুবাদের পর ছেলেমেয়েদেরও চুপ করাতে পারল অপৰ্ণা। বাড়ি করার ব্যাপারে স্বপ্নশীল মণীশকে সে দূরে রাখল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও কোনও পরামর্শই করল না। সে ধরল চারুশীলাকে। আপনার হাজব্যান্ড তো নামকরা মানুষ, যদি তার চেনাজানা কোনও ঠিকাদার বা রাজমিস্ত্রি ঠিক করে দেন তো ভাল হয়। চারু অবাক হয়ে বলল, তা কেন? সুব্ৰত নিজেই করে দেবে আপনার বাড়ি। অপর্ণা শিহরিত হয়ে বলে, কী যে বলেন। আমাদের বাড়ি নিতান্তই ছোট আর সাদামাটা। ওঁর মতো মস্ত মানুষ কেন ওরকম বাড়ি করতে যাবেন? তাতে কী? সাদামাটা বাড়ি করলে কি ওর জাত যাবে? তা নয়। আসলে উনি ব্যস্ত মানুষ। আমার তো ওঁকে দরকার নেই। একজন ভাল রাজমিস্ত্রি পেলেই আমার হয়ে যাবে। চারুশীলা অবশ্য এত সহজে ছাড়ল না। সুব্রতর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিল অপর্ণার। বলল, ওঁর বাড়িটা তোমাকেই করে দিতে হবে। অপর্ণা তো লজ্জায় মরে। কিন্তু সুব্রত এতটুকু বিব্রত বা বিরক্ত হল না। মিটিমিটি হাসিমুখে অপর্ণার বাড়ির প্ল্যানটা খুব খুঁটিয়ে দেখল। দু একটা প্রশ্ন করল। তারপর বলল, বাড়ির প্ল্যান ভালই হয়েছে। সয়েলটা একটু টেস্ট করিয়ে নিলে ভাল হত। জলা বা পুকুরটুকুর ছিল না তো ওখানে। তা তো জানি না। তাহলেও একটু ডীপ ফাউন্ডেশন করবেন। আমি মিস্ত্রি ঠিক করে দিচ্ছি। তাকেই বুঝিয়ে বলে দেবো সব। উঃ, বাঁচালেন। আপনি কি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি করাবেন, না কি কান্ট্রাক্টে? যদি নিজে করাই? সুব্রত মিস্টি হেসে বলল, করতে পারলে তো ভালই। কিন্তু প্রবলেমও আছে। মেটিরিয়াল চুরি হয়ে যাবে। চৌকিদার রেখেও সেটা আটকাতে পারবেন না। লোকাল মস্তানরা চাঁদা চাইবে। তারপর আপনার ফিজিক্যাল কষ্টটা তো আছেই। অনেকে বাড়ি করাতে গিয়ে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাহলে কন্ট্রাক্ট দেওয়াই কি ভাল? কলকাতায় সেটাই ভাল। একটু দেখাশুনো করলেই হবে। তাতে কি টাকা একটু বেশি লাগবে? সুব্রত মিটমিটি, হেসে বলে, যে টাকাটা বেশি লাগবে সেটা নিজে করলেও লেগে যাবে। চুরিটুরি গেলে
false
MZI
সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ঈশিতা যখন রাফির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সেই কথা বলার সিগনালটা ট্র্যাক করে রাফিকে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাফির ইয়েলো ক্যাবটাকে ট্র্যাক করা হলো এবং তখন একাধিক স্যাটেলাইট থেকে সেটাকে চোখে চোখে রাখা শুরু হয়ে গেল। শহরের বিভিন্ন জায়গায় রাখা এনডেভারের সিকিউরিটি গাড়িগুলোকে সেই খবর পৌঁছে দেওয়া হলো এবং তারা রাফির ইয়েলো ক্যাবটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ঈশিতার সঙ্গে কথা বলে রাফি যখন টেলিফোনটা রেখেছে, তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল, রাফি দেখল, সুহানা ফোন করেছে। সে ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, হ্যালো, সুহানা। সুহানা অন্য পাশ থেকে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, কী হলো, রাফি? তুমি কোথায়? নয়টার সময় তোমার ক্লাস, এখন বাজে নয়টা পনেরো। তোমার ছাত্রছাত্রীরা পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছে। বিশেষ করে তোমার ছাত্রীরা। তোমাকে পনেরো মিনিট দেখতে পায়নি, তাতেই তাদের হার্ট বিট মিস হতে শুরু করেছে। রাফি বলল, সুহানা। শোনো। আমি অসম্ভব বড় একটা ঝামেলার মাঝে পড়েছি। সুহানা সাথে সাথে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কী হয়েছে, রাফি? আমি এখন ঢাকায়। একটা ইয়েলো ক্যাবে থানাতে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছে শারমিন। থানাওয়ালারা আমার কথা শুনবে কি না, আমি বুঝতে পারছি না— রাফি তার কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে একটা বড় গাড়ি তার ক্যাবে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে ঠিক সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই পাশে আরও একটা গাড়ি থেমে যায়, সেখান থেকে কয়েকজন মানুষ নেমে এসে ক্যাবের দরজা খুলে রাফি আর শারমিনকে হ্যাচকা টান দিয়ে বের করে আনে। তারা কিছু বোঝার আগেই তাদের একটা ফোর হুঁইল ড্রাইভ জিপে তুলে নেওয়া হয় এবং সেটা টায়ারে কর্কশ শব্দ তুলে সামনে এগিয়ে যায়, ব্যস্ত রাস্তায় সেটা ইউ টার্ন নিয়ে উল্টোদিকে ছুটতে থাকে। রাফি হতবাক হয়ে গাড়ির ভেতর তাকাল, পেছনের সিটে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ বসে আছে। একজনের হাতে একটা বেঢপ রিভলবার, সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার ছাত্ররা আমার নিজের রিভলবারটা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এরা কী রকম ছাত্র, আর্মস ছিনতাই করে? রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির চেহারা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। মাঝবয়সী নিষ্ঠুর চেহারার মানুষ। মানুষটি হাতের রিভলবারটা শারমিনের মাথায় চুঁইয়ে বলল, চুল ছোট করে কাটলেই মেয়ে কি ছেলে হয়ে যায়? রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি বলল, এই মেয়েটার মগজ নাকি মিলিয়ন ডলার কেজিতে বিক্রি হবে। ইচ্ছে করছে, গুলি করে খুলি ফুটো করে সেই মগজটা দেখি—মিলিয়ন ডলারের মগজ দেখতে কী রকম! খুব উঁচুদরের রসিকতা করেছে, সে রকম ভঙ্গি করে মানুষটি হা হা করে। হাসতে থাকে। রসিকতাটা নিশ্চয়ই উঁচুদরের হয়নি, গাড়ির আর কেউ তার। হাসির সঙ্গে যোগ দিল না। মানুষটি সে কারণে একটু মনঃক্ষুন্ন হলো বলে মনে হলো। মুখটা শক্ত করে বলল, শোনো, মাস্টার সাহেব আর তোমার ছাত্রী, এই গাড়ির ভেতরে তোমরা কুঁ শব্দ করবে না। গাড়ির কাচ কালো রঙের, বাইরের কেউ তোমাদের দেখবে না। গাড়ি সাউন্ডপ্রুফ, চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললেও কেউ শুনতে পারবে না। তার পরও যদি বাড়াবাড়ি করো, আমি দুজনকে অজ্ঞান করে রাখব। অনেক আধুনিক উপায় আছে, আমি সেসবে যাব না, রিভলবারের বাট দিয়ে মাথার পেছনে শক্ত করে। মারব—অনেক পুরোনো পদ্ধতি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস কাজ করে। রাফি বুঝতে পারল, মানুষটি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে না। কাজেই সে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেই সে ঈশিতার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল, এখন সে নিজে ঠিক ঈশিতার জায়গায় এসে পড়েছে। তার জন্য এখন কে দুশ্চিন্তা করবে? কেউ কি আছে দুশ্চিন্তা করার? রাফির জন্য কেউই দুশ্চিন্তা করছিল না, সেটি অবশ্য সত্যি নয়। সুহানা যখন রাফির সাথে কথা বলছিল, তখন ঠিক কথার মাঝখানে সে শুনতে পেল। একটা বিকট শব্দ এবং তারপর কিছু উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। হঠাৎ করে টেলিফোনটা নীরব হয়ে গেল—আর কিছু বুঝতে না পারলেও অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে, সেটা বুঝতে সুহানার অসুবিধা হলো না। সে রাফির ক্লাসে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিল, তারপর সে অন্যদের খোঁজাখুঁজি করল। কাউকে না পেয়ে সে গেল নেটওয়ার্কিং ল্যাবে। রাফি আর শারমিনকে সেদিন এখানে একটা কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করতে দেখেছে—তারা কী কাজ করছিল, সেটা একটু বুঝতে চায়। প্রফেসর হাসান এলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, স্যার অনেক মানুষকে চেনেন, পুলিশকে হয়তো খবর দিতে পারবেন। তাদের কথাকে কেউ গুরুত্ব দেবে না, প্রফেসর হাসানকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে। ঘরটিতে ঢুকে ঈশিতা হতভম্ব হয়ে গেল। গতকাল কালো টেবিলটার যে মাথায় সে বসেছিল, আজকে সেখানে বসে আছে রাফি ও শারমিন। শারমিনের চুল ছেলেদের মতো করে কাটা, কিন্তু সে জন্য তাকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না—মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে রাফির সঙ্গে কথা বলেছে। ঈশিতা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রাফি, তুমি?বই কম। রাফি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, হ্যাঁ। কেমন করে? রাফি কিছু বলার আগে সাফারি কোট পরা চুল ছোট করে ছাঁটা মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তুমি যখন তার সঙ্গে পিরিতের কথা বলছিলে, তখন তাকে ট্র্যাক করেছি। এ জন্য যখন-তখন পিরিতের কথা বলতে হয় না। মানুষটি হা হা করে আনন্দে হাসতে থাকে। তার কথা বলার অশালীন ভঙ্গিটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঈশিতা রাফির কাছে গিয়ে বলল, তোমাকেও
false
shomresh
ছোটকাকাকে ধরিয়ে দিলে কোনো অন্যায় হবে না। বড় বড় পা ফেলে ও সরু গলিটায় চলে এলে। ক্রমশ ওর গতি কমে গেল এবং অবাক হয়ে চারধারে চেয়ে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। গলিটা একদম ফাঁকা। যেখানে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একটা গোরু নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। খুব হতাশ হয়ে পড়ল অনিমেষ। ওরা গেল কোথায়? একটু একটু করে গলিটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও ভীষণভাবে আশা করছিল ছেলেগুলোর দেখা পাবে। অথচ এই দুপুরবেলায় গলি এবং বড় রাস্তা ঠাসা রোদ্দুরে মেখে চুপচাপ পড়ে আছে। ওরা কি খোঁজ পাবে না বলে চলে গেল। ব্যাগটা ওজন যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। কোনো উপায় নেই, অনিমেষ সেটাকে টেনে টেনে বিরাম করের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। ছোটকাকা চলে যাবার পর বিরাম করের বাড়িতে অনিমেষের খাতির যেন বেড়ে গেল। মুভিং ক্যাসেল পরদিন স্কুল ছুটি হতেই ধরলেন। গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা, জেলা স্কুলের ছেলেরা ছুটির পর পিলপিল করে বেরিয়ে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। স্কুলের গেট পার হবার আগেই তপন ওঁকে দেখতে পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে একটা খোঁচা খেল অনিমেষ, ওই দ্যাখ, হোলি মাদার দাঁড়িয়ে আছেন। উইদাউট ডগ। অনিমেষ বলল, কী হচ্ছে কী? তপন থামল না, মাইরি, জলপাইগুড়িতে কোনো মেয়ের এরকম ব্লাউজ পরার হিম্মত নেই। শালা নিশীথবাবুটা বহুৎ চালু মাল! অনিমেষ এবার রেগে গেল, তপন, তুই যদি ভদ্রভাবে কথা না বলতে পারিস তা হলে আমার সঙ্গে আসিস না। মণ্টু এতক্ষণ শুনছিল চুপচাপ, এবার অনিমেষের পক্ষ নিল, সত্যি কথা। সব ব্যাপারে ইয়ার্কি করা ঠিক নয়। তারপর ফিসফিস করে বলল, মাসিমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দে না ভাই। ততক্ষণে ওরা রাস্তায় এসে পড়েছে। চোখাচোখি হতে মুভিং ক্যাসেল ঠোঁট টিপে মাথা সামান্য কাত করে হাসলেন অনিমেষ বলল, তোরা দাঁড়া, আমি আসছি। কাছাকাছি হতেই মুভিং ক্যাসেল অদ্ভুত মিষ্টি গলায় বললেন, বাবাঃ, ছুটি আর যেন হয় না, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বাড়িতে একটু আসবে না অনিমেষ দেখল স্কুলের অন্যান্য ছেলে যেতে-যেতে ওদের দেখছে। মণ্টু আর তপন চুপচাপ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অনিমেষ বলল, আমার সঙ্গে যে বন্ধুরা আছে? ও। চোখ বড় বড় করলেন মুভিং ক্যাসেল, ওঁরাও কংগ্রেসকে সার্পোট করে? অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না। মুভিং ক্যাসেল তাতে একটুও দুঃখিত হলেন না, আচ্ছা! তোমার বন্ধু যখন তখন ওরা নিশ্চয়ই ভালো ছেলে, কী বল? তা ওদের ডাকো না, ওরাও আসুক, বেশ আড্ডা দেওয়া যাবে খন। তোমার দাদা আবার আজকে প্লেনে কলকাতায় গেলেন। ঘোটকুটার শরীর খারাপ বলে আমি থেকে গেলাম। অনিমেষ হাতে নেড়ে বন্ধুদের ডাকল। মণ্টু বোধহয় এতটা আশা করতে পারেনি, ও তপনকে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু বলল, তারপর দুজনে আড়ষ্ট-পায়ে এদিকে আসতে লাগল। মুভিং ক্যাসেল গেটটা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন, এসো এসো, তোমরা তো অনিমেষের বন্ধু, এক ক্লাসেই পড় বুঝি? মণ্টু ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। তারপর ঝুঁকে পড়ে ওঁকে প্রণাম করতে গেল। প্রথম বুঝতে পারেনি মুভিং ক্যাসেল, তারপর সাপ দেখার মতো যতদূর সম্ভব শরীরটাকে সরিয়ে নিলেন, ওমা, এর যে দেখছি দারুণ ভক্তি! দিদি বউদিকে কি কেউ প্রণাম করে, বোকা ছেলে! এসো। মুভিং ক্যাসেলের পেছন পেছন যেতে-যেতে অনিমেষ মণ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। আজকাল কথায়-কথায় মুভিং ক্যাসেলের প্রসঙ্গ উঠলে মণ্টু মাসিমা বলে, বেচারার প্রথম চালটাই নষ্ট হয়ে গেল। বারান্দার বেতের চেয়ারে ওরা বসল। মুভিং ক্যাসেলের বসবার সময় চেয়ারটায় মচমচ শব্দ হতেই তিনি বললেন, খুব মোটা হয়ে গেছি, না? অনিমেষ কোনো কথা বলল না। উত্তরটা দিলে কারও স্বস্তি হবে না। মুভিং ক্যাসেলও বোধহয় চাননি জবাব, কী গরম পড়েছে, বাবা! পুজো এসে গেল কিন্তু ঠাণ্ডার নাম নেই। কথা বলতে বলতে বুকের আঁচল দিয়ে একটু হাওয়া নিলেন উনি, এবার তোমাদের দুজনের নাম জানা যাক। অনিমেষ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখল দুজনেই মুখ নিচু করে নাম বলল। কারণটা বুঝতে পেরে চট করে অনিমেষের কান লাল হয়ে গেল। আঁচলে হাওয়া খাওয়ার পর ওটা এমনভাবে কাঁধের ওপর রয়েছে যে মুভিং ক্যাসেলের বুকের গভীর ভাজটা একদম ওর মুখের মতো উন্মুক্ত। মুভিং ক্যাসেলের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই, নাম শুনে বললেন, বাঃ! সামনের বছর তো তোমরা সব কলেজ স্টুডেন্ট। এখন বলো তো, তোমরা কংগ্রেসকে কেন সাপোর্ট কর না? মণ্টু সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের দিকে তাকাল। তপন বলল, আমি এসব ভাবি না। মুভিং ক্যাসেল বললেন, তুমি? মণ্টু আস্তে-আস্তে বলল, আমি কংগ্রেসকে পছন্দ করি না। গুড। হাততালি দিয়ে উঠলেন মুভিং ক্যাসেল, আজ বেশ জমবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার আগে একটু চা হলে ভালো হয়, না? চা খাও তো সবাই? অনিমেষ বাড়িতে চা খায় না। কখনো-কখনো সর্দিকাশি হলে পিসিমা আদা দিয়ে চা তৈরি করে। দেন। কিন্তু আজ বন্ধুরা কেউ আপত্তি না করাতে ও চুপ করে থামল। মুভিং ক্যাসেল চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করে আবার বসে পড়লেন, আর পারি না। অনিমেষ ভাই, তুমি একটু যাও-না, ভেতরের রান্নাঘরে দেখবে আমাদের মেইড-সার্ভেন্ট আছে, ওকে বলবে চার কাপ চা আর খাবার দিতে। তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে। আদুরে মুখভঙ্গি করলেন উনি। বই-এর ব্যাগটা রেখে অনিমেষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মণ্টু আর মুভিং ক্যাসেলের আলোচনাটা শোনে। মণ্টু ইদানীং খুব কংগ্রেসকে গালাগালি দেয়। অনিমেষকে ঠাট্টা করে বলে, কবে ঘি খেয়েছিস এখন হাত চেটে গন্ধ নে। ও
false
manik_bandhopaddhay
ভাবনা কি তাদের? এখনো জ্বলছে বাবা আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাণী হঠাৎ বলে মুখ না ফিরিয়েই। তুই তো একটু শুলে পারতিস রাণী? গণেশের মা বলে আবেগহীন গলায়। এই মেয়েই যে যত ঝঞাট যত বিপাকের মূল এ কথা ভেবে তার কোনো জ্বালা নেই। সংসারের আর দশটা ঝঞাটে মেয়ে নয় বলে ওকে গঞ্জনা দেওয়া চলে, এই সৃষ্টিছাড়া ভয়ঙ্কর ব্যাপারে ওকে দায়িক ভাবা কি যায়? গণেশের মার অন্য দুশ্চিন্তা। মেয়ে তার খাঁটিই আছে, কিন্তু লোকে কি তা জানবে না মানবে! কেউ কিছু না বলুক, সবাই দরদ দেখাক, তবু মেয়ে তার ধৰ্মনাশের ছাপ মারা হয়ে রইল সকলের কাছে। সুধীর হয়তো মেয়েকে তার নেবে না এই অজুহাতে। এসব রাণী কি করে সইবে, অসহ্য হলে কেঁকের মাথায় কি করে বসবে, তাই ভাবে গণেশের মা। সেবার পদীর কচি মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাতরার ক্যাম্পে, সারারাত পদী মেয়ের কান্না শুনেছিল আর পাগলের মতো পাক দিয়েছিল ক্যাম্পের চারিদিকে। সকালে আমরা মেয়ে নিয়ে পদী গায়ে ফিরলে কি হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে, কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল চারিদিকের হিন্দু মুসলমান চাষাভূষো সব একজোট হয়ে, বড় হাকিম নিজে এসে ব্যবস্থা করার কথা না দিলে কাণ্ডই হয়ে যেত একটা। কাণ্ড হল শেষতক, তার মেয়েকে নিয়ে। পদীর মেয়ের দিকে ছিল সবাই, প্রাণ দিয়ে মায়া করেছে তাকে সবাই, সে নিজেও কি একদিন কেঁদে ফেলে নি তাকে বুকে জড়িয়ে দুটো কথা কইতে গিয়ে? তবু তো পুকুরে ড়ুবে মরল পদীর মেয়েটা। গায়ে থাকতে হলে রাণীই-বা কি করে বসত কে জানে? তার চেয়ে এ ভালো হয়েছে। ভাঙা ঘর আর ভিটেটুকু বাধা পড়ে আছে, ঋণের বোঝা জমে আছে পাহাড় হয়ে। কি হবে এ ভিটের মায়া করে? তার চেয়ে শহরে অচেনা লোকের মধ্যে রাণীও বাঁচবে শান্ত মনে, তারাও থাকবে সুখে শান্তিতে। গণেশের মার সুখশান্তির স্বপ্নও ভোলা আর খোসা দিয়ে গড়া। তার বেশি চাইতে ভুলেও গেছে, সাহসও হয় না। না খেতে পেয়ে একেবারে না মরলে, রোগে বিপাকে মরণাপন্ন না হলে, মাথা গুঁজবার ঠাঁইয়ের অভাব না ঘটলে তার কত শান্তি কত সুখ লাভ হত। কেশব একটি পুরোনো কম্বল হাতে করে ঘরে আসে, ঘরে তৈরী বালাপোষ গায়ে জড়িয়ে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে, শীর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি। সহজ শান্ত ভাব, একটু গাম্ভীর্যপূর্ণ। মাঝরাত্রে হঠাৎ এই খাপছাড়া অতিথি পরিবারটির আবির্ভাবে তাকে কিছুমাত্র ব্যস্ত বা বিপন্ন মনে হয় না। খিচুড়িটা নামবে এবার, কম্বলটা যাদবের কাছে নামিয়ে রেখে সে ঘরোয়া সুরে বলে, খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম করেই রওনা দিতে হবে। নৌকোয় ঘুমানো চলবে। নৌকো খুঁজতে গেছে। মোর তরে সবার বিপদ হল, পালাতে কেমন লাগছে বদ্যিমশায়। কেশব মাথা নেড়ে যেন তার এই অনুভূতির সঙ্গতিতেই সায় দেয়, বলে, পালাচ্ছ না তো, পালাবে কেন। ওরা তো ছেড়ে কথা কইবে না, কদিন তাণ্ডব চলবে চাদ্দিকে। তোমাদের ওপর ঝাল বেশি, প্রথম ধাক্কাটা পড়বে তোমাদের ওপর। তোমরা তাই কটা দিন নিরাপদ জায়গায় গিয়ে থাকবে। অবস্থা ভালো হলে, দেশের লোক প্রতিবাদ শুরু করলে অতটা যা তা করা চলবে না, যখন আইনসঙ্গত এনকোয়ারি শুরু হবে, কেশবের মুখে মৃদু হাসি দেখা দেয় ক্ষণিকের জন্য, তখন তোমরা ফিরে আসবে সাক্ষী দিতে। তোমার মেয়ে আমাদের তরফের বড় সাক্ষী। সাক্ষী দিতে হবে? দেব। আমি সাক্ষী দেব। রাণী এতক্ষণে জানালা ছেড়ে সরে আসে। কেশব নীরবে মাথা হেলিয়ে সায় দেয়। কাছাকাছি থাকতে পারি না কোথাও গা ঢাকা দিয়ে? যাদব শুধোয় সংশয়ের সঙ্গে। ছেলের কাছে যাবে বলেছিলে না? তাই ভালো। কলকাতাতেই যাও, কেশব বলে চিন্তিতভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে, সাক্ষী দেবার দরকার হবে কিনা শেষ পর্যন্ত তাই-বা কে বলতে পারে। উঁদে প্রজাগুলোকে জব্দ করার এ সুযোগ জগতবাবু ছাড়বে না। ও আবার কি পরামর্শ দেয়, কি দাড় করায়। নাঃ, ছেলের কাছেই যাও তুমি। কেশবের স্ত্রী মেনকা এসে বিনা ভূমিকায় বলে, এস দিকি তোমরা খেয়ে নেবে দুটি। ডিবরিটা আনিস তো বাছা তুই, কি নাম যেন তোর মা, রাণী? ওমা, ডিবরি যে নিভল বলে। তেল তো নেই অর। কেশব বলে। রসুই ঘরের ডিবরি থেকে দিচ্ছি একটু। সবাইকে একসাথে বসিয়ে দেয় মেনকা, রাণী আর গণেশের মাকে পর্যন্ত। খিচুড়ি খেতে বসে যাদবের চোখে হঠাৎ জল আসার উপক্রম হয়। তার মতো গরিব হাঘরে তুচ্ছ মানুষের জীবনেরও যে দাম আছে দশজনের কাছে, তার মতো লোকের মেয়ের সম্মান যে নিজের মেয়ের সম্মানের মতো হতে পারে দশজনের কাছে, এ জ্ঞান এ অভিজ্ঞতা তাকে প্রায় অভিভূত করে রেখেছে। প্রথমাবধি। চিরকাল নিজেকে সে জেনে এসেছে একান্ত অসহায়, দুর্ভিক্ষে হাড়ে মাসে টের। পেয়েছে সে বা তার পরিবারের বাচন মরণে কিছু এসে যায় না জগতের কারো। আজ সে জেনেছে। তা সত্যি নয়। ডান হাতে চোট লেগেছে, মুখে খাবার তুলতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে বেদনা যেন গায়ে লাগে না যাদবের, ব্যাণ্ডেজের নিচে মাথার ক্ষতটা যে দপদপ্‌ করছে সে যন্ত্রণাও বাতিল হয়ে গেছে। তার কাছে। ভিতরে একটা ক্ষোভ আর আক্রোশকেই যেন জাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে শরীরের আঘাতগুলির যন্ত্রণা। সে ফিরে আসবে, বৌ-ছেলে-মেয়েকে গণেশের কাছে রেখে সে ফিরে আসবে তার জন্য যারা লড়ছে তাদের সাথে যোগ দিতে। ভাগচাষের বাটোয়ারা আর বেগার খাটা নিয়ে যে লড়াই বাড়ছিল দিন দিন, যে হাঙ্গামার সুযোগে সঁজ সন্ধ্যায় মেয়েকে তার টেনে নিয়ে যাবার
false
shottojit_roy
শুনতে না পেয়ে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার ফেলুদাকে দেখলাম একটা মশালের আলোয়। সে একটা চারমিনার ধরাল। প্ৰথম নাচ শেষ হয়ে দ্বিতীয় নাচ শুরু হল। এর তাল একেবারে অন্য, আগেরটার চেয়ে অনেক দ্রুত। মেয়েরা একবার নিচু হচ্ছে পরস্পরের হাত ধরে, তার পরেই সোজা হয়ে উঠছে, তালে তালে, মাদল আর বাঁশির সঙ্গে। সেই সঙ্গে একটানা সুরে গান। ভেরি এক্সাইটিং মন্তব্য করলেন জটায়ু। আমাদের সামনে দিয়ে মিঃ নস্কর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আমাদের দিকে একটা প্রশ্ন ছড়ে দিয়ে— কেমন লাগছে? কী ব্যাপার? এমন জোর নাচ চলেছে আর আপনার কপালে খাঁজ? প্রশ্নটা জটায়ু করলেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসা ফেলুদাকে। ভ্রূকুটির কারণ আছে। পরিবেশটা ভাল নয়, ভাল নয়। —ম্যাক্সওয়েলকে দেখেছিস, তোপ্‌সে? কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি, কিন্তু এখন আর দেখছি না। ছাকরা গেল কোথায়? বলে আমাদের ছেড়ে ফেলুদা বা দিকে এগিয়ে গেল। লালমোহনবাবু বললেন, তোমার দাদাকে হেলপ করবে? চলো আমরাও গিয়ে দেখি ম্যাক্সওয়েল গেল কোথায়। চলুন। লালমোহনবাবুর হাত ধরে এগিয়ে গেলাম নাচের দলের পিছন দিকটায়। চাঁদু মল্লিক। কিশোরীলাল। এক ঝলক এক ঝলক দেখছি। একেকটা চেনা মুখ। কিন্তু টম কই? ওই যে পিটার। সেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভ্রূকুটি করে এদিক ওদিক দেখছে। হ্যাভ ইউ সিন টম? আমরাও ওকেই খুঁজছি। আই ভেন্ট লাইক দিস অ্যাট অল। পিটার টমকে খুঁজতে ডাইনে চলে গেল। আমরা বাঁয়ে এগিয়ে গেলাম। নাচ এখন আরও দ্রুত, মাদল বেজে চলেছে। নীচের দল গাইছে, দুলছে আর ঘুরছে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে ফেলুদা বেরিয়ে এল। চৌবেকে দেখেছিস? সে গম্ভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে এগিয়ে গেল। দুবার তাকে গলা তুলতে শুনলাম। ইন্সপেক্টর চৌবে! ইন্সপেক্টর চৌবে। এক মিনিটের মধ্যে ফেলুদাকে আবার দেখলাম, সঙ্গে চোবে। তারা দ্রুত এগিয়ে গেল ডান দিকে। কী ব্যাপার? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। সংক্ষেপে ম্যাক্সওয়েল বলে ফেলুদা আর চৌবে এগিয়ে গেল। এবার আমরা ফেলুদা আর চীবেকে অনুসরণ করে দৌড় শুরু করলাম। একটা গাছের ধরে গিয়ে ফেলুদা থামল। হাত দশেক দূরে একটা মশাল জ্বলছে। তাঁর আলোয় দেখলাম ম্যাক্সওয়েল মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে ঘাসের উপর লুটাচ্ছে তার ব্যাগ আর ফ্ল্যাশাসমেত ক্যামেরা। ইজ হি ডেড? চৌবের প্রশ্ন। না। অজ্ঞান। পালস আছে। চৌবের কাছে দেখলাম একটা ছোট্ট টর্চ রয়েছে। সেটা জ্বলিয়ে টমের মুখের উপর ফেলতে টমের চোখের পাতাটা যেন নড়ে উঠল। ফেলুদা এবারটমের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল। ম্যাক্সওয়েল। টম! ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে মশালের আলোয় ছুটে বেরিয়ে এল পিটার। হোয়াটস দ্য ম্যাটার উইথ হিমা? ইজ হি ডেড? না। অজ্ঞান, বললেন চৌবে। তবে জ্ঞান ফিরছে। ইতিমধ্যে টম চোখ খুলেছে। তার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত। কোথায় লেগেছে তোমার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। টম কোনওরকমে হাত দিয়ে মাথার পিছনটা দেখিয়ে দিল। এবার পিটার মাটি থেকে ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা খুলে ভিতরে হাত ঢোকাতে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দ্য রুবি ইজ গান, ভারী গলায় বলল পিটার। টমকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা আবার নস্করের বাড়িতে ফিরে এলাম। রুবি উধাও শুনে নস্করের অবস্থা দেখবার মতো হয়েছিল। সে শ্লেষ মেশানো গলায় বলল, তোমরা যা চেয়েছিলে তাই হল। ভারতবর্ষের রুবি ভারতবর্ষেই ফিরে এল, তবে তোমাদের পৃথিবী ভ্ৰমণ আমার হল না। পূৰ্বপল্লীর ডাক্তার সিংহ টমকে পরীক্ষা করে বললেন, মাথার পিছনের একটা অংশ ফুলেছে। কোনও ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করার ফলে টম সংজ্ঞা হারায়। এই আঘাত থেকে মৃত্যু হতে পারত কি? পিটার জিজ্ঞেস করল। আরেকটু জোরে হলে হতে পারত বইকী? বললেন ডাঃ সিংহ। আপাতত ওখানটায় বরফ ঘষে দেওয়া ছাড়া আর কোনও চিকিৎসা নেই। ব্যথা বেশি হলে একটা পেন। কিলার খেয়ে নিলে কাজ দেবে। ডাঃ সিংহ চলে যাবার পর চৌবে মুখ খুললেন। মিঃ ম্যাক্সওয়েল, আপনাকে যে আঘাত করেছে তাকে তো আপনি দেখতে পাননি বলে বললেন। না। সে লোক আমার পিছন দিক দিয়ে আসে। যতদূর বুঝতে পারছি, বললেন চৌবে, মাথার পিছনে বাড়ি মারার কারণ ওই পাথর চুরি করা। টম ম্যাক্সওয়েলের ব্যাগে এরকম একটা পাথর ছিল সেটা অনেকেই জানত না, যদিও রবার্টসনস রুবির কথা অনেকেই এর মধ্যে জেনে গেছে। যাঁরা টমের ব্যাগে পাথর আছে জানতেন তাঁরা হলেন আমি, মিস্টার মিত্তির, তাঁর ভাই, তাঁর বন্ধু লালমোহনবাবু, জগন্নাথ চাটুজ্যে, কিশোরীলাল এবং মিঃ নস্কর। মিঃ নস্কর হা হাঁ করে উঠলেন। –পাথরটা তো আমার হাতে চলেই আসত; সেখানে আমি এ রাস্তা নেব কেন-যেখানে আমার বাড়ি খেয়ে টম খুনিও হয়ে যেতে পারত? ও সব বলে লাভ নেই, মিঃ নস্কর। আপনি প্রাইম সাসপেক্ট। হিপূনোিটাইজড অবস্থায় মিঃ গাঙ্গুলী যা বলেছেন সেগুলো যে ফলবেই এমন কোনও গ্যারাস্টি নেই। এ রুবি যেমন তেমন রুবি নয়, আর আপনিও যেমন তেমন কালেক্টর নন। সে রুবি বৃহীত হয়ে যেতে পারে জেনে আপনি সেটা বিনা পয়সায় হাত করার চেষ্টা করবেন না? কী বলছেন। আপনি? ননসেন্স! ননসেন্স! বলে নস্কর চুপ করে গেলেন। চৌবে বলে চললেন, এ ছাড়া আছে কিশোরীলাল। তার বাপ পয়সা দিয়ে জিনিসটা কিনতে চেয়েছিলেন। তাতে ছেলের কোনও লাভ হত না। অথচ ছেলে রুবির মূল্য জানে, সেটা কোথায় থাকে তা জানে। এই অবস্থায় সেটাকে হাতাবার চেষ্টা করাটা কি খুব অস্বাভাবিক?..টমের উপর আক্রোশ ছিল এমন এক ব্যক্তি ওখানে উপস্থিত ছিলেন। সে হল চাঁদু মল্লিক। মাথায় বাড়ি মারাটা চাঁদুর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ সে
false
nihar_ronjon_gupta
একটা কাঁচের আলমারিতে কিছু বই আছে। বসুন। কিরীটী একটা চেয়ারে বসল। বসে আশুতোষের দিকে তাকাল। দস্তিদার আশুর যেমন বর্ণনা দিয়েছিল ঠিক তেমনিই দেখতে আশুতোষ। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, গায়ের রংটা ফসাই, একটু যেন বেশীই ফসা। বোধ হয় তার মার গায়ের রংই পেয়েছে ছেলে। পরনে মিলেরই প্যান্ট ও শার্ট, বোধ হয় ফিরে এসে তখনও জামা কাপড় বদলাবারও সময় পায় নি। শিবতোষের গায়ের বর্ণ বেশ কালোই বলতে হবে, কিন্তু আশুর মুখের গঠন, চোখ মুখ নাক চোয়াল ঠিক যেন তার বাপেরই মত। কোথা থেকে আসছেন? কি নাম আপনার-আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো? কিরীটী হেসে ফেললে, আমি কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি আশুবাবু। আমার নাম কিরীটী রায়। কলকাতা থেকে আসছি। কলকাতা থেকে–তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো? চিনলাম না আপনাকে— আপনি শিবতোষ মল্লিকের— কিরীটীকে তার কথা শেষ করতে দিল না আশু, রুক্ষ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলে উঠল, কে শিবতোষ মল্লিক আমি চিনি না, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আপনি আসতে পারেন। গলার স্বরে রুক্ষতা ও রীতিমত বিরক্তিই যেন ঝরে পড়ল। শিবতোষ মল্লিকের প্রথম পক্ষের সন্তান আপনি। আপনি সেটা স্বীকার না করলেও লোকে তাই বলবে। লোকে কাকে কি বলল না বলল তা নিয়ে আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই মশাই। আমি জানি সে আমার কেউ নয়, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই। বলুন তো সত্যিই কি জন্য আমার কাছে আপনি এসেছেন? আমি জানি আশুবাবু, আপনার স্বর্গীয়া জননীর প্রতি অবিচার এবং অত্যাচার হয়েছে— অবিচার! অত্যাচার! কোন ভদ্রলোক যে কোন ভদ্রমহিলার সঙ্গে, বিশেষ করে যিনি সে-বাড়ির বধূ—অমন জঘন্য কুৎসিত ব্যবহার করতে পারে, যা অতিবড় ছোটলোক, অশিক্ষিতেরাও করে না— আমি জানি। কিছুই জানেন না আপনি— অবিশ্যি লোকের মুখে যা শুনেছি। কি শুনেছেন? তাঁকে তাঁর শ্বশুর রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক স্বীকার করে নেননি। কিন্তু অপরাধটা কোথায়? তার ছেলেই তো– জানি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন আপনার মাকে– তাই বুঝি আমার নমাসের গর্ভবতী মা যখন তার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, চার মাস স্বামীর কোন রকম সংবাদ বা চিঠিপত্র না পেয়ে, রায়বাহাদুর বাপ মুখের ওপর তার দরজা বন্ধ করে দিল! ছেলে-তাঁর স্বামী দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আমার মা তো আশ্রয়ভিক্ষা করতে সেখানে যাননি, কেবলমাত্র স্বামীর সংবাদ নিতেই গিয়েছিলেন সত্যি বলছেন আপনি আশুবাবু? কিরীটী বুঝতে পারছিল, শিবতোষ মল্লিক সব সত্যি কথা বলেননি তাকে। হ্যাঁ, একবর্ণও মিথ্যা নয়। সেই কাপুরুষ-মহাপুরুষকেই আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ ভণ্ডটাকে আমি একদিন গলা টিপে হত্যা করব, তারপর ফাঁসি যাব। একটা আগ্নেয়গিরির মতই যেন ফুঁসতে লাগল আশু। আপনি বোধ হয় তাই কখনও তাঁকে স্বীকার করেননি এবং তাঁর গৃহেও যাননি! যে বাড়ির দরজা থেকে আমার নিরপরাধিনী মাকে অপমান আর লজ্জা মাথায় করে নিয়ে আসতে হয়েছে, সে বাড়ির দরজাও আশুতোষ মাড়ায় না। তবু আইনে বলে, আপনিই তাঁর একমাত্র বংশধর এখন— কোন দুঃখে! তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেই তার বংশধর। আমি তাকে স্বীকারও করি, আমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্কই নেই। আপনি জানেন একটা কথা, তাঁর সে ছেলেটি রবিবার খুন হয়েছে? হয়েছে, ঠিক হয়েছে—এবার ওকেও হতে হবে। আপনি কি ঐ সংবাদটি দিতেই এখানে এসেছেন কলকাতা থেকে? তাহলে জেনে যান, আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু নির্বাণীতোষবাবু তো আপনার কখনও কোন ক্ষতি করেননি আশুবাবু! তাছাড়া তাঁর বাপের কর্মের জন্যও নিশ্চয়ই তিনি দায়ী নন। এবং শুনলে বিশ্বাস হয়ত করবেন না , তিনি আপনাকে দাদার মতই শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন। কিরীটীর ঐ কথায়, বিশেষ করে তার শেষের সম্পূর্ণ বানানো কথাগুলিতে হঠাৎ যেন মনে হল আশুতোষ একটু বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে। আরও আপনি হয়ত জানেন না, দুর্ঘটনার মাত্র দুদিন আগে নির্বাণীতোষবাবু বিয়ে। করেছিলেন। রবিবার রাত্রে তিনি খুন হন, সে রাত্রে ছিল বৌভাত ও ফুলসজ্জা তাঁর। আশুতোষ পূর্ববৎ নির্বাক। হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাকে নিমন্ত্রণ করেননি? করেছিল। করেছিলেন নিমন্ত্রণ? হ্যাঁ। কে নিমন্ত্রণ করেছিলেন? রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিকের ছেলে, আপনাদের শিবতোষ মল্লিক নন— তবে কে? নির্বাণীতোষই একট চিঠি পাঠিয়েছিল। নির্বাণীতোষবাবু আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন নিজে? হ্যাঁ। আছে সে চিঠি? আছে বোধ হয়। দেখতে পারি চিঠিটা একবার? আলমারিটা খুলে–বইয়ের উপরে রাখা ছিল চিঠিটা, সেটা বের করে দিল আশুতোষ কিরীটীর হাতে। ডাকে এসেছে, খামের চিঠি। খামটা থেকে চিঠিটা বের করে পড়ল কিরীটী। সংক্ষিপ্ত চিঠি। চিঠির তারিখ দিন-পাঁচেক আগের। শ্রীচরণেষু দাদা, আপনি আমাকে কখনও স্বীকার না করলেও চিরদিন আপনাকে আমি আমার জ্যেষ্ঠ বলেই জেনে এসেছি। আর পাঁচদিন পরে—শুক্রবার আমার বিয়ে। আপনি আসবেন না আমি জানি, তাই এই পত্রে আপনার আশীর্বাদ চেয়ে নিচ্ছি। প্রণত—নির্বাণীতোষ। চিঠিটা পড়া শেষ হলে পুনরায় সেটা খামের মধ্যে ভরতে ভরতে কিরীটী বললে, কবে এ চিঠি পেয়েছেন আপনি? গত শনিবার। চিঠির জবাব— না, দিইনি। তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই। আপনি তো শুনেছেন আশুবাবু, রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কি প্রকৃতির লোক ছিলেন। আপনার জন্মদাতা হয়তো নিরুপায় হয়েই একটি ভদ্রঘরের নিরপরাধ মেয়েকে বিয়ে করবার সময় সেকথা তার মনে ছিল না? মেরুদণ্ডহীন অথর্ব পশু একটা! আবার যেন আশুতোষ আক্রোশে ফেটে পড়ল। তাহলে তাঁরও তো কিছু বলবার থাকতে পারে— থাকুক, তা দিয়ে আমার কোন দরকার নেই। হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করল কিরীটী, তাহলে আপনি সে-রাত্রে কলকাতায় যান নি? না—না। তবে কোথায় ছিলেন রবিবার রাত্রে? আপনি
false
humayun_ahmed
আমার নাম রেবেকা। ও আচ্ছা আচ্ছা। চিনতে পারেন নি? শরীরটা ভালো না তো। এইজন্যে সমস্যা হচ্ছে। স্যার, আমি আপনাকে চামড়ায় বাধানো একটা খাতা দিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে। তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার একী অবস্থা! একটু বেকায়দা অবস্থাতেই আছি। এরা আমাকে আটকে ফেলেছে। কেন? কেন তা তো জানি না। স্যার, আপনি জানবেন না তো কে জানবে? আপনি হচ্ছেন মিসির আলি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বের করুন কেন তারা আপনাকে আটকেছে। এরা কি আপনার শত্রুপক্ষ? না। তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু কি আপনি করেছেন? না। আপনাকে আটকে রাখলে তাদের কি কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়? না! আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষা কি করবেন? কী পরীক্ষা? ক্লিৎস টেস্ট। স্যার, মনে পড়েছে? হ্যাঁ, পড়েছে। ১০০ থেকে নিচের দিকে নামতে হবে। প্রথমবার একটি সংখ্যা বাদ দিয়ে নিচে নামা।। ১০০ থেকে হবে ৯৮, তারপর দুটা সংখ্যা বাদ ৯৫, তারপর তিন সংখ্যা বাদ ৯১। স্যার, পরীক্ষা দিতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি পানি এনে দিচ্ছি। পানি খান। পানি কোথায় পাবে? পানি তো বন্ধ। আমি কমোড থেকে পানি আনব। আপনি কল্পনা করবেন ঝরনার পবিত্ৰ পানি খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্যে আপনার পানি খাওয়াটা জরুরি। ঠিক না। স্যার? হ্যাঁ ঠিক। মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি কতক্ষণ ঘুমালেন তা জানেন না। পানির পিপাসায় তাঁর বুক শুকিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার শারীরিক শক্তি তাঁর নেই। মাথার কাছে দুঃখিত চোখমুখ করে পারুল দাঁড়িয়ে আছে। মিসির আলি বললেন, পারুল। আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে? আমি পারুল না। আমি এক ভূতনি। আমার নাম-হুড়বুড়ি। ও আচ্ছা, তুমি হুড়বুড়ি? জি হুড়বুড়ি। একটা ছড়া শুনবেন স্যার। হুড়বুড়ি, থুরথুরি বুড়বুড়ি, কুরকুরি ফুরফুরি, ফুরফুরি মিসির আলি বললেন, চুপ করো প্লিজ। হুড়বুড়ি চুপ করল। তখন বেজে উঠল। লাল টেলিফোন। এই টেলিফোনের তার ছেড়া, তারপরেও বাজছে কেন? টেলিফোন নিশ্চয়ই বাজছে না। তিনি ভুল শুনছেন। তার বিভ্ৰান্তির কাল শুরু হয়েছে। রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। এখন ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী হচ্ছে? হুড়বুড়ি বলল, স্যার! পুলিশ এসেছে। দরজা ভাঙছে। শব্দ শুনছেন? মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ও আচ্ছা পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে জসু আছে। মনে হয় সে-ই আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ এনেছে। স্যার! দরজা ভেঙে ফেলেছে। তাকিয়ে দেখুন, পুলিশ ঢুকছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি পুলিশ দেখতে পাচ্ছেন। জসুকে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মল্লিক সাহেবও আছেন। একজন মৃত মানুষ। যার ডেডবডি কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। মৃত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। স্যার, চোখ মেলুন। মিসির আলি চোখ মেললেন। তার কাছে মনে হলো তিনি হাসপাতালে আছেন। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ডাক্তার লাল সোয়েটারের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে। স্যার, আপনি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছেন এবং ভালো আছেন। আপনার শরীর খাদ্য গ্রহণের জন্যে এখনো তৈরি না বলে আপনাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। স্যার, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? পারছি। পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চান। কথা বলবেন? হুঁ। পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব এসে সামনে দাঁড়ালেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মিসির আলির এখন মনে হলো, তার হেলুসিনেশন হচ্ছে না। তিনি বাস্তবে বাস করছেন। হেলুসিনেশনের দৃশ্যগুলো চড়া রঙে আঁকা হয়। এখন তা না। মিসির আলি বললেন, আমি কত দিন বন্দি ছিলাম? রকিব বললেন, ছয় দিন। আমি বন্দি-এই খবর আপনাদের কে দিল? একজন মহিলা টেলিফোনে জানিয়েছেন। তার নাম পারুল। কবে জানিয়েছে? যেদিন আপনাকে আটকানো হয় তার পরদিন ভোরবেলা। আমরা তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেই নি। কারণ এই মহিলা উদ্ভট সব কথা বলছিলেন। তাঁর মৃত শ্বশুর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন, এইসব হাবিজাবি। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। কথা বলতে বা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে। পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, স্যার, আপনি রেস্ট নিন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আপনার কিছু সাহায্যও আমাদের দরকার। মৃত মানুষকে জীবিত দেখার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। একজন দাবি করছেন, তিনি মল্লিক সাহেব। তাঁর কর্মচারীরাও তা-ই বলছে। মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, একজন মৃত মানুষ কখনোই জীবিত হয়ে ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন। আমার ধারণা আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারব। তবে সুস্থ হওয়ার জন্যে আমাকে কিছুটা সময় দিন। রকিব বললেন, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। চোখ মেললেন তের ঘণ্টা পর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মুন হাউস হোটেলে ২১২ নম্বর ঘর। সময় সন্ধ্যা ৭টা। মল্লিক সাহেব বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট একটা নাটক হয়েছে। নাটক দেখেও তিনি তৃপ্তির হাসি হোসেছেন। নাটকটার প্রধান চরিত্র জামু। সে মিসির আলির জন্যে চা নিয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকে মল্লিক সাহেবকে বসে থাকতে দেখে আর্ত চিৎকার দিল-ও আল্লাগো! হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মল্লিক সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভয় খাইছে। প্যান্টে পিশাব না করে দেয়। মিসির আলি বললেন, ভয় পাওয়ারই কথা। সবার কাছে আপনি একজন মৃত মানুষ। আপনার শবদেহ কুয়া থেকে
false
MZI
অস্ত্র টেনে নামিয়ে দক্ষ হাতে লোভ করে বললেন, কখনো ভাবি নি এটা আবার ব্যবহার করতে হবে। ভেবেছিলাম খুনোখুনির পর্যায় পার হয়ে এসেছি। রিরা দেয়াল থেকে অন্য একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তাকে বাধা দিলেন না। এই অস্ত্র কে কখন কীভাবে ব্যবহার করতে পারবে—সেটি নিয়ে নানারকম নিয়মকানুন আছে, কিন্তু সেসব এখন পুরোপুরি অর্থহীন। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, তুমি ডান দিক দিয়ে যাও, আমি বাম দিকে আছি, মিনিট পাচেক আটকে রাখতে পারলেই অনেক। মাথা ঠাণ্ডা রেখ–খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি করো না। নিশানা ঠিক রেখ–হত্যা খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার—কিন্তু তারপরেও আমাদের করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য ফুড চেইন নামে একটা প্রক্রিয়ায় একজন প্রাণী অন্য প্রাণীকে বহুদিন থেকে হত্যা করে আসছে। মনে রেখ যত বেশিজন নীলমানবকে হত্যা করতে পারবে, আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। রিরা মাথা নাড়ল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তার হাত স্পর্শ করে বললেন, আমি খুব দুঃখিত রিরা। খুব দুঃখিত। আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন শব্দ করে হাসলেন, বললেন, যদিও সেই সুযোগটা হচ্ছে খুব অল্পবয়সে নীলমানবের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার সুযোগ। কার্গো বে-র করিভরে বড় ধাতব দরজার নিচু অংশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি বসিয়ে রিরা। অপেক্ষা করতে থাকে। দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নীলমানবেরা গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। নৃশংস নীলমান নিয়ে তার খুব কৌতূহল ছিল, একটু পরেই তাদেরকে সে দেখবে। প্রথমবার তাদেরকে সামনাসামনি দেখবে। হয়তো শেষবার। রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মহাকাশযানটিতে এক বিস্ময়কর নীরবতা। কিছুক্ষণ আগেই ভয়ংকর শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে কেঁপে উঠছিলএখন হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ্যকে অসহনীয় আতঙ্কের মতো মনে হতে থাকে। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে চারদিকে তাকাল। পুরো মহাকাশযানটি একটি ধ্বংসস্তুপের মতো, দেয়ালে বড় বড় গর্ত, ধাতব বিম ভেঙে পড়েছে, এদিকে সেদিকে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে, চারদিকে কালো। ধোয়া এবং পোড়া গন্ধ। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুরো মহাকাশযানে কোথাও কোনো জীবিত প্রাণীর শব্দ নেই। কারো কথা, কাবো নিশ্বাস, এমনকি যন্ত্রণার একটু কাতরধ্বনিও নেই। নীলমানব আর এই মহাকাশযানের মহাকাশচারীরা কি তা হলে পরস্পর পরস্পরকে একেবারে পরিপূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে? হঠাৎ করে রিয়ার ভেতরে এক অচিন্তনীয় আতঙ্ক এসে ভর করে—সে কি তা হলে এই মহাকাশযানে একমাত্র জীবিত প্রাণী? রিরা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, না না—এটা হতে পারে না। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। রিরা খুব সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করে, তীক্ষ্ণ চোখে সে তাকায়—কোথাও কি কেউআছে? করিডরের গোড়ায় সে ক্যাপ্টেন বর্কেনের মৃতদেহটি দেখতে পেল ভয়ংকর গোলাগুলির মাঝে থেকেও তার মৃতদেহটি আশ্চর্যরকম অক্ষত। মুখে এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় কোনো একটা কিছু দেখে কৌতুক বোধ করছেন। রিরা কিছুক্ষণ মৃতদেহটির কাছে দাঁড়িয়ে রইল, তার ভেতরে দুঃখ, ক্রোধ বা হতাশা কোনো ধরনের অনুভূতিই নেই, সে ভেতরে এক ধরনের আশ্চর্য শূন্যতা অনুভব করে। রিরা অনেকটা যন্ত্রের মতো মৃতদেহটি ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দুজন নীলমানবের মৃতদেহ পাওয়া গেল কন্ট্রোলরুমের দরজায়। শক্তিশালী কোনো বিস্ফোরকের আঘাতে একজনের মস্তিষ্কের বড় অংশ উড়ে গেছে। গুলির আঘাতে দ্বিতীয়জনের বুকের একটা অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কালচে এক ধরনের রক্তে পুরো জায়গাটা ভিজে আছে। মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের মৃতদেহের বেশিরভাগ তাদের কেবিনের কাছাকাছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাদের বেশিরভাগই ছিল নিরস্ত্র, প্রতিবোধ দূরে থাকুক নিজেদের রক্ষা করার সুযোগও কেউ পায় নি। ইঞ্জিনঘরের কাছাকাছি মনে হয় একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে ইতস্তত অনেকগুলো মৃতদেহ পড়ে আছে। নীলমানবদের মৃতদেহের বেশিরভাগই কুরু ইঞ্জিনের আশপাশে মনে হয় তারা ইঞ্জিনটা ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছিল। উপরে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকায় শেষপর্যন্ত ধ্বংস করতে পারে নি। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের মৃতদেহটি পাওয়া গেল কন্ট্রোল প্যানেলের উপর তার পায়ের কাছেই একজন নীলমানবের মৃতদেহ পড়ে আছে। আশপাশে চারদিকে ধস্তাধস্তির চিহ্ন একপর্যায়ে মনে হয় অস্ত্র হাতে এরা হাতাহাতি যুদ্ধ করেছে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি, একটি মানুষ কিংবা নীলমানবও বেঁচে নেই। পুরো ইঞ্জিনঘরটির ভেতরে মনে হয় একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে তার ভেতরে ধক ধক শব্দ করে এখনো ইঞ্জিনটি চলছে, সেটাই একটি রহস্য। রিরা ইঞ্জিনঘর থেকে বের হয়ে কমিউনিকেশনস ঘরে গেল, সেখান থেকে মূল প্রসেসর ঘরে। প্রসেসর ঘর থেকে শীতলঘর, সেখান থেকে কার্গোঘরে—কোথাও একজন জীবিত প্রাণী নেই। একজন মানুষ কিংবা একজন নীলমানব কেউ বেঁচে নেই। এই পুরো মহাকাশযানে সে একা অসংখ্য মানুষ এবং নীলমানবের মৃতদেহ নিয়ে মহাকাশ পাড়ি দেবে-রিরা হঠাৎ করে অসহনীয় আতঙ্কে থরথর করে কাপতে শুরু করে। ঠিক তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল, কোনো একজনের পদশব্দ কিংবা কোনো কিছু সরে যাবার শব্দ। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করে উঠল, কে? নিঃশব্দে মহাকাশযানে তার চিঙ্কার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। রিরা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। কোনো মহাকাশচারী হলে নিশ্চয়ই তার প্রশ্নের উত্তর দিত—এটি হয়তো কোনো নীলমান। ভয়ংকর দুর্ধর্ষ নৃশংস একজন নীলমানব। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তার অস্ত্রটি ধরে রাখে, কোনো একটা কিছুকে নড়তে দেখলেই সে গুলি করবে। আবার কিছু একটা নড়ে যাবার শব্দ হল—মনের ভুল নয়, নিশ্চিত শব্দ, কোনো জীবন্ত প্রাণীর সরে যাবার শব্দ। রিরা শক্ত হাতে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে এগুতে থাকে, করিডরের পাশেই একটা ছোট ঘর,
false
humayun_ahmed
পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ছেলেটির মা এমন ভাব করতে লাগল, যেন আমি তাকে মিলিটারির হাত থেকে ছুটিয়ে এনেছি। আমার জন্যে হালুয়া এবং পরোটা তৈরি হল। হালুয়া খাবার সময় ভদ্রমহিলা একটা তালপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। আমি বললাম, রোজার সময় দেখবেন। এরা বেশি ঝামেলা করবে না। আর কয়েকটা দিন। আমাদের কাদের মিয়াও খবর আনল, প্রথম রোজার দিন সব আটক লোকদের ছেড়ে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে বসবে। সব ঠিকঠাক। আমেরিকা নাকি শক্ত ধমক দিয়েছে। ইয়াহিয়া খানকে। ইয়াহিয়া মিটমাটের জন্যে একটা পথ খুঁজছে। বুঝলেন ছোড ভাই, সাপ গিলার অবস্থা হইছে। না পারে গিলতে না পারে রাখতে। কাদের পহেলা রমজানের জন্যে খুব উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তার উৎসাহের প্রধান কারণ, দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পাবে। দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পেলেন না। রমজানের সময় অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হল। আলবদর বাহিনী তৈরি হল। প্রথম বারের মতো অনুভব করলাম, কিছু কিছু যুদ্ধ সত্যি সত্যি হচ্ছে। নয়তো এতটা খারাপ অবস্থা হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইজাবুদ্দিন সাহেবও অনেকখানি মিইয়ে গেলেন। বারান্দায় এখন আর তিনি এক শ পাওয়ারের বাতি দুটি জ্বালান না। ছয় রোজার দিন রাতে তারাবীর নামাজ শেষে ফেরবার পথে তিনি মারা পড়লেন। হাসিমুখে খবর আনল কাদের মিয়া। প্রচণ্ড ধমক লোগালাম কাদেরকে, এই লোকটার জন্য বেঁচে আছিস তুই কাদের। আর যেই হাসে হাসুক, তুই হাসিস না। কাদেরের হাসি বন্ধ হল না। চোখ ছোট-ছোট করে বলল, খেইল শুরু হইছে। ছোড ভাই। বিসমিল্লাহ দিয়া শুরু। মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু বললেন, মানুষ মারাটা ঠিক না। মানুষ মারাটা কোনো হাসির জিনিস না কাদের মিয়া। ইজাবুদ্দিন সাহেব মানুষের অনেক উপকার করেছেন। দুলাভাই খবর পাঠিয়েছেন এক্ষুণি যেতে হবে। দুলাভাইয়ের গাড়ির এই ড্রাইভারটি নতুন রাখা হয়েছে। লোকটি বিহারী। মিলিটারি গাড়ি থামালেই সে গলা বের করে একগাদা কথা হড়হড় করে বলে। ফলস্বরূপ গাড়ি থেকে নামতে হয় না। দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, জিনিসপত্র গোছগাছ হচ্ছে। আপার মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। দুলাভাই বললেন, ইণ্ডিয়া যুদ্ধে নামবে, বুঝলে নাকি শফিক? শহর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। কখন ছাড়ছেন শহর? আন্দাজ করা দেখি? আজকেই যাচ্ছেন নাকি? ঠিক। এক ঘণ্টার মধ্যে। গাড়িতে করে যাব ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহে খবর দেয়া আছে। হঠাৎ করে যাচ্ছেন দুলাভাই! আজকেই ঠিক করলেন নাকি? হ্যাঁ। আজকে ঠিক করার পিছনে কোনো কারণ আছে? আছে। সিরিয়াস কারণ আছে। বলেন শুনি। তার আগে বল, তুমি একটা কাজ করতে পারবে কিনা? কী কাজ? লুনাকে তো চেন, শীলার বান্ধবী–এক মেজর বিয়ে করতে চায় তাকে। চিনি। সেই মেয়েটিকে তোমার ওখানে নিয়ে রাখবে। শুধু আজকের রাতটা। কাল ভোরে মেয়ের এক চাচা এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে। খবর দেওয়া হয়েছে, তাঁকে তোমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি। কিছুই বুঝতে পারছি না দুলাভাই। মেয়েটা কোথায়? এইখানেই আছে। শীলার ঘরে আছে। ব্যাপার মোটামুটি এই রকম, গত দশ দিন ধরে লুনা এই বাড়িতে আছে। মেয়ের বাবা-মা মেজর ভদ্রলোককে বলেছেন, মেয়ে চিটাগাং তার নানার বাড়িতে আছে। ঈদের পর আসবে। বিয়ের পাকা কথাবার্তা হবে তখন। মেজর সাহেব কিছুই বলেন নি। আজ সকালে কিছু লোকজন এসে মেয়ের বাবা-মাকে তুলে নিয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের ধারণা, তাঁকে ধরতে আসবে আজকালের মধ্যে। বড়ো আপা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মেয়েকে আমার এখানে রাখার কথা তো আমি বলি নি, তোর দুলাভাই গলা বাড়িয়ে বলেছে। এখন দেখ না ঝামেলা। ঝামেলা তো সবারই আপা। তুমি ঝামেলায় পড়লে দেখবে সাহায্যের জন্যে লোক আসছে। রাখা রাখা। লম্বা লম্বা কথা ভালো লাগে না। লম্বা কথা অনেক শুনেছি। বড়ো আপার ঢাকা ছাড়ার ইচ্ছা মোটেই নেই। তিনি আমার সামনেই এক বার দুলাভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, সবচেয়ে ভালো হয়। এই বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায়ও ওঠা। শফিকের ওখানে উঠতে দোষ কী? ঘর তো খালি পড়ে আছে। দুলাভাই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ঢাকা শহরে এক ঘণ্টার বেশি আমি থাকব না। ওরা আমাকে খুজছে। তুমি তো শেখ মুজিব! তোমাকে না হলে ওদের ঘুম হচ্ছে না। দুলাভাই শান্ত স্বরে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। আমাকে বললেন, লুনাকে সবকিছু বলা হয়েছে, খুব শক্ত মেয়ে। একটুও ঘাবড়ায় নি। আমি বললাম, যদি ওর চাচা না আসে? আসবেই। আর যদি না-আসে, তাহলে তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে যা করবার করবে। মেয়ের এক দূরসম্পর্কের খালা আছে। ঢাকায়। লুনার কাছে ঠিকানা আছে। ওর বাবা-মার খবর ওকে বলেছেন? কান্নাকাটি করছে না? আমাদের সামনে না। মেয়ে বড়ো শক্ত, মাচকাবার মেয়ে না। আমি খুবই ইমপ্রেসড! দুলাভাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, সেই টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে বলবে যে আমি চলে গেছি। কাকে বলব? যে টেলিফোন রিসিত করবে, তাকেই বলবে। বলবে মেসেজ রাখতে। এইটি কি আপনার ব্রিগেডিয়ার বন্ধুর নাম্বার? হ্যাঁ, তোমার ওর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। লুনাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছি। রাস্তায় নেমেই প্রচণ্ড ভয় লাগল। মনে হল রাস্তাঘাটগুলি যেন বড়ো নির্জন। যেন আজকেই ভয়ংকর একটা কিছু ঘটবে। শাহবাগের পাশে প্রকাণ্ড একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার বুক কাঁপতে লাগল। মনে হল ওরা আজ অবশ্যই আমাদের গাড়ি থামাবে। ঠাণ্ডা স্বরে বলবে, তোমার সঙ্গের ঐ মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে আমরা নিয়ে যাব। আমি বলব, জনাব, ও একটি নিতান্ত বাচ্চা মেয়ে। ক্লাস নাইনে পড়ে। ওরা দাঁত বের
false
MZI
বসে কাঁদছে। এক সময় ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রুহান। রুহান বলল, আমি জানি না। তোমার কী মনে হয় রুহান, আমাদের কি মেরে ফেলবে? কেন? শুধু শুধু মেরে ফেলবে কেন? গ্রাউসকে যে মেরে ফেলল। গ্রাউসকে মেরেছে কারণ সে ছিল আহাম্মক। তুমি আর আমি কী আহাম্মক? কিলি মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা আহাম্মক না। কিন্তু— কিন্তু কী? আমার খুব ভয় করছে। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ভয় পাবার কথা তখন ভয় পেতে হয়। যারা কখনো ভয় পায় না তারা স্বাভাবিক না। কিলি বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে লরিগুলো সারি বেঁধে ছুটে চলেছে। চাঁদ ড়ুবে গিয়ে বাইরে অন্ধকার। শরতের শেষ রাতের হিমেল বাতাসে রহান একটু শিউরে উঠল, এভাবে ধরে নিয়ে যাবে জানলে সে নিশ্চয়ই একটা গরম জ্যাকেট পরে আসত। কিলি আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুহান। বলো। ওরা আমাদের নিয়ে কী করবে বলে তোমার মনে হয়? রুহান মাথা নেড়ে বলল, জানি না। আমাদের অস্ত্র চালানো শেখাবে, যুদ্ধ করতে শেখাবে এটা কী তোমার সত্যি মনে হয়। হতেও পারে। পৃথিবীতে এখন খুব খারাপ সময়। সব জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধ করার মানুষের খুব অভাব। কিলি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব অস্থির লাগছে রুহান। রুহান কিলির ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ধৈর্য ধরো কিলি, দেখবে এক সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক এরকম সময়ে হঠাৎ করে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা চারজন অস্ত্র তাক করে উবু হয়ে বসে গেল। একজন চাপা গলায় বলল, সবাই মেঝেতে মাথা নিচু করে শুয়ে থাক। উঠবে না। খবরদার। রুহান অন্য সবার সাথে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে থাকে। শুনতে পায় তাদের মাথার উপর দিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে গুলি ছুটে যাচ্ছে। লরিতে বসে থাকা চারজন সশস্ত্র মানুষ ছাড়া ছাড়া ভাবে গুলি করছে, তার শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। যেভাবে গুলি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে গুলি থেমে গেল। সশস্ত্র মানুষগুলো আবার পা ঝুলিয়ে বসে হালকা গলায় কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনেই হয় না একটু আগে সবাই এত ভয়ঙ্কর গোলাগুলির ভেতর দিয়ে এসেছে। আর সেই ভয়ঙ্কর গোলাগুলিতে যে কেউ মারা পড়তে পারত। রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, শোনো। তোমাদের সাথে আমি একটু কথা বলতে পারি। একজন মাথা ঘুরিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কী কথা? সাধারণ কথা। মানুষটি কঠিন গলায় বলল, তোমরা ভেতরে এতজন আছ, নিজেদের ভেতরে কথা বল। আমাদের সাথে কেন কথা বলতে চাইছ? রুহান বলল, ভেতরে যারা আছে এখন তাদের কারো কথা বলার আগ্রহ নেই। সে খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভাব করে মানুষটা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, কেন? কথা বলার আগ্রহ নেই কেন? তোমাদের যদি কেউ মাঝরাতে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেত তাহলে তোমাদেরও কথা বলার কোনো আগ্রহ থাকত না। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, এই! এ তো কথাটা মিথ্যা বলে নাই। মনে আছে আমাদের যেদিন ধরে এনেছিল, তখন আমরা কী ভয় পেয়েছিলাম? রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমাদেরকেও ধরে এনেছিল! ধরে না আনলে কেউ নিজে থেকে আসবে নাকি? কেন ধরে এনেছিল? মানুষটা হাত দিয়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, দুদিন পরে তো নিজেরাই দেখবে। এখন এত কৌতূহল কেন? রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কৌতূহল খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষটা মাথা নাড়ল, চলন্ত লরি থেকে পিচিক করে নিচে একটু থুতু ফেলে বলল, ব্যবসা। রুহান বলল, ব্যবসা? হ্যাঁ। ব্যবসা। কিসের ব্যবসা? মানুষের। তোমাদের ধরে এনেছি বিক্রি করার জন্যে। বিক্রি করার জন্যে? হ্যাঁ। রুহান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, কার কাছে বিক্রি করবে? যে ভালো দাম দেবে তার কাছে। রুহান এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, যারা ভালো দাম দেবে তাদের কাছে বিক্রি করে দেবে? হ্যাঁ। অনেক বড় বড় পার্টি আছে। এখন সবচেয়ে বড় যে পার্টি তার নাম ক্রিভান। ক্রিভান? হ্যাঁ। সে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। রাতকে দিন করতে পারে দিনকে রাত। তারা আমাদের নিয়ে কী করবে? যুদ্ধ করার জন্যে অনেক মানুষের দরকার। ভালো যোদ্ধা পাওয়া খুব সোজা কথা না। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, সবাইকে তো আর যুদ্ধ করার। জন্যে কেনে না, অন্য কাজেও কেনে। অন্য কী কাজে কেনে? যদি কারো ভালো বুদ্ধি-শুদ্ধি থাকে তাহলে তার মগজটা ব্যবহার করা হয়। মাথার মাঝে ফুটো করে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ইমপালস পাঠিয়ে হিসেব নিকেশ করে। তাদেরকে বলে সক্রেটিস। রুহান নিজের অজান্তে কেমন যেন শিউরে উঠল, সশস্ত্র মানুষটি সেটা লক্ষ্য করল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ক্লোন করার মেশিন তো আজকাল আর পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এইগুলোর জন্যেও বিক্রি হয়। ভালো একজোড়া কিডনির অনেক দাম। প্রথম মানুষটি বলল, সবচেয়ে বেশি দামে কী বিক্রি হয় জান? কী? খেলোয়াড়। রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়? হ্যাঁ। একটা খেলোয়াড় মগজে ইলেকট্রড লাগানো সক্রেটিস থেকেও একশ দুইশ গুন বেশি দামে বিক্রি হয়। কীসের খেলোয়াড়? মানুষটি হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ করে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সবকিছু আগেই জেনে ফেললে হবে
false
MZI
নাক নেই, স্পর্শের অনুভূতি নেই। তোমার রয়েছে শুধু এক ভয়ংকর মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সেই মস্তিষ্কের ক্ষমতা সহস্রগুণ বেশি দুর্বলতাগুলিও সহস্র গুণ বেশি। নিশ্চয়ই বেশি। সেই মস্তিষ্কে যদি হঠাৎ লাগামছাড়া ভয়ংকর একটা ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি কী করবে? কী করবে? কোন ইন্দ্রিয় তোমাকে রক্ষা করবে? কোন ইন্দ্রিয়? গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার সবুজ মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যায়, মুখ গহ্বর থেকে ধারালো দাত, লকলকে জিব বের হয়ে আসে। জড়ানো গলার স্বরে সে চিৎকার করে বলল, আসবে না–কোন ভয়ংকর ভাবনা আসবে না, আসবে না– আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। তাই তুমি মহাকাশযানের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষকে তোমার পাশে এনে হাজির করেছ। যদি কখনো সেই ভয়ংকর ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি তোমার আশে পাশে আটকে রাখা মস্তিষ্কের সাহায্যে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। তারা হবে তোমার মায়ের চেহারা? ঘ্রাণ? তার গলার স্বরে? তার স্পর্শ! লেন হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত হাসতে শুরু করে। তার অপ্রকৃতস্থ হাসি সুড়ঙের মতো সেই ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। মহামতি গ্রাউলের চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে তার মুখাবয়ব বিস্তৃত হতে হতে ঘরের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেই ভয়ংকর চেহারা থেকে এক অবিশ্বাস্য আক্রোশ ফুটে বের হতে শুরু করে। লেন সেই ভয়ংকর চেহারার দিকে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি। ভেবেছ আমি তোমাকে ভয় পাব? তোমার দানবের চেহারা দেখে আমি আতংকে শিউরে উঠব? না। আমি তোমাকে ভয় পাই না। এতটুকু ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি তোমার নিজের ভেতরের সেই ভয়ংকর ভাবনার ভয়ে থরথর করে কাপতে থাক। তুমি ভীতু কাপুরুষ–তুমি অসহায় দুর্বল–তুমি তুচ্ছ! ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। ধ্বংস করে দিতে পারি না! গ্রাউল হঠাৎ আর্তনাদ করে বলল, না! হ্যাঁ। লেন হিংস্র গলায় বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমি তোমাকে এখন সেই প্রশ্নটি করব। যে প্রশ্নটির ভয়ে তুমি থর থর করে কাপছ। যে প্রশ্নটি করলে তুমি আমার চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে আমি তোমাকে সেই প্রশ্নটি করব। লেন এক মূহুর্ত থেমে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তীব্র স্বরে বলল, তুমি আমাকে বল, তোমার সেই ভয়ংকর ভাবনাটি কী? বল। গ্রাউলের মুখাবয়ব হঠাৎ এক অবর্ণনীয় আতংকে বিকৃত হয়ে যায়। চোখের মণি ঘোলাটে হয়ে আসে, মুখের মাংশপেশী থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার লকলকে জিভ মুখ থেকে বের হয়ে আসে, মুখের কষ থেকে লোল গড়িয়ে পড়ে। সেই বিকৃত কাতর চেহারায় ভাঙা গলায় বলল, না–না–না–আমি সেটা ভাবতে চাই না–ভাবতে চাই না তোমাকে ভাবতে হবে! লেন চিৎকার করে বলল, ভাবতে হবে। ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে আমাকে বলতে হবে। বলতে হবে। না। হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাকে বল। লেন হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, বল। গ্রাউল হঠাৎ পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। অবর্ণনীয় আতংকে থর থর করে কাপতে কাঁপতে বলল, একটা শিশু হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দূর দিগন্তে গিয়ে এক বিন্দুতে মিলে গেছে। শিশুর হাতে একটা ফুলের ঝাপি। সেই ঝাঁপিতে সে রাস্তার পাশে থেকে বুনোফুল তুলছে। সেই ফুল নিয়ে সে ছুটে গিয়েছে সামনে আর দিগন্ত তখন আরো দূরে সরে গিয়েছে। শিশুটি আবার ফুল তুলেছে ঝাপিতে। আবার ছুটে গিয়েছে সামনে দিগন্ত আরো দূরে সরে গিয়েছে। গ্রাউল হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, শিশুটির বুনোফুলের ঝাপি থেকে হঠাৎ সব ফুল ঝড়ে গেছে নিচে, শিশুটি ফুল তুলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে। তারপর আবার ছুটে গেছে সামনে। তখন সেই দিগন্ত আবার সরে গেছে দূরে। শিশুটি ছুটে যেতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। পারছে না। হঠাৎ ফুলের ঝাপি থেকে সব ফুল ঝড়ে গেল নিচে। শিশুটি সেই ফুল কুড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে! পারছে কিন্তু পারছে না। ছুটে যাচ্ছে কিন্তু যেতে পারছে না। পারছে না–পারছে না গ্রাউলের কথা জড়িয়ে যায়, গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে সে। চোখের মণি চোখ থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসতে থাকে, ঘোলাটে কালচে বেগুনি রংয়ের মতো চেহারা হয়ে আসে তার নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। থর থর করে কাপছে। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে সে অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। আমি লেনের দিকে তাকালাম, সে নেশাগ্রস্থ মানুষের মতো টলছে, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। তাল সামলে কোনভাবে দুই পা এগিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল সে। আমি ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলাম। সাথে সাথে সমস্ত মহাকাশযান নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমি লেনকে বুকে চেপে ধরে রেখে ফিস ফিস করে ডাকলাম, লেন, জেগে উঠো। দেখ তুমি গ্রাউলকে ধ্বংস করে দিয়েছ! দেখ! দেখ! লেন জেগে উঠল না। আমার বুকে অচেতন হয়ে পড়ে রইল। মহাকাশযানের বড় করিডোর ধরে মাঝারি ধরনের একটা ভাসমান যানে করে আমরা নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। কয়দিনের মাঝে আমরাও শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব, তার আগে শেষবার মহাকাশযানটা ঘুরে দেখছি। কিছুদিন আগেও অসংখ্য মানুষে পুরো এলাকাটা জনাকীর্ণ ছিল, এখন কেউ নেই। গ্রাউলের হাত থেকে কর্তৃত্ব সরিয়ে নিয়ে সাথে সাথে মহাকাশযানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যে লোভকে পুঁজি করে মানুষকে অমানুষে রূপান্তরিত করা হয়েছিল সেউ লোভের
false
humayun_ahmed
আমাদেরও কাঁদতে হবে নাকি? ইলোরা এবং নীরা এক সঙ্গে হেসে উঠল, সেই হাসিতে নইমাও যোগ দিল। নীরা বলল, তুই চট করে কেঁদে আমার একশ টাকা লস করিয়ে দিলি। তুই জিতবি, এই নিয়ে একশ টাকা বাজি ছিল। তুই যত মোটা হচ্ছিস তোর বুদ্ধিও ততো মোটা হচ্ছে। আবার সবাই হেসে উঠল। নীরা বলল, রবীন্দ্র সংগীত দে ভাই, ইংরেজি ভালো লাগছে না। ইলোরা বলল, ফর গডস সেক, রবীন্দ্র সংগীত না। সখী ভালোবাসি ভালোবাসি এই সব গান আমার অসহ্য। অসহ্য হলেও উপায় নেই। আনুশকা রাজেশ্বরী দত্তের রেকর্ড খুঁজতে শুরু করেছে। আনুশকা বলল, শুরুর বাজনাটা শুনে কেউ যদি বলতে পারিস এটা কোন গান তাহলে তাকে আমি পাঁচশ টাকা দেব। মন দিয়ে শোন—রেকর্ড বাজতে শুরু করেছে। সবাই চুপ করে আছে। সেতারের হালকা কাজ। কোন গান বোঝা যাচ্ছে না। গান হচ্ছে। রাজশ্বেরী দত্তের কিন্নর কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। চারটি তরুণী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিবে যায় বারে বারে আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে। আজি মঙ্গলবার ভোর সাতটা। চায়ের টেবিলে শুভ্র এবং ইয়াজউদ্দিন সাহেব বসে আছেন। রেহানা নেই। তিনি রান্নাঘরে। ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছে। তার তদারকি হচ্ছে। পিঠাগুলো কেন জানি কিছুতেই জোড়া লাগছে না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, আইজতো তোমাদের যাত্রা। শুভ্ৰ মাথা নাড়ল। সব ঠিক ঠাক আছে তো? আছে। রাতের ট্রেনে যাচ্ছ? জ্বি টিকেট কাটা হয়েছে? না। স্টেশনে গিয়ে কাটা হবে। এডভান্স কাটা হলো না কেন? সবাই যাবে কিনা এখনো ফাইন্যাল হয়নি। যাদের যাবার কথা তার চেয়ে কয়েকজন বেশিও হতে পারে। আবার যাদের যাবার কথা তাদের মাঝখানে থেকে কেউ কেউ বাদ পড়তে পারে। অনেক আগে থেকেইতো প্রোগ্রাম করা। বাদ পড়বে কেন? বল্টু বলছিল—সে যাবে কি যাবে না তা মঙ্গলবার রাত আটটার আগে বলতে পারবে না। ইয়াজউদ্দিন সাহেব থমথমে গলায় বললেন, বল্টু? বল্টু মানে? সয়েল সায়েন্সে পড়ে একটা ছেলে, আমার বন্ধু। বল্টু নামের ছেলে তোমার বন্ধু? ওর ভালো নাম অয়ন। লম্বায় খাটো বলে সবাই ওকে বল্টু ডাকে। সবাই বল্টু ডাকে বলে তুমিও ডাকবে? তুমি নিজেওতো অসম্ভব রোগা। তোমাকে যদি কেউ যক্ষ্মা রোগী ডাকে তোমার ভালো লাগবে? প্রথম কিছুদিন খারাপ লাগবে। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন মনে হবে এটাই আমার নাম। তাছাড়া বল্টুর মতো আমারো নাম আছে। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, তোমারও নাম আছে? হ্যাঁ। বাংলা নববর্ষে সবাইকে খেতাব দেয়া হয়। আমাকেও দিয়েছে। এটা এক ধরনের ফান। এতে আপসেট হবার কিছু নেই। তোমাকে কি নামে ডাকে? বাদ দাও বাবা, শুনলে তোমার হয়ত খারাপ লাগবে। খারাপ লাগলেও আমি শুনতে চাই। বন্ধু বান্ধবরা আমাকে ডাকে কানা-বাবা। চোখে কম দেখিতো, এই জন্যে। ইয়াজউদ্দিন শীতল গলায় বললেন, তোমাকে কানা-বাবা ডাকে? জ্বি। যারা তোমাকে কানা-বাবা ডাকে তাদের সঙ্গেই তুমি যাচ্ছ? শুভ্ৰ চুপ করে রইল। সামান্য নাম নিয়ে বাবা এত রাগছেন কেন সে বুঝতে পারছে না। কত কুৎসিত কুৎসিত নাম আছে। এই সব নামের তুলনায় কানা-বাবা তো খুব ভদ্র নাম। মজার নাম। ইয়াজউদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কানা-বাবা নাম তোমাকে নববর্ষে খেতাব হিসেবে দেয়া হলো? না। এই নামটা এম্নিতেই চালু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নাম চালু হয়ে যাওয়ায় তুমি খুব খুশি। নামে কিছু যায় আসে না বাবা। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে বেশ মোটা সোটা। এই জন্যে তার নাম ওয়েল ট্যাংকার। আরেকটি খুব রোগা মেয়ে আছে, তার নাম সূতা ক্রিমি। কি বললে সূতা ক্রিমি? জি। এই নামে তাকে ডাকা হয়? হ্যাঁ হয়। সেও কি সূতা ক্রিমি ডাকায় তোমার মতোই খুশি? না সে খুব রাগ করে। কান্নাকাটি করে। এই জন্যে তাকে পুরো নাম ধরে ডাকা হয় না, ছোট করে ডাকা হয়। কি ডাকা হয় জানতে পারি? তাকে আমরা ডাকি সূ-ক্রি। আমরা ডাকি মানে তুমি নিজেও ডাক? না। আমি কখনো ডাকি না। ওর আসল নামটা খুব সুন্দর। আমি ঐ নামেই ডাকি। এর আসল নামটা কি? নীলাঞ্জনা। ইয়াজউদ্দিন সিগারেট হাতে বসে রইলেন। যে মেয়ের নাম নীলাঞ্জনা তাকে ক্লাসের ছেলেরা ডাকছে সূতা ক্রিমি। কোনো মানে হয়? শুভ্র। জ্বি। নামকরণের বিষয় নিয়ে আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। শুনতেও চাচ্ছি। না। তোমাকে কিছু উপদেশ দেবার জন্যে বসে আছি। উপদেশগুলো দেবার আগে। একটা জিনিস জানতে চাই, যে সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তুমি যােচ্ছ, তারা কি। তোমাকে খুব আগ্রহ করে নিচ্ছে? না। খুব আগ্রহ করে নিচ্ছে না। বরং ওরা চাচ্ছে আমি যেন না যাই। এ রকম চাচ্ছে কেন? ওদের ধারণা আমি চোখে দেখতেই পাই না। আমাকে নিয়ে ওরা বিপদে পড়বে। মোতালেব বলে আমার এক বন্ধু আছে, সে বলছে, শুভ্ৰ তুই না গেলে ভালো হয়। তুই যদি যাস তাহলে তোকে কোলে নিয়ে নিয়ে আমাদের ঘুরতে হবে। মোতালেব কি তোমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু? হ্যাঁ। আমি তাই মনে করি। ওরা অবশ্যি তা করে না। মোতালেব তোমাকে তুই তুই করে বলে? হ্যাঁ। তুমিও কি তাই বল? না। আমি তুই বলতে পারি না। আমার প্রথম উপদেশ হচ্ছে ওদের সঙ্গে মিশতে হলে ওদের মতো হয়ে মিশতে হবে। তুমিও তুই বলবে। দ্বিতীয় উপদেশ কি? দ্বিতীয় উপদেশ হচ্ছে দলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা। সবাই তো পারে না। কেউ কেউ পারে। তারা
false
humayun_ahmed
প্রশ্ন করলেন, তোর কি খুব খারাপ লাগছে আনিস? কই না তো! আমেরিকা থেকে ফিরে এসে একটা সাদাসিধা ভালো মেয়ে বিয়ে করিস তুই। আনিস হেসে ফেলল। বড়োচাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসির কী হল? হাসছিস কেন? আমি আর বাঁচব না। দিস ইজ এ লস্ট গেম। বড়োচাচা কথা বললেন না। আনিসের সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু বড়োচাচা না যাওয়া পর্যন্ত সেটি সম্ভব নয়। সে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন তিনি ওঠেন, কিন্তু তিনি উঠলেন না। আনিসের সিগারেট-পিপাসা আরো বাড়িয়ে দিয়ে একটি চুরুট ধরালেন। আনিসের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কোনো কারণে আমার ওপর তোর কি কোনো রাগ আছে? কী যে বলেন চাচা। রাগ থাকবে কেন? না, সত্যি করে বল। কী মুশকিল, আমি রাগ করব কেন? কী হয়েছে। আপনার বলুন তো। আমার কিছু হয় নি। বড়োচাচা হঠাৎ ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। কাল রাত থেকে তাঁর মনে হচ্ছিল, আনিসের মনে তাঁর প্রতি কিছু অভিমান জমা আছে। আনিস। যদিও এখন হাসছে, তবু সেই হাসিমুখ দেখে তাঁর কষ্ট হতে থাকল। তিনি নিজের মনে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যাই আনিস বলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। বড়োচাচা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁরা সামান্য ব্যাপারে অভিভূত হন না। আজ আনিসকে দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি চাইছিলেন কিছু একটা করেন, কিন্তু কী করবেন তা তাঁর জানা নেই। আনিসের জন্যে তাঁর একটি গাঢ় দুর্বলতা আছে। নিজের দুর্বলতাকে তিনি কোনো কালেই প্রকাশ করতে পারেন না। প্রকাশ করবার খুব একটা ইচ্ছাও তাঁর কোনো কালে ছিল না। কিন্তু আজ তাঁর মন কাঁদতে লাগল। ইচ্ছে হল এমন কিছু করেন যাতে আনিস বুঝতে পারে এই গৃহে তার জন্যে একটি কোমল স্থান আছে। কিন্তু আনিস বড় অভিমানী হয়ে জন্মেছে। তার জন্যে কিছু করা সেই কারণেই হয়ে ওঠে না। খুব ছোটবেলায় আনিসের যখন এগার-বার বৎসর বয়স, তখনই বড়োচাচা আনিসের তীব্র অতিমানের খোঁজ পান। বড়ো হয়েছে বলে আনিস তখন আলাদা ঘরে ঘুমায়। তার ঘরটি একতলায়। পাশের ঘরে আনিস, জরী ও পরীদের মাস্টার সাহেব থাকেন। এক রাত্ৰিতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বড়োচাচা আনিসের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনলেন আনিস কাঁদছে। তিনি ডাকলেন, আনিস, কী হয়েছে রে? আনিস ফুঁপিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছি। আয় আমার ঘরে। আমার সঙ্গে থাকবি? না। তাহলে আমি সঙ্গে শুই? দরজা খোল তুই। আনিস দরজা খুলল না। তিনি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বড়োচাচার মনে হল জরীর বিয়ের এই দিনটি আনিসের জন্যে খুব একটা দুঃখের দিন। কিন্তু তাঁর কিছুই করবার নেই। যে-ছেলেটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হচ্ছে, তার খোঁজ বড়োচাচাই এনেছিলেন। তাঁর আবাল্যের বন্ধু আশরাফ আহমেদের বড়ো ছেলে। নাম ও বিনয়ী। লাজুক ও হৃদয়বান; দেখতে আনিসের মতো সুপুরুষ নয়। রোগা ও কালো। জরীর বাবা আপত্তি করেছিলেন। বারবার বলেছেন, ছেলের ধরনধারণ যেন কেমন। জরীর মারও ঠিক মত নেই; মিনমিন করে বলেছেন, ইউনিভার্সিটির মাস্টার, কয় পয়সা আর বেতন পায়। কিন্তু বড়োচাচার প্রবল মতের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তিই টিকল না। তাঁর যুক্তি হচ্ছে জরীর মতো একটি ভালো মেয়ের জন্যে এ-রকম এক জন ভাবুক ছেলেই দরকার, যে গল্প-কবিতা লেখে—জরী সুখ পাবে। কিন্তু আপত্তি উঠল সম্পূৰ্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি সেদিন শয্যাশায়ী। দাঁতের ব্যথায় কাতর। সন্ধ্যাবেলা ঘরের বাতি জ্বলেন নি। অন্ধকারে শুয়ে আছেন। জয়ী এসে কোমল গলায় ডাকল, বড়োচাচা। কি জরী? আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। বড়োচাচা বিছানায় উঠে বসলেন!। বিস্মিত হয়ে বললেন, বাতি জ্বালা, জরী। না, বাতি জ্বালাতে হবে না। জরী এসে বসল। তাঁর পাশে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে, জরী? বড়োচাচা, আমি— বল, কী ব্যাপার! জরী থেমে থেমে বলল, বড়োচাচা, আমি ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করব না। কেন, কী হয়েছে? বড়োচাচা, আমি আনিস ভাইকে বিয়ে করতে চাই। জরী কাঁদতে লাগল। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, আনিস জানে? জরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, জানে। তাকে আসতে বলেছিলাম, তার নাকি লজ্জা লাগে। দু জনেই বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটাল। বড়োচাচা এক সময় বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। সে-রাতে তিনি একটুও ঘুমুতে পারলেন না। অনেক বার তাঁর ইচ্ছে হল তিনি আনিসের কাছে যান, কিন্তু তিনি নিজের ঘরেই বসে রইলেন। তাঁর অনেক পুরনো কথা মনে পড়তে লাগল। জরীর অনেক অদ্ভুত আচরণ অর্থবহ হল। একটি মেয়ে তো শুধু শুধু একা ছাদে বসে কাঁদতে পারে না। সে চোখের জলের কোনো-না–কোনো কোমল কারণ থাকে। আশ্চর্য! এ সব তার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে? বিয়ে বড়োচাচাই ভেঙে দিয়েছিলেন। যদিও কাউকেই বলেন নি, এত আগ্রহ যে-বিয়ের জন্য ছিল। হঠাৎ তা উবে গেল কেন। আজ জরীর বিয়ে হচ্ছে। এবং আশ্চৰ্য, সেই ছেলেটির সঙ্গেই। মাঝখানে একটি ভালোবাসার সবুজ পর্দা দুলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কী? জীবন বহতা নদী। একটি মৃত্যুপথযাত্রী যুবকের জন্যে তার গতি কখনো থেমে যায় না। থেমে যাওয়া উচিত নয়। বড়োচাচার কষ্ট হতে লাগল। জরীর জন্য কষ্ট। আনিসের জন্য কষ্ট! এবং সেই সঙ্গে তাঁর মৃতা স্ত্রীর জন্যে কষ্ট। তাঁর ইচ্ছে হল আবার আনিসের ঘরে যান। তার মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় বলেন, আনিস তোর মনে আছে, এক বার আমার সঙ্গে জন্মাষ্টমীর মেলায় গিয়েছিলি, সেখানে– তিনি আবার আনিসের ঘরে ফিরে এলেন। আনিস পা দোলাতে দোলাতে সিগারেট টানছিল। বড়োচাচাকে দেখে সে সিগারেট লুকিয়ে ফেলল।
false
shordindu
ক্ষণকাল চক্ষু নত করিয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘স্বামী কোথায় জানি না। বাপ-মাকে খবর দিইনি। তারা বুড়ো মানুষ‌, কি হবে তাদের খবর দিয়ে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। আচ্ছা‌, একটা কথা বল দেখি‌, যে-রাত্রে প্রাণহারিবাবু খুন হয়েছিলেন‌, সে-রাত্রে তিনি যখন খেতে নামলেন না‌, তখন তুমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলে?’ মোহিনী সায় দিয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ বাবু।’ ‘ঘরে আলো জ্বলছিল?’ ‘হ্যাঁ বাবু।’ ‘ঘরের পিছন দিকের দরজা‌, অর্থাৎ স্নানের ঘরের দরজা খোলা দেখেছিলে?’ ‘না বাবু।’ মোহিনীর চোখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল। ‘দরজা বন্ধ ছিল?’ পলকের জন্য মোহিনী দ্বিধা করিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আমি কিছুই দেখিনি বাবু। কর্তাবাবু মরে পড়ে আছেন দেখে ছুটে পালিয়ে এসেছিলুম।’ ‘তুমি স্নানের ঘরের দরজা বন্ধ করে দাওনি?’ ‘আজ্ঞে না।’ ‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ একটু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল‌, ‘প্রাণহারবাবু তোমাকে পনেরো টাকা মাইনে দিতেন?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ ‘প্রতি মাসে ঠিক সময়ে মাইনে দিতেন?’ মানুষ যখন মনে মনে এক কথা ভাবে এবং মুখে অন্য কথা বলে তখন তাহার মুখ দেখিয়া বোঝা যায়‌, তেমনি অন্যমনস্কভাবে মোহিনী বলিল‌, ‘আমার মাইনে কর্তাবাবুর কাছে জমা থাকত‌, দরকার হলে দুএক টাকা চেয়ে নিতুম।’ ব্যোমকেশের পানে কটাক্ষপাত করিয়া দেখিলাম সে মৃদু হাসিতেছে। সে বলিল‌, ‘তোমার মাইনের টাকা বোধহয় মারা গেল। আচ্ছা‌, এবার আমার শেষ প্রশ্ন : তুমি কোনো ন্যাটা লোককে চোন?’ মোহিনী অবাক হইয়া বলিল‌, ‘ন্যাটা লোক! সে কাকে বলে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ন্যাটা জান না? যে ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাত বেশি চালায় তাকে ন্যাটা বলে।’ মোহিনী সহসা বুকের উপর হাত রাখিয়া বলিল‌, ‘না। বাবু্‌, সে রকম কাউকে আমি চিনি না।’ মোহিনী দাঁড়াইয়া রহিল‌, আমরা উপরে প্রাণহারির শয়নকক্ষে উঠিয়া গেলাম। চাবি পাওয়া গিয়াছে। বেশি খোঁজাখুঁজি করিতে হয় নাই; সিন্দুক ও দেয়ালের মাঝখানে যে স্বল্প-পরিসর স্থান ছিল সেই স্থানে সিন্দুকের পিঠে চাবিটা মোম দিয়া আটকানো ছিল। বরাট বলিল‌, ‘এই নিন।’ নম্বর খোদাই করা লম্বা একটি চাবি। ব্যোমকেশ তাহা পরিদর্শন করিয়া বলিল‌, ‘চলুন আবার ব্যাংকে।’ ব্যাঙ্কে গিয়া ম্যানেজারের নিকট চাবি পেশ করা হইল। তিনি এবার আর দ্বিরুক্তি করিলেন না‌, স্বয়ং উঠিয়া আমাদের ভল্টে লইয়া গেলেন। ব্যাঙ্কের বাড়ির নীচে মাটির তলায় ঘর‌, তাহার তিনটি দেয়াল জুড়িয়া কাতারে কাতারে দ্বারযুক্ত স্টীলের খোপ শোভা পাইতেছে। দুইটি চাবি মিলাইয়া প্রাণহারির খোপের কবাট খোলা হইল। খোপের মধ্যে টাকাকড়ি‌, গয়নাগটি কিছু নাই‌, কেবল কয়েকটি পুরাতন চিঠি এবং এক বাণ্ডিল বন্ধকী তমসুক। চিঠিগুলি প্রাণহরিকে লেখা নয়‌, প্রাণহারির দ্বারাও লিখিত নয়। অজ্ঞাতনামা পুরুষ বা নারীর দ্বারা অজ্ঞাতনামা লোকের নামে লেখা। সম্ভবত এই পত্রগুলিকে অস্ত্র করিয়া প্ৰাণহরি লেখক ও লেখিকাদের রুধির শোষণ করিতেন। চিঠিগুলিতে ব্যোমকেশের প্রয়োজন ছিল না‌, সে তমসুকগুলি লইয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ম্যানেজারের ঘরে বসিয়া সে একে একে তমসুকগুলিতে চোখ বুলাইল। তারপর একটি তমসুক তুলিয়া ধরিয়া বরাটকে বলিল‌, ‘এই নিন। আপনার আসামী।’ তমসুকে আইনসঙ্গত ভাষায় লেখা ছিল‌, মহাজন প্রাণহরি পোদ্দার ভগবানপুর নিবাসী ভুবনেশ্বর দাসকে ক্ৰেতব্য মাটরগাড়ি বন্ধক রাখিয়া আড়াই হাজার টাকা কর্জ দিয়াছেন। কীভাবে ভুবনেশ্বর দাস এই ঋণ শোধ করিবে তাহার শর্তও দলিলে লেখা আছে : পঞ্চাশ টাকা নগদ; প্রাণহরি মোটর ব্যবহার করিবেন তাহার মাসিক ভাড়া পাঁচশ টাকা; একুনে পঁচাত্তর টাকা হিসাবে মাসে শোধ হইবে। বরাট ভ্রূ তুলিয়া বোমকেশের পানে চাহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার কাজ শেষ হয়েছে‌, এবার যা করবার আপনি করবেন।’ বরাট বলিলেন‌, ‘কিন্তু খুনের প্রমাণ?’ ‘প্রমাণ আছে। তবে আদালতে দাঁড়াবে কিনা বলতে পারি না। এবার আমরা বাড়ি ফিরব‌, বেলা দেড়টা বেজে গেছে।’ ‘চলুন‌, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।’ পুলিস-কারে যাইতে যাইতে বেশি কথা হইল না। একবার বিরাট বলিলেন‌, ‘ভুবনকে অ্যারেস্ট করি তাহলে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘করুন। সে যদি স্বীকার করে তাহলে সব ন্যাটা চুকে যাবে।’ বাড়ির ফটকের সামনে আমাদের নামাইয়া দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল‌, বরাট বলিয়া গেলেন‌, ‘বিকেলবেলা আসব।’ অপরাহ্নে আন্দাজ পাঁচটার সময় আমরা ক্ষীরের মালপোয়া লইয়া বসিয়াছি এমন সময় প্রমোদ বরাট আসিলেন। মণীশবাবু কয়লাখনিতে গিয়াছেন‌, ফণীশ বাড়িতে আছে। ইন্দিরা এতক্ষণ আমাদের কাছেই ছিল‌, এখন বিরাটকে দেখিয়া ভিতরে গিয়াছে। আসামী কে তাহা শুনিবার পর আমার মাথাটা হিজিবিজি হইয়া গিয়াছিল‌, এখন কতকটা ধাতে আসিয়াছে। ইন্সপেক্টর বরাটের মুখখানা শুষ্ক‌, মন বিক্ষিপ্ত; সকালবেলা যে ইউনিফর্ম পরিয়া ছিলেন‌, এখনও তাঁহাই পরিয়া আছেন মনে হয়। তিনি আসিয়া হাস্যহীন মুখে পকেট হইতে একটি খাম বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন; বলিলেন‌, ‘এই নিন। আঙুলের ছাপের ফটো আর রিপোর্ট। তিনজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।’ ব্যোমকেশ খামটি না খুলিয়াই পকেটে রাখিল‌, বরাটের মুখের পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘আজ দুপুরে আপনার খাওয়া হয়নি দেখছি।’ বরাট মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘খাওয়া হবে কেথেকে। আপনার আসামী পালিয়েছে।’ ব্যোমকেশ এমনভাবে ঘাড় নাড়িল যেন ইহার জন্য সে প্রস্তুত ছিল। তারপর বিরাটকে বসিতে বলিয়া সে ফণীশের পানে চাহিল। ফণীশ দ্রুত অন্দরের দিকে চলিয়া গেল। বিরাট হেলান দিয়া ক্লান্ত স্বরে বলিলেন‌, ‘শুধু আসামী নয়‌, মোহিনীও পালিয়েছে। দু’জনে ট্যাক্সিতে চড়ে হাওয়া হয়েছে। কনস্টেবলটা প্ৰাণহারির বাড়িতে পাহারায় ছিল‌, কিন্তু মোহিনীকে আটক করবার হুকুম তার ছিল না। ভুবন দাস ট্যাক্সিতে এসে রাস্তা থেকে হর্ন বাজালো‌, মোহিনী বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। দু’জনে চলে গেল।’ ফণীশ এক থালা খাবার আনিয়া বরাটের সম্মুখে রাখিল‌, বরাট বিমৰ্ষভাবে আহার করিতে লাগিলেন। আমরাও মালপোয়াতে মন দিলাম। নীরবে আহার চলিতে লাগিল। বৈষ্ণবীয় জলযোগ সমাধা করিয়া সিগারেট ধরাইবার উপক্রম করিতেছি‌, বাহিরের
false
shomresh
যাব। আমার জিনিসপত্র তোরা নিয়ে যাস। জয়িতা বলল, অতদূরে কেন? আমরা তো সন্ধ্যের আগে এখান থেকে বের হচ্ছি না। তুই গাড়ি নিয়ে ট্রাম ডিপোর সামনে চলে আয়। আনন্দ বলল, সেই ভাল। কিন্তু কাল দুপুরে ফ্লাইট। তোরা অতক্ষণ কোথায় থাকবি? এই সমস্যাটাই বড় হয়ে দেখা দিল। কোন পরিচিত লোকের বাড়িতে থাকতে সাহস পাচ্ছিল না। ওরা। যে কোন মুহূর্তে বিপদ হতে পারে। আনন্দর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ল বাবার চিঠিটার কথা। বাবার সেই বান্ধবীর কাছে সাহায্যের জন্যে গেলে কেমন হয়! সঙ্গে সঙ্গে মতলবটা বাতিল করল সে। যাকে কখনও দ্যাখেনি তার কাছে সাহায্য চাওয়াটাই বোকামি, যদিও বাবার চিঠির ভাষা ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা অন্য রকমের ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত সুদীপ পথ বাতল। এয়ারপোর্ট হোটেল নয়, আজ সন্ধ্যেবেলায় ওরা সোজাসুজি ভি আই পি রোডে চলে যাক। প্রায় এয়ার পোর্টের কাছাকাছি ভি আই পি রোডের গায়ে একটা রেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে। সাধারণত যারা ফ্লাইট ধরবে বা ধরতে আসে তারাই ওখানে থাকে। চার্জও বেশি নয়। আনন্দ বলল, তাহলে আমরা একটু ঝুকি নেব। কল্যাণকে এখন কোথাও রেখে যাব না। ও জয়িতার সঙ্গে গাড়িতেই থাকবে। আমরা যদি মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বের হতে পারি তাহলে সোজা ওই রেস্ট হাউসে গিয়ে ওদের নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাব। হঠাৎ কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, যদি না বের হতে পারিস? তোদের কিছু হলে? আচমকা একটা হিমবাতাস বয়ে গেল ঘরে। সেটাকে কাটিয়ে উঠল আনন্দই, তা হলে তোরা অপেক্ষা করবি না। আমরা ধরা পড়লেই যে তোদের ধরা দিতে হবে এমন আমি চাই না। সঙ্গে টাকা আছে, এয়ার টিকেট আছে, যেভাবেই হোক নিজেদের বাঁচাবি। আমাদের বাদ দিয়ে যদি তোরা একটাও অ্যাকশন করত পারিস তা হলে সেটাও খুব মূল্যবান হবে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, বাগডোগরা থেকে কোথায় যাব? আনন্দ ওদের বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তা হলে ওরা সেইদিনই একত্রিত হবে। এখন সৌভাগ্য কতটা সেটাই দেখা যাক। পিঠে-বওয়া-ব্যাগ ছাড়াও দুটো চামড়ার ঝোলা কিনেছে সুদীপ। ঝোলাটা ওয়াটারপ্রুফ। তাতে যাবতীয় লড়াই-এর রসদ রাখা হয়েছে। ওইটে বহন করবে আনন্দ। সুদীপ ঘড়ি দেখল। আজ বৃদ্ধার জ্বর কম, কিন্তু দুর্বল হয়ে আছেন। ওর একবার মনে হল বের হবার আগে বৃদ্ধার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে আসা দরকার। মায়ের কাজটা যে এ জীবনে করতে পারল না সেটা অবশ্য বলা যাবে না, কিন্তু একটু পাশাপাশি বসলে খুশী হবেন উনি। ও নিচে নেমে গেল। জয়িতার কেবলই মনে হচ্ছিল কলকাতা থেকে চলে যাওয়ার আগে রামানন্দ রায়ের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু বাড়ির ফোনে পুলিশ আড়ি পেতেছে কিনা কে জানে। রামানন্দ রায়ের অফিসে অবশ্য যাওয়া যেত। সীতা রায় সুদীপকে বলেছিল দরকার হলে সাহায্য চাইতে। এক রাত্রে মা হঠাৎ অমন পালটে গেল কি করে। খুব ছেলেবেলায় যে মাকে সে হারিয়েছিল তাকেই এই মুহূর্তে সে দেখতে পেল। তা সত্ত্বেও নিজেকে শক্ত করতে চাইছিল সে। কারণ সে বুঝতে পারছিল অন্য দুই বন্ধুর মনের অবস্থায় খুব ফারাক নেই। আনন্দ বা কল্যাণ এখন নিশ্চয়ই ওদের বাড়ির কথা ভাবছে। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার পর সুদীপ শেষ কথাটা বলল, আমি আজ রাত্রে ফিরব না। কেন? কোথায় যাবে? বৃদ্ধা অবাক হয়ে গেলেন। কয়েকটা জরুরী কাজ আছে, সারতে হবে। ও তাই বল। আমি ভাবলাম তুমি অবনীর বাড়িতে যাবে। দ্যাখো, বলছিলাম কি, যদিও আমার গুরু রাড় বাড়ি যায়—তবুও আমার গুরু রামানন্দ রায়। তা বাপ তো গুরুর মতই। আপনার কথা আমার মনে থাকবে। সুদীপ উঠে পড়ল। এখন গয়া পড়ে গেছে। আকাশে মেঘ থাকায় আলো কমে যাচ্ছে দ্রুত। সে সিড়ি দিয়ে বলে উঠতে উঠতে বাদিকে তাকাল। এখান থেকে সামনের গলির একাংশ দেখা যায় গাছপালার ফাঁকে। সেখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে এপাশে তাকিয়ে। তার ঠিক পাশেই আর একা লোক দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছে। লোক দুটোর চেহারা দেখে সুদীপের সন্দেহ হল। ওরা পুলিশের লোক না হয়ে যায় না। নিশ্চয়ই ওখানে দাঁড়িয়ে কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে। সে আর ভাবতে পারল না। দৌড়ে ঘরে ঘরে চলে এসে বলল, চটপট জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আয়। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের খোঁজ পেয়েছে। কারা? কল্যাণের মুখ সাদা হয়ে গেল। আনন্দ বলল, কি করে বুঝলি? গলির মধ্যে দুটো সন্দেহজনক লোক দাঁড়িয়ে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। নিজে একটা ব্যাগ তুলে নিয়ে সে ডাকল, চলে আয়। জয়িতা বেরিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করল, বুড়ি আমাদের দেখতে পাবে না? পেলে পাবে। এখন ওসব ভাবার সময় নেই। প্রায় উবু হয়েই ওরা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এল। উঠোনের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েক সেকেন্ড সময় পাওয়া যাবে ওরা এলে। সুদীপ চারপাশে তাকাল। বৃদ্ধা তার ঘরে শুয়ে আছেন। দরজাটা এড়িয়ে গেলে তিনি দেখতে পাবেন না। ওর মনে পড়ল পেছনের পুকুরধারে আর একটা পথ আছে। সেই পথেও পুলিশ এসে গিয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু ওই পথ ছাড়া বের হবার কোন উপায় নেই। বুড়িকে ডিঙিয়ে ওরা পেছনের দরজায় চলে এল। সে নিচুগলায় আনন্দকে বলল, তোরা একটু সরে দাঁড়া। সেই বউটা এলে আমি ওর সঙ্গে ঘরের ভেতরে চলে যাব। গল্প করছি দেখলে তোরা ভেতরে ঢুকে ডানদিকের বারান্দার গায়ে
false
humayun_ahmed
ঘর থেকে বের হলেন। দরজা বন্ধ করলেন। তালা লাগানোর আওয়াজ পেলাম। তার মানে বেশ কিছু সময়ের জন্যে আমাকে এখানে থাকতে হবে। এখন বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে কোনো বাধা নেই। আজকের দিনটাও ঘুমানোর জন্যে ভালো। মেঘলা আকাশ। বাতাসে হিম। আমি আয়োজন করেই ঘুমুতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। অনেক দিন পর বাবা স্বপ্নে দেখা দিলেন। তার পরনে হাফপ্যান্ট। মাথায় নীল টুপি, গলায় মাফলার। কাধে জন্ম নিবন্ধনের ব্যাগ। এই হিমু, তোর জন্ম নিবন্ধনটা করে ফেলি। ফরম ফিলাপ কর। ফরম তুমি ফিলাপ করো। আমার বিষয়ে তো তুমি সবচে বেশি জানো। বাবা বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে বললেন, অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ? না। কুকুর নিয়ে ঘোরা শুরু করেছিস। এটাও তো ঠিক না। তোকে বলেছি না, বন্ধু পাতাবি না, শত্রু পাতাবি না। তোকে যা যা শিখিয়েছি তার কোনোটাই তো তুই পালন করছিস না। দুই লাখ টাকা ব্যাগে নিয়ে ঘুরছিস। ? তুই থাকবি কপর্দকশূন্য অবস্থায়। সরি বল। সরি। তোকে তালাবন্ধ করে রেখেছে না-কি? হুঁ। বুদ্ধি খেলে বের হয়ে যা। তালা খোলা তো কোনো ব্যাপার না। না-কি আমি খুলে দিয়ে যাব? দাও। ঠিক আছে, যাবার সময় তালা খুলে দিয়ে যাব। এখন ফরম ফিলাপ কর। কী বল। পাছায় কালো জন্মদাগ আছে। এটা দেয়া কি ঠিক হবে? কেন ঠিক হবে না! সত্য যত কঠিনই হোক, সত্য সত্যই। তুই একটু সরে আমাকে জায়গা দে। শুয়ে শুয়ে ফরম ফিলোপ করি। কিছু খাবে বাবা? টেবিলে সমুচা আছে। সমুচা তো আমিষ খাবার। আমি আমিষ খাবার কেন খাব! আমি নিরামিষাষি না? তুই কি আমিষ খাওয়া ধরেছিস? হুঁ। হিমু, আমি আপসেট। ভেরি ভেরি আপসেট। কম্বলটা গায়ের উপর তুলে দে না। ঠাণ্ডা লাগছে তো। আমি বাবার গায়ে কম্বল টেনে দিলাম। কোলবালিশটা দে। অনেক দিন কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাই না। আমি কোলবালিশ এগিয়ে দিলাম। বাবা কাগজপত্র ফেলে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। তাকে খুব ক্লাস্ত দেখাচ্ছে। মনে হয় অনেকদিন আরাম করে ঘুমান না। এখন কোলবালিশ জড়িয়ে সুখনিদ্ৰা। ঘুম ভাঙল ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে। পাকা দালানকোঠায় বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। যখন শোনা যায়। তখন ধরে নিতে হবে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। টেবিল ল্যাম্প জুলছে। সময় বোঝা যাচ্ছে না। এসেছি সকালে। এক ঘুমে রাত এনে ফেলব তা হয় না। প্লাষ্টিকের চেয়ারে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা একজন সুপুরুষ মধ্যবয়স্ক মানুষ। হাতে সিগারেট। ভুরু কুঁচকে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতের সিগারেট উঠানামা করছে। ইনি ভয়ঙ্কর আয়না মজিদ ভাবতেই কেমন যেন লাগে। আমি উঠে বসতে বসতে বললাম, আয়না ভাই! কয়টা বাজে? আয়না ভাই আমার সম্বোধনে মোটেই চমকালেন না। যেন ধরেই নিয়েছেন তাকে এই প্রশ্ন করা হবে। তিনি নির্বিকার গলায় বললেন, তিনটা বাজতে সাত शिनि। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, লম্বা ঘুম দিয়ে দিয়েছি। অনেকদিন এ রকম আরামের ঘুম হয় না। আয়না ভাই, আপনার সামনের চেয়ারে যে ব্যাগ ঝুলছে সেই ব্যাগে দুই লাখ টাকা আছে। নিয়ে নিন। আমি চলে যাই। প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। বাসায় যাব, খাওয়াদাওয়া করব। খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। থ্যাংক য়্যু। আমার কুকুরটাকেও খাওয়াতে হবে। কুকুরটা আছে, না চলে গেছে? আছে। আয়না মজিদ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনি ঘরের তালা কীভাবে খুললেন? তালা খুলে ঘরে শুয়ে থাকলেন কেন? চলে যান নি কেন? এই প্রশ্নগুলির জবাব চাই। আমি খানিকটা হকচাকিয়ে গেলাম। তালা সত্যি সত্যি খোলা হয়েছে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। জগতে রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। তবে স্বপ্নে বাবা এসে তালা খুলে ছেলেকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে–এরকম রহস্যময় ঘটনা ঘটে না। স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, টেনশনে লম্বু খোকন ঠিকমতো তালাই লাগায় নি। আপনি আমার প্রতিটি প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেবেন। জবাব দিতে থাকুন। আমি বললাম, জবাব দেব কেন? আমি কি রিমান্ডে? হ্যাঁ রিমান্ডে। আয়না ভাই শুনুন। আমি রিমান্ডে না। রিমান্ডে আপনি। আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন। আয়না মজিদের শরীর শক্ত হয়ে গেল। চোখে পলক পড়া বন্ধ। নিঃশ্বাসও মনে হয় বন্ধ। তিনি নিজেকে সামলানোর সময় নিচ্ছেন। তার ভেতরে ভয়ও মনে হয় কাজ করছে। তার মন বলছে প্ৰতিপক্ষ কঠিন। তাকে সাবধানে করতে হবে। ভয়ঙ্কর মানুষ সবসময় ভয়ঙ্কর ভীতু হয়ে থাকে। তারা মানুষ ভয় পায় না, দৈবে ভয় পায়। ঘরের তালা খুলে যাওয়াটা আমার পক্ষে কাজ করছে। আয়না মজিদ সুপার ন্যাচারাল কিছু আশঙ্কা করছেন। আপনার নাম হিমু? আমার নাম একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ ডাকে হিমু। কেউ ডাকে হিমালয়। আবার কেউ কেউ আয়না মজিদও ডাকেন। এস বি ইন্সপেক্টর কবীর সাহেব আমাকে ডাকেন আয়না মজিদ। আপনি সেই লোক যাকে পুলিশ আয়না মজিদ হিসাবে ধরেছে। এবং আপনি পুলিশ কাস্টিডি থেকে পালিয়ে এসেছেন? হুঁ। আপনার সঙ্গে আমার চেহারার মিল আছে, এটা কি আপনি জানেন? জানতাম না। আপনাকে দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। অবাক হচ্ছেন না? আমি বললাম, না। প্রকৃতি একই চেহারার মানুষ সবসময় সাতজন করে তৈরি করে। কে বলেছে? সবাই জানে। আপনি জানেন না, কারণ আপনি পড়াশুনা করার সময় পান নি। খুন-খারাবিতে সময় চলে গেছে। পুলিশ কাস্টিডি থেকে কীভাবে পালিয়েছেন? জানতে চান কেন? বিদ্যাটা শিখে রাখতে চাই। শিখলেও কাজে লাগাতে পারবেন না। আসুন ভাত খাই, তারপর কথা বলব। ভাত খাওয়ার
false
robindronath
ক্রমে এক বছর যখন কাটিল তখন, মাখন যে বরদার প্রতি অনাবশ্যক কঠোরাচরণ করিয়াছেন, সে কথা পিসিও বলিতে শুরু করিলেন। দুই বছর যখন গেল তখন পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলিতে লাগিল, বরদার পড়াশুনায় মন ছিল না বটে, কিন্তু মানুষটি বড়ো ভালো ছিল। বরদার অদর্শনকাল যতই দীর্ঘ হইল ততই, তার স্বভাব যে অত্যন্ত নির্মল ছিল, এমন-কি, সে যে তামাকটা পর্যন্ত খাইত না, এই অন্ধ বিশ্বাস পাড়ার লোকের মনে বদ্ধমূল হইতে লাগিল। স্কুলের পণ্ডিতমশায় স্বয়ং বলিলেন, এইজন্যই তো তিনি বরদাকে গোতম মুনি নাম দিয়াছিলেন, তখন হইতেই উহার বুদ্ধি বৈরাগ্যে একেবারে নিরেট হইয়া ছিল। পিসি প্রত্যহই অন্তত একবার করিয়া তাঁর দাদার জেদী মেজাজের ’রে দোষারোপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘বরদার এত লেখাপড়ার দরকারই বা কী ছিল। টাকার তো অভাব নাই। যাই বল, বাপু, তার শরীরে কিন্তু দোষ ছিল না। আহা, সোনার টুকরো ছেলে!’ তার স্বামী যে পবিত্রতার আদর্শ ছিল এবং সংসারসুদ্ধ সকলেই তার প্রতি অন্যায় করিয়াছে, সকল দুঃখের মধ্যে এই সান্ত্বনায়, এই গৌরবে ষোড়শীর মন ভরিয়া উঠিতে লাগিল। এদিকে বাপের ব্যথিত হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ দ্বিগুণ করিয়া ষোড়শীর উপর আসিয়া পড়িল। বউমা যাতে সুখে থাকে, মাখনের এই একমাত্র ভাবনা। তাঁর বড়ো ইচ্ছা, ষোড়শী তাঁকে এমন কিছু ফরমাশ করে যেটা দুর্লভ— অনেকটা কষ্ট করিয়া, লোকসান করিয়া তিনি তাকে একটু খুশি করিতে পারিলে যেন বাঁচেন— তিনি এমন করিয়া ত্যাগ স্বীকার করিতে চান যেটা তাঁর পক্ষে প্রায়শ্চিত্তের মতো হইতে পারে। ২ ষোড়শী পনেরো বছরে পড়িল। ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া যখন-তখন তার চোখ জলে ভরিয়া আসে। চিরপরিচিত সংসারটা তাকে চারি দিকে যেন আঁটিয়া ধরে, তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে। তার ঘরের প্রত্যেক জিনিসটা, তার বারান্দার প্রত্যেক রেলিঙটা, আলিসার উপর যে-কয়টা ফুলের গাছের টব চিরকাল ধরিয়া খাড়া দাঁড়াইয়া আছে, তারা সকলেই যেন অন্তরে অন্তরে তাকে বিরক্ত করিতে থাকিত। পদে পদে ঘরের খাটটা, আলনাটা, আলমারিটা— তার জীবনের শূন্যতাকে বিস্তারিত করিয়া ব্যাখ্যা করে; সমস্ত জিনিসপত্রের উপর তার রাগ হইতে থাকে। সংসারে তার একমাত্র আরামের জায়গা ছিল ঐ জানালার কাছটা। যে-বিশ্বটা তার বাহিরে সেইটেই ছিল তার সব চেয়ে আপন। কেননা, তার ‘ঘর হৈল বাহির, বাহির হৈল ঘর’। একদিন যখন বেলা দশটা— অন্তঃপুরে যখন বাটি, বারকোষ, ধামা, চুপড়ি, শিলনোড়া ও পানের বাক্সের ভিড় জমাইয়া ঘরকন্নার বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে— এমন সময় সংসারের সমস্ত ব্যস্ততা হইতে স্বতন্ত্র হইয়া জানালার কাছে ষোড়শী আপনার উদাস মনকে শূন্য আকাশে দিকে দিকে রওনা করিয়া দিতেছিল। হঠাৎ ‘জয় বিশ্বেশ্বর’ বলিয়া হাঁক দিয়া এক সন্ন্যাসী তাহাদের গেটের কাছে অশথতলা হইতে বাহির হইয়া আসিল। ষোড়শীর সমস্ত দেহতন্তু মীড়াটানা বীণার তারের মতো চরম ব্যকুলতায় বাজিয়া উঠিল। সে ছুটিয়া আসিয়া পিসিকে বলিল, “পিসিমা, ঐ সন্ন্যাসীঠাকুরের ভোগের আয়োজন করো।” এই শুরু হইল। সন্ন্যাসীর সেবা ষোড়শীর জীবনের লক্ষ্য হইয়া উঠিল। এতদিন পরে শ্বশুরের কাছে বধূর আবদারের পথ খুলিয়াছে। মাখন উৎসাহ দেখাইয়া বলিলেন, বাড়িতে বেশ ভালোরকম একটা অতিথিশালা খোলা চাই। মাখনবাবুর কিছুকাল হইতে আয় কমিতেছিল; কিন্তু তিনি বারো টাকা সুদে ধার করিয়া সৎকর্মে লাগিয়া গেলেন। সন্ন্যাসীও যথেষ্ট জুটিতে লাগিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশ যে খাঁটি নয়, মাখনের সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বউমার কাছে তার আভাস দিবার জো কী! বিশেষত জটাধারীরা যখন আহার-আরামের অপরিহার্য ত্রুটি লইয়া গালি দেয়, অভিশাপ দিতে ওঠে, তখন এক-একদিন ইচ্ছা হইত, তাদের ঘাড়ে ধরিয়া বিদায় করিতে। কিন্তু ষোড়শীর মুখ চাহিয়া তাহাদের পায়ে ধরিতে হইত। এই ছিল তাঁর কঠোর প্রায়শ্চিত্ত। সন্ন্যাসী আসিলেই প্রথমে অন্তঃপুরে একবার তার তলব পড়িত। পিসি তাকে লইয়া বসিতেন, ষোড়শী দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিত। এই সাবধানতার কারণ ছিল এই, পাছে সন্ন্যাসী তাকে প্রথমেই মা বলিয়া ডাকিয়া বসে। কেননা, কী জানি!— বরদার যে-ফটোগ্রাফখানি ষোড়শীর কাছে ছিল সেটা তার ছেলে বয়সের। সেই বালক-মুখের উপর গোঁফদাড়ি জটাজুট ছাইভস্ম যোগ করিয়া দিলে সেটার যে কিরকম অভিব্যক্তি হইতে পারে তা বলা শক্ত। কতবার কত মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছে, বুঝি কিছু কিছু মেলে; বুকের মধ্যে রক্ত দ্রুত বহিয়াছে, তার পরে দেখা যায়— কণ্ঠস্বরে ঠিক মিল নাই, নাকের ডগার কাছটা অন্যরকম। এমনি করিয়া ঘরের কোণে বসিয়াও নূতন নূতন সন্ন্যাসীর মধ্য দিয়া ষোড়শী যেন বিশ্বজগতে সন্ধানে বাহির হইয়াছে। এই সন্ধানই তার সুখ। এই সন্ধানই তার স্বামী, তার জীবনযৌবনের পরিপূর্ণতা। এই সন্ধানটিকেই ঘেরিয়া তার সংসারের সমস্ত আয়োজন। সকালে উঠিয়াই ইহার জন্য তার সেবার কাজ আরম্ভ হয়— এর আগে রান্নাঘরের কাজ সে কখনো করে নাই, এখন এই কাজেই তার বিলাস। সমস্তক্ষণই মনের মধ্যে তার প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বালানো থাকে। রাত্রে শুইতে যাইবার আগে, ‘কাল হয়তো আমার সেই অতিথি আসিয়া পৌঁছিবে’ এই চিন্তাটিই তার দিনের শেষ চিন্তা। এই যেমন সন্ধান চলিতেছে, অমনি সেইসঙ্গে যেমন করিয়া বিধাতা তিলোত্তমাকে গড়িয়াছিলেন তেমনি করিয়া ষোড়শী নানা সন্ন্যাসীর শ্রেষ্ঠ উপকরণ মিলাইয়া বরদার মূর্তিটিকে নিজের মনের মধ্যে উজ্জ্বল করিয়া তুলিতেছিল। পবিত্র তার সত্তা, তেজঃপুঞ্জ তার দেহ, গভীর তার জ্ঞান, অতি কঠোর তার ব্রত। এই সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করে এমন সাধ্য কার। সকল সন্ন্যসীর মধ্যে এই এক সন্ন্যাসীরই তো পূজা চলিতেছে। স্বয়ং তার শ্বশুরও যে এই পূজার প্রধান পূজারি, ষোড়শীর কাছে এর চেয়ে গৌরবের কথা আর কিছু ছিল না। কিন্তু, সন্ন্যাসী প্রতিদিনই তো আসে না। সেই ফাঁকগুলো বড়ো অসহ্য। ক্রমে সে ফাঁকও ভরিল। ষোড়শী ঘরে থাকিয়াই
false
humayun_ahmed
এত সহজে চমকাতে পারবে না, তাই না আপা? হ্যাঁ–আমাদের চমকানো খুব কঠিন বরং আমরা তাকে অতি সহজেই চমকে দিতে পারি। ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা চালাতে বলে তুমি তো প্রথমেই চমকে দিয়েছ? শাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–তোর খুব বুদ্ধি নীতু। তোর বুদ্ধি দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে চমকে যাই। আপা! হুঁ। মাঝি যে বলল উনাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না–এটা কেন বলল? গ্রামের মানুষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলতে পছন্দ করে এই জন্যে বলেছে। এইসব হচ্ছে কথার কথা। যেমন, সে আমাদের সম্পর্কে অন্যদের কাছে বলবে–আজ রাতে নৌকায় দুটা মেয়েকে পার করেছি। দুটাই পরীর মত সুন্দর। এর মধ্যে একটা মেয়ে এমন ভয় পাচ্ছিল, ভয়ে কিছুক্ষণ পর পর ফিট হচ্ছিল। কি, বলবে না এরকম? নীতু হাসিমুখে বলল, মনে হচ্ছে বলবে। আপা শোন, তুমি আরও নিচু গলায় কথা বল–আমার মনে হয় ঐ লোকটা আমাদের সব কথা শুনছে। না শুনছে না। ও নৌকা চালাতেই ব্যস্ত। নীতু গলা বের করে মতির দিকে তাকিয়ে বলল–আচ্ছা, আপনি কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন? মতি বলল, জি পাইতেছি। নৌকার ছইয়ের ভেতকে ফিসফিস কইরা কথা বললেও বাইরে থাইক্যা পরিষ্কার শোনা যায়। ছইয়ের পেছনে পর্দা না থাকলে শোনা যাইত না–বাতাসে শব্দ ভাইস্যা যাইত। পিছনে পর্দা এই জন্যে সব শুনতাছি। আমাদের কথায় রাগ করেননি তো? জি না। শীতে মতির শরীর কাঁপছে। ভেজা পাঞ্জাবিটা গা থেকে খুলে ফেলতে পারলে শীত কম লাগত। মেয়ে দুটাও তাকিয়ে আছে, পাঞ্জাবি খোলা ঠিক হবে না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের নাতনী, এদের সামনে আদবকায়দার বরখেলাফ করা যায় না। মতির ধারণা, ইতিমধ্যেই সে আদবকায়দা অনেক বরখেলাফ করে ফেলেছে। মাস্টার সাহেব তাকে কথা কম বলতে বলেছেন, সে কথা কম বলেনি। বেশিই বলেছে। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। কারণ ছাড়াই কথা বলতে ইচ্ছা করে। মেয়ে দুটা সেই রকম। তবে বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দর মানুষকে আপন বলে মনে হয় না, পর পর লাগে। শাহানা বলল, আপনি কি করেন? মতি লজ্জিত গলায় বলল, কিছু করি না। আফনের আন্দাজ ঠিক আছে। মাঝি পেছন থেকে বলল, মতি ভাই হইল আফনের গানের দলের অধিকারী। শাহানা বলল, সেটা কি? মতি আগের চেয়েও লজ্জিত গলায় বলল–আমার একটা গানের দল আছে। ছোট দল। বলেন কি? আপনি তাহলে মিউজিক্যাল টুপের কনডাক্টার? ইন্টারেস্টিং তে। মতি অস্বস্তি ঢাকার জন্যে কয়েকবার কাশল। গানের দল করা এমন কোন কাজ না যে বড় গলায় বলতে হয়। এইসব পরিচয় গোপন রাখাই ভাল। গ্রামাঞ্চলে কাজকর্মহীন বাদাইম্যারা গানের দল করে, যাত্রার দল করে। নীতু শাহানার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নৌকার দুলুনীতে শাহানারও ঘুম আসছে। গানের দল ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন না? মতি জবাব দিল না। অস্বস্তি ঢাকার জন্যে অকারণে কাশতে লাগল। শাহানা বলল, গানের দল যারা করবে অন্য কিছু করার তাদের সময়ই বা কোথায়? এইসব হল ক্রিয়েটিভ কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ। সৃষ্টিশীল কাজ যারা করে তারা অন্য কিছু করতে পারে না। তাদের মাথায় সব সময় একটা কাজই ঘুরে তো, সেই জন্যেই পারে না। মতি মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর কথা! এ রকম সুন্দর কথা এই জীবনে কেউ তাকে বলেনি। আপনার দল নিয়ে একদিন একটা উৎসব করবেন। আমরা শুনব। জ্বি আচ্ছা। আপনাদের কজনের দল? চাইর জনের। বাহ, সুন্দর তো–বিটলসদের দলেও ছিল চারজন। মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমরার মইধ্যে সবচে ওস্তাদ হইল আফনের পরাণ কাকা। ঢোল বাজায়। হাতের মধ্যে আছে মধু। আহা রে কি বাজনা! আপনি কি করেন? আমি গান গাই–গলা ভাল না–মোটামুটি। তয় আফনের দরদ দিয়া গাই–গলার অভাব এই কারণে লোকে ধরতে পারে না। শাহানা হাসল। মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল–পরাণ কাকার ঢোল শুনলে আফনের সারা জীবন মনে থাকব–আহা কি জিনিস! শুনব, উনার ঢোল শুনব। উনার মন-টন বেশি ভাল–স্ত্রীর সন্তান হবে। শেষ বয়সে সন্তান। শেষ বয়সে সন্তান হলে চিন্তা হবারই কথা। আরেকজন আছে আবদুল করিম, বেহালাবাদক। তয় উনারে এখনো দলে নিতে পারি নাই। চেষ্টায় আছি। উনিও খুব ভাল? আমার টেকা থাকলে উনার দুইটা হাত রূপা দিয়া বান্ধাইয়া দিতাম। সোনা দিয়ে বান্ধাতেন না কেন? সোনা দিয়ে বান্ধানো ভাল না? পুরুষছেলের জন্যে সোনা নিষিদ্ধ। এই জন্যে রূপার কথা বলেছে। ও আচ্ছা। আফনের সঙ্গে অনেক আজেবাজে কথা বইল্যা ফেলছি। মনে কিছু নিবেন না। কিছু মনে করব না। তাছাড়া আপনি আজেবাজে কথা কিছু বলেননি। সুখানপুকুর আর কতদূর? বেশি দূর না। আইস্যা পড়ছি। ধরেন আর এক ঘণ্টা। শাহানা চুপ করে আছে। মতি ক্লান্ত হয়ে লগি কোলের উপর নিয়ে বিশ্রাম করছে। দূরে কোথাও শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাঝি বলল, আবার বৃষ্টি নামতাছে। এই বছরের মত বৃষ্টি আর কোন বছর হয় নাই। শাহানার শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে ভাঁজ করা একটা চাদর আছে। কার না কার চাদর, গায়ে দিতে ইচ্ছা করে না। নিজের একটা চাদর থাকলে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকা যেত। বৃষ্টি নেমেছে জোরেসোরে। বিলের পানিতে বৃষ্টির শব্দ–কি যে অদ্ভু্ত! কি যে অদ্ভুত!! ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা থামল তখন দুবোনই ঘুমে অচেতন। মতি ওদের ঘুম ভাঙল না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এল। সাত ব্যাটারির টর্চ হাতে তিনি নদীর ঘাটে এলেন। মেয়েদের মুখে টর্চের আলো ফেলে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি ব্যাকুল গলায় ডাকলেন–শাহানা, এই শাহানা!
false
shorotchandra
ভয় নাই রে দিবাকর, নির্ভয়ে চল্‌। আমাদের সে উপীনদা আর নেই। এখন সহস্র অপরাধেও আর অপরাধ নেন না,—শুধু মুচকে মুচকে হাসেন,—ছি ছি, ঐ ্ধূলোবালির ওপর ওখানে অমন করে শুয়ো না বৌঠান। আচ্ছা, আমরা বাইরে যাচ্চি, তুমি একটু শোও—উঠো না যেন।—বলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া সতীশ পায়ের উপর একটু ঠেলা দিয়াই বুঝিল, কিরণময়ী সংজ্ঞা হারাইয়া লুটাইয়া পড়িয়াছে—ইচ্ছা করিয়া ভূ-শয্যা গ্রহণ করে নাই। সতীশ এবং দিবাকর উভয়েই পরস্পরের মুখের প্রতি চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মুহূর্ত-কয়েক পরে সতীশ ধীরে ধীরে কহিল, ঠিক এই ভয়ই আমার ছিল দিবাকর। আমি জানতুম এ-খবর উনি সইতে পারবেন না। দিবাকর চকিত হইয়া সতীশের মুখের প্রতি চাহিল, সতীশ বিস্ময়াপন্ন হইয়া বলিল, এতদিন এত কাছে থেকেও কি তুই এ কথা টের পাসনি দিবা? আবার ভয় হয়, বুঝি বা বৌঠানকে আমি মেরে ফেলতেই নিয়ে যাচ্চি। কিন্তু তবুও নিয়ে যেতেই হবে। এ জগতে দুটি লোক কিছুতেই সে শোক সইতে পারবে না, কিন্তু একটি ত স্বর্গে গেছেন, আর একটি—কিন্তু যা, জল নিয়ে আয় দিবাকর, আমি বাতাস করি—ও কি রে, কথা কস্‌নে কেন? অকস্মাৎ দিবাকরের আপাদমস্তক বারংবার কাঁপিয়া উঠিল, পরক্ষণেই সে অচেতন কিরণময়ীর দুই পদতলের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া বলিতে লাগিল, আমি সমস্ত বুঝেচি বৌদি, তুমি আমার পূজনীয়া গুরুজন তবে, কেন এতকাল গোপন করে আমাকে নরকে ডোবালে! আমি এ মহাপাপ থেকে কি করে উদ্ধার পাবো বৌদি! চুয়াল্লিশ উপেন্দ্র বলিয়াছিলেন, সাবিত্রী, হাড়-ক’খানা আমার গঙ্গায় দিস দিদি—অনেক জ্বালায় জ্বলেচি, তবু একটু ঠাণ্ডা হব। সাবিত্রীকে তিনি আজকাল কখনো ‘তুমি’ কখনো ‘তুই’ যা মুখে আসিত, তাই বলিয়াই ডাকিতেন। সাবিত্রী তাঁহার সেই শেষ ইচ্ছা এবং শেষ চিকিৎসার জন্য কিছুদিন হইল কলিকাতার জোড়াসাঁকোয় একটা বাড়ি ভাড়া লইয়া সিয়াছিল। আজ সন্ধ্যার পর এক পসলা ঝড়বৃষ্টি হইয়া গেলেও আকাশে মেঘ কাটে নাই। উপেন্দ্র অনেকক্ষণ পরে ক্লান্ত চোখ-দুটি মেলিয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, সুমুখের জানালাটা একটু খুলে দে দিদি, সেই বড় নক্ষত্রটি একবার দেখি। সাবিত্রী তাঁহার কপালের রুক্ষ চুলগুলি ধীরে ধীরে সরাইয়া দিতে দিতে মৃদুকণ্ঠে কহিল, গায়ে জোলো-হাওয়া লাগবে যে দাদা! লাগুক না বোন! আর আমার তাতে ভয় কি? ভয় তাঁহার শুধু আজ কেন, যেদিন হইতে সুরবালা গিয়াছে সেদিন হইতেই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া সাবিত্রীর ত ভয় ঘুচে নাই। তাহার বুঝি যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ; তাই মৃত্যু যখন শিয়রের পাশে তাহার সঙ্গে সমান আসন দখল করিয়া বসিয়া গেছে, তখনও সে তুচ্ছ জোলো-হাওয়াটাকে পর্যন্ত ঘরে ঢুকিতে দিতে সাহস পায় না। অনিচ্ছুককণ্ঠে কহিল, কিন্তু নক্ষত্র ত দেখা যায় না দাদা, আকাশে যে মেঘ করে আছে। উপেন্দ্র ম্লান চক্ষু-দুটি উৎসাহে বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, মেঘ? আহা, অসময়ে মেঘ দিদি, খুলে দে, খুলে দে—একবার দেখে নিই, আর ত দেখতে পাব না। বাহিরে আর্দ্র বায়ু জোরে বহিতেছিল; সাবিত্রী কপালে বুকে হাত দিয়া দেখিল জ্বর বাড়িতেছে; মিনতি করিয়া বলিল, ভাল হও, মেঘ কত দেখবে দাদা,—বাইরে ঝড় বইচে, আজ আমি জানালা খুলতে পারব না। তাহার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া উপেন্দ্র রাগ করিয়া বলিলেন, ভাল চাস তো খুলে দে সাবিত্রী, নইলে বর্ষার দিনে যখন মেঘ উঠবে, তখন কেঁদে কেঁদে মরবি তা বলে দিয়ে যাচ্চি। আমি আর দেখবার সময় পাব না। সাবিত্রী আর প্রতিবাদ না করিয়া একফোঁটা চোখের জল মুছিয়া উঠিয়া গিয়া জানালা খুলিয়া দিল। সেই খোলা জানালার বাহিরে উপেন্দ্র নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। আকাশের কোন্‌ এক অদৃশ্য প্রান্ত হইতে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইতেছিল, তাহারি আলোকচ্ছটায় সম্মুখের গাঢ় মেঘ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে, চাহিয়া চাহিয়া উপেন্দ্রর কিছুতেই যেন আর সাধ মিটে না এমনি মনে হইতে লাগিল। সাবিত্রী নিজেও একটা গরাদে ধরিয়া সেইদিকে চাহিয়াই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, উপেন্দ্রর দৃষ্টি হঠাৎ তাহার উপরে পড়িতে মনে মনে একটু হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা দে দে, জানালা বন্ধ করে দিয়ে কাছে এসে বস। কিন্তু এত মায়া ত ভাল নয় দিদি। একটুখানি গায়ে হাওয়া লাগতে দিতে চাও না, কিন্তু আমি চলে গেলে কি করবে বল ত! সাবিত্রী জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া কাছে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি ত আমাকে কাজ দিয়ে যাবে বলেছ। আমি তাই সারাজীবন ধরে করব। তুমি আমার চোখের ওপরেই দিনরাত থাকবে! পারবে করতে? সাবিত্রী আস্তে আস্তে বলিল, কেন পারব না দাদা? তোমার কথায় উনি ত কখনো না বলবেন না। উপেন্দ্র হাসিমুখে কহিল, উনি কে? সতীশ ত? সাবিত্রী ঘাড় হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিল। উপেন্দ্র তাহার সলজ্জ মৌন মুখের পানে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিলেন। বলিলেন, সাবিত্রী, সতীশ যে আমার কি, সে পরের পক্ষে বোঝা শক্ত। বাইরে থেকে যেটা দেখা যায়, তাতে সে আমার সঙ্গী, আমার আজন্ম সুহৃৎ। কিন্তু যে সম্বন্ধটা দেখা যায় না, সেখানে সতীশ আমার ছোটভাই, আমার শিষ্য, আমার চিরদিনের অনুগত সেবক। সেই রাত্রে তুই যদি দিদি, আত্মপ্রকাশ করে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতিস, আমার শেষজীবনটা হয়ত এত দুঃখে কাটত না। দিবাকরও হয়ত আমাকে এত ব্যথা দেবার সুযোগ পেত না। সাবিত্রী সজল-চক্ষে কহিল, আমি ফেরাতে তোমাদের চেয়েছিলুম দাদা, কিন্তু উনি কিছুতেই যেতে দিলেন না, দুই চৌকাঠে হাত দিয়ে আমার পথ আটকে রাখলেন। বললেন, আমি তোমাদের সামনে গেলে তোমাদের অপমান করা হবে। তাঁরই ইচ্ছে, বলিয়া উপেন্দ্র উপর দিকে চাহিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া নীরব হইলেন। বাড়িতে উপেন্দ্রর পিতা শিবপ্রসাদ বাতে
false
humayun_ahmed
না, তুমি চম্পা! পারুল সেজে দ্বিতীয়বার আমার কাছে এসেছ। গলা চেপে কথা বলছি। মাঝে মাঝে চেপে কথা বলার ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছ বলে মূল স্বর চলে আসছে। চম্পা! তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ। কেন করছ জানি না। জানতে চাচ্ছি না। তুমি এখন বিদায় হও। তোমার আর কোনো গল্প শুনতে আমি রাজি না। আমার ধারণা, তোমরা দুই বোনই অসুস্থ। স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তোমাদের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য না। চাচাজি, পারুল আপা কখনো কোথাও যায় না। কারও সঙ্গে কথাও বলে না। এই জন্যে বাধ্য হয়ে পারুল সেজে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাদের একটু সাহায্য করুন। মিসির আলি বললেন, আমার সাহায্যের তোমার প্রয়োজন নেই। আমাকে যা বলেছ পুলিশকে তা-ই বলবে। পুলিশ তদন্ত করে বের করবে। ঘটনা কী? চাচাজি! আমি এখন আপনাকে একটা জরুরি কথা বলব। মিসির আলি বললেন, আমি তোমার কোনো কথাই শুনব না। তাহলে কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা হবে। বলো কী সমস্যা? আপনি ভাড়াটে হিসেবে এখানে আর থাকতে পারবেন না। এখন সবকিছু চালাচ্ছে আমার বড়বোন পারুল। মিসির আলি বললেন, সমস্যা নেই, আমি বাড়ি ছেড়ে দিব। আজকেই ছাড়তে হবে। মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, পুরো মাসের ভাড়া আমার দেওয়া, তারপরেও আজ রাতেই বাড়ি ছেড়ে দেব। মিসির আলির মনে হলো তিনি অতি বৃদ্ধ মানুষের মতো আচরণ করছেন। অতি বৃদ্ধরা অকারণে অভিমান করে। তিনিও তা-ই করছেন। চম্পা মেয়েটির ওপর অভিমান ঘটিত রাগ করেছেন। চট করে কারও ওপর রেগে যাওয়া তার স্বভাবেই ছিল না। এ রকম কেন হচ্ছে? আজকের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হলে নতুন বাসা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা শহরে বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মিসির আলি অনেক খুঁজে পেতে মালিবাগের এক হোটেলে এসে উঠলেন। হোটেলের নাম ‘মুন হাউস’। হোটেলের মালিক কবীর সাহেবকে মিসির আলির কাছে যথেষ্টই ভদ্রলোক বলে মনে হলো। তিনি মিসির আলির বিছানা, বালিশ, সিঙ্গেল খাট, চেয়ার-টেবিল গুদামঘরে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মিসির আলির বারো ইঞ্চি কালার টিভি তার ঘরেই লাগানোর ব্যবস্থা করলেন। মুন হাউসে খাবারের ব্যবস্থা নেই। হোটেলের বয় টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। কবীর সাহেব মিসির আলিকে এই ঝামেলা থেকেও মুক্তি দিলেন। হোটেলের কর্মচারীদের জন্যে যে খাবার তৈরি হয়, তার সঙ্গে মিসির আলি এবং জসুও যুক্ত হয়ে গেল। হোটেলে মিসির আলির রুম নম্বর ২১১ বি। ২১১-র দুটা ঘর আছে। একটা ২১১ এ, আরেকটা ২১১ বি। এ-বি দিয়ে রুম নম্বর দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি বুঝতে পারলেন না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমাদের এই জগৎ কার্যকারণের জগৎ। কাৰ্যকারণ ছাড়া এখানে কিছুই হয় না। প্রথমে , তারপর । মিসির আলির ঘরটা বেশ বড়। ঘরে দুটা জানোলা। একটা পশ্চিমে আরেকটা পুবে। পশ্চিমের জানোলা খুললে প্ৰকাণ্ড এক কাঁঠালগাছ দেখা যায়। কাঁঠালগাছে কাক বাসা বেঁধেছে। জানালা দিয়ে তাকালে কাকের বাসায় চারটা ডিম দেখা যায়। কোকিলরা সন্তান বড় করার ঝামেলা এড়ানোর জন্যে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। এখানে কি কোনো কোকিলের ডিম আছে? মিসির আলি ঠিক করলেন, ডিম থেকে ছানা বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই হোটেলেই থাকবেন। নতুন বাসা খুঁজে বেড়াবেন না। রাত ন’টার দিকে হোটেলের মালিক নিজেই টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এলেন। গরম ভাত মুগের ডাল পটল ভাজি কৈ মাছের ঝোল। কবীর সাহেব বললেন, আয়োজন খারাপ, কিন্তু খেয়ে আনন্দ পাবেন। বাবুর্চির রান্না খুবই ভালো। সে যদি কাঁঠাল পাতার ঝোল রাধে, সেই ঝোল খেয়েও বলবেন, অসাধারণ! এই বাবুর্চি আবার ভালো পা দাবাতে পারে। আপনার যে বয়স তাতে পা দাবালে শরীর ভালো থাকবে। তাকে বলে দেব সে প্রতি রাতে এসে কিছুক্ষণ আপনার পা দাবাবে। মিসির আলি বললেন, আমার পা দাবাতে হবে না। শারীরিক এই আরাম আমি নেব না। আপনি আমার প্রতি যে বাড়তি মমতা দেখাচ্ছেন, তার কারণটা কী বলবেন? কবীর সাহেব বললেন, বাড়তি মমতা দেখাচ্ছি না। হোটেলের সব বোর্ডারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই খাবারের ব্যবস্থা করেন না, বা নিজে তার জন্যে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার আনেন না। কবীর সাহেব বললেন, আপনার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটা সবই আমার বাবার মতো। আমি আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আপনার বাবা কবে মারা গেছেন? আমার বয়স যখন পাঁচ তখন। মিসির আলি বললেন, পাঁচ বছর বয়সের কথা পরে মনে থাকে না। আপনার বাবার বিষয়ের খুব কম স্মৃতিই আপনার আছে। এই কারণেই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পাবেন। আমার আগেও নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পেয়েছেন। তাই না? জি। মিসির আলি রাতের খাবার খেয়ে সত্যি সত্যি আনন্দ পেলেন। পটল ভজিকে তিনি এত দিন। অখাদ্যের পর্যায়ে রেখেছিলেন। আজ মনে হলো এই ভাজি খাদ্যতালিকায় রোজ থাকতে পারে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর কবীর সাহেব বললেন, পান খাওয়ার অভ্যাস কি আছে? মিসির আলি বললেন, নাই। তবে আজ একটা পান খাব। তৃপ্তি করে খাবার খেলে কেন জানি না জর্দা দিয়ে পান খেতে ইচ্ছা করে। পান ছাড়া আর কিছু কি লাগবে? একটা বাইনোকুলার কি জোগাড় করে দিতে পারবেন? বাইনোকুলার দিয়ে কী করবেন? কাঁঠালগাছে একটা কাক বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার দৃশ্যটা দেখব। কবীর সাহেব বললেন, পান এনে দিচ্ছি। সকালবেলা বাইনোকুলার এনে দেব। চলবে না? অবশ্যই চলবে। থ্যাংক
false
shunil_gongopaddhay
নিজেকে প্রকাশ করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। একটু কিন্তু কিন্তু করে সে বলেই ফেলল আমি আবার বিয়ে করছি। তাই নাকি? খুশি হলাম। মানে, আজই বিয়ের নোটিশ দিয়ে এলাম…হঠাৎ ঠিক হল…আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল… দীপংকর আবার মুখ নীচু করে টাইপ রাইটারে চিঠিটা শেষ করতে লাগল। সরলার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই নেই। আসলে সে তার অভিমান গোপন করার চেষ্টা করছে। সরলা আবার বিয়ে করছে, কবে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল? দীপংকরকে একবার জানালো না। দীপংকর কি তার শত্রু? কাকে বিয়ে করছে, আবার কোনো একটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানকে? এ বিয়েই বা আবার কতদিন টিকবে কে জানে? ওদের কি কোনো নীতিবোধ আছে? অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে টাইপ করবার জন্যই হয়তো দীপংকরের ঘাড়ের কাছে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। দু-তিনদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এবার সে কিছুদিন ছুটি নেবে। চুলোয় যাক অফিস। সে একা আর কত কাজ করবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি বোধ করছে সরলা। সে টের পাচ্ছে দীপংকরের রাগ। কিন্তু আজকের দিনটাতে উনি রাগ না করলেই পারতেন! সে আস্তে আস্তে বলল, আমি ভেবেছিলাম, আপনার বন্ধুর কাছ থেকেই আপনি সব জানতে পারবেন। কী? দিলীপবাবু নিজেই আপনাকে সব খুলে বলবেন! কিন্তু দিলীপের তো বউ আছে। ওদের মধ্যে অনেকদিন বনিবনা নেই! দীপংকর বিশ্বাসই করতে পারছে না কথাটা। এ কখনো হতে পারে? দিলীপের স্ত্রী। সুতপাকে সে চেনে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে, দেখতেও ভালো—ওদের তো বেশ সুখী মনে হয়েছিল। কী করে বিয়ে হবে? ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গেছে? আমারই মতন। এখন সেপারেশন চলছে, আগামী মাসেই— দিলীপের তো দু-টি ছেলে-মেয়ে আছে। তা থাক-না। তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই। মিসেস বিশ্বাস, একজনের সংসার ভেঙে, আর একটা সংসার গড়লে, সে-সংসার নিয়ে কি সুখী হওয়া যায়? সুতপার সঙ্গে দিলীপের সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে—আমাদের মতন পরিবারে ওরকম হয়ই, কিন্তু সেটা শোধরাবার চেষ্টা করাই কি উচিত নয়? হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় একটা কিছু করে ফেলাই কি ঠিক? এ-দিকটা একবারও ভাববেন না? বিশেষ করে ওদের ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা দীপংকরের কথাগুলো গুরুগম্ভীর উপদেশের মতো শোনালো। সরলা চট করে উত্তর দিল, একটু সময় নিল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, মিস্টার ব্যানার্জি আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে সব জায়গায় এক নিয়ম খাটে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি জানি, এক বাড়িতে, এক সংসারে, একই ঘরে থেকে নিত্য তিরিশ দিন ঝগড়া করার চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। তাতে ছেলে-মেয়েদেরও ক্ষতি হয় না। উপকারই হয়। বাপ-মাকে রোজ রোজ ঝগড়া করতে দেখলে কী ছেলে-মেয়েদের খুব একটা ভালো লাগে বলতে চান? অনেক সময় সেটা তাদের জীবনের ওপর ছাপ ফেলে দেয়। আমরা অনেক ভেবেচিন্তেই এটা ঠিক করেছি। দিলীপবাবু ভীষণ অসুখী ছিলেন… সরলাকে একসঙ্গে এতকথা বলতে কোনোদিন শোনেনি দীপংকর। সে বুঝতেই পারল, তার যতই আপত্তি থাক, ওরা বিয়ে করবেই। একসঙ্গে তার মনের ওপর দিয়ে অনেক কথা খেলে গেল। দিলীপ তাহলে সত্যি বিয়ে করছে! দীপংকরের ধারণা ছিল, দিলীপ শুধু বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সুখের খেলা খেলে বেড়ায়, কারুর দায়িত্ব নিতে চায় না। …একবার বিয়ে ভেঙে আবার বিয়ে করা—এতবড়ো একটা ঝামেলার কাজ দীপংকর নিজে কখনোই পারত না। …বিয়ের পর সরলা আর চাকরি করবে না। সরলা ছাড়া এই ঘরটা…। তার ওপর যত কাজ দিয়ে নির্ভর করা যায়, সেরকম কি আর কারুকে..। কিংবা চাকরি করতেও পারে। মেয়েরা একবার চাকরিতে ঢুকলে সহজে ছাড়তে চায় না। আসবে সরলা এই ঘরে… কিন্তু তখন সে দিলীপের স্ত্রী। এ-ঘরে দরজা বন্ধ…সে কি তখনও সরলাকে যখন-তখন কাজের জন্য অনুরোধ করতে পারবে? দীপংকর জোরে বলে উঠল না, এ হতেই পারে না। বলে সে নিজেই চমকে উঠল। এ কী বলছে সে? এরকমভাবে কখনো বলা যায়? এটা তো দিলীপ আর সরলার নিজস্ব ব্যাপার। ওরা তো ছেলেমানুষ নয়! রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সে বলল, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেসুঝেই করেছেন, আমার এতসব কথা বলা উচিত নয়। তবু দীপংকর নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার রাগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, সরলা বিয়ে করে চলে যাবে এই ঘর থেকে—এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এখন সে বুঝতে পারছে, সরলা একটুক্ষণ ঘরের বাইরে থাকলে কেন সে ছটফট করত। তার ইচ্ছে হল, সে সরলার হাত জড়িয়ে মিনতি করে বলে, সরলা, তুমি দিলীপকে বিয়ে কোরো না! তুমি আর যাকে খুশি বিয়ে করো, এই অফিসের কারুকে নয়। তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! কিন্তু একথা দীপংকর বলতে পারে না। সরলা তার কে? সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। একজনের বদলে আর একজন আসবে। সে তো সরলাকে এতদিনের মধ্যে একবারও অন্তরঙ্গ সুরে কোনো কথা বলেনি। অভিমানে দীপংকর মুখ গোঁজ করে রইল। আপনি উঠুন না, আমি চটপট শেষ করে দিচ্ছি। না, ঠিক আছে। আপনি উঠুন-না, আমি চটপট শেষ করে দিচ্ছি। শিশুর মতন জেদ ধরে দীপংকরও বলল, বলছি তো, দরকার নেই! আসলে দীপংকর বলতে চাইল, এরপর থেকে আমাকেই সব করতে হবে। আমি আর কোনো স্টেনোগ্রাফারকে আমার ঘরে বসাব না। সরলা একদম কাছে এসে খুব নরম গলায় বলল, মি. ব্যানার্জি আপনি রাগ করবেন না। আমি চিঠিগুলো এক্ষুনি— সরলার খোলা চুল, পুরো হাত ব্লাউজ, তার শরীরের মৃদু গন্ধদীপংকরের এত কাছে! সরলার যে একটা আলাদা ধরনের রূপ আছে, তা যেন দীপংকর আগে কখনো লক্ষ করেনি। এই মেয়েকে তার কাছ থেকে অন্য একজন কেড়ে নিয়ে
false
robindronath
তখন লড়াই করবার জোর পাওয়া যায়, তখন স্বয়ং দেবতাই হন সহায়। হঠাৎ সেই বাইরের বিরুদ্ধতা একেবারে নিরস্ত হলে যুদ্ধ থামে কিন্তু সন্ধি হতে চায় না। তখন বেরিয়ে পড়ে নিজের ভিতরের প্রতিকূলতা। কুমু হঠাৎ দেখতে পেলে মধুসূদন যখন উদ্ধত ছিল তখন তার সঙ্গে ব্যবহার অপ্রিয় হোক তবুও তা সহজ ছিল; কিন্তু মধুসূদন যখন নম্র হয়েছে তখন তার সঙ্গে ব্যবহার কুমুর পক্ষে বড়ো শক্ত হয়ে উঠল। এখন তার ক্ষুব্ধ অভিমানের আড়াল থাকে না, তার সেই ফরাশখানার আশ্রয় চলে যায়, এখন দেবতার কাছে হাত জোড় করবার কোনো মানে নেই। মোতির মাকে কোনো ছুতোয় কুমু যদি রাখতে পারত তা হলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু নবীন গেল চলে, হতবুদ্ধি মোতির মাও আস্তে আস্তে চলল তার পিছনে। দরজার কাছে এসে একবার মুখ আড় করে উদ্‌বিগ্নভাবে কুমুদিনীর মুখের দিকে চেয়ে গেল। স্বামীর প্রসন্নতার হাত থেকে এই মেয়েটিকে এখন কে বাঁচাবে? মধুসূদন বললে, “বড়োবউ, কাপড় ছেড়ে শুতে আসবে না?” কুমু ধীরে ধীরে উঠে পাশের নাবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে– মুক্তির মেয়াদ যতটুকু পারে বাড়িয়ে নিতে চায়। সে ঘরে দেওয়ালের কাছে একটা চৌকি ছিল সেইটেতে বসে রইল। তার ব্যাকুল দেহটা যেন নিজের মধ্যে নিজের অন্তরাল খুঁজছে। মধুসূদন মাঝে মাঝে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায় আর হিসেব করতে থাকে কাপড় ছাড়বার জন্যে কতটা সময় দরকার। ইতিমধ্যে আয়নাতে নিজের মুখটা দেখলে, মাথার তেলোর যে জায়গাটাতে কড়া চুলগুলো বেমানান রকম খাড়া হয়ে থাকে বৃথা তার উপরে কয়েকবার বুরুশের চাপ লাগালে আর গায়ের কাপড়ে অনেকখানি দিলে ল্যাভেন্ডার ঢেলে। পনেরো মিনিট গেল; বেশ-বদলের পক্ষে সে সময়টা যথেষ্ট। মধুসূদন চুপি চুপি একবার নাবার ঘরের কাছে কান দিয়ে দাঁড়ালে, ভিতরে নড়াচড়ার কোনো শব্দ নেই– মনে ভাবলে কুমু হয়তো চুলটার বাহার করছে, খোঁপাটা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েরা সাজ করতে ভালোবাসে মধুসূদনেরও এ আন্দাজটা ছিল, অতএব সবুর করতেই হবে। আধঘণ্টা হল– মধুসূদন আর-একবার দরজার উপর কান লাগালে, এখনো কোনো শব্দ নেই। ফিরে এসে কেদারায় বসে পড়ে খাটের সামনের দেয়ালে বিলিতি যে ছবিটা ঝোলানো ছিল তার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ এক সময়ে ধড়্‌ফড়্‌ করে উঠে রুদ্ধ দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে, “বড়োবউ, এখনো হয় নি?” একটু পরেই আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। কুমুদিনী বেরিয়ে এল যেন সে স্বপ্নে-পাওয়া। যে কাপড় পরা ছিল তাই আছে; এ তো রাত্রে শোবার সাজ নয়। গায়ে একখানা প্রায় পুরো হাতা-ওয়ালা ব্রাউন রঙের সার্জের জামা, একটা লালপেড়ে বাদামি রঙের আলোয়ানের আঁচল মাথার উপর টেনে-দেওয়া। দরজার একটা পাল্লায় বাঁ হাত রেখে যেন কী দ্বিধার ভাবে দাঁড়িয়ে রইল– একখানি অপরূপ ছবি! নিটোল গৌরবর্ণ হাতে মকরমুখো প্লেন সোনার বালা– সেকেলে ছাঁদের– বোধ হয় এককালে তার মায়ের ছিল। এই মোটা ভারী বালা তার সুকুমার হাতকে যে-ঐশ্বর্যের মর্যাদা দিয়েছে সেটি ওর পক্ষে এত সহজ যে, ঐ অলংকারটা ওর শরীরে একটুমাত্র আড়ম্বরের সুর দেয় নি। মধুসূদন ওকে আবার যেন নতুন করে দেখলে। ওর মহিমায় আবার সে বিস্মিত হল। মধুসূদনের চিরার্জিত সমস্ত সম্পদ এতদিন পরে শ্রীলাভ করেছে এ কথা না মনে করে সে থাকতে পারলে না। সংসারে যে-সব লোকের সঙ্গে মধুসূদনের সর্বদা দেখাসাক্ষাৎ তাদের অধিকাংশের চেয়ে নিজেকে ধনগৌরবে অনেক বড়ো মনে করা তার অভ্যাস। আজ গ্যাসের আলোতে শোবার ঘরের দরজার পাশে ঐ-যে মেয়েটি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে মধুসূদনের মনে হল, আমার যথেষ্ট ধন নেই– মনে হল, যদি রাজচক্রবর্তী সম্রাট হতুম তা হলেই ওকে এ ঘরে মানাত। যেন প্রত্যক্ষ দেখতে পেলে এর স্বভাবটি জন্মাবধি লালিত একটি বিশুদ্ধ বংশমর্যাদার মধ্যে– অর্থাৎ এ যেন এর জন্মের পূর্ববর্তী বহু দীর্ঘকালকে অধিকার করে দাঁড়িয়ে। সেখানে বাইরে থেকে যে-সে প্রবেশ করতেই পারে না– সেখানেই আপন স্বাভাবিক স্বত্ব নিয়ে বিরাজ করছে বিপ্রদাস– তাকেও ঐ কুমুর মতোই একটি আত্মবিস্মৃত সহজ গৌরব সর্বদা ঘিরে রয়েছে। মধুসূদন এই কথাটাই কিছুতে সহ্য করতে পারে না। বিপ্রদাসের মধ্যে ঔদ্ধত্য একটুও নেই, আছে একটা দূরত্ব। অতিবড়ো আত্মীয়ও যে হঠাৎ এসে তার পিঠ চাপড়িয়ে বলতে পারে “কী হে, কেমন? ” এ যেন অসম্ভব। বিপ্রদাসের কাছে মধুসূদন মনে মনে কী রকম খাটো হয়ে থাকে সেইটেতে তার রাগ ধরে। সেই একই সূক্ষ্ম কারণে কুমুর উপরে মধুসূদন জোর করতে পারছে না– আপন সংসারে যেখানে সব চেয়ে তার কর্তৃত্ব করবার অধিকার সেইখানেই সে যেন সব চেয়ে হটে গিয়েছে। কিন্তু এখানে তার রাগ হয় না– কুমুর প্রতি আকর্ষণ দুর্নিবার বেগে প্রবল হয়ে ওঠে। আজ কুমুকে দেখে মধুসূদন স্পষ্টই বুঝলে কুমু তৈরি হয়ে আসে নি– একটা অদৃশ্য আড়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কী সুন্দর! কী একটা দীপ্যমান শুচিতা, শুভ্রতা! যেন নির্জন তুষারশিখরের উপর নির্মল উষা দেখা দিয়েছে। মধুসূদন একটু কাছে এগিয়ে এসে ধীর স্বরে বললে, “শুতে আসবে না বড়োবউ?” কুমু আশ্চর্য হয়ে গেল। সে নিশ্চয় মনে করেছিল মধুসূদন রাগ করবে, তাকে অপমানের কথা বলবে। হঠাৎ একটা চিরপরিচিত সুর তার মনে পড়ে গেল– তার বাবা স্নিগ্ধ গলায় কেমন করে তার মাকে বড়োবউ বলে ডাকতেন। সেইসঙ্গেই মনে পড়ল– মা তার বাবাকে কাছে আসতে বাধা দিয়ে কেমন করে চলে গিয়েছিলেন। এক মুহূর্তে তার চোখ ছল্‌ছলিয়ে এল– মাটিতে মধুসূদনের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে উঠল, “আমাকে মাপ করো।” মধুসূদন তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে তুলে চৌকির উপরে বসিয়ে
false
robindronath
রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়! ” এই কথাটা শুনিয়া আমার শ্বশুর একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। হৈম বুঝিল তাহার বাবার প্রস্তাব অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে। তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল। আমি আর সহিতে পরিলাম না। বাবার কাছে গিয়া বলিলাম, “ হৈমকে আমি লইয়া যাইব। ” বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, “ বটে রে — ” ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন। স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন! যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন। আর , আমিই তো সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের গুণবর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতাবিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে , সে কথা কে জানিত। পিতায় কন্যায় আর-একবার বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হইল। এইবারেও দুইজনেরই মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, “ বাবা, আর যদি কখনো তুমি আমাকে দেখিবার জন্য এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে আমি ঘরে কপাট দিব। ” বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, “ ফের যদি আসি তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব। ” ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই। তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না। শুনিতেছি, মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন । হয়তো একদিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না , ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ — থাক্‌, আর কাজ কী! ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাথরের ঘাট গোমতী নদীতে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য একদিন গ্রীষ্মকালের প্রভাতে স্নান করিতে আসিয়াছেন, সঙ্গে তাঁহার ভাই নক্ষত্ররায়ও আসিয়াছেন। এমন সময়ে একটি ছোটো মেয়ে তাহার ছোটো ভাইকে সঙ্গে করিয়া সেই ঘাটে আসিল। রাজার কাপড় টানিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?” রাজা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “মা, আমি তোমার সন্তান।” মেয়েটি বলিল, “আমাকে পূজার ফুল পাড়িয়া দাও-না।” রাজা বলিলেন, “আচ্ছা চলো।” অনুচরগণ অস্থির হইয়া উঠিল। তাহারা কহিল, “মহারাজ, আপনি কেন যাইবেন, আমরা পাড়িয়া দিতেছি।” রাজা বলিলেন, “না, আমাকে যখন বলিয়াছে আমিই পাড়িয়া দিব।” রাজা সেই মেয়েটির মুখের দিকের চাহিয়া দেখিলেন। সেদিনকার বিমল উষার সঙ্গে তাহার মুখের সাদৃশ্য ছিল। রাজার হাত ধরিয়া যখন সে মন্দিরসংলগ্ন ফুলবাগানে বেড়াইতেছিল, তখন চারি দিকের শুভ্র বেলফুলগুলির মতো তাহার ফুট্‌ফুটে মুখখানি হইতে যেন একটি বিমল সৌরভের ভাব উত্থিত হইয়া প্রভাতের কাননে ব্যাপ্ত হইতেছিল। ছোটো ভাইটি দিদির কাপড় ধরিয়া দিদির সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতেছিল। সে কেবল একমাত্র দিদিকেই জানে, রাজার সঙ্গে তাহার বড়ো-একটা ভাব হইল না। রাজা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী মা?” মেয়ে বলিল, “হাসি।” রাজা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন,”তোমার নাম কী?” ছেলেটি বড়ো বড়ো চোখ মেলিয়া দিদির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কিছু উত্তর করিল না। হাসি তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিল,”বল্‌-না ভাই, আমার নাম তাতা।” ছেলেটি তাহার অতি ছোটো দুইখানি ঠোঁট একটুখানি খুলিয়া গম্ভীরভাবে দিদির কথার প্রতিধ্বনির মতো বলিল,”আমার নাম তাতা।” বলিয়া দিদির কাপড় আরও শক্ত করিয়া ধরিল। হাসি রাজাকে বুঝাইয়া বলিল, “ও কিনা ছেলেমানুষ, তাই ওকে সকলে তাতা বলে।” ছোটো ভাইটির দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “আচ্ছা, বল্‌ দেখি মন্দির।” ছেলেটি দিদির মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “লদন্দ।” হাসি হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “তাতা মন্দির বলিতে পারে না, বলে লদন্দ।–আচ্ছা, বল্‌ দেখি কড়াই।” ছেলেটি গম্ভীর হইয়া বলিল, “বলাই।” হাসি আবার হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “তাতা আমাদের কড়াই বলিতে পারে না, বলে বলাই।” বলিয়া তাতাকে ধরিয়া চুমো খাইয়া খাইয়া অস্থির করিয়া দিল। তাতা সহসা দিদির এত হাসি ও এত আদরের কোনোই কারণ খুঁজিয়া পাইল না, সে কেবল মস্ত চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিল। বাস্তবিকই মন্দির এবং কড়াই শব্দ উচ্চারণ সম্বন্ধে তাতার সম্পূর্ণ ত্রুটি ছিল, ইহা অস্বীকার করা যায় না; তাতার বয়সে হাসি মন্দিরকে কখনোই লদন্দ বলিত না, সে মন্দিরকে বলিত পালু, আর সে কড়াইকে বলাই বলিত কিনা জানি না কিন্তু কড়িকে বলিত ঘয়ি, সুতরাং তাতার এরূপ বিচিত্র উচ্চারণ শুনিয়া তাহার যে অত্যন্ত হাসি পাইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী। তাতা সম্বন্ধে নানা ঘটনা সে রাজাকে বলিতে লাগিল। একবার একজন বুড়োমানুষ কম্বল জড়াইয়া আসিয়াছিল, তাতা তাহাকে ভাল্লুক বলিয়াছিল, এমনি তাতার মন্দবুদ্ধি। আর একবার তাতা গাছের আতাফলগুলিকে পাখি মনে করিয়া মোটা মোটা ছোটো দুটি হাতে তালি দিয়া তাহাদিগকে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তাতা যে হাসির চেয়ে অনেক ছেলেমানুষ, ইহা তাতার দিদি বিস্তর উদাহরণ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণ করিয়া দিল। তাতা নিজের বুদ্ধির পরিচয়ের কথা সম্পূর্ণ অবিচলিতচিত্তে শুনিতেছিল, যতটুকু বঝিতে পারিল তাহাতে ক্ষোভের কারণ কিছুই দেখিতে পাইল না। এইরূপে সেদিনকার সকালে ফুল তোলা শেষ হইল। ছোটো মেয়েটির আঁচল ভরিয়া যখন ফুল দিলেন তখন রাজার মনে হইল, যেন তাঁহার পূজা শেষ হইল; এই দুইটি সরল প্রাণের স্নেহের দৃশ্য দেখিয়া, এই পবিত্র হৃদয়ের আশ মিটাইয়া ফুল তুলিয়া দিয়া, তাঁহার যেন দেবপূজার কাজ হইল। তাহার পরদিন হইতে ঘুম ভাঙিলে সূর্য উঠিলেও রাজার
false
shorotchandra
পরলোকে তাঁহাকেই সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে একেবারে পথের ধূলায় টানিয়া আনা হইবে। এবং এইখানেই ইহার শেষ নয়। স্বামিস্পর্শ ভৈরবীর একান্ত নিষিদ্ধ। কত যুগ হইতে এই নিষ্ঠুর অনুশাসন ইহাদিগকে অঙ্গীকার করিয়া আসিতে হইয়াছে। সুতরাং ভাল-মন্দ যাই হোক, জীবনানন্দের শয্যাপ্রান্তে বসিয়া একটা রাত্রির জন্যও তাহাকে যে-হাত দিয়া তাঁহার সেবা করিতে হইয়াছে, সেই হাত দিয়া আর যে দেবীর সেবা করা চলিবে না তাহা নিশ্চিত, অথচ এইখানেই এই দেবীর প্রাঙ্গণতলেই তারাদাস যখন তাহাকে অজ্ঞাতকুলশীল একজনের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিল তখন সে কোন আপত্তিই করে নাই; এবং সমস্ত জানিয়াও যে সে নিঃসঙ্কোচে এতকাল ভৈরবীর কার্য করিয়া আসিয়াছে, ইহার জবাবদিহি আজ যদি সমস্ত ক্রুদ্ধ হিন্দুসমাজের কাছে করিতে হয়, ত সে যে কি হইবে সে তাহার চিন্তাতীত। আবার এ-সকল ত গেল কেবল একটা দিকের কথা, কিন্তু যে দিকটা একেবারেই তাহার আয়ত্তাতীত, তথায় কি যে হইবে সে তাহার কি জানে? যে জীবানন্দ একদিন তাহাদের বিবাহটাকে কেবল পরিহাস করিয়া গিয়াছিল, সে যদি আজ সমস্ত ইতিহাসটাকে নিছক গল্প বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, ত তাহাকে সত্য বলিয়া সপ্রমাণ করিতে সে নিজে ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জীবিত নাই। গৃহস্থালী-সম্বন্ধে রানীর মায়ের দুই-একটা কথার উত্তরে ষোড়শী কি যে জবাব দিল তাহার ঠিকানা নাই। মন্দিরের পুরোহিত কি একটা বিশেষ আদেশ গ্রহণ করিতে আসিয়া অন্যমনস্ক ভৈরবীর কাছে কি যে হুকুম পাইল তাহা ভাল বুঝিতেই পারিল না। নিত্যনিয়মিত পূজা-আহ্নিকে বসিয়া আজ ষোড়শী কোনমতেই মনস্থির করিতে পারিল না, অথচ যে জন্য তাহার সমস্ত চিত্ত উদ্‌ভ্রান্ত এবং চঞ্চল হইয়া রহিল, তাহার যথার্থ রূপটাও তাহাকে ধরা দিল না—কেবলমাত্র কতকগুলা অস্ফুট অনুচ্চারিত বাক্যই সমস্ত সকালটা একটা অর্থহীন প্রলাপে তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। রান্নার উদ্যোগ-আয়োজন পড়িয়া রহিল, সে রান্নাঘরে প্রবেশ করিল না – এ-সকল তাহার ভালই লাগিল না। এমনি করিয়া সমস্ত দিনটা যখন কোথা দিয়া কিভাবে কাটিয়া গেল, একপ্রকার ঘোলাটে মেঘলায় শীতের দিনের অপরাহ্ণ যখন অসময়েই গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল, তখন সে একাকী ঘরের মধ্যে আর থাকিতে না পারিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া আসিল, এবং ফকিরসাহেবকে স্মরণ করিয়া বারুইয়ের প্রপারে তাঁহারই আশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করিল। এমন অনেকদিন হইয়াছে সে একটুখানি ঘুরিয়া তাহার অনুগত বিপিন কিংবা দিগম্বরকে তাহাদের বাটীর সম্মুখ হইতে ডাক দিয়া সঙ্গে লইয়া গিয়াছে; কিন্তু আজ পাড়ার পথ দিয়া তাহাদিগকে ডাকিতে যাইতে তাহার সাহসও হইল না, প্রবৃত্তিও হইল না—একাকীই মাঠের পথ ধরিয়া নদীর অভিমুখে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া গেল। তাহার মনেও পড়িল না যে, ঘরগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল। এই পথটা বেশী নহে, বোধ করি অর্ধ ক্রোশের মধ্যেই, এবং নদীতেও এমন জল এসময়ে ছিল না যাহা স্বচ্ছন্দে হাঁটিয়া পার হওয়া না যায়, সুতরাং অভ্যাসবশত: এদিকে চিন্তিত হইবার কিছুই ছিল না। কেবল ফিরিয়া আসার কথাটাই একবার মনে হইল, অথচ ভিতরে ভিতরে বোধ হয় তাহার ভরসা ছিল যদি সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া অন্ধকার হইয়াই আসে ত ফকিরসাহেব কিছুতেই তাহাকে নিঃসঙ্গ ছাড়িয়া দিবেন না, কিছু একটা উপায় করিবেনই। মনের এই অবস্থাই তাহাকে জনহীন পথ ও ততোধিক নির্জন বালুময় নদীর উপকূলে আসন্ন সন্ধ্যা জানিয়াও দ্বিধামাত্র করিতে দিল না, বারুইয়ের প্রপারে সোজা সেই বিপুল বটবৃক্ষতলে সাধুর আশ্রমে আনিয়া উপনীত করিল এবং প্রথমেই যাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল, তিনি ফকিরসাহেব নহেন, রায়মহাশয়ের জামাতা ব্যারিস্টার-সাহেব। আজ তাঁহার পরিধানে কোট-প্যান্টের পরিবর্তে সাধারণ ভদ্রবাঙালীর ধুতি-চাদর প্রভৃতি ছিল। তিনিও ঠিক ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না; কি করিবেন সহসা ভাবিয়া না পাইয়া বোধ হয় কেবলমাত্র অভ্যাসবশতই উঠিয়া দাঁড়াইয়া কোনমতে একটা নমস্কার করিলেন। ভৈরবী চারিদিকে একবার চাহিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কোথায়? বসুসাহেব কহিলেন, আমারও জিজ্ঞাস্য তাই। হয়ত কাছাকাছি কোথাও গেছেন মনে করে আমিও প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে আছি। ভৈরবী মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, তিনি সন্ধ্যার সময় কোথাও থাকেন না, বোধ হয় এখুনি এসে পড়বেন। বসুসাহেব কহিলেন, এখানে থাকলে তাই তাঁর নিয়ম বটে, আমিও শুনে এসেচি। কিন্তু সন্ধ্যা ত হলো। আকাশের গতিকও তেমন ভাল নয়, বলিয়া তিনি সম্মুখে মাঠের প্রান্তে দৃষ্টিপাত করিলেন। ষোড়শীও তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সেইদিকে চাহিয়া নীরব হইল। পশ্চিম দিগন্তে তখন কালো কালো খণ্ড মেঘ ধীরে ধীরে জমা হইয়া উঠিতেছিল। এই নিস্তব্ধ জনহীন প্রান্তরে ছায়াচ্ছন্ন বৃক্ষতলের ঘনায়মান অন্ধকারে দাঁড়াইয়া উভয়ের কেহই কিছুক্ষণের জন্য কথা খুঁজিয়া পাইলেন না, অথচ এই বিসদৃশ অবস্থায় দুজনেই কেমন যেন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিলেন। এবং বোধ হয় এই মৌনতার সঙ্কট হইতে অব্যাহতি লাভের জন্যই যেন বসুসাহেব হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, কাল আমি চলে যাচ্চি, শীঘ্র আর আসা হবে কিনা জানিনে, কিন্তু ফকিরের সঙ্গে আর একবার দেখা না করে চলে যেতে হৈম আমাকে কিছুতেই দিলে না, তাই—কিন্তু তিনি ত কোথাও চলে যাননি? এই বলিয়া তিনি দু-এক পদ অগ্রসর হইয়া গেলেন, এবং অনতিদূরবর্তী কুটীরের সম্মুখে আসিয়া গলা বাড়াইয়া ক্ষণকাল ঘরের মধ্যে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, ভাল দেখা যায় না, কিন্তু কোথাও কিছু আছে বলেও মনে হয় না। মুসলমান ফকিরেরা ধুনি জ্বালে কিনা জানিনে, কিন্তু এই রকম কি একটা জল দিয়ে কে যেন নিবিয়ে দিয়ে গেছে বলে মনে হচ্চে। আপনি দেখুন দেখি, আমি আর ভিতরে যাবো না। তা হলে নিরর্থক অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। বলিয়া তিনি ষোড়শীর প্রতি চাহিয়া ফিরিয়া আসিলেন। কথাটা শুনিয়াই ষোড়শীর বুকের মধ্যে ধড়াস্‌ করিয়া উঠিল, এবং তাঁহার
false
robindronath
না ।” “আপনার এই উত্তেজনা ভালো হচ্ছে না ।” “তা হলে তোমরা যাও, আমাকে উত্তেজিত কোরো না।— মাসি, ডাক্তার গেছে ? আচ্ছা, তা হলে তুমি এই বিছানায় উঠে বোসো— আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে একটু শুই ।” “আচ্ছা, শোও, বাবা, লক্ষ্মীটি, একটু ঘুমোও ।” “না, মাসি, ঘুমোতে বোলো না— ঘুমোতে ঘুমোতে হয়তো আর ঘুম ভাঙবে না । এখনো আর-একটু আমার জেগে থাকবার দরকার আছে । তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ না ? ঐ যে আসছে । এখনই আসবে ।” ৫ “বাবা যতীন, একটু চেয়ে দেখো— ঐ যে এসেছে । একবারটি চাও ।” “কে এসেছে । স্বপ্ন ? ” “স্বপ্ন নয়, বাবা, মণি এসেছে— তোমার শ্বশুর এসেছেন ।” “তুমি কে ? ” “চিনতে পারছ না, বাবা, ঐ তো তোমার মণি ।” “মণি, সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে ।” “সব খুলেছে, বাপ আমার , সব খুলেছে ।” “না মাসি, আমার পায়ের উপর ও শাল নয়, ও শাল নয়, ও শাল মিথ্যে, ও শাল ফাঁকি।” “শাল নয়,যতীন । বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে— ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর্।— অমন করে কাঁদিস নে, বউ,কাঁদবার সময় আসছে— এখন একটুখানি চুপ কর্।” চিত্রগুপ্ত এমন অনেক পাপের হিসাব বড়ো অক্ষরে তাঁর খাতায় জমা করেন যা থাকে পাপীর নিজের অগোচরে। তেমনি এমন পাপও ঘটে যাকে আমিই চিনি পাপ ব’লে, আর কেউ না। যেটার কথা লিখতে বসেছি সেটা সেই জাতের। চিত্রগুপ্তের কাছে জবাবদিহি করবার পূর্বে আগে-ভাগে কবুল করলে অপরাধের মাত্রাটা হাল্কা হবে। ব্যাপারটা ঘটেছিল কাল শনিবার দিনে। সেদিন আমাদের পাড়ায় জৈনদের মহলে কী-একটা পরব ছিল। আমার স্ত্রী কলিকাকে নিয়ে মোটরে করে বেরিয়েছিলুম— চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল বন্ধু নয়নমোহনের বাড়িতে। স্ত্রীর কলিকা নামটি শ্বশুর-দত্ত, আমি ওর জন্য দায়ী নই। নামের উপযুক্ত তাঁর স্বভাব নয়, মতামত খুবই পরিস্ফুট। বড়োবাজারে বিলিতি কাপড়ের বিপক্ষে যখন পিকেট করতে বেরিয়েছিলেন, তখন দলের লোক ভক্তি ক’রে তাঁর নাম দিয়েছিল ধ্রুবব্রতা। আমার নাম গিরীন্দ্র দলের লোক আমাকে আমার পত্নীর পতি ব’লেই জানে, স্বনামের সার্থকতার প্রতি লক্ষ্য করে না। বিধাতার কৃপায় পৈতৃক উপার্জনের গুণে আমারও কিঞ্চিৎ সার্থকতা আছে। তার প্রতি দলের লোকের দৃষ্টি পড়ে চাঁদা আদায়ের সময়। স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর স্বভাবের অমিল থাকলেই মিল ভালো হয়, শুকনো মাটির সঙ্গে জলধারার মতো। আমার প্রকৃতি অত্যন্ত ঢিলে, কিছুই বেশি ক’রে চেপে ধরি নে। আমার স্ত্রীর প্রকৃতি অত্যন্ত আঁট, যা ধরেন তা কিছুতেই ছাড়েন না। আমাদের এই বৈষম্যের গুণেই সংসারে শান্তিরক্ষা হয়। কেবল একটা জায়গায় আমাদের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য ঘটেছে তার আর মিটমাট হতে পারল না। কলিকার বিশ্বাস, আমি স্বদেশকে ভালোবাসি নে। নিজের বিশ্বাসের উপর তাঁর বিশ্বাস অটল— তাই আমার আন্তরিক দেশ-ভালোবাসার যতই প্রমাণ দিয়েছি, তাঁদের নির্দিষ্ট বাহ্য লক্ষণের সঙ্গে মেলে না ব’লে কিছুতেই তাকে দেশ-ভালোবাসা ব’লে স্বীকার করাতে পারি নে। ছেলেবেলা থেকে আমি গ্রন্থবিলাসী, নতুন বইয়ের খবর পেলেই কিনে আনি। আমার শত্রুরাও কবুল করবে যে, সে বই প’ড়েও থাকি; বন্ধুরা খুবই জানেন যে, প’ড়ে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেও ছাড়ি নে।– সেই আলোচনার চোটে বন্ধুরা পাশ কাটিয়ে চলাতে অবশেষে একটি মাত্র মানুষে এসে ঠেকেছে, বনবিহারী, যাকে নিয়ে আমি রবিবারে আসর জমাই। আমি তার নাম দিয়েছি কোণবিহারী। ছাদে ব’সে তার সঙ্গে আলাপ করতে করতে এক-একদিন রাত্তির দুটো হয়ে যায়। আমরা যখন এই নেশায় ভোর তখন আমাদের পক্ষে সুদিন ছিল না। তখনকার পুলিস কারও বাড়িতে গীতা দেখলেই সিডিশনের প্রমাণ পেত। তখনকার দেশভক্ত যদি দেখত কারও ঘরে বিলিতি বইয়ের পাতা কাটা, তবে তাকে জানত দেশবিদ্রোহী। আমাকে ওরা শ্যামবর্ণের প্রলেপ দেওয়া শ্বেত-দ্বৈপায়ন ব’লেই গণ্য করত। সরস্বতীর বর্ণ সাদা ব’লেই সেদিন দেশভক্তদের কাছ থেকে তাঁর পূজা মেলা শক্ত হয়েছিল। যে সরোবরে তাঁর শ্বেতপদ্ম ফোটে সেই সরোবরের জলে দেশের কপাল-পোড়ানো আগুন নেবে না, বরঞ্চ বাড়ে, এমনি একটা রব উঠেছিল। সহধর্মিণীর সদ্‌দৃষ্টান্ত ও নিরন্তর তাগিদ সত্ত্বেও আমি খদ্দর পরি নে; তার কারণ এ নয় যে, খদ্দরে কোনো দোষ আছে বা গুণ নেই বা বেশভূষায় আমি শৌখিন। একেবারে উলটো— স্বাদেশিক চাল-চলনের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধ আমার আছে, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা তার অন্তর্গত নয়। ময়লা মোটা রকমের সাজ, আলুথালু রকমে ব্যবহার করাটাই আমার অভ্যাস। কলিকার ভাবান্তর ঘটবার পূর্ববর্তী যুগে চীনেবাজারের আগা-চওড়া জুতো পরতুম, সে জুতোয় প্রতিদিন কালিমা-লেপন করিয়ে নিতে ভুলতুম, মোজা পরতে আপদ বোধ হত, শার্ট না পরে পাঞ্জাবি পরতে আরাম পেতুম, আর সেই পাঞ্জাবিতে দুটো-একটা বোতামের অভাব ঘটলেও খেয়াল করতুম না— ইত্যাদি কারণে কলিকার সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ হবার আশঙ্কা ঘটেছিল। সে বলত, “দেখো, তোমার সঙ্গে কোথাও বেরতে আমার লজ্জা করে।” আমি বলতুম, “আমার অনুগত হবার দরকার নেই, আমাকে বাদ দিয়েই তুমি বেরিয়ো।” আজ যুগের পরিবর্তন হয়েছে, আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হয় নি। আজও কলিকা বলে, “তোমার সঙ্গে বেরতে আমার লজ্জা করে।” তখন কলিকা যে দলে ছিল তাদের উর্দি আমি ব্যবহার করিনি, আজ যে দলে ভিড়েছে তাদের উর্দিও গ্রহণ করতে পারলুম না। আমাকে নিয়ে আমার স্ত্রীর লজ্জা সমানই রয়ে গেল। এটা আমারই স্বভাবের দোষ। যে-কোনো দলেরই হোক, ভেক ধারণ করতে আমার সংকোচ লাগে। কিছুতেই এটা কাটাতে পারলুম না। অপর পক্ষে মতান্তর জিনিসটা কলিকা খতম ক’রে মেনে নিতে পারে না। ঝরনার ধারা
false