label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shorotchandra
আছে, যাহার গল্প লোকের মুখে শুনা ভিন্ন নিজে দেখিবার কল্পনা কোনদিন তাহার মনে স্থান পায় নাই। এইবার সেই-সকল আশ্চর্য সে স্বচক্ষে দেখিতে চলিয়াছে। তাহা ছাড়া সেখানে তাহার স্বামী ভগ্নদেহ ফিরিয়া পাইবে, একাকী সে-ই সেখানে ঘরণী, গৃহিণী, সর্বকার্যে স্বামীর সাহায্যকারিণী। সেখানে জলবায়ু স্বাস্থ্যকর, সেখানে জীবন-যাত্রার পথ সহজ ও সুগম, তিনি ভাল হইলে হয়ত একদিন তাহারা সেইখানেই তাহাদের ঘর-সংসার পাতিয়া বসিবে এবং অচিরভবিষ্যতে যে-সকল অপরিচিত অতিথিরা একে একে আসিয়া তাহাদের গৃহস্থালী পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে, তাহাদের কচি মুখগুলি নিতান্ত পরিচিতের মতই সে যেন চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। এমনি কত কি যে সুখের স্বপ্ন দিবানিশি তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, তার ইয়ত্তা নাই। আর সকল কথার মধ্যে স্বামী যে তাহাকে ছাড়িয়া আর স্বর্গে যাইতেও ভরসা করেন না, এই কথাটা মিশিয়া যেন তাহার সমস্ত চিন্তাকেই একেবারে মধুময় করিয়া তুলিল। আর তাহার কাহারও বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ, কোন নালিশ রহিল না—অন্তরের সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গিয়া হৃদয় গঙ্গাজলের মত নির্মল ও পবিত্র হইয়া উঠিল। আজ তাহার বড় সাধ হইতে লাগিল, যাইবার আগে একবার মৃণালকে দেখে এবং সমস্ত বুক দিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া জানা-অজানা সকল অপরাধের ক্ষমা-ভিক্ষা মাগিয়া লয়। আর সুরেশের জন্যও তাহার প্রাণ কাঁদিতে লাগিল। সে যে পরম বন্ধু হইয়াও লজ্জায় সঙ্কোচে তাহাদের দেখা দিতে পারে না, তাহার এই দুর্ভাগ্যের গোপন বেদনাটি সে আজ যেমন অনুভব করিল, এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাঁহারও কাছে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা চাহিয়া বিদায় লইবার আছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া জানিল, তিনি কাল হইতেই গৃহে নাই। যাইবার দিন সকাল হইতেই আকাশে মেঘ করিয়া টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িত আরম্ভ করিয়াছিল। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা হইয়াছে, কিছু কিছু স্টেশনেও পাঠানো হইয়াছে, টিকিট পর্যন্ত কেনা হইয়া গিয়াছে। অচলার জন্যও সেকেন্ড ক্লাস টিকিট কেনার প্রস্তাব হইয়াছিল, কিন্তু সে ঘোরতর আপত্তি তুলিয়া মহিমকে বলিয়াছিল, টাকা মিথ্যে নষ্ট করবার সাধ থাকে ত কিনতে দাও গে। আমি সুস্থ সবল, তা ছাড়া কত বড়লোকের মেয়েরা ইন্‌টার ক্লাসের মেয়েগাড়িতে যাচ্ছে, আর আমি পারিনে? আমি দেড়া ভাড়ার বেশি কোনমতেই যাবো না। সুতরাং সেইরূপ ব্যবস্থাই হইয়াছিল। সম্পূর্ণ দুটা দিন সুরেশের দেখা নাই। কিন্তু আজ সকালে দুর্যোগের জন্যই হোক বা অপর কোন কারণেই হোক, সে তাহার পড়িবার ঘরে ছিল। এই আনন্দহীন কক্ষের মধ্যে অচলা ঠিক যেন একটা বসন্তের দমকা বাতাসের মত গিয়া প্রবেশ করিল। তাহার কণ্ঠস্বরে আনন্দের আতিশয্য উপচাইয়া পড়িতেছিল, বলিল, সুরেশবাবু, এ জন্মে আমাদের আর মুখ দেখবেন না নাকি? এত বড় অপরাধটা কি করেছি, বলুন ত? সুরেশ চিঠি লিখিতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহাদের বাড়ি পুড়িয়া গেলে আশেপাশের গাছগুলার যে চেহারা অচলা আসিবার দিন চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছিল, সুরেশের এই মুখখানা এমনি করিয়াই তাহাদের স্মরণ করাইয়া দিল যে, সে মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। বসন্তের হাওয়া ফিরিয়া গেল—সে কি বলিতে আসিয়াছিল, সব ভুলিয়া কাছে আসিয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি অসুখ করেচে, সুরেশবাবু? কৈ, আমাকে ত এ কথা বলনি। শুধু পলকের নিমিত্তই সুরেশ মুখ তুলিয়াছিল। তৎক্ষণাৎ নত করিয়া কহিল, না, আমার কোন অসুখ করেনি, আমি ভালই আছি; বলিয়া সেই বইখানার পাতা উলটাইতে উলটাইতে পুনরায় কহিল, আজই ত তোমরা যাবে, সমস্ত ঠিক হয়েছে? কতকাল হয়ত আর দেখা হবে না। কিন্তু মিনিট-খানেক পর্যন্ত অপর পক্ষ হইতে উত্তর না পাইয়া সুরেশ বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার দুই চক্ষু জলে ভাসিতেছিল, চোখাচোখি হইবামাত্রই বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল। সুরেশের ধমনীতে উষ্ণ রক্তস্রোত উন্মত্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে তাহার সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া, আপনাকে সংযত করিয়া দৃষ্টি অবনত করিল। অচলা অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া গাঢ়স্বরে বলিয়া উঠিল, তোমার কখ্‌খনো শরীর ভাল নেই সুরেশবাবু, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। সুরেশ মাথা নাড়িয়া শুধু বলিল, না। না, কেন? তোমার জন্যে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না। দ্বারের বাহির হইতে বেহারা ডাকিয়া কহিল, বাবু, আপনার চা—বলিতে বলিতে সে পর্দা সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিল এবং পরক্ষণেই অচলা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বাহির হইয়া গেল। ঘণ্টা-খানেক পরে সে তাহার স্বামীর কক্ষে প্রবেশ করিলে মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ ক’দিন থেকে কোথায় গেছে জানো? পিসীমাকেও কিছু বলে যায়নি; সে কি আজ আমার সঙ্গে দেখা করবে না নাকি? অচলা আস্তে আস্তে কহিল, আজ ত তিনি বাড়িতেই আছেন। মহিম কহিল, না। এইমাত্র আমাকে ঝি বলে গেল, সে সকালেই কোথায় বেরিয়ে গেছে। অচলা চুপ করিয়া রহিল। ক্ষণকাল পূর্বেই যে তাহার সহিত সাক্ষাৎ ঘটিয়াছিল, সে যে অতিশয় অসুস্থ, সে যে ছেলেবেলার মত এবারও তোমার জীবন রক্ষা করিয়াছে—শুধু কেবল এইটুকু কৃতজ্ঞতার জন্যও একবার তাহাকে আমাদের ওখানে আহ্বান করা উচিত— আর তাহাকে ভয় নাই—লজ্জিতাকে সংশয়ের চক্ষে দেখিয়া আর লজ্জা দিয়ো না—তাহার অন্তরের এই-সকলের একটা কথাও জিহ্বা আজ উচ্চারণ করিতে পারিল না। সে স্বামীর মুখের প্রতি ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে পর্যন্ত পারিল না; নিঃশব্দে নিরুত্তরে হাতের কাছে যে-কোন একটা কাজের মধ্যে আপনাকে নিযুক্ত করিয়া দিল। ক্রমশঃ স্টেশনে যাইবার সময় নিকটবর্তী হইয়া উঠিল। নীচে কেদারবাবুর হাঁক-ডাক শোনা গেল এবং পিসীমা পূর্ণঘট প্রভৃতি লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। চাকরেরা জিনিসপত্র গাড়ির মাথায় তুলিয়া দিল, শুধু যিনি গৃহস্বামী, তাঁহারই কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না। অথচ, এই বলিয়া প্রকাশ্যে কেহ আলোচনা করিতেও সাহস করিল না—ব্যাপারটা ভিতরে ভিতরে এমনিই যেন সকলকে কুণ্ঠিত করিয়া
false
toslima_nasrin
আয়াত আছে, সেসবের উল্লেখ করে সেসব বিষয়ে মন্তব্য কেবল। লেখাটি, যেহেতু আরবি জানেন ভাল, তাঁকে দেখাই। কোরান বড়মামার নখদর্পনে। তিনি মুখস্ত আওড়ে যান কোরানের আয়াত এবং আয়াতের ব্যখ্যা। কোরানের প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ করেন। আমার পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়ে বড়মামা কয়েকটি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের বাংলা কোরান অনুবাদ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ইসলামি ফাউণ্ডেশন ট্রাস্টের কোরান, মাওলানা মওদুদির অনুবাদ সব তুলনা করে মিলিয়ে আমি আরবির অনুবাদ উদ্ধার করেছি, কিন্তু এই উদ্ধারের পরও আরও উদ্ধার করা যায় যদি ভাষাটি জানা থাকে ভাল। বড়মামা ভাষাটি জানেন বলে তিনি কোন আরবি শব্দকে ভাবান্তর করে কোন অনুবাদক কোনও একটি মোলায়েম অর্থ দাঁড় করিয়েছেন কোনও আয়াতের, সেগুলোও ধরে ফেলতে পারেন। মেয়েদের যখন মারবে তখন খুব আস্তে করে মারবে, মুখমণ্ডলে মেরো না — এরকম একটি অনুবাদ পড়ে বড়মামা হেসে বললেন, কোরানে আস্তে করে মারার কথা লেখা নেই, আস্তে করে শব্দদুটি অনুবাদক যোগ করেছে। যত পুরোনোকালের বাংলা কোরান পাওয়া যায়, তত সঠিক অনুবাদও পাওয়া যায়। দিন যত যাচ্ছে, যত আধনিক হচ্ছে সমাজ, মেয়েদের অধিকারের কথা উঠছে, ইসলামে নারীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এই দাবি করছেন ইসলামি পণ্ডিতরা, এই পণ্ডিতরাই কোরান অনুবাদের সময় নিজে থেকে আল্লাহর নিষ্ঠুরতা আড়াল করার দায়িত্ব নিয়েছেন। যেন আল্লাহ যদি আস্তে করে মারার কথা বলেন, আল্লাহকে খুব দরদী মনে হবে। আরবি ভাষাটি না জানলে আজকালকাল পণ্ডিতের আল্লাহর ওপর নাপতানিগুলো আবিস্কার করা যায় না। কোথাও কোন আয়াতের বাংলা অনুবাদে ভুল আছে কি না তা আরও সুক্ষ্ণভাবে দেখে দিতে বড়মামা আমার পুরো পাণ্ডুলিপি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর কিছু কিছু শব্দের ভুল শুদ্ধ করে নিয়ে আসেন। পাণ্ডুলিপি হাতে নিতেই বুঝি তিনি বেশ পরিশ্রম করেছেন এর পেছনে। শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা হতে থাকে বড় মামার সঙ্গে। সুরা আল নাজলএর একুশ আর বাইশ নম্বর আয়াত দুটো কোরান থেকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন আয়াত বসানো হয়েছে। কারণ মোহাম্মদ যে আয়াত উচ্চারণ করেছিলেন, সেগুলো তিনি পরে বলেছেন যে শয়তানের ছিল। মোহাম্মদের কানে কানে শয়তান উচ্চারণ করেছে আয়াত দুটো। মোহাম্মদ বুঝতে পারেননি কোন কণ্ঠস্বরটি আল্লাহর, কোনটি শয়তানের, অথবা তাঁর জিভে ভর করেছিল শয়তান, অথবা মাথায়, তাই কাবা শরীফের সামনে বসে তিনি উচ্চারণ করলেন..। কী উচ্চারণ করলেন, বড় মামাকে জিজ্ঞেস করি। বললেন, ‘তোমরা কি আল লাত, আল উযযা আর তিন নম্বর আল মানাতএর ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করিয়াছো?’ ‘এই টা কোরানে আছে, কিন্তু কোনটা বাদ দেওয়া হইছে?’ ‘দিজ আর ইন্টারমিডিয়ারিস এক্সলটেড হুজ ইন্টারসেশন ইজ টু বি হোপড ফর। এইটা তো একুশ নম্বর, আর বাইশ নম্বরটা হচ্ছে, সাচ এস দে ডু নট ফরগেট। —এই আয়াত দুইটা পরে শয়তানের আয়াত বইলা বাদ দিয়া লেখা হইছে, আর ইওরস দ্যা মেইলস এণ্ড হিজ দ্যা ফিমেইলস? তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর আল্লাহর জন্য কন্যা? এটা তো তবে প্রতারণা পূর্ণ বণ্টন!’ আমি জিভ কাটি লজ্জায়। বড় মামা বলেন, ‘লাত, উযযা আর মানাত কে কোরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর তিন কন্যা বলে বিশ্বাস করত। ওদের গডএর নাম তো আল্লাহ। আল্লাহ নামটা তো মোহাম্মদ ওদের কাছ থেকেই নিয়েছে, মানে মূর্তি পূজা যারা করত, যারা বহুঈশ্বরবাদী ছিল তাদের কাছ থেকে।’ ‘মোহাম্মদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল আল্লাহর তিন মেয়েরে সম্মান দেখানোর?’ প্রশ্ন করি। বড় মামা বলেন, ‘সেই সময় মানে সেই আটশ খ্রিস্টাব্দে যে ইসলামিক স্কলাররা মোহাম্মদের জীবনী লিখে গেছে, ইবনে জারির আল তাবারি, আল ওয়াহিদি, ইবনে সাদ, ইবনে ইসাক, তাদের ভাষ্য, যে, ওই সময় মককায় মোহাম্মদের তেমন কোনও অনুসারী ছিল না, যারা ছিল তাদের বেশির ভাগই মোহাম্মদকে ছেড়ে চলে গেছে। তখন কোরাইশদের দলে টানার জন্য সে তাদের তিন দেবীর কাছে মাথা নোয়াইছে। মোহাম্মদ এইটা বলার পর কোরাইশরা খুশি ছিল তার ওপর।..’ ‘আয়াতটা পাল্টাইল কখন?’ এমন সময় মা মা ঢোকেন ঘরে। আমরা চুপ হয়ে যাই। মা দুজনের মুখে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী আলাপ করতাছ তোমরা?’ বড় মামা সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘এই তো ওর পিজিতে পড়ার কথা বলতেছি! পড়লে তো মেডিকেল কলেজের প্রফেসার হইতে পারতো!’ মার মুখটি মুহূর্তে প্রসন্ন হয়ে ওঠে, ‘চা খাইবা মেবাই?’ ‘হ। এক কাপ চা দে।’ মা চা করতে চলে গেলেন। ঘরে আবার শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা চলতে থাকে। ‘সুরা হজ্জের বায়ান্ন আর তিপ্পান্ন আয়াতে তো আছে এই শয়তানের কথা। মোহাম্মদকে আল্লাহ বলতেছে, যে, আল্লাহ যত নবী রসুল পাঠাইছিল মোহাম্মদের আগে, সবাইরেই নাকি শয়তানে ধরছিল।’ হঠাৎ মার মুখটি দরজায়। ‘মেবাই তোমরা কী নিয়া কথা বলতাছ?’ আমি বলি, ‘না কিছু না, এমনি।’ ‘আমি শুনলাম আল্লাহ মোহাম্মদ!’ বড়মামার দিকে তাকিয়ে মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি নাসরিনরে কী শিখাইতাছ?’ বড় মামা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান ঘর থেকে, আমি পেছন পেছন যাই বলতে বলতে ‘আমারে আবার কি শিখাবে? এমনি আলাপ করতাছিলাম।’ ‘মেবাই, কী নিয়া আলাপ করতাছিলা তুমরা? কী বুদ্ধি দিতাছ আমার মেয়েরে?’ মা আগুন-চোখে তাকান বড়মামার দিকে। বড়মামা মার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালের চিত্রকর্মে, জানালার পর্দায়, দরজার হাতলে ফেলে রাখেন। মার গলা চড়তে থাকে। ‘এত বড় সর্বনাশ করতাছ তুমি মেয়েটার? জানতাছ তো কী হইতাছে দেশে। অত বড় বড় মিছিল যায়, দেখতাছ না? পত্রিকায় পড়তাছ না কি হইতাছে? তারপরও তুমি ওরে আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখার পরামর্শ দেও? মেয়েডা বাইচা
false
shomresh
নয়, মুরগি। মেজর চোখ বন্ধ করে বলে গেলেন। মুরগি আপনাদের তেড়ে এসেছিল? ইয়েস মাই বয়। পুঁচকে মুরগিগুলোকে দ্যাখোনি শত্রু দেখলে তেড়ে যেতে? তা লোপেজের লোকেরা কোনওমতে ওটাকে বয়ে নিয়ে এল তাঁবুতে। ধুমধাম করে মাংস রান্না করল। কিন্তু মুখে দিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল। ওই বিশাল পাখির তেজস্বী ভঙ্গি মনে পড়ে যেতে আর খেতে পারলাম না। সেই থেকে আমার জীবনে মুরগি বন্ধ। ওটা সত্যিই মুরগি, না অন্য কিছু? মেজর পিটপিট করলেন, তুমি কখনও আফ্রিকায় গিয়েছ? না। বিবর্তনের নিয়ম মেনে পৃথিবীর সব প্রাণী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এই যে হাতি দেখতে পাও, এদের হাজার পুরুষ আগের চেহারাটা কল্পনা করো। পাহাড়ের মতো। সেইজন্যে হাতির সঙ্গে পাহাড়ের উপমা এখনও দেওয়া হয়। কিন্তু সময় ওদের ছোট করে দিয়েছে। একটা টিকটিকি কুমিরের চেয়ে বড় ছিল আকৃতিতে। মুরগির ক্ষেত্রে তাই হওয়া স্বাভাবিক। তা আফ্রিকায় এখনও কিছু প্রাণী অতীতের ছায়া ধরে রেখেছে। ওটা মুরগিই। তা হলে তো আপনার ওখানে খাওয়ার কষ্ট হবে। ডালভাতের ওপর থাকতে হতে পারে। মেজর হাসলেন, কুছ পরোয়া নেই। আমার স্টকে কিছু সার্ডিন আছে। তাই দিয়ে চমৎকার ভাত খাওয়া যায়—সার্ডিনের বাটিচচ্চড়ি আর ভাত। সার্ডিন মাছ? ইয়েস মাই বয়। টিনে প্যাক করা। সবসময় সঙ্গে রাখি। তবে ওরা যেভাবে খায়, সেভাবে নয়। মাছটাকে টিন থেকে বের করে দিশি প্রথায় বাটিচচ্চড়ি বানিয়ে নিয়ে ভাতের ওপর ঢালো। আহা। মেজর যেন এখনই তার স্বাদ পেয়ে গেলেন। এই সময় অমল সোমের ঘর থেকে দুজনে বেরিয়ে এলেন। অমল সোম অনুপম ত্রিবেদীর সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিলেন। হ্যান্ডসাম শব্দটা চট করে মনে এল অর্জুনের। মিস্টার ত্রিবেদী বললেন, আপনার কথা আমি শুনেছি অর্জুনবাবু। পরিচয় হওয়ায় খুশি হলাম। আপনারা যে আমাদের জঙ্গলে থাকবেন, সেইজন্য গৌরবান্বিত বোধ করছি। শুনলাম এখানে আসার সময় নীল চ্যাটার্জির সঙ্গে আপনাদের আলাপ হয়েছে। আলাপ? মেজর খেপে গেলেন, লোকটা আমাকে অপমান করেছে। একবার হাতের কাছে পেলে এমন শিক্ষা দিতাম যে, বাছাধন টাইট হয়ে যেত। আপনারা বেড়াতে এসেছেন, ওসব না করাই ভাল। নীল আমাদের কাছেও সমস্যা। জঙ্গলের নিয়মকানুন মানছে না। অথচ ওর বিরুদ্ধে এমন কোনও সাক্ষী জোগাড় করতে পারিনি যে, আমরা ব্যবস্থা নেব। ওহে, আপনি যে ফুলের সন্ধানে এসেছেন, তার নাম কী? মেজর বললেন, বুনো ফুল। বাংলা নাম জানি না। তবে আমি নাম রেখেছি বিষগন্ধা। ত্রিবেদী বললেন, কয়েকটা মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে অবশ্য এসেছে এবং সেই সব মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন নেই। আমরা এখনও পর্যন্ত কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। জঙ্গলে মাঝে-মাঝেই সংক্রামক রোগ ছড়ায়, প্রাণীরা মারা যায়। তখন যে এলাকায় এটা ঘটে, সেই এলাকা থেকে বন্যপশুদের সরিয়ে দেওয়া হয়। যাদের সরানো সম্ভব হয় না, তাদের প্রতিষেধক দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এই মৃত্যুগুলো ঠিক এক জায়গায় হয়নি আর ঘন-ঘন হয় না। আপনি যদি কারণ আবিষ্কার করতে পারেন, তা হলে বিশাল উপকার হবে। মেজর মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব। কী অর্জুন? নিশ্চয়ই। অর্জুন সমর্থন করল। সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহিত মেজর বললেন, দেখুন মিস্টার ত্রিবেদী, একটা ছোট লাইটারকে যদি আমি, মানে আমরা, অতবড় আমেরিকা থেকে উদ্ধার করতে পারি, তা হলে এটাও সম্ভব হবে। কী ব্যাপার? ত্রিবেদী কৌতূহলী হল। অমল সোম বাধা দিলেন, ও-গল্প অন্য সময় শুনবেন। লাঞ্চ সেরে ওরা ত্রিবেদীর জিপে উঠল না। ত্রিবেদী বললেন, আপনারা মিস্টার ব্যানার্জির জিপসিতে আসুন। আমার জিপটিকে জঙ্গলের সবাই চেনে। আমি নীলপাড়ার রেঞ্জারকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। সে আপনাদের জন্যে বাংলোয় অপেক্ষা করবে। আমি আগামিকাল আমার রুটিন ভিজিটে ওখানে গিয়ে আপনাদের সঙ্গে দেখা করে আসব। অর্জুনের খটকা লাগল। যাওয়া হচ্ছে একটি ফুলের সন্ধানে। ভুল করে তার কাছাকাছি চলে না গেলে বিপদ নেই। মেজর অবশ্য কয়েকটা মাস্ক নিয়ে এসেছেন, যা নাকে পরলে বিষ শরীরে ঢুকবে না। এই আবিষ্কারের সঙ্গে কোনও শত্রুপক্ষের সম্পর্ক নেই যে, তাদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে হবে বলে এই লুকোচুরি দরকার। তার মনে পড়ল, জলপাইগুড়ি থেকে আসার সময় অমল সোম বলেছিলেন, এমনভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে চান, যাতে স্থানীয় মানুষ তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহলী না হয়! ত্রিবেদীর সঙ্গে অমল সোমের কী কথা হয়েছে তা জানা না গেলেও, অর্জুন অনুমান করল অনেক বড় রহস্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ভানু ব্যানার্জির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা সুহাসিনী চা বাগান ছেড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসিমারায় চলে এল। অমল সোম বসেছিলেন ড্রাইভারের পাশে, ওরা পেছনে। ভানু ব্যানার্জি কয়েকটা বড় বাজে চাল-ডাল-আনাজ দিয়ে দিয়েছেন, যদি প্রয়োজনে লাগে। মেজর গম্ভীর গলায় বললেন, অর্জুন! তুমি বাইকটাকে নিয়ে এলে ভাল করতে। অমল সোম বললেন, আমি নিষেধ করেছি। এদিকের রাস্তায় পাথর বেশি। তা ছাড়া জঙ্গলে বাইক চালালে ওখানকার বাসিন্দাদের বিরক্ত করা হবে। মেজর কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আমরা যে জঙ্গলে যাচ্ছি, তার কোনও চরিত্র, আই মিন বিশেষত্ব আছে? অমল সোম মাথা নাড়লেন, । নীলগিরি খুব গভীর জঙ্গল। শোনা যায়, যারা ডাকাতি করে, তাদের জায়গাটা খুব প্রিয়। তবে এই সময় হাতিরা ওখানে বেশি পরিমাণে রয়েছে বলে আমরা তাদের দেখা নাও পেতে পারি। এ ছাড়া জন্তু আছে প্রচুর। নীলগিরিতে খঞ্জন নামে এক ধরনের পাখি পাওয়া যায়, সাদা বুকের ঠিক মাঝখানে কালো চিহ্ন রয়েছে। একসময় এখানকার মানুষ ওই চিহ্নটাকে শালগ্রাম শিলা অথবা বিষ্ণুর প্রতীক বলে মনে করত। এ ছাড়া পাইথন কোবরার জন্যে জঙ্গলটা বিখ্যাত।
false
humayun_ahmed
এখানে নিয়ে আসবে? আমরা এক সঙ্গে সকালে নাশতা খাব। মারুফ চিন্তায় পড়ে গেল। বাবাকে নিয়ে হঠাৎ এই সমস্যা হবে সে বুঝতে পারে নি। একটা মিথ্যা ঢাকতে এখন পরপর অনেকগুলি মিথ্যা বলতে হবে। প্রতিটি মিথ্যাই খুব গুছিয়ে বলতে হবে। যেন যুক্তিতে কোন খুঁত না থাকে। হ্যালো কথা বলছ না কেন? নিয়ে আসতে পারবে সকালে? পারারতো কথা। তবে আমি নিশ্চিত না। নিশ্চিত না কেন? বাবা এসেই অকারণে আমার সঙ্গে ঝগড়া করলেন। নিতান্ত ফালতু বিষয় নিয়ে হৈ চৈ। রাগারাগি। আমি নাকি ছমাস ধরে তার চিঠির কোন জবাব দিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে। চিন্তিত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তুমি হু মাস চিঠি দেবে না আর উনি চিন্তিত হতে পারবেন না? অবশ্যই চিন্তিত হতে পারবেন তবে তার মানে এই না যে তিনি রিকশাওয়ালার সামনে আমাকে গাধা বলবেন। তিথি হাসতে হাসতে বলল, উনার স্বভাবও দেখি আমার বাবার মত। আমার বাবাও রেগে গেলে এমন গালাগালি করেন। তবে তার রাগ অবশ্যি বেশিক্ষণ থাকে না। বাবার রাগ ভাদ্র মাসের বৃষ্টির মত ক্ষণ স্থায়ী। আমার বাবারটা স্থায়ী। আমার উপর রাগ করেই রাতে ভাতটাত না খেয়ে ঘুমুতে গেছেন। ঘুম আসছে না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে ঘুম আসার কথা না। এপাশ ওপাশ করছেন। তিনি তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে মাথার কাছে রেখে দিয়েছেন। এটা হচ্ছে বিশেষ এক লক্ষণ–বাবা ফজরের নামাজ পড়েই বাসা ছেড়ে চলে যাবেন। বল কি? আমি প্রাণপন চেষ্টা করব উনাকে আটকে রাখতে। যদি পারি তাহলে অবশ্যই সকাল আটটার মধ্যে তোমাদের বাসায় এনে উপস্থিত করব। যদি না পারি তাহলে আমি নিজেই আসব। তাতে কাজ হবে? হ্যাঁ হবে। তোমাকে যে জন্যে টেলিফোন করেছিলাম সেটাইতো বলা হয় নি। কি জন্যে টেলিফোন করেছ? চার লাইনের কবিতা শুনাতে চেয়েছিলাম— শোনাও। থাক এখন না। কাল সকালে যখন আসব তখন শোনাব। না এক্ষণী শুনাও। নিঝুম রাতের জ্যেৎত্মা এসে স্মৃতির ভাড়ার লোটে ফাগুন হাওয়ায় সিদকাঠিটা বুকের মধ্যে ফোটে হৃদয় ফেটে কাব্য ঝরে ব্যথার শোনিত পারা রূপকথা নয়, রূপকথা নয়, এই জীবনের ধারা। জাফর সাহেব আটটার আগেই অফিসে চলে যান। আজ সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলের বাবা আসবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। কি কি বলবেন তাও গুছিয়ে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ছেলে চলে যাবে মেয়ে একা থাকবে এটা তার পছন্দ না। দুজন এক সঙ্গেই যাক। টিকিটের টাকা তিনি দেবেন। এটা কোন ব্যাপার না। তাঁর ক্ষিধে লেগেছে। এখনো নাশতা করেন নি। মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে নাশতা করবেন এই ভেবে রেখেছেন। তিথি বলল, তুমি খেয়ে নাও বাবা। তারা বোধহয় আসবেন না। আসবে না কেন? বাবা আর ছেলের মধ্যে রাগারাগি হয়েছে। মনে হয় বাবার রাগ ভাঙ্গানো যাচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও। ওরা যদি এসে দেখে আমরা নাশতা টাশতা খেয়ে বসে আছি সেটা কি একটা নিতান্তই অনুচিত কাজ হবে না? আমি না হয় অপেক্ষা করি। আচ্ছা দে দেখি। নাশতা করেই ফেলি। জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন তার মেয়ে অনেক খাবারের আয়োজন করেছে। পরোটা, ভূনা গোশত, পাউরুটি, মাখন, ডিম, একটা বাটিতে চিড়া ভাজা, অন্য একটা বাটিতে মুড়ি। জাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, পরোটা তুই ভেজেছিস না-কি? ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে। তিথি লজ্জিত গলায় বলল, পরোটা আমি ভাজি নি বাবা। পাশের ফ্ল্যাটের অরুনার মা, উনাকে বলেছিলাম। উনি বানিয়ে পাঠিয়েছেন। গোশতও উনি রান্না করেছেন? গোশত আমি রান্না করেছি। ভাল হয়নি বাবা? ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে অনেক পদ করেছিস। ঠিকমত নাশতা করলে দুপুরে আজ আর খেতে হবে না। তিথির লজ্জা লাগছে। এতগুলি পদ টেবিলে সাজানো বাবা নিশ্চয়ই মনে মনে। হাসছেন। তাছাড়া সে খানিকটা সাজগোজও করেছে। বাবার চোখে পড়ার কথা। তেমন আহামরি কিছু না–চোখে কাজল দিয়েছে। নতুন ভাঁজ ভাঙ্গা একটা শাড়ি পরেছে। তিথি। জি বাবা। তোর কি পাসপোর্ট আছে? না। পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে? না। তাহলে তুই এক কাজ কর। নিউমার্কেটে গিয়ে পাসপোর্টের জন্যে ছবি তোল। এরা ঘণ্টা খানিকের মধ্যে ছবি দিয়ে দেয়। ঐ ছবি নিয়ে তুই দুপুর বারটার মধ্যে আমার অফিসে চলে আসবি। তারপর তোকে নিয়ে আমি পাসপোর্ট অফিসে যাব। দু দিনের মধ্যে পাসপেটি বের করতে হবে। তিথি অস্পষ্ট গলায় বলল, কেন? আমি চাই তোরা দুজন যেন এক সঙ্গে যেতে পারিস। সেটাই ভাল হবে। তোর কোন আপত্তি আছে? তিথি লজ্জিত গলায় বলল, না। গুড। আপত্তি থাকাটা কোন কাজের কথা না। আজ সিলেটে যাচ্ছি মনে আছে তো? মনে আছে। জিনিস পত্র গুছিয়ে নে। তোর মাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে হবে। কাল সকালে পৌঁছব বিকেলের ট্রেনে সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসব। মা আসতে রাজি হবেতো? অবশ্যই রাজি হবে। মেয়ের বিয়ে মা আসবে না। কি বলিস তুই। ঝগড়া আপাতত মুলতুবী থাক। বিয়ে টিয়ে হয়ে যাক তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে। জাফর সাহেব চলে গেছেন। তিথি অপেক্ষা করছে। মারুফের আসার নাম নেই। আসতে না পারলে একটা টেলিফোন তো করবে। তাও করছে না। তিথির খিদে লেগেছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকার জন্যেই বোধহয় মাথা ধরেছে। হালকা ধরণের মাথা ব্যথা যা এক সময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তিথি খালি পেটে চা খেল। সকাল থেকে এই পর্যন্ত চার কাপ চা খাওয়া হয়েছে। সে ঠিক
false
toslima_nasrin
যে বইটির অশ্লীল শব্দ পড়ে ঘেন্না হয় লোকের, সেই বইটি তিনি তাঁর কিশোরী মেয়েদের পড়িয়েছেন, তাও নাকি রীতিমত আদেশ করে! ভদ্রমহিলা বলেন, এই বইটি প্রতিটি কিশোরীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। তিনি মনে করেন তাঁর মেয়েরা এখন অনেক বেশি সাবধানে চলাফেরা করার চেষ্টা করবে, ভুলিয়ে ভালিয়ে কেউ তাদের কোনও খালি ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না। এই বইটি লেখার জন্য আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে এরকম বই যেন আরও লিখি সেই অনুরোধ করলেন তিনি। বাইরের একশ থুতুর ছিটে ঘরের একটি ছোট্ট রুমালে মুছে নিই। আমাকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ কি? অনেকে অনুমান করেন, আমার লেখা। আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না কিছু কিছু সরকারি কর্তার। বিএনপির নিজস্ব পত্রিকা দৈনিক দিনকালে আপন মনের মাধুরি মিশায়ে আমাকে অপবাদ দেওয়া হয়, আমার বড় বাড় বেড়েছে, অশ্লীলতা আর অধর্মে ডুবে আমি আবোল তাবোল বকছি। আমাকে আমার জায়গা থেকে তুলে এখন দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ। সাপ খোপের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতেই আমার জীবন যাবে, হাতে আর কলম তোলার শক্তি পাবো না। জামালপুরের গহীন গ্রামে গিয়ে আমার চাকরি করা সম্ভব নয়, আমাকে ঢাকার কোনও জায়গায় বদলি করা হোক, ঢাকায় না হলে ঢাকার আশেপাশে হলেও চলবে এই অনুরোধ জানিয়ে লেখা আমার দরখাস্তে স্বাস্থ্য সচিব মঞ্জুরুল করিমের সই নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিই। মঞ্জুরুল করিমের আরেকটি পরিচয় তিনি কবি, কবি ইমরান নূর। কবি বলেই সইটি দিয়েছেন তিনি। ইমরান নূরের পরামর্শে নির্মলেন্দু গুণ কিছু একটা হবে এই আশা নিয়ে আমাকে নিয়ে যান শেখ হাসিনার কাছে। আমার বিশ্বাস না হলেও নির্মলেন্দু গুণের বিশ্বাস হাসিনা চাইলে আমার বদলি পাল্টাতে সাহায্য করতে পারেন। হাসিনার সঙ্গে গুণের জানাশোনা অনেকদিনের। দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়েছেন। হাসিনার উদ্দেশে ছাত্রাবস্থায় তিনি সম্ভবত কিছু প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, যেমন লিখেছিলেন বিউটি কুইন পূরবী বসুকে নিয়ে। হাসিনার মিন্টো রোডের বাসভবনে এর আগে দুবার আমি গিয়েছি। প্রথম তো রোজার সময় ইফতারির দাওয়াত খেতে, সেদিনই গুণ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিনে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। হাসিনা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে ওই প্রথম আমি গিয়েছি। বুক ছিঁড়ে যায় কষ্টে যখন দেখি সিঁড়ির সেই জায়গাটি যেখানে শেখ মুজিব দাঁড়িয়েছিলেন আর বুক তাঁর গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেল। পনেরোই আগস্ট উনিশশ পঁচাত্তর সাল। কী ভয়ংকর একটি দিন। শেখ মুজিবের পুরো পরিবারের ষোলো জনকে খুন করা হয়েছিল সেদিন। ভাল যে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন শেখ রেহানা দেশে ছিলেন না পনেরোই আগস্টে, তাহলেও তাঁদেরও খুন করা হত। আজ বীর দর্পে শেখ মুজিবের খুনীরা রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। খুনীগুলো ফ্রিডম পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলও শুরু করেছে, এর ছাত্র সংগঠনের নাম যুব কমাণ্ড। জামাতে ইসলামির মতই অবলীলায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে সারা দেশে। আজ শেখ হাসিনার মুখে আমরা শেখ মুজিবরের মুখটি দেখি। ঘোর আঁধারে একটি ক্ষীণ আলোর রশ্মি আমাদের আমাদের হৃদয়ে স্বপ্ন রচনা করে। হাসিনার সঙ্গে মিন্টো রোডে আরেকবার আমার দেখা হয়, কয়েকজন কবিকে যখন ডেকেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী আর আমি। হাসিনা অনেকক্ষণ তাঁর স্বামীর কথা বললেন, স্বামীটি যে কী নচ্ছ!র, তারই নিখুঁত বর্ণনা। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া নাকি ফাঁক পেলেই খালেদা জিয়াকে ফোন করে রসের গপ্প মারেন। রাজনীতি বা সাহিত্য নিয়ে কোনও গভীর আলোচনায় হাসিনা যাননি। খাওয়া দাওয়া ঘর সংসার এসব বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ সময় একাই কথা বলেছেন। আমি চুপচাপ বসে দেখছিলাম শেখ হাসিনাকে, তাঁর কথাবার্তা আমাকে মোটেও মুগ্ধ করেনি। আমি আওয়ামী লীগের কোনও সদস্য নই, কিছু নই, আওয়ামি-চক্ষু খুলে রাখি না যখন নেষনীকে দেখি। হজ্ব করে আসার পর হাসিনা কালো পট্টি বেঁধেছেন মাথায়, একটি চুলও যেন কারও নজরে না পড়ে। মেয়েদের চুলের মত অসভ্য নোংরা জিনিস যেন আর কিছু নেই, যে করেই হোক চুল ঢাকার জন্য তাই এত আকুলিবিকুলি। হাসিনার কালো পট্টির ঢং দেখলে আমার সত্যিই রাগ হয়। ধর্ম নিয়ে হাসিনা ঘরে সেদিন কোনও কথা বলেননি। ধর্ম নিয়ে বলেন বাইরে। তারপরও জানি, তাঁর দিকেই আজ তাকিয়ে আছে দেশের প্রগতিবাদী মানুষেরা। তিনিই যদি স্বাধীনতার শত্রুদের হাত থেকে, মৌলবাদীর হাত থেকে, সাম্প্রদায়িকতার কামড় থেকে দেশকে রক্ষা করেন। শেখ হাসিনা যখন আমাদের সামনে এসে বসলেন, নির্মলেন্দু গুণই বললেন, ‘তসলিমাকে তো বদলি করে দিয়েছে, আপনি এখন ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন।’ হাসিনা বললেন, ‘আমি তো ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় থাকলে সম্ভব হত। আমি তো কিছু করতে পারবো না।’ ‘তারপরও দেখেন। খালেদা সরকার তো ওকে খুব ভোগাচ্ছে। পাসপোর্ট এখনও দিচ্ছে না। আর ওরকম জায়গায় বদলি..। ওর লেখালেখি ওরা পছন্দ করে না বলেই এসব করছে।’ হাসিনা শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘ওর লেখা তো আমারও পছন্দ হয় না।’ নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। গুণ ম্যাড়ম্যাড়ে কণ্ঠে বলেন, ‘কেন, পছন্দ হয় না কেন?’ ‘ধর্ম সম্পর্কে ও কিছু না জেনে লেখে। ইসলামে যে নারী পুরুষের অধিকার সমান, ইসলামে মেয়েদের মর্যাদা যে সবচেয়ে বেশি —এইগুলো তো ও অস্বীকার করে।’ হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রী। চব্বিশ ঘন্টা তাঁর ব্যস্ততা। আমাদের জন্য সামান্য সময় ব্যয় করে ব্যস্ততা অথবা অন্য যে কারণেই হোক তিনি উঠে গেলেন। যাবার আগে তাঁর দলের এক সদস্যকে
false
robindronath
খুশি করিতে পারি, তাহাতেও এত দিকে এত ফাঁক ছিল। আমার গুরুসেবা দেখিয়া আমার স্বামীর মন খুশি হইতে থাকিত এবং আমার উপরে তাঁহার ভক্তি আরো বাড়িয়া যাইত। তিনি যখন দেখিতেন আমার কাছে শাস্ত্রব্যাখ্যা করিবার জন্য গুরুর বিশেষ উৎসাহ,তখন তিনি ভাবিতেন, গুরুর কাছে বুদ্ধিহীনতার জন্য তিনি বরাবর অশ্রদ্ধা পাইয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী এবার বুদ্ধির জোরে গুরুকে খুশি করিতে পারিল এই তাঁহার সৌভাগ্য। এমন করিয়া চার-পাঁচ বছর কোথা দিয়া যে কেমন করিয়া কাটিয়া গেল তাহা চোখে দেখিতে পাইলাম না। সমস্ত জীবনই এমনি করিয়া কাটিতে পারিত। কিন্তু, গোপনে কোথায় একটা চুরি চলিতেছিল, সেটা আমার কাছে ধরা পড়ে নাই, অন্তর্যামীর কাছে ধরা পড়িল। তার পর একদিনে একটি মুহূর্তে সমস্ত উলটপালট হইয়া গেল। সেদিন ফাল্গুনের সকালবেলায় ঘাটে যাইবার ছায়াপথে স্নান সারিয়া ভিজা কাপড়ে ঘরে ফিরিতেছিলাম। পথের একটি বাঁকে আমতলায় গুরুঠাকুরের সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁধে একখানি গামছা লইয়া কোন্‌-একটা সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করিতে করিতে স্নানে যাইতেছেন। ভিজা কাপড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াতে লজ্জায় একটু পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন। আমি জড়োসড়ো হইয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার মুখের ’পরে দৃষ্টি রাখিয়া বলিলেন, “তোমার দেহখানি সুন্দর।” ডালে ডালে রাজ্যের পাখি ডাকিতেছিল, পথের ধারে ধারে ঝোপে-ঝাপে ভাঁটি ফুল ফুটিয়াছে, আমের ডালে বোল ধরিতেছে। মনে হইল সমস্ত আকাশ-পাতাল পাগল হইয়া আলুথালু হইয়া উঠিয়াছে। কেমন করিয়া বাড়ি গেলাম কিছু জ্ঞান নাই। একেবারে সেই ভিজা কাপড়েই ঠাকুরঘরে ঢুকিলাম, চোখে যেন ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না— সেই ঘাটের পথের ছায়ার উপরকার আলোর চুম্‌কিগুলি আমার চোখের উপর কেবলই নাচিতে লাগিল। সেদিন গুরু আহার করিতে আসিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “আন্দী নাই কেন।” আমার স্বামী আমাকে খুঁজিয়া বেড়াইলেন, কোথাও দেখিতে পাইলেন না। ওগো, আমার সে পৃথিবী আর নাই, আমি সে সূর্যের আলো আর খুঁজিয়া পাইলাম না। ঠাকুরঘরে আমার ঠাকুরকে ডাকি, সে আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে। দিন কোথায় কেমন করিয়া কাটিল ঠিক জানি না। রাত্রে স্বামীর সঙ্গে দেখা হইবে। তখন যে সমস্ত নীরব এবং অন্ধকার। তখনি আমার স্বামীর মন যেন তারার মতো ফুটিয়া উঠে। সেই আঁধারে এক-একদিন তাঁহার মুখে একটা-আধটা কথা শুনিয়া হঠাৎ বুঝিতে পারি, এই সাদা মানুষটি যাহা বোঝেন তাহা কতই সহজে বুঝিতে পারেন। সংসারের কাজ সারিয়া আসিতে আমার দেরি হয় । তিনি আমার জন্য বিছানার বাহিরে অপেক্ষা করেন। প্রায়ই তখন আমাদের গুরুর কথা কিছু-না-কিছু হয়। অনেক রাত করিলাম। তখন তিন প্রহর হইবে, ঘরে আসিয়া দেখি, আমার স্বামী তখনো খাটে শোন নাই, নীচে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। আমি অতি সাবধানে শব্দ না করিয়া তাঁহার পায়ের তলায় শুইয়া পড়িলাম। ঘুমের ঘোরে একবার তিনি পা ছুঁড়িলেন, আমার বুকের উপর আসিয়া লাগিল। সেইটেই আমি তাঁর শেষদান বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি। পরদিন ভোরে যখন তাঁর ঘুম ভাঙিল আমি তখন উঠিয়া বসিয়া আছি। জানলার বাহিরে কাঁঠালগাছটার মাথার উপর দিয়া আঁধারের একধারে অল্প একটু রঙ ধরিয়াছে; তখনো কাক ডাকে নাই। আমি স্বামীর পায়ের কাছে মাথা লুটাইয়া প্রণাম করিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিলেন এবং আমার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “আর আমি সংসার করিব না।” স্বামী বোধ করি ভাবিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখিতেছেন- কোনো কথাই বলিতে পারিলেন না। আমি বলিলাম, “ আমার মাথার দিব্য, তুমি অন্য স্ত্রী বিবাহ করো। আমি বিদায় লইলাম।” স্বামী কহিলেন, “তুমি এ কী বলিতেছ। তোমাকে সংসার ছাড়িতে কে বলিল।” আমি বলিলাম, “গুরুঠাকুর।” স্বামী হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, “গুরুঠাকুর! এমন কথা তিনি কখন বলিলেন।” আমি বলিলাম, “আজ সকালে যখন স্নান করিয়া ফিরিতেছিলাম তাঁহার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল। তখনি বলিলেন।” স্বামীর কণ্ঠ কাঁপিয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন আদেশ কেন করিলেন।” আমি বলিলাম, “জানি না। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো, পারেন তো তিনিই বুঝাইয়া দিবেন।” স্বামী বলিলেন, “সংসারে থাকিয়াও তো সংসার ত্যাগ করা যায়, আমি সেই কথা গুরুকে বুঝাইয়া বলিব।” আমি বলিলাম, “হয়তো গুরু বুঝিতে পারেন, কিন্তু আমার মন বুঝিবে না। আমার সংসার করা আজ হইতে ঘুচিল।” স্বামী চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। আকাশ যখন ফরসা হইল তিনি বলিলেন, “চলো-না, দুজনে একবার তাঁর কাছেই যাই।” আমি হাত জোড় করিয়া বলিলাম, “তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা হইবে না।” তিনি আমার মুখের দিকে চাহিলেন,আমি মুখ নামাইলাম। তিনি আর কোনো কথা বলিলেন না। আমি জানি, আমার মনটা তিনি একরকম করিয়া দেখিয়া লইলেন। পৃথিবীতে দুটি মানুষ আমাকে সব চেয়ে ভালোবাসিয়াছিল, আমার ছেলে আর আমার স্বামী। সে ভালোবাসা আমার নারায়ণ, তাই সে মিথ্যা সহিতে পারিল না। একটি আমাকে ছাড়িয়া গেল, একটিকে আমি ছাড়িলাম। এখন সত্যকে খুঁজিতেছি, আর ফাঁকি নয়। এই বলিয়া সে গড় করিয়া প্রণাম করিল। সম্পর্ক মিলাইয়া দেখিতে গেলে বনমালী এবং হিমাংশুমালী উভয়ে মামাতো পিসতুতো ভাই; সেও অনেক হিসাব করিয়া দেখিলে তবে মেলে। কিন্তু ইহাদের দুই পরিবার বহুকাল হইতে প্রতিবেশী, মাঝে কেবল একটা বাগানের ব্যবধান, এইজন্য ইহাদের সম্পর্ক নিতান্ত নিকট না হইলেও ঘনিষ্ঠতার অভাব নাই। বনমালী হিমাংশুর চেয়ে অনেক বড়ো। হিমাংশুর যখন দন্ত এবং বাক্য-স্ফূর্তি হয় নাই তখন বনমালী তাহাকে কোলে করিয়া এই বাগানে সকালে সন্ধ্যায় হাওয়া খাওয়াইয়াছে, খেলা করিয়াছে, কান্না থামাইয়াছে, ঘুম পাড়াইয়াছে; এবং শিশুর মনোরঞ্জন করিবার জন্য পরিণতবুদ্ধি বয়স্ক লোকদিগকে সবেগে শিরশ্চালন, তারস্বরে প্রলাপভাষণ প্রভৃতি যে-সকল বয়সানুচিত চাপল্য এবং উৎকট উদ্যম প্রকাশ
false
humayun_ahmed
ও বলছেন তার মানে এখনও চিনতে পারেননি। আমি ডাক্তার। আপনার চিকিৎসা করেছিলাম। ঐ যে ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হলেন-। এখন চিনতে পেরেছি। আপনি ড্রেস অ্যাজ য়ু লাইক প্রতিযোগিতা করছেন নাকি? ইরানি মেয়ে সেজেছেন। ডাক্তাররা সাজতে পারবে না। এমন কোনো আইন আছে? না, আইন নেই। আপনার যদি তেমন কোনো কাজ না থাকে তা হলে উঠে আসুন। আমি গাড়িতে উঠলাম। ফারজানা বলল, আমি খুবই আনাড়ি ধরনের ড্রাইভার। আজই প্ৰথম সাহস করে একা একা বের হয়েছি। আপনার কাজ হলো সামনের দিকে লক্ষ্য করা, যথাসময়ে আমাকে ওয়ার্নিং দেয়া। পারবেন না? পারব। এক কাজ করলে কেমন হয়–ভিড়ের রাস্তা ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় চলে যাই। ঢাকা শহরে ফাঁকা রাস্তা কোথায়? হাইওয়েতে উঠবেন? হাইওয়েতে কখনো উঠিনি। চলুন আজ ওঠা যাক। ময়মনসিং-এর দিকে যাওয়া যাক। পথে ভদ্রটাইপের একটা জঙ্গল পড়বে। গাড়ি পার্ক করে আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারি। জঙ্গলে ঢুকব কেন? চুকতে না চাইলে ঢুকবেন না। আমরা জঙ্গল পাশে ফেলে হোস করে চলে যাব। আপনার পায়ে স্যান্ডেল নেই। সান্ডেল কি ছিঁড়ে গেছে? গাড়ি চালাতে চালাতে পায়ের দিকে তাকবেন না। এমতেই আপনি আনাড়ি ড্রাইভার। খুব আনাড়ি কি মনে হচ্ছে? না–খুব আনাড়ি মনে হচ্ছে না। আপনি কি জানেন হাসপাতাল থেকে আপনি চলে যাবার পর বেশ কয়েকবার আপনার কথা আমার মনে হয়েছে? আপনার এক আত্মীয়ের টেলিফোন নাম্বার ছিল। বোধহয় আপনার ফুপা। তাকে একদিন টেলিফোনও করলাম। তিনি বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন। ধমক দিলেন? ধমক দেয়ার মতোই। তিনি বললেন, আমাকে টেলিফোন করছেন কেন? হিমুর ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আর কখনো টেলিফোন করে বিরক্ত করবেন না। বলেই খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। আমি হাসলাম। ফারজানা বলল, হাসছেন কেন? আপনার গাড়ি চালানো খুব ভালো হচ্ছে–এইজন্যে হাসছি। আমরা কি ময়মনসিং-এর দিকে যাচ্ছি? হ্যাঁ। যে-জঙ্গলের কথা বলছেন সেখানে কি চা পাওয়া যাবে? অবশ্যই পাওয়া যাবে। পোষা জঙ্গল। সবই পাওয়া যায়। যখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন পিকনিক করতে আসেননি। আমি পড়াশোনা দেশে করিনি। আমার এম ডি ডিগ্রি বাইরের। বাংলা তো খুব সুন্দর বলছেন। আমার মা ছিলেন বাঙালি। ছিলেন বলছেন কেন? ছিলেন বলছি, কারণ–তিনি এখন নেই। তার খুব শখ ছিল তার মেয়ে দেশে ফিরে দেশের মানুষের সেবা করবে। আমি বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছি মার ইচ্ছাপূরণের জন্যে। আমি ভেবে রেখেছি— এদেশে পাঁচ বছর কাজ করব, তারপর ফিরে যাব। ক’বছর পার করেছেন? তিন বছর কয়েক মাস। দাঁড়ান, একজাক্ট ফিগার বলছি–তিন বছর চার মাস। বাংলাদেশে কাজ করতে কেমন লাগছে? মাঝে মাঝে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে খুবই বিরক্ত লাগে। এদেশের কিছু মজার ব্যাপার আছে। বিনয়কে এদেশে দুর্বলতা মনে করা হয়, বদমেজাজকে ব্যক্তিত্ব ভাবা হয়। মেয়ে মাত্রকেই অল্পবুদ্ধি ভাবা হয়। মেয়ে-ডাক্তার বললেই সবাই ভাবে ধাত্রী, যারা বাচ্চা ডেলিভারি ছাড়া আর কিছু জানে না। বাচ্চা ডেলিভারি ছাড়া আপনি আর কী জানেন? আমি একজন নিউরোলজিস্ট। আমার কাজকর্ম মানুষের মস্তিস্ক নিয়ে। আপনার প্ৰতি আমার আগ্রহের এটাও একটা কারণ। যে-কোনো কারণেই হোক আপনি প্ৰচণ্ড ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জ্বরের ঘোরে আপনি প্ৰলাপ বকতেন। সেইসব আমি শুনেছি। কিছু ম্যাগনেটিক টেপে রেকর্ড করাও আছে। রেকর্ড করেছেন? জি। রেকর্ডও করেছি। খুবই ইন্টারেস্টিং। আসলে আপনার উচিত একজন ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা। বাংলাদেশে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন না? আছে একজন। একজন কেন? অনেক তো থাকার কথা। একজনের নাম খুব শুনি। মিসির আলি সাহেব। ওনার সঙ্গে একটা আপয়েন্টমেন্ট করুন। প্রয়োজন মনে করলে আমিও যাব। আপনার এত আগ্রহ কেন? আমার আগ্রহের কারণ আছে, সেটা আপনাকে বলা যাবে না। ভালো কথা, আপনার সেই বিখ্যাত জঙ্গল আর কতদূর? এসে গেছি। মোড়টা পার হলেই জঙ্গল। জঙ্গলে আরেকদিন গেলে কেমন হয়? আজি ইচ্ছা করছে না। খুব ভালো হয়। শুধু একটা কাজ করুন, আমাকে নামিয়ে দিয়ে যান–এসেছি। যখন জঙ্গল দেখে যাই। সত্যি নামতে চান? হ্যাঁ চাই। ফিরবেন কীভাবে? ফেরা কোনো সমস্যা না। বাস পাওয়া যায়। ফারজানা দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। আমি শালবনে ঢুকে পড়লাম। পিকনিক পার্টি এড়িয়ে আমি ঢুকে পড়লাম গভীর জঙ্গলে। জঙ্গল সম্পর্কে আমার বাবার দীর্ঘ উপদেশ আছে— যখনই সময় পাইবে তখনই বনভূমিতে যাইবার চেষ্টা করিবে। বৃক্ষের সঙ্গে মান মানবশ্রেণির বন্ধন অতি প্রাচীন। আমার ধারণা আদি মানব একপর্যায়ে বৃক্ষের সহিত কথোপকথন করিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা নষ্ট হইয়াছে। তবে সাধনায় ফল হয়। মন কেন্দ্রীভূত করিতে যদি সক্ষম হও–তবে বৃক্ষের সহিত যোগাযোগেও সক্ষম হইবে। বৃক্ষরাজ তোমাকে এমন অনেক জ্ঞান দিতে সক্ষম হইবে যে-জ্ঞান এমিতে তুমি কখনো পাইবে না। কড়া রোদ উঠেছে। শালবনে ছায়া হয় না। তবু মোটামুটি ছায়াময় একটি বৃক্ষ দেখে তার নিচে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লাম। শীতের রোদ আরামদায়ক। শুকনো পাতার চাদরে শুয়ে আছি। নাড়াচড়া করলেই শুকনো পাতা মচমচে শব্দ করছে। যেমন বলছেনড়াচড়া করবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। শালগাছের যে ফুল হয় জানতাম না। পীতাভ ধরনের অনাকর্ষণীয় কিছু ফুল চোখে পড়ছে। শালের ফুলে কি গন্ধ হয়? এত উঁচুতে যে, ছিঁড়ে গন্ধ শোকা সম্ভব না। প্রকৃতি নিশ্চয়ই এই ফুল মানুষের জন্যে বানায়নি। মানুষের জন্যে বানালে ফুল ফুটত হাতের নাগালের ভেতর। ঘুমের ভেতর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম–গাছ নিয়ে স্বপ্ন। গাছ আমার সঙ্গে কথা বলছে। তবে উলটাপালটা কথা বলছে–কিংবা মিথ্যা কথা বলছে।
false
robindronath
জোগায়। আমি বললুম, অত অসুবিধা করবার দরকার কী। তার চেয়ে বরঞ্চ ছাতাটা তুমি নিয়ে যাও, যখনি সুযোগ হবে ফিরিয়ে দিলেই হবে।আর সে তিলমাত্র দেরি করল না। বললে, প্ল্যানটা শোনাচ্ছে ভালো। ছাতাটা বগলে করে চট্‌পট্‌ সরে পড়ল। ভয় ছিল, ফাউন্টেন-পেনের খোঁজ উঠে পড়ে। ছাতা ফেরাবার সুযোগ কোনোদিনই হবে না। হায় রে, আমার পনেরো টাকা দামের সিল্কের ছাতাটা। ছাতা ফিরবে না, ফাউন্টেন-পেনও ফিরবে না, কিন্তু সবচেয়ে আরামের কথা হচ্ছে— সেও ফিরবে না। কী বল, দাদামশায়! তোমার সেই ফাউন্টেন-পেন, সেই ছাতা, তুমি ফিরে পাবে না? ভদ্র বিধান-মতে ফিরে পাবার আশা নেই। আর, অভদ্র বিধান-মতে? ভালোমানুষের কুষ্ঠিতে সে লেখে না। আমি তো ভালোমানুষ নই, আমি তাকে চিঠি লিখব— তোমার সে কথা জানবার দরকার হবে না। আরে ছিছি, না না, সে কি হয়। আর, লিখে হবেই বা কী। সে বলবে আমি নিই নি। জানি, ও তাই বলবে। কিন্তু, আমরা যে জেনেছি ও চুরি করেছে, সেইটেই ওকে আমি জানাতে চাই। সর্বনাশ! ঠিক সেইটেই ওকে জানাতে চাই নে— ভদ্রলোকের ছেলে চুরি করেছে— ছিছি, কতবড়ো লজ্জার কথা। আমার এমন কত গেছে, তুমি তখন জন্মাও নি। তখন ব্রাউনিঙের কবিতার আদর নতুন বেড়েছে। খুব আগ্রহ করে পড়ছিলুম। আমার সাহিত্যিক বন্ধুকে উৎসাহ করে একটা কবিতা পড়ে শোনালুম। তিনি বললেন, এ বইটা আমার নিশ্চয় পড়া চাই, তিন দিন পরেই ফিরিয়ে দেব। আমার মুখ শুকিয়ে গেল। বললুম, এটা আমি এখন পড়ছি। এতই ভালোমানুষের সুরে বলেছিলুম যে বইটা রাখতে পারা গেল না। দিনকয়েক পরে খবর নিয়ে জানলুম, তিনি গেছেন একটা মকদ্দমার তদ্‌‍বির করতে বহরমপুরে। ফিরতে দেরি হবে। আমার জানা হকারকে বলে দিলুম, ব্রাউনিঙের বড়ো এডিশনটা যদি পাওয়া যায় আমাকে যেন জানায়। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, পাওয়া গেছে। বইটা বের করে দেখালে, আমারই সেই বই। যে পাতাখানায় আমার নাম লেখা ছিল সেই পাতাটা ছেঁড়া। কিনে নিলুম। তার পর থেকে সেই বইখানা লুকিয়ে রাখতে হল, যেন আমিই চোর। আমার লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাছে বইখানা তাঁর হাতে ঠেকে। আমার কাছে তাঁর বিদ্যে ধরা পড়েছে, এ কথাটা পাছে তিনি জানতে পান। আহা, হাজার হোক, ভদ্রলোক। আর বলতে হবে না, দাদামশায়, স্পষ্ট বুঝেছি কাকে বলে ভালোমানুষ। * * * মণিরাম সত্যই স্যায়না, বাহিরের ধাক্কা সে নেয় না। বেশি করে আপনারে দেখাতে চায় যেন কোনোমতে ঠেকাতে। যোগ্যতা থাকে যদি থাক্‌-না, ঢাকে তারে চাপা দিয়ে ঢাকনা। আপনারে ঠেলে রেখে কোণেতে তবে সে আরাম পায় মনেতে। যেথা তারে নিতে চায় আগিয়ে দূরে থাকে সে সভায় না গিয়ে। বলে না সে, আরো দে বা খুবই দে; ঠেলা নাহি মারে পেলে সুবিধে। যদি দেখে টানাটানি খাবারে বলে, কী যে পেট ভার, বাবা রে! ব্যঞ্জনে নুন নেই, খাবে তা; মুখ দেখে বোঝা নাহি যাবে তা। যদি শোনে, যা তা বলে লোকরা বলে, আহা, ওরা ছেলে-ছোকরা। পাঁচু বই নিয়ে গেল না বলে; বলে, খোঁটা দিয়ো নাকো তা ব’লে। বন্ধু ঠকায় যদি, সইবে; বলে, হিসাবের ভুল দৈবে। ধার নিয়ে যার কোনো সাড়া নেই বলে তারে, বিশেষ তো তাড়া নেই। যত কেন যায় তারে ঘা মারি বলে, দোষ ছিল বুঝি আমারি। আমার খুদে বন্ধুরা এসে হাজির তাদের নালিশ নিয়ে। বললে, দাদামশায় তুমি কি আমাদের ছেলেমানুষ মনে কর। তা, ভাই, ঐ ভুলটাই তো করেছিলুম। আজকাল নিজেরই বয়েসটার ভুল হিসেব করতে শুরু করেছি। রূপকথা আমাদের চলবে না, আমাদের বয়েস হয়ে গেছে। আমি বললুম, ভায়া, রূপকথার কথাটা তো কিছুই নয়। ওর রূপটাই হল আসল। সেটা সব বয়েসেই চলে। আচ্ছা, ভালো, যদি পছন্দ না হয় তবে দেখি খুঁজে-পেতে। নিজের বয়েসটাতে ডুব মেরে তোমাদের বয়েসটাকে মনে আনতে চেষ্টা করছি। তার থলি থেকে রূপকথা নাহয় বাদ দিলুম, তার পরের সারে দেখতে পাই মৎস্যনারীর উপাখ্যান। সেও চলবে না। তোমরা নতুন যুগের ছেলে, খাঁটি খবর চাও; ফস্‌ করে জিজ্ঞেস করে বসবে, লেজা যদি হয় মাছের, মুড়ো কী করে হবে মানুষের; রোসো, তবে ভেবে দেখি। তোমাদের বয়েসে, এমন-কি তোমাদের চেয়ে কিছু বেশি বয়েসে আমরা ম্যাজিকওয়ালা হরীশ হালদারকে পেয়ে বসেছিলুম। শুধু তাঁর ম্যাজিকে হাত ছিল না, সাহিত্যেও কলম চলত। আমাদের কাছে সেও ছিল ম্যাজিক-বিশেষ। আজও মনে আছে একটা ঝুল্‌ঝুলে খাতায় লেখা তাঁর নাটকটা, নাম ছিল মুক্তকুন্তলা। এমন নাম কার মাথায় আসতে পারে! কোথায় লাগে সূর্যমুখী, কুন্দনন্দিনী। তার পর তার মধ্যে যা সব লম্বা চালের কথাবার্তা, তার বুলিগুলো শুনে মনে হয়েছিল, এ কালিদাসের ছাপ-মারা মাল। বীরাঙ্গনার দাপট কী! আর দেশ-উদ্ধারের তাল ঠোকা! নাটকের রাজপুত্রটি ছিলেন স্বয়ং পুরুরাজের ভাগ্নে; নাম ছিল রণদুর্ধর্ষ সিং। এও একটা নাম বটে, মুক্তকুন্তলার নামের সঙ্গে সমান পাঁয়তারা করতে পারে। আমাদের তাক লেগে গেল। আলেকজাণ্ডার এসেছিলেন ভারত জয় করতে। রণদুর্ধর্ষ বিদায় নিতে এলেন মুক্তকুন্তলার কাছে। মুক্তকুন্তলা বললেন, যাও বীরবর, যুদ্ধে জয়লাভ করে এসো, আলেকজাণ্ডারের মুকুট এনে দেওয়া চাই আমার পায়ের তলায়। যুদ্ধে মারা পড়লেও পাবে তুমি স্বর্গলোক, আর যদি বেঁচে ফিরে এস তো স্বয়ং আছি আমি। উঃ, কতবড়ো চটাপট হাততালির জায়গা একবার ভেবে দেখো। আমি রাজি হলেম মুক্তকুন্তলা সাজতে, কেননা, আমার গলার আওয়াজটা ছিল মিহি। আমাদের দালানের পিছন দিকে খানিকটা পোড়ো জমি ছিল, তাকে বলা হত গোলাবাড়ি। সত্যিকার ছেলেমানুষের পক্ষে সেই জায়গাটা ছিল ছুটির স্বর্গ। সেই
false
manik_bandhopaddhay
মাসিকের পট বিজ্ঞাপনের ছবি একে দিন কাটায়। সেজন্য আপসোসও নেই, এমন অপদার্থ। বনবিহারীর অপরাধটা মতি বুঝিতে পারে না। বুঝিতে ইচ্ছা হয় না। কথার অন্তরালে স্নেহ ছিল বনবিহারীর, সমবেদনা ছিল। গ্রাম ছাড়িয়া আত্মীয়পরিজনের সঙ্গ ছাড়িয়া ছেলেমানুষ সে যে একটা অপরিচিত অদ্ভুত জগতে আসিয়া পড়িয়ছে, বনবিহারী ছাড়া কুমুদের আর কোনো বন্ধু বোধহয় তাহার খেয়ালও করে নাই। দুদিন পরে সকালবেলা বনবিহারী আবার আসিল। না-যাওয়ার অন্য অনেক অনুযোগ দিয়া বলিল, চলো কুমুদ, এখুনি যাই আজ, ওখানেই খাওয়াদাওয়া করবি। কুমুদ হাই তুলিয়া বলিল, যাব যাব, এত ব্যস্ত কেন? বনবিহারীর মুখখানা এবার একটু গম্ভীর দেখাইল। সুর ভারী করিয়া সে বলিল, তোর ব্যাপারটা কী বল তো কুমুদ? আমাদের ওদিকে যাস না আজ ছ মাস, যেতে বলায় আজ হাই উঠছে? সাতদিন তোর দেখা না পেলে আগে আমাদের ভাবনা হত। হঠাৎ যে ত্যাগ করলি আমাদের? ত্যাগ? ত্যাগের স্বভাব আমার নেই। এমনি হাই উঠছে–শ্রান্তিতে। সারাদিন শুয়ে থেকে শ্রান্তি! আর যেতে বলব না কুমুদ। কী দরকার? কাল-পরশুর মধ্যে একদিন হশ করে হাজির হব দেখিস। বনবিহার এবার হাসিল, হয়তো তার আগেই জয়া হশ কওে এসে হাজির হবে এখানে। কী শাস্তিটা তখন যে তোকে দেবে ভেবে পাচ্ছি না। খুকিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে একমাস হয়তো লুকিয়ে রেখে দেবে। বনবিহারীর মুখে খুকি শব্দটা মতির ভালোই লাগে। তবু সে আবদার করিয়া বলিল, আবার খুকি কেন? বনবিহারী চলিয়া গেলে কুমুদকে বলিল, চলো না যাই একদিন? অমন করে বলছেন! কুমুদ মৃদু হাসিয়া বলিল, উনি কি আর বলছেন মতি, ওর মুখ দিয়া আর একজন বলাচ্ছেন তার নাম জয়া, উনার তিনি পত্নী।–যাব, ইতিমধ্যে একদিন যাব। এদিকে ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যাবেলা কুমুদের সমাগত বন্ধুর সংখ্যা বাড়িতে থাকে, রীতিমতো আড্ডা বসে। চৌকিতে কুলায় না। চৌকি কাত করিয়া রাখিয়া মেঝেতে বিছানা ও চাদর বিছাইয়া সকলে বসে। কেহ অনর্গল কথা বলে, কেহ থাকিয়া থাকিয়া প্রবল শব্দ করিয়া হাসে, কেহ গুনগুন করিয়া ভাঁজে গানের সুর। দেয়ালে ঠেস দিযা শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত কেহ শুধু ঝিমায়। বিড়ি, সিগারেট আর চুরুটের ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হইয়া ওঠে। তাস খেলা হয়। টাকা পয়সার আদান-প্রদান দেখিয়া মতি বুঝিতে পারে জুয়া খেলা হইতেছে। মতির কান্না আসে। সহজভাবে সে নিশ্বাস ফেলিতে পারে না। লজ্জা করিতে কুমুদ তাহাকে বারণ করিয়াছে, কুমুদের বন্ধুরা একজন দুজন করিয়া আসিলে মতির বেশি লজ্জা করেও না। এ তো তা নয়। যে ঘর ছাড়িয়া এক মিনিটের জন্য তাহার বাহিরে যাওয়ার উপায় নাই, একপাল বন্ধু জুটাইয়া সে ঘরে কুমুদ সন্ধ্যা হইতে রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা দেয়, হাজার লজ্জা না করিলেও যে চলে না। মতি চা যোগায়। বিকালে স্টোভ ধরায়, রাত বারোটার আগে সে স্টোভ ঠাণ্ড হইবার সময় পায় না। বোধহয় কুমুদের বলা আছে, সন্ধ্যার বন্ধুরা মতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, চা পান প্রভৃতির প্রয়োজন পর্যন্ত কুমুদকে জানায়। চা করিয়া, পান সাজিয়াই মতির কর্তব্য শেষ, বিতরণ করিতে হয় না। এদিকের জানালায় গিয়া সে বসিয়া থাকে সমস্তক্ষণ। জানালার পাটগুলি ঘরের ভিতরে খোলে, তারই আড়ালে মতি একটু অন্তরাল পায়। ওইখানে মাঝে মাঝে মতির রোমাঞ্চ হয়। ভয়ে সে কাঁদিতেও পারে না, ঘরে এতগুলি মানুষ। রাগে দুঃখে অভিমানে পাখি হইয়া মতির গাওদিয়া উড়িয়া যাইতে সাধ হয়। ক্রমে রাত্রি বাড়ে। রাস্তার লোক চলাচল কমিয়া আসে, সরু গলিটার ওমাথায় ক্ষণিকের জন্য আলোকিত ট্রামগুলিকে আর যাইতে দেখা যায় না, তীব্র আলো নিভাইয়া পথের ও পাশের মনোহারি দোকানটি বন্ধ করা হয় ন আর দোকানটির ঠিক উপরের ঘরে মতিরই সমবয়সি একটি মেয়ে টেবিল চেয়ারে পড়া সাঙ্গ করিয়া শয়নের আয়োজন করে। দেখিয়া মতিরও ঘুম আসে। বন্ধুরা চলিয়া গেলে কুমুদ বলে, আগে বিছানা পাতবে? নামিয়ে দেব চৌকিটা? না, খেয়ে নেবে আগে? মতি সাড়া দেয় না! উঠিয়া কাছে যাইবে তাতেও কুমুদের আলস্য। বলে, শোনো, শুনে যাও। রাগ হল নাকি? আহা, শোনোই না। বেশিক্ষণ অবাধ্য হওয়ার সাহস মতির হয় না। কাছে গিয়া কাঁদিতে থাকে, বলে, এত লোক ঘরে এলে আমি কেমন করে থাকি? কুমুদ তাকে আদর করিয়া বলে, বন্ধুরা এলে কি তাড়িয়ে দিতে পারি মতি? ওরা তো জ্বালাতন করে না তোমাকে? তখন মতি বলে যে কুমুদ তবে আর একটা ঘর ভাড়া নিক। কুমুদ বলে, ঘরের ভাড়া কি সহজ, অত টাকা কোথায়? মতি তখন জবাব দেয় টাকার যখন এমন অভাব, খুব সস্তায় ছোটখাটো একটা বাড়ি ভাড়া নিলেই হয়। এখানে আর ভালো লাগিতেছে না মতির। আর তাও যদি না হয় বন্ধুদের কারো বাড়ি গিয়া কুমুদ আড্ডা বসাক। এত রাত পর্যন্ত তোমায় একা রেখে যাব? ভয় করবে না তোমার? না ভয় করবে না। ঘরে খিল দিয়ে থাকব। এবার আর কুমুদ এমন যুক্তি দেখায় না মতি যা খণ্ডন করিতে পারে। প্রথমেই মতিকে এমন সোহাগ করে যে সে অবশ, মন্ত্ৰমুগ্ধ হইয়া আসে। তারপর সে মতিকে বোঝায় বলে, ভেঙেচুরে গড়ে নেব বলিনি তোমাকে? বলিনি ঘর সংসার পেতে বসবার আশা কোরো না? সে তো সবাই করে, রাস্তায় মুটে থেকে মহারাজ পর্যন্ত। আমি তো সেইরকম নই মতি। নিয়ম মেনে চলতে হলে দুদিনে আমি মুষড়ে মরে যাব। ভেসে ভেসে বেড়াই, কাল কী হবে ভাবি না, যা ভালো লাগে তাই করি। আমার সঙ্গে থাকতে হলে কনেবউটি সেজে থাকলে চলবে কেন তোমার? বউ-মানুষ আমি, আমি এমন
false
humayun_ahmed
মায়া লাগে। রাতে সে কিছু খেল না। মাঝরাতের দিকে তার জ্বর খুব বাড়ল। আমি তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছি। সে বিড়বিড় করে নানান কথা বলছে—। জ্বরের ঘোরে বলছে বলেই আমার ধারণা। কোটিপতি হওয়া কঠিন কিছু না। ইচ্ছা করলে হওয়া যায়। দরকারটা কি বল? কোন দরকার নাই। অহানার কথাই ধর–অহনাও কিন্তু কোটিপতি। গরিব ঘরের মেয়ে ছিল। কি যে ভয়ঙ্কর গরিব চিন্তাই করতে পারবে না। অথচ এমন ভাল ছাত্রী। পড়াশোনার এত আগ্রহ। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ত তখন হলের সীটরেন্ট দেয়ার পয়সা নেই। সফিক আমার হাত দিয়ে টাকা পাঠাতো। সফিক একটা কথা বলে—নো ফ্ৰী লাঞ্চ। এই পৃথিবীতে সব কিছুই নগদ অর্থে কিনতে হবে। হো হো হো। বুঝতে পারছ কিছু? বুঝতে পারছি না। বুঝতে চাচ্ছিও না। টাকা দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে সফিক কিনেছে। এখন চাকা ঘুরে গেছে মেয়েটা কিনে নিয়েছে সফিককে। ঢাকা শহরে যত প্রোপার্টি সফিকের আছে সব কিন্তু ঐ মেয়ের নামে। এখন একবার যদি এই মেয়ে সফিককে ছেড়ে যায়–সফিক পথে বসবে। আজিমপুর কবরস্থানে বসে ভিক্ষা করতে হবে। সুর করে গান গাইতে হবে–আল্লাহুম্মা, সাল্লেআলা সাইয়াদেনা, মৌলানা মোহাম্মদ! প্লিজ চুপ করে থাক। ঘুমানোর চেষ্টা কর। আহা কথা বলতে ভাল লাগছে তো। শোন না কি বলি–দারুণ ইন্টারেস্টিং। আমি করতাম কি মাসের দুই তিন তারিখে টাকা নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। হল গেইট থেকে স্লীপ পাঠাতাম–জাহেদা খাতুন, সেকেন্ড ইয়ার অনার্স— রুম নাম্বারা…। উনার নামতো অহনা। অহনা পরে হয়েছে–তখন তার নাম ছিল জাহেদা খাতুন। বিয়ের পর হল অহনা। বুঝলে নবনী। খামে ভর্তি করে টাকা নিয়ে যেতাম। সব নতুন চকচকে নোট। জাহেদা টাকাগুলো হাতে নিত। আমি সঙ্গে করে মনিঅৰ্ডার ফরম নিয়ে যেতাম। এইখানে বসেই সে মনিঅৰ্ডার ফরম পূরণ করত। দেশে টাকা পাঠাতো। মনিঅৰ্ডার ফরমে লিখত–মা, তোমাকে কিছু টাকা পাঠালাম। এখানে দুটা মেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা টাকা পাই তাতে আমার চলে গিয়েও কিছু থাকে। পানি খাব নবনী। পানি দাও। আমি পানি এনে দিলাম। দুচুমুক খেয়েই রেখে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, একটা ফ্রিজ কেনা দরকার। জ্বর জ্বরি হলে ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছা করে। একটা ফ্রিজ কিনতে হবে। ফ্রিজ কেনার টাকা আছে। কালই একটা ফ্রিজ কিনে ফেলব। কি বল? আচ্ছা। আর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। তুমি একা একা থাক গান শোনার একটা কিছু থাকলে সময় কাটবে। আচ্ছা কেনা হবে। ড্রেসিং টেবিলটা এখনো দিয়ে যায় নি? না। কি রকম হারামজাদা চিন্তা করে দেখতো। ইচ্ছা করছে পিটায়ে লাশ বানায়ে ফেলি। জ্বর কমলে কাল সকালে একবার যাব।— এমন পিটন দিব। অবশ্যি অহনাকে আনার জন্যে কাল রাজশাহীও যেতে হতে পারে। আমি হলাম তার চড়নদার। বুঝতে পারছ? পারছি। সপ্তাহের ছুটি যখন হত তখন অহনাকে আমি সফিকের কাছে পৌঁছে দিতাম। যেতাম রিকশা করে। ওর আবার সেই সময় পেট্রোলের গন্ধ সহ্য হত না। প্রথম প্রথম রিকশা করে যাবার সময় খুব কাঁদতো। এই মেয়ে যে কি পরিমাণ কাঁদতে পারে তুমি বিশ্বাসও করবে না। আচ্ছা নবনী তুমি কি রকম কাঁদতে পারো? আমি জবাব দিলাম না। জ্বরের ঘোরে ও ঝিমিয়ে পড়ল। আমি পাশেই জেগে বসে আছি। একটু দূরে হাতপা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে মদিনা। মেয়েটা খুবই শান্ত। দোষের মধ্যে একটাই হঠাৎ দেখা যায় কাজ কর্ম বন্ধ রেখে কাঁদতে বসে। আমি যখন জিজ্ঞেস করি— কাঁদছিস কেনরে? সে দুহাতে চোখ মুছে কান্না বন্ধ করে ফিক করে হেসে ফেলে বলে, এম্নেই কান্দি। অভ্যাস। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। আমি কাঁদি কি-না। না। আমি কাঁদি না। অতি বড় দুঃসময়েও না। কি হবে কেঁদে? প্রবল জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে সে পড়ে আছে। আমি চুপচাপ বসে আছি তার মাথার কাছে। মানুষ কি আশ্চর্য প্রাণী। আজ আমি যার মাথার পাশে বসে আছি তার বদলে অন্য একজনের মাথার পাশেও বসতে পারতাম। পারতাম না? বিয়ে নামের একটা ব্যাপার দুজন অচেনাকে একসঙ্গে করে দিয়েছে। আমিতো স্যারের মাথার পাশেও বসে থাকতে পারতাম। স্যারের কথা এই মুহূর্তে ভাবটা কি ঠিক হচ্ছে। মুহূর্তে বানান কি যেন? হয়ের নীচে দীর্ঘ উকার। শুনুন স্যার, এই বানান আমি আর কোন দিন ভুল করিনি। করবও না শব্দটা মনে হলেই আপনাকে মনে পড়ে। একজন মানুষ কি তার প্রতিটি মুহূর্ত আলাদা করতে পারে? আমি পারি। স্যারের সঙ্গে মুহূর্তগুলি আমি পারি। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার তখন দেখাই হয় না। চাটাইয়ের যে ঢাকনি তিনি দিয়েছেন তা তিনি সরান নি। একদিন দেখি উত্তরের দরজাটাও তিনি তার দিকে থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন তার ঘরে যেতে হলে বাইরে দিয়ে যেতে হবে। আমি নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা এসে গেছে। দরজা বন্ধ করে রাত দিন পড়ার ভাণ করি। বই এ একেবারেই মন বসে না। চিঠি লেখার একটা খাতা করেছি। রোজ একটা করে চিঠি লিখি। মজার মজার সব চিঠি। কোনটাতে হাসির কথা থাকে। কোনটাতে রাগের কথা থাকে। কোন কোন চিঠি লিখে নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। ঠিক করে রেখেছি। এক বছরে ৩৬৫টা চিঠি লিখব। চিঠি লেখা শেষ হলে একদিন খাতা নিয়ে স্যারের কাছে যাব। তাকে বলব— স্যার দেখুন তো এখানে কি কি বানান ভুল আছে। অতিথিপুরে আমার ছোটখালার ননদের বিয়ে। খালা খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন অবশ্যই যাই। মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হবে। মা বললেন— নবনী যাবি? আমি বললাম পাগল হয়েছ? আমার পরীক্ষা না?
false
shordindu
চেয়ে বেশি কে জানে? মিসেস বক্সী‌, আজ যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কাকে ভাল লাগল বলুন।’ সত্যবতী নিঃসংশয়ে বলিল‌, ‘রজনীকে। ভারি সুন্দর স্বভাব‌, আমার বড় ভাল লেগেছে।’ সোমের মুখে একটু অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল। সত্যবতী সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিয়া চলিল‌, ‘যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনি মিষ্টি কথা; আর ভারি বুদ্ধিমতী।–আচ্ছা‌, মহীধরবাবু এখনও মেয়ের বিয়ে কোন দিচ্ছেন না? ওঁর তো টাকার অভাব নেই।’ দ্বারের নিকট হইতে একটি তীব্ৰ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিলাম— ‘বিধবা! বিধবা! বিধবাকে কোন হিন্দুর ছেলে বিয়ে করবে? মালতী দেবী কখন দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন জানিতে পারি নাই। সংবাদটি যেমন অপ্রত্যাশিত‌, সংবাদ-দাত্রীর আবিভবিও তেমনি বিস্ময়কর। হতভম্ব হইয়া তাকাইয়া রহিলাম। মালতী দেবী ঈষতিক্ত নয়নে আমাদের একে একে নিরীক্ষণ করিয়া আবার বলিলেন‌, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? উনি জানেন‌, ওঁকে জিজ্ঞেস করুন। এখানে সবাই জানে। অতি বড় বেহায়া না হলে বিধবা মেয়ে আইবুড়ো সেজে বেড়ায় না। কিন্তু দু’কান কাটার কি লজ্জা আছে? অত যে ছলা-কলা ওসব পুরুষ ধরবার ফাঁদ।’ মালতী দেবী যেমন আচম্বিতে আসিয়াছিলেন তেমনি অকস্মাৎ চলিয়া গেলেন। সিঁড়িতে তাঁর দুম দুম পায়ের শব্দ শোনা গেল। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হইয়াছিলেন অধ্যাপক সোম। তিনি লজ্জায় মাথা তুলিতে পারিতেছিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল। শেষে তিনি বিড়ম্বিত মুখ তুলিয়া দীনকণ্ঠে বলিলেন‌, ‘আমাকে আপনারা মাপ করুন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কোথাও পালিয়ে যাই-‘ তাঁর স্বর বুজিয়া গেল। ব্যোমকেশ শাস্তস্বরে প্রশ্ন করিল‌, ‘রাজনী সত্যিই বিধবা?’ সোম ধীরে ধীরে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। চৌদ্দ বছর বয়সে বিধবা হয়। মহীধর বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কৃতী ছাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের দু’দিন পরে প্লেনে চড়ে সে বিলেত যাত্ৰা করে; মহীধরবাবুই জামাইকে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে বিলেত পর্যন্ত পৌঁছল না; পথেই বিমান দুর্ঘটনা হয়ে মারা গেল। রজনীকে কুমারী বলা চলে।’ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। আমি সোমকে আর একটি সিগারেট দিলাম এবং দেশলাই জ্বালাইয়া ধরিলাম। সিগারেট ধরাইয়া সোম বলিলেন‌, ‘আপনারা আমার পারিবারিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। আমার জীবনের ইতিহাসও অনেকটা মহীধরবাবুর জামাইয়ের মত। গরীবের ছেলে ছিলাম এবং ভাল ছাত্র ছিলাম। বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় বিলেত যাই। কিন্তু উপসংহারটা সম্পূর্ণ অন্য রকমের হল। আমি বিদ্যালাভ করে ফিরে এলাম এবং কলেজের অধ্যাপক হলাম। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারলাম না। কাজ ছেড়ে দিয়ে আজ সাত বছর এখানে বাস করছি। অন্ন-বিস্ত্রের অভাব নেই; আমার স্ত্রীর অনেক টাকা।’ কথাগুলিতে অন্তরের তিক্ততা ফুটিয়া উঠিল। আমি একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কাজ ছেড়ে দিলেন কেন?’ সোম উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন‌, ‘লজ্জায়। স্ত্রী-স্বাধীনতার যুগে স্ত্রীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা যায় না—অথচ–। মাঝে মাঝে ভাবি‌, বিমান দুর্ঘটনাটা যদি রজনীর স্বামীর না হয়ে আমার হত সব দিক দিয়েই সুরাহা হত।’ সোম দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। ব্যোমকেশ পিছন হইতে বলিল‌, ‘প্রোফেসর সোম‌, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করি। যে গ্রুপ ছবিটা কিনেছিলেন সেটা কোথায়?’ সোম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘সেটা আমার স্ত্রী কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাতে আমি আর রজনী পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম।’ সোম ধীরপদে প্ৰস্থান করিলেন। রাত্রে আহারে বসিয়া বেশি কথাবার্তা হইল না। হঠাৎ এক সময় সত্যবতী বলিয়া উঠিল‌, ‘যে যাই বলুক‌, রজনী ভারি ভাল মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছে‌, বাপ যদি সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে চান তাতে দোষ কি?’ ব্যোমকেশ একবার সত্যবতীর পানে তাকাইল‌, তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বলিল‌, ‘আজ পার্টিতে একটা সামান্য ঘটনা লক্ষ্য করলাম‌, তোমাদের বোধ হয় চোখে পড়েনি। মহীধর বাবু তখন ছবি চুরির গল্প আরম্ভ করেছেন‌, সকলের দৃষ্টি তাঁর দিকে। দেখলাম ডাক্তার ঘটক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল‌, রজনী চুপি চুপি তার কাছে গিয়ে তার পকেটে একটা চিঠির মতন ভাঁজ-করা কাগজ ফেলে দিলে। দু’জনের মধ্যে একটা চকিত চাউনি খেলে গেল। তারপর রজনী সেখান থেকে সরে এল। আমার বোধ হয় আমি ছাড়া এ দৃশ্য আর কেউ লক্ষ্য করেনি। মালতী দেবীও না।’ দিন পাঁচ ছয় কাটিয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশের শরীর এই কয়দিনে আরও সারিয়াছে। তাহার আহার্যের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাইয়াছে; সত্যবতী তাহাকে দিনে দুইটা সিগারেট খাইবার অনুমতি দিয়াছে। আমি নিত্য গুরুভোজনের ফলে দিন দিন খোদার খাসী হইয়া উঠিতেছি‌, সত্যবতীর গায়েও গত্তি লাগিয়াছে। এখন আমরা প্রত্যহ বৈকালে ব্যোমকেশকে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় পদচারণ করি‌, কারণ হওয়া বদলের ইহা একটা অপরিহার্য অঙ্গ। সকলেই খুশি। একদিন আমরা পথ-ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছি‌, অধ্যাপক সোম আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন‌, বলিলেন‌, ‘চলুন‌, আজ আমিও আপনাদের সহযাত্রী।’ সত্যবতী একটু উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিল‌, ‘মিসেস সোম কি-?’ সোম প্ৰফুল্ল স্বরে বলিলেন‌, ‘তাঁর সর্দি হয়েছে। শুয়ে আছেন।’ সোম মিশুক লোক‌, কেবল স্ত্রী সঙ্গে থাকিলে একটু নিজীবী হইয়া পড়েন। আমরা নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ছবি চুরির প্রসঙ্গ আপনা হইতেই উঠিয়া পড়িল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা বলুন দেখি‌, ঐ ছবিখানা কাগজে বা পত্রিকায় ছাপানোর কোনও প্ৰস্তাব হয়েছিল কি?’ সোম চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, তারপর ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন‌, ‘কৈ‌, আমি তো কিছু জানি না। তবে নকুলেশবাবু মাঝে কলকাতা গিয়েছিলেন। বটে। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে তিনি ছবি ছাপতে দেবেন কি? মনে হয় না। বিশেষত ডেপুটি ঊষানাথবাবু জানতে পারলে ভারি অসন্তুষ্ট হবেন।’ ‘ঊষানাথবাবু অসন্তুষ্ট হবেন কেন?’ উনি একটু অদ্ভুত গোছের লোক। বাইরে বেশ গ্ৰাম্ভারি‌, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীরু প্রকৃতি। বিশেষত ইংরেজ
false
shorotchandra
উনি জবাফুল বড় ভালবাসেন। যে যা ব’লে দেয় তার তাই হয়। এ ত সবাই জানে। তুই জানিস নে? আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার অসুখ করেনি? ইন্দ্র আশ্চর্য হইয়া কহিল, আমার? আমার কখ্‌খনো অসুখ করে না। কখনো কিছু হয় না। হঠাৎ উদ্দীপ্ত হইয়া বলিল, দেখ্‌ শ্রীকান্ত, আমি তোকে একটা জিনিস শিখিয়ে দেব। যদি তুই দুবেলা খুব মন দিয়ে ঠাকুরদেবতার নাম করিস্‌—তাঁরা সব সামনে এসে দাঁড়াবেন, তুই স্পষ্ট দেখতে পাবি। তখন আর তোর কোন অসুখ করবে না। কেউ তোর একগাছি চুল পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না—তুই আপনি টের পাবি। আমার মতন যেখানে খুশি যা, যা খুশি কর্, কোন ভাবনা নেই। বুঝলি? আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, হুঁ। বঁড়শিতে টোপ দিয়া জলে ফেলিয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলাম, এখন তুমি কাকে নিয়ে সেখানে যাও? কোথায়? ওপারে মাছ ধরতে? ইন্দ্র ছিপটা তুলিয়া লইয়া সাবধানে পাশে রাখিয়া বলিল, আমি আর যাইনে। তাহার কথা শুনিয়া ভারি আশ্চর্য হইয়া গেলাম। কহিলাম, আর একদিনও যাওনি? না, একদিনও না। আমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে—কথাটা ইন্দ্র শেষ না করিয়াই ঠিক যেন থতমত খাইয়া চুপ করিয়া গেল। উহার সম্বন্ধে এই কথাই আমাকে অহরহ খোঁচার মত বিঁধিয়াছে। কোন মতেই সেই সেদিনের মাছ-বিক্রিটা ভুলিতে পারি নাই। তাই সে যদি বা চুপ করিয়া গেল, আমি পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, কে মাথার দিব্যি দিলে ভাই? তোমার মা? না, মা নয়। বলিয়া ইন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। তার পরে সে ছিপের গায়ে সুতাটা ধীরে ধীরে জড়াইতে জড়াইতে কহিল, শ্রীকান্ত, আমাদের সে রাত্রির কথা তুই বাড়িতে বলে দিস্‌নি? আমি বলিলাম, না। কিন্তু তোমার সঙ্গে চ’লে গিয়েছিলাম তা সবাই জানে। ইন্দ্র আর কোন প্রশ্ন করিল না। আমি ভাবিয়াছিলাম, এইবার সে উঠিবে, কিন্তু, তাহাও করিল না—চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার মুখে সর্বদাই কেমন একটা হাসির ভাব থাকে, এখন তাহাও নাই, এবং কি-একটা সে যেন আমাকে বলিতে চায়, অথচ তাহাও পারিতেছে না, বলিয়া উঠিতেও পারিতেছে না—বসিয়া থাকিতেও যেন অস্বস্তি বোধ করিতেছে। আপনারা পাঁচজন এখানে হয়ত বলিয়া বসিবেন, এটি বাপু তোমার কিন্তু মিছে কথা। অতখানি মনস্তত্ত্ব আবিষ্কার করিবার বয়সটা ত তা’ নয়। আমিও তাহা স্বীকার করি। কিন্তু আপনারাও এ কথাটা ভুলিতেছেন যে, আমি ইন্দ্রকে ভালবাসিয়াছিলাম। একজন আর একজনের মন বুঝে সহানুভূতি এবং ভালবাসা দিয়া—বয়স এবং বুদ্ধি দিয়া নয়। সংসারে যে যত ভালবাসিয়াছে, পরের হৃদয়ের ভাষা তাহার কাছে তত ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে। এই অত্যন্ত কঠিন অন্তর্দৃষ্টি শুধু ভালবাসার জোরেই পাওয়া যায়, আর কিছুতে নয়। তাহার প্রমাণ দিতেছি। ইন্দ্র মুখ তুলিয়া কি যেন বলিতে গেল, কিন্তু বলিতে না পারিয়া সমস্ত মুখ তার অকারণে রাঙ্গা হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি একটা শরের ডাঁটা ছিঁড়িয়া নতমুখে জলের উপর নাড়িতে নাড়িতে কহিল, শ্রীকান্ত! কি ভাই? তোর—তোর কাছে টাকা আছে? ক’ টাকা? ক’ টাকা? এই—ধর্‌, পাঁচ টাকা— আছে। তুমি নেবে? বলিয়া আমি ভারি খুশি হইয়া তাহার মুখপানে চাহিলাম। এ কয়টি টাকাই আমার ছিল। ইন্দ্রর কাজে লাগিবার অপেক্ষা তাহার সদ্ব্যবহার আমি কল্পনা করিতেও পারিতাম না। কিন্তু ইন্দ্র ত কৈ খুশি হইল না। মুখ যেন তাহার অধিকতর লজ্জায় কি একরকম হইয়া গেল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু আমি ত এখন তোকে ফিরিয়ে দিতে পারব না। আমি আর চাইনে, বলিয়া সগর্বে তাহার মুখের পানে চাহিলাম। আবার কিছুক্ষণ সে মুখ নীচু করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমি নিজে চাইনে। একজনদের দিতে হবে, তাই। তারা বড় দুঃখী রে—খেতেও পায় না। তুই যাবি সেখানে? চক্ষের নিমেষে আমার সে রাত্রির কথা মনে পড়িল। কহিলাম, সেই যাদের তুমি টাকা দিতে নেমে যেতে চেয়েছিলে? ইন্দ্র অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ তারাই। টাকা আমি নিজেই ত কত দিতে পারি, কিন্তু দিদি যে কিছুতে নিতে চায় না। তোকে একটিবার যেতে হবে শ্রীকান্ত, নইলে, এ টাকাও নেবে না; মনে করবে, আমি মায়ের বাক্স থেকে চুরি ক’রে এনেচি! যাবি শ্রীকান্ত? তারা বুঝি তোমার দিদি হয়? ইন্দ্র একটু হাসিয়া কহিল, না, দিদি হয় না—দিদি বলি। যাবি ত? আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া তখনি কহিল, দিনের বেলা গেলে সেখানে কোন ভয় নেই। কাল রবিবার; তুই খেয়েদেয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে থাকিস্‌, আমি নিয়ে যাব; আবার তখ্‌খুনি ফিরিয়ে আন্‌ব। যাবি ত ভাই? বলিয়া যেমন করিয়া সে আমার হাতটি ধরিয়া মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তাহাতে আমার ‘না’ বলিবার সাধ্য রহিল না। আমি দ্বিতীয়বার তাহার নৌকায় উঠিবার কথা দিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। কথা দিলাম সত্য, কিন্তু সে যে কতবড় দুঃসাহসের কথা সে ত আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। সমস্ত বিকালবেলাটা মন ভারী হইয়া রহিল, এবং রাত্রে ঘুমের ঘোরে প্রগাঢ় অশান্তির ভাব সর্বাঙ্গে বিচরণ করিয়া ফিরিতে লাগিল। ভোরবেলা উঠিয়া সর্বাগ্রে ইহাই মনে পড়িল আজ যেখানে যাইব বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছি, সেখানে যাইলে কোনমতেই আমার ভাল হইবে না। কোন সূত্রে কেহ জানিতে পারিলে, ফিরিয়া আসিয়া যে শাস্তি ভোগ করিতে হইবে, মেজদার জন্যও ছোড়দা বোধ করি সে শাস্তি কামনা করিতে পারিত না। অবশেষে খাওয়া-দাওয়া শেষ হইলে টাকা পাঁচটি লুকাইয়া লইয়া নিঃশব্দে যখন বাহির হইয়া পড়িলাম, তখন এমন কথাও অনেকবার মনে হইল—কাজ নাই গিয়া। নাই বা কথা রাখিলাম; এমনই বা তাহাতে কি আসে যায়! যথাস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, শরঝাড়ের নীচে সেই ছোট্ট নৌকাটির উপর ইন্দ্র উদ্‌গ্রীব হইয়া অপেক্ষা
false
shunil_gongopaddhay
কে লিখছে কে জানে! তা ছাড়া, গদ্য তেমন গুরুত্বও পায় না। অনেকের কাছেই এখনও কবিতাই প্রকৃত সাহিত্য, গদ্য-টদ্য খবরের কাগুজে ব্যাপার। হ্যাঁ, বঙ্কিমবাবু মহাকাব্যের বদলে গদ্য-আখ্যায়িকা লিখছেন বটে, সেগুলি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে, মেয়েরা খুব পড়ে, তা বলে বঙ্কিম তো ভারতচন্দ্র কিংবা চণ্ডীদাসের চেয়ে বড় নন। বিলেত ঘুরে এসে, পশ্চিমী সাহিত্যের সাম্প্রতিক ধারার সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হয়ে রবি বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতে গদ্যেরই যুগ আসছে। ক্রমশ নাটক-নভেলই কবিতার ওপর আধিপত্য করবে। লম্বা লম্বা পদ্যে লেখা মহাকাব্য আর কেউ পড়তে চাইবে না। বঙ্কিমবাবুও পদ্য ছেড়ে গদ্যে এসেছেন, তিনি ঠিক পথই ধরেছেন। গদ্য লেখার জন্য বঙ্কিমের কী অহংকার, রবি দু একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, বঙ্কিমবাবু পাত্তাই দেননি। প্রকাশ্যে তিনি রবির পিঠ চাপড়ান বটে, সেটা যেন খানিকটা করুণা, বাড়িতে গেলে কথাই বলতে চান না। বঙ্কিমের ওপর টেক্কা দিতে গেলে রবিকেও উপন্যাস লিখতে হবে। চন্দননগরে এসে সে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসেই বঙ্কিমের প্রধান খ্যাতি, রবিও বেছে নিয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমিকা। নাম দিয়েছে ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’। কবিতার মতন, এই গদ্য রচনার সময়ও নতুন বউঠানের ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে লিখতে লিখতে আর একটা উপন্যাসের প্লটও তার মাথায় এসেছে। এক রহস্যময়ী রমণীকে ঘিরে দুজন পুরুষের প্রণয় দ্বন্দ্ব। তবে এই বিষয়টা নিয়ে এখুনি লেখা ঠিক হবে কি না সে বিষয়ে সে মনঃস্থির করতে পারছে না। সকালবেলা বাগানে প্রাতরাশ খেতে খেতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ও রবি, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কাল বিকেলে একজন লোক একটি পত্র নিয়ে এসেছিল। ত্রিপুরার রাজ দরবারের দুজন দূত তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। রবি চমকে উঠে বলল, কেন? একটু দূরের চেয়ারে বসে কুরুশ কাঠি দিয়ে একটি পশমের আসন বুনছেন কাদম্বরী, তার মাঝখানে দু একটি অক্ষর ফুটে উঠেছে। আসনটি কার জন্য বোনা হচ্ছে তা তিনি বলবেন না কিছুতেই। বোনা থামিয়ে তিনি কৌতূহলী হয়ে তাকালেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কেন, তা আমি কী করে জানব। শুনেছি, ত্রিপুরার রাজারা কলকাতা থেকে মাস্টার ধরে নিয়ে যায়। তোকেও মাস্টার ঠাউরেছে নাকি? তোর তা হলে একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কাদম্বরী ফিক করে হেসে বললেন, রবি হবে মাস্টার? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ত্রিপুরায় এখনকার রাজার নাম কী যেন? বীরচাঁদ না ভীরুচাঁদ, না না, ওরা মাণিক্য হয়। বীরুমাণিক্য, ওই রাজার শখ নবরত্ব সভা বসাবার। আমাদের যদু ভট্টকেও তো ওখানে নিয়ে গেছে। তোকেও বোধ করি সভাকবি হিসেবে পাকড়ে নিয়ে যাবে। রবি বলল, জ্যোতিদাদা, আমি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না। কাদম্বরী বললেন, কেন, যাও না ত্রিপুরায়। তুমি বেশ রাজকবি হবে। কত সম্মান হবে। আমরা ত্রিপুরায় বেড়াতে যাব। রবির মুখে বেদনার রেখা ফুটিল, সে এক দৃষ্টিতে নতুন বউঠানের দিকে চেয়ে রইল। জ্যোতিদাদা বললেন, দেখা করবি না। কী রে, আমি যে আসতে বলে দিয়েছি। এখুনি এসে পড়বে। কী বলতে চায় শুনেই দেখ না। এই সব নেটিভ স্টেটের রাজারা এক একটি উৎকট জীব হয়। এদের কতরকম উদ্ভট খেয়ালের কথা যে শুনেছি! কেউ কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করে, কেউ পাঁচ সাতশো বিয়ে করে। মানডুর সুলতান গিয়াসুদ্দিন, তার হারেমে নাকি ছিল পনেরো হাজার নারী। তার দেহরক্ষীরাও নারী, সিংহাসন ঘিরে থাকত নারীরা, সে ব্যাটা সৰ্বক্ষণ স্ত্রীলোক ছাড়া কোনও পুরুষকে দেখতই না! আর একজন রাজার ছখানা পরোটা ভাজার জন্য তিরিশ সেরা ঘি খরচ হতো। এদের তো ডিফেন্স বাজেট নেই, সৈন্য নিয়ে কারুর সঙ্গে লড়তে হয় না, তাই টাকা পয়সা নিয়ে নয়-ছয় করে। দেখ এই ত্রিপুরার বীরুমাণিক্যের কোন বাই চেপেছে! কাদম্বরী বললেন, বাইরের লোক আসবে, আমি ভেতরে যাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ওঁরা তো রাজার দূত। মেজবৌদি লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তুমি এক রাজার দূতদের সামনে থাকতে পারবে না কেন? কাদম্বরী তাঁর কণ্ঠস্বরের অপ্ৰসন্নতা অনেকটা ঢেকে বললেন, তোমার মেজবৌদি যা যা পারেন, তার সব কি আমি পারি? কাদম্বরী থাকলেন না। চলে গেলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবিকে বললেন, সেবারে কী মজা হয়েছিল জানিস তো? লাটসাহেব কলকাতায় অনেককে ডেকেছেন, মেজদা মেজবৌদিকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তো কেউ বউদের নিয়ে যায় না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাথুরেঘাটার প্রসন্ন ঠাকুর, উনিতো আমাদের জ্ঞাতি, প্রথমে মেজবৌদিকে দেখে ভেবেছিলেন বেগম সেকেন্দার। ভূপালের ওই বেগম পুরুষ সেজে থাকেন, পুরুষের মতন দরবারে বসেন। তারপর প্রসন্ন ঠাকুর যে-ই চিনতে পারলেন যে বেগম নয়, উনি ঠাকুরবাড়ির বউ, অমনি রেগেমেগে উঠে গেলেন সেখানে থেকে। রবি বলল, বেগম সেকেন্দার তাঁর মেয়ের নাম দিয়েছেন শাহজাহান, তাই না? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ, খুব তেজী মহিলা। মুসলমান হয়েও পর্দা-ফর্দি ছিঁড়ে ফেলেছে। একটু পরেই এসে পড়লেন রাধারমণ ও শশিভূষণ। সঙ্গে একজন ভৃত্যের হাতে উপহার দ্রব্যের একটি ডালি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওঁদের বৈঠকখানা ঘরে এনে বসালেন। রাধারমণ বললেন, আমরা রবীন্দ্ৰবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, এই তো আমার ছোট ভাই রবি। রাধারমণ ও শশিভূষণ দুজনেই বিস্মিতভাবে চেয়ে রইলেন। এই সদ্য যুবকটির চোখে-মুখে এখনও লেগে রয়েছে কৈশোরের লাবণ্য। তার দৃষ্টি সলজ্জ। রাধারমণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইনিই ভগ্নহৃদয়’ কাব্যটি লিখেছেন? জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ বললেন, বিলক্ষণ। রবির আরও বই বেরিয়েছে। রাধারমণ এবারে গদগদভাবে বললেন, হে কবি, আপনাকে আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। ত্রিপুরার মহামান্য মহারাজ শ্ৰীল শ্ৰীযুক্ত বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য আপনার কাব্যখানি পড়ে মোহিত হয়েছেন। তিনি আপনাকে একটি মানপত্র পাঠিয়েছেন, আর সামান্য কিছু প্রীতির নিদর্শন।
false
MZI
বুলবুল অনেক দিন পরে ভাত খেল। আনোয়ারা অনেক যত্ন করে সবকিছু বেঁধে দিয়েছে, জহুর সেগুলো তুলে তুলে বুলবুলকে খাইয়ে দিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি এখন যাই? যাও বাবা। তুই একলা থাকতে পারবি তো? আমি একলা একলা আছি না? কোথায় ঘুমাস? ঐ যে ঝাঁপড়া গাছটা দেখছ? সেটার উপর? গাছের উপর? হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে হয় না। ভয় লাগে রাতের বেলা? বুলবুল ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, কেন বাবা? ভয় কেন লাগবে? তুই এইটুকুন মানুষ, এই চরের মাঝে একা একা— আমি একা থাকি না বাবা? তাহলে তোর সাথে কে থাকে? ঐ গাছটাতে কত পাখি থাকে তুমি জানো? পাখি? হ্যাঁ সত্যিকার পাখি। পাখিরা আমাকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসে? হ্যাঁ। আমার সাথে উড়ে বেড়ায়। খেলে। জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী আশ্চর্য! আসলে আশ্চর্য না, এইটাই স্বাভাবিক বাবা। জহুর অবাক হয়ে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল, এইটুকুন ছোট বাচ্চা কী সুন্দর বড় মানুষের মতো কথা বলছে। মনে হচ্ছে কয়েক দিনেই সে বড় হয়ে গেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে জহুর বলল, ঠিক আছে বাবা। আমি তাহলে যাই। এই যে পোঁটলাটা রাখ। কাঁথা কম্বল আছে। খাবার আছে—পানি আছে। এক টুকরা সাবান আছে। বুলবুল পোঁটলাটা হাতে নিয়ে বলল, আমার কিছু লাগবে না বাবা! আমি এমনিতেই ভালো আছি। না লাগলেও সাথে রাখ। জহুর নৌকাটা ঠেলে পানিতে নামাতে নামাতে বলল, বাবা বুলবুল। বলো বাবা। আমি এর পরের বার যখন আসব তখন তোকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে। দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে যেতে—সুন্দরবন অনেক দূর। জানি বাবা, তুমি বলেছ। গহিন অরণ্য, সেখানে তুই আর আমি থাকব। হ্যাঁ, বাবা। অনেক মজা হবে। কোনো মানুষ তোকে আর খুঁজে পাবে না। হ্যাঁ। আমি পাখিদের সাথে পাখি হয়ে থাকব। জহুর লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে পানিতে নামিয়ে দেয়। স্রোতের টানে নৌকাটা তরতর করে এগিয়ে যায়। সে পেছনে ফিরে দেখে নদীর তীরে বুলবুল দাঁড়িয়ে আছে। জোছনার আলোতে তাকে কেমন যেন অবাস্তুব স্বপ্নের মতো দেখায়। ঠিক কী কারণ জানা নেই জহুরের বুকটা গভীর বেদনায় ভরে আসে। তৃতীয় পর্ব প্রতিদিন সকালে বুলবুলের ঘুম ভাঙে পাখির ডাক শুনে। সেই সূর্য ওঠার আগে পাখিগুলো তার ঘরের চারপাশে ভিড় জমিয়ে কিচিরমিচির করে ডাকতে থাকে। শুধু কিচিরমিচির করে ডেকেই তারা ক্ষান্ত হয় না, ঘরের ভেতর ঢুকে তার শরীরের ওপর চেপে বসে, তিড়িংবিড়িং করে লাফায়, ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দেয়। তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। আজকেও যখন ছোট ছোট পাখি তাকে জাগানোর চেষ্টা করল বুলবুল চোখ খুলে তাকালো এবং সাথে সাথে পাখিগুলোর উত্তেজনা বেড়ে যায়, তারা দুই পায়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লাফাতে থাকে, কিচিরমিচির করে ডাকতে থাকে। বুলবুল বিড়বিড় করে বলল, তোমাদের সমস্যাটা কী? এত কিচিরমিচির করছ কেন? বুলবুলকে কথা বলতে দেখে পাখিগুলো আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং তারা আরো দ্রুত ছোটাছুটি করতে থাকে। তখন বুলবুল উঠে বসল এবং পাখিগুলোর মাঝে বিশাল একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। তাদের কিচিরমিচির ডাকে তখন সেখানে কান পাতা দায় হয়ে গেল। বুলবুল একবার চোখ কচলায়, হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে এবং তারপর বিড়বিড় করে বলে, যেখানে আমি নাই সেখানে পাখিরা কী করে বলবে আমাকে? পাখিগুলো তার কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে পারে না কিন্তু হালকা সুরটুকু বুঝতে পারে। তারা উড়ে উড়ে তার ঘাড়ে মাথায় হাতে বসে একটানা কিচিরমিচির করতে থাকে। বুলবুল তখন তার ঘর থেকে বের হয়ে গাছের বড় ডালে এসে দাঁড়িয়ে তার পাখা দুটো বিস্তৃত করে দিয়ে একবার ডানা ঝাঁপটিয়ে বলল, চল তাহলে, দিনটা শুরু করি। বুলবুলের কুচকুচে কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, দীর্ঘ সুগঠিত দেহ। সে তার দুটো পাখা ছড়িয়ে দিয়ে গাছের উঁচু ডাল থেকে শূন্যে ঝাঁপ দেয়, নিচে নামতে নামতে হঠাৎ করে সে ডানা ঝাঁপটিয়ে উপরে উঠতে থাকে, তার সাথে সাথে শত শত নানা আকারের পাখি কিচিরমিচির শব্দ করে উড়তে থাকে। বুলবুল সোজা উড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করে নিচে নেমে আসতে থাকে, নদীর পানিতে নেমে আসার আগে সে সতর্ক চোখে চারপাশে একবার দেখা নেয়, বনের পশুরী এখানে রাতে পানি খেতে আসে। পানিতে মুখ ধুয়ে সে সামনে এগিয়ে যায়, তীরের কাদামাটিতে বুনো পশুর পায়ের ছাপ। বেশির ভাগই হরিণ—তার মাঝে আলাদা করে একটা বাঘের পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। একটা বাঘিনী, নতুন বাচ্চা হয়েছে—এই এলাকার আশপাশেই থাকে। নদীর পানিতে ছলাৎ ছলাৎ করে হেঁটে বুলবুল মাছ ধরার খাঁচাটা টেনে পানি থেকে তুলল। মাঝারি আকারের একটা মাছ ছটফট করছে, উপরে তুলতেই ভোরবেলার সূর্যের নরম আলোতে তার শরীরটা চিকচিক করতে থাকে। বুলবুল মাছটা আঁচা থেকে বের করে তীরে উঠে আসে, নদীর মাঝামাঝি একটা কুমির পুরানো গাছের গুড়ির মতো ভেসে ছিল, সেটা এবার ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। পাখিগুলো নদীর পানিতে ঝাপটাঝাপটি করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মাটি খুঁটে খুঁটে কিছু খেতে চেষ্টা করে। বুলবুল ডানা ঝাঁপটিয়ে উপরে ওঠার সাথে সাথে পাখিগুলোও তার সাথে আবার উড়তে শুরু করে। বনের মাঝামাঝি ফাঁকা একটা জায়গায় বুলবুল তার আগুনটা জ্বালিয়ে রাখে, উপরের ছাই সরিয়ে সে গনগনে জ্বলন্ত কয়লা বের করে তার ওপর মাছটা বসিয়ে দেয়। মাছটা আধপোড়া না হওয়া পর্যন্ত সে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। পাখিগুলো আশপাশে গাছের ডালে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের
false
shirshendu
এইসব ভাবি আর কি! বাবা, আপনার কি বিদেশ দেখতে ইচ্ছে করে? বিষ্ণুপদ সভয়ে বলে, ও বাবা, না। কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, আজকাল যাওয়া কিছু শক্ত নয়। আমি বোধ হয় বছরখানেকের জন্য আমেরিকায় যাবো। আপনি যদি যেতে চান সব ব্যবস্থা হবে। বিষ্ণুপদ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে, তুই যে বলেছিস এটাই ঢের। আমার অত চাই না। আজকাল সবাই যায়। তারা যাক। আমার সইবে না। কৃষ্ণজীবন চুপ করে রইল। তার বাবা বিষ্ণুপদর পক্ষে যে আমেরিকা যাওয়া ঘটে উঠবে না তা সেও জানে। অত সৌভাগ্য করে আসেনি তার বাবা। কিন্তু বিষ্ণুপদ কি দুৰ্ভাগা? তাও মনে হয় না কৃষ্ণজীবনের। বিষ্ণুপদ বরাবর নিজের দুর্ভাগ্যগুলিকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। শান্ত সমাধিস্থ থেকেছে। মনের মধ্যে ড়ুব দেওয়ার কৌশল কি উত্তরাধিকার সূত্রে বিষ্ণুপদর কাছ থেকেই পায়নি কৃষ্ণজীবন। বাবা, কয়েকদিন কলকাতায় গিয়ে থাকবেন। বিষ্ণুপদ আবার খুব হাসল। বলল, আজকাল শরীরে নাড়া দিতে ইচ্ছে যায় না। মনে হয়, যত নাড়াচাড়া কম হয় ততই ভাল। কেন বাবা? কেমন যেন মনে হয়, শরীরেরও কিছু নালিশ আছে। ছুটি চাইছে। বায়ুপুরাণ পড়িসনি? পড়িনি, কিন্তু আপনার কাছে শুনেছি। বইখানা পড়িস। অনেক জ্ঞান হয়। জ্ঞান তো সবই বই থেকেই হয় বাবা। তা হয়। তবে বায়ুপুরাণ একখানা বেশ বই। অনেক লক্ষণ চিনিয়ে দেয়। বাংলাদেশে নিজের গাঁয়ে একবার যাবেন। কেন, সেখানে কী আছে? দেশের গাঁ, পিতৃপুরুষের ভিটে দেখতে ইচ্ছে হয় না? বিষ্ণুপদ হাসে আর মাথা নাড়ে, চোখে দেখে কি সুখ? বরং ভাবলে সুখ হয় একটু। সবই ভাবের জিনিস। নইলে কার মাটি, কার জমি, কার বসত? এগুলো কিছু না। দেশে কি খুব সুখে ছিলাম রে বাবা? খেয়েছি তো সেই কচু ঘেঁচু, বাস করেছি মাটির ভিটির ঘরে। তবু লোকের কেবল মনে হয় দেশে কত সুখে ছিলাম। ওটা হল ভাবের সুখ। কৃষ্ণজীবন এই সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হল। বাবার দিকে মায়াভরে চেয়ে থেকে বলল, বাবা, আপনি বড় ভাল বোঝেন। বিষ্ণুপদ ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে বলে, কিছু না কিছু না। বুঝি কোথায়? এই শেষ বয়সে এসে যেন ফের হামা দিচ্ছি। এই দুনিয়াটা, আর এই আমি, কিছুতেই যেন এই দুইয়ে যোগটা খুঁজে পাই না। আমিও পাই না বাবা। বোধ হয় কেউই পায় না। বিষ্ণুপদ তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটির দিকে উজ্জ্বল চোখে হাসিমুখ করে চেয়ে থেকে বলল, আমার কী তোকে দিই বল তো! জমি টমি কিছু নিলি না, ওয়ারিশ হলি না। কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, ওগুলো তো বাইরের জিনিস বাবা। আপনার কাছ থেকেই তো সব পেয়েছি। আজই ভাবছিলাম, আপনি যেমন নিজের মনের মধ্যে ড়ুব দিয়ে বসে থাকেন, আমারও ঠিক অমনি স্বভাব। আপনার কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। বিষ্ণুপদ খুশি হয়ে মাথা নাড়ে খুব। বলে, তা অবশ্য ঠিক। স্ত্রীকে জায়া বলে, তার কারণ স্ত্রীর ভিতর দিয়েই তো পুরুষ আবার জন্মায় তার সন্তান হয়। এ তত্ত্বটা বড় ভাল, ভাবলে একটা বলভরসা হয়। তাই তো বাবা। তোর কথা ভেবে খুব তাজ্জব হয়ে যাই মাঝে মাঝে। তোর মাকেও বলি, এই আমরা যেমন, তুই ঠিক সেরকম তো নোস। আমি ভাবি কি, আমার মতো মোটাবুদ্ধি মানুষের ছেলে হয়ে তোর এত বুদ্ধি কেমন করে হল? কৃষ্ণজীবন খুব হাসল। বলল, বাবা আপনার মোটাবুদ্ধি কে বলে? দেশের গায়ে লেখাপড়ার চাড় ছিল না, চর্চা ছিল না, আপনার তেমন উৎসাহ ছিল না। নইলে হয়তো দেখা যেত আপনি মস্ত মেধারই মানুষ। গায়ে গঞ্জে কত মেধা তো অনুশীলনেরই অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তা বটে। বলে বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, কিন্তু কিছু টের পাইনি কখনও। সারাজীবন একটা কাজই করেছি। ভেবেছি। মেলা ভেবেছি। সবই হাবিজাবি। আর তেমন কিছু করিনি। অবিন্যস্ত চিন্তা। মনে হয় গুছিয়ে ভাবতে পারলে, ভাবনার পরম্পরা ঠিক থাকলেও মানুষ ভেবেই কত কী করতে পারে। কৃষ্ণজীবন হাসতে হাসতে বলল, এই যে বলছিলেন আপনার মোটাবুদ্ধি! মোটাবুদ্ধির মগজ থেকে কি এসব কথা বেলোয়? শোন, আমার তো বিশেষ কিছু নেই। একটা মাদুলি আছে। আমার মাদুলি। তোর ঠাকুমা কোথা থেকে এনে পরিয়েছিল আমায়। কোনও কাজ হয়েছিল কি না জানি না। তবে অনেকদিন আমার হাতে বাঁধা ছিল। এই বছরখানেক হল তাগা ছিঁড়ে যাওয়ায় আর পরিনি। আমার খুব ইচ্ছে হয়, ওটা তোকে দিই। মাদুলি দিয়ে কী করব বাবা? বিষ্ণুপদ সলজ্জভাবে মাথা নেড়ে বলে, কিছু করবি না, তোর কাছে রাখবি। এইটেই তোকে দিলাম ওয়ারিশ হিসেবে। কেন বাবা? মাদুলি সামান্য জিনিস, ওর সঙ্গে স্বার্থ বা লোভের সম্পর্ক নেই। একটা কিছু দেওয়াও হল, পাঁচজনের চোখ টাটাল না, নিবি কৃষ্ণ। কৃষ্ণজীবন দুটি হাত পেতে বলল, দিন বাবা। তাই দিন। বিষ্ণুপদ উঠে ঘরে গেল। বাক্স খুলে একটা কৌটো বের করে আনল। কৌটোর ভিতর থেকে কালপ্রাচীন মাদুলিটি বেরোলো। মাদুলির তাম্রাভ বর্ণ কালচে হয়ে গেছে, ঘেঁড়া তাগাটা তেলচিটে। অপ্রতিভ বিষ্ণুপদ দ্বিধান্বিত করতলে মাদুলিটা নিয়ে বলল, এটাই। নিবি বাবা? ঘেন্না করবে না তো! কৃষ্ণজীবনের চোখে জল এল। মাথা নেড়ে বলল, না বাবা। ঘেন্না কেন করবে? বড় নোংরা হয়ে আছে। পুরোনো তো? ওইরকমই থাক বাবা। এতে একজন সৎ মানুষের স্পর্শ আছে। দিন। বিষ্ণুপদ মাদুলিটা তার হাতে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল, মনে মনে ভাবছিলাম, তোকে কী দিই! কাল রাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম, তোক এই মাদুলিটা দিচ্ছি। স্বপ্নের তো মাথামুণ্ডু থাকে না। তবু ভাবলাম, তা হলে দেওয়াই
false
humayun_ahmed
আজি এলে সমস্যা কি? আজ বৃহস্পতিবার। আপনার বোতল দিবস। আজ এলে আপনার বোতল দিবসটা মাটি হবে। কাল সন্ধ্যায় আসুন, হাতেনাতে আসামি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। বাদল কি সত্যি চাকরের কাজ নিয়েছে? জ্বি।। তবে পাৰ্ট টাইম কাজ। এটা একটা আশার কথা। খালু সাহেব, বুঝতে পারছি আজ আপনার মন খুবই অশান্ত। এক কাজ করেন, আজ একটু সকাল সকল ছাদে চলে যান। ওমর খৈয়াম বলেছেন— রাখি তোমার ওমর খৈয়াম। আমি কি চীজ, বাদল কাল সন্ধ্যায় জানবে। রানু-বাদল কথামালা আবার শুরু হয়েছে। আমি লকারের রিং ঘুরাচ্ছি এবং কথা শুনছি। রানু : জানেন, আমার খুব শখ টিভি নাটকে অভিনয় করা। কিন্তু এত বাজে চেহারা কে আমাকে নেবে বলুন। বাদল : তোমার চেহারা খারাপ কে বলল? রানু : সবাই বলে। বাদল : আমার সামনে বলে দেখুক। রানু : আপনার সামনে বললে আপনি কি করবেন? বাদল : আমি ঘুঁসি দিয়ে নাকসা ফাটিয়ে দেবো। রানু : (হাসি)। ঘটনা দ্রুত ঘটছে। কোন দিকে যাচ্ছে তাও বুঝা যাচ্ছে। লেখকরা আনন্দিত মানুষের বর্ণনা নানানভাবে করেন। কেউ লেখেন— লোকটা আনন্দে ঝলমল করছে। কেউ লেখেন–সে আনন্দো আটখানা। রবীন্দ্রনাথ লেখেন বিমলানন্দের চাপা আভায় তাহার মুখমণ্ডলে… এই মুহুর্তে আমি যাকে দেখছি তার আনন্দ কবি-সাহিত্যের ভাষায় প্ৰকাশ করা কঠিন। আনন্দে আটখানার জায়গায় আনন্দে এগারোখানা বলতে পারি। তাতেও ইতার-বিশেষ হয় না। আনন্দিত ভদ্রলোকের নাম আবদুস সাত্তার। ডবল স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক . . , শেফা ক্লিনিকের কর্ণধার। তিনি বসে আছেন পল্টু স্যারের সামনের বেতের চেয়ারে। তাঁর হাতে হলদিরামের শনপাপড়ির প্যাকেট। সন্দেশ রসগোল্লার মরণঘন্টা সম্ভবত বেজে গেছে। হলদিরাম বাবুরা বেঁটিয়ে সব বিদায় করার সংকল্পে নেমেছেন। সাত্তার সাহেব শনপাপড়ির প্যাকেট পল্টু স্যারের দিকে এগিয়ে বললেন, নে, তোর জন্যে এনেছি। ঘিয়ে ভাজা শানপাপড়ি। অমৃতের কাছাকাছি। পল্টু স্যার হাত বাড়িয়ে প্যাকেট করা অমৃত নিলেন। সাত্তর সাহেব বললেন, তোর চাকরিটাকে বল, প্যাকেট খুলে সুন্দর করে সাজিয়ে মিষ্টি দিতে। ওটার নাম যেন কি কাঞ্চনজঙ্ঘা না? ওর নাম হিমু। সাত্তার সাহেব আমাকে ডাকার আগেই আমি ছুটে গেলাম। চাকরদের দিলাম। সাত্তার সাহেবের ধমক দেয়ার কথা। ধমক দিলেন না। মধুর গলায় বললেন, ভাল আছিস? জ্বি স্যার, ভাল আছি। একটা শনপাপড়ি তুই নিয়ে যা। আরাম করে খাঁ। আমি বললাম, স্যার, একটা নিলে হবে না। আমরা চারজন। অনুমতি দিলে চার পিস নিয়ে যাই। চারজন মানে কি? আমি, স্যারের ড্রাইভার, স্যারের বাবুর্চি, পার্ট টাইম ক্লিনার। সাত্তার সাহেব চোখ কপালে তোলার চেষ্টা করতে করতে বললেন, টাকা পয়সারতো দেখি হরির লুট হচ্ছে। সব বন্ধ। এখন থেকে পুরো কনট্রোল আমার হাতে। হিমু, তুই যা, কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা খেতে খেতে আমি বুঝিয়ে বলব, কেন পুরো কনট্রোল আমার হাতে। পল্টু, তুমিও বই পড়া বন্ধ করে আমার কথা শোন। তোমারও শোনা প্রয়োজন। আমাদের সবার হাতে হলদিরামের একপিস করে শনপাপড়ি। সাত্তার সাহেবের হাতে চায়ের কাপ। পটু স্যারের হাতে একটা বই, নাম— বিষাক্ত গাছ থেকে সাবধান। লেখকের নাম প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য। বই পড়ায় বাধা পড়েছে বলে স্যার বিরক্ত। বিরক্তি প্ৰকাশ করতে পারছেন না বলে আরো বিরক্ত। কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টের মতো কম্পাউন্ড বিরক্তি। সাত্তার সাহেব খাকাড়ি দিয়ে গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, এখন আমি একটা সংবাদ দেব। সংবাদটা তোমাদের জন্যে আনন্দেরও হতে পারে, আবার নিরানন্দেরও হতে পারে। সংবাদটা হচ্ছে— পল্টুর বিষয় সম্পত্তির বিষয়ে কোটি একটা অর্ডার জারি করেছে। আমাকে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়েছে। পাওয়ার অব এটর্নির ফটোকপি আমার কাছেই আছে। চাইলে দেখতে পার। কেউ দেখতে চাও? দেখতে চাইলে আওয়াজ দাও। আমরা চারজনই একসঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ুলাম— দেখতে চাই না! পাওয়ার দেখাতে আনন্দ নেই, পাওয়ার না দেখাতেই আনন্দ। সাত্তার সাহেব পল্টন্টু স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই দেখতে চাস? পল্টু স্যার বললেন, কি দেখতে চাইব? পাওয়ার অব এটর্নি? মাখা এসব দেখতে চাইব কি জন্যে? জরুরি একটা বই পড়ছি। ঠিক আছে, তুই বই পড়তে থাক। আমি চা-টা শেষ করে এদের সঙ্গে আলাপ করতে থাকি। পল্টু স্যার গভীর মনযোগে পাঠ শুরু করলেন। আমি তার ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিলাম; তিনি পড়ছেন আতা গাছ। আতা গাছ যে বিষাক্ত আমার জানা ছিল না। জানা গেল, ফল ছাড়া এই গাছের সবই বিষাক্ত! একটি বিষাক্ত গাছ মিষ্টি ফল দিচ্ছে, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। মানুষের মধ্যেও কি এ রকম আছে? বিষাক্ত বাবা-মার অসাধারণ সন্তান। সাত্তার সাহেব গলা খাকড়ি দিয়ে আমার দিকে চোখ ইশারা করলেন। আমি ছুটে গেলাম, তার হাত থেকে চায়ের খালি পেয়ালা নিয়ে গেলাম। তিনি আয়েসী ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের স্যার যে মানসিকভাবে পঙ্গু একজন মানুষ, আশা করি। ইতোমধ্যে তোমরা বুঝেছি। হিমু, বল তুমি বুঝেছ? ইয়েস স্যার। ডাক্তাররা তার বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়েছেন যে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। ডাক্তারদের সার্টিফিকেট বিষয়ে তোমাদের কোনো কথা আছে? আমি বললাম, স্যার, কথা নাই। যে লোক দিনরাত বই পড়ে এবং পায়ে ফ্যানের বাতাস দেয় সে তো মানসিক ভারসাম্যহীন বটেই। সাত্তার সাহেব বললেন, গুড! তুই ইন্টেলিজেন্ট। তোকে আমার পছন্দ হচ্ছে। শুরুতে বদমাইশ টাইপ মনে হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে না। আমি ছুটে গিয়ে সাত্তার সাহেবকে কদমবুসি করে ফেললাম। চাকরশ্ৰেণীদের নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে–প্রশংসাসূচক কিছু শুনলেই অতি দ্রুত কদম বুসি করা তার একটি। সামান্য ধমক দিলে আড়ালে অশ্রুবর্ষণও নীতিমালার অংশ। আড়ালেরও বিশেষত্ব আছে!
false
shorotchandra
দুপুরবেলার কথাগুলোও মনে পড়িয়া গেল, এবং পড়ামাত্রই প্রেমের নদীতে জোয়ার শেষ হইয়া ভাটার টান ধরিল। সাবিত্রীর কথাগুলাকে সে তামাশা বলিয়া ভুল করিল না। হঠাৎ অত্যন্ত কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিল, তারা নির্বোধ! তাদের এমন বস্তু দেওয়ার প্রস্তাব করা উচিত ছিল যা বাক্সে তুলে রাখতে কারো জঞ্জাল বলে মনে হয় না। আমিও নির্বোধ কম নই, কেননা, আমিও ভুলেছিলাম ও-বস্তুটা তোমাদের কত অবহেলার সামগ্রী! এতটা বয়সে এত বড় ভুল হওয়া আমার উচিত ছিল না। আচ্ছা, চললাম। কথাটা সাবিত্রীকে শূলের মত বিঁধিল। ‘তোমাদের’ বলিয়া সতীশ যে তাহাকে কাহাদের সহিত অভিন্ন করিয়া দেখিল, সাবিত্রীর তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। কিন্তু পরিহাস কলহে পরিণত হইয়া হাতাহাতির উপক্রম হইতেছে দেখিয়া সে চুপ করিয়া গেল। সতীশ কিন্তু থামিতে পারিল না, বলিল, শিকারী বঁড়শিতে মাছ গেঁথে খেলিয়ে যেমন করে আমোদ করে, এতদিন আমাকে দিয়ে বোধ করি তুমি সেই তামাশাই করছিলে,—না? সাবিত্রী আর সহিতে পারিল না। তড়িৎবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বঁড়শিতে গেঁথে তোমাকে টেনেই তোলা যায়—খেলিয়ে তোলবার মত বড় মাছ তুমি নও। সতীশ নির্মমভাবে বিদ্রূপ করিয়া বলিল, নই আমি? সাবিত্রী কহিল, না, নও তুমি। তাহার ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। সতীশের মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতে লাগিল, অসচ্চরিত্র! আমার মত একটা স্ত্রীলোককে ভালবেসে ভালবাসার বড়াই করতে তোমার লজ্জা করে না? যাও তুমি—আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যে অপমান করো না। এই অপমানে সতীশ আরও নির্দয় হইয়া উঠিল। এবার অমার্জনীয় কুৎসিত বিদ্রূপ করিয়া বলিল, আমি অসচ্চরিত্র! কিন্তু সে যাই হোক সাবিত্রী, তোমার নামটা কিন্তু তোমার বাপ-মা সার্থক দিয়েছিলেন। সাবিত্রী সরিয়া গিয়া চৌকাঠ ধরিয়া ক্ষণকাল স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া শুধু বলিল, যাও! তাহার মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সতীশ অপমান ও ক্রোধের অসহ্য জ্বালায় সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করিয়া বলিল, কিন্তু যাবার আগে আর একবার আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দেবে না? কিংবা আর কোনও খেলা—আর কিছু— হঠাৎ দুজনের চোখাচোখি হইল। সাবিত্রী এক-পা কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, তুমি কসাইয়ের চেয়েও নিষ্ঠুর,—তুমি যাও! তুমি যাও! তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যাও! না যাও ত মাথা খুঁড়ে মরব—তুমি যাও! তাহার কণ্ঠস্বরের উত্তরোত্তর এবং অস্বাভাবিক তীব্রতায় অকস্মাৎ সতীশ ভীত হইয়া উঠিল এবং আর একটি কথাও না বলিয়া বাহির হইয়া গেল। কিন্তু অন্ধকার বারান্দার শেষ পর্যন্ত আসিয়া তাহাকে থামিতে হইল। কোন্‌ দিকে সিঁড়ি, কোন্‌ দিকে পথ, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। পকেটে হাত দিয়া দেখিল, দেশলাই নাই। এই নিরুপায় অবস্থা-সঙ্কটের মাঝখানে মিনিট-পাঁচেক চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া আবার তাহাকে সাবিত্রীর ঘরের দিকে ফিরিয়া আসিতে হইল। বাহির হইতে দেখিল, সাবিত্রী মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে। আস্তে আস্তে ডাকিল, সাবিত্রী! সাবিত্রী সাড়া দিল না। পুনর্বার ডাকিয়াও সাড়া না পাইয়া সতীশ ঘরের মধ্যে আসিয়া সাবিত্রীর মাথায় হাত দিল। ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিল, চক্ষু মুদ্রিত এবং মুখের মধ্যে আঙ্গুল দিয়া বুঝিল, সাবিত্রী মূর্ছিত হইয়া আছে। মুহূর্তের জন্য তাহার মনের মধ্যে একটা ভয় ও সঙ্কোচের উদয় হইল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই সাবিত্রীর অচেতন দেহটা তুলিয়া লইয়া শয্যায় শোয়াইয়া দিল, এবং চাদরের এক অংশ কলসীর জলে ভিজাইয়া লইয়া মুখের উপর, চোখের উপর ছিটাইয়া দিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। মিনিট দুই-তিন পরেই সাবিত্রী চোখ মেলিয়া মাথার উপর কাপড় টানিয়া দিয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া বলিল, তুমি যাওনি? সতীশ চুপ করিয়া বাতাস করিতে লাগিল। সাবিত্রী বিছানা হইতে উঠিয়া প্রদীপ হাতে লইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, চল, তোমাকে দোর খুলে দিয়ে আসি। তার পরে নিঃশব্দে পথ দেখাইয়া নীচে নামিয়া আসিল এবং দ্বার খুলিয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। মূর্ছিত সাবিত্রীকে শয্যায় শোয়াইতে সেই যে মুহূর্তের জন্য তাহার অচেতন দেহখানি তাহাকে বুকে তুলিয়া লইতে হইয়াছিল, সেই অবধি সতীশ কি রকম যেন অন্যমনস্ক হইয়াছিল; এখন দরজার বাহিরে আসিতেই তাহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল এবং কি একটা কথা বলিবার জন্য মুখ তুলিতেই সাবিত্রী বলিয়া উঠিল, না, আর একটি কথাও না, তোমার দেহটাকে ত তুমি পূর্বেই নষ্ট করেছ, কিন্তু সে না হয় একদিন পুড়েও ছাই হতে পারবে, কিন্তু একটা অস্পৃশ্য কুলটাকে ভালবেসে ভগবানের দেওয়া এই মনটার গালে আর কালি মাখিয়ো না। হয় তুমি কালই ও-বাসা ছেড়ে চলে যাও, না হয়, আমি আর ওখানে যাবো না। বলিয়াই সাবিত্রী উত্তরের জন্য প্রতীক্ষামাত্র না করিয়া সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। নয় সতীশ হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল। কেন যে সাবিত্রী অবিশ্রাম আকর্ষণ করে, কেনই বা কাছে আসিলে এমন নিষ্ঠুর আঘাত করিয়া দূরে সরাইয়া দেয়, সেদিন সারা রাত্রি ধরিয়া ভাবিয়াও ইহার একটা অস্পষ্ট কারণও খুঁজিয়া পাইল না। গত রাত্রির এক একটা কথা এখন পর্যন্ত তাহার হাড়ের মধ্যে ঝনঝন করিয়া বাজিতেছিল। তাই সে প্রত্যুষেই বাহির হইয়া গেল এবং একটা বাসা ঠিক করিয়া আসিয়া মুটে ডাকিয়া জিনিসপত্র বোঝাই দিতে লাগিল। ব্যাপার দেখিয়া বাসার সকলেই আশ্চর্য হইল। বেশী হইল বেহারী। সে কাছে আসিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কি তবে বাড়ি যাচ্ছেন? সতীশ তাহার হাতে গোটা-পাঁচেক টাকা গুঁজিয়া দিয়া বলিল, না বেহারী, বাড়ি নয়—স্কুলের কাছেই একটা বাসা পেয়েছি, তাই যাচ্ছি। বেহারী ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলল, কিন্তু সে ত এখনো আসেনি বাবু। সতীশ মুখ না তুলিয়াই কহিল, আসেনি? আচ্ছা, তুই বিছানাগুলো আমার বেঁধে দে, আমি ততক্ষণ রাখালবাবুর ঘর থেকে একবার আসি। বলিয়াই বাসার দেনা-পাওনা মিটাইয়া দিতে
false
shordindu
ভুজঙ্গধরবাবু একটা মুখভঙ্গী করিলেন‌, তারপর বনলক্ষ্মীকে দুই বাহুর দ্বারা তুলিয়া লইয়া বলিলেন,–’আমি ওকে ওর কুঠিতে নিয়ে যাচ্ছি‌, বিছানায় শুইয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিলেই জ্ঞান হবে। যেখানটা কেটে গেছে সেখানে টিঞ্চার আয়োডিন দিয়ে বেঁধে দিলেই চলবে। আপনারা কাজ চালান‌, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’ বিজয় এতক্ষণ যেন মোহাচ্ছন্ন হইয়া ছিল‌, বলিল—’চলুন‌, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।’ ‘আসুন বলিয়া ভুজঙ্গধরবাবু বনলক্ষ্মীকে লইয়া অগ্রসর হইলেন। দ্বার দিয়া বাহির হইতে হইতে তিনি বিজয়কে বলিতেছেন শুনিতে পাইলাম—’আপনি বরং এক কাজ করুন‌, আমার কুঠি থেকে টিঙ্কার আয়োডিনের শিশি আর ব্যাণ্ডেজ নিয়ে আসুন—‘ ব্যোমকেশ আর পাশের ঘরে ফিরিয়া না গিয়া এই ঘরেই বসিল‌, বলিল,–’কি বিপত্তি! অজিত‌, তুমি তো উপস্থিত ছিলে‌, কি হয়েছিল বল দেখি?’ যাহা যাহা ঘটিয়াছিল বলিলাম‌, দন্তরূচি কৌমুদীও বাদ দিলাম না। শুনিয়া ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল। বরাট ফিরিয়া আসিয়া বলিল,–’কাউকে দেখতে পেলাম না। জানালার বাইরে মানুষের পায়ের দাগ রয়েছে কিন্তু কাঁচা দাগ বলে মনে হল না। ইট পাটকেল অবশ্য অনেক পড়ে রয়েছে।’ যেখানে বনলক্ষ্মী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়ছিল। সেখানে একটা বাঁকা কালো জিনিস আলোয় চিকমিক করিতেছিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া সেটা তুলিয়া লইল‌, আলোয় ধরিয়া বলিল,–’ভাঙা কাচের চুড়ি। বোধহয় বনলক্ষ্মী পড়ে যাবার সময় চুড়ি ভেঙেছে।’ চুড়ির টুকরো বরাটকে দিয়া ব্যোমকেশ আবার আসিয়া বসিল, নেপালবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,–’আপনারা বোধহয় জানেন‌, পুলিসের সন্দেহ নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাই একটু খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে।–নেপালবাবু্‌, যে-রাত্ৰে নিশানাথবাবু মারা যান সে-রত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’ সোজাসুজি প্রশ্ন, প্রশ্নের অন্তর্নিহিত সন্দেহটিও খুব অস্পষ্ট নয়। নেপালবাবুর গলার শির উঁচু হইয়া উঠিল‌, কিন্তু তিনি বরাটের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করিয়া কষ্ট-সংযত কণ্ঠে বলিলেন,–’দাবা খেলছিলাম।’ এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপালের উপর চোখ পড়িল। সে কানের তুলা খুলিয়া ফেলিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া একাগ্রভাবে শুনিবার চেষ্টা করিতেছে। ব্যোমকেশ : দাবা খেলছিলেন? কার সঙ্গে? নেপাল : মুকুলের সঙ্গে। ব্যোমকেশ; উনি দাবা খেলতে জানেন? নেপাল; জানে কিনা একবার খেলে দেখুন না! ব্যোমকেশ; না না‌, তার দরকার নেই। তা আপনারা যখন খেলছিলেন‌, সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল? নেপাল : কেউ না। নিশানাথ যে সেই সময় মারা যাবে তা জানতাম না‌, জানলে সাক্ষী যোগাড় করে রাখতাম। ব্যোমকেশ; সে-রত্রে আপনারা এদিকে আসেননি? নেপাল : এদিকে আসব কি জন্যে? গরমে রাত্রে ঘুম আসে না। তাই দাবা খেলছিলাম। ব্যোমকেশ : তাহলে-সো-রাত্রে এ বাড়িতে কেউ এসেছিল। কিনা তা আপনারা বলতে পারেন নেপাল : না। এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপাল হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে‌, চোখ দুটা জ্বলজ্বল করিতেছে। সে প্ৰাণপণে একটা কিছু বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু মুখ দিয়া শব্দ বাহির হইল না। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’আপনি কি কিছু বলবেন? পানু সবেগে ঘাড় নাড়িয়া আবার কথা বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু এবারও কৃতকাৰ্য হইল না। নেপালবাবু মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন,–’যত সব হাবা কালার কাণ্ড।’ দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম ভুজঙ্গধরবাবু ফিরিয়া আসিয়াছেন এবং তীক্ষ্ণচক্ষে পানুগোপালকে দেখিতেছেন। তিনি অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন,–’পানু। বোধহয় কিছু বলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ও এখন উত্তেজিত হয়েছে‌, কিছু বলতে পারবে না। পরে ঠাণ্ডা হলে হয়তো—‘ ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’ওদিকের খবর কি?’ ‘বনলক্ষ্মীর জ্ঞান হয়েছে। কপাল ড্রেস করে দিয়েছি।’ ‘বিজয়বাবু কোথায়?’ ‘তিনি বনলক্ষ্মীর কাছে আছেন।’ ভুজঙ্গধরবাবুর অধরপ্রান্ত একটু প্রসারিত হইল। নেপালবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, কর্কশাস্বরে বলিলেন,–’আপনাদের জেরা আশা করি শেষ হয়েছে। আমরা এবার যেতে পারি?’ ব্যোমকেশ : একটু দাঁড়ান। (মুকুলকে) আপনি কখনও সিনেমায় অভিনয় করেছেন? মুকুলের মুখ শুকাইয়া গেল‌, সে ত্ৰস্ত-চোখে চারিদিকে চাহিয়া স্মৃলিতস্বরে বলিল,–’আমি–না‌, আমি কখনও সিনেমায় অভিনয় করিনি।’ নেপালবাবু। গর্জন করিয়া উঠিলেন,–’মিথ্যে কথা! কে বলে আমার মেয়ে সিনেমা করে! যত সব মিথ্যুক ছোটলোকের দল।’ ব্যোমকেশ শাস্তস্বরে বলিল,–’আপনার মেয়েকে সিনেমা স্টুডিওতে যাতায়াত করতে দেখেছে এমন সাক্ষীর অভাব নেই।‘ নেপাল আবার গর্জন ছাড়িতে উদ্যত হইয়াছিলেন‌, মুকুল পিতাকে থামাইয়া দিয়া বলিল,–’সিনেমা স্টুডিওতে আমি কয়েকবার গিয়েছি সত্যি, কিন্তু অভিনয় করিনি। চল বাবা।’ বলিয়া মুকুল ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। নেপালবাবু বাঘের মত এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে তাহার পশ্চাদ্বর্তী হইলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’রমেনবাবু ঠিকই ধরেছিলেন। যাক‌, ভূজঙ্গধরবাবু্‌, আপনাকেও একটি মাত্র প্রশ্ন করব। সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’ ভুজঙ্গধরবাবু একপেশে হাসি হাসিয়া বলিলেন,–’সে-রত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে বসে অনেকক্ষণ সেতার বাজিয়েছিলাম। সাক্ষী সাবুদ আছে কিনা জানি না।‘ ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল, তারপর উঠিয়া বরাটকে বলিল,–‘চলুন বনলক্ষ্মীকে দেখে আসি।’ বরাট‌, ব্যোমকেশ ও আমি বনলক্ষ্মীর কুঠিতে উপস্থিত হইলাম। ভিতরে প্রবেশ করিবার সময় পাশের খোলা জানালা দিয়া একটি নিভৃত দৃশ্য চোখে পড়িল। ঘরটি বোধহয় বনলক্ষ্মীর শয়নঘর; আলো জ্বলিতেছিল‌, কনলক্ষ্মী শয্যায় শুইয়া আছে‌, আর বিজয় শয্যার পাশে বসিয়া মৃদুস্বরে তাহার সহিত বাক্যালাপ করিতেছে। আমাদের পদশব্দে বিজয় বাহির হইয়া আসিল। বলিল, —’বনলক্ষ্মী এখনও বড় দুর্বল। মাথার চোট গুরুতর নয়‌, কিন্তু স্নায়ুতে শক লেগেছে। তাকে এখন জেরা করা ঠিক হবে কি?’ ব্যোমকেশ স্নিগ্ধস্বরে বলিল,–’জেরা করব না‌, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা শুধু তাকে দেখতে এসেছি‌, দেখেই চলে যাব।’ ‘তা—আসুন।’ ব্যোমকেশ ঘনিষ্ঠভাবে বিজয়ের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল,–’আপনাকে কিন্তু আর একটি কাজ করতে হবে বিজয়বাবু। একাজ আপনি ছাড়া আর কারুর দ্বারা হবে না।’ ‘কি করতে হবে বলুন।’ ‘পানুগোপাল কিছু জানে‌, আপনার কাকার মৃত্যুর রাত্রে বোধহয় কিছু দেখেছিল।! কিন্তু
false
robindronath
করে দুজনে তাই খেয়ে নিলে। রাজা গিয়ে দেখলেন, বুড়ো বাপ কুঁড়েঘরের দরোজায় বসে। সে বললে, মা, আজ দেরি হল কেন। কন্যা বললে, বাবা, অতিথি এনেছি তোমার ঘরে। বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে বললে, আমার গরিবের ঘর, কী দিয়ে আমি অতিথিসেবা করব। রাজা বললেন, আমি তো আর কিছুই চাই নে, পেয়েছি তোমার কন্যার হাতের সেবা। আজ আমি বিদায় নিলেম। আর-একদিন আসব। সাত দিন সাত রাত্রি চলে গেল, এবার রাজা এলেন রাজবেশে। তাঁর অশ্ব রথ সমস্ত রইল বনের বাহিরে। বৃদ্ধের পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন; বললেন, আমি বিজয়পত্তনের রাজা। রানী খুঁজতে বেরিয়েছিলাম দেশে বিদেশে। এতদিন পরে পেয়েছি— যদি তুমি আমায় দান কর, আর যদি কন্যা থাকেন রাজি। বৃদ্ধের চোখ জলে ভরে গেল। এল রাজহস্তী— কাঠকুড়ানি মেয়েকে পাশে নিয়ে রাজা ফিরে গেলেন রাজধানীতে। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের রাজকন্যারা শুনে বললে, ছি! * * * আসিল দিয়াড়ি হাতে রাজার ঝিয়ারি খিড়কির আঙিনায়, নামটি পিয়ারি। আমি শুধালেম তারে, এসেছ কী লাগি। সে কহিল চুপে চুপে, কিছু নাহি মাগি। আমি চাই ভালো ক’রে চিনে রাখো মোরে, আমার এ আলোটিতে মন লহো ভরে। আমি যে তোমার দ্বারে করি আসা-যাওয়া, তাই হেথা বকুলের বনে দেয় হাওয়া। যখন ফুটিয়া ওঠে যূথী বনময় আমার আঁচলে আনি তার পরিচয়। যেথা যত ফুল আছে বনে বনে ফোটে, আমার পরশ পেলে খুশি হয়ে ওঠে। শুকতারা ওঠে ভোরে, তুমি থাক একা, আমিই দেখাই তারে ঠিকমত দেখা। যখনি আমার শোনে নূপুরের ধ্বনি ঘাসে ঘাসে শিহরণ জাগে-যে তখনি। তোমার বাগানে সাজে ফুলের কেয়ারি, কানাকানি করে তারা, এসেছে পিয়ারি। অরুণের আভা লাগে সকালের মেঘে, ‘এসেছে পিয়ারি’ ব’লে বন ওঠে জেগে। পূর্ণিমারাতে আসে ফাগুনের দোল, ‘পিয়ারি পিয়ারি’ রবে ওঠে উতরোল। আমের মুকুলে হাওয়া মেতে ওঠে গ্রামে, চারি দিকে বাঁশি বাজে পিয়ারির নামে। শরতে ভরিয়া উঠে যমুনার বারি, কূলে কূলে গেয়ে চলে ‘পিয়ারি পিয়ারি’। কুসমি জিগেস করলে, দাদামশায়, ইরুমাসির বোধ হয় খুব বুদ্ধি ছিল। ছিল বৈকি, তোর চেয়ে বেশি ছিল। থমকে গেল কুসমি। অল্প একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ওঃ, তাই বুঝি তোমাকে এত করে বশ করেছিলেন? তুই যে উল্টো কথা বললি, বুদ্ধি দিয়ে কেউ কাউকে বশ করে? তবে? করে অবুদ্ধি দিয়ে। সকলেরই মধ্যে এক জায়গায় বাসা করে থাকে একটা বোকা, সেইখানে ভালো করে বোকামি চালাতে পারলে মানুষকে বশ করা সহজ হয়। তাই তো ভালোবাসাকে বলে মন ভোলানো। কেমন করে করতে হয় বলো-না। কিচ্ছু জানি নে, কী যে হয় সেই কথাই জানি, তাই তো বলতে যাচ্ছিলুম। আচ্ছা, বলো। আমার একটা কাঁচামি আছে, আমি সব-তাতেই অবাক হয়ে যাই; ইরু ঐখানেই পেয়ে বসেছিল। সে আমাকে কথায় কথায় কেবল তাক লাগিয়ে দিত। কিন্তু, ইরুমাসি তো তোমার চেয়ে ছোটো ছিলেন। অন্তত বছর খানেক ছোটো। কিন্তু আমি তার বয়সের নাগাল পেতুম না; এমন করে আমাকে চালাত, যেন আমার দুধে-দাঁত ওঠে নি। তার কাছে আমি হাঁ করেই থাকতুম। ভারি মজা। মজা বৈকি। তার কোনো-এক সাতমহল রাজবাড়ি নিয়ে সে আমাকে ছট্‌ফটিয়ে তুলেছিল। কোনো ঠিকানা পাই নি। একমাত্র সেই জানত রাজার বাড়ির সন্ধান। আমি পড়তুম থার্ড্‌ নম্বর রীডার; মাস্টারমশায়কে জিগ্‌‍‍গেস করেছি, মাস্টারমশায় হেসে আমার কান ধরে টেনে দিয়েছেন। জিগ্‌‍গেস করেছি ইরুকে, রাজবাড়িটা কোথায় বলো-না। সে চোখ দুটো এতখানি করে বলত, এই বাড়িতেই। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতুম হাঁ করে; বলতুম, এই বাড়িতেই— কোন্‌খানে আমাকে দেখিয়ে দাও-না। সে বলত, মন্তর না জানলে দেখবে কী করে। আমি বলতুম, মন্তর আমাকে বলে দাও-না। আমি তোমাকে আমার কাঁচাআম-কাটা ঝিনুকটা দেব। সে বলত, মন্তর বলে দিতে মানা আছে। আমি জিগ্‌‌‌‍গেস করতুম, বলে দিলে কী হয়। সে কেবল বলত, ও বাবা! কী যে হয় জানাই হল না।— তার ভঙ্গি দেখে গা শিউরে উঠত। ঠিক করেছিলুম, একদিন যখন ইরু রাজবাড়িতে যাবে আমি যাব লুকিয়ে লুকিয়ে তার পিছনে পিছনে। কিন্তু সে যেত রাজবাড়িতে আমি যখন যেতুম ইস্কুলে। একদিন জিগ্‌‌‍গেস করেছিলুম, অন্য সময়ে গেলে কী হয়। আবার সেই ‘ও বাবা’। পীড়াপীড়ি করতে সাহসে কুলোত না। আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে ইরু খুব একটা-কিছু মনে করত। হয়তো একদিন ইস্কুল থেকে আসতেই সে বলে উঠেছে, উঃ, সে কী পেল্লায় কাণ্ড। ব্যস্ত হয়ে জিগ‍্‍গেস করেছি, কী কাণ্ড। সে বলেছে, বলব না। ভালোই করত— কানে শুনতুম কী একটা কাণ্ড, মনে বরাবর রয়ে যেত পেল্লায় কাণ্ড। ইরু গিয়েছে হন্ত-দন্তর মাঠে, যখন আমি ঘুমোতুম। সেখানে পক্ষীরাজ ঘোড়া চরে বেড়ায়, মানুষকে কাছে পেলেই সে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যায় মেঘের মধ্যে। আমি হাততালি দিয়ে বলে উঠতুম, সে তো বেশ মজা। সে বলত, মজা বৈকি! ও বাবা! কী বিপদ ঘটতে পারত শোনা হয় নি, চুপ করে গেছি মুখের ভঙ্গি দেখে। ইরু দেখেছে পরীদের ঘরকন্না— সে বেশি দূরে নয়। আমাদের পুকুরের পুব পাড়িতে যে চীনেবট আছে তারই মোটা মোটা শিকড়গুলোর অন্ধকার ফাঁকে ফাঁকে। তাদের ফুল তুলে দিয়ে সে বশ করেছিল। তারা ফুলের মধু ছাড়া আর কিছু খায় না। ইরুর পরী-বাড়ি যাবার একমাত্র সময় ছিল দক্ষিণের বারান্দায় যখন নীলকমল মাস্টারের কাছে আমাদের পড়া করতে বসতে হত। ইরুকে জিগ্‌গেস করতুম, অন্য সময় গেলে কী হয়। ইরু বলত, পরীরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়। আরও অনেক কিছু ছিল তার অবাক-করা ঝুলিতে। কিন্তু,
false
MZI
মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে যায় না। মানুষ দরজা খুলে বাইরে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে গেলে কী হয়? কিছু হয় না। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে যেতে হলে তোমাকে লাফিয়ে নামতে হবে। দরজা খুলে বের হতে হলে তুমি হেঁটে হেঁটে বের হতে পারবে। নিকি তার দাঁতগুলো বের করে হাসল, বলল, কিন্তু আমি হেঁটে বের হতে চাই না। আমি লাফিয়ে বের হতে চাই। আমার লাফাতে খুব ভালো লাগে। আমি সেটি লক্ষ করেছি। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই তুমি লাফাতে পছন্দ করো। আমি এখনো মিক্কুর মতো লাফাতে পারি না। তুমি কখনোই মিরুর মতো লাফাতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর আর তুমি মানুষ। নিকি একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও যদি বানর হতাম তাহলে খুব মজা হতো, তাই না ক্রিনিটি? ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি চাপ অনুভব করে। চাপটি কমিয়ে সে বলল, না। তুমি বানর হলে বেশি মজা হতো না। নিকি মাথা নেড়ে বলল, হতো। হতো না। কেন হতো না? কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা বানরের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি। যার বুদ্ধিমত্তা যতো বেশি সেততো বেশি উপায়ে মজা করতে পারে। নিকি মুখ সুচালো করে কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইলতারপর জিজ্ঞেস করল, বুদ্ধিমত্তা কী? তোমার চারপাশে যা কিছু আছে সেটি দেখে বোঝার ক্ষমতা এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই। কে বলেছে নেই? আমি জানি। কেমন করে জান? এই যে তুমি কঠিন কঠিন জিনিম বলেছ আমি সেগুলো করতে পারিনা। বুঝিনা। তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। আমি বুঝতে চাইনা। তাহলে তুমি কী করতে চাও? আমি মিষ্ণুর সাথে এক গাছ থেকে আরেকাছে লাফ দিতে চাই। যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের শুধু এক গাছ থেকে আরেকাছে মাফ দিয়ে জীবন কাটাতে হয়না। তাদের আরো বড় কাজ করতে হয়। নিকি কিছুক্ষন চিন্তা করল, তারপর বলন, জমির বুদ্ধিমত্তা ভালো লাগে। না। ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি ক্রিনিটির দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে ক্রিনিটি বলল, নিকি। বল। তুমি ঘরের বাইরে যাচ্ছ কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই। আজকে অনেক সুন্দর রোদ। বাইরে ঠাণ্ডা নেই তাই আমার কাপড় পরারও কোনো দরকার নেই। ক্রিনিটি কৃত্রিমভাবে তার গলার স্বরটি একটুখানি গভীর এবং থমথমে করে নিয়ে বলল, মানুষ শুধুমাত্র শীত থেকে বাঁচার জন্যে কাপড় পরে না। মানুষ হচ্ছে একটি সভ্য প্রাণী। মানুষকে সবসময় কাপড় পরতে হয়। নিকি বলল, কিন্তু মিক্কু তো কাপড় পরে না। মিক্কু মোটেও সভ্য প্রাণী নয়। মিক্ক একটি বানর। কিকি কাপড় পরে না! কিকি একটি পাখি। নিকির চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি কোনো কাপড় পর না। আমি একটি যন্ত্র। যন্ত্রদের কাপড় পরতে হয় না। তুমি মানুষ তোমাকে কাপড় পরতে হবে। সবসময় অন্ততপক্ষে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডেকে একটি কাপড় পরতে হবে। নিকি যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে না পেরে অন্যপথে গেল। মুখ শক্ত করে বলল, আমি মানুষ হতে চাই না। ক্রিনিটি বলল, না চাইলেও কিছু করার নেই, তুমি এখন অন্য কিছু হতে পারবে না। তোমাকে মানুষ হয়েই থাকতে হবে। নিকি মুখ শক্ত করে বলল, কেন মানুষ হলে কাপড় পরতে হবে? মানুষ সভ্য প্রাণী। যখন তোমার সাথে অন্য মানুষের দেখা হবে তখন তোমার শরীরে কাপড় না থাকলে তারা তোমাকে অসভ্য ভাববে।। নিকি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। যদি আমার সাথে কখনো অন্য মানুষের দেখা হয় তখন আমি দৌড় দিয়ে কাপড় পরে নেব। ক্রিনিটি বলল, না। কাপড় পরা একটি অভ্যাসের ব্যাপার। যার সেই অভ্যাস নেই সে কখনো দৌড়ে কাপড় পরতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জান? কী? মানুষের সাথে কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক তোমাকে কাপড় পরে থাকতে হবে। নিকি মুখ গোঁজ করে বলল, কেন? তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমাকে দেখে শুনে রেখে বড় করি। সেজন্যে আমার তোমাকে ঠিক করে বড় করতে হবে। সভ্য মানুষের মতো বড় করতে হবে। নিকি এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মা-কে সে খুব ভালোবাসে। ক্রিনিটির কাছে তার মায়ের যে হলোগ্রাফিক ছবি আছে সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকবার সে তার মা-কে ধরতে গিয়ে দেখেছে সেটি সত্যি নয়। তার খুব ইচ্ছে করে একদিন সে ধরতে গিয়ে দেখবে সেটি সত্যি তখন তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। ক্রিনিটি তাকে বলেছে যে এটি কখনো হবে না, তবুও সে আশা করে আছে যে কোনো একদিন হয়তো এটি হয়ে যাবে। নিকি ঘরের ভেতর ফিরে গেলো, এক টুকরো কাপড় নিয়ে সেটি তার। কোমরে বেঁধে নিল, তারপর ক্রিনিটিকে বলল, এখন আমি বাইরে যাই? যাও। নিকি দরজা খুলে বাইরে যেতেই কক কক শব্দ করে একটি পাখি তার দিকে উড়ে আসে, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে সেটি তার ঘাড়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। নিকি তার হাতটি বাড়িয়ে দিতেই পাখিটি সেখানে বসে নিকির দিকে তাকিয়ে আবার কক কক শব্দ করে ডাকল। নিকি পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি মোটেও দেরি করতে চাইনি। ক্রিনিটি
false
shorotchandra
কমল কহিল, সেও জানি। আর ঐ চোখে-দেখার অহঙ্কারেই আপনারা গেলেন। হরেন্দ্র কহিল, অহঙ্কার আপনাদেরও কম নয়। সে-বেলা বৌদিদির খাওয়া হতো না,—উপবাস করে কাটাতেন, তবু হার মানতে চাইতেন না। কমল চুপ করিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। হরেন্দ্র বলিল, আপনাদের আশীর্বাদে মোটা বুদ্ধিই আমাদের অক্ষয় হয়ে থাক—এতেই লাভ বেশী। আপনাদের সূক্ষ্ম-বুদ্ধির অভিমানে উপোস করে মরতে আমরা নারাজ। কমল এ কথারও জবাব দিল না। হরেন্দ্র কহিল, এখন থেকে আপনার সূক্ষ্ম-বুদ্ধিটাকেও মধ্যে মধ্যে যাচাই করে দেখব। কমল বলিল, সে আপনি পারবেন না, গরীব বলে আপনার দয়া হবে। শুনিয়া হরেন্দ্র প্রথমটায় অপ্রতিভ হইল, তাহার পরে বলিল, দেখুন, এ কথার জবাব দিতে বাধে। কেন জানেন? মনে হয় যেন রাজরানী হওয়াই যাকে সাজে, কাঙালপনা তাকে মানায় না। মনে হয় যেন আপনার দারিদ্র্য পৃথিবীর সমস্ত বড়লোকের মেয়েকে উপহাস করচে। কথাটা তীরের মত গিয়া কমলের বুকে বাজিল। হরেন্দ্র পুনরায় কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কমল থামাইয়া দিয়া বলিল, আপনার খাওয়া হয়ে গেছে, এবার উঠুন। ও ঘরে গিয়ে সারা রাত গল্প শুনবো, এ ঘরের কাজটা ততক্ষণে সেরে নিই। খানিক পরে শোবার ঘরে আসিয়া কমল বসিল, কহিল, আজ আপনার বৌদিদির সমস্ত ইতিহাস না শুনে আপনাকে ছাড়বো না, তা যত রাত্রিই হোক। বলুন। হরেন্দ্র বিপদে পড়িল, কহিল, বৌদিদির সমস্ত কথা ত আমি জানিনে। তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার এই আগ্রায়, অবিনাশদাদার বাসায়। বস্তুতঃ তাঁর সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানিনে। যেটুকু এখানকার অনেকেই জানে, আমিও ততটুকুই জানি। কেবল একটা কথা বোধ করি সংসারে সকলের চেয়ে বেশী জানি, সে তাঁর অকলঙ্ক শুভ্রতা। স্বামী যখন মারা যান, তখন বয়স ছিল ওঁর উনিশ-কুড়ি,—তাঁকে সমস্ত হৃদয় দিয়েই পেয়েছিলেন। সে মোছেনি, মোছবার নয়,—জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সে স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকবে। পুরুষমহলে আশুবাবুর কথা যখন ওঠে—তাঁর নিষ্ঠাও অনন্যসাধারণ—আমি অস্বীকার করিনে, কিন্তু— হরেনবাবু, রাত্রি অনেক হ’লো, এখন ত আর বাসায় যাওয়া চলে না,—এই ঘরেই একটা বিছানা করে দিই? হরেন্দ্র বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এই ঘরে? কিন্তু আপনি? কমল কহিল, আমিও এইখানেই শোব। আর ত ঘর নেই। হরেন্দ্র লজ্জায় পাংশু হইয়া উঠিল। কমল হাসিয়া বলিল,আপনি ত ব্রহ্মচারী। আপনারও ভয়ের কারণ আছে নাকি? হরেন্দ্র স্তব্ধ নির্নিমেষ-চক্ষে শুধু চাহিয়া রহিল। এ যে কি প্রস্তাব সে কল্পনা করিতেও পারিল না। স্ত্রীলোক হইয়া এ কথা উচ্চারণ করিল কি করিয়া! তাহার অপরিসীম বিহ্বলতা কমলকেও ধাক্কা দিল।সে কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল,আমারই ভুল হয়েচে হরেনবাবু,আপনি বাসায় যান। তাইতেই আপনার অশেষ শ্রদ্ধার পাত্রী নীলিমার আশ্রমে ঠাঁই মেলেনি,মিলেছিল আশুবাবুর বাড়ি। নির্জন গৃহে অনাত্মীয় নরনারীর একটিমাত্র সম্বন্ধই আপনি জানেন—পুরুষের কাছে মেয়েমানুষ যে শুধুই মেয়েমানুষ,এর বেশী খবর আপনার কাছে আজও পৌঁছায় নি। ব্রহ্মচারী হলেও না। যান, আর দেরি করবেন না, আশ্রমে যান। এই বলিয়া সে নিজেই বাহিরের অন্ধকার বারান্দায় অদৃশ্য হইয়া গেল। হরেন্দ্র মূঢ়ের মত মিনিট দুই-তিন দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া আসিল। কুড়ি প্রায় মাসাধিক-কাল গত হইয়াছে। আগ্রায় ইন্‌ফ্লুয়েঞ্জার মহামারী মূর্তিটা শান্ত হইয়াছে;স্থানে স্থানে দুই-একটা নূতন আক্রমণের কথা না শুনা যায় তাহা নয়,তবে,মারাত্মক নয়। কমল ঘরে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে সেলাই করিতেছিল,হরেন্দ্র প্রবেশ করিল। তাহার হাতে একটা পুঁটুলি,নিকটে মেঝের উপর রাখিয়া দিয়া কহিল, যে-রকম খাটচেন তাতে তাগাদা করতে লজ্জা হয়। কিন্তু লোকগুলো এমনি বেহায়া যে দেখা হলেই জিজ্ঞেসা করবে,হলো? আমি কিন্তু স্পষ্টই জবাব দিই যে, ঢের দেরি। জরুরী থাকে ত না হয় বলুন, কাপড় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু মজা এই যে, আপনার হাতের তৈরী জিনিস যে একবার ব্যবহার করেচে, সে আর কোথাও যেতে চায় না। এই দেখুন না লালাদের বাড়ি থেকে আবার এক থান গরদ,আর নমুনার জামাটা দিয়ে গেল— কমল সেলাই হইতে মুখ তুলিয়া কহিল, নিলেন কেন? নিই সাধে? বললাম ছ মাসের আগে হবে না,—তাতেই রাজী। বললে, ছ মাসের পরে ত হবে তাতেই চলবে। এই দেখুন না মজুরির টাকা পর্যন্ত হাতে গুঁজে দিয়ে গেল।।এই বলিয়া সে পকেট হইতে একখানা নোটের মধ্যে মোড়া কয়েকটা টাকা ঠক্‌ করিয়া কমলের সম্মুখে ফেলিয়া দিল। কমল কহিল, অর্ডার এত বেশী আসতে থাকলে দেখচি আমাকে লোক রাখতে হবে। এই বলিয়া সে পুঁটুলিটা খুলিয়া ফেলিয়া পুরানো পাঞ্জাবি জামাটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়া কহিল, কোন বড় দোকানের বড় মিস্ত্রীর তৈরী,—আমাকে দিয়ে এ রকম হবে না। দামী কাপড়টা নষ্ট হয়ে যাবে, তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন। হরেন্দ্র বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল,আপনার চেয়ে বড় কারিগর এখানে কেউ আছে নাকি? এখানে না থাকে কলকাতায় আছে। সেইখানেই পাঠিয়ে দিতে বলবেন। না না, সে হবে না। আপনি যা পারেন তাই করে দেবেন, তাতেই হবে। হবে না হরেনবাবু, হলে দিতাম। এই বলিয়া সে হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, অজিতবাবু বড়লোক, শৌখিন মানুষ, যা-তা তৈরি করে দিলে তিনি পরতে পারবেন কেন? কাপড়টা মিথ্যে নষ্ট করে লাভ নেই,আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। হরেন্দ্র অতিশয় আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, কি করে জানলেন এটা অজিতবাবুর? কমল কহিল,আমি হাত গুণতে পারি। গরদের কাপড়, অগ্রিম মূল্য,অথচ ছ’মাস বিলম্ব হলেও চলে,—হিন্দুস্থানী লালাজিরা অত নির্বোধ নয়, হরেনবাবু। তাঁকে জানাবেন—তাঁর জামা তৈরি করার যোগ্যতা আমার নেই, আমি শুধু গরীবের সস্তা গায়ের কাপড়ই সেলাই করতে পারি। এ পারিনে। হরেন্দ্র বিপদে পড়িল। শেষে কহিল, এ তার ভারী ইচ্ছে। কিন্তু পাছে আপনি জানতে পারেন, পাছে আপনার মনে হয় আমরা কোনমতে আপনাকে কিছু
false
shorotchandra
ছুটাছুটি চেঁচামেচি করিয়া উঠিল। সমস্ত ঘরময় ভাঙ্গা টেবিল-চেয়ার, ভাঙ্গা কাঠের তোরঙ্গ, ভাঙ্গা টিন, খালি শিশি-বোতল এবং আরও কত কি প্রাচীন দিনের গৃহসজ্জার ভগ্নাংশ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। তাহারি একধারে একটা তক্তপোশ পাতা। ছেঁড়া গদি, ছেঁড়া তোশক, ছেঁড়া বালিশ প্রভৃতি গাদা করিয়া জোর করিয়া একধারে ঠেলিয়া রাখিয়া তাহারই একাংশে একটা মাদুর পাতা রহিয়াছে। এটা অভ্যাগতদের জন্য। স্ত্রীলোকটি মেঝের উপর কেরোসিনের ডিবাটা রাখিয়া দিয়া কহিল, একটু অপেক্ষা করুন, আমি সংবাদ দিই। বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইবামাত্রই সতীশ জুতাসুদ্ধ সেই অভ্যাগতের আসনটির উপর লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। উপেন্দ্র সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, ও কি ও? সতীশ ফিসফিস করিয়া তর্জন করিয়া উঠিল, আগে প্রাণ রক্ষে হোক, তার পরে ভদ্রতা রক্ষে হবে; দেখচ না, পায়ের কাছে আলো দেখে ঘরের সমস্ত সাপ-খোপ ছুটে আসচে। সতীশ যেমন করিয়া ভয় দেখাইল, তাহাতে বিচার-বিতর্কের আর অবসর রহিল না। উপেন্দ্রও লাফাইয়া উঠিয়া পড়িলেন। তক্তপোশের সেই সঙ্কীর্ণ জায়গাটিতে স্থানাভাবে উভয়ে যখন ঠেলাঠেলি করিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকটি ফিরিয়া আসিয়া সেই সময়ে কবাটের সুমুখে দাঁড়াইয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইঁহারা যে ভয় পাইয়াছেন, তাহা সে বুঝিতে পারিয়াছিল। বলিল, এটি আমার শ্বশুরের ভিটা, আপনারা অমর্যাদা করছেন! উপেন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া পড়িলেন এবং সতীশের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বিড়বিড় করিতে লাগিলেন, এমনি ভয় দেখিয়ে দিলে,—এমনি করে উঠল— সতীশ নামিল না। কিন্তু বিনয় করিয়া বলিল, ভয় কি সাধে দেখাই উপীনদা। আমার বিদ্যে চাণক্য শ্লোকের বেশী নয় জানি, কিন্তু এটুকু শিখেচি যে, আত্মরক্ষা অতি শ্রেষ্ঠ ধর্ম। স্ত্রীলোকটির পানে চাহিয়া বলিল, আচ্ছা, আপনিই বলুন দেখি, আত্মরক্ষার্থে একটু নিরাপদ জায়গা বেছে নেওয়া কি অন্যায় কাজ হয়েছে? আপনার শ্বশুরের ভিটার অসম্মান করা আমাদের সাধ্য নয়, বরং যথেষ্ট সম্মাননার সঙ্গেই আপনার আশ্রিত প্রজাপুঞ্জের পথ ছেড়ে দিয়ে এইটুকু জায়গায় দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনজনেই হাসিয়া উঠিলেন। ইহার পরিহাস যে এই দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীটিকে ব্যথিত করে নাই, বরং ইহার ভিতর যে সরলতা ও সমবেদনা প্রচ্ছন্ন ছিল, এই তরুণী অতি সহজেই তাহা গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন, তাহার হাস্যোজ্জ্বল মুখের ’পরে ইহার সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখিতে পাইয়া উপেন্দ্র মনে মনে অত্যন্ত আরাম বোধ করিলেন। তাহার মুখপানে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, প্রজাপুঞ্জ আপনার সুমুখে কখনই ওর উপরে অত্যাচার করতে সাহস করবে না। এখন ওই লোকটি বোধ করি নেমে আসতে পারে। নিশ্চয়, বলিয়া কেরোসিনের ডিবাটা হাতে তুলিয়া লইয়া বধূ সতীশের দিকে চাহিয়া ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া বলিল, এখন নির্ভয়ে রাজদর্শনে চলুন। এইটুকু হাস্য-পরিহাসেই অপরিচিতের দূরত্বটা যেন একেবারেই কমিয়া গেল, এবং তিনজনেই প্রফুল্লমুখে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। রাজ-দর্শনেচ্ছু উপেন্দ্র ও সতীশ হাসিমুখে আর একটি ঘরে ঢুকিয়াই শিহরিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। ক্রুদ্ধ গুরুমশায়ের অতর্কিত চড় খাইয়া হাস্য-নিরত শিশু-ছাত্রের মুখের ভাবটা যেমন করিয়া বদলায়, এই দুজনের মুখের হাসি তেমনি করিয়া এক-নিমেষে কালি হইয়া গেল। ক্ষণেক পরে লাঞ্ছিত ভাবটা কাটিয়া গেলে উপেন্দ্র অদূরবর্তী শয্যার নিকটে গিয়া ডাকিলেন,—হারানদা! হারান নির্জীবের মত পড়িয়া ছিলেন, অস্ফুটে বলিলেন, এস ভাই, এস। আর উঠতে বসতে পারিনে, তোমাকেও ক্লেশ দিলুম। এইটুকু বলিয়াই তিনি হাঁপাইতে লাগিলেন। উপেন্দ্র ধপ করিয়া বিছানার একদিকে বসিয়া পড়িলেন। দুই চোখ তাঁহার জলে ভরিয়া গেল এবং সমস্ত বক্ষপঞ্জর দুলাইয়া দিয়া একটা অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাঁহার কণ্ঠের প্রান্তসীমা পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। কথা কহিতে সাহস করিলেন না—দাঁতের উপর দাঁত চাপিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলেন। ওদিকে সতীশচন্দ্র মস্ত একটা কাঠের সিন্দুকের উপর শুষ্কমুখে বসিয়া রহিল। মলিন ও শতচ্ছিন্ন শয্যার শিয়রে একটা মাটির প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে, ঘরে অন্য আলো নাই, এইটুকু আলো রক্তশূন্য বিবর্ণ শীতল মুখের ’পরে লইয়া হারানের জীবন্ত মৃতদেহটা পড়িয়া আছে। সূর্যের উত্তাপ ও আকাশের বায়ু হইতে চিরদিন বিচ্ছিন্ন এই গৃহের অস্থিমজ্জায় যে জীর্ণতা ও অন্ধকার লালিত ও পুষ্ট হইয়া আসিয়াছে, এই কন্‌কনে শীতের রাত্রে অত্যল্প আলোকে, কুষ্ঠরোগের মত তাহা সমস্ত দেয়ালের গায়ে ফুটিয়া পড়িয়াছে। এই দিবানিশি অবরুদ্ধ গৃহের রুদ্ধ দুষ্ট বায়ু আত্মঘাতীর মুখোদ্গত বিষাক্ত ফেনের মত ফাঁপিয়া ফুলিয়া গৃহবাসীর কণ্ঠনালী যেন প্রতিমুহূর্তে রুদ্ধ করিয়া আনিতেছে। দ্বারে মৃত্যুদূতের প্রহরা পড়িয়াছে। সমস্ত দিকে চাহিয়া সতীশ বারংবার শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, সে চীৎকার করিয়া ছুটিয়া একেবারে রাস্তার উপর আসিয়া পড়িতে পারিলে বাঁচে, এখানে মানুষের জীবন থাকে কি করিয়া? অনতি দূরে বধূটি দাঁড়াইয়া ছিল, সেদিকে একবার চাহিয়াই সে আরো যেন ভয় পাইয়া গেল। কোথায় গেল ঐ অতুল রূপ! কোথায় গেল ঐ হাসি; তাহার দৃষ্টির সম্মুখে যেন কোন্‌ এক প্রেতলোকের পিশাচ উঠিয়া আসিল। সে ভাবিতে লাগিল, স্বামী যার এই, সে আবার হাসে, পরিহাসে যোগ দেয়, খোঁপা বাঁধে, টিপ পরে! একমুহূর্তের জন্য তাহার সমস্ত নারীজাতির উপরেই ঘৃণা জন্মিয়া গেল। এমন সময়ে হারান ডাকিলেন, কিরণ, উপীন এসেছে মা জানেন? বধূ কাছে আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, মা ঘুমুচ্ছেন। ডাক্তার বলে গেছেন ঘুমুলে তাঁকে যেন জাগানো না হয়। হারান মুখ বিকৃত করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, চুলোয় যাক গে ডাক্তার, তুমি যাও, বলো গে তাঁকে। উপেন্দ্র নিকটে বসিয়া সমস্তই শুনিতে পাইতেছিলেন, ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, আজ রাত্রে জানিয়ে প্রয়োজন নেই হারানদা। কাল সকালে জানালেই হবে। উপেন্দ্র বুঝিতে পারিলেন, ক্রমাগত রোগে ভুগিয়া হারান অত্যন্ত খিটখিটে হইয়া গিয়াছে। তাই, এই নিরপরাধিনী সেবাপরায়ণা বধূটির অকারণ তিরস্কারে একটা ব্যথা অনুভব করিয়া একটুখানি সান্ত্বনার ইঙ্গিত করিতে একবার তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন। কিছুই
false
MZI
আসতে আসতে আরো প্রায় এক বছর, কী হয় দেখার জন্যে আমি খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। নীষা বাচ্চাদের একটা হাসপাতালে ডাক্তারের একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। তার সাথে জীবন, মৃত্যু, ভালবাসা, বেঁচে থাকার সার্থকতা ইত্যাদি বড় বড় জিনিস নিয়ে প্রায়ই আমার সুদীর্ঘ আলাপ হত, ইদানীং ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছি। তার নাকি বিয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমারও তাই। (আমাদের দু’জনের অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। তবে সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধ্যায় একা শূন্য বাসায় ফিরে আসতে নাকি তার খুব খারাপ লাগে। কথাটা মিথ্যে নয়, তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দু’জনেই বিয়ে করব ঠিক করেছি। একজন আরেকজনকে, সেটাই সুবিধে, দু’জনের জন্যেই। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে খুবই অনাড়ম্বর। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন মানুষ আর রবোট্রন ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না। শহরতলির অ্যাপার্টমেন্টের সেই বুড়োকে বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। সাথে নীষা ছিল, বুড়ো তাকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করে দেখল মানুষ কি না, এখনো তার রবোট্রনকে খুব ভয়। (তার চেক নাকি আবার আসতে শুরু করেছে।) খুব বেশি যদি খুঁতখুঁতে না হই, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মোটামুটি খারাপ নয়। ছেলেটির চুল সোনালি রঙের, চোখ দুটো আকাশের মতো নীল। চেহারায় কোথায় জানি এক ধরনের বিষণ্ণতা লুকিয়ে আছে। মেয়েটির মাথা ভরা লালচে চুল, চোখ দুটি মেঘের মতো কালো। চেহারার মাঝে এক ধরনের উচ্ছল সজীবতা। ছেলেটি মেয়েটির একটি হাত স্পর্শ করে নরম গলায় বলল, আমি তোমাকে আজ একটি কথা বলতে চাই। মেয়েটি খিল খিল করে হাসল, বলল, জানি। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, আমিও তোমাকে আজ একটা কথা বলতে চাই। ছেলেটার চোখে মুখে বিস্ময়ের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ল, বলল, তুমিও আমাকে একটা কথা বলবে? হ্যাঁ। তাহলে বল। মেয়েটি রহস্যের মতো ভান করে বলল, তুমি আগে বল। ছেলেটি কয়েক মুহূর্ত মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি তো সবই জান। আমি খুব নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। খুবই একাকী একজন মানুষ। আমি যন্ত্রের মতো কাজ করে যেতাম–কেন করতাম নিজেই জানতাম না। তোমার সাথে পরিচয় হবার আগে আমার জীবনটা ছিল একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন, সাদামাটা। মাঝে মাঝে আমার মনে হতো জীবনটা বুঝি পুরোপুরি অর্থহীন। তোমার সাথে পরিচয় হবার পর হঠাৎ করে সবকিছু অন্যরকম হয়ে। উঠল। মনে হতে লাগল আমি যেন জীবনটার একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি। মেয়েটি মাথা নাড়ল, হাসি হাসি মুখে বলল, আমি জানি। তুমি এতো চমৎকার একটি মেয়ে, তোমার মাঝে এতো বিশাল প্রাণশক্তি, তুমি এতো চঞ্চল হাসিখুশি, শুধু তাই নয়, তুমি বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান, সফল, তোমার সাথে আমার মতো একজন মানুষের সম্পর্ক হবার কথা ছিল না। কিন্তু তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দাও নি তুমি আমার জীবনটাকে পরিপূর্ণ করেছ। আমি সেজন্যে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। মেয়েটি কোনো কথা বলল না, হাসি হাসি মুখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটি এবারে মেয়েটার হাতটা নিজের কাছে টেনে এনে বলল, তুমি জান আমাদের চারপাশের জগণ্টা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে। তুমি জান এই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠছে। প্রতিদিন শুনছি আমাদের চারপাশে আছে ভয়ংকর রবোমানব, তারা নাকি খুব ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে। তারা নাকি আমাদের মাঝে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। যখন তারা আমাদের মূল নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবে তখন আমরা নাকি হয়ে যাব দ্বিতীয় প্রজাতি। ছেলেটার মুখটা হঠাৎ একটু কঠিন হয়ে ওঠে, সে চাপা গলায় বলে, আমি কিন্তু সেটা বিশ্বাস করি না। মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না, স্থির দৃষ্টিতে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল! ছেলেটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মানব সভ্যতা ছেলেখেলা না। মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসা দিয়ে হাজার হাজার বছরে এটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। আর কিছু রোবট মানুষের চেহারা নিয়ে মানুষের মাঝে ঢুকে মানুষকে পরাজিত করে তাদের সভ্যতা দখল করে নেবে? অসম্ভব! মেয়েটি নিষ্পলক চোখে ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে দেখে মনে হয় ছেলেটার কথাগুলো যেন সে বুঝতে পারছে না, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারছে না। ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি অত্যন্ত গোপন একটা প্রজেক্টে কাজ করি। কী নিয়ে কাজ করি আমি সেটা তোমাকে বলতে পারব না, বলার অনুমতি নেই। যদি অনুমতি থাকত তাহলে আমি তোমাকে বলতে পারতাম, তুমি তাহলে বুঝতে পারতে আমরা কতোদূর এগিয়ে আছি। রবোমানবদের খুঁজে বের করার জন্যে আমাদের আর জটিল লোবোগ্রাফি করতে হবে না, আমি যে পদ্ধতিটা নিয়ে কাজ করছি সেটা ব্যবহার করে আমরা খুব সহজে রবোমানবদের বের করে ফেলতে পারব। এর মাঝে সেটা ব্যবহার শুরু হয়েছে, খুব চমৎকার ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমার মতো আরো অনেকে কাজ করছে, দেখবে আমাদের মানুষদের হারানো খুব কঠিন। মেয়েটির মুখে এবারে মৃদু একটু হাসি ফুটে উঠল। ছেলেটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তাই না? মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, করছি। আমার যদি অনুমতি থাকত তাহলে আমি তোমাকে আমার প্রজেক্টের কথা খুলে বলতাম। তোমাকে বলতে হবে না, আমি জানি। ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, তুমি জান? হ্যাঁ। কীভাবে জান? মেয়েটি নরম গলায় বলল, আমি আসলে একজন রবোমানব। আমার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তোমার কাছ থেকে এই প্রজেক্টের তথ্যগুলো বের করার। ছেলেটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হয় সে কিছু বুঝতে পারছে না।
false
shottojit_roy
লোকদের প্রতিকৃতি তৈরি করেন। ঠিক পুতুলের মতো করে। অর্থাৎ গায়ের রং, চুল, নখ, পোশাকটোশােক সব আসল মানুষের মতোই, কেবল সাইজ ছ। ইঞ্চির বেশি নয়। একথা সেকথার পর একটু বিনয়ী, কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন আপনি যদি আমার ওখানে দিনকতক আতিথ্য গ্ৰহণ করেন তা হলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব, সেই অবসরে আপনার একটি পুতুল-প্রতিকৃতি গড়ে নিতে পারব। লিন্ডকুইস্ট আরও বললেন যে তাঁর কালেকশনে নাকি কোনও বিখ্যাত ভারতীয়ের পুতুল-মূর্তি নেই, এবং আমি এই প্রস্তাবে রাজি হলে নাকি তিনি নিজেকে ধন্য মনে করবেন। কথায় কথায় আমার লেমিং সম্পর্কে জানিবার আগ্রহটিাও প্রকাশ পেয়ে গেল। তাতে ভদ্রলোক বললেন, লেমিং-এর সন্ধানে বনবাদাড়ে ঘোরার আগে তিনি তাঁর বাড়িতেই নাকি একটি লেমিং সংগ্রহ করে আমাকে দেখাতে পারবেন। এর পরে আর আমার কিছু বলার রইল না। আগামী বৃহস্পতিবার ভদ্রলোকের সঙ্গেই নরওয়ে যাত্রা করব স্থির করেছি। ১৭ই মে দু দিন হল সুলিটেলমা শহরে এসেছি। নরওয়ের উত্তরপ্রান্তে কিয়োলেন উপত্যকায় এ শহরটি ভারী মনোরম। আশেপাশে তামার খনি রয়েছে, আর শহরের পশ্চিমদিকে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সুলিটেলমা পর্বতশৃঙ্গ।। ৬০০০ ফিটের মতো হাইট, কাজেই আমাদের হিমালয়ের এক একটি শৃঙ্গের কাছে একে সামান্য টিলা বলে মনে হবে। কিন্তু নরওয়েতে এই শৃঙ্গ উচ্চতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। লিন্ডকুইস্ট আমাকে পরম যত্নে রেখেছেন। এঁর বাড়ির আশেপাশে আর কোনও বাড়িটাড়ি চোখে পড়ে না। এমনিই নরওয়ে দেশটায় লোকসংখ্যা কম, তার মধ্যেও লিন্ডকুইস্ট যেন একটি জনবিরল পরিবেশ বেছেই নিয়েছে। আমার এতে কোনও আপত্তি নেই। আমাদের গিরিডির বাড়িটাও নিরিবিলি জায়গা বেছেই তৈরি করেছিলাম। আমি। লেমিং এখনও দেখা হয়নি। দু-এক দিন সময় চেয়ে নিয়েছে। লিন্ডকুইস্ট। এতেও আপত্তি নেই-কারণ আমি হাতে কিছুটা সময় নিয়েই দেশ ছেড়েছি। আপাতত বিশ্রামের প্রয়োজন। ট্রাউট মাছ খাচ্ছি। আর খুব ভাল খাচ্ছি। সব মিলিয়ে বেশ আরামে আছি। তবে লিন্ডকুইস্টের একটা বাতিক মাঝে মাঝে কেমন যেন অসোয়াস্তির সৃষ্টি করে। সে আমার দিকে প্রায়ই একদৃষ্টি চেয়ে থাকে। কথা বলার সময় চাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যখন দুজনে চুপচাপ বসে থাকি, তখনও মাঝে মাঝে অনুভব করি যে সে স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আজ সকালে এর কারণটা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। লিন্ডকুইস্ট বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে বলল, কোনও লোকের পোট্রেট করার আগে কিছুদিন যদি ভাল করে তাকে দেখা যায়, তা হলে মূর্তি গড়ার সময় শিল্পীর কাজ সহজ হয়ে যায় এবং যার পোট্রেট হচ্ছে তাকেও আর একটানা বেশিক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয় না। আমার আরেকটা প্রশ্ন আরও চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, আপনার পুতুলগুলি কবে দেখাবেন? বড় কৌতুহল হচ্ছে কিন্তু। লিন্ডকুইস্ট বলল, পুতুলগুলোয় ধুলো পড়েছে। আমার চাকর হানস সেগুলো পরিষ্কার করলে পর কাল সন্ধ্যা নাগাদ সেগুলো দেখাতে পারব বলে আশা করছি। আর লেমিং? আগে পুতুল-তারপর লেমিং। কেমন? অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম। ১৮ মে রাত ১২টা দুই ঘণ্টা হল ঘরে ফিরেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত উত্তেজনা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই আজকের ঘটনা পরিষ্কার করে লিখতে রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছে। আজ সন্ধ্যা সাতটায় (সন্ধ্যা বলছি ঘড়ির টাইম অনুযায়ী কারণ এখানে সত্যিকারের রাতদিনের কোনও তফাত বোঝা যায় না) লিন্ডকুইস্ট তার বৈঠকখানায় একটা গোপন দরজা খুলে একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আমাকে মাটির নীচে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তার পুতুলগুলো দেখাল। আমি এ রকম আশ্চর্য জিনিস আর কখনও দেখিনি। টেবিলের উপর রাখা কাচের আবরণে ঢাকা যে জিনিসগুলি দেখলাম সেগুলিকে পুতুল বলতে বেশ দ্বিধা বোধ করছি। আসল মানুষের সঙ্গে এদের তফাত কেবল এই যে এগুলো নিম্প্রাণ। এবং এদের কোনওটাই ছ। ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়। মোটামুটি বলা যেতে পারে যে আসল মানুষের যা আয়তন, এগুলি তার দশভাগের এক ভাগ। সব সুদ্ধ ছটি পুতুল রয়েছে। সবই নামকরা লোকের, যদিও এদের সকলের চেহারার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না। যাদের দেখে চিনলাম, তাদের মধ্যে রয়েছে—ফরাসি ভূপৰ্যটক আরি ক্লেমো, আর নিগ্রো চ্যাম্পিয়ন বক্সার বব স্লিম্যান। আর ছ নম্বর কাচের খাঁচায় যে পুতুলটি কালো চশমা পরে ডান হাত কোটের পকেটের ভিতর ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হলেন পরলোকগত ব্রিটিশ প্রাণীতত্ত্ববিদ ও আমার বন্ধু আর্চিবল্ড অ্যাকরয়েড-ছ বছর আগে লেমিং-এর সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে নরওয়েতেই যাঁর মৃত্যু হয়। অ্যাকরয়েডের পুতুল দেখেই বুঝতে পারলাম পোট্রেট হিসেবে এগুলো কী আশ্চর্যরকম নিখুঁত। শুধু যে মোটামুটি তাঁর চেহারা মিলেছে তা নয়—এগুলো এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি যাতে নাকি মাথার চুল, গায়ের চামড়া, চোখের তারা, সবই একেবারে জীবন্ত বলে মনে হয়। এই শেষ পুতুলটি দেখে তো নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। অ্যাকরয়েডের সামনে আমাকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিন্ডকুইস্ট জিজ্ঞাসা করল, কী হল? একে চেনো নাকি? বললাম, বিলক্ষণ। ইংলন্ডে আলাপ হয়েছিল— প্রায় বন্ধুত্বই। লেমিং-এর খবর ওঁর কাছেই পাই। নরওয়েতেই তো ওঁর মৃত্যু হয় বলে শুনেছিলাম। তা হয়। তবে আমার ভাগ্যটা খুবই ভাল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই আমার এখানে এসেছিলেন, আর তখনই এই পুতুলটি তৈরি করে ফেলি। যাদের পুতুল দেখছ, তাদের সকলেই আমার বাড়িতে থেকে আমাকে সিটিং দিয়ে গেছে। গুপ্ত ঘরটা থেকে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় লিন্ডকুইস্ট বলল, পরশু থেকে তোমার পোট্রেটের কাজ শুরু করব। আমি ঘরে বসে বসে ডায়রি লিখছি, আর আ্যাকরয়েডের সেই হাসি হাসি মুখটা আমার মনে পড়ছে। কোনও মানুষের পক্ষে যে এমন পুতুল তৈরি করা সম্ভব হতে পারে এটা
false
humayun_ahmed
অর্ণব সবচে ভয় পায় সাপ। অথচ রাবারের সাপ তার সবচে পছন্দের। গত জন্মদিনে তাকে একটা রাবারের সাপ দেয়া হয়েছিল সেই সাপের লেজ ধরে না থাকলে তার রাতে ঘুম হয় না। সাপ খোপ পাওয়া গেলে কিনতে হবে। দরজা খুলে দিল শর্মিলা। নান্টু বলল, কেমন আছ? শর্মিলা বলল, ভাল। তার আজকের গলা অন্যদিনের মত বরফ শীতল না। মুখটাও মনে হচ্ছে হাসি হাসি। নান্টু বলল, সিগারেটের জন্যে ধন্যবাদ। তুমি কি চা খাবে? এক কাপ খেতে পারি। অর্ণব কোথায়? ওর জন্যে একটা প্লাস্টিকের মাকড়শা এনেছি। অর্ণব স্কুলে চলে গেছে। নান্টু সাহসে ভর করে বলে ফেলল—ওর সামারের ছুটি কবে? ওকে নিয়ে একটা প্ল্যান ছিল। কি প্ল্যান? নান্টু হড়বড় করে বলল, ঠিক ওকে নিয়ে প্ল্যান না। তোমাদের দুজনকে নিয়েই প্ল্যান। ভাবছিলাম এই ছুটিতে তোমাদের নিয়ে নেপাল ঘুরে আসব। হিমালয় কন্যা নেপাল। ঢাকা থেকে যে খরচে কক্সবাজারে যাওয়া যায়, সেই খরচে নেপাল ঘুরে আসা যায়। বিদেশ দেখা হল। দেশ বিদেশ ঘুরলে শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। নেপালের হোটেলে দুটা ঘর নিয়ে নিলাম। একটায় তোমরা মা-বেটা, একটায় আমি। ঘর পাশাপাশি নেয়ারও দরকার নেই। তোমরা থাকলে দোতলা বা তিনতলায়, আমি একতলায়। নান্টু ভেবেছিল কথা শুনেই শর্মিলা রেগে যাবে। সে রাগল না। তবে মুখ সামান্য গম্ভীর করে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল চা নিয়ে। শুধু চা না। ফুট কেক আছে, রসোমালাই আছে। নান্টু এক পিস কেক হাতে নিল। মনের ভুলে কেক চায়ে ড়ুবিয়ে এক কামড় দিল। শর্মিলা দেখেও কিছু বলল না। অন্য সময় এমন একটা ব্যাপার দেখলে চোখ সরু করে তাকাতো। তুমি তাহলে আমাদের নেপাল নিতে চাচ্ছ? দেশের ভেতরে কোথাও যদি যেতে চাও—সেখানেও নিতে পারি। কোন সমস্যা নেই। মনে হয় তোমার অনেক টাকা হয়েছে। আরে না। চাকরিই নেই। টাকা পাব কোথায়? তবে ব্যবস্থা একটা হবেই। চাকরি বাকরি আর করব না বলে ঠিক করেছি। ব্যবসা করব। ফুড বিজনেস। ফুড বিজনেস মানে? বিরানীর দোকান দেব। বাবুর্চির সঙ্গে কথা হয়েছে। সকালে এক হাড়ি বিরানী হবে। বিকালে এক হাড়ি। মাস তিনেক বাবুর্চি রেখে রান্নার কৌশলটা শিখে ফেলব। তারপর বাবুর্চি বিদেয় করে নিজেরাই রাঁধব। বাবুর্চির খরচটা বেঁচে গেল। খুবই লাভের ব্যাপার। তাই না-কি? হাজির বিরিয়ানীতে বিরানী বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেল। তোমার বিরিয়ানীর নাম কি হবে—পাজীর বিরিয়ানী? নান্টু হা হা করে হেসে ফেলল। শর্মিলার রসিকতাটা তার খুব মনে ধরেছে। শর্মিলা যে তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে তার জন্যেও ভাল লাগছে। তার কোন ব্যাপারে শর্মিলা অনেক দিন এত আগ্রহ দেখায় নি। নান্টু চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, লাভটা কেমন হবে একটু বুঝিয়ে বলি——মিডিয়াম সাইজ একটা পাতিলে চাল ধরে বিশ কেজি। বেস্ট কোয়ালিটি বাসমতি চাল হল ত্রিশ টাকা কেজি। কাজেই চাল লাগছে ছয়শ টাকার। বিশ কেজি চালে লাগছে দশ কেজি মাংস। দশ কেজি খাসির মাংসের দাম পরে—কেজি একশ টাকা হিসেশে এক হাজার টাকা। হিসাবটা কি ফলো করছ? চেষ্টা করছি। ঘি মশলাপাতি এইসব ধর পনেরোশ টাকা। কাজেই টোটেল খরচ হচ্ছে তিন হাজার টাকা। ফুল প্লেট পঞ্চাশ টাকা করে বিক্রি করলে নেট পাব ছয় হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি পাতিলে লাভ থাকবে তিন হাজার টাকা। দুই পাতিলে ছয় হাজার টাকা। মাসে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। ইস্টাবলিশমেন্ট খরচ, বাবুর্চির বেতন, বয় বেয়ারা সব মিলিয়ে ধরলাম পঞ্চাশ হাজার টাকা তারপরেও মাসে নেট প্রফিট হবে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। ইনশাল্লাহ। ভালতো। নান্টু আনন্দিত গলায় বলল, দোকানের নাম ঠিক করেছি অর্ণব বিরাণী হাউস। আমার ছেলের নামে বিরানীর নাম দিতে হবে না। তোমার নামে নাম দাও। নান্টু ভাইয়ের ভাই বিরানী। মামা হালিম আছে। ভাই বিরানীও হবে। নান্টু সামান্য দমে গেল। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা শর্মিলা ঠিক পছন্দ করছে না। তার চোখ সরু হয়ে গেছে। গলাও অনেক গম্ভীর শুনাচ্ছে। শর্মিলা শীতল গলায় বলল, বাবুর্চির খরচওতো তোমার লাগবে না। তুমিতো কয়েকমাস পরে নিজেই রাঁধবে। এটা মন্দ না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে অর্ণবের বাবা কি করেন? আমরা বলব, বাবুর্চি। আমাদের কোন খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজন হলে তোমাকে বাবুর্চি হিসেবে ভাড়া করে নিয়ে আসব। তোমরা নিশ্চয়ই বাইরের রান্নার কাজও করবে, করবে না? নান্টু অস্ট্রেলিয়ান সিগারেট ধরাল। ব্ৰিত গলায় বলল, তোমার পছন্দ না হলে বিরানী হাউসের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেব। শর্মিলা কঠিন গলায় বলল, আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে দরকার কি? আমিতো তোমার কেউ না। তোমার যা ইচ্ছা তুমি করবে। তুমি বাবুর্চি হলেও কিছু না। জুতা পালিশওয়ালা হলেও কিছু না। নান্টু অনেক কষ্টে বলল, ও আচ্ছা। শর্মিলা বলল, তোমাকে কি জন্যে ডেকেছি এখন শোন। তোমাকেতো বলে বলে আমি হয়রান হয়েছি। ইচ্ছা করেই তুমি গা করছ না। আজ আমি ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব। রাজশাহী থেকে আমার বড় ভাই এসেছেন। উনি সব ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের কোথাও যেতে হবে না। কিছু না। কাগজপত্র নিয়ে এখানে লোকজন আসবে। তুমি আমি একসঙ্গে সাইন করব। নান্টু পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। আজকের দিনে এমন কোন ঘটনা ঘটাবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। নান্টু প্রায় ফিস ফিস করে বলল, তুমি কি বিয়ে করছ নাকি? শর্মিলা সহজ ভাবে বলল, হ্যাঁ করছি। তোমাদের বিয়ের পর অর্ণব কি আমার সঙ্গে থাকবে? শর্মিলা বিরক্ত গলায় বলল, উদ্ভট কথা বলবে না। অর্ণব তোমার সঙ্গে মেসে
false
humayun_ahmed
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিতু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। নীল চোখ এবং সোনালী চুলের একজন আমেরিকান যুবক তার সামনে বসে আছে। যুবকটির চোখে মুখে চাপা হাসি। মিতু নিশ্চিত যে, সুদূর শৈশবে দেখা মিস্টার আগস্টের সঙ্গে এই যুবকের চেহারার অসম্ভব মিল–তবু এই আমেরিকান যুবক মিস্টার আগস্ট হতে পারে না। পুলিশের জনৈক কর্মকর্তা বললেন, মিস আপনি কি এই যুবককে চেনেন? মিতু বলল, না। সে ফিরেই আসছিল। হঠাৎ কি মনে করে যুবকের দিকে তাকিয়ে ইংরেজীতে বলল, এক সময় আমার নাম ছিল পাঁচ হাজার ছয় শত চুয়ান্ন। আজ আমার নাম বার হাজার তিনশ একুশ। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ? যুবকটি মিতুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইংরেজীতে বলল, কেমন আছ মিতু? মিতুর চোখে পানি এসে গেল। পুলিশ অফিসার অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, মিস আপনি কি যুবকটিকে চিনতে পারছেন? তাকে কি আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে? মিতু তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। যুবক মাথা নীচু করে বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। তার মুখ হাসিহাসি। মিতু বলল, আমি চিনি না। আমি এই যুবককে চিনি না। জহির লাজুক মুখে বলল, স্যার আজ একটু সকাল-সকাল বাড়ি যাব, একটা জরুরি কাজ। বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে গেল, গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। কথার মাঝখানে খুখুক করে কয়েকবার কাশল, নাকের ডগা ঈষৎ লালচে হয়ে গেল। হেডক্যাশিয়ার করিম সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন, ব্যাপারটা কি? জহির মাথা নিচু করে। অস্পষ্ট গলায় দ্বিতীয়বার বলল, একটা জরুরি কাজ। করিম সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। জরুরি কাজে বাড়িতে যাবে এটা বলতে গিয়ে লজ্জায় ভেঙে পড়ার অর্থ তিনি ধরতে পারলেন না। জহির অবশ্যি এনিতেই লাজুক ধরনের ছেলে। লজ্জার সঙ্গে আরো একটা অস্বস্তিকর জিনিস তার মধ্যে আছে, যার নাম বিনয়। সেই বিনয়ও বাড়াবাড়ি বিনয়। হাইকোর্টের সামনে একবার জহিরের সঙ্গে দেখা, সে সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছিল। করিম সাহেবকে দেখে আচমকা ব্রেক কষে নেমে পড়ল। বাকি পথটা সাইকেল টেনে পেছনে-পেছনে আসতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, তুমি পেছনেপেছনে আসছ কেন? যেখানে যাচ্ছ যাও। জহির বলল, অসুবিধা নেই স্যার। করিম সাহেব বুঝতে পারলেন এটা হচ্ছে জহিরের বিনয়ের একটা নমুনা। তিনি হেঁটে যাবেন আর জহির সাইকেলে তাকে পাস করে যাবে তা সে হতে দেবে না। তিনি বাধ্য হয়ে একটা রিকশা নিলেন, এবং জহিরের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। তিনি মিতব্যয়ী মানুষ। অকারণে টাকা খরচ করতে তাঁর ভালো লাগে না। ক্যাশ সেকশনে জহির তিন বছর ধরে আছে। এই তিন বছরে জহিরের বিখ্যাত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অনেক পরিচয় হয়েছে। প্রতিবারই তিনি বিরক্ত হয়েছেন। শুরুতে তাঁর মনে হয়েছিল জহিরের লজ্জা এবং বিনয় দুইই এক ধরনের ভড়ং, যা প্রথম কিছুদিন থাকে; তারপর আসল মূর্তি বের হয়। ইউনিয়ন-টিউনিয়ন করে গায়ে চর্বি জমে যায়; তখন মুখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মেয়েমানুষ বিষয়ক রসিকতা করে হা-হা করে হাসে। জহিরের বেলায় এখনো তা হয় নি। কে জানে হয়ত তার চরিত্রই এরকম। অফিস ছুটির দশ মিনিট আগেও যদি তার হাতে একটা মোটা ফাইল ধরিয়ে বলা হয়, জহির, হিসেবটা একটু দেখে দাও তো। সে তৎক্ষণাৎ বলবে, জ্বি আচ্ছা স্যার। বিনয়ী এবং ভদ্রমানুষেরা কাজ-কর্মে সুবিধার হয় না। তারা সাধারণত ফাঁকিবাজ হয়। জহির সে রকম নয়। ক্যাশের কাজ-কর্ম সে শুধু যে বোঝে তাই নালোই বোঝে। করিম সাহেব তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেন। আজ অফিসে কাজের চাপ আছে। ইয়ার এডিং, হিসাবপত্ৰ আপটু ডেট করতে হবে। করিম সাহেব, অডিট ঝামেলা করতে পারে এমন সব ফাইলগুলো আলাদা করে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন, ছুটির পরও কাজ করবেন। ক্ৰস চেকিং করবে জহির। অথচ বেছে-বেছে আজই তার সকাল-সকাল বাড়ি যেতে হবে। কোনো মানে হয়? করিম সাহেব বললেন, তুমি কি এখনি চলে যেতে চাও? জহির হাত কচলাতে লাগল। তার কানের ডগাও এখন ঈষৎ লাল। করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী? জহির প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, কিছু না স্যার। বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ? জ্বি না। বলতে কি কোনো অসুবিধা আছে? একটা বিয়ের ব্যাপার স্যার। বিয়ে? কার বিয়ে? জহির জবাব দিল না, ঘামতে লাগল। করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বিয়ে? ঠিক বিয়ে না স্যার। মেয়ে দেখা। তোমার জন্য? জহিরের মাথা আরো নিচু হয়ে গেল। করিম সাহেব হাসিমুখে বললেন, এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? এটা তো ভালো কথা। ইয়াং ম্যান বিয়ে করে সংসারী হবে, এ তো আনন্দের কথা। আজকাল ছেলেপুলেরা বিয়ে করতে চায় না। দায়িত্ব এড়াতে চায়। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করবে অথচ বিয়ে করবে না। জহির আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রইল। করিম সাহেব ফাইলপত্ৰ গুছাতে শুরু করলেন। জহির না থাকলে তাঁর থাকাও অর্থহীন। আজ তিনিও একটু সকাল-সকাল ফিরবেন। করিম সাহেব স্লয়ার বন্ধ করতে-করতে বললেন, মেয়ে কোথায় দেখতে যাবে? যাত্ৰাবাড়িতে। মেয়ে ওর বড় চাচার সঙ্গে থাকে। যাত্ৰাবাড়িতে অনেক দূর। যাবে কিসে? তোমার সাইকেলে করে নাকি? জহির রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, অফিসের গাড়ি নিয়ে যাও না কেন? অফিসের কর্মচারীরা বিশেষ-বিশেষ প্রয়োজনে গাড়ি নিতে পারবে এরকম নিয়মত আছে। গাড়ি লাগবে না স্যার। লাগবে না কেন? পাওয়া গেলেতো অসুবিধা কিছু নেই। আমাকে দিবে না স্যার। গাড়ি অফিসারদের জন্যে। দাঁড়াও আমি মোজাফফর সাহেবকে বলে দেখি। রিকশা করে মেয়ে দেখতে যাওয়া আর গাড়ি করে দেখতে যাওয়া তো এক না। করিম সাহেব উঠে গেলেন। জহির খুবই
false
manik_bandhopaddhay
নয়, লোকে নাম দিয়াছে কয়েদখানা। ঘরের পিছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপরে একটা ডোবা। ডোবার ওদিকে বাঁশবনের পরে আর মানুষের বসতি নাই, বহুদূর বিস্তৃত শস্যখেত আষাঢ়ের গোড়াতেই এখন অর্ধেকেব বেশি জলে ডুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবনে জেলেপাড়ার প্রায় সকলেরই পরিচিত একজোড়া পাঁচফুট লম্বা গোখুরা সাপ বাস করে। ডোবায় থাকে কয়েকটি গোসাপ। বড়ো ঘরখানায় সভা রীতিমতোই বসিয়াছিল। ঘরে ঢুকিয়া কুবের অবাক হইয়া দেখিল, সভাপতি রাসু নয়, হোসেন মিয়া। পীতমের কাঠের সিন্দুকটার উপরে কাঁথা ভাঁজ করিয়া পাতিয়া হোসেনকে বসিতে দেওয়া হইয়াছে। রাসু মিশিয়া গিয়াছে একেবারে ভিড়ের মধ্যে। সকলের মুখেই একটা দারুণ অস্বস্তির ভাব, আড়চোখে সকলে হোসেন মিয়ার দিকে চাহিতেছে। এতগুলি লোকের নিশ্বাসে ঘরের আবদ্ধ বাতাস হইয়া উঠিয়াছে দূষিত, গরমে হোসেন মিয়ার কপালে বড়ো বড়ো ফোঁটায় জমিয়া আছে ঘাম। এদিক ওদিক চাহিয়া কুবের টুপ করিয়া সকলের পিছনে বসিয়া পড়িল। হোসেন মিয়া এখানে আসিয়া জুটিল কোথা হইতে? এত লোকের সামনে রাসুর সঙ্গে যখন তাহার মুখোমুখি হইয়া গিয়াছে, কী কাণ্ডটা আজ হয় দ্যাখো! কুবের বিষাদ বোধ করে। আহা, এতবড়ো একটা কর্মঠ শক্তিশালী লোক, একগুঁযে সম্মানকামী লোক, কপালের ফেরে বড়ো জব্দ হইয়া গেল। রাসু তাহাকে একেবারে হাতেনাতে ধরাইযা দিয়াছে সকলের কাছে। যে এত প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিল, আজ বুঝি তার মুখ ফুটিয়া কথা বলিতেও বাধিতেছে। সোজাসুজি অপমান করিবার সাহস হয়তো কাহারও হয় নাই, কিন্তু কৌশলে নানাভাবে নানা ইঙ্গিতে কত লজ্জাই লোকটাকে সকলে না জানি এতক্ষণ দিয়াছে। কুবের এমনই মমতা বোধ করে যে সে ভাবিতে থাকে, পারিলে আজ সে হোসেন মিয়ার পক্ষই লইত। লোভ দেখাইয়া মিথ্যা আশ্বাস দিয়া হোসেন মিয়া যে রাসুর স্ত্রীপুত্রকে সুদূর ময়নাদ্বীপে লইয়া গিয়া হত্যা করিয়াছে, কোন যুক্তি দেখাইয়া তাহার এই কীর্তি সে সমর্থন করিত কুবের তাহা জানে না। সে যাকে ভয় করে, এতলোকের সামনে তার মাথা হেঁট হইযা যাওয়ায় মনে মনে সে শুধু ব্যথা পাইতেছিল। অন্ধ আবেগের সঙ্গে তার মনে হইতেছিল, যারা পঙ্গু অসহায় জীব, শক্তিকে লজ্জা দেওয়া তাদের পক্ষে ভালো কথা নয়-মানুষের ধর্মবিরুদ্ধ এ কাজ। এ কথা কুবের জানে যে হোসেন মিয়ার বিচার করিয়া শাস্তি বিধানের কল্পনা জেলেপাড়ার এই সমবেত মাতব্বরেরা করিবে না। তবু আজ এই সমষ্টি বিচারকের ভঙ্গি গ্রহণ করিয়াছে। কী স্পষ্ট ভাবেই না হোসেন মিয়াকে অপমান করিতেছে সকলের বসিবাব ভঙ্গি, চাহিবাব ভঙ্গি, চুপ করিয়া থাকার ভঙ্গি! বিচলিত ও উত্তেজিত হইযা এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে কুবের দেখিতে পাইল, জহর আমিনুদ্দি এবং আরও দুজন মুসলমান মাঝি অত্যন্ত গম্ভীরমুখে একদিকে বসিয়া আছে। ধরিতে গেলে এরাই কেতুপুরের মুসলমান মাঝির সমাজ, আরও দু-চারজন যারা আছে তারা একান্ত নগণ্য। এদেব সংখ্যা পাঁচ-ছয়ঘরের বেশি হইবে না। জেলেপাড়ার পূর্বদিকে এদের একত্র সন্নিবেশিত বাড়িগুলিতে বেড়ার বাহুল্য দেখিয়া সহজেই চিনিতে পারা যায়। যতই জীর্ণ হইয়া আসুক, ছেঁড়া চট দিয়া সুপারি গাছের পাতা দিয়া মেরামত করিয়া বেড়াগুলিকে এরা খাড়া করিয়া রাখে। অথচ খুব যে কঠোরভাবে পর্দাপ্রথা মানিয়া চলে তা বলা যায় না। মেয়ে, বাহিরে না আসিলে চলে না। নদীতে জল আনিতে যাইতে হয়, পুরুষেরা কেহ বাড়ি না থাকিলে দোকানে সওদা আনিতে যাইতে হয়, বাড়ির আনাচেকানাচে লাউ কুমড়া ফলিলে, মুর্গিতে ডিম পাড়িলে, গ্রামে গিয়া বেচিযা আসিতে হয়। বেড়াগুলি পর্দা রাখে শুধু অন্দরের আর এমন বউ-ঝি বাড়িতে যদি কেহ থাকে যাহার বয়স খুব কাচা—তাহার। এরা এবং জেলেপাড়ার অ-মুসলমান অধিবাসীরা সদ্ভাবেই দিন কাটায়। ধর্ম যতই পৃথক হোক দিনযাপনের মধ্যে তাহদের বিশেষ পার্থক্য নাই। সকলেই তাহারা সমভাবে ধর্মের চেয়ে এক বড়ো অধৰ্ম পালন করে—দারিদ্র্য। বিবাদ যদি কখনও বাধে, সে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিবাদ, মিটিয়াও যায় অল্পেই। কুবেরের সঙ্গে সিধুর যে কারণে বিবাদ হয়, আমিনুদ্দির সঙ্গে জহরের যে কারণে বিবাদ হয়, কুবের আমিনুদ্দির বিবাদও হয় সেই কারণেই। খুব খানিকটা গালাগালি ও কিছু হাতাহাতি হইয়া মীমাংসা হইয়া যায়। মধ্যস্থতা হয়তো করে জহর মাঝিই। বলে, কুবের বাই, ছাড়ান দাও। আরে হোই আমিনুদ্দি, সামাল দে। পোলাপানের পারা কাইজা করস, তগর শরম নাই? কুবের লক্ষ করিয়া আশ্চর্য হইল, এই আমিনুদ্দি আজ একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছে। হোসেন মিয়ার দিকে সে চাহিয়া নাই, সে চাহিয়া দেখিতেছে আমিনুদ্দিকে! আমিনুদ্দির অস্বস্তিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জহরের মধ্যস্থতায় অনেকবার বিবাদ মিটিলেও মনে মনে আমিনুদ্দির উপর কুবেরের রাগ ছিল। চোখে চোখে মিলিতে সে চোখ ফিরাইয়া লইল। কেহ কথা কহে না। কী ভাবিয়া হোসেন মিয়া হঠাৎ কুবেরকেই বিলম্বিত সম্ভাষণ জানাইয়া বসিল। পিছে বইলা ক্যান কুবের বাই? আগাইয়া বও। খানাপিনা হয় নাই? কুবের হঠাৎ বড়ো উল্লাস বোধ কবিল। আগাইয়া সকলের সামনে গিয়া বসিয়া বলিল, খাইছি মিয়া বাই। বাঁ হাতে নিজেব লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া হোসেন মিয়া বলিল, গণেশরে দেহি না? গেছে কই? কেডা জানে? ফিরতি বেলায় মেলার মদ্যি মাইজা কর্তা ডাইকা কয, গাঁয়ে ফেরস নাকি গণেশ?—মাছগুলা বাড়িতে দিয়া আসিস, লইয়া যা। কইয়া একডালা ইছামাচ দিলেন। মাছ দিবাব লাইগা গণশা কর্তাগো বাড়িতে গেছে সন্দ করি। মেজোকর্তার নাম অনন্ত তালুকদার। কেতুপুর গ্রামখানি তাহারই। জেলেপাড়াব যাহারা দু-এক বিঘা জমি রাখে, মেজোকর্তাকেই তাহারা খাজনা দিয়া থাকে। মেজোকর্তার নামোল্লেখে সকলে মন দিয়া কুবেরের কথা শুনিল। হোসেন মিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কর্তা আলেন কবে? আলেন আর বিষ্যুদবারে। হীরু মাঝি চোখ মিটমিট করিতে করিতে বলিল, মাইজ কর্তার সগল সংবাদ দেহি রাখস কুবের, ভুবন সা-র লগে মামলার কী হইল ক দেহি? কুবের
false
MZI
দশ বছর পর? জহুর আবারো সত্যি সত্যি হেসে ফেলল, বলল, দশ বছরে আমার ছোট বুলবুল একটা জওয়ান মানুষ হবে। তখন আমাকে আর তাকে দেখে রাখতে হবে না, আমার বুলবুল নিজেই তোমার ঘাড়টা কটাস করে ভেঙে দেবে। ডক্টর সেলিম বিস্ফারিত চোখে জহুরের দিকে তাকিয়ে রইল। পাশে দাঁড়ানো মোটা ঘাড়ের মানুষটা রিভলবারের বাঁট উঁচু করে জহুরের মাথায় মারার জন্যে এগিয়ে আসছিল, ডক্টর সেলিম তাকে থামাল। নিচু গলায় বলল, এখন ঝামেলা করো না। ঘাটে চলো। নদীর ঘাটে পৌঁছানোর আগেই তারা দেখতে পায় তাদের স্পিডবোটটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। কিছু মানুষ তাদের বোটটা জ্বালিয়ে দিয়েছে, পেট্রোলের ট্যাংকটা তাদের চোখের সামনেই সশব্দে ফেটে গেল। মাথা ঘুরিয়ে তারা তীরের দিকে তাকালো, দেখল চরের মানুষজন আস্তে। আস্তে ঘাটের দিকে আসছে। সবার সামনে হালকা পাতলা ছোট একটা মেয়ে, কোলে ছোট একটা বাচ্চা। অনেক দূর থেকেই ডক্টর সেলিম ছোট মেয়েটির চোখের প্রবল ঘৃণাটুকু বুঝতে পারে। সে ঘুরে কাঁপা গলায় বলল, বন্দুকে গুলি আছে তো? আছে। কতগুলো। যথেষ্ট। ডক্টর সেলিম দরদর করে ঘামতে থাকে, সে ঠিক বুঝতে পারছিল না ঠিক কতগুলো গুলি হলে সেটাকে যথেষ্ট বলা যাবে। নৌকাটাকে টেনে উপরে তুলে জহুর চাঁদের আলোতে তীরে উঠে এলো। চাপা গলায় ডাকল, বুলবুল! নির্জন চরে তার গলার স্বর অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়। কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার ডাকল, এবার আরেকটু গলা উঁচিয়ে, বুলবুল! একটু দূরে বড় একটা ঝাঁপড়া গাছের ওপর কিছু একটা নড়ে ওঠে, সেখান থেকে অতিকায় একটা পাখির মতো ভেসে ভেসে বুলবুল নামতে থাকে, জহুরের মাথার ওপর দুই পাক ঘুরে সে নিচে নেমে আসে। তারপর ছুটে জহুরের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাবা! এসেছ? হ্যাঁ বাবা। এসেছি। এত দেরি করলে কেন? দেরি করি নাই বাবা। আমি এর আগে আসতে পারতাম না। তোকে নিয়ে কত হইচই হয়েছে জানিস? শহর থেকে কত সাংবাদিক এসেছে। টেলিভিশন ক্যামেরা এসেছে। সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখছে। তাই আমি ঘর থেকে বের হই নাই। বলেছি তুই কোথায় গেছিস আমি জানি না। যখন সবার উত্তেজনা কমেছে, সবাই চলে গেছে তখন এসেছি। ঐ খারাপ লোকগুলোর কী হয়েছে বাবা? জহুর একটু হাসার ভঙ্গি করল, বলল, গ্রামের মানুষগুলো ধরে যা পিটুনি দিয়েছে সেটা বলার মতো না। স্পিডবোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। লিডার কে ছিল জানিস? কে বাবা? তোদের স্কুলের মেয়ে লিপি। এইটুকুন মেয়ে তার কী সাহস! রিভলবার বন্দুক নিয়েও কেউ পালাতে পারে নাই! মনে হয় দুই-চারজনের হাত-পাও ভেঙেছে। জহুর সুর পাল্টে বলল, যাই হোক, তোর কোনো সমস্যা হয় নাই তো? না বাবা। আমি তোর জন্যে পানি, শুকনা চিঁড়া আর গুড় রেখে গিয়েছিলাম। জানি বাবা। আমি খুঁজে খুঁজে বের করেছি। বুলবুল হেসে যোগ করল, গুড়ের মাঝে পিঁপড়া ধরেছিল, এছাড়া কোনো সমস্যা হয় নাই। কত দিন তুই ভালো করে খাস নাই। আনোয়ারা বুবু তোর জন্যে রান্না করে দিয়েছে। আয় খাবি। খুব খিদে পেয়েছে তাই না? না বাবা খিদে পায় নাই। আমি উড়ে উড়ে গাছের ওপর থেকে ফল ফুল খেতে পারি। পেট ভরে যায়। তাহলে তো ভালো। হ্যাঁ বাবা, তুমি বলেছিলে মনে নাই? আমার একা একা থাকা অভ্যাস করতে হবে। আমি অভ্যাস করেছি। জহুর খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, অভ্যাস হচ্ছে? হ্যাঁ বাবা। হচ্ছে। থাকতে পারবি? পারব। জহুর বুলবুলকে গভীর মমতায় নিজের কাছে টেনে আনে। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, বাবা বুলবুল! আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না! তোদের স্কুলের লিপির মতো ছোট মেয়ে আছে যে খুব সহজে তোকে মেনে নেবে। আবার শহরের অনেক বড় বড় অনেক বিখ্যাত, অনেক ক্ষমতাবান মানুষ আছে যারা মেনে নেবে না, যারা তোকে পেলেই ধরে খাঁচায় বন্ধ করবে, কেটে কুটে দেখবে। বিদেশে বিক্রি করে দেবে। সেই জন্যে আমি তোকে মানুষের সামনে নিতে চাই না। আমি জানি বাবা। তুমি আমাকে বলেছ। জহুর বুলবুলের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, আমি অনেক চিন্তা করেছি বাবা। তোর পাখাগুলো যদি কেটে ফেলা হতো— বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, না বাবা! আমি পাখা কেটে মানুষ হতে চাই না বাবা। আমি পাখা নিয়ে পাখি থাকতে চাই। জহুর মাথা নাড়ল, বলল, আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। সেই জন্যেই বলেছি, মানুষের মাঝে তোকে রাখা যাবে না। কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে পাখাগুলো আর কত দিন ঢেকে রাখব? বাবা, আমার খুব কষ্ট হতো। এখন আমার কোনো কষ্ট হয় না। আমি যখন আকাশে উড়ি আমার কী যে ভালো লাগে! সত্যি? হ্যাঁ বাবা। আমার যখন পাখায় আরো জোর হবে, তখন আমি তোমাকে পিঠে নিয়ে একদিন আকাশে উড়ব। তুমি দেখো– জহুর হাসির মতো এক ধরনের শব্দ করল। বলল, মাথা খারাপ হয়েছে? আমি তাহলে ভয়ে হার্টফেল করেই মরে যাব। কোনো ভয় নেই বাবা— তোর কোনো ভয় নেই। তোর পাখা আছে, তুই উড়তে পারিস। আমার অনেক ভয়! উপর থেকে সবকিছু দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় সবকিছু সমান! সবকিছু সুন্দর! আর কী মনে হয় জান? কী? মনে হয় আমার কোনো ভয় নাই। কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না। সেটা তো সত্যি কথা! তুই যদি আকাশে উড়িস তাহলে কে তোকে কী করবে? কে তোকে ছুঁবে? কে তোকে ধরবে? বুলবুল হাসার মতো একটু শব্দ করল। নৌকার গলুইয়ে
false
shirshendu
ইভেনচুয়ালিটির জন্য তৈরি থাকলেই ভাল। তাতে কোনও শকই তোমাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না। ডাক্তাররা যে রুগিদের মনের জোর রাখতে বলে, সেটা তা হলে কী? সেটাও দরকার। কিন্তু মনের জোরটাই সব নয়। একবার আমার ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে টাইফয়েড হয়েছিল। দিন চারেক টেম্পারেচার ঠায় একশো চারে দাঁড়িয়ে। তখনও টাইফয়েডের মডার্ন ট্রিটমেন্ট বেরোয়নি। চারদিনের দিন রক্ত পরীক্ষা করে টাইফয়েড ধরা গেল। আমি যেই বুঝলাম যে এ অসুখ সহজে সারবে না আর অ্যানুয়াল পরীক্ষাও দেওয়া হবে না, তখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে মনের খুব জোর করতে লাগলাম। বছর নষ্ট হওয়ার আতঙ্কে জোরটা বেশ ভালই দিয়েছিলাম। সন্ধেবেলা টেম্পারেচার সাতানব্বইতে নেমে গেল। ডাক্তাররা পর্যন্ত হাঁ। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। তারপরই তেড়ে জ্বর উঠল। আবার একশো-চার। ত্রিশ দিনের দিন ভাত খাই। খুবই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিলু। ঠোঁটদুটো লিপস্টিক সত্ত্বেও ভারী শুকনো দেখায়। অরুণ কয়েকবার ফিরে ফিরে দেখল বিলুকে। তারপর বলল, হতাশ হলে বোধহয়! বিলু কিছু বলল না। কিন্তু একটা বড় শ্বাস ফেলল। অরুণ গাঢ় আন্তরিক গলায় বলে, তোমাকে মিথ্যে কোনও স্তোক দেওয়াটা উচিত হত না বিলু। তার চেয়ে বাস্তববাদী হওয়া ভাল। আমি স্তোক চাইনি তো।–বিলু একটু অবাক হয়ে বলে। তবু বলছি প্রীতমের মনের জোরের ওপর নির্ভর করে খুব একটা বেশি আশা করে বোসো না। বিলু আবার একটু বড় শ্বাস ফেলে বলল, দিনরাত তো কেবল নেগেটিভ চিন্তাই করে যাই অরুণ! আমাকে সেটা আর শিখিয়ো না তুমি। নেগেটিভ চিন্তা করতেও বলিনি। যে-কোনও অবস্থার জন্য মনটাকে নিরপেক্ষ রাখা। হঠাৎ বিলু ঝাঁঝালো গলায় বলে, কেন বাজে বকছু অরুণ, মনকে নিরপেক্ষ রাখা কথাটাই ভণ্ডামি। কেউ কোনওদিন তা পারে না। চেষ্টা করলেই ডিটাচড হওয়া যায়। তুমি চেষ্টা করছ না। দিনে দিনে তুমি আরও বেশি জেবড়ে জড়িয়ে পড়ছ। বেশ করছি। অরুণ হাসল, কদিন পর দেখব তুমি হয়তো তারকেশ্বরে মানত করতেও যাচ্ছ। বিরক্ত হচ্ছিল বিলু। নীরস গলায় বলল, যদি বুঝি তাতে কাজ হবে তা হলে তাও করব। একজন মানুষের জন্যই করব তো! একটা শ্বাস ফেলে হতাশ গলায় অরুণ বলে, করো। মেয়েরা কোনওদিনই সংস্কারমুক্ত হতে পারে না, এ তো জানা কথা। আবার ভাষণ! ভাষণ কেন হবে! তোমাকে তো অন্যরকম জানতাম বিলু। তুমি ছিলে ঠান্ডা, লজিক্যাল, আনইমোশনাল। প্রীতমের এই অসুখ যখন হল তখনও তোমাকে ইমোশনাল হতে দেখিনি। হঠাৎ আজকাল তোমার ভিতরে একটু আবেগ-টাবেগ দেখছি। বিলু চুপ করে থাকে। এ কথার জবাব হয় না। অরুণ দীর্ঘকালের বন্ধু। বিলুর স্বভাব, বিলুর চরিত্র সবই অরুণের নখদর্পণে। সে যদি আজ কোনও কথা বলে তবে সেটা বাজে কথা হবে না। কথাটা মিথ্যেও নয়। বিলুর ভিতরে কোনওদিনই কোনও আবেগ ছিল না। কোনও কিছুতেই সে উত্তেজিত হয়নি কখনও। এমনকী জ্ঞানত কোনওদিন বিলু কোনও কারণেই কাদেনি। অথচ কান্না নাকি মেয়েদের বড় সহজেই আসে। প্রীতম সম্পর্কে বিলু কোনওদিন তেমন কোনও টানও বোধ করেনি, আবার বিরূপতাও নয়। কিন্তু এই সেদিন যখন লাবুর জন্মদিনে রোগা লোকটা বিছানায় বসে প্রাণপণে বেলুন ফোলানোর চেষ্টা করছিল তখন হঠাৎ সেই সামান্য দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ বিলুর ভিতরে খান খান শব্দে কী যেন ভেঙে গেল। হঠাৎ এল আবেগ, হঠাৎ এল ভয়। প্রীতম মরে যাবে, এই সত্যটাকে সে শান্ত বিমাদে গ্রহণ করে নিয়েছিল। কিন্তু রোগা কাঠির মতো হাতে বেলুনটা ধরে কাপতে কাপতে যখন নিজের মহার্ঘ শ্বাসবায়ু তার মধ্যে ভরে দেওয়ার চেষ্টা করছিল প্রীতম তখনই যেন বিলু টের পেল একটা মানুষের কাছে তার নিজের বেঁচে থাকাটা কত জরুরি। আজকাল আমার মধ্যে একটু-আধটু আবেগ আসছে ঠিকই।–বিলু অনেকক্ষণ বাদে বলল, কিন্তু তার মানে তো এ নয় যে, সেটা ইললজিক্যাল। অরুণ নিস্পৃহ গলায় বলে, আমি ইমোশন জিনিসটা বুঝি না। আমার নিজের তো কোনও সেন্টিমেন্ট নেই, বুঝব কী করে? আমার মা যেদিন মারা গেল সেদিন এক ফোটাও কঁদিনি। কোনও দুঃখ বা অভাব বোধ করিনি। আমি বিকেলে একটা পার্টিতেও গিয়েছিলাম। আমি হচ্ছি আলবিয়ার কামুর নায়কদের মতো। ভেরি মাচ কোন্ড-ব্লাডেড। বিলু চিমটি কেটে বলে, তোমার পরিবারকে জানি। বেশি বোকো না। মায়ের জন্য কাদবেই বা কেন, তুমি মাকে তো ভাল করে চেনোইনি। মানুষ হয়েছ গভর্নেসের কাছে। একটু বড় হতেই চলে গেলে বিদেশে। ওরকম পরিবারে কোনও ইমোশনাল সম্পর্কই গড়ে ওঠে না। তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তোমার ভিতরে যে ইমোশন টসটস করছে তা একদিন টের পাবে, দেখো। নিজেকে যত আধুনিক ভাবছ, ততটা নও। বাড়ির গলিতে গাড়ি ঢোকাবার আগেই বিলু নেমে গেল। অরুণ গাড়ি ব্যাক করিয়ে ঢোকাবে। অন্য দিন এই অবস্থায় বিলু গলির মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে ওর জন্য। আজ করল না। এক্ষুনি প্রীতমকে একবার দেখবার জন্য সে কিছুটা অস্থির বোধ করছিল। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে ঘরে ঢুকে দেখল, প্রীতম শান্তভাবে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বিলু হাতের ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে লঘু নিঃশব্দ পায়ে বিছানার কাছে আসে। তারপর খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে প্রীতমের হাত পা মুখ। একটু কি রং বদল হয়েছে চামড়ায়? সামান্য স্বাস্থ্যের ঝিকিমিকি কি দেখা যাচ্ছে না? ঠিক বুঝতে পারল না। এই এখন নিজের মনের ভিতরে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে দীপনাথ। কিছুতেই উঠতে পারছে। অনেক চোড়-পাঁচোড় করে যাচ্ছে। কিন্তু মনটা একবার হেঁচড়ে গেলে খুব সহজে তাকে আবার দু’পায়ে দাঁড় করানো যায় না। এই পৃথিবীতে সে কি সবচেয়ে বোকাদের দলে? যদি বা
false
humayun_ahmed
বেশ গুছিয়ে ফেলেছে। অবাক হওয়ারই কথা। তার দ্বিতীয় বই শুধু ভালোবাসা সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছে। মন্টু এখন নামী ব্যক্তি। অনেকেই তার কাছে আসে। মন্টু তো বাসাতে থাকে কমই, বাবা গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। এ ব্যাপারে বাবার উৎসাহ প্ৰায় সীমাহীন। কোন পত্রিকায় কী লিখল, তা তিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে খোঁজ রাখেন। সযত্নে পেপার-কাটিং জমিয়ে রাখেন। মন্টুর কাছেই শুনেছি, এক দিন বাবা নাকি কোন বই-এর দোকানে ঢুকে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার এখানে কিছু কিংশুক কবিতার বইটি আছে? দোকানী জবাব দিয়েছে, না নেই। তাহলে শুধু ভালোবাসা বইটি আছে? না, সেটাও নেই। বাবা রেগে গিয়ে বলেছেন, ভালো ভালো বই-ই নেই, আপনারা কেমন দোকানদার? মন্টুর সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলাপ করতেও তাঁর খুব উৎসাহ। মন্টু এ ব্যাপারে অত্যন্ত লাজুক বলেই তিনি সুযোগ পান না। সত্য-মিথ্যা জানি না, শুনেছি বাবা ওভারশীয়ার কাকুর বড়ো ছেলের বউকে প্রায়ই মন্টুর কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। এই মেয়েটিকে বাবা খুব পছন্দ করেন। মেয়েটির চেহারা অনেকটা রুনুর মতো। পেছন থেকে দেখলে রুনু বলে ভ্রম হয়। নিনুও অনেক বড়ো হয়েছে। সেদিন তাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোতেই দুটি ছেলে শিস দিল। নিনুকে বললাম, নিনু কোনো বদ ছেলে তোমাকে চিঠি—ফিঠি লিখলে না পড়ে আমাকে দিয়ে দেবে, আচ্ছা? নিনু লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় নেড়েছে। সেদিন রবিবার। সবার বাসায় থাকার কথা, কিন্তু বাসায় নেই। কেউ। বাবা। আর রাবেয়া গেছে ঝুনুকে আনতে, মন্টু তার পত্রিকা-অফিসে। পত্রিকা-অফিসের কাজ নাকি পুলিশের কাজের মতো। ছুটির কোনো হাঙ্গামাই নেই। বাসায় আমি আর নিনু। আমি ভেতরে বসে কাগজ পড়ছি, নিনু বলল, দাদা, এক জন ভদ্রলোক এসেছেন। কী রকম ভদ্রলোক? বুড়ো। চোখে চশমা। বেরিয়ে এসে দেখি বড়মামা। অনেক দিন পর দেখা, কিন্তু চিনতে অসুবিধা হল না। বড়মামা বললেন, আমাকে চিনতে পারছি? জ্বি, আপনি তো বড়মামা। অনেক দিন পর দেখা, চেনার কথা নয়। তুমিও বড়ো হয়েছ, আমিও বুড়ো। কী কর এখন? এখানকার এক কলেজে প্রফেসরি করি। বেশ, বেশ। বাসায় আর কেউ নেই? খালি খালি লাগছে। জ্বি না। বাবা এবং রাবেয়া গেছেন চিটাগাং আমার এক বোনের সেখানে বিয়ে হয়েছে। মামা চুপ করে শুনলেন। তাঁকে দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছি। হঠাৎ করে কেনই-বা এলেন। মা বেঁচে নেই যে আসবার একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তা ছাড়া মামাকে কেমন যেন লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল। মামা বললেন, আমার আব্বা–মানে তোমাদের নানা মারা গিয়েছেন দিন সাতেক হল। কী হয়েছিল? তেমন কিছু নয়! বয়স তো কম হয় নি তাঁর, নব্বুইয়ের কাছাকাছি। আজকালকার দিনে এত বাঁচে না কেউ। মামা বলতে বলতে অল্প হাসলেন কি ভেবে। বললেন, আমাকে আসতে দেখে অবাক হয়েছ, না? না-না, অবাক হব কেন? আপনি চা খাবেন? চা ছেড়ে দিযেছি, ডায়াবেটিসে ভুগছি। আচ্ছা, দাও এক কাপ চিনি ছাড়া। নিনুকে চায়ের কথা বলে এসে বসতেই মামা বললেন, বাবা শেষের দিকে তোমাদের কথা কেন জানি খুব বলতেন। তিনি সিলেটে আমার ছোটভাইয়ের কাছে ছিলেন। অসুখের খবর শুনে আমি গিয়েছিলাম। বাবা প্রায়ই বলতেন, ঢাকা গিয়েই তোমাদের এখানে আসতে পান। আগে কখনো এমন বলেন নি। মামা চশমার কাঁচ ঘষতে ঘষতে বললেন, বয়স হলে অনেক বদলে যায়, তাই না? জ্বি। শিরিন খুব আদরের ছিল সবার। তবে বড়ো গোঁয়ার ছিল। জান তো মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস, অন্যটি গোয়ার্তুমি। আমি কোনো কথা বললাম না। মামা বললেন, শিরিনের অনেক গুণ ছিল। সাধারণত মেয়েদের থাকে না। যখন সে এখানে চলে আসল, তখন সবাই দুঃখিত হয়েছিলাম। গুণ বিকাশে পরিবেশের প্রয়োজন হয় তো। নিনু চা নিয়ে ঢুকল। মামা চায়ে চুমুক দিয়ে চমকালেন, একি খুকি, চিনি দিয়ে এনেছ যে! নিনু আধহাত জিভ বের করে ফেলল। মামা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক দিন একটু অনিযম হোক না হয়। তোমার এক ভাই শুনেছি খুব নাম করেছে। আমি ঠিক চিনতাম না। কিটকি আমাকে বলল। কিটকি আমার ভাগ্নী, চিনেছ? জ্বি। তোমার বাবা আসলে সবাইকে নিয়ে যাবে আমাদের বাসায়। আমিই নিয়ে যাব। তোমার মার অনেক গয়না ছিল। সব ফেলে এসেছিল, সেগুলিও নিয়ে আসবে। মামা নিনুকে কাছে ডেকে আদর করতে লাগলেন, ফুলের মতো মেয়ে। তুমি যাবে আমার বাসায়? তোমাকে একটা জিনিস দেব। কী জিনিস? একটা ময়ূর। হিলট্রাক্টে থাকে–এক বন্ধু—আমাকে দিয়েছিল। পেখম হয়? হয় বোধকরি। আমি অবশ্যি পেখম হতে দেখি নি। আমি বললাম, মামা, মার একটা পুরনো রেকর্ড ছিল নাকি? হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে এখনো। তুমি চাও সেটি? শুনতে ইচ্ছে হয় খুব। নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মারা গান শুনতে ইচ্ছে তো হবেই। পাঠিয়ে দেব আমি, আমার মনে থাকবে। ঝুনুকে শেষ পর্যন্ত আসতে দিল তারা। তিন বৎসর পর দেখছি। মা হতে যাবার আগের শারীরিক অস্বাভাবিকতায় একটু যেন লজ্জিত। ছেলেবেলার উচ্ছ্বলতা ঢাকা পড়েছে অপরূপ কমনীয়তায়। মোটা হওয়াতে একটু যেন ফর্সা দেখাচ্ছে। দুপুরবেলা সে যখন এসেছে, তখন আমি কলেজে। মন্টু পাশের বাড়ি থেকে ফোন করল আসতে। পরীক্ষণ-সংক্রান্ত জরুরী মীটিং ছিল, আসতে পারলাম না। সারাক্ষণই ভাবছিলাম, কেমন না জানি হয়েছে বুঝুনুটা। সেদিনও একটা চিঠি পেয়েছি, তুমি তো মনে কর বিয়ে করে ঝুনু বদলে গেছে। বাসার কারো সঙ্গে কোনো যোগ নেই। তাই বাসার কোনো খবরই আমাকে দাও না। রাবেযা আপার যে জ্বর হয়েছিল, সে তো তুমি কিছু লেখি নি। বাবার চিঠিতে জানলাম। আর
false
nihar_ronjon_gupta
পর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা। বৃষ্টি হওয়ায় প্রখর তাপ-দাহ কিছুটা কমেছে। কৃষ্ণা একটা সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়ছে আর কিরীটী সোফার গায়ে হেলান দিয়ে সামনের ছোট টেবিলটার ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। বই পড়লেও কৃষার মনটা বইয়ের পাতার মধ্যে ঠিক ছিল না——সে মধ্যে মধ্যে চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল কৃষ, মিত্রানীর মৃত্যুরহস্যের কোন সমাধানে কিরীটী পৌঁছতে পারেনি—তাই তার ঐ নিঃশব্দতা। বাইরের চেহারাটা যতই শান্ত হোক, ভিতরে ভিতরে তার একটা অস্থির আলোড়ন চলেছে। চা খাবে? কৃষ্ণা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললে। চা! হ্যাঁ, চা করে আনি— নিয়ে এসো! কৃষ্ণা একপাশে বইটা রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই একটু পরে সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল দরজা ঠেলে। সুব্রতকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিরীটী ওর দিকে তাকাল চোখ তুলে—আচ্ছা সুব্রত। কি? মিত্রানী সেদিন অকস্মাৎ আক্রান্ত হবার পর নিশ্চয়ই চিৎকার করে উঠেছিল– সেটাই তো স্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ প্রতিরোধ যেমন মানুষ করে তেমনি শেষ একটা ভয়ার্ত চিৎকারও সে করে ওঠে। তাহলে— কি তাহলে? কাজল বোস নিশ্চয়ই সে চিৎকার শুনেছিল— কাজল বোস! হ্যাঁ, সে যে ঠিক সেই মুহূর্তে মিত্রানী ও আক্রান্তকারীর আশেপাশেই ছিল সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ—আর তার প্রমাণ হচ্ছে কাজলেরই ভাঙা চুড়ির কয়েকটি টুকরো মৃতদেহের অনতিদূরে, যেগুলো সুশীল নন্দী পরের দিন কুড়িয়ে পেয়েছেন। কাজল বোস আমাদের কাছে সে কথা চেপে গিয়েছে কিন্তু কেন? হোয়াট ইজ হার মোটিভ বিহাইন্ড? কি উদ্দেশ্যে? হয়ত হত্যার ব্যাপারে জড়িয়ে যাবার ভয়ে সে মুখ খোলেনি— হতে পারে—তবে এও হতে পারে–সে কাউকে শিল্ড করবার চেষ্টা করছে। তোমার তাই মনে হয়? অনুমান—অনুমান মাত্র আমার— অসম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু সে কে। কাকে সে আড়াল করার চেষ্টা করছে– কাজল বোসের একমাত্র ইন্টারেস্ট সুহাস মিত্র তার প্রেমাস্পদ—কিন্তু ঐখানেই। আমার যোগফলটা মিলছে না সুব্রত কিন্তু সুহাসই যদি হত্যা করে থাকে মিত্রানীকে—একটা বলিষ্ঠ অ্যাথলেট মানুষ ঠিক, ঠিক। কিন্তু সে সত্যিই ভালবাসতো মিত্রানীকে। যোগফলটা ঐখানেই বিয়োগফলে দাঁড়াচ্ছে। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ হয়ে চার হচ্ছে না—দুই থেকে বাদ গিয়ে শূন্য দাঁড়াচ্ছে। না—ঠিক মিলছে না। সুব্রত বললে, তবে আর কে হতে পারে? কেন, বিদ্যুৎ সরকার— বিদ্যুৎ সরকার– হ্যাঁ, তুই ভেবে দেখ—বিদ্যুৎ সরকারই সুহাসকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল। এবং সুহাস যেখানে গাছের ডাল চাপা পড়েছিল তারই কাছাকাছি মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়—আর বিদ্যুৎই সেটা দেখতে পায় প্রথম। একমাত্র ঐ বিদ্যুৎ সরকারেরই যোগাযোগ ছিল মিত্রানীর সঙ্গে– কিন্তু তাকে তো তুই প্রথম থেকেই বাদ দিয়েছিস— কিরীটী বললে, দিয়েছি ঠিকই কিন্তু যুক্তিরও সেটাই শেষ কথা নয়—হতেও পারে না তা। কৃষ্ণা ঐ সময় দুকাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, কখন এলে? এই– কিরীটী ও সুব্রতর দিকে দুকাপ চা এগিয়ে দিল কৃষ্ণা। তুমি খাবে না? সুব্রত শুধায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। তোমার জুতোর শব্দ আমি পেয়েছিলাম, কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বললে, আর এক কাপ তৈরী করেছি, তোমরা শুরু কর, আমারটা আমি নিয়ে আসছি— কিছুক্ষণ পরে, তখনো চায়ের কাপ কারো নিঃশেষ হয়নি– সুব্রত এক সময় বললে, তোর কথায় মনে হচ্ছে কিরীটী, সুহাস মিত্র আর কাজল বোস মিত্রানীর হত্যারহস্যের মধ্যে বেশ জটিলভাবে জড়িয়ে আছে—যেহেতু ওরা দুর্ঘটনাটা যখন ঘটে তখন খুবই কাছাকাছি ছিল— শুধু তাই নয় সুব্রত। তবে— সুহাসকে মিত্রানী যেমন ভালবাসত, সুহাসও তেমনি ভালবাসত মিত্রানীকে। সেদিক থেকে একমাত্র সুহাসের প্রতি কিছুটা যে সন্দেহ জাগে না তা নয় কিন্তু মজা হচ্ছে কেউ কাউকে সে কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি কিন্তু কেন? পরস্পরকে পরস্পরের ভালবাসা জানাবার সত্যিই কি কোথায়ও বাধা ছিল? কৃষ্ণা বললে, হয়ত কোন তৃতীয় ব্যক্তি সজল চক্রবর্তীর মত মিত্রানীর দিক থেকে যেমন ছিল—সুহাসের দিক থেকেও তেমনি ছিল— কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাল, আশ্চর্য কৃষ্ণা, ঐ। কথাটা তো একবারও আমার মনে হয়নি—ঠিক—তৃতীয় ব্যক্তি—তৃতীয় ব্যক্তি… সুব্রত বললে, মিত্রানীর ব্যাপারে না হয় সজল চক্রবর্তী ছিল কিন্তু সুহাসের বেলায় : কে ছিল তবে? কৃষ্ণা শান্ত গলায় বললে, তোমার ঐ প্রশ্নের জবাব একমাত্র একজনই দিতে বোধ হয় পারে কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তুমি বোধ হয় সুহাসের কথা বলছে কৃষ্ণা! হ্যাঁ— জংলী এসে ঐ সময় ঘরে ঢুকল। বাবু— জংলীর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, কে এসেছে? সুহাসবাবু বলে এক ভদ্রলোক। কৃষ্ণা হেসে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, যাক-দেখো মেঘ না চাইতেই জল স্বয়ং এসে হাজির একেবারে তোমার দরজায়। কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখন জলটা ভালো ভাবে বর্ষিত হলেই হয়। এই জংলী যা, বাবুকে এই ঘরে নিয়ে আয়— কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল-সুব্রত, রাত্রে এখানে তুমি খেয়ে যাবে কিন্তু— ঠিক আছে। সুব্রত জবাব দেয়। কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার একটু পরেই সুহাস মিত্র এসে কিরীটীর ঘরে ঢুকল। আসুন সুহাসবাবু—একটু আগে আপনার কথাই ভাবছিলাম। সুহাস মিত্র বসতে বসতে বললে, জানি কেন ভাবছিলেন। জানেন? কথাটা বলে কিরীটী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুহাস মিত্রের মুখের দিকে তাকাল! হ্যাঁ—আমি সেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বাড়িতে ফেরা অবধি একটি কথাই ভেবেছি—আপনার কাছে তো অজ্ঞাত কিছুই থাকবে না কিরীটীবাবু, পেটের কথা আপনি ঠিকই বের করবেন, তার চাইতে যা সেদিন বলতে পারিনি—ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, সেটা আপনার কাছে প্রকাশ করে দেওয়াই ভাল। কিন্তু তাহলেও বলবো। কিরীটীবাবু, সত্যি কথা বলতে কি ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে
false
MZI
নিতে শুরু করেছেন? কী বললি? দলিলগুলি খোঁজ করছে? সর্বনাশ! যদি কোনোভাবে পেয়ে যায় আমাদের কী অবস্থা হবে টের পাচ্ছিস? খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, স্কুলের জমি যা দখল নিয়েছি সব যাবে! মনে হয় জেল টেলও হয়ে যাবে। গুড়ুক গুড়ুক করে হুকো খাওয়ার শব্দ হতে লাগল এবং খোরাসানী ম্যাডাম টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা শুনতে লাগল, যার সাথে কথা বলছে সে নিশ্চয়ই খুব ঘনিষ্ঠ, মহিলা হয়ে সে যে হুকো টানছে সেটা নিয়ে তার কোনো লজ্জা নাই। খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানা বন্ধ করে বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক। জোহরা কামালের বাক্স খুঁজে পাওয়া গেলে এতদিনে পাওয়া যেতো! এই স্কুলের মাঝেই তো থাকবে, আমি ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুজেছি। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) আর এই বাক্সে যদি খুঁজে না পায় তাহলে আমাদের কিছু করতে পারবে না। জাল দলিল যেটা তৈরি হয়েছে সেইটা আসল দলিলের বাপ। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) তবে আবাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী মহা ঝামেলা তৈরি করেছে। সেইদিনের ছেমড়ী কিন্তু শালীর বুদ্ধি কী সাংঘাতিক! অফিসের দুইটা কাগজ দেখেই সন্দেহ করে ফেলল। (গুড়ুক গুড়ুক)। বুঝলি কালু, আবাগীর বেটির কোনো ভয় ডর নাই, পুরা স্কুলটাকে ওলট পালট করে ফেলল। খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানতে টতে আবার অন্য পাশে কী বলছে শুনতে থাকে, খানিকক্ষণ শুনে বলল, তাহলে তুই খবর পেয়েছিস আবাগীর বেটি ফিরে আসছে? আমি জানি কোথায় আসছে। (গুড়ুক গুড়ুক) আবাগীর বেটি ফিরে আসছে স্কুলে। তার পিয়ারের মেয়েদের দেখতে—তাদেরকে না বলে চলে গেছে তো, সেইজন্য মন টিকছে না। এসে নিশ্চয়ই তাদের বোঝ দিবে, সাহস দিবে। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) দাঁড়া আমি বোঝাচ্ছি ঠেলা। কয়টার দিকে পৌঁছাবে বল দেখি? টেলিফোনের অন্য পাশে বলা হল কয়টার সময় শান্তা আপা স্কুলে পৌঁছাবেন কিন্তু নিতু রেবেকা আর তানিয়া সময়টা শুনতে পেল না, তারা শুনল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, ঠিক আছে তাহলে আমি বাকি ব্যবস্থা করি। ওই আবাগীর বেটিরে আমি সিধা করে ছেড়ে দিব। (গুড়ুক গুড়ক) কালু, তুই জানিস শান্তা ছেমড়ি কী অবস্থা করেছে? মেয়েদের এমন লাই দিয়েছে যে ছয় ছয়টা মেয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেছে! স্কুলের ভিতর ইঞ্চি ইঞ্চি করে খোঁজা হয়েছে কোথাও নাই। সেই রিপোর্ট ও দিতে হবে (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) কিছু আর ভালো লাগে না। বদমাইস গুলিরে ধরতে গিয়ে বেকায়দা পড়ে মাজাটায় যা ব্যথা পেয়েছি, ওহ! রেখে দেই কালু, অনেক কাজ বাকি। খোরাসনী ম্যাডামের অনেক কাজ কী সেটা বোঝা গেল একটু পরে, ফোন করে কথা বলতে শুরু করল শহরের বড় কোন্ মাস্তানের সাথে। স্কুলের রাস্তার ঠিক কোন্ নির্জন জায়গায় রাত নয়টার দিকে রিক্সা করে শান্তা আপা আসবেন এবং সেখানে কী ভাবে তাকে আক্রমণ করে আচ্ছা মতন শিক্ষা দিতে হবে সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে থাকল। আচ্ছা মতন শিক্ষা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হল, জানে মারতে হবে না, হাত পা কিছু একটা ভেঙ্গে দিতে হবে। কোনো জয়েন্ট ভাঙ্গলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া যায়, সারতে খুব বেশি সময় নেয় এটা নিয়েও দীর্ঘ সময় আলোচনা করা হল। যে কাজটা ঠিক করে করতে হবে সেটা হচ্ছে ভয় দেখানো—এমন ভয় দেখাতে হবে যেন শান্তা চৌধুরী আর জীবনে এই এলাকায় না আসেন। যে মাস্তানের সাথে কথা হচ্ছে সে কীভাবে ভয় দেখাবে টেলিফোনে খোরাসানী ম্যাডামকে শোনাল এবং পদ্ধতিটা খোরাসানী ম্যাডামের খুব পছন্দ হল বলে মনে হল কারণ খোরাসানী ম্যাডাম দুলে দুলে হাসতে শুরু করল! বুতুরুন্নেসা স্কুলের কোনো মেয়ে কোনো দিন খোরাসানী ম্যাডামকে হাসতে দেখে নি, এখন হঠাৎ করে তার হাসি শুনে নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কেমন জানি শিউরে উঠে, তাদের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে, একজন মানুষের হাসি এরকম ভয়ংকর হতে পারে তারা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করতো না—হাসার সময় তার মুখটাও না জানি কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে! শান্তা আপার উপর কী রকম আক্রমণ করা হবে ঠিক করার পর তার জন্যে মাস্তানদের কত টাকা দিতে হবে সেটা নিয়ে দরদাম করা শুরু হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল একেবারে মাছের বাজারে মানুষ যেভাবে দরদাম করে ঠিক সেই ভাবে দরদাম করা হল খোরাসানী মাঙামকে মনে হল এই লাইনে খুব অভিজ্ঞ, খুন করা জন্যে কত রেট, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে কত, রগ কেটে দেওয়ার জন্যে কত বা গাড়ি ভাংচুর করার জন্যে কত রেট সব তার একেবারে মুখস্ত। শুধু তাই না বছরের কোন সময় এবং কোন্ দলের কোন্ সরকার থাকলে সেই রেট কীভাবে বাড়ে কমে সেটাও খোরাসানী ম্যাডাম জানে। তাই মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে এক হাজার নগদ, দুই হাজার কাজ শেষ হবার পর) রাত নয়টার দিকে স্কুলের রাস্তার নির্জন অংশে শান্তা ম্যাডামকে আক্রমণ করে পায়ের হাটু ভেঙ্গে দেওয়ার একটা কন্ট্রাক্ট করে ফেলা হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিজের কানে না শুনলে এটা বিশ্বাস কত কী না সন্দেহ। খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করেও কথা বলা যায় না তাই নিতু রেবেকা আর তনিয়ার অপেক্ষা করতে হল। খোরাসানী ম্যাডাম যখন টেলিফোনে হোস্টেলের চাউল সাপ্লয়ারের সাথে প্রতি কে জি চাউলের জন্যে তাকে কত টাকা ভাগ না দিলে সে অন্য সাপ্লায়ারের কাছে চলে যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে থাকল
false
tarashonkor
আমরা কিন্তু যে তিমিরে সেই তিমিরেই। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইট নেই। শ্রাবণের শেষ, আকাশ আচ্ছন্ন করিয়া মেঘের সমারো জমি উঠিয়াছে। কলেজের মেসের বারান্দায় রেলিঙের উপর কনুইয়ের ভর দিয়া দাঁড়াইয়া হাত দুইটির উপরে মুখ রাখিয়া শিবনাথ মেঘের দিকে চাহিয়া ছিল। মাঝে মাঝে বর্ষার বাতাসের এক একটা দুরন্ত প্রবাহের সঙ্গে রিমিঝিমি বৃষ্টি নামিয়া আসিতেছে, বৃষ্টির মৃদু ধারায় তাহার মাথার চুল সিক্ত, মুখের উপরেও বিন্দু বিন্দু জল জমিয়া আছে। পাতলা ধোঁয়ার মত ছোট ছোট জলীয় বাষ্পের কুণ্ডলী শনশন করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, একের পর এক মেঘগুলি যেন এদিকের বড় বড় বাড়িগুলির ছাদের আড়াল হইতে উঠিয়া ওদিকের বাড়িগুলির ছাদের আড়ালে মিলাইয়া যাইতেছে। নিচে জলসিক্ত শীতল কঠিন রাজপথ হ্যারিসন রোড। পাথরের ইটে বাঁধানো পরিধির মধ্যেও ট্রামলাইনগুলি চকচক করিতেছে। একতলার উপরে ট্রামের তারগুলি স্থানে স্থানে আড়াআড়ি বাঁধনে আবদ্ধ হইয়া বরাবর চলিয়া গিয়াছে। তারের গায়ে অসংখ্য জলবিন্দু জমিয়া জমিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। এই দুর্যোগেও ট্রামগাড়ি মোটর মানুষ চলার বিরাম নাই। বিচিত্র কঠিন শব্দে রাজপথ মুখরিত। বৎসর অতীত হইতে চলিল, তবুও কলিকাতাকে দেখিয়া শিবনাথের বিস্ময়ের এখনও শেষ হয় নাই। অদ্ভুত বিচিত্ৰ ঐশ্বর্যময়ী মহানগরীকে দেখিয়া শিবনাথ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া। গিয়াছিল। সে বিস্ময়ের ঘোর আজও সম্পূর্ণ কাটে নাই। তাহার বিপুল বিশাল বিস্তার, পথের জনতা, যানবাহনের উদ্ধত ক্ষিপ্ৰ গতি দেখিয়া শিবনাথ এখনও শঙ্কিত না হইয়া পারে না। আলোর উজ্জ্বলতা দোকানে পণ্যসম্ভারের বর্ণ-বৈচিত্র্যে বিচ্ছুরিত হইয়া আজও তাহার মনে মোহ। জাগাইয়া তোলে; স্থান কাল সব সে ভুলিয়া যায়। মধ্যে মধ্যে ভাবে, এত সম্পদ আছে পৃথিবীতে এত ধন, এত ঐশ্বর্য। সেদিন সে সুশীলকে বলিল, কলকাতা দেখে মধ্যে মধ্যে আমার মনে হয় কী জানেন, মনে হয়, দেশের যেন হৃৎপিণ্ড এটা; সমস্ত রক্তস্রোতের কেন্দ্রস্থল। সুশীল প্রায়ই শিবনাথের কাছে আসে, শিবনাথও সুশীলদের বাড়ি যায়। সুশীল শিবনাথের কথা শুনিয়া হাসিয়া উত্তর দিল, উপমাটা ভুল হল ভাই শিবনাথ। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের মতে, হৃৎপিণ্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন করে, সঞ্চার করে, শোষণ করে না। কলকাতার কাজ ঠিক উল্টো, কলকাতা করে দেশকে শোষণ। গঙ্গার ধারে ডকে গেছ কখনও, সেই শোষণ-করা রক্ত ভাগীরথীর টিউবে টিউবে বয়ে চলে যাচ্ছে দেশান্তরে, জাহাজে জাহাজে-ঝলকে ঝলকে। এই বিরাট শহরটা হল একটা শোষণযন্ত্র। এ কথার উত্তর শিবনাথ দিতে পারে নাই। নীরবে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। সুশীল আবার বলিল, মনে কর তো আপনার দেশের কথাভাঙা বাড়ি, কঙ্কালসার মানুষ, জলহীন পুকুর, সব শুকিয়ে যাচ্ছে এই শোষণে। তারপর ধীরে ধীরে দৃঢ় আবেগময় কণ্ঠে কত কথাই সে বলিল, দেশের কত লক্ষ লোক অনাহারে মরে, কত লক্ষ লোক থাকে অর্ধাশনে, কত লক্ষ ৫াক গৃহহীন, কত লক্ষ লোক বস্ত্ৰহীন, কত লক্ষ লোক মরে কুকুর-বেড়ালের মত বিনা চিকিৎ ৰায়। দেশের দারিদ্রের দুর্দশার ইতিহাস আরও বলিল, একদিন নাকি এই দেশের ছেলেরা সোেনার ভঁটা লইয়া খেলা করিত, দেশে বিদেশে অন্ন বিতরণ করিয়া দেশজননী নাম পাইয়াছিলেন—অন্নপূর্ণা। অফুরন্ত অন্নের ভাণ্ডার, অপর্যাপ্ত মণিমাণিক্য-স্বর্ণের স্তুপ। শুনিতে শুনিতে শিবনাথের চোখে জল আসিয়া। গেল। সুশীল নীরব হইলে সে প্রশ্ন করিল, এর প্রতিকার? হাসিয়া সুশীল বলিয়াছিল, কে করবে? আমরা। বহুবচন ছেড়ে কথা কও ভাই, এবং সেটা পরস্মৈপদী হলে চলবে না। সে একটা চরম উত্তেজনাময় আত্মহারা মুহূর্ত। শিবনাথ বলিল, আমি-আমি করব। সুশীল প্ৰশ্ন করিল, তোমার পণ কী? মুহুর্তে শিবনাথের মনে হইল, হাজার হাজার আকাশস্পর্শী অট্টালিকা, প্রশস্ত রাজপথ, কোলাহল-কলরবমুখরিত মহানগরী বিশাল অরণ্যে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে। অন্ধকার অরণ্যতলে দূর হইতে যেন অজানিত গম্ভীর কণ্ঠে কে তাহাকে প্ৰশ্ন করিতেছে, তোমার পণ কী? সর্বাঙ্গে তাহার শিহরন বহিয়া গেল, উষ্ণ রক্তস্রোত দ্রুতবেগে বহিয়া চলিয়াছিল; সে মুহুর্তে উত্তর করিল, ভক্তি। তাহার মনে হইল, চোখের সম্মুখে এক রহস্যময় আবরণীর অন্তরালে মহিমমণ্ডিত সার্থকতা জ্যোতির্ময় রূপ লইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। তাহার মুখ-চোখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। প্রদীপ্ত দৃষ্টিতে সে সুশীলের মুখের দিকে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। সুশীলও নীরব হইয়া একদৃষ্টে বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, শিবনাথ অধীর আগ্রহে বলিল, বলুন সুশীলদা, উপায় বলুন। বিচিত্ৰ মিষ্ট হাসি হাসিয়া সুশীল বলিল, এই ভক্তি নিয়ে দেশের সেবা কর ভাই, মা পরিতুষ্ট হয়ে উঠবেন। শিবনাথ ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আপনি আমায় বললেন না! বলব, আর একদিন।—বলিয়াই সুশীল উঠিয়া পড়িল। সিঁড়ির মুখ হইতে ফিরিয়া আবার সে বলিল, আজ আমাদের ওখানে যেও। মা বারবার করে বলে দিয়েছেন; দীপা তো আমাকে খেয়ে ফেললে। দীপা সুশীলের আট বছরের বোন, ফুটফুটে মেয়েটি, তাহার সম্মুখে কখনও ফ্রক পরিয়া বাহির হইবে না। সুশীল তাহাকে বলিয়াছে, শিবনাথের সঙ্গে তার বিবাহ হইবে। সে শাড়িখানা পরিয়া সলজ্জ ভঙ্গিতে তাহার সম্মুখেই দূরে দূরে ঘুরিবে ফিরিবে, কিছুতেই কাছে। আসিবে না; ডাকিলেই পলাইয়া যাইবে। বারান্দায় দাঁড়াইয়া মৃদু বর্ষাধারায় ভিজিতে ভিজিতে শিবনাথ সেদিনের কথাই ভাবিতেছিল। ভাবিতে ভাবিতে দীপার প্রসঙ্গে আসিয়াই মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল; এমন একটি অনাবিল কৌতুকের আনন্দে কেহ কি না হাসিয়া পারে! কী রকম? আকাশের সজল মেঘের দিকে চেয়ে বিরহী যক্ষের মত রয়েছেন যে? মাথার চুল, গায়ের জামাটা পর্যন্ত ভিজে গেছে, ব্যাপারটা কী?—একটি ছেলে আসিয়া শিবনাথের পাশে দাঁড়াইল। তাহার সাড়ায় আত্মস্থ হইয়া শিবনাথ মৃদু হাসিয়া বলিল, বেশ লাগছে ভিজতে। দেশে থাকতে কত ভিজতাম বর্ষায়! ছেলেটি হাসিয়া বলিল, আমি ভাবলাম, আপনি বুঝি প্রিয়ার কাছে লিপি পাঠাচ্ছেন। মেঘমালার মারফতে। বাই দি বাই, এই ঘণ্টা দুয়েক আগে, আড়াইটে হবে তখন, আপনার সম্বন্ধী এসেছিলেন আপনার সন্ধানে—কমলেশ মুখার্জি। চকিত
false
tarashonkor
আস্তা— ও সায়েব আস্তা বাঁধলে–কাহার কুলের অন্ন ঘুচালে পালকি ছেড়ে র্যালে চড়ে যত বাবু লোক। —ও সায়েব আস্তা— মধ্যে মধ্যে সেকালে তাদের ডাক পড়ত ওখানকার ‘বিয়েশাদি’তে পালকি বহনের জন্য। লক্ষ্মীনারায়ণকে বহন করে গড়র পক্ষী, শিবদুর্গাকে বহন করে দুধবরণ সঁড় প্রভু, পিথিমী’তে বর-কনে—সে ঠাকুর মহাশয়রাই হোন আর বণিকেরাই হোন আর মণ্ডলেরাই হোন আর শেখ সৈয়দই হোন, সকল জাতের বর-কনে—বহন করতে আছে এই ‘অশ্বগোত্ত’ কাহারেরা। কাহারেরা পালকি কাধে করলেই পবিত্র। পালকি চেপে ঠাকুরেরা চান করেন না। ওই পুণ্যেই তাদের বাড়বাড়ন্ত। সে কর্ম ঘুচিয়ে দিয়েছে ওই চন্ননপুরের কারখানা। কালে কালে কাল পাল্টায়। কালারুদ্র চড়কপাটায় ঘুরে কত বছর এল, কত গেল, কে তার হিসেব করে! আঁধার রাত্রে সুচাঁদ গল্প বলে গাজনের। বনওয়ারীর মত কাহার মাতব্বর যারা, তারা উদাস হয়ে গভীর অন্ধকার-ভরা বাঁশবনের দিকে তাকিয়ে ভাবে, দিশেহারা হয়ে যায়; কালে কালে কাল কেমন করে পাল্টায়, সে জানে কোপাই-বেটী। দাঁড়াও গিয়ে কোপাইয়ের কূলে। দেখবে, আজ যেখানে দহ, কাল সেখানে চর দেখা দেয়, শক্ত পাথুরে নদীর পাড় ধসে সেখানে দহ হয়। কিছুটা জানে কালীদহের মাথার বাবাঠাকুরের ‘আশ্চয়’ অর্থাৎ এই শিমুলবৃক্ষটি। কত কোটরে ভরা, কত ডাল ভেঙে পড়েছে, কত ডাল নতুন হয়েছে, কত পাতা ঝরেছে, কত ফুলও ফুটেছে, কত ফল ফেটেছে, কত বীজ এখানে ওখানে পড়েছে, কত বংশ বেড়েছে, কত বীজ নষ্ট হয়েছে, ওই উনি কিছু কিছু জানেন। তবে উনি তো কথা যাকে-তাকে বলেন না, বলেন। সাধুকে সন্ন্যাসীকে, আর নেহাত যে বাবাঠাকুরের সুনজরে পড়ে তাকে। তাকে বলেন দেখলাম অনেক কাল বাবা! রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখলাম, কেঠাকুর কংসকে মারলেন দেখলাম, বর্গীর হাঙ্গামা দেখলাম, সায়েবদের কুঠি দেখলাম, চৌধুরীদের আমল দেখলাম, চন্ননপুরের ঠাকুর মহাশয়দের বাবুমশায় হতে দেখলাম, কাহারদের ডাক পড়ল চন্ননপুরে—সে তো এই সেদিনের কথা রে বাবা! চন্ননপুরের ঠাকুরেরা বাবু হয়ে পিরান পরলেন, মসমসিয়ে জুতো পায়ে দিলেন, ছুত-পতিত খানিকটা কম করলেন। না করে উপায় কি বল! তাঁরা জমিজেরাদ কিনলেন, টাকা দান করতে লাগলেন, ইংরিজি শিখলেন। জমিদারিও কিনলেন কতজনে। চাকরি-বাকরিতে দেশ দেশান্তর যেতে লাগলেন। কীর্তনের দল ছিল চন্ননপুরে, সে দল ভেঙে হল যাত্রার দল। সে যাত্ৰাদলের গান বনওয়ারীও শুনেছে অল্পবয়সে। তারপর হয়েছে থিয়েটার। এই কালে কাহারদের ডাক বেশি করে পড়ল চন্ননপুরে। বাবু মশায়দের চাষে খাটতে, বাসে খাটতে, মানে দালানকোঠার ইট বইতে সুরকি ভাঙতে কাহার নইলে চলত না। মেয়েদের ডাক পড়ল মজুরনী হতে। এ কালে তখন সাহেবানদের কুঠি উঠে গিয়েছে, কত্তাঠাকুরের ‘কোশে সাহেব মেম ড়ুবে মরেছে, কাহারেরা চুরি-ডাকাতিও করে, আবার চাষও করে। কিন্তু চন্ননপুর হাঁসুলী বাঁকের উত্তর দিক হলেও আসলে হল দক্ষিণপুরী, ওখানে গেলে ওদের মঙ্গল হয় না। সেখানে ছিল শাপশাপান্তের ভয়, একালে হল অন্য ভয়। মেয়ে হারাতে লাগল। রাজমিস্ত্রি সকলেই প্রায় শেখ ভাই সাহেব, তারা মেয়েদের সঙ্গে ‘অঙ ধরিয়ে কলমা পড়িয়ে। বিবি করে ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। বাবুদের চাপরাসীও মেয়েদের নষ্ট করতে লাগল। বাবু। ভাইয়েরাও কাহার-মেয়েদের আঁচল ধরে টান দিলেন। ‘বানে’র ছেলে তাদের পরশ কাহারমেয়েরা সইতে পারবে কেন, তারাই ফেটে গেল পাপে। মাতব্বরে মুরুদ্বিতে বারণ করলে, দু হাত বাড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়াল—যাস না। যতটুকু না হলে নয়, যে যাওয়াটা না গেলে চলবে না তার বেশি ও-পথ হাঁটিস না। আবার কাল পাল্টাল। চন্ননপুরে এল কলের গাড়ি। লোহার লাইন পাতলে, মাটির সড়ক। বেঁধে কোথাও-বা মাটিতে ‘পুল বন্ধন’ হল। চন্ননপুর হল ‘দী’র ঘাট। পিথিমীর কালের ভাঙনের সকল ঢেউ এসে আগে আছড়ে পড়ে ওই চন্ননপুরে। বাবু মহাশয়েরা সে ঢেউ বুক পেতে নিতে পারেন। তাঁরা ‘বান’, তারা ‘নেকনপঠন’ জানেন, ভগবান তাদের ঘরে দিয়েছেন রাজলক্ষ্মী, তার কৃপাতে ওই ঢেউয়ের মুখে ঘরে এসে ঢেকে ভালটুকু যেমন কোপাইয়ের বানে ভাগ্যমন্তের জমিতে পড়ে সোনা-ফলানো পলেন মাটি। কাহারদের বুকে ও ঢেউ লাগলে সর্বনাশ হয়, যেমন কোপাইয়ের বান ভাগ্যহীনের জমিতে চাপায় শুধু বালি, বালি আর বালি। চন্ননপুরে রেললাইন পড়ল, তাতে বাবুদের জমির দাম বাড়ল, ব্যবসা-বাজার ফলাও হল, আর কাহারদের হল সর্বনাশ। একসঙ্গে এক দল মেয়ে চলে গেল। করালীর মা গিয়েছে ওই দলে। হায় রে নিলাজ বেহায়া করালী! আবার এসেছে নতুন ঢেউ যুদ্ধের ঢেউ। যুদ্ধের ঢেউ এসে আছাড় খেয়ে পড়েছে চন্ননপুরের ঘাটে। চন্ননপুরে লাইন বাড়বে। হাতছানির ইশারা দিচ্ছে করালীর হাত দিয়ে কাহারপাড়ায় অবুঝ অবোধদের কাছে। ভুলিস না, ভুলিস না তোরা। পাগলও এই সময় তার গান শেষ করে তারও গানে এই সুর। ইচ্ছে করেই বনওয়ারী তাকে এই গানটা গাইতে বলেছে। শুনুক, যে সব ছোকরা মনে মনে উসখুস করছে অথচ যেতে পারছে না, দুঃসাহস হচ্ছে না—তারা শুনুক, জ্ঞান হোক। আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। পাগল গেয়ে নিক আগে– জাতি যায় ধরম যায় মেলেচ্ছো কারখানা ও-পথে যেয়ো না বাবা, কাবাবার মানা। গা, তুই গেয়ে যা পাগল— মেয়েরা ও-পথে গেলে, ফেরে নাকো ঘরে বেজাতেতে দিয়ে জাত যায় দেশান্তরে। করালীর মা গিয়েছে। কে জানে পাখীর দশায় কি আছে! দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বনওয়ারী। পাগল গান শেষ করে, গায়— লক্ষ্মীরে চঞ্চল করে অলক্ষ্মীর কারখানা। ও-পথে হেঁটো না মানিক কত্তাবাবার মানা। বনওয়ারী বললে—তবে? পাগল, সাঙাত আমার, তবে? -–কি তবে? —করালীর খুব পিঠ চাপুড়েছিস শুনলাম কাল এতে। করালীকে গানটি শোনাস। পাগল চুপ করে গেল। সে ঠকে গিয়েছে। একটু পরে হেসে বলল—তু খুব ফিচেল বনওয়ারী। বনওয়ারী বললে—পাখীর কথা বলব না, বলতে নাই আমাকে, আমি মামা। তবে তাকে
false
MZI
বলব, স্যার, আপনার সাথে আমার বন্ধু টুকুনজিলের পরিচয় করিয়ে দিই। স্যার বলবেন, টুকুনজিল? আমি তখন বলব, জ্বি স্যার, মহাকাশের প্রাণী টুকুনজিল। তাকে দেখা খুব শক্ত, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছাড়া দেখা যায় না– ঠিক এরকম সময়ে কে যেন আমার ঘাড়ে টোকা দিল। আমি চমকে পিছনে তাকালাম। খুব ভালো কাপড় পরা একজন মানুষ। সামনে চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে, চোখে চশমা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, খোকা, শোন– আমাকে বলছেন? হ্যাঁ, তুমি একটু এদিকে আসবে? এখন তো আমার স্কুলে যাবার সময়। এক মিনিট– আমি হঠাৎ টের পেলাম, আমার দুই পাশে আরো দুইজন মানুষ আমার দুই হাত শক্ত করে ধরেছে। মানুষগুলো ভালো কাপড় পরা, মুখ কেমন যেন হাসি হাসি, কেউ দেখলে ভাববে আমার পরিচিত কোনো মানুষ কিছু-একটা মজার কথা বলবে আমার সাথে। কিন্তু আমার বুঝতে বাকি থাকে না, এর মাঝে মজার কিছু নেই। লোক দু’জন আমাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়ে যায়। কাছেই সেই মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, কাছাকাছি আসতেই দরজাটা খুলে গেল আর দুই জোড়া শক্ত হাত আমাকে ভিতরে টেনে নিল। পুরো ব্যাপারটা ঘটল চোখের পলকে, আমি কিছু বোঝার আগে। মাইক্রোবাসের জানালা টেনে তুলে রাখা, বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই। ভিতরে সব কয়জন বিদেশি, লাল রঙের চেহারা দেখলেই পিলে চমকে যায়। একজন হলুদ দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করে বলল, কুকা, টোমাড় কুনু বয় নায়–যার অর্থ নিশ্চয়ই খোকা, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন হাতের কনুইয়ের কাছে একটা খোঁচা লাগল, হাতটা সরানোর চেষ্টা করতেই দেখলাম কেউ-একজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাথা ঘোরাতেই দেখলাম, একটা সিরিঞ্জে করে কী-একটা ইনজেকশান দিচ্ছে আমাকে। প্রচণ্ড ভয়ে আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, কিন্তু তার আগেই হলুদ-দাঁতের লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে বলল, কুকা, কুনু বয় নায়। আমার গলা দিয়ে বিশেষ শব্দ বের হল না, যেটুকু বের হল, মাইক্রোবাসের ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে গেল তার বেশির ভাগ। আরেকটা চিৎকার দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শরীরে জোর পাই না আমি, হঠাৎ করে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নিশ্চয়ই আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। চোখ বন্ধ করার আগে দেখতে পেলাম, হলুদ-দাঁতের লালমুখো বিদেশিটা আমার উপর ঝুকে মুখে হাসির ভঙ্গি করে রেখেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি অনেক রকম স্বপ্ন দেখলাম। ছাড়া-ছাড়া আজগুবি সব স্বপ্ন। এক সময় স্বপ্নে দেখলাম আমি বাড়ি ফিরে গেছি, বাবা একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে এমন একটা ভঙ্গি করলেন, যেন আমাকে দেখতেই পান নি। আমি ডাকলাম, বাবা। বাবা অবাক হয়ে বললেন, কে কথা বলে? আমি বললাম, আমি। আমি কে? আমি বিলু। বিলু? হ্যাঁ। বাবা আকুল হয়ে বললেন, তুই কোথায় বাবা বিলু? আমি বললাম, এই তো, বাবা। বাবা মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন কিন্তু তবু আমাকে দেখতে পেলেন না। বললেন, কোথায় তুই? কোথায়? তোকে দেখতে পাই না কেন? আমি বললাম, এই তো বাবা,আমি এখানে। কোথায়? এই তো! বাবা, বাবা— বিলু বিলু বিলু— আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, কেউ-একজন সত্যি আমাকে ডাকছে। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললাম, উজ্জ্বল আলো ঘরে, তার মাঝে একজন আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে! আগে কোথায় জানি দেখেছি লোকটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলাম না। আমার হঠাৎ করে সব মনে পড়ে গেল। স্কুলে যাচ্ছিলাম আমি, তখন রাস্তা থেকে ধরে এনেছে আমাকে, আমি উঠে বসার যে করলাম। মাখার কোথায় জানি প্রচণ্ড যন্ত্রণা করে উঠল হঠাৎ। মনে হচ্ছে ভিতরে একটা শিরা ছিঁড়ে গেছে বা অন্য কিছু। আমার সামনে দাঁড়ানো লোকটা অন্তরঙ্গ সুরে বলল, কেমন লাগছে বিলু তোমার? কথা শুনে মনে হল যেন আমার কতদিনের পরিচিত। আমি জিব দিয়ে আমার শুকনো ঠেটি ভিজিয়ে বললাম, খারাপ। খুব খারাপ। এই তো এক্ষুণি ভালো লাগবে তোমার। আপনি কে? আমি কোথায়? এক্ষুণি জানবে তুমি, আমি কে। নাও, এই ওষুধটা খেয়ে নাও। ছোট একটা গ্লাসে করে লাল রঙের একটা ওষুধ আমার মুখের কাছে ধরল মানুষটা। আমি মাথা নাড়লাম, কি-না-কি খাইয়ে দিচ্ছে কে জানে। খেয়ে নওি, খেয়ে নাও, ভালো লাগবে বলে প্রায় জোর করে ওষুধটা আমার মুখের মাঝে ঢেলে দিল। ওষুধটা মিষ্টি এবং চমৎকার একটা সুগন্ধ, তবু আমি খেলাম না, মুখে রেখে দিলাম। লোকটা আবার কাছে আসতেই আমি পিচকারির মতো তার মুখে ওষুধটা কুলি করে দিলাম মানুষটাকে চিনতে পেরেছি, আজ সকালে সে আমাকে ধরে এনেছে। লাল ওষুধটা তার চশমা বেয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে তার চমৎকার কাপড়ে লাল লাল ছোপ হয়ে যায়। ঠা ঠা করে কে যেন হেসে উঠল হঠাৎ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লালমখৈর আরেকজন বিদেশি মানুষ। আগে একে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। কে জানে, হয়তো দেখেছি, এদের সবগুলোকে একই রকম দেখায়। ভালো কাপড়-পরা মানুষটি তার লাল লাল ছোপ কাপড় নিয়ে আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকাল। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি, ঘরে আর কেউ না থাকলে আমাকে মেরে বসত। কিন্তু আমি জানি আমার গায়ে কেউ হাত দেবে না। সারা পৃথিবীতে শুধু আমিই টুকুনজিলের খোঁজ জানি, এই লোকগুলো সে জনোই আমাকে ধরে এনেছে। বিদেশি লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কী যেন বলল, আমি তার একটা অক্ষরও বুঝতে পারলাম না। নিশ্চয়ই ইংরেজিই হবে,
false
shunil_gongopaddhay
মারামারি শুরু করেছে, রাস্তার সাধারণ মানুষ ঢেউয়ের মতন ছুটছে এক একবার এক একদিকে। দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, ভরতকেও দৌড়াতে হচ্ছে তাদের সঙ্গে। এরই মধ্যে এসে গেল অশ্বারোহী পুলিশ। দুম দাম করে বন্দুকের শব্দ হতে লাগল। ভরত এক সময় টের পেল, সে বউবাজারের রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছে শেয়ালদার দিকে। এ কোন দিকে যাচ্ছে সে? কোনও উপায়ও নেই, উল্টো দিকে ফিরতে গেলে মরতে হবে। ভূমিসূতা রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। কিন্তু সে তো নির্বোধ নয়, বেশির ভাগ লোক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই তার যাওয়া উচিত। ভরত অন্য লোকদের মুখ দেখার চেষ্টা করল। ভিড়ের মধ্যে দু’চারজন স্ত্রীলোকও আছে। ভদ্ৰ-গৃহস্থবাড়ির রমণীদের এ সময় রাস্তা দিয়ে হাঁটার প্রশ্নই ওঠে না। শিকার ধরার জন্য কিছু কিছু স্ত্রীলোক রাস্তায় ঘোরে। মেথরানি, দাসী জাতীয়াও রয়েছে কয়েকজন। তাদের মধ্যে ভূমিসূতাকে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ এক পক্ষকে ঠেলে সরিয়ে দিলে অন্য পক্ষ তেড়ে আসে। পুলিশের ঘোড়ার মুখ সেদিকে ফিরলে পেছনের গলি দিয়ে বেরিয়ে আসে আগের দল। ক’জন মরল তা বোঝা না গেলেও আহত হয়ে কাতরাচ্ছে বেশ কয়েকজন এরকম কিছু ঘটলে মৃতদেহগুলি সারা রাত রাস্তাতেই পড়ে থাকে, সকালবেলা মুদ্দোফরাসরা এসে টেনে নিয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা চলল এই তাণ্ডব। ঠিক যেখানে গোলমাল শুরু হয়েছিল, ভরত ফিরে এল সেখানে। ভূমিসূতার চিহ্নমাত্র নেই। ভরত যে মানুষের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, তা কি ভূমিসূতা দেখেনি? সে গেল কোথায়? রণক্ষেত্রে নিহতদের কাছে গিয়ে আত্মীয় স্বজনেরা যেমন আপনজনের মুখ চেনার চেষ্টা করে, সেই রকম ভাবে ভরত রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দেখল। না, এদের মধ্যে কোনও স্ত্রীলোক নেই। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি, পগারগুলো শুকনো। তাতে পড়ে গেলে বড় জোর হাত-পা ভাঙতে পারে, মরে তো যাবে না। ভরত চিৎকার করে কয়েকবার ভূমিসূতার নাম ধরে ডাকল। পথ এখন শুনশান। মনে হয় যেন ঘোর রাত্রি। ভরতের বুক চিপ টিপ করছে। ভূমিসূতা হারিয়ে গেল? কাছেই পতিতাপল্লী, ভূমিসূতার মতন একটি মেয়েকে দেখে গুণ্ডারা সেখানে ধরে নিয়ে যেতে পারে। শেষপর্যন্ত ভূমিসূতার এই পরিণতি হবে? না, তা হতেই পারে না। কলুটোলা নামটা ভূমিসূতা অনেকবার শুনেছে,লোককে জিজ্ঞেস করে সে সেখানে গিয়ে-থাকতে পারে। ভরত প্রাণপণে ছুটল। কলুটোলার মোড়ে যাদুগোপাল নেই। একে তো অনেক দেরি হয়ে গেছে, তা ছাড়া সে গোলমালের কথাও টের পেয়েছে নিশ্চয়ই, তাই ধরে নিয়েছে ভরতরা আজ আর আসবে না। ভূমিসূতা তা হলে কোথায় যেতে পারে? হারা-উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগল ভরত। সানকিভাঙা, কলাবাগান, ঠনঠনে পেরিয়ে পান্তির মাঠে পর্যন্ত দেখে এল সে, কোথাও কেউ নেই। পাগলের মতন ভরত একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার অন্যদিকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ডাকছে, ভূমি, ভূমি, ভূমিসূতা! আড়াল থেকে যেন একবার তাকে বলল, এই ছোঁড়া বাড়ি যা। আবার পুলিশ এসে তোকে ধরবে। কিন্তু ভূমিসূতাকে না নিয়ে ভরত একলা ফিরবে কী করে? মেয়েটাকে একবার পথে ফেলে গেলে সে চিরকালের মতন পথেই হারিয়ে যাবে। অনেকক্ষণ দৌড়োবার পর হঠাৎ ভরতের মনে হল, কলুটোলার কাছেই একটা বন্ধ দোকানের ওপরের সিঁড়িতে কে যেন বসে আছে। মানুষ, না কুকুর। ভরত কাছে গিয়ে দেখল, দোকানের দরজায় ঠেস দিয়ে, সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে একটি শাড়ি পরা মূর্তি। ডুরে শাড়িটা দেখেই সে চিনল। হ্যাঁ, ভূমিসূতা। ভরতের সারা শরীর ঘর্মাক্ত। তবু স্নিগ্ধ হয়ে গেল শরীর। অদ্ভুত এক আনন্দের আবেগে ভরে গেল বুক। ভূমিসূতাকে সে ফিরে পেয়েছে। খানিকটা দম নিয়ে সে বলল, ভূমি, ভূমি, তোমার কিছু হয়নি তো? ভূমিসূতা কোনও উত্তর দিল না। তার চক্ষুদুটো যেন জ্বলছে। সেই জ্বলন্ত চোখে সে স্থিরভাবে চেয়ে রইল ভরতের দিকে। ভরত বলল, তুমি, তুমি এখানে বসে আছ। আমি এই পথ দিয়ে কতবার গেলাম, তুমি আমায় দেখতে পাওনি। ভূমিসূতা। তবু কোনও উত্তর দিল না। ভরত বলল, এসো, উঠে এসো। ভূমিসূতা এবার তীব্র গলায় বলল, না! ভরত হ’কচাকিয়ে গিয়ে বলল, না মানে? এখন যাবে না? ভূমিসূতা বলল, কেন যাব? তুমি আমাকে বেড়াল-পার করতে চেয়েছিলে। যে-কোনও একটা জায়গায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলে! এবার তুমি বাড়ি যাও। আমি রাস্তাতেই থাকব। ভরত যেন আহত হয়ে বলল, এ কী কথা বলছি, ভূমি? আমি তোমাকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছি? আমি পড়ে গিয়েছিলাম, তুমি দেখতে পাওনি? ভূমিসূতা বলল, আমাকে নিয়ে আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ভিক্ষে করে খাব। আমার জন্য তোমার কত অসুবিধে হয়েছে, আমি আর কোনও দিন তোমাকে জ্বালাতন করব না। যাও, যাও, নিশ্চিন্তে চলে যাও! ভরত বলল, তুমি বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে তোমায় ছেড়ে দিইনি। আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমায় খুঁজছি। ভূমিসূতা বলল, কেন খুঁজছিলে? আমি মারি বা বাঁচি, তাতে তোমার কী আসে যায়! আমার কেউ নেই, আমি রাস্তাতেই থাকব। হঠাৎ ভরতের বুকে একটা মোচড় লাগল, জ্বালা করে উঠল দু’চোখ। আমার কেউ নেই, এ যে তারও জীবন-বাক্য, ভূমিসূতা তো ঠিক তারই মতন। এ পর্যন্ত বরাবর সে সঙ্গে কঠোর বা নির্লিপ্ত ব্যবহার করেছে, কিন্তু এই যে এতক্ষণ সে ভূমি খোজে উন্মত্তের মতন দৌড়োদৌড়ি করছিল, তখন সে ভাবছিল, ভূমিসূতাকে শেষ পর্যন্ত না পেলে সেও আর বাড়ি ফিরবে না। ভরত একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একবার তার মনে হল, এই অবমানিতা মানবীর কাছে তার হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু এখন এই রাস্তার ওপর তা করা যায় না। দূরে পুলিশের ঘোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে
false
shordindu
উঠিল। জনগণ যখন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, তখন তাহারা বিবেচনা করিয়া কাজ করে না—এ ক্ষেত্রেও তাহারা বিবেচনা করিল না। ক্রোধান্ধ মৌমাছির পাল যদি একটা মহিষকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে দৃশ্যটা যেরূপ হয়, এই মৎস্যন্যায়ের ব্যাপারটাও প্রায় তদ্রুপ হইল। গর্জমান চণ্ডকে সিংহাসন হইতে টানিয়া নামাইয়া বিদ্ৰোহ-নায়কেরা প্ৰথমে তাহার। মণিবন্ধ পর্যন্ত হস্ত কাটিয়া ফেলিল। মহারাজ চণ্ডকে এক কোপে শেষ করিয়া ফেলিলে চলিবে না, অন্য বিবেচনা না থাকিলেও এ বিবেচনা বিদ্রোহীদের ছিল। মহারাজ এত দিন ধরিয়া যাহা অগণিত প্রজাপুঞ্জকে দুই হস্তে বিতরণ করিয়াছেন, তাহাই তাহারা প্রত্যাৰ্পণ করিতে আসিয়াছে। এই প্রতাপািণক্রিয়া এক মুহূর্তে হয় না। অতঃপর চিণ্ডের পদদ্বয় জঙ্ঘাগ্ৰন্থি হইতে কাটিয়া লওয়া হইল। কিন্তু তাহাতেও প্রতিহিংসাপিপাসু জনতার তৃপ্তি হইল না। এভাবে চলিলে বড় শীঘ্ৰ মৃত্যু উপস্থিত হইবে—তাহা বাঞ্ছনীয় নয়। মৃত্যু তো নিস্কৃতি। সুতরাং জননায়করা মহারাজের বিখণ্ডিত রক্তাঞ্ছত দেহ ঘিরিয়া মন্ত্রণা করিতে বসিল। হিংসা-পরিচালিত জনতা চিরদিনই নিষ্ঠুর, সেকালে বুঝি তাহাদের নিষ্ঠুরতার অন্ত ছিল না। একজন নাসিকাহীন শৌণ্ডিক উত্তম পরামর্শ দিল। চণ্ডকে হত্যা করিয়া কাজ নাই, বরঞ্চ তাহাকে জীবিত রাখিবার চেষ্টাই করা হউক। তারপর এই অবস্থায় তাহাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া প্রকাশ্য সর্বজনগম্য স্থানে বধিয়া রাখা হউক। নাগরিকরা প্রত্যহ ইহাকে দেখিবে, ইহার গাত্রে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিবে! চণ্ডের এই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়া ভবিষ্যৎ রাজারাও যথেষ্ট শিক্ষালাভ করিতে পরিবে। সকলে মহোল্লাসে এই প্ৰস্তাব সমর্থনা করিল। প্ৰস্তাব কার্যে পরিণত হইতেও বিলম্ব হইল না। তারপর মগধবাসীর রক্ত কথঞ্চিৎ কবোষ্ণ হইলে তাহারা নূতন রাজা নিবাচন করিতে বসিল। শিশুনাগবংশেরই দূর-সম্পর্কিত সৌম্যাকান্তি এক যুবা—নাম সেনজিৎ—মৃগয়া পক্ষিপালন ও সূরা আস্বাদন করিয়া সুখে ও তৃপ্তিতে কালযাপন করিতেছিল, রাজা হইবার দুরাকাঙক্ষা তাহার ছিল না—সকলে তাহাকে ধরিয়া সিংহাসনে বসাইয়া দিল। সেনজিৎ অতিশয় নিরহঙ্কার সরলচিত্ত ও ক্রীড়াকৌতুকপ্রিয় যুবা; নারীজাতি ভিন্ন জগতে তাহার শত্রু ছিল না; তাই নাগরিকগণ সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। সেনজিৎ প্রথমটা রাজা হইতে আপত্তি করিল; কিন্তু তাহার বন্ধুমণ্ডলীকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিয়া সে দীর্ঘশ্বাস মোচনপূর্বক সিংহাসনে গিয়া বসিল। একজন ভীমকান্তি কৃষ্ণকায় নাগরিক স্বহস্তে নিজ অঙ্গুলি কাটিয়া তাহার ললাটে রক্ত-তিলক পরাইয়া দিল। সেনজিৎ করুণবচনে বলিল—যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন হইলে যুদ্ধ করিব, কিন্তু আমাকে রাজ্য শাসন বা বংশরক্ষা করিতে বলিও না। তাহাই হইল। কয়েকজন বিচক্ষণ মন্ত্রী রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন; মহারাজ সেনজিৎ পূর্ববৎ মৃগয়াদির চাচা করিয়া ও বটুকভট্টের সহিত রসালাপ করিয়া দিন কটাইতে লাগিল। নানা কারণে কাশী কৌশল লিচ্ছবি তখন যুদ্ধ করিতে উৎসুক ছিল না; ভিতরে যাহাই থাকুক, বাহিরে একটা মৌখিক মৈত্রী দেখা যাইতেছিল,—তাই মহারাজকে বর্ম-চৰ্ম পরিধান করিয়া শৌর্য প্রদর্শন করিতে হইল না। ওদিকে রাজ-অবরোধও শূন্য পড়িয়া রহিল। কাঞ্চুকী মহাশয় ছাড়া রাজ্যে আর কাহারও মনে খেদ রহিল না। মগধের অবস্থা যখন এইরূপ, তখন লিচ্ছবি রাজ্যের রাজধানী বৈশালীতেও ভিতরে ভিতরে অনেক কিছু ঘটিতেছিল। মহামনীষী কৌটিল্য তখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই, কিন্তু তাই বলিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কূটনীতির অভাব ছিল না। বৈশালীতে বাহ্য মিত্রতার অন্তরালে গোপনে গোপনে মগধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলিতেছিল। শিবমিশ্র বৈশালীতে সাদরে গৃহীত হইয়াছিলেন। লিচ্ছবিদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত—রাজা নাই। রাজার পরিবর্তে নিবাচিত নায়কগণ রাজ্য শাসন করেন। শিবমিশ্রেীর কাহিনী শুনিয়া তাহারা তাঁহাকে সসম্মানে মন্ত্রণাদাতা সচিবের পদ প্ৰদান করিলেন। কেবল শিবমিশ্রের নামটি ঈষৎ পরিবর্তিত হইয়া গেল। তাঁহার গণ্ডের শৃগালদংশনক্ষত শুকাইয়াছিল বটে, কিন্তু ক্ষত শুকাইলেও দাগ থাকিয়া যায়। তাঁহার মুখখানা শৃগালের মতো হইয়া গিয়াছিল। জনসাধারণ তাঁহাকে শিবমিশ্র বলিয়া ডাকিতে লাগিল। শিবমিশ্র তিক্ত হাসিলেন, কিন্তু আপত্তি করিলেন না। শৃগালের সহিত তুলনায় যে ধূর্ততার ইঙ্গিত আছে, তাহা তাঁহার অরুচিকর হইল না; ঐ নামই প্ৰতিষ্ঠা লাভ করিল। দিনে দিনে বৈশালীতে শিবামিশ্রের প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। ওদিকে তাঁহার গৃহে সেই শ্মশানলব্ধ অগ্নিকণা সাগিকের যত্নে বধিত হইয়া উঠিতে লাগিল। চণ্ড ও মোরিকার কন্যা উস্কাকে একমাত্র অগ্নির সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। যতই তাহার বয়স বাড়িতে লাগিল, জ্বলন্ত বহ্নির মতো রূপের সঙ্গে সঙ্গে ততই তাহার দুর্জয় দুর্বশ প্রকৃতি পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিল। শিবমিশ্র তাহাকে নানা বিদ্যা শিক্ষা দিলেন, কিন্তু তাহার প্রকৃতির উগ্রতা প্রশমিত করিবার চেষ্টা করিলেন না। মনে মনে বলিলেন—শিশুনাগবংশের এই বিষযাকণ্টক দিয়াই শিশুনাগ্যবংশের উচ্ছেদ করিব। তীক্ষ্ণ-মেধাবিনী উল্কা চতুঃষষ্টি কলা হইতে আরম্ভ করিয়া ধনুর্বিদ্যা, অসিবিদ্যা পর্যন্ত সমস্ত অবলীলাক্রমে শিখিয়া ফেলিল। কেবল নিজ উদ্দাম প্রকৃতি সংযত করিতে শিখিল না। মগধের প্রজাবিদ্রোহের সংবাদ যেদিন বৈশালীতে পৌঁছিল, সেদিন শিবমিশ্র গূঢ় হাস্য করিলেন। এই বিদ্রোহে তাঁহার কতখানি হাত ছিল, কেহ জানিত না। কিন্তু কিছু দিন পরে যখন আবার সংবাদ আসিল যে, শিশুনাগবংশেরই আর একজন যুবা রাজ্যাভিষিক্ত হইয়াছে, তখন তাঁহার মুখ অন্ধকার হইল। এই শিশুনাগবিংশ যেন সৰ্পবংশেরই মতো-কিছুতেই নিঃশেষ হইতে চায় না। তারপর আরও কয়েক বৎসর কাটিল; শিবমিশ্র উল্কার দিকে চাহিয়া প্ৰতীক্ষা করিতে লাগিলেন। যেদিন উল্কার বয়স ষোড়শ বৎসর পূর্ণ হইল, সেই দিন শিবমিশ্র তাহাকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন—বৎসে, তুমি আমার কন্যা নহ। তোমার জীবন-বৃত্তান্ত বলিতে চাহি, উপবেশন করব। ভাবলেশহীন কণ্ঠে শিবামিশ্র বলিতে লাগিলেন, উল্কা করলগ্নকপোলে বসিয়া সম্পূর্ণ কাহিনী শুনিল; তাহার স্থির চক্ষু নিমেষের জন্য শিবামিশ্রের মুখ হইতে নড়িল না। কাহিনী সমাপ্ত করিয়া শিবমিশ্র বলিলেন—প্ৰতিহিংসা-সাধনের জন্য তোমায় ষোড়শ বর্ষ পালন করিয়াছি। চণ্ড নাই, কিন্তু শিশুনাগবিংশ অদ্যাপি সন্দপেৰ্শ বিরাজ করিতেছে। সময় উপস্থিত—তোমার মাতা মোরিকা ও পালক পিতা শিবামিশ্রেীর প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ কর। কি করিতে হইবে। শিশুনাগবিংশকে উচ্ছেদ করিতে হইবে। পন্থা নির্দেশ করিয়া দিন। শুন, পূর্বেই বলিয়াছি, তুমি বিষকন্যা; তোমার উগ্র অলোকসামান্য রূপ তাহার নিদর্শন।
false
robindronath
একটা কথা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কিছুদিন থেকে। আর সেটা তোমাকে বলব, কিছুমনে কোরো না।” “না বললে মনে করব।” “ছেলেবেলা থেকে আদিতদার সঙ্গে একত্রে মানুষ হয়েছি। ভাই বোনের মতো নয়, দুই ভাই-এর মতো। নিজের হাতে দুজনে পাশাপাশি মাটি কুপিয়েছি, গাছ কেটেছি। জেঠাইমা আর মা দু তিন দিন পরে পরে মারা যান টাইফয়েডে, আমার বয়স তখন ছয়। বাবার মৃত্যু তার দু বছর পরে। জেঠামশাইয়ের মস্ত সাধ ছিল আমিই তাঁর বাগানটিকে বাঁচিয়ে রাখব আমার প্রাণ দিয়ে। তেমনি করেই আমাকে তৈরি করেছিলেন। কাউকে তিনি অবিশ্বাস করতে জানতেন না। যে-বন্ধুদের টাকা ধার দিয়েছিলেন তারা শোধ ক’রে বাগানকে দায়মুক্ত করবে এতে তাঁর সন্দেহ ছিল না। শোধ করেছেন কেবল আদিতদা, আর কেউ না। এই ইতিহাস হয়তো তুমি কিছু কিছু জান কিন্তু তবু আজ সব কথা গোড়া থেকে বলতে ইচ্ছে করছে।” “সমস্ত আবার নূতন লাগছে আমার।” “তার পরে জান হঠাৎ সবই ডুবল। যখন ডাঙায় টেনে তুলল বন্যা থেকে, তখন আর-একবার আদিতদার পাশে এসে ঠেকল আমার ভাগ্য। মিললুম তেমনি করেই–আমরা দুই ভাই, আমরা দুই বন্ধু। তারপর থেকে আদিতদার আশ্রয়ে আছি এও যেমন সত্যি, তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি সেও তেমনি সত্যি। পরিমাণে আমার দিক থেকে কিছু কম হয় নি এ আমি জোর করে বলব। তাই আমার পক্ষে একটুও কারণ ঘটে-নি সংকোচ করবার। এর আগে একত্রে ছিলেম যখন, তখন আমাদের যে-বয়স ছিল সেই বয়সটা নিয়েই যেন ফিরলুম, সেই সম্বন্ধ নিয়ে। এমনি করেই চিরদিন চলে যেতে পারত। আর বলে কী হবে।” “কথাটা শেষ করে ফেলো।” “হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মেরে কেন জানিয়ে দিলে যে আমার বয়স হয়েছে। যেদিনকার আড়ালে একসঙ্গে কাজ করেছি সেদিনকার আবরণ উড়ে গেছে এক মুহূর্তে। তুমি নিশ্চয় সব জান রমেনদা, আমার কিছুই ঢাকা থাকে না তোমার চোখে। আমার উপরে বউদির রাগ দেখে প্রথম প্রথম ভারি আশ্চর্য লেগেছিল, কিছুতেই বুঝতে পারি নি। এতদিন দৃষ্টি পড়ে নি নিজের উপর, বউদিদির বিরাগের আগুনের আভায় দেখতে পেলেম নিজেকে, ধরা পড়লুম নিজের কাছে। আমার কথা বুঝতে পারছ কি।” “তোমার ছেলেবেলাকার তলিয়ে-থাকা ভালোবাসা নাড়া খেয়ে ভেসে উঠছে উপরের তলায়।” “আমি কী করব বলো। নিজের কাছ থেকে নিজে পালাই কী করে।” বলতে বলতে রমেনের হাত চেপে ধরলে। রমেন চুপ করে রইল। আবার সে বললে, “যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ বেড়ে চলেছে আমার অন্যায়।” “অন্যায় কার উপরে।” “বউদির উপরে।” “দেখো সরলা, আমি মানি নে ও-সব পুঁথির কথা। দাবির হিসেব বিচার করবে কোন্‌ সত্য দিয়ে। তোমাদের মিলন কতকালের; তখন কোথায় ছিল বউদি।” “কী বলছ রমেনদা! আপন ইচ্ছের দোহাই দিয়ে এ কী আবদারের কথা। আদিত্যদার কথাও তো ভাবতে হবে।” “হবে বৈকি। তুমি কি ভাবছ, যে-আঘাতে চমকিয়ে দিয়েছে তোমাকে, সেই আঘাতটাই তাঁকে লাগে নি।” “রমেন নাকি।” পিছন থেকে শোনা গেল। “হাঁ দাদা।” রমেন উঠে পড়ল। “তোমার বউদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আয়া এসে এইমাত্র জানিয়ে গেল।” রমেন চলে গেল, সরলাও তখনি উঠে যাবার উপক্রম করলে। আদিত্য বললে, “যেয়ো না সরি, একটু বোসো।” আদিত্যের মুখ দেখে সরলার বুক ফেটে যেতে চায়। ঐ অবিশ্রাম কর্মরত আপনা-ভোলা মস্ত মানুষটা এতক্ষণ যেন কেবল পাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল হালভাঙা ঢেউখাওয়া নৌকার মতো। আদিত্য বললে, “আমরা দুজনে এ সংসারে জীবন আরম্ভ করেছিলেম একেবারে এক হয়ে। এত সহজ আমাদের মিল যে এর মধ্যে কোনো ভেদ কোনো কারণে ঘটতে পারে সে কথা মনে করাই অসম্ভব। তাই কি নয় সরি।” “অঙ্কুরে যা এক থাকে, বেড়ে উঠে তা ভাগ হয়ে যায় এ কথা না মেনে তো থাকবার জো নেই আদিতদা।” “সে ভাগ তো বাইরে, কেবল চোখে দেখার ভাগ। অন্তরে তো প্রাণের মধ্যে ভাগ হয় না। আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার ধাক্কা এসেছে। আমাকে যে এত বেশি বাজবে এ আমি কোনোদিন ভাবতেই পারতুম না। সরি, তুমি কি জান কী ধাক্কাটা এল হঠাৎ আমাদের ‘পরে।” “জানি ভাই, তুমি জানবার আগে থাকতেই।” “সইতে পারবে সরি?” “সইতেই হবে।” “মেয়েদের সহ্য করবার শক্তি কি আমাদের চেয়ে বেশি, তাই ভাবি।” “তোমরা পুরুষমানুষ দুঃখের সঙ্গে লড়াই কর, মেয়েরা যুগে যুগে দুঃখ কেবল সহ্যই করে। চোখের জল আর ধৈর্য, এ ছাড়া আর তো কিছুই সম্বল নেই তাদের।” “তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে এ আমি ঘটতে দেব না, দেব না। এ অন্যায়, এ নিষ্ঠুর অন্যায়।” –ব’লে মুঠো শক্ত করে আকাশে কোন্‌ অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত হল। সরলা কোলের উপর আদিত্যের হাতখানা নিয়ে তার উপরে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলে গেল যেন আপন মনে ধীরে ধীরে, “ন্যায় অন্যায়ের কথা নয় ভাই, সম্বন্ধের বন্ধন যখন ফাঁস হয়ে ওঠে তার ব্যথা বাজে নানা লোকের মধ্যে, টানাটানি পড়ে নানা দিক থেকে, কাকেই বা দোষ দেব।” “তুমি সহ্য করতে পারবে তা জানি। একদিনের কথা মনে পড়ছে। কী চুল ছিল তোমার, এখনো আছে। সে চুলের গর্ব ছিল তোমার মনে। সবাই সেই গর্বে প্রশ্রয় দিত। একদিন ঝগড়া হল তোমার সঙ্গে। দুপুরবেলা বালিশের ‘পরে চুল মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, আমি কাঁচি হাতে অন্তত আধহাতখানেক কেটে দিলাম। তখনই জেগে তুমি দাঁড়িয়ে উঠলে, তোমার ঐ কালো চোখ আরো কালো হয়ে উঠল। শুধু বললে, “মনে করেছ আমাকে জব্দ করবে?” ব’লে আমার হাত থেকে কাঁচি টেনে
false
tarashonkor
নাই—জাত মানি না! ছি, ওই আবার বলে নাকি এত বড় লোকের নাতি হয়ে? –বলে না বুঝি? –না। বলতে নাই। স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া বিশ্বনাথ হাসিত। অল্প বয়সে তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন ন্যায়রত্ব। বিশ্বনাথের মা—ন্যায়রত্বের পুত্রবধূ বহুদিন পূর্বেই মারা গিয়াছেন। ন্যায়রত্নের স্ত্রীবিশ্বনাথের পিতামহী মারা যাইতেই জয়া ঘরের গৃহিণী-পদ-গ্রহণ করিয়াছে। তখন তাহার বয়স ছিল সবে ষোল। বিশ্বনাথ সেবারেই ম্যাট্রিক পাস করিয়া কলেজে ভর্তি হইয়াছিল। তখন সে-ও ছিল পিতামহের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। হোস্টেলে থাকিত; সন্ধ্যা-আহ্নিক করিত নিয়মিত। তখন তাহার নিকট কেহ নাস্তিকতার কথা বলিলে—সে শিশু কেউটের মত ফণা তুলিয়া তাহাকে আক্ৰমণ করিত। এমনও হইয়াছে যে, তর্কে হারিয়া সে সমস্ত রাত্রি কাঁদিয়াছে। তাহার পর কিন্তু ধীরে ধীরে বিরাট মহানগরীর রূপ-রসের মধ্যে এবং দেশ-দেশান্তরের রাজনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে সে এক অভিনব উপলব্ধি লাভ করিতে আরম্ভ করিল। যখন তাহার এ পরিবর্তন সম্পূর্ণ হইল, তখন জয়ার দিকে চাহিয়া দেখিল—সে-ও জীবনে একটা পরিণতি লাভ করিয়াছে। তাহার কিশোর মন উত্তপ্ত তরল ধাতুর মত ন্যায়রত্নের ঘরের গৃহিণীর ছাচে পড়িয়া সেই রূপেই গড়িয়া উঠিয়াছে; শুধু তাই নয়—তাহার কৈশোরের উত্তাপও শীতল হইয়া আসিয়াছে। ছাঁচের মূর্তির উপাদান কঠিন হইয়া গিয়াছে; আর সে ছাঁচ হইতে গলাইয়া অন্য ছাচে ঢালিবার উপায় নাই। ভাঙিয়া গড়িতে গেলে এখন ছাঁচটা ভাঙিতে হইবে। ন্যায়রত্বের সঙ্গে জয় জড়াইয়া গিয়াছে। অবিচ্ছেদ্যভাবে। জয়াকে ভাঙিয়া গড়িতে গেলে তাহার দাদুকে আগে ভাঙিতে হইবে। তাই বিশ্বনাথ স্ত্রীর সঙ্গে ছলনা করিয়া দিনগুলি কাটাইয়া আসিয়াছে। স্বামীর হাসি দেখিয়া জয়া তাহাকে তিরস্কার করিত। তাহাতেও বিশ্বনাথ হাসিত। এ হাসিতে জয়া পাইত আশ্বাস। এ হাসিকে স্বামীর আনুগত্য ভাবিয়া, সে পাকা গৃহিণীর মত আপন মনেই বকিয়া যাইত। আজ জয়া দাদুকে বলিল—আপনি বড় উতলা মানুষ দাদু! রাত্রে নেমে জংশনে ডাকবাংলোয়। থাকবে শুনে অবধি আপনি পায়চারি করছেন। থাকবে তো হয়েছে কি? ন্যায়রত্ন ম্লান হাসি হাসিয়া নীরবে জয়ার দিকে চাহিলেন। সে হাসির অর্থ পরিষ্কারভাবে না বুঝিলেও অ্যাঁচটা জয়া বুঝিল। সে-ও হাসিয়া বলিল—আপনি আমাকে যত বোকা ভাবেন দাদু, তত বোকা আমি নই। তারা সব জংশনে নামবে রাত্রে দেড়টা-দুটোয়। তারপর জংশন থেকে রেলের পুল দিয়ে নদী পার হয়ে—কঙ্কণা, কুসুমপুর, শিবকালীপুর—তিনখানা গ্রাম পেরিয়ে আসতে হবে। তার চেয়ে রাতটা ডাকবাংলোয় থাকবে, ঘুমিয়েটুমিয়ে সকালবেলা দিব্যি খেয়াঘাটে নদী পার হয়ে সোজা চলে আসছে বাড়ি। ন্যায়রত্নকেও কথার যুক্তিটা মানিতে হইল। জয়া অযৌক্তিক কিছু বলে নাই। তা ছাড়া ন্যায়রত্বের আজ জয়ার বলটাই সকলের চেয়ে বড় বল। তাহার সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক করিয়া বিশ্বনাথ। যখন ন্যায়রত্ন-বংশের কুলধৰ্মপরায়ণা জয়ার আঁচল ধরিয়া হাসিমুখে বেড়াইত তখন তিনি মনে মনে হাসিতেন। মহাযোগী মহেশ্বর উন্মত্তের মত ছুটিয়াছিলেন মোহিনীর পশ্চাতে। বৈরাগীশ্ৰেষ্ঠ তপস্বী শিব উমার তপস্যায় ফিরিয়াছিলেন কৈলাসভবনে। তাঁহার জয়া যে একাধারে দুই, রূপে। সে মোহিনী, বিশ্বনাথের সেবায় তপস্যায় সে উমা। জয়াই তাহার ভরসা। জয়ার কথায় আবার তিনি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন—সেখানে এক বিন্দু উদ্বেগের চিহ্ন নাই। ন্যায়রত্ন এবার আশ্বাস পাইলেন। জয়ার যুক্তিটাকে বিচার করিয়া মানিয়া লইলেন–জয়া ঠিকই বলিয়াছে। রাত্রিতে বিছানায় শুইয়া আবার তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। জয়ার যুক্তি সহজ সরল কোথাও এতটুকু অবিশ্বাসের অবকাশ নাই; কিন্তু বিশ্বনাথ সংবাদটা তাহাকে না দিয়া দেবুকে। দিল কেন? বিশ্বনাথ আজকাল জয়াকে পোস্টকার্ডে চিঠি লেখে কেন? তাহাদের দুইজনের সম্বন্ধের রঙ কি তাহার ওই চিঠির ভাষার মত ফিকে হইয়া আসিয়াছে? লৌকিক মূল্য ছাড়া অন্য মূল্যের দাবি হারাইয়াছে?মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। তিনি বাহিরে আসিলেন। –কে? দাদু?—জয়ার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ন্যায়রত্ন চমকিয়া উঠিলেন। লক্ষ্য করিলেন–জয়ার ঘরের জানালার কপাটের ফাঁকে প্রদীপ্ত আলোর ছটা জাগিয়া রহিয়াছে। ন্যায়রত্ন বলিলেন, আমি। কিন্তু তুমি এখনও জেগে? জয়া দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। হাসিয়া বলিল—আপনার বুঝি ঘুম আসছে না? এখনও সেই সব উদ্ভট ভাবনা ভাবছেন? ন্যায়রত্ব আপনাকে সংযত করিয়া হাসিয়া বলিলেন—আসন্ন মিলনের পূর্বক্ষণে সকলেই অনিদ্রা রোগে ভোগে, রাজ্ঞি। শকুন্তলা যেদিন স্বামিগৃহে যাত্রা করেছিলেন, তার পূর্বরাত্রে তিনিও ঘুমোন নি জয়া হাসিয়া বলিল-আমি গোবিন্দজীর জন্যে চাদর তৈরি করছিলাম। গোবিন্দজীর জন্যে চাদর তৈরি করছিলে? আমার গোবিন্দজীকেও তুমি এবার কেড়ে নেবে। দেখছি। তোমার চারু মুখ আর সুচারু সেবায়—তোমার প্রেমে না পড়ে যান আমার গোবিন্দজী! জয়া নীরবে শুধু হাসিল। –চল, দেখি—কি চাদর তৈরি করছ? চমৎকার একফালি গরদ। গরদের ফলিটির চারিপাশে সোনালি পাড় বসাইয়া চাদর তৈয়ারি হইতেছে। ন্যায়রত্ন বলিলেন—বাঃ, চমৎকার সুন্দর হয়েছে ভাই। হাসিয়া জয়া বলিল—আপনার নাতি এনেছিল রুমাল তৈরি করবার জন্যে। আমি বললাম, রুমাল নয়—এতে গোবিন্দজীর চাদর হবে। জরি এনে দিয়ে। আর খানিকটা নীল রঙের খুব পাতলা ফিনফিনে বেনারসী সিল্কের টুকরো। রাধারানীর ওড়না করে দেব। গোবিন্দজীর চাদর হল—এইবার রাধারানীর ওড়না করব। ন্যায়রত্নের সমস্ত অন্তর আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তাহার ভাগ্যে যাই থাক–জয়ার কখনও অকল্যাণ হইতে পারে না, কখনও না। ভোরবেলায় উঠিয়াই কিন্তু ন্যায়রত্ন আবার চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। প্রত্যাশা করিয়াছিলেন বিশ্বনাথের ডাকেই তাহার ঘুম ভাঙিবে। সে আসিয়া এখান হইতে তাহার বন্ধুদের জন্যে গাড়ি পাঠাইবে। প্রাতঃকৃত্য শেষ করিয়া তিনি আসিয়া সঁড়াইলেন-টোল-বাড়ির সীমানার শেষপ্রান্তে। ওখান হইতে গ্রাম্য পথটা অনেকখানি দূর অবধি দেখা যায়। কাহার বাড়িতে কান্নার রোল উঠিতেছে। ন্যায়রত্ন একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। অকালমৃত্যুতে দেশ ছাইয়া গেল। আহা, আবার কে সন্তানহারা হইল বোঁ হয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া ন্যায়রত্ন ফিরিয়া চাদরখানি টানিয়া লইয়া পথে নামিলেন। আসিয়া দাঁড়াইলেন গ্রামের প্রান্তে। পূর্বদিগন্তে জবাকুসুম-সঙ্কাশ স তার উদয় হইয়াছে। চারিদিক সোনার বর্ণ আলোয় ভরিয়া উঠিয়াছে। দিগদিগন্ত স্পষ্ট পরিার। পঞ্চগ্রামের বিস্তীর্ণ শস্যহীন
false
shordindu
করিলাম‌, তাহার বিভক্ত ওষ্ঠ্যাধরের ফাঁকে দাঁতগুলা কুমীরের দাঁতের মত হিংস্ব। ভোঁতা মুখে ধারালো দাঁত। সব মিলাইয়া চেহারাটি নয়নরঞ্জন নয়। তার উপর দুশ্চরিত্র। পতিভক্তিতে রেবা হয়তো সীতা-সাবিত্রীর সমতুল্য ছিল না‌, কিন্তু সেজন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। সুনীল সরকার স্পষ্টতাই রাম কিংবা সত্যবানের সমকক্ষ নয়। সুনীল বোকার মত কিছুক্ষণ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল‌, শেষে ভাঙা ভাঙা গলায় বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু—’ ব্যোমকেশ খবরের কাগজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়াছিল‌, ঘাড় ফিরাইয়া বলিল‌, ‘সুনীলবাবু? আসুন।’ ন্যালা-ক্যাবলার মত ফ্যালফেলে মুখের ভাব লইয়া সুনীল টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; কে বলিবে তাহার ঘটে গোবর ছাড়া আর কিছু আছে! ব্যোমকেশ শুষ্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনার অভিনয় ভালই হচ্ছে‌, কিন্তু যতটা অভিনয় করছেন ততটা নির্বোধ আপনি নন। —বসুন।’ সুনীল থাপ করিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িল‌, সুবর্তুল চক্ষে ব্যোমকেশকে পরিদর্শন করিয়া স্বলিত স্বরে বলিল‌, ‘কী— কী বলছেন?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছু না। আপনি যখন বোকামির অভিনয় করবেনই তখন ও আলোচনায় লাভ নেই। —সুনীলবাবু্‌, পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পাবার জন্যে আপনি দুটো মানুষকে খুন করেছেন; এক‌, আপনার স্ত্রী; দুই‌, হুকুম সিং। এখানে এসে আমি সব খবর নিয়েছি। আপনি হুকুম সিংকে দিয়ে স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন‌, তারপর নিজের হাতে হুকুম সিংকে মেরেছিলেন। হুকুম সিং ছিল আপনার ষড়যন্ত্রের অংশীদার‌, তাই তাকে সরানো দরকার ছিল; সে বেঁচে থাকলে সারা জীবন ধরে আপনাকে দোহন করত। আপনি এক টিলে দুই পাখি মেরেছেন।’ সুনীল হ্যাঁ করিয়া শুনিতেছিল‌, হাউমাউ করিয়া উঠিল‌, ‘এ কি বলছেন। আপনি! রেবাকে আমি মেরেছি! এ কি বলছেন! একটা গুণ্ডা-যার নাম হুকুম সিং-সে। আমার স্ত্রীকে গলা টিপে মেরেছিল। আন্না দেখেছে-আন্না নিজের চোখে দেখেছে। হুকুম সিং রেবাকে গলা টিপে মারছে–’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুকুম সিং ভাড়াটে গুণ্ডা, তাকে আপনি টাকা খাইয়েছিলেন।’ ‘না না‌, এসব মিথ্যে কথা। রেবাকে আমি খুন করাইনি; সে আমার স্ত্রী‌, আমি তাকে ভালবাসতাম—’ ‘আপনি রোবাকে কি রকম ভালবাসতেন‌, তার প্রমাণ আমার পকেটে আছে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেটে আঙুলের টোকা মারিল। ‘কী? রেবার চিঠি? দেখি কি চিঠি রেবা আপনাকে লিখেছিল।’ ব্যোমকেশ চিঠি বাহির করিয়া সুনীলের হাতে দিতে দিতে বলিল‌, ‘চিঠি ছিঁড়বেন না। ওর ফটো-স্ট্যাট্‌ নকল আছে।’ ফুল তাহার সতর্কবাণী শুনিতে পাইল না‌, চিঠি খুলিয়া দুহাতে ধরিয়া একাগ্রচক্ষে পড়িতে লাগিল। এই সময় নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া রমণীবাবু ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হইল; ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল। চিঠি পড়া শেষ করিয়া সুনীল যখন চোখ তুলিল তখন প্রথমেই তাহার দৃষ্টি পড়িল রমণীবাবুর উপর। পলকের মধ্যে তাহার মুখ হইতে নিবুদ্ধিতার মুখোস খসিয়া পড়িল। ভোঁতা মুখে। ধারালো দাঁত নিষ্ক্রান্ত করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘ও-এই ব্যাপার। পুলিসের ষড়যন্ত্র! আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা।–ব্যোমকেশবাবু্‌, রেবার মৃত্যুর জন্যে দায়ী কে জানেন? ঐ রমণী দারোগা।’ বলিয়া রমণীবাবুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। আমরা সুনীলের দিক হইতে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, রমণীবাবু দায়ী! তার মানে?’ সুনীল বলিল‌, ‘মানে বুঝলেন না? রমণী দারোগা রেবার প্রাণের বন্ধু ছিল‌, যাকে বলে বঁধু। তাই তো আমার ওপর রমণী দারোগার এত আক্ৰোশ।’ ঘর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। আমি রমণীবাবুর মুখের পানে তাকাইলাম। তিনি একদৃষ্টি সুনীলের পানে চাহিয়া আছেন; মনে হয় তাহার সমস্ত দেহ তপ্ত লোহার মত রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। ভয় হইল এখনি বুঝি একটা অগ্নিকাণ্ড হইয়া যাইবে। ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে বলিল‌, ‘তাহলে এই কারণেই আপনি স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন?’ সুনীল বলিল‌, ‘আমি খুন করাইনি। এই জাল চিঠি দিয়ে আমাকে ধরবেন ভেবেছিলেন ‘ সুনীল চিঠিখানা মুঠির মধ্যে গোলা পাকাইয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিল—’সুনীল সরকারকে ধরা অত সহজ নয়। চললাম। যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে গ্রেপ্তার করুন‌, তারপর আমি দেখে নেব।’, আমরা নির্বাক বসিয়া রহিলাম‌, সুনীল ময়াল সাপের মত সর্পিল গতিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। এই কয়েক মুহুর্তে সুনীলের চরিত্র যেন চোখের সামনে মূর্তি ধরিয়া দাঁড়াইল। সাপের মত খল কপট নৃশংস‌, হঠাৎ ফণা তুলিয়া ছোবল মারে‌, আবার গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া যায়। সাংঘাতিক মানুষ। রমণীবাবু একটা অতিদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ কতকটা নিজমনেই বলিল‌, ‘ধরা গেল না।’ সহসা বাহির হইতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ আসিল। সকলে চমকিয়া উঠিলাম। সর্বাগ্রে ব্যোমকেশ উঠিয়া দ্বারের পানে চলিল‌, আমরা তাহার পিছন পিছন চলিলাম। ডাকবাংলোর সামনে সুনীলের মোটর দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহার সামনের চাকার পাশে মাটির উপর যে মূর্তিটা পড়িয়া আছে তাহা সুনীলের। তাহার পিঠের উপর হইতে একটা ছুরির মুঠ উঁচু হইয়া আছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় সুনীল কাৎ হইবার চেষ্টা করিল; আমি ও ব্যোমকেশ তাহাকে সাহায্য করিলাম বটে‌, কিন্তু অন্তিমকালে আমাদের সাহায্য কোনও কাজে আসিল না। সুনীল একবার চোখ মেলিল; আমাদের চিনিতে পারিল কিনা বলা যায় না‌, কেবল অস্ফুট স্বরে বলিল‌, ‘মুকুন্দ সিং–’ তারপর তাহার হৃৎস্পন্দন থামিয়া গেল। পথের সামনে ও পিছন দিকে তাকাইলাম‌, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না; পথ জনশূন্য। আমার ব্বিশ মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন ঘুরিতে লাগিল-মুকুন্দ সিং কে? নামটা চেনা-চেনা। তারপর মনে পড়িয়া গেল‌, হুকুম সিং-এর ভাইয়ের নাম মুকুন্দ সিং। মুকুন্দ সিং ভ্ৰাতৃহত্যার প্রতিশোধ লইয়াছে। লাশ চালান দেওয়া এবং আইনঘটিত অন্যান্য কর্তব্য শেষ করিতে সাড়ে নটা বাজিয়া গেল। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। রমণীবাবুও ক্লান্তমুখে আসিয়া আমাদের সঙ্গে বসিলেন। বীরেন তখনও পাশের ঘরে যন্ত্র লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল‌, রমণীবাবু তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন‌,
false
humayun_ahmed
রান্নাঘরের দরজা দিয়ে চুপিসারে চলে যায় কোথাও। কিন্তু তা সম্ভব হয়। এ রকম কিছু চিন্তা করাও বোকামি। টেলিফোন বাজছে। ইরিনা তাকাল লোকটির দিকে। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি কি টেলিফোন ধরতে পারি? হ্যাঁ পার। টেলিফোন করেছেন ইরিনার বাবা। তার গলায় বারবার কথা আটকে যাচ্ছে। যেন কোনো কারণে তিনি অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। কথার ফাঁকে ফাকে এবড় বড় করে শ্বাস ফেলছেন। তুমি কোথেকে কথা বলছি বাবা? খাদ্য দপ্তর থেকে ৷ তুমি কিছু বলবে? না। শুধু শুধু টেলিফোন করেছ? ইয়ে মা শোন— আমাকে কোথায় যেন পাঠাচ্ছে। কোথায় পাঠাচ্ছে? তা তো জানি না। অনেকক্ষণ শুধু শুধু বসিয়ে রাখল। এখন বলছে- কী বলছে? ইরিনার বাবা খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। যেন কাউকে দেখে ভয় পেয়েছেন। অনেক কিছু বলার ছিল, বলা হল না। ইরিনা টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাচ্ছে। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বলল, কোনো লাভ নেই, কেউ টেলিফোন ধরবে না। সত্যি কেউ ধরল না। ইরিনার কাঁদতে ইচ্ছা! হচ্ছে, কিন্তু এই কুৎসিত লোকটিকে চোখের জল দেখাতে ইচ্ছা করছে না। কান্না চেপে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার। এই কঠিন ব্যাপারটি সে কী করে পারছে কে জানে। কতক্ষণ পারবে তাও জানা নেই। পানি ফুটছে। কফি বানিয়ে ফেল। চিনি বেশি করে দেবে। আমি প্রচুর চিনি খাই। বুদ্ধিমান লোকেরা চিনি বেশি খায়, এই তথ্য কি তুমি জান? ইরিনা জবাব দিল না। লোকটি কফি খেল নিঃশব্দে। তার ধরনধারণ দেখে মনে হয়, কোনো তাড়া নেই। দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকতে পারবে। কফি শেষ করেই সে তার নীল ব্যাগ থেকে কি-একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল। বইয়ের লেখাগুলো অদ্ভুত, নিশ্চয়ই কোনো অপরিচিত ভাষা। লোকটি পড়তে পড়তে মুচকি মুচকি হাসছে। নিশ্চয় মজার কোনো বই। একটি লোহার রড হাতে নিয়ে চুপিচুপি লোকটির পেছনে চলে গেলে কেমন হয়। আচমকা প্ৰচণ্ড বেগে লোহার রডটি তার মাথায় বসিয়ে দেবে। ইরিনা মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই রকম কল্পনার কোনো মানে হয় না। লোকটি হাতের ঘড়িতে সময় দেখল। বইটি বন্ধ করে নীল ব্যাগে রেখে বলল, সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় আমাদের ট্রেন। কাজেই অনেকখানি সময় আছে। রাতে খাওয়া-দাওয়া আমরা ট্রেনেই সারব। কাজেই রান্নাবান্নার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি যদি সঙ্গে কিছু নিতে চাও, নিতে পাের। একটা মাঝারি ধরনের সুটকেস গুছিয়ে নাও। আমরা কোথায় যাচ্ছি? বিধি চ ২১১/৩; আমাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ইরিনা চুপ করে গেল। একবার ইচ্ছা হল গলা ফাটিয়ে কাদে। কিন্তু কী হবে কেন্দে? কে শুনবে? তুমি কি সঙ্গে কিছুই নেবে না? না। খুব ভালো কথা। ভ্রমণের সময় মালপত্র যত কম থাকে, ততই ভালো। সবচে ভলো যদি কিছুই না থাকে। হা হা হা। ইরিনা বলল, আমি কোনো অন্যায় করি নি। দুই শ পঞ্চাশটি বিধির প্রতিটি মেনে চলি। শৃঙ্খলা বোর্ড একবারও আমাকে সাবধান কার্ড পাঠায় নি। আপনি কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন? তুমি প্রতিটি বিধি মেনে চল, এটা ঠিক বললে না। এই মুহুর্তে তুমি বিধি ভঙ্গ করেছ। আমাকে প্রশ্ন করেছ। আর করব না। এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। কাদছ কেন তুমি? আমি কাঁদতেও পারব না? বিধিতে কিন্তু কাঁদতে পারব না, এমন কথা নেই। তা নেই। তবে কাঁদলেই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। আমি তা চাই না। আমি চাই খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তুমি আমার সঙ্গে হাঁটবে। আমি চমৎকার সব হাসির গল্প জানি। সেই সব গল্প তোমাকে পথে যেতে যেতে বলল। শুনে হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরে হাঁটবে। ইরিনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, দয়া করে বলুন, আমি কি করেছি। লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি জানি না তুমি কি করেছ। সত্যি আমি জানি না। আমাকে শুধু বলা হয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে। কোথায়? সেটা তোমাকে বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। সহজ কথায় তুমি অত্যন্ত মূল্যবান। কী করে বুঝলেন? তোমাকে ন্যার জন্য আমকাএ পাঠান হয়েছে, সেই কারনেই অনুমান করছি। আমি কোনো হেঁজিপোঁজি ব্যক্তি নই, আমি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। আমাকে এইসব কেন বলছেন? যাতে অকারণে তুমি ভয় না পাও, সেজন্যে বলছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ঠিক তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার চোেখও নীল। সে-ও তোমার মতো সুন্দর। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনার কোনো মেয়ে নেই। কেউ মিথ্যা বললে আমি বুঝতে পারি। মিথ্যা বলার সময় মানুষের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আমি অবিবাহিত। ইরিনা শান্ত স্বরে বলল, আপনি কি দয়া করে বলবেন, আমার বাবা-মা এ বাড়িতে ফিরে আসবেন কি না? আমার মনে হয়, তারা আর ফিরে আসবে না। ঘরে তালা লাগানোর তাহলে আর কোনো প্রয়োজন নেই, তাই না? আমার মনে হয়, নেই। আমি নিজেও বোধ হয়। আর কোনোদিন এ বাড়িতে ফিরে আসব না। সেই সম্ভাবনাই বেশি। চলুন আমরা রওনা হই। আমার হাত ধর। ইরিনা তার হাত ধরল। লোকটি বিনা ভূমিকায় একটা হাসির গল্প শুরু করল। লোকটির গল্প বলার ঢং অত্যন্ত চমৎকার। ইচ্ছা না করলেও শুনতে হয়। একজন মানুষ কী করে হঠাৎ একদিন ছোট হতে শুরু করলো সেই গল্প। ছোট হতে হতে মানুষটা একটা পিপড়ের মতো হয়ে গেল। তার চিন্তা-ভাবনাও হয়ে
false
shunil_gongopaddhay
মৃত্যু সংবাদ তাঁকে জানানো হয়নি। তারপর এক রাত্ৰে সুহাসিনীর প্রসব বেদনা উঠলো। এবং যথা সময়ে সে জন্ম দিল একটি পুত্রসন্তানের। পুত্ৰ! প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর বিধুশেখরের বংশে এই প্রথম পুত্ৰ সন্তান এলো। আর এই পুত্রটি গর্ভে থাকা অবস্থায় বিধুশেখর তাঁর কন্যার মৃত্যু কামনা করেছিলেন। সেকথা চিন্তা করেই বিধুশেখর শিহরিত হলেন। সেই লাজুক স্বল্পভাষী কিশোরটি আর নেই। এক সময় যার উপস্থিতিই টের পাওয়া যেত না এই গৃহে। এখন গঙ্গানারায়ণ বলিষ্ঠকায় রাশভারী যুবা। তার গৌরবর্ণ মুখে শ্যামল কোমল গুম্ফ দাড়ি গজিয়েছে কিছু কিছু। তার গুম্ফটি যদিও এখনো সুবিন্যস্ত করার মতন স্বাস্থ্যবান হয়নি, তবু কারুর সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কথা বলবার সময় সে তার নরম গুফের একপ্ৰান্ত পাকবার চেষ্টা করে যায়। এখন আর সহাধ্যায়ী বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্ৰাম্ভালপে কালক্ষেপণ করে না গঙ্গানারায়ণ।। সকালে কাছারিঘরে সে নিজে উপস্থিত থেকে গোমস্ত কর্মচারিদের নানাপ্রকার কাজের নির্দেশ দেয়। তারপর আহারাদি সম্পন্ন করে সে তাদের তিনটি হীস পরিদর্শনে যায়, তার কোটের পকেটে একটি ঘড়ি থাকে, কোনোদিন সে এক মিনিটও সময়ের ব্যত্যয় করে না। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যাকালেও ব্যবসায় কার্য্যের পরামর্শের জন্য বাড়িতে লোকজন আসে, তাদের সঙ্গে গঙ্গানারায়ণ অনেক রাত পর্যন্ত নিযুক্ত থাকে। বিধুশেখরও উপস্থিত থাকেন সেখানে আর মাঝে মাঝেই তাঁর সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের তর্কদ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। অবশ্য তার ভিতরের রোমাণ্টিক, আবেগপ্রবণ মনটি এখনো রয়ে গেছে, এখনো সে বিরলে গ্রন্থপাঠ করতে করতে অশ্রু বিসর্জন করে। তার স্ত্রী লীলাবতী অধিকাংশ সময়ই থাকে পিত্ৰালয়ে। লীলাবতীর বালিকা স্বভাব আর ঘূচালো না, বাবা-মা ও পুতুল খেলার সঙ্গিনীদের ছেড়ে সে এখনো বেশী দিন থাকতে পারে না, নানান ছুতো দেখিয়ে তো প্রায়ই বাগবাজারে বাপের বাড়ি চলে যায়। গঙ্গানারায়ণ অবশ্য এজন্য কোনোদিনই আপত্তি জানায়নি, লীলাবতী সম্পর্কে তার মনে বিন্দুমাত্র আগ্ৰহ জাগেনি। নিজের কক্ষে একাকী গঙ্গানারায়ণ এক একদিন দীপের আলোকে পুস্তক পাঠ করতে করতে সারারাত্রি জেগে কাটিয়ে দেয়। ইদানীং সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে তার আগ্রহ জেগেছে, ইংরেজী কাব্যগুলির পাশাপাশি সে সংস্কৃত কাব্যগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ে। তবে, সংস্কৃত কাব্যগুলিতে শৃঙ্গার রসের বড় আধিক্য, পড়তে পড়তে তরুণ গঙ্গানারায়ণের কৰ্ণমূল আরক্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে বই মুড়ে রেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকে। সেই সব গভীর নির্জন মধ্যরাত্রে বিন্দুবাসিনীর কথা তার মনে পড়ে যায়, তার অন্তরের মধ্যে সে যেন শুনতে পায় ঝড়ের গর্জন। সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে তার আর কোনোদিন দেখা হবে না! প্রায় সকালে গঙ্গানারায়ণের ঘুম ভাঙে এক কচি সুরেলা কণ্ঠে সংস্কৃত স্তোত্র পাঠ শুনে। নবীনকুমারের বয়েস এখন আট বছর, সে জেগে ওঠে অতি প্ৰাতে এবং দ্বিতলের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে উচ্চকণ্ঠে স্তোত্র পাঠ করে। আশ্চর্য এই বালকের স্মৃতিশক্তি, এতটুকু বয়েসেই সে মহাভারতের কঠিন কঠিন শ্লোক কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে। তার মেধা দেখে সকলেই চমৎকৃত। বিম্ববতী নবীনকুমারকে চোখের আড়াল করতে চান না বলে এখনও নবীনকুমারকে কোনও বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার শিক্ষার জন্য ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি করেননি। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজ থেকে বাছাই করা তিনজন ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা নবীনকুমারকে সংস্কৃত, ইংরেজী ও অঙ্ক শিক্ষা দেন। এ ছাড়া নবীনকুমারের সঙ্গীত প্রীতি লক্ষ্য করে এক ওস্তাদজীকেও মাসোহারার বন্দোবস্তে রাখা হয়েছে বাড়িতে, তাঁর কাছ থেকে নবীনকুমার কণ্ঠ সঙ্গীতের তালিম নেবে। ভিখারি বৈরাগীদের গান শুনলেই নবীনকুমার ঠিক ঠিক শিখে নেয়, যে-সব গানের কথার অর্থ তার একেবারেই বোঝার কথা নয়, সেগুলিও সে বেশ ভাব দিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গায়। মাঝে মাঝে সে তার মায়ের সামনে নানাপ্রকার নাট্য রঙ্গ করেও দেখায়, কোথা থেকে যে সে এসব শেখে, কে জানে! নবীনকুমার তার দাদা গঙ্গানারায়ণকে বড় ভালোবাসে। নবীন কিছু নতুন পাঠ শিখলেই সেটি তার দাদাকে শোনানো চাই। গঙ্গানারায়ণ ঘুম থেকে উঠেই নবীনকুমারকে নিজের ঘরে ডেকে আনে। গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করে, গাড় মানে কী? নবীন বলে, ঈশ্বর! গঙ্গানারায়ণ আবার বলে, লার্ড? নবীন বলে, প্ৰভু। তারপর নবীন নিজেই গড় গড় করে হাততালি দিতে দিতে বলে, আমি ফিলজফর মানে জানি! বিজ্ঞলোক। আর প্লৌম্যান মানে চাষা! নবীনেতে আর গঙ্গানারায়ণে এই সখ্য বিধুশেখরের চক্ষুশূল। গঙ্গানারায়ণ বেয়াদপী শুরু করলেও বিধুশেখর জানেন, একদিন নবীনকুমারকে দিয়েই তিনি এ গৃহ থেকে গঙ্গানারায়ণকে উৎখাত করবেন। এর জন্য প্রয়োজন শুধু অপেক্ষা। নবীনকুমার আর একটু বড় হোক, তখন বিধুশেখর দেখবেন গঙ্গানারায়ণের দপ কীভাবে ভাঙতে হয়। বিম্ববতী এক অপরাহ্ন ডেকে পাঠালেন গঙ্গানারায়ণকে। সকালবেলা বিম্ববতী যখন তাঁর পোষা পাখিদের ছোলা খাওয়ান তখন একবার গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। গঙ্গানারায়ণ এসে জননীকে প্ৰণাম করে, দু-একটি কুশল বাক্য বিনিময় হয় তখন। বৈষয়িক ব্যাপারে কোনো আলোচনা থাকলে দিনের অন্য সময়ে গঙ্গানারায়ণ নিজেই খবর পাঠিয়ে বিম্ববতীর কাছে যায়। অপরাহ্ন বিম্ববতী স্বয়ং যখন এত্তেলা পাঠিয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু গুরুতর ব্যাপার আছে। অবশ্য ব্যাপারটি তেমন কিছু গুরুতর নয়। গঙ্গানারায়ণ এসে মায়ের পদধূলি নিয়ে নত মস্তকে দাঁড়াবার পর বিম্ববতী বললেন, বাগবাজার থেকে তত্ত্ব এয়েচে আজ, তুই শুনিচিস? গঙ্গানারায়ণ একটু বিমূঢ় বোধ করলো। বাগবাজারে তার শ্বশুরালয়। তত্ত্ব সেখান থেকেই এসেছে মনে হয়। কিন্তু একথা তাকে জানাবার কী আছে? তত্ত্ববাহিকারা বড় বড় পরাতে নানাপ্রকার জিনিস সাজিয়ে অন্দরমহলেই চলে আসে এবং গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকেই তারা দক্ষিণা পায়। এসব মেয়েমহলের ব্যাপার, গঙ্গানারায়ণ মাথা ঘামাতে চায় না। গঙ্গানারায়ণ শুষ্ক কণ্ঠে বললো, ও! বিম্ববতী হেসে ফেলে বললেন, ও কী? তুই এর মর্ম বুজলিনি?
false
shorotchandra
বললেন, আমরা চললুম। মা বললেন, এসো। তার পরে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। এই বলিয়া বন্দনা নীরব হইল। যে কারণে তাহার যাওয়া, যে-সকল কথা মায়ের সম্মুখে দ্বিজু গত রাত্রে বলিয়াছিল, তাহার উল্লেখমাত্র করিল না। কয়েক মুহূর্ত মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিল, মা ভারী ভেঙ্গে পড়েছেন। দেখলে মায়া হয়,—লজ্জায় কারো কাছে যেন মুখ দেখাতে পারেন না। মৈত্রেয়ী ওঁর যে সেবা করছে বোধ হয় আপন মেয়েতে তা পারে না। মা সুস্থ হয়ে যদি ওঠেন সে শুধু ওর যত্নে। মেয়েটি বেশ ভাল, কিছুদিন ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন এই আমার অনুরোধ। তাই হবে। দ্বিজুবাবু, যাবার আগে আর একটি অনুরোধ করে যাবো? করুন। আপনাকে বিয়ে করতে হবে। কেন? বন্দনা বলিল, এই বৃহৎ পরিবার নইলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আপনাদের অনেক ক্ষতি হলো জানি কিন্তু যা রইলো সেও অনেক। আপনাদের কত দান, কত সৎকাজ, কত আশ্রিত-পরিজন, কত দীন-দরিদ্রের অবলম্বন আপনারা,—আর সে কি শুধু আজ? কত দীর্ঘকাল ধরে এই ধারা বয়ে চলেচে আপনাদের পরিবারে—কোনদিন বাধা পায়নি, সে কি এখন বন্ধ হবে? দাদার ভুলে যা গেলো সে ছিল বাহুল্য, সে ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত। যাক সে। যা রেখে গেলেন শান্তমনে তাকেই যথেষ্ট বলে নিন। সেই অবশিষ্ট আপনার অক্ষয় অজস্র হোক, প্রতিদিনের প্রয়োজনে ভগবান অভাব না রাখুন, আজ বিদায় নেবার পূর্বে তাঁর কাছে এই প্রার্থনা জানাই। দ্বিজদাসের চোখের জল আসিয়া পড়িল। বন্দনা বলিতে লাগিল, আপনার বাবা অখণ্ড ভরসায় দাদার ওপর সর্বস্ব রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা রইলো না। পিতার কাছে অপরাধী হয়ে রইলেন। কিন্তু সেই ত্রুটি যদি দৈন্য এনে তাঁদের পুণ্য কর্ম বাধাগ্রস্ত করে, কোনদিন মুখুয্যেমশাই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন না। এই অশান্তি থেকে তাঁকে আপনার বাঁচতে হবে। দ্বিজদাস অশ্রু সংবরণ করিয়া বলিল, দাদার কথা এমন করে কেউ ভাবেনি বন্দনা, আমিও না। এ কি আশ্চর্য! ভাগ্য ভালো যে, বাতিদানের ছায়ার আড়ালে সে বন্দনার মুখের চেহারা দেখিতে পাইল না। বলিল, দাদার জন্যে সকল দুঃখই নিতে পারি, কিন্তু তাঁর কাজের বোঝা বইবো কি করে—সাহস পাইনে যে! সেই-সব দেখতেই আজ বেরিয়েছিলুম। তাঁর ইস্কুল, পাঠশালা, টোল, মুসলমান ছেলেদের জন্যে মক্‌তব,—আর সেই কি দু-একটা? অনেকগুলো। প্রজাদের জল-নিকাশের একটা খাল কাটা হচ্চে, বহুদিন ধরে তার টাকা যোগাতে হবে। কাগজপত্রের সঙ্গে একটা দীর্ঘ তালিকা পেয়েছি—শুধু দানের অঙ্ক। তারা চাইতে এলে কি যে বলব, জানিনে। বন্দনা কহিল, বলবেন তারা পাবে। তাদের দিতেই হবে। কিন্তু জিজ্ঞেসা করি, এতকাল তিনি কিছুই কি কাউকে জানান নি? না। এর কারণ? দ্বিজদাস বলিল, সুকৃতি গোপন করার উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু জানাবেন কাকে? সংসারে তাঁর বন্ধু কেউ ত ছিল না। দুঃখ যখন এসেছে একাকী বহন করেছেন, আনন্দ যখন এসেছে তাকেও উপভোগ করেছেন একা। কিংবা, জানিয়ে থাকবেন হয়ত তাঁর ঐ একটি মাত্র বন্ধুকে—এই বলিয়া সে উপরের দিকে চাহিয়া কহিল, কিন্তু সে খবর আত্মীয়—স্বজন জানবে কি করে? জানেন শুধু তিনি আর তাঁর ঐ অন্তর্যামী। বন্দনা কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, আচ্ছা দ্বিজবাবু, আপনার কি মনে হয় মুখুয্যেমশাই কাউকে কোনদিন ভালোবাসেন নি? কোন মানুষকেই না? দ্বিজদাস বলিল, না, সে তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। মানুষের সংসারে এতবড় নিঃসঙ্গ একলা মানুষ আর নেই। তার পরে বহুক্ষণ অবধি উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। বন্দনা জোর করিয়া একটা ভার যেন ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিল, বলিল, তা হোক গে দ্বিজুবাবু। তাঁর সমস্ত কাজ আপনাকে তুলে নিতে হবে,—একটিও ফেলতে পারবেন না। কিন্তু আমি ত দাদা নই, একলা পারবো কেন বন্দনা? একলা ত নয়, দু’জনে নেবেন। তাই ত বলেছি আপনাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু ভালো না বাসলে আমি বিয়ে করবো কি করে? বন্দনা আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, এ কি বলছেন দ্বিজুবাবু? এ কথা ত আমাদের সমাজে শুধু আমরাই বলে থাকি। কিন্তু আপনাদের পরিবারে কে কবে ভালোবেসে বিয়ে করেছে যে আপনার না হলে নয়! এ ছলনা ছেড়ে দিন। দ্বিজদাস বলিল, এ বিধি আমাদের বাড়ির নয় বটে, কিন্তু সেই নজিরই কি চিরদিন মানতে হবে? তাতেই সুখী হবো এ বিশ্বাস আর নেই। বন্দনা বলিল, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তর্ক চলে না, সুখের জামিন দিতেও পারবো না, কারণ সে ধন যাঁর হাতে তাঁর ঠিকানা জানিনে। অদ্ভুত তাঁর বিচারপদ্ধতি,—তত্ত্ব-অন্বেষণ বৃথা। কিন্তু বিয়ের আগে নয়ন-মন-রঞ্জন পূর্বরাগের খেলা দেখলুম অনেক, আবার একদিন সে অনুরাগ দৌড় দিলে যে কোন্‌ গহনে, সে প্রহসনও দেখতে পেলুম অনেক। আমি বলি ও- ফাঁদে পা দিয়ে কাজ নেই দ্বিজুবাবু, সোনার মায়ামৃগ যে বনে চরে বেড়াচ্চে বেড়াক, এ বাড়িতে সমাদরে আহ্বান করে এনে কাজ নেই। দ্বিজদাস মৃদু হাসিয়া কহিল, তার মানে সুধীরবাবু দিয়েছে আপনার মন ভয়ানক বিগড়ে। বন্দনা হাসিয়া বলিল, হাঁ। কিন্তু মনের তখনও যেটুকু বাকী ছিল বিগড়ে দিলেন আপনি, আবার তার পরে এলেন অশোক! এখন পোড়া অদৃষ্টে উনি টিকে থাকলে বাঁচি। উনিটি কে? অশোক? তাঁকে আপনার ভয়টা কিসের? ভয়টা এই যে তিনিও হঠাৎ ভালোবাসতে শুরু করেছেন। কেউ ভালবাসার ধার দিয়েও যাবে না এই বুঝি আপনার সঙ্কল্প? হাঁ, এই আমার প্রতিজ্ঞা। বিয়ে যদি কখনো করি, মস্ত সুখের আশায় যেন মস্ত বিড়ম্বনায় না পা দিই। তাই অশোকবাবুকে কাল সতর্ক করে দিয়েছি, আমাকে ভালোবাসলেই আমি ছুটে পালাবো। শুনে তিনি কি বললেন? বললেন না কিছুই, শুধু দু’চোখ মেলে চেয়ে রইলেন। দেখে বড় দুঃখ হলো দ্বিজবাবু। দুঃখ যদি সত্যিই
false
humayun_ahmed
একদল ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল আর তার পরই মর্টারে গোলাবর্ষণ হতে লাগল। আমাদের দিকে সবাই চুপচাপ। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছি। রমজান মিয়া এই সময় উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কেউ ভয় পাবেন না, কেউ ভয় পাবেন না। তার পরই রমজান মিয়ার মেশিনগানের ক্যাটিক্যাট শব্দ শোনা যেতে লাগল। সতীশকে বললাম, শুরু করা দেখি, আল্লাহ ভরসা। আর তখনি মর্টারের গোলা এসে পড়ল। বারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ধোঁয়া পরিষ্কার হতেই দেখি আমি আনিসের কাধে শুয়ে। আনিস প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছে। সবাই যখন পালিয়েছে, সে তখন জীবন তুচ্ছ করে খোঁজ নিতে এসেছে আমার। মেথিকান্দার সেই যুদ্ধে আমাদের চার জন ছেলে মারা গেল। রমজান মিয়ার মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হারলাম। গুলী লেগে আবু ভাইয়ের ডান হাতের দুটি আঙুল উড়ে গেল। আবু ভাই তারপর একেবারে ক্ষেপে গেলেন। পাঁচ দিন পরই আবার দল নিয়ে এলেন মেথিকান্দায়। সেবারও দটি ছেলে মারা গেল। তৃতীয় দফায় আবার এলেন। সেবারও তাই হল। মিলিটারিরা তত দিনে মেথিকান্দাকে দুৰ্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করিয়েছে। চারিদিকে বড়ো বড়ো বাঙ্কার, রাত-দিন কড়া পাহারা। গুজব রটে গেল, মেথিকান্দা মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ। সতীশ বলত, যদি বলেন তাহলে গভর্ণর হাউসে বোমা মেরে আসব, কিন্তু মেথিকান্দায় যাব না, ওরে বাপ রে। কিন্তু আবু ভাইয়ের মুখে অন্য কথা, মেথিকান্দা আমিই কাজ করব। যদি না পারি, তাহলে গু খাই। চতুৰ্থ বারের মতো তিনি বিরাট দল নিয়ে গেলেন সেখানে। সবাই ফিরল, আবু ভাই ফিরলেন না। পঞ্চম বারের মতো যাচ্ছি। আমরা। আমার কি ভয় লাগছে নাকি? ছিঃ হুমায়ূন ছিঃ একটির পর একটি জায়গা তোমাদের দখলে চলে আসছে, মেথিকান্দায ঘাঁটি করে এক বার যদি সোনারদির রেলওয়ে ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বিরাট একটা অংশ তোমাদের হয়ে যাবে। আর এত ভয় পাওয়ারই—বা কী? মৃত্যুকে এত ভয় পেলে চলে? একটা গল্প আছে না–এক নাবিককে এক জন সংসারী লোক জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা কোথায় মারা গেছিলেন? তিনি নাবিক ছিলেন। সমুদ্রে জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরেছেন। আর আপনার দাদা? তিনিও ছিলেন নাবিক। মরেছেন জাহাজ ড়ুবিতে। সংসারী লোকটি আত্মকে উঠে বলল, কী সর্বনাশ! আপনিও তো মশাই নাবিক। আপনিও তো জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরবেন! নাবিকটি বলল, তা হয়তো মরব। কিন্তু নাবিক না হয়েও আপনার দাদা বিছানায় শুয়ে মরেছেন, ঠিক নয় কি? হ্যাঁ। আপনার বাবাও বিছানাতেই মরেছেন, নয় কি? হ্যাঁ, হাসপাতালে! আপনিও সেইভাবেই মরবেন। তাহলে বেশ-কমটা হল কোথায়? আসল কথা, আমার ভয় লাগছে। সাহস সঞ্চায়ের চেষ্টা করছি। ভয় পাওয়াতে লজ্জার কিছু আছে কি? আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এই মনে করে গুনগুন করে গান গাইতে চেষ্টা করলাম।–সেদিন দুজনে। শিস দিয়ে আমি বেশ ভালো সুর তুলতে পারি। কিন্তু গান গাইতে গেলেই চিত্তির। জরী বলে, তোমার মীড়গুলি খুব ভালো আসে, আর কিছুই হয় না। কি জানি বাবা, মীড় কাকে বলে। আমি এত সব জানি না। আমি তো তোর মতো বিখ্যাত শিল্পী নই, গান নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। বাথরুমে গোসল করতে করতে একটু গুনগুন করতে পারলেই হল। জাফরটা ভীষণ গান-পাগল। যেই গুনগুন করে একটু সুর ধরেছি, অমনি সে পিছিয়ে পড়েছে। এখন সে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। জাফর যাতে ভালোমতো শুনতে পায়, সেই জন্যে আরেকটু উঁচু গলায় গাইতে শুরু করলাম। আমার গুনগুন শুনেই এই? জরীর গান শুনলে তো আর হুঁশি থাকবে না। জাফরকে এক দিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, গান গায় যে কানিজ আহমেদ, তার নাম শুনেছি? সে চমকে উঠে বলল, নজরুল— গীতি গান যিনি, তাঁর কথা বলছেন? হ্যাঁ। খুব শুনেছি। আপনি চেনেন নাকি? আমি সে-কথা এড়িয়ে গিয়েছি। যুদ্ধটুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জাফরকে এক দিন বাসায় নিয়ে যাব। জরীকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেব, এর নাম আবু জাফর শামসুদ্দীন। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর জাফরকে হেসে বলব, জাফর, এর নাম হল জরী। আমার ছোট বোন। তুমি চিনলে চিনতেও পার, গানটান গায়, কানিজ আহমেদ। শুনেছি হয়তো। জাফর নিশ্চয়ই চোখ বড়ো করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। সেই দৃশ্যটি আমার বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে। তা ছাড়া আমার মনে একটি গোপন বাসনা আছে। জরীর সঙ্গে বিয়ে দ্বিয়ে দেব জ্বাফরের। যুদ্ধের মধ্যে যো-পরিচয়, তার চেয়ে খাঁটি পরিচয় আর কী হতে পারে? জাফরকে আমি ভালোভাবেই চিনেছি। কিন্তু জরীর কি পছন্দ হবে? বড়ো খুঁতখুতে মেয়ে। সমালোচনা করা তার স্বভাব। কেউ হয়তো বাসায় গিয়েছে আমার খোঁজে, জারী আমাকে এসে বলবে, দাদা, তোমার এক জন চ্যাপ্টা মতো বন্ধু এসেছে। অরুণকে সে বলত কাৎলা মাছ। অরুণ রেগে গিয়ে বলেছিল, কাৎলা মাছের কী দেখলে আমার মধ্যে? জরী সহজভাবে বলেছে, তোমার মাথাটা শরীরের তুলনায় বড়ো তো, এই জন্যে। আচ্ছা, রাগ করলে আর বলব না। আদর দিয়ে-দিয়ে মা জরীর মাথাটি খেয়ে বসে আছেন। অল্প বয়সেই অহংকারী আর আহ্লাদী হয়ে উঠেছে। কে জানে এর মধ্যে বিয়েই হয়ে গেছে হয়তো। অনেক দিন তাদের কোনো খবর পাই না। শুনেছি। বাবা আবার ঢাকা ফিরে এসেছেন। ওকালতি শুরুর চেষ্টা করছেন। দেশে এখন কি আর মামলা–মোকদ্দমা আছে? টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারছেন। কিনা কে জানে। ঢাকার অবস্থা নাকি সম্পূর্ণ অন্য রকম। কিছু চেনা যায় না। ইউনিভার্সিটি পাড়া খা-খী করে। দুপুরের পর রাস্তাঘাট নিঝরঝুম হয়ে যায়। ঢাকায় বড়ো যেতে ইচ্ছে করে। কত দিন ঢাকায় যাওয়া হয় না। আবার কি কখনো এ-রকম
false
shirshendu
ভাল বুঝবেন। কি জিজ্ঞেস করতে চান? অ্যাম আই ইন লাভ উইথ ইউ? ঝুমকি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর প্রায় পিসপিস করে বলল, তার আমি কী জানি! হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমিও জানি না। ঝুমকি চুপ করে রইল। হেমাঙ্গ সামান্য বিষণ্ণ গলায় বলল, এই কথাটাই অনুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ও ভুল বুঝল। আপনি বারবার অনুর কথা বলছেন কেন? ও ছেলেমানুষ, ওর কথা ধরবেন না। হেমাঙ্গ স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আমি যে কী ভীষণ সমস্যায় আছি তা বোঝাতে পারব না। কিসের সমস্যা? আগে বলুন আপনি নিশিপুরে গেলেন না কেন? ঝুমকি একটু চুপ। তারপর খুব নিচু গলায় বলল, আপনি আমাকে অ্যাভয়েড করতে চান বলে যাইনি। জানি। কিন্তু অ্যাভয়েড করতে চাইলেও পারছি না কেন? আপনি যাননি বলে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। দিনটাই মাটি হয়ে গেল যেন। ঝুমকি চুপ। আমি আপনাকে নিয়েই প্রবলেমে পড়েছি। রশ্মিকে নিয়ে আমার এই প্রবলেম ছিল না। আই নেভার মিসূড় হার। কিন্তু আপনাকে মিস করি কেন? ঝুমকি চুপ। কিছু বলুন, প্লিজ! ঝুমকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী বলব? তা হলে অন্য দিক দিয়ে বলুন, আমার সম্পর্কে আপনার মনোভাব কিরকম? ঝুমকি চুপ। বলবেন না? ঝুমকি খুব ক্ষীণগলায় বলে, বলে কী লাভ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আপনি ভাল থাকুন। ছাড়ছি। না, প্লিজ! ঝুমকি ফোন ছাড়ল না। ধরে রইল। ফোন ধরে রইল হেমাঙ্গও। কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছিল না। কিন্তু টের পাচ্ছিল দুজনেই ফোন ধরে আছে। পাঁচ মিনিট পর হেমাঙ্গ বলল, আমার কথা আসছে না। ঝুমকি মৃদুতম স্বরে বলল, আমি কী করব? আপনি আমাকে একটু গাইড করতে পারেন তো, নাকি? ঝুমকি চুপ। হেমাঙ্গ একটু ধৈর্য হারিয়ে বলল, আপনি কিছু পারেন না। কী পারতে হবে তাই তো বলেননি। আচ্ছ, কাল একবার দেখা হতে পারে? কোথায়? কোথাও। পারে! কিন্তু কোথায় দেখা হবে না জানলে যাবো কি করে? আপনি বিকেল তিনটের সময়ে আপনাদের বাড়ির কাছে ন নম্বর বাস টার্মিনাসে থাকতে পারবেন? পারব। কিছু মনে করলেন না তো! মনে করার মতো কিছু তো নয়। আপনি কি সাদা রং পছন্দ করেন? সাদা? হ্যাঁ। সাদা খোলের শাড়ি? ঝুমকি একটু হাসল, কেন? এমনি। আপনি পছন্দ করেন? হ্যাঁ। সাদা রঙে মেয়েদের এত মানায়! তাই বুঝি? কিছু মনে করলেন না তো! না। বিরক্ত করলাম। ছাড়ছি। ঝুমকি ক্ষীণ গলায় বলল, আচ্ছা। ফোনটা রেখে দেওয়ার পর কৃতকর্মের অনুশোচনায় তার মন ভরে গেল। এ কী করল সে! ঝুমকিকে কাল সে কেন ডাকল? কী বলবে? অস্থির হেমাঙ্গ কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি করল। তারপর ধীর পায়ে উঠে এল ছাদে। চাঁদ নেই। এক বুড়ি তারা কলকাতার স্নান আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিশৃঙ্খলভাবে। সকালেই হেমাঙ্গ হাজির হল বডন স্ট্রিটের বাড়িতে। মা। ছেলের দিকে তাকিয়ে মা একটু অবাক হয়ে বলে, এ কি, আজ অফিসে যাসনি? না। আজ তোমার হাতের রান্না খেতে এলাম। ও আবার কোন দিশি কথা! আমি আজকাল রাধি নাকি! রাধে তো ঠাকুর। কী খেতে চাস? হেমাঙ্গ বুঝতে পারল না, কেন সে বিডন স্ট্রিটে এল। মায়ের হাতের রান্না? একেবারেই নয়। তার আজ খাওয়ার কোনও ইচ্ছেই হচ্ছে না। তবু কিছুক্ষণ মায়ের সঙ্গে আবোল-তাবোল কথা বলল সে। আবোল-তাবোলই। কারণ বেশির ভাগ সময়েই সে বুঝতে পারল না সে কী বলছে। দুপুরে খাওয়ার পরই সে বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। আজ গাড়ি চালানো তার উচিত হচ্ছে না। সে সম্পূর্ণ অন্যমনস্কভাবে চালাচ্ছে। কিছু দেখছে না, কিছু শুনতে পাচ্ছে না। গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছে তার রিফ্লেক্স। গোলপার্কের কাছাকাছি। যখন সে পৌঁছলো তখন দুটোও বাজেনি। সাদার্ন অ্যাভেনিউ ধরে অনেকটা গিয়ে সে ফিরে এল। আবার গেল। কিছুক্ষণ লেকের ভিতর দিয়ে চালোল। তারপর ঘুরে এল গোলপার্কের কাছে। মাত্র আড়াইটে। সময় এত ধীরে যায়? গাড়ি নিয়ে ফের ঘুরপাক খেল সে। অনেকক্ষণ। তবু তিনটের ঘরে কিছুতে পৌঁছাচ্ছে না ঘড়ির কাটা। তাজ্জব ব্যাপার! ন নম্বর বাস টার্মিনাসের কাছেই গাড়ি পার্ক করে বসে থাকে সে। ঝুমকি কোন রাস্তা দিয়ে আসবে তা সে জানে। পূর্ণ দাস রোডের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকল। সে। ঘড়ির কাঁটা তিনটে পেরিয়ে গেল। কেউই এল না। গাড়ি থেকে নেমে অনেকবার গোটা বাস টার্মিনাল চষে ফেলল সে। সাড়ে তিনটে নাগাদ সে ফোন করল ঝুমকির বাড়িতে। কেউ ফোন ধরল না। চারটের পর সে চারুশীলার বাড়িতে ঢুকল। কেমন মাতালের মতো লাগছে নিজেকে। এটা প্রত্যাখ্যান কি না তা সে বুঝতে পারছে না। তার অপমানিত বোধ করা উচিত কি না তাও না। চারুশীলা বাড়িতে নেই। বাড়ির প্রকাণ্ড লিভিংরুমে একটা গভীর সোফায় ড়ুবে থেকে চোখ বুজে ঘটনাগুলিকে পরস্পরায় সাজাতে ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ। হল না। চোখ বুজে এল ক্লান্তিতে। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল টেরও পেল न्त्रों। চারুশীলাই ডেকে তুলল তাকে, কি রে? শরীর খারাপ নাকি? হাসবার একটা চেষ্টা করে হেমাঙ্গ বলল, কোথায় গিয়েছিলি? বসে আছি কতক্ষণ! গিয়েছিলাম নার্সিংহোমে। এখনই আবার যেতে হবে। কেন? কার অসুখ? মণীশবাবুর। হার্ট অ্যাটাক। মণীশবাবুর! বলে হাঁ করে থাকে হেমাঙ্গ। তোর ওখান থেকে ফিরেই নাকি বুকে ব্যথার কথা বলছিলেন, আজ সকালে নার্সিংহোমে রিমুভ করতে বলে ডাক্তার! ঝুমকি ফোন করেছিল, গাড়ি নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এলাম। হেমাঙ্গ বলল, ওঃ। আমি তো লাঞ্চ করতেই পারিনি। ভীষণ খিদে পাওয়ায় বাড়িতে এসেছি। এখনই যাবো।
false
tarashonkor
লুপ্ত হইয়া গেছে। খুটখুট। বুকের স্পন্দন বুঝি নিস্পন্দ হইয়া গেল, বুঝি সে আসিল। অতিকষ্টে ফিরিয়া দেখে, কাকটা ঘর-নিকানো পেলেটার কানায় বসিয়া সেটা উল্টাইয়া দিল। স্বস্তির একটা নিশ্বাস বুকখানাকে হালকা করিয়া দেয়। আঃ! চিন্তায় চিন্তায় বস্তু হারাইয়া যায়, লক্ষ্যশূন্য একাগ্র দৃষ্টিতে শুধু চাহিয়া থাকে। আবার শব্দ হয়, দামিনী চমকিয়া যেন জাগিয়া ওঠে, এবার রোয়া-ওঠা শীর্ণ কুকুরটা ঘরে ঢুকিয়া গিন্নিপনা করিতেছে দেখা যায়। মর্মদাহী চিন্তার গুমটের মাঝে স্বস্তির বাধা পাইয়া দামিনী যেন বাঁচিয়া যায়, যতক্ষণ পারে অবসরটুকু ধরিয়া রাখিতে চায়। কুকুরটাকে তাড়ায়, দূর দূর। পরমুহূর্তেই আবার চিন্তায় ড়ুবিয়া যায়; কুকুরটা বাহির হইল কি না, সে খেয়াল আর থাকে না। ওই বাধার ক্ষণটুকু জলমপ্লের প্রাণপণে মাথা তুলিয়া নিশ্বাস লওয়ার মত ক্ষীণ ও ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণের পাখায় সময় চলে, সে বোধও নারীটির থাকে না। আবার শব্দ হয়, এবার সত্যই সুবল আসিয়া দাঁড়ায়; অস্থির ভঙ্গি, দৃষ্টি কেমন! সমস্ত শরীর দামিনীর কেমন করিয়া ওঠে। সুবল কহিল, দিয়ে এলাম। উত্তর যোগায় না, কণ্ঠ যেন রুদ্ধ, একটা কাজ পাইবার তরে দামিনী ব্যাকুল হইয়া ওঠে। এই রসিদ—একখানা কাগজ সুবল নামাইয়া দেয়। দামিনীর হাত যেন অবশ, কাগজখানা পড়িয়াই রহিল। তবুও যে সুবল যায় না। তবে? বিনিময় চাহিবে, দাম দিয়াছে, দেহ চাহিবে! বউ!–এবার সুবলেরও কথা যোগায় না, কানের পাশ দিয়া আগুন ছোটে, বুকের ভিতরটা টগবগ করিয়া ফোটে। বউ!–এবার সুবল দামিনীর হাতখানা চাপিয়া ধরে, সুবলের হাতে যেন আগুন ছুটিতেছে, আর এ যেন হিম, অহল্যার দেহ বুঝি পাষাণ হইতে শুরু করিয়াছে। তবু দামিনী অস্থির চঞ্চল কণ্ঠে কহিল, তোমার পায়ে পড়ি, এখন যাও। সুবল বোহতের মত পলাইয়া গেল। সুবল গেল, কিন্তু সুবলের অস্তিত্বের আভাস গেল না; ও-বাড়িতে খুট শব্দ হয়, অস্থির পদশব্দে তার বুকের কথা দামিনীর কানে বাজে। সে শব্দ খিড়কির দুয়ার পর্যন্ত আগাইয়া আসে, কখনও গোষ্ঠর বাড়ির দুয়ার পর্যন্ত আবার ফিরিয়া যায়। এমনই সারাটা দিন, সন্ধ্যায়ও তাহার বিরাম নাই। গ্রাম নিশুতি হইয়া আসিল, পদশব্দ আরও আগাইয়া আসে, রাত্ৰি অন্ধকারে, দামিনী কাঠের মত বসিয়া। নীরবে দুইখানা হাত দামিনীর হিমানী-শীতল দেহখানা জড়াইয়া ধরিল, সর্বশরীরে সে যেন ক্লেদাক্ত সরীসৃপের স্পর্শ। নারী-দেহখানা আঁকিয়া বাঁকিয়া উঠিল। *** রাত্রি শেষ হইয়া আসে, দামিনী তেমনই নিস্পন্দ বসিয়া। কিন্তু অন্ধকার যত তরল হইয়া আসে, দামিনী তত অস্থির হইয়া ওঠে, মাটির বুকে লুকাইতে সাপের গর্তের মত একটা গৰ্ত খোঁজে, সঁ্যাতসেঁতে ময়লা, ঘোট। কিংবা এই রাত্রিটা যদি প্রভাত না হয়, এই অন্ধকার যদি বৎসর, যুগ, না প্রলয়াব্যাপী হয়। আঃ, তাহা হইলে ব্যাচে সে। সম্মুখেই সেই কাগজখানা পড়িয়া, সুবলের দেওয়া সেই রসিদটা, সেটা সে স্পর্শ করিতে পারে না। একদৃষ্টে দেখে। মনে হয়, ওই কালো কালো গুটি গুটি দাগের মধ্যে তাহার ওই ইতিহাস লেখা আছে। শরীর মন শিহরিয়া ওঠে। আবার কাহার টিপিয়া টিপিয়া পা ফেলার শব্দ হয়; দামিনীর বুকে আর উদ্বেগ জাগে না। বাবা, যে বান! কে? শ্বেতবস্ত্রাবৃত দামিনীকে দেখিয়া গোষ্ঠ চমকিয়া ওঠে; তারপর চিনিয়া কয়, ও, তুমি! খোট্টা আর আসে নাই? দামিনী কথা কয় না। একবার মনে হয়, ওই রসিদখানা আগাইয়া দেয়, চিৎকার করিয়া অভয় দেয়, ভয় নাই। ভীরু, ভয় নাই। আবার নিজেরই ভয় হয়, অতি যত্নে কাগজখানাও লুকাইয়া ফেলিতে ব্যগ্রতা জাগে। কিন্তু দুইটার একটাও হয় না, কাগজখানা স্পৰ্শ করিতে পারে না; অন্তরের অহল্যা বুঝি পাষাণই হইয়া গিয়াছে। গোষ্ঠ বলে, যে বান, গায়ে ঢুকল বলে। ক্ষণপরে আবার কহে, আর গায়ের পিতুল নাই, বানের আগে শ্মশান এসে গায়ে ঢুকছে। ব্যগ্রভাবে দামিনী প্রশ্ন করে, আর কত দেরি? প্রশ্নটার তাৎপর্য গোষ্ঠ বুঝিতে পারে না, দামিনীর মুখপানে চাহিয়া থাকে। আবার বর্ষণ প্রবল হইয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো ক্ষ্যাপা হাওয়া। পশ্চিমের দিগন্তে বুঝি কোনো ঘুমন্ত সুবিশাল অজগর সদ্য জাগিয়া ধরণীগ্রাসে আগাইয়া আসিতেছে। কালো মেঘের বুক চিরিয়া তাহার রক্তজিহ্বা ঘন ঘন লকলক করে; সমস্ত সৃষ্টিটা থরথর করিয়া কাঁপিয়া ওঠে; আকাশস্পর্শী বৃক্ষশীর্ষ, তাহার বিষনিশ্বাসে মাথা আছড়াইয়া মরে; উচ্চ গৃহচূড়ের পাশ দিয়া সে নিশ্বাস গর্জিয়া যায়–গো-গোঁ, পাষাণপুরীর অন্তস্তল পর্যন্ত চাড় খাইয়া চড়চড় করিয়া ওঠে। বৃষ্টির ছাট-হাওয়ার দাপটে অসহ তীক্ষ্ণ, সে যেন বিষের ছিটা, মৃত্যুর হিমানী মাখা। দাওয়ার উপর এমনই একটা দাপটে গোষ্ঠ ব্যতিব্যস্ত হইয়া বলে, ঘরে এস গো, ঘরে এস। দামিনীর এ প্রলয়তাণ্ডবে কেমন একটা উল্লাস জাগে, সে কথা কহিল না, শুধু সমস্ত অন্তর উনুখ করিয়া ওই প্রলয়লীলার উন্মত্ত আলিঙ্গনের মাঝে নিজের অস্তিত্ব লুপ্ত করিয়া দিতে চাহিতেছিল। ঘরখানার চালের পাশ দিয়া আবার একটা প্রবাহ বহিয়া যায়, সে বিষনিশ্বাসে ঘরখানার হাড়-পাঁজর মড়মড় করিয়া আর্তনাদ করিয়া ওঠে, চাল করিয়া ওঠে মচমচ। গোষ্ঠ শিহরিয়া ত্রস্তভাবে কহে, পিঁড়েখানটা কই গো, পিঁড়েখানটা, পবন-দেবতাকে বসতে পেতে দি উঠোনে। পিঁড়িখানা গোষ্ঠ উঠানে পাতিয়া দেয়, শান্ত হয়ে বস ঠাকুর, শান্ত হয়ে বস। দেবতা শান্ত হয় না; আবার ঝড় গোঙায়, দামিনীর পাশ হইতে রসিদখানা ঝড়ে উড়িয়া যায়। দামিনীর বুকখানা কত হালকা হইয়া ওঠে। গোষ্ঠ আৰ্তকণ্ঠে ডাকে, হে ভগবান, রক্ষে কর প্রভু, রক্ষে কর। আবার কহে, ডাক গো, ভগবানকে ডাক এ সঙ্কটে। না।—অতি স্পষ্ট দৃঢ় কণ্ঠস্বর। গোষ্ঠ হতভম্বর মত দামিনীর পানে তাকাইয়া কহে, ক্যানে? কি হবে ডেকে? প্রশ্নের উত্তর নাই, নির্বাক বিস্মিত নেত্রে গোষ্ঠ দামিনীর পানে চায়; বৃষ্টির দাপট স্বামী। স্ত্রীকে ভিজাইয়া, দাওয়ার দেওয়াল পর্যন্ত ভিজাইয়া দেয়, গোষ্ঠ ত্রস্ত শিশুর মত ঘরের দরজা
false
shordindu
দেবতা, মেয়ে পাঠাও… উপত্যকা পার হইয়া ওদিকের পাহাড়ে পৌঁছিতে মধ্যরাত্রি অতীত হইয়া গেল। আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদটা ক্ৰমে ভরাট হইয়া আসিতেছে, দুই-তিন দিনের মধ্যেই নিটোল আকার ধারণ করিবে। এখন শরৎকাল, আকাশে মেঘ সাদা ও হালকা হইয়াছে, আর বৃষ্টি পড়ে না। উপত্যকার মাঝখানে হ্রদ,—ঠিক মাঝখানে নহে, একটু পশ্চিম দিক ঘেষিয়া, —তাহার। কিনারায় লম্বা লম্বা ঘাস জন্মিয়াছে। ঘাসের আগায় শীষ গজাইয়া হেলিয়া পড়িয়াছে। আর কিছু দিন পরে ঐ শীষ পীতবর্ণ হইলে উত্তর হইতে পাখিরা আসিতে আরম্ভ করিবে। হ্রদের ধারা দিয়া যাইতে যাইতে দেখিলাম, হরিণের দল জল পান করিয়া চলিয়া গেল। তাহাদের মসৃণ গায়ে চাঁদের আলো চকচক করিয়া উঠিল। ক্রমে যেখানে আমার ক্ষীণা ঝরনাটি হ্রদের সঙ্গে মিশিয়াছে, সেইখানে আসিয়া পড়িলাম। এদিকে হ্রদের জল প্ৰায় পাহাড়ের কোল পর্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছে, মধ্যে ব্যবধান পঞ্চাশ হাতের বেশি নহে। সম্মুখেই পাহাড়ের জঙ্ঘার একটা খাঁজের মধ্যে আমার গুহা। আমি ঝরনার পাশ দিয়া উঠিয়া যখন আমার নূতন গৃহের সম্মুখে পৌঁছিলাম, তখন চাঁদের অপরিপুষ্ট চক্ৰটি গুহার পিছনে উচ্চ পাহাড়ের অন্তরালে লুকাইল। নূতন গৃহে নূতন আবেষ্টনীর মধ্যে আমি একাকী মনের আনন্দে বাস করিতে লাগিলাম। কাহারও সহিত দেখা হয় না— হরিণের অন্বেষণেও এদিকে কেহ আসে না। তাহার প্রধান কারণ, পাহাড়-দেবতার করােল মুখের এত কাছে কেহ আসিতে সাহস করে না। আমাদের জাতির মধ্যে এই চক্রাকৃতি পর্বতশ্রেণী একটি অতিকায় অজগর বলিয়া পরিচিত ছিল, এই অজগরই আমাদের পর্বত-দেবতা। পর্বত-দেবতার মুখ ছিল দংষ্ট্রাবহুল অন্ধকার একটা গহ্বর। বস্তুত, দূর হইতে দেখিলে মনে হইত, যেন শঙ্কাবৃত বিশাল একটা সরীসৃপ কুণ্ডলিত হইয়া তাহার ব্যাদিত মুখটা মাটির উপর রাখিয়া শুইয়া আছে। প্ৰাণান্তেও কেহ এই গহ্বরমুখের কাছে আসিত না। গ্রীষ্মের অবসানে যখন আকাশে মেঘ আসিয়া গর্জন করিত, তখন আমাদের পাহাড়-দেবতাও গর্জন করিতেন। উপত্যকা জলে ভরিয়া উঠিলে তৃষ্ণার্ত দেবতা ঐ মুখ দিয়া জল শুষিয়া লাইতেন। আমাদের গোষ্ঠী হইতে বিষা-ঋতুর প্রাক্কালে দেবতার গ্ৰীত্যর্থে জীবন্ত জীবজন্তু উৎসর্গ করা হইত। দেবতার মুখের নিকটে কেহ যাইতে সাহসী হইত না–দূর হইতে দেবতাকে উদ্দেশ করিয়া জন্তুগুলা ছাড়িয়া দিত। জন্তুগুলাও দেবতার ক্ষুধিত নিশ্বাসের আকর্ষণে ছুটিয়া গিয়া তাঁহার মুখে প্রবেশ করিত। দেবতা শ্ৰীত হইয়া তাহাদিগকে ভোজন করিতেন। দেবতার এই ভোজনরহস্য কেবল আমি ধরিয়া ফেলিয়াছিলাম; কিন্তু কাহাকেও বলি নাই। আমি দেখিয়াছিলাম, জন্তুগুলা কিছুকাল পরে দেবতার মুখ হইতে অক্ষতদেহে বাহির হইয়া আসে এবং স্বচ্ছন্দে বিচরণ করিতে করিতে পাহাড়ে ফিরিয়া যায়। পৰ্বত-দেবতার মুখ যে প্রকৃতপক্ষে একটা বড় গহ্বর ভিন্ন আর কিছুই নহে, তাহা আমি বেশ বুঝিয়েছিলাম, তাই তাহার নিকট যাইতে আমার ভয় করিত না। একবার কৌতুহলী হইয়া উহার ভিতরেও প্রবেশ করিয়াছিলাম, কিন্তু গহ্বরের মুখ প্রশস্ত হইলেও উহার ভিতরটা অত্যন্ত অন্ধকার, এজন্য বেশিদূর অগ্রসর হইতে পারি নাই। কিন্তু রন্ধ যে বহুদূর বিস্তৃত, তাহা বুঝিতে পারিয়ছিলাম। এই পাহাড়-দেবতার মুখ আমার গুহা হইতে প্রায় তিন শত হাত দূরে উত্তরে পর্বতের সানুদেশে অবস্থিত। এ-প্রান্তে দেবতার ভয়ে কেহ আসে না, অথচ এদিকে শিকারের যত সুবিধা, অন্য দিকে তত নহে। রাত্রিতে ঝরনা ও হৃদয়ের মোহনায় লুকাইয়া থাকিলে যত ইচ্ছা শিকার পাওয়া যায়— শিকারের জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয় না। আমার গুহাটি এমনই চমৎকার যে, অত্যন্ত কাছে আসিলেও ইহাকে গুহা বলিয়া চেনা যায় না। গুহার মুখটি ছোট— লতাপাতা দিয়া ঢাকা; কিন্তু ভিতরটি বেশ সুপ্রসর। ছাদ উচু— দাঁড়াইলে মাথা ঠেকে না; মেঝেটি একটি আস্ত সমতল পাথর দিয়া তৈয়ারি। তাহার উপর লম্বাভাবে শুইয়া রন্ধ্রপথে মুখ বাড়াইলে সমস্ত উপতাকাটি চোখের নীচে বিছাইয়া পড়ে। শীতের সময় একটা পাথর দিয়া স্বচ্ছন্দে গুহামুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া যায়, ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করিতে পারে না। তাহা ছাড়া রাত্রিকালে হিংস্ৰ জন্তুর অতর্কিত আক্রমণও এই উপায়ে প্রতিরোধ করা যায়। এইখানে নিঃসঙ্গ শান্তিতে আমার কয়েকদিন কাটিয়া গেল। আকাশের চাঁদ নিটোল পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়া আবার ক্ষীণ হইতে হইতে একদিন মিলাইয়া গেল। হ্রদের কিনারায় লম্বা ঘাসের শস্য পাকিয়া রং ধরিতে আরম্ভ করিল। পাখির ঝাঁক একে একে আসিয়া হ্রদের জলে পড়িতে লাগিল; তাহাদের মিলিত কণ্ঠের কলধ্বনি আমার নিশীথ নিদ্রাকে মধুর করিয়া তুলিল। একদিন অপরাহ্নে, আমার গুহার পাশে ঝরনা যেখানে পাহাড়ের এক ধাপ হইতে আর এক ধাপে লাফাইয়া পড়িয়াছে, সেই পৈঠার উপর বসিয়া আমি একটা নূতন ধনুক নিমণি করিতেছিলাম। দুই দিন আগে একটা হরিণ মারিয়াছিলাম, তাহারই অন্ত্রে ধনুকের ছিলা করিব বলিয়া জলে ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিয়ছিলাম। পাহাড়ে একপ্রকার মোটা বেত জন্মায়, তাহাতে খুব ভালো ধনুক হয়, সেই বেত একটা ভাঙিয়া আনিয়া শুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। উপস্থিত আমার বশীর ধারালো পাথরের ফলা দিয়া তাহারই দুই দিকে গুণ লগাইবার খাঁজ কাটিতেছিলাম। অস্তমান সূর্যের আলো আমার ঝরনার জলে রক্ত মাখাইয়া দিয়াছিল; নীচে হ্রদের জলে পাখিগুলি ডাকাডাকি করিতেছিল। ঝরনার চুর্ণ জলকণা নীচের ধাপ হইতে বাষ্পাকারে উঠিয়া অত্যন্ত মিঠাভাবে আমার অনাবৃত অঙ্গে লাগিতেছিল। মুখ নত করিয়া আমি আপন মনে ধনুকে গুণ-সংযোগে নিযুক্ত ছিলাম। হঠাৎ একটা অশ্রুতপূর্ব চিহি-চিহি শব্দে চোখ তুলিয়া উপত্যকার দিকে চাহিতেই বিস্ময়ে একেবারে নিম্পন্দ হইয়া গেলাম। এ কি! দেখিলাম, পাহাড়-দেবতার মুখবিবর হইতে পিপীলিকা-শ্রেণীর মতো একজাতীয় অদ্ভুত মানুষ ও ততোধিক অদ্ভুত জন্তু বাহির হইতেছে। এরূপ মানুষ ও এরূপ জন্তু জীবনে কখনও দেখি নাই। আগন্তুকগণ বহু নিম্নে উপত্যকায় ছিল, অতদূর হইতে আমাকে দেখিতে পাইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তথাপি আমি সন্তৰ্পণে বুকে হাঁটিয়া ঝরনার তীর হইতে আমার গুহায় ফিরিয়া আসিয়া লুকাইলাম।
false
humayun_ahmed
এত যন্ত্রণা তা কে জানত? মিলিও ঘুমুতে পারল না। সে লক্ষ্য করেছে পুতুল ফিরেছে। হাসি মুখে। তার সারা চোখ মুখে আনন্দে ঝলমল করছে। হাতে বড় একটা চকোলেটের টিন। টিন খুলে সবাইকে সে চকোলেট বিলি করছে। মিলিকে দিতে এসেছিল, মিলি কঠিন স্বরে বলেছে— আমি চকলেট খাই না। এই কথায় সে ফিক করে হেসে ফেলেছে। সেই হাসি মিলির বুকে শেলের মত বিধেছে। এসব কি? কি হচ্ছে এসব? বোঝার উপর শাকের আঁটির মত বড়। আপার একটি চিঠিও এস উপস্থিত— সেই চিঠির ভাব ভাষা সবই যেন কেমন অদ্ভুত— মিলি, আমি ভুল করেছি কি-না তা জানি না। হয়ত করেছি। করলেও এ ভুল মধুর ভুল। সব মানুষই তার জীবনে অনেক ভুল করে। কিন্তু আনন্দময় ভুল প্রায় কখনোই করে না। আমি করলাম। তার জন্যে কি তোমরা আমাকে ত্যাগ করবে… এই রকম চিঠি লেখার মানে কি? আপা এমন কি ভুল করবে যার জন্যে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীর সবাই ভুল করতে পারে, আপা পারে না। তারপরও যদি কোন ভুল করে থাকে তাহলে কি সেই ভুল? ভুলের ব্যাপারটা সে স্পষ্ট করে বলছে না কেন? নিরিবিলি বাড়ির সামনে দুটি আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টগর এবং নিশার জন্যে এই গাড়ি দুটি হচ্ছে ফরিদের উপহার। তারা আইসক্রীম খেতে চেয়েছে- ফরিদ দুগাড়ি আইসক্রম এনে বলেছে, খাও যত খাবে। আইসক্রিীম খাওয়া চলছে। খানিকটা মুখে দিয়েই— থু করে ফেলে দিতে আরেকটি হাতে নিচ্ছে। সারা মেঝেতে আইসক্রিমের স্তূপ। ঠাণ্ডায় দুজনেরই মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। পুতুল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল। তার কেন জানি এই দৃশ্য দেখতে বড় ভাল লাগছে। গভীর আনন্দবোধ হচ্ছে। কে জানে কি এই আনন্দের উৎস। তার নিউ মার্কেটে যাবার কথা ছিল তা না গিয়ে সে দোতলায় আনিসের ঘরে চলে গেল। আনিস মাথা নিচু করে একমনে কি যেন লিখছিল। মাথা না তুলেই বলল, ভেতরে এসো পুতুল। পুতুল ঘরে ঢুকল। বসল খাটের এক প্রান্তে। কেমন আছ? ভাল। এমদাদ সাহেব এসেছিলেন, বললেন তোমার না-কি বিয়ে। পুতুল কিছু বলল না। আনিস বলল, খবরটার মধ্যে একটা কিন্তু আছে বলে আমার ধারণা। আমি দূর থেকে যতদূর দেখেছি আমার মনে হয়েছে ডাক্তার এবং মিলির বিয়েটাই অবশ্যম্ভাবী। মাঝখান থেকে তুমি কি করে এলে বলতো? আমি আসি নাই। তাই না-কি? আনিস লেখা বন্ধ করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মাথা নিচু করে বসে থাকা গ্ৰাম্য বালিকাটিকে আজ কেন জানি আর গ্ৰাম্য বালিকা বলে মনে হচ্ছে না। পুতুল। জি। এসো চ খেতে খেতে দুজন খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি। পুতুল সঙ্গে চা বানাতে বসল। আনিস চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছে পুতুলের দিকে। সে চায়ের পানি গরম করছে। কেরোসিন কুকারের লালচে আভা এসে পড়েছে তার মুখে। সুন্দর লাগছে দেখতে। একটা মানুষকেই একেক পরিবেশে একেক রকম লাগে। পুতুল, তুমি কি টগর এবং নিশার কাণ্ড দেখেছ? দুজন দুগাড়ি আইসক্রীম নিয়ে বসেছে। পুতুল কিছু বলল না। মনে হল সে অন্য কিছু ভাবছে। জটিল কিছু যার সঙ্গে টগর নিশার তুচ্ছ কর্মকাণ্ডের কোন মিল নেই। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সে গভীর সমুদ্রে পড়েছে। কিছু ভাবছ পুতুল? জি। নিজের ভাবনার কথা কাউকে বলা ঠিক না। তবে তুমি যদি আমাকে বলতে চাও তাহলে বলতে পার। বলতে চাই। আপনাকে অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বলব। হঠাৎ করে আজ কেন? পুতুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চায়ের কাপ আনিসের সামনে রাখতে রাখতে প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই। এই কথাটা আমি অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বললাম। বলে যদি কোন অপরাধ করে থাকি ক্ষমা করবেন। পুতুল কিছুক্ষণ সরাসরি আনিসের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। আনিস স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তাকে এই জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি। আজকের সকালটা লেখালেখির জন্যে চমৎকার ছিল। বাচ্চারা পাশে নেই, কেউ হৈচৈ করছে না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বাতাসেও ফুলের মিষ্টি সৌরভ। সম্পূর্ণ অন্য রকম এটা সকাল অথচ সকালটা এক মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেছে। আনিস ভেবে পেল না কি করা উচিত। সে কি চুপ করে থাকবে? না-কি পুতুলকে ডেকে বুঝিয়ে বলবে? মনে হচ্ছে বুঝিয়ে বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু কি বলবে সে পুতুলকে? অন্ধ আবেগ কোন যুক্তি মানে না। চুপ করে থাকাই বোধ হয়। ভাল। বাচ্চা একটি মেয়ে তার প্রতি এ জাতীয় আবেগ লালন করছে তা বুঝতে তার এত সময় লাগল কেন? অনেক আগেই তো ব্যাপারটা তা চোখে পড়া উচিত ছিল। সেও কি অন্ধ? আনিস কি ঘরে আছ? আনিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফরিদ মামা ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে কেমন যেন বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে, যেন জীবনের ভীত নড়ে গেছে। সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। ফরিদ নিষ্প্রাণ গলায় বলল। আশা করি আমার সাম্প্রতিক উত্থানের সংবাদ শুনেছ। জ্বি শুনেছি। এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নানান ধরনের পরিবর্তন আমার মধ্যে হয়েছে। প্রথম পরিবর্তন কথাবার্তায় প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করছি। কেন করছি সেটাও একটা রহস্য। দ্বিতীয় পরিবর্তন রাতে ঘুম হচ্ছে না। ঘুম হচ্ছে না কেন? জানি না কেন। নিঘুম রাত পার করছি। গত রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমালাম তাও ভাল ঘুম হল না।
false
shirshendu
বীণা বলল, ভিতরে আসবে কি? নাকি নষ্ট মেয়ের ঘরে ঢুকলেও তোমার জাত যাবে! এই চিমটি-কাটা কথাটার জবাব দিল না নিমাই। জুতো ছেড়ে সে ঘরে ঢুকল। সেই আগের মতোই সব আছে। তবে দৈন্যদশাটা আজ চোখে পড়ল নিমাইয়ের। বোধ হয় সে নিজে আজকাল ভাল থাকে বলে এ ঘরটার দারিদ্র্য তার বেশি করে চোখে লাগছে। বিছানার একাধারে সন্তৰ্পণে বসিল নিমাই। কিছু বলল না। বীণা জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বলল, একটা খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল। আচমকা দেখে আমি এত চমকে গেছি যে, বুকটা ধড়াস-ধড়াস করছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চমকে গেলে কেন? তুমি কখনও আসবে বলে ভাবিনি তো! মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল নিমাইয়ের। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অম্বলটা কি খুব হচ্ছে নাকি আজকাল? হ্যাঁ। আজকাল যেন জলও সহ্য হয় না। খুব খালি পেটে থাকো বোধ হয়? এ কথাটার জবাব দিল না বীণাপাণি। জবাবের দরকারও নেই। মেয়েরা একা হলে খাওয়াদাওয়ার ঠিক থাকে না। নিজের জন্য কে আর কষ্ট করে, এরকম একখানা ভাব নিয়ে হয়তো একবেলা রান্নাই চড়াল না। খিদে পেলে চা খেয়ে খিদে মেরে দিল। ঠাকুরের আসনের দিকে চেয়ে দেখছিল নিমাই। মেলা পট আর ছবি গাদাগাদি করে রাখা। সামনে ফুল, বাতাসা, জল, নিবে-যাওয়া ধূপকাঠির দানি। পুজোআচ্চা করো বুঝি আজকাল? ও আমার পুতুলখেলা। নিমাই একটু হাসল। চারদিকে চেয়ে দেখে বলল, মেঝেটা এর মধ্যেই ফেটেফুটে গেছে দেখছি। হ্যাঁ। গাঁথনি তো তেমন নয়। ইট পেতে সিমেন্টের পলেস্তারা দিয়েছিলাম। ও কি টেকে? ঠাণ্ডা জল আছে? এ কথায় বীণা একটু শিউরে উঠল যেন। চাপা গলায় বলল, এ মা! ছিঃ ছিঃ! তোমাকে জলই দিইনি। বলেই আবার থমকাল, আমার হাতে খাবে তো জল? কেন, দোষ হবে নাকি? হবে না! আমি তো নষ্ট মেয়ে। নিমাই কিছু বলল না। বুকটা ব্যথিয়ে আছে। বীণা একটানা স্টিলের পরিষ্কার গেলাসে মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে দিল। জলটা খেয়ে নিমাই বলল, ডান হাতের আংটিটা কোথায়? নতমুখী বীণা একটু চুপ করে থেকে, খুব চাপা গলায় বলল, গত মাসে বেচিতে হয়েছে। নিমাই থম ধরে রইল। বিয়ের সময় তারা অনেক কষ্ট করে ওই আংটিটাই নতুন বউকে দিতে পেরেছিল আশীৰ্বাদ হিসেবে। অল্প সোনার পলকা আংটি। বীণা যখন জল দিত, ভাত দিত। তখন বরাবর নজরে পড়েছে নিমাইয়ের। চা করবো? নিমাই একটু ভেবে বলল, করতে পারো। তবে শুধু এক কাপ। আমি খাবো। তুমি খাবে না। বীণা একটু হাসল। বলল, তাই হবে। কিন্তু চা-পাতা ভাল নয়। তোমার ভাল লাগবে না। সস্তা চা তো। আমার কি বাছাবাছি আছে? নেশাও নেই। তবু করো একটু। বীণা চায়ের সঙ্গে দুখানা বিকুটিও দিতে পারল না। কোনওদিন বিস্কুট ছাড়া চা দেয়নি। আজ ভিতরে ভিতরেও বীণাপাণি ক্ষয়ে গেছে। অহংকারটুকু কি আছে এখনও? সেটাই ধরতে পারছে না। নিমাই। পোড়া কপালের কথা হল, তার নিজের চোখটাই আজ বড় ঝাঁপসা। বড় কষ্ট হচ্ছে বীণার জন্য। এ তার বউ ছিল বটে, কিন্তু আজ যেন মাঝখানে গহীন সমুদ্দুর। চা করার সময়টুকু একটু ফাঁক পেল নিমাই। কী বলার আছে বীণাকে তার? কিছুদিনের সম্পর্কহীনতায় তারা কি পরস্পরের কাছে পর হয়ে গেছে। আড় ভাঙছেনা। লজ্জা-লজ্জা করছে। কথা আসছে না। কমদামী চা-পাতা দিয়ে খুব যত্নে চা করে আনল বীণা।নিমাই বসে বসে চা খেল। খারাপ লাগল না। চা শেষ করে বলল, একটা কথা বলতে আসা। বলো। সজলবাবু একটা দল খুলতে চান। টাকার জন্য ঘোরাঘুরি করছেন। তোমার মত আছে বলে বলছেন। এমন কথাও বলছেন যে, আমাকে সেই যাত্ৰাদলের অর্ধেক হিস্যাদার করে দেবেন। সভয়ে বীণাপাণি বললে, মা গো! এত মিথ্যে কথাও বলতে পারে মানুষ! উনি যে সত্যি কথা বিশেষ বলেন না তা বুঝতে পারছি। সেইজন্যই তোমার কাছে যাচাই করে গেলাম। আর কী বলেছে? ওইসব পুরনো কথাই। ও বোধ হয় আমার নামে তোমার কাছে দুর্নােমও করে, তাই না? না তো! সজলবাবু তোমার খুব প্রশংসাই করেন। ওর কোন কথাই বিশ্বাস কোরো না। কিছু করার জন্য এত মারিয়া হয়ে উঠেছে যে ওর বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ও কি তোমার কাছে আসে? না, আমি ওকে আর বিশ্বাস করি না। আসতে বারণ করে দিয়েছি। মানুষটা খারাপ নন। তবে অভাবে স্বভাব নষ্ট। ওকে টাকা পয়সা দিও না। নষ্ট করবে। বড্ড নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে আছেন পেছনে। কী যে করি। চক্ষুলজ্জা বলেও তো কথা আছে। চক্ষুলজ্জা! বলে বীণাপাণি রাগের গলায় বলল, চক্ষুলজ্জায় পড়ে একটা জোচ্চোরকে টাকা দেবে! এসব কী কথা! নিমাই খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, আমি বড় দুর্বল মানুষ বীণা। লোক বিপদে পড়ে এলে আমার নিজের অতীতের কথা মনে হয়। ভাবি, কিছু সাহায্য করলে হয়তো এ লোকটা দাঁড়িয়ে যাবে। বীণা তার দিকে একটু রুষ্ট চোখে চেয়ে বলল, দয়াদাক্ষিণ অনেক দেখাতে পারবে। কিন্তু তার জন্য সজল কেন? নিমাই বীণার চোখে চোখ রাখল। অনেকক্ষণ। তারপর বলল, আমাকে পাহারা দেবে কে বীণা? বীণা মাথা নত করল। ফের জানালার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজ তোমার রান্নার জোগাড় তো কিছু দেখছি না! ক্ষীণ কণ্ঠে বীণা বলল, এখনও তো বেলা হয়নি। মোটে দশটা বাজে। আরও পরে রান্না চড়াই। আজি কী রাঁধবে? কেন, তুমি খাবে? খেলে? রাঁধব। যা চাও রাঁধব। নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলল, দোকানপাটে ধারদেনা কত আছে? বীণা একটু চুপ করে থেকে
false
shunil_gongopaddhay
নিয়ে কি সে জাপানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতে পারত? জাপানিরা অতি ভদ্র হয়। তা হলে নিশ্চয়ই হঠাৎ কোনও কারণে টোবি দত্তর স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছে। এমনও হতে পারে, মাথার গোলমাল হওয়ার পর থেকেই তার সব পুরনো কথা মনে পড়ে গেছে। এখানকার লোকেরা এক সময় তার ওপর কত খারাপ ব্যবহার করেছিল, সেইসব ভেবে-ভেবে রাগে ফুঁসতে থাকে। অনিবার্ণ বলল, রাগ জিনিসটা কিন্তু মানুষের খুব ক্ষতি করে। কাকাবাবু বললেন, মাঝে-মাঝে রেগে ওঠা ভাল। সব সময় ভাল নয়। সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও রাগ করতেন? কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই করতেন। হয়তো রেগে চঁচামেচি করতেন না। ভেতরে-ভেতরে ফুঁসতেন। ওঁর একটা কবিতা আছে, নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস … সেটা পড়লেই মনে হয়, লেখার সময় উনি খুব রেগে ছিলেন। অনির্বাণ বলল, আর তো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড়বড় ঝোপ ঠেলে গাড়ি চালানো মুশকিল। কাকাবাবু ঝুঁকে দুপাশ দেখে বললেন, এখানেও কিছু কিছু গাছের ডাল কাটা হয়েছে। আলোটা এদিকেই আসে। তুমি যতদূর পারো চালাও। তারপর নেমে পড়তে হবে। অনির্বাণ বলল, জঙ্গলে আর কিছুই তো দেখা গেল না এ পর্যন্ত। এদিকে আলো ফেলে কী দেখাতে চায় টোবি দত্ত? কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, হয়তো শেষপর্যন্ত দেখা যাবে কিছুই নেই। তখন যেন আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ো না। ভুল তো হতেই পারে। এটা আমার একটা থিয়োরি। একটু বাদে জিপটা থেমে গেল। জল-কাদায় চাকা পিছলে যাচ্ছে, সামনে বড়বড় ঝোপ। অনির্বাণ বলল, আর বোধ হয় সামনে এগিয়ে লাভ নেই। আজকের মতন এখান থেকেই ফেরা যাক। কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, নেমে পড়ো, নেমে পড়ো! তিনিই প্রথম নেমে একটা পেন্সিল টর্চ জ্বাললেন। কাছেই একটা গাছের সদ্য কাটা ডাল পড়ে আছে। ডালটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, হ্যাঁ, এইদিকেই এগোতে হবে। ঝোপঝাড় ঠেলে-ঠেলে যেতে কাকাবাবুরই অসুবিধে হচ্ছে বেশি। তবু তিনি যাচ্ছেন আগে-আগে। অনির্বাণ বলল, এই সময় যদি একটা হাতির পাল এসে পড়ে? সন্তু বলল, তা হলে আমাদের খুঁড়ে তুলে লোফালুফি খেলবে! কাকাবাবু বললেন, কোনওক্রমে যদি একটা হাতির পিঠে চেপে বসতে পারিস, তা হলে হাতিটা আর তোকে নামাতে পারবে না। অনির্বাণ বলল, অত সহজ নয়। হাতিটা তখন একটা বড় গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঘষবে। তাতেই চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাব! সন্তু বলল, সামনে একটা আলো! কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে টর্চ নিভিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ, কেউ শব্দ কোরো না। ঝোপঝাড়ের আড়ালে, বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে মিটমিটে আলো। সেই আলোর আশেপাশে কী আছে, তা দেখা যাচ্ছে না। কোনও শব্দও নেই। একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা টিপে টিপে এগোতে লাগল। কাকাবাবু মাঝে-মাঝে মাটির দিকে টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখে নিচ্ছেন। আরও খানিকটা যাওয়ার পর চোখে পড়ল একটা ভাঙা বাড়ি। প্রায় ধ্বংসস্তৃপই বলা যায়। কোনও এক সময় হয়তো কোচবিহারের রাজারা এখানে এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে শখের বিশ্রাম ভবন বানিয়েছিলেন। এখন ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কেউ খবরও রাখে না। বাড়িটার একটা কোণ থেকে আলোটা আসছে। কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্ত তা হলে এই বাড়িটাকেই দেখায়। অনির্বাণ বলল, এইরকম একটা ভাঙা বাড়ি দেখাবে কী জন্য? আলো জ্বলছে যখন, সাধারণ চোর-ডাকাতদের আখড়া হতে পারে। তার জন্য ওর এত আলোটালো ফেলার কী দরকার? কাকাবাবু বললেন, ধরো, যদি তোমাদের ইউ এফ ও কিংবা উড়ন্ত চাকির অদ্ভুত প্রাণীরা এখানে বাসা বেঁধে থাকে? অনির্বাণ বলল, উড়ন্ত চাকি যে আসেনি, তা তো প্রমাণ হয়ে গেছে। কাকাবাবু বললেন, কিছুই প্রমাণ হয়নি। কারা এই ভাঙা বাড়িতে আলো জ্বেলেছে, তা না দেখা পর্যন্ত সবটা বোঝা যাবে না। কাকাবাবু আবার এগোতে যেতেই অনির্বাণ তাঁকে বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়ান। ওর ভেতরে ঠিক কতজন আছে তার ঠিক নেই। আমরা মাত্র তিনজন। এক কাজ করা যাক, আমরা এখন ফিরে যাই। তারপর পুলিশ ফোর্স নিয়ে আবার এসে পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলব। কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ফিরে যাব? ভেতরটা দেখার এত ইচ্ছে হচ্ছে, ফিরে এসে যদি কিছুই না পাই! ততক্ষণে যদি সব ভোঁ-ভাঁ হয়ে যায়? তুমি বরং ফিরে যাও অনির্বাণ। আরও পুলিশ ডেকে আনন। আমি আর সন্তু এই দিকটা সামলাই ততক্ষণ। অনির্বাণ বলল, অসম্ভব! আপনাদের দুজনকে ফেলে রেখে আমি চলে যেতে পারি? আমিও তা হলে এখানে থাকব। দুপুরবেলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল খানিকক্ষণ। তারপর আকাশ একেবারে পরিষ্কার। বেশ কয়েকদিন পর ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা গেল। হেডমাস্টারমশাই ইস্কুল থেকে ফেরার পর সবাই মিলে বারান্দায় চা খেতে বসলেন। কথায়-কথায় হেডমাস্টারমশাই বললেন, দিনহাটার একটা ইস্কুলে কে একজন লোক দু লক্ষ টাকা দান করেছে। হঠাৎ এত টাকা পেয়ে সবাই অবাক! টাকাটা কে দিয়েছে, তা জানা যাচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, ত্যাপা নামে একটি গরিবের ছেলে একসময় ওই ইস্কুলে পড়ত। বিদেশে গিয়ে সে খুব বড়লোক হয়েছে। খুব সম্ভবত টাকাটা সে-ই দান করেছে! হেডমাস্টারমশাই বললেন, আমাদের গ্রামের টোবি দত্তও তো খুব বড়লোক। তার মামাদের অত বড় বাড়িটা কিনেছে। আমাদের ইস্কুলের বাড়িটা সারানো দরকার, সে কিছু টাকা দিলে পারত! দিয়েছে মোটে পাঁচ হাজার টাকা! মণিকা গরম-গরম বেগুনি আর পেঁয়াজি ভেজে এনেছে মুড়ির সঙ্গে। তোফা খাওয়া হল। মণিকা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু আজ সন্ধেবেলা কী করা হবে? মিলিটারির সেই সাহেব আসবেন? কাকাবাবু বললেন, ঠিক জানি না। কোনও খবর পাইনি। মণিকা বলল, আজ কিন্তু আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। সকালে আপনারা
false
humayun_ahmed
এসেছি। এত সুন্দর দৈ হয় বলার না। আমি আমেরিকায় ফিরে যাবার সময় তোকে দিয়ে যাব। আমি ঐ যন্ত্র দিয়ে কী করব? দৈ বানাবি। এরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে দেখে মনে হচ্ছে দৈ বানানো ভয়ংকর কোনো কাজ। বোমা বানানোর মত। অনেকটা সে রকমই। খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুতি প্ৰযুক্তির পেছনে সময় নষ্ট করা আমার জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সে ইচ্ছা করলে ভিক্ষা করে খাবে। কিন্তু হাড়ি পাতিল নিয়ে রান্না করতে বসবে না। ফজিলামি ধরনের কথা বলবি না তো হিমু। আমার অসহ্য লাগে। আয় দৈ কী করে বানাতে হয় দেখে শিখে রাখ। দুপুরে হালকা ধরনের কিছু করব। ভাত টেংরা মাছ টাইপ। রাতে কিছু স্পেশাল ডিশ। রাজস্থানের এক মহিলার কাছ থেকে চিকেনের একটা প্রিপারেশন শিখেছি। অপূর্ব। গ্ৰীন চিকেন। লাউ পাতা বেটে সবুজ রঙের একটা পেষ্ট করা হয়। সেই পেদ্ষ্টে ভিনিগার মিশিয়ে আস্ত মুরগী মাখিয়ে স্টীম করা হয়। মুরগী স্টীম হতে থাকবে এই ফাঁকে আরেকটা পেষ্ট বানাতে হবে। পোস্তা বাটা এবং বাদাম বাটার পেস্ট। রান্না বান্নার এইসব কথা শুনতে একটুও ভাল লাগছে না। তোর খালুর জ্ঞানের কথার চেয়ে রান্না বান্নার কথা শেখা অনেক ভাল। চুপ করে শোন। পোস্তা বাটা এবং বাদাম বাটার পেষ্টের সঙ্গে মিশাবি পেয়াজের রস। তারপর স্টীম মুরগীটার গায়ে এই পেষ্ট মাখাবি। বেসন যে ভবে মাখায় সেই ভাবে। হুঁ তারপর। এখন শুনতে মজা লাগছে না? খুবই মজা লাগছে। তারপর বলো— খুব পাতলা কাপড় দিয়ে মুরগীটাকে জড়াবি। সুতা দিয়ে পেঁচাবি যেন কাপড় সরে না যায়। মমীর মত আষ্টে পৃষ্ঠে কাপড় দিয়ে মুড়ানো? হুঁ। এই ভাবে ডীপ ফ্রীজে রেখে দিবি আধা ঘন্টা। লে হালুয়া। এই মুরগী কি ঠাণ্ডায় রান্না হবে? মোটেই ঠাণ্ডায় রান্না হবে না। ডীপ ফ্রীজে রাখা হয়েছে পেস্টটাকে জমাট বাধানোর জন্যে। ও আচ্ছা ৷ আধাঘন্টা পর ডীপ ফ্ৰীজ থেকে মুরগীটা তুলে ডুবন্ত ঘিতে ভেজে ফেলবি। কাপড় শুদ্ধ? অবশ্যই কাপড় শুদ্ধ। খাব কী ভাবে? কাপড়ও খাব? খাবার সময় কাপড় খুলে নিয়ে খাবি। এই জিনিসই কি আজ হচ্ছে? হ্যাঁ এই জিনিসই হচ্ছে। তুই চোখ এমন কপালে তুলে ফেললি কেন? মুরগী তো আর তোকে রান্না করতে হচ্ছে না। আমি রান্না করব। রান্নার সময় তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তোমার পাশে থাকতে বলবে না? না বলব না। তুই বরং টিভি দেখিস। এর মধ্যে তোর খালু সাহেব চলে আসবে। তার সঙ্গে গল্প করবি। কলিংবেল বেজে উঠল। মালু খালা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, দরজা খুলে দে তো হাদি এসেছে। আমি বললাম, বুঝলে কী করে হাদি। খালু সাহেবও তো হতে পারেন। খালা বললেন, ভক ভক করে রসুনের গন্ধ আসছে। সেখান থেকে বুঝেছি। হাদির গা থেকে রসুনের গন্ধ আসে। তুই রাসুনের গন্ধ পাচ্ছিস না? না। আমি পাচ্ছি। ভকভক করে গন্ধ আসছে। বুঝলি হিমু আমার সিক্সথ সেন্স বলছে আমার মৃত্যু হবে হাদি ব্যাটার হাতে। কেমন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকায়। তোমাকে সে খুনটা করবে। কেন? মোটিভ কী? এখানের সবকিছু দেখাশোনা করে সে। সে কিছু একটা গণ্ডগোল করে রেখেছে। আমাকে মেরে ফেললে গণ্ডগোলটা চোখে পড়বে না। . আমি দরজা খুললাম। খালু সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। নিউ অর্লিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক আরেফিন সাহেব। ভদ্রলোক শুধু যে জ্ঞানী তা না, তার চেহারাও জ্ঞানী জ্ঞানী। তাকে দেখলেই মনে হয় জ্ঞানের ঝকঝকে নতুন ডিকশনারী। তার চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি। বাইরে থেকে ঘুরে এসেছেন। অথচ তার পাঞ্জাবির ইস্ত্রী এতটুকু নষ্ট হয়নি। কেমন আছেন খালু সাহেব। ভাল আছি হিমু সাহেব। দেশে ফিরে তোমাকে না পেয়ে তোমার খালার প্রায় মাথা খারাপ হবার মত জোগাড় হয়েছিল। এখন আশাকরি তার মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে। বলতে বলতে খালু সাহেব হাসলেন। সেই হাসিও দেখার মত জ্ঞান ঝরে ঝরে পড়ছে। হিমু! জি। এসো বসো আমার সঙ্গে। গল্প করি। খালা বললেন, গল্প পরে করবে। আমি এখন রান্না করছি ও আমার পাশে থেকে রান্না দেখবে। আরেফিন খালু হাসিমুখে বললেন— আচ্ছা ঠিক আছে। দেখুক। বুঝলে হিমু রান্না হচ্ছে মেয়েদের কাছে একটি শিল্প কৰ্ম– , কোনো সৃষ্টিশীল কাজ যখন কেউ করে তখন কাউকে না কাউকে পাশে লাগে যে সেই কাজ এপ্রিশিয়েট করবে। কাজেই তুমি তোমার খালার পাশে থাক। মাঝে মধ্যে আমার কাছে কিছুক্ষণের জন্যে বসতে পাের। রান্না বিষয়ক কিছু মজার তথ্য আমার কাছে আছে। হয়তোবা তোমার ভাল লাগবে। আমি আমার সময়টা তিন ভাগে ভাগ করলাম। কিছুক্ষণ খালার সঙ্গে থাকি। তার রান্না দেখি। কিছুক্ষণ হাদি সাহেবের সঙ্গে থাকি। হাদি সাহেব মিস্ত্রী নিয়ে চলে এসেছেন, তারা দুজন ফ্যান নামাচ্ছেন। এদের কাজ কর্ম দেখি। তারপর যাই আরেফিন সাহেবের কাছে। মুগ্ধ হয়ে আরেফিন সাহেবের গল্প শুনি–বুঝলে হিমু। রান্না মাত্র তিন রকম, পোড়া ভাজা সিদ্ধ পৃথিবীর যাবতীয় রান্না এই তিনের পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন। রান্নার সবচে আদি রেসিপি বইটা কোথায় পাওয়া গেছে জান? জ্বি না। মিশরের পিরামিডের ভেতর। সমাধিকক্ষে। ফারাওদের খাবারের রেসিপি। সেই রেসিপি কি আছে। আপনার কাছে? হ্যাঁ আছে। তোমার খালাকে বলেওছিলাম রেসিপি দেখে রান্না করতে। মিশরের ফারাওদের খাবার খেয়ে দেখি। সে রাজি হয়নি। রাজি হননি কেন? রেসিপিটা হল ময়ুর রান্নার। পাখা শুদ্ধ আস্ত ময়ুর রান্না করা হয়। সেই ময়ুর খাবার টেবিলে এমন ভাবে সাজানো হয় যেন মনে হয়
false
nihar_ronjon_gupta
অনন্য আমতা আমতা করে বললে। হ্যাঁ— মনে নেই—মনে নেই। মনে করতে পারছি না তো কিছু। বিশ্বাস কর বিপাশা—আমি— বিপাশা অনন্যর হাত ধরে সোফাটার উপরে এনে বসাল আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে। অনন্য— বল। একটা কথার জবাব দেবে? কি কথার জবাব চাও? বল আগে যা জিজ্ঞাসা করব তার সত্য জবাব দেবে। দেব, বল এবারে কি তোমার প্রশ্ন, অনন্য বলল। তোমার মার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল? কেন তুমি তো জান, একটা দুর্ঘটনায়। কি সে দুর্ঘটনা? আমি তখন ছোট ছিলাম—তোমায় তো বলেছি। ছোট থাকলেও নিশ্চয়ই শুনেছ পরে—কারও না কারোর মুখে—সত্যি কি হয়েছিল, কি কারণে তার মৃত্যু হল? না—শুনিনি। শোন নি? না, না—কেন এক কথা বার বার জিজ্ঞাসা করছ বিপাশা। বলছি তো শুনিনি। আমি জানতে চাই—কি এমন দুর্ঘটনায় তোমার মার মৃত্যু হয়েছিল যাতে করে তোমার বাবা। পাগল হয়ে গেলেন, পরেশ হয়ত জানে– জানি না। দেখ আমি জানলে তো বলব। জানি না। কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ অনন্য কেমন। যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বাকি রাতটা কেউ আর কারও সঙ্গে কথা বললে না। দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রইল। বাইরে রাত ঝিমঝিম করতে থাকে। সকালবেলা—বেলা তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে দ্বিতীয় কাপ চায়ের আস্বাদ গ্রহণ করছিল, পাশে বসে সুব্রত। জংলী এসে বললে, মল্লিক সাহেব এসেছেন। কে? সুদর্শন? যা নিয়ে আয়। একটু পরে জংলীর পিছনে পিছনে এসে ঘরে প্রবেশ করল সুদর্শন। আরে এস, এস ভায়া—তারপর বল কি খবর, অনেক দিন পরে এলে। সুদর্শন বসতে বসতে বললে, আপনি তো দাদা আজকাল বড় একটা কারও সঙ্গে দেখাই করেন না শুনতে পাই। কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে। সুদর্শন বললে, তাই অযথা বিরক্ত করতে আসি না। বুঝতে পারছি, তা সাবিত্রীর খবর কি? সে যথারীতি সংসার আর ছেলে নিয়ে আছে—সামনের বছরে ছেলেকে ভর্তি করতে হবে, কোথায় কেমন করে ভর্তি করবে সেটাই এখন তার সর্বক্ষণের চিন্তা। হ্যাঁ—আজকাল ছেলেমেয়েদের পড়ানো যা একটা প্রবলেম হয়েছে। তা তোমার হঠাৎ আগমনের হেতুটা কি বল? দিনপাঁচেক আগে একটা নিউজ বের হয়েছে কাগজে, দেখেছেন কিনা জানি না। পার্ক স্ট্রীটের একটা ম্যানসননীলাকাশ নাম, তার চারতলার ফ্ল্যাট থেকে– মনে পড়ছে না, তা কি সুইসাইড বুঝি— তাহলে তো গণ্ডগোল মিটেই যেত। সুদর্শন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলে গেল কিরীটীকে। সব শোনার পর কিরীটী বললে, তাহলে তোমার ধারণা—ব্যাপারটার মধ্যে কোন ফাউল প্লে আছে। হ্যাঁ—আমার মনে হচ্ছে, ওটা আদৌ সুইসাইড নয়— হোমিসাইড! হ্যাঁ—আমার মনে হয়, রজতবাবুকে ঐ কালো কর্ডের ফাঁস গলায় দিয়ে হত্যা করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হুঁ। তা তোমাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কি বলছে? মৃত্যুর কারণ কি বলছে রিপোর্টে? গোলমালটা তো দাদা সেখানেই। কি রকম! ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলছে—ফ্রাকচার অফ দি বেস-স্কালই নাকি মৃত্যুর কারণ—কজ অব ডেথ। আর ঐ গলার ফাঁসটা? বলছে তাদের মতে, ঐ সরু কৰ্ডটা গলায় চেপে বসলেও সেটা নাকি মৃত্যুর কারণ নয়–কারণ– কি? কোন অ্যাসফেসিয়ার চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি মৃতদেহে। কিরীটী বললে, তা কেসটা যে একটা মার্ডার—গলার ঐ কালো কর্ডের ফসটি ছাড়া আর কোন যুক্তি তোমার আছে কি? উপর থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেহের ইনজুরি আরও বেশী থাকত অর্থাৎ যে রকম পাওয়া যেত তাও পাওয়া যায়নি। আর চারপাশে রক্তও বেশী থাকত। হুঁ। আর কিছু— তারপর ধরুন দাদা, মৃত্যু ঘটেছে, রিপোর্ট বলছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময়ে। এবং তাই যদি হয় তো ঐ সময় ঐ অত বড় ফ্ল্যাটবাড়িটার মধ্যে কেউ কি এমন জেগে ছিল না যারা একটা মানুষের দেহ অত উঁচু থেকে নীচে পড়লে যে শব্দটা হওয়া স্বাভাবিক সেই রকম একটা শব্দ শুনতে পেত না! অথচ আমি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, সেরকম কোন শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। ব্যাপারটা কি বেশ একটু সন্দেহজনক নয়? তা তো ঠিকই। ধরেই নিলাম না হয়, আবার সুদর্শন বলতে লাগল, ব্যাপারটা একটা সুইসাইড—কিন্তু লোকটা হঠাৎ দুতিন দিনের ছুটি নিয়ে এসে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইসাইড করতে গেল কেন? সরিবাবু ও তার বোন বকুল দেবীর স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, বিবাহের দিন ঠিক করবার জন্যই সে আম্বালা থেকে এসেছিল—সেক্ষেত্রে বকুল দেবীর সঙ্গে দেখা হবার আগেই এমন কি ঘটে গেল যাতে করে তাকে ঐভাবে আত্মহত্যা করতে হল শেষ পর্যন্ত! সুদর্শন থামে না। বলে চলে, অনন্য বক্সী ও তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর কথাটা তো ভুললে চলবে না—রজতবাবুর সঙ্গে একসময় বিপাশার ঘনিষ্ঠতা ছিল—এক পাড়ায় পাশাপাশিই বলতে গেলে বাড়িতে ওরা থাকত। আচমকা অনন্য বক্সী ওদের মাঝখানে এসে পড়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল—অনন্য বক্সীর সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিপাশার বিয়ে হয়ে গেল। তুমি বলতে চাও, সেখানেও কোন গোলমাল থাকতে পারে— পারে না কি! আপনিই বলুন! খবর নিয়েছিলে এবারে কলকাতায় আসার পর বিপাশা ও রজতবাবুর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা? কিরীটী বললে। না—এখনও খবর নিইনি। কেন নিলে না? আমি এখনও অনুসন্ধান চালাবার মত কোন একটা নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাইনি। আর সেই কারণেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি– কিরীটী একটু চুপ করে থেকে বললে, সুদর্শন, তোমার মুখ থেকে কেসটা সম্পর্কে যতটুকু শুনলাম তাতে আমার মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা ফাউল প্লে থাকা হয়ত বিচিত্র নয়। তুমি আপাতত এক কাজ কর। বলুন দাদা–সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল
false
robindronath
তন্ন-তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিল। এই-সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া মা আর থাকিতে পারিলেন না— তিনি সাহেবের সামনেই বাহির হইয়া ব্যাকুল হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওরে হরলাল, কী হইল রে।” হরলাল কহিল, “মা, টাকা চুরি গেছে।” মা কহিলেন, “চুরি কেমন করিয়া যাইবে। হরলাল,এমন সর্বনাশ কে করিল!” হরলাল কহিল, “মা, চুপ করো।” সন্ধান শেষ করিয়া সাহেব জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে রাত্রে কে ছিল।” হরলাল কহিল, “দ্বার বন্ধ করিয়া আমি একলা শুইয়াছিলাম— আর-কেহ ছিল না।” সাহেব টাকাগুলা গাড়িতে তুলিয়া হরলালকে কহিল, “আচ্ছা, বড়োসাহেবের কাছে চলো।” হরলালকে সাহেবের সঙ্গে চলিয়া যাইতে দেখিয়া মা তাহাদের পথ রোধ করিয়া কহিল, “সাহেব, আমার ছেলেকে কোথায় লইয়া যাইবে। আমি না খাইয়া এ ছেলে মানুষ করিয়াছি— আমার ছেলে কখনোই পরের টাকায় হাত দিবে না।” সাহেব বাংলা কথা কিছু না বুঝিয়া কহিল, “আচ্ছা, আচ্ছা!” হরলাল কহিল, “মা, তুমি কেন ব্যস্ত হইতেছ। বড়োসাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া আমি এখনই আসিতেছি।” মা উদ্‌বিগ্ন হইয়া কহিলেন, “তুই যে সকাল থেকে কিছুই খাস নাই।” সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া হরলাল গাড়িতে উঠিয়া চলিয়া গেল। মা মেজের উপরে লুটাইয়া পড়িয়া রহিলেন। বড়োসাহেব হরলালকে কহিলেন, “সত্য করিয়া বলো ব্যাপারখানা কী।” হরলাল কহিল, “আমি টাকা লই নাই।” বড়োসাহেব। সে কথা আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জান কে লইয়াছে। হরলাল কোনো উওর না দিয়া মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল । সাহেব । তোমার জ্ঞাতসারে এ টাকা কেহ লইয়াছে ? হরলাল কহিল, “আমার প্রাণ থাকিতে আমার জ্ঞাতসারে এ টাকা কেহ লইতে পারিত না ।” বড়োসাহেব কহিলেন, “দেখো হরলাল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়া কোনো জামিন না লইয়া এই দায়িত্বের কাজ দিয়াছিলাম। আপিসের সকলেই বিরোধী ছিল। তিন হাজার টাকা কিছুই বেশি নয় । কিন্তু তুমি আমাকে বড়ো লজ্জাতেই ফেলিবে। আজ সমস্ত দিন তোমাকে সময় দিলাম— যেমন করিয়া পার টাকা সংগ্রহ করিয়া আনো— তাহা হইলে এ লইয়া কোনো কথা তুলিব না, তুমি যেমন কাজ করিতেছ তেমনি করিবে ।” এই বলিয়া সাহেব উঠিয়া গেলেন । তখন বেলা এগারোটা হইয়া গেছে । হরলাল যখন মাথা নিচু করিয়া বাহির হইয়া গেল তখন আপিসের বাবুরা অত্যন্ত খুশি হইয়া হরলালের পতন লইয়া আলোচনা করিতে লাগিল। হরলাল একদিন সময় পাইল । আরো একটা দীর্ঘ দিন নৈরাশ্যের শেষতলের পঙ্ক আলোড়ন করিয়া তুলিবার মেয়াদ বাড়িল। উপায় কী, উপায় কী, উপায় কী— এই ভাবিতে ভাবিতে সেই রৌদ্রে হরলাল রাস্তায় বেড়াইতে লাগিল । শেষে উপায় আছে কি না সে ভাবনা বন্ধ হইয়া গেল , কিন্তু বিনা কারণে পথে ঘুরিয়া বেড়ানো থামিল না। যে কলিকাতা হাজার হাজার লোকের আশ্রয়স্থান তাহাই এক মুহূর্তে হরলালের পক্ষে একটা প্রকাণ্ড ফাঁসকলের মতো হইয়া উঠিল। ইহার কোনো দিকে বাহির হইবার কোনো পথ নাই। সমস্ত জনসমাজ এই অতিক্ষুদ্র হরলালকে চারি দিকে আটক করিয়া দাঁড়াইয়াছে। কেহ তাহাকে জানেও না, এবং তাহার প্রতি কাহারো মনে কোনোও বিদ্বেষও নাই, কিন্তু প্রত্যেক লোকেই তাহার শত্রু। অথচ, রাস্তার লোকে তাহার গা ঘেঁষিয়া তাহার পাশ দিয়া চলিয়াছে; আপিসের বাবুরা বাহিরে আসিয়া ঠোঙায় করিয়া জল খাইতেছেন, তাহার দিকে কেহ তাকাইতেছেন না ; ময়দানের ধারে অলস পথিক মাথার নীচে হাত রাখিয়া একটা পায়ের উপর আর-একটা পা তুলিয়া গাছের তলায় পড়িয়া আছে; স্যাকরাগাড়ি ভরতি করিয়া হিন্দুস্থানী মেয়েরা কালীঘাটে চলিয়াছে;একজন চাপরাসি একখানা চিঠি লইয়া হরলালের সম্মুখে ধরিয়া কহিল, “বাবু,ঠিকানা পড়িয়া দাও” — যেন তাহার সঙ্গে অন্য পথিকের কোনো প্রভেদ নাই; সেও ঠিকানা পড়িয়া তাহাকে বুঝাইয়া দিল। ক্রমে আপিস বন্ধ হইবার সময় আসিল। বাড়িমুখো গাড়িগুলো আপিসমহলের নানা রাস্তা দিয়া ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল । আপিসের বাবুরা ট্র্যাম ভরতি করিয়া থিয়েটারের বিজ্ঞাপন পড়িতে পড়িতে বাসায় ফিরিয়া চলিল । আজ হইতে হরলালের আপিস নাই, আপিসের ছুটি নাই, বাসায় ফিরিয়া যাইবার জন্য ট্র্যাম ধরিবার কোনো তাড়া নাই। শহরের সমস্ত কাজকর্ম, বাড়িঘর, গাড়িজুড়ি, আনাগোনা হরলালের কাছে কখনো-বা অত্যন্ত উৎকট সত্যের মতো দাঁত মেলিয়া উঠিতেছে, কখনো-বা একেবারে বস্তুহীন স্বপ্নের মতো ছায়া হইয়া আসিতেছে। আহার নাই,বিশ্রাম নাই, আশ্রয় নাই, কেমন করিয়া যে হরলালের দিন কাটিয়া গেল তাহা সে জানিতেও পারিল না । রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলিল— যেন একটা সতর্ক অন্ধকার দিকে দিকে তাহার সহস্র ক্রূর চক্ষু মেলিয়া শিকারলুব্ধ দানবের মতো চুপ করিয়া রহিল। রাত্রি কত হইল সে কথা হরলাল চিন্তাও করিল না । তাহার কপালের শিরা দব্‌ দব্‌ করিতেছে; মাথা যেন ফাটিয়া যাইতেছে ; সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলিতেছে ; পা আর চলে না । সমস্ত দিন পর্যায়ক্রমে বেদনার উত্তেজনা ও অবসাদের অসাড়তার মধ্যে মার কথা কেবল মনের মধ্যে যাতায়াত করিয়াছে— কলিকাতার অসংখ্য জনশ্রেণীর মধ্যে কেবল ঐ একটিমাএ নামই শুষ্ককণ্ঠ ভেদ করিয়া মুখে উঠিয়াছে— মা, মা,মা । আর-কাহাকেও ডাকিবার নাই । মনে করিল, রাত্রি যখন নিবিড় হইয়া আসিবে, কোনো লোকই যখন এই অতি সামান্য হরলালকে বিনা অপরাধে অপমান করিবার জন্য জাগিয়া থাকিবে না, তখন সে চুপ করিয়া তাহার মায়ের কোলের কাছে গিয়া শুইয়া পড়িবে— তাহার পরে ঘুম যেন আর না ভাঙে! পাছে তার মার সম্মুখে পুলিসের লোক বা আর-কেহ তাহাকে অপমান করিতে আসে এই ভয়ে সে বাসায় যাইতে পারিতেছিল না । শরীরের ভার যখন আর বহিতে পারে না এমন সময় হরলাল একটা ভাড়াটে গাড়ি দেখিয়া তাহাকে
false
shorotchandra
বন্দনা বাঁ হাত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, আসবো যদি আসার শক্তি থাকে,—পথ যদি থাকে তখনও খোলা, নইলে পারবো না ত আসতে মুখুয্যেমশাই। কথাটা শুনিয়া বিপ্রদাস যেন চমকিয়া গেল, বলিল, বটেই ত! বটেই ত! আসার পথ থাকে যদি খোলা,—চিরদিনের তরে যদি বন্ধ হয়ে সে না যায়। তখন এসো কিন্তু। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকো না। বন্দনা চোখের জল আবার মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, আমার একটি ভিক্ষে রইলো মুখুয্যেমশাই, আমার কথা যেন কাউকে বলবেন না। না, বলবো না। বলার লোক যে আমার নেই সে ত তুমি নিজেই জানতে পেরেচো। হাঁ পেরেচি। দুইজনে কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। বিপ্রদাস কহিল, এই বিপুল সংসারে আমি যে এতখানি একা এ কথা তুমি কি করে বুঝেছিলে বন্দনা? বন্দনা বলিল, কি জানি কি করে বুঝেছিলুম। আপনাদের বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এলুম, আপনি এলেন সঙ্গে। গাড়িতে সেই মাতাল সাহেবগুলোর কথা মনে পড়ে? ব্যাপারটা বিশেষ কিছু নয়—তবু মনে হলো যাদের আমরা চারপাশে দেখি তাদের দলের আপনি নয়,—একাকী কোন ভার কাঁধে নিতেই আপনার বাধে না। এই কথাই বলেছিলেন সেদিন দ্বিজুবাবু,—মিলিয়ে দেখলুম কারও কাছে কিছুই আপনি প্রত্যাশা করেন না। রাত্রে বিছানায় শুয়ে কেবলি আপনাকে মনে পড়ে—কিছুতে ঘুমোতে পারলুম না। শেষরাত্রে উঠে দেখি নীচে পূজোর ঘরে আলো জ্বলছে, আপনি বসেছেন ধ্যানে। একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে ভোর হয়ে এলো, পাছে চাকররা কেউ দেখতে পায়, ভয়ে ভয়ে পালিয়ে এলুম আমার ঘরে। আপনার সে মূর্তি আর ভুলতে পারলুম না মুখুয্যেমশাই, আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, দেখেছিলে নাকি আমাকে পূজো করতে? বন্দনা বলিল, পূজো করতে ত আপনার মাকেও দেখেচি, কিন্তু সে ও নয়। সে আলাদা। আপনি কিসের ধ্যান করেন মুখুয্যেমশাই? বিপ্রদাস পুনরায় হাসিয়া বলিল, সে জেনে তোমার কি হবে? তুমি ত তা করবে না! না করবো না। তবু জানতে ইচ্ছে করে। বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা কহিতে লাগিল, আমার সেইদিনই প্রথম মনে হয় সকলের মধ্যে থেকেও আপনি আলাদা, আপনি একা। যেখানে উঠলে আপনার সঙ্গী হওয়া যায় সে উঁচুতে ওরা কেউ উঠতে পারে না। আর একটা কথা জিজ্ঞেসা করবো মুখুয্যেমশাই? বলবেন? কি কথা বন্দনা? মেয়েদের ভালোবাসায় বোধ হয় আর আপনার প্রয়োজন নেই—না? এ প্রশ্নর মানে? মানে জানিনে, এমনি জিজ্ঞেসা করচি। এ বোধ হয় আর আপনি কামনা করেন না,—আপনার কাছে একেবারে তুচ্ছ হয়ে গেছে।—সত্যি কিনা বলুন। বিপ্রদাস উত্তর দিল না, শুধু হাসিমুখে চাহিয়া রহিল। নীচের প্রাঙ্গণে সহসা গাড়ির শব্দ শোনা গেল, আর পাওয়া গেল দ্বিজদাসের কণ্ঠস্বর। এবং, পরক্ষণেই দ্বারের কাছে আসিয়া অন্নদা ডাকিয়া বলিল, দ্বিজু এলো বিপিন। একলা নাকি? না, আর কেউ সঙ্গে এলো? না, একাই ত দেখচি। আর কেউ নেই। শুনিয়া বন্দনা ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বলিল, যাই মুখুয্যেমশাই, দেখি গে তাঁর খাবার যোগাড় ঠিক আছে কিনা। বলিয়া বাহির হইয়া গেল। সকালে দ্বিজু আসিয়া যখন বিপ্রদাসের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল তখন ঘরের একধারে বসিয়া বন্দনা পূজার সজ্জা প্রস্তুত করিতেছিল, দ্বিজদাস বলিল, এই পঞ্চমীতে মায়ের পুকুর – প্রতিষ্ঠা। বৃহৎ ব্যাপার দাদা! মায়ের কাজে ত বৃহৎ ব্যাপারই হয় দ্বিজু, এতে ভাবনার কি আছে? বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল। দ্বিজদাস কহিল, তা হয়। এবার সঙ্গে মিলেছে বাসুর ভালো হওয়ার মানতপূজো—সেও একটা অশ্বমেধ যজ্ঞ। অধ্যাপক বিদায়ের ফর্দ তৈরি হচ্ছে,—কুটুম্ব-সজ্জন অতিথি-অভ্যাগতের যে সংক্ষিপ্ত তালিকা বৌদিদির মুখে মুখে পেলুম তাতে আশঙ্কা হয় এবার আপনার অর্থে ওরা কিঞ্চিৎ গভীর খাবোল মারবে। সময় থাকতে সতর্ক হোন। বন্দনা মুখ তুলিল না, কিন্তু সামলাইতে না পারিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল। বিপ্রদাস বিষয়ী লোক, বিপ্রদাস কৃপণ, এ দুর্নাম একা মা ছাড়া প্রচার করিবার সুযোগ পাইলে কেহ ছাড়ে না। বিপ্রদাস নিজেও এ হাসিতে যোগ দিয়া বলিল, এবার কিন্তু তোর পালা। এবার খরচ হবে তোর। আমার? কোন আপত্তি নেই যদি থাকে। কিন্তু তাতে ব্যবস্থার কিছু অদল-বদল করতে হবে। বিদায় যারা পাবে তারা টোলের পণ্ডিত-সমাজ নয়, বরঞ্চ টোলের দোর বন্ধ করে যাদের বাইরে ঠেলে রাখা হয়েচে,—তারা। বিপ্রদাস তেমনই হাসিয়া কহিল, টোলের ওপর তোর রাগ কিসের? লোকের মুখে মুখে এদের শুধু নিন্দেই শুনলি, নিজে কখনও চোখে দেখলি নে। ওদের দলভুক্ত বলে হয়ত আমি পর্যন্ত তোর আমলে ভাত পাবো না। দ্বিজদাস কাছে আসিয়া আর একবার পায়ের ধূলা লইল, কহিল, ঐ কথাটা বলবেন না। আপনি দু দলেরই বাইরে, অথচ তৃতীয় স্থানটা যে কি তাও আমি জানিনে। শুধু এইটুকু জেনে রেখেচি আমার দাদা আমাদের বিচারের বাইরে। বিপ্রদাস কথাটাকে চাপা দিল। জিজ্ঞাসা করিল, আমার অসুখের কথা মা শোনেন নি ত? না। সে বরঞ্চ ছিল ভালো, পুকুর-প্রতিষ্ঠার হাঙ্গামা বন্ধ হতো। আত্মীয়দের আনবার ব্যবস্থা হয়েছে? হচ্চে। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—সকলকেই। সকন্যা অক্ষয়বাবুর আমন্ত্রণ-লিপি গেছে, মায়ের বিশ্বাস বৃহৎ ব্যাপারে মৈত্রেয়ীর অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে। আমার ওপর ভার পড়েছে তাঁদের নিয়ে যাবার। মা আর কাউকে নিয়ে যাবার কথা বলে দেননি? হাঁ, অনুদিকেও নিয়ে যেতে হবে। কলেজের ছেলেরা যদি কেউ যেতে চায় তারাও! তোর বৌদিদির কোন ফরমাস নেই? না। নীচে আবার মোটরের শব্দ পাওয়া গেল। হর্নের চেনা আওয়াজ কানে আসিতেই বন্দনা জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া বলিল, মাসীমার গাড়ি। আমি দেখি গে মুখুয্যেমশাই। আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক সেরে নিন—দেরি হয়ে যাচ্চে। বলিয়া বাহির হইয়া গেল। আমিও যাই মুখ-হাত ধুইগে। ঘণ্টা-খানেক পরে আসবো, বলিয়া দ্বিজদাসও চলিয়া গেল। বিপ্রদাসের পূজা-আহ্নিক সমাপ্ত
false
humayun_ahmed
করে বাড়িতে যাবেন। আজকাল বাড়িতে যাবার বিষয়ে তিনি আগ্রহ বোধ করেন না। যখন কাজকর্ম থাকে না তখন হাদিস কোরান পড়ে সময় কাটাতে চেষ্টা করেন। কোনো কিছুতেই মন বসে না। প্ৰচণ্ড অস্থিরতা বোধ করেন। অস্থিরতার কারণও তার কাছে খুব স্পষ্ট না। শরিফাই কারণ এটা ঠিক, তবে কোন অর্থে? শরিফাকে মাথা থেকে সম্পূর্ণ দূর করে তিনি দেশ থেকে আরেকটা মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসতে পারেন। এটাই করা উচিত। কিন্তু সেই মেয়ে তো শরিফার মতো হবে না। রং ঢং জানবে না। মজা করে কথা বলবে না। যদিও সারাক্ষণ হাসি মশকরা শোভন না। ইমাম করিম সাহেব কি মসজিদে? কে? আমি ইদরিস। কী চান? দুটা কথা বলব। করিম বিরক্ত হয়ে বের হলেন। কী বিষয়ে কথা বলতে চান? তালাক বিষয়ে। করিম বললেন, তালাক বিষয়ে আপনি কী বলবেন? দেওবন্দে ছিলাম। সেখানে বড় বড় আলেমদের তালাক বিষয়ে আলোচনা শুনেছি। কী শুনেছেন? নবীজির এক হাদিস আছে যেখানে তিনি বলেছেন, কেউ যদি পর পর তিনবার তালাক দেয় তা এক তালাক হিসাবে গণ্য হবে। এক তালাকের পর ইদ্দতকাল পার করতে হবে। ইদতের পর দ্বিতীয় তালাক আসতে হবে। তারপর আবার ইদ’তকাল পার করতে হবে। কাজেই আপনি যে তালাক দিয়েছেন তা হয় নাই। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঘরসংসার করতে পারেন। তাকে হিল্লা বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। করিম বললেন, যে বিষয় জানেন না সে বিষয়ে কথা বলবেন না। অন্য মাজহাবের লোকজন। এরকম কথাবার্তা বলে। আমরা হানাফি মাজহাবের। এই মাজহাবে আমার তালাক বৈধ হয়েছে। আপনি কোরান শরীফ মুখস্থ করে বসে আছেন। জানেন না কিছুই। ইদরিস বললেন, জি, কথা সত্য। ধর্ম নিয়া আপনার কোনো কথাবার্তা বলাই উচিত না। আপনি বিবাহ করেছিলেন এক বেশ্যা মেয়েকে। শুনেছি আপনার যে মেয়ে হয়েছে সে না-কি দিনরাত হিন্দু দেবদেবীর নাম বলে। ইদরিস বললেন, সে শুধু রাম বলে, আর কিছু না। রামই বা কেন বলবে? যাই হোক, সেটা আপনার ব্যাপার। এখন বিদায় হন। ধর্ম হাদিস কোরান এইসব নিয়া আর কোনো দিন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন না। মাওলানা ইদরিস মন খারাপ করে চলে এলেন। মীরার জন্যে তাকে এখন ভালো যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। বান্ধবপুরের বাইরে থেকেও হিন্দু মেয়েরা মীরাকে দিয়ে শাখা সিঁদুর ছোয়াতে আসছে। মীরার ডান পা ড়ুবানো পানি খেলে না-কি অনেক অসুখ সারছে। বিশেষ করে এই পানি শূলবেদনায় অব্যৰ্থ। ভক্তজনের কাছে মীরার পা ভেজানো পানি বিতরণ করার দায়িত্ব শ্ৰীনাথ নিজের কাঁধে নিয়েছেন। এই পানি খাবার নিয়মও আছে। পূর্ণিমা এবং অমাবশ্যার রাত ছাড়া খাওয়া যাবে না। পানি খাবার পর আর কোনো খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না। এইসব নিয়মকানুন তিনি না-কি স্বপ্নে পেয়েছেন। স্বপ্লে সাদা কাপড়ে সমস্ত শরীর এবং মুখ ঢাকা এক মহিলা এসে বলেছেন, শ্ৰীনাথ, তুই আমার সেবায়েত। কেউ যদি পা ভেজানো পানি চায় তুই দিবি এবং রোজ একবার আমার কানে শাখের শব্দ শুনাবি। শ্ৰীনাথ কিছুদিন হলো শাখ বাজাতে শুরু করেছেন। যখন তখন বাড়িতে শাখ বেজে উঠছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। লাবুস পুকুরঘাটে বসে আছে। আজ হঠাৎ শীত পড়েছে। উত্তরী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই হাওয়ার স্থানীয় নাম পাগলা হাওয়া। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে গারো পাহাড় ডিঙিয়ে এই হাওয়া এসে শীত নামায়। কিছু সময়ের জন্যে মনে হয় শীতকাল। প্রকৃতি ভ্ৰান্তি তৈরি করে। লাবুস বসে আছে খালি গায়ে। অসময়ের শীত গায়ে লাগাতে তার ভালো লাগছে। লাবুসের সামনে হুঙ্কা। হুঙ্কায় তামাক পুড়ছে। লাবুস তামাক খায় না। হাদিস উদ্দিন তারপরেও নিয়ম করে হুক্কা জ্বলিয়ে লাবুসের সামনে রাখছে। হাদিস উদিনের ধারণা কোনো একদিন মনের ভুলে ছোটকর্তা হুক্কার নিলে টান দিয়ে বসবেন। আস্তে আস্তে অভ্যাস ধরে যাবে। তার ওস্তাদ দরবার মিয়া আয়েশ করে তামাক খেতেন। গভীর রাতে হুঙ্কা টানার গুড়ুক গুড়ুক শব্দ শোনা যেত। সেই শব্দ আধো-ঘুম আধো-জাগরণে শোনার আনন্দই আলাদা। হাদিস উদ্দিন ছোটকর্তার কাছ থেকেও এটা আশা করে। লাবুসের পাশের সিঁড়িতে শ্ৰীনাথ এসে বসলেন। হঠাৎ শীত নামায় তিনি কাবু হয়ে পড়েছেন। চাদর গায়ে দিয়েছেন। কানঢাকা টুপি পরেছেন। তারপরেও শীত যাচ্ছে না। লাবুস বলল, কিছু বলবেন? শ্ৰীনাথ বললেন, একটা বিষয়ে আপনার অনুমতি নিতে এসেছি। সকলের স্বার্থে আপনি আশা করি অনুমতি দিবেন। আমি একটা মন্দির দিতে চাই। কী দিতে চান? মন্দির। মন্দিরের নাম মীরা মায়ের মন্দির। ও আচ্ছা। এই মন্দিরে কোনো মূর্তি থাকবে না। মীরা মায়ের ছবি থাকবে। ও আচ্ছা। আপনি কি অনুমতি দিয়েছেন? আপনি অনুমতি না দিলেও মন্দির আমাকে দিতেই হবে। আমি মায়ের আদেশ পেয়েছি। মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমাকে বলেছেন, আমি হেথায় হোথায় ঘুরে বেড়াই, আমার ভালো লাগে না। তুই আমার থাকার একটা জায়গা করে দে। আপনি সত্যি স্বপ্নে দেখেছেন? অবশ্যই। যদি মিথ্যা বলে থাকি যেন আমার শরীরে কুণ্ঠ হয়। সারা অঙ্গ গলে গলে পড়ে। লাবুস বলল, মিথ্যা আপনি বলেন নাই। সত্যি বলেছেন। এরকম স্বপ্ন আপনি দেখেছেন। মানুষ যা চিন্তা করে স্বপ্নে তাই আসে। স্বপ্নের কোনো মূল্য নাই। আমি আমার এখানে আপনাকে মন্দির বানাতে দিব না। মীরাকে নিয়ে যে ঝামেলা আপনি করছেন সেই ঝামেলাও আপনাকে আর করতে দিব না। মীরা আমার বোন। সৎ বোন। আমার যিনি মা, মীরারও তিনি মা। আপনি জানেন না? জানি। লাবুস হঠাৎ খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, মন্দির আমি বানাতে না দিলেও আপনি কিন্তু মন্দির বানাবেন।
false
MZI
সেটা হচ্ছে মায়ের কাছে চলে যাওয়া। মা’ই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। মেকু এবারে সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, মুখ হা করে জিভ বের করে এত জোরে কাঁদতে আরম্ভ করল যে বাবা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মেকুকে মায়ের হাতে দিয়ে দিলেন। মেকু সাথে সাথে মাকে শক্ত করে ধরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। হাত পুরোপুরি ব্যবহার করা শেখে নি তবু কষ্ট করে সে মায়ের কাপড় এখানে সেখানে ধরে ফেলল। মা মেকুকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস না বাবা! আমি আছি না?” মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলল, সত্যিই তো, তার মা আছে না? কার সাধ্যি আছে ধরে কাছে আসে। ঘরে যারা আছে তাদের একজন বলল, “দেখেছ, দেখেছ—মা’কে কেমন চিনেছে? মায়ের কাছে গিয়েই একেবারে শান্ত হয়ে গেল।” বুড়ি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে কী একটা কথা বলতে এসেছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজা খুলে ডাক্তার এসে ঢুকল। শুকনো মতন ডাক্তার, কাঁচাপাকা চুল এবং নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। ঘরের ভেতরে এত মানুষ দেখে ডাক্তার বলল, “আপনারা কিন্তু এখানে ভিড় করবেন না। বাচ্চাকে সবার কোলে নেওয়ার দরকার নেই। দূর থেকে একবার দেখে চলে যান।” বুড়ি গজগজ করে বলল, “বাচ্চার যা মেজাজ, কোলে নেয়ার ঠ্যালা আছে।” ডাক্তার বাবার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই মি হাসান। কংগ্র্যাচুলেশন।” বাবা একটু হেসে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।” “কী চেয়েছিলেন আপনি? ছেলে না মেয়ে?” “আমি আর কী চাইব! আমার স্ত্রী আগের থেকেই জানত যে তার ছেলে হবে!” “তাই নাকি? অ্যামনিওসিণ্টোসিস করেছিলেন নাকি?” “না না, সেরকম কিছু না। কোনো মেডিক্যাল ডায়াগনসিস না। তার এমনিতেই নাকি মনে হত যে বাচ্চাটা ছেলে!” বাবা যেন খুব একটা মজার কথা বলেছেন সেরকম ভান করে ডাক্তার হা হা করে হেসে উঠে। হাসি থামিয়ে সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। একটু ঝুঁকে পড়ে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডেলিভারির পর যা ভয় পেয়েছিলাম!” “কেন? কী হয়েছিল?” “ডেলিভারির পর বাচ্চা বাতাসের অক্সিজেন দিয়ে তার লাংস ব্যবহার শুরু করে। সেটা শুরু হয় বিকট একটা কান্না দিয়ে! সেই জন্যে সব বাচ্চা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে। কিন্তু আপনার বাচ্চা জন্মানোর পর কাঁদছিল না।” “সর্বনাশ! তারপর?” “তারপর আর কী? উলটো করে ধরে পাছায় একটা থাবা মেরে দিলাম—দুই নম্বর থাবাটা খেয়েই বাচ্চার সে কী চিৎকার!” ডাক্তার যেন খুব মজার একটা গল্প বলছে সেইরকম ভাব করে হা হা করে হাসতে লাগল। মেকু চোখের কোনা দিয়ে ডাক্তারকে দেখতে লাগল। এই তা হলে সেই ডাক্তার যে লোহার মত শক্ত হাত দিয়ে তার পাছায় এত জোরে থাবড়া মেরেছিল। কত বড় সাহস একবার কাছে এসে দেখুক না। বুড়িকে যেভাবে জোড়া পায়ে লাথি মেরেছিল সেইভাবে একটা লাথি বসিয়ে দেবে। ডাক্তার অবিশ্যি বেশ কাছে এসে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল কিন্তু মাথার কাছে থাকায় মেকু বেশি সুবিধে করতে পারল না। হাত দিয়ে অন্তত একটা খামচি দিতে পারলেও খারাপ হয় না। কিন্তু এখনো হাতের ব্যবহারটা ভালো করে শিখতে পারে নি। মেকু তবু একবার চেষ্টা করল, ডাক্তারের মুখটা কাছে আসতেই তার নাকে একটা খামচি দেওয়ার চেষ্টা করল, খামচিটা লাগল না। কিন্তু কিছু একটায় তার হাত লেগে যাওয়ায় সে শক্ত করে ধরে ফেলল। ডাক্তার অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, “কী আশ্চর্য! আমার চশমাটা ধরে ফেলেছে।” মেকু মনে মনে বলল, তোমার কপাল ভালো যে নাকটা ধরতে পারি নি। ধরতে পারলে দেখতে কী মজা হত। কিন্তু এই চশমাও আমি ছাড়ছি না। খুব একতা মজা হচ্ছে এরকম ভান করে ডাক্তার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মেকু চশমা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল এবং চশমাটা ডাক্তারের নাক থেকে ছুটে এল। মেকু এখনো তার হাত আর হাতের আঙুলকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে শিখে নি। তাই চশমাটা ধরে রাখতে পারল না, হাত থেকে সেটা ছুটে গেল এবং শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, শব্দ শুনে মনে হল কাচ ভেঙ্গে এক শ টুকরো হয়ে গেছে। ডাক্তার কাতর গলায় বলল, “চশমা! আমার চশমা!” কে একজন তুলে এনে চশমাটা ডাক্তারের হাতে দেয়, একটা কাচ ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে, অন্যটা তিন টুকরো হয়ে কোনো মতে ঝুলে আছে। ডাক্তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। দুর্বল গলায় বলল, “আমার এত দামি চশমা! আমেরিকা থেকে আনিয়েছিলাম, সিংগল লেন্স, বাইফোকাল, ননস্ক্রেচ গ্লাস। চার শ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম।” বাবা এগিয়ে এসে অপরাধীর মতো বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনার চশমাটা এইভাবে ভেঙে ফেলবে—” ডাক্তার সাহেব চশমাটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে জন্মের পর কখনো কখনো প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা ছোট বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে। আপনার এই বাচ্চার মনে হয় রিফ্লেক্স খুব ভালো। কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখছেন? যেন সবকিছু বুঝতে পারছে!” সবাই চলে যাবার পর মা বাবাকে বললেন, “ডাক্তার সাহেব বলছেন না জন্মের পর প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে?” “হ্যাঁ।” “আমার কী মনে হয় জান?” “কী?” মা লাজুক মুখে হেসে বললেন, “আমার এই বাচ্চার শুধু যে রিফ্লেক্স ভালো তা নয়, আসলে—” “আসলে কী?” “আসলেই সে সব বুঝতে পারে।” বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আসলে সব বুঝতে পারে?” “হ্যাঁ। তোমার চাচি সব খারাপ খারাপ
false
shomresh
শোনা যায় এই জঙ্গলে। একেবারে খালি হাতে এখোন ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে মানুষ এখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। হিংস্র মানুষের চেয়ে কোনও জন্তু হিংস্রতর হতে পারে না। হঠাৎ চোখে আলো এল। অর্জুন পথ ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকল। মিনিট তিনেক চলার পর একটা ভোলা চত্বর নজরে এল। জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু, তাঁবুর বাইরে কারবাইডের গ্যাসের আলো জ্বলছে গোটা চারেক। পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ করল পাশাপাশি আরও গোটা তিনেক ছোট তাঁবু আছে। মূল তাঁবু থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এলযে লোকগুলোকে সে অনুসরণ করে এখানে পৌঁছেছে তাদের দেখতে পাওয়া গেল। খুব বিনীত ভঙ্গিতে কথা শুনছে। তাঁবু থেকে বের হওয়া নতুন দুজন মানুষ ওদের পিঠ চাপড়াল। এবার কাজ সেরে আসা লোকগুলো ছোট তাঁবুর দিকে চলে গেল। অর্জুন দেখল দুজন কর্তাব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কথা বলে আবার তাঁবুর ভেতর ফিরে গেল। এবার সব শান্ত। শুধু গ্যাসের আলো দপদপ করে জ্বলছে। কোথাও কোনও পাহারাদার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। না থাকাটাই অস্বাভাবিক। যারা এত পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাববে না এমন হতেই পারে না। আর এগিয়ে যাওয়া বোকামি হবে, অর্জুন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। মচমচ শব্দ হচ্ছে শুকনো পাতায় পা পড়ায়, মাঝে মাঝেই সে থেমে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল। জন্তুজানোয়ার তাড়ানোর জন্য মানুষ ওই গলায় আওয়াজ করে। যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে খোলা চত্বরটাকে ঘুরে দেখল অর্জুন। জঙ্গলের মাঝখানে চমৎকার জায়গা বেছেছে এরা। ইতিমধ্যে নদীর দিকের পথ দিয়ে আরও চারজন লোক এসেছে। তারা বড় তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে সাহেব বলে ডাকার পর একজন কর্তা বেরিয়ে এসেছে। অর্জুন শুনল লোকটা রিপোর্ট করছে ডেডবডিটাকে নদীর জলে চুবিয়ে ভাল করে পাথর দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ভেসে যাওয়ার কোনও চান্স নেই। কতটির গলার স্বর জড়ান। অদ্ভুত হিন্দি উচ্চারণে লোকটা বলল খুব ভাল কাজ হয়েছে, কিন্তু তোমাদের এখানে এখন কে আসতে বলেছে। যে জায়গায় ডিউটি দেওয়া হয়েছে সেখানে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। সাহেব, এখন বাগানে কোনও মানুষ নেই। পুলিশ চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ভয়ে কেউ বা নে ঢুকবে না, তাই ভাবলাম খবরটা দিয়ে আসি। তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না। যা ভাববার আমরা ভাবব। যাও। কর্তা আবার তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেল। অর্জুনের মনে হল লোকগুলো এমন ব্যবহার আশা করেনি। তাঁবুর কাছ থেকে কিছুটা সরে এসে তারা একটু গজরাল, তারপর নদীর দিকে চলে গেল। এবার ফেরা উচিত। ভোর হতে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক বাকি আছে। ভানু ব্যানার্জি অনেক করে বলেছিলেন মিসেস দত্তের সঙ্গে বাগান থেকে চলে যেতে। না গিয়ে ভাল লাভ হল। অন্তত দরোয়ানের মৃতদেহের হদিস আর তাঁবুগুলোর অস্তিত্ব অজানা থাকত তা হলে। অর্জুন ডালপালা সরিয়ে হাঁটতে লাগল। তাঁবু ছেড়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার মনে হল সে দিক ভুল করেছে। নদীর দিকে যাওয়ার বদলে সে উল্টো দিকে চলে এসেছে। এখানে গাছের তলায় আগাছা বেশি। সে যত হাঁটছে তত ওপরের ডালে বসা বানরেরা হইচই শুরু করে দিয়েছে। এবং তখনই সে টিন পেটানোর শব্দ শুনতে পেল। দু-তিনটে টিন একসঙ্গে পেটানো হচ্ছে। এই ঘন জঙ্গলে মানুষ টিন পেটায় জন্তুজানোয়ার তাড়াতে। কিন্তু এত গভীরে এই অসময়ে মানুষ কী করছে? জঙ্গলে যারা চুরি করে কাঠ কাটতে আসে তারা নিজেদের অস্তিত্ব এভাবে জানাবে না। চোরা শিকারীরাও নিঃশব্দে থাকে। মাথার ওপর ঘুম-ভাঙা বানরের দল কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। অর্জুন তাদের এড়াতেই টিনের শব্দ লক্ষ করে এগোল। খুঁটিমারি রেঞ্জে থাকার সময় সে জেনেছিল বাঘজাতীয় হিংস্র পশু এলে বানরেরা এভাবে সারা জঙ্গলকে জানিয়ে দেয়। বানরের চিৎকারে পাখিদেরও ঘুম ভেঙেছে। মুহূর্তেই সমস্ত নৈঃশব্দ্য ভেঙে বাজার হয়ে গেল জঙ্গলটা। অর্জুন অসহায়ের মূতো তাকাল। সে বুঝতে পারল, যারা টিন পেটাচ্ছে তারা বানরের চিৎকার শুনে ভুল করছে। জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য সে দ্রুত পা চালাল। বানরগুলো পেছন ছাড়ছে না। এ-ডাল থেকে আর এক ডাল অন্ধকারেই লাফাতে লাগল তারা। অর্জুন টিনের আওয়াজ যেখানে হচ্ছে সেখানে পৌঁছে যেতেই গুলির শব্দ শুনল। আকাশ কাঁপিয়ে সেই শব্দ জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়তেই সব চিঙ্কার আচমকা থেমে গেল। একটা মানুষের হাসি শোনা গেল। সে হিন্দিতে বলল, টিন পেটালে আজকাল কাজ হয় না। শেরগুলো সব চালাক হয়ে গেছে। গুলির আওয়াজে এবার ভাগবে। দ্বিতীয় গলা প্রতিবাদ করল, সাহেব গুলি ছুঁড়তে মানা করেছিল কিন্তু? বাঘ খেয়ে গেলে সাহেব আমাদের বাঁচাবে? যা শুয়ে পড়, এখন আর কোনও ভয় নেই। আমি জেগে আছি। অর্জুন আর-একটু এগোল। তারপরেই তার চোখের সামনে এই অন্ধকারেও দৃশ্যটি অস্পষ্ট ভেসে উঠল। অনেকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটি খোঁড়া হচ্ছে। প্রায় পুকুরের আদল নিয়ে নিয়েছে জায়গাটা। পুকুরের গায়ে তাঁবু পড়েছে। মনে হচ্ছে শ্রমিকরা সেখানেই রাত্রে থাকে। একটি লোককে বন্দুক হাতে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। অন্ধকারে তার নাক-চোখ বোঝা যাচ্ছে না। অর্জুনের চোয়াল শক্ত হল। তাহলে ব্যাপারটা এই। আসল কাজটি হচ্ছে এখানে। এবং বোঝাই যাচ্ছে কাজটি এখনও সফল হয়নি। কিন্তু চারপাশে নেহাতই জঙ্গল, গভীর জঙ্গল। লোকগুলো মাটি খুঁড়ে করছেটা কী? ধীরে ধীরে সে সরে এল। অনেকটা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এক কোমর জল পেরিয়ে সে চাবাগানে পৌঁছল যখন, সুর্যদেব তখন জঙ্গলের মাথায় উঠে বসেছেন। বাংলোয় পৌঁছতে কোনও বাধা পাওয়া গেল না। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় সে ভটভটির আওয়াজ শুনতে পেল। আড়াল খুঁজতে যাওয়ার
false
tarashonkor
সে বসছে তার জায়গায়। মণ্ডল মহাশয়রা একপাশে বসে আছেন। হেদো মণ্ডল আছেন, আরও আছেন জনকয়েক। এবার মণ্ডল মহাশয়দের কড়া নজর গুড়ের উপর। পিথিমীতে যুদ্ধ বেধেছে। যুদ্ধ চলছে—সায়েব মহাশয়দের মধ্যে। জিনিসপত্রের নাকি দর চড়বে! ধান চাল গুড় কলাই সমস্ত কিছুরই দর উঠবে। তাই মণ্ডলেরা ‘সতর’ হয়েছেন, একটি ভাড় গুড় যেন না সরে। সরাবে আর কে? সরাতে তো কাহাররাই। বনওয়ারী মনে মনে একটু ‘বেথা’ পেয়েছে। এতে। অবিশ্যি কাহারেরা সাধু নয়, সবাই অবিশ্যি বনওয়ারী অতন পেল্লাদ নয়; চুরি খানিক আছেক’ করে আর সকলে। কিন্তু যতক্ষণ বনওয়ারী হাজির আছে শালের চালায়, ততক্ষণ কারুর ক্ষমতা নাই এক হাতা গুড় চুরি করে। এ কথা সবাই জানে। তবু বনওয়ারী থাকতে এমন নজর রাখার মানে তো বনওয়ারীকে অবিশ্বাস করা। তা করুন। বনওয়ারী আপন মনেই গুড় তৈরির কাজ করে যায়। সে ভাবে যুদ্ধের কথা। এ দুনিয়া আজব কারখানা। বৈষ্ণব ফকির গান করতে আসে, তাদের গানে শুনেছে। বনওয়ারী—এ দুনিয়া আজব কারখানা। ফকিররাও কাহারপাড়াতে আসে। তারা বলে— আল্লাতালার আজব কারখানা। তাই বটে। বনওয়ারী মনে মনে স্বীকার করে সে কথা। বাউল আসে, বৈষ্ণব আসে, সন্যেসী আসে, সবাই ওই এক কথাই শুনিয়ে যায়। কাহারেরা শোনে, ভাবে। আগে দেহের খাঁচায় অদেখা অচেনা পরানপাখির কথা ভেবে কথাটা স্বীকার করত। মায়ের ‘গভ্যের মধ্যে বসে কারিগর খাচা তৈরি করে হাড়ের শলা দিয়ে খাচা তৈরি করে পরিপাটি চামড়ার ঘেরাটোপ দিয়ে ঢেকে দেয়, তার মধ্যে সুড়ৎ করে এসে ঢেকে একটি পরানপাখি। সে পাখি নাচে, বুলি বলে, কত রঙ্গ করে। তার পরে আবার একদিন ফুড়ৎ করে উড়ে পালায়। ভেবে ভেবে কূলকিনারা মিলত না, কাহাররা ‘পিতিপুরুষ’ক্ৰমে নীলবর্ণ আকাশের দিকে চেয়ে ‘পরানপাখি’র আনাগোনার পথের দাগ আর সেই আজব কারিগরের আস্তানা খুঁজত; খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বাবাঠাকুরের বেলতলায় এবং ‘কালারুদ্দে’র দরবারে লুটিয়ে পড়ে বার বার বলত—অপরাধ মাৰ্জ্জনা কর বাবা! কোলের কাছে অন্ধকার, তুমি ‘অইচ’ পক্ষ দিয়ে ঢেকে, বক্ষ দিয়ে আগুলে,—আর তোমাকে আমরা খুঁজে মরছি কোথা কোন বেহ্মাণ্ডে বেহ্মাণ্ডে! এখন কিন্তু কোম্পানির কলের গাড়িতে, ‘অ্যালের পুলে, তারে তারে টেলিগেরাপে, হাওয়া গাড়িতে—দুনিয়ার আজব কারখানা তারা যেন চোখে দেখছে। তার উপরেও আজব কাণ্ড এই যুদ্ধ! অবাক রে বাবা! কোথা কোন্ ‘দ্যাশে সাত সমুদ্র তের ‘দী’ পারে কে করছে কার সঙ্গে যুদ্ধ, এখানে চড়বে ধানের দর, চালের দর, আলু গুড় কলাই তরিতরকারির দর! জাঙলের সদূগোপ মহাশয়রা কোমর বাঁধছে-টাকা জমাবে; বলাবলি করছে—কাপড়ের দর চড়বে। আবার নাকি কোম্পানিতে যুদ্ধের জন্য চাঁদা আদায় করবে। তবে কাহারপাড়ায় হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের মধ্যে যারা ছায়ার ঘেরায় বাস করে তাদের ভাবনা নাই। ধান চাল গুড়ের দাম বাড়লে তাদের কিছু লাভ নাই। তারা মনিবের ক্ষেতে খেটে খায়; ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পায়, তাও ছ মাস খেতে-খেতেই ফুরিয়ে যায়-বাকি ছ মাস মনিবের কাছে ‘দেড়ী’তে ধান নেয়, বেচবার মত ধান চাল তাদের নাই। বেচেও না, কেনেও না। বাড়ির কানাচে শাকপাতা হয়, পুকুরে বিলে নালায় নদীতে শামুক গুলি আছে-ধরে নিয়ে আসে। কয়লার দাম চড়ে; কাহারেরা জীবনে কখনও কয়লা পোড়ায় না, নদীর ধারে ঝোপজঙ্গল থেকে কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে; গরুর গোবর ঘেঁটে খুঁটে দেয়, তার দু-চারখানা নিজেরা পোড়ায়-বাকি বিক্রি করে চন্দনপুরে জাঙলে। কাপড়ের দর চড়লে কষ্ট বটে। তাই-বা কখানা কাপড় তাদের লাগে? পুরুষদের তো চাষের সময় ছ মাস অর্ধেক দিন গামছা পরেই কাটে। বাকি অর্ধেক দিনছ হাত মোটা কাপড় পরে। বছরে চারখানাতে ‘ছচলবছল’ অর্থাৎ সচ্ছল, তিনখানা হলেও চলে যায়। মেয়েরা ‘একটুকুন সাজতে গুজতে ভালবাসে, কোপাই নদীর ‘আলবোডেমি’ তাদের চিরকাল আছে, তাদের দু-একখানা মিহি ফুলপাড় শাড়ি চাই-ই। দুখানা হলেই খুব। বাইরে যাবার সময় পরে। ঘরে মোটা খাটো কাপড়েই চলে। তার জন্যেও খুব বেশি ভাবতে হয় না। ফুলপাড় মিহি শাড়ির দাম যোগাতে হয় না ঘরের কর্তাকে, মেয়েরা ও নিজেরাই রোজগার করে নেয়চন্দনপুর জাঙলে রেজা খেটে, ভদ্রজনের বাবুভাইয়ের কাছ থেকে। আর একটা যুদ্ধ দেখেছে বনওয়ারী। তেরশো বিশ একুশ সাল থেকে আরম্ভ হয়েছিল কয়েক বছরই ছিল; বেশ মনে আছে বনওয়ারীর। ছ টাকা জোড়া কাপড় হয়েছিল। ধানের দর হয়েছিল চার টাকা। এই তখনই চন্দনপুরের মুখুজ্জেবাবুরা কয়লার কারবারে কেঁপে রাজা হয়ে উঠল। বনওয়ারীর মনিব মাইতো। ঘোষ পাট কয়লা বেচে কম টাকা করে নাই। অনেক টাকা। আবার চন্দনপুরের চার-পাঁচ ঘর জমিদার-বাড়ি ভেঙে গেল, মহাল বিক্রি করলে; জাঙলের চৌধুরী-বাড়ি একেবারে ‘নাজেহাল’ হয়ে ফেল পড়ে গেল। জাঙলের সদ্‌গোপদের বৃদ্ধি ওই যুদ্ধের সময়। আগে সবাই ছিল খাটি চাষী, কাহার-কৃষাণদের সঙ্গে তারাও লাঙলের মুঠো ধরত, কোদাল ধরত, খাটো কাপড় পরত; যুদ্ধের বাজারে ধান চাল কলাই গুড় বেচে সবাই ভদ্রলোক হয়ে গেল। এবার আবার সবাই কোমর বেঁধেছে, এ যুদ্ধে যে তারা কি হবে, কে জানে। তবে তাদের মঙ্গল কামনা করে। কাহারেরা। তাদের লক্ষ্মীর বাড়বাড়ন্ত হলেই কাহারদের মঙ্গল, তাদের মা-লক্ষ্মীর ‘পাজের অর্থাৎ পদচিহ্নের ধুলো কুড়িয়েই কাহারদের লক্ষ্মী। যুদ্ধে কাহারদের কিছু যায় আসে না। সদ্‌গোপ মহাশয়রা চট বিছিয়ে বসে যুদ্ধের কথাই বলছেন। কথা হচ্ছে—মসনের চাষে এবার জোর দিতে হবে। চন্দনপুরের বাবুদের ‘গ্যাজেটে অর্থাৎ খবরের কাগজে নাকি বেরিয়েছে মসনের তেলের দরকার হবে যুদ্ধে, ওর দরটা খুব বেশি চড়বে। বনওয়ারী আপন মনেই সবিস্ময়ে ঘাড় নাড়তে থাকে। আজব কারখানাই বটে রে বাবা! ধান-চাল, কলাই-পাকড়, গুড়-আলু, এসবের চেয়ে দর বাড়বে মসনের। “প্যাটের খাদ্য নয়, গায়ে মাখবার
false
shottojit_roy
যে। মাথা হেঁট করে বসেছিলে। মাথায় আলো পড়ে চকচক…? ঠিক আছে, ঠিক আছে। অবিনাশবাবু একটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন, সেই যে কী এক বায়স্কোপ দেখেছিলাম—একই মানুষ দু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে—একই সময় এখানে ওখানে—আপনারও কি সেই দশা হল নাকি? তা কিছুই আশ্চর্য নয়। পইপই করে বলিছি ও সব গবেষণা ফবেষণার মধ্যে যাবেন না-ওতে ব্রেন অ্যাফেক্ট করে। গরিবের কথা বাসি হলে তবে ফলে কিনা! আরও আধঘণ্টা ছিলেন অবিনাশবাবু। বুঝতে পারছিলাম। একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটানোর ফাঁকে ফাঁকে ভদ্রলোক আমার দিকে আড় চোখে লক্ষ রাখছিলেন। আমি আর কোনও কথা বলতে পারিনি, কারণ আমার মাথার মধ্যে সব কেমন জানি গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে রামলোচনবাবুর বাড়ির দিকে গেলাম। ভদ্রলোক তাঁর গেটের বাইরে বাঁধানো রকটাতে বসে সুরেনডাক্তারের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমায় দেখে বললেন, আপনি একটা হিয়ারিং এন্ড ব্যবহার করুন। এত ডাকলুম সকালে, সাড়াই দিলেন না। কী খুঁজছিলেন মিত্তিরের আমবাগানে? কোনও আগাছোটাগাছা বুঝি? আমি একটু বোকার মতো হেসে আমতা আমতা করে আমার অন্যমনস্কতার একটা কাল্পনিক কারণ দিলাম। তারপর বিদায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উশ্রীর ধারে গিয়ে বসলাম। সত্যিই কি আমার মতিভ্রম হয়েছে—মস্তিষ্কের বিকার ঘটেছে? এরকম ভুল তো এর আগে কখনও হয়নি। সাতাশ বছর হল গিরিডিতে আছি। নানারকম কঠিন, জটিল গবেষণায় তার অনেকটা সময় কেটেছে—কিন্তু তার ফলে কখনও আমার স্বাভাবিক আচরণের কোনও ব্যতিক্রম ঘটেছে—এরকম কথা তো কাউকে কোনওদিন বলতে শুনিনি। হঠাৎ আজ এ কী হল? রাত্রে খাবার পর একবার ল্যাবরেটরিতে না গিয়ে পারলাম না। নিও-স্পেকট্রোস্কোিপটাকে যেমন রেখে গিয়েছিলাম, তেমনই আছে। জিনিসপত্র বইখাতা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি কোনওটা এতটুকু এদিক ওদিক হয়নি। এই ল্যাবরেটরিতে কি এসেছিলাম কাল রাত্রে? আর এসেছি অথচ টের পাইনি? অসম্ভব! ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম। দক্ষিণের জানোলা দিয়ে চাঁদের আলো টেবিলের ওপর এসে পড়ল। মনে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমি জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। জানালা দিয়ে আমার বাগান দেখা যাচ্ছে। এই বাগানে রোজ বিকালে রঙিন ছাতার তলায় আমার প্রিয় ডেকচেয়ারে আমি বসে থাকি। ছাতা এখনও রয়েছে। তার তলায় চেয়ারও। সে চেয়ার খালি থাকার কথা-কিন্তু দেখলাম তাতে কে জানি বসে রয়েছে। আমার বাড়িতে আমি, প্রহ্লাদ ও আমার বেড়াল নিউটন ছাড়া আর কেউ থাকে না। মাথা খারাপ না হলে প্রহ্লাদ কখনও ও চেয়ারে বসবে না। যে বসে আছে সে বৃদ্ধ। তার মাথায় টাক, কানের দুপাশে সামান্য পাকা চুল, গোঁফ ও দাড়ি অপরিচ্ছন্ন ভাবে ছাঁটা। যদিও সে আমার দিকে পাশ করে বসে আছে এবং আমার দিকে ফিরে চাইছে না তাও বেশ বুঝতে পারলাম যে তার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার আশ্চর্য মিল। এরকম অভিজ্ঞতা আর কারুর কখনও হয়েছে কি না জানি না। যমজ ভাইয়ের মধ্যে নিজের প্রতিরূপ দেখতে মানুষ অভ্যস্ত, কিন্তু আমার-যমজ কেন-কোনও ভাইই নেই! খুড়তুতো ভাই একটি আছেন—তিনি থাকেন বেরিলিতে—এবং তিনি লম্বায় ছফুট দুইঞ্চি। এ লোক তবে কে? হঠাৎ মনে হল—শহরের কোনও ছেলেছোকরা আমার ছদ্মবেশ নিয়ে আমার সঙ্গে মস্করা করছে না তো? তাই হবে। তা ছাড়া আর কিছুই নয়। বারগাণ্ডায় এক শখের থিয়েটারপাটি আছে। তাদের দলের কেউ নিশ্চয় এই প্র্যাকটিক্যাল জোকের জন্য দায়ী। অপরাধীকে হাতেনাতে ধরব বলে পা টিপে টিপে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দা পেরিয়ে বৈঠকখানার দরজা দিয়ে সোজা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যর্থ অভিযান। গিয়ে দেখি চেয়ার খালি। ক্যানভাসে হাত দিয়ে দেখি সেটা তখনও গরম রয়েছে। অর্থাৎ অল্পীক্ষণ আগেই কেউ যে সে চেয়ারটায় বসেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু চারিদিকে চেয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। জ্যোৎস্নার আলোতে আমার বাগানে গা ঢাকা দিয়ে থাকার কোনও উপায় নেই, কারণ একটি মাত্র গোলঞ্চ গাছের গুড়ির পিছনে ছাড়া লুকোবার কোনও জায়গা নেই। তা হলে কি আমার দেখবার ভুল? কিন্তু অবিনাশবাবু, রামলোচনবাবু-এর তবে কাকে দেখলেন! শোবার ঘরে ফিরে এসে অনুভব করলাম আমার উদ্বেগ আরও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আজ রাত্রে ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম হবে না। ১৪ই এপ্রিল ডবল শঙ্কুর রহস্যের যে ভাবে সমাধান হল, তার তুলনীয় কোনও ঘটনা আমার জীবনে আর কখনও ঘটেনি। গত দুদিন আমাকে দেখতে পাওয়ার ভয়ে আমি ঘর থেকে বেরোইনি। যদি ভুল করে বা নিজের অজ্ঞাতসারে কখনও বেরিয়ে পড়ি, তাই প্রহ্লাদকে বলেছিলাম। আমার শোবার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে তার গায়ের সঙ্গে একটা ভারী টেবিল লাগিয়ে দিতে। সকাল বিকালের কফি, আর দুপুর ও রাত্রের খাবার প্রহ্লাদ নিজেই টেবিল সরিয়ে দরজা খুলে ঘরে এনে দিয়েছে, খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থেকেছে আর খাওয়া হলে পর দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে টেবিল ঠেলে দিয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও প্রহ্লাদ দুদিনই খবর এনেছে যে লোকে নাকি আমায় শহরের এখানে সেখানে দেখতে পেয়েছে। উশ্রীর আশেপাশেই বেশি। আর যাঁরা আমায় দেখেছেন তাঁদের সকলেরই ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই আমি তাঁদের ডাকে সাড়া দিচ্ছি না। সুরেনাডাক্তার নাকি কাল বিকালে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই আমায় পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। প্ৰহ্লাদ বলে দিয়েছিল বাবু ঘুমোচ্ছেন, দেখা হবে না। আজ আর ঘরে বন্দি থাকতে না পেরে প্রহ্লাদকে ডেকে টেবিল সরিয়ে একেবারে সটান ল্যাবরেটরিতে গিয়ে হাজির হলাম। আমার চেয়ার, আমার টেবিল, আমার নতুন যন্ত্র, বৈদ্যুতিক তার, সলিউশনের পাত্র, খতাপত্র, সব যেমন ছিল তেমনই আছে। খালি চেয়ারটা দেখে লোভ হল। গিয়ে বসলাম। তারপর হাত বাড়িয়ে হেলমেটটা নিয়ে মাথায় পারলাম। বোতলের মধ্যে সলিউশন ছিল, তার
false
humayun_ahmed
তোমার জীবনে বিরাট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তুমি তারপর থেকে কথা বলা বন্ধ করেছ। ভালো করেছ। হড়বড় করে কথা বলার কিছু নেই। আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। আমি যদি হা-না জাতীয় কিছু জানতে চাই মাথা নেড়ে জবাব দেবে। আমি নাদিয়ার শিক্ষক, কাজেই তোমারও শিক্ষক। শিক্ষকের কথা মানতে হয়। যে বিরাট দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তা কি তোমার কারণে ঘটেছে? পদ্ম না-সূচক মাথা নাড়ল। অন্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই তুমি অন্যদের ওপরে রাগ করে কথা বন্ধ করেছু। খুব ভালো করছ। গাছপালার ওপর তোমার কি কোনো রাগ আছে? পদ্ম বিস্মিত হয়ে তাকাল। না-সূচক মাথা নাড়ল। বিদ্যুৎ বললেন, গাছপালার ওপর যখন রাগ নেই, তখন গাছপালার সঙ্গে কথা বলতেও বাধা নেই। যে দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তুমি বাগানের গাছগুলিকে সেই দুর্ঘটনার কথা বলবে। গাছ কিন্তু মানুষের কথা শোনে। গাছের অনুভূতি আছে—এটা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বলে গেছেন। গাছ তোমার সব কথা শুনবে। তোমার রাগ দুঃখ কষ্ট তখন কমতে থাকবে। কথা বলবে গাছের সঙ্গে? পদ্ম চুপ করে রইল। মাথা নাড়ল না। বিদ্যুত বললেন, আমি এখন তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাব। ম্যাজিকটা তোমার যদি পছন্দ হয়, তোমাকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমাকে একটা গাছের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমি চলে যাব। তুমি প্রথমে গাছটাকে ম্যাজিক দেখাবে। তারপর তোমার কষ্টের গল্প তাকে বলবে। বিদ্যুত পকেট থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ বের করলেন। কাগজ উল্টেপাল্টে পদ্মকে দেখালেন। পদ্ম কাগজ হাতে নিয়ে দেখল। বিদ্যুত পদ্মের হাত থেকে কাগজ নিয়ে ফুঁ দিতেই কাগজটা পাঁচ টাকার একটা নোট হয়ে গেল। পদ্ম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে—এটা বোঝা যাচ্ছে। সে টাকাটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। বিদ্যুত ম্যাজিকের কৌশল শেখালেন এবং লক্ষ করলেন, মেয়েটা বুদ্ধিমতী, কৌশলটা সুন্দর ধরতে পেরেছে। পদ্ম, ম্যাজিকটা কি পছন্দ হয়েছে? পছন্দ হলে মাথা নাড়ো। পদ্ম মাথা নাড়ল। বিদ্যুত বললেন, নাদিয়াকে মাজিকটা দেখিয়ো। খুব ভালোমতো প্রাকটিস করার পর দেখাবে। হুট করে দেখাবে না। এখন চলো আমার সঙ্গে, একটা গাছের সামনে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেই। নাদিয়াদের বাগানে একটা বকুলগাছ আছে। ওই গাছটা হোক তোমার প্রথম বন্ধু। আমার হাত ধরো। চলো যাই। বিদ্যুতের হাত ধরে পদ্ম সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। প্রণব দেখলেন বিদ্যুত হোসনা মেয়েটাকে একটা বকুলগাছের সামনে দাঁড় করিয়ে চলে আসছেন। মনে হচ্ছে হোসনা গাছের সঙ্গে কথা বলছে। ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বিদ্যুত প্রণবের কাছে এসে বললেন, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চলে যাব। আমি যে এসেছি এই খবরটা মনে হয় নাদিয়াকে দেননি। প্রণব জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি হোসনা মেয়েটার দিকে। বিদ্যুত বললেন, পদ্ম মেয়েটা হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমার ধারণা আজ সন্ধ্যা থেকে কথা বলা শুরু করবে। প্রণব বললেন, আপনি কি এখনই রওনা হবেন? রওনা হওয়া উচিত। দশটা বাজতে আধঘণ্টা বাকি। ট্রেন অবশ্য সময়মতো আসে না। লেট হয়। আমি এখনই রওনা হন। প্রণব বললেন, যদি আপত্তি না থাকে আপনাকে রেলস্টেশনে দিয়ে আসি। স্যারের গাড়ি আছে। গাড়িতে করে নিয়ে যাব। আপনার কি আপত্তি আছে। আমার আপত্তি নাই। তবে গাড়ি লাগবে না। ট্রেন এক ঘণ্টা লেট। বিদ্যুত টি স্টল থেকে চা কিনেছেন, হেঁটে হেঁটে চা খাচ্ছেন। তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছেন প্রণব। বিদ্যুত বললেন, আপনি চলে যান। আমার জন্যে সময় নষ্ট করছেন কেন? প্রণব বললেন, আমার প্রচুর সময়। নষ্ট করলে কারও কোনো ক্ষতি হয় না। বিদ্যুত বললেন, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আপনি আমাকে ধুরন্ধর বলেছেন। এটা সত্যভাষণ। সত্যভাষণের জন্যে ক্ষমা চাইতে হয় না। আপনি দেশের অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। দেশের অবস্থা বুঝিয়ে বলি? বলুন। দেশ এখন চলে গেছে ছাত্রদের হাতে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ চালাচ্ছে। তারা যা নির্দেশ দিচ্ছে সেইভাবে কাজ হচ্ছে। দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। তারা ভুল করা শুরু করবে। তখন বড় সমস্যা তৈরি হবে। এক ভুল থেকে আরেক ভুল। ভুলের চেইন রিঅ্যাকশান। পূর্বপাকিস্তান কি আলাদা হয়ে যাবে? না। পাকিস্তান সরকার দেশ ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করবে। অবশ্যই দেশে মার্শাল ল আসবে। আয়ুব খান কোনো সহজ জিনিস না। সে নিউট্রন শোষক নামাবে। নিউট্রনের সংখ্যা কমাবে। বিষয়টা বুঝলাম না। অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। রিঅ্যাকটারে নিউট্রনের সংখ্যা বেড়ে গেলে বিস্ফোরণ হয়। পূর্বপাকিস্তান এখন অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার। নিউট্রনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিস্ফোরণ বন্ধ করতে নিউট্রন শোষক লাগবে। আয়ুব খান তা জানেন। প্রণব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই। বুঝার কথাও না। জ্ঞানের কথা মূর্খ মানুষ বুঝবে না—এটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, আমি স্টেশনে আপনার সঙ্গে এসেছি জ্ঞানের কথা শোনার জন্যে না। আপনাকে একটা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যে। কী বিষয়। নাদিয়া মা’কে আপনার সঙ্গে কেন দেখা করতে দেই নাই সেই বিষয়। ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। আপনার দিক থেকে হয়তো প্রয়োজন নাই। আমার দিক থেকে আছে। বিদ্যুত বললেন, ব্যাখ্যাটা মনে হচ্ছে আমি জানি। তারপরেও আপনার কাছ থেকে শুনি। প্রণব বললেন, নাদিয়া মা’কে আমি কোলেপিঠে করে বড় করেছি। তার পিতা তাকে যতটা স্নেহ করেন, ভগবান সাক্ষী আমি তারচেয়ে কম করি না। আমি চিরকুমার মানুষ। আমার কেউ নাই। নাদিয়া মাকে আমি কন্যা জ্ঞান করি। মূল কথাটা বলুন। নাদিয়া মা আপনাকে দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেত। এটা আমি হতে দিতে পারি না।
false
shottojit_roy
ক্ৰমে সে সব মুছে গিয়ে শুধু রয়েছে থরের কণ্ঠস্বর। আমি আর সামারভিল সম্মোহিতের মতো চেয়ে আছি ক্রাগের মৃতদেহের দিকে। চামড়ার সবুজ ভাবটা দ্রুত মিলিয়ে আসছে আমাদের চোখের সামনে। তার বদলে লালের প্রলেপ পড়ছে ক্রাগের মুখে। ক্ৰমে সে লাল বেড়ে উঠল। সেই সঙ্গে অলৌকিক ভেলকির মতো মুখের বলিরেখাগুলো একে একে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। ওই যে হাতের শিরায় স্পন্দন শুরু হল! আমার দৃষ্টি টেবিলের পিছনে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো বৈদ্যুতিক ঘড়িটার দিকে। সেকেন্ড হ্যান্ডটা টিকটিক টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে ১২-র দিকে। আর পাঁচ সেকেন্ড। আর চার… তিন…দুই…এক… মাস্টার। থরের উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট পৈশাচিক চিৎকারে আমরা দুজনেই ছিটকে পিছিয়ে টাল হারিয়ে পড়লাম, থরের পায়ের তলায়। সেই অবস্থাতেই দেখলাম আলেকজান্ডার অ্যালয়সিয়াস ক্রাগের দুটো শীর্ণ হাত সজোরে নিজেদের বন্ধনমুক্ত করে শূন্যে প্রসারিত হল। তার পরমুহুর্তে ক্রাগের দেহের উপরার্ধ সটান সোজা হয়ে বসল খাটের উপর। বিশ্বাস হল? বিশ্বাস হল? ক্রাগের আস্ফালনে অপারেটিং রুমের কাচের জিনিস ঝনঝনি করে উঠল। আমিই যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সে কথা বিশ্বাস হল? আমরা দুজনেই চুপ, এবং ক্রাগও যে মৌনং সন্মতি লক্ষণম বলে ধরে নিলেন, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম, কারণ তাঁর মুখে ফুটে উঠল এক পৈশাচিক হাসি। কিন্তু পর মুহুর্তেই সে হাসি মিলিয়ে গেল। সে একদৃষ্টি আমাদের দুজনের দিকে দেখছে। তারপর তার দৃষ্টি চলে গেল দরজার দিকে। পাপাডোপুলস…তাকে দেখছি না কেন? এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে ক্রাগের। কোথায় পাপাডোপুলস? তিনি এবার প্রশ্ন করলেন। সে তোমাদের সাহায্য করেনি? সে ভয় পাচ্ছিল, বলল সামারভিল। তাকে আমরা রেহাই দিয়েছি। ক্রাগের মুখ থমথমে হয়ে গেল। কাপুরুষের শাস্তি একটাই। সে বিজ্ঞানের অবমাননা করেছে। পালিয়ে গিয়ে মুখের মতো কাজ করেছে সে, কারণ এ দুর্গে প্রবেশদ্বার আছে, কিন্তু পলায়নের পথ নেই। এবার ক্রাগের দৃষ্টি আমাদের দিকে ঘুরল। ক্ৰোধ চলে গিয়ে সেখানে দেখা দিল এক অদ্ভুত কৌতুকের ভাব। টেবিল থেকে ধীরে ধীরে নেমে সে আমাদের সামনে দাঁড়াল। তার দৃপ্ত ভঙ্গিতে বুঝলাম সে পুনর্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে পুনর্যৌবন ফিরে পেয়েছে। তার গলার স্বরেও আর বার্ধক্যের কোনও চিহ্ন নেই। থর আর ওডিনকে দিয়ে আর কোনও প্রয়োজন নেই আমার গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন ক্রাগ। তাদের জায়গা নেবে এখন তোমরা দুজন। যান্ত্রিক মানুষের নিজস্ব বুদ্ধি সীমিত। তোমাদের বুদ্ধি আছে। তোমরা আমার আদেশ মতো কাজ করবে। যে লোক সারা বিশ্বের মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে চলেছে, তারই অনুচর হবে তোমরা। ক্র্যাগ কথা বলতে বলতেই এক পাশে সরে গিয়ে একটা ছোট ক্যাবিনেটের দরজা খুলে তার থেকে একটা জিনিস বার করেছেন। একটা পাতলা রবারের মুখোশ। সেটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে পরে ক্রােগ তাঁর ডান হাতটা একটা সুইচের দিকে প্রসারিত করলেন। আমি জানি সুইচটা টিপলে কোনও অদৃশ্য ঝাঁঝরি বা নলের মুখ থেকে একটি সর্বনাশা গ্যাস নিৰ্গত হবে, এবং তার ফলে আমরা চিরকালের মতো– মাস্টার! ক্রাগের হাত সুইচের কাছে এসে থেমে গেল। সিঁড়ির মুখে নিলস এসে হাঁপাচ্ছে, তার চোখে বিহ্বল দৃষ্টি। প্রোফেসর পাপাডোপুলস পালিয়েছেন। পালিয়েছে? ক্ৰাগ যেন এ কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না! ইয়েস মাস্টার। প্রোফেসর সেই বন্ধ ঘরের সামনে গিয়েছিলেন; দরজার তালা ভাঙা, তাই হেনরিক সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। হেনরিকের হাতে রিভলভার ছিল। প্রোফেসর তাকে দেখে পালায়। হেনরিক পিছু নেয়। প্রোফেসর দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের বড় জানালাটা দিয়ে বাইরে কার্নিশে লাফিয়ে পড়েন। প্রোফেসর অত্যন্ত ক্ষিপ্র, অত্যন্ত– নিলসের কথা শেষ হল না। একটা নতুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দ এতই অপ্রত্যাশিত যে, ক্রাগও হতচকিত হয়ে সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। শব্দটা এবার আরও কাছে। নিলসের মুখ কাগজের মতো সাদা। সে দরজার সামনে থেকে ছিটকে সরে এল। পরমুহুর্তে একটা প্ৰকাণ্ড হুঙ্কার দিয়ে সিঁড়ি থেকে এক লাফে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করল একটা জানোয়ার। ঘরের নীল আলো তার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ রোমশ দেহে প্রতিফলিত। তার গলায় এখনও ঝুলছে সেই তারিখ লেখা কার্ড। একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে ক্রাগের মুখ থেকে। সেই শব্দ অতি কষ্টে উচ্চারিত দুটো নামে পরিণত হল— ওডিন! থর। ক্রাগ চেচাতে গিয়েও পারলেন না। এদিকে থর নিথর, নিষ্পন্দ। সামারভিল থিরের হাত থেকে বিশাল হাতুড়িটা বার করে নিল। দু হাতে সেটাকে শক্ত করে ধরে দু পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। জানোয়ার আমাদের আক্রমণ করলে ওই হাতুড়িতে আত্মরক্ষণ হবে না জানি; আর এও জানি যে, জানোয়ারের লক্ষ্য আমাদের দিকে নয়। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে তারই দিকে যে এত দিন তাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিল। বিপদের চরম মুহুর্তে আমার মাথা আশ্চর্যরকম পরিষ্কার থাকে সেটা আগেও দেখেছি। ক্রাগের ডান হাত সুইচের দিকে এগোচ্ছে দেখে, এবং সে গ্যাসের সাহায্যে বাঘ সমেত আমাদের দুজনকে বিধ্বস্ত করতে চাইছে জেনে আমি বিদুদ্বেগে এক হ্যাঁচক টানে তার মাথা থেকে মুখোশটা খুলে ফেললাম। আর সেই মুহুর্তে ব্ল্যাক প্যানথারও পড়ল তার উপর লাফিয়ে। ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাবার সময় শুনলাম ক্রাগের অভ্ৰভেদী আর্তনাদ। আর তার পরমুহুর্তেই শুনলাম পরিচিত গলায় আমাদের নাম ধরে ডাক। শঙ্কু! সামারভিল! আমরা উপরের করিডরে পৌঁছে গেছি, কিন্তু পাপাডোপুলস কোখেকে ডাকছে সেটা চট করে ঠাহর হল না। এই গোলকধাঁধার ভিতরে শব্দের উৎস কোন দিকে সেটা সব সময় বোঝা যায় না। সামনে ডাইনে একটা মোড়। সেটা ঘুরতেই সেই নিষিদ্ধ দরজা পড়ল। সেটা এখন খোলা। তার সামনে পা ছড়িয়ে রক্তাক্ত দেহে মরে পড়ে
false
toslima_nasrin
না এই দল। জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। মাননীয় স্পীকার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সংসদ ভবন শেরে বাংলা নগর, ঢাকা জনাব, যথাযথ সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে ১. বাংলাদেশের আপামর জনতা গভীর ভাবে ধর্মপ্রাণ এবং এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যপারে অত্যন্ত সচেতন ও যত্নশীল এ সত্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু কতিপয় বিভ্রান্ত মহল জনগণের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানাকে প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন মনে করে জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের হীন তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ হেন দুষ্কর্মের পিছনে ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সুস্থিতির প্রতি বৈরি মহল সমূহের মদদ ও যোগসাজস রয়েছে তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। ২. তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা ক্রমাগত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম, বই ও উপন্যাস লিখে একাধারে বাংলাদেশের সকল ধর্ম বিশ্বাসীর ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলছে। অন্যদিকে অত্যন্ত সুচতুর ও সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। ৩. মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যভিত্তিক অসৎ উদেবদশ্য প্রণোদিত উপন্যাস লজ্জা লিখার মাধ্যমে তসলিমা নাসরিন এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং দেশী বিদেশী কতিপয় সাম্প্রদায়িক মহলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণতার দিকে উস্কে দিয়েছে। অথচ সরকার শুধুমাত্র লজ্জা উপন্যাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও তসলিমা নাসরিনের বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে বহু উস্কানিমূলক বক্তব্য রয়েছে যা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। সরকারের এহেন আচরণে দেশপ্রেমিক জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্থ। ৪. যদিও সাংবিধানিকভাবে এবং দেশের প্রচলিত আইনে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানা এবং তাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু এ ধরনের দেশ ও ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান না থাকায় দেশদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী মহল সমূহ বেপরোয়া ভাবে অপকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক সংঘাত ও অস্থিরতার ইন্ধন যোগাচ্ছে। ৫. বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান। লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার বিভিন্ন বই ও লেখার মাধ্যমে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন, নবী(দঃ)এর হাদিস এবং ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন বিধি বিধানের প্রতি অবমাননামূলক কটাক্ষ প্রতিনিয়তই করে চলেছে এবং তার এহেন ধর্মদ্রোহী আচরণের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল সকল ধর্মীয় মহল থেকে জোর প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এ ব্যপারে দুর্বল আইনের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে রহস্যজনক ভাবে নিষিক্রয়তার পথই অবলম্বন করে চলেছেন। ফলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণেই বর্তমান আইন কানুন ও সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন। ৬. লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু ধর্মের উপরেই আঘাত হানছে না, সমাজে প্রচলিত সার্বজনিন মূল্যবোধের বিপরীতে ব্যভিচার, অবাধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক জুলুমের ফাঁপানো ফুলানো কল্পকাহিনী প্রচার করে সামাজিক সুস্থিতি বিনষ্টের অপপ্রায়াসেও লিপ্ত রয়েছে। তার লেখা যে পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে এবং তা এ দেশের যুব সমাজকে উμছৃঙ্খলতা ও নৈতিক অক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বৈ ত কিছুই নয়। এমতাবস্থায় আমরা দেশ প্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জোর দাবী জানাচ্ছি যে ১. দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী মুরতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড সহ কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন। ২. তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ৩. তার যাবতীয় আপত্তিকর লেখা বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। (শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক) আহবায়ক ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি সাত মসজিদ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা প্রায় একইরকম চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও দেওয়া হয়। ‘জনাব, আমরা অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সাথে আপনার সমীপে নিবেদন করছি যে বাংলাদেশের বারো কোটি দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ অনুভূতিতে আবমাননাসূচক আঘাত হেনে তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা….।’ লেখকের মাথার মূল্য ধার্য করা হয়েছে বাংলাদেশে। এ খবরটি বিশাল খবর, বিশেষ করে ইওরোপ আমেরিকায়। সালমান রুশদির ঘটনার পর এরকম একটি খবর লুফে নেবে বটে বিদেশের প্রচার মাধ্যম। একজন লেখক তাঁর লেখার কারণে ফতোয়ার শিকার হয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলছে মুসলিম মৌলবাদীরা। রাজপথে মিছিল হচ্ছে। এমন সব খবর পড়ে লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশের মানুষ। ইওরোপে আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে মানবাধিকার কর্র্মী, লেখক সমাজ, নারীবাদী দল। বিভিন্ন বিদেশী সংগঠন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে, আমাকে যেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়, মৌলবাদীদের যেন দমিয়ে রাখা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় উপ সম্পাদকীয় লেখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইংরেজিতে দুটো কথা না হয় চলে, তাই বলে লেখা! বলে দিতে নিই আমার পক্ষে অসম্ভব। তখন অসম্ভব কে সম্ভব করার জন্য এপির সাংবাদিক ফরিদ হোসেন এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে ফরিদ হোসেন বেশ অনেকবার যাওয়া আসা করেছেন আমার বাড়িতে, বিদেশি পত্রিকা থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার খবরাখবর নেওয়ার জন্য। ফরিদ হোসেন সুশিক্ষিত সাংবাদিক, অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক, আন্তরিক। কেবল সাংবাদিক হিসেবে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না, দুঃসময়ে বন্ধুর মত পাশে দাঁড়াতেও আসেন। উপসম্পাদকীয়টি আমি বাংলায় লিখি, ফরিদ হোসেন আমার বাংলার ইংরেজি করে দেন। ডাক্তার রশীদ ঢাকা মেডিকেল থেকে সিলেটের মৌলভীবাজারে বদলি হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে ঢাকায় এলে আমার বাড়িতেই ওঠেন, আমার লেখার ঘরে তাঁর শোবার জায়গা করে
false
toslima_nasrin
যে তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছো বলে আমাদের সম্পর্কে শেষ হওয়া উচিত। সম্পর্কটি শেষ হওয়া উচিত, তুমি আমাকে ভাল বাসো না বলে। ভাল তোমাকে আমি বাসি। রুদ্র জোর দিয়ে বলে। যে ভালবাসায় বিশ্বাস নেই! বিশ্বাস আমি তোমাকে করি। তুমি কর আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাসের কথা ভেবেছো? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? বিশ্বাস না থাকলে কি ভালবাসা যায়! শিল্পের মানুষদের একটু এরকম হয়ই। শিল্পের মানুষেরা সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে না। তোমার তা বোঝা উচিত। আমি শিল্পের মানুষ জেনেই তো আমাকে বিয়ে করেছো। তবে আর এত প্রশ্ন করো কেন? সমাজের নিয়ম কানুনের কথা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিস, সেই বিশ্বাসের কথা হচ্ছে। আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি, শিল্পের মানুষ হলে সাত খুন মাপ তাই না! শিল্পের মানুষ বলে যা কিছু করার স্বাধীনতা তোমার আছে। শিল্পের মানুষ না হলে বুঝি নেই!আমিও তো কবিতা লিখি, তাই বলে আমিও তাই তাই করতে পারব যা তুমি কর? নাকি আমার সেই স্বাধীনতা নেই যেহেতু আমি ভাল কবিতা লিখি না? যেহেতু তুমি ভাল লেখো, তুমি পারো! নাকি তুমি পুরুষ হয়েছো বলে পারো। আমি মেয়ে বলে আমার সে স্বাধীনতা থাকতে নেই? রুদ্র চপু করে থাকে। অনেকক্ষণ সে চেয়ে থাকে জানালায়, একটি উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই সামনে। শাদা চুনকাম করা একটি দেয়াল শুধু আমি রুদ্রর চোখে চেয়ে থাকি। অনেককক্ষণ ওভাবেই দেয়ালে চেয়ে থেকে সে বলে, শেষবারের মত ক্ষমা করতে পারো না? গতবারও তো শেষবার বলেছিলে? সত্যিকার শেষবার তোমার কোনওদিন হবে না। হবে। সে আগেও বলেছিলে। আসলে কি জানো, এ তোমার স্বভাব। স্বভাব বদলানো এত সহজে সম্ভব নয়। ঠিক আছে আমাকে আরও সময় দাও। আমি স্বভাব বদলাবো। কেন বদলাবে? তুমি কি সত্যিই চাও বদলাতে? চাইলে তুমি সেই শুরু থেকেই পারতে বদলাতে। আর বদলানোর প্রয়োজনটাই বা কি? তুমি তো মনে করো না তোমার স্বভাবে কোনও ত্রুটি আছে। রুদ্র বিছানা ছেড়ে উঠে যায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলতে বলতে, তোমাকে তো কতবার বলেছি,আমার সঙ্গে থাকো সবসময়। বিয়ের পর থেকে কতদিন আমার সঙ্গে থেকেছো বল! তোমার দ্বিধা ভাঙতেই লেগেছে তিন বছর। এভাবে একজন পুরুষ পারে নাকি একা থাকতে? আমি তো পেরেছি একা থাকতে। মেয়েদের জন্য যা সম্ভব, পুরুষের জন্য তা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়? যে কারণই হোক, আমি পারিনি। ঢাকা ফিরে তোমাকে বাড়িতে না দেখে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাই বেরিয়ে গিয়ে মদ খেয়েছি। আর মদ খাওয়ার কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছে। মনে হচ্ছে রাগ হলেই তুমি মদ খাও! আর যেন খাও না? তুমি না রাগ হলে মদ খাও না? তুমি কি সুখে থাকলে মদ খাও না? মদের কথা বাদ দাও। সম্পর্কের শুরু থেকে যে আমার সঙ্গে থাকোনি সেটার কি বলবে? ভাল করেই জানো ময়মনসিংহে থাকতে হয়েছে মেডিকেলে লেখাপড়া করার জন্য। এখন তো ঢাকায় পাকাপাকি থাকার আমার কোনও অসুবিধে নেই। দৌড়োচ্ছে! তো তুমিই। আমার সঙ্গে শুরু থেকেই থাকা উচিত ছিল তোমার। তার মানে তুমি কি বলতে চাও আমার ডাক্তারি পড়া ছেড়ে তোমার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল? তোমার সুবিধের জন্য। তাই তো? যেন তোমার কোনও স্খলন না হয়! আচ্ছা, আমার যখন চাকরি হবে, সে যে মোংলা বা মিঠেখালিতে হবে, তার তো কোনও কথা নেই। আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে, তুমি চিংড়ির ঘের দেখতে যাবে বা ধান বিক্রি করতে যাবে, তোমার সঙ্গে মোংলা মিঠেখালি যেতে হবে কারণ যদি তোমার শরীর উত্তেজিত হয় সেই উত্তেজনা মেটাতে যেন একটি মেয়েমানুষের শরীর তুমি হাতের কাছে পাও? রুদ্র চপু করে থাকে। আমি বলি,যখন তোমাকে ছাড়া থাকি, আমার শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে আমি তো অন্য কোনও পুরুষের কাছে যাই না। অন্য কোনও পুরুষের কোনও ভাবনাই তো আমার মাথায় উঁকি দেয় না। আমি তো পারি না, তুমি পারো কি করে! এর কারণ কি জানো? এর কারণ হল, আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই অন্য পুরুষের কাছে যেতে পারি না। আর তুমি আমাকে ভালবাসো না বলেই পারো। খুব সহজ উত্তর। সহজ উত্তরটি রুদ্র মানবে না জানি। সে বলবে সে আমাকে ভালবাসে। সে যে অন্য মেয়েদের সঙ্গে শুয়েছে, সে ভালবেসে নয়। রুদ্রর উত্তরও খুব সহজ। কিন্তু সহজ উত্তরটি না দিয়ে রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে, আমি মুক্ত দাম্পত্যে বিশ্বাস করি। তোমাকে আগেই বলেছি। যে দাম্পত্যে কোনও বন্ধন নেই। যে দাম্পত্য আর সব দাম্পত্য জীবনের মত নয়। যে দাম্পত্য জীবনে আমার কোনও শ্বাসকষ্ট হবে না। আমার মনে হবে না আমি আটকা পড়েছি। যে দাম্পত্য কোনও খাঁচা হয়, বরং মুক্ত আকাশ। রুদ্র তার লেখার টেবিলের চেয়ারে বসে বিছানায় পা তুলে দিয়ে বলে,—হ্যাঁ। তাই তো তোমাকে বলেছি। বলেছি যে কোনও আঁটসাঁট জামা আমাকে পরাতে চেও না। তার মানে কি এই যে তুমি যে কোনও মেয়ের সঙ্গে শোয়ার স্বাধীনতা চাও! তুমি সঙ্গে থাকলে আমি তো সে চাই না। আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি চাও? চাই না। হয়ে যায়। হয়ে যায় মানে? হয়ে যায় মানে হয়ে যায়। ধর আমারও যদি হয়ে যায়! তার মানে? চকিতে ভুরু কুঁচকে ওঠে রুদ্রর। পা নেমে যায় বিছানা থেকে। বিছানায় তার মুখোমুখি বসে, কুঁচকে থাকা ভুরুর তলে তার সঙ্কুচিত হয়ে আসা
false
humayun_ahmed
(আবারো ইবলিশের কাজ)। তিনি কল্পনা করেই যেতে লাগলেন। কী ঘটছে তিনি চোখের সামনে দেখতেও পাচ্ছেন- এই তিনি উঠানে পা দিলেন। জুলেখা জলচৌকিতে বসেছিল। পরনে শাড়ি। মাথায় ঘোমটা নেই। মাথাভর্তি চুল। তাঁকে দেখে লজ্জা পেয়ে জুলেখা উঠে দাঁড়াল। তিনি বললেন, এখানে কী চাও? তোমাকে না বলেছি। এ বাড়িতে আসবে না? আবার কেন আসছ? আপনাকে দেখার জন্যে আসছি। কেন? আমি যত মন্দই হই, আপনি আমার স্বামী। এরকম নাপাকি কথা বলব না। আমি নাপাক, কিন্তু আপনি আমার স্বামী— এর মধ্যে নাপাকি। কী? আমি তাওবা করব। তওবা করে আপনার সঙ্গে সংসার করব। চুপ। ধমক দিয়েন না। অজুর পানি দেন। আমি অজু করে তওবা করব। বাকি জীবন বোরকা পরে থাকব। কেউ জানবে না। আমি কে! এইখানে থাকলেই জানাজানি হবে। তাইলে চলেন নাও নিয়া দূরে চইলা যাই। ভাটি অঞ্চলে যাইবেন? ভাটির শেষ সীমায়? চুপ করব? না, চুপ করব না। উঠানে পা দিয়ে মাওলানার চিন্তা বন্ধ হলো। উঠানে কেউ নেই। জলচৌকি শূন্য। তাঁর মনটা খারাপ হলো। সব শয়তানের খেলা। মাওলানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। রাতে গোসল করে পবিত্র হলেন। শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তিনবার সূরা ইয়াসিন পাঠ করলেন। মন পবিত্র করার জন্যে এরচে’ ভালো সূরা নাই। তার মন ততটা পবিত্র হলো না। রাতে খেতে বসার সময় মনে হলো— জুলেখাকে ভাত খাইয়ে দেয়া উচিত ছিল। না খাইয়ে তাকে বিদায় করেছেন, কাজটা ঠিক হয় নাই। আজকে আয়োজনও ভালো ছিল। কাঠালের বিচি দিয়ে মুরগির সালুন। হাফেজ সাহেবের জন্যে রান্না করে কেউ একজন পাঠিয়েছে। আজ ডালটাও ভালো হয়েছে। আমচুর দিয়ে টক ডাল, এর স্বাদই অন্যরকম। মেয়েরা টিক পছন্দ করে। মাওলানার একবারও মনে হলো না— জুলেখা এ বাড়িতে আসে নি। পুরোটাই তাঁর কল্পনা। কিংবা তার ভাষায়— শয়তানের জটিল খেলা। মাওলানার মস্তিষ্ক বিকৃতির সেটাই শুরু। ফজরের নামাজ পড়ার জন্যে ঘুম ভাঙতেই মাওলানা শুনলেন পাশের ঘর থেকে জুলেখা মধুর স্বরে কোরান আবৃত্তি করছে। তিনি বললেন, জুলেখা, নিচু গলায় পড়। পরপুরুষ তোমার কণ্ঠস্বর শুনবে, এইটা ঠিক না। জুলেখা বলল, জঙ্গলার মধ্যে বাড়ি। আপনি ছাড়া এইখানে তো কেউ নাই। মাওলানা বললেন, এইটাও যুক্তির কথা। তারপরেও নিচু গলায় পড়া ভালো। ধর, জঙ্গলে কেউ লাকড়ির সন্ধানে যদি আসে। কিংবা হারানো গরু, যদি খুঁজতে খুঁজতে আসে। জুলেখা মনে হয় যুক্তি মেনেছে। এখন তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। রঙিলাবাড়ির ঘাটে মাঝারি আকৃতির বজরা এসে থেমেছে। বজরায় আছেন মোহনগঞ্জের বাম গ্রামের শৈলজারঞ্জন মজুমদার। রসায়নশাস্ত্ৰে . করা দারুণ পড়ুয়া মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন। শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান ভবনে যোগ দেবার চিঠি। মানুষটা গানপাগল। চান বিবি নামের অতি সুকণ্ঠী গায়িকার খবর পেয়ে এসেছেন। রঙিলাবাড়িতে উপস্থিত হতে তার রুচিতে বাঁধছে। তিনি চান বিবিকে খবর পাঠিয়েছেন। যদি সে বজরায় এসে কয়েকটা গান শোনায়। অপ্রচলিত গান সংগ্রহেও তার ঝোক আছে। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় (শ্রাবণ মাস এবং ভদ্র মাস) নৌকায় ঘুরে ঘুরে গান সংগ্রহের বাতিকও তাঁর আছে। তিনি শুধু যে গান লিখে রাখেন তা না, গানের সুরও আকার মাত্রিক স্বরলিপিতে লিখে ফেলেন। স্বরলিপি লেখার বিষয়ে তার দক্ষতা আছে। চান বিবি সন্ধ্যাবেলায় বজরায় উপস্থিত হলো। তার সঙ্গে দুজন দাসি। একজনের হাতে কার্পেটের আসন। অন্যজনের হাতে রূপার পানদানিতে সাজানো পান। চান বিবি কর্পেটের আসনে বসতে বসতে বলল, কী গান শুনবেন গো? শৈলজারঞ্জন মজুমদার বললেন, তুমি তোমার পছন্দের গান কর। চান বিবি বলল, আমার পছন্দের গান আমি করি আমার জন্য। আপনের জন্য কোন করব? শৈলজারঞ্জন বললেন, সেটাও তো কথা। তোমার যে গান গাইতে ইচ্ছা করে গাও। ধামাইল শুনবেন? শুনব। নাকি আমিন পাশার পাগলা গান শুনবেন। পাগলা গান কী? পদে পদে তালফেরতা মজা আছে। তোমার সঙ্গে তো তবলা নেই। তাল আসবে কোথেকে। আমার গলায় তাল আছে। শৈলজারঞ্জন তিনটি গান শুনেই বললেন, আর লাগবে না। চান বিবি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমার গান কি আপনার পছন্দ হয় নাই? পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আর শুনব না। আমি অতি বিখ্যাত একজন মানুষকে তোমার গান শোনার ব্যবস্থা করে দেব। উনাকে গান শুনিও। উনি যদি খুশি হন তাহলে তোমার মানবজন্ম ধন্য হবে। চান বিবি অবাক হয়ে বলল, এই মানুষ কে? শৈলজারঞ্জন বললেন, উনি বাংলাগানের রাজার রাজা। তার নাম রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর। তুমি নিশ্চয়ই তার গান কখনো শোন নি? আমি উনাকে চিনেছি। উনার গানরে বলে রবিবাবুর গান। একটা গানের সুর পরিষ্কার মনে আছে। কথা মনে নাই। এক দুই পদ মনে আসে। শৈলজারঞ্জন অবাক হয়ে বললেন, এক দুই পদ শোনাও তো। চান বিবি শুদ্ধ সুরে গাইল– চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে– নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে। শৈলজারঞ্জন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আমি গানটা ঠিক করে লিখে দেই? তুমি ভালোমতো শিখে রাখ। সত্যি যদি কোনোদিন সুযোগ হয়। রবীন্দ্রনাথকে গানটা শোনাবে। চান বিবি হ্যাঁ-সূচক ঘাড় কাত করল। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন ময়মনসিংহে। তিনদিন থাকবেন। শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের উপর কয়েকটা বক্তৃতা দেবেন। ময়মনসিংহের ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে থিয়েটার দেখবেন। তার জন্যে পাখি শিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তিনি শিকার পছন্দ করেন না বলে সেই প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে। তার বদলে ব্ৰহ্মপুত্র নদে বিহার এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান। রবীন্দ্ৰনাথ ময়মনসিংহে পৌঁছে জমিদারদের টানাটানিতে পড়ে গেলেন। কোথায় রাত কাটাবেন এই নিয়েও সমস্যা। শশীকান্ত আচার্য চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ
false
robindronath
লইয়া কহিল, “যখন ত্যাগ এবং লাভ একেবারে সমান হইয়া যায় তখনই তাহা যথার্থ লাভ, এই কথা আমার গুরু বলেন। সত্য বলিতেছি বোন, তোমার মতো অমনি সমস্ত নিবেদন করিয়া দিয়া যে সার্থকতা তাহাই যদি আমার ঘটে, তবে আমি ধন্য হইব।” কমলা কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন দিদি, তুমি তো সবই পাইবে, তোমার তো কোনো অভাবই থাকিবে না।” হেননলিনী কহিল, “যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ। আমার মুখে এ-সব কথা তোমার আশ্চর্য লাগিবে, আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগে, কিন্তু এ-সব কথা ঈশ্বর আমাকে ভাবাইতেছেন। জান না, বোন, আজ আমার মনে কী ভার চাপিয়া ছিল— তোমাকে পাইয়া আমার হৃদয় হালকা হইল, আমি বল পাইলাম, তাই আমি এত বকিতেছি। আমি কখনো কথা কহিতে পারি না, তুমি কেমন করিয়া আমার সব কথা টানিয়া লইতেছ ভাই ?” ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার উপরকার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা রমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল। চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে— তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন, সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করিয়াছ— সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ো না। যদিও আমি এক দিনের জন্য কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল, এ কথা তোমার কাছে আমার স্বীকার করা কর্তব্য। আজ আমার হৃদয় কী অবস্থায় আছে তাহা আমি নিশ্চয় জানি না। তুমি যদি আমাকে ত্যাগ না করিতে তবে তোমার মধ্যে আমি আশ্রয় লাভ করিতে পারিতাম। সেই আশ্বাসেই আমি আমার বিক্ষিপ্ত চিত্ত লইয়া তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট দেখিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করিয়া আমার নিকট হইতে বিমুখ হইয়াছ, যখন শুনিলাম অন্যের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধে তুমি সম্মতি দিয়াছ, তখন আমারও মন আবার দোলায়িত হইয়া উঠিল। দেখিলাম এখনো কমলাকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই। ভুলি বা না ভুলি, তাহাতে সংসারে আমি ছাড়া আর- কাহারো কোনো ক্ষতি নাই। আমারই বা ক্ষতি কিসের ! সংসারে যে দুটি রমণীকে আমি হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিয়াছি তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হইবার সাধ্য আমার নাই এবং তাঁহাদিগকে চিরজীবন স্মরণ করাই আমার পরম লাভ। আজ প্রাতে যখন তোমার সহিত ক্ষণিক সাক্ষাতের বিদ্যুদ্‌বৎ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম তখন একবার মনে মনে বলিলাম, ‘আমি হতভাগ্য !’ কিন্তু আর আমি সে কথা স্বীকার করিব না। আমি সবলচিত্তে আনন্দের সহিত তোমার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিতেছি— আমি পরিপূর্ণ-হৃদয়ে তোমার নিকট হইতে প্রস্থান করিব—তোমাদের কল্যাণে, বিধাতার কল্যাণে, আমি অন্তরের মধ্যে এই বিদায়কালে যেন কিছুমাত্র দীনতা অনুভব না করি। তুমি সুখী হও, তোমার মঙ্গল হউক। আমাকে তুমি ঘৃণা করিয়ো না, আমাকে ঘৃণা করিবার কোনো কারণ তোমার নাই। অন্নদাবাবু চৌকিতে বসিয়া বই পড়িতেছিলেন। হঠাৎ হেমনলিনীকে দেখিয়া তিনি চমকিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “হেম, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?” হেমনলিনী কহিল, “অসুখ করে নাই। বাবা, রমেশবাবুর একখানি চিঠি পাইয়াছি। এই লও, পড়া হইলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ো।” এই বলিয়া চিঠি দিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু চশমা লইয়া চিঠিখানি বার-দুয়েক পড়িলেন, তাহার পরে হেমনলিনীর নিকট ফেরত পাঠাইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। অবশেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, এ একপ্রকার ভালোই হইয়াছে। পাত্র হিসাবে রমেশের চেয়ে নলিনাক্ষ অনেক বেশি প্রার্থনীয়। ক্ষেত্র হইতে রমেশ যে আপনিই সরিয়া পড়িল, এ হইল ভালো। এ কথা ভাবিতেছেন, এমন-সময় নলিনাক্ষ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া অন্নদাবাবু একটু আশ্চর্য হইলেন। আজ পূর্বাহ্নে নলিনাক্ষের সঙ্গে অনেক ক্ষণ দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছে, আবার কয়েক ঘণ্টা যাইতে না যাইতেই সে কী মনে করিয়া আসিল ? বৃদ্ধ মনে মনে একটুখানি হাসিয়া স্থির করিলেন, হেমনলিনীর প্রতি নলিনাক্ষের মন পড়িয়াছে। কোনো ছুতা করিয়া হেমনলিনীর সহিত নলিনাক্ষের দেখা করাইয়া দিয়া নিজে সরিয়া যাইবেন কল্পনা করিতেছেন, এমন সময় নলিনাক্ষ কহিল, “অন্নদাবাবু, আমার সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব উঠিয়াছে। কথাটা বেশি দূর অগ্রসর হইবার পূর্বে আমার যাহা বক্তব্য আছে, বলিতে ইচ্ছা করি।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঠিক কথা, সে তো বলাই কর্তব্য।” নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি জানেন না, পূর্বেই আমার বিবাহ হইয়াছে।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “জানি। কিন্তু— ” নলিনাক্ষ। আপনি জানেন শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। কিন্তু তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ আপনি অনুমান করিতেছেন। নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এমন-কি, তিনি বাঁচিয়া আছেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি। অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঈশ্বর করুন, তাহাই যেন সত্য হয়। হেম, হেম।” হেমনলিনী আসিয়া কহিল, “কী বাবা !” অন্নদাবাবু। রমেশ তোমাকে যে চিঠি লিখিয়াছেন, তাহার মধ্যে যে অংশটুকু— হেমনলিনী সেই চিঠিখানি নলিনাক্ষের হাতে দিয়া কহিল, “এ চিঠির সমস্তটাই উঁহার পড়িয়া দেখা কর্তব্য।” এই বলিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল। চিঠিখানি পড়া শেষ করিয়া নলিনাক্ষ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “এমন শোচনীয় ঘটনা সংসারে প্রায় ঘটে না। চিঠিখানি পড়িতে দিয়া আপনার মনে আঘাত দেওয়া হইল, কিন্তু ইহা আপনার কাছে গোপন করাও আমাদের পক্ষে অন্যায় হইত।” নলিনাক্ষ একটুখানি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া উঠিল। চলিয়া যাইবার সময় উত্তরের বারান্দায়
false
humayun_ahmed
সঙ্গে নিয়েই খুলনা যাবেন। সেই পরিকল্পনাও কার্যকর করা যাচ্ছে না। মুনিরের দেখা নেই। সেই যে ডুব দিয়েছে, ডুবাই দিয়েছে। আর উদয় হচ্ছে না। তার ঠিকানা জানা নেই বলে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। সে কোথায় থাকে তা একবার মনে হয় বলেছিল– এখন মনে পড়ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সে খুব যত্ন করে মনে করে রাখে, প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো মুছে ফেলে। যেটেলিফোন নাম্বারটি মনে করা দরকার সেটি মনে পড়ে না, অথচ প্রয়োজন নেই এমন টেলিফোন নাম্বারগুলো একের পর এক মনে পড়তে থাকে। ডাক্তার এ মল্লিক। মানুষটি ছোটখাট। চেহারায় বয়সের তেমন ছাপ নেই, তবে মাথার সমস্ত চুল পাকা। যেন শরতের সাদা মেঘের একটা টুকরো মাথায় নিয়ে হাসিখুশি ধরনের এক জন মানুষ বসে আছেন। ডাক্তার এ মল্লিক বললেন, আমি কি আপনাকে চিনি? জ্বি-না। আমার নাম মিসির আলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ও, আচ্ছা আচ্ছা, আগে বলবেন তো। আগে বললে কি হত? না, মানে আরো খাতির করে বসতাম। মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে বললেন, আপনি যথেষ্ট খাতির করেছেন। ছুটির দিন, কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বাতিল করলেন। বাতিল করি নি। বাতিল করলে উপায় আছে? মহিলারা সেজোগুঁজে বসে আছে। তারা আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে! হা হা হা। কি ব্যাপার বলুন। আমি না-হয় বিকেলে আসি? পাগল হয়েছেন? বিকেলে দুটো প্রোগ্রাম। একটা জন্মদিন, একটা বিয়ে। যা বলবার এক্ষুণি বলুন। আমার নিজের কোথাও বেরুতে ইচ্ছা করছে না। আপনি আসায় একটা অজুহাত তৈরি হল। বাড়ির মেয়েদের বলতে পারব কাজে আটকা পড়েছি। হা হা হা। আসুন, আমার একটা ব্যক্তিগত ঘর আছে, সেখানে যাই। ডাক্তার সাহেবের ব্যক্তিগত ঘর দেখার মতো। মেঝেতে কাৰ্পেট বসার জন্যে চমৎকার কিছু রকিং চেয়ার। দেয়ালে অরিজিনাল পেইন্টিং। ঘরটিতে এয়ারকুলারও বসান। এটা হচ্ছে আমার নিজস্ব ড্রয়িং রুম। খুব নির্বাচিত কিছু অতিথির জন্যে। আমি কি খুব নির্বাচিত কেউ? কি জন্যে আপনি এসেছেন তা জানার পর বোঝা যাবে। তবে একটা অনুমান অবশ্যি করছি। ঢাকা থেকে শুধু আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন, সেই থেকেই অনুমানটা করছি। হা হা হা। একটু বসুন। ঠাণ্ডা কিছুদিতে বলি। মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। উনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ে খুব বিনীত ভঙ্গিতে মিষ্টির প্লেট নামিয়ে লাজুক হাসি হাসল। মিসির আলির অস্বস্তি আরো বাড়ল। তাঁর মন বলছে, এই মেয়েটির বিয়ের কোনো কথাবার্তা হচ্ছে। এবং তারা ধরেই নিয়েছে তিনি ঢাকা থেকে এই ব্যাপারেই এসেছেন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, যাচ্ছে না। তার উপর এই বোধহয় নির্দেশ। কি নাম তোমার খুকি? আমার নাম মীরা। বাহ্, খুব সুন্দর নাম। কী পড়? বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে পড়ি। বাহ্‌, ডাক্তারের মেয়ে ডাক্তারা এখন কি কলেজ ছুটি? জ্বি-না। বাবা হঠাৎ আসতে লিখলেন …। মেয়েটি কথা শেষ করল না। হঠাৎ অস্বাভাবিক লজ্জা পেয়ে গেল। মিসির আলি মনে-মনে ভাবলেন, চমৎকার একটি মেয়ে! এই মেয়ের বিয়ের সঙ্গে কোনো-না- কোনোভাবে যুক্ত থাকা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। মীরা, তুমি এখন যাও। তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দাও। ডাক্তার সাহেব ঘরে ঢুকলেন হাসিমুখে, কেমন দেখলেন আমার মেয়েকে? খুব ভালো মেয়ে! চমৎকার মেয়ে! আমি কিন্তু আপনার মেয়ের বিয়ের কোনো ব্যাপারে আসি নি। অন্য ব্যাপারে এসেছি। তবে মীরার বিয়ের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারলে অত্যন্ত খুশি হব। ডাক্তার সাহেব নিভে গেলেন। মিসির আলির বেশ খারাপ লাগল। ঢাকা থেকে কি কারোর আসার কথা ছিল? জ্বি, ছিল! গত পরশু আসার কথা। সেই জন্যেই মেয়েটাকে বরিশাল থেকে আনালাম। আমার বড় মেয়ে থাকে রাজশাহী, সেও এসেছে। মোটামুটি একটা বেইজ্জতি অবস্থা! নিশ্চয়ই কোনো- একটা ঝামেলা হয়েছে, যে জন্যে আসতে পারছে না। তা তো হতেই পারে। কিন্তু খবর তো দেবে? আপনি যদি চান তাহলে তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢাকায় ফিরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাতে পারি। ডাক্তার সাহেব হা-না কিছুই বললেন না। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে প্রস্তাবটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, তবে সরাসরি হ্যাঁ বলতে তাঁর বাধছে। সম্ভবত স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম আলাপ করবেন। তারপর বলবেন। মিসির আলি বললেন, আমি কি জন্যে এসেছি সেটা কি আপনাকে বলব? হ্যাঁ, বলুন। আপনি কি অনেকদিন নেত্রকোণায় ছিলেন? হ্যাঁ, ছিলাম। পাঁচ বছর ছিলাম নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে। সে তো অনেক দিন আগের কথা। কামরুদিন সাহেব নামে কাউকে চিনতেন? উকিল? বেশ নামকরা উকিল। খুব ভালো করে চিনতাম। অত্যন্ত মেজাজি লোক ছিলেন। অসম্ভব দিল-দরিয়া। টাকা রোজগার করতো দুই হাতে, খরচ করতো চার হাতে। কী-একটা অনুষ্ঠান একবার করলেন-ছেলের আকিকা কিংবা মেয়ের জন্মদিনে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! ভদ্রলোক মারা গেলেন কীভাবে? অ্যাপেনডিসাইটিস। মফস্বল শহরের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। অপারেশনের সে রকম সুবিধা নেই। আমিও ছিলাম না। থাকলে একটা কিছু অবশ্যই করতাম। ঐ দিনই রাত দশটার ট্রেনে ময়মনসিং চলে আসি। আপনি এইসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? একটা কারণ আছে। কারণটা এই মুহূর্তে বলতে চাই না। পরে বলব। আপনি কি ওদের কোনো আত্মীয়? জ্বি-না। কামরুদিন সাহেবের স্ত্রী সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন? কোন বিষয়ে বলুন তো? উনি কেমন ছিলেন, কীভাবে মারা গেলেন, এইসব। খুব রূপবতী মহিলা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো মানসিক পরিবর্তন ওঁর হয়েছিল কি না জানি না, তবে নানান রকম গুজব শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কি রকম গুজব? অভিভাবকহীন রূপবতী মেয়েদের নিয়ে যেসব গুজব সাধারণত ছড়ায়, সেইসব মুক্তি,
false
nazrul
বলে ভাবতে পারি, কিন্তু অন্তত চিঠিটা গাপ করবার সময় এ কথাটি মনে হয়নি। পাছে আমার এ রকম ত্রুটি স্বীকারে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, – না, কলা খাইনি’- রূপ হাস্যাস্পদ কৈফিয়তের সন্দেহ তোমার মনটাকে সশঙ্ক চঞ্চল করে তোলে, তাই এই আগে থেকেই কৈফিয়ত কাটলাম। তুমি এতে রেগো না বোন। কারণ আমি নিঃসন্দেহে ঘোষণা করতে পারি যে, মেয়েদের এই চুরি স্বভাবটা কিছুতেই যাবে না, তা তাঁরা এটা এড়িয়ে চলবার যতই কেন কসরত দেখান না। ‘ইল্লত যায় না ধুলে, আর খসলৎ যায় না মলে এই ডাক-পুরুষে কথাটি একদম খাঁটি সাচ্চা বাত। গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতিতে যে-সব বাছা-বাছা চিজ চুরি করার অপরাধে অপরাধিনী করা হয় (যেমন কী, মন চুরি, প্রাণ চুরি ইত্যাদি) আমি সে-সব চুরির কথা বলছিনে, কিন্তু মেয়েদের এই চুরি করে আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনা, চুরি করে দেখা, চুরি করে অন্যের পত্রটি বেমালুম গাপ করে নিদেনপক্ষে একবার পড়ে নেওয়া, এই চুরিগুলো যে ভদ্র-মহিলা ঝুটা বলে উড়িয়ে দেবেন তিনি যে সত্য কথা বলছেন না, এ আমি কারুর মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি! এ বিদ্যা যে আমাদের মজ্জাগত, জন্মগত। যাক –। তোমার চিঠিতে যা সব লিখেছ, তা নিয়ে আর তোমায় লজ্জা-রাঙা করে তুলব না। আমার পক্ষে ও আলোচনা অন্যায়, কেননা আমি নাকি তোমার মহামাননীয়া ভাবি সাহেবা, পূজনীয়া শিক্ষয়িত্রী অর্থাৎ একাধারে দুটো মস্ত আদব-কায়দা দাবি-দাওয়াকারিণী। তোমাদের মতো এরকম বিশ্রী হলেও কই আমি তো তোমাদের কখনও এরকম বিশ্রী শিক্ষা দিইনি। আমি ভালোবাসতে স্নেহ দিতে শিখিয়েচি, কিন্তু ভয় করে ভক্তি করাটা কখনও শিক্ষা দিইনি। অবশ্য আমায় ভালোবাস, না ভক্তি কর, জানি না। যদি কোনোদিন ওরকম পাঠশালের ছেলের গুরুমশাইকে ভক্তি করার মতো আমাকে ভয়-ভক্তি করে থাক, তবে এখন থেকে আর তা কোরো না! এটুকু না লিখে পারলাম না বলে তুমি যেন কষ্ট পেয়ো না। তোমার দুঃখ-কষ্টের কথাগুলি আমার বুকে তিরের ফলার মতো এসে বিঁধেচে। তুমি কি বুঝবে মাহ্‌বুবা, আমি যখন আসি তুমি তখন ছিলে পাড়াগাঁয়ের সাদাসিদে অশিক্ষিতা সরলা বালিকা, আমিই যে তোমায় এত কষ্ট করে এতদিন ধরে মনের মতোটি করে গড়ে তুলেছি। তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে আমার নববধূ কালটা বড্ড আনন্দেই কেটে গিয়েছে। সোফিটা বড়ো দুষ্টু, সে তো আর তেমন শিখতে পারলে না, কিন্তু তোমার ওই বিদ্রোহ-অভিমান-মাধুর্যের সাথে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ আমায় তোমাকে একটু বেশি করেই ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল। তার পর যখন শুনলাম তুমি আমাদেরই ঘরের বউ হয়ে থাকবে, তখন সে কী যে আনন্দে আর গর্বে আমার প্রাণ শতধারে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, সে বললে তুমি হয়তো বাড়াবাড়িই মনে করবে। আগে যখনই মনে হত, আমার পোষা-পাখি-তুমি হয়তো অন্য কারু সোনার খাঁচায় বন্দিনী হয়ে কোন্ দূরে দেশে চলে যাবে, তখন একটা হিংসুটে বেদনায় যেন আমি বড্ড অসুস্থতা অনুভব করতাম। এ ভাবটা কিন্তু আমার মনে জেগেছিল নূরুল হুদা আমাদের বাড়ি আসবার পর থেকে। তোমাদের দুজনকে দেখলেই আমার মনে মধুর একটা আকাঙ্ক্ষা রঙিন হয়ে দেখা দিত, কিন্তু নূরুর খাম-খেয়ালির ভয়ে, আর বনের পাখি পাছে আবার বনে উড়ে যায় এই শঙ্কায় আমি কোনো দিনই এ কথাটা পাড়তে সাহস করিনি। আমার এ মন-গুমরানি শেষে যখন অসহ্য হয়ে দাঁড়াল, তখন সবাইকে বলে-কয়ে বুঝিয়ে এক রকম ঠিক করলাম, কিন্তু বনের পাখি পোষ মেনেও মানলে না। সে চলে গেল! মিঠা আর আঠা এই দুটোর লোভকেও সে সামলাতে পারছিল না, কিন্তু শেষে ডানা-কাটার ভয়টাই তার হয়ে উঠল সবচেয়ে বেশি, তাই সে উড়ে গেল! আমার এই অতিরিক্ত স্নেহের বাড়াবাড়ির জন্যে আজ আমার যা কষ্ট, তা এক আল্লাই জানেন বোন, আর আমিই জানি। এক এক দিন সব কথা আমার মনে হয়, আর বুক ফেটে পড়বার মতন হয়ে যায়! তোদের দুইজনের কাকে যে বেশি স্নেহ করতাম, তা কোনোদিন আমি নিজেই বুঝতে পারতাম না, তাই তোরা দুটিতেই আমার চোখের সামনে থাকবি, আমোদ-আহ্লাদ করবি আর আমারও দেখে জান ঠান্ডা হবে, চোখ জুড়াবে ভেবেই এমন কাণ্ড করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু হয়ে গেল আর এক! এই যে মধ্যে গোলমাল হয়ে এত বড়ো একটা তাল পাকিয়ে গেল এতেও আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, আমার যেন আশা হচ্চে খোদা তোদের দু-হাত এক করবেন।… কিন্তু এইখানে একটা মস্ত কথা মনে পড়ে গেল ভাই, সত্যি কথা বলবি বোন আমার? নূরুর পলটনে চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তোকে যেন কেমন মন-মরা দেখাচ্চিল, – কী যেন চাপা ব্যথা তোর দেহে কাজে-কথায় অলস-ম্লান হয়ে তোকে মুষড়ে দিচ্ছিল, – আচ্ছা, আমার এ ধারণাটা সত্যি নয় কি? আজ এত দিনে এ কথাটা বলছি, তার কারণ তখন আহ্লাদের আবেশে ওটা আমি দেখেও দেখিনি। দেখলেও ভুল মনে হয়েছিল যে, বিয়ের আগে জোয়ান মেয়ের ওরকম হওয়াটা বিচিত্র নয়। তাই তখন যেন তোর ও মলিনমূর্তি দেখেও বেশ আলাদা রকমের একটা সুখ অনুভব করতাম। মানুষ কাছে থাকলে তাকে ঠিক বুঝে উঠবার অবসর হয়ে ওঠে না, তার নানান কাজ নানা হাব-ভাব কথা-বার্তা ইত্যাদি বাইরের জিনিসগুলোই মনকে এমন ভুলিয়ে রাখে যে, সে তার ভিতরকার কাজ অন্তরের আসল মূর্তিটার কথা একেবারেই ভেবে দেখতে পায় না। তার পর সে যখন চলে যায়, তখন তারই ওই কাজের সমস্ত খুঁটিনাটিগুলি অবসর-চিন্তায় এসে বাধা দেয়, আর তখন একে একে বদ্ধফুলের হঠাৎ পাপড়ি-খোলার মতন তার অন্ধদৃষ্টিও যেন খুলে যেতে থাকে এবং
false
shunil_gongopaddhay
সন্তু অবাক হয়ে বলল, আমি এক যাব? হ্যাঁ। আমি এক কেন যাব? না, তা হয় না। বেশি কথা বলিস না। তোকে একাই যেতে হবে। তুমি এখানে থাকবে? তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে। সহজে পারবে না। আমি লুকিয়ে থাকব। কাকাবাবু, আমি তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না। মা বলে দিয়েছেন, সব সময় তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে। সন্তু, অবুঝ হয়ো না। এখানে এখন দুজনের থাকার কোনও মনে হয় না। তাহলে দুজনেই মরব। আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, আমি মরে গেলেও কী এমন ক্ষতি আছে! মানুষ তো এক সময় না এক সময় মরেই! তবু মরার আগে এই রহস্যটা জেনে যাওয়ার চেষ্টা করব। তোমাকে বাঁচতেই হবে। তাছাড়া, তুমি গিয়ে দাশগুপ্তকে খবর দিলে তারা হয়তো আমাকে বাঁচাবার চেষ্টাও করতে পারে। কিন্তু তুমি তো একটা ক্ৰাচ নিয়ে বেশিক্ষণ হাঁটতেই পারবে না। আমি রাত্তিরটা এখানেই ঝোপের মধ্যে শুয়ে থাকব। সকালবেলা একটা গাছের ডাল জোগাড় করে নেব ঠিকই। আমার অসুবিধে হবে না। সমুদ্রের ধারটাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু আমি অন্ধকারের মধ্যে সমুদ্রের ধারে যাব। কী করে? রাস্তা হারিয়ে ফেলব। সমুদ্রের কাছে যাওয়া তো খুব সোজা। এই ঝর্নাটা যখন পাওয়া গেছে। এটার ধার দিয়ে ধার দিয়ে গেলেই হবে। এই ঝর্নাটা নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। খুব সাবধানে যাবে কিন্তু। সন্তুর বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। সে কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, কাকাবাবু, আমি যাব না। আমি তোমাকে একা ফেলে কিছুতেই যাব না। কাকাবাবু সন্তুর মাথায় হাত রেখে ভারী গলায় বললেন, সন্তু, এবার তোমাকে এখানে আনাই ভুল হয়েছে। এতটা বিপদের কথা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখানে আমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকা খুবই বিপজ্জনক। পুলিশকে একটা খবর দেওয়া খুবই দরকার। তুমিও চলে আমার সঙ্গে। আমি গেলে চলবে না। আমি ঐ সাহেবগুলোর ওপর নজর রাখতে চাই। তুমি এক ওদের সঙ্গে কী করবে? যদি ওরা আবার এদিকে এসে পড়ে? আমি লুকিয়ে থাকব, ওরা আমাকে দেখতে পাবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি এখানেই থাকব, অন্য কোথাও যাব না। তাহলে শুধু শুধু কেন একলা বসে থাকবে। না কাকাবাবু, তুমি চলো আমার সঙ্গে। আমি এক কিছুতেই যাব না। কাকাবাবু এবার গভীর কড়া গলায় বললেন, সন্তু, তোমাকে যেতে বলছি, যাও! তুমি জানো না, আমার কথার নড়াচড় হয় না? আমি অনেক ভেবেচিন্তেই তোমাকে যেতে বলেছি। আমি এখানেই থাকব। যাও, এক্ষুনি রওনা হও! সন্তু আর কথা বলার সাহস পেল না। এক পা এক পা করে চলতে শুরু করল। কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল, কিন্তু একটু বাদেই আর কাকাবাবুকে দেখতে পেল না। কাকাবাবুঝোপের অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। সন্তুও বড় পাথরটার ওপাশে চলে গেল। ঝর্নার পাশে বালির ওপর হালকা চাঁদের আলো, তাতে সন্তুর ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াটাই তার সঙ্গী। বন এত নিস্তব্ধ যে, এমনিতেই গা ছমছম করে। কোথায় আড়ালে গাছের ওপর জারোয়ারা লুকিয়ে আছে কে জানে। যে-কোনও সময় একটা তীর এসে গায়ে লাগতে পারে। সন্তু তাড়াতাড়ি ঝর্নার পাড় থেকে সরে জঙ্গলে চলে গেল। ঝর্নার পাশে থাকলে দূর থেকেও তাকে দেখা যাবে। কিন্তু বনের মধ্যে আসার পর ছায়াটাও আর তার সঙ্গী রইল না। মনের মধ্যে ভীষণ খারাপ লাগছে। কাকাবাবুকে এরকমভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া কি ঠিক হল? একলা এই ভয়ংকর জঙ্গলের মধ্যে উনি কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবেন? নিজে ভাল করে হাঁটতেও পারেন না। অথচ কাকাবাবু যে কিছুতেই শুনবেন না। অন্য কারুর কথা। ঝর্নাটা ক্রমশই চওড়া হচ্ছে। এখানে হাঁটাও খুব শক্ত। মাঝে-মাঝেই কাঁটাঝোপ। একটা বড় গাছের গায়ে একবার সন্তু হাত দিতেই তার হাত ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। গাছের গায়েও কাঁটা। খালি তার ভয় হচ্ছে। হোঁচটি খেয়ে পড়ে না যায়। তাকে সমুদ্রের ধারে পৌঁছতেই হবে। হঠাৎ একটা আওয়াজে সে দারুণ চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। শব্দটা এমনই বিকট যে, শরীরের রক্ত প্ৰায় জল হয়ে যায়। প্ৰথমে মনে হল, যেন একসঙ্গে দু-তিনটে পাখি ডেকে উঠল। কিন্তু কোনও পাখি এরকম বিশ্ৰী সূরে ডাকে? আর এত জোরে? শব্দটা এই রকম : কিলা কিলা কিলা কিলা কিলা কিলা! সন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু বাদেই সেই রকম আবার কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দ উঠল। ডান দিক থেকে। আগের শব্দটা এসেছিল বাঁ দিক থেকে। এবার মনে হল, যেন কয়েকজন লোক উলু দিচ্ছে। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গা শিউরে ওঠে। তারপর চারদিক থেকে কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দ উঠল। যেন শত শত লোক একসঙ্গে চিৎকার করছে। বনের সব দিক থেকে ঐ শব্দ করতে করতে কারা ছুটে আসছে। এর মধ্যেই দুমদুম করে গুলির শব্দ শুরু হয়ে গেল। তবু ঐ কিলা কিলা থামল না। সন্তু একটা পাথরের আড়ালে গুটিসুট মেরে বসে রইল। তার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে। তার মনে হচ্ছে যেন নরকের সব প্রাণীরা জেগে উঠে বন ঘিরে ধরছে। বন্দুকের গুলির শব্দ কিন্তু একটু বাদেই থেমে গেল, কিন্তু কিলা কিলা শব্দ থোমল না। এবার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঐ রকম শব্দ করে এক জায়গায় লাফাচ্ছে। তারপর শব্দটা একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল। ব্যাপারটা কী হল, তা বোঝার চেষ্টা করল। সন্তু। তার শরীর একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দু-হাত দিয়ে মুখটা ঘষতে লাগল জোরে জোরে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গুড়ি মেরে ঝিনার পাশে এসে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল অনেকটা।
false
shunil_gongopaddhay
চাও? তোমার সামনে এই মেয়েটাকে চাবুক পেটাব? কাকাবাবু বললেন, এটা কী অদ্ভুত প্রশ্ন। আমি কি তা চাইতে পারি? ওস্তাদ বলল, তা হলে কি এই মেয়েটার সামনে তোমায় চাবুক মেরে রক্ত বার করে দেব? দেবলীনা বলল, ইস, কাকাবাবুর গায়ে একবার হাত তুলে দ্যাখো না! কাকাবাবু হলে তোমাদের এমন শাস্তি দেবেন! ঠিক সিনেমায় বদমাশ লোকদের মতন ওরা দুজন বিশ্রীভাবে হা-হা করে হেসে উঠল। একে বলে অট্টহাসি। ওস্তাদ বলল, তাই নাকি? দেখবি তবে? সে শপাং করে একবার চাবুক কষাল কাকাবাবুর বুকে। কাকাবাবু একটুও নড়লেন না। ওস্তাদের চোখে চোখ রেখে তিনি শান্ত গলায় বললেন, দেবলীনা ঠিক বলেছে। আমার গায়ে কেউ হাত তুললে তাকে আমি শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না! ওস্তাদ আবার চাবুক তুলতেই কাকাবাবু সেটা খপ করে ধরে ফেললেন। এক হ্যাঁচকা টানে সেটা ছাড়িয়ে এনে ফেলে দিলেন নিজের পায়ের কাছে। ওস্তাদ আর ডাবু দুজনেই ততক্ষণে রিভলভার বার করে ফেলেছে। কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, এসব ছেলেমানুষি করছ কেন? কাজের কথা বলতে এসেছ, সে কথা বলো! চুরি করে আনা বাচ্চাগুলোকে কোথায় রেখেছ বলো। তাদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে ময়নার ছেলেকে তোমরা ফেরত পাবে না। এই আমার শেষ কথা! ওস্তাদ বলল, খুব তেজ দেখাচ্ছ, অ্যাঁ? তোমার হাত-পা বাঁধিনি। এখন যদি হাত-পা বেঁধে তোমায় জঙ্গলে ফেলে দিই, তা হলে কী করবে! বাঘগুলো অনেকদিন না খেয়ে আছে। তোমাকে পেলে দারুণ খুশি হবে। কিংবা তার আগেই সাপের কামড়ে খতম হয়ে যেতে পারো! কাকাবাবু সুর করে বললেন, বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি/আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরই মাথায় নাচি… সত্যেন দত্তর কবিতা পড়োনি! ডাবু বলল, চোপ! ব্যাটা পদ্য শোনাচ্ছে আমাদের! ওস্তাদ বলল, তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছ, যেন কিছুতেই ভয় পাও না! কাকাবাবু বললেন, ভয়কে যারা মানে, তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়, এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা। দেবলীনা খিলখিল করে হেসে উঠল। ডাবু বলল, ওস্তাদ, এ লোকটা বড্ড জ্বালাচ্ছে, খতম করে দিলেই তো হয়! পদ্য শুনলেই আমার গা জ্বালা করে! দেবলীনা বলল, কাকাবাবু, আর একটা বলো! ওস্তাদ বলল, যথেষ্ট হয়েছে! শোনো রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি শেষবারের মতন বলছি, তোমার কোনও শর্ত আমরা মানব না, তুমি ময়নার ছেলেকে ছেড়ে দেবে কি না! কাকাবাবু বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না! ওস্তাদ বলল, রায়চৌধুরী, তুমি আমাদের অনেক কিছু জেনে ফেলেছ। তুমি নিজেই জোর করে মাথা গলিয়েছ। তোমাকে মেরে ফেলা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই! কাকাবাবু বললেন, কেন বারবার এই বাজে কথা বলছ? আমাকে মারলে ময়নার ছেলেকে আর কোনওদিনই ফেরত পাবে না। এ একেবারে ধ্রুব সত্যি কথা! ওস্তাদ মুখোনা বিকৃত করে বলল, ময়নার ছেলেকে পাওয়া যাক বা না যাক, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। ময়না আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কী বলছ? আমার ছেলে— ওস্তাদ বলল, ডাবু, এই ময়নাটাকে বাইরে নিয়ে যা তো। ডাবু অমনই ময়নার ঘাড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল। ময়না আর্ত চিৎকার করতে লাগল, আমার ছেলে, আমার ছেলে— দেবলীনা বলল, এরা বড় বাজে লোক! ওস্তাদ বলল, রায়চৌধুরী, তুমি ময়নার ছেলের নাম করে আমাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে চাইছিলে! চুলোয় যাক ওর ছেলে। একটা ময়না গেলে আর একটা ময়না আসবে। কিন্তু তোমাকে মরতেই হবে। আর একটা লোক বাইরে থেকে ওস্তাদ, ওস্তাদ বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। সে হাঁপাচ্ছে। ওস্তাদ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে, ছোটগিরি? ছোটগিরি বলল, ওস্তাদ, জেটি ঘাটে লঞ্চ এসে গেছে! ওস্তাদ বলল, এসে গেছে? ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। আগে এদের দুজনের ব্যবস্থা করে যাই। ছোটগিরি বলল, বড়সাহেব বললেন, এক্ষুনি জিনিস পাচার করতে হবে। পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি দেরি করা যাবে না। একটা বাচ্চা বোধ হয় নিতে-নিতেই শেষ হয়ে যাবে! ওস্তাদ বলল, বড়সাহেব নিজে এসেছে? ছোটগিরি বলল, হ্যাঁ। পুরো একদিন দেরি হয়েছে বলে খুব রেগে আছে। তার ওপর বাচ্চা যদি কমে যায়—তুমি এক্ষুনি গিয়ে কথা বলো— ওস্তাদ বলল, ঠিক আছে, চল, যাচ্ছি। কাকাবাবু ও দেবলীনার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। এখানে ছাড়া-ছাড়া ভাবে চারখানা একই রকমের ঘর। পেছন দিকে জঙ্গল। একটা সরু ইটের রাস্তা চলে গেছে একেবারে নদীর ধারে। খুব চওড়া নদী। জোয়ারের সময় অনেকখানি জল উঠে আসে। এখন সবে জোয়ার শুরু হয়েছে, ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে জলে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লঞ্চ। ওস্তাদ সেই লঞ্চের ধারে গিয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলল। সে লোকটি সাহেবদের মতন ফরসা, কিন্তু খাঁটি সাহেব নয়, কথা বলছে হিন্দিতে। খুব ধমকাতে লাগল ওস্তাদকে। একটুক্ষণের মধ্যে সেই লঞ্চে নানা জিনিসপত্র তোলা হতে লাগল। বড়-বড় সব বাক্স। আর একটা ঘরের দরজা খুলে বার করে আনা হল কতকগুলো বাচ্চা ছেলেকে। তারপর, যেমন ভেড়ার পাল তাড়িয়ে নেওয়া হয়, সেইভাবে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাওয়া হল লঞ্চের দিকে। তারা সবাই কাঁদছে। ময়নাও কাঁদছে, কিন্তু সে শব্দ করতে পারছে না, কে যেন তার মুখটা বেঁধে দিয়েছে এর মধ্যে। তাকেও ঠেলতে ঠেলতে লঞ্চে তোলা হল। লঞ্চের ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে, ছাড়বে এক্ষুনি। ওস্তাদ নামের লোকটি বলল, দাঁড়াও এক মিনিট, আমি আসছি। সে একবার ফিরে এল কাকাবাবুদের ঘরটার কাছে। তারপর আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল লঞ্চে। লঞ্চটা এগিয়ে গেল মাঝনদীর দিকে। সেই সাহেবের মতন লোকটি ওপরের ডেকে
false
shirshendu
হাই ফিলজফি। চিঠিটা আমি বাবার জন্য রেখে দিয়েছি। ওর ওই সব ফিলজফি বাবার খুব পছন্দ হবে। মণীশ মৃদু হেসে বলে, ও মেয়েটাকে আমার খুব ভাল লাগে। বড় কিছু করবে দেখিস। অপর্ণা বলল, বড় সাহস। মেয়েদের অত সাহস ভাল নয়। বাড়ি ফিরে যখন সবাই এক প্রস্থ আড্ডায় বসল তখন বুবকা ফের বলল, দিদি, ইউ রিয়েলি লুক ডিফারেন্ট। তাকে আগে একটু কাঠখোট্টা লাগত, এখন লাগছে না। ঝুমকি একটু নার্ভাস হাসি হেসে বলল, যাঃ, আমি বুঝি কাঠখোট্টা ছিলাম। ছিলি একটু। আমি বদলাইনি মোটেই। বরং তুই একটু বদলেছিস। আগে কো-এড়ুকেশনে পড়তিস, একটু নরম ভাব ছিল। এখন হুমদো হুমদো ছেলেদের মধ্যে থাকিস, তাই তুই কাঠখোট্টা হয়েছিল। বুবকা হাঃ হাঃ করে খানিকক্ষণ হেসে বলল, কথাটা কিন্তু ঠিক। আমি এখন টোটাল ম্যাসকুলিন সারাউন্ডিংস-এ থাকি। মা নেই, অনু নেই, দিদি নেই, মেয়ে-বন্ধুরা নেই। কিন্তু ভালই লাগে। অপর্ণা হঠাৎ বলল, তোর কার জন্য সবচেয়ে বেশি মন খারাপ লাগে? বাবার জন্য অফ কোর্স। কিন্তু সকলের জন্যই। তবে কি জানো মা, এত বন্ধু আর অত পড়ার চাপ যে মন খারাপটারাপ সব উড়ে যায়। তারপর খেলাধুলা আছে, আচ্ছা আছে। মণীশ বলল, ইজ ইট থ্রিলিং? ভেরি মাচ। একটু গভীর রাতের দিকে যখন সবাই শুতে গেল তখন ঝুমকি এসে বুবকাকে ডাকল, এই ভাই, ঘুমিয়েছিস নাকি? না রে। আজ এতদিন পরে বাড়ি এসে এত অদ্ভুত লাগছে যে ঘুম আসছে না। আয় না, গল্প করি। ঝুমকি আলো না জ্বেলে চেয়ার টেনে বিছানার মুখোমুখি বসে বলল, আমাকে তোর অন্যরকম লাগছে কেন বল তো! কি জানি রে দিদি, বুঝতে পারছি না। তুই এমনভাবে বলছিলি যে আমার ভয় করছিল। কেন, ভয়ের কি আছে? কেমন মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি কোনও অন্যায় করে ফেলেছি। যাঃ, তোকে সেরকম লাগছে না মোটেই। মনে হয় তুই বোধহয় একটু ওয়েট গেন করেছিল। ওজন নিয়ে দেখি তো। তা হতে পারে। সেটাই হবে। ঝুমকি একটা শ্বাস ফেলে বলল, বাবা তোর জন্য খুব ভেঙে পড়েছিল, জানিস? জানি, মা বলেছে। কিন্তু বাবা সামলেও গেছে। জীবনটা যে কত বড় তা বাড়িতে থাকলে বোঝা যায় না। হস্টেলে থাকলে বোঝা যায় খানিকটা। কত বড় রে? ঠিক আন্দাজ করা মুশকিল। এখানে তোরা আছিস, তুই, মা, বাবা, অনু সবাই মিলে কেমন একটা ঘেরটোপ। নিজেকে ঠিক স্বাধীনভাবে ফিল করা যেত না। আমি হয় কারও ছেলে, নয়তো ভাই, নয়তোে দাদা। কিন্তু ওখানে তো তোরা নেই। হঠাৎ মনে হল অথৈ জলে পড়ে গেছি। তারপর ধীরে ধীরে মনে হতে লাগল, এই পৃথিবীটা অনেক বড় এবং এখানে তোরা ছাড়াও অনেক মানুষ আছে ঠিক বোঝাতে পারব না। হোয়েন আই অ্যাম অন মাই ওন তখন অন্যরকম ফিলিং হয়। তোর ভাল লাগছে ওখানে? খুব। আমাদের ভুলে যাচ্ছিস না তো! আরে না। দিদি, দাবা খেলবি? এত রাতে? আজ ঘুম আসবে না। আয় এক পাট্টি খেলি। ঠিক আছে। দাবায় দুবার হেরে যখন মাঝরাতে ঘুমাতে গেল ঝুমকি তখন তারও ঘুম এল না। আজকাল মাঝে মাঝে এটা হয়। বুকের ভিতরে একটা হায়-হায়, শূন্য ভাব ভর করে থাকে। সে কি ধরা পড়ে গেছে বুবকার চোখে? তার গভীর গোপন একটা অন্তর্জগতের ঘটনা কি ছায়া ফেলছে তার মুখে বা শরীরে? অনেকক্ষণ জেগে শুয়ে রইল ঝুমকি। কাউকে সে কখনও বলতে পারবে না। মরে গেলেও না। চারুমাসি বিদেশে চলে যাবে, তারপর আর ও বাড়িতে যাওয়া হবে না। আর হয়তো দেখাই হবে না হেমাঙ্গর সঙ্গে। না হোক। দেখা হয়েই বা কী হত? হেমাঙ্গ এখনও ড়ুবে আছে আকণ্ঠ রশ্মির প্রেমে। রশ্মি বিয়ে করেছে শুনে প্রায় বিবাগী হয়ে গ্রামে গিয়ে থানা গেড়ে ছিল। আবার ফিরেছে বটে, কিন্তু মেয়েদের আর লক্ষই করে না সে। হয়তো মেয়েদের ঘেন্নাই করে মনে মনে। করুক, তাতে আর ঝুমকির কী? পরদিন বুবকা সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখা করে এল। রাতের বেলা আড্ডা হল একটু। ভোর হতে না হতেই চলে গেল খড়গপুর। বাড়ি ফের ফাঁকা। এই ফঁকাটা আর ভরাট হবে না সহজে। ফাঁকাই থেকে যাবে। ঝুমকি চাকরি ছেড়েছে। কম্পিউটার শেখা শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করতে চাবুশীলার বাড়ি যায়। চারুশীলা গোছগাছ শুরু করেছে। বলে, জানিস, আমার আর এ দেশ ভালই লাগছে না। তুমি তো সুব্রতদার সঙ্গে বিদেশেই থাকতে পারো। বিদেশেও কী বেশি দিন ভাল লাগে আবিস? আমার মনটাই একটু চঞ্চল ধরনের। যখন ভাল নালাগে তখন কোথাও ভাল লাগতে চায় না। আর নিজের ইচ্ছেয় জায়গা বদল করলে তো হবে না। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো আছে। ওদের বিদেশেই পড়াও না কেন? সুব্রত সেটা পছন্দ করবে না। মেয়েটাকে এবার আমেরিকায় ভর্তি করে দেবো ভাবছি। সুব্রতর খুব ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু এখন বলছে, নাঃ, ওসব দেশে না রাখাই ভাল। কী যে করব বুঝতে পারছি না। তোমার যে কত সমস্যা। আমিই আমার সমস্যা। আর একদিন ঝুমকি গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসেছে, চারুশীলা এসে হঠাৎ বলল, হা রে, তুই বিয়ে করছিস না কেন বল তো! ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, বিয়ে? এখনই কিসের বিয়ে? এটাই তো বয়স। তোমার আমলে ছিল। এখন নয়। তোর কোনও অ্যাফেয়ার নেই তো? ঝুমকি লাল হয়ে বলল, থাকলে টের পেতে না? না। তুই ভীষণ চাপা। কাজ করতে দাও তো। বড্ড জ্বালাও। আমাকেও বলবি না? অ্যাফেয়ার নেই মাসি।
false
shunil_gongopaddhay
আমি বিরাট-বিরাট ঘোড়া, যাকে ওয়েলার ঘোড়া বলে, সেই ঘোড়ায় চাপতে পারি! সন্তু বলল, ওই গাঁট্টাগোট্টা লোকগুলো এই ছোট ঘোড়ায় চেপেই তো ঘুরে বেড়ায়। আমরা কেন পারব না? চল না দেখি! সন্তু জোজোর হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। গাছতলায় যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমাদের একটু ঘোড়ায় চাপতে দেবেন? ওদের সঙ্গে শিবু নামে যে লোকটি এসেছিল, সেও গল্প করছিল এখানকার লোকদের সঙ্গে। সেই শিশু সন্তুদের কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলল ওদের। ওরা সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। দুটো ঘোড়া খুলে এনে ওদের সাহায্য করল পিঠে চাপতে। তারপর একজন করে ঘোড়ার দড়ি ধরে হাঁটাতে লাগল ঘোড়াটাকে। ওরা গোল হয়ে খানিকটা জায়গা ঘুরল। সন্তু বলল, এই ঘোড়াগুলো বেশ শান্ত রে, জোজো। কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না। জোজো ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, বাঃ, এগুলো আবার ঘোড়া নাকি, গাধার অধম। আমি ঘোড়া ছুটিয়েছি, এইট্টি, নাইনটি মাইলস্ স্পিডে! আরব। দেশের আসল ঘোড়া। সন্তু তার সঙ্গের লোকটিকে বলল, আপনি একবার একটু ছেড়ে দিন না, নিজে নিজে চালাই। দুজন লোকই ঘোড়ার দড়ি ছেড়ে দিল। জোজো তার ঘোড়ার পেটে একটা লাথি মেরে চেঁচিয়ে বলল, হ্যাট, হ্যাট, হ্যাট… সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তড়বড়িয়ে ছুটতে শুরু করল, আর জোজো ছিটকে পড়ে গেল তার পিঠ থেকে। তবে সৌভাগ্যবশত সে পড়ল একটা ঝোপের ওপর, তার চোট লাগল না। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়তে ঝাড়তে জোজো বলল, দেখলি, দেখলি সন্তু, কীরকম একখানা ড্রাইভ দিলাম? তুই পারবি? কাকাবাবু মন্দিরের সিঁড়িতে বসে ওদের দেখছেন আর হাসছেন। এরপর তিনি নিজে যখন ঘোড়ায় চাপবেন, তখন জোজো আর সন্তুও বোধহয় হাসবে। তাঁরও অনেকদিন ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস নেই, তা ছাড়া খোঁড়া পা নিয়ে অসুবিধে হবে। কিন্তু ঘোড়া ছাড়া এখানে পায়ে হেঁটে বেশি দূর ঘোরাঘুরি করা সম্ভব নয়। ধনঞ্জয় আচার্য তাঁর লোকদের সঙ্গে কথা শেষ করে কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, হ্যাঁ, ওদের একজন ওই মূর্তিটার কথা জানে। নিজের চোখে দেখেনি, তবে অন্যদের কাছে শুনেছে। ওর কথা বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ওখানে আপনার যাওয়ার দরকার নেই। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কেন বলুন তো? ধনঞ্জয় বললেন, জায়গাটা অনেক দূর। অবুঝমাঢ় পেরিয়ে আরও অনেকখানি। আপনি তিরাংদের নাম শুনেছেন? কাকাবাবু বললেন, আমি মারিয়া, আর মুরিয়াদের কথা জানি। এই সব জায়গায় আগে একবার ঘুরেছি। কিন্তু তিরাংদের কথা তো শুনিনি। এদের কথা খুব কম লোকই জানে। মাত্র দুতিনখানা গ্রামে এরা থাকে। এদের একটা গ্রামে এই মূর্তি আছে। সেখানে বাইরের লোক বিশেষ কেউ যায় আসে না। এরা কি হিংস্র নাকি? বাইরের লোক দেখলে আক্রমণ করতে আসে? সেরকম কিছু শোনা যায়নি। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীরা এমনিতে বেশ শান্ত। কিন্তু কোনও কারণে রেগে গেলে তখন আর হিতাহিত-জ্ঞান থাকে না। তখন একেবারে খুন করে ফেলতেও এদের চোখের একটি পাতাও কাঁপে না। আপনি নিজে…মানে…আপনার দুটি পা ঠিক নেই, সঙ্গে দুটি অল্পবয়েসী ছেলে, এই অবস্থায় আপনাদের ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না। কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, মুশকিল কী জানেন, আমি যদি যেতে নাও চাই ছেলেদুটি ছাড়বে না। ওরা বড্ড জেদি। জায়গাটা ঠিক কোথায়, আপনি একটু ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দেবেন? জেনেশুনে আপনাদের ওই বিপদের মধ্যে পাঠাই কী করে? কাছাকাছি গিয়ে দেখে আসি অন্তত, সে রকম বিপদ দেখলে ভেতরে ঢুকব। আর একটা কথা, ধনঞ্জয়বাবু আপনার শিষ্যদের তো বেশ কয়েকটা ঘোড়া রয়েছে দেখছি। তার থেকে দুটো ধার নিতে পারি? ঘোড়া ছাড়া অতদূর যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা ঘোড়াদুটো বাবদ কিছু টাকা জমা রেখে যাব আপনার কাছে। টাকার কথা উঠছে না, আপনাদের আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না। কাকাবাবু তবু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধনঞ্জয় আচার্যকে দিয়ে একটা ম্যাপ আঁকিয়ে নিলেন। ওখানে কোনও সাদা কাগজ নেই, মন্দিরের দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল, তারই একটা পাতা ছিঁড়ে নেওয়া হল। কলম পাওয়া গেল সন্তুর কাছে। ধনঞ্জয় আচার্য এককালে একটু-আধটু লেখাপড়া জানতেন, কিন্তু গত পঁচিশ বছর কিছুই লেখেননি, তাই বাংলা অক্ষর লিখতে ভুলে গেছেন। অবুঝমাঢ় লিখতে গিয়ে অ অক্ষরটাই লিখতে পারেন না। কাকাবাবু বললেন, আপনি জায়গাগুলোর নাম বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি। দেখতে-দেখতে সন্ধে হয়ে এল। মন্দিরের কাছাকাছি জঙ্গলের গাছে অনেক রকম পাখি ডাকছে। একটু দূরে একটা কোনও পাখি খুব জোরে পিয়াও পিঁয়াও করে ডাকছে, গলায় তার সাংঘাতিক জোর। সন্তু বলল, এটা কী পাখি? এরকম ডাক তো শুনিনি! জোজো বলল, এটা মোটেই পাখি নয়, এটা ফেউয়ের ডাক। বাঘ বেরুলেই পেছন পেছন ফেউ বেরোয় শুনিনি? আমি খুব ভাল চিনি। সন্তু বলল, ভ্যাট, ফেউ আবার কী? ফেউ তো আসলে শেয়াল, বাঘ দেখে ভয় পেয়ে শেয়ালের ডাক তখন বদলে যায়। এটা পাখিরই ডাক। জোজো বলল, তুই কিছু জানিস না। এটা পাখি হতেই পারে না। এটা নির্ঘাত ফেউ। দুজনে তর্ক করতে করতে এক সময় বাজি ধরে ফেলল। এক বোতল কোল্ড ড্রিংক। ওরা কাকাবাবু আর ধনঞ্জয় আচার্যর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী ডাকছে? কাকাবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই ধনঞ্জয় আচার্য বললেন, ওটা তো ময়ূর। এদিকের জঙ্গলে কিছু ময়ুর আছে। সন্তু প্রথমে লজ্জা পেল। ময়ূরের ডাক সে আগে অনেক শুনেছে, তার চিনতে পারা উচিত। এখানে ডাকটা খুব জোরে শোনাচ্ছে। তারপরই সে জোজোকে বলল, তুই হেরে গেছিস! কোল্ড ড্রিংকটা পাওনা রইল। কলকাতায় ফিরে গিয়ে খাওয়াতে হবে কিন্তু! জোজো বলল,হেরেছি
false
shomresh
সপ্তাহের জন্যে খদ্দের তৈরি করে আসবে এরা। তখন ফেরার সময় গ্রামের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হবে। পুলিশ কিংবা সাধারণ মানুষ যদি তাদের কথা জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলবে অনেককাল আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও হতে পারে কারণ খচ্চরওয়ালারা পর্যন্ত ওদের দেখতে পায়নি। সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল পালদেমকে সিগারেট এবং চা-পাতার জন্যে টাকা দিতে। কিন্তু কিছু কেনা এযাত্রায় হবে না, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে চাইল না সে। তাছাড়া ওরা চা-পাতা এবং সিগারেট কিনতে দোকানে গেলে সন্দেহ বাড়বেই। সম্মিলিত আনন্দধ্বনির মধ্যে পালদেমরা যাত্রা শুরু করল। গ্রামের বাইরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিচ্ছে এরা। এই গ্রামের ইতিহাসে কখনও হয়নি। তাপল্যাঙের মানুষরা এখনও শঙ্কা এবং খুশিতে দুলছে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। গ্রামের শেষপ্রান্তে এই সময় কয়েকটা মানুষকে দেখা গেল। এরা একটু থমকে দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু করল। রোলেন এবং তার গ্রামের চারজন এই যাত্রা দেখতে এসেছে। জয়িতা এগিয়ে গেল বোলেনদের কাছে। সুদীপ এবং আনন্দ দুটো দৃশ্য দেখছিল। পালদেমরা যাচ্ছে এবং জয়িতা রোলেনদের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে হেসে কথা বলছে। সুদীপের অস্বস্তি হচ্ছিল। সেই সময় শেষবারের মত হাত তুলে পালদেমরা পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল। তাপল্যাঙের সমস্ত মানুষকে স্বনির্ভর করতে প্রথম দলটি বাণিজ্যে বের হল। পাঁচ দিন নয়, ওরা ফিরে এল দিন আটেক বাদে। এল উত্তেজিত হয়ে। দলের বেশির ভাগের উত্তেজনার কারণ নতুন জনপদ দর্শন। ফালুট পর্যন্ত ঠিক ছিল, তারপর যত ওরা নেমেছে তত বিস্মিত হয়েছে। সান্দাকফুর বাংলো বাড়ি, কালিয়াপোকরির বসতি দেখার পর সুকিয়াপোকরিতে গিয়ে তো একদম দিশেহারা। ডিমগুলো বিকেভঞ্জনে পৌঁছনোর আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। একটা বিরাট দল পাহাড় দেখার জন্য উঠছিল, তারাই কিনে নিয়েছে। সান্দাকফুতে মুরগিগুলো কিনেছিল কয়েকটা সাদা চামড়ার লোক। বুদ্ধি করে পালদেম চ্যাঙথাপু থেকে ওদের সম্ভাব্য দাম জেনে গিয়েছিল। বিদেশীদের কাছে তাই যেন অত্যন্ত সস্তা মনে হয়েছিল। সুকিয়াপোকরিতে এলাচ বিক্রি করতে অবশ্য ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। সেই জন্যে তিন দিন দেরি হয়ে গেল। পরে জেনেছে এবারে ওরা জলের দরে এলাচ বিক্রি করেছে। কিন্তু পাইকার ঠিক করে এসেছে ওরা। সুকিয়াপোকরি পর্যন্ত যেতে হবে না, কালিয়াপোকরি পর্যন্ত নামিয়ে দিলেই চলবে। ওখান থেকেই পাইকার চার চাকার গাড়ি করে নিচে নিয়ে যাবে। গ্রাম ছাড়ার আগে পালদেম ভাল করে টাকা চিনে গিয়েছিল। সে কুড়ি করে করে গুনে যা ঘোষণা করল তার যোগফল চারশো আশি টাকা। সুদীপ মন্তব্য করল, যে যেমন পেরেছে এদের টুপি পরিয়েছে। আনন্দ হাত তুলে ওকে কথা বলতে নিষেধ করতেই সুদীপ খেপে গেল। সে বলল, দ্যাখ আনন্দ, দিনকেদিন তোর ধরন-ধারণ খোমনির মত হয়ে যাচ্ছে। আমরা বন্ধু, তুই আমার ধর্মযাজক নোস। আমি এতদিন কিছু বলিনি কিন্তু! আমি ধর্মযাজক? আমাকে দেখে তাই মনে হয়? আনন্দ বিস্মিত হল। এমন মুখ করে থাকিস যেন পৃথিবীর সব সমস্যা বুঝে গেছিস। জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়ে গিয়েছে। ওয়াইন আর উওম্যান তো দূরের কথা, জাস্ট একটা খিস্তি উচ্চারণ করা মহাপাপ। তুই ছাড়া এখানে যেন কোন প্রাণ জাগত না! এরা তোকে আর জয়িতাকে অনেক আপন ভাবে কেন তা জানি না। তোর ভান এরা না বুঝতে পারলেও আমি বোকা নই। সুদীপ হঠাৎ উত্তেজিত হল। ভান? কি ভান করি আমি? পৃথিবীতে তোর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হল তাপল্যাঙের মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করা। আর সেটা ভাবতে গিয়ে তুই অন্য কিছু ভুলে যাস। এমন কি আমাকেও অপমান করিস! জয়িতা চুপচাপ শুনছিল, আনন্দরটা বুঝলাম, আমি কি ভান করি সুদীপ? সুদীপ জয়িতার দিকে তাকাল না, তুই শালা ছুপা রুস্তম! এদের মধ্যে এমনভাবে মিশে গেছিস যেন তোর বাপ-মা এখানেই জন্মেছিল! তাছাড়া ওই বোলেন লোকটার সঙ্গে এত ভাব কেন তোর? দেয়ার ইজ এ ধান্দা বিহাইন্ড দ্যাট, সেটা কি বুঝতে পারছি না। তোদের মনে রাখা উচিত আমরা চারজন এখানে লুকিয়ে থাকতে এসেছিলাম। এখানে থেকে যাওয়ার কোন পূর্ব পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। গ্রামটাকে দেখার পর আমরা এদের সাহায্য করার কথা ভেবেছিলাম। এই দুবছরে আমরা অনেক করেছি। এবার ওদের চরে খেতে দে। কিন্তু তোদের ভাবভঙ্গি দেখে মনেই হচ্ছে না কখনও এদের ছেড়ে যাবি। সেইটেই বিভ্রান্তিকর। আনন্দ বলল, সুদীপ, এ নিয়ে আলোচনা আমরা পরে করতে পারি। পালদেমের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা এখনও শোনা হয়নি। হ্যাঁ, পালদেম বল। তোমাদের জিনিসগুলো বিক্রি করতে কি কি অসুবিধে হয়েছে? পালদেম এতক্ষণ সুদীপের দিকে তাকিয়েছিল। ওর চটজলদি উচ্চারণের বাংলা মাথায় ঢুকছিল না তার। তবে সে বুঝতে পারছিল এদের মধ্যে ঝগড়া চলছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি খুব ঠকে গেছি? আসলে এত টাকা নিজেরা কখনও রোজগার করিনি তো, এর পরের বার এ রকম হবে না। পালদেমের এক সহযোগী হেসে বলল, আমরা যে বেতের দুটো ছোট ঝুড়িতে ডিম নিয়ে গিয়েছিলাম তাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সবাই জিজ্ঞাসা করছিল ওরকম ঝুড়ি আরও আছে কিনা। আনন্দ জয়িতার দিকে খুশিমুখে তাকাল? জয়িতা বলল, বাঃ, তাহলে তো আমরা প্রতি বছর ভাল ঝুড়ি সাপ্লাই দিতে পারি। আহা এই বেতশিল্পটা যদি ভাল জানা থাকত! কথা শুনলে লিভার ড্রাই হয়ে যায়। যেন মোটামুটি জানতিস কলকাতায় থাকাকালে। সুদীপ মন্তব্য করল। জয়িতার চোয়াল শক্ত হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, রাস্তায় তোমাদের আর কোন অসুবিধের সামনে পড়তে হয়নি পালদেম? কথা হচ্ছিল যৌথগৃহে বসে। প্রতিটি মানুষ ঠিকঠাক ফিরে এসেছে বলে গ্রামবাসীরা খুশিমুখে ভিড় করেছিল। পালদেম মাথা
false
humayun_ahmed
মিলাচ্ছি। তবে তোমার বিচার আমি করব না। অন্য কোনো বিচারক করবেন। আমি রিটায়ারমেন্ট চলে যাচ্ছি। হামান রাজা চৌধুরী হাজতে আছে। তার মামলা নতুন করে শুরু হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি মোনায়েম খান বিয়েতে উপস্থিত হওয়ার তারিখ দিয়েছিলেন। ওই তারিখে তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্থানে পালিয়ে গলেন। কালরাত্রি ২৫ মার্চ কালরাত্রি—এই তথ্য আমরা জানি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ হত্যা-উৎসবে মেতেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ঊনসত্তরের ২৫ মার্চও কিন্তু কালরাত্রি। ওই রাতে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের ক্ষমতা তুলে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে। পরিশিষ্ট কিছুক্ষণ আগে হাজেরা বিবি মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় নাদিয়া একাই উপস্থিত ছিল। দাদির পাশে বসে লিখছিল। হাজেরা বিবি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, কী লেখ? নাদিয়া বলল, তোমার কথা লিখি। লেখা ‘বন’ কর। আমার দিকে মুখ ফিরা। নাদিয়া খাতা রেখে দাদির দিকে ঘুরে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে। কী রকম? চেহারা উজ্জ্বল লাগছে। চোখ ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমে গেছে। হাজেরা বললেন, শইল্যের ভিতর মরণের বাতি জ্বলছে। মরণের বাতি জ্বললে চেহারায় জেল্লা লাগে। মরণের আবার বাতি আছে নাকি? আছে। আল্লাপাক এই বাতি জ্বালায় দেন। আজরাইল আইসা নিভায়। নাদিয়া বলল, তুমি খুব ভালো আছ, সুস্থ আছ। তোমার মরতে এখনো অনেক দেরি। হাজেরা বিবি শব্দ করে আনন্দময় হাসি হাসলেন। নাদিয়া বলল, বাহ! তুমি তো কিশোরী মেয়েদের মতো হাসছ। হাজেরা নাদিয়ার হাত ধরে কোমল গলায় বললেন, আমি তোর বাপের কাছে অপরাধ। তুই আমার হইয়া তার কাছে ক্ষমা চাইবি। মা ছেলের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে না। জায়েজ নাই। কী অপরাধ করেছ? ছোটবেলা থাইকা নানানভাবে তারে কষ্ট দিয়েছি। খাটের সাথে সারা দিন বাইন্ধ্যা রাখছি। খাওয়া দেই নাই। পুসকুনিতে একবার তারে নিয়া গোসলে নামছি, হঠাৎ তার মাথা পানিতে চাইপ্যা ধইরা বলছি- মর তুই মর। কেন দাদি? তোর দাদাজান তার ছেলেরে খুব পছন্দ করত। ছেলে ছিল তার চোখের মণি। ছেলেরে কষ্ট দিলে সে কষ্ট পাইত। এইজন্যে কষ্ট দিতাম। তোর দাদাজান ছিল অতি বহু মানুষ। কত দাসী যে তার কারণে পেট বাধাইছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। দাদাজানকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তুমি তার ছেলেকে কষ্ট দিয়েছ। কাজটা ভুল করেছ। অবশ্যই। হাবীব বড় হইছে তারপরেও তারে কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি ‘হাবু ডাকলে রাগ করে। ইচ্ছা কইরা ডাকি—হাবু হাবু হাবুরে। কেন দাদি? এখন তো আর দাদাজান বেঁচে নেই। এখন কেন কষ্ট দেওয়া? আমি চেয়েছি সে রাগ করুক। আমারে দুইটা মন্দ কথা বলুক। ছোটবেলায় তার দিকে যে অন্যায় করেছি তার কিছুটা কাটা যাক। কিন্তু আমি এমন ছেলে পেটে ধরেছি যে আমার উপর রাগ করে না। তারে রাগানির চেষ্টায় আমার ত্রুটি ছিল না। একসময় তার চরিত্র নিয়া কথা শুরু করলাম। অতি নোংরা কথা। সফুরার পেটে তার সন্তান–এইসব হাবিজাবি। তাও আমার পুলা রাগে না। নাদিয়া বলল, তোমার কাছে শুনে শুনে মা নিজেও কাজের মেয়েদের নানান কথা বলেন। বাবার সামনে যেন কেউ না যায়—এইসব। বাবার ত্রুটি আছে। নোংরা ত্রুটি নাই। হাজেরা বিবি বললেন, অবশ্যই নাই। এইটা আমার পুলা। ছগিরন মাগি, বছিরুন মাগির পুলা না। নোংরা কথা বন্ধ করো দাদি। হাজেরা বিবি বললেন, মইরাই তো যাইতেছি। পচা কথা আর বলতে পারব না। দুই একটা বলি। তোর পছন্দ না হইলে কানে হাত দিবি। আচ্ছা বলো যা বলতে চাও। তবে তুমি কঠিন চিজ। সহজে মারা যাওয়ার জিনিস না। তারপরেও ধুম কইরা মইরা যাইতে পারি। তুই তখন অবশ্যই আমার হইয়া তার কাছে পায়ে ধইরা ক্ষমা চাইবি। বললাম তো ক্ষমা চাব। মৃত্যুর কথাটা আপাতত বন্ধ থাকুক। দু’একটা আনন্দের কথা বলো। এখন তোর বাপরে ডাক দিয়া আন। আইজ তারে আমি হাবু ডাকব না। আইজ তারে ডাকব হাবীব। সুন্দর কইরা বলব, হাবীব। বাবা কেমন আছ? আমার সামনে বসো। কী বলতেছি মন দিয়া শোনো। সব মানুষের মাতৃঋণ থাকে। তোমার নাই। নাদিয়া বলল, এখন বাবাকে ডাকতে পারব না দাদি। আমি লেখা শেষ করব। হাজেরা বললেন, আচ্ছা খাক। লাগবে না। বলেই মাথা এলিয়ে পড়ে গেলেন। নাদিয়া তাকিয়ে ছিল, সে সত্যি সত্যি দাদির চোখে গোলাপি আলো দেখতে পেল। হাবীব চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে ছিলেন। নাদিয়া শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। বাবার কাধে হাত রেখে বলল, বাবা! আমি বাগানে কদমগাছের নিচে সারা রাত বসে থাকব। কেউ যেন সেখানে না যায়, কেউ যেন না যায়। হাবীব অবাক হয়ে বললেন, তোর কী হয়েছে রে মা? নাদিয়া বলল, আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। দাদিজান মারা গেছেন। নাদিয়া কদমগাছের নিচের বেদিতে বসে আছে কাছেই বকুলগাছে ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধে চারপাশ আমোদিত। ঝাক বেধে জোনাকি বের হয়েছে। নাদিয়া তার দাদির কথা ভাবছে না। সে তার ছোটমামার কথা ভাবছে। আবার সে তার মামার নাম ভুলে গেছে। কিছুতেই নাম মনে করতে পারছে না। মৃত মানুষ কত সহজেই না হারিয়ে যায়। জীবিত মানুষও মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। হাসান রাজা চৌধুরী এখনো জীবিত। হাজতে আছে। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে। যা হাসান রাজা তাকে একটা চিঠি লিখেছে। নাদিয়া তার উগ্র লিখে রেখেছে। পাঠানো হয়নি। নাদিয়া ভেবে রেখেছে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জেলহাজতে হাসান রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তাকে চিঠিটা হাতে হাতে দেবে। নাদিয়া লিখেছে— আমি তোমার সাহসে মুগ্ধ
false
shirshendu
খুব কাছ থেকে ধ্রুবর মুখখানা দেখে সম্মোহিত হয়ে গেল রেমি, কী সুন্দর! তার মেয়েলি অহংকার ভেসে গেল, উবে গেল অভিমান রাগ আর ঘৃণা। শরীর ও হৃদয় জুড়ে বেজে যাচ্ছিল এক দামামা। এই সেই রণবাদ্য যা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে দুই বিপরীত শরীরের সংঘর্ষ ও সংঘাত। একটি-দুটি রাত্রি কাটল শরীরের উন্মত্ততায়। কিন্তু এই বাড়ির ভিতরে ভিতরে যে বিভেদ, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস জমেছে বহুদিন ধরে, তা ছাড়বে কেন তাদের? বিয়ের একমাস পরেই ইলেকশন। কৃষ্ণকান্ত বিধানসভার নমিনেশন পেয়েছেন, বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা এবং ভীষণ ব্যস্ততা দেখা দিল। রান্নাঘরে বিশাল উনুন জ্বলে সারাদিন। দলের কর্মীরা অনেকেই এসে খায়। তা হচ্ছে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। বাড়িটা প্রায় বারোয়ারি বাড়ি হয়ে উঠল। একদিন সন্ধেবেলা ধ্রুব একটা লোককে কলার ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে এল। চেঁচিয়ে কৃষ্ণকান্তের উদ্দেশে বলতে লাগল, দেখুন, আপনার লোকজনকে একটু দেখে যান। কৃষ্ণকান্ত দলের লোকজনকে নিয়ে ওপরতলায় জরুরি মিটিং করছিলেন। মিটিং অবশ সারাদিন লেগেই থাকত। বিরক্ত মুখে কৃষ্ণকান্ত গাড়িবারান্দার ছাদে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন? ধ্রুব বলল, এই লোকটাকে চেনেন তো! এ হচ্ছে আপনার একজন ক্যামপেনার। রঘুবীর দাশশর্মা। চিনব না কেন? ও কী করেছে? একটু আগে হাজরা পার্কের উলটোদিকের গলিতে এ দুটো ছেলেকে মেরেছে। তারা দেয়ালে লিখছিল। সেই দেয়াল নাকি আপনার। শুধু এই কারণে দলবল নিয়ে এ গিয়ে ওদের তাড়া করে। গলিতে নিয়ে গিয়ে পেটে ছোরা মেরেছে। তারপর এসে ফুটপাথে বেঞ্চ পেতে বসে বিড়ি ফুকছে। কৃষ্ণকান্ত গমগমে গলায় বললেন, চেঁচিয়ো না, ছেড়ে দাও ওকে, আমি দেখছি। কী দেখবেন? সে আমি বুঝব। আপনি বুঝবেন কেন? এ লোকটাকে পুলিশের হাতে দেওয়া উচিত। কৃষ্ণকান্ত ধমক দিয়ে বললেন, ধ্রুব! ওকে ছেড়ে দাও। পুলিশে দেওয়ার দরকার হলে আমিই দেব। তুমি তোমার কাজে যাও। সেটা তো আইন নয়। আইন তোমার চেয়ে আমি ভাল জানি। জানেন, কিন্তু মানেন না। কৃষ্ণকান্ত একটু বিপদে পড়লেন। কারণ দলের লোকজন সব উঠে গাড়িবারান্দার ওপরে ভিড় করে পিতা পুত্রের নাটক দেখছে। নীচে এবং ফটকের বাইরেও লোক জমা হচ্ছে। কৃষ্ণকান্ত মরিয়া হয়েই বললেন, ও যে মেরেছে তার কোনও সাক্ষী আছে? আমিই সাক্ষী। তুমি একা? তা ছাড়া আর কে সাক্ষী দেবে? তুমি ঠিক দেখেছ? নিশ্চয়ই। আপনি থানায় টেলিফোন করুন। আমি সাক্ষী দেব। রঘুবীর দাশশর্মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একটু হাসছিলও মাঝে মাঝে। সে জানে ধ্রুব একটু পাগলা গোছের। সে এও জানে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী যে-কোনও বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবেনই। কৃষ্ণকান্ত বললেন, আমি থানায় ফোন করছি। রঘুবীরকে ওপরে আসতে বলো। ব্যাপারটা এইখানেই মিটে গেল অবশ্য। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ এসে রঘুবীরকে ধরে নিয়ে যায় এবং তার পরদিনই রঘুবীর ছাড়া পেয়ে অন্য এলাকায় কৃষ্ণকান্তর হয়ে খাটতে থাকে। কৃষ্ণকান্ত তখন একদিন রেমিকে ডেকে বললেন, বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিয়ে দামড়াটাকে সঙ্গে করে কদিন দার্জিলিং বেরিয়ে এসো তো মা। রিজার্ভেশন হয়ে গেছে। সেই তারা হানিমুনে চলল। রক্ষণশীল পরিবারের পক্ষে দারুণ আধুনিক ব্যাপার। মধুচন্দ্রিমা না নিমচন্দ্রিমা তা কে বলবে? ধ্রুব সেই আগের মতোই অস্বাভাবিক। কিছুতেই রেমিকে চিনতে চায় না। তাকায় না, কথা বলে না। দিনরাত একনাগাড়ে মদ খেয়ে যাচ্ছে। ইলেকশনের সময় তাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা কি বোঝেনি ধ্রুব? ঠিকই বুঝেছিল। আর রেমি বুঝতে পারছিল মাত্র কয়েকদিনের শারীরিক প্রেম ধ্রুবর ফুরিয়ে গেছে। শরীর আর কতদিন শরীরের বাঁধনে বাঁধা থাকতে পারে। যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যৌনতাই প্রধান সেখানে সম্পর্ক বাতাসের ভর সয় না। বর্ধমানে ধ্রুব রেমিকে বলল, যাও না, প্ল্যাটফর্মের কল থেকে জলের বোতলটা ভরে আনো। আমি?—রেমি অবাক হয়ে বলল, আমাকে জল আনতে বলছ? কেন, তুমি আনলে কী হয়? মেয়েরা কখনও এসব করে? যদি গাড়ি ছেড়ে দেয় আমি তো দৌড়ে এসে চলন্ত ট্রেনে উঠতেও পারব না। চেষ্টা করলে সব পারা যায়। পারবে। তুমি পারো গিয়ে। আমি তোমার মদ খাওয়ার জন্য জল আনতে পারব না। তা হলে আমি বাথরুমের জলই মিশিয়ে খাব। তা খেতে পারো। খাব? তুমি আমাকে খেতে দেবে? জানো, গাড়ির জলে এক লক্ষ রকমের জীবাণু আছে? তা আমি কী করব? তোমাকে তো আমি মদ খেতে বলিনি। মাইরি, যাও না। বলেছি তো পারব না। ঠিক আছে, তা হলে আমিই নামছি। যদি গাড়িতে উঠতে না পারি তা হলে তুমি একাই দার্জিলিং যেয়ো। এই বলে ধ্রুব নিজেই উঠল এবং জলের বোতল নিয়ে নেমে গেল। সেটা গ্রীষ্মকাল। প্ল্যাটফর্মের কলে দারুণ ভিড়। রেমি দেখল, ধ্রুব সেই ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়ল। কিন্তু তারপর আর তাকে দেখা যাচ্ছিল না। জল নিয়ে যাত্রীরা হুড়হুড়ি করে ফিরে আসছে। কল প্রায় কাঁকা হয়ে গেল। কিন্তু ধ্রুবকে আর দেখতে পেল না রেমি। গার্ডের হুইশিল বাজল। একসময়ে গাড়ি নড়ে উঠল। কিন্তু ধ্রুব? আতঙ্কে জানালা দিয়ে রেমি তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, এই তুমি কোথায়? ওগো, তুমি এসো শিগগির! গাড়ি ছেড়ে দিল যে! কিন্তু কোথায় ধ্রুব? বর্ধমান প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পিছন দিকে। মরিয়া রেমি গাড়ির অ্যালার্ম চেন ধরে ঝুলে পড়ল। গাড়ি থামতেই সে নেমে পড়ল আগুন-গরম প্ল্যাটফর্মে। তারপর ছুটতে লাগল পিছন দিকে। ধ্রুবকে অবশ্য পাওয়া গেল সহজেই। খুব নিবিষ্টমনে হুইলারের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। রেমি গিয়ে তার হাত ধরতেই সে একটুও লজ্জিত না হয়ে একটা হাই তুলে বলল, প্রেমের চেয়ে তা
false
shomresh
বলে মনে হচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে সুদীপের গালে হাত রাখল, সুদীপ! কোন সাড়া এল না সুদীপের কাছ থেকে। জয়িতার বুকের কান্নাটা গলায় উঠে আসছিল। সে আবার ওর চোখের কাছে আঙুল নিয়ে গেল। এবার চোখের পাতা বন্ধ হল। হঠাৎ আবেগে শরীর কাঁপানোয় জয়িতা দুহাতে সুদীপকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আনন্দ মুখ ফিরিয়ে দৃশ্যটা দেখল। এতটা পথ আসার সময় সে মেয়েটির কাছ থেকে যা জেনেছে তাতে সুদীপের মস্তিষ্কের অসাড়তা খুব অল্পে দূর হবে বলে মনে হয় না। কল্যাণটা চলে গেল, সুদীপ যদি এভাবে অকেজো হয়ে যায় তাহলে রইল তারা দুজন। কাজের পরিধি বিরাট অথচ মানুষ কম। পালদেমকে বোঝালে বুঝতে পারে কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা ওর নেই। সুদীপকে যে ভঙ্গিতে জয়িতা জড়িয়ে ধরেছে তা স্বাভাবিক সময়ে হত না। কল্যাণের একটা ধারণা ছিল জয়িতা সুদীপকেই বেশি পছন্দ করে। এমন কি ওর সঙ্গে সুদীপের প্রণয়-সম্পর্ক খুঁজে বার করতেও চেষ্টা করত। এসব ভাবনা কখনও আনন্দর মাথায় আসেনি। কিন্তু এখন ওই ভঙ্গি চোখের সামনে দেখে আনন্দর বারংবার কল্যাণের কথা মনে পড়ছিল। কল্যাণ দৃশ্যটা সহ্য করতে পারত না। ঠিক তখনই কাণ্ডটা ঘটল। ওরা কেউ পর্দাটার দিকে নজর দেয়নি। প্রত্যেকের দৃষ্টি তখন সুদীপ জয়িতার ওপরে। এমন সময় ঠিক ঘাড়ের পেছনে জান্তব চিৎকার আর মেয়েটির আর্তনাদ একই সঙ্গে শোনা গেল। চকিতে কয়েক পা সরে এসে আনন্দ দেখল মা ভালুটা বীভৎস দাঁত বের করে মেয়েটিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। আনন্দর মস্তিষ্ক এবং হাত একসঙ্গে কাজ করল। রিভলবারটা বের করে সজাগ রেখেছিল সে গুহার মুখে ভালুকটাকে দেখার পর। সেইটাই কাজে লাগল। শব্দটা ভয়ঙ্কর ভাবে গুহাটাকে কাপাল। প্রথম গুলিটা ভালুকটার প্রথম পায়ে লাগতেই সে আহত হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে সরে এল। খুব অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েও মেয়েটি যেন নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। আহত ভালুকটা এবার পেছনের দুই পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লা-ছিরিঙের উদ্দেশ্যে এগোতেই দ্বিতীয় গুলিটা সরাসরি বুকে লাগল। একটা পাহাড়ের মত কাপতে কাপতে ভালুকটা লুটিয়ে পড়ল গুহার মুখে। পড়ার সময় টেস্টটাকে ছিঁড়ে নিয়ে এল শরীরের নিচে। শব্দটা এখন বহুগুণ। যেন সমস্ত পাহাড়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আনন্দ চিৎকার করে সবাইকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলল। পর্দাটা তো ছিলই না, ভালুকটার শরীর ডিঙিয়ে ওরা বাইরে এসে দাঁড়াল। আনন্দ যার ভয় পেয়েছিল তা হল না। বিদেশী সিনেমায় দেখেছিল এই ধরনের শব্দ আলগা পাথর বা বরফ নড়িয়ে ধস নামায়। কিন্তু এখানকার পাহাড় শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরও ঠিকঠাক আছে। ধাতস্থ হবার পর জয়িতার খেয়াল হল সুদীপ বের হয়নি। এবং তখনই মেয়েটা ছুটে গেল ভেতরে। কান্নটা শুনতে পেল সবাই। সুদীপ কাঁদছে। জয়িতা ওদের বাইরেই অপেক্ষা করতে বলে নিজে এগিয়ে গেল। গুহার মধ্যে যেখানে সুদীপ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে এখন। আর সেই অবস্থায় ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। মেয়েটি এখন তার মাথার সামনে দাঁড়িয়ে। এই কান্না তাকেও অবাক করেছে। কিন্তু সে কোন কথা বলছে না, স্পর্শও না। জয়িতার সমস্ত শরীরে কদম ফুটল। সুদীপ কাঁদছে যখন তখন ওর অসাড় হওয়া মস্তিষ্ক এখন কাজ করছে। তার মানে ও আবার স্বাভাবিক হতে চলেছে। হয়তো ওই তীব্র শব্দ ওর চেতনা স্পষ্ট করতে সাহায্য করেছে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল, সুদীপ, অ্যাই সুদীপ, কি হয়েছে তোর? সুদীপের কান্নাটা অর্কস্মাৎ থামল। তারপর সেই অবস্থায় চুপচাপ বসে রইল। জয়িতা এবার আনন্দর গলা শুনল, ওকে এখন ডিস্টার্ব করিস না জয়ী। বরং ও যদি ঘুমাতে পারে তাহলে ভাল হয়—সুদীপ, তুই কি ঘুমাবি? বিছানা ঠিক করে দেব? সুদীপ কোন জবাব দিল না। তার বসার ভঙ্গিরও পরিবর্তন হল না। মেয়েটি তখনও পুতুলের মত দাঁড়িয়ে। আনন্দ দেখল লা-ছিরিঙ প্রাণপণে চেষ্টা করছে ভালুকটাকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার একার শক্তিতে সেটা অসম্ভব। ভালুকটার দিকে তাকালে বোঝা যায় এর বয়স বেশি নয়। লা-ছিরিঙ তার নিজস্ব ভাষায় জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু বলতেই মেয়েটি সাহায্যের জন্যে এগিয়ে গেল। ওই জানোয়ারটার শরীরে হাত দিতে জয়িতার ঘেন্না করছিল। তাছাড়া সুদীপের ব্যাপারটা তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। ও যদি চেতনা ফিরে পেয়ে থাকে তাহলে এখনো সাড়া দিচ্ছে না কেন? সুদীপের বিছানাটা বের করে সে একপাশে বিছিয়ে দিয়ে সুদীপকে ডাকল, সুদীপ আয়। মাথা নাড়ল সুদীপ। মুখে কিছু বলল না। ভঙ্গিও পালটাল না। আর এতেই খুশী হল জয়িতা। অন্তত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ও। অর্থাৎ স্বাভাবিক হবে একসময়। বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড়টা যেন আচমকা সরে গেল জয়িতার। সে দেখল ভালকুটাকে ওরা অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে গিয়েছে। লা-ছিরিঙ কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে চিৎ-করা ভালুকের বুকের চামড়া কাটতে লাগল। এখন গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। জয়িতা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর গোলাতে লাগল। সারারাত জেগে, ভোরে এই পরিশ্রম করে এখন সমস্ত শরীরে বমি-ভাব ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ খুব অসুস্থ মনে হল নিজেকে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনরকমে বাইরে এসে ভালুকটার বিপরীতে গিয়ে পেটে হাত রেখে বমি করল। শুধু তেতো জল ছাড়া আর কিছু বের হল না। ওরা সবাই ভালুকটাকে নিয়ে ব্যস্ত এখন। দমক আসছে জয়িতার কিন্তু মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছে না। এবং এখানে আসার পর সম্ভবত এই প্রথম তার হিমবাতাস ভাল লাগল। মুখের খোলা ফাটা জায়গাতেও তার স্পর্শ অনেক রমণীয় মনে হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে
false
shunil_gongopaddhay
নিজের পারিবারিক গণ্ডী, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের ছোট বৃত্ত ছাড়িয়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বৃহত্তম প্রাঙ্গণে। বিশেষত বিলেত থেকে ফেরার পর তার কণ্ঠে সুরের সঙ্গে মিশেছে দার্ঢ্য। ছেলেবেলায় সে যদু ভট্টের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিল, ব্ৰাহ্ম সমাজের বাধা গায়ক বিষ্ণু চক্ৰবর্তীর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছে, জ্যোতিদাদার পিয়ানো বাজনার সঙ্গে গলা মিলিয়েছে, তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মৰ্মে প্রবেশ করেছে খানিকটা। সব মিলিয়ে তার সঙ্গীত জ্ঞান সমৃদ্ধ কণ্ঠস্বরেও এসেছে নিজস্বতা। সবাই তাকে এখন গান শোনাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু রবি কি পেশাদার গায়ক হতে চায়? অভিনেতা হিসেবেও সে এর মধ্যেই অনেকটা সার্থক। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যে-কোনও নাট্য-উৎসবে রবির অনিবাৰ্য ভূমিকা, কলকাতার বিদ্বজ্জনেরা সে সব দেখতে আসেন। রেভারেন্ড কেষ্ট বাডুজ্যে বাল্মীকি প্রতিভায় রবির গান ও অভিনয় দেখেশুনে রবিকে অ্যাখ্যা দিয়েছিল, ‘বাল্মীকি কোকিল’! কিন্তু রবি তো নেহাত অভিনেতাও হতে চায় না। তার প্রধান ভালোবাসা যে কবিতা! বস্তুত, কবি হিসেবে রবি এ পর্যন্ত তেমন কোনও অসাধারণত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি। সে অনবরত কবিতা লিখে যেতে পারে, ছন্দ মিল আসে সাবলীলভাবে, কিন্তু কিছুতেই গভীরতা আসে না। তার শব্দগুলো এলিয়ে পড়া, ছাড়া ছাড়া, অস্পষ্ট। বিশুদ্ধ আবেগের বদলে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাস, বিষণ্ণতার বদলে হা-হুতাশ নয়। রবি কবিতা লিখতে গেলেই যেন হয়ে যায় ছন্দোবদ্ধ ব্যক্তিগত ডায়েরি কিংবা চিঠি, তাতে সার্বজনীনতার স্পর্শ লাগে না। রবি এখন তা বুঝতে পারছে, কিন্তু কী করে এর থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়? ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর কেউই বিশেষ ভালো কথা বলেনি। রবি ভাবছে, এই বইটির প্রচার বন্ধ করে দেবে। যাঁর মতামতকে রবি বিশেষ শ্ৰদ্ধা করে, সেই প্রিয়নাথ সেন বইখানি পড়ে রবিকে প্রায় ভৎসনাই করেছেন বলতে গেলে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রতিবেশী এই প্রিয়নাথ সেনের সঙ্গে রবির পরিচয় হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। এই মানুষটির জ্ঞানের পরিধি দেখে রবি একেবারে মুগ্ধ। প্রিয়নাথ যেন সাহিত্যের সাত সমুদ্রের নাবিক। তিনি পৃথিবীর সব কটি প্রধান ভাষার সাহিত্যের স্বাদ গ্ৰহণ করেছেন, রবির সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক, রবি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। প্রিয়নাথ নিজে কবি হতে চান না। তাই রবির প্রতি তার ঈর্ষা থাকারও কোনও কারণ নেই। ভগ্নহৃদয় পড়ে তিনি ভ্ৰকুঞ্চিত করে বলেছেন, এ সব কী লিখেছি হে, রবীন্দ্র? এ যে নিছক মেয়েলি ছড়ার মতন, এতে কোনও উচ্চাঙ্গের ভাব নেই, রস নেই। ভাষা এত দুর্বল! “এ পারে দাঁড়ায়ে, দেবী, গাহিনু যে শেষ গান/তোমারই মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়- / একটি নয়নজল তাহারে করিও দান…”। যাত্রা দলের ছোঁড়ারা এমন প্যানপ্যানানি গান গায়। ‘একটি নয়নজল’ আবার কী? তারপর এই যে লিখেছে, “বিষণ্ণ অধর দুটি অতি ধীরে ধীরে টুটি/ অতি ধীরে ধীরে ফুটে হাসির কিরণ …”। অধর আবার দুটো হয় কি করে? ওপরেরটি ওষ্ঠ, নীচেরটি অধর। তাও না হয় হল। অধর আবার টুটিবে কী করে? অধরের কথা লিখতে গিয়ে ভাষা কি মাথামুণ্ডও খোয়াবে? পরপর দু লাইনে “অতি ধীরে ধীরে” কোনও ভালো কবি লিখবে না! পরিবারের সবাই সব সময় প্রশংসা করে রবিকে উৎসাহিত করেন বটে, শুধু একজন ব্যতিক্রম। যাঁর উদ্দেশ্যে রবির অধিকাংশ কবিতা লেখা, তিনিই রবির প্রধান সমালোচক। নতুন বউঠান। রবির সব কবিতা তিনি প্রথম পাঠ করবেনই, রবি দেখাতে না চাইলেও জোর করে খাতা কেড়ে নেবেন। কিন্তু পড়তে পড়তে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কৌতুক হাস্যে বলেন, যাই বল, তুমি এখনও উঁচুদরের কবি হতে পারোনি, বিহারীলালের মতন তুমি লিখতে পার না? তোমার গানগুলি বেশ হয় বটে, কিন্তু কাব্যে বিহারীবাবু সেরা! কাদম্বরী বেশ ভালোই জানেন, কোন কথা তাঁর এই দেবরটির মনে বেশি জ্বালা ধরাবে। কোনও কবিই অন্যের সঙ্গে তুলনা সহ্য করতে পারে না। এই কথা শুনলে রবি পুরনো কবিতা ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে লিখতে বসে। বিহারীলালকে ছাড়িয়ে যেতেই হবে, নতুন বউঠানের কাছে সে-ই হবে একমাত্র কবি। কিন্তু পারা যাচ্ছে না কেন? মাঝখানে রবি বিহারীলাল চক্রবর্তীকে অনুসরণ করারও চেষ্টা করেছিল। ‘বাল্মীকি প্ৰতিভা’ তো বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’-এর আদলেই রচিত, তাতে অনেক লাইনও ঢুকে গেছে। নাঃ, ও ভাবে হবে না, ও ভাবে হবে না! রবি এর মধ্যে সত্যিকারের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে গদ্য রচনায়। সতেরো-আঠেরো বছর বয়েসে সে যেমন পরিচ্ছন্ন, নির্মেঘ, ধারালো গদ্য লিখেছে, তার তুলনা বাংলায় তো দূরের কথা ভূভারতে নেই। এমনকি সারা পৃথিবীতেই বা তার বয়সী এমন অবিশ্রান্ত গদ্য লেখক আর কে আছে? তার গদ্যে রয়েছে যুক্তি, কৌতুক, শ্লেষ ; নেই অকারণ উপমার বাহুল্য, নেই অনর্থক তৎসম শব্দ ঝঙ্কারের প্রতি মোহ। যারা রবিকে শুধু স্কুল-পালানো ছেলে মনে করে, তারা জানে না নিজস্ব পড়াশুনোর বিস্তার কতখানি। তার প্রবন্ধের বিষয়, বিয়াত্ৰিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য, নর্মান জাতি ও অ্যাঙ্গলোসাহিত্য, নিন্দাতত্ত্ব, নিঃস্বাৰ্থ প্রেম, বস্তুগত ও ভাবগত কবিতা, সঙ্গীত ও ভাব, চীনে মরণের ব্যবসায়, গোলাম চোর, গেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ ইত্যাদি। এ ছাড়া ‘য়ুরোপ যাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ নামে ধারাবাহিকভাবে যেগুলি সে তাতে ভারতীয় ও ইংরেজ সমাজের খুঁটিনাটি তুলনা, অল্প আঁচড়ে এক একটি চরিত্রকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা ও অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় আছে। কিন্তু পরিহাস এই যে, গদ্য লেখক হিসেবে রবির কোনও সুনাম হয়নি, ‘ভারতী’তে কোনও রচনাতেই লেখকের নাম থাকে না। রবির কয়েকখানি কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে, অনেকেই ঠাকুরবাড়ির এই ছোট ছেলেটিকে কবি হিসেবে চিনেছে, কিন্তু ভারতীয় ওই তীক্ষ্ণ গদ্য
false
manik_bandhopaddhay
আবার যদি মুখখানা তার কালো আর বাঁকা হইয়া যায়? রোমাঞ্চকর বিষাদের অনুভূতিতে রাজকুমারের সর্বাঙ্গে শিহরণ বহিয়া যায়। মালতীর সঙ্গে তার প্রায় দেখাই হয় না। মালতীও সাড়াশব্দ দেয় না। সরসীর কাছে রাজকুমার তার খবর পায়। আপনা হইতে সব ঠিক হইয়া যাইবে জানিলেও মালতীর সম্বন্ধে রাজকুমারের ভাবনা ছিল। আপনা হইতে সব ঠিক হইয়া যাওয়ার প্রক্রিয়াটি তো সহজ বা সংক্ষিপ্ত হইবে না মালতীর পক্ষে, কষ্টকর দীর্ঘ মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে তাকে কতদিন কাটাইতে হইবে কে জানে? তার সাহায্য পাইলে এই দুঃখের দিনগুলি হয়তো মালতীর আরেকটু সহনীয় হইত কিন্তু সে সাহস আর রাজকুমারের নাই। নিজের সম্বন্ধে তার একটা আতঙ্ক জন্মিয়া গিয়াছে। কয়েকটা দিন অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে কাটাইয়া একদিন সে সরসীর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিয়াছিল। অকপটে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়া প্রায় করুণ সুরে প্রশ্ন করিয়াছিল, কি করি বল তো সরসী? সরসী বলিয়াছিল, তোমার কিছু করতে হবে না। আমি সব ঠিক করে নেব। রাজকুমার চিন্তিতভাবে বলিয়াছিল, সেটা কি ঠিক হবে সরসী? যা বলার আমার বলাই উচিত, আমার হয়ে তুমি কিছু বলতে গেলে হয়তো ক্ষেপে যাবে। এমনিই কি হয়েছে কে জানে, একদিন ফোন পর্যন্ত করল না। যখন তখন ফোনে কথা বলতে পারবে বলে জোর করে আমাকে বাড়িতে ফোন নিয়েছে। কিছু বুঝতে পারছি না, সরসী। এমন অসহায় নম্ৰতার সঙ্গে রাজকুমারকে সরসী কোনোদিন কথা বলিতে শোনে নাই। ধরা গলার আওয়াজ রাজকুমারকে শোনাইতে না চাওয়ায় কিছুক্ষণ সে কথা বলিতে পারে নাই। তুমি কিছু ভেব না রাজু। তোমার হয়ে মালতীকে বলতে যাব কেন? যা বলার আমি নিজে বলব, যা করার আমি নিজেই করব। এসব মেয়েদের কাজ মেয়েরাই ভালো পারে। আমায় বিশ্বাস কর, আমি বলছি, মালতীর জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। মালতী চুপ করে গেছে কেন বুঝতে পার না? ওর ভয় হয়েছে। কিসের ভয়? তুমি যদি সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে চাও–এই ভয়। সেদিন নিজে থেকে তোমায় বলেছিল বটে, এখন কিন্তু ওর ভেতর থেকে উল্টো চাপ আসছে। যেতে বললে যাবে কিন্তু ওর উৎসাহ নিবে গেছে। সেদিন হোটেলের রুমে যেমন বুঝতে পারে নি হঠাৎ কেন অসুস্থ। হয়ে পড়ল, এখনো বেচারি সেইরকম বুঝতে পারছে না কি হয়েছে, অথচ তোমায় একবার ফোন করার সাহসও হচ্ছে না। সরসী মালতীর ভার নেওয়ায় রাজকুমার নিশ্চিন্ত হইয়াছে। নিজের অজ্ঞাতসারেই সরসীর উপর সে নির্ভর করিতে শিখিতেছিল, সব বিষয়ে সরসীর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা ও পরামর্শ করার প্রেরণাও তার এই মনোভাব হইতে আসিতেছে। তাকে রিণির প্রয়োজন, তাই শুধু উন্মাদিনী। রিণির সাহচর্য স্বীকার করিয়া সকলের জীবন হইতে নিজেকে দূরে সরাইয়া লইয়াছে, বাদ পড়িয়াছে সরসী। সরসীকেও সে মুক্তি দিতে চাহিয়াছিল, মুক্তি পাইতে সরসী অস্বীকার করিয়াছে। রাজকুমার। তাকে ডাকে না, সরসী নিজেই তার কাছে আসে, বাড়িতে না পাইলে স্যার কে এল-এর বাড়ি গিয়া তার খোঁজ করে। রিণি তাকে সহ্য করিতে পারে না, নিচে বসিয়া রাজকুমারের সঙ্গে সে কথা বলে। বার বার রিণি তাদের আলাপে বাধা দেয়, রাজকুমারকে উপরে ডাকিয়া অনেকক্ষণ আটকাইয়া রাখে, সরসী ধৈর্য হারায় না, বিরক্ত হয় না, অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকে। মাঝে মাঝে রাজকুমারের মনে হয়, সে যেন সকলকে রেহাই দেয় নাই, তাকেই সকলে পরিত্যাগ করিয়াছে, একমাত্র সরসী তাকে ছাটিয়া ফেলে নাই, আরো তার কাছে সরিয়া আসিয়াছে। স্যার কে এল-এর বাড়িতেই রাজকুমারের বেশিরভাগ সময় কাটে–রিণির কাছে। রাজকুমার না থাকিলে রিণি অস্থির হইয়া ওঠে, কাঁদিতে কাদিতে নিজের চুল ছেড়ে, রাগ করিয়া। আলমারির কাচ, চীনামাটির বাসন ভাঙে, বইয়ের পাতা ছিড়িয়া ফেলে, ধরিতে গেলে মানুষকে কামড়াইয়া দেয়, জামাকাপড় খুলিয়া ফেলিয়া নগ্ন দেহে রাজকুমারের খোজে বাহির হইয়া যাইতে চায় পথে। রাজকুমারকে দেখিলেই সে শান্ত হইয়া যায়, আশ্চর্যরকম শান্ত হইয়া যায়। প্রায় স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো কথা বলে ও শোনে, চলাফেরা করে, খাবার খায়, ঘুমায়। একটু তফাত। হইতে লক্ষ করিলে অজানা মানুষের তখন বুঝিবার উপায় থাকে না তার কিছু হইয়াছে। কোনো কোনো মুহুর্তে রাজকুমারের পর্যন্ত মনে হয় যে রিণি বুঝি সারিয়া উঠিয়াছে, একটা চমক দেওয়া উল্লাস জাগিতে না জাগিতে লয় পাইয়া যায়। রিণির চোখ রাজকুমার যত কাছেই থাক, যতই সুস্থ ও শান্ত মনে হোক রিণিকে, দুটি চোখের চাহনি রিণির ক্ষণিকের জন্যও স্বাভাবিক হয় না। প্রথম দিকে রাত্রে রিণিকে ঘুম পাড়াইয়া রাজকুমার নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইত, কিন্তু দেখা গেল এ ব্যবস্থা বজায় রাখা অসম্ভব। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া রিণি হৈচৈ সৃষ্টি করিয়া দেয়, কেউ তাকে সামলাইতে পারে না, শেষ পর্যন্ত রাজকুমারকে ডাকিয়া আনিতে হয়। রাত্রে রাজকুমারকে তাই এ বাড়িতে শোয়ার ব্যবস্থা করিতে হইয়াছে। স্যার কে এল কিছু বলেন নাই। রাজকুমার নিজেই তার কাছে প্রস্তাব করিয়াছিল। আপনার আপত্তি নেই তো? না। লোকে নানা কথা বলবে। বলুক। রাত্রে মাথার কাছে বিছানায় বসিয়া শিশুর মতো গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া রিণিকে সে ঘুম পাড়াইল, তারপর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে কথাটা আরো পরিষ্কার করিয়া নেওয়ার জন্য আরেকবার গেল স্যার কে এল-এর ঘরে। আপনি যদি ভালো মনে করেন, রিণিকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি। কেন? আপনি তো বুঝতে পারছেন, প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতোই আমাদের দিনরাত একত্রে থাকতে হবে–কতকাল ঠিক নেই। রাজু, স্ত্রী পাগল হলে স্বামী তাকে ত্যাগ করে। তবু আপনার মনে যদি– আমার মনে কিছু হবে না রাজু। শুধু মনে হবে তুমি রিণিকে সুস্থ করার
false
bongkim
নি:শব্দে নি:শব্দে চলিয়া যাইতেছিলেন। কিন্তু মনে ভাবিলেন, যদি মনুষ্য হয়? এত রাত্রে কে এ স্থানে? সে ত তুরককে দেখিলে দেখিয়া থাকিতে পারে? এই সন্দেহে হেমচন্দ্র ফিরিলেন। নির্ভয়ে বাপীতীরারোহণ করিলেন, সোপানমার্গে ধীরে ধীরে অবতরণ করিতে লাগিলেন। প্রেতিনী তাঁহার আগমন জানিতে পারিয়াও সরিল না, পূর্বমত রহিল। হেমচন্দ্র তাঁহার নিকটে আসিলেন। তখন সে উঠিয়া দাঁড়াইল। হেমচন্দ্রের দিকে ফিরিল; হস্তদ্বারা মুখাবরণকারী কেশদাম অপসৃত করিল। হেমচন্দ্র তাহার মুখ দেখাইলেন। সে প্রেতিনী নহে, কিন্তু প্রেতিনী হইলে হেমচন্দ্র অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইতেন না। কহিলেন, “কে, মনোরমা! তুমি এখানে?” মনোরমা কহিল, “আমি এখানে অনেকবার আসি-কিন্তু তুমি এখানে কেন?” হে। আমার কর্ম আছে। ম। এ রাত্রে কি কর্ম? হে। পশ্চাৎ বলিব; এ রাত্রে এখানে কেন? ম। তোমার এ বেশ কেন? হাতে শূল; কাঁকালে তরবারি; তরবারে এ কি জ্বলিতেছে? এ কি হীরা? মাথায় এ কি? ইহাতে ঝকমক করিয়া জ্বলিতেছে, এই বা কি? এও কি হীরা? এত হীরা পেলে কোথা? হে। আমার ছিল। ম। এ রাত্রে এত হীরা পরিয়া কোথায় যাইতেছ? চোরে যে কাড়িয়া লইবে? হে। আমার নিকট হইতে চোরে কাড়িতে পারে না। ম। তা এত রাত্রে এত অলঙ্কারে প্রয়োজন কি? তুমি কি বিবাহ করিতে যাইতেছ? হে। তোমার কি বোধ হয়, মনোরমা? ম। মানুষ মারিবার অস্ত্র লইয়া কেহ বিবাহ করিতে যায় না। তুমি যুদ্ধে যাইতেছ। হে। কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? তুমিই বা এখানে কি করিতেছিলে? ম। স্নান করিতেছিলাম। স্নান করিয়া বাতাসে চুল শুকাইতেছিলাম। এই দেখ, চুল এখনও ভিজা রহিয়াছে। এই বলিয়া মনোরমা আর্দ্র কেশ হেমচন্দ্রের হস্তে স্পর্শ করাইলেন। হে। রাত্রে স্নান কেন? ম। আমার গা জ্বালা করে। হে। গঙ্গাস্নান না করিয়া এখানে কেন? ম। এখানকার জল বড় শীতল। হে। তুমি সর্বদা এখানে আইস? ম। আসি। হে। আমি তোমার সম্বন্ধ করিতেছি-তোমার বিবাহ হইবে। বিবাহ হইলে এরূপ কি প্রকারে আসিবে? ম। আগে বিবাহ হউক। হেমচন্দ্র হাসিয়া কহিলেন, “তোমার লজ্জা নাই-তুমি কালামুখী |” ম। তিরস্কার কর কেন? তুমি যে বলিয়াছিলে, তিরস্কার করিবে না। হে। সে অপরাধ লইও না। এখান দিয়া কাহাকেও যাইতে দেখিয়াছ? ম। দেখিয়াছি। হে। তাহার কি বেশ? ম। তুরকের বেশ। হেমচন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “সে কি? তুমি তুরক চিনিলে কি প্রকারে?” ম। আমি পূর্বে তুরক দেখিয়াছি। হে। সে কি? কোথায় দেখিলে? ম। যেখানে দেখি না-তুমি কি সেই তুরকের অনুসরণ করিবে? হে। করিব-সে কোন্ পথে গেল? ম। কেন? হে। তাহাকে বধ করিব। ম। মানুষ মেরে কি হবে? হে। তুরক আমার পরম শত্রু। ম। তবে একটি মারিয়া কি তৃপ্তি লাভ করিবে? হে। আমি যত তুরক দেখিতে পাইব, তত মারিব। ম। পারিবে? হে। পারিব। মনোরমা বলিল, “তবে সাবধানে আমার সঙ্গে আইস |” হেমচন্দ্র ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। যবনযুদ্ধে এই বালিকা পথপ্রদর্শিনী! মনোরমা তাঁহার মানসিক ভাব বুঝিলেন; বলিলেন, “আমাকে বালিকা ভাবিয়া অবিশ্বাস করিতেছ?” হেমচন্দ্র মনোরমার প্রতি চাহিয়া দেখিলেন। বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভাবিলেন-মনোরমা কি মানুষী? ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পশুপতি গৌড়দেশের ধর্মাধিকার পশুপতি অসাধরণ ব্যক্তি; তিনি দ্বিতীয় গৌড়েশ্বর। রাজা বৃদ্ধ, বার্ধক্যের ধর্ম্মানুসারে পরমতাবলম্বী এবং রাজকার্যে অযত্নবান হইয়াছিলেন, সুতরাং প্রধানামাত্য ধর্মাধিকারের হস্তেই গৌড়রাজ্যের প্রকৃত ভার অর্পিত হইয়াছিল। এবং সম্পদে অথবা ঐশ্বর্যে পশুপতি গৌড়েশ্বরের সমকক্ষ ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছিলেন। পশুপতির বয়:ক্রম পঞ্চত্রিংশং বৎসর হইবে। তিনি দেখিতে অতি সুপুরুষ। তাঁহার শরীর দীর্ঘ, বক্ষ বিশাল, সর্বাঙ্গ অস্থিমাংসের উপযুক্ত সংযোগে সুন্দর। তাঁহার বর্ণ তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ; ললাট অতি বিস্তৃত, মানসিক শক্তির মন্দিরস্বরূপ। নাসিকা দীর্ঘ এবং উন্নত, চক্ষু ক্ষুদ্র, কিন্তু অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য-সম্পন্ন। মুখকান্তি জ্ঞানগাম্ভীর্যব্যঞ্জক এবং অনুদিন বিষয়ানুষ্ঠানজনিত চিন্তার গুণে কিছু পুরুষভাবপ্রকাশক। তাহা হইলে কি হয়, রাজসভাতলে তাঁহার ন্যায় সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ আর কেহই ছিল না। লোকে বলিত, গৌড়দেশে তাদৃশ পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিও কেহ ছিল না। পশুপতি জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু তাঁহার জন্মভূমি কোথা, তাহা কেহ বিশেষ জ্ঞাত ছিল না। কথিত ছিল যে, তাঁহার পিতা শাস্ত্রব্যবসায়ী দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। পশুপতি কেবল আপন বুদ্ধিবিদ্যার প্রভাবে গৌড়রাজ্যের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। পশুপতি যৌবনকালে কাশীধামে পিতার নিকট থাকিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতেন। তথায় কেশব নামে এক বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। হৈমবতী নামে কেশবের এক অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা ছিল। তাহার সহিত পশুপতির পরিণত হয়। কিন্তু অদৃষ্টবশত: বিবাহের রাত্রেই কেশব, সম্প্রদানের পর কন্যা লইয়া অদৃশ্য হইল। আর তাহার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই পর্যন্ত পশুপতি পত্নীসহবাসে বঞ্চিত ছিলেন। কারণবশত: একাল পর্যন্ত দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করেন নাই। তিনি এক্ষণে রাজপ্রাসাদতুল্য উচ্চ অট্টালিকায় বাস করিতেন, কিন্তু বামানয়ননি:সৃত জ্যোতির অভাবে সেই উচ্চ অট্টালিকা আজি অন্ধকারময়। আজি রাত্রে সেই উচ্চ অট্টালিকার এক নিভৃত কক্ষে পশুপতি একাকী দীপালোকে বসিয়া আছেন। এই কক্ষের পশ্চাতেই আম্রকানন। আম্রকাননে নিষ্ক্রান্ত হইবার জন্য একটি গুপ্তদ্বার আছে। সেই দ্বারে আসিয়া নিশীথকালে, মৃদু মৃদু কে আঘাত করিল। গৃহাভ্যন্তর হইতে পশুপতি দ্বার উদ্ঘাটিত করিলেন। এক ব্যক্তি গৃহে প্রবেশ করিল। সে মুসলমান। হেমচন্দ্র তাহাকেই বাতায়নপথে দেখিয়াছিলেন। পশুপতি, তখন তাহাকে পৃথগাসনে উপবেশন করিতে বলিয়া বিশ্বাসজনক অভিজ্ঞান দেখিতে চাহিলেন। মুসলমান অভিজ্ঞান দৃষ্ট করাইলেন। পশুপতি সংস্কৃতে কহিলেন, “বুঝিলাম আপনি তুরকসেনাপতির বিশ্বাসপাত্র। সুতরাং আমারও বিশ্বাসপাত্র। আপনারই নাম মহম্মদ আলি? এক্ষণে সেনাপতির অভিপ্রায় প্রকাশ করুন |” যবন সংস্কৃতে উত্তর দিলেন, কিন্তু তাঁহার সংস্কৃতে তিন ভাগ ফরাসী, আর অবশিষ্ট চতুর্থ ভাগ যেরূপ সংস্কৃত, তাহা ভারতবর্ষে কখন ব্যবহৃত হয় নাই। তাহা মহম্মদ আলিরই সৃষ্ট সংস্কৃত। পশুপতি বহুকষ্টে তাহার অর্থবোধ করিলেন।
false
shunil_gongopaddhay
করেনি ভুঁড়ি সম্পর্কে, হাসিটাও প্রায় অদৃশ্যই ছিল, তবু বোঝা যায়, ওর নিজের চেহারা নিয়ে বেশ গর্ব আছে, ও নাকি একসময় ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিল। নিজেই বলল সে কথা! একটুক্ষণ থাকার পরই বীরচন্দ্রের মনে হয়েছিল, কেন এলাম? লাট সাহেব ডাকলেই আসতে হবে। যতই ছোট হোক তিনি একটি স্বাধীন রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী, আর এই টমসন সাহেবটি তো রানী ভিক্টোরিয়ার একজন কর্মচারী মাত্র, তার নিবাসে কেন আসতে বাধ্য হবেন তিনি! ইংরেজ রাজপুরুষদের আমন্ত্রণ মানেই আদেশের সমতুল্য। এরা অস্ত্রবলে বলীয়ান, তাই এরা আদেশ করতে পারে। তুচ্ছ ছুতো করে ইংরেজ সরকার ত্রিপুরায় একজন পলিটিক্যাল এজেন্ট চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। রিভার্স টমসনের বিচ্ছিরি ঝোলা গোঁফ, বীরচন্দ্রের মতন বীরত্বব্যঞ্জন মোচ নয়, বীরচন্দ্র ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে মোচের ডগা পাকালেন কয়েকবার, কিন্তু ইংরেজটি তা গ্রাহ্যই করল না। অভিযোগ জানাবার কিছু নেই, কাকেইবা জানানো যাবে। ইংরেজ শক্তি ইচ্ছে করলেই যে-কোনও দিন বীরচন্দ্রের মাথা থেকে রাজমুকুটটা ছিনিয়ে নিতে পালে। এখনও নিচ্ছে না, কিন্তু নিতে যে পারে, তা মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দেয়। আজকের আমন্ত্রণে সূক্ষ্ম অবজ্ঞা প্রদর্শন তারই নিদর্শন। আমুদে স্বভাবের রাজা বীরচন্দ্রের মেজাজ যখন খারাপ হয়, তখন দু’তিন দিনেও মনের মেঘ কাটতে চায় না। সেদিন তিনি বাসস্থানে ফিরেও কথা বললেন না কারুর সঙ্গে। পরদিন কয়েকজন কবি ও গদ্যকারক ডাকা হয়েছে, সাহিত্যপ্রেমিক মহারাজ নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। শিশিরকুমার ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ বেশ কয়েকজন এসেছেন, দোতলার বৈঠকখানায় মহারাজ মধ্যমণি হয়ে বসলেন বটে, কিন্তু মুখমণ্ডল স্নান, কণ্ঠস্বরে একবারও পুলকের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল না, তিনি শুষ্কভাবে সকলকে আপ্যায়ন করলেন, তারপর একসময় ভেতরে চলে গেলেন। পরদিন শশিভূষণ ডেকে আনলেন কীর্তনিয়ার একটি দলকে। মহারাজ কীর্তন বিশেষ পছন্দ করেন, এই দলটি শোভাবাজার নিয়মিত আসর বসায়। মহারাজের মনের জড়তা কাটেনি, এমন চমৎকার গান, তাও তাঁর পছন্দ হলো না! গায়করা গেয়ে যাচ্ছে, মহারাজের কাছ থেকে কোনও বাহবা নেই। তারা রসের গান, প্রেমের গান, ভক্তির গান কতরকম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনাল, তারপর ধরল ইদানীং জনপ্রিয় এক শ্যামাসঙ্গীত। জানো না রে মন, পরম কারণ কালী কেবল মেয়ে নয় মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখন কখন পুরুষ হয় হয়ে এলোকেশী, করে লয়ে অসি দনুজভনয়ে করে… মহারাজ হাত তুলে সে গান থামিয়ে দিয়ে বললেন, হয়েছে, হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে। এ আবার গান নাকি! ‘কখন কখন পুরুষ হয়’। কী কথার ছিরি! তোমাদের মধ্যে এখানি কে রচেছে? অধিকারটি জিভ কেটে বলল, আজ্ঞে না মহারাজ, আমরা লিখব, এমন কী ক্ষমতা আছে! এটি সাধক কমলাকান্তর রচনা! মহারাজ শশিভূষণকে বললেন, এঁদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দাও। গায়কের দল বিদায় নেবার পর মহারাজ একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন শশিভূষণের দিকে। মনে মনে প্রমাদ গুণলেন শশিভূষণ। মহারাজের মেজাজ খুবই খারাপ। এখন এখানে আর কেউ নেই, মহারাজের মেজাজের সবটা ঝাল শশিভূষণের ওপরেই বৰ্ষিত হবে। কখনও কোনও ইংরেজ রাজপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই মহারাজের এরকম অপ্ৰসন্নতার পালা চলে কয়েকদিন। মহারাজ বললেন, তোমাদের কলকাতায় এসব কী অরাজকতা চলছে! জগন্মাতা কালীকে নিয়ে এই সব ফচকেমির গান লেখা হয়, তোমরা তা সহ্য কর? কালী কেবল মেয়ে নয়, কখন কখন পুরুষ হয়,- এ সব কী যা-তা কথা! মা কালী কেন পুরুষ হবেন? শশিভূষণ বুঝতে পারলেন, কমলাকান্ত কিংবা রামপ্রসাদের রচনার সঙ্গে পরিচিত নন মহারাজ। তিনি বৈষ্ণব পদাবলির অনুরক্ত। শাক্ত কবিরা কালীকে এমন আপন বোধ করেন যে, কালীকে ‘ন্যাকা মেয়ে’ বলতেও তাদের মুখে আটকায় না। মহারাজকে এসব কথা সহজে বোঝানো যাবে না, বরং বকুনি খেতে হবে। শশিভূষণ বিনীতভাবে বললেন, পুরুষ মানে এখানে ঠিক পুরুষ বোঝানো হয়নি, পৌরুষের শক্তি। সবই তো একই শক্তির প্রকাশ। মহারাজ আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, একই শক্তি মানে? কলকাতায় এসে শুনছি, কাগজে পড়ছি, ঈশ্বর নাকি এক ও নিরাকার। ঠাকুর-দেবতারা সব মিথ্যে! এত বড় বড় মন্দির বানিয়ে কালী, দুর্গা, শিব, বিষ্ণুব পূজা করছি, তা সব মিথ্যের পূজা! – আজ্ঞে ব্ৰাহ্মরা সে রকমই বলে বটে! ওঁরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করেন না। -ব্ৰাক্ষরা বিশ্বাস করে না, তুমি বিশ্বাস করা? – আমি ব্ৰাহ্মসমাজে এখন আর যাই না। — তা জানতে চাইছি না। তুমি ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস কর কি না, সেটা জানতে চাইছি। তোমার বাড়িতে গৃহদেবতার পূজা হয়? তুমি মন্দিরে গিয়ে গড় করা? — মহারাজ, পারিবারিকভাবে আমরা বৈষ্ণব। সংস্কারবলে ঠাকুর-দেবতার মূর্তির সামনে বহুবার গড় করেছি তো বটেই। তবে, অপরাধ নেবেন না মহারাজ, আমার এখন মনে হয়, মূর্তিগুলি সব প্রতীক, কালী দূর্গ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এঁরা সব এক একটি শক্তির প্রতীক। — প্রতীক? এসব নাস্তিকের কথা। প্রতীক না ছাই! উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী জাগ্রত দেবী! কালীঘাটের মন্দিরে হাজার বচ্ছর ধরে মানুষে পূজো দিচ্ছে কি এমনি এমনি? আমি বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে মূর্তির চোখে জল দেখেছি। আমাদের দেবতাদের যারা মিথ্যে বলে, তারা কুলাঙ্গার। কলকাতার শহরে স্লেচ্ছদের রাজত্ব, এখানে যো-যা খুশি বলতে পারে। আমার ত্রিপুরায় এমন কথা কেউ উচ্চারণ করে না। তোমরা ইংরেজদের পা চাটবে, একদিন সবাই খ্রিস্টান হয়ে যাবে! একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারাজ। তাঁর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, মুখখানি রক্তিম। আবার শশিভূষণের দিকে তাকিয়ে তিনি ঈষৎ সংযত স্বরে বললেন, আচ্ছা শশী মাস্টার, আমাকে একটা জিনিস বুঝিয়ে দাও তো! আমাদের হিন্দুদের ঈশ্বর যে নিরাকার, এটা বেরুল কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে? আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা, চোদ্দপুরুষ শিব, বিষ্ণু, কালী ঠাকুরের পুজো
false
shomresh
নিজের কোয়াটার্সে ফিরে এল। শমিতের বোধহয় চা খাওয়া শেষ। কাপ নামিয়ে রেখে বলল, ভাবছিলাম অফিসে ঢুকে দেখা করে যাব কিনা। আমি এবার যাচ্ছি। শরীর কেমন লাগছে? আর যাই হোক রাস্তায় পড়ে যাব না। বেশ। যে অসুবিধেগুলো ঘটালাম তার জন্যে আবার ক্ষমা চাইছি। বারংবার শুনলে মনে হয় ব্যাপারটা বানান। ও। জিনিসপত্রগুলো তুলতে গেল শমিত। দাঁড়াও। তিরিকে বলছি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ওগুলো পৌঁছে দিতে। তিরিকে? সেকি। দীপাবলী জবাব দিল না। ভিতরের ঘরে ঢুকেই তিরিকে দেখতে পেয়ে বলল, দাদাবাবুর শরীর এখনও ঠিক হয়নি। তুই একটু সঙ্গে যা। তিরি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কি হল? শুনতে পাচ্ছিস? আমাকে দাদাবাবুর সঙ্গে যেতে বলো না। কেন? তিরি জবাব দিল না, তেমনি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই অবাধ্যতা সত্ত্বেও রাগ করতে পারল না দীপাবলী। অফিসে চলে এসে বংশীকে পাঠাল শমিতের সাহায্যের জন্য। এখনও রোদের দাঁত ধারালো হয়নি। জানলা খোলাই ছিল। নিজের চেয়ারে বসে সে দেখল শমিত বংশীর পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এটাই ওর শেষ যাওয়া। এই জীবনে আর দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। একটু আত্মসম্মানজ্ঞান থাকলে শমিত নিশ্চয়ই তাকে বিরক্ত করতে আসবে না। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল দীপাবলীর। সে হেসে ফেলল। ক্ষত সেরে যাওয়ার পর ব্যান্ডেজ তোলার সময়ও তো অস্বস্তি হয়। হয় না? গতরাত্রে খাওয়া হয়নি, সকালে শুধু চা বিস্কুট পেটে গেছে, নটা নাগাদ দীপাবলী ভেতরে চলে এল। খিদে পেয়েছে খুব। দুটো ঘরের কোনটাতেই নেই তিরি। ভেতরের বারান্দায় গিয়ে রান্নাঘর দেখল সে। ঘরের দরজা ভেজানো, কেউ নেই। উঠোন কুয়ো কোথাও মেয়েটা নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত। একমাত্র বিশেষ প্রয়োজন পড়লে ও একা হাটতলায় যায়। বাজারপত্তর বংশীকে বললে সে-ই করে এনে দেয়। বাইরের জগৎ সম্পর্কে যে মেয়ে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে সে তাকে না জানিয়ে কোথায় যাবে। এবার চোখে পড়ল খিড়কির দরজা ভেতর থেকে আটকানো নেই। অর্থাৎ তিরি ওই পথে বেরিয়েছে তাকে এড়িয়ে যেতে। এই সময় তার ভেতরে আসার কথা নয়, সেই সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়? হঠাৎ মনে হল ও শমিতের চলে যাওয়া দেখতে যায়নি তো। খেয়ালের ঘোরে শমিত ওকে বিয়ের প্রস্তাব করেছে এবং তাতে মেয়েটার সব ভাবনা গোলমলে হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু মেয়েটা শমিতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও পরে এই কারণে আফসোস করেছে তবু সেই মুহূর্তের প্রত্যাখ্যানে সতো ছিল। তাহলে এখন যাবে কেন? দীপাবলী খিড়কির দরজাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেল। ফিরে এলে ও যখন এই পথে ঢুকতে পারবে না তখন বাধ্য হবে সামনে আসতে। আর যাই। হোক এইভাবে সমস্ত বাড়ি খোলা রেখে যাওয়াটা যে অন্যায় হয়েছে তা ওকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। খিড়কির দরজায় হাত দিতেই সে একটু পুরুষকণ্ঠ শুনতে পেল, তাহলে তুই আমার সঙ্গে যাবি না? শেষবার বলছি। দীপাবলী অবাক। বাড়ির এই পেছনদিকটায় শুধু মাঠ, ভাঙা মাঠ। সচরাচর কেউ এদিকে পা দেয় না। এখানে কে কথা বলছে? সে দাঁড়াল চুপচাপ। এবার তিরির গলা পাওয়া গেল, আমি নেখালিতে ফিরে যাব না। কেন? সেখানে গেলেই আমাকে অৰ্জুনবাবুর কাছে যেতে হবে। বাজে কথা বলিস না। আমি যে ঠিক বলছি তা তুমি জানোনা। ওহ, ঠিক আছে, তুই তো সতী না। এই অফিসার যদি মেয়েছেলে না হতো তাহলে কি তোকে ছাড়ত? তাহলে আমি এখানে থাকতাম না। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। বুঝলাম তুই আমাকে আর মানিস না। আমি কি তাই বলেছি? আমার কোন কথাই শুনছিস না। বলছি তো, যদি অন্যকোথাও গিয়ে ঘর নাও আমি রাজী আছি। তুমি এসব কথা বলছ, তাও রাজী। আমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারব না। তাহলে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো না। ও বুঝেছি। মেমসাহেবের ওই ভাইটা তোক মতলব দিয়েছে। খবরদার। ওঁর সম্পর্কে কোন খারাপ কথা বলবে না। কেন রে? তোর গায়ে লাগল কেন? মানুষটা সত্যি ভাল। আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাই নাকি? করলি না কেন? এঁটো শরীর দিয়ে পুজো হয় না, তাই। ছেলেটা হেসে উঠল। দীপাবলী আর দাঁড়াল না। দ্রুত উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় চলে এল। একেবারে অফিসঘরে পৌঁছে সে নিঃশ্বাস ফেলল যেন। চলে আসার সময় খিড়কির দরজা বন্ধ করার কথা খেয়ালেই আসেনি। সে সতীশবাবুকে ডাকল। বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়াতেই বসতে বলল। সতীশবাবু বললেন, হয়ে এসেছে, আর মিনিট পনেরর মধ্যে টাইপে দেব। ঠিক আছে। আপনাকে অন্য প্রশ্ন করব। বলুন। আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন আপনি অনুরোধ করেছিলেন তিরিকে যেন বাড়ির কাজে রাখি। ওর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? আজ্ঞে, নেখালির মেয়ে কিন্তু অল্পবয়সে গ্রামছাড়া। ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ শিখে। বেশ ভব্য হয়েছিল। তারপর ওকে নিয়ে গ্রামে গোলমাল হয়। আর তখন আপনার জায়গায় যেসব অফিসার এসেছিলেন তাদের লোকের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তিরির মত কাজ জানা মেয়ের কাজ পেতে অসুবিধে হয়নি। মেয়েটির চরিত্র কেমন? সেটা আপনি বলতে পারবেন মেমসাহেব। অনেকদিন তো দেখলেন। মেয়েরাই। মেয়েদের চরিত্ৰ ভাল বোঝেন? সতীশবাবু মাথা নামালেন। আমার আগের অফিসারদের সঙ্গে সম্পর্ক–। দেখুন মেমসাহেব, অভিবাবকহীন নারীর যদি ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষা না থাকলে তাহলে তারা তো অসহায় হয়ে পড়েই। কেন, ও কি কিছু করেছে? তেমন কিছু নয়। কিন্তু নেখালির কেউ ওর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আসে। ও বুঝেছি। আপনি জানেন? সবাই জানে না। আমি জানি। আমি মিঠাইকে এর আগে নিষেধ করেছিলাম। মিঠাই?
false
shirshendu
কী বললাম? ভাবলাম, কতদিন আটকাবে! না ছেড়ে উপায় আছে! একদিন এরোপ্লেন ছাড়াই তো ফুরু করে উড়ে যাবে। কত দূরে যাবে তার ঠিকানাই নেই। নয়নতারা আজ একটু হাসল। বলল, অত সোজা নয়। বেকেনবাবু সেদিন কী বলল জানো? বলেছে, আমি সধবা মরব। বিষ্ণুপদও হাসল, সধবা মরে যে কী সুখ কে জানে! তবে বলি কি মমরি নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ও কেউ দুদিন এগিয়ে আনতে পারবে না, পেছিয়েও দিতে পারবে না। দিনটা ঠিক করাই আছে। তবে আমাদের জানা নেই, এই যা। অদৃষ্ট মানে যা দৃষ্ট নয়, গোচর নয়। তা সে-ই ভাল। জানা থাকলে কি ভাল লাগত। নয়নতারা আর একটু তামাকপাতা মুখে পুরে বলল, হ্যাঁ গো, তোমাকে যে কৃষ্ণ কত জিনিস এনে দিয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করো না কেন? খেউড়ি হওয়ার কি সব এনে দিল না। ওঃ, সে আর এক কাও। কৌটোর মধ্যে সাবানের ফেনা পোরা আছে। ওপরে একটা জায়গায় চাপ দিলেই ভস ডস করে এত বেরিয়ে আসে। কৃষ্ণ শিখিয়ে পড়িয়েও দিয়ে গিয়েছিল সব। হল কি জানো, টিপতেই সে এমন ফেনা বেরুলো যে গালের ওপর গন্ধমাদন দাঁড়িয়ে গেল। এই এত ফেনা। তারমধ্যে নিজের গালখানাই খুঁজে পাই না। তারপর থেকে আর ব্যবহার করি না। চাকা সাবানই ভাল। নয়নতারা হেসে ফেলল। বলল, হাসাতেও পারো বাপু। আর ওই সুন্দর গন্ধওলা জিনিসটা। ওটা কামানোর পর লাগায়। আফটার শেভ লোশন। কেটেকুটে গেলে ওটা লাগালে আর বিষিয়ে যায় না। তা লাগাও না কেন? গন্ধ মেখে হবেটা কি? ফিটকিরিতেই কাজ হয়ে যায়। আছে জিনিসটা থাক। বড় হিসেব করো তুমি। এনে দিয়েছে, ব্যবহার করলেই তো হয়। বিষ্ণুপদ নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, আর তোমাকে যে ফোল্ডিং ছাতা, ব্যাগ, শাড়ি এনে দিয়েছে তা ব্যবহার করা কি? রেখে দিয়েছি। পটলের বউ এসে ব্যবহার করবে। আমারটাও পটলকেই দিয়ে যাবো। ম্যাপটা খুলে বিষ্ণুপদ দেখছি, বলল, তোমার একদম মনোেযোগ নেই। আমস্টারডামটা কোথায় এবার দেখাও তত। ভুলে গেছ? নয়নতারা আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল, এইখানে তো! ওঃ, পেরেছে তো, দশে দশ। নয়নতারা হাসল, আর আমার ওপর মাস্টারি ফলাতে হবে না। বিষ্ণুপদ একটু আনমনা হয়ে বলল, কৃষ্ণ এখন এইখানে। বুঝলে! হল্যান্ড। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, জল হেঁচে তবে মাটি বার করা হয়েছে। সেখানে চাষবাস হয়, বাড়ি ঘর করে লেকে থাকে, গাড়ি চলে। বাঁধ ভেঙে গেলে দেশ ভেসে যাবে চোখের পলকে। কিন্তু ডাঙে না। শয়ে শয়ে বছর ধরে দিব্যি আছে। হা গো, এই যে সমুদ্রকে হটিয়ে দিচ্ছে, এতে মানুষের পাপ হয় না? এ যে খোদার ওপর খোদকারি। বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তা কেন? মানুষকে যে এত বুদ্ধি, এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে না। আমার মতো ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবে সবাই? সে দেশে মাটির অভাব। সেই অভাব পুষিয়ে না নিলে চলবে. কেন? মাটির জন্যই দেখ না, এত ঝগড়া-কাজিয়া, মারপিট, আইয়ে ভাইয়ে মুখদর্শন বন্ধ। নয়নতারা ফের সাদা পাতা ছিঁড়ছিল। বিষ্ণুপদ একটু লক্ষ করে বলল, ডোজটা যেন বেশ বেড়েছে মনে হয়? ময়নতারা লজ্জা পেয়ে বলল, এবারের পাতাটায় কটা যেন কম। তা নয়, তোমার নেশাও বাড়ছে। অত খেও না। অম্বল হবে। আর অম্বল! মনটাই ভাল নেই। বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাপ দেখতে লাগল। কৃষ্ণ এখন আমস্টারডামে। কবচখানা সঙ্গে নিয়ে গেছে কি? না নি, তাতে কিছু নয়। কৃষ্ণ তো তারই ছেলে। ছেলের মধ্যে বাপের অস্তিত্ব থাকেই। কৃষ্ণের মধ্যে বিষ্ণুপদও কি একটু নেই? আছে বোধহয়। কী ভাবছো? এই নানা কথা। উল্টো-পাল্টা। ঠিক থাকে না। ভূগোল বইটা একটু আমাকে পড়ে শুনিও তো। তুমি নিজেও তো পড়তে পারো। অক্ষর চিনবো কি? ভুলে-টুলে গেছি বোধ হয়। ভোলোনি। চেষ্টা করলেই পারবে। তুমিই শুনিও। বিষ্ণুপদ হল্যান্ডের বিবরণ একটু পড়ে শোনাল নয়নতারাকে! বলল, বুঝতে পারছে? তা পারছি। এসব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে না তোমার? করলেই বা লাভ কি? বিষ্ণুপদ হাসিমুখে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমারও ইচ্ছে হয়। আমি কি ভাবি জানো? কৃষ্ণর সঙ্গে সঙ্গে আমার সত্তাটাও ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা দেশ। তুমি বেশ ভাবতে পারো। আমি পারি না। ওই জন্যই তো কচ্ছপ হওয়া তোমার আর হল না। ওইটে যদি পারতে তবে অনেক অশান্তি থেকে বেঁচে যেতে। নয়নতারা স্বামীর দিকে চেয়ে বলে, ওইটেই তো তফাত। বিষ্ণুপদ হাসিমুখে উঠোনের দিকে চেয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, নতুন শুড় ওঠেনি? না বোধ হয়। উঠলে রেমো ঠিক আনত। কেন, পায়েস খেতে ইচ্ছে যায় নাকি? তা যায়। এখানকার বাজারে বোধ হয় ওঠেনি। বলবখন রেমোকে। বললেই এনে দেবে। বিষ্ণুপদ একটু চুপ থেকে বলল, থাক। বলো না। নিজে থেকে আনলে সেটাই ভাল হবে। ও মা! ছেলের কাছে সংকোচ কিসের? সে তো ভক্ত হনুমানের মতো তৈরীই আছে। তা জানি। তবু থাক। কেন গো? বিষ্ণুপদ সামান্য সংকোচের সঙ্গে বলল, নোদা জিনিসটা ভাল নয়। ভাবছি জিভকে একটু শাসনে রাখব। আমার বাপু ওটা সহ্য হবে না। তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে গেলে না খাইয়ে আমার শাস্তি নেই। আবার বেশী বেলে তো টিক টিক করো। তাও করি। আমি বলেই করি। তোমাকে নিয়ে আর কে ভাববে বলে তো, আমার মতো? তা বটে। আজই আনাবো। বিষ্ণুপদ তবু মাথা নাড়ে, থাকগে। নবুর বাড়িতে অনেক খেজুর গাছ। তারা রস জ্বাল দেয়। করেও ভাল। বললেই দিয়ে যাবে। এখন থাক।
false
humayun_ahmed
তা ছাড়া কী? বাদলের মন ঐ মেয়ের কাছে পড়ে আছে। বাদলের মন ঐ মেয়ের কাছে, কী বলছিস তুই যে-মেয়ে লাথি দিয়ে তাকে নর্দমায় ফেলে দিল, যে তাকে ন্যাংটো করে দিল এতমানুষের সামনে, তার কাছে- যা পাওয়া যায় না। তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। বাদল যদি কোনোদিন ঐ মেয়ের নাম মুখে আনে তাকে আমি জুতাপেটা করব। জুতিয়ে আমি তার রস নামিয়ে দেব। জুতাপেটা করেও লাভ হবে না। ফুপু। আমি বরং দেখি জোড়াতালি দিয়ে কিছু করা যায় কি না। বাদল আঁখির টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে–যোগাযোগ করে দেখি। বাদল তোকে ঐ মেয়ের টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে? হ্যাঁ। দুধকলা দিয়ে আমি তো দেখি কালসাপ পুষেছি। তা-ই তো মনে হচ্ছে। যে-মেয়ে তোমাদের সবাইকে ন্যাংটো করে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখছে তার জন্যে এত ব্যাকুলতা! তার টেলিফোন নাম্বার নিয়ে ছোটাছুটি। বড় ফুপুর রাগ চরমে উঠে গিয়েছিল। তিনি বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে রাগ সামলালেন। থমথমে গলায় বললেন, হিমু শোন। বাদল যদি এ মেয়ের কথা মুখে আনে তাকে আমরা ত্যাজ্যপুত্র করব। এই কথাটা তাকে তুই বলবি। এক্ষুনি বলছি। বাদল বাসায় নেই, কোথায় যেন গেছে। তুই বসে থাক, বাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাবি না। আচ্ছা যাব না। বাদল গেছে কোথায়? জানি না। আঁখিদের বাসায় চলে যায়নি তো? বড় ফুপু রক্তচক্ষু করে তাকাচ্ছেন। এইবার বোধহয় তার ব্লাডপ্রেসার সত্যি সত্যি চড়েছে। অকারণে মানুষের চোখ এমন লাল হয় না। ফুপু তুমি শুয়ে থাকো। তোমার মাথায় পানিটানি দেয়া হোক। আমি বাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাচ্ছি না। ফুপা কোথায়? আর কোথায়, ছাদে। আমি ছাদের দিকে রওনা হলাম। আজ বুধবার— ফুপার মদ্যপান-দিবস। তার ছাদে থাকারই কথা। ফুপু অয়েলক্লথে মাথা রেখে আবার শুয়েছেন। বিপুল উৎসাহে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। ফুপা ছাদেই আছেন। তাকে যেন আনন্দিত বলেই মনে হলো। জিনিস মনে হয় পেটে পড়েছে। এবং ভালো ডোজেই পড়েছে। তাঁর চোখেমুখে উদাস এবং শান্তি-শান্তি ভাব। কে, হিমু? জি। আছিস কেমন হিমু? জি ভালো। কেমন ভালো— বেশি, কম, না মিডিয়াম? মিডিয়াম। আমার মনটা খুবই খারাপ হিমু। কেন। বাদলের বিয়েতে তো তুই যাসনি। বিরাট অপমানের হাত থেকে বেঁচে গেছিস। তারা বিয়ে দেয়নি। মেয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলেছে। বলেন কী? বানোয়াট গল্প ফেঁদেছে। মেয়ে নাকি রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? যার বিয়ে সে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি যাবে। আজকালকার ছেলেমেয়ে, এদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। এটা তুই অবিশ্যি ঠিক বলেছিস। আমাদের সময় আর বর্তমান সময় এক না। সোসাইটি চেঞ্জ হচ্ছে। ঘরে-ঘরে এখন ভিসিআর, ডিশ অ্যান্টেনা। এইসব দেখেশুনে ইয়াং ছেলেমেয়েরা নানান ধরনের ড্রামা করা শিখে যাচ্ছে। বিয়ের দিন রাগ করে। বান্ধবীর বাড়ি চলে যাওয়া সেই ড্রামারই একটা অংশ। ভালো বলেছিস হিমু। .এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলেই রাগ করে বান্ধবীর বাড়িতে গেছে। ছেলের বিয়ে হয়নি বলে আপনারা লজ্জার মধ্যে পড়েছেন। ওদের লজ্জা তো আরও বেশি। মেয়ের বিয়ে হলো না। অবশ্যই, অবশ্যই। ভাগ্যিস মুসলমান পরিবারের মেয়ে! হিন্দু মেয়ে হলে তো দুপড়া হয়ে যেত! এই মেয়ের আর বিয়েই হতো না। হিমু, ছেলেরা হচ্ছে হাসের মতো, গায়ে পানি লাগে না। আর মেয়েরা হচ্ছে মুরগির মতো, একফোঁটা পানিও ওদের গায়ে লেপটে যায়। আঁখি মেয়েটার জন্যে খুবই মায়া হচ্ছে হিমু। মায়া হওয়াই স্বাভাবিক। ঐদিন অবিশ্যি খুবই রাগ করেছিলাম। ভেবেছিলাম মানহানির মামলা করব। আপনার মতো মানুষ মানহানির মামলা কীভাবে করে! আপনি তো গ্রামের মামলাবাজ মোড়ল না। আপনি হচ্ছেন হৃদয়বান একজন মানুষ। ভালো কথা বলেছিস হিমু। হৃদয়বান কথাটা খুব খাঁটি বলেছিস। গাড়ি করে যখন আমি শেরাটন হোটেলের কাছে ফুলওয়ালি মেয়েগুলি ফুল নিয়ে আসে ধমক দিতে পারি না। কিনে ফেলি। ফুল নিয়ে আমি করব কী বল। তোর ফুপুকে যদি দিই। সে রেগে যাবে, ভাববে। আমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছে। কাজেই নর্দমায় ফেলে দি। একবার তোর ফুপুকে ফুল দিয়েছিলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ঢং কর কেন? তা-ই নাকি? এইসব দুঃখের কথা বলে কী হবে! বাদ দে। জি আচ্ছা, বাদ দিচ্ছি। তোর দুই বন্ধু এখনও আসছে না কেন বল তো? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ওদের কি আসার কথা নাকি? আসার কথা তো বটেই। ওদের আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রতি বুধবারে আসতে বলেছি। ভেরি গুড কোম্পানি। ওরা যে আমাকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করে সেটা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। ফুপু বলছিলেন ওরা নাকি ন্যাংটা হয়ে ছাদে নাচানাচি করছিল। ফুপা গ্লাসে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, তোর ফুপু বিন্দুতে সিন্ধু দেখে–কাশির শব্দ শুনে ভাবে যক্ষ্মা। ঐ রাতে কিছুই হয়নি। বেচারাদের গরম লাগছিল–আমি বললাম, শার্ট খুলে ফ্যালো। গরমে কষ্ট করার মানে কী! ওরা শার্ট খুলেছে। আমিও খুলছি, ব্যস? ও আচ্ছা। হিমু, তোর বন্ধু দুজন দেরি করছে কেন? এইসব জিনিস একা একা খাওয়া যায় না। খেতে খেতে মন খুলে কথা না বললে ভালো লাগে না। দুধ একা খাওয়া যায়, কিন্তু ড্রিংকসে বন্ধুবান্ধব লাগে। আসতে যখন বলেছেন অবশ্যই আসবে। তুই বরং এক কাজ কর, ঘরের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থোক। ওরা হয়তো বাসার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। বাসা চিনতে পারছে না বলে ঢুকতে পারছে না। গেট দিয়ে সোজা ছাদে নিয়ে আসবি। তোর ফুপুর জানার দরকার নেই। দুটো নিতান্তই গোবেচারা ভদ্র ছেলে–অথচ তোর ফুপু
false
shunil_gongopaddhay
কাকাবাবু কয়েক মুহুর্ত ভুরু কুঁচকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সন্তু, ওই লোকটাকে ধরে দাড় করা তো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই। সন্তু আর জোজো দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটির দুপাশে। ক্রাচ বগলে নিয়ে ওদের কাছে এলেন কাকাবাবু। ধুতি পরা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? আপনি হঠাৎ আমাকে ভয় দেখালেন কেন? লোকটি বলল, ভয় দেখাইনি তো! আপনাকে শুধু একটু সাবধান করতে চাইলাম। আমি একজন সাধারণ মানুষ। কাকাবাবু বললেন, গায়ে পড়ে সাবধান করতেই বা গেলেন কেন? লোকটি বলল, বাঃ, মানুষ মানুষকে সাহায্য করে না? কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক, আমার কী বিপদ হতে পারে, তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন? লোকটি বলল, না, তা জানি না। তবে, আপনি তো বিখ্যাত লোক। আপনার যেমন অনেক ভক্ত আছে, তেমনই বেশ কিছু শত্রুও আছে। তাই আপনাকে এখানে দেখে মনে হল, যদি শত্রুরা আপনার আসবার কথা টের পায়… আমি চলি, আমাকে বাস ধরতে হবে। সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট ক্যামেরা বের করে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? লোকটি একটু দ্বিধা করে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাদের কাকাবাবুর সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলে দাও। ছবিটা আমি বাঁধিয়ে রাখব। ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে সন্তু বলল, কিন্তু ছবিটা আপনাকে দেব কী করে? লোকটি বলল, সে আমি ঠিক জোগাড় করে নেব। আশাকরি তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। ছবি তোলা হয়ে গেলে সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আর-একটা কথা বলে যাই। আপনি যে কাজের জন্য এখানে এসেছেন, তা সফল হবে না! কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, যে কাজের জন্য এসেছি মানে? আমি তো কোনও কাজে আসিনি। এমনিই বেড়াতে এসেছি। লোকটি এবারে শুধু হাসল। তারপর হাত জোড় করে বলল, আচ্ছা চলি, নমস্কার! সে গেটের দিকে চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য! একজন সাধুবাবা বলল, পাঁচদিন পর আবার দেখা হবে। এই লোকটিও বলল, আবার দেখা হবে! এখানে থাকব মোটে তিনদিন, তারপর চলে যাব সম্বলপুর। জোজো বলল, আমার মনে হয়, এই লোকটি জ্যোতিষী। সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি? জোজো বলল, উনি সব কথা বলছিলেন কাকাবাবুর কপালের দিকে তাকিয়ে। কোনও কোনও জ্যোতিষী মানুষের কপাল দেখেই তার মনের কথা বলে দিতে পারে। আমার বাবা একবার দিল্লি এয়ারপোর্টে বসে ছিলেন, একসময় দেখতে পেলেন সদলবলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। রাজীব গাঁধীর কপালের দিকে তাকিয়েই বাবা চমকে উঠলেন। অমনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, রাজীব, রাজীব, এক মিনিট দাড়াও। ওইভাবে অবশ্য ডাকা উচিত হয়নি। অত লোকজনের মধ্যে, প্রধানমন্ত্রী তো। রাজীব সেই ডাক শুনতে পেয়ে ফিরে তাকালেন, তারপর কাছে এসে বাবাকে প্রণাম করলেন পায়ে হাত দিয়ে। ছেলেবেলায় ওঁর মায়ের হাত ধরে তো অনেকবার এসেছেন আমাদের বাড়িতে। আমার মায়ের হাতের রান্না চিড়ের পোলাও খেয়ে বলেছেন, আর-একটু দিন! বাবা ওঁকে সেদিন জিজ্ঞেস করলেন— জোজোর গল্প শেষ হল না, পুলিশের পোশাক-পরা একজন লোক হাজির হলেন দৌড়োতে দৌড়োতে। তার সঙ্গে একজন সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা। তাদের মধ্যে একজন বললেন, মাপ করবেন স্যার, আমাদের পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেল। আসলে এই ট্রেনটা কোনওদিন ঠিক সময়ে আসে না। অন্তত দেড়-দুঘণ্টা লেট হয়, আজই এসে পড়েছে ঠিক সময়। আমাদের আবার দেরি হল, রাস্তায় হাতি এসে পড়ে অনেকটা সময় নষ্ট করে দিল। কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে। ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম বিনয়ভূষণ মহাপাত্র, আর এর নাম গুরুপদ রায়। কাকাবাবু বললেন, এই যে আমার ভাইপো সন্তু আর ওর বন্ধু জোজো। চলুন এবার যাওয়া যাক! বিনয়ভূষণ বললেন, আগে একটু চা-টা খেয়ে বিশ্রাম নেবেন, না এক্ষুনি রওনা হবেন? কাকাবাবু বললেন, ট্রেনে এসেছি, পরিশ্রম তো হয়নি কিছু। বিশ্রাম নেওয়ার দরকার নেই। খিচিং পোঁছোতে কতক্ষণ লাগবে? বিনয়ভূষণ বললেন, জিপ এনেছি। ঘণ্টাদুয়েকের রাস্তা, তবে আবার যদি হাতি এসে পড়ে, তা হলেই মুশকিল। সন্তু বলল, হাতি এসে পড়লে তো ভালই। বেশ হাতি দেখা যাবে! ছবি তুলতে পারব? বিনয়ভূষণ বললেন, হাতির পাল এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। খুব কাছে তো যাওয়া যাবে না। মেজাজ খারাপ থাকলে জিপগাড়ি উলটে দেয়। জোজো বলল, হাতি তো এমনিতে খুব শান্ত প্রাণী। তাদের মেজাজ খারাপ হয় কেন? কাকাবাবু বললেন, জঙ্গল থেকে হাতিরা যখন বেরিয়ে আসে, মাঝে মাঝে তারা খিদের চোটে কোনও ফসলের খেতে ঢুকে পড়ে। তাতে প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়। হাতিরা যত খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি। সেইজন্য ফসল যারা চাষ করে, সেই চাষিরা খেপে যায়। হাতি তাড়াবার জন্য তারা বড় বড় জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে মারে। সেই মশালের আগুনে আহত হলে হাতিরাও খেপে ওঠে। তখন সামনে যা পায়, তাই ধ্বংস করে। জোজো বলল, ইস, হাতিদের গায়ে মশাল ছুড়ে মারে? ভেরি ব্যাড। ওদের খিদে পেলে তো ওরা ফসল খাবেই! সন্তু বলল, বা রে, চাষিরা কি হাতিদের খাওয়াবার জন্য ফসল ফলায়? ওই ফসল বিক্রি করে তাদের সারা বছর চলে। ফসল নষ্ট হয়ে গেলে তারাই বা খাবে কী? জোজো বলল, একেই বলে হর্নস অফ আ ডায়লেমা। আচ্ছা কাকাবাবু, যদি আপনাকে বিচার করতে বলা হয়, হাতিরা যদি খিদের সময় ফসল খেয়ে ফেলে, তারা তো জানে না কার খেত কিংবা কারা চাষ করেছে, খিদে পেয়েছে তাই খেয়েছে। আর ওদিকে চাষিরা তাদের ফসল নষ্ট হচ্ছে দেখে রাগের চোটে জ্বলন্ত মশাল
false
shunil_gongopaddhay
মিথ্যে কথা বলেছিলাম। কাকাবাবু বললেন, মিথ্যে কথা বলেছিলে। খুব খারাপ! তুমি যে সন্তু আর জোজোকে বাঘের ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলে, ওরা কিন্তু তার কোনও শোধ নেয়নি। এখন যদি গান না গাও, তা হলে ওরা কিন্তু শোধ নিতে পারে। কমলিকা দু-এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর গেয়ে উঠল, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে… খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, অপদার্থ! ঘরে আর কেউ নেই, তবু তিনি যেন সামনে কাউকে বকছেন, এইভাবে ধমক দিয়ে আবার বললেন, যতসব অপদার্থের দল! ছি, ছি! সন্তু তিনতলার ঘর থেকে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, কাকাবাবুর গলা শুনে থমকে দাঁড়াল। কে এসেছে এখন? কাকাবাবু ঘুমের মধ্যে কথা বলেন সে জানে, কিন্তু এখন তো ঘুমের সময় নয়। সে উঁকি দিল দরজার কাছে এসে। তাকে দেখতে পেয়ে কাকাবাবু বললেন, দেখেছিস কী কাণ্ড? ওরা দুজনে পালিয়েছে। সন্তুর ভুরুদুটো একটু কুঁচকে গেল। ওরা মানে কারা? কাকাবাবু মেঝে থেকে খবরের কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, পড়ে দ্যাখ। প্রথম পাতাতেই বেরিয়েছে। খবরটা পড়েও সন্তুর বিস্ময় কমল না। হাসপাতাল থেকে দুই কয়েদি উধাও! গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দুজন কয়েদিকে জেলহাজত থেকে পাঠানো হয়েছিল একটা হাসপাতালে, একজন পুলিশ তাদের পাহারাতেও ছিল, কিন্তু সেই পুলিশটির চোখে ধুলো দিয়ে আসামি দুজন পালিয়ে গেছে। তাদের নামও অদ্ভুত, ভাংলু আর ছোটগিরি। এরকম তো মাঝে-মাঝেই হয়, কাকাবাবু হঠাৎ এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ওই দুজন কয়েদির নাম আগে শোনেনি সন্তু। কাকাবাবু ওদের ধরেননি। এরকম ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে মাথাও ঘামান না কাকাবাবু। সাধারণ চোর-ডাকাত ধরা তাঁর কাজ নয়। কাকাবাবু বেশ রেগে আছেন বোঝা যায়। রাগ হলে তিনি তাঁর থুতনিতে চিমটি কাটেন। আপন মনে আবার বললেন, পুলিশগুলো হয়েছে যত নিষ্কর্মার দল। মুখ তুলে সন্তুকে বললেন, দ্যাখ তো রফিকুলকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা! এখনও হয়তো বাড়ি থেকে বেরোয়নি! রফিকুল আলম সদ্য ডি আই জি হয়েছেন, বড় বড় অপরাধীদের তাড়া করে বেড়ান। কাকাবাবুর খুব ভক্ত। এ-বাড়িতে প্রায়ই আসেন। মানুষটিকে দেখতে যেমন ভাল, কথাবার্তাও তেমনই ঝকঝকে। এখন টেলিফোনে কাউকে পাওয়া খুব সহজ। এরকম বড়বড় অফিসারদের সবার কাছেই মোবাইল ফোন থাকে, বাড়িতে বা অফিসে বা চলন্ত গাড়িতেও কথা বলা যায়। রফিকুল আলমের মোবাইল ফোনের নম্বরে রিং হতেই সন্তু তাদের কর্ডলেস ফোনটা কাকাবাবুর হাতে দিল। সে ধরেই নিল, আলমদা খুব ধমক খাবেন। কাকাবাবু কিন্তু নরম আর বিনীত গলায় বললেন, আদাব, রফিকুল আলমসাহেব। আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করলাম। আপনার কি দু মিনিট কথা বলার সময় হবে? রফিকুল বেশ হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি কে কথা বলছেন? কাকাবাবু তো? কাকাবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। রফিকুল বললেন, নমস্কার সার। আপনি হঠাৎ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন? কাকাবাবু বললেন, আপনারা ব্যস্ত মানুষ, আমি একজন রিটায়ার্ড সাধারণ লোক। তবু দু মিনিট যদি কথা বলার সুযোগ দেন! রফিকুল বললেন, কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই কোনও কারণে আমার ওপর রেগে গেছেন! না, না, রাগের কী আছে। আমি আসছি আপনার কাছে। না, না, আসতে হবে না, আসতে হবে না। শুধু দুটো কথা জিজ্ঞেস করব। আমি বেশি দূরে নেই। পার্ক স্ট্রিটে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাব। বলছি তো আসতে হবে না। আমার কাছে এসে কেন সময় নষ্ট করবেন? আমি আপনার সময় নষ্ট করতে চাই। কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই রফিকুল ফোন বন্ধ করে দিলেন। সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই ভাংলু আর ছোটগিরি কে? কাকাবাবু আবার গলার আওয়াজ বদলে ফেলে রাগের সুরে বললেন, কে আবার! দুটো মানুষ! কিংবা অমানুষও বলা যেতে পারে। সন্তু বুঝে গেল, এখন আর বিশেষ কিছু জানা যাবে না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখন কফি খাবে? কাকাবাবু দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওই ছোকরা আসুক, মিনিট পনেরো পরে দুকাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলো! সন্তু নীচে নেমে গেল। ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মনটা কৌতূহলে ছটফট করছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে কাকাবাবু ইজিপ্টের একটা ম্যাপ নিয়ে খুব মেতে ছিলেন। সেখানে কোনও জায়গায় মাটির তলায় খুব প্রাচীনকালের একটা বিশাল কবরখানা সদ্য আবিষ্কার করা হয়েছে। এমন কয়েকটা মূর্তিও পাওয়া গেছে, যেরকম দেখা যায়নি আগে। ইজিপ্টের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কাকাবাবুকে, আর পাঁচদিন পর কাকাবাবুর কায়রো যাওয়ার কথা, সন্তুও সঙ্গে যাবে, সব ঠিকঠাক। এর মধ্যে হঠাৎ ভাংলু আর ছোটগিরি এরকম অদ্ভুত নামের দুজন কয়েদিকে নিয়ে কাকাবাবু হঠাৎ এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? ভাংলু আর ছোটগিরি! খবরের কাগজে দেখা যায়, চোর-ডাকাতদের নামই এইরকম হয়, ছেনো, ল্যাংড়া, ছগুলাল, খোঁচন…। ওরা কি ইচ্ছে করে নিজেদের এইসব খারাপ নাম দেয়? সন্তু বসবার ঘরে এসে দেখল, তার মায়ের সঙ্গে গল্প করছে দেবলীনা। সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কখন এলি? সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দেবলীনা বলল, এই, তুই মুখোনা ওরকম বেগুনভাজার মতন করে আছিস কেন রে? সন্তু বলল, তুই একদিন একটা বেগুনভাজাকে জিজ্ঞেস করিস, তোমার মুখটা চাঁদের মতন নয় কেন? মা হাসতে হাসতে বললেন, ও মা, সন্তু, তুই মেনে নিলি যে তোর মুখোনা বেগুনভাজার মতন? দেবলীনা বলল, আয়নার সামনে দাঁড়ালে ও নিজেই তো দেখতে পায়। মা বললেন, আমার ছেলের মুখোনা না হয় তোর মতন এত সুন্দর নয়, তা বলে তুই ওকে বেগুনভাজা বলে কষ্ট দিবি? দেবলীনা বলল, আমার বাবা শিখিয়েছেন, কানাকে কানা বলতে নেই, খোঁড়া
false
humayun_ahmed
উপরের চামড়া থাকবে টাইট, ভিতরে হাডিড গুড়া। এক্কেবারে ট্যালকম পাউডার। কংকন বলল, আপনি বোধহয় জানেন না। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে খাগড়াছড়িতে ট্রান্সফার করতে পারি। ট্রান্সফার কর। তারচেয়ে ভালো হয়। চাকরি খেয়ে ফেল। বান্দরের বাচ্চা খান্দর। তুই একটা খান্দর। খান্দর কী জানস? বান্দরের থাকে একটা লেজ আর খান্দরের থাকে দুইটা লেজ। তোর প্যান্টের ভিতর আছে দুইটা লেজ। পাছায় হাত দিয়ে দেখ। কংকন শান্ত গলায় বলল, আপনার টেলিফোনটা কি ব্যবহার করতে পারি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটা কল করব। কোনো সমস্যা নাই, কল কর। আইজি স্যারকে করা। প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে কর। যত ইচ্ছা টেলিফোন করতে থাক। টেলিফোন করার আগে মাথাটা একটু সামনে এগিয়ে আন। তোর কান মিলে দিব। কী বললেন? বললাম মাথাটা একটু সামনে আন, তোর কান মলে দিব। বান্দরের বাচ্চা খান্দর। ইউ আর এ ম্যাড পারসন। নাজমুল হুদ আনন্দিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বেল টিপে কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, এই খান্দরটাকে কানে ধরে হাজতে নিয়ে ঢুকাও। কংকন কল্পনাও করে নি। সত্যি সত্যি এই কাজ করা হবে। এক পয়সা দামের কনস্টেবল তাকে কানে ধরে হাজতে ঢোকাবে। হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই যে সে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তার গা বিমঝিম করছে। বারবার মনে হচ্ছে এইসব কিছুই ঘটে নাই। সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙলেই দেখবে সে সুমনার পাশে শুয়ে আছে। তার পায়ের উপর সুমনার গাবদা পা। ওসি সাহেব মিস রিনকির খবর আরেকবার পড়লেন। তার মেজাজ আরও খানিকটা খারাপ হলো। তিনি গাধা খান নাম কেটে লিখলেন খান্দর খান। এতে তার মন খানিকটা শান্ত হলো। খ এর অনুপ্রাসটা ভালো লাগছে। এইসময় থানায় ঢুকাল কেয়া-খেয়ার বাবা, আফতাব। সে ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার আমার মেয়ে দুটার সংবাদ নিতে এসেছি। ওদের নাম… ওসি সাহেব কথা শেষ করতে দিলেন না। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হাজতে ঢুকে যাও। দেরি করবা না। এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনক, এর মধ্যে হাজতে ঢুকবে। আফতাব বলল, আপনি কী বললেন বুঝলাম না। স্যার, কোথায় ঢুকে যাব? হাজতে ঢুকে যাবে। আর কোথায়? আফতাব ভীত গলায় বলল, আমার মেয়েরা কি আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? ওদের কথা বিশ্বাস করার কিছু নাই। ওসি সাহেব বিকট গলায় চিৎকার দিলেন, ঘাউ! আফতাব লাফ দিয়ে সরে গেল। বিকট ঘাউ সে আশা করে নি। ওসি সাহেব ছামাদের কাছে ঘাউ শুনেছিলেন। তার মস্তিষ্ক ঘাউ জমা করে রেখে দিয়েছিল, সময় বুঝে বের করেছে। আফতাব বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমি নিরাপরাধ। ঘাউ ঘাউ! এবারের ঘাউ প্ৰচণ্ড নিনাদে। সেকেন্ড অফিসার এবং দুজন কনস্টেবল ছুটে এল। আফতাব বলল, জোবেদা নিজে ফাঁসিতে ঝুলেছে। আমি নামাতে গেছি। মেয়েরা এটা বুঝে নাই। তারা ভেবেছে আমি ফাঁসিতে ঝুলায়েছি। কেয়া খেয়ার মা। সে ফাঁসিতে ঝুলল কেন? তার সমস্যা কী? জানি না স্যার কী সমস্যা। তোর কী সমস্যা? আফতাব চুপ করে আছে। তার কলিজা শুকিয়ে আসছে। তিন বছর আগের ঘটনা সবাই ভুলে বসে আছে। আজ হঠাৎ কী হয়ে গেল। ওসি সাহেব বললেন, পুলিশ ইনভেসটিগেশন হয় নাই? হয়েছিল। পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে আত্মহত্যা। পুলিশকে কত টাকা দিয়েছিলি? তিন লাখ চব্বিশ হাজার। ভিটামটি সব গেছে। ম্যাজিষ্ট্রেট খবর দিয়ে আনাচ্ছি। ম্যাজিস্ট্রিটের সামনে জবানবন্দি দিবি। যা ঘটেছে সব খুলে বলবি। স্যার, আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। বাচ্চাগুলিকে কে দেখবে? আমি দেখব। সেকেন্ড অফিসার, হ্যান্ডকাফ পরায়ে চেয়ারের সাথে একে আটকে দাও। ম্যাজিস্টেটকে খবর দাও। বদমাইশটা জবানবন্দি দিবে। দিবি না? জি স্যার দিব। যে ওসিকে ঘুস দিয়েছিলি তার নাম কী? স্যার উনার নাম গফুর। মুখে বসন্তের দাগ। কংকনকে হাজত থেকে বের করা হচ্ছে। সে বলল, খবর তাহলে হয়েছে। ওসি সাহেব নিশ্চয়ই পাতলা পায়খানা শুরু করেছেন। কাপড়াচোপড় নষ্ট করে ফেলার কথা। হা হা হা। সেকেন্ড অফিসার বললেন, হা হা বন্ধ। তোকে ডলা দিতে নিয়ে যাচ্ছি। ফিমেল হাজত খালি, ঐখানে তোকে ডলা দেওয়া হবে। ওসি সাহেবের হুকুম। কংকন হতভম্ব গলায় বলল, ওসি সাহেবের না হয় মাথা খারাপ। ভাই, আপনার কি মাথা খারাপ? আমি ছাত্রলীগের বিশিষ্ট কর্মী। বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক। সেকেন্ড অফিসার গলা নামিয়ে বললেন, আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করেছি। আপনাকে পাকিস্তানি ডলা আমি নিজে দিব। পনেরো মিনিট ডলার পর আপনি যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তাহলে ডলা বন্ধ হবে। তা না হলে ডলা চলতেই থাকবে। তুলতুলা শরীর বানায়েছেন, ডলা দিতেও আরাম হবে। কংকনের মুখে স্কচটেপ লাগানো হলো। কোনোরকম শব্দ করার তার উপায় রইল না। আফতাব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। সে স্ত্রী হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ওসি সাহেবের ঘাউ শব্দই তার জন্যে কাল হয়েছে। কংকানও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। তবে তার জন্যে পাকিস্তানি কৌশলের প্রয়োজন পড়েছে। কংকন বলেছে– আমি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। পুলিশ কী করে যেন টের পায়। দৌড়ে আমাকে ধরে ফেলে। আমার পকেটে যে পিস্তল পাওয়া গেছে এটা আমার। বুকপকেটের ক্ষুরটা এক নাপিতের দোকান থেকে সংগ্রহ করেছি। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যে পিস্তল, ক্ষুরু, চাপাতি, রাম দা, পুলিশের সংগ্রহে পুলিশের সংগ্রহে সবসময় থাকে। কংকনের সঙ্গে তার স্ত্রী সুমনার টেলিফোনের কথাবার্তা মূল কাহিনীর জন্যে জরুরি না। তারপরেও উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না। পুরো টেলিফোনের কথাবার্তা ওসি সাহেবের সামনে হয় এবং কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। বিচারপর্ব শুরু হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তা আলামত হিসাবে কোর্টে জমা দেওয়া হয়।
false
MZI
যায়— ছিঃ! সাহায্য চাইবে কেন? সাহায্য মানে তো ভিক্ষা, এই বাচ্চা মেয়ে ভিক্ষা করবে কেন? ভোটকা হান্নান একটু থতমত খেয়ে গেল। টাকা-পয়সা তার কাছে সব সময়ই অমূল্য জিনিস, সেটা চাঁদাবাজি করেই আসুক আর ভিক্ষে করেই আসুক, সেটাকে কেউ এভাবে ছিঃ বলে উড়িয়ে দিতে পারে, আগে বুঝতে পারেনি। সে আবার চেষ্টা করল। বলল, টেলিভিশনে দেখালে একটা পরিচিতি হবে– রাফি এবার একটু কঠিন মুখ করে বলল, দেখো হান্নান, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ জানি না। আমি এই ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে জুনিয়র টিচার, এক সপ্তাহও হয়নি জয়েন করেছি। এই মেয়েটিকে নিয়ে তুমি টিভিতে যাবে, না সিনেমাতে যাবে সেটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলার দরকার থাকার কথা নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে যে কারণে তুমি তাকে টিভিতে নিতে যাচ্ছাে, সেই কারণটা আমি বের করেছি। কাজেই আমার একটু দায়দায়িত্ব এসে পড়েছে। বুঝেছো? জি স্যার, কিন্তু– আমার কথা আগে শেষ করি। রাফি মুখ আরও কঠিন করে বলল, আমি এই মেয়ের গার্জিয়ান না, কিন্তু যে গার্জিয়ান তাকে বলল, যদি সে মেয়ের ভালো চায়, যেন কোনোভাবেই তাকে রেডিও-টেলিভিশনে না পাঠায়। কিন্তু স্যার, আমি অলরেডি চ্যানেলে, খবরের কাগজে যোগাযোগ করেছি, তারা রাজি হয়েছে। আবার যোগাযোগ করো। করে বলো সম্ভব নয়। ভোটকা হান্নান এবার তার নিজের মুখটা কঠিন করে বলল, না স্যার, আমি সেটা করব না। যেহেতু কথা দিয়েছি, কথা রাখতে হবে স্যার। ভেরি গুড। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? যদি জোর করে এই মেয়েকে তুলে নিতে চাও, সেটা তোমার ব্যাপার। বাচ্চা মেয়ে গার্ডিয়ানের অনুমতি ছাড়া তুলে নিয়ে স্ট্রেট শিশু অপহরণের মামলায় পড়ে যাবে। ভোটকা হান্নান তার কালো মাঢ়ি এবং দুই প্রস্থ হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সাহস কেউ করবে না! আপনি নতুন এসেছেন তাই জানেন না। এমনি এমনি আমার নাম ভোটকা হান্নান হয়নি। ঠিক আছে ভোটকা হান্নানতুমি যেটা করতে চাও করো। আমি আমাদের হেডকে জানাব। স্যার। যদি চান প্রক্টর, ভিসি, পুলিশকে জানাবেন। তুমি তোমারটা করবে, আমি আমারটা করব। ভোটকা হান্নানকে এবার একটু দুর্বল দেখাল, মাথা চুলকে বলল, আমি ভাবলাম গরিব ফ্যামিলি সাহায্য করি। আপনি দেখি উল্টা কথা বলছেন। এটা উল্টা কথা না, এটা সোজা কথা। ছোট বাচ্চাকে ছোট বাচ্চাদের মতো থাকতে দিতে হয়। টেলিভিশনে টানাটানি করতে হয় না। কিন্তু স্যার অলরেডি মোবাইল করে দিয়েছি। আবার মোবাইল করে দাও। যাও। ভোটকা হান্নানকে কেমন জানি মনমরা দেখাল। সে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বের হয়ে গেল। অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর বাকের ঈশিতাকে বলল, এই যে নাও, এই চিঠিগুলো তোমার জন্য। ঈশিতা বলল, থাক, আমি এমনিতেই বেশ আছি, তোমার চিঠি না হলেও চলবে! বাকের প্রত্যেক দিন চিঠিগুলো থেকে উদ্ভট চিঠিগুলো আলাদা করে ঈশিতাকে পড়তে দেয়। সারা দেশ থেকে বিচিত্র বিচিত্র চিঠি আসে, কারও জিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও গ্রামে মানুষখেকো বিচিত্র প্রাণী, কেউ কবর দেওয়ার পর জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে, কারও গ্রামে দুই মাথাওয়ালা বাছুর জন্ম দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকের বলল, পড়ে দেখো। আজকের চিঠিতে তুমি পাবে মাত্র দশ হাজার টাকার মনুষ্যরূপী কম্পিউটার। মনুষ্যরূপী কম্পিউটার? এবার ঈশিতা একটু কৌতূহল দেখাল, কোথায়, দেখি? বাকের একটা খাম ঈশিতার দিকে এগিয়ে দিল। ঈশিতা চিঠি খুলে পড়ে। হেলাল নামের একজন লিখেছে—তাকে মাত্র দশ হাজার টাকা দিলেই সে খবরের কাগজে মানুষ কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। এই মানুষ কম্পিউটারের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া আছে, সে বার বছরের বালিকা, চোখের পলকে যেকোনো সংখ্যার সঙ্গে অন্য যেকোনো সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে। চিঠির নিচে একটা মোবাইল ফোনের নম্বর দেওয়া আছে। বাকের জিজ্ঞেস করল, কী? মাত্র দশ হাজার টাকায় মানুষ কম্পিউটার কিনতে চাও? কোন অপারেটিং সিস্টেম দেবে বলেছে? ঈশিতা হাসল। বলল, না হার্ড ড্রাইভের সাইজ কিংবা অপারেটিং সিস্টেম কিছুই দেওয়া নেই। তার পরও হয়তো আমি ফোন করতাম, কিন্তু এই দশ লাইনের চিঠিতে প্রায় দুই ডজন বানান ভুল। যে চিড়িয়া দন্ত্যস দিয়ে মানুষ বানান করে তাকে সিরিয়াসলি নেওয়া ঠিক না। তারপরও ঈশিতা হেলাল নামের মানুষটির টেলিফোন নম্বরটা টুকে রাখল। কিছুদিন আগে এনডেভারের সঙ্গে তার সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে যে কয়েকটা বিষয় নিয়ে তার কৌতূহল হয়েছে, তার একটা হচ্ছে নিউরাল নেটওয়ার্ক। বিষয়টা নিয়ে সে কিছুই জানত না। গত কিছুদিন থেকে সে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছে। সে জার্নালিজমের ছাত্রী। বিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার—এসব খুঁটিনাটি বিষয় ভালো বোঝে না। কী পড়াশোনা করবে, বুঝতে পারছে না। তাই ইন্টারনেট থেকে কিছু জিনিসপত্র ডাউনলোড করে পড়ার চেষ্টা করছে। ইন্টারনেটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে ঠিক যে বিষয়টা জানতে চায় সেটা ছাড়া সেখানে অন্য সবকিছু আছে। যদি ঠিক সেই বিষয়টা পেয়েও যায়, তাহলে সেটা হয় এমন দুর্বোধ্যভাবে লেখা আছে, যা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছু বোেঝার উপায় নেই, কিংবা হাস্যকর ছেলেমানুষিভাবে লেখা যে সেটা পড়ে পুরো বিষয়টা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা হয়ে যায়। তার প্রয়োজন একজন মানুষের যে এটি সম্পর্কে জানে এবং যে তাকে একটু সময় দেবে। ঈশিতার বয়স বেশি না, সেজেগুজে থাকলে তাকে মনে হয় বেশ ভালোই দেখায়, যদিও সে কখনোই সেজেগুজে থাকে না। কাজেই যাদের একটু সময় দেওয়া দরকার, দেখা যায় তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে এবং সময়টা দিচ্ছে ভুল জায়গায়! ঈশিতা যদিও বলেছিল, দন্ত্যস দিয়ে মানুষ বানান করা হেলাল নামের
false
shunil_gongopaddhay
বুঝিয়ে বলছি। বসুন আগে। আমাদের সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে, পঙ্গু লঙ্ঘয়তে গিরিং। তার মানে হল, ভগবানের কৃপা হলে আমার মতন কানা-খোঁড়া-পঙ্গুরাও পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে। আপনি ভগবান মানেন? হ্যাঁ, অফ কোর্স ভগবান মানি। আমি একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান। আমি ভগবান বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি মানুষের অফুরন্ত মানসিক শক্তিকে। মনের জোর থাকলে মানুষ সব কিছু পারে। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আমি পা পিছলে পড়ে মরে যেতেও পারি, তা বলে সেই ভয়ে আমি কোনওদিন পাহাড়ে উঠতে চাইব না, তা তো হয় না! কত লোক তো শহরের রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েও মরে! তা তো বটেই।তা তো বটেই! আপনারা চা কিংবা কফি কী খাবেন বলুন। কিছু আনাব? অশোক দেশাই এবারে বললেন, মিঃ নিনজানে সন্ধের পর বিয়ার ছাড়া অন্য কিছু খান না। আমার কোনও রকম নেশা নেই। পানও খাই না। আমি মিঃ নিনজানের জন্য বিয়ার বলে দিচ্ছি। মিঃ নিনজানে হাত তুলে বললেন, আমি যথেষ্ট বিয়ার পান করে এসেছি। রাত্তিরে আর-একটা জায়গায় নেমন্তন্ন আছে, সেখানে গিয়ে অনেক খেতে হবে। এখন কিছু খেতে চাই না। এখন কাজের কথা হোক। কাকাবাবু বললেন, কাজের কথা কিছু আছে নাকি? আমি তো তা জানতুম না। আমার ধারণ আমরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি। অশোক দেশাই বললেন, না, মানে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম নিয়ে দু-চারটে কথা বলার ছিল. সন্তু ওঁদের কাছে না বসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না। সে এক দৃষ্টিতে মিঃ নিনজানেকে লক্ষ করছে। ওঁকে অনেকটা বক্সার মহম্মদ আলির মতন দেখতে। কিন্তু ওঁর গলার আওয়াজটা কেমন যেন চেনা-চেনা। দুপুরে যারা ভয় দেখিয়ে টেলিফোন করেছিল, তাদের মধ্যে প্রথম যে-লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলছিল, তার গলার আওয়াজটা ঠিক মিঃ নিনজানের মতন নয়? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? উনি কাকাবাবুকে ভয় দেখাতে যাবেন কেন? কুবাবু বললেন, আমি মিঃ নিনজানেকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে মিঃ নিনজানে বললেন, নিশ্চয়ই। আপনার বয়েস কত? হঠাৎ এই প্রশ্ন? মিঃ র্যাজা রায়চৌড্রি, আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করলেন কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না তো! এমনিই, কৌতূহল। আমি আফ্রিকানদের বয়েস বুঝতে পারি না। আপনার মুখের চামড়া একটু কুঁচকে গেছে, কিন্তু আপনার চুল কুচকুচে আমার বয়েস আটান্ন! তা হলে তো আপনি আমার চেয়েও বেশ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য আমার চেয়েও ভাল, আপনার মাথায় কত চুল.আমি আজ পর্যন্ত একজনও টাক-মাথা আফ্রিকান দেখিনি। মিঃ নিনজানে। এবারে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। এতক্ষণ বাদে তাঁকে বেশ সহজ মনে হল। তিনি পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলবে? কাকাবাবু দুদিকে মাথা নাড়লেন। মিঃ নিনজানে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তা হলে একটা মজার গল্প বলি শুনুন! আপনি ব্ৰাইট ক্রিম বলে চুলের একটা ক্রিম আছে, নাম শুনেছেন? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি, আমাদের দেশেও চলে। একসময় আফ্রিকার কয়েকটা দেশে সেই ব্ৰাইট ক্রিমের খুব বিক্রি বেড়ে গেল। দোকানদাররা সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখন যে বিলিতি কোম্পানি এই ক্রিম বানায়, তাদের টনক নড়ল। তারা বুঝতেই পারল না, হঠাৎ আফ্রিকায় তাদের চুলের ক্রিমের বিক্রি বাড়ল কেন? আফ্রিকানদের তো এত পয়সা নেই। হেড-অফিস থেকে দুতিন জন সাহেব এল খোঁজ-খবর নিতে। তারা কিছুই বুঝতে পারল না। প্রত্যেক দোকানদার বলছে, সাহেব, আরও বেশি করে ব্ৰাইট ক্রিম পাঠাও! খদের ফিরে যাচ্ছে, আমরা গালাগালি খাচ্ছি! তারপর আরও দুজন বড়সাহেব এল মার্কেট রিসার্চ করতে। তাদের জিনিস বিক্রি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কেন যে এত বেশি বিক্রি হচ্ছে, তা কিছুতেই ধরতে পারছে না। প্রত্যেক মাসে ডিমান্ড দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছো! তখন কোম্পানি ঠিক করল, আফ্রিকার এই কয়েকটা দেশে এই সুযোগে আরও ব্রাইট বিলক্রিম পাঠাবে, বিক্রি আরও বাড়বে! প্রত্যেক কাগজে বড়-বড় করে বিজ্ঞাপন দিল, ব্রাইট ক্রিম চুলের স্বাস্থের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। চুল ভাল রাখতে হলে প্ৰত্যেক দিন ব্রাইট ক্রিম ব্যবহার করুন! শুধু খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন নয়, গ্রামে-গ্রামেও এই বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টাঙানো হল। তার ফলে কী হল বলুন তো, এই বিজ্ঞাপন বেরোবার পর ব্ৰাইট ক্রিম বিক্রি একদম বন্ধ হয়ে গেল। আর কেউ ওটা কেনে না। গল্প শেষ করে মিঃ নিনজানে বিরাট জোরে চেঁচিয়ে হাসতে লাগলেন। কাকাবাবু বললেন, আমি কিন্তু গল্পটার মর্ম ঠিক বুঝতে পারলুম না? অশোক দেশাই বললেন, বাকিটা আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আসলে ব্যাপার কী জানেন, আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির লোক ওই ক্রিম কিনত টোস্টে মাখিয়ে খাবার জন্য। জিনিসটার স্বাদও ভাল, দামেও মাখনের চেয়ে শস্তা। যখন তারা জানল ওটা চুলের ক্রিম, তখনই তারা কেনা বন্ধ করে দিল। চুলের যত্ন করার জন্য পয়সা দিয়ে কোনও চুলের ক্রিম কেনার কথা সাধারণ লোক কল্পনাই করতে পারে না। কাকাবাবুও হেসে বললেন, ভাল গল্প। আশা করি এটা সত্যি। মিঃ নিনজানে বললেন, মোটেই সত্যি নয়। নিছকই গল্প। তবে, আপনি আমাদের চুলের কথা তুললেন তো…। জানেন, আমাদের এখানে অনেকে অশোক দেশাই বললেন, এবারে আমার কথা সেরে নিই। সাড়ে সাতটার সময় আমার আর-একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। মিঃ রায়চৌধুরী এখানে আপনার প্রোগ্রাম কী তা জানেন নিশ্চয়ই? কাকাবাবু বললেন, প্রোগ্রাম তো সে-রকম কিছু নেই। ভুলাভাই দেশাই আমাকে বলেছেন। এখানে দু-একদিন থাকার পর আমরা অন্য একটা জায়গায় চলে যাব। মাসাইমারা ফরেস্টে নাকি আপনারা একটা নতুন হোটেল খুলেছেন? সেখানে আমাদের থাকার কথা। অশোক দেশাই গলা
false
shorotchandra
উপযুক্ত সজ্জায় একেবারে সজ্জিত হইয়াই আসিয়াছিল। কহিল, ওঁদের ওখানে আজ একবার যাওয়া চাই-ই। এই সাজসজ্জা তাহার নিজের জন্য নয়, ইহা যে তথাকার আগন্তুক রাজ-অতিথিদের উপলক্ষ করিয়া, এ কথা সুরেশ বুঝিল, তথাপি এই মণিমুক্তাখচিত রত্নালঙ্কার-ভূষিতা সুন্দরী নারী ক্ষণকালের নিমিত্ত তাহাকে মুগ্ধ করিয়া ফেলিল। বিস্ময়কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, চাই-ই কেন? রাক্ষুসী জ্বর নিয়েই কলিকাতা থেকে ফিরেছে—খবর পেলুম, জ্যাঠামশাই নিজেও নাকি কাল থেকে জ্বরে পড়েছেন। আসা পর্যন্ত তুমি কি একদিনও তাঁদের বাড়ি যাওনি? না। তাঁরাও কেউ আসেন নি? অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। রামবাবু নিজেও আসেন নি? না। এ বাটীতে আসিয়া পর্যন্ত সুরেশ প্লেগ লইয়া আপনাকে এমনি ব্যাপৃত রাখিয়াছিল যে, গৃহস্থালী ও আত্মীয়তার এই-সকল ছোটখাটো ত্রুটি সে লক্ষ্য করে নাই। তাই কথা শুনিয়া যাথার্থই বিস্ময়ভরে কহিল, আশ্চর্য! আচ্ছা যাও। অচলা বলিল, আশ্চর্য তাঁদের তত নয়, যত আমাদের। একজনের জ্বর, একজন নিজেও অসুখে না পড়া পর্যন্ত আত্মীয়দের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন। উচিত ছিল আমাদেরই যাওয়া। আচ্ছা, যাও। একটু সকাল সকাল ফিরো। অচলা একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তুমিও সঙ্গে চল। আমাকে কেন? অচলা রাগ করিয়া কহিল, নিজের অসুখের কথা মনে করতে না পারো, অন্ততঃ ডাক্তার বলেও চল। আচ্ছা চল, বলিয়া সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কাপড় ছাড়িতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল। এক্কাওয়ালা বেচারা কোন কিছুই হুকুম না পাইয়া তখনও অপেক্ষা করিয়াছিল। নীচে নামিয়া তাহাকে দেখিয়াই অচলা খামকা রাগিয়া উঠিয়া বেহারাকে তাহার কৈফিয়ত চাহিল এবং ভাড়া দিয়া তৎক্ষণাৎ বিদায় দিতে আদেশ করিল। সে সুরেশের মুখের দিকে চাহিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কাল— অচলাই তাহার জবাব দিল, কহিল না। বাবুর যাওয়া হবে না, এক্কার দরকার নেই। গাড়িতে উঠিয়া সুরেশ সম্মুখের আসনে বসিতে যাইতেছিল, আজ অচলা সহসা তাহার জামার খুঁট ধরিয়া টানিয়া পাশে বসিতে ইঙ্গিত করিল। গাড়ি চলিতে লাগিল, কেহই কোন কথা কহিল না, পাশাপাশি বসিয়া দু’জনেই দুইদিকের খোলা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। বাগানের গেট পার হইয়া গাড়ি যখন রাস্তায় আসিয়া পড়িল, তখন সুরেশ আস্তে আস্তে ডাকিল, অচলা! কেন? আজকাল আমি কি ভাবি জানো? না। এতকাল যা ভেবে এসেছি ঠিক তার উলটো। তখন ভাবতুম, কি করে তোমাকে পাবো; এখন অহর্নিশি চিন্তা করি, কি উপায়ে তোমাকে মুক্তি দেব। তোমার ভার যেন আমি আর বইতে পারিনে। এই অচিন্ত্যপূর্ব একান্ত নিষ্ঠুর আঘাতের গুরুত্বে ক্ষণকালের জন্য অচলার সমস্ত দেহ-মন একেবারে অসাড় হইয়া গেল। ঠিক যে বিশ্বাস করিতে পারিল তাহাও নয়, তথাপি অভিভূতের ন্যায় বসিয়া থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, আমি জানতুম। কিন্তু এ ত— সুরেশ বলিল, হাঁ, আমারই ভুল। তোমরা যাকে বল পাপের ফল। কিন্তু তবুও কথাটা সত্য। মন ছাড়া যে দেহ, তার বোঝা এমন অসহ্য ভারী, এ স্বপ্নেও ভাবিনি। অচলা চোখ তুলিয়া কহিল, তুমি কি আমাকে ফেলে চলে যাবে? সুরেশ লেশমাত্র দ্বিধা না করিয়া জবাব দিল, বেশ ধর তাই। ওই নিঃসঙ্কোচ উত্তর শুনিয়া অচলা একেবারে নীরব হইয়া গেল! তাহার রুদ্ধ হৃদয় মথিত করিয়া কেবল এই কথাটাই চারিদিকে মাথা কুটিয়া ফিরিতে লাগিল, এ সেই সুরেশ! এ সেই সুরেশ! আজ ইহারই কাছে সে দুঃসহ বোঝা, আজ সেই-ই তাহাকে ফেলিয়া যাইতে চাহে! কথাটা মুখের উপর উচ্চারণ করিতেও আজ তাহার কোথাও বাধিল না। অথচ পরমাশ্চর্য এই যে, এই লোকটিই তাহার সীমাহীন দুঃখের মূল! কাল পর্যন্ত ইহার বাতাসে সমস্ত দেহ বিষে ভরিয়া গিয়াছে! মেঘাবৃত অপরাহ্ন-আকাশতলে নির্জন রাজপথ প্রতিধ্বনিত করিয়া গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটিয়াছে, তাহারই মধ্যে বসিয়া এই দুটি নরনারী একেবারে নির্বাক! সুরেশ কি ভাবিতেছিল সেই জানে, কিন্তু তাহার উচ্চারিত বাক্যের কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করিয়াও আজ নূতন ভয়ে অচলার সমস্ত মন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সুরেশ নাই—সে একা। এই একাকিত্ব যে কত বৃহৎ, কিরূপ আকুল, তাহা বিদ্যুদ্বেগে তাহার মনের মধ্যে খেলিয়া গেল। অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় যে তরণী বাহিয়া সে সংসারসমুদ্রে ভাসিয়াছে, সে যে অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যেই তিল তিল করিয়া ডুবিতেছে, ইহা তাহার চেয়ে বেশি কেহ জানে না, তথাপি সেই সুপরিচিত ভয়ঙ্কর আশ্রয় ছাড়িয়া আজ সে দিক্‌চিহ্নহীন সমুদ্রে ভাসিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়াই তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া গেল। আজ তাহার কেউ নাই; তাহাকে ভালবাসিতে, তাহাকে ঘৃণা করিতে, তাহাকে রক্ষা করিতে, তাহাকে হত্যা করিতে, কোথাও কেহ নাই; সংসারে সে একেবারেই সঙ্গ-বিহীন! এই কথা মনে করিয়া তাহার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল। সহসা তাহার অশক্ত অবশ ডান হাতখানি খপ করিয়া সুরেশের ক্রোড়ের উপর পড়িতেই সে চমকিয়া চাহিল। অচলা নিরুদ্বেগ-কণ্ঠ প্রাণপণে পরিষ্কার করিয়া কহিল, আর কি তুমি আমাকে ভালবাস না? সুরেশ হাতখানি তাহার সযত্নে নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করিয়া কহিল, এ প্রশ্নের জবাব তেমন নিঃসংশয়ে দিতে পারিনে অচলা, মনে হয় সে যাই হোক, এ কথা সত্য যে, এই ভূতের বোঝা বয়ে বেড়াবার আর আমার শক্তি নেই। অচলা আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া অত্যন্ত মৃদু করুণকণ্ঠে কহিল, তুমি আর কোথায়ও আমাকে নিয়ে চল— যেখানে কোন বাঙালী নেই? হাঁ। যেখানে লজ্জা আমাকে প্রতিনিয়তই বিঁধবে না— সেখানে কি আমাকে তুমি ভালবাসতে পারবে অচলা? এ কি সত্য? বলিতে বলিতেই আকস্মিক আবেগে সে তাহার মাথাটা বুকের উপর টানিয়া লইয়া ওষ্ঠাধর চুম্বন করিল। অপমানে আজও অচলার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল, ঠোঁট দুটি ঠিক তেমনি বিছার কামড়ের মত জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু তবুও সে ঘাড় নাড়িয়া চুপি চুপি বলিল, হাঁ। এক সময় তোমাকে আমি ভালবাসতুম। না না—ছি—কেউ দেখতে
false
shottojit_roy
হলে তুমি রসুন খাও কি না। আর তোমার চুলের রং কালো ছিল কি না, এ সব জিজ্ঞেস করার কোনও দরকার হত না। এখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে দিনক্ষণ, লগ্ন, গবেষণাগারের ভৌগোলিক অবস্থান, পরীক্ষকের মনমেজাজ-স্বাস্থ্য-চেহারা সব কিছুরই সমন্বয় ঘটছে। এ জিনিস ফেলনা নয়; একে ঠাট্টা কোরো না। আর সাতশো বছরের পুরনো বাড়ি থাকবে না। কেন? ইউরোপে মধ্যযুগের কেল্লা দেখনি? তারা তো এখনও দিব্যি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সাভেদ্রা ছিল ধনী বংশের ছেলে। তার বাড়ির যা বর্ণনা পাচ্ছি, তাতে সেটাকে একটা ছোটখাটো কেল্লা বলেই মনে হয়। হলই না হয় একটু জীৰ্ণ অবস্থা; তার মধ্যে একটা ঘর কি পাওয়া যাবে না, যেটাকে আমরা ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি? অবিশ্যি সে বাড়িতে যদি এখনও লোক থেকে থাকে, তা হলে তাদের সঙ্গে হয়তো একটা বোঝাপড়া করতে হতে পারে। কিন্তু পয়সা দিলে কাজ হবে না। এটা আমি বিশ্বাস করি না। অ্যালকেমি তো–? এই সাতসকলে কী নিয়ে এত বাচসা হচ্ছে তোমাদের মধ্যে? সন্ডার্সকে ঘরে ঢুকতে আমরা কেউই দেখিনি। ক্রোল সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। সে সন্ডার্সকে পুরো ব্যাপারটা বলল। সব শেষে বলল, একটা কাল্পনিক জানোয়ারের সন্ধানে আমরা তিব্বত যেতে পারি, আর যেখানে সোনা তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে মাত্র দুই ঘণ্টার প্লেন জানি করে ঘরের কোনায় স্পেনে যেতে এত আপত্তি? সন্ডার্স দেখলাম তর্কের মধ্যে গেল না। কারণ বোধ হয় এই যে, ক্রোলের হাবভাবে একটা সাংঘাতিক গোঁ। আর একটা চরম উত্তেজনার ভাব ফুটে বেরোচ্ছিল। সন্ডার্স বলল, স্পেনে যেতে আমার আপত্তি নেই, হয়তো শঙ্কুরও নেই, কিন্তু তোমার এই গবেষণায় এক শঙ্কু ছাড়া আর কী কী উপাদান লাগবে সেটা জানতে পারি কি? উপাদানের চেয়েও যেটা বেশি জরুরি, বলল ক্রোল, সেটা হল সময়টা। সাভেদ্রা মিডসামারের সাত দিন আগে বা পরে যে কোনওদিন ঠিক দুপুর বারোটার সময় কাজ আরম্ভ করতে বলেছে—কারণ সারা বছরের মধ্যে ওই কাঁটা দিন সূর্যের তেজ থাকে সবচেয়ে বেশি। মালমশলা অত্যন্ত সহজলভ্য। পারা আর সিসার কথা তো সব দেশের অ্যালকেমিতেই পাওয়া যায়; এখানে সে দুটো আছে। এ ছাড়া লাগবে জল, গন্ধক, নুন, কিছু বিশেষ গাছের ডাল, পাতা ও শিকড়। যন্ত্রপাতির মধ্যে মাটি আর কাচের জিনিস ছাড়া আর কিছু চলবে না—এটাও অন্য অ্যালকেমির বইয়েতেও লেখে—আর এ ছাড়া চাই একটা হাপর, চুল্লি, মেঝেতে একটা চৌবাচ্চা– কেন, চৌবাচ্চা কেন? প্রশ্ন করল সন্ডার্স। বৃষ্টির জল ধরে জমিয়ে রাখতে হবে তাতে। এটা অন্য কোনও অ্যালকেমির বইয়েতে পাইনি। পরশপাথরের কথা বলেছে কি? আমি প্রশ্ন করলাম। পরশপাথরের সংস্কার সব দেশেই আছে। আমি যে সব অ্যালকেমির বিবরণ পড়েছি, তাতে পরশপাথর তৈরিই হল গবেষণার প্রথম কাজ। তারপর সেই পাথর ছুইয়ে অন্য ধাতুকে সোনায় পরিণত করা হয়। ক্রোল বলল, না। সাভেদ্রা পরশপাথরের কোনও উল্লেখ করেনি।. উপাদানগুলো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে একটা চিটচিটে পদার্থে পরিণত হবে। সেটাকে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশিয়ে পিউরিফাই করার একটা পর্ব আছে। তার ফলে যে তরল পদার্থের সৃষ্টি হয়, সেটাই ক্যাটালিস্টের কাজ করে। অর্থাৎ এই তরল পদার্থের সংস্পর্শে এসেই সাধারণ ধাতু সোনা হয়ে যায়। সাভেদ্রার ক্ষেত্রে পরীক্ষা সফল হয়েছিল কি? সন্ডার্স একটু বাঁকাভাবে প্রশ্নটা করল। ক্রোল একটুক্ষণ চুপ থেকে পাইপে তামাক ভরে বলল, পাণ্ডুলিপিটা আসলে একটা ডায়রি। অন্যের উপকারের জন্য টেক্সটু বই হিসেবে লেখা নয় এটা। পরীক্ষা যত সফলতার দিকে গেছে, সাভেদ্রার ভাষা ততই কাব্যময় হয়ে উঠেছে। আজ অমুক সময় আমি সোনা তৈরি করলাম—এ ধরনের কথা কোথাও লেখা নেই ঠিকই, কিন্তু সাভেদ্রা শেষের দিকে বলেছে–ক্রোল পিয়ানোর ওপরে রাখা পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে তার শেষ পাতাটা খুলে পড়ল-আজি নিজেকে শুধু বিজ্ঞানী বা জাদুকর বলে মনে হচ্ছে না; আজ মনে হচ্ছে। আমি শিল্পীর সেরা শিল্পী—যার মধ্যে এক ঐশ্বরিক প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে, যার হাতের মুঠোয় এসে গেছে সৃষ্ট বস্তুকে অবিনশ্বর রূপ দেবার অমোঘ ক্ষমতা.। এ থেকে কী বুঝতে চাও তোমরাই বুঝে নাও। আমি আর সন্ডার্স পরস্পরের দিকে চাইলাম। কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ; বুঝতে পারছি আমার মতো সন্ডার্সের মনেও হয়তো ক্রোলের উৎসাহের কিছুটা ছোঁয়াচ লেগেছে। সন্ডার্স যেন উৎসাহটাকে জোর করে চাপা দিয়ে পরের প্রশ্নটি করল। অনুষ্ঠান বা মন্ত্রতন্ত্রের প্রয়োজন হয় না এতে? ক্রোল পাইপে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, প্রেতাত্মা নামানোর ব্যাপার একটা আছে-যে দিন কাজ শুরু করা হবে, তার আগের দিন রাত্রে। কার প্ৰেতাত্মা? জগদ্বিখ্যাত আরবদেশীয় অ্যালকেমিস্ট জবীর ইবন হায়ানের। দশম শতাব্দীর এই মহান ব্যক্তিটির নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। আর কিছুই না—তাঁর কাছ থেকে আশীবাদ চেয়ে নেওয়া আর কী। তবে সে কাজটা আমি থাকতে কোনও অসুবিধা হবে না। ক্রোল মিউনিকে একটা প্ল্যানচেট সমিতির সভাপতি, সেটা আমি জানতাম। আর দরকার লাগবে ওকে। কথাটা বলল ক্রোল—আর তার দৃষ্টি ঘরের দরজার চৌকাঠের দিকে। চেয়ে দেখি, সেখানে সন্ডার্সের পারস্য দেশীয় মাজার মুস্তাফা দণ্ডায়মান। ওকে মানে? চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল। সন্ডার্স। সন্ডার্স বেড়াল-পাগল-কতকটা আমারই মতো। তিন বছর আগে আমার গিরিডির বাড়িতে এসে সে আমার বেড়াল নিউটনের গলায় একটা লাল সিন্ধের রিবন বেঁধে দিয়ে গিয়েছিল। ক্রোল বলল, বেড়াল সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছে সাভেদ্রা। গবেষণাগারে বেড়ালের উপস্থিতি অব্যর্থভাবে কাজে সাহায্য করে। তার অভাবে প্যাঁচা। কিন্তু আমার মনে হয়, বেড়াল যখন হাতের কাছে রয়েছেই, তখন প্যাঁচার চেয়ে… সন্ডার্স বা আমি কেউই সরাসরি ক্রোলকে স্পেন যাওয়া নিয়ে কথা দিলাম না—যদিও ক্রোল বার বার বলে
false
humayun_ahmed
সাদাও না। মাঝে মধ্যে লাল-সবুজের খেলা আছে। তুই তো পশ্চিমা মেয়ে না। তুই বাঙালি মেয়ে। বিয়ের দিন তুই পরবি টকটকে লাল রঙের শাড়ি। তুমি পাগল হয়েছ? লাল শাড়ি পরে আমি কাজির অফিসে যাব না-কি? এক কাজ কর, শাড়ির উপর বোরকা পরে ফেল। তাহলে কেউ বুঝবে। এই বুদ্ধি খারাপ না। ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ। কাল্পনিক কথােপকথন আর ভাল লাগছে না। এখন সত্যি সত্যি কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। রুনির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। সে মনে হয় রাতে ঘুমায় না। মীরু যত রাতেই টেলিফোন করুক দুটা রিং বাজার আগেই রুনি টেলিফোন ধরে সহজ গলায় বলবে–হ্যালো। টেলিফোনটা থাকে বড় খালার ড্রয়িং রুমে। দুটা রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন ধরতে হলে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে হয়। মীরার ধারণা তার বড় বোন রাত এগারোটার পর ড্রয়িং রুমেই চুপচাপ বসে থাকে। যার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার টেলিফোন কলের জন্যে অপেক্ষা। সেই কল আর আসে না। মীরা টেলিফোন করল। একবার রিং হবার পরই রুনি মিষ্টি গলায় বলল, হ্যালো। আমি মীরা। আপা তুমি জেগে আছ? হুঁ। ঐ লোকের কি টেলিফোন করার কথা? কারোরই টেলিফোন করার কথা না। ঘুম আসছে না বলে জেগে আছি। তুই জেগে আছিস কেন? আমি কেন জেগে আছি তা তোমাকে বলতে পারি কিন্তু তুমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা চারদিকে রাষ্ট্র করে দেবে, আমার হবে অসুবিধা। মীরা বাসার খবর কি? বাসার খবর ভাল। বাবা আমাকে ত্যাজ্য কন্যা করেছেন এটা কি সত্যি? হুঁ, সত্যি। তার মানে আমি বাবার বিষয়-সম্পত্তি কিছুই পাব না? না। তুই এত সহজভাবে না বলতে পারলি? তোর একটুও খারাপ লাগল।? খুট করে শব্দ হল। মীরুর বাবা দরজা খুলেছেন। মীরু চট করে টেলিফোন রেখে দিল। বাবা যদি দেখেন সে টেলিফোনে কথা বলছে তাহলে গজব হয়ে যাবে। মীরু তাকাল ঘড়ির দিকে। চারটা একুশ বাজে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আফজল। সাহেব বাথরুমে যাবেন। অজু করবেন। ফজরের নামাজ শেষ করে সূরা। আর রাহমান পড়বেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘুমুতে যাবার। আগে এক কাপ আদা চা খাবেন। একটা টোস্ট বিসকিট খাবেন। এই চা তাকে বানিয়ে দেবেন মীরুর মা জাহেদা বানু। আজ আফজল সাহেবের চা হবে না। কারণ জাহেদা বানু বাসায় নেই। তিনি ফুলবাড়িয়াতে গিয়েছেন। তাঁর এক চাচাতো বোনের বিয়ে। বিয়ে সেরে ফিরতে ফিরতে আরো দুই-এক দিন লাগবে। মীরু ঠিক করল সে যখন জেগেই আছে তখন আর বাবার রুটিনের ব্যতিক্রম করাবে না। এক কাপ চা নিজেই বানিয়ে দেবে। বাবা নিশ্চয়ই অবাক হবেন। খানিকটা খুশিও হয়তো হবেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করবেন না। এমন একটা ভাব ধরবেন যেন এরকমই হবার কথা। মেয়ে তাকে চা বানিয়ে দিচ্ছে এতে খুশি হবার কিছু নেই। এটা মেয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ছে। তিনি একবার জিজ্ঞেসও করবেন না এত ভোরে তার মেয়ে জেগে আছে কেন? তার কি কোনো সমস্যা? মীরু চায়ের পানি গরম করেছে। একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা চা-টা কখন খান, সূরা আর রাহমান পাঠ করার আগে না পড়ে? রান্না ঘরে শব্দ করে কে? বাবার গলা। গলাটা যেন কেমন অন্যরকম। অসুস্থ মানুষের চিকন গলা। দীর্ঘ বাক্য শেষ করার মতো দমও যেন নেই। মীরু বলল, বাবা আমি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি? আজফল সাহেব হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মা। একটু এদিকে আয়। মীরু বাবার শোবার ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল। বাবা জায়নামাজে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কি যেন বের হচ্ছে। ডান হাত একটু পরে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মীরু হতভম্ব হয়ে। বলল, কী হয়েছে বাবা? আফজল সাহেব থেমে থেমে বললেন, মারা যাচ্ছিগো মা। মারা যাচ্ছি। বুকে ব্যথা। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। গোঙাতে লাগলেন। মীরু এখন কী করবে? জিতু মিয়া ছাড়া বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। তারা দলবেঁধে আজমির শরিফ গিয়েছেন। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নেকে রেখে গেছেন বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে। সেই ভাগ্নে আধপাগল। সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসে। মীরু দৌড়ে টেলিফোন রিসিভার কানে নিল। ডায়াল টোন নেই। একটু আগেই সে কথা বলেছে আর এখন ডায়াল টোন নেই— এর মানে কি? মীরু টেলিফোন রেখে বাবার কাছে গেল। আফজাল সাহেব বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মীরু বলল, বাবা খুব খারাপ লাগছে? তিনি জবাব দিলেন না। মীরু বাবাকে ফেলে রেখে আবার টেলিফোনের কাছে গেল। এমন তো হতে পারে হঠাৎ টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। যে টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ নষ্ট হয় সেই টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ কি ঠিকও হতে পারে না? মীরু ছুটে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার কানে দিল। পোঁ পোঁ শব্দ হবার বদলে কেমন যেন ঝড়-তুফানের শব্দ হচ্ছে। শোঁ শো আওয়াজ। বৃষ্টির শব্দ। মীরু অনেকক্ষণ বুঝতেই পারল না যে বৃষ্টি-বাদলার শব্দ টেলিফোন রিসিভার থেকে আসছে না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সেই শব্দ। শ্রাবণ মাস বৃষ্টি-বাদলারই সময়। বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল, বৃষ্টি দেখেছেন? কেমন ঝুম ঝুমান্তি নেমেছে। শ্রাবণ মাসে টিপটিপ বৃষ্টি হয়। ঝুম বৃষ্টি হয় না। আবহাওয়া আসলেই বদলে যাচ্ছে। ওজোন স্কেয়ার ফুটো হয়ে গেছে। বারসাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফুটো হওয়া ওজোন
false
shomresh
পায়ের ওপর উপুড় হয়ে রইল আর আমি তাকে দেখব না? পালদেমকে জিজ্ঞাসা কর, ও তোকে চিনিয়ে দেবে। সুদীপ, তুই কি চাস? কি চাস মানে? তুই এখানে প্যারাডাইসের বিকল্প জীবন খুঁজছিস? সুদীপ কোন উত্তর দিল না। সে উঠে নিচে নেমে এল! মাথার ভেতরটা এখনও দপদপ করছে। আর এক কাপ চা পেলে হত। কিন্তু নিজে বানিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না! সে কোমরে হাত রেখে জন্তুগুলোকে দেখল। মালিকানা বদল হয়েছে কিন্তু ওদের কোন ভ্রক্ষেপ নেই। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক আমরা আমাদের মত আছি এমন ভাব। গতকালই খুঁটি পুঁতে কিছুটা জায়গা ঘিরে ওদের আটকে রেখেছে আনন্দ। মাথার উপরে খুবই পলকা ছাউনি। মুরগিগুলোর জন্যে একটু আলাদা ব্যবস্থা। সারারাত এই ঠাণ্ডায় কাটিয়েও ওরা মরে যায়নি। আজ একটাকে কাটলে কিরকম হয়? এই সময় বুক চিতিয়ে বসা একটা মুরগি কোঁক কোঁক করে ডেকে উঠতেই বাচ্চা মেয়েটা চঞ্চল হল। তারপর চটপট ঘেরার মধ্যে ঢুকে যেতেই মুরগিটা অত্যন্ত আপত্তি জানিয়ে সরে দাঁড়াল। খপ করে মাটি থেকে একটা ডিম তুলে ছুটে ফিরে এল মেয়েটা। এনে হাত খুলে জয়িতাকে দেখাল। জয়িতা হাতে তুলে ডিমটাকে দেখল। সুদীপ এই প্রথম চোখের সামনে মুরগির ডিমপাড়া দেখল। সে খুব সিরিয়াস গলায় বলল, ডিমটা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বল। তাহলে আমরা আর একটা মুরগি পাব। কথাটা শুনে জয়িতা বাচ্চাটার কাঁধে হাত বুলিয়ে ডিমটা ফিরিয়ে দিয়ে ইশারায় জানাল সে ওটা নিয়ে যেতে পারে। সুদীপ হাঁটছিল। ওই মুহূর্তেই সে জয়িতার সামনে থেকে সরে এসেছে। এখন যা বলবে জয়িতা ঠিক তার উলটোটা করবে। একা একা হাঁটতে তার নোক চেপে যাচ্ছিল। সে কোন অন্যায় করেনি। খামোখা এরা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ ঢালু পথ বেয়ে সেই ঝরনার কাছে পৌঁছে গেল। একটা পাথবের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাতে তার আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। সে এই ঝরনা দেখেছিল। মেয়েটা তাহলে এখানেই কোথাও লুকিয়েছিল। সে ভাল করে তাকাল। একটা মেয়ে কেন খামোখা এখানে লুকিয়ে থাকতে যাবে? হয়তো কোন কাজে সে এখানে এসেছিল। আজও যদি কোন কাজ, সেই কাজটাই পড়ে যায়। কোন ভিত্তি নেই কিন্তু সুদীপের মনে হল অপেক্ষা করলে মেয়েটার দেখা পাওয়া যাবে। সে পাথরটার আড়ালে চুপচাপ বসে পড়ল। ঠিক পায়ের সামনে দিয়ে স্রোত নামছে নিচে। পাথরে ধাক্কা খেয়ে জল ছিটকে উঠছে, ওপরে। সুদীপ হাত বাড়িয়ে জল স্পর্শ করল। যতটা ঠাণ্ডা বলে ভেবেছিল ততটা নয়। সে মুখে চোখে ঘাড়ে জল বোলাতে বেশ আরাম লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল একইভাবে। শুধু জলের শব্দ, কোন পাখির গলাও নেই! ঠাণ্ডায় বোধহয় পাখিরাও ডাকে না। আর এই নিস্তব্ধতায় সুদীপের চোখ বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু সেই সময় যেন পাতা মাড়ানোর আথবা মানুষের কথা বলার আওয়াজ তার কানে প্রবেশ করল। খুব চাপা গলা কেউ কথা বলছে। যেন সতর্ক করে দিচ্ছে একে অন্যকে। সুদীপ চোখ খুলে চারপাশে তাকাল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কাছাকাছি মানুষ আছে। সুদীপ আরও কিছুক্ষণ স্থির বসে বইল। যাবা কথা বলছে তারা। নিশ্চয়ই সামনে আসবে। কিন্তু তারপরেই সব চুপচাপ। একমাত্র জলেব শব্দ কানে। সুদীপ উঠল। পাথরের আড়ালে আড়ালে কিছুটা এগোতেই সে থমকে দাঁড়াল। একটা লোক ঝরনার ওপাশে নিজেকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখে ওপরদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ দেখার পর মুখ ফিরিয়ে নিচে কাউকে কিছু বলল। তারপর আবার মুখ তুলতেই সুদীপের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। একটু হতভম্ব ভাব, তারপরেই ঝট করে আড়ালে চলে গেল মূর্তিটা। এবং সেইসঙ্গে দ্রুত পায়ের আওয়াজ ওপাশের পাহাড়ে মিলিয়ে গেল। লোকটা ভাবভঙ্গি খুব সন্দেহজনক! চেহারাতেও বিশেষত্ব আছে। সরু দুটো গোঁফ মুখের দুপাশে অনেকটা ঝুলে আছে। সুদাপেব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে অনুসরণ করে। কিন্তু ঝরনাটা পার হবার কথা চিন্তা করে সে থমকে গেল। তাছাড়া ওই লোকটা একা ছিল না। একা একা পাগল কিংবা প্রেমে পড়া মহিলা ছাড়া কেউ কথা বলে না। এই অবস্থায় ঝরনা পাব হতে পারলেও অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু ওরা কারা? এই গ্রামের কেউ লুকিয়ে দেখবে কেন? তাকে দেখামাত্র পালাবার কোন কারণ নেই। তাছাড়া এই কদিনে গ্রামের যত মানুষ দেখেছে তাদের কাবও অমন ছুঁচলো ঝোলা গোঁফ চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা অবশ্যই সন্দেহজনক। সুদীপ ধীরে ধীরে গ্রামে উঠে এল। এখন হেঁটে গেলে গ্রামের মানুষ আগের মত অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু তাদের দেখার মধ্যে যে কৌতূহল নেই তাও বলা যায় না। সুদীপকে দেখে বাচ্চা ছেলে আঙুল তুলে দূরের একটা বাড়ি দেখাল। খানিকটা যেতেই সে আনন্দ আর পালদেমকে দেখতে পেল। আনন্দর মুখ গম্ভীর। পালদেমও অন্যদিকে তাকিয়ে। এই সময় কাহুন ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পালদেমকে কিছু বলতেই সে মাথা নাড়ল নিঃশব্দে। সুদীপ সামনে দাঁড়াতেই আনন্দ মুখ তুলে ওকে দেখল, মেয়েটাকে আর বাঁচানো গেল না। মনে হচ্ছে লাস্ট স্টেজ। আমি খুব ভুল করেছি। কি ভুল? সুদীপ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল। ওকে প্রথম দিনেই এদের দিয়ে দার্জিলিং-এ পাঠানো উচিত ছিল। এই কদিনে তো পৌঁছে যেত। হসপিটাল ট্রিটমেন্ট পেলে হয়তো বেঁচে যেত। ওরা দার্জিলিঙে যেত না। এই গ্রামে মৃত্যু নিশ্চয়ই নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু যারা কখনই গ্রামের বাইরে যায়নি তাদের দার্জিলিঙে অসুস্থকে নিয়ে যাওয়া সংস্কারে আটকাবে। কথাটা বলে সুদীপ দরজার দিকে তাকাল। সেখানে মোটামুটি ছোট ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল মেয়েটির মা।
false
shomresh
কিন্তু একি অবস্থা। নদীতে এক ফোঁটা জল নেই। এই নদী একে বেঁকে তাদের কোয়াটার্সের পেছন দিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে চলে যেত। ফ্যাক্টরির বিদ্যুৎ তৈরীতে সাহায্য করত। রিকশাওয়ালা বলল, এখন তো সব ইলেকট্রিক হয়ে গেছে দিদি। নদীর মুখ বন্ধ করে ওপাশ দিয়ে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তখনই তার খেয়াল হল। এ কোথায় যাচ্ছে সে? এতকালের অভ্যন্ত পথে যাওয়ার তো কোন কারণই নেই। অমরনাথের মৃত্যুর পরে চায়ের বাগানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। না, বড় ভাইকে কোম্পানি চাকরি দিয়েছে। বড় ভাই, হেসে ফেলল সে। ওরা তো বড় হবার পর কখনই তাকে দিদি বলে স্বীকার করেনি। অঞ্জলি চা বাগানের কাছে নতুন কলোনিতে কেনা জমিতে বাড়ি করেছে। সেখানেই আছে। সবাই। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরে ওকে নিশ্চয়ই কোয়াটার্স দিয়েছে কোম্পানি। ততক্ষণে সেই বিরাট মাঠ, চাঁপাফুলের গাছ এবং সার সার বাবুদের বাড়িগুলোর সামনে রিকশা চলে এসেছে। মাঠের মাঝখানে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল সে। সামনেই তাদের সেই কোয়াটার্স যেখানে সমস্ত ছেলেবেলা কেটেছে তার। মনে হচ্ছিল এখনই খবর পেয়ে অমরনাথ বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসবেন। ভাবামাত্র দরজা খুলে গেল। একটি বছর বারোর ছেলে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল। দীপাবলী হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকল। প্রথমে ছেলেটি সঙ্কোচে এগিয়ে আসতে চাইছিল না। দ্বিতীয়বারে শক্ত পায়ে কাছে এল। দীপাবলী তাকে জ্ঞািসা করল, তোমরা এখন এই বাড়িতে থাক বুঝি? ছেলেটি নীরবে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ, বলল। তোমাদের আগে যারা এ বাড়িতে থাকত তারা এখন কোথায় আছে, জানো? মা জানে! বলেই ছেলেটি দৌড়ে বারান্দা টপকে মা মা বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ছুটে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, শুনেছি এ বাড়িতে যিনি থাকতেন তিনি মারা গিয়েছেন। দীপাবলী জবাব দিল না। সে রিকশা থেকে নেমে চারপাশে নজর বোলাচ্ছিল। সময় মানুষের শরীর এবং জীবন থেকে যত দ্রুত সব কিছু কেড়ে নিতে পারে প্রকৃতির ক্ষেত্রে বোধহয় সেরকম সফল হয় না। এই মাঠ, ওই বাবি লেবুর গাছ এতগুলো বছরেও তেমন পাল্টায়নি এমনকি ওই একটা ডালভাঙ্গা চাঁপা গাছটাকেও অবিকল এই অবস্থায় দেখে গিয়েছিল। এইসময় ভেতর থেকে খুব রোগা চেহারার মধ্যবয়সী মহিলা বেরিয়ে এলেন। সম্ভবত রান্নাঘরে ছিলেন কারণ তাঁর শাড়িতে অযত্ন স্পষ্ট। বারান্দায় পা দেবার সময় মাথায় ঘোমটা টানার একটা চেষ্টা ছিল। সম্ভবত কোন পুরুষ সঙ্গে নেই বলে সেটা আর তুললেন না। মুখে চোখে অশিক্ষার ছাপ কিন্তু প্রশ্ন করলেন সরাসরি, আপনি কাউকে খুঁজছেন? হ্যাঁ। একসময় আমি এখানে থাকতাম। আমার বাবা অমরনাথবাবু এখানে চাকরি করতেন। ও। আমরা ওঁর নাম শুনেছি। আপনার বাবা? হ্যাঁ। কিন্তু ওঁর তো শুনেছি দুই ছেলে? হ্যাঁ, কিন্তু আমি ওঁকে বাবা বলেই জানতাম। ও, হ্যাঁ। আপনি কলকাতায় থাকেন, না? অল্প বয়সে বিয়ে হবার পরেই বিধবা হয়েছিলেন? তাই তো? ভদ্রমহিলার মুখচোখে প্রবল উৎসাহ। দীপাবলীর বুকে থম লাগল। এই সত্য, চূড়ান্ত সত্য তাকে বারংবার আড়ষ্ট করবে। অন্তত ফেলে যাওয়া পরিধিতে ফিরে এলে। ভদ্রমহিলা বললেন, আপনার গল্প আমরা খুব শুনেছি। ওই যে, শ্যামলবাবুর বউ, উনি বলেন। কিন্তু আপনার ভাই তো কোয়াটার্স পায়নি। পায়নি? না। আপনারা চলে যাওয়ার পর তো কোম্পানি আর বাড়ি বানায়নি। অথচ বাবুর সংখ্যা বেড়েছে। ও মা ঠাকুমাকে নিয়ে কলোনিতেই থাকে। তবে এখানে শুনছি কোয়ার্টার্স হবে। ওই মাঠের ওপাশে, তখন নিশ্চয়ই পাবে। কলোনিতে কোথায় থাকে জানেন? তা তো বলতে পারব না। ফরেস্টের রাস্তায়। এই পুজোয় ওর মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়ে দেখা হয়েছিল। এইসময় রিকশাওয়ালা বলে উঠল, ও হো, আমি বুঝতে পেরেছি। যে বাবু কলেনি থেকে চাবাগানে চাকরি করতে আসে তার বাড়িতে যাবেন তো? উঠে বসুন দিদিমণি, আমি নিয়ে যাচ্ছি। দীপাবলী স্বস্তি পেল। সে ভদ্রমহিলাকে আসছি বলে রিকশায় উঠে বসল। দীপাবলীর মনে হল ভদ্রমহিলার কৌতূহল তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু রিকশা চলতে শুরু করা মাত্র সে আবিষ্কার করল আবার সেই ক্লান্তি ফিরে আসছে। ভদ্রমহিলার কথায় যে একটু খুঁচিয়ে দেবার প্রবণতা ছিল। তাকে নিয়ে এখনও এই বদ্ধ জায়গায় গল্প তৈরী হয়। আচ্ছা, অতীত কেন উদার হতে পারে না! কেন সে এমন ভাবে রক্তাক্ত করে চলে সমানে। স্কুলের মাঠের পাশ দিয়ে ফরেস্টের দিকে মেছুয়া পূলের রাস্তায় এগিয়ে রিকশাটা ডান দিকে বাঁক নিল। এইসব অঞ্চল আগে পতিত ছিল। বুনো গাছে ভরা বলে কেউ আসত না। এখন তার চেহারা পাল্টেছে। পূর্ববঙ্গের মানুষেরা এখানে আশ্রয় নিয়ে সুন্দর কলোনি তৈরী করে ফেলেছেন। তবে বাড়িঘর এবং তার বাসিন্দাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আর্থিক অবস্থা খুব সুবিধের নয়। রিকশা থামল যে বাড়ির সামনে তার সামনে বাখারির বেড়া দেওয়া একটা জমি আছে যা হয়তো বাগানের জন্য ভাবা হয়েছিল কিন্তু কোনদিন কখনই চেষ্টা হয়নি। রিকশাওয়ালা বলল, এই বাড়ি। একতলা তিনঘরের কাঠের বাড়ি, সিমেন্টের মেঝে এবং টিনের চাল। পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে না। দীপাবলী ইতস্তত করল। বাড়ির কেউ সামনের দিকে নেই। সে রিকশাওয়ালাকে বলল, তুমি ভাই একটু অপেক্ষা কর। এখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। ছায়া ঘন হচ্ছে। দীপাবলী গেট খুলে জমিটা পেরিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে বন্ধ দরজায় শব্দ করল। দ্বিতীয়বারে যে গলা সাড়া দিল তা যে অঞ্জলির বুঝতে অসুবিধে হল না। দীপাবলী বলল, আমি। নিজের স্বর কেমন অচেনা লাগল নিজেরই কানে। সে শক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দরজা খুলল অঞ্জলি। দীপাবলী চমকে উঠল। এ কি চেহারা হয়েছে! রোগা, চোখ
false
tarashonkor
আমার চোখের ওপর এগারটি ঘরের হাল উঠে গিয়েছে। জমি গিয়ে ঢুকেছে কঙ্কণার ভদ্রলোকদের ঘরে। কঙ্কণায় কামার আলাদা। আমাদের এগারখানা হালের ধান কমে গিয়েছে। তারপরে ধরুন আমরা চাষের সময় কাজ করতাম লাঙ্গলেরগাড়ির, অন্য সময়ে গায়ের ঘরদের হত। আমরা পেরেক গজাল হাতা খুন্তি গড়ে দিতাম-বঁটি কোদাল কুড়ুল গড়তাম,গাঁয়ের লোকে কিনত। এখন গাঁয়ের লোকে সেসব কিনছেন বাজার থেকে। সস্তা পাচ্ছেন—তাই কিনছেন। আমাদের গিরিশ গাড়ি গড়ত, দরজা তৈরি করত; ঘরের চালকাঠামো করতে গিরিশকেই লোকে ডাকত। এখন অন্য জায়গা থেকে সস্তায় মিস্ত্রি এনে কাজ হচ্ছে। তারপর ধরুনধানের দর পাঁচ সিকে—দেড় টাকা, আর অন্য জিনিসপত্র আক্ৰা। এতে আমাদের এই নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকলে কি করে চলে, বলুন? ঘর-সংসার যখন করছি—তখন ঘরের লোকের মুখে তো দুটো দিতে হবে। তার ওপর ধরুন, আজকালকার হাল-চাল সে রকম নেই ছিরু এতক্ষণ ধরিয়া মনে মনে ফুলিতেছিল, সে সুযোগ পাইয়া বাধা দিয়া কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিল—তা বটে, আজকাল বার্নিশ-করা জুতো চাই, লম্বা লম্বা জামা চাই, সিগারেট চাই পরিবারের শেমিজ চাই, বডি চাই। —এই দেখ ছিরু মোড়ল, তুমি একটু হিসেব করে কথা বলবে। অনিরুদ্ধ এবার কঠিন স্বরে প্রতিবাদ করিয়া উঠিল। ছিরু বারকতক হেলিয়া-দুলিয়া বলিয়া উঠিল, হিসেব আমার করাই আছে রে বাপু। পঁচিশ টাকা ন আনা তিন পয়সা। আসল দশ টাকা, সুদ পনের টাকা ন আনা তিন পয়সা। তুই বরং কষে দেখতে পারিস। শুভঙ্করী জানিস তো? হিসাবটা অনিরুদ্ধের নিকট পাওনা হ্যান্ডনেটের হিসাব। অনিরুদ্ধ কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল সমস্ত মজলিসের দিকে একবার সে চাহিয়া দেখিল। সমস্ত মজলিসটাও এই আকস্মিক অপ্রত্যাশিত বৃঢ়তায় স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। অনিরুদ্ধ মজলিস হইতে উঠিয়া পড়িল। ছিরু ধমক দিয়া উঠিল—যাবে কোথা তুমি? অনিরুদ্ধ গ্রাহ্য করিল না, সে চলিয়া গেল। চৌধুরী এতক্ষণে বলিল—শ্ৰীহরি! ছিরু বলিল-আমাকে চোখ রাঙাবেন না চৌধুরী মশায়, দু-তিনবার আপনি আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন, আমি সহ্য করেছি। আর কিন্তু আমি সহ্য করব না। চৌধুরী এবার চাদরখানি ঘাড়ে ফেলিয়া বাঁশের লাঠিটা লইয়া উঠিল; বলিল—চললাম গো তা হলে। ব্রাহ্মণগণকে প্রণাম—আপনাদিগে নমস্কার। এই সময়ে গ্রামের পাতুলাল মুচি জোড়হাত করিয়া আগাইয়া আসিয়া বলিল চৌধুরী মহাশয়, আমার একটুকুন বিচার করে দিতে হবে। চৌধুরী সন্তৰ্পণে মজলিস হইতে বাহির হইবার উদ্যোগ করিয়া বলিলবল বাবা, এরা সব। রয়েছেন, বল! –চৌধুরী মশায়! চৌধুরী এবার চাহিয়া দেখিল—অনিরুদ্ধ আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। —একবার বসতে হবে চৌধুরী মশায়! ছিরু পালের টাকাটা আমি এনেছি—আপনারা থেকে কিন্তু আমার হ্যান্ডনোটটা ফেরতের ব্যবস্থা করে দিন। মজলিসসুদ্ধ লোক এতক্ষণে সচেতন হইয়া চৌধুরীকে ধরিয়া বসিল। কিন্তু চৌধুরী কিছুতেই নিরস্ত হইল না, সবিনয়ে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। অনিরুদ্ধ পঁচিশ টাকা দশ আনা মজলিসের সম্মুখে রাখিয়া বলিল—এখনই হ্যান্ডনোটখানা। নিয়ে এস ছিরু পাল! পরে হ্যান্ডনোটখানি ফেরত লইয়া বলিল–ও একটা পয়সা আমাকে আর ফেরত দিতে হবে। না। পান কিনে খেয়ো। এস হে গিরিশ, এস। হরিশ বলিল—ওই, তোমরা চললে যে হে? যার জন্যে মজলিস বসল— অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা আর ও কাজ করব না মশায়, জবাব দিলাম। যে মজলিস ছিরু মোড়লকে শাসন করতে পারে না, তাকে আমরা মানি না। তাহারা হনহন করিয়া চলিয়া গেল। মজলিস ভাঙিয়া গেল। পরদিন প্রাতেই শোনা গেল, অনিরুদ্ধের দুই বিঘা বাকুড়ির আধ-পাকা ধান কে বা কাহারা নিঃশেষে কাটিয়া তুলিয়া লইয়াছে। অনিরুদ্ধ ফসলশূন্য ক্ষেত্ৰখানার আইলের উপর স্থিরদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ দেখিল। নিম্ফল আক্ৰোশে তাহার লোহা-পেটা হাত দুখানা মুঠা বাঁধিয়া ডাইসযন্ত্রের মত কঠোর করিয়া তুলিল। তাহার পর সে অত্যন্ত দ্রুতপদে বাড়ি ফিরিয়া হাতকাটা জামাটা টানিয়া সেটার মধ্যে মাথা গলাইতে গলাইতে বাহির দরজার দিকে অগ্রসর হইল। অনিরুদ্ধের স্ত্রীর নাম পদ্মমণিদীর্ঘাঙ্গী পরিপূর্ণ-যৌবনা কালো মেয়েটি। টিকালো নাক, টানা-টানা ভাসা-ভাসা ডাগর দুটি চোখ। পদ্মের রূপ না থাক, শ্ৰী আছে। পদ্মের দেহে অদ্ভুত শক্তি, পরিশ্রম করে সে উদয়াস্ত। তেমনি তীক্ষ্ণ তাহার সাংসারিক বুদ্ধি। অনিরুদ্ধকে এইভাবে বাহির হইতে দেখিয়া সে স্বামী অপেক্ষাও দ্রুতপদে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল—চললে কোথায়? রূঢ়দৃষ্টিতে চাহিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—ফিঙের মত পেছনে লাগলি কেন? যেখানে যাই না, তোর সে খোঁজে কাজ কি? হাসিয়া পদ্ম বলিল—পেছনে লাগি নাই। তার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আর, খোঁজে আমার দরকার আছে বৈকি। মারামারি করতে যেতে পাবে না তুমি। অনিরুদ্ধ বলিল-মারামারি করতে যাই নাই, থানা যাচ্ছি, পথ ছাড়। –থানা? পদ্মর কণ্ঠস্বরের মধ্যে উদ্বেগ পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। –হ্যাঁ, থানা। শালা ছিরে চাষার নামে আমি ডাইরি করে আসব। রাগে অনিরুদ্ধের কণ্ঠস্বর রণ-রণ করিতেছিল। পদ্ম স্থিরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলনা। সত্যি হলেও ছিরু মোড়ল তোমার ধান চুরি করেছে—এ চাকলায় কে এ কথা বিশ্বাস করবে? অনিরুদ্ধের কিন্তু তখন এ পরামর্শ শুনিবার মত অবস্থা নয়, সে ঠেলিয়া পদ্মকে সরাইয়া। দিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিল। অনিরুদ্ধের অনুমান অভ্রান্ত,ধান শ্ৰীহরি পালই কাটিয়া লইয়াছে। কিন্তু পদ্ম যাহা বলিয়াছে সে-ও নিষ্ঠুরভাবে সত্য, ধনীকে চোর প্রতিপন্ন করা বড় সহজ। নয়। শ্ৰীহরি ধনী। এ চাকলায় কাছাকাছি তিনখানা গ্রাম—কালীপুর, শিবপুর ও কঙ্কণা-এ তিনখানা গ্রামে ছি পাল বা শ্রীহরি পালের ধনের খ্যাতি যথেষ্ট। কালীপুর ও শিবপুর সরকারি সেরেস্তায় দুখানা ভিন্ন। গ্রাম হিসাবে জমিদারের অধীন স্বতন্ত্র মৌজা হইলেও কার্যত একখানাই গ্রাম। একটা দিঘির এপারওপার মাত্র। শ্ৰীহরির বাস এই কালীপুরে। এ দুখানা গ্রামের মধ্যে শ্ৰীহরির সমকক্ষ ব্যক্তি আর কেহ নাই। শিবপুরের হেলা চাটুজ্জেরও টাকা ও ধান যথেষ্ট; তবে লোকে বলে—শ্ৰীহরির ঘরে সোনার ইট আছে,
false
shunil_gongopaddhay
বলল, প্রমিস? কাকাবাবু বললেন, প্রমিস! লোকটি বিল্টুকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিল। কাকাবাবু বললেন, রিভলভারটা ফেলে দাও! সে সেটা ফেলে দিতেই কাকাবাবু সেটা তুলে নিয়ে পকেটে ভরলেন। তারপর বিন্দুকে বললেন, বিল্টু, তুই উঠোনের বাইরে গিয়ে দাঁড়া তো। বিল্টু বলল, না, আমি তোমার সঙ্গে যাব। কাকাবাবু বললেন, যা বলছি, কথা শোন। বাইরে দাঁড়া। রান! ওয়ান, টু, থ্রি। বিন্দু দৌড়ে চলে গেল। কাকাবাবু এবার লোকটিকে বললেন, তোমাকে প্রাণে মারব না কথা দিয়েছি, কিন্তু তোমাকে শাস্তি তো পেতেই হবে। ছোট ছেলেমেয়েদের চুরি করে নিয়ে তাদের প্রাণ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে, তারা অমানুষ! তাদের ক্ষমা নেই। কাকাবাবু সেই বড়বাবুর দুই ঊরুতে দুটি গুলি চালিয়ে দিলেন। লোকটি আর্তনাদ করে উঠল। কাকাবাবু বললেন, পায়ে গুলি করলে কেউ মরে না। চিকিৎসা করালে সেরে উঠবে। বড়জোর খোঁড়া হয়ে থাকবে আমার মতো। আর এখন আমাকে তাড়াও করতে পারবে না। বলরাম এর মধ্যে অনেকটা সামলে উঠেছে। কাকাবাবু তার দিকে পিছন ফিরে রয়েছেন। সে একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে ছুড়ে মারল কাকাবাবুর দিকে। জ্বলন্ত কাঠটা কাকাবাবুর মাথায় লাগলে সাংঘাতিক কাণ্ড হতে পারত। কিন্তু সেটা লাগল কাকাবাবুর পিঠে! তিনি অমনই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমিই বা বাদ যাবে কেন? তারও দুই ঊরু ফুড়ে গেল দুই গুলিতে! কাকাবাবু গায়ের কোটটা তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে মাটিতে চাপড়ে আগুন নেভালেন। ওদের তিনজনের দু পায়ে গুলি লেগেছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কাকাবাবু বললেন, থাকো এইভাবে। আমি তোমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। বিল্টু উঠোনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাকাবাবুর এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতটা বিল্টুর কাঁধে রেখে বললেন, চল রে বিল্টু। বিল্টু বলল, তোমার হাত জ্বালা করছে না? কতটা পুড়েছে! কাকাবাবু বললেন, ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে! ভাঙা জায়গাটা পার হওয়ার পর সেই দুধওলাকে দেখা গেল, পাশে আরএকটা লোক। কাকাবাবু তাদের ভয় দেখাবার জন্য শূন্যে একটা গুলি ছুড়লেন। অমনই দৌড় লাগাল তারা! কাছেই রয়েছে একটা জিপ। কাকাবাবু বিন্দুকে নিয়ে সেই গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। আধঘণ্টা পর রাস্তার ধারে একটা থানা দেখে থামলেন কাকাবাবু। ভিতরে ঢুকে একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, কাছাকাছি কোনও ডাক্তারের চেম্বার কিংবা হাসপাতাল আছে? আমার হাতের চিকিৎসা করাতে হবে। কাকাবাবুর দুহাতের কবজির অবস্থা দেখে শিউরে উঠে পুলিশটি বলল, ওরেব্বাস, এই হাত নিয়ে আপনি গাড়ি চালালেন কী করে? কাকাবাবু যে এই হাতে রাইফেলও চালিয়েছেন, তা সে জানবে কী করে! ডাক্তারের কথা জেনে নিয়ে কাকাবাবু পুলিশটিকে বললেন, জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা বাড়িটায় যান। এখনই। সেখানে তিনজন ক্রিমিনালকে পাবেন? গাড়ি চালাচ্ছে সিদ্ধার্থ। সামনের সিটে কাকাবাবু আর বিল্টু। পিছনের সিটে সন্তু আর জোজো আর রিনি। যাওয়া হচ্ছে এয়ারপোর্টের দিকে। কাকাবাবুর সঙ্গে বিল্টু আর রিনি যাবে দিল্লি। কাকাবাবুর বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মার বাড়িতে থাকা হবে। কাকাবাবুর দুহাতেই ব্যান্ডেজ। জোজো বলল, এবার বিন্দুই হিরো। আমি আর সন্তু কোনও চান্সই পেলাম না! কাকাবাবু বললেন, বিল্টু আসল হিরো তো হবে আগামীকাল। দিল্লিতে। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ফার্স্ট প্রাইজ নেবে। সিদ্ধার্থ বলল, রিনি এত ভাল ছবি আঁকে, ও কোনও প্রাইজই পেল না। আর বিল্টু ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেল! রিনি বলল, আমি ওকে শিখিয়েছি। ও পাওয়া মানেই তো আমারও পাওয়া। সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, বিন্দুকে যেখানে আটকে রেখেছিল, সেই জায়গাটা কোথায়? কাকাবাবু বললেন, বিহারে। ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলের জায়গা। বিল্টু বলল, আমাদের বাঘ দেখা হল না। কাকাবাবু, আমরা কিন্তু পরে বাঘ দেখতে যাব। কাকাবাবু বললেন, যাব তো নিশ্চয়ই। তবে, বাঘ তো চোখ বুজলেই দেখা যায়, তাই না? জোজো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, বিল্টু যে বলল, ওদের পালের গোদাটাকে অন্যরা বড়বাবু বলে ডাকছিল, ও কীসের বড়বাবু? কাকাবাবু বললেন, সেটা তো জিজ্ঞেস করা হয়নি! সন্তু বলল, বোধহয় হেড অফিসের বড়বাবু! কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে! ওর গোঁফ ছিল নাকি রে বিল্টু? বিল্টু খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, হেড অফিসের বড়বাবু, লোকটি বড় শান্ত! মোটেই শান্ত নয়, খুব পাজি! কাকাবাবু বললেন, তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনও জানত। সন্তু বলল, দিব্যি ছিলেন খোশমেজাজে চেয়ারখানি চেপে। বিল্টু বলল, একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন খেপে। কাকাবাবু বললেন, আঁতকে উঠে হাত-পা ছুঁড়ে চক্ষু করে গোল। সন্তু বলল, হঠাৎ বলেন, গেলুম গেলুম আমায় ধরে তোল। কাকাবাবু বললেন, তাই শুনে কেউ…ইয়ে, তারপর কী যেন? অনেক দিন পড়িনি তো, মনে পড়ছে না। কী রে, সন্তু, তোর মনে আছে? সন্তু বলল, বিল্টু সব জানে! বিল্টু জিজ্ঞেস করল, তুমি পারবে কিনা বলো। সন্তু বলল, নাঃ, আমারও মনে নেই। বিল্টু গড়গড়িয়ে বলল, তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ বা হাঁকে পুলিশ, কেউ বা বলে, কামড়ে দেবে, সাবধানেতে তুলিস? আরও দু লাইন বলে থেমে গিয়ে বিল্টু হাততালি দিয়ে বলে উঠল, তোমরা পারলে না তো! হেরে গেলে, আমার কাছে হেরে গেলে! সিদ্ধার্থ বলল, এটাতেও বিল্টু ফার্স্ট! কাকাবাবু মনে মনে হাসলেন। তিনি ভাল করে জানেন যে, তাঁর সবটা মনে না থাকলেও সন্তুর পুরোটা মুখস্ত। সে ইচ্ছে করে বলল না। ছোটদের কাছে হেরে গিয়েও যে বড়দের কত আনন্দ হয়, তা ছোটরা জানতেও পারে না। বিল্টু পকেট থেকে মাউথঅর্গান বের করে বাজাতে লাগল। আকাশ থেকে একটা প্লেন নামছে এয়ারপোর্টে। গাড়ির দরজাটা বন্ধ হওয়ার পর কাকাবাবু জানলার কাচ খুলে একবার ওপর দিকে তাকালেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে
false
shunil_gongopaddhay
খোলা তলোয়ার। জগাই মল্লিকের মুখখানা রাগে বীভৎস হয়ে গেছে, সে বলল, এই জন্যই আমি ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ-কারবার করি না! এই ওকে মারিস না, এদিকে নিয়ে আয়। দেবলীনা নিজেকে ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, কিন্তু সেই লোকটার ভীমের মতন চেহারা। সে টানতে-টানতে দেবলীনাকে নিয়ে এল। ঘরের মধ্যে। সন্তুও ভেবেছিল, নীচে যখন পুলিশ এসেছে তখন এই সুযোগে একটা গোলমাল বাধিয়ে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তো ভাল। জগাই মল্লিকের হাতে কোনও অস্ত্রই নেই, তাকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়। কিন্তু সে একবার কাকাবাবুর দিকে তাকাতেই কাকাবাবুঘাড় নেড়ে তাকে নিষেধ করলেন। গোপন দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরের মধ্যে প্রথমে দেবলীনাকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। তারপর কাকাবাবু আর সন্তুকেও ঠেলে-ঠেলে ঢোকানো হল। ভেতরটা একেবারে ঘুটফুটে অন্ধকার। জগাই মল্লিক সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই দেখা গেল, সেই ঘরেও অনেক পাথরের মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে। জগাই মল্লিক বলল, শুনুন, রায়চৌধুরীবাবু, কোনও রকম গণ্ডগোল করার চেষ্টা করলে আর এ-ঘর থেকে জ্যান্ত বেরুতে পারবেন না। সেরকম ব্যবস্থা করা আছে। এখান থেকে হাজার চ্যাঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। এই বিছুদুটোকে সামলান 1 এর পরের বার কিন্তু আমি আর দয়া-মায়া দেখাব না। কাকাবাবু বললেন, আপনাকে বোধহয় একবার নীচে যেতে হবে। ঠিক আছে চলে যান, দয়া-মায়া নিয়ে এখন চিন্তা করতে হবে না? জগাই মল্লিক এক পা এগিয়ে এসে বলল, ততক্ষণে আপনি একটা কাজ সেরে ফেলুন! এক কোণে কালো কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢাকা রয়েছে। সেই কালো কাপড়টা তুলে জগাই মল্লিক বলল, এই দেখুন, চিনতে পারেন?। কাকাবাবু বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠলেন। বললেন, এতক্ষণে বুঝলুম, আমাকে ধরে রাখার জন্য আপনার এত গরজ কেন? দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে দুটি হুবহু একরকম কালো পাথরের মূর্তি। প্রায় দেড় হাত লম্বা। দুটো মূর্তিরই ডান দিকের কান ভাঙা! জগাই মল্লিক বলল, আপনারই আবিষ্কার, আপনি তো চিনবেনই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে… দুটো ছিল না। একটা ছিল। বালুরঘাট মিউজিয়াম থেকে চুরি যায়। যে চুরি করেছে। সে কী সেয়ানা দেখুন! সঙ্গে-সঙ্গে একটি কপি বানিয়ে ফেলেছে। কোনটা আসল, কোনটা নকল ধরবার উপায় নেই। এখন দুটোই আমার হাতে এসে পড়েছে। আসলটার জন্য বিদেশের এক পার্টি অর্ডার দিয়ে রেখেছে, ভাল দাম দেবে। কিন্তু দুটোর মধ্যে কোনটা যে আসল সেটা বুঝতে পারছি না। জানেন তো, ফরেনে ভেজাল মাল পাঠালে ওরা কীরকম চটে যায়? নাম খারাপ হয়ে যায়? আমি সেরকম কারবার করি না? কাকাবাবু মুর্তি দুটোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। জগাই মল্লিক বলল, আপনার জিনিস, আপনি আসলটা বেছে দিন। তারপর আপনার ছুটি। ভেজালটা আমি বালুরঘাটে পাঠিয়ে দেব। মিউজিয়ামে কটা লোকই বা যায়, সেখানে আসল মূর্তি রইল না নকল রইল, তাতে কিছু আসবে যাবে না! চটপট কাজ শেষ করে ফেলুন। আমি পুলিশকে ভজিয়ে ফিরে আসছি।! জগাই মল্লিক বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সন্তু দেখল, এ-ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই। কাকাবাবু বসে পড়ে দেবলীনার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ইশ, কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে! দেবলীনা চোখ খুলে বলল, আমার বেশি লাগেনি। কাকাবাবু বললেন, শোনো, ছেলেখেলার ব্যাপার নয়। একটু ভুল হলেই এরা যখন-তখন মেরে ফেলতে পারে। নিজে থেকে কিছু করতে যাবে না। আমি যা বলব, তাই-ই শুনবে। সন্তু, তোকেও এই কথাটা বলে রাখছি। দেবলীনা বলল, নীচে পুলিশ এসেছে, আপনারা সবাই মিলে চ্যাঁচালেন না। কেন? কাকাবাবু বললেন, তাতে কি কিছু লাভ হত? পুলিশ মানেই তো সবাই ভাল নয়? ঘুষখোর পুলিশও আছে। এরা টাকা পয়সা দিয়ে অনেক পুলিশকে হাত করে রাখে। সেরকম পুলিশ কেউ যদি জানতেও পারে যে আমরা এখানে বন্দী হয়ে আছি, তাও কিছু করবে না। দেবলীনা অবিশ্বাসের সুরে বলল, পুলিশ ডাকাতদের ধরবে না? তা হলে আমরা এখান থেকে বেরুব কী করে? কাকাবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে দেবলীনার মাথার রক্ত মুছে দিতে-দিতে সন্তুকে বললেন, তুই আমার একটা ক্রাচ দিয়ে এই ঘরের সব দেয়াল আর মেঝেটা ঠুকে ঠুকে দ্যাখ তো। যে দেয়াল দিয়ে আমরা ঢুকলাম সেটা বাদ দিয়ে। সন্তু ঠিক বুঝতে না পেরেও একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে দেয়ালে ঠুকতে লাগল। কাকাবাবু দেবলীনার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কোনওরকমে। তারপর বললেন, পুরনো আমলের বাড়ি। এতে যেমন আধুনিক লিফট বসিয়েছে, ইলেকট্রিক আলো আছে, তেমনি আবার গুপ্ত কুঠুরিও রেখে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ঘর থেকেও বেরুবার একটা রাস্তা আছে। সন্তু ঠুকে-ঠুকে কোথাও ফাঁপা শব্দ পেল না। কাকাবাবু ঘরের চারপাশটা দেখলেন। এক কোণে অনেকগুলো মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে, সেগুলো সরিয়ে ফেলে বললেন, এইখানটা ঠুকে দ্যাখ তো! সন্তু এসে সেইখানে জোরে-জোরে ঠুকতেই ঠং ঠং শব্দ হল। কাকাবাবু বললেন, দেখলি? তলাটা ফাঁকা। গুপ্ত কুঠুরি মানেই তা যাওয়া-আসার দুটো ব্যবস্থা থাকবেই। ফাঁদে পড়ে গেলে পালাবার একটা থাকে। একটা চতুষ্কোণ দাগ রয়েছে মেঝের সেই জায়গাটায়। কিন্তু সেখানকার পাথরটা সরানো যাবে কী করে? সন্তু অনেক টানাটানি করেও সুবিধে করতে পারল না। কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন বোধহয় খোলা হয়নি। জ্যাম হয়ে গেছে। দেখি, আমি চেষ্টা করি, এটা খুলতেই হবে। তিনি প্রথমে ক্রাচ দিয়ে সেই রেখার চারপাশ ঝুঁকলেন। কোনও লাভ হল না। তারপর তিনি হাত দিয়ে টিপতে লাগলেন। চতুষ্কোণ রেখার একধারে একবার দুহাতের তালু দিয়ে জোরে চাপ দিতেই আর একটা দিক উঁচু হয়ে উঠল। পরিশ্রমে কাকাবাবুর কপালে ঘাম জমে
false
humayun_ahmed
তার চোখ কেন জানি জ্বালা করছে। মাথাও ভার ভার লাগছে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিলে হয়ত ভাল লাগবে। তিনতলায় নিশ্চয়ই বাথরুম আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে বাথরুমটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় চলে যেতে। আতাউরকে টেলিফোন করে বললে কেমন হয়, ফিসফিস করে বলা— এই শোন আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। তুমি একটা বেবীটেক্সি নিয়ে চলে এসতো। আমাকে বাসায় নিয়ে যাও। মানুষটাকে তুমি করে সে কি কখনো বলতে পারবে? মনে হয় না। বিয়ের পরেও হয়ত আপনি আপনি করেই বলবে। তৃণা শামার কাছে এগিয়ে এসে বলল, তোর কী হয়েছে? শামা বলল, কিছু হয় নি। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ওপর দিয়ে ঘন্টায় একশ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেমন জবুথলু হয়ে বসে আছিল। সমস্যা কী? কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অবশ্যই আছে। বলতে চাইলে বলতে পারিস। উড় উড়া শুনছি তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে? হুঁ। তুই নিজের মুখে আমাদের বলছিস না কেন? কেন আমরা উড়া উড়া শুনব? ছেলে পছন্দ হয় নি। তাইতো? বল হ্যাঁ বা না? শামা চুপ করে রইল। তৃণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এরেঞ্জড ম্যারেজে এ রকম হবে। বাবা মা ধরে বেঁধে এক বার নিয়ে আসবে। হাঁসি মুখে সেই বান্দরকে বিয়ে করতে হবে। বাকি জীবন সেই বান্দর গলায় ঝুলে থাকবে। তাকে আর গলা থেকে নামানো যাবে না। এখানে শামা কে? শামা চমকে তাকাল। এ বাড়ির কোনো বুয়াই হবে। তাকে খুঁজছে। শামা কে? শামা? শামা কাপা গলায় বলল, আমি শামা। কী হয়েছে? দোতলায় যান আফা। আপনের টেলিফোন। শামা ভেবেই পেল না, কে তাকে এ বাড়িতে টেলিফোন করবে। এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার সে নিজেই জানে না। টেলিফোনে কি কোনো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে? আজ কি শনিবার? শনিবারটা শামার জন্যে খুব খারাপ। শনিবার মানেই কোনো না কোনো খারাপ সংবাদ আসবেই। শামা বলল, টেলিফোন কোন ঘরে? বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, টেলিফোন সব ঘরে আছে। আপনে দোতলায় চলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শামা দেখল হলুদ ব্লেজার পরা এক ভদ্ৰলোক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন। বেঁটে খাট মানুষ, মাথাভর্তি চুল। বিরক্তিতে তাঁর চোখ কুঁচকে আছে, তবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মধ্যে ছেলেমানুষি আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। যেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও একটা খেলা। ভদ্রলোকের চেহারাতেও ছেলেমানুষি আছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পৃথিবীতে জন্মায় যাদের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। এই ভদ্ৰলোক সেরকম। বাসে এই ভদ্রলোকের পাশে বসলে কোনো মেয়েই অস্বস্তি বোধ করবে না। ভদ্রলোক শামাকে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনি কি মীরার বান্ধবীদের একজন? জি। আমি আমার চশমা তিনতলার খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে হাত মুখ ধুতে গিয়েছিলাম। হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি চশমাটা নেই। আমার মাইওপিয়া আছে। চশমার পাওয়ার থ্রি ডাইওপটার। আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে সিঁড়িতে দু’বার হোঁচট খেয়েছি। আমার ধারণা মীরার বান্ধবীরা মজা করার জন্যে চশমা লুকিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক না। আপনি মীরার বান্ধবীদের একজন। আপনি কি চশমাটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন? আপনি কি জানেন চশমাটা কার কাছে? জি না। প্রথম ভুলটা আমিই করেছি। চশমা সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। এমন তো না যে বাথরুমে চশমা রাখার জায়গা নেই। বেসিনে রাখা যেত। তবে একবার বেসিনে রেখেছিলাম। বেসিন থেকে পড়ে চশমার গ্লাস ফ্রেম থেকে বের হয়ে এসেছিল। সরি, আপনাকে আটকে রেখেছি। কিছু মনে করবেন না। ভদ্রলোক আগের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলেন। শামার খুবই মজা লাগছে। কোনো বয়স্ক মানুষকে এইভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে সে আগে কখনো দেখে নি। হড়বড় করে অকারণে এত কথা বলতেও শশানে নি। ভদ্রলোক এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন শামাকে তিনি অনেকদিন থেকে চেনেন। হ্যালো কে? শামা, গলা চিনতে পারছি না? আমি মুত্তালিব। তোদর বাড়িওয়ালা চাচা। এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন? ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। , . তুই কি অবাক হয়েছিল? হুঁ। তোর গলাতে আমি চিনতে পারছি না। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিস কেন? একটা জিনিস খেয়াল রাখবি, টেলিফোনে কথা বলার সময় যতটা সম্ভব মিষ্টি গলায় কথা বলবি। কারণটাও ব্যাখ্যা করি। টেলিফোন কনভারসেশনের পুরোটাই অডিও। মুখ দেখা যাচ্ছে না— গলার স্বরটাই ভরসা। কাজেই সেই স্বরটা মিষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কি আমার কথায় লজিক খুঁজে পাচ্ছিস? শামা কিছু বলল না। সে স্বস্তিবোধ করছে। কারণ মুত্তালিব চাচার গলা স্বাভাবিক। তিনি হাসি মুখে কথা বলছেন। কোনো খারাপ সংবাদ থাকলে তিনি এমন হাসিমুখে কথা বলতেন না। হ্যালো শামা? হ্যাঁ শুনছি। এই টেলিফোন নাম্বার কী করে জোগাড় করলাম সেটা বলি। কী জন্যে টেলিফোন করেছেন সেটা আগে বলুন। স্টেপ বাই স্টেপ বলি। তুই এতো ছটফট করছিস কেন? মনে হচ্ছে পাবলিক টেলিফোন থেকে টেলিফোন করছিস তোর পেছনে লম্বা লাইন। সবাই তোকে তাড়া দিচ্ছে। শোন শামা, হ্যালো হ্যালো… শুনছি। আমি করেছি কী শোন। প্রথমে এশাকে বললাম, তোমার বোনের ডায়েরি ঘেঁটে দেখ তার কোনো বান্ধবীর নাম্বার লেখা আছে কিনা। সে একজনের নাম্বার দিল। তৃণা মেয়েটার নাম। আমি তৃণার বাসায় টেলিফোন করে এই বাড়ির নাম্বার নিলাম। বুঝেছিস? বুঝলাম। আপনার অনেক বুদ্ধি। এখন বলুন টেলিফোন করেছেন কেন? টেলিফোন করেছি
false
shomresh
বলতে ভদ্রমহিলা ড়ুকরে কেঁদে উঠে আঁচলে চোখ ঢাকলেন। রাধার দাদা চাপা গলায় বলল, মা, শান্ত হেও। আর আমারে শান্ত হইয়া থাকতে কইস না তোরা। শান্ত হইয়া করুমটা কি? ভগবান আমার কথা শুনব? শুনব না। তার কান্না থামছিল না। হকচকিয়ে গিয়েছিল দীপা। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে মাসিমা? কি হয় নাই তাই কও। তুমি তো সব জানো, জানো না? আমি বুঝতে পারছি না মাসিমা। এবার রাধার দাদা বলল, মা, তুমি আমাকে কথা বলতে দাও। বল! যত ইচ্ছা বল। আমি আর পারি না! ভদ্রমহিলা নিঃশ্বাস ফেললেন শব্দ করে। দীপা কোন কুলকিনারা ভেবে পাচ্ছিল না। রাধার দাদা জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে রাধা কিছু বলেছে? কি ব্যাপারে বলুন! গৌরাঙ্গ নামের একটি ছেলেকে নিয়ে কোন কথা? দীপা শক্ত হল। তাহলে ঘটনা এই। তাহলে তার উচিত সত্যি কথা বলা। যা সত্যি তাই বললে রাধার উপকারই হবে। সে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল, হ্যাঁ। কি বিপদ বলুন তো। আমি সারাদিন ব্যবসা নিয়ে থাকি, কিছুই দেখতে পারি না সংসারের আর এই ফাঁকে ও এমন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসল! কি কাণ্ড। রাধার মত মেয়ে কোন অন্যায় করতে পারে না। আমিও তাই ভাবতাম। আমি জানি না কাউকে ভালবাসা আপনাদের চোখে অন্যায় কিনা। রাধার মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে রাধার দাদা বলল, এ নিয়ে তর্ক করতে চাই না। আচ্ছা, আপনার সঙ্গে যেদিন রাধা নাটক দেখতে গিয়েছিল সেদিন গৌরাঙ্গ সঙ্গে ছিল? বিপদ কোন দিক দিয়ে আসবে ঠাওর করতে পারিছল না। দীপা, তবু সে সত্যি কথাটাই বলল, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গিয়েছিল। না, ওটা হঠাৎ দেখা হওয়া নয়। আমি জানি না। কিন্তু কি হয়েছে বলবেন তো? আপনার এই ঘরে কখনও গৌরাঙ্গ এসে রাধার সঙ্গে দেখা করেছে? আমার এখানে? না। কক্ষনো নয়। রাধার মা অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর বললেন, তুমি সত্য কথা বল মা। বিশ্বাস করুন, এখানে গৌরাঙ্গবাবু কখনও আসেননি। আমি শুনেছিলাম জাত নিয়ে আপনাদের আপত্তি আছে। কিন্তু ওকে পড়াশুনা করার সুযোগ দিয়েছেন, নিজেরটা বুঝতে পারে ও। তখন–। নিজেরটা যদি বুঝতে পারত তাহলে কোন কথাই উঠত না। পাকিস্তান থেকে যখন এসেছিলাম তখন সব ছেড়ে আসতে হয়েছিল। এ দেশে এ অবস্থায় থেকে জাত নিয়ে কদিন পড়ে থাকতে পারতাম? রাধার মা বললেন, ওরে সব কথা বল, সব কথা খুইল্যা বল, ও যদি বন্ধুরে বুঝাইতে পারে, আমি তো আর কোন পথ দেখি না। রাধার দাদা অন্যদিকে মুখ ফেরালো, রাধার বিয়ের জন্যে মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ছেলে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু কাল দুপুরে রাধা স্পষ্ট বলে দিল সে গৌরাঙ্গ ছাড়া অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। মা মেনে নেয়নি। চিৎকার, বকাঝকা চলছিল। দুপুরে খেতে এসে আমি সব শুনে মাকে বোঝালাম অনেক করে। তার মেয়ে যদি এই করে শান্তি পায়, পাক। নিজের ভবিষ্যৎ নিজে বুঝে নিতে চাইছে। যখন তখন তাই নিক। আপনি নিশ্চয়ই জানেন গৌরাঙ্গরা থাকে বাসস্ট্যান্ডের ও-পাড়ায়। খেয়ে দেয়ে দোকানে যাচ্ছি এমন সময় গৌরাঙ্গর বাবার সঙ্গে দেখা। দু-একটা কথার পর ওঁকে বললাম যে সামনের রবিবার ওঁদের বাড়িতে আমি যাব। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন বললাম, মনে হয় আপনার ছেলের সঙ্গে আমার বোনের ভাব হয়েছে। দুজনেই যখন প্ৰাপ্তবয়স্ক তখন বিয়েটা দেওয়া দরকার। তারপর? দীপার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক বেশ আধুনিক। উদার। উনি কথা শুনে খুব খেপে গেলেন। বললেন, এদেশে এসে আমরা অধঃপতনে গিয়েছি। ছেলে ধরার জন্যে মেয়েকে লেলিয়ে দিচ্ছি, এইসব। আমারও রাগ হয়ে গেল। দু-একটা কথা শুনিয়ে দিলাম। জাতটাতের কথাও এসে পড়ল। উনি বললেন জাত ধুয়ে জল খেতে। জাত-ফাত ছিল পূর্ববঙ্গে। এখানে শুধু টাকা দিয়ে পরিচয় হয়। তার ছেলের জন্যে যেসব সম্বন্ধ আসছে তারা এত দেবে অত দেবে। ওই টাকা পেলে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন। আর কথা না বাড়িয়ে আমি দোকানে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজে মন দিতে পারছিলাম না। বোনটার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই সন্ধের পরে দোকান বন্ধ করে আবার ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন কুড়ি ভরি সোনা, বিশ হাজার টাকা নগদ না পেলে ছেলের বিয়ে আমার বোনের সঙ্গে দেবেন না। অনেক অনুরোধেও নরম হলেন না। আমি তখন গৌরাঙ্গর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। সে এল। সব শুনে বলল, তার বাবা যা বলেছেন তার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। রাধার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মাত্র, তার বেশী কোন ঘনিষ্ঠতা নেই। শুনে আমি হতভম্ব। তারপর? দীপার গলার স্বর পাল্টে গেল। সমস্ত শরীর রাগে জ্বলতে শুরু করেছে এর মধ্যে। রাধার দাদা বলল, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে কিছু বলার ছিল না। বাড়িতে ফিরে এসে সেই যে রাধা ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে তা এখন পর্যন্ত খোলেনি। কি করব ভাবতে পারছি না! সে কি! কাল থেকে খাওয়া দাওয়া করেনি? না। অনেক ডাকাডাকি হয়েছে সাড়া দিচ্ছে না। একটু একটু করে পাড়ার লোক এই নিয়ে ফিসফিসানি শুরু করেছে। তাই মাকে বললাম। আপনার কাছে আসতে। আপনি যদি এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারেন। ও হো, আমাকে খবর দিলেই আমি চলে যেতাম। চলুন। এখনই। আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে? ছেড়ে দিন তো! আগে দেখি রাধা কি করছে? রাধার মা বললেন, সকাল থিকা তো বাসায় উনান ধরাই নাই। ভাত খাইয়া আইতে কমু
false
shomresh
চালান করে সে পা বাড়াল। গ্রামের বাইরে পৌঁছে তার মনে পড়ে গেল, আঃ, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কি? সতীশবাবু জানতে চাইনেল। ওই মাতলি মেয়েটাকে দেখতে চেয়েছিলাম। ও। তা মাতলি কি এখন গ্রামে আছে? ফিরে যাবেন? না। চলুন। চুপচাপ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দীপাবলী বলল, আচ্ছা সতীশবাবু, আপনার কখনও মনে। হয়েছে সরকার কেন আমাদের এখানে মাইনে দিয়ে রেখেছেন? কতটুকু কাজ করতে হয় আমাদের? কতটুকু কাজ করার ক্ষমতা আমাদের দেওয়া হয়েছে? চার পাশে এত সমস্যা অথচ আমরা কিছুই করতে পারি না। সতীশবাবু মাথা নাড়লেন, কথাটা ঠিক না। তবে দেখুন, আপনার আগে যেসব অফিসার এসেছিলেন তাদের মাথাতেও কাজ করার কোনও ইচ্ছে ছিল না। নইলে তাঁরাও তো চেষ্টা করতেন ওদের জন্যে একটু পানীয় জলের ব্যবস্থা করার। হ্যাঁ। সেটাই তো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেখালিতে কুয়ো নলকূপ বসার পর কাছাকাছি আরও পাঁচটা গ্রামের মানুষ এসে দাবী জানিয়েছিল, তাদেরও সমান সুবিধে চাই। নেখালির মানুষ পাবে আর তারা কি দোষ করল। মন্ত্রীমশাইকে এনে শুধু নেখালি দেখানো হল কেন? তাদের গ্রামেও তো নিয়ে যাওয়া যেত। সতীশবাবু ওদের বেঝাতে চেয়েছিলেন, সরকার বাহাদুর যে টাকা দিয়েছেন তাতে নেখালির বাইরের গ্রামগুলোতেও একটা করে নলকূপ বসেছে। অতএব কাউকে বঞ্চিত করার ইচ্ছে তাঁদের ছিল না। টাকা বেশী পাওয়া গেলে সমানভাবে ব্যবস্থা করা যেত। মন্ত্রীমশাই দেখতে চেয়েছিলেন বলে তাঁকে নেখালিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লোকগুলো অবশ্যই এই ব্যখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলেছিল, নেখালির মেয়ে মেমসাহেবের বাড়িতে কাজ করে বলেই উনি ওই গ্রামকে বিশেষ সুবিধে দিয়েছেন। এটা অন্যায় খুব অন্যায়। লোগুলো দাবী জানিয়েছিল কিন্তু মারমুখী হয়নি। ওদের সেই অভ্যেস বা ক্ষমতা ছিল না। সতীশবাবু অবশ্য সন্দেহ করেছিলেন ওদের এই আসার পেছনে অন্য কারো হাত আছে। মুখে নামটা উচ্চারণ না করলেও এখন তো বুঝতে বাকি নেই। জেলায় এই তল্লাটে অৰ্জুন নায়েক যেন বাতাসের মত জড়িয়ে আছে সর্বত্র। কোন কিছুই তাকে বাদ দিয়ে হয় না। এমন কি এখানে যে প্রাইমারি স্কুল রয়েছে পদাধিকার বলে সে তার প্রেসিডেন্ট কিন্তু সেক্রেটারি অৰ্জুন নায়েক। যদিও আজ পর্যন্ত সেই স্কুলে কোন মিটিং হয়নি। দুজন মাস্টার প্রায় ছাত্রবিহীন অবস্থায় স্কুল চালাচ্ছেন। কোনরকম সরকারি সাহয্য নিয়মিত তাঁরা পান না। ওঁদের চেয়ে সত্যসাধন মাস্টারের অবস্থা ঢের ভাল ছিল। তিনি অন্তত কিছু সচ্ছল অভিভাবকের ছেলেমেয়েকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন। দীপাবলী সতীশবাবুকে বলল, চলুন, ওদিকের গ্রামটা দেখে আসি। এখান থেকে অন্তত ক্রোশ দুই হবে। আপনার কষ্ট হবে? আপনার হবে। অভ্যেস নেই তো। ঠিক আছে। হোক। যারা চিনতো তারা এল, যারা চিনতো না সতীশবাবুকে সঙ্গে দেখে চিনে ফেলল। এই রকে একজন মহিলা অফিসার আছেন এ খবর তো সবার জানা। গ্রামের মেয়েরা ড্যাবডেবিয়ে দেখছে তাকে। দীপাবলীর মনে হল নেখালির মানুষদের চেয়ে এদের অবস্থা ভাল। সতীশবাবু বললেন, এ গ্রামের কেউ না কেউ হয় হাটতলা নয় শহরে গঞ্জে চাকরি করছে। তফাৎ এই কারণেই। বৃষ্টির কারণে লোগুলো খুশী। কিন্তু তারা দেখালো সদ্য বসানো টিউবয়েল টিপলেও জল আসছে না। প্রথম দিন ঘোলা জল বেরিয়েছিল। দ্বিতীয় দিনে পরিষ্কার। সাতদিনের মাথায় সেই যে বিগড়ালো আর কাজ করছে না। দীপাবলী প্রশ্ন করল, কল খারাপ হয়েছে খবরটা দাওনি কেন? একজন বলল, দিয়েছিলাম কাজ হয়নি। আশ্চর্য! কাকে দিয়েছিলে? সতীশবাবু, আমায় বলেননি কেন? সতীশবাবু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন লোকটাকে, আমাদের অফিসে গিয়েছিলি? লোকটা মাথা নাড়ল, না। অর্জুনবাবুর লোক কল বসিয়েছে তাই তাকেই খবর দিয়েছিলাম। তিনি বলে দিয়েছেন এখন কিছু হবে না। হঠাৎ মাথা গরম হয়ে গেল দীপাবলীর। এদের কিছু বলে অবশ্য লাভ নেই। অর্জুনের সঙ্গেই কথা বলবে সে। লোকটা যেন রাজার মত এই অঞ্চল দখল করে বসে আছে। সতীশবাবু বললেন, কল বসিয়েছে সরকার। অর্জুনবাবু ঠিকা নিয়েছিলেন। আমরা না বললে তিনি সারাবেন কি করে? যখন কিছু সমস্যা হবে তখন অফিসে গিয়ে বলবি তোরা। এ হে, ঠিক সময়ে জানালে এত দিনে কল ঠিক হয়ে যেত তোদের। গ্রামের মানুষ অবশ্য একটি কলের ওপর নির্ভর করে না। দীপাবলী দেখল অন্তত চারটে। গভীর কুয়ো আছে। সেগুলোর গঠন বেশ মজবুত। জানা গেল অর্জুনবাবুর বাবার আমলে ওগুলো তৈরী হয়েছিল। ভিজে যাওয়া শাড়ি এরই মধ্যে প্রায় শুকিয়ে আসছিল। ফেরার সময় দীপাবলী টের পেল পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে। দূরত্ব কম নয়, দুপুরও গড়িয়েছে তার ওপর সহজ পায়ে হাঁটা যাচ্ছে না ভেজা মাটির জন্যে। তবু তার ইচ্ছে করছিল সোজা অৰ্জুনবাবুর বাড়িতে গিয়ে কৈফিয়ৎ চাইবে। কল বসবার এত অল্প সময়ের মধ্যে তা খারাপ হয় কি করে। আর সারানো হবে কি না তা বলার মালিক তিনি নন। অফিসে যখন ফিরে এল ওরা তখন শরীর একদম বিপর্যস্ত। বাবুরা সবাই খেতে চলে গিয়েছে দরজা বন্ধ করে। সতীশবাবু বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলেন এতটা ঘেঁটে। তিনি বাড়ি ফিরে গেলে দীপাবলী স্নান করে এসে শুয়ে পড়ল। তিরি জিজ্ঞাসা করল, খেতে দেব? একটু পরে। দুটো পায়ে খুব ব্যথা করছে। অনেক হেঁটেছ? হাঁ। গরম তেল মালিশ করে দেব? চট করে উঠে বসল দীপাবলী। আজ পর্যন্ত তার পায়ে কেউ তেল মালিশ করে দেয়নি। সে হাসল, না রে। তুই খাবার দে। খাওয়ার পর আবার বৃষ্টি নামল। এবার আরও জোরে। আকাশ অন্ধকার করে। সেই। সঙ্গে হাওয়া। ফলে জানলা বন্ধ করতে হল। বেলা সাড়ে তিনটেতে লণ্ঠন জ্বালতে হল তিরিকে। গতকালের কোন মানুষ আজকের এই দিনটাকে
false
toslima_nasrin
মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। গাজিপুরে কালীগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারের কালী মন্দিরে পুজোর আগে যে মূর্তিটি তৈরি হচ্ছিল, ভেঙে ফেলা হয়। – তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকীপুর গ্রামে হরিতলা মন্দিরে পুজোর আগে তৈরি করা মুর্তি ভেঙে দেয়। পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় কালী মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ড্রেন করা হয়েছে। বরগুনা জেলার ফুলঝুরি বাজারের দুর্গ প্রতিমা বিজয়া দশমীর দিন মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের দুর্গ প্রতিমা পূজার কয়েকদিন আগে ভেঙে ফেলে। এসবের কোনও স্ট্রিচার হয়নি। বাংলাদেশ নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সুরঞ্জন হঠাৎ হেসে ওঠে। এক ঘরে, ঘরে কিরণময়ী নেই, একটি বেড়াল শুয়েছিল। দরজার পাশে, বেড়ালটি চমকে তাকায় সুরঞ্জনের হাসির শব্দে। বেড়ালটি কি আজ ঢাকেশ্বরী মন্দির যায়নি? আচ্ছ এই বেড়ালের জাত কি? সে কি হিন্দু? হিন্দুর বাড়িতে যখন থাকে, হিন্দুই হবে বোধহয়। সাদা কালোয় মেশানো রঙ, নীল চোখদুটোয় মায়া, বেড়ালের চোখ থেকেও কি করুণা ঝরছে। তবে তো এটিও মুসলমান! নিশ্চয়ই মুক্তচিন্তার বিবেকবান মুসলমান, আজকাল ওরা আবার হিন্দুদের দিকে করুণ চোখে তাকায়। বেড়ালটি উঠে যায়। এ বাড়িতে চুলো জ্বলছে না খুব একটা, এরকম হতে পারে, বেড়ালটি পাশের মুসলমান বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে বসিল, বেড়ালটির তা হলে জাত নেই। জাত কেবল মানুষের আছে। মানুষেরই মন্দির মসজিদ আছে। সুরঞ্জন দেখে সিঁড়িতে রোদ এসে পড়েছে, বেলা অনেক হল, আজ ডিসেম্বরের না তারিখ, তার খুব বেড়াল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে পুজো করল না, মন্দিরে গেল না, দেশে সমাজতন্ত্র আনবে বলে পণ্য করুল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল, মিছিল করল, মিটিং-এ ভাল ভাল কথা বলল, কৃষকের কথা ভাবল, শ্রমিকের কথা ভাবল, দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভেবে ভেবে নিজের দিকে, সংসারের দিকে তাকাবার অবসরও পায়নি। আর এই সুরঞ্জনকে সবাই আঙুল তুলে বলছে সে হিন্দু : পাড়ার ছেলেরা তাকে ‘ধর ধর বলে ধ্বনি দেয়। আজ হয়ত ওরা ধরে মার দিচ্ছে না, কাল দেবে। গৌতম ডিম কিনতে গিয়ে মার খায়, সে মোড়ের মতির দোকানে সিগারেট কিনতে যাবে, পিঠে হঠাৎ পড়বে এসে প্রবল ঘুষি, ঠোঁট থেকে সিগারেটটি পড়ে যাবে তার, ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখবে কুদ্দুস, রহমান, বেলায়েত, সোবহান এরা সব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে শক্ত লাঠি, ধারালো ছোরা। দৃশ্যটি ভাবতেই সুরঞ্জন চোখ বন্ধ করে ফেলে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তবে সুরঞ্জনও কি ভয় পায়? সে তো ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। বিছানা ছেড়ে সে উঠোনে বেড়ালটিকে খোঁজে। কী নিস্তব্ধ বাড়ি। মনে হয় কতকাল এই বাড়িতে কেউ থাকে না। একাত্তরে গ্রাম থেকে যখন ফিরে এসেছিল, ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতে বড় বড় ঘাস গজিয়ে গিয়েছিল, থমথমে, গোটা বাড়িটায় একটি জিনিস নেই, তার লাটিম মার্বেল ঘুড়ি নাটাই ক্যারমবোর্ড দাবা বইপত্র কিছু নেই। খাঁ খাঁ করা বাড়িটিতে ঢুকে যেমন বুক কেঁপেছিল, সুরঞ্জনের তেমন বুক কাঁপে। সুধাময় কি সারাদিন শুয়ে থাকেন? প্রেসার যদি বাড়েই, ডাক্তার ডাকবে কে? বাজার করা, ওষুধ কেনা, মিস্ত্ৰি ভাকা, পত্রিকা রাখা এ ধরনের কোনও কাজই সুরঞ্জন কখনও করেনি। সে বাড়িতে তিনাবেল নয়ত দুবেলা খায়, রাত হলে বাড়ি ফেরে, বেশি রাতে হলো নিজের ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে ঢোকা যায়, ঢোকে। টাকা পয়সার দরকার হলে কিরণময়ী নয় সুধাময়ের কাছে চেয়ে নেয়। টাকা চাইতে তার লজ্জাই হয়। তেত্রিশ বছর বয়স, এখনও কোনও উপার্জন নেই। সুধাময় বলেছিলেন–রিটায়ার করছি, তুই কিছু কর সুরঞ্জন।’ ‘আমার দ্বারা চাকরি-বাকরি করা হবে না।’ বলে সে কুটক্যামেলা এড়িয়ে গেছে। বাইরের ঘরে রোগী দেখে সংসার চালাচ্ছেন সুধাময়। রাত করে ঘরে ফিরেছে, পার্টি অফিসে, মধুর কেন্টিনে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিসে, প্রেস ক্লাবে, বত্ৰিশ নম্বরে সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সুরঞ্জন ঘরে ফিরেছে। ভাত ঢাকা থাকত টেবিলে, কোনও দিন খেয়ে, কোনও দিন না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। দূরত্ব এভাবেই তৈরি হচ্ছিল সংসারের সঙ্গে তার, কিন্তু আজ যখন কিরণময়ী সকালের চা দিতে গিয়ে বসলেন তার বিছানায়, সুরঞ্জন অনুভব করেছে। তার মত উড়নচন্তীি উদাসীন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলের ওপর এখনও বাবা মায়ের পরম নির্ভরতা। কি দিয়েছে। সে এই সংসারকে? এক সময়ের বিত্তবান সুধাময় ডাল-ভাত খেয়ে এখন তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। সুরঞ্জনও তোলে, তার মনে আছে ছোটবেলায় তাকে নাক চেপে ধরে দুধ গেলানো হত, মাখন না খেলে পিঠে মাির পড়ত, আর এখন যদি সে কিরুণাময়ীর কাছে আবদার করে আমার সেই খাঁটি দুধ চাই, ননী চাই, মাখন চাই; দুপুরে মাছ চাই মাংস চাই, ঘিয়ে ভাজা পরোটা চাই; সুধাময়ের ক্ষমতা হবে খাওয়াবার? অবশ্য প্রাচুর্য বা বিলাসিতার প্রতি সুরঞ্জনের কোনও আকর্ষণ জন্মায়নি। না জন্মাবার কারণ সুধাময়। সমান বয়সের বন্ধুরা যখন নতুন ডিজাইনের প্যাস্ট শার্ট বানাতো, সুধাময় তখন ছেলের জন্য কিনে আনতেন আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালিলিওর জীবনী, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী, গোর্কি টলস্টয়ের গল্প। সুধাময় চাইতেন ছেলে তাঁর মানুষ হবে। আজ সকালে বেজাত বেড়ালটিকে খুঁজতে খুঁজতে তার নিজের কাছেই জানতে ইচ্ছে হল সে কি আন্দীে মানুষ হয়েছে? তার কোনও লোভ নেই, সম্পদ বা সম্পঞ্জির প্রতি মোহ নেই, নিজের স্বার্থের চেয়ে দশজুনের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। এসবোকই কি মানুষ হওয়া বলে! সুরঞ্জন এলোমেলো হাঁটতে থাকে বারান্দায়। সুধাময় পত্রিকা পড়ছিলেন। ছেলের দিকে চোখ পড়তেই ডাকেন—সুরঞ্জন, শোন। -কল। খাটের রেলিং ধরে দাঁড়ায় সে। —যোশী আর আদভানি সহ আটজন গ্রেফতার হয়েছে শুনেছিস? ওদিকে চারশ’রও বেশি মারা গেছে। ইউ পি-র কল্যাণ
false
shottojit_roy
‘এদের একটি পুরনো চাকর আছে, সে ওদিকের ঘরে বিছানা করছিল। একটা শব্দ পেয়ে আসে। ঘর তখন অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর আগেই সে একটা প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই সুযোগে চোর বাবাজি হাওয়া।’ ফেলুদার কপালে আবার সেই বিখ্যাত ভ্রাকুটি। বলল, ‘একবার চাকরটার সঙ্গে কথা বলব।’ চাকরের নাম বংশলোচন। দেখলাম ঘুষিটা খাওয়ার ফলে তার এখনও যন্ত্রণা আর ভয়— কোনওটাই যায়নি। ফেলুদা বলল, “কোথায় ব্যথা ? চাকরটা চি চি করে উত্তর দিল, তলপেটে।’ তলপেটে? ঘুষি তলপেটে মেরেছিল?’ ‘সে কী হাতের জোর-বাপরে বাপ! মনে হল যেন পেটে এসে একখানা পাথর লাগল। আর তার পরেই সব অন্ধকার।’ ‘আওয়াজটা শুনলে কখন? তখন তুমি কী করছিলে ?’ ‘টাইম তো দেখিনি বাবু! আমি তখন মায়ের ঘরে বিছানা করছি। দুটো ছেলে এসে কীর্তন গান করছিল তাই শুনছিলাম। মা ঠাকরুণ ছিলেন পুজোর ঘরে; বললেন ছেলেটাকে পয়সা দিয়ে আয়। আমি যাব যাব করছি এমন সময় বাবুর ঘর থেকে ঘটিবাটি পড়ার মতো একটা শব্দ পেলাম। ভাবলাম—-কেউ তো নাই—তা জিনিস পড়ে কেন ? তাই দেখতে গেছি—আর ঘরে ঢুকতেই…’ বংশলোচন আর কিছু বলতে পারল না। সব শুনে-টুনে বুঝলাম, আমরা চলে যাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চোর এসেছিল। আমি ভাবলাম ফেলুদা বোধহয় আরও কিছু জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও আর কোনও কথাই বলল না। সেই মোটা পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে রাস্তায় এসে ফেলুদার মুখের চেহারা একদম বদলে গেল। এ চেহারা আমি জানি। ফেলুদা কী জানি একটা রাস্তা দেখতে পেয়েছে, আর সে রাস্তা দিয়ে গেলেই রহস্যের সমাধানে পৌঁছনো যাবে। পাশ দিয়ে খালি ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল, কিন্তু ফেলুদা থামাল না। আমরা দুজনে হাঁটতে লাগলাম। ফেলুদার দেখাদেখি আমিও ভাবতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাতে খুব বেশিদূর এগোতে পারলাম না। প্রতুলবাবু যে চোর নন সেটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যদিও প্রতুলবাবুকে বেশ জোয়ান লোক বলে মনে হয়, আর ওঁর গলার আওয়াজটা বেশ ভারী। কিন্তু তাও এটা কিছুতেই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল না যে, প্রতুলবাবু একটা বাড়ির পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠতে পারেন। তার জন্য যেন আরও অনেক কম বয়সের লোকের দরকার। তা হলে চোর কে? আর ফেলুদা কোন জিনিসটার কথা এত মন দিয়ে ভাবছে ? কিছুক্ষণ হাঁটার পরে দেখি আমরা নীলমণিবাবুর বাড়ির পাঁচিলের পাশে এসে পড়েছি। ফেলুদা পাঁচিলটা বাঁয়ে রেখে ধীরে ধীরে হাঁটতে আরম্ভ করল। কিছুদূর গিয়ে পাঁচিলটা বাঁ দিকে ঘুরেছে। ফেলুদাও ঘুরল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও। এদিকে রাস্ত নেই, ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হয়। মোড় ঘুরে আঠারো কি উনিশ পা হাঁটার পর ফেলুদা হঠাৎ থেমে গিয়ে পাঁচিলের একটা বিশেষ অংশের দিকে খুব মন দিয়ে দেখল। তারপর সেই জায়গাটার খুব কাছ থেকে একটা ছবি তুলল। আমি দেখলাম সেখানে একটা ব্রাউন রঙের হাতের ছাপ রয়েছে। পুরো হাত নয়—দুটো আঙুল আর তেলোর খানিকটা অংশ–কিন্তু তা থেকেই বোঝা যায় যে সেটা বাচ্চা ছেলের হাত। এবার আমরা যে পথে এসেছিলাম সে পথে গিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সোজা একেবারে বাড়ির দিকে চলে গেলাম। খবর পাঠাতেই নীলমণিবাবু বেশ ব্যস্ত হয়ে নীচে চলে এলেন। আমরা তিনজনেই বৈঠকখানায় বসার পর নীলমণিবাবু বললেন, আপনি শুনলে কী বলবেন জানি না, তবে আমার মনটা আজ কালকের চেয়ে কিছুটা হালকা। আমার মতো দুর্দশা যে আরেকজনেরও হয়েছে, সেটা ভেবে খানিকটা কষ্টের লাঘব হচ্ছে। কিন্তু তাও একটা প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অবধি কষ্ট যাবে না—কোথায় গেল আমার আনুবিস ? বলুন ? আপনি এত বড় ডিটেকটিভ—দু-দুটো ডাকাতি দুদিন উপরি উপরি হয়ে গেল আর আপনি এখনও যেই তিমিরে সেই তিমিরে? ফেলুদা একটা প্রশ্ন করে ফেলল। আপনার ভাগনেটি কেমন আছে? ‘কে, বুন্টু ? ও আজ অনেকটা ভাল। ওষুধে কাজ দিয়েছে। আজ জ্বরটা অনেক কমে গেছে? আচ্ছা—বাইরের কোনও ছেলেটেলে কি পাঁচিল টপকে এখানে আসে? ঝুন্টুর সঙ্গে খেলতে-টেলতে ?’ পাঁচিল টপকে? কেন বলুন তো? আপনার পাঁচিলের বাইরের দিকটায় একটা বাচ্চা ছেলের হাতের ছাপ দেখছিলাম। ছাপ মানে ? কীরকম ছাপ ?’ ‘ব্রাউন রঙের ছাপ। টাটকা ?’ বলা মুশকিল—তবে খুব পুরনো নয়।’ কই, আমি তো কোনওদিন কোনও বাচ্চাকে আসতে দেখিনি। বাচ্চা বলতে এক আসে— তাও সেটা পাঁচিল টপকে নয়—একটা ছোকরা ভিখিরি। দিব্যি শ্যামাসংগীত গায়। তবে হ্যাঁ— আমার বাগানের পশ্চিম দিকে একটা জামরুল গাছ আছে! মধ্যে মধ্যে বাইরের ছেলে পাঁচিল টপকে এসে সে গাছের ফল পেড়ে খায় না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না।’ ‘হুঁ…’ নীলমণিবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘চোরের বিষয় আর কিছু জানতে পারলেন কি ?’ ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল। ‘লোকটার হাতের জোর সাংঘাতিক এক ঘুষিতে প্রতুলবাবুর চাকরকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।’ তা হলে এচুরি-ওচুরি এক চোরই করেছে তাতে সন্দেহ নেই। হতে পারে। তবে গায়ের জোরটা এখানে বড় কথা বলে আমার মনে হয় না। একটা বীভৎস বুদ্ধিরও ইঙ্গিত যেন পাওয়া যাচ্ছে।’ নীলমণিবাবু যেন মুষড়ে পড়লেন। বললেন, আশা করি সে বুদ্ধিকে জব্দ করার মতো বুদ্ধি আপনার আছে। না হলে তো আমার মূর্তি ফিরে পাবার আশা ছাড়তে হয়।’ ফেলুদা বলল, আরও দুটো দিন অপেক্ষা করুন। এখন পর্যন্ত কখনও ফেলুমিত্তিরের ডিফিট হয়নি।’ নীলমণিবাবুর বাড়ির গাড়িবারান্দা থেকে গেট অবধি নুড়ি পাথর দেওয়া রাস্তা। সেটার মাঝামাঝি যখন পৌছেছি তখন একটা কট্ কট্ শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি নীলমণিবাবুর দোতলার
false