label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
robindronath
লাগিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি কোনো জোর করতে চাই নে। সুচরিতা যদি আপত্তি করেন তবে আমি–” হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তো তোমাদের ভাব কিছুই বুঝে উঠতে পারি নে। তোমারই তো ছেলে ওঁকে হিন্দুমতে লইয়েছেন, তুমি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লে চলবে কেন?” পরেশবাবুর বাড়িতে সর্বদাই অপরাধভীরুর মতো যে হরিমোহিনী ছিলেন, যিনি কোনো মানুষকে ঈষৎমাত্র অনুকূল বোধ করিলেই একান্ত আগ্রহের সহিত অবলম্বন করিয়া ধরিতেন, সে হরিমোহিনী কোথায়? নিজের অধিকার রক্ষা করিবার জন্য ইনি আজ বাঘিনীর মতো দাঁড়াইয়াছেন; তাঁহার সুচরিতাকে তাঁহার কাছ হইতে ভাঙাইয়া লইবার জন্য চারি দিকে নানা বিরুদ্ধ শক্তি কাজ করিতেছে এই সন্দেহে তিনি সর্বদাই কণ্টকিত হইয়া আছেন। কে স্বপক্ষ কে বিপক্ষ তাহা বুঝিতেই পারিতেছেন না, এইজন্য তাঁহার মনে আজ আর স্বচ্ছন্দতা নাই। পূর্বে সমস্ত সংসারকে শূন্য দেখিয়া যে দেবতাকে ব্যাকুলচিত্তে আশ্রয় করিয়াছিলেন সেই দেবপূজাতেও তাঁহার চিত্ত স্থির হইতেছে না। একদিন তিনি ঘোরতর সংসারী ছিলেন–নিদারুণ শোকে যখন তাঁহার বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিয়াছিল তখন তিনি মনেও করিতে পারেন নাই যে আবার কোনোদিন তাঁহার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি আত্মীয়পরিজনের প্রতি কিছুমাত্র আসক্তি ফিরিয়া আসিবে; কিন্তু আজ হৃদয়ক্ষতের একটু আরোগ্য হইতেই সংসার পুনরায় তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাঁহার মনকে টানাটানি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, আবার সমস্ত আশা-আকাঙক্ষা তাহার অনেক দিনের ক্ষুধা লইয়া পূর্বের মতোই জাগিয়া উঠিতেছে, যাহা ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন সেই দিকে পুনর্বার ফিরিবার বেগ এমনি উগ্র হইয়া উঠিয়াছে যে সংসারে যখন ছিলেন তখনো তাঁহাকে এত চঞ্চল করিতে পারে নাই। অল্প কয় দিনেই হরিমোহিনীর মুখে চক্ষে, ভাবে ভঙ্গীতে, কথায় ব্যবহারে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিয়া আনন্দময়ী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন এবং সুচরিতার জন্য তাঁহার স্নেহকোমল হৃদয়ে অত্যন্ত ব্যথা বোধ করিতে লাগিলেন। এমন যে একটা সংকট প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহা জানিলে তিনি কখনোই সুচরিতাকে ডাকিতে আসিতেন না। এখন কী করিলে সুচরিতাকে আঘাত হইতে বাঁচাইতে পারিবেন সে তাহার পক্ষে একটা সমস্যার বিষয় হইয়া উঠিল। গোরার প্রতি লক্ষ করিয়া যখন হরিমোহিনী কথা কহিলেন তখন সুচরিতা মুখ নত করিয়া নীরবে ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার ভয় নেই বোন! আমি তো আগে জানতুম না। তা, আর ওকে পীড়াপীড়ি করব না। তুমিও ওকে আর কিছু বোলো না। ও আগে একরকম করে মানুষ হয়েছে, হঠাৎ ওকে যদি বেশি চাপ দাও সে আবার সইবে না।” হরিমোহিনী কহিলেন, “সে কি আমি বুঝি নে, আমার এত বয়স হল! তোমার মুখের সামনেই বলুক-না, আমি কি ওকে কোনোদিন কিছু কষ্ট দিয়েছি। ওর যা খুশি তাই তো করছে, আমি কখনো একটি কথা কই নে–বলি, ভগবান ওকে বাঁচিয়ে রাখুন সেই আমার ঢের–যে আমার কপাল, কোন্‌দিন কী ঘটে সেই ভয়ে ঘুম হয় না।” আনন্দময়ী যাইবার সময় সুচরিতা তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। আনন্দময়ী সকরুণ স্নেহে তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমি আসব, মা, তোমাকে সব খবর দিয়ে যাব–কোনো বিঘ্ন হবে না–ঈশ্বরের আশীর্বাদে শুভকর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে।” সুচরিতা কোনো কথা কহিল না। পরদিন প্রাতে আনন্দময়ী লছমিয়াকে লইয়া যখন সেই বাসাবাড়ির বহুদিনসঞ্চিত ধূলি ক্ষয় করিবার জন্য একেবারে জলপ্লাবন বাধাইয়া দিয়াছেন এমন সময় সুচরিতা আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি ঝাঁটা ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন। তার পরে ধোওয়ামোছা জিনিসপত্র-নাড়াচাড়া ও সাজানোর ধুম পড়িয়া গেল। পরেশবাবু খরচের জন্য সুচরিতার হাতে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা দিয়াছিলেন; সেই তহবিল লইয়া উভয়ে মিলিয়া বার বার করিয়া কত ফর্দ তৈরি এবং তাহার সংশোধনে প্রবৃত্ত হইলেন। অনতিকাল পরে পরেশ স্বয়ং ললিতাকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। ললিতার পক্ষে তাহার বাড়ি অসহ্য হইয়াছিল। কেহ তাহাকে কোনো কথা বলিতে সাহস করিত না, কিন্তু তাহাদের নীরবতা পদে পদে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। অবশেষে বরদাসুন্দরীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করিবার জন্য যখন তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ দলে দলে বাড়ি আসিতে লাগিল তখন পরেশ ললিতাকে এ বাড়ি হইতে লইয়া যাওয়াই শ্রেয় জ্ঞান করিলেন। ললিতা বিদায় হইবার সময় বরদাসুন্দরীকে প্রণাম করিতে গেল; তিনি মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিলেন এবং সে চলিয়া গেলে অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। ললিতার বিবাহ-ব্যাপারে লাবণ্য ও লীলার মনে মনে যথেষ্ট ঔৎসুক্য ছিল; কোনো উপায়ে যদি তাহারা ছুটি পাইত তবে বিবাহ-আসরে ছুটিয়া যাইতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করিত না। কিন্তু ললিতা যখন বিদায় হইয়া গেল তখন ব্রাহ্মপরিবারের কঠোর কর্তব্য স্মরণ করিয়া তাহারা মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া রহিল। দরজার কাছে সুধীরের সঙ্গে চকিতের মতো ললিতার দেখা হইল; কিন্তু সুধীরের পশ্চাতেই তাহাদের সমাজের আরো কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, এই কারণে তাহার সঙ্গে কোনো কথা হইতেই পারিল না। গাড়িতে উঠিয়া ললিতা দেখিল আসনের এক কোণে কাগজে মোড়া কী-একটা রহিয়াছে। খুলিয়া দেখিল, জর্মান-রৌপ্যের একটি ফুলদানি, তাহার গায়ে ইংরাজি ভাষায় খোদা রহিয়াছে, “আনন্দিত দম্পতিকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করুন’ এবং একটি কার্ডে ইংরাজিতে সুধীরের কেবল নামের আদ্যক্ষরটি ছিল। ললিতা আজ হৃদয়কে কঠিন করিয়া পণ করিয়াছিল সে চোখের জল ফেলিবে না, কিন্তু পিতৃগৃহ হইতে বিদায়মুহূর্তে তাহাদের বাল্যবন্ধুর এই একটিমাত্র স্নেহোপহার হাতে লইয়া তাহার দুই চক্ষু দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। পরেশবাবু চক্ষু মুদ্রিত করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। আনন্দময়ী “এসো এসো, মা এসো” বলিয়া ললিতার দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে লইয়া আসিলেন, যেন এখনই তাহার জন্য তিনি প্রতীক্ষা করিয়া ছিলেন। পরেশবাবু সুচরিতাকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিলেন, “ললিতা আমার ঘর থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে এসেছে।”
false
shirshendu
দেয়, অকারণে অন্যায্য প্রশংসা করে এবং হাবিজাবি কথাও মন দিয়ে শোনে। মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো চালানোর জন্য এসব লোককে সবসময়েই সঙ্গী হিসেবে চায়। মানুষের ইচ্ছাপূরণে সাহায্য করে বলেই কিছু দয়া ও দাক্ষিণ্য তারা পেয়ে থাকে। লোক বড় কম জোটায়নি চারুশীলা। সন্ধের পর একে একে এল রিয়া আর মোহিনী, এল ঝুমকি, এল দাড়িওলা এবং বিষণ্ণ হেমাঙ্গ। আরও জনা তিনেককে চেনে না চয়ন। দেখা গেল, সকলেরই ডিনারের নেমন্তন্ন। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও বেশ বিরাট। সেদ্ধ ভাত খেয়ে খেয়ে চয়নের পেট মরে গেছে। আজকাল সে একদম বেশি খেতে পারে না। বিশেষ করে ঝালমশলার খাবার খেলেই তার পেটের গোলমাল হয়। কিন্তু বোধ হয় তার স্বাহারে চারুশীলা খুশি নয়। তাই ডিনার টেবিলে তাকে নিয়েই পড়ল চারুশীলা, ও কী চয়নবাবু, ওটুকু মাছ নিলেন যে! ভাতটা আরও নিন তো! …আর একটা মুরগির টুকরো নিতে হবে। …হাত গুটিয়ে রয়েছেন যে, পুডিংটা নিন। হেমাঙ্গ বিরক্ত হয়ে বলল, মানুষকে খাইয়ে মারতে চাস নাকি? এটা বেশি ফুড ইনটেকের যুগ নয়। মানুষ যত কম খাবে তত বেশিদিন বাঁচবে। চারুশীলা ঈষৎ ব্লগের গলায় বলে, আহা, বন থেকে বেরোলো টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। এসব ফিলজফি কি সুন্দরবন থেকে শিখে এলি নাকি? নিজের চেহারাটা তো চিমসে তালপাতার সেপাই বানিয়েছিল। সুন্দরবনে শিখবো কেন? তুই মডার্ন ওয়ার্ল্ডের খবরই রাখিস না। বরং সুব্রতদাকে জিজ্ঞেস কর ঠিক বলছি কি না। সুব্রত শান্ত মানুষ, বেশি কথা বলে না। তর্কবিতর্ক একেবারেই করে না। শাস্ত হেসে বলল, তোমার লাইফ স্টাইলটা খুবই স্পার্টান হয়ে গেছে। সেটাই কি ভাল নয়? সুব্রত মাথা নেড়ে বলে, ভালই। আমাকে ও চিমসে বলছে ব্রতদা, শুনলেন? শুনেছি। আমার তো মনে হয় তুমি অনেক লিন হয়েছে, আর চটপটে। রংটাও বেশ ট্যান হয়েছে। চারুশীলা একটু অবাক হয়ে বলে, তুমি এর প্রশংসা করছো? ধন্যি তোমাকে। ওকে চাষা ছাড়া আর কিছু মনে হয় এখন? কী কালো হয়েছে, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, মুখে জঙ্গল। সুব্রত মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। হেমাঙ্গ একটু মাথা তুলে বলল, টুকটুকে ফর্সা নাদুসনুদুস ন্যাদসমার্কা চেহারা বুঝি ভাল? হাসতে গিয়ে ঝুমকি বিষম খেল। একটু জল চলকে গেল মোহিনীর হাতের গেলাস থেকে। কিন্তু এইসব হাসিঠাট্টার মধ্যেও চয়ন লক্ষ করছিল, হেমাঙ্গর চোখ আসছে না। একটা গভীর ক্লান্তি, হতাশা এবং হয়তোবা একটা অপরাধবোধে ছেয়ে আছে তার চোখ। হেমাঙ্গ আর রশ্মির ব্যাপারটা চয়ন জানে বলেই আরও ভাল বোঝা গেল। দুখানা গাড়ি হলেই হয়ে যেত। কিন্তু বন্দোবস্ত হয়েছে তিনখানা গাড়ির। চারুশীলার দুটো, হেমাঙ্গর একটা। চয়ন পড়ল হেমাঙ্গর ভাগে। সামনের সিটে পাশাপাশি বসে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেমাঙ্গ বলে, চয়নবাবু গান জানেন? আজ্ঞে না। জানলে আপনাকে আজ একটা গান শোনাতে বলতাম। কী গান? যখন ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল। কাল রাতেও স্টিরিওতে শুনলাম। আপনার মনটা খুব খারাপ, না? একটা হাত স্টিয়ারিং থেকে তুলে দাড়ি আঁচড়াল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, আমি বোধ হয় একটা ইমবেসাইল। কিন্তু কিছু করার ছিল না। চয়ন চুপ করে থাকে। এ ব্যাপারে সে কথা বলার অধিকারী নয়। হেমাঙ্গ বাইপাসের দিকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে আয়নায় একবার পিছনের গাড়িগুলো ঠিকঠাক আসছে কি না দেখে নিল। তারপর বলল, অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? উই আর বোথ ইন লাভ উইথ ইচ আদার। কিন্তু কতগুলো মেটেরিয়াল কারণে, মাইনর পয়েন্টে আটকে রইলাম। দিস ইজ দা জোক অফ এ লাইফটাইম! চয়ন মৃদু অস্বস্তি বোধ করছে। এই কথার মধ্যে সে একটা ভুল ধরতে পারছে। স্পষ্ট নয়, কিন্তু আবছা হলেও সত্যি। সে মৃদু স্বরে বলল, দুঃখের ব্যাপার। আপনিও তাই মনে করেন? চয়ন সোজা সামনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তাই তো। দোষটা কার বলুন তো? আমারই, না? চয়ন মাথা নেড়ে বলল, না। তবে কার? বোধ হয় ঘটনাচক্রের। আপনি তো রাজি ছিলেন। আমার যে কেবলই মনে হয় আমি ওকে অপমান করেছি। চয়ন খুব ভয়ে ভয়ে বলে, অপমান! কই, মনে হয় না তো! কিন্তু প্রত্যাখ্যান মানেই তো অপমান। চয়ন সংকোচের সঙ্গে বলে, প্রত্যাখ্যান! এটা কি তাই? নয় তো? হেমাঙ্গ কী শুনতে চাইছে তা চয়ন বুঝতে পারল। বলল, না, প্রত্যাখ্যান কেন হবে? অন্তত লোকে তো তাই ভাববে? চয়ন একটু ভাববার ভান করল। তারপর একটু সরল গলায় বলে, আমার তা মনে হয় না। হেমাঙ্গ সামনের হেডলাইটে উজ্জ্বল রাস্তার দিকে চেয়ে বলে, কি জানি, আমার তো সন্দেহ ছিল সবাই আমাকেই দায়ী করবে। ডি ছি করবে, খানিকটা সেই ভয়েই তো গায়ে পালিয়ে ছিলাম। চয়ন মৃদু হেসে বলে, আপনার গাঁয়ের বাড়িটা খুব সুন্দর। আপনার ভাল লেগেছে? যাদের চোখ আর রুচি আছে তাদের ভালই লাগবে। বসবাস করার পক্ষে শহর একদম বাজে জায়গা। বুক ভরে দমটা অবধি নেওয়ার উপায় নেই। কৃষ্ণজীবনবাবু কি আর সাধে পরিবেশ-পরিবেশ করে এত অস্থির হন! আমার তো ইচ্ছে করছে কালকেই আবার গায়ে চলে যাই। যাবেন আমার সঙ্গে? চয়ন একটু শঙ্কিত হয়ে বলে, আমার তো উপায় নেই। টিউশনি? আজ্ঞে। আমারও তো কত কাজ কলকাতায়। কিন্তু জীবনের আনন্দটাই যদি না থাকে তা হলে পয়সা দিয়ে কী হবে? তা তো বটেই। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালাল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, তা হলে আপনি বলছেন রশির সঙ্গে আমি বিট্রে করিনি। না তো! একটা যেন স্বস্তির শ্বাস মোচন করে হেমাঙ্গ বলে, রশি খুব ভাল স্বভাবের মেয়ে। কাল নিজে গিয়ে আমাকে কলকাতায় টেনে
false
robindronath
বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইঁহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নির্ভর ঢের বেশি; সুতরাং পূর্বে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন। আমিও নীলরতনের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া এক সময় বিশেষ সুবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম। প্রথমে গ্রামের একটি আলাপী লোকের বাসায় ছিলাম, তাহার পরে বাপের কাছ হইতেও কিছু কিছু অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম। লেখাপড়া যথানিয়মে চলিতে লাগিল। ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম। দেশের জন্য হঠাৎ প্রাণবিসর্জন করা যে আশু আবশ্যক, এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু, কী করিয়া উক্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে আমি জানিতাম না, এবং কেহ দৃষ্টান্তও দেখাইত না। কিন্তু, তাহা বলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রুটি ছিল না। আমরা পাড়াগেঁয়ে ছেলে, কলিকাতার ইঁচড়ে-পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করিতে শিখি নাই; সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। আমাদের সভার কর্তৃপীয়েরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার খাতা লইয়া না-খাইয়া দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতাম, রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিতাম, সভাস্থলে গিয়া বেঞ্চি চৌকি সাজাইতাম, দলপতির নামে কেহ একটা কথা বলিলে কোমর বাঁধিয়া মারামারি করিতে উদ্যত হইতাম। শহরের ছেলেরা এই-সব লক্ষণ দেখিয়া আমাদিগকে বাঙাল বলিত। নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু মাটসীনি গারিবাল্ডি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম। এমন সময়ে আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হইলেন। আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি, তখন সুরবালার বয়স আট; এখন আমি আঠারো। পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে। কিন্তু, এ দিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব – বাপকে বলিলাম, বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না। দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম, উকিল রামলোচনবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। পতিত ভারতের চাঁদা-আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল। এন্ট্রেন্স্ পাস করিয়াছি, ফাস্ট্ আর্ট্স্ দিব, এমন সময় পিতার মৃত্যু হইল। সংসারে কেবল আমি একা নই; মাতা এবং দুটি ভগিনী আছেন। সুতরাং কালেজ ছাড়িয়া কাজের সন্ধানে ফিরিতে হইল। বহু চেষ্টায় নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোটো শহরে এন্ট্রেন্স্ স্কুলের সেকেন্ড্ মাস্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম। মনে করিলাম, আমার উপযুক্ত কাজ পাইয়াছি। উপদেশ এবং উৎসাহ দিয়া এক-একটি ছাত্রকে ভাবী ভারতের এক-একটি সেনাপতি করিয়া তুলিব। কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম। দেখিলাম, ভাবী ভারতবর্ষ অপেক্ষা আসন্ন এগ্‌জামিনের তাড়া ঢের বেশি। ছাত্রদিগকে গ্রামার অ্যাল্‌জেব্রার বহির্ভূত কোনো কথা বলিলে হেড্‌মাস্টার রাগ করে। মাস-দুয়েকের মধ্যে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হইয়া আসিল। আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারূপ কল্পনা করে, অবশেষে কার্যেক্ষেত্র নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে লেজ-মলা খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্রাত্যহিক মাটি-ভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জাব্না খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে; লম্ফে ঝম্পে আর উৎসাহ থাকে না। অগ্নিদাহের আশঙ্কায় একজন করিয়া মাস্টার স্কুলের ঘরেতেই বাস করিত। আমি একা মানুষ, আমার উপরেই সেই ভার পড়িয়াছিল। স্কুলের বড়ো আটচালার সংলগ্ন একটি চালায় আমি বাস করিতাম। স্কুলঘরটি লোকালয় হইতে কিছু দূরে একটি বড়ো পুষ্করিণীর ধারে। চারি দিকে সুপারি নারিকেল এবং মাদারের গাছ, এবং স্কুলগৃহের প্রায় গায়েই দুটা প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিম গাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হইয়া ছায়া দান করিতেছে। একটা কথা এতদিন উলেখ করি নাই এবং এতদিন উলেখযোগ্য বলিয়া মনে হয় নাই। এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা আমাদের স্কুলঘরের অনতিদূরে। এবং তাঁহার সঙ্গে তাঁহার স্ত্রী-আমার বাল্যসখী সুরবালা – ছিল, তাহা আমার জানা ছিল। রামলোচনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হইল। সুরবালার সহিত বাল্যকালে আমার জানাশোনা ছিল তাহা রামলোচনবাবু জানিতেন কি না জানি না, আমিও নূতন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলা সঙ্গত বোধ করিলাম না। এবং সুরবালা যে কোনো কালে আমার জীবনের সঙ্গে কোনোরূপে জড়িত ছিল, সে কথা আমার ভালো করিয়া মনে উদয় হইল না। একদিন ছুটির দিনে রামলোচনবাবুর বাসায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছি। মনে নাই কী বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল, বোধ করি বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা সম্বন্ধে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মাণ ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে এ সম্বন্ধে ঘণ্টাখানেক-দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে। এমন সময়ে পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু একটু চুড়ির টুংটাং, কাপড়ের একটুখানি খস্‌খস্ এবং পায়েরও একটুখানি শব্দ শুনিতে পাইলাম; বেশ বুঝিতে পারিলাম, জানালার ফাঁক দিয়া কোনো কৌতূহলপূর্ণ নেত্র আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। তৎক্ষণাৎ দুখানি চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল-বিশ্বাস সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পলব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টন্‌টন্ করিয়া উঠিল। বাসায় ফিরিয়া আসিলাম, কিন্তু সেই ব্যথা লাগিয়া রহিল। লিখি পড়ি, যাহা করি, কিছুতেই মনের ভার দূর হয় না; মনটা সহসা একটা বৃহৎ বোঝার মতো হইয়া বুকের শিরা ধরিয়া দুলিতে লাগিল। সন্ধ্যাবেলায় একটু স্থির হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমনটা হইল কেন। মনের মধ্য হইতে উত্তর আসিল, তোমার সে সুরবালা কোথায় গেল। আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম, আমি তো তাহাকে ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছি। সে কি চিরকাল আমার জন্য বসিয়া থাকিবে। মনের ভিতরে কে বলিল, তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না। সেই শৈশবের
false
manik_bandhopaddhay
না, সোজাসুজি ওদের ত্যাগ করিবার সাহস তো তার নাই, এখন সে ওদের কাছে দারিদ্র্যের ভান করে, দেড় বছর গরিব হইয়া থাকিবার পর এটা সহজেই করিতে পারে। তার মধ্যে ভারি একটা অস্থিরতা আসিয়াছে, কিছুদিন খুব দূর্তি করিয়া কাটানোর পর শ্ৰান্ত মানুষের যে রকম আসে, কিছু ভালো লাগে না, কি করিবে ঠিক পায় না। শ্যামার সঙ্গে গোড়া হইতে মনের মিল করিয়া রাখিলে এখন সে বাড়িতেই একটি সুখ-দুঃখের সঙ্গী পাইত, আর তাহা হইবার উপায় নাই–সাংসারিক ব্যাপারে ও ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে শ্যামার সঙ্গে তাহার কতগুলি মত ও অনুভূতি খাপ খায় মাত্র, শ্যামার কাছে বেশি আর কিছু আশা করা যায় না। অথচ এদিকে বাহিরে মদ খাইয়া একা একা স্ফুর্তিও জমে না, সব কি রকম নিরানন্দ অসার মনে হয়। অনেক প্রত্যাশা করিয়া হয়তো সে তাহার পরিচিত কোনো মেয়ের বাড়ি যায়, কিন্তু নিজের মনে আনন্দ না থাকিলে পরে কেন আনন্দ দিতে পারিবে, তাও টাকার বিনিময়ে? আজকাল হাজার মদ গিলিয়াও নেশা পর্যন্ত যেন জমিতে চায় না, কেবল কান্না আসে। কত কি দুঃখ উথলিয়া ওঠে। এক-একদিন সে করে কি, সকাল সকাল প্রেস হইতে বাড়ি ফেরে। শ্যামার রান্নার সময় সে ছেলেমেয়েদের সামলায়, বারান্দায় পায়চারি করিয়া ছোট খোকামণিকে ঘুম পাড়ায়, মুখের কাছে। বাটি ধরিয়া বুকুকে খাওয়ায় দুধ। বুকুকে কোলে করিয়া ঘুম পাড়াইতে হয় না, সে বিছানায় শুইয়াই ঘুমায়, ঘুমাইয়া পড়িবার আগে একজনকে শুধু তাহার পিঠে আস্তে আস্তে চুলকাইয়া দিতে হয়। তারপর বাকি থাকে বিধান, সে খানিকক্ষণ পড়ে, তারপর তাকে গল্প বলিয়া রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত জাগাইয়া রাখিতে হয়। এসব শীতল অনেকটা নিখুঁতভাবেই করে। সকলের খাওয়া শেষ হইলে গর্বিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তামাক টানিতে টানিতে শ্যামার কি বলিবার আছে, শুনিবার প্রতীক্ষা করে। শ্যামার কাছে সে কিছু প্রশংসার আশা করে বৈকি। শ্যামা কিন্তু কিছু বলে না। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হয় সে রান্না করিয়াছে, শীতল ছেলে রাখিয়াছে, কোনো পক্ষেরই এতে কিছু বাহাদুরি নাই। শেষে শীতল বলে, কি দুই যে ওরা হয়েছে শ্যামা, সামলাতে হয়রান হয়ে গেছিওদের নিয়ে তুমি রান্না কর কি করে? শ্যামা বলে, মণিকে ঘুম পাড়িয়ে নি, বুকুকে খোকা রাখে। এত সহজ? শীতল বড় দমিয়া যায়, সন্ধ্যা হইতে ওদের সামলাইতে সে হিমশিম খাইয়া গেল, শ্যামা এখন অবলীলাক্রমে তাহাদের ব্যবস্থা করে? শ্যামা হাই তুলিয়া বলে, এক একদিন কিন্তু ভারি মুশকিলে পড়ি বাবু, মণি ঘুমোয় না, বুকুটা ঘ্যান ঘ্যান করে, সবাই মিলে আমাকে ওরা খেয়ে ফেলতে চায়, মরেও তেমনি মার খেয়ে। তুমি বাড়ি থাকলে বাঁচি, ফিরো দিকি একটু সকাল সকাল রোজ? শ্যামা আঁচল বিছাইয়া শ্ৰান্ত দেহ মেঝেতে এলাইয়া দেয়, বলে, তুমি থাকলে ওদেরও ভালো লাগে, সন্ধ্যাবেলা তোমায় দেখতে না পেলে বুকু তো আগে কেঁদেই অস্থির হত। শীতল আগ্ৰহ গোপন করিয়া জিজ্ঞাসা করে, আজকাল কাঁদে না? আজকাল ভুলে গেছে। হ্যাগো, মুদি দোকানে টাকা দাও নি? দিয়েছি। মুদি আজ সত্যভামাকে তাগিদ দিয়েছে। তামাক পুড়ে গেছে, এবার রাখ, দেব আরেক ছিলিম সেজে? শীতল বলে, না থাক। আবোল-তাবোল খরচ করে কেন যে টাকাগুলো নষ্ট কর, দোতলার একখানা ঘর তুলতে পারলে একটা কাজের মতো কাজ হত, টাকা উড়িয়ে লাভ কি? তারপর তাহারা ঘরে যায়, মণি আর বুকুর মাঝখানে শ্যামা শুইয়া পড়ে। বিধান একটা স্বতন্ত্র ছোট চৌকিতে শোয়, শোয়ার আগে একটি বিড়ি খাইবার জন্য শীতল সে চৌকিতে বসিবামাত্র বিধান চিৎকার করিয়া জাগিয়া যায়। শীতল তাড়াতাড়ি বলে, আমি রে খোকা, আমি, ভয় কি? –বিধান কিন্তু শীতলকে চায় না, সে কাঁদিতে থাকে। শ্যামা বলে, আয় খোকা, আমার কাছে আয়। সে রাত্রে ব্যবস্থা উল্টাইয়া যায়। শীতলের বিছানায় শোয় বিধান, বিধানের ছোট্ট চৌকিটিতে শীতল পা মেলিতে পারে না। একটা অদ্ভুত ঈর্ষার জ্বালা বোধ করিতে করিতে সে মা ও ছেলের আলাপ শোনে। স্বপন দেখছিলি, না রে খোকা? কিসের স্বপন রে? ভুলে গেছি মা। খুঁকির গায়ে তুমি যেন পা তুলে দিও না বাবা। কি করে দেব? পাশবালিশ আছে যে? তুই যে পাশবালিশ ডিঙ্গিয়ে আসিস। বালিশের তলে কি হাতড়াচ্ছিস? টর্চটা একটু দাও না মা। কি করবি টর্চ দিয়ে রাতদুপুরে? এমনি জ্বলে খরচ করে ফ্যাল, শেষে দরকারের সময় মরব তখন অন্ধকারে। একটু পরেই ঘরে টর্চের আলো বারকয়েক জুলিয়া নিবিয়া যায়। দেয়ালের গায়ে টিকটিকির ডাক শুনিয়া বিধান তাকে খুঁজিয়া বাহির করে। নে হয়েছে, দে এবার। জল খাব মা। জল খাইয়া বিধান মত বদলায়। আমি এখানে পোব না মা, যা গন্ধ! শ্যামা হাসে, তোর বিছানায় বুঝি গন্ধ নেই খোকা? ভারি সাধু হয়েছিল, না? বড়দিনের সময় রাখালের সঙ্গে মন্দা কলিকাতায় বেড়াইতে আসিল, পর পর তাহার দুটি মেয়ে হইয়াছে, মেয়ে দুইটিকে সে সঙ্গে আনিল, ছেলেরা রহিল বনগাঁয়ে। মন্দার বড় মেয়েটি খোড়া পা লইয়া জন্মিয়াছিল, এখন প্রায় চার বছর বয়স হইয়াছে, কথা বলিতে শেখে নাই, মুখ দিয়া সর্বদা লালা পড়ে। মেয়েটাকে দেখিয়া শ্যামা বড় মমতা বোধ করিল। কত কষ্টই পাইবে জীবনে! এখন অবশ্য মমতা করিয়া সকলেই তাহা বলিবে, বড় হইয়া ও যখন সকলের গলগ্ৰহ হইয়া উঠিবে, ফেলাও চলিবে না, রাখিতেও গা জ্বালা করিবে, লাঞ্ছনা শুরু হইবে তখন। মন্দা মেয়ের নাম রাখিয়াছে শোভা। শুনিলে মনটা কেমন করিয়া ওঠে। এমন মেয়ের ওরকম নাম রাখা কেন? মন্দা বলিল, ওকে ডাকি বাদু বলে। শ্যামা ভাবিয়াছিল, সতীন আসিবার পর মন্দার
false
bongkim
জলে ভাসাইয়া দিয়া কাঁদিতে বসিল। কেন কাঁদিতে বসিল, তাহা আমি জানি না। আমি স্ত্রীলোকের মনের কথা কি প্রকারে বলিব? তবে আমার বড়ই সন্দেহ হয়, ঐ দুষ্ট কোকিল রোহিণীকে কাঁদাইয়াছে। সপ্তম পরিচ্ছেদ বারুণী পুষ্করিণী লইয়া আমি বড় গোলে পড়িলাম–আমি তাহা বর্ণনা করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। পুষ্করিণীটি অতি বৃহৎ–নীল কাচের আয়না মত ঘাসের ফ্রেমে আঁটা পড়িয়া আছে।সেই ঘাসের ফ্রেমের পরে আর একখানা ফ্রেম—বাগানের ফ্রেম,–পুষ্করিণীর চারি পাশে বাবুদের বাগান—উদ্যানবৃক্ষের এবং উদ্যানপ্রাচীরের বিরাম নাই। সেই ফ্রেমখানা বড় জাঁকাল—লাল, কালো, সবুজ গোলাপী, সাদা, জরদ, নানাবর্ণ ফুলে মিনে করা—নানা ফলের পাতর বসান। মাঝে মাঝে সাদা বৈঠকখানা বাড়ীগুলা এক একখানা বড় বড় হীরার মত অস্তগামী সূর্যের কিরণে জ্বলিতেছিল। আর মাথার উপর আকাশ—সেও সেই বাগান ফ্রেমে আঁটা, সেও একখানা নীল আয়না। আর সেই নীল আকাশ, আর সেই বাগানের ফ্রেম, আর সেই ঘাসের ফ্রেম, ফুল, ফল, গাছ, বাড়ী সব সেই নীল জলের দর্পণে প্রতিবিম্বিত হইতেছিল। মাঝে মাঝে সেই কোকিলটা ডাকিতেছিল। এ সকল একরকম বুঝান যায়, কিন্তু সেই আকাশ, আর সেই পুকুর, আর সেই কোকিলের ডাকের সঙ্গে রোহিণীর মনের কি সম্বন্ধ, সেইটি বুঝাইতে পারিতেছি না। তাই বলিতেছিলাম যে, এই বারুণী পুকুর লইয়া আমি বড় গোলে পড়িলাম। আমিও গোলে পড়িলাম, আর গোবিন্দলালও বড় গোলে পড়িল। গোবিন্দলালও সেই কুসুমিতা লতার অন্তরাল হইতে দেখিতেছিলেন যে, রোহিণী আসিয়া ঘাটের রাণায় একা বসিয়া কাঁদিতেছে। গোবিন্দলাল বাবু মনে মনে সিদ্ধান্ত করিলেন, এ, পাড়ায় কোন মেয়ে ছেলের সঙ্গে কোন্দল করিয়া আসিয়া কাঁদিতেছে। আমরা গোবিন্দলালের সিদ্ধান্তে তত ভরাভর করি না। রোহিণী কাঁদিতে লাগিল। রোহিণী কি ভাবিতেছিল, বলিতে পারি না। কিন্তু বোধ হয় ভাবিতেছিল যে, কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোন সুখভোগ করিতে পাইলাম না। কোন্ দোষে আমাকে এ রুপ যৌবন থাকিতে কেবল শ জীবনের সকল সুখে সুখী–কোন্ পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ–আমার কপালে শূন্য? দূর হৌক–পরের সুখ দেখিয়া আমি কাতর নই–কিন্তু আমার সকল পথ বন্ধ কেন? আমার এ অসুখের জীবন রাখিয়া কি করি? তা, আমরা ত বলিয়াছি, রোহিণী লোক ভাল নয়। দেখ, একটুতে কত হিংসা! রোহিণীর অনেক দোষ–তার কান্না দেখে কাঁদিতে ইচ্ছা করে কি? করে না। কিন্তু অত বিচারে কাজ নাই!–পরের কান্না দেখিলেই ভাল। দেবতার মেঘ কণ্টকক্ষেত্র দেখিয়া বৃষ্টি সম্বরণ করে না। তা, তোমরা রোহিণীর জন্য একবার আহা বল। দেখ, এখনও রোহিণী, ঘাটে বসিয়া কপালে হাত দিয়া কাঁদিতেছে–শূন্য কলসী জলের উপর বাতাসে নাচিতেছে। শেষে সূর্য অস্ত গেলেন; ক্রমে সরোবরের নীল জলে কালো ছায়া পড়িল–শেষে অন্ধকার হইয়া আসিল। পাখী সকল উড়িয়া গিয়া গাছে বসিতে লাগিল। গোরু সকল গৃহাভিমুখে ফিরিল। তখন চন্দ্র উঠিল–অন্ধকারের উপর মৃদু আলো ফুটিল। তখনও রোহিণী ঘাটে বসিয়া কাঁদিতেছে–তাহার কলসী তখনও জলে ভাসিতেছে। তখন গোবিন্দলাল উদ্যান হইতে গৃহাভিমুখে চলিলেন–যাইবার সময়ে দেখিতে পাইলেন যে, তখনও রোহিণী ঘাটে বসিয়া আছে। এতক্ষণ অবলা একা বসিয়া কাঁদিতেছে দেখিয়া, তাঁহার একটু দুখ উপস্থিত হইল। তখন তাঁহার মনে হইল যে, এ স্ত্রীলোক সচ্চরিত্রা হউক, দুশ্চরিত্রা হউক, এও সেই জগৎপিতার প্রেরিত–সংসারপতঙ্গ আমিও সেই তাঁহার প্রেরিত সংসারপতঙ্গ; অতএব এও আমার ভগিনী। যদি ইহার দুঃখ নিবারণ করিতে পারি–তবে কেন করিব না? গোবিন্দলাল ধীরে ধীরে সোপানবলী অবতরণ করিয়া রোহিণীর কাছে গিয়া, তাহার পার্শ্বে চম্পকনির্মিত মূতিবৎ সেই চম্পকবর্ণ চন্দ্রকিরণে দাঁড়াইলেন। রোহিণী দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। গোবিন্দলাল বলিলেন, “রোহিণী! তুমি এতক্ষণ একা বসিয়া কাঁদিতেছ কেন?” রোহিণী উঠিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু কথা কহিল না। গোবিন্দলাল পুনরপি বলিলেন, “তোমার কিসের দুঃখ, আমায় কি বলিবে না? যদি আমি কোন উপকার করিতে পারি |” যে রোহিণী হরলালের সম্মুখে মুখরার ন্যায় কথোপকথন করিয়াছিল–গোবিন্দলালের সম্মুখে সে রোহিণী একটি কথাও কহিতে পারিল না। কিছু বলিল না–গঠিত পুত্তলীর মত সেই সরোবর সোপানের শোভা বর্ধিত করিতে লাগিল। গোবিন্দলাল স্বচ্ছ সরোবরজলে সেই ভাস্করকীর্তিকল্প মূতির ছায়া দেখিলেন, পূর্ণচন্দ্রের ছায়া দেখিলেন এবং কুসুমিত কাঞ্চনাদি বৃক্ষের ছায়া দেখিলেন। সব সুন্দর–কেবল নির্দয়তা অসুন্দর! সৃষ্টি করুণাময়ী–মনুষ্য অকরুণ। গোবিন্দলাল প্রকৃতির স্পষ্টাক্ষর পড়িলেন। রোহিণীকে আবার বলিলেন, “তোমার যদি কোন বিষয়ে কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, কালি হউক, আমাকে জানাইও। নিজে না বলিতে পার, তবে আমাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকদের দ্বারায় জানাইও |” রোহিণী এবার কথা কহিল। বলিল, “একদিন বলিব। আজ নহে। এক দিন তোমাকে আমার কথা শুনিতে হইবে|” গোবিন্দলাল স্বীকৃত হইয়া, গৃহাভিমুখে গেলেন। রোহিণী জলে ঝাঁপ দিয়া কলসী ধরিয়া তাহাতে জল পুরিল–কলসী তখন বক্–বক্–গল্–গল্–করিয়া বিস্তর আপত্তি করিল। আমি জানি, শূন্য কলসীতে জল পুরিতে গেলে কলসী, কি মৃৎকলসী, কি মনুষ্যকলসী, এইরূপ আপত্তি করিয়া থাকে–বড় গণ্ডগোল করে। পরে অন্তঃশূন্য কলসী, পূর্ণতোয় হইলে রোহিনী ঘাটে উঠিয়া আর্দ্রবস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছদিত করিয়া, ধীরে ধীরে ঘরে যাইতে লাগিল। তখন চলৎ ছলৎ ঠনাক্! ঝিনিক্ ঠিনিকি ঠিন! বলিয়া, কলসীতে আর কলসীর জলেতে আর রোহিণীর বালাতে কথোপকথন হইতে লাগিল। আর রোহিণীর মনও সেই কথোপকথনে আসিয়া যোগ দিল– রোহিণীর মন বলিল–উইল চুরি করা কাজটা! জল বলিল–ছলাৎ! রোহিণীর মন–কাজটা ভাল হয় নাই। বালা বলিল–ঠিন্ ঠিনা–না! তা ত না– রোহিণীর মন–এখন উপায়? কলসী–ঠনক্ ঢনক্ ঢন্–উপায় আমি,-দড়ি সহযোগে। অষ্টম পরিচ্ছেদ রোহিণী সকাল সকাল পাককার্য সমাধা করিয়া, ব্রহ্মানন্দকে ভোজন করাইয়া, আপনি অনাহারে শয়নগৃহে দ্বার রুদ্ধ করিয়া গিয়া শয়ন করিল। নিদ্রার জন্য নহে–চিন্তার জন্য। তুমি দার্শনিক এবং বিজ্ঞানবিদগণের মতামত ক্ষণকাল
false
humayun_ahmed
যায় না। আবার কোনো কোনো দিন আছে–সব পাওয়া যায়। সেদিন তুমি যা চাইবে তাই পাবে। শাহেদা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর। মেয়েটাকে আজ অনেক বড় বড় লাগছে। ঝুমুর বলল, মা শোন, আপার একটা কথা তোমাকে বলি–আপাকে নিয়ে মাঝে মাঝে তুমি দুশ্চিন্তা কর। আজেবাজে কথা ভাব। এইসব ভাবার কোনো কারণ নেই। আপা মরে যাবে তবুও অন্যায় কিছু করবে না। শাহেদার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুমুর বলল, সিনেমার কাজ, শুটিঙের কাজ–রাত দিন বাইরে থাকতে হয় বলে লোকজন আজেবাজে কথা বলে। ওদের আজেবাজে কথা বলার কোনো কারণ নেই। শাহেদা কাপা গলায় বললেন, সেইটাই তো আমি বলি মা। আমার নিজের মেয়ে আমি তাকে জানি না? লোকজনের আজেবাজে কথা বলার কোনো অধিকারও নেই। আপা কি সামান্য চাকরির জন্যে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যায় নি? কেউ কি দিয়েছে তাকে কিছু জোগাড় করে? আজি কোন বড় বড় কথা বলে? শাহেদার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখ মুছলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন–তুই যে বললি ও রাতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদে। কাঁদে কেন? মনের দুঃখে কাঁদে। আমার মনে হয় বেশিরভাগ সময় মবিন ভাইয়ের জন্যে কাঁদে। প্রায়ই তো মবিন ভাইয়ের টিউশ্যানি চলে যায়। বেচারার প্রায় না খেয়ে থাকার মতো জোগাড় হয়। একবার কী হয়েছে জান মা? প্ৰায় দশদিন মবিন ভাই ভাত খায় নি। যে হোটেলে বাকিতে খেত তারা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে… থাক এসব শুনতে চাচ্ছি না। শোন না মা—মবিন ভাই বাধ্য হয়ে চিড়া আর গুড় কিনে আনল। চিড়া পানিতে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে খায়। আপা জানতে পেরে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে এসে খুব কাঁদছিল। শাহেদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ঝুমুর এসে মায়ের পাশে বসল। কোমল গলায় বলল, তুমি মবিন ভাইয়ের সঙ্গে আপার বিয়ে দাও মা। ওরা কয়েকটা দিন আনন্দ করুক। ও বউকে খাওয়াবে কী? চিড়া আর গুড় খাওয়াবে। তাতে কী মা? ওরা দু’জন যখন বারান্দায় বসে গল্প করবে তখন দেখো তোমার কত ভালো লাগবে। শাহেদা দেখলেন ঝুমুরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। প্ৰেম দেওয়ানার ডাবিং আজমল তরফদারের ছবি ‘প্ৰেম দেওয়ানা’র ডাবিং শুরু হয়েছে। ডাবিং স্টুডিওতে জমজমাট অবস্থা। ন’টা থেকে শিফট শুরু হলেও স্টার সুপারস্টাররা দশটা-এগারটার দিকে আসেন। যিনি যত বড়ো স্টার তিনি আসবেন তত দেরিতে। গ্যালাক্সি স্টার ফরহাদের সেই হিসেবে বারটার দিকে আসার কথা। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় তিনি সকাল ন’টার সময় চলে এসেছেন। তাঁর মুডও আজ খুব ভালো। গাড়ি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে বললেন, আজমল ভাই জস্পেশ করে চা বানান দেখি। আপনার ব্যাটেলিয়ান রেডি? হ্যাঁ রেডি। দেখবেন ইনশাল্লাহু চল্লিশ লুপ এক শিফটে নামিয়ে দেব। ম্যাডাম এসেছেন? এখনো আসেন নি। ডায়ালগ দিতে বলুন। বসে বসে মুখস্থ করতে থাকি। চা তো এখনো দিল না। ফরহাদ সাহেব ডাবিং রুমে ঢুকে গেলেন। আজমল তরফদারের সঙ্গে বিমল দাঁড়িয়ে আছে। সে এসেছে বিশেষ কারণে, রেশমাকে বড় সাহেবের অফিসে নিয়ে যেতে হবে। বড় সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। রেশমা’র আজ ডাবিং আছে। সে ন’টার আগেই এসে পড়ে। আজই শুধু দেরি হচ্ছে। বিমল ফরহাদকে দেখিয়ে নিচু গলায় বলল, উনি কি আপনার ছবির হিরো? হুঁ। যা তা হিরো না গ্যালাক্সি হিট হিরো। আমাদের ছবিতে কি উনি থাকছেন? হুঁ। না থাকলেই ভালো হত। কেন? গাধা। অভনয় জানে না। তাহলে তাকে নিচ্ছেন কেন? রিকশাওয়ালারা তাকে দেখতে চায়। তাকে কি নতুন ছবির কথা বলা হয়েছে? এখনো বলা হয় নি, তবে সে জেনে গেছে যে আমরা বড় বাজেটে নামছি। ছবি পাড়ায় খবর হয়ে গেছে। আজ যে ন’টার সময় উপস্থিত–এই কারণেই উপস্থিত। আপনাকে খাতির করা শুরু করেছে? হুঁ। লুপ লাগানো হয়েছে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য বড় পদায় দেখানো হচ্ছে। ছবি দেখে দেখে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ডায়ালগ বলবেন, ম্যাগনেটিক ফিতায় সেই শব্দ ধরা হবে। পরে একসঙ্গে জোড়া লাগানো হবে। বিমল বলল, ব্যাপারটা তো খুব ইন্টারেস্টিং। কাগজে-কলমে খুব ইন্টারেস্টিং। তবে কাজ শুরু হলে দেখবে কত ঝামেলা। ঠোঁট মেলানো যায় না। ডায়ালগ যায় একদিকে ঠোঁট নড়ে অন্যদিকে। কাজ শুরু হবে কখন? ম্যাডাম এলেই শুরু হবে। ফরহাদ সাহেব চায়ের কাপ এবং হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আজমল তরফদারের কাছে চলে এলেন। কাজ শুরু হবে। কখন আজমল ভাই? এই তো অল্প কিছুক্ষণ। আপনার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করি? নতুন বই নাকি করছেন? বিগ বাজেট মুভি। হ্যাঁ। স্টোরি লেখা হয়েছে? হচ্ছে। নায়ক-নায়িকা কয় পেয়ার? ওয়ান ওর টু? এখনো কিছুই ঠিক হয় নি। আর্টিস্টের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন? এখনো ভাবি নি। আমার অবশ্য দম ফেলার সময় নেই। হেভি বুকিং। তারপরেও আপনার ব্যাপার অন্য। থ্যাংক য়্যু। আপনার ‘প্ৰেম দেওয়ানা’ও হিট করবে। ডায়ালগ মারাত্মক। হিট ডায়ালগ। ডায়ালগের জন্যে উঠে যাবে…. কথাবার্তার এই পর্যায়ে ডাবিং স্টুডিওর দরজা ফাঁক করে রেশমা তাকাল। আজমল তরফদার ফরহাদ সাহেবের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, রেশমা এস এস। রেশমা পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেল। আজমল তরফদার এরকম অন্তরিক ভঙ্গিতে ডাকবেন ভাবাই যায় না। সে দেরি করে এসেছে বলেই কি রসিকতা করছেন? এখনই কুৎসিত গালি শুরু হবে? হলভর্তি মানুষের সামনে গালি শুনতে এত খারাপ লাগে। তার হাত-পা জমে যাবার মতো হলো। দাঁড়িয়ে আছ কেন, আস? পরিচয় করিয়ে দিই— এ হলো বিমল। বিমলচন্দ্র হাওলাদার। বিমল এর নাম রেশমা। বিমল তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিনীতভাবে সে সালাম দিল। ফরহাদ পর্যন্ত অবাক
false
toslima_nasrin
তোমার। তুমি ঠা ঠা করে হাস, তোমার ঠোঁট, চোখ, গ্রীবা তোমার। তুমি আদ্যন্ত তোমার। তুমি আমূল তোমার। ওই দেখ, ওরা তোমাকে খুবলে খেতে আসছে, ওরা তোমাকে চাখতে আসছে, ছিড়তে আসছে, ওরা মৃত্যুর আরেক নাম। ওরা বীভৎসতার আরেক নাম, ওরা তোমাকে পান করতে আসছে, লেহন করতে আসছে, ওরা তোমাকে দলিত করতে আসছে। ওরা পুরুষ। ওরা মানুষ নয়। নারী তুমি সতর্ক হও । তোমার দিকে ধেয়ে আসা পুরুষেরা মূলত আসে অবাধ কাম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে, কর্তৃত্বের ক্রোধ। এই জগৎ তোমার নারী, এই জগতে তুমি যেমন ইচ্ছে বাঁচ। এই জগৎ যদি একটা নদী হয়, তুমি নদী জুড়ে সাতার কাটো। এই জগৎ যদি একটা আকাশ হয়, তুমি আকাশ জুড়ে ওড়। জীবন যদি তোমার হয়, যা আসলেই তোমার, তবে সেই জীবন তুমি যেমন ইচ্ছে যাপন কর। তোমার কর্তৃত্ব তুমি নাও নারী। আমি মৃত্যু দেখেছি। আমি পাপ দেখেছি, পঙ্ক দেখেছি। আর যেন কোনও নারীকে এত কাটাতার পেরোতে না হয়, শত ছিন্ন হতে না হয়। আর যেন কোনও নারীকে কেবল গন্তব্যে পৌছোবার জন্য পেরোতে না হয় এমন দুর্গম অরণ্য। আর যেন কোনও নারীকে বুনো মোষ এমন না তাড়ায়, আর যেন পুরুষের গুহা থেকে রক্তাক্ত বেরোতে না হয় কোনও নারীকে। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে যে নারী, তাকে বলি বেঁচে থেক। রক্তশূন্যতায় ভুগছে যে নারী, তাকে বলি বেঁচে থেক। যে নারী বন্ধ্যাতে ভুগছে, প্রসব কষ্টে ভুগছে, তাকে বলি বেঁচে থেক। খুব ভোরে দল বেঁধে হেঁটে যাওয়া বস্ত্র বালিকাদের বলি বেঁচে থেক, ঘুটে কুড়োনো কিশোরীকে বলি বেঁচে থেকু, বেঁচে ওঠ নারী। চমৎকার বেঁচে ওঠ। এই আমি সকল দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। এই আমি কোনও অশ্লীলতা ও অসুস্থতার সঙ্গে আপস করিনি। নারী তুমি হাত ধর সুন্দরের, নারী তুমি হাত ধর স্বপ্নের। পূর্বাভাস অনেকে বলে পূর্বাভাস পত্রিকাটি তোমার সঙ্গে এত শক্রতা করল, তারপরও এতে লেখ! ‘শক্রতা’ শব্দটির ব্যাপারে আমি অবশ্য আপত্তি করি না, কারণ একথা সত্য যে একজন লেখককে যে ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়া উচিত—পূর্বাভাস তা দেয়নি—যদিও আমি পূর্বাভাসেরই নিয়মিত লেখক বা কলামিস্ট ছিলাম। এই শক্রতার বিরুদ্ধে আমার করণীয় কিছুই ছিল না, আমার পক্ষে সম্ভব নয় লোক লাগিয়ে পূর্বাভাসের কব্জির হাড় ভেঙে ফেলা, অথবা কষে দুই থাপ্পড় লাগানো। সম্ভব নয় এইজন্য বলছি যে, আমাকে তা মানায় না, আহিরিটোলা থেকে মস্তান জোগাড় করা কোনও মেয়েমানুষের কৰ্ম্ম নয়। আমি কোথাও কোনও মিত্রতার আশা করি না। আমি যদি পথচারী হই, পথে নয়; আমি যদি বধু হই, গৃহে নয়। আমি যদি কর্মী হই, কর্মক্ষেত্রে নয়। আমি যদি লেখক হই, পত্রিকায় নয়। মিত্রতার আশা করা নেহাত বোকামো ছাড়া কিছু নয় জানি। কারণ মেয়ে জাতীয় মানুষগুলো নিতান্তই ব্যবহারের জিনিস। যতক্ষণ এরা ব্যবহার উপযোগী, ততক্ষণ কদর। কাঠে ঘুণ ধরলে, লোহয় মরচে ধরলে—সেই কাঠ বা লোহার কদর আর তেমন থাকে না। তেমনি মেয়ে নামক দ্রব্য যখন অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে ব্যবহারের, সেও কাঠ বা লোহার মত, জুতো বা জামার মত নিক্ষিপ্ত হয়। নিক্ষিপ্ত হওয়াই সম্ভবত মেয়েদের নিশ্চিত নিয়তি। আর তাই হলে মান-মর্যাদা, শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি দামি ব্যাপারগুলো যত প্রতিভাবান মেয়েই হোক, দাবি করতে পারে না। তাই পূর্বাভাসের আশোভন আচরণেও আমি নীরব থেকেছি। নীরব থাকবার একটিই কারণ যত বড় কলামিস্টই হই না কেন, আমি মেয়ে। আমার মেয়ে নামের পরিচয়টিই সব ফুড়ে, সব ভেঙে উজিয়ে ওঠে। যেহেতু মানুষের ইতিহাসে নেই, চরিত্রে নেই, নীতি ও নিয়মে নেই যে মেয়েরা মূলত মানুষ, সে যখন আইনজীবী—আইনজীবীই, সে যখন চিকিৎসক—চিকিৎসকই, সে যখন লেখক–লেখকই। তাই ওই উজিয়ে ওঠা ‘মেয়ে’, ওই প্রধান এবং একমাত্র ‘মেয়ে’ পরিচয় নিয়ে সকলে ধুন্ধুমার নেচে ওঠে। পূর্বাভাস সকলের চেয়ে পৃথক কিছু নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, বাইরে নেই। যতক্ষণ অন্যের সম্পদ হিসেবে সে অন্যের স্বার্থসাধন করবে—ততক্ষণ তার স্তুতি গাইবে লোকে, নিরাপত্তার নামে তাকে আবৃত করবে, আড়াল করবে। মুঠো খুলে বেরোতে চাইলেই ফুসে ওঠে স্ততিকারিরাই, মুখোশ ছিড়ে বেরিয়ে পড়ে তাদের আসল আদল। নারী এই মুখোশগুলো চেনে না। নারী এই মুখোশগুলোকে বার বার প্রকৃত মুখ বলে ভুল করে। কারও ছায়ায় নারী নিজেকে নিরাপদ ভেবে ভুল করে। নারী ভুলে যায় পুরুষ কোনও বৃক্ষ নয়, যে কেবল ছায়াই দেবে। পুরুষের ছায়ার ছুতোয় শেকড় বাড়িয়ে নারীর রূপরস শোষণ করে, নারীর গুণগন্ধ শোষণ করে। অনেকে বলে—আপনার লজ্জা হয় না পূর্বাভাসে লিখতে, যে পূর্বাভাস আপনাকে এমন ডোবাল। ডুবিয়েছে যে একথা অস্বীকার করি না। এ জগতে নারী হচ্ছে জীবন্ত খড়কুটো, কেউ ইচ্ছে করলে তাকে ডোবাতে পারে, ইচ্ছে করলে ভাসাতেও পারে। আজ তাকে এ ডোবাবে, কাল ও ডোবাবে, কেউ আবার করুণা করে একদিন তাকে হঠাৎ ভাসাবে। নারী তো নিজের নিয়ন্ত্রক নয়। ডুবে-ভেসে তাকে পার করতে হয় জলজ জীবন। হ্যাঁ লজ্জা হয় আমার, তবে নিজের জন্য নয়, লজ্জা হয় ওদের জন্য যারা যখন খুশি নারীকে ডোবায়-ভাসায়, মূলত নারীকেই। লজ্জা হয় ওই প্রগতিবাদিদের জন্য, যারা সামাজিক শৃঙ্খল ছিড়ে বেরিয়ে আসা প্রগতির পক্ষের নারীকেই পুনরায় পণ্য করে তোলে, লজ্জা হয় ওদের জন্য, যারা নিজেরাও একবার নিজেদের কৃতকর্মে লজ্জিত হয় না। আমাকে কেউ সম্মান দেবে কি না দেবে সে আমার ভাববার বিষয় নয়। এই সমাজ-প্রদত্ত ঠুনকো সম্মানের জন্য যদি আমি প্রাণ পেতে বসে থাকি—সে আমারই
false
toslima_nasrin
কেন? তাকে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, কামালকে তো পালাতে হয় না? এই দেশ কামালের যতটুকু, সুরঞ্জনেরও ঠিক ততটুকু। নাগরিক অধিকার দুজনের সমান হবারই কথা। কিন্তু কামালের মত সে কেন উদ্ধত দাঁড়াতে পারে না! সে কেন দাবি করতে পারে না আমি এই মাটির সন্তান, আমার যেন কোন আমার যেন কোনও অনিষ্ট না হয়! সুরঞ্জন শুয়েই থাকে, ওঠে না। মায়া এঘরে ওঘরে অস্থির হাঁটে। বোঝাতে চায় কিছু একটা ঘটে গেলে পরে দুঃখ করে লাভ নেই। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে স্তব্ধ বসে আছেন সুধাময় আর কিরণময়ী। তাঁরাও ভাবছেন সুরঞ্জয় বুঝি এবারও নব্বই-এর অক্টোবরের মত কোনও মুসলমান বাড়িতে তাঁদের লুকোতে নেবে। কিন্তু আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুরঞ্জনের। সারাদিন শুয়েই কাটাবে সে ভাবে। কামাল বা কেউ নিতে এলে বলবে–‘বাড়ি ছেড়ে যাবো না, যা হয় হোক।’ আজ ডিসেম্বরের সাত তারিখ। গতকাল দুপুরে অযোধ্যার সরযূ নদীরে তীরে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করসেবকরা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তিনটি গুম্বুজসহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরং দলের সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পি এ সি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের নৃশংস কাণ্ড দেখে। দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে একটি গম্বুজ ভাঙা হয়, চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটে পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজও ভেঙে ফেলে উম্মত করসেবকরা। সৌধ ভাঙতে গিয়ে চারজন করসেবক ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। সুরঞ্জন শুয়ে শুয়েই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোয়। আজ ব্যানার হেডিং–‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত।’ সে অযোধ্যায় যায়নি। বাবরি মসজিদ দেখেনি। দেখবে কী করে, দেশের বাইরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি। রাম কোথায় জন্মেছিল, আর তার কোন মাটি ফুঁড়ে মসজিদ গজিয়েছে এসব তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। তবে ‘ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে যে কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত; সমগ্র কল্যাণবোধের ওপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত’–এ কথা সে মানে। ‘বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ নিয়ে হয়ে যাবে প্রচণ্ড তাণ্ডব। মন্দিরগুলো ধুলিস্যাৎ হবে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়বে, দোকানপাট লুট হবে। বি জে পি-র উস্কানিতে করসেবকেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে এ দেশের মৌলবাদী দলকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করছে। বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগীরা কি তাদের উন্মত্ত আচরণের জের কেবল ভারতের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে ভেবেছে? ভারতে শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মরছে পাঁচশ ছশ একহাজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দুর স্বার্থরক্ষকরা কি জানে দু থেকে আড়াই কোটি হিন্দু এই বাংলাদেশে আছে? শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু রয়েছে, তাদের কী দুর্দশা হবে হিন্দু মৌলবাদিরা একবার ভেবেছে? রাজনৈতিক দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির জানা উচিত ভারত কোনও বিচ্ছিন্ন জম্বুদ্বীপ নয়। ভারতে যদি বিষফোঁড়ার জন্ম হয় তার যন্ত্রণা শুধু ভারতই ভোগ করবে না, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে, অন্তত প্রতিবেশী দেশে তো সবার আগে।’ সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তার গা ধাক্কা দিয়ে মায়া বলে–তুমি উঠবে কি না বল। বাবা মা তোমার ভরসায় বসে আছেন। সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে–তোর ইচ্ছে হলে তুই চলে যা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না। –আর ওঁরা? –জানি না। –যদি কিছু হয়? –কী হবে! –ধর, বাড়ি লুট করল। পুড়িয়ে ফেলল। –ফেলবে। –তুমি তার পরও বসে থাকবে? –বসে না, শুয়ে থাকব। সুরঞ্জন খালি পেটে একটা সিগারেট ধরায়। তার চায়ের তেষ্টা পায়। কিরণময়ী সকালে এক কাপ চা তাকে দেন, আজ দিচ্ছেন না। এ সময় তাকে কে দেবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। মায়াকে বলা বৃথা। পালাবার কথা ছাড়া আপাতত মেয়েটি কিছুই ভাবছে না। চা বানাতে বললে ওর গলা আবারও সপ্তমে চড়বে। সে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতে অয়ারে, কিন্তু আলস্য তাকে ছাড়ছে না। ওঘরে টেলিভিশন চলছে। তার ইচ্ছে হয় না সি এন এন-এর সামনে চোখ গোল গোল করে বসে থাকতে। ওঘরে খানিক পর পর মায়া চেঁচিয়ে উঠছে–দাদা শুয়ে আছে, পেপার পড়ছে, তার কোনও হুঁশ নেই। হুঁশ সুরঞ্জনের নেই এ কথা ঠিক নয়। সে ঠিকই বোঝে যে কোন সময় দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে একদঙ্গল লোক, তাদের কতক চেনা কতক অচেনা, তারা বাড়ির জিনিপত্র ভাঙবে, লুট করবে, আর যাবার সময় বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেবে। এ অবস্থায় কামাল বা হায়দারের বাড়িতে উঠলে কেউ বলবে না আমাদের জায়গা নেই। কিন্তু তার খুব লজ্জা হয় যেতে। মায়া চেঁচাচ্ছে–তোমরা না যাও আমি একাই তবে চলে যাই। পারুলের বাড়ি গিয়ে বসে থাকি। দাদা কোথাও নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার না হয় বেঁচে থাকার দরকার নেই, আমার আছে। মায়া ধারণা করছে সুরঞ্জন যে কারণেই হোক আজ কারও বাড়িতে তাদের লুকোতে নেবে না। অগত্যা সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি সুরঞ্জনকে ভোগায় খুব। নিরাপত্তা নব্বই-এর অক্টোবরেও ছিল না। ঢাকেশ্বরী মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দিল একদল লোক। পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, বাধা দিল না। পুড়ে গেল মূল মন্দির, ওরা ধ্বংস করে
false
nazrul
হয় না। তাতে আমার ধাত তো তোর জানা আছে, – যখন লিখি তখন খুবই লিখি, আবার যখন লিখি নে তখন একেবারে গুম। তুই আমার অভিমানের কথা লিখেছিস, কিন্তু ওই মেয়েলি জিনিসটার সঙ্গে আমার বিলকুল পরিচয় নেই। আর তারহীন বার্তাবহের সন্দেশ বলে বেশি লাফালাফি করতে হবে না তোকে, ও সন্দেশওয়ালার নাম আমি চোখ বুঁজেই বলে দিতে পারি। তিনি হচ্ছেন, আমার সহধর্মিণী-সহোদর শ্রীমান মনুয়র! দেখেছিস আমার দরবেশি কেরামতি! তুই হচ্ছিস একটি নিরেট আহাম্মক, তা না হলে ওর কথায় বিশ্বাস করিস? হাঁ, তবে একদিন কথায় কথায় তোকে কাঠখোট্টা বলে ফেলেছিলাম বটে! কিন্তু তোর এখনকার লেখার তোড় দেখে আমার বাস্তবিকই অনুশোচনা হচ্চে যে, তোকে ওরকম বলা ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। এখন আমার ইচ্ছে হচ্চে, তোর ঘাড়ে কিছু ভয়ানক রকমের উপাধিব্যাধি চড়িয়ে দি, কিন্তু নানান ঝঞ্ঝাটে আমার বুদ্ধিটা আজ মগজে এমন সাংঘাতিক রকমে দৌড়ে বেড়াচ্ছে যে, তার লাগামটি কষে ধরবারও জো-টি নেই!… এই হয়েছে রে, – হ – য়ে – ছে! – ইতিমধ্যে পাশের ঘরে মুড়ো ঝ্যাঁটাহস্তে দুটো ঝি-এর মধ্যে কোঁদল ‘ফুল ফোর্সে’ আরম্ভ হয়ে গেছে। – বুঝেছিস, এই মেয়েদের মতো খারাব জানোয়ার আর দুনিয়ায় নেই। এরা হচ্ছে পাতিহাঁসের জাত। যেখানেই দু-চারটে জুটবে, সেখানেই ‘কচর কচর বকর বকর’ লাগিয়ে দেবে। এদের জ্বালায় ভাবুকের ভাবুকতা, কবির কল্পনা এমন করুণভাবে কর্পূরের মতো উবে যায় যে, বেচারিকে বাধ্য হয়ে তখন শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট একটি বিশেষ লম্বকর্ণ ভারবাহীর মতোই নিশ্চেষ্ট ভ্যাবাকান্ত হয়ে পড়তে হয়। গেরো –গেরো! দুত্তোর মেয়েমানুয়ের কপালে আগুন! এরা এ ঘর হতে আমায় উঠাবে তবে ছাড়বে দেখছি। অতএব আপাতত চিঠি লেখা মুলতবি রাখতে হল ভাই। আমার ইচ্ছে হয়, এই মেয়েগুলোকে গোরু-খেদা করে খেদিয়ে তেপান্তরের মাঠে ঠেলে উঠাই গিয়ে। ওঃ, সব গুলিয়ে দিলে আমার! (দুপুরবেলা) বাপ রে বার! বাঁচা গেছে! – ঝি দুটোর মুখে ফেনা উঠে এইমাত্র তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। অতএব কিছুক্ষণের জন্য মাত্র সে ঝগড়াটা ধামাচাপা আছে। এই অবসরে আমিও চিঠিটা শেষ করে ফেলি। নইলে, ফের জেগে উঠে ওরা যদি ধামাচাপা ঝগড়াটার জের চালায় তা হলেই গেছি আর কী! অনেক সময় হয়তো আমার কাজে কথায় একটু মুরুব্বি ধরনের চাল অলক্ষিতেই এসে পড়ে। আর তোর মতো চিরশিশু মনের তাতেই ঠেকে হোঁচট খেযে ভ্যাবা-চ্যাকা লেগে যায়, নয়? কিন্তু আমার এদিন ছিল না, আমার মনে তোরই মতো একটি চিরশিশু জাগ্রত ছিল রে, সে আজ বাঁধা পড়ে তার সে সরল চঞ্চলতা আর আকুলতা ভুলে গিয়েছে। তাই বড়ো দুঃখে আমার সেই মনের বনের হরিণশিশু জলভরা চোখে আকাশের মুক্ত নীলিমায় চেয়ে দেখে, আর তার এই সোনার শিকলটায় করুণভাবে ঝংকার দেয়।… যাক ওসব কথা। তোকে একটা নীরস তত্ত্বকথা শুনাতে চাই এখানে, সেইটাই মন দিয়ে শোন। – মানুষ যতদিন বিয়ে না করে, ততদিন তার থাকে দুটো পা। সে তখন স্বচ্ছন্দে যে কোনো দ্বিপদ প্রাণীর মতো হেঁটে বেড়াতে পারে, মুক্ত আকাশের মুক্ত পাখির মতো স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতেও পারে; – কিন্তু যেই সে বিয়ে করলে, অমনি হয়ে গেল তার দু-জোড়া বা এক গণ্ডা পা। কাজেই সে তখন হয়ে গেল একটি চতুষ্পদ জন্তু। বেচারার তখন স্বাধীনভাবে বিচরণ করবার ক্ষমতা তো গেলই (কারণ চার-চারটে পা নিয়ে তো কোনো জন্তুকে উড়তে দেখলাম না!) অধিকন্তু সে হয়ে পড়ল একটা স্থাবর জমি-জমারই মতো। একেবারে মাটির সঙ্গে ‘জয়েন’! তারপর দৈবক্রমে যদি একটি সন্তান এসে জুটল, তাহলে হল সে একটি ষটপদ মক্ষিকা – সর্বদাই আহরণে ব্যস্ত। আর একটি বংশবৃদ্ধি হইলেই – অষ্টপদ পিপীলিকা; দিন নেই, রাত নেই – ছোটো শুধু আহারের চেষ্টায়। তারপর, এই বংশবৃদ্ধি যখন বংশ-ঝাড়েরই মতো চরম উন্নতি লাভ করল, অর্থাৎ কিনা নিতান্ত অর্বাচীনের মতো গিন্নি যখন এক বস্তা সন্তান প্রসব করে ফেললেন, বেচারা পুরুষ তখন হয়ে গেল একেবারে বহুপদবিশিষ্ট একটি অলস কেন্নো! বেশ একটা হতাশ – নির্বিকার ভাব! কোনো বস্তু নেই – ছুঁইলেই জড়সড়। আমার এত দূর উন্নতি না হলেও যখন আল্লার নাম নিয়ে শুরু হয়েছে রে ভাই, তখন কি আর একে আগড় দিয়েও ঠেকানো যাবে! এ রকম অবস্থায় পড়লে সে সত্যি সত্যিই ‘সবারই মত বদলায়!’… তারপর, ওরে ছ্যাঁচা ঝিনুক! তুই যে অত করে নিজকে লুকিয়ে রাখতে চাস সমুদ্দুর, না ডোবার ভিতরে, কিন্তু পারবি কি! আমি যে এঁটেল ‘লটে-ছ্যাঁচড়’ ডুবুরি! তুই পারস্যোপকূলের সমুদ্রের পাঁকে গিয়ে লুকোলেও এ ডুবুরির হাত এড়াতে পারিবি নে, জেনে রাখিস। মানিক কি কখনও লুকানো যায় রে আহাম্মক? খোশবুকে কি রুমাল চাপা রাখা যায়?… হায় কপাল, এই কুড়ি-একুশ বছর বয়সে তোর মতো উদাসীনরা আবার সংসারের কী বুঝবে? শুধু কবির কল্পনায় তোরা সংসারকে ভালোবাসিস, এখানের যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর কেবল তাই তোদের স্বচ্ছ প্রাণে প্রতিফলিত হয়, তাই তোদের সঙ্গে আমাদের দুনিয়াদার লোকের কিছুতেই পুরোমাত্রায় খাপ খায় না। এক জায়গাতে একটু ফাঁক থাকবেই থাকবে, তা আমরা যতই মিশ খাওয়াতে চেষ্টা করি না! কারণ, বড়ো কঠিনভাবে দুনিয়ার – বাস্তব জগতের নিষ্ঠুর সত্যগুলো আমাদের হাড়ে হাড়ে ভোগ করতে হয়! তোরা কল্পনারাজ্যের দেবশিশু, বনের চখা-হরিণ, আর আমরা, বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসে-গড়া মানব, খাঁচার পাখি! – এইখানেই যে ভাই মস্ত আর আদত বৈষম্য! কোনো ফরাসি লেখক বলেছেন যে, খোদা মানুষকে বাক্‌শক্তি দিয়েছেন শুধু মনকে গোপন করবার জন্যে। আর এ একেবারে নিরেট সত্য কথা। তাই
false
shottojit_roy
ঝুঁকেছিল। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে জানালা দিয়ে লাফিয়ে…ওঃ হরিব্‌ল্‌, হরিব্‌ল্‌!’ ফণী ডাক্তার বললেন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনাকে একটু ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। আপনার কম্‌প্লিট রেস্টের দরকার।’ ফণীবাবু উঠে পড়লেন। ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘ফণীবাবু কাল রাত্রে রুগি দেখতে গেস্‌লেন বুঝি? কোটের পিছনে কাদার ছিটে লাগল কী করে?’ ফণীবাবু তেমন কিছু না ঘাবড়িয়ে বললেন, ‘ডাক্তারের লাইফ তো জানেনই–আর্তের সেবায় যখন জীবনটাই উৎসর্গ করিচি, তখন ডাক যখনই আসুক না কেন, বেরোতেই হবে। সে ঝড়ই হোক, আর বৃষ্টিই হোক, আর বরফই পড়ুক।’ ফণীবাবু তাঁর পাওনা টাকা নিয়ে চলে গেলেন। রাজনবাবু এবার সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘তোমরা আসাতে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেস্‌লুম, জানো। এবার বোধহয় বৈঠকখানায় গিয়ে একটু বসা চলতে পারে।’ ফেলুদা আর তিনকড়িবাবু হাত ধরাধরি করে রাজেনবাবুকে বৈঠকখানায় এনে বসালেন। তিনকড়িবাবু বললেন, ‘স্টেশনে ফোন করেছিলুম যদি যাওয়াটা দু দিন পেছোনো যায়। রহস্যের সমাধান না করে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু ওরা বললে এ-টিকিট ক্যানসেল করলে দশ দিনের আগে বুকিং পাওয়া যাবে না।’ এটা শুনে আমার ভালই লাগল। আমি চাইছিলাম ফেলুদা একাই ডিটেক্‌টিভের কাজটা করুক। তিনকড়িবাবু যেন ফেলুদার অনেকটা কাজ আগে-আগেই করে দিচ্ছিলেন। রাজেনবাবু বললেন, ‘আমার চাকরটার পাহারা দেবার কথা ছিল, কিন্তু আমি নিজেই কাল দশটার সময় তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। ওর বাড়িতে খুব অসুখ। বুড়ো বাপ আছে, তার এখন-তখন অবস্থা।’ ফেলুদা বলল, ‘মাস্কটা কেমন ছিল মনে আছে?’ রাজেনবাবু বললেন, ‘খুবই সাধারণ নেপালি মুখোশ, দার্জিলিং শহরেই অন্তত আরও তিন-চার শ’ খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। আমার এই ঘরেই তো আরও পাঁচখানা রয়েছে–ওই যে, দ্যাখো-না।’ রাজেনবাবু যে মুখোশটার দিকে আঙুল দেখালেন, ঠিক সেই জিনিসটা কাল ফেলুদা আমার জন্য কিনে দিয়েছে। তিনকড়িবাবু এতক্ষণ বেশি কথা বলেননি, এবার বিওললেন, ‘আমার মনে এবার বোধহয় পুলিশে একটা খবর দেওয়া উচিত। একটা প্রোটেক্‌শনেরও তো দরকার। কাল যা ঘটেছে, তার পরে তো আর ব্যাপারটাকে ঠাট্টা বলে নেওয়া চলে না। ফেলুবাবু, তুমি তোমার নিজের ইচ্ছে মত তদন্ত চালিয়ে যেতে পারো, তাতে তোমায় কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু আমি সব দিক বিবেচনা করে বলছি, এবার পুলিশের সাহায্য নেওয়া দরকার। আমি বরং যাই, গিয়ে একটা ডায়েরি করে আসি। প্রাণের ভয় আছে বলে মনে হয় না, তবে রাজেনবাবু, আপনার ঘণ্টাটা একটু সাবধানে রাখবেন।’ আমরা যখন উঠছি, তখন ফেলুদা রাজেনবাবুকে বলল, ‘তিনকড়িবাবু তো চলে যাচ্ছেন। তার মানে আপনার একটি ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি আজ রাতটা ও ঘরে এসে থাকি, তা হলে আপনার কোনও আপত্তি আছে কি?’ রাজেনবাবু বললেন, ‘মোটেই না। আপত্তি কি? তুমি তো হলে আমার প্রায় আত্মীয়ের মতো। আর সত্যি বলতে কী, যতো বুড়ো হচ্ছি তত যেন সাহসটা কমে আসছে। ছেলেবয়সে দুরন্ত হলে নাকি বুড়ো বয়সে মানুষ ম্যাদা মেরে যায়।’ তিনকড়িবাবুকে ফেলুদা বলল স্টেশনে ওঁকে ‘সি-অফ’ করতে যাবে। ফেরার পথে যখন নেপাল কিউরিও শপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন আমাদের দুজনেরই চোখ গেল দোকানের ভিতর। দেখলাম দুজন ভদ্রলোক দোকানের ভিতর জিনিসপত্র দেখছে আর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। দেখে মনে হয় দুজনের অনেক দিনের আলাপ। একজন অবনী ঘোষাল, আর একজন প্রবীর মজুমদার। আমি ফেলুদার দিকে চাইলাম। তার মুখের ভাব দেখে মনে হল না সে কোনও আশ্চর্য জিনিস দেখেছে। সাড়ে দশটার সময় স্টেশনে গেলাম তিনকড়িবাবুকে গুড বাই করতে। উনি এলেন আমাদেরও পাঁচ মিনিট পরে। ‘চড়াই উঠে উঠে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে তাই আস্তে হাঁটতে হল।’ সত্যিই ভদ্রলোক একটু খোঁড়াচ্ছিলেন। নীল রঙের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠে তিনকড়িবাবু তাঁর অ্যাটাচিকেস খুলে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট ফেলুদাকে দিলেন। ‘এটা কিনতেও একটু সময় লাগল। রাজেনবাবু তো আর কিউরিওর দোকানে যেতে পারলেন না, অথচ কাল সত্যিই অনেক ভাল জিনিস এসেছে। তার থেকে একটি সামান্য জিনিস বাছাই করে ওঁর জন্য এনেছি। তোমরা আমার নাম করে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওঁকে দিয়ে দিও। ফেলুদা প্যাকেটটা নিয়ে বলল, আপনার ঠিকানা দিয়ে গেলেন না? মিস্ট্রিটা সল্‌ভ করে আপনাকে জানিয়ে দেব ভাবছিলাম যে।’ তিনকড়িবাবু বললেন, ‘আমার প্রকাশকের ঠিকানাটা আমার বইতেই পাবে–তার কেয়ারে লিখলেই চিঠি আমার কাছে পৌঁছে যাবে। গুড লাক!’ ট্রেন ছেড়ে দিল। ফেলুদা আমাকে বলল, ‘লোকটা বিদেশে জন্মালে দারুন নাম আর পয়সা করত। পর পর এতগুলো ভাল রহস্য উপন্যাস খুব কম লোকেই লিখেছে।’ সারা দিন ধরে ফেলুদা রাজেনবাবুর ব্যাপারটা নিয়ে নানান জায়গায় ঘোরাফেরা করল। আমি অনেক করে বলতেও আমাকে সঙ্গে নিল না। সন্ধেবেলা যখন রাজেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছি, তখন ফেলুদাকে বললাম, ‘কোথায় কোথায় গেলে সেইটে অন্তত বলবে তো!’ ফেলুদা বলল, ‘দুবার মাউণ্ট এভারেস্ট হোটেল, একবার ফণী মিত্তরের বাড়ি, একবার নেপাল কিউরিও শপ, একবার লাইব্রেরি, আর এছাড়াও আরও কয়েকটা জায়গা।’ ‘ও।’ ‘আর কিছু জানতে চাস?’ ‘অপরাধী কে বুঝতে পেরেছ?’ ‘এখনও বলার সময় আসেনি।’ ‘কাউকে সন্দেহ করেছ?’ ‘ভাল ডিটেক্‌টিভ হলে প্রত্যেককেই সন্দেহ করতে হয়।’ ‘প্রত্যেককে মানে?’ ‘এই ধর–তুই।’ ‘আমি?’ ‘যার কাছে এই মুখোশ আছে, সে-ই সন্দেহের পাত্র, সে যে-লোকই হোক।’ ‘তা হলে তুমিই বা বাদ যাবে কেন?’ ‘বেশি বাজে বকিস্‌নি।’ ‘বা রে–তুমি যে রাজেনবাবুকে আগে চিনতে, সে কথা তো গোড়ায় বলোনি। তার মানে সত্য গোপন করেছ। আর আমার মুখোশ তো ইচ্ছে করলে তুমিও ব্যবহার করতে পারো–হাতের কাছেই থাকে।’ ‘শাটাপ্‌, শাটাপ্‌!’ রাজেনবাবুকে এ বেলা দেখে তবু অনেকটা ভাল লাগল।
false
nihar_ronjon_gupta
তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কর্তার হুকুম আছে কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়। রাতে শংকর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু। কাল থেকে তা হলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই? হ্যাঁ দিন। দুচার দিনের মধ্যে আমার তো মনে হয়। আর খুনটুন হবে না। শংকর হাসতে হাসতে বললে, আপনি গুণতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু? না, গুণতে ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারিদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান। যাহোক, শংকর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামী কাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয়। সেই আদেশ দিয়ে দিল। বিমলবাবুকঁচুমাচু ভাবে বললে,আবার ঐ ভূতপ্ৰেতগুলোকে চটাবেন স্যার। আমি আপনার , যা দেবেন, তাই করবো। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মতো একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার। ভূতপ্রেতের ব্যাপার। কখন কি ঘটে যায়। শংকর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান সব ব্যবস্থা করুনগে যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু করতে পারে। কিন্তু স্যার। যান যান রাত্রি হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি। বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কী বলুন? আমি আপনাদের বইত নয়। বিমলবাবু চলে গেলেন। বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভলভারটা গুঁজে গায়ে একটা কালো রঙের ফারের ওভারকেট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল। পায়ে চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা গুড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিকে বরাবর চলে গেছে। সুব্রত এগিয়ে চলে, পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতিমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলো, জ্বলে আর নিভে, নিভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমের হাওয়া হিল হিল করে বহে যায়। সর্বাঙ্গ শির শির করে ওঠে। কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে। সুব্ৰত এগিয়ে চলে। অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে। তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীল-কুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধুম্রােচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়। চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, তার শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালু-রাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকে বেঁকে আপনি খেয়াল খুশিতে অদূরবর্তী পলাশ বনের ভিতর দিয়ে বির বির করে কোথায় বহে চলেছে কে জানে? পলাশ বনের উত্তর দিকে ৬ ও ৭ নম্বর কুলি ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশীর আওয়াজ শোনা যায়। সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরা পাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস-সি শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বুকের ভিতরকার হৃদপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল। পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টাৰ্চটা টেনে বের করল। যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোতাম টিপে দিল। অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে। কিন্তু ও কে?…অন্ধকারে পলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁজছে। আশ্চর্য। এই অন্ধকারে পলাশ বনের মধ্যে আমন করে লোকটা কী খুঁজছে? সুব্ৰত এগিয়ে গেল। লোকটা বোধ করি পাগল হবে। এক মাথা বঁকড়া বঁকড়া এলোমেলো বিস্রস্ত জট পাকান চুল। মুখ, ধূলো বালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্ৰী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকেট, শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা ন্যাকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন প্যান্ট। সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না। সুব্রতর কথায় শুকনো ঝরে পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়। এই তুই কে? সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল। লোকটা কেবল হাসে। হাসি যেন আর থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে। সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল। সহসা লোকটা ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু! সুব্ৰত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে। তোর নাম কি? কোথায় থাকিস? আমার নাম রাজা বটে …থাকি উই-যেথা মারাংবরু রইছে। এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস? তাতে তুর দরকারডা কী? যা ভাগ। সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না। সুব্ৰত সেখান থেকে চলে এল। পলাশ বন ছাড়ালেই ৬ নং কুলীর ধাওড়া। রতন মাঝি সেখানেই থাকে। পলাশ ও শালবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলিধাওড়ার সামনে প্ৰজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস। মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে,
false
shordindu
রাজাদের মধ্যে। তাই বলিয়া সকলেই বহু বিবাহ করিতেন না। এক পত্নীতে যাঁহারা সুখী হইতেন তাঁহারা একনিষ্ঠ থাকিতেন। জাতবর্মাও একনিষ্ঠ ছিলেন। জাতবর্মা ও বীরশ্রী দুই মাস আনন্দে কাটাইয়া দিলেন। তারপর ত্রিপুরী হইতে পত্র লইয়া দূত আসিল। যৌবনশ্রীর স্বয়ংবরে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ কন্যা-জামাতাকে আহ্বান করিয়াছেন। জাতবর্মা প্রথমটা ইতস্তত করিয়াছিলেন, শ্বশুর মহাশয়ের ব্যাপারে আবার জড়াইয়া পড়িবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না। কিন্তু বীরশ্রী স্বামীকে শয্যায় পাড়িয়া ফেলিয়া দুই মৃণালভুজে তাঁহার কণ্ঠাশ্লেয করিয়া ধরিলেন, বলিলেন—যৌবনার স্বয়ংবরে যদি আমায় না নিয়ে যাও, জন্মে তোমার সঙ্গে কথা কইব না। এরূপ অবস্থায় কোনও স্বামীই অধিকক্ষণ আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে পারে না, জাতবর্মা তবু বলিলেন—কিন্তু বীরা, ভেবে দেখ, যৌবনশ্রী যদি স্বয়ংবর সভায় আমার গলায় মালা দেয় তখন যে বড় বিপদ হবে। বীরশ্রী মুখ টিপিয়া হাসিলেন—বেশ তো, ভালই হবে। দুই বোনে কেমন একসঙ্গে থাকব। জাতবর্মা বলিলেন—তোমাদের দুই বোনের না হয় ভালই হবে। কিন্তু আমি? একটি বোনকেই সামলাতে পারি না বীরশ্রী স্বামীর মুখের উপর মুখ রাখিয়া চুপিচুপি বলিলেন—ভয় নেই, তোমাকে আমি স্বয়ংবর সভায় যেতে দেব না, ঘরে বন্ধ করে রাখব। সুতরাং রাজী হইতে হইল। মহারাজ বজ্রবর্মাও আপত্তি করিলেন না। যাত্রার উদ্যোগ আয়োজন হইল। বাংলা দেশ হইতে ত্রিপুরী যাইতে হইলে জলপথই প্রশস্ত। স্থলপথে যাইলে অনেক লোকজন সঙ্গে লইতে হয়, জলপথ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। জাতবর্মা নৌকা সাজাইয়া বীরশ্রীকে লইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। বড় নৌকা; চৌদ্দজন নাবিক, দুইজন ভীমকায় দেহরক্ষী সঙ্গে আছে। উপরন্তু খাদ্যাদি অতিরিক্ত বস্তু বহনের জন্য একটি ছোট ডিঙা। নৌকা প্রথমে উত্তরমুখে চলিল, তারপর কজঙ্গলের গিরিসংকট পার হইয়া পশ্চিমমুখী হইল। এখান হইতে মগধের সীমান্ত আরম্ভ। এতদিন গুণবৃক্ষের শীর্ষে রাজকীয় কেতন উড়িতেছিল, মগধে প্রবেশ করিয়া জাতবর্মা কেতন নামাইয়া লইবার আদেশ দিলেন। পররাজ্যে আত্মপরিচয় ঘোষণার প্রয়োজন নাই। মগধে অবশ্য বন্দর নাই, নৌ-সৈন্যের দ্বারা শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা নাই। যে-কালে এখানে অসংখ্য বিশাল রণতরীর সমাবেশ সেতুবন্ধ রামেশ্বরের শৈলশিখরশ্রেণী বলিয়া মনে হইত সে-কাল আর নাই। তবু যথাসম্ভব প্রচ্ছন্নভাবে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাত্রার এক পক্ষ পরে একদিন প্রত্যুষে জাতবর্মার নৌকা পাটলিপুত্র পার হইয়া গেল। আর কয়েক ক্রোশ পরে গঙ্গা-শোণ সঙ্গম; সন্ধ্যার পূর্বেই সেখানে পৌঁছানো যাইবে। একবার শোণ নদে প্রবেশ করিতে পারিলে অনেকটা নিশ্চিন্ত, সম্মুখে মাত্র সাত-আট দিনের পথ বাকি থাকিবে। এ পর্যন্ত অবশ্য নিরুপদ্রবেই আসা গিয়াছে, কিন্তু নারী লইয়া পথে যাত্রা করিলে মনে সর্বদাই চিন্তা লাগিয়া থাকে। এইজন্যই প্রবাদ আছে—পথি নারী বিবর্জিতা। সেদিন দ্বিপ্রহরে দেখা গেল পাটলিপুত্রের ঘাট হইতে একটি নৌকা বাহির হইয়া তাঁহাদের পিছু লইয়াছে। জেলেডিঙি বা খেয়াতরী নয়, বেশ বড় নৌকা। অবশ্য ইহাতে উদ্বিগ্ন হইবার কিছু নাই, নৌকাটি সম্ভবত কাশী বা প্রয়াগ যাইতেছে। সন্ধ্যার মুখে জাতবর্মা শোণের মোহানার কাছে। নৌকা বাঁধিলেন। দুই দণ্ড পরে অস্ফুট চন্দ্রালোকে গা ঢাকিয়া অন্য নৌকাটি নিশাচর পেচকের ন্যায় অদূরে আসিয়া পাল নামাইল। জাতবর্মা মনে মনে খুবই শঙ্কিত হইলেন কিন্তু বাহিরে কিছু প্রকাশ করিলেন না। নাবিক ও রক্ষীরা আপনা হইতেই সতর্ক হইয়াছিল, তাহাদের কিছু বলিতে হইল না। কিয়কাল চিন্তিতভাবে নৌকার পট্টপত্তনের উপর বিচরণ করিয়া জাতবর্মা মুখে প্রফুল্লতা আনিয়া রইঘরে প্রবেশ করিলেন। বীরাকে কিছু বলা হইবে না, সে ভয় পাইতে পারে। রইঘরে দীপ জ্বলিয়াছে। বীরশ্রী আপন হাতে বেণী রচনা করিয়া দর্পণ হস্তে সীমন্তে সিন্দুর পরিতেছেন। সীমন্তে সিন্দুর পরার রীতি তিনি বিবাহের পর শিখিয়াছেন, বঙ্গ-মগধের বাহিরে দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতে সিঁথির সিন্দুর পরার রীতি নাই; বিবাহিতা রমণীরা কণ্ঠে মঙ্গলসূত্র ও ললাটে কুঙ্কমের টিপ পরেন। জাতবর্মা বীরশ্রীর কাছে গিয়া দাঁড়াইলে বীরশ্রী মৃদু হাসিয়া স্বামীর ভূমধ্যে সিন্দুরের ফোঁটা আঁকিয়া দিলেন। জাতবর্মা আপত্তি করিলেন না। তৎকালে স্ত্রী ও পুরুষের প্রসাধন অনেকটা একই প্রকার ছিল; বিলাসী পুরুষেরা অঙ্গদ কুণ্ডল পরিতেন, লাক্ষারসে নখ ও অধর রঞ্জিত করিতেন, চোখে কাজল দিতেন। গলায় হার থাকিত, পায়ে ময়ূরপঙ্খী পাদুকা। জাতবর্মা বাঁশি লইয়া পালঙ্কের পাশে বসিলেন এবং ধীরে ধীরে বাজাইতে আরম্ভ করিলেন। বীরশ্রী আসিয়া তাঁহার কাঁধে মাথা রাখিয়া পাশে বসিলেন, তারপর তাঁহার কণ্ঠ হইতে গানের মৃদু গুঞ্জরন বাহির হইল। দুইজনেই সঙ্গীতবিদ্যায় নিপুণ। নির্জন গঙ্গার তীরে নৌকার দীপালোকিত রতিগৃহে যেন গন্ধর্বলোকের মায়া সৃষ্ট হইল। ছয়। পরদিন প্রাতঃকালে দুই নৌকা প্রায় একই সময় কাছি খুলিয়া যাত্রা শুরু করিল। রাত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে নাই, তাই উভয় পক্ষই নিশ্চিন্ত হইয়াছেন—অপর পক্ষ দস্যু তস্কর নয়। বংগাল দেশের নৌকা আগে আগে শোণ নদে প্রবেশ করিল, তাহার পাঁচ রশি পিছনে বিগ্রহপালের নৌকা। এতক্ষণ তাঁহারা পশ্চিম দিকে চলিতেছিলেন, এখন দক্ষিণ-পশ্চিমে চলিলেন। এই পথে আরও তিন দিন চলিলে মগধের সীমানায় পৌঁছানো যাইবে; তারপর হইতে চেদিরাজ্যের আরম্ভ। সূর্যোদয় হইল। শশাণের স্বর্ণাভ জল কাঁচা রৌদ্রে ঝলমল করিয়া উঠিল। দুইটি নৌকা আগে-পিছে চলিয়াছে। যাত্রীদের মন নিশ্চিন্ত হইয়াছে বটে কিন্তু দুশ্চিন্তার পরিবর্তে কৌতূহল জাগিয়াছে।ওরা কারা? কোথায় যাইতেছে? ওরাও কি ত্রিপুরী যাইবে? না যাইতেও পারে; হয়তো পথে রোহিতাশ্বগড়ে থাকিয়া যাইবে। রোহিতাশ্বগড় শোণ নদের তীরে মগধের দক্ষিণ। সীমান্তের প্রহরী। অনঙ্গপাল নদীতে মাছ ধরার উদ্যোগ করিতেছিল। মাছ না হইলে তাহার চলে না; সে মুগার সূতা, বঁড়শি প্রভৃতি সঙ্গে আনিয়াছিল। এখন নৌকার পিছন দিকে গিয়া বসিল, বঁড়শিতে টোপ গাঁথিয়া দূরে জলের মধ্যে ফেলিয়া সূতা ধরিয়া বসিয়া রহিল। সকালবেলার নরম রৌদ্র বড় মিঠা। বিগ্রহপাল বন্ধুর কাছে আসিয়া বসিলেন। দুইজনে অলস জল্পনা করিতে লাগিলেন। গঙ্গার জল ধূসর, শোণের জল সোনালি কেন? কত জাতের হাঁস চরে বসিয়া
false
humayun_ahmed
আছে। তার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। নারী কণ্ঠ আবারো তীক্ষ্ণ গলায় বললে–আপনি কে? আমার নাম আনিস। আমি এ বাড়ির ভাড়াটে। আপনি কি ভয় পেয়েছেন? হ্যাঁ। ভয়ের কিছু নেই। আমি মানুষ। ভূত কখনো কবিতা বলে না। তাছাড়া ভূতের ছায়া পড়ে না। এই দেখুন। আমার ছায়া পড়েছে। নারীমূর্তি কিছু বলল না। গায়ের চাদর টেনে দিল। তাতে তার মুখ আরো ঢাকা পড়ে গেল। আনিস বলল, আপনি কে জানতে পারি কি? আমার নাম বিলু। আমি এ বাড়ির বড় মেয়ে। ছাদে কি করছেন? কিছু করছি না। টবের গাছগুলো দেখতে এসেছিলাম। মাঝখানে আপনি ভয় দেখিয়ে দিলেন। সত্যি ভয় পেয়েছেন? হ্যাঁ। কেন বলুনতো? বিলু সহজ গলায় বলল, রহিমার মার ধারণা এ বাড়ির ছাদে না-কি ভূত আছে। সে প্রায়ই দেখে। আপনাকে হঠাৎ দেখে… আচ্ছা যাই। বিলু সিঁড়ির দিকে রওনা হল। আনিস বলল, আপনার টবের গাছ দেখা হয়ে গেল? হ্যাঁ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। আপনার আরো কিছুক্ষণ ছাদে থাকার ইচ্ছা! ছিল, আমার কারণে চলে যাচ্ছেন। আপনার ধারণা ঠিক না। আমার শীত শীত লাগছে। তাছাড়া অনেকক্ষণ ছাদে ছিলাম। আনিস সহজ গলায় বলল, আপনাকে ভয় দেখানোর জন্যে দুঃখিত। বিলু হেসে ফেলল। বেশ শব্দ করে হাসল। আনিস হাসি শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এই হাসি তার পরিচিত। এ জীবনে অনেকবার শুনেছে। রেশমা এম্‌নি করেই হাসত, কিশোরীদের ঝনঝনে গলা, যে গলায় একই সঙ্গে আনন্দ এবং বিষাদ মাখানে। বিলু বলল, যাই কেমন? আনিস দ্বিতীয়বার চমকাল। রেশমাও কোথাও যাবার আগে মাথা কাত করে বলত, যাই কেমন? যেন অনুমতি প্রার্থনা করছে। যদি অনুমতি পাওয়া না যায় তাহলে যাবে না। বিলু। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সিঁড়ির মাথায় মূর্তির মত আনিস দাঁড়িয়ে। সে ফিসফিস করে বলল, আলোটুকু তোমায় দিলাম। ছায়া থাক আমার কাছে। তার ভাল লাগছে না। কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছে। অনেক অনেক দূরের দেশ থেকে যেমন হঠাৎ রেশমা উঠে এল। এ কেমন করে হয়? যে চলে গেছে সে আর আসে না। মানুষের কোন বিকল্প হয় না। কি যেন কথাগুলো? এ পৃথিবী একবার পায় তারে কোন দিন পায় নাকো আর, লাইনগুলো কি ঠিক আছে না ভুল-টুল কিছু হল? এমদাদ এবং তার নাতনীকে থাকার জন্যে যে ঘরটা দেয়া হয়েছে সে ঘর এমন্দাদের খুবই পছন্দ হল। সে তিনবার বলল, দক্ষিণ দুয়ারী জানালা লক্ষ্য করে দেখ। ঘুম হবে তোফা। পুতুল শুকনো গলায় বলল, ঘুম ভাল হইলেই ভাল। আরাম কইরা ঘুমাও। খাটিও দুইটা আছে। একটা তোর একটা আমার। ব্যবস্থা ভালই। কি কস পুতুল? পুতুল চুপ করে রইল। এমদাদ বলল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম বুঝলি। কিছুই বলা যায় না। যদি চাকর বাকরের ঘর দিয়া বসে। দিয়া বসতেও তো পারে। মানী লোকের মানতো সবাই দেখে না। আরে আরো কারবার দেইখ্যা যা। ঘরের লগে পেসাবখানা। এলাহী কারবার। আনন্দে এমদাদের মুখ ঝলমল করছে। শুধু পুতুল মুখ কাল করে রেখেছে। কিছুতেই তার মন বসছে না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হবার কষ্ট ও যন্ত্রণা সে তার ক্ষুদ্র জীবনে অনেকবার ভোগ করেছে। এখন আবার শুরু হল। ইচ্ছা মৃত্যুর ক্ষমতা যদি মানুষের থাকতো তাহলে বড় ভাল হত। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হত না। ७ श्रृंङ्गल। কি দাদাজান? ঘর ভালই দিছে ঠিক না? হুঁ। এখন খেয়াল রাখবি সবের সাথে যেন ভাল ব্যবহার হয়। যে যা কয় শুনবি আর মুখে বলবি— জ্বি কথা ঠিক। এই কথার উপরে কথা নাই। গেরাম দেশে লোক বলে মুখের কথায় চিড়া ভিজে না–মিথ্যা কথা, মুখের কথায় সব ভিজে। তোর মুখ এমন শুকনা দেহায় ক্যানরে পুতুল? এইখানে কদিন থাকবা? আসতে না আসতেই কদিন থাকবা? থাকা না থাকা নিয়া তুই চিন্তা করবি না। এইটা আমার উপড়ে ছাইড়া দে। যা হাত মুখ ধুইয়া আয় চাইরডা দানাপানি মুখে দেই। এই বাড়ির খাওয়া খাদ্যও ভাল হওনের কথা। এমন্দাদের আশঙ্কা ছিল হয়ত চাকর বাকিরদের সঙ্গে মেঝেতে পাটি পেতে খেতে দেবে। যদি দেয় তাহলে বেইজাতির সীমা থাকবে না। দেখা গেল খাবার টেবিলেই খেতে দেয়া হয়েছে। বাড়ির কত্রী স্বয়ং তদারক করছেন। চিকন চালের ভাত, পাবদা মাছ, একটা সজি, মুগের ডাল। খাওয়ার শেষে পায়েস। তোফা ব্যবস্থা। মিনু বললেন, পেট ভরেছে তো এমদাদ সাহেব? ঘরে যা ছিল তাই দিয়েছি। নতুন কিছু করা হয়নি। কোন অসুবিধা হয় নাই। শুধু একটু দৈ থাকলে ভাল হইত। খাওয়ার পর দৈ থাকলে হজমের সহায়ক হয়। তার উপর আপনার ছোটবেলা থাইক্যা খাইয়া অভ্যাস। ভবিষ্যতে আপনার জন্য দৈায়ের ব্যবস্থা রাখব। আলহামদুলিল্লাহ্। এখন মা জননী অবস্থা পইড়া গেছে। একটা সময় ছিল খোন্দকার বাড়ির সামনে দিয়া লোকজন ছাতা মাথায় দিয়া যাইত না। নিয়ম ছিল না। জুতা খুইল্যা হাতে নিতে হইত বুঝলেন মা জননী। তাই বুঝি! জি। এবার কি হইল শুনেন মা জননী। খোন্দকার বাড়ির সামনে দিয়ে এক লোক যাইতেছে হঠাৎ খ্যক করে কােশ ফেলল। সাথে সাথে দারোয়ান ঘাড় ধরে নিয়া আসল–বলল হারামজাদা এত বড় সাহস। খোন্দকার বাড়ির সামনে কাশ ফেলস। নাকে খত দে। মাটিতে চাটা দে–তারপরে যা যেখানে যাবি। পুতুলের এইসব কথা শুনতে অসহ্য লাগে। না শুনেও উপায় নেই। দাদাজান যেখানে যাবে সেইখানেই এইসব বলবে। পুতুলের ধারণা সবই মিথ্যা কথা। সে খাওয়ার মাঝ পথে উঠে পড়ল। এমন্দাদের তাতে সুবিধাই হল। সে
false
humayun_ahmed
সে পুলিশের কাছে ধরা দিবে। তবে আপনি যে ছেলেকে বোরকা পরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাখছেন তা ঠিক না। আপনার দুই সঙ্গীও বিষয়টা জানে। এটাও ঠিক না। ছেলে এমন জায়গায় থাকবে যে আপনি ‘াড়া আর কেউ জানবে না। হাজি সাহেব বললেন, আমার এমন কোনো জায়গা নাই। শিলচরে আমার খালাত ভাই থাকে। ছেলে সেখানে যেতে রাজি না। আপনি কোথায় থাকেন? আমি হোটেলে উঠেছি। হোটেলের নাম ‘আল হেলাল। আপনার ছেলেও আপনার সঙ্গে থাকে? জি। আপনার দুই সঙ্গীকে না জানিয়ে ছেলেকে আমার এখানে দিয়ে যাবেন। সে মামার এখানে লুকিয়ে থাকবে। আপনি একা পারবেন না। আমার পাংখাপুলার রশিদকে পাঠাব। সে অতি বিচক্ষণ। আমার এখানে ছেলেকে রাখতে আপনার আপত্তি আছে? হাজি সাহেব বললেন, জি-না জনাব। ছেলের মত আছে কি না একটু জেনে নেই। হাবীব কঠিন গলায় বললেন, আপনার ছেলের মতামত বলে এখন কিছু নাই। যেদিন মামলার রায় হয়ে যাবে, হাইকোর্ট থেকে আপিলের ফলাফল হাতে আসবে, তখন তার মতামত শুরু হবে। হাজি সাহেব বললেন, আমি খবর নিয়েছি অনেক খুনের আসামিকে আপনি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। আমার ছেলেকে কি ছাড়িয়ে আনতে পারবেন? হাবীব বললেন, ছেলে যদি বলে আমি খুন করেছি তাহলে ছাড়িয়ে আনতে পারব না। তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। এই প্রথম হাসান রাজা চৌধুরী মুখ খুলল। সে শান্ত গলায় বলল, আমি মিথ্যা কথা বলব না। হাবীব বললেন, তাহলে তো বাবা আমার কাছে খামাখা এসেছ। সত্যি কথা বলে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ো। তোমাকে আমি একটা কথা বলি, তুমি কঁসিতে ঝুলিলে আমার কিছু যায় আসে না। আবার তুমি খালাস পেয়ে নৌকাবাইচ খেললেও কিছু যায় আসে না। বুঝেছ? হাসান বলল, জি। হাবীব বললেন, আমার অনুমানশক্তি ভালো। তুমি খুনটা কেন করেছ সেটা আমি অনুমান করতে পারি। বলব আমার অনুমান? হাসান বলল, না। হাবীব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, চিন্তাভাবনা করে ঠিক করুন কী করবেন? হাজি সাহেব বললেন, আপনি কি চলে যাচ্ছেন। হাবীব বললেন, জি। গভর্নর মোনায়েম খানকে আজ বার কাউন্সিল থেকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি বার কাউন্সিলের প্রধান। সময় ১৯৬৮, এশিয়ার লৌহমানব বলে স্বীকৃত আয়ুব খান হাসি হাসি মুখে পাকিস্তানের সব ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই পাকিস্তানেই তার উন্নয়নের দশ বছর পালিত হচ্ছে। বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংহতি আরও প্রবল করার বাসনায় তিনি এক সভায় ঘোষণা করলেন, বাংলা-উর্দু মিলিয়ে এক নতুন ভাষা পাকিস্তানে তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতের পাকিস্তানিরা এই ভাষাতেই কথা বলবে। সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করল বাংলা বর্ণমালা লিখন রীতির সংস্কার করা প্রয়োজন।(১) পূর্বপাকিস্তানে মোনায়েম খান নামের একজনের রাজত্বকাল। তার উত্থানের গল্পটি এরকম—তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ বারের অতি সাধারণ একজন ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। আয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি নামের অদ্ভুত পদ্ধতিতে এমএলএ হন। নির্বাচিত এমএলএ-রা যাবেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে সংসদ বসবে। এয়ারপোর্টে ছাত্ররা তাদের ঘিরে ধরল। তাদের দাবিদাওয়া যেন সংসদে পেশ করা হয়। সবাই চুপ করে থাকলেন, শুধু মোনায়েম খান বললেন, এইসব দাবিদাওয়া কোনো কাজের কথা না। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হাতে। লাগল। এক পর্যায়ে কিছু ছাত্র তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধাক্কা খেয়ে মোনায়েম খানের টুপি উড়ে গেল। এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হলো। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে ছবিটি ছাপা হলো। আয়ুব খান বুঝে গেলেন মোনায়েম খানকে তার প্রয়োজন। তিনি শুরুতে তাঁকে করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিছুদিন পরেই গভর্নর। মোনায়েম খানকে নিয়ে মজার মজার সব গল্প। যেমন, তিনি রাতে ঘুমানোর সময় বুকের ওপর একটা বই নিয়ে ঘুমান। বইটির নাম , বইটির লেখক আয়ুব খান। তিনি না-কি টিভি এবং বেতারের দুই প্রধানকে গভর্নর হাউসে চা খেতে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আমার সম্পর্কে কিছু অপপ্রচার আছে। আমি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত বিরোধী। অবশ্যই না। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে আমি চাই এখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনারা মুসলমান গীতিকারদের দিয়ে লেখাবেন। বেতার এবং টিভিতে মুসলমানদের লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আনন্দমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্তি নিয়েও গল্প আছে। মোনায়েম খান ঠিক করলেন তিনিই প্রিন্সিপাল নির্বাচন করবেন। ঠিক মানুষকে নিতে হবে। নয়তো সমস্যা। দু’জন ক্যান্ডিডেটের একজনকে বললেন, সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছেন। তিনি বললেন, পরোটা ডিমভাজি। এই ক্যান্ডিডেট সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে গেলেন। কারণ ডিম হিন্দুয়ানি শব্দ। যে ডিম বলবে সে ইসলামি তমুদ্দনের একজন হবে না। অন্য ক্যান্ডিডেট বললেন, রুটি আর আন্ডাভাজি দিয়ে নাশতা করেছি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হলেন। কারণ ‘আভা’ মুসলমানি শব্দ। তবে তাকেও মোনায়েম খান বললেন, আল্ডা না বলে আপনি যদি বইদা বলতেন তাহলে আমি আরও খুশি হতাম। বইদা হলো ডিমের খাস আরবি। অনেকেই বইদা বলে। আপনার বলতে অসুবিধা কী? এখন থেকে বইদা বলবেন। মোনায়েম খান তার রাজত্বকালে অতি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করলেন তা হলো, এনএসএফ নামের ছাত্র সংগঠনকে পুরোপুরি গুণ্ডাবাহিনীতে রূপান্তর করা। তিনি এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন। এনএসএফকে গুণ্ডামির অলিখিত লাইসেন্স দেওয়া হলো। বিষয়টা পুলিশ বাহিনীকেও জানানো হলো। এই সরকারি দলের একজনের নাম পাচপাত্তুর। সে টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থাকে। হাতে সাইকেলের চেইন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাতাল হাওয়া’ গ্রন্থে পাচপাত্তুরের ভূমিকা আছে বলেই তার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হচ্ছে। শুরুতে পাচপাণ্ডুর নামকরণের ইতিহাসটা বলা যাক। তার আসল নাম সাইদুর। তার বাবা বিএম কলেজের শিক্ষক। সে ছিল ..
false
toslima_nasrin
নিতে নিতে সুন্দরের সঙ্গে বাস করব আমরা, ভালবাসা আমাদের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও যাবে না। চন্দনা ভাল না লাগায় ভগু তে ভগু তে লেখে আমার ভাল লাগছে না, আমি যেন জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধে। ভাল লাগা ভালবাসা এসব শব্দগুলো সব পুরোনো মনে হচ্ছে। আমি তোকে বোঝাতে পারছি না। কেবল মনে হচ্ছে আমি যেন আমাতে নেই। আজ সারাদিন মন খারাপ, সামান্য আঘাত লেগে মেহগিনি পাতাগুলো যখন ঝিরঝির ফুলের মত প্রশান্তির মত ঝরে পড়ে তখন ইচ্ছে করে কোনও জিনস জ্যাকেটের পিঠে মাথা রেখে হোন্ডায় চড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই। আমি জানি, কি নির্মম ভাবে জানি অথচ বলিনি কারও কাছে এসব আমার জন্য কেবল অলীক স্বপ্ন মাত্র। আমাকে আঘাত কর তুই, চোখে জল না থাকলে আমি ভাল থাকি না তো, কিছুতেই না, আসলে আমার কি হয়েছে আমি তোকে বলতে পারব না, তাহলে জেনে যাবে, সবাই জেনে যাবে। আমি কেবল ছটফট করছি, আকুল হয়ে মরছি অথচ কি জানিস পুরো ব্যাপারটা তুই জানবি না, নেভার, তুই আমার এত আপন, এত ঘনিষ্ঠ, হৃদয়ের এত কাছে থাকিস তুই, তবু বলা হবে না। হায়রে মন। এই মনটাই আমার শত্রু। সব যখন ঠিকঠাক চলে, ঠিক সে মুহূর্তেই আমি বদলে যাই। মন নামক এই পদার্থটি বিট্রে করে বসে আমার সঙ্গে। আমি ভাল নেই, একদম না, চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, একধরনের ঈর্ষায় হিংসেয় আমি ছিন্নভিন্ন হই অবিরত, অথচ বোঝাতে পারি না। বুঝতেও পারি না এই ঈর্ষা কার বিরুদ্ধে, এই দ্বন্দ ্ব কেন। তবে কি আমি আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চাই? আমি কি আমাকে আর ভালবাসি না? কি জানি .. যদি কোনও এক নীল চোখের গ্রীক যুবক, যদি কোনও এপোলো আমাকে ভালবাসার কথা বলত ..! আমার ভেতর সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। আমি আর কোনওকিছুতে আনন্দ পাই না। মনে পড়ে আসামী হাজিরের সদানন্দ কি এক অব্যক্ত যনণ্ত্রায় আর্তনাদ করত, মনে কর তেমন কোনও অব্যক্ত যন্ত্রণায় আমি আর্তনাদ করছি। এই একঘেয়ে জীবন আর ভাল লাগে না। তুই আমাকে মনোহর উত্তরণে নিয়ে যেতে পারবি? মন কাঁদে, তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার, তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে মন মনরে আমার। বুঝতে পারিস কি বললাম? বুঝিস না? আমি তোকে কাছে পেতে চাইছি। আমি কেবল তোকেই চাই, কতকাল দেখিনি তোকে। এই সংসার এই মায়ার বন্ধন ছেড়ে চল ঘুরে বেড়াই বাউলের একতারা নিয়ে, তুই হবি বৈষ্ণব আমি বৈষ্ণবি, টুং টাং শব্দ তুলে আমরা গাইব দুজনেই, পাখি ছটফটাইয়া মরে, শিকল ছিঁড়িতে না পারে, খাঁচা ভাঙিতে না পারে, পাখি ছটফটাইয়া মরে। অথবা চোক্ষেরই নাম আরশিনগর, একদিন ক্ষইয়া যাবে, পোড়া চোখে যা দেখিলাম তাই রইয়া যাবে। চন্দনাকে দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লেখা ছাড়া ছাদে, ঘরের কোণে, বারান্দায়, মাঠের ঘাসে, ভোরের শিউলিতলায়, সেগুন গাছের ছায়ায় বসে একটি জিনিসই তখন হয়, কবিতা লেখা। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে কবিতা পত্রিকা আসে আমার ঠিকানায়। পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চল থেকেও আসে কবিতার ছোট কাগজ। এগুলো এক ধরনের শেকলের মত, একটি থেকে আরেকটি, আরেকটি থেকে আরেকটি করে করে ব্যাপ্ত হতে থাকে। ছোট কবিতা পত্রিকায়, ঢাকার সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও পাঠাই কবিতা। কোথাও না কোথাও ছাপা হতে থাকে কিছু না কিছু একদিন আমার ভাবনার পুকুরে ঢিল পড়ে, কোত্থেকে পড়ে, কি করে পড়ে কিছু না জেনে আমি পুকুর পাড়ে নিস্পন্দ বসে থাকি। পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ ক্রমে বড় হতে হতে পায়ে আছড়ে পড়ে, আমার শরীর ভিজতে থাকে জলে। আমি তবু নিস্পন্দ বসে থাকি। নিস্পন্দ আমাকে দেখতে লাগে, ভেতরে আমার উঁকি দিচ্ছে একটি ইচ্ছের অঙ্কুর। আমি তো চেষ্টা করলে নিজেই একটি কবিতা পত্রিকা বের করতে পারি। পারি না কি? পারি। মন বলে পারি। ডলি পালের বাড়ি থেকে ভেসে আসা উলুধ্বনির শব্দ আমাকে সচকিত করে। দশদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কী নাম দেব পত্রিকার? কী দেব নাম? আমাকে দুদিন কিংবা তিনদিন ভাবতে হয় না। মন বলে, সেঁজুতি! হ্যাঁ সেঁজুতিই। সন্ধ্যাপ্রদীপ। চন্দনার কাছে চাওয়ামাত্র কবিতা পাঠিয়ে দেয়, ইশকুল শেষ হওয়ার পরও বাংলার শিক্ষিকা সুরাইয়া বেগম আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, তাঁকে দিয়ে নতুন একটি কবিতা লিখিয়ে নিই আর ছোটদাকে বলে শহরের কিছু কবির কবিতা আনিয়ে শখের বশে সুখের ঘোরে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলি সেঁজুতির, কিছু টুকরো খবর শেষের পাতায়, সাহিত্যের সাহিত্যিকের, সাহিত্যের কোন ছোট পত্রিকা কোত্থেকে কারা বের করেছে, কেমন হয়েছে ভাল না মন্দ, মন্দ হলে কেন ভাল হলে তাই বা কেন, এসব। দাদা বললেন আমার একটা কবিতা ছাপা। তাঁর কবিতার খাতা থেকে সবচেয়ে ভাল কবিতাটি নিই। আমার খবরটাও লেইখা দে। লেইখা দে পাতা পত্রিকার সম্পাদক ফয়জুল কবীর নোমানএর প্রথম কবিতার বই পারাপার শিগরি বেরোচ্ছে। তাও লিখে দিই। দাদা খুশি। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাজানোর সময় হয়ে এল, কে টাকা দেবে, কে প্রেসে যাবে, কে ছেপে আনবে সেঁজুতি! পারাপার নামে দাদা কোনও বই লেখা শুরুই করেননি, তবু তাঁর অনুরোধে খবরটি দেবার কারণেই সম্ভবত তিনি বললেন ঠিক আছে যা, আমি তর এই সেঁজুতি ছাপার খরচ দিয়াম নে। প্রেসের সবাইরে তো আমি চিনি, পাতা পত্রিকা ছাপানোর কারণে। দাদার কানের কাছে পিনপিন করে বেজেই চলল আমার গানা ও দাদা, ও দাদা, তুমি তো কইছ ছাপাইয়া দিবা, দেও। ধৈর্য ধর।
false
shirshendu
কালু অন্য দিনের চেয়ে বেশী মনোযোগ দিয়ে একটা টিউবের লিক সারাচ্ছিল। কালুর সঙ্গে তার খুব ভাব। গণা না থাকলে কালু অনেক সময় বিনা পয়সাতেও তার চাকায় পাম্প দিয়ে দেয়। এই কালু, কোথায় কে খুন হয়েছে রে? খুন! বলে কালু আকাশ থেকে পড়ে, জানি না তো! বটতলায় আজ দোকানপাট খোলনি তেমন। লোকজন দেখা যাচ্ছে না। থমথমে ভাব। এই যে শুনলাম কে খুন হয়েছে। আমার বাবা নয় তো! কালু মাথা নেড়ে বলে, আমি কিছু শুনিনি। কালু যে মিথ্যে কথা বলছে তা এক লহমায় বুঝে গেল পটল। লোজন সব কোন দিকে গেছে জানিস? আমি কিছু জানি না। কাজ করছি এখন। বাদুর দোকানে জিজ্ঞেস করতেই চা-ওলা ছেলেটা বলল, ঘোষপাড়ার নাবালে যাও। কেটে ফেলে রেখে গেছে রাতে। কে খুন হল? কে জানে! আমার বাবা নয় তো! ছেলেটা নির্বিকার মুখে নিদুরের মতো বলল, হতে পারে। দেখগে, চিনতে পারে কিনা। পটলের হাত পা থথর করে কাঁপছিল। সাইকেলটা সে কালুর সামনে ফেলে রেখে বলল, এটা রইল। এখন চালাতে পারব না। দৌড়তে দৌড়তে পটল যখন নাবালের ধারে পৌছোলো তখন ভিডটা বেড়েছে। মেলা লোক, কিন্তু গণ্ডগোল নেই। জীবনে খুন-হওয়া মানুষ কখনও দেখেনি পটল। মানুষকে যে এভাবে অনাদরে ফেলে রাখা যায়, মারা যায় তা তার কল্পনাতেও ছিল না কখনও। জলে আধ-ডোবা লোকটার নিথর পা দুখানার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল সে। আমার বাবা নয় তো! হতে পারে তার বাবা-ইও টা। সবুজ জামা আর কালো প্যান্ট তো বাবার আছে। কাছেই দশরথ সাহা দাঁড়িয়ে। সে মুখ তুলে লম্বা লোটার দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, দশরথ জ্যাঠা, এ আমার বাবা নয় তো! দশরথ সাহা তার দিকে চেয়ে একটু যেন চমকে উঠল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কেন তোর বাবা বাড়ি নেই? না। কাল দুপুর থেকে আর ফেরেনি। দশরথ সাহা কেমনধারা মুখ করে বলে, যা বাঢ়ি যা। পুলিশ এসে লাশ না তুললে কিছু বলা যাচ্ছে না। গিয়ে বামাচরণকে পাঠিয়ে দে। সে আসবে না। কী হয়েছে বলুন না! কে কি বলবে বাবা? দেখছিস তো কাণ্ডখানা! লোকে নানা কথা বলাবলি করছে। তুই আর থাকিস না এখানে। কেন জ্যাঠা? আমি থাকলে কী হবে? কী যে হবে তা দশরথও জানে না। দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, বাড়ির বড় কাউকে পাঠিয়ে দি গে যা। পটল কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাদের যে আর কেউ নেই। দাদু বুড়ো মানুষ, বসা মানুষ, দাদু কি আসতে পারবে এত দূরে? পটল হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ছুটতে লাগল বটতলার দিকে। জ্যাঠা এখনও বোধ হয় বেরোয়নি। সে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে ঠিক নিয়ে আসবে। সাইকেলের দোকানের কাছাকাছি আসতেই সে একজন নতুন মানুষকে দেখতে পেল। জলকাদা মাখা মানুষ, কিন্তু এ গায়ের হেটো মানুষ নয়। লম্বা চওড়া চেহারা, বাবু মানুষ। মুখটা পটলের বড় চেনা। কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভাববার সময় ছিল না তার। সাইকেলটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, এমন সময় লোকটা ডাকল। তাকে, এই, তুই পটল না। উদ্ভ্রান্ত চোখে পটল লোকটার দিকে চাইল। চিনতে পারল। তারপর হঠাৎ ঊা করে কেঁদে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরল সে, বড়জ্যাঠা, আমার বাবা খুন হয়ে গেছে। কৃষ্ণজীবন ভীষণ অবাক হয়ে বলল, খুন হয়ে গেছে! বলিস কী? ঘোষপাড়ার নাবালে পড়ে আছে বাবা। কৃষ্ণজীবন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরকম করিস না। আয় তো, দেখে আসি। পটল অঝোরে কাঁদছে। নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে তার। পৃথিবীতে এখন বড়জ্যাঠার চেয়ে বড় সম্বল আর সহায় তার কেউ নেই যেন, এমনভাবে আঁকড়ে ধরল সে কৃষ্ণজীবনকে। নাবালের ভিড়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণজীবন লাশটাকে দেখল। তারপর পটলের দিকে চেয়ে বলল, কে বলেছে যে ও তোর বাবা? সবাই জানে। কৃষ্ণজীবন পটলকে শক্ত করে ধরে বলল, রামজীবনের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে মস্ত কাটা দাগ আছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মহাদেব ঘোষের বাড়িতে পেয়ারা চুরি করতে গিয়েছিল রামজীবন। মহাদেব ঘোষ একটা দা ছুঁড়ে মেরেছিল। দাগটা এখনও আছে। আরও বেশি করে আছে। এ লোকটির বাঁ পায়ের গোড়ালিতে কোনও দাগ নেই। পটল হাঁ করে কিছুক্ষণ জ্যাঠার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, এ আমার বাবা নয়? কখনোই নয়। চল, বাড়ি চল। পটলের মনে হল, বড়জ্যাঠা যেন মানুষ নয়। যেন দেবদূত। সেদিন গাঁয়ের স্কুলের অডিট সেরে রশ্মি রায় আর সে একসঙ্গেই ফেরে। এক ট্রেনে, এক কম্পার্টমেন্টে পাশাপাশি বসে এবং একই ট্যাক্সির উষ্ণ, নরম অন্ধকার ও নিকট সান্নিধ্যে। যে কেউ শুনলে বলবে, তবে আর কি, হয়েই তো গেছে। হয়ে যায়নি, তবে এই এতটা একসঙ্গে থাকার ধকল আজও সামলে উঠতে পারেনি হেমাঙ্গ। আর সেই মাদক গন্ধটা, সেই মারাত্মক বিদেশীসেন্ট মেয়েটার গা থেকে উড়ে এসে কুংফু কারাটে চালিয়ে হেমাঙ্গর হৃদয়কে প্রায় ধরাশায়ী করে ছেড়েছিল। প্রেমের মধ্যে কি গন্ধেরও একটা ভূমিকা আছে। কোনও কোনও সেন্ট কি হৃদয়-বিদারক? কই, সেসব সেন্টের প্রস্তুতকারকরা তো নোবেল প্রাইজ পায় না। তাদের অবশ্যই নোবেল-টোবেল দেওয়া উচিত। রাস্তা কম নয়। মেয়েটাও কথা বলতে ভালবাসে। ফলে দুজনের মধ্যে একটা কথার জালও শক্তভাবে বোনা হয়েছিল। প্রথম স্কুল নিয়ে, তারপর ভারতবর্ষের এলানো কর্মবিমুখ জীবনদর্শন নিয়ে, প্রশাসনিক পরিকাঠামোর জটিলতা নিয়ে, মানুষের দুরারোগ্য দুনীতি নিয়ে, চিকিৎসার অতীত ধান্ধাবাজি নিয়ে। কথাবার্তা পার্সোনাল লেভেলে এল ট্যাক্সিতে, শিয়ালদা থেকে হাজরার মাঝখানে। রশ্মি রায় জিজ্ঞেস করল, আমি একটু বেশি কথা বলি,
false
humayun_ahmed
হবেন। এমন একটা নামের ভার বহন করার মতো শক্তি ভদ্রলোকের কি আছে? থাকার কথা না। বেশির ভাগ মানুষের মনের জোর তেমন থাকে না। ভদ্রলোকের অবস্থা ছেড়ে দে ছাত্ৰ সমাজ কেঁদে বাঁচি হবার কথা। স্যার আসব? ভদ্রলোক তাঁর ঘরে কম্পিউটারের কানেকশন জাতীয় কী করছিল। এখন চোখে চশমা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে? ভাবটা এরকম যেন আমাকে চিনতেই পারছেন না। আমি বললাম, স্যার আমি মৃন্ময়ী। কিছু বলবে? আপনি বলেছিলেন ক্লাসের শেষে যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। আমি দেখা করতে এসেছি। ও আচ্ছা আচ্ছা। সরি ভুলে গিয়েছিলাম। এসো। চেয়ারটায় বোস। আমি চেয়ারে বসলাম। আমার মেজাজ খারাপ লাগছে। ভদ্রলোক বেশ ভালো করেই জানেন তিনি আমাকে আসতে বলেছেন। তারপরেও ভান করলেন তাঁর মনে নেই। এই ভানটা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মৃন্ময়ী তোমার কি বাড়িতে ফেরার খুব তাড়া আছে? তাড়া থাকলে আজ চলে যাও। অন্য আরেকদিন কথা বলব আমি পোর্ট লাইনের কানেকশনটা দিতে পারছি না। কানেকশন না দিতে পারা পর্যন্ত অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারছি না। আপনি কানেকশন দিন আমি অপেক্ষা করছি। কী জন্যে ডেকেছেন এটা না জানা পর্যন্ত আমার নিজের মধ্যেও এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করবে। অস্বস্তি কাজ করবে কেন? আজ আপনার সঙ্গে আমাদের প্রথম ক্লাস হলো। ক্লাসের মাঝখানে বেশ আয়োজন করেই আপনি আমাকে বললেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। অস্বস্তির কারণটা এইখানেই। তোমাদের এখানে কি এই নিয়ম যে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রকে দেখা করতে বলতে পারবে না? অবশ্যই বলতে পারবে। তবে তার জন্যে কারণ থাকতে হবে। গল্প করার জন্যে আমি কাউকে ডাকতে পারি না? ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কি একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করা যায় না? সব সময় দূরত্ব থাকতে হবে? আমি। নিয়ম ভাঙতে চাই। নিয়ম ভাঙতে হলে শক্তি লাগে। সেই শক্তি কি আপনার আছে? আমার ধারণা আছে। থাকলে তো ভালোই। ক্লাসে আমার বক্তৃতা তোমার কেমন লাগল? ভালো। তবে আপনার প্রধান চেষ্টা ছিল আপনি যে অন্যদের চেয়ে আলাদা এটা প্রমাণ করা। কেউ যদি আলাদা হয় এমিতেই তা ধরা পড়ে। আয়োজন করে আমি আলাদা এটা প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আপনার এই জিনিসটা আমার খারাপ লেগেছে। তোমার নিজের কি মনে হয় না আমি অন্যদের মতো না? আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা? আমি শান্ত গলায় বললাম, আমাদের ক্লাসে সতেরো জন স্টুডেন্ট। এই সতেরো জনের ভেতর থেকে আপনি আমাকে সিঙ্গেল আউট করে প্রশ্নগুলো করছেন কেন? কারণ তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। প্রথম দেখাতেই পছন্দের একটা কথা সমাজে প্রচলিত। ঐ ব্যাপারটাই ঘটেছে। তোমাকে আলাদা একটি মেয়ে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি হয়তো অন্য আর দশজনের মতোই কিন্তু তুমি না। আমার ধারণা হয়েছে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে আমার ভালো লাগবে। এইজন্যেই তোমাকে খবর দিয়েছি। আমি যদি সমাজের আর দশজনের মতো হস্তাম আমি আমার পছন্দের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতাম। অল্প অল্প করে তোমার সঙ্গে পরিচয় হতো। একদিন হয়তো ডিজাইনের একটা বই তোমাকে পড়তে দিলাম। বই ফেরত দেবার সময় এক কাপ কফি খাওয়ালাম। টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে দিলাম যাতে ক্লাসের কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে টেলিফোন করতে পারো। তারপর একদিন তোমার টেলিফোন নাম্বার নিলাম। নানান ধাপ পার হয়ে আসা। আমি সবগুলি ধাপ এক সঙ্গে পার হতে চাই। তুমি আমার কথায় হার্ট হচ্ছ না তো? না হার্ট হচ্ছি না। আমি যখন আপনার ঘরে ঢুকলাম তখন কিন্তু আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি বা না-চেনার ভান করেছেন। তুমি একটা ব্যাপার লক্ষ করে নি। আমি শর্ট সাইটেড মানুষ। আমার চোখে চশমা ছিল। কাছের জিনিস দেখার জন্য আমি যখন চশমা পরি তখন দূরের জিনিস দেখতে পাই না। তোমাকে আমি আসলেই চিনতে পারি নি। তুমি কি কফি খাবে? আমি খুব ভালো কফি বানাতে পারি। না, কফি খাব না। আইসক্রিম খাবে? আমি শুনেছি ঢাকা শহরে খুব ভালো ভালো আইসক্রিমের দোকান হয়েছে। না আইসক্রিমও খাব না। আমাকে বাসায় যেতে হবে। আমি তোমাকে নামিয়ে দেই। বাসাটাও চিনে আসি। কখননা যদি যেতে বলে চট করে চলে যেতে পারব। তোমাকে কষ্ট করে ঠিকানা বলতে হবে না। আমি যদি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই তাতে কি তোমার আপত্তি আছে? না, আপত্তি নেই। থ্যাংক য়্যু। আমি বিরক্ত বোধ করছি। বিরক্তি চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের একজন শিক্ষক যদি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে চান তাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষটা নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চেষ্টাটা যে হাস্যকর তাও ভদ্ৰলোক বুঝতে পারছে না। মানুষটা কি বোক? যে এক লাফে অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে চায় তার প্রথমেই জানতে চাওয়া উচিত যাকে নিয়ে সে সিঁড়ি ভাঙতে চাচ্ছে সে কি তা চায়? আমি বললাম, স্যার আপনার কি দেরি হবে? স্যার হাসিমুখে বললেন, না দেরি হবে না। পোর্ট কানেকশন আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক্সপার্ট কাউকে আনতে হবে। ভালো কথা— মোটর সাইকেলে চড়া কি তোমার অভ্যাস আছে? মোটর সাইকেল? গাড়ি আমার খুবই অপছন্দ। মোটর সাইকেল আমার অতি পছন্দের বাহন। মোটর সাইকেলে . মোটর সাইকেলে কখনো চড়েছ? না। চড়তে আপত্তি আছে? না আপত্তি নেই। বাঙালি মেয়েদের সম্পর্কে আমার যে কনসেপ্ট ছিল তার অনেকখানিই তুমি ভেঙে দিয়েছ। মোটর সাইকেলে তুমি আমার পেছনে যাচ্ছ এই দৃশ্য দেখে তোমার বন্ধুরা তোমাকে
false
robindronath
উঠেছে তা মানুষের সকল সঞ্চয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। হিতৈষী একটা কথা ভালো করে ভেবে দেখে না, গল্পরচনার নেশাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সবশেষের নেশা; তাঁকে শোধন করতে না পারলে মানুষকে শোধন করার আশা করা যায় না। একদিন তিনি তাঁর কারখানাঘরে আগুন থেকে জল, জল থেকে মাটি গড়তে লেগে গিয়েছিলেন। সৃষ্টি তখন গলদ্‌‍ঘর্ম, বাষ্পভারাকুল। ধাতুপাথরের পিণ্ডগুলো তখন থাকে থাকে গাঁথা হচ্ছে; চার দিকে মালমসলা ছড়ানো আর দমাদম পিটনি। সেদিন বিধাতাকে দেখলে কোনোমতে মনে করা যেতে পারত না যে, তাঁর মধ্যে কোথাও কিছু ছেলেমানুষি আছে। তখনকার কাণ্ডকারখানা যাকে বলে ‘সারবান’। তার পরে কখন শুরু হল প্রাণের পত্তন। জাগল ঘাস, উঠল গাছ, ছুটল পশু, উড়ল পাখি। কেউ বা মাটিতে বাঁধা থেকে আকাশে অঞ্জলি পেতে দাঁড়াল, কেউ বা ছাড়া পেয়ে পৃথিবীময় আপনাকে বহুধা বিস্তার করে চলল, কেউ বা জলের যবনিকাতলে নিঃশব্দ নৃত্যে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে ব্যস্ত, কেউ বা আকাশে ডানা মেলে সূর্যালোকের বেদীতলে গানের অর্ঘ্যরচনায় উৎসুক। এখন থেকেই ধরা পড়তে লাগল বিধাতার মনের চাঞ্চল্য। এমন করে বহু যুগ কেটে যায়। হঠাৎ এক সময়ে কোন্ খেয়ালে সৃষ্টিকর্তার কারখানায় উনপঞ্চাশ পবনের তলব পড়ল। তাদের সবক’টাকে নিয়ে তিনি মানুষ গড়লেন। এত দিন পরে আরম্ভ হল তাঁর গল্পের পালা। বহুকাল কেটেছে তাঁর বিজ্ঞানে, কারুশিল্পে; এইবার তাঁর শুরু হল সাহিত্য। মানুষকে তিনি গল্পে গল্পে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। পশুপাখির জীবন হল আহার নিদ্রা সন্তানপালন; মানুষের জীবন হল গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা; সুখদুঃখ রাগবিরাগ ভালোমন্দের কত ঘাতপ্রতিঘাত। ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের, সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্তন। নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরস্পর দেখা হতেই প্রশ্ন এই, ‘কী হল হে, কী খবর, তার পরে?’ এই ‘তার পরে’র সঙ্গে ’তার পরে’ বোনা হয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের গল্প গাঁথা হচ্ছে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনী, তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস। বিধাতার-রচা ইতিহাস আর মানুষের-রচা কাহিনী, এই দুইয়ে মিলে মানুষের সংসার। মানুষের পক্ষে কেবল-যে অশোকের গল্প, আকবরের গল্পই সত্য তা নয়; যে রাজপুত্র সাত-সমুদ্র-পারে সাত-রাজার-ধন মানিকের সন্ধানে চলে সেও সত্য; আর সেই ভক্তিবিমুগ্ধ হনুমানের সরল বীরত্বের কথাও সত্য যে হনুমান গন্ধমাদনকে উৎপাটিত করে আনতে সংশয় বোধ করে না। এই মানুষের পক্ষে আরঞ্জেব যেমন সত্য দুর্যোধনও তেমনি সত্য। কোন্‌‍টার প্রমাণ বেশি, কোন্‌‍টার প্রমাণ কম, সে হিসাবে নয়; কেবল গল্প হিসাবে কোন্‌‍টা খাঁটি, সেইটেই তার পক্ষে সবচেয়ে সত্য। মানুষ বিধাতার সাহিত্যলোকেই মানুষ; সুতরাং না সে বস্তুতে গড়া, না তত্ত্বে—অনেক চেষ্টা করে হিতৈষী কোনোমতেই এই কথা মানুষকে ভোলাতে পারলে না। অবশেষে হয়রান হয়ে হিতকথার সঙ্গে গল্পের সন্ধিস্থাপন করতে সে চেষ্টা করে, কিন্তু চিরকালের স্বভাবদোষে কিছুতে জোড়া মেলাতে পারে না। তখন গল্পও যায় কেটে, হিতকথাও পড়ে খ’সে, আবর্জনা জমে ওঠে। বৈশাখ ১৩২৭ সৃষ্টির কাজ প্রায় শেষ হয়ে যখন ছুটির ঘণ্টা বাজে ব’লে, হেনকালে ব্রহ্মার মাথায় একটা ভাবোদয় হল। ভাণ্ডারীকে ডেকে বললেন, ‘ওহে ভাণ্ডারী, আমার কারখানাঘরে কিছু কিছু পঞ্চভূতের জোগাড় করে আনো, আর-একটা নতুন প্রাণী সৃষ্টি করব।’ ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বললে, ‘পিতামহ, আপনি যখন উৎসাহ করে হাতি গড়লেন, তিমি গড়লেন, অজগর সর্প গড়লেন, সিংহ-ব্যাঘ্র গড়লেন, তখন হিসাবের দিকে আদৌ খেয়াল করলেন না। যতগুলো ভারি আর কড়া জাতের ভূত ছিল সব প্রায় নিকাশ হয়ে এল। ক্ষিতি অপ্ তেজ তলায় এসে ঠেকেছে। থাকবার মধ্যে আছে মরুৎ ব্যোম, তা সে যত চাই।’ চতুর্‌‍মুখ কিছুক্ষণ ধরে চারজোড়া গোঁফে তা দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ভালো, ভাণ্ডারে যা আছে তাই নিয়ে এসো, দেখা যাক।’ এবারে প্রাণীটিকে গড়বার বেলা ব্রহ্মা ক্ষিতি-অপ-তেজটাকে খুব হাতে রেখে খরচ করলেন। তাকে না দিলেন শিঙ, না দিলেন নখ; আর দাঁত যা দিলেন তাতে চিবনো চলে, কামড়ানো চলে না। তেজের ভাণ্ড থেকে কিছু খরচ করলেন বটে, তাতে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো কোনো কাজে লাগবার মতো হল কিন্তু তার লড়াইয়ের শখ রইল না। এই প্রাণীটি হচ্ছে ঘোড়া। এ ডিম পাড়ে না তবু বাজারে তার ডিম নিয়ে একটা গুজব আছে, তাই একে দ্বিজ বলা চলে। আর যাই হোক, সৃষ্টিকর্তা এর গড়নের মধ্যে মরুৎ আর ব্যোম একেবারে ঠেসে দিলেন। ফল হল এই যে, এর মনটা প্রায় ষোলো-আনা গেল মুক্তির দিকে। এ হাওয়ার আগে ছুটতে চায়, অসীম আকাশকে পেরিয়ে যাবে ব’লে পণ ক’রে বসে। অন্য-সকল প্রাণী কারণ উপস্থিত হলে দৌড়য়; এ দৌড়য় বিনা কারণে; যেন তার নিজেই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। কিছু কাড়তে চায় না, কাউকে মারতে চায় না, কেবলই পালাতে চায়— পালাতে পালাতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পরে ‘না’ হয়ে যাবে, এই তার মৎলব। জ্ঞানীরা বলেন, ধাতের মধ্যে মরুৎব্যোম যখন ক্ষিতি-অপ-তেজকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ওঠে তখন এইরকমই ঘটে। ব্রহ্মা বড়ো খুশি হলেন। বাসার জন্যে তিনি অন্য জন্তুর কাউকে দিলেন বন, কাউকে দিলেন গুহা, কিন্তু এর দৌড় দেখতে ভালোবাসেন ব’লে একে দিলেন খোলা মাঠ। মাঠের ধারে থাকে মানুষ। কাড়াকুড়ি করে সে যা-কিছু জমায় সমস্তই মস্ত বোঝা হয়ে ওঠে। তাই যখন মাঠের মধ্যে ঘোড়াটাকে ছুটতে দেখে মনে মনে ভাবে, ‘এটাকে কোনো গতিকে বাঁধতে পারলে আমাদের হাট করার বড়ো সুবিধে।’ ফাঁস লাগিয়ে ধরলে একদিন ঘোড়াটাকে। তার পিঠে দিলে জিন, মুখে দিলে কাঁটা-লাগাম। ঘাড়ে তার লাগায়
false
shomresh
হয়ে গেল। যেন বুঝে নিতে সময় লাগছে সবার। কান মাথা নেড়ে মুখ ফেরালেন, আমি কি দলে থাকব? আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই থাকবেন, সবাই যদি দলে আপনাকে চায়। কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। আনন্দর অস্বস্তি বাড়ছিল। কি ব্যাপার? ব্যবস্থাটা এদের মনঃপুত হচ্ছে না নাকি? এইসময় সে সুদীপকে এগিয়ে আসতে দেখল। ওপরে উঠে এসে সুদীপ বলল, অভ্যেস কখনও একদিনে তৈরি হয় না। উই শু্যড হেল্প দেম। সে চিৎকার করল, যারা এই দলে থাকতে চাও তারা ওপরে উঠে এস। এবার নড়াচড়া শুরু হল। এ ওর দিকে তাকায়। কিন্তু উঠতে যেন সঙ্কোচ বোধ করছে সবাই। এইসময় সাওদের গুটি গুটি পায়ে ওপরে উঠে এল। তাকে দেখে লা-ছিরিঙ এগিয়ে গেল। এবং অমনি আরও পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী মানুষ এগিয়ে এল। আনন্দ পালদেমকে ধরে নিয়ে গুনল, আটজন। সুদীপ হাঁকল, আরও দুজন চাই। জনতার মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করল, তোমরা দুজন তো আছ। আনন্দ কিছু বলার আগেই সুদীপ জানাল, না, আমরা দলে থাকতে পারি না। আমরা বাইরের লোক। আমার নাম সুদীপ, ওর নাম আনন্দ, তোমাদের নামের সঙ্গেও মেলে না। এই গ্রামের মানুষের ভালমন্দ দেখাশোনা করবে গ্রামেরই মানুষ, বাইরের লোক নয়। এইসময় কাহুন গিয়ে দাঁড়ালেন দলে। নজন হল। আর একজন চাই। হঠাৎ একটি মেয়ে বলল, দলে সব ছেলে থাকছে কেন? একজন মেয়ে চাই। সুদীপ বলল, নিশ্চয়ই। মেয়েরা আগে আসছে না বলেই থাকছে না। দশ নম্বরের জন্যে তুমি এসো। মেয়েটা মাথা নাড়ল, আমি কি কিছু জানি যে দলে যাব। দ্রিমিত কোথায়? দ্রিমিত যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হল, দ্রিমিত! দ্রিমিত! দ্রিমিত। দুটি মধ্যবয়সিনী গিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল জয়িতাকে। সুদীপ বাধা দিল, আরে ওকে আনছ কেন? ও তো আমাদের মতই বাইরের লোক! যে মেয়েটা কথা বলছিল সে ফুঁসে উঠল, কে বলেছে বাইরের লোক? ওর নাম দ্রিমিত। দ্রিমিত আমাদের নাম। ওর পোশাক আমাদের পোশাক। তুমি নিজেকে এখনও বাইরের লোক ভাবতে পার কিন্তু দ্রিমিত তা ভাবে না। ওকে আমরা আমাদের লোক মনে করি। কথাটার সমর্থন মিলল অনেক গলায়। সুদীপ কাঁধ নাচাল। ওরা ততক্ষণে জয়িতাকে ওপরে তুলে দিয়েছে। সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, চমৎকার! বলে নিচে নেমে পাথরে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আনন্দ বলল, তাহলে এই দশজন আগামী বারোটা চাঁদ পর্যন্ত গ্রামের দায়িত্বে থাকবে। এই সময়ে যদি এরা ভাল কাজ করে তাহলে আবার দায়িত্ব পাবে। যদি কেউ খারাপ কিছু করে তাহলে গ্রামের সমস্ত মানুষ এক হয়ে তাকে দল থেকে সরিয়ে দেবে। তোমরা এ ব্যাপারে রাজী? ঠিক কথা, ঠিক কথা। সবাই চেঁচিয়ে বলল। আনন্দ এবার ঘোষণা করল, কে কোন্ দায়িত্ব নেবে তা এরা নিজেরা ঠিক করবে। এখন যে যার কাজে তোমরা যেতে পার। জমায়েত যখন ভাঙব ভাঙব করছে উল্লসিত হয়ে তখন একজন, এক বৃদ্ধ, চিৎকার করল, সবাই বলছে তোমরা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, কথাটা ঠিক? কথাটা আনন্দর কানেও এসেছিল। সে মাথা নাড়ল, আমি জানি না। বৃদ্ধ বলল, আমরা খুব খারাপ ছিলাম। তোমরা চলে গেলে আবার খারাপ থাকব। আনন্দ প্রতিবাদ করল, কেন খারাপ থাকবে? তোমরা তো শিখে নিয়েছ ভালভাবে থাকতে গেলে কি কি করতে হয়। তোমাদের এই শেখাটা অনেক সভ্যদেশের মানুষ শিখতে পারেনি। বৃদ্ধর কানে যেন কথাগুলো ঢুকল না, আগে কেউ গ্রামের বাইরে যেতে সাহস করত না, এখন যাচ্ছে। সেখানে অনেক ডাইনি ওৎ পেতে বসে আছে। তারা এদের যাদু করবে। তোমরা না থাকলে এরা গ্রামের কোন নিয়মকানুন মানবে না। তাছাড়া–। আনন্দ দেখল বৃদ্ধ উদাস হয়ে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। সে জিজ্ঞাসা করল, তাছাড়া? আমাদের বাপ মা যারা স্বর্গে গিয়েছে তারা আমাদের কিছু শেখায়নি। আমরাও এদের কিছু শেখাতে পারিনি। এরা, যেসব বাচ্চা এখন জন্মাচ্ছে তাদের কিছু না শিখিয়ে বড় করছে। আসলে আমরা কিছুই জানি না, শেখাতে পারব কি করে। আমরা যখন মরে যাব, এরা যখন মরে যাবে তখন একই অবস্থা চলবে। তোমবা থেকে গেলে এ অবস্থা চলতে পারত না। আনন্দ কিছু বলার আগে পালদেম বলল, তাহলে এরা কি করে আমাদের বাচ্চাদের শেখাবে? বৃদ্ধ জবাব দিল, কেউ রক্তের টানে শেখে, কেউ দেখে শেখে। ওরা চলে গেলে যারা আসবে তারা কিছুই শিখবে না। এখনও এই গ্রামের তিনটে পরিবার আলাদা রয়ে গেছে। আনন্দ উৎসাহিত করল, তোমরা মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করছ। আমরা যাচ্ছি না এখনই। তবে পুলিশ যদি আমাদের ধরে নিয়ে যায় তাহলে অন্য কথা। বৃদ্ধ চিৎকার করল, পুলিশদের আমরা ঢুকতে দেব না। প্রতিধ্বনিত হল অনেক গলা পাহাড়ে পাহাড়ে, দেব না, দেব না। জমায়েত যখন ভেঙেছে, মানুষজন যখন চলে যাচ্ছে তখন আনন্দ এগিয়ে গেল জয়িতার দিকে, কনগ্রাচুলেশন জয়িতা। জয়িতা মাথা নাড়ল, উঁহু, জয়িতা নয়, দ্রিমিত। ও হ্যাঁ, দ্রিমিত। আনন্দ মাথা নেড়ে নিজেকে সংশোধন করল। এইসময় সেই মেয়েটা এসে দাঁড়াল সুদীপের পাশে। ও যে এতক্ষণ জমায়েতে ছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আনন্দ তখন পালদেমদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নেমে গেছে। জয়িতা গ্রামের তিনটে মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে, হঠাৎ সুদীপ এগিয়ে এল তার সামনে, জয়িতা, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে, এদিকে আয়। জয়িতা ওর গলার স্বর শুনে চমকে তাকাল! অতান্ত রাগী দেখাচ্ছে সুদীপের মুখ। সে হাসবার চেষ্টা করল। জয়িতা এখন মরে গেছে সুদীপ, আমি দ্রিমিত। এইসব ন্যাকামি রাখ।
false
shunil_gongopaddhay
বটে, কিন্তু তার দেবতা অন্য। এই ছাদের এক অংশ থেকে, এমনকি ঠাকুর ঘরের জানলা দিয়েও দেখা যায় ভরতের ঘরখানি, সংলগ্ন অলিন্দ এবং নীচের দিকে যাবার সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ। দিনের বেলা ভরতের বকুনির ভয়ে সে কাছাকাছি যায় না, এখান থেকে তৃষিতের মতন তাকিয়ে থাকে। যদি এক পলকের জন্যও তাকে দেখা যায়। ভরত যখন ঘরের মধ্যে বসে পড়াশুনো করে, তখন তাকে দেখতে পারার উপায় নেই। কখনও কখনও সে বারান্দায় আসে, তার এক কোণে রান্নার উদ্যোগ করে, সেই সময় তার পিঠ কিংবা মুখের এক পাশ দেখতে পেলেই ভূমিসূতা ধন্য হয়। ভরত কিছুই টের পায় না। ইদানীং সে চুরুট টানা অভ্যেস করেছে, কলেজের ছাত্ররা প্রায় সকলেই তামাক খায়, ভরত অবশ্য নিজের বাড়িতে হুঁকো-তামাকের ব্যবস্থা রাখেনি, মাঝে মাঝে চুরুট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়, তখন সে পথের দৃশ্য দেখে, এদিকের ছাদ বা ঠাকুরঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করার কোনও প্রয়োজন তার ঘটে না। ঠাকুরঘরে পুজোর সব ব্যবস্থা করা ছাড়াও ভূমিসূতার অন্য আরও কাজ আছে। বড় তরফের গিন্নি ও ছেলেমেয়েদের বিছানা তুলতে হয়, এরা দেরি করে ওঠে, পুজোর কাজ সেরে ভূমিসূতা তা এক ফাঁকে এসে বালিশের ওয়াড় বদলায়, সুজনি চাদর কাচতে নেয়, তোশক রোদ্দুরে দেয়। এ ছাড়া তাকে কাঁথা সেলাই করতে হয়, ভূমিসূতা সূচিশিল্প জানে, কাঁথার ওপর সে নানারকম নকশা ফুটিয়ে তোলে। পান সাজার দায়িত্বও অনেকটা তার। জাঁতি দিয়ে এত সরু সরু করে সুপুরি কাটতে তার মতন আর কেউ পারে না। দুপুরবেলা গিন্নিমা পানের বাটা সামনে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেন, ভূমিসূতা সুপুরি, চুন, খয়ের, লবঙ্গ, এলাচ সঠিক পরিমাণে সাজিয়ে দেয়, গিন্নিমা নিজের হাতে খিলি করেন। ভূমিসূতার এত সব গুণ পছন্দ করেন বড় তরফের গিন্নি, তা বলে কোনও বিশেষ প্রশংসা বা পুরস্কার সে পায় না। সে তো টাকা দিয়ে কিনে আনা একটি দাসী, তাকে যা যা হুকুম করা হবে, সব কিছুই পালন করতে সে বাধ্য। ভূমিসূতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই, সে যেমন আছে তেমনই থাকবে, চিরকাল এরকম কাজ করে যাবে, এটাই যেন স্বাভাবিক। পান সাজার আসরে বড় গিন্নির সঙ্গে আরও দু’একজন মহিলা এসে যোগ দেয় মাঝে মাঝে। মুখরোচক পরনিন্দার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম বিয়ের সম্বন্ধ নিয়েও আলোচনা হয়। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কোন বাড়িতে বিয়ের যুগ্যি কন্যা আছে আর কোন বাড়ির ছেলে লায়েক হয়েছে, তাদের বিয়ের চিন্তায় এই সব মহিলাদের খুব মাথাব্যথা। রামাই দত্তদের বাড়ির একটি বারো বছরের মেয়ে এখনও অনুঢ়া, সে কি লজ্জার কথা! অমন ধিঙ্গি মেয়ের কপালে কি আর বর জুটবে এর পরে? কাছেই বসে ভূমিসূতা এক মনে সুপুরি কাটে, তার বয়েস প্রায় ষোলো, তার শরীরে যৌবনের সব লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তার বিয়ের কথা কিন্তু এই মহিলাদের একবারও মনে পড়ে না। সে যে দাসী! কাছে একটা বিড়াল বসে থাকলে যেমন গোপন কথা বলতে বাধা নেই, এই মহিলারা সেরকম গ্রাহ্যই করে না ভূমিসূতার উপস্থিতি। ভূমিসূতা কান খাড়া করে সব শোনে। তার ভারি আশ্চর্য লাগে, বড় গিন্নি এবং তাঁর সঙ্গিনীদের অধিকাংশ চটুল নিন্দেই অন্য মেয়েদের সম্পর্কে। মেয়েরাই যেন মেয়েদের প্রধান শত্রু। কৃষ্ণভামিনীর এক দিদির পুত্রবধূ, তার নাম নয়নতারা, সেই মেয়েটির প্রসঙ্গ ওঠে রোজ একবার। তারা থাকে জানবাজারে। সেই নয়নতারা নাকি শাশুড়ির মুখে মুখে কথা বলে, হাই হিল জুতো পরে মন্দিরে পুজো দিতে যায়, নাটক-নভেল পড়ে, স্বামী-শ্বশুরের সেবা না করে নিজেদের পল্লীর কতকগুলো হতভাগা ছেলেকে জুটিয়ে তাদের পড়াশুনো শেখায়, রান্নাঘরে মন নেই, এই রকম তার অনেক দোষ। এ বাড়ির এক বুড়ি পিসি ছড়া কেটে বলেন, ‘হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে, পাড়াপড়শী জব্দ হয় চোখে আঙুল দিলে’! হ্যাঁ লা, ভামিনী, তোর দিদি ওই বউটাকে ঝ্যাঁটা পেটা করে না কেন? অমন মেয়ের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে হয়। পড়ত যদি আমাদের হাতে…। নয়নতারা নামের মেয়েটিকে কখনও দেখেনি ভূমিসূতা, তবু তার জন্য কষ্ট হয়। একদিন জানা গেল, সেই নয়নতারা গায়ে আগুন দিয়ে তার সব জ্বালা জুড়িয়েছে। তাতে মহিলামহলের কী আনন্দ! যাক, আপদ বিদায় হয়েছে। “অভাগার ঘোড়া মরে, ভাগ্যবন্তের মাগ মরে!” বীরশ্বেরের আবার একটি ভালো দেখে বিয়ে দিতে হবে। পাত্রী তো তৈরি আছে, ওই রামাই দত্তের কন্যা। রামাই দত্তের নজর খুব উঁচু, এক একটি মেয়ের বিয়েতে লক্ষ টাকার সোনা-দানা দেয়। এদের এই পরচর্চার আসর থেকে ভূমিসূতা যখন তখন সরে পড়তে পারে। অন্য সব কাজই সে করে। কিন্তু কোনও কাজেই তার মন নেই। যখন তখন সে চলে যায় ছাদে, ভরতের ঘরের দিকে ব্যাকুল নয়নে চেয়ে থাকে। ভূমিসূতার এই দেবতাটিও পাথরের। কোনও সময়েই একটুও সাড়া দেয় না। ভরত যখন কলেজে চলে যায়, তখন ভূমিসূতা অনেকটা স্বাধীনতা পায়। দরজার তালা দেয় না ভরত, শুধু শিকল তুলে চলে যায়, নীচের সদর দরজা তো বন্ধই থাকে। ভূমিসূতা নির্জন দুপুরে শিকল খুলে চোরের মতন নিঃশব্দে ভরতের ঘরে ঢোকে। ভরতের চেয়ারে বসে, ভরতের পাঠ্য বই চোখের সামনে খুলে ধরে। ভরতের খাটেও একবার শুয়ে নেয় চট করে। এই ভাবে সে ভরতের স্পর্শ পায়। ভরতের ঘরের বই সে নিয়ে যেতে সাহস করে না, কিন্তু কোনও কোনও বই রোজ দুপুরে পড়ে যায় খানিকটা করে। এইভাবে সে বঙ্কিমচন্দ্রের বেশ কয়েকটি রচনা পড়ে ফেলেছে। একদিন সকালবেলা ছাদ থেকে দেখল, এ বাড়ির বিপরীত দিকে, রাস্তার ওপারে যে
false
humayun_ahmed
কল্পনা করলে স্পষ্ট দেখতে পায়। আপনার কথা বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন মনে কর ইমা। ইমাকে আমি কখনো দেখি নি। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তার মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তার নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘামও দেখতে পাই। মেয়েটার আবার খুব নাক ঘামে। মেয়েটা কে? ওকে আমি বিয়ে করব। তবে তাকে কখনো দেখি নি। আসলে তার অস্তিত্বও নেই। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। শুধু তুমি কেন? তোমাদের গুরুদেব মহাজ্ঞানী সিডিসিও কিছু বুঝতে পারবে না। সে কল্পনার এই ব্যাপারটা জানে। এই বিষয়ে তার প্রচুর পড়াশোনা আছে বলেই ব্যাপারটা সম্পর্কে তার ধারণা হয়ত আছে কিন্তু এর বেশি না। ভাল কথা, ঘুমুতে যাবার আগে আমি সিডিসিকে সামান্য কাজ দিয়ে গিয়েছিলাম। কাজটা কি সে করেছে? জ্বি করেছেন। উনার করা রিপোর্টটা খাবার টেবিলে রাখা আছে। কফি খেতে-খেতে আপনি রিপোর্টটার উপর চোখ বোলাতে পারেন। আমি এখন বিছানা থেকে নামব না। আজ ছুটির দিন তো। আজ আমি রিলা করব। আজ কি ছুটির দিন? হ্যাঁ আজ রবিবার। আপনি সামান্য ভুল করছেন। মহাকাশযানে সাপ্তাহিক হিসেব রাখা হয় না। গ্যালাকটিক ক্যালেন্ডার রাখা হয়। টাইম ডাইলেশন হিসেবের মধ্যে ধরে সময় রাখা হয়। গ্যালাকটিক ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখ 32116012. অবশ্যি এই হিসেবে মহাকাশযানের যাত্রীদের জৈবসময় ধরা হয় নি। খামোকা বকবক করবে না। মানুষ যে কোন দিনকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। আমি ঘোষণা দিচ্ছি আজ ছুটির দিন—আজ রোববার। জ্বি আচ্ছা। আমি রিপোর্ট এনে দিচ্ছি। আমি যখন ঘুমে ছিলাম তখন কেউ কি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল? মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছে আপনি ঘুমুচ্ছেন, আপনাকে এখন বিরক্ত করা যাবে না। ভাল বলেছ। তাকে বলে দেয়া উচিত ছিল আমি যখন জেগে থাকি তখনও আমাকে বিরক্ত করা যাবে না। আমাকে যখন-তখন বিরক্ত করার অধিকার শুধু একজনকেই দেয়া হয়েছে তার নাম ইমা। আপনি বলেছেন ইমার কোন অস্তিত্ব নেই। তাতে কী হয়েছে? আমি যদি গভীর ঘুমেও থাকি ইমা খবর দিলেই তুমি আমাকে ডেকে দেবে। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক আপনাকে যা বলার আমি বলে যাচ্ছি-মহান পদার্থবিদ সুরাও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। বেশি রকম উদ্বিগ্ন? জ্বি। উনি বলছিলেন অত্যন্ত জরুরি ব্যাপারে উনি কথা বলতে চান। তুমি এক কাজ কর। রিপোর্টটা আমার হাতে দাও এবং আমি যেন সুরার সঙ্গে কথা বলতে পারি তার ব্যবস্থা করে দাও। কোন্ বোতাম টিপতে হবে, কোন্ ডায়াল ঘুরাতে হবে কিছুই তো জানি না। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু সিডিসিকে বলবেন আপনি মহান সুরার সঙ্গে কথা বলতে চান। আজ ছুটির দিন তো আমি খুবই ক্লান্ত। আমি কাউকে কিছু বলতে পারব না। যা বলার আমার হয়ে তুমি বলে দাও। জ্বি আচ্ছা। আপনি কি আগে কথা বলবেন, না রিপোর্ট পড়বেন? আগে কথা বলব। আমার কথা শেষ হবার আগইে পর্দায় সুরার মুখ দেখা গেল। তাঁকে আসলেই খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। আমি হাসিমুখে বললাম, মহান সুরা! আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন? হ্যাঁ চেয়েছি—তুমি ঘুমুচ্ছিলে। আমি বললাম, তবু তোমার ঘুম ভাঙাতে, সিডিসি রাজি হল না। এখন ঘুম ভেঙেছে, বলুন ব্যাপারটা কী? তুমি যা ভেবেছ তা না। আমি কী ভেবেছি যা ঠিক না। ঐ যে তুমি বললে ল্যাঝিম সমীকরণের সমাধান চুরি করেছে। আসলে সে তা করে নি। পদার্থবিদ ভদ্ৰলোকও তোমার মতো ভেবেছিলেন। তিনি ল্যাঝিমের কপোট্রন খুলে পরীক্ষা করেছেন। ল্যাঝিম নির্দোষ। তাহলে তো ব্যাপারটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। জট পাকাচ্ছে মানে? খুবই জট পাকিয়ে গেছে। আমি ভয়ংকর টেনশান বোধ করছি। বই শেষ হতে কত বাকি? আর চল্লিশ পৃষ্ঠার মতো আছে। আপনি দয়া করে দ্রুত বইটা শেষ করে আমাকে ব্যাপারটা কী জানান। আমার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। সত্যি কথা বলেছ। মন দিয়ে যে বইটা পড়ব তাও পারছি না। লিলিয়ান একটু পর-পর যোগাযোগ করছে। সে মিটিং-এর পর মিটিং করছে। মহাউত্তেজিত। উত্তেজিত কেন? তার ধারণা হয়েছে কম্পিউটার সিডিসি বিগড়ে গেছে। মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু তার হাতে সেহেতু যে কোন সময় একটা বড়রকমের দুর্ঘটনা ঘটবে। লিলিয়ান চাচ্ছে হাইপার ডাইভে যাবার আগেই পুরো ব্যাপারটা নিষ্পত্তি থোক। আমরা কতক্ষণে হাইপার ডাইভে যাচ্ছি? আমাদের হাতে সময় অল্পই আছে। এত অল্প সময়ে সবকিছুর সমাধান হওয়া প্রায় অসম্ভব। আমি নিজেও এই বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিতে পারছি না—কারণ আমি ব্যস্ত। জ্বি বুঝতে পারছি। বইটা যে দ্রুত পড়ে শেষ করব তাও পারছি নাসাবধানে পড়তে হচ্ছে। অবশ্যই সাবধানে পড়বেন। আপনি তো আর পদার্থবিদ্যার সূত্র পড়ছেন। না যে হুড়হুড় করে পড়ে যাবেন। আপনি পড়ছেন উপন্যাস। মন লাগিয়ে পড়তে হবে তো? ঠিক বলেছ। স্যার আমি তাহলে বিদায় নিচ্ছি। আপনি বইটা পড়ে শেষ করুন। তারপর কথা হবে। সিডিসি তোমার কোন সমস্যা করছে না তো? জি না করছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে। আমার ধারণা সে আমায় অতিরিক্ত খাতির করছে। তুমি কি এতে বিস্মিত হচ্ছ? না আমি বিস্মিত হচ্ছি না। স্রুরা হাসিমুখে বললেন, আমিও বিস্মিত হচ্ছি না। এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে। কম্পিউটার সিডিসির তৈরি করা রিপোর্টটা আমি পড়তে শুরু করেছি। বেশ গুছিয়ে লেখা রিপোর্ট। পড়তে ভাল লাগছে। সিডিসি হয়ত আমার ডিএনএ প্রফাইল থেকে
false
MZI
লেগেছে? কৰি কিং–চৌধুরী চমকে উঠে বলল, কেঁন সঁর্দি লাঁগবে কেঁন? আমি বললাম, ফ্যাঁত করে নাকটা ঝেড়ে সর্দি ক্লিয়ার করে ফেলুন, তা হলে আর নাঁকি সুঁরে কঁথা বঁলতে হঁবে নাঁ। আমি কথা শুনে কবি কিংকর চৌধুরী কেমন জানি শিউরে উঠল, মনে হল ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবে! তার আগেই মিলু আর বিলু হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করে। শিউলি ধমক দিয়ে বলল, ভেতরে যাও মিলু-বিলু। অভদ্রের মতো হাসছ কেন? আমি এসকে দুই হাতে ধরে নিয়ে গেলাম। বিলু আর মিলুর সাথে আমিও তখন হা হ কা হাতে আ: করেছি। হাসির মতো ছোঁয়াচে আর কিছু নেই। মিলু-বিলুর ঘরে আমি ঘামে ভেজা শার্ট খুলে আরাম করে বসলাম। বিলু ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছে, মিলু তারপরেও একটা পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। আমি পেট চুলকাতে চুলকাতে এলাম, তারপর বল তোদের কী খবর? মিলু মুখ কালো করে বলল, খবর ভালো না মামা। কেন? কী হয়েছে? দেখলে না নিজের চোখে? কবি কাকু এসে আমাদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে! আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, কেন? কী হয়েছে? আমরা জোরে কথা বলতে পারি না। হাসতে পারি না। টেলিভিশন দেখতে পারি না। আম্মু এই লম্বা লম্বা কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে। আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, এত বড় সাহস শিউলির? বিলু বলল, শুধু আম্মু না মামা–আব্বুও সাথে তাল দিচ্ছে। বিলু বলল, তাল দিচ্ছে বলছিস কী? আব্বুই তো প্রথমে কবি কাকুকে বাসায় আনল। আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় আউক করে শব্দ করলাম। সাথে সাথে মিলু আর বিলু হি হি করে হাসতে শুরু করল। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, হাসছিস কেন গাধা? মিলু হাসতে হাসতে বলল, তুমি যখন আউক শব্দ কর সেটা শুনলেই হাসিতে পেট ফেটে যায়। আমি বললাম, আমি মরি যন্ত্রণায় আর তোরা সেটা নিয়ে হাসিস? মায়া-দয়া বলে তোদের কিছু নেই? সেটা শুনে দুজনে আরো জোরে হাসতে শুরু করে। কিন্তু একটু পরেই তাদের হাসি থেমে গেল। মিলু মুখ কাচুমাচু করে বলল, এই কবি কাকু আসার পর থেকে বাসায় কোনো আনন্দ নেই, খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, খাওয়াদাওয়া নষ্ট হয়েছে মানে? কবি কাকু খালি শাকসবজি খায় তো, তাই বাসায় আজকাল মাছ-মাংস কিছু রান্না হয় না। আমি বললাম, বলিস কী তোরা? সত্যি মামা। বিশ্বাস কর। এই কবি মাছ-মাংস খায় না? উঁহ। শুধু শাকসবজি। আর খাবার স্যালাইন। খাবার স্যালাইন! আমি অবাক হয়ে বললাম, খাবার স্যালাইন একটা খাবার জিনিস হল নাকি? আমি না শুনেছি মানুষের ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খায়! বিলু মাথা নাড়ল, উঁহুঁ মামা। কবি কাকু সব সময় চুকচুক করে খাবার স্যালাইন খেতে থাকে। আম্মু আপুকে বুঝিয়েছে এটা খাওয়া নাকি ভালো, এখন আন্ধু-আম্মু সব সময় আমাদেরকে স্যালাইন খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এত বড় সাহস শিউলির আর শরীফের? মিলু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আম্মু-আব্দুর দোষ নাই মামা। সব ঝামেলা হচ্ছে কৰি কাকুর জন্য—- আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, খুন করে ফেলব এই কবির বাচ্চা কবিকে— করতে চাইলে কর, কিন্তু দেরি কোরো না। দেরি হলে কিন্তু আমাদের জীবন শেষ। আর না করতে চাইলে এখনি বলে দাও। বিলু মুখ শুকনো করে বলল, আমাদের মিছিমিছি আশা দিও না। আমি বিলু আর মিলুর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললাম, বিলু, মিলু তোরা চিন্তা করিস না। আমি কোনো একটা হেস্তনেস্ত করে দেব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখ। আমি সবকিছু স্যু করতে পারি কিন্তু খাওয়ার ওপরে হস্তক্ষেপ কোনোভাবে সহ্য করব না। উত্তেজনায় বেশি জোরে ঝাকুনি দিয়ে ফেলেছিলাম বলে যন্ত্রণায় আবার শব্দ করতে হল, আউক। আর সেই শব্দ শুনে বিলু আর মিলু আবার হি হি করে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পর শিউলি এসে বলল, ভাইয়া খেতে অস। আর তোমার দোহাই লাগে, খাবার টেবিলে বসে তুমি কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আমি কখনো উল্টাপাল্টা কথা বলি না। কিন্তু আমার সাথে কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললে আমিও তাকে ছেড়ে দিই না। শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, ভাইয়া, প্লিজ! কবি কিংকর চৌধুরী খুব বিখ্যাত মানুষ, খুব সম্মানী মানুষ। তাকে যা ইচ্ছে তা বলে ফেললা না। সে যদি বলে আমি তাকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? আর পেতনির মতো নাকি সুরে কথা স্বলে কেন? শুনলেই মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়। শিউলি বলল, ওনার কথা বলার স্টাইলই ওরকম। স্টাইলের খেতা পুড়ি। এরপর থেকে বলবি নাক ঝেড়ে আসতে। শিউলি কঁদো কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, ভাইয়া প্লিজ! খাবার টেবিলে গিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। মিলু আর বিলু ঠিকই বলেছে, টেবিলে শাকভর্তা ডাল এরকম কিছু জিনিস। মাছ-মাংস-ডিম জাতীয় কিছু নেই। কবি কিংকর চৌধুরী ঢুলুঢুলু চোখে বলল, শিউলি তোমার হাতেঁর পটল ভর্তাটা যা চমৎকার, একেবারে বিষ্ণু দের একটা কবিতার অঁতো। শিউলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললাম, কী রে শিউলি! শুধু দেখি ঘাস লতা পাতা বেঁধে রেখেছিস। আমাদেরকে কি ছাগল পেয়েছিস নাকি? শিউলি বলল, আজকে নিরামিষ মেনু। মানুষকে দাওয়াত দিয়ে নিরামিষ খাওয়াচ্ছিস, ব্যাপারটা কী? কবি কিংকর চৌধুরী বলল, মাঁছ মাঁংস খাওয়া বর্বরতা! ওঁসব খেঁলে পঁশু রিঁপু জেঁগে ওঁঠে। কে বলেছে? আমি টেবিলে কিল দিয়ে বললাম, পৃথিবীর সব মানুষ মাছ-মাংস খাচ্ছে। তাদের
false
nihar_ronjon_gupta
অশ্রু। ভুলে যাও–ভুলে যাও সব ব্যাপারটা— দাদা, এতদিন জানতাম কিরীটী রায়ের কাছে অন্যায়ের পাপের কোন ক্ষমা নেই কিন্তু আজ বুঝলাম, এত বড় ক্ষমা বোধ হয় একমাত্র কিরীটী রায়ের পক্ষেই সম্ভব। ওরে না না—আমিও মানুষ—দোষ-গুণ-ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই তোমাদের কিরীটী রায়। গাড়ি তখন কিরীটী বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছে। কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে গেল। আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ মৃদু আলোর ঝরনা দিয়ে যেন পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। টেলিগ্রামটা এসেছিল বিকেলের দিকে–সংক্ষিপ্ত তার। টেলিগ্রামে লেখা ছিল : সুকুমার, বিবাহ করেছি। তোমার নতুন বৌদিকে নিয়ে আগামী শনিবার সকালের ট্রেনে পৌছাব। শরদিন্দু। আগামী শনিবার মানে কাল বাদে পরশুই। মনে মনে হিসাব করে দেখল সুকুমার, হাতে মাত্র একটা দিন তাহলে আর আছে। কোন্ ট্রেনে এবং ঠিক কখন ট্রেনটা পৌছাবে হাওড়া স্টেশনে সেসব কিছুই নেই তারবার্তার মধ্যে। টেলিগ্রামটা পেয়ে সুকুমার কম বিস্মিত হয়নি। তা বিস্মিত হবারই কথা। শরদিন্দুর যখন প্রায় চল্লিশ বৎসর বয়স তখনই তার প্রথমা স্ত্রী মানসী আকস্মিক ভাবে মারা যায় জলমগ্ন হয়ে সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে। স্ত্রী মানসীকে হারিয়ে শরদিন্দু যখন একা ফিরে এসেছিল পুরী থেকে—সুকুমার চমকে উঠেছিল। শরদিন্দুর চোখেমুখে যেন একটা সর্বস্ব হারানোর ব্যথা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো—চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল। সারামুখে খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। সুকুমার শুধিয়েছিল, কি হয়েছে শরদিন্দুদা, তুমি একা কেন—বৌদি কোথায়? শরদিন্দু ফ্যালফ্যাল করে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুকুমারের মুখের দিকে। ঠোঁট দুটো তার অল্প অল্প কাঁপছে।–মানসী নেই সুকুমার! নেই? বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুকুমার শরদিন্দুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ। সত্যি সুকুমার যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে ড়ুবে গিয়েছে মানসী। সে কি! অনেক বারণ করেছিলাম রে, সমুদ্রে আমার সঙ্গে স্নান করতে নেমো না কিন্তু শুনল না। আমার কথা। আত্মীয়-পরিচিতের দল সবাই জানত শরদিন্দু কি প্রচণ্ড ভালোবাসত তার স্ত্রীকে। মানসীকে নিজে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিল শরদিন্দু বৎসর দুই আগে। অমন সুখী দম্পতি বড় একটা চোখে পড়ত না সচরাচর। এক দণ্ড স্ত্রীকে চোখের সামনে দেখলে যেন পাগল হয়ে যেত শরদিন্দু। প্রথম প্রথম হাসত নীরজা স্বামীর রকমসকম দেখে। পরে কিন্তু তার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় বাসা বেঁধেছিল। সুকুমারকে একদিন মানসী বলেছিল, জান সুকু, আমার কেন যেন বড্ড ভয় করে। ভয়? ভয় কিসের বৌদি? ভয় তোমার দাদার ঐ প্রচণ্ড ভালোবাসাকে। সুকুমার হেসেছে, বলেছে, কি যে বল বৌদি! না, না সত্যি ভাই, তোমার দাদা কাছে এলেই—আমার যেন মনে হয়— দাদা চিরদিনই ঐরকম বৌদি। যাকে সে ভালোবাসে, তাকে যেন এক দণ্ড চোখের আড়াল করতে চায় না। শরদিন্দুর ঔষধ তৈরির একটা কারখানা ছিল বাগমারিতে। কারখানাটা খুব বিরাটও নয়, আবার ছোটও নয়। ঔষধের ব্যাপারটা নিজে ভাল করে যাতে বুঝতে পারে বিলেতে গিয়ে তাই বি-ফারমা পাস করে এসেছিল। কারখানাটা ছিল যেন তার প্রাণ। সকাল সাড়ে নটায় স্নান সেরে শুরু হত প্রস্তুতি। বরাবর সুকুমার দেখেছে দশটা বাজতেই শরদিন্দুর গাড়িটা বের হয়ে যেত। হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরুত শরদিন্দু, লাঞ্চ কারখানাতেই সারত। ফিরত সেই রাত সাড়ে নটা—কোন কোন দিন রাত দশটা—আবার সাড়ে দশটাও বেজে যেত বাড়িতে ফিরতে। একরাশ ফাইল নিয়ে ফিরত। বাড়ি ফিরে স্নান করে ঘরে বসত। ভৃত্য গোকুল ইতিমধ্যে টেবিলে স্কচ হুইস্কির বোতল-গ্লাস রেখে যেত, মধ্যে মধ্যে গ্লাসে চুমুক দিত শরদিন্দু আর ফাইল দেখত। রাত এগারোটা বাজলে গোকুল এসে সামনে দাঁড়াত।–খাবার কি টেবিলে দেব? আর একটু পরে-বলে শরদিন্দু আবার তার ফাইলে মনোসংযোগ করত। গোকুল চলে যেত। আবার আধঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গোকুল এসে সামনে দাঁড়াত। এবার খাবার দেব টেবিলে? দিবি—আচ্ছা দে! সুকুমার খেয়েছে? হ্যাঁ, সুকুদাদা তো কখন খেয়ে শুয়ে পড়েছে। সুকু আজ কারখানা থেকে কখন ফিরেছিল রে গোকুল? শরদিন্দু শুধাত। গোকুল বলত, সুকুদাদাবাবু তো সেই সন্ধ্যাবেলাতেই ফিরে এসেছে। শরদিন্দু হাসত। বলত, সুকুটা জীবনে কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না। গোকুল অনেক দিন আছে ঐ বাড়িতে। হিসেব করলে খুব কম করেও পনেরো বছর তো হবেই। সেই শরদিন্দুর বাবা রজতসিন্ধুর আমল থেকে। খেতে খেতে প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে কথা হত। গোকুল একসময় বলত, এবারে একটা বিয়ে কর খোকাবাবু! বিয়ে? খেতে খেতে তাকাত শরদিন্দু ভৃত্যের মুখের দিকে। হ্যাঁ। এ কি একটা বাড়ি—এ যেন একটা ভূতুড়ে বাড়ি। গোকুল বলত, বয়স তো চল্লিশ হতে চললকবে আর বিয়ে করবে? তোর মতে এবারে একটা বিয়ে করা দরকার, তাই না রে গোকুল? শরদিন্দু বলত, ঠিক বলেছিস। বিয়ে সত্যিই একটা বোধ হয় করা দরকার এবার। ঠিক আছে, সামনের মাসেই বিয়ে করে ফেলব একটা তুই দেখে নিস। কিন্তু সে সামনের মাস আর আসত না। অবশেষে সত্যিই একদিন হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল শরদিন্দু। ঘটনাটা আকস্মিকই বলতে হবে। পরেশ নন্দী কারখানার অনেক দিনের পুরাতন কর্মচারী, অ্যাকউন্টস রাখতেন। ক্রনিক হাঁপানির রোগী, প্রায়ই অসুস্থ হতেন। অফিসে আসতে পারতেন না। একদিন শরদিন্দু বললে, আপনি এবার রিটায়ার করুন পরেশবাবু। কিন্তু স্যার– মাসে একশো টাকা করে পেনসন পাবেন, যান এখন সামনের মাস থেকে রিটায়ার করবেন। ঐ এক ধরনের মানুষ ছিল শরদিন্দু, যা একবার বলবে তা করবেই। পরেশ নন্দী সেটা জানতেন। তাই পরেশ নন্দী বুঝতে পারেন, তাকে রিটায়ার করতেই হবে এবারে। শরদিন্দু কথাটা বলে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছিল—কোম্পানিতে যে নতুন সায়েন্টিস্ট এসেছেন, কমলেশ ব্যানার্জী, তিনি নতুন একটা ফরমুলা বের করেছেন বেবি ফুডের—সেই। কাগজপত্রগুলোই খুঁটিয়ে দেখছিল শরদিন্দু—তাতে মনোসংযোগ করল। পরেশ
false
manik_bandhopaddhay
ক্লাবে বনানীর পদার্পণ ঘটত কদাচিৎ বিশেষ কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপার। থাকলে। ক্লাবের সভ্য হলেও সে বাইরের নিমন্ত্রিতাদের একজনের মতো আলগোছে গা বাঁচিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগদানের দায় সেরে বিদায় নিত। ক্লাবের দৈনন্দিন মেলামেশা খেলাধুলা গল্পগুজব আনন্দ করার সঙ্গে কোনোদিন তার সম্পর্ক ছিল না। আজকাল মাঝে মাঝে আসে, ক্লাবের সান্ধ্য জীবনে অংশগ্রহণ করে। কারো সঙ্গে মেলামেশা আলাপ আলোচনায় তার এতটুকু দ্বিধা সঙ্কোচের ভাব দেখা যায় না। জমকালো রূপ, বেশভূষাতেও এদেশী আভিজাত্যের মার্জিত রুচির চরম নিদর্শন–নিজেকে জাহির করার জন্যেই বনানী যেন এভাবে সেজেগুজে ক্লাবে আসে। বনানীকে দশজনের চেয়ে চেয়ে দেখা নিজের চোখে চেয়ে দেখেই প্রভাসের অহঙ্কার ও আনন্দ উল্লাসের যেন সীমা থাকে না। বনানীকে ভালবাসার জন্য, আদর করার জন্য এক অদম্য অদ্ভুত ব্যাকুলতা ও উন্মাদনা জাগে। বাড়িতে যাকে সর্বদা কাছে পাওয়া যায়, আদরে সোহাগে আপন করা যায়, আলিঙ্গনের বাঁধন মানতে যে সুখী হয় অনাত্মীয়া অলভ্যা প্রিয়ার মতোই তার চলাফেরা প্রভাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে দ্যাখে। তবু কেন পেগ চালিয়ে যায়। কোনো তত বাধা নেই মদ গেলার পালা সাঙ্গ করে সজ্ঞানে ওই বনানীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরার–নানা বেশে সাজিয়ে অথবা সমস্ত সাজ খুলে ফেলে দুটি চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে ওর রূপ দেখার। কিন্তু প্রভাস জানে, বাড়ি যখন ফিরবে, বনানীর সঙ্গেই হয়তো ফিরবে, ততক্ষণে মন থেকে মিলিয়ে যাবে এই রঙিন মোহ নেশার রঙে জগৎ সংসারের মতো বনানীও অন্যরকম হয়ে যাবে। মাতাল হয়তো সে হবে না, রোজ সে মাতাল হয় না। কিন্তু বনানীর জন্য এখানকার এখনকার এই মোহের ঘোরটাকে বাড়ি ফিরে মনে হবে হাস্যকর ছেলেমানুষি মমি। ক্লাবে বনানী নানারকম কানাঘুষা শোনে। সে সমস্তের মোট কথাটা এই যে, চাষী মজুরেরা নাকি ক্ষেপে যাবার ফিকিরে আছে। ইভা তাকে বলে, তোমার ভদ্রলোকটির হয়েছে দুদিক দিয়ে মুশকিল। একদিকে জমিদারি, আরেকদিকে কারখানা। অথচ ওর কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত ভাব। শুধু কারখানার ভাবনায় বার্টির রাত্রে ঘুম হয় না। বনানী বলে, ঘুম পাড়িয়ে দিলেই পার। একসাথে বাড়ি ফেরার সময় প্রভাস প্রায় প্রকৃতিস্থ থাকলেও বনানী ওসব কথা তোলে নাসকালবেলার জন্যে মুলতুবি রেখে দেয়। একথা ওকথা বলতে বলতে একসময় সহজভাবে জিজ্ঞাসা করে, আজ বাড়ি গিয়ে আর না খেয়ে পারবে না? প্রভাস সরলভাবে বলে, বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করে দেখি। কথা দিয়ে হয়তো কথা রাখতে পারব না। বাড়ি ফিরে দোতলার মন্দিরের পাশে খোলা ছাদে আকাশের নিচে চুপচাপ বসে প্ৰভাস খানিকক্ষণ নিজের মনে কি যেন সব ভাবে। তারপর মেঘনাদকে ডেকে বোতল গ্লাস দিতে বলে বনানীকে ডেকে পাঠায়। বনানীর সামনে নিজের হাতে গ্লাসে মদ ঢালে। বনানী লক্ষ করে, পেগের হিসাব বাতিল করে সে খুশির হিসাবে মদ ঢেলেছে। বনানী গা এলিয়ে দেয় না। জোরে একটু নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলে না। আশ্চর্য এই, এ অবস্থাতেও সে তুলতে পারে না যে, তার বড় খিদে পেয়েছে। প্রভাস ডেকে না পাঠালে সে খেতে বসে যেত। প্রভাস গ্লাসে চুমুক দিয়েও আশ্চর্য রকম ধীর শান্ত স্বাভাবিক গলায় কথা বলে–বনানী ভাবে, আর কতক্ষণ বজায় থাকবে এই শান্ত সুস্থ ভাব? প্রভাস বলে, আমি কি ভাবি না? বুঝবার চেষ্টা করি না? অনেক ভেবেছি, এটুকু বুঝেছি যে, আমার মধ্যে একটা সাংঘাতিক গলদ আছে–কিন্তু আসল ব্যাপার আজো বুঝতে পারি নি। বিশ্বাস কর, শুধু নেশার জন্যে আমি মদ খাই না, অন্য কারণ আছে। এটা আমার কল্পনা নয়, বানানো কথা নয়। তুমি যখন গঙ্গাসাগরে গিয়েছিলে, আমি কলকাতায় তিনজন বড় স্পেশালিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করেছি। অনেকরকম পরীক্ষা দরকার ছিল, সে সব ভবিষ্যতের জন্য রেখে আমি শুধু মোটামুটি ওপিনিয়ন চেয়েছিলাম। ওদের মতও তাই–আমার মধ্যে একটা গোলমাল আছে। শারীরিক মানসিক কারণ জড়ানো গোলমাল–জটিল ব্যাপার। ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগবে, চিকিৎসা করে সারাতেও সময় লাগবে। বনানী চুপ করে থাকে। আরেকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে প্রভাস বলে যায়, মানে জানি না কিন্তু ব্যাপারটা জানি। আমার কিছু ভালো লাগে না। কোনো অভাব নেই, স্বাস্থ্য খারাপ নয়, তোমার মতো এমন আমার বৌ তবু আমার কিছু ভালো লাগে না। দুঃখ কষ্ট কিছু নয়, জ্বালা যন্ত্ৰণা টের পাই না, জীবনটা শুধু বিস্বাদ লাগে। অসুখ নেই কিন্তু সুখ বলেও আমার যেন কিছু নেই। সোজা কথায় ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় জান? ধর দিন-রাত সবসময় তুমি কিছু চাওকী চাও তা জান না। বনানী চুপ করে থাকে। মনে মনে হাসছ না তো? বনানী এ কথার জবাব না দিয়ে বলে, কিছুদিন বাইরে গিয়ে থাকলে, বিশ্রাম করলে– প্রভাস একটু হাসে। বাইরে যাই নি আমি?–কতবার গিয়েছি তুমিও তো জান। একা গিয়েছি, তোমায় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু স্বস্তি পাই নি। বনানী ভেবেচিন্তে বলে, এটাই হয়তো বৈরাগ্য–মানুষ যেজন্যে সংসার ছেড়ে চলে যায়, সন্ন্যাসী হয়ে যোগসাধনা করে। প্রভাস গ্লাসটা খালি করে, বলে, সংসার ছাড়তে আমার একটুও ইচ্ছা করে না। আমি যে ভালো না লাগার কথা বলছি তার অন্যরকম মানে কোরো না। তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে আমি কয়েকদিনের মধ্যেই মরে যাব। বনানী চুপ করে থাকে। প্রভাস এবার খানিকটা বিহ্বলতা, খানিকটা ব্যাকুলতার সঙ্গে বলে, বিশ্বাস কর, সত্যি মরে যাব। লোকে হয়তো বলবে মদ খেয়ে খেয়ে মরেছে কিন্তু আসলে তোমার জন্যেই মরে যাব। বনানী বলে, তা জানি। মাতাল হয়েও নইলে আমার ধমকে ঠাণ্ডা হয়ে যাও। নেশা জমাট বাঁধছিল, প্রভাস খুশি হয়ে উঠে এসে বনানীর মাথায় গাল রেখে দাঁড়ায়, একটু জড়ানো সুরে বলে,
false
tarashonkor
সে কথা তিনকড়ি জানে না। কিন্তু সে অধীরভাবেই বলিল—লোকের নরকেও ঠাঁই হবে না। সে কথা আমি কুসুমপুরওয়ালাদের বলে এলাম। –কুসুমপুরওয়ালারাও এই কথা আলোচনা করছে নাকি? –তারাই তো করছে। বলছে-দের ঘোষ মুখুয্যেবাবুদের সঙ্গে তলায় তলায় ষড় করছে। নইলে ডায়রি করতে তার করতে সঙ্গে গেল না কেন? শুনিয়া দেবুর সর্বাঙ্গ যেন হিম হইয়া গেল। তিনকড়ি বলিল—আরও বলছে দেবু ঘোষ যখন কাছারিতে ওঠে, তক্ষুনি বাবু ইশারায় দেবুকে চোখ টিপে দিয়েছিল। তাতেই দেবু মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে। দেবু যেন পাথর হইয়া গিয়াছে; কোনো উত্তর দিল না, নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিল। সংবাদটা আরও বিশদভাবে পাওয়া গেল তারাচরণ নাপিতের কাছে। পাঁচখানা গ্রামেই তাহার যজমান আছে। নিয়মিত যায় আসে। সে বিবৃতির শেষে মাথা চুলকাইয়া বলিল—কি আর বলব বলুন, পণ্ডিত! দেবু চুপ করিয়া ভাবিতেছিল মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা। তারাচরণ আবার বলিল—কলিকালে কারুর ভাল করতে নাই! তারাচরণ এ সব বিষয়ে নির্বিকার ব্যক্তি, পরনিন্দা শুনিয়া শুনিয়া তাহার মনে প্রায় ঘটা পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তবু দেবনাথের প্রসঙ্গে এই ধারার ঘটনায় সে ব্যথা অনুভব না করিয়া পারে নাই। দেবু বলিল—এর মধ্যে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বাড়ি গিয়েছিলে? –গিয়েছিলাম; ঠাকুর মশাইও শুনেছেন। –শুনেছেন? –হ্যাঁ। ঘোষ একদিন ঠাকুর মশায়ের কাছেও গিয়েছিল কিনা। –কে? শ্ৰীহরি? –হ্যাঁ। ঘোষ খুব উঠে পড়ে লেগেছে। কাল দেখবেন একবার কাণ্ডখানা। –কাণ্ড? –পাঁচখানা গায়ের মধ্যে কঙ্কণা-কুসুমপুরের কথা বাদ দেন। বাদবাকি গায়ের মাতব্বর মোড়লদের কাণ্ডকারখানা দেখবেন। ঘোষ কাল ধানের মরাই খুলবে! —শ্ৰীহরি ধান দেবে তা হলে? –হ্যাঁ। যারা এই পঞ্চগেরামী মজলিসের কথায়, ঘোষের কথায় যায় দিয়েছে, তাগিদে ঘোষ ধান দেবে। অবিশ্যি অনেক লোক রাজি হয় নাই, তবে মাতব্বরেরা সবাই চলেছে। মোড়লদের মধ্যে কেবল দেখুড়ের তিনকড়ি পাল বলেছে—৩ মি ওসবের মধ্যে নেই। দেবু আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। আজ তাহার মাথায় যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। নানা উন্মত্ত ইচ্ছা তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছে। মনে হয় দেখুড়িয়ার ওই দুর্দান্ত ভল্লাদের নেতা হইয়া এ অঞ্চলের মাতব্বরগুলোকে ধ্বংস করিয়া দেয়। সর্বাগ্রে ওই শ্ৰীহরিকে। তাহার। সর্বস্ব লুঠতরাজ করিয়া তাহাকে অন্ধ করিয়া, তাহার ঘরে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। তারাচরণ বুলিলচাষের সময় এই ধানের অভাব না হলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন হত না, ধর্মঘট করে মাতব্বরেরাই ক্ষেপেছিল। আপনাকে ওরাই টেনে নামালে। কিন্তু ধান বন্ধ হতেই মনে মনে সব হায়-হায় করছিল। এখন ঘোষ নিজে থেকে যেই মজলিশ করে আপনাকে পতিত করবার কথা নিয়ে মোড়লদের বাড়ি গেল, মোড়লরা দেখলে—এই ফঁক; সব একেবারে ঢলে পড়ল। তা ছাড়া– —তা ছাড়া? স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া দেবু প্রশ্ন করিল। –তা ছাড়া—তারাচরণ আবার একটু থামিয়া বলিল—একালের লোকজনকে তো জানেন গো; স্বভাব-চরিত্র কটা লোকের ভাল বলুনঃ কামার-বউয়ের, দুর্গার কথা শুনে লোকে সব রসস্থ হয়ে উঠেছে। …হুঁ। এ সম্বন্ধে ন্যায়রত্ন মশায় কি বলেছেন জান? শ্ৰীহরি গিয়েছিল বললে যে? হাত দুইটি যুক্ত করিয়া তারাচরণ প্রণাম জানাইয়া বলিল—ঠাকুর মশায়? সে হাসিল, হাসিয়া বলিল—ঠাকুর মশায় বলেছেন,আহা—বেশ কথাটা বলেছেন গো! পণ্ডিত লোকের কথা তো! আমি মুখস্ত করেছিলাম, দাঁড়ান মনে করি। একটু ভাবিয়া সে হতাশভাবে বলিলনা, আর মনে নাই। হ্যাঁ, তবে বলেছেন—আমাকে ছাড়ান দাও। তুমি পাল থেকে ঘোষ হয়েছ, তুমিই তো মস্ত পণ্ডিত হে! যা হয় কঙ্কণার বাবুদের নিয়ে করগে। ন্যায়রত্ব শ্রীহরিকে বলিয়াছিলেন—আমার কাল গত হয়েছে ঘোষ। আমি তোমাদের বাতিল বিধাতা। আমার বিধি তোমাদের চলবে না। আর বিধি বিধানও আমি দিই না। তারপরও হাসিয়া বলিয়াছেন-কঙ্কণার বাবুদের কাছে যাও তারাই তোমাদের মহামহোপাধ্যায়; তুমি পাল থেকে ঘোষ হয়েছ—নিজেই তো একজন উপাধ্যায় হে! দেবু সান্ত্বনায় জুড়াইয়া গেল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নিজের উন্মত্ততাকে সে শাসন করিল। ছি ছি! সে এ কি কল্পনা করিতেছে? তারাচরণ বলিল—কঙ্কণার বাবুদের কথা উঠল তাই বলছি; কুসুমপুরের শেখদের ব্যাপারে আপনাকে নিয়ে কথাটা কে রটিয়েছে জানেন? ওই বাবুরাই! –বাবুরা? কি রটিয়েছে? –হ্যাঁ। বাবুদের নায়েব নিজে বলেছে ইরসাদকে। বলেছে, দেবু ঘোষ কাছারিতে উঠেই বাবুকে চোখ টিপে ইশেরা করেছিল যে, হাঙ্গামা বেশি বাড়বে না আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তা নইলে বাবু রহমকে ছেড়ে দিতেন না। বাবুও বুঝে দেবুকে ইশেরা করে এক হাত দেখিয়ে দিয়েছেন–আচ্ছা, মিটিয়ে দাও; তা হলে পাঁচশো টাকা দেব। দেবু বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া গেল। বাবুদের নায়েব এই কথা বলিয়াছে! দেবু অবাক হইয়া গেলেও কথাটা সত্য। মুখুয্যেবাবুর মত তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি সত্যই বিরল। মুসলমানেরা যখন দল বাঁধিয়া আসিয়াছিল তখন তিনি বিচলিত হইয়াছিলেন, একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা আশঙ্কা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে তিনি ভয় পান নাই। বরং তিনি এমন ক্ষেত্রে তাহাই চাহিয়াছিলেন; তাহা হইলে মরিলে মরিত কয়েকজন দারোয়ান চাপরাসী এবং জনকয়েক মুসলমান চাষী; তিনি সর্বপশ্চাতে আগ্নেয়াস্ত্রের আড়ালে অক্ষত থাকিতেন। তারপর মামলাপর্বে তাঁহার বাড়ি চড়াও করিয়া লুঠতরাজ এবং দাঙ্গার অভিযোগে এই চাষীকুলকে তিনি নিষ্পেষিত করিয়া দিতে ন। কিন্তু দেবু আসিয়া ব্যাপারটা অন্য রকম করিয়া দিল। দেবুর জীবনের কাহিনীও তিনি শুনিয়াছেন; সে কাহিনী দেবুকে এমন একটা মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়াছে, যাহার সম্মুখে তাহার মত ব্যক্তিকেও সঙ্কুচিত হইতে হয়। কারণ দেবু জীবনে যাহা পারিয়াছে, তিনি পারেন নাই। দেবু তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া জনতাকে শান্ত রাখিয়া নিমেষে রহমকে উঠাইয়া লইয়া গেল। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। সমস্ত অপরাধ এখন তাহার ঘাড়ে। ঠিক এই সময় তাঁহার কানে আসিল—কঙ্কণার অপর কোনো বাবুর নায়েব যে পরামর্শ দিয়াছে সেই কথা; আরও শুনিলে দেবু মিথ্যা ডায়রি করিতে এবং তার পাঠাইতে চায় না বলিয়া থানায় যায়
false
robindronath
“অভাব কী। আমারই তো ভাসুরের এক মেয়ে আছে, যেমন সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী। মেয়েটির বয়স হইল, কেবল উপযুক্ত বরের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করিয়া আছে; তোমার মতো কুলীন পাইলে এখনি বিবাহ দিয়া দেয়।” স্বামী চকিত হইয়া কহিলেন, “বিবাহের কথা কে বলিতেছে।” পিসিমা কহিলেন, “ওমা, বিবাহ না করিলে ভদ্রঘরের মেয়ে কি তোমার ঘরে অমনি আসিয়া পড়িয়া থাকিবে।” কথাটা সংগত বটে এবং স্বামী তাহার কোনো সদুত্তর দিতে পারিলেন না। আমার রুদ্ধ চক্ষুর অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে আমি একলা দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বমুখে ডাকিতে লাগিলাম, “ভগবান আমার স্বামীকে রক্ষা করো।” তাহার দিনকয়েক পরে একদিন সকালবেলায় আমার পূজা-আহ্নিক সারিয়া বাহিরে আসিতেই পিসিমা কহিলেন, “বউমা, যে ভাসুরঝির কথা বলিয়াছিলাম সেই আমাদের হেমাঙ্গিনী আজ দেশ হইতে আসিয়াছে। হিমু, ইনি তোমার দিদি, ইঁহাকে প্রণাম করো।” এমন সময় আমার স্বামী হঠাৎ আসিয়া যেন অপরিচিত স্ত্রীলোককে দেখিয়া ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন। পিসিমা কহিলেন, “কোথা যাস, অবিনাশ।” স্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে।” পিসিমা কহিলেন, “এই মেয়েটিই আমার সেই ভাসুরঝি হেমাঙ্গিনী।” ইহাকে কখন আনা হইল, কে আনিল, কী বৃত্তান্ত, লইয়া আমার স্বামী বারংবার অনেক অনাবশ্যক বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমি মনে মনে কহিলাম, ‘যাহ ঘটিতেছে তাহা তো সবই বুঝিতেছি, কিন্তু ইহার উপরে আবার ছলনা আরম্ভ হইল? লুকাচুরি, ঢাকাঢাকি, মিথ্যাকথা! অধর্ম করিতে যদি হয় তো করো, সে নিজের অশান্ত প্রবৃত্তির জন্য, কিন্তু আমার জন্য কেন হীনতা করা। আমাকে ভুলাইবার জন্য কেন মিথ্যাচরণ।’ হেমাঙ্গিনীর হাত ধরিয়া আমি তাহাকে আমার শয়নগৃহে লইয়া গেলাম। তাহার মুখে গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে দেখিলাম; মুখটি সুন্দর হইবে, বয়সও চোদ্দপনেরার কম হইবে না। বালিকা হঠাৎ মধুর উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল; কহিল, “ও কী করিতেছ। আমার ভূত ঝাড়াইয়া দিবে নাকি।” সেই উন্মুক্ত সরল হাস্যধ্বনিতে আমাদের মাঝখানের একটা অন্ধকার মেঘ যেন একমুহূর্তে কাটিয়া গেল। আমি দক্ষিণবাহুতে তাহার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া কহিলাম, “আমি তোমাকে দেখিতেছি, ভাই।” বলিয়া তাহার কোমল মুখখানিতে আর-একবার হাত বুলাইলাম। “দেখিতেছ?” বলিয়া সে আবার হাসিতে লাগিল। কহিল, “আমি কি তোমার বাগানের সিম না বেগুন যে হাত বুলাইয়া দেখিতেছ কতবড়োটা হইয়াছি?” তখন আমার হঠাৎ মনে হইল, আমি যে অন্ধ তাহা হেমাঙ্গিনী জানে না। কহিলাম, “বোন, আমি যে অন্ধ।” শুনিয়া সে কিছুক্ষণ আশ্চর্য হইয়া গম্ভীর হইয়া রহিল। বেশ বুঝিতে পারিলাম, তাহার কুতূহলী তরুণ আয়ত নেত্র দিয়া সে আমার দৃষ্টিহীন-চক্ষু এবং মুখের ভাব মনোযোগের সহিত দেখিল; তাহার পরে কহিল, “ওঃ, তাই বুঝি কাকিকে এখানে আনাইয়াছ? ” আমি কহিলাম, “না, আমি ডাকি নাই। তোমার কাকি আপনি আসিয়াছেন।” বালিকা আবার হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “দয়া করিয়া? তাহা হইলে দয়াময়ী শীঘ্র নড়িতেছেন না। কিন্তু, বাবা আমাকে এখানে কেন পাঠাইলেন।” এমন সময়ে পিসিমা ঘরে প্রবেশ করিলেন। এতক্ষণ আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁহার কথাবার্তা চলিতেছিল। ঘরে আসিতেই হেমাঙ্গিনী কহিল, “কাকি, আমরা বাড়ি ফিরিব কবে বলো।” পিসিমা কহিলেন, “ওমা! এইমাত্র আসিয়াই অমনি যাই-যাই। অমন চঞ্চল মেয়েও তো দেখি নাই।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “কাকি, তোমার তো এখান হইতে শীঘ্র নড়িবার গতিক দেখি না। তা, তোমার এ হল আত্মীয়ঘর, তুমি যতদিন খুশি থাকো; আমি কিন্তু চলিয়া যাইব, তা তোমাকে বলিয়া রাখিতেছি।” এই বলিয়া আমার হাত ধরিয়া কহিল, “কী বলো ভাই, তোমরা তো আমার ঠিক আপন নও।” আমি তাহার এই-সকল প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া তাহাকে আমার বুকের কাছে টানিয়া লইলাম। দেখিলাম, পিসিমা যতই প্রবলা হউন এই কন্যাটিকে তাঁহার সামলাইবার সাধ্য নাই। পিসিমা প্রকাশ্যে রাগ না দেখাইয়া হেমাঙ্গিনীকে একটু আদর করিবার চেষ্টা করিলেন; সে তাহা যেন গা হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিল। পিসিমা সমস্ত ব্যাপারটাকে আদুরে মেয়ের একটা পরিহাসের মতো উড়াইয়া দিয়া হাসিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন। আবার কী ভাবিয়া ফিরিয়া আসিয়া হেমাঙ্গিনীকে কহিলেন, “হিমু চল্‌, তোর স্নানের বেলা হইল।” সে আমার কাছে আসিয়া কহিল, “আমরা দুইজনে ঘাটে যাইব, কী বলো ভাই।” পিসিমা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্ষান্ত দিলেন; তিনি জানিতেন, টানাটানি করিতে গেলে হেমাঙ্গিনীরই জয় হইবে এবং তাঁহাদের মধ্যেকার বিরোধ অশোভনরূপে আমার সম্মুখে প্রকাশ হইবে। খিড়কির ঘাটে যাইতে যাইতে হেমাঙ্গিনী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ছেলেপুলে নাই কেন।” আমি ঈষৎ হাসিয়া কহিলাম, “কেন তাহা কী করিয়া জানিব, ঈশ্বর দেন নাই।” হেমাঙ্গিনী কহিল, “অবশ্য তোমার ভিতরে কিছু পাপ ছিল।” আমি কহিলাম, “তাহাও অন্তর্যামী জানেন।” বালিকা প্রমাণস্বরূপে কহিল, “দেখো-না, কাকির ভিতরে এত কুটিলতা যে উঁহার গর্ভে সন্তান জন্মিতে পায় না।” পাপপুণ্য সুখদুঃখ দন্ডপুরস্কারের তত্ত্ব নিজেও বুঝি না, বালিকাকেও বুঝাইলাম না; কেবল একটা নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে তাঁহাকে কহিলাম, তুমিই জান! হেমাঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “ওমা, আমার কথা শুনিয়াও তোমার নিশ্বাস পড়ে! আমার কথা বুঝি কেহ গ্রাহ্য করে” দেখিলাম, স্বামীর ডাক্তারি ব্যবসায়ে ব্যাঘাত হইতে লাগিল; দূরে ডাক পড়িলে তো যানই না, কাছে কোথাও গেলেও চট্‌পট্‌ সারিয়া চলিয়া আসেন। পূর্বে যখন কর্মের অবসরে ঘরে থাকিতেন, মধ্যাহ্নে আহার এবং নিদ্রার সময়ে কেবল বাড়ির ভিতরে আসিতেন। এখন পিসিমাও যখন-তখন ডাকিয়া পাঠান, তিনিও অনাবশ্যক পিসিমার খবর লইতে আসেন। পিসিমা যখন ডাক ছাড়িয়া বলেন, “হিমু, আমার পানের বাটাটা নিয়ে আয় তো” , আমি বুঝিতে পারি, পিসিমার ঘরে আমার স্বামী আসিয়াছেন। প্রথম প্রথম দিন-দুইতিন হেমাঙ্গিনী পানের বাটা, তেলের বাটি, সিঁদুরের কৌটো প্রভৃতি যথাদিষ্ট লইয়া যাইত। কিন্তু, তাহার পরে ডাক পড়িলে সে আর কিছুতেই নড়িত না, ঝির হাত দিয়া আদিষ্ট দ্রব্য
false
humayun_ahmed
প্রচণ্ড সর্দিতে তাঁর নাক বন্ধ। তিন ঘন্টার ভেতর ছটা টাইলান খেয়েও কিছু হচ্ছে না। রেবেকা লক্ষ করল, ক্লাস হবে না শুনে আমেরিকান ছাত্রগুলি বাংলাদেশের ছাত্রদের মতোই হৈ-হৈ করে উঠল, যেন একটি মহানন্দের ব্যাপার ঘটে গেছে। ড. রেলিং বললেন, যে-সব বিদেশী ছাত্রছাত্রী এখনো ক্রিসমাসের ডিনারের। দাওয়াত পায় নি তাদের জন্য আমরা কিছু হোস্ট যোগাড় করেছি। তাদের লিস্ট অফিসে আছে। বিদেশী ছাত্রদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন পছন্দসই হোস্ট বেছে নেয়। রেবেকার নিমন্ত্রণ এসেছে দু জায়গা থেকে। প্রফেসর ওয়ারডিংটন এবং ড. রেলিং। কোনটিতে সে যাবে, এখন মনস্থির করতে পারে নি। খালিহাতে নিশ্চয়ই যাওয়া যাবে না। একটা কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে। কী কেনা যায় কে জানে? পাশা ভাইকে নিয়ে যেতে হবে এক বার ওয়েস্ট একারে। ক্রিসমাসের সবচেয়ে বড়ো বাজার নাকি সেখানেই। রেবেকা খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াল নিজের মনে। এত সকাল-সকাল ডরমিটরিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ডরমিটরিতে যাওয়া মানেই নিজের ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকা। এর চেয়ে বিশাল ইউনিভার্সিটিতে নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে তার বেশ লাগে। হ্যালো রেবেকা। রেবেকা তাকিয়ে দেখল রেড চায়নার মি ইন ছোট-ঘোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে। রেবেকা, তুমি কেমন আছ? একটু আগেই ক্লাসে যার সঙ্গে ছিল, সে এখন তাকে জিজ্ঞেস করছে।-কেমন আছ? রেবেকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মি ইন বলল, চল, কফি খাই। রেবেকা গেল তার সঙ্গে। মি ইন কোনো একটা ব্যাপারে একটু উত্তেজিত। রেবেকা বলল, আমাকে কি তুমি কিছু বলবে? হ্যাঁ। চল, কফি খেতে-খেতে বলব। মি ইন যে কথাটি বলল, তার জন্যে রেবেকা ঠিক প্রস্তুত ছিল না। রেবেকা, এরা আমাকে এই ইউনিভার্সিটিতে একটি টিচিং এ্যাসিস্টেন্টশিপ দিয়েছে। এরা চায় আমি স্প্রিং কোয়ার্টার থেকেই ক্লাস করতে শুরু করি। তাই নাকি? হ্যাঁ, চিঠিটা আমার সঙ্গেই আছে। দেখতে চাও? না, দেখতে চাই না। মি ইন চিন্তিত মুখে বলল, আমেরিকানরা উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করে না। এর পেছনে কোন পলিটিক্যাল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। কী উদ্দেশ্য থাকবে? সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি। তোমাকে এই অফার দেবার পেছনে কারণ থাকতে পারে। আমাকে দেবার কারণ নেই। আমি খুবই মিডিওকার এক জন ছাত্রী। এত ভাবছ কেন? অফার দিচ্ছে যখন, নিয়ে নাও। নিয়ে নাও বললেই তো নেওয়া যায় না। দেখতে হবে আমার দেশ রাজি হয় কিনা। রাজি হবে না, এটা প্ৰায় ধরেই নেওয়া যেতে পারে। মি ইন এই ব্যাপারটায় যথেষ্টই বিচলিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। সে দ্বিতীয় পেয়ালা কফি নিয়ে এল। রেবেকা কিছু হালকা কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু মি ইনের মন নেই। রেবেকা বলল, মি ইন, এই ছবিটা দেখ। কেমন চমৎকার একটা কাঠের বাড়ি, দেখলে? হুঁ, দেখলাম। পাঁচ হাজার ডলার থাকলেই এই বাড়িটা কেনা যায়। আমার কাছে যদি থাকত, আমি কিনতাম। এত বড় একটা বাড়ির তোমার দরকারটা কী? আরে, মেয়েটা বলে কি! দরকার না থাকলে বুঝি বিশাল একটা বাড়ি থাকতে পারবে না? মি ইন বলল, ছবিতে বাড়িটা যত সুন্দর লাগছে, আসলে তত সুন্দর নয়। ছবিতে সব জিনিস ভালো দেখায়। আমেরিকা তুমি সহ্যই করতে পার না। তাই না মি ইন? হ্যাঁ, তাই, নোংরা আমেরিকানদের কোন কিছুই ভালো হতে পারে না। রেবেকা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, চল না–বাড়িটা দেখে আসি। ক্রিসেন্ট লেকের পাশেই বাড়ি। কাছেই তো। একটা ক্যাব নিয়ে যাব। পাগল নাকি তুমি। কেন, অসুবিধা কী? শুধু শুধু এই বাড়ি দেখে কী হবে! তুমি তো আর কিনছ না? কিনতে ইচ্ছে করে যে মি ইন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বাংলাদেশী এই মেয়েটি অদ্ভুত। পড়াশোনায় খুব তুখোড়। এবং বেশ সাহসী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে-দেশে হয় নি, সে-দেশের মেয়েরা সাহসী হয় না বলে একটি কথা প্রচলিত আছে–তা সম্ভবত ঠিক নয়। রেবেকা, চল ওঠা যাক। তুমি যাও, আমি একটু বসব। একা-একা বসে থাকবে? একা কোথায়, এত লোকজন? মি ইন চলে যেতেই রেবেকা বোনের চিঠি খুলল। বাড়ির চিঠিগুলি সে সাধারণত রাতে শোবার সময় পড়ে। পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে যায়। কত ছোটখাট সুখস্মৃতি মনে পড়ে সমস্ত হৃদয়কে অভিভূত করে দেয়। আপা, তোমার দেশে ফেরার দিন তো ঘনিয়ে এল। সিরিয়াস একটা রিসেপশন আমরা তোমাকে দেব। এয়ারপোর্টে হাজির হব ফুলের মালা নিয়ে। এখনি তার প্রস্তুতি চলছে। মা সব আত্মীয়স্বজনকে চিঠি দিয়েছেন তোমার আসবার তারিখ জানিয়ে। এদিকে ছোট দুলাভাইও মনে হয় তোমার বিরহে খানিকটা কাতর। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি, তোমাদের একটা বিরাট ছবি বাঁধান। এরকম কায়দা করে তুমি ছবি কখন তুললে, তা তো জানি না। স্টুডিওতে তোলা ছবি নিশ্চয়ই। ছবিতে তোমাকে খুব ফর্সা লাগছে। আর দুলাভাইকে বেশ বোকা-বোকা লাগছে। ভালো কথা, দুলাভাই হঠাৎ কী মনে করে গোফ রাখতে শুরু করেছিলেন। আমি এবং টুটুল স্ট্রং প্রোটেস্ট করায় সেই গোঁফ হেঁটে ফেলা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, গোঁফ থাকা অবস্থাতেই ভালো দেখাচ্ছিল। তোমার কাছে দুলাভাইয়ের একটা গোফলা ছবি পাঠালাম। তুমি তোমার মতামত জানিয়ে চিঠি দেবে। তুমি যদি ইয়েস বল তাহলে আবার গোীফ রাখান হবে। এখন দিচ্ছি সবচে ইন্টারেস্টিং খবরটি। হোট দুলাভাই ওদের বাড়ির দোতলায় একটা ঘর তুলছেন–তুমি এসে ঐ ঘরে উঠবে। দুলাভাইয়ের এক আর্কিটেক্ট ফ্রেণ্ড ডিজাইন দিয়েছেন। শোবার ঘরের সঙ্গে ছোট্ট একটা ড্রেসিংরুম। বিরাট এ্যাটাচড় বাথ। এই হলঘরের মতো বড়ো বাথরুমে বাথটাবের ব্যবস্থাও থাকবে। বিদেশী বাথটাবগুলির সাংঘাতিক দাম। দেশীগুলি আবার দেখতে ভালো না।
false
humayun_ahmed
হচ্ছে। বৃষ্টির ছাটে ঘর ভেসে যাচ্ছে। দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। বন্ধ করতে পারছে না। ছেলেটা দেবদূতের মতো সুন্দর। এবং দেখতে অবিকল আমার মতো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম রাশেদ বাবাটিং দরজা বন্ধ করছিং আমি বই পড়ছিং এবং মজা পাচ্ছিং। ছেলেটা বলল, বাবা আমি ভিজে যাচ্ছি। আমার ঈদের নতুন শার্ট ভিজে যাচেছ। আমি বললাম, ভিজুক। সে বলল, ঘরের ভেতর পানির সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে বাবা। আমি বললাম, হোক সমুদ্র। আমরা সমুদ্র স্নান করব। হঠাৎ আমার সম্বিৎ ফিরল। আমি দেখলাম, আমি বই হাতে খাটে বসে আছি। কোথাও কোনো ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে না। আমার ঘরে কেউ নেই। অথচ যা দেখেছি, অত্যন্ত স্পষ্ট দেখেছি। আমার প্রথম পুত্র রাশেদ জন্মের তৃতীয় দিনের দিন মারা যায়। আমি তাকেই দেখেছি। আমার মস্তিষ্ক কি কিছুক্ষণের জন্য আমাকে বিভ্রান্ত করেছে? নাকি যে -এর কথা বলা হয় তা প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। কিছুক্ষণের জন্যে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। সেই জগতে পুত্র রাশেদ বেঁচে আছে। মানুষের মস্তিষ্ক অতি জটিল, অতি দুর্বোধ্য এক বস্তু। তার কাণ্ডকারখানা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও স্পষ্ট না। মস্তিষ্কের -এর কী কাজ তা এখনও কেউ ধরতে পারেনি। কেটে পুরোপুরি বাদ দিলেও মানুষের কোনো সমস্যা হয় না। মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম . এ অংশটি মানুষের চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রক। এর নিচেই -এর অবস্থান। হাইপোথেলামাসের কারণেই মানুষ আনন্দ-বেদনার অনুভূতি পায়। মস্তিষ্কের এ অংশটি অনুভূতি নিয়ন্ত্রক। এই অংশ উত্তেজিত হলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। সাইকোলজিস্টরা বলেন, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে প্রবল ক্ষুধা এবং শারীরিক ও মানসিক যাতনায় হাইপোথেলামাস উত্তেজিত হয়। তখন মানুষের বিচিত্র সব অনুভূতি হয়। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিমভাবে হাইপোথেলামাস উত্তেজিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা এ রকমসাইকোলজিস্টরা বললেন, মানুষ ছয়টি ইন্দ্রিয় দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেই মস্তিষ্ক অসহায় হয়ে পড়বে। সে বুঝতে পারবে না এখন কী হচ্ছে। মস্তিষ্কে প্রবল অস্থিরতা দেখা দেবে। এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির জন্য সে বিচিত্র কর্মকাণ্ড শুরু করবে। মস্তিষ্ক বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হলে কী করে তা দেখার জন্য তারা অদ্ভুত এক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। শব্দনিরোধী ( ) একটা ঘর তৈরি হলো। সেই ঘরে চৌবাচ্চায় একজন মানুষকে রাখা হলো। চৌবাচ্চার পানিতে কপার সালফেট মিশিয়ে তার ঘনত্ব করা হলো মানুষের শরীরের ঘনত্বের সমান। পানির তাপ রাখা হলো মানুষটির শরীরের তাপমাত্রায়। মানুষটির নাক বন্ধ করে দেওয়া হলো যাতে সে ঘ্রাণ না পায়। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে দেওয়া হলো। অর্থাৎ মানুষটির প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের কর্মক্ষমতা বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরীক্ষা শুরু হলো সাতজন ভালেন্টিয়ারকে নিয়ে। তারা সবাই ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রত্যেককে এক ঘণ্টা করে আলাদা ঘরে ঢোকানো হলো। পরীক্ষার ফলাফল হলো ভয়াবহ। সাতজনের মধ্যে দুজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে বের হলো। একজন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। একজন বলল, সে অদ্ভুত এক জগতে চলে গিয়েছিল। সেই জগতে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই। সবাই ইচ্ছা করলেই ভাসতে পারে। একজন বলল, সে তার মৃত পিতা, মাতা, দাদা-দাদিকে দেখতে পেয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। বাকি তিনজন বলল, তাঁরা যে দেখেছে এবং গুলছে তা তারা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। শুধু এইটুকু বলবে যে, ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে। আমার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এ রকম কিছু ঘটেছে। ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে শরীর অসন্ন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবল হতাশা বোধ। আমার মস্তিষ্ক প্রবলভাবে উত্তেজিত হয়ে মৃত পুত্রকে উপস্থিত করেছে আমার সামনে। আমার হাতে নলিনী বাবুর লেখা কিছু কাগজ। তিনি যে শুধু গাছপালা এবং আকাশের তারা দেখে বেড়াচ্ছেন তা না। মাঝে মাঝে লেখালেখিও করেছেন। যারা সুন্দর করে গল্প করে তারা সুন্দর করে লেখে। ব্যাপারটা নিপাতনে সিদ্ধের মতো। নলিনী বাবু বেশ গুছিয়ে লিখেছেন। লেখাকে নানান অংশে বিভক্তও করেছেন। শুরুর অংশের নাম–ধন্যবাদ পত্র। এ রকম অনেক অংশ আছে। তবে সব লেখাই সংক্ষিপ্ত। ধন্যবাদ পত্র লেখক সাহেব! আপনি আমাকে অপূর্ব এক বাগানে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি একা একা বাগানে হাঁটি। নিজেকে তখন আদি পুরুষ আদমের মতো মনে হয়। যেন এই পৃথিবীতে আমি একা। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বর্গের উদ্যানে। আমাকে স্বর্গবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ পত্রের পরের অংশের নাম–সীতা। সীতা লেখক সাহেব! আপনি হঠাৎ করে সীতা প্রসঙ্গ তুলায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ডায়েরি পড়ে বিস্ময়ের সমাপ্তি হয়েছে। বুঝতে পেরেছি ডায়েরিতে সীতার নাম পড়েছেন বলে তার বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। এক বিস্ময়ের সমাপ্তি হলেও এখন অন্য বিস্ময়! ডায়েরিতে এই নাম কে লিখল? ডায়েরি আমি অতি মনোযোগে ডায়েরি পড়েছি। জটিল সব জ্ঞানের কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। ডায়েরিতে একটি সংস্কৃত শ্লোক পড়ে অত্যন্ত অনিন্দিত হয়েছি। এই শ্লোক আমার মা বলতেন। আমি যেসব শ্লোক জানি সবই মার কাছ থেকে শেখা। এই শ্লেকিটা ভুলে গিয়েছিলাম। ভেকো মমকায়তে দিব্যং চূতফলং প্রাপ্য ন গর্বং যাতি কোকিলঃ পীত্বা কৰ্মপানীয়ং ভেকো মকমকায়তে ॥ (অর্থ) কোকিল আম ফল খেয়েও গর্বিত হয় না। কিন্তু ব্যাঙ কর্দমযুক্ত জলপান করেও গর্বে মকমক শব্দ করতে থাকে। অশোক বৃক্ষ এবং অর্শ ব্যাধি আজ একটি অশোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি সতেজ প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক বৃক্ষ। আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের কাছে একটা অশোক গাছ ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার মা গাছটাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন (আমার দুঃখ জগতের মার কথা বলছি। বাবার এক সময় অর্শ
false
humayun_ahmed
কিছুই খাই না। এত রাতে চা-কফি খেলে ঘুম হয় না। ক্যাফিনঘটিত সমস্যা। রহমত বলল, ডিকেফিনেটেড কফি দিব স্যার? বেয়ারা শ্রেণীর কারো মুখে ডিকেফিনেটেড শব্দটা শুনলে ধাক্কার মতো লাগে। সে এই শব্দটা যে শুনে শুনে শিখেছে তা-না। সে এই শব্দের মানেও জানে। মতিন বলল, তোমার পড়াশোনা কী? রহমত বলল, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। ভালো করেছ, এখন ট্রলি নিয়ে বিদায় হও, আমি ঘুমাব। রহমত বলল, বড় সাহেব কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। কী কথা? উনি কী কথা বলবেন সেটা তো স্যার আমি জানি না। তবে মনে হয় আজকের ঘটনা নিয়ে কথা বলবেন। এই যে আপনার মাথা ফাটল, স্টিচ দেয়া। লাগল। মতিন বলল, তুমি তোমার বড় সাহেবকে বলল যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। রাতে আর কথা হবে না। মিথ্যা কথা বলব স্যার? তুমি মিথ্যা বলো না? নিজের কারণে বলি, অন্যের কারণে বলি না। তাহলে যাও সত্য কথাটাই বলো। সত্য কথাটা কী? সত্য কথাটা হলো, আমি এখন কথা বলতে চাচ্ছি না। একটা ঘটনা ঘটেছে, ঘটনাটা হজম করছি। গুরুপাক ঘটনা তো, হজম করতে সময় লাগছে। এই কথাটা গুছিয়ে বলতে পারবে? পারব স্যার। মতিন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, রহমত, তোমার কি কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে? জি স্যার আছে। রাত দশটার পর কফি খাও? জি স্যার খাই। তাহলে চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বসো। কফি খাও। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। রহমত বলল, চেয়ারে বসতে হবে না স্যার। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাব। মতিন বলল, তুমি চেয়ারে বসে আরাম করে কফি খাও। এতে আমার সম্মানের কোনো হানি হবে না। আমি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি না। বেকার গ্রাজুয়েট। বেকার গ্রাজুয়েটকে সম্মান করতে হয় না। রহমত চেয়ারে বসতে বসতে বলল, শুকরিয়া। মতিন বলল, কতদিন ধরে এ বাড়িতে আছ? রহমত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তিন বছর। কমল ছেলেটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে? আছে। যোগাযোগটা কোন পর্যায়ের? ভালো যোগাযোগ? জি স্যার। উনি আমাকে ডাকেন আংকেল ফলিয়া। ফলিয়াটা কে? জানি না। উনি নিজের মনে অনেক কিছু বানান। তোমার সঙ্গে তার গল্প হয়? জি স্যার। কী নিয়ে গল্প? উনি যখন যেই বই পড়েন সেই বই নিয়ে গল্প। ফিবোনাক্কি সিরিয়েল কী জানেন? জি স্যার। ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, …। ছোট সাহেব আমাকে বলেছেন, আমি মুখস্থ করেছি। এই সংখ্যাগুলির বিশেষত্ব কি তুমি জানো? জানি স্যার। ছোট সাহেব বলেছেন, এর প্রতিটি সংখ্যা আগের দুটা সংখ্যার যোগফল। এরকম সিরিয়েল আরো আছে? জি স্যার আছে। যেমন ১, ৪, ৯, ১৬, ২৫… এর বিশেষত্ব কী? বিশেষত্ব জানি না স্যার। অঙ্ক ফঙ্ক ছাড়া আর কী নিয়ে কথা হয়? নানান বিষয়। আজ কথা হয়েছে? জি হয়েছে। কী নিয়ে কথা হলো? বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞানের কথাটা কী? শব্দের গতি। শব্দের গতি মানে কী? রহমত কফির কাপ ট্রলিতে রাখতে রাখতে বলল, শব্দ ঘণ্টায় সাতশ পঞ্চাশ মাইল বেগে যায়। শব্দের গতি এর চেয়ে বেশি হলে আমাদের কী সুবিধা হতো এই নিয়ে কথা। কী সুবিধা হতো? ছোট সাহেব বলেছেন কী সুবিধা হতো। আমি বুঝতে পারি নাই। উনার বেশিরভাগ কথাই আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু তুমি ভাব কর যেন বুঝতে পারছ। জি ভাব করি, কিন্তু ছোট সাহেব বুঝতে পারেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজকের ঘটনা নিয়ে কথা হয়েছে? আমার মাথা ফাটার ঘটনা? জি-না। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও। রাতে স্ন্যাকস জাতীয় কিছু খাবেন স্যার? দিয়ে যাব? না, শুধু এসিটা এমন করে দাও যেন ঘর আরো ঠাণ্ডা হয়। একুশ সেন্টিগ্রেডে দেয়া আছে। এমন কর যেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে পারি। আঠারো দেই? দাও। রহমত বলল, টেম্পারেচার কীভাবে কন্ট্রোল করে আপনাকে শিখিয়ে দেই স্যার–যদি বেশি ঠাণ্ডা লাগে তাহলে নিজে নিজে ঠিক করতে পারবেন। না। আমি শিখব না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা শিখতে চায় না। আমি তাদের দলে। রহমত ঘর থেকে বের হবার আগে আগে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, বড় সাহেব লাইব্রেরি ঘরে আছেন। দুই মিনিটের জন্যে কি আসবেন? বড় সাহেব খুব খুশি হবেন। মতিন হাই তুলতে তুলতে বলল, উনার সঙ্গে এখন দেখা হলে আমি খুব অখুশি হবো। আমার কাছে আমার খুশিটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট। কাজেই দেখা হবে না। জি আচ্ছা স্যার। ঘর অতি দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মতিনের গায়ের চাঁদরে শীত মানছে না। কাবার্ডে হলুদ রঙের একটা কম্বল আছে। মনে হচ্ছে কম্বল গায়ে দিতে হবে। মতিনের মোবাইল টেলিফোন আবার বাজছে। ধরব না ধরব না করেই মতিন টেলিফোন ধরল। তার ধারণা ছিল নিশু টেলিফোন করেছে। তা-না, টেলিফোন করেছেন মতিনের বড় বোন সালেহা। তাঁর গলা কাঁপা কাঁপা। এই নিয়ে তোকে এগারোবার টেলিফোন করলাম। তুই কোথায়? মতিন বলল, বড় আপা, আমি একটা ডিপ ফ্রিজের ভেতর শুয়ে আছি। সালেহা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কোথায়? ডিপ ফ্রিজের ভেতর। তোমরা যেখানে মাছ-মাংস রেখে বাসি কর সেখানে। তোর কোন কথাটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, কোনটা ঠাট্টা কোনটা সিরিয়াস আমি কিছুই বুঝি না। এখন আর বুঝতে চাই না। তৌহিদার কাছ থেকে শুনলাম তুই বাসায় এসেছিলি। কী জন্যে? ফ্রিজের ভেতর ঢোকার আগে তোমার কাছ থেকে দোয়া নিতে এসেছিলাম। ফাইজলামি রেখে সত্যি কথা বল, তোর টাকার দরকার? না। দরকার থাকলে বল। দরকার
false
shordindu
রহস্য এতদিনে পাওয়া গেছে। আপনি গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’ ডাক্তার বললেন–’বেশ‌, তাই বলছি। আজ রাত্রি সাড়ে আটটার সময় তিনটি ছোকরা একজন অজ্ঞান লোককে ট্যাক্সিতে নিয়ে এখানে এল। তারা রবীন্দ্র সরোবরে বেড়াতে গিয়েছিল‌, দেখল একটা গাছের তলায় বেঞ্চির পাশে মানুষ পড়ে আছে। দেশলাই জ্বেলে মানুষটাকে দেখল‌, তার পিঠের বাঁ দিকে শজারুর কাঁটা বিঁধে আছে। লোকটা কিন্তু মরেনি‌, অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ওদের মধ্যে একজন লোকটিকে চিনতে পারল‌, তাদের ফ্যাক্টরির মালিক দেবাশিস ভট্ট। তখন তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এল। ‘ছোকরাকে টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা করলাম। শজারুর কাঁটা দিয়ে হত্যা করার কথা সবাই জানে; আমি ভাবলাম এ ক্ষেত্রে কাঁটা বোধ হয়। হার্ট পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিন্তু হার্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি–অবাক কাণ্ড। হার্ট নেই! তারপর বুকের ডান দিকে হার্ট খুঁজে পেলাম। প্রকৃতির খেয়ালে ছোকরা ডান দিকে হার্ট নিয়ে জন্মেছে। ‘শজারুর কাঁটা হার্টকে বিধতে পারেনি বটে‌, কিন্তু বাঁ দিকের ফুসফুসে বিঁধেছে। সেটাও কম সিরিয়াস নয়। যতক্ষণ কাঁটা বিধে আছে‌, ততক্ষণ রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে না‌, কিন্তু কাঁটা বার করলেই ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। ‘যাহোক‌, খুব সাবধানে পিঠ থেকে কাঁটা বার করলাম। ছ’ ইঞ্চি লম্বা কাঁটা‌, তার দুইঞ্চি বাইরে বেরিয়ে ছিল‌, বাকিটা সোজা ফুসফুসের মধ্যে ঢুকেছিল। এই দেখুন সেই কাঁটা।’ ডাক্তার পকেট থেকে একটি শজারুর কাঁটা বার করে ব্যোমকেশের হাতে দিলেন। শজারুর কাঁটা অনেকেই দেখেছেন‌, সবিস্তারে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। এই কাঁটাটি নিরুনের মত সরু‌, কাচের কাঠির মত অনমনীয় এবং ডাক্তারি শল্যের মত তীক্ষ্ণগ্র। মারাত্মক অস্ত্রটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর হাতে দিল‌, বলল—’তারপর বলুন।’ ডাক্তার বললেন–’কাঁটা বার করলাম। ছোকরার বরাত ভাল ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হল না। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান হল‌, নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়ে স্ত্রীর কাছে খবর পাঠাতে বলল। তারপর তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ালাম। ওর স্ত্রী যখন এল তখন ও ঘুমুচ্ছে।’ ব্যোমকেশ বলল–’বাইরে একটি মেয়ে বসে আছে‌, সেই কি-?’ ডাক্তার বললেন-’হ্যাঁ, দেবাশিসের স্ত্রী। ও স্বামীর কাছে থাকতে চায়‌, কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়। ওকে বললাম‌, বাড়ি ফিরে যাও; কিন্তু ও যাবে না।’ ‘ওকে স্বামীর কাছে যেতে দেওয়া হয়েছিল?’ ‘একবার ঘরে গিয়ে স্বামীকে দেখে এসেছে। আমরা আশ্বাস দিয়েছি‌, আশঙ্কার বিশেষ কারণ নেই‌, তুমি বাড়ি যাও‌, কাল সকালে আবার এস। কিন্তু ও কিছুতেই যাবে না।’ ব্যোমকেশ উঠবার উপক্রম করে বলল–’আচ্ছা‌, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।’ ডাক্তার বললেন–বেশ তো‌, দেখুন না। কিন্তু একটা কথা। ওর স্বামীকে কেউ খুন করবার চেষ্টা করেছিল একথা ওকে বলা হয়নি‌, বলা হয়েছে অ্যাকসিডেন্টে বুকে চোট লেগেছে। আপনারাও তাই বলবেন। মেয়েটি এমনিতেই শক্‌ পেয়েছে‌, ওকথা শুনলে আরো বেশি শক পাবে।’ ‘না‌, বলব না।’ রাখালবাবু বললেন-‘শজারুর কাঁটা আমি রাখলাম। এই নিয়ে চারটি হল।’ দীপা বেঞ্চির ওপর ঠিক আগের মতাই সোজা হয়ে বসে ছিল‌, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু তার কাছে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। রাখালবাবু বললেন—’আমি পুলিসের লোক। ইনি শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী।’ ব্যোমকেশের নাম দীপার মনে কোনো দাগ কাটল না। তার শঙ্কাভরা চোখ একবার এর মুখে একবার ওর মুখে যাতায়াত করতে লাগল। ব্যোমকেশ নরম সুরে বলল–’আপনি ভয় পাবেন না। আপনার স্বামীর গুরুতর আঘাত লেগেছিল বটে‌, কিন্তু জীবনের আশঙ্কা আর নেই।’ দীপা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বোধ করি নিজেকে সংযত করল। তারপর ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল–’আমাকে ওঘরে থাকতে দিচ্ছে না কেন?’ ব্যোমকেশ বলল–’দেখুন‌, আপনার স্বামীকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে‌, এ সময় আপনি তাঁর কাছে থেকে কী করবেন? তার চেয়ে–’ দীপা বলল–’না‌, আমাকে যদি ওর কাছে থাকতে না দেওয়া হয়‌, আমি সারা রাত্রি এখানে বসে থাকব।’ ব্যোমকেশ বলল–’কিন্তু রুগীর ঘরে ডাক্তার আর নার্স ছাড়া এসময় অন্য কারুর থাকা নিষেধ।’ দীপা বলল—’আমি কিছু করব না‌, খাটের একপাশে চুপটি করে বসে থাকব।’ ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ দীপাকে বোঝাবার চেষ্টা করল‌, কিন্তু তাকে টলাতে পারল না। তখন সে মাথা চুলকে বলল—’আচ্ছা‌, ডাক্তারবাবুকে বলে দেখি। দেবাশিসবাবুর কি অন্য কোনো আত্মীয় এখানে নেই?’ ‘না‌, ওঁর অন্য কোনো আত্মীয় নেই।’ ‘আপনার নিশ্চয় আত্মীয়স্বজন আছেন। তাঁরা কোথায় থাকেন‌, তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে?’ দীপা বলল—’তাঁরা কাছেই থাকেন‌, কিন্তু তাঁদের খবর দিতে ভুল হয়ে গেছে।’ ব্যোমকেশ বলল–’ঠিকানা দিন‌, আমরা তাঁদের খবর দিচ্ছি।’ দীপা ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিল। ব্যোমকেশ তখন ডাক্তার গুপ্তর কাছে ফিরে গিয়ে বলল—’ডাক্তারবাবু্‌, বউটিকে স্বামীর কাছে থাকতে দিন। ও বুদ্ধিমতী বলেই মনে হল‌, কিন্তু বড় ভয় পেয়েছে।‘ ডাক্তারবাবু দু’ একবার আপত্তি করলেন‌, স্ত্রীজাতি বড় ভাবপ্রবণ‌, আবেগের বশে যদি স্বামীকে আঁকড়ে ধরে‌, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজী হলেন। ব্যোমকেশ দীপাকে ডেকে এনে যে ঘরে দেবাশিস ছিল সেই ঘরে নিয়ে গেল। দীপা পা টিপে টিপে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল‌, সামনের দিকে ঝুকে ব্যগ্র চোখে দেবাশিসের মুখ দেখল। দেবাশিস পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে‌, তার মুখের ভাব শান্ত প্রসন্ন। দীপা তার মুখের ওপর চোখ‌, রেখে অতি সন্তৰ্পণে খাটের পাশে বসল। একজন নার্সও সঙ্গে এসেছিল‌, সে ঠোঁটে আঙুল রেখে দীপাকে সতর্ক করে দিল। রাত্রি এগারোটার সময় হাসপাতাল থেকে বেরুবার পথে রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে চাইলেন–’বউটির বাপের বাড়িতে টেলিফোন করতে হবে।’ ব্যোমকেশ বলল–’না‌, সশরীরে সেখানে উপস্থিত হওয়া দরকার। আজ রাত্রে তোমার বিশ্রাম নেই।’ রাখালবাবু বললেন–’আমি বিশ্রামের জন্যে ব্যস্ত নই।’ পুলিসের গাড়িতে দীপার বাপের বাড়িতে পৌঁছুঁতে পাঁচ মিনিটও লাগল না।
false
shomresh
একমাত্র অবলম্বন। শিলিগুড়িতে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। সুদীপ এবং মাসীমা চলে গিয়েছেন স্টেশনের দিকে। গতকাল থেকে শমিতের কোন পাত্তা নেই। মায়াকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল তার ইউনিটের সবাই। শমিত নাকি নেমে গিয়েছে আগেই। প্রযোজক পুলিশকে রাজী করিয়েছেন এটাকে দুর্ঘটনা বলতে। খুন নয়, যদি আত্মহত্যাও হয় তাহলে কার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করত? সুদীপ অথবা শমিত কেউ মায়ার ভাবাবেগের জন্য দায়ী নয়। মানুষ মরে গেলেই যদি তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষার শেষ তাহলে এখন কিছুই বলার নেই। কিন্তু মরে যাওয়া মানুষ জীবিতদের মনে যে প্রতিক্রিয়া রেখে গেল তার দায় বইতে হয় অনেকদিন, কারো কারো ক্ষেত্রে সারাজীবন। শমিতকে সেই দায় বইতে হবে। নেখালিতে বসে অনাচার করে শমিত যে অশ্রদ্ধা পেয়েছিল দীপাবলীর কাছে আজ সেই শমিতের জন্যে মন কেমন করে সমবেদনায় ভরে গেল। শিলিগুড়ি-আলিপুরদুয়ারের বাসে স্টকেশ নিয়ে উঠে বসল দীপাবলী। অনেকক্ষণ থেকে যে ভাবনা অস্পষ্ট ছিল এখন সেটা প্রকট হল। চা-বাগানে গিয়ে কোথায় উঠবে। সে? এখন সাড়ে এগারটা। অন্তত তিনটের আগে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই। গতকাল থেকেই পেটে কিছু পড়েনি। খুব ক্লান্ত লাগছে। মৃতদেহ সৎকার হবার আগে যেমন খাওয়ার প্রশ্ন ছিল না তেমনি শ্মশান থেকে ফিরে মাসীমাকে নিয়ে হোটলে থাকার সময় তা ভাবাও যাচ্ছিল না। আজ সকালে শুধু এক কাপ চা পেটে পড়েছে। মনে হয় সুদীপেরও একই অবস্থা। মাসীমা খাওয়ার কথা বললেই মাথা নেড়ে গিয়েছেন। এই অবস্থায় ইচ্ছে। হলেও তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন বাস যখন শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে সেবকের দিকে এগোচ্ছে তখন শরীর কেমন অসাড় লাগছিল তার। সেবকের পথে বেশী যাওয়া আসা করতে হয়নি কখনও। উত্তর বাংলায় অনেক মানুষ কখনই দার্জিলিং-এ যাননি। তাঁদের কাছে পাহাড়ের রোমাঞ্চ এনে দেয় সেবক ব্রিজ-সংশ্লিষ্ট পথটুকু। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ, নিচে বয়ে যাওয়া তিস্তার শব্দ, ঘুরপাক খাওয়া পথ, পাশের হাঁ করা খাদ, দীপাবলী চুপচাপ দেখে গেল। সমস্ত ভাবনা ছাপিয়ে হঠাৎ, মায়ার মুখ চোখের সামনেটা জুড়ে বসেছে। মায়া নেই। একটি মধ্য কুড়ির যুবতী মেয়ে যার অনেক ইচ্ছে ছিল এবং সেইসঙ্গে অভিমান, প্রয়োজনে যে তাকে সবসময় হাত বাড়িয়ে সাহায্য করেছে সে আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। কলেজের প্রথম বছরে যে মায়াকে সে দেখেছিল তার চেহারা ছিল শীর্ণ, সদ্য তরুণীর চাঞ্চল্যে ভরপুর সেইসঙ্গে নিয়মভাঙার প্রবণতায় সবার চোখে পড়ে যেতে গর্বিত হত। একটু একটু করে তার শরীর এবং মন পাল্টাতে লাগল। দীপাবলী জানে, শুধু অভিমানের বিষক্ৰিয়া মায়াকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। এমন কেন হয়? কত মানুষ তো কোন কারণ ছাড়াই এক শো বছর বেঁচে থাকেন। দীপাবলী জানলা দিয়ে তাকাল। এই মুহূর্তে বাস যদি ফুট তিনেক পিছলে যায় তাহলে সে-ও মায়ার মত পৃথিবী থেকে মুছে যাবে। চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। মায়া চলে গিয়েছে, কিন্তু অনেক বড় ক্ষত রেখে গিয়েছে দু-একজনের মনে। মাসীমা এবং শমিত। সুদীপও হয়তো ভুলতে পারবে না সারাজীবন। কিন্তু সক্রিয়ভাবে স্মৃতিটাকে বহন করবে প্রথম দুইজন। সে চলে গেলে কেউ কি মনে রাখবে? কেউ? কোন মুখ মনে আসছে না। বুকের ভেতরটা কেমন শুকনো, কাঠকাঠ। হঠাৎ আবছা হয়ে ভেসে এল অলোকের মুখ। যে ভদ্রতা এবং পরিশীলিত আগ্রহ সে অলোকের মধ্যে দেখেছে তাও তো স্মৃতিবহন করার পক্ষে পূর্ণতা পায়নি। সোজা হয়ে বসল সে। এসব কি ভাবছে? মরে গেলে কে চিন্তা করবে কি করবে না তাতে তার কি দরকার? মরার পর সে কি দেখতে আসবে? যত্তসব! তাছাড়া এত সাতোড়াতাড়ি সে মরবেই বা কেন? এই জন্যে বলে মৃত্যু বড় ছোঁয়াচে অনুভূতি তৈরী করে। শ্মশানে গেলে যে কারণে বৈরাগ্য আসে। দুপাশে চায়ের বাগান রেখে বাস ছুটে চলছিল। আর এই চা-পাতা দেখামাত্র আচমকা ক্লান্তি সরে গেল মন থেকে, শরীরটাও ভাল হয়ে গেল। এত সবুজ, এমন নীল আকাশ, এমন নিশ্চিত নিৰ্জনতা যা কিনা সে জন্মাবধি দেখে এসেছে, আজ পরমাত্মীয় বলে মনে হল। বাজারহাট হয়ে বিনাগুড়ি দিয়ে বাস চলে যাবে গন্তব্যস্থলে। তাকে চাবাগানে যেতে হলে বাস পাল্টাতে হবে বিনাগুড়িতেই। কিন্তু গিয়ে শোনা গেল পথে একটি ব্রিজ গোলমাল করায় বাস পাল্টানোর প্রশ্ন নেই। সে এবার চাবাগানের মুখেই নামতে পারবে। ক্রমশ চোখের ওপর পরিচিত দৃশ্যগুলো ছুটে এল। সমস্ত বুকে এখন সুখের ঢেউ কলকল করছে। চৌমাথায় নেমে পড়ল দীপাবলী। নেমে দেখল জায়গাটা একদম পাল্টে গিয়েছে রাস্তাটা তো চওড়া হয়েছে কিন্তু তার চেয়ে বেশী চোখে পড়ছে দোকানের সাইনবোর্ড। প্রায় শহুরে চেহারা এনে দিয়েছে এই চৌমাথাকে। স্কুলে পড়ার সময় এই পথে কতবার যাওয়া আসা করেছে এককালে। তখন দোকান ছিল হাতে গোনা। হতশ্ৰী। সেগুলো এখনও আগের চেহারা নিয়ে টিকে আছে কিন্তু তার আশেপাশে আধুনিক চেহারার দোকান জাঁকিয়ে বসেছে। এমন কি উত্তরছাঁটে উত্তম সেলুনও চোখে পড়ল। বাসস্ট্যান্ডে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই তাকাচ্ছিল। কিন্তু একটিও চেনামুখ নেই। এইসময় একটি রিকশা এসে দাঁড়াল পাশে, কোথায় যাবেন দিদিমণি? রিকশা? বাঃ, চমৎকার। সে উঠে বসল, বাগানে যাব। তেমাথা ছেড়ে বাজারের পাশ দিয়ে রিকশা ছুটল। এই জায়গাগুলো একই আছে দেখে কিছুটা স্বস্তি এল। রবিবারে এখানে যখন হাট বসে তখন চেহারাটা পাল্টে যায়। সে দেখল জগু মণ্ডলের সাইকেলের দোকানের সামনে একটি যুবক দাঁড়িয়ে কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে। একেই কি ছেলেবেলায় হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় সে দেখেছিল? বাঁ দিকে মুখাৰ্জীদের স্টেশনারির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। মন্টুদা আগে এইসময় খেতে যেত বাড়িতে। এখনও কি, একই নিয়ম চলছে। এবার নদীটা। ছোট্ট
false
humayun_ahmed
আয়। তারপর দেখ আমি কী করি। কী করবে? মানহানির মামলা। দশ লাখ টাকার মানহানির মামলা। ঘাড়ে গামছা দিয়ে টাকা আদায় করব। মগের মুলুক পেয়েছে? মগ’স মুল্লুক। যুথী বলল, বাবা, চিৎকার কোরো না। আজহার বললেন, এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, তারপরেও আমি চিৎকার করব না? মুখে চুষনি দিয়ে বসে থাকব? . যুথী অনেক সময় নিয়ে অবেলায় গোসল করল। নতুন একটা শাড়ি পরল। এই শাড়ি টুনু তাকে দিয়ে বলেছিল, বিরাট কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটলে এই শাড়িটা। পরবি। আজ কি যুথির জীবনের খুব আনন্দের কোনো দিন? অবশ্যই না। তারপরেও এই শাড়িটা সে কেন পরল। নিজেও জানে না। মানুষের অনেক কর্মকাণ্ডই যুক্তিছাড়া। পুলিশ যুথীর ঘরও লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। ঘর গোছাতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এই মুহুর্তে মন চাইছে ভাইয়ের লেখা মাহিনের মৃত্যু গল্পটা পড়তে। গল্পটা খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছে না। দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত টুনুর লেখা গল্প। মূল উপন্যাসের সঙ্গে এই গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মূল উপন্যাসে থাকতে চান, তারা এই অধ্যায়টা বাদ দিতে পারেন। মাহিনের মৃত্যু তৃপ্ত সেন রাত দশটা থেকে দশটা পীচ এই সময়ের মধ্যে মাহিনের মৃত্যু হবে। এই তথ্য সে জানত। তাকে সন্ধ্যা ছাঁটায় মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পর তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সে হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। মাহিনের স্ত্রী শেফালী বলল, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? মাহিন মুখে কিছু বলল না, হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শেফালী বলল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? হুঁ। বেশি? না বেশি না। কতবার বলেছি। একজন ডাক্তার দেখাও। আমার কোনো কথা তুমি শোনো না। বুকে তেল মালিশ করে দিব? না। ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব। খুব ঠান্ডা। শেফালী বলল, ফ্রিজের মনে হয় গ্যাস চলে গেছে। ঠান্ডা হয় না। পাশের ফ্ল্যাট থেকে এনে দেই? লাগবে না। কেন লাগবে না! ঠান্ড পানি নিয়ে আসছি। শেফালী পানির বোতল নিয়ে এসেছে। মাহিনের হাতে পানির গ্ৰাস। এমনিতেই পানি ঠান্ডা, তারপরেও গ্লাসে দুটা বরফের টুকরা ভাসছে। মাহিন বরফের টুকরা দুটার দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী বলল, গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ, চুমুক দিচ্ছ না কেন? মাহিন পানির গ্লাসে চুমুক দিল। পানি তিতা লাগছে। মৃত্যুর আগে পানি তিতা লাগে–এই কথা সে শুনেছে। বাস্তবেও যে লাগে তা জানা ছিল না। পানি শুধু যে তিতা লাগছে তা-না, রসুন রসুন গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। শেফালী বলল, শ্বাসকষ্টটা কি কমেছে? মাহিন বলল, হুঁ। শেফালী বলল, ভিডিওর দোকান থেকে একটা ছবি এনেছি। দেখবো? অনেকদিন আমরা একসঙ্গে ছবি দেখি না। মাহিন বলল, ছবি দেখব। কী ছবি? গজনি। খুব না-কি ভালো ছবি। হিন্দি? হুঁ হিন্দি। আমি তো হিন্দি বুঝি না। শেফালী বলল, আমি বুঝিয়ে দেব। মাহিন বলল, আচ্ছা। বাবু কখন আসবে? শেফালী বলল, এগারোটার দিকে বড় ভাইজান বাবুকে নামিয়ে দিবেন। সে খুব মজা করছে। সবাইকে ছড়া শোনাচ্ছে। বাবুছড়া জানে না-কি? শেফালী বলল, তুমি তো ঘরেই থাকো না। বাইরে বাইরে ঘোরো। বাবু কত কী যে শিখেছে! বানিয়ে বানিয়ে গানও গায়। কী গান? শেফালী তার আড়াই বছরের ছেলের গান ছেলের মতো করে গেয়ে শোনাল– মামণি ভালো বেশি ভালো অনেক ভুলো বনেক ভালো। মাহিন বলল, বনেক ভালোটা কী? শেফালী বলল, বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তোমার ছেলে যে বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলে। মনে হয় বড় হয়ে কবি হবে। মাহিন হঠাৎ বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে। শেফালী লজ্জা পেয়ে গেল। মাহিন এই ধরনের কথা কখনো বলে না; বাসাতেই থাকে না, কথা কখন বলবে! মাহিন ঘড়ি দেখল। সাতটা বাজে। এখনো হাতে তিনঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে ছবি দেখে ফেলা যায়। তার মাথায় পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা আসছে না। তার বস এমন জিনিস যে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসে থাকলে সেখান থেকেও ধরে নিয়ে আসবে। বিসের সঙ্গে যে দুনম্বরিটা সে করেছে তা কারোরই ধরতে পারার কথা না। বাস ঠিকই ধরেছে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। শেফালী বলল, সব রেডি করেছি। এসো ছবি দেখি। মাহিন বলল, কাছে আসো, তোমার সঙ্গে জরুরি। আলাপ আছে। শেফালী চিন্তিত মুখে এগিয়ে এল। মাহিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার নামে একটা ব্যাংক একাউন্ট আছে। ব্র্যাক ব্যাংক। মিরপুর শাখা। একাউন্ট নাম্বার টেলিফোন বুকে লেখা আছে। শেফালী অবাক হয়ে বলল, আমার নামে ব্যাংক একাউন্ট? হ্যাঁ। সেখানে অনেক টাকা জমা আছে। আমার ভালোমন্দ কিছু হলে সেই টাকা ব্যবহার করবে। তোমার ভালোমন্দ কিছু হবে কেন? মানুষের ভালোমন্দ যে-কোনো সময় হয়। বিছানায় শুয়ে হার্টফেল করে মানুষ মরে যায় না? চলো ছবি দেখি। ছবি চলছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে শেফালী। স্বামীকে হিন্দি ডায়ালগ তার বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। সে এতটাই মুগ্ধ যে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেও না। মাহিন তাকিয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। তার স্ত্রী এত সুন্দর তা সে আগে কখনো লক্ষ করে নি। শেফালী হাসলে গালে টোল পড়ে তাও লক্ষ করে নি। তার ইচ্ছা করছে। স্ত্রীর গা ঘেঁসে বসতে। কিন্তু কেন জানি লজ্জা লাগছে। ছবি শেষ হবার পরপরই গেট থেকে দারোয়ান ইন্টারকমে জানাল–ইসকান্দর নামে একজন তার বন্ধু নিয়ে এসেছে। এদের ঢুকতে দিবে কি না? মাহিন বলল, ঢুকতে দাও। শেফালী বলল, কে এসেছে? মাহিন বলল, তুমি শোবার ঘরে যাও। শেফালী আবার বলল, কে এসেছে? মাহিন বলল, কে এসেছে তোমার জানার দরকার নাই।
false
humayun_ahmed
বোধ করলেন। সর্বপ্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব পরম করুণাময় আল্লাহপাকের। নিম্নশ্রেণীর প্রাণের জন্যে তা একশ’ ভাগ সত্যি। প্রতিটি পিপড়ার খাবারের ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন। মানুষকে তিনি অস্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পাঠিয়েছেন বলে তার খাবার তাকেই সংগ্ৰহ করতে হয়। ক্ষুধায় অস্থির হয়ে শিশু খুবই কাঁদছে। মাওলানার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। তার মন বলছে, আল্লাহপাক তাঁকে জটিল এক পরীক্ষায় ফেলেছেন। এই পরীক্ষা থেকে তিনি কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন বুঝতে পারছেন না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই তাকে বের হতে হবে। দেরি করা যাবে না। উঠানে লণ্ঠন হাতে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ইদরিস বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দেখেন লাবুস। লাবুস বলল, বোনকে দেখতে এসেছি। তার নাম কী? মাওলানা বললেন, নাম জানি না। তার মা কী নাম রেখেছে বলে যায় নাই। তবে তার ইচ্ছা ছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে মীরা। লাবুস বলল, বোনকে আমার কোলে দিন। বাচ্চা কাঁদছিল। লাবুসের কোলে উঠে কিছুক্ষণের জন্যে তার কান্না থামল। সে কৌতূহলী হয়ে নতুন মানুষটাকে দেখছে। লাবুস বলল, আমি আমার বোনের নাম রাখলাম পুষ্পরানি। মাওলানা বললেন, তুমি কি এর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? এ ক্ষুধায় অস্থির হয়েছে। লারুস বলল, আমি সব ব্যবস্থা করেই আপনাকে নিতে এসেছি। কী ব্যবস্থা করেছ? লাবুস বলল, একটা মেয়ে রেখেছি যে পুষ্পারানির দেখাশোনা করবে। আমার বোনের যা যা লাগবে তার সব ব্যবস্থা করেছি। মাওলানা বললেন, ব্যবস্থা করেছি, ব্যবস্থা করেছি— এমন কথা বলব না। এতে অহঙ্কার প্রকাশ হয়। ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহপাক। তোমার মাধ্যমে করেছেন। লাবুস বলল, আমার ভুল হয়েছে। এখন আমার সঙ্গে চলেন। মাওলানা বললেন, আল্লাহপাকের হিসাব সাধারণ মানুষের বোঝা সম্ভব না। আমি বাচ্চাটাকে কী খাওয়াব কী পরাব ভেবে খুব অস্থির হয়ে ছিলাম। কাঁদতে ছিলাম। আমার একবারও মনে হয় নাই যে, আল্লাহপাক সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। পুষ্পরানি আবার কাঁদতে শুরু করেছে। লাবুস পুষ্পরানিকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রওনা হয়েছে। হারিকেন হাতে নিয়ে মাওলানা আগে আগে যাচ্ছেন। আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে যাচ্ছেন। ছোট শিশুদের দিকে ভূত-প্রেতের নজর থাকে বেশি। সেই শিশু যদি রূপ নিয়ে আসে তাহলে সমস্যা আরো বেশি হয়। জিনরা সুন্দর মানবশিশু তাদের দেশে নিয়ে যেতে আগ্রহী থাকে বলে তিনি শুনেছেন। মানুষ জিনের বাচ্চা পালতে পারে না, কিন্তু জিন মানুষের বাচ্চা পালতে পারে— এটাও এক রহস্য। জগৎ রহস্যময়। জামে মসজিদের ইমাম করিম সাহেবের স্ত্রী শরিফা আজ সারাদিন অভুক্ত। এমন না যে ঘরে খাবার নাই। খাবার আছে, কিন্তু সে খেতে পারছে না। ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া তার একশ’ টাকা চুরি গেছে। চুরি কখন হয়েছে। সে অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারছে না। গত রাতে চুরি হয়েছে এটা পরিষ্কার। তবে চোর একশ’ টাকা ছাড়া আর কিছুই নেয় নি। টাকাটা সে রেখেছিল অতি গোপন জায়গায়— শুকনা বড়ুই-এর হাঁড়িতে। টাকার ওপর শুকনা বড়ুই বিছানো। চোর এই গোপন জায়গা থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেল কীভাবে কে জানে! শরিফা ঘটনোটা তার স্বামীকে বলতে পারছে না। তার ধারণা ঘটনা শুনলেই তার স্বামী খুব রাগ করবেন। স্বামীর কাছ থেকে ধমক বা কড়া কথা শুনতে তার একেবারেই ভালো লাগে না। একবার ধমক, শুনলে তার কয়েকদিন মন খারাপ থাকে। শরিফা আজ সারাদিনই একমনে পাঠ করেছে— ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।’ কারো মৃত্যুসংবাদ শুনলে এই দোয়া পাঠ করতে হয়, আবার কিছু হারিয়ে গেলে এই দোয়া পড়লে হারানো বস্তু ফিরে আসে। এই দোয়া পড়ে সে একবার তার হারিয়ে যাওয়া সোনার নাকফুল খুঁজে পেয়েছিল। উঠান ঝাড়ু দিতে সে শলার ঝাড়ু নিয়ে উঠানে গেছে। হঠাৎ দেখে রোদ পড়ে ঝাড়ুর ভেতর কী যেন ঝকমক করে উঠল। নাকফুল ঝাড়ুর শলায় আটকে ছিল। রাতে খেতে বসে করিম বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ? চোখ-মুখ শুকনা। জ্বর উঠেছে? শরিফা বলল, শরীর ঠিক আছে। কোনো বিষয় নিয়া কি চিন্তাযুক্ত? আপনারে নিয়া চিন্তাযুক্ত। করিম ভুরু কুঁচকে বললেন, আমারে নিয়া কী চিন্তা? শরিফা বলল, জিন খোররম যে আপনারে ত্যক্ত করতেছে এই নিয়া চিন্তা। করিম বললেন, এইসব নিয়া তুমি চিন্তা করব না। আমার সমস্যা আমি সমাধান করব। এর মধ্যে সমাধান কিছুটা হয়েছে— মসজিদ থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা বন্ধন দিয়েছি। ভূত-প্ৰেত-জিন-পরী এইটুক রাস্তায় আর আসবে না। বন্ধন দেওনের পরে তার আর দেখা পান নাই? দুই দিন দেখেছি- জংলায় হাঁটতেছে, রাস্তায় উঠতে পরে নাই। চেষ্টা নিয়েছে, পারে নাই। শরিফা বলল, একবার বন্ধন দিলে কতদিন থাকে? চন্দ্র তারিখ হিসাবে থাকে। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনে বন্ধন দিলে পূর্ণিমা পর্যন্ত থাকে। যাই হোক, কথা চালাচালি বন্ধ। খাওয়া হলো ইবাদত। ইবাদতের সময় कशी बळी यांट्र না। শরিফা বলল, ইবাদতের জন্য পুণ্য আছে না? করিম বললেন, অবশ্যই আছে। শরিফা বলল, যে শুকনা মরিচভর্তা দিয়া ভাত খাইতেছে তার পুণ্য বেশি, না-কি যে দশ পদ পোলাও-কোৰ্মা খাইতেছে তার পুণ্য বেশি? করিম বললেন, মরিচভর্তা দিয়া যে খাইতেছে তার পুণ্য অনেক অনেক বেশি। শরিফা বলল, আমার মনে হয় যে দশ পদ দিয়া খাইতেছে তার পুণ্য বেশি। আরাম কইরা মনের আনন্দে সে খাইতেছে। বইলাই পুণ্য বেশি। শুকনা মরিচভর্তা দিয়া যে খাইতেছে সে বোজার হইয়া খাইতেছে। ‘ করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, যা জানো না তা নিয়া বাহাস করব না। আচ্ছা আর করব না। বারান্দায় পাটি দেও, জায়নামাজ দেও। আজ রাতে ঘুমাব না। সারারাত ইবাদত বন্দেগি করে
false
shunil_gongopaddhay
একসঙ্গে কাটায়। কুসুমকুমারীর স্বামী অঘোরনাথ, নবীনকুমারের চেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। প্ৰথমা পত্নীর মৃত্যুর পর সে নাকি ব্ৰাহ্ম হতে গিয়েছিল, ঠিক সময়ে সে খবর পেয়ে তার মা গলার সামনে একটি বড় আশি বটি ধরে বলেছিলেন, আমার কথা শুনবিনি, তুই জোর করে যাবি? তো যা, ফিরে এসে আমার মরা মুখ দেকবি! মাতৃহন্তা হতে হবে বলেই অঘোরনাথ শেষ পর্যন্ত ব্ৰাহ্ম হয়নি। কিন্তু সেই সময় থেকেই নাকি সৰ্বক্ষণ সে বিষণ্ণ উদাসীন হয়ে দিন কাটায়। সে তাদের পৈতৃক জমিদারি কার্য দেখে না, কলকাতায় তাদের নিজস্ব হীসেও যায় না। দ্বিতীয় বিবাহের পরও তার মানসিক কৈব্য কাটেনি। পত্নীর কাছ থেকে এই সব তথ্য জানলো নবীনকুমার। ব্ৰাহ্মদের সম্পর্কে তার সঠিক কোনো ধারণা এখনো গড়ে ওঠেনি। ব্ৰাহ্ম শুনলেই তার মনে পড়ে কিছু দাড়িওয়ালা গভীর গভীর মানুষ, যারা কদাচ হাসে না, এবং অনেকেই রূপের ফ্রেমের চশমা চোখে দেয়। কুসুমকুমারীর স্বামী সে রকম মানুষ? কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে ওপরে উঠে এসে নবীনকুমার বললো, তোমার যদি ছেলে হয়। আর তোমার মিতেনীর স্বযদি মেয়ে হয়, তা হলে তোমাদের ছেলেমেয়ের সত্যিকারের বিয়ে হলে বেশ হয়, তাই না? কৃষ্ণভামিনী একটুও লজিত না হয়ে বললো, আমি তো তাই ঠিক করে রেখিচি! নবীনকুমার আড়চোখে তার বালিকা বধূর মুখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণভাবে নজর করে দেখলো। একটি বিষয়ে নবীনকুমারের মনে খটকা আছে। সে জানে যে বিবাহিত নারী পুরুষদেরই শুধু সন্তানাদি হয়। যাদের বিবাহ হয়নি কিংবা যে স্ত্রীলোকেরা বিধবা এবং যে পুরুষরা একা থাকে, তাদের কখনো পুত্ৰ কন্যা হয় না। কিন্তু বিবাহের পর ঠিক কখন, কীভাবে এবং কেন পুত্ৰ কন্যা জন্মায়, সে সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা নেই। প্রায়ই সে এই কৌতূহলে ছটফট করে কিন্তু কারুকেই জিজ্ঞেস করতে পারে না। সে যে-সব কেতাব পড়েছে, তার মধ্যেও এর কোনো উত্তর নেই। কলেজে ভর্তি হবার পর নবীনকুমারের মধ্যে একটা সবজান্তা ভাব এসেছে, কিন্তু এই একটি বিষয়ে অজ্ঞতা তাকে পীড়া দেয়। কৃষ্ণভামিনী তার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট হলেও এ ব্যাপারটা জানে নাকি? লজ্জাবশত এ কথাটি সে নিজের স্ত্রীকেও জিজ্ঞেস করতে পারলো না। কৃষ্ণভামিনী শয়ন কক্ষে ঢুকে মন দিয়ে তার পুতুলের সংসার গুছোতে লাগলো। এর মধ্যে একটি পুতুল পাওয়া যাচ্ছে না, সেটি কুসুমকুমারীরও নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পরও সেটি না পেয়ে সে নবীনকুমাকে চেপে ধরে বললো, আপনি নিশ্চয়ই নুকিয়েচেন! আমার পুতুল কোতায়? নবীনকুমার নিরীহ মুখ করে বললো, কই, আমি তো দেকিনি। কৃষ্ণভামিনী বললো, তা হলে কোতায় গেল? ওটা আমার মা কালীঘাট থেকে কিনে এনেছেলেন, ঐ পুতুলটা সবচে ভালো। নবীনকুমার বললো, তা হলে বোধ হয় তোমার মিতেনীর খুব পছন্দ হয়েচে, সেই সেটা চুরি করে নিয়ে গ্যাচে! কী, আপনি আমার মিতেনীকে চোর বললেন? এ কথা বলেই কৃষ্ণভামিনী সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল নবীনকমারের গালে। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থেকেই নবীনকুমার লাফিয়ে গিয়ে কৃষ্ণভামিনীর চুলের মুঠি চেপে ধরলো এবং কণ্ঠস্বর বিকট করে বললো, রে রে, হতভাগিনী তোর এ দুমতি! আজি তোরে নরকে পাঠাইব! পরনিন্দা, অতি লোভ, স্বামী প্রহরণ, যেই নারী করে তার নরকে গমন! খানিকক্ষণ ঝাঁটাপটি করার পর কৃষ্ণভামিনী নবীনকুমারের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলো। হঠাৎ রাগ হলে তার মাথার ঠিক থাকে না। কিন্তু স্বামীর গায়ে হাত তোলা যে মহা পাপ, তা সে জানে। নবীনকুমারের কাছে অবশ্য এ সবই কৌতুক। সারা দিনের প্রতিটি ঘটনা থেকেই সে মজার উপাদান খোঁজে। কৃষ্ণভামিনী ক্ষমা চাইবার পর সে জাজিমের তলা থেকে বার করে দিল লুকোনো পুতুলটি। এই দুই কিশোর-বালিকার খুনসুট, বিবাদ ও রাগ ছাড়া এই অট্টালিকার দ্বিতল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। আর কোনো কক্ষে প্ৰাণের সাড়া নেই। বিম্ববতী পুত্ৰশোকে শয্যা নিয়েছেন। ইব্রাহিমপুর থেকে বেশ কিছুদিন আগে ফিরে এসেছে বজরা। বৃদ্ধ খাজাঞ্চি সেনমশাই অশুভারাক্রান্ত নয়নে সব কথা জানিয়েছেন বিম্ববতীকে। গঙ্গানারায়ণের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেনমশাই তার তল্লাশে লোক পাঠিয়েছিলেন নানা দিকে, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ যেন কপূরের মত মিলিয়ে গেছে। শূন্যে। গঙ্গানারায়ণকে বজরা থেকে বলপ্রয়োগ করে কেড়ে নিয়ে যাওয়া কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না, প্রহরীরা সে রকম একটি শব্দও শোনেনি। স্বেচ্ছায় সে রাত্ৰিবেলা বজরা ছেড়ে চলে যাবে, এও যে বড় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সে বজরার মালিক, তার হুকুমেই বজরা যেখানে খুশী যেতে পারে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে যদি তার সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা না থাকতো, তবে সে রাত্ৰেই তো নোঙর তুলে কলকাতার অভিমুখে রওনা হওয়া যেত। এমনকি একথা সেনমশাই অনেকবার বলেও ছিলেন গঙ্গানারায়ণকে। গঙ্গানারায়ণ এক বস্ত্রে চলে গেছে। এ বড় বিচিত্ৰ ঘটনা, এমনটি আর কখনো শোনা যায়নি। গঙ্গানারায়ণ নিরুদ্দিষ্ট বা মৃত। মৃত বলেই বেশী সন্দেহ হয়। নবীনকুমারের জন্মের পর থেকে গঙ্গানারায়ণের প্রতি বিম্ববতীর মনোযোগ অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় গঙ্গানারায়ণও তো ছিল তাঁর অতি আদরের। এখন নবীনকুমারও তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গঙ্গানারায়ণের সংবাদ শুনে বিম্ববতীর মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হয়েছিল, প্রথম পুত্রের প্রতি তাঁর সমস্ত স্নেহ ভালোবাসা ফিরে এলো শোক ও পরিতাপ হয়ে। গঙ্গানারায়ণ তাঁর আপনি গর্ভের সন্তান নয়, তবু তার প্রতি বিম্ববতীর নাড়ির টান আছে যে সে কথা বিম্ববতী আবার অনুভব করলেন। বিম্ববতী কয়েকদিন কেঁদে ভাসালেন। জনে জনে অনুরোধ করলেন, যত টাকাই লাগুক, গঙ্গানারায়ণের সন্ধানে আবার সারা দেশ তোলপাড় করে খুঁজে দেখা হোক। কিন্তু কারুরই গরজ নেই সে ব্যাপারে। বিধুশেখর তাঁর মন থেকে গঙ্গানারায়ণকে মুছে ফেলতে চান। কর্মচারীরা শুধু
false
humayun_ahmed
মীরা। মনজুরের ধারণা, মীরার মতো গুছিয়ে এবং সুন্দর করে কোনো মেয়ে কথা বলতে পারে না। প্রথম দিনে খানিকক্ষণ কথা বলার পর মীরা বলল, আপনার নামের প্রথম অক্ষর এবং শেষ অক্ষর দিয়ে আমার নাম–এটা কি আপনি লক্ষ করেছেন? মনজুর বিস্মিত হয়ে বলল, এখন লক্ষ করলাম। আগে করি নি। মীরা হাসতে হাসতে বলল, নামের এই মিল কী প্ৰকাশ করে বলতে পারেন? জ্বি না। চিন্তা করে দেখুন তো বের করতে পারেন। কিনা। যদি বের করতে পারেন। তাহলে টেলিফোন করে জানাবেন। যদি বের করতে না পারেন তা হলে টেলিফোন করবেন না। মনজুর তৃতীয় দিনে টেলিফোন করল। সে কে, তার কী নাম কিছুই বলতে হলো না। হ্যালো বলতেই মীরা বলল, ও আপনি? রহস্য উদ্ধার করে ফেলেছেন?? জানতাম আপনি পারবেন। মনজুর কাঁচুমাচু গলায় বলল, জ্বি না, পারি নি। পারেন নি তাহলে টেলিফোন করলেন যে? আপনার কাছ থেকে জানার জন্যে। আচ্ছা, আপনাকে আরো সাতদিন সময় দিচ্ছি। সাতদিন পরেও যদি না পারেন তাহলে বলে দেব। রাখি, কেমন? মনজুর অনেক কিছু ভাবল–নামের মিল কী বুঝাচ্ছে? চার অক্ষরের দুটি মিলে যাচ্ছে। প্রথমটি এবং শেষটি। তাতে কী হয়? আদৌ কি কিছু হয়? সাতদিন পর মীরার সঙ্গে আবার কথা হলো। সে হাসতে হাসতে বলল, এখনো পারেন নি? এত সহজ আর আপনি পারছেন না। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি নিম্ন পর্যায়ের। আমার মেজ মামার ধারণা আমি গাধা-মানব। তাই তো দেখছি। মিলটা কী দয়া করে যদি বলেন… মীরা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক করে বলুন তো আপনার আগ্ৰহ কি মিল জানার জন্যে না আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে? মনজুর গুছিয়ে কথা বলতে পারলেও তৎক্ষণাৎ তার মাথায় হঠাৎ করে কোনো জবাব এল না। মীরা বলল, হ্যালো, কথা বলছেন না কেন? আপনি অ্যামবারাসড় বোধ করছেন? জ্বি না। মনে হচ্ছে আপনি অ্যামবারাসড়। সরি, আমি কাউকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না। রাখি, কেমন? পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে। মনজুর দুধ চিনিবিহীন চা নিয়ে বিছানায় বসল। আশ্চৰ্য, টেলিফোনে কুঁ-কুঁ-পিঁড়িং জাতীয় শব্দ হচ্ছে! ব্যাপারটা কী? মনজুর অবাক হয়ে তাকাল। গত দুমাস ধরে টেলিফোন ডেড। বিলের টাকা জমা না দেয়ায় লাইন সম্ভবত কেটে দিয়েছে। টেলিফোন অফিসে একবার যাওয়া দরকার। যেতে ইচ্ছা করছে না। টেলিফোন ছাড়া তার খুব যে অসুবিধা হচ্ছে তাও না। বরং এক রকম আরামই অনুভব করছে। টেলিফোনে আবার কুঁ-কুঁ শব্দ। আপনা। আপনি ঠিক হয়ে গেল নাকি! এ দেশে সবই সম্ভব। যে নিয়মিত বিল দিয়ে যায়। তার লাইন কাটা যায়। আর তার মতো ডিফল্টারদের কাটা লাইন আপনা। আপনি মেরামত হয়ে যায়। মনজুর রিসিভার তুলে কোমল গলায় বলল, হ্যালো। হ্যালো। ওপাশ থেকে আট ন বছর বয়সী বালকের গলা শোনা গোল হ্যালো বড় চাচু? আমি বড় চাচু না খোকা–তুমি কেমন আছ? আমি ভালো, আপনি কে? আমার নাম মনজুর। মনজুর চাচু? তাও বলতে পাের। তুমি স্কুলে যাও নি? উঁহু। কেন বল তো? আমার জ্বর। বল কী, একটু আগে তো বললে–তুমি ভালো! ছেলেটা হকচাকিয়ে গেল। ভুল ধরিয়ে দিলে ছোটরা অসম্ভব লজ্জা পায়। নাম কী তোমার খোকা? ইমরুল। ইমরুল? সর্বনাশ, তুমি যখন একটু বড় হবে সবাই তোমাকে কী বলে ক্ষ্যাপাবে জান? সবাই বলবে–ভিমরুল। ভিমরুল কী? ভিমরুল কী বলার আগেই টেলিফোন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একেবারেই ঠাণ্ডা। শোঁ-শোঁ–পি-পি কোনো আওয়াজ নেই। টেলিফোনটা ঠিক থাকলে মীরাকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করা যেত।—কোঁটার গায়ে ‘সমুদ্র’ লেখা কেন? উত্তরে মীরা তার স্বভাব মতো বলতো–তুমি আন্দাজ কর তো কেন? আমি পারছি না। তবু চেষ্টা করা। তোমাকে সাতদিন সময় দিলাম। আধুনিক জগতের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে আছে–রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন … অষ্টম আশ্চর্য (মনজুরের মতে) তার সঙ্গে মীরার বিয়ে। যাকে বলে হুলস্থূল বিবাহ। মীরার বাবা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মনসুর উদ্দিন এক হাজার লোককে দাওয়াত করেছিলেন। দাওয়াতি লোকজনদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মন্ত্রী। ফ্ল্যাগ দেয়া গাড়ি করে এসেছিলেন। তারা কিছুই খেলেন না। তাদের মধ্যে মাত্র একজন মনজুরের সঙ্গে হ্যাঁন্ডশেক করে বললেন, হ্যালো ইয়াং ম্যান। বেষ্ট অব ইওর লাক। বাসর হলো মীরার বড় ভাইয়ের বাসায়। বিছানার উপর বেলি ফুলের যে চাদর বিছানো তার দামই নাকি দুহাজার টাকা। মীরা বাসর রাতে প্রথম যে কথাটি বলল, তা হচ্ছে–এই বিছানার বিশেষত্ব কী বল তো? মনজুর কিছু বলতে পারল না। কী–বলতে পারলে না? এটা হচ্ছে ওয়াটার বেড। বাংলায় জল-তোশক বলতে পার। এখানে ঘুমালে মনে হবে পানির মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। বল কী! ভাইয়া আমেরিকা থেকে আনিয়েছে। সে খুবই শৌখিন। বেচারা নিজে অবশ্যি এই বিছানায় ঘুমাতে পারে না। ওর পিঠে ব্যথা। ডাক্তার নরম বিছানায় শোয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তাই নাকি? হ্যাঁ। বেচারা ঘুমায় মেঝেতে পাটি পেতে। বাধ্য হয়ে ভাবিকেও তাই করতে হয়। একে বলে পোয়েটিক জাসটিস। আচ্ছা, তুমি এমন মুখ ভোঁতা করে বসে আছ কেন? কথা বল। কী কথা বলব? কী কথা বলবে সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে? ইন্টারেটিং কোনো কথা বল। বুঝড়ের কথা বাকি জীবনে অসংখ্যবার মনে করা হবে–কাজেই কথাগুলি খুব সুন্দর হওয়া উচিত। মনজুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের বাথরুমটা কোন দিকে? মীরা হেসে ফেলে বলল, তোমার প্রথম কথা আমার কাছে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। দ্বিতীয় কথাটা কী? ফুলের গন্ধে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ফুলগুলোকে অন্য কোথাও রাখা যায় না? না। আর কিছু বলবে? ইন্টারেস্টিং আর
false
robindronath
বৃদ্ধবয়সে পেন্সন লইয়া মরে ; বহু চেষ্টা ও সন্ধানের পর এই দ্বিতীয় পণ্ডিতটার নিরীহতার প্রতি আমার যেরূপ সুগভীর অশ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল কোনো অতিক্ষুদ্র ঘটিবাটিচোরের প্রতি তেমন হয় নাই । অবশেষে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরই বাসার অনতিদূরে একটি গ্যাসপোস্টের নীচে একটা মানুষ দেখিলাম , বিনা আবশ্যকে সে উৎসুকভাবে একই স্থানে ঘুরিতেছে ফিরিতেছে । তাহাকে দেখিয়া আমার সন্দেহমাত্র রহিল না যে , সে একটি-কোনো গোপন দুরভিসন্ধির পশ্চাতে নিযুক্ত রহিয়াছে । নিজে অন্ধকারে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তাহার চেহারাখানা বেশ ভালো করিয়া দেখিয়া লইলাম — তরুণ বয়স , দেখিতে সুশ্রী । আমি মনে মনে কহিলাম , ‘ দুষ্কর্ম করিবার এই তো ঠিক উপযুক্ত চেহারা ; নিজের মুখশ্রী যাহাদের সর্বপ্রধান বিরুদ্ধ সাক্ষী তাহারা যেন সর্বপ্রকার অপরাধের কাজ সর্বযত্নে পরিহার করে ; সৎকার্য করিয়া তাহারা নিষ্ফল হইতে পারে কিন্তু দুষ্কর্ম দ্বারা সফলতালাভও তাহাদের পক্ষে দুরাশা । ‘ দেখিলাম , এই ছোকরাটির চেহারাটাই ইহার সর্বপ্রধান বাহাদুরি ; সেজন্য আমি মনে মনে অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহার তারিফ করিলাম, বলিলাম , ‘ ভগবান তোমাকে যে দুর্লভ সুবিধাটি দিয়াছেন সেটাকে রীতিমতো কাজে খাটাইতে পার , তবে তো বলি শাবাশ। ‘ আমি অন্ধকার হইতে তাহার সম্মুখে আসিয়াই পৃষ্ঠে চপেটাঘাতপূর্বক বলিলাম , “ এই যে, ভালো আছেন তো ? ” সে তৎক্ষণাৎ প্রবলমাত্রায় চমকিয়া উঠিয়া একেবারে ফ্যাকাসে হইয়া উঠিল । আমি কহিলাম , “ মাপ করিবেন , ভুল হইয়াছে , হঠাৎ আপনাকে অন্য লোক ঠাওরাইয়াছিলাম । ” মনে মনে কহিলাম , কিছুমাত্র ভুল করি নাই , যাহা ঠাওরাইয়াছিলাম তাই বটে । কিন্তু এতটা অধিক চমকিয়া ওঠা তাহার পক্ষে অনুপযুক্ত হইয়াছিল , ইহাতে আমি কিছু ক্ষুণ্ন হইলাম । নিজের শরীরের প্রতি তাহার আরো অধিক দখল থাকা উচিত ছিল ; কিন্তু শ্রেষ্ঠতার সম্পূর্ণ আদর্শ অপরাধীশ্রেণীর মধেও বিরল । চোরকেও সেরা চোর করিয়া তুলিতে প্রকৃতি কৃপণতা করিয়া থাকে । অন্তরালে আসিয়া দেখিলাম , সে ত্রস্তভাবে গ্যাসপোস্ট ছাড়িয়া চলিয়া গেল । পিছনে পিছনে গেলাম; দেখিলাম, ছোকরাটি গোলদিঘির মধ্যে প্রবেশ করিয়া পুষ্কুরিণীতীরে তৃণশয্যার উপর চিত হইয়া শুইয়া পড়িল ; আমি ভাবিলাম , উপায়চিন্তার এ একটা স্থান বটে , গ্যাসপোস্টের তলদেশ অপেক্ষা অনেকাংশে ভালো — লোকে যদি কিছু সন্দেহ করে তো বড়োজোর এই ভাবিতে পারে যে , ছোকরাটি অন্ধকার আকাশে প্রেয়সীর মুখচন্দ্র অঙ্কিত করিয়া কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির অভাব পূরণ করিতেছে । ছেলেটির প্রতি উত্তরোত্তর আমার চিত্ত আকৃষ্ট হইতে লাগিল । অনুসন্ধান করিয়া তাহার বাসা জানিলাম । মন্মথ তাহার নাম , সে কলেজের ছাত্র , পরীক্ষা ফেল্ করিয়া গ্রীষ্মাবকাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে , তাহার বাসার সহবাসী ছাত্রগণ সকলেই আপন আপন বাড়ি চলিয়া গেছে । দীর্ঘ অবকাশকালে সকল ছাত্রই বাসা ছাড়িয়া পালায় , এই লোকটিকে কোন্‌ দুষ্টগ্রহ ছুটি দিতেছে না সেটা বাহির করিতে কৃতসংকল্প হইলাম । আমিও ছাত্র সাজিয়া তাহার বাসার এক অংশ গ্রহণ করিলাম । প্রথম দিন যখন সে আমাকে দেখিল, কেমন একরকম করিয়া সে আমার মুখের দিকে চাহিল তাহার ভাবটা ভালো বুঝিলাম না । যেন সে বিস্মিত , যেন সে আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছে , এমনি একটা ভাব । বুঝিলাম , শিকারীর উপযুক্ত শিকার বটে , ইহাকে সোজাভাবে ফস্‌ করিয়া কায়দা করা যাইবে না । অথচ যখন তাহার সহিত প্রণয়বন্ধনের চেষ্টা করিলাম তখন সে ধরা দিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিল না । কিন্তু মনে হইল , সেও আমাকে সুতীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে , সেও আমাকে চিনিতে চায় । মনুষ্যচরিত্রের প্রতি এইরূপ সদাসতর্ক সজাগ কৌতূহল , ইহা ওস্তাদের লক্ষণ । এত অল্প বয়সে এতটা চাতুরী দেখিয়া বড়ো খুশি হইলাম । মনে ভাবিলাম , মাঝখানে একজন রমণী না আনিলে এই অসাধারণ অকালধূর্ত ছেলেটির হৃদয়দ্বার উদ্ঘাটন করা সহজ হইবে না । একদিন গদ্‌গদকণ্ঠে মন্মথকে বলিলাম , “ ভাই , একটি স্ত্রীলোককে আমি ভালোবাসি , কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না । ” প্রথমটা সে যেন কিছু চকিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল , তাহার পর ঈষৎ হাসিয়া কহিল , “ এরূপ দুর্যোগ বিরল নহে । এইপ্রকার মজা করিবার জন্যই কৌতুকপর বিধাতা নরনারীর প্রভেদ করিয়াছেন । ” আমি কহিলাম , “ তোমার পরামর্শ ও সাহায্য চাহি । ” সে সম্মত হইল । আমি বানাইয়া বানাইয়া অনেক ইতিহাস কহিলাম ; সে সাগ্রহে কৌতূহলে সমস্ত কথা শুনিল , কিন্তু অধিক কথা কহিল না । আমার ধারণা ছিল , ভালোবাসার , বিশেষত গর্হিত ভালোবাসার , ব্যাপার প্রকাশ করিয়া বলিলে মানুষের মধ্যে অন্তরঙ্গতা দ্রুত বাড়িয়া উঠে ; কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে তাহার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না , ছোকরাটি পূর্বাপেক্ষা যেন চুপ মারিয়া গেল , অথচ সকল কথা যেন মনে গাঁথিয়া লইল। ছেলেটির প্রতি আমার ভক্তির সীমা রহিল না । এদিকে মন্মথ প্রত্যহ গোপনে দ্বার রোধ করিয়া কী করে , এবং তাহার গোপন অভিসন্ধি কিরূপে কতদূর অগ্রসর হইতেছে আমি তাহার ঠিকানা করিতে পারিলাম না , অথচ অগ্রসর হইতেছিল তাহার সন্দেহ নাই । কী একটা নিগূঢ় ব্যাপারে সে ব্যাপৃত আছে এবং সম্প্রতি সেটা অত্যন্ত পরিপক্ক হইয়াছে , তাহা এই নবযুবকটির মুখ দেখিবামাত্র বুঝা যাইত । আমি গোপন চাবিতে তাহার ডেস্‌‌ক খুলিয়া দেখিয়াছি , তাহাতে একটা অত্যন্ত দুর্বোধ কবিতার খাতা , কলেজের বক্তৃতার নোট এবং বাড়ির লোকের গোটাকতক
false
shirshendu
ওয়ালেট বের করে নিল। বেশ পুরুষ্টু ওয়ালেট। তারপর হাতের অস্ত্রটা একটা ঝোলায় পুরে নিয়ে সে দ্রুত ফটক পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ‘স্যার, স্যার…’ বলে কে যেন প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল। গভীর ঘোরের মধ্যেও সেই ডাকটা ববির কানে পৌঁছোল। খুব ক্ষীণভাবে। স্যার, আমরা মরে যাচ্ছি… আমরা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি স্যার, যে আগ্নেয়গিরি এখুনি ইরাপ্ট করবে। ববির ঘোরটা কাটল। মাথায় হাত দিয়ে তিনি ‘ওঃ’ বলে কাতর একটা আওয়াজ করলেন। মুখের ওপর একটা চেনা মুখ ঝুলে আছে। ইন্দ্রজিৎ। এত বড় বড় চোখ ইন্দ্রজিতের। ববি দুর্বল গলায় বললেন, কী বলছ? রেড বাটন প্রেস করে বদমাশটা পালিয়েছে এক মিনিট হয়ে গেল। কিছু করুন স্যার। দিদিমণি সব তার কেটে ফেলেছেন। ববি এবার চমকে জেগে উঠলেন, ডেটোনেটর অ্যাক্টিভ! সর্বনাশ! কিন্তু আমি যে— আপনি উঠবেন না। শুধু বলুন কী করতে হবে? ববি দেখতে পেলেন, মেঝের চৌকো গর্তের মধ্যে নেমে পাগলের মতো তার কেটে কেটে ওপরে জড়ো করছে লীনা। ববি চেঁচিয়ে বললেন, লীনা! লীনা পাগলের মতো চোখে ফিরে তাকাল। ববি শান্ত স্বরে বললেন, এক্সপ্লোসিভের মাথায় একটা নীল বোতাম আছে। সেটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে টান দিলেই একটা সরু ডার্ট বেরিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি করুন। ববির দিকে চেয়েই লীনা শান্ত হল। মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল। ইন্দ্রজিৎ চিৎকার করছিল, আর পাঁচ সেকেন্ড… চার সেকেন্ড… তিন সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… লীনা নীল বোতামটা তার ওড়না দিয়ে চেপে ধরে বাঁ দিকে প্রাণপণে মোচড় দিচ্ছিল। একটু ধীরে ঘুরছিল পাঁচ। বড় শক্ত। আর এক সেকেন্ড… লীনা একটা টান দিয়ে ডার্টটা বের করে ফেলল। ইন্দ্রজিৎ কানে আঙুল দিয়ে চোখ বুজে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু বলল, জিরো… লীনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গর্তটার মধ্যেই। ইন্দ্রজিৎ কান থেকে হাত নামাল, ঘড়ি দেখল, তারপর দু’হাত তুলে চেঁচাতে লাগল, জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা, জয় বাবা মহাদেব… স্যার, আমি যদিও নাস্তিক, কিন্তু ফর দি টাইম বিয়িং… জয় মা দুর্গা, জয় মা কালী, হর হর মহাদেব… ববি দু’বার উঠবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তার শরীরের গভীর ক্ষতগুলি টাটিয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে স্নায়ুতন্তুজাল। বুকের মধ্যে হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে। তৃতীয়বার উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ববি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। বাঘিনীর মতো উঠে এসে লীনা উপুড় হয়ে পড়ল ববির ওপর। না, শ্বাস চলছে, নাড়ি চলছে। তবে বড় দ্রুত। ববির গায়ে হাত রেখে লীনা বুঝল, অন্তত একশো দুই তিন ডিগ্রি জ্বর। অবস্থাগতিক দেখে ইন্দ্রজিৎও ববির কাছে হাঁটু গেড়ে বসল, কেমন বুঝছেন? এখনই কোনও নার্সিং হোম-এ নেওয়া দরকার। নো প্রবলেম। চলুন ধরাধরি করে ওপরে তুলি। আমাদের গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা আছে। আমি চট করে নিয়ে আসব গিয়ে। দু’জনে একরকম চ্যাংদোলা করে ববিকে ধীরে ধীরে ওপরে নিয়ে এল। দরজার বাইরে পা দিয়েই যে দৃশ্যটা দেখল দু’জনে তাতে লীনা একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে চোখ ঢাকল। আর ইন্দ্রজিৎ এমন হা হয়ে গেল যে বলার নয়। লীনার চিৎকারেই বোধহয় ববির জ্ঞান দ্বিতীয়বার ফিরল। ওরা বারান্দায় শুইয়ে দিয়েছিল তাঁকে। তিনি এবার ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। দু’টি রক্তাক্ত দেহ অনেকটা তফাতে পড়ে আছে। এই দৃশ্যটাই সম্ভবত ববির ভিতরে কিছু উদ্দীপনা সঞ্চার করে দিল। তিনি দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালেন। লীনা তখনও চোখ ঢেকে কাঁপছে, টলছে। ববি অনুচ্চ স্বরে বললেন, লীনা, এরা দুজন বেঁচে থাকলে আমাদের কারও শান্তি থাকত না। এ দেশের সরকারেরও নয়। যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে। লীনা চোখ থেকে হাত সরিয়ে ববির দিকে তাকাল। চোখ ভরা জল। হঠাৎ এই অবস্থাতেও সে একটু হাসল, আমার নামটা তা হলে মনে পড়েছে আপনার! ববি চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, পড়েছে। আর ভুলব না। ইন্দ্রজিৎ বিস্ময় কাটিয়ে গিয়ে গাড়িটা নিয়ে এল। ববি মাথা নেড়ে বললেন, এখনই নয়। যাও ইন্দ্রজিৎ, ছাদটা দেখে এসো। ওখানে একজন স্নাইপার মজুত ছিল। যদিও আমার ধারণা সে পালিয়ে গেছে। ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে ওপরে গেল তারপর ফিরে এসে বলল, কেউ নেই স্যার। পিছনের বাগানে যে দু’জন পড়ে আছে তাদের একটু খবর নাও। যদি জ্ঞান না-ফিরে থাকে তবে হাত আর পা বেঁধে সেলার-এ ঢুকিয়ে দরজায় তালা দাও। এসব কাজে ইন্দ্রজিৎ খুবই পাকা এবং নির্ভরযোগ্য। দু’জন সংজ্ঞাহীন লোককে বেঁধে মাটির নীচে একটা অতিরিক্ত ঘরে বন্ধ করে আসতে তার সব মিলিয়ে পঁচিশ মিনিট লাগল। ববি কলকাতায় এক্স-সার্ভিসমেনদের একটা সিকিউরিটি এজেন্সিকে ফোন করলেন। তারা এসে নীল মঞ্জিলের নিরাপত্তার ভার নেবে এবং দু’জন বন্দিকে তুলে দেবে পুলিশের হাতে। পুলিশকেও তারাই নিয়ে আসবে এখানে। ববি আর-একটা ফোন করলেন। ট্রাংক কল। দিল্লির প্রতিরক্ষা দফতরে। লীনা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, আপনার এখনই মেডিক্যাল অ্যাটেনশন দরকার। কলকাতা অনেক দূর। কেন সময় নষ্ট করছেন? আপনার পিঠের জামা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ববি লীনার দিকে ঘুম-ঘুম ক্লান্ত চোখে চেয়ে বললেন, ওরা নীল মঞ্জিলের সমস্ত ভার আমাকে দিতে চাইছে। বিরক্ত লীনা বলল, ওসব পরে শুনব। এখন চলুন। ববি ধীরে ধীরে হেঁটে গাড়িতে এসে উঠলেন। পিছনের সিটে লীনা তার পাশে বসল। ইন্দ্রজিৎ গাড়ি ছেড়ে দিল। ববি কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ধীরে ধীরে টলতে লাগলেন। ইন্দ্রজিৎ রিয়ারভিউ মিররে তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল। বলল, শুয়ে পড়ুন স্যার। আপনাকে সাংঘাতিক সিক দেখাচ্ছে। দিদিমণির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ুন। আমি তাকাব না। রিয়ারভিউ মিররটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে
false
robindronath
সুখ আর কিছু হতে পারে না। খানিক পরে বিপ্রদাস আবার বললে, “আরো-একটা কথা তোকে বলে রাখি কুমু, খুব শীঘ্রই আমাদের কাল বদল হবে, আমাদের চালও বদলাবে। আমাদের থাকতে হবে গরিবের মতো। তখন তুই থাকবি আমাদের গরিবের ঐশ্বর্য হয়ে।” কুমুর চোখে জল এল, বললে, “আমার এমন ভাগ্য যদি হয় তো বেঁচে যাই।” বিপ্রদাস মধুসূদনের চিঠি হাতে রাখলে, উত্তর দিলে না। দুদিন পরেই নবীন মোতির মা হাবলুকে নিয়ে এসে উপস্থিত। হাবলু জ্যাঠাইমার কোলে চড়ে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদে নিলে। কান্নাটা কিসের জন্যে স্পষ্ট করে বলা শক্ত– অতীতের জন্যে অভিমান, না বর্তমানের জন্যে আবদার, না ভবিষ্যতের জন্যে ভাবনা? কুমু হাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললে, “কঠিন সংসার গোপাল, কান্নার অন্ত নেই। কী আছে আমার, কী দিতে পারি যাতে মানুষের ছেলের কান্না কমে! কান্না দিয়ে কান্না মেটাতে চাই, তার বেশি শক্তি নেই। যে ভালোবাসা আপনাকে দেয় তার অধিক আর কিছু দিতে পারে না, বাছারা, সেই ভালোবাসা তোরা পেয়েছিস; জ্যাঠাইমা চিরদিন থাকবে না, কিন্তু এই কথাটা মনে রাখিস, মনে রাখিস, মনে রাখিস।” বলে তার গালে চুমো খেলে। নবীন বললে, “বউরানী, এবার রজবপুরে পৈতৃক ঘরে চলেছি; এখানকার পালা সাঙ্গ হল।” কুমু ব্যাকুল হয়ে বললে, “আমি হতভাগিনী এসে তোমাদের এই বিপদ ঘটালুম।” নবীন বললে, “ঠিক তার উলটো। অনেক দিন থেকেই মনটা যাই-যাই করছিল। বেঁধে-সেধে তৈরি হয়ে ছিলুম, এমন সময় তুমি এলে আমাদের ঘরে। ঘরের আশ খুব করেই মিটেছিল, কিন্তু বিধাতার সইল না।” সেদিন মধুসূদন ফিরে গিয়ে তুমুল একটা বিপ্লব বাধিয়েছিল তা বোঝা গেল। নবীন যাই বলুক, কুমুই যে ওদের সংসারের সমস্ত ওলটপালট করে দিয়েছে মোতির মার তাতে সন্দেহ নেই, আর সেই অপরাধ সে সহজে ক্ষমা করতে চায় না। তার মত এই যে, এখনো কুমুর সেখানে যাওয়া উচিত মাথা হেঁট করে, তার পরে যত লাঞ্ছনাই হোক সেটা মেনে নেওয়া চাই। গলা বেশ একটু কঠিন করেই জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কি শ্বশুরবাড়ি একেবারেই যাবে না ঠিক করেছ?” কুমু তার উত্তরে শক্ত করেই বললে, “না, যাব না।” মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে তোমার গতি কোথায়?” কুমু বললে, “মস্ত এই পৃথিবী, এর মধ্যে কোনো-এক জায়গায় আমারও একটুখানি ঠাঁই হতে পারবে। জীবনে অনেক যায় খসে, তবুও কিছু বাকি থাকে।” কুমু বুঝতে পারছিল, মোতির মার মন ওর কাছ থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুরপো, তা হলে কী করবে এখন?” “নদীর ধারে কিছু জমি আছে তার থেকে মোটা ভাতও জুটবে, কিছু হাওয়া খাওয়াও চলবে।” মোতির মা উষ্মার সঙ্গেই বললে, “ওগো মশায়, না, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। ঐ মির্জাপুরের অন্নজলে দাবি রাখি, সে কেউ কাড়তে পারবে না। আমরা তো এত বেশি সম্মানী লোক নই, বড়োঠাকুর তাড়া দিলেই অমনি বিবাগী হয়ে চলে যাব। তিনিই আবার আজ বাদে কাল ফিরিয়ে ডাকবেন, তখন ফিরেও আসব, ইতিমধ্যে সবুর সইবে, এই বলে রাখলুম।” নবীন একটু ক্ষুণ্ন হয়ে বললে, “সে কথা জানি মেজোবউ, কিন্তু তা নিয়ে বড়াই করি নে। পুনর্জন্ম যদি থাকে তবে সম্মানী হয়েই যেন জন্মাই, তাতে অন্নজলের যদি টানাটানি ঘটে সেও স্বীকার।” বস্তত নবীন অনেকবারই দাদার আশ্রয় ছেড়ে গ্রামে চাষবাসের সংকল্প করেছে। মোতির মা মুখে তর্জনগর্জন করেছে, কাজের বেলায় কিছুতেই সহজে নড়তে চায় নি, নবীনকে বারে বারে আটকে রেখেছে। সে জানে ভাশুরের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি আছে। ভাশুর তো শ্বশুরের স্থানীয়। তার মতে ভাশুর অন্যায় করতে পারে কিন্তু তাকে অপমান বলা চলে না। কুমুর প্রতি কুমুর স্বামীর ব্যবহার যেমনই হোক তাই বলে কুমু স্বামীর ঘর অস্বীকার করতে পারে, এ কথা মোতির মার কাছে নিতান্ত সৃষ্টিছাড়া। খবর এল ডাক্তার এসেছে। কুমু বললে, “একটু অপেক্ষা করো, শুনে আসি ডাক্তার কী বলে।” ডাক্তার কুমুকে বলে গেল, নাড়ি আরো খারাপ, রাত্তিরে ঘুম কমেছে, বোধ হয় রোগী ঠিক বিশ্রাম পাচ্ছে না। অতিথিদের কাছে কুমু ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় কালু এসে বললে, “একটা কথা না বলে থাকতে পারছি নে, জাল বড়ো জটিল হয়ে এসেছে, তুমি যদি এই সময়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে না যাও, বিপদ আরো ঘনিয়ে ধরবে। আমি তো কোনো উপায় ভেবে পাচ্ছি নে।” কুমু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কালু বললে, “তোমার স্বামীর ওখান থেকে তাগিদ এসেছে, সেটা অগ্রাহ্য করবার শক্তি কি আমাদের আছে? আমরা যে একেবারে তার মুঠোর মধ্যে।” কুমু বারান্দায় রেলিং চেপে ধরে বললে, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে কালুদা। প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে, মনে হয় মরণ ছাড়া কোনো রাস্তাই আমার খোলা নেই।” এই বলে কুমু দ্রুতপদে চলে গেল। দাদার ঘরে যখন কুমু ছিল, সেই অবকাশে ক্ষেমাপিসির সঙ্গে মোতির মার কিছু কথাবার্তা হয়ে গেছে। নানারকম লক্ষণ মিলিয়ে দুজনেরই মনে সন্দেহ হয়েছে কুমু গর্ভিণী। মোতির মা খুশি হয়ে উঠল, মনে মনে বললে, মা কালী করুন তাই যেন হয়। এইবার জব্দ! মানিনী শ্বশুরবাড়িকে অবজ্ঞা করতে চান, কিন্তু এ যে নাড়িতে গ্রন্থি লাগল, শুধু তো আঁচলে আঁচলে নয়, পালাবে কেমন করে! কুমুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে মোতির মা তার সন্দেহের কথাটা বললে। কুমুর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সে হাত মুঠো করে বললে, “না না, এ কখনোই হতে পারে না, কিছুতেই না।” মোতির মা বিরক্ত হয়েই বললে, “কেন হতে পারবে না ভাই? তুমি যতবড়ো ঘরেরই মেয়ে হও-না
false
shunil_gongopaddhay
মুখ! সে বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় কিছু লেখাই হলো না শেষ পর্যন্ত। ‘শৈশব সঙ্গীত’ প্রকাশের সময় সে আবার ভাবল, ভাবের ঘরে চুরি করবে কেন? কাদম্বরী উৎসাহ না দিলে এর অনেক কবিতা লেখাই হতো না। এ বই একমাত্র তারই প্রাপ্য। এর এক মাস পরেই ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ প্রেসে গেল। রবি যথেষ্ট সচেতন যে পরপর সব বইগুলি মৃত নতুন বউঠানকেই প্রাকারান্তরে উৎসর্গ করা হচ্ছে বলে চারপাশে একটা ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। জ্ঞানদানন্দিনী ভুরু কুঁচকেছেন, বাঁকা মন্তব্য করেছেন স্বর্ণকুমারী। কিন্তু এ বই তো অন্য কারুকে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভানু নামটাই যে তাঁর দেওয়া। এই কবিতাগুলি নিয়ে দুজনের মধ্যে কত গোপন কৌতুক ছিল, তা অন্য কেউ বুঝবেই না। নতুন বউঠান নেই, তবু তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কি করে করবে রবি! এ বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠাতেও রবি কোনও নাম লিখল না। শুধু লিখল, ‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।’ রাস্তার খন্দে চাকা পড়ে যাওয়ায় রবির যেন ঘোর ভাঙল। তার দু চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা গড়াচ্ছে। ইস, দিনের বেলা, পথের মানুষ দেখতে পেয়ে গেল নাকি? তাড়াতাড়ি সে মুখ মুছল। আজকাল এই হয়েছে, যখন তখন তার চোখ দিয়ে জলের রেখা নেমে আসে! বাড়িতে, পরিচিত লোকজনদের সামনে সে সচেতন থাকে, কিন্তু পথে, কিছুক্ষণের একাকীত্বে, তার কোনও সংযম থাকে না। বাবামশাই ওই কথাটা বললেন কেন? ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেসে তার আর বই ছাপানো উচিত নয়? অন্য প্রকাশক তার বই চায় না। নিজে যে বইগুলি ছাপিয়েছে, তা রাশিকৃতভাবে জমে আছে, বিক্রি হয় অতি সামান্য। বঙ্কিমবাবুর বইগুলির দারুণ কাটতি, এমনকি জাল সংস্করণ পর্যন্ত বেরোয়। আর রবির লেখা পছন্দ করে না পাঠকেরা। বিক্রিই যদি না হয়, তা হলে একটার পর একটা বই ছাপিয়েই বা লাভ কি? পিপলস লাইব্রেরি, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি, ক্যানিং লাইব্রেরি এই সব দোকানে অনেক বই জমা দেওয়া আছে, তারা একটা পয়সাও দেবার নাম করে না। হঠাৎ রবির মনে পড়ল, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোক ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি’ নামে একটা দোকান খুলেছেন, গল্প-কবিতার বইও সেখান থেকে বিক্রি করার কথা বলছিলেন একদিন। তবে খুচরো বিক্রেতা নন, তিনি হোলসেলার হতে চান। তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। প্ৰতাপ মজুমদারের কাছে পরে গেলেও চলবে, রবি কোচোয়ানকে নির্দেশ দিল কলেজ স্ট্রিট যেতে। সে রাস্তার সাতানব্বই নম্বর বাড়িতে বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরির বেশ প্রশস্ত দোকান। কাচের শো কেসে নতুন নতুন বই শোভা পাচ্ছে, বঙ্কিম বাবুর বইই জুড়ে আছে অনেকখানি স্থান, মাইকেল মধুসূদনের দু-তিনখানি, হেম বাঁড়ুজ্যের বৃত্রসংহার দু খণ্ড, হুতোম প্যাঁচার নকশা, তারেক গাঙুলির স্বর্ণলতা, এমনকি নবীন সেনের পলাশির যুদ্ধ। রবি বাইরে দাঁড়িয়ে সাজানো বইগুলি দেখল। তার একটি বইও নেই। পলাশীর যুদ্ধের পাঠক আছে। তার ‘প্রভাত সঙ্গীত’-এর সমাদর করার মতন কেউ নেই। লোকে কি এখনও কাহিনীমূলক কাব্যই চায়, লিরিকের মর্ম বোঝে না! কেউ কেউ রবিকে উপদেশ দেয়, তুমি মহাকাব্যের স্টাইলে একটা কিছু লেখো না কেন? গুরুদাসবাবু খাতির করে রবিকে নিয়ে ভেতরের একটি ছোট ঘরে বসলেন। হুঁকো-কলকে আনা হল তার জন্য, আর একটা পিরিচে কয়েক খিলি পান। লেখক হিসেবে তেমন কিছু দরের না হলেও দেবেন ঠাকুরের ছেলে তো বটে! তা ছাড়া গায়ক হিসেবেও রবির বেশ নাম হয়েছে। নানা কথার পর গুরুদাসবাবু এক অভিনব প্রস্তাব দিলেন। রবির বই তেমন বিক্রি হয় না, তিনি নিজস্ব উপায়ে, নিজের সুবিধেমতন দামে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন, তবে কমিশনের ভিত্তিতে নয়, তিনি একসঙ্গে রবির সব কটি বইয়ের সমস্ত অবিক্রিত কপি কিনে নেবেন কিছু থোক টাকা দিয়ে। রবির ১৬টি বইয়ের মধ্যে কয়েকটি নেহাতই পুস্তিকা, ১২টি বেছে নেওয়া হল, ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেসের গুদামে ও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কত বই জমে আছে তার একটা মোটামুটি হিসেব কষা হল, প্রায় আট হাজার বই, তার জন্য গুরুদাসবাবু দিতে চাইলেন দু হাজার তিনশো ন টাকা। দরাদারির প্রশ্নই ওঠে না। লাভ-লোকসানেরও হিসেব কষায় কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ আর কিছুদিনের মধ্যেই তো এইসব ছাপানো পৃষ্ঠা উইপোকার খাদ্য হতো। তৎক্ষণাৎ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হল, রবির হাতে অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হল। নগদ এগারোশো টাকা। রবির প্রায় বিহ্বল অবস্থা। এতগুলো টাকা! তার বই বিক্রির টাকা! এ পর্যন্ত লিখে সে কোনও জায়গা থেকে একটা পয়সাও পায়নি। রবি যেন কল্পনায় দেখতে পেল, এবার তার বইগুলি পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের ঘরে ঘরে, দূর দূরান্তের মানুষ তার লেখা পড়ছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এই খবর সর্বপ্রথম যাঁকে দেওয়া যেত, যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন, তিনি আজ কোথায়? ‘অসীমে সুনীলে শূন্যে / বিশ্ব কোথা ভেসে গেছে / তারে যেন দেখা নাহি যায় / নিশীথের মাঝে শুধু / মহান একাকী আমি। অতলেতে ডুবি রে কোথায়…’ এ টাকার সদব্যবহার করতে হবে, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে রবি একটা ভোজ লাগিয়ে দিল। প্রিয়নাথ সেন, শ্ৰীশ মজুমদার, অক্ষয় চৌধুরী এলেন, নগেন গুপ্তকে পাওয়া গেল না। তিনি করাচিতে একটি পত্রিকার সম্পাদনার চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। রবির বালিকা বধূটি এর মধ্যেই রান্নার ব্যাপারে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে। জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে সে আর ফিরে যায়নি, জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকেই সে রোজ ফ্রক পরে স্কুলে যায়, আবার বাড়িতে যখন সে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়, তখন আর তাকে তেমন ছোটটি মনে হয় না, রান্নাঘরের ঠাকুরদের সে পাকা গিন্নির মতন নির্দেশ
false
MZI
জাগিয়ে তুলতে পারবে না? না, এই সিলিন্ডারটিকে বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত পাঠাতে পারবে না। এটি বলতে পারো তথ্য বা সঙ্কেতের দিক থেকে একেবারে নিচ্ছিদ্র। সামরিক অফিসারটি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথে আনুষ্ঠানিক বোঝাপড়া শেষ করে আমাকে ছোট একটি ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ইবান, তুমি এখন তোমার যাত্রা শুরু করতে পার। আমি ভল্টের দেওয়ালে আটকে রাখা সারি সারি সিলিন্ডারগুলোর দিকে তাকালাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ছাড়াও এখানে অন্য মানুষ রয়েছে। কেউ-কেউ প্রতিরক্ষা বাহিনীর, কেউ-কেউ একেবারে সাধারণ যাত্রী। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে তাদের পরিচয় দেওয়া রয়েছে, আমার আলাদা করে জানার কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ ছাড়াও এই মহাকাশযানে অন্য জিনিসপত্র রয়েছে, যার কিছু কিছু আমার জানার কথা নয়। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে সেগুলি মানুষের এক কলোনি থেকে অন্য কলোনিতে পৌছে দেবার কথা। ম্যাঙ্গেল কৃাসের কথা আলাদা, সে যে কোন মহাকাশযানে থাকলে সেটি মহাকাশযানের অধিনায়কের জানা প্রয়োজন। জড় বস্তু হিসেবে থাকলেও সেটি জানা প্রয়োজন। সামরিক অফিসার এবং তার সাথে আসা টেকনিশিয়ানরা নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিতে শুরু করে। ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে যাওয়া যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেয়া খুব সহজ নয় কিন্তু এই টেকনিশিয়ানরা দক্ষ, তাদের হাতের কাজ দেখতে ভালো লাগে। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। একজন একজন করে সবাই এসে আমার সামনে মাথা নিচু অভিবাদন করে তাদের স্কাউটশিপে উঠে গেল। সামরিক অফিসার আমার হাত ধরে সেখানে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইবান। আমি হেসে বললাম, আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না! সামরিক অফিসার আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে তার স্কাউটশিপে ঢুকে গেল, আমি ফোবিয়ানের গোল বায়ু-নিরোধক দরজাটা বন্ধ করে দিতেই স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পেলাম, আমি এখন এখানে একা। আমি নিজের ভিতরে একধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম, এই বিশাল মহাকাশযানটিতে আমি একা একা-এক বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করব— এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে। এই দীর্ঘ সময়ে আমার সাথে কথা বলার জন্যেও কোনো সত্যিকার মানুষ থাকবে না। মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকারে, হিম শীতল পরিবেশে এই বিশাল মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে উড়ে যাবে। নতুন এই মহাকাশযানে হয়ত অজানা কোনো বিপদ অপেক্ষা করে আছে, মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি দুটি বিশাল ব্ল্যাক হোল, তার পাশে দিয়ে বিপজ্জনক একটি কক্ষপথ দিয়ে আমাকে যেতে হবে। সেখানে মহাকাশ-দস্যুরা ওৎ পেতে আছে, কে জানে, হয়ত বিচিত্র কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে হবে! জানি না সেই দীর্ঘ যাত্রা কখনো শেষ হবে কি না, রিশি নক্ষত্রের সেই মানবকলোনিতে পৌঁছাতে পারব কি না। যদিওবা পৌঁছাই সেই একযুগ পর আমার মায়ের সাথে দেখা হবে কি না সে কথাটিই-বা কে বলতে পারে! আমি জোর করে আমার ভেতর থেকে সব চিন্তা দূর করে সরিয়ে দিয়ে ভেসে ভেসে মহাকাশযানের ওপরের দিকে যেতে থাকি। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে আমাকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন যখন প্রচণ্ড গর্জন। করে এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করে মহাকাশে পাড়ি দেবে তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসার সাথে সাথে আমি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণকারী মূল। নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, পঞ্চম মাত্রার আন্তঃ নক্ষত্র মহাকাশযান ফোবিয়ানের পক্ষ থেকে আপনাকে এই মহাকাশযানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মহামান্য ইবান। মানুষের কণ্ঠস্বরে এধরনের যান্ত্রিক কথা শুনলে সবসময়েই আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি— আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়েই মনে করি যন্ত্র এবং মানুষের কথার মাঝে একটা স্পষ্ট পার্থক্য থাকা দরকার। মানুষের কথা শোনার সময় তাকে সবসময়েই আমরা দেখতে পাই, মুখের ভাবভঙ্গি থেকে কথার অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যন্ত্রের বেলায় সেটা সম্ভব নয়— সত্যি কথা বলতে কী কথাটা কোথা থেকে আসছে অনেক সময় সেটাও বুঝতে পারি না। আমি চেয়ারে নিজেকে নিরাপত্তা বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, আমি যদি বলি তোমার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম না! নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর তরল গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্যি সেটা বলতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি কে? আমি ফোবি। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মানুষের সংযোগকারী মডিউল ফোবি। আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতে করতে বললাম, আচ্ছা ফোবি, আমি যদি এখন তোমাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল করি তাহলে কী হবে? কিছুই হবে না মহামান্য ইবান। আমি মানুষ নই, আমার ভেতরে কোনো মান-অপমান বোধ নেই— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি, যেভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করা যায় সেভাবে সাহায্য করব। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে ফোবিয়ানের ইঞ্জিনগুলোর খুঁটিনাটি পরীক্ষা করতে করতে বললাম, ফোবি, আমি যতদূর জানি তোমার নিউরাল নেটওয়ার্ক মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক গুণ ভালো বলা হয়, মানুষ থেকে বারো গুণ বেশি তোমার বুদ্ধিমত্তা— যার অর্থ তুমি আসলে আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। কাজেই প্রকৃত অর্থে আমার তোমাকে বলা উচিৎ মহামান্য ফোবি— ফোবি এবারে প্রায় হাসার মতো করে শব্দ করল, বলল, আপনি ভুল করছেন মহামান্য ইবান, আমি নিউরাল নেটওয়ার্ক নই— আমি শুধুমাত্র নিউরাল নেটওয়ার্কের মানুষের সাথে যোগাযোগকারী মডিউল। নিউরাল নেটওয়ার্ক যদি একটা মানুষ হয় তাহলে আমি তার কণ্ঠস্বর। আমার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা নেই। আর সম্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার কোনো অর্থ নেই মহামান্য ইবান। দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখা গেছে একজন মানুষ এবং একজন যন্ত্রকে পাশাপাশি কাজ করতে দেয়া হলে মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে খানিকটা প্রাধান্য দিতে হয়, পুরো ব্যাপারটি অনেক
false
shomresh
না সার। অনেক লম্বা, দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। ওই শুনুন। অর্জুন খেয়াল করেনি ওরা জঙ্গলের কাছে আসামাত্র ওই কান্না থেমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে হঠাৎ সেই কান্না যেন জঙ্গলময় ছড়িয়ে পড়ল। মেজর বললেন, এই জঙ্গলে শকুন ছাড়া অন্য কোনও পাখি থাকে বলে মনে হয় না। এগুলো শকুনের বাচ্চার চিৎকার। পাশ দিয়ে হাঁটা যাক, পথ একটা না একটা থাকবেই। চলুন। প্রথমে গোরানসাহেব হাঁটছিলেন। তাঁর টর্চের লম্বা লম্বা আলো জঙ্গলের শরীরে পথ খুঁজছিল। ওঁর পেছনেই মেজর। উত্তমকুমার দ্রুত অর্জুনের সামনে চলে এলেন। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এঁরা এই জঙ্গলে কী খুঁজছেন? প্রেতাত্মা। ড্রাকুলা হলে খুব ভাল হয়। সর্বনাশা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এঁরা এব্যাপারে খুব এক্সপার্ট। কী বলছেন আপনি? বড় বড় ওঝারাও এখানে ঢুকতে চায় না। বছরখানেক আগে দুটো দাগি আসামি এই জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিল। তিনদিন বাদে খুব শকুন উড়ছে দেখে গ্রামের লোক আমাদের খবর দেয়। দিনদুপুরে দুজন ওঝাকে সঙ্গে নিয়ে দশজনের ফোর্স এসে পচা ডেডবডি উদ্ধার করে। তার অর্ধেকটাই শকুনের পেটে চলে গিয়েছিল বলে পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো যায়নি। লোকে বলে ওই দুটো দাগির আত্মাই নাকি এখানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদে, উত্তমকুমার বললেন। অসম্ভব নয়। এখানকার ওরিজিন্যাল আত্মারা বোধ হয় ওদের থাকতে দিচ্ছে না। হতে পারে। গ্রামের লোকরা এই কথাই বলে। দেখা গেল গোরানসাহেব দাঁড়িয়ে আলোর ইশারা করছেন। তাঁর সামনেই একটা পায়েচলা পথ। ওঁরা সেই পথে ঢুকলেন। পথটা হাঁটার পক্ষে মোটেই আরামের নয়। তেঁতুলগাছের যেসব ডাল নীচে নেমে এসেছে তার ছোঁয়া লাগামাত্র কাঁটা ফুটছিল। ওই কাঁটা এত শক্ত এবং ধারালো যে, উত্তমকুমার বারংবার উঃ আঃ করছিলেন। দেখা গেল, শুধু তেঁতুল নয়, কুলগাছও সঙ্গে মিশে আছে। বাইরে থেকে যতটা ঘন দেখাচ্ছিল, খানিকটা ভেতরে আসার পর তেমন মনে হল না। মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়েই বোধ হয় শকুনের বাচ্চাগুলো তাদের কান্না থামিয়েছে। অর্জুন মেজরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনদিকে যাবেন? সেটাই তো বুঝতে পারছি না। গোরানসাহেব ইংরেজিতে বললেন, ওই জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। চলো, ওখানে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করি। শকুনের বাচ্চাগুলো যখন আমাদের কথা টের পেয়ে গেছে তখন তাঁরা কেউ থাকলে জানতেই পারবেন। বলতে বলতে তিনি শক্ত হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ ঘুরতে লাগল। অর্জুন অবাক হয়ে ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে মুখ ফেরাতে দেখতে পেল অন্ধকারে একটা কিছু নড়ছে। মেজরও সেটা বুঝতে পেরে টর্চ জ্বালতেই সাপটাকে দেখা গেল। অন্তত হাতপাঁচেক লম্বা, মোটা, কালো হলুদ রঙের সাপটা মাটি থেকে সোজা হয়ে ফণা তুলে দাঁড়াবার সময় চকিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। ওরকম বিদ্যুতের মতো বৃদ্ধ গোরানসাহেব যে ছুটে গিয়ে ওর গলা টিপে ধরতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। বাঁ হাতে টর্চ আর ডান হাতে ভারী সাপটাকে তুলে মাটিতে আছাড় মারছিলেন গোরানসাহেব। তারপর টর্চ এগিয়ে দিলেন অর্জুনের দিকে। অর্জুন সেটাকে ঘুরিয়ে ওঁর ওপর আলো ফেলতেই বাঁ হাতে একটা ছুরি বের করলেন ব্যাগ থেকে। ডান হাতের মুঠোয় ধরা সাপটার মাথার নীচে ছুরি চালাতেই শরীরটা দুটুকরো হয়ে গেল। শরীরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। একটা চওড়া ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে মাথাটাকে ভাল করে মুড়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন গোরানসাহেব। এই কর্মটি অবাক হয়ে দেখছিলেন উত্তমকুমার। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে? অর্জুন বলল, একজন গবেষক। আঁ! সাপের মাথা নিয়ে গবেষণা করেন নাকি? বোধ হয়। সাঙ্ঘাতিক। ওরকম বিষাক্ত সাপকে কীভাবে ধরলেন! অর্জুন গোরানসাহেবের ওপর থেকে টর্চের আলো সরায়নি। ওঁর মুখে যে বিকৃতি এসেছিল, ঠোঁটে যে বীভৎস হাসিটা ফুটেছিল তা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে যেতে সে আলো নেভাল। গোরানসাহেব মেজরের পাশে এসে দাঁড়ালেন, আমার মনে হয় এবার ফিরে গেলেই ভাল হবে। এখানে থাকা মানে সময় নষ্ট করা। হঠাৎ? যেখানে এই সাপ থাকে সেখানে ড্রাকুলা থাকতে পারে না। গোরান, তোমাকে অনেকবার বলেছি এদেশের কেউ ড্রাকুলার নাম বইয়ের বাইরে শোনেনি। ড্রাকুলার কথা অশিক্ষিত মানুষেরাও জানে না। এরা বিশ্বাস করে ভূত, প্রেত, আত্মায়। ওঃ নো। এরা মনে করে বাজে আত্মা মানুষের শরীরে ঢুকে তাকে দিয়ে খারাপ কাজ করায়। আমি কি ভুল বলছি? গোরানসাহেব প্রতিবাদ করলেন। হ্যাঁ। তা করে। কিন্তু সেই মানুষ দিনেও জেগে থাকে, ঘুমোয় না। আর সাপের সঙ্গে প্রেতাত্মার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু সাপ আছে বলে তারা এই বন থেকে চলে যাবে কেন? বিরক্ত হলেন মেজর। দুটো সমান শক্তিশালী শত্রু সাধারণত এক জায়গায় থাকে না। মেজর হাসলেন, শুনেছি সাপ শয়তানের বন্ধু, তুমি শত্রু বলছ কেন? শয়তান ড্রাকুলা নয়। প্রেতাত্মা নয়। সে ঈশ্বরের শত্রু। তর্কটা থেমে গেল, কারণ দূরে গাড়ির এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। ওরা নেমে আসার পরে ড্রাইভার গাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। ভয় পেয়ে সে গাড়ি নিয়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছে না তো? উত্তমকুমার কান পেতে শুনে বললেন, না সার। এটা আপনাদের গাড়ির আওয়াজ নয়। তা হলে আপনার জিপটা চলে এসেছে। আমাদের ড্রাইভার মোটা টাকা ভাড়া হিসেবে পাবে, সে না বলে চলে যাবে না। অর্জুন বলল। না সার। আমার জিপ নয়। এটা একটা ম্যাটাডোরের আওয়াজ। এত রাত্রে হুতুমপুরে ম্যাটাডোর এল কেন? আওয়াজটা ওদের বাঁ দিকের কোথাও থেমে গেল। অর্জুন মনে করার চেষ্টা করল। ওরা এখানে এসেছে ডান দিক থেকে। অর্থাৎ ওদের গাড়ি রয়েছে ডান দিকে। যদি কেউ এখন গাড়ি নিয়ে আসে তা
false
humayun_ahmed
নাসিম হতভম্ব হয়ে বলল, কেন? জিনিস ঠিকমত দেন নি। লো কোয়ালিটি জিনিস দিয়েছেন। সব জিনিস তো স্যরি আপনাদের দেখিয়ে–আপনাদের এখোলে নিয়ে তারপর ডেলিভারি দিয়েছি। তা দিয়েছেন, তবে যে জিনিস দেখিয়েছেন সেই জিনিস দেন নি। দিয়েছেন রদ্দি মাল। বাবু বলল, স্যার আপনার কথা ঠিক না। যা দেখিয়েছি তাই দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, কোন উনিশ-বিশ হয় নি। আপনি বললে তো হবে না–মিষ্টির ব্যাপারে ময়রার কথা গ্রাহ্য না। আমাদের নিজস্ব টিম ইনকোয়ারি করেছে। তারা বলেছে–লো কোয়ালিটি। তার মানে কি এই যে আমরা বিল পাব না? না। সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর চেয়ার রিজেক্টেড হয়েছে। যেগুলি দিয়েছেন ফেরত নেবেন, নতুন করে দেবেন। তারপর দেখা যাবে। বাবু বলল, আমাদের এটা তো স্যার খুব ছোট ফার্ম। আমাদের অর্থবল নেই বললেই হয়… আমাকে এসব বলে লাভ নেই। আমি আমার ডিসিশান জানিয়ে দিলাম। কাল ট্রাক নিয়ে এসে ফার্নিচার তুলে নিয়ে যাবেন। আমি আলসারের রোগী। আমাকে টাইমলি খেতে হয়। আপনারা এখন দয়া করে যান, আমি খেতে বসব। আমরা স্যার বাইরে অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করে লাভ কিছু নেই। যা বলার বলে দিয়েছি। আমাদের কিছু বলার ছিল স্যার। আমার মনে হয় না আপনাদের কিছু বলার আছে। তারপরেও যদি কিছু বলার থাকে, আমার পি, একে বলুন। বাবু এবং নাসিম মুখ শুকনো করে বের হয়ে এল। এই কাজটা এরা খুব আশা নিয়ে করেছিল। তারা যা চেয়েছে তাই দিয়েছে। বড় কাজ, ঠিকমত করলে পরে আরো কাজ পাওয়া যাবে। দুজনই পরিশ্রমের চূড়ান্ত করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে সবই জলে গেছে। সমস্যাটা কি বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক কি তাদের কাছ থেকে ঘুষ চাচ্ছেন? তাও তো মনে হচ্ছে না। কাজ দেবার সময় তিনি হাসিমুখে বলেছেন–আপনারা দুই ইয়াং ম্যান, ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে ব্যবসায় নেমেছেন দেখে ভাল লাগছে। আপনারা লোয়েস্ট টেণ্ডার দিয়েছেন। লোয়েস্ট টেণ্ডারে কাজ দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবু আপনাদের দিচ্ছি। আমি চাই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বিজনেসে আসুক। আপনারা সৎভাবে কাজ করবেন, আমি আপনাদের ব্যাক করব। কেউ যদি টাকা-পয়সা চায়–চট করে দেবেন না। আমাকে প্রথমে জানাবেন। নাসিম হাত কচলাতে কচলাতে বলেছে, আপনার কথা শুনে বড় ভাল লাগছে স্যার। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করার কথা যা বললেন–সেটা অর্ধেক সত্যি। বাবু এম. এ. পাস করেছে। আমার বিদ্যা স্যার আই. এ. পর্যন্ত। থার্ড ডিভিশন পেয়েছিলাম–ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারি নি। আপনি স্যার আমাদের উপর একটু দোয়া রাখবেন। নাসিম এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলেছে, এবং গদগদ গলায় বলেছে–আপনি স্যার বলতে গেলে আমাদের ফাদারের মত। আমাদের দুজনেরই ফাদার। নেই। ঠিক আছে। ঠিক আছে। তোমরা অনেস্টলি কাজ কর, আমি দেখব। সেই একই ভদ্রলোক আজ উল্টো কথা কেন বলছেন বাবু বা নাসিম দুজনের কারো মাথাতেই তা আসছে না। এতদিন তুমি তুমি করে বলেছেন, আজ বলছেন আপনি করে। মানেটা কি? সূর্যের চেয়ে বালি সব সময়ই বেশি গরম হয়। অফিসারের চেয়ে পি,এর দাপট থাকে বেশি। রহমান সাহেবের পি.এর বেলায় এই থিওরি খাটল না। ভদ্রলোক হাসি-খুশি। নিজেই এদের দুজনকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ালেন। নাসিম বলল, ব্যাপারটা কি ভাই সাহেব বলুন তো। আমরা কি ভুল করেছি? ভুল কিছু করেন নি। তাহলে? বিল না পেলে বিশ্বাস করুন ভাই আমার অফিসে যে সিলিং ফ্যান আছে ঐটাতে ঝুলতে হবে। বোনের গয়না বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছি। সে দিতে চায় নি। বলতে গেলে জোর করে নিয়েছি। দুলাভাই কিছু জানে না। জানতে পারলে বোনকে সেফটি পিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁটিয়ে মারবে। সমস্যাটা কোথায় আপনি আমাকে বলুন তো। হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করতে পারবেন? হাজার পঞ্চাশেক টাকা তো আমাদের লাভ হবে না। সব খরচ টরচ বাদ দিয়ে তেতাল্লিশ হাজার টাকা লাভ হবে। এর মধ্যে সুদের টাকা দিতে হবে আঠাশ হাজার। এইসব আমাকে শুনায়ে কোন লাভ নেই রে ভাই। পঞ্চাশ হাজার টাকা, জোগাড় করুন। ব্যবস্থা হবে। বাবু হতভম্ভ গলায় বলল, কে নেবে এই টাকা? আপনার তো সেটা দিয়ে দরকার নাই। আমাদের রক্ত পানিকরা টাকা কে নেবে এটা জানা আমাদের দরকার নেই? কি বলছেন আপনি? আপনারা এই লাইনে খুবই নতুন। টাকাটা কে নেবে বুঝতে পারছেন না কেন? আপনাদের সঙ্গে কে কথা বলছে–আমি। আমি কার লোক? রহমান সাহেবের লোক। কে আপনাদের আমার সঙ্গে কথা বলতে বলল? রহমান সাহেব বললেন। এখন কিছু বুঝতে পারছেন? না, এখনো বুঝতে পারছি না। কেউ এখানে টেডার দেয় না। কেন দেয় না বুঝতে পারছেন না। এখানে টেন্ডার দিয়ে কেউ লাভ করতে পারে না। সব ঠিকঠাক মত চলে–শেষটায় ধরা খায়। হা হা হা। আপনি হাসছেন? হাসি আসছে আপনার? আপনাদের দুজনের বেকুবি দেখে হাসছি। নাসিম সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, টাকাটা দিতে হবে? সিস্টেমটা কি? সিস্টেম খুব সোজা। একটা ঠিকানা দেব–ঐ ঠিকানায় একটা রঙ্গিন টিভি চব্বিশ ইঞ্চি সনি, আর একটা ন্যাশনাল কোম্পানির -10 ভিসিআর দিয়ে আসবেন। স্যারের মেজো মেয়ের বাসা। যেদিন দিবেন তার পরের দিন বিলে সই হবে। দেব ঠিকানা? দিন। ঠিকানা ভদ্রলোকের পকেটে লেখাই ছিল। তিনি ঠিকানা বের করে দিতে দিতে বললেন–এর পরেও আপনাদের হাজার পঁচিশেক টাকা লাভ থাকবে। কথা ছিল সেগুন কাঠ দিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিল বানাবেন। বানিয়েছেন কড়ই কাঠে। কড়ই কাঠের সিএফটি হল তিনশ দশ। আর সেগুন এগার শ। বাবু বলল, কড়ই কাঠের
false
shorotchandra
সে চলিয়া গেল। দয়াময়ী স্নেহের চক্ষে সেই দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, সকল দিকে দৃষ্টি আছে। কেবল লেখাপড়াই নয় বিপিন, মেয়েটা জানে না এমন কাজ নেই। আর তেমনি মিষ্টি কথা। ভার দিয়ে নিশ্চিন্দি—সংসারের কিচ্ছুটি চেয়ে দেখতে হয় না। বিপ্রদাস কহিল, ম্লেচ্ছ বলে আর ঘেন্না কর না ত মা? দয়াময়ী বলিলেন, তোর এক কথা! ম্লেচ্ছ হতে যাবে কিসের জন্যে,—ওর মা একবার বিলেত গিয়েছিল বলেই লোকে মেমসাহেব বলে দুর্নাম রটালে। নইলে আমাদের মতই বাঙালী ঘরের মেয়ে। বন্দনা জুতো পরে—তা পরলেই বা! বিদেশে অমন সবাই পরে। লোকজনের সামনে বার হয়—তাতেই বা দোষ কি? বোম্বায়ে ত আর ঘোমটা দেওয়া নেই—ছেলেবেলা থেকে যা শিখেচে তাই করে। আমার যেমন বৌমা তেমনি ও। বাপের সঙ্গে চলে যাবে বলচে—শুনলে মন কেমন করে বাবা। বিপ্রদাস কহিল, মন কেমন করলে চলবে কেন মা? বন্দনা থাকতে আসেনি,—দুদিন পরে ওকে যেতে ত হবেই। দয়াময়ী কহিলেন, যাবে সত্যি, কিন্তু ছেড়ে দিতে মন চায় না,—ইচ্ছে করে চিরকাল ধরে রেখে দিই। বিপ্রদাস ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, সে ত আর সত্যিই হবার জো নেই মা—পরের মেয়েকে অত জড়িও না। দুদিনের জন্যে এসেছে সেই ভালো। এই বলিয়া সে কিছু অন্যমনস্কের মত বাহিরে চলিয়া গেল। কথাটা দয়াময়ীর বেশ মনঃপূত হইল না। কিন্তু সে ক্ষণকালের ব্যাপার মাত্র। বলরামপুরে ফিরিবার কেহ নাম করেন না, তাঁহাদের দিনগুলা কাটিতে লাগিল যেন উৎসবের মত—হাসিয়া, গল্প করিয়া এবং চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করিয়া। সকলের সঙ্গেই হাস্য-পরিহাসে এতটা হাল্কা হইতে দয়াময়ীকে ইতিপূর্বে কেহ কখনও দেখে নাই,— তাঁহার অন্তরে কোথায় যেন একটা আনন্দের উৎস নিরন্তর প্রবাহিত হইতেছিল, তাঁহার বয়স ও প্রকৃতিসিদ্ধ গাম্ভীর্যকে সেই স্রোতে মাঝে মাঝে যেন ভাসাইয়া দিতে চায়। সতীর সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে প্রায়ই কি কথা হয়, তাহার অর্থ শুধু শাশুড়ী-বধূই বুঝে, আরও একজন হয়ত কিছু-একটা অনুমান করে সে অন্নদা। সস্ত্রীক পাঞ্জাবের ব্যারিস্টারসাহেব এতদিন থাকিয়া কাল বাড়ি গেছেন, তাঁহাদের উভয়ের নামই বসন্ত, এই লইয়া দয়াময়ী যাইবার সময়ে কৌতুক করিয়াছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি করাইয়া লইয়াছেন যে, কর্মস্থলে ফিরিবার পূর্বে আবার দেখা দিয়া যাইতে হইবে। হয় কলিকাতায়, নয় বলরামপুরে। রায়সাহেবের পা ভাল হইয়াছে, আগামী সপ্তাহে তিনি বোম্বাই যাত্রা করিবেন, দয়াময়ী নিজে দরবার করিয়া বন্দনার কিছুদিনের ছুটি মঞ্জুর করাইয়া লইয়াছেন, সে যে বোম্বায়ের পরিবর্তে বলরামপুরে গিয়া অন্ততঃ আরও একটা মাস দিদির কাছে অবস্থান করিবে এ ব্যবস্থা পাকা হইয়াছে। মুখুয্যেদের মামলা-মকদ্দমা হাইকোর্টে লাগিয়াই থাকে, একটা বড়রকম মামলার তারিখ নিকটবর্তী হইতেছিল, তাই বিপ্রদাস স্থির করিল আর বাড়ি না গিয়া এই দিনটা পার কারিয়া দিয়া সকলকে লইয়া দেশে ফিরিবে। নানা কাজে তাহাকে সর্বদাই বাহিরে থাকিতে হয়, আজ ছিল রবিবার, দয়াময়ী আসিয়া হাসিমুখে বলিলেন, একটা মজার কথা শুনেচিস বিপিন? বিপ্রদাস আদালতের কাগজ দেখিতেছিল, চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, কি কথা মা? দয়াময়ী বলিলেন, দ্বিজুদের কি-একটা হাঙ্গামার মিটিং ছিল আজ, পুলিশে হতে দেবে না, আর ওরা করবেই। লাঠালাঠি মাথা ফাটাফাটি হ’তই, শুনে ভয়ে মরি— সে গেছে নাকি? না। সেই কথাই ত তোকে বলতে এলুম। কারও মানা শুনবে না, এমন কি ওর বৌদিদির কথা পর্যন্তও না, শেষে শুনতে হ’ল বন্দনার কথা। খবরটা যত মজারই হোক মায়ের সুপরিচিত মর্যাদায় কোথায় যেন একটু ঘা দিল। বিপ্রদাস মনে মনে বিস্মিত হইয়াও মুখে শুধু বলিল, সত্যি নাকি? দয়াময়ী হাসিয়া জবাব দিলেন, তাই ত হ’ল দেখলুম। কবে নাকি ওদের শর্ত হয়েছিল এখানে একজন জুতো পরবে না, চাল- চলনে এ বাড়ির নিয়ম লঙ্ঘন করবে না, আর তার বদলে অন্যজনকে তার অনুরোধ মেনে চলতে হবে। বন্দনা ওর ঘরে ঢুকে শুধু বললে, দ্বিজুবাবু, শর্ত মনে আছে ত? আপনি কিছুতে আজ যেতে পাবেন না। দ্বিজু স্বীকার করে বললে, বেশ তাই হবে, যাব না। শুনে আমার ভাবনা ঘুচল বিপিন। কি করে আসবে, কি ফ্যাসাদ বাধবে—কর্তা বেঁচে নেই, কি ভয়ে ভয়েই যে ওকে নিয়ে থাকি তা বলতে পারিনে। বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। মা বলিতে লাগিলেন, আগে তবু ওর ইস্কুল-কলেজ, পড়াশুনা, একজামিন-পাস করা ছিল, এখন সে বালাই ঘুচেছে, হাতে কাজ না থাকলে বাইরের কোন্‌ ঝঞ্ঝাট যে কখন ঘরে টেনে আনবে তা কেউ বলতে পারে না। ভাবি, শেষ পর্যন্ত এত বড় বংশের ও একটা কলঙ্ক হয়ে না দাঁড়ায়। বিপ্রদাস হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, কহিল, না, মা সে ভয় ক’র না, দ্বিজু কলঙ্কের কাজ কখনো করবে না। মা বলিলেন, ধর যদি হঠাৎ একটা জেল হয়েই যায়? সেই আশঙ্কা কি নেই? বিপ্রদাস কহিল, আশঙ্কা আছে মানি, কিন্তু জেলের মধ্যে ত কলঙ্ক নেই মা, কলঙ্ক আছে কাজের মধ্যে। তেমন কাজ সে কোনদিন করবে না। ধর যদি আমারি কখন জেল হয়,—হতেও ত পারে, তখন কি আমার জন্যে তুমি লজ্জা পাবে মা? বলবে কি বিপিন আমার বংশের কলঙ্ক? কথাটা দয়াময়ীকে শূল-বিদ্ধ করিল। কি জানি কোন নিহিত ইঙ্গিত নাই ত? এই ছেলেটিকে বুকে করিয়া এতবড় করিয়াছেন, বেশ জানিতেন, সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য বিপ্রদাস পারে না এমন কাজ নাই। কোন বিপদ, কোন ফলাফলই সে গ্রাহ্য করে না অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে। যখন তাহার মাত্র আঠারো বৎসর বয়স তখন একটি মুসলমান-পরিবারের পক্ষ লইয়া সে একাকী এমন কাণ্ড করিয়াছিল যে কি করিয়া প্রাণ লইয়া ফিরিতে পারিল তাহা আজও দয়াময়ীর সমস্যার ব্যাপার। বন্দনার মুখে সেদিনকার ট্রেনের ঘটনা শুনিয়া তিনি শঙ্কায় একেবারে নির্বাক হইয়া
false
robindronath
না। পীতাম্বরকে এতদিন ভারী রাজা বলিয়া মনে হইত, কিন্তু আজ আর তাহা কাহারও মনে হইল না; নক্ষত্ররায়কে দেখিয়া সকলেই একবাক্যে বলিল, “হাঁ, রাজপুত্র এইরকমই হয় বটে।” এইরূপে পীতাম্বর তাঁহার পাকা দালান ও চণ্ডীমণ্ডপসুদ্ধ একেবারে লুপ্ত হইয়া গেলেন বটে, কিন্তু তাঁহার আনন্দের আর সীমা রহিল না। নক্ষত্ররায়কে তিনি এমনি রাজা বলিয়া অনুভব করিলেন যে নিজের ক্ষুদ্র রাজমহিমা নক্ষত্ররায়ের চরণে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়া তিনি পরম সুখী হইলেন। নক্ষত্ররায় কদাচিৎ হাতি চড়িয়া বাহির হইলে পীতাম্বর আপনার প্রজাদের ডাকিয়া বলিতেন, “রাজা দেখেছিস? ওই দেখ্‌ রাজা দেখ্‌।” মাছতেরকারি আহার্য দ্রব্য উপহার লইয়া পীতাম্বর প্রতিদিন নক্ষত্ররায়কে দেখিতে আসিতেন–নক্ষত্ররায়ের তরুণ সুন্দর মুখ দেখিয়া পীতাম্বরের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিত। নক্ষত্ররায়ই গ্রামের রাজা হইয়া উঠিলেন। পীতাম্বর প্রজাদের মধ্যে গিয়া ভর্তি হইলেন। প্রতিদিন তিন বেলা নহবত বাজিতে লাগিল, গ্রামের পথে হাতি-ঘোড়া চলিতে লাগিল, রাজদ্বারে মুক্ত তরবারির বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল, হাটবাজার বসিয়া গেল। পীতাম্বর এবং তাঁহার প্রজারা পুলকিত হইয়া উঠিলেন। নক্ষত্ররায় এই নির্বাসনের রাজা হইয়া উঠিয়া সমস্ত দুঃখ ভুলিলেন। এখানে রাজত্বের ভার কিছুমাত্র নাই, অথচ রাজত্বের সুখ সম্পূর্ণ আছে। এখানে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বদেশে তাঁহার এত প্রবল প্রতাপ ছিল না। তাহা ছাড়া, এখানে রঘুপতির ছায়া নাই। মনের উল্লাসে নক্ষত্ররায় বিলাসে মগ্ন হইলেন। ঢাকা নগরী হইতে নটনটী আসিল, নৃত্যগীতবাদ্যে নক্ষত্ররায়ের তিলেক অরুচি নাই। নক্ষত্ররায় ত্রিপুরার রাজ-অনুষ্ঠান সমস্তই অবলম্বন করিলেন। ভৃত্যদের মধ্যে কাহারও নাম রাখিলেন মন্ত্রী, কাহারও নাম রাখিলেন সেনাপতি, পীতাম্বর দেওয়ানজি নামে চলিত হইলেন। রীতিমত রাজ-দরবার বসিত। নক্ষত্ররায় পরম আড়ম্বরে বিচার করিতেন। নকুড় আসিয়া নালিশ করিল, “মথুর আমায় “কুত্তো কয়েছে।” তাহার বিধিমত বিচার বসিল। বিবিধ প্রমাণ সংগ্রহের পর মথুর দোষী সাব্যস্ত হইলে নক্ষত্ররায় পরম গম্ভীরভাবে বিচারাসন হইতে আদেশ করিলেন–নকুড় মথুরকে দুই কানমলা দেয়। এইরূপে সুখে সময় কাটিতে লাগিল। এক-একদিন হাতে নিতান্ত কাজ না থাকিলে সৃষ্টিছাড়া একটা কোনো নূতন আমোদ উদ্ভাবনের জন্য মন্ত্রীকে তলব পড়িত। মন্ত্রী রাজসভাসদ্‌দিগকে সমবেত করিয়া নিতান্ত উদ্‌বিগ্ন ব্যাকুলভাবে নূতন খেলা বাহির করিতে প্রবৃত্ত হইতেন, গভীর চিন্তা এবং পরামর্শের অবধি থাকিত না। একদিন সৈন্যসামন্ত লইয়া পীতাম্বরের চণ্ডীমণ্ডপ আক্রমণ করা হইয়াছিল, এবং তাঁহার পুকুর হইতে মাছ ও তাঁহার বাগান হইতে ডাব ও পালংশাক লুঠের দ্রব্যের স্বরূপ অত্যন্ত ধুম করিয়া বাদ্য বাজাইয়া প্রাসাদে আনা হইয়াছিল। এইরূপ খেলাতে নক্ষত্ররায়ের প্রতি পীতাম্বরের স্নেহ আরো গাঢ় হইত। আজ প্রাসাদে বিড়াল-শাবকের বিবাহ। নক্ষত্ররায়ের একটি শিশু বিড়ালী ছিল, তাহার সহিত মণ্ডলদের বিড়ালের বিবাহ হইবে। চুড়োমণি ঘটক ঘটকালির স্বরূপ তিন শত টাকা ও একটা শাল পাইয়াছে। গায়ে-হলুদ প্রভৃতি সমস্ত উপক্রমণিকা হইয়া গিয়াছে। আজ শুভলগ্নে সন্ধ্যার সময়ে বিবাহ হইবে। এ কয় দিন রাজবাটীতে কাহারও তিলার্ধ অবসর নাই। সন্ধ্যার সময় পথঘাট আলোকিত হইল, নহবত বসিল। মণ্ডলদের বাড়ি হইতে চতুর্দোলায় চড়িয়া কিংখাবের বেশ পরিয়া পাত্র অতি কাতর স্বরে মিউ মিউ করিতে করিতে যাত্রা করিয়াছে। মণ্ডলদের বাড়ির ছোটো ছেলেটি মিত-বরের মতো তাহার গলার দড়িটি ধরিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। উলু-শঙ্খধ্বনির মধ্যে পাত্র সভাস্থ হইল। পুরোহিতের নাম কেনারাম, কিন্তু নক্ষত্ররায় তাহার নাম রাখিয়াছিলেন রঘুপতি। নক্ষত্ররায় আসল রঘুপতিকে ভয় করিতেন, এইজন্য নকল রঘুপতিকে লইয়া খেলা করিয়া সুখী হইতেন। এমন-কি, কথায় কথায় তাহাকে উৎপীড়ন করিতেন; গরিব কেনারাম সমস্ত নীরবে সহ্য করিত। আজ দৈবদুর্বিপাকে কেনারাম সভায় অনুপস্থিত–তাহার ছেলেটি জ্বরবিকারে মরিতেছে। নক্ষত্ররায় অধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘুপতি কোথায়?” ভৃত্য বলিল, “তাঁহার বাড়িতে ব্যামো।” নক্ষত্ররায় দ্বিগুণ হাঁকিয়া বলিলেন, “বোলাও উস্‌কো।” লোক ছুটিল। ততক্ষণ রোরুদ্যমান বিড়ালের সমক্ষে নাচগান চলিতে লাগিল। নক্ষত্ররায় বলিলেন, “সাহানা গাও।” সাহানা গান আরম্ভ হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে ভৃত্য আসিয়া নিবেদন করিল, “রঘুপতি আসিয়াছেন।” নক্ষত্ররায় সরোষে বলিলেন, “বোলাও।” তৎক্ষণাৎ পুরোহিত গৃহে প্রবেশ করিলেন। পুরোহিতকে দেখিয়াই নক্ষত্ররায়ের ভ্রূকুটি কোথায় মিলাইয়া গেল, তাঁহার সম্পূর্ণ ভাবান্তর উপস্থিত হইল। তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, কপালে ঘর্ম দেখা দিল। সাহানা গান, সারঙ্গ ও মৃদঙ্গ সহসা বন্ধ হইল; কেবল বিড়ালের মিউ মিউ ধ্বনি নিস্তব্ধ ঘরে দিগুণ জাগিয়া উঠিল। এ রঘুপতিই বটে । তাহার আর সন্দেহ নাই। দীর্ঘ, শীর্ণ, তেজস্বী, বহুদিনের ক্ষুধিত কুকুরের মতো চক্ষু দুটো জ্বলিতেছে। ধুলায় পরিপূর্ণ দুই পা তিনি কিংখাব মছলন্দের উপর স্থাপন করিয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “নক্ষত্ররায়!” নক্ষত্ররায় চুপ করিয়া রহিলেন। রঘুপতি বলিলেন, “তুমি রঘুপতিকে ডাকিয়াছ। আমি আসিয়াছি।” নক্ষত্ররায় অস্পষ্টস্বরে কহিলেন,”ঠাকুর–ঠাকুর!” রঘুপতি কহিলেন, “উঠিয়া এস।” নক্ষত্ররায় ধীরে ধীরে সভা হইতে উঠিয়া গেলেন। বিড়ালের বিয়ে, সাহানা এবং সারঙ্গ একেবারে বন্ধ হইল। রঘুপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ-সব কী হইতেছিল?” নক্ষত্ররায় মাথা চুলকাইয়া কহিলেন, “নাচ হইতেছিল।” রঘুপতি ঘৃণায় কুঞ্চিত হইয়া কহিলেন, “ছি ছি!” নক্ষত্র অপরাধীর ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। রঘুপতি কহিলেন, “কাল এখান হইতে যাত্রা করিতে হইবে। তাহার উদ্‌যোগ করো।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “কোথায় যাইতে হইবে?” রঘুপতি। সে কথা পরে হইবে। আপাতত আমার সঙ্গে বাহির হইয়া পড়ো। নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি এখানে বেশ আছি।” রঘুপতি। বেশ আছি! তুমি রাজবংশে জন্মিয়াছ, তোমার পূর্বপুরুষেরা সকলে রাজত্ব করিয়া আসিয়াছেন। তুমি কিনা আজ এই বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা হইয়া বসিয়াছ আর বলিতেছ “বেশ আছি”! রঘুপতি তীব্র বাক্যে ও তীক্ষ্ণ কটাক্ষে প্রমাণ করিয়া দিলেন যে, নক্ষত্ররায় ভালো নাই। নক্ষত্ররায়ও রঘুপতির মুখের তেজে কতকটা সেইরকমই বঝিলেন। তিনি বলিলেন, “বেশ আর কী এমনি আছি! কিন্তু আর কী করিব? উপায় কী আছে?” রঘুপতি। উপায় ঢের আছে–উপায়ের অভাব নাই। আমি তোমাকে উপায় দেখাইয়া দিব, তুমি আমার
false
shomresh
অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে। শুধু দেখা যাচ্ছে দোতলায় আলো জ্বলছে এবং তার একটি জানলা খোলা। অর্থাৎ ফোটোগ্রাফার বাড়িতে আছে। বাড়ির একতলা অন্ধকার এবং সদর দরজা বন্ধ। বিদেশের নাম্বার ডায়াল করা ঝকমারি। আঙুল ব্যথা হয়ে যায়। আচ্ছা, এখন ওদের সময়টা কী? সকাল হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। নিজের মনেই কথা বলতে বলতে কমলাপতি বলে উঠলেন, হ্যালো? হ্যাঁ, মিসেস হালদার আছেন? ও, আপনি ওঁর ছেলে? আমি কমলাপতি মুখোপাধ্যায় বলছি, সল্ট লেকের উলটো দিকের বাড়ি। চিনতে পেরেছেন? গুড! আচ্ছা, আপনার বাড়িতে যিনি কেয়ারটেকার হিসেবে আছেন তাঁকে চেনেন ভাল করে? কী? আপনি জানেন না কেউ এখানে কেয়ারটেকার হিসেবে আছে কিনা? আরে আপনার বোনই তো কিছুদিন আগে রেখে গেছেন। আপনার বোন বলেননি? তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। আমার নাম্বার আপনার মায়ের কাছে আছে। জেনে আমাকে জানালে খুশি হব। একটু সমস্যা হয়েছে। রাখছি। ঝপ করে টেলিফোন নামিয়ে রেখে কমলাপতি চোখ বড় করলেন, বোন দাদাকে না জানিয়ে লোকটাকে এখানে রেখেছে। তাই? কীরকম বিল উঠবে বলো তো? আচমকা প্রসঙ্গ পালটাতে হেসে ফেলল অর্জুন, আমার ধারণা নেই। যাকগে। এখন কী করা যায়? আচ্ছা, লোকটাকে গিয়ে চার্জ করব? কী ব্যাপারে? ওর আইডেন্টিটি? উনি যা বলবেন তাই আপনাকে মেনে নিতে হবে। তারপর? এই সময় কাজের লোকটি এক কাপ চা নিয়ে এল। কমলাপতি বললেন, উনি তোমাকে ঘুষ দিচ্ছেন। চা খাও কিন্তু ওঁর কেসটা হাতে নিয়ো না। চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু খেতে হল। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলে কমলাপতি গলা শুনে ইশারায় বোঝালেন বিদেশের ফোন। বললেন, হ্যাঁ। আপনার বোন বললেন তিনিই রেখে গেছেন। ওঁর পরিচিত? ওয়াশিংটনে থাকেন। ও, ফোনে এর মধ্যে কথা বলা হয়ে গেল! না, না, ওঁকে টেলিফোন করার দরকার নেই। সমস্যাটা হল, এ-পাড়ার দেখাশোনা করার জন্যে যে কমিটি তৈরি হচ্ছে তাতে আপনাদের তরফে ওঁকে নেওয়া যায় কিনা তাই নিয়ে সমস্যায় পড়েছি সবাই। নেব না। বেশিদিন থাকবেন না। আচ্ছা। রিসিভার নামিয়ে হাসলেন কমলাপতি, যৌবনে কলেজের নাটকে অভিনয় করতাম। সেই অভিজ্ঞতাটা চালিয়ে কীরকম ম্যানেজ করে নিলাম বলো! বেশিদিন থাকবে না। নতুন কোনও ঘটনা ঘটলে কমলাপতিকে জানিয়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এল অর্জুন। গঙ্গাপদ বলল ডক্টর পত্ৰনৰীশ গবেষণাঘরে ঢুকেছেন। তিনি আজ রাত্রে নামবেন না। অর্জুনকে খেয়ে নিতে বলেছেন। রাত্রে একা-একা খেতে-খেতে অর্জুন পুরো ব্যাপারটা ভাল করে বলল। সে এখানে এসে যে জায়গায় ছিল তার থেকে এক পাও এগোতে পারেনি। ওই তথাকথিত ফোটোগ্রাফারকে নিয়ে সে অনর্থক মাথা ঘামাচ্ছে। ডক্টর হালদারের মেয়ে যখন তাকে চেনেন তখন আর রহস্যের কিছু নেই। গঙ্গাপদ খাবার দেওয়ার সময় টেলিফোন বাজল। সে রিসিভার তুলে দুবার হ্যালো বলে কাছে এসে জানাল, সেই সাহেব বোধ হয়, বাবুর নাম বলছে। কিন্তু বাবু তো আজ রাত্রে তাঁকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। আপনি একটু বলে দিন না বাবু। অর্জুন রিসিভার তুলে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন? কাটাকাটা গলায় জবাব এল, আমি ডক্টরের হিতৈষী। আপনি কে বলছেন? আমি ডক্টর পত্ৰনবীশের সেক্রেটারি। উনি এখন ল্যাবরেটরিতে আছেন, যদি কিছু বলার থাকে তা হলে আমাকে বলতে পারেন। ডক্টরকে আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তার কী সিদ্ধান্ত হল? ডক্টর পত্ৰনবীশ ওব্যাপারে মন স্থির করতে পারেননি। কারণ আপনি আপনার নাম-ঠিকানা জানাননি। এব্যাপারে আপনার কোনও শর্ত আছে কিনা তাও জানা যাচ্ছে না। উনি রাজি হলে এ-সবই জানানো হবে। তা হলে আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয়। আপনি এ বাড়িতে কাল চলে আসুন। একটা ছোট্ট হাসির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর গলা শোনা গেল, দেখতে পাচ্ছি ডক্টর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আমরা জানতাম ওঁর কোনও সেক্রেটারি ছিল না। আপনি কি ওই লোকাল পুলিশ অফিসারের লোক যিনি আমি শেষবার কোথা থেকে ফোন করেছি জেনে আমায় খুঁজতে লোক পাঠিয়েছিলেন? আপনি এসব কী বলছেন? উত্তর না দিয়ে লাইনটা কেটে দিল লোকটা। অর্জুন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এতক্ষণে রহস্য জট বাঁধছে। যে ফোন করছে সে হেঁজিপেজি কেউ নয়। সে মুখ ফিরিয়ে দেখল গঙ্গাপদ দরজার গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ তার কথা শুনছিল। এই লোকটা স্পাই নয় তো! অর্জুন বিরক্ত হল, কী চাই? খাবার দেব? দাও। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ফোন বাজল। অবনীবাবুর গলা, কে? অর্জুনবাবু নাকি? আজও তো ডক্টরের সেই ফোন এসেছিল। আপনি কথা বলেছেন? হ্যাঁ। আমরা ট্র্যাক রেখেছিলাম। লোকটা এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিল। ওই পাবলিক বুথ। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। আপনি কথাবার্তা শুনেছেন? হ্যাঁ। অপারেটর আমায় রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে। অবনীমোহন হাসলেন, ও যখন জানতে পেরেছে আমি এর মধ্যে এসে গেছি তখন আর দেখা করার সাহস পাবে না। ঠিক আছে, গুড নাইট। রাত্রের খাওয়া শেষ করে অর্জুন একবার ওপরে গেল। গবেষণাঘরের দরজা বন্ধ। ডক্টরকে এখন ডাকাডাকি করে লাভ নেই। সে নীচে নেমে গঙ্গাপদকে জিজ্ঞেস করল, বাইরের দরজার চাবি তোমার কাছে আছে? গঙ্গাপদ মাথা নাড়ল, না বাবু। আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। শব্দ পেলে দরজা খুলে দিতে পারবে? হ্যাঁ বাবু। আমি তো বাইরের ঘরেই শুই। ঘুম আমার খুব পাতলা। সাড়ে দশটা নাগাদ অর্জুন বেরিয়ে পড়ল। এমনিতেই সল্ট লেকের রাস্তায় মানুষজন কম দেখা যায়, এই সময়ে মনে হল পরিত্যক্ত শহরে হাঁটছে সে। মাঝে-মাঝে হেডলাইট জ্বেলে হুসহাস করে ছুটে যাওয়া কয়েকটা গাড়ি ছাড়া কোথাও কোনও প্রাণের স্পর্শ নেই। জলপাইগুড়ির
false
humayun_ahmed
শেষে বাবা আমাকে হলের বাইরে নিয়ে যান। তখনো আমি ফোপাচ্ছিলাম। তোমার কিছু মনে নেই, তাই না। মনে থাকবে না কেন? মনে আছে। নাটকটা সুবিধার ছিল না। মেলোড্রামা। খুবই দুর্বল সংলাপ। রিকশা গলির মোড়ে থামল। জায়গাটা হচ্ছে শান্তিবাগা। গলির ভেতর তিনতলা বাড়ির দোতলায় তারা থাকে। একটাই ফ্ল্যাট। দু’টি পরিবার শেয়ার করে। কমন রান্নাঘর। তবে তাতে তেমন অসুবিধা হয় না। বাড়ির গেটের কাছে এসে আসিফ থমকে দাঁড়াল। বিব্রত গলায় বলল, আমি তোমার সঙ্গে আর যাচ্ছি না। সকালে ফিরব। লীনা অবাক হয়ে বলল, তার মানে! শেলীর এ্যাপিন্ডিসাইটিস অপারেশন হবে রাত এগারটায়। থাকা দরকার। দুলাভাই চিটাগাং গেছেন। বড়। আপা একা। এতক্ষণ এটা আমাকে বলনি কেন? এই তো বললাম। চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার শরীর খারাপ–রেস্ট দরকার। আমার শরীর খারাপ তোমাকে বলল কে? কয়েক রাত ধরেই তো ঘুমুতে পারছি না। যতবার উঠি, দেখি চুপচাপ বিছানায় বসে আছি। লীনা বলল, বেশ তো যাবে যাও–ভাত খেয়ে যাও। ভাত খাব না। একদম খিদে নেই। সম্ভাবেলা ভাজাতুজি কি সব খেয়েছি, টক চেকুর উঠছে। যাই লীনা বেশ মন খারাপ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। জরুরি কথাটা এখন তার মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে ডাকবে আসিফকে? ডেকে বলবে জরুরি কথাটা? ডাকাটা কি ঠিক হবে? এখন মনে হচ্ছে কথাটা তেমন জরুরি নয়। দোতলার ফ্ল্যাটটা লীনারা যাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকছে, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। স্বামী স্ত্রী এবং তিন বছর বয়েসি একটি মেয়ে। একজন কাজের ছেলে আছে, সে বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। পরিবারের কর্তা হাশমত আলি বেশ বয়স্ক লোক। চল্লিশের মতো বয়স। আগে একবার বিয়ে করেছিলেন। ঐ পক্ষের দু’টি মেয়ে আছে। মেয়েরা তাদের নানার বাড়িতে থাকে। নানার বাড়ি টঙ্গীতে। মাঝে মাঝে আসে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যাবেলা চলে যায়। হাশমত সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী বেনু। এই মেয়েটার বয়স খুবই কম। পনেরো-ষোল হওয়া বিচিত্র নয়। গ্রামের মেয়ে। তবে শহরে চাল-চলন দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলেছে। মেয়েটি সুন্দরী, তাবে বাচ্চা হবার পর গাল-টাল ভেঙে গেছে। বাচ্চাটা মায়ের কোল ছাড়া থাকতেই পারে না। বেনুকে সারাদিন বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়। লীনাকে সে খুবই পছন্দ করে। যতক্ষণ লীনা বাসায় থাকে বেনু তার পেছনে থাকে। ব্যাপারটা লীনার পছন্দ না হলেও কিছু বলে না। এই সাদাসিধা অল্প বয়েসী মেয়েটাকে লীনার ভালই লাগে। সেই তুলনায় হাশমত আলিকে তার একেবারেই ভাল লাগে না। লোকটার সব কিছু কেমন যেন গ্ৰাম্য। রেলের বাধা মাইনের চাকরিতেও তার রোজগার সন্দেহজনকভাবে ভাল। তবে তার ব্যবহার ভাল। গত মাসে সে একটা ফ্রিজ কিনেছে এবং লীনাকে বলেছে, কিছু এরিয়ার টাকা পেলাম, তারপর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিলাম, তারপর কিনে ফেললাম। একটা সখ ছিল ভাবী। লীনা বলল, ভাল করেছেন। এখন আরাম করে ঠাণ্ডা পানি খেতে পারবেন। হা হা হা। বেনু, ভাবীকে একটা পেপসি দাও। এখন থাক। না ভাবী খান। খেতে হবে। এটা ভাবী আপনি নিজের ফ্রিজ ভাববেন। রিকোয়েস্ট। বেনু শোন, নিচের একটা তাক ভাবীর। খবরদার কিছু রাখবে না। যদি দেখি তোমার কিছু আছে তাহলে অসুবিধা আছে। জিনিসটা কেমন কিনলাম ভাবী? খুব ভাল। খুব সুন্দর। অনেকগুলি টাকা চলে গেল, তবু সখের একটা জিনিস, তাই না ভাবী? তা-তো বটেই। হাশমত আলির মধ্যেও এক ধরনের সরলতা আছে। এটা লীনার ভাল লাগে। এরা সুখেই আছে। নিজেদের নিয়ে আনন্দে আছে। পৃথিবী সমাজ-টমাজ এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্রক মাথাব্যথা নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসে এরা গভীর আনন্দ খুঁজে পায়। প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাত হাশমত আলি বড়-সড় একটা মাছ কিনে এনেছে। বেনু সেই মাছ কাটছে। হাশমত আলি উবু হয়ে তার সামনে বসে আছে। মাছটা কি রকম, সেই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। পুকুরের মাছ, কি বল বেনু? রঙটা কেমন কালো দেখ না। শ্যাওলার নিচে থেকে কালো হয়ে গেছে। নদীর মাছ হলে লাল হত। তোলটা ঠিক আছে কি না দেখ তো। ঠিক আছে। তেল দিয়ে বড়া বানাতে পারবে। মাছের তেলের বড়া–তার স্বাদই অন্য রকম। দুটো বড় করে পিস কাট। ভেজে লীনা ভাবীদের দিয়ে এস। ওরা বোধ হয় শুয়ে পড়েছে। সকালে দেব। আরো না এখনই দাও। টাটকা জিনিসের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। গভীর রাতে প্লেটে ভাজা মাছ নিয়ে হাশমত আলি নিজেই দরজা ধাক্কায় ভাবী ঘুমিয়ে পড়লেন না কী? ও ভাবী, ভাবী। পরিষ্কার বোঝা যায়। এই পরিবারটি লীনাদের বেশ পছন্দ করে। কেন করে সেও এক রহস্য। এতদিন একসঙ্গে আছে, এর মধ্যে এক’দিনও নাটক দেখার ব্যাপার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। হাশমত আলি অবশ্যি প্রায়ই বলে, এক’দিন যাব। বুঝলেন ভাবী, আপনাদের কাণ্ড কারখানা দেখে আসব। মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। সারাক্ষণ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। বাচ্চা নিয়ে কী যাওয়া যায় ভাবী? বেনুকে এক’দিন নিয়ে দেখাব। গ্রামের মেয়ে, কিছু তো এই জীবনে দেখেনি। সিঁড়ির বাতি বোধ হয় আবার চুরি হয়েছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে উঠতে হচ্ছে। একটা সিঁড়ি আছে ভাঙা। বাড়িওয়ালাকে কতবার বলা হয়েছে। এখনো কিছু করছে না। দরজা খুলে দিল বেনু। অবাক হয়ে বলল, এত রাতে একা একা আসলেন ভাবী না একা না। তোমার ভাই নামিয়ে দিয়ে গেছে। ভাই আবার গেলেন কই? তার এক ভাগ্নির অপারেশন। ও আল্লা! কী হইছে? কী হয়েছে লীনা নিজেও ভালমতো জানে না। জানা উচিত ছিল। কথাবার্তা শুনে হাশমত
false
shunil_gongopaddhay
করবে না? কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা। ভয়েস অ্যাকটিভেটেড। টোবি দত্ত হুকুম না দিলে কিছুই করবে না। ওদিকে সমর চৌধুরী একটা ঘুসি চালাতে যেতেই টোবি দত্ত ধরে ফেলল তাঁর হাত। এক হ্যাঁচকা টানে তাঁকে ফেলে দিল উলটে। টোবি দত্ত তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সমর চৌধুরী আবার উঠে দাঁড়ালেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ত্যাপা, তোর মতন দু-তিনটেকে আমি ছিঁড়ে ফেলতে পারি। তারপর শুরু হয়ে গেল শুম্ভ-নিশুম্ভর লড়াই। একবার টোবি সমরকে মাটিতে ফেলে বুকে চেপে বসে, আবার সমর দু-পায়ের লাথিতে টোবিকে ছিটকে ফেলে দেন। কঙ্কাল-রোবটটা ওঁদের পাশে-পাশে ঘুরছে, যেন সে রেফারি। মারামারিতে বাধা দিচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, সন্তু, সোনার থলি দুটোর ওপর তুই নজর রাখ। অনির্বাণ, তুমি সমরের রিভলভারটা তুলে নাও। যদি ওর চ্যালারা ফিরে আসে, তখন কাজে লাগবে। তবে মনে হয় ভূতের ভয়ে ওরা আর ফিরবে না। এই রোবটটাও ওদের তিনজনকে মেরেছে। অনির্বাণ বলল, এদের লড়াই কতক্ষণ চলবে? কে জিতবে বোঝা যাচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, আমি চাই টোবি জিতুক। সমর চৌধুরী আর্মি অফিসার হয়েও স্মাগলারদের দল চালান। এঁরা দেশের শত্রু। সমাজের ঘৃণ্য জীব। সেই তুলনায় টোবি এমন কিছু অন্যায় করেনি। সে প্রতিশোধ নিতে এসেছে! অনির্বাণ বলল, একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে এরকম খুনোখুনির লড়াই আমার দেখা উচিত নয়। ওদের ছাড়িয়ে দিয়ে অ্যারেস্ট করা দরকার। কাকাবাবু বললেন, চেষ্টা করে দ্যাখো! অনির্বাণ কাছে এগিয়ে যেতেই কঙ্কালটা একটা হাত বাড়িয়ে দিল। সে অন্য কাউকে কাছে যেতে দেবে না। হঠাৎ টোবি দত্ত সমর চৌধুরীকে বাগে পেয়ে একটা গাছের সঙ্গে চেপে ধরে। দুবার মাথা ঠুকে দিল খুব জোরে। সমর চৌধুরী আর সহ্য করতে পারলে না। ঢলে পড়ে গেলেন মাটিতে। টোবি দত্ত জয়ের আনন্দে একটা দৈত্যের মতন হুঙ্কার দিয়ে বলল, এইবার রাজু, আর কোথায় পালাবি? চোখের বদলে চোখ। চোখের বদলে চোখ! আমার চোখ নষ্ট করেছিলি, তোর দুটো চোখই আমি আজ গেলে দেব! সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা সরু কাঠি খুঁজতে লাগল। অনির্বাণ উত্তেজিতভাবে বলল, ও সমর চৌধুরীর চোখ গেলে দেবে। এই দৃশ্য আমরা দেখব? কাকাবাবু বললেন, তুমি আর সন্তু ওকে আটকাও। আমি কঙ্কালটাকে সামলাচ্ছি। কাকাবাবু কঙ্কালটার কাছে এগিয়ে যেতেই সে হাত বাড়িয়ে বাধা দিল। কাকাবাবুও খপ করে তার হাতখানা চেপে ধরলেন। তারপর শুরু হল পাঞ্জার লড়াই। কাকাবাবুর হাতে দারুণ শক্তি, কিন্তু একটা রোবটের সঙ্গে পারবেন কেন? কঙ্কালের হাতখানা লোহার, তাতে সাদা রং করা। কাকাবাবু প্রাণপণে লড়তে লাগলেন। টোবি দত্ত অন্য কিছু না পেয়ে একটা গাছের সরু ডাল ভেঙে নিয়ে অজ্ঞান সমর চৌধুরীর বুকের ওপর চেপে বসল। কাকাবাবু প্রাণপণে রোবটের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছেন, তাঁর পাশ দিয়ে সন্তু আর অনির্বাণ ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল টোবি দত্তর ওপর। টোবি দত্ত দু হাত চালিয়ে ওদের সরিয়ে দিতে চাইল। সন্তু চেপে ধরল তার গলা, অনির্বাণ রিভলভারের বাঁট দিয়ে খুব জোরে মারল তার মাথায়। তারই মধ্যে টোবি দত্ত গাছের ডালটা ঢুকিয়ে দিয়েছে সমর চৌধুরীর এক চোখে। কাকাবাবু বললেন, আমি আর পারছি না! সন্তু, তোরা সরে যা শিগগির! কঙ্কালটা তাঁকে ঠেলে ফেলে দিল দূরে। তারপর এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে সন্তু আর অনির্বাণকে দু হাতে তুলে ছুড়ে দিল। টোবি দত্ত অজ্ঞান হয়ে গেছে। কঙ্কালটা তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। তারপর দুলতে-দুলতে হেঁটে-হেঁটে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের অন্ধকারে। অনির্বাণ ধুলো ঝেড়ে উঠে বসে বলল, টোবি দত্তকে নিয়ে চলে গেল? কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই সেরকম প্রোগ্রাম করা ছিল রোবটটাকে। এখন আমরা চেষ্টা করলেও টোবিকে উদ্ধার করতে পারব না। পরে অনেক সময় পাবে। এর পর টোবিকে ধরা কিংবা তাকে শাস্তি দেওয়া পুলিশের কাজ। আমি আর সন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। সমর চৌধুরীর এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে যে তিনি মারা যাবেন! ওঁকে বাঁচানো দরকার। বাঁচিয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া দরকার। সমর চৌধুরীর ঘোড়াটা কোনওক্রমে বাঁধন খুলে পালিয়ে গেছে এর মধ্যে। সমর চৌধুরীকে নিয়ে যেতে হবে খানিকটা দূরে জিপে। তাঁর এখনও পুরো জ্ঞান ফেরেনি। চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে আর গলা দিয়ে বেরোচ্ছে একটা গোঙানির শব্দ। সন্তু আর অনির্বাণ সমর চৌধুরীকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। কাকাবাবুকে নিতে হল সোনার থলি দুটো। ফাগুলালের দলবল কঙ্কালের ভয়ে একেবারেই পালিয়েছে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে কাকাবাবু ওপরের দিকে তাকালেন। আকাশে আজ ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। দমকা হাওয়া উঠছে মাঝে-মাঝে। তাতে জঙ্গলের নানারকম গাছে নানারকম পাতায় শব্দ হচ্ছে বিভিন্ন রকম। কাকাবাবু মনে-মনে বললেন, কী সুন্দর আজকের রাতটা! এর মধ্যেও মানুষ মারামারি, খুনোখুনি করে? ছিঃ! এর চেয়ে নদীর ধারে বসে গান গাইলে কত ভাল লাগত! অরণ্যের দিনরাত্রি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সকালবেলা ধলভূমগড় স্টেশনে চারজন যুবক ট্রেন থেকে নামলো। ছোট্ট স্টেশন, সারা দিন-রাতে দুতিনবার মাত্র সরব হয়ে ওঠে, বাকি সময়টা অলসভাবে নিঝুম। আলাদা টিকিট কালেক্টার নেই, স্টেশন মাস্টার নিজেই ট্রেন থেকে নামা ছোট্ট যাত্রীদলের দিকে এগিয়ে আসেন টিকিটের জন্য—যাত্রীরা অধিকাংশ স্থানীয় লোক, নেংটি পরা সাঁওতাল আর ওরাওঁ–তাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে একখানা করে লাঠি, আট হাত শাড়ি ফেরত দিয়ে পরা মেয়েরাআমি পল্লবের মতন তারা পাঁচজন পাঁচজন হাত ধরাধরি করে থাকে ও গানের সুরে কথা বা ঝগড়া করে যায়, এ ছাড়া দুচারজন আধা-বিহারী আধা-বাঙালিবাবু কিংবা পাইকার। এর মধ্যে ঐ চারজন যুবক একটুখানি নতুনত্ব, কেননা এই জায়গায় কখনো চেঞ্জাররা আসে না,
false
humayun_ahmed
পাঠাগার হবে। বিশ ইঞ্চি টিভি দিবে। পাঠাগারে। ভাল। এরশাদ সাহেবের দলটা খারাপ না কি বলেন? খরচপাতি করছে। জিয়া সাহেবের সময় এত খরচপাতি করে নাই। খালি খাল কাটা হয়েছে। কি বলেন বাকের ভাই? বাকের জবাব দিল না। জলিল মিয়া হৃষ্টচিত্তে বলতে লাগল, মিলিটারি ছাড়া এই দেশ ঠিক রাখা যাবে না। এরশাদ সাব মিলিটারি মানুষ। দুই মেয়ে পলিটিশিয়ানদের কেমন চরকি বাজি দেখিয়ে দিল। ঠিক বললাম। কিনা বলেন বাকের ভাই? ঠিকই বলেছেন। মেয়ে মানুষের কাজ হইল বাচ্চা দেওয়া। এই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ মেয়ে মানুষ দিয়ে হয় না। ঠিক বললাম না বাকের ভাই? বাকের উত্তর না দিয়ে উঠে এল। জলিল মিয়ার দোকানে এখন কাস্টমার নেই। সে অনবরত বকর বকর করতে থাকবে। পলিটিক্স তার প্ৰিয় বিষয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় সে ছিল জিয়া ভক্ত। এখন এরশাদ প্রেমিক। এরশাদ সাহেবের একটা বাঁধানো ছবি দোকানে ঝুলিছিল। লোকজন হৈচৈ করাতে ছবি সরিয়ে ফেলেছে। এই দেশের মানুষগুলি অদ্ভুত যে ক্ষমতায় থাকে তাকে কেউ সহ্য করতে পারে না। সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। কেন যায়? বাকের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পৰ্যন্ত কয়েকবার হাটল। রাস্তার মোড়ে টর্চ হাতে দু’জন ট্রাফিক পুলিশ। এই রকম জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ? নিৰ্ঘাৎ মিনিস্টার সাহেব আসছেন সেই উপলক্ষে। একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি কেমন জমেছে। সব কিছু? বাকের মনস্থির করতে পারল না। মুনাদের বাসায় গেলে কেমন হয়? না, তাদেরও পাওয়া যাবে না। সেজেগুজে দল বেঁধে হয়তো গিয়েছে থিয়েটার দেখতে। বাকের রওয়ানা হল কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িটির দিকে। এই বাড়ির কেউ থিয়েটারে যাবে না। এরা ঘরে থাকবে। সে যদি গিয়ে বলে, চলুন থিয়েটার দেখে আসি তাহলে কেমন হয়? চশমা পরা বুড়ি তার উত্তরে কি বলবে? মেয়ে তিনটিই বা কি করবো? এদের সঙ্গে এখনো কথাবার্তা হয়নি? নাম পৰ্যন্ত জানা নেই। এদের নিশ্চয়ই খুব বাহারি নাম। ফুলেশ্বরী, রত্নেশ্বরী এ রকম। এর নিশ্চয়ই কণা, বীণু এ রকম নাম রাখবে না; রাখলেও বদলে ফেলবে। গেট তালাবন্ধ। গেটের ভেতরে একটি কালো রঙের গাড়ি। জোবেদ আলিকে দেখা গোল গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে সেহে হেসে কি বলছে। জোবেদ আলির হাতে সিগারেট। অথচ কয়েক’দিন আগেই সে বলেছে সিগারেট খায় না। বাকের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকল, এই যে জোবেদ আলি সাহেব। একটু শুনে যান। জোবেদ আলি গম্ভীর মুখে এগিয়ে এল। কেমন আছেন ভাই? ভাল। কি চান? কিছু চাই না। গল্পগুজব করতে আসলাম। জোবেদ আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের হাসিমুখে বলল, থিয়েটারে যান নাই? রাতের পাখিরা হচ্ছে। জি না। থিয়েটার দেখি না। মেয়েরাও যায় নাই? না। যান নাই কেন? কাস্টমার এসেছে নাকি? কি বললেন? বললাম কাস্টমার এসেছে নাকি? মেয়ে তিনটা তো ব্যবসা করে তাই না? জোবেদ আলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ভদ্রপাড়ায় বেশ্যাবাড়ি খুলে ফেললেন? জোবেদ আলি থমথমে গলায় বলল, পাগলের মত কি বলছেন? বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক বলছি। একটা কথাও ভুল বলি নাই। গেট খুলেন। বুড়ির সঙ্গে কথা বলব। আপনি সকাল বেলায় আসেন। যা বলার সকালে বলবেন। বাকের সিগারেট ধরিয়ে উদাস স্বরে বলল, বেশ্যার দালালি কতদিন ধরে করছেন? আমাকে বলছেন? হ্যাঁ আপনাকেই। আপনি ছাড়া আর কে আছে। নেন সিগারেট নেন। আমি সিগারেট খাই না। একটু আগেই তো দেখলাম সিগারেট টানছেন। জোবেদ আলি নিচু গলায় বলল–বাকের ভাই, আপনি সকালে আসেন। এখন হৈচৈ করবেন না। হৈচৈ? হৈচৈ কোথায় করলাম? ভাই আপনি এখন যান। সাদা শাড়ি পরা ফর্সা মহিলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সে রিনারিনে গলায় বলল, কে কথা বলে রে? জোবেদ আলি বলল, কেউ না আম্মা। জোবেদ আলি এই মহিলাকে আম্মা ডাকে নাকি? এটা জানা ছিল না। বাকের সিগারেট টানতে টানতে রাস্তার দিকে রওনা হল। এখন তার বেশ একটা ফুর্তির ভাব হচ্ছে। কালো গাড়িতে করে যে ভদ্রলোক তিন কন্যার কাছে এসেছেন তার শার্টের কলার চেপে ধরলে কেমন হয়? বাকের নিজের মনে খানিক্ষণ হাসল। দলবল জুটিয়ে বাড়ি ঘেরাও করলে হয়। কিন্তু সবাই গেছে রাতের পাখিরা দেখতে। সেখান থেকে হাতী নিয়ে টেনেও কাউকে আনা যাবে না। বাকের মুনাদের ঘরের দিকে রওনা হল। কাউকে ঘটনাটা বলতে না পারলে রাতে ঘুম হবে না। অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। বাকের হাসিমুখে বলল, খবর কি মুনা? মুনা বিরসমুখে বলল, কোনো কাজে এসেছেন? না কোনো কাজ নেই। যাচ্ছিলাম। এদিক গিয়ে ভাবলাম…। আমার শরীরটা ভাল না। এখন চলে যান। বাসায় কেউ নেই? না। মামা কোথায় যেন গেছেন। বাবু গেছে বকুলের শ্বশুর বাড়ি। ও আচচ্ছা। একা এক ভয় লাগছে না? আমার এত ভয়টয় নেই। একটা মজার খবর আছে মুনা। রহস্যভেদ হয়েছে। ভূতের কাছে মামদোবাজি। ফটাস করে হাড়ি ভেঙে ফেলেছি। অপেন মার্কেট পট ব্ৰেকিং হয়ে গেছে। কি বকবক করছেন? শুনলে লাফ দিয়ে উঠবে। লাফ দিয়ে উঠার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এখন যান তো। বেশিক্ষণ না এক মিনিট বসব। বাকের ঘরে ঢুকে পড়ল। সহজ গলায় বলল, চা কর এক কাপ। চা খেয়ে জুত হয়ে বসে গল্পটা করি। আপনি বড্ড বিরক্ত করেন বাকের ভাই। বিরক্ত করব না। এক মিনিটের মামলা। তুমি নাটক দেখতে যাওনি। যাইনি। সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুধু শুধু কথা বলা আপনার একটা বদ অভ্যাস। তা ঠিক। নাটকে মিনিসটার
false
humayun_ahmed
হেনা সরে গেল না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। ইমাম সাহেবের চালা ঘরে বাতি জ্বলছে। আনিস সাইকেলের বেল টিপতেই সকিনা বের হয়ে এল। তার মাথা কালো চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের হয়ে আছে। সেই মুখ ভয়ে ছোট হয়ে আছে। আনিস বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম… মেয়েটি আনিসকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি আপনেরে চিনি। বাপজান আপনার কথা আমাকে চিঠিতে লিখেছেন। আপনি একা একা ভয় পাচ্ছেন কি-না দেখতে এসেছি। সকিনা বলল, আমার ভয় কম। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি। আমি খুবই ভয় পেয়েছি। আমার ব্যাপজান মানুষ মারতেছে এটা কেমন কথা। আনিস বলল, এটা খুবই ভুল কথা। এটা নিয়ে আপনি মোটেই দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আপনি বরং এক কাজ করুন–আমার বাসায় চলুন। আমার স্ত্রী আছে। আপনার থাকতে সমস্যা হবে না। আমার স্ত্রী কাল সকালে ঢাকা চলে যাবে। আমার মনে হয় আপনারাও চলে যাওয়া ভালো। বাপজানরে এইভাবে ফেলে রেখে চলে যাব? বাপজানের মৃত্যুর কোনো বিচার হবে না? আনিস কী বলবে বুঝতে পারল না। সকিনা বলল, সবাই আপনাকে খুব ভালো পায়। আমার ব্যাপজান চিঠিতে লিখেছিলেন। আপনি ফিরিশতার মতো মানুষ। আপনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি চলে যাব। আনিস বলল, আমি আপনাকে চলে যেতেই বলছি। কারো ওপর কোনো রাগ না রেখে আপনি চলে যান। সকিনা বলল, আচ্ছা আমি চলে যাব। তবে রাতটা এখানেই থাকব। ভয় পাবেন না? না, ভয় পাব না। জহির উদ্দিন খাঁ সাহেব আমার জন্যে পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। তার হুকুম মতো আমার সঙ্গে একজন মহিলা থাকেন। মসজিদে একজন পুরুষ মানুষ থাকে। তাই না-কি? তিনি এই কাজটা প্রথম দিন থেকেই আমার জন্যে করেছেন। কেন করেছেন তা আমি জানি না। দুই বেলা আমার জন্যে তিনি ভাত তরকারি পাঠান। একটা কথা আছে না–গরু মেরে জুতা দান। আমার মনে হয় ব্যাপারটা সে রকম। আনিস বলল, সে রকম তো নাও হতে পারে। হয়তো যে কাজটা উনি করেছেন তার জন্যে তিনি অনুতপ্ত। হয়তো আপনাকে দেখে তার মায়া লেগেছে। আমার ধারণা লোকে উনাকে যতটা খারাপ ভাবে তত খারাপ উনি না। সকিনা কঠিন গলায় বলল, আমার বাবাই শুধু খারাপ। খারাপ কাজ করে সে শাস্তি পেয়েছে। মৃত্যুর পরেও খারাপ কাজ করছে। মানুষ মারছে। কিছু মনে করবেন না ডাক্তার সাহেব মনের দুঃখে কিছু কঠিন কথা বললাম। আমি কিছু মনে করি নি। সকিনা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি হাসান নামের লোকটার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। জহির খাঁ সাহেব হাসানকে আর তার ছেলেকে দূরে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি চান না আমি তার সঙ্গে কথা বলি। আনিস বলল, পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার দরকার কী? সকিনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন ঘটনা সত্যি? আনিস বলল, আমি কিছু বিশ্বাস করি না। আবার কোনো কিছু অবিশ্বাসও করি না। আমি শুধু একটা জিনিসই জানি–প্ৰাণী হিসেবে মানুষ খুবই অদ্ভুত। কোনো প্রাণীই তার স্বজাতিকে হত্যা করে না। শুধু মানুষ করে। মাটির হাঁড়ির মুখ কলাপাতা দিয়ে বাঁধা। বাঁধন খুলতে খুলতে মরজিনার চোখ চকচক করতে লাগল। সে আদুরে গলায় বলল, আইজ আবার কী আনছেন? মতি উদাস গলায় বলল, জানি না। কী আনছি। খুইল্যা দেখ। জিনিসটা কী চিনতেছি না তো। মুখে দিয়া দেখ। মরজিনা বলল, দেখতে জানি কেমন। ঘিন্না ঘিন্না লাগতেছে। ঘিন্না লাগলে খাইও না। সবেরে সব জিনিস সয়না। ঘি খাইলে কুত্তার লোম পইড়া যায়। জিনিসটা হইল তেলিকান্দির সরভাজা। তেলিকান্দির সরভাজা? নাটোরের কাঁচাগুল্লা, পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই যে রকম–তেলিকান্দির সরভাজাও একই রকম। রমেশ কারিগরের সাক্ষাত নাতি ওস্তাদ পরমেশ কারিগরের নিজের হাতে পাক দেওয়া জিনিস। ঢাকা শহরের রাইস আদমীরা নগদ টেকা দিয়া এই জিনিস নিয়া যায়। সাতদিন আগে অর্ডার দেওন লাগে। বহুত ঝামেলা কইরা তোমার জন্যে জোগাড় করছি। তুমি জিনিস চিনলা না, আমার আর করনের কী আছে! এইটা হইল আমার কপাল। মরজিনা আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা সরভাজা মুখে দিল। মতি বলল, গন্ধ ভালো না, কিন্তু খাইতে ভালো। খাওয়াটাই আসল, গন্ধ কিছু না। গু যদি খাইতে ভালো হইত–মানুষ নাকে চাপ দিয়া সমানে গু খাইত। মরজিনা আগ্রহ করে খাচ্ছে। মতির এই দৃশ্য দেখতে বড় ভালো লাগছে। আহারে বেচারি! ভালো মন্দ খাইতে এত পছন্দ করে সেই ভালো মন্দ খাওয়ার ব্যবস্থাই তারে আল্লাহপাক দেয় নাই। তেলিকান্দির সরভাজা যে আসলে ওস্তাদ পরমেশ কারিগর বানায় নি, মতি নিজে বানিয়েছে–এটা বলতে ইচ্ছা করছে। মতি চায়ের দোকান থেকে তিন কাপ দুধের সর কিনে নিয়ে সোয়াবিন তেলে ভেজে ফেলেছে। সঙ্গে চার চামচ চিনি দিয়েছে। তেজপাতা ছিল না বলে দেওয়া হয় নি। কড়াই থেকে কালো রং ওঠায় জিনিসটা দেখতে বিদঘুটে হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? খাওয়া হলো আসল। মতি বলল, মরজিনা মজা পাইছ? মরজিনা বলল, আরেকবার আনন লাগব। মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চেষ্টা নিব। পারব কি-না বলতে পারি না। পরমেশ কাগিগররা আমার মতো দুই পয়সা দামের মানুষ ক্যামনে ধরে কও দেখি। একবার যখন ধরতে পারছেন, আরেকবার পারবেন। দেখি চেষ্টা নিব। মরজিনা বলল, আমারে সোনার কিছু কিন্যা দিয়েন–মেয়েছেলের শইল্যে সোনার কোনো জিনিস না থাকলে দোষ লাগে। এমন সুন্দর সোনার একটা নাকছবি ছিল–কই যে পড়ছে! মতি বলল, চিন্তা নিও না। দিব সোনার নাকছবি। স্বাধীন ব্যবসায় নামতেছি–টেকা পয়সার
false
shottojit_roy
পাশে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে প্রীতীনবাবু। নীচে একটা গোস্টরুম আছে, তাতে এখন রয়েছেন মহেশবাবুর বন্ধু অখিল চক্রবর্তী। অরুণবাবুর দুই সন্তানের মধ্যে বড়টি ছেলে, সে এখন বিলেতে, আর মেয়েটির সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় রয়ে গেছে। মহেশবাবুর বেডরুমেও দেখলাম কিছু পাথর আর প্রজাপতি রয়েছে। একটা বুকসেলফে পাশাপাশি রাখা অনেকগুলো একরকম দেখতে বইয়ের দিকে ফেলুদার দৃষ্টি গিয়েছিল, ভদ্রলোক বললেন। ওগুলো ওঁর ডায়ারি। চল্লিশ বছর একটানা ডায়রি লিখেছেন। উনি। খাটের পাশে টেবিলে ছোট্ট বাঁধানো ছবি দেখে লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, আরে, এ যে দেখছি মুক্তানন্দের ছবি। মহেশবাবু হেসে বললেন, আমার বন্ধু অখিল দিয়েছে। ওটা। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, তিনটে মহাদেশের শক্তি এঁর পিছনে। কারেক্‌ট। বললেন লালমোহনবাবু, বিরাট তান্ত্রিক সাধু। ইন্ডিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা-সর্বত্র এঁর শিষ্য। আপনি তো অনেক খবর রাখেন দেখছি, বললেন মহেশ চৌধুরী, আপনিও এঁর শিষ্য নাকি? আজ্ঞে না, তবে আমার পাড়ায় আছেন একজন। দোতলায় থাকতেই একটা গাড়ির শব্দ পেয়েছিলাম, নীচে এসে দেখি, যে-দুজনের কথা মহেশবাবু বলছিলেন, তাঁরা এসে গেছেন। একজন মহেশবাবুরই বয়সী, সাধারণ ধূতি পাঞ্জাবি আর গাঢ় খয়েরি রঙের আলোয়ান গায়ে। ইনি যে উকিল-টুকিল ছিলেন না কোনওদিন সেটা বলে দিতে হয় না, আর সাহেবিয়াও কোনও গন্ধ নেই। এর মধ্যে; অন্য ভদ্রলোককে মনে হল চল্লিশের নীচে বয়স, বেশ হাসিখুশি সপ্রতিভা ভাব, মহেশবাবু আসতেই তাঁকে টিপ করে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির হাতে মিষ্টির হাঁড়ি ছিল, সেটা তিনি প্রীতীনবাবুর হাতে চালান দিয়ে মহেশবাবুর দিকে ফিরে বললেনগআমার কথা যদি শোনো তো পিকনিকের পরিকল্পনাটা বাদ দাও। একে যাত্রা অশুভ, তার উপর বাঘ পালিয়েছে। শার্দুলবাবাজী যদি মুক্তানন্দের শিষ্যটিষ্য হন তা হলে একবার ছিন্নমস্তায় হাজিরা দেওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়। মহেশবাবু আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “আলাপ করিয়ে দিই—এই কুন্ডাকড়াকা ভদ্রলোকটি হলেন আমার অনেকদিনের বন্ধু শ্ৰীঅখিলবন্ধু চক্রবর্ত, এক্স-স্কুলমাস্টার, জ্যোতিষচৰ্চা আর আয়ুৰ্বেদ হচ্ছে এনার হবি; আর ইনি হলেন শ্ৰীমান শঙ্করলাল মিশ্র, আমার অত্যন্ত স্নেহের পত্র, বলতে পারেন আমার মিসিং পুত্রের স্থান অনেকটা অধিকার করে আছেন। সবাই যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে দেখে অখিলবাবু আরেকবার বললেন, তা হলে আমার নিষেধ কেউ মানছে না? না ভাই, বললেন মহেশ চৌধুরী, ‘আমি খবর পেয়েছি বাঘের নাম সুলতান, কাজেই সে মুসলমান, তান্ত্রিক নয়। — ভাল কথা, মিঃ মিত্তির যদি সময় পান তো সাকৰ্ণসটা একবার দেখে নেবেন। আমাদের ইনভাইট করেছিল। পরশু! বীেমা আর বিবিদিদিমণিকে নিয়ে আমি দেখে এসেছি। দিশি সার্কাস যে এত উন্নত করেছে জানতাম না। আর বাঘের খেলার তো তুলনাই নেই। কিন্তু পরশু নাকি বাঘের খেলায় গোলমাল হয়েছিল? প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু। সেটা খেলোয়াড়ের কোনও গণ্ডগোলে নয়। জানোয়ারেরও তো মুড বলে একটি জিনিস আছে। সে-তো আর কলের পুতুল না যে চাবি টিপলেই লক্ষ-ঝম্প করবে। কিন্তু সেই মুড়ের ঠেলা তো এখন সামলানো দায়, বললেন অরুণবাবু। শহরে তো প্যানিক। ওটাকে এক্ষুনি মেরে ফেলা উচিত। বিলিক্তি সাকর্স হলে এ জিনিস কক্ষনও হত না। মহেশবাবু একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ,-তুমি তো আবার বন্যপশু-সংহার সমিতির সভাপতি কি না, তোমার হাত তো নিশপিশ করবেই। রাজরাপ্লা রওনা হবার আগে আর একজনের সঙ্গে আলাপ হল। উনি হলেন প্রীতীনবাবুর স্ত্রী নীলিমা দেবী। এঁকে দেখে বুঝলাম যে চৌধুরী পরিবারের সকলেই বেশ ভাল দেখতে। রাজরাপ্পা হাজারিবাগ থেকে আশি কিলোমিটার। ৪৮ কিলোমিটার গিয়ে রামগড় পড়ে, সেখান থেকে বাঁয়ে রাস্তা ধরে গোলা বলে একটা জায়গা হয়ে ভেড়া নদী পর্যন্ত গাড়ি যায়। নদী হেঁটে পেরিয়ে খানিকদূর গিয়েই রাজরাপ্লা! শঙ্করলাল মিশ্রের গাড়ি নেই। তিনি আমাদের গাড়িতেই এলেন। দুজন বেয়ারাকেও নেওয়া হয়েছে পিকনিকের দলে, তাদের একজন হল বুড়ো নূরমহম্মদ, যে মহেশবাবুর ওকালতির জীবনের শুরু থেকে আছে। অন্য জন হল ষণ্ডা মাক জগৎ সিং, যার জিম্মায় রয়েছে অরুণবাবুর বন্দুক আর টাটার বাক্স। মিঃ মিশ্রকে দেখেই বেশ ভাল লেগেছিল, তার সঙ্গে কথা বলে আরও ভাল লাগল। ভদ্রলোকের জীবনের ঘটনাও শোনবার মতো। শঙ্করলালের বাবা দীনদয়াল মিশ্র ছিলেন মহেশবাবুর দারোয়ান। আজ থেকে পঁয়ত্ৰিশ বছর আগে, যখন শঙ্করলালের বয়স চার-দীনদয়াল নাকি এক’দিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। দুদিন পরে এক কাঠুরে তার মৃতদেহ দেখতে পায় মহেশবাবুর বাড়ি থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে একটা জঙ্গলের মধ্যে। কোনও জানোয়ারের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দীনদয়াল ওই জঙ্গলে কেন গিয়েছিল সেটা জানা যায়নি। একটা পুরনো শিবমন্দির আছে সেখানে, কিন্তু দীনদয়াল কোনওদিন সেখানে যেত না! এই ঘটনার পর থেকে নাকি মহেশবাবুর ভীষণ মায়া পড়ে যায় বাপহারা চার বছরের শিশু শঙ্করলালের উপর। তিনি শঙ্করলালকে মানুষ করার ভার নেন। শঙ্করলালও খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল; পরীক্ষায় বৃত্তি পায়, বি এ পাশ করে রাঁচিতে শঙ্কর বুক স্টোর্স নামে একটা বইয়ের দোকান খোলে। হাজারিবাগে ব্রাঞ্চ আছে, দু জায়গাতেই যাতায়াত আছে ভদ্রলোকের। এই খবরটা শুনে অবিশ্যি লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারলেন না। এই বইয়ের দোকানে বাংলা বইও পাওয়া যায় কি না।নিশ্চয়ই, বললেন শঙ্করলাল, আপনার বইও বিক্রি করেছি আমরা। ফেলুদা সব শুনে বলল, মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলে তা হলে আপনারই বয়সী ছিলেন? বীরেন্দ্র ছিল আমার চেয়ে কয়েকমাসের ছাট, বলল। শঙ্করলাল। আমরা দুজন ইস্কুলে এক ক্লাসেই পড়েছি, যদিও কলেজের পড়াটা ওরা তিন ভাই-ই করেছে কলকাতায় ওদের এক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে থেকে। বীরেনের পড়াশুনায় মন ছিল না। সে ছিল বেপরোয়া, রোম্যান্টিক প্রকৃতির ছেলে। উনিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে
false
shunil_gongopaddhay
রত্নেশদাকে বলল, আচ্ছা, দাদা, তোমার অফিসের ঐ বিজয় শাকসেনার ব্যবহারটা কেমন একটু অস্বাভাবিক লাগল না? ছোড়দি বলল, আমার মনে হল, ভদ্রলোক আমাদের দেখে যেন একটু চমকে উঠলেন। আমরা যে এই শনিবার পাঁচমারিতে আসব, তুমি অফিসে জানাওনি? রত্নেশদা বলল, হ্যাঁ, জানাব না কেন? বিজয়কেও তো বলেছিলাম। বিজয়ও যে এখানে আসবে, সেটা জানতুম না। অবশ্য চীফ মিনিস্টারের এখানে আসবার কথা আছে ঠিকই। আমি বললুম, ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনার নিরুদ্দেশ হবার কথা উনি আমাদের কাছে প্ৰথম শুনলেন? রত্নেশদা বলল, ও যে বলল আজি খুব ভোরে বেরিয়েছে। রেডিও শোনেনি, কাগজও পড়েনি। তাহলে জানবে কী করে? আমি বললুম, রেড়িওতে আজ সকালে জানালেও ডক্টর শাকসেনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাল সকাল থেকে। কাল সারা দিনে উনি কোনও খবর পাননি? ওঁরা এক বাড়িতে থাকেন না বুঝি? রত্নেশদা বলল, তা অবশ্য ঠিক। এক বাড়িতে না থাকলেও খুব কাছাকাছি বাড়ি। বিজয়ের কাকার বাড়ি থেকে দেখা যায়। ও-বাড়িতে কিছু হলে বিজয় নিশ্চয়ই জানবে? নিপুদা বলল, আমাদের মুখে খবরটা শুনেও ওকে খুব একটা ব্যস্ত হতে দেখলুম না। ওদের কাকা-ভাইপোতে ঝগড়া নাকি? রত্নেশদা বলল, আরে না, না। বিজয় ওর কাকাকে একেবারে দেবতার মতন। শ্রদ্ধা করে। তা ছাড়া বিজয় মানুষটা খুব ভাল। কারুর সঙ্গেই ওর ঝগড়াঝাঁটি নেই। দীপ্ত বলল, আমি একটা কথা বলব? আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? চিরঞ্জীব শাকসেনাকে কারা ধরে নিয়ে গেছে, তা ঐ বিজয়বাবু জানেন। তারা বিজয়বাবুকে ভয় দেখিয়েছে যে, মুখ খুললেই মেরে ফেলবে। সেইজন্যই উনি পাঁচমারিতে পালিয়ে এসেছেন। ছোড়দি বলল, দীপ্ত ঠিকই বলেছে, আমারও কিন্তু তাই মনে হচ্ছে। রত্নেশদা বলল, ওর কাকার এত বড় বিপদ হলে বিজয় নিজের প্রাণের ভয়ে চুপ করে থাকবে, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। ও হয়তো সত্যিই খবরটা জানত না। কাল সারাদিন বোধহয় ব্যস্ত ছিল-আরো তাই তো, বিজয় তো গতকাল অফিসেও আসেনি। নিপুদা বলল, উনি পাঁচমারিতে কোথায় উঠেছেন, সে-কথাও তো আমাদের বললেন না। হঠাৎ চলে গেলেন। রত্নেশদা বলল, পাঁচমারি ছোট জায়গা, সবার সঙ্গে সবার রোজ দেখা হয়। বিজয় নিশ্চয়ই সার্কিট হাউসে উঠেছে। কাল সকালেই আবার দেখা হবে। একটু বাদেই পরপর দুবার দুড়ুম দুড়ুম করে বন্দুকের শব্দ শোনা গেল! আমরা চমকে উঠলুম! জায়গাটা এমনই শান্ত আর নিস্তব্ধ যে, সেই আওয়াজ যেন কমানের গৰ্জনের মতন শোনাল। শীত অগ্রাহ্য করেও আমরা চলে এলুম বারান্দায়। এই টিলার ওপর থেকে পাঁচমারির অন্য বাড়িগুলোর আলো একটু-একটু দেখা যায়। যেন ছড়ানো-ছেটানো অনেকগুলো তারা। দূরে কোথাও সামান্য গোলমালের আভাস পাওয়া গেল। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই বোঝা গেল না। এত রাতে কে বন্দুক ছুঁড়বে? জঙ্গলে কেউ শিকার করতে গেছে? এই শীতের মধ্যেও যদি কেউ শিকারে যায়, তবে তার শখকে ধন্য বলতে হবে! আর বেশিক্ষণ আমাদের গল্প জমল না। সকলের মন টনছিল বিছানার দিকে। শোওয়ামাত্র ঘুম। পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, তখন নটা বেজে গেছে। চারদিকে ঝলমল করছে। য়োদ। শীতও অনেক কম। হোটেলের লম্বা টানা বারান্দায় অনেকগুলো বেতের চেয়ার আর টেবিল। আমরা এক জায়গায় গোল হয়ে বসে চা খেতে লাগলুম। মিংমা চা খেল পরপর চার কাপ। ছোড়াদির এই শীতে সর্দি লেগে গেছে, হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করছে বারবার। কয়েকজন বেয়ারা এক কোণে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা ঘলছে, আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল রাত্রের সেই গুলির আওয়াজের কথা। আমি জিজ্ঞেস করলুম, রত্নেশদা, কালকের সেই গুলি— রত্নেশদা বলল, ও হ্যাঁ, তাই তো! একজন বেয়ারাকে ডেকে রত্নেশদা জিজ্ঞেস করল, কাল রাত্রে কিসের শব্দ হয়েছিল? তোমরা শুনেছ? বেয়ারাটি বলল, সাব, এমন কাণ্ড এখানে কোনওদিন হয়নি। পাঁচমারিতে বেশি লোক আসে না, যারা আসে তারা সব বাছাই-বাছাই মানুষ। এখানে কোনওদিন কোনও হাঙ্গামা-হুজোত হয় না। এই প্রথম এখানে এমন একটা খারাপ ব্যাপার হল– কী হয়েছে, আগে তাই বলো না! সার্কিট হাউসে কারা এসে কাল এক বাবুকে গুলি করেছে। রত্নেশদা চমকে উঠে বলল, অ্যাঁ? সার্কিট হাউসে? কে গুলি করেছে? কাকে করেছে? কেউ মারা গেছে? বেয়ারাটি অত খবর জানে না। সে সব শুনেছে অন্য লোকের মুখে। একদল ডাকাত নাকি এসেছিল, একজন না। দুজন মরে গেছে। ডাকাতরা অনেক কিছু নিয়ে গেছে। ব্রেকফার্স্ট না খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লুম তক্ষুনি। ছোড়দি আর মিংমাকে রেখে যাওয়া হল। সার্কিট হাউসের সামনে তখনও কুড়ি-পঁচিশ জন লোক দাঁড়িয়ে জটলা, করছে। আমরা পৌঁছে বুঝলুম, আমাদের ঠিক পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। একটুর জন্য দেখা হল না। কাল রাত্রে কেউ এসে গুলি ছুঁড়েছে ঠিকই। কেন ছুঁড়েছে বা কে ছুঁড়েছে তা বোঝা যায়নি। গুলির শব্দ শুনে সার্কিট হাউসের অন্য বাসিন্দারা উঠে এসে দেখে যে, বারান্দায় একজন লোক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তখনও মরেনি, অজ্ঞান। এখানকার হেলথ সেন্টারে একজন মাত্র ডাক্তার, তিনি আবার কাল বিকেলেই চলে গেছেন। জব্বলপুরে। তখন অন্যরা কোনও রকমে আহত লোকটিকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। গুলি লেগেছে উরুতে। আজ সকালে এই পাঁচ মিনিট আগে লাকটিকে নিয়ে যাওয়া হল শহরের হাসপাতালে। সঙ্গে সার্কিট হাউস থেকেও দুজন গেছেন। একটু খোঁজ করতেই জানা গেল, আহত লোকটির নাম বিজয় শাকসেনা। পাঁচমারিতে আমাদের থাকার কথা ছিল চার-পাঁচ দিন। কিন্তু আমরা ফিরে এলুম দু দিনের মধ্যেই। এত ভাল জায়গা, তবু আমাদের মন টিকছিল না। সেই গুলি চলবার পর টুরিস্টরা অনেকেই ফিরে গেল। জায়গাটা এমনিতেই ফাঁকা, এখন যেন একেবারে শুনশান। আমরা অবশ্য
false
shirshendu
শ্রীনাথ তৃষাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখেছে। কোনও ভাবান্তর চোখে পড়েনি। কিন্তু শ্রীনাথ এও জানে, মুখের ভাবে ধরা পড়ার মতো কাঁচা মেয়ে তৃষা নয়। এই পুরো জমিজমা, সম্পত্তি একা হাতে সামলাচ্ছে তৃষা। সোমনাথ মার খেয়ে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দাদার সম্পত্তির ভাগ দাবি করে মামলা ঠুকেছে। সেই মামলাও একা চালাচ্ছে তৃষা। আদালতে গিয়ে উইলের প্রোবেট বের করেছে। উকিলের বাড়ি যাতায়াত করছে। দরকারমতো উকিলকে পরামর্শ দিচ্ছে। এরকম বউ থাকলে মেনিমুখো মানুষের গৌরব হওয়ার কথা। ঘরে এসে গা থেকে ঘামে-ভেজা গেঞ্জিটা খুলে সেটা দিয়েই গা মুছে নিল শ্রীনাথ। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে রইল একটু। মাথায় অজস্র চিন্তার ভিড়। কোনওটাই কাজের চিন্তা নয়। মল্লিনাথের এই ভাবন-ঘরের চারদিকেই অজস্র জানালা। আলোয় হাওয়ায় ঘরে ভাসাসি কাণ্ড। ভারী সুন্দর। কিন্তু সারাক্ষণ একটা অস্বস্তির কাটা বিধে থাকে শ্রীনাথের মনে। এ বাড়ি দাদা বানিয়েছিল, এখন এর মালিক তার বউ তৃষা। এসব তার নয়, সে এ বাড়ির কেউ নয়। গোলপা একটা মুখ উঁকি দিল দরজায়। আবছা একটা ফেঁপানির শব্দ। আধবোজা চোখেই মুখখানা নজবে এল শ্রীনাথের। তার মেজো মেয়ে মঞ্জ। শ্রীনাথ সোজা হয়ে বসে বলল, কী রে? কাঁদছিস নাকি? কোনও জবাব নেই। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে অবশেষে মঞ্জু আড়াল থেকে বেরিয়ে কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু। খোলা চুল নেমে এসে খানিকটা আড়াল করেছে মুখখানা। আগে ছেলেমেয়ের ওপর বড় মায়া ছিল শ্রীনাথের। বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে পারত না। এখন কে যেন আর বুকের মধ্যে তেমন ব্যাকুলতা নেই, টান নেই। ছেলেমেয়েদের দেখলে, হঠাৎ যেন মনে হয়, অন্য কারও ছেলেমেয়ে। আগে খুব মিশত ওদের সঙ্গে শ্রীনাথ, আজকাল গা বাঁচিয়ে থাকে। পারতপক্ষে ওরাও আজকাল তার কাছে ঘেঁষে না। মেয়ে দুটো তবু মাঝে মাঝে একটু-আধটু ডাক-খোঁজ করে, কিন্তু ছেলের সঙ্গে প্রায় পরিচয়ই নেই শ্রীনাথের। ছেলে সজল পুরোপুরি তার মায়ের সম্পত্তি। এইভাবে বন্ধনমুক্তি শ্রীনাথের খুব খারাপও লাগছে না। শ্রীনাথ আর কিছু বলছে না দেখে মঞ্জু এলোচুল খোঁপায় বাঁধল, চোখ মুছল, তারপর খুব সংকোচে সাবধানি পায়ে ঘরে এসে চৌকির বিছানায় বসে বলল, তোমার এ ঘরের চাবিটা আজ আমাকে দিয়ে যাবে বাবা? বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কেন? আমি এখানে দুপুরটা থাকব। তাই বা থাকবি কেন? ঝগড়া করেছিস নাকি কারও সঙ্গে? ভাই ভীষণ পাজি। সারাদিন মাকে নালিশ করে মার খাওয়ায়। আজও মা কীরকম মেরেছে দেখো। গাল এখনও ফুলে আছে দেখেছ? দেখল শ্রীনাথ। তৃষা এরকমই মারে! শ্রীনাথ উঠে দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বলল, এ ঘরে তোকে খুঁজে পাবে না নাকি? মঞ্জু সংকোচের গলায় বলে, ভাই তো তোমাকে ভয় পায়। এ ঘরে আসতে সাহস পাবে না। এ কথায় একটু থমকাল শ্রীনাথ। এ বাড়ির কেউ তাকে ভয় পায় এটা নতুন কথা। সজল কে তাকে ভয় পায় তা বুঝতে চেষ্টা করেও পারল না। মাথাও ঘামাল না বিশেষ। বালতি মগ আর সর্ষের তেলের শিশি নিয়ে ঘবের পিছন দিকে টিউবওয়েলে যেতে যেতে বলল, চাবি রেখে দিস, কিন্তু জিনিসপত্র ঘাঁটিস না। বিশাল উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় নিকোনো শানের মেঝেয় পরিপাটি গালচের আসনের সামনে বাড়া ভাত আর ঢাকা-দেওয়া জলের গেলাসটি সাজিয়ে রাখার দৃশ্যটি দেখলে তখনও তার সেই একটি কথাই মনে আসে। এ বাড়িতে সে বড় বেশি অতিথির মতো। তৃষার কাজ নয়, এ হচ্ছে রাঁধুনি বামনির যত্ন-আত্তি। পিছনে অবশ্য তৃষার হুকুম আছে। কিন্তু এক কালে গরিব অবস্থার সময়ে কলকাতার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের ভাড়াটে বাসায় তৃষা নিজের হাতে বেঁধে তাকে খেতে দিত, তখনও কোনওদিন এত যত্নে ভাত বেড়ে দেয়নি। তবে তৃষা ভাত বেড়ে না দিলেও আজ কাছেপিঠেই ছিল। শ্রীনাথ খেতে বসার পরই সামনে এসে বসে বলল, কতদিন হয়ে গেল বিলুর চিঠি এসেছে। প্রীতমবাবুর অত অসুখ, তোমার একবার দেখতে যাওয়া উচিত ছিল না? রোজই তো কলকাতা যাচ্ছ। একদিন অফিসের পর গিয়ে ঘুৱে আসতে কী হয়? ভগ্নিপতির অসুখের খবর একটা কানে এসেছিল বটে শ্রীনাথের। অতটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন বলল, কী অসুখ? খুব খারাপ কিছু নাকি? তৃষা বলল, অত ভেঙে তো লেখেনি। শুধু লিখেছে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না পর্যন্ত। শ্রীনাথ ভ্রু কোঁচকাল। কতকাল হল সে বিলুর খবর রাখে না? বছরখানেক হবে? তা হবে বোধহয়। গতবার বিলু ভাইফেঁাটায় ডেকেছিল। সেবারই শেষ দেখা। এবার ভাইফোটায় বিলুও ডাকেনি, শ্রীনাথেরও ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এতকাল মায়ের পেটের বোনকে একেবারে ভুলে সে ছিল কী করে? শ্রীনাথ পাতের দিকে চোখ রেখেই বলল, চিকিৎসার ব্যবস্থা কী করেছে? কী আবার করবে? স্বামীর অসুখ হলে স্ত্রীরা যেমন করে তেমনই ব্যবস্থা করেছে। নিজে গিয়ে দেখে এলেই তো হয়। উদাস উদার গলায় শ্রীনাথ বলল, যাব। আজই যেয়ো পারলে। দেরি করা ঠিক নয়। আজই?–বলে ভাবল একটু শ্ৰীনাথ। কী হয়েছে তার আজকাল, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে এক পা হাঁটতে হলেও কেন যে জড়তা আসে। কেন, আজ কি কোনও কাজ আছে? শ্রীনাথ বলে, অফিস ছুটির পর বাসে ট্রামে বড্ড ভিড়। তার চেয়ে কোনও ছুটির দিনে– তৃষা মাথা নেড়ে বলে, তা তুমি কি যাবে? ছুটির দিনে মানুষকে আলিস্যির ভূতে পায়। ব্যাপারটা ফেলে রাখলে আবার বছর গড়িয়ে যাবে। যেতে হলে আজই যাও। বিলুকে বোলো আমি মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। নইলে আমিও যেতাম। দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে
false
shottojit_roy
আর দরকার হল না। গাড়ি অদৃশ্য হবার আগেই ফেলুদার রিভলভারের দুটো অব্যৰ্থ গুলি তার পিছনের দুটো টায়ারকে ফাঁসিয়ে দিল। জিপটা রাস্তার একদিকে কেদ্‌রে গিয়ে একটা গাছের গায়ে ধাক্কা লেগে থেমে গেল। দেখলাম শশধর বাবু লাফিয়ে পড়ে উৰ্ধৰ্বশ্বাসে বনের দিকে ছুটলেন। ড্রাইভারটা উলটো দিক দিয়ে বেরিয়ে জিপের স্টার্টিং হ্যান্ডেলটা উঁচিয়ে এগিয়ে এল। ফেলুদা তাকে অগ্রাহ্য করে ছুটিল বনের দিকে–আমরা তিনজন তার পিছনে! ড্রাইভারকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ আমাদের থোণ্ডুপও তার জিপের হ্যান্ডেলটা হাতে নিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা চারজন অন্ধকার বনের ভিতর ঢুকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় দশ মিনিট খোঁজার পর হেলমুটের একটা হাঁক শুনে তার দিকে গিয়ে দেখি, শশধর বাবু একটা প্রকাণ্ড বুড়ো গাছের পাশে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত মুখ করে অদ্ভুত ভাবে লাফাচ্ছেন আর ছটফট করছেন। আরও কাছে যেতে বুঝলাম যে তাঁকে জোঁকে ধরেছে–একটা নয়–অন্তত দুশো-তিনশো লকলকে জোঁক তাঁর দুই পায়ের হাঁটু অবধি, আর কাঁধে, ঘাড়ে আর কনুইয়ের কাছটায় কিলবিল করছে। হেলমুট বলল, ‘ভদ্রলোক বোধহয় এই আলগা শেকড়টায় হোঁচটি খেয়ে মাটিতে পড়েছিলেন, তাতেই এই দশা।’ ফেলুদা শশধরবাবুর কোটের কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে তাকে বনের বার করল। তারপর আমাকে বলল, ‘দৌড়ে গিয়ে জোঁক-ছাড়ানো কাঠিগুলো নিয়ে আয়৷’ আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। আমরা ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে আছি। হেলমুট বাইরে দাঁড়িয়ে অকির্ডের ছবি তুলছে। থোণ্ডুপ গেজিং থেকে পুলিশ নিয়ে এসেছে। মূর্তিটা শশধর বাবুর কাছেই পাওয়া গেছে। খুনের সময় মূর্তিটা নেবার কথা তাঁর খেয়াল হয়নি। পরের দিন সেটার কথা মনে পড়ায় লোভ সামলাতে না পেরে খুনের জায়গায় ফিরে গিয়ে সেটা একটা ঝোপের পাশ থেকে খুঁজে বার করেন। উনি যখন মূর্তি নিয়ে উঠে আসছেন, তখন নিশিকান্তবাবু একই উদ্দেশ্যে নামছেন। নিশিকান্ত শশধরকে দেখেনি, কিন্তু শশধর নিশিকান্তকে দেখেছে, আর সেই থেকে তাকে শাসাতে শুরু করেছে। আরও একটা ব্যাপার–বম্বেতে নাকি শশধর বাবুর একটি সাকরেদ ছিল—তার সঙ্গে গ্যাংটক থেকে শশধরবাবুর টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। সেই সকরেদই নাকি ফেলুদার টেলিফোন ধরে, এবং ফেলুদার টেলিগ্রামের খবরটা সে-ই নাকি গ্যাংটকে শশধরবাবুকে জানায়। ফেলুদা সঙ্গে পান এনেছিল; চিবোতে চিবোতে নিশিকাস্তুবাবুকে বলল, ‘আপনিও যে একটি ছোটখাটো ক্রিমিনাল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নেহাত আপনার ভাগ্য ভাল তাই আপনি যমন্তকটা ফিরে পাননি। পেলে আপনার জন্যে একটা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হত।’ নিশিকান্তবাবু কাঁচুমাচু ভাব করে বললেন, ‘পানিশমেন্ট তো হয়েচেই স্যার! তিন-তিনখানা জোঁক বেরিয়েছে আমার ডান পায়ের মোজার ভিতর থেকে। অনেক রক্ত খেয়েছে ব্যাটারা। ফলে বেশ উইক বোধ করছি।’ ‘যাই হোক–ঠাকুরদাদার সংগ্রহ করা কোনও তিব্বতি জিনিস আশা করি ভবিষ্যতে বিক্রি করবেন না। এই নিন আপনার বোতাম।’ এই প্রথম লক্ষ করলাম ভদ্রলোকের শার্টের গলার সবচেয়ে নীচের ঝোতামটা নেই। নিশিকান্তবাবু বোতামটা ফেরত নিয়ে তাঁর চারকোনা গোঁফের নীচে সেই পুরনো হাসিটা হেসে বললেন, ‘থ্যা–মানে থ্যাঙ্কস।’ গোসাঁইপুরে আপনার চেনা একজন কে থাকেন না? রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলীকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। আমরা, থ্রি মাস্কেটিয়ারস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গঙ্গার ধারে পৌঁছে গেছি। প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে যে গম্বুজওয়ালা ঘরটা আছে সেটার মধ্যে বসে চানাচুর আর গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছি। সময় হচ্ছে বিকেল পাঁচটা, তারিখ অক্টোবরের তেরোই। আমাদের সামনেই জলের মধ্যে একটা বয়া ভাসছে, সেটার ব্যবহার কী সেটা লালমোহনবাবুকে বুঝিয়ে দিয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভদ্রলোক বললেন, আছে। বইকী। তুলসীবাবু। তুলসীচরণ দাশগুপ্ত। এথিনিয়ামে অঙ্ক আর জিয়োগ্রাফি পড়াতেন। রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রিটে থাকতেন, এখন রিটায়ার করে চলে গেছেন গোসাঁইপুর। ওখানে পৈতৃক বাড়ি আছে। ভদ্রলোক তো কতবার আমাকে যাবার জন্য লিখেছেন। আমার বিশেষ ভক্ত, জানেন তো? নিজেও গল্প-টল্প লেখেন, ছোটদের জন্য। সন্দেশে গোটা দুই বেরিয়েচে। -কিন্তু হঠাৎ গোসাঁইপুর কেন? ওখান থেকে একটা চিঠি এসেছে। লিখেছেন জীবনলাল মল্লিক। শ্যামলাল মল্লিক, তস্য পুত্র জীবনলাল। বংশ-পরিচয় তৃতীয় খণ্ড খুলে দেখলাম গোসাঁইপুরের জমিদার ছিলেন এই মল্লিকরা। ফেলুদা থামল। কারণ একটা জাহাজ প্রচণ্ড জোরে ভোঁ দিয়ে উঠেছে। আজই সকালে গোসাঁইপুরের চিঠিটা এসেছে সেটা জানি। যদিও তাতে কী লেখা ছিল জানি না। চিঠিটা পড়ে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল সেটা লক্ষ করেছিলাম। কী লিখেছেন ভদ্রলোক? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। লিখেছেন তাঁর পিতাকে নাকি কেহ বা কাহারা হত্যা করার সংকল্প করেছে। আমি গিয়ে যদি ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে পারি তা হলে উনি বিশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করবেন এবং আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করবেন। চলুন না মশাই বললেন লালমোহনবাবু। বেশ তো ঝাড়াঝাপটা এখন; আমার নতুন বই বেরিয়ে গেছে। আপনার হাতেও ইমিডিয়েট কিছু নেই, তা ছাড়া হিল্লি-দিল্লি তো অনেক হল, এবার স্বাদবাদলের জন্য পল্লীগ্রামটা মন্দ কী? কাছেই সেগুনহাটিতে শুনিচি বিরাট মেলা হয় এই সময়টাতেই। চলুন স্যার, বেরিয়ে পড়ি। ওঁদের বাড়িতে নাকি থাকার অসুবিধে আছে, তাই মাইল তিনেক দূরে শ্ৰীপুরে কোন এক চেনা বাড়িতে আমার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। সাইকেল রিকশাতে যাতায়াত। আমার মনে হচ্ছিল গোসাঁইপুরেই থাকতে পারলে সুবিধে হত। তাই আপনার বন্ধুটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। আমার বন্ধু উইল বি ড্যাম গ্র্যাড। আর আপনি যাচ্ছেন শুনলে তো কথাই নেই। উনি আপনার দারুণ ভক্ত। আর কার কার ভক্ত সেটা জেনে নিই। লালমোহনবাবু এই খোঁচা-দেওয়া প্রশ্নটাকেও সিরিয়াসলি নিয়ে বললেন, জগদীশ বোসের নাম করতে শুনিচি এককালে, বলতেন। অত বড় মনীষী পৃথিবীতে নেই; আর গোবরবাবুর কাছে বোধহয় ছেলেবেলা কুস্তি শিখেছে; আর— আর, ওই যথেষ্ট। *** গোসাঁইপুর যেতে
false
shirshendu
কথাটা শুনল শ্রীনাথ। তারপর বলে, খবর আমিও কিছু রাখি, কিন্তু সেগুলো বলতে গেলে চেঁচামেচি হবে, খবর আরও ছড়াবে। ওসব কথা থাক। কথাগুলো কি বটতলার মিটিং-এর জন্য জমিয়ে রাখছ? নোক জড়ো করে না বললে সুখ নেই? শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, বলার এখনও অনেক বাকি। ঠিকই বলেছ, তোক জড়ো করে না বললে সুখ নেই। তবে দীপু জানল বলে আর দুঃখ করার কী? তুমিই তো ঢোল সহরত করতে বেরিয়ে পড়েছ। শ্রীনাথ অন্ধকারের দিকে চেয়ে বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে বলল, দীপুর কথা আলাদা। আমি পাবলিককে যা-ই বলে থাকি দীপুকে বলিনি। তুমি যদি বলতে থাকে তবে আমাকেও লাজ-লজ্জার বালাই ঝেড়ে ফেলে বলতে হবে। বলো না। বাকি থাকে কেন? সব বলব? সব বলতে কী? আর কিছু বাকি আছে নাকি? আছে। পাবলিককেও আমি সব বলিনি। বলতে বলছ? তৃষা মুখ তুলে খুব সহজভাবে তাকাল। চোখে বেড়ালের মতো জুলজুলে চাউনি নেই। কিছু ক্লান্তি কি? অন্তত গলায় একটা পরিশ্রান্ত স্বর ফুটল, তুমি কী করতে না করতে তুমিই জানো। ছেলেপুলেরা ঘরদোর নোংরা করেই, মেয়েরা তা ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। আমারও সারা জীবন তাই করতে হবে। দুঃখ কিসের? সব আবর্জনা কি যাবে তাতে? চেষ্টা তো করতেই হবে। নোংরা কি তুমিই কিছু কম করেছ এই সংসারকে? এবার ঝগড়ার কথা কে বলছে শুনি! শ্রীনাথ সামলে নিল। বাস্তবিক তৃষার সঙ্গে আর ঝগড়া করার কোনও মানেই হয় না। সামলে নিয়ে সে বলল, তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব। দেবে? চাইবে?–তৃষা অবাক হয়ে বলে, কী চাও বলো। খুব দূরে কোথাও এক ফালি জমি কিনে চাষবাস করব ভেবেছিলাম। তুমি তাতে বাগড়া দিয়েছ। জমির কোনও খবরই পাচ্ছি না। যদি বাধা না দাও তবে আমি একটু জমি কিনে চাষবাস নিয়ে থাকতে পারি। আমি বাগড়া দিইনি। দিয়েছ। শোনো ওসব করে লাভ নেই। আমি ঠিক করেছি, জমি যদি কিনতে নাই পারি তবে অন্তত কলকাতায় একটা মেসে গিয়ে উঠব। সেটা কি আটকাতে পারবে? আটকাব কেন? কেন তা আমি কি জানি? হয়তো তোমার কোনও এক্সপেরিমেন্টের জন্য আমার মতো একটা গিনিপিগ দরকার। ওসব তোমার নিজের মনের কথা? আমি বাধা দেব না। দিইওনি। তোমাকে নিয়ে আমার কোনও এক্সপেরিমেন্টও করার ইচ্ছে নেই। আমি দূরে গেলে তোমারই সুবিধে। পাবলিককে ঘরের কথা বলার কেউ থাকবে না। পাবলিককে নিয়ে তো আমি ভাবছি না। তারা তোমাকেও চেনে, আমাকেও চেনে। আমি ভাবছি তোমার বাবার কথা, তোমার ছেলেমেয়ে এবং সংসারের কথা। তুমি গেলে এদের কে দেখবে? একটু অবাক হয়ে শ্রীনাথ বলে, এদের এতকাল কি আমি দেখাশুনো করতাম নাকি? না, এতকাল আমিই করেছি। কিন্তু আমারও তো ক্লান্তি আছে, বয়স আছে। আমি বরং বলি, এতকাল তো আমিই দেখলাম, এবার তুমি দেখো, আমি যাই। কোথায় যাবে? এ প্রশ্ন তো তোমাকে আমি করিনি। তবে তুমিই বা করছ কেন? কোথাও যাব। শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, এ সম্পত্তি আমার নয়, তোমার। এখানে এসব আগলে আমি থাকতে যাব কেন? তৃষা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, সম্পত্তির সুখ কীরকম তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তুমি যদি চাও তো তোমার নামে লিখে দিতে পারি। আমার নামে লিখে দেবে কেন? আমি নেবই বা কোন লজ্জায়? উদাস মুখে তৃষা বলে, সেসব জানি না। সম্পত্তি না নিলে বলার কিছু নেই, কিন্তু সংসারের দায়িত্ব আমি একা নিতে পারব না। এসব তোমার সাজানো কথা। তুমিও জানো, আমিও জানি, দায়িত্ব আমার কোনওকালে ছিল না, আজও নেই। তুমি আমাকে দায়িত্ব দাওনি, আমিও নিইনি। এতকালের কথা দিয়ে কী হবে? আমি বলছি এখনকার কথা। এতকাল অন্যরকম ছিল বলে চিরকালই তাই থাকবে নাকি? শ্রীনাথ বিমর্ষ মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি জানি তৃষা, তুমি আমাকে আটকে রাখতে চাও। যদিও আমাকে তোমার আর প্রয়োজন নেই। এরকমভাবে যারা ভাবে তাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি ওভাবে ভাবি না। তোমার মনের খবর রাখি না। কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আমি এ বাড়িতে ভারচুয়ালি কয়ে রয়েছি। কেউ তোমাকে কয়েদ রাখেনি। না, দরজায় তালা দিয়ে কয়েদ তো তুমি করোনি। তুমি শুধু আমার বেরিয়ে যাওয়ার পথগুলো আটকে দিয়েছ। তৃষা হাঁটু তুলে তার ওপর থুতনি রেখে কী যেন ভাবল একটু। তারপর বলল, তুমি কলকাতার মেসে থাকবে? থাকব। তাতে বাধা কোথায়? বাধা যে নেই তাও নয়। মেসে আমি বহুকাল থাকতে পারব না। তুমি জেনে গেছ যে, গাছপালা ছাড়া আমি আজকাল থাকতে পারি না। হাতে পায়ে মাটি না লাগালে আমার স্বস্তি নেই। কলকাতায় গেলে আমি ছটফট করে মরব। সেই জনাই যদি আমি কলকাতার মেসে যেতে চাই তবে তুমি বাধা দেবে না, আমি জানি। আমি তোমাকে নিয়ে অত খুঁটিয়ে ভাবিনি। মিছিমিছি তুমি আমাকে এক মস্ত শত্রু মনে করে বসে আছে। যদি আমি শত্রু হতাম তবে অনেক কিছু করতে পারতাম। তাও জানি। তোমার অপার করুণা। ঠাট্টা কোরো না। এখন আর ওসব ভাল শোনায় না। শ্রীনাথ বাঁকা হাসি হেসে বলে, শত্রুতার বদলে বরং আমার কিছু উপকারই করতে চেয়েছ। স্টেশনের স্টলে সরিৎকে লেলিয়ে দিয়ে কয়েকটা ছেলেকে মার খাইয়েছ। আমাকে নিয়ে ওরা মশকরা করত সেটা তোমার সহ্য হয়নি। বড় বড় চোখে চেয়ে তৃষা বলে, তোমার মান-অপমানবোধ নেই জানি। তা বলে তোমার পরিচয়টা তো মুছে যায়নি। তোমার অপমানে এই পরিবারেরও অপমান, সেটা ভুলতে পারিনি। মনে রেখো, এই
false
toslima_nasrin
কোনও তুলো পড়ে থাকতে দেখলে মার সন্দেহ হবে, ভেবে গুটিয়ে যাই। তুলো যদি পায়খানায় ফেলি, বদনি বদনি পানি ঢেলেও সেটি দূর করা যাবে না। আটকে যাবে পথে, গু মুত সব ফোয়ারার মত উত্থিত হবে। মাথা থেকে সার্জারি মেডিসিন গায়নোকলজি গেছে আমার, মাথায় কেবল একটি রোগ, একটি রোগ থেকে বাঁচার উপায়। শরীরে মাথা ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা একটি রোগ সবার চোখ থেকে লুকোনো। হাসপাতালে প্রতিদিন রোগির চিকিৎসা করছি, অথচ নিজের শরীরে একটি রোগ। এই রোগ নিয়ে কোনও চেনা ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় না। এই রোগ এখন আর প্রাথমিক স্তরে নেই, দ্বিতীয় স্তরে চলে গেছে। পেনিসিলিন ইনজেকশন যেটি নেওয়া হয়েছে সেটিও শরীরে কাজ করেনি। রোগটি তৃতীয় স্তরে এসে স্নায়ুতন ্ত্র অচল করে দেবে। নিউরোসিফিলিসে আক্রান্ত হওয়া মানে মৃত্যু। আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকি। রাতে একটি মৃত্যুকে আমি পাশে নিয়ে ঘুমোই। একটি মৃত্যুকে নিয়ে সকালবেলা জেগে উঠি। কলেজে যাই, সঙ্গে একটি মৃত্যু যায়। কলেজ থেকে ফিরি, একটি মৃত্যু ফেরে। সন্ধের বারান্দায় একা একা বসে থাকি উঠোনের দিকে মখু করে। একটি মৃত্যু বসে থাকে পাশে। এ অবস্থায় একদিন মুখে খাওয়ার পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিনি।এ কাজে দেবে না জেনেও কিনি। যদি অ−লৗকিক ভাবেও কাজে দেয়। যদি হাই ডোজ খেয়ে এ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি পাই। ওষধু লুকিয়ে রাখি তোশকের তলে যেন কেউ না দেখে। একসময় জ্বর হলে ওষধু লুকিয়ে ফেলে দিতাম, ওষধু খেতে,গিলতে ভয় ছিল। এখন লুকিয়ে ওষধু খাই। এখন বারোটির জায়গায় বাহাত্তরটি খাই। এতেও কিন্তু কাজ হয় না। দাদার ফেলে যাওয়া ওষুধের বাক্স ঘেঁটে ঘুমের ওষধু নিয়ে খাই। অন্তত ঘুমিয়ে যদি মৃত্যুকে আড়াল করা যায়। কিন্তু একসময় জাগতে তো হয়। মার মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয়। বাড়ির আর কেউ লক্ষ না করলেও মা ঠিকই লক্ষ করেন, আমি ঠিক আগের মত নেই। কড়িকাঠের দিকে চোখ রেখে শুয়ে আছি, মা দরজার কাছে থামেন, কী এত ভাবস? না কিছু ভাবি না তো! এমনি শুইয়া রইছি। আমার কাছে লুকাস কেন? লুকোনো ছাড়া আমার আর উপায় নেই মা, মনে মনে বলি। তর কিছু একটা হইছে রে। খুব খারাপ কিছু হইছে তর। খুব খারাপ কিছু আমি পাশ ফিরে শুই। মার মখু যেন আমাকে না দেখতে হয়। অথবা আমার মখু টি মাকে। রুদ্র আবার মোংলা চলে গেছে। ওখানে বসে ধান চালের হিসেব করে। টাকা গোনে। কবিতা লেখে। আর আমার জন্য হঠাৎ হঠাৎ দুশ্চিন্তা করে। তার দুশ্চিন্তার উত্তর লিখি। অবকাশ ১৬.৮.৮৩ রোদ, এগারো তারিখে লেখা তোমার ছোট্ট চিঠিটি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তোমার কিচ্ছু ভাল লাগে না, আমার কথা ভেবে তুমি একফোঁটা শান্তি পাচ্ছে! না—এসব পড়ে রীতিমত হাসি পায়। দয়া করে এধরণের কথা অন্তত আমাকে তুমি দ্বিতীয়বার বোলো না। বিশ্বাস করো, আর যা কিছুই সহ্য করি, এসব ন্যাকামো কথায় আমার ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে। আর কত আগুন তুমি জ্বালাবে? পুড়ে পুড়ে আমি তো ছাই হয়ে গেছি। এতটুকু টের পাও না? কিচ্ছু বুঝতে পারো না? তুমি অনুযোগ করতে আমি নাকি কথা বলি না। আমি তো এখন অনর্গল কথা বলি, প্রচুর হাসি, হাসতে হাসতে ইদানিং আমার চোখ ভিজে যায়। চোখের ভেতরে একটা সমুদ্র লুকিয়ে থাকে, একটি নোনা জলের সমুদ্র নিয়ে এসেছি আমি। প্রতিনিয়ত যে রোগ আমাকে খুবলে খাচ্ছে, তা বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাওয়া খারাপ মেয়ে মানুষদের রোগ। নিজেকে খুব বেশি ভালমানুষ ভাবতাম, ফুলের মত সুন্দর পবিত্র ভাবতাম, একফোঁটা পাপ করিনি কোনোদিন। তাই বোধহয় অহংকারের শাস্তি পেতে হল এভাবে। ফুলে যেমন কীট এসে খেয়ে ফেলে পাপঁ ড়ি, সব সৌন্দর্য নষ্ট করে, মানুষের ঘৃণায় অবহেলায় বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন সবার অলক্ষ্যে টপু করে মরে যায়। কেউ তাতে দুঃখ করে না। খুব বেশি স্বপ্ন ছিল আমার। এতটা স্বপ্ন কেউ দেখে না। খুব বেশি বিশ্বাস আর ভালবাসায় নির্মাণ করা স্বপ্ন। চোখের সামনে দেখেছি আকাঙক্ষার ঘরদোর পুড়ে গেল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখন শাদামাটা মানুষ আমি, স্বপ্নের বালাই নেই। বুকে বাসনা নেই, আশা নেই, আকাঙক্ষা নেই। কেবল একটা মানুষের শরীরের মত শরীর। ভেতরে সব ফাঁকা, সব শূন্য। বেশ হালকা মনে হয় নিজেকে। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। কোথায় আছি, কি করছি, এসবও ভুলে থাকতে ইচ্ছে করে বলে ডায়জিপাম খাই। মনে হয় আকাশে উড়ছি, রাতের আকাশ। চাঁদ নেই, জ্যোৎস্না নেই, কালো আধাঁর আকাশ। বাবা মার উচ্চাকাঙ্খাকে পায়ে মাড়িয়ে, সমস্ত আত্মীয় স্বজনের কল্পনাকে গুড়িয়ে দিয়ে, তাবৎ লোকের সমালোচনাকে তুচ্ছ মনে করে আমি তোমার কাছে গেলাম। বিনিময়ে তুমি আমাকে যা দিলে সে তো আমার সারাজীবনের পরম পাওয়া। তোমার এই উপহার আমি মাথায় করে রাখব। এ থেকে আমার পরিত্রাণ নেই। তাই তো আমি ভাল হচ্ছি না এবং ভাল হবো না। চারপাশে বড় বড় স্যাংকারে ভরে গেছে। আর প্রতিনিয়ত যে ডিসচার্জ হচ্ছে খুব র‌্যাপিডলি তার ক্যারেকটার পাল্টাচ্ছে। কালো আবর্জনার মত ডিসচার্জ, দগুর্ ন্ধে ডুবে থাকে শরীর। জটিল একটি ব্যাপার, খুব বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটছে, ষ্পষ্ট বোঝা যায়। এখন একটি কম−প্লক্স এসেছে আমার মধ্যে, ইনফিরিওরিটি কম−প্লক্স। হঠাৎ খুব বেশি নীরব হয়ে গেছি। কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলি না। সব্বাই খুব পড়াশোনা করে। সামনে পরীক্ষা। আমি কোনোকিছু পড়তে পারি না। বইপত্র ছুঁতে ইচ্ছে করে না। কেবল ওই আকাশ।
false
toslima_nasrin
কথা আর কত কইয়া দিতে হইব? মার্জিন রেখে অঙ্ক করার কথা এই প্রথম বললেন তিনি। যা হোক। এবার আসল কথা পাড়লেন। চিঠি কারে লিখছ? কোন চিঠি? এবার একটি চড় উড়ে এল গাল বরাবর। কোন চিঠি যেন জানো না? এই চিঠি। বুক পকেট থেকে বের করলেন অর্ধেক পাতায় লেখা চিঠিটি। জুয়েল কেডা? কই থাকে? কী করে? ঢাকায় থাকে। কী করে জানি না। জানো না? আমার সাথে ফাতরামি কর? ফাতরামি আমি দেবনাথ পণ্ডিতের সঙ্গে করতে যাব, এমন সাহস আমার নেই। দেবনাথ পণ্ডিত তাঁর বিশাল শরীর, বিশাল বপু কলাগাছের গায়ের মত বাহু, আর শক্ত সাগর কলার মত আঙুল সামনে নিয়ে বসে থাকেন, আর আমি যতটা সম্ভব মৃত তৃণের মত পড়ে থাকি তাঁর পায়ের কাছে। চিঠিটি ছিঁড়ে টুকরো করে আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনি বেরিয়ে যান। দেবনাথ পণ্ডিতের কিল চড়, বাবার ধমক, মার ঘ্যানঘ্যান, ছোটদার নিরানন্দ, গীতার অভিমান, দাদার দাদাগিরি এসবের মধ্যে আমি একা বসে থাকি। মুখ গুঁজে রাখি বইয়ে। পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষা সামনে তা জানি, কিন্তু ছোটদার বন্ধুরা বাড়িতে বেড়াতে আসে, জ্যোতির্ময় দত্তের ছেলে বাবুয়া দত্ত, তকবীর পত্রিকার সম্পাদকের ছেলে পলক ফেলা যায় না এমন সুদর্শন তফসির আহমেদ, লেডিকিলার বলে খ্যাত সাহেব কোয়ার্টারে থাকা ডিসির ছেলে সোহান, যাকেই দেখি তার প্রেমে পড়ে যাই মনে মনে, মনে মনে তার মনের কথা শুনি,কোথায় পাব কলসি কন্যা কোথায় পাব দড়ি, তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুইবা মরি। অথচ আমার দিকে ফিরে তাকায় না কেউ, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে কৎু সিত মেয়ে বলে মনে হতে থাকে। চিত্রালী পুর্বাণী যেমন বন্ধ হয়, পত্রমিতাদের কাছে চিঠি লেখাও ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। কেবল ভাল কিছু সুন্দর হাতের লেখার, কাব্যময় ভাষার চিঠিগুলোর উত্তর দিই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র কামরুল হাসান সেলিম চিঠি লেখে আশ্চর্য সুন্দর, যেন আকাশপার থেকে স্বপ্নের কথা বলছে। বাছাইয়ে সেলিমকে রাখি, চিঠি লিখতে থাকি কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে সমুদ্রপার থেকে। যেন এ জগতের নয়, অন্য কোনও জগতে আমরা আপন দুজন মানুষ মুখোমুখি বসে স্বপ্নের কথা বলছি। ওই স্বপ্নের জগতে কোনও মানুষ নেই, ঘরবাড়ি নেই, কেবল আকাশ আর সমুদ্র, সমুদ্রের ধারে নানার রঙের ফুল, প্রজাপতি, আকাশ জুড়ে কেবল সপ্তবণর্ রং, তুলোর মত মেঘ আর লেজঅলা পাখি। এভাবেই চলতে পারত, কিন্তু একদিন হঠাৎ, হঠাৎই কলেজ গেটের কাছে এক দীর্ঘাঙ্গ যুবক এসে সামনে দাঁড়ায়, আমার মাথার চুল তেলে চোবানো, শক্ত করে বেণী গাথাঁ, নিশ্চিত শাকচুন্নির মত দেখতে লাগছে আমাকে। সামনে দাঁড়ানো দুজন ছেলের মধ্যে একজন সেলিম। কাছে এসে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ছিটকে সরে গিয়ে দ্রুত একটি রিক্সা নিয়ে ধুকপুক বুক নিয়ে বাড়ি ফিরি। সেলিম সেদিন ঢাকা ফিরে গিয়ে চিঠি লেখে ময়মনসিংহে তার এক বন্ধুর কাছে সে এসেছিল, আমার সঙ্গে একবার দেখা হলে মন্দ হয় না বলেই বন্ধুকে নিয়ে সে কলেজ গেটে দাঁড়িয়েছিল আমার অপেক্ষায়, কথা বলিনি বলে মন খারাপ করে ফিরে গিয়েছে। দেখা না করার কি আছে, শব্দের সাহসী মেয়েটি বুক ফুলিয়ে বলে দেয়, এসো দেখা হবে। কোথায় দেখা হবে? এ এক সমস্যা বটে। স্টেশন রোডের তাজমহল রেস্তোরাঁয় শহরের কবিকুল আড্ডা দেয়, অবশ্য কোনও মেয়ে ওখানে একা যায় না, প্রশ্ন ওঠে না, ওখানেই সেলিমের সঙ্গে আমার দেখা হবে জানিয়ে দিই। ছোটদা এক বিকেলে গীতা আর আমাকে নিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। যেহেতু ছোটদার সঙ্গে মেয়েমানুষ আছে, আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছিল পর্দার আড়ালে। মেয়েমানুষ এলে এরকমই নিয়ম, দূরে যাও,আড়ালে যাও। তাজমহলের লোকেরা উঁকি দিয়ে বারবারই দেখেছে আমাদের। সেলিম আমার চিঠি পেয়েই ময়মনসিংহে কবে কখন আসছে জানিয়ে চিঠি লিখল। দেখা হওয়ার দিন আমি সেজেগুজে চন্দনার জন্মদিনে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই। তাজমহলের দরজায় সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। বুকের কাপঁুনি সমস্ত শক্তিবলে থামিয়ে আমি ঢুকি রেস্তোরাঁয়, পর্দার আড়ালে কেবিনে বসতে হয়। সেলিমের মুখোমুখি বসি যদিও, চা খাব বলে দুজনের জন্য দুটো চা চাই যদিও, তার চোখের দিকে আমার তাকানো হয় না, তার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি নীরবতা, হ্যাঁ, হুঁ, না, নেই আর দুএকটি ভাববাচ্যে বাক্য ছাড়া আর কিছু উচ্চাজ্ঞরত হয় না, কেবল মৌনতার সঙ্গেই বাচাল হয়ে উঠি। যদিও চিঠিতে তুমি লিখি, সামনে তুমি বলা, লক্ষ করি, অসম্ভব। ওই চা পর্যন্তই, চা শেষ হলে আমি উসখুশ করি। চা তো শেষ হল, এবার কি, এবার উঠে পড়া ছাড়া আর কি হতে পারে! জিভের ডগায় যাই শব্দটি আসে আর যায়। আমার কোনও এক চিঠিতে অহল্যা শব্দটি ছিল। সে কারণেই কি না জানি না, হঠাৎ একটি প্রশ্ন সেলিম করে অহল্যা শব্দের মানে কি জানো? আমি রা করি না। হেসে বলে, ন্যাংটো। যে যাই শব্দটি আমার জিভের ডগায় আসে আর যায় করছিল, সেটি এবার এসে যায়। আমি যাই বলে য়চ্ছন্দে চলে যাই। পেছনে হতভম্ব বসে থাকে সেলিম। ছোটদা সেদিনই খবর নিয়ে এলেন,তুই নাকি তাজমহলে গেসিলি? কে কইল তুমারে? কোন বেডার সাথে নাকি বইয়া আলাপ করছস? শহরে রইটা গেছে খবর। সীমা ছাড়াইয়া যাইতাছস। সীমা ছাড়িয়ে গেছি তা বুঝি। কিন্তু সীমা ছাড়ানো মেয়েটিকে একটি গণ্ডমূখর্ বলে মনে হয়। কেন সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সে! রেস্তোরাঁ থেকে হঠাৎ চলে গিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে? সে কি বোঝাতে চেয়েছে
false
MZI
এই যে টংগুলো দেখছ, তার মধ্যে প্রথম যে টংটা দেখছ, সেখানে কখনো যাবে না। কেন? এটা যে চালায়, সে হচ্ছে জামাতি। এইখানে রড-কিরিচি এগুলো লুকিয়ে রাখা হয়। যখন হল অ্যাটাক করে, তখন এখান থেকে সাপ্লাই দেওয়া হয়। ইন্টারেস্টিং! পরের টংগুলোতে যেতে পারো। সেকেন্ড টং খুব ভালো পেঁয়াজো ভাজে। থার্ড টঙের রং-চা ফার্স্ট ক্লাস। ফোর্থ টঙে গরম জিলাপি পাবে। আমরা সাধারণত এই জিলাপি খেতে যাই। তুমি জিলাপি খাও তো? হ্যাঁ, খাই। কম বয়সী লেকচারাররা দল বেঁধে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেসব ছাত্রছাত্রী সেখানে বসেছিল, তারা উঠে একটু পেছনে সরে গেল। যে মানুষটি জিলাপি ভাজছে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, এই শারমিন, স্যারদের বেঞ্চ মুছে দে। বেঞ্চগুলো মোছর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটি এক ধরনের তোষামোদ। শারমিন নামের মেয়েটি একটা ন্যাকড়া দিয়ে বেঞ্চগুলো মুছে দিল। মেয়েটির বয়স বারো কিংবা তেরো—মায়াকাড়া চেহারা, এই বয়সে মেয়েদের চেহারায় এক ধরনের লাবণ্য আসতে শুরু করে। কম বয়সী লেকচারাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, প্লেটে করে গরম জিলাপি আনা হয়। সবাই খেতে খেতে গল্প করে। হঠাৎ রানা বলে, ওই যে সমীর যাচ্ছে। ডাকো সমীরকে। একজন গলা উঁচিয়ে ডাকল, সমীর! জিলাপি খেয়ে যাও। সমীর অন্যদের সমবয়সী, উশকোখুশকো চুল এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রানা গলা নামিয়ে বলল, সমীর হচ্ছে আমাদের মধ্যে হার্ডকোর সায়েন্টিস্ট। বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। ভাইরাস আর ব্যাক্টেরিয়া ছাড়া কোনো কথা বলে না। রানার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যই কি না কে জানে, সমীর এসেই বলল, তোরা আজকের খবরের কাগজ দেখেছিস? রানা জানতে চাইল, কেন, কী হয়েছে? খুব বাজে একটা ভাইরাস ডিটেক্ট করেছে। ইনফ্যাক্ট, এটা ভাইরাস না প্রিওন, তা এখনো সিওর না। প্রিওনটা কী জিনিস? কবির বলল, থাক থাক! এখন প্রিওন-ফ্রিওনের কথা থাক। জিলাপি খা। গরম জিলাপি খেলে সব ভাইরাস শেষ হয়ে যাবে। ঠাট্টা নয়, খুব ডেঞ্জারাস। সমীর খুব গম্ভীর মুখে বলল, সরাসরি ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে। আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ। কেন, আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ কেন? কোনো রকম প্রটেকশন নেই। কোনোভাবে ইনফেক্টেড একজন আসতে পারলেই এপিডেমিক শুরু হয়ে যাবে। কবির বলল, থাক থাক, পৃথিবীর সব ভাইরাসের জন্য তোর দুশ্চিন্তা করতে হবে না, অন্যদেরও একটু দুশ্চিন্তা করতে দে। তুই জিলাপি খা। সমীর খুব দুশ্চিন্তিত মুখে জিলাপি খেতে থাকে। সবাই উঠে পড়ার সময় কবির জিলাপি তৈরি করতে থাকা মানুষটিকেজিজ্ঞেস করল, আমাদের কত হয়েছে? মানুষটা কিছু বলার আগেই শারমিন নামের মেয়েটি বলল, একেক জনের তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা। সুহানা জিজ্ঞেস করল, সব মিলিয়ে কত? চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা। আমি দিয়ে দিচ্ছি। কবির বলল, তুই কেন দিবি? আজ আমাদের নতুন কলিগ এসেছে, তার সম্মানে। রানা বলল, আর আমরা এত দিন থেকে আছি, আমাদের কোনো সম্মান নেই? সম্মান দেখানোর মতো এখনো কোনো কারণ খুঁজে পাইনি! সুহানা তার ব্যাগ থেকে এক শ টাকার একটা নোট বের করে শারমিনের হাতে দিয়ে বলল, নাও। বাকিটা তোমার। মেয়েটির মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। সবাই মিলে যখন ওরা হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে, তখন সুহানা রাফিকে বলল, শারমিন মেয়েটাকে দেখেছ? হ্যাঁ। কী হয়েছে? কত বিল হয়েছে জানতে চাইলেই সে একটা আজগুবি সংখ্যা বলে দেয়। কেন বলে, কে জানে!। রাফি অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টঙের কাছে গাছের ওপর একটা কাগজে জিলাপি, সিঙাড়া, বিস্কুট এবং চায়ের দাম লেখা আছে। সে ভেবেছিল, বিলটা দিয়ে দেবে, তাই মনে মনে হিসাব করছিল, কত হয়েছে। সবাই মিলে যা খেয়েছে, সেটা হিসাব করলে সত্যিই চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। সাতজনের মধ্যে ভাগ করলে সেটা আসলেই মাথাপিছু তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। শারমিন আজগুবি কিছু বলেনি, নিখুঁত হিসাব করেছে। রাফি তখনো জানত না, এই বাচ্চা মেয়েটির কারণে আর কিছুদিনের মধ্যেই তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটবে। নুরুল ইসলাম টেবিলে বল পয়েন্ট কলমটা অন্যমনস্কভাবে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, ঈশিতা। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা ঈশিতা বলল, বলেন। বিকেলটা ফ্রি রেখো। কেন? তোমাকে এনডেভারের অফিসে যেতে হবে। আমাকে? হ্যাঁ। কেন? নুরুল ইসলাম দেশের জনপ্রিয় একটা পত্রিকার সম্পাদক, পত্রিকা কীভাবে চালাতে হয়, সেটা খুব ভালো জানেন কি না, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারে কিন্তু ব্যবসা জানেন কি না, সেটা নিয়ে কেউ সন্দেহ করে না। টেলিফোন কোম্পানির ওপর কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হওয়ার পর থেকে কোম্পানিগুলো তার পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়। কৃতজ্ঞতাবশত, নুরুল ইসলামও তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বন্ধ রেখেছেন। এ মুহূর্তে তাঁর পত্রিকায় ব্যাংকগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হচ্ছে। তিনি ব্যাংকের জিএমদের কাছ থেকে ফোন পেতে শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে তাদের থেকেও নিয়মিত বিজ্ঞাপন আসতে থাকবে। নুরুল ইসলাম ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, এনডেভারের সিইওর একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। ঈশিতা বলল, সেটা বুঝেছি, কিন্তু আমি কেন? আরও সিনিয়র রিপোর্টাররা আছেন। তিনটা কারণ। প্রথম কারণ হচ্ছে, তুমি ভালো ইংরেজি জান। শুদ্ধ বিদেশি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলতে পার। বিদেশিদের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য এ রকম রিপোর্টার দরকার। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এনডেভার একটা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি। তাদের কী প্রশ্ন করতে হয়, সেগুলো সিনিয়র সাংবাদিকেরা জানে না, তোমরা জান। তৃতীয় কারণটা বলা যাবে না। যদি বলি, তাহলে নারীবাদী সংগঠনগুলো আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ঈশিতা হেসে ফেলল, তার মানে তিনটা কারণের মধ্যে তৃতীয় কারণটাই ইম্পরট্যান্ট! অন্যগুলো এমনি এমনি বলেছেন। তাই না?
false
robindronath
আর কাহারও উদর কমিবার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করিতেছে না। সীতারামের অন্যান্য গলগ্রহের সঙ্গে শখটিও বজায় আছে, সেটি ধারের উপর বর্ধিত হইতেছে, সুদও যে-পরিমাণে পুষ্ট হইতেছে, সেও সেই পরিমাণে পুষ্ট হইয়া উঠিতেছে। উদয়াদিত্য সীতারামের দারিদ্র৻দশা শুনিয়া তাহার ও ভাগবতের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দিলেন। সীতারাম টাকাটা পাইয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া পড়িল। মহারাজার নিকট উদয়াদিত্যের নাম করিয়া অবধি সে নিজের কাছে ও উদয়াদিত্যের কাছে নিতান্ত অপরাধী হইয়া আছে। উদয়াদিত্যের টাকা পাইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। একদিন যুবরাজের সাক্ষাৎ পাইয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া তাঁহাকে ভগবান, জগদীশ্বর, দয়াময় সম্বোধন করিয়া বিস্তর ক্ষমা চাহিল। ভাগবত লোকটা অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রকৃতির। সে শতরঞ্চ খেলে, তামাক খায় ও প্রতিবেশীদিগকে স্বর্গনরকের জমি বিলি করিয়া দেয়। সে যখন উদয়াদিত্যের টাকা পাইল, তখন মুখ বাঁকাইয়া নানা ভাবভঙ্গীতে জানাইল যে যুবরাজ তাহার যে সর্বনাশ করিয়াছেন এ টাকাতে তাহার কী প্রতিশোধ হইবে। টাকাটা লইতে সে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না। যুবরাজ কর্মচ্যুত প্রহরীদ্বয়কে মাসিক বৃত্তি দিতেছেন, এ-কথা প্রতাপাদিত্যের কানে গেল। আগে হইলে যাইত না। আগে তিনি উদয়াদিত্যকে এত অবহেলা করিতেন যে, উদয়াদিত্য সম্বন্ধে সকল কথা তাঁহার কানে যাইত না। মহারাজ জানিতেন যে, উদয়াদিত্য প্রজাদের সহিত মিশিতেন, এবং অনেক সময়ে প্রজাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাঁহার বিরুদ্ধাচারণ করিয়াছেন, কিন্তু সেগুলি প্রায় এমন সামান্য ও এমন অল্পে অল্পে তাহা তাঁহার সহিয়া আসিয়াছিল যে, বিশেষ একটা কিছু না হইলে উদয়াদিত্যের অস্তিত্ব তাঁহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারিত না। এইবার উদয়াদিত্যের প্রতি তাঁহার একটু বিশেষ মনোযোগ পড়িয়াছে, তাই উপরি-উক্ত ঘটনাটি অবিলম্বে তাঁহার কানে গেল। শুনিয়া প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন। উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া আনিলেন ও কহিলেন, “আমি যে সীতারামকে ও ভাগবতকে কর্মচ্যুত করিলাম, সে কি কেবল রাজকোষে তাহাদের বেতন দিবার উপযুক্ত অর্থ ছিল না বলিয়া? তবে যে তুমি নিজের হইতে তাহাদের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দিয়াছ?” উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “আমি দোষী। আপনি তাহাদের দণ্ড দিয়া আমাকে দণ্ডিত করিয়াছেন। আমি আপনার সেই বিচার অনুসারে মাসে মাসে তাহাদের নিকট দণ্ড দিয়া থাকি।” ইতিপূর্বে কখনোই প্রতাপাদিত্যকে উদয়াদিত্যের কথা মনোযোগ দিয়া শুনিতে হয় নাই। উদয়াদিত্যের ধীর গম্ভীর বিনীত স্বর ও তাঁহার সুসংযত কথাগুলি প্রতাপাদিত্যের নিতান্ত মন্দ লাগিল না। উদয়াদিত্যের কথায় কোনো উত্তর না দিয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আমি আদেশ করিতেছি উদয়, ভবিষ্যতে তাহাদের যেন আর অর্থসাহায্য না করা হয়।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমার প্রতি আরো গুরুতর শাস্তির আদেশ হইল।” হাত জোড় করিয়া কহিলেন, “কিন্তু এমন কী অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে এতবড়ো শাস্তি আমাকে বহন করিতে হইবে? আমি কী করিয়া দেখিব, আমার জন্য আট-নয়টি ক্ষুধিত মুখে অন্ন জুটিতেছে না, আট-নয়টি হতভাগা নিরাশ্রয় হইয়া পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতেছে, অথচ আমার পাতে অন্নের অভাব নাই? পিতা, আমার যাহা-কিছু সব আপনারই প্রসাদে। আপনি আমার পাতে আবশ্যকের অধিক অন্ন দিতেছেন, কিন্তু আপনি যদি আমার আহারের সময় আমার সম্মুখে আট-নয়টি ক্ষুধিত কাতরকে বসাইয়া রাখেন, অথচ তাহাদের মুখে অন্ন তুলিয়া দিতে বাধা দেন, তবে সে অন্ন যে আমার বিষ।” উত্তেজিত উদয়াদিত্যকে প্রতাপাদিত্য কথা কহিবার সময় কিছুমাত্র বাধা দিলেন না, সমস্ত কথা শেষ হইলে পরে আস্তে আস্তে কহিলেন, “তোমার যা বক্তব্য তাহা শুনিলাম, এক্ষণে আমার যা বক্তব্য তাহা বলি। ভাগবত ও সীতারামের বৃত্তি আমি বন্ধ করিয়া দিয়াছি, আর কেহ যদি তাহাদের বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দেয়, তবে সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারী বলিয়া গণ্য হইবে।” প্রতাপাদিত্যের মনে মনে বিশেষ একটু রোষের উদয় হইয়াছিল। সম্ভবত তিনি নিজেও তাহার কারণ বুঝিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার কারণ এই “আমি যেন ভারি একটা নিষ্ঠুরতা করিয়াছি, তাই দয়ার শরীর উদয়াদিত্য তাহার প্রতিবিধান করিতে আসিলেন। দেখি, তিনি দয়া করিয়া কী করিতে পারেন। আমি যেখানে নিষ্ঠুর সেখানে আর যে কেহ দয়ালু হইবে, এতবড়ো আস্পর্ধা কাহার প্রাণে সয়!’ উদয়াদিত্য সুরমার কাছে গিয়া সমস্ত কহিলেন। সুরমা কহিল, “সেদিন সমস্ত দিন কিছু খাইতে পায় নাই, সন্ধ্যাবেলায় সীতারামের মা সীতারামের ছোটো মেয়েটিকে লইয়া আমার কাছে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। আমি সেই সন্ধ্যাবেলায় কিছু দিই, তবে তাহার সমস্ত পরিবার খাইতে পায়। সীতারামের মেয়েটি দুধের মেয়ে, সমস্ত দিন কিছু খায় নাই, তাহার মুখপানে কি তাকানো যায়। ইহাদের কিছু কিছু না দিলে ইহারা যাইবে কোথায়?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “বিশেষত রাজবাটী হইতে যখন তাহারা তাড়িত হইয়াছে, তখন পিতার ভয়ে অন্য কেহ তাহাদের কর্ম দিতে বা সাহায্য করিতে সাহস করিবে না, এ-সময়ে আমরাও যদি বিমুখ হই তাহা হইলে তাহাদের আর সংসারে কেহই থাকিবে না। সাহায্য আমি করিবই, তাহার জন্য ভাবিয়ো না সুরমা, কিন্তু অনর্থক পিতাকে অসন্তুষ্ট করা ভালো হয় না, যাহাতে এ-কাজটা সমাধা করা যায়, তাহার উপায় করিতে হইবে।” সুরমা উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিল, “তোমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, আমি সমস্ত করিব। আমার উপরে ভার দাও।” সুরমা নিজেকে দিয়া উদয়াদিত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চায়। এই বৎসরটা উদয়াদিত্যের দুর্বৎসর পড়িয়াছে। অদৃষ্ট তাঁহাকে যে-কাজেই প্রবৃত্ত করাইতেছে, সবগুলিই তাঁহার পিতার বিরুদ্ধে; অথচ সেগুলি এমন কাজ যে, সুরমার মতো স্ত্রী প্রাণ ধরিয়া স্বামীকে সে-কাজ হইতে নিবৃত্ত করিতে পারে না। সুরমা তেমন স্ত্রী নহে। স্বামী যখন ধর্মযুদ্ধে যান, তখন সুরমা নিজের হাতে তাঁহার বর্ম বাঁধিয়া দেয়, তাহার পর ঘরে গিয়া সে কাঁদে। সুরমার প্রাণ প্রতি পদে ভয়ে আকুল হইয়াছে, অথচ উদয়াদিত্যকে সে প্রতি পদে ভরসা দিয়াছে। উদয়াদিত্য ঘোর বিপদের সময় সুরমার
false
humayun_ahmed
যা তৈরি হয় অতি অখাদ্য। নাড়ি ভূড়ি উল্টে আসে। কী আর করব, শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে। তাতো বটেই। এদিকে স্যার বিপদের উপর বিপদ… যাকে বলে মহাবিপদ। ৪ নম্বর দূরবতী বিপদ সংকেত। কী বিপদ? বলতেও লজ্জা লাগছে, না বলেও পারছি না। বলে ফেল। সত্যি কথা বলতে কী স্যার, এই বিপদে পড়েই আপনার কাছে আসা। আপনার কি স্যার মনে আছে প্ৰথম যেদিন আপনার কাছে এসেছিলাম সেদিন বলেছিলাম মহাবিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আমি একজন বিপদগ্ৰস্ত ভূত। হ্যাঁ মনে আছে। প্রতিবারই ভাবি বিপদের কথাটা আপনাকে বলব। শেষে নাসিকা লাজায় বলতে लेि भी। নাসিকালজ্জা? মানুষের লজ্জা সবটাই চোখে, এই জন্যে তারা বলে চক্ষুলজ্জা। আমাদের সবটাই নাকে। এই জন্যেই আমরা বলি নাসিকালজ্জা। এমনিতে স্যার আমরা মুখে কথা বলি। লজ্জা পেলে মুখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, তখন কথা বলি নাকে। ও আচ্ছা। এখন বলো তোমার বিপদের কথাটা শুনি। বঁড় লঁজ্জা স্যাঁর। লজ্জা দূর করে বলো–অন্য দিকে তাকিয়ে বলো তাহলে লজ্জা লাগবে না। ভূত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা শুরু করল। বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ের জন্যে খুব প্রেসাব দিচ্ছে স্যার। এদিকে আমার নিজের বিয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। আমি পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি নিয়ে থাকি। একটু দেশ ভ্রমণেরও শখ আছে। গত সপ্তাহে ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঘুরে এলাম। সেখানে কালভৈরবীর মূর্তি দেখে এসেছি। বড়ই আনন্দ পেয়েছি। বিয়ে করলে এইসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব। কেন? স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে! আপনি কি স্যার পাগল হয়েছেন? বাবা-মা যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন তাকে নিয়ে দেশ বিদেশে ঘোরার প্রশ্নই ওঠে না। কেন? তার নাম শুনেলই বুঝবেন কেন, তখন আর আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। তার নাম হলো ফা-চল্লিশ। ফা-চল্লিশ মানে? ফা-চল্লিশ মানে চল্লিশ নম্বর ফাজিল। ফাজিল নাকি? ফাজিল বলে ফাজিল। রাত দিন গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। একে ভয় দেখায়, তাকে ভয় দেখায়। সেদিন ধানমন্ডি থানার ওসিকে ভয় দেখিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে এইসব করা কি ঠিক? স্যার আপনি বলুন। পুলিশের সঙ্গে রসিকতা না করাই ভালো। এটা তো স্যার সাধারণ কথা। যে-কোনো বোকা জানে। সেও জানে, জানে না যে তা না। তবে এই যে বললাম।–ফাজিল। দেখতে কেমন? দেখতে ভালো। সর্বনাশ তো এতেই হয়েছে। মা-বাবা ভূতানির রূপ দেখে মুগ্ধ : তাদের এক কথা–বিয়ে ফা-চল্লিশের সঙ্গেই দিতে হবে। স্যার, এখন আপনিই বলুন রূপ বড় না জ্ঞান বড় ঢ় রূপ চিরস্থায়ী না জ্ঞান চিরস্থায়ী? স্যার বলুন, আপনিই বলুন? দুটা দুজিনিস। অবশ্যই। একটার সঙ্গে অন্যটার তুলনাই চলে না। আমি বাবা-মাকে বলে দিয়েছিচিরকুমাব থাকব। নো হাংকি পাংকি। বিয়ে-সংসার এইসব আমাকে দিয়ে হবে না। এইজন্যেই স্যার আপনার সাহায্য দরকার। আমি কীভাবে সাহায্য করব তাতো বুঝতে পারছি না। আপনি নিজেও তো স্যার চিরকুমার। আপনি আমাকে শলা পরামর্শ দেবেন। কীভাবে আত্মীয়স্বজনদের চাপ কাটানো দেয়া যায় সেটা বলবেন। আমি সেই মতো কাজ করব। ও আচ্ছা। শুধু ও আচ্ছা বললে হবে না স্যার। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। ফাচল্লিশ যেভাবে বিরক্ত করা শুরু করেছে–অসহ্য। ওফ। মেয়েটা তোমাকে বিরক্ত করছে? বিরক্ত মানে মহাবিরক্ত। হয়তো কোনো জ্ঞানের বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি তখন সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। হাসবে। নানান রকম ঢং করবে। এতে চিন্তার বিঘ্ন হয়। হওয়ারই কথা। মনে করুন। আমি কোনো রাস্তা দিয়ে যাব, সে করবে। কী আগে ভাগে সেই রাস্তার কোনো বাঁশ গাছে পা দুলিয়ে বসে থাকবে। পা নাচাবে। উপর থেকে গায়ে থুথু ফেলবে। আমার মনে হয় মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে। এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছেন স্যার। আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলেছে। ইচ্ছা হচ্ছে বিষ খাই। এখন আপনি ভরসা। ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করে অধমের জীবন রক্ষা করুন। দেখি কী করা যায়। তাহলে স্যার আমি আজ যাই। আপনি ঘুমান। অনেকক্ষণ ডিসটার্ব করলাম। নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন স্যার। ভূত চলে যাবার পরেও অনেক রাত পর্যন্ত আখলাক সাহেব ঘুমাতে পারলেন না। একবার মনে হয় পুরো ব্যাপারটা কল্পনা; আবার মনে হয়–না কল্পনা না, সবই সত্যি। জগৎ খুবই রহস্যময় যে জন্যে মহাকবি শেক্সপিয়র বলেছিলেন–কী যেন বলেছিলেন? মনে পড়েছে না। তিনি অনেকক্ষণ বিছানায় এপোশ ওপাশ করে শেক্সপিয়রের বাণী মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ল না। এই মনে আসছে, এই আসছে না–এমন ভাব। লাইনগুলি মনে না। আসা পর্যন্ত ঘুম আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কী করা যায়? তাঁর মনে হলো ঘোড়ার মতো চারপায়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মনে পড়বে। একটু লজ্জাও লাগছে। এত লজ্জা করলে জীবন চলে না। তিনি হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন। চারপায়ে একটু হাঁটলেনও–বিছানাটা হাঁটাহাঁটির জন্যে ছোট হয়ে গেছে। অর্ডার দিয়ে একটা বড় খাট এবং বড় মশারি কিনতে হবে। আখলাক সাহেব অল্প জায়গার ভেতরই একটু চক্কর দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে শেক্সপিয়রের বাণী মনে পড়ল– … ..বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ডে বহু কিছুই আছে যা মানবের চিন্তা ও কল্পনার অতীত… ..শেক্সপিয়র এইসব জিনিস তো আর গাজা খেয়ে লেখেন নি, জেনে শুনেই লিখেছেন। তাঁর মতো মানুষের গাজা খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই ভূতের ব্যাপারটা সত্যি হতেও পারে। চারপায়ে হাঁটার যে সব উপকারিতার কথা ভূত বলেছে তাও সত্যি… স্মৃতিশক্তি যে বাড়ে তা তো তিনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখলেন। অন্যদের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এ দেশের মানুষ সবকিছু বিশ্বাস করে,
false
MZI
টুকরাটা কী একটু দেখতে পারি। এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় একশ জন মেয়ে এবং ছয়জন ম্যাডাম আর একজন বুয়া এক সাথে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে মাথা ঘোরানো ঘোরতর বেআইনী কাজ জেনেও সব কয়টি মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিতুকে দেখার চেষ্টা করল। খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল তার মাথায় বুঝি বাজ পড়েছে, খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলর, কী? কী বললি? নিতুর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ঢাকের মতো শব্দ করছে কিন্তু সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে খুব স্বাভাবিক থাকার ভান করে শান্ত গলায় বলল, আমি কাপড়টা একটু কাছে থেকে দেখতে চাইছিলাম। খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর কথা শুনে এত অবাক হয়েছে যে রেগে উঠতেও ভুলে গেছে, আবার তোতলাতে তোতলাতে বলল, কে-কে-কেন? আমার ঘুমের কাপড়টা অনেকটা এই রকম। অনেকটা এইরকম? জি ম্যাডাম? খোরাসানী ম্যাডাম কাপড়ের টুকরাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেল—এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখটা ভয়ংকর করে বাঘের গর্জনের মতো হুংকার দিয়ে বলল, এইখানে আয়। নিতু তখন কুলকুল করে ঘামছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রেখে হেঁটে হেঁটে খোরাসানী ম্যাডামের কাছে এগিয়ে এল। খোরাসানী ম্যাডাম তার ঘুমের কাপড়ের ভেঁড়া টুকরাটা ওপরে ধরে রাখল যেন নিতুকে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। নিতু কাছে আসতেই কাক করে তার ঘাড় ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলে নিয়ে কাপড়ের টুকরাটার সামনে তাকে ধরে রাখে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিতু ছটফট করতে থাকে, যখন মনে হয় নিশ্বাস আটকে তার বুক ফেটে যাবে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে ওপর থেকে ছেড়ে দিল, সে নিচে পড়ে গিয়ে তাল সামলে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। খোরাসানী ম্যাডাম তখন তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটা নিচে নামিয়ে এনে দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় জিজ্ঞেস করল, কাপড়টা কি চিনেছিস ঘেসে সাপ? চিনে জোক? মাকড়শীর ডিম? জি ম্যাডাম। নিতু মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে সবাই শুনতে পারে সে রকম ভাবে বলল, এইটা আমার জামার কাপড়ের টুকরা। নিতর গলার স্বর শুনে সবাই এত অবাক হল যে আকাশ থেকে একটা বজ্রপাত হলেও বুঝি কেউ এত অবাক হত না। সবচেয়ে বেশি অবাক হল খোরাসানী ম্যাডাম নিজে, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ এইভাবে একটা কথা বলতে পারে খোরাসানী ম্যাডাম চিন্তাও করতে পারে না। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর জামার কাপড়ের টুকরা মাঝ রাতে ছাতিম গাছে কেমন করে গেল? জানি না ম্যাডাম। জানিস না? না, ম্যাডাম। খোরাসানী ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুই মাঝরাতে কেন ছাতিম গাছে উঠেছিলি জানিস না? না ম্যাডাম। তবে— খোরাসানী ম্যাডাম চোখ ছোট ছোট করে বলল, তবে? তবে আমার শরীরে ব্যথা এবং পায়ে খামচির দাগ দেখে মনে হয়— দেখে মনে হয়? দেখে মনে হয় আমি নিশ্চয়ই উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়েছি। আর– আর? কুকুর বিড়াল কিছুএকটা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ হাঁ করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার সামনে প্রায় একশ মেয়ে বিস্ফোরিত চোখে এই নাটক দেখতে লাগল। খোরাসানী ম্যাডামের কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে কেমন জানি বিচিত্র দেখাতে থাকে। হঠাৎ করে তার ভয়ংকর কুকুর সিংঘির কথা মনে পড়েছে, যদি দশ বার বছরের একটা মেয়ে সেই ভয়ংকর কুকুরের আক্রমণকে কুকুর বিড়াল আঁচড়ে দিয়েছে বলে ব্যাখ্যা করে তবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। নিতু মুখ শক্ত করে বলল, আমি শুনেছি আমি নাকি ঘুমের মাঝে স্লিপ ওয়াকিং করি। নিশ্চয়ই গত রাতে আমি স্লিপ ওয়াকিং করেছি। খোরাসানী ম্যাডাম খানিকক্ষণ নিতুর মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, স্লিপ ওয়াকিং করার জন্যে এখনই এই মেয়েটার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলবে নাকি ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখবে চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যা। লাইনে গিয়ে দাঁড়া। দেখি তুই কত বড় ধড়িবাজ। খালি মুণ্ডুটা ছিড়ব না কি পুরো শরীরটাকে কিমা বানিয়ে সিংঘিকে খেতে দিব একটু ভেবে দেখি। নিতু বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে লাইনে নিজের জায়গায় দাঁড়াল। এ যাত্রা সে বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু কতক্ষণের জন্যে বেঁচেছে কে জানে। টিফিনের ছুটিতে লম্বা মতন একটা মেয়ে এসে নিতুর চুল টেনে ধরল, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই ছেমড়ি। নিতু মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল, জোড়া ভুরু, কেঁকড়া চুল দুই গালে ফুস্কুরির মতো ব্রণ। নিতুর চুল টেনে মাথা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, এই ছেমড়ি, তুই গুল গপ্পা মারার জায়গা পাস না? নিতু ঝটকা মেরে নিজের মাথা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমাকে ছেমড়ি বলবে না। তাহলে কী বলব? আমার নাম নিতু। মেয়েটা তার ছোট ছোট ধারালো দাঁত বের করে হেসে বলল, নিতু বড় কঠিন নাম, বলতে গিয়ে দাও ভেঙ্গে যায়। ছেমড়ি কলা খুব সোজা। এই দ্যাখ ছে-ম-ড়ি! কতসোজা! যেন খুব মজার ব্যাপার হয়েছে সে রকম ভান করে মেয়েটা দুলে দুলে হি-হি করে হাসতে শুরু করল। নিতু কী করবে বুঝতে পারল না। সব ক্লাশে এ রকম একটা করে মেয়ে থাকে যার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ট হয়ে যায়। আগে স্কুল থেকে বাসায় গেলে এদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যেতো কিন্তু এখানে কী হবে? স্কুল থেকে যাবে হোস্টেলে সেখানে তো এই যন্ত্রণা আরো
false
shunil_gongopaddhay
করলেন, সন্তু এখানে আছে? অংশুমান চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ, আপনার ভাইপো আর আমাদের জোজো এখানেই আছে। কোনও চিন্তা নেই। কাকাবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, সন্তু, সন্তু? কোনও উত্তর এল না। ডাকবাংলোর লোকটি বলল, ছেলেদুটি তো চলে গেছে, স্যার? অংশুমান চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন, চলে গেছে? তার মানে? কোথায় চলে গেছে? লোকটি বলল, আজ সন্ধেবেলাতেই চলে গেল। ওরা বলল যে, এই জায়গাটা ভাল লাগছে না। তাই বোধহয় নারানপুরের দিকে গেল। সঙ্গে কে ছিল? সঙ্গে আর একজন লোক ছিল, নাম ঠিক জানি না। ৯৪ কাকাবাবু অংশুমান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সন্তুর কথা বলে আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছেন। এখানেও সন্তুর দেখা পাওয়া গেল না। এরপরেও কি আপনাকে আমি বিশ্বাস করব? অংশুমান চৌধুরী বললেন, এখানেই থাকার কথা ছিল। সন্ধেবেলা ওরা দুজনে কেন চলে গেল তা আমি জানি না। আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলব কেন? নারানপুর এখান থেকে বেশি দূরে নয়, কাল সকালেই খোঁজ করা যাবে। আপনি যে সত্যি কথা বলছেন তার প্রমাণ কী? প্রমাণ, মানে, তারা তো ছিলই এখানে। এই, ইয়ে, ছেলে দুটি ডাকবাংলোর খাতায় নাম-টাম লেখেনি? ডাকবাংলোর লোকটি বলল, হ্যাঁ স্যার, লিখেছে। ওদের সঙ্গের লোকটি সব চার্জ মিটিয়ে দিয়ে গেছে। অংশুমান চৌধুরী বললেন, কই, খাতাটা দেখাও এঁকে। সবাই ঢুকে এল ডাকবাংলোর মধ্যে। কাকাবাবু খাতাটা দেখলেন। সন্তু নিজের নাম লিখেছে। সুনন্দ রায়চৌধুরী। হাতের লেখাটা সন্তুরই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাকাবাবু বললেন, আপনার চালাকিটা বোঝা এমন কিছু শক্ত নয়। আপনারা সন্তুকে বলেছেন, আমি এক জায়গায় আছি। সেই শুনে সন্তু সেখানে যাচ্ছে। আবার আমাকে বলছেন, সন্তু ওমুক জায়গায় আছে। আমিও তাই শুনে সেখানে যেতে রাজি হচ্ছি। সন্তুকে এখান থেকে সরানো হল কেন আমি জানতে চাই। অংশুমান চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশাই, আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন? আপনার ভাইপো যদি নিজের ইচ্ছেয় অন্য জায়গায় চলে যায়, তা হলে আমি কী করব? কাকাবাবু এর উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, মাধব রাও হাত তুলে বললেন, আগে আমাকে একটা কথা বলতে দিন। আমি খুব টায়ার্ড। এই বাংলোতে আমার থাকার ইচ্ছে নেই। আমি আজ রাতেই জগদলপুরে চলে যাব। তার আগে আমার বন্ধু অনন্ত পট্টনায়কের পক্ষ থেকে একটা ফাইনাল কথা বলে নিতে চাই। ডাকবাংলোর লোকটির দিকে ফিরে তিনি বললেন, আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াবেন, প্লিজ। আমি এঁদের দুজনের সঙ্গে প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই। লোকটি বাইরে চলে যেতেই মাধব রাও দরজা বন্ধ করে দিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, আপনাকে কিংবা আপনার নেফিউ-কে কলকাতা থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারে আমাদের কোনও দোষ দিতে পারবেন না। এসব ব্যবস্থা করেছেন মিঃ অংশুমান চৌধুরী। সে আপনি ওঁর সঙ্গে বুঝে নেবেন। আমরা কেউ আর এর মধ্যে থাকতে চাই না। আমরা শুধু আমাদের চুরি যাওয়া মূর্তিটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। কাকাবাবু বললেন, আপনাদের মূর্তি সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। মাধব রাও বললেন, আমার কথাটা শেষ করতে দিন। এরপর থেকে আমরা আর আপনাদের কাছে থাকব না। আমি জগদলপুরে দিন-দশেক থাকব। এর মধ্যে আপনাদের একজন যদি মূর্তিটা উদ্ধার করে আনতে পারেন, তাহলে আমরা তিন লক্ষ টাকা দেব। সব খরচ-খরচা আপনাদের। আর যদি দুজনে এক সঙ্গে উদ্ধার করে আনেন, তা হলে টাকাটা দুজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। কাকাবাবু দারুণ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আমি কতবার বলব যে, আপনাদের ওই মূর্তি-টুর্তির ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই? মাধব রাও বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আমি শেষবার অনুরোধ করছি, আপনি আমার সঙ্গে ওরকম ধমক দিয়ে কথা বলবেন না। আপনি কাজ করতে চান না, তো ইউ মে গো টু হেল! আপনার যা খুশি করুন। আমাদের অফার আমি জানিয়ে দিয়েছি, এখন আমি চলে যাচ্ছি! কাকাবাবু মাধব রাও-এর হাত চেপে ধরে বললেন, না, এখন আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। এখন আপনি আমাকে নারানপুরে নিয়ে চলুন। আমি আজ রাতেই সন্তুর খোঁজ করতে চাই। মাধব রাও এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। অন্য হাতটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আমার ওপর গায়ের জোর ফলাবার চেষ্টা করবেন না। তার ফল ভাল হবে না। আপনাকে আমি নারানপুরে নিয়ে যেতে বাধ্য কেন হব? আমি কি আপনার হুকুমের চাকর? কাকাবাবু কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন মাধব রাও-এর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, না, আপনি আমার হুকুমের চাকর নন। আমি আপনার সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলেছি বলে দুঃখিত্ব। আমার মেজাজ ঠিক নেই। আমাকে আর আমার ভাইপোকে আপনারা কেন অকারণে ঝাটে জড়াচ্ছেন? অংশুমান চৌধুরী কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, কী রাজা রায়চৌধুবী, মাধব রাওকে পকেটে হাত ঢোকাতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? আপনাকে তো সবাই খুব বীরপুরুষ বলে জানে! কাকাবাবু বললেন, শ্রীকৃষ্ণ কখন শিশুপালকে বধ করেছিলেন জানেন? শিশুপালের একশোটা অপরাধ ক্ষমা করবার পর। আপনার অপরাধও কিন্তু প্রায় একশোটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অংশুমান চৌধুরী বললেন, নিজে ভয় পেয়ে উলটে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? এবার আমার গায়ে একটু হাত ছোঁয়ালে কিন্তু আপনার অন্য পাটা আস্ত রাখব না। আমি যা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। আমার যথেষ্ট টাকা আছে। আমার আর টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। ওদের ওই তিন লাখ টাকা পুরস্কারের লোভে আমি-এ কাজে নামিনি। আপনার সঙ্গে আমার একটা প্রাইভেট চ্যালেঞ্জ আছে। আপনি মূর্তিটা উদ্ধার করে আনতে পারলে ওই
false
toslima_nasrin
পৃষ্ঠাব্যাপী তসলিমার ছবি ছাপিয়ে পত্রিকাটি ব্যবসায়িক ফায়দা লুটেছে। কারণ তসলিমা নাসরিনের বিষয় নিয়ে কিছু লিখলে পত্রিকা চলে বেশি, পত্রিকার কাটতি বেশি। সম্প্রতি এই পত্রিকার নেপথ্য মালিক কুখ্যাত মাওলানা মান্নানের উস্কানিতে গঠিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি এনজিওদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিষোদগার করছে। স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকেই এনজিওরা এদেশে কাজ করে আসলেও এনজিওদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা এত চরমে ছিল না। এখন এর বিরোধিতা করার কি কারণ? এনজিওরা এখন ব্যাপক প্রাথমিক ও বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী চায় না যে, আমাদের দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক। তারা তাদের মাতব্বরি খবরদারি টিকিয়ে রাখার জন্য এ দেশের মানুষকে অশিক্ষিত রাখতে চায়। এনজিওদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী ও গ্রামীণ মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদের আঁতে ঘা লেগেছে। কারণ তাদের মহাজনি ও দাদন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব সাম্প্রদায়িক ও ফতোয়াবাজ গোষ্ঠীর ব্যাপারে সরকার একেবারে নীরব। বরং বলা যায় পঈচ্ছত সমর্থন দিয়ে চলেছে। তসলিমা নাসরিন ও জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা তারই প্রমাণ করে। তাই আজকের প্রশ্ন, স্বার্থপর ধুরন্ধর এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে দেশ কি মধ্যযুগে ফিরে যাবে? নাকি আমরা গণতন্ত্রের পথে, ব্যক্তি স্বাধীনতার পথে, মানুষের মানবিক মূল্যবোধের পথে অগ্রসর হব! আমাদের দাবি অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আরোপিত মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করা হোক। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের উপর আরোপিত মামলা প্রত্যাহার করা হোক। ফতোয়াবাজদের বেআইনি কার্যক্রম বন্ধ করা হোক। ————– মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র ————- আজকের আরেকটি খবরের কথা আমি এখনও বলিনি। খবরটি খুব বড় খবর। পত্রিকার প্রথম পাতার খবর। না বলার কারণটি সম্ভবত বেঁচে থাকার একটি আশা, যত ক্ষীণই হোক তা, আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি আমার বাঁচার আর কোনও সম্ভাবনা আর নেই। এই ফতোয়া সিলেটের ছাহাবা সৈনিক পরিষদের দেওয়া ফতোয়ার মত নয়। এ ফতোয়া অন্যরকম। এই ফতোয়া মুফতীর দেওয়া ফতোয়া। ইসলামি আইনে একমাত্র মুফতীরই অধিকার আছে ফতোয়া দেওয়ার। সম্ভবত আমার মৃত্যু না হলে কেউ এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। যে কোনও সময় যে কেউ আমার মাথাটি কেটে নেবে। আগের পঞ্চাশ হাজার, আর এখনকার এক লক্ষ, মোট দেড়লক্ষ টাকা মূল্য আমার এই মাথার। মূল্যবান মাথাটি বনবন করে ঘোরে, মূল্যবান মাথাটি বাঁচাবার কোনও বুদ্ধিই এই মাথায় নেই। তসলিমাকে হত্যার জন্য লাখ টাকা পুরুরস্কার ঘোষণা খুলুনা, ১০ই জুনুন। আজ বিকেলে স্থা্থানীয় শহীদ পার্কে আয়োজিত এক সীরাতুন্নুন্নবী সম্মেলনে লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য এক লাখ টাকা পুরুরস্কার ঘোষণা করা হয়। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম এর খুলুলনা জেলা কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা রফি আহমেদ মহল্লী। সীরাতুন্নুন্নবী সম্মেলনের অন্যতম বক্তা মুফুফতী সৈয়দ নজরুল ইসলাম তসলিমা নাসরিনকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ইসলামের দুশমন, কোরানের অপব্যাখ্যাকারী তসলিমা নাসরিনকে যে ব্যক্তি হত্যা করতে পারবে, তাকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এ সময় তিনি তাঁর ব্যাংকের হিসাব নম্বরও উল্লেখ করেন। তসলিমার হত্যাকারীকে তিনি তাঁর ঢাকার বাসার (৩১৪/২ লালবাগ) ঠিকানায় যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান। বারো জুন, রবিবার ইনকিলাবের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত তসলিমাগংদের বিরুদ্ধে জেহাদি আন্দোলনের খবরই লেখা হয়। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, মন্তব্য, কলাম প্রতিদিন যা চলছে, তা তসলিমার বিরুদ্ধে। তসলিমাসহ মুরতাদদের ফাঁসি ও ধর্মদ্রোহী পত্রিকা নিষিদ্ধ করতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ। ইসলামের ক্ষতি করার জন্য যুগে যুগে কুলাঙ্গারের আবির্ভাব ঘটেছে, বলেছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। লেখিকা তসলিমা তাঁর যা ইচ্ছা তাই লিখুন, কিন্তু লেখার স্বাধীনতার নামে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানার অধিকার তাঁর নেই। দেশজুড়ে যে জেহাদী আন্দোলন চলছে, তা তিনি সমর্থন করছেন এবং ধর্মদ্রোহীতার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারটিকেও তিনি সমর্থন করছেন। মিজান চৌধুরী যে সে লোক নন, তিনি বড় রাজনৈতিক নেতা, একসময় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, তারপর এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। এখন তিনি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ভারপ্রাপ্ত এই জন্য যে আসল চেয়ারম্যান এখন জেলে। খালেদা তাঁকে জেলে ভরে রেখেছেন। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কমে গেছে, তাই জনপ্রিয়তা অর্জন করার জন্য মিজান চৌধুরী ইসলামী দলের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। দেশ ও ঈমানবিরোধী চক্রান্ত রুখতে আজকের সংগ্রামী মিছিলে শরিক হোন। ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা গঠনের লক্ষে গঠিত সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মুফতী ফজলুল হক আমিনী আজ ১২ই জুন সকাল দশটায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে দেশবাসীকে সমবেত হয়ে দেশ ও ঈমানবিরোধী অপতৎপরতা রুখতে সংগ্রামী মিছিলে শরিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, আমরা জনতার মিছিল নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবো এবং মুরতাদ তসলিমা নাসরিনগংদের ফাঁসি, জনকণ্ঠ নিষিদ্ধকরণ এবং ধর্মদ্রোহিতার জন্য মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়নের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করব। এই নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়েই আমরা সেই সব হায়েনাচক্রের দাফন প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাবো, যারা একটি সরল, ধর্মপ্রাণ ও আত্মমর্যাদাবান জাতিকে বারবার বোকা মনে করে রক্তাক্ত করে চলেছে। এই চক্রের দুঃসাহস আজ সীমাহীন স্পর্ধার রূপ ধারণ করেছে। এরা মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবতার জিগির তুলে অব্যাহতভাবে ঈমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে সব রকম অস্ত্র প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এই হায়েনাচক্র এখন জাতির মুখোমুখি দাঁড়াতে চাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে শহর বন্দর, গ্রাম পর্যায়ের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ । এদের মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য ১২ জুনের স্মারকলিপি প্রদানের শোভাযাত্রায় শরিক হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। তসলিমার ফাঁসির দাবিতে বরিশালে স্মরণকালের বৃহত্তম
false
shunil_gongopaddhay
ঠাকুর সিং! নাও, এবার তোমার লোকদের বলল আমার ড্রাইভারকে নামিয়ে দিতে। বেচারার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। ঠাকুর সিং ফ্যালফ্যাল করে একবার কাকাবাবুর দিকে, আর-একবার নিজের লোক দুটোর দিকে তাকাল। সেই লোক দুটো একটা উঁচু টুল এনে মহিমকে নামিয়ে দিল। পায়ের বাঁধন খোলার পরও মহিম সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। বসে পড়ল মাটিতে। কাকাবাবু তলোয়ারটা ঠাকুর সিংয়ের বুক থেকে সরিয়ে আবার ঝুলিয়ে দিলেন দেওয়ালে। এবার জামার তলায় হাত দিয়ে কোমর থেকে বার করলেন রিভলভার। সেটা দেখিয়ে বললেন, আমার কাছে এটাও ছিল। এটা আমি এক পায়ে দাঁড়িয়েও ভাল চালাতে পারি। তোমাদের রাইফেলের চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি, আর আমার একটা গুলিও ফসকায় না। তুমি যখন তলোয়ার ঠেকালে আমার গলাতে, আমি এক গুলিতে তোমাকে শেষ করে দিতে পারতাম। মনে রেখো ঠাকুর সিং, তুমি যদি মানুষকে মারতে চাও, তা হলে অন্য কেউও যে-কোনওদিন তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। ঠাকুর সিং কথা বলতে পারছে না। এখনও সামলে উঠতে পারেনি। তার মতন এক বীরপুরুষ একজন খোঁড়া, মধ্যবয়স্ক বাঙালির কাছে তলোয়ার খেলায় হেরে যাবে, এটা যেন সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার অনুচরদের কাছে তার সম্মান অনেকটা কমে গেল! কপালটা ঘেমে গেছে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছল ঠাকুর সিং। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, রায়চৌধুরীসাব, তুমি আমাকে হারিয়ে দিলেও এখান থেকে বেরোতে পারবে না। আমার দশ-বারোজন লোকের হাতে বন্দুক আছে। তারা একসঙ্গে ঘিরে ধরে তোমাদের খতম করে দিতে পারে, তোমার ওই পিস্তল দিয়ে আটকাতে পারবে না। কিন্তু আমি গুণীর ইজ্জত দিতে জানি। তুমি তলোয়ারে আমাকে হারিয়েছ, আমি তার সম্মান দেব। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না, তোমরা ফিরে যাও! কাকাবাবু বললেন, যাব কী, এখনও তো আসল কথাটাই বলা হয়নি। এখন তো আর লুকোচুরির কিছু নেই। এখন সোজাসুজি কথা বলা যেতে পারে। তোমার কাছে আমি বিশেষ একটা ব্যাপার, জানতে এসেছি। কিন্তু এ-ঘরে নয়। এখানকার সব জানলা বন্ধ, বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে। চলো না, তোমার বৈঠকখানাতেই আবার বসা যাক। ঠাকুর সিং সবিস্ময়ে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্তু আর জোজো মহিমের দু হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। মহিমও হাঁ করে চেয়ে আছে কাকাবাবুর দিকে। যেন, এমন মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি। আবার এসে বসা হল সেই জমকালোভাবে সাজানো ঘরটিতে। কাকাবাবু খুব সহজভাবে বললেন, সিংজি, তখন শরবত-টরবত খাওয়ালে, কিন্তু চা খাওয়া হয়নি। এখন কি এককাপ চা পাওয়া যেতে পারে? কাকাবাবুর গলা শুনে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি। একটু আগে যে দুজনের মধ্যে তলোয়ার নিয়ে জীবন-মরণ যুদ্ধ হয়ে গেল, ঠাকুর সিং খুনটুনের হুমকি দিয়েছিল, তা যেন কিছুই না। ঠাকুর সিং হাঁক দিয়ে বলল, কই হ্যায়? চায়ে লাও। আচ্ছাসে কলকাত্তাই চা বানাও! তারপর সে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর বলুন? কাকাবাবু বললেন, তুমি সাইমন বুবুম্বা নামে কারও নাম শুনেছ? ঠাকুর সিং মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। কাকাবাবু বললেন, তুমি জানো, সাইমন বুবুম্বা বিদেশ থেকে এসেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠাকুর সিং বলল, হাঁ জানি। কেউ তাকে গুম করেছে। মুক্তিপণ চেয়েছে। এই ব্যাপারের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক আছে? হ্যাঁ, আছে। খুব সম্পর্ক আছে। তাকে তো আমারই জিম্মায় রেখেছি। এই বাড়িতেই। এবার কাকাবাবুর অবাক হওয়ার পালা। তাঁর ভুরু দুটো কপালে উঠে গেল। এত সহজে স্বীকার করে ফেলল লোকটা! দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাকাবাবু বললেন, এ বাড়িতেই আছে? গুড! তবে তো সব ঝামেলাই চুকে গেল। ঠাকুর সিং, সাইমন বুবুম্বার কোনও ক্ষতি হলে আমাদের দেশের খুব বিপদ হয়ে যাবে। তুমি তাকে আমাদের হাতে তুলে দাও, দেশ তোমার কাছে ঋণী থাকবে। ঠাকুর সিং বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ওসব দেশ-ফেশ আমি বুঝি না। তোমাদের মতন শহরের লোকেরা দেশ নিয়ে মাথা ঘামায়। এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে যাও, মাল ডেলিভারি নিয়ে যাও। এটা আমার ব্যবসা। কাকাবাবু বললেন, তুমি বলছ কী, ঠাকুর সিং! মানুষ চুরি তোমার ব্যবসা? সাইমন বুবুম্বা তোমার কাছে আছে আমরা জেনে গেলাম। এখন তো পুলিশ ডেকে এনে তাকে উদ্ধার করে নিতে পারি। ঠাকুর সিং বলল, শোনো রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি সাফ-সাফ সব কথা বলে দিচ্ছি। আমি মানুষ চুরি করি না, মুক্তিপণও আমি নিজের হাতে নিই না। সেসব কারবার অন্য লোক করে। আমি শুধু জিম্মাদার। এখন সারাদেশে যখন-তখন মানুষ গুম হয়। অসমে, বিহারে, পঞ্জাবে, অন্ধ্র প্রদেশে। সেসব অন্য-অন্য পার্টির কাজ। আমার কাছে তারা সেইসব লোকগুলোকে এনে রাখে। আমি তাদের দেখভাল করি। খাওয়াই-দাওয়াই। মুক্তিপণের একটা বখরা আমি পাই, ব্যস! পুলিশ তোমার হদিস পায়নি? বিহারের পুলিশের সাহস নেই আমার বাড়ির ধারেকাছে আসে। কিন্তু সাইমন বুবুম্বাকে যে আমার চাই। তাকে না নিয়ে আমি ফিরব না। ওসব ফিকির ছাড়ো, রায়চৌধুরী। তোমাকে আর এই বাচ্চা দুটোকে আমি ছেড়ে দেব কথা দিয়েছি, ভালয়-ভালয় ফিরে যাও। দ্বিতীয়বার যদি গণ্ডগোল করো, আমার ব্যবসার ক্ষতি করতে চাও, তা হলে কিন্তু আমি আর ছাড়ব না। কুত্তা দিয়ে তোমাদের খাওয়াব! ওরে বাবা, খুব যে ভয় দেখাচ্ছ দেখছি। আমি মিথ্যে কথা বলি না। সাইমন বুবুম্বা একটা স্পেশাল কেস। খুব বড় ব্যাপার। এর পেছনে অনেক বড় কোনও লোক আছে। অনেক টাকার খেলা। তুমি কিছুই করতে পারবে না, রায়চৌধুরী। বাইরের পুলিশ এনেও কোনও লাভ হবে না। আমার বাড়িটা দেখছ তো? পাহাড়ের ওপর। পুলিশের গাড়ি এলে
false
shottojit_roy
আজই সকলে কেনা। ভেরি গুড। মিনিটখানেক আরও আমড়াগাছির পর শট আরম্ভ হল। ক্যামেরা আর সাউন্ড চালু হল, আর পুলকবাবু বলে উঠলেন, অ্যাকশন! লালমোহনবাবু মুখে চুরুট পুরলেন ঠিকই, কিন্তু দেশলাইটা ধরাতে গিয়ে বারুদের দিকটা হাতে ধরে উলটা দিকটা ঘষতে লাগলেন দেশলাইয়ের গায়ে। খচ্‌ খচ্‌ খচ্‌ খচ্‌–দেশলাই আর জ্বলে না, এ দিকে ক্যামেরা চলেছে ঘড়ঘড় শব্দ করে। কাট, কাট। চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল। লালুদা, আপনার বোধহয়— সরি ভাই, ভেরি সরি। এবার আর ভুল হবে না। দ্বিতীয়বার অবিশ্যি চুরুট আর সিগারেট ঠিকই জ্বলল, কিন্তু চুরুটে টানটা একটু বেশি মাত্রায় হওয়ায় লালমোহনবাবুর বিষম লেগে শটুটা নষ্ট হয়ে গেল, আর পুলক ঘোষালকে আবার চেঁচিয়ে বলতে হল, কাট, কাট! তিনবারের বার আর কোনও ভুল হল না। ও কে! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল, আর সকলে লালমোহনবাবুকে তারিফ করে হাততালি দিয়ে উঠল। আশ্চর্য এই যে, আরও পাঁচ ঘণ্টা লালমোহনবাবুকে নিয়ে কাজ হল আর তার মধ্যে ভদ্রলোক একটাও ভুল করলেন না। এর মধ্যে অবিশ্যি ভদ্রলোককে দুবার বাথরুমে যেতে হয়েছিল; সেটা শীতের জন্যও হতে পারে আবার নার্ভাসনেসের জন্যও হতে পারে। মোট কথা, পুলক ঘোষাল স্যাটিসফাইড। কাল আবার সেম টাইমে লো যাবে কিন্তু, বললেন পুলকবাবু। লোক যাবার কোনও দরকার ছিল না ভাই, বললেন লালমোহনবাবু। আমি এমনিই চলে আসতে পারতাম। না না, তা কি হয়? বললেন পুলকবাবু। আমরা সকলের জন্যই লোক পাঠাই। ওটা আমাদের একটা নিয়ম। লালমোহনবাবুর মেক-আপ তুলতে লাগল দশ মিনিট, তারপর প্রোডাকশনের একটা জিপে করে আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম। নিজের ঘরে না গিয়ে আমাদের ডাবল রুমে এসে লালমোহনবাবু বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ফেলুদাকে বলে দিলাম। লালমোহনবাবুর কাজ খুব ভাল হয়েছে আর সকলে খুব তারিফ করেছে। বাঃ, তা হলে আর কী, বলল ফেলুদা, তা হলে তো বাজিমাৎ। একটা নতুন দিক খুলে গেল। এবার আর শুধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক নয়, চলচ্চিত্রাভিনেতাও বটে। লালমোহনবাবু এতক্ষণ চোখ বুজে পড়ে ছিলেন, হঠাৎ চোখ খুলে উঠে বসে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, দেখছেন, আরেকটু হলে ভুলেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে যে একটা অত্যন্ত জরুরি কথা বলার আছে। কী ব্যাপার? শুনুন মন দিয়ে। আজ দেড়টায় লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। আমি সেই ফাঁকে টুক করে একবার স্মল ওয়র্ক সািরতে গিয়েছিলাম বাথরুমে। বাড়ির দক্ষিণে আমাদের কাজ হচ্ছে; সে দিকে বাথরুম আছে, কিন্তু তার ভেতর এরা শুটিং-এর যাবতীয় মালপত্তর রেখেছে; তাই আমাকে যেতে হল উত্তর দিকে—অর্থাৎ যে দিকে মিঃ মজুমদার থাকেন। প্রোডাকশনের একজন ছোকরাই আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিল। আমি গেলুম। এটা একটা আলাদা বাথরুম, বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড় নয়। আমি কাজ সেরে হাত ধুয়ে চাখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, বাইরে এসেই কাছের কোনও একটা ঘর থেকে শুনি মিঃ মজুমদারের গলা। ভদ্রলোক কাকে যেন কড়া গলায় শাসনের সুরে বলছেন, ইউ আর এ লায়ার; তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। যদিও গলার স্বর চাপা, কিন্তু তাতে যে ঘোর বিরক্তি প্ৰকাশ পাচ্ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলায় বললেন কথাটা? ঠিক আমি যেমন বললাম। প্ৰথম অংশ ইংরিজি, বাকিটা বাংলা। তার মানে ভদ্রলোক তখনও ঘুমোননি? না; কারণ কাল যখন লাঞ্চ ব্রেক হয়, তখনও ভদ্রলোককে দক্ষিণের বারান্দায় দেখেছি। উনি শুটিং দেখতে এসেছিলেন। সকালে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি দেড়টায় বড়িটা খান, তার পর ঘুমোন। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন দেড়টা বেজে মিনিট সাতেক হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের কথার উত্তরে অন্য লোকটি কিছু বললেন না? বলে থাকলেও সেটা এত চাপা গলায় যে, আমি শুনতে পাইনি। আমার আবার তখন তাড়া—লাঞ্চ রেডি—তাই আর অপেক্ষা না করে চলে এলাম। কিন্তু মিঃ মজুমদারই যে কথাটা বলেছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তার মানে হয় রজত বোস, না হয় নিজের ছেলে সমীরণ মজুমদারকে বলেছেন কথাটা। লালমোহনবাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে বললেন, তবে একটা কথা কিন্তু বলতেই হবে মশাই। এই সব বোম্বাই-অভিনেতাদের বিষয়ে যত কিছু শোনা যায়, আসলে তত কিছু নয়। এটা কেন বলছেন? লাঞ্চের পর রায়নার সঙ্গে একটা শট ছিল, সেটা ছেকরার ভুলের জন্য পাঁচবার করে নিতে হল। সামান্য ডায়ালগ, তবু বার বার ভুল করছে। ও রকম হয়েই থাকে, বলল ফেলুদা, সেরা অভিনেতারও হঠাৎ হঠাৎ নাৰ্ভ ফেল করতে পারে। সব শেষে জটায়ু বললেন, যেটুকু নার্ভাসনেস ছিল, আজ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। আর কোনও ভাবনা নেই। বজ্ৰপাতটা হল পরের দিন, তবে আসল ঘটনাটা সরাসরি না বলে আগে দিনটা কীভাবে গেল বলি। দিনটা মেঘলা, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা রয়েছে আড়ালে। আমি ফেলুদার সঙ্গে সকলে বেরিয়ে একটু কেনাকাটা সেরে, বার্চ হিল রোড দিয়ে খানিকদূর বেড়িয়ে এগারোটা নাগাত রওনা দিলাম নয়নপুর ভিলায়। গতকাল রাত্রেও ফেলুদা লালমোহনবাবুকে তালিম দিয়েছে। এবারে সাড়ে তিনের জায়গায় সবসুদ্ধ পাঁচ লাইন ডায়ালগ। আজ আর চুরুট-সিগারেট ধরানোর ব্যাপার নেই, তাই সেদিক থেকে বাঁচোয়া। লালমোহনবাবুর সাতটা শট ছিল। সাড়ে নটায় কাজ আরম্ভ হয়েছে। আড়াইটেয় লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। লাঞ্চের আগে চারটে, পরে তিনটে শট হয়ে সাড়ে চারটের সময় লালমোহনবাবু ফ্রি হয়ে গেলেন। পুলক ঘোষাল বলল, জিপের ব্যবস্থা আছে লালুদা, আপনি এনি টাইম যেতে চাইলে যেতে পারেন। লালমোহনবাবু বললেন, আজি যখন তাড়াতাড়ি শেষ হল, তখন ভাবছি হেঁটেই বাড়ি ফিরব; গাড়ির দরকার নেই। জাস্ট অ্যাজ ইউ লাইক, বলল পুলক ঘোষাল। পুলক ঘোষাল চলে গেলে পর লালমোহনবাবু বললেন, এদের চা-টা বেশ ভাল; এক্ষুনি চা দেবে,
false
shordindu
বিক্রয় হইতেছে, বিক্ৰেত্রী রক্তাধরা চঞ্চলাক্ষী যুবতী। ক্রেতার অপ্রতুল নাই, রূপশিখাকৃষ্ট নাগরিকগণ চারিদিকে ভিড় করিয়া আছে; চপল পরিহাস, সরস ইঙ্গিত, লোল কটাক্ষের বিনিময় চলিতেছে। যে পসারিণী যত সুন্দরী ও রসিকা, তাহার পণ্য তত অধিক বিক্রয় হইতেছে। বিপণির ফাঁকে ফাঁকে মদিরাগৃহ। পিপাসু নাগরিকগণ সেখানে গিয়া নিজ নিজ রুচি অনুসারে গৌড়ী মাধ্বী পান করিতেছে। আসবে যাহাদের রুচি নাই তাহারা কপিখ সুবাসিত তক্র বা ফলারস সেবন করিয়া শরীর শীতল করিতেছে। মদিরাগৃহের অভ্যন্তরে বহু কক্ষ; কক্ষগুলি সুসজ্জিত, তাহাতে আস্তরণের উপর বসিয়া ধনী বণিকপুত্রগণ দ্যূতক্রীড়া করিতেছে। কোনও কক্ষে মৃদঙ্গ সপ্তস্বরা সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা হইতেছে। মদিরাগৃহের কিঙ্করীগণ চষক ও ভৃঙ্গার হস্তে সকলকে আসব যোগাইতেছে। নগর-নারীদের গৃহদ্বারে পুষ্পমালা দুলিতেছে; অভ্যন্তর হইতে মৃদু রক্তাভ আলোক রশ্মি ও যন্ত্রের স্বপ্নমদির নিক্কণ পথচারীকে উন্মন করিয়া তুলিতেছে। পথে সুশান্বেষী নাগরিকের মন্থর যাতায়াত, কুসুমের মদমোহিত গন্ধ, প্রসাধন ও ভূষণাদির বৈচিত্র্য, কচিৎ কৌতুক-বিগলিতা নারীর কণ্ঠ হইতে বিচ্ছুরিত হাস্য, কচিৎ কলহের কর্কশ রূঢ়স্বর—এই সব মিলিয়া এক অপূর্ব সম্মোহন সৃষ্টি করিয়াছে। বিলাস বিহ্বলতার আবর্ত হইতে দূরে নগরের আর একটি কেন্দ্র রাজপুরী। পূর্বেই বলিয়াছি—নগর সর্বত্র সমভূমি নয়, কোথাও উচ্চ কোথাও নীচ। যে ভূমির উপর রাজপুরী অবস্থিত তাহা নগরীর মধ্যে সর্বোচ্চ, নগরীতে প্রবেশ করিয়া চক্ষু তুলিলেই সর্বাগ্রে রাজপুরীর ভীমকান্তি আয়তন চোখে পড়ে, মনে হয় কপোতকূট দুর্গের মধ্যস্থলে আর একটি দুর্গ সগর্বে মাথা তুলিয়া আছে। প্রথমে প্রাকার বেষ্টন; স্কুল চতুষ্কোণ প্রস্তরে নির্মিত—প্রস্থে দ্বাদশ হস্ত, দৈর্ঘ্যে প্রায় অর্ধ ক্রোশ-বলয়ের ন্যায় চক্রাকারে পুরভূমিকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। প্রাকারের অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ আছে; কিন্তু সে কথা পরে হইবে। নগরীর প্রধান পথ যেখানে আসিয়া প্রাকার স্পর্শ করিয়াছে সেইখানে উচ্চ তোরণদ্বার। ইহাই রাজপুরী হইতে আগম নিগমের একমাত্র পথ। শলাকা কণ্টকিত লৌহের বিশাল কবাট; দুই পাশে স্থল বর্তুল তোরণ-স্তম্ভ; তোরণ-স্তম্ভের অভ্যন্তরে প্রতীহার-গৃহ। শূলহস্ত প্রতীহার দিবারাত্র তোরণ পাহারা দিতেছে। তোরণ অতিক্রম করিয়া সম্মুখেই সভাগৃহ। তাহার পশ্চাতে মন্ত্রগৃহ। অতঃপর দক্ষিণে বামে বহু ভবন—কোষাগার আয়ুধগৃহ যন্ত্রভবন-কাছাকাছি হইলেও প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র দণ্ডায়মান। মধ্যস্থলে রাজ-অবরোধের মর্মরনির্মিত ত্রি-ভূমক প্রাসাদ—সাত কৌটার মধ্যস্থিত মৌক্তিক, সাত শত রাক্ষসীর বিনিদ্র সতর্কতা যেন নিরন্তর তাহাকে ঘিরিয়া আছে। দ্বারে দ্বারে যবনী প্রতিহারীর পাহারা। এই ত্রি-ভূমক প্রাসাদের উন্মুক্ত ছাদে পুষ্পকীর্ণ কোমল পক্ষ্মল আস্তরণের উপর অর্ধশয়ান হইয়া রাজকুমারী রট্টা যশোধরা প্রিয়সখী সুগোপার সহিত কথা কহিতেছিলেন। কথা এমন কিছু নয়, আকাশের দিকে চাহিয়া অলসকণ্ঠে দুএকটি তুচ্ছ উক্তি, তারপর নীরবতা, আবার দুএকটি তুচ্ছ কথা। এমনিভাবে আলাপ চলিতেছিল। যেখানে মনের মধ্যে বিচ্ছেদ নাই, সেখানে অবিচ্ছেদ কথা বলার প্রয়োজন হয় না। প্রপাপালিকা সুগোপার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে। কুমারী রট্টা যশোধরাকেও তিনি দেখিয়াছেন, হয়তো চিনিতে পারেন নাই। যে কিশোর কার্তিকেয় বিদ্যুতের মত সুগোপার জলসত্রে দেখা দিয়াছিলেন, যাঁহার অশ্ব চুরি করিয়া চিত্ৰক পলায়ন করিয়াছিল, তিনি আর কেহ নহেন, মৃগয়াবেশধারিণী রাজনন্দিনী রট্টা। হূণদুহিতা পুরুষবেশে মৃগয়া করিতে ভালবাসিতেন। কবি কালিদাস বলিয়াছেন, বল্কল পরিধান করিলে সুন্দরী তন্বীকে অধিক সুন্দর দেখায়। হয়তো দেখায়, আমরা কখনও পরীক্ষা করিয়া দেখি নাই। কিন্তু যোদ্ধৃবেশ ধারণ করিলে রূপসীর রূপ বর্ধিত হয় একথা স্বীকার করিতে পারিব না। ভাল দেখাইতে পারে, কিন্তু অধিক সুন্দর দেখায় না। আমরা বলিব, কুমারী রট্টার মত যিনি তন্বী ও সুন্দরী, যাঁহার বয়স আঠার বৎসর—তিনি অলকগুচ্ছ কুকলি দ্বারা অনুবিদ্ধ করুন, লোভ্ররেণু দিয়া মুখের পাণ্ডুশ্রী আনয়ন করুন, চূড়াপাশে নব কুরুবক ধারণ করুন, কর্ণে শিরীষ পুষ্পের অবতংস দুলাইয়া দিন, হৃৎস্পন্দনের তালে যূথীকঞ্চুক নৃত্য করিতে থাকুক, নীবিবন্ধে কর্ণিকার কাঞ্চী মূৰ্ছিত হইয়া থাক—লোভী পুরুষ তো দূরের কথা, অনসূয়া সখীরাও ফিরিয়া ফিরিয়া সে রূপ দেখিবে। তেমনই, পুষ্পভরণভূষিতা রট্টার পানে সখী সুগোপাও থাকিয়া থাকিয়া বিমুগ্ধ নেত্রে চাহিতেছিল। দুই সখীর মধ্যে গভীর ভালবাসা। রাজকন্যাও যখন সুগোপার পানে তাঁহার অলস নেত্র ফিরাইতেছিলেন, তখন তাঁহার হিমকরস্নিগ্ধ দৃষ্টি অকারণেই সখীকে প্রীতির রসে অভিষিক্ত করিয়া দিতেছিল। দুইজনে আশৈশব খেলার সাথী; যৌবনে এই প্রীতি আরও গাঢ় হইয়াছিল। সুগোপার স্বামী সংসার সবই ছিল, কিন্তু তাহার জীবন আবর্তিত হইত রট্টাকে কেন্দ্র করিয়া। আর, বিশাল রাজ-অবরোধের মধ্যে একাকিনী কুমারী রট্টা—তিনিও এই বাল্যসখীকে একান্ত আপনার জানিয়া বুকে টানিয়া লইয়াছিলেন। তবু, রাজকন্যার সহিত প্রপাপালিকার ভালবাসা বিস্ময়কর মনে হইতে পারে। কিন্তু এতই কি বিস্ময়কর? রাজায় রাজায় কি প্রণয় হয়? রাজকুমারীর সহিত রাজকুমারীর প্রণয় হয়? হয়তো হয়, কিন্তু তাহা বড় দুর্লভ। যেখানে অবস্থার তারতম্য আছে সেইখানেই প্রকৃত ভালবাসা জন্মে। নিঝরের জল পর্বত শিখর হইতে গভীর খাদে ঝাঁপাইয়া পড়ে, উচ্চাভিলাষী ধূম নিম্ন হইতে ঊর্ধ্বে আকাশে উত্থিত হয়। ইহাই স্বাভাবিক। তাহা ছাড়া রট্টার ধমনীতে হূণ রক্ত আভিজাত্যের প্রভেদ স্বীকার করিত না। হূণ বর্বর হোক, সে আভিজাত্যের উপাসক নয়, শক্তির উপাসক। রট্টা একমুঠি মল্লিকা ফুল আস্তরণ হইতে তুলিয়া লইয়া আঘ্রাণ গ্রহণ করিলেন, তারপর চাঁদের দিকে চাহিয়া বলিলেন—মধুঋতু তো শেষ হইতে চলিল; এবার ফুলও ফুরাইবে। সুগোপা, তখন তুই কি করিবি? রট্টার বাম কর্ণ হইতে শিরীষ পুষ্পের ঝুমকা খুলিয়া গিয়াছিল, সুগোপা উঠিয়া সযত্নে সেটি পরাইয়া দিল। মুকুরের মত ললাট হইতে দুএকটি চূর্ণ কুন্তল সরাইয়া দিয়া বলিল—ফুল যখন ফুরাইবে, তখন চন্দন দিয়া তোমাকে সাজাইব। চুলে স্নিগ্ধ স্নানকষায় মাখিয়া কপূর সুবাসিত জলে ধারাযন্ত্রে তুমি স্নান করিবে, আমি তোমার মুখে চন্দনের তিলক, বুকে চন্দনের পত্রলেখা আঁকিয়া দিব; সিক্ত উশীরের পাখা দিয়া তোমাকে ব্যজন করিব। সখি, তবু কি তোমার দেহের তাপ জুড়াইবে না? সুগোপর মুখে একটু চাপা হাসি। হাসির গৃঢ় ইঙ্গিত রট্টা
false
shottojit_roy
অন্ধকার দেখলাম। বিষের প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে আমার চরম বিপদ। পাগলের মতো সারা ঘরময় ওষুধ খুঁজে বেড়াচ্ছি, যদিও জানি যে, ওটা ব্যাগে ছাড়া আর কোথাও থাকতে পারে না। শেষটায় অসহায় বোধে এনরিকোর ঘরে ফোন করলাম, কিন্তু সেও ঘরে নেই। বেশ বুঝতে পারছি এবার শরীর সত্যি করেই অবসন্ন হয়ে আসছে। হয়তো বিষের মাত্রা আজ থেকে বাড়িয়ে দিয়েছে রান্ডি, যাতে অল্পদিনের মধ্যে সে ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলতে পারে। অবশেষে শয্যা নিতে বাধ্য হলাম। সমস্ত গায়ে ব্যথা করছে, হাত-পা অবশ, মাথা বিম বিষম। এই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আবার এনরিকোকে ফোন করলাম। সে এখনও ঘরে ফেরেনি। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, পাটিলছে। তাই আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টি যেন একটু ঘোলাটে। মৃত্যু কি এর মধ্যেই ঘনিয়ে এল? টেবিলের ওপর ট্র্যাভেলিং ক্লাকটার দিকে চাইলাম। ন’টা। তার মানে তো এখন হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছিলাম। টাইম মেশিনে। দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকে রন্ডি তার শাসনি শুরু করল। এ-সব কথা আমি কালই শুনেছি, আজি আরেকবার শুনতে হল। কোনও কোনও ভাইরাস ইনফেকশনে এখন লোক মরছে, কারণ তার সঠিক ওষুধ ডাক্তারেরা এখনও জানে না। তুমিও তাতেই মরবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তারপর লুইজি রন্ডি টাইম মেশিনের একচ্ছত্র সম্রাট। টাকার আমার অভাব নেই, কিন্তু টাকার নেশা বড়— খট খট খট!— রন্ডি চমকে উঠল। সে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। খট খট খট!— রন্ডি নড়ছে না তার জায়গা থেকে। তার মুখ ফ্যাকাশে, দৃষ্টি বিস্ফারিত। আমি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে গিয়ে রান্ডিকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দরজাটা খুলে নিস্তেজ ভাবে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম। ঘরে ঢুকে এল সশস্ত্র পুলিশ। ক্রোল ও এনরিকো সত্যিই আমার বন্ধুর কাজ করেছে। সেদিন টাইম মেশিনের সাহায্যে যখন ক্লাইবারের ঘরে যাই, তখন দেখেছিলাম ক্লাইবারের লাইটার দিয়ে রন্ডি নিজের সিগারেট ধরাচ্ছে। হয়তো সে ভেবেছিল যে, লাইটারটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কিন্তু তাড়াহুড়োতে সেটা তার মনে পড়েনি। আর আমি নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখেও খেয়াল করিনি। খেয়াল হওয়ামাত্র ক্রোলকে সেটা জানিয়ে দিয়ে বলি যে লাইটারে খুনির আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে, এবং সে ছাপ রন্ডির পাইপের ছাপের সঙ্গে মিলে যাবে। শেষপর্যন্ত তাই হল। আর আমার মিরাকিউরল পাওয়া গেল রন্ডির ঘরে, এবং সেটা খেয়ে শরীর সম্পূর্ণ সারিয়ে নিতে লাগল চার ঘণ্টা। আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৯২ প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল আজ আমার জীবনে একটা স্মরণীয় দিন! সুইডিস অ্যাকাডেমি অফ সায়ান্স আজ আমাকে ডক্টর উপাধি দান করে আমার গত পাঁচ বছরের পরিশ্রম সার্থক করল। এক ফলের বীজের সঙ্গে আর এক ফলের বীজ মিশিয়ে এমন আশ্চর্য সুন্দর, সুগন্ধ, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর নতুন ফল যে তৈরি হতে পারে, এটা আমার এই রিসার্চের আগে কেউ জানত না। গতবছর সুইডেনের বৈজ্ঞানিক সভেন্ডসেন আমার গিরিডির ল্যাবরেটরিতে এসে আমার ফলের নমুনা দেখে এবং চোখ একেবারে থ। দেশে ফিরে গিয়ে কাগজে লেখালেখির ফলে আমার এই আবিষ্কারের কথা বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে! আমার আজকের এই সম্মানের জন্য সভেন্ডসেন অনেকখানি দায়ী! তাই এখন ডায়রি লিখতে বসে তাঁর প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠছে! সুইডেনে আগে আসিনি। এসে ভালই লাগছে। সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেশ। এটা মে মাস—তাই চব্বিশ ঘণ্টাই সূর্য দেখছি। কিন্তু সে সূর্য কেমন ঘোলাটে, নিস্তেজ। সবসময়ই মনে হয় সন্ধ্যা হয়ে আছে। শীতকালে যখন রাত ফুরোতে চায় না। তখন না জানি লোকের মনের অবস্থা কেমন হয়। শুনেছি। ছ। মাস রাত্রের পর প্রথম সূর্যের আলো দেখে এখানের লোক নাকি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আত্মহত্যা করে। আমরা যারা বিষুবরেখার কাছাকাছি থাকি, তারা বোধ হয় ভালই আছি। বেশি উত্তরে ঠাণ্ডা দেশে যারা থাকে তাদের হিংসে করার কোনও কারণ নেই। এখানের কাজ সেরে নরওয়েতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। এর অবিশ্যি একটা কারণ আছে! বছর চারেক আগে যখন ইংলন্ডে যাই তখন বিখ্যাত প্ৰাণীতত্ত্ববিদ প্রোফেসর আর্চিবল্ড অ্যাকরয়েডের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ আলাপ হয়। সাসেক্সে তাঁর কটেজে একটা উইক এন্ডও কাটিয়ে এসেছিলাম। অ্যাকরয়েডও তখন নরওয়ে যাব যাব করছেন, কারণ সেখানে নাকি লেমিং বলে ইঁদুর জাতীয় এক অদ্ভুত জানোয়ার বাস করে—সেইটে তিনি স্টাডি করবেন। লেমিং এক আশ্চর্য প্রাণী। বছরের কোনও একটা সময় এরা কাতারে কাতারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে যাত্রা করে। পথে শেয়াল, নেকড়ে, ঈগল পাখি ইত্যাদির আক্রমণ অগ্রাহ্য করে খেতের ফসল নিঃশেষ করে, সব শেষে সমুদ্রে পৌঁছে সেই সমুদ্রের জলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে! দুঃখের বিষয় অ্যাকরয়েডের স্টাডি বোধ হয়। অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল, কারণ গিরিডি থাকতেই কাগজে পড়েছিলাম, নরওয়ে ভ্রমণের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। অ্যাকরয়েডের পক্ষে যেটা সম্ভব হয়নি, আমার দ্বারা সেটা হয় কি না দেখব বলেই নরওয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। রাত্রে ডিনারের পর হোটেলে ফেরার কিছু পরে আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল, তখনও আমার মাথায় লেমিং-এর চিন্তাই ঘুরছিল। দরজা খুলে দেখি একটি মাঝবয়সি লম্বা ভদ্রলোক, মাথায় সোনালি চুল, চোখে সোনার চশমা, আর সেই চশমার পুরু কাচের পিছনে এক জোড়া তীক্ষ্ণ নীল চোখ। ভদ্রলোক ঠোঁট ফাঁক করে অল্প হেসে যখন তাঁর পরিচয় দিলেন তখন লক্ষ করলাম তাঁর একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। তাঁর কথায় জানলাম তাঁর বাস নরওয়ের সুলিটেলমা শহরে। নাম গ্রেগর লিন্ডকুইস্ট। লোকটি নাকি শিল্পী,
false
shirshendu
লজ্জা পেয়ে সরে এল ঘরে। সমীরের সশ্রদ্ধ ভাব দেখে সে বুঝতে পারছিল, তার শ্বশুরের পলিটিক্যাল এজেন্ট লামা দার্জিলিং-এর কেওকেটা লোক। তার চেহারাতেও যথেষ্ট বুদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। তবে খুব হাসছিল লোকটা। লজ্জা ঢাকতে রেমি তার সুটকেস খুলে দুহাজার টাকা বের করে দিয়ে বলল, আমার শ্বশুরমশাই টাকাটা আপনাকে দিতে বলেছেন। লামা টাকাটা বুকপকেটে রেখে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, খুব ভয় পাচ্ছেন তো। আর-একটা ঢিল এসে শার্শি ভাঙতেই কাচের টুকরো ছিটকে পড়ল চারদিকে। তবে ঘরখানা বড় এবং উত্তরের জানালায় ভারী পরদা টানা দেওয়া থাকায় তাদের গায়ে এসে পড়ল না। রেমিকে কিছু বলতে হল না, পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে লামা নিজেই মাথা নাড়ল। মৃদুস্বরে বলল, সিচুয়েশন ইজ গ্রেভ অ্যান্ড স্যাড। লোকে এটার মধ্যে পলিটিক্যাল মোটিভেশন পেয়ে যাবে অ্যান্ড দেয়ার উইল বি স্ক্যান্ডাল। এনিওয়ে, আমি দেখছি। আপনারা আজ একটু বেশি রাতে কিংবা কাল খুব ভোরে দার্জিলিং কুইট করলে ভাল হয়। লামা চলে গেল এবং ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ভোজবাজিতে থেমে গেল বাইরের হাঙ্গামা। শুকনো মুখে সমীর বলল, ম্যাডাম কী করবেন? আমি চলে যাব। কিন্তু ধ্রুববাবু যেতে চাইছেন না। আমি একটু আগেই লাউঞ্জে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি। ও না গেলে যাবে না, আমার কিছু করার নেই। আমি যাব। একা? আপনি আমাকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত নিয়ে চলুন। কাল আমি প্লেন ধরে কলকাতা ফিরে যাব। কাজটা কি ঠিক হবে? অত চিন্তা করতে পারব না। আমি যাব। আপনি গাড়ি রেডি রাখবেন। গাড়ি রেডিই আছে। তবে শিলিগুড়ি থেকে কাকা আসছেন। তার জন্য একটু ওয়েট করা ভাল। রেমি জেদি মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বলল, আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই। একটু রিস্ক নিচ্ছেন বউদি। নিলে নিচ্ছি। অবশ্য যদি আপনার কোনও অসুবিধে না থাকে– সমীর একটু হেসে বলল, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সারভিস। আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। আমি ধ্রুববাবুকে একটু জানিয়ে আসি। নইলে হয়তো ভাববেন তার বউকে নিয়ে পালিয়ে গেছি। রেমি স্পষ্ট করে সমীরের দিকে চেয়ে বলল, আমি কিন্তু সত্যিই পালাচ্ছি। আপনি ওকে জানালে জানাতে পারেন, কিন্তু আমি আর ওর সঙ্গে থাকছি না। বলেন কী? আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। কলকাতায় ফিরেই ডিভোর্সের দরখাস্ত করব। সমীরের চোখেমুখে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠল। আমতা-আমতা করে বলল, এটা তো একটা মেজর ডিসিশন। এত তাড়াতাড়ি নিলেন? ডিসিশনটা তাড়াতাড়ি নিলে জীবনটা আবার নতুন করে তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারব। আমাদের সম্পর্কটা কেমন তা তো আপনাকে বলেছিও। বলেছেন ঠিকই। কিন্তু আমি ভাবছিলাম ধ্রুববাবুর এসব ব্যাপার বোধহয় খুব ডিপ সেট নয়। খানিকটা অভিনয়ও থাকতে পারে। তার মানে?— প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রেমি। উনি হয়তো সকলকে বিপন্ন করে তুলে এক ধরনের আনন্দ পান। যাক গে, আপনি নিশ্চয়ই সেটা আমার চেয়ে ভাল বোঝেন। মার কাছে মাসির গল্প করে লাভ কী? কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল রেমির। কিন্তু সে তো জানে, তা নয়। রেমি ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলল, অভিনয়-টয় নয়। আমি জানি। কখন বেরোকেন? রাত দশটার মধ্যে দার্জিলিং ঘুমিয়ে পড়ে। দশটায় স্টার্ট দিলে আমি আপনাকে সাড়ে বারোটায় শিলিগুড়ি পৌঁছে দিতে পারব। বাড়ির লোক আমাকে অত রাতে দেখে কিছু বলবে না? বলতে পারে। তবে আমি একটা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে দেবোখন। তা হলে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না। সমীর চলে গেলে রেমি নিশ্চিন্ত হয়ে একটা শ্বাস ফেলল। প্ল্যানটা ঠিকমতোই এগোচ্ছিল। রেমি বাক্স গুছিয়ে নিয়েছে। অনিচ্ছের সঙ্গেও ঘরে খাবার আনিয়ে খানিকটা খেয়েছে। গরম পোশাক পরে অপেক্ষা করেছে সমীরের জন্য। আর তার পালানোর পথ বিপ্নহীন করতে ধ্রুব গিয়ে ঢুকেছে বার এ। রাত নটার মধ্যে তার চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। তাকে একবার বলেছিল সমীর, বউদি শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছেন ধ্রুববাবু। আপনিও যাবেন তো? ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে এই তুচ্ছ প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়েছে। রাত দশটার কয়েক মিনিট আগে বেয়ারা এসে রেমির মালপত্র নিয়ে গাড়িতে তুলল। রেমি নেমে এল নীচে। যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল। হোটেলের সামনের বাগানের গাছপালার আড়াল থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে এল লামা। গায়ে ওভারকোট, মুখে মার্কামারা হাসি। তবে হাসিটা তখন আর স্বতঃস্ফূর্ত নয়। রেমিকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? ভীষণ চমকে উঠেছিল রেমি। শীত বাতাসের একটা চাবুক যেন তাকে কাপিয়ে দিয়ে গেল। কষ্টে বলল, আমি চলে যাচ্ছি। ধ্রুববাবু কোথায়? ও যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না? রেমি নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভ্রুকুটি করে বলল, সেটা তো ও জানবে, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? সমীর সামনের সিটে উঠতে গিয়েও লামাকে দেখে স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে ফিরে লামা হাসিমুখে বলল, কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। উনি চান ধ্রুববাবুকে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। আপনি রেমি দেবীকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? লামাকে দেখে সমীর যে ভয় পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সে কাঁধটা উঁচু করে বলল, ধ্রুববাবুর পারমিশন নিয়েই উনি যাচ্ছেন। আমি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি। লামা একটু ক্ষুব্ধ গলায় বলল, কাজটা ঠিক হল কি? ধ্রুববাবু এখন সেনসে নেই, এ সময়ে ওঁর স্ত্রী চলে যাচ্ছেন। আমার কিছু করার ছিল না মিস্টার লামা। লামা রেমির দিকে ফিরে বলল, আপনি যেতে চাইছেন, কিন্তু এভাবে যেতে পারবেন না। হাঙ্গামা থেমেছে বটে কিন্তু রাস্তা এখনও পরিষ্কার নয়। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে। লামা গেট-এর দিকে হাঁটতে লাগল। সমীর নিচু স্বরে রেমিকে বলল, কিছু করার নেই। চলুন
false
nazrul
সব লইল পাছ, প্যাঁচা গিয়া উঠল গাছ। প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং। প্যাঁচা কয়, বাপ বারিত যাও, পাস লইছে সব হাপের ছাও ইঁদুর জবাই কইর‍্যা খায়, বোচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়। ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ে। বেচারা সবুর তাড়াতাড়ি তার কুঠরিতে ঢুকে দোর লাগিয়ে দেয়। বাইরে থেকে বেড়ার ফাঁকে মুখ রেখে রুস্তম গায় – প্যাঁচা, একবার খ্যাচখ্যাচাও গর্ত থাইক্যা ফুচকি দাও। মুচকি হাইস্যা কও কথা প্যাঁচারে মোর খাও মাথা! সবুর কথা কয় না। নীরবে বই নিয়ে পড়তে বসে। যেন কিছুই হয়নি। রুস্তমি দলও নাছোড়বান্দা। আবার গায় – মেকুরের ছাও মক্কা যায়, প্যাঁচায় পড়ে, দেইখ্যা আয়। হঠাৎ আলি নসিব মিয়াঁকে দেখে ছেলের দল পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। আলি নসিব মিয়াঁ রসিক লোক। তিনি ছেলেদের হাত থেকে সবুরকে বাঁচালেও না হেসে থাকতে পারলেন না। হাসতে হাসতে বাড়ি ঢুকে দেখেন তাঁর একমাত্র সন্তান নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কাছে নালিশ করছে – কেন পাড়ার ছেলেরা রোজ রোজ সবুরকে অমন করে জ্বালিয়ে মারবে? তাদের কেউ তো সবুরকে খেতে দেয় না! তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রুস্তমিদল গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল – প্যাঁচা মিয়াঁ কেতাব পড়ে হাঁড়ি নড়ে দাড়ি নড়ে! নূরজাহান রাগে তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার যত রাগ পড়ল গিয়ে তার বাবার উপরে। তার বাবা তো ইচ্ছা করলেই ওদের ধমকে দিতে পারেন। বেচারা সবুর গরিব, স্কুলে পড়ে না, মাদ্রাসায় পড়ে – এই তো তার অপরাধ। মাদ্রাসায় না পড়ে সে যদি খানায় পড়ত ডোবায় পড়ত – তাতেই বা কার কী ক্ষতি হত। কেন ওরা আদা-জল খেয়ে ওর পিছনে এমন করে লাগবে? আলি নসিব মিয়াঁ সব বুঝলেন। কিন্তু বুঝেও তিনি কিছুতেই হাসি চাপতে পারলেন না। হেসে ফেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কি হইছেরে বেডি? ছেমরাডা প্যাঁচার লাহান বাড়িতে বইয়্যা রইব, একডা কতা কইব না, তাইনাসেন উয়ারে প্যাঁচা কয়।’ নূরজাহান রেগে উত্তর দিল, ‘আপনি আর কইবেন না, আব্বা, হে বেডায় ঘরে বইয়া কাঁদে আর আপনি হাসেন! আমি পোলা অইলে এইদুন একচটকনা দিতাম রুস্তম্যারে আর উই ইবলিশা পোলাপানেরে, যে, ওই হ্যানে পাইর‍্যা যাইত উৎকা মাইর‍্যা। উইঠ্যা আর দানাপানি খাইবার অইত না!’ বলেই কেঁদে ফেললে। আলি নসিব মিয়াঁ মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘চুপ দে বেডি, এইবারে ইবলিশের পোলারা আইলে দাবার পইর‍্যা লইয়া যাইব! মুনশি বেডারে কইয়্যা দিবাম, হে ওই রুস্তম্যারে ধইরা তার কান দুডা এক্কেরে মুতা কইর‍্যা কাইট্যা হালাইবো!’ নূরজাহান অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, ‘আব্বাজান, চা খাইবেন নি?’ আলি নসিব মিয়াঁ হেসে ফেলে বললেন, ‘বেডির বুঝি য়্যাহন চায়ের কথা মনে পল।’ নূরজাহান আলি নসিব মিয়াঁর একমাত্র সন্তান বলে অতিমাত্রায় আদুরে মেয়ে। বয়স পনেরো পেরিয়ে গেছে। অথচ বিয়ে দেবার নাম নেই বাপ-মায়ের। কথা উঠলে বলেন, মনের মতো জামাই না পেলে বিয়ে দেওয়া যায় কী করে! মেয়েকে তো হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া যায় না! আসল কথা তা নয়। নূরজাহানের বাপ-মা ভাবতেই পারেন না, ওঁদের ঘরের আলো নূরজাহান অন্য ঘরে চলে গেলে তাঁরা এই আঁধার পুরীতে থাকবেন কী করে! নইলে এত ঐশ্বর্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণীর বরের অভাব হয় না। সন্বন্ধও যে আসে না, এমন নয় ; কিন্তু আলি নসিব মিয়াঁ এমন উদাসীনভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেন যে, তারা আর বেশি দূর না এগিয়ে সরে পড়ে। নূরজাহান বাড়িতে থেকে সামান্য লেখাপড়া শিখেছে। এখন সবুরের কাছে উর্দু পড়ে। শরিফ ঘরের এত বড়ো মেয়েকে অনাত্মীয় যুবকের কাছে পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাছেই আসতে দেয় না বাপ মা ; কিন্তু এদিক দিয়ে সবুরের এতই সুনাম ছিল যে, সে নূরজাহানকে পড়ায় জেনেও কোনো লোক এতটুকু কথা উত্থাপন করেনি। সবুর যতক্ষণ নূরজাহানকে পড়ায় ততক্ষণ একভাবে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকে, একটিবারও নূরজাহানের মুখের দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়ি ঢোকে মাথা নিচু করে, বেরিয়ে যায় মাথা নিচু করে! নূরজাহান, তার বাবা মা সকলে প্রথম প্রথম হাসত – এখন সয়ে গেছে! সত্যসত্যই, এই তিন বছর সবুর এই বাড়িতে আছে, এর মধ্যে সে একদিনের জন্যও নূরজাহানের হাত আর পা ছাড়া মুখ দেখেনি। এ নূরজাহান জাহানের জ্যোতি না হলেও বীররামপুরের জ্যোতি – জোহরা সেতারা, এ সম্বন্ধে কারও মতদ্বৈধ নাই। নূরজাহানের নিজেরও যথেষ্ট গর্ব আছে, মনে মনে তার রূপের সম্বন্ধে। আগে হত না – এখন কিন্তু নূরজাহানের সে অহংকারে আঘাত লাগে – দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তার রূপের কি তা হলে কোনো আকর্ষণই নেই? আজ তিন বছর সে সবুরের কাছে পড়ছে – এত কাছে তবু সে একদিন মুখ তুলে তাকে দেখল না? সবুর তাকে ভালোবাসুক – এমন কথা সে ভাবতেই পারে না, – কিন্তু ভালো না বাসলেও যার রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে – যাকে একটু দেখতে পেলে অন্য যে কোনো যুবক জন্মের জন্য ধন্য হয়ে যায় – তাকে একটিবার একটুক্ষণের জন্যেও চেয়েও দেখল না! তার সতীত্ব কি নারীর সতীত্বের চেয়েও ঠুনকো? ভাবতে ভাবতে সবুরের উপর তার আক্রোশ বেড়ে ওঠে, মন বিষিয়ে যায়, ভাবে আর তার কাছে পড়বে না! কিন্তু যখন দেখে – নির্দোষ নির্বিরোধ নিরীহ সবুরের উপর রুস্তমি দল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারে না। আহা, বেচারার হয়ে কথা কইবার যে
false
humayun_ahmed
রেফ চমকে উঠল। বিছানার উপর অপরিচিত একটা মেয়ে বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে হাসছে। রেফ পরপর দুবার। কে বলে তৃতীয়বার বলার আগে থমকে গেল। মেয়েটা অপরিচিত কেই না, অষ্টম ধারা রোবট-কন্যা শেফ। শেফ শান্তগলায় বলল, চমকে উঠলে কেন? চিনতে পারছিলাম না। চিনতে পারবে না কেন? আমি তো আগের মতোই আছি। শুধু চুলটা অন্যরকম করে আঁচড়েছি। চুল অন্যরকম করে আঁচড়ানোয় আমাকে ভাল দেখাচ্ছে না? রেফ্‌ জবাব দিল না। কোন মানবী এই ধরনের কথা বললে জবাব দেবার ব্যাপারটা আসত। রোবটের এই প্রশ্নের জবাব দেয়া অর্থহীন। তাছাড়া চুল অন্য রকম করে আঁচড়ানোয় শেফকে মোটেই ভাল লাগছে না। বরং আগের চেয়ে খারাপ লাগছে। ঘুম কেমন হয়েছে? ভাল। তুমি যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলে আমি তোমার পাশেই ছিলাম। তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাল। ঘুমের মধ্যে তুমি শেফাকে ডাকছিলে। রেফ্‌ বিরক্ত গলায় বলল, এটা তো নতুন কিছু না। এটা আমার পুরনো রোগ। তুমি এই রোগের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এ রকম ভাব করছ যেন তুমি প্রথম ব্যাপারটা দেখলে। শেফ বলল, আজ প্রথম লক্ষ করলাম তুমি খুব আবেগ নিয়ে শেফাকে ডাকলে। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কেন ভাল লেগেছে সেটাও বলি। আমার ধারণা শেফার সঙ্গে আমার কোন যোগসূত্র আছে। শেফাকে যদি তোমার ভাল লাগে তাহলে আমাকেও ভাল লাগবে। কিছু মনে কোরো না। তোমাকে ভাল লাগছে না। এমরান টি যেমন রোবট পছন্দ করেন না। আমিও করি না। শেফ বলল, আমার খুবই মন খারাপ লাগছে। তোমাকে কাটা কাটা কিছু কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। তা বলব না, কারণ তোমার সঙ্গে আর হয়ত আমার দেখা হবে না। রেফ্‌ হাই তুলল, তার ঘুম এখনো পুরোপুরি কাটে নি। দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমুব। শেফ বলল, তোমার সঙ্গে কেন দেখা হবে না, এটা জিজ্ঞেস কর? রেফ্‌ বলল, কেন দেখা হবে না, আমি আন্দাজ করতে পারছি। তোমাকে এমরান টি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তুমি বড় ধরনের অপরাধ করেছ। তার বিচার হবে। তোমার কপোট্রন নষ্ট করা হবে। এটা জেনেও তোমার খারাপ লাগছে না? মৃত্যুর মতো ভয়াবহ একটা ব্যাপার ঘটছে তাতেও তোমার কোন কিছুই যাচ্ছে-আসছে না? রেফ্‌ বিরক্ত গলায় বলল, তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটছে তাকে মৃত্যু বলা যায় না। মৃত্যু পুরোপুরি জৈবিক ব্যাপার। মেশিনের যেমন জন্ম বলে আলাদা কিছু নেই, তেমনই মৃত্যু বলেও কিছু নেই। শেফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের জন্ম-মৃত্যু না থাকলে কি আর করা যাবে। মাঝে মাঝে মনে হয় জন্ম-মৃত্যু থাকাটা খারাপ না। কেন এ ধরনের কথা মনে হয় বলব? রে বলল, না। তুমি এখন দয়া করে চলে যাবে। যন্ত্রের সঙ্গে কথা চালাচালি করতে ভাল লাগছে না। আমি ঘুমুব। এমরান টি আমার সঙ্গে যে-সব কথাবার্তা বলবেন তা কি তুমি শুনতে চাও? শুনতে চাইলে গোপনে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। শুনতে চাই না। আঁড়ি পেতে কথা শোনা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তাহলে বিদায়? আচ্ছা বিদায়। শুভ রাত্রি। হ্যাঁ শুভ রাত্রি। চলে যাচ্ছি কিন্তু। যাও। তুমি চাইলে তোমার মাথায় ইলিবিলি কেটে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। আমি চাচ্ছি না। রেফ্‌ লক্ষ করল শেফ চলে যাচ্ছে কিন্তু বারবারই পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। যেন চলে যেতে তার ভয়ংকর খারাপ লাগছে। তার চোখে পানিও দেখা গেল। নতুন ধারার এইসব রোবট মানুষের এত কাছাকাছি যে মাঝেমধ্যেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। মনে হয় এরা বোধহয় রোবট না, মানুষ। এমরান টির সামনে শেফ বসে আছে। শেফের বাঁদিকে রেলা। এমরান টিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি প্রশ্নপর্ব শুরু করবেন। তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুরু কুঁচকে আছে। রেলা বলল, স্যার আমি কি চলে যাব? এমরান টি বললেন, না তুমি থাকবে। আমি শেফকে কিছু প্রশ্ন করব, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। তুমি নবম ধারার রোবট, তোমার বুদ্ধি নিশ্চয়ই শেফ এর চেয়ে বেশি। রেলা ক্ষীণ স্বরে বলল, বুদ্ধির ব্যাপারটাই স্যার বিতর্কিত। বুদ্ধির নানান ধারা আছে। এখন পর্যন্ত একশ উনিশটি মূলধারা বের করা হয়েছে… চুপ। আমাকে জ্ঞান দেবে না। আমি কোন কম্পিউটারের কাছ থেকে জ্ঞান ধার করব না। শেফ বলল, বই পড়ে যদি আপনি জ্ঞান নিতে পারেন, কম্পিউটারের কাছ থেকে নিতে সমস্যা কোথায়? এমরান টি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমরা তো মনে হচ্ছে মহাজ্ঞানী। তোমরাই বল সমস্যা কোথায়? রেলা বলল, স্যার কোন বিচিত্র কারণে আপনি একধরনের হীনমন্যতায় ভুগছেন। আপনার ভয় বুদ্ধির খেলায় আপনি কম্পিউটারের কাছে হেরে যাবেন। হয়ত এই কারণেই আপনি কম্পিউটার পছন্দ করেন না। এমরান টি বললেন, যান্ত্রিক বুদ্ধি এবং মানসিক বুদ্ধির তফাতটার পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি একটি বাক্য বলব। তোমরা দুজনই বাক্যটি নিয়ে চিন্তা করে বাক্যটি সম্পর্কে আমার মতামত দেবে। বাক্যটা হচ্ছে– আমি এখন যা বললাম মিথ্যা বললাম। শেফের ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। সে হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর হয়ে গেল। রেলার মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। এমরান টি বললেন, শেফ এই বাক্যটি সম্পর্কে তোমার মতামত বল। শেফ বলল, স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। এই হাস্যকর বাক্যটি দিয়ে প্রথম যুগের রোবটদের বিভ্রান্ত করা হত। প্রথম যুগের রোবট সাধারণ মানের কপোট্রন ব্রেইন ব্যবহার করত। সেই ব্রেইন ধরতে পারত না যে এই বাক্যটি নিম্নস্তরের বুদ্ধির মানুষদের একটা সাধারণ খেলা। খেলাটা কি
false
humayun_ahmed
নিশ্চয়ই আছে। এই মেয়ে এখন এই সাপখোপের মধ্যে এক-একা হাঁটবে। অসহ্য, অসহ্য! কিন্তু করার কিছুই নেই। তাঁর মনে হল, মেয়েটি মরে গেলে তিনি মুক্তি পান। জন্মের পরপর তিন্নির জন্ডিস হয়েছিল। গা হলুদ হয়ে মরমর অবস্থা। মেয়েকে ঢাকা পিজিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। বহু কষ্টে তাকে সারিয়ে তোলা হয়েছে। সেই সময় কিছু-একটা হয়ে গেলে, আজ এই ভয়াবহ কষ্ট সহ্য করতে হত না। তিনি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর পায়চারি করলেন। এক বার ভাবলেন বাগানে যাবেন। কিন্তু সেই চিন্তা দীর্ঘস্থায়ী হল না। কী হবে বাগানে গিয়ে? তিনি কি পারবেন। এই মেয়েকে ফেরাতে? পারবেন না। সেই ক্ষমতাই তাঁর নেই! হয়তো কারোরই নেই। পীর-ফকির ধরলে কেমন হয়? তিনি নিজে এইসব বিশ্বাস করেন না। সারা জীবন তিনি ভেবেছেন, অস্বাভাবিক কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু এখন দেখছেন, তাঁর ধারণা সত্যি নয়। অস্বাভাবিক ক্ষমতা মানুষের থাকতে পারে। তিন্নিরই আছে। কাজেই পীর-ফকিরের কাছে বা সাধুসন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া যেতে পারে। স্যার। কে? তিনি দেখলেন, চায়ের পেয়ালা হাতে নিজাম দাঁড়িয়ে আছে। তিনি চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন। নিজাম বলল, ঐ লোকটা আসছে। কোন লোক? আগে যে ছিলেন! ও, মিসির আলি? জ্বি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। বরকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, দেখা করার কোনো দরকার নেই। আমি এখন ঘর থেকে বেরুব না। ভদ্রলোককে তাঁর ঘর দেখিয়ে দাও! খাবার দাবারের ব্যবস্থা করি। আর তিনি যদি তিন্নির সঙ্গে দেখা করতে চান, তাহলে তিন্নিকে খবর দাও! তিনি বাগানে গিয়েছে। নিজাম চলে গেল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টি হবে বোধহয়। বাতাস ভারি হয়ে আছে। চারদিকে অসহ্য গুমট। মিসির আলি এসেছেন সন্ধ্যাবেলায়, এখন রাত এগারটা। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার শেষ করেছেন। প্রায় চার ঘন্টার মতো হল, তিনি এ বাড়িতে আছেন। নিজাম এর মধ্যে দু বার জিজ্ঞেস করেছে, সে তিন্নিকে খবর দেবে কি না। তিনি বলেছেন, খবর দেবার দরকার নেই। কারণ তিনি নিশ্চয়ই জানে যে তিনি এসেছেন। আলাদা করে বলার কোনোই প্রয়োজন নেই। তিন্নি আছে কোথায়? বাগানে। এই রাতের বেলায় বাগানে কী করছে! জানি না। স্যার। কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যার পর বাগানে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত থাকে। তাই নাকি? জ্বি স্যার। এত রাত পর্যন্ত বাগানে সে কী করে? বাড়ির পিছনের দিকে একটা বড়ই গাছ আছে। সেই বড়ই গাছের কাছে একটা গর্ত, ঐখানে চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকে। ও, আচ্ছা! মিসির আলির মুখ দেখে মনে হল, তিনি এই খবরে তেমন অবাক হন নি। বেশ সহজভাবে বললেন, তুমি বারান্দায় আমাকে একটা চেয়ার দাও। বারান্দায় বসে আকাশের শোভা দেখি। আর শোন, ভালো করে এক কাপ চা দিও! আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হবে বোধহয়। মিসির আলি বরাদ্দায় এসে বসবার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। মিসির আলি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন তিনি বেরিয়ে আসবে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এ-রকম একটি ঝড়-জলের রাতে বাচ্চা একটি মেয়ে এক-একা বাগানে। কত রকম অদ্ভুত সমস্যা আমাদের চারদিকে। মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে। কেরোসিনের বাহারি ল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে। নিজাম একটি ল্যাম্প বাইরে নিয়ে আসতেই হাওয়া লেগে সেটি দপ করে নিতে গেল। ঠিক তখন মিসির আলি দেখলেন, তিনি বের হয়ে আসছে। ধ্ৰুপসে গিয়েছে মেয়েটি। তিনিই তাঁকে দেখেছে। সে এগিয়ে এল মিসির আলির দিকে। আপনি কখন এসেছেন? অনেকক্ষণ হল। তুমি বুঝতে পার নি? ন। এখন দেখলাম! মিসির আলি বেশ অবাক। মেয়েটি বুঝতে পারল না কেন? টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কি নষ্ট হয়ে গেছে? নিজাম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মিসির আলি বললেন, তিনি, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এস, আমরা গল্প করি। ঝড়বৃষ্টির রাতে গল্প করতে বেশ ভালো লাগে। আর নিজাম, তুমি আমাদের দু জনের জন্যে চা নিয়ে এস। তিন্নি, তুমি চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে? না। নিজাম ফিসফিস করে বলল, আপা আজ সারাদিন কিছু খায় নাই। মিসির আলি বললেন, তাহলে কিছু খাবারও নিয়ে এস। হালকা কোনো খাবার। না, আমি কিছুই খাব না, খিদে নেই। ঠিক আছে, না খেলে। এস, গল্প করি। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস। তোমার সমস্ত পা কাদায় মাখামাখি। তিনি চলে গেল। নিজাম এক পট চা এনে রাখল। সামনে। মিসির আলি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কিন্তু মেয়েটি সে রাতে আর তাঁর কাছে এল না। খুব ঝড় হল সারা রাত! শো-শোঁ করে হাওয়া বইতে থাকল। মিসির আলি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারলেন না। তাঁর বারবার মনে হতে লাগল, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি যোগাযোগ করবে তাঁর সঙ্গে। দুজন দু জায়গায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবেন। কিন্তু তা হল না। সূর্য এখনো ওঠে নি। মিসির আলি দ্রুত পা ফেলছেন। ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী মনে হচ্ছে এখনো ঘুমিয়ে। দিনের কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় নি। কাল রাতের বৃষ্টির জন্যেই বুঝি চারদিক ঝিলমিল করছে। মিসির আলি গত রাতটা প্রায় অম্বুমেই কাটিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যে খারাপ লাগছে না। শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই, তিনি খুঁজছেন। চা-ওয়ালাকে। পাওনা টাকাটা দিয়ে দেবেন।। গল্পগুজব করবেন। তাঁর মনে একটা আশঙ্কা ছিল, হয়তো এই চাওয়ালা বুড়োর আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। বাকি জীবন মনের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঘটনা কাঁটার মত বিধে থাকবে। আশঙ্কা সত্যি হল না। বুড়োকে পাওয়া গেল। কেতলিতে চায়ের পানি ফুটে উঠেছে। কেতলির নল
false
bongkim
মৃন্ময় প্রদীপ, তাহাতে তৈলাভাব; শয্যোপরিস্থ জীবনপ্রদীপেও তাহাই। আর শয্যাপার্শ্বেও আর এক প্রদীপ ছিল,-এক অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতির্ময়রূপিণী বালিকা। তৈলহীন প্রদীপের জ্যোতি: অপ্রখর বলিয়াই হউক, অথবা গৃহবাসী দুই জন আশু ভাবী বিরহের চিন্তায় প্রগাঢ়তর বিমনা থাকার কারণেই হউক, নগেন্দ্রের প্রবেশকালে কেহই তাঁহাকে দেখিল না। তখন নগেন্দ্র দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া সেই প্রাচীনের মুখনির্গত চরমকালিক দু:খের কথা সকল শুনিতে লাগিলেন। এই দুই জন, প্রাচীন এবং বালিকা, এই বহুলোকপূর্ণ লোকালয়ে নি:সহায়। এক দিন ইহাদিগের সম্পদ ছিল, লোক-জন, দাস-দাসী, সহায়-সৌষ্ঠব সব ছিল। কিন্তু চঞ্চলা কমলার কৃপার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সকলই গিয়াছিল। সদ্য:সমাগত দারিদ্র্যের পীড়নে পুত্রকন্যার মুখমণ্ডল, হিমনিষিক্ত পদ্মবৎ দিন দিন ম্লান দেখিয়া, অগ্রেই গৃহিণী নদী-সৈকতশয্যায় শয়ন করিলেন। আর সকল তারাগুলিও সেই চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে নিবিল। এক বংশধর পুত্র, মাতার চক্ষের মণি, পিতার বার্ধক্যের ভরসা, সেও পিতৃসমক্ষে চিতারোহণ করিল। কেহ রহিল না, কেবল প্রাচীন আর এই লোকমনোমোহিনী বালিকা, সেই বিজনবনবেষ্টিত ভগ্ন গৃহে বাস করিতে লাগিল। পরস্পরে পরস্পরে একমাত্র উপায়। কুন্দনন্দিনী বিবাহের বয়স অতিক্রম করিয়াছিল, কিন্তু কুন্দ পিতার অন্ধের যষ্টি, এই সংসারবন্ধনের এখন একমাত্র গ্রন্থি; বৃদ্ধ প্রাণ ধরিয়া তাহাকে পরহস্তে সমর্পণ করিতে পারিলেন না। “আর কিছু দিন যাক্,-কুন্দকে বিলাইয়া দিয়া কোথায় থাকিব? কি লইয়া থাকিব?” বিবাহের কথা মনে হইলে, বৃদ্ধ এইরূপ ভাবিতেন। এ কথা তাঁহার মনে হইত না যে, যে দিন তাঁহার ডাক পড়িবে, সে দিন কুন্দকে কোথায় রাখিয়া যাইবেন। আজি অকস্মাৎ যমদূত আসিয়া শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইল। তিনি ত চলিলেন। কুন্দনন্দিনী কালি কোথায় দাঁড়াইবে? এই গভীর অনিবার্য যন্ত্রণা মুমূর্ষুর প্রতি নিশ্বাসে ব্যক্ত হইতেছিল। অবিরল মুদ্রিতোন্মুখনেত্রে বারিধারা পড়িতেছিল। আর শিরোদেশে প্রস্তরময়ী মূর্তির ন্যায় সেই ত্রয়োদশবর্ষীয়া বালিকা স্থিরদৃষ্টে মৃত্যুমেঘাচ্ছন্ন পিতৃমুখপ্রতি চাহিয়াছিল। আপনা ভুলিয়া, কালি কোথা যাইবে তাহা ভুলিয়া, কেবল গমনোন্মুখের মুখপ্রতি চাহিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধের বাক্যস্ফূর্তি অস্পষ্টতর হইতে লাগিল। নিশ্বাস কণ্ঠাগত হইল, চক্ষু নিস্তেজ হইল; ব্যথিতপ্রাণ ব্যথা হইতে নিষ্কৃতি পাইল। সেই নিভৃত কক্ষে, স্তিমিত প্রদীপে, কুন্দনন্দিনী একাকিনী পিতার মৃতদেহ ক্রোড়ে লইয়া বসিয়া রহিলেন। নিশা ঘনান্ধকারাবৃতা; বাহিরে এখনও বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি পড়িতেছিল, বৃক্ষপত্রে তাহার শব্দ হইতেছিল, বায়ু রহিয়া রহিয়া গর্জন করিতেছিল, ভগ্ন গৃহের কবাট সকল শব্দিত হইতেছিল। গৃহমধ্যে নির্বাণোন্মুখ চঞ্চল ক্ষীণ প্রদীপালোক, ক্ষণে ক্ষণে শবমুখে পড়িয়া আবার ক্ষণে ক্ষণে অন্ধকারবৎ হইতেছিল। সে প্রদীপে অনেকক্ষণ তৈলসেক হয় নাই। এই সময়ে দুই চারি বার উজ্জ্বলতর হইয়া প্রদীপ নিবিয়া গেল। তখন নগেন্দ্র নি:শব্দপদসঞ্চারে গৃহদ্বার হইতে অপসৃত হইলেন। তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ছায়া পূর্বগামিনী নিশীথ সময়। ভগ্ন গৃহমধ্যে কুন্দনন্দিনী ও তাহার পিতার শব। কুন্দ ডাকিল, “বাবা |” কেহ উত্তর দিল না। কুন্দ একবার মনে করিল, পিতা ঘুমাইলেন, আবার মনে করিল, বুঝি মৃত্যু–কুন্দ সে কথা স্পষ্ট মুখে আনিতে পারিল না। শেষে, কুন্দ আর ডাকিতেও পারিল না, ভাবিতেও পারিল না। অন্ধকারে ব্যজনহস্তে যেখানে তাহার পিতা জীবিতাবস্থায় শয়ান ছিলেন, এক্ষণে যেখানে তাঁহার শব পড়িয়াছিল, সেইখানেই বায়ুসঞ্চালন করিতে লাগিল। নিদ্রাই শেষে স্থির করিল, কেন না, মরিলে কুন্দের দশা কি হইবে? দিবারাত্রি জাগরণে এবং এক্ষণকার ক্লেশে বালিকার তন্দ্রা আসিল। কুন্দনন্দিনী রাত্রি দিবা জাগিয়া পিতৃসেবা করিয়াছিল। নিদ্রাকর্ষণ হইলে কুন্দনন্দিনী তালবৃন্তহস্তে সেই অনাবৃত কঠিন শীতল হর্ম্যতলে আপন মৃণালনিন্দিত বাহূপরি মস্তক রক্ষা করিয়া নিদ্রা গেল। তখন কুন্দনন্দিনী স্বপ্ন দেখিল। দেখিল, যেন রাত্রি অতি পরিষ্কার জ্যোৎস্নাময়ী। আকাশ উজ্জ্বল নীল, সেই প্রভাময় নীল আকাশমণ্ডলে যেন বৃহচ্চন্দ্রমণ্ডলের বিকাশ হইয়াছে। এত বড় চন্দ্রমণ্ডল কুন্দ কখন দেখে নাই। তাহার দীপ্তিও অতিশয় ভাস্বর, অথচ নয়নস্নিগ্ধকর। কিন্তু সেই রমণীয় প্রকাণ্ড চন্দ্রমণ্ডলমধ্যে চন্দ্র নাই; তৎপরিবর্তে কুন্দ মণ্ডলমধ্যবর্তিনী এক অপূর্ব জ্যোতির্ময়ী দৈবী মূর্তি দেখিল। সেই জ্যোতির্ময়ী মূর্তিসনাথ চন্দ্রমণ্ডল যেন উচ্চ গগন পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে নীচে নামিতেছিল। ক্রমে সেই চন্দ্রমণ্ডল, সহস্র শীতলরশ্মি স্ফুরিত করিয়া, কুন্দনন্দিনী কুণ্ডলাদি মস্তকের উপর আসিল। তখন কুন্দ দেখিল যে, সেই মণ্ডলমধ্যশোভিনী, আলোকময়ী, কিরীট-ভূষণালঙ্কৃতা মূর্তি স্ত্রীলোকের আকৃতিবিশিষ্টা। রমণীয় কারুণ্যপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল ; স্নেহপরিপূর্ণ হাস্য অধরে স্ফুরিত হইতেছে। তখন কুন্দ সভয়ে সানন্দে চিনিল যে, সেই করুণাময়ী তাহার বহুকাল-মৃতা প্রসূতির অবয়ব ধারণ করিয়াছে। আলোকময়ী সস্নেহাননে কুন্দকে ভূতল হইতে উত্থিতা করিয়া ক্রোড়ে লইলেন। এবং মাতৃহীনা কুন্দ বহুকাল পরে ‘মা’ কথা মুখে আনিয়া যেন চরিতার্থ হইল। পরে জ্যোতির্মণ্ডলমধ্যস্থা কুন্দের মুখচুম্বন করিয়া বলিলেন, “বাছা! তুই বিস্তর দু:খ পাইয়াছিস। আমি জানিতেছি যে, বিস্তর দু:খ পাইবি। তোর এই বালিকা বয়:, এই কুসুমকোমল শরীর, তোর শরীরে সে দু:খ সহিবে না। অতএব তুই আর এখানে থাকিস না। পৃথিবী ত্যাগ করিয়া আমার সঙ্গে আয় |” কুন্দ যেন ইহাতে উত্তর করিল যে, “কোথায় যাইব?” তখন কুন্দের জননী ঊর্ধ্বে অঙ্গুলিনির্দেশ দ্বারা উজ্জ্বল প্রজ্বলিত নক্ষত্রলোক দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “ঐ দেশ।” কুন্দ তখন যেন বহুদূরবর্তী বেলাবিহীন অনন্তসাগরপারস্থবৎ, অপরিজ্ঞাত নক্ষত্রলোক দৃষ্টি করিয়া কহিল, “আমি অত দূর যাইতে পারিব না; আমার বল নাই।” তখন ইহা শুনিয়া জননীর কারুণ্য-প্রফুল্ল অথচ গম্ভীর মুখমণ্ডলে ঈষৎ অনাহ্লাদজনিতবৎ ভ্রকুটি বিকাশ হইল, এবং তিনি মৃদুগম্ভীর স্বরে কহিলেন, “বাছা, যাহা তোমার ইচ্ছা তাহা কর। কিন্তু আমার সঙ্গে আসিলে ভাল করিতে। ইহার পর তুমি ঐ নক্ষত্রালোকপ্রতি চাহিয়া তথায় আসিবার জন্য কাতর হইবে। আমি আর একবার তোমাকে দেখা দিব। যখন তুমি মন:পীড়ায় ধূল্যলুণ্ঠিতা হইয়া, আমাকে মনে করিয়া, আমার কাছে আসিবার জন্য কাঁদিবে, তখন আমি আবার দেখা দিব, তখন আমার সঙ্গে আসিও। এখন তুমি আমার অঙ্গুলিসঙ্কেতনীতনয়নে আকাশপ্রান্তে চাহিয়া দেখ। আমি তোমাকে দুইটি মনুষ্যমূর্তি দেখাইতেছি। এই দুই মনুষ্যই
false
shunil_gongopaddhay
ওপর থেকে আবার একটা পেল্লায় পাথর এসে পড়ল গোল নৌকোর ওপরে। আর-একটা জগগুর মাথায়। এর মধ্যে নৌকোটাও উলটে গেছে, কস্তুরী আর জগ্‌গু পড়ে গেছে জলে। কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার হল কিছু বুঝতে পারছি না। কেউ কোনও শব্দ করিস না। চুপচাপ শুয়ে থাক। দেখা যাক, এরপর কে আসে। এবার শোনা গেল একটা উঁচু গলায় গান! একজন কেউ গাইছে, হোয়েং গেল! হোয়েং গেল! খানিকদূরে টিবির ওপর থেকে গড়িয়ে নেমে এল রঞ্জন আর রিঙ্কু! কস্তুরী সাঁতার জানে না। সে জলে হাবুড়ুবু খাচ্ছে। রিঙ্কু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে তুলল তাকে। রঞ্জন বলল, ও ব্যাটাকে তুলো না, ও একটু নাকানিচোবানি খাক। সন্তু রঞ্জনদা বলে চিৎকার করে ছুটে গেল ওদের দিকে! কাকাবাবু হেসে বললেন, রঞ্জনটা একটা খেলা দেখাল বটে। আমি তো শেষ মুহূর্তে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলুম।, চল, জোজো। কস্তুরী মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে আর বলছে, আমার হিরে! জলে ড়ুবে গেল! আমার হিরে! কী সর্বনাশ হল। কেন আমাকে জল থেকে তুললে! সব গেল। সব গেল! জোজো হতাশভাবে বলল, কাকাবাবু, হিরেটা জলে ড়ুবে গেল! এত কাণ্ডের পরও হিরেটা রাখা গেল না! কাকাবাবু হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, এই নদীতে বেশি জল নেই। জেলে এনে জাল ফেলে দেখতে হবে। পাওয়া যাবে মনে হয়! পেতেই হবে! রঞ্জন রিঙ্কুকে জিজ্ঞেস করল, এ-মেয়েটা এত কাঁদছে কেন? মোটে একখানা হিরে গেছে, তাতে কী হয়েছে? সন্তু বলল, ও রঞ্জনদা! তুমি তো হিরেটার কথা কিছুই জানো না। এটা বিজয়নগরের হিরে, ওয়ার্লড ফেমাস, এটার জন্য আমরা কত কষ্ট করেছি… রঞ্জন সন্তুর কাঁধ চাপড়ে বলল, আরে, রাখ তো হিরের কথা। হিরে মানে তো কয়লা! একটুকরো কয়লাও যা, একটা হিরেও তা। তারপর সে কাকাবাবুকে দেখে আনন্দে দুহাত তুলে বিশাল শরীর নিয়ে নেচে-নেচে গাইতে লাগল। হোয়েং গেল! সবং কিছুং ঠিকঠাকং হয়েং গেল! কাকাবাবু, কেমং আছেন? কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আর একটু কাজ বাকি আছে। চলল, আগে ওপারে যাওয়া যাক। আমি আর কস্তুরী আগে খেয়া নৌকোয় যাব। তোমরা জগ্গুর ওপরে নজর রাখো, ওকে ওপারে নিয়ে যাবার দরকার নেই। কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে কস্তুরীর হাত ধরলেন। কস্তুরী জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, আমি এখন যাব না! কাকাবাবু তার চোখের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, এখন আমি যা বলব, তাই-ই তোমাকে শুনতে হবে। চলো, দেরি করো না! গোল নৌকোটায় উঠে কাকাবাবু বসে পড়লেন। তাঁর চোখের ইঙ্গিত পেয়ে রঞ্জন আর সন্তু কস্তুরীকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে দিল। মাঝ নদীতে এসে কাকাবাবু বললেন, কস্তুরী, এত কষ্ট করে উদ্ধার করার পরও হিরেটা হারিয়ে গেল? ছি ছি ছি, কী দুঃখের কথা! কস্তুরী বলল, নৌকোটা উল্টে গেল যে হঠাৎ! হিরেটা জলে পড়ে গেল। এর চেয়ে আমার ড়ুবে মরা ভাল ছিল! কত টাকা খরচ করেছি! কত কষ্ট করেছি, সব গেল? কাকাবাবু বললেন, নদীতে পড়লেও আবার ভোলা যেতে পারে। অত নিরাশ হচ্ছ কেন? এই জায়গাতেই তো পড়েছিল, তাই না? কস্তুরী খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, প্রায় এই জায়গায়। নদীতে স্রোত আছে। বোধহয় দূরে সরে গেছে। কাকাবাবু বললেন, একবার ড়ুব দিয়ে দ্যাখো তো, পাওয়া যায় কি না! কস্তুরী আঁৎকে উঠে বলল, আমি ড়ুব দেব? আমি সাঁতার জানি না। কাকাবাবু বললেন, তাতে কী হয়েছে? একবার ড়ুব দাও, তারপর তোমাকে আমি ঠিক তুলব। কস্তুরী দু হাত ছড়িয়ে বলল, না, না, না, আমি পারব না। আমি পারব। কাকাবাবু বজ্র কঠিন হাতে কস্তুরীর কাঁধ চেপে ধরে বললেন, তোমাকে ড়ুব দিতেই হবে। কিংবা, হিরেটা যদি তুমি লুকিয়ে রেখে থাকে, তা হলে ভালয় ভালয় আমাকে দিয়ে দাও! ওটা সরকারের সম্পত্তি। কস্তুরী বলল, আমি লুকিয়ে রাখিনি! মিঃ রায়চৌধুরী, বিলিভ মী! জলে পড়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, তা হলে তোমাকে ড়ুব দিতেই হবে। ঠিক একটা পুতুলের মতন কাকাবাবু তাকে উঁচুতে তুলে জলে ফেলে দিলেন। পাড়ে রঞ্জন, রিঙ্কু, জোজো আর সন্তু অবাক হয়ে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জন রিভলভারটা ঠেকিয়ে রেখেছে জগ্গুর পিঠে। কস্তুরী জলে ড়ুবতে ড়ুবতে কোনওরকমে একবার মাথা তুলতেই কাকাবাবু তার একটা হাত ধরে বললেন, পেলে না? আবার ড়ুব দেবে? না, তোমার। কাছেই আছে, এখনও বলো! দারুণ আতঙ্কে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কস্তুরী কোনওরকমে বলল, আমার কাছে নেই, আমার কাছে নেই! আমি শপথ করছি। কাকাবাবু বললেন, তা হলে আবার ড়ুব দাও। কাকাবাবু কস্তুরীর মাথাটা জলের মধ্যে ঠেসে ধরে রইলেন। প্রায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল কস্তুরী। তারপর কাকাবাবু আর একবার তাকে তুলতেই সে, কোনওক্রমে দম আটকানো গলায় বলল, বাঁচান! আছে? কাকাবাবু এবার এক ঝটকায় কস্তুরীকে তুলে আনলেন নৌকোর ওপরে। হাসতে হাসতে বললেন, কোনও মেয়ে অত দামি একটা হিরে চট করে জলে ফেলে দেবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি? কোথায় লুকিয়েছ, বার করো! কস্তুরী হাঁপাতে হাঁপাতে দম নিতে লাগল। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু হাসলেন। কস্তুরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর জামার ভেতর থেকে বার করে আনল সেই মুর্গীর ডিমের সমান হিরেটা। কাকাবাবু সেটা উঁচু করে তুলে সন্তুদের দেখিয়ে বললেন, এই দ্যাখ, পাওয়া গেছে! রঞ্জন আবার দু হাত তুলে নাচতে নাচতে গেয়ে উঠল, হোয়েং গেল! পাওয়াং গেল! সত্যি সত্যি বিজয়নগরের হিরে পাওয়া গেল। হোয়েং গেল! খেল খতম্!… উঃ, কী শীত, কী শীত! এখানকার হাওয়ার যেন ভয়ঙ্কর দাঁত
false
shomresh
পারছ, আমার পক্ষে ছদ্মবেশ ধারণ করা অসম্ভব! অর্জুন বলল, অমলদা ছদ্মবেশের কথা বলেননি, বলেছেন আমরা যে সাধারণ মানুষ—এই ইম্প্রেশন রাখতে। আপনার খিদে পায়নি? খুব। কিন্তু এখানকার দোকানের যা চেহারা তাতে খেতে ভরসা হচ্ছে না ভাই। কেন? ভারতে এলে বাইরের ভাজাভুজি আমি একদম খাই না। তবে রসগোল্লা খাওয়া যেতে পারে। অর্জুন কথা বাড়াল না। বিদেশে যাঁরা দীর্ঘকাল আছেন, তাঁদের পক্ষে চট করে ভারতীয় খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। কোনও উন্নাসিকতা নয়, ওঁদের শরীরের সিস্টেম ভেজাল অথবা পোড়া তেল বরদাস্ত করতে পারে না। বিট্‌সাহেব এব্যাপারে একটা নিষ্ঠুর উপমা দিয়েছিলেন অনেক কাল আগে। ফুটপাতে যেসব শিশু বড় হয়, তাদের সহ্যশক্তি অনেক বেশি। নোংরা, বাসি খাবার খেলেও কিছু ক্ষতি হয় না তাদের। কারণ সেটাকে অতিক্রম করার শক্তি একটু-একটু করে অর্জন করেছে তারা। কিন্তু যত্ন এবং নিরাপত্তার মধ্যে সমস্ত সুবিধের সঙ্গে যারা বড় হচ্ছে, তারা একদিনও ফুটপাতের শিশুর সঙ্গী হতে পারবে না। আমেরিকান খাবারদাবারের সঙ্গে আমাদের সাধারণ দোকানের খাবারের এতটাই প্রভেদ। মেজর গোটাচারেক রসগোল্লা খেয়ে বললেন, অমৃত। অর্জুন জিলিপি খেল। ভাজা মিষ্টি খেতে ওর খুব ভাল লাগে। যদিও এখন ভরদুপুর, এসব খাওয়ার সময় নয়, তবু অমলদাকে ফেলে ভাতের হোটেলের সন্ধানে যাওয়া যায় না। দাম মিটিয়ে ওরা দেখতে পেল, একটা জিপ তাদের বাইকের পাশে দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভার গোছের একজন নীচে নেমে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। পাশের দোকানদার লোকটাকে কিছু বলতে সে এগিয়ে এসে নমস্কার করল, আপনারা জলপাইগুড়ি থেকে আসছেন? হ্যাঁ। অর্জুন বোঝার চেষ্টা করল। আপনাদের মধ্যে একজনের নাম অর্জুন? হ্যাঁ, ঠিকই। তা হলে আমার সঙ্গে চলুন। সাহেবরা অপেক্ষা করছেন। আমি এক ঘণ্টা আগেও এসেছি। কোথায় যাব? কোন সাহেব? সুহাসিনী বাগানের সাহেব। আপনাদের একজন বোধ হয় আগেই এসে গেছেন। লোকটা জিপের দিকে এগোল। মেজর বললেন, এটা কীরকম হল! মিস্টার সোম প্রচারিত হতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু এখন তো সবাই দেখল। যাক গে, যাবে নাকি? মনে হচ্ছে অমলদাই পাঠিয়েছেন। কাছেই তো বাগানটা। আপনি কি জিপে বসবেন? অবশ্যই। গটগট করে মেজর জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিপটাকে অনুসরণ করে অর্জুন চা বাগানের ভেতর একটা সুন্দর বাংলোর সামনে পৌঁছে গেল। খানিক দূরে ফ্যাক্টরির আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে এখন কাজের সময়। বাংলোয় ঢোকার সময় যে দরোয়ান গেট খুলেছিল, তাকে দেখতে অনেকটা হিন্দি সিনেমার অনুপম খেরের মতো। গাড়ির শব্দ পেয়েই সিঁড়ি বেয়ে যে মানুষটি নেমে এলেন তাঁকে অর্জুন চেনে। ইদানীং জলপাইগুড়ির বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ইনি উপস্থিত হন। ছিপছিপে পেটা শরীরের পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিটি একসময় পাহাড়ে উঠতেন। ভদ্রলোক হাত তুলে হাসতে-হাসতে বললেন, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, এই চা-বাগানে আপনাদের পেয়ে আমি খুব গর্বিত। কি অর্জুনবাবু, ভাল আছেন? হ্যাঁ, আপনি? চলে যাচ্ছে ভাই। পাণ্ডববর্জিত হয়ে থাকি, তবু তৃতীয় পাণ্ডবের সান্নিধ্য পাব বলে এখন পুলকিত। আসুন সার, আমি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। মেজরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। আমি বোধ হয় আপনার নাম শুনেছি। আপনি অভিনেতা? মেজর বেশ হাসি-হাসি মুখে হাত ঝাঁকালেন। না সার! তিনি আমার শ্রদ্ধার মানুষ এবং অনেক বয়স্ক। সেই ভানুবাবু থাকতেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে আমার নামের মিলের জন্যে প্রথমে সঙ্কোচ বোধ করতাম, এখন করি না। আপন পরিচয় আমি একটু আগে অমলবাবুর কাছে শুনেছি, আসুন, লাঞ্চ রেডি। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এসে অর্জুন বুঝল, চা বাগানের ম্যানেজাররা বেশ আরামেই থাকেন। সুন্দর সাজানো ড্রইংরুমের সোফায় বসে ছিলেন অমল সোম, সামনের গ্লাসে পানীয়, জিজ্ঞেস করলেন, পথে কোথায় কোথায় নেমেছিলে? আমি বেশি স্পিড নিতে পারিনি; অবশ্য এক জায়গায় একটু সময় নষ্ট হয়েছে। অর্জুন বলল। আপনার শরীরের অবস্থা কেমন মেজর? নামার সময় মনে হচ্ছিল কোমরের নীচটা নেই। হরিল রাস্তা। আমি এমনটা হবে আন্দাজ করেছিলাম। হাসিমারায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ভানুবাবুর কথা মনে এল। কোনও-কোনও মানুষের সহ্যশক্তি সাধারণের চেয়েও বেশি। ভানুবাবুও তেমনই। তারপর এসে যখন জানতে পারলাম ওঁর স্ত্রী চন্দ্রিমা এখন কল্যাণীতে, তখন মনে হল আজকের দিনটায় এখানে জেঁকে বসা যেতে পারে। অমল সোম হাসলেন। একথা চন্দ্রিমা শুনলে দুঃখ পাবে। ও থাকলে আরও বেশি যত্ন করত। ভানুবাবু প্রতিবাদ করলেন। আমি ওঁকে দুঃখ দিতে চাইনি। কিন্তু তিনটে উটকো লোককে উনি কেনই বা যত্ন করতে যাবেন! ভানুবাবু মাথা নাড়লেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, লাঞ্চের আগে কোনও ড্রিঙ্ক? মেজর মাথার ওপর হাত তুললেন, নো। আমি, যাকে বলে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, ঠিক তাই। টেবিলে বসে খাবারের ব্যবস্থা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। খানসামা খাবার পরিবেশন করছিল। মেজর খেতে-খেতে দারুণ, ডিলিসিয়াস, ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করছিলেন। অমল সোম বললেন, মেজর, ভানুবাবু এডমন্ড হিলারির সঙ্গে এভারেস্টে ইয়েতিব সন্ধানে গিয়েছিলেন। খাওয়া থামিয়ে মেজর কিছুক্ষণ তাকালেন, বঙ্গ সন্তান হয়ে সাহেবকে বোঝাতে পারলেন, যা-যা দেখতে পাওয়া গেল না—তা নেই বলে ঘোষণা করা ঠিক নয়? আমরা কোনও প্রমাণ পাইনি। আপনারা না পেতে পারেন, আমি পেয়েছি। আমি একবার তেইশ হাজার ফুট উঁচুতে তিন রাত্তিব ছিলাম। প্রচণ্ড তুষারঝড়ের জন্যে না পারছিলাম এগোতে, না পিছোতে। আমার সঙ্গী ছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্রায়ান নিকলসন। নামকরা মাউন্টেনিয়ার। তৃতীয় দিনে ব্রায়ানকে টেন্টে রেখে আমি একটু বেরিয়েছিলাম বরফের কন্ডিশন বুঝতে। মিনিট তিনেক গিয়েছি, এমন সময় চিৎকার কানে আসতেই কোনও রকমে ফিরে এলাম টেস্টে। দেখলাম ব্রায়ান অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওর জ্ঞান ফিরতেই ভয়ার্ত গলায় বলল, সেখানে থাকবে না। আমি বেরিয়ে যেতে সে টেস্টের বাইরে পা বাড়িয়ে চারপাশ দেখছিল, এমন সময় কেউ
false
shunil_gongopaddhay
করে বোঝেন কতদিনের পুরনো? অসিত বলল, তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। সামান্য একটুকরো কাগজও পরীক্ষা করে বলা যায়, কতদিন আগে সেটা তৈরি হয়েছিল। কাকাবাবু হেসে বললেন, মনে করো দীপা, তোমার ওই গয়নার বাক্সটা ছিল বেগম নূরজাহানের, তা হলেই ওটার দাম হয়ে যাবে কয়েক লক্ষ টাকা। আমি কলকাতায় একটা বাড়িতে একটা সাধারণ কাচের দোয়াত দেখেছিলাম, সেই দোয়াতটা সম্রাট নেপোলিয়ান ব্যবহার করতেন। সেইজন্যই সেটার অনেক দাম। অসিত বলল, ওই দোয়াতটা কোন বাড়িতে আছে আমি জানি। আমি পাঁচ লক্ষ টাকা দাম দিতে চেয়েছিলাম, তাও তারা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। দীপা বলল, একটা দোয়াতের দাম পাঁচ লাখ টাকা? বিমান বলল, নেপোলিয়ানের দোয়াত! চা-পর্ব শেষ হতে সবাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বারান্দাটা দুদিকেই চলে গেছে অনেকখানি। বিমান বলল, ডান দিকটায় অনেকখানি ভাঙা। ছাদ খসে পড়েছে। বিশেষ কিছু দেখার নেই। চলুন, বাঁ দিকটা দেখা যাক। অসিত বলল, চলুন, পরে ডান দিকটাও দেখব। অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরেটা, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু কাকাবাবুর ক্রাচের আওয়াজ হতে লাগল খট খট করে। পর পর। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। কোনওটাতেই তালা নেই, বিমান দরজা ঠেলে ঠেলে খুলে দেখতে লাগল। তিন-চারখানা ঘরে কিছুই নেই। একটা ঘরে অনেকগুলো ভাঙা চেয়ার-টেবিল উলটোপালটা করে রাখা। একটা ঝাড়লণ্ঠন চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, মনে হয়, ওপর থেকে একদিন খসে পড়েছিল, তারপর আর কেউ সেটাতে হাত দেয়নি। অসিত জিনিসগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। দীপা খানিকটা অধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওগুলো কালকে ভাল করে দেখবেন। এখন চলুন, তাড়াতাড়ি একবার চক্কর দিয়ে আসা যাক। অসিত ঝাড়লণ্ঠনের একটা প্রিজম তুলে নিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে, চলুন। আর-একটা ঘরে রয়েছে শুধু বালিশ আর তোশক। লাল মখমলের কয়েকটা তাকিয়া বেশ দামি মনে হলেও সেগুলো ছিঁড়ে তুলো বেরিয়ে এসেছে। দীপা বলল, এই ঘরটায় কি বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ। এখানে কোনও বাঘ-টাঘ লুকিয়ে নেই তো? কাকাবাবুর সঙ্গেও টর্চ রয়েছে। তিনি ওপরের দিকে আলো ফেলে বললেন, ওই দ্যাখো, কত চামচিকে বাসা বেঁধে আছে। চামচিকের এইরকম গন্ধ হয়! দীপা বলল, চলো, চলো, শিগগির এখান থেকে বেরিয়ে চলো। আর-একটুখানি যাওয়ার পর বারান্দাটা একদিকে বাঁক নিয়েছে। সেখানে ছাতের দিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। পাশে একটা খালি ঘর, তার দরজা খোলা। সেখানে দাঁড়িয়ে বিমান বলল, আমার ছোটমামা এখান থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। দীপা বলল, পড়ে গিয়েছিলেন, না ঠেলে মেরে ফেলা হয়েছিল? বিমান বলল, অনেকে তা-ই বলে। কিন্তু শুধু-শুধু কেউ ঠেলে ফেলবে কেন? দীপা বলল, তোমার মা-ও তো বলেন, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল! অসিত বারান্দার রেলিংটায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এটা তো বেশ মজবুতই রয়েছে এখনও, এখান দিয়ে শুধু-শুধু কারও পড়ে যাওয়া তো স্বাভাবিক নয়! বিমান বলল, মোট কথা, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাকাবাবু বললেন, বিমান, তোমার ওই ছোটমামা কতদিন আগে মারা গেছেন? বিমান বলল, প্রায় কুড়ি বছর! কাকাবাবু বললেন, ওঃ অতদিন আগে। তা হলে আর ওই ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। এখন তো আর ওই রহস্যের সমাধান করা যাবে না। অসিত জিজ্ঞেস করল, ওপরের সিঁড়িটা ছাদে গেছে? নিশ্চয়ই মস্ত বড় ছাদ। বিমান বলল, ছাদে একখানা ঘর আছে, সেটাই ছিল আমাদের ক্রিশ্চান দাদুর ঘর। সেটা বছরের পর বছর তালাবন্ধই পড়ে থাকে। দীপা বেশ জোরে বলে উঠল, ওখানে এখন যাওয়া হবে না। না, না, কিছুতেই না। দিনের বেলা দেখবেন। অসিত বলল, ছাদে যেতে তো ভালই লাগবে। বাইরেটাও অনেকখানি। দেখা যাবে। দীপা আবার সেইরকমভাবে বলল, কাল সকালে। অসিত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের খালি ঘরটায় কিসের যেন একটা শব্দ হল। চমকে ঘুরে দাঁড়াল চারজনই। বিমান টর্চ সেদিকে ফিরিয়ে বলল, কে? আর কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই। আর এগোতে যেতেই দীপা হাত চেপে ধরে বলল, এই, তুমি ভেতরে যেও না! বিমান বলল, দাঁড়াও, দেখি ভেতরে কী আছে। তুমি শব্দ শোনোনি? অসিত এগিয়ে গিয়ে টর্চের জোরালো আলো ফেলতেই দেখা গেল, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়ামূর্তি। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, খালি গা। আলোয় যেন চকচক করে উঠল তার দু চোখ। দীপা ও মা গো বলে আর্ত চিৎকার করে উঠল। অসিত নিজের টর্চটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, আপনারা কেউ, আলোটা ধরুন তো! ক্যামেরা! আমি ক্যামেরা বার করছি। কাকাবাবু ততক্ষণে পকেটের রিভলভারে হাত দিয়েছেন, ওটা সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকে। কিন্তু তিনি রিভলভারটা বার করলেন না। সেই মূর্তিটা ছুটে এল ওদের দিকে। বিমান আর দীপাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলেন না। বিমান আর দীপা দুজনেই দারুণ ভয় পেয়ে বসে পড়ল মাটিতে। অসিত ততক্ষণে ক্যামেরা খুলে বলল, চলে গেল? ভূতটা চলে গেল? কাকাবাবু হেসে বললেন, ঘরটার এক কোণে একটা বিছানা পাতা আছে। ভূতেরা বিছানা পেতে শোয়, এমন কখনও শুনিনি। সত্যিই এবার দেখা গেল, ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা মাদুর, বালিশ, ছেঁড়া কাঁথার বিছানা। কিছু এঁটো শালপাতা, একটা কলকে। কাকাবাবু বললেন, আমরা বোধ হয় কারও ঘুম ভাঙিয়েছি। আমাদের চেয়েও ও বেচারা ভয় পেয়েছে বেশি। অসিত বলল, যাঃ! প্রথম ভূতটা ফসকে গেল। বিমান উঠে দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ গরম করে বলল,এখানে কে থাকবে? কারও তো থাকার কথা
false
shordindu
চুয়ার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানি সাদা হইয়া গেল। তাহার চোখে পরিত্রাণের ব্যাকুল আকাঙ্খা ও ক্ষণ-বিস্ফোরিত আশার আলো ফুটিয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, “কেন আমাকে মিছে আশা দিচ্ছ?”—বলিয়া দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। চন্দনদাস বসিয়া পড়িল। কিয়ৎকাল বসিয়া থাকিয়া অন্যমনস্কভাবে একখানা বাতাসা তুলিয়া লইয়া মুখে দিল; তারপর আলগোছে ঘটির জল গলায় ঢালিয়া জলপান করিল। শেষে পান দুটি মুখে পুরিয়া বুড়ির দিকে তাকাইয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “ঠান্‌দি, এবার তোমার গল্প বলো।” “বলব, কিন্তু তুমি আগে একটা কথা দাও।” “কি?” “তুমি ওকে উদ্ধার করবে?” “করব। অন্তত প্রাণপণে চেষ্টা করব।” “বেশ, উদ্ধার করা মানে ওকে এ দেশ থেকে নিয়ে পালাতে হবে। পারবে?” “পারব—খুব পারব।” “ভালো, কিন্তু তারপর?” “তারপর কি?” বুড়ি একটু দ্বিধা করিল; শেষে বলিল, “কিছু মনে করো না, সব কথা স্পষ্ট করে বলাই ভালো। তুমি জোয়ান ছেলে, চুয়াও যুবতী মেয়ে, তুমি ওকে চুরি করে নিয়ে যাবে। তারপর?” চন্দনদাস জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিয়া রহিল। বুড়ি তখন স্পষ্ট করিয়া বলিল, “ওকে বিয়ে করতে পারবে?” চন্দনদাসের চোখে সম্মুখে যেন একটা নূতন আলো জ্বলিয়া উঠিল; সে উদ্ভাসিত মুখে বলিল, “পারব।” “তোমার বাপ-মা—“ “তাঁরা আমার কথায় অমত করবেন না।” বৃদ্ধা কম্পিত স্বরে বলিল, “বেঁচে থাকো দাদা, তুমি বড় ভালো ছেলে। কিন্তু ছুঁড়ির যা কপালে—“ বুড়ি তখন চুয়ার কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। চন্দনদাস করতলে কপোল রাখিয়ে শুনিতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে সে টের পাইল, চুয়া কখন চুপি চুপি আসিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়াছে। চুয়ার বাপের নাম কাঞ্চনদাস। বেনেদের মধ্যে সে বেশ সংগতিপন্ন গৃহস্থ ছিল; চুয়ার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন কাঞ্চনদাস বাণিজ্যের জন্য নৌকা সাজাইয়া সমুদ্রযাত্রা করিল। কাঞ্চনদাসের নৌকা গঙ্গার বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল—আর ফিরিল না। সংবাদ আসিল, নৌকাডুবি হইয়া কাঞ্চনদাস মারা গিয়াছে। এই ঘটনার এক বৎসর পরে চুয়ার মাও মরিল। তখন বুড়ি ছাড়া চুয়াকে দেখিবার আর কেহ রহিল না। বুড়ি কাঞ্চনদাসের মাসে—আট বছর বয়স হইতে সে হাতে করিয়া চুয়াকে মানুষ করিয়াছে। নৌকাডুবিতে কাঞ্চনদাসের সমস্ত সম্পত্তিই ভরাডুবি হইয়াছিল, কেবল এই ভদ্রাসনটি বাঁচিয়াছিল। বুড়ি দোকান করিয়া কষ্টে সংসার চালাইতে লাগিল। এইভাবে বৎসরাধিক কাল কাটিল। চুয়ার বয়স যখন দশ বছর, তখন এক গৃহস্থের ছেলের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইল। এই সময় একদিন জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া এই পথ দিয়া যাইতেছিল। চুয়াকে বাড়ির সম্মুখে খেলা করিতে দেখিয়া সে ঘোড়া হইতে নামিল। দুর্দান্ত জমিদারের মহাপাষণ্ড ভাইপো মাধবের নাম শুনিয়া দেশের লোক তো দূরের কথা, কাজি সাহেব পর্যন্ত থরথর করিয়া কাঁপে। রাজার শাসন—সমাজের শাসন কিছুই সে মানে না। জাতিতে ব্রাহ্মণ হইলে কি হয়, স্বভাব তার চণ্ডালের মতো। সে দশ বছরের চুয়াকে চিবুক তুলিয়া ধরিয়া দেখিল, তারপর বাড়িতে আসিয়া তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল। বুড়ি ভয়ে ভয়ে পরিচয় দিল। শুনিয়া মাধব বলিল, এ মেয়ের বিবাহ দেওয়া হইবে না, ইহাকে দৈবকার্য্যের জন্য মানত করিতে হইবে। ষোল বছর পর্যন্ত কুমারী থাকিবে, তারপর মাধব আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইবে। তান্ত্রিক সাধারণায় উত্তরসাধিকার স্থান অধিকার করিয়া কন্যার ষোল বছরের কৌমার্য সার্থক হইবে। সাধ্রক—স্বয়ং মাধব। এই হুকুম জাতি করিয়া মাধব প্রস্থান করিল। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল; তান্ত্রিক সাধনার গূঢ় মর্মার্থ বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না। বণিক-সমাজ মাধবের বিরুদ্ধে কিছু করিতে সাহস করিল না, তাহারা চুয়াকে জাতিচ্যুত করিল। বিবাহও ভাঙিয়া গেল। ক্রমে চুয়ার বয়স বাড়িতে লাগিল—বারো বছর বয়স হইল। বুড়ি দেশে কাহারও নিকট সাহায্য না পাইয়া শেষে চুয়াকে লইয়া দেশ ছাড়িয়া পলাইবার মতলব করিল। কিন্তু বুড়ির হাতে পয়সা কম, আত্মীয়বন্ধুরও একান্ত অভাব। তাহার মতলব সিদ্ধ হইল না; মাধবের কানে সংবাদ গেল। মাধব আসিয়া বুড়িকে পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত দ্বারা শাসন করিল; তারপর চুয়াকে পাহাড়া দিবার জন্য চাঁপাকে পাঠাইয়া দিল। নাপিত-কন্যা চাঁপা চুয়ার অভিভাবিকাপদে অধিষ্ঠিত হইল। চাঁপা বয়সকালে তান্ত্রিক সাধন-ভজন করিয়াছিল, এখন যৌবনান্তে ধর্মকর্ম ত্যাগ করিয়াছে। সে দুয়া ও বুড়ির উপর কড়া নজর রাখিতে লাগিল। এইভাবে চারি বৎসর কাটিয়াছে। কয়েকদিন আগে মাধব আসিয়াছিল। সে চুয়াকে দেখিয়া গিয়াছে এবং বলিয়া গিয়াছে যে, আগামী অমাবস্যার রাত্রিতেই চুয়াকে দৈবকার্যে উৎসর্গ করিতে হইবে—সেজন্য যেন সে প্রস্তুত থাকে। অনুষ্ঠানের যাহাতে কোনও ত্রুটি না হয়, এজন্য মাধব নিজেই সমস্ত বিধান দিয়া গিয়াছে। অমাবশ্যার সন্ধ্যার সময় চুয়া গঙ্গার ঘাটে গিয়া স্নান করিবে; স্নানান্তে রক্তবস্ত্র, জবামাল্য ও রক্তচন্দনের ফোঁটা পরিয়া ঘাট হইতে একেবারে সাধনস্থলে অর্থাৎ উদ্যানবাটিকায় উপস্থিত হইবে। সঙ্গে ঢাক-ঢোল ইত্যাদি বাজিতে বাজিতে যাইবে। মাধব এইরূপ শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা দিয়া চলিয়া যাইবার পর পাঁচ দিন কাটিয়া গিয়াছে। আজ কৃষনা চতুর্দশী—কাল অমাবস্যা। গল্প শেষ করিয়া বুড়ি কাঁদিএ কাঁদিতে বলিল, “দাদা, সব কথা তোমায় বললুম। এখন দেখ, যদি মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারো। তুমি ছাড়া ওর আর গরি নেই।” গল্প শুনিতে শুনিতে চন্দনদাসের বুকের ভিতরটা জ্বালা করিতেছিল, ঐ দানবপ্রকৃতি লোকটার বিরুদ্ধে ক্রোধ ও আক্রোশ অগ্নিশিখার মতো তাহার দেহকে দাহ করিতেছিল। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিয়া উঠিল, “আমি যদি চুয়াকে বিয়ে করে কাল আমার নৌকোয় তুলেনিয়ে দেশে নিয়ে যাই—কে কি করতে পারে?” দ্বারের আড়ালে চুয়ার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। কিন্তু বুড়ি মাথা নাড়িয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, “তা হয় না দাদা। চাঁপা রাক্ষুশী আছে—সে কখনই হতে দেবে না।” চন্দনদাস বলিল, “চাঁপাকে সোনায় মুড়ে দেব। তাতে রাজী না হয়, মুখে কাপড় বেঁধে
false
shordindu
রহিলাম। বেঞ্চির সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম‌, একটি ছোকরা ঠেসান দিয়া বসিয়া আছে–যেন বসিয়া বসিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মাথা বুকের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে‌, পা সম্মুখদিকে প্রসারিত। অধরোষ্ঠ হইতে একটি সিগারেট বুলিতেছে–সিগারেটে অগ্নিসংযোগ হয় নাই। মুষ্টিবদ্ধ বাঁ হাতের মধ্যে একটি দেশলাইয়ের বাক্স। একটি মেডিক্যাল ছাত্ৰ নাড়ি ধরিয়া দেখিতেছিল‌, বলিল‌, ‘নাড়ি নেই–মারা গেছে।’ সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল‌, ভিড়ের মধ্যে ভাল দেখা যাইতেছিল না। ব্যোমকেশ চিবুক ধরিয়া মৃতের আনমিত মুখ তুলিয়াই যেন বিদ্যুদাহতের মত ছাড়িয়া দিল! আমারও বুকে হাতুড়ির মত একটা প্ৰবল আঘাত লাগিল; দেখিলাম—আমাদের হাবুল। পুলিস আসিয়া পৌঁছতে বিলম্ব হইল না পুলিস আসিয়া পৌঁছতে বিলম্ব হইল না। আমরা দেবকুমারবাবুর ঠিকানা পুলিসকে জানাইয়া বাহির হইয়া আসিলাম। তখন রাস্তায় গ্যাস জ্বলিয়াছে। দ্রুতপদে বাসার দিকে ফিরিতে ফিরিতে ব্যোমকেশ কয়েকবার যেন ভয়ার্ত শ্বাস-সংহত স্বরে বলিল‌, ‘উঃ! নিয়তির কি নির্মম প্ৰতিশোধ! কি নিদারুণ পরিহাস!’ আমার মাথার ভিতর বুদ্ধিবৃত্তি যেন স্তম্ভিত নিশ্চল হইয়া গিয়াছিল; তবু অসীম অনুশোচনার সঙ্গে কেবল এই কথাটাই মনে হইতে লাগিল–পরলোক যদি থাকে‌, তবে যাহার মৃত্যুতে হাবুল এত কাতর হইয়াছিল সেই পরম স্নেহাস্পদ ভগিনীর সহিত তাহার এতক্ষণে মিলন হইয়াছে। বাসায় পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ নিজের লাইব্রেরি-ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। শুনিতে পাইলাম‌, সে টেলিফোনে কথা বলিতেছে। প্রায় এক ঘণ্টা পরে সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ক্লান্তস্বরে পুটরামকে চা তৈয়ার করিতে বলিল‌, তারপর বুকে ঘাড় গুজিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। যে ট্র্যাজেডির শেষ অঙ্কে যবনিকা পড়িতে আর দেরি নাই‌, তাহার সম্বন্ধে বৃথা প্রশ্ন করিয়া আমি আর তাহাকে বিরক্ত করিলাম না। রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বীরেনবাবু আসিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওয়ারেন্ট এনেছেন?’ বীরেনবাবু ঘাড় নাড়িলেন। তখন আবার আমরা বাহির হইলাম। দেবকুমারবাবুর বাসায় আসিতে তিন চার মিনিট লাগিল। দেখিলাম‌, বাড়ি নিস্তব্ধ‌, উপরের ঘরগুলির জানালায় আলো নাই‌, কেবল নীচে বসিবার ঘরে বাতি জ্বলিতেছে। বীরেনবাবু কড়া নাড়িলেন‌, কিন্তু ভিতর হইতে সাড়া আসিল না। তখন তিনি দ্বার ঠেলিলেন‌, ভেজানো দ্বার খুলিয়া গেল। আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। বাহিরের ক্ষুদ্র ঘরটিতে তক্তপোশ পাতা‌, তাহার উপর দেবকুমারবাবু নিশ্চলভাবে বসিয়া আছেন। আমরা প্রবেশ করিলে তিনি রক্তবর্ণ চক্ষু তুলিয়া আমাদের পানে চাহিলেন। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিবার পর তাঁহার মুখে একটা তিক্ত হাসি দেখা দিল‌, তিনি মাথা নাড়িয়া অস্ফুট স্বরে বলিলেন‌, ‘সকলি গরল ভেল–’ বীরেনবাবু অগ্রসর হইয়া বলিলেন‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে।’ দেবকুমারবাবুর যেন চমক ভাঙ্গিল‌, তিনি দারোগাবাবুর পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনারা এসেছেন-ভালই হল। আমি নিজেই থানায় যাচ্ছিলুম—’ দুই হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘হাতকড়া লাগান।’ বীরেনবাবু বলিলেন‌, ‘তার দরকার নেই। কোন অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল শুনুন— বলিয়া অভিযোগ পড়িয়া শুনাইবার উপক্ৰম করিলেন। দেবকুমারবাবু কিন্তু ইতিমধ্যে আবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন; পকেটে হাত দিয়া তিনি যেন কি খুঁজতে খুঁজতে নিজ মনে বলিলেন‌, ‘নিয়তি! নইলে হাবুলও ঐ বাক্স থেকেই দেশলায়ের কাঠি বার করতে গেল কেন? কি ভেবেছিলুম‌, কি হল! ভেবেছিলুম‌, রেখার ভাল বিয়ে দেব‌, নিজের একটা বড় ল্যাবরেটরি করব‌, হাবুলকে বিলেত পাঠাব–’ পকেট হইতে সিগার বাহির করিয়া তিনি মুখে ধরিলেন। ব্যোমকেশ নিজের দেশলাই জ্বালিয়া তাঁহার সিগারে অগ্নি সংযোগ করিয়া দিল। তারপর বলিল‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, আপনার দেশলাইটা আমাদের দিতে হবে।’ দেবকুমারবাবুর চোখে আবার সচেতন দৃষ্টি ফিরিয়া আসিল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু? আপনিও এসেছেন? ভয় নেই–আমি আত্মহত্যা করব না। ছেলেকে মেরেছি–মেয়েকে মেরেছি‌, আমি খুনী আসামীর মত ফাঁসিকাঠে ঝুলতে চাই–’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দেশলাইয়ের বাক্সট তবে দিন।’ সাবধান‌, বড় ভয়ানক জিনিস। প্রত্যেকটি কাঠি এক-একটি মৃত্যুবাণ। একবার জ্বলিলে আর রক্ষে নেই—‘ বোমকেশ দেশলাইয়ের বাক্সটা বীরেনবাবুর হাতে দিল‌, তিনি সন্তৰ্পণে সেটা পকেটে রাখিলেন। দেবকুমারবাবু বলিয়া চলিলেন‌, ‘কি অদ্ভুত আবিষ্কারই করেছিলুম; পলকের মধ্যে মৃত্যু হবে‌, কিন্তু কোথাও এতটুকু চিহ্ন থাকবে না। আধুনিক যুদ্ধ-নীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যেত! বিষ নয়–এ মহামারী। কিন্তু সকলি গরল ভেল—’ তিনি বুকভাঙা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। বীরেনবাবু মৃদুস্বরে বলিলেন‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, এবার যাবার সময় হয়েছে।’ ‘চলুন’–তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ একটু কুষ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনার স্ত্রী কি বাড়িতেই আছেন?’ ‘স্ত্রী!’–দেবকুমারবাবুর চোখ পাগলের চোখের মত ঘোলা হইয়া গেল। তিনি হা হা করিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন‌, বলিলেন‌, ‘স্ত্রী! আমার ফাঁসির পর ইন্সিওরেন্সের সব টাকা সেই পাবে! প্রকৃতির পরিহাস নয়? চলুন।’ একটা ট্যাক্সি ডাকা হইল। ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া দেবকুমারবাবুকে তাহাতে তুলিয়া দিল; বীরেনবাবু তাঁহার পাশে বসিলেন। দুইজন কনস্টেবল ইতিমধ্যে কোথা হইতে আবির্ভূত হইয়াছিল‌, তাহারাও ট্যাক্সিতে চাপিয়া বসিল। দেবকুমারবাবু গাড়ির ভিতর হইতে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমার রেখার মৃত্যুর কিনারা করতে চেয়েছিলেন–আপনাকে ধন্যবাদ—’ আমরা ফুটপাথে দাঁড়াইয়া রহিলাম‌, ট্যাক্সি চলিয়া গেল। দিন দুই বোমকেশ এ বিষয়ে কোনও কথা কহিল না। তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়া আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না। তৃতীয় দিন বৈকালে সে নিজেই বলিতে আরম্ভ করিল; এলোমেলোভাবে কতকটা যেন নিজ মনেই বলিতে লাগিল– ‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে– ‌, দেবকুমারবাবুর হয়েছিল তাই! নিজের স্ত্রীকে তিনি মারতে চেয়েছিলেন‌, কিন্তু এমনই অদৃষ্ট্রের খেলা‌, দু’বার তিনি তাঁর অমোঘ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন‌, দু’বারই সে অগ্নিবাণ লাগল গিয়ে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্ৰ-কন্যার বুকে। ‘দেবকুমার অপ্রত্যাশিতভাবে এক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে সে আবিষ্কারের সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না। এ এমনই আবিষ্কার যে‌, তার পেটেন্ট নেওয়া চলে না; কারণ‌, সাধারণ ব্যবসায়-জগতে এর ব্যবহার নেই। কিন্তু ঘৃণাক্ষরে এর ফরমুলা জানতে পারলে জাপান জামানী ফ্রান্স প্রভৃতি যুদ্ধোদ্যত রাজ্যলোলুপ জাতি নিজেদের
false
humayun_ahmed
সাহেব শুধু শুধু রফিককে মেরে ফেলার চেষ্টা করবেন কেন? সে অপরাধটা কি করেছে? নৌকা প্রবলভাবে দুলে উঠল। কেউ একজন ঝাপ দিয়ে নৌকায় উঠেছে। রফিক ধড়মড় করে উঠে বসল। নৌকার ছই-এর মুখ ভারি পর্দায় ঢাকা। পর্দা সরিয়ে শেফা মাথা বের করে বলল, স্যার কেমন আছেন? রফিক বলল, তুমি কি কোন খাবার এনেছ। শেফা বলল, কলা এনেছি। বসে বসে কলা খান। বাটির মধ্যে মুড়ি আছে। এক গাল মুড়ি নিবেন আর কলায় কামড় দিবেন। পাটালি গুড়ও আছে। রফিক বলল, আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় ভুলে গেছ। শেফা বলল, আমি শুধু পড়া ভুলে যাই। অন্য কিছু ভুলি না। আপনি কথা না বলে আগে ভালমত খেয়ে পেট ভরান। তোমার বাবা কি সত্যি-সত্যি আমাকে মেরে ফেলতে চান? হুঁ। আপনার খোঁজে লোক নেমে গেছে। কি আশ্চর্য কথা। কোন আশ্চর্য কথা না, এক দুইটা মানুষ বিলে পুঁতে ফেলা বাবার কাছে। কিছু না। তুমি যে এখানে এসেছ কেউ জানে? মা জানে। উনি তোমার বাবাকে বলে দেবেন না। না। না কেন? উনি আমাকে খুবই ভালবাসেন। তোমার বাবাওতো তোমাকে ভালবাসেন। দুজনের ভালবাসা দুরকম। আমার জন্যে মার ভালবাসায় আপনি আছেন। কিন্তু বাবার ভালবাসায় আপনি নাই। এটা কি রকম কথা। কি রকম কথা এটা চিন্তা করতে হবে না। আপনি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করেন। কলা কয়টা খেয়েছেন? দুইটা। আরেকটা খান তাহলে দানে দানে তিনদান হবে। দানে দানে তিনদান হবে মানে কি? উফ আপনে এত মানে খুঁজেন কেন? আচ্ছা শুনুন আপনাকে একটা কলার গল্প বলি। কলার কি গল্প? এক দেশে ছিল একটা সারি কলা আর ছিল একটা পাতিলেবু। দুজনের খুব দোস্তি। একদিন কলা পাতিলেবুকে বলল, আচ্ছা ভাই লেবু, লোকে ভাত খাওয়ার সময় তাদের চিপা দিয়ে রস বের করে তোদের কষ্ট হয় না। তার উত্তরে পাতিলেবু বলল, কষ্ট তো হয়ই। কিন্তু ভাই কলা, লোকজন তোদর খাবার সময় যে বাকল খুলে নেংটো করে ফেলে তোদর লজ্জা লাগে না? রফিক খাওয়া বন্ধ করে গল্প শুনছে। মেয়েটা যে এত সুন্দর করে গল্প বলতে পারে তাই সে জানত না। গল্পটা কেমন লাগল স্যার? ভাল। এই গল্পটা আমি দাদিজানের কাছে শুনেছি। দাদিজানের মতো সুন্দর করে আমি বলতে পারলাম না। দাদিজানের কাছ থেকে আপনি যদি এই গল্প শুনতেন তাহলে জীবনে আর কলা খেতে পারতেন না। কেন? নেংটো করে কলা খেতে আপনার লজ্জা লাগতো। শেফা খিলখিল করে হাসছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে হাসির শব্দ মিশে অদ্ভুত শোনাচ্ছে। বাতাসের বেগও বেড়েছে। নৌকা অনেক বেশি দুলছে। শেফা বলল, স্যার উঠুন। এখন চলে যেতে হবে। কোথায় যাব? ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ধরে সোজা দক্ষিণ দিকে যাবেন। এক মাইলের মতো যাবেন তখন দেখবেন হাতের ডান দিকে দুটা বিরাট তাল গাছ। তালগাছ দুটা তো আগেও দেখেছেন। এরার নাম মামা-ভাইগনা তালগাছ। তালগাছের নিচে দাঁড়ায়ে সোজা তাকায়ে দেখবেন কোন্ বাড়িতে বাতি জ্বলতেছে। ঐ বাড়িতে চলে যাবেন। কার বাড়িতে যাব? জালাল খাঁ সাহেবের বাড়ি। উনার বাড়িতে সারারাতই বাতি জ্বলে। জালাল খাঁ সাহেবের জামাই এখনো আছেন। উনি আপনেরে খুব ভাল পান। উনার সঙ্গে ঢাকায় চলে যাবেন। মামলা ডিসমিস। মামলা ডিসমিস? অবশ্যই মামলা ডিসমিস। বাপজান জালাল খাঁ সাহেবের এলাকায় কিছু করতে পারবে না। সবার এলাকা ভাগ করা। তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না? অবশ্যই দেখা হবে। দেখা হবে এবং বিবাহ হবে। স্যার আমি ছাত্রী খুব খারাপ কিন্তু বউ খুব ভাল। আপনার যে মাথার অসুখ আছে। রাতে বোরায় ধরে, চিল্লাফাল্লা করেন, এই অসুখ আমি দুই দিনে সারায়ে দিব। তুমি নিশ্চিত তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? অবশ্যই। মা স্বীকার পেয়েছেন। আর কোন চিন্তা নাই। মাকে দেখলে মনে হয় মা এই দুনিয়ার কিছুই বুঝে না। ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। আসলে সবকিছুই তাঁর হাতের মুঠার মধ্যে। মা বাপজানকে এক হাটে কিনে সেই হাটেই দশজনের কাছে বিক্রি করবেন। বাপজান টেরও পাবেন না। বাপজান মনের আনন্দে কঁচা সুপারি দিয়ে পান খাবেন, আর পানের পিক ফেলবেন। হি হি হি। গভীর রাতে ফরহাদ রফিককে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হল। বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্ত হল আনন্দ। ফরহাদ সাহেবের স্ত্রী তার চাচাতো বোনের বিয়েতে মিশাখালি। গিয়েছে। খবর পাঠিয়েছে রাতে ফিরবে না। ফরহাদের কথা বলার কেউ নেই। সে এতক্ষণ একা একা বাংলাঘরে বসে বৃষ্টি দেখছিল। সে রফিককে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, আপনার একি অবস্থা। বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি। ঘটনা কি? কোন ঘটনা না। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দেখা করতে এসেছেন খুবই ভাল কথা। আমি খুবই খুশি হয়েছি যে দেখা করতে এসেছেন। এমন গগ্রামে রাত দেড়টার সময় যে কেউ দেখা করতে আসতে পারে তাই জানতাম না। আপনি চলে যাবেন আর দেখা হবে না। আপনি এসেছেন আমি খুবই খুশি হয়েছি। আপনাকে আমি একটা প্রস্তাবও দিচ্ছি। আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। আপনাকে নিয়ে আমার কিছু পরিকল্পনা আছে। আচ্ছা পরিকল্পনার কথা পরে বলব। এখন আপনার গোসলের ব্যবস্থা করি। শুকনা কাপড়ের ব্যবস্থা করি। আজ সারারাত গল্প করব। বাংলাঘরেই শোবার জায়গা হল। পাশাপাশি দুটা খাট। একটায় রফিক, অন্যটায় ফরহাদ। ফরহাদের হাতে ফ্লাস্ক। সে ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়ে সত্যি-সত্যি সারারাত গল্প করার প্রস্তুতি নিয়েছে। রফিক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শরীর ভাল নেই। জ্বর আসছে। ঠাণ্ডাটা তাকে খুব কাহিল। করে ফেলেছে। রফিক সাহেব। জ্বি
false
shorotchandra
সে আসনে আসিয়া বসিল, এবং আচ্ছাদন খুলিয়া আহারে প্রবৃত্ত হইল। ভারতী সাবধানে সর্বপ্রকার স্পর্শ বাঁচাইয়া দূরে ভূমিতলে বসিয়া ইহাই তদারক করিতে গিয়া মনে মনে কুণ্ঠিত ও অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। সে ক্রীশ্চান বলিয়া হোটেলের রন্ধনশালায় প্রবেশ করিতে পারে নাই, এই গভীর রাত্রে, সকলের আহারান্তে যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাহাই যে কোনমতে সংগ্রহ করিয়া সরকারমশায় হাজির করিয়াছিলেন ভারতী তাহা ভাবিয়া দেখে নাই। ঘরে যথেষ্ট আলোক ছিল না, তথাপি আবরণ উন্মোচন করায় অন্ন-ব্যঞ্জনের যে মূর্তি প্রকাশিত হইল তাহাতে মুখে আর তাহার কথা রহিল না। অনেকদিন সে তাহাদের উপরের ঘর হইতে মেঝের ছিদ্রপথে এই লোকটির খাওয়ার ব্যাপার লুকাইয়া লক্ষ্য করিয়াছে, তেওয়ারীর ছোটখাটো সামান্য ত্রুটিতে সেই খুঁতখুঁতে মানুষটির খাওয়া নষ্ট হইতে কতদিন ভারতী নিজের চোখে দেখিয়াছে, সে-ই যখন আজ নিঃশব্দ ম্লানমুখে এই কদন্ন ভোজনে প্রবৃত্ত হইল, তখন কিছুতেই সে আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, থাক থাক, ও আর খেয়ে কাজ নেই,—এ আপনি খেতে পারবেন না। অপূর্ব বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, খেতে পারব না? কেন? ভারতী কেবলমাত্র মাথা নাড়িয়া জবাব দিল, না, পারবেন না। অপূর্ব প্রতিবাদ করিয়া তেমনি মাথা নাড়িয়া কহিল, না, বেশ পারবো, এই বলিয়া সে ভাত ভাঙ্গিবার উদ্যোগ করিতেই ভারতী উঠিয়া একেবারে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আপনি পারলেও আমি পারব না। জোর করে খেয়ে অসুখ হলে এ বিদেশে আমাকেই ভুগে মরতে হবে। উঠুন। অপূর্ব উঠিয়া দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কি খাবো তাহলে? আজ আবার তলওয়ারকর পর্যন্ত আফিসে আসেন নি,—যা পারি এই দুটি না হয় খেয়ে নি? কি বলেন? এই বলিয়া সে এমন করিয়া ভারতীর মুখের প্রতি চাহিল যে তাহার অপরিসীম ক্ষুধার কথা অপরের বুঝিতে আর লেশমাত্র বাকী রহিল না। ভারতী ম্লানমুখে হাসিল; কিন্তু মাথা নাড়িয়া বলিল, এ ছাই-পাঁশ আমি মরে গেলেও ত আপনাকে খেতে দিতে পারব না অপূর্ববাবু,—হাত ধুয়ে উপরে চলুন, আমি বরঞ্চ আর কোন ব্যবস্থা করচি। অনুরোধ অথবা আদেশমত অপূর্ব শান্ত বালকের মত হাত ধুইয়া উপরে উঠিয়া আসিল। মিনিট-দশেকের মধ্যেই পুনরায় সেই সরকারমশায় এবং তাঁহার হোটেলের সহযোগীটি আসিয়া দেখা দিলেন। এবার ভাতের বদলে একজনের হাতে মুড়ির পাত্র এবং দুধের বাটি, অপরের হাতে সামান্য কিছু ফল ও জলের ঘটি; আয়োজন দেখিয়া অপূর্ব মনে মনে খুশী হইল। এইটুকু সময়ে এতখানি সুব্যবস্থা সে কল্পনাও করে নাই। তাহারা চলিয়া গেলে অপূর্ব হৃষ্টচিত্তে আহারে মন দিল। দ্বারের বাহিরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়াইয়া ভারতী দেখিতেছিল, অপূর্ব কহিল, আপনি ঘরে এসে বসুন। কাঠের মেঝেতে দোষ ধরতে গেলে আর বর্মায় বাস করা চলে না। ভারতী সেইখান হইতেই সহাস্যে কহিল, বলেন কি? আপনার মত যে একেবারে উদার হয়ে উঠল! অপূর্ব কহিল, না, এতে সত্যই দোষ নেই। ডাক্তারবাবু বললেন, চলুন, ফিরে যাই—আমিও ফিরে এলাম। এখানে যে মাতালের কাণ্ডে খুনোখুনি ব্যাপার হয়ে আছে সে কে জানতো? জানলে কি করতেন? জানলে? অর্থাৎ,—আমার জন্যে আপনাকে এত কষ্ট পেতে হবে জানলে আমি কখখনো ফিরে আসতে রাজী হতাম না। ভারতী কহিল, খুব সম্ভব বটে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি নিজেই ইচ্ছে করে ফিরে এসেছেন। অপূর্বর মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে মুখের গ্রাস গিলিয়া লইয়া সজোরে প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কখখনো না! নিশ্চয় না! কাল বরঞ্চ আপনি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন! ভারতী শান্তভাবে কহিল, এত জিজ্ঞাসা-পড়ারই বা দরকার কি? আপনার কথাই কি আর বিশ্বাস করা যায় না! তাহার কণ্ঠস্বরের কোমলতা সত্ত্বেও অপূর্বর গা জ্বলিয়া গেল। সে ফিরিয়া আসিতেই ভারতী যে মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিল তাহা স্মরণ করিয়া উত্তাপের সহিত বলিল, আমার মিথ্যে কথা বলা অভ্যাস নয়,—আপনি বিশ্বাস না করতে পারেন। ভারতী কহিল, আমিই বা বিশ্বাস না করব কেন? অপূর্ব বলিল, তা জানিনে। যার যেমন স্বভাব । এই বলিয়া সে মুখ নীচু করিয়া আহারে মন দিল। ভারতী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আপনি মিথ্যে রাগ করচেন। ডাক্তারের কথায় না এসে নিজের ইচ্ছেয় ফিরে এলেই বা দোষ কি, তাই শুধু আপনাকে আমি বলছিলাম। এই যে তখন আপনি নিজে খুঁজে খুঁজে আমার এখানে এলেন তাতেই কি কোন দোষ হয়েছে? অপূর্ব খাবার হইতে মুখ তুলিল না, বলিল, বিকেলবেলা সংবাদ নিতে আসা এবং দুপুররাত্রে বিনা কারণে ফিরে আসা ঠিক এক নয়। ভারতী তৎক্ষণাৎ কহিল, নয়ই ত। তাইত আপনাকে জিজ্ঞেসা করছিলাম, একটু জানিয়ে গেলে ত এতখানি খাবার কষ্ট হতো না।সমস্তই ত ঠিক করে রাখা যেতে পারতো। অপূর্ব নীরবে খাইতে লাগিল, উত্তর দিল না। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হইয়া আসিল তখন হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল, ভারতী স্নিগ্ধ সকৌতুক দৃষ্টে তাহার প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া আছে। কহিল, দেখুন ত খাবার কত কষ্টই হল! অপূর্ব গম্ভীর হইয়া বলিল, আজ আপনার যে কি হয়েছে জানিনে, খুব সোজা কথাও কিছুতে বুঝতে পারচেন না। ভারতী বলিল, আর এমনও ত হতে পারে খুব সোজা নয় বলেই বুঝতে পারচি নে? বলিয়াই ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল। এই হাসি দেখিয়া সে নিজেও হাসিল, তাহার সন্দেহ হইল, হয়ত ভারতী এতক্ষণ তাহাকে শুধু মিথ্যা জ্বালাতন করিতেছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাহার মনে পড়িল, এমনি ধারা সব ছোটখাটো ব্যাপার লইয়া এই খ্রীষ্টান মেয়েটি তাহাকে প্রথম হইতেই কেবল খোঁচা দিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে, অথচ, ইহা বিদ্বেষ নয়, কারণ, যে-কোন বিপদের মধ্যে এতবড় নিঃসংশয় নির্ভরের
false
humayun_ahmed
দিয়ে দেন। ছেলেকে নিয়ে চলে যাক। বাবা বললেন, যে জিনিস আমি জানি না সেটা আমি কেন করব? আমি বললাম, তাদের মনের শান্তির জন্যে করবেন। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, অন্যের শান্তি নিয়া আমি মাথা ঘামাই না। তুমি এই বিষয়ে আমার সঙ্গে দরবার করবা না। এরা গাছতলায় বসে আছে। থাকুক। রাত এগারোটার দিকে বাবা বললেন, ঝাল মুরগির সালুন রান্না করো। পোলাও রান্না করো। ছেলেকে ডাক। এই ছেলে দিনের পর দিন বিস্বাদ জাউ ভাত খায়। পোলাউ দেখে মুখে রুচি আসবে। আরাম করে খাবে। তাতেই কাজ হবার কথা। দেখা যাক। তাদেরকে যত্ন করে খাবার দেয়া হলো। বড় বড় জামবাটি ভর্তি মাংস। পোলাও-এর ডিসে ধোয়া উঠা কালিজিরা চালের সুগন্ধি পোলাও। ছেলেটার নাম নসু। মিয়া। সে চোখ বড় বড় খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকল। বাবা বললেন, একে এলাচি লেবু দাও। পিয়াজ, কাঁচামরিচ দাও। নসু মিয়া ভয়ে ভয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা আগ্রহের সঙ্গে বলল, খাও গো বাপাধন। উনি যখন খেতে বলেছেন খ্যাও। বমি যদি হয়— হইব। নিশ্চিন্ত মনে খাও। নসু ভরপেট খেল। তার কোনো সমস্যাই হলো না। সকালবেলা ডিমভুনা দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে বাবার হাত ধরে বাড়ি রওনা হয়ে গেল। ঘটনাটার মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক বিষয় নেই। কিন্তু পিতা এবং পুত্ৰ বিষয়টিকে ফকিরি ঘটনা হিসেবে ধরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম মনে করাই স্বাভাবিক। মানুষ অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। আমি নিজেও তো করি। আমার মা রমিলা যা বলেন বিশ্বাস করি। (সৎ মা না বলে মা বললাম। উনাকে আমার মা ভাবতেই ভালো লাগে) মাসুদের মৃত্যুর পর উনি খুবই চুপচাপ হয়ে গেছেন। সারাদিন বিছানার এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। তবে সন্ধ্যার পর তার মধ্যে এক ধরনের ছটফটানি দেখা যায়। তিনি ঘরে বাতি দেবার জন্যে হৈচৈ শুরু করেন। চাপা গলায় তিনি বলতে থাকেন–বাতি দেও! সব ঘরে বাতি দেও। কোনো ঘর যেন বাকি না থাকে। আমি তাঁকে একটা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছি। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। টর্চ লাইটটা তিনি খুব পছন্দ করেছেন। চাপা গলায় বলেছেন, ভালো করেছ মা। অন্ধকারে ভয় লাগে। কিসের ভয়? আছে, বিষয় আছে। তোমার সব বিষয় জানার প্রয়োজন নাই। সব কিছু সবের জন্যে না। আমার এই অপ্রকৃতস্ত মা পরীবানু বিষয়ে একটা ভবিষ্যতবাণী করেছেন। আমি মনেপ্ৰাণে তার কথা বিশ্বাস করছি। তিনি বলেছেন– এই মেয়েটার যমজ সন্তান হবে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। দুই সন্তানসহ সে আবার এক স্বামীর সংসার করবে। সেই স্বামীর মতো ভালো মানুষ ত্রিভুবনে নাই। মেয়েটার জীবন অতি সুখে কাটবে। আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করি। মানুষের বিশ্বাস যুক্তি মানে না। আমার বিশ্বাসের পিছনেও কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি দিয়ে হবেই বা কী? আমাদের চারপাশের যে জগৎ সেই জগৎ কতটা যুক্তিনির্ভর। এখন আমার ভাবতে ভালো লাগে, কেউ একজন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। কঠিন নিয়ন্ত্রণ। যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার কাছেই সবকিছু সমৰ্পণ করা ভালো না? কী হবে চিন্তা-ভাবনা করে? জোছনা রাতে আমি প্রায়ই একা একা মাসুদের কবরের কাছে যাই। চুপচাপ বসে থাকি। আমার ভালো লাগে। আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। পড়াশোনা শেষ করতে হবে–এইসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। রেজাল্টের খবরে বাবা আরো একবার বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন টানিয়েছেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ হারিকেন দেখেছে। তারা জানতে এসেছে ঘটনা কী। তাদের প্রত্যেককেই বাবা বলেছেন–আমার মেয়ে পেতলের ঘাড়া ভর্তি সোনার মোহর পেয়েছে। বড় ভাগ্যবতী আমার এই মেয়ে। শ্রাবণ মাস। ভোমরা নদী ফুলে-ফোঁপে উঠেছে। শহরবাড়ির সামনের বিস্তৃত মাঠ জলমগ্ন। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসবে। পাঁচ-ছয় বছর পর পর এরকম হয়, শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসে। পানিতে জোয়ার-ভাটার টান পর্যন্ত হয়। মঞ্জু অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর প্রধান কাজ গামবুট পরে পানিতে হাঁটাহাঁটি। সে নিজে নেত্রকোনা শহর থেকে গামবুট কিনে এনেছে। রাতে সে শহরবাড়িতে ঘুমায় না। পানশি নৌকায় ঘুমায়। পানশি নৌকা উত্তরের ঘাটে বাধা থাকে। নৌকার ছাঁইয়ের ভেতর ডাবল তোষকের বিছানা। তোষকের উপর সুনামগঞ্জের শীতলপাটি। কোলবালিশ। এলাহি ব্যবস্থা। মঞ্জুর রান্নবান্না নৌকার ভেতরই হয়। রান্না করে নিরঞ্জন। বন্দুও উঠে এসেছে নৌকায়। তার কােজ নৌকার গলুইয়ে ছিপ ফেলে বসে থাকা। এই কাজটা সে গভীর আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে করে। তাকে দেখে মনে হয়, এতদিনে সে মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। ফাৎনার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু নামের মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে তার বড় ভালো লাগে। সব গল্পই সে সাধারণভাবে শুরু করে, শেষ করে ভূত-প্রেতে। মঞ্জুকে কিছুদিন হলো সে মামা ডাকা শুরু করেছে। মামা, পানি কেমন বাড়তাছে দেখছেন? হুঁ। শহরবাড়ির ভিতরে যদি পানি না। ঢুকে, আমি আমার দুই কান কাঁইট্টা কুত্তরে খাওয়াইয়া দিব। এইটা আমার ওয়াদা। আপনেরে সাক্ষি মাইন্যা কথাটা বললাম। ইয়াদ রাইখেন। ইয়াদ রাখব। আপনের ঘটনাটা কী বলেন দেখি, নিজ দেশ গ্রামে আর ফিরবেন না? ফিরব না কেন? অবশ্যই ফিরব। এদের একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে, এখন যাই কীভাবে? পরীবানুর সন্তান হোক তারপরে বিদায়। আপনারে একটা কথা বলি মামা? বলো। আপনে যদি চইল্যা যান। আপনার সাথে আমিও যাব। তুমি চলে গেলে এখানে চলবে কীভাবে? না চললে নাই। আমি এই বাড়ির কিনা গোলাম না। আমার যেখানে ইচ্ছা আমি যাব। আমারে কিন্তু সাথে
false
zahir_rayhan
মা। কিন্তু বাক্স থেকে বেরুতে গিয়ে ওরা অনুভব করলো হাত পাগুলো আর সোজা করতে পারছে না। বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলতে গিয়ে দেখলো মেরুদণ্ডে টান পড়ছে। ব্যথা লাগছে। দীর্ঘদিন একটা বাক্সের মধ্যে হাত পা গুটিয়ে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে ওরা ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুষ্পদু হয়ে গেছে। তবু হাত পাগুলো সোজা করে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো ওরা। চতুষ্পদ মানুষগুলো। সহসা বাইরে আবার সেই হিংস্রতার ধ্বনি শোনা গেল। সচকিত হলো ঊনিশটি প্রাণ। বিকলাঙ্গ মানুষগুলো পাখির মতো কিচমিচ শব্দ তুলে মইটার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তালাটা বন্ধ করে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন মা। বুড়ো বাবা বিছনায় বসে বসে তছবি গুনছেন। তিন সন্তান উৎকর্ণ হয়ে বন্য ধ্বনি শুনছে। চৌদ্দ বছরের মেয়েটি হঠাৎ বললো, বাবা, কারা যেন কড়া নাড়ছে। বুড়ো বাবা অস্বস্তিতে ছবি নামিয়ে রাখলেন। তিনি সন্তানের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, বাতিগুলো সব নিভিয়ে দাও। বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো তার। মা চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে কাছে টেনে নিলেন। কানে কানে বললেন, ওঘরে গিয়ে ওদের একেবারে চুপ থাকতে বলে এসো। যেন কোন রকম শব্দ না করে, যাও। বলে স্বামীর দিকে তাকলেন তিনি। দরজায় করাঘাতের মাত্রা উচ্ছ্বল হয়ে পড়ছে। বুড়ো বাবা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। দরজা খুলে দেবেন তিনি। বুড়ি মা। তাঁর তিন সন্তান। আর চৌদ্দ বছরের মেয়েটি। সবাই গভীর উৎকণ্ঠা বুকে নিয়ে সিঁড়ির মাথায় নীরবে দাঁড়িয়ে। বুড়ো বাবা দরজা খুললেন। বাইরে থেকে বন্য হিংস্রতা চিৎকার করে উঠলো। বাড়ির ভেতর থেকে ওদের বের করে দাও। এখানে কেউ নেই। বিশ্বাস করে। এখানে কেউ নেই। বুড়ো বাবা এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন। মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। এক সঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ চিত্তার জুড়লো তোমরা কাদের আশ্রয় দিয়েছে আমরা জানি। নিজেদের ভালো চাও তো ওদের আমাদের হাতে দিয়ে দাও। তোমরা ভুল করছে। আমাদের এখানে কেউ নেই। কিন্তু ওরা বিশ্বাস করতো না। বুড়ো বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ভেতরে এসে ঢুকলো ওরা। তারপর পুরো বাড়িটা তচনচ করে ফেলতে লাগলো। বাক্সঘরে তখন কবরের নীরবতা। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো ওরা। ভয়ে। আতঙ্কে। আর সেই মুহূর্তে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটির প্রসব বেদনা উঠেছে। একটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছে সে। ঊনিশ জন মৃতপ্রায় মানুষ চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে শিশুটির জন্য প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। না। না। এখন নয়। এখন নয়। মুমূর্ষু মহিলাটি যন্ত্রণার অস্থিরতায় বারবার নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর ঘর্মাক্ত দেহটাকে আয়ত্তে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সেও চায় না এ মুহূর্তে শিশুটির জন্ম হোক। কিন্তু! সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ঊনিশ জন মানুষের অভিসম্পাত কুড়োতে কুড়োতে শিশুটি ভূমিষ্ট হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে, দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে, ঊনিশ জনের একজন সেই বাচ্চাটির গলা টিপে ধরলো। নিচে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওরা এখন এ ঘরে এসে আশ্রিত মানুষগুলোকে খুঁজছে। প্রসূতির চোখ জোড়া হয়তো পৃথিবীর প্রতি ঘৃণায় একবার কুঞ্চিত হলো। তারপর বিবর্ণ মণিতে প্রাণের চিহ্ন রইলো না। আর বাচ্চাটার সঙ্গে সঙ্গে তার মা-ও মারা গেলো। মৃত মহিলার স্বামী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আকিয়ে রইলো সেদিকে। সহসা কান্নার আবেগে ভেঙ্গে পড়তে গিয়ে নিজেই মুখখানা দুহাতে চেপে ধরলো। না। না। এখন নয়। এখন কান্নাও নয়। এখন শুধু নীরবে দুটি মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করো আর নিজেদের আসন্ন মরণ সম্ভাবনার কথা ভেবে ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকে। মৃত্যুর বন্যতার শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। ওরা কান পাতলো। ভাল করে শোনার চেষ্টা করলো। শুনলো। বুড়ি মা নিচে থেকে বলছেন। আর ভয়ের কিছু নেই, ওরা চলে গেছে। বুড়ি মার কণ্ঠস্বর শুনে মৃত মহিলার স্বামী পরক্ষণে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। তার মৃত স্ত্রীর জন্যে। তার মৃত নবজাতকটির জন্যে। ইভা আর তপু তখন ছুটছে। পালাচ্ছে ওরা। দীর্ঘ পথ চলায় ওরা ক্লান্ত। বিবর্ণ বিধ্বস্ত। তবু জীবনের জন্য। বাঁচার জন্যে। সুখের জন্যে। ওরা দুটছে। সহসা থমকে দাঁড়ালো ওরা। ইভা আর তপু। দেখলো। সামনে সীমাহীন সমুদ্র। আর সেই সমুদ্রের সৈকতে, অফুরন্ত ঢেউয়ের পটভূমিকায় একটি ক্রুশ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। ক্রুশের পেছনে লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কে? ক্রুশবিদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে সহসা প্রশ্ন করলো ইভা। অনেকক্ষণ কোন জবাব দিলো না তপু। সে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। তারপর বললো, যিশু। যিশু। হ্যাঁ। যিশুখৃষ্ট। ওরা গতকাল তাঁকে হত্যা করেছে। দুজোড় চোখ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। যেন এক অনন্ত সময়ের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে ওরা। সহসা আবার সেই হিংস্র বন্য ধ্বনি তাড়া করে এালো। পাগলা কুকুরগুলো খোঁজ পেয়ে গেছে ওদের। শূকর শূকরীরা চিৎকার করে আসছে পেছনে। ইভার একখানা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবার ছুটলো তপু। প্রাণপণে ছুটছে ওরা। সহসা। কিসের সঙ্গে যেন হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ওরা। চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহ। ছেলে। বুড়ো। মেয়ে। শিশু। অপু আর ইভা চমকে উঠলো। দেখলো। সেই অসংখ্য মৃতদেহের মাঝখানে ওদের দুজনের মৃতদেহও পড়ে আছে। নিজের মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ইভা। তাকালো তপু। বুশেনওয়ান্ডে। না। অসউইজে। না। স্ট্যালিনগ্রাডে? অথবা ভিয়েতনামে? ভয়ে শিউরে উঠে তপুর বুকে মুখ লুকালো ইভা। সহসা কাছাকাছি কোথায় যেন প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করলে তপু। একটা বাচ্চা ছেলে কাদছে। দুজনে মাথা তুলে তাকালো ওরা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। মৃতদেহগুলোর মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো ইভা আর তপু। কিছুদূর এসে দেখলো। একটি মৃত মা
false
humayun_ahmed
অবস্থায় পকেটে আছে। ব্যাপারটা মজার তো! কর্নেল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার দেশের কোন জিনিসটা সবচে ভালো? মোবারক হোসেন বললেন, স্যার, আপনি তোমার দেশ বলছেন কেন? দেশটা তো আপনারও। কর্নেল সাহেবের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি সেই হাসি তৎক্ষণাৎ মুছে ফেলে গভীর গলায় বললেন–তোমাকে খুশি করার জন্যে বলেছি। এই দেশ যে আমার সেটা আমি জানি। যাই হোক, প্রশ্নের জবাব দাও–তোমার দেশের কোন জিনিসটা তোমার সবচে ভালো লাগে? মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, মুক্তাগাছার মণ্ডা। জিনিসটা কী? এক ধরনের মিষ্টান্ন। ছানা দিয়ে তৈরি হয়। ভাপে পাকানো হয়। এত জিনিস থাকতে তোমার কাছে তোমার দেশের সবচে পছন্দের জিনিস মুক্তাগাছার মণ্ডা! জি স্যার। ভালো কথা, এখন বলো–তোমার কি মনে হয়। এই দেশটা আলাদা হয়ে যাবে? দুই দেশের পতাকা হবে দুই রকম? স্যার পাকিস্তান ভাঙবে না। কোন যুক্তিতে বলছি ভাঙবে না? কোনো যুক্তি না। আমার মন বলছে ভাঙবে না। কর্নেল সাহেব পকেট থেকে আরেকটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিতে দিতে বললেন, আমারও তাই ধারণা। যার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়াদী তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাইবেন না। তিনি চাইবেন অখণ্ড পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে। তবে জেনারেল ইয়াহিয়াকেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সব কথাই মেনে নিচ্ছেন। নভেম্বরের জলোচ্ছাসের পর মাওলানা ভাসানী চাইলেন ইলেকশন পিছিয়ে দিতে। মানুষের এত দুর্ভোগ, এর মধ্যে ইলেকশন কী! কিন্তু শেখ মুজিব ইলেকশন পিছিয়ে দিতে রাজি হলেন না। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে খুশি করার জন্যে ইলেকশন পিছলেন না। আমার ধারণা ইয়াহিয়া শুধু একটা জিনিসই চাচ্ছেন–যা হবার হোক, যার ইচ্ছা ক্ষমতায় যাক, শুধু পাকিস্তান টিকে থাকুক। ইন্সপেক্টর মোবারক! জি স্যার তোমার মনের ইচ্ছাটাও তো সে-রকম। তাই না? জি স্যার। তোমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখন থেকে তোমার ডিউটি শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের ধানমণ্ডির বাড়িতে। তুমি সেই বাড়িতে ঢুকবে। নিজের একটা জায়গা করে নিবে। কীভাবে করবে। সেটা তোমার ব্যাপার। স্যার, আমার কাজটা কী? ঐ বাড়িতে অবস্থান নেওয়াটাই তোমার কাজ। আর কিছু না। আর কিছুই না? না। আর কিছু না। প্রতি সপ্তাতে একবার বুধবার সন্ধ্যায়–জোহর সাহেবের সঙ্গে এই বাড়িতে দেখা করবে। তার সঙ্গে গল্পগুজব করবে। জোহর কে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। ঐ যে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। মোবারক হোসেন জোহর সাহেবের দিকে তাকাল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। জোহর তার জবাব দিলেন না। আগের মতোই চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর পূর্ণিয়া জেলার লোক। আমার অতি ঘনিষ্ঠ একজন। সে একজন কবি। তার শায়ের শুনলে মুগ্ধ হবে। তার পছন্দের কবির নাম শুনলেও তুমি চমকে উঠবে। তার পছন্দের কবির নাম টেগোর। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ। মোবারক হোসেন চমকালেন না। তবে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর একজন চেইন স্ম্যোকার। এখন ইন্সপেক্টর মোবারক বলো তো দেখি–তুমি এই ঘরে ঢোকার পর থেকে জোহর কয়টা সিগারেট খেয়েছে? নয়টা। ভালো! তোমার অবজারবেশন ভালো। তুমি যেতে পাের। স্যার চলে যাব? হ্যা চলে যাবে। স্নামালিকুম স্যার। ওয়ালাইকুম সালাম। ইন্সপেক্টর শোন, তোমার ছেলের জন্মদিন উৎসব থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছি— এতে তুমি কিছু মনে করবে না। দেশের কল্যাণের জন্যে ছোটখাটো স্বাৰ্থ বিসর্জন দিতে হয়। মোবারক হোসেন চমকালেন না। এরা তার ছেলের জন্মদিন জানে–এতে বিস্মিত হবার কিছু নাই। গোয়েন্দা বিভাগ তার সম্পর্কে কিছু না জেনেশুনে তাকে ডাকবে না। তার ছেলের নাম যে ইয়াহিয়া–এটাও তারা অবশ্যই জানে। ইন্সপেক্টর! ইয়েস স্যার। তুমি কিছু বলবে? জি-না স্যার। তোমাকে সামান্য টিপস্ দিয়ে দেই। শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হওয়া খুবই সহজ কাজ। এই মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালির প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি সমস্ত বাঙালিকে বিশ্বাস করেন। আর আমরা প্রতিটি বাঙালিকে অবিশ্বাস করি। তিনিও ভুল করছেন। আমরাও ভুল করছি। ভুলের মাশুল তিনি যেমন দেবেন। আমরাও দেব। কে কতটুকু দেবে কে জানে! ঠিক আছে, তুমি যাও। . ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটাকে কি বাড়ি বলা যাবে? বাড়ি মানেই অলস দুপুর। বাড়ি মানেই ভদ্র মাসের গরমে আচমকা উড়ে আসা হিমেল হাওয়া। বাড়ি মানে বারান্দার রেলিং-এ শুকাতে দেয়া রঙিন শাড়ি। এখানে সেরকম কিছু নেই–বাজারের মতো ভিড়। এই একদল আসছে। এই যাচ্ছে। যারা আসছে প্রথম কিছুক্ষণ খুবই উত্তেজিত অবস্থায় থাকছে। কয়েকবার স্লোগান দেয়ার পর তাদের উত্তেজনা বাপ করে অনেকখানি কমে যাচ্ছে। তখন তাদের খানিকটা দিশাহরাও মনে হচ্ছে। স্লোগান পর্ব শেষ। এখন কী করা উচিত তা বুঝতে না পেরে দিশাহারা। দল নিয়ে এসে হুট করে চলে যাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ থাকতে হয়। দল পরিচালনা করে যারা এসেছেন, শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে তাদের মান থাকে না। গ্রহকে ঘিরে উপগ্রহ ঘুরপাক খায়। শেখ সাহেব বিশাল গ্রহ। তাকে ঘিরে ঘুরপাক খাওয়া উপগ্রহের সংখ্যাও সেই কারণে অনেক। তাদের ডিঙিয়ে শেখ সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল। তবু চেষ্টা চালাতে হয়। মোবারক হোসেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকেন। কাণ্ডকারখানা দেখেন। তাঁর ভালোই লাগে। দুপুরে কখনো কখনো বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি খাবার আসে। কোনোদিন তেহারি, কোনোদিন খিচুড়ি মাংস। তখন চারদিকে আলাদা উত্তেজনা তৈরি হয়। এই উত্তেজনা দেখতেও খারাপ লাগে না। সবচে ভালো লাগে পাতি নেতাদের জ্ঞানী জ্ঞানী আলোচনা। পাতি নেতাদের সঙ্গেও পাতি উপগ্ৰহ থাকে। পাতি নেতাদের আলোচনা চলে পাতি উপগ্রহদের সঙ্গে। মাওলানা কী চাচ্ছে
false
humayun_ahmed
করেছিলাম তার কাছে মেয়েটারে রাইখা আসব। আল্লাহপাক আপনেরে মিলায়ে দিয়েছে। যন্ত্রণা ঘাড় থাইক্যা নামছে। ভাইজান, আপনে তার কে হন? আমি তার চাচা। আলহামদুলিল্লাহ, থাকেন এখন চাচায়-ভাইস্তিতে। কংকন এখনো খামচি দিয়ে শাহেদের পা ধরে আছে। কিছুতেই মুখ তুলছে না। বারবার তার ছোট্ট শরীর কোপে কেঁপে উঠছে। শাহেদ তার পিঠে হাত রেখে বলল, কংকন ভয় পেও না। আমি তোমাকে তোমার বাবা-মার কাছে নিয়ে যাব। কংকন, ঠিক আছে? হুঁ। ক্ষিধে লেগেছে? কিছু খাবে? কলা খাবে? কলা কিনে দেই, একটা কলা খাও? হুঁ। শাহেদ কলা কিনে কংকনের হাতে দিতে গিয়ে দেখল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গা গরম। জ্বর এসেছে। ঘুমের মধ্যে বমি করে সে শাহেদের প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। কংকনের সঙ্গে আমার দেখা হয় নিউইয়র্কে। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ আমাকে বইমেলায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী বাঙালিরা বইমেলা উপলক্ষে খুব হৈচৈ আনন্দ কবছে। খাবারের দোকান বসেছে। একদিকে ভিডিও প্রদর্শনী, বড় প্রজেকশন টিভিতে নাটক দেখানো হচ্ছে। শাড়ি-গয়নার দোকানও আছে। অতি জমজমাট অবস্থা। এর মধ্যে ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের অতি রূপবতী এক তরুণী এসে পুরো বাঙালি কায়দায় আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি চমকে পা সরিয়ে নিলাম। তরুণী বলল, আপনাকে চাচা ডাকব, না স্যার ডাকব? আমি বললাম, তোমার যা ডাকতে ইচ্ছা করে ডাক। তাহলে চাচা ডাকি। স্যার ডাকলে মনে হবে। আপনি সত্যি আমার স্যার। এক্ষুনি আমাকে ধমক দেবেন। তাছাড়া আপনার চেহারাও রাগী রাগী। তরুণীর গুছিয়ে কথা বলার ভঙ্গি বেশ ভালো লাগল। সে বলল, আমি আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। আপনি তো লেখক মানুষ, আপনাকে সুন্দর একটা গল্প শুনাব। আমি বললাম, শোনা গল্প আমি লিখি না। সে বলল, আমার গল্পটা আপনার লিখতে ইচ্ছা করবে। এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে এক হাজার ডলার বাজি রাখতে পারি। মেলা শেষ করে আমি কংকনের সঙ্গে তার অ্যাপার্টমেন্টে গেলাম। নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলি যেমন হয় সেরকম। ছোট কিন্তু খুব গোছানো। এক কথায় বললে বলতে হবে, ছবির মতো সাজানো সংসার। কংকন বিয়ে করেছে এক আমেরিকানকে। সে কনস্ট্রাকশান ফার্মে চাকরি করে। তাদের একটা ছেলেও আছে। ছেলের নাম রবিন। তবে তাকে ডাকা হয় রবি নামে। ছেলে তার বাবার সঙ্গে লায়ন কিং ছবি দেখতে গিয়েছে। কংকন বলল, আপনি থাকতে থাকতেই ওরা এসে পড়বে। আমরা একসঙ্গে ডিনার করব। আমাকে ডিনার পর্যন্ত থাকতে হবে? অবশ্যই। তবে আপনার ভয় নেই–বাংলাদেশের মতো রাত দশটায় ডিনার না। এখানে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ডিনার করা হয়। আপনি যেভাবে পা তুলে বসেন, সেইভাবে আরাম করে বসুন, আমি গল্প করি। আমি পা তুলে বসি তুমি জানো কীভাবে? বইমেলায় দেখলাম। আপনাদের লেখকদেরই শুধু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকবে, আমাদের পাঠকদের থাকবে না? আমি নরম সোফায় পা তুলে বসেছি। কংকন গল্প শুরু করেছে। খুব ছোট ছিলাম তো, পরিষ্কার কিছু মনে নেই। আবছা আবছা সব স্মৃতি। সেই আবছা স্মৃতির মধ্যেও কিছু কিছু আবার খুবই স্পষ্ট। যেমন ধরুন, আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে–শাহেদ চাচা বাজারের মতো একটা জায়গায় আমাকে গোসল করাচ্ছেন। মাথায় পানি ঢালছেন কেতলি দিয়ে। সেই পানিটা গরম। কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢালেন, তারপর গায়ে সাবান ডলেন। সাবান থেকে লেবুর মতো গন্ধ আসছিল— এটা পরিষ্কার মনে আছে। সেই স্মৃতি এমনভাবে মাথায় ঢুকে আছে যে আমি এখনো লেমন ফ্লেভারের সাবান ছাড়া অন্য সাবান ব্যবহার করি না। শাহেদ চাচা আমাকে নতুন জামা কিনে দিলেন। জুতা কিনে দিলেন। সস্তা ধরনের প্লাস্টিকের পুতুল কিনে দিলেন। পুতুলটা এখনো আমার সঙ্গে আছে। আপনাকে দেখােব। আমরা এক রাত থাকলাম হোটেলে। চাচাকে জড়িয়ে ধরে কী আরাম করে যে সেই হোটেলে ঘুমালাম! আমি ঠিক করেছি। যদি কোনোদিন বাংলাদেশে যাওয়া হয়, তাহলে হোটেলটা খুঁজে বের করব। এক রাত থাকব সেই হোটেলে। হোটেল খুঁজে বের করতে পারবে? অবশ্যই পারব। হোটেলটি দাউদকান্দি নামের এক জায়গায়। টিনের ঘর। হোটেল থেকে নদী দেখা যায়। হোটেলের সব খুঁটিনাটি আমার মনে আছে। তারপর বলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মাইলের পর মাইল শাহেদ চাচা আমাকে ঘাড়ে নিয়ে হেঁটেছেন। আমরা তখন বর্ডার ক্রস করছি। বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছি আগরতলায়। চাচা ক্লান্ত হয়ে যান। আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে বলেন, মা, কিছুক্ষণ হাঁটতে পারবে? আমি বলি, হ্যাঁ। আমি হাঁটতে পারি না। চাচা আবার আমাকে ঘাড়ে তুলে নেন। আমার কোনো কষ্ট হচ্ছিল না। আমার খুবই মজা লাগছিল। আমাদের সঙ্গে আরো অনেক লোক যাচ্ছিল। একজন বৃদ্ধা মহিলা যাচ্ছিলেন। তাঁর ছেলে তাকে কোলে করে নিচ্ছিল। বৃদ্ধ মহিলার কথা তোমার মনে আছে? জি আমার মনে আছে। কারণ শাহেদ চাচা আমাকে বলছিল–ছেলে তার মাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমি আমার মাকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছি। মজা না? তারপর কী হলো বলো। আমরা আগরতলা পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। সেখান থেকে শরণার্থী শিবিরে ট্রাকে করে যেতে হয়। ট্রাকে ওঠার সময় শাহেদ চাচা বললেন, মা শোন, অনেকগুলো শিবির আছে। আমরা তোমার মাকে প্রত্যেকটা শিবিরে খুঁজব। তাকে পাওয়া যাবে–সে সম্ভাবনা খুবই কম। পাওয়া না গেলে তুমি মন খারাপ করবে না। আমি তো তোমার সঙ্গে আছি! আমি যেভাবেই হোক তোমাকে তোমার মার কাছে পৌঁছে দেব। ঠিক আছে মা? আমি বললাম, ঠিক আছে। ট্রাকে আমার জ্বর এসে গেল। চাচা চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার মাকে জড়িয়ে ধরে আছি। মজার ব্যাপার
false
shirshendu
তাও বটে। তা হলে আবার কী? আমরা ভদ্রমহিলাকে কাল বুঝিয়ে দেব ইট ওয়াজ রিয়েলি ফান। আর কিছু নয়। ধ্রুব একটু চুপ করে থেকে সদানন্দকে চাপা স্বরে বলে, আমাকে লক-আপে নিয়ে চলো। সে কী? নিয়ে চলো, সদানন্দ। ধারা যে কমপ্লেন করেছে তা অনেকটা সত্যি। রাখুন তো দাদা। ওসব মেয়েছেলেকে আমরা চিনি। দুবার ডিভোর্স করেছে, ছেলেছোকরাকে নাচিয়ে বেড়ায়। ওসব আমরা জানি। ডিভোর্সের খবর জানলে কী করে? বাঃ, এতক্ষণ ধরে তদন্ত করতে হল না? লোকজন জমেছিল? দু-চারজন। ও নিয়ে ভাববেন না। সাক্ষী কেউ দেবে না। কেসটা হাস-আপ করবে, সদানন্দ? কেই নয় তার আবার হাস আপ! এটা কেস নাকি? যেসব মেয়েছেলের পিছনে চোদ্দোটা পুরুষ ঘোরে তাদের ওরকম কেস দু-চারটে হয়ই। আপনি এর সঙ্গে আর মিশবেন না। লবণহ্রদ ছাড়িয়ে জিপ বেলেঘাটা পেরোচ্ছে। নির্জন রাস্তাঘাট। কটা বাজল বলো তো, সদানন্দ। সাড়ে বারোটা। বাকি রাস্তাটা ধ্রুব চুপচাপই রইল। শুধু সদানন্দর নানা কথার জবাবে হুঁ হাঁ করে ঠেকা দিয়ে গেল। খুব নিরাপদে এবং ঘটনাহীন ভাবেই বাড়ি পৌঁছে যায় ধ্রুব। ডাইনিং হল-এ ঢুকে ঢাকা-দেওয়া খাবার গোগ্রাসে খায় সে। তারপর ঘরে এসে সিগারেট ধরায়। বড় ভয় করছে তার। একা ঘরে ততটা ভয় হত না। আজ তারা দুজন। সে আর সে। ধ্রুব আর ধ্রুব। উঠে আলমারি খুলে হুইস্কি বের করে ধ্রুব। তারপর অন্তহীন জলস্রোতে ভেসে যেতে থাকে। একসময়ে বোতল এবং সে একই সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। অচেতন অবস্থায় রাত কেটে যায়। ধ্রুবর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, তীব্র মাথার যন্ত্রণা, পেটে গোলান, মুখ তিক্ত কষায় শুষ্কতায় ভরা। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। কে যেন ডাকছে, ধ্রুব, ধ্রুব! কে? আমি। গলার স্বরটা চিনতে পারে ধ্রুব। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো উঠে বসে মেঝের ওপর। দরজায় কৃষ্ণকান্ত দাঁড়িয়ে। কিছু বলছেন? বলছিলাম তৈরি হয়ে একবার নার্সিংহোম-এ যাও। যাচ্ছি। বউমা আর বাচ্চা ভালই আছে। চিন্তা নেই। তোমার একবার যাওয়া কর্তব্য বলে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ধ্রুব উঠল। টলে পড়ে যেতে যেতে দাঁড়াল। কৃষ্ণকান্ত চলে গেছেন। তবু ফাঁকা দরজাটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে সে। গত দুমাসের মধ্যে বোধহয় এই প্রথম তার সঙ্গে কথা বললেন কৃষ্ণকান্ত। কিন্তু কেন বললেন? ব্যাপারটা কী? “আবার সেই কিশোরী। কিন্তু এখন তাহাকে আর কিশোরী বলি কী করিয়া? বয়সের এক নূতন ঋতু আসিয়া তাহাকে যেন পত্রে পুষ্পে ফলভারে অপরূপ সাজে সাজাইয়াছে। “কিশোরী যে সুন্দরী তাহা বলা যায় না। কিন্তু সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কী তাহাও তত খুঁজিয়া বা বুঝিয়া পাইলাম না। শাস্ত্রোক্ত সৌন্দর্য লক্ষণের সহিত যাহার বিন্দুমাত্র মিল নাই সেও এমন এক আকর্ষণে বরণীয়া হইয়া উঠে যাহার ব্যাখ্যা হয় না। ক্ষীণ কটি, উন্নত বক্ষ, গুরু নিতম্ব, পর্ক বিদাধর বা হরিণ-নয়নের যতই প্রশংসা থাকুক, এ সকল যাহার নাই সেও অন্য কারণে যে সৌন্দর্যের লহর তুলিতে পারে এই কিশোরীই তাহার প্রমাণ। “কী দিয়া ইহার সেই রূপের বর্ণনা করিব? আমার ভাষাজ্ঞান বা বর্ণনাশক্তি তেমন নাই। শুধু বলিতে পারি এই যুবতীর মধ্যে একটি বুদ্ধির দ্যুতি আছে, যাহা সচরাচর মহিলাকুলে দেখিতে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ শরীর, মেদবর্জিত মজবুত গঠন, কাঠামোতে কোমলতার কিছু অভাব আছে বটে, কিন্তু মুখখানা কেহ যেন নরুনে চাছিয়া কুঁদিয়া তুলিয়াছে। ইহার গায়ের রং তাম্রাভ। গৌরী নহে বলিয়া ইহার অগৌরবের কিছু নাই। যুবতীর গাত্রবর্ণ নূতন তামার পয়সার মতোই উজ্জ্বল। “এই বয়সে মেয়েদের কটাক্ষ করিবার প্রবণতা থাকে। এই যুবতী চোখের সেই কটাক্ষ দিয়া অনায়াসে পুরুষচিত্ত জয় করিতে পারে। সচ্চিদানন্দ তো চোখ দেখিয়াই মজিয়াছে। কিন্তু আশ্চর্য এই, যুবতী তাহার এই একাগ্নী বাণ কদাচিৎ প্রয়োগ করে। “মাঝখানে কিছুদিন বিষয়কর্মে কিছু ব্যস্ত হইয়া পড়ায় এবং সকালে ঘুরিয়া বেড়ানোর ফলে সাক্ষাৎ বিশেষ হয় নাই। একদিন শীতকালে সন্ধ্যাবেলা বসিয়া রবিবাবুর একটি কাব্য পাঠ করিতেছি এমন সময় সুনয়নী আসিয়া নিকটে এক মোড়া টানিয়া বসিল। আমি আড়চোখে তাহাকে দেখিয়া মনে মনে কিছু সন্ত্রস্ত হইলাম। স্ত্রীলোকদিগের বিশেষ করিয়া সংসারী স্ত্রীলোকদিগের স্বামীর সহিত বিশেষ কোনও প্রয়োজন কদাচিৎ দেখা দেয়। সর্বদা নৈকট্য ও বাক্যালাপ হেতু সুনয়নীর সহিত আমার নূতন করিয়া কোনও প্রয়োজন দেখা দেয় না। কিন্তু স্ত্রীলোকরা স্বামীকে অন্যমনস্ক থাকিতে দিতে চায় না। কী জানি হয়তো ভাবে, স্বামী অন্যমনস্ক বা কর্মব্যস্ত থাকিলে তাহার উপর অধিকার কমিয়া যায়। “সুনয়নী একটা এমব্রয়ডারি হাতে নিয়া কিছুক্ষণ সেলাই মকশো করিল। তারপর দাঁত দিয়া একটি সুতা কাটিয়া বলিল, বাব্বাঃ, যা কঠিন ডিজাইন। “আমি ইহার জবাব দিলাম না। “সুনয়নী উসখুস করিতে লাগিল। তারপর বলিল, শুনছ? শুনছি। একটা কথা। বলো। রাগ করবে না তো? না। একটা জিনিস শিখিয়ে দেবে? কী জিনিস? আমার খুব বন্দুক চালানো শিখতে ইচ্ছে করে। “চমকিয়া উঠিলাম। এই নির্বোধ স্ত্রীলোক বলে কী? বন্দুক চালনা শিখিবে! বলিলাম, মাথা খারাপ নাকি? কেন? শিখতে নেই? শিখে করবে কী? সে আমি বুঝব। বলো শেখাবে? এ বুদ্ধি কে দিল তোমাকে? কেউ দেয়নি। আমি শিখব। “আমি হাসিতে লাগিলাম। স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না থাকিলেও সুনয়নীকে আমি চিনি। তাহার স্বভাবও আমার অজানা নয়। একে ধনীকন্যা বলিয়া আদরে লালিত পালিত হইয়াছে, জমিদারবাড়ির বধূ হইয়া আসিবার পর তাহার গায়ে আর হাওয়া লাগে নাই। বন্দুকের মতো হিংস্র জিনিস ইহার হাতে কল্পনা করিতেও কষ্ট হয়। হাসছ যে! হাসবার কথাই তো। তুমি শিখবে বন্দুক! তা হলে সূর্য পশ্চিমে উঠবে। কেন? এমন কী শক্ত কাজ? মেয়েরা পারে না?
false
humayun_ahmed
তৃষ্ণা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। কলিংবেল টিপে পানি খেতে চাইলে কেমন হয়? একবার পানি চাইলে দরজা খুলতেই হবে। তৃষ্ণাৰ্তকে পানি দেবে না। এমন বাঙালি মেয়ের এখনো জন্ম হয়নি। রোজহাশরের ময়দানে সূর্য চলে আসবে মাথার এক হাত উপরে। তৃষ্ণায় তখন বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইবে। তখন শুধুমাত্র তাদেরকেই পানি পান করানো হবে যারা তৃষ্ণর্তিকে পানি পান করিয়েছে। আমি কলিংবেলে হাত রাখলাম। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বডি বিল্ডার উপস্থিত হলেন। মনে হচ্ছে তাকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে। সম্ভবত তামান্নার মা পেছনের বারান্দা থেকে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে কথা বলেছেন। কারণ বডি বিল্ডার শীতল গলায় বলল, ব্রাদার একটু নিচে আসেন। কুইক। এইসব ক্ষেত্রে কোন রকম তর্কবিতর্কে যাওয়া ঠিক না। আমি হাসি মুখে বডি বিন্ডারের সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। সেখানে আরো কয়েকজন অপেক্ষা করছে। অপেক্ষমান এক শুটকা যুবকই মনে হয় বডি বিণ্ডারদের লীডার। সে জ্ঞানী টাইপ মুখ করে চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছে। মুখে সিগারেট। তবে সিগারেটে আগুন নেই। হাতে লাইটার আছে। সিগারেট এখনো ধরানো হয়নি। শুটকা তরুণ লাইটারটা এক হাত থেকে আরেক হাতে লোফালুফি করছে। নিশ্চয়ই ভিসিআরে এমন কোন ছবি দেখেছে সেখানে নায়ক এইভাবে চেয়ারে বসে পা নাচায়, ঠোঁটে থাকে সিগারেট। সে হাতে লাইটার নিয়ে জগলিং করে। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরানোর দৃশ্যটিও ইস্টারেষ্টিং হবার কথা। আমি সেই দৃশ্য দেখার জন্যে আগ্ৰহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। বডি বিল্ডার শুটকার দিকে তাকিয়ে বলল, মনা ভাই, ধইরা আনছি। মন ভাই পা নাচানো বন্ধ করে আমাকে দেখলেন। ইন্টারোগেশন পর্ব শুরু হল। কি নাম? হিমু। এখানে কার কাছে? তামান্নার কাছে। তামান্না কে হয়? কিছু হয় না। কিছু হয় না। তাহলে এসেছেন কেন? এখনো কিছু হয় না। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। তার মানে কি? তামান্নার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চলছে। মনা ভাই সঙ্গে সঙ্গে পা নাচানো বন্ধ করল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাল। সে মনে হয় খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছে। হকচকিয়ে যাবার কারণে সিগারেট ধরানোর দৃশ্য তেমন জমল না। প্রেমের বিয়ে না। এরেনজড ম্যারেজ? এরেনজড ম্যারেজ। কথাবার্তা হচ্ছে। কথাবার্তা কি পাকা হয়ে গেছে। এখনো পাকেনি। বিয়ে পাকতে একটু সময় লাগে। স্ট্রেইট কথা জিজ্ঞেস করছি, স্ট্রেইট জবাব দেবেন। জ্বি আচ্ছা। মনা ভাই বডি বিল্ডারকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল। তাদের সঙ্গে কানে কানে কিছু কথা হল। বডি বিল্ডার অতি দ্রুত চলে গেল। সে ফিরে না আসা পর্যন্ত কর্মকান্ড স্থগিত। মনাভাই আবারো লাইটার নিয়ে লোফালুফি করছেন। আমি দেখছি ইতিমধ্যে আরো কিছু উৎসাহী দর্শক উপস্থিত হয়েছে। মজাদার কিছু দেখার আগ্রহে দর্শকরা চক চক করছে। এই ফ্লাটবাড়িতে মনা ভাই এর কারণে প্রায়ই মনে হয় মজাদার কিছু হয়। বডি বিল্ডার ফেরত এল এবং আনন্দিত গলায় জানোল যে, তামান্নার মা হিমু নামে কাউকে চেনেন এবং তার মেয়ের কোন বিয়ের কথা হচ্ছে না। মনা ভাই এর চোখ আনন্দে ঝলসে উঠল। সে মুখে সুরুয়া টানার মত শব্দ করল। বুঝতে পারছি আমার কাটা খাল দিয়ে হাঙ্গর ঢুকে পড়েছে। হাঙ্গরের হাত থেকে শুধুমাত্র তামান্নাই আমাকে বাঁচাতে পারে। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, মনা ভাই, আমার বিচার যা করার তামান্না এলে করবেন। আপাতত দড়ি দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখুন। যাতে আমি পালিয়ে যেতে না পারি। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখব। জ্বি সেটাই ভাল হবে। শুধু একটা রিকোয়েষ্ট। কাউকে দিয়ে এক জগ ঠান্ডা পানি আনিয়ে দিন। মনা ভাই বলল, তুমি জামাই মানুষ পানি খাবে? তোমার জন্যে সরবতের ব্যবস্থা করি। ঠান্ডা সরবত। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, জি আচ্ছা। চারদিকে হাসাহাসি পড়ে গেল।‘ আমি ছাড়া পেলাম রাত এগারোটায়। তোমান্না তার এক অসুস্থ বান্ধবীকে দেখতে গিয়ে ফিরতে দেরি করেছে। যে কারণে আমার রিলিজ অর্ডারেও দেরি হল। তামান্না আমাকে রিকশায় তুলে দিল এবং গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, আপনি দয়া করে আর কখনো এ বাড়িতে আসবেন না। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে এইসব ভুলে যান। আপনার সঙ্গে আমার কোন বিয়ের কথা হচ্ছে না। আমি বললাম, তামান্না, রিকশা ভাড়াটা দিয়ে দাও। আমার কাছে একটাও পয়সা নেই। তামান্না বলল, রিকশা ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। দয়া করে আমাকে তুমি করে ডাকবেন না। ঘরে ঢুকে চিঠি পেলাম। দুটা চিঠি। ফাতেমা খালার ম্যানেজার লিখেছেন এবং ব্যাঙচি লিখেছে। প্রথম পড়লাম ম্যানেজারের চিঠি। হিমু সাহেব, গত তিন দিনে আমি চারবার। আপনার খোঁজ করেছি। আপনি কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না। আপনাদের মেসের ম্যানেজার বলল, হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া নাকি আপনার পুরানো রোগ। গত বছর একনাগাড়ে তিন মাস আপনার কোন খোঁজ ছিল না। আমি খুবই চিন্তিত বোধ করছি। কারণ ম্যাডামের সিঙ্গাপুরে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী। তিনি আপনার সঙ্গে কথা না বলে যেতে পারছেন না। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসের টিকিট কাটা আছে, কিন্তু আপনার কারণে কনফার্ম করা যাচ্ছে না। যাই হোক, এই চিঠি আপনার হাতে যেদিন আসবে দয়া করে। সেদিনই ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বিনীত রকিবুল ইসলাম। ব্যাঙাচির চিঠিটার অর্ধেক বল পয়েন্টে লেখা। কয়েক লাইন বল পয়েন্টের কালি ফুরিয়ে যাওয়ায় বিনা কালিতে লেখা। তারপর লেখা পেনসিলে। দোস্ত, আমার উপর রাগ নিশ্চয়ই করেছিস। দোস্ত কি করব বল–থানায় যেতে সাহসে কুলায়নি। তবে তোর জন্যে কোরান মজিদ খতম দিয়েছি। জুমাবারে ইমাম সাহেবকে বলে স্পেশাল দোয়া করিয়ে দিয়েছি। তুই যে হাজতে আছিস সেই কথা বলিনি। শুধু বলেছি বিপদগ্ৰস্ত মমিন মুসলমান। হাজতে
false
shunil_gongopaddhay
দুদল শ্রমিকের মধ্যে। সেদিন সন্ধের পর মিঃ বিশ্বাস একটু বেশি নেশা করে ফেললেন। তীব্র কণ্ঠে তিনি বললেন, সঞ্জয়, আজকের কালপ্রিটদের একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলো—ওসব গুণ্ডা-বদমাশদের আমি আমার মিলে রাখবো না। সঞ্জয় বললো, হাঁ, পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে। –ওসব পুলিশ-ফুলিশ না। আমাদের নিজেদের মিলের শ্রমিকদের আমরা চিনবো না? আমি সব রিপোর্ট পেয়েছি–ঐ যেগুলো দল পাকায়, ইউনিয়ন করে-সব কটাকে চিনি! সঞ্জয় একটু অবাক হয়ে বললো, কিন্তু আজকের দাঙ্গাটার মধ্যে তো খানিকটা বাঙালি-বিহারী ফিলিং ছিল-ইউনিয়নের লোকরা থামাতে গিয়েছিল। –মোটেই না, ওসব ওদের চালাকি! ঐ তোমার সেই রতন, তার এক চেলা আছে! কি যেন নাম, দাঁড়াও–আমার কাছে কাগজে লেখা আছে–এত চেষ্টা করছি এদের উন্নতি করার–আমি চাই শ্রমিকদের স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং উন্নত হবে, ওরা মানুষের মতন বাঁচবে, বেশি খাটবে–বেশি রোজগার করবে–তা নয়, কতগুলো সুইন্ডলার পলিটিসিয়ানের প্যাঁচে ভুলে ইউনিয়ন আর দল পাকানো–এতে দেশের কোনোদিন উন্নতি হবে তুমি বলতে চাও! শ্রমিকরা যতদিন বস্তিতে থাকবে।ততদিন দেশের উন্নতি নেই। ওদেরও ভালোভাবে বাঁচতে দিতে হবে।তার জন্য দরকার হলো কাজ, আরও কাজ-বুঝলে, কাজ না করে শুধু শুধু ইউনিয়ন আর ভোট– আবেগে মিঃ বিশ্বাসের গলা কাঁপতে থাকে। সঞ্জয় সিগারেট টান দিতে ভুলে যায়। অনুরাধা এই সময় ঘরে ঢুকলো! একটা অদ্ভুত ধরনের ব্লাউজ পরেছে। অনুরাধা-কনুই পর্যন্ত হাতী সেখানে ফ্রিল দিয়ে ফুলের মতন তৈরি করা, গলার কাছটও ফুল-ফুল ধরনের, গত শতাব্দীর মেমসাহেবদের মতন মনে হয়—এবং সেই ব্লাউজে অপূর্ব দেখাচ্ছে অনুরাধাকে। সারাদিনের দুর্ভাবনা ও উত্তেজনা ভুলে গিয়ে সঞ্জয় তার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। অনুরাধা মুক্তোর মতন দাঁত দেখিয়ে হাসলো, বললো, তোমরা দুজনে এত সিরিয়াস ফেস করে বসে আছ কেন? সঞ্জয়দা, ক্যারাম খেলবে? সঞ্জয় কিছু উত্তর দেবার আগেই মিঃ বিশ্বাস বললেন, দাঁড়াও মা-মণি আমাদের কাজগুলো আগে সেরে ফেলি! এসে সঞ্জয়, আগে রিপোর্টটা তৈরি করে ফেলা যাক; বদমাশগুলোর সব কটাকে কাল ছাঁটাই করে দেবো। অনুরাধা বললো, সঞ্জয়দা, আজ রাত্রে এখানে খেয়ে যান-না। আমি আজ একটা পুডিংএর এক্সপেরিমেণ্ট করেছি! সঞ্জয় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। অনুরাধা তার সঙ্গে নেহাত ভদ্রতাই করছে, তবু অনেকক্ষণ অনুরাধার সাহচর্য পাবার লোভে সঞ্জয় আর দ্বিরুক্তি করে না। মিঃ বিশ্বাস উঠে গিয়ে কোটের পকেট থেকে একটা কাগজ এনে বললেন, এই নাও, এতে বদমাশগুলোর নাম আছে। এদের অপরাধের ডেফিনিট গ্রুফ আছে আমাদের কাছে, তুমি এক্ষুনি নোটিশ তৈরি করে ফেলো। আমি চাইছি। এদের উন্নতি করতে, আর এরা নিজেদের পায়ে কুড়ুল বসাবে। এই এরিয়ার আর কোন মিল—ফ্যাক্টরিতে আমাদের মতন মজুরদের বাথরুমে ফ্রি সাবান সাপ্লাই করা হয়, খোঁজ নিয়ে দেখো তো! একটু বেশি রাত্রে সঞ্জয় যখন নিজের কোয়ার্টারে ফিরছিল, তখন দেখতে পেলো রাস্তার মোড়ে একদল লোক জটিল করছে। একটু গা ছমছম করে উঠেছিল তার। দাঙ্গার উত্তেজনা বুয়েছে, তাকে মজুররা হয়তো মালিক পক্ষের লোক বলে ভাবে, হঠাৎ আক্রমণ করে বসা বিচিত্র নয়। মিঃ বিশ্বাস তাঁর গাড়ি করে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সঞ্জয় আপত্তি করেছিল। পাঁচ সাত মিনিটের পথ-এজন্য গাড়ি নেবার কোনো মানে হয় না। দঙ্গল থেকে দুজন লোক এগিয়ে এলো সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয় চিনতে পারলো রতনকে! উত্তেজিত উগ্ৰ মুখ। বললো, স্যার, আমাদের শ্রমিক আন্দোলনকে যে-ভাবে বানচাল করে দেওয়া হচ্ছে– সঞ্জয় রুক্ষভাবে বললে, এত রাত্রে সে-কথা আমাকে বলতে এসেছো কেন? –এত রাত্রেই আসতে হলো, আপনাকে একটা ব্যাপারে সাক্ষী থাকতে হবে। -সাক্ষী? আমি? হাঁঃ, স্যার–এই ভিখুরামকে এদিকে নিয়ে আয় তো! সেই দাঙ্গলের চারজন লোক একজন লোককে টানতে টানতে নিয়ে এলো! সে লোকটার প্রচণ্ড নেশা, পাটিলছে, চোখ দুটো লাল–একজন তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো, বল, স্যারের কাছে বল কিন্তু টাকা পেয়েছিস। সঞ্জয় বিস্থিতভাবে জিজ্ঞেস করলো, এসব কি ব্যাপার? রতন বললো, আজকের দাঙ্গাটা কেন হলো, সেটা নিজের কানে আপনি শুনে রাখুন! –আমার কাছে কেন? পুলিশের কাছে যাও! –বাঃ, আপনি আমাদের অফিসার–আপনি জানবেন না? সঞ্জয় মনে মনে একটু হাসলো। কারুর উপকার কিংবা ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই। সে শুধু চাকরি করছে। শ্রমিকরা তাকে মাইনে দেয় না, মাইনে দেয় মালিক। মালিকের কথা মতন কাজ না করলে-তাকেই চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার জায়গায় অন্য লোক এসে–সে কাজ করবে। রতন হঠাৎ সেই মাতালটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে বললো, বল না। শালা, বড় সাহেবের কাছ থেকে তুই কত টাকা পেয়েছিস। সঞ্জয় রেগে উঠে ধমকে বললো রতনকে, রতন, তুমি ভদ্রবংশের ছেলে মিলে কাজ করতে এসেছে।সৎভাবে কাজ করবে সেটাই আশা করেছিলাম! তার বদলে এরকম গুপ্তামি-বদমাইশী। রতন রাগলো না, হেসে বললো, শুনুন স্যার, গুণ্ডামি-বদমাইশী কে করে! এই ভিখুরাম মদ খেয়ে সব স্বীকার করেছে।বড় সাহেবের পেয়ারের লোক ঘনুসরকার ভিখুকে আড়াইশো টাকা দিয়েছে মাঝামারি বাঁধাবার জন্য। শুধু ভিখু একা নয়, বাঙালিদের মধ্যেও দুতিনজন পেয়েছে–দুদলকে না উসকালে মারামারি হবে কেন? মারামারি কেন বাধিয়েছে জানেন–যাতে আমাদের ইউনিয়ানটা ভেঙে যায়—আমরা যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি জানাবো–সেটা যাতে না হয়—সেই জন্যই দলাদলি মারামারি লাগিয়ে—আপনি তো জানেনই স্যার, পর পর দুবছর পাটের ওভার–প্রোডাকশন হয়েছে।রেট নেমে যাচ্ছে—সেই জন্য কোম্পানি চায় কাজ কমাতে, লোক ছাঁটাই করতে–কিন্তু আমাদের শ্রমিক-মজদুর ঐক্য কিছুতেই নষ্ট করা যাবে না—আমরা জান দিয়ে ইউনিয়ানটকে বাঁচাবো। মজদুরের আবার বাঙালি বিহারী কি! মজদুরের কোনো জাত নেই— সঞ্জয় বেশ হকচাকিয়ে রতনের বক্তৃতা শোনে। পুরুতের ছেলে রতন সংস্কৃত উচ্চারণ করতে ভয় পেলেও বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বেশ জোরালোভাবে এসব
false
tarashonkor
দল! সব একদিকে ছুটল। কাহারের ছেলে হয়ে ধুত্ত্ব শেয়ালের ফন্দি জানে না হতভাগারা! হায় হায় হায়! কালীর আড্ডায় দিনরাত গিয়ে গিয়ে ওদের এই দশা, সেখানে দিনরাত দ্যাশ-বিদেশের আজা-উজিরের গল্প। এসব কুলকর্মের কথা তো হয় না, শিখবে কি করে? ওই একটা শেয়াল ছুটে পালাচ্ছে। তা হলে আসল শিকারি পিছন দিকে কোথাও আছে নিশ্চয়। এই ফাঁকে সে এসে একটা ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে পালাবে। আচ্ছা ধূর্তের জাত! রাখাল থাকলে ধূর্তেরা এইভাবে একটা এক দিকে দেখা দেবেউলটো দিকে লুকিয়ে থাকবে আর একটা কি দুটো। রাখালেরা যেমনই ছুটবে দেখা-দেওয়া ধূৰ্তটার দিকে, অমনিই পিছন দিক থেকে সেটা বার হয়ে ঝপ করে ভেড়া ছাগল যা সামনে পাবে মেরে টেনে নিয়ে পালাবে। সাধে “পণ্ডিত মহাশয়’ বলে শেয়ালকে! কিন্তু এদিকের ধূর্ত পণ্ডিতটি কই? কোথায়? যেখানেই থাক, বনওয়ারী ভেড়ার পালের দিকে ছুটতে লাগল। সামনে একটা নালা। প্রচণ্ড এক লাফ দিয়ে সশব্দে পার হল বনওয়ারী। সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘খ্যা’ করে শব্দ হল, তারপরই নালার কুল-ঝোপ থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে পালাল একটা শেয়াল। ছুট ছুট-উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে শেয়ালটা। হরি হরি, পণ্ডিত মহাশয় এইখানেই নালাকে পেছনে রেখে কুলবনের ঝোপে ঝোপে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভেড়াগুলোর দিকে! বনওয়ারী ঠিক হাত পাঁচেক দূরে লা। ফয়ে পড়েছে। ঘাড়ে পড়লে ঠিক হত। ওঃ-ওঃ—এখন ছুটছে পণ্ডিত! ধর্— ধরধর, ধূৰ্তকে ধ! পণ্ডিতকে ধর! খুব একচোট হেসে ঘোড়াগুলোকে পণ্ডিতদের ধূর্ত বুদ্ধির কৌশল বুঝিয়ে দিয়ে বললে— খবরদার, সবাই মিলে কখনও ছুটে যাবি না, একজনা থাকবি ছাগলভেড়ার কাছে—বড় দেখে একজনা থাকবি। তা লইলে পণ্ডিত দাঁত মেলে খ্যাখ্যা করে তেড়ে এসে ছেলেমানুষকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করে পালাবে। তারপর বললে—ককেটায় আগুন আছে? ট্যাক থেকে বিড়ি বার করলে সে। ধরিয়ে নিলে। ওই কত্তার ‘থান’ দেখা যাচ্ছে। প্রণাম করলে বনওয়ারী। বাড়ি ফিরতে গিয়ে গায়ের ধারে এসে মনে পড়ল-বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। বউ বলেছিল—“চার পয়সার পোস্তদানা আনতে। ভুলে গিয়েছে। জাঙলে পানার মনিবের দোকান থেকে নিয়ে গেলে হত। কিন্তু না, থাক্। ধার সে নেবে। না। চার আনা পয়সার দু আনা নিজে খেয়েছে, দু আনা দিয়েছে সিধুকে। এতে তার মন খুশি হয়েছে—সিধুকে পয়সা দিয়েছে, এতে তার মন ভারি খুশি। আহা, ‘দুভাগ’ মেয়ে! সিধু এখন আঁস্তাকুড়ের অন্নের সমান। আঁস্তাকুড়ে যে অন্ন পড়ে, সে অন্ন আর তুলে নেবার উপায় নাই। কিন্তু সে অন্নও তো লক্ষ্মী! তার জন্য মন না কেঁদে তো পারে না। *** এর কয়েকদিন পরেই হাঁসুলী বাঁকে কাহারপাড়া বাঁশবাঁদিতে আবার একবার বাদ্যি বেজে উঠল। এবার বাজল ঢোল কাঁসি সানাই –কুরুতাক-কুরুতাক-কুরুম-কুরুম। বায়েন এসেছিল একদল, ঢোল কাঁসি সানাই। মেয়েরা এবার দিচ্ছে উলু-উলু-উলু-লু-লু-লু। তারই সঙ্গে ঢুলী বাজাচ্ছে—কুরুর—কুরুর–কুরুর—তাক—তাক–তাক। কাসিতে বাজল কাঁই—কাঁই-কাঁই। সানায়ে সুর উঠল—আহা মরি মরি মরি রে মরি, শ্যামের পাশে রাইকিশোরী। বাঁশবাঁদির বাঁশবনে-বনে চঞ্চল হয়ে উঠল পাখির কঁক; তলায় আদ্যিকালের পচা এবং শুকনো। পাতার মধ্যে থেকে দু-চারটা খরগোশ বার হয়ে ছুটে পালাল নদীর ধারের জঙ্গলের দিকে। শিয়ালগুলি এত ভীরু নয়, তারা প্রথমটা একবার চঞ্চল হয়েই স্থির হল। সাহেবডাঙার দিকে বুনো শুয়োরগুলো নিজেদের আড্ডায় বার কয়েক গো-গোঁ করে উঠল। শীতকালের আমেজ এখনও আছে, সাপেরা এখনও মাটির তলায় না-খেয়ে ‘ছ-মেসে দম নিয়ে অসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছে—তারা মাথা তুলতে চেষ্টা করলে; কিন্তু পারলে না। পাখী ও করালীর বিয়ে। কাহারপাড়ায় মাত লাগল। তেল হলুদ রঙ নিয়ে মাতামাতি। করালীর সঙ্গে পাখীর সাঙা, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ। নসুরাম–করালীর নসুদিদি–গাছকোমর বেঁধে তেল-হলুদ মেখে, কাপড়ে রঙ নিয়ে হা-হা করে আসছে আর গাইছে— ‘আমার বিয়ে যেমন তেমন—দাদার বিয়ের আয়বেঁশে-আয় ঢকাঢক্‌ মদ খেসে।” প্রচুর মদ, বড় বড় হাঁড়ি থেকে বাটি ভরে তুলে ঢেলে দিচ্ছে একজন, সকলে আকণ্ঠ পান। করছে। করালী দরাজ হাতে খরচ করছে। তার সঙ্গে কাহারপাড়ার কার সঙ্গ? সে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে লাঙ্গল চষে না, হিম্‌-প্লো হাঁক হেঁকে পালকি বয়ে খায় না, সে ‘অ্যাল’ কোম্পানিতে চাকরি করে, নগদ ‘ওজকার’। সে সেটা দেখিয়ে দিতে চায়, বুঝিয়ে দিতে চায় এই সুযোগে। সে দেড় কুড়ি টাকা নগদ খরচ করেছে। খাসি কিনেছে, ছোলার ডাল কিনেছে— জ্ঞাতিভোজনে সে চুনোপ্টির অম্বল আর কাচা কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত দেবে না। পাখীকে শাখা-শাড়ি-সিঁদুর-নোয়া ছাড়াও দেবে অনেক জিনিস, অনেক গয়না; রুপদস্তার নয়, রুপোর গয়না। হাতে চারগাছা করে আটগাছা চুড়ি, গলায় দড়ি-হার, কোমরে এ ছাড়া একপ্রস্থ গিলটির গয়না—সুতহার, পার্শী মাকড়ি, হাতে বাজু অনন্ত বালা। পাড়ার ঝিউড়ী-বউড়ীরা ধন্য ধন্য করেছে করালীকে। ছেলে-ছোকরারাও বাহবা দিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করছে, রেল কোম্পানির ওই আজব কারখানায় চাকরির চেষ্টা ওরাও অতঃপর করবে। পরক্ষণেই দমে যাচ্ছে। যে মাতব্বর। আছে, সে কি ও-মুখে কাউকে হাঁটতে দেবে? করালীর মত বুকের পাটা তাদের নয়, তারা বনওয়ারী মাতব্বরকে অমান্য করে রেল কোম্পানিতে খাটতে যেতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনের সামনে ভেসে ওঠে বনওয়ারীর মূর্তি। চোখ বড় করে হাত তুলে বলছে, পিতি নুরুষের বারণ। সাবোধান। কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর হয়ত করালীকেও এবার কায়দা করলে। তাকে বার বার প্রতিজ্ঞা। করিয়ে নিয়েছে, পঞ্চায়েতের হুকুম অমান্য করা চলবে না। দেবতা-গোঁসাইকে মানতে হবে, অনাচার অধৰ্ম করবে না। পাকাচুলের কথা না-শোন না-ই শুনবে, কিন্তু প্ৰবীণ মুরুরি ‘রপমান’ কখনও করবে না; করালী সে প্রতিজ্ঞা করেছে। এই বিয়ের খরচ নিয়েও বনওয়ারী তাকে বলেছিল—এত ভাল লয় করালী। যা রয় সয় তা করতে হয়। এত খরচ করতে তু পাবি কোথা? করালী অন্য সময় হলে বলত—আজারা
false
shorotchandra
না, সে তোমার শোনবার নয়। বিমলবাবু, আজও আপনার যাওয়া হলো না? বিমলবাবু বলিলেন, না হলো না। জ্যাঠামশাই একটু না সারলে বোধ করি যেতে পারবো না। কথাটা তাঁহার শেষ হইবামাত্র রমণীবাবু সরোষে বলিয়া উঠিলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করে কি তুমি বাইরে গিয়েছিলে? সবিতা শান্তভাবে উত্তর দিল, তুমি ত তখন ছিলে না। জবাবটা ক্রোধ উদ্রেক করিবার মতো নয়, কিন্তু তিনি রাগিয়াই ছিলেন, তাই হঠাৎ চেঁচাইয়া উঠিলেন—থাকি না-থাকি সে আমি বুঝবো, কিন্তু আমার হুকুম ছাড়া তুমি এক-পা বার হবে না আজ স্পষ্ট করে বলে দিলুম। শুনতে পেলে? শুনিতে সকলে পাইলেন; বিমলবাবু সঙ্কোচে ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, রমণীবাবু আজ আমি উঠি—কাজ আছে। না না আপনি বসুন। কিন্তু এই সব বেলাল্লাপনা আমি যে বরদাস্ত করিনে তাই শুধু ওকে জানিয়ে দিলুম। সবিতা প্রশ্ন করিল, বেলাল্লাপনা তুমি কাকে বল? বলি, তুমি যা করে বেড়াচ্চো তাকে। যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানোকে। কাজ থাকলেও যাবো না? না। আমি যা বলবো সেই তোমার কাজ। অন্য কাজ, নেই। তাই ত এতকাল করে এসেচি সেজবাবু, কিন্তু এখন কি আমাকে তোমার অবিশ্বাস হয়? অবিশ্বাস তাহার প্রতি কোনদিন হয় না, তবু ক্রোধের উপর রমণীবাবু বলিয়া বসিলেন, হয়, একশোবার হয়। তুমি সীতা না সাবিত্রী যে অবিশ্বাস হতে পারে না? একজনকে ঠকাতে পেরেচো, আমাকে পারো না। বিমলবাবু লজ্জায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, ইঁহাদের কলহের মাঝখানে কথা বলাও চলে না, কিন্তু সবিতা স্থির হইয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে রমণীবাবুর মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, তারপরে বলিল, সেজবাবু, তুমি জানো আমি মিছে কথা বলিনে। আমাদের সম্বন্ধ আজ থেকে শেষ হলো। আর তুমি আমার বাড়িতে এসো না। কলহ-বিবাদ ইতিপূর্বেও হইয়াছে, কিন্তু সমস্তই এক-তরফা। হাঙ্গামা, চেঁচামেচির ভয়ে চিরদিনই সবিতা চুপ করিয়া গেছে, পাছে গোপন কথাটা কাহারো কানে যায়। সেই নতুন-বৌয়ের মুখের এতবড় শক্ত কথায় রমণীবাবু ক্ষেপিয়া গেলেন, বিশেষতঃ তৃতীয় ব্যক্তির সমক্ষে। মুখখানা বিকৃত করিয়া কহিলেন, কার বাড়ি এ? তোমার? বলতে একটু লজ্জা হলো না? সবিতা তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া বহুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপরে আস্তে আস্তে বলিল, হাঁ, আমার লজ্জা হওয়া উচিত সেজবাবু, তুমি সত্যি কথাই বলেচো। না, এ-বাড়ি আমার নয়, তোমার—তুমিই দিয়েছিলে। কাল আমি আর কোথাও চলে যাবো, তখন সবই তোমার থাকবে। তেরো বৎসর পরে চলে যাবার দিনে তোমার একটা কপর্দকও আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো না, সমস্ত তোমাকে ফিরিয়ে দিলুম। এই কণ্ঠস্বরে রমণীবাবুর চমক ভাঙ্গিল, হতবুদ্ধি হইয়া বলিলেন, কাল চলে যাবে কি রকম? হাঁ, আমি কালই চলে যাবো! চলে যাবো বললেই যেতে দেবো তোমাকে? আমাকে বাধা দেবার মিথ্যে চেষ্টা করো না সেজবাবু, আমাদের সমস্ত শেষ হয়ে গেছে। এ আর ফিরবে না। এতক্ষণে রমণীবাবুর হুঁশ হইল যে ব্যাপারটা সত্যই ভয়ানক হইয়া উঠিল; ভয় পাইয়া কহিলেন, আমি কি সত্যিই বলেচি নতুন-বৌ এ-বাড়ি তোমার নয়, আমার? রাগের মাথায় কি একটা কথা বার হয়ে যায় না? সবিতা কহিল, রাগের জন্য নয়। রাগ যখন পড়ে যাবে—হয়তো দেরি হবে—তখন বুঝবে এতবড় বাড়ি দান করার ক্ষতি তোমার সইবে না, চিরকাল কাঁটার মতো তোমার মনে এই কথাটাই ফুটবে যে, আমাদের দুজনের দেনা-পাওনায় একলা তুমিই ঠকেচো। দাঁড়িপাল্লায় একটা দিক যখন শূন্য দেখবে তখন অন্যদিকে বাটখারার ভার তোমার বুকে যাঁতার মতো চেপে বসবে—সে সহ্য করার শিক্ষা তোমার হয়নি। কিন্তু আর তর্ক করার জোর আমার নেই—আমি বড় ক্লান্ত। বিমলবাবু, আর বোধ করি দেখা হবার আমাদের অবকাশ হবে না—আমি কালকেই চলে যাবো। কোথায় যাবেন? সে এখনো জানিনে। কিন্তু যাবার আগে দেখা হবেই। আমি আবার আসবো। সময় পান আসবেন। আজ কিন্তু আমি চললুম। এই বলিয়া সবিতা আজ উভয়কেই নমস্কার করিয়া উঠিয়া গেল। বিমলবাবু বলিলেন, রমণীবাবু আমারও নমস্কার নিন—চললুম। নয় এতবড় কথাটা জানাজানি হইতে বাকি রহিল না, প্রভাত না হইতেই ভাড়াটেরা সবাই শুনিল কাল রাত্রে কর্তা ও গৃহিণীতে তুমুল কলহ হইয়া গেছে ও নতুন-মা প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন কালই এ-গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন। অন্য কেহ হইলে তাহারা শুধু মৃদু হাসিয়া স্বকার্যে মন দিত, কিন্তু ইঁহার সম্বন্ধে তাহা পারিল না। ঠিক যে বিশ্বাস করিতে পারিল তাহাও নয়, কিন্তু বিষয়টা এতই গুরুতর যে, সত্য হইলে ভাবনার সীমা নাই। শহরে এত অল্পমূল্যে এমন বাসস্থান যে কোথাও মিলিবে না, ভয় এই শুধু নয়, তাহাদের কতদিনের ভাড়া বাকি পড়িয়া আছে এবং কতভাবেই না এই গৃহস্বামিনীর কাছে তাহারা ঋণী। অনেকে প্রায় ভুলিয়াই গেছে এ-গৃহ তাহাদের নিজের নয়। তাহারা সারদাকে ধরিয়া পড়িল এবং সে আসিয়া ম্লান-মুখে কহিল, এ কি কথা সবাই আজ বলাবলি করচে মা? কি কথা সারদা? ওরা বলচে আজই এ-বাড়ি থেকে আপনি চলে যাবেন। ওরা সত্যি কথাই বলেচে সারদা। সত্যি কথা! সত্যিই চলে যাবেন আপনি? সত্যিই চলে যাবো সারদা। শুনিয়া সারদা স্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপরে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কোথায় যাবেন? নতুন-মা বলিলেন, সে এখনো স্থির করিনি, শুধু যেতে যে হবে এইটুকুই স্থির করেচি মা। সারদার দু’চক্ষু জলে ভরিয়া গেল, কহিল, ওরা কেউ বিশ্বাস করতে পারচে না মা, ভাবচে এ কেবল আপনার রাগের কথা—রাগ পড়লেই মিটে যাবে। আমিও ভাবতে পারিনে মা, বিনা-মেঘে আমাদের মাথায় এতবড় বজ্রাঘাত হবে—নিরাশ্রয়ে আমরা কে কোথায় ভেসে যাবো। তবু, ওরা যা জানে না আমি তা জানি। আমি বুঝতে পেরেচি মা, সম্প্রতি এ-বাড়ি আপনার কাছে এত তেতো হয়ে উঠেছে যে, সে
false
bongkim
শুনিলাম। যে নাম জপ করিয়া মরিতে হইবে, তা শুনিয়া লই। তার পর বিদায় দিয়া কাঁদিতে বসি। আ পোড়ারমুখী বসন্ত! না বুঝিয়া, না জানিয়া এ সামগ্রী কেন পাঠাইলি? জানিস না কি, এ জীবনসমুদ্র অমন করিয়া মন্থন করিতে গেলে, কাহারও কপালে অমৃত, কাহারও কপালে গরল উঠে! “আচ্ছা! পরিচয়টা ত দিই |” এই ভাবিয়া রাধারাণী, যাহা প্রাণের অধিক যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা বাহির করিয়া আনিল। সে সেই নোটখানি; বলিয়াছি, রাধারাণী তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল। রাধারাণী তাহা আঁচলে বাঁধিল। বাঁধিতে বাঁধিতে ভাবিতে লাগিল– “আচ্ছা, যদি মনের বাসনা পূরিবার মতনই হয়? তবে শেষ কথাটা কে বলিবে?” এই ভাবিয়া রাধারাণী আপনাআপনি হাসিয়া কুটপাট হইল। “আ, ছি–ছি–ছি! তা ত পারিব না। বসন্তকে যদি আনাইতাম! ভাল, উঁহাকে এখন দুদিন বসাইয়া রাখিয়া বসন্তকে আনাইতে পারিব না? উনি না হয় সে দুই দিন আমার লাইব্রেরি হইতে বহি পড়ুন না! পড়া শুনা করেন না কি? ওঁরই জন্য ত লাইব্রেরি করিয়া রাখিয়াছি। তা যদি দুই দিন থাকিতে রাজি না হন? উঁহার যদি কাজ থাকে? তবে কি হবে? ওঁতে আমাতেই সে কথাটা কি হবে? ক্ষতি কি, ইংরেজের মেয়ের কি হয়? আমাদের দেশে তাতে নিন্দা আছে, তা আমি দেশের লোকের নিন্দার ভয়ে কোন্ কাজটাই করি? এই যে ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিয়ে করলেম না, এতে কে না কি বলে? আমি ত বুড়া বয়স পর্যন্ত কুমারী;-তা এ কাজটা না হয় ইংরেজের মেয়ের মত হইল |” তার পর রাধারাণী বিষণ্ণ মনে ভাবিল, তা যেন হলো; তাতেও বড় গোল! মোমবাতিতে গড়া মেয়েদের মাঝখানে প্রথাটা এই যে, পুরুষ মানুষেই কথাটা পাড়িবে। ইনি যদি কথাটা না পাড়েন? না পাড়েন, তবে–তবে হে ভগবান! বলিয়া দাও, কি করিব! লজ্জাও তুমি গড়িয়াছ–যে আগুনে আমি পুড়িতেছি, তাহাও তুমি গড়িয়াছ! এ আগুনে সে লজ্জা কি পুড়িবে না? তুমি এই সহায়হীনা, অনাথাকে দয়া করিয়া, পবিত্রতার আবরণে আমাকে আবৃত করিয়া লজ্জার আবরণ কাড়িয়া লও। তোমার কৃপায় যেন আমি এক দণ্ডের জন্য মুখরা হই!” সপ্তম পরিচ্ছেদ ভগবান বুঝি, সে কথাও শুনিলেন। বিশুদ্ধচিত্তে যাহা বলিবে, তাহাই বুঝি তিনি শুনেন। রাধারাণী মৃদু হাসি হাসিতে হাসিতে, গজেন্দ্রমনে রুক্মিণীকুমারের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রুক্মিণীকুমার তখন বলিলেন, “আপনি আমাকে বিদায় দিয়াও যান নাই, আমি যে কথা জানিবার জন্য আসিয়াছি, তাহাও জানিতে পারি নাই। তাই এখনও যাই নাই |” রা। আপনি রাধারাণীর জন্য আসিয়াছেন, আমারও মনে আছে। এ বাড়ীতে একজন রাধারাণী আছে, সত্য বটে। সে আপনার নিকট পরিচিত হইবে কি না, সেই কথাটা ঠিক করিতে গিয়াছিলাম। রু। তার পর? রাধারাণী তখন অল্প একটু হাসিয়া, একবার আপনার পা-র দিকে চাহিয়া, আপনার হাতের অলঙ্কার খুঁটিয়া; সেই ঘরে বসান একটা প্রস্তরনির্মিত প্রতিকৃতি পানে চাহিয়া, রুক্মিণীকুমারের পানে চাহিয়া বলিল–“আপনি বলিয়াছেন, রুক্মিণীকুমার আপনার যথার্থ নাম নহে। রাধারাণীর যে আরাধ্য দেবতা, তাহার নাম পর্যন্ত এখনও সে শুনিতে পায় নাই |” রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আরাধ্য দেবতা! কে বলিল?” রাধারাণী কথাটা অনবধানে বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, এখন সামলাইতে গিয়া বলিয়া ফেলিলেন, “নাম ঐরূপে জিজ্ঞাসা করিতে হয় |” কি বোকা মেয়ে। রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আমার নাম দেবেন্দ্রনারায়ণ রায় |” রাধারাণী গুপ্তভাবে দুই হাত যুক্ত করিয়া মনে মনে ডাকিল, “জয় জগদীশ্বর! তোমার কৃপা অনন্ত!” প্রকাশ্যে বলিল, “রাজা দেবেন্দ্রনারায়ণের নাম শুনিয়াছি |” দেবেন্দ্রনারায়ণ বলিলেন, “অমনই সকলেই রাজা কবলায়। আমাকে যে কুমার বলে, সে যথেষ্ট সম্মান করে|” রা। এক্ষণে আমার সাহস বাড়িল। জানিলাম যে, আপনি আমার স্বজাতি। এখন স্পর্ধা হইতেছে, আজি আপনাকে আমার আতিথ্য স্বীকার করাই। দে। সে কথা পরে হবে। রাধারাণী কৈ? রা। ভোজনের পর সে কথা বলিব। দে। মনে দু:খ থাকিলে ভোজনে তৃপ্তি হয় না। রা। রাধারাণীর জন্য এত দু:খ? কেন? দে। তা জানি না, বড় দু:খ-আট বৎসরের দু:খ, তাই জানি! রা। হঠাৎ রাধারাণীর পরিচয় দিতে আমার কিছু সঙ্কোচ হইতেছে। আপনি রাধারাণীকে পাইলে কি করিবেন? দে। কি আর করিব? একবার দেখিব। রা। একবার দেখিবার জন্য এই আট বৎসর এত কাতর? দে। রকম রকমের মানুষ থাকে। রা। আচ্ছা, আমি ভোজনের পরে আপনাকে আপনার রাধারাণী দেখাইব। ঐ বড় আয়না দেখিতেছেন; উহার ভিতর দেখাইব। চাক্ষুষ দেখিতে পাইবেন না। দে। চাক্ষুষ সাক্ষাতেই বা কি আপত্তি? আমি যে আট বৎসর কাতর! ভিতরে ভিতরে দুইজনে দুইজনকে বুঝিতেছেন কিনা জানি না, কিন্তু কথাবার্তা এইরূপ হইতে লাগিল। রাধারাণী বলিতে লাগিল, “সে কথাটায় তত বিশ্বাস হয় না। আপনি আট বৎসর পূর্বে তাহাকে দেখিয়াছিলেন, তখন তাহার বয়স কত? দে। এগার হইবে। রা। এগার বৎসরের বালিকার উপর এত অনুরাগ? দে। হয় না কি? রা। কখনও শুনি নাই। দে। তবে মনে করুন কৌতূহল! রা। সে আবার কি? দে। শুধুই দেখিবার ইচ্ছা। রা। তা, দেখাইব, ঐ বড় আয়নার ভিতর। আপনি বাহিরে থাকিবেন। দে। কেন, সম্মুখ সাক্ষাতে আপত্তি কি? রা। সে কুলের কুলবতী। দে। আপনিও ত তাই। রা। আমার কিছু বিষয় আছে। নিজে তাহার তত্ত্বাবধান করি। সুতরাং সকলের সমুখেই আমাকে বাহির হইতে হয়। আমি কাহারও অধীন নই। সে তাহার স্বামীর অধীন, স্বামীর অনুমতি ব্যতীত– দে। স্বামী! রা। হাঁ! আশ্চর্য হইলেন যে? দে। বিবাহিতা! রা। হিন্দুর মেয়ে–ঊনিশ বৎসর বয়স–বিবাহিতা নহে? দেবেন্দ্রনারায়ণ অনেক্ষণ মাথায় হাত দিয়া রহিলেন। রাধারাণী বলিলেন, “কেন, আপনি কি তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন?” দে। মানুষ কি না ইচ্ছা
false
toslima_nasrin
যায় আল্লাহর কাছে, দেহটা পড়ে থাকে দুনিয়ায়। রুহুটাই সব। রুহু কি করে ওড়ে, শাদা কবুতরের মত? মা বলেছেন রুহু অদৃশ্য, দেখা যায় না। অদৃশ্য কত কি যে আছে দুনিয়ায়। মুবাশ্বেরা মরে যাওয়ার পর শরাফ মামা আল্লাহর পথ থেকে সরে এলেন, তাঁকে নছিহতের কেউ নেই বলে আর। তিনি আবার প্যান্ট শার্ট পরে দুনিয়াদারিতে নামলেন। ঘরের ট্রাংকে তিনি কিছুদিন স্মৃতি তুলে রেখেছিলেন রক্তের দাগ পড়া ত্যানাতুনোর। দাদা ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশি এক ওষুধ কোম্পানির চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহে। দাদা বলেন, চাকরি নিছি মার লাইগা। মারে এই সংসারে কেউ দেখার নাই। কেউ মারে একটা পয়সা দেয় না। মা যেন আর কষ্ট না করে। চাকরির প্রথম বেতন দিয়ে দাদা মা’র জন্য শাড়ি কিনে আনলেন চারটে। মা’র জন্য সোনার বালা গড়তে দিলেন। শাড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদলেন মা। শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দাদার আনা শাড়ি তিনি পরলেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কুঁচি কাটলেন শাড়ির। মা’কে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। দাদাকে বুকে জড়িয়ে মা চোখের জলে ভেসে বললেন — আমার লাইগা আর কিছু কিননের দরকার নাই বাবা। আমার কিছু না হইলেই চলব। তুমি টাকা পয়সা জমাও। তুমার ভবিষ্যতে কাজে লাগব। ন্যূজ্ব, নত মা এখন শিরদাঁড়া টান টান করে হাঁটেন। তাঁর পেটের ছেলে টাকা পয়সা কামাচ্ছে, তাঁর আর কোনও মাগীখোর লোকের কাছে হাত পাতার দরকার নেই। মা’কে এত উচ্ছ্বল, এত প্রাণবান আর কখনও হতে দেখিনি। কাফেরের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলে পাপ হয়, ফজলিখালা তাই নিজে মা’কে নিয়ে কাচারিতে গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে। মা তালাকনামার কাগজে সই করেছিলেন কাচারিতে বসে। বাবার হাতে কাগজ এলে তিনি ধুত্তুরি বলে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সে কাগজ। কাফেরের সঙ্গে এক ছাদের তলে বাস করতে মা’র গা জ্বলে, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন বলে বলেও মা’র কখনও কোথাও চলে যাওয়া হয়নি এ বাড়ি ছেড়ে। মা কোথাও যান নি কখনও, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে, নাকি থেকে গেছেন বাড়িটির জন্য, নিজে হাতে লাগানো গাছপালাগুলোর জন্য, আর বাড়ির মানুষগুলোর জন্য এক অদ্ভুত মায়ায় — সে আমার বোঝা হয়নি। — ইউনিভার্সিটি থেইকা গ্রাজুয়েট হইয়া ফিরছে আমার পুত্রধন। আমার আনন্দ আর ধরে না। বাবা দাঁত কটমট করে চলছেন দাদা ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই। গ্রাজুয়েট ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন মাস্টার ডিগ্রি হাতে নিয়ে ফিরতে, আর দাদা বুক পকেটে আনন্দমোহনের বি এসসি পাশের কাগজ নিয়েই বছর দুই পর ফিরলেন। বাবা বলেন এর চেয়ে মইরা যাওয়া ভাল। দাদা মাছের মত চোখ করে বসে থেকে বাবার টিপ্পনি শোনেন। দাদা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গুছিয়ে বসলেন। ছোটদার খাটটি ঘর থেকে সরিয়ে বাইরে বারান্দায় খাড়া করে রাখলেন। খাটটি সরানোয়, আশ্চর্য, বাবা বিষম রাগ করলেন। তিনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন, বললেন — এই খাট যেইখানে ছিল, সেইখানে নিয়া রাখ। যার খাট সে ফিইরা আইলে থাকব কই! যেমন বিছানা পাতা ছিল, তেমন কইরা রাখ। মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন — কামাল কি আর ফিইরা আইব! শুনছি, শহর ছাইড়া চইলা গেছে। ইসলামপুর না কই যেন থাকে। কি খায় কেমনে থাকে কেডা জানে! বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন শুনে। — কী খায় না খায় তা জাইনা আমার কী! না খাইয়া মইরা যাক। ভুগুক। আমার কী! তুমি হইলা নষ্টের গোড়া। তুমি কথা কইও না। তুমার আসকারা পাইয়া ছেলেমেয়েগুলা নষ্ট হইছে। মা শিরদাঁড়া টান টান করে হেঁটে এসে চিবুক উঁচিয়ে বলেন — কথা কইতাম না ক্যা! আমারে আর কতদিন বোবা বানাইয়া রাখবা! আমি কি কারও খাই না পরি! আমার ছেলেই এহন আমারে টাকা পয়সা দেয়, কাপড় চোপড় দেয়, তেল সাবান দেয়। আমার আর ঠেকা নাই কুনো বেডার। ছেড়াডারে কী পাষন্ডের মত মাইরা বাড়ি থেইকা ভাগাইছে। এহন খাট সাজাইয়া রাইখা কি লাভ। লাভ কী! লাভ, বাবা বলেন, বাবা বুঝবেন, মা’র বোঝার কোনও প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই কিনে এনে ভারি গলায় দাদা নিজে পড়ছেন, আমাকে পড়তে বলছেন। কবিতা পড়তে থাকি একটির পর একটি, দাদা উচ্চারণ শুধরে দেন, কোথায় আবেগ কতখানি দরকার, কোথায় জোর, কোথায় না, কোথায় ধীরে, কোথায় দ্রুত বলে দেন। দাদা বলেন — হৃদয় না ঢাইলা পড়তে পারলে কবিতা পড়বি না। দাদা আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজন করেন দু’জনের। আমরা দু’জনই শ্রোতা, দু’জনই আবৃত্তিকার। দাদা বিচারক। আমার এক নতুন জীবন শুরু হয় দাদার চৌহদ্দিতে। ওষুধ কোম্পানীর একটি লাল নোটবুক আমাকে দেন, প্রতিদিন দুটো তিনটে করে কবিতা লিখে দাদাকে দেখাতে থাকি। কোনওটিকে ভাল বলেন, কোনওটিকে খুব ভাল, কোনওটি সম্পর্কে বলেন — এইডা গু হইছে, কবিতা হয় নাই। কবিতার খাতাটি ইস্কুলের মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজন বাড়ি নিয়ে যায়। খাতাটি আমার হাতে ফিরতে ফিরতে মাস শেষ হয়ে যায়। কাড়াকাড়ি পড়ে যায় মেয়েদের মধ্যে। দাদা মুক্ত বিহঙ্গ নামে আমার একটি কবিতা পড়ে বলেন — ইস, পাতা পত্রিকাডা থাকলে, তর এই কবিতাডা আমি ছাপাইতাম। কেবল কবিতা নয়, গল্পেরও আসর বসান দাদা। দাদা একটি পড়েন, আমি একটি। কোনও কোনও লাইন আহা আহা বলে দু’তিনবার পড়েন, শিখে আমিও তা করি। বাবা বাড়ি ফেরা অবদি আসর রীতিমত গতিময় থাকে। কখনও গানের আসরও বসে। আমাকে গাইতে
false
robindronath
পায়চারি করিয়া পাহারা দিতেছে। ঘরেতে একটি অতি ক্ষুদ্র জানালা কাটা। তাহার মধ্য দিয়া খানিকটা আকাশ, একটা বাঁশঝাড় ও একটি শিবমন্দির দেখা যায়। উদয়াদিত্য প্রথম যখন কারাগারে প্রবেশ করিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। জানালার কাছে মুখ রাখিয়া ভূমিতে গিয়া বসিলেন। বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ জমিয়া আছে। রাস্তায় জল দাঁড়াইয়াছে। নিস্তব্ধ রাত্রে দৈবাৎ দুই-একজন পথিক চলিতেছে, ছপ্‌ ছপ্‌ করিয়া তাহাদের পায়ের শব্দ হইতেছে। পূর্বদিক হইতে কারাগারের হৃৎস্পন্দন-ধ্বনির মতো প্রহরীদের পদশব্দ অনবরত কানে আসিতেছে। এক-এক প্রহর অতীত হইতে লাগিল, দূর হইতে এক-একটা হাঁক শোনা যাইতেছে। আকাশে একটিমাত্র তারা নাই। যে বাঁশঝাড়ের দিকে উদয়াদিত্য চাহিয়া আছেন তাহা জোনাকিতে একেবারে ছাইয়া ফেলিয়াছে। সে-রাত্রে উদয়াদিত্য আর শয়ন করিলেন না, জানালার কাছে বসিয়া প্রহরীদের অবিরাম পদশব্দ শুনিতে লাগিলেন। বিভা আজ সন্ধ্যাবেলায় একবার অন্তঃপুরের বাগানে গিয়াছে। প্রাসাদে বোধ করি অনেক লোক। চারিদিকে দাসদাসী, চারিদিকেই পিসি মাসি, কথায় কথায় “কী হইয়াছে, কী বৃত্তান্ত” জিজ্ঞাসা করে, প্রতি অশ্রুবিন্দুর হিসাব দিতে হয়, প্রতি দীর্ঘনিশ্বাসের বিস্তৃত ভাষ্য ও সমালোচনা বাহির হইতে থাকে। বিভা বুঝি আর পারে নাই। ছুটিয়া বাগানে আসিয়াছে। সূর্য আজ মেঘের মধ্যেই উঠিয়াছে, মেঘের মধ্যেই অস্ত গেল। কখন যে দিনের অবসান হইল ও সন্ধ্যার আরম্ভ হইল বুঝা গেল না। বিকালের দিকে পশ্চিমের মুখে একটুখানি সোনার রেখা ফুটিয়াছিল, কিন্তু দিন শেষ হইতে না হইতেই মিলাইয়া গেল। আঁধারের উপর আঁধার ঘনাইতে লাগিল। দিগন্ত হইতে দিগন্ত আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ঘনশ্রেণী ঝাউগাছগুলির মাথার উপর অন্ধকার এমনি করিয়া জমিয়া আসিল যে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা ব্যবধান আর দেখা গেল না, ঠিক মনে হইতে লাগিল যেন সহস্র দীর্ঘ পায়ের উপর ভর দিয়া একটা প্রকাণ্ড বিস্তৃত নিস্তব্ধ অন্ধকার দাঁড়াইয়া আছে। রাত হইতে লাগিল, রাজবাড়ির প্রদীপ একে একে নিবিয়া গেল। বিভা ঝাউগাছের তলায় বসিয়া আছে। বিভা স্বভাবতই ভীরু, কিন্তু আজ তাহার ভয় নাই। কেবল যতই আঁধার বাড়িতেছে, ততই তাহার মনে হইতেছে যেন পৃথিবীকে কে তাহার কাছ হইতে কাড়িয়া লইতেছে, যেন সুখ হইতে শান্তি হইতে জগৎ-সংসারের উপকূল হইতে কে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছে, অতলস্পর্শ অন্ধকারে সমুদ্রের মধ্যে সে পড়িয়া গিয়াছে। ক্রমেই ডুবিতেছে, ক্রমেই নামিতেছে, মাথার উপরে অন্ধকার ক্রমেই বাড়িতেছে, পদতলে ভূমি নাই, চারিদিকে কিছুই নাই। আশ্রয় উপকূল জগৎ-সংসার ক্রমেই দূর হইতে দূরে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতে লাগিল যেন একটু একটু করিয়া তাহার সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড ব্যবধান আকাশের দিকে উঠিতেছে। তাহার ওপর কত কী পড়িয়া রহিল। প্রাণ যেন আকুল হইয়া উঠিল। যেন ওপারে সকলই দেখা যাইতেছে; সেখানকার সূর্যালোক, খেলাধুলা, উৎসব সকলই দেখা যাইতেছে; কে যেন নিষ্ঠুরভাবে, কঠোর হস্তে তাহাকে ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহার কাছে বুকের শিরা টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেও সে যেন সেদিকে যাইতে দিবে না। বিভা যেন আজ দিব্যচক্ষু পাইয়াছে; এই চরাচরব্যাপী ঘনঘোর অন্ধকারের উপর বিধাতা যেন বিভার ভবিষ্যৎ অদৃষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন, অনন্ত জগৎ-সংসারে একাকী বসিয়া বিভা যেন তাহাই পাঠ করিতেছে; তাই তাহার চক্ষে জল নাই, দেহ নিস্পন্দ, নেত্র নির্নিমেষ। রাত্রি দুই প্রহরের পর একটা বাতাস উঠিল, অন্ধকারে গাছপালাগুলা হা হা করিয়া উঠিল। বাতাস অতি দূরে হূ হূ করিয়া শিশুর কণ্ঠে কাঁদিতে লাগিল। বিভার মনে হইতে লাগিল, যেন দূর দূর দূরান্তরে সমুদ্রের তীরে বসিয়া বিভার সাধের স্নেহের প্রেমের শিশুগুলি দুই হাত বাড়াইয়া কাঁদিতেছে, আকুল হইয়া তাহারা বিভাকে ডাকিতেছে, তাহারা কোলে আসিতে চায়, সম্মুখে তাহারা পথ দেখিতে পাইতেছে না, যেন তাহাদের ক্রন্দন এই শত যোজন লক্ষ যোজন গাঢ় স্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করিয়া বিভার কানে আসিয়া পৌঁছিল। বিভার প্রাণ যেন কাতর হইয়া কহিল, “কে রে, তোরা কে, তোরা কে কাঁদিতেছিস, তোরা কোথায়।” বিভা মনে মনে যেন এই লক্ষ যোজন অন্ধকারের পথে একাকিনী যাত্রা করিল। সহস্র বৎসর ধরিয়া যেন অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিল, পথ শেষ হইল না, কাহাকেও দেখিতে পাইল না। কেবল সেই বায়ুহীন শব্দহীন দিনরাত্রিহীন জনশূন্য তারাশূন্য দিগ্‌দিগন্তশূন্য মহান্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে চারি দিক হইতে ক্রন্দন শুনিতে পাইল, কেবল বাতাস দূর হইতে করিতে লাগিল হূ হূ। সমস্ত রাত্রি অনিদ্রায় কাটিয়া গেল। পরদিন বিভা কারাগারে উদয়াদিত্যের নিকট যাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিল, সেখানে তাহার যাওয়া নিষেধ। সমস্ত দিন ধরিয়া অনেক কাঁদাকাটি করিল। এমন কি স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের কাছে গেল। বিভা তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিল। অনেক কষ্টে সম্মতি পাইল। পরদিন প্রভাত হইতে না হইতেই বিভা শয্যা হইতে উঠিয়া কারাগৃহে প্রবেশ করিল। গিয়া দেখিল উদয়াদিত্য বিছানায় শোন নাই। ভূমিতলে বসিয়া বাতায়নের উপরে মাথা দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। দেখিয়া বিভার প্রাণ যেন বুক ফাটিয়া কাঁদিয়া উঠিতে চাহিল। অনেক কষ্টে রোদন সংবরণ করিল। অতি ধীরে নিঃশব্দে উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বসিল। ক্রমে প্রভাত পরিষ্কার হইয়া আসিল। নিকটের বন হইতে পাখিরা গাহিয়া উঠিল। পাশের রাজপথ হইতে পান্থেরা গান গাহিয়া উঠিল, দুই-একটি রাত্রি-জাগরণে ক্লান্ত প্রহরী আলো দেখিয়া মৃদুস্বরে গান গাহিতে লাগিল। নিকটস্থ মন্দির হইতে শাঁখ-ঘণ্টার শব্দ উঠিল। উদয়াদিত্য সহসা চমকিয়া জাগিয়া উঠিলেন। বিভাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “এ কী বিভা, এত সকালে যে?” ঘরের চারি দিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, “এ কী, আমি কোথায়?” মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়িল, তিনি কোথায়। বিভার দিকে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আঃ! বিভা, তুই আসিয়াছিস? কাল তোকে সমস্তদিন দেখি নাই, মনে হইয়াছিল বুঝি তোদের আর দেখিতে পাইব না।” বিভা উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল, “দাদা, মাটিতে বসিয়া কেন? খাটে
false
humayun_ahmed
একটা আঙটি। ইলার আঙটি। সে আঙটি খুলে হাত ধুয়েছিল। তারপর আর পরতে মনে নেই। এমন কোন ভয়ংকর ঘটনা না। কিন্তু জামান কি বিশ্রী কাণ্ড করল। হাত উঁচিয়ে ছুটে এল–কাণ্ডজ্ঞান নেই? তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? ইলার বয়স চব্বিশ। এই চব্বিশ বছরের জীবনে সে প্রথম একজনকে দেখল যে হাত উঁচিয়ে তাকে মারতে আসছে। আঙটি ফেলে আসায় যে মানুষ এমন করেছে সে যদি শুনে ইলার স্যুটকেসে তার মানিব্যাগ। মাঝে মাঝে সেখান থেকে টাকা বের করে সে খরচ করে। তাহলে কি করবে? তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু ইলা শুনতে পারে। এমন ভয়ংকর কিছু যে শোনার পর ঐ মানুষটা হাত উঁচিয়ে তাকে মারতে আসবে না কারণ তার সেই ক্ষমতা থাকবে না। সে অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ইলাকে দেখবে। কিংবা মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাবে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হবে। টিভিতে ম্যাকগাইভার শুরু হবার পর ইলা নিচে নামল। ম্যাকগাইভারের কাণ্ডকারখানা দেখবে না। ভয়ে বুক ধড়ফড় করাটা তাহলে আবার শুরু হতে পারে। গেট খোলা রাখার কথা হাসানকে বলে আসতে হবে। পেছনের বাড়ির ঐ ঘটনার পর দশটা বাজার আগেই গেট বন্ধ করে দিচ্ছে। হাসানকে পাওয়া গেল না। সে বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় ক্যাম্পখাট পেতে ঘুমায়। ঝড় বৃষ্টির সময়ও একই জায়গা। তখন পর্দার মত কি যেন দেয়। এই ছেলেটির জন্যে বাড়ির ভেতরে কোন জায়গা হয় নি। আজ ঝড় না হোক, বৃষ্টি হবে। অসহ্য গরম পড়েছে। আকাশ মেঘলা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ইলা বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে বলে আসতে গেল। বৃষ্টির মধ্যে জামান এসে যদি দাঁড়িয়ে থাকে, আর যদি গেট খোলা না হয় তার পরবর্তী অবস্থা কি হবে চিন্তা করা যায় না। বাড়িওয়ালার স্ত্রী সুলতানী খেতে বসেছেন। আজ তাঁকে অন্যদিনের চেয়েও মোটা লাগছে। গলার চামড়া থলথল করছে। ব্লাউজের বোতাম লাগান নি। তাঁর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ইলাকে দেখে বললেন–বসে যাও তো মা। চারটা ভাত খাও আমার সাথে। রূপচান্দা শুটকির দোপেঁয়াজা। ঝাল ঝাল করে রাঁধা। খেয়ে দেখ। ইলা বলল, আরেক দিন খাব। আজ রাতে গেটটা একটু খোলা রাখতে হবে। হাসানকে যদি একটু বলে দেন। দিব, বলে দিব। আরেকটা কাজ আছে। অন্তুকে ডাক্তার দেখাতে হবে। চিন্তা করো না তে। হাসান নিয়ে যাবে। সারাদিন তো ঘরে বসেই ঝিমায়। ঐ দিন মগবাজার যাবে–আমার কাছে রিকশা ভাড়া চায়। চিন্তা করে দেখ কত বড় সাহস। মগবাজার এমন কি দূর। গাখী, তুই হেঁটে চলে যা। এত বাবুয়ানা কিসের? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা শুনতে ভাল লাগছে না, আবার চলে যাওয়া যাচ্ছে না। খাওয়া বন্ধ রেখে একজন এত আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে তার সামনে থেকে উঠে চলে যাওয়া যায় না। বস না মা, দাঁড়িয়ে আছ কেন? অন্তু একা আছে। থাকুক না একা। একটা জিনিস তোমার মধ্যে দেখি যেটা আমার পছন্দ না। কাজের লোক তুমি মাথায় তুলে রাখ। কাজের লোক থাকবে কাজের লোকের মত। কয়েকদিন আগে দেখলাম রিকশা করে যাচ্ছ, চাকর ছোঁড়া বসে আছে তোমার পাশে। সে বসবে নিচে। পায়ের কাছে। পাশে বসালে এরা কোলে বসতে চাইবে। খালা এখন যাই। আহা বস না। পেপসি আছে–পেপসি খাবে। খাও একটা পেপসি। ও রত্না, পেপসি দে। ইলাকে বসতে হল। পেপসির গ্লাস হাতে নিতে হল। সুলতানা গলা নিচু করে বললেন, পেছনের বাড়ির ঘটনা পত্রিকায় উঠেছে, দেখেছ? ব্যাপার সব ফাস করে দিয়েছে। রেইপ কেইস। হেডিং ছিল–গৃহবধূ ধর্ষিতা। আমি মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসবেন্ড্রটা খুব চালাক। চোখে মুখে কথা বলে। আমাকে বলে কি–খালাম্মা দেখেন না– পত্রিকায় বানিয়ে বানিয়ে কি সব লিখেছে। এখন কাউকে মুখ দেখাতে পারি না। আমি মানহানির মামলা করব। হাতকড়া পরাব। দুজন এডভোকেটের সাথে আলাপও করেছি। বুঝলে ইলা, ইতং বিতং কথা বলেই যাচ্ছে। শাক দিয়ে কি আর মহি ঢাকা যায়? পত্রিকায় কি উঠেছে সেই ঘটনার সবটা ইলাকে শুনতে হল। সুলতানা ফিস ফিস করে বললেন, ঘটনা আরো আছে। এত বড় ঘটনা ঘটল আর মেয়ে সাড়াশব্দ করল না। চুপ করে রইল। এর কারণ কি? চিৎকার দিলেও তো দশজনে শুনত? কিছু মেয়ে আছে এইসব পছন্দ করে … তারা চায় রেইপড হতে। একজনে মন ভরে না। ইলা বলল, খালা আমি উঠি? অহি মা বোস না, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। তোমার ছোট বোনটাকে ঐদিন দেখলাম। মুখের কাটিং ভাল। রঙ ময়লা, রঙ ভাল হলে আমার ছেলেটার জন্য বলতাম–কালো মেয়ে বিয়ে করিয়ে কি হবে… ইলা উঠে পড়ল। আর বসে থাকা যায় না। টুকটুক করে কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে। ইলার বুক ধক করে উঠল। তার কি বিশ্রী কোন অসুখ হয়ে যাচ্ছে? দরজার সামান্য টোকায় পৃখিবীর কেউ এমন চমকে উঠে না। সে চমকাচ্ছে কেন? কে? ভাবী আমি। আমি হাসান। আপনি কি আমাকে খুঁজছিলেন? হ্যাঁ খুঁজছিলাম। ইলা দরজা খুলতে খুলতে বলল, তোমাকে না একবার বলেছি আপা ডাকতে। আজ আবার ভাবী ডাকছ। দাঁড়িয়ে আছ কেন, ভেতরে আস। হাসান খুব অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ইলা বলল, ভাই, আমাকে আরেকটা কাজ করে দিতে হবে। অন্তুর মুখের অবস্থা দেখ। ফুলেটুলে কি হয়েছে। ডাক্তারের কাছে একটু নিয়ে যাবে। জ্বি আচ্ছা। ঐ দিনের কিছু টাকা পাওনা ছিল, ঐ টাকাও তো নাও নি। এখন দিয়ে দিন। আরেকটা কাজ করে দিতে হবে। অন্তু মিয়ার জন্যে একটা মশারি কিনে দিতে হবে। সিঙ্গেল মশারি।
false
humayun_ahmed
ধমক দিয়ে তিশকে বিদায় করলাম। এবং বলে দিলাম এক্ষুণি যেন ইনো নামের মেয়েটিকে সত্যি কথাটা বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী তরুণীর সঙ্গেও আমি কথা বলতে আগ্রহী নই। তিশ আমার সব কথা শশানে না। অনেক কাজ সে তার নিজের লজিক খাটিয়ে করে। কাজেই সে ইনোকে কিছুই বলল না। এবং ইনো নামের অত্যন্ত রূপবতী বালিকা বালিকা চেহারার মেয়েটি এক সময় আমার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বলল, আসব? এই জাতীয় একটি মেয়ের মুখের ওপর না বলা খুব মুশকিল। আমি হা-না কিছুই বললাম না। তিশ আমাকে বলল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। সাহসের অভাবে বলতে পারছেন না। তিশ সত্যি কথা বলে নি। বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। আপনার সঙ্গেই শুধু নয়, কারো সঙ্গেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেন করে না? জানি না কেন। মানুষের সঙ্গ আমার কাছে অসহ্য বলে মনে হয়। আমার সঙ্গও অসহ্য বোধ হচ্ছে? হ্যাঁ, হচ্ছে। সত্যি বলছেন? হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আপনিলে গেলেই আমি খুশি হব। মেয়েটি চলে গেল না। ঘরে ঢুকল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আপনি আমাকে তাড়াবার জন্য এইসব বলছেন। কিন্তু আমি এত সহজে যাচ্ছি না। আমার বয়স একত্রিশ। গত পঁচিশ বছরের কথা আমার মনে আছে। এই পঁচিশ বছরে কেউ আমাকে বলে নি যে আমার সঙ্গ তার পছন্দ নয়। যদিও আমি অনেকের সঙ্গ পছন্দ করি না। তবে পছন্দ না করলেও কাউকে মুখের ওপর সে কথা বলতে পারি না। এত সাহস আমার নেই। আমি বোধ হয় একটু বেশি কথা বলছি, তাই না? হ্যাঁ। তাই। বিশ্বাস করুন আমি এত কথা বলি না। কিন্তু মহাকাশযানে উঠবার পর থেকে কেন জানি ক্ৰমাগত কথা বলছি। এটা বোধ হয়, হচ্ছে ভয় পাওয়ার কারণে। ভীত মানুষ দুধরনের কাণ্ড করে হয় আমার মতো বেশি কথা বলে, নয় আপনার মতো কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতো, তাই না? না। বলেন কী! হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে যাচ্ছেন, এটা ভেবেও কি আপনার ভয় বা রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছে না? না, আমি কিছু ভাবি না। সে কি! কেন? ভাবতে ইচ্ছা করে না। ইএসপি ক্ষমতাধর সব মানুষই কি আপনার মতো হয়? তাও আমি জানি না। এরকম কারো সঙ্গে আমার এখনো দেখা হয় নি। ইনো খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, এখানে আসার পেছনে আমার অন্য একটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে উদ্দেশ্যটা বলব। ইনো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তরল চোখ। কিছু কিছু চোখ আছে তাকালে মনে হয় জলভরা চোখ। যেন চোখের ভেতরের টলটল জল দেখা যাচ্ছে। আমি কিছুই বললাম না। ইনো বলক, আমি এসেছি আপনার ইএসপি ক্ষমতা কী রকম তা পরীক্ষা করে দেখতে। আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি অস্বীকার করলে তো হবে না। আমাদের বলা হয়েছে আপনার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রতিটি জেনার টেস্টে আপনি এক শ করে পেয়েছেন। কেউ তা পায় না। জেনার টেস্টের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বেশ, না জানলে ক্ষতি নেই। এখন মন দিয়ে শুনুন আমি কি বলছি। আমার জ্যাকেটের পকেটে এক খণ্ড কাগজে আমি তিন লাইনের একটা কবিতা লিখে এনেছি। কী লিখেছি আপনি কি বলতে পারবেন? কাগজটা না দেখে কী করে বলব? কী লেখা আছে তা জানতে হলে লেখাগুলি আমাকে পড়তে হবে। লেখা পড়ে তো যে কেউ বলতে পারবে। তাহলে আপনার বিশেষত্ব কোথায়? বিশেষত্ব কিছুই নেই। এখন আপনি যদি দয়া করে উঠে যান এবং আমাকে একা থাকতে দেন তাহলে খুব খুশি হব। ইনো উঠে দাঁড়াল। অপমানে মেয়েটির মুখ কালো হয়ে গেছে। তার অপমানিত মুখ দেখতে আমার একটু যেন খারাপই লাগছে। সে আমাকে কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নামিয়ে নিল। আর ঠিক তখন বিদ্যুৎ চমকের মতো তার জ্যাকেটের পকেটে রাখা কাগজটির লেখাগুলি আমি পড়তে পারলাম। ব্যাপারটা কী করে হল আমি নিজেও জানি না। প্রতিটি লাইন জ্বলজ্বল করছে। রাত্রি কখনো সূর্যকে পায় না। তাতে ক্ষতি নেই। কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। এক বার ইচ্ছা হল, কাগজটায় কী লেখা ইনোকে বলি। তারপরই ভাবলাম কী দরকার? কী হবে বলে? ইনো নরম গলায় বলল, আপনি যে সত্যি সত্যি বিরক্ত হচ্ছিলেন তা বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে আমি এতক্ষণ বসে থাকতাম না। আমি খুবই লজ্জিত, আমাকে ক্ষমা করবেন। সে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে এলোমেলো ভাবে। প্রচুর মদ্যপানের পর মানুষ ঠিক এই ভঙ্গিতেই হাঁটে। আমি এত কঠিন না হলেও পারতাম না। তিশ যখন খাবার নিয়ে এল তখন তাকে বললাম, তিশ, তুমি জীববিজ্ঞানী ইনোকে একটা কৰ্থা বলে আসতে পারবে। তিশ উৎফুল্ল গলায় বলল, অবশ্যই পারব। কী কথা? কবিতার তিনটি লাইন–রাত্রি কখনো সূর্যকে পায় না।/তাতে ক্ষতি নেই।/কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি। তিশ অবাক হয়ে বলল, এর মানে তো কিছু বুঝতে পারছি না। সূর্য যা, নক্ষত্রও তো তাই। নাম ভিন্ন কিন্তু জিনিস তো একই। তোমার বোঝার দরকার নেই। ইনোকে বললেই তিনি বুঝবেন। আর যদি বুঝতে না পারে? যদি আমাকে বুঝিয়ে দিতে বলে, তা হলে তো মুশকিলে পড়ব। তোমাকে যা করতে বলছি তাই কর। বেশ, করব। আমাকে শুধু একটা কথা বল–এটা কি কোনো প্রেমবিষয়ক কবিতা? জানি না। ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। প্রেম বিষয়ক কবিতা বলেই তো মনে হচ্ছে। তিশকে খুব
false
robindronath
দেখেই বুঝেছি টাকার সুবিধে করতে পার নি।” “নাই যদি পেরে থাকি, সেটা জেনে তোমার লাভ হবে কী?” “সে আমি বলতে পারি নে, কিন্তু আমাকে জানতেই হবে। টাকা ধার পাও নি তুমি?” “না, পাই নি।” “সহজে পাবে না?” “পাব নিশ্চয়ই, কিন্তু সহজে নয়। তা দিদি, তোমার কথার জবাব দেওয়ার চেষ্টা ছেড়ে পাবার চেষ্টায় বেরোলে কাজ হয়তো কিছু এগাতে পারে। আমি চললুম।” খানিকটা গিয়েই আবার ফিরে এসে কালু বললে, “খুকি, এখানে যে তুমি আজ চলে এলে, তার মধ্যে তো কোনো কাঁটা খোঁচা নেই? ঠিক সত্যি করে বলো।” “আছে কি না তা আমি খুব স্পষ্ট করে জানি নে।” “স্বামীর সম্মতি পেয়েছ?” “না চাইতেই তিনি সম্মতি দিয়েছেন।” “রাগ করে?” “তাও আমি ঠিক জানি নে; বলেছেন, ডেকে পাঠাবার আগে আমার যাবার দরকার নেই।” “সে কোনো কাজের কথা নয়, তার আগেই যেয়ো, নিজে থেকেই যেয়ো।” “গেলে হুকুম মানা হবে না।” “আচ্ছা, সে আমি দেখব।” দাদা আজ এই-যে বিষম বিপদে পড়েছে, এর সমস্ত অপরাধ কুমুর, এ কথা না মনে করে কুমু থাকতে পারল না। নিজেকে মারতে ইচ্ছে করে, খুব কঠিন মার। শুনেছে এমন সন্ন্যাসী আছে যারা কণ্টকশয্যায় শুয়ে থাকে, ও সেইরকম করে শুতে রাজি, যদি তাতে কোনো ফল পায়। কোনো যোগী কোনো সিদ্ধপুরুষ যদি ওকে রাস্তা দেখিয়ে দেয় তা হলে চিরদিন তার কাছে বিকিয়ে থাকতে পারে। নিশ্চয়ই তেমন কেউ আছে, কিন্তু কোথায় তাকে পাওয়া যায়? যদি মেয়েমানুষ না হত তা হলে যা হয় একটা কিছু উপায় সে করতই। কিন্তু মেজদাদা কী করছেন? একলা দাদার ঘাড়ে সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কোন্‌ প্রাণে ইংলণ্ডে বসে আছেন? কুমু ঘরে ঢুকে দেখে বিপ্রদাস কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিছানায় পড়ে আছে। এমন করলে শরীর কি সারতে পারে! বিরুদ্ধ ভাগ্যের দুয়ারে মাথা কুটে মরতে ইচ্ছে করে। দাদার শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে কুমু বললে, “মেজদাদা কবে আসবেন?” “তা তো বলতে পারি নে।” “তাকে আসতে লেখো-না।” “কেন বল্‌ দেখি!” “সংসারের সমস্ত দায় একলা তোমারই ঘাড়ে, এ তুমি বইবে কী করে?” “কারো-বা থাকে দাবি, কারো-বা থাকে দায়; এই দুই নিয়ে সংসার। দায়টাকেই আমি আমার করেছি, এই আমি অন্যকে দেব কেন?” “আমি যদি পুরুষমানুষ হতুম জোর করে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতুম।” “তা হলেই তো বুঝতে পারছিস কুমু, দায় ঘাড়ে নেবার একটা লোভ আছে। তুই নিজে নিতে পারছিস নে বলেই তোর মেজদাদাকে দিয়ে সাধ মেটাতে চাস। কেন আমিই-বা কী অপরাধ করেছি।” “দাদা, তুমি টাকা ধার করতে এসেছ?” “কিসের থেকে বুঝলি?” “তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। আচ্ছা, আমি কি কিছুই করতে পারি নে?” “কী করে বলো?” “এই মনে করো, কোনো দলিলে সই করে। আমার সইয়ের কি কোনো দামই নেই?” “খুবই দাম আছে; সে আমাদের কাছে, মহাজনের কাছে নয়।” “তোমার পায়ে পড়ি দাদা, বলো, আমি কী করতে পারি।” “লক্ষ্মী হয়ে শান্ত হয়ে থাক্‌, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর্‌, মনে রাখিস সংসারে সেও একটা মস্ত কাজ। তুফানের মুখে নৌকো ঠিক রাখাও যেমন একটা কাজ, মাথা ঠিক রাখাও তেমনি। আমার এসরাজটা নিয়ে আয়, একটু বাজা।” “দাদা, আমার বড়ো ইচ্ছে করছে একটা কিছু করি।” “বাজানোটা বুঝি একটা কিছু নয়।” “আমি চাই খুব একটা শক্ত কাজ।” “দলিলে নাম সই করবার চেয়ে এসরাজ বাজানো অনেক বেশি শক্ত। আন্‌ যন্ত্রটা।” একদিন মধুসূদনকে সকলেই যেমন ভয় করত, শ্যামাসুন্দরীরও ভয় ছিল তেমনি। ভিতরে ভিতরে মধুসূদন তার দিকে কখনো কখনো যেন টলেছে, শ্যামাসুন্দরী তা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু কোন্‌ দিক দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে যে ওর কাছে যাওয়া যায় তা ঠাহর করতে পারত না। হাতড়ে হাতড়ে মাঝে মাঝে চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবার ফিরেছে ধাক্কা খেয়ে। মধুসূদন একনিষ্ঠ হয়ে ব্যাবসা গড়ে তুলছিল, কাঞ্চনের সাধনায় কামিনীকে সে অত্যন্তই তুচ্ছ করেছে, মেয়েরা সেইজন্যে ওকে অত্যন্তই ভয় করত। কিন্তু এই ভয়েরও একটা আকর্ষণ আছে। দুরু দুরু বক্ষ এবং সংকুচিত ব্যবহার নিয়েই শ্যামাসুন্দরী ঈষৎ একটা আবরণের আড়ালে মুগ্ধমনে মধুসূদনের কাছে কাছে ফিরেছে। এক-একবার যখন অসতর্ক অবস্থায় মধুসূদন ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিয়েছে, সেই সময়েই যথার্থ ভয়ের কারণ ঘটেছে; তার অনতিপরেই কিছুদিন ধরে বিপরীত দিক থেকে মধুসূদন প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে ওর জীবনে মেয়েরা একেবারেই হেয়। তাই এতকাল শ্যামাসুন্দরী নিজেকে খুবই সংযত করে রেখেছিল। মধুসূদনের বিয়ের পর থেকে সে আর থাকতে পারছিল না। কুমুকে মধুসূদন যদি অন্য সাধারণ মেয়ের মতোই অবজ্ঞা করত, তা হলে সেটা একরকম সহ্য হত। কিন্তু শ্যামা যখন দেখলে রাশ আলগা দিয়ে মধুসূদনও কোনো মেয়েকে নিয়ে অন্ধবেগে মেতে উঠতে পারে, তখন সংযম রক্ষা তার পক্ষে আর সহজ রইল না। এ কয়দিন সাহস করে যখন তখন একটু একটু এগিয়ে আসছিল, দেখেছিল এগিয়ে আসা চলে। মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প বাধা পেয়েছে কিন্তু সেও দেখলে কেটে যায়। মধুসূদনের দুর্বলতা ধরা পড়েছে, সেইজন্যেই শ্যামার নিজের মধ্যেও ধৈর্য বাঁধ মানতে আর পারে না। কুমু চলে আসবার আগের রাত্রে মধুসূদন শ্যামাকে যত কাছে টেনেছিল এমন তো আর কখনোই হয় নি। তার পরেই ওর ভয় হল পাছে উলটো ধাক্কাটা জোরে এসে লাগে। কিন্তু এটুকু শ্যামা বুঝে নিয়েছে যে, ভীরুতা যদি না করে তবে ভয়ের কারণ আপনি কেটে যাবে। সকালেই মধুসূদন বেরিয়ে গিয়েছিল, বেলা একটা পেরিয়ে বাড়ি এসেছে। ইদানীং অনেক কাল
false
tarashonkor
কথা সেতাবের মনে আছে। বাপ প্রতাপ মণ্ডলের ঠিকাদারির জমজমাট আমলে সেও বাপের মত নিজেকে এ গ্রামের সকল ছেলে হইতে পৃথক বলিয়া ভাবিতে শুরু করিয়াছিল। আর মহাতাপ একেবারে প্রায় আদুরে গোপাল বনিয়া গিয়াছিল। ছেলেবেলা হইতেই মহাতাপ সরল চঞ্চল। বাপের অবস্থার আকস্মিক উন্নতিতে সে আদর পাইয়া হইয়া উঠিয়াছিল দুর্দান্ত। সবই মনে আছে সেতাবের। ইউনিয়ন বোর্ডের সেক্রেটারি পাঠক সেদিন যে বলিয়া গেল গাড়িওয়ালারা ও মজুরেরা দল বাঁধিয়া পাওনার জন্য আসিবে এবং গোলা ভাঙিয়া ধান বিক্রি করিয়া টাকা উসুল করিয়া লইবে সে কথা সে মিথ্যা বলে নাই। একদিন সত্যই তাহারা আসিল। সঙ্গে আসিল প্রতাপের জ্ঞাতিভাই ধানের পাইকার গোপাল ঘোষ; ওই ঘোঁতন ঘোষের বাপ। সেতাব মহাতাপের মা তখন বউ মানুষ, বয়সও অল্প, তিরিশও হয় নাই; সেদিন সে ঘোমটা খুলিয়া গিয়া দাঁড়াইল মোটা মোড়লের বাড়িতে। মোটা মোড়ল ধর্মভীরু মানুষ এবং ভাল মানুষ। প্রতাপের সঙ্গে ইদানীং তাহার কথাবার্তা বড় একটা ছিল না। মোটা মোড়ল গ্রাম সম্পর্কে দাদা বলিয়া কয়েকবার প্রতাপকে সৎপরামর্শ দিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু প্রতাপ সে কথার উত্তরে বলিয়াছিল—আমার উন্নতিতে বুক সবার টাটিয়ে গেল তা আমি জানি। পরামর্শ আমি কারুর চাই না। মোটা মোড়ল এ উত্তরে আঘাত পাইয়াছিল। সেদিন হরিকে স্মরণ করিয়া প্রতাপের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিল এবং সেই হইতে এদিক আর বড় মাড়ায় নাই। পথে প্রতাপের সঙ্গে দেখা হইলে পাশ কাটাইয়া সরিয়া যাইত। কিন্তু প্রতাপের বিধবা বধূ সেদিন গিয়া দাঁড়াইবা মাত্র সে বলিল—সে কি! চল মা চল! দেখি। সে আসিয়া খাতা দেখিয়া ধান বিক্রি করিয়া সকলের পাওনা শোধ করিয়া দিল। পাঠককে বলিল—হিসাবের খাতাটা যে একবার বার করতে হবে পাঠক মশাই! পাঠক আকাশ হইতে পড়িলখাতা তো মোড়লের বাড়িতে। খাতাপত্র তো আমি জানি না। মোটা মোড়ল অনেক চেষ্টা করিয়াও পাঠককে কায়দা করিতে পারিল না। গোটা গ্রামের লোক প্রতাপের ছেলেদের বিরুদ্ধেই একরকম দাঁড়াইয়াছিল। মোটা মোড়ল একা কোনো রকমেই তাহাদের বুঝাইতে পারিল না। দোষী প্রতাপ মরিয়া গিয়াছে, তাহার ছেলেরা নির্দোষ নিরপরাধ একথা তাহারা কোনো রকমেই বুঝিল না। ওদিকে হঠাৎ মহাজন নালিশ করিয়া বসিল–সে টাকা পাইবে। তিন হাজার টাকা। তিন হাজার টাকা? প্রতাপ মোড়ল টাকা ধার করিয়াছে? পাঠক বলিল–করিয়াছে। হ্যান্ডনেটের বয়ান সে লিখিয়াছে এবং প্রতাপ সই করিয়াছে। ব্যবসায়ের জন্য টাকার প্রয়োজন হইয়াছিল। সকল ব্যবসায়ীকেই ধার করিতে হয়। ব্রাহ্মণ সন্তান হইয়া মিথ্যা বলতে পাঠক পারিবে না। আসল কথা কিন্তু অন্য। দরখাস্ত ইত্যাদির জন্য প্রতাপ কিছু সাদা কাগজে সই করিয়া পাঠককে দিয়াছিল। পাঠক মহাজনের সঙ্গে ষড়যন্ত্ৰ করিয়া সেই কাগজে হ্যান্ডনেট বানাইয়াছে। এদিকে ছোট ছেলে মহাতাপ পড়িল জ্বরে। জ্বর দাঁড়াইল টাইফয়েডে। প্রতাপের টাইফয়েডের বিষ তাহাকে পাড়িয়া ফেলিল। যমে মানুষে টানাটানি করিয়া মহাতাপ বাঁচিল কিন্তু কেমন বোকা বুদ্ধিহীন হইয়া গেল। প্রথম প্রথম কথার জড়তা হইয়াছিল। কথা বলিলে বুঝিতে পারি না, ফ্যালফাল করিয়া মানুষের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিত। সেতাবের মনে পড়ে সেতাবও সারা পৃথিবীর দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিত। সে নেহাত ছোট ছিল না। বুঝিবার বয়স তাহার হইয়াছিল। বাপ বাঁচিয়া থাকিতে শুনিত পাঠক বলিত, আরও দু-চার জন বলিত, মোড়ল, ছেলেকে তুমি ভাল করে পড়াও। ওকে ওভারসিয়ারি পড়াবে। ওভারসিয়ার হলে এ ব্যবসা একেবারে হইহই করে চলবে। কথাটা কি করিয়া ছড়াইয়া পড়িয়া নবগ্রামের ইস্কুল পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। সেখানে ঘোঁতন ছিল তাহার সহপাঠী। ঘোঁতন পড়াশুনাতে ভাল ছিল এবং নবগ্রামের আধাশহুরে ফ্যাশন ও কথাবার্তাতেও পাকা ছিল। সে তাহাকে ঠাট্টা করিয়া ওপোর স্যার বলিয়া ডাকিতে শুরু করিয়াছিল। তাহাতে সেতাব লজ্জা অনুভব করিত বটে কিন্তু তাহার মধ্যেও গোপন অহঙ্কার অনুভব করিত। হঠাৎ বাপ মরিতেই ঘোঁতনের ওই ঠাট্টাটা মারাত্মক রূপে অসহনীয় হইয়া উঠিল। অন্যদিকে গ্রামে পথে ঘাটে লোকজন তাহাকে দেখিয়া বলিতে শুরু করিল—ছেলেটা তো বড় হয়েছে, আবার পড়া কেন রে বাপু? এই অবস্থায়! যা হোক কুলকর্মে লাগলে দুমুঠো খেতে পাবে তো। পড়েই বা করবে কি? হুঁ। ওদিকে ম গাজন নালিশ করিয়া ডিক্রি করিল। প্রায় বিঘা দশেক জমি বিক্রি হইয়া গেল। বৎসরের শেষে কৃষাণ মজুরেরা অবশিষ্ট জমির ধান তুলিয়া ভাগ করিয়া যে ধান লইয়া মণ্ডলবাড়ির উঠানে মরাই বাঁধিল তাহাতে বাড়ির উঠানের একটা কোণও ভাল করিয়া ভরিল না। অথচ আগে উঠানটার অর্ধেকটা মরাইয়ে মরাইয়ে ভরিয়া থাকিত। সেতাব মহাতাপের লুকোচুরি খেলার আদর্শ ক্ষেত্র হইয়া উঠিত। সেতাবের মা মরাইয়ের দিকে তাকাইয়া দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিল, সঙ্গে সঙ্গে চোখে জল গড়াইয়া আসিল। আর বছর দুয়ের মধ্যে আরও দুঃসময় আসিল। সেদিনও সেতাবের মা কাঁদতেছিল। সেতাব সেদিন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া নির্বাক হইয়া বসিয়া ছিল। পরীক্ষায় সে একটা বিষয়ে ফেল করিয়াছে। প্রথম ডাকে প্রমোশন পায় নাই; দ্বিতীয় ডাকে পাইবে কি না তাহারও কোনো স্থিরতা নাই। তাই চুপচাপ বসিয়া ছিল, কথাটা মাকেও বলে নাই। হঠাৎ মায়ের চোখে জল দেখিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বার দুই পাক মারিয়া বলিল-আমি আর পড়ব না। —পড়বি না? মা অবাক হইয়া ছেলের মুখের দিকে তাকাইল। –না। এবার প্রমোশন পাই নাই। বাধা দিয়া মা বলিল না পেয়েছিস এবার ভাল করে পড়। আসছে বার ভাল করে উঠবি? –না। আর পড়ব না। –করবি কি? আমার মুণ্ডু? –না। চাষবাস করব। নইলে যা আছে তাও থাকবে না। ধার করে ধান খেতে হবে। তার দায়ে জমি বিকিয়ে যাবে। সেতাব পড়া ছাড়িয়া সেই সংসারের হাল ধরিল। দেহ তাহার দুর্বল ছিল, নিজে হালের মুঠা ধরিয়া বিশেষ কিছু করিতে পারিল
false
nihar_ronjon_gupta
খুন করবার ইচ্ছা ছিল এবং ধারালো অস্ত্ৰ হাতের কাছে পেয়ে সেই ইচ্ছাই এই ভয়ঙ্কর হত্যায় পরিণত হয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো খুনীর মনে রক্ত দেখবার পিপাসা জেগেছিল! তারপরই এই খুন। দয়া করে একটু ভেবে দেখুন ডাক্তার, যতদূর সব দেখেশুনে মনে হয়, এক্ষেত্রে খুনটা হঠাৎ একটা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে হয়নি। খুব সাবধানের সঙ্গে এবং আগে থেকে ভেবেচিন্তেই এই খুন করা হয়েছে। চেয়ে দেখুন, মৃতদেহের টা দেখেও কি আপনার মনে কোন কিছুই আসছে না? মৃত্যুদেহ দেখে এইটুকু কেবল বোঝা যায়, খুনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মধ্যে পরস্পরের কোন রকম হাতাহাতি বা ঝটাপটি হয়নি! নিশ্চয়ই না, মৃতদেহের থেকে স্পষ্টই মনে হয়। পিছন থেকে আচমকা কেউ ওঁকে ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করেছে, যে সময় হয়তো বেচারী কোন কারণে টেবিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু করতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে আর একটা জিনিস বিশেষ করে লক্ষ্য করবার আছে। টেবিলের ঠিক ওপরে দেওয়ালে ঝুলানো যে ঢাল-তলোয়ার আছে, মেঝে থেকে ওর উচ্চতা প্রায় আট-ন ফিট হবে এবং একথা যদি ধরে নেওয়াই হয় মৃতদেহের হাতে ধরা ঐ ধারালো তলোয়ারটা সামনের ঐ দেওয়ালে টাঙানো ঢালের অন্য পাশ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই টেবিলের ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল দেওয়ালে টাঙানো তলোয়ারটা হত্যাকারীকে নামাতে, কেননা অতখানি লম্বা কোন মানুষ হতে পারে না। শুধু তলোয়ারটা নামাতেই নয়, সেই তলোয়ার দিয়ে মিঃ মিত্ৰকে খুন করতে হলে মিঃ মিত্রকে নিশ্চয়ই সুবোধ শিশুটির মত গলাটা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। আর তা যদি না হয়ে থাকে, অর্থাৎ মিঃ মিত্রের অজান্তেই যদি তাঁকে খুন করা হয়ে থাকে, তবে বলতে হয় মিঃ মিত্র অন্ধ ও কালা, চোখেও তিনি কোন কিছু দেখতে পাননি, কানেও কোন শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু কুমারসাহেবের মত একজন ধনী গণ্যমান্য লোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী যে কালা ছিলেন এ কথাই বা বলা যায় কী করে? বলতে বলতে কিরীটী সহসা কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী কুমারসাহেব, আপনিই বলুন না, আপনার সেক্রেটারি কি সত্যিসত্যিই অন্ধ আর কালা ছিলেন নাকি? না। মৃদুস্বরে কুমারসাহেব জবাব দিলেন। যাই হোক, বেচারীর যে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, এ একেবারে অবধারিত। ডাঃ চট্টরাজ বললেন। আরো দেখুন, কিরীটী ডাঃ চট্টরাজকে আহ্বান করলেন, এই টেবিলের পাশের সোফাটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখুন। সোফার ওপরে এই বড় বড় বালিশগুলো দেখেছেন? এগুলো তুলে ধরছি দেখুন—এগুলোর গায়ে এখনো একটা লম্বালম্বি সরু চাপের দাগ রয়েছে। একটু ভাল করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে কষ্ট হবে না যে এর তলাতেই তলোয়ারটা লুকানো ছিল। খুনী আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেছিল এবং মনে হয়। মিঃ মিত্র এ ঘরে ঢুকবার আগেই খুনী এখানে এসে অপেক্ষা করছিল। মনে হয় সে জানত মিঃ মিত্ৰ নিশ্চয়ই এ-ঘরে আসবেন। আর এমন লোক খুন করেছে যে মিঃ মিত্রের বেশ পরিচিত। তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আপনার সন্দেহ অমূলক, স্যার দিগেন্দ্র মিঃ মিত্রের একেবারেই অপরিচিত, তা ছাড়া যে খুনী, তার এ-বাড়ীতে এবং কুমারসাহেবের এই প্রাইভেট রুমে বিশেষ রকম যাতায়াত আছে এবং সে এ ঘরে এলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না—এক কথায় খুনী কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। জানাশোনার বা পরিচিতের মধ্যেই কেউ, যার পক্ষে অনায়াসেই, মিঃ মিত্র যখন কোন কারণে দেয়ালের এদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, সেই অবসরে বালিশের তলা থেকে লুকানো তলোয়ারটা টেনে বার করে মিঃ মিত্রের গলাটা এক কোপে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলতে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু বন্ধু, তুমি একটা কথা ভুলে যােচ্ছ, ডাক্তার বললেন, মৃতদেহের দেখে মনে হয় না কি যে মিঃ মিত্ৰ যেন কেপটা ঘাড়ে নেবার জন্যে ঝুঁকে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন? হ্যাঁ, সেই তো হচ্ছে কথা, কিরীটী বলতে লাগল, এবং ঐ পয়েন্ট থেকেই ধরতে হবে খুনীকে। খুনী এখনও এই বাড়িতেই আছে। সে এখনো পর্যন্ত এ-বাড়ী ছেড়ে চলে যায় নি, যদি অন্ততঃ আমার সহকারীরা সজাগ থেকে থাকে। হলঘরে যাবার ঐ দরজাটা খুলে যদি কেউ এ-ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকে ইতিমধ্যেই? আমি প্রশ্ন করলাম। অসম্ভব। হরিচরণ সাড়ে নটা থেকেই হলঘরে আছে, যদি কেউ গিয়ে থাকতই তার দৃষ্টিকে কোনমতেই ফাঁকি দিতে পারত না। জািন কটার সময় আন্দাজ মিঃ মিত্র এই ঘরে এসে ঢুকেছিলেন? এবারে জবাব দিলাম। আমিই, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, রাত্রি তখন ঠিক সাড়ে নটা হবে, কেননা তখন আমি আমার হাতঘড়িটায় সময় দেখেছিলাম। কিরীটী এবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল, ঠিক রাত্রি দশটা এখন। ঠিক যে সময় খুন হয়েছিল, অপরাধী সেই সময়টা যে অন্য জায়গায় উপস্থিত ছিল, এ কথাটা প্রমাণ করবার জন্য যদি সব কিছু আগে থেকেই বন্দোবস্ত করে থেকে থাকে, তা হলেও সে এই ফাকি দিতে পারত না। কিরীটী একটা সিগার বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। একগাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিম্নস্বরে বলতে লাগল, আশ্চর্য, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। যতটুকু বুঝতে পারছি, কোন স্থিরমস্তিক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এই কাজ করেছে, কিন্তু মাথাটা দেহ থেকে পৃথক হয়ে মেঝের ঠিক মধ্যিখানেই বা এল কি করে? আর ঐভাবেই বা ঠিক ঘাড়ের ওপর বসে ছিল কি করে? বাইরের হলঘর থেকে একটা মৃদু গানের সুরের রেশ তখনও ভেসে আসছিল। কিরীটী কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ও-ঘরে যান কুমারসাহেব, অতিথিরা বেশীক্ষণ আপনাকে না দেখলে একটা গোলমালের সৃষ্টি হতে পারে। আর গোলমাল! দীর্ঘশ্বাস
false
shirshendu
কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। সুবলভাই খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। তাড়াবে! তার মানেটা কী? সেই কবে শিশুবয়সে এক জ্ঞাতি কাকার হাত ধরে খুব ভয়ে ভয়ে দেউড়ি পেরিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। বগলে একটি পুঁটুলিতে দু-একটা জামাকাপড়। সেই থেকে টানা এই বাড়ির চৌহদ্দিতে রয়ে গেছে সে। সত্তর-আশি বছর ধরে। শ্যামকান্তর চেয়েও সে বয়সে বড় ছিল। এ বাড়ি ছাড়া তার যে আর কোথাও কোনও আশ্রয় ছিল তা আজ আর মনেও পড়ে না। সুবলভাইয়ের কথাটা বিশ্বাস হল না। জিজ্ঞেস করল, কর্তাবাবা কী বলে? কর্তাবাবারও তাই মত। খরচ কমাতে হবে। মেয়ের বিয়ে এসে যাচ্ছে। তার খরচ আছে। কিছু মামলা-মোকদ্দমা লাগবে, তারও খরচ আছে। কথাটা মাথায় সেঁধোয় না সুবলভাইয়ের। নব্বই বছর ধরে তার মগজ কেবল গাছপালা আর মাটির গুণাগুণ নিয়ে ভেবেছে। আজকাল মাথায় একটু কুয়াশার মতো কী যেন জমে থাকে। বুদ্ধি খেলতে চায় না। পুরোনো কথা মনে পড়তে চায় না। কুলে নিজের ছেলের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। হুঁকোয় একটা আলগা টান দিয়ে সে বলে, জমিদারের মেয়ের বিয়ে কি ঝি-চাকরের মাইনের জন্য আটকায়? কর্তাবাবুর আর সব মেয়েদের বিয়ে হয়নি? তার জন্য কটা কর্মচারীর চাকরি। গেছে? সে তো তুমি বললে। শচীনকে সে কথা কে বোঝাবে! সে হল হা-ঘরে ছোট নজরের লোক। জমিদারের উঁচু নজর সে পাবে কোথায়? যত সব ছোটোলোকি কারবার। চিন্তিত সুবলভাই হুঁকোয় ঘনঘন টান মারে। তারপর একটু কেশে নিয়ে বলে, গত মাসেও কাছারি থেকে জনা দুইকে বিদেয় দেওয়া হল। এরকম চললে এ তো ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে। হরনাথ একটু রাগত স্বরে বলে, তাতে শালা শচীনের কী? সে মাসের শেষে পুরো তনখা টানবে। কর্তাবাবার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে টোপর মাথায় দিয়ে। সুবলভাই উদাস দৃষ্টিতে পুকুরের ধারে বাঁধা হরিণটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, কর্তাবাবার নজর ছোট হয়ে যাচ্ছে। শচীনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া মানে মেয়েটাকে একদম জলে ফেলে দেওয়া। কর্তাবাবা যদি নিজের বুদ্ধিতে চলত তাহলে সে একরকম ছিল। এ হল আমাদের মনু ঠাকরোনের বুদ্ধি। শচীন একটা পাত্র! ছিঃ ছিঃ! আমি যাব কোথায় বলল তো! কেন, যাবে কেন? ব্রহ্মপুত্রের জলে ড়ুবে মরবে। আমিও তাই করব ঠিক করেছি। তিন কুলে কেউ নেই, দেশ গাঁ কবে হেজেমেজে গেছে। বুড়ো বয়সে তো ভিক্ষে করতে পারব না। সুবলভাই হাঁ করে দম নেয় একটু। থেলো হুঁকোর আগুন মিইয়ে গেছে। কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষটা বিশেষ চাপা থাকছে না। কয়েকদিন আগে শচীন একটা লিস্ট করে হেমকান্তর হাতে দিয়ে গেছে। সেই লিস্টে জনা পনেরো কর্মচারীর নাম আছে। শচীন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, এই জনা পনেরো লোক এস্টেটের লায়াবিলিটি। অকর্মণ্য, বয়স্ক, ফাঁকিবাজ বা রোগগ্রস্ত বলে এদের দিয়ে তেমন কাজ আদায় হচ্ছে না বা হওয়ার আশাও নেই। হেমকান্তর বৈষয়িক অবস্থা যা তাতে এইসব অপোগণ্ডকে পোষা একটা বিরাট ক্ষতি। এই দয়ালু বিলাসিতার ভার বইবার মতো জোর হেমকান্তর এস্টেটের নেই। হেমকান্ত লিস্টটা দেখেছেন। যে পনেরোজনের নাম আছে তাদের মধ্যে কয়েকজন খুব প্রাচীন আমলের লোক। তাঁর বাবা শ্যামকান্ত এদের চাকরি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বেতনভুক্ত সকলকেই হেমকান্ত বহুদিন ধরে চেনেন জানেন। এদের ঠিক কর্মচারী বলে মনে হত না তাঁর। যেন এক যৌথ পরিবারেরই লোক। কিন্তু শচীন বাজে কথা বলেনি। এত সব কর্মচারীকে পুষে তার আর লাভ নেই। তবু ছেলে কনককান্তিকে ডেকে এক সন্ধ্যায় লিস্টটা তার হাতে দিয়ে বললেন, দেখো তো, শচীন এই সব কর্মচারীকে বরখাস্ত করতে বলেছে। কাজটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। কনককান্তি লিস্টটা এক ঝলক দেখেই বাপের হাতে ফেরত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, কাজটা ঠিক হবে না কেন? জমিদারি মানে তো খয়রাতি কারবার নয়। শচীন বুদ্ধিমান ছেলে, ঠিক পরামর্শই। দিয়েছে। হেমকান্ত দুর্বল গলায় বলেন, সেটা মানছি। কিন্তু এদের গতিটা কী হবে ভেবে দেখেছ? সেটা কি আমাদের ভাববার কথা? বাবার আমল থেকে আছে কয়েকজন। এদের অনেকেই এখানে সপরিবারে বাস করে। যাওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। সে দায় তো আমাদের নয়। কয়েকজনের যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। শুনছি এখন সব এস্টেট থেকেই কর্মচারী ছাটাই হচ্ছে। নতুন কাজ কেউ পাচ্ছে না। এরা সব যে না খেতে পেয়ে মরবে। কনককান্তি বিনীত গলায় বলল, জমিদারির আয় চিরকাল এইসব পোষার জন্য বারো আনা উড়ে যায়। আপনাকে এখন তো আয়ের দিকটা দেখতেই হবে। গত দুদিন আমিও শচীনের সঙ্গে বসে কাগজপত্র দেখেছি। অবস্থা ভাল ঠেকছে না। সে গেল একটা দিক। এদিকে কর্মচারীরা তো প্রায় বসে বসে মাইনে নিচ্ছে। এস্টেট দেখার লোক নেই, আদায় উসুল নেই, ওদের কাজটাই বা কী? একথায় হেমকান্ত একটু লজ্জা পেলেন। প্রকারান্তরে এ তার অপারগতার প্রতি ইঙ্গিত। তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, সে অবশ্য ঠিক কথা। তবু প্রথা বলেও একটা জিনিস আছে। প্রথা আঁকড়ে থাকতে গেলে যে নিলামে চড়াতে হবে সব কিছু। দিনকাল বদলে যাচ্ছে, পুরনো প্রথা আঁকড়ে থাকলে চলবে কেন? আমি তো জমিদার বাড়ির ছেলে। ব্রাহ্মণ সন্তান, তবু আমি তো ব্যাবসা করতে নেমেছি। হেমকান্তর মনটা সায় দিচ্ছে না। তবে তিনি কনকের সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না। ওরা সব সময়ে। ঠিক কথাই বলে। ওদের কথায় যুক্তির কোনও অভাব নেই। তিনি বললেন, আচ্ছা। ঠিক আছে। কনককান্তি তবু চলে গেল না। একটু অপেক্ষা করে হঠাৎ বলল, একটা কথা, বাবা। বলো। শচীনের লিস্টে আমাদের পুরুতমশাইয়েব নাম নেই। কিন্তু আমি মনে করি ওঁর
false
shomresh
হাসিটা হাসল, আপনাকে এখানেই নামিয়ে দিচ্ছি কেন জানতে চাইলেন না? আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধে আছে। আমার নয়, আপনার। আমার সঙ্গে এক জিপে অন্ধকারে ফিরছেন দেখলে আপনার নামে গল্প তৈরী হবে। সম্মান বলে কি একটার কথা বলছিলেন না, তখন সেটাই বাঁচবে। মাটিতে নেমে দীপাবলী বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মাতলামি করিনি তো? এখনও পর্যন্ত না। তাহলে তো চুকে গেল। চলি ম্যাডাম। আমরা তো নষ্ট হয়ে গেছি, আপনার মত ঠিক থাকা কিছু মানুষের সঙ্গ পেলে তাই খারাপ লাগে না। আপনারা মানে? এই আমি, এস ডি ও, ডি এম মন্ত্রী যারা পরস্পরের কাঁধে ভর দিয়ে চলি। কথা শেষ করেই জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল অর্জুন। কিছুক্ষণ সেই ছুটন্ত আলোর স্তূপ দেখল দীপাবলী। তারপর পা বাড়াল। বাড়ির সামনে পৌঁছে সে অবাক হল। অফিসঘরে আলো জ্বলছে। এখন ওখানে কারও থাকার কথা নয়। সে অফিসের দরজায় শব্দ করল। তিনবারের বার দরজা খুলল। চমকে উঠল দীপাবলী। সতীশবাবু দাঁড়িয়ে আছে, কুণ্ঠিত ভঙ্গী। আরও বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি? সতীশবাবু বললেন, কদিনের কাজ জমে ছিল– কাজ জমে ছিল? তাই বলে আপনি এখন কাজ করবেন? সতীশবাবু চুপ করে রইলেন। দীপাবলী কুল পাচ্ছিল না। যাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছে। গতকাল, দাহ করে যিনি ফিরেছেন আজ দুপুরের পর তিনি এত রাত্রে সরকারি কাজ করতে ছুটে আসবেন ভাবা যায়? সে নিচু গলায় বলল, সতীশবাবু আমি খুব ক্ষুধার্ত, একা খেতে ইচ্ছে করছে না, আমার সঙ্গে কিছু খাবেন? পৃথিবী থেকে প্রিয়তম মানুষ অকস্মাৎ সরে গেলে যে অন্ধকার নেমে আসে তার স্থায়িত্ব কতটুকু? কারো কারো হয়তো শ্মশান থেকে বেরিয়ে আসার পরেই তা দূর হতে আরম্ভ করে, কেউ সারাজীবন মনের আনাচে কানাচে তাকে আঁকড়ে থাকেন। তবু যে কোন চলে যাওয়া মানেই জলের বুকে গর্ত খোঁড়া, যা পর মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়া জলের ঢেউ-য়ে বুজে যায়, বেঁচে থাকার নিয়মে সেইটেই শেষ সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘরবাড়ি, জমি বাগান, আত্মীয়তা অথবা ভালবাসা যা একটি মানুষ বুক ভরে ভালবাসে জীবন ধরে তার আয়ু কতদিন এমন ভাবনা সচরাচর আসে না। যারা পড়ে রইল তাদের হাহুতাশের সময় খুব কম, কারণ মানুষ ভুলে যেতে বড় ভালবাসে। সতীশবাবু দীপাবলীকে খুব ধাক্কা দিলেন। ভুলে যাওয়া এক কথা আর ভুলবার চেষ্টা করা আর এক। স্ত্রীর মৃতদেহের পাশে যে মানুষ পাথরের মত বসে থাকতে পারেন সেই মানুষ দাহ করে ফিরে এসে অফিসের কাজ করবেন কেন? ভুলে যাওয়ার এই চেষ্টা যেন আন্ডারলাইন করা। স্ত্রীর মুখাগ্নি করেছিলেন ভদ্রলোক। পরদিন আচার অনুযায়ী পোশাক পরে অফিসে এলেন ঠিক সময়ে যেন কিছুই ঘটে যায়নি এমন ভঙ্গীতে কাজ শুরু করলেন। ভুলে যাওয়ার এই অতিরিক্ত চেষ্টাই বলে দিচ্ছে তিনি ভুলতে পারবেন না। ধুয়ে ফেলার জন্যে জল দরকার হয়। অন্য বাবুদের মুখে দীপাবলী শুনছে সতীশবাবু একবারও কাঁদেননি। জমে যাওয়া সেই কান্নার ওপর প্রাত্যহিকের ভিত গড়ছেন ভদ্রলোক, যে কোন মুহূর্তে গলন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দুপুরের ছুটির আগে দীপাবলী সতীশবাবুকে ডেকে বলল, সতীশবাবু, আমার মনে হয় কিছু দিন আপনার ছুটি নেওয়া উচিত। চমকে উঠলেন ভদ্রলোক, কেন? উত্তরটা দেওয়া গেল না। কথা ঘোরালো দীপাবলী, এই সময় তো কিছু নিয়মকানুনের মধ্যে আপনাকে থাকতে হচ্ছে। সেসব করে চাকরিতে আসলে পরিশ্রম হবে। না। একা বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। এখানে এলে তবু ফাইল পত্তর, পাঁচজন মানুষ দেখে নিঃশ্বাস নিতে পারি। তবে আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে ছুটি নিতে আমি বাধ্য। মাথা নিচু করে বললেন বৃদ্ধ। মাথা নাড়ল দীপাবলী, ঠিক আছে, যাতে আপনার স্বস্তি হয় তাই করুন। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। বৃদ্ধ মাথা নেড়ে দরজার দিকে এগিয়েই আবার ফিরে দাঁড়ালেন, নেখালির জন্যে যে প্রপোজাল পাঠিয়েছেন সেটা খুব ভাল হয়েছে। লাভ হল না সতীশবাবু। ডি এম বলেছেন একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না। সে কি! মন্ত্রী মহাশয় নিজের মুখে বলে গিয়েছেন সাহায্য দেবেন। আমার চেয়ে আপনার এই ব্যাপার ভাল বোঝার কথা সতীশবাবু। আপনি তো অনেকদিন ধরে কাজ করছেন ডিপার্টমেন্টে। সতীশবাবু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন বলে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ। আমি তো ব্রিটিশ আমল থেকে কাজ করছি। তা তারা সহজে প্রতিশ্রুতি দিত না। তবে দিলে অবশ্যই রাখত। ওটাই ওদের চরিত্র ছিল। কিন্তু এর জন্যে আমাদের খুব অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে। অসুবিধে কেন? মেমসাহেব, যারা কখনও কিছু পায়নি, পাওয়ার আশা কেউ দ্যাখ্যায়নি তারা চিরকাল মাথা নিচু করে থাকে। কিন্তু আমরা ওদের মনে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছি পাবে বলে, স্বয়ং মন্ত্রীমশাইকে ওরা চোখে দেখল এখন না পেলে হইচই করতে পারে। বুঝলাম। দেখা যাক। দীপাবলী গম্ভীর হয়ে গেল। সতীশবাবু ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এবং তারপরেই জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল। দীপাবলী ভেতরে যাবে। বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, শব্দটা কানে আসামাত্র শক্ত হল। অর্জুন যদি মনে করে যখন ইচ্ছে তখন এলে সে দেখা করবে তাহলে ভুল করছে। অন্তত আজ দুপুরের ছুটির এই সময়ে সে দেখা করছে না। প্রয়োজন হলে অফিসের সময় আসতে বলে দেবে সে সতীশবাবুকে দিয়ে। কিন্তু সতীশবাবু ফিরে এসে বললেন, দারোগাবাবু দেখা করতে এসেছেন। বললেন, মিনিট দুয়েকের ব্যাপার। দাবোগার নাম শুনে অবাক হল সে। লোকটার কথা সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। সে মাথা নেড়ে বলল, আসতে বলুন। দারোগা ঘরে এলেন, উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন, বসে হাসলেন। কি ব্যাপার,
false
shorotchandra
রামায়ণ-মহাভারত পড়িতে এবং এক-আধটু চিঠিপত্র লিখিতে শিখিয়াছিল—শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের কোন ধার ধারিত না, তাই ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় ধারণা তাহার নিতান্তই মোটা ধরনের ছিল। অথচ এ সম্বন্ধে কোন যুক্তিতর্কও সহিতে পারিত না। ছেলেবেলায় এই সব লইয়া কখনও-বা পীতাম্বরের সহিত কখনও-বা বিরাজের সহিত মারপিট হইয়া যাইত। বিরাজ তাহার অপেক্ষা মাত্র চার বছরের ছোট ছিল—তেমন মানিত না। একবার সে মার খাইয়া নীলাম্বরের পেট কামড়াইয়া রক্ত বাহির করিয়া দিয়াছিল। শাশুড়ী উভয়কে ছাড়াইয়া দিয়া বিরাজকে র্ভৎসনা করিয়া বলিয়াছিলেন, ছি মা, গুরুজনকে অমন করে কামড়ে দিতে নেই। বিরাজ কাদিঁতে কাদিঁতে বলিয়াছিল, ও আমাকে আগে মেরেছিল। তিনি পুত্রকে ডাকিয়া শপথ দিয়াছিলেন, বিরাজের গায়ে কখন যেন সে হাত না তোলে। তখন তাহার বয়স চৌদ্দ বৎসর, আজ প্রায় ত্রিশ হইতে চলিয়াছে—সেই অবধি মাতৃভক্ত নীলাম্বর সেদিন পর্যন্ত মাতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করে নাই। আজ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পুরাতন দিনের এইসব বিস্মৃত কাহিনী স্মরণ করিয়া প্রথমে সে মায়ের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা চাহিয়া তাহার জাগ্রত ঠাকুরকে দুটা সোজা কথায় বিড়বিড় করিয়া বুঝাইয়া বলিতেছিল—অন্তর্যামী ঠাকুর! তুমি ত সমস্তই দেখতে পেয়েচ! সে যখন এতটুকু অপরাধ করেনি, তখন সমস্ত পাপ আমার মাথায় দিয়ে তাকে স্বর্গে যেতে দাও। এখানে সে অনেক দুঃখ পেয়ে গেছে, আর তাকে দুঃখ দিও না। তাহার নিমীলিত চোখের কোণ বাহিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল। হঠাৎ তাহার ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল। বাবা! নীলাম্বর বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, ছোটবৌ অদূরে বসিয়া আছে। তাহার মুখে সামান্য একটু ঘোমটা, সে সহজকণ্ঠে বলিল, আমি আপনার মেয়ে, বাবা, ভেতরে আসুন, স্নান করে আজ আপনাকে দুটি খেতে হবে। প্রথমে নীলাম্বর নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল—কত যুগ যেন গত হইয়াছে, তাহাকে কেহ খাইতে ডাকে নাই। ছোটবৌ পুনরায় বলিল, বাবা, রান্না হয়ে গেছে। এইবার সে বুঝিল। একবার তাহার সর্বশরীর কাঁপিয়া উঠিল, তার পর সেইখানে উপুড় হইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল—রান্না হয়ে গেল মা! গ্রামের সবাই শুনিল, সবাই বিশ্বাস করিল, বিরাজবৌ জলে ডুবিয়া মরিয়াছে; বিশ্বাস করিল না শুধু ধূর্ত পীতাম্বর। সে মনে মনে তর্ক করিতে লাগিল, এই নদীতে এত বাঁক, এত ঝোপঝাড়, মৃতদেহ কোথাও-না-কোথাও আটকাইবে। নদীতে নৌকা লইয়া, ধারে ধারে বেড়াইয়া, তটভূমের সমস্ত বন-জঙ্গল লোক দিয়া তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করিয়াও যখন শবের কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না, তখন তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল, বৌঠান আর যাই করুক, নদীতে ডুবিয়া মরে নাই। কিছুকাল পূর্বে একটা সন্দেহ তাহার মনে উঠিয়াছিল, আবার সেই সন্দেহটাই মনের মধ্যে পাক খাইতে লাগিল। অথচ কাহারো কাছে বলিবার জো নাই। একবার মোহিনীকে বলিতে গিয়াছিল, সে জিভ কাটিয়া কানে আঙুল দিয়া পিছাইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তা হলে ঠাকুর-দেবতাও মিছে, রাতও মিছে, দিনও মিছে। দেয়ালে টাঙানো অন্নপূর্ণার ছবির দিকে চাহিয়া বলিল, দিদি ওঁর অংশ ছিলেন। এ কথা আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানি, বলিয়া চলিয়া গেল। পীতাম্বর রাগ করিল না—হঠাৎ সে যেন আলাদা মানুষ হইয়া গিয়াছিল। মোহিনী ভাসুরের সহিত কথা কহিতে শুরু করিয়াছে। ভাত বাড়িয়া দিয়া একটুখানি আড়ালে বসিয়া একটু একটু করিয়া সমস্ত ঘটনা শুনিয়া লইল। সমস্ত সংসারের মাঝে শুধু সেই জানিল কি ঘটিয়াছিল, শুধু সেই বুঝিল, কি মর্মান্তিক ব্যথা ওঁর বুকে বিঁধিয়া রহিল। নীলাম্বর বলিল, মা, যত দোষই করে থাকি না কেন, জ্ঞানে ত করিনি, তবে কি করে মায়া কাটিয়ে চলে গেল? আর সইতে পারছিল না, তাই কি গেল মা? মোহিনী অনেক কথা জানিত। একবার ইচ্ছা হইল বলে, দিদি যাবে বলিয়াই একদিন স্বামীর ভার তাহার উপর দিয়াছিল; কিন্তু চুপ করিয়া রহিল। পীতাম্বর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি দাদার সঙ্গে কথা কও? মোহিনী জবাব দিল, বাবা বলি, তাই কথা কই। পীতাম্বর হাসিয়া বলিল, কিন্তু লোকে শুনলে নিন্দে করবে যে! মোহিনী রুষ্টভাবে বলিল, লোকে আর কি পারে যে করবে? তাদের কাজ তারা করুক, আমার কাজ আমি করি। এ যাত্রা ওঁকে যদি বাঁচিয়ে তুলতে পারি ত লোকের নিন্দে আমি মাথায় পেতে নেব।—বলিয়া কাজে চলিয়া গেল। তের পনের মাস গত হইয়াছে। আগামী শারদীয়া পূজার আনন্দ-আভাস জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। অপরাহ্নবেলায় নীলাম্বর একখানা কম্বলের আসনের উপর স্থির হইয়া বসিয়া আছে। দেহ অত্যন্ত কৃশ, মুখ ঈষৎ পান্ডুর, মাথায় ছোট ছোট জটা, চোখে বৈরাগ্য ও বিশ্বব্যাপী করুণা। মহাভারতখানি বন্ধ করিয়া বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে সম্বোধন করিয়া বলিল, মা, পুঁটিদের বোধ করি আজ আর আসা হ’ল না। শুভ্রবস্ত্রপরিহিতা নিরাভরণা ছোটবৌ অনতিদূরে বসিয়া এতক্ষণ মহাভারত শুনিতেছিল, বেলার দিকে চাহিয়া বলিল, না বাবা, এখনও সময় আছে—আসতেও পারে। দুর্দান্ত শ্বশুরের মৃত্যুতে পুঁটি এখন স্বাধীন। সে স্বামীপুত্র ও দাসদাসী সঙ্গে করিয়া আজ বাপের বাড়ি আসিতেছে এবং পূজার কয়দিন এখানেই থাকিবে বলিয়া খবর পাঠাইয়াছে। আজিও সে কোন সংবাদই জানে না। তাহার মাতৃসমা বৌদিদি নাই—ছয়মাস পূর্বে সর্পাঘাতে ছোটদাদা মরিয়াছে, কোন কথাই সে জানে না। নীলাম্বর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, না এলেই বোধ করি ছিল ভাল, একসঙ্গে এতগুলো সে কি সইতে পারবে মা! প্রিয়তমা ছোটভগিনীকে স্মরণ করিয়া বহুদিন পরে আজ তাহার শুষ্ক চক্ষে জল দেখা দিল। যে রাত্রে পীতাম্বর সর্পদষ্ট হইয়া তাহার দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, আমার কোন ওষুধপত্র চাই না দাদা, শুধু তোমার পায়ের ধূলা আমার মাথায় মুখে দাও, এতে যদি না বাঁচি ত আর বাঁচতেও চাইনে, বলিয়া সর্বপ্রকার ঝড়-ফুঁক সজোরে প্রত্যাখ্যান করিয়া ক্রমাগত তাহার পায়ের নীচে মাথা ঘষিয়াছিল এবং বিষের যাতনায় অব্যাহতি পাইবার আশায়
false
zahir_rayhan
না প্রত্যেকে আলাদা করে। তসলিম এতক্ষণে কথা বললো, আমার কাছে কিন্তু বেশি ফিল্ম নেই। ফিল্ম না থাকলে এসেছেন কেন? হাসিনা পরক্ষণে জবাব দিলো, না এলেই পারতেন। এই হাসিনা। ওর চুলের গোছা ধরে টান দিলো মরিয়ম। তসলিমের কচি মুখখানা লাল হয়ে গোলো। লিলি হেসে বললো, রাগ করো না হাসিনা–আরেক দিন ভর্তি ফিল্ম নিয়ে আসবে ও। মরিয়ম বললো, বড় বেশি ফাজিল হয়ে গেছে। ফটাে তোলার জন্যে মাহমুদকে ডাকতে গেলে ও বললো, আমার অত সখ নেই। মরিয়ম বললো, সবাই তুলছি আমরা। মাহমুদ জবাব দিলো, তোমরা তোলা গে। মা এসে বললো, কেন কি হয়েছে। ভাইবোন সবাই মিলে ওরা একটা ফটাে তুলতে চাইছে, তাতে তোর এত আপত্তি কেন শুনি? তুই এমন হলি কেন অ্যাঁ? উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো মাহমুদ। দোরগোড়ায় লিলিকে উঁকি মারতে দেখে থেমে গেলো সে। উঠে দাঁড়াতে মৃদু গলায় বললো, চলো তোমাদের যখন এত সখ হয়েছে। কিন্তু কোথায় বসে ফটাে তুলবে তা এক সমস্যা দাঁড়িয়ে গেলো। ছাদে বসে তুলবে বলে আগে ভেবেছিলো। ওরা। মাহমুদ বললো, পাগলামো আর কি। এক সঙ্গে সবাই ওখানে উঠলে ছাত্র ভেঙ্গে পড়বে। হাসিনা বললো, একজন করে উঠলে তো হয়। কিন্তু গ্রুপ ফটাে তুলতে হলে সকলকে একসঙ্গে বসতে হবে। অবশেষে ঠিক হলো কুয়োর পাশে পাক ঘরের সামনে যে অপরিসর আঙ্গিনাটা আছে সেখানে বসবে ওরা। ফটো তোলার ব্যাপারে হাসমত আলী কোন আপত্তি করলেন না। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার সাহস তাঁর নেই। শুধু একবার মাথা চুলকে বললেন, আমায় কেন? বলতে বলতে কুয়োতলায় নেমে এলেন তিনি। সালেহা বিবি বেঁকে বসলেন। বললেন, তোমরা তোলো, আমি দেখি। মরিয়ম বললো, এসো না মা। লিলি বললো, আসুন খালা খাআম্মা। সালেহা বিবি বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মরবো, ফটাে তুললে গুনাহ হয়। মনে তারও ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কার বারবার বাধা দিচ্ছিলো এসে। মাহমুদ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ। বিরক্ত হয়ে এবার বললো, ফটাে তোলার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে এসো মা তোমাদের অত ধানাইপানাই আমার ভালো লাগে না, আমি চললাম। ও চলে যেতে উদ্যত হলো। ওর রাগ দেখে ফিক করে হেসে দিলো লিলি। দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে ওর দিকে তাকালো মাহমুদ। একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মেয়েটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না বোধ হয়। চোখ নামিয়ে নিলো। মা এতক্ষণে রাজী হলেন। পাকঘরের সিঁড়ির ওপর পাশাপাশি বসলো। মা-বাবা মাঝখানে। বাবার পাশে মাহমুদ। মায়ের পাশে মরিয়ম। সামনে বসলো হাসিনা, দুলু আর খোকন। তসলিম বললো, একটু অপেক্ষা করতে হবে। রোদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘটা সরে যাক৷ একফাঁকে খোকনের মনে পড়লো তার ফুটবলটার কথা। দৌড় দিয়ে খাটের তলা থেকে ওটা বের করে এনে কোলে নিয়ে বসলো সে। ওর ফুটবল নিয়ে বসতে দেখে, দুলুর মনে পড়লো ওর পুতুলটার কথা। ছুটে গিয়ে পুতুলটা নিয়ে এলো সে, ওর মুখে হাসি। খোকন একবার নিজের ফুটবল আর ওর পুতুলটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বঁকালো, আর আস্তে করে বললো, আমার দেখাদেখি। মেঘ সরে গেছে, সকলেই ক্যামেরাটার দিকে তাকালো এবার। গ্রুপ ফটো তোলা হয়ে গেছে। মাহমুদ চলে যাচ্ছিলো। হাসিনা পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ওর। ভাইয়া পালাচ্ছে কেন, আমি তুমি আর আপা একখানা তুলবো। মাহমুদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বাজে আবদার করো না। মরিয়ম ডাকলো–ভাইয়া। নাও, তুলতে হলে তাড়াতাড়ি তোল। মাহমুদ আবার এসে বসলো পাকঘরের সিড়ির ওপর। মরিয়ম আর হাসিনা ওর দু-পাশে। লিলি মৃদু মৃদু হাসছিলো আর দেখছিলো ওদের। ওর দিকে চোখ পড়তে মরিয়ম বললো, এসো না লিলি তুমিও এসো। হাসিনা ডাকলো, আসুন লিলি আপা, আসুন না। ওর গলায় অবদারের সুর। মাহমুদের দিকে তাকিয়ে, মুখখানা রক্তে লাল হয়ে গেলো লিলির। দ্রুত ঘাড় নাড়লো সে–না তুলব না। মাহমুদ এ প্রথম বললো ওর সঙ্গে–এত লজ্জা নিয়ে আপনি শহরে বেরোন কি করে? ফটো তুলতে আসুন। লিলি এবার সরাসরি তাকালো ওর দিকে। মুখখানা স্নান হয়ে গেছে তার। মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললো, আপনারা তুলুন। ফটো তোলা শেষ হলে তসলিমকে ধরে বসলো হাসিনা–আমাকে ছবি তোলা শেখাতে হবে। তসলিম সুবোধ বালকের মত মাথা নোয়ালো, আচ্ছা। হাসিনা বললো, আচ্ছা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার দেখা পাওয়া যাবে কোথায়? তসলিম সঠিক কোন উত্তর না দিতে পেরে ইতস্তত করছিলো। হাসিনা বললো, আপনি আমাদের বাসায় আসবেন, রোজ একবার করে আসতে হবে কিন্তু। তসলিম মৃদু হেসে সায় দিলো–আসবো। হাসিনা সহজে ছেড়ে দিলো না তাকে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো। কি করে ছবি ওঠে তা জিজ্ঞেস করলো। একটা ক্যামেরার দাম কতো জানতে চাইলো। আজকে তোলা ফটোগুলো কবে পর্যন্ত পাবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলো। তসলিম কবে থেকে শিখেছে, শিখতে তার কতদিন লেগেছে, হাসিনার কতদিন লাগতে পারে, এমনি নানা আলাপের শেষে বললো, আমাকে কিন্তু শিখাতে হবে নইলে… কথাটা শেষ না করলেও অপূর্ব ভঙ্গিতে ওকে শাসলো হাসিনা। এতদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকলেও আজ লিলির সঙ্গে বাইরে বেরুলো মরিয়ম। দুটি কারণ ছিলো এর পিছনে। প্রথমত মাহমুদকে এ-মুহূর্তে এড়াতে চায় সে। দ্বিতীয়ত নিরালায় বসে মনসুর সম্পর্কে লিলির সঙ্গে আলাপ করবে। একটা সিদ্ধান্ত অবিলম্বে নিতে চায় মরিয়ম। বাসায় ফিরতে সাঁঝ হয়ে গেলো। দুপুরে লিলির ওখানে খেয়েছে সে। তারপর গল্প করতে করতে কখন বেলা পড়ে এসেছে সে খেয়াল ছিলো না। বাইরে থেকে হাসিনার উচ্ছসিত গলার স্বর শুনে বুঝতে পেরেছিলো, মনসুর এসেছে।
false
shomresh
নামিয়ে দিয়ে সে বলল, এর আগে দুবার চা নিয়ে এসে ডেকেছিলাম আপনার ঘুম ভাঙেনি। কাল রাত্রেও আপনি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। না তো। কাল তিনটে পর্যন্ত আমি জেগেছিলাম। নেহি মেমসাব। আমি লস্যি নিয়ে এসে আপনার দরজায় নক করেছি তিনবার আপনি খেলেননি। তারপর ওঘরে গিয়ে সাহেবকে বললাম। সাহেব বললেন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই বিরক্ত করার দরকার নেই। লোকটা চলে গেল। লজ্জিত হল দীপাবলী। গতরাত্রে ভয় না পেলে লস্যি জুটত। সেক্ষেত্রে ঘুম আসত তাড়াতাড়ি। আর সে ওই টোকাটার অন্য মানে করে অনর্থক কিসব ভেবে গিয়েছে। ঈশ্বর যদি মানুষকে অন্তত একদিনের জন্যে অন্যের মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দিতেন তাহলে নব্বইভাগ মানুষ কেউ কারো সঙ্গে থাকতে পারত না। চা খাওয়ার পর অলোকের ঘরের দরজায় গেল সে। অলোক চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম হল? একটু। আপনি বাড়ি ফিরছেন কখন? বারোটার পর। এই প্রথম দিল্লীতে হোটলে থাকলাম। আমার জন্যে কষ্ট করতে হল। তা করলাম। আসুন, বসুন। আমার ঘরের দরজা খোলা আছে। অলোক চেয়ার ছেড়ে খাটের এমন জায়গায় গিয়ে বসল যেখান থেকে দীপাবলীর দরজা দেখা যায়, নিন, আমি এখান থেকেই পাহারা দিতে পারব। দীপাবলী মৃদু হেসে চেয়ারটায় বসল, আপনার বাবা মা শুনলে কি ভাববেন। বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝবেন। তাহলে আজ মুসৌরি চললেন? হ্যাঁ। কিন্তু ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটার জন্যে কোন চিন্তা নেই। কিন্তু আপনি কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট দেরাদুন হয়ে মুসৌরিতে চলে যেতে পারতেন। দুন এক্সপ্রেসে। টিকিট পাইনি। ওরাই বলল দিল্লী হয়ে যেতে। ভাগ্যিস। নইলে আপনার দেখা পেতাম না। সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আচ্ছা, বলুন তো আপনি ঠিক কি করতে যাচ্ছেন? আমি আই এ এস দিয়েছিলাম জানেন তো? সেটা তো জানিই। বাবা এই নিয়ে খুব উত্তেজিত। আমার প্রথম প্রেফারেন্স ছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। কিন্তু অত ভাল ছাত্রী নই বলে সেটা জুটল না। দ্বিতীয় চাওয়া ছিল আই পি এস অথবা আই আর এস। আপনি আই পি এস, মানে পুলিশ সার্ভিস চেয়েছিলেন? হ্যাঁ। এদেশে একমাত্র পুলিশের হাতেই কিছু ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা নিয়ে আপনি কি করবেন? পাইনি যখন তখন আর ও নিয়ে ভেবে কি লাভ? আমি রেভিন্যু সার্ভিসে সিলেকটেড হয়েছি। ভাবলাম দিল্লী হয়ে যখন যাচ্ছি তখন এখানে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে জানাব যে রেভিন্যু সার্ভিসে আমাকে যেন ইনকাম ট্যাক্সে দেওয়া হয়। এই পছন্দটা ওখানে গিয়ে জানালে চলে কিনা তা জানি না। ইনকাম ট্যাক্স? চেঁচিয়ে উঠল অলোক। চিৎকার করার কি আছে? ও তো পুলিশের চেয়ে ডেঞ্জারাস! তার মানে? বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ধরলে ছত্রিশ। এটা সবাই জানি। কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স যাকে ধরে তার ঘা গোনা যায় না, একেবারে চামড়া ছাড়িয়ে ছেড়ে দেয়। কোথাও যদি নিজের পরিচয় দেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার বলে তাহলে লোকে আপনাকে এড়িয়ে যাবে অথবা খাতির করবে। কেন? ভাববে আপনি খুব বড় চোর নয় ডাকাত। এই ভুলটা ভাঙানো দরকার। দেখুন আপনি পারেন যদি। যা মজ্জাগত হয়ে গেছে তা দূর করা আমার আপনার দ্বারা সম্ভব নয়। তা মুসৌরিতে কতদিন? কয়েকমাস। ওখানকার অ্যাকাডেমিতে সব গ্রুপের ক্যান্ডিডেটই যায়। তারপর? তারপরে যেতে হবে নাগপুরে। নাগপুরে? হ্যাঁ, ডাইরেক্ট ট্যাক্সের ট্রেনিং ওখানে হয়। তারপর? পোস্টিং। আমি পশ্চিমবাংলাই চাইব। একটু চুপ করে থাকল অলোক। তারপর নিচু গলায় বলল, আপনি দিল্লীতে পপাস্টেড হতে চাইলে ওরা দেবে না? আমি জানি না। কিন্তু দিল্লীতে আমি থাকতে চাইব কেন? অলোক মুখ নামাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, আপনি না চাইলে তো কোন কথাই নেই। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কি পারছেন না? আপনি কি বলতে চাইছেন? দীপাবলী, আমি আপনাকে এক্সপেক্ট করছি। আমার বাবা মা আপনাকে দেখে খুব খুশী হয়েছিলেন। এঁদের ইচ্ছে আপনাকে পাওয়ার। আর আমার ইচ্ছের কথাও আপনার অজানা নয়। আর এটা সম্ভব হতে পারে যদি আপনি দিল্লীতে পোস্টিং নেন। অবশ্যই এসব আমার ভাবনা। আপনার তরফ থেকে আপত্তি থাকলে কিছু বলার নেই। দীপাবলী এইরকম সরাসরি প্রস্তাব আশা করেনি। ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত কাঁপুনি এসে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছিল না সে। অলোকও আর কথা বলছে না। ঘরের এই নীরবতা খুব অস্বস্তিকর। শেষপর্যন্ত দীপাবলী বলতে পারল, আমাকে একটু ভাবতে দিন। বেশ তো, ভাবুন। আসলে এতদিন একা একা থেকে আজকাল খুব ভয় হয় আমি কারো সঙ্গে বাস করলে অ্যাডজাস্ট করতে পারব কিনা। এরকম হওয়ার কারণ একা একা থাকা? নিশ্চয়ই। এই আমি এখন স্বাধীন। স্বাধীনতা মানে আমার কাছে বন্ধুহীন জীবনযাপন নয়। কিন্তু আমার ভালমন্দ পছন্দ করার স্বাধীনতা থাকায় যে অভ্যেস তৈরী হয়ে গেছে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ের পরে সে ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করব না। মানলাম। কিন্তু–। বলুন, খোলাখুলি কথা বলুন। আমি নিজেকেই ভয় পাই। মানে? ওই যে বললাম, মানাতে পারব কিনা। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। দীপাবলী চোখ বন্ধ করল, আপনি আমাকে লোভী করে তুলছেন। না। আমি আপনাকে বাস্তবে নেমে আসতে বলছি। দীপাবলী মুখ নামাল, আপনি তো আমাকে ভাল করে জানেন না। এমন কিছু যদি থাকে তাহলে জানাতে পারেন। দীপাবলী নিঃশ্বাস ফেলল। সেটা দেখে অলোক হাসল, আমি যদিও একটা প্রশ্ন করিনি। আমাকে গ্রহণ করতে আপনার আপত্তি আছে? আমি একটু ভাবব। ভাবনাটা কি আমার যোগ্যতা নিয়ে? না। নিজেকে নিয়ে। সত্যি কি এত ভাবার কিছু আছে? দেখুন, জীবনে প্রথমবার আমার যখন বারো বছর
false