label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
toslima_nasrin
রুনু আর ঝুনু খালার শুরু হল আমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলা। আমি হাঁটছি কথা বলছি দৌড়োচ্ছি–এ যেন অদ্ভুত মজার ব্যাপার। যেন আমার ফিরে আসার কথা ছিল, যেমন গিয়েছিলাম তেমন। বাবা শহরে পা দিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, মা’র একাকিত্ব বাবার পক্ষে অনুমান করা শক্ত। তাঁর সম্ভবত সময়ও নেই। তিনি মেডিকেল কলেজে ছাত্র পড়ানোর চাকরি শেষ করে বিকেলে তাজ ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকানের ভেতরে ছোট্ট একটি কোঠায় বসে রাত নটা অবদি রোগী দেখেন। ডাক্তার লেখা পর্দা সরিয়ে কোঠায় ঢুকতে হয়। ছ’বছর বয়সে আমাকে বেশ অনেকদিন যেতে হয়েছে বাবার ফার্মেসিতে, পেটে ইনজেকশন নিতে। ইস্কুল থেকে ফিরে বাঘা কুকুরটি আমাদের উঠোনে শুয়ে আছে দেখে আধলা ইট তুলে কুকুরটিকে ছুঁড়েছিলাম। বাঘাটি এমন চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে যেন ছিঁড়ে খাবে, সারা গা ঘাএ ভরা, লোম ওঠা, পাড়ার ছেলেরা কুকুরটিকে দেখলেই ঢিল ছোঁড়ে, তাই আমিও সেদিন। ঢিল ছুঁড়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে যেই না সিঁড়িতে পা দেব, বাঘা উড়ে এসে আমার উরু কামড়ে ধরে। ধার-দাঁতে ছিঁড়ে নেয় শাদা মাংস। কুকুরের কামড় খাওয়া আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবার ডাক্তারখানায়। প্রথমদিন দু’হাতে দুটো আর নাভির কিনারে একটি ইনজেকশন দিয়ে দেন বাবা, এরপর প্রতিদিন একটি করে চৌদ্দটি। ইনজেকশন দেওয়ার পর বাবা আমাকে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসগোল্লা কিনে খাওয়াতেন। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে পিরিচ থেকে রসগোল্লা চামচে তুলে খেতাম। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় রিক্সায় চড়ে বাবার কাছে যাওয়ায় আমার বিষম আনন্দ হত। সুইঁ ফোঁড়ানোর ব্যথাও মনে হত নিতান্ত পিঁপড়ের কামড়। স্বদেশী বাজারে ওষুধের গন্ধঅলা দোকানটিতে বসে বাবার অপেক্ষায় রোগিদের বসে থাকা দেখতাম, বাবাকে দেখতাম রোগির নাড়ি টিপতে, রোগীকে শুইয়ে কানে নল লাগিয়ে রোগির বুক পেট পরীক্ষা করতে, কাগজে খচখচ করে ওষুধ লিখতে। বাবার অন্য এক রূপ আমার দেখা হয় তখন, রাতে ঘরে ফেরা ক্লান্ত বিরক্ত অস্পষ্ট অচেনা মানুষ নন তিনি আর। বাবাকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তাঁকে ভালবাসা আমাদের কারও জন্য সহজ ছিল না। বাবা হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসেন খোলস ছেড়ে। আলাদা বাড়িতে সংসার সাজানোর জিনিসপত্র কিনে গুছিয়ে বসার পর মা’কে বললেন কী এখন খুশি হইছ ত? এখন ত আর তুমার জামাইরে কেউ ঘরজামাই কইত না। মা সস্তা লিপস্টিক মাখা ঠোঁটজোড়া ফুলিয়ে রঙিন কাচের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ তুলে বলেন–হ, কইত না। তাতে আমার কি! আমারে ত কইবই কালা পচা। লেখাপড়া নাই। বিদ্যাবুদ্ধি নাই। — তুমি হইলা তিনজনের মা। মায়ের দায়িত্ব ছেলেমেয়ে মানুষ করা। এদেরে ভাল কইরা লেখাপড়া করাও, এতেই শান্তি পাইবা। তুমি কালাপচা হইলেও বিয়া ত আমি তুমারে করছি, করি নাই? মা’র খোলা কোমর আঙুলে টিপে টিপে বাবা বলেন। বাবার কথায় আর আদরে মা’র মন ভরে না। মা’র আবারও ভয় হতে থাকে রাজিয়া বেগম এই বুঝি বাবার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন। বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকেন মা। বাইরে ঝিঁ ঝি ডাকে। কুকুর কাঁদে। রাত বাড়তে থাকে হু হু করে। দরজায় কড়া নড়ার শব্দ আবার নিজের শ্বাসের শব্দে হারিয়ে যাবে ভয়ে তিনি শ্বাস আটকে রাখেন। এক অমাবস্যার রাতে বাবা ফেরেন না, দু’উঠোন পেরিয়ে এসে নানিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মা বলেন–ও মা, নোমানের বাবা ত এহনও ফিরতাছে না। এগারোডা বাইজা গেছে। না জানি কই গেল। না জানি ওই বেডির বাসাত রাইত কাটাইতাছে। নানি ধমকে থামান মা’কে–যা ঘুমা গা। জামাইএর লাইগা ত কাইন্দা মরলি। নিজের স্বার্থডা দেখ। নিজের কথা ভাব। কানলে তর লাভ কি! তুই কি কাইন্দা বেডাইনরে ফিরাইতে পারবি? মা’র মনে পড়ে নানি কী মরা কান্না কেঁদেছিলেন যেদিন এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে নানা বাড়ি এলেন। দিব্যি বউএর সঙ্গে বিছানা পেতে শুতে শুরু করলেন, আর নানি পাশের বিছানায় শুয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদে বালিশ ভেজাতেন। মা জিজ্ঞেস করেছিলেন এত কান্দো ক্যান মা? নানি বলেছিলেন বড় হ, বুঝবি। বুঝবি বেডাইনরে কুনো বিশ্বাস নাই। এগোর জাতটা বড় খারাপ। সে রাতে বাবা বাড়ি ফেরেন রাত দুটোয়। মা জেগেই ছিলেন। বাবা বললেন এক রোগির বাড়িতে দেরি হইয়া গেল। রোগীর শ্বাস যায় যায় অবস্থা। তারে নিয়া আবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। পরের রাতও ঘন হতে থাকে। বাবা বাড়ি ফেরেন না। মা ছোটদাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন চল। যেমনে আছস, চল। ছোটদার হাত ধরে টর্চ জ্বেলে অন্ধকার পুকুরঘাটের দিকে হনহন করে হাঁটেন মা। বড় রাস্তায় একটি রিক্সা জোটে, সেটি করেই পনেরো নম্বর পচা পুকুর পাড়ের বাড়িতে মাঝরাতে এসে থামেন। এক বুড়ো, খালি গা, লুঙ্গি পরা, বারান্দার চেয়ারে বসে হাওয়া খাচ্ছিলেন বাইরের, খনখনে গলায় বললেন–এত রাইতে কেডা? — এইডা কি চাকলাদারের বাড়ি? মা জিজ্ঞেস করেন। — আমিই চাকলাদার। আপনে কেডা? খনখনে গলা আবারও। মা বারান্দায় উঠে এসে বলেন–ভাইসাব, আপনের বাড়িতে কি আমার স্বামী আইছে? ডাক্তার রজব আলী? চাকলাদারের বুকের বেরিয়ে হয়ে থাকা হাড়গুলো নড়ে। তিনি দরজা আগলে বলেন — না আসে নাই। চাকলাদারের কঙ্কাল এক ধাক্কায় সরিয়ে ভেতরে ঢোকেন মা। বসার ঘর পেরোলেই শোবার। ঘরের বাতি নেবানো, জানালা গলে আসা ল্যাম্পোস্টের আবছা আলোয় দেখেন বিছানায় মশারি টাঙানো। মশারি তুলে মা টর্চ জ্বাললেন হাতের। শুয়ে আছেন বাবা, সঙ্গে রাজিয়া বেগম। রাজিয়া বেগমের বুকের জাম্বুরা দুটো খোলা। বাবা ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠেন। কোনও কথা না বলে দ্রুত কাপড় চোপড় পরলেন, জুতো
false
shunil_gongopaddhay
করি না। এ পর্যন্ত কেউ পারেনি। কাকাবাবু ঠিক যেভাবেই হোক ওর চোখে ধুলো দেবেন। রণবীর গুপ্ত বললেন, এ পর্যন্ত কেউ পারেনি বলে যে এবারেও পারবে না, তার কি কোনও মানে আছে? এই ঝুঁকি নেওয়া যায় না। এস পি সাহেব জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, কাকাবাবু এই ধরনের অপরাধী অনেক দেখেছেন। কিন্তু ওঁর বন্ধুর তো এসব অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া উনি আমেরিকার নাগরিক। ওঁর কোনও ক্ষতি হলে আমাদের দেশেরই দারুণ বদনাম হয়ে যাবে! রণবীর গুপ্ত বললেন, গৌতমবাবুর স্ত্রী টাকা দিতে রাজি আছেন। কুড়ি-পঁচিশ লাখ উনি এদেশ থেকেই জোগাড় করতে পারবেন। একটু দরাদরি করলে পঞ্চাশ লাখ থেকে কমিয়ে বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ লাখে রাজি করানো যেতে পারে শঙ্কর রায়বর্মনকে। অতনু সরকার বললেন, আমরা সরকারি লোক হয়ে তো টাকা দেওয়ার ব্যাপারটায় অংশ নিতে পারি না। আমাদের কিছু না-জানার ভান করতে হবে। রণবীর গুপ্ত বললেন, একবার টাকা পেলে শঙ্কর রায়বর্মন কিছুতেই কাকাবাবুকে এমনি এমনি ছাড়বে না। কাকাবাবুর টাকা কে দেবে? অতনু সরকার জিজ্ঞেস করলেন, একজন চাবাগানের ম্যানেজারকেও তো ধরে রেখেছে। রায় বর্মনের কাছ থেকে চিঠিপত্র নিয়ে আসে কে? জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, একজন লোককে পাঠায়। সে বোবা আর কালা। তার কাছ থেকে তো কোনও কথাই জানার উপায় নেই। তাকে অনুসরণ করেও কোনও লাভ হয় না। সে নিউ জলপাইগুঁড়ি রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকে। অত যাত্রীদের মধ্যে কে যে কখন ওর কাছে চিঠি দিয়ে যায়, তা বোঝা যায় না। অতনু সরকার বললেন, ওই বোবা কালা লোকটাকে একবার দেখলে হয়। অনেক বোবা কালা কিন্তু আসলে কথা বলতে পারে, একটু হুড়কো দিলেই মুখ ছুটবে। জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, লোকটাকে ধরে আনা যায়, কিন্তু… রণবীর গুপ্ত বললেন, শঙ্কর রায়বর্মনের প্রত্যেক চিঠিতে লেখা থাকে, আমার দূতের ওপর যদি কোনও অত্যাচার করা হয়, তা হলে আমি সঙ্গে সঙ্গে বদলা নেব। বন্দিদের একজনের হাত কিংবা পা কেটে পাঠাব। একবার যে সত্যি একটা হাত কেটে পাঠিয়েছিল। লোকটা ঠিক খবর পেয়ে যায়। জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, লোকটা লেখাপড়া জানে। ইংরিজিতে চিঠি লেখে, ভাল ইংরিজি। অতনু সরকার বললেন, লেখাপড়া-জানা ডাকাত! জাহাঙ্গির চৌধুরী বললেন, ও তো নিজেকে বলে রাজা। কিং অব তরাই! অতনু সরকার বললেন, হুঁ, রাজা না গজা। ওকে যেদিন ধরব, সেদিন কড়াইতে গরম তেলে ভাজব! এখন এক কাজ করুন, সরাসরি পুলিশ অ্যাকশান শুরু না করে আট-দশজন ইনফরমার ছড়িয়ে দিন চতুর্দিকে। তারা ওর গতিবিধির সন্ধান জানুক। ও তো মাঝে-মাঝে শহরে আসে বললেন, সেই অবস্থায় ওকে ধরতে হবে। এর মধ্যে টাকা নিয়ে দরাদরি শুরু করুন, তাতে ও ভাববে ভয় পেয়ে আমরা ওকে টাকা দিতেই চাই। ফরেস্ট অফিসার আমজাদ আলিকেও কাজে লাগান। সে-ই তো লোকটার আসল চেহারাটা চেনে। আর একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি। ওই যে কাকাবাবুর ভাইপো সন্তু, ওকে চোখে চোখে রাখবেন। ও যে কখন দারুণ দুঃসাহস দেখিয়ে কী কাণ্ড করে বসবে, তার ঠিক নেই। সন্তু আর জোজো তখন সার্কিট হাউজের দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করছে আমজাদ আলির সঙ্গে। আমজাদ আলির মতন সন্তুও তো দেখেছে শঙ্কর রায়বর্মনকে। কিন্তু দুজনের বর্ণনা মিলছে না। শঙ্কর রায়বর্মন পুলিশের ছদ্মবেশে কাকাবাবুদের ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল। উঁদরেল পুলিশ অফিসারের মতন তার মুখে মস্ত বড় গোঁফ। আমজাদ আলি বললেন, আমি যখন ওকে দেখেছি, তখন ওর কোনওরকম গোঁফই ছিল না। সন্তু বলল, থুতনির কাছে একটা কাটা দাগ। আমজাদ আলি বললেন, আমি থুতনিতে কাটা দাগ দেখিনি, ঠোঁটে ছিল শ্বেতির মতন সাদা সাদা দাগ, আর নাকের ওপর আঁচিল। সন্তু বলল, একবার মাথার টুপি খুলেছিল। মাঝখানে গোল টাক। আমজাদ আলি বললেন, আমি দেখেছি, কপালের দিকে একটুখানি টাক, কিন্তু মাঝখানে তো অনেক চুল ছিল। জোজো বলল, যেমন টাকের ওপর পরচুলা পরে অনেকে, তোমনই টাকওয়ালা পরচুলাও কিনতে পাওয়া যায়। থিয়েটারের লোকেরা পরে। আসল কথা হল নাক। বেশ খাড়া নাক নয়, বোঁচা নাক। নাক দিয়েই তোক চেনা যায়। সন্তু বলল, খাড়া, টিকলো নাক। আমজাদ আলি বললেন, আমি তো দেখেছি, খাড়াও নয়, বোঁচাও নয়, মাঝারি। জোজো বলল, এই মাঝারি নাক নিয়েই খুব মুশকিল। মেক আপ দিয়ে মাঝারি নাককে টিকলো করা যায়, আবার বোঁচা বোঁচাও দেখানো যায়। কিন্তু সত্যিকারের টিকলো নাককে বোঁচা করা যায় না। ভুরু কীরকম? সন্তু বলল, প্রায় যেন জোড়া। আমজাদ আলি বললেন, আমি তো দেখেছি ফাঁক ফাক। আমাদেরই মতন। জোজো বলল, সাদা কিংবা কালো রং দিয়ে দুরকমই করা যায়। আমজাদ আলি বললেন, সন্তু, তোমাদের কাছে শঙ্কর রায়বর্মন এসেছিল। পুলিশের ছদ্মবেশে। তখন নিশ্চয়ই গোঁফ লাগিয়ে নানারকম মেক আপ নিয়ে এসেছিল। আমি জঙ্গলের মধ্যে যখন দেখেছি, তখন ওর ছদ্মবেশ ধরার কথা নয়। সেটাই ওর আসল চেহারা। জোজো বলল, তার কোনও মানে নেই। সবসময়েই ও অনেকরকম ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করতে পারে। যাতে ওর নিজের লোকও ওর আসল চেহারাটা জানতে পারবে না। কেউ ওকে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দিতে পারবে না। আমজাদ আলি বললেন, তাও হয়তো ঠিক। আমার ধারণা, লোকটা সবসময় জঙ্গলে থাকে না। মাঝে-মাঝে সাধারণ লোকের মতন শহরে এসে থাকে। হয়তো শহরে ওর বাড়িও আছে। আমার একটা সন্দেহ হয়, সে-কথা কাউকে বলিনি, কারণ সেটা ভুলও হতে পারে। সন্তু বলল, আমাদের বলুন! আমজাদ আলি বললেন, জলপাইগুঁড়ি শহরে একজন ভদ্রলোক আছেন, তাকে দেখলেই আমার শঙ্কর রায়বর্মনের কথা মনে পড়ে। অথচ
false
MZI
শফিকের কিছু হয়েছে? আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি বের হয়ে এল। অরুণ আপা এক পা পিছনে সরে এসে দেয়ালটা ধরে নিজেকে সামলে নিলেন। বারান্দায় তখনো সবাই দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল অ্যাংগুন মনে হয় আকাশকে ছুঁয়ে ফেলবে। মুক্তিবাহিনীর আগুন। কেউ জানতে পারুল না। অরু আপার পথিবী কেমন করে ধ্বসে পড়ছে সেই আগুনের সাথে সাথে। বেলা দশটার দিকে মাইক দিয়ে একজন মানুষ ঘোষণা করতে করতে গেল যে শহরের অবস্থা শাস্ত, ভয়ের কারণ নেই। যে সব দুষ্কৃতকারী এসেছিল বীর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়। একজনকে জ্যান্ত ধরা হয়েছে। গুলীবিদ্ধ সেই দুষ্কৃতকারীকে কিছুক্ষণের মাঝে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে আসা হবে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইসলামিক দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করার ঘূণ্য ষড়যন্ত্র করার অপরাধের জন্যে ভারতের অনুচর। এই দুষ্কৃতকারীকে দৃষ্টাস্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। সেই শাস্তিদৃশ্য নিজের চোখে দেখার জন্যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজরফ আলী সবাইকে ঈদগাহে উপস্থিত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। মাইকের ঘোষণাটি শূনে আমার সারা শরীর কাঁপিতে থাকে। ভারতের অনুচর আর দুষ্কৃতকারী বলতে এরা বোঝাচ্ছে শফিক ভাইকে। শফিক ভাই নূর মুহম্মদের বেকারী থেকে পালাতে পারেন নি, মিলিটারীরা তাঁকে ধরে ফেলেছে। এখন শান্তি কমিটির লোকেরা মিলে তাকে সবার সামনে খুন করবে? খুন করবে? শফিক ভাইকে খুন করবে? আমার হঠাৎ সারা শরীর গুলিয়ে উঠল, কিছু বোঝার আগে আমি হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। আম্মা ছুটে আমাকে ধরলেন, কি হয়েছে। বাবা? হঠাৎ কি হয়েছে? ভাইকে মেরে ফেলবে! কি বলছিস তুই? হ্যাঁ আম্মা। শফিক ভাই কাল রাতের যুদ্ধে গুলী খেয়েছেন। তুই তুই কেমন করে জানিস? আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম, আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আস্তে আস্তে বললেন, হায় খোদা, এ তুমি কি করলে খোদা? রাশেদ এল এগারটার দিকে। সে ঈদগাহের মাঠ হয়ে এসেছে। সেখানে একটা গাছ থেকে লম্বা একটা ফাঁসির দড়ি ঝোলানো হয়েছে। রাজাকাররা জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। আজরফ আলী এসে গেছে, শফিক ভাইকে আনলেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা শফিক ভাইকে বাচাতে চেষ্টা করবে না। জানি না। নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু কেমন করে করবে? তাহলে? যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা হয়তো ধরে রেখেছে। অনেকে এভাবে মারা যাবে। রাশেদ বিষন্ন মুখে বলল, আমি জানি না। আমরা চুপ করে বসে রইলাম। রাশেদ আস্তে আস্তে বলল, আমি কি করেছি জানিস? কি? যারা ওখানে মজা দেখতে এসেছে তাদেরকে বলেছি যে শোনা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সুইসাইড স্কোয়াড ঈদগাহে আসছে। ভয়ংকর গোলাগুলী হবে। নিজেরাও মরবে যারা আছে তাদেরকেও শেষ করে দেবে। বানিয়ে বলেছিস? না। পুরোটা বানিয়ে বলি নাই। তাহলে? রাশেদ হাত নেড়ে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। কিন্তু জানিস, যখন খবরটা শান্তি বাহিনীর কাছে গেছে তখন হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেছে, লোকজন সরে যাচ্ছে। তাহলে কি শফিক ভাইকে এখন মারবে না? জানি না। ঠিক তখন আবার মাইকে ঘোষণা দিতে দিতে একটা ক্লিক্সা আসতে থাকে। ঘোষণায় বলা হয় বিশেষ কারণে দুস্কৃতিকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে তারা এখন যেন ঈদগাহে না যায়। নতুন করে সময় ঘোষণা করা হবে। রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমার খবরটা কাজে দিয়েছে মনে হয়, শফিক ভাই এখন জানে বেঁচে গেলেন। কিন্তু কতক্ষণ? জানি না। সারাদিন আমাদের শহরটাতে হেলিকপ্টার আসতে লাগল। মিলিটারী নিশ্চয়ই অনেক মারা পড়েছে, অনেক আহত হয়েছে। যারা বেশি আহত তাদেরকে হেলিকপ্টারে সরিয়ে নিচ্ছে। রেল স্টেশনে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। স্পেশাল ট্রেন এসেছে একটা, অনেক মিলিটারী নেমেছে সেই ট্রেন থেকে। ষ্ট্রেচারে করে অনেক মৃতদেহ তোলা হচ্ছে ট্রেনে। অস্ত্রগারটা যখন উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের স্কুলের একটা অংশও নাকি উড়ে গেছে। স্কুলের লাইব্রেরী ছিল সেটা, কত মজার বই ছিল সেখানে। দুদিন পরে আমরা খবর পেলাম শফিক ভাই এখনো বেঁচে আছেন। শুধু যে বেঁচে আছেন। তাই নয়। তাকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শান্তি কমিটি আর রাজাকাররা তাকে এখনই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানী মিলিটারীরা তাকে আরো কয়দিন বাঁচিয়ে রেখে তার কাছ থেকে কিছু খবর বের করতে চায়। খবর বের করার জন্যে তার উপর অত্যাচার করা হবে। আর মানুষকে অত্যাচার করতে হলে আগে নাকি তাকে সুস্থ করে নিতে হয়। মানুষকে অত্যাচার করার জন্যে সবচেয়ে ভয়ংকর নিয়মগুলি নাকি পাকিস্তানী মিলিটারী থেকে ভাল করে কেউ জানে না। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখে, নখের নিচে গরম সূচী ঢুকিয়ে দেয়, নখ টেনে তুলে ফেলে, ঝুলিয়ে রেখে চাবুক দিয়ে মারতে থাকে আরো কত কি। আমি আর রাশেদ কয়েকদিন সরকারী হাসপাতালের আশে-পাশে দিয়ে ঘুরে এসেছি। একদিন ভিতরেও গিয়েছি, এক, কোণায় একটা ঘরের বাইরে দুইজন পুলিশ আর রাজাকার বসে আছে। ভিতরে কে আছে জিজ্ঞেস করেছিলাম সাহস করে, তখন আমাদের ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছে। অবিশ্যি কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেই আমরা বের করে ফেলেছি। ভিতরে শফিক ভাই আছেন। মনে হয় আগের থেকে ভাল আছেন, খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাকি একটু হাঁটতে পারেন। ভাল ভাল ওষুধ দেয়া হচ্ছে তাকে তাড়াতাড়ি ভাল করে নেয়ার জন্যে। দু’একদিনের মাঝেই তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে অত্যাচার করে খবর বের করার জন্যে। তারপর তাকে মেরে ফেলা হবে। অত্যাচার করার সময়েই নাকি সাধারণত মারা যায় আলাদা করে আর
false
shomresh
অপেক্ষা করছে। হঠাৎ কল্যাণ বলল, আমরা যে লোকটা বয়ে নিয়ে আসছি এরা তার খোঁজ করছে না তো? খটকা লাগল আনন্দর। লোকটা বাইরে থেকে আসছে, না ভেতর থেকে বাইরে যাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। সে হিন্দীতে বলল, তোমাদের মধ্যে কেউ আমাদের সঙ্গে আসবে? কেন? লোকটা বোধ হয় এবার নিচু গলায় সঙ্গী দুজনকে প্রস্তাবটা নিজের ভাষায় বোঝাল। আমরা একটা লোককে পেয়েছি। সে খুব অসুস্থ। প্রায় ফালুটের কাছাকাছি মাটিতে পড়েছিল লোকটা। আমরা ওকে যত্ন করে নিয়ে এসেছি। তোমরা এসে দেখতে পার ঠিক ওকেই খুঁজছ কিনা। আনন্দ কথাগুলো বলে কল্যাণকে ইঙ্গিতে হাঁটতে বলল। ওরা যে পেছনে আসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এগোচ্ছিল আনন্দ। খানিকটা দূর নামার পর কল্যাণ প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, ওরা আসছে। পেছন থেকে ছুরি মারবে না তো? ছুরি কেন মারবে? আনন্দ মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল না। কি জানি বাবা! দেখতে যেমন, এখানে ক্যানিবালরা থাকে কিনা ঈশ্বর জানেন! কল্যাণের কথা শেষ হওয়ামাত্র অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল আনন্দ। এভাবে সে কোনদিন প্রাণ খুলে হাসেনি। হাসিটা যেন পেটের ভেতর থেকে ছিটকে উঠছিল। কল্যাণ এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে কোন প্রশ্ন পর্যন্ত করতে পারল না। এবং তিনজন অনুসরণকারী অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ওই শব্দ যেহেতু পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তাই আনন্দ কোনমতে নিজেকে সংবরণ করামাত্র নিচ থেকে সুদীপের চিৎকার ভেসে এল। বোধ হয় সে কারণ জিজ্ঞাসা করছে। আনন্দ বলল, তোর মাথায় এটা কি করে ঢুকল?। তাই বলে এইরকম হাসার কোন মানে হয় না। কল্যাণকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল। কয়েক পা হাঁটার পর আনন্দর মনে হল পেছনে পদশব্দ নেই। সে মুখ ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কল্যাণও সেটা লক্ষ্য করে বলল, কি ব্যাপার? আনন্দ ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। লোক তিনটে সুদীপের গলা শুনে বিভ্রান্ত হয়েছে। ওরা বোধ হয় ভয় পাচ্ছে প্রকাশ্যে যেতে। সে কল্যাণকে কথা না বলে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। আশেপাশে যে শব্দ হচ্ছে তাতে একথা স্পষ্ট অনুসরণকারীরা ফিরে যায়নি। শুধু তারা বোধ হয় প্রকাশ্যে আসার ঝুঁকি নিতে রাজী নয়। অনেকটা সময় লাগল ওদের সুদীপের কাছে পৌঁছাতে। সুদীপ দাঁড়িয়েছিল। জয়িতা একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। সেই লোকটা শুয়ে রয়েছে চোখ বন্ধ করে। খুব দ্রুত আনন্দ সুদীপকে ঘটনাটা বলল। ওরা লোকটির চারপাশে চলে আসতেই মাথার ওপরে শব্দ হল। আনন্দ সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, তোমরা কি এই লোকটিকেই খুঁজছ? কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কাটল। তারপর ওপরের পাথরের গায়ে একটা শরীর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, হ্যাঁ। লোকটাকে খুঁজে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তোমরা চলে যাও। কিন্তু আমাদের আপাতত যাওয়ার জায়গা নেই। আমরা তোমাদের গ্রামে যেতে চাই। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। এই লোকটাকে আমি খুঁজছিলাম, পেয়ে গেছি, এবার তোমরা তোমাদের ধান্দায় যাও, ওকে নিয়ে আমরা গ্রামে ফিরে যাবো। তোমাদের গ্রামের নাম ওয়ালাং চাও? না। সেটা আমাদের গ্রাম থেকে চারঘণ্টার পথ। তোমরা এখান থেকে ওয়ালাং চাঙে যেতে পারবে না। যে পথ দিয়ে এসেছিলে সেদিকেই ফিরে যাও। এই লোকটা বেঁচে আছে তো? সুদীপ জবাব দিল, আছে। আমি ওকে ওষুধ দিয়েছি। আনন্দ বলল, আমাদের এই সঙ্গীরা হাটতে পারছে না। ওর পায়ে লেগেছে। তোমরা আমাদের আজকের রাতটা তোমাদের গ্রামে থাকতে দেবে? তোমরা কারা জানি না। অপরিচিত মানুষকে গ্রামে থাকতে দেওয়ার নিয়ম নেই। আমরা খারাপ মানুষ নই। তাহলে এই অসুস্থ মানুষটাকে কষ্ট করে বয়ে আনতাম না। তাছাড়া আমরা চারজনই পুরুষ নই। একজন মহিলাও আমাদের মধ্যে আছে। লোকটা যেন বিস্মিত হয়ে বলল, মহিলা আছে তো কি হয়েছে। তাজ্জব ব্যপার! জয়িতা কথাটা বুঝতে পেরে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, সাবাস! তুইও শেষ পর্যন্ত আমাকে ক্যাপিটাল করে সিমপ্যাথি পেতে চাইছিলি। কিন্তু ওদের কাছে ছেলেমেয়েদের কোন প্রভেদ নেই। তাই তো চাই। কথা শেষ করে সে উঠে এগিয়ে গেল। সেই পড়ে যাওয়ার সময় সম্ভবত চোট পেয়েছিল জয়িতা কারণ হাঁটার সময় বোঝা গেল সে খোড়াচ্ছে। একেবারে পাথরটার সামনে পেীছে সে লোকটাকে বলল, আমরা ফিরে যেতে পারব না। আজকের রাতটা তোমাদের গ্রামে আমরা থাকতে চাই। সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই, তোমরা আমাদের মরে যেতে বল? কি রকম মানুষ তোমরা? ওর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে লোকটা চট করে জবাব দিতে পারল না। সে ধীরে ধীরে আড়ালে ফিরে গেল। সুদীপ বলল, সমানে হুকুম করে যাচ্ছে লোকটা একটা ছুরি হাতে নিয়ে। এটা সহ্য করা যায় না। দেব নাকি ঠাণ্ডা করে? আনন্দ দ্রুত বলে উঠল, না। কক্ষনো না। সহ্য কর। মনে হয় আখেরে কাজ দেবে। সুদীপ বলল, কিন্তু এই অসুস্থ মানুষটাকে বয়ে এনে ধরিয়ে দেব? অন্যায় হবে না? আনন্দ জবাব দিল, ও যদি সত্যি অপরাধী হয় তাহলে অন্যায় কিসের? নিশ্চয়ই একটা বিচার করবে ওরা। এখানে থাকলে তো রাত নামলেই মরে যাবে। তাতে ওর কি ভাল হবে? লোকটা আবার উদয় হল, তোমরা ওর কাছ থেকে সরে দাঁড়াও। যে জিনিসটার খোঁজ করছি তা যদি ওর সঙ্গে থাকে তাহলে তোমাদের আমরা গ্রামে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তোমরা যদি বেইমানি কর তাহলে কাউকে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। আনন্দ ইঙ্গিত করতেই সবাই লোকটাকে ছেড়ে সরে এল। এত যে কথাবার্তা চলছে তা লোকটার কানে ঢুকলই না। প্রায় মৃতদেহের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে লোকটা। ওরা বেশ কিছুটা
false
shomresh
পুলিশের গাড়ির দিকে তার নজর দেওয়ার সময় নেই। মিনিটখানেকের মধ্যেই বি-বিপ আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। অর্জুন বুঝল আরও পুলিশের গাড়ি ছুটে আসছে তার দিকে। এরা সম্ভবত হাইওয়ের ধাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার ওবা গুলি করবেই। অর্জুন পাশের জঙ্গলের দিকে তাকাল। এই জঙ্গলটাই তো? তিনটে সিড়িঙ্গে গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলো কোথায়? বুলডগের মতো গাড়িগুলো ছুটে আসছে পেছনে। অর্জুন দেখতে পেল হাইওয়ে থেকে একটা সরু পথ চলে গেছে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে। সে চকিতে স্টিয়ারিং ঘোরাল। ব্রেক কষেও শেষরক্ষা করতে পারল না, গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল রাস্তার পাশের রেলিঙে। মেরে স্থির হয়ে গেল। দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে অর্জুন জঙ্গলের দিকে দৌড়তে লাগল। পুলিশের গাড়িগুলো ব্রেক কষে থামতে-থামতে সে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এবং তখনই তার কানে খুব নিচু পরদায় ঘেউ-ঘেউ ডাক ভেসে এল। অর্জুন চিৎকার করে উঠল, তাতান। কিন্তু চিকারটা এবার পেছন থেকে। অর্জুন দেখল একগাদা পুলিশ চেনবাঁধা কুকুর হাতে নিয়ে ছুটে আসছে। কুকুরগুলো হিংস্র, ডাকছে তারাই। অর্জুন ছুটল। একটা সময় কুকুরের ডাক মিলিয়ে গেল, কিন্তু খুব কাছ থেকে নিচু গলার ডাক ভেসে এল। অর্জুনের মনে হল তাতানকে নিয়ে সেই অন্য গ্রহবাসী তার সামনে এগিয়ে চলেছে। এর মানে ওরা সারাক্ষণ তার সঙ্গে ছিল। মাথার ওপর এখন বিমানের আওয়াজ। অদ্ভুত চেহারার বিমানগুলো এখন জঙ্গল খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই তাদের একটা অর্জুনকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে জোরালো আগুনের একটা রশ্মি নেমে এল ওপর থেকে। অর্জুন দৌড়ে সময়মতো সরে গিয়ে দেখল সেই জায়গার গাছপালা পুড়ে কালো হয়ে গেল। স্তিমিত হয়ে আসা কুকুরের ডাক অনুসরণ করে কিছুটা যেতেই সে তিনটে সিড়িঙ্গে গাছ দেখতে পেল। অর্জুন এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, খেয়াল করেনি একজন পুলিশ অফিসার তার দিকে এগিয়ে আসছে। যখন দেখতে পেল তখন মেশিনটার উদ্দেশ্যে না দৌড়ে কোনও উপায় নেই। মাথার পাশ দিয়ে দু-দুবার গুলি ছুটে গেল। মেশিনটার কাছে পৌঁছে দরজা খুলে সে পেছনে তাকিয়ে হিংস্র পুলিশটিকে দেখতে পেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে বন্দুক তাক করেছে। হঠাৎই লোকটা হতভম্ব হয়ে পাশে ঘুরে দাঁড়াল। অদৃশ্য কিছু তাকে ধাক্কা মেরেছে বলে মনে হল। অর্জুন আর অপেক্ষা না করে মেশিনে উঠে বসে ইঞ্জিন চালু করার সুইচে হাত দিয়ে নব ঘোরাতে লাগল। একশো সত্তর বছর পিছিয়ে যেতে হবে তাকে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনিতে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। অর্জুন চোখ মেলে দেখল চারপাশ-কেমন অন্ধকার-অন্ধকার। সে কোথায়, প্রথমে ঠাওর করতে পারল না। শরীর একটু স্থির হতে সে মেশিন থেকে নামার চেষ্টা করল। কয়েক সেকেন্ড বাদে সে বুঝতে পারল এটা ডক্টর গুপ্তর গবেষণাগার। কোনও পুলিশ অফিসার সামনে নেই বন্দুক উঁচিয়ে। অর্জুন ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগোল। না। বিদ্যুতের ছোঁয়া নেই ওখানে। দরজা ঠেলল সে। ধীরে-ধীরে খুলে গেল সেটা। সেই সিঁড়ি এখন অন্ধকারে ঢাকা। নীচের ঘরে একটা হ্যাজাক জ্বলছে। কিছু লোক কথাবার্তা বলছে। অর্জুন হ্যাজাকের আলো লক্ষ করে নীচে নেমে আসতেই একজন চিৎকার করে উঠল, কে? কে ওখানে? অর্জুন দেখল, খাঁকি পোশাক পরা পুলিশ অফিসার। ভদ্রলোক একা নন, সঙ্গে আরও তিনজন সেপাই আছেন। চারজনেই উঠে এসেছেন অর্জুনের সামনে। প্রত্যেকের চোখেমুখে বিস্ময়। অর্জুন বলল, আমি অর্জুন। ডক্টর গুপ্ত আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। অফিসারটির চোখ ছোট হল, কখন নিয়ে এসেছিলেন? সন্ধেবেলায়। ঠিক সন্ধে হয়নি তখনও। আপনি ওপরে ছিলেন সেই থেকে? হ্যাঁ। মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাননি? আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি এই বাড়ি। ওপরের ঘরে কেউ ছিল না। এই, একে অ্যারেস্ট করো। অফিসার হুকুম করলেন। এর কিছুক্ষণ বাদে, গভীর রাত্রে অর্জুন শিলিগুড়ির থানায় বসে ছিল। দারোগাবাবু বাইরে গিয়েছেন কাজে। তিনি না ফেরা পর্যন্ত কেউ তার কথা শুনবে না। অর্জুন হতাশ হয়ে পড়ছিল। একশো সত্তর বছর আগে গিয়ে তাকে পুলিশের হাতে পড়তে হয়েছিল। প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেও সেই একই অবস্থা? দারোগাবাবু এলেন রাত দুটোর সময়। রিপোর্ট নিশ্চয়ই আগেই পেয়েছিলেন, ঘরে ঢুকে বললেন, কে হে তুমি? ওই বাংলোয় কোন মতলবে ঢুকেছিলে? অর্জুন বলল, আপনারা খুব ভুল করছেন। আমি একজন সত্যসন্ধানী। আমার নাম অর্জুন। জলপাইগুড়ি শহরে থাকি। ডক্টর গুপ্তই আমাকে ওখানে নিয়ে যান। হঠাৎ দারোগাবাবুর মুখচোখ বদলে গেল, আরে তাই তো! আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? ডক্টর গুপ্তকে যখন হসপিটালাইজড করা হয় তখনও তিনি আপনার নাম বলছিলেন। উনি কেমন আছেন? খুব খারাপ। বাঁচার কোনও চান্স নেই। হেড ইনজুরি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বেঁচে যাবেন। অর্জুন বলল। মানে? কিছু না। আর কী হয়েছে? যারা এসেছিল ডাকাতি করতে তারা নীচের তলাই তছনছ করেছে, ওপরের ঘরে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু একটা খবর আমরা ডক্টর গুপ্তকে দিতে পারিনি। ওঁর যা কন্ডিশন। কী খবর? কারেন্ট অফ করে ওপরের ঘরে ঢুকে আমরা কোনও কুকুরের দেখা পাইনি। আপনিও ছিলেন না। ডাক্তার গুপ্ত কেবলই তাতান-তাতান করছিলেন! দারোগার আবার মনে পড়ল, আপনি কোথায় ছিলেন? ওপরের ঘরে অনেকগুলো যন্ত্র ছিল, তার একটাতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অঘোরে ঘুমিয়েছি। অর্জুন হাসল। আচ্ছা। হ্যাঁ, যন্ত্রগুলো দেখেছি কিন্তু কী থেকে কী হয়ে যাবে ভেবে আর খুলে দেখিনি। তা হলে কুকুরটাও তার একটাতে থাকতে পারে। দারোগা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। না, নেই। তাতান এখানে নেই। মাথা নাড়ল অর্জুন। দারোগাবাবুই রাত্রে শাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঘুম ভাঙার পর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাজ্জব অর্জুন। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ির তারিখ
false
robindronath
তোমার ইরুমাসি গিয়েছেন চলে শ্বশুরবাড়ি। আমাকে অবাক করে দেবার লোকের অভাব ঘটেছিল। ঠিক সেই সময় এসেছিলেন হরীশচন্দ্র হালদার একমাথা টাক নিয়ে। তাঁর তাক লাগিয়ে দেবার রকমটা ছিল আলাদা, তোমার ইরুমাসির উল্টো। সেদিন তোমার ইরুমাসি শুরু করেছিল জটাইবুড়ির কথা। ঐ জটাইবুড়ির সঙ্গে অমাবস্যার রাত্রে আলাপ পরিচয় হত। সে বুড়িটার কাজ ছিল চাঁদে বসে চরকা কাটা। সে চরকা বেশিদিন আর চলল না। ঠিক এমন সময় পালা জমাতে এলেন প্রোফেসার হরীশ হালদার। নামের গোড়ায় পদবীটা তাঁর নিজের হাতেই লাগানো। তাঁর ছিল ম্যাজিক-দেখানো হাত। একদিন বাদলা দিনের সন্ধেবেলায় চায়ের সঙ্গে চিঁড়েভাজা খাওয়ার পর তিনি বলে বসলেন, এমন ম্যাজিক আছে যাতে সামনের ঐ দেয়ালগুলো হয়ে যাবে ফাঁকা। পজ্ঞানন দাদা টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, এ বিদ্যে ছিল বটে ঋষিদের জানা। শুনে প্রোফেসার রেগে টেবিল চাপড়ে বললেন, আরে রেখে দিন আপনার মুনি ঋষি, দৈত্য দানা, ভূত প্রেত। পজ্ঞানন দাদা বললেন, আপনি তবে কী মানেন। হরীশ একটিমাত্র ছোটো কথায় বলে দিলেন, দ্রব্যগুণ। আমরা ব্যস্ত হয়ে বললুম, সে জিনিসটা কী। প্রোফেসার বলে উঠলেন, আর যাই হোক, বানানো কথা নয়, মন্তর নয়, তন্তর নয়, বোকা-ভুলোনো আজগুবি কথা নয়। আমরা ধরে পড়লুম, তবে সেই দ্রব্যগুণটা কী। প্রোফেসার বলেলন, বুঝিয়ে বলি। আগুন জিনিসটা একটা আশ্চর্য জিনিস, কিন্তু তোমাদের ঐ-সব ঋষিমুনির কথায় জ্বলে না। দরকার হয় জ্বালানি কাঠের। আমার ম্যাজিকও তাই। সাত বছর হরতকি খেয়ে তপস্যা করতে হয় না। জেনে নিতে হয় দ্রব্যগুণ। জানবা মাত্র তুমিও পার আমিও পারি। কী বলেন প্রোফেসার, আমিও পারি ঐ দেয়ালটাকে হাওয়া করে দিতে? পার বৈকি। হিড়িংফিড়িং দরকার হয় না, দরকার হয় মাল-মসলার। আমি বললেম, বলে দিন-না কী চাই। দিচ্ছি। কিছু না— কিছু না, কেবল একটা বিলিতি আমড়ার আঁঠি আর শিলনোড়ার শিল। আমি বললুম, এ তো খুবই সহজ। আমড়ার আঁঠি আর শিল আনিয়ে দেব, তুমি দেয়ালটাকে উড়িয়ে দাও। আমড়ার গাছটা হওয়া চাই ঠিক আট বছর সাত মাসের। কৃষ্ণদ্বাদশীর চাঁদ ওঠবার এক দণ্ড আগে তার অঙ্কুরটা সবে দেখা দিয়েছে। সেই তিথিটা পড়া চাই শুক্রবারে রাত্রির এক প্রহর থাকতে। আবার শুক্কুর বারটা অগ্রহায়ণের ঊণিশে তারিখে না হলে চলবে না। ভেবে দেখো বাবা, এতে ফাঁকি কিছুই নেই। দিনখন তারিখ সমস্ত পাকা করে বেঁধে দেওয়া। আমরা ভাবলুম, কথাটা শোনাচ্ছে অত্যন্ত বেশি খাঁটি। বুড়ো মালীটাকে সন্ধান করতে লাগিয়ে দেব। এখনো সামান্য কিছু বাকি আছে। ঐ শিলটা তিব্বতের লামারা কালিম্পঙের হাটে বেচতে নিয়ে আসে ধবলেশ্বর পাহাড় থেকে। পঞ্চানন দাদা এ পার থেকে ও পার পর্যন্ত টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, এটা কিছু শক্ত ঠেকছে। প্রোফেসার বললেন, শক্ত কিছুই নয়। সন্ধান করলেই পাওয়া যাবে। মনে মনে ভাবলুম, সন্ধান করাই চাই, ছাড়া হবে না— তার পরে শিল নিয়ে কী করতে হবে। রোসো, অল্প একটু বাকি আছে। একটা দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ চাই। পঞ্চানন দাদা বললেন, সে শঙ্খ পাওয়া তো সহজ নয়। যে পায় সে যে রাজা হয়। হ্যাঁ, রাজা হয় না মাথা হয়। শঙ্খ জিনিসটা শঙ্খ। যাকে বাংলায় বলে শাঁখ। সেই শঙ্খটা আমড়ার আঁঠি দিয়ে, শিলের উপর রেখে, ঘষতে হবে। ঘষতে ঘষতে আঁঠির চিহ্ন থাকবে না, শঙ্খ যাবে ক্ষয়ে। আর, শিলটা যাবে কাদা হয়ে। এইবার এই পিণ্ডিটা নিয়ে দাও বুলিয়ে দেয়ালের গায়। বাস্‌। এ’কেই বলে দ্রব্যগুণ। দ্রব্যগুণেই দেয়ালটা দেয়াল হয়েছে। মন্তরে হয় নি। আর দ্রব্যগুণেই সেটা হয়ে যাবে ধোঁয়া, এতে আশ্চর্য কী। আমি বললুম, তাই তো, কথাটা খুব সত্যি শোনাচ্ছে। পঞ্চানন দাদা মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন বসে বসে, বাঁ হাতে হুঁকোটা ধ’রে। আমাদের সন্ধানের ত্রুটিতে এই সামান্য কথাটার প্রমাণ হলই না। এতদিন পরে ইরুর মন্তর তন্তর রাজবাড়ি, মনে হল, সব বাজে। কিন্তু, অধ্যাপকের দ্রব্যগুণের মধ্যে কোনোখানেই তো ফাঁকি নেই। দেয়াল রইল নিরেট হয়ে। অধ্যাপকের ’পরে আমাদের ভক্তিও রইল অটল হয়ে। কিন্তু, একবার দৈবাৎ কী মনের ভুলে দ্রব্যগুণটাকে নাগালের মধ্যে এনে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ফলের আঁঠি মাটিতে পুঁতে এক ঘণ্টার মধ্যেই গাছও পাওয়া যাবে, ফলও পাওয়া যাবে। আমরা বললুম, আশ্চর্য। হ. চ. হ. বললেন, কিছু আশ্চর্য নয়, দ্রব্যগুণ। ঐ আঁঠিতে মনসাসিজের আঠা একুশবার লাগিয়ে একুশবার শুকোতে হবে। তার পরে পোঁতো মাটিতে আর দেখো কী হয়। উঠে-প’ড়ে জোগাড় করতে লাগলুম। মাস দুয়েক লাগল আঠা মাখাতে আর শুকোতে। কী আশ্চর্য, গাছও হল ফলও ধরল, কিন্তু সাত বছরে! এখন বুঝেছি কাকে বলে দ্রব্যগুণ। হ. চ. হ. বললেন, ঠিক আঠা লাগানো হয় নি। বুঝলেম, ঐ ঠিক আঠাটা দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যায় না। বুঝতে সময় লেগেছে। * * * যেটা যা হয়েই থাকে সেটা তো হবেই— হয় না যা তাই হলে ম্যাজিক তবেই। নিয়মের বেড়াটাতে ভেঙে গেলে খুঁটি জগতের ইস্কুলে তবে পাই ছুটি। অঙ্কর কেলাসেতে অঙ্কই কষি— সেথায় সংখ্যাগুলো যদি পড়ে খসি, বোর্ডের ’পরে যদি হঠাৎ নাম্‌তা বোকার মতন করে আম্‌তা-আম্‌তা, দুইয়ে দুইয়ে চার যদি কোনো উচ্ছ্বাসে একেবারে চ’ড়ে বসে ঊনপঞ্চাশে, ভুল তবু নির্ভুল ম্যাজিক তো সেই; ‘পাঁচ-সাতে পঁয়ত্রিশ’এ কোনো মজা নেই। মিথ্যেটা সত্যই আছে কোনোখানে, কবিরা শুনেছি তারি রাস্তাটা জানে— তাদের ম্যাজিকওলা খ্যাপা পদ্যের দোকানেতে তাই এত জোটে খদ্দের। আজ তোমাকে যে গল্পটা বলব মনে করেছি সেটা তোমার ভালো লাগবে না। তুমি বললেও ভালো লাগবে না কেন। যে লোকটার কথা বলব সে চিতোর থেকে
false
toslima_nasrin
পাকিস্তান। জিলকে ইশারায় বসতে বললাম সোফায়, আমার মতই সে মন দিয়ে খেলা দেখতে লাগল। এক ঘন্টা কেটে গেল খেলা দেখেই। এই একটি ঘন্টা আমি জিলের সঙ্গে কোনওরকম কথা বলিনি, বলিনি কারণ আমি নিশ্চিত যে খেলার মাঝখানে কথা বললে ছেলে বিরক্ত হবে। আমাদের বাড়িতে এরকমই নিয়ম, আর যেসময় বিরক্ত কর কর, খেলা দেখার সময় নয়, বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার সময় নয়, আরও বিশেষ করে সে খেলা যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়। জাদেজা শূন্য করে বিদেয় হল। শচিনও বাইশ না তেইশ করে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেল। আজহার তিন করে শেষ। এরপর ধুত্তুরি বলে খেলা থেকে চোখ সরিয়ে জিল কোন দলের সমর্থক তা জানতে চাই। প্রশ্ন শুনে বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে–এই খেলার নাম কি? খেলার নাম কি মানে? তুমি জানো না কী খেলা এটি! আকাশ থেকে আমার সত্যিকার পড়া যাকে বলে। জিল মাথা নাড়ে। সে জানে না। খেলার মাথামুণ্ডু কিছুই সে বোঝেনি। বলে কি! ইউরোপের ছেলে, ইংলেন্ডের পাশের দেশে তার দেশ, আর সে কি না ক্রিকেট কি, কাকে বলে তার কিছুই জানে না! না, জানে না! ক্রিকেট খেলা জিল তার বাপের জন্মে দেখেনি, শোনেওনি ক্রিকেট বলে একটি খেলা আছে এই জগতে। একবার কবে কোথাও শুনেছিল ইংরেজরা একটি খেলা খেলে, যে খেলায় বেশির ভাগই খেলোয়াড়ই মাঠের মধ্যে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে, একজন বা দুজন কেবল দৌড়োয়; সেই উদ্ভট খেলাটির নামই যে ক্রিকেট, তা আজ সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। তাহলে এক ঘন্টা যে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখলে! দেখলাম! কী আর করতে পারি! তুমি তো কথা বলছিলে না। তুমি ব্যস্ত। হায় কান্ড। আমি ভেবেছিলাম আমার চেয়ে জিলই বুঝি বেশি উপভোগ করছে খেলা। যাই হোক, যখন কথা বলার সময় হল, তখন বেচারার যাওয়ার সময়ও হল। হাতে মাত্র একঘন্টা সময় নিয়ে সে এসেছিল আমার বাড়িতে। বলল কাল সে আমাকে নিয়ে যাবে ফরাসি দূতাবাসে। এই দূতাবাসেই আমি আগে গিয়েছিলাম ভিসার জন্য। আমাকে পাঠানো রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশনের আমন্ত্রণ দেখেও দূতাবাসের লোকেরা কঠিন কণ্ঠে বলে দিয়েছে যে এসব আমন্ত্রণে কাজ হবে না, ভিসা হবে না। কেন হবে না, কী কারণ, তার কিছুই বলেনি। ভিসা হবেনার খবর শুনে রিপোর্টাস সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের লোকেরা জিলকে পাঠিয়ে দিয়েছে প্যারিস থেকে ঢাকায়, যেন ভিসার ব্যবস্থা করে আমাকে নিরাপদে নির্বিঘ্নে প্যারিস নিয়ে পৌঁছোয়। জিল আমাকে পরদিন দূতাবাসে নিয়ে গিয়ে ভিসা পাইয়ে দিল। যে ভিসা দিতে চায়নি দূতাবাস, সেই ভিসাই কী চমৎকার দিয়ে দিল। যে জিনিসটি হবে না বলে জানি, সেটি কী যে কী অজ্ঞাত কারণে মাঝে মাঝে হয়ে বসে থাকে! জিল টিকিট নিয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক হয়ে এয়ার ফ্রান্সে প্যারিস। যে আমার পাসপোর্টই ছিল না, সে আমার পাসপোর্ট হয়েছে, দুর্লভ পাসপোর্টে দুর্লভ ভিসাও জুটে গেছে। পাসপোর্টটি কখনই হয়ত পেতাম না যদি না বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের সরকারকে চাপ দিত আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার আশা আমি আসলে একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমেরিকা নাক গলালে হুকুম নড়ে তো হাকিম নড়ে না প্রবাদটি বোধহয় অচল হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, এই অসম্ভবটি সম্ভব করার পেছনে লেখক সংগঠন পেন এর ভূমিকা আছে, পেন যদি প্যানপ্যান না করত, তবে আমেরিকার সরকার মোটে সজাগ হত না। ফতোয়ার খবর, মোল্লাদের আন্দোলনের খবর তো আছেই, নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা আমার উপসম্পাদকীয়টিও সম্ভবত অনেকটা কাজ করেছে আমার ব্যাপারে আমেরিকার সরকারের উদ্যোগী হওয়ার। তা না হলে তাদের কি দায় পড়েছিল বাড়ি বয়ে এসে আমার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে যাওয়ার! কত মানুষের ওপর এ দেশে অন্যায় হচ্ছে, কত নিরপরাধ মিছিমিছি জেলে পচে মরছে, কত মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো হচ্ছে, দেশছাড়া করা হচ্ছে, কই তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের আমেরিকান অ্যান্ড্রু সাহেব কি দৌড়োদৌড়ি করছেন কিছু! সুটকেসে কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিলাম। এপ্রিলে এখানে গরমে সেদ্ধ হলেও ওখানে তো অন্তত শীত শীত আবহাওয়ার মধ্যে পড়তে হবে। তবু শাড়ি নিলাম কিছু। প্যান্ট সার্ট ভাল তেমন নেই আমার। লালমাটিয়ায় গিয়ে ছোটদার কাছ থেকে তাঁর একটি কোট নিয়ে এলাম। দু তিনটি সার্ট প্যান্টও নিলাম। গায়ে আমার ঢ্যালঢ্যাল করে ওসব, কিন্তু চলে। বাড়ি কেনার পর টাকা পয়সার অত ছড়াছড়ি নেই যে নতুন কাপড় কিনব। জিল মোটা একটি বই নিয়ে এসেছে আমার জন্য। রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স বের করেছে। পৃথিবীর কোথায় কোথায় লেখক সাংবাদিকদের কলম কেড়ে নেওয়া আছে, কাকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, কাকে পেটানো হচ্ছে, কাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার খবর। বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা, দেশটি অতি দরিদ্র। বন্যা ঘূর্ণিঝড় দারিদ্র পীড়িত এই দেশে একজন লেখক আছে, তাকে মৌলবাদীরা আক্রমণ করছে। সরকার তার বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার পাসপোর্ট আটক করেছে। জিল বলল,জ্ঞবাংলাদেশে এই আমি প্রথম এলাম। এ দেশ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। কেবল তোমার কথা জানি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা করতে অনেকেই আসবে, সবাই ওরা তোমার সম্পর্কে জানে। আমরা তোমাকে জানতে চাই। তোমার বই পড়তে চাই।’ জিল এখানকার কিছু সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদপষেনর স্বাধীনতা বিষয়ে কথা বলেছে। জিলকে নিয়ে শামসুর রাহমানের বাড়ি ঘুরে এসে শেরাটন হোটেলের ক্যাফেতে বসে চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম এখানকার সাংবাদিকদের তার কেমন লেগেছে? জিল পকেট থেকে কিছু
false
robindronath
আপনি সহসা পথের মধ্যে আমাকে বাহির করিয়া দিয়াছেন। আপনি বলিয়াছেন, কেই বা পিতা, কেই বা মাতা, কেই বা ভ্রাতা! আপনি বলিয়াছেন, পৃথিবীতে কোনো বন্ধন নাই, স্নেহপ্রেমের পবিত্র অধিকার নাই। যাঁহাকে মা বলিয়া জানিতাম আপনি তাঁহাকে বলিয়াছেন শক্তি–যে যেখানে হিংসা করিতেছে, যে যেখানে রক্তপাত করিতেছে, যেখানেই ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, যেখানেই দুই জন মানুষে যুদ্ধ, সেইখানেই এই তৃষিত শক্তি রক্তলালসায় তাঁহার খর্পর লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন! আপনি মায়ের কোল হইতে আমাকে এ কী রাক্ষসীর দেশে নির্বাসিত করিয়া দিয়াছেন!” রঘুপতি অনেক ক্ষণ স্তম্ভিত ইহায়া বসিয়া রহিলেন। অবশেষে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “তবে তুমি স্বাধীন হইলে, বন্ধনমুক্ত হইলে, তোমার উপর হইতে আমার সমস্ত অধিকার আমি প্রত্যাহরণ করিলাম। তাহাতেই যদি তুমি সুখী হও, তবে তাই হউক।” বলিয়া উঠিবার উদ্‌যোগ করিলেন। জয়সিংহ তাঁহার পা ধরিয়া বলিলেন, “না না না প্রভু–আপনি আমাকে ত্যাগ করিলেও আমি আপনাকে ত্যাগ করিতে পারি না। আমি রহিলাম–আপনার পদতলেই রহিলাম, আপনি যাহা ইচ্ছা করিবেন। আপনার পথ ছাড়া আমার অন্য পথ নাই। রঘুপতি তখন জয়সিংহকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন–তাঁহার অশ্রু প্রবাহিত হইয়া জয়সিংহের স্কন্ধে পড়িতে লাগিল। মন্দিরে অনেক লোক জমা হইয়াছে। খুব কোলাহল উঠিয়াছে। রঘুপতি রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন,”তোমরা কী করিতে আসিয়াছ?” তাহারা নানা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “আমরা ঠাকরুন দর্শন করতে আসিয়াছি।” রঘুপতি বলিয়া উঠিলেন,”ঠাকুরুন কোথায়? ঠাকরুন এ রাজ্য থেকে চলে গেছেন। তোরা ঠাকরুনকে রাখতে পারলি কৈ? তিনি চলে গেছেন।” ভারি গোলমাল উঠিল, নানা দিক হইতে নানা কথা শুনা যাইতে লাগিল। “সে কী কথা ঠাকুর!” “আমরা কী অপরাধ করেছি ঠকুর?” “মা কি কিছুতেই প্রসন্ন হবেন না?” “আমার ভাইপোর ব্যামো ছিল ব’লে আমি ক’দিন পূজা দিতে আসি নি।” (তার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহারই উপেক্ষা সহিতে না পারিয়া দেবী দেশ ছাড়িতেছেন।) “আমার পাঁঠা দুটি ঠাকরুনকে দেব মনে করেছিলুম, বিস্তর দূর বলে আসতে পারি নি।” (দুটো পাঁঠা দিতে দেরি করিয়া রাজ্যের যে এরূপ অমঙ্গল ঘটিল, ইহাই মনে করিয়া সে কাতর হইতেছিল।) “গোবর্ধন যা মানত করেছিল তা মাকে দেয় নি বটে, কিন্তু মাও তো তেমনি তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তার পিলে বেড়ে ঢাক হয়েছে, সে আজ ছ মাস বিছানায় পড়ে।” (গোবর্ধন তাহার প্লীহার অতিশয্য লইয়া চুলায় যাক্‌, মা দেশে থাকুন–এইরূপ সে মনে মনে প্রার্থনা করিল। সকলেই অভাগা গোবর্ধনের প্লীহার প্রচুর উন্নতি কামনা করিতে লাগিল।) ভিড়ের মধ্যে একটি দীর্ঘপ্রস্থ লোক ছিল, সে সকলকে ধমক দিয়া থামাইল এবং রঘুপতিকে জোড়হস্তে করিল, “ঠাকুর, মা কেন চলিয়া গেলেন, আমাদের কী অপরাধ হইয়াছিল?” রঘুপতি কহিলেন, “তোরা মায়ের জন্য এক ফোঁটা রক্ত দিতে পারিস নে, এই তো তোদের ভক্তি।” সকলে চুপ করিয়া রহিল। অবশেষে কথা উঠিতে লাগিল। অস্পষ্ট স্বরে কেহ কেহ বলিতে লাগিল, “রাজার নিষেধ, আমরা কী করিব!” জয়সিংহ প্রস্তরের পুত্তলিকার মতো স্থির হইয়া বসিয়াছিলেন। “মায়ের নিষেধ” এই কথা তড়িদ্‌বেগে তাঁহার রসনাগ্রে উঠিয়াছিল; কিন্তু তিনি আপনাকে দমন করিলেন, একটি কথা কহিলেন না! রঘুপতি তীব্রস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “রাজা কে! মায়ের সিংহাসন কি রাজার সিংহাসনের নীচে ! তবে এই মাতৃহীন দেশে তোদের রাজাকে লইয়াই তোরা থাক্‌। দেখি তোদের কে রক্ষা করে।” জনতার মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ শব্দ উঠিল। সকলেই সাবধানে কথা কহিতে লাগিল। রঘুপতি দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, “রাজাকেই বড়ো করিয়া লইয়া তোদের মাকে তোরা রাজ্য হইতে অপমান করিয়া বিদায় করিলি। সুখে থাকিবি মনে করিস নে। আর তিন বৎসর পরে এতবড়ো রাজ্যে তোদের ভিটের চিহ্ন থাকিবে না–তোদের বংশে বাতি দিবার কেহ থাকিবে না।” জনতার মধ্যে সাগরের গুন্‌ গুন্‌ শব্দ ক্রমশ স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল। জনতাও ক্রমে বাড়িতেছে। সেই দীর্ঘ লোকটি জোড়হাত করিয়া রঘুপতিকে কহিল, “সন্তান যদি অপরাধ ক’রে থাকে তবে মা তাকে শাস্তি দিন, কিন্তু মা সন্তানকে একেবারে পরিত্যাগ করে যাবে এ কি কখনো হয়! প্রভু, বলে দিন কী করলে মা ফিরে আসবেন।” রঘুপতি কহিলেন, “তোদের এই রাজা যখন এ রাজ্য হইতে বাহির হইয়া যাইবেন, মাও তখন এই রাজ্যে পুনর্বার পদার্পণ করিবেন।” এই কথা শুনিয়া জনতার গুন গুন্‌ শব্দ হঠাৎ থামিয়া গেল। হঠাৎ চতুর্দিক সুগভীর নিস্তব্ধ হইয়া গেল, অবেশেষে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে লাগিল; কেহ সাহস করিয়া কথা কহিতে পারিল না। রঘুপতি মেঘগম্ভীর স্বরে কহিলেন, “তবে তোরা দেখিবি! আয়, আমার সঙ্গে আয়। অনেক দূর হতে অনেক আশা করিয়া তোরা ঠাকরুনকে দর্শন করিতে আসিয়াছিস–চল্‌ একবার মন্দিরে চল্‌।” সকলে সভয়ে মন্দিরের প্রাঙ্গণে আসিয়া সমবেত হইল। মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ ছিল রঘুপতি ধীরে ধীরে দ্বার খুলিয়া দিলেন। কিয়ৎক্ষণ কাহারও মুখে বাক্যস্ফূর্তি হইল না। প্রতিমার মুখ দেখা যাইতেছে না, প্রতিমার পশ্চাদ্ভাগ দর্শকের দিকে স্থাপিত। মা বিমুখ হইয়াছেন। সহসা জনতার মধ্য হইতে ক্রন্দনধ্বনি উঠিল, “একবার ফিরে দাঁড়া মা! আমরা কী অপরাধ করেছি!” চারি দিকে “মা কোথায়, মা কোথায়” রব উঠিল। প্রতিমা পাষাণ বলিয়াই ফিরিল না। অনেকে মূর্ছা গেল। ছেলেরা কিছু না বুঝিয়া কাঁদিয়া উঠিল। বৃদ্ধেরা মাতৃহারা শিশুসন্তানের মতো কাঁদিতে লাগিল, “মা, ওমা!” স্ত্রীলোকদের ঘোমটা খুলিয়া গেল, অঞ্চল খসিয়া পড়িল, তাহারা বক্ষে করাঘাত করিতে লাগিল। যুবকেরা কম্পিত ঊর্ধ্বস্বরে বলিতে লাগিল “মা, তোকে আমরা ফিরিয়ে আনব–তোকে আমরা ছাড়ব না।” একজন পাগল গাহিয়া উঠিল- “মা আমার পাষাণের মেয়ে সন্তানে দেখলি নে চেয়ে।” মন্দিরের দ্বারে দাঁড়াইয়া সমস্ত রাজ্য যেন “মা” “মা” করিয়া বিলাপ করিতে লাগিল–কিন্তু প্রতিমা ফিরিল না। মধ্যাহ্নের সূর্য প্রখর হইয়া উঠিল,
false
shunil_gongopaddhay
যোগ্য নেতৃত্ব না থাকলে কার নির্দেশে তারা লড়াই করার জন্য এগিয়ে যাবে? বিশৃঙ্খলভাবে লড়তে গেলে তারা শুধুমার খেয়েই মরবে! দিগম্বর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা চাষীদের বোঝাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সকলে তাদের চেনে না কিংবা বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে ফরাজীরাও নীল চাষীদের লড়াই করার ডাক দিয়েছে। সব দিকে যদি একসঙ্গে শুরু হয়। লড়াই, তবে নীল ব্যবসার ভিত্ ধসে পড়তে পারে। এখন পাকেচক্রে এই নেতৃত্বের ভার গঙ্গানারায়ণের ওপরই বর্তেছে। ইতিমধ্যেই মাঝে মাঝে এখানে ওখানে সংঘর্ষ বাঁধছে। কুঠীয়ালদের পাইকদের আক্রমণ করছে গ্রামবাসীরা। এক অত্যাচারী আমিনের লাশ ভাসতে দেখা গেছে নদীর জলে। ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন এক সাহেব, দূর থেকে কে তীর নিক্ষেপ করেছে, সে তীর সাহেবের গায়ে না লাগলেও ঘোড়াটি তীরবিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হয়, সাহেবের পা ভেঙে যায়। গ্রাম-গ্রামান্তরে সমস্ত মানুষের বিশ্বাস, এই সব কীর্তিই গঙ্গানারায়ণের। মধ্যরাতে শোনা যায় দূরে কোথাও গোলাগুলির শব্দ। গৃহস্থরা ঘুম ভেঙে উঠে বসে বলে, ঐ গঙ্গানারায়ণ সিংগী যাচ্ছে সাহেবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আর কিছুদিন পরেই বোধ হয় লোকে গঙ্গানারায়ণের কাল্পনিক মূর্তি গড়িয়ে পুজো করবে! গঙ্গানারায়ণ বললো, কিন্তু আমি তো এসব কিচুই করিনি। দিগম্বর বিশ্বাস বললো, আপনের নামে তো রাটেছে। সেইতেই আমাগো লাভ। আপনের নামে এবার মন্তরের মতন কাজ হবে। আপনের ডাক শুইনলে সক্কলডি এক স্থানে এসে খাড়াবে, আপনে হুকুম দিলে এক দিকে ধেয়ে যাবে। লোকে ভাবে আপনের অলৌকিক শক্তি আছে। আপনে হিমালয় পাহাড়ের থনে আইছেন-বোঝলেন না, কুসংস্কারাচ্ছইন্য বদ্ধ জীব সব, তুক-তাক, মন্তর-তন্তর, এই সবের দিকে অন্ধের মতন টান। আপনে সেডারে কামে লাগান। আপনের নামে এত কিছু রটছে, এবার কিছু ঘটান। গঙ্গানারায়ণের তবু জড়তা কাটে না। যতই হোক সে একজন অন্তর্মুখী মানুষ। এক সঙ্গে এতগুলি মানুষের জীবন-মরণের ঝুঁকি নিয়ে এত বড় একটা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তাকে। এক একবার সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আবার ভেতর থেকে কেউ যেন রাশ টেনে ধরে। তখনি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সে দিগম্বর বিশ্বাসকে বললো, আরও পরামর্শের জন্যে সেখানেই দিন দু-এক থেকে যেতে। পরের দিনই একদল গ্রামবাসী এসে উপস্থিত। দূর দূরান্তর থেকে যেমন লোকে কোনো জাগ্রত ঠাকুরের কাছে ধনাদিতে আসে, সেইরকম তারাও এসেছে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন গঙ্গানারায়ণের কাছে তাদের দুঃখের কথা জানাতে। তারা গঙ্গানারায়ণের পায়ের কাছে কেঁদে পড়লো। নীলকুঠীর পাইকরা তাদের গ্রাম থেকে দুটি যুবতী বধূকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায় কোনো গৃহবধূর ধর্মনাশ হলে সবংশে নির্বংশ হবার অভিশাপ লাগে। গঙ্গানারায়ণ কি এর প্ৰতিকার করবে না? তোরাপ ও তার দলবল হই-হুই রই-রই করে উঠলো। বেশ কিছুদিন বনবাসের ফলে তাদের মধ্যে যেন বন্য আদিম শক্তি জেগেছে। তারা আঘাত হানবার জন্য উন্মুখ। ইদানীং নারী হরণের ঘটনা বেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ কুঠীয়ালদের ধারণা, চাষীদের ঘরের লক্ষ্মী কেড়ে নিয়ে গেলে তারা কাঁদতে কাঁদতেই আধমড়া হয়ে যায়। তখন সামান্য অঙ্গুলি হেলনেই তারা গড়িয়ে গড়িয়ে এসে পা চাটে। দিগম্বর বিশ্বাস গঙ্গানারায়ণকে বললো, চলেন না, একবার শক্তি পরীক্ষা হইয়া যাক। নানা কোলাহলের মধ্যে গঙ্গানারায়ণ সম্মতি জানাতে বাধ্য হলো। সেই রাতেই প্ৰায় চল্লিশজন লাঠিধারী কৃষকের একটি দল নিয়ে তারা আক্রমণ করলো একটি নীলকুঠী। এবং প্রথমবারেই তাদের জয় হলো অতি সহজে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেই নীলকুঠীতে হয় বন্দুক ছিল না অথবা চালাবার মতন সম্বিৎ কারুর ছিল না। দুজন সাহেবই ছিল অত্যন্ত নেশাগ্ৰস্ত। গঙ্গানারায়ণকে বিশেষ কিছু করতেই হলো না। বন্দুক হাতে নিয়ে সে শুধু গেল আগে আগে, আর হিংস্র উন্মাদনায় ছুটে এলো চাষীরা তার পিছু পিছু। এর আগে কোনো নীলকুঠী আক্রমণ করার মতন সাহস কেউ দেখায়নি, এরা সোজা গিয়ে ভেঙে ফেললো নীলকুঠার দ্বার। একজন সাহেব কোনোক্রমে পলায়ন করলো, অপর সাহেবটিকে ভূপাতিত করে তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়াল তোরাপ। যুবতী বধু দুটিকে পাওয়া গেল অর্ধমৃত অবস্থায়। যে-সব ঘটনায় গঙ্গানারায়ণের কোনো অংশ ছিল না, তারও কৃতিত্ব জমা হচ্ছিল গঙ্গানারায়ণের নামে। এবার তার সত্যিকারের একটি জয়-কাহিনী ছড়িয়ে পড়লো দশগুণ হয়ে। গ্ৰাম্য কবিয়ালরা গান বাঁধলো গঙ্গানারায়ণের নামে : এবার নীলের ক্যাঁতায় আগুন লেগেছে গঙ্গা সিংগী ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ওরে ওরে নীল হনুমান, দাঁড়া দাঁড়া গঙ্গা সিংগী দুয়োরে আছে খাড়া। কর্মযজ্ঞ একবার শুরু হবার পর আর দ্বিধার দোলাচলের সুযোগ রইলো না। গঙ্গানারায়ণ ঘন ঘন বদল করতে লাগলো তার আস্তানা। এবং এক একদিন এক এক গ্রামে সদলবলে ঝটিকার মতন উপস্থিত হয়ে কৃষকদের বিদ্রোহের দীক্ষা দিতে লাগলো। যে দু-চারজন চাষী তাদের জমিতে নীল চাষ করেছিল, সে সব জমি থেকে উপড়ে ফেলা হলো নীল-ফসল। নীলকুঠীর পাইকদের সঙ্গেও সংঘর্ষ হলো কয়েকবার। দিগম্বর বিশ্বাস ঠিকই বলেছিল, তার উপস্থিতিই অলৌকিক শক্তির মতন কাজ করে। যেখানেই সে যায়, সেখানেই জোয়ারের স্রোতের মতন ছুটে আসে চাষীরা, তাদের বিরুদ্ধে নীলকুঠীর পাইকরা কী করবে! একটি ক্ষেত্রে বন্দুকের গুলি চালাতে হয়েছিল গঙ্গানারায়ণকে। বিপরীত দিক থেকে এক সাহেবও গুলি ছুঁড়েছিল। উভয়পক্ষের কেউই হতাহত হয়নি, তবু তাতেও যেন গঙ্গানারায়ণের অলৌকিক শক্তির আরও বেশী করে প্রকাশ হলো। আকাশ ফাটানো চিৎকারে গঙ্গানারায়ণের নামে জয়ধ্বনি তুললো তার অনুগামীরা। প্ৰায় মাসাবাধিকাল গঙ্গানারায়ণের জয়যাত্রা অব্যাহত রইলো। মনে হলো যেন সাহেবরা পশ্চাৎ অপসরণ করেছে অনেক আগেই। কোনো জায়গাতেই গঙ্গানারায়ণের দলকে তেমন বড় বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নীলকর ও পুলিস হাত মিলিয়ে চলে, তেমনও দেখা গেল না। চাষীদের অনেকখানি মনোবল ফিরে এলো। ভিটেমাটি ছেড়ে যারা পলায়ন
false
humayun_ahmed
খাটবে। তাদের বিয়েশাদি হবে তাদের মতোই বান্দি বংশের লোকজনদের সঙ্গে। সহজ হিসাব। তখনকার ব্যবস্থায় রঙিলা বাড়ি এমন কিছু খারাপ জায়গা না। পুরুষ মানুষদের আমোদ-ফুর্তির অধিকার আছে। তারা খাটাখাটনি করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থের খানিকটা যদি নিজের আনন্দের জন্যে ব্যয় করে, তাতে ক্ষতি কী? পুরুষ মানুষ দিনরাত স্ত্রীর আঁচলে বাধা থাকলে ধরতে হবে সে পুরুষ মানুষই না। তার কোনো সমস্যা আছে। ক্ষমতাবান পুরুষদের হতে হবে শৌখিনদার। তারা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করবে। রঙিলা বাড়িতে যাবে। কিছুদিনের জন্যে বাড়িতে ঘাটুগানের ছেলে নিয়ে আসবে। ঘাটুগানের এইসব ছেলে নৃত্যবিদ্যা এবং সঙ্গীতে পারদশী। শৌখিনদার পুরুষের নানান আবদার (!) এরা মিটাবে। এইসব কর্মকাণ্ডে স্ত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার কিছু নাই। ঘাটুছেলেরা তাদের সতিন না। এরা কিছুদিনের জন্যে এসেছে। সতিনের মতো চিরস্থায়ী সত্ত্ব নিয়ে আসে নি। বান্ধবপুর সেই সময় অতি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। রমরমা পাটের ব্যবসা। লবণের ব্যবসা। মাছের ব্যবসা। নতুন লঞ্চঘাট হয়েছে। দিনরাত লঞ্চের ভোঁ শোনা যায়। বরফকল বসেছে। প্যাটরায় বরফ ভর্তি হয়ে দৈত্যকৃতির মাছ চলে যায় নারায়ণগঞ্জ, কোলকাতায়। জলমহাল নিয়ে মারামারি খুনখুনি হয়। সাহেব পুলিশ অফিসার হাতিতে করে তদন্তে আসেন। তদন্ত শেষে পাখি শিকার করেন। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে রঙিলা উৎসব হয়। নর্তকীরা নাচ-গান করে। ঘাটছেলেরা বুকে নারিকেলের মালা বেঁধে ঠোঁটে রঙ দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গিমায় অতি নোংরা গান ধরে। সাহেবরা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলেন, , . এই বিপুল কর্মকাণ্ডে আমাদের জুলেখা অতি নগণ্য একজন। আপাতত তার কথা থাকুক। আমরা চলে যাই হরিচরণের স্কুলে। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা নয়। নয়জনের মধ্যে একজন মাত্র মুসলমান। তার নাম জহির। এই ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হবে। অতিরিক্ত ভালো। স্মরণশক্তি অসাধারণ। একবার কিছু পড়লেই তার মনে থাকে। শশী মাস্টার তার এই ছাত্রটিকে কোনো এক বিচিত্র কারণে সহ্য করতে পারেন না। ব্রিটিশ সরকার সে সময়ে একটি বৃত্তি চালু করেছিলেন। সমগ্ৰ ভারতে ক্লাস টুর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এই বৃত্তি দেয়া হতো। মাসিক দুটাকা হারে এক বৎসরের জন্যে বৃত্তি। সুলেমানের ছেলে জহির এই বৃত্তি পেয়ে সবাইকে চমকে দিল। জেলা শিক্ষা অফিসার আলহাজ রমিজউদ্দিন সাহেব বৃত্তির খবর নিয়ে বান্ধবপুরে উপস্থিত হলেন। জহিরের মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া করলেন। তারপর জহিরকে কাছে টেনে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার মা নাকি তোমাদের সঙ্গে থাকে না। এটা কি সত্য? জহির বলল, সত্য। সে থাকে কোথায়? জহির চুপ করে রইল। জবাব দিল না। কোথায় থাকে জানো না? জহির এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। আলহাজ রমিজউদ্দিন গলা আরো খাদে নামিয়ে বললেন, লোকমুখে শুনলাম তোমার মা রঙিলা নটিবাড়িতে থাকে, এটা কি সত্য? সত্য। ঠিক আছে। ঠিক আছে। যা হয় সবই আল্লাহ পাকের হুকুমেই হয়। উনার হুকুম বিনা কিছু হয় না। তুমি নিজের মতো লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। তোমার মা কোথায় থাকে কী সমাচার তা নিয়া মাথা ঘামাবে না। ঠিক আছে? হুঁ। ছি না, বলো জি আচ্ছা, জনাব। এইসব সাহি আদব। শুধু লেখাপড়া শিখলে হবে না। আদবও শিখতে হবে। বিলো, জি আচ্ছা, জনাব। জি আচ্ছা, জনাব। আলহাজ্বরমিজউদ্দিন জহিরকে একটা ফাউন্টেনপেন উপহার হিসেবে দিয়ে গেলেন। ফাউন্টেনপেনের নাম রাইটার। শশী মাস্টারের কাছে জুলেখার শীতলপাটি পৌঁছেছে। যে নিয়ে এসেছে তার নাম সামছু সদাগর। মিশাখালি বাজারে তার পাটের আড়ত। শশী মাস্টার বললেন, পাটি কে দিয়েছে? সামছু সদাগর বললেন, রঙিলা নটিবাড়ির এক নটি দিয়েছে। রাখলে রাখেন, না রাখলে ফেলে দেন। নটির নাম চান বিবি। চান বিবি নামে কাউকে আমি চিনি না। আপনি মাস্টার মানুষ। আপনার না চেনাই ভালো। তার আরেক নাম জুলেখা। জুলেখা? সামছু সদাগর বললেন, এখন কি চিনেছেন? হ্যাঁ চিনেছি। পরিচয় ছিল আপনার সাথে? ছিল। চাইপা যান। কাউরে কবেন না। মাস্টার সাব, উঠি? শশী মাস্টার সারা দুপুর ঝিম ধরে বসে রইলেন। সন্ধ্যার পর কলের গান ছেড়ে জামগাছের নিচে গভীর রাত পর্যন্ত বসে রইলেন। মাওলানা ইদরিসের কাছে জুলেখার পাঠানো তুর্কি টুপি পৌঁছেছে। সামছু সদাগরই নিয়ে গেছে। মাওলানা বললেন, আপনারে তো চিনলাম না। সামছু সদাগর বললেন, আমারে চেনার প্রয়োজন নাই। আপনার কাছে একটা জিনিস পৌঁছায়ে দেওয়ার কথা। দিলাম। জিনিসটা দিয়েছে কে? চান বিবি দিয়েছে। চান বিবিকে তো চিনি না! সামছু সদাগর উদাস গলায় বললেন, এখন তারে না চেনাই ভালো। সময়ে চেনা সময়ে না-চেনা বুদ্ধিমান মানুষের লক্ষণ। আপনি বুদ্ধিমান। মাওলানা ইদরিস বললেন, একজন এত সুন্দর একটা টুপি পাঠায়েছে, তারে চিনিব না- এটা কেমন কথা? সামছু বলল, চিনতে হইলে রঙিলা নটি বাড়িতে যান। ঐ মেয়ে রঙিলা বাড়ির নটি। মাওলানা হতভম্ব গলায় বললেন, এইটা কী কথা? সত্য কথা। নটি বেটি আপনারে টুপি পাঠায়েছে। বড়ই সৌন্দর্য মেয়ে। বেহেশতের হুর বরাবর সুন্দর। তার টুপি আপনি মাথায় দিয়ে জুম্মার নামাজ। না গাঙের পানিতে ফেলবেন— এটা আপনার বিবেচনা। আমি উঠলাম। তুর্কি ফেজ টুপিটা টিনের ট্রাঙ্কের উপর রাখা। টুপিটা কোথেকে এসেছে মাওলানা এখন বুঝতে পারছেন। এই টুপি মাথায় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। গাঙের পানিতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। টুপির মতো পবিত্র একটি বস্তু পানিতে ফেলে দেওয়া কি ঠিক? এই বিষয়ে হাদিস কোরানের পরিষ্কার ব্যাখ্যা কী তাও তিনি জানেন না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন তাও সম্ভব হচ্ছে না। হাদিস কোরান জানা লোক আশেপাশে কেউ নেই। তাঁর খুবই ইচ্ছা দেওবন্দ মাদ্রাসায় যাওয়া। তার মনে
false
humayun_ahmed
তুলে রেখে বাড়ি চলে যায়। খাবার দিয়ে গেছে রিমি? হ্যাঁ। অনি খেয়েছে? হ্যাঁ। তুমি বোধ হয় খাও নি। মোমবাতি তো শেষ হয়ে এল। আরো আছে, না এটাই সর্বশেষ? আর একটা আছে। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস। খেতে বসে যাই। সব বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তৌহিদ মনে-মনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে রিমি তেমন রাগ করে নি। অবশ্যি মুখের ভঙ্গি এখনো খানিকটা কঠিন। আরো আগেই আসতাম। রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। টর্চ তো কিনেছ দেখি। টর্চের আলোয় কিছু বোঝা যায় না। ছোট্ট একটা জায়গায় আলো পড়ে। আজ কী খাবার দিয়েছে? মুরগির গোশত আর রূপচান্দা মাছ। ভাজি আছে, ডাল আছে। অনেক খাবার। খাবার ঠাণ্ডা হলেও তৌহিদ প্রচুর খেয়ে ফেলল। পয়সায় কেনা খাবার নষ্ট করা ঠিক না এই বলে প্লেটে খাবার তুলতে লাগল। রান্নাটাও ভালো হয়েছে, তাই না রিমি? হ্যাঁ। ঝাল অবশ্যি বেশি দিয়েছে। ঝালটা মাকের জন্যে খারাপ তবে হার্টের জন্যে ভালো। বিশেষ করে কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ হ্ৰষসিসের জন্যে একটা চমৎকার মেডিসিন। তুমি যদি ডেইলি একটা করে কাঁচামরিচ খাও; তোমার কোনদিন থ্রম্বসিস হবে না। রিমি বলল, তুমি দেরি করে আসায় আমি রাগ করি নি। কাজেই আমাকে খুশি করার জন্যে শুধু-শুধু কথা বলতে হবে না। তৌহিদের অস্বস্তির সীমা রইল না। তার অকারণে কথা বলার রহস্য রিমি ঠিকই ধরেছে। আজ আর কার্পেট বিছানো হল না। ঠাণ্ডা পড়েছে। কম্বল গায়ে দিতে হবে। খাটেই বিছানা তৈরি হল। তৌহিদ বলল, তুমি বরং অনির সঙ্গে শোও। ও একা আছে। বিদ্যুৎ চমকালে ভয়-টয় পাবে। ভয় পাবে না। মোমবাতি নিভিয়ে রিমি ঘুমুতে এল। তৌহিদ বলল, তুমি কি জরুরি কিছু আমাকে বলবে? হ্যাঁ। কী করে বুঝলে? তুমি যেমন আমার মনের কথাটা ধরে ফেল, আমিও তোমারটা ধরতে পারি। সব সময় পারি না। মাঝে-মাঝে পারি। কী বলবে? খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রিমি বলল, তুমি কি আমাকে ভালবাস? অবশ্যিই বাসি। না বাস না। আমাকে তুমি ভয় পাও। ভালবাস না। যাকে ভয় পাওয়া যায় তাকে বুঝি ভালবাসা যায় না? হয়ত যায়; তবে আমার জন্যে তোমার মনে কোনো ভালবাসা নেই। এমন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কখন করলে? আজ? আবিষ্কার অনেক আগেই করেছি, আজ শুধু বললাম। কী দেখে তুমি এমন সিদ্ধান্তে চলে এলে, সেটা আমাকে বল। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখি নি বা রং-তুলি দিয়ে তোমার ছবি আঁকার চেষ্টা করি নি। তার কারণ তোমার প্রতি আমার ভালবাসা নেই তা কিন্তু না, তার কারণ আমি কবিতা লিখতে পারি না। ছবিও আঁকতে জানি না। রিমি হালকা গলায় বলল, আবিষ্কার কখন করলাম জান? কখন? ফরহাদ ভাইয়ের ব্যাপারটা জানার পরও তুমি যখন চুপ করে রইলে, কোনোরকম কৌতূহল দেখালে না তখন বুঝলাম আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি অতীতে কী করেছি না করেছি তাতে তোমার কিছুই যায়-আসে না। তৌহিদ শান্ত গলায় বলল, ব্যাপারটা সেরকম নয় রিমি। তখন তোমার বয়স ছিল নিতান্তই অল্প। অল্প বয়সে একটা ভুল করেছ… ভুল করেছি বলছ কেন? এমনও তো হতে পারে ঐ দিন যা করেছিলাম ঠিকই করেছিলাম। বল, হতে পারে না? হ্যাঁ পারে। হতে পারে। ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারত, পারত না? না? হ্যাঁ পারত। আজ আমার যে সংসার আছেতাঁকে নিয়েও এম্নি একটা সংসার নিশ্চয়ই হতে পারত। আজ যেমন তোমাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে এসেছি, তখন তাঁকে নিয়ে আসতাম। তুমি আমার হাত ধরে আমাকে সমুদ্রমানে নিয়ে যাও নি। তিনি হয়ত যেতেন। কাজেই তাঁর সাথে পালিয়ে গিয়ে ভুল করেছি আর তোমাকে বিয়ে করে শুদ্ধ কাজটা করা হয়েছে এটা বলছ কেন? তৌহিদ কিছু বলল না। রিমি যে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা সে জানে। বিশেষ করে সে যখন রেগে যায় তখন খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলে। এমনভাবে কথা বলে যে প্রতিটি বাক্য বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। তৌহিদ ঠিক করল সে একটি কথাও বলবে না। চুপ করে থাকবে। কথার পিঠে কথা না বললেই উৎসাহ হারিয়ে রিমি চুপ করে যাবে। রিমি চুপ করল না। সে কথা বলে যেতে থাকল আপন মনে। কাউকে শোনাবার জন্যে নয়, যেন সে নিজেকেই শোনাতে চায়। রিমির গলার স্বর নিচু কিন্তু সে প্রতিটি বাক্য খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছে। রিমি বলছে, তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার আগে একজন ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ঐ ডাক্তার এফআরসিএস করতে বিলেত যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হলে আমিও বিলেত যেতাম, আমার অন্য একটা জীবন। হত। সেই জীবনটাও নিশ্চয়ই ভুল হত না? এই আলোচনা থাক। না থাকবে কেন? আমার অনেক কথা বলার আছে; আমি সেগুলি তোমাকে বলতে চাই। একজন আমি মেজরের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রমোশন পেয়ে এতদিনে নিশ্চয়ই ব্রিগেডিয়ার-ফ্রিগেডিয়ার হয়েছেন। আর তুমি এগার বছর মাস্টারি করার পর এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার হয়েছে। তাও এ্যাকটিং পোষ্টে। আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এই কারণে তুমি কি মনে-মনে কষ্ট পাও? হ্যাঁ পাই। আমি কখন স্কুল মাস্টার বিয়ে করতে চাই নি। কী আর করবে বল, তোমার দুর্ভাগ্য। দুর্ভাগ্য তো বটেই। উঠে যাচ্ছ কোথায়? একটা সিগারেট খাব। কেন, মাথা জাম হয়ে গেছে? তৌহিদ উত্তর দিল না। বিছানা থেকে নেমে সিগারেট ধরাল। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সমুদ্র
false
shunil_gongopaddhay
এক-এক করে সব আসতে লাগল। এরা বিপ্লবী হলেও দিনের বেলায় নিশ্চয়ই অন্য কাজ করে। অন্ধকার হয়ে আসার পর কয়েকটা মশাল জ্বালা হল চত্বরে। কাকাবাবু বাইরেই চেয়ার পেতে বসে ছিলেন, এক সময় সেখানে হাতে একটা মশাল নিয়ে উপস্থিত হল হানি আলকাদি। আজ তাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। জলপাই-সবুজ রঙের পোশাক পরা, মাথার চুলে একটা রিবন বাঁধা। চোখ দুটো একেবারে ঝকঝকি করছে। হাসিমুখে সে বলল, হ্যালো, প্রফেসার! হাউ আর ইউ দিস ইভনিং? কাকাবাবুও হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা অনেকেই আমাকে প্রফেসার বলো কেন? আমি তো কখনও কোনও কলেজে পড়ইনি! হানি আলকাদি বলল, ওঃ হে! আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের এখানে অনেক কলেজেই আগে ইন্ডিয়ান প্রফেসাররা পড়াতেন। সেইজন্য কোনও ডিগনিফাইড চেহারার ইন্ডিয়ান দেখলেই আমাদের প্রফেসার মনে হয়। যাই হোক, তুমি এক-একা বিরক্ত হয়ে যাওনি তো? বাইরে বসে আকাশের রং-ফেরা দেখছিলে? সূর্যাস্তের সময় এখানকার আকাশ সত্যি বড় অপূর্ব দেখায়। দুপুরে একবার ঝড় উঠেছিল, তারপর আকাশ আবার ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল! মিঃ রায়চৌধুরী, একটা কথা বলতে পারেন? পৃথিবীর থেকে আকাশের রং আমার বেশি সুন্দর লাগে। আকাশে নীল, সাদা, লাল, সোনালি, রুপোলি, কালো সব রং-ই দেখা যায়। কিন্তু সবুজ রং কখনও দেখা যায় না কেন? আমি প্রায়ই এ কথাটা ভাবি। কাকাবাবু জোরে হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, তোমাকে দেখার আগে তোমার সম্পর্কে কত কথাই শুনেছিলাম। তুমি নাকি সাঙ্ঘাতিক এক বিপ্লবী, ভয়ংকর নিষ্ঠুর। এখন তো দেখছি তুমি একটি স্বপ্ন-দেখা নরম স্বভাবের যুবক। হানি আলকাদি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, যারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে জানে না, তারা কী করে বিপ্লবী হবে? তারপর হাতঘড়ি দেখে বলল, ইয়োর নেফিউ গুড বি হিয়ার এনি মিনিট। তুমি কি আজ রাত্তিরেই বেরিয়ে পড়তে চাও? কাকাবাবু বললেন, যতটা এগিয়ে থাকা যায়, ততটাই ভাল। কাল ভোর থেকে কাজ শুরু করা যেতে পারে। মশালটা বালিতে গেথে হানি আলকাদি, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, মুফতি মহম্মদ ছবির উইলে কী লিখে গেছেন, তা জানার জন্য আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। তুমি তা বলবে না, না? কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আর একটু ধৈর্য ধরো। এই সময় গাড়ির শব্দ হতেই দুজনে উৎকৰ্ণ হয়ে উঠল। গাড়িটা থামতেই ডাগো আবদাল্লা ছুটে এল ওদের দিকে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। অতবড় চেহারার একটি লোককে শিশুর মতন কাঁদতে দেখে কাকাবাবু প্রথমে অবাক হলেও সঙ্গে-সঙ্গে বুঝে গেলেন কী ঘটেছে। হানি আলকাদি প্ৰায় লাফিয়ে উঠে তীব্র গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? ছেলেটাকে আনিসনি? ডাগো আবদাল্লা বলল, আমাকে যা খুশি শাস্তি দাও, এফেন্দি! আমার চোখের সামনে থেকে ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে গেল। আমি কিছুই করতে পারিনি। ওদের চারটে রাইফেল ছিল। হানি আলকাদি চিৎকার করে বলল, বেওকুফ, আগে বল, কারা নিয়ে গেছে! তুই তাদের চিনেছিস? কাদের এত সাহস যে, আমার লোকের ওপর হাত দেয়? ডাগো আবদাল্লা বলল, হ্যাঁ চিনি, এফেন্দি। ওরাও আমাকে চিনেছে। আমার নাম ধরে ডাকল। ওরা আল মামুনের লোক। হানি আলকাদির সুন্দর মুখখানা এবারে রাগে একেবারে হিংস্র হয়ে উঠল। সে ডাগো আবদাল্লার চুলের মুঠি ধরে বলল, সেই কুকুরটা তোর সামনে থেকে ছেলেটাকে নিয়ে গেল, তুই বেঁচে ফিরে এলি? ওদের একটাকেও তুই খতম করেছিস? আল মামুন! আজি আমি ওকে শেষ করে দেব। নিজের হাতে ওকে একটু-একটু করে কাটব। ডাগোকে ছেড়ে দিয়ে হানি আলকাদি হাততালি দিয়ে নিজের লোকদের ডাকতে লাগল। ডাগো বলল, একটা চিঠি দিয়েছে। বলেছে, বারো ঘণ্টার মধ্যে উত্তর চাই। কাকাবাবু আরবি ভাষা মোটামুটি জানেন। ওদের কথাবার্তা প্ৰায় সবটাই বুঝতে পারছিলেন। এবারে হাত বাড়িয়ে বললেন, দেখি চিঠিটা। চিঠিখানা কাকাবাবুকে উদ্দেশ করে লেখা নয়। লিখেছে। হানি আলকাদিকে। চিঠিটা এই রকম : আল মামুন নিজে হানি আলকাদির মতন একজন নগণ্য, নিবেধি লোককে চিঠি লেখার যোগ্য মনে করে না। আল মামুন তার দলের একজন লোক মারফত জানাচ্ছে যে, মিঃ রাজা রায়চৌধুরীকে বন্দী করে রাখার কোনও অধিকার হানি আলকাদির নেই। মিঃ রাজা রায়চৌধুরী আল মামুনের লোক। আল মামুনের কাছেই তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হবে। মুফতি মহম্মদের উত্তরাধিকারী আল মামুন, তার কথা সবাই মান্য করবে। যে আল মামুনের অবাধ্য হবে, সে শান্তি পাবে। হানি আলকাদি যদি ১২ ঘণ্টার মধ্যে আল মামুনের আদেশ না পালন করে, তা হলে সে কঠিন শাস্তি পাবে। মিঃ রাজা রায়চৌধুরীকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ১২ ঘণ্টা পার হলে তাঁর ভাইপো খুন হবে, তার মৃতদেহ কেউ খুঁজে পাবে না। নিবেধি হানি আলকাদি যেন আরও বেশি নিবোঁধের মতন কাজ না করে। চিঠিটা পড়ার সময় কাকাবাবু কোনও উত্তেজনার চিন্তু দেখালেন না। শান্তভাবে চিঠিটা এগিয়ে দিলেন হানি আলকাদির দিকে। হানি আলকাদি চিঠিটা পড়তে পড়তে যেন লাফাতে লাগল। পড়া হয়ে গেলে কাগজটা গোল্লা পাকিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার ওপরে লাথি কষাল কয়েকটা। সেই সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগল, একটা আলুর বস্তার ইদুর! বাঁধা কপির পোকা! নর্দমার আরশোলা ঐ আল মামুনটাকে আমি টিপে মেরে ফেলব! আজ রাতে আমার ফোর্স নিয়ে গিয়ে ঐ বাঁদরের গায়ের উকুনটাকে আমি সবংশে শেষ করব। কাকাবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, হানি আলকাদি, এখন চ্যাঁচামেচি করার সময় নয়, আমি তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই! হানি আলকাদি এগিয়ে আসতে-আসতে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, রায়চৌধুরী, হানি আলকাদি যখন রেগে গেছে, তখন আল
false
shunil_gongopaddhay
সঙ্গে কিছু এনেছিল কি না ভরত লক্ষ করেনি, ঘরের মধ্যে শুধু পড়ে আছে তার কপালের ব্যান্ডেজ বাঁধা ন্যাকড়ার। তাতে লেগে আছে রক্ত। ভরতের কাছে আসবার জন্য ভূমিসূতা বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছিল, সেই ভূমিসূতাকে গ্রহণ করার অধিকার নেই ভরতের। ভূমিসূতা ঠিক মতন পৌঁছেছে কিনা তা একবার খোঁজ নিয়ে দেখতেই হবে। একটু আগে যদি বেরিয়ে থাকে তাহলে এখনও রাস্তায় তাকে পাওয়া যেতে পারে। শশিভূষণের কাছে ঠিক মতন ভূমিসূতাকে সমৰ্পণ করায় দায়িত্ব ভরতের। সে আবার ছুটে বেরিয়ে এল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিম ডাল দিয়ে দাঁতন করছে বাণীবিনোদ। সে ভরতকে দেখে এক গাল হাসল। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নেই। এত সকালে গাড়ি ঘোড়া পাওয়া যায় না। ভাড়ার গাড়িগুলো বেরোয় একটু দেরিতে। সার্কুলার রোড দিয়ে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িও চলে না। অগত্যা দৌড়োতেই হল ভরতকে। পথের দু’দিকে অনবরত মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে সে মনে মনে বলতে লাগল, ভূমি, তুমি সুখী হবে। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে একবার বিয়ে হয়ে গেলে, তোমার নিজস্ব সংসার হলে তুমি বুঝতে পারবে, এইটাই ঠিক। ভরত কেউ না, সে তোমাকে কিছুই দিতে পারত না। ক্রীতদাসী ছিলে, তুমি হবে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ঘরণী। রাজবাড়ির সামনে এসে ভরত থমকে দাঁড়াল। এই প্রাসাদ তার কাছে সিংহের গুহা। মহারাজ হয়তো এখনও জাগেননি, কিন্তু ত্রিপুরার অন্য কোনও কর্মচারি তাকে দেখতে পেলেই মহারাজের কাছে খবর চলে যাবে। মৃত ভরত হয়ে উঠবে জীবন্ত, নতুন করে তার মাথার ওপর ঝুলবো দণ্ডাজ্ঞা। এখন এসব চিন্তা করার সময় নেই। গেটের দারোয়ান একজন ফেরিওয়ালাকে ঢুকতে দিচ্ছে, সেই ফাঁক দিয়ে ভরতও ছুটে গেল। বাণীবিনোদের কাছে শুনে শুনে এ বাড়ির অনেক তার জানা। দোতলায় সে চলে এল শশিভূষণের মহলে। শশিভূষণ জেগে উঠেছেন, একটা আরাম কেদারায় তিনি বসে আছেন জানলার দিকে চেয়ে। ভরত সোজা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের ওপর। পাগলের মতন শশিভূষণের ফর্সা পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে সে বলতে লাগল, স্যার, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি তাকে চাইনি, ফিরিয়ে দিয়েছি, সে-ও আপনাকেই চায়, আমি কেউ না, আমি কেউ না, সে আপনাকে… শশিভূষণ কঠোর ভাবে বললেন, ফের নষ্টামি করতে এসেছিস, বলেছি না, আমি তোদের দুজনেরই আর মুখ দেখতে চাই না! ভরত বলল, আমি তাকে ছুঁইনি, আমি কাল রাত্তিরে বাড়িতে থাকিনি। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন, আমি মরে যাব। এক্ষুনি মরে যাব। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। শশিভূষণ বললেন, কোথায় ফিরিয়ে দিয়েছিস? ভরত বলল, এখানে। সে এখানে আসেনি? শশিভূষণ বললেন, এখানে সে আসবে কেন? আমি তো তাকে আর চাই না। না, না, চাই না! ভরত মুখ তুলে উদভান্তের মতন বলল, এখানে সে আসেনি? আমার বাড়িতে সে নেই। রাস্তাতেও দেখিনি। সে কোথায়, সে, কোথায়? আগের রাতে শশিভূষণ ভরতকে আঘাত করতে গিয়েও সামলে নিয়েছিলেন, আজ আর পারলেন না। ভরতের চুলের মুঠি ধরে রক্তচক্ষে বললেন, আমি তাকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম, তুই তার মন বিষিয়ে দিয়েছিস, তুই নিজে তাকে লোভ করেছিলি। বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা! রাখতে পারলি না। তাকে হারালি, হারামজাদা, তুই দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে! তিনি সবেগে ভরতকে ঠেলে ফেলে দিলেন মাটিতে। শশিভূষণ ভবানীপুরের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর আনালেন, ভূমিসূতা সেখানেও যায়নি। এই রাজবাড়িতে তার জিনিসপত্র পড়ে আছে, এখানেও সে ফিরে এল না। সে কোথাও নেই। ভরত নিজের বাড়ি ফিরল না। শহরের সমস্ত পথ চষে বেড়াল সারা সকাল-দুপুর। গঙ্গার ধারের সবকটি ঘাট খুঁজে দেখল। ভূমিসূতা অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিকেলবেলায় অভুক্ত, শ্ৰান্ত শরীরে ভরত শুয়ে পড়ল গঙ্গার তীরে এক গাছতলায়। একটু পরে তার ঘুম এসে গেল। গত রাত্রে সে এক পলকের জন্য চক্ষু বোজেনি, আজ সে এখানেই ঘুমোবে সারা রাত। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, বৃষ্টি নামবে খানিক বাদেই। তা নামুক, যে আকাশে ঈশ্বর থাকেন, সেদিকে ভরত আজ চোখ তুলে চায়নি একবারও। ভরত ঘুমিয়েই রইল। গঙ্গাবক্ষে ভোঁ বাজিয়ে যাতায়াত করছে কত কলের জাহাজ, দেশ বিদেশ থেকে কত যাত্রী এসে নামছে। এই রাজধানী শহর সদাব্যস্ত, রাজা কিংবা নফর, হঠাৎ ধনী কিংবা কাঙালি সবাই ছোটাছুটি করছে নানান উদ্দেশ্য নিয়ে। নদীর ধারের রাস্তা দিয়েও অনেকে মেটেবুরুজ বা খিদিরপুর যায়। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দেও ঘুম ভাঙাল না ভরতের। সন্ধের একটু আগে ইডেন বাগানে গোরাদের ব্যান্ড বেজে উঠল, তা শুনবার জন্যও ভিড় করে দাঁড়াল অনেকে। বাজনাদারদের মুখগুলি গৰ্বমণ্ডিত। যেন তারা স্বর্গ থেকে নেমে এসে এই কালোকোলো ভারতীয়দের অভিনব বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনাচ্ছে। উত্তম সাজে সজ্জিত হয়ে বেশ কিছু সাহেব মেম ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক যুবতী সান্ধ্য ভ্রমণে এল স্ট্যান্ডে, কত বিচিত্র তাদের পোশাক। তারা কলহাস্যে মুখরিত করে দিল বাতাস। ঘাটে ধপধপে সাদা রং করা অনেকগুলি মাঝারি মাপের বজরা নোঙর করা আছে। এগুলি কিছু কিছু ইংরেজ রাজপুরুষের নিজস্ব। এক এক করে সেই সব বজরা ভাসল। পথচারীরা কেউ কেউ এক পলক এই শায়িত মানুষটির দৃষ্টিপাত করেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। পোশাক ও মুখশ্ৰী ভদ্রোচিত, তবু সে এমন অসময়ে কেন গাছতলায় শুয়ে আছে, তা নিয়ে কৌতূহল দেখায় না কেউ। শহরের মানুষ বড়ই নির্দয়। সারাদিন এক দানাও খাদ্য মুখে তোলেনি, তবু এ কী কঠিন ঘুম ভরতের। যেন মরণ ঘুম। তার ব্যর্থতা, তার অপরাধবোধ ও গ্লানি ঘুমের মধ্যে গেছে, স্বপ্নে সে আর ভূমিসূতাকে তল্লাশ করছে না। এক পাশ ফিরে সে শুয়ে আছে, তার মুখে ক্লিষ্ট রেখা
false
toslima_nasrin
ছুঁড়ে দেওয়া বল লাফিয়ে মুখে নিতে পারে না। পপি একখানা শাদামাটা চোর তাড়ানো কুকুর হয়ে ওঠে। মা শাদামাটা কুকুরকে আদরযত্ন করেন, রেনুকেও করেন। রেনু মা’র গা টিপে দেয় রাতে। বিলি কেটে দেয় চুলে। মা তাকে আরবি অক্ষর শেখানো শেষ করে বাংলা অক্ষর শেখাতে শুরু করেন। তবু রেনু বিনিয়ে বিনিয়ে ফাঁক পেলেই কাঁদে, তার মা’র জন্য পরান পোড়ে। এত করলাম তারপরও কান্দস, মা বলেন, বান্দির জাত বান্দিই থাকবি। বাড়ি বাড়ি বান্দিগিরি কইরাই তর খাইতে অইব। বাবা রেনুর ঘাড় ত্যাড়ামির খবর শুনে তার মা’কে খুঁজে পেতে নিয়ে আসেন বাড়িতে। মা’কে বলেন–রেনুর মায়েরেও রাখো। মায়ে ভারি কাম করব, আর ছেড়ি করবে ফুটফইরমাশ। রেনুর মা’র জন্য পরদিন বাবা একটা ছাপা সুতি শাড়ি কিনে আনেন। মা শাড়িটির বুনট দু’আঙুলে পরখ করে বলেন কাপড়ডার বাইন বড় ভালা। দামি কাপড়। এরম কাপড় আমিও বছরে দুইডা পাই না। কাজে লাগা অবদি রেনুর মা’কে উঠতে বসতে ধমকান মা। বাবা বাড়ি ফিরলে বলেন — এই বেডির স্বভাব চরিত্র ভালা না। –ক্যান কি করছে? বাবার চোখে কৌতূহল। –বাজার লইয়া দোহানের কর্মচারি আইছিল দুপুরে, দেহি ফিসফিস কইরা কথা কয় হের সাথে। মা বলেন–একখান ব্লাউজ দিছি পিনতে। পিন্দোনা। ব্যাডাইনের সামনে বুক দেহাইয়া হাডে। বাবা চুপ করে থাকেন। বাবার চুপ হয়ে থাকা দেখলে মা’র গা জ্বলে। মাস পার হয় রেনু আর তার মা’কে দিয়েই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মা আবার অসময়ে বাড়ি ফিরতে থাকেন, জায়নামাজে বসে জিকির করতে থাকেন আল্লাহর। সংসারে এই আছেন তিনি, এই নেই। রেনুর মা’র হাতে অলক্ষে চলে যায় গোটা সংসারের ভার। তেল লাগবে কি নুন লাগবে, কালিজিরা কি এলাচি, রেনুর মা’র কাছেই জিজ্ঞেস করেন বাবা। অবসরে সে চুল বাঁধে, গুনগুনিয়ে গান করে। মা’র দেখে এত রাগ হয় যে বলেন–গান কইর না রেনুর মা। কামের মানুষ কাম করবা। মুখ বুইজা করবা। রেনুর মা গুনগুন থামায়। সে সময়ই এক রাতে, যে রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে শরৎচন্দোর দেবদাস পড়ে কেঁদে কেটে বালিশ ভিজিয়ে তোষকের তলায় নিরাপদে বইটি রেখে সবে ঘুমিয়েছি, ভীষণ শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠি। শব্দটি ঠিক কিসের প্রথম অনুমান হয় না। কান পেতে থেকে বুঝি মা’র চিৎকার, সেই সঙ্গে দরজায় শব্দ, ধুড়ুম ধুড়ুম। কোনও বন্ধ দরজা ঠেলছে কেউ। জোরে। ভাঙতে চাইছে। বাড়িতে কি ডাকাত এল! আমার হাত পা অবশ হতে শুরু করে, গা ঘামতে। শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে থাকি আশংকায়। চোখ বুজে, যেন অঘোরে ঘুমোচ্ছি, যেন গলায় কোপ বসাতে মায়া হয় চোর ডাকাতের। কেউ দৌড়োচ্ছে বারান্দায়। আরও একজন কেউ। তীব্র চিৎকার বারান্দার দিকে আসছে। কেউ একজন গলা চেপে কথা বলছে, কাকে, কি, বোঝার সাধ্য নেই। ঘুম আমার যেমন ভাঙে, ইয়াসমিনেরও। ও ফিসফিস করে বলে–কী হইছে বুবু? — জানি না। অষ্ফুট স্বরে বলি। বুকের ভেতর ধুমধুম করে হাতুড়ি পড়ে আমার। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বারান্দার দাপাদাপি কমে এলে দাদাকে, ছোটদাকে ঘুম থেকে তুলে যে খবরটি দেন মা, তা চোর ডাকাতের নয়। বাবার। বাবা ধরা পড়েছেন রাত আড়াইটায় রান্নাঘরে রেনুর মা’র বিছানায়। মা’র পাতলা ঘুম, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঘরগুলোয় হেঁটে হেঁটে পরখ করছিলেন দরজা জানালা সব বন্ধ আছে কি না, চোরের উপদ্রব যেহেতু, তাই করেন উঠে। বাবার ঘরের দরজাখানা বারান্দায় যাওয়ার, দেখলেন মা, সিটকিনি খোলা। মশারি তুলে দেখলেন বাবা নেই বিছানায়। পেশাবখানায় খুঁজলেন, বাবা নেই। বারান্দায়, নেই। রান্নাঘরের ভেতর থেকে শব্দ আসছে কিছুর। কান পেতে শুনলেন ভেতরে বাবার গলা আর চৌকির, রেনুর মা যে চৌকিতে বিছানা পাতছে গত সাতদিন ধরে, মটমট আওয়াজ। এত রাতে বাবা শুতে গেছেন রান্নাঘরে রেনুর মা’র সঙ্গে! আমি মশারির চাঁদির দিকে চেয়ে থাকি নিস্প্রাণ। আমার পাশে ইয়াসমিন শুয়ে থাকে বড় বড় চোখ মেলে, নিশব্দে। দুনিয়াদারি ছেড়ে দেওয়া মা বিনিয়ে বিনিয়ে সারারাত কাঁদেন। মা’র কান্নার সঙ্গে জেগে থাকে আমার, ছোটদার, দাদার আর ইয়াসমিনের দীর্ঘনিঃশ্বাস। পীরবাড়িতে ঢুকলে আমার গা ছমছম করে। এ বাড়ির সবগুলো গাছই, আমার আশংকা হয়, জ্বিন ভূত পেত্নীর বাসা। কখন কোন গাছের তল দিয়ে যাওয়ার সময় জ্বিন লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে কে জানে, মা’র আঙুল শক্ত করে ধরে পীরের ঘরের দিকে হাঁটি। আসলে আমি হাঁটি না, মা হাঁটেন, আমাকে হাঁটতে হয়। মা মুরিদ হয়েছেন পীরের। শাড়ি ছেড়ে জামা পাজামা ধরেছেন। মা’কে মা বলে মনে হয় না। পীরের ঘরে বসে আছেন ছ’সাতটি মেয়ে, পরনে ওদের পায়ের পাতা অবদি ঝুলে থাকা লম্বা জামা, মাথায় ওড়না। জামাগুলো শরীরের সঙ্গে এমন মিশে থাকে যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় উদোম গায়ে বুঝি ওরা। একজনের পরনে কেবল শাড়ি। গলায় তাবিজ ঝুলছে চারটে। মাথায় ঘোমটা টানা। খুব বিমর্ষ মুখ তাঁর। পীরের পায়ের ওপর দু’হাত রেখে তিনি বলেন — পুলা না হইলে স্বামী আমারে তালাক দিব হুজুর। খুব ধীরে কথা বলেন পীর আমিরুল্লাহ, কথা যখন বলেন পাঁচ আঙুলে দাড়ি আঁচড়ান। ছাদের কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে, চোখে অপার মায়া, বলেন– আল্লাহর নাম লও, আল্লাহ ছাড়া দেওয়ার মালিক কেউ নেই, আমি তো উছিলা মাত্র। মাঝরাতে জিকির করবে। তিনি পরওয়ার দেগার, দো জাহানের মালিক, তার কাছে কাঁদো আলেয়া। না কাঁদলে তার মন নরম হবে কেন, বল! বান্দা যদি হাত পাতে, সেই হাত আল্লাহ ফেরান না। তার অসীম দয়া। আলেয়া
false
shomresh
গিয়েছে। আর একজন বেঁচে থেকেও অকেজো। এই অবস্থায় আর একটা দুর্ঘটনা ঘটাবার কোন মানে হয় না। তাছাড়া আমরা তো জলে পড়ে নেই। আনন্দ খুব একটা ভুল বলছে না। কিন্তু জয়িতার মনে হল এরকম কথা সেই সব মানুষেরাই বলে থাকে যারা উদ্যম হারিয়ে ফেলে। সে বলল, কিন্তু এইভাবে আটকে থেকে আমরা কি করতে পারি। পুলিশ গ্রামে এসে আমাদের কথা জানতেই পারবে। বলা যায় না, হয়তো এর জন্যে আমাদের কাছাকাছি মানুষদের ওপর ওরা অত্যাচার করতে পারে। আমার মনে হয় যতদূর সম্ভব নেমে গিয়ে একটু হদিশ নেওয়া যাক। বিপদ বুঝলে ফিরে আসব। আনন্দ এবার দোনমনা করল, এত বরফের মধ্যে সুদীপকে নিয়ে নামা যাবে? সুদীপ ওই মেয়েটার সঙ্গে এখানেই থাক। যদি ফিরে আসি তত ভাল, নইলে লা-ছিরিঙ নিশ্চয়ই ওকে নামিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। মেয়েটি তো ওকে যত্ন করছে বেশ। আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। গতরাত্রে মেয়েটির ব্যবহার তারও চোখে পড়েছে। সুদীপের যা অবস্থা তাতে মেয়েটির এই ব্যবহার তার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হল জয়িতা বোধ হয় ব্যাপারটা ঠিক সহ্য করতে পারছে না। ও বুঝতে পারছিল না মেয়েরা কেন এত অসহনীয় হয়ে ওঠে একটি পুরুষকে ঘিরে? বিশেষ করে যার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক নেই এমন পুরুষের সঙ্গে কোন মেয়ে ঘনিষ্ঠ হলেও সেই দৃশ্যের কাছাকাছি থাকাটা তাদের কাছে কেন অস্বস্তির হয়? শেষবার সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু আমরা চলে গেলে ভালুকটালুকও তো আসতে পারে। গুহাটার কথা নিশ্চয়ই পাহাড়ি জন্তুদের জানার কথা। এইটে মাথায় আসেনি। জয়িতা এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর সোজা গুহায় ফিরে গেল। সুদীপ বসে আছে। আর মেয়েটি গুনগুন করে গান শোনাচ্ছে। জয়িতাকে দেখে মেয়েটি থেমে গেল। সে সরাসরি সুদীপের দিকে চলে এল, কেমন আছিস সুদীপ? সুদীপের চোখের পাতা পড়ল। জয়িতার মনে হল ওর মাথায় একটা কিছু এসেছে নইলে মুখ অমন উজ্জ্বল হত না। ঠোঁট ফাঁক হল সুদীপের। তারপর অনেক কষ্টে কিছু বলল। কিন্তু সেই শব্দগুলো বোধগম্য হল না জয়িতার। সে মেয়েটির দিকে ফিরল, আমরা একবার গ্রামের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যদি পোঁছতে না পারি, তাহলে ফিরে আসব। পারলে ওরা আসবে তোমাদের নিয়ে যেতে। ঠিক আছে? মেয়েটি মাথা নাড়ল। কতটা সে বুঝতে পারল তা অনুমানে এল না। জয়িতা শেষ প্রশ্নটা উচ্চারণ করল, কিন্তু কোন জন্তু-জানোয়ার এলে কি করবে তোমরা? মেয়েটি এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর উঠে সুদীপের বিছানার নিচু থেকে একটা লাঠি বের করে সামনে রাখল। জয়িতা বুঝল কিছু করার নেই। ওর হাতে রিভলবার দিয়ে যাওয়া যায় না। এই তুষারঝড়ের পর কোন পাহাড়ি জন্তুর আবির্ভাব হবে বলে মনে হয় না, হলে ওই লাঠি যে কোন কাজেই লাগবে না তা এই মেয়েটি কি জানে না! জয়িতা আবার বাইরে বেরিয়ে এল। আনন্দর সঙ্গে ভালুকছানা দুটো এবার খেলা করছে। ব্যাপারটা চোখে পড়ামাত্র চিড়বিড়িয়ে উঠল মন, এটা কি খেলার সময়? ওকে দেখতে পেয়ে আনন্দ চিৎকার করল, কি ঠিক করলি? আমি একাই যাব। জয়িতা শক্ত গলায় বলল। আর ইউ ম্যাড? আনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ল। জয়িতা মাথা নাড়ল, ভেবেচিন্তেই বলছি। লা-ছিরিঙ আর পালদেমকে আমাদের সাহায্য করার জন্য পুলিশ আরেস্ট করতে পারে, সে ক্ষেত্রে কে খবর দেবে আমাদের? কোন পুলিশ? ইন্ডিয়ান পুলিশ ওদের আরেস্ট করতে পারে না। এই নির্জন পাহাড়ে আইন কতটা সক্রিয় আমার সন্দেহ আছে। নেপালী পুলিশ সঙ্গে থাকতে পারে। আনন্দ এক মুহূর্ত কিছু ভাবল। তারপর নিচু গলায় বলল, ঠিক আছে, যা। আমি সুদীপকে এইভাবে ছেড়ে যেতে পারছি না। বেশ সাহস নিয়ে নামা শুরু করল জয়িতা। মাঝে মাঝেই হাঁটু ড়ুবে যাচ্ছে নরম বরফে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আনন্দ অথবা গুহা চোখের আড়ালে চলে গেল। এখন নির্জন সাদা পাহাড়ে সে একা। কোথাও কোন শব্দ নেই। এমনকি একটি পাখিও কোথাও ডাকছে না। খুব সাবধানে জয়িতা কমলারঙের রোদ গায়ে মেখে পা ফেলছিল। পাথর এবং তার খাজগুলো এখন বরফের আড়ালে। সামান্য অসাবধানতা যে বিপদ ডেকে আনবে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ নামবার পর সে হাঁপাতে লাগল। এমন একটা বরফশূন্য জায়গা নেই যেখানে বসে জিরোতে পারে। যে পথ দিয়ে ওরা উঠে এসেছিল সে পথ উধাও। হাতে পায়ে যাচাই করে জয়িতা নামছিল। এখন তাকে পথ করে নিতে হবে। এবং তখনই তার পতন হল। যে বরফকে তার শক্ত মনে হয়েছিল তা তাকে টেনে নিয়ে গেল অনেকটা নিচে। কোনরকমে দুটো হাতে ভর রেখে নিজেকে সামলাল সে। থরথর করে কাঁপছে বুক। আর একটু ওপাশে পড়লেই এই জীবনে উঠে দাঁড়াতে হত না। যেখানে পড়েছিল সেই বরফের ওপরে বসে রইল সে কিছুক্ষণ। এখান থেকে নামার জায়গা নেই। কিন্তু নিচের জঙ্গলের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে। সেখানেও সাদাটে তুষার জড়ানো। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর শরীর ধাতস্থ হল। একমাত্র হাঁটু এবং কনুইতে ব্যথা ছাড়া অন্য অস্বস্তি নেই। সে উঠে দাঁড়াল। এখনও সবুজের কোন চিহ্ন নেই। ক্যাপ্টেন স্কট অথবা হান্ট এইরকম বা এর চেয়ে বীভৎস বরফের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। সেইসব কাহিনী পড়ার সময় যে উত্তেজনা আসত তার বিন্দুমাত্র এখন নেই। বরং একটা শীতল ভয় ছড়িয়ে পড়ছে মনে—যদি আরও বরফ পড়ে, যদি এখান থেকে বেব হতে না পারে। ডান দিকে একটি চাতালের মত বরফ রয়েছে দেখতে পেল সে। ওটা শক্ত না নরম তা এখান থেকে বোঝা
false
humayun_ahmed
সব ট্র্যাস। ডাস্টবিনে ফেলে দেবার জিনিস। যে কবিতার লাইন তোর খাতায় লিখেছে তার পেছনেও কোনো সত্য নেই। অন্যের ধার করা লাইন। তার গল্প উপন্যাসও সে রকম। তুই ঐ পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দে। অপলা অবাক হয়ে বলল, কী বলছি তুমি? ঠিকই বলছি, ছিঁড়ে ফেল। না, ওটা আমি ছিঁড়ব না। দে পাতাটা আমার কাছে। অপলা খাতা দিল না। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। রানু খাতাটা হাতে নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে ছিড়ি কুচি কুচি করে ফেলল। আপা তুমি এ রকম করলে কেন? ঠিকই করেছি। না, তুমি ঠিক করনি। এটা আমার জিনিস। আমার জন্যে লেখা। এটা তুমি ছিড়তে পার না। তোমার নিজের যা আছে সে সব ছিঁড়ে ফেল। আমার গুলি কেন? অপলা কেঁদে ফেলল। রানু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বাইল আপলার দিকে। সে নিজেও নিজের আচরণে খুব অবাক হয়েছে। সে কেন এরকম করল? সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটেছে আলমের জন্যে। আলম আজ না এলে এটা হত না। তার আসার কারণেই রানু, অস্থিরতায় ভুগছিল। খাতা ছিঁড়ে ফেলার পেছনে অন্য কোনো যুক্তি নেই। এমন ছেলেমানুষি একটি কাণ্ড রানু করতে পারে না। অপলা, আই এ্যাম সরি। কিছু মনে করিস না। আপলা টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে। রানু তার পিঠে হাত রাখল। হঠাৎ তার মনে হল অপলার মতো একটি মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ে হলে বেশ হত। এই কথাটি তার কেন মনে হল কে জানে। ওসমান সাহেব বাথরুমে হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন। কাল রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। চোখ লাল হয়ে আছে। মাথা ভার ভার। এই অবস্থাতেই তাকে বেরুতে হবে। আজ অনেকগুলি কথা বলবেন। কলেজে যাবেন। প্রিন্সিপ্যালকে বলবেন মাস্টারি। আর করব না। আমি অসুস্থ। মাস্টারিতে মন বসছে না। রানুর কাছে যাবেন। রানুকে বলবেন বেশ কিছু দিনের জন্য তিনি গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন। নবীর কাছে যেতে হবে। নবী। খবর পাঠিয়েছে খুব দরকার। ওসমান সাহেব বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখলেন রানু এসেছে। সকাল সাতটায় হঠাৎ তার আসার কোনো কারণ নেই। কী ব্যাপার রানু? রানু সহজ স্বরে বলল, তুমি একটা কাগজে লিখে দাও–হায় সখা এত স্বৰ্গপুরি নয়। পুষ্পে কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়। তারপর নাম সই কর। কেন? দরকার আছে। এই নাও কাগজ। ওসমান সাহেব লিখতে বসলেন। লিখতে লিখতে বললেন, তুমি কেমন আছ রানু? রানু কিছু বলল না। ওসমান সাহেব বললেন, বাবার শরীর খারাপ হয়েছে। বেশ খারাপ। তাতে তো তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। অন্যের অসুখ-বিসুখে তোমার কিছু যায় আসে না। তোমার উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা সুখে থাকলেই হল। ওরা সুখে আছে তো? তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বাস। কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে আমার ভাল লাগে না। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা ঝগড়ার আর বসার ভঙ্গিটা হচ্ছে সন্ধির। বসলেই সন্ধি হয়ে যাবে তোমার সঙ্গে? কেন অদ্ভুত কথাবার্তা বলে আমাকে ভুলাতে চাইছ? আমি অপলা নই। ওসমান সাহেব কাগজ এগিয়ে দিলেন। রানু দেখল। শুধু দু’টি লাইনই নয় বেশ ক’টি লাইন সেখানে লেখা। বিদায় অভিশাপ পুরো কবিতাটি তার মুখস্থ। বিয়ের রাতে কী মনে করে যেন সে কবিতাটি শুনিয়েছিল। হয় তো রানুকে অভিভূত করতে চেয়েছিল। রানু কী অভিভূত হয়েছিল। রানুর মনে পড়ল না। মিলি বসে আছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মিলির বর এতটা আশা করেনি। তার ধারণা ছিল ডাক্তারের কাছে যাবার কথা শুনে সে রোগে উঠবে। হৈচৈ করবে। ইদানীং সে খুব হৈচৈ করছে। কিন্তু আজ সে বেশ শান্ত। সহজ সুরে পাশে বসা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। মহিলা পান খাচ্ছেন। তিনি নিশ্চয়ই পেসেন্ট নন। কোন রোগী ডাক্তারের কাছে এসে এমন আরাম করে পান চিবোয় না। মিলি তার বরকে হাত ইশারা করে ডাকল। মতিয়ুর নড়ল না। কাছে গেলেই মিলি হয়ত চট করে রেগে যাবে। সহজ স্বাভাবিক ভাব মুহুর্তের মধ্যে মাটি হবে। মিলি নিজেই এগিয়ে এল। হাসি মুখে বলল, আমাকে একটা পান এনে দেবে? পান খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ডাক্তারের কাছেও সে বেশ স্বাভাবিক রইল। মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল, পান খাচ্ছি বলে রাগ করছেন না তো? ডাক্তার সাহেব হাসলেন। না, রাগ করব কেন? আমার বড় ভাই খুলি রাগ করেন। তাই বুঝি? জি। কাউকে পান খেতে দেখলেই তার নাকি গরুর জাবর কাটার কথা মনে হয়। ভাইয়া এমনিতে খুব গম্ভীর। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব মজার কথা বলে? আপনি আমার ভাইকে চেনন তো? হ্যাঁ নামে চিনি। টিভিতে একবার দেখেছিলাম। কী একটা প্রোগ্রামে যেন এসেছিলেন। টিভিতে খুব লাজুক মনে হচ্ছিল। উনার কোনো বই পড়েছেন? গল্পের বই পড়ার অভ্যাস আমার খুব কম। আমারো কম। ভাইয়া আমাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছে, সেটি শেষ করতেও আমার এক মাস লেগেছে। আপনি বোধ হয়। আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। বিশ্বাস করব না কেন? কেউ বিশ্বাস করে না। মিলি হাই তুলল। সন্ধ্যাবেলার দিকে তার একবার প্রচণ্ড ঘুম পায়। তারপর বাকি রাতটা কাটে জেগে। কি কষ্ট! কি কষ্ট! আপনার ভাইকে আপনি খুব পছন্দ করেন? হুঁ। আর কাকে পছন্দ করেন? আর কাউকে না। কাউকে না? না। আমার এই কথাটিও আপনি বিশ্বাস করছেন না, তাই না? বিশ্বাস করব না কেন? আমার কেন জানি শুধু মনে হয় কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমি অবশ্যি খুব মিথ্যা কথা বলি। সে তো আমরা সবাই বলি। আমিও বলি। মিলি খানিকক্ষণ চুপ করে
false
shunil_gongopaddhay
চিবুক ভর দিয়ে। গঙ্গানারায়ণ পিছন ফিরে ক্রুদ্ধভাবে চলে গেল, সিঁড়িতে তার পদশব্দ হতে লাগলো, তবু কেউ তাকে ফিরে আসবার জন্য ডাকলো না। পথ দিয়ে সে পদব্ৰজে ধাবিত হলো নিজের বাড়ির দিকে। এ গৃহও শান্য। কারুর সঙ্গে কথা বলে যে সে তার মস্তিষ্ক জুড়োবে, তার উপায় নেই। অথচ বন্ধু-বান্ধব কারো কাছে যেতেও তার ইচ্ছে হলো না। শান্ত, মৃদু স্বভাবের গঙ্গানারায়ণ আজ অত্যন্ত চঞ্চল ও উদভ্ৰান্ত। শহরে স্ত্রীলোকের অভাব নেই। ইচ্ছা হলে গঙ্গানারায়ণ এখনই জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে কোনো রূপসী সঙ্গীতপটীয়সী বারাঙ্গনার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হতে পারে, তার এখন অর্থেরও অভাব নেই। কিন্তু বিন্দুবাসিনী ছাড়া আর কোনো রমণী তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। বিন্দু তার জীবনে শুধু নারীর প্রয়োজন মেটারে না, বিন্দু তার চেয়েও বেশী অনেক কিছু। সেই বিন্দু তাকে প্রত্যাখ্যান করে ফিরিয়ে দিল। সেই সন্ধ্যাকালেই নিজের শয্যায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো গঙ্গানারায়ণ। গঙ্গানারায়ণের এই চাঞ্চল্য এর পরের কয়েকদিনেও কমলো না একটুও। অথচ মন শাস্ত করা দরকার। অনেকটা শান্তি পাওয়া যায় দেবেন্দ্রবাবুর কাছে গিয়ে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীগুলি শুনলে। তার কলেজ জীবনের সহপাঠী রাজনারায়ণ বসু এখন দেবেন্দ্রবাবুর তত্ত্ববোধিনী সভার অধীনে উপনিষদ অনুবাদকের চাকুরি করে। একসময় রাজনারায়ণ অতিরিক্ত মদ্যপান শুরু করেছিল, এখন কিছুটা শুধরেছে। রাজনারায়ণ একসময় ছিল সংশয়বাদী, সকল ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো, এখন যেন তার মন খানিকটা ফিরেছে। ধর্মপথে। দেবেন্দ্রবাবু উপনিষদের শ্লোকগুলি পাঠ করে তারপর তার অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেন। সেই শুনে শুনে রাজনারায়ণ এই শ্লোকগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করে। উপনিষদের দুরূহ শ্লোকগুলি দেবেন্দ্ৰবাবু এমনই প্ৰাঞ্জল ও সুললিত ভাষায় ব্যাখ্যা করেন যে তা শুনবার জন্য অনেকেই সেখানে ভিড় করে। গঙ্গানারায়ণ একদিন তার বন্ধু রাজনারায়ণের সঙ্গে গিয়ে দেবেন্দ্রবাবুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। দেবেন্দ্রবাবুও তাকে প্রীতির চক্ষে দেখেন। কয়েকদিন সেখানে গিয়েও গঙ্গানারায়ণের মন শান্ত হলো না। ধর্ম, দর্শন, সমাজ, সংস্কার কিছুই যেন আর তার ভালো লাগে না। মন সর্বক্ষণ বিন্দুর সান্নিধ্যে যাবার জন্য ছটফট করে। নিজেকে শাস্তি দেবার জন্য সে জমিদারি পরিদর্শনে চলে গেল কুষ্টিয়ায়। সেখানে পৌঁছেই বুঝলো, সে আরও ভুল করেছে। কলকাতায় তবু বরং এটুকু সান্ত্বনা ছিল যে, বিন্দু অদূরেই আছে, ইচ্ছা করলেই সে ছুটে গিয়ে বিন্দুকে একবার দেখে আসতে পারে। কিন্তু কুষ্টিয়া যেন তার কাছে মরুভূমির ন্যায় প্রতীয়মান হলো। কাজকর্ম সব অসমাপ্ত রেখে সে আবার ফিরে এলো কলকাতায়। আবার এক সায়াহ্নে সে বিন্দুর ঠাকুরঘরে উপস্থিত হয়ে বললো, আমি হার মানলাম বিন্দু। তোকে ছেড়ে আমি কিছুতেই দূরে রইতে পাচ্চি না! বিন্দু রাগ করলো না, বরং সুমিষ্ট স্বরে তাকে বললো, আয়, দোরের কাচে বোস। শরীরের উপর খুব বুঝি অযত্ন করচিস? কিন্তু শুধু বিন্দুর সুমিষ্ট বাক্য শুনলেই গঙ্গানারায়ণের মন ভরে না। আর। দূরে থাকার সময় সে ভেবেছিল, বুঝি একবার বিন্দুর মুখখানি দেখলেই তার হৃদয় জুড়োবে। কাছে এসে বুঝলো, পতঙ্গ যেমন অগ্নিশিখার দিকে ধায়, তেমনি বিন্দুর রূপরাশির মধ্যে সে চায় আকণ্ঠ নিমজিত হতে। বিন্দু কিছুতেই তাকে প্রশ্রয় দেবে না। গঙ্গানারায়ণ যদি দূরে বসে তার সঙ্গে গল্পগাছা করতে চায় তার আপত্তি নেই, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ তার হস্ত আকর্ষণ করলেই বিন্দু বলে, তুই কি চাস আমি মারি? পাপের পথে যাওয়ার চেয়ে মরণও ভালো। গঙ্গানারায়ণ প্রশ্ন করে, আর কিচু নয়, আমি যদি তোর ক্ৰোড়ে মাথা দিয়ে শুই, তাও কি পাপ? বিন্দু বলে, অমন কতা উচ্চারণ করাও পাপ। এমন কি হাতে হাত ছোঁয়াও পাপ। গঙ্গানারায়ণ উন্মত্তবৎ হয়ে উঠলো। সে জিদ ধরলো, বিন্দুর এই প্রতিরোধ সে ভাঙবেই। বিন্দুকে না পেলে তার জীবনের আর সব কিছু ব্যর্থ। তার আর দিগ্বিদিক জ্ঞান রইলো না। অফিস-কাছারি থেকে সে যখন তখন চলে এসে বসে থাকে বিন্দুর কাছে। সে গৃহে তার অবারিতদ্বার। যে-কোনো সময় সে আসতে পারে, যার কাছে খুশী সে যেতে পারে, কেউ তাকে বাধা দেবে না। কিন্তু সে যে আর কারো কাছে নয়, শুধু সৰ্বক্ষণ বিন্দুর কাছেই নিভৃতে বসে থাকে, এটা যে দৃষ্টিকটু এ বোধ তার লুপ্ত হয়ে গেছে। বিন্দুকে ছাড়া এ জগতের আর কিছুই যেন সে এখন দেখতে পায় না। এক নিঝুম দ্বিপ্রহরে গঙ্গানারায়ণ আবার বিন্দুর ওপর বলপ্রয়োগ করতে গেল। বিন্দু সেদিন কেঁদে ফেললো একেবারে। বিন্দু বড় অসহায়। সে চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে না, কারণ গঙ্গানারায়ণ যে তার বড় প্রিয়, গঙ্গানারায়ণের সম্মানহানি হোক, তাই বা সে চাইবে কী করে! সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, আমার মরণই ভালো। তুই কেন এমনভাবে নিজের সর্বনাশ করচিস গঙ্গা? তুই আমায় বিষ। এনে দে! গঙ্গানারায়ণ বিন্দুকে বক্ষে আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলো, আমি আর কিচু জানি না, আয় আজ তুই আমি দুইজনে মরণ-উৎসবে মাতি। বিন্দু ফিসফিস করে বললে, ছেড়ে দে, ওরে আমায় ছেড়ে দে, আমায় এমনভাবে নরকের দিকে য় যাসনি— পক্ষকাল ধরেই এ বাড়ির দাসদাসী মহলে পাঁচরকম কথা কানাকানি হচ্ছিল। কথা পৌঁছেছিল বাড়ির গৃহিণীরও কানে। দাসী সমভিব্যাহারে বিন্দুর মা নিজে সেই সময় এসে এ দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলেন। গৃহদেবতার সামনে ব্যভিচারক্রিয়া চলছে। তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন, বিন্দু! তারপর কপাল চাপড়ে বললেন, হা অদৃষ্ট, এ কি কল্লে? বিন্দু, পোড়ারমুখী, ঘরজ্বালানী, তুই মরলিনি কেন? তোর মনে মনে এই ছেল? গঙ্গা আমাদের সোনার টুকরো ছেলে, তুই তার ওপর বিষ নজর দিইচিস! ডাইনী! গঙ্গানারায়ণের চৈতন্য উদয় হলো। বিন্দুর কাছ থেকে সরে এসে নতমস্তকে বললো, খুড়িমা,
false
shunil_gongopaddhay
বারবার ফোন করছেন উতলা হয়ে। আর একবার ফোন করতেই সন্তুকে বাধ্য হয়ে একটা ছোট্ট মিথ্যে কথা বলতে হল। সন্তু বলল, মাসিমা, কাল তো জোজোর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। সে নিশ্চয়ই জোজোকে জোর করে ধরে রেখেছে। এখন আমাদের কলেজ ছুটি, তাই জোজো থেকে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবে। একথা বলে তো দিল, কিন্তু জোজো যদি দু-একদিনের মধ্যেও না ফেরে? যদি তার সত্যিই কোনও বিপদ হয়ে থাকে? তখন সবাই বলবে, আগেই কেন পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি। এখন পুলিশে খবর দিলে তারা প্রথমেই ভাল করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য জোজোদের বাড়িতে যাবে। তাতে জোজোর মা আরও ব্যাকুল হয়ে পড়বেন না? নিশ্চয়ই কান্নাকাটি শুরু করে দেবেন! কী মুশকিলেই ফেলে দিল জোজো! অসীম দত্ত কাকাবাবুকে একটা কার্ড দিয়েছিলেন। কাকাবাবু সেই কার্ড দেখে অফিসে ফোন করলেন। সেখান থেকে জানানো হল, তিনি অফিসে আসেননি, বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে ফোন করার পর একটি মেয়ে বলল, অসীম দত্ত বাড়িতেও নেই, মাংস কিনে আনতে গেছেন, খানিক বাদেই ফিরবেন। কাকাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অসীমের মেয়ে? তোমার নাম কী? মেয়েটি বলল, আমার নাম রূপকথা, ডাকনাম অলি। কাকাবাবু বললেন, শোনো অলি, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, তোমার বাবাকে বাড়িতে থাকতে বলো, আমি এক্ষুনি আসছি। কাকাবাবুর নাম শুনে অলি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু ফোন রেখে দিলেন। সন্তুকে বললেন, তৈরি হয়ে নে। মাকে বলে যা, রাত্রে আমরা নাও ফিরতে পারি। আজ আর কাকাবাবু গাড়ি নিলেন না। একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলেন আলিপুরে অসীম দত্তর বাড়িতে। দরজা খুলে অসীম দত্ত সারামুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, আমি তোমার বাড়িতে যাব বলেছিলাম, তার আগে তুমিই চলে এলে? দ্যাখো, আমার মেয়ে কী কাণ্ড করেছে! বসবার ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, একগাদা নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে। টেবিলের ওপর দুখানা ফুলদানি ভর্তি ফুল, এক জন লোক ক্যামেরা তুলে খচাত-খচাত করে ছবি তুলতে লাগল। কাকাবাবু বললেন, এ কী! অসীম দত্ত বললেন, আমার মেয়ে তোমার কী দারুণ ভক্ত, তুমি জানো! কতবার বলেছে, তোমাকে দেখতে যাবে। আজ তুমি নিজেই আসছ শুনে পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে ডেকে এনেছে। অলির বয়েস তো তেরো-চোদ্দো বছর, একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরে আছে। সে একটা রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিল কাকাবাবুর গলায়। তারপর কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল। কাকাবাবু তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে বললেন, থাক, থাক! একজন মহিলা বললেন, সন্তু কোথায় গেল? সে এসেছে? অসীম দত্ত সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আরে, তুমি পেছনে লুকিয়ে আছ কেন? সামনে এসো সেই মহিলাটি বললেন, ও মা, সত্যি-সত্যি সন্তু নামে কেউ আছে? এ তো দারুণ ছেলে, কাকাবাবুর চেয়ে কম যায় না। অলি একটা ফুলের তোড়া তুলে দিল সন্তুর হাতে। সন্তু লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। ওদের দুজনকে বসানো হল দুটি চেয়ারে। অনেকে বলতে লাগল, আমরা সন্তু আর কাকাবাবুর সঙ্গে ছবি তুলব! এক-একজন পাশে এসে দাঁড়ায়, ক্যামেরাম্যানটি ছবি তোলে। এরই মধ্যে অনেকে মিলে কাকাবাবুকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল, রাজা কনিষ্কর মুণ্ডু আবার খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তার কি ছবি তোলা আছে? মাউন্ট এভারেস্টে যাওয়ার পথে কি সত্যিই ইয়েতি দেখা গিয়েছিল? আন্দামানের জাবোয়ারা এখনও বিষাক্ত তীর ছোড়ে? কাকাবাবু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর হাত তুলে বললেন, আজ এই পর্যন্ত থাক। অসীমের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। অসীম দত্ত সবাইকে বললেন, ছবি তোলা তো হয়েছে, এবার আপনারা একটু পাশের ঘরে যান। ঘর খালি হয়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু গলা থেকে মালা খুলে ফেলতে লাগলেন। অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি কিছু জরুরি কথা আছে? কাকাবাবু বললেন, তোমার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এসেছি। কাল আমার সঙ্গে দুজনকে দেখেছিলে তো? আমার ভাইপো সন্তুর সঙ্গে ওর বন্ধু জোজোও ছিল। সেই জোজোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? কাকাবাবু বললেন, সে আমাদের সঙ্গে কাল ফেরেনি। আমরা কাকদ্বীপে একটা সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম। একটা লোক মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখাচ্ছিল, জোজো নিজেই এগিয়ে গেল, ম্যাজিশিয়ানটা কীসব কায়দা-টায়দা করল, তারপর, মানে, তারপর জোজো আর নেই! অসীম দত্ত ঠাট্টার সুরে বললেন, বলো কী! জলজ্যান্ত ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে গেল? একেবারে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়? কাকাবাবু বিব্রতভাবে বললেন, শুনলে সবাই মনে করবে গাঁজাখুরি ব্যাপার। কিন্তু ওই খেলার পর জোজোকে আর আমরা দেখিনি, এটাও ঠিক। সন্তু এবার বলল, ওই খেলার পর জোজো শিঙাড়া আর রসগোল্লা খেয়েছিল, ম্যানেজার বলেছেন। অদৃশ্য হয়ে থাকলে কি কিছু খাওয়া যায়? অসীম দত্ত আরও মজা করে বললেন, সেও তো একটা প্রশ্ন বটে। অদৃশ্য হলে কি খেতে পারে? ভূতেরা কি কিছু খায়? কাকাবাবু এবার গলায় জোর এনে বললেন, ইয়ার্কি রাখো তো! ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার কোনও বিপদ হতে পারে তো! যদি তাকে কেউ জোর করে আটকে রেখে থাকে? অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, জোজোর বয়েস কত? কাকাবাবু বললেন, ষোলো-সতেরো হবে! সন্তু বলল, সতেরো। আমার সমান। অসীম দত্ত বললেন, ওই বয়েসের ছেলেদের ধরে রাখা খুব শক্ত। কী সন্তু, তোমায় কেউ কোথাও আটকে রাখতে পারবে? সন্তু মাথা নিচু করে হাসল। অনেকবারই কাকাবাবুর শত্রুরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারেনি। অসীম দত্ত বললেন, ঠিক আছে। কাকদ্বীপ থানায় খবর পাঠাচ্ছি, ওরা খোঁজখবর
false
humayun_ahmed
ততটা জোরাল নয়। কুয়াশার মতো পড়ছে। বাসা পর্যন্ত যেতে মাথা সামান্য ভিজবে, এর বেশি কিছু হবে না। ঝম-ঝম বৃষ্টি হলে মন্দ হত না। অনেকদিন ধুম বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। মেয়েটি আসছে তার পিছনে-পিছনে। স্যাভেল খলে হাতে নিয়েছে, পা ফেলছে খুব সাবধানে। এর বাড়ি বোধ হয় আশেপাশে কোথাও হবে। একা-একা যেতে ভয় পাচ্ছে। বলে সঙ্গে আসছে। আসুক ক্ষতি তো কিছু নেই। এত সাবধানতায়ও কাজ দিল না। মেয়েটি পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে যে কাদায় মাখামাখি হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে হাত ধরে তোলার কোনো অর্থ হয় না। আবার পাশ-কেটে চলে যেতেও খারাপ লাগে। এই জাতীয় মেয়ের সংখ্যা শহরে দ্রুত বাড়ছে। কলেজের ইসমাইল সাহেবের ধারণা শহরটা প্ৰসটিটিউটের শহর হয়ে যাচ্ছে। ইসমাইল সাহেব লোকটি বেশ রসিক। যাই বলেন শুনতে ভালো লাগে। বুঝলেন সাহেব, ঐরকম একজনের পাল্লায় পড়েছিলাম। রাত দশটার মতো। বাজে। আমার ভায়রার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি ঝিকাতলা। একটু ভেতরের দিকে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটছি, তখন এই মেয়েটা এসে উপস্থিত। নরম গলায় বলল, আজ রাতটা কি আপনি আমাকে থাকতে দিতে পারেন? আমি তো বুঝতেই পারি নাই রে ভাই। কচি চেহারা, ভদ্ৰ সাজ-পোশাক। আপনি কী বললেন? আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার? জিওগ্রাফির মনসুর সাহেব চাপা হাসি হেসে বললেন, মা বলে ডাকলেন না? আপনার তো আবার মেয়েদের মা ডাকার একটা প্রবণতা আছে। নামা ডাকি নি। কলেজের মেয়েগুলিকে মা বলি। বাইরে বলি না। তারপর কি হল শোনেন—আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার? … সে বলল, অনেক অসুবিধা। বলেই হাসল, তখনই ব্যাপারটা বুঝলাম। কি করলেন? পাঁচটা টাকা দিলাম। টাকাটা নিল না। তখনই বুঝলাম ভালো ফ্যামিলির মেয়ে, ছ্যাচড়া ধরনের হলে নিত। মনসুর সাহেব বাঁকা হাসি হেসে বললেন, আপনার মনের অবস্থাটা তখন কী হল বলুন। কী আবার হবে। কিছু হয় নি-একটু স্যাড ফিল করেছি। শুধুই স্যাড আর কিছু না? একবারের জন্যেও কি মনে হয় নি এই মেয়েটির সঙ্গে কিছু সময় কাটালে কি আর এমন ক্ষতি হবে? ঘরে ফিরলে সেই তো বাসি স্ত্রী। অর্থের বিনিময়ে টাটকা একজন তরুণীর সঙ্গ মন্দ কি? কী-সব বাজে কথা বলছেন মনসুর সাহেব? বাজে কথা একেবারেই বলছি না। নিতান্ত সত্যি-সত্যি কথাটা বলছি। হার্ড টুথ। নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করবেন না। নিজেকে দিয়ে বিচার করছি না আপনাকে দিয়েই আমি আপনাকে বিচার করছি। এই যে মেয়েগুলিকে আপনি মা মা ডাকেন, তার পিছনে কি অন্য কিছু কাজ করে না? মা বলে সহজেই একজনের পিঠে হাত রাখতে পারছেন। স্পর্শের আনন্দটুকুর জন্যে আপনি মা ডাকছেন। আমি খুব ভুল বলছি? ইসমাইল সাহেব স্যান্ডেল খুলে মনসুর সাহেবকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি ব্যাপার। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত জিনিসটা গড়াল। প্রিন্সিপ্যাল দার্শনিকের মতো বললেন, মেয়েমানুষ কী জিনিস দেখলেন। সামান্য মেয়েমানুষের কথা থেকে স্যান্ডেল নিয়ে ছোটাছুটি। এই খবর বাইরে লিক হলে টিচার্স ক্যুনিটি হিসাবে আমাদের স্থান কোথায় হবে বলেন দেখি? আপনাদের মতো হাইলি এড়ুকেটেড লোক যদি …… বৃষ্টি এবার বড় বড় ফোঁটায় পড়তে শুরু করেছে। আহসান তার পাউরুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভেজা পাউরুটি নিয়ে ঘরে ফেরার কোন অর্থ হয় না। মেয়েটিকে পাউরুটিটা দিয়ে দিলে কেমন হয়? চিন্তাটা মাথায় আসায় আহসান অস্বস্তি বোধ করছে। হঠাৎ একটা পাউরুটি দেওয়ার কথা তার মনে হল কেন? কেন সে পাউরুটি দিতে চাচ্ছে? মেয়েটি অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে কী যেন খুজছে। তার মধ্যে একধরনের ব্যাকুলতা। কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও আহসান বলল, কি খুঁজছ? বলেই সে নিজে চমকে উঠল। সে কি খুঁজছে না খুঁজছে তা নিয়ে আহসানের মাথাব্যথা কেন? মেয়েটি খোঁজা বন্ধ করে আহসানকে দেখছে। জায়গাটা অন্ধকার, সে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আমার স্যান্ডেল খুঁজতেছি। তুমি কি এই দিকে থাক? না। কোথায় থাক? মেয়েটি জবাব দিল না। ধুম বৃষ্টি চলছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে মনে হতে পারে সে অপেক্ষা করছে। মেয়েটির জন্যে। স্যান্ডেল পাওয়া গেছে? না। নাম কি তোমার? রেবা। এটা নিশ্চয়ই ছদ্মনাম। আসল নাম অন্য কিছু। ঠিক নামটি এরা ্কখনো বলে না। এটা তোমার ঠিক নাম? না। আহসান পা বাড়াল। আশ্চর্য মেয়েটিও আসছে। আহসান থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শীতল গলায় বলল, আমার সঙ্গে-সঙ্গে আছ কেন? মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার হাঁটতে শুরু করল, আহসানের পাশে পাশে আসছে। দু জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটছে অথচ কেউ কোনো কথা বলছে না। জায়গায়জায়গায় পানি জমে আছে। পা পড়তেই ছপ-ছপ শব্দ হচ্ছে। চারদিকে ব্যাঙ ডাকছে। জায়গাটা পুরোপুরি গ্রামের মতো হয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে নিকষ অন্ধকার। তারিনকে নিয়ে একবার ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আঠারবাড়ি স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে কুতুবপুর যেতে হয়েছিল। কি ফুর্তি তার। আহসান বার বার বলছিল, হাত ধরে হাঁট, পিছলে পড়বে। তারিন হাসতে-হাসতে বলেছে, পিছলে পড়লে একা পড়ব। তোমার হাত ধরে থাকলে তুমিও পড়বে। দু জন পড়লে লাভ কি বল? তার কথা শেষ হবার আগেই আহসান নিজে পিছলে পড়ল। তারিনের হাসি আর থামেই না। আহ কী করছ? লোকজন জড়ো হবে। হোক জড়ো। হাসার সময় হাসব। কাঁদার সময় কাঁদব। সত্যি-সত্যি। তারিনের হাসিতে লোকজন এসে পড়ল। তারা কিছুতেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যেতে দেবে না। তারিন যাবেই। শেষ পর্যন্ত একদল লোক সঙ্গে
false
shorotchandra
ধরে পেটের রোগে এবং স্বদেশী ম্যালেরিয়া জ্বরে। তখন বাপের দায়িত্ব হচ্ছে বিদেশী কুইনিন ও বার্লির গুঁড়ো যোগানো, এবং মায়ের ঘাড়ে পড়ে—ঐ যে বললুম, আঁতুড়ে গিয়ে পুনরায় ভর্তি হবার মুলতুবির ফুরসতে—ঐগুলো খাঁটি দেশী জলে গুলে তাকে গেলানো। তারপরে যথাসময়ে সূতিকাগৃহের হাঙ্গামা মিটিয়ে নবকুমার কোলে করে বেরিয়ে এসে প্রথমটার জন্যে দিন-কতক চ্যাঁচানো। রাজলক্ষ্মী নীলবর্ণ হইয়া কহিল, চ্যাঁচানো কেন? বলিলাম, ওটা মায়ের স্বভাব বোলে। এমন কি কেরানীর ঘরেও তার অন্যথা দেখা যায় না, যখন ভগবান তাঁর দায়িত্ব শোধ করতে ছেলেটাকে শ্রীচরণে টেনে নেন! বাছা রে! এতক্ষণ বাহিরের দিকে চাহিয়াই কথা কহিতেছিলাম, অকস্মাৎ দৃষ্টি ফিরাইতে দেখিলাম, তাহার বড় বড় দুটি চক্ষু অশ্রুজলে ভাসিতেছে। অতিশয় ক্লেশ বোধ করিলাম। মনে হইল, এ বেচারাকে নিরর্থক দুঃখ দিয়া আমার লাভ কি? অধিকাংশ ধনীর মত ইহারও না হয় জগতের এই বিরাট দুঃখের দিকটা অগোচরেই থাকিত। বাঙ্গলার ক্ষুদ্র চাকুরিজীবী প্রকাণ্ড দরিদ্র গৃহস্থ পরিবার যে শুধু খাদ্যাভাবেই ম্যালেরিয়া, ওলাওঠা প্রভৃতি উপলক্ষ করিয়া প্রতিদিন শূন্য হইয়া যাইতেছে, অন্যান্য বড়লোকের মত এও না হয় এ কথাটা নাই জানিত। কি এমন তাহাতে বেশি ক্ষতি হইত! ঠিক এমনি সময় রাজলক্ষ্মী চোখ মুছিতে মুছিতে অবরুদ্ধ স্বরে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, হোক কেরানী, তবু তারা তোমার চেয়ে ঢের ভাল। তুমি ত পাষাণ। তোমার নিজের কোন দুঃখ নেই বলে এঁদের দুঃখকষ্ট এমন আহ্লাদ করে বর্ণনা করচ। আমার কিন্তু বুক ফেটে যাচ্ছে। বলিয়া সে অঞ্চলে ঘন ঘন চোখ মুছিতে লাগিল। ইহার প্রতিবাদ করিলাম না। কারণ তাহাতে লাভ হইত না। বরঞ্চ সবিনয়ে কহিলাম, এঁদের সুখের ভাগটাও ত আমার কপালে জোটে না। বাড়ি পৌঁছতে এঁদের আগ্রহটাও ভেবে দেখবার বিষয়। রাজলক্ষ্মীর মুখ হাসি ও কান্নায় মুহূর্তেই দীপ্ত হইয়া উঠিল। কহিল, আমিও ত তাই বলচি! আজ বাবা আসচে বলে ছেলেপুলেরা সব পথ চেয়ে আছে। কিসের কষ্ট? ওঁদের মাইনে হয়ত কম, তেমনি বাবুয়ানিও নেই। কিন্তু, তাই বলে কি পঁচিশ-ত্রিশ টাকা, এত কম? কখ্‌খনো নয়। অন্ততঃ—এক শ দেড় শ টাকা, আমি নিশ্চয় বলচি। বলিলাম, হতেও পারে। আমি হয়ত ঠিক জানিনে। উৎসাহ পাইয়া রাজলক্ষ্মীর লোভ বাড়িয়া গেল। অতিশয় ক্ষুদ্র কেরানীর জন্যও মাসে দেড় শ টাকা মাহিনা তাহার মনঃপূত হইল না। কহিল, শুধু কি ওই মাইনেটিই ওঁদের ভরসা তুমি মনে কর? সবাই উপরিও কত পান! কহিলাম, উপরিটা কি? প্যালা? আর সে কথা কহিল না, মুখ ভার করিয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। খানিক পরে বাহিরের দিকেই চোখ রাখিয়া বলিল, তোমাকে যতই দেখচি, ততই তোমার ওপর থেকে আমার মন চলে যাচ্চে। তুমি ছাড়া আর আমার গতি নেই জানো ব’লেই আমাকে তুমি এমন ক’রে বেঁধো। এতদিনের পরে আজ বোধ করি এই প্রথম তাহার হাত-দুটি জোর করিয়া নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইলাম। তাহার মুখের পানে চাহিয়া কি যেন একটা বলিতেও চাহিলাম, কিন্তু গাড়ি আসিয়া স্টেশনের ধারে দাঁড়াইল। একটা স্বতন্ত্র গাড়ি রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও বঙ্কু কিছু কিছু জিনিসপত্র লইয়া পূর্বাহ্নেই আসিয়াছিল। সে রতনকে কোচবাক্সে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। হাত ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিলাম; যে কথাটা মুখে আসিয়া পড়িয়াছিল, আবার তাহা নীরবে অন্তরের ভিতরে গিয়া লুকাইল। আড়াইটার লোকাল ছাড়ে-ছাড়ে। আমাদের ট্রেন পরে। এমন সময়ে একটি প্রৌঢ়গোছের দরিদ্র ভদ্রলোক একহাতে নানাজাতীয় তরিতরকারির পুঁটুলি এবং অন্য হাতে দাঁড়সুদ্ধ একটি মাটির পাখি লইয়া শুধু প্লাটফরমের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যভাবে ছুটিতে গিয়া রাজলক্ষ্মীর গায়ে আসিয়া পড়িল। মাটির পুতুল মাটিতে পড়িয়া গুঁড়া হইয়া গেল। লোকটা হায় হায় করিয়া বোধ করি কুড়াইতে যাইতেছিল, পাঁড়েজী হুঙ্কার ছাড়িয়া একলম্ফে তাহার ঘাড় চাপিয়া ধরিল এবং বঙ্কু ছড়ি তুলিয়া বুড়ো কানা ইত্যাদি বলিয়া মারে আর কি! আমি একটু দূরে অন্যমনস্ক ছিলাম, শশব্যস্তে রণস্থলে আসিয়া পড়িলাম। লোকটি ভয়ে এবং লজ্জায় বার বার বলিতে লাগিল, দেখতে পাইনি মা, আমার ভারি অন্যায় হয়ে গেছে— আমি তাড়াতাড়ি ছাড়াইয়া দিয়া বলিলাম, যা হবার হয়েচে, আপনি শীঘ্র যান, আপনার ট্রেন ছেড়ে দিল বলে। লোকটি তবুও তাহার পুতুলের টুকরা কয়টা কুড়াইবার জন্য বারকয়েক ইতস্ততঃ করিয়া শেষে দৌড় দিল, কিন্তু অধিক দূর ছুটিতে হইল না, গাড়ি ছাড়িয়া দিল। তখন ফিরিয়া আসিয়া সেই আর একদফা ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া সেই ভাঙ্গা অংশগুলা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইল দেখিয়া, আমি ঈষৎ হাসিয়া কহিলাম, ওতে আর কি হবে? লোকটি কহিল, কিছুই না মশাই। মেয়েটার অসুখ—গেল সোমবারে বাড়ি থেকে আসবার সময় বলে দিলে, আমার জন্যে একটি পাখি-পুতুল কিনে এনো না! কিনতে গেলুম, ব্যাটা গরজ বুঝে দর হাঁকলে কিনা—দু আনা— তার একটি পয়সা কম নয়। তাই সই। মরি-বাঁচি করে আট-আটটা পয়সা ফেলে দিয়ে নিলুম, কিন্তু এমনি অদেষ্ট দেখুন না যে, দোড়গোড়ায় এনে ভেঙ্গে গেল! রোগা মেয়েটার হাতে দিতে পারলুম না। বেটি কেঁদে বলবে, বাবা আনলে না। যা হোক টুকরোগুলো নিয়ে যাই, দেখিয়ে বলব, মা, এ মাসের মাইনেটা পেলে আগে তোর পুতুল কিনে তবে আমার অন্য কাজ। বলিয়া সমস্তগুলি কুড়াইয়া সযত্নে চাদরের খুঁটে বাঁধিয়া কহিল, আপনার স্ত্রীর বোধ হয় বড্ড লেগেচে—আমি দেখতে পাইনি। লোকসানকে লোকসানও হ’লো, গাড়িটাও পেলুম না—পেলে তবুও রোগা মেয়েটাকে আধঘণ্টা আগে গিয়ে দেখতে পেতুম। বলিতে বলিতে ভদ্রলোকটি পুনরায় প্লাটফরমের দিকে প্রস্থান করিল। বঙ্কু পাঁড়েজীকে লইয়া কি-একটা প্রয়োজনে অন্যত্র চলিয়া গেল; আমি হঠাৎ ফিরিয়া চাহিয়া দেখি, শ্রাবণের ধারার মত রাজলক্ষ্মীর দুই চক্ষু অশ্রুজলে ভাসিয়া যাইতেছে।
false
humayun_ahmed
হাই ওঠার কথা না। কিন্তু এই মানুষটি আশেপাশে থাকলে তার হাই ওঠে। লোকটি অবশ্য বুঝতে পারে না। তাই ওঠার সঙ্গে যে অবহেলার একটা ব্যাপার আছে, তা বোধহয় সে জানেও না। জানলেও তার হয়তো কিছু যায় আসে না। সোমা। লোকটার গলার স্বর অবশ্যি মিষ্টি। না, মিষ্টি বলাটা ঠিক হচ্ছে না। পুরুষদের গলা মিষ্টি হয় না। ধাতব একটা ঝংকার শুধু থাকে। এই লোকের তা আছে। শুনতে ভালো লাগে। কথা শুনলে জবাব দিতে ইচ্ছে করে। এই সোমা। আসছি। একটু লবণ দাও। লবণ দিয়ে কী করবে? দাঁত ঘষব। শালা দাঁতে পেইন উঠেছে। সোমা লবণ আনতে গেল। তার কানে ঝনঝন করে বাজছে—দাঁত ঘষব। শালা দাঁতে পেইন উঠেছে। লোটা কি ইচ্ছে করলে শালা শব্দটা বাদ দিতে পারত না? বোধহয় না। এইসব শব্দ তার রক্তে মিশে আছে। এই ঘরে একটা সাদা রঙের বিড়াল আসে। বিড়ালটার একটা চোখ নষ্ট। তাই সে বিড়ালটাকে ডাকে কানাশালি। বিড়ালটাকে শালি না ডাকলে কি চলত না? সোমা ঝকঝকে একটা পিরিচের ঠিক মাঝখানে খানিকটা লবণ নিল। কিছু ছড়িয়ে গিয়েছিল সাবধানে সে একত্র করল। অসুন্দর কোনকিছুই তার ভালো লাগে না। যদিও তাকে বাস করতে হয় অসুন্দরের মধ্যে। লোকটা তার হাত থেকে পিরিচ নিল। লবণ কত সুন্দর করে সাজানো সেদিকে সে লক্ষও করছে না। আঙুলে লবণ নিয়ে বিকট ভঙ্গিতে দাঁত ঘষছে। মাঝে-মাঝে থুথু করে থুথু ফেলছে। সোমা বাথরুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়িয়ে না থাকলেও চলত, তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। কেন আছে লোকটা কি তা জানে? মনে হয় জানে না। সোমা। বল। শালার রক্ত পড়ছে। মাঢ়ী নষ্ট হয়ে গেছে। নিমের ডাল জোগাড় করতে হবে। টুথপেস্ট ফুপেস্ট দাঁতের বারটা বাজিয়ে দেয়। কিছু বলবে না বলবে না করেও সোমা বলল, নিমের ডাল কোথায় পাবে? আছে সবই আছে। ঢাকা শহরে সব আছে। শালার ইন্টারেস্টিং একটা শহর। ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভাত বাড়ব? বাড়। মিনু হারামজাদী কোথায়? ঘুনুচ্ছে। নয়টা বাজতেই ঘুম-হারামজাদী পেয়েছে কী? মাসে সত্তর টাকা দিই ওর মুখ দেখার জন্য? কানে ধরে তোল। এগারটার আগে ঘুমাতে দেখলে থাপ্পড় দিয়ে হারামজাদীর দাঁত ফেলে দেব। ওর জ্বর। আমি ভাত বাড়ছি—অসুবিধা তো কিছু নেই। অসুবিধা থাকুক আর না থাকুক, নটার সময় ঘুমাবে কেন? ফাজিলের ফাজিল। সোমা রান্না ঘরে চলে গেল। খাবার গরম করল। কেটলিতে চায়ের পানি চড়িয়ে দিল। খাওয়াদাওয়ার পর তোকটা এক কাপ চা খায়। আদা দিয়ে কড়া এক কাপ চা। এতে নাকি পিত্ত পরিষ্কার হয়। আজ খাওয়ার আয়োজন ভালো না। ছোট মাছের তরকারি, আলু ভাজা এবং ডাল। মুগের ডাল। লোটার খুব প্রিয় জিনিস। হুসহস শব্দ করে ডাল খাবে। চোখ চকচক করতে থাকবে। খাবার সময় বেশ কয়েকবার বলবেলো হয়েছে। গুড কুকিং। এক নম্বরি ডাল। তারা খেতে বসতে বসতে দশটা বেজে গেল। বারান্দায় টেবিল। দুজনে বসেছে। মুখোমুখি। লোকটা প্লেটে ডাল নিতে নিতে বলল, মুগের ডাল না-কি? সোমা জবাব দিল না। লোকটা হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ডালের গন্ধটা ফাইন। মনে হচ্ছে গুড কুকিং হয়েছে। ডাল ভেজে নিয়েছিলে? হুঁ। গুড। ভেরি গুড। মুগের ডালের আসল রহস্য ভাজার মধ্যে। অল্প ভাজাও যাবে না, আবার বেশিও ভাজা যাবে না। ডিফিকাল্ট। খুব ডিফিকাল্ট। সাদা বিড়ালটা চলে এসেছে। লোকটার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। খামচি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। খেতে না দেওয়া পর্যন্ত এরকম করতেই থাকবে। মাঝে-মাঝে কামড়ও দেবে। সোমা। বল। কানাশালির আবার পেট হয়েছে—দেখছ? শালি ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি তিন মাসে এক বার করে পেট। অবস্থাটা চিন্তা কর। শালি মনে হচ্ছে বিরাট প্রেমিকা। সোমা মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নেই। শুনতেই হবে। অসুন্দর কোনো দৃশ্য দেখতে না চাইলে আমরা চোখ বন্ধ করতে পারি। কান বন্ধ করার কোন উপায় নেই। সোমা। বল। শালির লাইগেশন করিয়ে দিলে কেমন হয়? ফুর্তি করে বেড়াবে। পেট হবে না। ফাইন ব্যবস্থা। বিড়ালেরও লাইগেশন হয়। তুমি জান? জানি না। হয়। খোঁজ নিয়েছি। বদরুল সায়েবের এক শালা পশু হাসপাতালের কম্পাউন্ডার। তার কাছে শুনলাম। শালিকে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাব। কষ্টটা দেখ না, তিন মাস পর-পর-ডালটা ভালো হয়েছে। গুড কুকিং। সোমা জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, বিড়াল জানোয়ার ভালো। ফুর্তিফার্তা যা করে মানুষের আড়ালে করে, আর কুকুরের অবস্থাটা দেখ– সোমা ভাবল লোকটাকে কঠিন কিছু বলবে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। থাক আজ আর বলে কি হবে? কোনো দরকার নেই। সোমা উঠে পড়ল। লোটা বিস্মিত হয়ে বলল, খাওয়া হয়ে গেল? হুঁ। একটা বাটিতে করে শালিকে খানিকটা দুধ খেতে দাও। এখন শালির ভালো মন্দ খাওয়া দরকার। ডালটা ভালো হয়েছে সোমা। গুড কুকিং। সোমা বাটিতে করে বেশ খানিকটা দুধ বিড়ালটাকে এনে দিল। বিড়ালটা জিত ভিজিয়ে ভিজিয়ে দুধ খাচ্ছে আবার ফিরে যাচ্ছে লোকটার পায়ের কাছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার ফিরে আসছে বাটির কাছে। সোমার কাছে এক বারও আসছে না। বিড়ালরাও অনেক কিছু বুঝতে পারে। সোমা। বল। শালিকে এখন থেকে রোজ খানিকটা দুধ দেবে। এই সময় খাওয়াটা ভালো দরকার। তিন মাস পরপর পেট হয়ে যাচ্ছে। কি অবস্থা দেখা লোকটা শব্দ করে ঢেকুর তুলল। বাটিতে সামান্য যা ডাল ছিল চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলল। গোঁফে হলুদ রঙের ছোপ। সোমা এক বার ভাবল, বলবে
false
shorotchandra
ঠিকানা বলে দাও, আমরা ত পরশু সকালের গাড়িতে বাড়ি যাচ্ছি, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজে তোমাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হব, দেখি বুড়ো-বুড়ি আমাকে কি জবাব দেন। তোমার যাঁরা শ্বশুর-শাশুড়ি, তাঁরা আমারও তাই—তাঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আমার কোন লজ্জা নেই। অচলা চকিত হইয়া কহিল, তোমরা পরশু দেশে যাবে, এ কথা ত শুনিনি? এখানে কে কে থাকবেন? বীণাপাণি কহিল, কেউ না, শুধু চাকর-দরোয়ান বাড়ি পাহারা দেবে। আমার জাঠ-শাশুড়ি অনেকদিন থেকেই শয্যাগত, তাঁর প্রাণের আশা আর নেই—তিনি সকলকেই একবার দেখতে চেয়েছেন। অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তোমার শ্বশুরবাড়িটি কোথায়? বীণাপাণি বলিল, কলকাতার পটলডাঙ্গায়। পটলডাঙ্গা নাম শুনিয়া অচলার মুখ শুষ্ক হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে কহিল, বীণা, তা হলে আমাদেরও এ-বাড়ি ছেড়ে কালই যেতে হয়। এখানে থাকা ত আর চলে না। বীণাপাণি হাসিয়া উঠিল। বলিল, তাই বুঝি তোমাদের বাড়ি ফেরবার জন্য এত সাধাসাধি করচি? এতক্ষণে বুঝি আমার কথার তুমি এই অর্থ করলে! না দিদি, আমার ঘাট হয়েছে, তোমাকে কোথাও যেতে আর কখনো আমি বলব না; যতদিন ইচ্ছে এই কুঁড়েঘরে তোমরা বাস কর, আমাদের কারও আপত্তি নেই। কিন্তু এই সদয় নিমন্ত্রণের অচলা কোন উত্তরই দিতে পারিল না। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের যাওয়া কি সত্যই স্থির হয়ে গেছে? বীণাপাণি কহিল, স্থির বৈ কি। আজ আমাদের গাড়ি পর্যন্ত রিজার্ভ করা হয়েচে। বাবার ঘরে যদি একবার উঁকি মারো ত দেখতে পাবে বোধ হয়, পনের-আনা জিনিসপত্রই বাঁধাছাঁদা ঠিকঠাক। দাসী আসিয়া দ্বার-প্রান্তে দাঁড়াইয়া কহিল, বৌমা, মা একবার তোমাকে রান্নাঘরে ডাকচেন। যাই, বলিয়া সে একটু হাসিয়া সহসা আর একবার দুই বাহু দিয়া অচলার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া কানে কানে কহিল, এতদিন লোকের ভিড়ে অনেক মুশকিলেই তোমাদের দিন কেটেচে। এবার খালি বাড়ি—কেউ কোথাও নেই—আপদ-বালাই আমিও দূর হয়ে যাবো—এবার বুঝলে না ভাই দিদিমণিটি? বলিয়া সখীর কপোলের উপর দুটি আঙুলের একটু চাপ দিয়াই দ্রুতবেগে দাসীর অনুসরণ করিয়া চলিয়া গেল। এক টুকরা আনন্দ, খানিকটা দক্ষিণা হাওয়ার মত এই সৌভাগ্যবতী তরুণী লঘুপদে দৃষ্টির বাহিরে অপসৃত হইয়া গেল, কিন্তু তাহার কানে কানে বলা শেষ কথা-দুটি অচলা দুই কানের মধ্যে লইয়া সেইখানে পাষাণ-মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আজিকার রাত্রি এবং কল্যকার দিনটা মাত্র বাকী । তাহার পরে আর কোন বাধা, কোন বিঘ্ন নাই—এই নির্জন নীরব পুরীর মধ্যে—কাছে এবং দূরে, তাহার যতদূর দৃষ্টি যায়—ভবিষ্যতের মধ্যে চোখ মেলিয়া দেখিল—কেবল একাকী এবং কেবলমাত্র সুরেশ ব্যতীত আর কিছুই তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না। দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ এই জনহীন পুরীর মধ্যে কেবলমাত্র সুরেশকে লইয়া জীবনযাপন করিতে হইবে এবং সেই দুর্দিন প্রতি মুহূর্তে আসন্ন হইয়া আসিতেছে। বাধা নাই, ব্যবধান নাই, লজ্জা নাই—আজ নয় কাল বলিয়া একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিবার পর্যন্ত সুযোগ মিলিবে না। বীণাপাণি বলিয়াছিল, সুরমাদিদি, শ্বশুর-ঘর আপনার ঘর, সেখানে হেঁট হয়ে যেতে মেয়েমানুষের কোন শরম নেই। হায় রে, হায়! তাহার কে আছে, আর কি নাই, সে জমাখরচের হিসাব তাহার অন্তর্যামী ভিন্ন আর কে রাখিয়াছে! তথাপি আজও তাহার আপনার স্বামী আছে এবং আপনার বলিতে সেই তাহাদের পোড়া ভিটাটা এখনও পৃথিবীর অঙ্ক হইতে লুপ্ত হইয়া যায় নাই। আজিও সে একটা নিমিষের তরেও তাহার মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে পারে। আবদ্ধ পশুর চোখের উপর হইতে যতক্ষণ না এই বাহিরের ফাঁকটা একেবারে আবৃত হইয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যেমন সে একই স্থানে বারংবার মাথা কুটিয়া মরিতে থাকে, ঠিক তেমনি করিয়াই তাহার অবাধ্য মনের প্রচণ্ড কামনা তাহার বক্ষের মধ্যে হাহাকার করিয়া বাহিরের জন্য পথ খুঁজিয়া মরিতে লাগিল। পার্শ্বের ঘরে সুরেশ নিরুদ্বেগে নিদ্রিত, মধ্যের দরজাটা ঈষৎ উন্মুক্ত এবং তাহারই এ-ধারে মেঝের উপর মাদুর পাতিয়া আপনার আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকিয়া হিন্দুস্থানী দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছে। সমস্ত বাটীর মধ্যে কেহ যে জাগিয়া আছে, তাহার আভাসমাত্র নাই—শুধু সেই যেন অগ্নিশয্যার উপরে দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। অনেক দিন এই পালঙ্কের উপরেই তাহার পার্শ্বে বীণাপাণি শয়ন করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার স্বামী উপস্থিত, সে তাহার নিজের ঘরে শুইতে গিয়াছে, এবং পাছে এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া নিজের বিক্ষিপ্ত পীড়িত চিত্ত অকস্মাৎ তাহাদেরই অবরূদ্ধ কক্ষের সুষুপ্ত পর্যঙ্কের প্রতি দৃষ্টি হানিয়া হিংসায়, অপমানে, লজ্জার অণু-পরমাণুতে বিদীর্ণ হইয়া মরে, এই ভয়ে সে যেন আপনাকে আপনি প্রচণ্ড শক্তিতে টানিয়া ফিরাইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত দেহটা তার তীব্র তড়িৎস্পৃষ্টের ন্যায় থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। পার্শ্বের কোন একটা ঘরের ঘড়িতে দুইটা বাজিল। গায়ের গরম কাপড়খানা ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া বসিতেই অনুভব করিল, এই শীতের রাত্রেও তাহার কপালে-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে। তখন শয্যা ছাড়িয়া মাথার দিকের জানালাটা খুলিয়া দিতেই দেখিতে পাইল, কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর খণ্ড-চন্দ্র ঠিক সম্মুখেই দেখা দিয়াছে, এবং তাহারই স্নিগ্ধ মৃদু কিরণে শোনের নীল জল বহুদূর পর্যন্ত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। গভীর রাত্রির ঠাণ্ডা বাতাস তাহার তপ্ত ললাটের উপর স্নেহের হাত বুলাইয়া দিল এবং সেইখানে সেই জানালার উপরে সে তাহার অদৃষ্টের শেষ সমস্যা লইয়া বসিয়া পড়িল। এই কথাটা অচলা নিশ্চয় বুঝিয়াছিল যে, তাহার এই অভিশপ্ত, হতভাগ্য জীবনের যাহা কিছু সত্য, সমস্তটাই লোকের কাছে শুধু কেবল একটা অদ্ভুত উপন্যাসের মত শুনাইবে এবং যেদিন হইতে এই কাহিনীর প্রথম সূত্রপাত হইয়াছিল, সেইদিন হইতে যত মিথ্যা এ জীবনে সত্যের মুখোশ পরিয়া দেখা দিয়া গিয়াছে, তাহাদের একটি একটি করিয়া মনে করিয়া ক্রোধে, ক্ষোভে, অভিমানে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল এবং
false
shunil_gongopaddhay
স্বরে বলল, যেতে যে হবেই। কথা দিয়েছি! কাদম্বরী বললেন, কাকে কথা দিয়েছ? কী কথা দিয়েছ? আমায় আগে কিছু বলনি তো? রবি বলল, তুমি তো জান, রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর বিয়ে। সেই বিয়ের দিনের জন্য আমাকে দুটি গান লিখে দিতে বলেছিলেন। কয়েকজনকে গান দুটো শিখিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাদম্বরী খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, অন্যদের শিখিয়ে দিতে হবে কেন? তুমি নিজেই গাইলে তো পার। তোমার চেয়ে ভালো আর কে গায়? রবি বলল, সে বিয়ের দিন তো আমি যেতে পারব না! কাদম্বরী আরও বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কি! ঋষিমশাইয়ের মেয়ের বিয়ে, তাতে তুমি যাবে না? উনি কত দুঃখ পাবেন। তোমাকে এত ভালোবাসেন। রবি বলল, ঋষিমশাই নিজেই মেয়ের বিয়েতে যাবেন না। বাবামশাই আমাদেরও যেতে নিষেধ করেছেন! ব্ৰাহ্মদের তিন শরিকের রেষারেষি এক একটা বিবাহকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সঙ্গে কেশব সেনের নব বিধানের ব্যবধান এখন দুস্তর, মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ। কেশবের দল ভাঙা বিদ্রোহী তরুণ গোষ্ঠী যে সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ স্থাপন করেছে, তার প্রতি বরং আদি ব্রাহ্মসমাজের বটবৃক্ষ দেবেন্দ্রনাথের প্রসন্ন দৃষ্টি আছে। তরুণদের পৃথক প্রার্থনাগৃহ গড়ার জন্য তিনি সাত হাজার টাকা দান করেছেন, কেশবের দলকে দুর্বল করে দেবার জন্য এও এক ধরনের রাজনীতি। হিন্দুদের সঙ্গে ব্ৰাহ্মদের বিবাহ হয় না। হিন্দুরাই বিয়ে দিতে চায় না। আবার তিন শরিকের মধ্যেও বিবাহ-সম্পর্ক বন্ধ হবার উপক্রম। রাজনারায়ণ বসু দেবেন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগত, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতা, তার মেয়ে লীলাবতীর বয়েস সতেরো, তার সঙ্গে বিবাহ হবে কৃষ্ণকুমার মিত্রের। কৃষ্ণকুমার অতি সুপাত্র, আপত্তির কোনও কারণ নেই, যদিও তার বয়েস কিঞ্চিৎ বেশি এখন আটাশ। সম্বন্ধ করা বিয়ে নয়, পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে দেখেছে এবং মনোনীত করেছে। সব কিছুই তো শুভ ছিল, কিন্তু অতি সামান্য ব্যাপারে মনোমালিন্য দেখা দিল। কৃষ্ণকুমার ব্ৰাহ্মদের তৃতীয় দল অর্থাৎ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য, এবং সে জেদ ধরেছে বিবাহ হবে তাদের মতে। কিছুকাল আগে সিভিল ম্যারেজ বিল পাস হয়েছে, এতে জাতি-বিচার নেই, মন্ত্র কিংবা পুরুতের কোনও স্থান নেই, তরুণ ব্রাহ্মের দল এটাই মানে। আদি ব্ৰাহ্মরা আবার এর ঘোর বিরোধী, কারণ রেজিস্ট্রি করে বিয়ে মানে তো নিরীশ্বর বিবাহ, নাস্তিকতা! দেবেন্দ্রনাথ তা শুনেই এ বিয়েতে অসম্মতি জানালেন। রাজনারায়ণ বসু দেখলেন যে তাঁর মেয়ে এই পাত্ৰকেই বিয়ে করতে খুব আগ্রহী, তিনি মেয়ের ইচ্ছেতে বাধা দিলেন না। মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ সৌভাগ্যের অন্তরায় হবেন কেন তিনি! কিন্তু বিয়ের দিন কন্যা পক্ষের কেউ যাবে না, ঠাকুরবাড়ির কেউও যাবে না। কাদম্বরী যখন বুঝলেন, রবিকে যেতেই হবে, সে সাড়ে আটটার স্টিমার ধরবে, বেশি সময় নেই, তখন তিনি দোলন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কিছু খেয়ে যাবে তো? চল, তোমার জলখাবারের ব্যবস্থা করে দি গে। কয়েক পা গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, তুমি রাত্তিরে কলকাতায় থেকে যাবে না তো? ফিরে আসবে, কথা দাও! কোতোয়ালির ঘাট থেকে স্টিমারে চাপাবার পর রবির মন কিছুটা উতলা হয়ে উঠল। এমন ভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি, আজ না গেলেই বা কী ক্ষতি হতো! অন্য কেউ তার গান গাইলে রবির বেশ ভাল লাগে। ব্ৰাহ্মসমাজের উপাসনায় এখন অনেকেই গাইছে। সব সময় নিজেকে গাইতে হয় না, অন্যরা আগ্রহ করে শেখে। ভাগ্নে সত্যপ্ৰসাদ তাকে একদিন বলেছিল, দেহোর মোড়ে কয়েকটি ছাত্রকে সে রবির গান গাইতে শুনেছে। কথাটা শুনে গোপন পুলকের রোমাঞ্চ হয়েছিল রবির, সম্পূর্ণ অচেনা লোকেরাও তার গান পছন্দ করেছে। বিলেত যাবার আগে পর্যন্ত রবি প্রায় সর্বক্ষণই জ্যোতিদাদা ও নতুন বউঠানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত ফিরত। জ্যোতিদাদা যখন থাকতেন না, তখন মুখোমুখি দুজনে। কত কথা, কত নীরবতা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন মনে এক একটা আলোর বিন্দু। এখন রবিকে লেখার জন্য অনেক সময় দিতে হয়, বাইরের পৃথিবীও ডাকাডাকি করে। তবু নতুন বউঠানের সাহচর্যেই সে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়। গান শোনাতে শোনাতে উৎসুকভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি সামান্য প্রশংসা করলে রবি ধন্য হয়ে যায়। আজ নতুন বউঠানের মনটা ভালো ছিল, পাখির ডাক শুনে জেগে তিনি খুব ভোরে ফুল কুড়োতে নেমেছিলেন, রবিকে নিয়ে অনেকক্ষণ থাকতে চেয়েছিলেন বাগানে। আজই কেন রবিকে চলে যেতে হল! এখন জোয়ার রয়েছে, স্টিমারের গতি বেশ দ্রুত। ভরা গঙ্গায় ঢেউ তুলে স্টিমারটা এগিয়ে চলল কলকাতার দিকে। নানা জাতের অনেক যাত্রী, কারুর সঙ্গে একটি কথাও বলেনি রবি, অচেনা মানুষদের সঙ্গে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভাব জমাতে পারে না। ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে গান দুটি ভেঁজে নিচ্ছে বারবার। আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষার দৃশ্য তার চক্ষুকে আরাম দেয়। এক সময় চোখে পড়ল দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির কালী মন্দির। রবির ভুরু একটু কুঁচকে গেল। কালী মন্দির দেখলেই তার চোখে ভাসে একটা হাঁড়িকাঠ আর পাঁঠা বলির পর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা টকটকে রক্ত। তার গা গুলিয়ে ওঠে। জন্ম থেকেই মূর্তিপূজার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ব্ৰাহ্মরা নিজেদের হিন্দুও মনে করে না। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের বিরহর কাহিনী, যমুনা পুলিনে বাঁশি বাজায় এক শ্যামবর্ণ যুবা, বিবাহিতা রাধা উচাটন হয় সেই বাঁশি শুনে। ছুটে আসে সে নীল রাত্রির কুঞ্জবনে, এসব তাকে আকৃষ্ট করে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীকেও তার বেশ পছন্দ। কিন্তু কালী, ওই করাল মূর্তিকেও মানুষ পুজা করে কেন? দেবতার পূজার নামে মানুষ কী করে হিংসায় মাতে, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে পশু বলি দেয়, তা তার বুদ্ধির অগম্য।
false
shordindu
দিল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে হাসিতে হাসিতে বায়ুবেগে অশ্ব ছুটাইয়া দিল। পাটলিপুত্রের দুৰ্গতোরণে যখন উল্কা পৌঁছিল, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। শান্তির সময় দিবাভাগে তোরণে প্রহরী থাকে না, নাগরিকগণও মধ্যাহ্নের খর রৌদ্রতাপে স্ব স্ব গৃহচ্ছায়া আশ্রয় করিয়াছে; তাই তোরণ জনশূন্য। কেবল উষ্কার পথশ্ৰান্ত সহচরীগণ উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করিতেছে। উল্কা উন্নত তোরণ-সম্মুখে ক্ষণেক দাঁড়াইল। একবার উত্তরে দূর-প্রসারিত শূল-কণ্টকিত শ্মশানভূমির দিকে দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরে তোরণ-প্রবেশ করিল। কিন্তু তোরণ উত্তীর্ণ হইয়া কয়েক পদ যাইতে না যাইতে আবার তাহার গতি রুদ্ধ হইল। সহসা পার্শ্ব হইতে বিকৃতকণ্ঠে কে চিৎকার করিয়া উঠিল—জল! জল! জল দাও! রুক্ষ উগ্ৰকণ্ঠের এই প্রার্থনা কানে যাইতেই উল্কা অশ্বের মুখ ফিরাইল। দেখিল, তোরণপার্শ্বস্থ প্রাচীরগাত্র হইতে লৌহবলয়-সংলগ্ন স্কুল শৃঙ্খল বুলিতেছে, শৃঙ্খলের প্রান্ত এক নিরাকার বীভৎস মূর্তির কটিতে আবদ্ধ। মূর্তির করপত্র নাই, পদদ্বয়ও জঙ্ঘা সন্ধি হইতে বিচ্ছিন্ন—জটাবদ্ধ দীর্ঘ কেশে মুখ প্রায় আবৃত। সে তপ্ত পাষাণ-চত্বরের উপর কৃষ্ণকায় কুম্ভীরের মতো পড়িয়া আছে এবং লেলিহা রসনায় অদূরস্থ জলকুণ্ডের দিকে তাকাইয়া মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছে—জল! জল। মাধ্যন্দিন সূৰ্যতাপে তাহার রোমশ দেহ হইতে স্বেদ নির্গত হইয়া চত্বর সিক্ত করিয়া দিতেছে। উল্কা উদাসীনভাবে সেই দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার মনে করুণার উদ্রেক হইল না। শুধু সে মনে মনে ভাবিল—এই মগধবাসীরা দেখিতেছি নিষ্ঠুরতায় অতিশয় নিপুণ। শৃঙ্খলিত ব্যক্তি জন-সমাগম দেখিয়া জানুতে ভর দিয়া উঠিল, রক্তিম চক্ষে চাহিয়া বন্য জন্তুর মতো গর্জন করিল—জলি! জল দাও! উল্কা একজন সহচরকে ইঙ্গিত করিল; সে জলকুণ্ড হইতে জল আনিয়া তাহাকে পান করাইল। শৃঙ্খলিত ব্যক্তি উত্তপ্ত মরুভূমির মতো জল শুষিয়া লইল। তারপর তৃষ্ণা নিবারিত হইলে অবশিষ্ট জল সর্বাঙ্গ মাখিয়া লইল। উল্কা জিজ্ঞাসা করিল—কোন অপরাধে তোমার এরূপ দণ্ড হইয়াছে? গত তিন বৎসর ধরিয়া বন্দী প্রতিনিয়ত বিদ্যুপকারী নাগরিকদের নিকট এই একই প্রশ্ন শুনিয়া আসিতেছে। সে উত্তর দিল না—হিংস্ৰদূষ্টিতে উল্কার দিকে তাকাইয়া পিছু ফিরিয়া বসিল। উল্কা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল—কে তোমার এরূপ অবস্থা করিয়াছে? শিশুনাগবংশের রাজা? শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দন্ত বাহির করিয়া বন্দী ফিরিয়া চাহিল। তাহার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইল, একবার মুক্তি পাইলে সে উল্কাকে দুই বাহুতে পিষিয়া মারিয়া ফেলিবে। উল্কা যে তাঁহাকে এইমাত্র পিপাসার পানীয় দিয়াছে, সে জন্য তাহার কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা নাই। সে বিকৃত মুখে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিল—পথের কুকুর সব, দূর হইয়া যা। লজ্জা নাই? একদিন আমি তোদের পদতলে পিষ্ট করিয়াছি, আবার যেদিন এই শৃঙ্খল ছিড়িব, সেদিন আবার পদদলিত করিব। এখন পলায়ন কর-আমার সম্মুখ হইতে দূর হ। উল্কার চোখের দৃষ্টি সহসা তীব্ৰ হইয়া উঠিল; সে অশ্বাপূষ্ঠে ঝুঁকিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কে তুমি? তোমার নাম কি? ক্ষিপ্তপ্রায় বন্দী দুই বাহু দ্বারা নিজ বক্ষে আঘাত করিতে করিতে বলিল—কে আমি? কে আমি? তুই জানিস না? মিথ্যাবাদিনি, আমাকে কে না জানে? আমি চণ্ড—আমি মহারাজ চণ্ড! তোর প্রভু। তোর দণ্ডমুণ্ডের অধীশ্বর! বুঝিলি? আমি মগধের নায্য অধিপতি মহারাজ চণ্ড। উল্কা ক্ষণকালের জন্য যেন পাষাণে পরিণত হইয়া গেল। তারপর তাহার সমস্ত দেহ কম্পিত হইতে লাগিল, ঘন ঘন নিশ্বাস বহিল, নাসা স্ফুরিত হইতে লাগিল। তাহার এই পরিবর্তন বন্দীরও লক্ষ্যগোচর হইল, উন্মত্ত প্ৰলাপ বকিতে বকিতে সে সহসা থামিয়া গিয়া নিষ্পলক নেত্ৰে চাহিয়া রহিল। উল্কা কথঞ্চিৎ আত্মসম্বরণ করিয়া সহচরদের দিকে ফিরিল, ধীরস্বরে কহিল—তোমরা ঐ পিপ্পলীবৃক্ষতলে গিয়া আমার প্রতীক্ষা কর, আমি এখনই যাইতেছি। সহচরীগণ প্ৰস্থান করিল। তখন উল্কা অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া বন্দীর সম্মুখীন হইল। চত্বরের উপর উঠিয়া একাগ্ৰদূষ্টিতে বন্দীর মুখ নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল—তুমিই ভূতপূর্ব রাজা চণ্ড। চণ্ড সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল—ভূতপূর্ব নয়—আমিই রাজা। আমি যত দিন আছি, তত দিন মগধে অন্য রাজা নাই। তোমাকে তবে প্ৰজারা হত্যা করে নাই? আমাকে হত্যা করিতে পারে, এত শক্তি কাহার? রক্তহীন অধরে উল্কা জিজ্ঞাসা করিল—মহারাজ চণ্ড, মোরিকা নামী জনৈকা দাসীর কথা মনে পড়ে? চণ্ডের জীবনে বহুশত মোরিকা ক্রীড়াপুত্তলীর মতো যাতায়াত করিয়াছে, দাসী মোরিকার কথা তাহার মনে পড়িল না। উল্কা তখন জিজ্ঞাসা করিল—মোরিকার এক বিষকন্যা জন্মিয়াছিল, মনে পড়ে? এবার চণ্ডের চক্ষুতে স্মৃতির আলো ফুটিল, সে হিংস্ৰহাস্যে দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল—মনে পড়ে, সেই বিষকন্যাকে শ্মশানে প্রোথিত করাইয়াছিলাম। শিবমিশ্রকেও শ্মশানের শৃগালে ভক্ষণ করিয়াছিল। অতীত নৃশংসতার স্মৃতির মধ্যেই এখন চণ্ডের একমাত্র আনন্দ ছিল। উল্কা অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল—সে বিষকন্যা মরে নাই, শিবমিশ্রকেও শৃগালে ভক্ষণ করে নাই। মহারাজ, নিজের কন্যাকে চিনিতে পারিতেছেন না? চণ্ড চমকিত হইয়া মুণ্ড ফিরাইল।। উল্কা তাহার কাছে গিয়া কৰ্ণকুহরে বলিল—আমিই সেই বিষকন্যা। মহারাজ, শিশুনাগবংশের চিরন্তন রীতি স্মরণ আছে কি? এ বংশের রক্ত যাহার দেহে আছে, সেই পিতৃহন্ত হইবে। —তাই বহুদূর হইতে বংশের প্রথা পালন করিতে আসিয়াছি। চণ্ড কথা কহিবার অবকাশ পাইল না। উদ্যতফণা সৰ্প যেমন বিদ্যুদ্বেগে দংশন করে, তেমনই উল্কার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে প্ৰবেশ করিল। সে উর্ধর্বমুখ হইয়া পড়িয়া গেল, তাহার প্রকাণ্ড দেহ মৃত্যু-যন্ত্রণায় ধড়ফড় করিতে লাগিল। দুইবার সে বাক্য-নিঃসরণের চেষ্টা করিল। কিন্তু বাক্যস্ফুর্তি হইল না—মুখ দিয়া গাঢ় রক্ত নিৰ্গলিত হইয়া পড়িল। শেষে কয়েকবার পদপ্রক্ষেপ করিয়া চণ্ডের দেহ স্থির হইল। উল্কা কটিলগ্ন হস্তে দাঁড়াইয়া দেখিল। তারপর ধীরপদে গিয়া নিজ অশ্বে আরোহণ করিল, আর পিছু ফিরিয়া তাকাইল না। তাহার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইয়া রহিল। নির্জন তোরণপার্শ্বে মধ্যাহ্ন-রৌদ্রে ষোল বৎসরের পুরাতন নাট্যের শেষ অঙ্কে যে দ্রুত অভিনয় হইয়া গেল, জনপূর্ণ পাটলিপুত্রের কেহ তাহা দেখিল না। এইরূপে শোণিতপঙ্কে দুই হস্ত রঞ্জিত করিয়া মগধের বিষকন্যা আবার মগধের মহাস্থানীয়ে পদাপণ করিল। মদন-মহোৎসবের
false
shunil_gongopaddhay
হারটার দাম আগেই দিয়ে দিয়েছে, অসিত ব্যাঙ্ক থেকে সেই চেক ভাঙিয়ে নিল? ওরা অনেক খাবারের অর্ডার দিয়েছে। সন্তু আস্তে-আস্তে খেতে লাগল। বেশ খানিকটা সময় লাগবে মনে হচ্ছে। সন্তু এক গেলাস লস্যি নিল। কালো চশমা-পরা লোকটা দূরে ঘোরাঘুরি করছে। ওর কাছে যদি রিভলভার থাকে, তা হলে তো এখন ওই দামি চুনির হারটা কেড়ে নেওয়া কিছুই নয়। লোকটা নিচ্ছে না কেন? যে-মেয়েটির কম বয়েস, সে এখন মালাটা গলায় পরে আছে। রোদ্দুরে ঝকঝক করছে লাল রঙের পাথরগুলো। ওদের খাওয়া শেষ হতে দেরি আছে। সন্তু ঝট করে একবার উঠে গেল। বাগানের রেস্তরাঁর একপাশেই হোটেল। এখানে লোক থাকে। লবিতে ফোন রয়েছে কয়েকটা। সন্তু পয়সা ফেলে ফোন করল বাড়িতে। কাকাবাবু নেই, মা ধরলেন। সন্তু একটু নিরাশ হয়ে বলল, কাকাবাবু নেই? ফিরলেই বলবে, গ্রিনভিউ হোটেল, একটি সতেরো বছর বয়েসী মেয়ে, চুনির মালা! মা দারুণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি? সন্তু বলল, মনে রাখতে পারবে না? গ্রিনভিউ হোটেল, একটি সতেরো বছর বয়েসী মেয়ে.. তার মানে কী? তোমাকে মানে বুঝতে হবে না। শুধু কথাগুলো মনে রাখবে! গ্রিনভিউ হোটেল? তুই সেখানে কী করছিস? কাজ আছে। কাজ আছে। একটা সতেরো বছরের মেয়ে। তার সঙ্গে তোর কী করে ভাব হল? সন্তু, ওইসব হোটেলের মেয়েদের সঙ্গে ভাব করতে তোকে কে বলেছে? আঃ, কে বলেছে যে আমার সঙ্গে ভাব হয়েছে? তার সঙ্গে আমার কোনও কথাই হয়নি! তবে তার কথা বলছিস কেন? তা তুমি বুঝবে না। শুধু কথাগুলো মনে রাখবে। তুই দুপুরে বাড়িতে খেতে আসবি না? না। ফোন রেখে সন্তু আবার তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় ফিরে গেল। ওরা বিল মেটাচ্ছে। সন্তু আগেই বিল দিয়ে দিয়েছে, নিজের থলেটা তুলে নিয়ে চলে গেল এক কোণে। ওরা খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গেল হোটেলের লবির দিকে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। ওই হোটেলেরই কোনও ঘরে মেয়ে দুটি থাকে তা হলে! কেননা, অল্প বয়েসী মেয়েটি চাবি চেয়ে আনল কাউন্টার থেকে। লিফট থামার পর অল্প বয়েসী মেয়েটি ঢুকে গেল, অসিত আর অন্য মহিলাটি গেল না। দূর থেকে সন্তু দেখল, সেই কম বয়েসী মেয়েটির গলায় দুলছে চুনির মালা। অন্য মহিলাটি ও অসিত হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ট্যাক্সিতে উঠল। সন্তু একবার ভাবল, বাচ্চা মেয়েটা হোটেলের ঘরে একলা থাকবে, ওর কাছ থেকে এখন যদি চুনির মালাটা কেউ কেড়ে নেয়? সন্তুর কি উচিত মেয়েটার ঘরের বাইরে পাহারা দেওয়া? কিন্তু মেয়েটা লিফটে উঠে কোন্ তলায়, কত নম্বর ঘরে গেল কে জানে! তা ছাড়া কাকাবাবু তাকে বলেছেন, অসিতকে ফলো করতে। অসিতদের ট্যাক্সি এল নিউ মার্কেটে। এখানে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে ওরা গেঞ্জি, রুমাল, মোজা কিনল অনেকগুলো। এক দোকান থেকে চটিও কিনল অসিত। সন্তু পেছন-পেছন ঘুরছে, তার আর কিছুই করার নেই। নিউ মার্কেটে কেনাকাটা সেরে অসিত সেই মহিলাকে নিয়ে ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে চলে এল গঙ্গার ধারে। খানিকটা যাওয়ার পর এক জায়গায় ট্যাক্সিটা থামাল। তার থেকে নেমে এবার অসিত ভাড়া মিটিয়ে দিল, খালি ট্যাক্সিটা ঘুরে চলে গেল উলটো দিকে। গঙ্গার ধার দিয়ে অলসভাবে পাশাপাশি হাঁটছে অসিত আর সেই মহিলাটি। দুজনে মাথা নেড়ে কী যেন বলছে। কেউ রাস্তা দিয়ে আস্তে-আস্তে হাঁটলে, তাকে গাড়ি নিয়ে ফলো করা যায় না। সেটা বিচ্ছিরি দেখায়। সন্তুও গাড়িটাকে এক জায়গায় থামতে বলে নেমে পড়ল। অসিত এখনও তাকে লক্ষ করেনি। একবারও তার দিকে ফিরে চায়নি। একজন ছোট ছেলে অনুসরণ করবে, এরকমটা কেউ ভাবতে পারে না। সন্তু ঠিক করল, অসিতের খুব কাছাকাছি গিয়ে হাঁটবে। ওরা কী কথা বলছে, তা শোনার চেষ্টা করবে। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। ওদের কাছাকাছি যেতেই অসিত সেই মহিলাকে নিয়ে একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল জলের ধারে। সেখানে একটা নৌকো থেমে আছে। নৌকোর মাঝির সঙ্গে দু-একটা কী কথা বলে ওরা নৌকোয় উঠে গেল, মাঝিটিও দড়ি খুলে দিল। সন্তু মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। এবার কী করা যায়? কাছাকাছি আর কোনও নৌকো নেই। একটু দূরেই গোটা দু-এক জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। অসিতদের নৌকোটা সেইদিকেই যাচ্ছে, একটু বাদেই জাহাজের আড়ালে চলে যাবে। সেই সাদা রঙের গাড়িটাকে অনেকক্ষণ দেখেনি সন্তু। হঠাৎ কোথা থেকে খুব জোরে এসে থামল। কালো চশমা পরা লোকটি নেমে এসে দৌড়ে গঙ্গার ধারে রেলিং-এর কাছে গিয়ে দেখল অসিতদের নৌকোটা। মনে হল, এই লোকটাও খুব হতাশ হয়েছে। গাড়ি নিয়ে তো কোনও নৌকোকে ফলো করা যায় না। গঙ্গায় আরও অনেক নৌকো ভাসছে, কিন্তু এখানে ঘাটের কাছে একটাও নেই। কালো চশমা-পরা লোকটা আবার ফিরে এল নিজের গাড়ির কাছে। একবার যেন সন্তুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। কিংবা অন্য কোনও কারণেও হাসতে পারে। তার গাড়িটা স্টার্ট নিয়েই ফুল স্পিডে চলে গেল হাওড়া ব্রিজের দিকে। সন্তু ক্যামেরা বার করে নৌকোটার ছবি তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু শাটার টেপা গেল না। তার মানে ফিল্ম শেষ। সন্তুর মনে হল, আর অসিতকে ফলো করা মানে বৃথা চেষ্টা। শুধু-শুধু গাড়ি ভাড়া বাড়বে। নৌকো থেকে অসিত কোথায় নামবে, তার কি কোনও ঠিক আছে? গঙ্গার ওপারে চলে যেতে পারে। গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভারটি জিজ্ঞেস করল, এবার কোথায় যাব? ট্যাক্সিটা তো চলে গেল, লোকটাকে এখন কোথায় পাবেন? সন্তু ধমক দিয়ে বলল, আপনাকে বলেছি না, কোথায় যাব, কেন যাব জিজ্ঞেস করবেন না। এখন আমার বাড়িতে চলুন। ড্রাইভারটি ধমক খেয়েও
false
shomresh
যাচ্ছে তাকে ও ঠিক চেনে না। এই শরীরটা থেকে যে বুক-ভরে-যাওয়া সুগন্ধ বেরুচ্ছে সেটাই যেন একটা আড়াল তৈরি করে ফেলেছে। এত সুন্দর গন্ধ মুভিং ক্যাসেলের শরীর থেকেও বের হয় না। বিলিতি সেন্ট বোধহয়। মোড়ের মাথায় এসে একটা রিকশা নিল ছোটকাকা। কোনো দর-কষাকষি করল না, বলল, ঘণ্টা চারেক থাকতে হবে, দশ টাকা পাবে। রিকশাওয়ালাটা বোধহয় এরকম খদ্দের আগে পায়নি, অবক হয়ে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ল। ছোটকাকার পাশে রিকশায় বসতে অনিমেষের মনে হল ওর জামাকাপড়ও গন্ধে ভুরভুর করছে এখন। হাওয়া কেটে ছুটছে রিকশাটা টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে। ছোটকাকা বলল, আগে পোস্টঅফিসের দিকে চলো। ঘাড় নেড়ে রিকশাওয়ালা পি ডব্লু ডি অফিস ছাড়িয়ে করলা নদীর পুলের ওপর উঠল। করলা নদীর একদিকটায় কচুরিপানা কম। আরও একটু বাঁদিকে তাকালে তিস্তা দেখা যায়-করলা-তিস্তার সঙ্গমটায় কিং সাহেবের ঘাট। করলা নদীর দিকে তাকাতেই চট করে অনির সেই ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ও সোজা হয়ে বসল। অলসভাবে শরীরটা রেখে প্রিয়তোষ শহর দেখছিল। এই কয় বছরে একটুও বদলায়নি জলপাইগুড়ি, শুধু নতুন নতুন কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছে এদিকটায়। করলার পারে বিরাট জায়গা জুড়ে হলঘরমতন কিছু হচ্ছে। হঠাৎ ও লক্ষ করল অনিমেষ কেমন সিঁটিয়ে বসে আছে। কী হল তোর? প্রিয়তোষ পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞাসা করল। মনে পড়ে যাওয়া থেকে অনিমেষ চুপচাপ ভাবছিল কথাটা বলবে কি না। ও ঠিক বুঝে উঠছিল না যে ছোটকাকা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে। ও নিজে অবশ্য আর গার্লস স্কুলে যায়নি, কিন্তু তপুপিসি যে এখনও এখানে আছে এ-খবর সে জানে। আর আশ্চর্য, এতদিন জলপাইগুড়ি শহরে থেকে তপপিসি একদিনের জন্যও ওদে বাড়িতে আসেনি! তপুপিসির কথা ছোটকাকুকে কীভাবে বলবে মনেমনে গোছাচ্ছিল সে। প্রিয়তোষ অবাক হচ্ছিল ওর মুখ দেখে। নরম গলায় বলল, কিছু বলবি? ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তারপর উলটোদিকে কারখানার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার একটা চিঠি আমি পুলিশকে নিতে দিইনি। চিঠিটা দাদুর বড় আলমারিতে আছে। প্রিয়তোষ ব্যাপারটা ধরতে পারল না একবিন্দু, আমার চিঠি? কী বলছিস, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি সুটকেসে রেখে গেল ছোটাকাক, অথচ এখন কিছুই মনে পড়ছে না। চিঠির সমস্ত লাইনগুলো অবশ্য অনিমেষের নিজের মনে নেই, কিন্তু সব মিলিয়ে এই বোধটা ওর মনে আছে যে তপুলিসি খুব দুঃখ পেয়েছিল আর চিঠিটা পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই তপুপিসির ওপর অত্যাচার করত। অথচ ছোটকাকা কিছু বুঝতে পারছে না! তপুপিসির লেখা একটা চিঠি তোমার সুটকেসে পেয়েছিলাম আমি। তোমাকে খুঁজতে আসার আগেই লুকিয়ে ফেলেছিলাম। চিঠিটা দাদুর কাছে আছে। অনিমেষ আস্তে-আস্তে কথাগুলো বলল। ব্যাপারটা বুঝতে যেন একটু সময় লাগল ছোটকাকার। তারপর নিজের মনেই যেন বলল, ও, আচ্ছা! আমার একদম খেয়াল ছিল না চিঠিটার কথা। তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বলল, তুই পড়েছিস? মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমি জানতাম না ওটা কার চিঠি। কথা বলেই ও বুঝতে পারল যে ঠিক বলা হল না। কারণ ছোটকাকুর সুটকেসে অন্য কার চিঠি থাকতে যাবে! আর চিঠিটা খুলেই ও তপুপিসির নাম দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু চিঠিটা তখন না-পড়ে উপায় ছিল না-এটা মনে পড়ছে। রিকশাওয়ালা পোস্টঅফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোটকাকা এফ ডি আই স্কুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কদমতলা দিয়ে মাষকলাইবাড়ি চলো।…বাবা কী বলল? শেষ প্রশ্নটা ওকে করছে বুঝতে পেরে অনিমেষ বলল, দাদু কিছু বলেননি, শুধু আলমারিতে তুলে রেখে দিলেন। রাহুতবাড়ির তলাটা জমজমাট। এখনও সন্ধে হয়নি, আশেপাশে প্রচুর সাইকেলরিকশা ছুটে যাচ্ছে। প্রিয়তোষ চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ছোটকাকা তাকে ছোটকাকা একবারও কিন্তু তপুপিসির কথা জিজ্ঞাসা করল না। নাকি এখানকার সব খবর যেমন ছোটকাকা জানে তপূপিসির কথাও অজানা নয়! তপুপিসি ওকে খবরটা দিয়ে নিজে থেকেই বলেছিল, তাই হোটকাকাকে বলা ওর কর্তব্য। ছোটকাকা, তপুপিসি তোমাকে দেখা করতে বলেছে। তপু তোকে বলেছে? হ্যাঁ। তোর সঙ্গে কেথায় দেখা হল? স্বৰ্গছেঁড়ায়? না। তপুপিসি স্বৰ্গছেঁড়ায় নেই এখন। এখানে গার্লস স্কুলে কাজ করে তপুপিসি। তোমার খবর নিতে আমি একদিন ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার খবর নিতে? আমার খবর ওর কাছে পাবি কী করে মনে হল। অনেক কষ্টে অনিমেষ বলতে পারল, তোমার চিঠিটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল। প্রিয়তোষ কোনো কথা বলল না। থানার পাশ দিয়ে রুবি বোর্ডিং ছাড়িয়ে কদমতলার রাস্তায় যাচ্ছিল রিকশাটা। অনিমেষ দেখল রূপশ্রী সিনেমার সামনেটা একদম ফাঁকা, সামান্য কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে। আর ওপরে বিরাট সাইনবোর্ডে একটা ছোট ছেলে তার চেয়ে বড় একটা মেয়ের সঙ্গে দৌড়ে যাচ্ছে। সামনে একটা গাড়ি রাস্তা জুড়ে থাকায় ওদের রিকশাটা দাঁড়িয়ে গেল। অনিমেষ সিনেমার হোডিং-এ ছবির নামটা পড়ল, পথের পাঁচালী। কীরকম ছবি এটা একদম ভিড় নেই কেন? ওর মনে পড়ল আলোছায়াতে দস্যু মোন হচ্ছে, মণ্টু বলছিল ভীষণ ভিড় হচ্ছে। আর তখনই অনিমেষ সিনেমা হলের গেটের দিকে তাকিয়ে প্রায় উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তোষ চমকে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করল, কী হল? চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, তপুপিসি! প্রিয়তোষের কপালে সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটে ভজ আঁকা হয়ে গেল! মুখ ঘুরিয়ে অনিমেষের দৃষ্টি অনুসরণ করে ও সিনেমা হলের সামনেটা ভালো করে দেখল। আট-দশজন স্কুলের মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে নীলপাড় সাদা শাড়ি পরে তপু টিকিট গুনছে। কিছু বলার আগেই অনিমেষ লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত হেঁটে তপপিসির কাছে গিয়ে হাজির হল। ওকে দেখতে পায়নি তপুপিসি, অনিমেষ কাছে
false
shunil_gongopaddhay
ওরা আমাদের বিশ্বাস করবে? আপন জন বলে ভাববে? শেখর বললো, তুই একটা মধ্যবিত্ত, তোর কথা কে শুনবে? কেউ শুনবে না। বিপ্লব যদি কখনো হয় তবে তার নেতা ওদের মধ্যে থেকেই জন্মাবে। –কবে? ভিড়ের মধ্যে লখাকে দেখতে পেয়ে শেখর ওকে ডেকে উঠলো। লখার সঙ্গে স্পষ্ট চোখাচোখি হতেও লেখা সাড়া দিলো না, চট করে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। অসীম হাসতে হাসতে বললো, ওর অভিমান হয়েছে! আসবে আবার ঠিক, কলকাতায় চাকরি দেবার লোভ দেখিয়েছি। পরমেশ্বরের সঙ্গে অপর্ণা আর জয়াও এসেছে। ওরা চারজন তখন জুয়ার বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে, অসীম শেখরকে বলছিল, কি রে, খেলবি নাকি? শেখর বলছিল, কী হবে খেলে, গরিব বেচারারার এক্ষুনি আমাদের কাছে হেরে সর্বস্বাস্ত হয়ে যাবে! এ খেলায় যার বেশি টাকা থাকে সেই জেতে, আমি কতবার দেখেছি! এদের সঙ্গে খেলতে ভালো লাগে না– অসীম বললে, যা, যা, চাল মারিস না! তুই সব খেলাতেই জিতিস? খেলে দ্যাখ না? শেখর হেসে পকেট থেকে ব্যাগ বার করলো! ফিন্স ফিস করে বললো, অসীম তুই আমার জুয়া খেলা দেখিস নি। সুনীল আর অবিনাশের সঙ্গে বারীণদার আড্ডায় এক সময় কি ভুল কালাম কাণ্ড করেছি, তুই তা জানিস না। একটা লাল দুটাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে শেখর বললো, ছড়িদার, রাখো ওটা হরতনের ওপর রাখো। যে লোকটু বোর্ড পেতেছে, সে সম্ভ্রমের সুরে বললো, পুরা দুরুপিয়া, মালিক? এখানে সিকি-আধুলির বেশি কেউ খেলে না, সামৰ্থ্য নেই। শেখর ঘাড় হেলালো। টিনের কৌটের মধ্যে একটা বড় ছক্কা ঘটং ঘটং করে নেড়ে ওলটালো লোকটা। রুহিতন। শেখর হেরেছে। শেখরের মুখে কিন্তু তখনো টেপা হাসি। এবার একটা পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ফিন্‌ হরতন। সেবারেও শেখরের হার! শেখর একটা দশ টাকার নোট রাখলে সেই হরতনেই। আবার হার। আবার হরুতনে কুড়ি টাকা। সবাই উদ্‌গ্ৰীব হয়ে শেখরকে দেখছে। সেবার হরতন উঠলো, শেখর বললো দাও। হে ছড়িদার, ষাট টাকা দাও! দেখলি অসীম এ খেলাটা এতই সোজা। সঞ্জয় বললো, থাক শেখর, টাকাটা তুই নিস নি। বেচারা গরিব লোক। শেখর বললো, অত দয়ামায়া আমার নেই। জুয়ার টাকা আমি ছাড়ি না। এমন সময় পেছন থেকে জয়ী বলেছিল, একি, কতক্ষণ থেকে আপনাদের খুঁজছি! ওরা পেছন ফিরে বললো, আমরাও তো তোমাদের খুঁজছি। রুণি, তোমার কাচের চুড়ি কেনা হয়েছে? হয় নি? চলো খুঁজে দেখি। –আপনাদের আরেকজন কই? ওরা তাকিয়ে দেখলো, রবি নেই। একটু আগেও ছিল। অসীম বললো, কিছু একটা কিনছে বোধহয়। এসে পড়বে এক্ষুনি! অপর্ণা বললো, আমরা তো সব জায়গাই ঘুরে এলুম, ওকে কোথাও দেখলুম না তো! –একটু আগেও তো ছিল আমাদের সঙ্গে। কিছু বলে যায় নি যখন, তখন কাছেই কোথাও গেছে? হয়তো– –আপনারা ঐ ভিড়ের মধ্যে কি করছিলেন? –জুয়া খেলছিলাম! শেখর অনেক টাকা জিতে নিয়েছে! জুয়ার কথা শুনে জয়া একটু আঁৎকে উঠলো। ভর্ৎসনার চোখে শেখরকে দেখে বললো, ছি ছি, ঐসব লোকের মধ্যে বসে আপনারা জুয়া খেলছিলেন? শেখর হাসতে হাসতে বললে, তাতে কী হয়েছে? জিততে বেশ লাগে। তুমি একটু খেলবে নাকি? –মাগো। বলতে লজ্জা করলো না আপনার? হাটের মধ্যে বসে আমি জুয়া খেলবো–আর বাকি থাকবে কি? অপর্ণা কিন্তু অত্যন্ত উৎসাহ পেয়ে গেল। উজ্জ্বলভাবে দাবি জানালো, আমি খেলবো একটু! আমায় খেলাটা শিখিয়ে দিন। কত টাকা লাগবে? দুবোনের বদলে অপর্ণা আর জয়াকে দুই বন্ধু বলেই মনে হয় সব সময়। তার মধ্যে অপর্ণারই ব্যক্তিত্ব বেশি। এবার কিছু জয়া হঠাৎ দিদিগিরি ফলিয়ে ভারী গলায় বললো, না, রুণি, ছেলেমানুষী করিস না! –কেন, একটু খেলি, বেশি না। –না। বাবা শুনলে রাগ করবেন। দিদির কথার অবাধ্য হবে কি হবে না–এই রকম দ্বিধা অপর্ণার মুখে। সে আর কিছু বলার আগেই শেখর তার চোখে সিগারেটের ধোঁয়া ছুঁড়ে বললো, রুণির খুব শখ দেখছি। এই বয়েসেই জুয়া খেলায় এত ঝোঁক? থাক, খেলতে হবে না, চলো। পায়ে পায়ে সম্পূর্ণ হাটটাই ঘোরা হয়ে যায় আবার। সঞ্জয় বার বার চোরা চাহনিতে দেখছে অপৰ্ণাকে। অনুরাধার সঙ্গে অপর্ণার সত্যিই দারুণ মিল। শুধু চেহারায় নয়, স্বভাবেও। অনুরাধা। যদি এই মেলায় আসতো।তাহলে সেও নিশ্চয়ই জুয়া খেলতে চাইতো। হঠাৎ একটা কথা কল্পনা করে সঞ্জয়ের হাসি পেলো! মিঃ বিশ্বাস যদি কখনো দেখতে পেতেন, এই রকম একটা হাটে কতগুলো নোংরা আর জংলী লোকের সঙ্গে বসে তাঁর মেয়ে জুয়া খেলতে চাইছে–তাহলে তাঁর মুখের চেহারা কেমন হতো? মিঃবিশ্বাস খুব স্পোর্টের ভক্ত, জুয়া খেলাকেও তিনি কি স্পোর্ট হিসেবে নিতে পারতেন? কিংবা গেইম ফর রিল্যাক্সেশনঃ মিঃ বিশ্বাসের ওপর কোনো একটা প্রতিশোধ নেবার দারুণ ইচ্ছে হয়। সঞ্জয়ের। অসীম বারবার চেষ্টা করছে অপৰ্ণাক্স পাশে পাশে হাঁটতে। অপর্ণা কখনো এদিক-ওদিক চলে গেলে অসীম আবার স্থান বদলে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। অপর্ণার কৌতূহলের শেষ নেই। যে-কোনো ভিড় দেখলেই সে একবার উঁকি দেবে। এমনকি বাঁদর নাচও তার দাঁড়িয়ে দেখা অনেক খুঁজে একটা পছন্দসই চুড়ির দোকান পাওয়া গেল। অন্যদের সরিয়ে ওরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জয়ার হাত নরম-সহজেই সে হাত ভর্তি চুড়ি পরে ফেললো, কিন্তু অপর্ণার হাত একটু শক্ত, অনভিজ্ঞ চুড়িওয়ালা অনবরত পরাতে গিয়ে ভাঙছে। অসীম তার পাশে বসে পড়ে বললো, ধ্যাৎ দাও, আমি পরিয়ে দিচ্ছি। অপর্ণা ভ্রূভঙ্গি করে বললো, আপনি চুড়ি পরাতেও পারেন বুঝি? –পারতে না পারি, ওর মত ভাঙতে তো পারবো! ভাঙছেই যখন, ওর বদলে আমিই ভাঙি। –কিন্তু ও ভাঙলে পয়সা লাগবে না, আপনি ভাঙলে
false
humayun_ahmed
বলল, চুপ করুনতো কুদ্দুস সাহেব, আপনার কথা শুনতে ভাল व्लां96छ না। কুদ্দুস সাহেব বললেন, সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। করব কি বল, কথা বলা হয়ে গেছে। অভ্যাস। তোমার অবস্থা দেখে খারাপও লাগছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। তাতে যদি কিছু হয়। কিছু হল না। প্রেমের ক্ষেত্রে দৈব কখনোই সহায় হয় না। গল্পে, সিনেমায় হয়। জীবনটা গল্প সিনেমা নয়। জীবনের নায়িকারা, নায়কদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলেও চিনতে পারে না। স্যাভলনের শিশি। কিনতে একবারই ফার্মেসীতে আসে। দ্বিতীয়বার আসে না। গল্পে উপন্যাসে নায়িকারা ঘন ঘন অসুখে পড়ে। ডাক্তার নায়ক তখন চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলে। বাস্তবের নায়িকাদের কখনো কোন অসুখ হয় না, আর হলেও অন্য ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেন। অবশ্যি মনসুরের বেলায় দৈব সহায় হল। শরৎকালের এক সন্ধ্যায় তার ডাক পড়ল নিরিবিলিতে। সোবাহান সাহেবের প্রেসার মাপতে হবে। তাঁর প্রেসার হাই হয়েছে। মাথা ঘুরছে। ব্লাড প্রেসার নামক ব্যাধিটির উপর, কৃতজ্ঞতায় মনসুরের মন ভরে গেল। বারান্দায় মিলি দাঁড়িয়েছিল। এও এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য। বারান্দায় সে নাও থাকতে পারত। মিলির সঙ্গে দেখা না হলেও কিছু করার ছিল না। মিলির জন্যে তো আর তাকে ডাকা হয়নি। মিলি বলল, স্লামালিকুম। ওয়ালাইকুম সালাম। আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। মনসুর হতভম্ব। বলে কি এই মেয়ে। এই কথাগুলো কি সত্যি সত্যি বলছে না মনসুর কল্পনা করছে? কল্পনা হওয়াই সম্ভব। নিশ্চয়ই কল্পনা। হেলসিনেশন। আপনাকে বলেছে বোধ হয়। বাবার ব্লাড প্রেসার মাপার জন্যে আপনাকে খবর দেখা হয়েছে। জ্বি বলেছে। আপনার সঙ্গে একটা গোপন ষড়যন্ত্র করার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি। জ্বি বলুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে। যদি দেখেন বাবার প্রেসার খুব হাই না। তবু বলবেন হাই। বাবার রেস্টের দরকার। ভয় না দেখালে তিনি রেস্ট নেবেন না। আপনি মিথ্যা করে বলতে পারবে না? জ্বি না। মিলির দৃষ্টি তীব্ৰ হল। মনসুর বলল, আমি মিথ্যা বলতে পারি না। মিথ্যা বলতে পারেন না? জ্বি না। ও আচ্ছা, আমার জানা ছিল না। আপনাকে দেখে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতাই মনে হয়েছিল, যারা প্রয়োজনে কিছু মিথ্যা-টিথ্যাও বলতে পারে। আপনি যে অসাধারণ তা বুঝতে পারি নি। আপনি কি রাগ করলেন? কথায় কথায় রাগ করা আমার স্বভাব না। আসুন, দোতলায় যেতে হবে। বাবা দোতলায়। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠার পর মনসুর নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, একটা ভুল হয়ে গেছে। কি ভুল? প্রেসার মাপার যন্ত্র ফেলে এসেছি। সেকি, প্রেসার মাপার জন্যেইতো আপনাকে ডাকা হয়েছে–সেই জিনিসই আপনি ফেলে এসেছেন? আপনি মানুষ হিসেবে শুধু যে অসাধারণ তাই না, মনে হচ্ছে খুব ভুলো মন। আমি এক দৌড়ে নিয়ে আসব। যাব। আর আসব। আপনাকে যেতে হবে না। আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি, ও নিয়ে আসবে। না না। আমিই যাই। এক মিনিট। মনসুর অতি দ্রুত সিঁড়ি টপকাচ্ছে। সেই দ্রুত সিঁড়ি ভাঙা দেখে মিলির মনে হল–একটা একসিডেন্ট হতে যাচ্ছে, হবেই হবে। না হয়েই যায় না। আর তখনি হুড়মুড় শব্দ হল। ডাক্তার সাহেব মাঝ সিড়ি থেকে বলের মত গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলেন। শব্দ শুনে সোবাহান সাহেব এবং মিনু বেরিয়ে এলেন, ফরিদ বেরিয়ে এল, বাসার কাজের ছেলে কাদের ছুটে এল। সোবাহান সাহেব বললেন, এ কে? মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব। তোমার প্রেসার মাপতে এসেছেন। প্রেসার মাপতে এসে মাটিতে শুয়ে থাকার কারণ কি? পা পিছলে পড়ে গেছেন বাবা। পা পিছলে পড়েছে টেনে তুলবি না? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মিলিকে টেনে তুলতে হল না, মনসুর নিজেই উঠল। সার্টের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, একদম ব্যথা পাইনি। সত্যি বলছি। তার চারপাশের লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। সোবাহান সাহেব কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মনসুর বলল, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাব। সোবাহান সাহেব বললেন, অবশ্যই খাবে। মিলি একে নিয়ে ফ্যানের নিচে বসা। কাদের এগিয়ে এসে বলল, আমারে ধইরা ধইরা হাঁটেন। ডাক্তার সাব। চিন্তার কিছু নাই, উপরে আল্লা নিচে মাটি। নিচে মাটি এমন কোন লক্ষণ মনসুর পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে চোরাবালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পা ডেবে ডেবে যাচ্ছে। ঘরটাও মনে হচ্ছে একটু একটু দুলছে। কে যেন বলল, বাবা তুমি এখানে বস। কে বলল কথাটা? ঐ মহিলা না? ইনি বোধ হয় মিলির মা। তাকে কি সালাম দেয়া হয়েছে? স্নামালিকুম বলা দরকার না? দেরী হয়ে গেছে বোধ হয়। দেরী হলেও বলা দরকার। নিন পানি নিন। মনসুর পানি নিল। নিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলর, স্নামালিকুম। বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছে। কথা এমন জিনিস একবার বলা হয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। মনসুর লক্ষ্য করল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সে নিশ্চয়ই খুব উল্টা পাল্টা কিছু বলেছে। টেনশনের সময় তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মনসুর অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে শব্দ করে হাসল। অবস্থা স্বাভাবিক হল না মনে হল আরো খারাপ হয়ে গেল। ফরিদ বলল, ছোকরার মনে হয় ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। কেমন করে হাসছে দেখুন না দুলাভাই। অবিকল পাগলের হাসি। সোবাহান সাহেব বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার। ফরিদ বলল, ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেতো মনে হচ্ছে না। আমার ধারণা ব্রেইন হেমারেজ। হোয়াট এ পিটি, এ রকম ইয়াং এজ। আনিস অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ঙ্কর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে
false
shomresh
একটাই বাস দিনে দুবার যায় এবং ফেরে। সকালের বাসে ভিড় ছাদেও থিক থিক করে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কণ্ডাক্টর ব্যস্ত হয়ে ভিড় হঠিয়ে জায়গা করে দিল বসার। দীপবলী জানত না এখানে আসার এত অল্প দিনের মধ্যেই তাকে এত লোক চিনে গিয়েছে। বাসে বসে আর একটা অভিজ্ঞতা হল। চেঁচামেচি বকরকর যা হবার তা হচ্ছে পেছন দিকে। তার সামনে যেসব দেহাতি এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি বসে তারা রয়েছে বেশ গম্ভীর মুখে। যেন কথা না বলে তারা তাকে সম্মান দেখাচ্ছে। এর মধ্যেই বাসের জানলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গরম হাওয়ার জন্যে। চুপচাপ বসে এল দীপাবলী। নামার আগে কণ্ডাক্টরকে ডাকল সে, এই যে ভাই, টিকিটের দাম নাও। লোকটার বয়স বেশী নয়, এক হাত জিভ বের করে মাথা নাড়ল। কেন? দীপাবলী বেশ বিরক্ত হল। না মেমসাহেব, পারব না, আমার চাকরি চলে যাবে। তাহলে তো তোমাদের বাসে আমি উঠতেই পারব না। একি কথা বলছেন! আপনি হলেন গিয়ে আমাদের5, না, না। প্রায় পালিয়েই গেল সে। দীপাবলী বুঝল কোন লাভ হবে না। সে মুখে যতই বলুক ভাড়া না নিলে বাসে উঠবে না কিন্তু ভাল করেই জানে বাসে না উঠে কোন উপায় নেই। স্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিল। সে। দশটা বাজতে পনের মিনিট বাকি। এবার লোক ওঠা নামা করছে যে দেড় ঘণ্টার পথ প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা লাগিয়ে দিল বাস। সে অবশ্য এস ডি ওর অফিসে যেতে পারত। মিনিট চল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছানো যেত সেখানে। এস ডি ওর জিপে চড়ে। সোজা শহরে। কিন্তু গতকালের ঘটনার পর ব্যাপারটা ভাবতেই ভাল লাগেনি। সার্কিট হাউসের সামনে পৌঁছে মোটামুটি ভিড় দেখতে পেল। আদেশ মান্য করে সবাই। জমায়েত হয়ে মন্ত্রীর অপেক্ষা করছেন। ডি এম নেই। জানা গেল তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে আসবেন। অরবিন্দ সেন এগিয়ে এলেন, নমস্কার মিসেস ব্যানার্জী, কেমন আছেন? দীপাবলী একটু আড়ষ্ট হল। সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে হলে নিজের ঠিকুজি জানিয়ে দিতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও দীপাকে নিয়ম মানতে হয়েছে। পরলোকগত অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর পরিচয় তাকে বহন করতেই হয় এই কারণে বাধ্য হয়ে। সে মাথা নাড়ল, ভাল। আপনি? আর বলবেন না। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাতে পারছি না। যা গরম? আপনাদের ওদিকে প্রব্লেম কেমন? নাথিং। কিছু নেই। আপনার হাতে ওটা কি? এই কিছু কাগজপত্র। মন্ত্রীমশাই যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে বলতে হবে তো? তাহলে আপনি খুব সিরিয়াসলি কাজকর্ম করছেন বলুন! দীপাবলী হাসল। যেন কাজকর্ম করা একটা অন্যায় ব্যাপার এমনই মনে হল ওর এর কথা শুনে। সে দেখল তার এস ডি ও আর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন দূরে দাঁড়িয়ে। যাঁর সঙ্গে উনি কথা বলছেন তাঁর নজর এদিকেই। দীপাবলীকে দুচোখে গিলছেন। তিনি। হঠাৎ এস ডি ও এদিকে তাকালেন। তারপর ওরা এগিয়ে এলেন। সরি মিসেস ব্যানার্জি, কাল শরীর এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে যেতে পারিনি কিন্তু আমি আপনাকে খবর পাঠিয়েছিলাম। এস ডি ও বললেন। হ্যাঁ। আপনি এখন কেমন আছেন? ভাল না। মন্ত্রী না এলে আজ বের হতাম না। বলেই যেন মনে পড়ল, তা আপনি আমার ওখানেই তো আসতে পারতেন, আমি আসছিলামই! ২০ বুঝতে পারিনি আসবেন কি না, অসুস্থ শুনলাম? আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি সুধীর গুপ্তভায়া, সাউথ ডিস্ট্রিক্টের এস ডি ও। আমারই ব্যাচমেট। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্ৰলোক দুহাত জোড় করে নমস্কার করলেন, আপনার কথা আগেই শুনেছিলাম। আপনার মত সুন্দরী মহিলা এই চাকরিতে আছেন ভাবাই যায় না? কেন? চাকরি বুঝি অসুন্দরী মহিলাদের জন্যে? না, না, সুন্দরীরা সাধারণত পটের বিবি হন। এত খাটাখাটুনির চাকরি তাদের সহ্য হয় না। আমি এটাই মিন করতে চেয়েছি। দীপাবলী হাসল, তাহলে বলব আপনার দেখার পরিধি বেশী বড় নয়। এইসময় তিনটে গাড়ি ছুটে এল। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এস ডি ওরা এগিয়ে গেলেন ব্যস্ত হয়ে। গাড়ি থেকে মন্ত্রী, ডি এম নামলেন। দীপাবলী দেখল মন্ত্রীর বয়স হয়েছে কিন্তু খাদির পাঞ্জাবি ও ধুতিতে বেশ সৌম্য দেখাচ্ছে তাঁকে। পুলিশের সুপারও ছিলেন পেছনের জিপে। অফিসাররা সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন তাঁদের সারির মধ্যে দিয়ে নমস্কার করতে করতে মন্ত্রীমশাই ডি এম-কে নিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে গেলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। মিনিট চারেকের মধ্যে মিটিং আরম্ভ হল। মন্ত্রী এবং ডি এম বসেছেন ঘরে একদিকে, • এপার্শে অফিসাররা। দীপাবলী দ্বিতীয় সারির এক কোণে বসে শুনছিল। ডি এম ভূমিকা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রীমশাই বললেন, না, না, কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আপনাদের সোজাসুজি কিছু কথা বলি। এই জেলায় খরা যেন চিরস্থায়ী। বন্দোবস্ত করেছে। বৃষ্টি হয় না তাই চাষবাসও হয় না। কৃষকরা খুব কষ্টে বেঁচে আছেন। আমরা অবশ্য তাঁদের নানারকম সাহায্য করি তা আপনারা জানেন। কিছু পরিকল্পনা নেওয়া। হয়েছে যাতে এই এলাকায় চাষবাস হয়। এ ব্যাপারে আপনাদের আরও বেশী পরিশ্রম করতে হবে। আর চাষ ছাড়া ওদের হাতে শ্রমের বিনিময়ে যাতে কিছু পয়সা আসে, নিয়মিত। রোজগার করে যেতে পারে তার জন্যে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বারংবার বলেছেন কৃষকরাই হল ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবরকম চেষ্টা করা উচিত। মন্ত্রী হাত বাড়িয়ে গ্লাস। তুলে নিয়ে দুটো চুমুক দিলেন, জল। এই জেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জলের অভাব। ঈশ্বর এই জেলাকে মেরে রেখেছেন কোন বড় নদী না দিয়ে। জল ছাড়া চাষবাস করা সম্ভব।
false
shordindu
বলিয়া গেলেন—নদীর ধারে যাবি। যদি নৌকা আসে– মন্দোদরী বলিল—আচ্ছা গো আচ্ছা। তিন মাস ধরে নদীর ধারে যাচ্ছি, আজও যাব। কিন্তু কোথায় নৌকা! তারা কি এখনো বসে আছে, কোকালে দেশে ফিরে গেছে। তবু যাস। চিপিটক গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া ছাগল চরাইতে চলিয়া গেলেন। তাঁহার আশার প্রদীপ ক্রমেই নির্বাপিত হইয়া আসিতেছে। তারপর গ্রামের মেয়েরা ঘরের কাজকর্ম সারিয়া নদীতে জল আনিতে গেল, তখন মন্দোদরীও কলস কাঁখে তাহাদের সঙ্গে গল্প করিতে করিতে চলিল। মেয়েরা নদীর ঘাটে বেশিক্ষণ রহিল না, গা ধুইয়া নিজ নিজ কলসে জল ভরিয়া গ্রামে ফিরিয়া গেল। মন্দোদরী বালুর উপর পা ছড়াইয়া বসিয়া রহিল। স্নিগ্ধ পরিবেশ। আকাশে মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা, সম্মুখে খরস্রোতা নদীর কলধ্বনি। একাকিনী বসিয়া বসিয়া মন্দোদরীর ঘুম আসিতে লাগিল। বার দুই হাই তুলিয়া সে বালুর উপর কাত হইয়া শয়ন করিল, তারপর ঘুমাইয়া পড়িল। দিবানিদ্রার অভ্যাস তাহার এখনো যায় নাই। বেলা তৃতীয় প্রহর অতীত হইবার পর মুখে সূক্ষ্ম বৃষ্টির ছিটা লাগিয়া তাহার ঘুম ভাঙ্গিল। সে চোখ মুছিতে মুছিতে উঠিয়া বসিল। তারপর সম্মুখে নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে নিষ্পলক হইয়া গেল। বৃষ্টির সূক্ষ্ম পদার ভিতর দিয়া দেখা গেল, আগে পিছে তিনটি বহি নদীর মাঝখান দিয়া পূর্বমুখে চলিয়াছে। পাল-তোলা বহিত্র তিনটি মনে হয় কোন্ অচিন দেশের পাখি। কিন্তু মন্দোদরীর প্রাণে বিন্দুমাত্র কবিত্ব নাই। সে দেখিল, অচিন দেশের পাখি নয়, তিনটি অত্যন্ত পরিচিত বহি কলিঙ্গ দেশে ফিরিয়া চলিয়াছে। মন্দোদরীর বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দ হইতে লাগিল। সে ক্ষণকাল ব্যায়ত চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া মুখে আঁচল ঢাকা দিয়া আবার শুইয়া পড়িল। কী আপদ! নৌকাগুলি এতদিন। বিজয়নগরেই ছিল! এতদিন ধরিয়া কী করিতেছিল? ভাগ্যে গ্রামের অন্য কেহ দেখিয়া ফেলে নাই। জয় দারুব্রহ্ম! তিন-চারি দণ্ড শুইয়া থাকিবার পর সে মুখের আঁচল সরাইয়া সন্তর্পণে উঁকি মারিল, তারপর গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বসিল। নৌকা তিনটি চলিয়া গিয়াছে, তুঙ্গভদ্রার বুক শূন্য। সূর্য ড়ুবু ড়ুবু হইল। মন্দোদরী কলস কাঁখে লইয়া গজেন্দ্রগমনে ফিরিয়া চলিল। চিপিটক গ্রামে গুহার সম্মুখে বসিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, মন্দোদরীকে আসিতে দেখিয়া তাহার পানে সপ্রশ্ন ভঙ্গি করিলেন। মন্দোদরী কলসটি গুহামুখের কাছে নামাইয়া হাত উল্টাইয়া বলিল—কোথায় নৌকো! মিছিমিছি ভূতের বেগার। কাল থেকে আমি আর যেতে পারব না, যেতে হয় তুমি যেও। বলিয়া মন্দোদরী গুহামধ্যে প্রবেশ করিল। চিপিটক আকাশের পানে চোখ তুলিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। মুরশিদাবাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অনাবৃত চত্বরে বহুদিন ধরিয়া একখানি রাজসিংহাসন পড়িয়া থাকিত। ইহার নাম তক্ত মোবারক—মঙ্গলময় সিংহাসন। অতি সাধারণ প্রস্তরে নির্মিত অনতিবৃহৎ সিংহাসন, বোধ করি দেড় শত বৎসর এমনি অনাদরে অবহেলায় পড়িয়াছিল। যে বণিক-সম্প্রদায়ের তুলাদণ্ড সহসা একদিন রাজদণ্ডে পরিণত হইয়াছিল, তাঁহারা সুড়ঙ্গপথের অন্ধকারে আপন সিংহাসন লইয়া আসিয়াছিলেন, এই পুরাতন সিংহাসন ব্যবহার করেন নাই। তক্ত মোবারকে শেষ উপবেশন করিয়াছিলেন প্রভুদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর। পরবর্তী কালে লর্ড কার্জন প্রত্নরক্ষায় তৎপর হইয়া এই সিংহাসন কলিকাতায় আনয়ন করেন, পরে উহা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত হয়। তক্ত মোবারক—মঙ্গলময় সিংহাসন! কথিত আছে, এখনও গ্রীষ্মকালে এই সিংহাসনের পাষাণগাত্র বহিয়া রক্তবর্ণ স্বেদ ঝরিতে থাকে, যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত ক্ষরিত হইতেছে। সেকালে মুরশিদাবাদের মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, বাদশাহীর অতীত গৌরবগরিমা স্মরণ করিয়া তক্ত মোবারক শোণিতাণু বিসর্জন করে। কিন্তু তাহা ভ্রান্ত বিশ্বাস। তক্ত মোবারকের শশাণিত-ক্ষরণের ইতিকথা আরও নিগুঢ়, আরও মর্মান্তিক। তক্ত মোবারকের মতো এমন অভিশপ্ত সিংহাসন বোধ করি পৃথিবীতে আর নাই। সুবা বিহারের অন্তর্ভুক্ত মুঙ্গের শহরে এই সিংহাসন নির্মিত হইয়াছিল, সম্রাট সাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান সুজা আদেশ দিয়া উহা নির্মাণ করাইয়াছিলেন। জন্মক্ষণ হইতেই অভিশাপের কালকূট যে এই সিংহাসনের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ডটি নিষিক্ত করিয়া রাখিয়াছে সুজা তাহা জানিতেন না, বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বুঝিতে পারেন নাই; এই বিশেষত্বহীন স্থূল কারুকার্যখচিত সিংহাসনটির প্রতি তাঁহার অহেতুক মোহ জন্মিয়াছিল। তখন সাজাহানের রাজত্বশেষে ভ্রাতৃযুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। ঔরংজেবের নিকট পরাভূত হইয়া সুলতান সুজা পলায়নের পথে কিছুকাল মুঙ্গেরে অবস্থান করিয়াছিলেন; তারপর ঔরংজেবের সেনাপতি মীরজুর তাড়া খাইয়া সেখান হইতে রাজমহলে পলায়ন করেন। তক্ত মোবারক তাঁহার সঙ্গে ছিল। কিন্তু রাজমহলেও বেশি দিন থাকা চলিল না, তিনি সিংহাসন লইয়া ঢাকায় গেলেন। মীরজুমলা যখন তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ঢাকায় উপস্থিত হইলেন তখন সুজার শোচনীয় অবস্থা; তিনি তক্ত মোবারক ঢাকায় ফেলিয়া আরাকানে পলায়ন করিলেন। অতঃপর যে রক্ত-কলুষিত স্বখাত-সলিলে তাঁহার সমাধি হইল তাহার বহু কিম্বদন্তী আছে, কিন্তু জীবিতলোকে আর তাঁহাকে দেখা যায় নাই। শাহেনশা বাদশার পুত্র এবং ময়ূর সিংহাসনের উমেদার সুজার ইতিবৃত্ত এইখানেই শেষ। অভিশাপ কিন্তু এখনই শেষ হইল না। পরিত্যক্ত সিংহাসন মীরজুমলার কবলে আসিল। মীরজুমলা অন্তরে অন্তরে দুরন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন; সুবা বাংলার সিংহাসনের উপর তাঁহার লোভ ছিল। তক্ত মোবারক হাতে পাইয়া তাঁহার লোভ আরও বাড়িল। কিন্তু ঔরংজেবকে তিনি যমের মতো ভয় করিতেন। একদিন গোপনে তিনি নিজ শিবিরে তক্ত মোবারকের উপর মসলন্দ পাতিয়া বসিলেন এবং আলবোলায় অম্বুরী তামাকু সেবন করিতে করিতে প্রভু-দ্রোহিতার স্বপ্ন দেখিলেন। ইহার কিছুদিন পরে অকস্মাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল। অতঃপর তক্ত মোবারক কি করিয়া ঢাকা হইতে আবার পশ্চিম বঙ্গে ফিরিয়া আসিল তাহার কোনও ইতিহাস নাই। নবাবী আমলে মুরশিদকুলি খাঁর জামাতা সুজা খাঁ এই সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। শীঘ্রই তাঁহার মৃত্যু হইল। তাঁহার পুত্র সরফরাজ সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। সরফরাজকেও বেশি দিন রাজ্য ভোগ করিতে হয় নাই। গিরিয়ার প্রান্তরে বিদ্রোহী ভৃত্য আলিবর্দির সহিত যুদ্ধে তিনি নিহত হইলেন। আলিবর্দি শূন্য সিংহাসন দখল করিলেন! আলিবর্দির পালা শেষ হইলে আসিলেন সিরাজদ্দৌলা। তাঁহার
false
toslima_nasrin
কোনও সময় রোগি আসতে পারে। আরে বাদ দেন, রোগী এলে নাসর্ আপনাকে ডাকবে, চিন্তু করবেন না। চিন্তা আমি ও নিয়ে করি না, কারণ জানি রোগী এলেই নাসর্ আমাকে খবর পাঠাবেন। চিন্তা করি মালিকের উদ্দেশ্য নিয়ে। মালিক কি কারণে আমাকে ডেকেছেন এখানে, কোনও জরুরি কথা কি আছে? থাকলে তিনি জরুরি কথাটি না বলে আমাকে বসতে বললেন কেন! বসলে ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে ঠিক কোন গলিতে আমার বাড়ি, তিনি প্রায়ই ওদিকে যান বলে কোনও এক বিকেলে আমার বাড়িতেও যাবেন, বলেন কেন! একজন কবিকে কি কারণে বিয়ে করেছি, কবিকে বিয়ে করে মোটেও বুদ্ধির কাজ করিনি, বলেন কেন! স্বামীকে আমার পাশে একদমই মানায় না, স্বামী নিয়ে আমি আদৌ সুখে আছি কি না ইত্যাদিই বা কেন! আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর এত ভাবনা কেন! আমি নিশ্চিত, এগুলো কোনও জরুরি কথা নয়। কথা বলতে বলতে যে মাঝে মাঝেই চুমুক দিচ্ছেন গেলাসে, না বললেও আমি বুঝি তিনি মদ্যপান করছেন। নিশ্চিন্তে বসে, মালিক যা চাইছেন, সুখ দুঃখের গল্প করা আমার হয় না। আমি তাঁর অবাধ্য হয়ে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে শাদা একটি কাগজে বড় বড় করে লিখি সজ্ঞানে য়ইচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি আমি। দূরত্ব ছিয়াশি সালের শেষদিকে ঘটনাটি ঘটে। দেড়মাস পর ফিরবে বলে রুদ্র মোংলায় চিংড়ির ব্যবসা দেখতে গেলে যেহেতু আমার কিছু করার নেই ঢাকায়, ময়মনসিংহে চলে যাই। ময়মনসিংহ থেকে দেড়মাস পর ফিরে দেখি রুদ্র ফেরেনি এখনও। কবে ফিরবে জানতে চাইলে মেরি বলে আরও দুসপ্তাহ দেরি হবে। রুদ্রহীন ঘরটিতে একলা বসে থাকি, ঘরটি খুব খালি খালি লাগে। টেবিলে কবিতার খাতা পড়ে আছে, যেন লিখছিল, এই মাত্র উঠে সে অন্য ঘরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আবার লিখবে কবিতা। আমি চোখ বুজে অন্য ঘর থেকে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষা করি মনে মনে। মনে মনে তার একটি হাত রাখি আমার কাঁধে, শুনি একটি খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কখন এলে? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার! কাঁধের হাতটি ক্রমশ নেমে আসছে বুকে, আরেকটি কাঁধেও আরেকটি উষ্ণ হাত, সেই হাতটিও নেমে আসছে। গা শিথিল হয়ে আসছে আমার, আমার গালে তার দাড়ি- গাল ঘসতে ঘসতে বলছে, সোনা আমার মানিক আমার, বউ আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচি না রে! আমার তৃষ্ণাতর্ ঠোঁট জোড়া সিক্ত হতে চাইছে, ঠোঁটে তার দীর্ঘ দীর্ঘ উষ্ণ সিক্ত চুম্বন। অভূত এক শিহরণ আমার গা কাপাঁচ্ছে। মাথাটি এলিয়ে পড়ে টেবিলের খাতায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পাওয়ায় না পাওয়ায় চণূর্ হই। খাতাটির শেষ পাতায় লিখি, আমার ভাল লাগছে না, ভাল লাগছে না। কেন আসোনি তুমি। বউ ছেড়ে এত দীর্ঘদিন কি করে থাকো তুমি। বড় একা লাগে আমার। তুমিহীন একটি মুহূতর্ও আমার কাছে অসহ্য। আমার আপন কেউ নেই এক তুমি ছাড়া। আমার জীবন কাটে না তুমি ছাড়া। হয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয় তুমি আমার কাছে চলে এসো। গোছানো বিছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকি এক শরীর তৃষ্ণা নিয়ে। একটি বেদনার্ত হাত এগিয়ে যায় বিছানার চাদরে রুদ্রর ফেলে যাওয়া স্পর্শ পেতে, বুলোতে থাকে চাদর। ফেলে যাওয়া ঘ্রাণ পেতে বালিশে মুখ চেপে তার ছিঁটেফোঁটা শুঁকতে শুঁকতে বলি, কবে আসবে তুমি, আমার আর ভাল লাগে না একা থাকতে। তুমি ফিরে এসো প্রাণ। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো। আমার সর্বসুখ তুমি ফিরে এসো। বালিশ ভিজে যায় শব্দহীন কান্নায়। সচকিত হই বাড়ির মানুষদের সম্ভাব্য কোতূহলের কথা ভেবে, দুহাতে চোখ মুছে, মেরিকে ডেকে, আমি না হয় দুসপ্তাহ পর ফিরব, বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে ও বলে, এক্ষুনি যাচ্ছ বৌদি? বসো, চা খেয়ে যাও। শুষ্ক-হাসি ঠোঁটে, বলি, না চায়ের তৃষ্ণা নেই। রাজাবাজারের মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি। রুদ্রহীন ঢাকা শহর আমার কাছে ধু ধু মরুর মত লাগে। মহাখালি থেকে হঠাৎ ধুত্তরি বলে রিক্সা ঘুরিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাই। ভাল লাগে না ময়মনসিংহ যেতে। অবকাশে আমি অনাকাঙ্খিত অতিথি। মা প্রায়ই বলেন, বাপ মার অমতে বিয়া করছস। খুব সুখে না থাকবি কইছিলি! এখন এত বাপের বাড়ি আসতে হয় কেন? বাবার চোখের সামনে পড়লে কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন, মাকে ডেকে বলেন, ওই ছেড়ি আমার বাসায় আইছে কেন? ওরে বাসা থেইকা ভাগাও। আমার বাসায় আসার ওর কি অধিকার আছে? আমি কি কামাই করি আরেক বেডার বউরে খাওয়ানির জন্য নাকি? ওরে খাওন দিবা না। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতে উদাস বসে রুদ্রকে ভাবি, দিন রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বেচারা। নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। নিশ্চয়ই বউটির কথা মনে করে যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে আসতে চাইছে। পারছে না বলে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিই আঁচলে। আমার এই মগ্নতায় টোকা দিয়ে গীতা বলে, কি রে, কি ভাবস? তর জামাই কই? তারে লইয়া আইলি না কেন? আমার বুঝি একলা আসা মানা? সবসময় জামাই লইয়া আইতে হইব? কি, রাগারাগি হইছে নাকি! নাহ! রাগারাগি হইব কেন! তাই তো মনে হইতাছে। জামাই আছে ঢাকায়? নাহ। গীতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। টুলুর ঠোঁটেও হাসি। এ বাড়িতে গীতার ছোট ভাই টুলু থাকে। কালো-ছেলে মোটা-ছেলে, নাকের-নিচে-শুঁয়োপোকা-মোচ- ছেলে টুলুকে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি দিয়ে ঢাকায় এনে ছোটদা নিজের বাড়িতে রাখছেন। বাঁকা হাসিটি নিয়েই টুলু হাঁক দেয় এক
false
shunil_gongopaddhay
পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেছে, তাতেই তাঁর ক্লান্তি কমে গেল। যাক, আর খুঁজে বেড়াতে হবে না! টিকেন্দ্রজিৎ চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, কী ব্যাপার বলো তো রায়চৌধুরী, তোমার এত মরার শখ কেন? সারাদিন তুমি আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছ! উইপোকা যেমন মরার জন্য আলোর দিকে ছুটে আসে, সেইরকম তুমিও আমার হাতেই মরতে চাও! কাকাবাবু বললেন, আমি একা এসেছি। সঙ্গে পুলিশ কিংবা আর্মি আনিনি। তোমার সঙ্গে আমার শেষ লড়াইটা বাকি আছে। টিকেন্দ্রজিৎ হা-হা করে হেসে উঠে বলল, কীসের শেষ লড়াই? এক্ষুনি গুলি করে তোমার মাথা ছাতু করে দিতে পারি, সব শেষ হয়ে যাবে। এর আগে অন্তত পাঁচ বার তোমাকে পেছন থেকে গুলি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তুমি আমার নাম ধরে এত ডাকছ, তাই আমার কৌতূহল হল। এত আন্তরিকভাবে ডাকলে লোকে ভগবানেরও দেখা পেয়ে যায়, তাই আমি তোমার সামনে এলাম। কাকাবাবু বললেন, পেছন থেকে গুলি করে কাপুরুষরা। তুমি এক সময় খেলোয়াড় ছিলে। খেলার নিয়ম মানবে না? সাহস থাকে তো সামনাসামনি লড়ে যাও! টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, এটা ছেলেখেলা নয়! তুমি আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছ। বহু টাকার ক্ষতি হয়ে গেল। সামান্য কয়েকটা গণ্ডার মরলে কী ক্ষতি হত? তার বদলে তোমাকে মরতে হবে। আমার মায়াদয়া নেই। তোমাকে এখানে মেরে ফেলে দিয়ে গেলেও পুলিশ কোনও দিন আমাকে ধরতে পারবে না। তুমি রাইফেল তোলার চেষ্টা করলেই আমি গুলি চালাব, তুমি খতম হয়ে যাবে। কাকাবাবু বললেন, এর আগে অনেকেই আমাকে একথা বলেছে, কিন্তু কেউ তো এ-পর্যন্ত মারতে পারেনি। আমি ম্যাজিক জানি, তাই আমি বারবার বেঁচে যাই। তুমি প্রথম বার টিপ ফসকাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমি দু হাতে রাইফেল ধরে নেব। তারপর? তুমি যদি অপ্রস্তুত থাকতে, আমি কিন্তু প্রথমেই তোমাকে গুলি করতাম না। তোমাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি যখন, তোমাকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিতাম। যদি পুরুষ মানুষ হও, সামনাসামনি সমানে-সমানে লড়তে এসো। টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তোমার সঙ্গে সামনাসামনি আমি কী লড়ব? হাতাহাতি? কাকাবাবু বললেন, রাজি আছি। টিকেন্দ্রজিৎ বলল, এ তো আচ্ছা পাগল দেখছি! তুমি একে তো খোঁড়া, তায় প্রায় বুড়ো। তুমি পারবে আমার সঙ্গে? তুমি তো দৌড়তেই পারবে না। আমি দৌড়ে-দৌড়ে তোমার চার পাশে ঘুরব, আমাকে ছুঁতেও পারবে না তুমি। আমি তোমার হাত-পা ছিঁড়ে ফেলব, ঘাড় মুচড়ে দেব। আমার কত শক্তি, জানো না তুমি! কাকাবাবু বললেন, তুমিও আমার শক্তি জানো না। টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তলোয়ার ধরতে জানো? কাকাবাবু বললেন, জানি। জোগাড় করো, তলোয়ার লড়তেও রাজি আছি। টিকেন্দ্রজিৎ বলল, একজন খোঁড়া লোকের সঙ্গে তলোয়ার লড়তে হবে? লোকে শুনলে হাসবে। দশ গোনারও সময় পাবে না। তোমার পেট ফুটো করে দেব। আমি ফেসিং চ্যাম্পিয়ান। কাকাবাবু বললেন, তোমার মতো চ্যাম্পিয়ান আমি ঢের দেখেছি। আমার একটা পা-ই তোমার সঙ্গে লড়ার জন্য যথেষ্ট! তলোয়ার যখন নেই, তখন ড়ুয়েল লড়ো! টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, ড়ুয়েল? হা-হা-হা-হা! তুমি জানো না, একজন পুলিশ কমিশনার আমার নাম দিয়েছে ফাস্টেস্ট গান অ্যালাইভ। তুমি চোখের পলক ফেলবার আগে আমি গুলি চালাতে পারি। তুমি মরবে, মরবে রায়চৌধুরী। তোমার আর নিস্তার নেই। কাকাবাবু বললেন, ড়ুয়েল লড়তে গিয়ে মৃত্যু অনেক সম্মানজনক। তুমি যদি মরো, তা হলে লোকে অন্তত এইটুকু বলবে যে, তুমি বীরের মতন মরেছ। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে টিকেন্দ্রজিৎ বলল, ঠিক আছে, চুকিয়ে ফেলা যাক। আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কাকাবাবুও নেমে পড়ে বললেন, রাইফেল, না রিভলভার? টিকেন্দ্রজিৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যেটা ইচ্ছে, দুটোই আমার কাছে সমান। কাকাবাবু বললেন, তবু তোমাকে আমি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। তুমি কোনটা চাও? টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, ঠিক আছে, রিভলভার। দুজনেই রাইফেল নামিয়ে রেখে রিভলভার বের করল। কাকাবাবু বললেন, আমরা দুজনে উলটো দিকে ঠিক কুড়ি পা হেঁটে যাব। টিকেন্দ্ৰজিৎ বলল, তারপর অন্য একজনের দশ গোনার কথা। এখানে কে গুনবে। দুজনে দুদিকে গিয়ে দাড়াল। টিকেন্দ্ৰজিৎ বীরের মতন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকাবাবু খোঁড়া পায়ে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না, একটু ঝুঁকে আছেন। টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, এক… কাকাবাবু বাঁ হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন। টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, দুই, তিন, চার, পাঁচ… কাকাবাবুর রিভলভার সমেত ডান হাতটা নীচের দিকে নামানো। টিকেন্দ্রজিৎ গুনল, ছয়, সাত, আট, নয়.. কাকাবাবুর কোনও উত্তেজনা নেই। তিনি সোজা চেয়ে আছেন তার প্রতিপক্ষের দিকে। টিকেন্দ্রজিৎ দশ বলেই কায়দা করে লাফিয়ে উঠল শুন্যে। বলল, তুমি মারো! পরপর তিনটি গুলির শব্দ হল। টিকেন্দ্রজিৎ ঝুপ করে নেমে এল মাটিতে। ওদিকে কাকাবাবুও মাটিতে পড়ে আছেন উপুড় হয়ে। প্রথমে টিকেন্দ্রজিৎ কাতর শব্দ করে উঠল, আঃ! কাকাবাবু আস্তে-আস্তে উঠে বসলেন। তারপর এক পায়ে লাফাতে-লাফাতে চলে এলেন টিকেন্দ্রজিতের কাছে। টিকেন্দ্রজিৎ যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াতে শুরু করেছে। তার ডান হাত ও ডান পায়ের হাঁটুর কাছটা রক্তে মাখা। রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেছে অনেক দূরে। টিকেন্দ্রজিৎ কাতরভাবে বলতে লাগল, আমার আঙুল, আমার বুড়ো আঙুলটা নেই। আর কোনও দিন আমি অস্ত্র ধরতে পারব না। আমার হাঁটু, হাঁটু ভেঙে গেছে। আমি আর বাঁচতে চাই না। রায়চৌধুরী, তুমি আর-একবার গুলি করে আমায় মেরে ফেলো। কাকাবাবু বললেন, আমি মানুষ মারি না। জীবনে একটাও লোককে মেরে ফেলিনি! তোমাকে শাস্তি দেওয়ার কথা ছিল, শাস্তি দিয়েছি। তুমি আমার চুলের মুঠি ধরেছিলে। জীবনে আর কোনও কিছুই মুঠোয় চেপে ধরতে পারবে না। ডান পায়ে লাথি মেরেছিলে, আর কোনও দিন কাউকে লাথি মারতে পারবে না। টিকেন্দ্রজিৎ আবার বলল, আমায় মেরে ফেলো। এই অবস্থায়
false
humayun_ahmed
বত্রিশ দাঁতে হেসে ফেলল-–যেন সাত রাজার ধন হাতে পেয়েছে। প্ল্যান করেছিলাম, রাতের অন্ধকারে এক হাত নেব। কিন্তু ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল না। দুপুরের রোদ একটু কমতেই রওনা হয়ে গেল। বৃষ্টি বোধ করি একেবারেই থেমে গেল। চা বানান হচ্ছে শুনছি। ওদের মিলিটারি মিলিটারি বলে চেঁচিয়ে ওঠার আগেই উঠে পড়ব। কিনা ভাবছি, তখনি অনেক দূরে কোথায় হই হই শব্দ পাওয়া গেল। নিমিষের মধ্যে আমাদের নৌকার সাড়া-শব্দ বন্ধ। চায়ের পানি ফোটার বিজ বিজ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো আওয়াজ নেই। হাসান বলল, নৌকা আসন্তাছে। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শরীরে। ধ্বক করে উঠল বুক। কিসের নৌকা, কাদের নৌকা-কে জানে? মিলিটারিরা অবশ্যি স্পীডবোট ছাত্ম নড়াচড়া করে না। তা ছাড়া রাতের বেলা তারা ঘাঁটি ছেড়ে খুব প্রয়োজন ছাড়া নড়ে না। তবে রাজাকারের উপদ্রব বেড়েছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য লুটপাট করা। এই পথে শরণার্থীদের নৌকা মেঘালয়ের দিকে যায়। সে সব নৌকায় হামলা করলে টাকা-পয়সা গয়না-টয়না পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অল্পবয়সী সুশ্ৰী মেয়েও পাওয়া যায়। দূরের নৌকা দেখলাম স্পষ্ট হয়েছে। সেখান থেকে ভয় পাওয়া গলায় কে যেন হাক দিল, কার নৌকা গো? আমাদের নৌকা থেকে মজিদ চেঁচিয়ে বলল, তোমার কার নৌক? ব্যাপারীর নৌকা। মাছ যায়। শুনে পেটের মধ্যে হাসির বুদবুদি ওঠে। ব্যাপারী মাছের চালান দেয়ার আর সময় পেল না। আর মাছ নিয়ে যাচ্ছে এমন জায়গায়, যেখানে দেড় টাকায় একএকটা মাঝারি সাইজের রক্তই পাওয়া যায়। হুমায়ূন ভাইয়ের গম্ভীর গলা শোনা গেল, এই যে মাছের ব্যাপারী, নৌকা আন এদিকে। কী আশ্চৰ্য, এই কথাতেই নৌকার ভেতর থেকে বহুকণ্ঠের কান্না শুরু হয়ে গেল! ছোট ছোট ছেলেমেয়ের গলার আওয়াজও আছে। এই বাচ্চাগুলি এতক্ষণ কী করে চুপ করে ছিল তাই ভাবি। নৌকার ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। মজিদ বলল, ভয় নাই ব্যাপারী, নৌকা কাছে আন। আপনারা কী করেন? ভয় নাই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। আস এদিকে, কিছু খবর নেই। মুক্তিবাহিনী, মুক্তিবাহিনী! আনন্দের একটা হাল্লা। উঠল। নৌকা দুটিতে। অনেক কৌতূহলী মুখ উঁকি মারল। এরা হয়তো আগে কখনো মুক্তিবাহিনী দেখে নি, শুধু নাম শুনেছে। মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় কৌতূহলী মুখগুলি দেখতে ভালো লাগে। নমস্কার গো বাবাসকল। আমার নাম হরি পাল। কাসুন্দিয়ার জগৎ পালের নাম তো জানেন। আমি জগৎ পালের ছোট ভাই। আমার আর জ্যাঠার পরিবার আছে। এই নৌকায়। মোট একুশ জন। হরি পাল লোকটা বাক্যবাগীশ। কথা বলেই যেতে লাগল। দেখতে পাচ্ছি, তার ঘনঘন তৃপ্তির নিঃশ্বাস পড়ছে। নৌকার ভেতরের ছেলেমেয়েগুলির কৌতূহলের সীমা নেই। ক্রমাগত উঁকিঝুকি দিচ্ছে। এদের মধ্যে একটি মেয়ের চেহারা এমন মনকাড়া যে চোখ ফেরান যায় না। আমি বললাম, ও খুকি, কী নাম তোমার? খুকি জবাব দেবার আগেই হরি পাল বলল, এর ডাকনাম মালতী। ভালো নাম সরোজিনী। আর এর বড়ো যে, তার নাম লক্ষ্মী। ভালো নাম কমলা। ও মালতী, বাবুরে নমস্কার দে। মালতী ফিক করে হেসে ফেলল। হরি পালকে চা খেতে দেওয়া হল এক কাপ। এত তৃপ্তি করে সে বোধ হয় বহু দিন চা খায় নি। খাওয়া শেষে ভোঁস ভোঁস করে কেঁদে ফেলল। তাদের কাছে আমাদের একটিমাত্র জিজ্ঞাসা ছিল–শিয়ালজানী খালে কোনো নৌকা বাঁধা দেখেছে। কিনা। আমাদের একটি দল সেখানে থাকার কথা। কিন্তু হরি পাল বা হরি পালের মাঝি, কেউই সে-কথা বলতে পারল না। হাসান আলি নৌকা ছেড়ে দিল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দাঁড় পড়ছে। হরি পালদের নৌকাকে পেছনে ফেলে এগচ্ছি, হঠাৎ শুনলাম ইনিয়েবিনিয়ে সে–নৌকা থেকে কে একটি মেয়ে কাঁদছে। হয়তো তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে, হয়তো তার ছেলেটিকে বেঁধে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। নিস্তব্ধ দিগন্ত, বিস্তৃত জলরাশি, আকাশে পরিষ্কার চাঁদ-এ সবের সঙ্গে এই করুণ কান্না কিছুতেই মেলান যায় না। শুধু শুধু মন খারাপ হয়ে যায়। এগারটা বেজে গেছে। দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছান অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্যি তা নিয়ে কাউকে খুব চিন্তিতও মনে হচ্ছে না। আনিস দেখি আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। মজিদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। আমি বললাম, হাসান আলি, দুটোর মধ্যে পৌঁছতে পারব তো? হাসান আলি জবাব দিল না। বিশ্ৰী স্বভাব তার। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভান করবে যেন শুনতে পায় নি। যখন মনে করবে। জবাব দেওয়া প্রয়োজন, তখনি জবাব দেবে, তার আগে নয়। আমি আবার বললাম, কী মনে হয়। হাসান আলি, দুটোর মধ্যে রামদিয়া পৌঁছব? কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই জাতীয় লোক নিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল। আমি তো সহ্যও করতে পারি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দিই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় এক বাড়ি-হারামজাদা ছোটলোক! কিন্তু রাগ সামলাতে হয়। কারণ লোকটা দারুণ কাজের। এ অঞ্চলটা তার নিখাদপণে। নিকষ অন্ধকারে মাঝে মাঝে আমাদের এত সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মনে হয়েছে ব্যাটা বিড়ালের মতো অন্ধকারেও দেখতে পায়। খাটতে পারে যন্ত্রের মতো। সারা রাত নৌকা চালিয়ে কিছুমাত্র ক্লান্ত না হয়ে বিশ-ত্রিশ মাইল হেঁটে মেরে দিতে পারে। আবু ভাই হাসান আলির কথা উঠলেই বলতেন, দি জায়েন্ট। কিন্তু এই এক তোষ, মুখ খুলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করে যাবে। প্রথম প্রথম মনে হত হয়তো কানে কম শোনে। ও আল্লা, শেষে দেখি এক মাইল দূরের ঝিঝি পোকার ডাকটিও বুঝি তার কান এড়ায় না। কুড়ালখালির কাছে এক বার-আমাদের সমস্ত
false
shunil_gongopaddhay
সিঁড়ি উঠে গেছে, তাতে লাল কার্পেট পাতা। সেই সিঁড়ির বাঁকের মুখে একজন কর্মচারির সঙ্গে কথা বলছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। ঘি রঙের সিস্কের শাড়ি পরা, সামনে কুচি দেওয়া, কাঁধের কাছে আঁচলে একটা ব্ৰোচ আঁটা, তাতে দুটি চুনী-পান্না বসানো। বাড়িতে কোনও উৎসব থাকুক বা না থাকুক, প্রতিদিন জ্ঞানদানন্দিনী বিকেলে ভালো করে গা ধুয়ে উত্তম সাজসজ্জা করে থাকেন। অন্যদের, এমনকি ভৃত্যদেরও পোশাকের মালিন্য সহ্য করতে পারেন না তিনি। জ্ঞানদানন্দিনী রূপসী, তবে সে রূপ স্নিগ্ধ নয়, প্রখর, তাঁর ব্যক্তিত্বের আভা মণ্ডিত। দুটি জীবিত পুত্র-কন্যা ছাড়াও যে তাঁর যে আরও দুটি সন্তান জন্মেছিল, নিঁখুত শরীরে গড়নে তার কোনও ছাপ নেই, তেত্ৰিশ বছর বয়সের এক পরিপূর্ণ যুবতী। রবিকে দেখে তিনি কথা থামিয়ে কয়েক পলক বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন, রবি? এতদিনে আমাদের মনে পড়ল? চন্দননগরে লুকিয়ে আছ বুঝি? রবি হেসে বলল, মেজ বউঠান, আমার খিদে পেয়েছে। কি খাওয়াবে বল! জ্ঞানদানন্দিনী আরও কাছে এসে বললেন, এ কী রুখুসুখু চেহারা হয়েছে। জুতোয় কাদা মাখা মাখি, খুলে ফেল, খুলে ফেল! রবি বলল, সারা দুপুর গান শেখাতে হয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে। সুরেন পেছনের বাগানে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলছে, বিবি পিয়ানো বাজাচ্ছে পাশের ঘরে বসে। রবির গলার আওয়াজ শুনে সে খুশিতে ঝলমল মুখে ছুটে এল, রবির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, রবিকা, তুমি এতদিন আসনি কেন? এই বয়সেই যা সুন্দরী বিবি, কালে সে ঠাকুরবাড়ির সেরা রূপসীদেরও ওপরে টেক্কা দেবে মনে হয়। বিবির সমবিয়েসী আর একটি মেয়েও বেরিয়ে এল পিয়ানোর ঘর থেকে, সে রবির দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা। সে কয়েকদিন এ বাড়িতে এসে রয়েছে। এই দুই বালিকাকে সোফায় পাশে বসিয়ে রবি চন্দননগরের গল্প শোনাতে লাগল। তার জন্য রুপোর রেকাবিতে এল কেক-পেস্ট্রি। জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, রবি, তুমি ভালো দিনে এসেছ। আজ সুরির জন্মদিন, অনেকে আসবে, তুমি গান গাইবে। বিবি আবদার করে বসল, রবিকা, তুমি রাত্তিরে এখানে থাকবে। তুমি আজ যাবে না। এই অ্যাত্ত বড় কেক কাটা হবে। ইংরেজ সমাজের দেখাদেখি জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করেছেন। হিন্দুরা এই ব্যাপারটা জানেই না। ব্ৰাহ্মরাও এতদিন এই প্ৰথা গ্ৰহণ করেনি। তবে অনেকেরই এখন ভালো লাগছে। একজন বাচ্চার জন্মদিন উপলক্ষে অন্য অনেক বাচ্চা আনন্দে মেতে থাকে। এই একটাই উৎসব যাতে বাচ্চারা গুরুত্ব পায়। জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, তুমি এতদিন ধরে চন্দননগরে পড়ে আছ কেন, রবি? তুমি আমাদের এখানে এসে থাকো। কত ঘর খালি রয়েছে। বিবি আর সুরি তোমাকে এত ভালোবাসে, ওরা তোমার কথা এত বলে। রবির একটা হাত চেপে ধরে বিবি বলল, রবিকা আর যাবে না, যাবে না, যাবে না! জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, নতুনও আসবে। সেও তো আজ রাত্তিরে এখানে থাকবে বলেছে। আমি নতুনকে বলেছি, এবার চন্দননগর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসো। বাগানবাড়িতে লোকে দু’চার দিনের জন্য যায়। শহুরে মানুষ কি শহর ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারে? কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর রবি লক্ষ করল, জ্ঞানদানন্দিনী নতুন বউঠানের কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করা দূরে থাক, একবারও তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না। দুই জায়ে ভাব নেই। বরং একটা সূক্ষ্ম অপছন্দের ব্যাপার রয়েছে পরস্পরের মধ্যে। জ্যোতিদাদার সঙ্গে নতুন গুণবান ভাইয়ের বিয়ে দিতে সত্যেন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি ছিল। মেয়ের বাবা সম্পর্কে বিরাগের ভাব ছিল বলে মেয়ে সম্পর্কে আপত্তি। জ্ঞানদানন্দিনী চেষ্টা করেছিলেন একটি বিলেত ফেরতা মেয়ের সঙ্গে তাঁর এই প্ৰিয় দেবরটির বিয়ে দিতে, সেটা শেষ পর্যন্ত হল না। সত্যেন্দ্ৰনাথ বাবামশাইয়ের কাছেও তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, একে পিরালির বংশ, তায় ব্ৰাহ্ম, এই পরিবারে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দুই মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। পাত্রী অতি দুর্লব। সহজে পাত্রী পাওয়া যায় না বলে যে-কোনও হেঁজিপেঁজি মেয়ের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতন এক অসাধারণ পুরুষের বিয়ে দিতে হবে। আর কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত না? পিতৃপরিচয় যাই হোক, কাদম্বরী যে হেঁজিপেঁজি নন তা তিনি প্রমাণ করেছেন। মেজদাদা, মেজবউঠান তা এখনও মানতে চান না কেন? জ্ঞানদানন্দিনীরই মতন অতি সামান্য অবস্থা থেকে এসে কাদম্বরী নিজেকে অন্যভাবে তৈরি করে নিয়েছেন, এখন রূপে-গুণে তিনি অতুলনীয়। তবে জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে কাদম্বরীর গভীর প্রভেদও আছে। জ্ঞানদানন্দিনীর বাস্তব জ্ঞান অতি তীক্ষ্ণ, সব দিকে তার নজর, যেমন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিশেষ যত্ন নেন, তেমনি টাকা পয়সার হিসেব বুঝে দক্ষভাবে সংসার চালাতে পারেন। স্বামী প্রবাসে, তিনি আলাদা বাড়িতে এসে নিজের সংসার তো সুষ্ঠুভাবে চালাচ্ছেন! যে-কোনও মানুষকে দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করাবার ক্ষমতা আছে। কারুর অসুখ-বিসুখ হলে সেবা করতেও তাঁর জুড়ি নেই। আবার বই পড়তে ভালোবাসেন, লিখতে পারেন, গান-বাজনা আমোদ-আহ্লাদেও সমান উৎসাহী। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণা। অন্যদিকে কাদম্বরীও লেখাপড়া শিখেছেন, তাঁর রুচি অতি সূক্ষ্ম, গান ভালোবাসেন, অভিনয় করতে জানেন, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে যেন তার কোনও সম্পর্ক নেই। বাইশ বছর বয়সেও তাঁর সন্তান হয়নি, টাকা পয়সা নিয়ে কখনও মাথাই ঘামান না, আপনি খেয়ালে থাকেন। তাঁর উপস্থিতিতে রবি সব সময় যেন একটা রহস্যের ইঙ্গিত পায়। জোড়াসাঁকোয় যখন থাকেন, তখনও কাদম্বরী তাঁদের তেতলার মহলেই অধিকাংশ সময় কাটান, বাড়ির অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারেন না সাবলীলভাবে। এ যে তার অহংকার নয়, তার স্বভাবের ধরনটাই এ রকম, তা রবি বোঝে। আস্তে আস্তে আরও অনেকে আসছে। কয়েকজন প্রতিবেশী মেম এল তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। হলঘরে একটা টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে কেকটি, সুরি আজ দশ পেরিয়ে এগারো বছরে পা দেবে তাই গোল করে
false
humayun_ahmed
কমপ্লিট হয়নি। স্টিল ফ্রেমে কংক্রিট দেয়া হয়েছে। শেপ দাঁড়িয়ে গেছে তবে ফাইন্যাল ফিনিসিং হয়নি। ফিনিশিং হবে, রঙ হবে। মোটামুটিভাবে যে-কাজটা শেষ হয়েছে, তা হল যে জলভূমিতে ডায়নোসর দাঁড়িয়ে আছে সেটা। আলোর ব্যবস্থা করা শেষ। আজকে সবাইকে ডেকেছি ব্যবস্থাটা কেমন পরী করার জন্যে। মিজু আমরা কি শুরু করব? মিজু আবারো বিড়বিড় করল। হাসান বলল, ওকে লাইট। বড় জেনারেটরটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল। হাসানের কথার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু হল। ঘড়ঘড় সঙ্গে বনভূমি কেঁপে কেঁপে উঠছে। লীনা তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বকধ্বক করছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ঝিলের অন্ধকার পানিতে হঠাৎ যেন কিছু হল। পানি দেখা যেতে শুরু করল। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল তখন। পানিতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হল। পানি হয়ে গেল গাঢ় নীল। যেন এই ঝিল পার্থিব জগতের না। সত্যি সত্যি মায়ানগরের মাঝিল। গাঢ় নীল পানি পানি থেকে নীলাভ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে ডায়নোসরগুলির গায়ে আলো পড়েছে। ডায়নোসরের ছায়া পড়েছে নীল পানিতে। কী অলৌকিক অবিশ্বাস্য ছবি! লীনা তাকাল হাসানের দিকে। হাসানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঝিলের গাঢ় নীল রঙের পানি যেমন সুন্দর–হাসানের চোখের পানিও সেরকমই সুন্দর। হাসান বলল, লীনা কেমন দেখলে? লীনা বলল, স্যার আমি আমার জীবনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি। হাসান বলল, শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াবে আমি নিজেও কল্পনা করিনি। পানির রঙ গাঢ় নীল থেকে গাঢ় লাল হবে— এই ব্যবস্থা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখব। এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নীল রঙটাই পারফেক্ট। আমারো সেরকম মনে হচ্ছে স্যার। হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পানির রঙ নীল হবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে আমাদের জায়গাটার নাম মায়ানগর। মায়ানগরের পানির রঙ সবুজ হতে পারে, লাল হতে পারে, বেগুনি হতে পারে। পারে না? জ্বি স্যার পারে। আবার সোনালি হতে পারে। কি বলো, পারে না? জ্বি পারে। সমস্যা কী জানো চোখে অভ্যস্ত না এমন কোনো রঙ ব্যবহার করলে কিন্তু যে এফেক্ট আমরা আশা করছি তা পাব না। পানির নীল রঙ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কাজেই পানির রঙ নীলের কাছাকাছি থাকতে হবে। বলো তোমার এই বিষয়ে কী মত? লীনা বলল, স্যার আপনি যা বলেন তাই আমার কাছে সত্যি মনে হয়। এখন আপনি যদি বলেন–পানির রঙ কুচকুচে কালো হলে খুব সুন্দর লাগবে। আমার কাছে সেটাই সত্যি মনে হবে। হাসান বলল, কুচকুচে কালো রঙের পানি দেখে যদি তোমার ভালো না লাগে, তারপরেও কি বলবে আমার কথাই ঠিক? জ্বি বলব। কেন বলবে, কোন্ যুক্তিতে বলবে? তখন আমার মনে হবে, আমার কাছে সুন্দর লাগছে না, কারণ আমার দেখার চোখ নেই। চলো ফিরে যাই। চলুন। ঝিলের পানির রঙ নিয়ে আরেকটা চিন্তা মাথায় এসেছে। চিন্তাটা উদ্ভট, তারপরেও পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। উদ্ভব চিন্তাটা কি আমাকে বলবেন? না বলব না। লীনা শোননা, আমি ঢাকায় যাচ্ছি। ইয়াকুব সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। আজ রাতেই দেখা করতে হবে। যত রাতই হোক আমি যেন দেখা করি। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন। আমার টেনশান লাগছে। কিসের টেনশান স্যার? ইয়াকুব সাহেব খেয়ালি ধরনের মানুষ। আমাকে যদি বলেন— এই কাজের এখানেই সমাপ্তি। টাকা অনেক বেশি খরচ হয়ে গেছে। আর খরচ করা যাবে না এই নিয়েই টেনশান। তিনি মাঝপথে কাজ থামিয়ে দেবেন। তা দিতে পারেন। খেয়ালি মানুষের খেয়াল হল পানির বুদ্বুদের মতো। দেখতে সুন্দর, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। কে জানে তার নাতনী হয়তো খবর পাঠিয়েছে–সে আসবে না। লীনা বলল, স্যার আপনি শুধুশুধু টেনশান করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইয়াকুব সাহেবকে একবার যদি এনে আপনি ডায়নোসর পার্ক দেখান তাহলেই হবে। বিয়ের কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে দেখাতে হয়। প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে কিছুই দেখাব না। শালবনের ভেতর দিয়ে পথ। হাসান আগৈ আগে যাচ্ছে, তার কয়েক পা পেছনে লীনা। হাসানের অভ্যাস অতি দ্রুত হাঁটা। লীনাকে তার সঙ্গে সঙ্গে আসতে কষ্ট করতে হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। হাসানের হাতে টর্চলাইট। টর্চলাইটের খুব আলো। মনে হচ্ছে জাহাজ থেকে জঙ্গলে সার্চলাইট ফেলা হচ্ছে। লীনা। জ্বি স্যার। শালবনের একটা বিশেষ ব্যাপার কি তোমার চোখে পড়েছে? আমার চোখ খুব সাধারণ। বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়ে না। জোনাকি চোখে পড়ছে না? জ্বি স্যার। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। জোনাকি বলে যে একটা অপূর্ব ব্যাপার আছে–ভুলেই গিয়েছিলাম। জোনাকি পোকার চাষ করা গেলে ভালো হত। মায়ানগরে কৃষ্ণপক্ষের রাতে হাজার হাজর জোনাকিপোকা জ্বলছে— অপূর্ব দেখাবে না? জ্বি দেখাবে। জোনাকিপোকা কোন্ আবহাওয়ায় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে তা জানার চেষ্টা করছি। আমেরিকায় আমার এক বন্ধুকে ই-মেইল করেছি ফায়ার ফ্লাই সম্পর্কে প্রকাশিত সব বই যেন পাঠায়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ। রেস্ট নেবে? লীনা কিছু বলল না। হাসান দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের টর্চ নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। শালগাছের মাথার উপরে তারাভর্তি আকাশ ঝলমল করছে। হাসান বলল, লীনা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— তুমি কিছু মনে কোরো না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এই চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে যাবার কথা চিন্তা করছ? লীনা চমকে উঠে বলল, এই কথা কেন বললেন স্যার? হাসান বলল, আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে এই কথাটা বলছে। অবশ্যি সিক্সথ সেন্স আসলে তো কিছু না–অবচেতন মনের চিন্তা। অবচেতন মন নানান তথ্য
false
shordindu
বহিতেছে; রাত্রিতে নিশ্চয় বৃষ্টি হইবে। কিন্তু সেজন্য কাহারও উদ্বেগ নাই। আসন্ন কর্মের উল্লাসে সকলে মহানন্দে গান গাহিতে গাহিতে চলিল। মগধরাজ্যের স্থানীয় বলিয়া তখন রাজগৃহ হইতে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চতুর্দিকে বিভিন্ন রাজ্যে যাইবার পথ ছিল। তদৃভিন্ন নগর হইতে নগরান্তরে যাইবার পথও ছিল। রাজকোষ হইতে পথের জন্য প্রভূত অর্থ ব্যয় করা হইত। আবশ্যক হিসাবে পথের উপর প্রস্তরখণ্ড বিছাইয়া পথ পাকা করা হইত, পথিকের সুবিধার জন্য পথের ধারে কুপ খনন করানো হইত, ছায়া করিবার জন্য দুই ধারে বট, অশ্বত্থ, শাল্মলী বৃক্ষ রোপিত হইত। মধ্যে নদী পড়িলে সেতু বা খেয়ার বন্দোবস্ত থাকিত। এই সকল পথে দলবদ্ধ বৈদেশিক বণিকগণ অশ্ব, গর্দভ ও উষ্ট্রপৃষ্ঠে মহার্ঘ পণ্যভার বহন করিয়া নগরে নগরে ক্ৰয়-বিক্রয় করিয়া বেড়াইত; নট-কুশীলব সম্প্রদায় আপন আপন কলা-নৈপুণ্য দেখাইয়া ফিরিত। রাজদূত দ্রুতগামী অশ্বে চড়িয়া বায়ুবেগে গোপনবোতা বহন করিয়া রাজসমীপে উপস্থিত হইত। কদাচ রাত্রিকালে এই সকল পথে দাসু-তস্করের ভয়ও শুনা যাইত। বন্য আটবিক জাতিরা এইরূপ উৎপাত করিত। কিন্তু তাহা কচিৎ, কালেভদ্রে। পথের পাশে সৈনিকের গুল্ম থাকায় তস্কর্যগণ অধিক অত্যাচার করিতে সাহসী হইত না। রাজপথ যথাসম্ভব নিরাপদ ছিল। উত্তরে ভাগীরথী তীর পর্যন্ত মগধের সীমা।–সেই পর্যন্ত পথ গিয়াছে। আমরা সেই পথ ধরিয়া চলিলাম। ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া আসিল, বায়ু স্তব্ধ এবং আকাশে মেঘপুঞ্জ বর্ষণোন্মুখ হইয়া রহিল। আমরা রাত্রির মতো পথসন্নিকটে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে আশ্রয় লইলাম। প্ৰত্যেকের সহিত এক সন্ধ্যার আহার্য ছিল। কিন্তু বর্ষাকালে উন্মুক্ত প্রাস্তরে রন্ধনের সুবিধা নাই। কষ্টে যদি বা অগ্নি জ্বালা যায়, বৃষ্টি পড়িলেই নিবিয়া যাইবার সম্ভাবনা। তথাপি অনেকে একটা মৃত বৃক্ষ হইতে কাষ্ঠ সংগ্ৰহ করিয়া যব-গোধূমচূর্ণ ও শত্ৰু শানিয়া পিষ্টক-পুরোডাশ তৈয়ার করিতে লাগিল। আবার যাহারা অতটা পরিশ্রম স্বীকার করিতে অনিচ্ছুক, তাহারা চিপিটক জলে সিক্ত করিয়া দধি-শর্করা সহযোগে ভোজনের আয়োজন করিতে লাগিল। চারিদিক হইতে দশ হাজার লোকের কলরব, গুঞ্জন, গান, চিৎকার, গালিগালাজ আসিতেছে। দূরে দূরে ধুনির ন্যায় অগ্নি জ্বলিতেছে। অন্ধকারে তাহারই আশেপাশে মানুষের ছায়ামূর্তি ঘূরিতেছে। ক্কচিৎ অগ্নিতে তৈল বা ঘৃত প্রদানের ফলে অগ্নি অত্যুজ্জ্বল শিখা তুলিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে। সেই আলোকে চতুষ্পার্শ্বে উপবিষ্ট মানুষের মুখ ক্ষণকালের জন্য স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। এ যেন সহসা বিজন প্ৰান্তর—মধ্যে এক ভৌতিক উৎসব আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। আমার সহিত কদলী, কপিত্থ, রসাল ইত্যাদি ফল, কিঞ্চিৎ মৃগমাংস এবং এক দ্রোণ লোধ্ররেণু চিত্রকাদির দ্বারা সুরভিত হিঙ্গুল-বর্ণ অতি উৎকৃষ্ট আসব ছিল। আমি তদ্দ্বারা আমার নৈশ আহার সুসম্পন্ন করিলাম। ক্রমে রাত্ৰি গভীর হইতে চলিল। এক বৃহৎ বৃক্ষতলে মৃত্তিকার উপর আস্তরণ পাতিয়া আমি শয়নের উপক্ৰম করিতেছি, এমন সময় অন্ধকারে দুই জন লোক আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে?” একজন উত্তর দিল, “নায়ক, আমি এই ছাউনির রক্ষী। অপরিচিত এক ব্যক্তি কূপের নিকট বসিয়াছিল, তাই আদেশমত ধরিয়া আনিয়াছি।” আমি বলিলাম, “মশাল জ্বাল।” মশাল জ্বলিলে দেখিলাম, প্রহরীর সঙ্গে এক দীর্ঘাকৃতি নগ্নপ্রায় অতিশয় শ্মশ্রুগুম্ফজটাবহুল পুরুষ। শুকচঞ্চুর ন্যায় বক্র নাসা, চক্ষু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কূপ-সন্নিকটে কি করিতেছিলে?” সে ব্যক্তি স্থিরনেত্রে আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “তুমি রাষ্ট্রপতি হইবে; তোমার ললাটে রাজদণ্ড দেখিতেছি।” কৈতববাদে ভুলিবার বয়স আমার নাই। উপরন্তু মহামাত্য যে সন্দেহ আমার মনের মধ্যে সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছিলেন, এই অপরিচিত জটিল সন্ন্যাসীকে দেখিবামাত্র তাহা জাগরকে হইয়া উঠিল। বলিলাম, “আপনি দেখিতেছি। জ্যোতির্বিদ। আসন পরিগ্রহ করুন।” আসন গ্ৰহণ করিয়া জটাধারী কহিলেন, “আমি শৈব সন্ন্যাসী। রুদ্রের কৃপায় আমার তৃতীয় নয়ন উল্মীলিত হইয়াছে। ত্রিকাল আমার নখ-দর্পণে প্রকট হয়। আমি দেখিতেছি, তুমি অদূর-ভবিষ্যতে মহালোকপালরূপে রাজদণ্ড ধারণ করবে। তোমার যশোদীপ্তিতে ভূতপূর্ব রাজনগণের কীর্তিপ্ৰভা ম্লান হইয়া যাইবে।” সন্ন্যাসীকে বুঝিয়া লইলাম। অত্যন্ত শ্রদ্ধাপ্লুতকণ্ঠে কহিলাম, “আপনি মহাজ্ঞানী। আমি অতি দুষ্কর কার্যে যাইতেছি; কার্যে সফল হইব কি না, আজ্ঞা করুন।” ত্রিকালদর্শী ভ্রূকুটি করিয়া কিছুক্ষণ নিমীলিতনেত্রে রহিলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতেছ?” আমি হাসিয়া বলিলাম, “আপনিই বলুন।” সন্ন্যাসী তখন মৃত্তিকার উপর এক খণ্ড প্রস্তর দিয়া রাশিচক্র আঁকিলেন। আমি মৃদু হাস্যে প্রশ্ন করিলাম, “এ কি, আপনার নখ-দর্পণ কোথায় গেল?” সন্ন্যাসী আমার প্রতি সন্দেহপ্রখর এক দৃষ্টি হানিয়া কহিলেন, “সূক্ষ্ম গণনা নখ-দর্পণে হয় না। তুমি জ্যোতিষশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ, এ সকল বুঝিবে না।” আমি বিনীতভাবে নীরব রহিলাম। সন্ন্যাসী গভীর মনঃসংযোগে রাশিচক্ৰে আঁক কষিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ অঙ্কপাত করিবার পর মুখ তুলিয়া কহিলেন, “তুমি কোনও গুপ্ত রাজকার্যে পররাজ্যে যাইতেছ। শনি ও মঙ্গল দৃষ্টি-বিনিময় করিতেছে, এজন্য মনে হয় তুমি যুদ্ধ-সংক্রান্ত কোনও গূঢ় কার্যে ব্যাপৃত আছ।” এই বলিয়া সপ্রশ্ননেত্রে আমার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। আমি চমৎকৃত হইয়া বলিলাম, “আপনি সত্যই ভবিষ্যদ্দর্শী, আপনার অগোচর কিছুই নাই। আমি রাজানুজ্ঞায় লিচ্ছবি দেশে যাইতেছি, কি উদ্দেশ্যে যাইতেছি। তাহা অবশ্যই আপনার ন্যায় জ্ঞানীর অবিদিত নাই। এখন কৃপা করিয়া আমার এক সুহৃদের ভাগ্যগণনা করিয়া দিতে হইবে। প্রহরী, কুলিক মিহিরমিত্র জম্বু-বৃক্ষতলে আশ্রয় লয়াছেন, তাঁহাকে ডাক।” কুলিক মিহিরমিত্র আমার অধীনে প্রধান শিল্পী এবং আমার প্রাণোপম বন্ধু। ভাস্কর্যে তাহার যেরূপ অধিকার, জ্যোতিষশাস্ত্ৰেও সেইরূপ পারদর্শিতা। ভৃগু, পরাশর, জৈমিনি তাহার কণ্ঠাগ্রে। মিহিরমিত্র আসিয়া উপবিষ্ট হইলে, আমি সন্নাসীকে নির্দেশ করিয়া কহিলাম, “ইনি জ্যোতিষশাস্ত্ৰে মহাপণ্ডিত, তোমার ভাগ্য গণনা করিবেন।” মিহিরামিত্ৰ সন্ন্যাসীর দিকে ফিরিয়া বসিল। তাঁহার আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ করিয়া নিজ করতল প্রসারিত করিয়া বলিল, “কোন লগ্নে আমার জন্ম?” সন্ন্যাসীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঈষৎ চাঞ্চল্য ও উৎকণ্ঠার লক্ষণ দেখা দিল। সে করতলের প্রতি দৃকপাত না করিয়াই বলিল, “তোমার অকালমৃত্যু ঘটিবে।” মিহিরমিত্র বলিল, “ঘটুক, কোন
false
shunil_gongopaddhay
ছোটাছুটি করতে লাগলো চতুর্দিকে, তাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত অস্ত্ৰ। লালকেল্লা জনশূন্য। কয়েক মাসের দ্বাদশাহ বাহাদুর শাহ সপরিবারে পলাতক। ইংরেজ সৈন্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাঁদের কারুকে না পেয়ে অপরিসীম ক্ৰোধে উন্মত্তবৎ হয়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে আঘাত করে করে ভাঙতে লাগলো দেওয়ান-ই-খাসের স্বগোিপম দেওয়ালসজা। দুর্লভ প্রস্তরের কারুকাজ টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে লাগলো মেঝেতে। সেনাপতি কোনোক্রমে শান্ত করলেন তাঁর বাহিনীকে। প্রাঙ্গণে উড়িয়ে দেওয়া হলো ইউনিয়ন জ্যাক, যুদ্ধ বিজয়ের জন্য পরম করুণাময় ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য সেখানে অনুষ্ঠিত হলো থ্যাঙ্কস গিভিং প্রার্থনা। লালকেল্লা থেকে চার মাইল দূরে হুমায়ুনের সমাধি ভবনে সম্রাট তখন সদলবলে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গে তখনও হাজারখানেক সিপাহী। তাঁর পরমার্শদাতারা তাঁকে পরস্পর-বিরোধী উস্কানি দিচ্ছে তখনও। কেউ বললো, এখনো সময় আছে, জাঁহাপনা দিল্লি ছেড়ে পলায়ন করুন, লক্ষ্ণৌয়ের দিকে সিপাহীরা আজও আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। কেউ বললো, বাদশাহ বরং দূত পাঠান ইংরেজের কাছে, তিনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করার জন্য বলুন যে এ বিদ্রোহে তাঁর সম্মতি ছিল না, সিপাহীরা জোর করে তাঁর ওপর কর্তৃত্বের ভার চাপিয়ে গেছে। বৃদ্ধ, বিমূঢ় সম্রাট এর কোনোটাই করলেন না, বিহ্বল ও জড়ের মতন তিনি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলেন তাঁর পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের সুবিশাল সমাধিভবনে। সেই হুমায়ুন, যিনি একবার সাম্রাজ্য হারিয়েও আবার তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ইংরেজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর একচক্ষু কানা রজব আলী সম্রাটের গতিবিধির সম্পূর্ণ বিবরণ এসে দাখিল করলো। পরদিনই ইংরেজ বাহিনীর সবচেয়ে দুঃসাহসী এবং হঠকারী সেনাপতি হডসন মাত্র পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে এগিয়ে গেল হুমায়ুনের সমাধির দিকে। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ এই যে সম্রাট বাহাদুর শাহকে সশরীরে বন্দী করতে হবে। সেইজন্য হাত নিসপিস করলেও হডসন সন্ধি করার আদেশ পাঠালেন সম্রাটের কাছে। পূর্ণ তিন ঘণ্টা রোদুরের মধ্যে অপেক্ষা করতে হলো হডসনকে, কোনো উত্তর এলো না। যে সহস্ৰাধিক সশস্ত্ৰ সিপাহী হুমায়ুনের সমাধি প্রহরায় রয়েছে, তারা ইচ্ছে করলে হাডসনের ক্ষুদ্র বাহিনীটিকে অল্পকালের মধ্যেই পর্যুদস্ত করতে পারে, কিন্তু তাদেরও আক্রমণ করার নির্দেশ দিল না কেউ। তারপর এক সময় মসলিনের পদাঘেরা একটা পাল্কি খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। তার মধ্যে শুয়ে আছেন এক ক্ষুদ্রকায় বৃদ্ধ, যাঁর গুফ, দাড়ি ও মুখের রঙ একই রকম শ্বেত। ওষ্ঠে আলবোলার নল। সম্রাট সম্পূর্ণ বাক্যহীন। বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রাখা হলো লালকেল্লার একটি ক্ষুদ্র কক্ষে। তাঁর খাদ্য পানীয়ের জন্য সাময়িকভাবে ভাতা বরাদ হলো দৈনিক দু আনা। সদ্য রাজ্যহীন, খেতাবহীন বাদশা সেখানে প্রায়ই বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন, হিন্দুস্তানীওমে কুছ দোস্ত, কুছ শাগির্দ, কুছ আজীজ, কুছ মাসুক, উও সব কে খাকমে মিল গ্যয়ে-। সব বন্ধু, প্রিয়, দোসর, আত্মীয় শেষ হয়ে গেল, শেষ হয়ে গেল। সম্রাটকে বন্দী করেই ক্ষান্ত হলো না হডসন; এবার রাজকুমারদের পালা। উচ্ছৃঙ্খল, হঠকারী শাহী বংশের দুলালরা এই কয়েক মাস দিল্লিতে বসে ধরাকে সারা জ্ঞান করেছে। এবাবে হডসন সঙ্গে নিল একশো জন অশ্বারোহী, ওদিকে হুমায়ুনের সমাধির সামনেও প্রচুর ভিড় জমেছে। জনতা মাঝে মাঝে ধ্বনি তুলছে জেহাদের। কিন্তু রাজকুমারেরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করার বদলে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিল। রাজকুমাররা বেরিয়ে আসার পর তাদের সামনে পিছনে সৈন্য সাজিয়ে অগ্রসর হবার হুকুম দিল হাডসন। আর তাদের পাশে পাশে বিলাপ করতে করতে চললো দিল্লির মুসলমানরা। খানিক দূর যাবার পর আর ধৈর্য রাখতে পারলো না হডসন। রাজপুত্র নামধারী এই বর্বর যুবকদের এখনো দিনের পর দিন বন্দী অবস্থায় খাইয়ে পরিয়ে তোয়াজ করে রাখতে হবে! খ্ৰীষ্টান নারী ও শিশুদের হত্যার জন্য এরাও দায়ী নয়? রাজকুমারদের মান সম্ভ্রম ধূলিসাৎ করবার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গরুর গাড়িতে, নিজে ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো হডসন। রাজকুমারদের পথে নামিয়ে হডসন কর্কশ গলায় হুকুম দিল তাদের সব বহুমূল্য পোশাক-পরিচ্ছদ তখনই খুলে ফেলবার জন্য। প্রায় নগ্ন অবস্থায় দণ্ডায়মান সেই রাজকুমারদের একেবারে বুকের কাছে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে নিজের হাতে প্ৰত্যেককে খুন করলো হডসন। তারপর উন্নত গ্ৰীবা ঘুরিয়ে হডসন তার অনুচরদের হুকুম দিল মৃতদেহগুলো কোতোয়ালির সামনে পথের উপর ফেলে রাখা হোক। দেখুক দিল্লির লোক! সেখানেও শেষ নয়। কোনো এক অতিরিক্ত ইংরেজ-তোষামুদে দুই রাজকুমারের মুণ্ড কেটে নিয়ে তারপর সেই দুই ছিন্নমুণ্ড থালায় সাজিয়ে উপহার হিসেবে প্রেরণ করলো বাহাদুর শাহের কাছে। রাজকুমারদের হত্যার পরই শুরু হলো প্ৰতিশোধ গ্রহণের পর্ব। সৈন্যবাহিনীকে দেওয়া হলো নির্বিচার হত্যা ও অবাধ লুণ্ঠনের অধিকার। দিল্লি নগরী নারকীয় রূপ ধারণ করলো, পথে পথে ছড়ানো মৃতদেহ, গৃহে গৃহে তাণ্ডব ও হাহাকার। খ্ৰীষ্টান হত্যার বদলা নেবার জন্য ইংরেজ জাতির মনে আর কোনো বিবেকের বাধা নেই। রুল অব ল এখন মুলতুবি। দিল্লির পর অন্যান্য বিদ্রোহী নগরীও একে একে ফিরে আসতে লাগলো ইংরেজের করায়ত্তে, সেসব স্থলের সামান্য সিপাহী-গন্ধযুক্ত হাজার হাজার মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হতে লাগলো। ফাঁসীতে ঝোলাতে সময় অযথা ব্যয় হয় বলে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে মনুষ্য-শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া অনেক বেশী সুবিধাজনক। মানুষই এমনভাবে মানুষকে মারতে পারে। বিজয় অভিযান শুরু হওয়ার পর কোম্পানির রাজত্বের রাজধানী কলকাতা নগরীতেও দেখা গেল প্ৰবল প্ৰতিক্রিয়া। ইংরেজ সমাজ এবং তাদের সংবাদপত্রগুলি হিংসা-ক্ৰোধে লেলিহান ভাষায় দাবি তুললো প্ৰতিশোধের। ভারতীয়দের তারা সম্বোধন করতে লাগলো কুকুর, বাঁদর, নরকের কীট এবং আরও কদৰ্য ভাষায়। কোনো ভারতীয়ই বিশ্বাসযোগ্য নয়, এবং যে-হেতু ভারতীয়রা পুরোপুরি মনুষ্য পদবাচ্য নয়, তাই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব খোঁজারও কোনো
false
shomresh
নাম কী? খনাতিক মোজাম্বা। যে নৌকোয় চড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতাম, তার মাঝি ছিল লোকটা। অথচ কবিতা লিল নির্ঘাত নোবেল পেয়ে যেত অ্যাদ্দিনে। লাইনটা শুনুন, হে বৃষ্টি, মেঘ না থাকলে তোমার অস্তিত্ব নেই যেমন, আমার দুঃখগুলোরও কোনও মূল্য নেই আমি না থাকলে। বিউটিফুল। কী বলেন? মেজর জিজ্ঞেস করলেন। সত্যিই ভাল। কিন্তু বৃষ্টির জন্যই বারান্দায় পোকা বাড়ছে। আমরা যদি তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি, তা হলে কারও অসুবিধে আছে? অমল সোম জানতে চাইলেন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে। শুয়ে পড়ব। সবাই মিলে? মেজর অবাক! হ্যাঁ। কেন? আমাদের সতর্ক থাকা উচিত নয় কি? নীল চ্যাটার্জি তার বন্ধুর হেনস্থার বদলা নিতে এখানে আসবে না? যা ফেরোসাস লোক! মেজর কথা শেষ করেই কানখাড়া করলেন। বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। তারপরেই দূরে হেডলাইটের আলো দেখা গেল, আবছা। মেজর উঠে দাঁড়ালেন, আমার অস্ত্রটা নিয়ে আসি। তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলেন। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়িটা একেবারে বাংলোর গায়ে এসে থামল। দরজা খুলে কে ভেতরে ঢুকে গেল, ওপর থেকে বোঝা গেল না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ হল। ওরা দেখল চৌকিদার দৌড়ে উঠে এসেছে, সাব, নীলবাবু এসেছেন, দেখা করতে চান। অমল সোম বললেন, নিয়ে এসো। চৌকিদার নেমে গেলে অমল সোম বললেন, ছেলেটা মোটেই মাথামোটা নয়। নীল উঠে এল। বৃষ্টির জল তার জ্যাকেটে লেগেছে। ওপরে এসে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার। আপনাদের কি বিরক্ত করলাম? অমল সোম বললেন, মোটেই নয়। বসুন। চেয়ার টেনে পা ছড়িয়ে বসল নীল, আরে, আপনারা নিজেদের পরিচয় দেবেন তো, কীরকম মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল বলুন তো! আপনি তো অর্জুন? আমি আপনার ফ্যান। সেই লাইটারের আমল থেকে। আপনার বাংলাদেশে গিয়ে রহস্য উদ্ধারের শেষটা অবশ্য আমাকে টানেনি। যাকগে, আমি এলাম অনেকটা দিদির চাপে। যা হয়েছে সব ভুলে যান। এনজয় ইওর টিপ। অনেক ধন্যবাদ। শুনলাম আপনারা নাকি একটা ফুলের খোঁজে এসেছেন, যা বিষের গন্ধ ছড়ায়। ইন্টারেস্টিং। এব্যাপারে যদি আমার সাহায্য দরকার হয়, তা হলে বলবেন। নিশ্চয়ই বলব। অমল সোম শান্ত গলায় বললেন। তা হলে আজ চলি। আপনারা গল্প করুন। নমস্কার। হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল নীল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি যে ম্যাজিক জানেন, তা কখনও পড়িনি তো! আমার নির্বোধ বন্ধু যা করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন আপনি। হাত নেড়ে আগুন জ্বালাতে এদেশের সাধু-সন্ন্যাসীরা এককালে পারতেন। অবশ্য আমেরিকানরা বোতাম টিপে সেটা করতে পারে। নমস্কার। দ্রুত চলে গেল নীল। তারপরেই গাড়িটা পাক খেয়ে ফিরে গেল। সে উঠে এসেছিল গাড়ির হেডলাইট না নিভিয়ে। জায়গার অন্ধকার আরও বেড়ে গেল। অমল সোম হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বুঝতে পারলে অর্জুন? অর্জুন মাথা নাড়ল, না। এ যে দেখছি একদম উলটো ব্যবহার। হ্যাঁ। আমি যা ভেবেছিলাম, নীলবাবু তার অনেক বেশি বুদ্ধিমান। উনি এসে এই বৃষ্টির মধ্যে জানিয়ে গেলেন আমাদের সম্পর্কে সমস্ত খবর ওঁর নেওয়া হয়ে গিয়েছে। মেজর বেরিয়ে এলেন, আমার মনে হয় ছেলেটা ভয় পেয়েছে। বন্ধুকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি দেখে বুঝতে পেরেছে ওরও ওই একই অবস্থা করব আমরা। অমল সোম উঠে পড়লেন, ভয় পেয়েছে কিনা জানি না, তবে অর্জুন যে বোম টিপে আগুন জ্বালিয়েছিল, সেটা ধরতে পেরেছে নীলবাবু। আর আপনি যে আমেরিকায় থাকেন, সেই খবর নিশ্চয়ই ওর জানা হয়ে গেছে। সন্ধের পরই রাতের খাবার দেওয়া হল। কিন্তু অর্জুন খেল না। সে বলল, এখন আমার একটুও খিদে পাচ্ছে না, আপনারা খেয়ে নিন, আমি পরে খাব। মেজর তাই শুনে খাওয়ার সময়টা পিছিয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু অমল সোম সেটা করতে দিলেন না। ওঁরা যখন নীচের খাবার ঘরে যাচ্ছেন, তখন দোতলার বারান্দায় বসে অর্জুন বৃষ্টি দেখছিল। যদিও তার মন পড়ে ছিল জঙ্গলের মধ্যে। শালগাছ-ঘেরা জায়গাটায় নিশ্চয়ই এখন বৃষ্টির জল ঢুকে পড়েছে। বেচারা সুন্দর! অন্যায়ের সঙ্গে হাত মেলাবে না বলে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে ওকে। নীল চ্যাটার্জি যখন তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করল, তখন সে সুন্দরের কথা ওকে বলতে পারত। অর্জুনের অনুরোধ হয়তো নীল রাখত। কিন্তু না, তাতে সুন্দরেরই ক্ষতি বাড়ত। ওর মুখে থর শিকারের কাহিনী অর্জুনরা জেনে গিয়েছে, তা বোঝার পর নীল আর পিছিয়ে যেত না। বরং সুন্দর যে এ অঞ্চলে আছে তা জেনে যেত। সুন্দরকে সে রাত্রে এখানে আসতে বলেছে। সেই কারণে অমল সোম বলা সত্ত্বেও রাতের খাবার খেল না। এমন বৃষ্টির রাত্রে চৌকিদার বাবুর্চি বেশিক্ষণ জেগে থাকবে না। তখন সুন্দর এলে খাবারটা ওর সঙ্গে ভাগ করে খেতে পারবে। অর্জুন দেখল বাবুর্চি ওর খাবার ওপরে নিয়ে আসছে। শোওয়ার ঘরের টেবিলে যত্ন করে ঢেকে রেখে নেমে গেল। অমল সোম এবং মেজর খাওয়া শেষ করে ওপরে উঠে এলেন। মেজর বললেন, খেতে পেলেই শুতে চায়, কথাটা আমার ক্ষেত্রে খুব খাটে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ুন। অর্জুন বলল। আফ্রিকাতেও তাই করতেন? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন। আফ্রিকা ন্য। গ্রিনল্যান্ড থেকে একশো কিলোমিটার উত্তরে বরফের ওপর তাঁবু খাটিয়ে তিন রাত ছিলাম। তখন শুধুই রাত। সময় বুঝতে হলে ঘড়ি দেখতে হত। বিকেল পাঁচটার সময় খেয়েদেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে যেতাম। আমার সঙ্গে ছিলেন এক বৃদ্ধ বিজ্ঞানী, স্ট্যানলি স্টিভেনসন। স্ট্যানলির ঘুম আসত না। সে জেগে জেগে হাওয়ার শব্দ শুনত। হাওয়াদের নাকি নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। থাকতে পারে। আমি চললাম। অমল সোম নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
false
humayun_ahmed
একা না। একজন সঙ্গীও আছে। সঙ্গীর নাম সরফরাজ। সুন্দর চেহারা। গোলগাল মুখ। কানঢাকা টুপি পরে আছেন। তিনি যাবেন কোলকাতা। কালীবাড়িতে লঞ্চ বদল করতে হয়। রাতে কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে মসজিদে উঠেছেন। সরফরাজ সঙ্গী হিসেবে ভালো। মাওলানাকে দেখে বললেন, আপনার পায়ের যে অবস্থা তিন-চার দিন নড়তে পারবেন না। ফোসকার চিকিৎসা না করলে পায়ে ঘা হয়ে যাবে। রাতে কিছু খেয়েছেন? মাওলানা বললেন, জি-না জনাব। আমার কাছে আখের গুড় আছে, খাবেন? দুর্ভিক্ষের কারণে দেশের অবস্থা এমন যে টাকা থাকলেও খাওয়া পাওয়া মুশকিল। আখের গুড় খেয়ে পানি খান, ক্ষুধা কমবে। সরফরাজ গুড় বের করে দিলেন। নিজেই মাটির সরায় করে পানি এনে দিলেন। মাওলানা তৃপ্তি করে পানি খেয়ে বললেন, জনাবের এশার নামাজ কি পড়া হয়েছে? পড়া না হয়ে থাকলে আসুন দুই ভাই মিলে নামাজটা পড়ে ফেলি। সরফরাজ বললেন, আমি মুসলমান না। যখন মসজিদে থাকার দরকার পড়ে তখন মুসলমান নাম নেই। আপনি কোন ধর্মের? আমি কোনো ধর্মেরই না। মহাত্মা কবীরের অনুসারী বলতে পারেন। (ধর্মগুরু। গুরু নানকের সমসাময়িক।) মহাত্মা কবীরের নাম শুনেছেন? জি-না জনাব। আমি মুর্থ মানুষ। মহাত্মা কবীর বলেছেন পাথর পূজে হরি মেলে তো হাম পূজেঙ্গে পাহাড়। অর্থ বুঝেছেন? জি-না। অর্থ হলো পাথর পূজা করে যদি ভগবান পাওয়া যেত তাহলে ছোট্ট পাথর পূজা না করে আমি পাহাড় পূজা করতাম। শুয়ে পড়ুন। আপনাকে খুবই কাহিল দেখাচ্ছে। নামাজ টামাজ যা পড়ার কাল পড়বেন। কাজা পড়ে ফেলবেন। তাছাড়া ভ্রমণের সময় নামাজের ব্যাপারে আপনাদের কিছু রেয়াত আছে না? জি আছে। তাহলে আর কথা কী। টেনে ঘুম দিন। মাওলানা ইদরিস ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর গাঢ় ঘুম হলো। ফজরের ওয়াক্তে মুসল্লিরা এসে তার ঘুম ভাঙাল। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন, কোমরের সঙ্গে বাধা খুঁনিটা নেই। নিশিসঙ্গী কবীরভক্তও নেই। শরীর কাঁপিয়ে তার জ্বর এলো। ইদরিস মসজিদের বারান্দায় কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে রইলেন। ভাগ্যকে দুষতে ইচ্ছা করছে। দুষতে পারছেন না। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তুমি ভাগ্যকে দোষ দিও না। কারণ আমিই ভাগ্য।’ কালীবাড়ির মসজিদে তিনদিন তিন রাত প্রায় অচেতন অবস্থায় কাটালেন। চতুর্থদিনে মুসল্লিরা তাকে কোলকাতার এক লঞ্চে তুলে দিলেন। মসজিদে মরে পড়ে থাকার চেয়ে লঞ্চে মরে থাকুক। মাওলানা লঞ্চের খোলা ডেকে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। ডেকের এক কোনায় বাদ্য বাজনার দল বসেছে। শীত কাটানোর জন্যে তারা গান করছে। গান জমছে না। বারবার তাল কাটছে। মূল গায়ক বড়ই বিরক্ত হচ্ছে। কালী, হলি মা রাসবিহারী নটবর বেশে বৃন্দাবনে। বৃন্দাবনে এ এ এ এ… লঞ্চ বড় নদীতে পড়ে খুব দুলছে। মাওলানার মনে হচ্ছে তিনি গড়িয়ে পানিতে পড়ে যাচ্ছেন। গানের দলের মূল গায়েনকে বললেন, বাবা, আমাকে একটু ধরেন। গায়েন তাঁর কথা শুনতে পেল না। সে কানে হাত দিয়ে লম্বা করে সুর টানল— বৃন্দাবনে এ এ এ। রাত অনেক। ধনু শেখ দলবল নিয়ে লাবুসের বাড়িতে এসেছেন। পান্ধিতে করে এসেছেন। পাল্কির ভেতরই বসে আছেন। তার হাতে পােচ ব্যাটারির টর্চ। তার সঙ্গীদের মধ্যে একজনের হাতে হ্যাজাক বাতি। হ্যাজাকের ঝকঝকে সাদা আলোয় লাবুসের বাড়ির উঠান আলোকিত। লাবুস এগিয়ে এলো। এত রাতে ধনু শেখের আসার কারণ সে বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে। কেমন আছ লাবুস? ভালো আছি। সবকিছু কি ঠিকঠাক? জি ঠিকঠাক। কোনোখানে বেতাল কিছু আছে? লাবুস বিস্মিত হয়ে বলল, না! লাবুসের পাশে শ্ৰীনাথ এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হৈচৈ শুনে জেগেছেন। আচমকা ঘুম ভাঙায় ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছেন না। ধনু শেখ বললেন, আমার স্ত্রী শরিফা কি তোমার বাড়িতে লুকায়ে আছে? জি না। হুট কইরা না বলব না। চিন্তা ভাবনা কইরা বল। তোমার এই বিশাল বাড়ির কোনো চিপায় চাপায় লুকায়া থাকতে পারে। ভালোমতো সন্ধান না কইরাই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তুমি নিজে সন্ধান কর। আমার লোকজনও সন্ধান করবে। জি আচ্ছা। শরিফার সাথে আমার সামান্য মনকষাকষি হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এইসব হয়। সে রাগ করে বের হয়ে গেছে। বুঝেছ? জি। আপনি কি ভেতরে এসে বসবেন? আমারে ভিতরে নেওয়া আরো ঝামেলা। কোলে কইরা নিতে হবে। তার প্রয়োজন নাই। যেখানে আছি ভালো আছি। তোমার এখানে কি তামাকের ব্যবস্থা আছে? ব্যবস্থা থাকলে তামাক দিতে বলো। হাদিস উদ্দিন তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। ধনু শেখ গুড়ুক গুড়ুক করে নল টানছেন। তামাকের ধোঁয়া চিন্তা পরিষ্কারক। ধনু শেখ হাদিস উদিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর নাম কী? হাদিস উদ্দিন। লোকমুখে শুনি শশাংক পাল মরে প্রেতিযোনি প্ৰাপ্ত হয়েছেন। এই বাড়ির আশেপাশে তারে দেখা যায়। কথা কি সত্য? জি সত্য। ষোল আনা সত্য। তুই কোনোদিন দেখেছিস? জে না। তাহলে কীভাবে বললি ষোল আনা সত্য? শ্ৰীনাথ বাবু দেখেছেন। শ্ৰীনাথটা কে? গোমস্তার কাজ করে। সো কই? এতক্ষণ আপনার সামনেই ছিল, এখন ছোটকর্তার সঙ্গে অন্দরে গেছেন। তারে ডাক দিয়া আন। ভূতের কী ঘটনা শুনি। হাদিস উদ্দিন এক দৌড়ে অন্দরে ঢুকল। গভীর রাতে হঠাৎ এই কর্মব্যস্ততায় সে আনন্দ পাচ্ছে। ধনু শেখ আরাম করে হুক্কা টানছেন, এটাও তার জন্যে আনন্দের। ভালো জিনিসের মর্ম সবাই বুঝে না। তোমার নাম শ্ৰীনাথ? জি। চেহারা-ছবি তো ভালো না। শ্ৰীনাথ নাম না হয়ে বিশ্ৰীনাথ নাম হলে মানানসই হতো। হা হা হা। নিজের রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে ধনু শেখ অনেকক্ষণ হাসলেন। শ্ৰীনাথ শুকনা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। শশাংক পালের ভূত তুমি নাকি দেখেছ?
false
shunil_gongopaddhay
তবে সে সাধু ইনি নন। ইনি তখন তীর্থ করতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতে। একজন চেলার উপর ভর দিয়ে গিয়েছিলেন এই আখড়া দেখাশোনার। সেই চেলাটিরও গুপ্তধন পাওয়ার লোভ হয়েছিল। সাধু হলেও অনেকের লোভ যায় না। সেই চেলাটির জেল হয়েছিল মাত্র তিন বছর। ছাড়া পাওয়ার পর সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। এই সাধুবাবার অবশ্য কোনও দোষ বা লোভের কথা জানা যায় না। সন্ধে হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে বিদায় নিল সকলে! এখান থেকে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। পশ্চিম আকাশে অস্ত সূর্যের লাল রেখা। সেদিকে বেশ মেঘ জমেছে। কাকাবাবু ঠিক করেই এসেছেন। আজ আর ফিরবেন না, রাতটা এখানেই কাটাবেন। এই জায়গাতেই কাকাবাবু এক রাতে দশ জন ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিল কর্নেলের ভাই সুরজকান্ত। কর্নেল যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, এটাই তো সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। সে-রাতে কাকাবাবু পুলিশকে খবর দিয়ে রেখেছিলেন। আজ তিনি পুলিশের কোনও সাহায্য চাননি। সুদর্শনও কিছু জানেন না। অন্য লোকজন সব বিদায় নেওয়ার পর সাধুবাবা জিজ্ঞেস করলেন, বলিয়ে রায়চৌধুরীসাব, কেয়া খবর? কাকাবাবু বললেন, সাধুজি, আপনি রাতে কী খান? সাধুবাবা বললেন, দো-তিন রোটি, থোড়া ডাল, অউর এক চামচ মধু। দিনের বেলা ফল ছাড়া কিছু খাই না। কাকাবাবু বললেন, মধু? সাধুবাবা বললেন, এক চেলা মধু দিয়েছে। শিষ্যরাই সবকিছু দেয়। কাকাবাবু বললেন, আজ আর দুখানা রুটি বেশি বানাবেন? আপনার সঙ্গে খাব। রাতে এখানেই থাকব। একটা এক্সট্রা খাটিয়া আছে নিশ্চয়ই। সাধুবাবা বললেন, আপনি আমার মেহমান। আপনি আমার সঙ্গে অন্ন ভাগ করবেন, এতে আমার পুণ্য হবে। কিন্তু রাজাজি, একটা কথা আছে। বাইরের মানুষরা চলে গেলে আমি পূজায় বসি। ধ্যান করি। তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর রুটি পাকাই। আপনি কি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবেন? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাতে কোনও অসুবিধে নেই। আমিও বেশি রাতে খাই। আচ্ছা সাধুজি, এখানে কি এখনও রাতে কেউ আসে? সাধুবাবা বললেন, মাঝে মাঝে আসে। আওয়াজ শুনতে পাই। তবে কাউকে দেখতে পাই না। কাকাবাবু বললেন, এখানে তো সারা রাত দুজন গার্ডের পাহারা দেওয়ার কথা। সাধুবাবা বললেন, কথা তো আছে। কিন্তু কাজ নেই। গার্ড দুজন একটু রাত হলেই ভেগে যায়। পাহাড়ের নীচের গাঁওয়ে গিয়ে আরামসে শুয়ে থাকে। কাকাবাবু বললেন, তা হলে কি এখনও গুপ্তধনের লোভে কেউ কেউ আসে? এখানে গুপ্তধন কিছু নেই, আমি জানি। তবু গুপ্তধনের কথা একবার রটে গেলে লোকের মনে সেটা গেঁথে যায়। যাই হোক, যারা আসে, তারা আপনাকে বিরক্ত করে না তো? সাধুবাবা বললেন, নাঃ! শুধু এক রাতে আমি খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছি, একসময় মনে হল, কেউ আমার খাটিয়াটা ঠেলছে। ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, কী একটা জানোয়ার দৌড়ে পালাল। মনে হল, জংলি শুয়োর। কাকাবাবু বললেন, এখানে শুয়োর আছে নাকি? সাধুবাবা বললেন, আছে। সেই থেকে আমি ধুনি জ্বালিয়ে রেখে তার পাশে শুই। আগুন দেখলে কোনও জানোয়ার কাছে আসে না। একটু পরে সাধুজি পুজোয় বসলেন। কাকাবাবু হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেন সামনের খোলা জায়গাটার দিকে। সাধুবাবা ঠিকই বলেছেন, পাহারাদার দুজনই নেই। তারা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। লোহার গেটটা তালাবন্ধ। তবে সেই গেট টপকে আসা খুবই সহজ। কর্নেল আর লায়লা কি এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে! ওরা কি হোটেলটার উপর নজর রাখেনি? তার ট্যাক্সিটা অনুসরণ করলেই এখানে পৌঁছে যেতে পারে। দিনেরবেলা দেখা জায়গাগুলোই রাতে রহস্যময় মনে হয়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সত্যিই যেন কেউ লুকিয়ে আছে। কাকাবাবু ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, এসো, কর্নেল! এসো ধ্যানচাঁদ ওরফে জগমোহন, আমাকে মারতে চাও তো এসো, লড়ে যাও! রাজা রায়চৌধুরীকে এ পর্যন্ত অনেকেই মারতে চেয়েছে, তুমি পারো কিনা দেখি! তোমার সঙ্গে লড়াইয়ে যদি হেরে যাই, তবে মরব। তার জন্য আমি রেডি। আর আমায় যদি মারতে না পারে, তা হলেও তোমাকে আমি ছাড়ব না। সন্তুকে তুমি প্রায় মেরে ফেলেছিলে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে! কোথাও একটু খসখস শব্দ হলেই কাকাবাবু চট করে সেদিকে ফিরে। তাকাচ্ছিলেন। আজ বোধহয় পূর্ণিমা, এর মধ্যেই আস্ত একখানা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে আকাশে। গরম কমে গিয়ে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা তারা। কী সুন্দর এই সময়টা। চতুর্দিক একেবারে শান্ত। পিছন দিকে একটা খসখস শব্দ হলেও কাকাবাবু আর ফিরলেন না সেদিকে। না, তিনি আর মৃত্যুর কথা ভাববেন না। এমন শান্ত, সুন্দর জায়গায় খুনোখুনি কিংবা মৃত্যুর কথা চিন্তা করার কোনও মানে হয় না। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে আনন্দের। মানুষ কেন নিজে বেঁচে থেকে অন্যদেরও বাঁচতে দেয় না! ইতালি থেকে একটা চিঠি এসেছে কাকাবাবুর নামে। তাঁর বন্ধু রুডলফ আন্তোনিও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আল্পস পাহাড়ে একটা অভিযানে যাওয়ার জন্য। ইতালি, ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের মাঝখানে এই আল্পস পাহাড়। ইউরোপে সবচেয়ে বড়, উপরে বরফ ঢাকা। আগে ফরাসি দেশ থেকে ইতালি যেতে হলে এই পাহাড় পেরিয়ে যেতে হত। অনেক উঁচু পর্যন্ত ঘোরানো ঘোরানো সেই রাস্তা এখনও আছে। এখন আল্পসের পেটের ভিতর দিয়ে একটা টানেল তৈরি হয়েছে। খুব সম্ভবত সাড়ে ষোলো কিলোমিটার লম্বা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টানেল। গাড়িটাড়ি সেই টানেলের মধ্যে দিয়ে এদেশওদেশ চলে যেতে পারে অনেক কম সময়ে। অত বড় টানেলের মধ্যে যদি কোনও গাড়ি হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়, তাতে খুব বিপদ। অন্য গাড়িও পার হতে পারে না। দারুণ ট্রাফিক জ্যাম, সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা। কিছুদিন আগে, আল্পসের সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা গাড়িতে আগুন
false
shordindu
কামিজের গলা ধরিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল; জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিয়া বলিল, ‘ইনস্পেক্টরবাবু, একে ধরে রাখুন—ছাড়বেন না। আর, কথা কইতে দেবেন না।’ মাখন ভয়ে আধমরা হইয়া গিয়াছিল, বলিল, ‘আমি—’ ‘চুপ! বিধুবাবু একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনিয়ে নিন। আসামীর নাম দেবার দরকার নেই—নামটা পরে ভর্তি করে নিলেই হবে।’ বিধুবাবুর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘ততক্ষণ এই লোকটাকে ল্যাজে খেলান—আমরা আসছি।’ বিধুবাবু বুদ্ধিভ্রষ্টের মত বলিলেন, ‘কিন্তু আমি কিছুই—’ ‘পরে হবে। ইতিমধ্যে আপনি ওয়ারেন্টখানা আনিয়ে রাখুন। এস অজিত।’ দ্রুতপদে ব্যোমকেশ উপরে উঠিয়া গিয়া ফণীর কবাটে টোকা মারিল। ফণী আসিয়া দরজা খুলিয়া সম্মুখে ব্যোমকেশকে দেখিয়া ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’ আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের ব্যস্তসমস্ত ভাব আর ছিল না, সে সাহস্যমুখে বলিল, ‘আপনি শুনে সুখী হবেন, করালীবাবুর প্রকৃত হত্যাকারী কে—তা আমরা জানতে পেরেছি।’ ফণী একটু মলিন হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা গ্রেপ্তার হয়েছেন জানি। কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।’ ‘বিশ্বাস না হবারই তো কথা। তাঁর ঘর থেকে আর একটা উইল বেরিয়েছে।–সে উইলের ওয়ারিস আপনি!’ ফণী বলিল, ‘তাও শুনেছি। কথাটা শুনে অবধি আমার মনটা যেন তেতো হয়ে গেছে। তুচ্ছ টাকার জন্যে মামার অপঘাতে প্রাণে গেল।’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘অর্থমনর্থম্! তিনি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, এতেও আমি খুশি হতে পারছি না ব্যোমকেশবাবু। নাই দিতেন টাকা—তবু তো তিনি বেঁচে থাকতেন।’ ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বইগুলা দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘তা তো বটেই। পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ—শঙ্করাচার্য তো আর মিথ্যে বলেননি! এটা কি বই? ফিজিওলজি! সুকুমারবাবুর বই দেখছি।’ বইখানা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ নামপত্রটা দেখিল। ফণী একটু হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা মাঝে মাঝে আমাকে তাঁর ডাক্তারি বই পড়তে দিতেন। কি আশ্চার্য দেখুন। এ বাড়িতে আমি সুকুমারদাকেই সবচেয়ে আপনার লোক মনে করতুম—এমন কি, দাদাদের চেয়েও—অথচ তিনিই—’ ব্যোমকেশ আরও কতকগুলি বই খুলিয়া দেখিয়া বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি তো দেখছি একজন পাকা গ্রন্থকীটি! সব বই দাগ দিয়া পড়েছেন।’ ফণী বলিল, ‘হ্যাঁ। পড়া ছাড়া আর তো কোনও অ্যামুজমেন্ট নেই—সঙ্গীও নেই। এক সুকুমারদা রোজ সন্ধ্যাবেলা খানিকক্ষণ আমার কাছে এসে বসতেন। আচ্ছা, ব্যোমকেশবাবু, সত্যই কি সুকুমারদা এ কাজ করেছেন? কোন সন্দেহ নেই?’ ব্যোমকেশ চেয়ারে আসিয়া বসিল, বলিল, ‘অপরাধীর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহের বিশেষ স্থান নেই। বসুন—আপনাকে সব কথা বলছি।’ ফণী বিছানায় উপবেশন করিল, আমি তাহার পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন, হত্যা দু’রকম হয়—এক, রাগের মাথায় হত্যা, যাকে বলে; আর এক, সঙ্কল্প করে হত্যা। রাগের মাথায় যে—লোক খুন করে, তাকে ধরা কঠিন নয়—অধিকাংশ সময় সে নিজেই ধরা দেয়। কিন্তু যে লোক ভেবে-চিন্তে নিজেকে যথাসম্ভব সন্দেহমুক্ত করে খুন করে, তাকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কে আসামী, তার নাম আমরা জানতে পারি না, পাঁচজন লোকের ওপর সন্দেহ হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমরা কোন্ পথে চলব? তখন আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে—হত্যার প্রণালী থেকে হত্যাকারীর প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করা। ‘বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি—হত্যাকারী লোকটা একাধারে বোকা এবং চতুর। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত খুন করেছে অথচ নির্বোধের মত খুনের যা-কিছু প্রমাণ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে। বলুন দেখি, সত্যবতী ছুঁচ দিয়ে খুন করবার কি দরকার ছিল? বাজারে কি ছুঁচ পাওয়া না? আর উইলখানা যত্ন করে লুকিয়ে রাখবার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি? ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ন্যাটা চুকে যেত। এ থেকে কি মনে হয়?’ ফণী হাতের উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘কি মনে হয়?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকমির ভান করতে পারে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসামী যে হোক সে বুদ্ধিমান। ‘কিন্তু বুদ্ধিমান লোকও ভুল করে,বোকা সাজবার চেষ্টাও সব সময় সফল হয় না। এ ক্ষেত্রেও আসামী কয়েকটা ছোট ছোট ভুল করেছিল বলে আমি তাকে ধরতে পেরেছি।’ ফণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ভুল সে করেছিল?’ ‘বলছি।’ ব্যোমকেশ পকেট হাটকাইয়া একটা সাদা কাগজ বাহির করিল—‘কিন্তু তার আগে এ বাড়ির একটা নক্সা তৈরি করে দেখাতে চাই। একটা পেন্সিল আছে কি? যে কোনও পেন্সিল হলেই চলবে।’ ফণীর বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা ছিল, তাহার ভিতর হইতে সে একটা লাল পেন্সিল বাহির করিয়া দিল। পেন্সিলটা লইয়া ব্যোমকেশ ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃদু হাস্যে সেটা পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘থাক, প্ল্যান্ আঁকবার দরকার নেই—মুখেই বলছি। অপরাধী ‍প্রধানত তিনটি ভুল করেছিল। প্রথমে—সে গ্রে’র অ্যানাটমির এক জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছিল; দ্বিতীয়—সে বাক্স টানবার সময় একটু শব্দ করে ফেলেছিল; আর তৃতীয়—সে আইন ভাল জানত না।’ ফণীর মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা একেবারে মড়ার মত হইয়া গিয়াছিল, সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল,‘আইন জানত না?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আর সেই জন্যেই তার অতবড় অপরাধটা ব্যর্থ হয়ে গেল।’ শুঙ্ক অধর লেহন করিয়া ফণী বলিল, ‘আপনি কি বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’ ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সুকুমারবাবুর ঘর থেকে যে উইলটা বেরিয়েছে—উইল হিসেবে সেটা মূল্যহীন। তাতে সাক্ষীর দস্তখত নেই।’ মনে হইল, ফণী এবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। অনেকক্ষণ কেহ কোনও কথা বলিল না; দৃষ্টিহীন শুঙ্ক চক্ষু মেলিয়া ফণী মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করিয়া ধরিয়া অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, ‘সব বৃথা—সব মিছে—’ ব্যোমকেশবাবু, আমাকে
false
humayun_ahmed
হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? ভালোই হবে তোমার। আনিস হাসতে-হাসতে বলল, টাকার জন্যে তোমাকে বিয়ে করতে হবে কেন? তোমার নিজের দাম তো কিছু কম নয়। আমাকে খুশি করার জন্যে বলছ? না। নিশানাথ বাবুর কথা মনে নেই, তিনি বলেছিলেন তোমাকে দেখতে ইণ্ডিয়ান গডেসের মতো লাগে। আমার মনে আছে। আনিস, আমার যখন টাকা হবে, তখন আমি ঐ ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোককে একটি বুইক স্কাইলার্ক গাড়ি কিনে দেব। ওর কি বুইক স্কাইলার্ক গাড়ি আছে? না, ওর সে-সবের বালাই নেই। ম্যাকের স্কাইলার্ক গাড়ি ছিল। ম্যাক ছিল দারুণ বড়লোক। ওর সঙ্গে আমি অনেক বার ডেটে গিয়েছি। ও আমাকে একটা ড্রেস কিনে দিযেছিল, যার দাম দু শ পাঁচাত্তর ডলার। আমি তোমাকে দেখাব। আনিস চুপ করে রইল। মালিশা মনে হল একটু টলছে। আনিস বলল, আর খেও না, মালিশা। কেন? খাব না কেন? বেশি হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাত কাঁপছে। হাত কাঁপছে, কারণ আমার জ্বর আসছে। আমার শরীর বেশি ভালো নয়। ডাক্তার দেখিয়েছ? না। ডাক্তার দেখাবার মতো কিছু নয়, তা ছাড়া আমার হেলথ ইনসুরেন্স নেই। ডাক্তারের কাছে গেলেই গাদাখানিক ডলার লাগবে। সেটা কে আমাকে দেবে? তুমি নিশ্চয়ই দেবে না। হা হা হা। কেক চলে এল দশটার দিকে। সিলোফেন কাগজে মোড়া দশটি লাল টুকটুকে গোলাপ। মালিশা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে দেখল ফুলগুলি। আনিস হাসিমুখে বলল, শুভ জন্মদিন, মালিশা। মালিশা জবাব দিল না। তার চোখে জল আসছে। সে তা গোপন করবার জন্যে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। এ বৎসর প্রচণ্ড শীত পড়েছে। ফার্গোতে যারা বসবাস করে তারা পর্যন্ত বলছে।–ন্যাস্টি ওয়েদার। ফেব্রুয়ারি মাসেই চার ফুটের মতো বরফ জমে গেল শহরে। সন্ধ্যার পর লোকজন আর ঘর ছেড়ে বের হয় না। কেউ যে শপিং-এ গিয়ে ঘুরেফিরে মন তাজা করবে, সে উপায় নেই। ঘণ্টাখানিক গাড়ি ঠাণ্ডায় পড়ে থাকলেই আর স্টার্ট নেবে না। বড়ো বড়ো উইন্টার সেল হচ্ছে, সেখানে পর্যন্ত লোকজন নেই। টমের দিনকাল বেশ খারাপ হয়ে গেল। কাজ নেই। গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে বাচ্চাদের বইয়ের একটি ইলাস্ট্রেশন ছাড়া আর কোনো কাজ জুটল না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি বিক্রিও বন্ধ। এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পায়ে হেঁটে কেউ চলাফেরা করে না! সবাই বের হয় গাড়ি নিয়ে। কার দায় পড়েছে গাড়ি থামিয়ে ছবি কিনবে? সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, বাড়িটি ছেড়ে শহরতলির একটা এ্যাপার্টমেন্ট নিতে হয়েছে। সেখানে রান্নাঘর এবং বাথরুম শেয়ার করতে হয়। টম বেশ কয়েক বার বলেছে, এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে, কিন্তু বলা পর্যন্তই। সে নাকি বরফে—ঢাকা শহরের কয়েকটি ছবি একেই বিদায় হবে। ছবি একে ফেললেই হয়, কিন্তু এখনো তার মনমতো বরফ জমা হয় নি। প্রকৃতির কাছে সম্পূৰ্ণ পরাজিত একটি শহরের ছবি আঁকব, তারপর বিদায়। বুঝলে রুনকি, এখনো সময় হয় নি। পরাজিত হবার আর বাকি কোথায়? অনেক বাকি। এখনো বাকি আছে। এই এ্যাপার্টমেন্টটিতে রুনকির গা ঘিনঘিন করে। যে–মেয়েটির সঙ্গে রান্নাঘর ও বাথরুম শেয়ার করতে হয়, সে সবকিছু বড়ো ময়লা করে রাখে। গভীর গাত পর্যন্ত হাই ভল্যুমে গান শোনে। সময়ে-অসময়ে টমের কাছে সিগারেট চায়। ভালো লাগে না রুনকির। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্রায়ই এ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে মদ খেয়ে লোকজন গলা ফাটিয়ে চেঁচায়। কিছুদিন আগেই পুলিশ এসে ছ নম্বর ঘর থেকে একটি লোককে ধরে নিয়ে গেল। এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে পারলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যায়। কিন্তু যাবার উপায় নেই, এর চেয়ে সস্তায় ফার্গোতে এ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যাবে না। টম নিজেও অনেক খোঁজাখুজি করেছে। কিন্তু ওর হাত একেবারেই খালি। অবস্থা এরকম চললে আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটের জন্যে হাত পাততে হবে। টমের তাতে খুবই আপত্তি। আমি কি ভিখিরি, যে আন-এমপ্লয়মেন্ট নেব? যখন কিছুই থাকবে না, তখন কী করবে? তখন অন্য কোথাও যাব। এই নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কোনো কাজ-টাজ করে টমকে সাহায্য করার ইচ্ছা হয়। রুনকির, কিন্তু শীতের সময়টায় কাজ পাওয়া খুব মুশকিল। একটি কাজ পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ ফার্গোতে। গাড়ি ছাড়া অত দূর যাওয়ার কোনোই উপায় নেই। বাস ঐ লাইনে যায় না। টমের গাড়িও নেই। দিন-রাত ঘরেই বসে থাকতে হয় রুনকির। ইউনিভার্সিটির ক্লাস বাদ দিতে হয়েছে। উইন্টার কোয়ার্টারে নাম রেজিস্ট্রি করা হয় নি। ধারে সাত শ ডলার যোগাড় করা গেল না। টম কাজের খোঁজে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে। রুনকি ঘরেই থাকে। ভালো লাগে না। টম সেদিন বলল, তুমি বাবা-মার কাছে ফিরে যাও, রুনকি। কেন? তোমার এখানে আর মন লাগছে না। আমি কি বলেছি, মন লাগছে না? বলতে লজ্জা লাগছে বলে বলছ না। বাবা-মার কাছে ফিরে যেতেও তোমার লজ্জা লাগছে। লজ্জার কিছু নেই, রুনকি। তুমি বড্ড বাজে কথা বল, টম। টম হেসে বলেছে, এইটি তুমি ভুল বললে রুনকি। বাজে কথা আমি কখনে, বলি না। তোমার মধ্যে দ্বিধা দেখতে পাচ্ছি বলেই বলছি। তোমার কি ধারণা, আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না? সে কথা আমি বলি নি, রুন। তুমি কি আমাকে ভালোবাস? তুমি খুব চমৎকার একটি মেয়ে। তোমাকে যে কেউ ভালোবাসবে। তুমি কিন্তু আমার কথার জবাব দাও নি। আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি রুনকি। যদি সত্যি ভালোবাস, তাহলে,–প্লীজ, চল, অন্য কোথাও যাই। আর কয়েকটা দিন, প্রকৃতির কাছে শহরের পরাজয়ের ছবিটা শেষ করেই রওনা হব। রুনকির এখন মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে মার সঙ্গে গিয়ে কথা বলে, কিন্তু সাহস হয় না। তার দিকে তাকিয়েই মা
false
robindronath
কথা সবগুলিই বলা হইয়া গেল বটে, কিন্তু মনুষ্যসমাজে মনের ভাব আর-একটু বাহুল্য করিয়া প্রকাশ করা আবশ্যক। মৃন্ময়ীও তাহা বুঝিল; এইজন্য আরো অনেকণ ভাবিয়া ভাবিয়া আর কয়েকটি নূতন কথা যোগ করিয়া দিল – ‘এইবার তুমি আমাকে চিঠি লিখো, আর কেমন আছ লিখো, আর বাড়ি এসো, মা ভালো আছেন, বিশু পুঁটি ভালো আছে, কাল আমাদের কালো গোরুর বাছুর হয়েছে।’ এই বলিয়া চিঠি শেষ করিল। চিঠি লেফাফায় মুড়িয়া প্রত্যেক অক্ষরটির উপর একটি ফোঁটা করিয়া মনের ভালোবাসা দিয়া লিখিল, শ্রীযুক্ত বাবু অপূর্বকৃষ্ণ রায়। ভালোবাসা যতই দিক, তবু লাইন সোজা, অক্ষর সুছাঁদ এবং বানান শুদ্ধ হইল না। লেফাফায় নামটুকু ব্যতীত আরো যে কিছু লেখা আবশ্যক মৃন্ময়ীর তাহা জানা ছিল না। পাছে শাশুড়ি অথবা আর-কাহারও দৃষ্টিপথে পড়ে, সেই লজ্জায় চিঠিখানি একটি বিশ্বস্ত দাসীর হাত দিয়া ডাকে পাঠাইয়া দিল। বলাবাহুল্য, এ পত্রের কোনো ফল হইল না, অপূর্ব বাড়ি আসিল না। অষ্টম পরিচ্ছেদ মা দেখিলেন, ছুটি হইল তবু অপূর্ব বাড়ি আসিল না। মনে করিলেন এখনো সে তাঁহার উপর রাগ করিয়া আছে। মৃন্ময়ীও স্থির করিল, অপূর্ব তাহার উপর বিরক্ত হইয়া আছে, তখন আপনার চিঠিখানা মনে করিয়া সে লজ্জায় মরিয়া যাইতে লাগিল। সে চিঠিখানা যে কত তুচ্ছ, তাহাতে যে কোনো কথাই লেখা হয় নাই, তাহার মনের ভাব যে কিছুই প্রকাশ করা হয় নাই, সেটা পাঠ করিয়া অপূর্ব যে মৃন্ময়ীকে আরো ছেলেমানুষ মনে করিতেছে, মনে মনে আরো অবজ্ঞা করিতেছে, ইহা ভাবিয়া সে শরবিদ্ধের ন্যায় অন্তরে অন্তরে ছট্ফট্ করিতে লাগিল। দাসীকে বার বার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সে চিঠিখানা তুই কি ডাকে দিয়ে এসেছিস।” দাসী তাহাকে সহস্রবার আশ্বাস দিয়া কহিল, “হাঁ গো, আমি নিজের হাতে বাক্সের মধ্যে ফেলে দিয়েছি, বাবু তা এতদিনে কোন্ কালে পেয়েছে।” অবশেষে অপূর্বর মা একদিন মৃন্ময়ীকে ডাকিয়া কহিলেন, “বউমা, অপু অনেকদিন তো বাড়ি এল না, তাই মনে করছি, কলকাতায় গিয়ে তাকে দেখে আসি গে। তুমি সঙ্গে যাবে ?” মৃন্ময়ী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল এবং ঘরের মধ্যে আসিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিছানার উপর পড়িয়া বালিশখানা বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া হাসিয়া নড়িয়া-চড়িয়া মনের আবেগ উন্মুক্ত করিয়া দিল; তাহার পর ক্রমে গম্ভীর হইয়া, বিষন্ন হইয়া আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া বসিয়া কাঁদিতে লাগিল। অপূর্বকে কোনো খবর না দিয়া এই দুটি অনুতপ্তা রমণী তাহার প্রসন্নতা ভিক্ষা করিবার জন্য কলিকাতায় যাত্রা করিল। অপূর্বর মা সেখানে তাঁহার জামাইবাড়িতে গিয়া উঠিলেন। সেদিন মৃন্ময়ীর পত্রের প্রত্যাশায় নিরাশ হইয়া সন্ধ্যাবেলায় অপূর্ব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া নিজেই তাহাকে পত্র লিখিতে বসিয়াছে। কোনো কথাই পছন্দমত হইতেছে না। এমন একটা সম্বোধন খুঁজিতেছে যাহাতে ভালোবাসাও প্রকাশ হয় অথচ অভিমানও ব্যক্ত করে; কথা না পাইয়া মাতৃভাষার উপর অশ্রদ্ধা দৃঢ়তর হইতেছে। এমন সময় ভগ্নীপতির নিকট হইতে পত্র পাইল, ‘মা আসিয়াছেন, শীঘ্র আসিবে এবং রাত্রে এইখানেই আহারাদি করিবে। সংবাদ সমস্ত ভালো।’ – শেষ আশ্বাস সত্ত্বেও অপূর্ব অমঙ্গলশঙ্কায় বিমর্ষ হইয়া উঠিল। অবিলম্বে ভগ্নীর বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল। সাক্ষাৎমাত্রই মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মা, সব ভালো তো ?” মা কহিলেন, “সব ভালো। তুই ছুটিতে বাড়ি গেলি না, তাই আমি তোকে নিতে এসেছি।” অপূর্ব কহিল, “সেজন্য এত কষ্ট করিয়া আসিবার কী আবশ্যক ছিল ; আইন পরীক্ষার পড়াশুনা-” ইত্যাদি। আহারের সময় ভগ্নী জিজ্ঞাসা করিল, ‘দাদা, এবার বউকে তোমার সঙ্গে আনলে না কেন।” দাদা গম্ভীরভাবে কহিতে লাগিল, “আইনের পড়াশুনা – ” ইত্যাদি। ভগ্নীপতি হাসিয়া কহিল, “ও-সমস্ত মিথ্যা ওজর। আমাদের ভয়ে আনতে সাহস হয় না।” ভগ্নী কহিল, “ভয়ংকর লোকটাই বটে। ছেলেমানুষ হঠাৎ দেখলে আচমকা আঁৎকে উঠতে পারে।” এইভাবে হাস্যপরিহাস চলিতে লাগিল, কিন্তু অপূর্ব অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া রহিল। কোনো কথা তাহার ভালো লাগিতেছিল না। তাহার মনে হইতেছিল সেই যখন মা কলিকাতায় আসিলেন তখন মৃন্ময়ী ইচ্ছা করিলে অনায়াসে তাঁহার সহিত আসিতে পারিত। বোধ হয়, মা তাহাকে সঙ্গে আনিবার চেষ্টাও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে সম্মত হয় নাই। এ সম্বন্ধে সংকোচবশত মাকে কোনো প্রশ্ন করিতে পারিল না – সমস্ত মানবজীবন এবং বিশ্বরচনাটা আগাগোড়া ভ্রান্তিসংকুল বলিয়া বোধ হইল। আহারান্তে প্রবলবেগে বাতাস উঠিয়া বিষম বৃষ্টি আরম্ভ হইল। ভগ্নী কহিল, “দাদা, আজ আমাদের এখানেই থেকে যাও।” দাদা কহিল, “না, বাড়ি যেতে হবে; আজ কাজ আছে।” ভগ্নীপতি কহিল, “রাত্রে তোমার আবার এত কাজ কিসের। এখানে এক রাত্রি থেকে গেলে তোমার তো কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না, তোমার ভাবনা কী।” অনেক পীড়াপীড়ির পর বিস্তর অনিচ্ছা-সত্ত্বে অপূর্ব সে রাত্রি থাকিয়া যাইতে সম্মত হইল। ভগ্নী কহিল, ‘দাদা, তোমাকে শ্রান্ত দেখাচ্ছে, তুমি আর দেরি করো না, চলো শুতে চলো।” অপূর্বরও সেই ইচ্ছা। শয্যাতলে অন্ধকারের মধ্যে একলা হইতে পারিলে বাঁচে, কথার উত্তর-প্রত্যুত্তর করিতে ভালো লাগিতেছে না। শয়নগৃহের দ্বারে আসিয়া দেখিল ঘর অন্ধকার। ভগ্নী কহিল, “বাতাসে আলো নিবে গেছে দেখছি। তা, আলো এনে দেব কি, দাদা।” অপূর্ব কহিল, “না, দরকার নেই, আমি রাত্রে আলো রাখি নে।” ভগ্নী চলিয়া গেলে অপূর্ব অন্ধকারে সাবধানে খাটের অভিমুখে গেল। খাটে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইতেছে এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্বণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময়প্রকাশের অবসর দিল না। অপূর্ব প্রথমে চমকিয়া উঠিল, তাহার পর বুঝিতে পারিল, অনেক দিনের একটি হাস্যবাধায়-অসম্পন্ন চেষ্টা আজ অশ্রুজলধারায় সমাপ্ত হইল। আশ্বিন, ১৩০০ প্রথম পরিচ্ছেদ
false
shunil_gongopaddhay
বুঝিবে এবং লৌকিকতার ত্রুটি ক্ষমা করিবে। এক সময় আমার এক বন্ধু পুত্র আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দৈবক্রমে রাণুকে দেখিয়া তাহাকে বিবাহের জন্য উৎসুক হইয়া উঠে। সগোত্রে বিবাহে তাহার পিতার সম্মতি হইবে না আশঙ্কা করিয়া আমি প্রথমে বাধা দিই। তখন তাহার পিতা কলিকাতায় ছিলেন না। সেই ছেলেটি ও তাহার একজন গুরুস্থানীয় আমাকে বারবার আশ্বাস দিলেন যে, আপত্তি গুরুতর হইবে না এবং বিবাহ নিশ্চয়ই ঘটিবে। ছেলেটি ভাল, তাহার হাতে রাণু কষ্ট পাইবে না নিশ্চয় ভাবিয়া আমি তাহাদের পরিচয়ে বাধা দিই নাই, কিন্তু পরিচয় বলিতে একবার শান্তিনিকেতনে দেখা হইয়াছিল। রাণু তখন আমার কন্যা মীরা ও বউমার সঙ্গে ছিল। ছেলেটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হওয়া তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। আপনি আমার কন্যা বেলাকে জানিতেন। তাহার ছোট ভাই শমী বাঁচিয়া নাই। আমি অনেকবার ভাবিয়াছি যে, সে যদি বাঁচিয়া থাকিত, তবে রাণুর সঙ্গে নিশ্চয় তাহার বিবাহ দিতাম। সঙ্গে সঙ্গে আর একটি চিঠি লিখলেন সরযুকে : চিঠি পেয়ে বজ্রাহত হলুম। কিন্তু ভয় পেয়ো না। আমার যা সাধ্য তা আমি করবো। কে আজই চিঠি লিখে দিলুম। কে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছি। খুব সম্ভব দুজনেই এখানে আসবেন। রাণুকে বোলো, বেশি উদ্বিগ্ন না হয়। সমস্তই ঠিক হয়ে যাবে। চিঠি লিখছেন, আর কবির হাতে কাঁপছে। নিন্দুকরা এর মধ্যে আরও কত বিষ ছড়াচ্ছে কে জানে! ওই সব আড়ালের নিন্দুকরা কারা তা জানার উপায় নেই, খুব কাছের মানুষও হতে পারে। কবি স্নান করলেন না, আহারেও তাঁর রুচি হল না। কবির শরীর খারাপ মনে করে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতিমা খোঁজ নিতে এল বারংবার। কবি তাকেও কিছু বলতে পারছেন না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থেকেও তাঁর ঘুম এল না। চোখে ভাসতে লাগল রাণুর মুখ। সে ও কি এসব শুনেছে? কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার? সে কি কান্নাকাটি করছে খুব। প্রশান্তর মুখে কবি শুনেছেন, ভাবী স্বামীর সঙ্গেই বেশ ভাব হয়ে গেছে রাণুর। মনে মনে সে একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে এই বিয়ের জন্য। এখন যদি বিয়েটা ভেঙে যায়। যে-আঘাত সে পাবে, তার পরেও কি সে তার ভানুদাদাকে ভালো বাসতে পারবে? তিনিই বা রাণুকে সান্ত্বনা দেবেন কোন ভাষায়? সস্ত্রীক রাজেন মুখার্জি যখন কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন তাঁর সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকটি কুৎসাপূর্ণ চিঠি। দু’পক্ষে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলল। কবি বারবার ব্যাকুল ভাবে বোঝাতে লাগলেন, রাণুদের পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁর অনেকদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, রাণুকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন, কিছু কুলোক তার মন্দ ব্যাখা করতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, বীরেনের মতামত নেওয়া হবে। সে রাজি হলে আর কোনও বাধা থাকবে না। বীরেন বিলিতি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত। সে রাণুকে দেখেছে একাধিক বার, কথা বলেছে, তাকে পছন্দ করেছে। উড়ো চিঠি টিটি সে গ্রাহ্য করে না, তার আপত্তির কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বিয়ের তারিখও ধার্য হয়ে গেল। মেঘ মুক্ত হয়ে কবি বিরাট স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। রাণু এসব কিছুই জানে না। সে বিয়ের আগের কয়েকটা দিন ভানুদাদার সঙ্গে কাটাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। লিখছে চিঠির পর চিঠি। কবি এখন সতর্ক হয়ে গেছেন। রাণুর চিঠির উত্তর দিচ্ছেন নির্লিপ্ত ভাষায়। শেষ চিঠিতে লিখলেন : বিবাহের অধিকদিন আগে তোমার পক্ষে কলকাতা যাওয়া ঠিক হবে না। বিশেষত আমার বাড়িতে থাকলে সর্বদাই নানাদিক থেকে উৎপাতের আশঙ্কা আছে। খুবই ইচ্ছা ছিল, বিবাহের আগে কিছুকাল তোমরা সবাই আমার বাড়িতেই থাকব কিন্তু সেটা ঘটতে দিল না। শান্তিনিকেতনে ওদের উৎপাত চিঠি ছাড়া আর কোনও আকারে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং এখানে তোমরা যতদিন খুশি নিরুপদ্রবে থাকতে পারো। রাণু প্রায় জোর করেই বাবা-মাকে রাজি করিয়ে, সবাইকে নিয়ে চলে এল শান্তিনিকেতন। এবার যেন অন্যরকম। পদে পদে বিধিনিষেধ। সবাই খালি উপদেশ দেয়, দৌড়োবে না, বৃষ্টি ভিজবে না, দুপুর রোদে বেরোলে রং কালো হয়ে যাবে। ঠিক সময় খাবে, ঠিক সময় ঘুমোবে। এমনকী রাণুর ভানুদাদাও সবার সামনে তাকে অনবরত উপদেশ দেন, শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কেমনভাবে ব্যবহার করতে হবে সবার সঙ্গে। গুরুজনদের সেবা আর ছোটদের প্রতি স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে হতে হবে আদর্শ স্ত্রী। রাণু অন্য সব বিধিনিষেধ মানে, শুধু রাত্তিরবেলা সে একবার ভানুদাদার কাছে যাবেই যাবে। তখন ভানুদাদা তার একান্ত আপন। ভানুদাদাও অপেক্ষা করেন তার জন্য। ওপরের বারান্দায় জ্যোৎস্নালোকে বসে দুজনের কত কথা, কত গান। এখন আর বাবা-মাও তাকে নিষেধ করেন না। আর তো মাত্র কয়েকটি দিন, তারপর মেয়ে চলে যাবে পরের বাড়িতে। সব মাবাবারই মনটা এই সময় নরম হয়ে থাকে। খুব বড়লোকের বাড়ির বউরা বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে না। বিয়ের পর রাণুর সঙ্গে আর কবে দেখা হবে, তার ঠিক নেই! সেইজন্যই এখন বেশি শাসন করে মেয়ের মনে আঘাত দিতে মন চায় না। সব বাঙালি মেয়েকেই একটা বয়েস থেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। রাণুর এর চেয়ে ভাল বিয়ে তো আশা করা যায় না। তার মনে খুশির ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, আবার যখন তখন কান্নাও পায়। মুক্ত বিহঙ্গকে বন্দি করা হবে খাঁচায়, হোক না সেটা সোনার তৈরি খাঁচা। ভানুদাদার সঙ্গে হাসি-গল্প করতে করতে হঠাৎ সে কেঁদে ফেলে ঝরঝরিয়ে। কবি বাধা দেন না, চেয়ে থাকেন একদৃষ্টিতে। এক সময় কান্না থামিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ভানুদাদা, আমি আর শান্তিনিকেতনে আসব না? কবি বললেন, না এসে পারবে? তোমার স্বামীকে বুঝিয়ো। রাণু বলল, কী জানি ভয় করে।
false
humayun_ahmed
বানাবার তিনি একটি স্কুল খুলেছিলেন। তিনি একটি স্কুল চালাতেন। আমি সেই স্কুলের ছাত্র। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বাবা মারা গেলেন। দয়া করে চুপ কর, আর কিছু জানতে চাচ্ছি না। খাবার খবরটা কী? খারাপ খবর হলো—আপনার রিলিজ পেতে একটু দেরি হবে। যিনি আপনাকে রিলিজ করবেন, তিনি রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছেন। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি যে গাড়িতে আছেন সেটা ভাঙা হবে। গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে কেন? আমাদের এখানে গাড়ি ভাঙচুর করতে কারণ লাগে না। যে-কোনো কারণে মেজাজ খারাপ হলে আমরা প্রথম যে কাজটা করি সেটা হচ্ছে গাড়ি ভাঙচুর। আমি এক্ষুনি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি—গাড়ি ভাঙচুরের অবস্থা কী? তোমাকে কোনো খোঁজ নিতে হবে না। আমি উনার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। অনেক টেপাটিপি করে তাঁকে পাওয়া গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাও? আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম, আপনার গাড়ি তো পাওয়া গেছে। খালু সাহেব বললেন, পুলিশ তাই জানিয়েছে। কোথায় গেছে, গাড়িচোর ধরা পড়ল কি-না কিছুই না বলে টেলিফোন রেখে দিল। এরপর থেকে কতবার যে টেলিফোন করলাম—কেউ টেলিফোন ধরে না। খালু সাহেব, গাড়িচোর ধরা পড়েছে। সে হাজতে আছে। বদমাইশ মকবুলটা কি ধরা পড়েছে? না। পুলিশ তার দিকে ধাওয়া করার আগেই সে এক দৌড়ে হাওয়া। গাড়ি আছে কোথায় জানো? গাড়ি আছে ধানমণ্ডি থানায়। ওসি সাহেবের নির্দেশে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুল-টুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে। ফুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে মানে? বরের গাড়ি, না সাজালে কি হয়? বর তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই গাড়িতে করেই যাবে। বর মানে? বরটা কে? এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলেন? বর আমি। হিমু, . জি আচ্ছা। তুমি কখনো আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। কখনো না। সরাসরি দেখা তো করতে পারব? তাও পারবে না। বিয়ের পর আমরা স্বামী-স্ত্রী কি আপনাকে কদমবুসিও করব না? তুমি কোনো একটা খেলা নিয়ে মেতেছ। বিশেষ কোনো খেলা খেলছ। আমি তোমার খেলায় নেই। জি আচ্ছে। মনে রেখো, টেলিফোনে সরাসরি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবে না। আপনি যদি টেলিফোন করেন তখন কি ধরব? আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি—কখনো তোমাকে টেলিফোন করব না। . তোমার খালা এবং আমি ভিন্ন ব্যক্তি। দুইজন দুই গ্রহে বাস করি। তোমার খালা অকারণে তোমাকে দিনের মধ্যে একশবার টেলিফোন করবে। কারণ তার টেলিফোনে কথা বলার ব্যাধি আছে। আমার নেই। এটা তোমার সঙ্গে আমার শেষ সংলাপ। আর তোমার সঙ্গে কথা হবে না। খালু সাহেবম আমার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আবার আমাকে টেলিফোন করবেন। আমি সেই টেলিফোন ধরব না। কিন্তু আপনি করতেই থাকবেন। করতেই থাকবেন। ! খালুসাহেব, শব্দের উৎপত্তি কি আপনি জানেন? সর্বপ্রথম এই শব্দ ব্যবহার করা হয় অ্যাথেন্সবাসীদের প্রতি। সমগ্র অ্যাথেন্সবাসীকেই বলা হয়েছিল, কারণ তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নেয় নি। চুপ ফাজিল! ফাজিল শব্দের অর্থ জানলে আপনি আমাকে এই গালি দিতেন না। এটা আরবি ভাষার একটা শব্দ। এর অর্থ জ্ঞানী। খালুসাহেব লাইন কেটে দিলেন। এই কাজটা তাঁর আরো আগেই করা উচিত ছিল। এতক্ষণ কেন করলেন না কে বলবে! আমি কম্বল মোড়া ডেডবডির দিকে তাকিয়ে খালু সাহেবের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। তিনি টেলিফোন করলেন না। মাজেদা খালা করলেন। হ্যালো খালা! হ্যালো। কী জন্যে টেলিফোন করেছি ভুলে গেছি। অথচ তোর সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। জরুরি কথা বলার জন্যে চুলায় গরুর মাংস রেখেই চলে এসে টেলিফোন করলাম—এখন কিছুই মনে পড়ছে না। কী করি বল তো? আমি বুদ্ধি করে কথাটা তোমার মাথার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারি। চেষ্টা করব? কর। কেউ একজন তোমাকে এমন কিছু বলছে তা তোমার আমাকে বলার কথা। সেই কেউ একজন তোমার তেমন পরিচিত না পরিচিত হলে নাম মনে পড়ত…। থাক থাক আর বলতে হবে না। এখন সব মনে পড়েছে। রেনুর মা টেলিফোন করেছিলেন। তোকে চাচ্ছিলেন। রেনুর বাবা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। তোর তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার কথা। নিয়ে তো এসেছি। উনি কোথায়? উনি হাজতে। হাজতে মানে? পুলিশ চুরির অপরাধে তাঁকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। উনার পেয়েছে বাথরুম। এখনো বাথরুমে যাবার সুযোগ পান নি। শাদা চামড়া হিসেবে পুলিশ যে খাতির করবে, তা করছে না। কী আবোলতাবোল বকছিস? আবোলতাবোল হলেও যা বলছি সবই সত্যি। তুমি মনে করে দেখ তো—আমি কিখনো এমন কিছু বলেছি যা পরে দেখা গেছে সেটা মিথ্যা? উনি কার গাড়ি চুরি করেছেন? খালু সাহেবের গাড়ি। তবে উনি সরাসরি চুরির সঙ্গে যুক্ত না। উনি পাকচক্রে ধরা খেয়েছেন। তোর খালু সাহেব কি ঘটনা জানে? না। তুই নিজে কোথায়? আমিও হাজতে। খালা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মনে হয় অধিক শোকে লোহা, পাথরের চেয়েও কঠিন। তোকে আল্লার দোহাই লাগে, সত্যি কথা বল। আমি সত্যি কথাই বলছি। তুমি কি ফার্গুসেন জুনিয়রের সঙ্গে কথা বলবে? খালা কিছু বললেন না। আমি টেলিফোন ফার্গুসেনের দিকে বাড়িয়ে বললাম, একটু কথা বলুন তো। ওপাশে আমার মাজেদা খালা। বলুন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ। ফার্গুসেন যন্ত্রের মতো বললেন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ। যা ভেবেছিলাম তাই হচ্ছে। খালু সাহেবের টেলিফোন আসতে শুরু করেছে। একের পর এক আসছে, আমি কেটে দিচ্ছি। মানুষটা রাগে চিড়বিড় করছে ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। আমার আনন্দ পাবার জন্যে আরেকজনকে রাগে ছটফট করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে
false
shunil_gongopaddhay
লোক দেখে টোবি ডাকতে-ডাকতে ছুটে গেল ওদের দিকে। অমনই। একজন গুলি করে টোবিকে মেরে ফেলল। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে বেঁধে ফেলতে লাগল, আমি কী করেই বা ওদের বাধা দেব? কোনওদিন কারও গায়ে হাত তুলিনি। ওদের একজন মূর্তি ভাঙতে লাগল, আর-একজন আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, যদি বাঁচতে চাও তো ব্যাঙ্গালোর চলে যাও। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। নরেন্দ্র ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাঙ্গালোর? হঠাৎ ব্যাঙ্গালোর কেন? ভার্গব বললেন, ব্যাঙ্গালোরে আমার পৈতৃক বাড়ি, ওরা সেটা জানে বোধ হয়। আমি আসলে কনাটকের লোক, যদিও অন্ধ্রপ্রদেশে আছি অনেক বছর। ওরা আমাকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে তাড়াতে চায়। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ননসেন্স! কনাটকের লোক অন্ধ্রপ্রদেশে থাকতে পারবে না? আপনার মতন একজন পণ্ডিত মানুষকে পেয়ে এদের ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা। বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ হল। নরেন্দ্র ভার্মা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বললেন, পুলিশ কমিশনার এর মধ্যে এসে গেলেন? সিঁড়ি দিয়ে পায়ের আওয়াজ করে উঠে এলেন একজন। সাদা প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরা। বেশ সুদর্শন পুরুষ। গোঁফ নেই, দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না। ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বললেন, আমার নাম সুধীর রাজমহেন্দ্ৰী, কমিশনার সাহেব খুব ব্যস্ত আছেন। উনি ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে আমাকে আসতে বললেন। আমি ডি আই জি, ক্রাইম। নরেন্দ্র ভার্মা নিজের নাম বলে জানালেন, আমি দিল্লি থেকে এসেছি। সুধীর রাজমহেন্দ্রী বললেন, আমি প্রোফেসর ভার্গবকে চিনি, মানে কাগজে ছবি দেখেছি, ওঁর লেখা বইও পড়েছি। উনি নিশ্চয়ই রাজা রায়চৌধুরী? এবাড়িতে ডাকাতি হয়েছে? নরেন্দ্র ভার্মা সব ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানালেন। রাজমহেন্দ্ৰী ভুরু কুঁচকে বললেন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কর্নাটকের মানুষদের তাড়াবার জন্য কোনও দল তৈরি হয়েছে, এমন শুনিনি। খোঁজ নিতে হবে। এবাড়ির সামনে দুজন পুলিশ পোস্টিং করে দিলে আর তারা হামলা করতে সাহস করবে না! তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আপনার কী ঝঞ্ঝাট হয়েছে, তাও আমি শুনেছি। মনে হচ্ছে আপনার ব্যাপারটা আর প্রোফেসর ভার্গবের ব্যাপারটা দুটো আলাদা দলের কাজ। আপনারটাই বেশি সিরিয়াস। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমারও মনে হয়, দুটো আলাদা দলের কাজ। রাজমহেন্দ্ৰী বললেন, সবটা আপনাদের বুঝিয়ে বলি। ভাইজাগ এমনিতে শান্তিপূর্ণ শহর। খুনোখুনি বিশেষ হয় না। চোর-ডাকাত যে একেবারে নেই তা নয়, তবে অন্য শহরের চেয়ে কম। বাইরে থেকে বহু লোক এখানে বেড়াতে আসে, কাজে কর্মেও আসে, তাদের কোনও ক্ষতি হয় না। গণ্ডগোল হয় পোর্ট এলাকায়। সব পোর্টেই নানারকম স্মাগলিং চলে, মাঝে-মাঝে কিছু ধরা পড়ে, আবার বেড়ে ওঠে। এই স্মাগলিং চালায় নানান রাজ্যের লোক। অন্ধ্রের লোকই বড় কম। যারা ধরা পড়ে তারা মরাঠি, তামিল, পঞ্জাবি, বাঙালি, এমনকী কিছু কিছু চিনেও আছে। সুতরাং সেই স্মাগলাররা নিশ্চয়ই প্রোফেসর ভার্গবের মতো নিরীহ লোককে নিয়ে মাথা থামাবে না, কনাটকের লোককে অন্ধ্রপ্রদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথাও বলবে না। কিন্তু রাজা রায়চৌধুরীকে নিয়ে তাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আপনি অনেক বড়-বড় ক্রিমিনালকে ঘায়েল করেছেন আমি জানি। একবার আন্দামানের খুব বড় একটা স্মাগলারদের গোটা দলকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এখানকার স্মাগলাররা ভাবছে, আপনি ভাইজাগে এসেছেন সেরকমই কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। কাকাবাবু বললেন, সত্যিই কিন্তু আমি সেজন্য আসিনি। আমি থাকি কলকাতায়, এত দূর ভাইজাগ শহরের স্মাগলিং নিয়ে মাথা থামাব কেন? কেউ আমাকে এ কাজের দায়িত্বও দেয়নি। আমি এসেছি প্রোফেসর ভার্গবের মূর্তিগুলো দেখার জন্য। এটা আমার শখ। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, মুশকিল হচ্ছে কী জানো, রাজা, তুমি নিছক শখের জন্য কোথাও যাবে, এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তুমি যেখানেই যাও, সেখানকার অপরাধীরা তোমার গতিবিধি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। রাজমহেন্দ্ৰী প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা এখন খুবই সাঙ্ঘাতিক একটা ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। আপনারা বিশিষ্ট ব্যক্তি, আপনাদের কাছে বলা যেতে পারে। বন্দরে জাহাজ থেকে নানারকম জিনিসপত্র, যেমন ধরুন ঘড়ি, রেডিয়ো, ভি সি আর, সিগারেট, সোনা এইসব স্মাগলিং হয়। সব বন্দরেই হয়। কিন্তু গোপন রিপোের্ট পাওয়া গেছে যে এখন ভাইজাগ বন্দর দিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাচার হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। সেগুলো কিনছে ওখানকার তামিল টাইগার বিদ্রোহীরা। আপনারা জানেন, ভারত সরকার ওখানকার বিদ্রোহীদের কোনওরকম অস্ত্র সাহায্য করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ স্মাগলাররা অস্ত্র পাচার করছে। এতে দু দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরাও এই রিপোর্ট পেয়েছি। দিল্লিতে এই নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীও চিন্তিত। রাজমহেন্দ্রী বললেন, যে-কোনও উপায়েই হোক এই স্মাগলিং বন্ধ করতেই হবে। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে হ্যান্ড গ্রেনেড বা হাত-বোমাই যাচ্ছে বেশি। কোথায় এই বোমাগুলো বানানো হচ্ছে, কোন পথে এই বন্দরে আসছে, তা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। রাজমহেন্দ্ৰী কাকাবাবুর দিকে জিজ্ঞাসুভাবে চেয়ে রইলেন। কাকাবাবু বললেন, এটা গুরুতর ব্যাপার ঠিকই। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি, এই স্মাগলারদের ধরার জন্য দিল্লি থেকে আমার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়নি। সেজন্য আমি আসিনি। এরকম কাজের দায়িত্বও আমি নিতে পারব না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার সে-ক্ষমতাও নেই। রাজমহেন্দ্রী বললেন, তা হলে আমি অনুরোধ করব, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, আপনি কিছুদিনের জন্য গা-ঢাকা দিন। আজ দুপুরেই আপনাকে ছুরি মারার চেষ্টা হয়েছে। ওরা আবার আপনার ওপর আক্রমণ করবে। আপনি কি পুলিশ পাহারায় চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন? আপনার কলকাতায় ফিরে যাওয়াই উচিত। আমরা আপনাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব। প্রোফেসর ভার্গবের বাড়ির সামনে দুটি পুলিশ পোস্টিং করিয়ে দিলেই চলবে, ওরা এখানে আর আসতে সাহস
false
shomresh
সপ্তর্ষি বলল, ‘মা গো, আর পারব না। ও হ্যাঁ, আজ তো পুজো শুরু হয়ে গেল। টুবলুদের গিফ্‌ট দিয়েছ তো?’ ‘ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না ডার্লিং।’ জ্যাকেট পরে টাই বেঁধে বাই বলে দরজার দিকে এগোচ্ছিল সপ্তর্ষি, পেছন থেকে উর্বশী বলল, ‘উঁহু!’ সপ্তর্ষি তাকিয়ে দেখল অনেক রহস্য মুখে ছড়িয়ে উর্বশী হাসছে। যদি কিছু হুট করে মাথায় এসে যায় তাই সে লতা মঙ্গেশকরের গান মনে মনে গাইতে লাগল, ‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি।’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল উর্বশী। সাগরিকা ছবির শেষ দৃশ্যে সুচিত্রা সেন এত জোরে ছুটে উত্তমকুমারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। ধাক্কাটা কোনও মতে সামলাতে সামলাতে সপ্তর্ষি শুনল, ‘তুমি আমাকে একটু আদর করে যাবে বলে ভেবেছিলে, বলো, ঠিক কি না!’ ‘তুমি যে আমারই ওগো, জীবনে মরণে’ গাইতে গাইতে সপ্তর্ষি উর্বশীর মাথায় চিবুক লাগিয়ে দেখেও না দেখার ভান করল। সিঁথিটা একটু চওড়া হয়েছে। তা ভাল। কে না জানে কলকাতার সবচেয়ে ভাল রাস্তার নাম রেড রোড! সপ্তর্ষি বেরিয়ে গেলে চেয়ারে বসল উর্বশী। জীবনে এ রকম সকাল তার আসেনি। কিন্তু তিনটে ব্যাপার তার বোধগম্য হচ্ছিল না। সে কী করে সপ্তর্ষির ভাবনাগুলো বুঝে ফেলছে? গত কাল সন্ধ্যায় তো এ রকম হয়নি। এটা কি মা দুর্গা এসেছেন বলে? তা তিনি তো প্রতি বছরই আসেন, কোনও বার হয় না। দ্বিতীয়ত, আজ সকাল থেকে সপ্তর্ষি এত গান মনে মনে গাইছে কেন? ওর গলায় যে কোনও দিন গান শোনেনি। তৃতীয়ত, তার মাথায় চিবুক রেখে রেড রোড বলল কেন? সবচেয়ে ভাল রাস্তা। এটা কি কমপ্লিমেন্ট? ফোন বাজল। রিসিভার তুলতেই টুবলুর গলা, ‘ও মাসিমণি, প্রমিস রাখবে না?’ ‘রাখব রাখব।’ হাসল উর্বশী। ‘কবে রাখবে? পুজো তো শুরু হয়ে গেল।’ টুবলুর কথা শুনে একটু ভাবল উর্বশী, ‘সপ্তমীর আগেই।’ টুবলু তার বোনের ছেলে। বছর বারো বয়স। উর্বশী ঠিক করল সে আইপড কিনে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে টুবলুর হাতে দিয়ে দেবে। আলমারির দিকে তাকাল উর্বশী। এখনও অফিসে পৌঁছয়নি সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষির মুখ মনে এল, কিন্তু ও এখন কী ভাবছে, বুঝতে পারল না। এটা কী হল? আউট অব সাইট হলে কি, আউট অব মাইণ্ড হয়ে যায়? পোশাক বদলে নিয়ে সেজেগুজে আলমারি খুলল উর্বশী। তার পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সপ্তর্ষির লকার খুলে ডান হাতটা গর্তে ঢোকাল। এ কী! ভেতরটা একদম ফাঁকা কেন? এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই। অথচ কাল বিকেলে অফিসের পর বাড়ি এসে বাণ্ডিলগুলোকে ঢোকাতে দেখেছে সে সপ্তর্ষিকে। তার পর আর আলমারি খোলেনি সপ্তর্ষি। সে সব সময় ওর সঙ্গে ছিল। আজ ঘুম থেকে তোলার পরও সে এই ঘরের বাইরে একা যায়নি। কেঁদে ফেলল উর্বশী। এখন টুবলুকে কী করে মুখ দেখাবে। হঠাৎ ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, সে যখন স্নান করতে করতে প্ল্যানটা ভাবছিল তখন সেই ভাবনা কি ও বুঝে ফেলেছিল? ফলে টাকা সরিয়ে বিছানায় ঘাপটি মেরে পড়েছিল? টেকো, ডায়েবেটিক, ভুঁড়িদাস, ভাড় মে যাওয়া ঘুষখোরটার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে! নিজের ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার টাকা তোলার জন্যে চেক বই বের করল উর্বশী। অফিসের লিফ্‌টে জনা আটেক মানুষ। হন্তদন্ত হয়ে সপ্তর্ষি ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে লিফ্‌ট উঠতে লাগল ওপরে। হঠাৎ পাশের মহিলা ঘুরে দাঁড়িয়ে সপাটে চড় মারলেন এক প্রৌঢ়কে, ‘আপনি আপনি আমার সম্পর্কে…, ছি ছি।’ ‘মানে, মানে… আমাকে চড় মারলেন কেন? জানেন আমি কে?’ ‘একশো বার মারব। আপনি আমার বুক নিয়ে অশ্লীল কথা ভাবেননি?’ মহিলা চিৎকার করলেন, ‘দেখুন, এই আধবুড়ো আমার সম্পর্কে অশ্লীল ভাবনা ভাবছে।’ তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হতেই সপ্তর্ষি মনে মনে জনগণমন গাইতে শুরু করল। পৃথিবীতে প্রথম গান আবিষ্কার করেছিল কে? গান গাইলে মনে ভাবনা আসে না। লিফ্‌ট ছ’তলায় উঠলে ছেঁড়া জামা নিয়ে প্রৌঢ় নেমে গেলেন সুড়ুৎ করে। মহিলা চিৎকার করলেন, ‘সকাল থেকে এটা আরম্ভ হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ এত দিন মুখোশ পরে বসেছিল। অ্যাই, লিফ্‌ট চলছে না কেন?’ লিফ্‌টম্যান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সপ্তর্ষিকে দেখিয়ে বলল, ‘কী করব ম্যাডাম, সাহেব জাতীয় সংগীত গাইছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সকাল সকাল পুজো শুরু না হলেও প্রতিমা দর্শন করে আসা কলকাতার অনেক মানুষের অভ্যাস। যাঁরা ভিড় এড়াতে চান, শান্তিতে ঠাকুর দেখতে চান তাঁরা পঞ্চমী ষষ্ঠীতেই কাজটা সেরে ফেলেন! ভোর ছ’টায় একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল যে মণ্ডপের সামনে, তাদের থিম হল মুরগি। মণ্ডপে ডিমের প্রতিমা। এত সকালে দর্শক নেই। পুজোর উদ্বোধন সন্ধ্যায়, তাই মাইকে গান বাজছিল: হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম। গাড়ি থেকে নামল যে পরিবার, তারা এই সকালে নতুন জামা পরে এসেছে। বাবা মা যুবতী মেয়ে তরুণ ছেলে। ডেকরেশন দেখে ছেলেটি বলল, ‘আঃ, ফ্যান্টা।’ মা বলল, ‘দুগ্গা ঠাকুরের কাছে এসে ইংরেজি বলো না ববি।’ ছেলে বলল, ‘বাট মা, চার পাশে মুরগি আর মুরগি। আচ্ছা এগুলো কি দিশি, না বয়লার?’ মা জবাব দিল না। এগোতে এগোতে ভাবল, তোমার বাবা জানে। বাবা উদাসীন হল, ওগুলো আমি। আমাকে তোমরা মুরগি করেছ। মেয়ে বলল, ‘বাবা, টু মাচ। মন নিচু করো না।’ তখনও মণ্ডপের সামনে পর্দার আড়াল। এক জন স্বেচ্ছাসেবক বলল, ‘সরি। আমাদের পুজো উদ্বোধন করবেন সুস্মিতা সেন। তার আগে পর্দা সরানো যাবে না।’ অনেক অনুরোধেও কাজ হল না। এই সময় স্বেচ্ছাসেবকদের নেতা এগিয়ে এসে সব শুনে বললেন, ‘পর্দা উঠবে না।
false
MZI
সেটা ঘুণাক্ষরেও জরিনার মাথায় আসে নি বলে সে সেটা ধরতে পারল না। পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে ঘুরে জরিনার দিকে তাকাল, চোখ লাল করে বলল, “কী বললেন?” জরিনা থতমত খেয়ে বলল, “আমি বলি নাই।” “তা হলে কে বলেছে?” জরিনা ঘুরে পিছনে তাকাল, আশেপাশে কেউ নাই, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো, তা হলে কে পুলিশটাকে ভটকু মিয়া ডেকেছে? মোটা মানুষকে ভটকু মিয়া ডাকলে রাগ তো করতেই পারে, আর সেই মোটা মানুষটি যদি পুলিশ হয় তা হলে তো কোনো কথাই নেই। পুলিশ গর্জন করে বলল, “আপনি কেন আমাকে ভটকু মিয়া ডাকলেন?” জরিনা আবার চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি ডাকি নাই।” পুলিশটা কিছুক্ষণ চোখ লাল করে জরিনার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “খবরদার, কখনো এভাবে কথা বলবেন না।” জরিনা মিনমিন করে বলল, “বলব না।” পুলিশটা ঘুরে আবার হাঁটতে থাকে, ফাঁড়া কেটেছে মনে করে জরিনা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করতে যাচ্ছিল কিন্তু মেকু সে সুযোগ দিল না, আবার পুলিশটাকে ডাকল, বলল, “ভোটকা মিয়ার, তেজ দেখো!” এত বড় পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে পাই করে ঘুরে জরিনার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “কী বললেন? কী বললেন আপনি? আমি ভোটকা মিয়া? আমার তেজ হয়েছে?” জরিনা একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কে কথা বলছে? সে কি বলবে বুজতে পারল না কিন্তু তার আগেই স্পষ্ট মনে হল এই বাচ্চাটা কথা বলেছে! এটা কি সম্ভব? পুলিশটা মহা তেড়িয়া হয়ে প্রায় জরিনার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, চিৎকার করে বলল, “কী বললেন আপনি? আপনার কত বড় সাহস একজন পুলিশ অফিসারের সাথে এইভাবে কথা বলেন? মুখ ঢেকে রেখেছেন বাঁদরামো করার জন্যে?” জরিনা বিস্ফোরিত চোখে মেকুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে – এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার পর থেকে তাদের দুর্গতি, রাতে ভূতের কথা বলা, সবকিছু হঠাৎ যেন পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে জরিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পুলিশ অফিসারটা একেবারে জরিনার গায়ের উপর উঠে হুংকার দিল, বলল, “কী হল? কথা বলেন না কেন?” জরিনার হয়ে মেকু কথার উত্তর দিল, বলল, “এই তো বলছি। আমাকে চেনো না ভোটকা মিয়া? আজকের পত্রিকায় আমার ছবি দেখ নাই?” “কী ছবি?” পুলিশ আরো একটু এগিয়ে এল। “দূর থেকে কথা বল। বেশি কাছে আসলে ঘুষি মেরে তোমার দাঁত ভেঙে ফেলব।” “কী বললেন? কী বললেন আপনি?” পুলিশ অফিসার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আপনি ভাবছেন মহিলা হয়েছেন দেখে আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবেন? আপনাকে এরেস্ট করে এমন কোৎকা দেব –” মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। শুধু তাই নয় মনে হয়, একজনের হাতে আজকের পত্রিকাও আছে। সে বলল, “চোপ কর ব্যাটা বদমাইশ । পত্রিকায় আমার ছবি দেখলে তোমার কাপড়ে বাথরুম হয়ে যাবে।” যার হাতে পত্রিকাটি ছিল সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আজকের পত্রিকায় বাচ্চা কিডন্যাপের ছবি ছাপা হয়েছে।” পুলিশ অফিসার বলল, “আপনি কী বলতে চান আপনি সেই কিডন্যাপার?” এতক্ষণে জরিনা নিজেকে একটু সামলাতে পেরেছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেকু বলল, “হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে আরেকটু কাছে আস – ভোটকা মিয়া। ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে তোমার মাথা ফুটো করে দেব।” “কী বললেন?” পুলিশ অফিসার হুংকার দিয়ে চোখের পলকে তার কোমরে ঝোলানো রিভলবারটা হাতে নিয়ে নিল। জরিনার দিকে তাক করে বলল, “কত বড় সাহস – একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করার ভয় দেখায়!” জরিনা এবারে মোটামুটি ভেঙে পড়ল, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “দেখেন, আমি আপনাকে কিছুই বলি নাই।” পুলিশ অফিসার মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এখন আমার হাতে রিভলবার দেখে ভয় পেয়ে সিধে হয়ে গেছেন!” “না না সেটা নয়। আমি আপনাকে কিছু বলি নাই।” “তা হলে কে বলেছে?” “আমার মুখ ঢাকা তাই আপনি ভেবেছেন আমি কথা বলছি। আসলে আমি বলি নাই।” পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “তা হলে কে বলেছে?” জরিনা মেকুকে দেখিয়ে বলল, “এই যে, এই বাচ্চাটা।” পুলিশ অফিসার এবং চারপাশে থাকা মানুষগুলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ এক সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে সবাই একবারে গড়াগড়ি খেতে থাকে। জরিনা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যিই বলছি! খোদার কসম!” পুলিশ অফিসার হাসি থামিয়ে উপস্থিত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ড্রাগস খেয়েছে। ড্রাগস খেয়ে মাতলামি করছে।” জরিনা বলল, “আমি মাতলামি করছি না। সত্যি কথা বলছি এই বাচ্চা কথা বলতে পারে। মহা ত্যাঁদড় –” পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করেন। ফাজলেমি করবেন না।” “খোদার কসম।” মেকু তখন ঠিক ছোট বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে সেরকম ভান করে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “এই যে বাচ্চা কথা বলছে!” আরেকজন টিটকারী করে বলল, “হ্যাঁ! একেবারে ব্যান্ড সংগীত!” উপস্থিত সবাই আবার হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠে – জরিনা ঠিক বুঝতে পারল না, এই কথাটার মাঝে এত হাসির কী আছে! জরিনা মেকুর দিকে তাকাল, মেকু তার মাড়ি বের করে হেসে জরিনার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপে দেয়! কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া তাকে এভাবে নাকানী চুবানী খাইয়েছে? এটা কী সম্ভব? সে অবিশ্বাস করবে কেমন করে একেবারে নিজের চোখে দেখছে! জরিনা চারিদিকে তাকাল, একেবারে
false
MZI
উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না। বলল, তরুণটিকে আমার খুব প্রয়োজন। আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও। না। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। রবোটের মতো প্রাণীটি তার হাত বাড়িয়ে হঠাৎ আমার মাথায় স্পর্শ করে, উচ্চচাপের বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা অনুভূতি হয় আমার, ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু থাকে না আমার! চোখের সামনে লাল একটা পর্দা খেলতে থাকে, তা হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ রুকাসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি, টু। রবোটের মতো প্রাণীটি সাথে সাথে ছেড়ে দিল আমাকে, তারপর ছুটে গেল রুকাসের দিকে, শিস দেয়ার মতো শব্দ করল মুখে একবার বিজাতীয় ভাষায়। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম, পুরাতন বন্ধু এক জন আরেকজনকে যেরকম গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে, তেমনি করে রুকাস আলিঙ্গন করছে প্রাণীটাকে। এই রবোটের মতো প্রাণীটা আর যাই হোক, বায়োবট নয়। দ্রুত কোনো এক ভাষায় এক জন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, দেখে মনে হয় কথা কাটাকাটি হচ্ছে, কিন্তু রুকাসের মুখে হাসি, নিশ্চয়ই ভাষাটিই এরকম। একটু পরেই দু’জনে আমার দিকে এগিয়ে এল। রবোটের মতো প্রাণীটি আমার সামনে মাথা নিচু করে অভিনন্দন করার ভঙ্গি করে বলল, তোমার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎপ্রবাহ করানোর জন্যে দুঃখিত। আমি বললাম, ভেবেছিলাম তুমি বায়োবট। আমি জানতাম না রুকাস তোমার বন্ধু। রুকাস? রুকাস হেসে বলল, হ্যাঁ, এখানে আমার নাম রুকাস! রুকাস! কি আশ্চর্য নাম! আমি রবোটটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি? তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? আমি টুবু। আমি সপ্তম বিবর্তনের চতুর্থ পর্যায়ের ষষ্ঠ প্রজাতির রবোট। রুকাসকে রক্ষা করার প্রাথমিক দায়িত্ব আমার উপর ছিল। যেহেতু তার গোপনীয়তা নষ্ট হয়েছে, আমাকে তার সাহায্যের জন্যে আসতে হয়েছে। টুবু নামক রবোটটি এবারে রুকাসের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে এত বড় একটা ভুল করলে? তিন তিনটি থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটালে এক জায়গায়? তুমি কোথায় আছ সেটা কি গোপন আছে আর? তুমি আমার জায়গায় হলে তাই করতে। আমি তো মাত্র তিনটি বিস্ফোরণ করেছি, তুমি করতে ছয়টি। টুবু মাথা নেড়ে বলল, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চল তোমার বাসায়। তোমাকে ঘিরে একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ দাঁড় করাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা তিনজন আমাদের বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করি। ঘরের আলোতে আমি প্রথমবার টুবুকে ভালো করে দেখলাম। বড় বড় ফটোসেলের চোখ, ছোট নার্ক এবং বিস্তৃত মুখে তার চেহারায় কেমন জানি একটি সারল্য রয়েছে। তার গলার স্বর খানিকটা ধাতব, যান্ত্রিক, এবং ভাবলেশহীন। আমি উপস্থিত থাকলে সে ভদ্রতা করে আমাদের ভাষায় রুকাসের সাথে কথাবার্তা বলে, যেন আমি বুঝতে পারি। তাদের নিজেদের ভাষা অত্যন্ত সুন্দর, সুরেলা এবং দ্রুত। মাঝে মাঝেই মনে হয় শিস দেয়ার মতো শব্দ হয়। টুবু তার ঘাড়ের একটা বাক্স খুলে ভিতর থেকে জিনিসপত্র বের করতে থাকে। নানা আকারের ছোট-বড় যন্ত্রপাতি। সেইসব যন্ত্রপাতি খুলে গিয়ে নানা ধরনের আকৃতি নিতে থাকে। ঘন্টাখানেকের মাঝেই রুকাসের ঘরটি একটি অবিশ্বাস্য রূপ নিয়ে নেয়। ঘরের মাঝামাঝি লাল আলোতে এই পুরো এলাকার একটি ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। বাইরে থেকে যে-কেউ আমাদের এই এলাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করলে এই ত্রিমাত্রিক ছবিটিতে তাকে দেখা যাবে। সেটি ধ্বংস করার নানারকম উপায় রয়েছে এবং বন্ধুভাবাপন্ন নয় এরকম মহাকাশযানকে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের কোনো ধরনের মহাকাশযান নেই এবং বাইরে থেকে শুধুমাত্র আমাদের উপর হামলা করার জন্যেই মহাকাশযানগুলো এসে হাজির হয় শুনে টুবু খুব অবাক হল। রুকাসকে রক্ষা করার জন্যে এই পুরো এলাকা ঘিরে একটা শক্তিবলয় এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে টুবু অন্য কাজে মন দিল। প্রথমে রুকাসকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল। রুকাস তার গায়ের কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে থাকে, টুবু তার উপর উবু হয়ে ঝুঁকে তাকে পরীক্ষা করতে থাকে। খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বলল, তোমার শরীর চমৎকার আছে। আমি যে ধরনের আশঙ্কা করেছিলাম সেরকম কিছু হয় নি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি আশঙ্কা করেছিলে? এখানকার স্থানীয় রোগ-জীবাণু এবং ভাইরাসে রুকাসের শরীর ভ্যস্ত নয়, সে ধরনের কোনো কিছুতে আক্রান্ত হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হবে। তার শরীরে নানারকম প্রতিষেধক এবং অ্যান্টিবডি দিয়ে পাঠানো হয়েছে, সেগুলো চমৎকার কাজ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টুকু, যদি রুকাসকে নিয়ে যাবার জন্যে এখানে বায়োবট আসে, তুমি বুঝতে পারবে? পারার কথা। তারা কী আসবে? আজ হোক কাল হোক, তারা আসবে। কেন? রুকাস যদি বেঁচে থাকে, বায়োটের একটি মহাবিপর্যয় হবার কথা। আমাদের, মানুষের পক্ষে যেরকম রয়েছে রুকাস, বায়োবটদের দিকে তেমনি রয়েছে এক জন—ক্লডিয়ান। এই দুজনের মাঝে এক জন বেঁচে থাকবে, কে বাঁচবে তার উপর নির্ভর করবে সবকিছু। ক্লডিয়ান! আমি রুকাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ক্লডিয়ানের কথা শুনেছ? শুনেছি। সে কী রকম? কত বয়স? দেখতে কেমন? আমি ঠিক জানি না। টুকু বলল, ক্লডিয়ান বর্তমান বায়োবট গোষ্ঠীর দলপতি। তার বয়স সম্ভবত চল্লিশ থেকে ষাটের মাঝে। বায়োবটদের হিসেবে সেটা বলা যায় তরুণ। তাদের আয়ু আজকাল দু’ শ’ পঞ্চাশ থেকে তিন শ’য়ের কাছাকাছি। সে দেখতে কেমন? বায়োবটদের নিজেদের চেহারা নেই। অপুষ্ট মুখমণ্ডল যন্ত্রপাতিতে ঢাকা থাকে, সেই যন্ত্রের চেহারা হচ্ছে তাদের চেহারা। ক্লডিয়ান কী রকম মানুষ? ক্লডিয়ান মানুষ নয়, বায়োবট। কিন্তু তার মাথায় এখনো মানুষের মস্তিষ্ক, তার চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই মানুষের। রুকাস এবং টুবু দু’জনেই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। টুবু বলল, কিন্তু তাদের শরীর এমনভাবে যন্ত্রের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে, যে, খুব বড় পরিবর্তন হয়েছে তাদের
false
shorotchandra
হইল না—বরঞ্চ সমস্ত আবহাওয়া, আলো, বাতাস যেন কালকের চেয়েও বেশি করিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল। এতবড় আইবুড়ো মেয়ে দেখিয়া পাড়ার লোক ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল। আমাদের বাঙ্গালাদেশে মেয়ের বয়স ঠিক করিয়া বলার রীতি নাই। সবাই জানে, বাপ-মাকে দু-এক বছর হাতে রাখিয়া বলিতে হয়। সুতরাং দুর্গা যখন বলিলেন, তের, তখন সবাই বুঝিল পনর। তা ছাড়া একমাত্র সন্তান বলিয়া, নিজেরা না খাইয়া মেয়েকে খাওয়াইয়াছিলেন, পরাইয়াছিলেন—সেই নিটোল স্বাস্থ্যই এখন আরও কাল হইল—জ্ঞানদার যথার্থ বয়সের বিরুদ্ধে ইহাই বেশি করিয়া সাক্ষ্য দিতে লাগিল। দুই দিন না যাইতেই শম্ভু কথাপ্রসঙ্গে ভগিনীকে কহিলেন, মেয়েটার জন্য ত পাড়ায় মুখ দেখানো ভার হয়েছে। একটি ভারী সুপাত্র হাতে আছে, দিবি? দুর্গা বলিলেন, জামাই আমার স্থির হয়ে আছে—আর কোথাও হতে পারে না। শম্ভু বলিলেন, তা হলে ত কথাই নেই। কিন্তু এমন সুপাত্র বড় ভাগ্যে মেলে, তা বলে দিচ্চি। কুড়ি-পঁচিশ বিঘে ব্রহ্মত্র, পুকুর, বাগান, ধানের গোলা—লেখাপড়াতেও— দুর্গা কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন, না দাদা, আর কোথাও হবার জো নেই—এই বছরটা বাদে সেখানেই আমাকে মেয়ে দিতে হবে। শম্ভু বলিলেন, কিন্তু, আমার বিবেচনায়—এই সামনের অঘ্রানেই মেয়ে উচ্ছুগ্যু করা কর্তব্য হয়েছে। দুর্গা আর নিরর্থক প্রতিবাদ না করিয়া—কাজ আছে, বলিয়া উঠিয়া গেলেন। ক্রমশঃ প্রকাশ পাইল, এই সুপাত্রটি শম্ভুরই এ-পক্ষের বড় শ্যালক। স্ত্রীর মৃত্যু ঘটায়, প্রায় ছয় মাস যাবৎ বেকার অবস্থায় আছেন—আর বেশিদিন থাকা কেহই সঙ্গত মনে করে না। বিশেষতঃ ঘরে অনেকগুলি কাচ্চা-বাচ্চা থাকায় একটি ডাগর মেয়ে নিতান্তই আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। সেইজন্যই বোধ করি, দুর্গার বারংবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও এই সুপাত্রটি একদিন সহসা আবির্ভূত হইয়া সম্মুখেই জ্ঞানদাকে দেখিতে পাইলেন, এবং বলা বাহুল্য যে, পছন্দ করিয়াই ফিরিয়া গেলেন। অনতিকাল মধ্যেই ভগিনীর প্রতি শম্ভুনাথের স্নেহের অনুরোধ কঠোর নির্যাতনের আকার ধরিয়া দাঁড়াইল। একদিন তিনি স্পষ্টই জানাইয়া দিলেন যে, প্রিয়নাথের অবর্তমানে তিনিই এখন ভাগিনেয়ীর যথার্থ অভিভাবক। সুতরাং আবশ্যক হইলে এই সামনের অঘ্রানেই তিনি জোর করিয়া বিবাহ দিবেন। দাদার সঙ্গে বাদানুবাদ করিয়া দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া মেয়ের পানে চাহিয়াই বুঝিতে পারিলেন, সে সমস্ত শুনিয়াছে। তাহার দুই চক্ষু ফুলিয়া রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, আমি বেঁচে থাকতে ভয় কি মা! মুখে অভয় দিলেন বটে, কিন্তু ভয়ে তাঁহার নিজের বুকের অন্তঃস্থল পর্যন্ত শুকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল। এ-সব দেশে এরূপ জোর করিয়া বিবাহ দেওয়া যে একটা সচরাচর ঘটনা, তাহা তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না। মায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া মেয়ে উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিতে লাগিল। মা তাহার কপালে বুকে হাত দিয়া দেখিলেন, জ্বরে গা ফাটিয়া যাইতেছে। চোখ মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কখন জ্বর হল মা? কাল রাত্তির থেকে। আমাকে জানাস নি কেন? আজকাল যে ভয়ানক ম্যালেরিয়ার সময়। মেয়ে চুপ করিয়া রহিল, জবাব দিল না। দাদার বৌয়ের সহিত দুর্গা এ পর্যন্ত কোনপ্রকার ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করেন নাই। শুধু যে তাহার বিকট চেহারা ও ততোধিক বিকট হাসি দেখিলেই তাঁহার গা জ্বলিয়া যাইত তাহা নহে, তাহার অতি কর্কশ কণ্ঠস্বরও তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা স্বভাবতঃই একটু উচ্চকণ্ঠে কথা কহে; কিন্তু বৌয়ের কথাবার্তা একটু দূর হইতে শুনিলে ঝগড়া বলিয়া মনে হইত। তাহার উপর সে যেমন মুখরা, তেমনি যুদ্ধবিশারদ। কিন্তু তাহার একটা গুন দুর্গা টের পাইয়াছিল—সে গায়ে পড়িয়া ঝগড়া করিতে চাহিত না। তার গন্তব্য পথ ছাড়িয়া দিলে, সে কাহাকেও কিছু বলিত না—ছেলে-পিলে ঘর-সংসার লইয়াই থাকিত, পরের কথায় কান দিত না। প্রথমে আসিয়াই দুর্গা একদিন তাহার রান্নাবান্নার সাহায্য করিতে গিয়াছিলেন। তাহাতে সে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিল—তুমি দু’দিনের জন্যে এসেচ ঠাকুরঝি, তোমাকে কাজ করতে হবে না। আমি রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর কাউকে দিতে পারব না। সেই অবধি দুর্গা এবিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন! আজ বেলা দেখিয়া বৌ দোর-গোড়ায় স্বাভাবিক চিৎকারশব্দে প্রশ্ন করিল, আজ খাওয়া-দাওয়া কি হবে না ঠাকুরঝি? হেঁসেল নিয়ে বসে থাকব? দুর্গা মুখ তুলিয়া বলিলেন, মেয়েটার ভারী জ্বর হয়েচে বৌ; তোমরা খাও গে, আমরা আজ আর কেউ খাব না। বৌ কহিল, মেয়ের জ্বর, তা তোমার কি হ’ল গো? জ্বর আবার কার না হয়? নাও, উঠে এসো। দুর্গা কাতরকণ্ঠে কহিলেন, না বৌ, আমাকে খেতে বল না—মেয়ে ফেলে আমি মুখে ভাত তুলতে পারব না। তোমাদের সব আদিখ্যেতা, বলিয়া বৌ চলিয়া গেল। রান্নাঘর হইতে পুনরায় কহিল, জ্বর হয়েচে কবরেজ ডেকে পাঁচন সিদ্ধ করে দাও। ম্যালোয়ারী জ্বরে আবার খায় না কে? আমাদের দেশে ওসব উপোস-তিরেসের পাঠ নেই বাপু! বলিয়া সে নিজের কাজে মন দিল। অপরাহ্নবেলায় সে নিজেই একবাটি পাঁচন সিদ্ধ করিয়া আনিয়া কহিল, ওলো ও গেনি, উঠে পাঁচন খা! ভাতে জল দিয়ে রেখেছি, চল, খাবি আয়। মামীকে সে অত্যন্ত ভয় করিত। বিনাবাক্যে উঠিয়া খানিকটা তিক্ত পাঁচন গিলিয়া বমি করিয়া ফেলিয়া পুনরায় শুইয়া পড়িল। দুর্গা ঘরে ছিল না, বমির শব্দে ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মামী রাগ করিয়া উঠানে গিয়া সমস্ত পাড়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন, এ-সব বাবুমেয়ে নিয়ে আমাদের গরীব, দুঃখীর ঘরে আসা কেন বাপু? সেই হইতেই জ্ঞানদার অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িতেই লাগিল। তাহার ভামিনী-মামী সেই যে প্রথম দিনেই বলিয়াছিল, বাছা! পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক’টা লোক মরে, মরে যা তা ঐ ম্যালোয়ারীতে। একবার ধরলে আর রক্ষে নেই। তাহার কথাটার সত্যতা সপ্রমাণ হইতে বেশি বিলম্ব ঘটিল না, অনতিকালমধ্যেই জ্ঞানদাকে একেবারে শয্যাগত করিয়া ফেলিল। সেদিন কার্তিকের সংক্রান্তি; দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া
false
robindronath
মাঝগঙ্গায় আজ আর নৌকা নাই, দু-একখানা যা দেখা যাইতেছে তাহাদের উৎকণ্ঠিত ভাব স্পষ্টই বুঝা যায়। জলার্থিনী মেয়েরা আজ ঘাটে অধিক বিলম্ব করিতেছে না। জলের উপরে মেঘবিচ্ছুরিত একটা রুদ্র আলোক পড়িয়াছে এবং ক্ষণে ক্ষণে নদীনীর এক তীর হইতে আর-এক তীর পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিতেছে। স্টীমার যথানিময়ে চলিয়াছে। দুর্যোগের নানা অসুবিধার মধ্যে কোনোমতে কমলার রাঁধাবাড়া চলিতে লাগিল। চক্রবর্তী আকাশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “মা, ও বেলা যাহাতে রাঁধিতে না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। তুমি খিচুড়ি চড়াইয়া দাও, আমি ইতিমধ্যে রুটি গড়িয়া রাখি।” খাওয়াদাওয়া শেষ হইতে আজ অনেক বেলা হইল। দমকা হাওয়ার জোর ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। নদী ফেনাইয়া ফেনাইয়া ফুলিতে লাগিল। সূর্য অস্ত গেছে কি না বুঝা গেল না। সকাল-সকাল স্টীমার নোঙর ফেলিল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘের মধ্য হইতে বিকারের পাংশুবর্ণ হাসির মতো একবার জ্যোৎস্নার আলো বাহির হইতে লাগিল। তুমুলবেগে বাতাস এবং মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। কমলা একবার জলে ডুবিয়াছে–ঝড়ের ঝাপটাকে সে অগ্রাহ্য করিতে পারে না। রমেশ আসিয়া তাহাকে আশ্বাস দিল, “স্টীমারে কোনো ভয় নাই কমলা। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে পার, আমি পাশের ঘরেই জাগিয়া আছি।” দ্বারের কাছে আসিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “মা লক্ষ্মী, ভয় নাই, ঝড়ের বাপের সাধ্য কী তোমাকে স্পর্শ করে।” ঝড়ের বাপের সাধ্য কতদূর তাহা নিশ্চয় বলা কঠিন, কিন্তু ঝড়ের সাধ্য যে কী তাহা কমলার অগোচর নাই; সে তাড়াতাড়ি দ্বারের কাছে গিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল, “খুড়োমশায়, তুমি ঘরে আসিয়া বোসো।” চক্রবর্তী সসংকোচে কহিলেন, “তোমাদের যে এখন শোবার সময় হইল মা, আমি এখন–” ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন রমেশ সেখানে নাই; আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “রমেশবাবু এই ঝড়ে গেলেন কোথায়? শাক-চুরি তো তাঁহার অভ্যাস নাই।” “কে ও, খুড়ো নাকি? এই-যে, আমি পাশের ঘরেই আছি।” পাশের ঘরে চক্রবর্তী উঁকি মারিয়া দেখিলেন, রমেশ বিছানায় অর্ধশয়ান অবস্থায় আলো জ্বালিয়া বই পড়িতেছে। চক্রবর্তী কহিলেন, “বউমা যে একলা ভয়ে সারা হইলেন। আপনার বই তো ঝড়কে ডরায় না, ওটা এখন রাখিয়া দিলে অন্যায় হয় না। আসুন এ ঘরে।” কমলা একটা দুর্নিবার আবেগবশে আত্মবিসমৃত হইয়া তাড়াতাড়ি চক্রবর্তীর হাত দৃঢ়ভাবে চাপিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “না, না খুড়োমশায়! না, না।” ঝড়ের কল্লোলে কমলার এ কথা রমেশের কানে গেল না, কিন্তু চক্রবর্তী বিসিমত হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। রমেশ বই রাখিয়া এ ঘরে উঠিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “কী চক্রবর্তী-খুড়ো, ব্যাপার কী? কমলা বুঝি আপনাকে–” কমলা রমেশের মুখের দিকে না চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না, না, আমি উঁহাকে কেবল গল্প বলিবার জন্য ডাকিয়াছিলাম।” কিসের প্রতিবাদে যে কমলা ‘না না’ বলিল তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিতে পারিত না। এই ‘না’র অর্থ এই যে, যদি মনে কর আমার ভয় ভাঙাইবার দরকার আছে–না, দরকার নাই। যদি মনে কর আমাকে সঙ্গ দিবার প্রয়োজন–না, প্রয়োজন নাই। পরক্ষণেই কমলা কহিল, “খুড়োমশায়, রাত হইয়া যাইতেছে, আপনি শুইতে যান। একবার উমেশের খবর লইবেন, সে হয়তো ভয় পাইতেছে।” দরজার কাছ হইতে একটা আওয়াজ আসিল “মা, আমি কাহাকেও ভয় করি না।” উমেশ মুড়িসুড়ি দিয়া কমলার দ্বারের কাছে বসিয়া আছে। কমলার হৃদয় বিগলিত হইয়া গেল; সে তাড়াতাড়ি বাহিরে গিয়া কহিল, “হ্যাঁ রে উমেশ, তুই ঝড়-জলে ভিজিতেছিস কেন? লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার, যা খুড়োমশায়ের সঙ্গে শুইতে যা।” কমলার মুখে লক্ষ্মীছাড়া-সম্বোধনে উমেশ বিশেষ পরিতৃপ্ত হইয়া চক্রবর্তী-খুড়ার সঙ্গে শুইতে গেল। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “যতক্ষণ না ঘুম আসে আমি বসিয়া গল্প করিব কি?” কমলা কহিল, “না, আমার ভারি ঘুম পাইয়াছে।” রমেশ কমলার মনের ভাব যে না বুঝিল তাহা নয়, কিন্তু সে আর দ্বিরুক্তি করিল না; কমলার অভিমানক্ষুণ্ন মুখের দিকে তাকাইয়া সে ধীরে ধীরে আপন কক্ষে চলিয়া গেল। বিছানার মধ্যে স্থির হইয়া ঘুমের অপেক্ষায় পড়িয়া থাকিতে পারে, এমন শান্তি কমলার মনে ছিল না। তবু সে জোর করিয়া শুইল। ঝড়ের বেগের সঙ্গে জলের কল্লোল ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। খালাসিদের গোলমাল শোনা যাইতে লাগিল। মাঝে মাঝে এঞ্জিন-ঘরে সারেঙের আদেশসূচক ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। প্রবল বায়ুবেগের বিরুদ্ধে জাহাজকে স্থির রাখিবার জন্য নোঙর-বাঁধা অবস্থাতেও এঞ্জিন ধীরে ধীরে চলিতে থাকিল। কমলা বিছানা ছাড়িয়া কামরার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ক্ষণকালের জন্য বৃষ্টির বিশ্রাম হইয়াছে, কিন্তু ঝড়ের বাতাস শরবিদ্ধ জন্তুর মতো চীৎকার করিয়া দিগ্‌বিদিকে ছুটিয়া বেড়াইতেছে। মেঘসত্ত্বেও শুক্লচতুর্দশীর আকাশ ক্ষীণ আলোকে অশান্ত সংহারমূর্তি অপরিস্ফুটভাবে প্রকাশ করিতেছে। তীর স্পষ্ট লক্ষ্য হইতেছে না; নদী ঝাপসা দেখা যাইতেছে; কিন্তু ঊর্ধ্বে নিমেন, দূরে নিকটে, দৃশ্যে অদৃশ্যে একটা মূঢ় উন্মত্ততা, একটা অন্ধ আন্দোলন যেন অদ্ভুত মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া যমরাজের উদ্যতশৃঙ্গ কালো মহিষটার মতো মাথা ঝাঁকা দিয়া দিয়া উঠিতেছে। এই পাগল রাত্রি, এই আকুল আকাশের দিকে চাহিয়া, কমলার বুকের ভিতরটা যে দুলিতে লাগিল তাহা ভয়ে কি আনন্দে নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এই প্রলয়ের মধ্যে যে একটা বাধাহীন শক্তি, একটা বন্ধনহীন স্বাধীনতা আছে, তাহা যেন কমলার হৃদয়ের মধ্যে একটা সুপ্ত সঙ্গিনীকে জাগাইয়া তুলিল। এই বিশ্বব্যাপী, বিদ্রোহের বেগ কমলার চিত্তকে বিচলিত করিল। কিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাহার উত্তর কি এই ঝড়ের গর্জনের মধ্যে পাওয়া যায়? না, তাহা কমলার হৃদয়াবেগেরই মতো অব্যক্ত। একটা কোন্‌ অনির্দিষ্ট অমূর্ত মিথ্যার, স্বপ্নের, অন্ধকারের জাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার জন্য আকাশপাতালে এই মাতামাতি, এই রোষগর্জিত ক্রন্দন। পথহীন প্রান্তরের প্রান্ত হইতে বাতাস কেবল ‘না না’ বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে নিশীথরাত্রে ছুটিয়া আসিতেছে–একটা কেবল প্রচণ্ড অস্বীকার। কিসের অস্বীকার? তাহা নিশ্চয় বলা
false
humayun_ahmed
মেরাজউদ্দিন বললেন, ইনফরমেশন গেদার করার আমার অনেক মেকানিজম আছে। দুপুরে কী খাবে বলো। এমন কিছু বলো যা জোগাড় করতে আমার কষ্ট হবে এবং হয়তো জোগাড় করতে পারব না। আমি কতটুক পারি তারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। যুথী বলল, মানুষকে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখিয়ে চমকে দিতে ভালোবাসেন, তাই না? হয়তোবা। আপনার ছেলে কিন্তু আপনার মতো হয় নি। সে গিনি সোনা হয়েছে। গিনি সোনাটা কী? বাইশ ভাগ শোনা দুই ভাগ তামা। তার তামার অংশ কোনটা? যুথী বলল, তার বোকামিটা। এখনো তো বললে না তুমি কী খাবে? কী খেতে ইচ্ছা করছে? যুথী বলল, আপনার এখানে আমার কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না। কারণ কী? যুথী বলল, আমি দীর্ঘ সময় আপনার সঙ্গে আছি। আমি আপনার জন্যে একটি আনন্দসংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি আপনার মেয়ের বয়েসী, অথচ একবারও আপনার মুখ থেকে মা শব্দটি বের হলো না। এই বিস্ময়ের কারণেই খেতে ইচ্ছা করছে না। যুথী উঠে দাঁড়াল। মেরাজউদ্দিন বললেন, বোস। বোস বললাম। যুথী বলল, কী আশ্চর্য, আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন? মেরাজউদ্দিন বললেন, মেয়েকে ধমকানো যায়। তোমাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করলাম। . মা, বলো কী খাবে? যুথী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, পোলাওয়ের চালের ভাত, টাটকা পুঁটি মাছ ভাজা, সরিষা দিয়ে সজিনা, কৈ মাছের ঝোল, মুগ ডাল। মেরাজউদ্দিন কিছুটা বিস্ময় এবং কিছুটা আনন্দ নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সহজ স্বাভাবিক একটা মেয়ে। প্রায় বিশেষত্বহীন। তবে এই মেয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। পরিবেশের সঙ্গে রঙ বদলানোর ক্ষমতা এর অবশ্যই আছে। যুথী বলল, আপনার ঘড়ির নিচের লেখাটার অর্থ বুঝতে পারছি না। মেরাজউদ্দিন বললেন, লেখাটার অর্থ একেকজন একেকভাবে করে। তুমি নিজে একটা অর্থ বের করো। যুথী বলল, মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। আত্মহত্যার অর্থ তার কাছে সময় আটকে যাওয়া। মেরাজউদ্দিন বললেন, মানুষকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দেয় এমন একটা লেখা আমি কেন ঘরে সাজিয়ে রাখাব? চিন্তা করে আসল অর্থটা বের করো। যেদিন বের করবে সেদিন তোমাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। মেরাজউদ্দিন সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাড়ি ফিরেন। বারান্দায় বসে স্ত্রীর সঙ্গে এককাপ চা খান। এই অভ্যাস তাঁর অনেকদিনের। চায়ের এই আসরে শুভ্ৰকে কখনো ডাকা হয় না। মেরাজউদ্দিন মনে করেন চা পানের এই উৎসব শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী দুজনের। আজ তিনি ঠিক সময়ে ফিরেছেন, কিন্তু চায়ের আসরে বসতে পারেন নি। রেহানার কাছে একজন পীর সাহেব এসেছেন। তিনি নখে তিল তেল দিয়ে কী সব মন্ত্র (বা দোয়াদুরুদ) পাঠ করেন। তখন নখে হারানো ব্যক্তির ছবি ফুটে ওঠে। সে কোথায় আছে কী করছে সবই জানা যায়। পীর সাহেবের নাম কাশেম কুতুবি। বয়স পঞ্চাশের মতো। মাথার চুল এবং দাড়ি মেন্দি দিয়ে লাল করা। মেন্দি মনে হয় বেশ ভালো জাতের। চুল-দাড়ির লাল রঙ চকচক করছে। তার চোখে ভারী চশমা। গায়ের লেবাস গেরুয়া। পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল নেই। মোটা কাঁঠাল কাঠের লাল খড়ম। কাশেম কুতুবি মেরাজউদ্দিনকে দেখে বললেন, স্যার আমার হলো টেলিভিশন সিস্টেম। পর্দা ছোট, মাত্র আধা ইঞ্চি। কালার নাই। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। মেরাজউদ্দিন স্ত্রীর পাশে বসলেন। শুভ্ৰ বিষয়ে তাঁর সব দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন আদিভৌতিক কর্মকাণ্ড দেখা যেতে পারে। কাশেম কুতুবি তাঁর বুড়ো আঙুলের নখের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। যদিও ঘরে এসি চলছে, তারপরেও উনার এক অ্যাসিসটেন্ট হুজুরের মাথায় তালপাখা দিয়ে বাতাস করছে। কাশেম কুতুবি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি। সে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে। রেহানা আগ্রহ নিয়ে বললেন, সুন্দরবন নাকি পাৰ্বত্য চট্টগ্রাম? বলা মুশকিল। পর্দা ছোট তো। সব পরিষ্কার দেখা যায় না। তাছাড়া আমার নিজের চোখেও কিছু সমস্যা হয়েছে। ভালো দেখি না। এইজন্যে চশমা খরিদ করতে হয়েছে। রেহানা বললেন, ছেলে কি দেশের ভেতরে আছে? কাশেম কুতুবি বললেন, বর্ডার এলাকায় আছে। মেরাজউদ্দিন বললেন, বর্ডার এলাকায় আছে। এটা বুঝলেন কীভাবে? কুতুবি বললেন, আমি নখে যেমন দেখি কিছু আবার ইশারাতেও পাই। বর্ডারের বিষয়টা ইশারাতে পেয়েছি। মেরাজউদ্দিন বললেন, ইশারায় আর কী পাচ্ছেন? ছেলে ঘরে ফিরতে চায় না। একটা মেয়ের সঙ্গে তার ভাব-ভালোবাসা হয়েছে। তার সঙ্গে সে সংসার করতে চায়। মেরাজউদ্দিন বললেন, ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে মেয়ে পেল কোথায়? কুতুবি হাসিমুখে বললেন, মেয়েছেলে সব জায়গায় পাওয়া যায় জনাব। ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়, আবার মরুভূমিতেও পাওয়া যায়। রেহানা বললেন, তুমি সামনে থেকে যাও তো। তোমার কারণে উনি ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। মেরাজউদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, কুতুবি সাহেব। ভালোমতো দেখুন। আমার ছেলের সন্ধানদাতার জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুরস্কারটা নিতে পারেন কি না দেখুন। মেরাজউদ্দিন বারান্দায় চা খেতে খেতে শুভ্রর চিঠি আরেকবার পড়লেন। বিশেষ কোনো চিঠির পুরো অর্থ ধরতে হলে চিঠিটা তিনবার পড়তে হয়। তিনি দুবার পড়েছেন। আরও একবার পড়তে হবে। যুথীর বাবা আজহারের মাথা পুরোপুরিই গেছে। এখন তাঁকে আনন্দিত এবং সুখী মানুষ বলে মনে হয়। নিজের বাড়ির কাউকেই তিনি এখন চেনেন না। চিনলেও অল্প সময়ের জন্যে চেনেন। বাড়ির মানুষদের অতিথি হিসেবে দেখেন এবং যথেষ্ট আদরষত্ব করেন। গতকাল যুথী দুপুরে বাইরে থেকে ফিরেছে, তিনি মেয়েকে দেখে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মা, যুথী তো এখনো ফিরে নি। একটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে চলে আসবে। দুপুরে তার বাসায় খাবার অভ্যাস। মা, তোমাকে চা দিতে বলি। চা খেতে খেতে আমার
false
shorotchandra
না, আমি বড় ক্লান্ত। তবে থাক, থাক। রাতও আর নেই। ভারতী পাশের ঘরে আসিয়া দেখিল, আলোটা তখনও মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে, এবং তেওয়ারী তেমনি চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। অদূরে ভাঙাগোছের একখানা ডেকচেয়ার পড়িয়া ছিল, তাহাতেই আসিয়া সে উপবেশন করিল। অপূর্বর ঘরে ভাল আরামচৌকি ছিল কিন্তু ওই লোকটিকে সুমুখে রাখিয়া একই ঘরের মধ্যে রাত্রিযাপন করিতে আজ তাহার অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হইল। ডেকচেয়ারটায় কোনমতে একটু হেলান দিয়া পড়িয়া মনের মধ্যে যে তাহার কি করিতে লাগিল তাহার সীমা নাই। ইতিপূর্বে এই ঘরের মধ্যেই সে একাধিক বার কঠিন ধাক্কা-খাইয়াছে, কিন্তু আজিকার সহিত তাহার তুলনাই হয় না। ভারতীর প্রথমেই মনে হইল, কি করিয়া এবং কাহার অপরিসীম করুণায় অপূর্ব সুনিশ্চিত ও প্রত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে আজ রক্ষা পাইল, অথচ রাত্রিটাও প্রভাত হইল না, এতবড় কথাটা সে ভুলিয়াই গেল। তাহার পরম বন্ধু তলওয়ারকরের প্রতি, দলের প্রতি এবং বিশেষ করিয়া ওই ডাক্তার লোকটির প্রতি যে কি অপরিসীম অপরাধ করিয়াছে সে কথাই তাহার মনে নাই। সেখানে বড় চাকরি ও হাতের দাগটাই তাহার সমস্ত স্থান জুড়িয়া বসিয়াছে। সেইখানে বসিয়া হঠাৎ ভারতীর চোখে পড়িল, সুমুখের খোলা জানালার ফাঁক দিয়া ভোরের আলো দেখা দিয়াছে। সে মুহূর্তে উঠিয়া নিঃশব্দে দ্বার খুলিল, এবং কদর্য, অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত স্থানে মাতালের নেশা কাটিয়া গেলে সে যেমন করিয়া মুখ ঢাকিয়া পলায়ন করে, ঠিক তেমনি করিয়া সে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। একুশ পরদিন অপরাহ্নবেলায় সকল কথা, সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবৃত করিয়া ভারতী পরিশেষে কহিল, অপূর্ববাবু যে মস্ত লোক এ ভুল আমি একদিনও করিনি, কিন্তু তিনি যে এত সামান্য, এত তুচ্ছ,— এ ধারণাও আমার ছিল না। ভারতীর ঘরে খাটের উপর বসিয়া সব্যসাচী ডাক্তার একখানা বইয়ের পাতা উলটাইতেছিলেন, তাহার প্রতি চাহিয়া গম্ভীরমুখে কহিলেন, কিন্তু আমি জানতাম। লোকটা এত তুচ্ছ না হলে কি এতবড় ভালবাসা তোমার এত তুচ্ছ কারণেই যায়? যাক, বাঁচা গেল ভাই, কাকে কি ভেবে মিথ্যে দুঃখ পাচ্ছিলে বৈ ত নয়! ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র, বিশেষ করিয়া মেঝের উপর ছড়ানো পুস্তকের রাশি চাহিয়া দেখিলেই বুঝা যায় এ ঘরে ইতিপূর্বে পুলিশ-তদন্ত হইয়া গেছে। সেইগুলা সব গুছাইতে গুছাইতে ভারতী কথা কহিতেছিল। সে হাতের কাজ বন্ধ করিয়া সবিস্ময়ে চোখ তুলিয়া বলিল, তুমি তামাশা করচ দাদা? না। নিশ্চয়। ডাক্তার কহিলেন, আমার মত ভয়ানক লোক, যে বোমা-পিস্তল কেবল মানুষ খুন করে বেড়ায়, তার মুখে তামাশা? ভারতী কহিল, আমি ত বলিনে তুমি মানুষ খুন করে বেড়াও! ও-কাজ তুমি পারোই না। কিন্তু তামাশা ছাড়া এ কি হতে পারে বলত? ঘণ্টা দুই-তিনের মধ্যেই যে সব ভুলে গিয়ে মনে রাখলে শুধু হাতের দাগ আর পাঁচ শ’ টাকার চাকরি, তার চেয়ে অধম, ক্ষুদ্র ব্যক্তি আর ত আমি দেখতে পাইনে। তুমি বলছিলে এ আমার মোহ। ভাল, তাই যদি হয়, তুমি আশীর্বাদ কর, এ মোহ আমার চিরদিনের মত কেটে যাক, আমি সমস্ত দেহ-মন দিয়ে তোমার দেশের কাজে লেগে যাই। ডাক্তারের ওষ্ঠাধর চাপা হাসিতে বিকশিত হইয়া উঠিল, কহিলেন, তোমার মুখের ভাষাটা যে মোহ কাটার মতই তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু মুশকিল এই যে কণ্ঠস্বরে তার আভাসটুকু পর্যন্ত নেই। তা সে যাই হোক, ভারতী, তোমাকে দিয়ে আমার দেশের কাজ কিন্তু এক তিলও হবে না। তার চেয়ে তোমার অপূর্ববাবুই ঢের ভাল। দেনাপাওনার চুলচেরা বিচার করতে করতে বোঝাপড়া একদিন তোমাদের হয়ে যেতেও পারে। বরঞ্চ, তাই কর গে। ভারতী কহিল, তার মানে দেশকে আমি ভালবাসতে পারব না? ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, অনেক পরীক্ষা না দিলে কিন্তু ঠিক করে কিছুই বলা যায় না ভাই। ভারতী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া সহসা জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, এই তোমাকে আজ বলে রাখলাম দাদা, সমস্ত পরীক্ষাতেই আমি উত্তীর্ণ হতে পারবো। তোমার কাজের মধ্যে এত স্বার্থ, এত সংশয়, এতবড় ক্ষুদ্রতার স্থান নেই। তাহার উত্তেজনায় ডাক্তার হাসিলেন, পরে ক্রীড়াচ্ছলে নিজের ললাটে করাঘাত করিয়া বলিলেন, হা আমার পোড়া কপাল! দেশ মানে কি বুঝে রেখেচ খানিকটা মস্তবড় মাটি, নদ-নদী আর পাহাড়? একটিমাত্র অপূর্বকে নিয়েই জীবনে ধিক্কার জন্মে গেল, বৈরাগী হতে চাও, আর সেখানে কেবল শত-সহস্র অপূর্বই নয়, তার দাদারাও বিচরণ করেন। আরে পরাধীন দেশের সব চেয়ে বড় অভিসম্পাতই তো হলো কৃতঘ্নতা! যাদের সেবা করবে তারাই তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, প্রাণ যাদের বাঁচাবে, তারাই তোমাকে বিক্রি করে দিতে চাইবে! মূঢ়তা আর অকৃতজ্ঞতা প্রতি পদক্ষেপে তোমায় ছুঁচের মত বিঁধবে। শ্রদ্ধা নেই, স্নেহ নেই, সহানুভূতিই নেই, কেউ কাছে ডাকবে না, কেউ সাহায্য করতে আসবে না, বিষধর সাপের মত তোমাকে দেখে লোকে দূরে সরে যাবে। দেশকে ভালবাসার এই আমাদের পুরস্কার, ভারতী, এর বেশী দাবী করবার কিছু যদি থাকে, ত সে শুধু পরলোকে। এতবড় ভয়ানক পরীক্ষা তুমি কিসের জন্যে দিতে যাবে, বোন? বরঞ্চ, আশীর্বাদ করি অপূর্বকে নিয়ে তুমি সুখী হও,—আমি নিশ্চয় জানি, তার সকল দ্বিধা, সকল সংস্কার ছাপিয়ে তোমার মূল্য একদিন তার চোখে পড়বেই পড়বে। ভারতীর দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত নীরবে নতমুখে থাকিয়া প্রবল চেষ্টায় তাহা নিবারণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পার না বলেই কোনমতে আমাকে বিদায় করে দিতে চাও দাদা? তাহার এই একান্ত সরল নিঃসঙ্কোচ প্রশ্নের এমনি সোজা উত্তর বোধ হয় ডাক্তারের মুখে আসিল না, হাসিয়া বলিলেন, তোমার মত লক্ষ্মী মেয়ের
false
shomresh
হল সব বেঠিক হয়ে যাবে। তোমরা তোমাদের ঘরে ফিরে যাও। আমি পালার সঙ্গে কথা বলে দুতিনজনকে নিয়ে আসছি। বেরিয়ে যাওয়ার সময় আনন্দ ছেলেগুলোকে বলল বস্তাগুলো কোথায় রাখতে হবে। এখন পায়ের তলায় কুচি বরফ জমাট হতে চলেছে। হাওয়া বইছে। তবে সেই হাওয়ায় বরফ ভেসে আসছে না বলে কষ্টটা কম হচ্ছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল আনন্দ, তারপর জয়িতাকে বলল, তুই আস্তানায় যা, আমি সুদীপকে দেখে আসি। ওকে যে করেই হোক তুলতে হবে। জয়িতা বলল, তুই একা পারবি না। সে আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটির ঘরের দিকে রওনা হল। সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। দাঁতে দাঁতে একনাগাড়ে শব্দ বাজছে। আনন্দ দরজাটা ঠেলতে কোন মানবিক আওয়াজ শুনতে পেল না। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ডাকল, সুদীপ। কোন সাড়া এল না ভেতর থেকে। জয়িতা ভেতরে ঢুকে পড়ল। আনন্দ দাঁড়িয়েছিল। এই সময় অন্ধকারে জয়িতার গলা শোনা গেল, ওরা এ ঘরে নেই। সেকি রে? আনন্দ অবাক। একটা পরিপূর্ণ মাতাল এমন অবস্থায় বাইরে যাবে কেন? জয়িতা ফিরে এল, আমি বুঝতে পারছি না। সুদীপের কোন হুঁশ ছিল না নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু কোথায় ওর খোঁজ করি বল তো? পালদেমের সাহায্য চাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। ওরা চুপচাপ প্রায় ছুটে আসছিল। জয়িতা রহস্যটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। ওর মনে এতক্ষণ যে অস্বস্তিটা নখ বসাচ্ছিল আচমকা সেটা জরাগ্রস্ত হয়ে ভয়ে রূপান্তরিত হল। যদি পাশের গ্রামের মানুষরা এমন রাতের সুযোগে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে আসে এবং সুদীপকে খুন করে কোথাও ফেলে যায়? অসম্ভব নয়। কারণ সেই ঘটনার পর ওরা বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ওই সময় মাথা গরম না করলে এই ঘটনাটা ঘটত না। সুদীপ যাই করুক, এমন সোজা মনের ছেলে সে দ্যাখেনি। সোজা কিন্তু বেহিসাবী। আর শেষটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত। আস্তানার বারান্দায় উঠে আনন্দ বিস্মিত। ভেতরে আগুন জ্বলছে। এবং সেই সঙ্গে একটি নারীকণ্ঠে অবোধ্য ভাষায় সুর খেলা করে যাচ্ছে। সন্ধ্যা মুখোঁপাধ্যায়ের প্রথম দিকের সিনেমার একটি হিট গান যা কিনা ঠিক এই রকম মেলোডিয়াস। সে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। মেয়েটি আগুনের পাশে উবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। আর তার সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সুদীপ। আগুনটাকে ওরাই জ্বালিয়েছে। কথা না বুঝলেও সুর মানুষের মনে ভাষা তৈরি করতে পারে যদি তা আন্তরিক হয়। সুখ এবং দুঃখের প্রান্তে এমন একটা অনুভূতি আছে যার প্রকাশ একটাই সুরে সম্ভব। এই গান শুনে আনন্দ বুঝতে পারছিল না মেয়েটি দুঃখী না সুখী! জয়িতা এগিয়ে যেতেই মেয়েটি গান থামিয়ে চমকে মুখ তুলল। তারপর সরল হাসল। আনন্দ দেখল, জয়িতার মুখে আগুনের আভা লেগেছে। সে চটপট জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কখন এসেছ এখানে? মেয়েটির একটা হাত সুদীপের বুকের ওপরে তখনও। সেই অবস্থায় বলল, অনেকক্ষণ। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চলে আসার পর ও আর আমার ঘরে থাকতে চাইল না। হঠাৎ জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওর কাছে ঠিক কি চাও? আমি? মেয়েটি মাথা নিচু করল এবার, তারপর চুপ করে বসে রইল। জয়িতা আবার জিজ্ঞাসা করল, না, চুপ করে থাকলে চলবে না। তুমি সুদীপ–। আমি জানতে চাই সুদীপ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা? আর তাই করে থাকলে সেটা তোমার প্রশ্রয়েই হয়েছে। ব্যাপারটা তোমাকে বলতে হবে! আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা এখন যে গুছিয়ে কথা বলতে পারছে না তা সে বুঝতে পারল। জয়িতা জানতে চাইছে সুদীপ মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে কিনা। কোন মেয়েকে এরকম প্রশ্ন সরাসরি করা যে অস্বস্তিকর তা এই মুহূর্তে জয়িতাও ভুলে গিয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে সুদীপের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে ঝাকাতেই সুদীপ চোখ মেলল। চোখ দুটো এখন টকটকে লাল। প্রথমে মনে হল সুদীপ চিনতে পারছে না। মেয়েটি বলল, ওকে ঘুমাতে দাও। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ও এখানে কিভাবে এল? মনে হচ্ছে হেঁটে আসেনি। মেয়েটি মাথা নাড়ল, আমি নিয়ে এসেছি। জয়িতা মেয়েটাকে ভাল করে দেখল আবার। সুদীপকে বয়ে নিয়ে আসার শক্তি ও ধরে? আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ তোমাকে কিছু বলেছে? হ্যাঁ। মেয়েটি হাসল, ও বলেছে এখন থেকে আমরা বন্ধু। আনন্দ উঠে এল জয়িতার কাছে। তারপর নিচু গলায় বাংলায় বলল, মাথা গরম করিস না। মনে হচ্ছে মেয়েটা ইনোসেন্ট। তবে পালদেমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে বুঝতে পারছি না। জয়িতা সুদীপের দিকে তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। ওর ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল। এমনিতেই এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অন্যদের মত তার ঠোঁটেও এখন ফাটল এবং সামান্য ক্ষতের চিহ্ন তবু এই বিকৃতিটা ধরা পড়ল। জয়িতা অন্যমনস্ক গলায় বলল, মানুষ কেন মদ খায় যদি এই অবস্থা হয়। এই সময় দরজায় শব্দ হল। আনন্দ গলা তুলে আসতে বললে পালদেমরা এল। ওরা দুজন, পালমে আর লা-ছিরিঙ। মেয়েটিকে দেখে পালদেমের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, ওদের দেখামাত্র মেয়েটি আগুনের সামিধ্য ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। পালদেম আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ও কি এখন এই ঘরেই থাকে? আনন্দ মাথা নাড়ল, না। আমাদের এই বন্ধু অসুস্থ, তাই ওকে নিয়ে এসেছে। লা-হিরিঙ বলল, ওর খুব নেশা হয়ে গিয়েছে। পালদেম মেয়েটিকে দেখল, ওর সামনে তোমরা কথা বলতে চাও? আমি ওকে বিশ্বাস করি না, যতদিন ও আবার বিয়ে না করে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, বিয়ে করার সঙ্গে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি
false
humayun_ahmed
যেন ঝলমল করে সূর্যের আলো। শুটিং যেন ঠিকমত হয়। মঈন নামের মানুষটা যেন তার কাজ সুন্দর মত গুছিয়ে শেষ করতে পারেন। সেলিম ভাইয়ের একটা দৃশ্য দিয়ে শুটিং শুরু হবে। গাছের নীচে বসে তিনি ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করবেন। গ্রামের একটা ছেলে কৌতূহলী হয়ে দৃশ্যটা দেখবে। ছেলেটির দিকে না তাকিয়েই তিনি বলবেন— ছবি তুলবি? ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়বে। তখন দূর থেকে দিলুর গলা শোনা যাবে। দিলু চেঁচিয়ে বলবে–আমার একটা ছবি তুলে দিন। আমার ছবি। সেলিম ভাই দিলুর দিকে তাকিয়ে হাসবেন। দিলু এসে দাঁড়াবে। তার ছবি তোলা হবে। তখন দিলু বলবে–এখন এই পিচ্চিটার পাশে একটা ছবি তুলব। বলেই সে ছেলেটার সঙ্গে দাড়িয়ে ছবি তুলবে। তারপর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে ছুটে যাবে পুকুর ঘাটের দিকে। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে তখন জামিল বসে আছেন। তাঁর হাতে একটা বই। পেঙ্গুইন পেপার ব্যাক। দিলু এসে জামিলের পাশে বসবে এবং বলবে, জামিল ভাই আমি আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলব। সেলিম ভাই ছবি তুলে দেবেন। জামিল বলবেন–যা ভাগ। দিলু আহত চোখে তাকিয়ে থাকবে জামিলের দিকে। জামিল তার আহত অভিমানী দৃষ্টি বুঝতে পারবেন না কারণ তিনি বই থেকে একবারও চোখ তোলেন নি। জামিল তখন বলবেন— দিলু যা তো কাউকে বল, আমাকে যেন কড়া করে এক কাপ চা দেয়। চিনি হাফ চামচ। দিলু উঠে দাঁড়াবে। তারপর একটা কান্ড করবে— জামিলের হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারবে পুকুরের দিকে। বই ছুঁড়ে ফেলেই দিলু ছুটে চলে যাচ্ছে। জামিল হতভম্ব। বইটা পুকুরের পানিতে ভাসছে। জামিল একবার তাকাচ্ছেন বইটার দিকে, একবার দিলুর দিকে। দিলুর ছুটে যাবার ব্যাপারটা সেলিমও দেখছেন। তিনি ক্যামেরা তুলে দিলুর ছুটে যাবার দৃশ্য নিয়ে নিলেন। শাটার টিপতেই ফ্রেমে বন্দি হল দিলু। সিকোয়েন্সের এইখানেই সমাপ্তি। কাজ শুরু হচ্ছে না। তিথিকণার মেকাপ শেষ হয় নি। সে এসে পৌছায় নি। সর্পভুক সেলিম ভাই এসেছেন। তার গাল টাল ভেঙ্গে একাকার। শরীর মনে হয় পুরোপুরি সারে নি। কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি। আমার দিকে যতবার চোখ পড়ছেচোখ ঝট করে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ডিরেক্টর সাহেব জাম গাছের নীচে বসে আছেন। তার পায়ের কাছে টুল। টুলে পা তোলা। বসার ভঙ্গি বেশ আয়েশী। সিগারেট টানছেন। সিগারেট টানতে টানতে গল্প করছেন। শ্রেতা মওলানা সাহেব। মওলানা গভীর আগ্রহে কথা শুনছেন। নিশ্চয়ই ধর্ম সংক্রান্ত কোন কথা। সেলিম ভাই যে জায়গায় তার কাজ হবে ঠিক সেই জায়গাতেই বসা। তার পাশেই পিচ্চি ছেলেটা বসে আছে। ছেলেটাকে এখান থেকে নেয়া হয়েছে। গারো ছেলে। নাক চ্যাপ্টা বলে অন্য রকম সুন্দর। গায়ের রং ধবধবে শাদা। গারোদের মধ্যে কালো কম। সেলিম ভাই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছেন। ছেলেটা কথা বলছে না, শুধু শুনে যাচ্ছে। তাদের কারো কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার কান খুব পরিষ্কার। অন্য সময় হলে তাদের কথা শুনতে পেতাম–আজ পাচ্ছি না। আজ আমার মন অন্য রকম হয়ে আছে। সেই অন্য রকমটা কী নিজেও বুঝতে পারছি না। পাপিয়া ম্যাডাম তাঁর মেয়ের সঙ্গে কী একটা খেলা খেলছেন। কোন ইলেকট্রনিক গেম হবে। লুডু বোর্ডের মত বোর্ড। সাপ এবং মইয়ের ছবি আছে। তবে কৌটায় ছক্কা নিয়ে চলতে হয় না। চালার বদলে বোতাম টিপতে হয়। বোতাম টিপলেই শুরুতে মেরী হ্যান্ড আ লিটল ল্যাম্বের বাজনা বাজে তারপর এক থেকে ছয়ের ভেতর একটা সংখ্যা ভেসে ওঠে। বোতাম টেপার ফাঁকে ফাঁকে পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলছেন। খুব সাধারণ কথা। কথা বলতে হয় বলেই বলা। মেয়ে সঙ্গে আছে বলে তিনি অন্য সবার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন এ রকম হতে পারে। শুনলাম তোমার মার শরীর ভাল না? জ্বি। সমস্যাটা কী? জ্বর। ডাক্তার দেখিয়েছ? জ্বি। পাপিয়া ম্যাডামের মেয়েও চায় না–তার মা কারো সঙ্গে কথা বলুক। পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেই মেয়ে তাঁর মায়ের হাত ধরে টানে। আমি তাদের খেলাটা বুঝতে চেস্টা করলাম। তাতেও মেয়েটির আপত্তি। আমার দিকে তাকিয়ে সে কঠিন গলায় বলল, . ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে চমৎকার ইংরেজি শুনলে ভাল লাগে। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েটা স্বল্পভাষী। তার মা দশটা কথা বললে সে দুটা কথা বলছে। ছোটবেলাতেই যে মেয়ে এত কম কথা বলে–বড় হলে তার অবস্থা কী হবে? খুব বেশি বকবক করবে? না পুরোপুরি চুপ হয়ে যাবে? আমাকে কেউ তেমন লক্ষ্য করছে না। শুটিং এর সময় সবার সঙ্গে বসে থাকতে যতটা অস্বস্থিকর হবে বলে ভেবেছিলাম ততটা লাগছে না। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ক্যামেরাম্যান আজীজ আংকেল বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। আকাশে বড় বড় মেঘের খণ্ড। মেঘ ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সূর্য ঢাকা পড়ছে। আজীজ আংকেল নিশ্চয়ই মনে মনে হিসেব করছেন— কতক্ষণ সান পাওয়া যাবে। দিনে শুটিং-এর সময় সব ক্যামেরাম্যান সূর্য উপাসক হয়ে যান। আজ শুটিং খুব কষ্টকর হবে। একটু পর পর সান না পাওয়ার কারণে শট কাট হবে। আর্টিস্টদের উপর খুব চাপ পড়বে। অভিনয়ে ডিসকনটিনিউটি চলে আসবে। ইউনিটের একটা ছেলে ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছে। সবাইকে চা দিচ্ছে। লাল টকটকে ফ্লাস্কে চা। চারদিক সবুজ বলেই ফ্লাস্কের লাল রঙ খুব সুন্দর ফুটেছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। অন্য সময় হলে আমি চা খেতাম না। আজ নিজ থেকে চা চেয়ে নিলাম। কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। চা খাচ্ছি—তাকিয়ে আছি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। আমার তাকিয়ে
false
tarashonkor
প্রশস্ত! মনে হইল—এই ভাল। বাকী দিনগুলা এই ঘাটে ঘাটে বাসা বাঁধিয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিয়াই কাটাইয়া দিবে। পরদিন অপরাহ্লে সামনে গামছা পাতিয়া ঘাটের এক পাশে বসিয়া সে গান ধরিয়া দিল— এই খেদ মোর মনে। কণ্ঠস্বর তাহার অতি মিষ্ট। লোক জমিল। পয়সাও কিছু পড়িল। কিন্তু গান শেষে একজন বলিল—কাশীতে এসে এ খেদ কেন হে ছোকরা? একজন মহিলা বলিলেন—হ্যাঁ বাবা, ভাল গান গাও। মহাজনের পদ গাও। রামপ্রসাদের গান—কমলাকান্তের গান—এই সব গান। সে এবার ধরিল— “আমার কাশী যেতে মন কই সরে? সর্বনাশী এলোকেশী—সে যে সঙ্গে সঙ্গে ফেরে!” গান শেষ করিবার সঙ্গে সঙ্গে মন যেন তাহার বিকল হইয়া গেল। তাহার সমস্ত অন্যরটা এক গভীর বেদনার উদাসীনতায় ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িল গ্রামের মা চণ্ডীকে। রামপ্রসাদের এলোকেশীর মত মা চণ্ডী আজ এই কাশীতে আসিয়া তাহার আশেপাশে ফিরিতেছেন। মায়ের পিছু পিছু যেন বসন ফিরিতেছে; ঠাকুরঝি ফিরিতেছে; রাজন ফিরিতেছে। বিপ্ৰপদ ফিরিতেছে। মাসী বেহালাদার—ভিড় করিয়া ফিরিতেছে। কাশীর চেয়ে তাহার গ্রাম ভাল। কাশীতে জীবনের জন্য খেদ করিবার অধিকার নাই। কিন্তু জীবনের জন্য খেদ না করিয়া সে বাঁচিবে কি করিয়া? নিতাই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যা। এখানে এখন প্রচণ্ড গরম। ঘাটে ও ঘাটের উপর পথে দলে দলে লোক আসিতেছে যাইতেছে, আলাপ-আলোচনা চলিতেছে—কিন্তু সব কথাই যেন নিতাইয়ের নিকট হইতে বহুদূরের কথা বলিয়া মনে হইতেছে, স্বরধ্বনির রেশই কানে আসিতেছে, কিন্তু শব্দের অর্থের কথা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। কাছে থাকিয়াও মানুষগুলিও যেন অনেকদূরের মানুষ। ভাল লাগিতেছে না। এ তাহার ভাল লাগিতেছে না। হোক কাশী; বিশ্বনাথের রাজত্ব; স্বর্গের সিংহ-দরজা, তবু তাহার ভাল লাগিতেছে না। ভিক্ষা তাহার ভাল লাগিতেছে না। মহাজনের পদ তাহার ভাল জানা নাই। আর নিজের গান ছাড়িয়া ওসব গান যত ভাল হোক গাহিয়া কাল কাটাইবার কল্পনাও করিতে পারে না সে। নিজের যেন ওরকম পদ ঠিক আসেও না। তাহার উপর, সে ভিক্ষা বৃত্তিতেও ঠিক আনন্দ পাইতেছে না। কোথায় আনন্দ। সে অন্তত পাইতেছে না। কবিগানের আসর। ঝলমলে আলো। হাজারে লোক। ভাল লাগিতেছে না তাহার। মনে পড়িল মায়ের কথা কয়টি। কবিয়াল তুমি, দেশে ফিরে যাও। স্তব্ধ হইয়া অনেকক্ষণ সে বসিয়া রহিল। কতক্ষণ পরে—তাহার খেয়াল ছিল না—অকস্মাৎ সে অনুভব করিল জনকোলাহল স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। সচেতন হইয়া—চারিদিকে চাহিয়া দেখিল—লোকজন নাই; বোধ হয় যে যাহার ঘরে ফিরিয়া গিয়াছে। ঘাটের উপর দুই-চারিজন লোক ঘুমে অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে। সেও ঘাটের উপর শুইয়া পড়িল। এই গভীর রাত্রে অচেনা শহরে পথ চিনিয়া যাওয়া সম্ভবপর হইবে না। আর কোথায়ই বা যাইবে? চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল ঘাটের নীচে গঙ্গাস্রোতের নিম্ন কলস্বর ধ্বনিত হইতেছে। সেই শবাই সে শুনিতে লাগিল। অপরিচয়ের পীড়ায় পীড়িত অস্বচ্ছন্দ তাহার মন অদ্ভূত কল্পনাপ্রবণ হইয়া উঠিয়াছিল —গঙ্গার স্রোতের শব্দ শুনিতে শুনিতেও নিতাইয়ের মনে হইল—গঙ্গাও যেন দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলিতেছে। কাটোয়ায়, নবদ্বীপেও তো সে গঙ্গার শব্দ শুনিয়াছে; কাটোয়ায়, যে-দিন বসন্তর দেহ পোড়াইয়াছিল, সে দিন তো গঙ্গা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলিয়াছিল। এখানকার সবই কি দুর্বোধ্য ভাষায় কথা কয়? আবার তাহার মায়ের কথা মনে পড়িল। সমস্ত দিনের মধ্যে পাখীর ডাক সে অনেক শুনিয়াছে, কিন্তু ‘বউ কথা কও’ বলিয়া তো তাহদের কেউ ডাকে নাই; ‘চোখ গেল’ বলিয়া তো কোন পাখী ডাকে নাই—’কৃষ্ণ কোথা রে’ বলিয়াও তো কোন পাখী কাঁদিয়া ফেরে নাই ” কাকের স্বর পর্যন্ত কেমন ভিন্ন রকম! মা তাহাকে যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই সঠিক। অকস্মাৎ তাহার মনে হইল—বিশ্বনাথ? বিশ্বনাথই যে এই রাজ্যের রাজা; তবে তিনিও কি—এই দেশেরই ভাষা বলেন? তাহার এই ভক্তদের মতই তবে কি তিনি তাহার কথা— তাহার বন্দনা বুঝিতে পারেন না? হিন্দী ভজন? হিন্দী ভজনেই কি তিনি বেশী খুশী হন? ‘মা অন্নপূর্ণা –তিনিও কি হিন্দী বলেন? ক্ষুধার সময় তিনি যদি নিতাইকে প্রশ্ন করেন— তবে কি ওই হিন্দীতে কথা বলিবেন? তবে? তবে? তবে সে কাহাকে গান শুনাইবে? আবার তাহার মনে পড়িল—তাহাদের গ্রামের ‘মা চণ্ডী’কে, সঙ্গে সঙ্গে ‘বুড়াশিব’কে। পাগলিনী ক্ষ্যাপা মা। ভাঙড় ভোলা! “ওমা দিগম্বরী নাচ গো।” সঙ্গে সঙ্গে বেহারার কাঁধে চড়িয়া ক্ষ্যাপী মা নাচে। “হাড়ের মালা গলায় ভোলা নাচে থিয়া থিয়া।” ভোলানাথ নাচে, তাহার সঙ্গে গাজনের ভক্তেরা নাচে। হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে লোক আশেপাশে যাহার দাঁড়াইয়া থাকে—তাহারাও মনে মনে নাচে। আবার সর্বনাশী এলোকেশীর মত মা চণ্ডী আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইলেন। তাঁহার সঙ্গে সবাই। সবাইকে মনে পড়িল। প্রথমেই মনে পড়িল ঝুমুর দলটিকে—নির্মলা বোনকে মনে পড়িল—ললিতাকে মনে হইল, মাসী আসিয়া ‘বাবা’ বলিয়া তাহার চোথের সামনে দাঁড়াইল। বেহালাদার, দোহার, বাজনদার, রাজন, বণিক মাতুল, বিপ্ৰপদ ঠাকুর, সকলে দূরে যেন ভিড় জমাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঠাকুরঝিকে মনে পড়িল, কৃষ্ণচূড়ার গাছতলায় পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ওই যে! —গ্রামের ধারের নদী ও নদীর ধারে চরভূমিতে তরির চাষ, বিস্তীর্ণ মাঠ, বৈশাখে মাঠের ধূলা, কালবৈশাখীর ঝড়, কালো মেঘ, ঘনঘোর অন্ধকার, সেই চোখ ধাঁধানে বিদ্যুৎ—সেই কড়্‌ কড়্‌ শব্দে মেঘের ডাক —ঝর্‌ ঝর্‌ বৃষ্টি—সব মনে হইল। পূর্ণিমায় ধর্মরাজ-পূজার উৎসব। ঢাক শিঙা কাঁসির বাজনার সঙ্গে ফুলের মালা গলায় ভক্তদলের নাচ। গভীর রাত্রে বাগান হইতে ভক্তদলের ফল সংগ্রহ; কত কথা মনে পড়িল;–বাবুদের পুরানো বাগানে গাছের কোটরে অজগরের মত গোখরার বাস; গোখুরাগুলা ডালে ডালে বেড়ায়, দোল খায়; কিন্তু ভক্তের যখন ‘জয় ধৰ্মরঞ্জো’ বলিয়া রোল দিয়া গাছে চড়ে, তখন সেগুলা সন্তর্পণে কোথায় গিয়া লুকাইয় পড়ে। বাগানের সেই পুরানো বটগাছতলায় অরণ্যষষ্ঠীর দিন
false
shordindu
খোঁড়া করে দিলাম। কিন্তু এখানে আর নয়, হয়তো লোকজন এসে পড়বে। কিন্তু দিল্লীর অধিবাসীরা বুদ্ধিমান, দ্বিপ্রহর রাত্রে অতিবড় বিকট শব্দ শুনিলেও ঘরের বাহির হয় না। ময়ূর ও শিলাবতী মামুদের বিলীয়মান কাতরোক্তি শুনিতে শুনিতে চলিলেন। দেবদারু বৃক্ষতলে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন কবুতর বিবি দাঁড়াইয়া আছে। চুপিচুপি কথা হইল। কবুতর বিবি কোঁচড় হইতে একটি ধূম্রবর্ণ কপোত বাহির করিয়া দিল। একটু পাখার ঝটপট শব্দ, শিলাবতী কপোতটিকে নিজ বস্ত্রমধ্যে লুকাইলেন। ময়ূর মালিক কাফুরের নিকট যত স্বর্ণমুদ্রা পাইয়াছিল সমস্ত কবুতর বিবির হাতে দিল। শিলাবতী কবুতর বিবির গণ্ডে চুম্বন করিলেন, উভয়ের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইল। তারপর কবুতর বিবি ছায়ার মতো হারেমের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। বৃক্ষচ্ছায়াতলে দাঁড়াইয়া ময়ূর বলিল—আর বাসায় ফিরে গিয়ে কাজ নেই। চলুন, নগরের দক্ষিণ দরজার কাছে লুকিয়ে থাকি, দরজা খুললে বেরিয়ে যাব। দিল্লীতে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। পরদিন পান্থশালায় ফিরিয়া গিয়া ময়ূর আরও সাতদিন সেখানে রহিল; তারপর কপোতের পায়ে জতুনিবদ্ধ পত্র বাঁধিয়া কপোতকে উড়াইয়া দিল। অভ্রান্ত কপোত একবার চক্রাকারে ঘুরিয়া দিল্লীর দিকে উড়িয়া চলিল। ময়ূর মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইল, কপোত রাজপ্রাসাদের চূড়ায় গিয়া বসিয়াছে, কোনও পরিচারিকা তাহার পায়ে পত্র বাঁধা আছে দেখিয়া সুলতানকে খবর দিল। তারপর সুলতান আলাউদ্দিনই সেই পত্র পড়িলেন। দুরাচারীর পাপজর্জরিত জীবনের চরম পরিণাম। ইহার পর আলাউদ্দিন বিকৃত মস্তিষ্ক ও ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিন বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। ইহাই ইতিহাসের সাক্ষ্য। চৈত্র মাসের শেষে একদা রাত্রিকালে রাজা ভূপ সিংহ প্রাসাদের ছাদে উঠিয়া একাকী পদচারণ করিতেছিলেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি চন্দ্রহীন; পঞ্চমী তিথির চাঁদ বিলম্বে উঠিবে। নক্ষত্ৰ-বিকীর্ণ স্বল্পান্ধকারে পরিক্রমণ করিতে করিতে রাজা চিন্তা করিতেছিলেন। মাত্র কয়েক মাস পূর্বে চঞ্চরীকে লইয়া ময়ূর দিল্লী গিয়াছে, এখনও তাহার ফিরিবার সময় হয় নাই। কিন্তু সকলের মনেই উদ্বেগপূর্ণ প্রতীক্ষ্ণ, সকলেই যেন অন্যমনস্ক। রাজসংসারের ভৃত্যপরিজন নিঃশব্দে কাজ করিয়া যায়, কাহারও মুখে হাসি নাই। সীমন্তিনীর মুখে শীর্ণ কঠিনতা; রাজকুমারী সোমশুক্লা দিন দিন যেন শুকাইয়া যাইতেছেন। রাজা মনে মনে ভাবিতেছেন—এই তাহার শেষ চেষ্টা, এ চেষ্টা যদি নিস্ফল হয়, আর কিছু করিবার নাই। ময়ূর কি পারিবে? যদি না পারে— সম্প্রতি রাজার মনে একটু নির্বেদের ভাব আসিয়াছে। প্রতিহিংসা কি এতই বড়! যদি তাঁহার প্রতিহিংসা চরিতার্থ না হয় তাহাতেই বা কি? সূর্য-চন্দ্রের গতি রুদ্ধ হইবে না। তিনি একদিন মরিবেন, মহাপাপী আলাউদ্দিনও মরিবে; তখন প্রতিহিংসা কোথায় থাকিবে? জীবন অনিত্য, হিংসাদ্বেষ অনিত্য; মৃত্যুই পরম অবসান। পূর্বাকাশে পীতাভ খণ্ডচন্দ্র উদয় হইল। রাজপুরী সুপ্ত, নগর সুপ্ত, পৃথিবীও সুপ্ত। এই সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে মহাপ্রকৃতি যেন দীপ জ্বালিয়া দিয়াছে। এই পরম মুহূর্তেও কি মানুষের মনে হিংসাদ্বেষ আছে! হায়, সংসারে যদি হিংসাদ্বেষ না থাকিত! ময়ূর কি ফিরিয়া আসিবে? তাহার প্রতি ভূপ সিংহের মেহ জন্মিয়াছিল, বিশ্বাস জন্মিয়াছিল; সে যদি ফিরিয়া না আসে, যদি রামরুদ্রের মতো সেও ঘাতকের হস্তে হত হয়— নিস্তব্ধ বাতাসে অশ্বের ক্ষীণ হ্রেষাধ্বনি শুনিয়া রাজা সেই দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। রাজপুরীর সম্মুখ পথ দিয়া একদল লোক আসিতেছে। রাজার চোখের দৃষ্টি এখনও তীক্ষ্ণ আছে, তিনি। দেখিলেন যাহারা আসিতেছে তাহাদের মধ্যে একটা দোলা এবং একজন অশ্বারোহী রহিয়াছে। রাজা রুদ্ধশ্বাসে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর দ্রুত ছাদ হইতে নামিতে লাগিলেন। নিশ্চয় ময়ূর ফিরিয়াছে। কিন্তু সঙ্গে দোলা কেন? তবে কি চঞ্চরীকে ফিরাইয়া আনিয়াছে! দ্বিতলে অবতরণ করিলে কুমারী সোমশুক্লা পিছন হইতে চকিতস্বরে ডাকিলেন—পিতা! কিন্তু রাজা শুনিতে পাইলেন না। ময়ূর প্রাসাদ সম্মুখে অশ্ব হইতে অবতরণ করিল। রাজা একাকী দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহার পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া বলিল—আর্য, আমি ফিরে এসেছি। কার্যসিদ্ধি হয়েছে। কার্যসিদ্ধির কথা রাজার কানে পৌঁছিল কিনা সন্দেহ; তিনি কম্পিত স্বরে বলিলেন— দোলায় কে? ময়ূর বলিল—একটি স্ত্রীলোক আপনার দর্শন চায়, তাকে সঙ্গে এনেছি। মহারাজ, আপনি নিজ কক্ষে গিয়ে বসুন, আমি এখনি দর্শনপ্রার্থিনীকে নিয়ে আসছি। রাজা কক্ষে গিয়া স্বয়ং দীপ জ্বালিলেন, তারপর ভূমিতলে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার দেহমনের সমস্ত শক্তি যেন ফুরাইয়া গিয়াছে, স্নায়ুমণ্ডল আলোড়িত হইতেছে। ময়ূর কাহাকে সঙ্গে আনিয়াছে? কে তাঁহার দর্শনপ্রার্থিনী? ময়ূর দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, সঙ্গে কৃষ্ণাননা একটি স্ত্রীলোেক। দ্বারের কাছে ক্ষণকাল ন যযৌ ন তস্থৌ থাকিয়া স্ত্রীলোকটি ছুটিয়া আসিয়া রাজার পদপ্রান্তে পড়িল, অবরুদ্ধস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—পিতা, আমাকে কি গৃহে স্থান দেবেন? আমি দাসী হয়ে থাকব, আমার পরিচয় কেউ জানবে না— রাজা পক্ষাঘাতগ্রস্তের ন্যায় ক্ষণেক নিশ্চল রহিলেন, তারপর উন্মত্তবৎ চিৎকার করিয়া উঠিলেন—শিলা! শিলা! ময়ূর দ্বারের কাছে প্রহরীর ন্যায় ঋজুদেহে দাঁড়াইয়া রহিল। শিলাবতী প্রথমে ময়ূরের সঙ্গে পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিতে চাহেন নাই, বলিয়াছিলেন—আমি ভ্ৰষ্টা ধর্মচ্যুতা, আমাকে গৃহে স্থান দিলে পিতার কলঙ্ক হবে। তিনি যদি আমাকে গ্রহণ না করেন? ময়ূর বলিয়াছিল—যদি গ্রহণ না করেন আমরা দুই ভাই-বোন অন্য কোথাও চলে যাব। বিস্তীণা পৃথিবীতে কি দুটি মানুষের স্থান হবে না? তখন শিলাবতী সম্মত হইয়াছিলেন। ময়ূর চাহিয়া দেখিল, রাজার বাহ্যজ্ঞান নাই, তিনি কন্যাকে শিশুর মতো আদর করিতেছেন—মা আমার! মা আমার! কন্যা! কন্যা! কন্যা! ময়ূর একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। এই হৃদয়াবেগ হইতে দূরে সরিয়া যাওয়াই ভাল। সে দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে, আবার ইতস্তত করিতেছে, এমন সময় কেহ তাহার হস্ত স্পর্শ করিল। ময়ূর ফিরিয়া দেখিল, সোমশুক্লা! সোমশুক্লার মুখ ঈষৎ কৃশ, চোখের কোলে ছায়া, কিন্তু তাঁহার হাসি দেখিয়া ময়ূরের মনে হইল ইহার অধিক পুরস্কার বুঝি পৃথিবীতে আর নাই। সে কুমারীর হাত ধরিয়া উদ্যানে লইয়া গেল। চাঁদ আর একটু উপরে উঠিয়াছে, আর একটু উজ্জ্বল হইয়াছে। চন্দ্রালোকে দুইজনে পরস্পরের মুখ দেখিলেন, তারপর
false
bongkim
রাজ্য? রাজত্ব কি বিনা সৌন্দর্যে; শোভা পায়? পরা |” নির্মিল অলঙ্কার পরাইল; সে কুসুমিততরুবিনিন্দিত কান্তি দেখিয়া কাঁদিল। কিছু বলিল না। চঞ্চল তখন নির্মইলের গলা ধরিয়া কাঁদিল। চঞ্চল তার পর বলিল, “নির্‍মল ! আর তোমায় দেখিব না! কেন বিধাতা এমন বিড়ম্বনা করিলেন! দেখ, ক্ষুদ্র কাঁটার গাছ যেখানে জন্মে, সেইখানে থাকে; আমি কেন রূপনগরে থাকিতে পাইলাম না!” নির্মেল বলিল, “আমায় আবার দেখিবে। তুমি যেখানে থাক, আমার সঙ্গে আবার দেখা হইবে। আমায় না দেখিলে তোমার মরা হইবে না; তোমায় না দেখিলে আমার মরা হইবে না |” চ। আমি দিল্লীর পথে মরিব। নি । দিল্লীর পথে তবে আমায় দেখিবে। চ। সে কি নির্মথল ? কি প্রকারে তুমি যাইবে? নির্ম ল কিছু বলিল না। চঞ্চলের গলা ধরিয়া কাঁদিল। চঞ্চলকুমারী বেশভূষা সমাপন করিয়া মহাদেবের মন্দিরে গেলেন। নিত্যব্রত শিবপূজা ভক্তিভাবে করিলেন। পূজান্তে বলিলেন, “দেবদেব মহাদেব! মরিতে চলিলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, বালিকার মরণে তোমার এত তুষ্টি কেন? প্রভু! আমি বাঁচিলে কি তোমার সৃষ্টি চলিত না? যদি এতই মনে ছিল, কেন আমাকে রাজার মেয়ে করিয়া সংসারে পাঠাইয়াছিলে?” মহাদেবের বন্দনা করিয়া চঞ্চলকুমারী মাতৃচরণ বন্দনা করিতে গেলেন। মাতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল। পিতার চরণে গিয়া প্রণাম করিল। পিতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল! তার পর একে একে সখীজনের কাছে, চঞ্চল বিদায় গ্রহণ করিল। সকলে কাঁদিয়া গণ্ডগোল করিল। চঞ্চল কাহাকে অলঙ্কার, কাহাকে খেলনা, কাহাকে অর্থ দিয়া পুরস্কৃত করিলেন। কাহাকে বলিলেন, “কাঁদিও না–আমি আবার আসিব |” কাহাকে বলিলেন, “কাঁদিও না–দেখিতেছ না, আমি পৃথিবীশ্বরী হইতে যাইতেছি |” কাহাকেও বলিলেন, “কাঁদিও না–কাঁদিলে যদি দু:খ যাইত, তবে আমি কাঁদিয়া রূপনগরের পাহাড় ভাসাইতাম |” সকলের কাছে বিদায় গ্রহণ করিয়া, চঞ্চলকুমারী দোলারোহণে চলিলেন। এক সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য দোলার অগ্রে স্থাপিত হইয়াছে;এক সহস্র পশ্চাতে । রজতমন্ডিত রত্নখচিত সে শিবিকা,বিচিত্র সুবর্ণ-খচিত বস্ত্রে আবৃত হইয়াছে ; আসাসোঁটা লইয়া চোপদার বা‍গ্‌জালে গ্রাম্য দর্শকবর্গকে আনন্দিত করিতেছে। চঞ্চলকুমারী শিবিকায় আরোহণ করিলে, দুর্গমধ্য হইতে শঙ্খ নিনাদিত হইল; কুসুম ও লাজাবলীতে শিবিকা পরিপূর্ণ হইল; সেনাপতি চলিবার আজ্ঞা দিলেন; তখন অকস্মাৎ মুক্তপথ তড়াগের জলের ন্যায় সেই অশ্বারোহিশ্রেণী প্রবাহিত হইল। বল্গা দংশিত করিয়া, নাচিতে নাচিতে অশ্বশ্রেণী চলিল–অশ্বারোহীদিগের অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা বাজিল। অশ্বারোহিগণ প্রভাতবায়ুপ্রফুল্ল হইয়া কেহ কেহ গান করিতেছিল। শিবিকার পশ্চাতেই যে অশ্বারোহিগণ ছিল, তাহার মধ্যে অগ্রবর্তী একজন গায়িতেছিল– “শরম্ ভরম্ সে পিয়ারী, সোমরত বংশীধারী, ঝুরত লোচনসে বারি! ন সম্‌ঝে গোপকুমারী, যেহিন্ বৈঠত মুরারি, বিহারত রাহ তুমারি ||” রাজকুমারীর কর্ণে সে গীত প্রবেশ করিল। তিনি ভাবিলেন, “হায়! যদি সওয়ারের গীত সত্য হইত!” রাজকুমারী তখন রাজসিংহকে ভাবিতেছিলেন। তিনি জানিতেন না যে, আঙ্গুল-কাটা মাণিকলাল তাঁহার পশ্চাতে এই গীত গায়িতেছিল। মাণিকলাল, যত্ন করিয়া শিবিকার পশ্চাতে স্থান গ্রহণ করিয়াছিল। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : নির্মবল কুমারীর অগাধ জলে ঝাঁপ এদিকে নির্ম লকুমারীর বড় গোলমাল বাধিল। চঞ্চল ত রত্নখচিত শিবিকারোহণে চলিয়া গেল–আগে পিছে দুই সহস্র কুমারপ্রতিম অশ্বারোহী আল্লার মহিমার শব্দে রূপনগরের পাহাড় ধ্বনিত করিয়া চলিল। কিন্তু নির্মকলের কান্না ত থামে না। একা–একা–একা–শত পৌরজনের মধ্যে চঞ্চল অভাবে নির্মতল বড়ই একা। নির্মাল উচ্চ গৃহচূড়ার উপর উঠিয়া দেখিতে লাগিল–দেখিতে লাগিল, পাদক্রোশ-পরিমিত অজগর সর্পের ন্যায় সেই অশ্বারোহী সৈনিকশ্রেণী পার্ব ত্য পথে বিসর্পিত হইয়া উঠিতেছে, নামিতেছে–প্রভাতসূর্যোকিরণে তাহাদিগের ঊর্ধ্বোঞর্ত্থিত উজ্জ্বল বর্শাফলক সকল জ্বলিতেছে। কতক্ষণ নির্মেল চাহিয়া রহিল। চক্ষু জ্বালা করিতে লাগিল। তখন নির্মতল চক্ষু মুছিয়া, ছাদের উপর হইতে নামিল। নির্মিল একটা কিছু ভাবিয়া ছাদের উপর হইতে নামিয়াছিল। নামিয়া প্রথমে অলঙ্কার সকল খুলিয়া কোথায় লুকাইয়া রাখিল, কেহ দেখিতে পাইল না। সঞ্চিত অর্থমধ্যে কতিপয় মুদ্রা নির্ম ল গোপনে সংগ্রহ করিল। কেবল তাহাই লইয়া নির্মপল একাকিনী রাজপুরী হইতে নিষ্ক্রান্তা হইল। পরে দৃঢ়পদে অশ্বারোহী সেনা যে পথে গিয়াছে, সেই পথে একাকিনী তাহাদের অনুবর্তিলনী হইল। তৃতীয় পরিচ্ছেদ : রণপণ্ডিত মবারক বৃহৎ অজগর সর্পের ন্যায় ফিরিতে ফিরিতে, ঘুরিতে ঘুরিতে সেই অশ্বারোহী সেনা পার্বরত্য পথে চলিল। যে রন্ধ্রপথের পার্শ্বস্থ পর্বপতের উপর আরোহণ করিয়া মাণিকলাল রাজসিংহের সঙ্গে দেখা করিয়া আসিয়াছিল, বিবরে প্রবিশ্যমান মহোরগের ন্যায় সেই অশ্বারোহিশ্রেণী সেই রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিল। অশ্বসকলের অসংখ্য পদবিক্ষেপধ্বনি পর্ব্তের গায়ে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। এমন কি, সেই স্থির শব্দহীন বিজন প্রদেশে অশ্বারোহিদিগের অস্ত্রের মৃদু শব্দ একত্র সমুত্থিত হইয়া রোমহর্ষণ প্রতিধ্বনির উৎপত্তির কারণ হইতে লাগিল। মাঝে মাঝে অশ্বগণের হ্রেষারব–আর সৈনিকের ডাক হাঁক। পর্বধততলে যে সকল লতা-গুল্ম ছিল–শব্দাঘাতে তাহার পাতা সকল কাঁপিতে লাগিল। ক্ষুদ্র বন্য পশু পক্ষী কীট যাহারা সে বিজন প্রদেশে নির্ভয়ে বাস করিত, তাহারা সকলে দ্রুত পলায়ন করিল। এইরূপে সমুদয় অশ্বারোহির সারি সেই রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিল। তখন হঠাৎ গুম্ করিয়া একটা বিকট শব্দ হইল। যেখানে শব্দ হইল, সে প্রদেশের অশ্বারোহিরা ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। দেখিল, পর্ব তশিখরদেশ হইতে বৃহৎ শিলাখণ্ড পর্ব্তচ্যুত হইয়া সৈন্যমধ্যে পড়িয়াছে। চাপে একজন অশ্বারোহী মরিয়াছে, আর একজন আহত হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে, ব্যাপার কি, তাহা কেহ বুঝিতে না বুঝিতে, আবার সৈন্যমধ্যে শিলাখণ্ড পড়িল–এক, দুই, তিন, চারি, ক্রমে দশ, পঁচিশ–তখনই একেবারে শত শত ছোট বড় শিলাবৃষ্টি হইতে লাগিল–বহুসংখ্যক অশ্ব ও অশ্বারোহী কেহ হত, কেহ আহত হইয়া পথের উপর পড়িয়া পথ একেবারে রুদ্ধ করিয়া ফেলিল । অশ্বসকল আরোহী লইয়া পলায়নের জন্য বেগবান হইল–কিন্তু অগ্রে পশ্চাতে পথ সৈনিকের ঠেলাঠেলিতে অবরুদ্ধ–অশ্বের উপর অশ্ব, আরোহীর উপর আরোহী চাপিয়া পড়িতে লাগিল–সৈনিকেরা পরস্পর অস্ত্রাঘাত করিয়া পথ করিতে লাগিল–শৃঙ্খলা একেবারে ভগ্ন হইয়া
false
toslima_nasrin
সাত দিনের মধ্যে তাকে বন্দী করার ও তার সমস্ত কর্ম বাজেয়াপ্ত করার জন্য জোর দাবী উঠেছে। অন্যথায় সিলেট শহর সহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর প্রতিবাদে হরতালের ডাক পড়িয়াছে। বাদিনী তাহার বিভিন্ন কলামে নারী স্বাধীনতার নামে পুরুষের বিরুদ্ধে অযথা কটুক্তি ও লাগামহীন অশ্রাব্য ভাষা ব্যাবহার করিয়া শ্রেণী বিদ্বেষ সৃষ্টি করার যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, নারীদেরকে কোন অংশেই বা কোন কলামেই সম্মান না দেখাইয়া তাহাদেরকে কলুষিত করার চেষ্টা করিয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় মুসলিম পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিবর্গকে অসম্মান করিবার এক জঘন্য ও হীন চেষ্টা চালাইয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় দেশিয় প্রচলিত স্বাভাবিক নিয়ম নীতি ভঙ্গ করিয়া শালীনতা, ভদ্রতা লংঘন করিয়া কুরুচিপূর্ণ ও নগ্ন যৌন বিষয়ে আলোচনা করিয়া পাঠক সমাজকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলিয়া দিয়াছেন। নির্বাচিত কলামের শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের সমাদৃত মুসলিম সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার করিয়াছেন বটে এবং যে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়া কল্পিত নারী ঘটিত এক উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনায় ভরপুর অসভ্য সমাজ রূপায়নের জন্য যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। পুরুষের ধর্মীয় বিধান মোতাবেক একাধিক স্ত্রী অনুমতির প্রতি বাদিনী জঘন্যভাবে আক্রমণ করিয়াছেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামীর উপস্থিতিও সমাজ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে থাকার দাবী করিয়াছেন। যাহা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে স্ত্রীর জন্য জেনা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মানুষের পিতৃ পরিচয় নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে তদোপরি সুন্দর মানব জীবন ও স্মরাণাতীতকাল হইতে প্রতিষ্ঠিত মানব সভ্যতা ধুলায় মিশিয়া যাইবে। যে ষড়যন্ত্রের হোতা বাদিনী নিজে। বাদিনী তাহার উক্ত গ্রন্থে জরায়ুর স্বাধীনতার উপরও জোরালো বক্তব্য রাখিয়াছেন। জরায়ু নেহায়েতই নারীদের শরীরে একটি বিশেষ অংশ যার মাধ্যমে মানব জনম ও মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়া আছে। উক্ত তথাকথিত স্বাধীনতার সাথে বাদিনী আল্লাহর স্বাভাবিক সৃষ্টির প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করিয়াছেন। যার মাধ্যমে বাদিনীর ধর্মচ্যূতি ঘটিয়াছে বিধায় কোরানের আলোকে মুরতাদ হিসাবে অভিশপ্ত সালমান রুশদির ন্যায় মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে।’ উচিত জবাবের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। উচিত জবাব বহাল তবিয়তে বিরাজ করে বাজারে। আদালতের মুরব্বীগণ আমার পক্ষে রায় দিয়ে উচিত জবাবকে একটি উচিত জবাব দেবার পক্ষে নন। আমি মানবরূপী শয়তান, তাঁরা আল্লাহর বান্দা, সৃষ্টির সেরা জীব। আমি কেন পেরে উঠব আল্লাহর দয়া যাদের ওপর, তাদের ব্যবসা নষ্ট করতে! আমার ওপর তো আল্লাহ তায়ালার করুণা বর্ষিত হয়নি। উচিত জবাব হামেশাই দেওয়া হচ্ছে আমাকে। উচিত অনুচিত নিয়ে দুঃখ করে সময় নষ্ট করতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। আমার সময়গুলো অন্যভাবে ব্যয় হতে থাকে। কারও জন্য কিছু করে। যা করতে চাই, যেমন করে করতে চাই তা করতে পারি না বলে লিখতে হয়। আমাকে আমূল তোলপাড় করা ভাবনা গুলোর কতটুকুই আর প্রকাশ করতে পারি লিখে! ভাবনা হবে না কেন, প্রতিনিয়তই মেয়েরা লাঞ্ছিতা হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে। দেশের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেগুলো আমাকে নাড়ায়, কাঁদায়, ভাবায়, ক্ষুব্ধ করে, ব্যথিত করে সেসব নিয়ে লিখি। কোনও গভীর তত্ত্ব কথা নয়। তথ্যবহুলও কোনও প্রবন্ধ নয়। লেখাগুলো একধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। গবেষণা করে কিছু বার করা নয়। দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়, পরদিন সে পত্রিকার পাতা বাদামের ঠোঙা হয়ে যায়। সাপ্তাহিকী গুলোয় ছাপা হয়, সপ্তাহ গেলে সেসব কাগজ চলে যায় ময়লা ফেলার বাক্সে। পচা পুরোনো জিনিসের সঙ্গে মিশে যায়। আমার প্রতিদিনকার কলামের টুকরো টুকরো কিছু বাক্য.. . ‘শাহিদা নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করে ফেলল লিয়াকত ম্যাজিস্ট্রেট কারণ শাহিদা লিয়াকতের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। লিয়াকতের সঙ্গে হয়ত শাহিদার বন্ধুত্ব ছিল, এই সম্পর্কের ছুতোয় লিয়াকত জোর খাটিয়েছে। লিয়াকত ভেবেই নিয়েছে সে পুরুষ, সে যা বলবে শাহিদাকে তা-ই শুনতে হবে। শাহিদা শোনেনি সম্ভবত শোনেনি এই জন্য যে সে একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ে, তার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম সে দিতে চায়। কিন্তু তা মানবে কেন লিয়াকত, সে পুরুষ, সে তার গায়ের জোর তার ছুরির জোর তার পুরুষঅঙ্গের জোর না খাটালে সে আর পুরুষ কেন! পুরুষ এমনই জন্তু বিশেষ যে দাঁত নখ চোখের হিংস্রতা দিয়ে সে তার পুরুষত্ব জাহির করতে চায়। মনুষ্যত্ব, আমি সবসময়ই দেখেছি পুরুষের মধ্যে খুব কম। মনুষ্যত্বের সঙ্গে পুরুষত্বের বোধহয় চিরকালীন এক বিরোধ আছেই। লিয়াকত যদি বিয়ে করত শাহিদাকে, এরকম আঘাতে আঘাতে শাহিদাকে তিল তিল করে মরতে হত, কেউ দেখতে পেত না তার ভেতরের ক্ষরণ, লোকে ভাবত — কী চমৎকার জুটি! লোকে এখনও চোখে কালি পড়া নিরন্তর মার খাওয়া স্ত্রীদের নির্দ্বিধায় সুখী বলে বিবেচনা করে। লিয়াকত পুরুষের মত পুরুষ। সে পুরুষের যোগ্য কাজই করেছে। নারীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে। প্রেম প্রেমই। এর আগে পরে পরকিয়া বা আপনকিয়া শব্দ ব্যবহার করলে প্রেমের মহিমাই নষ্ট হয়। ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদা পরকিয়া প্রেম করত এবং সন্তানটি তার স্বামীর ঔরসজাত নয়, এ নিয়ে পত্রিকাগুলো এখন মুখর। প্রেম সে করতেই পারে, স্বামীর যদি স্পার্মলেস সিমেন থাকে অথবা সে উত্থানরহিত হয়, স্ত্রী তার প্রেমিকের সন্তান গর্ভে নিতেই পারে, মানুষ তার মনে এবং শরীরে কাকে বহন করবে বা না করবে সে একান্তই তার ব্যপার। শাহিদার প্রেম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা মানে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুধু নয়, পদক্ষেপ করাও। অবশ্য জীবিত মেয়েদেরই যেখানে স্বাধীনতা নেই, সেখানে মৃত মেয়ের আবার স্বাধীনতা কি! বাসাবোয় নিলুফার নামের এক মেয়েকে খুন করেছে তার স্বামী। সেই স্বামী এখন বহাল তবিয়তে আছে।
false
shunil_gongopaddhay
দিদি। সন্তু কাকাবাবুকে কোনওদিন গান গাইতে শোনোনি। কিন্তু এখন এই চলন্ত গাড়িতে কাকাবাবু গুনগুন করে গান ধরেছেন। মেশিনগান ও রিভলভারধারী কয়েকজন দস্যুর সঙ্গে যে তিনি বসে আছেন সে ব্যাপারে যেন তাঁর কোনও দুশ্চিন্তাই নেই। অথচ সন্তুর বুকের মধ্যে ধকধক করছে। কাকাবাবু যে গান গাইছেন, তার সুরও যেমন বেসুরো, কথাগুলোও অদ্ভুত। কাকাবাবু গাইছেন : যদি যাও বঙ্গে কপাল তোমার সঙ্গে। ত্রিপুরায় যারা যায় তারা খুব কাঁঠাল খায়। ধর্মনগর উদয়পুর কোনদিকে আর কতদূর… এই রকম আরও কী সব যেন কাকাবাবু একটানা গেয়ে যেতে লাগলেন, সন্তু সব কথা বুঝতে পারল না গাড়ির আওয়াজে। গাড়িটা যে খুব জোরে ছুটছে, তা বোঝা যায়। সন্তু মনে-মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করল। ঘণ্টায় কত মাইল? ষাট? রাত্তিরবেলা রাস্তা ফাঁকা, আরও বেশিও হতে পারে। এই রকম বিপদের মধ্যেও মানুষের ঘুম পায়? কাকাবাবু অনেকক্ষণ চুপচাপ। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্তুরও ঝিমুনি এসেছিল খানিকটা, হঠাৎ আবার ধড়ফড় করে উঠে বসল। আর অমনি একজন কেউ তার মাথায় একটা চাপড় মেরে বলল, চুপ করে বসে থাক। অত ছটফটানি কিসের? অন্যান্যবারে সন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি বিপদের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু আগে সব সময়ই মনে হয়েছে, কাকাবাবু কিছু না কিছু একটা উপায় বার করবেনই। কিন্তু এবারে কাকাবাবুরই তো মাথার ঠিক নেই। এবারে আর উদ্ধার পাওয়া যাবে কী করে? কাকাবাবুর মতন একজন অসুস্থ লোককে ধরে নিয়ে যাবার জন্য এই লোকগুলো এত ব্যস্ত কেন, তাও সন্তু বুঝতে পারছে না। পুরনো কোনও শত্রুতা? গাড়ির গতি কমে এল আস্তে আস্তে। তারপর থামল এক জায়গায়। সন্তুর চোখ বাঁধা। তাকে এখন কী করতে হবে সে জানে না। একজন লোক সন্তুর হাত ধরে ট্রেকার থেকে নীচে নামল। একজন কেউ হুকুমের সুরে বলল, ছেলেটার চোখ খুলে দাও; কিন্তু হাত বেঁধে রাখো ওর। খেয়াল রেখো, ও কিন্তু মহা বিচ্ছু ছেলে! সন্তুর চোখের বাঁধন খুলে দেবার পর সে দেখল অনেক গাছপালার মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে থেমেছে তাদের গাড়ি। সেই বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন বেশ লম্বামতন লোক, নস্যি রঙের সুট পরা, চোখে কালো চশমা। অন্ধ ছাড়া আর কেউ যে রাত্তিরে কালো চশমা পরে, তা সন্তু আগে জানত না। একজন লোক কাকাবাবুর এক হাত ধরে নীচে নামাতে গেল। কাকাবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। বেশ জোরেই পড়েছেন, কারণ সন্তু ঠকাস করে ওঁর মাথা ঠুকে যাবার শব্দ পেল। কালো-চশমা পরা লম্বা লোকটি ধমক দিয়ে বলল, ইডিয়েট! সাবধানে! জানো না, ওর এক পায়ে চোট আছে। নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না! একজন ওর মাথার কাছে রিভলভার ধরে থাকো, কখন যে কী করবে ঠিক নেই। ওকে সার্চ করেছ? দুজন লোক কাকাবাবুকে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন বলল, হ্যাঁ, সার্চ করে দেখেছি, কাছে কোনও ওয়েপন্ নেই। কাকাবাবুর গায়ে স্লিপিং সুট। খালি পা। আছাড় খাবার সময় নিশ্চয়ই খুব ব্যথা লেগেছে। কিন্তু তাঁর যেন সে বোধই নেই। তিনি আবার গুনগুন করে গান ধরলেন : যদি যাও বঙ্গে কপাল তোমার সঙ্গে যারা যায় ত্রিপুরায় যখন-তখন আছাড় খায়…। লম্বা, কালো-চশমা পরা লোকটি বিস্ময়ে একটা শিস দিয়ে উঠল। তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, গান গাইছ, অ্যাঁ? কী রায়চৌধুরী, নেশা-টেশা করেছ নাকি? কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, পি লে, পি লে, হরিনাম কা পেয়ালা–ইন ঠুন ঠুন। মাতোয়ালা, মাতোয়ালা, হরিনাম কা পেয়ালা! লোকটি এক হাত বাড়িয়ে কাকাবাবুর থুতনি ধরে উঁচু করে বললেন, ওসব নকশা ছাড়ো। কী রায়চৌধুরী, আমায় চিনতে পারো? কাকাবাবু একদৃষ্টে লোকটির মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চেনা চেনা লাগছে। তুমি পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা না? লোকটি ঠাস করে এত জোরে চড় মারল কাকাবাবুর গালে যে, কাকাবাবুর মুখটা ঘুরে গেল। তারপর অন্য গালে ঠিক তত জোরে আবার একটা চড় মেরে লোকটা বলল, এবার নেশা কেটেছে? এবার ভাল করে দ্যাখো তো চিনতে পারো কি না? কাকাবাবু আবার লোকটির মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। সেই একই রকম গলায় বললেন, হুঁ, আগের বারে ভুল হয়েছিল। তুমি আসলে রামগড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা, হাসির কথা শুনলে বলে হাসব, না না না না! লোকটি আবার মারবার জন্য হাত তুলতেই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, মারবেন না, মারবেন না। উনি সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ। সন্তু দারুণ চমকে উঠল। এ তো ডাক্তার প্রকাশ সরকারের গলা! কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে সন্তু তাকে দেখতে পেল না। বেশি খুঁজবারও সময় নেই। সন্তু আবার এদিকে তাকাল। কালো-চশমা পরা লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, রায়চৌধুরী অতি ধুরন্ধর! ওসব ভেক আমি জানি। ওর পেটের কথা আমি ঠিক বার করবই। দেখি ও কত মার সহ্য করতে পারে। লোকটি আবার এক চড় কষাতে গেল কাকাবাবুকে। তার আগেই সন্তু ছুটে গিয়ে এক কুঁ মারল লোকটার পেটে। আচমকা আঘাত পেয়ে লোকটা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন লোক এসে চেপে ধরল সন্তুকে। একজন তার কপালের ওপর রিভলভারের নল চেপে ধরল। লম্বা লোকটি উঠে পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, বলেছিলুম, এটা একটা শয়তানের বাচ্ছা। ওর ব্যবস্থা আমি পরে করছি। আগে বুড়োটাকে টিট করি। কাকাবাবু এই সব কোনও ব্যাপারেই একটুও বিচলিত হননি। মুখে এখনও মৃদু-মৃদু হাসি। লম্বা লোকটি তাঁর মুখোমুখি হতেই তিনি বললেন, তা হলে কী ঠিক হল? তুমি পান্তভূতের ছানা, না
false
nihar_ronjon_gupta
সেই কথাটাই বলব। কিরীটীর কথায় ও মধুসুদনকে চোখ মেলে উঠে বসতে দেখে এতক্ষণে যেন সকলে সম্বিৎ ফিরে পান। সকলেই একটা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সকলেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়। কিরীটী তখন আবার বলছে, হ্যাঁ, কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই অভিনয়ের অনুষ্ঠানটি আমি মধুবাবুর সঙ্গে গতরাত্রে পরামর্শ করে করেছি এবং আজকের ব্যাপারটা নিছক একটা অভিনয় হলেও, গতকাল সন্ধ্যায় ঠিক অনুরূপ ব্যাপারটি নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্য বলেই আমরা জানি। কারণ গত সন্ধ্যায় ঠিক আজকের মতই কাপে এক চুমুক দিয়েই বিজনবাবু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে-এবং যদিও ময়না তদন্তের ফলাফল এখনো আমরা জানতে পারিনি, তথাপি আমি আপনাদের সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি, হতভাগ্য বিজনবাবুর মৃত্যুর পশ্চাতেও আছে আগের দুবারের মতই মারাত্মক নিকোটিন বিষপ্রয়োগই। ঘরের মধ্যে সকলেই স্তব্ধ, বিমূঢ় ও নির্বাক। কিরীটী আবার বলে, নিকোটিন বিষপ্রয়োগেই যদি বিজনবাবুর মৃত্যু হয়ে থাকে তো কাল নিশ্চয়ই তার চায়ের কাপের মধ্যেই আমাদের অলক্ষ্যে হয় নিজ হাতে বা অন্য কারও সহযোগিতায় হত্যাকারী ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রান্নাঘরের পাশের ঘরে গত সন্ধ্যায় শকুন্তলা দেবী গোকুলের সাহায্যে আমাদের জন্য চা তৈরী করেছিলেন বলেই আমরা জানি। এবং ঐ সময় তারা দুজনেই বাইরে গিয়েছিলেন—শকুন্তলা দেবী দুবার ও গোকুল একবার। কাজেই ঐ গোকুল বা শকুন্তলা দেবী যদি চায়ে না বিষ মিশিয়ে থাকেন– সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের দৃষ্টি অদূরে উপবিষ্ট শকুন্তলার উপর গিয়ে পতিত হল। না, না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সহসা যেন চাপা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল শকুন্তলা, বিষ আমি দিইনি— কিন্তু কিরীটী শকুন্তলার সেই আর্ত চিৎকারে যেন কর্ণপাতও করল না। সে যেমন বলছিল বলতে লাগল, যা, কেবল শকুন্তলা দেবী বা গোকুলই নয়—কাল এ-বাড়িতে যাঁরা ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের যে কারও পক্ষেই বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল। অর্থাৎ যে কেউ বিষ মেশাতে পারেন। আবার ঐ সময় চিৎকার করে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার, হাউ অ্যাবসার্ড! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? ঠিকই বলছি বৃন্দাবনবাবু, একমাত্র আমি ও শচীবিলাসবাবু ব্যতীত কাল সকলেই আপনারা এ ঘর থেকে ঐ সময়ের মধ্যে বেরিয়েছেন আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকলেই এবারে চুপ। তাই যদি হয়, তাহলে আপনাদের যে কারো পক্ষেই গতকাল চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল এ কথাটা নিশ্চয়ই কেউ ডিনাই করতে পারবেন না! যাক যা বলছিলাম, তারপর ট্রেতে করে চায়ের যে কাপগুলো গোকুল নিয়ে এল তার মধ্যেই কোন একটি কাপে নিকোটিন বিষমিশ্রিত চায়ে চুমুক দিয়েই নিজের অজ্ঞাতে বিজনবাবু আমাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। কথা অবিশ্যি এর মধ্যে একটা আছে। গোকুলই সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিল। নিজে যদি দোষী হয় তো সে জেনেই পূর্বাহ্নে বিজনবাবুর হাতে বিষমিশ্রিত চায়ের কাপটি তুলে দিয়েছিল; আর সে যদি নির্দোষী হয়ে থাকে তো অজ্ঞাতেই সে বিজনবাবুর হাতে ঐ বিষের কাপটি তুলে দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আর একটা সন্দেহ জাগতে পারে আমাদের মনে। বিজনবাবুর হাতে অজ্ঞাতে বা না জেনে যদি গোকুল বিষের কাপটি তুলে দিয়েই থাকে, তাহলে কি বিজনবাবুর মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্টাল! আর তাই যদি হয়, হত্যাকারীর এইম কার উপরে ছিল? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিজনবাবুর মৃত্যুটা একেবারে অ্যাকসিডেন্টাল নয়। বিজনবাবু হত্যাকারীর লিস্টে তত ছিলেনই-আরো কেউ ছিল! সে কি! অধস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করেন এবারে ডাঃ অধিকারী। হ্যাঁ, ডাঃ অধিকারী। আরও কেউ ছিল এবং এখনও তিনি পূর্ববৎ হত্যাকারীর লিস্টে আছেন। কিরীটীর শেষের কথায় সকলে আবার ভীতদৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। মৃত্যু–আবার কার জন্য মৃত্যু এখানে ওৎ পেতে আছে কে জানে? এ কি সর্বনেশে কথা! কিরীটী একটু থেমে আবার তখন বলতে শুরু করেছে, তবে আমার বিশ্বাস, বেচারী গোকুল হয়ত দোষী নয়। তা সে যাই হোক, বর্তমানে আমাদের সব চাইতে বেশী ভাববার কথা হচ্ছে, পর পর যেভাবে তিনটি মৃত্যু এ বাড়িতে ঘটেছে সেরকম নাটকীয় ব্যাপারের আর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য নয় কি? কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়-সহসা কিরীটীকে বাধা দিয়ে ডাঃ অধিকারী বললেন, দশরথের কথা ছেড়ে দিলেও সারদা আর বিজনের মৃত্যু যদি ঐ নিকোটিন বিষপানেই তাদের অজ্ঞাতে হয়ে থাকে তো গ্লাসে ও কাপে– কিরীটী শেষ করতে দিল না ডাঃ অধিকারীকে কথাটা, বললে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে, নিকোটিন বিষ গ্লাসে পাওয়া উচিত ছিল ও কাপেও পাওয়া উচিত ছিল, তাই না? হ্যাঁ, মানে– ডাঃ অধিকারী, গ্লাসেও যেমন নিকোটিনের নামগন্ধ পাওয়া যায়নি, ঐ কাপেও পাওয়া যেত না। তাই মিথ্যে আমি কাপটা আর কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য বিমলবাবুকে পাঠাতে বলিনি। তবে? কিন্তু কেন? গ্লাসে ও কাপে যদি সত্যই নিকোটিন দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন নিকোটিন অ্যানালিসিসে কাপে বা গ্লাসে পাওয়া যাবে না? সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা ঋজু ও ধারাল হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, পাওয়া যায়নি ও যাবে না—তার কারণ সারদাবাবুর ঘরে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল এবং গতকাল সোফার তলায় যে কাপটা পাওয়া গিয়েছে, আদপেই। সে গ্লাস এবং সেই কাপ সারদাবাবু বা বিজনবাবু ব্যবহার করেননি তাদের মৃত্যুর পূর্বে। হোয়াট ড়ু ইউ মিন, মিঃ রায়? তার মানে? তীক্ষ্ণ একটা চীৎকারের মতই যেন ডাঃ অধিকারীর প্রশ্নটা কিরীটীর প্রতি নিক্ষিপ্ত হল। এবারে শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী বললে, একসাটলি তাই ডাঃ অধিকারী। বলতে বলতে সহসা জামার পকেট থেকে একটা কাপ বের করে সম্মুখস্থিত টেবিলের উপরে রক্ষিত
false
humayun_ahmed
কেউ আছে নাম সীতা। হ্যাঁ চিনি। তার কি কখনো শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছিল? গায়ে গুটি বের হয়েছিল? হাম হয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিল। আপনি কিভাবে জানেন? আমি জবাব দিলাম না। জবাব দেবার সময় আসেনি। সকালে নাশতা খেতে বসেছি। নলিনী বাবু কিছু খাবেন না। এগারোটার দিকে ভাত খাবেন। তিনি তার আগের একাহারি নিয়মে ফিরে যাচ্ছেন। এটা ভালো লক্ষণ। দ্রুত সুস্থতার দিকে যাওয়া। আমি বললাম, এই ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখুন তো, ভালো করে দেখে বলুন ডায়েরির লেখাগুলি কি আপনার? নলিনী বাবু অনেক সময় নিয়ে দেখলেন। বারবার পাতা উল্টে দেখছেন। তাঁকে অত্যন্ত কনফিউজড মনে হলো। নলিনী বাবু বললেন, ডায়েরির লেখা আমার। কিন্তু আমি লিখি নাই। বাপারটা গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে না? হচ্ছে। ডায়েরিটা আপনার নীলগঞ্জের বাড়ি থেকে আমি এনেছি। এখন ফিরত দিলাম। আপনি নিজে প্রতিটি লেখা খুব মন দিয়ে পড়বেন। আমি কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে বসব। কোথায় যাচ্ছেন? সিঙ্গাপুর। আমার হার্টের কিছু সমস্যা আছে। বছরে দুবার ডাক্তার দেখানোর কথা। আমি অবশ্যি একবার দেখাই। কদিন থাকবেন? সব মিলিয়ে চার-পাঁচ দিন লাগবে। আপনি আপনার নিজের বাড়িঘর মনে করে এখানে থাকবেন। এরা সবাই আপনার দেখাশোনা করবে। যদি প্রয়োজন মনে করেন নীলগঞ্জ থেকে রামচন্দ্রকে নিয়ে আসবেন। কাউকে আনতে হবে না। আমি এখানে ভালো আছি। আপনার যদি লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে ম্যানেজারকে বললেই কাগজ-কলম দিবে। আমি তো লেখক না যে আমার লেখালেখি করতে ইচ্ছে করবে। কাগজ-কলম লাগবে। আমি বললাম, ঘুমিয়ে থাকে মহান লেখক অলেখকের অন্তরে। নলিনী বাবু সুন্দর করে হাসলেন। আমি বললাম, আমি চাই আপনি আপনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলুন। যা মনে আসে লিখবেন। ভাষা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাববেন না। আমি আপনাদের মিসির আলি না। তারপরেও সমাধান করে ফেলব। নলিনী বাবু বললেন, সমাধান মানে সমাপ্তি! সমাপ্তি বলে কিছু নেই। সিঙ্গাপুরে যাওয়া কি কারণে যেন বাতিল হয়ে গেল। আমার জন্যে ভালোই হলো। স্থান বদলের বিষয় চলে এসেছে। ধানমণ্ডিতে আমার নিজের ফ্ল্যাট তৈরি। ফ্ল্যাটটি করা হয়েছে একজন মানুষের জন্যে। বিদেশে এ ধরনের ফ্ল্যাটের নাম স্টুডিও এপার্টমেন্ট। বিশাল একটা শোবার ঘর। একটা লাইব্রেরি। আমি চেয়েছিলাম এমন একটা ফ্ল্যাট যেখানে শুধু বাথরুম দেয়াল বন্দি থাকবে। বাইরের দেয়াল ছাড়া আর কোনো দেয়াল থাকবে না। বসার ঘর, শোবার ঘর, লাইব্রেরি ঘর বলে আলাদা কিছু থাকবে না। একটাই ঘর। বাড়ির আর্কিটেক্ট আমার কলেজ জীবনের বন্ধু করিম। তাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না। সে বলল, তোমার মাথা খারাপ হতে পারে আমার মাথা খারাপ না। নতুন বাড়িতে সংসার পাতার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে সময় কাটতে লাগল। আজ এটা কিনি কাল ওটা কিনি। রোজ সন্ধ্যায় অজ্ঞা। আচ্ছা বন্ধ করার জন্যে গৃহিণী নেই। সিগারেটের ধোঁয়ায় বাড়ি গ্যাস চেম্বার হলেও বলার কেউ নেই। আমার বন্ধুরা সন্ধ্যা মিলাবার আগেই চলে আসে। রাত গভীর হলে নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা ওঠে। কেউ কেউ আবার থেকেও যায়। তারা বলে, বেচারা হুমায়ূন একা একা থাকবে, আচ্ছা আমিও থেকে যাই। আমার ফ্ল্যাটের আড্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। আড়ার নামও দেয়া হলো–বৃদ্ধ বোকা সংঘ। , এই ক্লাবে নতুন নতুন সদস্য যোগ হতে থাকল। আমি সাময়িকভাবে নলিনী বাবুর কথা ভুলে গেলাম। ম্যানেজারের কাছে খবর পাই তিনি ভালো আছেন। এক বেলা খাবার খান। সারাদিন ঘুরে ঘুরে গাছপালা দেখেন। সন্ধ্যাবেলা দিঘীর ঘাটে বসে তারা দেখেন। আমার নিজের এক সময় তারা দেখার শখ ছিল। তিনটা টেলিস্কোপ নুহাশ পল্লীতে আছে। আমার তারা দেখার শখ স্থায়ী হয়নি বলে টেলিস্কোপে ধুলা জমেছে। নলিনী বাবু টেলিস্কোপের ধুলা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করছেন জেনে ভালো লাগল। এক বিকেলে শাওন বেড়াতে এলো। তার হাতে প্লাস্টিকের বাটিতে কি একটা খাবার। সে উপস্থিত থাকতেই আমার বন্ধুরা উপস্থিত হওয়া শুরু করল। শাওন আমাকে আড়ালে নিয়ে বলল, এরা কারা? আমি বললাম আমার বন্ধুরা। আড্ডা দিতে এসেছে। আমি আপনার এই আড্ডার খবর পেয়েছি। আড্ডা নাকি রাত দুটাতিনটা পর্যন্ত চলে। সব দিল না। মাঝে মাঝে চলে। আদ্রা যখন জমে যায় তখন চলে। রাতে আপনাদের খাবারের কি ব্যবস্থা। ফ্ল্যাটে তো রান্নার কোনো লোক দেখছি না। রাতে হোটেল থেকে খাবার আসে। আপনি দিনে কোথায় খান? দিনে মাজহারদের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। অন্য প্রকাশের মালিক মাজহার। তুমি তো চেনো। প্রতিদিন খাবার আসে? হুঁ। আপনার লজ্জা করে না? লজ্জা করবে কি জন্যে? মাজহার আমার পুত্রস্থানীয়। আপনার বাড়ি ভর্তি এইসব কিসের বোতল? আমি এই প্রশ্নের জবাব দিলাম না। জ্ঞানী মানুষ সব প্রশ্নের জবাব দেয়। সেই মুহূর্তে জ্ঞানী হবার প্রয়োজন দেখা দিল। শাওন কঠিন গলায় বলল, আপনি এই ভাবে জীবনযাপন করবেন আমি তা হতে দেব না। আপনার বয়স হয়েছে, আপনার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। আপনার দরকার শান্তি। আপনাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। আপনার অনেক কাজ বাকি। কি কাজ বাকি? আপনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। লিখেছেন? না। মধ্যাহ্ন নামে একটা উপন্যাস লেখার কথা বলেছিলেন। ইংরেজ শাসন থেকে দেশ বিভাগ পর্যন্ত ইতিহাস সেখানে থাকবে। লিখেছেন? না। ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা ছিল। লিখেছেন? না। আজ থেকে এই বাড়িতে আড্ডা বন্ধ। আপনার ভিখিরির মতো অন্য বাড়ির খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা বন্ধ। আমি বললাম, তুমি যে কথাগুলো বলছ সেগুলি বলার জন্য অধিকার লাগে। সেই অধিকার কি তোমার আছে?
false
humayun_ahmed
উপায় নাই। জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন? জ্যান্ত খাওনের নিয়ম। খাওনের পর ডাইল দিয়ে কুলি করলেই সব হজম। তবে ভাইজান–টিকটিকির লেজের বিষয়ে সাবধান। টিকটিকির সব বিষ তার লেজে। লেজ খাওয়া যায় না? তাও খাওয়া যায়। অনেক ঝামেলা আছে। লেজটারে প্রথম পুইড়া ছাই বানাইতে হয়। সেই ছাই সিগারেটের শুকার সাথে মিশাইয়া টানতে হয়। আপনি টেনেছেন? জ্বে-না, অত ঝামেলা পুষায় না। আতাহার বলল, জ্যান্ত টিকটিকি খান, ঘেন্না লাগে না? ঘিন্নার কি আছে? মাছ মাংস মানুষে খায় না? অত ঘিন্না করলে দুনিয়াতে বাঁচন যায় না। তাছাড়া ভাইজান, ডাইল-খোরের অত ঘিন্না থাকে না। এইটাই ডাইলের মজা। ডাইল খাইলে কোন কিছুতে ঘিন্না লাগে না। সবেরে বড় আপন লাগে। দুনিয়াটা যে রঙ্গিলা এইটা ডাইল না খাইলে বুঝা যায় না। আতাহার ঘৃণা ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদের চোখে কোন ঘৃণা নেই, বিস্ময়ও নেই। তার চোখে শুধুই কৌতূহল। নির্ভেজাল কৌতূহল। কুদ্দুস টিনের কোটা থেকে একটা টিকটিকি বের করে আনল। বা হাতের আঙুলে একটা টোকা দিতেই টিকটিকির লেজ খসে পড়ল। কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, বড়ই আজিব পোকা। লেজ খুইল্যা পড়ে, আবার লেজ হয়। ছাদের দিকে মুখ করে কুদ্দুস প্রকাণ্ড হা করে টিকটিকিটা মুখের ভেতর ছেড়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করল। কচ কচ শব্দ হচ্ছে। আতাহার ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দুহাতে পেট চেপে রাস্তায় বসে পড়ল। মনে হচ্ছে বমি করতে করতে সে রাস্তাতেই নেতিয়ে পড়বে। রাস্তা ফাকা, দূরে ডাস্টবিনের কাছে একটা কুকুর ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। কুকুরটা ভীত পায়ে আতাহারের দিকে আসছে। আতাহারের মনে হল কুকুরটার চোখ মমতা ও সহানুভূতিতে আর্দ্র। আতাহার ডাকল, আয় আয়, তুই আমার কাছে আয়। কালো রঙের কুকুর এগিয়ে আসছে। আতাহার আবারো ডাকল, আয় আয়–। কি আশ্চর্য! এই অদ্ভূত অবস্থাতেই তার মাথায় কবিতার লাইন আছে। কোন মানে হয়? একজন কবি সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেন–একগাদা বমি সামনে নিয়ে সে বসে আছে। এর ভেতর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্যের জন্ম অন্ধকারে। আলোর জন্মদাত্রী মা অবশ্যই অন্ধকার। একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেলো। ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর। বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন? আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার। আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি– অন্ধকারকে দেখব বলে। আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার। একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল। বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার। কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার! কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল। তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে। তবু সে হাঁটছে– তাকে যেতে হবে আরো গভীর অন্ধকারে। যে অন্ধকার–আলোর জন্মদাত্রী। কণার মুখ হাসিহাসি। তাকে দেখে মনে হতে পারে আনন্দময় কোন অভিজ্ঞতার জন্যে সে অপেক্ষা করছে। তার গায়ে ইস্ত্রি করা সুতীর ছাপা শাড়ি। শাদা জমিনে নীল রঙের ফুলের ছাপ। কণাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শরীরে নীল ফুল ফুটে আছে। সত্যি সত্যি ফুটে আছে। কণা মাথায় গন্ধ তেল দিয়ে চুল বেঁধেছে। মাথার গন্ধটাকেই মনে হচ্ছে ফুলের গন্ধ। নার্স ঘরে ঢুকে কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ঘণ্টা খানিক। কণা ঠিক আছে বলে আগের মত হাসি হাসি মুখ করে বসে রইল। নার্স বলল, আপনার স্বামী আসেন নি? জ্বি না। উনি এলে ভাল হত। কণা হাসল। সেই হাসি যা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। কণা তার তেইশ বছরের জীবনে এই হাসি অনেকবার ব্যবহার করেছে। হয়ত আরো অসংখ্যবার ব্যবহার করতে হবে। তার এখন আর ভাল লাগে না। হাসিটা সে শুধুমাত্র একজনের জন্যেই ব্যবহার করতে চায়। হাসি হল শরীরেরই একটা অংশ। ঠোঁটের ফাকে ফুলের মত ফুটে ওঠে। শরীর যেমন সবার জন্যে নয়–হাসিও তেমনি সবার জন্য না। কণা বসে আছে ধানমণ্ডি পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে তার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা হবে। নতুন। একজন মানুষের দায়িত্ব নেয়ার সামৰ্থ তার স্বামীর নেই। অনেক আলাপ আলোচনা করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবার পর কণা হোসেছে খিলখিল করে। কণার স্বামী বিরক্ত মুখে বলেছে, হাস কেন? কণা বলেছে, হাসতে ভাল লাগে এইজন্যে হাসি। ছোটবেলায় খুব কাঁদিতাম এইজন্যে নাম হয়ে গিয়েছিল কাদুনি। কী দুনি থেকে কানি। কানি থেকে কণা। বুঝলেন সাহেব? এত কথা বল কেন? আচ্ছা যাও, কথাও বলব না। কণা শান্ত মুখে কেরোসিনের চুলা ধরিয়েছে। কৌটায় সামান্য কিছু কফি আছে। স্বামীকে কফি বানিয়ে দিয়ে সে অবাক করে দেবে। চা ভেবে চুমুক দিয়ে দেখবে কফি। সে আঁৎকে উঠবে। মজার একটা ব্যাপার হবে। কণা সারাজীবন চেয়েছে তাকে ঘিরে সারাক্ষণ মজার মজার সব ঘটনা ঘটুক। কিন্তু তার জীবনটা এ রকম যে তাকে ঘিরে মজার কোন ঘটনা কখনো ঘটে না। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে। তাকে কাপড় খুলে আধাবুড়ো একজন মানুষের সামনে নানান অঙ্গ ভঙ্গি করে বসে থাকতে হয়। আধাবুড়ো মানুষটা তার ছবি আঁকে। তবে মানুষটা ভাল। ঋষির মত মানুষ। মানুষটার চোখে লোভ ঝিলমিল করে না। কখনোই সে কোন অজুহাতে হাত দিয়ে তার নগ্ন শরীর জুয়ে দেয় না। মানুষ এ রকম হয় কিভাবে? একটা স্বাভাবিক জীবন কণার কেন হল না? আল্লাহ কি জন্মের সময় তার কপালে লিখে দিয়েছেন–এই মেয়েটার কোন স্বাভাবিক জীবন হবে না? সে সরক্ষণ ভয়ংকরের
false
humayun_ahmed
উকিল-মোক্তার নিয়ে বাসায় উপস্থিত। আমি ভাবলাম কী না কী, পরে শুনি এই ব্যাপার। আমাকে ডেকে বলে—সুরমা, তুমি কিন্তু সাক্ষী। সাক্ষী আমি বুঝায়ে দিয়েছি। মারধর করেছ? ইয়ারকি করিস না হিমু। ইয়ারকি ভালো লাগছে না। খালুজানকে দাও। কথা বলি। ওকে দেব কোথেকে? ও কি বাসায় আছে? জুতিয়ে বের করে দিয়েছি না? স্যান্ডেল-পেটা করেছি। স্পঞ্জ স্যান্ডেল, না চামড়া? হারামজাদা, রসিকতা করিস না। তোকেও জুতা-পেটা করব। খালুজানকে কখন থেকে বের করলে? আজ? হ্যাঁ, সন্ধ্যাবেলা। উকিল-মোক্তার সব নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘর থেকে বের হয়েছে। মোক্তার ব্যাটা ফাইল নিয়ে হুড়মুড় করে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছে। তুমি কি সত্যি সত্যি স্যান্ডেল-পেটা করেছ? অবশ্যই। রাখি খালা? শোন হিমু, গাধাটার সঙ্গে তোর যদি দেখা হয় তাহলে গাধাকে বলবি সে যেন আর ত্রিসীমানায় না আসে… জি আচ্ছা, আমি বলব। তবে বলার দরকার হবে বলে মনে হয় না। কত বড় সাহস! আমার জমি, আমার বাড়ি সে দান করে দিচ্ছে, আর আমাকে বলছে সাক্ষী হতে। মদ খেয়ে খেয়ে মাথার বারোটা বেজে গেছে সেই খেয়াল নেই। খুব খাচ্ছেন বুঝি? অফিসে গিয়েছিলি, কিছু টের পাস নি? রাত-দিন তো ওর উপরই আছে। গাধার চাকরিও চলে গেছে। বলো কী! অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আমাকে টেলিফোন ছাড়তে হলো না। আপনা আপনি লাইন কেটে গেল। আমি ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেছে। আমার ধারণা, মেসে ফিরে দেখব বড় খালু বসে আছেন। আমার ইনট্যুশন তাই বলছে। কিছুদিন পালিয়ে থাকার জন্যে আমার আস্তানা সর্বোত্তম। গ্রীন ফার্মেসির ছেলেটাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে দু’প্যাকেট ডানহিল সিগারেট কিনলাম। বড় খালুর এই হচ্ছে ব্র্যান্ড। আমার ধারণা, মেসে পা দেয়ামাত্র বড় খালু বলবেন, হিমু, সিগারেট এনে দে। মেসে ফিরলাম। আমার ঘরের দরজা খোলা। ঘর অন্ধকার। খাটের উপর কেউ একজন শুয়ে আছে। আমি ঘরে ঢুকলাম। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললাম, বড় খালু, আপনার সিগারেট। ডানহিল। বড় খালু জড়ানো গলায় বললেন, থ্যাংকস। তোর এখানে দু-একদিন থাকব। অসুবিধা আছে? আমার কোনো অসুবিধা নেই। আপনি থাকতে পারবেন কিনা কে জানে। নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য যে কোনো জায়গায় আমি থাকতে পারি। নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য যে কোনো জায়গায়ই আমার স্বর্গ—দি হেভেন। কিছু খেয়েছেন? না। চলুন আমার সঙ্গে। হোটেলের খাবার খেতে অসুবিধা নেই তো? না। বড় খালুর উঠে দাঁড়িয়েছেন,তবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি শিথিল। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর মদ্যপান করেছেন। মুখে থেকে ভকভক করে কুৎসিত গন্ধ আসছে। কথাবার্তা পুরো এলোমেলো। হিমু! জি। তোর এই মেসের ম্যানেজার এসেছিল। তোর নাকি আজই মেস ছেড়ে দেবার কথা? হুঁ। আমি রিকোয়েস্ট করে আর এক সপ্তাহ টাইম এক্সটেনশান করেছি। ভালো করেছেন। এক সপ্তাহ পর যদি বের করে দেয়, দুজন একসঙ্গেই বের হয়ে যাব। কী বলিস? সেটা মন্দ হবে না। শীতকাল হওয়ায় মুশকিল হয়েছে। গরমকাল হলে পার্কের বেঞ্চিতে আরাম ঘুমানো যেত। হুঁ। তুই শুধু হুঁ হাঁ করছিস কেন? কথা বল। বি হ্যাপি। বুঝলি হিমু, তোর এই মেসের লোকজন খুবই মাইডিয়ার। এক ভদ্রলোক তোর ঘরের তালা অনেক যন্ত্রাণা করে খুলে দিয়েছেন। একজন এসে তাস খেলার জন্যে ইনভাইট করলেন। ভালো তো। তোদের এখানে কাজের মেয়েটা যে আছে, কী যেন তার নাম? ময়নার মা? আরে ধুৎ! ময়না হলো তার মেয়ের নাম। ওর নিজের নাম কী? নাম জানি না খালু। মনে পড়েছে, ওর নাম হলো কইতরী। সুন্দর না নামটা? হ্যাঁ, সুন্দর। কইতরী আমাকে চা এনে দিল। অনেকক্ষণ গল্প করলাম কইতরীর সঙ্গে। অসাধারণ মহিলা। গরিব ঘরে জন্মেছে বলে সে হয়েছে ঝি। বড়লোকের ঘরে জন্মালে ইউনির্ভাসিটির অঙ্কের টিচার হতো…। বড় খালুকে হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামালাম। তিনি দেখি এক একবার হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়ে যাচ্ছেন। বেতাল অবস্থা। বড় খালু,বমি-টমি হবে না তো? তুই কি পাগল-টাগল হয়ে গেলি? আমি কি এ্যামেচার? আমি হলাম প্রফেশনাল পানকারী। আমার কিছুই হবে না। না হলেই ভালো। বুঝলি হিমু,ঐ কইতরী মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। . না বড় খালু, . ঠিকই বলেছিস, , , . তাই নাকি? তোর খালাকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কইতরীকে বিয়ে করে ফেললে কেমন হয়? তাহলে তোর খালা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। উচিত শিক্ষা হবে। সবাই বলবে—ছিঃ ছিঃ! ঝি বিয়ে করে ফেলেছে। হো-হো-হো। হি-হি-হি। আপনার অবস্থা কাহিল বলে মনে হচ্ছে। তোর খালার অবস্থা তো কাহিল করে ফেলব। একেবারে কাহিলেস্ট করে দেব। কাহিল-কাহিলার –কাহিলেস্ট, তখন সে বুঝবে হাউ মেনি রাইস, হাউ মেনি পেডি। হি-হি-হি। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। হিমু! জি। একটা কী যে জরুরি কথা তোকে বলা দরকার, মনে পড়ছে না। ফরগটেন। মনে পড়লে বলবেন। খুবই জরুরি ব্যাপার। এখানে দাঁড়া। দাঁড়ালে মনে পড়বে। মাতাল মানুষের কাছে সবই জরুরি। তারা অতি তুচ্ছ ব্যাপারকে আকাশে তোলে। আমি বড় খালুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর কিছু মনে পড়ছে না। দাঁড়িয়ে থাকলে মনে পড়বে না। বরং আমরা হাঁটি। হাঁটলে ব্রেইন ঝাঁকুনি খাবে, তাতে যদি মনে আসে। এটা মন্দ না। তাঁকে নিয়ে হোটেলে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। তিনি হাঁটার সময় ইচ্ছে করে বেশি বিশি মাথা ঝাঁকালেন—তাতেও লাভ হলো না। হোটেলে খেতে বসে তাঁর মনে পড়ে গেল। আনন্দিত গলায় বললেন, মনে পড়েছে। আলেয়া এসেছিল তোর কাছে। চিনেছিস তো? সম্পর্কে তোর খালা হয়। তার বোনের মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিস—খুকি
false
tarashonkor
নিশ্চয় বলিত, হ্যাঁ, ও পাস করতে পারত কিনা, আমার পয়ে পাস হয়েছে। তাহাকে আজ একখানা চিঠি। দিতে হইবে। মন আবার চকিত হইয়া উঠিল, শুধু নাস্তিকে নয়, অনেক জায়গায় চিঠি দিতে হইবে। যেখানে যত– হো সবুজ গাড়িকা আসোয়ার!—পিছন হইতে কাহার কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল, হো সবুজ গাড়িকা আসোয়ার! শিবু হাসিয়া ব্রেক কষিল। কমলেশ, এ কমলেশ ছাড়া আর কেহ নয়। কমলেশ ও তাহার। গাড়ি একসঙ্গে আসিয়াছিল, কমলেশের গাড়ির রঙ চকোলেট রঙের, তাহার গাড়ির রঙ সবুজ। কমলেশ পিছনে পড়িলে ওই বলিয়াই হাঁক দেয়। বেচারা কমলেশ! নান্তিকে লইয়া এই বিরোধের পর হইতে তাহাদের বাড়িতে যাইতে পারে না। আর তাহারও কেমন বাঁধ-বাধ ঠেকে। সশব্দে কমলেশের গাড়িখানা পাশে আসিয়া থামিল। শিবু সহাস্যে বলিল, শুনেছ? নিশ্চয়। নইলে পলাতক আসামিকে এমনিভাবে ধরার জন্যে ছুটি! তারপর, এমন উর্ধ্বশ্বাসে চলেছ কোথায়? দেবীমন্দিরে। মাকে প্রণাম করে আসি, গোঁসাইবাবাকে প্রণাম করে আসি। চল। চলিতে চলিতে কমলেশ বলিল, চল না, দিনকতক বেড়িয়ে আসি। মামা এসেছেন কিনা, তিনি বললেন, যাও না, শিবুকে নিয়ে কাশী ঘুরে এস না দিনকতক। শিবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বলতে পারছি না এখন। এতে ভাববার কী আছে? অনেক। সে পরে হবে এখন। বলিতে বলিতেই সে গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। দেবীর স্থানে তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে। কমলেশও নামিয়া পড়িল। নিবিড় জঙ্গলে ঘেরা আশ্রম—বহুকালের প্রাচীন তন্ত্রসাধনার স্থান। রামজী সাধু সদাপ্ৰজ্বলিত ধুনির সম্মুখে একটি ছোট বাঁধানো আসনের উপর বসিয়া ছিলেন। দেবীমন্দিরের পূজক পুরোহিত কয়েকজন পাশে বসিয়া গল্প করিতেছিল। শিবু ঝড়ের মত আসিয়া বলিল, গোঁসাই-বাবা, আমি পাস হয়েছি, ফাষ্ট্র ডিভিশনে পাস হয়েছি। সাধু মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া শিবুকে শিশুর মত বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, জিতা রহো বেটা; বাবা হামার। শিবু বলিল, ছাড়, তোমাকে প্রণাম করি। মাকে প্রণাম করি। সন্ন্যাসী আশীর্বাদ করিয়া দেবীর আশীর্বাদী বিপত্রের মালা শিবুর গলায় পরাইয়া দিয়া বলিলেন, বাস, এখন আপনা রাজ করো বেটা, বাপ-দাদাকে গদ্দিমে বৈঠো, জিমিদারি দেখো, দুষ্টকে দমন করো, শিষ্টকে পালন করো। কমলেশ মৃদু মৃদু হাসিতেছিল। শিবু আরক্তিম মুখে সন্ন্যাসীকে বলিল, এখন আমি পড়ব গোঁসাই-বাবা। হাঁ! বাহা বাহা, বেটা রে হামার! উ তো ভাল কথা রে বাবা। তা তুমার জিমিদারি কৌন্‌ চালাবে বাবা? এখনই আমার জমিদারি দেখবার সময় হয়েছে নাকি? হা-হা করিয়া হাসিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে বাপ রে বাপ রে! এখনও তুমি ছোট আছ বাবা! জানিসরে বাবা, আকবর বাদশা বারো বরষ উমরসে হিন্দুস্থানকে রাজ চালায়েছেন। লিখাপড়িতি না শিখিয়েছিলেন আকবর শা। তবভি কেতনা লড়াই উনি জিতলেন, তামাম হিন্দুস্থান উনি জয় করিয়েছিলেন। কমলেশ বলিল, ছত্রপতি শিবাজীও লেখাপড়া জানতেন না। করজোড়ে নমস্কার করিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে বাপ রে, মহারাজ শিউজিমায়ী ভবানীকে বরপুত্র। জিজ্জাবাই মা-ভবানীকে সহচরী জয়া কি বিজয়া কোই হোবে। হিন্দুধরমকে উনি রাখিয়েছেন রে বাবা। হামার পল্টন যব পুনামে ছিলো, তখুন দেখিয়েছি হামি উন্‌কে কীর্তি। শিবু বলিল, আজ সন্ধেবেলায় কিন্তু যেতে হবে, লড়াইয়ের গল্প বলতে হবে। সন্ন্যাসী সৈনিকের মত বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া হাকিয়া উঠিলেন, টানান্‌শান। কমলেশ হাসিয়া বলিল, অ্যাটেনশন। শিবু মুখ না ফিরাইয়া বলিল, জানি। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সন্ন্যাসীর বীরভঙ্গিমার দিকে চাহিয়া ছিল। সন্ন্যাসী আবার হাকিলেন, রাট বাট ট্রান। সঙ্গে সঙ্গে রাইট অ্যাবাউট টার্ন করিয়া হাসিয়া বলিলেন, সনঝাতে কুইক মাচ করিয়ে যাবে হামি বাবা। এখুন তুমি লোক কুইক মাচ করো। এহি বাজল বিউগল। মুখে তিনি অতি চমৎকার বিউগলের শব্দ নকল করিতে পারেন। কিন্তু বিউগল বাজানো আর হইল না, তিনি বিস্মিত হইয়া কাহাকে প্ৰশ্ন করিলেন, আরে আরে, তুমি কাঁদছিস কেনে মায়ী? শিবু ও কমলেশ বিস্মিত হইয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, একটি প্রৌঢ়া নিম্নজাতীয়া স্ত্রীলোক পিছনে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছে। কমলেশ ব্যগ্ৰভাবে প্ৰশ্ন করিল, ফ্যালার মা, কাঁদছিস কেন তুই? ফ্যালা কমলেশের বাড়ির মাহিন্দার, গরুর পরিচর্যা করে। ফালার মা কমলেশকে দেখিয়া ড়ুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ওগো বাবু গো, ফেলা আমার সরদ-গরম হয়ে মাঠে পড়ে রইছে গো। ওগো, গোঁসাইবাবাকে বলে দাও একবার গাড়িখানি দিতে। অনেক প্ৰশ্ন করিয়া বিবরণ জানা গেল, ফ্যালা কমলেশদেরই আদেশক্রমে মাটির জালা আনিবার জন্য তিন ক্রোশ দূরবর্তী গ্রামে কুমোর-বাড়ি গিয়াছিল, ফিরিবার পথে সহসা অসুস্থ হইয়া এই দেবীমন্দিরের অনতিদূরে জ্ঞানশূন্যের মত পড়িয়া আছে। সংবাদ পাইয়া বিধবা মা ও তরুণী পত্নী সেখানে গিয়াছিল, কিন্তু ফ্যালার মত জোয়ানকে তুলিয়া আনিবার মত সাধ্য তাহাদের হয় নাই। তাই পুত্রবধূকে সেখানে রাখিয়া সে এই নিকটবর্তী দেবীস্থানেই ছুটিয়া আসিয়াছে। ফ্যালার মা কমলেশের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া কহিল, ওগো বাবু, তুমি গোঁসাইবাবাকে বলে দাও গো। কমলেশকে বলিতে হইল না, সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে হারামজাদী বেটি, তু কানসি কেনে? চল, কাহা তুমার লেড়কা, হামি দেখি।—বলিয়া নিজেই বলদ দুইটা খুলিয়া গাড়িতে জুতিয়া ফেলিলেন। শিবু বলিল, দাঁড়াও গোঁসাই-বাবা, কতকগুলো খড় দিয়ে দিই। বাঁশগুলো বেরিয়ে আছে, পিঠে লাগবে যে। প্ৰকাণ্ড জোয়ান, মাটিতে পড়িয়া আছে একটা সদ্য-কাটা গাছের মত। মাথার শিয়রে তরুণী বধূটি ভয়ে উদ্বেগে মাটির পুতুলের মত বসিয়া আছে। মধ্যে মধ্যে রোগী অনুনাসিক সুরে চাহিতেছে, জঁল। চারিদিকে লাল কাকরের প্রান্তর ধু-ধু করিতেছে। বৈশাখের বিশেষ করিয়া এ বৎসরের নিদারুণ গ্রীষ্মের উত্তাপ মানুষের দেহেরও জলীয় অংশ শোষণ করিয়া লইতেছে। কোথাও জলের চিহ্ন নাই। সন্ন্যাসী বলিলেন, কঁহাসে জল আনলি রে মায়ী? বধূটি নীরব হইয়া রহিল, ফ্যালার মা বলিল, আজ্ঞে জল কোথা পাব বাবা? শিবু তিরস্কার করিয়া বলিল, ওখানে বললি না কেন যে, জল
false
tarashonkor
গুপ্ত বিদ্যা-এ তো পেকাশ করতে নিষেধ আছে। মেয়েটা একটু চুপ করে থেকে বললে—যদি বিশ্বাস কর ধরমভাই, তবে বুলি শোন। এ যে কি গাছ তার নাম আমরাও জানি না। বেদেরা বলে—সেই যখন সাঁতালী পাহাড় থেকে বেদেরা ভাসল নৌকাতে, তখুন ওই কালনাগিনী কন্যে যে আভরণ অঙ্গে পর্যা নেচেছিল, তাথেই এক টুকরা মূল ছিল লেগে। সাঁতালী ছাড়ল বেদেরা, সঙ্গে সঙ্গে ধন্বন্তরির বিদ্যা চাঁদো বেনের শাপে হল বিস্মরণ। লতুন বিদ্যা দিলেন মা-বিষহরি। এখুন ধন্বন্তরির বিদ্যার ওই মূলটুকুই কন্যের আভরণে লেগে সঙ্গে এল, তাই পুঁতলে শিরবেদে নতুন সাঁতালী গাঁয়ে হিজল বিলের কূলে। গাছ আছে, শিকড় নিয়া ওষুদ করি। কিন্তু নাম তো জানি না ধরমভাই। আর ই গাছ সাঁতালী ছাড়াও তো আর কুথাও নাই পিথিমীতে। তা হলে তুমাকে নাম বলব, কি গাছ চিনায়ে দিব কি করা কও? এইটি তুমি রাখ, লাগ যদি ডংশন করে আর সি ডংশনের পিছাতে যদি দেবরোষ কি ব্ৰহ্মরোষ না থাকে ধন্বন্তরি—তবে ইয়ার এক রতি জলে বেট্যা গোলমরিচের সাথে খাওয়াই দিবা, পরানা যদি তিল-পরিমাণও থাকে, তবে সে পরানকে ফিরতে হবে, এক পহরের মধ্যে মড়ার মত মনিষ্যি চোখ মেলে চাইবে। আর একটি শিকড়ও সে দিয়েছিল শিবরামকে। তীব্র তার গন্ধ। এতকাল পরেও বৃদ্ধ শিবরাম বলেন-বাবা, সে গন্ধে নাক জ্বালা করে, নিশ্বাসের সঙ্গে বুকের মধ্যে গিয়ে সে যেন আত্মার শ্বাসরোধ করে। শবলা সেদিন এই শিকড় তার হাতে দিয়ে বলেছিল—এই ওষুদ হাতে নিয়া তুমি রাজগোখুরার ছামনে গিয়া দাঁড়াইবা, তাকে মাথা নিচু কর্যা পথ থেকে সর্যা দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমাকে দেখায়ে দিই পরখ কর্যা। খুলে দিলে সে একটা সাপের কাঁপি। কালো কেউটে একটা মুহূর্তে ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। সদ্য-ধরা সাপ বোধ হয়। শিবরাম পিছিয়ে এলেন। হেসে বেদেনী বললে ভয় নাই, বিষদাঁত ভেঙে দিছি, বিষ গেলে নিছি। এসো এসো, তুমি জড়িটা হাতে নিয়া আগায়ে এসো। বিষদাঁত ভাঙা, বিষও গেলে নেওয়া হয়েছে সবই সত্যি; কিন্তু শিবরাম কি করে কোন সাহসে এগিয়ে যাবেন! দাঁতের গোড়ায় যদি থাকে একটা ভাঙা কণা? যদি থলিতে থাকে সুচের ডগাটিকে সিক্ত করতে লাগে যতটুকু বিষ ততটুকু? কিংবা বিষ গেলে নেওয়ার পর এরই মধ্যে যদি আবার সঞ্চিত হয়ে থাকে? সে আর কতটুকু? ওই দাঁতের ভাঙা কণার মুখটুকু ভিজিয়ে দিতে কতটুকু তরল পদার্থের দরকার হবেপুরো এক বিন্দুরও প্রয়োজন হবে না। এক বিন্দুর ভগ্নাংশ। বেদের মেয়ে শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বললে—ডর লাগছে? দাও, জড়িটা আমাকে দাও। জড়িটা নিয়ে সে হাতখানা এগিয়ে নিয়ে গেল। আশ্চর্য! সাপটার ফণা সংকুচিত হয়ে গেল, দেখতে দেখতে সাপটা যেন শিথিলদেহ হয়ে। ঝাঁপির ভিতর নেতিয়ে পড়ে গেল। মানুষ যেমন অজ্ঞান হয়ে যায় তেমনি, ঠিক তেমনিভাবে। –ধর, ইবার তুমি ধর। শিবরামের হাতে শিকড়টা দিয়ে এবার শবলা যা করলে শিবরাম তা কল্পনাও করতে পারেন। নি। আর একটা ঝাঁপি খুলে এক উদ্যতফণা সাপ ধরে হঠাৎ শিবরামের হাতের উপর চাপিয়ে দিলে। সাপের শীতল স্পর্শ। স্পর্শটা শুধু ঠাণ্ডাই নয়, ওর সঙ্গে আরও কিছু আছে। সাপের ত্বকের মসৃণতার একটা ক্রিয়া আছে। শিবরাম নিজেও যেন সাপটার মত শিথিলদেহ হয়ে যাচ্ছিলেন। তবু প্রাণপণে আত্মসংবরণ করলেন। শবলা ছেড়ে দিলে সাপটাকে; সেটা ঝুলতে লাগল। শিবরামের হাতের উপর নিপ্ৰাণ ফুলের মালার মত। আশ্চর্য! শিবরাম বলেন—সে এক বিস্ময়কর ভেষজ বাবা। সমস্ত জীবনটা এই ওষুধ কত খুঁজেছি, পাই নি। বেদেদের জিজ্ঞাসা করেছি—তারা বলে নি। তারা বলে—কোথা পাবেন বাবা এমন ওষুধ? আপনাকে কে মিথ্যে কথা বলেছে। শিবরাম শবলার নাম বলতে পারেন নি। বারণ করেছিল শবলা। বলেছিল–ই ওষুদ তুমি কখুনও বেদেকুলের ছামনে বার করিও না। তারা জানলি পর আমার জীবনটা যাবে। পঞ্চায়েত বসবে, বিচার করে বুলবে—বেটিটা বিশ্বাস ভেঙেছে, বেদেদের লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে পরকে দিয়েছে। এই জড়ি যদি অন্যে পায় তবে আর বেদের রইল কি? বেদের ছামনে সাপ মাথা নামায়, তিল পরিমাণ পরান থাকলে বেদের ওষুদে ফিরে, সেই জন্যেই মান্যি বেদের। নইলে আর কিসের মানি! কুলের লক্ষ্মীকে যে বিয়ে দেয়, মরণ হল তার সাজা। মেরে ফেলাবে আমাকে। শিবরাম কোনো বেদের কাছে আজও নাম করেন নি শবলার। কখনও দেখান নি সেই জড়ি। ওদিকে বেলা পড়ে আসছিল; গঙ্গার পশ্চিম কূলে ঘন জঙ্গলের মাথার মধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে। দ্বিপ্রহর শেষ ঘোষণা করে দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ পাখিরা কলকল করে ডেকে উঠল; গাছের ঘনপল্লবের ভিতর থেকে কাকগুলো রাস্তায় নামছে। শিবরাম চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আচার্য ফিরবেন এইবার। —তুমি এমন করছ ক্যানে? এমন চঞ্চল হল্যা ক্যানে গ? —তুমি এবার যাও শবলা, কবিরাজ মশাই এবার ফিরবেন। কবিরাজ বারণ করে দিয়েছেন। শিষ্যদের সাবধান বাবা, বেদেদের মেয়েদের সম্পর্কে তোমরা সাবধান। ওরা সাক্ষাৎ মায়াবিনী। শবলা ঝাঁপি গুটিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল বেরিয়ে। কিন্তু আবার ফিরে এল। —কি শবলা? –একটি জিনিস দিবা ভাই? –কি বল? শবলা ইতস্তত করে মৃদুস্বরে প্রার্থিত দ্রব্যের নাম করলে। চমকে উঠলেন শিবরাম। সর্বনাশ! ঐ সর্বনাশী বলে কি? শিবরাম শিউরে বলে উঠলেন নানা-না। সে পারব না। সে পারব না। সে আমি— মিথ্যে কথাটা মুখ দিয়ে বের হল না তাঁর। বলতে গেলেন—সে আমি জানি না। কিন্তু জানি না কথাটা উচ্চারণ করতে পারলেন না। শবলা তাঁর কাছে নরহত্যার বিষ চেয়েছে ওষুধের নামে। মাতৃকুক্ষিতে সদ্যসমাগত সন্তান-হত্যার ভেষজ চেয়েছে সে। যে চোখে স্বপ্ন দেখা মানা, সে চোখে অবাধ্য স্বপ্ন এসে যদি নামে, সে স্বপ্নকে
false
shunil_gongopaddhay
আশ্চর্য কী কথা! এখন দেখছি, এরা ইচ্ছে করেই হোটেলটা খারাপভাবে চালাচ্ছে। যাতে টুরিস্ট বেশি না আসে। কাল মাঝরাতে উঠে দেখি কী, কোথাও আগুন জ্বলছে না। আমার আমলে এটা ভাবাই যেত না। এই রকম করলে টুরিস্ট আসবে কেন? ছমাস বাদে। ওই নিনজানে আর দেশাই আমাকে বলবে, তোমার হোটেল ভাল চলে না। অতএব দাম কমাও! হয়তো অর্ধেকও দাম দেবে না। মিঃ লাফাৰ্গ, তুমিও ব্যবসায়ী, ওরাও ব্যবসায়ী, ব্যবসার ক্ষেত্রে এরকম দরাদরি তো চলেই? এটা দরদরি নয়, স্রেফ জোচুরি। আমি ওদের ফাঁদে পড়ে গেছি। কিন্তু দুজন টুরিস্ট এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে-কথাটা তো ঠিক। তাতে এই জায়গাটা সম্পর্কে বদনাম তো রটাবেই। শোনো, ওহে ভারতীয়, এবারে আমি জার্মানিতে গিয়েছিলুম ওই ব্যাপারেই খোঁজখবর নিতে। যে দুজন টুরিস্ট অদৃশ্য হয়ে গেছে, তারা জাতে জার্মান, তাদের পরিচয় আমি জানতে গিয়েছিলুম। কী জানলুম ভাবতে পারো? ওই লোক দুটো ছিল ভাড়াটে গুণ্ডা, যাদের বলে মার্সিনারি, টাকার বিনিময়ে যে-কোনও দেশে গিয়ে ওরা যুদ্ধ করে, মানুষ খুন করে। ম্যানেজার যে বলল, ওদের একজন ছিল গায়ক আর একজন অধ্যাপক? তা হলে এখানে খাতায় নাম লেখার সময় ওরা মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিল। আমি ওদের সম্পর্কে ঠিক খবর নিয়েছি। ওদের সঙ্গে সবসময় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্ৰ থাকত। সুতরাং, ওরা হঠাৎ জন্তু-জানোয়ারের মুখে প্ৰাণ দেবে, তা কি বিশ্বাস করা যায়? তা হলে ওরা গেল কোথায়? নিজেরাই ইচ্ছে করে কোথাও লুকিয়ে আছে? এখানে খোলা জায়গায় কোনও মানুষ চব্বিশ ঘণ্টাও বেঁচে থাকতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আচ্ছা, মিঃ নিনজানে আর মিঃ দেশাইয়ের অন্য কী কী ব্যবসা আছে, তা তুমি জানো? আমি যতদূর জানি, ওরা আগে কখনও হোটেল চালায়নি। পিয়ের লাফর্গ হঠাৎ থেমে গিয়ে কাকাবাবুর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আবার সন্তুকে দেখলেন। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এতসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ, কেন? তুমি কে? কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি একজন টুরিস্ট। আমার ভাইপোকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি। তোমাকে এসব জিজ্ঞেস করেছি, নিছক কৌতূহলে। তুমি এই হোটেলের মালিক, তুমি অনেক কিছু জানবে। আমি কাগজে-কলমে এখনও এই হোটেলের মালিক হলেও আমার কথা কেউ শুনছে না। এই হোটেলে যা সব কাণ্ডকারখানা চলছে, তা তোমার না। জানাই ভাল, জানলে তুমি বিপদে পড়ে যাবে। আমার বিপদে পড়া অভ্যোস আছে। আমি যেখানেই যাই, সেখানেই কিছু না কিছু ঘটে যায়। টাকা-পয়সার ক্ষতি যা হবে হোক। কিন্তু আমার এত পরিশ্রমে গড়া হোটেলটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটাই আমি সহ্য করতে পারছি না। হোটেলটার যদি এরকম বদনাম হয়, তা হলে ভবিষ্যতেও তো আর লোক আসতে চাইবে না। যারা এখন এই হোটেলটি চালাচ্ছে, তাদেরও তো এই দিকটা চিন্তা করা উচিত। হোটেলের ম্যানেজারটি তো বেশ কাজের লোক মনে হল। হ্যাঁ, এই নতুন ম্যানেজারটা কাজের লোক তো বটেই। তবে, হোটেল চালানোর চেয়ে অন্য অনেক ব্যাপারে তার উৎসাহ বেশি! তবে, তোমাকে আবার বলছি, তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে যেও না। মাথা থাকলেই মাথা ঘামাতে হয়, এই তো মুশকিল! তুমি হ্যারি ওটাংগোর নাম শুনেছ? তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল জানো? এবারে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। কয়েক মুহূর্ত ওই বুড়ো হোটেল-মালিকের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, হ্যারি ওটাংগো…হ্যাঁ, তার কথা আমি জানি। কারিযুকির কথাও আমি জানি। আমি ওইরকমই কিছু সন্দেহ করেছিলাম। তুমি মনে করিয়ে দিলে, সেজন্য ধন্যবান। অনেক ধন্যবাদ! বৃদ্ধটি বললেন, আমি তোমাকে সাবধান করছি, এখানকার কোনও ব্যাপারে মাথা গলিও না। তুমি বিদেশি, তুমি কিছুই করতে পারবে না। বেড়াতে এসেছি, বেড়াও, ফিরে যাও! বৃদ্ধ টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। কাকাবাবু এক মনে কফিতে চুমুক দিতে লাগলেন। পাশের টেবিলে আমেরিকান ছেলেমেয়ে দুটি বসেছে। কাল ওরা খুব হাসিখুশি ছিল, আজ সকালে বেশ গভীর। কেউ কোনও কথা বলছে না। ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে নাকি? সন্তু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, গুড মর্নিং। কাল রাত্তিরে ঘুম হয়েছিল? মেয়েটি বলল, মর্নিং! হ্যাঁ, না, ঠিক ঘুম হয়নি; অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম, তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম…তোমরা কাল রাত্তিরে তাঁবুর মধ্যে একটা মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিলে? সন্তু বলল, মিষ্টি গন্ধ? কই, না তো! আমেরিকান ছেলেটি বলল, গন্ধটা আমিও পেয়েছি। এ-রকম কোনও জন্তু আছে কি না জিজ্ঞেস করতে হবে, যার গা থেকে মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ বেরোয়। ওই গন্ধটা নাকে আসার পর আমার গা গুলোচ্ছিল, সকালেও বমি-বমি পাচ্ছে। মেয়েটি বলল, আমার তো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। চলো, আজই চলে যাই। ছেলেটি বলল, দ্যাখো, একটু বাদে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আজকের দিনটা অন্তত থাকি। মেয়েটি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়তেই ছেলেটও তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেল কাকাবাবু কোটের পকেট থেকে একটা বই বার করে পড়তে লাগলেন মন দিয়ে। দূরে আর-একটা টেবিলে ম্যানেজার ফিলিপের সঙ্গে গুনার ওলেন গল্প করছেন। সন্তুকে তিনি হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। সন্তু উঠে গেল ওদের টেবিলে। ম্যানেজার ফিলিপ একটা চেয়ার টেনে বসতে দিল তাকে। গুনার ওলেন হাসতে হাসতে বললেন, বুড়ো হোটেল-মালিকের সঙ্গে এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিল তোমাদের? আমি তো ওই বুড়োটার কাছে ঘেঁষি না। বড় বেশি কথা বলে। ফিলিপ বলল, উনি লোক ভাল। তবে ইদানীং মাথায় একটু গোলমাল হয়েছে বোধহয়। হোটেলটা বিক্রি করার ব্যবস্থা করে উনি কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। কদিন বাদে আমাদের সরকার এমনিই এটা দখল করে নিত, তখন উনি একটাও পয়সা পেতেন না। পিয়ের লাফাৰ্গকে সন্তুর বেশ পছন্দ
false
robindronath
আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিহারী কোথায় গেল।” আমি বলিলাম, “তিনি বিশেষ কাজে গেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফিরিবার কথা আছে।” তাহার পর হইতে তিনি থাকিয়া থাকিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। মুখে কিছুই বলেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন কাহার অপেক্ষা করিতেছেন। কাল তোমার টেলিগ্রাম পাইয়া জানাইলাম, আজ তুমি আসিবে। শুনিয়া তিনি আজ তোমার জন্য বিশেষ করিয়া খাবার আয়োজন করিতে বলিয়াছেন। তুমি যাহা যাহা ভালোবাস, সমস্ত আনিতে দিয়াছেন, সম্মুখের বারান্দায় রাঁধিবার আয়োজন করাইয়াছেন, তিনি ঘর হইতে দেখাইয়া দিবেন। ডাক্তারের নিষেধ কিছুতেই শুনিলেন না। আমাকে এই খানিকক্ষণ হইল ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “বউমা, তুমি নিজের হাতে সমস্ত রাঁধিবে, আমি আজ সামনে বসাইয়া বিহারীকে খাওয়াইব। ” শুনিয়া বিহারীর চোখ ছলছল করিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মা আছেন কেমন।” আশা কহিল, “তুমি একবার নিজে দেখিবে এসো–আমার তো বোধ হয়, ব্যামো আরো বাড়িয়াছে।” তখন বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্র বাহিরে দাঁড়াইয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। আশা বাড়ির কর্তৃত্ব অনায়াসে গ্রহণ করিয়াছে–সে মহেন্দ্রকে কেমন সহজে ঘরে ঢুকিতে নিষেধ করিল। না করিল সংকোচ, না করিল অভিমান। মহেন্দ্রের বল আজ কতখানি কমিয়া গেছে। সে অপরাধী, সে বাহিরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল–মার ঘরেও ঢুকিতে পারিল না। তাহার পরে ইহাও আশ্চর্য–বিহারীর সঙ্গে আশা কেমন অকুন্ঠিতভাবে কথাবার্তা কহিল। সমস্ত পরামর্শ তাহারই সঙ্গে। সেই আজ সংসারের একমাত্র রক্ষক, সকলের সুহৃৎ। তাহার গতিবিধি সর্বত্র, তাহার উপদেশেই সমস্ত চলিতেছে। মহেন্দ্র কিছুদিনের জন্য যে-জায়গাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেছে, ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সে-জায়গা ঠিক আর তেমনটি নাই। বিহারী ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী তাঁহার করুণ চক্ষু তাহার মুখের দিকে রাখিয়া কহিলেন, “বিহারী, ফিরিয়াছিস?” বিহারী কহিল, “হাঁ, মা, ফিরিয়া আসিলাম।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোর কাজ শেষ হইয়া গেছে?” বলিয়া তাহার মুখের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে চাহিলেন। বিহারী প্রফুল্লমুখে “হাঁ মা, কাজ সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন আমার আর-কোনো ভাবনা নাই” বলিয়া একবার বাহিরের দিকে চাহিল। রাজলক্ষ্মী। আজ বউমা তোমার জন্য নিজের হাতে রাঁধিবেন, আমি এখান হইতে দেখাইয়া দিব। ডাক্তার বারণ করে–কিন্তু আর বারণ কিসের জন্য, বাছা। আমি কি একবার তোদের খাওয়া দেখিয়া যাইব না। বিহারী কহিল, “ডাক্তারের বারণ করিবার তো কোনো হেতু দেখি না, মা–তুমি না দেখাইয়া দিলে চলিবে কেন। ছেলেবেলা হইতে তোমার হাতের রান্নাই আমরা ভালোবাসিতে শিখিয়াছি–মহিনদার তো পশ্চিমের ডালরুটি খাইয়া অরুচি ধরিয়া গেছে–আজ সে তোমার মাছের ঝোল পাইলে বাঁচিয়া যাইবে। আজ আমরা দুই ভাই ছেলেবেলাকার মতো রেষারেষি করিয়া খাইব, তোমার বউমা অন্নে কুলাইতে পারিলে হয়।” যদিচ রাজলক্ষ্মী বুঝিয়াছিলেন, বিহারী মহেন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, তবু তাহার নাম শুনিতেই তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া নিশ্বাস ক্ষণকালের জন্য কঠিন হইয়া উঠিল। সে-ভাবটা কাটিয়া গেলে বিহারী কহিল, “পশ্চিমে গিয়া মহিনদার শরীর অনেকটা ভালো হইয়াছে। আজ পথের অনিয়মে সে একটু মলান আছে, স্নানাহার করিলেই শুধরাইয়া উঠিবে।” রাজলক্ষ্মী তবু মহেন্দ্রের কথা কিছু বলিলেন না। তখন বিহারী কহিল, “মা, মহিনদা বাহিরেই দাঁড়াইয়া আছে, তুমি না ডাকিলে সে তো আসিতে পারিতেছে না।” রাজলক্ষ্মী কিছু না বলিয়াই দরজার দিকে চাহিলেন। চাহিতেই বিহারী ডাকিল, “মহিনদা, এসো।” মহেন্দ্র ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। পাছে হৃৎপিণ্ড হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায়, এই ভয়ে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখের দিকে তখনই চাহিতে পারিলেন না। চক্ষু অর্ধনিমীলিত করিলেন। মহেন্দ্র বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল। মহেন্দ্র মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পা ধরিয়া পড়িয়া রহিল। বক্ষের স্পন্দনে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে অন্নপূর্ণা ধীরে ধীরে কহিলেন, “দিদি, মহিনকে তুমি উঠিতে বলো, নহিলে ও উঠিবে না।” রাজলক্ষ্মী কষ্টে বাক্যস্ফুরণ করিয়া কহিলেন, “মহিন ওঠ্‌।” মহিনের নাম উচ্চারণমাত্র অনেক দিন পরে তাঁহার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রু পড়িয়া তাঁহার হৃদয়ের বেদনা লঘু হইয়া আসিল। তখন মহেন্দ্র উঠিয়া মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া খাটের উপর বুক দিয়া তাহার মার পাশে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী কষ্টে পাশ ফিরিয়া দুই হাতে মহেন্দ্রের মাথা লইয়া তাহার মস্তক আঘ্রাণ করিলেন, তাহার ললাট চুম্বন করিলেন। মহেন্দ্র রুদ্ধকন্ঠে কহিল, “মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে মাপ করো।” বক্ষ শান্ত হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও কথা বলিস নে মহিন, আমি তোকে মাপ না করিয়া কি বাঁচি। বউমা, বউমা কোথায় গেল।” আশা পাশের ঘরে পথ্য তৈরি করিতেছিল–অন্নপূর্ণা তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন। তখন রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ভূতল হইতে উঠিয়া তাঁহার খাটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। মহেন্দ্র খাটে বসিলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের পার্শ্বে স্থান-নির্দেশ করিয়া আশাকে কহিলেন, “বউমা, এইখানে তুমি বসো–আজ আমি একবার তোমাদের দুজনকে একত্রে বসাইয়া দেখিব, তাহা হইলে আমার সকল দুঃখ ঘুচিবে। বউমা, আমার কাছে আর লজ্জা করিয়ো না–আর মহিনের ‘পরেও মনের মধ্যে কোনো অভিমান না রাখিয়া একবার এইখানে বসো–আমার চোখ জুড়াও মা।” তখন ঘোমটা-মাথায় আশা লজ্জায় ধীরে ধীরে আসিয়া কম্পিতবক্ষে মহেন্দ্রের পাশে গিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী স্বহস্তে আশার ডান হাত তুলিয়া লইয়া মহেন্দ্রের ডান হাতে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন–কহিলেন, “আমার এই মাকে তোর হাতে দিয়া গেলাম, মহিন–আমার এই কথাটি মনে রাখিস, তুই এমন লক্ষ্মী আর কোথাও পাবি নে। মেজোবউ, এসো, ইহাদের একবার আশীর্বাদ করো-তোমার পুণ্যে ইহাদের মঙ্গল হউক।” অন্নপূর্ণা সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই উভয়ে চোখের জলে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল। অন্নপূর্ণা উভয়ের মস্তকচুম্বন করিয়া কহিলেন, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।” রাজলক্ষ্মী। বিহারী, এসো বাবা, মহিনকে তুমি একবার ক্ষমা করো। বিহারী তখনই মহেন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াতেই মহেন্দ্র উঠিয়া দৃঢবাহু দ্বারা বিহারীকে
false
shomresh
বলে মনে হয় তাহলে বলতে হবে তুমি সৌন্দর্যের মানেই বোঝ না। একটুও উত্তেজিত না হয়ে কথাগুলো বলল দীপাবলী। এই বোঝাটা ব্যক্তিবিশেষে তফাত হয়, হয় না? তবু তার একটা সীমা থাকে। তুমিও পাল্টাওনি। একই রকম অহঙ্কারী রয়ে গেলে। দীপাবলী ঠোঁট কামড়ালো। তার মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনেই। এরা সবাই যখন তাকে অহঙ্কারী বলে তখন তাতে একটু তেতো মিশে থাকে। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে ফুটপাত দেখল সে। কোন মতে নিজেকে সামলে নিল একসময়। কথা বলতে আর ভাল লাগছে না। এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে একই কথা আওড়াতে হবে। মুখ ফিরিয়ে দীপাবলীকে দেখে অসীমও বুঝেছিল ব্যাপারটা। সের আর কথা না বলে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল। কিন্তু মাঝে মাঝে আড়চোখে দীপাবলীকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারল না। হঠাৎ দীপাবলী নড়েচড়ে বসল। তার মনে হল সে কেন। অসীমের সঙ্গে চা খেতে যাচ্ছে? যে কোন সিনেমা হলে ঢুকে সময় কাটাতে পারত। অসীম তার কাছে আলাদা গুরুত্ব পাবে কেন? যে কেউ চা খেতে বললে তার সঙ্গে চলে যেতে হবে।কিন্তু এখন গাড়ি থামাতে বলে নেমে গেলে খুব নাটকীয় হবে। অন্তত অসীমের শেষ কথার পর। হয়তো এই মনে হওয়াটাও ওই কথা শোনার প্রতিক্রিয়া। মিডলটন রোডে গাড়ি পার্ক করে অসীম যে সহজ ভঙ্গিতে ফুরিসে ঢুকল তাতে বোঝা গেল এখানে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে। মুখোমুখি বসার পর সে বেয়ারাকে বলল, আব্দুল, কি খাওয়াতে পার বল? আব্দুল জবাব দেবার আগেই দীপাবলী বলল, আমি শুধু চা খাব। হাত তুলল অসীম, শুধু চা কেন? এখানে যখন এসেছ তখন নিদেনপক্ষে প্যাস্ট্রি খাও। এদের প্যাস্ট্রি কলকাতার সেরা। নাঃ, শুধু চা। সেটাই আব্দুলকে আনতে বলে অসীম হাসল, আমার কথায় সেই যে রেগেছ এখনও তার কোন উপশম হল না। আগে হল তর্ক করতে। এখন কিছু করার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে। বাঃ। এটা একটা পরিবর্তন। কলকাতায় কোথায় আছ? মায়ার বাপের বাড়িতে ঘর ভাড়া করে আছি। একা? হাসল দীপাবলী, সেটাই তো আমার স্বভাব। তোমার খবর বল। এই তো, ব্যবসা করছি। বিয়ে করছে তো? নাঃ। এত জোর দিয়ে না বললে! ইচ্ছে হয়নি বলব না, হয়েছে, কিন্তু করা হয়নি। আর বয়স তো খুব বেশী নয়। এই প্ৰথম অসীমকে ভাল লাগল দীপাবলীর। সহজ কথাটা স্বাভাবিকভাবে বলতে পারায় মনে হল অসীমের সঙ্গে আড্ডা মারা যায়। পূর্বপরিচিতা মেয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলে বেশীর ভাগ ছেলেরা এই বিষয় নিয়ে কিছুটা নাটক করে। অসীম সেই জড়তা দেখাল না। সে বলল, এখানে তোমার নিয়মিত আসার অভ্যেস আছে, না? হ্যাঁ, জায়গাটাকে আমার ভাল লাগে। ভাল দীপাবলীরও লাগছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চায়ের দোকান। টেবিলে টেবিলে যারা বসে গল্প করছে তাদের গলার স্বর নিচুতেই। আদবকায়দা মানা ভদ্ৰ সভ্য মানুষেরা কোনরকম বেপরোয়া ছবি তৈরি করছেন না। ক্লান্তির পর এই নরম ঠাণ্ডায় বসতে খুব আরাম হচ্ছিল। একটা মেনুকার্ড টেবিলে রাখা ছিল। সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠল দীপাবলী। চায়ের পট পাঁচ টাকা? তাও দুকাপের বেশী থাকবে না। কফি হাউসে এক কাপ কফি পঞ্চাশ পয়সায় পাওয়া যায়। বসন্ত কেবিনের চা আরও শস্তা। পকেটে কি পরিমাণ পয়সা থাকলে লোকে এখানে আসতে পারে। সে বিস্ময় প্রকাশ না করে পারল না। অসীম বলল, আসলে এরা যে মানের চা দেয় তা মধ্যবিত্ত কোন রেস্টুরেন্টে পাবে না। যে আরামে বসে তুমি সময় কাটাচ্ছ তার জন্যেও তো একটা দাম দেওয়া উচিত। তুমি যদি আরাম করতে চাও তাহলে তার জন্যে উপযুক্ত দাম তো দিতেই হবে। আমরা সাধারণ মানুষ, দাম দেখলেই চমকে উঠি। আমি অসাধারণ নই কিন্তু, তবে একটু আরামে থাকার চেষ্টা করি। কেউ কেউ প্রচুর রোজগার করেন কিন্তু তাঁদের এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে ইচ্ছে থাকলেও পয়সা খরচ করতে পারে না। যদি কখনও টাকা পকেটে না থাকে তাহলে এখানে আসব না কিন্তু তাই বলে আফসোসও করব না। বাঃ, চমৎকার থিওরি তৈরি করে নিয়েছ তো। দীপাবলী হাসল, মনে হচ্ছে এর মধ্যেই তুমি সাফল্যের সুবিধেগুলো রপ্ত করে ফেলেছ। মদ খাও? খাই না বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে লোকে যেমন পায়েস খায় তেমনি আমি মদ খাই। অসীম চা আসছে দেখে একটু সরে বসল। পায়েস খাওয়ার সঙ্গে মদের কি সম্পর্ক? হাসল অসীম, বাঙালি পায়েস খায় জন্মদিনে আর শীত পড়লে। বাকি মাসগুলোতে সচরাচর কেউ পায়েস রাঁধে না। আমারও তেমনি বড় অর্ডার পেতে পার্টি দিলে বা তেমন কেউ নেমন্তন্ন করলে হাতে মদের গ্লাস তুলতেই হয়। কিন্তু মদ খাওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পাই। অবশ্য সেরকম ব্যাপার বছরে কয়েকবারই ঘটে। আবার ভাল লাগল দীপার। আজ অবধি সে কাউকে বলতে শোনেনি যে সে মদ খায়। বাঙালির মদ লুকোবার সহজাত প্রবণতা আছে। যে শমিত অমন বেপরোয়া সে যখন নেখালিতে গিয়ে দিশি মদ গিলেছে তখন বোঝাই যায় কলকাতায় তার মদ খাওয়ার অভ্যেস ছিল। কিন্তু কখনই তার কথাবার্তায় সেটা আগে বুঝতে দেয়নি। হয়তো অসীম প্রচুর পরিমাণে খায়, নিজেকে ঢাকতে আগেভাগে স্বীকার করে ভদ্র সাজতে চাইছে। কিন্তু তাই বা কজন করে। আর তখনই তার চোখের সামনে অর্জুন নায়েকের মুখ ভেসে উঠল। সন্ধে নামলে যে লোকটা মদ ছাড়া থাকতে পারে না, মদ খাওয়ার ব্যাপারে যার কোন লাজলজ্জা নেই তাকে সে কোন পর্যায়ে ফেলবে? অর্জুনের চোখমুখের ওপর সুরার ছাপ পড়েছে। চোখের তলায়
false
bongkim
দেখিতে আসিল। সুন্দরী শৈবলিনীর মৃত্যুসম্বাদ শুনিয়া নিতান্ত দুঃখিতা হইল, কিন্তু বলিল, “যাহা হইবার তাহা হইয়াছে। কিন্তু শৈবলিনী এখন সুখী হইল। তাহার বাঁচা অপেক্ষা মরাই যে সুখের, তা আর কোন্ মুখে না বলিব?” প্রতাপ, রূপসী ও সুন্দরীর সাক্ষাতের পর, পুনর্বার গৃহত্যাগ করিয়া গেলেন। অচিরাৎ দেশে দেশে রাষ্ট্র হইল যে, মুঙ্গের হইতে কাটোয়া পর্যন্ত যাবতীয় দস্যু ও লাঠিয়াল দলবদ্ধ হইতেছে, প্রতাপ রায় তাহাদিগকে দলবদ্ধ করিতেছে। শুনিয়া গুর্গ ণ খাঁ চিন্তাযুক্ত হইলেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : শৈবলিনী কি করিল মহান্ধকারময় পর্বতগুহা—পৃষ্ঠচ্ছেদী উপলশয্যায় শুইয়া শৈবলিনী। মহাকায় পুরুষ, শৈবলিনীকে তথায় ফেলিয়া দিয়া গিয়াছেন। ঝড় বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছে—কিন্তু গুহামধ্যে অন্ধকার—কেবল অন্ধকার—অন্ধকারে ঘোরতর নিঃশব্দ। নয়ন মুদিলে অন্ধকার—চক্ষু চাহিলে তেমনই অন্ধকার। নিঃশব্দ—কেবল কোথাও পর্বতস্থ রন্ধ্রপথে বিন্দু বিন্দু বারি গুহাতলস্থ শিলার উপর পড়িয়া, ক্ষণে ক্ষণে টিপ্ টাপ্ শব্দ করিতেছে। আর যেন কোন জীব, মনুষ্য কি পশু—কে জানে?—সেই গুহামধ্যে নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে। এতক্ষণে শৈবলিনী ভয়ের বশীভূতা হইলেন। ভয়? তাহাও নহে। মনুষ্যের স্থিরবুদ্ধিতার সীমা আছে—শৈবলিনী সেই সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন। শৈবলিনীর ভয় নাই—কেন না, জীবন তাঁহার পক্ষে অবহনীয়, অসহনীয় ভার হইয়া উঠিয়াছিল—ফেলিতে পারিলেই ভাল। বাকি যাহা—সুখ, ধর্ম, জাতি, কুল, মান, সকলই গিয়াছিল— আর যাইবে কি? কিসের ভয়? কিন্তু শৈবলিনী আশৈশব, চিরকাল যে আশা হৃদয়মধ্যে সযত্নে, সঙ্গোপনে পালিত করিয়াছিল, সেই দিন বা তাহার পূর্বেই, তাহার উচ্ছেদ করিয়াছিল; যাহার জন্য সর্বত্যাগিনী হইয়াছিল, এক্ষণে তাহাও ত্যাগ করিয়াছে; চিত্ত নিতান্ত বিকল, নিতান্ত বলশূন্য। আবার প্রায় দুই দিন অনশন, তাহাতে পথশ্রান্তি, পর্বতারোহণশ্রান্তি; বাত্যাবৃষ্টিজনিত পীড়াভোগ; শরীরও নিতান্ত বিকল, নিতান্ত বলশূন্য; তাহার পর এই ভীষণ দৈব ব্যাপার—দৈব বলিয়াই শৈবলিনীর বোধ হইল—মানবচিত্ত আর কতক্ষণ প্রকৃতিস্থ থাকে? দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল, মন ভাঙ্গিয়া পড়িল—শৈবলিনী অপহৃতচেতনা হইয়া অর্ধনিদ্রাভিভূত, অর্ধজাগ্রতাবস্থায় রহিল। গুহাতলস্থ উপলখণ্ড সকলে পৃষ্ঠদেশ ব্যথিত হইতেছিল। সম্পূর্ণরূপে চৈতন্য বিলুপ্ত হইলে, শৈবলিনী দেখিল, সম্মুখে এক অনন্তবিস্তৃতা নদী। কিন্তু নদীতে জল নাই—দু-কূল প্লাবিত করিয়া রুধিরের স্রোতঃ বহিতেছে। তাহাতে অস্থি, গলিত নরদেহ, নৃমুণ্ড, কঙ্কালাদি ভাসিতেছে। কুম্ভীরাকৃত জীব সকল—চর্ম মাংসাদি-বর্জিত-কেবল অস্থি, ও বৃহৎ, ভীষণ, উজ্জ্বল চক্ষুর্দ্বয়বিশিষ্ট—ইতস্ততঃ বিচরণ করিয়া সেই সকল গলিত শব ধরিয়া খাইতেছে। শৈবলিনী দেখিল যে, যে মহাকায় পুরুষ তাহাকে পর্বত হইতে ধৃত করিয়া আনিয়াছে, সেই আবার তাহাকে ধৃত করিয়া সেই নদীতীরে আনিয়া বসাইল। সে প্রদেশে রৌদ্র নাই, জ্যোৎস্না নাই, তারা নাই, মেঘ নাই, আলোক মাত্র নাই—অথচ অন্ধকার নাই। সকলই দেখা যাইতেছে—কিন্তু অস্পষ্ট। রুধিরের নদী, গলিত শব, স্রোতোবাহিত কঙ্কালমালা, অস্থিময় কুম্ভীরগণ, সকলই ভীষণান্ধকারে দেখা যাইতেছে। নদীতীরে বালুকা নাই—তৎপরিবর্তে লৌহসূচী সকল অগ্রভাগ ঊর্ধ্ব করিয়া রহিয়াছে। শৈবলিনীকে মহাকায় পুরুষ সেইখানে বসাইয়া নদী পার হইতে বলিলেন। পারের কোন উপায় নাই। নৌকা নাই, সেতু নাই। মহাকায় পুরুষ বলিলেন, সাঁতার দিয়া পার হ, তুই সাঁতার জানিস—গঙ্গায় প্রতাপের সঙ্গে অনেক সাঁতার দিয়াছিস। শৈবলিনী এই রুধিরের নদীতে কি প্রকারে সাঁতার দিবে? মহাকায় পুরুষ তখন ইতস্থিত বেত্র প্রহার জন্য উত্থিত করিলেন। শৈবলিনী সভয়ে দেখিল যে, সেই বেত্র জ্বলন্ত লোহিত লৌহনির্মিত। শৈবলিনীর বিলম্ব দেখিয়া, মহাকায় পুরুষ শৈবলিনীর পৃষ্ঠে বেত্রাঘাত করিতে লাগিলেন। শৈবলিনী প্রহারে দগ্ধ হইতে লাগিল। শৈবলিনী প্রহার সহ্য করিতে না পারিয়া রুধিরের নদীতে ঝাঁপ দিল। অমনি অস্থিময় কুম্ভীর সকল তাহাকে ধরিতে আসিল, কিন্তু ধরিল না। শৈবলিনী সাঁতার দিয়া চলিল; রুধিরস্রোতঃ বদনমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। মহাকায় পুরুষ তাহার সঙ্গে সঙ্গে রুধিরস্রোতের উপর দিয়া পদব্রজে চলিলেন—ডুবিলেন না। মধ্যে মধ্যে পূতিগন্ধবিশিষ্ট গলিত শব ভাসিয়া আসিয়া শৈবলিনীর গাত্রে লাগিতে লাগিল। এইরূপে শৈবলিনী পরপারে উপস্থিত হইল। সেখানে কূলে উঠিয়া চাহিয়া দেখিয়া, “রক্ষা কর! রক্ষা কর” বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। সম্মুখে যাহা দেখিল, তাহার সীমা নাই, আকার নাই, বর্ণ নাই, নাম নাই। তথায় আলোক অতি ক্ষীণ, কিন্তু এতাদৃশ উত্তপ্ত যে, তাহা চক্ষে প্রবেশ মাত্র শৈবলিনীর চক্ষু বিদীর্ণ হইতে লাগিল—বিষসংযোগে যেরূপ জ্বালা সম্ভব, চক্ষে সেইরূপ জ্বালা ধরিল। নাসিকায় এরূপ ভয়ানক পূতিগন্ধ প্রবেশ করিল যে, শৈবলিনী নাসিকা আবৃত করিয়াও উন্মত্তার ন্যায় হইল। কর্ণে, অতি কঠোর, কর্কশ, ভয়াবহ শব্দ সকল এককালে প্রবেশ করিতে লাগিল—হৃদয়-বিদারক আর্তনাদ, পৈশাচিক হাস্য, বিকট হুঙ্কার, পর্বতবিদারণ, অশনিপতন, শিলাঘর্ষণ, জলকল্লোল, অগ্নিগর্জন, মুমূর্ষুর ক্রন্দন, সকলই এককালে শ্রবণ বিদীর্ণ করিতে লাগিল। সম্মুখ হইতে ক্ষণে ক্ষণে ভীমনাদে এরূপ প্রচণ্ড বায়ু বহিতে লাগিল যে, তাহাতে শৈবলিনীকে অগ্নিশিখার ন্যায় দগ্ধ করিতে লাগিল—কখন বা শীতে শতসহস্র ছুরিকাঘাতের ন্যায় অঙ্গ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিতে লাগিল। শৈবলিনী ডাকিতে লাগিল, “প্রাণ যায়! রক্ষা কর!” তখন অসহ্য পূতিগন্ধবিশিষ্ট এক বৃহৎ কদর্য কীট আসিয়া শৈবলিনীর মুখে প্রবেশ করিতে প্রবৃত্ত হইল। শৈবলিনী তখন চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, “রক্ষা কর! এ নরক! এখান হইতে উদ্ধারের কি উপায় নাই?” মহাকায় পুরুষ বলিলেন, “আছে ।” স্বপ্নাবস্থায় আত্মকৃত চীৎকারে শৈবলিনীর মোহনিদ্রা ভঙ্গ হইল। কিন্তু তখনও ভ্রান্তি যায় নাই—পৃষ্ঠে প্রস্তর ফুটিতেছে। শৈবলিনী ভ্রান্তিবেশে জাগ্রতেও ডাকিয়া বলিল, “আমার কি হবে! আমার উদ্ধারের কি উপায় নাই?” গুহামধ্য হইতে গম্ভীর শব্দ হইল, “আছে ।” এ কি এ? শৈবলিনী কি সত্যসত্যই নরকে? শৈবলিনী বিস্মিত, বিমুগ্ধ, ভীতচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল, “কি উপায়?” গুহামধ্য হইতে উত্তর হইল, “দ্বাদশবার্ষিক ব্রত অবলম্বন কর ।” এ কি দৈববাণী? শৈবলিনী কাতর হইয়া বলিতে লাগিল, “কি সে ব্রত? কে আমায় শিখাইবে?” উত্তর—আমি শিখাইব। শৈ। তুমি কে? উত্তর—ব্রত গ্রহণ কর। শৈ। কি করিব? উত্তর—তোমার ও চীনবাস ত্যাগ করিয়া, আমি যে বসন দিই, তাই পর। হাত বাড়াও। শৈবলিনী হাত বাড়াইল। প্রসারিত হস্তের উপর একখণ্ড
false
shirshendu
না তোমরা! কে বিশ্বাস করবে রেমি যে, নিতান্তই ধ্রুবকে আকর্ষণ করার জন্য তুমি রাজাকে অত প্রশ্রয় দিয়েছিলে! কেউ করবে না। আমি মস্ত একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তার ফল কী হল? সবাই বিশ্বাস করল, রাজা আর আমি প্রেমে পড়েছি। কিন্তু যার বিশ্বাস হওয়ার কথা তারই হল না। কে বলো তো! ধ্রুব? হ্যাঁ। সারাজীবন সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কষ্ট কী জানো? অবহেলা? ঠিক। অবহেলা। সে বিশ্বাসই করল না যে, আমি রাজার প্রেমে পড়েছি। কিংবা বিশ্বাস করলেও পাত্তা দিল না তেমন। পুরুষ মানুষের দখলদার মন থাকে, দখলের জায়গায় অন্য কেউ হাত বাড়ালে সে গর্জে ওঠে। তবু ও গর্জাল না। আমাকে দখল করতে চায়নি তো কখনও, তাই। একেই তো অবহেলা বলে, না? তুমি বড় নির্লজ্জ, রেমি। এই নারী স্বাধীনতার যুগে ওই মদ্যপ, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর ও অপ্রকৃতিস্থ ধ্রুবর সম্মোহন কাটাতে পারলে না। অবোধ মুগ্ধ হয়ে বইলে। তা নয়। তা নয় গো। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ওর মধ্যে কোনও রহস্য আছে কি না। ছেড়ে গেলে তো জানা হত না। ছেড়ে তো যাওনি। জানতে পারলে কি? না। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল। ছদ্মবেশ কিছুতেই খুলতে পারলাম না। ছদ্মবেশ নয় রেমি। ধ্রুবকে সবাই জানে। ও যা, ও তাই। তুমি খামোকা ধানখেতে বেগুন খুঁজতে নেমেছিলে। ওর মধ্যে কোনও রহস্য নেই। ছদ্মবেশও নেই। তবে কেন ওর চোখের মধ্যে আমি এক-এক সময়ে খুব গভীর একটা কিছু লক্ষ করতাম। তোমার মনের ভুল, রেমি। যার প্রতি আমাদের দুর্বলতা থাকে তার মধ্যে আমরা নানা কাল্পনিক গুণ আরোপ করে নিই। না, আমি মানি না। আমি যত বেশি ওকে টের পেতাম তেমন তো কেউ টের পেত না ওকে। তোমরা বুঝবে না গো। অপাত্রে তোমার সব ভালবাসা গেল রেমি, তার চেয়ে রাজাকে একটু ভালবাসলে পারতে। রাজাকে তো বহু মেয়ে ভালবাসত। কত রূপ, কত গুণ। তুমি কেন পারলে না? আমিও বাসতাম। তবে প্রেমিকের মতো নয়। তবে কেমন? যেমন ভাইয়ের ওপর বোনের ভালবাসা। রাজা কিন্তু– জানি। বোলো না গো। তুমি টের পেতে রেমি? পেতাম। প্রথম দিন থেকেই। আর ধ্রুব তোমাকে পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করার উদার অনুমতি দিয়েছিল। তবু পারলে না? বোকার মতো কথা বোলো না। মেয়েমানুষ কোনওদিন কখনও একজন ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষকে ভালবাসতে পারে না। এমনকী এই নারী স্বাধীনতার যুগেও। যাদের দেখো অনেক পুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বা একটা ছেড়ে তিনটে-চারটে বিয়ে করে তারা কাউকেই ভালবাসতে পারেনি কখনও ওরকম হয় না। বলছ একথা বিশ্বাস করতে? বলছি। ভালবাসলে দোষঘাট অত ধরতে চায় না মানুষ। তুমিই না একটু আগে বললে যার ওপর দুর্বলতা থাকে তার ওপর মানুষ কাল্পনিক গুণ আরোপ করতে থাকে! বলেছি। তা হলে? স্বামীর শতেক দোষ থাক। বিবাহ মানে তো বহন। ঠিক সওয়া যায়, বয়ে নেওয়া যায়। তুমি তো পারলে না। কে বলল পারিনি! মরে যাচ্ছি বলে বলছ? সে তো মরতে হতই একদিন। ধ্রুবকে তা হলে তুমি ভালবাসতে রেমি? কী জানি! অত গর্ব করে বলতে পারব না যে, বাসতাম। তবে চেষ্টা করেছি। অন্য কোনও পুরুষকে ভাববার সময় যখন হল না, তখন বুঝে নাও, বাসতাম। আর তার জন্য আর-একটা পুরুষকে ডোবালে? না তো। রাজা ড়ুববে কেন? ভালবাসলেই কি ডোবে? তুমি যে ড়ুবেছ। আমি! সে ঠিক ডোবা নয়। তুমি বুঝবে না গো। আর যদি ড়ুবেই থাকি তা হলে বুঝে নিয়ে আমি ড়ুবতেই চেয়েছিলাম। নানা তরঙ্গ আজ রেমিকে ওলটপালট করে দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে তার শেষ কয়েকটি মুহূর্ত বয়ে যাচ্ছে। কৃপণের ধন। আর-একবার চেতনা ফিরল রেমির। মুখোশ পরা একটা লোক নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। রেমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে গেল। গলার স্বর ফুটল না। অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ হল শুধু। তারপর অন্ধকার হয়ে গেল চেতনা! কেউ বাধা দিল না রাজা আর রেমিকে। ঠিক সদ্য প্রেমে পড়া উদ্দাম দুটি তরুণ তরুণীর মতো তারা বেরিয়ে পড়েছিল আনন্দের হাট লুট করতে। ছিল নৈকট্যের শিহরন, ছিল নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রাকৃত আকর্ষণ, ছিল সুন্দরের প্রতি মুগ্ধতা। সব ছিল। ধ্রুবও ছিল নিষ্ক্রিয় ও উদার প্রশ্রয়দাতা। তবু একদিন রাজা বলেছিল, বউদি, এক কোটি বছর তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরলেও বোধহয় কেউ তোমার মন পাবে না। রেমি অবাক হয়ে বলল, একথার মানে? তুমি রিমোট কন্ট্রোলড এক রোবট মাত্র। তোমার নিজস্ব সত্তা নেই। ও বাবা! কী সব ইংরিজিতে গালাগাল দিচ্ছ গো! গালাগালই বটে। তোমার গায়ে লাগে? গালাগাল দিলে লাগারই তো কথা। না, লাগার কথা নয়। চৌধুরীবাড়ির বউদের চামড়া মোটা হয়ে যায়। তোমারও হয়েছে। কেন বলল তো! কী করে যে এত সহ্য করো জানি না। রেমি মুখ টিপে হাসল একটু। ব্যান্ডেলে বেড়াতে গিয়েছিল তারা। রাজার ফাংশন ছিল। একটু আগেই পৌঁছে তারা বিখ্যাত চার্চ দেখে গঙ্গার ধারে বসেছিল একটু। শীতকালের মন্দস্রোত নদী। আকাশে সাদা রোদ। ফাংশনের কিছু ছেলে পিছু পিছু ঘুরঘুর করছিল প্রথম থেকেই। রাজা তাদের অনেক করে বুঝিয়ে ভাগাল। তারপর হঠাৎ রেমির কাছে ঘন হয়ে বসে বলল, কেন বুঝতে চাইছ না রেমি? কী বুঝতে চাইছি না? এরকম ভাবে চলে না। কীরকম হলে চলবে? তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কী করে বুঝলে? ধ্রুবদা তোমাকে ভালবাসে না। তবে কাকে বাসে? তা জানি না। তবে তোমাকে বাসে না। আমার তা মনে হয় না। তার মানে! তোমার
false
robindronath
প্রথম পরিচ্ছেদ অক্ষয়কুমারের শ্বশুর হিন্দুসমাজে ছিলেন, কিন্তু তাঁহার চালচলন অত্যন্ত নব্য ছিল। মেয়েদের তিনি দীর্ঘকাল অবিবাহিত রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইতেছিলেন। লোকে আপত্তি করিলে বলিতেন, আমরা কুলীন, আমাদের ঘরে তো চিরকালই এইরূপ প্রথা। তাঁহার মৃত্যুর পর বিধবা জগত্তারিণীর ইচ্ছা, লেখাপড়া বন্ধ করিয়া মেয়েগুলির বিবাহ দিয়া নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু তিনি ঢিলা প্রকৃতির স্ত্রীলোক, ইচ্ছা যাহা হয় তাহার উপায় অন্বেষণ করিয়া উঠিতে পারেন না। সময় যতই অতীত হইতে থাকে আর পাঁচজনের উপর দোষারোপ করিতে থাকেন। জামাতা অক্ষয়কুমার পুরা নব্য। শ্যালীগুলিকে তিনি পাস করাইয়া নব্যসমাজের খোলাখুলি মন্ত্রে দীক্ষিত করিতে ইচ্ছুক। সেক্রেটারিয়েটে তিনি বড়োরকমের কাজ করেন, গরমের সময় তাঁহাকে সিমলা পাহাড়ে আপিস করিতে হয়। অনেক রাজঘরের দূত, বড়ো সাহেবের সহিত বোঝাপড়া করাইয়া দিবার জন্য বিপদে-আপদে তাঁহার হাতে-পায়ে আসিয়া ধরে। এই-সকল নানা কারণে শ্বশুরবাড়িতে তাঁহার পসার বেশি। বিধবা শাশুড়ি তাঁহাকেই অনাথা পরিবারের অভিভাবক বলিয়া জ্ঞান করেন। শীতের কয় মাস শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে তিনি কলিকাতায় তাঁহার ধনী শ্বশুরগৃহেই যাপন করেন। সেই কয় মাস তাঁহার শ্যালী-সমিতিতে উৎসব পড়িয়া যায়। সেইরূপ কলিকাতা-বাসের সময় একদা শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী পুরবালার সঙ্গে অক্ষয়কুমারের নিম্নলিখিত মতো কথাবার্তা হয়– পুরবালা। তোমার নিজের বোন হলে দেখতুম কেমন চুপ করে বসে থাকতে! এতদিনে এক-একটির তিনটি-চারটি করে পাত্র জুটিয়ে আনতে! ওরা আমার বোন কিনা– অক্ষয়। মানব-চরিত্রের কিছুই তোমার কাছে লুকোনো নেই। নিজের বোনে এবং স্ত্রীর বোনে যে কত প্রভেদ তা এই কাঁচা বয়সেই বুঝে নিয়েছ। তা ভাই, শ্বশুরের কোনো কন্যাটিকেই পরের হাতে সমর্পণ করতে কিছুতেই মন সরে না– এ বিষয়ে আমার ঔদার্যের অভাব আছে তা স্বীকার করতে হবে। পুরবালা সামান্য একটু রাগের মতো ভাব করিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, “দেখো, তোমার সঙ্গে আমার একটা বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে।” অক্ষয়। একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তো মন্ত্র পড়ে বিবাহের দিনেই হয়ে গেছে, আবার আর-একটা! পুরবালা। ওগো, এটা তত ভয়ানক নয়। এটা হয়তো তেমন অসহ্য না হতেও পারে। অক্ষয় যাত্রার অধিকারীর মতো হাত নাড়িয়া বলিল, “সখী, তবে খুলে বলো!” বলিয়া ঝিঁঝিটে গান ধরিল– কী জানি কী ভেবেছ মনে, খুলে বলো ললনে! কী কথা হায় ভেসে যায় ওই ছলছল নয়নে! এইখানে বলা আবশ্যক, অক্ষয়কুমার ঝোঁকের মাথায় দুটো-চারটে লাইন গান মুখে মুখে বানাইয়া গাহিয়া দিতে পারিতেন। কিন্তু কখনোই কোনো গান রীতিমত সম্পূর্ণ করিতেন না। বন্ধুরা বিরক্ত হইয়া বলিতেন, “তোমার এমন অসামান্য ক্ষমতা, কিন্তু গানগুলো শেষ কর না কেন?” অক্ষয় ফস করিয়া তান ধরিয়া তাহার জবাব দিতেন– সখা শেষ করা কি ভালো? তেল ফুরোবার আগেই আমি নিবিয়ে দেব আলো! এইরূপ ব্যবহারে সকলেই বিরক্ত হইয়া বলে, অক্ষয়কে কিছুতেই পারিয়া উঠা যায় না। পুরবালাও ত্যক্ত হইয়া বলিলেন, “ওস্তাদজি, থামো! আমার প্রস্তাব এই যে দিনের মধ্যে একটা সময় ঠিক করো যখন তোমার ঠাট্টা বন্ধ থাকবে– যখন তোমার সঙ্গে দুটো-একটা কাজের কথা হতে পারবে!” অক্ষয়। গরিবের ছেলে, স্ত্রীকে কথা বলতে দিতে ভরসা হয় না, পাছে খপ্‌ করে বাজুবন্দ চেয়ে বসে। আবার গান– পাছে চেয়ে বসে আমার মন আমি তাই ভয়ে ভয়ে থাকি, পাছে চোখে চোখে পড়ে বাঁধা আমি তাই তো তুলি নে আঁখি। পুরবালা। তবে যাও! অক্ষয়। না না, রাগারাগি না! আচ্ছা, যা বল তাই শুনব! খাতায় নাম লিখিয়ে তোমার ঠাট্টানিবারণী সভার সভ্য হব! তোমার সামনে কোনোরকমের বেয়াদবি করব না! তা, কী কথা হচ্ছিল! শ্যালীদের বিবাহ! উত্তম প্রস্তাব! পুরবালা গম্ভীর বিষণ্ন হইয়া কহিল, “দেখো, এখন বাবা নেই। মা তোমারই মুখ চেয়ে আছেন। তোমারই কথা শুনে এখনো তিনি বেশি বয়স পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এখন যদি সৎপাত্র না জুটিয়ে দিতে পার তা হলে কী অন্যায় হবে ভেবে দেখো দেখি!” অক্ষয় দুর্লক্ষণ দেখিয়া পূর্বাপেক্ষা কথঞ্চিৎ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “আমি তো তোমাকে বলেইছি তোমরা কোনো ভাবনা কোরো না। আমার শ্যালীপতিরা গোকুলে বাড়ছেন।” পুরবালা। গোকুলটি কোথায়? অক্ষয়। যেখান থেকে এই হতভাগ্যকে তোমার গোষ্ঠে ভরতি করেছ। আমাদের সেই চিরকুমার-সভা। পুরবালা সন্দেহ প্রকাশ করিয়া কহিল, “প্রজাপতির সঙ্গে তাদের যে লড়াই!” অক্ষয়। দেবতার সঙ্গে লড়াই করে পারবে কেন? তাঁকে কেবল চটিয়ে দেয় মাত্র। সেইজন্যে ভগবান প্রজাপতির বিশেষ ঝোঁক ঐ সভাটার উপরেই। সরাচাপা হাঁড়ির মধ্যে মাংস যেমন গুমে গুমে সিদ্ধ হতে থাকে– প্রতিজ্ঞার মধ্যে চাপা থেকে সভ্যগুলিও একেবারে হাড়ের কাছ পর্যন্ত নরম হয়ে উঠেছেন– দিব্যি বিবাহযোগ্য হয়ে এসেছেন– এখন পাতে দিলেই হয়। আমিও তো এক কালে ঐ সভার সভাপতি ছিলুম! আনন্দিতা পুরবালা বিজয়গর্বে ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কিরকম দশাটা হয়েছিল!” অক্ষয়। সে আর কী বলব! প্রতিজ্ঞা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করব না, কিন্তু শেষকালে এমনি হল যে,মনে হত শ্রীকৃষ্ণের ষোলোশো গোপিনী যদি-বা সম্প্রতি দুষ্প্রাপ্য হন অন্তত মহাকালীর চৌষট্টি হাজার যোগিনীর সন্ধান পেলেও একবার পেট ভরে প্রেমালাপটা করে নিই– ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আর কি! পুরবালা। চৌষট্টি হাজারের শখ মিটল? অক্ষয়। সে আর তোমার মুখের সামনে বলব না! জাঁক হবে। তবে ইশারায় বলতে পারি মা কালী দয়া করেছেন বটে! এই বলিয়া পুরবালার চিবুক ধরিয়া মুখটি একটুখানি তুলিয়া সকৌতুকে স্নিগ্ধ প্রেমে একবার নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। পুরবালা কৃত্রিম কলহে মুখ সরাইয়া লইয়া কহিলেন, “তবে আমিও বলি, বাবা ভোলানাথের নন্দীভৃঙ্গীর অভাব ছিল না, আমাকে বুঝি তিনি দয়া করেছিলেন!” অক্ষয়। তা হতে পারে, সেইজন্যেই কার্তিকটি পেয়েছ! পুরবালা। আবার ঠাট্টা শুরু
false
humayun_ahmed
এর পরপরই বাবরি চুল রেখে ফেলল। দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিল। আপাতত তার প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ, তাকে যথাসময়ে আবার আনা হবে। আজ বুধবার। মোবারক হোসেনের ছুটির দিন। ছুটির দিনেও তিনি কিছু সময় অফিস করেন। সকাল দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত শেখ সাহেবের বাড়িতে থাকেন। সেখান থেকে সরাসরি চলে যান। আমিনবাজার। সপ্তাহের বাজার আমিনবাজার থেকে করে চলে আসেন মৌলবীবাজার। সেখানে কুদ্দুস নামের একজন কসাই তাকে গরুর মাংস দেয়। বাজারের সেরা মাংস । তিনি বাসায় ফিরেন দুপুর বারোটার মধ্যে। তখন ইয়াহিয়াকে গোসল দেয়া হয়। গোসলের আগে তার গায়ে খাঁটি সরিষার তেল মাখানো হয়। তেল মাখানোর সময় সে খুব হাত-পা ছুঁড়ে হাসে। আবার যখন তাকে গামলার পানিতে নামানো হয়, তখন সে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে। শিশুপুত্রের হাসি এবং কান্না দুটাই তিনি দেখতে ভালোবাসেন। মোবারক হোসেন সপ্তাহে একদিন দুপুরে ঘুমান। ঘুম ভাঙার পর মোহাম্মদপুর যাবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রস্তুতি মানে মানসিক প্ৰস্তুতি। মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরী রোডে যেতে হবে মনে হলেই তিনি এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেন। বুধবার দুপুরের ঘুমও তাঁর ভালো হয় না। ঘুমের মধ্যে বিকট এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখেন। একবার স্বপ্নে দেখলেন, কর্নেল শাহরুখ খানের কোলে তিনি বসে আছেন। স্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। যেন কর্নেল সাহেবের কোলে বসে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত এবং শোভন।। আরেকবার স্বপ্নে দেখলেন–তিনি, কর্নেল সাহেব এবং জোহর সাহেব খেতে বসেছেন। টেবিলে আস্ত খাসির একটা রোষ্ট সাজানো। সবাই সেই রোষ্ট থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে খাসিটা জীবিত। যখনই তার গা থেকে মাংস ছেড়া হচ্ছে তখনই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে এবং বিড়বিড় কবে বলছেআস্তে, আস্তে। এরকম কুৎসিত এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। জোহর সাহেব তার সঙ্গে খুবই সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলেন। মাঝে-মাঝে হাসি তামাশাও করেন। সন্ধ্যাবেলা চায়ের সঙ্গে কাবাব খেতে দেন। মাঝেমাঝে থাকে গরুর পায়া। গরম গরম রুমালি রুটি দিয়ে পায়া খেতে অতি সুস্বাদু। জোহর সাহেব বেশিরভাগ কথাবার্তাই বলেন খাবারদাবার নিয়ে। তিনি কোথায় কখন কোন ভালো খাবারটা খেয়েছেন সেই গল্প। মিঠা কাবাব নামের একটা কাবাবের কথা তার কাছে প্রায়ই শোনা যায়। গাজরের রসে মাংস। জ্বাল দেয়া হয়। তারপর সেই মাংস টুকরা টুকরা করে আগুনে ঝলসে খাওয়া। জোহর সাহেবের ধারণা, বেহেশতেও এই খানা পাওয়া যাবে কি-না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। খাওয়া-দাওয়ার ফাকে ফাঁকে রাজনীতি নিয়েও কথা হয়। রাজনৈতিক আলাপের সময় এই মানুষটা কোনোরকম সংশয় ছাড়া কথা বলেন। তখন তার চোখ বন্ধ থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, তিনি যা বলছেন তা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। বুঝলেন ইন্সপেক্টর সাহেব, একটা দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না তা সেই দেশের মানুষ কিংবা সেই দেশের কোনো বিপ্লবী নেতার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলার উপর। ভারত চাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হোক, এতে তার সুবিধা। তার চিরশত্রু পাকিস্তানের একটা শিক্ষা হয়। পাকিস্তানের কোমর ভেঙে যায়। আরেক দিকে আছে চীন। ভারতের আরেক শত্ৰু। কাজেই পাকিস্তানের বন্ধু। বিরাট এক শক্তি। ১৯৬২ সনে ভারতের উপর এমন চড়াও হয়েছিল যে ভারতের বুকোব রক্ত জমে পানি হয়ে গিয়েছিল। চীন কিছুতেই চাইবে না পাকিস্তান ভেঙে যাক। যেহেতু চীন চাচ্ছে না, আমেরিকাও চাইবে না। ভারতের পাশে থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এইসব হিসাবনিকাশে যে পাল্লা ভারী হবে সেই পাল্লাই… বুঝতে পারছেন? জি পারছি। শেখ মুজিব। যদি বোকামি করেন, কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন, তাহলে কী হবে দেখা যাক। সাতদিনের মাথায় মিলিটারি বিদ্রোহ দমন করবে। ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, তাহলে পনেরো দিনের মাথায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অনেক বড় বড় বিপ্লবী নেতাকে তখন দেখা যাবে–পাক সার যামিন শাদ বাদ গান করছেন। মানুষ সবসময় শক্তের পূজারী। দুর্বলকে মানুষ কখনো পছন্দ করে না। কেন বলুন তো? জানি না। কারণ বেশিরভাগ মানুষই দুর্বল। সে তার নিজের দুর্বলতা জানে। এই দুর্বলতা সে ঘৃণা করে। কাজেই অন্যের দুর্বলতাকেও সে ঘৃণা করে। . এখন ইন্সপেক্টর সাহেব বলুন দেখি, শেখ মুজিব কি ভুল করবেন? স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার হতে চাইবেন। জি করবেন। এটা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বিকল্প নাই। মানুষ তাঁকে নেতা বানিয়েছে, মানুষের ইচ্ছাকে তাঁর দাম দিতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা যদি সত্যি সত্যি দেয়া হয়, তাহলে কী পরিমাণ মানুষ এই দেশে মারা যাবে সেই সম্পর্কে তাঁর কি কোনো ধারণা আছে? শুধুমাত্র ঢাকা শহরের রাস্তাতেই এক হাঁটু রক্ত হবার কথা। বাদ দেন এসব, যা হবার হবে। এখন বলেন আছেন কেমন? জি ভালো। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সবাই ভালো? জি। এদের ঢাকায় রেখে লাভ নাই। এদের কোনো নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন। নিরাপদ জায়গা কোনটা? সেটাই একটা কথা, নিরাপদ জায়গাটা কী? এই বিষয়ে একটা শের আছে। পুরোপুরি মনে নাই, ভুলে গেছি। ভাবাৰ্থ হলো– আমাকে একটা নিরাপদ জায়গার সন্ধান হে পারোয়ার দেগার তুমি দাও যে নিরাপদ স্থানে প্ৰেম আমাকে স্পর্শ করবে না। দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মোবারক হোসেন পুত্রের হাসি এবং কান্না দেখলেন। তিনি বড়ই মজা পেলেন। এই সময়টাতে তার একবারও শের শাহ সুরী রোডের কথা মনে পড়ল না। আজই যে সেখানে যেতে হবে এবং আজই কর্নেল সাহেব উপস্থিত থাকবেন— এটাও মনে থাকল না। অথচ তিনি খবর দিয়ে রেখেছেন। মুক্তাগাছার মণ্ডা
false
toslima_nasrin
ব্যস্ত গীতা নিয়ে, গীতা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে পদার্থবিদ হওয়ার স্বপ্ন বিদেয় করে নৃত্যকলায় মন শরীর সব ঢেলে দিয়েছে। নাচের দলের সঙ্গে বার্মা যাচ্ছে। আমি ব্যস্ত লেখাপড়া নিয়ে। ইয়াসমিনও। মা পড়ে থাকেন একা। কালো কুচ্ছিত হতদরিদ্র মা। কিছু না থাকা মাকে একরকম মানিয়ে যায়। মার যে সায়া থাকলে শাড়ি নেই, শাড়ি থাকলে ব্লাউজ নেই এসব দেখে আমরা অভ্যস্ত মার ফিনফিনে তেলহীন চুল বাতাসে উড়বে, ফিতে না পেয়ে মা পাজামার দড়ি খুলে বা চটের দড়িতে চুল বাঁধবেন, দেখে আমরা মখু টিপে হাসব, আমাদের ওই হাসিতেও অনেকটা অভ্যস্ত আমরা। মা বাড়িতে অনেকটা হাস্যকর পদার্থ। মাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি হাসেন বাবা। চাকরি পাওয়ার পর দাদা মাকে শাড়ি সায়া কিনে দিয়েছেন, কিন্তু বিয়ের কথা ভেবে ভেবে নিজের সংসারের আসবাবপত্র বানাতে বানাতে আর নিজের জামা কাপড় সুটবুট কেনায় দাদাও এমন ব্যস্ত যে মাঝে মাঝেই ভুলে যান যে মার গত ঈদের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। মা তাঁর ছেঁড়া শাড়িগুলো নিয়ে গিয়ে নানিবাড়ির পেছনের বস্তি থেকে কাথাঁ বানিয়ে এনেছেন। একটু শীত নামলেই মা কাথাঁ বের করে প্রত্যেকের বিছানায় দিয়ে আসেন। মার কাথাঁর উষ্ণতায় আমাদের এত আরাম হয় যে আমরা সময়ের চেয়ে বেশি ঘুমোই, আর মা তুলো বেরিয়ে আসা ছেঁড়া লেপের তলায়, গা অর্ধেক ঢাকে তো অর্ধেক বেরিয়ে আসে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলে খাট নড়বড় করে, শুয়ে থাকেন। মা স্বপ্ন দেখতে থাকেন একটি নকশি কাথাঁর, কাঁথাটি বানিয়ে যদি কোনও এক রাতে বাবার শীত শীত লাগা গায়ের ওপর আলগোছে বিছিয়ে বাবাকে চমকে দিতে পারতেন! বাবা অবশ্য মার কোনও কিছুতে চমকান না। মা খুব চমৎকার খিচুড়ি রাধঁলেও না, মাথায় তেল দিয়ে ভাল একটি শাড়ি পরে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মিষ্টি হেসে সামনে এলেও না। চাঁদনি রাতে জানালায় বসে ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসে নি তো বুঝি আর জীবনে আমার! গাইলেও না। বাবার মন মায়ে নেই। মা বোঝেন তা। আমরাও বুঝি। সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝখানে কখনও কখনও ক্লান্ত শুয়ে থাকেন তিনি। মার শুয়ে থাকা দেখলে বাবা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন। এভাবে শুয়ে থাকলে সংসার উচ্ছন্নে যাবে বাবার ধারণা। বাড়িতে চোর ঢুকে সব নিয়ে যাবে। কাজের মানুষগুলো কাজে ফাঁকি দেবে, চুরি করে মাছ মাংস খেয়ে ফেলবে। মেয়েরা পড়াশোনা রেখে আড্ডা পেটাবে। বাবার অমন বাড়ি মাথায় করা চিৎকারের দিনে মা একদিন শুয়ে থাকা থেকে নিজের শরীরটি টেনে তুলে বলেন,পাইলসের রক্ত গেছে অনেক। শইল কাহিল হইয়া গেছে। বাবা শুনে বলেন, ঢং দেইখা বাচি না। মা অনেকদিন বাবাকে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, পাইলসের কি কোনও চিকিৎসা নাই? বাবা বলেছেন, না। এই যে এত্ত এত্ত রক্ত যায়। পায়খানা ভইরা রক্ত যায়। এইভাবে রক্ত যাওয়া খারাপ না? গম্ভীর কণ্ঠে বাবা উত্তর দেন, না। মার চটি ছিঁড়ে পড়ে আছে অনেকদিন, বাবাকে চটি কেনার কথা বলা হয়, বাবা শুনেও শুনলেন না। আমার বা ইয়াসমিনের চটি পরে কোথাও যাবার হলে মা যান, আর ঘরে বারান্দায় উঠোনে তো খালি পায়েই। বাড়ির লোকের খুব একটা চোখে পড়ে না আজকাল মার কি নেই, মার কি প্রয়োজন। নানার মত বেহিসেবি বাউণ্ডুলে মানুষের নজরে পড়ে মার পাদুকাহীন জীবন। তিনি একদিন মার জন্য একজোড়া শাদা কাপড়ের জুতো কিনে নিয়ে এলেন। এরকম জুতো যে মেয়েরা কখনও পরে না সে ধারণা নানার নেই। কিন্তু মা জুতো জোড়া পেয়েই খুশিতে আটখানা, বাড়ির সবাইকে দেখালেন যে তাঁর বাজান তাঁর জন্য জুতো এনেছেন। সেদিন মা নানার জন্য বেশি মিষ্টি দিয়ে,নানার চিনি খাওয়া বারণ জেনেও,পায়েশ রাঁধেন। নানা খেয়ে দেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের জন্য দোয়া করেন, মেয়ের যেন বেহেসত নসীব হয়। বেহেসতের খাবার দাবারের বর্ণনা করেন নানা, বেহেসতে এমন খানা একবার খাইব তো চল্লিশ হাজার বছর খাইতেই থাকব, ঢেকুর একটা আইব তো মেসকাম্বর। নানার বর্ণনা শুনে আমার ধারণা হয় বেহেসতের ভাল ভাল খানা খাওয়ার লোভেই নানা বুঝি নামাজ রোজা করেন। নওমহলে পীরের প্রতাপ এমনই বেড়েছে যে, এখন আর রিক্সাঅলাকে বলতে হয় না, নওমহল চান্দুর দোকানের পিছনে যাইবা? নওমহলের পীর বাড়ি বললে রিক্সাঅলা চেনে। আগে মা চারআনা করে যেতেন, দাম বেড়ে পরে আট আনা হল, আট আনা থেকেও লাফিয়ে এক টাকা। মার হাতে অত পয়সা নেই যে ঘন ঘন তিনি বাপের বাড়ি বা পীর বাড়ি ছুটবেন। অনেক সময় যেতে ইচ্ছে করলেও মাকে ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরতে হয়। সেদিন সকালে আমি ইশকুলে যাব, এক প্যাঁচে শাড়ি পরে, তার ওপর রংচটা বোরখাটি পরে, পায়ে নানার দেওয়া কাপড়ের জুতো, বললেন আমারে নামাইয়া দিবা রেললাইনের মোড়টায়? মার আপাদমস্তক দেখে আমি নাক কুঁচকে বলি, তুমি আরেকটা রিক্সা নিয়া গেলেই তো পারো! রিক্সাভাড়া নাই যে। নাই তো কারও কাছ থেইকা নেও। কেউ ত দিল না। আজকে যাইও না তাইলে,বাদ দেও। অন্যদিন যাও। মা আমার উপদেশ মানেন না। মার কাছে আজ এবং অন্যদিনে কোনও পার্থক্য নেই। অগত্যা সঙ্গে নিতে হয় মাকে। মনে মনে প্রার্থণা করতে হয় যেন রাস্তায় চেনা কেউ না পড়ে, রংচটা বোরখা আর মোজাহীন কাপড়ের জুতো পরা কারও সঙ্গে আমাকে যেন কেউ না দেখে। সি কে ঘোষ রোড পার হয়ে রেললাইনের সামনে মা নেমে যান। বেশির ভাগ রাস্তাই সামনে পড়ে
false
nihar_ronjon_gupta
সহকমী হিসাবে এখানে কাজ করছিলেন। বলুন না মশাই, চুপ করে আছেন কেন? খেতেন নাকি তিনি? আজ্ঞে! বলুন! কঠিন আদেশের সুর কিরাটীর কণ্ঠে ঝঙ্কত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ম্যানেজারবাবু মাথা নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর একসময় মৃদুস্বরে বললেন, আজ্ঞে মাসখানেক হবে, তিনি আফিং একটু একটু করে গরম কফির সঙ্গে খেতেন। বলতেন, অন্য কোন বদ নেসার থেকে আফিং খাওয়াটা নাকি ভাল। তাছাড়া তার পেটের গোলমাল আছে বলে ডাক্তার নাকি পরামর্শ দিয়েছিল প্রত্যহ একটু একটু করে আফিং খেতে। আফিং ধরবার পর উপকারও নাকি পাচ্ছিলেন। ভাল কথা! খুব ভাল কথা! কিন্তু আপনাদের কুমারসাহেবও কি ঐ সঙ্গে কোন নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নাকি? আজ্ঞে, তিনি বোধ হয় ঐ একই সময় থেকে আফিং খাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় কুমারসাহেব আফিংয়ে অনেক দিন থেকে অভ্যস্ত। বেশ। আচ্ছা আজ রাত্রে কুমারসাহেবকে আপনারা ভাং বা সিদ্ধি জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে সিগারেট তৈরী করে দিয়েছিলেন? আজ্ঞে– বলুন, জবাব দিন! আজ্ঞে হ্যাঁ। কেননা আমি ভেবেছিলাম সিদ্ধি খেলে তিনি একটু চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। জানি না কেন যেন আজ চার-পাঁচদিন একটা চিঠি পেয়ে অবধি তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সর্বদাই মনমরা, যেন কি কেবলই ভাবছেন তাই ভাবলাম, আজকের এই উৎসবের দিন, সাধারণ সিদ্ধির সরবত-টরবত দিলে হয়তো তিনি আপত্তি করতে পারেন, তাই সিগারেট তৈরী করে রেখেছিলাম। এ রকম মাঝে আরো দুবার সিগারেট করে খাইয়েছিও তাকে। সন্ধ্যার অল্প পরেই আমি তখন কুমারসাহেবের লাইব্রেরী ঘর বসে কয়েকটা হিসাবপত্র মিলিয়ে নিচ্ছি, কুমারসাহেব যেন খুব উত্তেজিত হয়েছেন এমন অবস্থায় এসে লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেন, বললেন, এক কাপ গরম কফি খাওয়াতে পারেন ম্যানেজারবাবু? আর আপনার সেই সিগরট কয়েকটা দিতে পারেন? তারপর তিনি আমাকে একটু আগে বাথরুমে কী দেখেছেন তাই বলতে লাগলেন। আমি নিজে তাকে কফি নিয়ে এসে দিলাম ও পকেট থেকে তৈরী করা গোটাপাঁচেক সিগারেটও দিলাম। আজকেই আপনি তাহলে প্রথম তাকে ঐ ধরনের সিগারেট দিয়েছিলেন বোধ হয়? আজ্ঞে না। দিন পাঁচেক আগে একবার গোটাপাঁচেক তৈরী করে দিয়েছিলাম। তবেই দেখুন ডাক্তার, ভাং বা সিদ্ধির প্রভাবে কুমারসাহেব কল্পনার বিভীষিকা দেখেননি, সিগারেট পান করবার আগেই দেখেছেন। তারপর ম্যানেজারের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, বেশ। আচ্ছা ম্যানেজারবাবু কুমারসাহেবের সঙ্গে যখন আপনার দেখা হয় তখন ঠিক কত রাত্রি হবে বলতে পারেন? মানে রাত্রি তখন কটা বাজে? আজ্ঞে রাত্ৰি নটা হবে। আচ্ছা, তারপর আপনি কী করলেন? তারপর আরও কিছুক্ষণ আমি ঐখানেই ছিলাম, কেননা কুমারসাহেব সিগারেট নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন দ্রুতপদে। তারপর হিসাবপত্র দেখা হয়ে গেলে প্রায় রাত্ৰি সাড়ে নটার সময় আমি নীচে নেমে যাই। এর পর ম্যানেজারবাবুকে কিরীটী বিদায় দিল। ভদ্রলোকও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, কেননা তিনি একপ্রকার দৌড়েই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। ম্যানেজার ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কিরীটীও বোধ করি কি ভাবছিল। ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কিরীটীর দিকে চেয়ে এবারে আমিই প্রশ্ন করলাম, আজকের ব্যাপারের অনেক কিছুই যেন তুমি এখনো চেপে রাখছ বলে মন হচ্ছে কিরীটী? একটা সূত্র অবিশ্যি পাওয়া যাচ্ছে, মিঃ শুভঙ্কর মিত্র নেশা করতেন! কিরীটী মৃদু হেসে বলে সেটা এমন বিশেষ একটা সূত্র নয়। কিন্তু এই সম্পর্কে আপাতত যতটা জানতে পেরেছ, তাতে করে তোমার মতামতটা কী সুব্রত? যতটুকু জেনেছ বা শুনেছ। এর মধ্যে কোন অসামঞ্জস্য বা অবিশ্বাস্য মনে হয় কী? একটা অসামঞ্জস্য খুব মোটা ভাবেই চোখে পড়েছে। ডাঃ চট্টরাজ বাধা দিলেন, এক মিনিট সুব্রতবাবু! বলে হঠাৎ কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটা কথা রায়, তোমার ধারণা বোধ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে আজ রাত্রের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন? যদি বলি ডাঃ চট্টরাজ তাই! এমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি এখানে আজ হয়েতো এসেছেন, যার সঙ্গে মিঃ মিত্রের বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তা ছাড়া কোন নিমন্ত্রণ-বাড়ির একটা কার্ড যোগাড় করে এখানে আসাটা এমন বিশেষ কিছুই একটা কঠিন ব্যাপার বলে কি মন হয় ডাঃ চট্টরাজ? না। কিন্তু তাহলে তুমি স্থিরনিশ্চিত যে, স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে এসে আজ রাত্রে হতভাগ্য শুভঙ্কর মিত্রকে খুন করেছেন? কিন্তু— মৃদু হেসে সহজ স্বাভাবিক স্বরে কিরীটী জবাব দিল, নিশ্চয়ই। এতে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু বন্ধু, এক্ষেত্রে মিঃ মিত্রের মত একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে স্যার দিগেন্দ্রের খুন করবার কী এমন সার্থকতা থাকতে পারে সেটাই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অবিশ্যি কুমারসাহেবকে হত্যা করলেও না হয় বোঝা যেত; কেননা তাঁর মুখে শুনেছি স্যার দিগেন্দ্র প্রায় তিন-চারখানা চিঠিতে একাধিকবার কুমারসাহেবকে শাসিয়েছেন তার প্রাণ নেবেন বলে। এবং যে কারণেই হোক কুমারসাহেবের ওপরে তাঁর একটা আক্রোশও আছে। কিরীটী এবার বলে, জানেন কিনা আপনারা জানি না—গতকাল রাত্রে কুমারসাহেব শেষ চিঠি পেয়েছেন স্যার দিগেন্দ্রর কাছ থেকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সেক্রেটারী সাহেবও একখান চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, বলতে বলতে একখানা চিঠি পকেট থেকে টেনে বের করে কিরীটী চিঠিটা পড়তে শুরু করে ঃ আমাদের সাত পুরুষের সঞ্চিত অৰ্থ নিয়ে তুমি যে এই দানধ্যানের ছেলেখেলায় মেতে উঠেছ, এর সকল ঋণ কালই তোমার আপন বুকের রক্ত দিয়ে কড়ায়গণ্ডায় পরিশোধ করত হবে। বুকের রক্ত ঢেলে অর্জিত এ অর্থ অপব্যবহার করে যে পাপ করেছ, তা বুকের রক্তেই শেষ হয়ে যাক। আঃ, তাজা টুকটুকে লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে ঠাণ্ডা মাটির বুকের
false
humayun_ahmed
তো মনে আসছে না। তুমি বল, আমি শুনি। বলতে বলতে মনজুর হাই তুলল। মীরা বলল, তোমার ঘুম পাচ্ছে নাকি? হ্যাঁ। গত দুই রাত এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। আমার ছোট্ট বাসা আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে–শোব কী, দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। খুব বেশি ঘুম গেলে ঘুমিয়ে পড়। বাসর রাতে যে বকবক করতেই হবে এমন কথা নেই। মশারি ফেলবে না? দরজা-জানালায় নেট লাগানাে–মশা আসবে না, তাছাড়া ঘরে ফুল থাকলে মশা আসে না। ফুলের গন্ধ মশারা সহ্য করতে পারে না। তাই নাকি? জানতাম না তো! ঘুম পেলে শুয়ে পড়। মনজুর শুয়ে পড়ল। এক ঘুমে রাত কাবার। মনজুরের ধারণা, সবচে’ আরামের ঘুম সে ঘুমিয়েছে বাসর রাতে। কাফে লবঙ্গ চা খেতে খেতে মনজুর আজ সারাদিনে কী কী করবে। ঠিক করে ফেলল। তার ভিজিটিং কার্ডের উল্টো পিঠে এক দুই করে লিখল, (১) অফিস, সকাল দশটা। (২) বড়মামার সঙ্গে কথাবার্তা এবং তার অফিসে দুপুরের খাওয়া। (৩) খালাকে চিঠি লেখা এবং নিজ হাতে পোস্ট করা। (৪) ইদরিসের সঙ্গে ঝগড়া।[ সন্ধ্যায়, তাকে তার বাসায় ধরতে হবে।] (৫) মীরার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা। [রাত দশটার পর।] এই জাতীয় একটা লিস্ট মনজুর প্রতিদিন ভোরেই করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছেলিষ্ট অনুযায়ী কোনো কাজই শেষ পর্যন্ত করা হয় না। তবু লিস্টটা করলে মনে এক ধরনের শান্তি পাওয়া যায়। লিষ্টের পাঁচ নম্বরে মীরার সঙ্গে কথা বলা। রাত দশটার পরে তাকে সব সময় পাওয়া যায় না। এগারটার পর হলে মোটামুটি নিশ্চিত যে পাওয়া যাবে। শীতের রাতে এগারটার পর টেলিফোন জোগাড় করাই এক সমস্যা। সব দোকানপাট বন্ধ। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে করা যায়। তবে তার জন্যে বাড়ির ভাড়া ক্লিয়ার করা দরকার। আজ রাতে বাড়িভাড়া নিয়ে যদি যাওয়া যায় তাহলে উঠে আসার সময় হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলা যেতে পারে, ভাই সাহেব! টেলিফোনটা ঠিক আছে? উনার টেলিফোন অবশ্যি বেশিরভাগ সময়ই খারাপ থাকে। নিজেই খারাপ করে রাখে। কিনা কে জানে! তারচে’ এখন চলে গেলে কেমন হয়? মীরাকে ভোরবেলার দিকে সব সময় পাওয়া যায়। মনজুর ভিজিটিং কার্ড বের করে পাঁচ নম্বর আইটেমে টিক চিহ্ন দিল। মীরা সহজ স্বরে বলল, তুমি এত ভোরে! মনজুর বলল, ভোর কোথায়। আটটা চল্লিশ বাজে। কোনো কাজে এসেছ? ভাবলাম সেপারেশনের টার্মস এন্ড কন্ডিশনসগুলো নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করি। মীরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, টার্মস এন্ড কন্ডিশনস মানে? ঠাট্টা করছি নাকি? তোমার রূঢ় আমি কি কিছু চাচ্ছি? তােমার এমন কােনাে রাজত্ব নেই অর্ধেক আমাকে দিয়ে তা ঠিক, তবু আইনের কিছু ব্যাপারস্যাপার আছে। তার জন্যে তো গত মাসের সাতাশ তারিখে ভাইয়া সুপ্রিম কোর্টের লইয়ার এম. জামানকে ঘরে বসিয়ে রেখেছিলেন। তোমার আসার কথা ছিল, তুমি আস নি। সেটা আমি এক্সপ্লেইন করেছি। হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ে গেল। কী তোমার অফিস আর কী তার জরুরি কাজ! একটা কথা পরিষ্কার করে বল তো–সেপারেশনে তোমার কি ইচ্ছা নেই? আরে কী বলে! ইচ্ছা থাকবে না কেন? দুজন মিলেই তো ঠিক করলাম। চা খাওয়াতে পার? মীরা চা আনতে উঠে গেল। তাকে আজ অপূর্ব দেখাচ্ছে। বিয়ের সময় এতটা সুন্দর ছিল না। আলাদা হবার পর থেকে সুন্দর হতে শুরু করেছে। খানিকটা রোগও হয়েছে। রোগার জন্যেই লম্বা লম্বা লাগছে নাকি? চেহারায় চাপা আনন্দের আভা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মীরা এখন সুখে আছে। সমস্ত চেহারায় মায়াবতী মায়াবতী ভাব। নীল শাড়ির জন্যেও হতে পারে। ধবধবে সাদা ব্লাউজের সঙ্গে নীল শাড়ি পরলে মেয়েদের মধ্যে একটা আকাশ আকাশ ভােব চলে আসে। শাড়িটা আকাশ, ব্লাউজ হলো পূর্ণিমার চাঁদ। উপমা নিখুঁত হলো না। রাতের আকাশ নীল হয় না। হয় ঘন কৃষ্ণবর্ণ। নাও, চা নাও। চায়ের সঙ্গে আর কিছু দেব? না। নাশতা খেয়ে এসেছ? হুঁ। কোথায় খেলে? তোমার সেই কাফে লবঙ্গ? হুঁ। এক অক্ষরে জবাব দিচ্ছি কেন? আমরা আলাদা থাকাছি বলে কথা বলা যাবে না। তা তো না। কী কথা ছিল? সেপারেশনের পরে আমাদের যদি পথেঘাটে দেখা হয় তাহলে আমরা সিভিলাইজড় মানুষের মতো বিহেভ করব। তা অবশ্যই করব। এক ধরনের সাধারণ বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে থাকবে। তুমি চা খােচ্ছ না কেন? চিনি বেশি হয়েছে? না। চিনি ঠিক আছে। তোমাকে অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। তোমার শরীরে অসুখ অসুখ গন্ধ। মনজুর কিছু না বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেটের কড়া ধোঁয়ায় অসুখ অসুখ গন্ধটা যদি তাড়ানো যায়। মীরার ঘাণশক্তি কুকুরের চেয়েও প্রবল। যখন অসুখ অসুখ গন্ধ বলছে তখন বুঝতে হবে ঠিকই বলছে। কথার জবাব দিচ্ছে না কেন? অসুখ নাকি? আরে না। বিনা পেস্টে দাঁত মেজেছি–গন্ধ যা পাচ্ছি। আমার মনে হয় মুখ থেকে পাচ্ছ। মুখের গন্ধ আমি চিনি। তোমার গা থেকে জুর জ্বর গন্ধ আসছে। সিগারেটও মনে হয় প্রচুর খাচ্ছ। হেভি টেনশনে থাকি। সিগারেটের ধোয়ার উপর দিয়ে টেনশানটা পার করার চেষ্টা করি। কীসের এত টেনশান? আছে অনেক। আচ্ছা তোমাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করি, ধর একজন লোকের খুব নিকট কোনো আত্মীয় মারা গেছে। তাকে সান্তনা দিতে হবে। কী বলে সান্ত্বনা দিবে? কে মারা গেছে? কে মারা গেছে সেটা জরুরি না। কী কথা বললে সে সান্ত্বনা পাবে সেটা বল। কোনাে কথাতেই সে সান্ত্বনা পাবে না। তুমি যদি তার গায়ে হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাক তাহলে খানিকটা সাত্ত্বিনা পেতে পারে। মনজুর উঠে দাঁড়াল। মীরা
false
humayun_ahmed
নামিয়ে দিবে। যুথীর মা সালমা বললেন, তোর বাবার সত্যি ব্যথা উঠেছিল। এমন ভয় লাগল। পাখা দিয়ে বাতাস করলাম অনেকক্ষণ। ইলেকট্রিসিটি ছিল না তো, এইজন্যে পাখা দিয়ে বাতাস। যুথী বলল, পাখা কোথায় যে পাখা দিয়ে বাতাস? এই বাড়িতে তো কোনো পাখা নেই। কেন মিথ্যা কথা বলছি মা? আজহার কথা ঘুরাবার জন্যে বললেন, মা, খেয়ে এসেছিস? যুথী বলল, আটটার সময় কী খেয়ে আসব? খাবার দিবে। রাত দশটায়। আজহার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েকে একটা ডিম ভেজে ভাত দাও। পটলভাজি আছে না? পটলভাজি ভালো হয়েছে। মা যুথী, যাও খেয়ে আসো। পিতামাতা যদি ভুলও করে তারপরেও তাদের উপর রাগ করতে নাই। তবে বুকের ব্যথার ব্যাপারটা মিথ্যা না। যুথী খেতে বসেছে। সালমা বললেন, তুই কি তোর বাবার মানিব্যাগ থেকে কোনো টাকা নিয়েছিস? পাঁচশ টাকার হিসাব মিলছে না। যুথী বলল, মা, আমি আমার নিজের খরচ টিউশনির টাকায় করি। তোমাদের কাছ থেকে একটা পয়সা নেই না। সালমা বললেন, তোর বাবার তো সব হিসাবের টাকা। হিসাব না করলে সংসারও চালাতে পারত না। একটা মানুষ হিসাব করতে করতে বুড়ো হয়ে গেল। তার কোনো শখ মিটাল না, আহাদ মিটাল না। যুথী বলল, পুরনো ঘ্যানঘ্যাননি বন্ধ করো তো মা! বুদ্ধি হবার পর থেকে তোমার এই ঘ্যানঘ্যাননি শুনছি। সালমা চুপ করে গেলেন। রাত দশটায় টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার পাঠাল নীপা; আজহার দ্বিতীয়বার খেতে বসলেন। আনন্দে তার চোখমুখ ঝলমল করতে লাগল। তিনি কয়েকবার বললেন, টুনু বাড়িতে থাকলে মজা করে খেত। মিস করল। বিরাট মিস। টুনু আজহারের বড় ছেলে। সে দেশের বাড়িতে গেছে ধান-চালের ভাগ আনতে। স্বামীর সঙ্গে সালমাও খেতে বসেছেন। একটা খাবার মুখে দিয়ে বললেন, মাছ কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। আজহার বললেন, কথা না বলে আরাম করে খাও তো। হাই ক্লাস ফুড় মিষ্টি মিষ্টি হয়। লোয়ার লেবেল ফুড হয় ঝাল। এমন ঝাল যে মুখে দেওয়া যায় না। যুথী মা! সব কি ঘরের রান্না? যুথী বলল, খাবার এসেছে হোটেল সোনারগাঁ আর হোটেল রেডিসন থেকে। আজহার বললেন, বললাম না হাই ক্লাস ফুড! যুথী মা, তুইও বোস। মাংসের এই আইটেম অসাধারণ হয়েছে। যুথী বলল, প্রতিটি কথার শুরুতে একবার করে যুথী মা বলবে না। শুধু যুথী ডাকবে। আজহার বিস্মিত গলায় বললেন, নিজের মেয়েকে মা ডাকতে পারব না! যুথী বলল, বাবা খাও তো। কথা বন্ধ। যুথী বাবা-মার খাওয়া দেখছে। তাদের এক রাতে দ্বিতীয়বার খেতে বসা এবং আনন্দের সঙ্গে খাওয়ার দৃশ্য দেখে হঠাৎ তার চোখে পানি এসে গেল। চোখের পানি গোপন করার জন্যে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। শুভ্র বাথরুম। হাট শাওয়ার নিচ্ছে। তার মা রেহানা বাথরুমের বাইরে তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। রাগে তাঁর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রাগ সামলে রেখেছেন। ছেলে নানান ঝামেলার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। এখনো রাতের খাবার খায় নি। খাওয়া শেষ হোক। তাকে কঠিন কিছু কথা আজ রাতে শুনতেই হবে, তবে এখন না। রাথরুমের দরজা সামান্য খোলা। শুভ্র কখনোই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে না। ছোটবেলায় একবার বাথরুমের দরজা বন্ধ করে আর খুলতে পারে নি। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করা হয়। সেই থেকে তার ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। শুভ্ৰ, মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছ? হুঁ। মাথায় গরম পানি দিয়ো না। আচ্ছা। যে মেয়েটা তোমাকে উদ্ধার করেছে তার নাম যেন কী? তুমি একবার বলেছ। আমি ভুলে গেছি। যুথী। মিডল ক্লাস ফ্যামিলি নেম। নাম থেকে ক্লাস বোঝা যায় মা? অবশ্যই বোঝা যায়। যুথী, বকুল, পারুল, এইসব ফুলের নামে নাম হয় লোয়ার মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে। শুভ্ৰ কি খুব হাই ক্লাস নাম মা? তোমার গায়ের রঙ দেখে তোমার নাম দিয়েছিলাম শুভ্ৰ। ওরাও হয়তো তাই করেছে। ফুলের মতো স্বভাব দেখে ফুলের নামে নাম রেখেছে। যুথী মেয়েটার স্বভাব ফুলের মতো? উঁহু। খুব রাগী। আমাকে কঠিন গলায় গালি দিয়েছে! আমাকে বলেছে, মানসিক প্রতিবন্ধী, গাধামানব। তুমি চুপ করে গালি শুনলে? হ্যাঁ। আমি নিশ্চয়ই তাকে গালি দেব না। মা, মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। গলার স্বরের টক মিষ্টি বুঝা শিখলে কবে থেকে? তুমি রাগ করছ না-কি মা? তোমার খাটের ওপর টাওয়েল রাখলাম। আমি টেবিল সাজাতে বলছি। তুমি খাবার টেবিলে চলে এসো। আচ্ছা। শুভ্ৰর বাবা মেরাজউদ্দিন সাহেব খাবার টেবিলে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তার হাতে এই সংখ্যা , গ্লোবাল ওয়ামিং-এর ওপর একটা লেখা ছাপা হয়েছে। মন দিয়ে পড়ছেন। শুভ্র ঘরে ঢুকতেই তিনি পত্রিকা বন্ধ করলেন এবং বললেন, সারা দিন তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝামেলা গিয়েছে শুনেছি। কীভাবে উদ্ধার পেয়েছ তাও শুনেছি। তোমাকে কিছু উপদেশ দেওয়া প্রয়োজন, তবে খাবার টেবিল উপদেশ দেওয়ার না। শুভ্র বলল, কেমন আছ বাবা? মেরাজউদ্দিন বললেন, ভালো আছি। বেশির ভাগ সময় আমি ভালো থাকি। তোমার মা বেশির ভাগ সময় তোমার চিস্তায় অস্থির থাকেন। আজ তোমার কোনো খবর না পেয়ে তার প্রেসার নিচেরটা একশ দিশে চলে গিয়েছিল। শুভ্ৰ বলল, বাবা! তোমার গাড়িটা ওরা পুড়িয়ে ফেলেছে। সরি ফর দ্যাট। মেরাজউদ্দিন বললেন, সরি হবার কিছু নেই। গাড়ির সবরকম ইনস্যুরেন্স করা আছে। গাড়ির প্রসঙ্গ থাকুক। যে মেয়েটির জন্মদিনে অনিমন্ত্রিতভাবে ভাবে উপস্থিত হয়েছিলে, তাকে আ ভোরবেলা একটি উপহার পাঠাবে। আর যে মেয়েটি তোমাকে সাহায্য করেছে, তাকেও একটা উপহার পাঠাবে। শুভ্ৰ প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল, এটা তো বাবা সম্ভব হবে
false
shomresh
জানানো হয়েছে। কিন্তু থানা যদি অ্যাকশন না নেয়, তা হলে তো আমরা অসহায়। শুধু-শুধু আপনাকেও অপমান করে গেল, বড়সাহেব জানলে আমার মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। রেঞ্জারকে দুঃখিত দেখাচ্ছিল। এবার অর্জুন কথা বলল, অমলদা, আপনি কেন চুপ করে রইলেন? কথা বলার সময় তখন ছিল না, অর্জুন। উন্মাদের হাতে অস্ত্র থাকলে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যাক, ওরা যে-জন্যে এসেছিল তা সফল হল। অমলদার দৃষ্টি লক্ষ করে ওরা দেখল দ্বিতীয় গাড়িটা বাংলোর সামনে দিয়ে দ্রুত চলে গেল। অর্জুন বলল, লোকটাকে নিয়ে গেল? সেটাই তো স্বাভাবিক। অমল সোম বললেন। সার, আপনি নিম টি-এস্টেটে যেতে চাইছিলেন, ওখানেই নীলবাবু থাকেন। ঠিকই। সেজন্যেই যাচ্ছি। অমল সোম বললেন, আর দেরি করবেন, বেরিয়ে পড়ুন। বাংলোর বাইরে এখন ঘন অন্ধকার। গোটাদুয়েক টর্চ, চারজন বনকর্মী, যাদের হাতে অস্ত্র বলতে লাঠি, জঙ্গলে ঢুকল। অর্জুন রেঞ্জারের সঙ্গে হাঁটছিল। অর্জুন বলল, লোকটা ওই রকম অসভ্য ব্যবহার সবার সঙ্গে করে? হ্যাঁ। তবে যেখানে স্বার্থ থাকে, সেখানে যথেষ্ট ভদ্রলোক। আসলে কী করে জানি না ও কয়েক বছরের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাবশালী হয়ে পড়েছে। কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না। চাকরির জন্যে আমি এই বনবাদাড়ে পড়ে আছি। ও ইচ্ছে করলে আমার বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। নীল চ্যাটার্জি কি শুধু চায়ের ব্যবসাই করে? ওর যে কীসের ব্যবসা নেই, সেটাই বোঝা মুশকিল। রেঞ্জারের নির্দেশে কর্মীরা চিৎকার করতে লাগল। টর্চের আলো গাছেদের গায়ে-গায়ে ধাক্কা খাচ্ছিল। অর্জুন চিৎকার করল, মেজর। মেজর! শুনছেন? কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎই গাছের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। টর্চের আলো তার ওপর পড়তেই লোকটা চট করে আড়ালে চলে গেল। রেঞ্জার চিৎকার করলেন, কে ওখানে? গলা ভেসে এল, আপনারা যাকে খুঁজছেন, তিনি বোধ হয় ওপাশের গর্তে পড়ে আছেন। তুমি কে? রেঞ্জার ধমকে উঠলেন। কোনও উত্তর এল না। বেঞ্জার কর্মীদের হুকুম দিলেন, ধরো তো লোকটাকে। কিন্তু টর্চের আলোয় লোকটাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। রাতের অন্ধকারে কাছাকাছি গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেও হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। লোকটা জঙ্গলে আনাড়ি নয়। রেঞ্জার বলল, অদ্ভুত ব্যাপার! অন্ধকারে চিনতে পারলাম না, কিন্তু রাত-বিরেতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর মতো লোক তো এই অঞ্চলে নেই। অর্জুনের মাথায় তখন মেজরের চিন্তা। সে রেঞ্জারকে বলতেই মেজরকে খুঁজে বের করতে আর সময় লাগল না। শুকনো পাতায় ভর্তি একটা গর্তে মেজর পাশ ফিরে শুয়ে আছেন, টর্চের আলোয় মনে হচ্ছিল আরামে ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু তিনি যে অজ্ঞান হয়ে আছেন, সেটা টের পেতে দেরি হল না। বনকর্মীরা ধরাধরি করে ওঁকে বের করে নিয়ে এলেন। অর্জুন মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বুঝল নিঃশ্বাস পড়ছে। বিস্তর ডাকাডাকির পর মেজর চোখ খুললেন। কিন্তু তাঁর কথা বলার সামর্থ্য ছিল না। বনকর্মীদের সাহায্যে ওঁকে জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে আসা হল। বাংলোর বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে ডাক্তার পাওয়া যাবে না? রেঞ্জার বললেন, আশেপাশের প্রতিটি চা বাগানে একজন করে ডাক্তার আছেন, কিন্তু এই রাত্রে তাঁরা কেউই আসবেন না। আপনি যদি চান, তা হলে গাড়ি বের করে ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি। শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই, কিছু হলে হার্টের ব্যাপার হতে পারে। অমল সোম বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, একটু দেখি। তিনি ওঁর নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, খুব দুর্বল লাগছে? মেজর কোনওমতে শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন, হু। অমল সোম অর্জুনকে বললেন, একটু গরম দুধ খাইয়ে দিলে কাজ হতে পারে। গরম দুধ পেতে অসুবিধা হল না। বাবুর্চি সেটা এনে দিতে অর্জুন একটু একটু করে মেজরকে খাইয়ে দিল। অমল সোম বললেন, ওকে এবার ঘুমোতে দাও। একজনকে অপেক্ষা করতে বলে রেঞ্জার বাকি বনকর্মীদের ছেড়ে দিলেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেঞ্জার বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে আজ। ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন আর সেই খবরটা দিয়ে গেল ভূতের মতো একজন। না হয় বুঝলাম চুরিটুরির ধান্দায় লোকটা জঙ্গলে ঢুকেছিল। কিন্তু আমাদের খবর দেওয়ার গরজ তো হওয়া উচিত নয়। অমল সোম বললেন, হ্যাঁ। এই ব্যাপারটা অদ্ভুত। তবে অপরাধীদের মনেও মাঝে মাঝে বিবেক জেগে ওঠে। জেল পালানো অথবা গ্রেপ্তার এড়ানো অপরাধীদের কাছে এই জঙ্গল তো লুকিয়ে থাকার পক্ষে দারুণ। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু মেজর তো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ভীরু নন। সেটা উনি জেগে না উঠলে বোঝা যাবে না। যাক, আজ অনেক হয়েছে। এবার খেয়ে নাও। রেঞ্জারসাহেব, আপনিও এখানে খেয়ে নেবেন নাকি? রেঞ্জার আপত্তি জানালেন, না, না,। আমি এবার চলি। বাবুর্চি, সাহেবদের খানা লাগাও। বাবুর্চি বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল, আদেশ পাওয়া মাত্র নীচে নেমে গেল। রেঞ্জার বললেন, কাল সকাল আটটায় গাড়ি পাঠাব? বেশ। অমল সোম মাথা নাড়লেন। ঠিক তখনই চিৎকার শোনা গেল। বাবুর্চি চেঁচাচ্ছে। রেঞ্জারের পেছন পেছন ছুটে গেল অর্জুন। কিচেনেল দরজা খোলা। বাবুর্চি তাদের দেখে হাউমাউ করে বলল, কোই আদমি খানা চুরি কিয়া সাব। সবজি আউর রোটি লে লিয়া। কিচেনের পেছন দিকের জানলা খোলা। রেঞ্জার জানালা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতে কাউকে দেখা গেল না। একচিলতে মাঠ, মাঠের পর জঙ্গল। বাবুর্চি যে পাত্রে রুটি রেখেছিল, তার ঢাকনা একপাশে পড়ে আছে। অর্ধেক রুটি নেই, সঙ্গে নেই সবজির বড় বাটি। অথচ চিকেনে হাত দেয়নি চোর। রেঞ্জার বললেন, কেউ যদি খাবার চুরি করতে আসে, তা হলে আগে চিকেন নেবে। এ কী ধরনের চোর?
false
toslima_nasrin
রেখে সে মশলা বাটে, বাসন মাজে,.ঘর মোছে, উঠোন ঝাট দেয়, দিয়ে পাকঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে বিড়িতে আগুন ধরায়। ফুলবাহারি চাল পড়া না খাওয়ায় কানের দুল চুরি করেছে যে সে ই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় সকলে। ও চাল পড়া খাবে না ঠিক আছে বাটি চালানের আয়োজন হোক। এরকম একটি প্রস্তাব দেন রুনুখালা। বাটি চালান দেবে জবেদা খাতুন, কানা মামুর বউ। উঠোনে এঁটেল মাটি লেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কাসার বাটি, এই বাটিতে তুলা রাশির কেউ হাত রাখলে বাটি আপনা মতে চলবে, চোরের সামনে গিয়ে থামবে বাটি। বাটি চালান হচ্ছে বাড়িতে, জবেদা খাতুন তুলারাশি, বাটি তার হাতে চলছে, এ ঘরের আঙিনা ওঘরের কোণা পেরিয়ে আমাদের পাকঘরে বাটি এসে থামে, একেবারে ফুলবাহারির পাছার তলায়। ফুলবাহারি তখন মশলা বাটছে। বাটির পেছনে পেছনে বাড়ির লোক এসে জড়ো হয়। হাশেম মামা চড়া গলায় বলেন–ফুলবাহারি দুল বাইর কইরা দেও। ফুলবাহারি ফুঁসে উঠে পদ্ম গোখরার মত, ওর কানে ঝিলমিল করে সস্তা সোনালি দুল, বলে–আমি চুরি করি নাই। আমি গরিব বইলাই আপনেরা মনে করতাছুইন আমি চুর। মানুষ গরিব অইলেই চুর অয় না। চুর অইলে চুরিই করতাম, খাইটা খাইতাম না। আপনেগো বাটি ভুল চলে। রুনু খালা ফুলবাহারির গায়ে ঠোনা মেরে বলেন– যে নারী ঝনঝনাইয়া কয়রে কথা, ধপধপাইয়া হাঁটে সেই নারীর খসমের জাতি মরে হাটে ঘাটে। বাটি ভুল মানুষের কাছে গেছে এ কথা কেউ মানে না। নানি বলেন–ফুলবাহারি, দুল জুড়া দিয়া দেও। যেহানে রাখছ কও, আমরাই বাইর কইরা লই। ফুলবাহারির হাত ভরা হলুদ, দাঁড়িয়ে আছে হলুদ হাত শূন্যে ধরে, শুকিয়ে চড়চড় করা বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলবাহারি বলে–আপনেগো মদ্যেই কেউ চুরি করছুইন দুল। আমি করি নাই। কথা শেষ হওয়ার আগেই মা ঝাঁপিয়ে চুলের গোছা ধরে টেনে ওকে নিয়ে আসেন পাকঘরের বাইরে উঠোনে, আমগাছ তলায়। ফুলবাহারির চুল যায় আগে আগে, শরীর যায় পেছনে, পা পারে না আঁকড়ে রাখতে চেয়েও মাটি। টুটু মামা চুলো থেকে আধপোড়া খড়ি এনে বেদম পেটাতে শুরু করেন ফুলবাহারিকে। ওর কানের বিড়ি মাটিতে পড়ে গায়ের নিচে চিপসে যায়, সারা উঠোন গড়াতে গড়াতে গলা ছেড়ে চেঁচায়–ফুলবাহারি চুরি করে না। ফুলবাহারিকে সেদিনই কাজ ছেড়ে চলে যেতে হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল ফুলবাহারি। ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ঝুনুখালার দুল ও চুরি করেনি। ও ঠিকই বলেছে যে বাটি ভুল চলেছে। ফুলবাহারি চলে যাওয়ার পরদিনই বস্তির মাঝবয়সী মেয়েমানুষ তইতইকে কাজে রাখা হল। তইতইএর নাম আসলে নূরজাহান। নূরজাহানের কিছু পোষা হাঁস আছে, হাঁসগুলোকে সন্ধে হলে সে বাড়ি নিয়ে যায় আয় আয় তই তই বলে ডেকে ডেকে। হাঁসেরা পুকুরঘাট থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে উঠে এসে নুরজাহানের পেছন পেছন হেঁটে বাড়ি ফেরে। গোঁধুলির আলস্য ভেঙে পুকর পাড়ে দাঁড়িয়ে নুরজাহানের তই তই ডাক শুনে টুটুমামা নূরজাহানকে তইতই বলে ডাকা শুরু করল। সেই থেকে তাকে তইতই বলেই সবাই ডাকে, এক নানি ছাড়া। তইতই ওরফে নুরজাহান ওরফে আলেক খালেকের মা, বেটে, পান খাওয়া লাল দেঁতো, আমাদের তখন ছুটা কামের বেটি। তইতই সকাল দুপুর বাড়ির মশলা বাটার, থাল বাসন ধোয়ার, ঘর দোর ঝারু দেওয়ার কাজ করে। আমাদের আলাদা সংসারের চুলোয় রান্নাবান্না করে। মাসিক পাঁচ টাকা বেতন তইতইএর, ভাত পায় এক বেলা। বাড়িতে ছুটা বা বাঁধা কামের বেটি পাওয়া মোটে মুশকিল নয়। পা বাড়ালে বস্তি, হাত বাড়ালে মেয়েমানুষ। একটিকে বিদেয় করলে জোটে আরেকটি। ফুলবাহারি কানের দুল চুরির দায়ে চেলা কাঠের মার খেয়ে বাড়ির বার হল, তইতই এল। তইতইকে ছাঁটাই করা হল কাজে ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে। কি রকম ফাঁকি, না, সন্ধের আগেই তড়িঘড়ি বাড়ি ছাড়ে সে, ঘরে তার আলেক খালেক আছে, আছে ছ’জোড়া হাঁস। মা নানিকে বললেন– তইতইর কামে মন নাই। রাইতের রান্ধাবাড়া আমারে একলা করতে হয়। বান্ধা কামের বেটি ছাড়া আমার পুষাইত না। নানি বললেন–দেখ আর কয়ডা দিন। নুরজাহানের স্বভাব টভাব ত ভালাই। চুরি টুরি করে না। মা নানির কথায় গললেন না। আধা মাসের আড়াই টাকা হাতে ধরিয়ে তইতইকে বলে দিলেন–যতদিন কাম করছ, হিশাব কইরা বেতন লইয়া যাও। আমি নতুন কামের বেডি রাইখ্যা লইয়াম। তইতই বিদেয় হলে কারও কোনও আফসোস নেই। বস্তিতে কি আর মেয়েমানুষের অভাব! তইতই নেই, মাকে একাই রান্নাঘরে বসতে হয়, চুলো ধরাতে হয়, আনাজপাতি কুটতে হয়, মাছ মাংস ধুয়ে রান্না চড়াতে হয়। চুলোয় আগুন ধরাতে মা দেশলাই খোঁজেন, ফুলবাহারি বা তই তই চুলো ধরাতো, দেশলাই ওরাই জানে রেখেছে কোথায়। — যা আমানুদ্দৌলার কাছ থেইকা একটা ম্যাচ লইয়া আয় তো। তইতই যেদিন গেল, সেদিনই মা ফরমাশ দেন আমাকে। মা জানেন কাকার কাছে দেশলাই আছে, তাঁকে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছেন তিনি। আমার কাকার ঘরটি সেটি, যে ঘরে খড়ি থাকত, যে ঘরে মজার একটি জিনিস দেখাবেন বলে শরাফ মামা এক মরা বিকেলে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি কাকা শুয়ে আছেন চৌকিতে। কাকা দেখতে বাবার মত। কোঁকড়া চুল, খাড়া নাক, বড় বড় চোখ, ঘন কালো ভুরু, ফর্সা গায়ের রং। বাবাকে ইটের তলে চেপে খানিকটা চ্যাপ্টা করে মাথা চেপে লম্বায় খানিকটা খাটো করে দিলে আমান কাকাই দাঁড়াবে। ঘরটির চেহারা পুরো বদলে গেছে। খড়ি নেই, ইঁদুর নেই। টিনের বেড়ায় লাগানো একটি বাঁধানো ছবি, চুলে ঢেউ তোলা পায়ে পাম্পসু পরা কাকার
false
bongkim
রোহিণী কাঁদিতে বসিল। “এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া আমার যাওয়া হইবে না–না দেখিয়া মরিয়া যাইব। আমি কলিকাতায় গেলে, গোবিন্দলালকে দেখিতে পাইব না? আমি যাইব না। এই হরিদ্রাগ্রাম আমার স্বর্গ, এখানে গোবিন্দলালের মন্দির। এই হরিদ্রাগ্রামই আমার শ্মশান, এখানে আমি পুড়িয়া মরিব। শ্মশানে মরিতে পায় না, এমন কপালও আছে। আমি যদি এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া না যাই, ত আমার কে কি করিতে পারে? কৃষ্ণকান্ত রায় আমার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবে? আমি আবার আসিব। গোবিন্দলাল রাগ করিবে? করে করুক,-তবু আমি তাহাকে দেখিব। আমার চক্ষু ত কাড়িয়া লইতে পারিবে না। আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না–কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না |” এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয়া দ্বার খুলিয়া আবার–“পতঙ্গবদ্বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ”–সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি–আমায় রক্ষা কর–আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও–আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি–তাহাকে যত বার দেখিব, ততবার–আমার অসহ্য যন্ত্রণা–অনন্ত সুখ। আমি বিধবা–আমার ধর্ম গেল–সুখ গেল–প্রাণ গেল–রহিল কি প্রভু? রাখিব কি প্রভু?–হে দেবতা! হে দুর্গা–হে কালি–হে জগন্নাথ–আমায় সুমতি দাও–আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না |” তবু সেই স্ফীত, হৃত, অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়–থামিল না। কখনও ভাবিল, গরল খাই; কখনও ভাবিল, গোবিন্দলালের পদপ্রান্তে পড়িয়া, অন্তঃকরণ মুক্ত করিয়া সকল কথা বলি; কখনও ভাবিল, পলাইয়া যাই; কখনও ভাবিল, বারুণীতে ডুবে মরি; কখনও ভাবিল ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া গোবিন্দলালকে কাড়িয়া লইয়া দেশান্তরে পলাইয়া যাই। রোহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে গোবিন্দলালের কাছে পুর্নবার উপস্থিত হইল। গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন? কলিকাতায় যাওয়া স্থির হইল ত?” রো। না। গো। সে কি? এইমাত্র আমার কাছে স্বীকার করিয়াছিলে? রো। যাইতে পারিব না। গো। বলিতে পারি না। জোর করিবার আমার কোনই অধিকার নাই–কিন্তু গেলে ভাল হইত। রো। কিসে ভাল হইত? গোবিন্দলাল অধোবদন হইলেন। স্পষ্ট করিয়া কোন কথা বলিবার তিনি কে?” রোহিণী চক্ষের জল লুকাইয়া মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিয়া গেল। গোবিন্দলাল নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। তখন ভোমরা নাচিতে নাচিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “ভাব‍ছ কি?” গো। বল দেখি। ভ্র। আমার কালো রূপ। গো। ইঃ- ভোমরা ঘোরতর কোপাবিষ্ট হইয়া বলিল, “সে কি? আমায় ভাব্ছ না? আমি ছাড়া, পৃথিবীতে তোমার অন্য চিন্তা আছে?” গো। আছে না ত কি? সর্বে সর্বময়ী আর কি! আমি অন্য মানুষ ভাব‍তেছি। ভ্রমর তখন গোবিন্দলালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া, মুখচুম্বন করিয়া, আদরে গলিয়া গিয়া, আধো আধো, মৃদু মৃদু হাসিমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্য মানুষ–কাকে ভাব্দ‍ছ বল না?” গো। কি হবে তোমায় বলিয়া? ভ্র। বল না! গো। তুমি রাগ করিবে। ভ্র। করি কর্ ‍বো–বল না। গো। যাও, দেখ গিয়া সকলের খাওয়া হলো কি না। ভ্র। দেখ্ক‍বো এখন–বল না কে মানুষ? গো। সিয়াকুল কাঁটা! রোহিণীকে ভাব‍‍ছিলাম। ভ্র। কেন রোহিণীকে ভাব‍‍ছিলে? গো। তা কি জানি? ভ্র। জান–বল না। গো। মানুষ কি মানুষকে ভাবে না? ভ্র। না। যে যাকে ভালবাসে, সে তাকেই ভাবে, আমি তোমাকে ভাবি–তুমি আমাকে ভাব। গো। তবে আমি রোহিণীকে ভালবাসি। ভ্র। মিছে কথা–তুমি আমাকে ভালবাস–আর কাকেও তোমার ভালবাস্ল‍তে নাই–কেন রোহিণীকে ভাব্ন‍ছিলে বল না? গো। বিধবাকে মাছ খাইতে আছে? ভ্র। না। গো। বিধবাকে মাছ খাইতে নাই, তবু তারিণীর মা মাছ খায় কেন? ভ্র। তার পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করে। গো। আমারও পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করি। রোহিণীকে ভালবাসি। ধা করিয়া গোবিন্দলালের গালে ভোমরা এক ঠোনা মারিল। বড় রাগ করিয়া বলিল, “আমি শ্রীমতী ভোমরা দাসী–আমার সাক্ষাতে মিছে কথা?” গোবিন্দলাল হারি মানিল। ভ্রমরের স্কন্ধে হস্ত আরোপিত করিয়া, প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্য মধুরিমাময় তাহার মুখমণ্ডল স্বকরপল্লবে গ্রহণ করিয়া, মৃদু মৃদু অথচ গম্ভীর, কাতর কণ্ঠে গোবিন্দলাল বলিল, “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে |” তীব্র বেগে গোবিন্দলালের হাত হইতে মুখমণ্ডল মুক্ত করিয়া, ভোমরা দূরে গিয়া, দাঁড়াইল। হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “-আবাগী–পোড়ারমুখী–বাঁদরী মরুক! মরুক! মরুক! মরুক! মরুক!” গোবিন্দলাল হাসিয়া বলিলেন, “এখনই এত গালি কেন? তোমার সাত রাজার ধন এক মাণিক এখনও ত কেড়ে নেয় নি |” ভোমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর তা কেন–তা কি পারে–তা মাগী তোমার সাক্ষাতে বলিল কেন?” গো। ঠিক ভোমরা–বলা তাহার উচিত ছিল না–তাই ভাবিতেছিলাম। আমি তাহাকে বাস উঠাইয়া কলিকাতায় গিয়া বাস করিতে বলিয়াছিলাম–খরচ পর্যন্ত দিতে স্বীকার করিয়াছিলাম। ভো। তার পর? গো। তার পর, সে রাজি হইল না। ভো।ভাল, আমি তাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি? গো। পার, কিন্তু আমি পরামর্শটা শুনিব। ভো। শোন। এই বলিয়া ভোমরা “ক্ষীরি! ক্ষীরি!” করিয়া একজন চাকরাণীকে ডাকিল। তখন ক্ষীরোদা–ওরফে ক্ষীরোদমণি–ওরফে ক্ষীরাব্ধিতনয়া—–ওরফে শুধু ক্ষীরি আসিয়া দাঁড়াইল–মোটাসোটা গাটা গোটা–মল পায়ে–গোট পরা–হাসি চাহনিতে ভরা ভরা। ভোমরা বলিল, “ক্ষীরি,-রোহিণী পোড়ারমুখীর কাছে এখনই একবার যাইতে পার‍বি?” ক্ষীরি বলিল, “পারব না কেন? কি বল‍‍তে হবে?” ভোমরা বলিল, “আমার নাম করিয়া বলিয়া আয় যে, তিনি বল‍‍লেন, তুমি মর|” “এই? যাই |” বলিয়া ক্ষীরদা ওরফে ক্ষীরি–মল বাজাইয়া চলিল। গমনকালে ভোমরা বলিয়া দিল, “কি বলে, আমায় বলিয়া যাস |” “আচ্ছা |” বলিয়া ক্ষীরোদা গেল। অল্পকালমধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “বলিয়া আসিয়াছি |” ভো। সে কি বলিল? ক্ষীরি। সে বলিল, উপায় বলিয়া দিতে বলিও। ভো। তবে আবার যা। বলিয়া আয় যে–বারুণী পুকুরে–সন্ধ্যেবেলা কলসী গলায় দিয়ে– বুঝেছিস?”
false
nihar_ronjon_gupta
শেষ। চিঠিটা ঐ পর্যন্তই লেখা—আর লেখা হয়নি। চিঠিটা হাতে করে কিরীটী বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় চিঠিটা পকেটে নিয়ে বের হয়ে এল। রাত তখন প্রায় সোয়া নটা। ১৭নং ঘরে মালতী ছিলেন। কিরীটী তার ঘরেই থাকবার ব্যবস্থা করেছিল মালতীর এবং নিজে নীচের একটা ঘরে শিট করেছিল। দরজা বন্ধ দরজার গায়ে টোকা দিতেই সাড়া এল। কে? মালতী দেবী, আমি কিরীটী রায়–দরজাটা খুলুন। মালতী দরজা খুলে দিল। ঘরে আসতে পারি? আসুন। দরজা ছেড়ে দিলেন মালতী। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন। কার চিঠি? কিসের চিঠি? মালতী শুধালেন। চিঠিটা আপনার স্বামীর লেখা আর আপনাকেই লেখা–চিঠিটা শেষ করতে পারেননি, তাই হয়তো পোস্ট করেননি। কোথায় পেলেন এটা? আপনার স্বামীর সুটকেসে। পড়ে দেখুন–আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর এর মধ্যে পাবেন। মালতী হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। মালতী কিরীটীর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন বটে কিন্তু মনে হল তার জন্য যেন মনের মধ্যে। কোন তাগিদ ছিল না। কোন ইচ্ছা বা আগ্রহও না। কিরীটী আর দাঁড়াল না। কিরীটী স্থির করেছিল পরের দিনই সে চলে যাবে। মালতী দেবীর কাজটুকু যখন শেষ হয়ে। গিয়েছে, পুরীতে থাকা তো আর প্রয়োজন নেই। কেবল একটা কাজ বাকি। হোটেলের বোর্ডারদের গতিবিধির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, হেমন্ত সাহুকে বলে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। হোটেল থেকে এখনও কেউ যাননি। রাত্রে আহারাদির পর নিজের ঘরে বসে বসে কিরীটী সেই কথাটাই ভাবছিল। রাত তখন গোটা দশেক হবে। থানা থেকে হেমন্ত সাহুর লোক এল তার একটা চিঠি নিয়ে। সাব, হুজুর আপনাকে একবার থানায় যেতে বলেছেন। কিরীটী আর দেরী করে না। উঠে পড়ল। লোকটা একটা সাইকেল-রিকশা এনেছিল। উঠে বসল কিরীটী সাইকেল-রিক্‌শায়। শ্রাবণের আকাশটা আজ পরিষ্কার, কোথাও কোন মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝকঝক করছে। আকাশভরা একরাশ তারা। সমুদ্রের একটানা গর্জন, বাতাস হু-হু করে ভেসে আসছে। কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র। ফেনার মুকুট মাথায় বালুবেলার ওপরে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। থানার অফিসঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন, আর তার সামনে মুখখামুখি বসেছিল যে লোকটা তাকে দেখে কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা জেগে ওঠে-সলিল দত্ত মজুমদার। এই যে আসুন মিঃ রায়, হেমন্ত সাহু বললেন। কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। আমি জানতে চাই দারোগাবাবু-সলিল দত্ত মজুমদার বললে ভুবনেশ্বরের হোটেল থেকে আমাকে এখানে এভাবে ধরে আনা হল কেন? জবাব দিল কিরীটীই, দাবোগাবাবুর কঠিন নির্দেশ সত্ত্বেও আপনি গতকাল কাউকে কিছু না। বলে হোটেল থেকে পালিয়েছিলেন কেন? পালিয়েছিলাম। কে আপনাকে বললে? যেভাবে চলে গিয়েছিলেন সেটা পালানো ছাড়া আর কি! আমি কারও হুকুমের চাকর নই। কিন্তু আইন যে কোন সময় আপনার গতি রুখতে পারে– অন্যায় আইন— ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা পরে হবে, আপনি পালিয়েছিলেন কেন তাই বলুন? আবারও বলছি, আমি পালাইনি—চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল ঐভাবে চলে গেলেই আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। শুনুন, আপনাকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে। অ্যারেস্ট। শুনতে পারি কি কিজন্য? আপনার বিরুদ্ধে তিন-তিনটি হত্যার অভিযোগ! কি পাগলের মত আবোলতাবোল বকছেন? তিন বৎসর আগে পুরীর হোটেলে এক রাত্রে জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করেন আপনি, এবং তিন বৎসর পরে আরও দুজনকে পর পর হত্যা করেন—প্রথমে অনুরাধা দেবী ও পরে ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে– মশাই গাঁজা-টাজা সেবন করেন নাকি? আপনি বলতে চান আপনি ঐ হত্যাগুলি করেননি? নিশ্চয়ই না–সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বরে এতটুকু কোন দ্বিধা বা সংকোচমাত্রও নেই, শান্ত, নিরুদ্বিগ্নতা ঐ অদ্ভুত আজগুবি চিন্তাটা আপনাদের উর্বর মস্তিষ্কে কি করে এবং কেনই বা এল জানতে পারি কি? নিশ্চয়ই। কিরীটীও অনুরূপ শান্ত গলায় জবাব দিল, জানতে পারেন বৈকি। বক্র হাসি দেখা গেল সলিল দত্ত মজুমদারের ওষ্ঠপ্রান্তে, আমিই যে তাদের হত্যা করেছি তার কোন প্রমাণ কি আপনাদের কাছে আছে? প্রমাণ ছাড়া কি দাবোগাবাবু আপনার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন? তাই নাকি? তা কি প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে বলুন তো? মোটামুটি যে চারটি প্রমাণ— চারটি প্রমাণ। হ্যাঁ। কিরীটী শান্তগলায় বললে, যে রাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করা হয়– সেরাত্রে তো হোটেলের ত্রিসীমানায়ও আমি ছিলাম না। আমি ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম, ম্যানেজার ভবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন। সে অ্যালিবাইটা আপনার ধোপে টিকবে না, কারণ সেরাত্রে আপনি আদৌ ভুবনেশ্বরে যাননি। আর জগন্নাথ পাণ্ডাই সে সাক্ষ্য দেবে। মনে হল আপনি যেন একটু চমকে উঠলেন : মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার একটা কথা জানা প্রয়োজন, জগন্নাথ পাণ্ডা আপাতত নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থান করছে—আদালতেই যা বলবার সে বলবে; তারপর ২ নং প্রমাণ আপনার ব্যবহৃত বিলেত থেকে আনা রেইনকোট, মানে ওয়াটারপ্রুফটা—যেটা আপনি সেরাত্রে জলঝড়ের মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন—তারপর আপনার কাজকর্ম চুকে যাবার পর হোটেল থেকে বের হয়ে গিয়ে সমুদ্রতীরে একটা কাঁটাঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। সেটার স্থানে স্থানে এখনও যথেষ্ট রক্তচিহ্ন আছে—যে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে প্রমাণ করবে অনুরাধা দেবীরই রক্ত, সেটা এখন সেরাত্রের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রমাণ হিসাবে থানায়-ই আছে। শেষের কথাগুলো শুনতে শুনতে কিরীটীর মনে হল যেন সলিল দত্ত মজুমদারের মুখের চেহারাটা কেমন পালটে যাচ্ছে। এবার আসা যাক তৃতীয় প্রমাণে—আপনার পিস্তলটা, যেটার সাহায্যে তৃতীয় দিন রাত্রে আপনি আপনার হতভাগ্য নির্বোধ সম্বন্ধী ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে হত্যা করেছিলেন, সেই পিস্তলটা আজ শেষরাত্রে একজন জেলে সমুদ্রের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছে—ঐ পিস্তলের নম্বরটাই প্রমাণ দেবে, ঐ পিস্তলের লাইসেন্স হোল্ডার কে! কিরীটীর মনে হল, সলিল দত্ত মজুমদারের থুতনীটা যেন ঝুলে পড়েছে। বলছিলাম না চারটি প্রমাণ আপাতত আমাদের হাতে আছে, চতুর্থ প্রমাণ
false
shorotchandra
থেকে খেয়ে কখন গেলেন? ভবানী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, সে ত এখানে খায়নি। তাগাদার পথে শুধু এক গেলাস জল খেয়ে চলে গেল। চক্রবর্তী কহিল, এই নাও। আজ বড়বাবুর জন্মতিথি। বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বলে এসেচে, মায়ের প্রসাদ পেতে যাচ্চি। তা হলে সারাদিন খাওয়াই হয়নি দেখচি। শুনিয়া ভবানীর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। বিনোদ পাশের ঘরেই ছিল, চক্রবর্তীর সাড়া পাইয়া কাছে আসিয়া বসিল। তামাশা করিয়া কহিল, কি চক্রবর্তীমশাই, নিমাই রায়ের তাঁবে চাকরি হচ্চে কেমন? চক্রবর্তী আশ্চর্য হইয়া কহিল, নিমাই রায়? রামঃ—সে কি দোকানে ঢুকতে পারে নাকি? বিনোদ বলিল, শুনতে পাই দাদাকে সে গ্রাস করে বসে আছে? চক্রবর্তী ভবানীকে দেখাইয়া হাসিয়া কহিল, উনি বেঁচে থাকতে সেটি হবার জো নেই ছোটবাবু। আমাকে তাড়িয়ে সর্বস্বর মালিক হতেই এসেছিলেন বটে, কিন্তু মায়ের একটা হুকুমে সব ফেঁসে গেল। এখন ঠকিয়ে-মজিয়ে ছ্যাঁচড়ামি করে যা দু’পয়সা আদায় হয়, দোকানে হাত দেবার জো নেই। বলিয়া চক্রবর্তী সেদিনের সমস্ত ইতিহাস বিবৃত করিয়া কহিল, বড়বাবু একটুখানি বড্ড সোজা মানুষ কিনা, লোকের প্যাঁচ-স্যাঁচ ধরতে পারে না। কিন্তু তা হলে কি হয়, পিতৃমাতৃভক্তি যে অচলা—সেই যে বললেন, মায়ের হুকুম রদ করবার আমার সাধ্যি নেই—তা এত কাঁদাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি—না, কিছুতে না | আমার বাপের হুকুম—মায়ের হুকুম! আমি যেমন কর্তা ছিলাম—তেমনি আছি ছোটবাবু। বিনোদের দু’চক্ষু জ্বালা করিয়া জলে ভরিয়া গেল। চক্রবর্তী কহিতে লাগিল, এমন বড়ভাই কি কারু হয় ছোটবাবু? মুখে কেবল বিনোদ আর বিনোদ। আমার বিনোদের মত পাশ কেউ করেনি, আমার বিনোদের মত লেখাপড়া কেউ শেখেনি, আমার বিনোদের মত ভাই কারু জন্মায় নি। লোকে তোমার নামে কত অপবাদ দিয়েচে ছোটবাবু, আমার কাছে এসে হেসে বলেন, চক্কোত্তিমশাই, শালারা কেবল আমার ভায়ের হিংসে করে দুর্নাম রটায়। আমি তাদের কথায় বিশ্বাস করব, আমাকে এমনি বোকাই ঠাউরেচে শালারা! একটু থামিয়া কহিল, এই সেদিন কে এক কাশীর পণ্ডিত এসে তোমার মন ভাল করে দেবে বলে একশ-আট সোনার তুলসীপাতার দাম প্রায় পাঁচ শ টাকা বড়বাবুর কাছে হাতিয়ে নিয়ে গেছে। আমি কত নিষেধ করলুম, কিছুতেই শুনলেন না; বললেন, আমার বিনোদের যদি সুমতি হয়, আমার বিনোদ যদি এম. এ. পাশ করে—যায় যাক আমার পাঁচ শ টাকা। বিনোদ চোখ মুছিয়া ফেলিয়া আর্দ্রস্বরে কহিল, কত লোক যে আমার নাম করে দাদাকে ঠকিয়ে নিয়ে যায়, সে আমিও শুনেচি চক্কোত্তিমশাই। চক্রবর্তী গলা খাটো করিয়া কহিল, এই জয়লাল বাঁড়ুয্যেই কি কম টাকা মেরে নিয়েচে ছোটবাবু! ওই ব্যাটাই ত যত নষ্টের গোড়া। বলিয়া সে কর্তার মৃত্যুর পরে সেই ঠিকানা বাহির করিয়া দিবার গল্প করিল। ভবানী কোন কথায় একটি কথাও কহেন নাই—শুধু তাঁর দুই চোখে শ্রাবণের ধারা বহিয়া যাইতেছিল। চক্রবর্তী বিদায় লইলে বিনোদ শুইতে গেল; কিন্তু সারারাত্রি তাহার ঘুম হইল না। কেন এমন একটা অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটিল, পিতা তাহাকে একভাবে বঞ্চিত করিয়া গেলেন, দাদা তাহাকে কিছুই দিতে চাহিতেছে না, চক্রবর্তীর মুখে আজ সেই ইতিহাস অবগত হইয়া সে ক্রমাগত ইহাই চিন্তা করিতে লাগিল। বিনোদের বন্ধুরা বিশেষ উদ্যোগী হইয়া কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক সঙ্গে করিয়া রবিবারের সকালবেলা গোকুলের বৈঠকখানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। গোকুল দোকানে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, এতগুলি ভদ্রলোকের আকস্মিক অভ্যাগমে তটস্থ হইয়া উঠিল। বিশেষ করিয়া ডেপুটিবাবুকে এবং সদরআলা গিরিশবাবুকে দেখিয়া তাঁহাদের যে কোথায় বসাইবে, কি করিবে, ভাবিয়া পাইল না। বিনোদ নিঃশব্দে মলিনমুখে একধারে গিয়া বসিল। তাহার চেহারা দেখিলে মনে হয় তাহাকে যেন বলি দিবার জন্যে ধরিয়া আনা হইয়াছে। বাঁড়ুয্যেমশাই ছিলেন, কথাটা তিনিই পাড়িলেন। দেখিতে দেখিতে গোকুলের চোখ আরক্ত হইয়া উঠিল। কহিল, ওঃ, তাই এত লোক! যান আপনারা নালিশ করুন গে, আমি এক সিকি-পয়সা ওই হতভাগা নচ্ছারকে দেব না। ও মদ খায়। আর সকলে মৌন হইয়া রহিলেন। বাঁড়ুয্যেমশাই ভঙ্গী করিয়া হাসিয়া বলিলেন, বেশ, তাই যেন খায়, কিন্তু তুমি ওর হক্কের বিষয় আটকাবার কে? তুমি যে তোমার বাপের মরণকালে জোচ্চুরি করে উইল লিখে নাওনি তার প্রমাণ কি? গোকুল আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিয়া চিৎকার করিয়া কহিল, জুচ্চুরি করেছি? আমি জোচ্চোর? কোন্ শালা বলে? গিরিশবাবু প্রাচীন লোক। তিনি মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, গোকুলবাবু অমন উতলা হবেন না, একটু শান্ত হয়ে জবাব দিন। বাঁড়ুয্যেমশাই পুরানো দিনের অনেক কথাই নাকি জানিতেন, তাই চোখ ঘুরাইয়া কহিলেন, তা হলে আদালতে গিয়ে তোমার মাকে সাক্ষী দিতে হবে গোকুল। তিনি যা ভাবিয়াছিলেন, ঠিক তাই। গোকুল উন্মত্ত হইয়া উঠিল—কি, আমার মাকে দাঁড় করাবে আদালতে? সাক্ষীর কাঠগড়ায়? নি গে যা তোরা সব বিষয়-আশয়—নি গে যা—আমি চাইনে। আমি যাব না আদালতে; মাকে নিয়ে আমি কাশীবাসী হবো। নিমাই রায়ও উপস্থিত ছিলেন, চোখ টিপিয়া বলিলেন, আহা-হা, থাক না গোকুল। কর কি, কি-সব বলচ? গোকুল সে কথা কানেও তুলিল না। সকলের সন্মুখে ডান-পা বাড়াইয়া দিয়া বিনোদকে লক্ষ্য করিয়া তেমনি চিৎকারে কহিল, আয় হতভাগা এদিকে আয়, এই পা বাড়িয়ে দিয়েচি—ছুঁয়ে বল—তোর দাদা জোচ্চোর | সমস্ত না এই দণ্ডে তোকে ছেড়ে দিই ত আমি বৈকুন্ঠ মজুমদারের ছেলে নই। নিমাই ভয়ে শশব্যস্ত হইয়া উঠিল, আহা-হা, কর কি বাবাজী। করুক না ওরা নালিশ—বিচারে যা হয় তাই হবে—এ-সব দিব্যি-দিলেসা কেন? চল চল, বাড়ির ভেতরে চল। বলিয়া তাহার একটা হাত ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল। কিন্তু বিনোদ মাথা তুলিয়া চাহিল না, একটা কথার জবাবও দিল না—একভাবে নীরবে বসিয়া রহিল। গোকুল সজোরে হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, না, আমি এক-পা নড়ব
false
MZI
আর অবাক হয়ে দেখলাম লুকাসের হাত কবজির কাছ থেকে ছিড়ে উড়ে গেছে। লুকাস খপ করে নিজের কাটা হাতটা ধরে বিকৃত মুখে কী-একটা বলে চেচিয়ে ওঠে, কেউ-একজন নিশ্চয়ই তাকে গুলি করেছে। দূরে পুলিসের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম একটা হেলিকপ্টারও আছে উপরে কোথাও। পারলাম না, আমি পারলাম না, লুকাস কাটা হাতটা বিদায়ের ভঙ্গিতে নেড়ে ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। সামনে পুলিসের গাড়ি থেকে আবার তাকে গুলি করা হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল, কিন্তু তার গায়ে গুলি লাগল কিনা বুঝতে পারলাম না। ধোয়া সরে গেলে দেখতে পেলাম লুকাস তখনো ছুটছে, দেয়ালের পাশে গিয়ে এক লাফে সে প্রায় বিশ ফুট উচু দেয়ালে উঠে গেল, উপরে বৈদ্যুতিক তারগুলো ধরে সে নিজেকে মুহূর্তের জন্যে সামলে নেয়। বৈদ্যুতিক তারে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার ভোন্ট থাকার কথা, কিন্তু লুকাসের কাছে সেটা কোনো সমস্যা বলে মনে হল না। আবার পুলিসের গাড়ি থেকে লুকাসকে গুলি করা হল, গুলির আঘাতে লুকাসকে দেয়ালের অন্য পাশে ছিটকে পড়ে যেতে দেখলাম, নিচে খাড়া খাদ অন্তত দুই শ’ ফুট নেমে গেছে, কপাল খারাপ হলে হাজারখানেক ফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। মানুষ হলে বেঁচে থাকার কোনো প্রশ্নই আসত না, কিন্তু রবোটেরা, বিশেষ করে এই আশ্চর্য রবোট্রনেরা কতটুকু আঘাত সহ্য করতে পারে বলা কঠিন। গুলিটা কোথায় লেগেছে কে জানে, হয়তো এমন জায়গায় লেগেছে যে বেশি ক্ষতি হয় নি, হয়তো সামলে নেবে। আমি নিজের অজ্ঞাতেই প্রার্থনা করতে থাকি লুকাস যেন ঠিকঠিকভাবে পালিয়ে যেতে পারে। পুলিসের গাড়িটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমার ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পুলিস অফিসার ধীরেসুস্থে নেমে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে যায়। আরেকজন হাতের চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি কথা বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছে এসে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে আমার দিকে সহৃদয়ভাবে হেসে জিজ্ঞেস করল, কি খবর আপনার? আমি উত্তরে ভদ্রতাসূচক কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি দ্বিতীয় বার ট্রাকিওশানটি চালু করা হল। এক মুহূর্তে আমার সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে, মনে হতে থাকে কেউ যেন গনগনে গরম সুচ আমার লোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতরে কেউ যেন গলিত সীসা ঢেলে সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন করে দিল। আমি গাড়ির সীটটি খামচে ধরে প্রাণপণে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলাম, নিজের অজান্তে আমার গলা দিয়ে বীভৎস গোঙানোর মতো আওয়াজ বের হতে থাকে। আমার মনে হয় অনন্তকাল থেকে আমি যেন ওখানে পড়ে আছি। অনেক কষ্টে আমি চোখ খুলে তাকালাম, পুলিস অফিসারটি তখনো মুখে হাসি নিয়ে আমাকে দেখছে। আমার কিছু করার নেই, অসহায়ভাবে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ৩ শাস্তি আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন? এই নিয়ে আমাকে চতুর্থ বার একই প্রশ্ন করা হল। একটি প্রাচীন রবোট বা নির্বোধ কম্পিউটারের কাছ থেকে এরকম জিজ্ঞাসাবাদে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সে একজন জলজ্যান্ত মানুষ। আগেও দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন কেমন জানি একচক্ষু হরিণের মতো হয়, নিজেদের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। বলুন, আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন? আমি ওকে ছাড়ি নি, ও নিজেই পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও পালানোর সুযোগ পেয়েছে, কারণ আপনি লাল কার্ড দেখিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তার কথা মেনে নিলাম, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, তাই আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। লোকটি তবু উত্তরের জন্যে বসে রইল, বলল, বলুন। কী বলব? কেন তাকে ছাড়িয়ে নিলেন? আমার মায়া হচ্ছিল, মেয়েটাকে যেভাবে মারা হল সেটা ছিল অমানুষিক নিষ্ঠুরতা। মায়া? নিষ্ঠুরতা? লোকটা পারলে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। আমার পাশে যে ডাক্তার মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছেন কী বলেছে? ডাক্তার মেয়েটি দেখতে বেশ, আমার জন্যে খানিকটা সমবেদনা আছে টের পাচ্ছি। লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি আবার রাগ-রাগ মুখে আমার দিকে তাকায়, রবোট্রনের জন্যে মায়া হয়? একটা পেন্সিল ভাঙলে মায়া হয় না? লোকটি নিজের কথাকে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যেই সম্ভবত তার হাতের পেন্সিলটি ভেঙে ফেলল। ডাক্তার মেয়েটি প্রথম বার কথা বলল, আপনি খামোকা উত্তেজিত হচ্ছেন। পেন্সিল আর রবোট্রন এক জিনিস নয়। রবোট্রন দেখতে এত মানুষের মতো যে তাদের ধ্বংস করতে দেখা খুব কষ্টকর, মনে হয় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমরা আগেও দেখেছি, অনেকে রবোট্রন ধ্বংস করা সহ্য করতে পারে না। লোকটি এবার রাগ-রাগ মুখে ডাক্তার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, রবোট্রনেরা কী করছে সেটা যদি সবাই জানত, তাহলে সহ্য করা নিয়ে খুব সমস্যা হত না। ক্রুগো কম্পিউটারের শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন? দেখেছি। তাহলে? কিন্তু ক’জন ঐ রিপোর্টের খোঁজ রাখে? আর ঐ রিপোর্টের সব সত্যি, তার কি নিশ্চয়তা আছে? লোকটি ভুরু কুঁচকে ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকাল, আপনি বলতে চান ক্রুগো কম্পিউটার একটা মিথ্যা রিপোর্ট লিখবে? মেয়েটি উত্তর না দিয়ে আবার কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি খানিকক্ষণ চিন্তিত মুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনি জানেন, আপনি যে কাজটি করেছেন তার শাস্তি কী? আমি এবারে সত্যি সত্যি মধুর ভঙ্গি করে হেসে বললাম, জানি। কী? মৃত্যুদণ্ড। লোকটার চোখ ছোট ছোট হয়ে এল, আপনি ভাবছেন আপনাকে যখন ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে
false
humayun_ahmed
করব? আমি কি আইবির লোক? আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? ধমক দিতে হলে নীতুকে ধমক দাও। নীতুটা কে ভাইয়া? সাজ্জাদের ছোট বোন। ও আচ্ছা, সাজ্জাদ ভাইয়ার ছোট বোন। তোমার মুখে তো কোন দিন তার নাম শুনিনি। নাম শোনার কি আছে? এই নাও নীতুর চিরকুট। ফেলে দে। আমি ওটা নিয়ে করব কি? খবর যা জানার তা তো জানলামাই। এখন চিরকুট দিয়ে হবে কি? তাবিজ করে গলায় ঝুলাব? মিলি আবারও হাসল। সেই হাসি দেখে আতাহারের মন দ্রবীভূত হল। সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা খেতে ভাল হয়েছে। মিলি হাসি মুখে বলল, ভাইয়া, দুই মিনিটের জন্য বসি? খুব জরুরি কথা আছে। ভয়াবহ একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাবাকে সেই সমস্যার কথা কিভাবে বলা হবে বুঝতে পারছি না। তোমার পরামর্শ দরকার। সমস্যাটা কি? ফরহাদ ভাইয়া পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। সে কি? আজ তার সেকেন্ড পেপার ছিল। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে দেখল। খুব সহজ প্রশ্ন। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর যে সে জানে তাই না–তার ঝাড়া মুখস্থ। এই আনন্দে তার মাথা ঘুরে গেল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান হবার পর দেখে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সারা শরীর পানিতে ভেজা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তার পর আর হলে ঢোকেনি। তার জন্যে গরম দুধ আনা হয়েছিল। দুধ খেয়ে সে বাসায় চলে এসেছে। বলিস কি? মিলি এখনও হাসছে। আতাহার শক্তিকত বোধ করছে। ঘটনা যা ঘটেছে তাতে হাসোহাসি করা যায় না। বাবা ঘটনা শুনে কি করবেন তা ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফরহাদ এখন করছে কি? ঘুমুচ্ছে। ঘুমুচ্ছে মানে? ঘুমুচ্ছে মানে ঘুমুচ্ছে। স্লিপিং। আরাম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আতাহার বিড় বিড় করে বলল, ওহি মাই গড়! মিলি বলল, ওহি মাই গড় বলা ঠিক না ভাইয়া। গড় তো তোমার একা না। কাজেই আমাদের বলা উচিত–ওহ আওয়ার গড়! মিলির ফাজলামি ধরনের কথা শুনতে ভাল লাগছে না। আতাহার চিন্তিত মুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মুষল ধারে পড়ছে। বৃষ্টি রাত একটা পর্যন্ত হল। আতাহারের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যৰ্থ করে দিয়ে রাত একটার সময়ই নোংরা। পানি বাড়িতে ঢুকে গেল। সেই রাতে আতাহারের খুব ভাল ঘুম হল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল। সে জাপানে। কিমানো পরা এক জাপানি তরুণী তার সঙ্গে হেসে হেসে বাংলায় কথা বলছে। তরুণীর মুখটা কিছুটা নীতুর মত। আতাহার বলল, আপনি এত সুন্দর বাংলা কোথায় শিখেছেন? জাপানি তরুণী তাতে খুব মজা পেয়ে গেল। খিল খিল করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনি ছাড়া আর আমাকে কে শেখাবে? আতাহার কিছুতেই ভেবে পেল না কখন সে এই মেয়েকে বাংলা শিখিয়েছে। স্বপ্নের মধ্যেই তার খুব অস্থির লাগতে লাগল। রশীদ সাহেব বললেন, তুই যাচ্ছিস কোথায়? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আতাহার সত্যি সত্যি ভুলে গেল সে কোথায় যাচ্ছে। কিছুতেই মনে করতে পারল না–অথচ সে একটা বিশেষ কাজেই বেরুচ্ছিল। কাজটা কি তা বাবাকে দেখার আগ পর্যন্ত মনে ছিল–এখন আর মনে নেই। একটা বিশেষ বয়সের পর বাবা-ছেলের সম্পর্ক বন্ধুর মত হবার কথা–তাদের হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের দূরত্ব বাড়ছে। এক সময় তার বাবা ঘোড়া সেজেছেন এবং সে তার বাবার পিঠে বসেছে এটা ভাবতেও এখন গা শির শির করে। তবে ঘটনা সত্যি। ঘোড়া সাজা রশীদ সাহেবের ছবি আছে। বেশ যত্নে আছে। ছবিটা বঁধানো এবং রশীদ সাহেবের শোবার ঘরে বাকাভাবে টানানো। কি রে, কথা বলছিস না কেন? যাচ্ছিস কোথায়? পলিটিক্যাল লোক। আমাকে জাপানে নিয়ে যাবেন বলেছেন। মানুষের মুখের কথায় বিভ্রান্ত হবি না। মিষ্টি কথায় ভুলবি না। তার কি দায় পড়েছে তোকে জাপানে নেয়ার? উনি এর জন্যে টাকা নেন। আদম ব্যবসা? প্রায় সে রকমই। জাপানে গিয়ে কি করবি? ঝাড়ুদার হবি? তোকে এম. এ. পাশ করিয়েছি ঝাড়ুদার হবার জন্যে? আতাহার একবার ভাবল বলে–কোন কাজকে ছোট ভাবা ঠিক না। ক্লাস নাইনে মুখস্থ করা রচনা আছে না। শুমের মর্যাদা। যে জাতি শ্রমের মর্যাদা দিতে জানে না সেই জাতির সামনে ভয়াবহ দিন–উদাহরণ বাংলাদেশ। কিছুই বলা হল না। আতাহার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রশীদ সাহেব বললেন, ঐ লোককে কত টাকা দিতে হবে? দুই লাখ টাকা। বলিস কি? এত টাকা! এইসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করা। যার দেশে কিছু হয় না তার বিদেশেও হয় না। বুঝলি? জ্বি। এখন একটা কাজ কর–পত্রিকার অফিসে যা–একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে আয়। মনিকা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চায়। বিক্রি করে ঝামেলা চুকিয়ে দেই। উল্টাপাল্টা কথা তোর মাকে লিখেছে–ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া না-কি খেয়ে ফেলেছি। নিজের বাবা প্রসঙ্গে এই বক্তব্য। ধরে চাবাকানো দরকার। বিজ্ঞাপনটা কি লেখা আছে? হ্যাঁ, লেখা আছে। আমার টেবিলের উপর আছে। বিজ্ঞাপন ছাপাতে বাবা টাকা লাগবে। টাকা তো লাগবেই। তোর মুখ দেখে তো আর বিজ্ঞাপন ছাপবে না। আয় টাকা নিয়ে যা। আতাহার টাকা নেয়ার জন্যে বাবার পেছনে পেছনে গেল। রশীদ পাঁচটা একশ টাকার নোট দিলেন। বিরস মুখে বললেন, যা লাগবে দিয়ে বাকিটা আমাকে ফেরত দিবি। জ্বি আচ্ছা। পত্রিকা অফিস থেকে ফেরার পথে নাখালপাড়া হয়ে ফিরবি। নাখালপাড়ায় কি? আমার এক পুরানো ছাত্রী, ফরিদা নাম, তাকে এই চিঠিটা দিবি। তার হাতেই দিবি–অন্য কারো হাতে না। খামের উপরে ঠিকানা লেখা আছে। জ্বি আচ্ছা। আতাহার ঘর থেকে বের হয়ে মুক্তির
false
tarashonkor
খুঁট অ্যাঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে নাগিনী কন্যে। গঙ্গার কূলে বটগাছের তলায় খেজুর-চাটাইয়ের খুঁট চেপে ধরতে গিয়েও সেদিন শবলা তা ধরলে না। কি হবে ও? কি হবে? কি হবে? এত বড় জোয়ানটাই তার জন্যে প্রাণটা দিয়েছে। না হয় সেও প্রাণটা দেবে। তার প্রেতাত্মা যদি ওই গঙ্গার ধারে এসে থাকে? বুকের ভিতরটা তার হুহু করে উঠল। উঠে বসল সে খেজুর-চাটাইয়ের উপর। আকাশ থেকে মাটির বুক পর্যন্ত থমথম করছে অন্ধকার। আকাশে সাতভাই তারা ঘুরপাক। খেয়ে হেলে পড়বার উদ্যোগ করছে। চারিদিকটায় দুপহর ঘোষণার ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। নিশির ডাক এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, ধক-ধক-ধক-ধক। চোখে তার আর পলক পড়ছে না। অন্ধকারের দিকে চেয়ে রয়েছে। গাছপালা মিশে গিয়েছে অন্ধকারের সঙ্গে, শহর ঢেকে। গিয়েছে অন্ধকারের মধ্যে, ঘাট মাঠ ক্ষেত খামার বন বসতি বাজার হাট মানুষ জন—সব-সবসব অন্ধকারের মধ্যে মিশে গিয়েছে। যেন কিছুই নাই কোথাও; আছে শুধু অন্ধকার–জগৎজোড়া এক কালো পাথা—র– সে উঠল; এগিয়ে চলল। এগিয়ে চলল গঙ্গার দিকে। গঙ্গার উঁচু পাড় ভেঙে সে নেমে গিয়ে বসল—সেইখানটিতে, যেখানটিতে সেদিন সেই জোয়ান ছেলেটা তার জন্যে বসে ছিল। একটানা ছলছল ছলছল শব্দ উঠছে গঙ্গার স্রোতে, মধ্যে মধ্যে গঙ্গার স্রোত পাড়ের উপর। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। পাশেই একটু দূরে তাদের নৌকাগুলি দোল খাচ্ছে। ভিজে। মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে কাঁদতে লাগল। ইচ্ছে হল, সেও ঝাঁপ দেয় গঙ্গার জলে। মা-গঙ্গা! মোর অঙ্গের জ্বালা তুমি জুড়িয়ে দিয়ে, মুছিয়ে দিয়ে। মা গঙ্গা! আমার জন্যে শুধু আমার জন্যে সে দিলে তার পরানটা! হায় রে! হায় রে! তার বুকে জ্বালাও তো কম নয়। জ্বালা কি শুধু বুকে? জ্বালা যে সর্বাঙ্গে। হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজে চমকে উঠল সে। চিনতে পারল সে, এ কার গলার আওয়াজ। বুড়ার! বুড়া ঠিক জেগেছে। ঠিক বুঝতে পেরেছে। দেখেছে, শবলার বিছানায় শবলা নাই। মুহূর্তে শবলা নেমে পড়ল গঙ্গার জলে। একটু পাশেই তাদের নৌকাগুলি গাঙের ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। সে সেই নৌকাগুলির ধারে ধারে ঘুরে একটি নৌকায় উঠে পড়ল। এটি তারই নৌকা। লাগিনী কন্যের লা। মা-বিষহরির বারি আছে এই নৌকায়। উপুড় হয়ে সে পড়ে রইল বারির সামনে। রক্ষা কর মা, রক্ষা কর। বুড়ার হাত থেকে রক্ষা কর। নিশির নেশা থেকে শবলারে তুমি বাঁচাও। বেদেকুলের পুণ্যি যেন শবলা থেকে নষ্ট না হয়। জোয়ানটার প্রাণ গিয়েছে—তুমি যদি নিয়েছ মা, তবে শবলার বলবার কিছু নাই। কিন্তু মা গ, জননী গ, যদি মানুষে ষড়যন্ত্র করে নিয়ে থাকে তবে তুমি তার বিচার কোরো। সূক্ষ্ম বিচার তোমার মা–সেই বিচারে দণ্ড দিয়ে। -–তুমি তার বিচার করো মা বিচার কোরো। কখন যে সে চিৎকার করে উঠেছিল, সে নিজেই জানে না। কিন্তু সে চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল নৌকার পাহারাদারদের। তারা সভয়ে সন্তৰ্পণে এসে দেখলে শবলা পড়ে আছে বিষহরির বারির সম্মুখে। চিৎকার করছে—বিচার কোরো। বেদের ছেলেরা জানে, নাগিনী কন্যার আত্মা–সে মানুষের আত্মা নয়, নাগকুলের নাগ-আত্মা। বিষহরি তার হাতে পুজো নেবেন বলে তাকে পাঠান বেদেকুলে জন্ম নিতে। তার ভর হয়। চোখ রাঙা হয়ে ওঠে—চুল এলিয়ে পড়ে—সে তখন আর আপনার মধ্যে আত্মস্থ থাকে না। সাক্ষাৎ দেবতার সঙ্গে তার তখন যোগাযোগ হয়। বেদেকুলের পাপপুণ্যের পট খুলে যায় তার লাল চোখের সামনে। সে অনর্গল বলে যায়—এই পাপ, এই পাপ। হবে না–এমন হবে না? বেদের ছেলেরা শিউরে উঠল ভয়ে। ভিজে কাপড়ে ভিজে চুলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নাগিনী কন্যে। হাত জোড় করে চিৎকার করছে—বিচার কোরো। তারা নৌকাতে উঠছে নৌকা দুলছে—তবু হুঁশ নাই। এ নিশ্চয় ভর। এই নিশীথ রাত্রি এই চিৎকার, উঃ! চিৎকারে অন্ধকারটা যেন চিরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বেদেরা জেগে উঠল। এসে ভিড় করে দাঁড়াল গঙ্গার কূলে। হাত জোড় করে সমবেত স্বরে চিৎকার করে উঠলরক্ষা কর মা, রক্ষা কর। কিন্তু সর্দার কই? সর্দার? বুড়া? বুড়া কই? ভাদু বেদে কলে–সর্দার! অ–গ! কই? কই? কোথায় বুড়া? বুড়া নাই। ভাদু শবলার কাকা। ভাদু বললে শবলার মাকে। প্রৌঢ়া সুরধুনী বেদেনীকে বললে—ভাজ বউ গ, তুমি দেখ একবার। কন্যেটারে ডাক। বেদেনী ঘাড় নাড়লেনা দেওর, লারব। ওরে কি এখুন ছোঁয়া যায়? –তবে? –তবে সবাই মিল্যা একজোট হয়ে চিল্লায়ে ডাক দাও। দেখ কি হয়? —সেই ভাল। লে গ,–সবাই মিল্যা একসাথে লে। হে—মা– সকলে সুর মিশিয়ে দিলে একসঙ্গে।—হে মা-বিষহরি গ! স্তব্ধ নিশীথ রাত্রির সুষুপ্ত সৃষ্টি চকিত হয়ে উঠল। ধ্বনির প্রতিধ্বনি উঠল গঙ্গার কূলে ও-পাশের ঘন বৃক্ষসন্নিবেশে, ছুটে গেল এ পারের প্রান্তরে, ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তরে। শবলার চেতনা ফিরে এল। সে মাথা তুললে।—কি? পরমুহূর্তেই সে সব বুঝতে পারলে। তার ভর এসেছিল। দেবতা তার পরান পুতলির মাথার উপর হাত রেখেছিলেন। শরীরটা এখনও তার ঝিমঝিম করছে। তবু সে উঠে। বসল। উঠিছে, উঠে বসিছে, কন্যে উঠে বসিছে গ!–বললে জটাধারী বেদে। বেদেরা আবার ধ্বনি দিলে—জয় মা-বিষহরি! টলতে টলতে বেরিয়ে এল শবলা। —ধর গ। ভাজবউ, কন্যেরে ধর। টলিছে। সুরধুনী বেদেনী এবার জলে নামল। –কি হছিল কন্যে? বেটি? শবলা বললে–মা দেখা দিলেন গ। পরশ দিলেন। —কি কইলেন? –কইলেন? চোখ দুটো ঝকমক করে উঠল তার। সে বললে—সূক্ষ্ম বিচার করবেন না। সুতার ধারে সূক্ষ্ম বিচার। ঠিক এই সময় তটভূমির উপর কুকুরের চিৎকার শোনা গেল। সকলে চমকে উঠল। কি সে গলার আওয়াজ কুকুরের! একসঙ্গে দু-তিনটে চিৎকার করে
false
humayun_ahmed
শুরু করতে হবে। কিন্তু তিনি বিরক্ত হচ্ছেন না। তাঁর ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে। তিনি কান পেতে গানের কথাগুলি শোনার চেষ্টা করছেন। দিনের প্রথম আলোয় তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম তুমি এলে না। মধ্যাহ্নের তীব্র আলোয় তোমাকে কেমন দেখায় জানা হল না, কারণ তুমি মধ্যাহ্নে এলে না। সূর্যের শেষ রশ্মি কি তোমার রঙ বদলে দেয়? আমি জানি না, কারণ তুমি এলে রাতের অন্ধকারে। প্রিয়তম, আমি শুধু তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারে কি করে দেখব? ফিহা মুগ্ধ গলায় বললেন, গাধাটাতে ভালো গাইছে। বেশ ভালো গাইছে। পাঠক বলল, ডাটা এন্ট্রির কাজটা আজ বন্ধ থাকলে কি ক্ষতি হবে? থাকুক বন্ধ থাকুক। আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে আমি কি অভিনন্দন জানাতে পরি? হ্যাঁ পার। পাঠক নিচু গলায় বলল, মানুষের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। তারপরেও মনে হয় আপনার আনন্দ আমি খানিকটা বুঝতে পারছি। ধন্যবাদ পাঠক। সময় সমীকরণের অনেকগুলি ধাপ আপনি অতিক্রম করে এসেছেন। সীমাহীন আপনার প্রতিভা। শেষ ধাপটি অতিক্রম করতে আপনার স্ত্রী আপনাকে সাহায্য করবে। এই শুভ কামনা। সে কি করে সাহায্য করবে? এই জটিল জগতে তার স্থান কোথায়? সে তার মতো করে আপনাকে সাহায্য করবে। গণিত এবং পদার্থবিদ্যার সাহায্যের প্রয়োজন আপনার নেই, স্যার। হ্যাঁ তাও বোধ হয় ঠিক। একটি ক্ষুদ্র জায়গায় আমি আটকে গেছি। আমি জট খুলতে পারছি না। আপনি জটটা বুঝতে পারছেন। সারাক্ষণ তাকিয়ে আছেন জটটির দিকে। এই জট আপনাআপনি খুলবে। না খুললে সমূহ বিপদ পাঠক। জট খুলতে না পারলে মেটালিস্টরা আমাদের গ্রাস করে নেবে। সামনের পৃথিবী হবে মানবশূন্য পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে থাকবে শুধু মেন্টালিস্ট আর কেউ না। মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে পাঠক। অতি দ্রুত কমে আসছে। পাঠক বলল, যে ক্ষমতাধর সেই টিকে থাকবে। এ সত্য স্বীকার করে নেয়াই কি ভালো না স্যার? তুমি মেন্টালিস্টদের ক্ষমতাধর বলছ? হ্যাঁ বলছি। ওরা যে টিকে যাচ্ছে এটিই কি সবচে বড় প্রমাণ নয় যে ওরা ক্ষমতাধর। সময় সমীকরণের আমি সমাধান বের করব। আমি নিজে যাব অতীতের পৃথিবীতে। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট যে বিশেষ পরীক্ষাটি করে প্রথম মেন্টালিস্ট শিশু তৈরি করেছিলেন সেই পরীক্ষা আমি করতে দেব না। তা যদি করতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে মানুষই ক্ষমতাধর। মেন্টালিস্টরা নয়। অবশ্যই মানুষ ক্ষমতাধর। আমি তা প্রমাণ করব পাঠক। আমি তা প্রমাণ করব। শোন পাঠক, আমার সমস্যা কোন জায়গাটায় হচ্ছে আমি তোমাকে বলিখুব সাদামাটাভাবে বলা যায় সময়ের শুরু হচ্ছে বিগ বেংগে। তারপর সময় এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে… আমাকে বলে কোনো লাভ হবে না। আমি তো স্যার এ ব্যাপারে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না– আমি জানি, আমি জানি, তবু তুমি শোন—একজন কাউকে শুনাতে ইচ্ছা করছে—সময়কে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রের সঙ্গে তুলনা কর। খুব সহজ অর্থে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র কি বলছে? বলছে সময় যতই এগুচ্ছে। গরম জিনিস ততই শীতল হচ্ছে। ধর এক কাপ কফি টেবিলে রাখা হল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গরম কফি আরো গরম হবে না। ঠাণ্ডা হতে থাকবে। এই তথ্য স্যার আমি জানি। হ্যাঁ জান। অবশ্যই জান। কিন্তু এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার আছে। এটি একটি পরিসংখ্যানগত সূত্র। পরিসংখ্যান কাজ করে অসংখ্য অণুপরমাণু নিয়ে। সমষ্টিগতভাবে এই সব অণুপরমাণু গরম থেকে শীতল অবশ্যই হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান আরো বলে এর মধ্যে কিছু অণুপরমাণু গরম থেকে আরো গরম হয়ে যেতে পারে। তাতে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র ব্যাহত হবে না। বুঝতে পারছ? পারছি। তাহলে বুঝতেই পারছ—এই সব অণু পরমাণু সময়ের উল্টো দিকে যাচ্ছে। আমার কাজ হচ্ছে তাদের নিয়ে। আমি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করেছি যে সময়ের উল্টোদিকে যাওয়া সম্ভব। হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব। দেখ পাঠক বহু পুরাতন একটা সূত্র দেখা যাক। = √(1–2 / 2) ধরা যাক হচ্ছে একটি বস্তুর গতি। আলোর গতি। অতীতে যেতে হলে তাঁর মান হতে হবে আলোর গতির চেয়ে বেশি। যখন তা হবে তখন বস্তুর ওজন, বস্তুর দৈর্ঘ্যপ্রস্থ সব হয়ে যাবে কাল্পনিক সংখ্যা। সবার আগে চলে আসবে √-12 আসবে না? আসবে। এই সমস্যার সমাধান আমার কাছে খুব জটিল কখনো মনে হয় নি। গণিত শাস্ত্রে আমরা কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে শুরু করি এবং এক সময় সেটাকে সত্যিকার সংখ্যায় রূপান্তরিত করি। আমি অগ্রসর হচ্ছি কোন দিকে জান? আমার জানার কথা নয় স্যার। হা তোমার জানার কথা নয়। অবশ্যই তোমার জানার কথা নয়— দুধরনের বস্তুর কণার কথা চিন্তা করা যাক। আলোর চেয়ে কম গতিসম্পন্ন বস্তুকণা যেমন ধর, ইলেকট্রন, প্রোটন, যাদের বলা হয় টারডিওস, আবার অন্য কণা চিন্তা কর যাদের গতি আলোর চেয়ে বেশি। এরা হচ্ছে টেকিওনস… এরা কাল্পনিক কণা। এদের অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই তাকে অস্তিত্ব দিতে হলে কি করতে হবে? তুমি স্পেস নিয়ে চিন্তা কর। স্পেসকে কি করলে এই কণাগুলি তৈরি হবে… স্যার আপনি কি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছেন? হ্যাঁ আমি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছি। আমি কতটা কাছাকাছি চলে এসেছি তুমি কি তা বুঝতে পারছ? বুঝতে পারছি না। তবে আপনার আনন্দ দেখে খানিকটা অনুমান করতে পারছি। আমি খুব কাছাকাছি আছি। খুব কাছাকাছি। একটি মাত্র জট সেই জট খুলে যাচ্ছে। স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। পেছনের বাগানে চেয়ার পেতে দি। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করুন। সে এখন আমার স্ত্রী নয় পাঠক। আমাকে মারলা লির কাছে যেতে হবে। লাইসেন্স নিয়ে আসতে হবে।
false
shottojit_roy
হ্যাঁ, শুনেছি বটে। ওই চোরাবালিতাল থেকে মন্দাকিনী নদীর উৎপত্তি। কেদারনাথের পিছন দিয়ে পাথর আর বরফের উপর দিয়ে মাইল তিনেক যেতে হবে। হ্রদের ধারে একটা গুহায় বাস করে ভবানী। উপাধ্যায় অংশটা তার নাম থেকে উবে গেছে; এখন সে ভবানীবাবা। এক থাকে, কাছেপিঠে আর কেউ থাকে না। কাল সকালে আপনার চেষ্টা করে দেখতে পাবেন। আপনার সঙ্গে এবার দেখা হয়েছে? না, তবে স্থানীয় লোকের কাছে খবর পেয়েছি। ফলমূলের জন্য তাকে বাজারে আসতে হয় মাঝে মাঝে। আপনি আমাদের অশেষ উপকার করলেন, মিঃ মজুমদার। কিন্তু তাঁর অতীতের ইতিহাস কি এখানে কেউ জানে? তা তো জানতেই পারে, বললেন মাখনবাবু, কারণ সে তো চিকিৎসা এখনও সম্পূর্ণ ছাড়েনি। এই কেদারনাথের মোহান্তই তো বলছিলেন যে, ভবানী সম্প্রতি নাকি একটি ছেলের পোলিও সরিয়ে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা, সে কিছু দিনের মধ্যে আর চিকিৎসা করবে না–পুরোপরি সন্ন্যাসী বনে যাবে। একটা শেষ প্রশ্ন, বলল ফেলুদা, ভদ্রলোক কোন দেশি তা আপনি জানেন? এ বিষয় তো তাকে কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে সে আমার সঙ্গে সব সময় হিন্দিতেই কথা বলেছে। ভাল হিন্দি। তাতে অন্য কোনও প্রদেশের ছাপ পাইনি কখনও। মাখনবাবু চলে গেলেন। লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে আমাদের দল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। এবার এগিয়ে এসে বললেন, বিড়লা গেস্ট হাউস থেকে আমাদের তলব পড়েছে। কে ডাকছে? প্রশ্ন করল ফেলুদা। একজন বেঁটে ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, মিঃ সিংঘানিয়া। ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল! আমাদের দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, মনে হচ্ছে এই সিংঘানিয়াই এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে হরিদ্বার গিয়েছিলেন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমার মনে হয়, একে খানিকটা সময় দেওয়া যেতে পারে-চলিয়ে। যদিও চারিদিকে অনেকগুলো বরফের পাহাড়ের চূড়োতে এখনও রোদ রয়েছে।–তার কোনওটা সোনালি, কোনওটা লাল, কোনওটা গোলাপি-কেদার শহরের উপর অন্ধকার নেমে এসেছে। বিড়লা গেস্ট হাউস কেদারনাথের মন্দিরের পাশেই কাজেই আমরা তিন মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখে মনে হল, এখানে হয়তো এটাই থাকবার সবচেয়ে ভাল জায়গা। অন্তত পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে তো বটেই; খাবারের কথা জানি না। খাবারের ব্যাপারে। এমনিতেও শুনছি, এখানে আলু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। বেঁটে লোকটা আমাদের আগে আগে পথ দেখিয়ে বিড়লা গেস্ট হাউসের দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। বেশ বড় ঘর, চারিদিকে চারটে গদি পাতা। মাথার উপর একটা ঝুলন্ত লোহার ডাণ্ডা থেকে বেরোনো তিনটি হুকে টিমটিম করে তিনটে বালব। জ্বলছে। কেদারনাথে ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, কিন্তু আলোর কোনও তেজ নেই। আমরা মিনিটখানেক অপেক্ষা করতেই, যিনি আমাদের আহ্বান করেছিলেন, তাঁর আবির্ভাব হল। যা ভাবা যায়, সেটা যখন না হয়–তখন মনের অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সিংঘানিয়ার নামটার সঙ্গে সিংহের মিল আছে বলে বোধহয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে আশা করেছিলাম। যিনি এলেন তাঁর মাঝারি গড়ন, মেজাজে মাঝারি গাম্ভীৰ্য্য, গলার স্বর সরুও নয় মোটাও নয়। শুধু একটা মোটা পাকানো গোঁফে বলা যায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব এসেছে। মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া বললেন ভদ্রলোক–প্লিজ সিট ডাউন। আমরা তিনজনে দুটো গদিতে ভাগাভাগি করে বসলাম, সিংঘানিয়া বসলেন তৃতীয় গদিতে সোজা আমাদের দিকে মুখ করে। কথা হল ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে। সিংঘানিয়া বললেন, আপনার খ্যাতির সঙ্গে আমি পরিচিত মিঃ মিটার, কিন্তু আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়নি। ফেলুদা বলল, বিপদে না পড়লে তো আর আমার ডাক পড়ে না, তাই আলাপ হবার সুযোগও হয় না। আমি অবিশ্যি আপনাকে বিপদে পড়ে ডাকিনি। তা জানি, বলল ফেলুদা।আপনার নামও কিন্তু আমি শুনেছি। অবিশ্যি সিংঘানিয়া তো অনেক আছে, কাজেই যাঁর নাম শুনেছি, তিনিই আপনি কিনা বলতে পারব না। আই অ্যাম ভেরি ইন্টারেস্টেড টু নো, আপনি কী ভাবে আমার নাম শুনলেন। আপনি হরিদ্বার গিয়েছিলেন কখনও? সার্টেনলি। সেখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন? করেছিলাম। বাইকী; কিন্তু আপনি সেটা জানলেন কী করে? উপাধ্যায়ের বাড়িওয়ালা আমাকে বলেছিলেন যে, মিঃ সিংঘানিয়া এবং আর একজন ভদ্রলোক উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আর কিছু বলেননি? বলেছিলেন যে উপাধ্যায়কে নাকি আপনি লোভে ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু উপাধ্যায় সেটা কাটিয়ে ওঠে। হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ ম্যান, দিস উপাধ্যায়! আমি এমন লোক আর দ্বিতীয় দেখিনি। ভেবে দেখুন। মিঃ মিটার-লোকটার রোজগার মাসে পাঁচশো টাকার বেশি নয়, কারণ গরিবদের সে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। সেই লোককে আমি পাঁচ লাখ টাকা অফার করুলাম। আপনি জানেন বোধহয় যে, ওঁর কাছে একটা অত্যন্ত ভ্যালুয়েক্ল লকেট আছে—খুব সম্ভবত এককালে সেটা ট্র্যাভাঙ্কোরের মহারাজার ছিল। সে তো জানি, কিন্তু আমার জানার কৌতুহল হচ্ছে, আপনি এই লকেটের খবরটা জানলেন কী করে। ওটা তো রাজার পাঁচ-ছ জন খুব কাছের লোক ছাড়া আর কারও কাছে প্রচার হয়নি। আমি খবরটা জেনেছিলাম। সেই কাছের লোকেদের একজনের কাছ থেকেই। আমার জুয়েলারির ব্যবসা আছে দিল্লিতে। আমার কাছে এই লকেটের খবর আনে রূপনারায়ণগড়ের ম্যানেজার মিঃ পুরীর ছেলে দেবীশঙ্কর পুরী। সে আমাকে লকেটা কিনতে বলে। ন্যাচারেলি হি এক্সপেক্টেড এ পারসেনটেজ। আমরা গেলাম হরিদ্ধার। উপাধ্যায় রিফিউজ করলেন। পুরীর উৎসাহ চলে গেল। কিন্তু আমি ওটা কেনার লোভ ছাড়তে পারছি না। আমার মনে হয়, এখনও চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যাবে। তখন তিনি ডাক্তারি করছিলেন, লোকের সেবা করছিলেন, এখন হি ইজ এ সন্ন্যাসী। একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর ওই রকম একটা পার্থিব সম্পদের উপর কোনও আসক্তি থাকবে, এটা ভাবতে একটু অদ্ভুত লাগছে না? আমি চাই, ওঁকে
false
shunil_gongopaddhay
বলল, আজ হাওয়ার খুব জোর। এর মধ্যে বোট চালানো খুব রিস্কি। অন্য লোকটি বলল, সারাদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি আর ভাল লাগে না। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। আজ আর কি কোথাও যেতে হবে? ড্রাইভারটি বলল, এখনও বুঝতে পারছি না। আমিও ভাবছি শুয়ে পড়ব। এখানে দুজনের জায়গা হয়ে যাবে। অন্য লোকটি বলল, হ্যাঁ, হয়ে যাবে কোনওরকমে। অতি সাধারণ কথাবার্তা। এটা সাধারণ মাছধরা বোটও হতে পারে। আসামের ড্রাইভারটা এখানে এসে কাজ নিয়েছে? তা হলেও ওই লোকটা যে সন্তুকে মারতে গিয়েছিল, তাতে তো সন্দেহ নেই। ওকে পুলিশে ধরাতেই হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়। সন্তু পেছন ফিরতেই শুনতে পেল ড্রাইভারটি বলছে, শুনছি তো আজকের বেশি আর থাকতে হবে না। কাল পদ্মনাভনকে সরিয়ে দেবে। পদ্মনাভন! এরা জানে পদ্মনাভন কোথায় আছে। পুলিশ কিংবা কাকাবাবু যা জানতে পারেননি, সন্তু বাইচান্স তা জেনে ফেলেছে। সন্তু তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ডেকের ওপর মুখ বাড়িয়েই আবার নিচু করে নিল মাথা। সর্বনাশ! দুজন লোক টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে একেবারে বোটের কাছে এসে গেছে। একজন আলো ফেলল ডেকের ওপর। অন্যজন চেঁচিয়ে ডাকল, বাঘা! বাঘা। নীচের ক্যাবিন থেকে একজন উত্তর দিল, যাই! চোখের পলকে রেলিং ধরে গড়িয়ে নেমে এসে সন্তু চলে গেল সিঁড়ির নীচে। সে জায়গাটা ঘন অন্ধকার, কিসের যেন বস্তা রাখা হয়েছে কয়েকটা। আর-একটু হলেই সন্তু ধরা পড়ে যেত। তার বুকটা ধড়ফড় করছে। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। এখান থেকে যে-কোনও উপায়ে পালাতেই হবে।কাকাবাবুকে খবরটা দিতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যাবে সব কিছু। অন্য লোক দুটো উঠে এসেছে বোটের উপর। সন্তুর নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করল। আর এক মিনিট সময় পেলে সে নেমে পড়ার সময় পেয়ে যেত। ড্রাইভারটিকে চিনতে পারার পরই তার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। এঞ্জিনের গোঁ-গোঁ শব্দ শুরু হল। বোটটা এবার স্টার্ট দেবে। সন্তু ভাল সাঁতার জানে। কিন্তু সে যে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারও উপায় নেই। একবার সে উঁকি মেরে দেখল সিঁড়ির ঠিক ওপরেই একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মোটর বোটটা ছুটতে শুরু করল। এত রাত্রে কি এরা মাছ ধরতে যাচ্ছে? বোটটায় সন্তু মাছধরা জাল দেখতে পায়নি। ভেতরে মাছ-মাছ গন্ধও পায়নি। এরা কোথায় যাচ্ছে কে জানে? একটুও নড়াচড়া না করে সন্তু নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। ধরা পড়লে আর বাঁচার উপায় থাকবে না। কুমার সিং-এর ড্রাইভার তাকে ঠিক চিনতে পারবে। যারা পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, তারা এখানে তাকে মেরে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। তার দেহটাও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনওদিন। হাঙর-টাঙরেরা খেয়ে ফেলবে। কাকাবাবু জানতেই পারবেন না, সন্তু কোথায় গেল! মোটর বোটটা তীব্র বেগে ছুটছে। আর লাফাচ্ছে অনবরত। মাঝে-মাঝে জলের ঝাপটা চলে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ভিজে যাচ্ছে সন্তুর সারা গা, ওপরে লোকগুলো কী যেন কথা বলছে, শোনা যাচ্ছে না কিছুই। কতক্ষণ ধরে বোটটা চলছে তা বুঝতে পারছে না সন্তু। মনে হচ্ছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা। হয়তো অতটা নয়, তবু একভাবে একটুও নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে তার এক-একটা মিনিটকেই এক ঘন্টা বলে মনে হচ্ছে। হাঁটুর কাছটা চুলকোচ্ছে, কিন্তু নিচু হতেও সাহস করছে না সন্তু। কেউ একজন নামছে সিঁড়ি দিয়ে। পাতলা কাঠের সিঁড়ি, মাঝখানে ফাঁক-ফাঁক। সিঁড়ির পেছনে জায়গাও খুব কম। লোকটার পা সন্তুর গায়ে লেগে যেতে পারে। সন্তু নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কিন্তু তার বুকের মধ্যে ধৰ্ধক আওয়াজটা কি শোনা যাবে। এই সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় পেছন ফিরে নামতে হয়, আর ওঠবার সময় সামনের দিকে ফিরে। এবার হয়তো লোকটা সন্তুকে দেখতে পাবে না, কিন্তু ওঠবার সময়? ধরা পড়ে গেলে সন্তু কী দিয়ে লড়াই করবে? হাতের নখ আর দাঁত ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র নেই তার কাছে। এদের হাতে মরার চেয়ে যে-কোনও উপায়ে সে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করবে। তারপর যা হয় হোক। কিন্তু এরা চারজন। হঠাৎ এঞ্জিনের আওয়াজটা থেমে গেল। সমুদ্রের বুকে এতদূর এসে এরা থামছে কোথায়? এখানে কোনও দ্বীপ আছে? গোপালপুরের কাছাকাছি কোনও দ্বীপের কথা সন্তু শোনেনি। যে-লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল, সে আবার দুপদাপ করে ওপরে উঠে গেল। সে একটু ভাল করে তাকালেই সন্তুকে দেখতে পেয়ে যেত। কিন্তু সে কিছুই সন্দেহ করেনি। বোটটা একেবারে থেমে গেছে। কয়েকজন নামছে মনে হল। সন্তু তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে। সবাই নেমে যাচ্ছে কি না আগে বোঝ দরকার। মিনিট পাঁচেক পরে আবার একজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে ক্যাবিনের মধ্যে ঢুকে গেল। ওপরে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার একটা ঝুঁকি নিতেই হবে। সন্তু টপ করে সিঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওপরের ডেকে উঁকি মারল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্তু এক দৌড়ে সামনের দিকে চলে এসে একটা লাফ মারতে গিয়েও থেমে গেল। মোটর বোটটা জলে ভাসছে বটে, কিন্তু একটু দূরেই তীর দেখা যাচ্ছে। সন্তু জলের মধ্যে লাফ দিলে ঝপাং করে শব্দ হবে। ক্যাবিনের ভেতরের লোকটা সেই শব্দ শুনে ফেলতে পারে। অন্য লোকগুলো নেমে চলে গেছে, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। সন্তু লাফ না দিয়ে বোটটার একদিক ধরে ঝুলে পড়ে খুব আস্তে জলে নামল। তারপর একটু হেঁটে ডাঙায় পৌঁছেই একটা দৌড় লাগাল। মুক্তি! মুক্তি! ওরা তাকে ধরতে পারেনি। আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না। এই জায়গাটা গোপালপুর থেকে যতই দূরে থোক,
false
MZI
তর্ক করি না! বছর খানেক আগে আমার একজন সহকর্মী যে এক সময় আমার ছাত্র ছিল ভয়ংকর একটা এক্সিডেন্টে পড়ে সেখান থেকে ফোন করেছে। মুখোমুখি বাস দূর্ঘটনায় ষোলজন সেখানেই মারা গেছে, আহত সহকর্মীকে ঢাকায় এনে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার ফাঁকে আমি আমার মাকে ফোন করে বলেছি, “মা আমার একজন টিচার এক্সিডেন্ট করেছে- তাঁর জন্যে দোয়া করেন।” আমার মা তখনই তাঁর জন্যে দোয়ার করার জন্য জায়নামাজে বসে গেছেন। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর তাঁর কুলখানিতে কোরান খতম করার জন্য ছোট ছোট বাচ্চা বাচ্চা পাঁচ ছয়জন মেয়ে এসেছিল, এই টূকু বয়সে তারা কোরান হাফেজ। মাথা দুলিয়ে সুরেলা গলায় কোরান শরীফ পড়ে কয়েক ঘণ্টার মাঝে তারা কোরান শরীফ শেষ করে ফেলল। (আমি তাঁদের আমার লেখা কয়েকটা বই দিলাম, ভূতের বইটা পেয়ে তাদের কি আনন্দ!) একদিন নুহাস পল্লীতে বসে আছি তখন সাত আটজন অত্যন্ত সুদর্শন তরুন আমাকে ঘিরে ধরল ছবি তোলার জন্যে। ছবি তোলার পর জানতে পারলাম তারা সবাই একে অপরের কাজিন এবং সবাই কোরান হাফেজ। হুমায়ূন আহমেদের জন্যে কোরান খতম করে তারা তার কবরে এসেছে তার জন্যে দোয়া করার জন্যে-শুনে কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। আমাদের কাছে এটাই হচ্ছে ধর্ম, এর মাঝে শুধু একজনের জন্যে আরেকজনের ভালোবাসা। যখন দুঃখ কষ্ট হতাশা এসে ভর করে তখন ধর্ম একটা শান্তনা নিয়ে আসে, একটা ভরসা নিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়েরা তাদের সন্তানের মাথায় হাত রেখে “ফি আমানিল্লাহ” বলে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। সন্তানেরা হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে গেছে যুদ্ধ শেষে কেউ কেউ ফিরে এসেছে সৃষ্টিকর্তা কাউকে কাউকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। আমি একজন মায়ের কথা জানি যিনি তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের জন্যে টানা নয়মাস রোজা রেখেছিলেন। আমার নিজের মা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে বুক আমাদের ভাইবোনদের রক্ষা করেছিলেন। এই দেশের সাধারন মানুষের কাছে এটাই হচ্ছে ধর্মের রুপ, এর মাঝে শুধুমাত্র ভালোবাসা আর শান্তি, আছে বিশ্বাস এবং ভরসা। সেই ধর্মকে হেফাজত করার জন্যে এপ্রিলের ৬ তারিখ যখন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কয়েক লাখ পুরুষ মানুষ জড়ো হয়েছিল তখন কেন এই দেশের মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের বুক কেঁপে ওঠেছিল? এই দেশের অর্ধেক মানুষ মেয়ে, সেই মেয়েদের অবমাননা করার ঘোষনা দেয়া হেফাজতে ইসলামের ধর্মের সাথে আমাদের পরিচিত শান্ত কোমল ভালোবাসা সহনশীলতা সহমর্মিতার ধর্মের মাঝে এতো পার্থক্য কেন? তাঁদের রাজনীতির সাথে কেনো সম্পর্ক নেই সেই কথাটি একশবার জোর গলায় ঘোষনা দেবার পরও বিএনপি এর বড় বড় নেতারা কেন মঞ্চে গিয়ে বসে থাকলেন? এই দেশে রং বদল করতে সবচেয়ে পারদর্শী জেনারেল এরশাদ কেন তাদের পানি খাইয়ে সেবা করার জন্যে এতো ব্যস্ত হলেন? জামাতে ইসলামী হঠাৎ করে কেন হেফাজতে ইসলামের মাঝে তাদের আদর্শ খুঁজে পেতে শুরু করল? নারায়নগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানও কেন হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন জানিয়ে রাখলেন? ২ শাহবাগের তরুনেরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচারের দাবিতে একটা বিস্ময়কর জাগরনের জন্ম দিয়েছিল তখন হঠাৎ করে তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে নাস্তিক দাবী করে একটা প্রচার শুরু হল। একজন মানুষ যদি শুধু মাত্র নিজে থেকে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে ঘোষনা দেয় তাহলে হয়তো তাকে নাস্তিক বলা যায় অন্যদের পক্ষে কোনোভাবেই একজনকে নাস্তিক বলা সম্ভব নয়। একজন মানুষকে নানাভাবে গালাগালি করা এক কথা কিন্তু তাকে নাস্তিক বা মুরতাদ বলা সম্পূর্ন অন্য একটি ব্যাপার। এটি আসলে মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করা, ধর্মান্ধ মানুষ এই ঘোষনাটি মেনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে এরকম উদাহারন আমাদের চোখের সামনেই আছে। কাজেই একজন মানুষ বা একদল মানুষকে নাস্তিক ঘোষনা দেয়া আসলে তাঁকে প্রানের ঝুকিতে ফেলে দেয়া। রাজনৈতিক নেতারা সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন কিংবা সত্যি সত্যি তাদের অপবাদের কারনে কেউ একজন খুন হয়ে গেলে তারা খুব অপরাধবোধে ভুগবেন সেটা কেউ বিশ্বাস করেনা। সত্যি কথা বলতে কী ব্যাপারটা সম্পূর্ন অন্যরকম, একজন মানুষের মৃত্যু তাদের কাছে স্বজন হারা মানুষের বুক ভাঙ্গা হাহাকার নয়, সেটি রাজনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ন একটি “লাশ”। কে কতো দক্ষভাবে সেই লাশটা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে, কতো ব্যাপক উন্মাদনা তৈরী করতে পারবে সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। তাই খালেদা জিয়া প্রকাশ্য সভায় জনতার কাছে লাশ চাইতে দ্বিধা করেননি। “আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শাহবাগের তরুনদের নাস্তিক ঘোষনা দিয়ে প্রচারনা শুরু করেছিলেন তখন তার ভিতরে কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। আমি মোটামুটি লিখে দিতে পারি শাহবাগের সব তরুন নাস্তিক সেটা নিজেরাও বিশ্বাস করেন না কিন্তু সেটা প্রচার করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না। সেই প্রচারনার কারনে যে উন্মাদনা তৈরী হয়েছিল এবং তাঁর কারনে যে কয়টি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল তার জন্যে সম্পাদক মহোদয়ের বুকের ভিতর কোনো অনুশোচনা কিনা সেটি আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। সম্ভবত হয়নি- কারন আমার দেশের সম্পাদক মহোদয়কে অত্যন্ত সঙ্গত কারনে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং এই দেশের পনেরটি গুরুত্বপূর্ন পত্রিকার ততোধিক গুরুত্বপূর্ন সম্পাদক প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে তার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। মোটামুটি একই সময়ে প্রায় একই ধরনের কারন দেখিয়ে চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পনেরোজন সম্পাদক তখন একত্র হয়ে তাদের জন্যে মুখ ফুটে কোনো কথা বলেননি। ভাগ্যিস গোলাম আজম কিংবা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মত যুদ্ধাপরাধীদের কোনো পত্রিকার সাথে সম্পর্ক নেই, যদি থাকতো তাহলে এই পনেরোজন
false
shirshendu
বেরোবে না। তুমি খুব সাধুপুরুষ! তা নই। তবে ভিতু। ভয়টা কাকে? আমাকে? না সমাজকে? সবাইকেই। ওটা কোনও কথা হল? আমি কি তোমার ক্ষতি করব বলে আসি? নিমাই চুপ করে থাকে। এ কথার জবাব দিতে গেলে মনো খুব দুঃখ পাবে। মনো নিজের মনেই বলে, তোমার হোটেলেও তো ঝি লাগে। সেই কাজটাই না হয় দাও আমাকে। তোমার দুটো ভাতও ফুটিয়ে দেবো। আমার ঘরভাড়া আর খোরাকিটা দিয়ে দিও। মনো, তুই আর কাউকে দেখ। ইস, আমি যেন ওরকম। একটা না একটা ধরলেই হল বুঝি? তোমার কাছে আসি কি এমনি? ভাল লাগে বলেই না! আমাকে তোর ভাল লাগে কেন? লাগলে কি করব? তোর মাথাটাই গেছে। আমি হলাম একেবারে অপদার্থ লোক। কড়ে আঙুলের মতো মানুষ। ওই ডাইনি তোমার মাথাটা চিবিয়ে রেখেছে গো! কিছুতেই আর তোমার অন্য দিকে নজর পড়ছে না। তা হ্যাঁ গো, নিমাইদাদা, পুরুষ মানুষের কি একজন নিয়ে চলে? কত পুরুষ দেখলাম। দেখেছিস। ভাল। অমন ফাঁকা গলায় কথা কইছে কেন? ওই যে নিরঞ্জনবাবু, কতটা চেনে ওঁকে? যখন আগেরবার এখানে ঠিকাদারি নিয়ে এলেন তখন দেখেছি, রাতে ফুলিয়া বলে একটা কামিনকে রোজ ঘরে নিত। জানি। জানো? জানব না কেন? সবাই জানে। ওটা হল দুপক্ষের বন্দোবস্ত। এরও দরকার, ওরও দরকার। তোমার বুঝি দরকার নেই? নিমাই মাথা নাড়ে, না। তুই ঘরে যা। ঘরে যায় বটে মনো, কিন্তু দুতিন রাত্তির পর ফের আসে। কয়েকটা টাকা দাও নিমাইদাদা, শোধ দিতে পারব না। অন্য দিকে পুষিয়ে দেবো। ও সব বলতে নেই রে। তুমি কী বলো তো! আমি একটা কিছু না। বুঝতে তোর দেরি হচ্ছে কেন? তোমার বদনামের ভয় তো! এখানে কে তোমার বদনাম করবে? সবকটাই তো বদমাশ। সবাই বদমাশ হলে কি চন্দ্ৰ সূৰ্য উঠত? সবাই বদমাশ যদি বা হয় তাতেই কি আমাদেরও সব বাঁধ ভেঙে দিতে হবে? আচ্ছা লোক তুমি মাইরি। শুয়ে থাকগে মনো। মাথা ঠাণ্ডা কর গে। টাকা দেবে না? শুধবি কি করে? ঠিক শুধবো। ও হয় না রে। আমাকে টাকার ফেরে ফেলিস না। আমি বড় গরিব। মনো কাঁদে। হার মানে। শেষে বলে, মোটে বিশ-বাইশ বছর বয়স আমার, এই বয়সেই সব চলে গেল। তোমার মায়া হয় না। দুর পাগল! মায়া হবে না কেন? মায়া হলেই কি ঘর করতে হয় নাকি? মনে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, মেয়ে হয়ে জন্মালে বুঝতে পারতে কেমন ঘেন্নার জীবন আমাদের। একটা পুরুষ মানুষ না হলে আমাদের সব নেতিয়ে পড়ে। সেই পুরুষ আমাকে পছন্দ করবে কিনা, আমাকে রাখবে কিনা তাই নিয়েই সারাক্ষণ বুকের মধ্যে ধুকুপুকু। মেয়েমানুষের বেঁচে থাকাটাই কত ঘেন্নার কথা। তুই অমন অস্থির হচ্ছিস কেন? ধৈর্য ধরে দেখ কী হয়। উপদেশ দিও না গো। সব জানি। আমাদের আবার কী হবে। লেখাপড়া জানি না, রূপ নেই, টাকা নেই। আমাদের মতো মেয়েদের গতি কি হয় জানোনা? শেষ অবধি গিয়ে ভাগাড়ে পড়তে হবে। শেয়াল-শকুনে ছিঁড়ে যাবে। মা গো! উঃ! ও সব কথা বলিস না মনে। বলব না। চোখের সামনে যা সব দেখছি। ব্যথিত, দুঃখিত নিমাই চুপ করে বসে থাকে। সে তো আর অন্ধ নয়। মেয়েমানুষের মাংস নিয়ে ব্যবসা সে কিছু কম দেখেনি। তুমি লোক বড় ভাল গো, নিমাইদাদা। আমার একটা গতি করে দাও। নইলে কিন্তু কপালে আমার লাইনে নামাই আছে। নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনোর গতি সে কি করে করবে বুঝতে পারে না। তার ছোট্টো কারবারে তো বেশি লোক লাগে না। তার চেয়ে বড় কথা, মনো কাছাকাছি থাকলে তার বিপদের ভয়টাও থেকে যাবে। মনে চলে যাওয়ার পরও নিমাই বসে বসে অনেকক্ষণ মেয়েমানুষ নিয়ে ভাবে। বীণাপাণিও মেয়েমানুষ। যখন বিয়ে হয়ে কিশোরী বীণাপাণি এল তখন ভিতু, ছোটোখাটো, অভিমানী, সোহাগী মেয়েটা যেন নিমাইয়ের অন্ধকার জীবনটাই আলোয় ভরে দিয়েছিল। বীণাপাণি আজও নিমাইয়ের কাছে পুরোনো হয়নি। আজও রোজ, সর্বদা মনের মধ্যে বীণাপাণির যাতায়াত। কিন্তু বীণাপাণি নিমাইয়ের কাছে যা, অন্যের কাছে তো তা নয়। সে যাত্রার নটী, একা, অভিভাবকহীন। সেও তো লোভী পুরুষের চোখে নারীমাংস ছাড়া আর কিছু নয়। বুকটা বড় ব্যথিয়ে ওঠে নিমাইয়ের। বুকের মধ্যে যেন এক শূন্য প্ৰান্তরে শুকনো বাতাস হু হু করে বয়ে যায়। আজও বীণা তার খোঁজ নেয়নি। বছর ঘুরতে চলল। পতিতপাবন দত্ত মশাইয়ের তুলো আর তোশক-বালিশের কারবার উঠে যাচ্ছে। দোকানখানা বন্দোবস্তে নিয়ে ফেলল নিমাই। নিজের টাকাতেই কুলিয়ে গেল। তবে দোকান নিলেই তো হল না। চেয়ার টেবিল, বেসিন, কল, বাসনপত্র নিয়ে মেলা খরচ। নিরঞ্জনবাবু বললেন, টাকা দিচ্ছি। সব দিক সামলে ভাল করে দোকান দাও। হিসেবটা ঠিকমতো রেখো। হিসেবের ব্যাপারে তোমার গাফিলতি আছে। আর চৌকিদারের চাকরিটাও তোমাকে করতে হবে না। আমি অন্য লোক দেখে নিচ্ছি। নিমাই হাতজোড় করে বলে, আজ্ঞে না। ওটা ছাড়ব না। বেতন দিতে হবে না, ওটা আমি বেগার খেটে দেবো। কোন দুঃখে। ওটা আমার পয়া চাকরি। নিরঞ্জনবাবু হাসেন, পাগল আর কাকে বলে! রাত জাগলে দোকান করবে কি করে? আজ্ঞে পারব। এত খাটলে শরীর ঠিক রাখতে পারবে? শরীরের কথা ভাবলেই শরীর বেগড়াই করে। ভগবান শরীর দিয়েছেন খাটানোর জন্য, বসিয়ে রাখার জন্য তো নয়। তাহলে করা। বেতনও পাবে। কলিকালে সৎ আর সাধুদের তো কলকে নেই। তা তোমার যদি এই ঘোর কলিকালে কিছু উন্নতি হয় তবে বুকে বল ভরসা পাবো।
false
manik_bandhopaddhay
যে বিচার-বিশ্লেষণ চলিতেছে, তার সীমা নাই। খোলা দরজা দিয়ে দুধের বাটিটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বিভূতির মা আগাগোড়া একটা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়া দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়া রহিল। তখন মনটা মহেশ চৌধুরীর বড় খারাপ হইয়া গেল। কি দোষ করিয়াছে বিভূতির মা? অন্যের পাপে সে কেন কষ্ট পায়? সেদিনের কথা মহেশের মনে পড়িতে থাকে, সদানন্দের কুটিরের সামনে তার সঙ্গে বিভূতির মা যখন গাছতলায় বৃষ্টিতে ভিজিতেছিল। বিছানার একপ্রান্তে পা গুটাইয়া বসিয়া। মহেশ ভাবিতে থাকে। বিভূতির মাকে তুলিয়া খাওয়ানো যায়, সেটা তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কি লাভ হইবে? বিভূতির সম্বন্ধে যা সে ভাবিতেছে, তাই যদি স্থির করিয়া ফেলে, তখন বিভূতির মাকে যে কষ্টটা ভোগ করিতে হইবে, তার তুলনায় এখনকার এ কষ্ট কিছুই নয়। বিভূতিকে বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে বলিবে কিনা, এই কথাটাই মহেশ ভাবিতেছিল। বিড়াল মারার জন্য নয়, বিভূতির প্রকৃতি যে কখনো বদলাইবে না, এটা সে ভালো করিয়া টের পাইয়া গিয়াছে বলিয়া। এখন বিভূতিকে বাড়িতে থাকিতে দেওয়ার অর্থই কি তাকে সমর্থন করা নয়? শুধু ছেলে বলিয়া তাকে আর কি ক্ষমা করা চলে, চোখ কান পুঁজিয়া আর কি আশা করা চলে এখনো তার সংশোধন সম্ভব? বিনা প্রতিবাদে এখন চুপ করিয়া থাকা আর বিভূতিকে স্পষ্ট বলিয়া দেওয়া যে, সে যা খুশি করিতে পারে, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। তার ছেলে বলিয়া বিভূতির অন্যায় করার যে বিশেষ সুযোগসুবিধা আছে, মানুষের উপর যে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, বিভূতিকে জানিয়া শুনিয়া সে সমস্ত ব্যবহার করিতে দেওয়া আর তার নিজের অন্যায় করার মধ্যেই বা পার্থক্য কি? মনে মনে মহেশ চৌধুরী স্পষ্টই বুঝিতে পারে, এ বিষয়ে আর ভাবিবার কিছু নাই, বিভূতিকে বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে বলা উচিত কি অনুচিত, এটা আর প্রশ্নই নয়, এখন আসল সমস্যা দাঁড়াইয়াছে এই যে, বিভূতি তার ছেলে। বিভূতি যে তার স্ত্রীরও ছেলে, এটা এতক্ষণ মহেশের যেন খেয়াল ছিল না। বিভূতির মার চাদরমুড়ি দেওয়া মূর্তি এই আসল সমস্যাটাকে তাই একটু বেশিরকম জটিল করিয়া দিয়াছে। বিভূতির মার ছেলেকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দেওয়ার অধিকার কি তার আছে? ভালো ছেলে, সৎ ছেলে, আদর্শবাদী ছেলে গ্রামে আর এমন ছেলে নাই। কেবল বুদ্ধিটা একটু বিকৃতভালো মন্দের ধারণাটা ভুল। অনেকগুলি মানুষকে ক্ষেপাইয়া তুলিবার আনন্দ, দুদিন পরে যখন প্রচণ্ড একটা সংঘর্ষ ঘটিয়া যাইবে, কতকগুলি মানুষ যাইবে জেলে আর কতকগুলি যাইবে হাসপাতালে আর কতকগুলির দেহ উঠিবে চিতায়, আনন্দের তখন আর তার সীমা থাকিবে না। জেল, হাসপাতাল বা চিতা, এর কোনোটার জন্য নিজেরও অবশ্য তার ভয় নাই। ছেলের এই নিৰ্ভীকতাও মহেশের আরেকটা বিপদ। নিজের কথা যে ভাবে না, স্বাধীনভাবে চলাফেরার বয়স যার হইয়াছে, ছেলে বলিয়া আর মতের সঙ্গে মত মেলে না বলিয়া তার উপর বাপের অধিকার খাটানোর কথা ভাবিতে মনটা মহেশের খুঁতখুঁত করে। মহেশ চৌধুরী নির্বাক হইয়া থাকে প্রায় তিন দিন। গম্ভীর নয়, বিষণ্ণ নয়, উদাস নয়, শুধু নির্বাক। বিভূতির মাও নির্বাক হইয়া থাকে, কিন্তু তাকে বড় বেশি গম্ভীর, বিষণ্ণ আর উদাস মনে হয়। বিভূতি বলে, কি হয়েছে মা? বিভূতির মা বলে, কিছু হয় নি। বিভূতি পিছন হইতে মাকে জড়াইয়া ধরিয়া কানের কাছে মুখ নিয়া চুপি চুপি বলে, শোন, আমার জন্যে ভেব না। ভয় নেই, আমি আর জেলে যাব না। সে সব ছেলেমানুষি বোকামির দিন কেটে গেছে। তবু বিভূতির মার প্রথমটা মন-মরা ভাব কাটিতে চায় না। বরং বাড়িবার উপক্রম হয়। কারণ, একদিন মহেশ চৌধুরী সোজাসুজি বিভূতির সম্বন্ধে তার সিদ্ধান্তের কথাটা তাকে শুনাইয়া দেয়। বিভূতির মা প্রথমটা শোনে হাঁ করিয়া, তারপর সঁতে দাঁতে ঘষিয়া বলে, বেশ তো, তাড়িয়ে দাও। তুমি কি করবে? আমিঃ গলায় কলসী বেঁধে পুকুরে গিয়ে ড়ুব দেব। সত্যি? না, তামাশা করছ? ছোট ছেলেকে প্রথমভাগ পড়ানোর মতো ধৈর্যের সঙ্গে বিভূতির মা বলে, দ্যাখ, স্পষ্ট কথা বলি তোমাকে, শোন। তুমি না থাকলেও আমার একরকম করে দিন কেটে যাবে, কিন্তু ছেলে ছাড়া আমি বাঁচব না বলে রাখছি। মহেশ তা জানি, এতদিন খেয়াল করে নাই। এই কথা ভাবছ বুঝি কদিন? বিভূতির মা জিজ্ঞাসা করে। মহেশ চৌধুরী নীরবে মাথা হেলাইয়া সায় দেয়। বিভূমির মা তার মুখের সামনে হাত নাড়িয়া বলে, কেন শুনি? কি জন্যে শুনি? ওর কথা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার কি শুনি? ছেলে বড় হয়েছে বিয়ে-থা দিয়েছ, তার যা খুশি সে করুক। তোমার তাতে কি? তোমার কাজ তুমি করে যাও, তার কাজ সে করুক তুমি কেন ওর পেছনে লাগতে যাবে? মহেশ ভাবিতে ভাবিতে বলে, নিজের কাজ করার জন্যই তো ওর পেছনে লাগতে হচ্ছে গো। ভাবিতে ভাবিতে মহেশ চৌধুরীর দিন কাটে। মানুষটার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে সদানন্দের অধঃপতনের আঘাতে অথবা সদানন্দের সম্বন্ধে ভুল করার ধাক্কায়। আর যেন নিজের উপর সে সহজ বিশ্বাস নাই। সমস্ত প্রশ্নই আজকাল ধাধার মতো মনে হয়। কত সন্দেহই যে মনে জাগে। জীবনের পথে চলিবার জন্য আত্মবিশ্বাসের একটিমাত্র রাজপথ ধরিয়া এতকাল চলিবার পর বুদ্ধিবিবেচনা যেন ক্রমাগত ভিন্ন ভিন্ন পথের অস্তিত্ব দেখাইয়া তার সঙ্গে খেলা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। বিভূতির মার সঙ্গে আলোচনা করার পর একটা যে প্রচণ্ড সংশয় মহেশের মনে জাগে, তার তুলনা নাই। বিভূতি সম্বন্ধে কি করা উচিত স্থির করিয়া ফেলার পর সেটা করা সত্যই উচিত কিনা। সে বিষয়ে আরো কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তার মনে আসিয়াছে,
false
tarashonkor
দি-নি! —কেন? বেপদটা কি হল? বস, আমার সাথে খানিক গল্প কর নিশ্চিন্দি। মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল কালোবউ। —বলি, হাসি তোমার আসছে? —কেনে? তোমাকে দেখে হাসি আসবে না কেনে? —বলি কাল আতে সনজেকালে শিস শোন নাই? কালোবউ এবার শঙ্কিত হয়ে উঠল। হা, তা শুনেছি ভাই। —তবে? তবের ব্যাপারটা হলরাত্রির অন্ধকার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবনাটা কালো-বউ ভুলে গিয়েছে। বনওয়ারী এবার বসল। কোটা নিয়ে টানতে টানতে সবিস্তারে কালোশশীকে বললে করালীর কুকুরটার রোমাঞ্চকর ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা। বললে—তোমাকে বলব কি ভাই, একেবারে মুখে অ তুলে মাথা কাছড়ে মরে গেল। শেষকালে হল কি– মুখের কাছ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে ধরলে বনওয়ারী—তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল অপরিসীম আতঙ্ক, গায়ের রোমগুলি কাটার মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। কালোশশী মুখ হ করে শুনছিল। হাতে আঁটা নিয়ে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বনওয়ারী বললে কুকুরটার চোখ ফেটে যাওয়ার কথা। বললে—ফোসকার মত ফুলে উঠে ফ-টা-স করে ফেটে গেল। আর গলগল করে অক্ত। শিউরে উঠল কালোশশী—ওঃ, মাগো! বনওয়ারী বললে—তাই এয়েছিলাম পরমদাদার কাছে; পিতিবিধেন তো করতে হবে। –তা হবে বৈকি! কত্তার আশ্চয়ে বাস করে কত্তার কোপে পড়ে বাঁচব কি করে? —সেই তো। তা তোমরা করছ কি? —আমরা? হঠাৎ কালোশশী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল তার স্বামীর উপর।–আমার কপালে ঝাঁটা আর তার কপালে ছাই–বুঝলা দেওর, তার কপালে ছাই। এ পাড়ার অদেষ্টই মন্দ। বুঝলা না? মাতব্বর যদি মাতব্বরের মত হয় তো দশের জন্য ভাবে। সে কি আর তুমি ভাই! সে হল–ফরম আটপৌরে। আতদিন নিজের ভাবনা, জমি-পয়সা আর ওই পয়সা-জমি। কাল আতে সবাই শুনেছে শিস। ভয়ও সবাই পেয়েছে। কিন্তু কি হবে? মাতব্বর গেল চন্ননপুরে, বড়বাবুদের কাছারিতে। তামাম সাহেবডাঙ্গা কিনেছে বাবুরা, শুনেছ তো? চমকে উঠল বনওয়ারী। কথাটি তার কাছে একটা মূল্যবান কথা। সে প্রশ্ন করলে—সকলে উঠে সেখানেই গিয়েছে বুঝি? —আবার কোথাও বলব কি দেওর, আতে স্বপন দেখে কথা কয়—বিড়বিড় করে ওই কথা। নয়ানজুলি, ছেচের জল, দে কেটে দে, কোদালে করে মাথা কুপিয়ে দোব-এই কথা। বনওয়ারী অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চন্ননপুরের বড়বাবুরা রাজাতুল্য লোক, মস্ত কয়লার ব্যবসা। তারা হঠাৎ জমির উপর নজর দিয়েছেন। পতিত জমি যেখানে যা আছে কিনে চলেছেন। জমি কাটাবেন। কতক নিজেরা কাটিয়ে চাষ করবেন, কতক প্রজাবিলি করবেন। পরমদাদা ভারি। বুদ্ধিমান লোক। খাজখবর অনেক রাখে। সে ঠিক গিয়ে হাজির হয়েছে বাবুদের দরবারে। আর সে কি করছে? নাঃ, ছি ছি ছি! বনওয়ারীর সমস্ত বৈষয়িক কাজগুলি মনে পড়ে গেল। জাঙলে মনিব-বাড়ি যেতে হবে। ধান পিটানো শেষ হয়ে গিয়েছে—এখনও বছরের দেনা-পাওনার হিসাব হয় নাই। সেখানে একবার যাওয়া উচিত। তারপর একবার চন্ননপুর যেতেই হবে। কালো-বউয়ের কথাগুলি বনওয়ারীর কানে আর যাচ্ছেই না প্রায়! কালোশশী বলেই চলেছিল-পাশে আমি যে একটা মানুষ শুয়ে থাকি, তা অসুখবিসুখ কি দেহ খারাপ হলে যদি কাতরে কাতরে মরেও যাই, তবু তার ঘুম ভাঙে না। বললে বলে কি জান? বলেনাক ডাকে, তাতেই শুনতে পাই না। সে নাক ডাকা যদি শোন। কালোশশী মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল। বনওয়ারী হঠাৎ উঠে পড়ল। হুঁকোটা ঠেসিয়ে রেখে দিয়ে বললে—আমি ভাই তা হলে ওঠলাম। —বস বস। আর একবার না হয় তামুক সেজে দি। আমারও তো কাজকৰ্ম্ম আছে ভাই। মুনিব-বাড়ি যেতে হবে। তা, পরে থেমে গেল বনওয়ারী। চন্ননপুর যাওয়ার অভিপ্ৰায়ের কথাটা আর বললে না সে। হাজার হলেও কালোশশী পর। কালোশশী তার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আক্ষেপের একটা শব্দ করে বললে–হা-রে, হা-রে! সব পুরুষই এক! ওই কাজ কাজ আর কাজ! মুখে তার এক বিচিত্র অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। বনওয়ারী একটু অপ্রস্তুত হল। সে হাসতে চেষ্টা করে বললে—তা ভাই, কাজ করলেও সে তো সবই তোমাদের জন্যেই। ওজগার করে সমপ্পন তো তোমাদের হাতেই। বলতে বলতে সে বেরিয়ে এল পরমের বাড়ি থেকে। নইলে এ কথাতেও কালোশশীর কথায় ছেদ পড়বে না। কাজ অনেক। বনওয়ারীর একদণ্ড বসে থাকলে চলে? ভাই কালোশশী, তোমাকে ভাল তো বারি, কিন্তু উপায় কি? রঙের ছাপ একবার মনে লাগলে কি আর ওঠে? হোক না দেখা এক যুগ পরে, দেখা হলেই দুজনের ঠোঁটেই হাসি ফোটে। ওই রঙটার রকমই হল পাকা। একবার লে, ঘষে ঘষে হিয়ে ক্ষয়ে ফেললেও ওঠে না। কিন্তু যার উপায় নাই, তার জন্যে কেঁদেকেটে মন খারাপ করেই বা লাভ কি? তোমার মায়ের বাপ যে তখন বেহারা-কাহার বলে তোমাকে দিলে না বনওয়ারীর হাতে! আর পরমের সঙ্গে যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেল, তখন বনওয়ারী আর হেসে দুটো কথা কয়ে করবে কি? আর তেমন জাতের মানুষ নয় বনওয়ারী। কৰ্তব্যধর্ম বলে একটা কথা আছে। একটা পাড়ার মাতব্বর সে। হরিবোল! হরিবোল! পভু, তুমিই বনওয়ারীকে বাঁচিও। বাঘ-শুয়োর-সাপ-ঝড়-বান—এসব থেকে বাঁচাতে বলে না বনওয়ারী, বনওয়ারীকে তুমি এইসব অন্যায় কারণ থেকে বাঁচিও। কাজ অনেক। পাড়ায় ফিরে সুচাঁদপিসিকে বলতে হবে—যেন প্রতি বাড়ি ঘুরে পুজোর চাঁদা আর চাল তুলে রাখে। যে মেয়েগুলান ঘুটে মাথায় করে দুধ নিয়ে চন্ননপুরে যাবে, দুধ ও ঘুটে বেচে তারপর সারাদিনটা সেখানে বাবুদের ইমারতে মজুরনী খাটবে, তাদেরই বলে দিতে হবে অবসর করে কেউ যেন কাছারিতে পরমের সঙ্গে দেখা করে সকাল সকাল তাকে বাড়ি ফিরতে বলে। যদি তার চন্ননপুরে যাওয়া আজ না-ই হয়, মুনিব-বাড়িতে যদি আটক পড়েই যায় কোনো রকমে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা ঠাওরালে সে। মুনিব-বাড়িতে তো রকমের অভাব নাই। খামারটা
false
shomresh
ছাড়া খাবার দিতে হচ্ছে। আর কেউ আসেন না? ওঁর দাদা। দু দিন এসেছিলেন। দুই ভাই-এর মধ্যে ঝগড়া দেখে আমি আসতে নিষেধ করেছি। অসুস্থ মানুষকে দেখতে আসছে না। সম্পত্তি হাতাতে? অমন আসার কোন দরকার নেই। ওঁর বন্ধু হরদের শয়তানটা আসতো আর কানের কাছে গুজর গুজুর করতো। দিন রাত বদ মতলব দিত। ওকে। আনা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিস। এইসময় অমরনাথের কানে প্রতুলবাবুর চিনচিনে গলা এল, হরদেবের সঙ্গে আপনার দেখা হয়? হরদেবের সঙ্গে? অমরনাথ ঢোঁক গিললেন! হরদের সম্পর্কে আনার মনোভাব তিনি জেনেছেন। এমন লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় জানলে এ বাড়িতে ঢোকা বন্ধ না হয়ে যায়। তিনি দুদিক বাঁচিয়ে বললেন, সেই যে যেদিন এসেছিলাম সেদিন দেখেছিলাম। তাকে এড়িয়ে চলবেন। দু মুখো সাপ। প্ৰতুলবাবু চোখ বন্ধ করলেন। অ্যাদ্দিনে চৈতন্য হল। অনেক বলে কয়ে ব্যবসা থেকে ভাগিয়েছিলাম। আনা বিজয়িনীর গলায় কথাগুলো বলল। অমরনাথের কৌতূহল হল, তিনি তো একসময় খুব বন্ধু ছিলেন প্রতুলবাবুর, মানে এমন শুনেছিলাম। ঠিকই। আনা বলল, এ বাড়িতে আসতেন। শুধু ধান্দা নিয়ে। আমার শরীরে দু-দুবার হাত দেবার চেষ্টা করেছেন। ওঁর বিয়ে করা বউ-এর সঙ্গে ফসিট নাস্টি করতেন। তারপর যেই ইনি অসুখে পড়লেন অমনি আমার কানে মন্ত্র দিতে এলেন যদি আমি ওঁর সঙ্গে হাত মেলাই তাহলে একেবারে রাজধানী করে দেবেন। বুড়ো শেয়াল। অমরনাথ মনে মনে শঙ্কিত হলেন। হরদেবের চরিত্রের এই দিকটা তিনি জানতেন না। এই লোক স্বার্থের জন্যে অনেক দূর যেতে পারে। ওঁকে দীপার হোস্টেলে দেখা করতে বলে তিনি অন্যায় করেছেন। আনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমি না। আসা পর্যন্ত উঠে যাবেন না। হাজার কুটুম মানুষ। অমরনাথ ঘড়ি দেখলেন। সন্ধের সময়েও নৌকো ওপারে যায়। তখন আর সরাসরি চা-বাগানে যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে না। ধুপগুঁড়িতে গিয়ে বদল করতে হবে কিন্তু প্রতুলবাবুকে একা পাওয়ার সুযোগ তো আর পারেন কিনা কে জানে! তিনি বললেন, আপনার ব্যবসাপাতির কি খবর? হাতটা অসহায়ভাবে নাড়লেন প্রতুলবাবু, সব শেষ। এখন দিন গুনছি। এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয়? এ কথা কেন বলছেন? চিকিৎসা নিশ্চয়ই আছে। ছাই আছে। দিনরাত ওষুধ গিলছি। কি হচ্ছে? প্রতুলবাবু নিঃশ্বাস ফেললেন, কিন্তু মরতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না। সত্যি বলছি। চারদিকে এত কিছু ছড়ানো, আমার এত টাকা আর আমি অসময়ে মরে যাব? মৃত্যুর কথা চিন্তা করবেন না। করছি কি সাধে। ওই যে মেয়েছেলেটা আমার সেবা করছে, আজকাল তো ওর শরীরটাকেও এক মিনিট ছুতে পারি না। সমস্ত শরীরে ব্যথা আমার। কত কি ভোগ করার ছিল মশাই, আর হল না। প্রতুলবাবুর চোখের কোলে উপচে জল গড়িয়ে এল। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অমরনাথ। এই অবস্থাতে যে মানুষ বলে দিন গুনছি। তার এখনও ভোগের তৃষ্ণা মিটাল না? প্ৰায়শ্চিত্ত আর করে হবে? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির কোন বিলিব্যবস্থা করেছেন? একটা কিছু করে রাখা তো উচিত। হুঁ করব। এখনই তো মরছি না। প্রতুলবাবু চোখ বন্ধ করেই বললেন। অমরনাথ হোঁচট খেলেন। লোকটা বলে কি! তিনি কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রতুলবাবু এখন অত্যন্ত ক্লান্ত ভঙ্গিতে পাডে রয়েছেন। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আমি মনে করতেন্তু পারছি না। আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি। কিনা, যখন আমার মেয়ে জলপাইগুড়িতে পরীক্ষা দিতে এসেছিল তখন কি আপনি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? প্রতুলবাবুর মাথা ঈষৎ নড়ল। অমরনাথ বুঝলেন, উনি হাঁ বললেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি কিছু বলার ছিল? প্রতুলবাবু বললেন, ছিল। তবে এখন আর নেই। অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন। এরপাব। আর ফেরার উপায় থাকবে কিনা সন্দেহ। তিনি বললেন, যদি কোন প্রয়োজন হয় খবর পাঠাবেন, আমি তৎক্ষণাৎ চলে আসব। প্রতুলবাবু এবার চোখ খুললে, আমি একবার বউমাকে দেখতে চাই। অমরনাথ দুর্বল বোধ করলেন। প্রতুলবাবু তাঁর দিকে তাকিয়ে। তিনি বললেন, এ তো খুবই ভাল কথা। তবে, আমার মেয়ে বড় জেদী। প্রতুলবাবু হাসলেন, এককালে মাংস কেনার আগে খাসিটাকে দেখতাম। যার ঘাড় শক্ত, জেদী, টুস মারছে আর গায়ের রঙ কালো সেটাকেই কাটতে বলতাম। জেদীদের পোষ মানাতে আনন্দ পেতাম তখন। আজ ক্ষমতা নেই, বিছানায় পড়ে আছি। কিন্তু আপনার মেয়েকে তো ভাল করে মনেও নেই। এই করছর সে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। আমার এই বিষয়সম্পত্তির সে একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। আর একজন তো পাগল হয়ে হাসপাতালে। ওর সঙ্গে তাই আমি কথা বলতে চাই। যদি সে সারাজীবন বৈধব্য পালন করে তাহলে– ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন প্রতুলবাবু। অমরনাথ পাথরের মত দাঁড়িয়েছিলেন। পেছনে শব্দ হল। আনা ছোট একটা ট্রেতে চা আর মিষ্টি রেখে সামনে এসে দাঁড়াল, নিন, এগুলো খেয়ে নিন। অমরনাথের যেন সম্বিত ফিরল, না না। আমার খুব দেরি হয়ে গেছে। আরও একটু হোক। আনা হাসল, আচ্ছা, আপনি বরং বাইরের ঘরে বসে খাবেন আসুন। রুগীর সামনে–। আনা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অমরনাথের আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। তিনি প্রতুলবাবুকে বললেন, আচ্ছা, আজ তাহলে চলি। নমস্কার। প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন। বাইরের ঘরে পৌঁছে অমরনাথ দেখলেন টেবিলে চা মিষ্টি রেখে আনা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, এসবের কি দরকার ছিল। বাড়িতে যখন অসুস্থ মানুষ—। বাঃ। কুটুম শুকনো মুখে ফিরে যাবে? আনা হাসল। আমি তাহলে চা খাচ্ছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চা খেয়ে নিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু আনা শুনল না, ওমা, বসে খান। এতে এ বাড়ির অকল্যাণ হবে। অগত্যা বসলেন অমরনাথ। আনা খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে।
false
shordindu
গায়ে খাকি কোট‌, মাথায় চুল ক্রু-কাট করে ছাঁটা। সে সতর্কভাবে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে ঘরে ঢুকল। রাখালবাবুর টেবিলের সামনে দড়িয়ে ধরা-ধরা গলায় বলল–’বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি।’ ‘বসুন।’ লোকটি সন্তপণে সামনের চেয়ারে বসল‌, একবার ব্যোমকেশের দিকে তীক্ষ্ণ সতর্ক চোখ ফেরাল। রাখালবাবু সহজ সুরে বললেন— ‘ইলেকট্রিক মেল্টারের কাজের জন্য এসেছেন?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘সাটিফিকেট এনেছেন?’ লোকটি খানিক চুপ করে থেকে বলল–’আমার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। তিন বছর অসুখে ভুগেছি‌, কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তারপর–সাটিফিকেট হারিয়ে ফেলেছি।’ ‘আগে কোথায় কাজ করতেন?’ ‘নাগপুরে একটা আয়রন ফাউন্ড্রি আছে‌, সেখানে কাজ করতাম।–দেখুন‌, আমি সত্যিই ইলেকট্রিক মেল্টারের কাজ জানি। বিশ্বাস না হয় আমি নিজের খরচে বম্বে গিয়ে তা প্রমাণ করে দিতে পারি।’ রাখালবাবু লোকটিকে ভাল করে দেখলেন‌, তারপর বললেন–’সে কথা মন্দ নয়। কিন্তু আমাদের এটা ব্রাঞ্চ অফিস‌, সবেমাত্র খোলা হয়েছে। আমি নিজের দায়িত্বে কিছু করতে পারি না। তবে এক কাজ করা যেতে পারে। আমি আজ বম্বেতে হেড অফিসে ‘তার করব‌, কাল বিকেল নাগাদ উত্তর পাব। আপনি কাল এই সময়ে যদি আসেন–’ ‘আসব‌, নিশ্চয় আসব।’ লোকটি উঠে দাঁড়াল। রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘বক্সী‌, ভদ্রলোকের নাম আর ঠিকানা লিখে নাও।‘ ব্যোমকেশ বলল–’আজ্ঞে।’ নাম আর ঠিকানা দিতে হবে শুনে লোকটি একটু থতিয়ে গেল‌, তারপর বলল–’আমার নাম নৃসিংহ মল্লিক। ঠিকানা ১৭ নম্বর কুঞ্জ মিস্ত্রী লেন।’ ব্যোমকেশ নাম ঠিকানা লিখে নিল। ইতিমধ্যে রাখালবাবু টেবিলের তলায় একটি গুপ্ত বোতাম টিপেছিলেন‌, বাইরে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে খবর গিয়েছিল যে‌, ঘর থেকে যে ব্যক্তি বেরুবে তাকে অনুসরণ করতে হবে। রাখালবাবু নিঃসংশয়ে বুঝেছিলেন যে‌, এই ব্যক্তিই নরেশ মণ্ডল। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করার আগে তার বাসার ঠিকানা পাকিভাবে জানা দরকার। সেখানে বন্দুক পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কিছুই প্রয়োজন হলো না। নরেশ দোরের দিকে পা বাড়িয়েছে এমন সময় আর একটি লোক ঘরে প্রবেশ করল। নবাগতকে চিনতে তিলমাত্র বিলম্ব হয় না‌, একেবারে অশোক মাইতির যমজ ভাই। সুতরাং গঙ্গাপদ চৌধুরী। আজ আর তার মুখে দাড়ি নেই। গঙ্গাপদ নরেশকে দেখার আগেই নরেশ গঙ্গাপদকে দেখেছিল; বাঘের মত চাপা গর্জন তার গলা থেকে বেরিয়ে এল‌, তারপর সে গঙ্গাপদর ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল। দুহাতে তার গলা টিপে ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে বলতে লাগল— ‘পেয়েছি তোকে! শালা— শূয়ার কা বাচ্চা— আর যাবি কোথায়!’ রাখালবাবু দ্রুত পকেট থেকে বাঁশি বার করে বাজালেন। আরদালি এবং আর যেসব পুলিসের লোক আনাচে-কানাচে ছিল তারা ছুটে এল। গলা টিপুনি খেয়ে গঙ্গাপদর তখন জিভ বেরিয়ে পড়েছে। সকলে মিলে টানাটানি করে নরেশ আর গঙ্গাপদকে আলাদা করল। রাখালবাবু নরেশের হাতে হাতকড়া পর্যালেন। বললেন— নরেশ মণ্ডল‌, গঙ্গাপদ চৌধুরীকে খুনের চেষ্টার অপরাধে তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’ নরেশ মণ্ডল রাখালবাবুর কথা শুনতেই পেল না‌, গঙ্গাপদর পানে আরক্ত চক্ষু মেলে গজরাতে লাগল–‘হারামজাদা বেইমান‌, তোর বুক চিরে রক্ত পান করব–’ ব্যোমকেশ এতক্ষণ বসেছিল‌, চেয়ার ছেড়ে ওঠেনি। সে এখন টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট ধরাল। রাখালবাবু তাঁর একজন সহকর্মীকে বললেন–‘ধীরেন‌, এই নাও নরেশ মণ্ডলের ঠিকানা। ওর ঘর খানাতল্লাশ কর। সম্ভবত একটা রিভলবার কিংবা পিস্তল পাবে।—আমরা এদের দু’জনকে লক-আপ-এ নিয়ে যাচ্ছি।’ গঙ্গাপদ মেঝোয় বসে গলায় হাত বুলোচ্ছিল‌, চমকে উঠে বলল–’আমাকে লক-আপ-এ রাখবেন। আমি কী অপরাধ করেছি?’ রাখালবাবু বললেন–‘তুমি অশোক মাইতিকে খুন করাবার চেষ্টা করেছিলে। তোমার অপরাধ পিনাল কোডের কোন দফায় পড়ে পাবলিক প্রসিকিউটার তা স্থির করবেন। ওঠো এখন। ‘ সন্ধ্যের পর ব্যোমকেশের বসবার ঘরে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে রাখালবাবু বললেন–’আচ্ছা ব্যোমকেশদা‌, নরেশ মণ্ডল আর গঙ্গাপদ চৌধুরী–দু’জনেই চাকরির খোঁজে আসবে আপনি আশা করেছিলেন?’ ব্যোমকেশ বলল–’আশা করিনি‌, তবে সম্ভাবনাটা মনের মধ্যে ছিল। কিন্তু ওরা যে একই সময়ে এসে গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ শুরু করে দেবে তা কল্পনা করিনি। ভালই হলো‌, একই ছিপে জোড়ামাছ উঠল। — নরেশ মণ্ডলের ঘরখানা তল্লাশ করে কী পেলে?’ ‘পিস্তল পাওয়া গেছে। ওর বিরুদ্ধে মামলা পাকা হয়ে গেছে। এখন দেখা যাক গঙ্গাপদকে পাকড়ানো যায় কি না। তাকে হাজতে রেখেছি‌, আর কিছু না হোক‌, কয়েকদিন হাজত-বাস করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক।’ ‘হুঁ। অশোক মাইতির খবর কি?’ ‘সে এখনো হাসপাতাল থেকে বেরোয়নি। বেরুলেও তাকে এখন কলকাতায় থাকতে হবে। সে আমাদের প্রধান সাক্ষী।‘ ব্যোমকেশ হঠাৎ হেসে উঠল‌, বলল— ‘কথায় বলে‌, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়‌, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। অশোক মাইতি খুব বেঁচে গেছে। ও না বাঁচলে এমন রহস্যটা রহস্যই থেকে যেত।’ নিরুপমা হোটেলের ম্যানেজার হরিশচন্দ্র হোড় ঘুম ভেঙেই ঘড়ি দেখলেন–সাড়ে‌, ছটা। তিনি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ইঃ‌, আজ বেজায় দেরি হয়ে গেছে। তিনি ডাকলেন‌, ‘গুণধর!’ তকমা-উর্দি পর সদর খানসামা গুণধর এসে দাঁড়াল। শীর্ণকান্তি অত্যন্ত কর্মকুশল চৌকশ লোক, হোটেলের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির প্রতি নজর আছে। হরিশচন্দ্র তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেড-টি দেওয়া হয়েছে?’ গুণধর বলল‌, ‘আজ্ঞে। তেতলার সবাই চা নিয়েছেন‌, কেবল দোতলার দুনম্বর ঘরে টোকা দিয়ে সাড়া পেলাম না।’ হরিশচন্দ্র বললেন‌, ‘দোতলার দু’নম্বর–রাজকুমারবাবু। পনেরো মিনিট পরে আবার টোকা দিও।–বাজারে কে গেছে?’ ‘জেনারেলকে নিয়ে সরকার মশায় গেছেন।’ ‘বেশ। আমার চা নিয়ে এস।’ হরিশচন্দ্র উঠে কক্ষ-সংলগ্ন বাথরুমে প্রবেশ করলেন। রাসবিহারী অ্যাভেন্ম ও গড়িয়াহাটার চৌমাথা থেকে অনতিদূরে নিরুপমা হোটেল। দেশী হোটেল হলেও তার ভাবভঙ্গী একটু বিলিতি-ঘেষা। চাকরেরা খানসামার মত তকমা-উর্দি পারে‌, সদর দরজার সামনে সকাল বিকেল জেনারেলের মত সাজপোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে এবং যোগ্য ব্যক্তিকে সেলাম করে। তিনতলা বাড়ির প্রত্যেক তলায় আটখানি ঘর। নীচের
false
humayun_ahmed
হয়ে বললাম, কীসের প্রতিজ্ঞা? ঢাকায় গিয়ে রকিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবি না। এসব কি বলছিস, আমি দেখা করব কেন? আর ওর চিঠির জবাব দিবি না। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নীলু, কাঁদতে শুরু করল। ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, কথা দে আমাকে আমার গা ছুঁয়ে বল। কী যে কাণ্ড তোর! আমি নীলুকে জড়িয়ে ধরলাম। এমন বোকা কেন নীলুটা? সেদিন আকাশের রঙ ছিল ঘন নীল। আমরা এমনিত কখনো আকাশ দেখি না। আমরা আকাশের দিকে তাকাই মন খারাপ হলে। মন বিষন্ন হলে আকাশও বিষন্ন হয়। হেমন্তের এই ঝকঝকে সকালে আকাশটা অসম্ভব বিষন্ন হয়ে গেল। আমি তবু মুখে হাসি টেনে রাখলাম। ভোরবেলা নাশতা খাবার সময় খুব হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করলাম। নজুমলা চাচাও আজ আমাদের সঙ্গে নাশতা খেলেন। নীলু বসে রইল পাথরের মত মুখ করে। বাবা একবার সাবধানে চলাফেরার কথা বললেন। একা একা কোথাও যাবার দরকার নেই। কোথাও যেতে হলে বন্ধু-বান্ধব কাউকে সঙ্গে নিবি। নজমুল চাচা বললেন, চিন্তার কিছু নেই, সফদর সাহেব প্রতি শুক্রবারে এসে বাসায় নিয়ে যাবেন। আর ছুটি ছাটা হলো নিজে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছে দেবেন। অতি ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি। আমি তাদের কথায় হা-না কিছুই বললাম না। ঠিক যখন যাবার সময় হল তখন ইচ্ছে করল। চেঁচিয়ে বলি–আমি এইখানেই থাকব। এখানকার কলেজে ভর্তি হব। কিছুই বলা হল না। নজমুল চাচা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। ট্রেন ছাড়তে খুব দেরি করতে লাগল। বাবা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। নীলু সেতারা কেউ আসেনি। ওরা খুব কাদছিল। বাবা বলেছিলেন, তোরা আসিস না। তোরা থাক এখানে। আর এত কান্নাকাটির কি আছে। দুই মাস পরে তো আসছেই। ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় বাবা মনে হল খুব অবাক হয়ে পড়েছেন। যেন ভাবতে পারেননি ট্রেন এক সময় ছেড়ে দেবে। তিনি জানোলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার বা হাত শক্ত করে চেপে ধরে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগলেন। নজমুল চাচা বললেন, আরে কর কি, হাত ছেড়ে দাও। বাবা হাত ছাড়লেন না। যেন শেষমূহুর্তে তার মনে হল আমি চলে যাচ্ছি। তিনি ট্রেনের লোকজন, প্লাটফরমের গাদাগাদি ভিড় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফুপিয়ে উঠলেন, আমার আম্মি। আমার রাত্ৰিমণি। ওরে বেটি টুনটুন। আমি পাথরের মত মুখ করে বসে রইলাম। পৃথিবীতে এত কষ্ট কেন থাকে? কেন এত দুঃখ চারদিকে? জানালার ওপাশে কি সুন্দর সব দৃশ্য। গাঢ় নীল রঙের ডোবা একটি। তার ওপর সাদা মেঘের ছায়া পড়েছে। কঞ্চি হাতে একটি ছোট্ট ছেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে। পাট বোঝাই একটি গরুর গাড়ির চাকা আটকে গেছে। গরুটি ধবধবে সাদা। এক সময় নজমুল চাচা বললেন, ছিঃ মা কাঁদে না। বিলু, তোর দুটি চিঠিই পেয়েছি। প্রথমটির জবাব সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলাম। রমজান ভাইকে পোস্ট করতে দিয়েছি। ওমা দুই দিন পরে দেখি তার বাজারের ব্যাগ থেকে চিঠি বেরুল। ভিজে ন্যাত। ন্যাতা! অথচ রমজান ভাই আমাকে বলেছে সে নিজ হাতে চিঠি ফেলেছে। দেখ অবস্থা। তারপর তোমার দুনম্বর চিঠিটি এল। ভাবলাম রাতে জবাব লিখব। রাত ছাড়া চিঠি লিখতে ভাল লাগে না। কিন্তু রাতে বাবার খুব জ্বর এল। মাথায় পানি ঢালতে হল, ডাক্তার আনতে হল। ডাক্তার বলছেন ম্যালেরিয়া। দেশে কী এখন ম্যালেরিয়া আছে নাকি যে ম্যালেরিয়া হবে। ডাক্তারটির বয়স খুব কম, আমার মনে হয় নতুন পাস করেছে। আমার মত পাস। বইটই ভালমতো পড়েনি। আমার সঙ্গে গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল। মিস নীলু, ভয়ের কিছু নেই। আমি আবার এসে দেখে যাব। আমি হেসে বাঁচি না। মিস নীলু আবার কি! কলেজে ওঠার পর দেখি অনেকেই সম্মান-টম্মান করছে। বিশেষ করে আমাদের কলেজের একজন লজিকের স্যার–নাজিবর রহমান ভুইয়া। উনি সব সময় আপনি আপনি করছেন। ছাত্রীরা তার নাম দিয়েছে প্ৰেমকুমার। কারণ তিনি নাকি সব মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম করবার চেষ্টা করেন। তাকে প্রতি বছর পাঁচ ছ’বছর হাফসোল খেতে হয়। হাফসোল কী জানিস তো? নাকি তোদের কলেজে এসব কথা বলে না? যাই হোক নজিবর রহমান স্যার কী করল তোকে বলি। ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নজিবর রহমান স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনি ভ্রূ কুচকে বললেন, তুমি ফাস্ট ইয়ারের না? জি স্যার। গত ক্লাসে আসিনি কেন? বাবার জ্বর ছিল তাই আসিনি। লজিকের কতগুলি ইম্পর্টেন্ট ডেফিনেশন পড়িয়েছি। মিস করলে পরেরগুলি ধরতে পারবে না। আমি চুপ করে রইলাম। নজিবর রহমান স্যার গভীরভাবে কিছুক্ষণ মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে আমার কাছে প্রিপেয়ারড নোট আছে। একবার এসে নিয়ে যেও। আমি অবশ্যি নোট নিতে যাইনি। গেলেই আমার নাম হয়ে যেত প্রেমকুমারী। হিহিহি। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কাছে শুনেছি তার কাছে ক্লাস নোটের দশ-বারোটা কপি তৈরি থাকে। যাদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করার ইচ্ছে হয় তাদের তিনি ডেকে ডেকে দেন। ভদ্রলোক কিন্তু পড়ান খুব ভাল। আমাদের আরেকজন স্যার আছে খুব ভাল পড়ান। তাঁর নাম কি জানিস? তাঁর নাম মুরগির গু। কী জন্যে বেচারার এই নাম হল। অনেকদিন ধরে তাঁর এই নাম চলছে। ছোটখাটো মানুষ, খুব পান খান। ক্লাস শুরু করবার আগে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে একটা প্রচণ্ড বাড়ি দিয়ে বলেন, নিস্তব্ধতা! ছাত্রীগণ নিস্তব্ধতা হিরন্ময়!। প্রথম দিন তো আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম, কিন্তু পরে দেখি সাংঘাতিক ভাল পড়ান। তার একটা ভাল নাম হওয়া দরকার ছিল। ক্লাসের অনেক কথা লিখলাম। আরো মজার মজার ব্যাপার আছে, পরে লিখব। একজন আপা আছেন
false
humayun_ahmed
পারছি না। বাবা। উনি একটা অদ্ভুত ছবি নিয়ে এসেছিলেন। মনে হয় আমার বিয়ের ছবি। কি আবোল-তাবোল বকছিস! তোর বিয়ের ছবি মানে? তোর বিয়েটা হল কবে? নিজাম সাহেব উত্তেজনায় মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর ভ্রূকুঞ্চিত। কপালের চামড়ায় গভীর ভাঁজ। ব্যাপারটা কী, আমাকে গুছিয়ে বল। আমি জানলে তো গুছিয়ে বলব। আমাকে জানতে হবে না? আমার মনে হয়। উনি জানেন। কি বারবার উনিী-উনি করছিস, উনিটা কে? মিসির আলি সাহেব। কী মুশকিল, মিসির আলিটা কে? একবার তো বলেছি বাবা, মুনির সাহেবের বন্ধু। সে-রাতে নিজাম সাহেবের ভালো ঘুম হল না। বারবার জেগে উঠলেন। শেষরাতের দিকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন প্ৰকাণ্ড একটা মাকড়সার পেটের সঙ্গে তিনি সেঁটে রয়েছেন। মাকড়সাটা তাঁকে পেটে নিয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। ঐ মাকড়সার পেছনে-পেছনে আরো কয়েকটা মাকড়সা তাঁর দখল নেবার চেষ্টা করছে। বড় মাকড়সাটার সঙ্গে পারছে না। মাকড়সাটার গা থেকে পিচ্ছিল কি একটা বের হচ্ছে। তাঁর গা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কোঁদে উঠলেন। কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন! দরজায় খুব আলতো করে কে যেন হাত রাখল। মিসির আলি কেরোসিনের চুলোয় চা বসিয়েছেন। সেখান থেকেই বললেন, কে? কোনোরকম জবাব পাওয়া গেল না। কেউ দরজার কড়াও নাড়ছে না। মিসির আলি উঠে এলেন। দরজার ও-পাশে একজন— কেউ আছে কড়া না-নাড়লেও তা বোঝা যাচ্ছে। মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় খুব দুর্বল নয়, অনেক কিছুই সে ধরতে পারে। হয়তো কোনো ভিখিরি। কড়া নাড়তে সঙ্কোচ বোধ করছে, কিংবা এমন কেউ, যে ঠিকানা গুলিয়ে ফেলেছে। মিসির আলি দরজা খুলে চমকে উঠলেন–নীলু দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই সে নানান জায়গায় ঘুরছে। তার শান্তমুখে শ্ৰান্তির ছায়া! কেমন আছ নীলু? ভালো! ভেতরে অসব? কী আশ্চৰ্য কেন আসবে না? আমি ভাবছিলাম, আপনি আমাকে ঘরেই ঢুকতে দেবেন না। এ-রকম মনে করার কোনো কারণ আছে? হ্যাঁ, আছে। আপনি আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঠিকানা বদল করেছেন। ইউনিভার্সিটিতেও যান না। ইউনিভার্সিটিতে যাই না, কারণ আমি এক বছরের ছুটি নিয়েছি। এস, ভেতরে এসে বস। নীলু ভেতরে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নিচু গলায় বলল, আর কেউ নেই? আর কে থাকবে? তুমি কি ভেবেছিলে বিয়ে করে, সংসার পেতে বসেছি? না, তা ভাবি নি। আপনি গৃহী মানুষ নন। তাহলে আমি কি সন্ন্যাসী? না, তাও না। নীলু, তুমি আরাম করে বাস।–আমি চা বানাচ্ছিলাম। চা শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলব! চা-টা আমি বানিয়ে দিই? দাও! সব হাতের কাছেই আছে-হাত বাড়ালেই পাবে। নীলু শীতল গলায় বলল, হাতের কাছে থাকলেই হাত বাড়ালে সব কিছু পাওয়া না। মিসির আলি এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় কথার পিঠে কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। কিছুতেই সহজ হতে পারেন না, অথচ তার সঙ্গেই সম্পর্কটা সবচে সহজ হওয়া উচিত ছিল। নীলু চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আপনি আমাকে কিছু না বলে বাড়িটা বদলালেন কেন? নানান ঝামেলায় বলা হয়ে ওঠে নি। বাজে কথা বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করেই এটা করেছেন। এবং কেন করেছেন তাও জানি। কেন করেছি? লোকলজ্জার ভয়ে। আমার মতো একটা অল্পবয়সী মেয়ে আপনার মতো আধাবুড়োর পেছনে দিন-রাত ঘুরঘুর করে, এটা আপনার ভালো লাগে নি। সারাক্ষণ ভেবেছেন, লোকে না-জানি কি বলছে। লোকে কি বলছে না-বলছে, তা নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না। তাও অবশ্যি ঠিক। আপনি মাথা ঘামান বড়-বড় বিষয় নিয়ে। মিসির আলি আলোচনার মোড় ঘোরাবার জন্যে বললেন, ইন্টারেষ্টিং একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছি, বুঝলে নীলু। একটা মানুষের অনেক কটা জীবন থাকার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নীলু বলল, এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না। ভালো না লাগলেও শোন—এই যে তুমি এসেছ আমার কাছে, এটা ঘটছে এই জীবনে। অন্য এক জীবনে আমি হয়তো গিয়েছি তোমার কাছে। সেই জীবনে আমি হয়তো তোমার পেছনে-পেছনে ঘুরছি, আর তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ। আপনি কি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন? আমি কথার কথা বলছি নীলু। নীলু থমথমে গলায় বলল, আপনার ঠিকানা বের করার জন্যে আমি যে কী কষ্ট করেছি, তা যদি আপনি জানতেন … । জানলে কী হত? না-কী আর হত? কিছুই হত না। নীলুর চোখ ছলছল করছে। মিসির আলি ভয় করছেন, হয়তো কেঁদে ফেলবে। তবে এই মেয়েটি শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদবে না। নিজেকে সামলে নেবে। হ্যাঁ, তাই হচ্ছে। নীলু নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সে সহজ গলায় বলল, চায়ে চিনি হয়েছে তো? মিসির আলি হাসলেন। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। বিনু অবাক হয়ে বলল, আপনি? মুনির অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। নিচু গলায় বলল, স্যার কি বাসায় নেই? বাসায় থাকবেন কেন? এখন তো ওঁর অফিসে থাকবায় কথা। তাই না? ও, আচ্ছা–হ্যাঁ। আপনি অফিসে যান নি? না। আমি তাহলে যাই। বসতে চাইলে বসুন! মুনির বারান্দায় চেয়ারটায় বসে পড়ে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। টানা টানা গলায় বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম…। চা খাবেন, না লেবু দিয়ে দিয়ে সরবত বানিয়ে দেব? আপনি খুব ক্লান্ত, সেই জন্যে বলছি। না, কিছু লাগবে না। বিনু ভেতরে চলে গেল। আবার ফিরে এল লেবুর সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে। আমাদের তো ফ্ৰীজ নেই, এই জন্যে খুব ঠাণ্ডা হবে না। গরম সরবত। মুনির হেসে ফেলল। বিনু বলল, আমার মনে হয়, আপনি আমাকে কিছু বলতে এসেছেন। বলে ফেলুন।
false
humayun_ahmed
না। দিঘি পর্যন্তু সে কীভাবে গেল সেটাই তারানগরের বর্তমান আলোচ্য বিষয়। রহস্যময় এই জগতের বিপুল রহস্যের অতি সামান্যই আমরা জানি। আমাদের উচিত এই সামান্য জ্ঞান নিয়েই তুষ্ট থাকা। বেশি জানতে না চাওয়া। . কৌতূহলী পাঠকদের জন্যে তারাশঙ্করের ডাইনী গল্পটি দিয়ে দেওয়া হলো। ডাইনী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে কবে নামকরণ করিয়াছিল সে ইতিহাস বিস্মৃতির গর্ভে সমাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু নামটি আজও পূর্ণগৌরবে বর্তমান ছাতি-ফাটার মাঠে জলহীন ছায়াশূন্য দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরটির এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া অপর প্রান্তের দিকে চাহিলে ওপারের গ্রামচিহ্নের গাছপালাগুলিকে কালো প্রলেপের মত মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন যেন কেমন উদাস হইয়া উঠে। এপার হইতে ওপার পর্যন্ত অতিক্রম করিতে গেলে তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া মানুষের মৃত্যু হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়; বিশেষ করিয়া গ্রীষ্মকালে। তখন যেন ছাতি-ফাটার মাঠ নামগৌরবে মহামারীর সমকক্ষতা লাভ করিবার জন্য লালায়িত হইয়া উঠে। ঘন ধূমাচ্ছিন্নতার মত ধূলার একটা ধূসর আস্তরণে মাটি হইতে আকাশের কোল পর্যন্ত আছন্ন হইয়া থাকে; অপর প্রান্তের সুদূর গ্রামচিহ্নে সীমারেখা প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। তখন ছাতি-ফাটার মাঠের সে রূপ অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর! শূন্যলোকে ভাসে একটি ধূধূসরতা, নিম্নলোকে তৃণচিহ্নহীন মাঠে সদ্য-নির্বাপিত চিতাভস্মের রূপ ও উত্তপ্ত স্পর্শ। ফ্যাকাশে রঙের নরম ধূলার রাশি প্রায় এক হাত পুরু হইয়া জমিয়া থাকে। গাছের মধ্যে এত বড় প্রান্তরটার এখানে ওখানে কতকগুলি থৈৱী ও সেয়াকুল জাতীয় কণ্ঠকগুল্ম। কোনো বড় গাছ নাই—বড় গাছ এখানে জন্মায় না, কোথাও জল নাই, গোটাকয়েক শুভূগর্ভ জলাশয় আছে, কিন্তু জল তাহাতে থাকে না। মাঠখানির চারিদিকেই ছোট ছোট পল্লী—সবই নিরক্ষর চাষীদের গ্রাম; সত্য কথা তাহারা গোপন করিতে জানে না—তাহারা বলে, কোন অতীতকালের এক মহানাগ এখানে আসিয়া বসতি করিয়াছিল, তাহারই বিষের জ্বালায় মাঠখানির রসময়ী রূপ, বীজপ্রসবিনী শক্তি পুড়িয়া ক্ষার হইয়া গিয়াছে। তখন নাকি আকাশলোকে সঞ্চরমাণ পতঙ্গ-পক্ষীও পঙ্গু হইয়া ঝরা-পাতার মত ঘুরিতে ঘুরিতে আসিয়া পড়িত সেই মহানগরের গ্রামের মধ্যে। সে নাগ আর নাই, কিন্তু বিষজর্জরত এখনও কমে নাই। অভিশপ্ত ছাতিফাটার মাঠ! তাহারই ভাগ্যদোষে ঐ বিষজর্জরতার উপরে আর এক ক্রুর দৃষ্টি তাহার উপর প্রসারিত হইয়া আছে। মাঠখানার পূর্বপ্রান্তে দলদলির জুলা, অর্থাৎ অত্যন্ত গভীর পঙ্কিল ঝরনা জাতীয় জলটার উপরেই রামনগরের সাহাদের যে আমবাগান আছে, সেই আমবাগানে আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়া বাস করিতেছে এক ডাকিনী—ভীষণ শক্তিশালিনী নিষ্ঠুর ক্রুর একটা বৃদ্ধা ডাকিনী। লোকে তাহাকে পরিহার করিয়াই চলে, তবু চল্লিশ বৎসর ধরিয়া দূর হইতে তাহাকে দেখিয়া তাহার প্রতিটি অঙ্গের বর্ণনা তাহারা দিতে পারে, তাহার দৃষ্টি নাকি অপলক স্থির, আর সে দৃষ্টি নাকি আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়াই নিবদ্ধ হইয়া আছে এই মাঠখানার উপর। দলদলির উপরেই আমবাগানের ছায়ার মধ্যে নিঃসঙ্গ একখানি মেটে ঘর; ঘরখানার মুখ ঐ ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে। দুয়ারের সম্মুখেই লম্বা একখানি খড়ে-ছাওয়া বারান্দা—সেই বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া বসিয়ী নিমেষহীন দৃষ্টিতে বৃদ্ধা চাহিয়া থাকে ঐ ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে। তাহার কাজের মধ্যে সে আপন ঘরদুয়ারটি পরিষ্কার করিয়া গোবরমাটি দিয়া নিকাইয়া লয়, তাহার পর বাহি হয় ভিক্ষায়। দুই-তিনটা বাড়িতে গিয়া দাড়াইলেই তাহার কাজ হইয়া যায়, লোকে ভয়ে ভয়ে ভিক্ষা বেশী পরিমাণেই দিয়া থাকে; সেরখানেক চাল হইলেই সে আর ভিক্ষা করে না, বাড়ি ফিরিয়া আসে। ফিরিবার পথে অর্ধেক চাল বিক্রি করিয়া দোকান হইতে একটু নুন, একটু সরিষার তেল, অরি খানিকটা কেরোসিন তেল কিনিয়া আনে। বাড়ি ফিরিয়া আর একবার বাহির হয় শুকনো গোবর ও দুই-চারিটা শুকনো ডালপালার সন্ধানে। ইহার পর সমস্তটা দিন সে দাওয়ার উপর নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকে। এমনি করিয়া চল্লিশ বৎসর সে একই ধারায় ঐ মাঠের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। বৃদ্ধার বাড়ি এখানে নয়, কোথায় যে বাড়ি সে কথাও কেহ সঠিক জানে না। তবে একথা নাকি নিঃসন্দেহ যে, তিন-চারখানা গ্রাম একরূপ ধ্বংস করিয়া অবশেষে একদা আকাশপথে একটা গাছকে চালাইয়া লইয়া যাইতে যাইতে এই ছাতি-ফাটার মাঠের নির্জন রূপে মুগ্ধ হইয়া নামিয়া আসিয়া এইখানে ঘর বাঁধিয়াছে। নির্জনতা উহারা ভালোবাসে, মানুষের সাক্ষাৎ উহারা চায় না। মানুষ দেখলেই যে তাহার অনিষ্ট-স্পৃহা জাগিয়া উঠে। ঐ সর্বনাশী লোলুপশক্তিটা সাপের মত লকলকে জিভ বাহির করিয়া ফণা তুলিয়া নাচিয়া উঠে। না হইলেও সে তো মানুষ। আপনার দৃষ্টি দেখিয়া সে আপনিই শিহরিয়া উঠে। বহুকালের পুরানো একখানি—আয়না—সেই আয়নায় আপনার চোখের প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাহার নিজের ভয় হয়—ক্ষুদ্রায়তন চোখের মধ্যে পিঙ্গল দুইটি তারা, দৃষ্টিতে ছুরির মত একটা ঝকঝকে ধার। জরা-কুঞ্চিত মুখ, শণের মত সাদা চুল, দন্তহীন মুখ। আপন প্রতিবিম্ব দেখিতে দেখিতে ঠোঁট দুইটি তাহার থরথর করিয়া কাপিয়া উঠিল। সে আয়নাখানি নামাইয়া রাখিয়া দিল। আয়নাখানার চারিদিকে কাঠের ঘেরটা একেবারে কালো হইয়া গিয়াছে, অথচ মৃত অবস্থায় কি সুন্দর লালচে রঙ, আর কি পালিশই না ছিল! আর আয়নার কাচখানা ছিল রোদ-চকচকে পুকুরের জলের মত। কাচখানার ভিতর একখানা মুখ কি পরিষ্কারই না দেখা যাইত। ছোট কপালখানিকে ঘেরিয়া একরাশ চুল ঘন কালো নয়, একটু লালচে আভা ছিল চুলে; কপালের নিচেই টিকোল নাক; চোখ দুইটি ছোটই ছিল— চোখের তারা দুইটিও খয়রা রঙেরই ছিল–লোকেও সে চোখ দেখিয়া ভয় করিত। কিন্তু তাহার বড় ভালো লাগত, ছোট চোখ দুইটি আরও একটু ছোট করিয়া তাকাইলে মনে হইত, আকাশের কোল পর্যন্ত এ চোখ দিয়া দেখা যায়। অকস্মাৎ সে শিহরিয়া উঠিল—সরুণ দিয়া চেরা, ছুরির মত চোখে, বিজলীর মত এই দৃষ্টিতে যাহাকে তাহার ভালো লাগে তাহার আর রক্ষা থাকে না। কোথা দিয়া যে কি হইয়া যায়, কেমন করিয়া
false
toslima_nasrin
করতে। বাড়ির গাছে গাছে জিনও থাকে। বাড়িটিতে ঢোকার পর থেকে ফজলিখালাকে প্রায়ই জিনে ধরেছে, জিন একদিন দু’দিন থাকে, কখনও সাতদিন, আমিরুল্লাহ নিজে যখন জিন ছাড়ান ফজলিখালা ধপাশ করে পড়েন মেঝেয়, জিনেরা এভাবেই মানুষের শরীর ছেড়ে বের হয়। জিনে ধরলে ফজলিখালা মাথার ঘোমটা ফেলে দেন, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান একা একা বোরখা ছাড়া, রাস্তায় এর ওর সঙ্গে হেসে হেসে হাবিজাবি কথা বলেন, নওমহলের মোড়ে নিজের স্বামীকে দেখে ফজলিখালা নাকি একদিন বলেছিলেন কি মুসা ভাই কই যাইন? বাদাম খাইবাইন। জিন ছাড়ানো এক বিষম ব্যাপার। ফজলিখালাকে রাস্তা থেকে সাড়াশির ধরে মত টেনে আনা হয় বাড়িতে। বাড়ির সবচেয়ে অন্ধকার ঘরে তাঁকে বন্দি করে আমিরুল্লাহ লাঠি হাতে ঢোকেন সে ঘরে। প্রথমে জিজ্ঞেস করেন–কি কারণ তোমার এইসব করার? ফজলিখালা বলেন–আমার কিছু ভালা লাগে না। আমার শহর সুদ্ধা ঘুইরা বেড়াইতে ইচ্ছা করে। আমার বাদাম খাইতে, পোড়াবাড়ির চমচম খাইতে ইচ্ছা করে। হি হি হি। আসলে ফজলিখালা তো আর কথা বলেন না, বলে শরাফত নামের জিন। তাঁর শরীরের মধ্যে শরাফত বসা, যা কিছু করছে ঘোমটা খুলে, বুকের কাপড় ফেলে সব শরাফতই। বিচ্ছিরি নাচ নাচছে, লাগামছাড়া কথা বলছে, সব শরাফত। ফজলিখালা তো আর এমন বেপর্দা বেশরম হতে পারেন না। আমিরুল্লাহ নরম স্বরে বলেন–শোন, তোমার তো আমরা কোনও ক্ষতি করিনি। তুমি কেন আমাদের এত ঝামেলা করছ বাপু। ছেড়ে যাওনা ছেলেবউকে। ছেলে বউ আমাদের কত সতীসাধ্বী। এমন আর কটা বউ হয়। এই বউকে তুমি আর জ্বালিও না বাপু। ছেড়ে যাও। ফজলিখালা লাফিয়ে ওঠেন বিছানায়, নাচতে শুরু করেন গান গেয়ে–আয় তবে সহচরি হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান। আমিরুল্লাহ চোখ নামিয়ে নেন ছেলেবউএর উদ্বাহু নৃত্য দেখে। –তোমাকে কি করে বিদেয় করতে সে কিন্তু আমি জানি বাপু। আমিরুল্লাহ কঠিন স্বরে বলেন। শুনে লাফ দিয়ে নামেন বিছানা থেকে ফজলিখালা। শাড়ি তুলে পায়ের গোড়ালির ওপর নিজেকে লাটিমের মত ঘোরান। খিলখিল হেসে বলেন–তুমি আমার কচু করবা। আমিরুল্লাহ মুখের পেশি কঠিন হতে থাকে। — তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। — হ্যাঁ তাই যামু। আমার যেমন ইচ্ছা করে তাই করুম। বাধা দিবি তো তোদেরে মাইরা ফালামু কইলাম। বটি দিয়া কুবাইয়া মারুম। আমারে চিনস নাই! ফজলিখালা হাত পা ছুড়তে ছুঁড়তে বলেন। আমিরুল্লাহ এবার হাতের লাঠিটি শক্ত করে ধরেন। ছেলেবউ হাত পা ছোঁড়ে যেমন, তিনি লাঠিও ছোঁড়েন ছেলেবউএর পিঠে, ঘাড়ে, মাথায়। এমন মার কখনও খাননি ফজলিখালা, নানা তাঁকে এক চড় কষিয়েছিলেন পিঠে সন্ধেয় পড়তে বসে বইএর ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিলেন বলে, পরদিনই তাঁকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে পেট ভরে পোড়াবাড়ির চমচম খাইয়েছিলেন। ফজলিখালার মনে হয় হাড়গোড় তাঁর সব ভেঙে যাচ্ছে। তিনি কাতর স্বরে বলতে থাকেন–আর করুম না, ছাইড়া দেন আমারে। –ছেড়ে যাবি তো! আমিরুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন। –হ। ছাইড়া যামু। সত্যি কইলাম ছাইড়া যামু। ফজলিখালা উপুড় হয়ে পড়েন শ্বশুরের পায়ে। –নাম কি তোর? –শরাফত। –থাকিস কোথায়? –নিম গাছে। ফজলিখালার ক্লান্ত শরীর হেলে পড়ল মেঝেয়। চোখ অনেকক্ষণ তিনি খুললেন না। হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসলেন, সামনে শ্বশুরকে দেখে তড়িঘড়ি ঘোমটা মাথায় দিয়ে বললেন–আব্বাজি আপনি এখানে? ঘর এত অন্ধকার কেন! ফজলিখালা উঠে সোজা কলতলায়, বলতে বলতে–আব্বাজির অযুর পানি তো এখনও দেওয়া হয়নি, বেলা কম হল নাকি! উঠোনে দাঁড়িয়ে আমিরুল্লাহ বউ ছেলে মেয়ে সবাই দেখল জিন ছেড়ে যাওয়ার পর ফজলিখালা কি করে আগের সেই ফজলিখালা হয়ে উঠলেন। সকলে হাঁফ ছাড়লেন। শরাফত নামের জিনটি প্রায়ই আছড় করে ফজলিখালার ওপর। কিন্তু জিন ফিনের ঝামেলা না হলে তিনি বেশ আল্লাহভক্ত, শ্বশুর স্বামীর বড় বাধ্য। হি হি হি হাসেন না, ঘোমটা খসে না মাথা থেকে। মাঝে মাঝে জিন তাড়ানোর কারণে পিঠে তাঁর কালশিরে দাগ পড়ে। ফর্সা সুডোল পিঠখানায় কালো দাগ, চাঁদের গায়ে কলঙ্ক। ফজলিখালা মা’র গা থেকে হাত সরিয়ে চোখের জল ওড়নায় মুছতে মুছতে বলেন –এটাই শান্তির পথ বড়বু, আব্বাজির মজলিশে আসো, আল্লাহ রসুলের কথা শোনো। আখেরাতে কাজ দেবে। দুনিয়াদারি আর কদিনের বল। এক পলকের। মা দুনিয়াদারির মোহ দূর করতেই চান। বাবা যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ালে মা’র যেন কিছু আসে না যায়, যেন আল্লাহর ধ্যানে মত্ত থেকে সব ভুলে যেতে পারেন। আব্বাজি, বুঝলে বড়বু, তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে বললেই তুমি কবরের আযাব থেকে মুক্তি পাবে, পুলসেরাত পার হয়ে যাবে তরতর করে। হাশরের ময়দানে পাল্লাখানা ভারি হওয়া চাই তো! সংসারের জালে এত জড়িয়ে গেলে কি সম্বল নিয়ে ওইপারে যাবে? মা মাথা নাড়েন। ঠিক কথা। আখেরাতের সম্বল কিছুই নেই মা’র, মা’র তাই মনে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেও আজকাল গাফিলতি হয়। কোরান শরিফের ওপর ধুলো জমছে। তাক ধেকে নামানো হয় না অনেকদিন। এ কালে সুখ হল না, পরকালেও যদি না হয়! আচমকা মা’র মনে ভয় ঢোকে। ফজলিখালা মা’কে নছিহত করে পাঙ্গাস মাছের পেটি দিয়ে ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে কালো বোরখায় গা ঢেকে হাজিবাড়ি জঙ্গল সাফ করে বানানো শ্বশুরবাড়ি চলে যান। নওমহলে। পরদিন থেকে বাড়িতে নাস্তার পাট চুকলেই মা বোরখা চাপান গায়ে। কোথায়? নওমহল। সপ্তাহ যায়। মাস যায়। মা কোথায় যাও? নওমহল। ব্যস কারু মুখে রা নেই। আমরা চার ভাই বোন খাবার টেবিলে বা সোফায় বা বারান্দায় বসে থেকে দেখি মা আমাদের পেছন ফেলে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন।
false
toslima_nasrin
মা বললেন–চল। মা আর ছোটদার পেছন পেছন হেঁটে বাবা রিক্সায় উঠলেন। কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেননি সারা পথ। সারা পথ রিক্সায় মা’র কোলে বসে ছোটদা কেবল হাতের টর্চটিকে একবার জ্বালাতে লাগলেন, একবার নেবাতে। বাড়িতে আমি তখন ঘুম থেকে জেগে মা মা করে কাঁদছি। কান্না থামাতে দাদা তাঁর বাঁ হাতের কণে আঙুল ঢুকিয়ে রাখেন আমার মুখে, সেটি চুষতে চুষতে আমার কান্না থামে। ছোটদার হাতে তখনও টর্চ, জ্বলছে নিবছে। খ. নান্দাইল থানার পাঁচরুখি বাজারের দক্ষিণে মাদারিনগর নামের অজপাঁড়াগাঁয়ে জনাব আলী কৃষকের ঘরে বাবার জন্ম। কৃষকের কিছু ধানি জমি ছিল, কিছু গরু ছিল। আমার কৃষক বড়দাদা, খাটুরে জোয়ান, বলদ জুড়ে ক্ষেতে লাঙল দিতেন, বাবাকে সঙ্গে যেতে হত ফুট ফরমাশ খাটতে, বাবাও লাঙল দেবেন, কৃষকের ছেলে কৃষক হবেন, ক্ষেতে বীজ ছড়াবেন, বীজ থেকে চারা হবে, চারা বড় হয়ে ধান হবে, ধান পাকবে, ধান কেটে গোলায় তুলবেন কিন্তু এক রাতে বাড়ির দাওয়ায় হুঁকো টানতে টানতে জাফর আলী সরকার, বড়দাদারও বাবা, বলেন–ও জনাব আলী, ছেড়ারে পাঠশালায় দেও। পাঠশালায় দিতাম কেরে, বাড়িত কাম নাই! খাটুরে জোয়ান গামছায় পিঠের মশা তাড়াতে তাড়াতে বলেন। পাঠশালায় গেলে বিদ্বান অইব। দশটা লুকের খাতির পাইব। লেকাপড়া শিইখা চাকরিবাকরি করব। দেহ না, খুশির বাপ লেহাপড়া করছে, শহরে চাকরি করে, গেরামের বেবাক জমি কিইনা লইতাছে। জাফর আলী সরকার, মাদারিনগর পাঠশালার মাস্টার, ছেলের কাছে নরম স্বরে কথাটি পাড়েন। — আছিলাম বর্গা চাষী। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুড়াইত। দিন রাইত খাইটা আইজ নিজের কিছু জমি করছি। রজব আলী কাইম কাজ শিখতাছে। এই তো আর কয়দিন পরে নিজেই লাঙল ধরব। বাপ বেটায় মিইলা কাম করলে আরও কিছু জমি কিনন যাইব। জনাব আলী ছাউনি খসে পড়া গোয়াল ঘরের দিকে চেয়ে বলেন। — জনাব আলী, দিন বদলাইতাছে। গেরামের শশীকান্ত, রজনীকান্ত, নীরদ, জোতির্ময় কইলকাতা গেল লেকাপড়া করতে। লেকাপড়া জানা মানুষরে লুকে মান্য গইন্য করে। ছেড়া তুমার লেকাপড়া জানলে লুকে তুমারেও মান্য করব। রজব আলী পাঠশালা থেইকা দুফুরে ফিইরা গরু চড়াইল, ফুট ফরমাইস খাটল।ওরে তো আর কইলকাতা দিতাছ না। জাফর আলী হুঁকো দিয়ে জনাব আলীর হাতে, পিঠে হাত বোলান ছেলের — জনাব আলী, দুইডা দিন চিন্তা কর। ফকফকে জ্যোৎস্না উঠোনে। রজব আলী গরুর গামলায় নুন পানি ঢালেন আর আড়ে আড়ে দেখেন বাপ দাদাকে। খুশিতে মন নাচে তাঁর। জাফর আলী হাঁক ছাড়েন–কইরে, রজব আলী কই! রজব আলী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান, নুন মাথা হাত লুঙ্গিতে মুছে। –কি রে, পাঠশালায় পড়বি? সজোরে মাথা নেড়ে রজব আলী বলেন–হ। জনাব আলীর হুঁকো টানার শব্দ হয়, ফরৎ ফরৎ। পাঁচরুখি বাজার থেকে শাদা জামা, নতুন একখানা ধুতি, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় কিনে আনেন জাফর আলী নাতির জন্য। নাতি পরদিন সকালে পেট ভরে পান্তা খেয়ে, গাভির দুধ দুইয়ে, খড় কেটে গামলায় ভরে, পুকুরে নেয়ে এসে নতুন ধুতি জামা পরে হাতে কলাপাতা আর বাঁশের কলম নিয়ে ক্ষেতের আল বেয়ে খালি পায়ে পাঠশালায় যান। মাস্টার বলেন একে এক এক, ছাত্ররা তারস্বরে বলে একে একে এক। দুইয়ে একে দুই, তিনে একে তিন। রাতে চাটাই পেতে বসে বর্ণপরিচয় বইয়ের পাতা ওল্টান রজব আলী, তাঁর একদমে পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে পুরো বই। কাঠাঁল পাতার ওপর সর্ষের তেল ঢেলে কুপির ওপর ধরে রাখেন, কুপির কালো ধোঁয়া বেরিয়ে তেল জমাট করে, সেই জমাট তেলকালি পানিতে গুলে রজব আলী কালি বানান, বাঁশের কলম ওই কালিতে ডুবিয়ে কলাপাতায় অ আ লেখেন। পরদিন কখন সকাল হবে, কখন আবার পাঠশালায় যাবেন, এই উত্তেজনায় তিনি ছটফট করেন। জনাব আলী ধমক লাগান–কুপি নিভা রজব আলী, তেল খরচা অইব। মাসিক পাঁচ টাকা বেতনের মাস্টারি জাফর আলীর। পাচরুখি বাজার থেকে এক শিশি কেরোসিন তেল কিনে বাজারের তাবৎ লোককে বলে আসেন, নাতিরে পাঠশালায় দিলাম, নাতি লেকাপড়া করে রাইতে, কুপ্পিতে বাড়তি তেল লাগে। রজব আলী দেখবা বড় হইয়া ইংরেজের অপিসে কেরানি হইব। জাফর আলীর আশকারায় রজব আলীর পড়া দ্রুত এগোয়, চাটাইয়ের ওপর পা ছড়িয়ে বসে রজব আলী বর্ণপরিচয় শেষ করে বাল্যশিক্ষা পড়েন, গোপাল বড় সুবোধ ছেলে, তাহাকে যাহা দেওয়া যায়, সে তাহাই খায়। জাফর আলী উঠোনে বসে হুঁকো টানেন আর নাতির পড়ার শব্দ শোনেন। তাঁর ইচ্ছে করে পাঠশালা শেষ করিয়ে রজব আলীকে চন্ডিপাশা ইস্কুলে পড়াতে। তিন মাইল হেঁটে রজব আলী চন্ডিপাশা ইস্কুলেও যান। ইস্কুলে কালিচরণ, বলরাম, নিশিকান্তকে ছাড়িয়ে যান। মেট্রিকের ফল হাতে দিয়ে পন্ডিতমশাই বলেন রজব আলী, লেখাপড়া চালাইয়া যা, ছাড়িস না। রজব আলী লেখাপড়া ছাড়েননি। শহরে যাওয়ার অনুমতি মেলে না, পন্ডিতমশাই নিজে বাড়ি এসে জনাব আলী সরকারকে বলে যান–ছেলে আপনের জজ ব্যারিস্টার হইব। গুষ্ঠির ভাগ্য ফিরব। ছেলেরে যাইতে দেন। সেই রজব আলী হাতে দুটো জামা, একখানা পাজামা, আর এক জোড়া কালো রাবারের জুতো, এক শিশি সর্ষের তেল ভরা পুঁটলি নিয়ে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। পকেটে চার আনা পয়সা সম্বল। বাড়ি খোঁজেন জায়গির থাকার, চেনা এক লোক এক মোক্তারের বাড়িতে জায়গির থাকার কাজ দেন। ভাল ফল দেখিয়ে লিটন মেডিকেল ইস্কুলে ভর্তি হন। আত্মীয় বন্ধুহীন শহরে জায়গির বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে করতে শহরের নতুন বাজারে মনিরুদ্দিন মুন্সির সঙ্গে দেখা হয় বাবার একদিন। দরাজ দিল মুন্সির, দোকানের গদিতে বসে রাস্তার ফকির খাওয়ান বিনে পয়সায়। দেখে বাবার চোখ চকচক করে
false
shunil_gongopaddhay
করে দাঁড়িয়ে রইলেন বিধুশেখর। তাঁর ওষ্ঠে মৃদু হাস্য। পার্বতীর মতন ন যযৌ। ন তন্থেী হয়ে রইলেন বিম্ববতী। বিধুশেখরকে এই কক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্ৰহণ করতে বলবেন, না তিনি নিজেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন, তা বুঝতে পারলেন না। লাঠি ঠকঠকিয়ে বিধুশেখর এগিয়ে এলেন কয়েক পা। জরিপ করার ভঙ্গিতে চতুর্দিকে মাথা ঘুরিয়ে কক্ষটি দেখলেন কয়েকবার। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, এগারো বচর, প্রায় এক যুগ আগে এ ঘরে আমি শেষ এয়েচিলুম। সেবার রামকমলের সান্নিপাতিক হলো, তোমার মনে আচে, বিম্ব? বিম্ববতী নিঃশব্দে ঘাড় হেলালেন। বিধুশেখর আবার বললেন, ছোট্‌কু বিদ্ধেমানে গ্যাচে শুনিচি, কবে ফিরবে? আজকাল লোকমুখে আমায় এসব খপর পেতে হয়। বিম্ববতীও জানেন না যে নবীনকুমার ঠিক কবে প্রত্যাগমন করবে। তাই তিনি নিরুত্তর রইলেন। বিধুশেখরের কণ্ঠে সামান্য অভিযোগের সুর এসেছিল, এবার সেটি মুছে ফেলে তিনি আবার হাসলেন। তারপর বললেন, বিম্ব, তোমার সঙ্গে এ ঘরে আমার কখনো দেকা হয়নি কো। সে কথা ঠিক। মধ্যে মধ্যে রামকমল সিংহের সুদীর্ঘ প্রবাস কালে বিধুশেখর আসতেন বিম্ববতীর খোঁজ খবর নিতে। তখন বিম্ববতীর নিজস্ব কক্ষেই দেখা হতো। সম্পূর্ণ অকারণেই প্রায়, বিম্ববতী গলায় আঁচল জড়িয়ে বিধুশেখরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্ৰণাম করলেন। বিধুশেখর বিস্মিত হলেন না। তিনি ডান হাত তুলে আশীর্বাদ করে কুসুম, চির-আয়ুৰ্ৱতী হও, সৌভাগ্যশালিনী হও! তুমি একা একা এ ঘরে ডাঁড়িয়ে কাঁদছেলে কেন, বিম্ববতী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কী জানি। বিধুশেখর এগিয়ে গিয়ে পালঙ্কের ওপর বসে পড়ে বললেন, তুমি আমায় কখনো কাঁদতে দেকেচো? আমি পুরুষকারে বিশ্বাসী, কান্নায় বিশ্বাসী নই। কিন্তু এদানি আমার কী হয়েছে কে জানে, আমারও চোকে জল আসে, যকন তোকন। আমি ভাবি, এ আবার কী জ্বালা? বোধ হয় বুড়ো বয়সে আমার ভীমরতি ধরলো! বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার শরীর ভালো আচে? বিধুশেখর বললেন, হ্যাঁ, ভালো, বেশ ভালো, হটাৎ যেন বেশী ভালো হয়ে গ্যাচে! পিন্দিমের সলতে নেববার আগে একবার বেশী করে জ্বলে ওঠে না? এ বোধ হয় সেই দশা! তুমি ভালো আচো বিম্ব? -হ্যাঁ। —আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। যতদিন বাঁচবো, তোমায় দেকে যাবো। তুমি তো জানো বিম্ব, আমি ইচ্ছে করলে এ বাড়ির মালিক হতে পাতুম! এইসব বিষয় সম্পত্তি আঁমার হতে পাত্তো! এই ঘরে, এই ছাপরাখাটে আমার জন্য বিছনা পাতা হতো— মধ্যপথে কথা থামিয়ে বিধুশেখর হাসতে লাগলেন। রীতিমতন খুশীর, উপভোগের উপহাস্য। বিম্ববতী আকুল নয়নে চেয়ে রইলেন বিধুশেখরের মুখের দিকে। এক সময় হাসি থামিয়ে বিধুশেখর বললেন, দ্যাকো, এই আমার এক নতুন উপসর্গ। আগে কখনো আমায় অকারণে হাসতে দেকোচো? কান্নার মতন হাসিও, আমার এক নতুন ব্যাধি। বিম্ববতীর মনে হলো, এই বিধুশেখর তাঁর অচেনা। ইনি একজন নতুন মানুষ। ডাকসাঁইটে পুরুষ বিধুশেখর মুখুজ্যের পক্ষে হঠাৎ হাসি বা কান্না অন্যদের কাছে অকল্পনীয়। -এবার মনে পড়েচে, বিম্ব, কেন হাসলুম। পরে বলচি। তোমার সঙ্গে কটা কতা আচে, সেইজন্যই এয়েচি। ছোট্‌কু যে বড় ভাবিয়ে তুললে! এ ছেলেকে সামাল না দিলে যে সব যাবে! বিম্ববতী আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কী করেচে ছোট্‌কু? –কলুটোলায় তোমাদের যে সাত বিঘে জমি ছেল, তা বেচে দিয়েচে! এমন গোখুরির কাজ কেউ করে? নগরের একেবারে মন্দ্যিখানে, ও তো জমি নয়, সোনা, দিন দিন দাম বাড়চে! মেডিকেল হাসপাতালের একেবারে গায়ে। আমায় ঘুনাক্ষরে কিচু জানায়নি। কেন এমন কাণ্ড করলো, জানো? –কেন? –আমার ওপর টক্কর দেবার সাধ। সবাইকে দেকালে যে আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেও সে তার বিষয় সম্পত্তি নিয়ে যা খুশী করতে পারে। এই যদি যা খুশীর নমুনা হয়, তা হলে দুদিনেই তো সব ফুকে দেবে! —ছোট্‌কু আমাকেও কিচু বলেনি। —বিম্ব, গঙ্গাকে আমি সহ্য করতে পাত্তুম না, তুমি সেজন্য মনে ব্যথা পেতে, আমি জানি। কিন্তু গঙ্গা বড় অসমীচীন কাজ করেছেল, আমার বিধবা মেয়ে বিন্দু, সে তার ভগ্নীর মতন, তার প্রতি সে কু-নজর দিয়েছেল। ছিঃ! সেজন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনি। কিন্তু ছোট্‌কু, সে তো আমার বুকের ধন, তার কোনো আবদারে আমি বাধা দিই না, সে আনন্দ ফুর্তি করতে চাইলেও… —ছোট্‌কুর কোনো বদ অভ্যেস নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে সে কেন আকচা-আকচি করতে চায়? আমি তার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেও সে দূরে সরে যায়। আমি কি তার প্রতিপক্ষ হতে পারি? তাকে আমি দু চক্ষের মণি করে রাকতে চাই, আর সে আমার চোকে ধুলো দিতে চায় কেন? আমার বড় কষ্ট হয়— —ছোট্‌কু এখনো ছেলেমানুষ! —কিন্তু তার ধরন ধারণ যে পাকা! সে তবিলের চাবি চাইলে, আমি এক কতায় দিয়ে দিলুম। সে টাকা চাইলে, যত লাখ টাকা চাক, আমি এক কতায় দিতে পারি। তবু তাকে জমি বেচতে হবে, আমায় নুকিয়ে? আমার এ দুঃখু আমি তোমায় ছাড়া আর কাকে জানাবো? বিধুশেখর তাঁর একটু আগেকার উক্তির সত্য প্রমাণিত করার জন্য নিরত হলেন এবং তাঁর চক্ষু থেকে জল করতে লাগলো। বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চক্ষু মুছে তিনি বললেন, কেন হাসচিলুম জানো? এই দ্যাকো— বিধুশেখর দলিলের মতন একটি লম্বা তুলেটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন বিম্ববতীর দিকে। সে কাগজ দেখে আর বিম্ববতী কি বুঝবেন, তিনি উৎসুকভাবে বিধুশেখরের কাছ থেকে আরও কিছু শোনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। —কলুটোলার সেই জমি আমিই কিনে নিইচি। বলচিলুম না। তোমাদের এই সব বিষয়-সম্পত্তি আমিই কিনে নিতে পাতুম! এবার বুঝি তাই-ই হলো, ছোট্‌কু যা বেচবে, তা আমাকেই কিনে নিতে হবে! হো-হো-হো-হে! হাসির
false