label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shomresh
আসুন। এই কেলো, কোনার বেঞ্চিটা ভাল করে পুছে দে। হুকুম শানামাত্র একটি শীর্ণ বালক ন্যাতা হাতে ছুটে গিয়ে বেঞ্চি পরিষ্কার করল। তার ধরণ দেখে এবার দুজন নির্বাক দর্শক হেসে উঠল। মুখ তোলা সঙ্কোচটাকে চেপে রেখে এগিয়ে গিয়ে বসল বেঞ্চিতে। বসেই বুঝল এইরকম পাড়ার অতি সাধারণ চায়ের দোকানে এই কলকাতা শহরেও কোন মেয়ে চা খেতে ঢকে না। আর সেই কারণেই এদের অস্বস্তি। বসার পরেই বিদঘুটে গন্ধ টের পেল দীপাবলী। ময়লা থেকে তৈরী হওয়া গন্ধ। ইতিমধ্যে খদ্দেররা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। যদিও তাদের আগের স্বাভাবিক ছন্দ কেটে গিয়েছে। প্রত্যেকেই চোরা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। অস্বস্তিটাকে আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। চা নিয়ে এল দোকানদার নিজেই। লম্বা টেবিলের কোনায় কাপ ডিস রেখে এমনভাবে দাঁড়াল যে দীপাবলী বুঝল লোকটা কিছু বলতে চাইছে। সে কাপ তুলল। বিবর্ণ কিন্তু ফাটা নয়। গভীর মুখে চুমুক দিয়ে দেখল চা খারাপ নয়। দোকানদার জিজ্ঞাসা করল, খারাপ হয়নি তো? দীপাবলী হাসল, না, ভালই। লোকটা বীরদৰ্পে চারপাশে তাকাতেই একজন বলে উঠল, স্পেশ্যাল খাতির কাছ বকুদা, চা তো ভাল হবেই। আমাদের জন্যে যা বানাও তা কে দিলে গিলতে পারনে না। তোদের মন ভরাতে পারব না জীবনে। দোকানদার মুখ ফেরাল, আপনাকে এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি কয়েকবার। কোন বাড়িতে থাকেন? দীপাবলী মায়াদের বাড়ির হদিশটা দিল। লোকটির জানার আগ্রহ ছিল না, নতুন ভাড়া এসেছেন বুঝি? ঠিক ভাড়া নয়। ওরা আমার পরিচিত। আমি আগে সরকারি চাকরি করতাম। শেষ কথাটা শোনামাত্র গুঞ্জনটা আবার থেমে গেল। দীপাবলী দেখল দোকানদারের মুখের চেহারা বদলে গেল, ও, ও। তা আপনি বললে সকাল বিকেলে কেলোকে দিয়ে আমি চা পাঠিয়ে দিতে পারি। আসলে আমার এই দোকান আপনাদের ঠিক উপযুক্ত তো নয়। কেন? এই তো ওনারা খাচ্ছেন। এবার একটি ছেলে বলে উঠল, এবার জবাব দাও বকুদা। আমরা মানুষ নই, বলো। দোকানদার হেঁ হেঁ করে হাসল, আঃ, তোমরা হলে ব্যাটাছেলে! তাতে কি তফাত হল। প্রশ্নটা করল দীপাবলী। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উঠে এল, একশবার। ঠিক বলেছেন দিদি। তুমি এক পয়সা দোকানের পেছনৈ খরচ করবে না অথচ লাভ করবে যোলআনা। তাই দোকানটাকে নরক করে রেখেছ। এখন দিদির মত মহিলারা এলে তোমার অসুবিধে হবে। আমার কোন কিছুতেই যখন ভাল দেখতে পাও না তখন এখানে আসো কেন? আসাও চাই আবার সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেবে। না দিদি, এ পাড়ায় তো মেয়েদের চায়ের দোকানে ঢাকার চল নেই। ওই ট্রামরাস্তার ধারে যে সব বড় চায়ের দোকান আছে সেখানেই তারা যায়। প্রথম দিন বলে সবাই চুপ করে আছে কিন্তু ভেতরে যেসব খিস্তি খেউড় চলে তাতে আপনি দুদণ্ড বসতে পারবেন না। দীপাবলী কাপ নামিয়ে রাখল। দোকানদারের শেষ কথাগুলোর প্রতিবাদ কেউ করল না। বরং ছেলেটি বলল, কথাটা কিন্তু খাঁটি। আসলে বকুদার দোকানে এসে প্রাণ খুলে কথা বলা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, আপনি এলে একটু অস্বস্তি হবেই। চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। আর তার পরের দিনই মায়ার মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার চা খেতে ইচ্ছে করছিল আমাকে বলনি কেন? ছি ছি। পাড়ার ওই উদোম দোকানে গিয়ে কখনও চা খেতে হয়। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কে বলল আপনাকে? কাজের মেয়েটা। পাড়াতে এটা এখন খবর। দোকানটায় চা বিক্রি হয়, সবাই খাচ্ছে তাই আমিও খেতে গেলাম। অবশ্য গিয়ে বুঝলাম আমি যাওয়াতে ওদের খুব অসুবিধে হয়েছে। তুমি জানোনা ওখানে কি না হয়। পরনিন্দা পরচর্চার কথা ছেড়ে দাও, রেসের স্লিপ লেখা থেকে সন্ধের পর ঝাঁপ বন্ধ করে মদ পর্যন্ত চলে। কিন্তু দিনের বেলায় ভদ্রলোকেরা গিয়ে চা খান। মায়ার মা হেসেছিলেন, দীপা, আমরা চেষ্টা করলেও এমন অনেক জায়গা থেকে যাবেই যেখানে ছেলে এবং মেয়ের পার্থক্য থাকবে। জোর করে তুমি তা দূর করতে পারবে না। ইংরেজি কাগজের বিজ্ঞাপনগুলোর একটাও মনের মত নয়। স্কুলের ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সি খবরই বেশী। কিছু চাকরি বেসরকারি অফিসগুলোতে এবং সেখানে অভিজ্ঞতার উল্লেখ প্রথমেই। শর্টহ্যান্ড টাইপ শিখলে স্টেনোগ্রাফারের কাজ পাওয়া যায়। দীপাবলী কাগজ ভাঁজ করল। এবং তখনই তার মাথায় ভাবনা এল। একবার চেষ্টা করলে হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভাল ফল হয়নি মানে এমন নয় যে আর কখনও হবে না। সরকারি চাকরিতে শুরুটা যদি ওপর থেকে করা যায় তাহলে প্রথম দিকে যতই। অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হোক স্বাধীনভাবে কাজ করার কিছু সুযোগও পাওয়া যাবে। যেটা সে প্রথমবারের পায়নি তা দ্বিতীয় বারেও পাবে না এমন কে বলতে পারে। আর এটা হাতের মোয়া নয় যে সে চাইলেই পেয়ে যাবে। বাংলা ছবির নায়িকারা পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়। জীবনের ছবি যে অন্যরকম তা সে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখেছে তা একমাত্র ওপরতলার সরকারি চাকরিতেই সম্ভব। কর্তৃত্ব চাই। একজন সওদাগরী অফিসের মোটা মাইনের অফিসারের চেয়ে সাধারণ সরকারী অফিসার জনতার কাছে বেশী মর্যাদা এদেশে এখনও পেয়ে থাকেন। সার্টিফিকেটের হিসেবে এখনও তার হাতে সেই পরীক্ষা দেবার কিছু সময় অবশিষ্ট আছে। অবশ্য তার সঠিক বয়স আর সার্টিফিকেটের বয়সের তফাতেই বা কি! ক্রমশ একটা জেদ প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল দীপাবলীকে। হাতে যা টাকা আছে তাতে অন্তত মাসীমাকে এক বছরের জন্যে থাকাখাওয়ার পয়সা দিয়ে সে পরীক্ষাটা নিয়ে থাকতে পারবে। যে সময় নষ্ট হল তা কখনও ফিরে আসবে না, কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে দোষ কি? হ্যাঁ, এই একবছর
false
robindronath
এখানে থাকিলে আমি কিছুতেই পাস করিতে পারিব না।” হরলাল চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। বেণু কহিল, “আজ এই কথা লইয়া বাবা আমাকে যাহা মুখে আসিয়াছে তাহাই বলিয়াছেন। তাই আমি বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি। মা থাকিলে এমন কখনোই হইতে পারিত না।” বলিতে বলিতে সে অভিমানে কাঁদিতে লাগিল। হরলাল কহিল, “চলো, আমি-সুদ্ধ তোমার বাবার কাছে যাই, পরামর্শ করিয়া যাহা ভালো হয় স্থির করা যাইবে।” বেণু কহিল, “ না, আমি সেখানে যাইব না।” বাপের সঙ্গে রাগারাগি করিয়া হরলালের বাড়িতে আসিয়া বেণু থাকিবে, এ কথাটা হরলালের মোটেই ভালো লাগিল না। অথচ ‘আমার বাড়ি থাকিতে পারিবে না’ এ কথা বলাও বড়ো শক্ত। হরলাল ভাবিল, ‘আর-একটু বাদে মনটা একটু ঠাণ্ডা হইলেই ইহাকে ভুলাইয়া বাড়ি লইয়া যাইব।’ জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি খাইয়া আসিয়াছ? ” বেণু কহিল, “না, আমার ক্ষুধা নাই- আমি আজ খাইব না।” হরলাল কহিল, “ সে কি হয়।” তাড়াতাড়ি মাকে গিয়া কহিল, “মা, বেণু আসিয়াছে তাহার জন্য কিছু খাবার চাই।” শুনিয়া মা ভারি খুশি হইয়া খাবার তৈরি করিতে গেলেন। হরলাল আপিসের কাপড় ছাড়িয়া মুখহাত ধুইয়া বেণুর কাছে আসিয়া বসিল। একটুখানি কাশিয়া, একটুখানি ইতস্তত করিয়া, সে বেণুর কাঁধের উপর হাত রাখিয়া কহিল, “বেণু, কাজটা ভালো হইতেছে না। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া বাড়ি হইতে চলিয়া আসা, এটা তোমার উপযুক্ত নয়। ” শুনিয়া তখনই বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া বেণু কহিল, “আপনার এখানে যদি সুবিধা না হয়, আমি সতীশের বাড়ি যাইব।” বলিয়া সে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল। হরলাল তার হাত ধরিয়া কহিল, “রোসো, কিছু খাইয়া যাও।” বেণু রাগ করিয়া কহিল, “ না, আমি খাইতে পারিব না।” বলিয়া হাত ছাড়াইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। এমন সময় হরলালের জন্য যে জলখাবার প্রস্তুত ছিল তাহাই বেণুর জন্য থালায় গুছাইয়া মা তাহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কহিলেন, “কোথায় যাও , বাছা!” বেণু কহিল, “আমার কাজ আছে, আমি চলিলাম। ” মা কহিলেন, “সে কি হয় বাছা, কিছু না খাইয়া যাইতে পারিবে না।” এই বলিয়া সেই বারান্দায় পাত পাড়িয়া তাহাকে হাতে ধরিয়া খাইতে বসাইলেন। বেণু রাগ করিয়া কিছু খাইতেছে না, খাবার লইয়া একটু নাড়াচাড়া করিতেছে মাত্র, এমন সময় দরজার কাছে একটা গাড়ি আসিয়া থামিল। প্রথমে একটা দরোয়ান ও তাহার পশ্চাতে স্বয়ং অধরবাবু মচ্‌মচ্‌ শব্দে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে আসিয়া উপস্থিত । বেণুর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। মা ঘরের মধ্যে সরিয়া গেলেন। অধর ছেলের সম্মুখে আসিয়া ক্রোধে কম্পিত কণ্ঠে হরলালের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “এই বুঝি ! রতিকান্ত আমাকে তখনই বলিয়াছিল, কিন্তু তোমার পেটে যে এত মতলব ছিল তাহা আমি বিশ্বাস করি নাই। তুমি মনে করিয়াছ, বেণুকে বশ করিয়া উহার ঘাড় ভাঙিয়া খাইবে। কিন্তু, সে হইতে দিব না। ছেলে চুরি করিবে! তোমার নামে পুলিস-কেস করিব, তোমাকে জেলে ঠেলিব তবে ছাড়িব।” এই বলিয়া বেণুর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চল্‌। ওঠ্‌। ” বেণু কোনো কথাটি না কহিয়া তাহার বাপের পিছনে পিছনে চলিয়া গেল। সেদিন কেবল হরলালের মুখেই খাবার উঠিল না। ৯ এবারে হরলালের সদাগর-আপিস কী জানি কী কারণে মফস্বল হইতে প্রচুর পরিমাণে চাল ডাল খরিদ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এই উপলক্ষে হরলালকে প্রতি সপ্তাহেই শনিবার ভোরের গাড়িতে সাত-আট হাজার টাকা লইয়া মফস্বলে যাইতে হইত। পাইকেরদিগকে হাতে হাতে দাম চুকাইয়া দিবার জন্য মফস্বলের একটা বিশেষ কেন্দ্রে তাহাদের যে আপিস আছে সেইখানে দশ ও পাঁচ টাকার নোট ও নগদ টাকা লইয়া সে যাইত, সেখানে রসিদ ও খাতা দেখিয়া গত সপ্তাহের মোটা হিসাব মিলাইয়া বর্তমান সপ্তাহের কাজ চালাইবার জন্য টাকা রাখিয়া আসিত। সঙ্গে আপিসের দুইজন দরোয়ান যাইত। হরলালের জামিন নাই বলিয়া আপিসে একটা কথা উঠিয়াছিল, কিন্তু বড়োসাহেব নিজের উপর সমস্ত ঝুঁকি লইয়া বলিয়াছিলেন— হরলালের জামিনের প্রয়োজন নাই। মাঘ মাস হইতে এইভাবে কাজ চলিতেছে, চৈত্র পর্যন্ত চলিবে এমন সম্ভাবনা আছে। এই ব্যাপার লইয়া হরলাল বিশেষ ব্যস্ত ছিল। প্রায়ই তাহাকে অনেক রাত্রে আপিস হইতে ফিরিতে হইত। একদিন এইরূপ রাত্রে ফিরিয়া শুনিল বেণু আসিয়াছিল, মা তাহাকে খাওয়াইয়া যত্ন করিয়া বসাইয়াছিলেন- সেদিন তাহার সঙ্গে কথাবার্তা গল্প করিয়া তাহার প্রতি তাঁহার মন আরো স্নেহে আকৃষ্ট হইয়াছে। এমন আরো দুই-একদিন হইতে লাগিল। মা বলিলেন, “বাড়িতে মা নাই নাকি, সেইজন্য সেখানে তাহার মন টেঁকে না। আমি বেণুকে তোর ছোটো ভাইয়ের মতো আপন ছেলের মতোই দেখি। সেই স্নেহ পাইয়া আমাকে কেবল মা বলিয়া ডাকিবার জন্য এখানে আসে।” এই বলিয়া আঁচলের প্রান্ত দিয়া তিনি চোখ মুছিলেন। হরলালের একদিন বেণুর সঙ্গে দেখা হইল। সেদিন সে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত কথাবার্তা হইল। বেনু বলিল, “বাবা আজকাল এমন হইয়া উঠিয়াছেন যে আমি কিছুতেই বাড়িতে টিকিতে পারিতেছি না। বিশেষত শুনিতে পাইতেছি, তিনি বিবাহ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। রতিবাবু সম্বন্ধ লইয়া আসিতেছেন— তাঁহার সঙ্গে কেবলই পরামর্শ চলিতেছে। পূর্বে আমি কোথাও গিয়া দেরি করিলে বাবা অস্থির হইয়া উঠিতেন, এখন যদি আমি দুই-চারিদিন বাড়িতে না ফিরি তাহা হইলে তিনি আরাম বোধ করেন। আমি বাড়ি থাকিলে বিবাহের আলোচনা সাবধানে করিতে হয় বলিয়া আমি না থাকিলে তিনি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচেন। এ বিবাহ যদি হয় তবে আমি বাড়িতে থাকিতে পারিব না। আমাকে আপনি উদ্ধারের একটা পথ দেখাইয়া দিন— আমি স্বতন্ত্র হইতে চাই।” স্নেহে ও বেদনায় হরলালের হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সংকটের সময়
false
shomresh
রেখে যাও। ওটা হারানো উচিত হবে না। অর্জুন হেসে বলল, এটার কোনও মূল্য আমার কাছে নেই। তবে যেসব আফ্রিকান একে ভয় বা শ্রদ্ধা করেন তাঁদের অসম্মান আমি করছি না। অবশ্য সঠিক জায়গায় যদি এটা পৌঁছয় তার চেষ্টা করা উচিত। কারেক্ট। এক কাজ করি। ওর ড়ুপ্লিকেট বানিয়ে নিই। কোথায় পাবেন? চলো। তৈরি হয়ে ওরা যখন বেরোতে যাচ্ছে তখন দরজার ওপারে সিদ্ধাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সিম্বা অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার বাবার হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আসলে কোনও বিরল জিনিস দেখলে ওঁর মাথায় ন্যায়-অন্যায় বোধ কাজ করে না। মেজর বললেন, এটা উনি নিজে না বলে তোমাকে কেন পাঠিয়েছেন? বাবা আসতে লজ্জা পাচ্ছেন। সিম্বা ম্লান গসল। অর্জুন বলল, ওঁকে বলবেন সমস্যাটা আমি বুঝেছি। কিন্তু এখন আমরা বের হচ্ছি। আপনাকে তাই ভেতরে আসতে বলতে পারছি না। সিম্বা বলল, আমি স্পানিশ জানি। তার মানে? অর্জুন অবাক। যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে তখন টেলিফোনে কথা বললেন তাঁর কাছে যদি যান তা হলে আমি সঙ্গে থাকলে উপকার হবে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমি ইংরেজিতে কথা বলেছি। ও, তাই তো! সিম্বা মাথা নাড়ল। আর মেজর স্প্যানিশ ভালই জানেন। সিম্বা আর কথা না বাড়িয়ে ওদের সঙ্গে লিফটে নীচে নেমে এল। বাড়ির বাইরে এসে মেজর বললেন, চলো হে, টিউব নিতে হবে। টিউব শব্দটি কানে যেতে সিম্বা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? আপনারা গাড়ি নিচ্ছেন না? মাই ডিয়ার বেবি, আমার গাড়িটাকে তোমার বাবার বন্ধুরা কাল রাত্রে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। মেজর ঘুরে বললেন। ও মাই গড! সিম্বা বলল। তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। আমাদের জ্যাকসন হাইটে নামিয়ে দিতে পারবে? টিউবে উঠতে আমার খুব খারাপ লাগে। মেজর বললেন। স্বচ্ছন্দে। আসুন। সিম্বা যেন খুশি হল। নিউ জার্সির রাস্তায় লোকজন দেখা যায় না, কিন্তু কুইন্সের চেহারাটা আলাদা। এখন সকাল। গাড়ির ভিড় এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু যা আছে তা কলকাতাতেও দেখা যাবে না। অর্জুনের মনে পড়ল কোনও একটা কাগজে পড়েছিল, শুধু নিউ ইয়র্কে যত গাড়ি চলে তার সংখ্যা সমস্ত ভারতবর্ষের গাড়ির সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে। জ্যাকসন হাইটে যেখানে গাড়ি পার্ক করল সিম্বা, সেটাকে ভারতীয় পাড়া বলে মনে হল অর্জুনের। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই ফুটপাথে হেঁটে যাওয়া মানুষদের বাংলায় কথা বলতে শুনে সে আরও অবাক হল। মেজর বললেন, যখনই বাংলা শুনতে ইচ্ছে করে তখনই চলে আসি এখানে। বাংলাদেশিরা এই পাড়াটা প্রায় দখল করে ফেলেছে। ওদের কম্পিটিটার হল কিছু গুজরাতি ব্যবসায়ী। ওই দ্যাখো, রয়াল বেঙ্গল রেস্টুরেন্ট, দারুণ ইলিশ মাছ রাঁধে। মুখ তুলে একটা সাইনবোর্ড দেখে অর্জুনের মন জুড়িয়ে গেল। বাংলা হরফে লেখা রয়েছে, মুক্তধারা। সমস্ত বাংলা বই এবং বাংলা গানের ক্যাসেট পাওয়া যায়। ও টি বি অথবা অফ ট্র্যাক বেটিং সেন্টার হল জুয়া খেলার কেন্দ্র। এই পূর্ব-উপকূলে যত রেসকোর্স আছে তার রেসের ছবি এখানকার ভিডিওতে দেখানো হয়। এখন অবশ্য দোকানটি বন্ধ। ও টি বির পাশ দিয়ে খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল সিঁড়িটাকে। বাঁ দিক দিয়ে নীচে নেমে গেছে। অর্থাৎ গ্যাব্রিয়েলা টেলিফোনে যা বলেছে তা মিলে যাচ্ছে। মাথার ওপর দুমদুম শব্দ করে ট্রেন চলে গেল। অর্জুন বলল, এদিকে যেতে হবে। সিম্বা ওদের সঙ্গে আসেনি। গাড়ি পার্ক করে সেখানেই থেকে গেছে। অর্জুন চেয়েছিল মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে কিন্তু মেজর ওকে অনুরোধ করেছেন ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। মেয়েটার কথাবার্তা খারাপ নয়। অন্তত ও কোনও ক্ষতি করবে না বলেই অর্জুনের মনে হয়। অর্জুন হেসে ফেলল। সে ক্ষতির কথা ভাবছে, এখন পর্যন্ত মেয়েটা তো তাদের উপকার করেই যাচ্ছে। নীচে নামতেই কাগজের স্টলটাকে দেখতে পেলে অর্জুন। একটি বয়স্কা মহিলা কাগজ বিক্রি করছেন। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি? মহিলা ফিরেও তাকাল না। আর একজন খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। লোকটা কাগজ নিয়ে চলে যেতেই মহিলা আঙুল তুলে কাগজগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল। ওয়ান্ট পেপার? নো। দেন গেট লস্ট। মহিলা অন্যদিকে তাকাল। এবার মেজর এগিয়ে এল, হাই। হি ইজ আস্কিং ফর গ্যাব্রিয়েলা। মেজরের উচ্চারণ আমেরিকানদের মতো জড়ানো। মহিলা চট করে তাকাল, হোয়াট ইজ হিজ নেম? অর্জুন। মেজর একই গলায় উচ্চারণ করলেন। মহিলা চট করে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, সরি। শি ইজ নট হেয়ার। হোয়ার ইজ শি? গ্যাবি আটলান্টিক সিটিতে গিয়েছে। হতেই পারে না। ও ওর মাসির বাড়িতে থাকবে বলেছিল। তাই ইচ্ছে ছিল ওর। কিন্তু জানোই তো, পরিস্থিতি পালটায়। ও অর্জুনের জন্যে তাজমহল ক্যাসিনোতে অপেক্ষা করবে। আমরা ওখানে যে যাব তা ও আশা করল কী করে? ননসেন্স! আমি জানি না। ও বলেছে দুপুর একটা থেকে দুটো তাজমহলের এক ডলারের সট মেশিনের সামনে বসে থাকবে। এখন কেটে পড়ো। এই খবরটা তুমি কতজনকে দিয়েছ? তুমি কী বলতে চাও? আমি কাগজ বিক্রি করি, বন্ধুত্ব নয়। গ্যাবি আমার খুব ভাল বন্ধু। ও ওই ছেলেটার চেহারার বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিল। মেজর হাঁটতে শুরু করলেন, অদ্ভুত ব্যাপার! অর্জুন জিজ্ঞেস করল, জায়গাটা কোথায়? কীভাবে যাওয়া যায়? সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এখানে দেখা করতে বলে মেয়েটা পালাল কেন? তোমাকে জ্বালাচ্ছে না তো। তাতে ওর কী লাভ? তা ঠিক। তুমি যদি না যাও তা হলে ওর কী লাভ হবে? আর গেলেই বা কী
false
robindronath
কোনো কাজের কথাই নহে।” রাজা কহিলেন, “আমি রাজত্ব করিবার যোগ্য নহি, তাহারই সকল লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। সেইজন্য আমার প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস নাই, সেইজন্যই দুর্ভিক্ষের সূচনা, সেইজন্যই এই যুদ্ধ। রাজ্য-পরিত্যাগের জন্য এ-সকল ভগবানের আদেশ।” বিল্বন কহিলেন, “এ কখনোই ভগবানের আদেশ নহে। ঈশ্বর তোমার উপরে রাজ্যভার অর্পণ করিয়াছেন; যতদিন রাজকার্য নিঃসংকট ছিল ততদিন তোমার সহজ কর্তব্য অনায়াসে পালন করিয়াছ, যখনই রাজ্যভার গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে তখনই তাহা দূরে নিক্ষেপ করিয়া তুমি স্বাধীন হইতে চাহিতেছ এবং ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া আপনাকে ফাঁকি দিয়া সুখী করিতে চাহিতেছ।” কথাটা গোবিন্দমাণিক্যের মনে লাগিল। তিনি নিরুত্তর হইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। অবশেষে নিতান্ত কাতর হইয়া বলিলেন, “মনে করো-না ঠাকুর, আমার পরাজয় হইয়াছে, নক্ষত্র আমাকে বধ করিয়া রাজা হইয়াছে।” বিল্বন কহিলেন, “যদি সত্য তাহাই ঘটে তাহা হইলে আমি মহারাজের জন্য শোক করিব না। কিন্তু মহারাজ যদি কর্তব্যে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করেন, তবেই আমাদের শোকের কারণ ঘটিবে।” রাজা কিঞ্চিৎ অধীর হইয়া কহিলেন, “আপন ভাইয়ের রক্তপাত করিব!” বিল্বন কহিলেন, “কর্তব্যের কাছে ভাই বন্ধু কেহই নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কী উপদেশ দিয়াছিলেন স্মরণ করিয়া দেখুন।” রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি কি বল আমি স্বহস্তে এই তরবারি লইয়া নক্ষত্ররায়কে আঘাত করিব?” বিল্বন কহিলেন, “হাঁ।” সহসা ধ্রুব আসিয়া গম্ভীর ভাবে কহিল, “ছি, ও কথা বলতে নেই।” ধ্রুব খেলা করিতেছিল, দুই পক্ষের কী একটা গোলমাল শুনিয়া সহসা তাহার মনে হইল দুইজনে অবশ্যই একটা দুষ্টামি করিতেছে, অতএব সময় থাকিতে দুইজনকে কিঞ্চিৎ শাসন করিয়া আসা আবশ্যক। এই-সকল বিবেচনা করিয়া তিনি হঠাৎ আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ছি, ও কথা বলতে নেই।” পুরোহিত ঠাকুরের অত্যন্ত আমোদ বোধ হইল। তিনি হাসিয়া উঠিলেন, ধ্রুবকে কোলে লইয়া চুমো খাইতে লাগিলেন। কিন্তু রাজা হাসিলেন না। তাঁহার মনে হইল যেন বালকের মুখে তিনি দৈববাণী শুনিলেন। তিনি অসন্দিগ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ঠাকুর, আমি স্থির করিয়াছি এ রক্তপাত আমি ঘটিতে দিব না, আমি যুদ্ধ করিব না।” বিল্বন ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। অবশেষে কহিলেন, “মহারাজের যদি যুদ্ধ করিতেই আপত্তি থাকে, তবে আর-এক কাজ করুন। আপনি নক্ষত্ররায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে যুদ্ধ হইতে বিরত করুন।” গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ইহাতে আমি সম্মত আছি।” বিল্বন কহিলেন, “তবে সেইরূপ প্রস্তাব লিখিয়া নক্ষত্ররায়ের নিকট পাঠানো হউক।” অবশেষে তাহাই স্থির হইল। নক্ষত্ররায় সৈন্য লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন, কোথাও তিলমাত্র বাধা পাইলেন না। ত্রিপুরার যে গ্রামেই তিনি পদার্পণ করিলেন সেই গ্রামই তাঁহাকে রাজা বলিয়া বরণ করিতে লাগিল। পদে পদে রাজত্বের আস্বাদ পাইতে লাগিলেন–ক্ষুধা আরও বাড়িতে লাগিল, চারি দিকের বিস্তৃত ক্ষেত্র, গ্রাম, পর্বতশ্রেণী, নদী সমস্তই “আমার” বলিয়া মনে হইতে লাগিল এবং সেই অধিকারব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজেও যেন অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া অত্যন্ত প্রশস্ত হইয়া পড়িতে লাগিলেন। মোগল-সৈন্যরা যাহা চায় তিনি তাহাই তাহাদিগকে লইতে আলী হুকুম দিয়া দিলেন। মনে হইল এ-সমস্তই আমার এবং ইহারা আমারই রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। ইহাদিগকে কোনো সুখ হইতে বঞ্চিত করা হইবে না–স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়া মোগলেরা তাঁহার আতিথ্যের ও রাজবৎ উদারতা ও বদান্যতার অনেক প্রশংসা করিবে; বলিবে, “ত্রিপুরার রাজা বড়ো কম রাজা নহে।” মোগলসৈন্যদের নিকট হইতে খ্যাতি লাভ করিবার জন্য তিনি সততই উৎসুক হইয়া রহিলেন। তাহারা তাঁহাকে কোনো-প্রকার শ্রুতিমধুর সম্ভাষণ করিলে তিনি নিতান্ত জল হইয়া যান। সর্বদাই ভয় হয় পাছে কোনো নিন্দার কারণ ঘটে। রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, যুদ্ধের তো কোনো উদ্‌যোগ দেখা যাইতেছে না।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “না ঠাকুর, ভয় পাইয়াছে।” বলিয়া অত্যন্ত হাসিতে লাগিলেন। রঘুপতি হাসিবার বিশেষ কোনো কারণ দেখিলেন না, কিন্তু তথাপি হাসিলেন। নক্ষত্ররায় কহিলেন, “নক্ষত্ররায় নবাবের সৈন্য লইয়া আসিয়াছে। বড়ো সহজ ব্যাপার নহে।” রঘুপতি কহিলেন, “দেখি এবার কে কাহাকে নির্বাসনে পাঠায়। কেমন?” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি ইচ্ছা করিলে নির্বাসনদণ্ড দিতে পারি, কারারুদ্ধ করিতেও পারি–বধের হুকুম দিতেও পারি। এখনো স্থির করি নাই কোন্‌টা করিব।” বলিয়া অতিশয় বিজ্ঞভাবে অনেক বিবেচনা করিতে লাগিলেন। রঘুপতি কহিলেন, “অত ভাবিবেন না মহারাজ। এখনো অনেক সময় আছে। কিন্তু আমার ভয় হইতেছে, গোবিন্দমাণিক্য যুদ্ধ না করিয়াই আপনাকে পরাভূত করিবেন।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “সে কেমন করিয়া হইবে?” রঘুপতি কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য সৈন্যগুলোকে আড়ালে রাখিয়া বিস্তর ভ্রাতৃস্নেহ দেখাইবেন। গলা ধরিয়া বলিবেন–ছোটো ভাই আমার, এস ঘরে এস, দুধ-সর খাওসে। মহারাজ কাঁদিয়া বলিবেন–যে আজ্ঞে, আমি এখনি যাইতেছি। অধিক বিলম্ব হইবে না। বলিয়া নাগরা জুতোজোড়াটা পায়ে দিয়া দাদার পিছনে পিছনে মাথা নিচু করিয়া টা-ু ঘোড়াটির মতো চলিবেন। বাদশাহের মোগল ফৌজ তামাশা দেখিয়া হাসিয়া ঘরে ফিরিয়া যাইবে।” নক্ষত্ররায় রঘুপতির মুখে এই তীব্র বিদ্রূপ শুনিয়া অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন। কিঞ্চিৎ হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া বলিলেন, “আমাকে কি ছেলেমানুষ পাইয়াছে যে এমনি করিয়া ভুলাইবে। তাহার জো নাই। সে হবে না ঠাকুর। দেখিয়া লইয়ো।” সেইদিন গোবিন্দমাণিক্যের চিঠি আসিয়া পৌঁছিল। সে চিঠি রঘুপতি খুলিলেন। রাজা অত্যন্ত স্নেহপ্রকাশ করিয়া সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিয়াছেন। চিঠি নক্ষত্ররায়কে দেখাইলেন না। দূতকে বলিয়া দিলেন, “কষ্ট স্বীকার করিয়া গোবিন্দমাণিক্যের এতদূর আসিবার দরকার নেই। সৈন্য ও তরবারি লইয়া মহারাজ নক্ষত্রমাণিক্য শীঘ্রই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। গোবিন্দমাণিক্য এই অল্প কাল যেন প্রিয়ভ্রাতৃবিরহে অধিক কাতর হইয়া না পড়েন। আট বৎসর নির্বাসনে থাকিলে ইহা অপেক্ষা আরও অধিক কাল বিচ্ছেদের সম্ভাবনা ছিল।” রঘুপতি নক্ষত্ররায়কে গিয়া কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য নির্বাসিত ছোটো ভাইকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ একখানি চিঠি লিখিয়াছেন।” নক্ষত্ররায় পরম উপেক্ষার ভান করিয়া হাসিয়া বলিলেন, “সত্য
false
shorotchandra
চায়ের বাটিটা নিঃশেষ করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল; পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া বলিল, আর দশ মিনিট সময় আছে, আমি চললুম। বিজয়া মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল, কলকাতায় ফিরে যাবার এই বুঝি শেষ ট্রেন? নরেন উঠিয়া দাঁড়াইয়া টুপিটা মাথায় দিয়া বলিল, আরও একটা আছে বটে, সে কিন্তু ঘণ্টা-দেড়েক পরে। চললুম—নমস্কার। বলিয়া লাঠিটা তুলিয়া একটু দ্রুতপদেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। একবিংশ পরিচ্ছেদ বিলাস যথাসময়ে কাছারিতে আসিয়া নিজের কাজ করিয়া বাড়ি চলিয়া যাইত; নিতান্ত প্রয়োজন হইলে কর্মচারী পাঠাইয়া বিজয়ার মত লইত, কিন্তু আপনি আসিত না। তাহাকে ডাকাইয়া না পাঠাইলে যে নিজে যাচিয়া আসিবে না, ইহাও বিজয়া বুঝিয়াছিল। অথচ তাহার আচরণের মধ্যে অনুতাপ এবং আহত অভিমানের বেদনা ভিন্ন ক্রোধের জ্বালা প্রকাশ পাইত না বলিয়া বিজয়ার নিজেরও রাগ পড়িয়া গিয়াছিল। বরঞ্চ, আপনার ব্যবহারের মধ্যেই কেমন যেন একটা নাটক অভিনয়ের আভাস অনুভব করিয়া তাহার মাঝে মাঝে ভারী লজ্জা করিত। প্রায়ই মনে হইত, কত লোকেই না জানি এই লইয়া হাসি-তামাশা করিতেছে। তা ছাড়া যে লোক সকলের চক্ষেই এতদিন সর্বময় হইয়া বিরাজ করিতেছিল, বিশেষ করিয়া জমিদারির কাজে-অকাজে সে যাহাদিগকে শাসন করিয়া শত্রু করিয়া তুলিয়াছে, তাহাদের সকলের কাছে তাহাকে অকস্মাৎ এতখানি ছোট করিয়া দিয়া বিজয়া আপনার নিভৃত হৃদয়ে সত্যকার ব্যথা অনুভব করিতেছিল। পূর্বের অবস্থাকে ফিরাইয়া না আনিয়া শুধু এই ঘটনাকে কোনমতে সে যদি সম্পূর্ণ ‘না’ করিয়া দিতে পারিত তাহা হইলে বাঁচিয়া যাইত। এমনি যখন তাহার মনের ভাব, সেই সময় হঠাৎ একদিন বিকালে কাছারির বেহারা আসিয়া জানাইল বিলাসবাবু দেখা করিতে চান। ব্যাপারটা একেবারে নূতন। বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই কহিল, আসতে বল। তাহার মনের ভিতরটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় দুলিতে লাগিল; কিন্তু বিলাস প্রবেশ করিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া শান্তভাবে নমস্কার করিয়া কহিল, আসুন। বিলাস আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, কাজের ভিড়ে আসতে পারিনে, তোমার শরীর ভাল আছে? বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ। সেই ওষুধটাই চলছে? বিজয়া ইহার উত্তর দিল না, কিন্তু বিলাসও প্রশ্নের পুনরুক্তি না করিয়া অন্য কথা কহিল। বলিল, কাল নব-বৎসরের নূতন দিন—আমার ইচ্ছা হয় সকলকে একত্র করে কাল সকালবেলা একটু ভগবানের নাম করা হয়। সে যে তাহার প্রশ্ন লইয়া পীড়াপীড়ি করিল না, কেবল ইহাতেই বিজয়ার মনের উপর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে খুশী হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ত খুব ভাল কথা। বিলাস বলিল, কিন্তু নানা কারণে মন্দিরে যাওয়ার সুবিধে হলো না। যদি তোমার অমত না হয় ত আমি বলি এইখানেই— বিজয়া তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া সায় দিল, এমন কি উৎসাহিত হইয়া উঠিল। কহিল, তা হলে ঘরটাকে একটুখানি ফুল-পাতা-লতা দিয়ে সাজালে ভাল হয় না? আপনাদের বাড়িতে ত ফুলের অভাব নেই—যদি মালীকে হুকুম দিয়ে কাল ভোর থাকতেই—কি বলেন? হতে পারে না কি? বিলাস বিশেষ কোন প্রকার আনন্দের আড়ম্বর না দেখাইয়া সহজভাবে বলিল, বেশ, তাই হবে। আমি সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করে দেব। বিজয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, কাল ত বৎসরের প্রথম দিন—আচ্ছা, আমি বলি কি অমনি একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করলে কি— বিলাস এ প্রস্তাবও অনুমোদন করিল এবং উপাসনার পরে জলযোগের আয়োজন যাহাতে ভাল রকম হয়, সে বিষয়ে নায়েবকে হুকুম দিয়া যাইবে জানাইল। আরও দুই-চারিটা সাধারণ কথাবার্তার পরে সে বিদায় গ্রহণ করিলে বহুদিনের পরে বিজয়ার অন্তরের মধ্যে তৃপ্তি ও উল্লাসের দক্ষিণা-বাতাস দিতে লাগিল। সেদিনকার সেই প্রকাশ্য সংঘর্ষের পর হইতে অব্যক্ত গ্লানির আকারে যে বস্তুটি তাহাকে অনুক্ষণ দুঃখ দিতেছিল, তাহার ভার যে কত ছিল, আজ নিষ্কৃতি পাইয়া সে যেমন অনুভব করিল এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাই আজ তাহার ব্যথার সহিত মনে হইতে লাগিল, এই কয়েকদিনের মধ্যে বিলাস পূর্বেকার অপেক্ষা যেন অনেকটা রোগা হইয়া গিয়াছে। অপমান ও অনুশোচনার আঘাত ইহার প্রকৃতিকে যে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে তাহা চোখের উপর সুস্পষ্ট দেখিতে পাইয়া অজ্ঞাতসারে বিজয়ার দীর্ঘশ্বাস পড়িল, এবং বৃদ্ধ রাসবিহারীর সেদিনের কথাগুলি চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিল। বিলাসবিহারী তাহাকে যে অত্যন্ত ভালবাসে তাহা ভাষায়, ইঙ্গিতে, ভঙ্গীতে, সর্বপ্রকারেই ব্যক্ত করা হইয়াছে, অথচ একটা দিনের জন্যও সঙ্গোপনে এই ভালবাসার কথা বিজয়ার মনে স্থান পায় না। বরঞ্চ, সন্ধ্যার ঘনীভূত অন্ধকারে একাকী ঘরের মধ্যে সঙ্গ-বিহীন প্রাণটা যখন ব্যথায় ব্যাকুল হইয়া উঠে, তখন কল্পনার নিঃশব্দ-পদসঞ্চারে ধীরে ধীরে যে আসিয়া তাহার পাশে বসে, সে বিলাস নয়, আর একজন। অলস মধ্যাহ্নে বইয়ে যখন মন বসে না, সেলাইয়ের কাজও অসহ্য বোধ হয়, প্রকাণ্ড শূন্য বাড়িটা রবি-করে খাঁ খাঁ করিতে থাকে তখন সুদূর ভবিষ্যতে একদিন এই শূন্য গৃহই পূর্ণ করিয়া যে ঘরকন্নার স্নিগ্ধ ছবিটি তাহার অন্তরে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতে থাকে, তাহার মধ্যে কোথাও বিলাসের জন্য এতটুকু স্থান থাকে না।অথচ, যে লোকটি সমস্ত জায়গা জুড়িয়া বসে, সংসার-যাত্রার দুর্গম পথে সহায় বা সহযোগী হিসাবে মূল্য তাহার বিলাসের অপেক্ষা অনেক কম। সে যেমন অপটু, তেমনি নিরুপায়। বিপদের দিনে ইহার কাছে কোন সাহায্যই মিলিবে না। তবুও এই অকেজো মানুষটারই সমস্ত অকাজের বোঝা সে নিজে সারাজীবন মাথায় লইয়া চলিতেছে মনে করিতেও বিজয়ার সমস্ত দেহ-মন অপরিমিত আনন্দবেগে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে। বিলাস চলিয়া গেলে বিজয়ার এই মনোভাবের আজও যে কোন ব্যতিক্রম ঘটিল তাহা নহে, কিন্তু আজ সে বিনা প্রার্থনায় বিলাসের দোষের পুনর্বিচারের ভার হাতে তুলিয়া লইল, এবং ঘটনাচক্রে তাহার স্বভাবের যে পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে বাস্তবিক স্বভাব যে
false
humayun_ahmed
অতি বুদ্ধিমান মানুষ। কেউ একজন তার সামনে অনাগ্রহ নিয়ে বসে থাকবে এটা বুঝতে না-পারার কোনো কারণ তার নেই। কিন্তু মোহিত সাহেবের মনে হচ্ছে ইয়াকুব সাহেব এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। ডাক্তার! জ্বি। তুমি যেটাকে শিশুপার্ক বললে, সেটা আসলে পার্ক না। তার নাম দেয়া হয়েছে, মায়ানগর। নামটা কেমন? খারাপ না। মায়ানগর নামটা ভালো, না-কি মায়াপুরী? একই। মায়ানগরে যাবার পর তোমার চোখে মায়া লেগে থাকবে। যাই দেখবে মনে হবে মায়া-বিভ্ৰম-জাদু। ভালো তো। একটা ডায়নোসর পার্ক হচ্ছে। দশটা নানান ধরনের ডায়ানোসর বানানো হচ্ছে। ডায়নোসরগুলি কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে না। এক হাঁটু পানিতে থাকবে। ও। ডায়নোসর তো স্থবির। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে তাদের স্থবিরতা খানিকটা দূর হয়। ও। কী করা হয়েছে শোনো। যে পানির উপর ডায়নোসরগুলি দাঁড়িয়ে আছে–সেই পানির রঙ পরিবর্তনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভোরবেলায় পানির রঙ থাকবে গাঢ় নীল। যতই সময় যাবে পানির রঙ বদলাতে থাকবে। ঠিক সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার সময় পানির রঙ হবে গাঢ় লাল। পানির নিচে থাকবে লাইটিঙের ব্যবস্থা। তোমার কাছে ব্যবস্থাটা কেমন লাগছে? খারাপ না। আমি শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এই বয়সে আমি যদি মুগ্ধ হই তাহলে বাচ্চাদের অবস্থা কী হবে চিন্তা কর। আজ উঠি। সামান্য কাজও আছে। বড়মেয়ের শাশুড়ি আজমির শরিফ যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। কাল পরশু আবার এসো, মায়ানগরের অন্য প্রজেক্টগুলির কথা বলব। কুবরিকের একটা ছবি আছে, তুমি হয়তো দেখনি 2001 , আর্থার সি ক্লার্কের উপন্যাস নিয়ে বানানো ছবি। সেখানে একটা অদ্ভুত স্লেভ আছে। মসৃণ স্লেভ–অনেকদূর পর্যন্ত উঠেছে। সেখান থেকে বিচিত্র সুরের সংগীত শোনা যায় সেই ব্যবস্থাও হচ্ছে। আমার কাছে ডিজাইনের কপি আছে। তোমাকে দেখাব। আচ্ছা। ইয়াকুব সাহেব ছেলেমানুষের মতো কিছুক্ষণ পা নাচালেন। হাতের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরালেন। এতক্ষণ আনন্দে ছটফট করছিলেন হঠাৎ সব আনন্দ দূর হয়ে গেল। তার মনে হল এলেনা শেষপর্যন্ত আসবে না। যাবার তারিখ ঠিকঠাক হবে, প্লেনের টিকিট কাটা হবে। তখন বড় ধরনের কোনো ঝামেলা হবে। এলেনার মাম্পস হবে। কিংবা তার স্কুল থেকে ঠিক করা হবে ছাত্রছাত্রীদের সামার-ক্যাম্পে যেতে হবে। এলেনা নিজেই ডিজাইন করে একটা কার্ড পাঠাবে। সেই কার্ডে লেখা থাকবে : . এর আগেও দুবার এই ঘটনা ঘটেছে। এবারেরটা নিয়ে হবে তিনবার। কথায় বলে দানে দানে তিনবার। তবে এবার যদি এলেনা আসতে না পারে তাহলে আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। এই সত্য ইয়াকুব সাহেব খুব ভালো করে জানেন। তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তাঁর কাজকর্ম বহুদূর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কখনো মনে হয়নি একটা সময় আসবে যখন কাজ গুটানোর প্রয়োজন পড়বে। কাজ ছড়ানো যেমন কঠিন, গুটানোও কঠিন। ছড়ানোর ব্যাপারটা আনন্দময়, গুটানোর কাজটা বিষাদমাখা। ইয়াকুব সাহেব ভুরু কুঁচকালেন। হিসেবে কিছু ভুল হচ্ছে–তিনি আসলে কাজ গুটাচ্ছেন না। আরো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এলিনের জন্মদিনে বাজারে নতুন একটা চা আসছে। তার নিজের বাগানের চা। চায়ের নাম ঠিক হয়েছে। এদেশের সবচে বড় বিজ্ঞাপনসংস্থাকে দেয়া হয়েছে নতুন চায়ের কেমপেইন ঠিকমতো করতে। পোস্টার দিয়ে সারাদেশ মুড়ে দিতে হবে। টিভির যে-কোনো চ্যানেল খুললে প্রতিদিন অন্তত দুবার যেন চায়ের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তিনি যতদূর জানেন টিভি স্পট তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কিছু কাজ হচ্ছে বোম্বেতে। একটা বিজ্ঞাপনচিত্রের আইডিয়া তার খুব পছন্দ হয়েছে। গম্ভীর ধরনের বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছেন। তার ফুটফুটে ছ-সাত বছরের বাচ্চামেয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা পিরিচ। বাবা পিরিচে খানিকটা চা ঢেলে দিলেন। মেয়ের মুখে হাসি। সে পিরিচের চায়ে চুমুক দিচ্ছে। লেখা ফুটে উঠল : ইয়া-চা। ইয়াকুব সাহেব নিজেকে সব কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে রাখবেন, এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে ঘটনা সে রকম ঘটবে না। তার শরীর খুবই অসুস্থ্য। ডাক্তাররা মোটামুটি ইংগিত দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর উচিত বড় যাত্রার প্রস্তুতি নেয়া। ব্যাগ গোছানো। তা না করে তিনি শেষ মুহূর্তে আরও বড় কাজে ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছেন। চা কোম্পানির চা বাজারজাত করার নানান পরিকল্পনা তার মাথায় আসছে। চায়ের নাম তার পছন্দ হচ্ছে না। নামের ব্যাপারে তিনি এখন একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। অসংখ্য নামের মধ্যে ইয়াকুব সাহেবের ইয়া-চা নামটা পছন্দ হয়েছে। ইয়াকুব নামের প্রথম দুটি অক্ষর ইয়া-চার মধ্যে আছে সেজন্যে না। ইয়া শব্দটাই আনন্দময়। ইয়াকুব সাহেবের ধারণা, ঠিকমতো বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে পারলে মানুষদের মধ্যে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া যাবে— চা কয় রকম? দুরকম। সাধারণ চা এবং ইয়া-চা। অচ্ছাি বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে এটাও তো খারাপ না। কী চা খাবেন? সাধারণ চা, নাকি ইয়া-চা? ইয়া-চা নামটা দিয়েছে হাসানের সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছিল সে। নামকরণের জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক সে পাবে। এটা করা হবে সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানটা করা হবে সোনারগাঁ হোটেলে। অতিথিদের সবাইকে সুন্দর কাপড়ের ব্যাগে একব্যাগ চা দেয়া হবে। চায়ের সঙ্গে ইয়া-চা লগো বসানো একটা টিপট এবং দুটা কাপ। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া মাত্র কেমপেইন শুরু হবে। বিজ্ঞাপনের ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করে এদেশের প্রতিটি মানুষের মাথায় ইয়া-চা ঢুকিয়ে দেবেন। তার এক জীবনে তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। এখানেও তাই হবে। ইয়াকুব সাহেব আবারো পা দোলাতে শুরু করেছেন। তাঁর চোখেমুখে বিষাদের ছাপ এখন আর নেই। তাঁকে শিশুর
false
MZI
বলুন। আমি তো বিদেশে থাকি, এখানে কোথায় কী আছে ভালো করে চিনি না। ফারিহা বলল, ঠিক আছে, ধানমণ্ডি এলাকায় নতুন একটা শপিং মল হয়েছে, খুব সুন্দর, সেখানে আসেন বিকেল চারটায়। ঠিকানাটা বলছি, তার আগে আপনাকে বলে দিই আমাকে খুঁজে বের করবেন কীভাবে। আমি লাল শাড়ি পরে আসব, সবুজ ব্লাউজ আর লাল টিপ। চুলে থাকবে বেলিফুল। ইশতিয়াক হাসান আনন্দে আটখানা হয়ে গেল, বলল, গুড, গুড ভেরি গুড। ফ্যান্টাস্টিক। ফারিহা বলল, আরও সহজ করে দিই। একটা পাসওয়ার্ড ঠিক করে নিই। আপনি বলবেন, তোমাকে দেখে আমার তেঁতুলের কথা মনে পড়ছে। তেঁতুল? ইশতিয়াক হাসান, একটু অবাক হয়ে বলল, তেঁতুল কেন বলব? ফারিহা বলল, পাসওয়ার্ডের তো কোনো মাথামুণ্ডু থাকে না। এটাও সে রকম, একটা কথার কথা। ঠিক আছে? ঠিক আছে। ফারিহা বলল, এবার ঠিকানাটা বলে দিই। তারপর ফারিহা ঠিকানাটা বলে দিল, নিচ তলায় কোথায় সে অপেক্ষা করবে সেটাও ইশতিয়াক হাসানকে বলে দিল। টেলিফোনটা রাখার পর ছোটাচ্চু মেঘস্বরে বলল, এইসবের মানে কী? কোন সবের? তুমি এই বদমাইশ লোকের সাথে দেখা করতে চাচ্ছ কেন? ফারিহা বলল, যে মানুষ বিদেশ থেকে এসেছে বিয়ে করার জন্য, বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার পরও সেটা গোপন করে অন্য মেয়ের সাথে চা-কফি খেতে চায়, তার চেহারাটা একটু দেখার ইচ্ছে করছে। ছোটাচ্চু বলল, তুমি লাল শাড়ি পরে চুলে বেলিফুল লাগিয়ে এর সাথে দেখা করতে যাবে-কাজটা ঠিক হচ্ছে? ফারিহা বলল, জানি না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই। শাড়ি-ব্লাউজ ইস্ত্রি করতে হবে। তুমি চাইলে চারটার সময় ধানমণ্ডির মলে আসতে পারো। আমি? ছোটাচ্চুর মুখ শক্ত হয়ে গেল, আমি কেন যাব? তুমি সেজেগুজে চা-কফি খেতে যাচ্ছ, আমি সেখানে গিয়ে কী করব? ফারিহা বলল, ঠিক আছে—না যেতে চাইলে নাই। তারপর ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, তুমি তোমার রিপোর্টটা ঠিক করে লেখো। মানুষটা ড্রাগস খায় না, টাকাপয়সার লোভ নাই, মনে হয় চেহারা ভালো, স্মার্ট, খুব সুন্দর করে কথা বলে, কিন্তু– কিন্তু কী? কিন্তু এই লোকের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ফারিহা চলে যাওয়ার পর ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে টুনিকে বলল, টুনি, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? করো। আমার এই বন্ধু ফারিহাকে তোর কেমন লাগে? খুবই ভালো লাগে। ফারিহা আপু হচ্ছে সুপার ডুপার। ফ্যান্টাস্টিক। ও। ছোটাচ্চু আবার চুপ করে গেল। টুনি বলল, ছোটাচ্চু। উ। তুমি আজকে বিকেলে ধানমণ্ডির মলে আমাকে নিয়ে যাবে? ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। চারটে বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি। ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানের বাইরে রাখা টেবিলে বসেছে। টুনি একটা আইসক্রিম খাচ্ছে, ছোটাচ্চু খাচ্ছে ব্ল্যাক কফি। কফিটা তেতো, খেতে বিস্বাদ, পোড়া কাঠের মতো গন্ধ, প্রত্যেকবার চুমুক দেওয়ার পর ছোটাচ্চু মুখটা বিকৃত করছে, কিন্তু তার পরও খেয়ে যাচ্ছে। টুনি আইসক্রিমের একটা কোনা কামড় দিয়ে বলল, ফারিহা আপু এখনো আসে নাই। কোনো একটা কারণে ছোটাচ্চুর মনটা একটু খারাপ, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দার্শনিকের মতো বলল, বুঝলি টুনি, তোকে আর কী বলব, তুই তো। সবই জানিস। আমি হচ্ছি অকাজের মানুষ। সবাই লেখাপড়া করে হাইফাই চাকরি করে, গলায় টাই লাগিয়ে অফিসে যায়, বড় বড় কাজ করে, তার চেয়ে বড় বড় কথা বলে। ইংরেজি আর বাংলা মিলিয়ে। আমি কিছুই করি না। আমার ফ্রি থাকার জায়গা আছে, ফ্রি খাওয়ার জায়গা আছে, তাই কোনো চিন্তা নাই। আমি তোদের জন্য ছাগল রং করে দিই। প্ল্যানচেট করে তোদের জন্য ভূত নামাই। মায়ের রাজাকার টাইপের খালাতো ভাইকে ভয় দেখাই। ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলি—তোর কি মনে হয় কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করবে? ছোটাচ্চু টুনির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, নিজেই বলল, করবে না। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে এ রকম কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করবে না। করা উচিৎ না। কিন্তু– ছোটাচ্চু তার বিদঘুটে কালো কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, কিন্তু ফারিহার কথা আলাদা। লেখাপড়ায় ভালো, চেহারা ভালো, খুবই স্মার্ট, বুদ্ধিমতী, বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু আসলে মনটা খুবই নরম। এই রকম একটা মেয়ে আমাকে মনে হয় পছন্দই করে। আমি যদি বলি, মনে হয় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। অনেক টাকা বেতনে চাকরি করবে, আমাকে খাওয়াবে, তোদের সাথে হইচই করবে। ছোটাচ্চু আবার তার কালো বিদঘুটে তিতকুটে কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, কিন্তু আমি ফারিহাকে কিছু বলতে পারি না। কেন জানিস? কেন? ভয়ে। টুনি অবাক হয়ে বলল, ভয়ে? ফারিহা আপুকে তোমার ভয় করে? হ্যাঁ। করে। কারণটা কী জানিস? কী? ফারিহার মতো ডেঞ্জারাস মানুষ আমি জন্মেও দেখি নাই। তার মাথার মধ্যে যে কী ভয়ংকর প্ল্যান কাজ করে তুই চিন্তাও করতে পারবি না। টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, ফারিহা আপু ডেঞ্জারাস? হ্যাঁ। যেমন ধর আজকের ব্যাপারটা। ফারিহা ওই পাঁজি মানুষটাকে এইখানে তার সাথে দেখা করতে বলেছে। ফারিহা বলেছে সে লাল শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ, লাল টিপ, চুলে বকুল ফুল লাগিয়ে এখানে আসবে। সে এসেছে? না, আসে নাই। কিন্তু লাল শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ, লাল টিপ আর চুলে বকুল ফুল লাগিয়ে কেউ কি এসেছে? হ্যাঁ এসেছে। এসেছে? টুনি চমকে উঠে বলল, কোথায়? ওই যে বইয়ের দোকানের সামনে। ফারিহা নিজে না এসে ওই মেয়েটাকে পাঠিয়েছে। মেয়েটাকে আমি চিনি। মেয়েটার
false
bongkim
আপনারা বিভোর হইয়া, এ উহার গায়ে ঢলিয়া পড়িতেছে, তখনই তোমার সেই ডাল হইতে ডাকিয়া বলিও, “কু-উঃ”। যখন দেখিবে, বকুলের অতি ঘনবিন্যস্ত মধুরশ্যামল স্নিগ্ধোজ্জ্বল পত্ররাশির শোভা আর গাছে ধরে না-পূর্ণযৌবনা সুন্দরীর লাবণ্যের ন্যায় হাসিয়া হাসিয়া, ভাসিয়া হেলিয়া দুলিয়া, ভাঙ্গিয়া গলিয়া, উছলিয়া উঠিতেছে, তাহার অসংখ্য প্রস্ফুট কুসুমের গন্ধে আকাশ মাতিয়া উঠিতেছে-তখন তাহারই আশ্রয়ে বসিয়া, সেই পাতার স্পর্শে অঙ্গ শীতল করিয়া, সেই গন্ধে দেহ পবিত্র করিয়া, সেই বকুলকুঞ্জ হইতে ডাকিও, এ “কু-উ”। যখন দেখিবে, শুভ্র-মুখী, শুদ্ধশরীরা, সুন্দরী নবমল্লিকা সন্ধ্যা-শিশিরে সিক্ত হইয়া, আলোক-প্রাখর্য্যের হ্রাস দেখিয়া ধীরে ধীরে মুখখানি খুলিতে সাহস করিতেছে-স্তরে স্তরে অসংখ্য অকলঙ্ক দল-রাজি বিকসিত করিবার উপক্রম করিতেছে,-যখন দেখিবে যে, ভ্রমর সে রূপ দেখিয়া-“আদরেতে আগুসারি”-কণ্ঠভরা গুনগুন্ মধু ঢালিয়া দিতেছে-তখন, হে কালামুখ ! আবার “কু-উঃ” বলিয়া ডাকিয়া মনের জ্বালা নিবাইও। আর যখনই গৃহস্থের গৃহপ্রাঙ্গণস্থ দাড়িম্বশাখায় বসিয়া দেখিবে, সেই গৃহপুষ্পরূপিণী কন্যাগণের সেই লতার দোলানি, সেই গন্ধরাজের প্রস্ফুটতা, সেই বকুলের রূপোচ্ছ্বাস, সেই মল্লিকার অমলতা, একাধারে মিলিত করিয়াছে, তখনই তাহাদের মুখের উপর, ঐ পঞ্চম-স্বরে, গৃহপ্রাচীর প্রতিধ্বনিত করিয়া সবাইকে ডাকিয়া বলিও, এত রূপ, এত সুখ, এত পবিত্রতা-এ “কু-উঃ”! ঐটি তোমার জিত-ঐ পঞ্চম-স্বর! নহিলে তোমার ও কু-উ কেহ শুনিত না। এ পৃথিবীতে গ্লাডষ্টোন, ডিস্রেলি প্রভৃতির ন্যায়-তুমি কেবল গলাবাজিতে জিতিয়া গেলে-নহিলে অত কালো চলিত না; তোমার চেয়ে হাঁড়িচাঁচা ভাল। গলাবাজির এত গুণ না থাকিলে, যিনি বাজে নবেল লিখিয়াছেন, তিনি রাজমন্ত্রী হইবেন কেন? আর জন ষ্টুয়ার্ট মিল পার্লিয়ামেন্টে স্থান পাইলেন না কেন? তবে কোকিল, তুমি প্রকৃতির মহা-পার্লিয়ামেন্টে দাঁড়াইয়া নক্ষত্রময় নীলচন্দ্রাতপ-মণ্ডিত, গিরিনদীনগরকুঞ্জাদি বেঞ্চে সুসজ্জিত, ঐ মহাসভা-গৃহে, তোমার এ মধুর পঞ্চম-স্বরে-কু-উঃ বলিয়া ডাক-সিংহাসন হইতে হষ্টিংস পর্য্যন্ত সকলেই কাঁপিয়া উঠুক। “কু-উঃ”! ভাল, তাই; ও কলকণ্ঠে কু বলিলে কু মানিব, সু বলিলে সু মানিব। কু বৈ কি? সব কু। লতায় কণ্টক আছে; কুসুমে কীট আছে; গন্ধে বিষ আছে; পত্র শুষ্ক হয়, রূপ বিকৃত হয়, স্ত্রীজাতি বঞ্চনা জানে। কু-উঃ বটে-তুমি গাও। কিন্তু তুমি ঐ পঞ্চম-স্বরে কু বলিলেই কু মানিব-নচেৎ কুঁকড়ো বাবাজি “কু ক্কু কু কু” বলিয়া আমার সুখের প্রভাত-নিদ্রাকে কু বলিলে আমি মানিব না। তার গলা নাই। গলাবাজিতে সংসার শাসিত হয় বটে, কিন্তু কেবল চেঁচাইলে হয় না; যদি শব্দ-মন্ত্রে সংসার জয় করিবে, তবে যেন তোমার স্বরে পঞ্চম লাগে-বে-পর্দা বা কড়িমধ্যমের কাজ নয়। সর্ জেমস্ মাকিণ্টশ্, তাঁহার বক্তৃতায় ফিলজফির9 কড়িমধ্যম মিশাইয়া হারিয়া গেলেন-আর মেকলে রেটরিকের10 পঞ্চম লাগাইয়া জিতিয়া গেলেন। ভারতচন্দ্র আদিরস পঞ্চমে ধরিয়া জিতিয়া গিয়াছেন-কবিকঙ্কণের ঋষভস্বর কে শুনে? দেখ, লোকের বৃদ্ধ পিতা-মাতার বেসুরো বকাবকিতে কোন্ ফল দর্শে? আর যখন বাবুর গৃহিণী বাবুর সুর বাঁধিয়া দিবার জন্য বাবুর কাণ টিপিয়া ধরিয়া পঞ্চমে গলার আওয়াজ দেন, তখন বাবু পিড়িং-পিড়িং বলেন, কি না? তবে তোমার স্বরকে পঞ্চম স্বর কেন বলে, তাহা বুঝি না। যাহা মিষ্ট তাহাই পঞ্চম? দুইটি পঞ্চম মিষ্ট বটে,-সুরের পঞ্চম, আর আলতাপরা ছোট পায়ের গুজরী পঞ্চম। তবে, সুর, পঞ্চমে উঠিলেই মিষ্ট; পায়ের পঞ্চম, পা হইতে নামাইলেই মিষ্ট। কোন্ স্বর পঞ্চম, কোন্ স্বর সপ্তম, কে মধ্যম, কে গান্ধার, আমাকে কে বুঝাইয়া দিবে? এটি হাতীর ডাক, ওটি ঘোড়ার ডাক, সেটি ময়ূরের কেকা, ওটি বানরের কিচিমিচি, এ বলিলে ত কিছু বুঝিতে পারি না। আমি আফিংখোর-বেসুরো শুনি, বেসুরো বুঝি, বেসুরো লিখি-ধৈবত গান্ধার নিষাদ পঞ্চমের কি ধার ধারি? যদি কেহ পাখোয়াজ তানপুরা দাড়ি দাঁত লইয়া আমাকে সপ্ত সুর বুঝাইতে আসে, তবে তাহার গর্জ্জন শুনিয়া মঙ্গলা গাইয়ের সদ্যপ্রসূত বৎসের ধ্বনি আমার মনে পড়ে-তাহার পীতাবশিষ্ট নির্জ্জল দুগ্ধের অনুধ্যানে মন ব্যস্ত হয়-সুর বুঝা হয় না। আমি গায়কের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়া তাঁহাকে কায়মনোবাক্যে আশীর্ব্বাদ করি, যেন তিনি জন্মান্তরে মঙ্গলার বৎস হন। এখন আয়, পাখী! তোতে আমাতে একবার পঞ্চম গাই। তুইও যে, আমিও সে-সমান দুঃখের দুঃখী, সমান সুখের সুখী। তুই এই পুষ্পকাননে, বৃক্ষে বৃক্ষে আপনার আনন্দে গাইয়া বেড়াস্-আমিও এই সংসার-কাননে, গৃহে গৃহে, আপনার আনন্দে এই দপ্তর লিখিয়া বেড়াই-আয়, ভাই, তোতে আমাতে মিলে মিশে পঞ্চম গাই। তোরও কেহ নাই-আনন্দ আছে, আমারও কেহ নাই-আনন্দ আছে। তোর পুঁজিপাটা ঐ গলা; আমার পুঁজিপাটা এই আফিঙ্গের ডেলা; তুই এ সংসারে পঞ্চম স্বর ভালবাসিস্-আমিও তাই; তুই পঞ্চম স্বরে কারে ডাকিস? আমিই বা কারে? বল্ দেখি, পাখী, কারে? যে সুন্দর, তাকেই ডাকি; যে ভাল তাকেই ডাকি। যে আমার ডাক শুনে, তাকেই ডাকি। এই যে আশ্চর্য্য ব্রহ্মাণ্ড দেখিয়া কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বিস্মিত হইয়া আছি, ইহাকেই ডাকি। এই অনন্ত সুন্দর জগৎ-শরীরে যিনি আত্মা, তাঁহাকে ডাকি। আমিও ডাকি, তুইও ডাকিস্। জানিয়া ডাকি, না জানিয়া ডাকি, সমান কথা; তুইও কিছু জানিস্ না, আমিও জানিও না; তোরও ডাক পৌঁছিবে, আমারও ডাক পৌঁছিবে। যদি সর্ব্বশব্দগ্রাহী কোন কর্ণ থাকে, তবে তোর আমার ডাক পৌঁছিবে না কেন? আয়, ভাই, একবার মিলে মিশে দুই জনে পঞ্চম-স্বরে ডাকি। তবে, কুহুরবে সাধা গলায়, কোকিল একবার ডাক্ দেখি রে! কণ্ঠ নাই বলিয়া আমার মনের কথা কখন বলিতে পাইলাম না। যদি তোর ও ভুবন-ভুলান স্বর পাইতাম, ত বলিতাম। তুই আমার সেই মনের কথা প্রকাশ করিয়া দিয়া এই পুষ্পময় কুঞ্জবনে একবার ডাক্ দেখি রে! কি কথাটি বলিব বলিব মনে করি, বলিতে জানি না, সেই কথাটি তুই বল্ দেখি রে! কমলাকান্তের মনের কথা, এ জন্মে বলা হইল না-যদি কোকিলের কণ্ঠ পাই-অমানুষী ভাষা পাই, আর নক্ষত্রদিগকে শ্রোতা পাই, তবে মনের
false
humayun_ahmed
কথামালায় এক পাতা লিখে। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, পিরিচে টোষ্ট বিস্কুট।। সকালের প্রথম চা। জসু পরোটা-ভাজি আনতে গেছে। সে নিজে ভালো পরোটা বানায়, তবে নিজের বানানো পরোটা সে খেতে পারে না। তার পরোটা-ভাজি সে দোকান থেকে কিনে আনে। দুপুরে প্রায়ই সে মল্লিক সাহেবের কাঁচ্চি হাউস থেকে খেয়ে আসে। কাঁচ্চি হাউসের লোকজন তাকে চেনে। জসুকে টাকা দিতে হয় না। মিসির আলি লিখছেন– নাতিদের প্রসঙ্গে মল্লিক সাহেব দু’বার আমাকে বলেছেন, তার এক হালি নাতি। দুই নাতি এবং দুই নাতনি। আমি তাঁর দুই নাতির কথাই জানি। জসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও দুই জনের কথাই বলছে। মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে যেমন তাদের দুই বাবাকে দেখে, মল্লিক সাহেবও কি একইভাবে দুই নাতির জায়গায় চার নাতি দেখেন? বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। হাতে সময় আছে। মল্লিক সাহেবের বাড়ির অবস্থা শান্ত। “পশ্চিম রণাঙ্গন নিচুপ’-টাইপ শান্ত। একটি শিশু মারা গেছে, তার প্রভাব কারও ওপরেই মনে হয় পড়ে নি। ছক্কা-বক্কা ছেলে কোলে নিয়ে আগের মতোই হাঁটাহাঁটি করছে। আগে দু’জনের কোলে দুটি ছেলে থাকত। এখন একজন ভাগাভাগি করে দু’জনের কোলে থাকছে। সুরমা হোমিও হাসপাতালে মল্লিক সাহেব নিয়মিত বসা শুরু করেছেন। সুরমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম। এই স্ত্রীকে মনে হয় মল্লিক সাহেব খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর বেবিটেক্সির প্রতিটির পেছনে লেখা, ‘সুরমা পরিবহন’। মল্লিক সাহেবের প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো আমার হাতে নেই। মহিলা রূপবতী ছিলেন, সবসময় বোরকা পরে থাকতেন। ঘরের মধ্যেও বোরকা খুলতেন না। এই বাড়ির সবকিছুই জট পাকিয়ে আন্ধা গিন্টু হয়ে আছে। এই জাতীয় আন্ধা গিন্টুর সুবিধা হচ্ছে, কোনোরকমে একটা গিন্টু খুলে ফেললে বাকিগুলি একের পর এক আপনাতেই খুলতে থাকে। আমাকে অবশ্যি গিন্টু খোলার দায়িত্ব কেউ দেয় নি। কর্মহীন মানুষ কর্ম খুঁজে বেড়ায়। আমার মনে হয় এই দশাই চলছে। মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঠান্ডা সরপড়া চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর মুখ সামান্য বিকৃতও হলো না। নিজের মনেই ভাবলেন, এক ধরনের নির্বিকারত্ব সবার মধ্যেই আছে। তিনি যেমন চায়ের ঠান্ডা গরম বিষয়ে নির্বিকার, মল্লিকের দুই পুত্ৰও আশপাশে কী ঘটছে। সেই বিষয়ে নির্বিকার। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের শিশুপুত্ৰ বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। অবশ্য এই শিশুটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে তা না। মল্লিক সাহেব তার চিকিৎসা করেছেন। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেন নি। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শিশুদের জন্য বিষ। সিগারেট হাতে বারান্দায় এসে মিসির আলি অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কানে ধরে উঠবোস করছে। কতবার উঠবোস। করা হচ্ছে তারা সেই হিসােবও রাখছে। শব্দ করে বলছে—৪১, ৪২, ৪৩ ছক্কা-বক্কা দুই ভাইয়ের একটির শিশুপুত্র দু’জনের মাঝখানে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাতে কাঠি লজেন্স। সে লজেন্স চুষছে। এ ধরনের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। মিসির আলি ঘরে ঢুকে বই খুললেন। বিজ্ঞান যে পর্যায়ে চলে গেছে এখন যে-কোনো গাঁজাখুরি গল্পও বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ব্ল্যাকহোলের বইটিতেও লেখক এই জিনিস করেছেন। কঠিন বিজ্ঞানের লেবাসে কল্পগল্প। চাচাজি আসব? মিসির আলি চমকে তাকালেন। দুই ভাই মুখ কাচুমাচু করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চাটি নেই। মিসির আলি বই বন্ধ করে বললেন, এসো। দুই ভাই ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি লাগিয়ে দিল। চাচাজি, আপনার ঘরে একটু বসি? বসো। কোনো সমস্যা নেই। চা খাবে? জি-না। সকালের নাশতা করেছ? জি। বিরিয়ানি খেয়েছি। কথা বলছে বড়ভাই। ছোটভাই ঠোঁট নাড়াচ্ছে। এইবার ছোটভাই কথা শুরু করল, বড়জন চুপ।। বাবা এক শ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলেছিলেন, আমরা এক শ দশ বার করেছি। দশটা ফ্রি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না। চাচাজি? অবশ্যই ভালো করেছি। শাস্তিটা হয়েছে কী জন্য? অপরাধ কী করেছিলে? উনার দিকে তাকিয়ে হেসেছি। হেসে ফেলার জন্য শাস্তি? খারাপ হাসি হেসেছি চাচাজি। হাসির ভালো-খারাপ আছে? জি আছে। মিসির আলি বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটা খারাপ হাসি দাও তো। দেখি ব্যাপারটা কী? দুই ভাই চুপ করে আছে। মনে হয় তাদের পক্ষে খারাপ হাসি দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না। ছোটভাই বলল, চাচাজি, আপনি কি অন্য ঘরে যাবেন? আমরা এখন বেয়াদবি করব। কী বেয়াদবি করবে? সিগারেট খাব ৷ আমার সামনে খাও। অসুবিধা নেই। চাচাজি, মন থেকে অনুমতি দিয়েছেন? হ্যাঁ। আপনার মতো মানুষ ত্ৰিভুবনে কম আছে। বলতে বলতে বড়ভাই শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল। একটা সিগারেটই দু’জনে মিলে টানছে। কুৎসিত গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। তারা যে সিগারেট টানছে তা সাধারণ সিগারেট না। গাঁজাভর্তি সিগারেট। মিসির আলির মনে হলো রহস্যের একটা জটি খুলেছে। গাজা ডিলিউশনের দরজা খুলে দেয়। এইজন্যেই লোকগানে বলা হয়-‘গাঁজার নৌকা শূন্যের ভরে যায়।’ বক্কা বিনীত গলায় বলল, চাচাজি কি একটা টান দিবেন? মিসির আলি বললেন, না। তোমরা কি নিয়মিত খাও? দুই ভাই একসঙ্গে বলল, জি-না। আজ একটা বিশেষ দিন। বিশেষ দিন কী জন্যে? দুই ভাইয়ের কেউই জবাব দিল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল। তার মিনিট দশোকের, মাথায় জিপভর্তি করে পুলিশের গাড়ি চলে এল। পুলিশের কাছে দুই ভাই স্বীকার করল, তারা ধাক্কা দিয়ে তাদের বাবাকে কুয়ায় ফেলে দিয়েছে। দমকল বাহিনীর লোক এসে গহিন কুয়া থেকে অনেক ঝামেলা করে মল্লিক সাহেবের ডেডবডি উদ্ধার করল। মল্লিক
false
shirshendu
কিছু বেশবাস করিতে হইল। রাজেনবাবুর স্ত্রী আসিলেন। অবশ্য তাঁহার অবগুণ্ঠিত মুখের ভাবটি দেখিতে পাইলাম না। বিশাখার সহিত নিচু স্বরে কথা কহিতে কহিতে ঠাকুরদালানের দিকে চলিয়া গেলেন। “রাজেনবাবু বলিলেন, শচীনেরও আসার কথা। “যোলোকলায় পূর্ণ হয় তাহা হইলে। ভাবী জামাতা বাবাজীবন শ্বশুরের বিবাহ দেখিতে আসিতেছে, ইহা অপেক্ষা কি মৃত্যু শ্রেয় ছিল না! “রাজেনবাবু আমার মুখের ভাব দেখিয়া মনের কথা অনুমান করিয়া কহিলেন, আপনি বড় বিমর্ষ হয়ে আছেন। রঙ্গময়ির দিকটাও তো ভাববেন! বহুকাল ধরে সে আপনার পরিচর্যা করে আসছে। বিয়ে অবধি হল না। তার একটা সামাজিক পরিচয়ের কি দরকার নেই। “জবাব দিলাম না। “রাজেনবাবু নিজেই কহিলেন, বলতে পারেন শচীনই একরকম এই বিয়ের হোত। আমরা সেকেলে লোক, সে শিক্ষিত এবং আধুনিক স্বভাবের। কাজেই সে আমাদের কাছে সব কিছু বুঝিয়ে বলেছে। রঙ্গময়িকেও সে রাজি করিয়েছে। শুধু আনাকে রাজি করানোর সাহস দেখায়নি। সে ভার রঙ্গময়ি নিয়েছিল। অযথা শচীনের জন্য সংকোচ বোধ করবেন না। “একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। বাড়ির চাকর বাকর দাসদাসী এবং কর্মচারীরাও আছে। তাহারাও জানিবে। লজ্জায় যে কী করিয়া তাহাদের কাছে মুখ দেখাইব তাহা বুঝিতেছি না। “ঠাকুরদালানে যখন পৌছিলাম তখন চারিদিক অন্ধকারে ঢাকিয়াছে। মস্ত বারান্দায় স্নিগ্ধ দীপ জ্বলিতেছে। যজ্ঞকাষ্ঠ ও অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুত। একধারে বিশাখা ও রাজেনবাবুর স্ত্রী বসিয়া আছে। বিনদচন্দ্র কিছু উদ্বিগ্ন, তটস্থ। একখানা পুঁথিহাতে বসিয়া ছিলেন, আমাদের দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। “যখন আসন গ্রহণ করিলাম তখন মনে হইতেছিল যূপকাষ্ঠে আমাকে ফেলিয়া বলির আয়োজন চলিয়াছে। বিনোদচন্দ্ৰ কহিলেন, বিবাহ শাস্ত্রমতেই হবে। স্ত্রী-আচারগুলো বাহুল্য বলে বাদ দিচ্ছি। “আমি মাথা নাড়িয়া সম্মতি দিলাম। “যখন বিনোদচন্দ্রের রুণা স্ত্রী তাহার কন্যাকে বিবাহস্থলে লইয়া আসিলেন তখন আমি সেদিকে দৃকপাত করিতে পারি নাই। অধোবদমে বসিয়া নিজের শ্রাদ্ধ করিতেছিলাম। “কিন্তু দৃকপাত করিতে হইল। একটি রক্তাভ রেশমি বন্ত্রে অঙ্গ আচ্ছাদন করিয়া, ঘোমটা দিয়া মনু যখন আমার হস্তে সমর্পিতা হইতেছিল তখন একবার চারচোখে মিলন ঘটিল। “চন্দনচর্চিত মুখ, একটু রূপটানের প্রলেপ, কাজল সবই ছিল। কিন্তু তাহার চেয়েও অনেক বেশি যে জিনিসটি প্রকটিত হইতেছিল তাহা অভ্যন্তরীণ এক দীপ্তি! নারীর নিজস্ব দীপ্তি থাকিতে পারে। থাকেও। কিন্তু পুরুষের দ্বারাই বুঝি সে প্রকৃত দীপ্তি পায়। আজ রঙ্গময়ির মুখে যে দীপ্তি দেখিলাম তাহা আর কখনও দেখি নাই। সে আনন্দিত মুখশ্রী একটু ফুৎকারে আমার সব দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব উড়াইয়া দিল, বুকে বল আসিল। মনে হইল, আমার এই অপ্রতিভ পরিস্থিতিতে আর কেহ না থাকে, পাশটিতে তো মনু থাকিবে। তাহার উপর আমি কি সর্বাধিক নির্ভরশীল নহি? “বিবাহ হইয়া গেল। “এই বিবাহে বাসর জাগিবার দায় নাই। সকলে বিদায় লইল। শচীন ঠাকুরদালানে ওঠে নাই। একটু দূরে সাইকেলে ভর রাখিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। উঠানে স্বল্প আলোয় দাসদাসী ও কর্মচারীরাও উপস্থিত ছিল। কিন্তু আমার আর ততটা সংকোচ বোধ হইতেছিল না। মনুর স্পর্শে আমার ভিতরে তাহার তেজ ও সাহস সংক্রামিত হইয়াছে। “বিবাহের পর যখন দুইজনে জোড়ে হাঁটিয়া ঘরে আসিলাম তখন এক আশ্চর্য অনুভূতি হইতেছিল। ভাঁটানো বয়সে বেশ আবার জোয়ার লাগিয়াছে। মনে হইতেছে পৃথিবীর দুঃখ, সন্তাপ, দুর্দৈবের সহিত আরও বহুকাল সংগ্রাম করিতে পারিব। “সামান্য কিছু আহার করিয়া একটু অধিক রাত্রে আমরা এক শয্যায় রাত্রিবাস করিতে ঘরে ঢুকিলাম। মনু দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া ঘোমটা সরাইয়া আমার দিকে তীব্র চোখে চাহিয়া কহিল, অমন করছিলে কেন? তটস্থ হইয়া কহিলাম, কেমন? চোরের মতো বসে থেকে এমন একখানা ভাব করছিলে যেন কেউ তোমাকে ধরেবেঁধে বিয়ে করতে বসিয়েছে। একরকম তাহাই। তবু মুখে হাসি টানিয়া কহিলাম, হঠাৎ ঘটে গেল তো, তাই। মোটেই হঠাৎ নয়। আমাদের এই বিয়ে বহুকাল আগে থেকেই ঘটে ছিল। শুধু অনুষ্ঠানটুকু হল আজ। বলো তাই কি না! কী আর কহিব! বলিলাম, তাই হবে, মনু। আমি কেমন তা তো জানোই। জানি বলেই তো এই কাণ্ড করলাম। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ ছাড়া পথ ছিল না। “গভীর রাত্রি পর্যন্ত দুজনে নানা কথা কহিলাম। সেসব কোনও প্রেমালাপ নহে। ঘরসংসারের কথা, কৃষ্ণর কথা, ছেলেমেয়েদের কথা, সুনয়নীর কথাও। আমাদের নূতন কথা তো কিছুই নাই। তবু পুরাতন সব কথার মধ্যেই একটু নূতনের সুর লাগিতেছিল। “আমরা একই শয্যায় পাশাপাশি শয়ন করিলাম। কিন্তু কেহই দেহের সীমানা লঙঘন করিলাম। এমনকী একটি চুম্বনও নহে। বড় লজ্জা ও সংকোচ হইতেছিল। “পরদিন সকাল হইতে না হইতেই মনু সংসারের চারদিক সামাল দিতে ঝাপাইয়া পড়িল। এখন সে আর নিতান্ত পুরোহিকন্যা নহে, সে এ বাড়ির গৃহিণী। তাহার গৃহিণীপনা দেখিবার মতোই। এমন সুচারুভাবে সে সবকিছু গোছগাছ করিতে লাগিল যে আমি ভরসা পাইলাম। “দ্বিপ্রহরে একান্তে সে আমাকে বলিল, শোনো, আমরা কিন্তু এখানে থাকব না। কোথায় থাকবে? কাশীতে লোক পাঠাও। কাশী! হ্যাঁ। আমাদের বাড়িটা সেখানে ফাঁকা পড়ে আছে। লোক গিয়ে সেটা মেরামত করতে থাকুক। বিশাখার বিয়ের পরই আমরা চলে যাব। সেটাই কি ঠিক হবে? হবে। এস্টেট শচীন দেখবে। তোমাকে ভাবতে হবে না। “চুপ করিয়া গেলাম। মনু যাহা বলে তাহা ঠিকই বলে। তাহার পরামর্শ শুনিয়া আমার কখনও ক্ষতি হয় নাই। “কালরাত্রি কাটিয়া ফুলশয্যা আসিল। কীরূপে সেই রাত্রির বর্ণনা করিব? আমার ভিতরে যে পুরুষ এতকাল নিদ্রিত ছিল, সুনয়নীর সংস্পর্শেও যাহার ঘুম পুরাপুরি ভাঙে নাই, সেই পুরুষটিকেই যেন মনু আজ জাগাইয়া তুলিল। কাম ও প্রেমের মধ্যে পার্থক্য যোজনবিস্তার। কাম তত যে কোনও নারী-পুরুষেই সংঘটিত হইতে পারে। কিন্তু দুটি নরনারী যখন যুগক্ষয়ি প্রতীক্ষার ভিতর দিয়া পরস্পরকে প্রার্থনা করে
false
toslima_nasrin
করছি, যা চাইছ তা পাবে বলে আমাদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে অন্দরমহলের অন্দরে চলে গেল। ফজলিখালাও অদৃশ্য। সম্ভবত হুমায়রা নিজে বোরখা পরে আসছে আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু ওভাবে প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর নিজে তো সে বোরখা পরে এলই না আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে যেতে, বরং আমাদের নিয়ে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর ঘরে ঢুকল। পীর আমিরুল্লাহ শাদা আলখাল্লায় শাদা টুপিতে বসেছিলেন বিছানায়। তাঁর মেহেদি লাগানো দাড়ি নড়ছিল যখন তিনি আমাদের দেখে মাথা নাড়ছিলেন আসুন আসুন ভঙ্গিতে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে রইল পাশে। পীর ছাড়াও পীরের কন্যা জোহরা ছিল ঘরে, আর কিছু আইবুড়ি। আমাদের এ ঘরে ঢোকানোর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অনুমান করি, মেয়ে-মৌলবি পেতে হলে কেবল ফজলিখালা আর হুমায়রার অনুমতি যথেষ্ট নয়, আমাকে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর কাছে আবেদন পেশ করতে হবে আমাকে, তাঁর অনুমতি মিললেই আমাদের কাজ হাসিল হবে। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর পীর আমিরুল্লাহ কিছু জানতে চাইলেন না আমরা কেন এসেছি, কি কারণ। আদৌ তিনি আমাদের এ বাড়িতে আগমনের উদ্দেশ্য জানেন কি না আমার সন্দেহ হয়। সম্পণূর্ অপ্রাসঙ্গিকভাবে, আর কাউকে না হলেও, আমাদের, আমাকে সাফিনাজকে, হালিদা আর পারুলকে হতবাক করে বলেন, তারপর বুঝলেন কি না আল্লাহর পথে আসা খুব সহজ কথা নয়, দুনিয়াদারির মোহ ত্যাগ যারা করতে পেরেছে, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা আখেরাতে সর্বোচ্চ সম্মানের আয়োজন করেছেন। ঘরের অন্যান্যদের মখু থেকে আহ আহ শব্দ ওঠে। সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য তৃষ্ণা সেই আহ শব্দে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া, দুনিয়াদারির সাময়িক সংসার, মায়ার জাল ছিঁড়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদের জন্য কি ধরণের সম্মান অপেক্ষা করছে পরকালে তার পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণনা করেন এবং দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকলে আল্লাহতায়ালা কি ধরনের শাস্তি লিখে রেখেছেন তারও ভয়াবহ বিবরণ দিতে তিনি ভোলেন না। বর্ণনা দীর্ঘ। বিবরণ অতিদীর্ঘ।সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল বার বার আমার দিকে কুঞ্চিত চোখে তাকাচ্ছে, বুঝে পাচ্ছে না কি ঘটছে এখানে, ফিসফিস করছে, চল চল। দেরি হয়ে গেল। আমিও ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কেন আমাদের এখানে দাঁড় করিয়ে আল্লাহতায়ালার শাস্তি এবং পুরস্কারের আদ্যোপান্ত জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। হুমায়রাকে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করি যে আমাদের সময় নেই সময় খরচ করার। মেয়ে-মৌলবির জন্য এসেছি আমরা, এসব শুনতে নয়। আমার ইশারার দিকে ফিরে তাকায় না হুমায়রা। বড় বিব্রত বোধ করি বান্ধবীদের সামনে। মেয়ে-মৌলবি যোগাড় করে দেবার লোভ দেখিয়ে এদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আটকে পড়েছি। পীর আমিরুল্লাহ আমাদের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকান, বাকি সময় তিনি মেঝে নয়ত সিলিংএর দিকে, উঠোনের গাছগাছালি নয়ত আইবুড়িদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন আল্লাহতায়ালার গুণাগুণ। যেন কোনও মানুষের মখু থেকে নয়, রবোটের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সব। কোরান হাদিসের প্রতিটি শব্দ আমিরুল্লাহ মুখস্থ ঠোঁটস্থ অন্তঃস্থ করে ফেলেছেন, পরীক্ষা সামনে এলে পরীক্ষার্থীরা যেমন মখু স্থ করে সিলেবাসের বইগুলো। শব্দগুলো আমিরুল্লাহর মখু থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকির মত, গায়ে এসে লাগছে ফুলকি। হঠাৎ মনে হয়, লোকটি আমিরুল্লাহ নন, লোকটি স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এই ঘরটি ঘর নয়, এটি হাশরের মাঠ, এখানে চারজন পাপীর বিচার করছেন আল্লাহতায়ালা। বিরতিহীন বয়ানে পীর আমিরুল্লাহর মুখে ফেনা উঠে এলে হুমায়রা একটি ক্যাসেট চালিয়ে দেয়। ক্যাসেটে আমিরুল্লাহর কণ্ঠে কোরান হাদিসের কথা। ঠিক একই কথা যা তিনি বর্ণনা করেছেন মুখে। একই কথা একই ভাষায় একই সুরে। আমি এরমধ্যে অনেকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়েছি। অনেকবার বলেছি আমি যাই। হুমায়রা চাপা কণ্ঠে ধমক দিয়েছে, আল্লাহর কথা শুনলে এত ধৈর্যহারা হও কেন? অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনতে হয় আল্লাহতায়ালার কথা। আল্লাহর পথে এসেছো। এখন মন থেকে শয়তান ঝেড়ে ফেলতে হবে। শয়তানই আল্লাহ থেকে মন ফেরায় অন্যদিকে। এ কথায় স্পষ্ট হয় সে কি অনুমান করছে। সারা বাড়ির চোখ আমাদের দিকে, চোখগুলো জানে যে আমরা দুনিয়াদারি ফেলে আল্লাহর পথে চলে এসেছি, না এলেও এ বাড়িতে ঢুকেছি বলে আল্লাহর পথে নেওয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক ধোয়া হচ্ছে পণু ্যজলে। ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক ঘন্টা পেরেলো, দু ঘন্টাও। দেখছি সাফিনাজ আর হালিদার মুখে বিস্ময়, বিরক্তি আর বিষম বিষাদ। আমার গা ছমছম করে, ভূুতের ভয়ে এককালে যেমন করত। মনে হতে থাকে এ বাড়ির কোনও মানুষই সত্যিকার মানুষ নয়। এই ভূতুড়ে বাড়িটি থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকি। কিন্তু যতক্ষণ আমিরুল্লাহর কোরান হাদিসের ব্যাখ্যা শেষ না হচ্ছে ক্যাসেটে, আমাকে উঠতে দেবে না হুমায়রা। অদৃশ্য শেকলে আমরা বাধাঁ। এভাবে দিন ফুরিয়ে যাবে, রাতও, টের পাই। এক ক্যাসেট ফুরিয়ে গেলে আরেক ক্যাসেট চালানো হচ্ছে। আল্লাহতায়ালার এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে কানাগলি থেকে বেরোবার সবকটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষিধেয় আমাদের পেট জ্বলছে। বিকেল পার হয়ে যাচ্ছে, হোস্টেলে মিলাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আছে অনেকক্ষণ। শ্বাস দ্রুত হচ্ছে। এবার যান্ত্রিক বয়ানের মাঝখানে হঠাৎ উঠে দরজার দিকে পা বাড়াই, ভূতের রাজ্য থেকে যত শিগগির সম্ভব পালানোই যে মঙ্গল তা আমি যেমন জানি, আমার গতিময় পাদুটেও জানে। উঠোনের অনেকগুলো চোখ আমাকে হাঁ করে দেখতে দেখতে ফিসফিস করছে, হামিমা আপার মেয়ে আল্লাহর পথে এসেছে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া আর করতে চায় না, এখন থেকে নিয়মিত কোরান হাদিস শুনতে এখানে আসবে। শুনছি বিচিত্র উচ্চারণে বাক্যগুলো, কত সুমতি হয়েছে মেয়েদের। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়ে যারাই আসে, কাউকে হুজুর ফিরিয়ে দেন না। হুমায়রার আদেশ উপদেশ
false
shordindu
‘আমার একটা লগ আসবার কথা আছে। এলেই খবর দেবেন। আমরা ওয়েটিং রুমে আছি।’ আমরা তিনজনে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে গিয়া বসিলাম। পাণ্ডে ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখিতে লাগিলেন। ঠিক সাড়ে দশটার সময় স্টেশন-মাস্টার খবর দিলেন‌, ‘‘লগ’ এসেছে। সব ভাল। ফার্স্ট ক্লাস।’ এখনও পয়তাল্লিশ মিনিট। কিন্তু পয়তাল্লিশ মিনিট সময় যত দীর্ঘই হোক‌, প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হইতে বাধ্য। গাড়ি আসার ঘণ্টা বাজিল। আমরা প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমাদের সকলের গায়ে ওভারকেট এবং মাথায় পশমের টুপি‌, সুতরাং সহসা দেখিয়া কেহ যে চিনিয়া ফেলিবে সে সম্ভাবনা নাই। তারপর বহু প্ৰতীক্ষিত গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। পাণ্ডে সাহেব নাটকের রঙ্গমঞ্চ ভালই নিবাচন করিয়াছিলেন। আয়োজনেরও কিছু ত্রুটি রাখেন নাই; কিন্তু তবু নাটক জমিতে পাইল না‌, পটোত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা পড়িয়া গেল। গাড়ির প্রথম শ্রেণীর কামরা যেখানে থামে আমরা সেইখানে দাঁড়াইয়াছিলাম। ঠিক আমাদের সামনে প্রথম শ্রেণীর কামরা দেখা গেল। জানালাগুলির কাঠের কবাট বন্ধ‌, তাই অভ্যন্তরভাগ দেখা গেল না। অল্পকাল-মধ্যে দরজা খুলিয়া গেল। একজন কুলি ছুটিয়া গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং দুইটি বড় বড় চামড়ার সুটকেস নামাইয়া রাখিল। কামরায় একটি মাত্র যাত্রী ছিলেন‌, তিনি এবার বাহির হইয়া আসিলেন। কোটপ্যান্ট-পরা অপরিচিত ভদ্রলোক‌, গোঁফ-দাড়ি কামানো‌, চোখে ফিকা নীল চশমা। তিনি সুটকেস দুটি কুলির মাথায় তুলিবার ব্যবস্থা করিতেছেন‌, পাণ্ডে এবং ব্যোমকেশ তাঁহার দুই পাশে গিয়া দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ একটু দুঃখিত স্বরে বলিল‌, ‘অমরেশবাবু্‌, আপনার যাওয়া হল না। ফিরে যেতে হবে।’ অমরেশবাবু! ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা! গোঁফ-দাড়ি কামানো মুখ দেখিয়া একেবারে চিনিতে পারি নাই। অমরেশ রাহা একবার দক্ষিণে একবার বামে ঘাড় ফিরাইলেন‌, তারপর ক্ষিপ্ৰহস্তে পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া নিজের কপালে ঠেকাইয়া ঘোড়া টানিলেন। চড়াৎ করিয়া শব্দ হইল। মুহুর্তমধ্যে অমরেশ রাহার ভূপতিত দেহ ঘিরিয়া লোক জমিয়া গেল। পাণ্ডে হুইসল বাজাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের বহু লোক আসিয়া স্থানটা ঘিরিয়া ফেলিল। পাণ্ডে কড়া সুরে বলিলেন‌, ‘ইন্সপেক্টর দুবে‌, সুটকেস দুটো আপনার জিম্মায়।’ একজন লোক ভিড় ঠেলিয়া প্রবেশ করিল। চিনিলাম‌, ডাক্তার ঘটক। সে বলিল‌, ‘কি হয়েছে? এ কে?’ পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘অমরেশ রাহা। দেখুন তো বেঁচে আছে কি না।’ ডাক্তার ঘটক নত হইয়া দেহ পরীক্ষা করিল‌, তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘মারা গেছে।’ ভিড়ের ভিতর হইতে দন্তবাদ্যসহযোগে একটা বিস্ময়-কুতুহলী স্বর শোনা গেল‌, ‘অমরেশ রাহা মারা গেছে।–অ্যাঁ! কি হয়েছিল? তার দাড়ি কোথায়-অ্যাঁ–!’ ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার। ডাক্তার ঘটক ও নকুলেশবাবুকে লক্ষ্য করিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাদের গাড়িও এসে। পড়েছে। এখন বলবার সময় নেই‌, ফিরে এসে শুনবেন।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটা সাংঘাতিক ভুল করেছিলুম। অমরেশ রাহা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার‌, তার যে পিস্তলের লাইসেন্স থাকতে পারে একথা মনেই আসেনি।’ সত্যবতী বলিল‌, ‘না‌, গোড়া থেকে বল।’ ২রা জানুয়ারি। কলিকাতায় ফিরিয়া চলিয়াছি। ডি.এস.পি. পাণ্ডে‌, মহীধর বাবু ও রজনী স্টেশনে আসিয়া আমাদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া গিয়াছেন। এতক্ষণে আমরা নিশ্চিন্ত মনে একত্র হইতে পারিয়াছি। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দুটো জিনিস জট পাকিয়ে গিয়েছিল—এক‌, ছবি চুরি; দ্বিতীয়‌, ডাক্তার আর রজনীর গুপ্ত প্ৰণয়। ওদের প্রণয় গুপ্ত হলেও তাতে নিন্দের কিছু ছিল না। ওরা কলকাতায় গিয়ে রেজিষ্টি করে বিয়ে করেছে। সম্ভবত রজনীর মাসী আর মেসো জানেন‌, আর কেউ জানে না; মহীধর বাবুও না। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন‌, ততদিন কেউ জানবে না। মহীধর বাবু সেকেলে লোক নয়‌, তবু বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে সাবেক সংস্কার ত্যাগ করতে পারেননি। তাই ওরা লুকিয়ে বিয়ে করে সব দিক রক্ষা করেছে।’ জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘খবরটা কি ডাক্তারের কাছে পেলে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উহু’। ডাক্তারকে ঘাঁটাইনি‌, ও যে রকম রুখে ছিল‌, কিছু বলতে গেলেই কামড়ে দিত। আমি রজনীকে আড়ালে বলেছিলাম‌, সব জানি। সে জিজ্ঞেস করেছিল‌, ব্যোমকেশীবাবু্‌, আমরা কি অন্যায় করেছি? আমি বলেছিলাম–না। তোমরা যে বিদ্রোহের ঝোঁকে মহীধর বাবুকে দুঃখ দাওনি‌, এতেই তোমাদের গৌরব। উগ্ৰ বিদ্রোহে বেশি কাজ হয় না‌, কেবল বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগিয়ে তোলা হয়। বিদ্রোহের সঙ্গে সহিষ্ণুতা চাই। তোমরা সুখী হবে।’ সত্যবতী বলিল‌, ‘তারপর বল।’ ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘ছবি চুরির ব্যাপারটাকে যদি হাল্কা ভাবে নাও তাহলে তার অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু যদি গুরুতর ব্যাপার মনে কর‌, তাহলে তার একটিমাত্ৰ ব্যাখ্যা হয়–ঐ গ্রুপের মধ্যে এমন একজন আছে যে নিজের চেহারা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চায়। ‘কিন্তু কি উদ্দেশ্যে?–একটা উদ্দেশ্য এই হতে পারে যে ঐ দলে একজন দাগী আসামী আছে যে নিজের ছবির প্রচার চায় না। প্রস্তাবটা কিন্তু টেকসই নয়। ঐ গ্রুপে যারা আছে তারা কেউ লুকিয়ে বেড়ায় না‌, তাদের সকলেই চেনে। সুতরাং ছবি চুরি করার কোনও মানে হয় না। ‘দাগী আসামীর সম্ভাবনা ত্যাগ করতে হচ্ছে। কিন্তু যদি ঐ দলে এমন কেউ থাকে যে ভবিষ্যতে দাগী আসামী হবার জন্যে প্ৰস্তুত হচ্ছে‌, অর্থাৎ একটা গুরুতর অপরাধ করে কেটে পড়বার চেষ্টায় আছে‌, তাহলে সে নিজের ছবি লোপাট করবার চেষ্টা করবে। অজিত‌, তুমি তো লেখক‌, শুধু ভাষার দ্বারা একটা লোকের এমন হুবহু বৰ্ণনা দিতে পাের যাতে তাকে দেখলেই চেনা যায়?-পারবে না; বিশেষত তার চেহারা যদি মামুলি হয় তাহলে একেবারেই পারবে না। কিন্তু একটা ফটোগ্রাফ মুহুর্তমধ্যে তার চেহারাখানা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারে। তাই দাগী আসামীদের ফটো পুলিসের ফাইলে রাখা থাকে। ‘তাহলে পাওয়া গেল‌, ঐ দলের একটা লোক গুরুতর অপরাধ করে ডুব মারবার ফন্দি আটিছে। এখন প্রশ্ন এই-সংকল্পিত অপরাধটা কি এবং লোকটা কে? ‘গুপের লোকগুলিকে একে একে ধরা যাক। —মহীধরবাবু ডুব মারবেন
false
shirshendu
টেলিফোনে গলা শুনেই তো বুঝতে পারছি খুব খুশি হননি। বাড়িতে এসে দেখুন পাত্তা দিই কি না! সমীর ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বলল, বাড়িতে যাব না, তবে আপনার সঙ্গে আমার একটা দরকার আছে বউদি। রেমি ঠোঁট কামড়ে বলল, আচ্ছা, আপনি আমাকে তখন থেকে বউদি-বউদি করে যাচ্ছেন কেন বলুন তো! দার্জিলিং-এ তো দিব্যি নাম ধরে ডাকছিলেন! ডেকেছিলাম নাকি? কেন, মনে নেই? সমীর হেসে বলে, আছে। কিন্তু তখন হয়তো নানা ঘটনায় লঘু-গুরু জ্ঞান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞানের নাড়ি তো বেশ টনটনে দেখছি। কী দরকার বলুন তো! আছে। আজ বা কাল আপনার একটু সময় হবে? কখন? বিকেলের দিকে! হতে পারে। আমি নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেলে উঠেছি। জায়গাটা চেনেন? চিনি। কেন? আসতে পারবেন একা? একা! হ্যাঁ বউদি, কাউকে না জানিয়ে আসবেন। রেমি একটু ইতস্তত করে বলল, এ বাড়ির মেয়ে-বউরা হুটহাট বেরোতে পারে না। শ্বশুরমশাই পছন্দ করেন না ওসব। আমার দরকারটা খুব জরুরি। আপনি তো এ বাড়িতেই আসতে পারেন। না। পারি না। কেন বলুন তো! সমীর একটু চুপ থেকে বলল, আপনি আপনার শ্বশুরকে কতটা চেনেন জানি না। উনি কিন্তু ভীষণ ডেঞ্জারাস টাইপের লোক। তাই নাকি? উনি কি আপনার ওপর চটে আছেন? ঘটনাটা আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন! কোন ঘটনা? দার্জিলিং-এ আপনি একবার উত্তেজনার বশে আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। মনে আছে? রেমি লজ্জা পেয়ে বলে, ধরেছিলাম নাকি? ধরেছিলেন। এবং সেটা দেখতে পেয়েছিল লামা। তাকে ভোলেননি নিশ্চয়! না, ভুলিনি। আমি তখনই বলেছিলাম লামা ব্যাপারটা আপনার শ্বশুরকে রিপোর্ট করতে পারে। হ্যাঁ, বলেছিলেন। লামা কি রিপোর্ট করেছে? করেছে। কাকা একদিন আমাকে ডেকে কয়েকটা অপ্রিয় প্রশ্নও করেন। কৃষ্ণকান্তবাবু ব্যাপারটা ওঁকে জানিয়েছেন। তাই আপনি এ বাড়িতে আসতে ভয় পাচ্ছেন? ঠিক ভয় নয়। সংকোচ। কৃষ্ণকান্তবাবু হয়তো আমাকে খুব সুনজরে দেখবেন না। রেমি একটু রাগের গলায় বলল, ওটা তো কাপুরুষতা। আপনি না এলেই বরং সন্দেহটা বাড়বে। তা নয়। আমি তো কৃষ্ণকান্তবাবুর বাড়িতে বড় একটা যাই না। কাজেই এখন না গেলেও সন্দেহের কারণ নেই। গেলে বরং সন্দেহটাকে আরও খামোক খুঁচিয়ে তোলা হবে। আপনি খুব হিসেবি লোক। কমপ্লিমেন্টটা ভাল নয়। কিন্তু আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টটার কী হবে বলুন। কেনিলওয়ার্থ হোটেল আমি চিনি। কখন যেতে হবে বলুন। কাল বিকেল পাঁচটায়। আমি রিসেপশনে থাকব। আপনি কি নিজেদের গাড়িতে আসবেন? আমাদের গাড়ি তো মোটে একটা। সেটা শ্বশুরমশাই ব্যবহার করেন। আমি যাব ট্যাকসিতে। কেন বলুন তো! যাক বাঁচা গেল! আমি গাড়িটা অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম। রেমি সন্দেহের গলায় বলে, এত গোপনীয়তা কীসের বলুন তো! আপনি কি ভয় পাচ্ছেন বউদি? তেমন কিছু নয়। ভয় তো আপনিই পাচ্ছেন মনে হচ্ছে। আমার ভয়ের একটু কারণ আছে। প্লিজ, আমার সঙ্গে ফোনে আপনার কথা হল সেটা কাউকে বলবেন না। না বললাম। তা হলে কাল বিকেলে? আচ্ছা। পরদিন বিকেলে একটা ট্যাকসি করে যেতে যেতে রেমির মনে হল, আমি কেন যাচ্ছি? এই গোপনীয়তা, এই রহস্য সত্ত্বেও একটা হোটেলে একজন পরপুরুষের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা ঠিক নয়। তবু কেন যাচ্ছি? তার একটু ভয়-ভয় করছিল। আবার আগ্রহও বোধ করছিল সে। তার ঘটনাহীন একঘেয়ে জীবনে একটা কিছু অন্যরকম ঘটুক না একদিন। হোটেলের রিসেপশনে সমীর অপেক্ষা করছিল। একটু কালো আর রোগা হয়ে গেছে। মুখে উদ্বেগের সুস্পষ্ট চিহ্ন। বউদি।— বলে এগিয়ে এল সে। রেমি খুব সেজে এসেছে। বিশুদ্ধ মুগার ওপর রেশমি বুটির দারুণ একখানা শাড়ি পরেছে সে। গায়ে রুপোর গয়নার একটা সেট। খুবই ভাল দেখাচ্ছে তাকে, সে জানে। কিন্তু সমীর তেমন মুগ্ধ হয়ে গেল না তো! রেমি বলল, কী ব্যাপার বলুন তো! ঘরে চলুন বলছি। দোতলায় একটা বেশ কেতাদুরস্ত ঘরে তাকে নিয়ে গেল সমীর। কিন্তু ঘরে ঢুকেই থমকে গেল রেমি। লন্ডভন্ড একটা মস্ত বিছানায় এলোচুলে, অবিন্যস্ত বদনে পড়ে আছে যে তাকে কষ্ট করে চিনতে হয়। সে ছন্দা। মুখ ফুলে আছে। চোখের কোলে জলের সুপষ্ট দাগ। কাজল আর লিপস্টিক লেপটে আছে মুখময়। এপাশ-ওপাশ করতে করতে এক নাগাড়ে উঃ বাবা উঃ বাবা করে যাচ্ছে ভাঙা রেকর্ডের মতো। এ কী?–রেমি চেঁচিয়ে ওঠে। ছন্দা কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে তাকে দেখল। তারপর হঠাৎ উঠে বসে কেঁদে ফেলল। আঁচল তুলে মুখে চাপা দিয়ে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না। কী পারবে না? বলে রেমি গিয়ে তাড়াতাড়ি ছন্দার পাশে বসে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে, কী হয়েছে ছন্দা? তুমি এখানে কেন? ছন্দা কাঁদছে। জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। সমীর একটু অপ্রতিভ মুখে বলল, আমরা একটা কাণ্ড করে ফেলেছি বউদি। রেমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিল। হোটেলের ঘরে এভাবে ছন্দা আর সমীর, এর একটাই মানে হয়। তার আজন্ম সংস্কার আর রুচিবোধে এমন অদ্ভুত আর ঘিনঘিনে লাগছিল ব্যাপারটা যে তা বলার নয়। রেমি বলল, কী কাণ্ড সমীরবাবু? আপনি কি ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন? না। ঠিক তা নয়। ছন্দার কলকাতায় আসার কথা ছিল। আমার সঙ্গেই। তা হলে? হোটেলে ওঠার কথা ছিল না। উঠলেন কেন তবে? ছিঃ ছিঃ। প্লিজ বউদি, ওরকম করবেন না। তাতে ও আরও বিগড়ে যাবে। বিগড়োবারই তো কথা। দোষটা তো সবটাই আমার নয়। ওরও। ওকেই জিজ্ঞেস করুন। আমি আধ ঘণ্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি। সমীর বাইরে গিয়ে দরজা টেনে দিল। স্তব্ধ ঘরে ছন্দার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল রেমির কাছে। যান্ত্রিকভাবে সে ছন্দার মাথায়
false
shordindu
ও সংবাদপত্রের ব্যবচ্ছেদ করিতেছিলাম। গত তিন মাস একেবারে বেকারভাবে বসিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশের ধৈর্যের লৌহ-শৃঙ্খলও বোধ করি ছিড়িবার উপক্ৰম করিয়াছিল। দিনের পর দিন সংবাদপত্রের নিম্প্রাণ ও বৈচিত্র্যহীন পৃষ্ঠা হইতে অপদাৰ্থ খবর সংগ্ৰহ করিয়া সময় আর কাটিতে চাহিতেছিল না। আমার নিজের মনের অবস্থা যেরূপ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল‌, তাহা হইতেই বুঝিতেছিলাম‌, ব্যোমকেশের মস্তিষ্কের ক্ষুধা ইন্ধন অভাবে কিরূপ উগ্র ও দুর্বাহ হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তবু সমবেদনা প্রকাশ করিয়া তাহাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করি নাই; বরঞ্চ এই অনীন্সিত নৈষ্কর্মের জন্য যেন সে-ই মূলতঃ দায়ী্‌্‌, এমনিভাবে তাহাকে ব্যঙ্গ-বিদ্যুপ করিয়াছি। আজ প্রভাতে তাহার এই হতাশাপূর্ণ ভাব দেখিয়া আমার একটু অনুশোচনা হইল। মস্তিষ্কের খোরাক সহসা বন্ধ হইয়া গেলে সুস্থ বলবান মস্তিষ্কের কিরূপ দুৰ্দশা হয়‌, তাহা তো জানিই‌, উপরন্তু আবার বন্ধুর খোঁচা খাইতে হইলে ব্যাপারটা নিতান্তই নিষ্কারুশি হইয়া পড়ে। আমি আর তাহাকে প্রশ্ন না করিয়া অনুতপ্ত চিত্তে খবরের কাগজখানা খুলিলাম। এই সময়ে চারিদিকে সভা সমিতি ও অধিবেশনের ধুম পড়িয়া যায়‌, এবারেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। সংবাদ-ব্যবসায়ীরা সরসতর সংবাদের অভাবে এইসব সভার মামুলি বিবরণ ছাপিয়া পৃষ্ঠা পূর্ণ করিয়াছে। তাহার ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা ও থিয়েটার-সাকাসের বিজ্ঞাপন সচিত্র ও বিচিত্ররূপে আমোদ-লোলুপ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিতেছে। দেখিলাম‌, কলিকাতাতেই গোটা পাঁচেক বড় বড় সভা চলিতেছে। তা ছাড়া দিল্লীতে নিখিল ভারতীয় বিজ্ঞান-সভার অধিবেশন বসিয়াছে। ভারতের নানা দিগদেশ হইতে অনেক হোমরা-চোমরা বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত একজোট হইয়াছেন এবং বাক্যধুমে বোধ করি দিল্লীর আকাশ বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছেন। সংবাদপত্রের মারফত যতটুকু ধুম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহারই ঠেলায় মস্তিষ্ক কোটরে কুল পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। আমি সময় সময় ভাবি‌, আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিকরা কাজ না করিয়া এত বাগবিস্তার করেন কেন? দেখিতে পাই‌, যিনি যত বড় বৈজ্ঞানিক‌, তিনি তার চতুৰ্ত্তণ বাগ্মী। বেশি কিছু নয়‌, স্টীম এঞ্জিন বা এরোপ্লেনের মত একটা যন্ত্রও যদি ইহারা আবিষ্কার করিতে পারিতেন‌, তাহা হইলেও তাঁহাদের বাচালতা ধৈর্য ধরিয়া শুনিতাম। কিন্তু ও সব দূরে থাক‌, মশা মারিবার একটা বিষও তাঁহারা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। বুজরুকি আর কাহাকে বলে! নিরুৎসুকিভাবে বিজ্ঞান-কংগ্রেসের বিবরণ পড়িতে পড়িতে একটা নাম দৃষ্টি আকর্ষণ করিলইনি কলিকাতার একজন খ্যাতনামা প্রফেসর ও বিজ্ঞান-গবেষক-নাম দেবকুমার সরকার। বিজ্ঞান-সভায় ইনি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়াছেন। অবশ্য ইনি ছাড়া অন্য কোনও বাঙালী যে বক্তৃতা দেন নাই‌, এমন নয়‌, অনেকেই দিয়াছেন; কিন্তু বিশেষ করিয়া দেবকুমারবাবুর নামটা চোখে পড়িবার কারণ, কলিকাতায় তিনি আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের বাসার কয়েকখানা বাড়ির পরে গলির মুখে তাঁহার বাসা। তাঁহার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ আলাপ ছিল না‌, কিন্তু তাঁহার পুত্ৰ হাবুলের সম্পর্কে আমরা তাঁহার সহিত নেপথ্য হইতেই ঘনিষ্ঠ হইয়া পড়িয়ছিলাম। দেবকুমারবাবুর ছেলে হাবুল কিছুদিন হইতে ব্যোমকেশের ভক্ত হইয়া পড়িয়ছিল। ছোকরার বয়স আঠারো-উনিশ‌, কলেজের দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পড়িত। ভালমানুষ ছেলে‌, আমাদের সম্মুখে বেশি কথা বলিতে পারিত না‌, তদগতভাবে ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া থাকিত। ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া এই অস্ফুটবাক ভক্তের পূজা গ্ৰহণ করিত; কখনও চা খাইবার নিমন্ত্ৰণ করিত। হাবুল একেবারে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইত। এই হাবুলের পিতা কিরূপ বক্তৃতা দিয়াছেন‌, জানিবার জন্য একটু কৌতুহল হইল। পড়িয়া দেখিলাম‌, দেশী বৈজ্ঞানিকদের অভাব অসুবিধার সম্বন্ধে ভদ্রলোক যাহা বলিয়াছেন‌, তাহা নেহাত মিথ্যা নয়। ব্যোমকেশকে পড়িয়া শুনাইলে তাহার মনটা বিষয়াস্তরে সঞ্চারিত হইয়া হয়তো একটু প্ৰফুল্ল হইতে পারে‌, তাই বলিলাম‌, ‘ওহে‌, হাবুলের বাবা দেবকুমারবাবু বক্তৃতা দিয়েছেন‌, শোনো।‘ ব্যোমকেশ কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইল না‌, বিশেষ ঔৎসুক্যও প্রকাশ করিল না। আমি্‌্‌, পড়িতে আরম্ভ করিলাম– ‘এ কথা সত্য যে‌, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্য ব্যতীত কোনও জাতি বড় হইতে পারে নাই। অনেকের ধারণা এইরূপ যে‌, ভারতবাসী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পরাভূখ এবং তাহাদের উদ্ভাবনী শক্তি নাই—এই জন্যই ভারত পরনির্ভর ও পরাধীন হইয়া আছে। এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্ৰমাত্মক‌, ভারতের গরিমাময় অতীত তাহার প্রমাণ। নব্য-বিজ্ঞানের যাহা বীজমন্ত্র, তাহা যে ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হইয়াছিল ও পরে কাশপুষ্পের বীজের ন্যায় বায়ুতাড়িত হইয়া দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে‌, তাহা সুধীসমাজে উল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র। গণিত‌, জ্যোতিষ‌, নিদান‌, স্থাপত্য-এই চতুস্তম্ভের উপর আধুনিক বিজ্ঞান ও তৎপ্রসূত সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত‌, অথচ ঐ চারিটি বিজ্ঞানেরই জন্মভূমি ভারতবর্ষ। ‘কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে‌, বর্তমানে আমাদের এই অসামান্য উদ্ভাবনী প্রতিভা নিস্তেজ ও ম্ৰিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার কারণ কি? আমরা কি মানসিক বলে পূর্বাপেক্ষা হীন হইয়া পড়িয়াছি? না–তাহা নহে। আমাদের প্রতিভা অ-ফলপ্রসূ হইবার অন্য কারণ আছে। ‘পুরাকালে আচার্য ও ঋষিগণ-যাঁহাদের বর্তমানকালে আমরা বলিয়া থাকি–রাজ-অনুগ্রহের আওতায় বসিয়া সাধনা করিতেন। অর্থচিন্তা তাঁহাদের ছিল না‌, অর্থের প্রয়োজন হইলে রাজা সে অর্থ যোগাইতেন; সাধনার সাফল্যের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন হইত‌, রাজকোষের অসীম ঐশ্বর্য তৎক্ষণাৎ তাহা যোগাইয়া দিত। আচার্যগণ অভাবমুক্ত হইয়া কুষ্ঠাহীন-চিত্তে সাধনা করিতেন এবং অস্তিমে সিদ্ধি লাভ করিতেন। ‘কিন্তু বর্তমান ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের অবস্থা কিরূপ? রাজা বৈজ্ঞানিক-গবেষণার পরিপোষক নহেন-ধনী ব্যক্তিরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য অর্থব্যয় করিতে কুষ্ঠিত। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমিত আয়োজনের উপর নির্ভর করিয়া উদ্ধৃবৃত্তির সাহায্যে আমাদের সাধনায় প্রবৃত্ত হইতে হয়; ফলে আমাদের সিদ্ধিও তদুপযুক্ত হইয়া থাকে। মুষিক যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও হস্তীকে পৃষ্ঠে বহন করিতে পারে না‌, আমরাও তেমনই বড় বড় আবিক্রিয়ায় সফল হইতে পারি না; ক্ষুধাক্ষীণ মস্তিষ্ক বৃহতের ধারণা করিতে পারে না। ‘তবু আমি গর্ব করিয়া বলিতে পারি‌, যদি আমরা অর্থের অভাবে পীড়িত না হইয়া অকুণ্ঠ-চিত্তে সাধনা করিতে পারিতাম‌, তাহা হইলে আমরা জগতের কোনও জাতির নিকটেই নূ্যন হইয়া থাকিতাম না। কিন্তু হায়! অর্থ নাই-কমলার কৃপার
false
shorotchandra
কিন্তু কি ভাবিতেছে, তাহাই যাচাই করিবার জন্য কহিল, দেখে এলেন ত! এই বুদ্ধিমতীটিকে নিয়ে আমাকে ঘর করতে হয়। কিন্তু, এমনিই ত তাঁকে আঁটবার জো নেই, তাতে আপনি আজ তামাশা করে যে সার্টিফিকেট দিয়ে এলেন, এবার আর তার নাগাল পাওয়াই যাবে না। কিরণময়ী ইহার কোন উত্তর করিল না। একটুখানি অপেক্ষা করিয়া উপেন্দ্র হাসিয়া কহিল, কিন্তু এইখানেই এর শেষ নয় বৌঠান। ও এত বড় বোকা যে জন্মাবধি কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারে না। কিরণময়ী তেমনি নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। উপেন্দ্র বলিল, কেন জানেন? একে ত তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতা তাকে চতুর্দিকে ঘিরে দিবা-রাত্রি পাহারা দিয়ে আছে,—তা ছাড়া, যা ঘটেনি, সেইটুকু সে নিজের বুদ্ধি খরচ করে বানিয়ে বলবে সে ক্ষমতাই ওর নেই। কিরণময়ী রুদ্ধকণ্ঠে সংক্ষেপে কহিল, ভালই ত। উপেন্দ্র কহিল, অতটাই যে ভাল, তা আমার মনে হয় না বৌঠান। সংসার করতে গেলে একটু-আধটু মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হয়। যাতে কারো কোন ক্ষতি নেই, অথচ একটা অশান্তি, একটা উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তাতে দোষ কি? আমি ত বলি বরং ভালই। বেশ ত, শেখাতে পার না? শিখবে কি করে বৌঠান? একটি অতি ছোট মিথ্যের জন্য যুধিষ্ঠিরের দুর্গতি হয়েছিল সে যে মহাভারতে লেখা আছে। দেব-দেবতারা যেরকম হাঁ করে তার পানে চেয়ে বসে আছে, তাতে জেনে-শুনে মিথ্যে কথা বললে আর কি তার রক্ষা আছে! তারা হিড়হিড় করে টেনে ওকে নরকে ডুবিয়ে দেবে। একটু থামিয়া কহিল, বৌঠান, ঠাকুর-দেবতার চেহারা ও চোখ বুজে এমনি স্পষ্ট দেখতে পায় যে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। কেউ ঢাল-খাঁড়া নিয়ে, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম নিয়ে, কেউ বাঁশী হাতে করে এমনি প্রত্যক্ষ হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ান যে, শুনে আমার গা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। আর কারো মুখ থেকে ও-রকম শুনলে আমি মিথ্যা বানানো গল্প বলে হেসেই উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু তার সম্বন্ধে এ অপবাদ ত মুখে আনবারই জো নেই। বলিয়া, শ্রদ্ধায় প্রেমে গর্বে বিগলিত-চিত্তে সস্নেহ কৌতুকের স্বরে কহিল, তাই দেখে-শুনে ওকে মানুষ না বলে একটি জানোয়ার বললেও চলে। বলিহারি তাঁর বুদ্ধি—যিনি ছেলেবেলায় ওর পশুরাজ নাম রেখেছিলেন—ও কি বৌঠান? গাড়ি মোড় ফিরিতেই পথের উজ্জ্বল গ্যাসের আলোক সহসা কিরণময়ীর মুখের উপর আসিয়া পড়ায় উপেন্দ্র অত্যন্ত চমকিয়া দেখিল তাহার সমস্ত মুখখানি চোখের জলে ভাসিয়া যাইতেছে। উপেন্দ্র লজ্জায় স্তব্ধ অধোবদনে বসিয়া রহিল না। না জানিয়া যেখানে সে আনন্দ মাধুর্যে মগ্ন হইয়া স্নেহে সম্ভ্রমে পরিহাসের পর পরিহাস করিয়া চলিতেছিল, আর একজন সেইখানে ঠিক তাহারই মুখের সম্মুখে বসিয়া কি জানি কিসের বেদনায় নিঃশব্দ রোদনে বক্ষ বিদীর্ণ করিতেছিল। পাথুরেঘাটার বাটীতে উভয়ে যখন আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন রাত্রি একপ্রহর হইয়াছে। প্রায় সমস্ত পথটাই কিরণময়ী মৌন হইয়া ছিল; কিন্তু ভিতরে পা দিয়াই হঠাৎ অত্যন্ত অনুতপ্ত-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আ, আমার পোড়া কপাল! কেবল ঘুরিয়ে নিয়েই ত বেড়াচ্চি। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত একফোঁটা জলটুকু যে খেতে পেলে না ঠাকুরপো, তা আর এ হতভাগীর চোখে পড়ল না। হাত-মুখ ধোবে? তবে থাক গে। আমার সঙ্গে রান্নাঘরে এস, দুখানা লুচি ভেজে দিতে দশ মিনিটের বেশী লাগবে না। তুই কাঠের উনুনটা জ্বেলে দিয়ে তবে বাড়ি যাস্‌ ঝি! যা মা, চট করে যা। লক্ষ্মী মা আমার। ঝি কবাট খুলিয়া দিতে আসিয়াছিল, এবং অমনি ঘরে যাইবে ভাবিয়াছিল। কিন্তু আদেশ পালন করিতে আবার তাহাকে উপরে যাইতে হইল। সদর দরজা বন্ধ করিয়া সে দ্রুতপদে চলিয়া গেল। কিন্তু এই লুচি ভাজার প্রস্তাবে উপেন্দ্র একেবারে শশব্যস্ত হইয়া উঠিল। তীব্র প্রতিবাদ করিয়া কহিল, সে কিছুতেই হতে পারবে না বৌঠান! আজ আপনি অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আমি ফিরে গিয়েই খাব—আমার জন্যে কোনমতেই কষ্ট করতে পারবেন না। পারব না কেন? উপেন্দ্র কহিল, না না, সে কিছুতেই হবে না—কোনমতেই না। কিরণময়ী মুচকিয়া হাসিল, হাসিমুখে বলিল, তুমি ঠাকুরপো বড্ড যশের কাঙাল। এত যশ নিয়ে রাখবে কোথায় বল ত? সহসা এরূপ মন্তব্যের হেতু বুঝিতে না পারিয়া উপেন্দ্র কিছু বিস্মিত হইল। কিরণময়ী কহিল, তা বৈ কি ঠাকুরপো! তোমার পরোপকারের যশ এমন নিঃস্বার্থ, এমন নির্লিপ্ত হওয়া চাই, যেন স্বর্গে মর্ত্যে কোথাও তার জোড়া না থাকে। আমাদের জন্যে তুমি যা করেছ ঠাকুরপো, তাতে আমি বুক চিরে পা ধুইয়ে দিতে গেলেও ত তোমার আপত্তি করা সাজে না। আর এই দুটো খাবার তৈরী করে দেওয়ার কথাতেই ঘাড় নাড়চ? ছি, ছি, কি আমাদের তুমি ভাবো বল ত? মানুষ নই আমরা? না, মানুষের রক্ত আমাদের দেহে বয় না! উপেন্দ্র অত্যন্ত লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হইয়া বলিল, এ-সব কোন কথা ভেবেই আমি আপত্তি করতে যাইনি বৌঠান। আমি শুধু— শুধু কি ঠাকুরপো? তবে বুঝি ঘরে ফেরবার তাড়ায় কি বলছি না বলছি হুঁশ ছিল না? উপেন্দ্র বাঁচিয়া গেল। পরিহাস আবার সহজপথে ফিরিয়া আসায় সে খুশী হইয়া সহাস্যে কহিল, ও বদনামটা আমার আছে বটে বৌঠান, সে আমি অস্বীকার করতে পারিনে। কিন্তু এখন সেজন্য নয়। যথার্থই আমি ভেবেছিলুম, আজ আপনি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েচি? হলুমই বা! বলিয়া কিরণময়ী পুনরায় একটু হাসিল। তার পরে সহসা গম্ভীর হইয়া কহিল, হায় রে! আজ যদি আমার সতীশ-ঠাকুরপো থাকতেন! তা হলে নিজের কথা আর নিজের মুখে বলতে হতো না। তিনি সহস্রবদন হয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিতেন। না ঠাকুরপো, আমার নিজের ত ও-সব শ্রান্তি-ক্লান্তির শখ করবার অবস্থাই নয়, তা ছাড়া, বাঙালীর ঘরের কোন মেয়ের পক্ষেই
false
shunil_gongopaddhay
স্বয়ং রূপচাঁদ পক্ষী মশায়। পক্ষীর দলের শিরোমণি রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয় ইদানীং আর বাড়ি থেকে বিশেষ বের হন না। পক্ষীর দলের সেই রবরবা অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। সেই রাজা নবকেষ্টও নেই, গোপীমোহন ঠাকুরও নেই, তেমন পৃষ্ঠপোষক আর পাওয়া যাবে না। আর সেই এক আসনে বসে একশত ছিলিম গাঁজা টানার মতন কলজের জোর দেখানো মানুষই বা কোথায়! রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয় অনেক দিন পর্যন্ত দল টিকিয়ে রেখেছিলেন, তারপর কালের নিয়মে সবই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক দিন পর তিনি বাগবাজারের বাসা থেকে কয়েকজন ইয়ার বক্সীর সঙ্গে বেরিয়েছেন তাঁর সেই পুরাতন, মাকামারা গাড়িটি নিয়ে। উদ্দেশ্য বাগবাজারে গিয়ে আগেকার দিনের সঙ্গীরা যে কয়েকজন বেঁচে বর্তে আছেন, তাঁদের নিয়ে আবার একটি ঘরোয়া আসর বসাবেন। কিন্তু তাঁকে চিনতে পেরে পথচারীরা চার পাশ দিয়ে ঘিরে ধরে খাঁচা-গাড়ি আটক করে দিল। সকলের অনুরোধ, একখানা গান শোনাতেই হবে। রূপচাঁদ দাস পক্ষী মশায়ের বয়েস এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি, কণ্ঠে আর সেই আগেকার মতন জোর কিংবা লহরী নেই। তবু এত লোকের উপরোধে তাঁকে গাইতেই হলো। গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি ধরলেন : চিরদিন সমান যায় না রে ভাই, উন্নতি বিলয় প্ৰায় দেখতে পাই, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসিচে সদাই কালে হত হবে দুনিয়া।… কয়েকজন এনকোর, এনকোর বলে উঠলো। কয়েকজন বললো, এ গান নয়। এ বড় উঁচু ভাবের গান। একখানা রসের গান হোক! খগপতি রূপচাঁদ হাত জোড় করে বললেন, সে রকম আর পারি না। এখন ক্ষমা দাও, ভাইগণ। কিন্তু জনতা তা মানবে না। রসের গান শোনাতেই হবে। কেউ কেউ বলে উঠলো, সঙ্গে কন্ধে নেই? দু-চার দম দিয়ে নিন না, তা হলে গলা খোলতাই হবে! বাধ্য হয়েই রূপচাঁদ আবার ধরলেন : গো মেনকা শোন তোর অম্বিকার গতি গাঁজা টেনে শ্মশানে যায় পশুপতি মাঠে ঘাটে বেড়ায় ছুটে কার্তিক-গণেশ দুই নাতি। শৈশবে যদি শিখাতে দুটিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা আসিত পাশ করে অনায়াসে দুটিতে বিদ্যাবুদ্ধির জোরে। হতো হাইকেটের বিচারপতি…। এতেই হাসির হর-রা পড়ে যায়। শব্দে আকৃষ্ট হয়ে নতুন লোক এসে জমে। দু চারজন ইংরেজী শিক্ষিত যুবক অভক্তিও প্রকাশ করে। একজন বললো, ড্যাম! এই গেঁজেল পক্ষীর দল তো গোল্লায় গেসলো, আবার কি রিটার্ন করলো? কালটা কি পেচিয়ে যাচ্চে না এগুচ্চে! কিন্তু উপভোক্তাদের সংখ্যাই বেশী। আরও কয়েকখানি গান শোনাতে হলো রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয়কে। তারপর অনেকে মিলে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলো : আমারে ফ্রড করে! আমারে ফ্রড করে! ওটা একবার না শোনালে ছাড়ান-ছোড়ন নেই। তখন রূপচাঁদ ধরলেন তাঁর বিখ্যাত গান : আমারে ফ্রড করে কালিয়া ড্যাম তুই কোথা গেলি আই য়্যাম ফর ইউ ভেরি সরি, গোলডেন বডি হলো কালি। হো মাই ডিয়ার, ডিয়ারেস্ট মধুপুরে তুই গেলি কৃষ্ট ও মাই ডিয়ার, হাউ টু রেস্ট হিয়র ডিয়র বনমালী। (শুন রে শ্যাম তোরে বলি।) পুওর কিরিচর মিল্ক গেরেল তাদের ব্রেস্টে মারলি শেল ননসেন্স তোর নাইকো আক্কেল ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট করিলি। (ফিমেলগণে ফেল করিলি।) গান থামিয়ে রূপচাঁদ বললেন, আর মনে নেই। কিন্তু মনে করিয়ে দেবার মতন মানুষ আছে। শ্রোতাদের মধ্য থেকেই দু তিন জন বলে উঠলো, লম্পট শঠের ফরচুন! লম্পট শঠের ফরচুন! রূপচাঁদ আবার ধরলেন : লম্পট শঠের ফরচুন খুললো মথুরাতে কিং হলো আংকেলের প্রাণ নাশিল কুবুজার কুঁজ পেলে ডালি…। তালতলার রাস্তায় এই সন্ধ্যায় রূপচাঁদ পক্ষীকে পেয়ে বিনি। পয়সায় দুশো মজা লুটলো পথের মানুষ। তাদের মধ্যে আগাগোড়া প্রচ্ছন্নভাবে মিশে রইলো নবীনকুমার। দুলালের ধারণা, তার বাবুর মাথাটি বিগড়ে গেছে একেবারে। অতি অল্প বয়েস থেকেই সে নবীনকুমারের নানা প্রকার উৎকট বাতিকের সঙ্গে পরিচিত, যুবাবিয়েসে তার খামখেয়ালিপনা বেড়েছে বই কমেনি, সদাসর্বদা দুলাল ছায়ার মতন তার পশ্চাতে থেকে তাল সামলেছে। কিন্তু এখন এ কী অবস্থা, এর যে কোনো প্রকার মাথামুণ্ডু নেই। এ নিশ্চয়ই এক প্রকার গুপ্ত উন্মাদ-রোগ। এ বিষয়ে দুলাল আর পাঁচ জনের সঙ্গে পরামর্শ করারও সাহস পায় না। অন্তত গঙ্গানারায়ণকে একবার জানানো কর্তব্য, কিন্তু গঙ্গানারায়ণের সামনে এসেও দুলাল বলি বলি করেও কথাটি মুখ ফুটে বলতে পারে না। তার পশ্চাতে তার সম্পর্কে দুলাল কিছু আলোচনা করেছে, একথা নবীনকুমার জানতে পারলে চটে একেবারে আগুন হবে, এমন কি দুলালের গদোনও চলে যেতে পারে। নবীনকুমারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে এই নগরীর বড় মানুষদের সমাজ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে যথেষ্ট, বাইরের ঠাট-ঠমক ভেদ করে অনেকেরই ভেতরের আসল স্বরূপটি জানতে তার বাকি নেই। সেই সব মানুষদের তুলনায় তার মনিব নবীনকুমার সিংহকে সে অগাধ শ্রদ্ধা না করে পারে না। তবু, এতদিন পর দুলালের ইচ্ছে হয় তার মনিবকে ছেড়ে চলে যেতে। এতকাল নবীনকুমারের সংস্পর্শে থেকে তার চরিত্রের খানিকটা প্রভাব দুলালের ওপরেও পড়েছে।অন্যান্য সাধারণ মানুষদের তুলনায় তার মন অনেকখানি মুক্ত, ভূত-প্ৰেত কিংবা দেব-দ্বিজের প্রতি তার অহেতুক ভয় বা ভক্তি নেই। কোনোদিন পাঠশালা-বিদ্যালয়ে না গেলেও সে নিজের চেষ্টায় কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে। সে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করে এবং সুন্দর চিঠি লিখতে পারে। সিংহ-বাড়ির অনেকেই পত্র-রচনার প্রয়োজনে দুলালের শরণাপন্ন হয়। তার হস্তাক্ষর দেখে চমৎকৃত হয়ে নবীনকুমার একদিন বিশেষ তারিফ করেছিল। এবং যে-কমাস নবীনকুমার পরিদর্শক-এর সম্পাদক ছিল, তখন মধ্যে মধ্যে সে দুলালকে দিয়ে নিজের রচনা কপি করিয়েছে। দুলাল যেমন নবীনকুমারের সব হুকুম বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করে, সেইরকম নবীনকুমারও দুলালের প্রতি সর্বদা উদার হস্ত। কিছুদিন আগে সে দুলালের পুত্রের নামে একটি বেশ বড় বাড়ি লিখে
false
shirshendu
নিয়ে গিয়ে তোমাদের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসছি। তারপর আর আমার দায়িত্ব থাকবে না। দারোয়ান চা দিয়ে গেল। শ্রীনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তাতে হয়তো আপত্তি উঠবে না। কিন্তু আমি বাবার কথাটাই ভাবছি। কী ভাবছ? বাবার খুব কষ্ট হবে হয়তো। বাবার কষ্টের কথা যদি সত্যিই ভাবো তবে কষ্ট দিয়ো না। মুখের মতো জবাব পেয়ে শ্রীনাথ চুপ করে গেল। চা খেয়ে উঠল সোমনাথ। বলল, তা হলে ওই কথাটাই ফাইনাল। শ্রীনাথ উর্ধ্বমুখে ভাইয়ের মুখখানা দেখল। বাবাকে ও কেন রতনপুরে চালান করছে তার সত্যি কারণটা বুঝতে চেষ্টা করল। সম্ভবত সোমনাথ বাবাকে ওখানে পাঠিয়ে ক্ষীণ একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। নইলে মাসে তিনশো টাকার ফালতু আয় জলাঞ্জলি দিত না। সোমনাথ চলে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ কাজ করল শ্রীনাথ। যখন উঠল তখন সন্ধে সাতটা। খারাপ পাড়ায় যেতে হলে প্রথম প্রথম একটু বুকের জোর চাই। একা যেতে সাহসও হয় না। কিন্তু আশ্চর্য আশেপাশে বন্ধুবেশী আড়কাঠিরা ইচ্ছেটাকে ঠিক টের পেয়ে যায় এবং তারাই পৌঁছে দেয় মেয়েমানুষের ঘরে। শ্রীনাথেরও তাই হয়েছিল। যখন ফেবারিট কেবিনে আড্ডা মারত তখন কানাই বোস নামে একজন ঠিকাদারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সে খারাপ পাড়ায় যেত এবং সেইসব গল্পও করত খুলে মেলে। শ্রীনাথকে খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল সে-ই। তারপর থেকে অবশ্য আর বাধা হয়নি। যেতে যেতেই শ্রীনাথের অভিজ্ঞতা হয়েছে, কলকাতা শহরে নাম লেখানো এবং ন-লেখানো খারাপ মেয়ে অঢেল। আজকাল তার চোখ পাকা হয়েছে। রাস্তায় ঘাটে যে-কোনও মেয়েকে একনজর দেখলেই বুঝতে পারে, খারাপ না ভাল। তা ছাড়া যাতায়াতে বহু দালালের সঙ্গে চেনা হয়েছে। তারাও খোঁজ দেয়। বাবুল দস্তিদার নামে একজন বন্ধু গোছের দালাল কদিন আগে বলেছিল, শ্রীনাথবাবু, আপনি লো ক্লাসের মেয়েদের কাছে যান কেন? ওরা তো পান্তা ভাত। কোনও মজা নেই। যাদের রেস্ত আছে তারা নানারকম এনজয়মেন্ট করবে। শরীরের ব্যাপারটারও তো অনেক রকম স্টাইল আছে। বাবুল তাকে হাওড়া ময়দানের কাছে নমিতার খোঁজ দেয়। দেখে খারাপ মেয়ে মনে করা বেশ কঠিন। একদম আধুনিকা। ফটাফট ইংরেজি বলে, দারুণ সাজে, গিটার বাজায়, বি এ পাশ। রবি ঠাকুর থেকে বিষ্ণু দে পর্যন্ত কোটেশন দেয়। খরচ অনেক বেশি বটে, কিন্তু নমিতা কেবলমাত্র শরীরী তো নয়। সে শ্রীনাথের সঙ্গে বেড়ায়, রেস্টুরেন্টে খায়, সিনেমা-থিয়েটারও দেখে। সারাক্ষণ বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগ কথাই প্রেম-ভালবাসা ঘেঁষা। এমন সব কথা যা শ্রীনাথের বয়ঃসন্ধির যৌবনকে ফিরিয়ে আনে। নমিতার চোখের চাউনি, ঠোঁটের হাসি সব কিছুই অত্যন্ত উষ্ণ, নিবিড় এবং অনেকটাই যেন আন্তরিক। বিভ্রমই বটে, তবে বিভ্রমই তো মানুষ চায়। শ্রীনাথ তাই সম্প্রতি নমিতার খাতায় নাম লিখিয়েছে। জমানো টাকা হু-হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা যাক। জীবনে টাকা দিয়ে তো কিছু পাওয়া চাই। শ্রীনাথ মনে করে নমিতার কাছে সে কিছু পাচ্ছে। কৃত্রিম হলেও পাচ্ছে। নমিতার খদ্দেরের সংখ্যা বেশি নয়। দিন ও সময় বাঁধা থাকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া যাওয়া যায় না। এইটেই একমাত্র যা অসুবিধে। আজ শ্রীনাথের দিন নয়। তবু মনটা ভাল ছিল না বলে হাওড়ায় এসে গাড়ি ধরতে গিয়ে ধরল। বেরিয়ে বাসে উঠে ময়দানের কাছে নমিতার দোতলার ফ্ল্যাটে এসে উঠল। আশ্চর্য! নমিতা একা ফাঁকা ঘরে সেজেগুজে বসে আছে। তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে বলল, আজ একটা ছোটলোকের আসার কথা ছিল। দেখো তো, সারা বিকেলটা বসে বসে নষ্ট করলাম। তুমি এলে, কী ভাগ্যি! খুশি হয়েছ? সকলের বেলায় হই না। তুমি তো সকলের মতো নও! নই? নমিতা হেসে ফেলে বলে, বললে ভাববে তেল দিচ্ছি। তা কিন্তু নয়। সোফায় বসে শ্রীনাথ হাসিমুখে বলল, আমি কীরকম ৩ আজ তোমার মুখে শুনব। বলো তো। যাঃ।–লজ্জায় যেন লাল হল নমিতা। মুখ দু’ হাতে ঢেকে বলল, এভাবে বলা যায় কি? বোঝো না কেন? নমিতার দোভাঁজ করা বিনুনির সঙ্গে অনেকগুলো আলগা ফিতে বাঁধা! তাতে ভারী ছুকরি দেখাচ্ছে ওকে। কানে মস্ত রুপোর কানপাশা। হাতে রুপোর চুড়ি। একটু অবাঙালি সাজে আজ ওর আকর্ষণ তিনগুণ বেড়েছে। মায়া ও মতিভ্রমের দিকে অভাসবশে হাত বাড়াল শ্রীনাথ। কিন্তু তারপর শরীরে সেই খিতখিত ভাব। যেন অপবিত্রতা, অশৌচ। বাড়িতে ফিরে কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে গরম জল বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। স্নান করবে। এমন সময় দরজার বাইরে সজল এসে দাঁড়ায়। বাবা! এসো। শ্রীনাথ নরম স্বরে ডাকে। মনে মনে ভাবে সজলের সঙ্গে এই দেখা হওয়ার আগে স্নানটা সেরে নেওয়া উচিত ছিল। স্নান না করে যেন এই অবস্থায় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে নেই। কোথায় যেন আটকায়। সজল একটু যেন সংকোচের সঙ্গে ঘরে আসে। মুখে একটু লজ্জার হাসি। সজল দেখতে ভারী মিষ্টি। মুখখানা যেন নরুন দিয়ে চেঁচে তৈরি। শরীরের হাড়গুলো চওড়া। লম্বাটে গড়ন। বড় হলে ও খুব লম্বা চওড়া আর শক্তিমান পুরুষ হয়ে দাঁড়াবে। সজল ঘরে ঢুকে কৌতূহলভরে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখতে থাকে। হঠাৎ বলে, জল গরম করছ কেন বাবা? চা খাবে? ছোড়দিকে বলো না, করে দেবে। না, চা খাব না। তবে? চান করব। এত রাতে!–সজল অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। কী বড় বড় অন্তর্ভেদী চোখ। কিছুতেই শ্রীনাথ ওর চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল, পায়ে নোংরা লেগেছিল। বুকটা ঢিব ঢিব করে ওঠে শ্রীনাথের। হে ভগবান! আর যাই হোক ছেলের কাছে যেন কোনওদিন মুখ কালো না হয়। সজল বলে, তোমার শীত করবে না? শীত করবে বলেই তো গরম
false
toslima_nasrin
রান্নাঘরে ধুম পড়ে গেলে রান্নার। আমার ঘরটি ধুয়ে মুছে সাজিয়ে গুজিয়ে দেওয়া হল সম্মানীয় অতিথিকে। বাবা জানোয়ারি করা তো দূরের কথা, রীতিমত সৈয়দ হকের সঙ্গে স্যুট টাই পরে খেতে বসেছেন, বাড়িতে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করার অভ্যেসকে মাচায় তুলে রেখে দুদিন তিনি মানুষের মত আচরণ করেছেন। দ্বিতীয়বার অবকাশে তাঁর আর থাকা হয়নি, কারণ হচ্ছে ছোটদা। সৈয়দ হকের পদধূলি অবকাশে পড়ার পর যে ধন্য ধন্য ভাব ছিল বাড়ির সবার মধ্যে, একদিন ছোটদা সেই ধন্যভাবের দুধে পাঁচ ফোটা চোনা ছিটিয়ে দিলেন। বলে গেলেন ‘সারা ঢাকা শহর জানে হকুর কীর্তিকলাপ, মেয়েমানুষ লইয়া ফুর্তি করার ওস্তাদ এই হকু। লুইচ্চা।’ ব্যস, সৈয়দ হক নিষিদ্ধ অবকাশে, নিষিদ্ধ বলে তিনি যে ময়মনসিংহে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তা নয়, এসেছেন, সার্কিস হাউজের অতিথিভবনে থেকেছেন। তিনি, সারা দেশই, বলেছেন, ঘুরে বেড়ান। ঘুরে বেড়ালে অভিজ্ঞতা বাড়ে। মানুষ দেখতে হয়, মানুষ। মানুষের চেয়ে চমৎকার কিছু আর জগতে নেই। মানুষ কী করে কথা বলে, কী করে হাসে, কী করে লজ্জা পায়, কী করে ভয় — সবই হচ্ছে দেখার বিষয়। সৈয়দ হকের প্রায় পদতলে বসে আমি হাঁ হয়ে শুনে গেছি তাঁর দর্শন। ঢাকায় নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতেও তিনি এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, ছোটদা সামান্য সৌজন্যও দেখাননি। ছোটদার ওপর রাগও হয়েছিল আমার বিষম। সারা ঢাকা শহর জানে বলে তিনি যে মন্তব্যটি করেছেন, তা তাঁর নিজের নয়, অন্য একজনের, যে অন্যটি বিমানের কোনও কর্মচারি অথবা কোনও ভুতপূর্ব চিত্রালী-লেখক। সারা ঢাকা শহর জানে এই কথার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ লোক, সাহিত্য জগতে যাদের পদচারণা নেই, সৈয়দ হককে চেনেই না, সাহিত্যজগতে যাদের আছে, তাদের বেশির ভাগই সৈয়দ হককে শ্রদ্ধা করেন। যাই হোক, দুধচোনাটিকে বিশুদ্ধ দুধ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবকাশে সৈয়দ হক নিষিদ্ধ হয়েই রইলেন, নিষিদ্ধ হয়েছিলেন বলে তাঁর প্রতি পক্ষপাত আমার বেশি ছিল। তিনি ডাকলেই আমি দেখা করতে গিয়েছি, সে সার্কিট হাউজে হোক, রেস্তোরাঁয় হোক, ঘুরে বেড়াতে মুক্তাগাছা হোক। কুদ্দুস বয়াতির ওপর তথ্যচিত্র বানাতে যখন তিনি নদীর পাড়ে ব্যস্ত, সেখানেও তাঁর ডাক পেয়ে ছুটে গিয়েছি। সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। একজন বড় লেখকের, মাঝে মাঝে কবিতা টবিতা লেখার অভ্যেস আছে এমন সাহিত্য অনুরাগী ছেলে মেয়েদের প্রতি যে সহমর্মিতা থাকে, আমার প্রতি তা-ই ছিল তাঁর। সেটি ক্রমে ক্রমে বাক্তিগত হয়ে উঠল, বিশেষ করে তিনি যখন রুদ্রর সঙ্গে কেন আমি বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইছি তার কারণটি জানতে চেয়েছিলেন এবং সে কারণে ময়মনসিংহ অবদি এসেছিলেন। সাহিত্যিক বা অসাহিত্যিক যে কথাই হত তাঁর এবং আমার মধ্যে, মূল বক্তা ছিলেন তিনিই। তাঁকেই বক্তা হিসেবে মানায়। ইয়াসমিনকেও তিনি ‘এই কি করছিস কেমন আছিস, কাছে আয় তো, বোস এখানে’ বলে লজ্জায় লাল হয়ে থাকা ইয়াসমিনকে কাছে বসিয়ে রাজ্যির গল্প শোনাতেন। উপদেশও দিতেন। উপদেশ আমাকেও দিতেন, কি করে কবিতা লিখতে হয়, কি করে ছন্দের জন্য শব্দ না গুনে কানকে সজাগ রাখতে হয় বলতেন। মন দিয়ে আমার সব কবিতাই তিনি পড়েছেন, প্রায় প্রতিটি কবিতা নিয়ে কিছু না কিছু বলেছেন, কোনটি ভাল হয়েছে, কোনটি কী হলে ভাল হত, কোন শব্দটি না বসিয়ে কোন শব্দটি বসালে বেশ শোনাতো — এসবে তাঁর কোনওরকম কৃত্রিমতা ছিল না। ইয়াসমিনের হঠাৎ অবকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে আমি যেমন ভেঙে পড়েছিলাম, সৈয়দ হকও তেমন। সৈয়দ হক আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে কাঁদলেন হাউ মাউ করে, কাঁদলেন ইয়াসমিনের জন্য। পরে ইয়াসমিনের নতুন বাড়িতে তিনি বেশ কবার গেছেন নেমন্তন্ন খেতে। একবার, আমি তখন ঢাকায়, তিনি তাঁর অল্প বয়সী এক প্রেমিকাকে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেখতে গেলেন। সারাদিন ইয়াসমিনের ঘরে মেয়েটির সঙ্গে খুনসুঁটিতে মেতে ছিলেন। জড়িয়ে ধরা, চুমু টুমু সবই চলেছে। নতুন বাড়িতে ইয়াসমিনের অস্বস্তির শেষ নেই, ওর বয়স্ক অতিথি একটি বাচ্চা মেয়ে নিয়ে খালি ঘরে কী করছে বাড়ির অনেকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল ওর দিকে। এই মেয়েটিকে আমি আর ইয়াসমিন দুজনই দেখেছিলাম সৈয়দ হকের অনুবাদে টেম্পেস্ট নাটক যেদিন হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসেছিলাম, পেছনের আসনে সৈয়দ হক। পেছন ফিরে ক’বার দেখেছি তাঁর চোখ নাটকে নয়, চোখ মেয়েটিতে। এই মেয়েটি পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করতে নিয়েছিল এমনই গভীর ছিল তার ব্যক্তিগত শোক, সেই শোক থেকে তিনি তাকে উঠিয়ে এনে জীবনের এক দ্যূতিময় রূপ দেখিয়েছেন, মেয়েটির ভেতর সঞ্জীবিত করেছেন ভালবাসার বোধ — তিনি আমাকে বলেছেন সব। কখনও সৈয়দ হক অবিকল বাবার মত, ভাল ভাল উপদেশ বর্ষণ করছেন, কখনও বড় ভাইয়ের মত আগলে আগলে রাখছেন, কখনও সমবয়সী বন্ধুর মত সরস কথাবার্তা বলছেন, কখনও আবার তাঁর দুটো চোখে হঠাৎ ঝলসে ওঠে নেকড়ের নীল হাসি। মাঝে মাঝে মনে হয় ঝলসে উঠছে, আবার কখনও মনে হয় না উঠছে না। রাঙামাটি আর কাপ্তাই এ এক ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে করার সময় তাঁর ভেতরের বাবর আলীটি জেগে উঠেছিল, আরেক বার মনে হয় না জেগে ওঠেনি। ঘনিষ্ঠতার শুরু থেকে সৈয়দ হক আমাকে দোদুল দোলায় দুলিয়েছেন। রুদ্রকে কেন আমি আমি ত্যাগ করতে চাই তা জেনে আমার বেদনার্ত মনে তাঁর সমবেদনা বুলোতে তিনি যখন আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন ময়মনসিংহের এক রেস্তোরাঁয় খেতে বসে, ঠিক ব্রার হুকের ওপর হাতটি পড়েছিল তাঁর, পিঠ আমার ধনুকের মত বেঁকে গেছে মুহূর্তে,
false
shirshendu
এসেছিল না, সে কিন্তু খুব সুন্দর! কোন রোগা মেয়েটা? ঝুমকি গো! হেমাঙ্গ একটা বিষম খেল। তারপর বলল, ওঃ, তাকে বুঝি তুই খুব সুন্দর দেখিস? সুন্দর নয়? হেমাঙ্গ ভাতটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, তাতে আমার কী? ওকে তোমার পছন্দ নয়? পছন্দ করে কী করব রে? সে তো আর আমাকে পছন্দ করেনি। কী করে বুঝলে? ওসব বুঝতে কি দেরি হয় রে। তার বুঝি কেউ আছে? থাকতেই পারে। আমার মনে খুব ইচ্ছে, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক। রশ্মিও খুব ভাল ছিল, কিন্তু বড্ড মেমসাহেবের মতো দেখতে। তাকে বুঝি তোর পছন্দ ছিল না? ছিল। তবে কেমন যেন একটু বিলিতি গন্ধ। এ মেয়েটা কেমন আটপৌরে। হেমাঙ্গ হেসে বলে, আটপৌরে মানে জানিস? ওই কথার কথা একটা। খাওয়া সেরে একটু উঠোনের রোদে চেয়ার পেতে বসে থাকে হেমাঙ্গ। বাসন্তী চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরে অবধিও তার কথাটা কানে বাজতে থাকে। হেমাঙ্গর। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাত্র। চেয়ারে বসেই ভাতম্বুমে কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। হিজিবিজি স্বপ্ন দেখছিল। তাদের বিডন স্ট্রিটের বাড়ির পাশেই নুটুবাবু বলে একজন থিয়েটারের লোক থাকে। পাড়ার লোকে বলে, নুটুবাবু নাকি মেয়ের দালাল। স্বপ্ন দেখল, সেই নুটুবাবু বিয়ে করে ফিরেছেন। সঙ্গে নতুন বউ নিয়ে গাড়ি থেকে নামছেন। হেমাঙ্গ দেখল। নতমুখী বউটি ঝুমকি। হেমাঙ্গ চেঁচাতে লাগল, ঝুমকি! পালিয়ে যান, এ লোকটা ভাল নয়! ঝুমকি তার দিকে চেয়ে একটু হাসল। কে জানে কেন স্বপ্ন দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল তার। পরদিন সারাক্ষণ মনটা বিগড়েই রইল। একটুও ভাল লাগল না। বিকেলের দিকে কলকাতা রওনা হল সে। সোমবার অফিস করে হঠাৎ অনেকদিন বাদে সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে এল চারুশীলার বাড়ি। যাক বাবা, এতদিনে আমাকে মনে পড়ল? দাঁড়া শাখ-টাখ বাজাই। হেমাঙ্গ একটু হাসল, গরিবদের কথা ভাবিস তা হলে? তুই গরিবদের চেয়েও খারাপ। তুই একটা ইডিয়ট। তাও বটে, এখন ভাল-মন্দ কিছু খাওয়া তো! কেন, ভালমন্দ খাওয়ানোর জন্য আমি কেন? বিয়ে করে বউ আনি, সে খাওয়াবে। বউরা কি ভালমন্দ খাওয়ায়? ওরা তো আটপৌরে। ইস, কথা শিখেছে! আটপৌরে! হ্যাঁ রে, ঝুমকি কোথায় বল তো! লোকটা বিনীতভাবে নমস্কার করে বলল, আপনি এই গ্রামের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, আমরা তার কী প্রতিদান দিতে পারি? কত সামান্য আমরা। এই গ্রামের কোনও গৌরব কখনও ছিল না। আপনার সুবাদে আজ আমরা বলে বেড়াই এ হল কৃষ্ণজীবন বিশ্বাসের গ্রাম। কৃষ্ণজীবন অত্যন্ত অরন্তি বোধ করে বলল, গৌরব। গৌরবের কি আছে? আমি সামান্যই করতে পেরেছি। কত কী পারিনি। আপনার কৃতিত্ব কতখানি তার পরিমাপ করার মতো শিক্ষাও তো এ গায়ের মানুষদের নেই। তারা শুধু জানে, কৃষ্ণজীবন বিশ্বাস এখন মস্ত মানুষ। তবে আমি আপনার বইখানা পড়েছি। মন্ত্ৰমুগ্ধ করে রাখে, মনটা যেন কেমন হয়ে যায়। অদ্ভুত আপনার ভাষা, তেমনি পর্যবেক্ষণ। কৃষ্ণজীবন খুশি হয়ে বলল, আমার বই আপনি কোথায় পেলেন? এ দেশে তো বিশেষ পাওয়া যায় বলে শুনিনি। লোকটি অমায়িক হেসে বলে, পেপারব্যাক এডিশন বেরোলে হয়তো আসবে। এখনও আসেনি। তবে আমার এক ভাগ্নী নিউ জার্সিতে থাকে। তাকে আপনার বইটির কথা লিখেছিলাম। সে নিয়ে এসেছিল। একটা তৃপ্তির শ্বাস ছাড়ল কৃষ্ণজীবন। সে খ্যাতি চায় না, প্রচুর টাকাও করতে চায় না, সে চায় তার কথা লোকে শুনুক, বুঝুঁক। সে তো এই পৃথিবীর মঙ্গল চায়, মানুষের জন্য চাষ একটি সবুজ দূষণমুক্ত পৃথিবী। সে চায় দোলনের নিরাপদ বড় হওয়া। ভাবীকালের মানুষেরা যেন তাদের অভিশাপ না দেয়। লোকটি বলল, আপনার বাবাকে গত তিন দিন ধরে আমি বইয়ের বিভিন্ন অংশ অনুবাদ করে শুনিয়েছি। উনি খুব খুশি হয়েছেন। কৃষ্ণজীবন আবেগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। বাবাকে যে এ বইটির কিছু অংশ শোনানো দরকার এটাই তার মনে হয়নি। সে গাঢ় কণ্ঠে বলল, বড় ভাল করেছেন। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো। কী যে বলেন। এই বইটির কথা আমি অনেককে বলেছি। কিন্তু গ্রামের লোক তো ইংরিজি পড়তে পারে না। আপনি বরং এর একটা বাংলা ভাষ্য বের করুন। কৃষ্ণজীবন ম্লান হেসে বলে, বাংলা এডিশন বেরোলেও গ্রামের লোক পড়বে না। প্রথমত, তাদের বই পড়ার অভ্যাস নেই, দ্বিতীয় তাদের বই কেনার মতো সামর্থ্য নেই। লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কথা। তবু বলি, ধীরে ধীরে এই বইয়ের কদর বাংলাতেও হবে। আমাদের গ্রামগুলোতে সভ্যতার কোনও খবরই পৌঁছতে চায় না। বড় পিছিয়ে আছে সব কিছু। তবু যদি লাইব্রেরিতে এক-আধ কপি করে রাখা হয় তা হলে এক-আধজনও তো পড়বে। কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, আপনি এই বইয়ের প্রচার নিয়ে ভাববেন না। এ দেশের লোক আজ পর্যন্ত কারও কোনও শিক্ষাই নেয়নি। আমারটাও নেবে না। ভাল কথা শোনে, বুঝতেও পারে, কিন্তু কাজের সময় পাশ কাটিয়ে যায়। লোকটি বিনীত হেসে বলে, তবু কি হাল ছাড়লে চলবে? কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার প্ল্যান কী ছিল জানেন? গান, যাত্রা, নাটক কবিগানের ভিতর দিয়ে এ সব মানুষকে শেখাবো। গাছ কেটো না, পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখে। কিন্তু পরে হাল ছেড়েছি। দেখলাম এরা এন্টারটেনমেন্টটা নেয়, শিক্ষাটা সাবধানে মাছের কাঁটার মতো বেছে ফেলে দেয়। লোকটি এ কথায় যেন একটু চিন্তিত হয়ে কৃষ্ণজীবনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মাত্র কয়েকদিন আগে লোকটির। সঙ্গে পরিচয়। পটলের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। বছর দুই আগে চাকরি নিয়ে এসেছে। একটু আত্মভোলা, পড়ুয়া ধরনের মানুষ। আশ্চর্যের বিষয় এঁর লেখাপড়া এবং জ্ঞান বেশ বিস্ময়কর।
false
shorotchandra
আকস্মিক পরিবর্তনে। একটু বিস্মিত হইয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হয়েচে? তিনি ক্ষণকাল একদৃষ্টে আমার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন, তার পরে ধরা-গলায় বলিয়া উঠিলেন, হবার আর কি বাকি রইল বাবু? শুনলাম, কাল নাকি ঠাকুরপো হাটের মধ্যে নিজের হাতে বেগুন বেচতেছিলেন। কথাটা ঠিক বিশ্বাস হইল না, এবং মন ভাল থাকিলে হয়ত হাসিয়াই ফেলিতাম। কহিলাম, অধ্যাপক মানুষ তিনি হঠাৎ বেগুনই বা পেলেন কোথায়, আর বেচতেই বা গেলেন কেন? কুশারীগৃহিণী বলিলেন, ওই হতভাগীর জ্বালায়। বাড়ির মধ্যেই নাকি গোটাকয়েক গাছে বেগুন ফলেছিল, তাই পাঠিয়ে দিয়েছিল হাটে বেচতে—এমন করে শত্রুতা করলে আমরা গাঁয়ে বাস করি কি করে? বলিলাম, কিন্তু একে শত্রুতা করা বলচেন কেন? তাঁরা ত আপনাদের কিছুর মধ্যেই নেই। অভাব হয়েছে, নিজের জিনিস বিক্রি করতে গেছেন, তাতে আপনার নালিশ কি? আমার জবাব শুনিয়া কুশারীগৃহিণী বিহ্বলের মত চাহিয়া থাকিয়া শেষে কহিলেন, এই বিচারই যদি করেন, তাহলে আমার বলবার আর কিছু নেই, মনিবের কাছে নালিশ জানাবারও কিছু নেই—আমি উঠলাম। শেষের দিকে তাঁহার গলা একেবারে ধরিয়া গেল দেখিয়া ধীরে ধীরে কহিলাম, দেখুন, এর চেয়ে বরঞ্চ আপনার মনিব-ঠাকরুনকে জানাবেন, তিনি হয়ত সকল কথা বুঝতেও পারবেন, আপনার উপকার করতেও পারবেন। তিনি মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিলেন, আর আমি কাউকে বলতেও চাইনে, আমার উপকার করেও কারও কাজ নেই। এই বলিয়া তিনি সহসা অঞ্চলে চোখ মুছিয়া বলিলেন, আগে আগে কর্তা বলতেন, দু’মাস যাক, আপনিই ফিরে আসবে। তারপরে সাহস দিতেন, থাকো না আরও মাস-দুই চেপে, সব শুধরে যাবে—কিন্তু এমনি করে মিথ্যে আশায় আশায় প্রায় বছর ঘুরে গেল। কিন্তু কাল যখন শুনলাম সে উঠানের দুটো বেগুন পর্যন্ত বেচতে পেরেচে, তখন কারও কথায় আর আমার কোন ভরসা নেই। হতভাগী সমস্ত সংসার ছারখার করে দেবে, কিন্তু ও-বাড়িতে আর পা দেবে না। বাবু, মেয়েমানুষে যে এমন শক্ত পাষাণ হতে পারে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তিনি কহিতে লাগিলেন, কর্তা ওকে কোনদিন চিনতে পারেন নি, কিন্তু আমি চিনেছিলাম। প্রথম প্রথম এর-ওর-তার নাম করে লুকিয়ে লুকিয়ে জিনিসপত্র পাঠাতাম; উনি বলতেন, সুনন্দা জেনেশুনেই নেয়—কিন্তু অমন করলে তাদের চৈতন্য হবে না। আমিও ভাবতাম, হবেও বা! কিন্তু একদিন সব ভুল ভেঙ্গে গেল। কি করে সে জানতে পারে, যতদিন যা-কিছু দিয়েচি, একটা লোকের মাথায় সমস্ত টান মেরে আমাদের উঠানের মাঝখানে ফেলে দিয়ে গেল। তাতে কর্তার তবুও চৈতন্য হ’ল না—হ’ল আমার। এতক্ষণে আমি তাঁর মনের কথাটা ঠিক বুঝিতে পারিলাম। সদয়কণ্ঠে কহিলাম, এখন আপনি কি করতে চান? আচ্ছা, তাঁরা কি আপনাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বা কোনপ্রকার শত্রুতা করবার চেষ্টা করেন? কুশারীগৃহিণী আর একদফা কাঁদিয়া ফেলিয়া কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, পোড়াকপাল, তা হলে ত একটা উপায় হ’ত। সে আমাদের এমনি ত্যাগ করেচে যে, কোনদিন যেন আমাদের চোখেও দেখেনি, নামও শোনেনি, এমনি কঠিন, এমনি পাষাণ মেয়ে! আমাদের দু’জনকে সুনন্দা তার বাপ-মায়ের বেশি ভালবাসত; কিন্তু যেদিন থেকে শুনেচে তার ভাশুরের বিষয় পাপের বিষয়, সেই দিন থেকে তার সমস্ত মন যেন একেবারে পাথর হয়ে গেছে। স্বামী-পুত্র নিয়ে সে দিনের পর দিন শুকিয়ে মরবে, তবু এর কড়াক্রান্তি ছোঁবে না। কিন্তু এতবড় সম্পত্তি কি আমরা ফেলে দিতে পারি বাবু? সে যেমন দয়ামায়াহীন—ছেলেপুলে নিয়ে না খেয়ে মরতেও পারে, কিন্তু আমরা ত তা পারিনে। কি জবাব দিব ভাবিয়া পাইলাম না, শুধু আস্তে আস্তে কহিলাম, আশ্চর্য মেয়েমানুষ! বেলা পড়িয়া আসিতেছিল, কুশারীগৃহিণী নীরবে কেবল ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু হঠাৎ দুই হাত জোড় করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, সত্যি বলচি বাবু, এদের মাঝে পড়ে আমার বুকখানা যেন ফেটে যেতে চায়। কিন্তু শুনতে পাই আজকাল সে মার নাকি বড় বাধ্য—কোন একটা উপায় হয় না? আমি যে আর সইতে পারিনে। আমি চুপ করিয়া রহিলাম। তিনিও আর কিছু বলিতে পারিলেন না—তেমনি অশ্রু মুছিতে মুছিতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেলেন। দশ মানুষের পরকালের চিন্তার মধ্যে নাকি পরের চিন্তার ঠাঁই নাই, না হইলে আমার খাওয়া-পরার চিন্তা রাজলক্ষ্মী পরিত্যাগ করিতে পারে এত বড় বিস্ময় সংসারে আর কি আছে? এই গঙ্গামাটিতে আমরা কতদিনই বা আসিয়াছি, এই ক’টা দিনের মধ্যেই হঠাৎ সে কতদূরেই না সরিয়া গেল! আমার খাবার কথা জিজ্ঞেসা করিতে আসে এখন বামুনঠাকুর, আমাকে খাওয়াইতে বসে রতন। একপক্ষে বাঁচিয়াছি, সে দুর্লঙ্ঘ্য পীড়াপীড়ি আর নাই। রোগা শরীরে এগারোটার মধ্যে না খাইলে এখন আর অসুখ করে না। এখন যেমন ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা খাই। শুধু রতনের পুনঃপুনঃ উত্তেজনায় ও বামুনঠাকুরের সখেদ আত্মর্ভৎসনায় স্বল্পাহারের বড় সুযোগ পাই না—সে বেচারা ম্লানমুখে কেবলি মনে করিতে থাকে, তাহারই রান্নার দোষে আমার খাওয়া হইল না। কোনমতে ইহাদের সন্তুষ্ট করিয়া বিছানায় গিয়া বসি। সম্মুখের সেই খোলা জানালা, আর সেই ঊষর প্রান্তরের তীব্র তপ্ত হাওয়া। মধ্যাহ্নের দীর্ঘ দিনমান কেবলমাত্র এই ছায়াহীন শুষ্কতার প্রতি চাহিয়া চাহিয়া যখন আর কাটিতে চাহিত না, তখন একটা প্রশ্ন সবচেয়ে আমার বেশি মনে পড়িত—সে আমাদের সম্বন্ধের কথাটা। ভাল আমাকে সে আজও বাসে, ইহলোকে আমিই তার একান্ত আপনার, কিন্তু লোকান্তরে তার কাছে আমি তত বড়ই পর। তাহার ধর্মজীবনের আমি যে সঙ্গী নই, সেখানে আমাকে দাবি করিবার যে তাহার কোন দলিল নাই, হিন্দুঘরের মেয়ে হইয়া একথা সে ভুলে নাই। এই পৃথিবীটাই শুধু নয়, ইহারও অতীত যে স্থানটা আছে, পাথেয় তাহার শুধু আমাকে কেবল ভালবাসিয়াই অর্জন করা যাইবে না, এ-সংশয় বোধ করি খুব বড় করিয়াই তাহার
false
bongkim
সাহায্য করিতে হইবে? কাহার আনুগত্য করিতে হইবে? মানসিংহের। গুরুদেব! এ দেহ বর্তমানে এ কার্য বীরেন্দ্রসিংহ হইতে হইবে না।” অভিরাম স্বামী বিষণ্ণ হইয়া নীরব হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি পাঠানের সহায়তা করা তোমার শ্রেয়ঃ হইল?” বীরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “পক্ষাপক্ষ প্রভেদ করা কি শ্রেয়ঃ।” অ। হাঁ, পক্ষাপক্ষ প্রভেদ করা শ্রেয়ঃ। বী। তবে আমার পাঠান-সহকারী হওয়া শ্রেয়ঃ। অভিরাম স্বামী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া পুনরায় নীরব হইলেন; চক্ষে তাঁহার বারিবিন্দু উপস্থিত হইল। দেখিয়া বীরেন্দ্রসিংহ যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “গুরো! ক্ষমা করুন; আমি না জানিয়া কি অপরাধ করিলাম আজ্ঞা করুন।” অভিরাম স্বামী উত্তরীয় বস্ত্রে চক্ষু পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, “শ্রবণ কর, আমি কয়েক দিবস পর্যন্ত জ্যোতিষী-গণনায় নিযুক্ত আছি, তোমা অপেক্ষা তোমার কন্যা আমার স্নেহের পাত্রী, ইহা তুমি অবগত আছ; স্বভাবতঃ তৎসম্বন্ধেই বহুবিধ গণনা করিলাম।” বীরেন্দ্রসিংহের মুখ বিশুষ্ক হইল; আগ্রহ সহকারে পরমহংসকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গণনায় কি দেখিলেন?” পরমহংস কহিলেন, “দেখিলাম যে মোগল সেনাপতি হইতে তিলোত্তমার মহৎ অমঙ্গল।” বীরেন্দ্রসিংহের মুখ কৃষ্ণবর্ণ হইল। অভিরাম স্বামী কহিতে লাগিলেন, “মোগলেরা বিপক্ষ হইলেই তৎকর্তৃক তিলোত্তমার অমঙ্গল সম্ভবে; স্বপক্ষ হইলে সম্ভবে না, এজন্যই আমি তোমাকে মোগল পক্ষে প্রবৃত্তি লওয়াইতেছিলাম। এই কথা ব্যক্ত করিয়া তোমাকে মনঃপীড়া দিতে আমার ইচ্ছা ছিল না; মনুষ্যযত্ন বিফল; বুঝি ললাটলিপি অবশ্য ঘটিবে, নহিলে তুমি এত স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইবে কেন?” বীরেন্দ্রসিংহ মৌন হইয়া থাকিলেন। অভিরাম স্বামী কহিলেন, “বীরেন্দ্র, দ্বারে কতলু খাঁর দূত দণ্ডায়মান; আমি তাহাকে দেখিয়াই তোমার নিকট আসিয়াছি, আমার নিষেধক্রমেই দৌবারিকেরা এ পর্যন্ত তাহাকে তোমার সম্মুখে আসিতে দেয় নাই। এক্ষণে আমার বক্তব্য সমাপন হইয়াছে, দূতকে আহ্বান করিয়া উচিত প্রত্যুত্তর দাও|” বীরেন্দ্রসিংহ নিশ্বাসসহকারে মস্তকোত্তলন করিয়া কহিলেন, “গুরুদেব! যতদিন তিলোত্তমাকে না দেখিয়াছিলাম, ততদিন কন্যা বলিয়া তাহাকে স্মরণও করিতাম না; এক্ষণে তিলোত্তমা ব্যতীত আর আমার সংসারে কেহই নাই; আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করিলাম; অদ্যাবধি ভূতপূর্ব বিসর্জন দিলাম; মানসিংহের অনুগামী হইব; দৌবারিক দূতকে আনয়ন করুক।” আজ্ঞাতে দৌবারিক দূতকে আনয়ন করিল। দূত কতলু খাঁর পত্র প্রদান করিল। পত্রের মর্ম এই যে, বীরেন্দ্রসিংহ এক সহস্র অশ্বারোহী সেনা আর পঞ্চ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাঠানশিবিরে প্রেরণ করুন, নচেৎ কতলু খাঁ বিংশতি সহস্র সেনা গড় মান্দারণে প্রেরণ করিবেন। বীরেন্দ্রসিংহ পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, “দূত! তোমার প্রভুকে কহিও, তিনিই সেনা প্রেরণ করুন।” দূত নতশির হইয়া প্রস্থান করিল। সকল কথা অন্তরালে থাকিয়া বিমলা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিলেন। সপ্তম পরিচ্ছেদ : অসাবধানতা দুর্গের যে ভাগে দুর্গমূল বিধৌত করিয়া আমোদর নদী কলকল রবে প্রবহণ করে, সেই অংশে এক কক্ষবাতায়নে বসিয়া তিলোত্তমা নদীজলাবর্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত, পশ্চিমগগনে অস্তাচলগত দিনমণির ম্লান কিরণে যে সকল মেঘ কাঞ্চনকান্তি ধারণ করিয়াছিল, তৎসহিত নীলাম্বরপ্রতিবিম্ব স্রোতস্বতীজলমধ্যে কম্পিত হইতেছিল; নদীপারস্থিত উচ্চ অট্টালিকা এবং দীর্ঘ তরুবর সকল বিমলাকাশপটে চিত্রবৎ দেখাইতেছিল; দুর্গমধ্যে ময়ূর সারসাদি কলনাদী পক্ষিগণ প্রফুল্লচিত্তে রব করিতেছিল; কোথাও রজনীর উদয়ে নীড়ান্বেষণে ব্যস্ত বিহঙ্গম নীলাম্বর-তলে বিনা শব্দে উড়িতেছিল; আম্রকানন দোলাইয়া আমোদর-স্পর্শ-শীতল নৈদাঘ বায়ু তিলোত্তমার অলককুন্তল অথবা অংসারূঢ় চারুবাস কম্পিত করিতেছিল। তিলোত্তমা সুন্দরী। পাঠক! কখন কিশোর বয়সে কোন স্থিরা, ধীরা, কোমল-প্রকৃতি কিশোরীর নবসঞ্চারিত লাবণ্য প্রেমচক্ষুতে দেখিয়াছেন? একবার মাত্র দেখিয়া চিরজীবন মধ্যে যাহার মাধুর্য বিস্মৃত হইতে পারেন নাই; কৈশোরে, যৌবনে, প্রগলভর বয়সে, কার্যে, বিশ্রামে, জাগ্রতে, নিদ্রায়, পুন:পুন: যে মনোমোহিনী মূর্তি স্মরণ-পথে স্বপ্নবৎ যাতায়াত করে, অথচ তৎসম্বন্ধে কখনও চিত্তমালিন্যজনক লালসা জন্মায় না, এমন তরুণী দেখিয়াছেন? যদি দেখিয়া থাকেন, তবেই তিলোত্তমার অবয়ব মনোমধ্যে স্বরূপ অনুভূত করিতে পারিবেন। যে মূর্তি সৌন্দর্যপ্রভাপ্রাচুর্যে মন প্রদীপ্ত করে, যে মূর্তি কোমলতা, মাধুর্যাদি গুণে চিত্তের সন্তুষ্টি জন্মায়, এ সেই মূর্তি। যে মূর্তি সন্ধ্যাসমীরণ-কম্পিতা বসন্তলতার ন্যায় স্মৃতিমধ্যে দুলিতে থাকে, এ সেই মূর্তি। তিলোত্তমার বয়স ষোড়শ বৎসর, সুতরাং তাঁহার দেহায়তন প্রগলভ।বয়সী রমণীদিগের ন্যায় অদ্যাপি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় নাই। দেহায়তনে ও মুখাবয়বে কিঞ্চিৎ বালিকাভাব ছিল। সুগঠিত সুগোল ললাট, অপ্রশস্ত নহে, অথচ অতিপ্রশস্তও নহে, নিশীথ-কৌমুদীদীপ্ত নদীর ন্যায় প্রশান্তভাব-প্রকাশক; তৎপার্শ্বে অতি নিবিড়-বর্ণ কুঞ্চিতালক কেশসকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংসে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগের অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে; ললাটতলে ভ্রূযুগ সুবঙ্কিম, নিবিড় বর্ণ, চিত্রকরলিখিতবৎ হইয়াও কিঞ্চিৎ অধিক সূক্ষ্মাকার; আর এক সূতা স্থূল হইলে নির্দোষ হইত। পাঠক কি চঞ্চল চক্ষু ভালবাস? তবে তিলোত্তমা তোমার মনোরঞ্জিনী হইতে পারিবে না। তিলোত্তমার চক্ষু অতি শান্ত; তাহাতে “বিদ্যুদ্দামস্ফুরণচকিত” কটাক্ষ নিক্ষেপ হইত না। চক্ষু দুটি অতি প্রশস্ত, অতি সুঠাম, অতি শান্তজ্যোতি:। আর চক্ষুর বর্ণ, ঊষাকালে সূর্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্বে, চন্দ্রাস্তের সময়ে আকাশের যে কোমল নীলবর্ণ প্রকাশ পায়, সেইরূপ; সেই প্রশস্ত পরিষ্কার চক্ষে যখন তিলোত্তমা দৃষ্টি করিতেন, তখন তাহাতে কিছুমাত্র কুটিলতা থাকিত না; তিলোত্তমা অপাঙ্গে অর্ধদৃষ্টি করিতে জানিতেন না, দৃষ্টিতে কেবল স্পষ্টতা আর সরলতা; দৃষ্টির সরলতাও বটে; মনের সরলতাও বটে; তবে যদি তাঁহার পানে কেহ চাহিয়া দেখিত, তবে তৎক্ষণাৎ কোমল পল্লব দুখানি পড়িয়া যাইত; তিলোত্তমা তখন ধরাতল ভিন্ন অন্যত্র দৃষ্টি করিতেন না। ওষ্ঠাধর দুখানি গোলাবী, রসে টলমল করিত; ছোট ছোট, একটু ঘুরান, একটু ফুলান, একটু হাসি হাসি; সে ওষ্ঠাধারে যদি একবার হাসি দেখিতে হবে তবে যোগী হও, মুনি হও, যুবা হও, বৃদ্ধ হও, আর ভুলিতে পারিতে না। অথচ সে হাসিতে সরলতা ও বালিকাভাব ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। তিলোত্তমার শরীর সুগঠন হইয়াও পূর্ণায়ত ছিল না; বয়সের নবীনতা প্রযুক্তই হউক বা শরীরের স্বাভাবিক গঠনের জন্যই হউক, এই সুন্দর দেহে ক্ষীণতা ব্যতীত স্থূলতাগুণ ছিল না। অথচ তন্বীর
false
toslima_nasrin
জানে সে ব্যাপারটি জোবায়েদ হোসেনের মস্তি−স্কর স্মরণ-কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরীক্ষার সময় এই স্মরণ কোষে কোনওরকম টোকা যদি পড়ে। ভাল পড়াশোনা করলেই যে ডাক্তারি পাশ করা যায় তা নয়। শিক্ষকদের করুণা না জুটলে সব গেল। এক্সটারনালদের কবল থেকে বাঁচার জন্য ইন্টারনালদের ওপর ভরসা করতেই হয়, ইন্টারনালদের শ্যেন নজরে পড়লে এক্সাটারনাল আর ইন্টারনাল এই দুকবলে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বাবা এ কলেজের অধ্যাপক বলে যে এনায়েত কবির আর জোবায়েদ হোসেনের মত হিংস্র বাঘের কবল থেকে রক্ষা পাবো, তা মনে করার কোনও কারণ নেই। এ কথা বাবাও বলে দিয়েছেন। যত ছাত্র ছাত্রী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার হয়ে বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারে না, কারণ এই শেষ পরীক্ষাতেই দূর্ঘটনাটি ঘটে। আমার সঙ্গেই ক্লাস করছে আমার চেয়ে দুবছর তিনবছর এমনকি পাঁচ ছ বছর আগে আটকে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীরা। ওদের মলিন মখু দেখে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবি, এরকমই কি হতে যাচ্ছি আমি!সুতরাং আমাকে বাবার উপদেশে আর জোবায়েদ হোসেনের ভয়ে মনোযোগী হতে হয় তা নয়, নিজের জন্যই হতে হয়, এক ক্লাসে দুদুবার পড়ে থাকলে নিজের জীবনের যে সমস্যা, তার সমাধান তো হবেই না বরং আরো জট পাকাবে, যত দ্রুত ঝামেলা শেষ করে রুদ্রর সঙ্গে সংসার করা যায়, রুদ্রর এলোমেলো জীবনকে পরিপাটি করা যায়!সংসার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে, যে সংসার তাকে স্থিরতা দেবে বলে সে বিশ্বাস করে, প্রতিজ্ঞা করেছে যে ভুলটি সে করেছে এমন ভুল ভবিষ্যতে হবে না আর, আশায় আশায় থেকে বছরগুলি এই তো ফুরিয়ে আসছে, রুদ্র পরিকল্পনা করে ফেলেছে পাকাপাকি ভাবে সে ঢাকায় চলে আসবে, ঢাকায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। রুদ্রর এই উদ্যোগ আমার জ্বলতে থাকা পুড়তে থাকা স্বপ্নের বাড়িঘরে ফোঁটা ফোঁটা জলের মত ঝরে। প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রসবকক্ষে বিরামহীন আসছে বিভিন্ন বয়সের প্রসূতি, কেউ প্রথম সন্তান, কেউ দ্বিতীয়, এমনকি সপ্তম সন্তানও জন্ম দিতে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে প্রসুতিরা।একটি নিম্নগামি চাপের উপদেশ দিই তাদের। যে চাপের ফলে জলের থলি নেমে আসবে নিচের দিকে, থলি ফুটো করে দিলে পৃথিবীর পথে যাত্রা করবে একটি শিশু। এই যাত্রা যেন শুভযাত্রা হয়, শিশুর হৃদপিণ্ডের ধ্বনিতে যেন কোনও কিন্তু না থাকে, সেদিকে চোখ কান খোলা রাখি। পথ প্রশস্ত করে দিই শিশুর যাত্রায় যেন বিঘ্ন না হয়। কিন্তু যখনই, সে প্রথম হোক, দ্বিতীয় হোক তৃতীয় হোক, আগমন ঘটে কোনও শিশুর, যদি সে মেয়ে-শিশু হয়, আর্তনাদ করে ওঠে শিশুর মা। কক্ষের বাইরে অপেক্ষারত আত্মীয়দের কাছে কন্যাসন্তান জন্মের খবর দেওয়ামাত্র মখু গুলো চোখের সামনে বিষাদে আচ্ছত হয়। মেয়ে জন্ম যে কি রকম অনাকাংখিত, তা আমার প্রতিদিন দেখা হতে থাকে। সাতটি পুত্রসন্তান জন্ম দেবার পর কেউ হয়ত একটি কন্যাসন্তান আকাঙক্ষা করে, তাও হাতে গোনা কজন মাত্রই করে। কন্যা নয়, কন্যা নয় পুত্র চাই পুত্র চাই, এই প্রবল প্রখর আকাঙক্ষা নিয়ে প্রসূতির আত্মীয়রা ভিড় করে প্রসুতিকক্ষের বাইরে। কন্যাজন্মদানের পর আমি একুশ বছর বয়সী এক তরুণীর আর্তনাদ থামাতে বলেছিলাম, নিজে মেয়ে হয়ে আপনি একটি মেয়ের জন্ম চাইছেন না, ছি! তরুণী অস্ফুট স্বরে বলল, আমারে যে তালাক দিবে, তালাক দিলে আমি কই যাবো! তালাক দিবে কেন? একটা সুস্থ সুন্দর বাচ্চা জন্ম দিছেন আপনি। আপনার খুশি হওয়ার কথা। মিষ্টি খাওয়ান সবাইরে। মেয়ে জন্ম দিছি আপা। আমি তো অপয়া! ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তরুণী। প্রসবকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে ধ্বনিত হতে থাকে, আমি তো অপয়া, আমি তো অপয়া। কানে হাত চাপা দিয়ে বেরিয়ে যাই আমি। ডাক্তারদের, হতে যাওয়ার ডাক্তারদের, নার্সদের জন্য খাঁচা ভরে মিষ্টি আসে প্রসবকক্ষের বাইরে। সে মিষ্টি পুত্রজন্মের আনন্দে। আমি অপেক্ষা করে থাকি কন্যা জন্মের কারণে কোনও একটি দম্পতির সন্তুষ্টি দেখার। আমার দেখা হয় না। মেয়ে হইছে, তাতে কি হইছে। মেয়েরাই তো ভাল। মেয়েরা বাপ মায়ের দেখাশোনা করে। আপনার মেয়েরে লেখাপড়া করাইবেন, ইশকুল কলেজে পড়াইবেন, আমার মত ডাক্তার হবে আপনার মেয়ে। দুঃখ করবেন না। বলে বলে যতবারই আমি কাঁদতে বারণ করি দুঃখিতা নারীদের, ততই তারা কাঁদে, প্রাণ ভরে কাঁদে প্রসব কক্ষের ভেতর। জরায়ুর ফুল ঝরে যায়, অন্তরে বিঁধে থাকে সহস্র কাঁটা। কেবল পুত্রসন্তান জন্ম দিলেই প্রসব যন্ত্রণা ম্লান হয়ে প্রশান্তির হাসি ফোটে মুখে, প্রসবকক্ষে হাসি ফোটে, প্রসবকক্ষের বাইরে ফোটে। প্রসব যনণ্ত্রার চেয়েও বড় এক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমাকে প্রতিদিন প্রসবকক্ষ থেকে বেরোতে হয়। সমাজের বিকট কৎু সিত রূপটি পরিষ্কার হতে থাকে চেতনায়। কে আমি কি আমি কেন আমি এই প্রশ্নগুলো আমি তসবিহর গোটা নাড়ার মত নাড়তে থাকি। অনাকাঙ্খিত কোনও কন্যা সন্তান, কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে আর্তনাদ করা প্রসবকক্ষের কোনও দুঃখিতা এবং এই আমার মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাই না। সমাজের নিয়মগুলো ছিঁড়ে ফেলার জন্য যখন আমার হাতদুটো নিশপিশ করছে, লিলির গালে একটি শক্ত চড় কষাই কেন আমি একবার নয় চার চার বার ডাকার পরও ও কাছে আসেনি, কেন জানতে চায়নি আমার কি প্রয়োজন। চড় খেয়ে থতমত খাওয়া লিলিকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে ঠেলে বলি, যা এক্ষুনি চা নিয়া আয়। লিলি, দশ বছর বয়সের মেয়েটি নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে ফেলতে যায় রান্নাঘর থেকে এঁটো বাসনের সপ্তূ নিয়ে কলতলার দিকে যেতে থাকা তার মায়ের কাছে বলতে যে আমি চা চাচ্ছি। লিলির মা সপ্তূ নামিয়ে রেখে চায়ের পানি বসায় চুলোয়।
false
toslima_nasrin
না। সম্পর্কটি আমার দুশ্চিন্তা ঘোচায়। পুরুষহীন-একাকীত্বের যন্ত্রণা ঘোচায়। কায়সার আমার কাছে কখনও যুবক, কখনও শিশু। কখনও সে দৃশ্যমান, কখনও সে অদৃশ্য। তবে সে যতক্ষণ আমার সামনে থাকে, সে আমার, সম্পর্ণই সে আমার। সে মানুষ কিম্বা অমানুষ সে আমার। সে শত্রু কিংবা বন্ধু, সে আমার। আমার রাগ, দুঃখ, আমার কষ্ট, সুখ সব তার ওপর বর্ষণ করতে পারি আমি। রাগ হলে ছিঁড়ে রক্তাক্ত করলাম, কষ্ট হলে কাঁদলাম, সুখ হলে হৈ চৈ করলাম, নিঃশব্দে কিন্তু সাদরে সে বরণ করে সব। কখনও তাকে বুকের কাছে নিয়ে আদর করছি, কখনও ধমকে বিদেয় করছি। কায়সার রাগ করে না কোনও চড়, ঘুষি, লাথিতে। সে জানে আবার তাকে আমি বুকে নেব। হয়ত সে বোঝে, যে, তার জন্য আমার একধরনের ভালবাসা আছে। আসলে, আছে। ভালবাসা আমার প্রিয় পুতুলটির জন্যও তো আমার আছে। বাইরের হাজার রকম কাজের পর সারা দিনের শেষে একটি নিজের কিছু সে মানুষ হোক, সে বস্তু হোক, মানুষ চায়। কায়সার আমার সেরকম। কায়সার আমাকে ভালবাসে, এটি আমাকে স্বস্তি দেয়, এটি আমাকে সুখ দেয়, আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমাকে মুক্তি দেয়, আমাকে ব্যস্ত হতে দেয় কাজে। কায়সারকে, আমি না অনুভব করলেও, এটা ঠিক, যে আমার ভীষণ রকম প্রয়োজন। তাকে নিয়ে আমি যে কোনও কোথাও যেতে পারি। কোনও কুণ্ঠা আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের বাড়িতে তাকে নিয়ে যাই অথবা তারা আমার বাড়িতে এসে কায়সারকে দেখে, আমাদের আড্ডায় এক কিনারে সে যখন চুপচাপ বসে থাকে। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না, এ কে, এর সঙ্গে কী আমার সম্পর্ক। আমি অনুমান করি যে তারা অনুমান করে নিচ্ছে সম্পর্কটি কি! এতে কারও কারও চোখ হয়ত কপালে ওঠে। কারও কপালের চোখের দিকে আমি মোটেও ফিরে তাকাই না। ফিরে না তাকালেই কপালের চোখ ধীরে ধীরে চোখের জায়গায় ফিরে আসে। বাড়িতে বোন আছে, বোনজামাই আছে, কুলসুম আছে, এমন কী মা আছেন, আর আমি কায়সারকে আমার শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করছি। কেউ এ নিয়ে কোনও কথা বলে না, এমন কী মাও নন। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে আমি নই, মা বরং নিজেকে লুকিয়ে রাখেন অন্য ঘরে যেন মাকে দেখে আমার কোনও সংকোচ না হয়। আমার সুখে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়ান না। মা আমাকে সুখী দেখতে চান, আমাকে তৃপ্ত দেখতে চান। মা এত বেশি আমাকে নিয়ে ভাবেন যে আমার অর্থনৈতিক কোনও দুরবস্থা না থাকলেও তিনি আমার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। তিনি থাকলে তাঁর জন্য বাড়তি খাবার দরকার হয়, তাই তিনি চলে যান ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে চাল ডাল আনাজপাতি যখনই যা তিনি সংগ্রহ করতে পারেন, নিয়ে উদয় হন। বসে বসে দীর্ঘদিন সেই অন্ন ধ্বংস করতে তিনি রাজি নন বলে আবার উধাও হন। উধাও হওয়ার আগে অবশ্য কুলসুমকে শিখিয়ে দিয়ে যান আমাকে যত্ন করার সকল রকম পদ্ধতি। আমি কি অনেকটা বাবার মত হয়ে যাচ্ছি! বাবার মত প্রতাপ আমার। সংসার চলে আমার টাকায়, সম্পূর্ণই আমার নির্দেশে। শান্তিবাগের বাড়িতে যেমন সবাই আমাকে সমীহ করে চলে, আমার কখন কী প্রয়োজন, তা আমি না চাইতেই হাতের কাছে এগিয়ে দেয়, অবকাশের লোকেরাও বুঝে শুনে কথা বলে। বাবাও আমার দিকে আর কড়া চোখে মুখ খিঁচিয়ে তাকান না বরং তিনি আমাকে স্বর নরম করে বলেন, ‘তোমার কি কোনও পরিচিত কেউ আছে কোনও কোনও চাকরি টাকরি দেওয়ার! থাকলে মঞ্জুরে কোনও রকম একটা চাকরির যোগাড় কইরা দিও।’ মঞ্জু ঈমান কাকার ছেলে। লেখাপড়া করেনি বেশি। বাবা যেমন তার নান্দাইলের বাড়ির সবার লেখাপড়া চাকরি বাকরির দেখাশোনা করেন, আমাকেও ওরকম করতে হয় অনেকটা। খসরুকে বলে মঞ্জুকে একটি চাকরি জুটিয়ে দিই। সাভারে খসরুর জেনারেটর তৈরির কারখানা আছে, সেই কারখানায় অল্প বেতনে শ্রমিকের একটি চাকরি। আমাদের কোনও বড় বড় মামা কাকা নেই কোনও উঁচু পদে, যাদের কাছে বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য যাওয়া যায়। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যদি কারও যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি থাকে, সে বাবার। এরপর যতটুকু যা আছে, আমার। মঞ্জুকে আর মোতালেবকে খসরু আর কায়সারকে বলে চাকরি দুটো দিয়ে সংসারে বাবার মত একটি অবস্থান হয় আমার। কায়সারকে নিয়ে আমি অবকাশে গিয়েছি, বাবা একবারও প্রশ্ন করেননি কে এই ছেলে কী পরিচয়, কেন তার সঙ্গে আমি মিশছি। আসলে এসব প্রশ্নের অনেক উর্ধে আমি। এ কী কেবলই আমি স্বনির্ভর বলে! তা ঠিক নয়। আমি তো আরমানিটোলায় থাকাকালীনও স্বনির্ভর ছিলাম। এ তবে কী কারণে! আমি দায়িত্ববান বলে! ইয়াসমিন আর মিলনের দায়িত্ব নিয়েছি বলে! অন্তত আমার বাড়িতে তাদের থাকা খাওয়ার! নাকি আমি বড় হয়েছি বলে। অর্থাৎ বয়স হয়েছে বলে! কত আর বয়স, তিরিশও তো হয়নি। নাকি আগের চেয়ে আমার য়চ্ছলত! বেশি বলে! নাকি আমাকে বলে কোনও লাভ হয় না বলে, আমি কারও উপদেশের তোয়াককা করি না বলে! নাকি আমার নাম হয়েছে বলে! নাম তো তখনও আমার ছিল, যখন আমাকে আমার সুখের সংসার ভেঙে ঘাড় ধরে বাবা আমাকে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছিলেন বন্দি করার জন্য! নাকি এখন আমার বেশি নাম হয়েছে বলে! যে কারণেই হোক আমার ভাল লাগে যে আমার কোনো কাজে আমাকে কেউ বাধা দেবার নেই। স্বাধীনতার সত্যিকার স্বাদ আমি উপভোগ করি। বন্ধু, শুভাকাঙ্খী, কবি সাহিত্যিক কেউ না কেউ আমার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই আসছেন। সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ
false
tarashonkor
খবরদার! –কি হব? –আমার মত হবি। –না, তুমি ছাই। রোগা— –ওরে বেটা, বুদ্ধিতে আমার মত হবি। অঙ্ক শিখবি। কাউকে এক পয়সা ছাড়বি না। –পয়সা দাও। –ওরে বেটা, অনেক পয়সা জমিয়েছি তোর জন্যে। সব তোর জন্যে, বুঝলি? –কাউকে দেব না। –হ্যাঁ। কেউ আমাকে দেয় নি, কেউ ছাড়ে নি মানকে। বাবা দেনা করেছিল, কেউ ছাড়ে নি। বুঝলি? আর পরিবারের কাছে টাকা নিবি না। তোর বড়মা দেনার সময় গয়না দিয়েছিল দেনা শোধ করতে। তার পাপ আমাকে আজ ভুগতে হচ্ছে। খবরদার মানকে। হাঁ। রাখালটা হুঁকা-কল্কে সেতাবের হাতে দিল। সেতাব বলিল, শোন, তু একবার ঘোঁতন ঘোষের বাড়ি যাবি, বুঝলি? বলবি পঞ্চায়েত মোড়লেরা একবার ডেকেছে। বুঝলি? রাখালটা বলিল—সে আসবে না গো। বড় ত্যাঁদড় নোক ঘোঁতন। —তা হোক, তু যাবি। আমি বলছি—তু যাবি। আসে না-আসে আমি বুঝব। এই কাগজখানা দিবি। রাখালটা বলিল, তা হলে এখুনি যাই। নইলে ঘোঁতন মুড়ি খেয়ে বিড়ি টানতে টানতে বেরিয়ে যাবে, আর সেই ভাত খাবার বেলা পর্যন্ত পাব না। ঘোঁতনের বাড়ি গোপডাঙায়। ঠিক পাশের গ্রামে। এই গ্রাম ও আধাশহর লক্ষ্মীপুরের মাঝখানে গোপডাঙা–ছোট একখানি গ্রাম। লক্ষ্মীপুরেরই কাছাকাছি বেশি। লক্ষ্মীপুর অনেকদিনের সমৃদ্ধ গ্রাম। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-প্রধান সমাজ। গোপডাঙার টানটা চিরকাল ঐ দিকেই বেশি। ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থ বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকেরা গোপডাঙার চাষীদের এবং গোপদের উৎপনের পুরনো খরিদ্দার। গোপডাঙার তরিতরকারি এবং দুধ, দুই লক্ষ্মীপুরের অন্নকে পঞ্চাশ না-হোক বেশ কয়েক প্রকার ব্যঞ্জনে সমৃদ্ধ করিয়াছে। এবং গুড় ও দুধ সহযোগে পরমানু না হোক পায়সানে পরিণত করিয়াছে। শুধু তাই নয় এই গ্রামের চাষীরাই। বরাবর ব্রাহ্মণ কায়স্থদের জমিজেরাত ভাগে ঠিকায় করিয়া আসিয়াছে। এবং সেকালে ইহা হইতেই তাহাদের দু-চার জন বছরে নিজের খামারে একটা মরাই-ও বাঁধিয়াছে আবার অজন্মার বছরে ঠিকার ধান শোধ না করিতে পারিয়া খতও লিখিয়াছে। খতের আসল, সুদে বাড়িয়া। তাহাদের পৈতৃক জমি বিক্রয় করিতে বাধ্য করিয়াছে। এ সব পুরনো কথা। তাহার পর মাঝে একটা সময় আসিয়াছিল যখন লক্ষ্মীপুরের ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বাঁড়ুজ্জে মশায়, মুখুজ্জে মশায়, বোস মশায়, ঘোষ মহাশয়ের সকলেই ও-সব উপাধি ছাড়িয়া বাবু মশাই ইলেন; ঘরে ঘরে তক্তপোশ-ফরাসের বদলে চেয়ার-টেবিল হইল, টোল পাঠশালা উঠিয়া গল, ইংরিজি ইস্কুল হইল, বাবুরা শহরে চাকরি ধরিল। উকিল হইল, মোক্তার হইল, ডাক্তার হইল। শরবত ছাড়িয়া চা ধরিল, হুঁকার সঙ্গে সিগারেট ঢুকিল, তখন লক্ষ্মীপুরে খানসাম র চাহিদাটা বাড়িয়া গেল। এই সময় গোপডাঙার অনেকে চাষের মত অভদ্র কাজ ছাড়িয়া এই শৌখিন কাজে ঢাকিল। ছোট বড় করিয়া চুল ইহারাই প্রথম ঘটিল, চাদরের বদলে কামিজ আমদানি করিল। কাছেই বক্রেশ্বর নদী ইহার পর বক্রেশ্বর নদী দিয়া অনেক জল বহিয়া গেল। শুধু বহিয়াই গেল না, বন্যায় চারিপাশ ড়ুবাইয়া দিয়াও গেল। চাষের জমিতে পলিও পড়িল, বালিও চাপিল। সেতাবদের গ্রাম নয়নপুরের চাষীরা বালি-পড়া জমির বালি তুলিল, পলি-পড়া জমিতে সোনা ফলাইল। কিন্তু গোপডাঙার চাষীরা চাষ একেবারে তুলিয়া না দিলেও ওই জীবিকার উপর আস্থা হারাইল। তাহারা চাষের সঙ্গে এটা ওটা ব্যবসায়ে হাত দিল। কেহ নবগ্রামে দোকান করিল। মুদির দোকান, বিড়ির দোকান ইত্যাদি এবং ছেলেদের ইস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল। দুই চারটি ছেলে ম্যাট্রিক পাস করিল, একজন এম এ পাস করিল, একজন বি-এল হইল এবং গোপডাঙার বাস উঠাইয়া কর্মস্থল শহরে চলিয়া গেল। ঘোঁতনের বাবা গোপাল ঘোষ নিজে চাষবাসের সঙ্গে পাইকারি অর্থাৎ ধানের দালালির কাজ ধরিয়াছিল। লক্ষ্মীপুরের বণিকদের কাছে টাকা লইয়া গ্রামে গ্রামে ধান কিনিত এবং সেই ধান গাড়ি বোঝাই করিয়া বণিকদের গদিতে পৌঁছাইয়া দিত। কিছু লাভ থাকিত দরের মাথায়, আর কিছু থাকিত ওজনের মাথায়। খরিদ্দারের ঘরে হাতের টিপে যে ওজনটা সে লাভ করিত—সেইটার দাম মিলিত। ইহার উপর আছে কিছু ঢলতা—কিছু আছে। ঈশ্বরের নামে বৃত্তির ভাগ। ঘোঁতনকে ইস্কুলে দিয়াছিল। ঘোঁতন ও সেতাব কয়েক ক্লাস একসঙ্গে পড়িয়াছিল। ঘোঁতন ছেলে মন্দ ছিল না, সেতাবের মত সে এম্‌কে অ্যাম, একে অ্যান, একে অ্যাল বলিত না। চোস্ত উচ্চারণ ছিল তার। লক্ষ্মীপুরের বাবুদের ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলিত, স্কুলে ডিবেটিং ক্লাবে ডিবেট করিত। ভাল আবৃত্তি করিতে পারি। লক্ষ্মীপুরের থিয়েটার ক্লাবের রিহারস্যালের দিন হইতে অভিনয়ের দিন পর্যন্ত নিয়মিত আড়ালে-আবডালে থাকিয়া শুনিত, শিখিত। ক্লাবের লাইব্রেরি হইতে নাটক নভেল পড়িত। লোকে বলিত ছেলেটির ভবিষ্যৎ আছে। মাস্টাররাও আশা করিতেন, ঘোঁতন অন্তত সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করিবে। মন দিয়া পড়িলে ফার্স্ট ডিভিশনেও যাইতে পারবে। হয়ত পারিত। কিন্তু গোপাল ঘোষ মরিয়া সব গোলমাল হইয়া গেল। ঘোঁতন বন্ধাশূন্য অশ্বের মত ধাবমান রইল। ফার্স্ট ক্লাসে উঠিয়া সে প্রেমে পড়িয়া গেল। মনে মনে সে বেশ কিছুদিন হইতেই প্রেমে পড়িয়াছিল। স্থানীয় মাইনর গার্লস স্কুলের মাইনর ক্লাসের ছাত্রীদের প্রত্যেকটিকেই কিছুদিনের জন্য প্ৰিয়তমা ভাবিতেছিল। কিন্তু জাতের বাধা বা অন্য বাধা স্মরণ করিয়া সে কথা প্রকাশ করিতে পারি না। নিজের খাতায় তাহাদের নাম লিখিত এবং খুব যত্নের সঙ্গে কাটিত। হঠাৎ প্রকাশ্যে প্রেমে পড়িবার সুযোগ জুটিয়া গেল। স্থানীয় সবরেজেষ্ট্রি আপিসেই তাহাদের স্বজাতি এক কেরানী আসিল—এবং তাহার বড় মেয়েটি মাইনর ক্লাসে ভর্তি হইল। লম্বা ধরনের শ্যামবৰ্ণ মেয়ে, বয়স বোধহয় তের-চৌদ্দ; কিন্তু ঘোতনের প্রেমে পড়িবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। মাইনর ক্লাসে পড়ে; বেণি ঝুলাইয়া ফেরত দিয়া কাপড় পরিয়া স্কুলে যায়—সুতরাং ইহার চেয়ে অধিক আয়োজন আর কী হইতে পারে লক্ষ্মীপুরে। ঘোঁতন প্রেমে পড়িল, মেয়েটির বাপের সহিত আলাপ করিল। তাহাদের বাড়িসুদ্ধ নিমন্ত্ৰণ করিয়া বাড়ি আনিয়া খাওয়াইল। এই সময়েই উমেশ মণ্ডল কাদম্বিনীর বিবাহের জন্য তোক পাঠাইল। ঘোঁতন তাহাকে সোজা না
false
shottojit_roy
ব্লাড। ব্লাড? লোকটা বলে কী? তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে গেল সামনের রাজস্থানি লোকটার দিকে। লোকটা মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। এবার তার বেঞ্চির উপরে তোলা পা দুটোর দিকে চোখ গেল। দেখলাম, বুড়ো আঙুলের পাশটা ছাল উঠে রক্ত জমে রয়েছে। তারপর বুঝলাম এতক্ষণ কাপড়ে যেগুলোকে মাটির দাগ বলে মনে হচ্ছিল, সেগুলো আসলে শুকনো লালচে রক্ত। ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি, ও দিব্যি একমনে বই পড়ে চলেছে। লালমোহনবাবুর পক্ষে বোধহয় ফেলুদার নিশ্চিন্ত ভাবটা সহ্য হল না। তিনি হঠাৎ সেই শুকনো গলাতেই বলে উঠলেন, মিস্টার মিটার, সাস্‌পিশাস্‌ ব্লাড-মার্কস অন আওয়ার নিউ কো-প্যাসেঞ্জার। ফেলুদা বই থেকে চোখ তুলে একবার ঘুমন্ত লোকটার দিকে দেখে নিয়ে বলল, প্রব্যাবলি কজড বাই বাগ্‌স। রক্তের কারণ ছারপোকা হতে পারে জেনে জটায়ু কেমন জানি মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভয় যে কাটল না সেটা তার জড়োসড়ো ভাব আর বার বার ভুরু কুঁচকে আড়চাখে ঘুমন্ত লোকটার দিকে চাওয়া থেকে বুঝতে পারছিলাম। দুপুর আড়াইটার সময় গাড়ি মাড়ওয়ার জংশনে পৌঁছাল। খাওয়াটা স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে সেরে ঘণ্টাখানেক প্লাটফর্মে পায়চারি করে সাড়ে তিনটেয় যোধপুরের গাড়িতে ওঠার সময় আর সেই লাল জামা-পরা লোকটাকে দেখতে পেলাম না। আড়াই ঘণ্টার জার্নির মধ্যে ঘন ঘন। উটের দল চোখে পড়ায় লালমাহনবাবু বার বার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। যোধপুরে পৌঁছালাম ছটা বেজে দশ মিনিটে। ট্রেনটি কুড়ি মিনিট লেট করেছে। কলকাতা হলে এতক্ষণে সূর্য ডুবে যেত, কিন্তু এ দিকটা পশ্চিমে বলে এখনও দিব্যি রোদ রয়েছে। আমাদের বুকিং ছিল সার্কিট হাউসে। লালমোহনবাবু বললেন তিনি নিউ বম্বে লিজে থাকছেন। ‘কাল সকাল সকাল এসে পড়ব, একসঙ্গে ফোর্টে যাওয়া যাবে’ বলে ভদ্রলোক টাঙ্গার লাইনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুনলাম সার্কিট হাউসটা খুব কাছেই। যেতে যেতে বাড়ির ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছিলাম একটা বিরাট পাথরের পাঁচিল–প্রায় একটা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, এককালে পুরো যোধপুর শহরটাই নাকি ওই পাঁচিলটা দিয়ে ঘেরা ছিল। ওটার সাত জায়গায় নাকি সাতটা ফটক আছে। বাইরে থেকে সৈন্য আক্রমণ করতে আসছে জানলে ওই ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হত। আরেকটা রাস্তার মোড় ঘুরতেই ফেলুদা বলল, ওই দ্যাখ বাঁদিকে। চেয়ে দেখি শহরের বাড়ির মাথার উপর দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে বিরাট থমথমে এক কেল্লা। বুঝলাম ওটাই হল বিখ্যাত যোধপুর ফোর্ট। আমি জানতাম এখানকার রাজারা মোগলদের হয়ে লড়াই করেছে। কখন কেল্লাটা কাছ থেকে দেখতে পাব সেটা ভাবতে ভাবতেই সার্কিট হাউসে পৌঁছে গেলাম। গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে একটা বাগানের পাশ দিয়ে গিয়ে একটা পোর্টিকের তলায় আমাদের ট্যাক্সি দাঁড়াল। মালপত্তর নামিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কলকাতা থেকে আসছি কি না। আর ফেলুদার নাম মিস্টার মিটার কি না। ফেলুদা হ্যাঁ বলতে ভদ্রলোক বললেন—আপনাদের জন্য একতলায় একটা ডাবল রুম বুক করা আছে। খাতায় নাম সই করার সময় আমাদের নামের কয়েক লাইন উপরেই পর পর দুটো নাম চোখে পড়ল–ডক্টর এইচ বি হাজরা আর মাস্টার এম ধর। সার্কিট হাউসের প্ল্যানটা খুব সহজ। ঢুকেই একটা বড় খোলা জায়গা, বা দিকে রিসেপশন কাউন্টার আর ম্যানেজারের ঘর, সামনে দোতলার সিঁড়ি, ডাইনে আর বাঁয়ে দু দিকে লম্বা বারান্দার পাশে পর পর লাইন করে ঘন্ধু। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা রয়েছে। একজন বেয়ারা এসে আমাদের মাল তুলে নিল, আমরা তার পিছন পিছন ডানদিকের বারান্দা দিয়ে রওনা দিলাম। তিন নম্বর ঘরের দিকে। একজন সরু গোঁফাওয়ালা মাঝবয়সী ভদ্রলোক একটা বেতের চেয়ারে বসে, একজন মাড়ওয়ারি টুপি পরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন; আমরা তাঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় পরিষ্কার বাংলায় বললেন, বাঙালি মনে হচ্ছে? ফেলুদা হেসে হ্যাঁ বলল। আমরা তিন নম্বর ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। বেশ বড় ঘর। দুটো পাশাপাশি খাট, তাতে আবার মশারির ব্যবস্থা রয়েছে। এক পাশে একটা দুজন-বসার আর দুটো একজন-বসার সোফা, আর একটা গোল টেবিলের উপর একটা অ্যাশ-ষ্ট্রে। এ ছাড়া ড্রেসিং টেবিল, আলমারি আর খাটের পাশে দুটো ছাট টেবিলে জলের ফ্লাস্ক, গেলাস আর বেড-সাইড ল্যাম্প।। ঘরের সঙ্গে লাগা বাথরুমের দরজাটা বাঁ দিকে। ফেলুদা বেয়ারাকে চা আনতে বলে পাখাটা খুলে দিয়ে সোফায় বসে বলল, খাতায় নাম দুটো দেখলি? আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু ওই চাড়া-দেওয়া গোঁফওয়ালা লোকটা আশা করি ডক্টর হাজরা নন। কেন? হলে ক্ষতি কী? ক্ষতি যে কী সেটা অবিশ্যি আমি চট করে ভেবে বলতে পারলাম না। ফেলুদা আমার ইতস্তত ভাব দেখে বলল, তোর আসলে লোকটাকে দেখে ভাল লাগেনি। তুই মনে মনে চাইছিস যে ডক্টর হাজরা লোকটা খুব শাস্তশিষ্ট হাসিখুশি অমায়িক হন—এই তো? ফেলুদা ঠিকই ধরেছে। এ লোকটাকে দেখলে বেশ সেয়ানা বলেই মনে হয়। তা ছাড়া বোধহয় বেশ লম্বা। আর জাঁদরেল। ডাক্তার বলতে যা বোঝায় তা মোটেই নয়। ফেলুদা একটা সিগারেট শেষ করতে না করতেই চা এসে গেল, আর বেয়ারা ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই দরজায় টোকা পড়ল। ফেলুদা ভীষণ বিলিতি কায়দায় বলে উঠল, কাম ইন! পদ ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলেন মিলিটারি গোঁফ। ডিসটর্ব করছি না তো? মোটেই না। বসুন। চা খাবেন? নাঃ। এই অল্পক্ষিণ অাগেই খেয়েছি। আর ফ্র্যাংকলি স্পিকিং-চা-টা এখানে তেমন সুবিধের নয়। শুধু এখানে বলছি কেন, ভারতবর্ষ হল খাস চায়ের দেশ, অথচ কটা হাটেলে কটা ডাকবাংলোয় কটা
false
robindronath
মানিয়াছেন, এবারেও তাঁহাকে অগত্যা হার মানিতে হইল, কিন্তু মন হইতে তাহার বিরুদ্ধতা ঘুচিল না। এ ঘরের ছেলে দোলাই মুড়ি দিয়া গুড়মুড়ি খায়, এমন বিসদৃশ দৃশ্য দিনের পর দিন কি দেখা যায়। পূজার সময় তাঁহার মনে পড়ে, কর্তাদের আমলে নূতন সাজসজ্জা পরিয়া তাঁহারা কিরূপ উৎসাহ বোধ করিয়াছেন। পূজার দিনে রাসমণি কালীপদর জন্য যে সস্তা কাপড়জামার ব্যবস্থা করিয়াছেন সাবেক কালে তাঁহাদের বাড়ির ভৃত্যেরাও তাহাতে আপত্তি করিত। রাসমণি স্বামীকে অনেক করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, কালীপদকে যাহা দেওয়া যায় তাহাতেই সে খুশি হয়, সে তো সাবেক দস্তুরের কথা কিছু জানে না— তুমি কেন মিছামিছি মন ভার করিয়া থাক। কিন্তু ভবানীচরণ কিছুতেই ভুলিতে পারেন না যে, বেচারা কালীপদ আপন বংশের গৌরব জানে না বলিয়া তাহাকে ঠকানো হইতেছে। বস্তুত সামান্য উপহার পাইয়া সে যখন গর্বে ও আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে তাঁহাকে ছুটিয়া দেখাইতে আসে তখন তাহাতেই ভবানীচরণকে যেন আরো আঘাত করিতে থাকে। তিনি সে কিছুতেই দেখিতে পারেন না। তাঁহাকে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যাইতে হয়। ভবাণীচরণের মকদ্দমা চালাইবার পর হইতে তাঁহাদের গুরূঠাকুরের ঘরে বেশ কিঞ্চিৎ অর্থাসমাগম হইয়াছে। তাহাতে সন্তুষ্ট না থাকিয়া গুরুপুত্রটি প্রতিবৎসর পূজার কিছু পূর্বে কলিকাতা হইতে নানাপ্রকার চোখ-ভোলানো সস্তা শৌখিন জিনিস আনাইয়া কয়েক মাসের জন্য ব্যবসা চালাইয়া থাকেন। অদৃশ্য কালি, ছিপ-ছড়ি-ছাতার একত্র সমবায়, ছবি-আঁকা চিঠির কাগজ, নিলামে-কেনা নানা রঙের পচা রেশম ও সাটিনের থান, কবিতা-লেখা পাড়ওয়ালা শাড়ি প্রভৃতি লইয়া তিনি গ্রামের নরনারীর মন উতলা করিয়া দেন। কলিকাতার বাবুমহলে আজকাল এই-সমস্ত উপকরণ না হইলে ভদ্রতা রক্ষা হয় না শুনিয়া গ্রামের উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিমাত্রই আপনার গ্রাম্যতা ঘুচাইবার জন্য সাধ্যাতিরিক্ত ব্যয় করিতে ছাড়েন না। একবার বগলাচরণ একটা অত্যাশ্চার্য মেমের মূর্তি আনিয়াছিলেন। তার কোন্‌- এক জায়গায় দম দিলে মেম চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রবল বেগে নিজেকে পাখা করিতে থাকে। এই বীজনপরায়ণ গ্রীষ্মকাতর মেমমূর্তিটির প্রতি কালীপদর অত্যন্ত লোভ জন্মিল। কালীপদ তাহার মাকে বেশ চেনে, এইজন্য মার কাছে কিছু না বলিয়া ভবানীচরণের কাছে করুণকণ্ঠে আবেদন উপস্থিত করিল। ভবানীচরণ তখনই উদারভাবে তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন, কিন্তু তাহার দাম শুনিয়া তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল। টাকাকড়ি আদায়ও করেন রাসমণি, তহবিলও তাঁহার কাছে, খরচও তাঁহার হাত দিয়াই হয়। ভবানীচরণ ভিখারীর মতো তাঁহার অন্নপূর্ণার দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রথমে বিস্তর অপ্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করিয়া অবশেষে এক সময়ে ধাঁ করিয়া আপনার মনের ইচ্ছাটা বলিয়া ফেলিলেন। রাসমণি অত্যন্ত সংক্ষেপে বলিলেন, “পাগল হইয়াছ! ” ভবানীচরণ চুপ করিয়া খানিকক্ষণ ভাবিতে লাগিলেন। তাহার পরে হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “আচ্ছা দেখো, ভাতের সঙ্গে তুমি যে রোজ আমাকে ঘি আর পায়স দাও সেটার তো প্রয়োজন নাই।” রাসমণি বলিলেন, “প্রয়োজন নাই তো কী।” ভবানীচরণ কহিলেন, “কবিরাজ বলে, উহাতে পিত্ত বৃদ্ধি হয়।” রাসমণি তীক্ষ্মভাবে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “তোমার কবিরাজ তো সব জানে! ” ভবানীচরণ কহিলেন, “আমি তো বলি রাত্রে আমার লুচি বন্ধ করিয়া ভাতের ব্যবস্থা করিয়া দিলে ভালো হয়। উহাতে পেট ভার করে।” রাসমণি কহিলেন, “পেট ভার করিয়া আজ পর্যন্ত তোমার তো কোনো অনিষ্ট হইতে দেখিলাম না। জন্মকাল হইতে লুচি খাইয়াই তো তুমি মানুষ।” ভবানীচরণ সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার করিতেই প্রস্তুত— কিন্তু সে দিকে ভারি কড়াক্কড়। ঘিয়ের দর বাড়িতেছে তবু লুচির সংখ্যা ঠিক সমানই আছে। মধ্যাহ্নভোজনে পায়সটা যখন আছেই তখন দইটা না দিলে কোনো ক্ষতিই হয় না— কিন্তু বাহুল্য হইলেও এ বাড়িতে বাবুরা বরাবর দই পায়স খাইয়া আসিয়াছেন। কোনোদিন ভবানীচরণের ভোগে সেই চিরন্তন দধির অনটন দেখিলে রাসমণি-কিছুতেই তাহা সহ্য করিতে পারেন না। অতএব গায়ে-হাওয়া-লাগানো সেই মেমমূর্তিটিই ভবানীচরণের দই-পায়স-ঘি-লুচির কোনো ছিদ্রপথ দিয়া সে প্রবেশ করিবে এমন উপায় দেখা গেল না। ভবানীচরণ তাঁহার গুরুপুত্রের বাসায় একদিন যেন নিতান্ত অকারণেই গেলেন এবং বিস্তর অপ্রাসঙ্গিক কথার পর সেই মেমের খবরটা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার বর্তমান আর্থিক দুর্গতির কথা বগলাচরণের কাছে গোপন থাকিবার কোনো কারণ নাই তাহা তিনি জানেন, তবু আজ তাঁহার টাকা নাই বলিয়া ঐ একটা সামান্য খেলনা তিনি তাঁহার ছেলের জন্য কিনিতে পারিতেছেন না, এ কথার আভাস দিতেও তাঁহার যেন মাথা ছিঁড়িয়া পড়িতে লাগিল। তবু দুঃসহ সংকোচকেও অধঃকৃত করিয়া তিনি তাঁহার চাদরের ভিতর হইতে কাপড়ে-মোড়া একটি দামী পুরাতন জামিয়ার বাহির করিলেন। রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে কহিলেন, “সময়টা কিছু খারাপ পড়িয়াছে, নগদ টাকা হাতে বেশি নাই— তাই মনে করিয়াছি, এই জামিয়ারটি তোমার কাছে বন্ধক রাখিয়া সেই পুতুলটা কালীপদর জন্য লইয়া যাইব।” জামিয়ারের চেয়ে অল্প দামের কোনো জিনিস যদি হইত তবে বগলাচরণের বাধিত না — কিন্তু সে জানিত এটা হজম করিয়া উঠিতে পারিবে না— গ্রামের লোকেরা তো নিন্দা করিবেই, তাহার উপরে রাসমণির রসনা হইতে যাহা বাহির হইবে তাহা সরস হইবে না। জামিয়ারটাকে পুনরায় চাদরের মধ্যে গোপন করিয়া হতাশ হইয়া ভবানীচরণকে ফিরিতে হইল। কালীপদ পিতাকে রোজ জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার সেই মেমের কী হইল।” ভবানীচরণ রোজই হাসিমুখে বলেন, “রোস— এখনই কী। সপ্তমী পূজার দিন আগে আসুক। প্রতিদিনই মুখে হাসি টানিয়া আনা দুঃসাধ্যকর হইতে লাগিল। আজ চতুর্থী। ভবানীচরণ অসময়ে অন্তঃপুরে কী একটা ছুতা করিয়া গেলেন। যেন হঠাৎ কথাপ্রসঙ্গে রাসমণিকে বলিয়া উঠিলেন, “দেখো, আমি কয়দিন হইতে লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, কালীপদর শরীরটা যেন দিনে দিনে খারাপ হইয়া যাইতেছে।” রাসমণি কহিলেন, “বালাই। খারাপ হইতে যাইবে কেন। ওর তো আমি কোনো অসুখ দেখি না।” ভবানীচরণ কহিলেন, “দেখ নাই! ও চুপ করিয়া বসিয়া থাকে।
false
humayun_ahmed
আশ্চর্য! তাড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন? আমি জানি না কেন আসছে। মাঝে মাঝে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কী করি না করি নিজেই বুঝি না। সরি। কী সব অদ্ভুত ব্যাপার যে আমার হচ্ছে। তুমি যখন রাত জেগে পড়, আমিও রাত জগতে চেষ্টা করি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাধ্য হয়ে ঘুমুতে যাই। তখন আর ঘুম আসে না। রাতের পর রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটাই। তুমি কি সেটা জান? না। এখন জানলাম। আমার কী করা উচিত? ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত। ঘুমের ওষুধ আমার আছে। কিন্তু আমি খাই না। রাত জেগে আমি নানান কথা ভাবি। আমার ভালোই লাগে। আমাদের দিনগুলো এই ভাবেই কাটছিল। তারপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল। তখন আমি এম.এ. ক্লাসের ছাত্র। বর্ষাকাল। কদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে! ক্লাস থেকে ফিরেছি। বিকেলে। গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি, রানু এই বৃষ্টির মধ্যে বাগানে দাঁড়িয়ে ভিজছে। কী যে সুন্দর তাকে লাগছে! আমি চেঁচিয়ে বললাম-এই রানু এই! রানু ছুটে এল। হাসতে হাসতে বলল, এই যে ভাই ভালো ছাত্ৰ-তুমি কি আমার সঙ্গে একটু বৃষ্টিতে ভিজবে? নাকি খারাপ ছাত্রীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা নিষেধ? আমি বললাম, না নিষেধ না-চল বৃষ্টিতে ভিজি। অসুখে পড়লে আমাকে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না। না, দোষ দেব না। দাঁড়াও খাতাটা রেখে আসি। রানু বলল, না না। খাতা রাখতে যেতে পারবে না। খাতা ছুড়ে ফেলে দাও। আমি খাতা ছুড়ে ফেললাম। রানু চেঁচিয়ে বলল, স্যান্ডেল খুলে ফেল। আজ আমরা গায়ে কাঁদা মাখব। পানিতে গড়াগড়ি খাব। দেখো বাগানে পানি জমেছে। আমি স্যান্ডেল ছুড়ে ফেললাম। রানু বলল-আজ বাসায় কেউ নেই। পুরো বাড়িতে শুধু আমরা দুজন। রানু কথাগুলো কি অন্যভাবে বলল? কেমন যেন শোনাল। যেন সে প্রবল জুরের ঘোরে কথা বলছে। কী বলছে সে নিজেও জানে না। আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে রানু? রানু থেমে থেমে বলল, আমার কী হয়েছে আমি জানি না। আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। আমি আজ ভয়ংকর একটা অন্যায় করব। তুমি রাগ করতে পারবে না। আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবতে পারবে না। রানু ঘোর লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে অদ্ভুক্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাব আর যাই ভাব-আমি এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা অন্যায় করব। প্লিজ চোখ বন্ধ করা। তুমি তাকিয়ে থাকলে অন্যায়টা আমি করতে পারব না। চোখ বন্ধ করতে গিয়েও চোখ বন্ধ করতে পারলাম না। আমি বুঝতে পারছি রানু কী করতে যাচ্ছে। আমি কেন যে কোনো মানুষই তা বুঝবে। আমার নিজেরও যেন কেমন লাগছে। হঠাৎ দোতলার দিকে তাকালাম, আমার সমস্ত শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি দেখলাম আমার উলঙ্গ মাস্টার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তিনি কী চান আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম। তিনি আমার সব প্রিয়জনদের একে একে সরিয়ে দিচ্ছেন-প্ৰথমে বাবা, তারপর সর্দার চাচা। এখন রানু। তা সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না। আমি রানুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। সে মাটিতে পড়ে গেল। সে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমাকে এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে। যেভাবে আছ সেইভাবে। রানু কোনো প্রশ্ন করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। ইসমাইল চাচা ঢুকলেন তার কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনি বললেন-কী ব্যাপার? আমি কঠিন গলায় বললাম, চাচা। আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে? আমি তার জবাব দিলাম না। রানু মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে গেল। তার এক ঘণ্টার ভেতরই বাবা মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন। অনেক অনেক দিন পর আমি আবার একা হয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন হয়ে বৃষ্টি নামল। রীতিমতো ঝড় শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি অন্ধকার বারান্দায় বসে রইলাম। আমার দৃষ্টি দোতলার বারান্দার দিকে। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে–সেই আলোয় আমি উলঙ্গ মাস্টার সাহেবকে রেলিঙে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বাতাসের এক একটা ঝাপটা আসছে। সেই ঝাপটায় ভেসে আসছে সিগারেটের কড়া গন্ধ। আবারো সেই গন্ধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হাসনাহেনার গন্ধে। সেবার আমাদের হাসনাহেনা গাছে প্রথমবারের মতো ফুল ফুটেছিল। মানুষের সঙ্গে গাছের হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। নয়তো কখনো যে গাছে ফুল ফোটে না-হঠাৎ সেখানে কেন ফুল ফুটল? রাত বাড়তে লাগল। বৃষ্টি বাড়তে লাগল। কামরাঙা গাছের ডাল বাতাসে নড়তে লাগল। আমি এগিয়ে গেলাম দোতলার দিকে। সিঁড়ির মুখ কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ। মাস্টার সাহেব বললেন, কাঁটাতারের বেড়া খুলে রেখেছি, তুমি উঠে এস। আমি উঠে গেলাম। কঠিন গলায় বললাম, আপনি কী চান? তিনি বললেন, আমি কিছু চাই না তন্ময়। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আপনার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। তুমি তো ভুল কথা বলছি তন্ময়। এখনই আমার সাহায্যের তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করব। আমি আমার কথা রাখি। আপনি কেউ না। আপনি আমার অসুস্থ মনের কল্পনা। কে বলল তোমাকে? আমি মনোবিদ্যার ছাত্র। আমি জানি। আমি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি। সিজোফ্ৰেনিয়ার রুগিদের হেলুসিনেশন হয়। তারা চোখের সামনে অনেক কিছু দেখতে পায়। আমি তাই দেখছি। তোমাদের ইসমাইল সাহেব কি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি? না। তিনি কিছু আমাকে দেখেছেন।
false
shorotchandra
তাই ত হে! চোঙদার কহিলেন, নিঃসন্দেহ। তবে, বহুত টাকার খেলা—একসঙ্গে জোটাতে পারলে হয়। গোলোক কহিলেন, কনটাক্টো দেখিয়ে কর্জ করবে—শক্ত হবে কেন? চোঙদার মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, তা বটে, কিন্তু পেলে হয়। আমাকে বলছিল কিনা। খবর শুনিয়া গোলোক উৎসুক হইয়া উঠিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, বলছিল নাকি? সুদ কি দিতে চায়? চোঙদার কহিলেন, চার পয়সা ত বটেই। হয়ত— এই ‘হয়ত’—টাকে গোলোক শেষ করিতে দিলেন না। রাগ করিয়া বলিলেন, চার পয়সা! টাকায় টাকা মারবে, আর সুদের বেলায় চার পয়সা! দশ আনা ছ’ আনা হয়ত, না হয় একবার দেখা করতে বলো। চোঙদার কিছু আশ্চর্য হইয়াই জিজ্ঞাসা করিল, টাকাটা আপনিই দেবেন নাকি সাহেবকে? কথাটা কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে— মুহূর্তে গোলোক নিজেকে সাবধান করিয়া লইয়া একটু শুষ্ক হাস্য করিয়া বলিলেন, রাধামাধব! তুমি ক্ষেপলে চোঙদার! বরঞ্চ, পারি ত নিষেধ করেই দেব। আর জানাজানির মধ্যে ত তুমি আর আমি। কিন্তু তাও বলি, টাকা ধার ও নেবেই, নিয়ে বাপের শ্রাদ্ধ করবে, কি বাই-নাচ দেবে, কি গরু চালান দেবে, তাতে মহাজনের কি? এই বলিয়া তাহার মুখের প্রতি সম্মতির জন্য ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া নিজেই বলিলেন, তা নয় চোঙদার, শুধু একটা কথার কথা বলচি যে, অত খোঁজ নিতে গেলে মহাজনের চলে না; কিন্তু আমাকে ত চিরকাল দেখে আসচ, ব্রাহ্মণের ছেলে, ধর্মপথে থেকে ভিক্ষে করি সে ভালো, কিন্তু অধর্মের পয়সা যেন কখনো না ছুঁতে হয়। কেবল তাঁর পদেই চিরদিন মতি স্থির রেখেচি বলেই আজ পাঁচখানা গ্রামের সমাজপতি। আজ মুখের একটা কথায় বামুনকে শূদ্দুর, শূদ্দুরকে বামুনের দলে তুলে দিতে পারি। মধুসূদন! তুমিই ভরসা! সেবার সেই ভারী অসুখে জয়গোপাল ডাক্তার বললে, সোডার জল আপনাকে খেতেই হবে। আমি বললুম, ডাক্তার, জন্মালেই মরতে হবে সেটা কিছু বেশী কথা নয়, কিন্তু গোলোক চাটুয্যেকে ও-কথা যেন আর দ্বিতীয়বার না কানে শুনতে হয়। কেনারামের পুত্র হররাম চাটুয্যের পৌত্রযাঁর একবিন্দু পাদোদকের আশায় স্বয়ং ভাঁড়ারহাটির রাজাকেও পালকি-বেহারা পাঠিয়ে দিতে হ’ত। চোঙদার দ্বিতীয়বার প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ও-কথা কে আর অস্বীকার করবে বলুন—ও ত পৃথিবীসুদ্ধ লোকে জানে। গোলোক প্রত্যুত্তরে শুধু কেবল একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, মধুসূদন! তুমিই ভরসা! চোঙদার প্রস্থানের উপক্রম করিতে তিনি ডাকিয়া কহিলেন, আর দেখ, হরেনের কাছ থেকে এলে, রেলের রসিদটা দেখিয়ে যেয়ো। চোঙদার ঘাড় নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে। গোলোক কহিলেন, তা হলে আট শ আর পাঁচ শ হলো! বাকী রইল সতের শ—মাসতিনেক সময় আছে—হয়ে যাবে, কি বল হে? চোঙদার বলিলেন, আজ্ঞে হয়ে যাবে বৈ কি। গোলোক কহিলেন, তাই তোমাকে তখনই বলেছিলুম চোঙদার, একেবারে ওটা পুরোপুরি হাজার-পাঁচেকের কন্‌টাক্টোই করে ফেল। তখন সাহস করলে না— চোঙদার কহিলেন, আজ্ঞে, অতগুলো ছাগল-ভেড়া যদি যোগাড় না হয়ে ওঠে— গোলোক প্রতিবাদ করিলেন না, কহিলেন, তাই ভাল, তাই ভাল। ধর্মপথে একের জায়গায় আধ, আধের জায়গায় সিকি হয় সেও ঢের, কিন্তু অধর্মের পথে মোহরও কিছু নয়। বুঝলে না চোঙদার? মধুসূদন! তুমিই ভরসা! চোঙদার আর কিছু না বলিয়া প্রস্থান করিলে ভগবদ্ভক্ত গৃহস্থ-সন্ন্যাসী চাটুয্যেমহাশয় দগ্ধ হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চিন্তিতমুখে তামাক টানিতে লাগিলেন, বিষয়কর্ম বোধ করি বা বিষের মতই বোধ হইতে লাগিল, কিন্তু এমনি সময়ে অন্দরের দিকের কবাটটা ঈষৎ উদ্ঘাটিত করিয়া দাসী মুখ বাড়াইয়া কহিল, মাসীমা একবার ভেতরে ডাকচেন। গোলোক চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন বল্‌ ত সদু? দাসী কহিল, একটুখানি জলখাবার নিয়ে বসে আছেন মাসীমা। গোলোক হুঁকাটা রাখিয়া দিয়া একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, তোর মাসীর জ্বালায় আর আমি পারিনে সদু। পর্বদিনটায় যে একবেলা উপবাস করব সে বুঝি তার সইল না! এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং যাইতে যাইতে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া গেলেন, সংসারে থেকে পরকালের দুটো কাজ করার কতই না বিঘ্ন! মধুসূদন! হরি! ঘ সন্ধ্যার শরীরটা কিছুদিন হইতে তেমন ভাল চলিতেছিল না। প্রায়ই জ্বর হইত, এবং পিতার চিকিৎসাধীনে থাকিয়া সে যেন ধীরে ধীরে মন্দের দিকেই পথ করিতেছিল। মা বিপিন ডাক্তারকে ডাকিয়া পাঠাইবেন বলিয়া প্রত্যহ ভয় দেখাইতেছিলেন, এবং এই লইয়া মাতায়-কন্যায় একটু না একটু কলহ প্রায় প্রতিদিনই ঘটিতেছিল। আজ সায়াহ্নবেলায় সন্ধ্যা সম্মুখের বারান্দায় একটি খুঁটি ঠেস দিয়া বসিয়া মাতৃ-প্রদত্ত সাগুর বাটিটা চোখ বুজিয়া নিঃশেষ করিল এবং তাড়াতাড়ি একটি পান মুখে পুরিয়া দিয়া কোনমতে সেগুলার ঊর্ধ্বগতি নিবারণ করিল। এই খাদ্যবস্তুটার প্রতি তাহার অতিশয় বিতৃষ্ণা ছিল, কিন্তু তথাপি না খাওয়া এবং কম খাওয়া লইয়া আর তাহার কথা সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা হইল না। কোথাও না কোথাও হইতে মা যে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াছেন, ইহা সে নিশ্চয় জানিত। ইতিপূর্বে বোধ হয় সে একখানা বই পড়িতেছিল—তাহার খোলা পাতাটা উপুড় করিয়া তাহার কোলের উপর রাখা ছিল, সেইখানা পুনরায় হাতে তুলিয়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেই শুনিতে পাইল প্রাঙ্গণের একপ্রান্ত হইতে ডাক আসিল, খুড়ীমা, কৈ গো? যে বাড়ি ঢুকিয়াছিল সে অরুণ। তাহার জামাকাপড় এবং পরিশ্রান্ত চেহারা দেখিলেই বুঝা যায় সেই এইমাত্র অন্যত্র হইতে আসিতেছে। মুহূর্তের জন্য সন্ধ্যার পাণ্ডুর মলিন মুখের উপর একটা রক্তিমাভা দেখা দিয়া গেল। সে চোখ তুলিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি বুঝি কোলকাতা থেকে আসচ অরুণদা? অরুণ কাছে আসিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, হাঁ, কিন্তু তোমাকে এমন শুক্‌নো দেখাচ্চে কেন? আবার জ্বর নাকি? সন্ধ্যা বলিল, ঐ-রকম কিছু একটা হবে বোধ হয়; কিন্তু তোমার চেহারাটাও ত খুব তাজা দেখাচ্চে না। অরুণ হাসিয়া কহিল, চেহারার আর অপরাধ কি?
false
humayun_ahmed
দেয়। ইংরে রাজ পরিবারকে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়। তাকে কি পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়েছিল? না। সে তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যায় এই বিষয়ে কোনো তথ্য নাই। আপনার কাছে কি এই ধরনের কোনো গল্প আছে? পরকাল থেকে কেউ ফিরে এসেছে? প্রশান্ত বাবু বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, না। আমি বললাম, প্রশান্ত বাবু! মানুষ যখন সত্যি কথা বলে তখন চোখের দিকে তাকিয়ে বলে। মিথ্যা যখন বলে, চোখ নামিয়ে নেয়। পরকাল থেকে মানুষ ফিরে আসার ব্যাপারটা নিয়ে আপনার আগ্ৰহ দেখে মনে হচ্ছে আপনি এ ধরনের কোনো গল্প জানেন। আমাকে গল্পটা বলুন আমি চেষ্টা করব লৌকিক ব্যাখ্যা দিতে। অতীন্দ্ৰিয় ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে আমার ভালো লাগে। আপনি খাওয়া-দাওয়া করুন। তারপর বলি। তবে আপনার কাছে আমি ব্যাখ্যা চাই না। ব্যাখ্যা ভগবানের কাছে চাই। আর কারো কাছে না।। আমি খেতে বসলাম। অতি উপাদেয় খিচুড়ি। হালকা পাঁচফুড়ুনের বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘিয়ের গন্ধ। খিচুড়ি রান্নায় অস্কার পুরস্কার থাকলে প্ৰশান্ত বাবু দুটা অস্কার পেতেন। আমি বললাম, গল্প শুরু করুন। প্ৰশান্ত বাবু অস্বস্তি এবং দ্বিধার সঙ্গে থেমে থেমে কথা বলা শুরু করলেন। ভাবটা এ রকম যে তিনি একটা খুন করেছেন। এখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছেন। আমার বড় ভাইয়ের নাম বিকাশ ভট্টাচার্য। তাঁর স্ত্রী এক মাসের শিশুপুত্ৰ রেখে একদিনের জ্বরে স্বৰ্গবাসী হন। আমার বড় ভাই পরম আদরে এবং যত্নে শিশুপুত্র লালন করতে থাকেন। আমরা কথায় বলি নয়নের মণি। আমার ভাইয়ের কাছে সত্যিকার অর্থেই তার পুত্র ছিল নয়নের মণি। সন্তান চোখের আড়াল হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তার হাঁপানির টান উঠে যেত। ছেলের যখন নয়। বৎসর বয়স তখন সে পানিতে ড়ুবে মারা যায়। ছেলেটার শখ ছিল বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পুকুর ঘাটে চলে যাওয়া। পানিতে চিল মেরে খেলা করা। দুপুরবেলা ভাই যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন সে পুকুরঘাটে খেলতে গিয়ে পা পিছলে মারা যায়। সোমবার সন্ধ্যায়। তাকে সাজনাতলা শ্মশানঘাটে দাহ করা হয়। আমার বড় ভাই উন্মাদের মতো হয়ে যান। চিৎকার করতে থাকেন— মানি না, মানি না। আমি ভগবান মানি না। ভগবানের মুখে আমি থুথু দেই! মানি না। আমি ভগবান মানি না। তখন বৈশাখ মাস। ঝড়-বৃষ্টির সময়! তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। দাহ হয়ে গেছে। লোকজন চলে গেছে। আমার বড় ভাইকে ঘরে আনার অনেক চেষ্টা করা হলো। তিনি এলেন না। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বসে রইলেন এবং কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করতে লাগলেন, মানি না, মানি না—আমি ভগবান মানি না। রাত তিনটায় তিনি শূন্য বাড়িতে ফিরলেন। শোবার ঘরে ঢুকে দেখেন— ঘরে হারিকেন জুলছে। খাটের উপর তার ছেলে বসে আছে। পা দুলাচ্ছে। আমার ভাই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পায় তাঁর জ্ঞান ফিরল। তখনো ছেলে খাটে বসা। ভাই বললেন, বাবা তুমি কে? সে বলল, আমি কমল! আমি এসেছি। কোথেকে এসেছ বাবা? পানির ভিতর থেকে। তুমি কি চলে যাবে? বন। আমার ভাই বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু তিনি একটি ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। চারদিকে প্রচার করলেন- পুত্ৰ শোক ভুলার জন্যে তিনি একটি কন্যা দত্তক নিয়েছেন। তিনি কমলকে মেয়েদের পোশাক পর্যালেন। তার নাম দিলেন কমলা। গ্রামের লোক সহজেই বিশ্বাস করল। দু’একজন শুধু বলল, পালক মেয়েটার সঙ্গে মৃত ছেলেটার চেহারার মিল আছে। আমি বললাম, ছেলেটা কি এখনো আছে? হুঁ আছে। কোথায়? ভাইজান তাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। গৌহাটিতে থাকেন। ছেলেটার কি মানুষের মতো বুদ্ধি আছে? প্রশান্ত বাবু বললেন, না। দশ বছর আগে সে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। সে কোনো খাদ্য খায় না। দিনে-রাতে কখনো ঘুমায় না। রাতে পুকুরঘাটে বসে থাকতে খুব পছন্দ করে। হামা-ভূতের ভয়ে অনেকদিন পুকুরঘাটে যাওয়া হয় না। আমি বললাম, আপনার বড় ভাইয়ের ছেলে তার বাবার সঙ্গে গৌহাটিতে থাকে। সেখানে হামা-ভূত গেল কিভারে? প্রশান্ত বাবু চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, বারান্দায় দুটা মেয়েদের জামা শুকোতে দেয়া আছে। আপনি একা থাকেন। মেয়েদের জামা কেন? ছেলেটা কি আপনার? প্রশান্ত বাবু বিড়বিড় করে বললেন, জে আর্জেন্তু, আমারই সস্তান। কত বছর আগের ঘটনা। অর্থাৎ কত বছর আগে ছেলে ফিরে এসেছে? একুশ বছর। ছেলে আগের মতোই আছে। বয়স বাড়েনি? প্রশান্ত বাবু জবাব দিলেন না। আমি বললাম, ছেলেটাকে ডাকুন। কথা বলি। না। আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে সে ভয় পায়। আমি বললাম, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। তার জন্যেও জরুরি। আপনার জন্যেও জরুরি। প্রশান্ত বাবু বললেন, না। আপনার সঙ্গে গল্পটা করে আমি বিরাট ভুল করেছি। ভুল আর বাড়াব না। আমি প্রশান্ত বাবুকে অগ্রাহ্য করে উঁচু গলায় ডাকলাম, কমল! কমল। নয়-দশ বছর বয়েসি মেয়েদের পোশাক পরা এক বালক দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল। আমাকে এক পলক দেখে বাবার দিকে আসতে শুরু করল। প্রশান্ত বাবু কঠিন গলায় বললেন, ঘরে যাও। ঘরে যাও বললাম। ছেলেটি ঘরের দিকে যাচ্ছে। এক পা টেনে টেনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, তার পায়ে কি সমস্যা? প্রশান্ত বাবু কঠিন গলায় বললেন, তার পায়ে কি সমস্যা সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নাই। হামা-ভূত রহস্য ভেদ করার জন্যে আমি গ্রামে এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-এর মর্যাদা পেলাম। আমাকে রেল স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্যে দুজন রওনা হলো। একজন মাথায় ছাতা ধরে
false
nihar_ronjon_gupta
তারপর? আমি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম—দেখলাম বাবা দুহাতে মার গলা টিপে ধরলেন। মা ছটফট করতে করতে একসময় এলিয়ে পড়লেন—আর বাবা তখন মার অচেতন দেহটা দুহাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরে এসে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিলেন। বিপাশা যেন একেবারে পাথর। অনন্য একটু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, পরের দিন পুলিশ এল—বাবার সঙ্গে সে-সুমকার পুলিশ কমিশনারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রায়ই তিনি আমাদের এখানে আসতেন, মার সঙ্গে বসে বসে গল্প করতেন– তিনি– তিনিই হচ্ছেন অবিনাশ মামা–মার আপন খুড়তুতো ভাই–যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত অবিনাশ মামাই ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে চাপা দিয়ে দেন বোধ হয়, অবিশ্যি সবটাই আমার ধারণা—আমি পুরোপুরি সব জানি না। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাবা ক্রমশ যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন। বেশীর ভাগই চুপচাপ—একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন—আপনমনে বিড় বিড় করতেন আর ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করতেন। ভাবতে পার সে-সময়কার মনের অবস্থা আমার বিপাশা, রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারতাম না, ঘুমোলেই দেখতাম এসে সামনে দাঁড়িয়েছে—মাথাটা ফেটে তার চৌচির হয়ে ঘিলু বের হয়ে পড়েছে—অনন্য দুহাতে মুখ ঢাকল। বিপাশা নিঃশব্দ স্থির প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে। অনন্য আবার বলতে লাগল, ক্রমশ বাবা যেন কেমন অ্যাবনরম্যাল হয়ে যেতে লাগলেন— ঐ সময় আমার পিসিমা এলেন আমাদের বাড়িতে পিসিমা আসাতে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাবার ঐ একমাত্র বোন, বিধবা বিবাহের তিন বৎসর পর পিসেমশাই একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন পিসিমা-বাবা তাকে নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাবা আর ভাল হলেন না। আমি যেবারে ম্যাট্রিক দিই—বাবা একেবারে ঘোর উন্মাদ হয়ে গেলেন—তখন ডাক্তারদের পরামর্শেই তাঁকে রাঁচীতে রেখে আসা হল। বুঝতেই পারছ তখন আমি বেশ বড় হয়েছি—সব বুঝতে পারি। এই বিরাট বাড়িতে তখন আমি, পিসিমা আর কিছুদিন হল বাবাকে দেখাশুনা করবার জন্য পরেশকে রাখা হয়েছিল, সেই পরেশ। পরেশ কিন্তু বাবাকে রাঁচীতে পাঠাতে চায় নি। সে বলেছিল বাবার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। সেই সর্বক্ষণ তার দেখাশুনা করবে। কিন্তু বাবা তখন রীতিমত ভায়োলেন্ট। সেখানকার চিকিৎসায়, অনন্য বলতে লাগল, বাবার অবস্থা ক্রমশ একটু একটু ভাল হয়ে উঠতে লাগল—অনেকটা শান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপর আর কোন প্রােগ্রেসই হয়নি! চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। আলো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না—অন্ধকার ঘরে থাকেন। ডাক্তাররা বললেন সুস্থ আর হবেন না আগের মত, আর স্বাভাবিক হবেন না। ব্রেনের কিছু সেলস্ অ্যাট্রফি করে গিয়েছে, বাবা সেই অবস্থাতেই এখনও আছেন—বি.এ. পড়ি যখন মধ্যে মধ্যে তাঁকে দেখতে যেতাম। তোমাকে চিনতে পারেন? না। আচ্ছা, ঐ যে মণির কথা বললে—সে— আমার ছোট একটি ভাই হয়েছিল, আমার থেকে আট বছরের ছোট-বাবা তাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন। এই সব কথা কতদিন তোমাকে বলব ভেবেছি, কিন্তু পারিনি বলতে। কে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে—আমার কণ্ঠ রোধ করেছে। বাবার কথা কোনদিনই আমি ভুলতে পারিনি। আমার মনের একটা অংশ যেন বাবা অধিকার করে রেখেছেন। তারপর দেখা দিল আমার মনের মধ্যে এক ভয়– ভয়! কিসের ভয়? বাবা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ান। একমাথা কাঁচা-পাকা রুক্ষ এলোমেলো চুল—একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি—আর বড় বড় দুটো রক্তচক্ষু। রাত্রে শয্যায় গিয়ে শুলেই যেন বাবার আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করত। আর মনে হত কে যেন অন্ধকারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতাম। দিনের বেলাটা কোন ভয় আতঙ্ক থাকত না-রাত্রি হলেই হত শুরু সেই ভয়ের বিভীষিকা। এমনি করেই চলছিল—তোমার সঙ্গে আলাপ হল ঐ সময়–কেন যেন তোমার কাছে গেলে আমার সবর্ভয় চলে যেত। বিপাশা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও অনন্যর মুখের দিকে। আশঙ্কা অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাস যেন তার দুচোখের দৃষ্টিতে। অনন্য আবার একটু থেমে বলতে লাগল, তুমি এলে এ-বাড়িতে—ভাবলাম আর বুঝি আমাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। দুঃস্বপ্নের পীড়ায় আমাকে বুঝি আর পীড়িত হতে হবে না। কটা দিন ভালই কাটল, কিন্তু ক্রমশ আবার যেন আগের সেই দ্বিধা, সংশয় ও ভয় আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল একটু একটু করে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। ঘুমোবার চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। মনে হত কে যেন দুহাতে ঠেলে আমাকে শয্যা থেকে তুলে দিচ্ছে। ঘরের বাইরে সিঁড়ির দিকে ঠেলছে—এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম উপরে—কে যেন ঠেলত আমাকে সামনের দিকে– দাদাবাবু! কে? আজ্ঞে আমি পরেশ। পরেশ এসে সামনে দাঁড়াল। ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকাল অনন্য পরেশের দিকে–বিরক্ত কণ্ঠে বললে, কি হয়েছে? দুজন বাবু এসেছেন— কে বাবু? একজন মনে হল সেই পুলিশ অফিসার—অন্যজনকে চিনতে পারলাম না। ব্যালকনির আলোটা তখনও জ্বালানো হয়নি—অন্ধকার। নীচের বাগানে অন্ধকারে ঝোপে ঝোপে একঝাক জোনাকি আলোর বিন্দু ছড়িয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আপনমনেই অনন্য বললে, আবার পুলিশ কেন! যা এইখানেই ডেকে আন— পরেশ চলে গেল। একটু পরেই সুদর্শনের সঙ্গে কিরীটী এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল। বিপাশা ইতিমধ্যে ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল। নমস্কার। সুদর্শন বললে, অনন্যবাবু, আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম। বসুন—অনন্য বললে। সুদর্শন বললে, এঁকে আপনি চিনবেন হয়তনাম হয়ত শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়। কিরীটী নামটা শুনেই বিপাশা যেন কেমন ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাল। সুদর্শন আবার বললে, পুলিশের বড়কর্তা মিঃ গুপ্তর নির্দেশেই উনি এখানে এসেছেন— কেন? অনন্য শুধাল। ক্যাঃ চৌধুরী যিনি কয়দিন আগে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে– বুঝেছি, তা আমার কাছে কেন মিঃ মল্লিক!
false
robindronath
মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।” এই বলিয়া মাতা পরমস্নেহে কর্মে অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেত্রপাত করিলেন। কেমন করিয়া এই অকর্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্বপ্রকার আরামে রাখিতে পারিবেন, বিনোদিনীর সহিত রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ। এই পুত্রসেবাব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিন্ত, পরম সুখী। সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্র বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ন হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত। মহেন্দ্রকে শুনাইয়া শুনাইয়া তিনি কহিলেন, “বউ, আজ তো তুমি মহিনের গরম কাপড় রোদে দিয়া তুলিলে, কাল মহিনের নূতন রুমালগুলিতে উহার নামের অক্ষর সেলাই করিয়া দিতে হইবে। তোমাকে এখানে আনিয়া অবধি যত্ন-আদর করিতে পারিলাম না বাছা, কেবল খাটাইয়া মারিলাম।” বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, অমন করিয়া যদি বল তবে বুঝিব তুমি আমাকে পর ভাবিতেছ।” রাজলক্ষ্মী আদর করিয়া কহিলেন, “আহা মা, তোমার মতো আপন আমি পাব কোথায়।” বিনোদিনীর কাপড়-তোলা শেষ হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এখন কি তবে সেই চিনির রসটা চড়াইয়া দিব, না, এখন তোমার অন্য কাজ আছে?” বিনোদিনী কহিল, “না, পিসিমা, অন্য কাজ আর কই। চলো মিঠাইগুলি তৈরি করিয়া আসি গে।” মহেন্দ্র কহিল, “মা, এইমাত্র অনুতাপ করিতেছিলে উহাকে খাটাইয়া মারিতেছ, আবার এখনই কাজে টানিয়া লইয়া চলিলে?” রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে যে কাজ করিতেই ভালোবাসে।” মহেন্দ্র কহিল, “আজ সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে কোনো কাজ নাই, ভাবিয়াছিলাম বালিকে লইয়া একটা বই পড়িব।” বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, বেশ তো, আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনেই ঠাকুরপোর বই-পড়া শুনিতে আসিব–কী বল।” রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “মহিন আমার নিতান্ত একলা পড়িয়াছে, এখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখা আবশ্যক।” কহিলেন, “তা বেশ তো, মহিনের খাবার তৈরি শেষ করিয়া আমরা আজ সন্ধ্যাবেলা পড়া শুনিতে আসিব। কী বলিস, মহিন।” বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একবার দেখিয়া লইল। মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা।” কিন্তু তাহার আর উৎসাহ রহিল না। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে-সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল। মহেন্দ্র রাগ করিয়া ভাবিল, “আমিও আজ বাহির হইয়া যাইব–দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিব।” বলিয়া তখনই বাহিরে যাইবার কাপড় পরিল। কিন্তু সংকল্প কাজে পরিণত হইল না। মহেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাদে পায়চারি করিয়া বেড়াইল, সিঁড়ির দিকে অনেক বার চাহিল, শেষে ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িল। বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিল, “আমি আজ মিঠাই স্পর্শ না করিয়া মাকে জানাইয়া দিব, এত দীর্ঘকাল ধরিয়া চিনির রস জ্বাল দিলে তাহাতে মিষ্টত্ব থাকে না।” আজ আহারের সময় বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানির ভয়ে প্রায় উপরে উঠিতে চান না, বিনোদিনী তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াই সঙ্গে আনিয়াছে। মহেন্দ্র অত্যন্ত গম্ভীর মুখে খাইতে বসিল। বিনোদিনী কহিল, “ও কী ঠাকুরপো, আজ তুমি কিছুই খাইতেছ না যে!” রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু অসুখ করে নাই তো?” বিনোদিনী কহিল, “এত করিয়া মিঠাই করিলাম, কিছু মুখে দিতেই হইবে। ভালো হয় নি বুঝি? তবে থাক্‌। না না, অনুরোধে পড়িয়া জোর করিয়া খাওয়া কিছু নয়। না না, কাজ নাই।” মহেন্দ্র কহিল, “ভালো মুশকিলেই ফেলিলে। মিঠাইটাই সব চেয়ে খাইবার ইচ্ছা, লাগিতেছেও ভালো, তুমি বাধা দিলে শুনিব কেন।” দুইটি মিঠাই মহেন্দ্র নিঃশেূর্বক খাইল–তাহার একটি দানা, একটু গুঁড়া পর্যন্ত ফেলিল না। আহারান্তে তিন জনে মহেন্দ্রের শোবার ঘরে আসিয়া বসিলেন। পড়িবার প্রস্তাবটা মহেন্দ্র আর তুলিল না। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুই কী বই পড়িবি বলিয়াছিলি, আরম্ভ কর-না।” মহেন্দ্র কহিল, “কিন্তু তাহাতে ঠাকুর-দেবতার কথা কিছুই নাই, তোমার শুনিতে ভালো লাগিবে না।” ভালো লাগিবে না! যেমন করিয়া হোক, ভালো লাগিবার জন্য রাজলক্ষ্মী কৃতসংকল্প। মহেন্দ্র যদি তুর্কি ভাষাও পড়ে, তাঁহার ভালো লাগিতেই হইবে। আহা বেচারা মহিন, বউ কাশী গেছে, একলা পড়িয়া আছে-তোহার যা ভালো লাগিবে মাতার তাহার ভালো না লাগিলে চলিবে কেন। বিনোদিনী কহিল, “এক কাজ করো-না ঠাকুরপো, পিসিমার ঘরে বাংলা শান্তিশতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না। পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।” মহেন্দ্র নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “মা, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।” কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সন্ধ্যার পর তাঁহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল্‌, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।” মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “কেন মা, তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।” বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিমা, তুমি এখানে থাকো, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে।” রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো–দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমারা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও–আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না।” রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবামাত্র মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না–বলিয়া উটিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।” বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী, ভাই! আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম। তবে কি তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।” বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠিবার উপক্রম করিল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “অমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।” বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না তোমারও তো প্রাণ কঠিন কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া
false
robindronath
কথা শুনিয়া আকাশপাতাল চিন্তা করিয়া কহিল, “কোন্‌ টাকার কথা বলছ। এর মধ্যে তোমার কাছ থেকে কিছু নিয়েছি নাকি।” ভূপতি সাল-তারিখ স্মরণ করাইয়া দিলে মতিলাল কহিল, “ওঃ, সেটা তো অনেকদিন হল তামাদি হয়ে গেছে।” ভূপতির চক্ষে তাহার চতুর্দিকের চেহারা সমস্ত বদল হইয়া গেল। সংসারের যে অংশ হইতে মুখোশ খসিয়া পড়িল সে দিকটা দেখিয়া আতঙ্কে ভূপতির শরীর কন্টকিত হইয়া উঠিল। হঠাৎ বন্যা আসিয়া পড়িলে ভীত ব্যক্তি যেখানে সকলের চেয়ে উচ্চ চূড়া দেখে সেইখানে যেমন ছুটিয়া যায়, সংশয়াক্রান্ত বহিঃসংসার হইতে ভূপতি তেমনি বেগে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল, মনে মনে কহিল, “আর যাই হোক, চারু তো আমাকে বঞ্চনা করিবে না।” চারু তখন খাটে বসিয়া কোলের উপর বালিশ এবং বালিশের উপর খাতা রাখিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া একমনে লিখিতেছিল। ভূপতি যখন নিতান্ত তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল তখনই তাহার চেতনা হইল, তাড়াতাড়ি তাহার খাতাটা পায়ের নীচে চাপিয়া বসিল। মনে যখন বেদনা থাকে তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়। চারু এমন অনাবশ্যক সত্বরতার সহিত তাহার লেখা গোপন করিল দেখিয়া ভূপতির মনে বাজিল। ভূপতি ধীরে ধীরে খাটের উপর চারুর পাশে বসিল। চারু তাহার রচনাস্রোতে অনপেক্ষিত বাধা পাইয়া এবং ভূপতির কাছে হঠাৎ খাতা লুকাইবার ব্যস্ততায় অপ্রতিভ হইয়া কোনো কথাই জোগাইয়া উঠিতে পারিল না। সেদিন ভূপতির নিজের কিছু দিবার বা কহিবার ছিল না। সে রিক্তহস্তে চারুর নিকটে প্রার্থী হইয়া আসিয়াছিল। চারুর কাছ হইতে আশঙ্কাধর্মী ভালোবাসার একটা-কোনো প্রশ্ন, একটা-কিছু আদর পাইলেই তাহার ক্ষত-যন্ত্রণায় ঔষধ পড়িত। কিন্তু ‘হ্যাদে লক্ষ্মী হৈল লক্ষ্মীছাড়া’, এক মুহূর্তের প্রয়োজনে প্রীতিভাণ্ডারের চাবি চারু যেন কোনোখানে খুঁজিয়া পাইল না। উভয়ের সুকঠিন মৌনে ঘরের নীরবতা অত্যন্ত নিবিড় হইয়া আসিল। খানিকক্ষণ নিতান্ত চুপচাপ থাকিয়া ভূপতি নিশ্বাস ফেলিয়া খাট ছাড়িয়া উঠিল এবং ধীরে ধীরে বাহিরে চলিয়া আসিল। সেই সময় অমল বিস্তর শক্ত শক্ত কথা মনের মধ্যে বোঝাই করিয়া লইয়া চারুর ঘরে দ্রুতপদে আসিতেছিল, পথের মধ্যে অমল ভূপতির অত্যন্ত শুষ্ক বিবর্ণ মুখ দেখিয়া উদ্‌বিগ্ন হইয়া থামিল, জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, তোমার অসুখ করেছে? ” অমলের স্নিগ্ধস্বর শুনিবামাত্র হঠাৎ ভূপতির সমস্ত হৃদয় তাহার অশ্রুরাশি লইয়া বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বাহির হইল না। সবলে আত্মসংবরণ করিয়া ভূপতি আর্দ্রস্বরে কহিল, “কিছু হয় নি, অমল। এবারে কাগজে তোমার কোনো লেখা বেরচ্ছে কি।” অমল শক্ত শক্ত কথা যাহা সঞ্চয় করিয়াছিল তাহা কোথায় গেল। তাড়াতাড়ি চারুর ঘরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বউঠান, দাদার কী হয়েছে বলো দেখি।” চারু কহিল, “কই, তা তো কিছু বুঝতে পারলুম না। অন্য কাগজে বোধ হয় ওঁর কাগজকে গাল দিয়ে থাকবে।” অমল মাথা নাড়িল। না ডাকিতেই অমল আসিল এবং সহজভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল দেখিয়া চারু অত্যন্ত আরাম পাইল। একেবারেই লেখার কথা পাড়িল–– কহিল, “আজ আমি ‘অমাবস্যার আলো’ বলে একটা লেখা লিখছিলুম; আর একটু হলেই তিনি সেটা দেখে ফেলেছিলেন।” চারু নিশ্চয় স্থির করিয়াছিল, তাহার নূতন লেখাটা দেখিবার জন্য অমল পীড়াপীড়ি করিবে। সেই অভিপ্রায়ে খাতাখানা একটু নাড়াচাড়াও করিল। কিন্তু, অমল একবার তীব্রদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চারুর মুখের দিকে চাহিল–– কী বুঝিল, কী ভাবিল জানি না। চকিত হইয়া উঠিয়া পড়িল। পর্বতপথে চলিতে চলিতে হঠাৎ এক সময়ে মেঘের কুয়াশা কাটিবামাত্র পথিক যেন চমকিয়া দেখিল, সে সহস্র হস্ত গভীর গহ্বরের মধ্যে পা বাড়াইতে যাইতেছিল। অমল কোনো কথা না বলিয়া একেবারে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। চারু অমলের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারের কোনো তাৎপর্য বুঝিতে পারিল না। একাদশ পরিচ্ছেদ পরদিন ভূপতি আবার অসময়ে শয়নঘরে আসিয়া চারুকে ডাকাইয়া আনাইল। কহিল, “চারু, অমলের বেশ একটি ভালো বিবাহের প্রস্তাব এসেছে।” চারু অন্যমনস্ক ছিল। কহিল, “ভালো কী এসেছে।” ভূপতি। বিয়ের সম্বন্ধ। চারু। কেন, আমাকে কি পছন্দ হল না। ভূপতি উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। কহিল, “তোমাকে পছন্দ হল কি না সে কথা এখনো অমলকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। যদি বা হয়ে থাকে আমার তো একটা ছোটো খাটো দাবি আছে, সে আমি ফস্‌ করে ছাড়ছি নে।” চারু। আঃ, কী বকছ তার ঠিক নেই। তুমি যে বললে, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। চারুর মুখ লাল হইয়া উঠিল। ভূপতি। তা হলে কি ছুটে তোমাকে খবর দিতে আসতুম? বকশিশ পাবার তো আশা ছিল না। চারু। অমলের সম্বন্ধ এসেছে? বেশ তো। তা হলে আর দেরি কেন। ভূপতি। বর্ধমানের উকিল রঘুনাথবাবু তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে অমলকে বিলেত পাঠাতে চান। চারু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বিলেত? ” ভূপতি। হাঁ,বিলেত। চারু। অমল বিলেত যাবে? বেশ মজা তো। বেশ হয়েছে, ভালোই হয়েছে তা তুমি তাকে একবার বলে দেখো। ভূপতি। আমি বলবার আগে তুমি তাকে একবার ডেকে বুঝিয়ে বললে ভালো হয় না? চারু। আমি তো তিন হাজার বার বলেছি। সে আমার কথা রাখে না। আমি তাকে বলতে পারব না। ভূপতি। তোমার কি মনে হয়, সে করবে না? চারু। আরো তো অনেকবার চেষ্টা দেখা গেছে, কোনোমতে তো রাজি হয় নি। ভূপতি। কিন্তু এবারকার এ প্রস্তাবটা তার পক্ষে ছাড়া উচিত হবে না। আমার অনেক দেনা হয়ে গেছে, অমলকে আমি তো আর সেরকম করে আশ্রয় দিতে পারব না। ভূপতি অমলকে ডাকিয়া পাঠাইল। অমল আসিলে তাহাকে বলিল, “বর্ধমানের উকিল রঘুনাথবাবুর মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাঁর ইচ্ছে বিবাহ দিয়ে তোমাকে বিলেত পাঠিয়ে দেবেন। তোমার কী মত।” অমল কহিল, “তোমার যদি অনুমতি থাকে,
false
humayun_ahmed
সাহেব বললেন, যারা যখ বানাতো তারা কিন্তু ভয়ংকর ছিলেন না। সাধারণ মানুষই ছিলেন। তাদের সংসার ছিল, ছেলেমেয়ে ছিল। তাঁরা ধর্ম-কর্ম করতেন, দান ধ্যান করতেন। তার পরেও ভয়ংকর ব্যাপারটা কোন না কোন ভাবে তাদের চরিত্রে ছিল। ছিল না? হ্যাঁ ছিল। যদি যখন থাকে তাহলে খনো আছে। মানুষ জন্মসূত্রে তার চরিত্রে এই ভয়ংকর ব্যাপারটি নিয়ে এসেছে। আমার ছবিটা মানুষের মনের ঐ দিকটাই দেখাবে। ছবির নাম কী হবে? নাম ঠিক করি নি। ছবিটা কি সত্যি সত্যি বানানো হবে? তাও জানি না। অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করে। করতে পারি কোথায়? টাকা নেই। টাকা নেই। আপনার স্ত্রী টাকা দেয়া বন্ধ করেছে? ডিরেক্টর সাহেব জবাব দিলেন না। হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বকুল যখের গল্পটা তোমার কাছে কেমন লাগল। প্রশ্নটা এমন আচমকা করা হল যে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমি যে গল্পটা এত আগ্রহের সঙ্গে শুনছি তা তিনি লক্ষ্য করবেন আমি ভাবি নি। এক পলকের জন্য আমার মনে হল আসলে গল্পটা তিনি আমাকেই শুনাতে চাচ্ছিলেন। পাপিয়া ম্যাডাম উপলক্ষ্য মাত্র। তার পরেই মনে হল–আরে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি–ঘুম আসছে না। এক সময় আমার নিজেকেই যখের মত মনে হল। আমি যেন একটা যখ — পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য আমার কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। অথচ এই সৌন্দর্য আমি উপভোগ করতে পারছি না। আমি শুধু পাহারা দিচ্ছি। আচ্ছা সব মানুষই কি খানিকটা যখের মত না? তাদের কাজ অন্যের ধনরত্ন পাহারা দেয়া। মা যেমন আমার ধনরত্ন পাহারা দিচ্ছেন, আমি অন্য একজনেরটা পাহারা দিচ্ছি। দূর পাগলের মত কী ভাবছি! আমার ঘুমিয়ে পড়া দরকার। মানুষের ইচ্ছা-ঘুমের ক্ষমতা থাকার খুব প্রয়োজন ছিল। ইচ্ছা করা মাত্র আনন্দময় ঘুম চোখে নামবে–আর কী শান্তি। তা-না ঘুমের জন্যে অন্য একজনের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সেই অন্য একজন ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুম আসবে। ঘুম পাড়াতে না চাইলে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে হবে। মওলানা মেরাজ মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে–ঘুম আসার কোন দোয়া তাঁর জানা আছে কি-না। মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। আজ তিনি বাতি জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে আসব–না বাতি জ্বালানোই থাকবে? বুঝতে পারছি না। ডাইরি লেখা যেতে পারে। মাঝে মাঝে আমি যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই আর ঘুম আসবে না, তখন ডাইরি লিখতে বসি। আজ সারাদিনে লেখার মত অনেক কিছুই ঘটেছে। মনে মনে রাফ করে ফেললে কেমন হয়। রাফ করতে করতে এক সময় হয়ত ঘুম এসে যাবে। আমি মনে মনে ডাইরি লেখা শুরু করলাম। হাতি ও পিঁপড়া সংবাদ হাতি এবং পিঁপড়া বিষয়ক একটা গল্প ডিরেক্টর সাহেব আমাকে বলেছেন। গল্পটা আমি আগেও শুনেছি। তবে তিনি অনেক মজা করে বলেছেন। এই মানুষটার গল্প বলার ক্ষমতা ভাল। তবে তিনি যে খুব ভাল গল্প বলেন তা তিনি জানেন। একজন যখন জেনে ফেলে সে খুব ভাল গল্প করতে পারে তখন তার গল্প বলায় ওস্তাদী একটা ভাব এসে পড়ে। উনার মধ্যেও তা এসেছে। আমার মামাও খুব ভাল গল্প বলতে পারেন। তবে তিনি তাঁর এই ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। জানেন না বলেই নিজের মনে মজা করে গল্প করেন। শুনতে অসম্ভব ভাল লাগে। হাতি এবং পিঁপড়ার এই গল্পটা মামাকে বললে–তিনি আরো অনেক বেশি মজা করে এই গল্প অন্যদের করবেন। তবে সমস্যা হচ্ছে কী, যারা খুব ভাল গল্প করতে পারে তারা শুধু নিজেরই গল্প করতে চায়। অন্যদের গল্প শুনতে চায় না। আমি নিজেও খুব ভাল গল্প করতে পারি। ডিরেক্টর সাহেবকে আমি একদিন আমার গল্প শুনাব। সেই একদিনটা কবে আমি জানি না। আজ উনাকে গল্প শুনাবার একটা সুযোগ আমার ছিল। আমি সেই সুযোগ গ্রহণ করি নি। হাফিজ আলির স্ত্রী হাফিজ আলির স্ত্রীর নাম, আমি এখনো জানি না। আমি কেন কেউই জানে না। এই মহিলা না-কি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। ইউনিটের সবাই এই মহিলার ব্যাপারে উৎসাহী। আমি উৎসাহী বোধ করছি না–তবে ভদ্রমহিলাকে আমার খুব দেখার শখ। একটা কাজ করলে কেমন হয়–একদিন চুপি চুপি দ্রমহিলার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়ে যদি বলি, শুনুন আমার নাম রেশমী। আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। আজ আমি এসেছি আপনার ভবিষ্যৎ বলতে। আপনি কি আপনার নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চান? তাহলে ভদ্রমহিলার মুখের ভাব কেমন হবে? তিনি কি নিজের ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী হবেন? সেলিম ভাই আমার ধারণা সেলিম ভাই খুব ভাল অভিনয় করবেন। তাকে ভাল অভিনয় করার ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি। তার ভেতরে আত্মবিশ্বাসের ভাব জাগিয়ে তুললেই হবে, আর কিছু লাগবে না। একজন যুবক ছেলের আত্মবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তখনই যখন সে হঠাৎ দেখে একটা তরুণী রূপবতী মেয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তখন সমস্ত পৃথিবীটা মনে হয় তার হাতের মুঠোয়। আমি অনায়াসেই সেলিম ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাবার অভিনয় করতে পারি। তবে এখন এই অভিনয় করলে লাভ হবে না। কারণ সেলিম ভাই নিজে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছেন। আমার দিকে তার তাকানোর ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি সবই পালটে গেছে। এখন আমি আর তাকে সাহায্য করতে পারব না। মা ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করে বললেন, বাবু ও বাবু। বাৰু। তিনি তার বাবাকে ডাকছেন। আহা বেচারী। আমি মার গায়ে হাত রাখলাম, কোমল গলায় ডাকলাম, মা মা। মা ঘুমের মধ্যেই বললেন, হুঁ! আমি
false
robindronath
ধন্য তুমি। তুমি কোমল, তুমি কিশোর, আর দৈত্যটা হল যেমন প্রবীণ তেমনি কঠোর; তুমি ছোটো, তোমার তূণ ছোটো, তোমার তীর ছোটো, আর ও হল বিপুল, ওর বর্ম মোটা, ওর গদা মস্ত। তুব তো দেখি, দিকে দিকে তোমার ধ্বজা উড়ল, দৈত্যটার পিঠের উপর তুমি পা রেখেছ; পাথর মানছে হার, ধুলো দাসখত লিখে দিচ্ছে।’ বট বললে, ‘তুমি এত সমারোহ কোথায় দেখলে।’ আমি বললেম, ‘তোমার লড়াইকে দেখি শান্তির রূপে, তোমার কর্মকে দেখি বিশ্রামের বেশে, তোমার জয়কে দেখি নম্রতার মূর্তিতে। সেইজন্যেই তো তোমার ছায়ায় সাধক এসে বসেছে ঐ সহজ যুদ্ধজয়ের মন্ত্র আর ঐ সহজ অধিকারের সন্ধিটি শেখবার জন্যে। প্রাণ যে কেমন ক’রে কাজ করে, অরণ্যে অরণ্যে তারই পাঠশালা খুলেছ। তাই যারা ক্লান্ত তারা তোমার ছায়ায় আসে, যারা আর্ত তারা তোমার বাণী খোঁজে।’ আমার স্তব শুনে বটের ভিতরকার প্রাণপুরুষ বুঝি খুশি হল; সে বলে উঠল, ‘আমি বেরিয়েছি মরুদৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে; কিন্তু আমার এক ছোটো ভাই আছে, সে যে কোন্ লড়াইয়ে কোথায় চলে গেল আমি তার আর নাগাল পাই নে। কিছুক্ষণ আগে তারই কথা কি তুমি বলছিলে।’ ‘হ্যাঁ, তাকেই আমরা নাম দিয়েছি, মন।’ ‘সে আমার চেয়ে চঞ্চল। কিছুতে তার সন্তোষ নেই। সেই অশান্তটার খবর আমাকে দিতে পার?’ আমি বললেম, ‘কিছু কিছু পারি বই কি। তুমি লড়ছ বাঁচবার জন্যে, সে লড়ছে পাবার জন্যে, আরও দূরে আর-একটা লড়াই চলছে ছাড়বার জন্যে। তোমার লড়াই অসাড়ের সঙ্গে, তার লড়াই অভাবের সঙ্গে, আরও একটা লড়াই আছে সঞ্চয়ের সঙ্গে। লড়াই জটিল হয়ে উঠল, ব্যূহের মধ্যে যে প্রবেশ করছে ব্যূহ থেকে বেরোবার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হার জিত অনিশ্চিত ব’লে ধাঁদা লাগল। এই দ্বিধার মধ্যে তোমার ঐ সবুজ পতাকা যোদ্ধাদের আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে, ’জয়, প্রাণের জয়।’ গানের তান বেড়ে বেড়ে চলেছে, কোন্ সপ্তক থেকে কোন্ সপ্তকে চড়ল তার ঠিকানা নেই। এই স্বর সংকটের মধ্যে তোমার তম্বুরাটি সরল তারে বলছে, ‘ভয় নেই, ভয় নেই।’ বলছে, ’এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে।’ ফাল্গুন ১৩২৬ বাঁশির বাণী চিরদিনের বাণী—শিবের জটা থেকে গঙ্গার ধারা, প্রতি দিনের মাটির বুক বেয়ে চলেছে; অমরাবতীর শিশু নেমে এল মর্ত্যের ধূলি দিয়ে স্বর্গ-স্বর্গ খেলতে। পথের ধারে দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনি আর মন যে কেমন করে বুঝতে পারি নে। সেই ব্যথাকে চেনা সুখদুঃখের সঙ্গে মেলাতে যাই, মেলে না। দেখি, চেনা হাসির চেয়ে সে উজ্জ্বল, চেনা চোখের জলের চেয়ে সে গভীর। আর, মনে হতে থাকে, চেনাটা সত্য নয়, অচেনাই সত্য। মন এমন সৃষ্টিছাড়া ভাব ভাবে কী করে। কথায় তার কোনো জবাব নেই। আজ ভোরবেলাতেই উঠে শুনি, বিয়েবাড়িতে বাঁশি বাজছে। বিয়ের এই প্রথম দিনের সুরের সঙ্গে প্রতি দিনের সুরের মিল কোথায়। গোপন অতৃপ্তি, গভীর নৈরাশ্য; অবহেলা, অপমান, অবসাদ; তুচ্ছ কামনার কার্পণ্য, কুশ্রী নীরসতার কলহ,ক্ষমাহীন ক্ষুদ্রতার সংঘাত, অভ্যস্ত জীবনযাত্রার ধূলিলিপ্ত দারিদ্র্য—বাঁশির দৈববাণীতে এসব বার্তার আভাস কোথায়। গানের সুর সংসারের উপর থেকে এই-সমস্ত চেনা কথার পর্দা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। চিরদিনকার বর-কনের শুভদৃষ্টি হচ্ছে কোন্ রক্তাংশুকের সলজ্জ অবগুণ্ঠনতলে, তাই তার তানে তানে প্রকাশ হয়ে পড়ল। যখন সেখানকার মালাবদলের গান বাঁশিতে বেজে উঠল তখন এখানকার এই কনেটির দিকে চেয়ে দেখলেম; তার গলায় সোনার হার, তার পায়ে দুগাছি মল, সে যেন কান্নার সরোবরে আনন্দের পদ্মটির উপরে দাঁড়িয়ে। সুরের ভিতর দিয়ে তাকে সংসারের মানুষ ব’লে আর চেনা গেল না। সেই চেনা ঘরের মেয়ে অচিন ঘরের বউ হয়ে দেখা দিলে। বাঁশি বলে, এই কথাই সত্য। ১৩২৬ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে— মাটির কাছে ধরা দেবে ব’লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে। তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই— আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী। কিন্তু, কোন দেবতার কৌতুকহাস্যের মতো অপরিমিত চঞ্চলতা নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঐ ছোটো মেয়েটির জন্ম। মা তাকে রেগে বলে ‘দস্যি’, বাপ তাকে হেসে বলে ‘পাগলি’। সে পলাতকা ঝর্নার জল, শাসনের পাথর ডিঙিয়ে চলে। তার মনটি যেন বেণুবনের উপর-ডালের পাতা, কেবলই ঝির্ ঝির্ করে কাঁপছে। ২ আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে— বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানা-ভেজা পাখির মতো। ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে। ৩ কিছুদিন আগে রৌদ্রের শাসন ছিল প্রখর; দিগন্তের মুখ বিবর্ণ; গাছের পাতাগুলো শুকনো হলদে, হতাশ্বাস। এমন সময় হঠাৎ কালো আলুথালু পাগলা মেঘ আকাশের কোণে কোণে তাঁবু ফেললে। সূর্যাস্তের একটা রক্তরশ্মি খাপের ভিতর থেকে তলোয়ারের মতো বেরিয়ে এল। অর্ধেক রাত্রে দেখি দরজাগুলো খড়্খড়্ শব্দে কাঁপছে। সমস্ত শহরের ঘুমটাকে ঝড়ের হাওয়া ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে। উঠে দেখি, গলির আলোটা ঘন বৃষ্টির মধ্যে মাতালের ঘোলা চোখের মতো দেখতে। আর গির্জের ঘড়ির শব্দ এল যেন বৃষ্টির শব্দের চাদর মুড়ি দিয়ে। সকালবেলায় জলের ধারা আরও ঘনিয়ে এল—
false
bongkim
তাহাকেই আহত, নিহত, অশ্বচরণবিদলিত করিয়া সম্মুখে তাহারা অগ্রসর হইতে লাগিল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া মুসলমান সেনাপতি সীতারামের গতিরোধ জন্য একটা কামান সূচীব্যূহের সম্মুখ দিকে পাঠাইলেন। ইতিপূর্বেই মুসলমানেরা দুর্গপ্রাচীর ভগ্ন করিবার জন্য কামান সকল তদুপযুক্ত স্থানে পাতিয়াছিল, এজন্য সূচীব্যূহের সম্মুখে হঠাৎ কামান আনিয়া উপস্থিত করিতে পারে নাই। এক্ষণে, রাজা রাণী পলাইতেছে জানিতে পারিয়া, বহু কষ্টে ও যত্নে একটা কামান তুলিয়া লইয়া সেনাপতি সূচীব্যূহের সম্মুখে পাঠাইলেন। নিজে সে দিকে যাইতে পারিলেন না; কেন না, দুর্গদ্বার মুক্ত পাইয়া অধিকাংশ সৈন্য লুঠের লোভে সেই দিকে যাইতেছে। সুতরাং তাঁহাকেও সেই দিকে যাইতে হইল—সুবাদারের প্রাপ্য রাজভাণ্ডার পাঁচ জনে লুঠিয়া না আত্মসাৎ করে। কামান আসিয়া সীতারামের সূচীব্যূহের সম্মুখে পৌঁছিল। দেখিয়া, সীতারামের পক্ষের সকলে প্রমাদ গণিল। কিন্তু শ্রী প্রমাদ গণিল না। শ্রী জয়ন্তী দুই জনে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া কামানের সম্মুখে আসিল। শ্রী, জয়ন্তীর মুখ চাহিয়া হাসিয়া, কামানের মুখে আপনার বক্ষ স্থাপন করিয়া, চারি দিক চাহিয়া ঈষৎ, মৃদু, প্রফুল্ল, জয়সূচক হাসি হাসিল। জয়ন্তীও শ্রীর মুখপানে চাহিয়া, তার পর গোলন্দাজের মুখপানে চাহিয়া, সেইরূপ হাসি হাসিল-দুই জনে যেন বলাবলি করিল-“তোপ জিতিয়া লইয়াছি |” দেখিয়া শুনিয়া, গোলন্দাজ হাতের পলিতা ফেলিয়া দিয়া বিনীতভাবে তোপ হইতে তফাতে দাঁড়াইল। সেই অবসরে সীতারাম লাফ দিয়া আসিয়া তাহাকে কাটিয়া ফেলিবার জন্য তরবারি উঠাইলেন। জয়ন্তী অমনি চীৎকার করিল, “কি কর! কি কর! মহারাজ রক্ষা কর!” “শত্রুকে আবার রক্ষা কি?” বলিয়া সীতারাম সেই উত্থিত তরবারির আঘাতে গোলন্দাজের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া তোপ দখল করিয়া লইলেন। দখল করিয়াই ক্ষিপ্রহস্ত, অদ্বিতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত সীতারাম, সেই তোপ ফিরাইয়া দিয়া আপনার সূচীব্যূহের জন্য পথ সাফ করিতে লাগিলেন। সীতারামের হাতে তোপ প্রলয়কালের মেঘের মত বিরামশূন্য গভীর গর্জন আরম্ভ করিল। তদ্বর্ষিত অনন্ত লৌহপিণ্ডশ্রেণীর আঘাতে মুসলমান সেনা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া সম্মুখ ছাড়িয়া চারি দিকে পলাইতে লাগিল। সূচীব্যূহের পথ সাফ! তখন সীতারাম অনায়াসে নিজ মহিষী ও পুত্র-কন্যা ও হতাবশিষ্ট সিপাহিগণ লইয়া মুসলমানকতক কাটিয়া বৈরিশূন্য স্থানে উত্তীর্ণ হইলেন। মুসলমানেরা দুর্গ লুঠিতে লাগিল। এইরূপে সীতারামের রাজ্যধ্বংস হইল। চতুর্বিশতিতম পরিচ্ছেদ শ্রী সন্ধ্যার পর জয়ন্তীকে নিভৃতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “জয়ন্তী! সেই গোলন্দাজ কে?” জ। যাহাকে মহারাজ কাটিয়া ফেলিয়াছেন? শ্রী। হাঁ, তুমি মহারাজকে কাটিতে নিষেধ করিয়াছিলে কেন? জ। সন্ন্যাসিনীর জানিয়া কি হইবে? শ্রী। না হয় একটু চোখের জল পড়িবে! তাহাতে সন্ন্যাসধর্ম ভ্রষ্ট হয় না। জ। চোখের জলই বা কেন পড়িবে? শ্রী। জীবন্তে আমি চিনিতে পারি নাই। কিন্তু তোমার নিষেধবাক্য শুনিয়া আমি মরা মুখখানা একটু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়াছিলাম। আমার একটা সন্দেহ হইতেছে। সে ব্যক্তি যেই হউক, আমিই তার মৃত্যুর কারণ। আমি তোপের মুখে বুক না দিলে সে অবশ্য তোপ দাগিত। তাহা হইলে মহারাজা নিশ্চিত বিনষ্ট হইতেন, গোলন্দাজকে তখন আর কে মারিত? জ। সে মরিয়াছে, মহারাজা বাঁচিয়াছেন, সে তোমার উপযুক্ত কাজই হইয়াছে-তবে আর কথায় কাজ কি? শ্রী। তবু মনের সন্দেহটা ভাঙ্গিয়া রাখিতে হইবে। জ। সন্ন্যাসিনীর এ উৎকণ্ঠা কেন? শ্রী। সন্ন্যাসিনীই হউক, যেই হউক, মানুষ মানুষই চিরকাল থাকিবে। আমি তোমাকে দেবী বলিয়াই জানি, কিন্তু যখন তুমিও লোকালয়ের লৌকিক লজ্জায় অভিভূত হইয়াছিলে, তখন আমার সন্ন্যাসবিভ্রংশের কথা কেন বল? জ। তবে চল, সন্দেহ মিটিয়া আসি। আমি সে স্থানে একটা চিহ্ন রাখিয়া আসিয়াছি- রাত্রেও সে স্থানের ঠিক পাইব। কিন্তু আলো লইয়া যাইতে হইবে। এই বলিয়া দুই জনে খড়ের মশাল তৈয়ার করিয়া তাহা জ্বালিয়া রণক্ষেত্র দেখিতে চলিল। চিহ্ন ধরিয়া জয়ন্তী অভীপ্সিত স্থানে পৌঁছিল। সেখানে মশালের আলো ধরিয়া তল্লাশ করিতে করিতে সেই গোলন্দাজের মৃতদেহ পাওয়া গেল। দেখিয়া শ্রীর সন্দেহ ভাঙ্গিল না। তখন জয়ন্তী সেই শবের রাশীকৃত পাকা চুল ধরিয়া টানিল—পরচুলা খসিয়া আসিল; শ্বেত শ্মশ্রু ধরিয়া টানিল-পরচুলা খসিয়া আসিল। তখন আর শ্রীর সন্দেহ রহিল না-গঙ্গারাম বটে। শ্রীর চক্ষু দিয়া অবিরল জলধারা পড়িতে লাগিল। জয়ন্তী বলিল, “বহিন, যদি এ শোকে কাতর হইবে, তবে কেন সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলে?” শ্রী বলিল, “মহারাজ আমাকে বৃথা ভর্ৎসনা করিয়াছেন। আমি তাঁহার প্রাণহন্ত্রী হই নাই—আপনার সহোদরেরই প্রাণঘাতিনী হইয়াছি। বিধিলিপি এত দিনে ফলিল |” জ। বিধাতা কাহার দ্বারা কাহার দণ্ড করেন, তাহার বলা যায় না। তোমা হইতেই গঙ্গারাম দুই বার জীবন লাভ করিয়াছিল, আবার তোমা হইতেই ইহার বিনাশ হইল। যাই হউক, গঙ্গারাম পাপ করিয়াছিল, আবার পাপ করিতে আসিয়াছিল। বোধ হয়, রমার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা জানে না, ছদ্মবেশে ছলনা দ্বারা তাহাকে লাভ করিবার জন্যই মুসলমান সেনার গোলন্দাজ হইয়া আসিয়াছিল। কেন না, রমা তাহাকে চিনিতে পারিলে কখনই তাহার সঙ্গে যাইবে না মনে করিয়া থাকিবে। বোধ হয়, শিবিকাতে, রমা ছিল মনে করিয়া, তোপ লইয়া পথ রোধ করিয়াছিল। যাই হৌক, উহার জন্য বৃথা রোদন না করিয়া, উহার দাহ করা যাক আইস। তখন দুই জনে ধরাধরি করিয়া গঙ্গারামের শব উপযুক্ত স্থানে লইয়া গিয়া দাহ করিল। জয়ন্তী ও শ্রী আর সীতারামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিল না। সেই রাত্রিতে তাহারা কোথায় অন্ধকারে মিশিয়া গেল, কেহ জানিল না। পরিশিষ্ট আমাদের পূর্বপরিচিত বন্ধুদ্বয় রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ ইতিপূর্বেই পলাইয়া নলডাঙ্গায় বাস করিতেছিলেন। সেখানে একখানি আটচালায় বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন। রা। কেমন হে ভায়া! মহম্মদপুরের খবরটা শুনেছ? শ্যা। আজ্ঞে হাঁ-সে ত জানাই ছিল। গড়—টড় সব মুসলমানে দখল করে লুঠপাট করে নিয়েছে। রা। রাজা-রাণীর কি হ’লো, কিছু ঠিক খবর রাখ? শ্যা। শোনা যাচ্ছে, তাঁদের না কি বেঁধে মুরশিদাবাদ চালান দিয়েছে। সেখানে না কি তাঁদের
false
robindronath
তিনি যোগমায়ার গাত্রস্পর্শপূর্বক শপথ করিতে উদ্যত হইলেও তাঁহার ব্যবহারে তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইত। তিনি মনে করিতেন, ‘নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এই পুত্রহীনা বিধবার প্রতি অন্যায় অত্যাচার করিত, তাই নিতান্ত সহ্য করিতে না পারিয়া পলাইয়া কাদম্বিনী আমার আশ্রয় লইয়াছে। যখন ইহার বাপ মা কেহই নাই তখন আমি ইহাকে কী করিয়া ত্যাগ করি।’ এই বলিয়া তিনি কোনোরূপ সন্ধান লইতে ক্লান্ত ছিলেন এবং কাদম্বিনীকেও এই অপ্রীতিকর বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া ব্যথিত করিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইত না। তখন তাঁহার স্ত্রী তাঁহার অসাড় কর্তব্যবুদ্ধিতে নানাপ্রকার আঘাত দিতে লাগিল। কাদম্বিনীর শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া যে তাঁহার গৃহের শান্তিরক্ষার পক্ষে একান্ত আবশ্যক, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন। অবশেষে স্থির করিলেন, হঠাৎ চিঠি লিখিয়া বসিলে ভালো ফল না’ও হইতে পারে, অতএব রানীহাটে তিনি নিজে গিয়া সন্ধান লইয়া যাহা কর্তব্য স্থির করিবেন। শ্রীপতি তো গেলেন, এ দিকে যোগমায়া আসিয়া কাদম্বিনীকে কহিল, “সই, এখানে তোমার আর থাকা ভালো দেখাইতেছে না। লোকে বলিবে কী।” কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে যোগমায়ার মুখের দিকে তাকাইয়া কহিল, “লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী।” যোগমায়া কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গেল। কিঞ্চিৎ রাগিয়া কহিল, “তোমার না থাকে, আমাদের তো আছে। আমরা পরের ঘরের বধূকে কী বলিয়া আটক করিয়া রাখিব।” কাদম্বিনী কহিল, “আমার শ্বশুরঘর কোথায়।” যোগমায়া ভাবিল, ‘আ মরণ! পোড়াকপালি বলে কী ?’ কাদম্বিনী ধীরে ধীরে কহিল, “আমি কি তোমাদের কেহ। আমি কি এ পৃথিবীর। তোমরা হাসিতেছ, কাঁদিতেছ, ভালোবাসিতেছ, সবাই আপন আপন লইয়া আছ, আমি তো কেবল চাহিয়া আছি। তোমরা মানুষ, আর আমি ছায়া। বুঝিতে পারি না, ভগবান আমাকে তোমাদের এই সংসারের মাঝখানে কেন রাখিয়াছেন। তোমরাও ভয় কর পাছে তোমাদের হাসিখেলার মধ্যে আমি অমঙ্গল আনি – আমিও বুঝিয়া উঠিতে পারি না, তোমাদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। কিন্তু, ঈশ্বর যখন আমাদের জন্য আর-কোনো স্থান গড়িয়া রাখেন নাই, তখন কাজে-কাজেই বন্ধন ছিঁড়িয়া যায় তবু তোমাদের কাছেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াই।” এমনিভাবে চাহিয়া কথাগুলা বলিয়া গেল যে, যোগমায়া কেমন একরকম করিয়া মোটের উপর একটা কী বুঝিতে পারিল, কিন্তু আসল কথাটা বুঝিল না, জবাবও দিতে পারিল না। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করিতেও পারিল না। অত্যন্ত ভারগ্রস্ত গম্ভীর ভাবে চলিয়া গেল। চতুর্থ পরিচ্ছেদ রাত্রি প্রায় যখন দশটা তখন শ্রীপতি রানীহাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। মুষলধারে বৃষ্টিতে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতেছে। ক্রমাগতই তাহার ঝর্ ঝর্ শব্দে মনে হইতেছে, বৃষ্টির শেষ নাই, আজ রাত্রিরও শেষ নাই। যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইল।” শ্রীপতি কহিলেন, “সে অনেক কথা। পরে হইবে।” বলিয়া কাপড় ছাড়িয়া আহার করিলেন এবং তামাক খাইয়া শুইতে গেলেন। ভাবটা অত্যন্ত চিন্তিত। যোগমায়া অনেকণ কৌতূহল দমন করিয়া ছিলেন, শয্যায় প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী শুনিলে, বলো।” শ্রীপতি কহিলেন, “নিশ্চয় তুমি একটা ভুল করিয়াছ।” শুনিবামাত্র যোগমায়া মনে মনে ঈষৎ রাগ করিলেন। ভুল মেয়েরা কখনোই করে না; যদি-বা করে কোনো সুবুদ্ধি পুরুষের সেটা উল্লেখ করা কর্তব্য হয় না, নিজের ঘাড় পাতিয়া লওয়াই সুযুক্তি। যোগমায়া কিঞ্চিৎ উষ্ণভাবে কহিলেন, “কিরকম শুনি।” শ্রীপতি কহিলেন, “যে স্ত্রীলোকটিকে তোমার ঘরে স্থান দিয়াছ সে তোমার সই কাদম্বিনী নহে।” এমনতরো কথা শুনিলে সহজেই রাগ হইতে পারে – বিশেষত নিজের স্বামীর মুখে শুনিলে তো কথাই নাই। যোগমায়া কহিলেন, “আমার সইকে আমি চিনি না, তোমার কাছ হইতে চিনিয়া লইতে হইবে – কী কথার শ্রী।” শ্রীপতি বুঝাইলেন, এ স্থলে কথার শ্রী লইয়া কোনোরূপ তর্ক হইতেছে না, প্রমাণ দেখিতে হইবে। যোগমায়ার সই কাদম্বিনী যে মারা গিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। যোগমায়া কহিলেন, “ঐ শোনো। তুমি নিশ্চয় একটা গোল পাকাইয়া আসিয়াছ। কোথায় যাইতে কোথায় গিয়াছ, কী শুনিতে কী শুনিয়াছ তাহার ঠিক নাই। তোমাকে নিজে যাইতে কে বলিল, একখানা চিঠি লিখিয়া দিলেই সমস্ত পরিষ্কার হইত।” নিজের কর্মপটুতার প্রতি স্ত্রীর এইরূপ বিশ্বাসের অভাবে শ্রীপতি অত্যন্ত ক্ষুন্ন হইয়া বিস্তারিতভাবে সমস্ত প্রমাণ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনো ফল হইল না। উভয় পক্ষে হাঁ না করিতে করিতে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইয়া গেল। যদিও কাদম্বিনীকে এই দণ্ডেই গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া সম্বন্ধে স্বামী স্ত্রী কাহারও মতভেদ ছিল না – কারণ, শ্রীপতির বিশ্বাস তাঁহার অতিথি ছদ্মপরিচয়ে তাঁহার স্ত্রীকে এতদিন প্রতারণা করিয়াছে এবং যোগমায়ার বিশ্বাস সে কুলত্যাগিনী – তথাপি উপস্থিত তর্কটা সম্বন্ধে উভয়ের কেহই হার মানিতে চাহেন না। উভয়ের কণ্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চ হইয়া উঠিতে লাগিল, ভুলিয়া গেলেন পাশের ঘরেই কাদম্বিনী শুইয়া আছে। একজন বলেন, “ভালো বিপদেই পড়া গেল। আমি নিজের কানে শুনিয়া আসিলাম।” আর-একজন দৃঢ়স্বরে বলেন, “সে কথা বলিলে মানিব কেন, আমি নিজের চক্ষে দেখিতেছি।” অবশেষে যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, কাদম্বিনী কবে মরিল বলো দেখি।” ভাবিলেন কাদম্বিনীর কোনো-একটা চিঠির তারিখের সহিত অনৈক্য বাহির করিয়া শ্রীপতির ভ্রম সপ্রমাণ করিয়া দিবেন। শ্রীপতি যে তারিখের কথা বলিলেন, উভয়ে হিসাব করিয়া দেখিলেন, যেদিন সন্ধ্যাবেলায় কাদম্বিনী তাঁহাদের বাড়িতে আসে সে তারিখ ঠিক তাহার পূর্বের দিনেই পড়ে। শুনিবামাত্র যোগমায়ার বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল, শ্রীপতিরও কেমন একরকম বোধ হইতে লাগিল। এমন সময়ে তাঁহাদের ঘরের দ্বার খুলিয়া গেল, একটা বাদলার বাতাস আসিয়া প্রদীপটা ফস্ করিয়া নিবিয়া গেল। বাহিরের অন্ধকার প্রবেশ করিয়া এক মুহূর্তে সমস্ত ঘরটা আগাগোড়া ভরিয়া গেল। কাদম্বিনী একেবারে ঘরের ভিতর আসিয়া দাঁড়াইল। তখন রাত্রি আড়াই প্রহর হইয়া গিয়াছে, বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতেছে। কাদম্বিনী কহিল, “সই, আমি তোমার সেই কাদম্বিনী, কিন্তু এখন আমি আর বাঁচিয়া নাই।
false
toslima_nasrin
কি ঘটছে? বড় বড় মাঠে ময়দানে ঘটছে কি? সিলেটে ২৯ জুলাইএর লং মার্চ সফল করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারী ময়দানে ভাষণ দেন ইসলাম ও রাষ্ট্রদোহী প্রতিরোধ মোর্চার মহাসচিব মাওলানা ফজলুল হক আমিনী। বিশাল ময়দান, বিশাল জমায়েত, বিশাল ভাষণ। সিলেট ঘুরে এসে বিবৃতি দিয়েছেন, সিলেটসহ সারা দেশে যে গণজাগরণ দেখে এসেছি তাতে প্রতীয়মান হয় যে আগামী ২৯ জুলাই পবিত্র কোরান দিবসে ঢাকায় তৌহিদী জনতার ঢল নামবে। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ জনতা লং মার্চ করে ঢাকায় আসার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তৌহিদী জনতার ঈমানের জোয়ারে সেদিন নাস্তিক মুরতাদ চক্রের দাফন করা হবে। ৩০ জুন সফল হরতাল পালিত হওয়ার পর প্রায় ৯ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল, অথচ সরকার আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেনি। এনজিওদের পক্ষে সরকারের কোন কোন মন্ত্রীর সমর্থন এবং আলেম উলেমাদের ঢালাওভাবে ফতোয়াবাজ আখ্যা দানে জনমনে আরও পরম ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের এহেন ভূমিকা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। কিন্তু আমাদের নিয়মতান্ত্রিকতাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে। চট্টগ্রামে নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসার উদ্যোগে শাহাদাতে কারবালা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে আজকে এক শ্রেণীর মুরতাদ নাস্তিক ধর্মদ্রোহী দেশ হতে ঈমানী আওয়াজকে বন্ধ করার জন্য এবং দেশকে একটি নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তসলিমার মত বেহায়া, নাস্তিক মহিলাকে এ কাজে লেলিয়ে দিয়ে কোরান হাদিস এবং দ্বীনি ধ্যান ধারণার ওপর নির্লজ্জ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় শাহাদাতে কারবালার দীপ্ত শপথ নিয়ে সকল ধর্মদ্রোহী মুরতাদদের প্রতিহত করার আহবান জানিয়ে বক্তারা বলেন, ১২ কোটি ইসলামপ্রিয় মানুষ দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সকল ইসলামদ্রোহীদের বিষদাঁত ভেঙে দেবেই। আরও খবর। ঢাকা ভার্সিটির ২৬৫ জন ছাত্র ছাত্রীর বিবৃতি। তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার করুন। আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির ছাত্র শাখার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬৫ জন ছাত্র ছাত্রী এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও জাতীয় উজ্জীবন নিশ্চিত করার জন্য দেশে বিদেশে নিন্দিত, চরম সাম্প্রদায়িক, আমাদের এই রাষ্ট্র ও তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের শত্রু, ভারতের বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি, আনন্দবাজারীদের সেবাদাসী তসলিমা নাসরিনকে ধর্ম এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন এ লেখিকা দেশে বিদেশে মুদ্রিত তার লেখায়, সাক্ষাতকারে আলাপ আলোচনায় যে আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বিবৃতিতে তিন দিনের মধ্যে তসলিমাকে গ্রেফতার ও তার সমর্থক পত্রিকাগুলোকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলা হয়, আমরা অবিলম্বে উক্ত লেখিকার সমস্ত রচনার মুদ্রণ, পুনঃমুদ্রণ ও অনুবাদ দেশে বিদেশে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। তসলিমার মত রাষ্ট্রদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, ধর্ম ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বদ্রোহীকে প্রতিহত করে স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও জাতীয় উজ্জীবন অব্যাহত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে সচেতন ও দেশপ্রেমিক সকল ছাত্রছাত্রী ভাই বোনসহ সমগ্র জাতির প্রতিও আহবান জানাচ্ছি। বিবৃতি প্রদানকারীদের মধ্যে আছেন, মোঃ মনিরুজ্জামান, মোঃ আবদুল লতিফ, মোঃ ইউছুফ আলী, মোঃ ছফিউল্লাহ, মোঃ মাহবুবুর রহমান, মোঃ সেলিম রেজা, মোঃ ফজলুর রহমান, নার্গিস আখতার প্রমুখ। ঢাকায় যুব কমাণ্ডের বিশাল সভায় বলা হয়েছে, ৩০ জুনের গণরায়কে পাশ কাটানোর পদক্ষেপ দেশবাসী মানবে না। ওদিকে দিনাজপুরে মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে জামাতে ইসলামীর ডাকে বিক্ষোভ দিবস পালন হয়। পবিত্র কোরান অবমাননাকারী ধর্মদ্রোহী মুরতাদদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ এই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। সকালে প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে, পরে জেলা প্রশাসককে ৮ দফা দাবির একটি স্মারকলিপি দেয় জামাতিরা। এ সময় কী ঘটছে আমার জীবনে, কী হচ্ছে দেশে, তা পত্রিকার সংবাদগুলোই দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি তো সারাদিন অন্ধকার ঘরে গা ঢেকে মাথা ঢেকে বসেই আছি। বসে থাকতে থাকতে পিঠে খিল ধরে যায়, পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে। আমার তো আর বিশেষ কোনও খবর নেই। হঠাৎ হঠাৎ আমার বসে থাকার স্থবিরতায় কেউ কেউ তরঙ্গ তুলে উদয় হন। জ উদয় হলেন দুপুরবেলা। দেশের অবস্থা সম্পর্কে জর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা হওয়ার পর যখন চুপচাপ বসে আছি দুজনই একটি হতাশার দিকে তাকিয়ে, জ চুলের কথা তোলেন। ঙই নাকি জকে দিয়ে চুল কিনিয়েছেন। চুল! এই চুলটি কিছুতেই আসলে আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। ভূত হয়ে দিনরাতই ভয় দেখাচ্ছে। গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় চুলের ভয়ে। চুলের প্রসঙ্গ আমাকে এত অস্বস্তি দিতে থাকে যে আমি প্রসঙ্গ পাল্টে দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছের দিকে নজর দিই। দেশের কথা বলতে বলতেই সুফিয়া কামালের প্রসঙ্গ ওঠে। জ সুফিয়া কামালের প্রশংসা করছেন কারণ এই এত বয়স হওয়ার পরও তিনি সভায় যাচ্ছেন, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহবান জানাচ্ছেন। সুফিয়া কামালকে তিনি খালাম্মা বলে স−ম্বাধন করেন। শুধু জ নন, সুফিয়া কামালের বয়সে ছোট সবাই তাঁকে খালাম্মা বলে, তিনি হয়ে গেছেন জাতীয় খালাম্মা। জাহানারা ইমামকে ডাকা হয় আম্মা বলে। আম্মা আর খালাম্মা ডাক আমার মুখ দিয়ে কখনও বেরোয়নি। আমি পারি না হঠাৎ কাউকে আম্মা বলে ডাকতে। ওসব ডাকলেই যে সম্মান দেখানো হয়, না ডাকলে হয় না, তা আমি মানি না। সুফিয়া কামালকে সুফিয়া কামাল ডেকেই আমি যথেষ্ট সম্মান করতে পারি। তিনি জাতীয় সমন্বয় কমিটির এক সভায় মানুষকে বলেছেন, আল্লাহর নাম নিয়ে জেগে উঠুন, মৌলবাদীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করুন। সুফিয়া কামাল নিজে খুব ধর্মবিশ্বাসী মানুষ, তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকেই মানুষকে
false
shunil_gongopaddhay
দিয়ে বললেন, সেই ব্যাপারেই আপনাকে দু-একটা কথা বলতে এসেছি। আপনি এই হোটেলে যতদিন খুশি থাকতে পারেন। যদি কোথাও বেড়াতে যেতে চান, ভিক্টোরিয়া লেক কিংবা কিলিমাঞ্জারো পাহাড়ে, তারও সব ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মাসাইমারা ফরেস্টে যে হোটেলে আপনাদের যাওয়ার কথা আমার কাকা আপনাদের বলে দিয়েছেন, সেখানে যাওয়াটা ঠিক হব কি না, তাতেই একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কাকাবাবু বললেন, আমরা সেখানে গেলে আপনাদের অসুবিধে হবে? তা হলে থোক, যাব না? অশোক দেশাই একটু জোরে বলে উঠলেন, না, না, আমাদের অসুবিধে কিছু নেই। আপনি গেলে আমরা খুশিই হব। কিন্তু আপনি আমাদের মাননীয় অতিথি, সেখানে গিয়ে যদি আপনার খারাপ লাগে, মানে… কেন, সেখানে খারাপ লাগবে কেন! আপনার কোকা সে-জায়গাটার উচ্চ প্ৰশংসা করছিলেন। মাসাইমারা ফরেস্ট আমারও দেখার খুব ইচ্ছে আছে। বিশ্ববিখ্যাত ফরেস্ট, আমার ভাইপোকে নিয়ে এসেছি, ওরাও খুব ভাল লাগবে এই আশা করে… তা হলে পুরো ব্যাপারটা আপনাকে খুলে বলতে হয়। বলুন। মাসাইমারা গেইম রিজার্ভের একেবারে মাঝখানে কয়েকটা হোটেল আছে। তার মধ্যে একটা আমরা নিয়েছি। এখনও কিনিনি। আপাতত ম্যানেজমেন্টের ভার নিয়েছি। ছ। মাস দেখার পর পুরোপুরি কিনে নেব, এরকম কথা আছে। সেই হোটেলের নাম লিটল ভাইসরয়। অদ্ভুত নাম তো। ভাইসরয় আবার লিটল? এ-নামটারও একটা ইতিহাস আছে। আগে ওখানে শুধু ভাইসরয় নামে একটা হোটেল ছিল। তারপর খুব কাছাকাছিই আর-একটা হোটেল খোলা হল, তার নাম দেওয়া হল লিটল ভাইসরয়। আসলে কিন্তু দ্বিতীয় হোটেলটা, যেটা নতুন সেটাই বেশি বড়। ক্রমে এক সময় মূল ভাইসরয় হোটেল উঠে গেল, কিন্তু অন্য হোটেলের নাম লিট্‌ল ভাইসরয়ই রয়ে গেল। এই হোটেলটাই এখন আমাদের। সেখানে আমি গেলে আপনাদের কি অসুবিধে হবে? না না, আমাদের অসুবিধের কোনও প্রশ্নই নেই। বরং আপনার মতন একজন মানুষ গেলে আমাদের খুবই উপকার হতে পারে। আমার কাকা সেই কথা ভেবেই আপনাকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভাল-মন্দ সব দিক আপনাকে আগে জানানো দরকার বলে আমি মনে করি। সেটাই আমার নীতি। মন্দ দিক কিছু আছে বুঝি? মিঃ রায়চৌধুরী, লিটল ভাইসরয় খুব দামি হোটেল। ওটা চালাবার খরচ অনেক। প্রধানত ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানরাই ওখানে বেড়াতে যায়। কিন্তু গত তিন-চার মাস ধরে ওখানে টুরিস্টের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। লোকে ভয়ে ওখানে যেতে চাইছে না। হোটেলের দুজন বোর্ডার রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁজে পাওয়া যায়নি মনে হারিয়ে গেছে, না কোথাও কোনও জন্তু-জানোয়ারের হাতে পড়েছে? প্রথমত ওখানে আমরা খুব সাবধানতা অবলম্বন করি। জন্তু-জানোয়ারের হাতে পড়ার প্রায় কোনও সম্ভাবনাই নেই। দ্বিতীয়ত, কোনও জন্তু-জানোয়ারের মুখে যদি দৈবাৎ পড়েও যায়, কোনও জানোয়ারই তো মানুষের জামা-কাপড় সুন্ধু খেয়ে ফেলে না। তাদের কোনওরকম চিহ্নই পাওয়া যায়নি। সন্তু ফশ করে বলল, যদি কুমির কিংবা জলহস্তী জলের তলায় টেনে নিয়ে যায়? অশোক দেশাই সন্তুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দুজন মানুষকে এক সঙ্গে জলের তলায় টেনে নেবে? এরকম ঘটনা এখানকার ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তা ছাড়া লোক দুটি তো বোকা নয়, দুজনেই জার্মান ব্যবসায়ী। কাকাবাবু বললেন, সেই ঘটনাটি রটে গেছে, তাই টুরিস্ট যেতে চায় না? শুধু সেই জন্যই নয়। এর পরেও যারা গেছে, তারা ফিরে এসে অভিযোগ করেছে যে, রাত্তিরে তারা ঘুমোতে পারে না। কিসের যেন একটা অস্বস্তি হয়। যদিও আমাদের ব্যবস্থার কোনও ক্রুটি নেই.হোটেলটা চালাতে গিয়ে এখন আমাদের খুবই ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এখন আপনি ভেবে দেখুন। সেখানে যাবেন কি না। মিঃ নিনজানে বললেন, আপনার কোনও বিপদ হোক, তা আমরা কেউ চাই না। কাকাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, হ্যারি ওটাংগোর ঠিক কী হয়েছিল। আপনারা জানেন? দেশাই আর নিনজানে দুজনেই যেন চমকে উঠল। এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। নিনজানে একটা রুমাল বার করে কপাল মুছল, অশোক দেশাই বলল, আপনি…আপনি হ্যারি ওটাংগোর নাম জানলেন কী করে? কাকাবাবু বললেন, উনি বিখ্যাত লোক, সারা পৃথিবীর লোক ওঁর নাম জানে। উনি কয়েক মাস আগে অদ্ভুতভাবে মারা গেলেন, কাগজে পড়েছি। দেশাই বলল, উনি কোনও হিংস্ৰ জন্তুর সামনে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, এইটুকুই আমরা জানি। নিনজানে খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল, ওই ওটাংগোর সঙ্গে আমাদের হোটেলের কী সম্পর্ক? মাসাইমারায় গেলে আপনাদের যাতে কোনও বিপদ না হয়, সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব। কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারি। আমি সেজন্য ও-কথা জিজ্ঞেস করিনি। দেশাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনি বেড়াতে এসেছেন, মনের সুখে বেড়ান। এখানকার ঝঞাটি নিয়ে মাথা ঘামাবেন কেন? সেজন্যই আপনাকে ওই হোটেলটায় পাঠাতে চাইছিলাম না। আবার পরের বছর আসনু না! তখন হোটেলটা ঠিকমতন চালু হয়ে যাবে। কাকাবাবু হাসিমুখে তাকালেন সন্তুর দিকে। তারপর বললেন, আমাদাবাদের ভুলাভাই দেশাই অতি চালাক লোক। এখানে আমাদের পাঠাবার সময় এমনভাবে কথা বলল, যেন আমাকে কোনও কাজ করতে হবে না, মাথা খাটাতে হবে না, শুধু বেড়ানো আর বিশ্রাম। কিন্তু তার মনে একটা মতলব ছিল ঠিকই, এখন সেটা বোঝা যাচ্ছে। অশোক দেশাই বললেন, আপনি ওখানে না যেতে চাইলে আমরা মোটেই ইনসিস্ট করব না। আপনি যত দিন খুশি বিশ্রাম নিন, ইচ্ছে মতো বেড়ান, তারপর ফিরে যান। কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বিপদের গন্ধ পেলে আমি যে সেখানে না গিয়ে পারি না। মাসাইমারা যেতেই হবে। কী বলিস, সন্তু? সন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল। কাকাবাবু বললেন, আপনারা আমাদের যাবার ব্যবস্থা করুন। আরও দু-একদিন বরং ভেবে দেখুন, তারপর ঠিক করুন।
false
shorotchandra
এসেছেন তাই বটে। সত্যিই আমরা খুব কষ্ট করে থাকি। কিন্তু থাকেন কেন? অজিতবাবু বড়লোক, আপনার নিজের অবস্থাও অসচ্ছল নয়,—কষ্ট পাওয়ার ত কারণ নেই। হরেন্দ্র কহিল, কারণ না থাক, প্রয়োজন আছে। আমার বিশ্বাস এ আপনিও বোঝেন বলে নিজের সম্বন্ধেও এমনি ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। অথচ বাইরে থেকে কেউ যদি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে বসে, তাকেই কি এর হেতু দিতে পারেন? কমল বলিল, বাইরের লোককে না পারি, ভিতরের লোককে দিতে পারব। আমি সত্যিই বড় দরিদ্র, নিজেকে ভরণ-পোষণ করবার যতটুকু শক্তি আছে তাতে এর বেশী চলে না। বাবা আমাকে দিয়ে যেতে পারেন নি কিছুই, কিন্তু পরের অনুগ্রহ থেকে মুক্তি পাবার এই বীজমন্ত্রটুকু দান করে গিয়েছিলেন। হরেন্দ্র তাহার মুখের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। এই বিদেশে কমল যে কিরূপ নিরুপায় তাহা সে জানিত। শুধু অর্থের জন্যই নয়,—সমাজ, সম্মান, সহানুভূতি কোন দিক দিয়াই তাহার তাকাইবার কিছু নাই। কিন্তু, এ সত্যও সে স্মরণ না করিয়া পারিল না যে, এতবড় নিঃসহায়তাও এই রমণীকে লেশমাত্র দুর্বল করিতে পারে নাই। আজও সে ভিক্ষা চাহে না—ভিক্ষা দেয়। যে শিবনাথ তাহার এতবড় দুর্গতির মূল তাহাকেও দান করিবার সম্বল তাহার শেষ হয় নাই। এবং বোধ করি সাহস ও সান্ত্বনা দিবার অভিপ্রায়েই কহিল, আপনার সঙ্গে আমি তর্ক করচি নে কমল, কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারিনে যে, আমাদের মত আপনার দারিদ্র্যও প্রকৃত নয়, একবার ইচ্ছে করলেই এ দুঃখ মরীচিকার মত মিলিয়ে যাবে। কিন্তু সে ইচ্ছে আপনার নেই, কারণ আপনিও জানেন স্বেচ্ছায় নেওয়া দুঃখকে ঐশ্বর্যের মতই ভোগ করা যায়। কমল বলিল, যায়। কিন্তু কেন জানেন? ওটা অপ্রয়োজনের দুঃখ,—দুঃখের অভিনয় বলে। সকল অভিনয়ের মধ্যেই খানিকটা কৌতুক থাকে, তাকে উপভোগ করায় বাধা নেই। এই বলিয়া সে নিজেও কৌতুকভরে হাসিল। সহসা ভারী একটা বেসুরা বাজিল। খোঁচা খাইয়া হরেন্দ্র ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জবাব দিল, কিন্তু এটা ত মানেন যে, প্রাচুর্যের মাঝেই জীবন তুচ্ছ হয়ে আসে, অথচ, দুঃখ-দৈন্যের মধ্যে দিয়ে মানুষের চরিত্র মহৎ ও সত্য হয়ে গড়ে ওঠে? কমল স্টোভের উপর হইতে কড়াটা নামাইয়া রাখিল, এবং আর একটা কি চড়াইয়া দিয়া বলিল, সত্য হয়ে গড়ে ওঠার জন্যে ওদিকেও খানিকটা সত্য থাকা চাই হরেনবাবু। বড়লোক, বাস্তবিক অভাব নেই, তবু ছদ্ম-অভাবের আয়োজনে ব্যস্ত। আবার যোগ দিয়েছেন অজিতবাবু। আপনার আশ্রমের ফিলজফি আমি বুঝিনে, কিন্তু এটা বুঝি, দৈন্য-ভোগের বিড়ম্বনা দিয়ে কখনো বৃহৎকে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় শুধু খানিকটা দম্ভ আর অহমিকা। সংস্কারে অন্ধ না হয়ে একটুখানি চেয়ে থাকলেই এ বস্তু দেখতে পাবেন,—দৃষ্টান্তের জন্যে ভারত পর্যটন করে বেড়াতে হবে না। কিন্তু তর্ক থাক, রান্না শেষ হয়ে এল, এবার খেতে বসুন। হরেন্দ্র হতাশ হইয়া বলিল, মুশকিল এই যে ভারতবর্ষের ফিলজফি বোঝা আপনার সাধ্য নয়। আপনার শিরার মধ্যে ম্লেচ্ছ-রক্তের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে—হিন্দুর আদর্শ ও-চোখে তামাশা বলেই ঠেকবে। দিন, কি রান্না হয়েছে খেতে দিন। এই যে দিই, বলিয়া কমল আসন পাতিয়া ঠাঁই করিয়া দিল। একটুও রাগ করিল না। হরেন্দ্র সেইদিকে চাহিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আচ্ছা ধরুন, কেউ যদি যথার্থ-ই সমস্ত বিলিয়ে দিয়ে সত্যকার অভাব ও দৈন্যের মাঝেই নেমে আসে তখন ত অভিনয় বলে তাকে তামাশা করা চলবে না! তখন ত— কমল বাধা দিয়া কহিল, না, তখন আর তামাশা নয়, তখন সত্যিকার পাগল বলে মাথা চাপড়ে কাঁদবার সময় হবে। হরেনবাবু, কিছুকাল পূর্বে আমিও কতকটা আপনার মত করেই ভেবেচি, উপবাসের নেশার মত আমাকেও তা মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করেচে, কিন্তু এখন সে সংশয় আমার ঘুচেচে। দৈন্য এবং অভাব ইচ্ছাতেই আসুক বা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আসুক, ও নিয়ে দর্প করবার কিছু নেই। ওর মাঝে আছে শূন্যতা, ওর মাঝে আছে দুর্বলতা, ওর মাঝে আছে পাপ,—অভাব যে মানুষকে কত হীন, কত ছোট করে আনে, সে আমি দেখে এসেছি মহামারীর মধ্যে,—মুচীদের পাড়ায় গিয়ে। আরও একজন দেখেচেন, তিনি আপনার বন্ধু রাজেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে ত কিছু পাওয়া যাবে না, —আসামের গভীর অরণ্যের মত কি যে সেখানে লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। আমি প্রায় ভাবি, আপনারা তাঁকেই দিলেন বিদায় করে। সেই যে কথায় আছে—মণি ফেলে অঞ্চলে কাঁচখণ্ড গেরো দেওয়া,—আপনারা ঠিক কি তাই করলেন! ভেতর থেকে কোথাও নিষেধ পেলেন না? আশ্চর্য! হরেন্দ্র উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল। আয়োজন সামান্য, তথাপি কি যত্ন করিয়াই না কমল অতিথিকে খাওয়াইল। খাইতে বসিয়া হরেন্দ্রর বার বার করিয়া নীলিমাকে স্মরণ হইল; নারীত্বের শান্ত মাধুর্য ও শুচিতার আদর্শে ইঁহার চেয়ে বড় সে কাহাকেও ভাবিত না। মনে মনে বলিল, শিক্ষা, সংস্কার, রুচি ও প্রবৃত্তিতে বিভেদ ইঁহাদের মধ্যে যত বেশীই থাক, সেবা ও মমতায় ইঁহারা একেবারে এক। ওটা বাহিরের বস্তু বলিয়াই বৈষম্যেরও অবধি নাই, তর্কও শেষ হয় না, কিন্তু নারীর যেটি নিজস্ব আপন, সর্বপ্রকার মতামতের একান্ত বহির্ভূত, সেই গূঢ় অন্তর্দেশের রূপটি দেখিলে একেবারে চোখ জুড়াইয়া যায়। নানা কারণে আজ হরেন্দ্রর ক্ষুধা ছিল না, শুধু একজনকে প্রসন্ন করিতেই সে সাধ্যের অতিরিক্ত ভোজন করিল। কি একটা তরকারী ভাল লাগিয়াছে বলিয়া পাত্র উজাড় করিয়া ভক্ষণ করিল, কহিল, অনেকদিন অসময়ে হাজির হয়ে বৌদিদিকেও ঠিক এমনি করেই জব্দ করেচি, কমল। কাকে, নীলিমাকে? হাঁ। তিনি জব্দ হতেন? নিশ্চয়। কিন্তু স্বীকার করতেন না। কমল হাসিয়া বলিল, কেবল আপনি নয়, সমস্ত পুরুষমানুষেরই এমনি মোটা বুদ্ধি। হরেন্দ্র তর্ক করিয়া বলিল, আমি চোখে দেখেচি
false
tarashonkor
বাড়ি ঢুকিয়া পড়িল। *** ঊনত্ৰিশে চৈত্র অনিরুদ্ধের মামলার দিন পড়িয়াছে। বিচার করিবার কিছু নাই; সে নিজেই স্বীকারোক্তি করিয়াছে। পুলিশের কাছে করিয়াছিল। হাকিমের কাছেও করিয়াছে। উকিলমোক্তার কাহারও পরামর্শেই সে তাহা প্রত্যাহার করে নাই। সে যেন অকস্মাৎ বেপরোয়া হইয়া উঠিয়াছে। সেই দিনের সর্বজনের বাহবা তাহাকে যেন একটা নেশা ধরাইয়া দিয়াছে। সাজা তাহার হইবেই। দেবু কয়েক দিনই সদর শহরে গিয়াছিল, উকিল-মোক্তারও দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু সকল উকিল-মোক্তারে এক কথাই বলিয়াছে। সাজা দুই মাস হইতে ছয় মাস পর্যন্ত হইতে পারে। কিন্তু সাজা হইবে। ইহার মধ্যে ইন্সপেকটার আসিয়া একবার তদন্ত করিয়া গিয়াছে। প্রজা-সমিতির সহিত কোনো সংস্রব আছে কি না ইহাই ছিল তদন্তের বিষয়। ইন্সপেকটার তাহার ধারণা স্পষ্টই গ্রামের লোকের কাছে বলিয়া গিয়াছে—প্রজা-সমিতি এ কাজ করতে বলে নাই এটা ঠিক, কিন্তু প্রজা-সমিতি যদি না থাকত গ্রামে, তবে এ কাও হত না। এতে আমি নিঃসন্দেহ। দুর্গাকে ডাকা হইয়াছিল—তাহার বিরুদ্ধে নাকি রিপোর্ট হইয়াছে। কে রিপোর্ট করিয়াছে না বলিলেও দুর্গা বুঝিয়াছে। ইন্সপেকটার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিয়াছিল, শুনছি তোর যত দাগী বদমায়েশ লোকের সঙ্গে আলাপ, তাদের সঙ্গে তুই—ব্যাপার কি বল তো? দুর্গা হাত জোড় করিয়া বলিল-আজ্ঞে হুজুর, আমি নষ্ট-দুষ্ট—এ কথা সত্যি। তবে মশায়, আমাদের গায়ের ছিরু পাল। জিভ কাটিয়া সে বলিলনা, মানে ঘোষ মহাশয়, শ্রীহরি ঘোষ, থানার জমাদারবাবু, ইউনান বোর্ডের পেসিডেনবাবু—এর সব যে দাগী বদমাশ নোক-এ কি করে জানব বলুন! মেলামেশা আলাপ তো আমার এঁদের সঙ্গে। ইন্সপেকটার ধমক দিল। দুর্গা কিন্তু অকুতোভয়। বলিল—আপনি ডাকুন সবাইকে আমি মুখে মুখে বলছি। এই সেদিন রেতে জমাদার ঘোষমশায়ের বৈঠকখানায় এসে আমোদ করতে আমাকে ডেকেছিলেন-আমি গেছিলাম। সেদিন ঘোষমশায়ের খিড়কির পুকুরে আমাকে সাপে কামড়েছিল—পেরমাই ছিল তাই বেঁচেছি। রামকিষণ সিপাইজি ছিল, ভূপাল থানাদার ছিল। শুধান সকলকে। আমার কথা তো কারু কাছে ছাপি নাই। ইন্সপেকটার আর কোনো কথা না বাড়াইয়া কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিল—আচ্ছা আচ্ছা, যাও তুমি, সাবধানে থাকবে। পরম ভক্তিসহকারে একটি প্রণাম করিয়া দুর্গা চলিয়া আসিয়াছিল। ইহার পর বিপদ হইল পদ্মকে লইয়া। তাহার মেজাজের অন্ত পাওয়া ভার। এই এখনই সে এক রকম, আবার মুহূর্ত পরেই সে আর এক রকমের মানুষ। উচ্চিংড়ে গোবরা পর্যন্ত প্রায় হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছে। তবে তাহারা বাড়িতে বড় একটা থাকে না। বিশ তারিখ হইতে গাজনের ঢাক বাজিয়াছে, মাঠের চেঁচুড়ে দিঘি হইতে বুড়াশিব চণ্ডীমণ্ডপ জাকাইয়া বসিয়াছেন, তাহারা দুই জনে নন্দী-ভৃঙ্গীর মত অহরহ চণ্ডীমণ্ডপে হাজির আছে। গাজনের ভক্তের দল বাণ-গোসাই লইয়া গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা সাধিতে যায়—ছোঁড়া দুইটাও সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। গ্রামে গাজনে এবার প্রচুর সমারোহ। শ্ৰীহরি চণ্ডীমণ্ডপে দেউল ও নাটমন্দির তৈরির সঙ্কল্প মুলতুবি রাখিলেও হঠাৎ এই কাণ্ডের পর গাজনের আয়োজনে সে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে। লোকে ভক্ত হইতে চাহিতেছে না কেন তাহার কারণ সে বোঝে। দেবু ঘোষ, জগন ডাক্তার আর দুগ্ধপোষ্য একটা আগন্তুক বালক ষড়যন্ত্ৰ করিয়া তাহাকে অপমান করিবার জন্যই গাজন ব্যৰ্থ করিবার ব্যবস্থা করিয়াছে, তাহা শ্ৰীহরি বোঝে। তাই হঠাৎ সে এবার গাজনে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেল। ছোট ধরনের একটি মেলার আয়োজনও করিয়া ফেলিল। দুই দল ভাল বোলান গান—একদল ঝুমুর, একদল কবিগানের পাল্লার ব্যবস্থা করিয়া সে গ্যাট হইয়া বসিল। যাহারা বলিয়াছে চণ্ডীমণ্ডপ ছাইব না, তাহারাই যেন চব্বিশ ঘণ্টা আনন্দ আয়োজনের দ্বারপ্রান্তে পথের কুকুরের মত দাঁড়াইয়া থাকে তাহারই জন্য এত আয়োজন। ভাত ছড়াইলে কাক ও কুকুর আপনি আসিয়া জোটে। সেই যেদিন ধান দাদন করে, সেদিন গ্রামের লোক তাহার বাড়ির আশপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিয়াছে। ইহারই মধ্যে ভবেশ খুড়া বহুজনের দরবার লইয়া আসিয়াছে। কথাবার্তা চলিতেছে, তাহারা ঘাট মানিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে প্রস্তুত; প্রজা-সমিতিও তাহারা ছাড়িয়া দিবে বলিয়া কথা দিয়াছে। গড়গড়া টানিতে টানিতে শ্ৰীহরি আপন মনেই হাসিল। তবে ওই হরিজনের দলকে সে ক্ষমা করিবে না। কুকুর হইয়া উহারা ঠাকুরের মাথার উপর উঠিতে চায়! কাল আবার অনিরুদ্ধের মামলার দিন। সদরে যাইতে হইবে। শ্ৰীহরি চঞ্চল হইয়া উঠিল। অনিরুদ্ধ জেলে গেলে পদ্ম একা থাকিবে। অন্নের অভাব হইবে বস্ত্রের অভাব হইবে। দীর্ঘতনু, আয়তনয়না, উদ্ধতা, মুখরা কামারনী। এবার সে কি করে দেখিতে হইবে। তারপর অনিরুদ্ধের চার বিঘা বাকুড়ি। কামারের গোটা জোটাই নিলামে উঠিয়াছে। হয়ত নিলাম এতদিন হইয়া গেল। যাক। কালু শেখ আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল—হজুরের মা ডাকিতেছে। –মা? ও, আজ যে আবার নীলষষ্ঠী! শ্ৰীহরি উঠিয়া বাড়ির ভিতরে গেল। চৈত্র-সংক্রান্তির পূর্বদিন নীল-ষষ্ঠী। তিথিতে ষষ্ঠী না হইলেও মেয়েদের যাদের নীলের মানত আছে, তাহারা ষষ্ঠীর উপবাস করিবে, পূজা করিবে, সন্তানের কপালে ফোঁটা দিবে। নীল অর্থাৎ নীলকণ্ঠ এই দিনে নাকি লীলাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। লীলাবতীর কোল আলো করিয়া নীলমণির শোভা। নীলষষ্ঠী করিলে নীলমণির মত সন্তান হয়। পদ্ম সকল ষষ্ঠীই পালন করে; সে-ও উপবাস করিয়া আছে। কিন্তু বিপদ হইয়াছে উচ্চিংড়ে ও গোবরাকে লইয়া। আজ সকালবেলা হইতেই তাহাদের দেখা নাই। চড়ক-পাটা বাহির হইয়াছে। ঢাক বাজাইয়া ভক্তরা গ্রামে গ্রামে ফিরিতেছে। একটা লোহার কাটায় কণ্টকিত তক্তার উপর একজন ভক্ত শুইয়া থাকিবে। সে কি সোজা কথা! সেই বিস্ময়কর ব্যাপারের পিছনে পিছনে তাহারা ফিরিতেছে। আগে এখানে বাণ ফেঁড়া হইত, এখন আর হয় না। পদ্ম অপেক্ষা করিয়া অবশেষে নিজেই চণ্ডীমণ্ডপের প্রান্তে আসিয়া পাঁড়াইল। চণ্ডীমণ্ডপে ঢাক বাজিতেছে। বোধ হয় এ বেলার মত চড়ক ফিরিয়া আসিল। চণ্ডীমণ্ডপ ঘিরিয়া মেলা বসিয়াছে। খানবিশেক দোকান। তেলেভাজা মিষ্টির দোকানই বেশি। বেগুনি, ফুলুরী, পাপড়-ভাজা হইতেছে। ছেলেরা দলে দলে আসিয়া কিনিয়া খাইতেছে।
false
humayun_ahmed
থেকে অনেক দূরে। তবু সমুদ্রের হুমহম ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসছে। রিমিও তৌহিদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কান্না-কান্না গলায় বলল, আমার ভাগ্য আসলেই খারাপ। তৌহিদ বলল, আমারও মনে হয় তোমার খুব ভালো একটা বিয়ে হতে পারত। ভালোভালো সব সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে আমার মতো একজন অপদার্থের সঙ্গে তোমার বিয়ে হল এটাই আশ্চর্য। কেন হল জান? হল কারণ তোমার মতো খোজখবর না নিয়ে কেউ বিয়ে করে। না। যাদের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছে তারাই খোঁজখবর করেছে। যখন জানতে পেরেছে আমি একটা ছেলের সঙ্গে একবার পালিয়ে গিয়েছিলাম তখনি পিছিয়ে গেছে। অবশ্যি ঐ মেজর সাহেব আমাকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তারপরও তিনি রাজি ছিলেন। বিয়ের দিন-তারিখও হয়ে গিয়েছিল। তাহলে বিয়েটা হল না কেন? হল না কারণ মেজর সাহেব একটা উড়ো চিঠি পেলেন। ঐ উড়ো চিঠিতে লেখা ছিল—আমি যে শুধু পালিয়ে গিয়েছিলাম তাই না, গৌরীপুরের একটা হোটেলে রাতও কাটিয়েছিলাম। হোটলটার নাম শাস্তি বোর্ডিং। তোমরা এরকম কোনো উড়ো চিঠি পাও নি? না। যদি পেতে হলে কি বিয়ে ভেঙে দিতে? তোমার কী হয়েছে বল তো রিমি। আমি দেরি করে ফেরায় তুমি যদি রাগ করে থাক তাহলে হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। এস আমরা ঘুমুতে যাই। সকালে ঘুম ভাঙলে মন শান্ত হবে। আমার মন শান্তই আছে। তোমার মনও শান্ত। তোমার শান্ত মনকে একটু শুধু অশান্ত করব। গল্পটা পুরোপুরি বলব। আজই শুধু বলব। আর কোনোদিন বলব না। বস, চেয়ারটায় বস। আমার দিকে তাকাও। তাকালেও তো তোমাকে দেখতে পারছি না। বারান্দা অন্ধকার। অন্ধকার হলেও তাকাও। তৌহিদ তাকাল। রিমি কথা শুরু করল, ওর সঙ্গে আমি রওনা হলাম ভোরবেলা। ট্রেনে করে। গৌরীপুর স্টেশনে আমরা নামলাম। উনি আমাকে লেডিজ ওয়েটিং রুমে বসিয়ে চা আনতে গেলেন। আমি বসে আছি, হঠাৎ মেজো চাচা সেখানে ঢুকে অবাক হয়ে বললেন, তুই এখানে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। মেজো চাচা বললেন, কি রে, তার বাবা-মা কোথায়? কার সঙ্গে এসেছিস? আমি বললাম, মার সঙ্গে নেত্র চাচা বললেন, তোর মা কোথায়? আমি বললাম, চাচা আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি মাকে ডেকে আনছি। মা কলে হাত ধুতে গেছে। বলেই ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ঘর থেকে বের হয়েই ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। দুজনে ছুটলাম ওভার ব্রিজের দিকে। মেজো চাচা আমাদের আর খুঁজে পেলেন না। একরাত আমরা কাটালাম গৌরীপুরের সেই হোটলে। পরদিন সেই হোটেল থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়। মেজো চাচা ছিলেন, থানার ওসি ছিলেন, আরো অনেকেই ছিল—এই হচ্ছে আমার গল্প। তৌহিদ বলল, রিমি, এই গল্প আমি জানি। তুমি জান। হ্যাঁ জানি। বিয়ের পর শুনেছি শান্তি বোর্ডিং-এর দোতলায় ছয় নম্বর ঘরে তোমরা ছিলে। তোমাদেরভাবভঙ্গি দেখে বোর্ডিং-এর ম্যানেজারের সন্দেহ হয়। সেই পুলিশে খবর দেয়। তুমি ঐ বোর্ডিং-এ পা দেয়ার পর থেকেই খুব কান্নাকাটি শুরু করেছিলে। রিমি বলল, তুমি ছাড়া এই ঘটনা আর কে জানে? তোমার মা জানেন? হ্যাঁ জানেন। তিনি শুনে কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ও বাচ্চা একটা মেয়ে। এরা অনেক ভুল করে। সে একটা ভুল, করেছে—তুই ক্ষমা করে দে। রিমি শব্দ করে হাসল। তৌহিদ কঠিন গলায় বলল, হাসছ কেন? মা কি কোনো হাসির কথা বলেছিলেন? অবশ্যই। তিনি বলেছিলেন গা বাঁচানো কথা। তোমার মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি পরিবারের স্ক্যান্ডেল প্রচার হোক তা চান নি। তুমিও চাও নি। তুমি চাও নি কারণ তুমি হচ্ছ মেরুদণ্ডহীন একজন স্কুল মাস্টার। তোমার কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তুমি খুব ভালো করেই জানতে একটি বউকে বিদেয় করে দিলে দ্বিতীয় একজনকে জোগাড় করা তোমার জন্যে শক্ত। তারচে এই তো ভালো। সুন্দরী একটি মেয়েমানুষ হাতের কাছে আছে। ঘরের কাজকর্ম করছে। রাতে শারীরিক প্রয়োজনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে। তৌহিদ নিচু গলায় বলল, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাম্ রিমি। আমি খুবই তুচ্ছ এবং নগণ্য একজন মানুষ তা ঠিক, কিন্তু তুচ্ছ নগণ্য একজন মানুষের হৃদয়ও তো বড় হতে পারে। বড় হৃদয়ের কথা আমাকে বলবে না। বড় হৃদয়, বড় মহৎ এইসব খুবই বাজে কথা। তুমি হচ্ছ গা-বাঁচানো মানুষ। তোমার কি মনে আছে, তোমাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম? প্রচও ভিড়ের সুযোগে একটা লোক আমার বুকে হাত দিল। তোমার মনে আছে? আছে। তুমি দেখেও না দেখার ভান করলে। এটা করলে কেন? তোমার হৃদয় বড় বলে? না, তা কিন্তু না। তুমি গা বাঁচাতে চাইলে। ঝামেলা এড়াতে চাইলে। তুমি যা চাও তা হচ্ছে কোনো ঝামেলা, কোনো যন্ত্ৰণা ছাড়া জীবনটা পার করে দিতে। স্ত্রীকে সামান্য ভালবাসলে যদি ঝামেলা কমে তাহলে সেই সামান্য ভালবাসাও তুমি দিতে প্রস্তুত আছ। আমার কথা শেষ হয়েছে, চল ঘুমুতে যাই। চল। আরেকটা শেষ কথা শুধু—এরপর থেকে আমি কিন্তু আর কোন দিন তোমার সঙ্গে শোব না। কোনদিন আমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। আমার যাবার জায়গা নেই; কাজেই আমাকে থাকতে হবে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আমি আবার পড়াশোনা করব। আবার বি.এ. পরীক্ষা দেব। অবশ্যই পাস করব। তারপর একটা চাকরি খুজে তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে। আমি বাধা দেব না। তা দেবে না। বাধা দিলেই ঝামেলা। তুমি চাও ঝামেলাহীন একটা জীবন। রিমি এসে অনির পাশে শুয়ে পড়ল। তার কপালের শিরা দপদপ
false
shunil_gongopaddhay
সোজা কথা? অনেক সময় লাগবে। ওসমান বলল, যতদিন না টাকাটা আসে, ততদিন তুই এই ভাবে থাকবি বেইমানের এই শাস্তি! তলোয়ারটা খাপে ভরে ওসমান হা হা করে একটা অট্টহাসি দিল। কুলসম বলল, এই লোকটাকে আমার কোনওদিনই ভাল লাগে না। একে কিছু খেতে দেওয়াও উচিত না। ওসমান বলল, কিছু খেতে দিবি না। শুধু জল চাইলে জল দিবি। তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আজ মেজাজটা বেশ খুশ আছে। চলো বাঙালিবাবু, তোমার সঙ্গে দাবা খেলি? ওসমান ভিড়ের মধ্যে দাবা খেলা পছন্দ করে না। তাই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায়, গাছের ছায়ায় খেলতে বসা হল। ওসমান বলল, তুমি ভাল বুদ্ধি দিয়েছ। আমার এত রাগ হয়েছিল, আমি আর একটু হলে মোহন সিংকে কেটেই ফেলতাম। তা হলে আর এক কোটি টাকা পাওয়া যেত না। কাকাবাবু বললেন, মানুষকে কেটে ফেললে কী পাওয়া যায় জানো? জেল কিংবা ফাঁসি। ওসমান ঠোঁট উলটে বলল, ওসব আমি পরোয়া করি না। আমাকে কে ধরবে? কাকাবাবু বললেন, তোমার রাজা সামলাও। এই কিস্তি দিলাম! ওসমান দাবার গুটিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মহাবিস্ময়ের সঙ্গে বলল, তুমি আমাকে এত সহজে হারিয়ে দিলে? অ্যাঁ? এর আগে তুমি বারবার হেরেছ! কাকাবাবু বললেন, তখন তো ইচ্ছে করে হেরেছি। ওসমান বলল, কেন, ইচ্ছে করে হেরেছ কেন? কাকাবাবু বললেন, তোমাকে খুশি করার জন্য। নইলে, দাবা খেলায় তুমি আমার কাছে ছেলেমানুষ! ওসমান বলল, বাজে কথা। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তুমি জোচ্চুরি করে এই দানটা জিতেছ। আর এক দান খেলে দ্যাখো! আবার ছক সাজানো হল। এবার কাকাবাবু আরও তাড়াতাড়ি ওসমানকে হারিয়ে দিলেন। ওসমান হাঁ করে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, তোমার খেলা দেখেই বুঝেছি। তুমি আমাকে একবারও হারাতে পারবে না। ওসমান বলল, আমি দাবায় চ্যাম্পিয়ান। আমায় কেউ কখনও দাবা খেলায় হারাতে পারেনি। কাকাবাবু বললেন, আমাদের বাংলায় একটা কথা আছে। বন-গাঁয়ে শিয়াল রাজা। তুমি হচ্ছ তাই। তুমি তো খেলো শুধু তোমার দলের লোকদের সঙ্গে। বাইরের লোকদের সঙ্গে তো খেলোনি! হঠাৎ ওসমানের চোখদুটো জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে বলল, তোমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। এক্ষুনি মেরে ফেলতে হবে। কাকাবাবু বললেন, আরে আরে, অত রেগে যাচ্ছ কেন? খেলায় তো হার-জিত আছেই! ওসমান তবু দুহাত বাড়িয়ে এল কাকাবাবুর গলা টিপে ধরার জন্য। কাকাবাবু সেই হাতদুটো ধরে ফেলে ঝটকা টান দিয়ে তাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে দিলেন দূরে! তারপর বললেন, এখন যাকে কুংফু ক্যারাটে বলে, আমাদের সময় সেটাকে বলা হত যুযুৎসু! সেটা আমি ভালই জানি। এক জাপানির কাছে শিখেছিলাম। ওসমান রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে তলোয়ারটা বার করে বলল, এবার? কাকাবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্রাচ ফেলে দিয়ে আর একটা ক্রাচ তুলে বললেন, ওতেও তুমি খুব সুবিধে করতে পারবে না। আমি এটা দিয়ে লড়ব। ওসমান বলল, তুমি একটা বেওকুফ। তোমার পা খোঁড়া, ওই একটা লাঠি দিয়ে তুমি আমার তলোয়ারের সঙ্গে লড়বে? এবার তুমি মরবে। আমার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। কাকাবাবু বললেন, খোঁড়া পায়ের জন্য খানিকটা অসুবিধে হয় বটে, কিন্তু তাতেও অনেকেই হেরে যায়। চেষ্টা করে দ্যাখো। ওসমান তলোয়ার চালাতে শুরু করলে কাকাবাবু প্রথম কয়েকবার ঠুক ঠুক। করে আটকালেন শুধু। তারপর হঠাৎ যেন খেপে উঠে নিজে এগিয়ে এসে দড়াম দড়াম করে মারতে লাগলেন। একবার লাফিয়ে উঠে ওসমানের হাতে এত জোর মারলেন যে, তার হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে পড়ে গেল। ওসমান কয়েক মুহূর্ত হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দূরে একজন লোককে দেখে চেঁচিয়ে ডাকল, আপ্পা রাও! আপ্পা রাও! কাকাবাবু বললেন, এবার তোমার লোকজন ডাকবে? অনেক লোক ঘিরে ফেললে কিছু করতে পারব না, আমি দৌড়তে পারি না যে! আর বন্দুক পিস্তলের বিরুদ্ধেও খালি হাতে লড়তে পারব না। কিন্তু তুমি আমাকে মারবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন? আপ্পা রাও ছুটতে ছুটতে কাছে এসে দাঁড়াল। ওসমান বলল, একটা ঘোড়া নিয়ে এসো। চোখ বাঁধার কাপড় আর দড়িও আনবে। আপ্পা রাও দৌড়ে ফিরে গেল। ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, আমি তোমার সম্পর্কে মত বদলে ফেলেছি। তোমায় মারব না। তোমায় মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কাকাবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, সে কী! এমনি এমনি মুক্তি দিয়ে দেবে? ওসমান বলল, হ্যাঁ। মোহন সিংয়ের কাছ থেকে এক কোটি টাকা পেলে তোমার টাকাটাও ওতেই উশুল হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে আর ধরে রাখার কারণ নেই। শুধু একটা শর্ত আছে। আমি যে তোমার কাছে দাবা আর তলোয়ারে হেরেছি, এ কথা কাউকে বলতে পারবে না। কাকাবাবু হেসে বললেন, ঠিক আছে, সে কথা কাউকে বলব না। কিন্তু আমি এখন মুক্তি পেতে চাই না। ওসমান চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি মুক্তি চাও না? কেন? কাকাবাবু চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই জায়গাটা আমার বেশ লাগছে। আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাই! ওসমান বলল, তোমার মাথা খারাপ? কখন রাগের চোটে আমি তোমাকে মেরে বসব তার ঠিক আছে? ছেড়ে দিচ্ছি, পালাও। কাকাবাবু বললেন, পালাবার আমার একটুও ইচ্ছে নেই। বেশ আছি! ওসমান বলল, এরকম কথা কোনও বন্দির মুখে আমি আগে কখনও শুনিনি। তোমাকে দেখছি জোর করে তাড়াতে হবে। আপ্পা রাও একটা ঘোড়ায় চড়ে ফিরে এল। আপ্পা রাওয়ের কাছে রিভলভার আছে, সুতরাং গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। ওরা যখন তাঁর হাত ও চোখ
false
humayun_ahmed
লাগল। শওকত বিরক্ত মুখে বলল, তুমি যা করছি তা যে ছেলেমানুষ তা কি বুঝতে পারছি? তিতলী এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। শওকত ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যা করছ তা হচ্ছে হাস্যকর ছেলেমানুষ। যখন ছেলেমানুষিটা শুরু করেছিলে আমি তোমাকে বাধা দেই নি। আমার ধারণা ছিল বাধা দিলে এটা আরো বাড়বে। আমি ভেবেছি সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দেখছি হচ্ছে না। এখন কী করবে? শোন তিতলী! আমার ধৈর্য অপরিসীম। আমি তোমাকে আরো সময় দেব। দু’বছর, তিন বছর, চার বছর…কোনো অসুবিধা নেই। আমি দেখতে চাই এক সময় তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। যদি কোনোদিনই ভুল বুঝতে না পারি? তুমি তো বোকা মেয়ে না। বুদ্ধিমতী মেয়ে–আমি নিশ্চিত তুমি ভুল বুঝতে পারবে। তখন আমরা জীবন শুরু করব। সে জীবন অবশ্যই আনন্দময় হবে। আনন্দময় হলেই তো ভালো। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার কি এর মধ্যে দেখা হয়েছে? না। টেলিফোনে কথা হয়েছে? না। শোন তিতলী আমি চাচ্ছি ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার দেখা হোক, কথা হোক। কেন চাচ্ছ? আমার ধারণা ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার যদি দু-একবার দেখা হয়–তুমি তোমার ভুল দ্রুত বুঝতে পারবে। এক কাজ করা যাক-আমি ভদ্রলোককে বাসায় একদিন খেতে বলি। কোনো প্ৰয়োজন নেই। তোমার অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। আমি তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করবো। তিতলী চুপ করে আছে। তার দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে। শওকত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তিতলী ঠিক তার সামনে বসা। নতুন বউরা শ্বশুরবাড়িতে এসে শুরুর কিছু দিন ঘোমটা দিয়ে থাকে। তার মাথায়ও ঘোমটা। লালপাড়ের কালো শাড়িতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দেবী প্রতিমার মতো মেয়েটি চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। শওকত নিশ্চিত জানে এই শক্তমুখ একদিন কোমল হবে। সেই একদিনটা কবে এটাই সে জানে না। তিতলী! জ্বি। আমি আশপাশে থাকলে তোমার কি অসহ্য লাগে? না। আমি আশপাশে থাকলে তোমার মুখ শক্ত হয়ে থাকে। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি। নাদিয়াকে কনগ্রাচুলেট করতে যাবে না? যাব। আমি সঙ্গে গেলে কোনো অসুবিধা আছে? অসুবিধা নেই–তবে আমি একাই যেতে চাই। ব্যাপারটা খুব অশোভন হবে না? তুমি আমার সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করছ, সেটা ལ་ལས་ཀ་༢ বাড়ির কেউ জানে না। সবাই জানে আমরা খুব সুখে আছি। আনন্দে সেটা জানাই তো ভালো। তাদের জন্যে ভালো তো বটেই। তাদের সেই ভালোতে যেন খুঁত না থাকে সেই চেষ্টা তো আমাদের করা উচিত। তোমার পক্ষ থেকে কিছু অভিনয় দরকার। কাজেই হাসিমুখে আমার সঙ্গে চল। আচ্ছা। আরেকটা কথা। তুমি তো জানই আমি পি.এইচডি করতে বাইরে যাচ্ছি। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? সেটা তোমার ইচ্ছা। অর্থাৎ তোমার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। না। সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার না যাওয়াই ভালো। এখানে থাকতে পার বা ইচ্ছে করলে তোমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পার। আমি এখানেই থাকব। বেশ তো থাকবে। যদি এর মধ্যে তোমার ইচ্ছা করে আমার কাছে যেতে-চিঠি দিলেই আমি টিকিট পাঠাব। তুমি চলে আসবে। আচ্ছা। তোমার সব কথাই তো এ পর্যন্ত শুনে আসছি–এখন তুমি কি আমার একটা কথা শুনবে? কথাটা হচ্ছে–চল আমার সঙ্গে দুজন মিলে কোনো সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসি। যেমন ধর নেপাল। সুন্দর দৃশ্যের পাশে থাকলে মন সুন্দর হয়। পুরনো অসুন্দর ধুয়ে মুছে যায়। যাবে? তুমি বললে যাব। ভেরি গুড। তোমার নাশতা খাওয়া তো হয়েছে। আমি কি এখন উঠতে পারি? শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, পার। তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। সে অনেক চেষ্টা করেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে সমস্যাটা সামলাতে পারছে। না। ভবিষ্যতেও পারবে কি না বুঝতে পারছে না। হাসান নামের ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার কি দেখা করা উচিত? তার সমস্যা মেটানোর জন্য ভদ্রলোকের সাহায্য প্রার্থনা করাটা কি ঠিক হবে? ভদ্রলোক কি সাহায্য করবেন? মনে হয় করবেন। যে-কোনো বিবেকবান মানুষেরই সাহায্য করা উচিত। তিতলীকে না জানিয়ে ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলে হয়। সহজ স্বাভাবিকভাবে সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করা হবে। ক্ষতি কী? তিতলী! তিতলী! তিতলী এসে দাঁড়াল। কিছু বলল না। শওকত বলল, আচ্ছা যাও। এমনি ডেকেছিলাম। ও আচ্ছা শোন, নাদিয়ার ইন্টারভ্যুটা পড়েছ? না। পড় নি কেন? নাকি প্ৰতিজ্ঞা করেছ। আমার কেনা খবরের কাগজও পড়বে না? আমি কোনো প্ৰতিজ্ঞা করি নি। পড়ে দেখ। ভালো লাগবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তোমার প্রিয় মানুষ কে? সে তোমার নাম বলেছে। ও আচ্ছা। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তিতলী! থ্যাংক য়্যু। তুমি কি আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ রাখবে? খুব ছোট্ট অনুরোধ? কী অনুরোধ? হাসলে তোমাকে কেমন দেখায় আমি জানি না। একটু হাস আমি দেখি। এত বড় খুশির একটা খবর পেয়েছ। এমনিতেই তো হাসা উচিত। উচিত কাজ কি মানুষ সব সময় করতে পার? না, উচিত কাজ মানুষ সব সময় করতে পারে না। মানুষ বরং অনুচিত কাজটাই সব সময় করে। আমাকে বিয়ে করাটা ছিল খুবই অনুচিত কাজ সেই কাজটা তুমি করেছি। বিয়ের পর পুরনো সমস্যা ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হওয়াটা ছিল উচিত কাজতুমি করছি উল্টোটা। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাস কথা বলি। তিতলী বসল। শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো। তুমি কি আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও? চুপ করে থেকে না, বল হ্যাঁ বা না। মুক্তি চাইলে পাব? তিতলী তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। শওকত চুপ
false
shirshendu
ঝুমকি হেসে ফেলল, বলছিই তো! আপনি শুনলেন না? নিশিপুরের বাড়ির কথা? হ্যাঁ। সাজিয়ে নিলে আরও সুন্দর হবে। মাটিটা তো খুব ভাল, কেন যে ভাল ভাল গাছ লাগাননি! হেমাঙ্গর চোখমুখ আলো হয়ে গেল। আবেগকম্পিত গলায় বলল, উঃ, একটা ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিসের দুশ্চিন্তা? চারুদি বলছিল, আপনি নাকি নিশিপুর পছন্দ করেন না। চারুমাসি নিজেই করে না, তাই বলেছে। আবার এক শনিবার দুজনের দেখা হল হেমাঙ্গর বাড়িতেই। হেমাঙ্গ অনেকটাই সেরে উঠেছে। বাঁ পায়ের খোঁড়ানিটা একদম নেই। মন দিয়ে একসারসাইজ করে সে। গরম-ঠাণ্ডা কমপ্রেস নিচ্ছে। মালিশ করতে বিশেষজ্ঞ আসছে। শনিবার যখন ঝুমকি এল ম্যাসিওর লোকটি তখন বিদায় নিচ্ছে। ঝুমকিকে বলল, আর দিন পনেরো ম্যাসাজ করলেই হবে। অলমোস্ট নরম্যাল। তাকে দেখেই আজ হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে হেমাঙ্গ বলল, আমার মা আপনার জন্য একটা জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? এতে কিন্তু আমার কোনও ভূমিকা নেই। আপনি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবেন না। হেমাঙ্গ ড্রয়ার থেকে একটা চ্যাপটা গয়নার বাক্স বের করে ঝুমকির হাতে দিয়ে বলল, এইটে। ঝুমকি বাক্সটা খুলে অবাক হয়ে গেল। একটা সাবেক ভারী নেকলেস। লকেটে হিরের সেটিং। অন্তত বারো-চোদ্দ ভরি ওজন। কিছু মনে করলেন না তো! ঝুমকি জবাব দিল না। নেকলেসটা গলায় পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু দেখল নিজেকে। তারপর হঠাৎ হেমাঙ্গর দিকে ফিরে বলল, কেমন দেখাচ্ছে? হেমাঙ্গ সলজ্জ চেখে চেয়ে দেখে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, এসব কি আধুনিক মেয়েরা পরে? আমি জিজ্ঞেস করেছি কেমন দেখাচ্ছে। ভালই তো! ঝুমকি ফের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল একটু। এমন স্বাভাবিক হাবভাব যেন নেকলেস পেয়ে সে একটুও অবাক হয়নি। হেমাঙ্গর দিকে ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, একটু পরে থাকি নেকলেসটা? হ্যাঁ। কিন্তু ওসব জিনিস পরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা না করাই ভাল। ছিনতাইবাজরা পিছু নেবে। নিক না। আজ আমি এটা পরেই বাড়ি যাবো। হেমাঙ্গ সাভয়ে বলল, সর্বনাশ! যাবোই। হেমাঙ্গ বলল, তাহলে আমি গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসব। গাড়ি চালানো এখনও বারণ, খেয়াল আছে? বারণ ছিল, এখন আর নেই। ডাক্তার কাল বলেছে এখন একটু-আধটু চালাতে পারি। তার দরকার নেই। নেকলেসটা এখন এখানেই থাকবে। হেমাঙ্গ নিজের নখ দেখছিল। খুব সলাজ ভাব। হঠাৎ মিনমিন করে বলল, আচ্ছা নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে গুরুজনদের এই যে ঢুকে পড়া এটা আপনার কেমন লাগে? কে, আমার তো বেশ ভালই লাগে। এরকমই হওয়া উচিত। আপনি কিন্তু বেশ সেকেলে আছেন। সেকেলেদের কি অপছন্দ নাকি? না না, তা বলছি না। বলছি, নরনারীর সম্পর্ককে তো আজকাল তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার বলে ভাবা হচ্ছে পৃথিবীতে। এর মধ্যে আত্মীয় বা গুরুজনদের কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। সেটাকে ইন্টারফিয়ারেন্স বলে মনে করা হচ্ছে। তাই না? আমার তা মনে হয় না। আপনার বুঝি মনে হয়? হেমাঙ্গ খুব লজ্জিত হয়ে পড়ল। তারপর আরও মিনমিনে গলায় বলল, আসলে আমি একুশ শতকের জীবনযাত্রার প্যাটার্নটার কথা ভাবছি। কি কি থাকবে, আর কি কি থাকবে না। পৃথিবী তো আস্তে আস্তে লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে। সুইডেনে এমন সব দৃশ্য দেখেছি যে আমার একসময়ে নরনারী সম্পর্ক নিয়েই একটা রিপালশন তৈরি হয়েছিল। একটু কড়া গলায় ঝুমকি বলল, সুইডেনে আর কখনও যাবেন না। হেমাঙ্গ একটু ভড়কে গিয়ে বলল, আমি মোটেই যেতে চাইছি না। কিন্তু বলছি রোমান্স জিনিসটা তো পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। দেখুন না, এখন বাঙালি ছেলেমেয়েরাও কত ফিলি মেলামেলা করে। তাদের মধ্যে সেই রোমান্টিক ভীতু-ভীতু ভাবটা আর নেই। দে টক ফ্রিলি অ্যাবাউট এভরিথিং…। অল সর্টস অফ সেক্রেট থিংস। ঝুমকি একটু হাসল। বলল, আমি কিন্তু সেকেলে। এ কথায় কে জানে কেন, আর এক দফা লজ্জা পেল হেমাঙ্গ। হেমাঙ্গ এর পরের তিন দিন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল আর একটা সমস্যা। সমস্যাটা হল রোমান্টিক প্ৰেমটা বিয়ের পরই উবে যায়। আর রহস্য-রোমাঞ্চ থাকে না, প্রেমিক-প্রেমিকরা হয়ে যায় সাদামাটা স্বামী-স্ত্রী এবং তখন সহ রহস্যের সমাপ্তি। একটু ফাঁক, একটু দূরত্ব, একটু পিপাসা না থাকলে এই রহস্যময়তা টিকবে কি করে? এমন কোন উপায় আছে যাতে স্বামী এবং স্ত্রী হয়েও নারী-পুরুষ পরস্পরের কাছে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ভীষণ আকর্ষক থেকে যেতে পারে? এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারল না সে এবং ক্রমশ অস্থির হল। সমস্যাটা অতঃপর টেলিফোনেই সে নিবেদন করল ঝুমকিকে। রাত দশটায়। ঝুমকি বোধ হয় একটা হাই চাপাবার চেষ্টা করে বলল, আচ্ছা এ ব্যাপারটা ভেবে দেখব। সুত্যি ভাববেন? হুঁ। এটা আপনার কাছেও কি প্রবলেম বলে মনে হয়? এখন হচ্ছে। মুগ্ধ আর একটা কথা। কী? আমি দুদিন ধরে গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছি। সাবধান কিন্তু। অনেক দিন অভ্যোস নেই। না, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বলছিলাম, আগামী কাল অফিসের পর কি আপনাকে পিক-আপ করতে পারি? পারেন। তাহলে ছটায়? গোলপার্ক ন নম্বর টার্মিনাসে। তা কেন? বাড়িতে এলেই তো হয়। একটু লজ্জা করছে। কিছু লজ্জার নেই। কাল কী রঙের শাড়ি পরতে হবে? নীল। কিংবা আপনার যা ইচ্ছে। না, নীলই পরব। তাহলে ছটায়? হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িতে আসবেন। মা বোধ হয় কাল আপনার জন্য কোনও খাবার তৈরি করবে। আরে! উনি কি জানেন যে আমি ফোন করছি? হ্যাঁ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ছিঃ ছিঃ। লজ্জা করছে। আমি কি খুব বেহায়া? মোটেই নয়। শুধু একটু রোমান্টিক। যন্ত্রণাটা। তবু হেমাঙ্গকে ছাড়ছে না। ফোন করার পর সে
false
shunil_gongopaddhay
সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার গাইতে লাগল, দুই হৃদয়ে নদী একত্র মিলিল যদি…। এক নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছে স্টিমার, রবি গাইছে দুটি নদীর গান। বাবুঘাটে স্টিমার থেকে নেমে ভাড়ার গাড়ির জন্য রবিকে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতে হল। কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে রাস্তা, লোকজনের ভিড়, মুটে-মজুরদের ঠেলাঠেলি, এর মধ্যে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করল রবি, তাও পারা যায় না। একজন তার পা মাড়িয়ে জুতো নোংরা করে দিল। বৃষ্টির দিনে গাড়ি দুর্লভ হয়ে যায়, ফিটন একটাও নেই, কেরাঞ্চি গাড়িগুলোতে একসঙ্গে চার-পাঁচজন যাত্রী হুড়মুড়ে করে উঠে পড়ছে। ও রকম বারোয়ারি গাড়িতে যেতে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা অভ্যস্ত নয়। এর চেয়ে পদব্রজে গমনই প্রশস্ত। অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সদলবলে আশ্রয় নেবার পর মেটেবুরুজ অঞ্চলটিতে প্রচুর দোকানপাট বসে গেছে, পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাকে আসে কোপ্তা-কাবাব ও আরও নানাবিধ মোগলাই খানার সুগন্ধ। এই অঞ্চলটিতে মুসলমানদের প্রাধান্য, বাংলা কথা প্রায় শোনাই যায় না। রবির মনে পড়ল, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ যখন আই সি এস হয়ে বিলেত থেকে এসে আমেদাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেকটর ও ম্যাজিস্টেটের চাকরি নেন তখন এই মেটেবরুজ থেকে আব্দুল নামে একজন বাবুর্চিকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আব্দুলের যেমন ছিল রান্নার হাত তেমনই ছিল গাল-গল্পের সঞ্চয়। রবি সেই সময় কিছুদিন গিয়ে থেকেছিল মেজদাদার কাছে। বাড়িখানা কী, বাদশাহী আমলের প্রাসাদ, যেন এক স্তব্ধ ইতিহাস। কলকাতা শহরটি বড় অর্বাচীন, এখানে ইতিহাসের কোনও রূপ নেই। আমেদাবাদে সেই শাহিবাগ-প্রাসাদের প্ৰকাণ্ড ছাদে জ্যোৎস্না রাতে একা একা পদচারণ করবার সময় মনে হতো যেন চারপাশ থেকে অনেক অশরীরী ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বাড়িতে গান-বাজনার আসরে অনেকেই যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে নবাব বাহাদুরের পরিচয় আছে, রবি ঠিক করল সেও একদিন ওই আসরে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে রবি চলে এল লালবাজারের কাছে। এখানে একটি ভাড়া-গাড়ির আড্ডা আছে, রবি সেখানে একটি ল্যান্ডো গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে কথা বলছে, এমন সময় পাশে আর একটি গাড়ি দাঁড়াল, সেই গাড়ি থেকে ঝুঁকে এক ব্যক্তি বলল, আরে রবীন্দ্ৰবাবু যে, এসো, এসো, এ গাড়িতে উঠে এসো! রবি ফিরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। এই ব্যক্তিটির নাম শিবনাথ ভট্টাচাৰ্য, অনেকে শাস্ত্রীমশাই বলেও ডাকে। রবির চেয়ে বয়েসে চোদ্দ পনেরো বছরের বড়; রবিকে বালক বয়েস থেকেই চেনেন, আগে শুধু রবি বলতেন, এখন রবীন্দ্ৰবাবু বলে সম্বোধন করছেন। সাহিত্য জগতে এঁর বেশ সুনাম আছে, আবার তেজস্বী সমাজ সংস্কারক। বিধবা বিবাহ ও নারী শিক্ষার জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন। চোদ্দ বছরের কম বয়েসী বালিকাদের বিবাহ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রবক্তা, পরে কুচবিহার রাজবাড়ীতে নিজের অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ দিতে গিয়ে কেশববাবু যখন সেই আদর্শ থেকে চ্যুত হলেন, তখন শিবনাথের নেতৃত্বেই দলত্যাগীরা সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ গড়ল। এখন ছেলে-ছোকরা মহলে এই তৃতীয় শরিকটিই বেশি জনপ্রিয়। শিবনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কোথায় এসেছিলে? রবি সঙ্কুচিতভাবে বলল, আমি তো আপনাদেরই ওখানে যাব, আসছি চন্দননগর থেকে। দেরি হয়ে গেল—। শিবনাথ ধুতির ট্যাঁক থেকে একটা গোল ঘড়ি বার করে দেখলেন। তরুণ ব্ৰাহ্মরা অতিশয় সময়ানুবর্তী, ঘড়ির কাটা মেনে চলেন। রবির গান শেখাতে যাবার কথা দুপুর বারোটার সময়, এখন একটা বেজে দশ মিনিট। তবু শিবনাথ বললেন, তাতে কী হয়েছে, এত দূরের পথ। নগেন, কেদাররা অবশ্যই অপেক্ষা করবে। আমার সঙ্গেও ওদের কথা হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ি ঝুমঝুমিয়ে ছুটতে লাগল। রবির আশঙ্কা হয়েছিল, আদি ব্ৰাহ্মরা রাজনারায়ণ বসুর মেয়ের বিয়েতে যে উপস্থিত থাকবে না সেই প্রসঙ্গ তুলে শিবনাথ তির্যক মন্তব্য করবেন। কিন্তু শিবনাথ সে দিকে গেলেন না। এমনকি এককালের খ্রিস্ট ভক্ত কেশব সেনের সাম্প্রতিক বৈষ্ণবীয় চালচলন যে অনেকের ঠাট্টা-বিদ্রূপের প্রিয় বিষয়, তারও উল্লেখ করলেন না একবারও। বয়েসে অনেক কনিষ্ঠ রবি যেন তারই সমসাময়িক একজন লেখক, এই ভাব নিয়ে সাহিত্য আলোচনা করতে লাগলেন। গাড়ি থেকে নামবার সময় শিবনাথ বললেন, আমাদের সভায় এসে তুমি যে গান শেখাতে সম্মত হয়েছ, তাতেই আমি বিলক্ষণ খুশি হয়েছি। সভাগৃহে দশ-বারোজন পুরুষ উপস্থিত। রবি ভেতরে এসে নমস্কার জানিয়ে তার বিলম্বের জন্য মার্জনা চাইল। সকলেই অতিশয় ভদ্রতার সঙ্গে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, না, না, কিছুমাত্ৰ দেরি হয়নি, আমরা সবাই আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি। গান শিখবেন মোট পাঁচজন। শুভ্র ফরাসের একদিকে তাঁরা বসেছেন, একটু দূরে তাদের মুখোমুখি রবি। গায়কদের একজনের হাতে এসাজ, আর একজনের হাতে খঞ্জনি। তত্ত্ববোধিনী প্রেস থেকে গানের কথা ছাপিয়ে সেই কাগজ ওঁদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। রবি প্রথমে দুই হৃদয়ের নদী গানটার এক লাইন গেয়ে বলল, এটা সাহানা ঝাঁপতাল- গায়কদের সবারই বেশ তৈরি গলা, সহজেই গান তুলে নিতে পারেন। ওঁদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেরই বয়েস রবির চেয়ে ঢের বেশি। নগেন চাটুজ্জে, সুন্দরীমোহন দাস, কেদার মিত্তিরকে তো রবি চেনেই, অন্ধ চুনীলালের গানও সে শুনেছে আগে। অন্যজন যেন বয়েসে রবির চেয়েও কিছু ছোট, বেশ বলিষ্ঠকায় এক সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবা, বড় বড় টানা টানা চোখ, গাঢ় ভুরু। আলাপ করিয়ে দেবার সময় ওর নাম বলা হয়েছে। নরেন দত্ত, সে একজন কলেজের ছাত্র। রবির প্রথমে মনে হয়েছিল এই যুবকটি তার একেবারেই অচেনা। একটু পরে মনে হল, এই মুখের আদলটি সে আগে কোথাও দেখেছে। তারও পরে মনে পড়ল, বড়দাদার ছেলে দীপুর সঙ্গে এই নরেন দত্তকে সে তাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই দু’এক বার দেখে থাকবে। তখন সে আরও ছোট ছিল, খুব
false
shottojit_roy
চাকরিটা কী সে তো জানেনই। জানি। তবে আমার ধারণা ছিল চাকরিটা খুশি হয়েই করেন আপনি। পাগল! সব পেটের দায়ে। এক কালে বিজু সাকাসের বাঘের ইন-চার্জ ছিলুম—তা সে বাঘ তো আফিম খেয়ে গুম হয়ে পড়ে থাকত। বনবিহারীবাবুর এই সব জানোয়ারের কাছে তো সে দুগ্ধপোষ্য শিশু। সেদিন বেড়ালের আঁচড়, আর কাল এই থুতনিতে হাইনার চাপড়! আর পারলুম না। সকালে গিয়ে বলে এসেছি—আমার মাইনে চুকিয়ে দিন। আমি ফিরে যাচ্ছি সার্কাস পার্টিতে। তা ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন। ফেলুদা যেন খবরটা শুনে অবাক হয়ে গেল। বলল, সেকী, আপনি বনবিহারীবাবুর চাকরি ছেড়ে দিলেন? কাল বিকেলেও তো আমরা ওঁর ওখানে ঘুরে এলাম। জানি। শুধু আপনারা কেন, অনেকেই যাবেন। কিন্তু আমি আর ও তল্লাটেই নয়। এই এখন স্টেশনে যাব, গিয়ে হাওড়ার টিকিট কাটব। ব্যস্—ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়ে নিশ্চিস্ত আর-– ভদ্রলোক নিচু হয়ে ফেলুদার কানের কাছে মুখ নিয়ে এলেন, –একটা কথা বলে যাই—উনি লোকটি খুব সুবিধের নন? বনবিহারীবাবু? আগে ঠিকই ছিলেন, ইদানীং হাতে একটি জিনিস পেয়ে মাথাটি গেছে বিগড়ে। কী জিনিস? সে আর না হয় নাই বললাম—বলে গণেশ গুহ তার চায়ের পয়স টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে হাওয়া হয়ে গেল। ফেলুদা এবার মহাবীরের দিকে ফিরে বললেন, আপনি দেখেছেন বনবিহারীবাবুর চিড়িয়াখানা? ইচ্ছে ছিল যাওয়ার—কিন্তু হয়নি। বাবার আপত্তি ছিল। ওই ধরনের জানোয়ার-টানোয়ার উনি একদম পছন্দ করতেন না। একটা আরশোলা দেখলেই বাবার প্রায় হা প্যালপিটেশন হয়ে যেত! তবে এবার ভাবছি একদিন গিয়ে দেখে আসব। মহাবীর তুড়ি মেরে বেয়ারাকে ডাকল! ফেলুদা অবিশ্যি চায়ের দামটা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মহাবীর দিতে দিল না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে ফিল্মের অ্যাক্টরের অনেক টাকা, কাজেই মহাবীর দিলে কোনও ক্ষতি নেই। বিলটা দেবার পর মহাবীর তার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ফেলুদার দিয়ে এগিয়ে দিল। দেখলাম প্যাকেটটা চারমিনারের। আপনি কদিন আছেন? মহাবীর জিজ্ঞেস করল। পরশু দিন-দুয়েকের জন্য হরিদ্বার যাচ্ছি, তারপর ফিরে এসে বাকি এ মাসটা আছি। আপনারা সবাই যাচ্ছেন হরিদ্বার? ধীরেনবাবুর কাজ আছে তাই উনি যাবেন না। আমরা তিনজন যাচ্ছি, আর বোধ হয় বনবিহারীবাবু। উনি লছমনঝুলায় একটা অজগরের সন্ধানে যাচ্ছেন। রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে পড়লাম। মহাবীর বলল, আমার কিন্তু গাড়ি আছে—আমি লিফট দিতে পারি। ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে বলল, না, থাক। মোটর তো কলকাতায় হামেশাই চড়ি। এখানে টাঙ্গাটা বেড়ে লাগছে। এবার মহাবীর ফেলুদার কাছে এসে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই ভাল লাগল। একটা কথা আপনাকে বলছি—যদি জানতে পারি যে বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হয়নি, তার জন্য অন্য কেউ দায়ী, তা হলে সেই অপরাধী খুনিকে খুঁজে বার করে তার প্রতিশোধ আমি নেবই। আমার বয়স বেশি না হতে পারে, কিন্তু আমি চার বছর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ছিলাম। রিভলভারের লাইসেন্স আছে, আমার মতো অব্যৰ্থ টিপ খুব বেশি লোকের নেই। …গুড বাই। মহাবীর রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে একটা কালো স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে উঠে হুশ করে বেরিয়ে চলে গেল। ফেলুদা খালি বলল, সাবাস। আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা যে বলেছিল প্যাঁচের মধ্যে প্যাঁচ সেটা খুব ভুল নয়। টাঙ্গার খোঁজে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে ব্লেড জিনিসটার খুব বেশি দরকার বোধহয় ফেলুদার নেই। হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে। লখ্‌নৌ থেকে সন্ধ্যায় গাড়ি ছাড়ে, আর হরিদ্বার পৌঁছায় সাড়ে চারটায়। লখ্‌নৌ আসার আগে যখন হরিদ্বার যাবার কথা হয় তখন আমার খুব মজা লেগেছিল। কারণ পুরী ছাড়া আমি কোনও তীর্থস্থান দেখিনি। কিন্তু লখ্‌নৌতে এসে আংটির ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আর সে রহস্যের এখনও কোনও সমাধান না হওয়ায়, আমার এখন আর লখ্‌নৌ ছেড়ে যেতে খুব বেশি ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু ফেলুদার দেখলাম উৎসাহের কোনও অভাব নেই। ও বলল, হরিদ্বার, হৃষীকেশ আর লছমনঝুলা–এই তিনটে জায়গা পর পর দেখতে দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং লাগে। কারণ তিন জায়গার গঙ্গা দেখবি তিন রকম। যত উত্তরে যাবি তত দেখবি নদীর ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে। আর ফাইন্যালি লছমনঝুলায় গিয়ে দেখবি একেবারে উত্তাল পাহাড়ে নদী। তোড়ের শব্দে প্রায় কথাই শোনা যায় না। আমি বললাম, তোমার এ সব দেখা আছে বুঝি? সেই যেবার ক্রিকেট খেলতে লখ্‌নৌ এলাম, সেবারই দেখা সেরে গেছি। ধীরুকাক অবিশ্যি আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না, তবে উনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের সকলকে স্টেশনে নিয়ে এলেন। কামরাতে মালপত্র রাখতে না রাখতে আরেকজন ভদ্রলোক এসে পড়লেন, তিনি হচ্ছেন ডাঃ শ্ৰীবাস্তব! আমি ভাবলাম উনিও বুঝি ধীরুকাকার মতো সি-অফ করতে এসেছেন, কিন্তু তারপর দেখলাম কুলির মাথা থেকে সুটকেস নামাচ্ছেন। আমাদের সকলেরই অবাক ভাব দেখে শ্ৰীবাস্তব হেসে বললেন, বীরুবাবুকে বলিয়েছিলাম যেন আপনাদের না বোলেম। উনি জানতেন আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বোলেন তো! বাবা দেখলাম খুশি হয়েই বললেন, খুব ভালই হল। আমি ভাবতে পারিনি আপনি আসতে পারবেন, তা না হলে আমি নিজেই আপনাকে বলতাম। শ্রীবাস্তব বেঞ্চির একটা কোণ ঝেড়ে সেখানে বসে বললেন, সত্যি জানেন কী—কদিন বড্ড ওয়ারিড আছি। আমাকে বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন না। পিয়ারিলালের দেওয়া জিনিসটা এইভাবে গেল—ভাবলে বড় খারাপ লাগে। শহর ছেড়ে দুদিনের জন্য আপনাদের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারলে খানিকটা শান্তি পাব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বনবিহারীবাবুও এসে পড়লেন। তাঁর মালপত্তর যেন একজনের পক্ষে একটু বেশিই মনে হল। ভদ্রলোক হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, এইবার রগড়
false
bongkim
আমার পিতার রাজ্যচোর। আমারই সে বধ্য। ব্রা। তবে তাহার উপর যে হাতী রাগিয়া আক্রমণ করিয়াছিল, তুমি বখ্ে‍তিয়ারকে না মারিয়া সে হাতীকে মারিলে কেন? হে। আমি কি চোরের মত বিনা যুদ্ধে শত্রু মারিব? আমি মগধবিজেতাকে যুদ্ধে জয় করিয়া পিতার রাজ্য উদ্ধার করিব। নহিলে আমার মগধ-রাজপুত্র নামে কলঙ্ক। ব্রাহ্মণ কিঞ্চিৎ পরুষভাবে কহিলেন, “এ সকল ঘটনা ত অনেক দিন হইয়া গিয়াছে, ইহার পূর্বে তোমার এখানে আসার সম্ভাবনা ছিল। তুমি কেন বিলম্ব করিলে? তুমি মথুরায় গিয়াছিলে?” হেমচন্দ্র অধোবদন হইলেন। ব্রাহ্মণ কহিলেন, “বুঝিলাম তুমি মথুরায় গিয়াছিলে, আমার নিষেধ গ্রাহ্য কর নাই। যাহাকে দেখিতে মথুরায় গিয়াছিলে, তাহার কি সাক্ষাৎ পাইয়াছ?” এবার হেমচন্দ্র রুক্ষভাবে কহিলেন, “সাক্ষাৎ যে পাইলাম না, সে আপনারই দয়া। মৃণালিনীকে আপনি কোথায় পাঠাইয়াছেন?” মাধবাচার্য কহিলেন, “আমি যে কোথায় পাঠাইয়াছি, তাহা তুমি কি প্রকারে সিদ্ধান্ত করিলে?” হে। মাধবাচার্য ভিন্ন এ মন্ত্রণা কাহার? আমি মৃণালিনীর ধাত্রীর মুখে শুনিলাম যে, মৃণালিনী আমার আঙ্গটি দেখিয়া কোথায় গিয়াছে, আর তাহার উদ্দেশ নাই। আমার আঙ্গটি আপনি পাথেয় জন্য চাহিয়া লইয়াছিলেন। আঙ্গটির পরিবর্তে অন্য রত্ন দিতে চাহিয়াছিলাম; কিন্তু আপনি লন নাই। তখনই আমি সন্দিহান হইয়াছিলাম, কিন্তু আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই, এ জন্যই বিনা বিবাদে আঙ্গটি দিয়াছিলাম। কিন্তু আমার সে অসতর্কতার আপনিই সমুচিত প্রতিফল দিয়াছেন। মাধবাচার্য কহিলেন, “যদি তাহাই হয়, আমার উপর রাগ করিও না। তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে? যবননিপাত তোমার একমাত্র ধ্যানস্বরূপ হওয়া উচিত। এখন মৃণালিনী তোমার মন অধিকার করিবে কেন? একবার তুমি মৃণালিনীর আশায় মথুরায় বসিয়া ছিলে বলিয়া তোমার বাপের রাজ্য হারাইয়াছ; যবনাগমনকালে হেমচন্দ্র যদি মথুরায় না থাকিয়া মগধে থাকিত, তবে মগধজয় কেন হইবে? আবার কি সেই মৃণালিনী-পাশে বদ্ধ হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবে? মাধবাচার্যের জীবন থাকিতে তাহা হইবে না। সুতরাং যেখানে থাকিলে তুমি মৃণালিনীকে পাইবে না, আমি তাহাকে সেইখানে রাখিয়াছি |” হে। আপনার দেবকার্য আপনি উদ্ধার করুন; আমি এই পর্যন্ত। মা। তোমার দুর্বুদ্ধি ঘটিয়াছে। এই কি তোমার দেবভক্তি? ভাল, তাহাই না হউক; দেবতারা আত্মকর্ম সাধন জন্য তোমার ন্যায় মনুষ্যের সাহায্যের অপেক্ষা করেন না। কিন্তু তুমি কাপুরুষ যদি না হও, তবে তুমি কি প্রকারে শত্রুশাসন হইতে অবসর পাইতে চাও? এই কি তোমার বীরগর্ব? এই কি তোমার শিক্ষা? রাজবংশে জন্মিয়া কি প্রকারে আপনার রাজ্যোদ্ধারে বিমুখ হইতে চাহিতেছ? হে। রাজ্য-শিক্ষা-গর্ব অতল জলে ডুবিয়া যাউক। মা। নরাধম! তোমার জননী কেন তোমায় দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করিয়া যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল? কেনই বা দ্বাদশ বর্ষ দেবারাধনা ত্যাগ করিয়া এ পাষণ্ডকে সকল বিদ্যা শিখাইলাম? মাধবাচার্য অনেকক্ষণ নীরবে করলগ্নকপোল হইয়া রহিলেন। ক্রমে হেমচন্দ্রের অনিন্দ্য গৌর মুখকান্তি মধ্যাহ্ন-মরীচি-বিশোষিত স্থলপদ্মবৎ আরক্তবর্ণ হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু গর্ভাগ্নিগিরি-শিখর-তুল্য, তিনি স্থির ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরিশেষে মাধবাচার্য কহিলেন, “হেমচন্দ্র, ধৈর্যাবলম্বন কর। মৃণালিনী কোথায়, তাহা বলিব- মৃণালিনীর সহিত তোমার বিবাহ দেওয়াইব। কিন্তু এক্ষণে আমার পরামর্শের অনুবর্তী হও, আগে আপনার কাজ সাধন কর |” হেমচন্দ্র কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় না বলিলে, আমি যবনবধের জন্য অস্ত্র স্পর্শ করিব না |” মাধবাচার্য কহিলেন, “আর যদি মৃণালিনী মরিয়া থাকে?” হেমচন্দ্রের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি কহিলেন, “তবে সে আপনারই কাজ |” মাধবাচার্য কহিলেন, “আমি স্বীকার করিতেছি, আমিই দেবকার্যের কণ্টককে বিনষ্ট করিয়াছি।” হেমচন্দ্রের মুখকান্তি বর্ষণোন্মুখ মেঘবৎ হইল। ত্রস্তহস্তে ধনুকে শরসংযোগ করিয়া কহিলেন, “যে মৃণালিনীর বধকর্তা, সে আমার বধ্য। এই শরে গুরুহত্যা ব্রহ্মহত্যা উভয় দুষ্ক্রিয়া সাধন করিব |” মাধবাচার্য হাস্য করিলেন, কহিলেন, “গুরুহত্যায় ব্রাহ্মহত্যায় তোমার যত আমোদ, স্ত্রীহত্যায় আমার তত নহে। এক্ষণে তোমাকে পাতকের ভাগী হইতে হইবে না। মৃণালিনী জীবিতা আছে। পার, তাহার সন্ধান করিয়া সাক্ষাৎ কর। এক্ষণে আমার আশ্রম হইতে স্থানান্তরে যাও। আশ্রম কলুষিত করিও না; অপাত্রে আমি কোন ভার দিই না |” এই বলিয়া মাধবাচার্য পূর্ববৎ জপে নিযুক্ত হইলেন। হেমচন্দ্র আশ্রম হইতে নির্গত হইলেন। ঘাটে আসিয়া ক্ষুদ্র তরণী আরোহণ করিলেন। যে দ্বিতীয় ব্যক্তি নৌকায় ছিল, তাহাকে বলিলেন, “দিগ্বিজয়! নৌকো ছাড়িয়া দাও |” দিগ্বিজয় বলিল, “কোথায় যাইব?” হেমচন্দ্র বলিলেন, “যেখানে ইচ্ছা- যমালয় |” দিগ্বিজয় প্রভুর স্বভাব বুঝিত। অস্ফুটস্বরে কহিল, “সেটা অল্প পথ |” এই বলিয়া সে তরণী ছাড়িয়া দিয়া স্রোতের প্রতিকূলে বাহিতে লাগিল। হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া শেষে কহিলেন, “দূর হউক! ফিরিয়া চল |” দিগ্বিজয় নৌকা ফিরাইয়া পুনরপি প্রয়াগের ঘাটে উপনীত হইল। হেমচন্দ্র লম্ফে তীরে অবতরণ করিয়া পুনর্বার মাধবাচার্যের আশ্রমে গেলেন। তাঁহাকে দেখিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “পুনর্বার কেন আসিয়াছ?” হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই স্বীকার করিব। মৃণালিনী কোথায় আছে আজ্ঞা করুন |” মা। তুমি সত্যবাদী-আমার আজ্ঞাপালন করিতে স্বীকার করিলে, ইহাতেই আমি সন্তুষ্ট হইলাম। গৌড়নগরে এক শিষ্যের বাটীতে মৃণালিনীকে রাখিয়াছি। তোমাকেও সেই প্রদেশে যাইতে হইবে। কিন্তু তুমি তাহার সাক্ষাৎ পাইবে না। শিষ্যের প্রতি আমার বিশেষ আজ্ঞা আছে যে, যতদিন মৃণালিনী তাঁহার গৃহে থাকিবে, ততদিন সে পুরুষান্তরের সাক্ষাৎ না পায়। হে। সাক্ষাৎ না পাই, যাহা বলিলেন, ইহাতেই আমি চরিতার্থ হইলাম। এক্ষণে কি কার্য করিতে হইবে অনুমতি করুন। মা। তুমি দিল্লী গিয়া যবনের মন্ত্রণা কি জানিয়া আসিয়াছ? হে। যবনেরা বঙ্গবিজয়ের উদ্যোগ করিতেছে। অতি ত্বরায় বখ্স‍তিয়ার খিলিজি সেনা লইয়া, গৌড়ে যাত্রা করিবে। মাধবাচার্যের মুখ হর্ষপ্রফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন, “এতদিনে বিধাতা বুঝি এ দেশের প্রতি সদয় হইলেন |” হেমচন্দ্র একতানমনে মাধবাচার্যের প্রতি চাহিয়া তাঁহার কথার
false
toslima_nasrin
বিয়ের ধুম। কালো ফটকের সামনে গাছপাতা ফুলপাতায় চমৎকার একটি প্রবেশদ্বার বানানো হয়েছে। বাবার বন্ধুদের গাড়ি ধার করে বাবা, আমরা ছোটরা, দাদার বন্ধুরা গেলাম অর্জুনখিলায়। দাদার মত নিলাজ লোক মুখে রুমাল চেপে বসে রইলেন, মাথায় টোপর, পরনে শাদা শেরওয়ানি, শাদা পাজামা, শাদা নাগরা। বাইরে শামিয়ানার তলে বসে কাজীকে কবুল বললেন, ভেতর ঘরে হাসিনা কাজীর সামনে একই কথা বলল, কবুল। মেয়েদের অবশ্য অমুক লোকের অমুক পুত্রের সঙ্গে এত টাকা দেনমোহরে বিবাহ করিতে রাজি আছ কি না জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলা শোভন দেখায় না, কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদতে হয়, কেঁদে কেটে ক্লান্ত হলে মা খালাদের কিছু ঠেলা গুঁতো খেয়ে শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়। হাসিনা খুব একটা সময় নেয়নি কবুল বলতে। হাসিনার কবুল বলা মানে বিয়ে ঘটে যাওয়া। এবার বিদায় নেবার পালা। হাসিনার মা বাবার হাতে মেয়ে সমপর্ণ করলেন। আমি অবাক হয়ে সব কাণ্ড দেখছিলাম, বিয়ের এমন সব কাণ্ড এত কাছ থেকে আমার আগে দেখা হয় নি। ফুলে সাজানো গাড়িতে দাদা বউ নিয়ে বসলেন, দুপাশে আমি আমি ইয়াসমিন, পেছনের গাড়িতে বরযাষনী। দাদা সব কিছুর নীল নকশা আগে থেকেই এঁকে রেখেছিলেন। নীল নকশা অনুযায়ী আমরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলাম বাড়িতে বরবধূর গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান জমকালো করতে, কুলো থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটোতে বরবধূর গায়ে। কুলো হাতে নিয়ে ফুল ছিটোচ্ছি লাল কাপের্টের কিনারে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বাবা লোক খুঁজছেন বউ বরণ করার জন্য। মা দাঁড়িয়ে ছিলেন খোলা দরজার সামনে বরবধূ বরণ করতে। সারাদিন বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি এই ক্ষণটির। মার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাবার বন্ধুদের বউ। মাকে দরজার সামনে থেকে তুমি সর, দূরে যাও, দূরে যাও বলে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে বাবা এম এ কাহারের ছোটভাই আবদুল মোমিনের বউকে বিগলিত হেসে বললেন, ভাবী আসেন আপনে, আমার ছেলে আর ছেলের বউরে বরণ করেন। মা পেছনে পড়ে রইলেন, ধনী আবদুল মোমিনের সোনার গয়নায় মোড়া বউটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাদার আর লাল ঘোমটা মাথার নতমখু হাসিনার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করলেন। রুনুখালা অবাক তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য, বাড়িতে মা তার ছেলে আর ছেলের বউরে ঢোকালো না! ঢোকালো অন্য কেউ! রুনুখালা সরে যান দৃশ্য থেকে। দাদার কিনে দেওয়া না-কাতান শাড়ি পরে পুত্রবধূসহ পুত্রের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মা বিড়বিড় করে দোয়া পড়েন দাদা আর দাদার বউএর সুখী জীবনের জন্য। দাদার সাজানো ঘর, বিছানায় ছড়ানো লাল গোলাপের পাপড়ি, ওর মাধ্যে লাল বেনারসি পরা বউ বসেছে। দাদা এঘর ওঘর করেন। দাদাকে দেখে আগের দাদাই মনে হয়, কিন্তু আবার ভাবি এ দাদা আগের দাদা নয়, এ বিবাহিত দাদা। ঠোটেঁ একটি কাঁপা কাপাঁ বিব্রত হাসি লেগে থাকে দাদার। রাতে সোফায় বসে পা নাড়ছিলেন তিনি, বাবা অন্যদিনের মতই বললেন, অনেক রাত হইছে, যাও শুইয়া পড় গিয়া। দাদা শুতে যাবেন তাঁর ঘরে, আগের রাতেও একা শুয়েছেন, আজ তাঁর বিছানায় আরেকজন, যার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়নি, প্রেম হয়নি। আমি ভাবছিলাম কি কথা বলবে দুজন! দুটো অচেনা মানুষ! ইচ্ছে করে দাদার ঘরের দরজায় কান পেতে শুনি কী হচ্ছে ভেতরে! দাদা যদি বউএর কোনও খুঁত আবিষ্কার করেন এই রাতে, তবে আবার রাতেই সোফায় এসে বসে থাকেন কি না। অনেক রাত অবদি বিষম কৌতূুহলের যনণ্ত্রায় আমার ঘুম হয় না। সকালে দাদা বেরোলেন আগে, পেছন পেছন হাসিনা। দাদার লজ্জা লজ্জা মখু , পেছনে হাসিনার নির্লজ্জ হাসি। বাড়ির সবার চোখ দুজনের মুখে। ছোটদা চোখ নাচিয়ে বললেন কী বৌদি, নাকের ফুল খুলছিলা রাতে? হাসিনা খসখসে গলায় বলল কিছু হয় নাই তো। জিজ্ঞেস করি, নাকের ফুল খুলতে হয় কেন? হাসিনা আমার পিঠে খোঁচা মেরে বলল, বিয়ের রাতে খুলতে হয়। কেন খুলতে হয়? জানো না? না তো! ওইগুলা হওয়া মানেই নাকের ফুল খোলা। ওইগুলা কোনগুলা? হাসিনা জোরে হাসল। নিজেকে খুব বোকা মনে হয় আমার। হাসিনা খুব সহজে সহজ হয়ে যায়। ছোটদা বয়সে অনেক বড় হলেও ছোটদাকে দিব্যি নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। গীতাকেও। অবলীলায় তুমি সম্বোধন করছে। সে বড় বউ বলেই নাকি দাদার যারা ছোট, তাদের তার ছোট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। হাসিনাকে অবাক হয়ে দেখি, আমার মনে হয় না মুমিনুন্নিসা কলেজে পড়া এটি সেই মেয়ে, যে মেয়েটিকে দূর থেকে দেখতাম হাঁটছে চত্বরে, নাফিসার সঙ্গে হাতে হাত ধরে। আনুর মা, বাড়ির নতুন কাজের মহিলা, বালতিতে পানি নিয়ে ঘর মুছতে এল, বললাম, দেখছ নতুন বউরে? বউএর শইলে তো গোসত নাই। তা ঠিক, হাসিনার শরীরে মেদমাংসের অভাব, আমার যেমন। আর বউ তো সকালে গোসলও করল না, কাপড়ও লাড়ল না ! কেন, এই শীতের সময় সকালের ঠাণ্ডা পানিতে কেউ কি গোসল করে নাকি! হ। সকালে ঘুম থেইকা উইঠাই গোসল কইরা,শইলের কাপড় ধইয়া পরে ঘরে যাইতে হয়। কেন, দুপুরে গোসল করলে হয় না? আর কাপড় না ধইলে হয় না? আনুর মা সজোরে মাথা নাড়ে, নিশ্চিত কণ্ঠে বলে, না। কৌতূুহল আমাকে গ্রাস করছে। হাসিনাকে বলি, কী নাকি গোসল করতে হয়, আর কাপড় ভিজাইতে? হাসিনা বলল, ওইগুলা হইলে হয়। ওইগুলা কোনগুলা? হাসিনা এবারও জোরে হাসল। আমার জানা হল না ওইগুলা কোনগুলা। হাসিনা আর আমি যদিও মুমিনুন্নিসা কলেজে এক বর্ষেই পড়েছি, তাকে আমার মোটেও বান্ধবী গোছের কিছু বলে মনে হয় না,
false
manik_bandhopaddhay
কি বিশ্বাসঘাতক সদানন্দ। নিজে রাজ্য সৃষ্টি করিয়া নিজেকে বিসর্জন দিয়া সদানন্দকে রাজা করিয়াছে যে, আজ সদানন্দ তাকেই হীন মতলববাজ মানুষ মনে করিয়া তুচ্ছ করে। অন্যমনে বিপিন এক কুটিরের অধিবাসীদের সঙ্গে দুটি-একটি কথা বলিয়া অন্য কুটিরে চলিয়া যায়। কেহ শয়ন করিয়াছে, কেহ শয়নের আয়োজন করিতেছে, কেহ আসনে বসিয়া চিন্তাসাধনায় মগ্ন হইয়াছে, কেহ বারান্দায় বসিয়া করিতেছে মেঘের গতিতে চাঁদের গতি সৃষ্টির ভ্রান্তিকে উপভোগ। উমা আর রাবলীর কুটিরের সামনে আসিয়া বিপিনের অন্যমনস্কতা ঘুচিয়া গেল। বারান্দার নিচে দাঁড়াইয়া আছে শশধর, বারান্দায় থাম ধরিয়া দাঁড়াইয়া তার সঙ্গে কথা বলিতেছে রত্নাবলী। চিনিতে পারিয়াও বিপিন জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কে? শশধর উৎসাহের সঙ্গে বলিল, আমায় চিনলেন না? সেই যে সেদিন– রত্নাবলী সোজাসুজি বলিল, উনি মহেশবাবুর ভাগ্নে। বিপিন বলিল, এত রাত্রে আপনি এখানে কি করছেন? বিপিনের গলার সুরে শশধরের উৎসাহ নিভিয়া গিয়াছিল, সে আমতা আমতা করিয়া বলিল, মহেশবাবু বললেন কিনা তার হইয়া রত্নাবলী কথাটা পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া বলিল, মহেশবাবুর খুব অসুখ, এক শ চারে জ্বর উঠেছে; মাধবীকে একবার দেখবার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। শশধরবাবু তাই বলতে এসেছেন, মাধবী যদি একবার যায়– এত রাত্রে! দিনের বেলা বলতে এলেই হত। বিপিনের আবির্ভাবেই রত্নাবলী যেন বিরক্ত হইয়াছিল, জেরা আরম্ভ করায় সে যেন রাগিয়া গেল, আপনি বুঝছেন না দিনের বেলা অতটা ব্যাকুল হন নি! এখন এত বেশি ছটফট করছেন যে, শশধরবাবু ভাবলেন, মাধবীকে যেতে বলে গেছেন, এ খরবটা জানালে হয়তো একটু শান্ত হবেন। তাই এখন বলতে এসেছেন। নইলে এত রাত্রে ওঁর আশ্রমে আসবার দরকার! এত কথা এক সঙ্গে রত্নাবলী কোনোদিন বলে না। চাঁদের আলোতেও বোঝা যায়, রত্নাবলীর দাঁতগুলি কি ধবধবে। ব্যাপারটা বিপিনের একটু জটিল মনে হইতে লাগিল। মহেশ চৌধুরীর খুব অসুখ হইয়াছে, মাধবীকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে, শুধু এই ব্যাপারটুকুই কম জটিল নয়। জগতে এত লোক থাকিতে মাধবীলতাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুলতা কেন? কতটুকুই বা তার পরিচয় মাধবীর সঙ্গে! মাধবীলতাকে কথাটা জানাইতে এত রাত্রে আশ্রমে আসিয়া রত্নাবলীর সঙ্গে শশধরের গল্প জুড়িয়া দেওয়াটাও জটিল ব্যাপার বৈকি। উমা আর মাধবীলতার অনুপস্থিতির ব্যাপারটা আরো বেশি জটিল। জিজ্ঞাসা করায় রত্নাবলী বলিল, ওরা খাচ্ছে। এখনো খাওয়া হয় নি কেন? রত্নাবলী মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়া ঝাঁঝালো গলায় বলিল, কারণ আছে, ওসব মেয়েদের ব্যাপার আপনি বুঝবেন না। পারি না বাপু আর আপনার কথার জবাব দিতে। মনে মনেও কোনো রকমেই বিপিন রাগ করিতে পারিতেছিল না, আশ্রমের নিয়ম ভঙ্গ করা তার কাছে গুরুতর মনে হইতেছিল না। আশ্রমের নিয়মেই যেন এসব ঘটিতেছে, আগাগোড়া তার নিজেরও সমর্থন আছে। একটু ভাবিল বিপিন, তারপর কোনোরকমে গলা গম্ভীর করিয়া বলিল, আপনি ভেতরে যান, রাত্রে কেউ কোনো দরকারে আশ্রমে এলে এবার থেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর আপনি বাড়ি ফিরে যান শশধরবাবু, মহেশবাবুকে বলুন গিয়ে মাধবীকে সঙ্গে করে নিয়ে আমি যাচ্ছি। আজ রাত্রেই যাবেন? অসুখবিসুখের সময় কি দিন-রাত্রির বিচার করলে চলে? সময় বুঝে মানুষের অসুখ হয় না। বুড়ো মানুষ, এমন অসুখে পড়েছেন, তাঁর সামান্য একটা ইচ্ছা যদি আমরা না পূর্ণ করিতে পারি, আমাদের আশ্রমে থাকা কেন? নিজেরা সুখে থাকার জন্য আমরা আশ্রম-বাস করি না শশধরবাবু। শশধর অভিভূত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। বিপিন তাগিদ দিয়ে বলে, দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আপনি যান। বলুন গিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা যাচ্ছি। শশধর চলিয়া গেলে রত্নাবলী জিজ্ঞাসা করিল, এত দূর রাস্তা যাবেন কি করে? হেঁটে? সে ভাবনা তো আপনাকে ভাবতে বলি নি? আপনাকে যা বললাম তাই করুন, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। রত্নাবলী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, আমি সঙ্গে যাব না? বিপিন বলিল, না। এত রাত্রে বিপিন মাধবীলতাকে সঙ্গে করিয়া মহেশ চৌধুরীর বাড়ি যাইবে। মহেশ চৌধুরীর। বাড়ি কাছে নয়, আশ্রম হইতে প্রায় চার মাইল পথ। বিপথে মাঠ-ঘাট বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়া গেলে পথ কিছু সংক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু এখন বর্ষাকালে দিনের বেলাও সে পথে যাতায়াত করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আশ্রম হইতে বাগবাদা যাইতে হইলে সাতুর গা ঘেঁরিয়া যাইতে হইবে, সাতুনা বেশি দূরে নয়। সাতুনা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই পথের ধারে ছাড়া ছাড়া ভাবে কয়েকজন গৃহস্থের খানকয়েক বাড়ি আর ক্ষেতখামার পাওয়া যায়, তাদের কারো কারো গরুর গাড়ি আছে। বিপিন কি লোক পাঠাইয়া গরুর গাড়ি আনাইয়া লইবে? অথবা মাধবীকে সঙ্গে করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করিয়া দিবে, পথে ওই ছোট পাহাড়টিতে হোক, সাতুনায় হোক, কারো কাছে সগ্ৰহ করিয়া লইবে গরুর গাড়িঃ গরুর গাড়ি না পাওয়া গেলে হটিয়াই হাজির হইবে বাগবাদায় মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে? এই সব ভাবিতে ভাবিতে রত্নাবলীর সর্বাঙ্গে কাটা দেয়–আকাশ ও পৃথিবীব্যাপী ক্ষান্তবর্ষার রাত্রি রত্নাবলীকে ঘিরিয়া আছে, নির্জন পথ বাহিয়া দুজন হাঁটিয়া চলিয়াছে ঘুমন্ত গ্রামের গা ঘেঁষিয়া, পথের খানিক খানিক ভিজা চাঁদের আলোয় ঢাকা আর খানিক খানিক বড় বড় গাছের ছায়ায় প্রায় অন্ধকার, কোথাও ঝোপঝাড় পথের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, কোথাও দুদিকেই জলভরা ক্ষেত হাঁটিয়া চলিতে চলিতে দুজন কখন উঠিয়া বসিয়াছে গরুর গাড়িতে ছাউনির মধ্যে, গাড়ির দোলনে এদিক-ওদিক চলিতে কখন তারা জড়াইয়া ধরিয়াছে পরস্পরকে, কখন শশধরের দুটি হাত অন্ধের দুটি হাতের মতো রত্নাবলীর সর্বাঙ্গে ব্যাকুল আগ্রহে খুঁজিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে রত্নাবলীর সর্বাঙ্গের পরিচয় একা বিপিনের সঙ্গে একাকিনী মাধবীর এত রাত্রে মহেশ চৌধুরীর বাড়ি যাওয়ার নানারকম অসুবিধা ও অসঙ্গতির কথা ভাবিতে ভাবিতে রত্নাবলীর গায়ে সত্যই কাঁটা দিয়া ওঠে। বিপিনের কি মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে? কাল
false
shorotchandra
হবে না, কিন্তু যাঁর জন্যে ভাবনা তাঁর প্রতি যেন দৃষ্টি থাকে। সুরেশ কহিল, তা আছে, কিন্তু তোমার কিছু খাবার, কিংবা শুধু একটু জল— অচলা সহাস্যে বলিল, না গো না, আমার কিছু চাইনে। কিন্তু তুমি নিজে কি জলে ভিজে অসুখ করতে চাও নাকি? সুরেশ পলকমাত্র অচলার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু আনত করিল, কহিল, অনেকদিন থেকেই ত চাইচি, কিন্তু হতভাগ্যের কাছে অসুখ পর্যন্ত ঘেঁষতে চায় না যে! কথা শুনিয়া অচলার কর্ণমূল পর্যন্ত লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু পাছে সুরেশ মুখ তুলিয়াই তাহা দেখিতে পায়, এই আশঙ্কায় সে কোনমতে ইহাকে একটা পরিহাসের আকার দিতে জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, একবার চল না। তখন এমন খাটুনি খাটাব যে— কিন্তু কথাটাকে সে শেষ করিতে পারিল না, তাহার অদৃশ্য লজ্জা এই ছদ্ম রহস্যের বাহ্য প্রকাশকে যেন অর্ধপথেই ধিক্কার দিয়া থামাইয়া দিল। গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা বাজিল, সুরেশ কি বলিবার জন্য মুখ তুলিয়াও অবশেষে কিছু না বলিয়াই চলিয়া যাইতেছিল, সহসা বাধা পাইয়া ফিরিয়া দেখিল, তাহার র‍্যাপারের একটা খুঁট অচলার হাতের মুঠার মধ্যে। সে ফিসফিস করিয়া অকস্মাৎ তর্জন করিয়া উঠিল, তোমাকে আমি সঙ্গে যেতে ডেকেছি, এ কথা সকলের কাছে প্রকাশ করে দিলে কেন? কেন আমাকে অমন অপ্রতিভ করলে? ঠিক এই কথাটাই সুরেশ তখন হইতে সহস্রবার তোলাপাড়া করিয়া অনুশোচনায় দগ্ধ হইতেছিল, তাই প্রত্যুত্তরে কেবল করুণকণ্ঠে কহিল, আমি না বুঝে অপরাধ করে ফেলেছি অচলা। অচলা লেশমাত্র শান্ত না হইয়া তেমনি উত্তপ্তস্বরে জবাব দিল, না বুঝে বৈ কি! সকলের কাছে আমার শুধু মাথা হেঁট করবার জন্যেই তুমি ইচ্ছে করে বলেচ। ট্রেন চলিতে শুরু করিয়াছিল; সুরেশ আর কথা কহিবার অবকাশ পাইল না; অচলা তাহার গায়ের কাপড় ছাড়িয়া দিতেই সে দুরুদুরু বক্ষে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল; সে কোনদিকে না চাহিয়া ছুটিয়া চলিল বটে, কিন্তু তাহাকে দৃষ্টি দ্বারা অনুসরণ করিতে গিয়া আর একজনের হৃৎস্পন্দন একেবারে থামিয়া যাইবার উপক্রম করিল। অচলার চোখ পড়িয়া গেল, আর একটা জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া মহিম ঠিক তাহাদের দিকেই চাহিয়া আছে। সে স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া যখন উপবেশন করিল, সেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, উনিই বুঝি আপনার বাবু? অন্যমনস্ক অচলা শুধু একটা হুঁ দিয়াই আর একটা জানালার বাহিরে গাছপালা, মাঠ-ময়দানের প্রতি শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল; যে গল্প অসমাপ্ত রাখিয়া সে সুরেশের কাছে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে সম্পূর্ণ করিবার আর তাহার প্রবৃত্তিমাত্র রহিল না। আবার গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পার হইয়া যাইতে লাগিল, আবার মনের ক্ষোভ কাটিয়া গিয়া মুখ নির্মল ও প্রশান্ত হইয়া উঠিল, আবার সে তাহার সঙ্গিনীর সহিত স্বচ্ছন্দচিত্তে কথাবার্তায় যোগ দিতে পারিল; যে লজ্জা ঘণ্টা-কয়েকমাত্র পূর্বে তাহাকে পীড়িত করিয়া তুলিয়াছিল, সে আর তাহার মনেও রহিল না। একটা বড় স্টেশনে সুরেশ খানসামার হাতে চা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী উপস্থিত করিল। অচলা সেগুলি গ্রহণ করিয়া সস্নেহ অনুযোগের স্বরে কহিল, তোমাকে এত হাঙ্গামা করতে কে বলে দিচ্ছে বল ত? তোমার বন্ধুরত্নটি বুঝি? এ বিষয়ে সুরেশ কাহারো যে বলার অপেক্ষা রাখে না, অচলা তাহা ভাল করিয়াই জানিত, তথাপি এই অযাচিত যত্নটুকুর পরিবর্তে সে এই স্নিগ্ধ খোঁচাটুকু না দিয়া যেন থাকিতে পারিল না। সুরেশ মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া যাইতেছিল, অচলা ফিরিয়া ডাকিল। সে চাপা হাসির আভাসটুকু তখনও তাহার ওষ্ঠাধরে লাগিয়া ছিল। তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্রই অচলা সহসা মুচকিয়া হাসিয়া ফেলিয়াই লজ্জায় কুণ্ঠায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। এই আরক্ত আভাসটুকু সুরেশ দুই চক্ষু দিয়া যেন আকণ্ঠ পান করিয়া লইল। অচলা স্বামীর সংবাদের জন্যই সুরেশকে ফিরিয়া ডাকিয়াছিল। তাঁহার কোনপ্রকার ক্লেশ বা অসুবিধা হইতেছে কি না, বা কিছু আবশ্যক আছে কি না—একবার আসিতে পারেন কি না, এই-সকল একটি একটি করিয়া জানিয়া লইতে সে চাহিয়াছিল; কিন্তু ইহার পরে এ-সম্বন্ধে আর একটি প্রশ্ন করিবারও তাহার শক্তি রহিল না। সে অসঙ্গত গাম্ভীর্যের সহিত শুধু জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের ত এলাহাবাদে গাড়ি বদল করতে হবে? কত রাত্রে সেখানে পৌঁছবে জানেন? একবার জেনে এসে আমাকে বলে যেতে পারবেন? আচ্ছা, বলিয়া সুরেশ একটু আশ্চর্য হইয়াই চলিয়া গেল। অচলা ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সেই মেয়েটি তাহার জায়গা ছাড়িয়া দূরে গিয়া বসিয়াছে। অচলা অন্তরের বিরক্তি গোপন করিতে না পারিয়া কহিল, আপনাদের বাড়িতে বুঝি কেউ চা-রুটি খায় না? মেয়েটি সবিনয়ে হাসিয়া বলিল, হায় হায়, ও দৌরাত্ম্য থেকে বুঝি কোন বাড়ি নিস্তার পেয়েচে ভাবেন? ও ত সবাই খায়। অচলা কহিল, তবে যে বড় ঘৃণায় সরে বসলেন? মেয়েটি লজ্জিতস্বরে বলিল, না ভাই, ঘৃণায় নয়—পুরুষেরা ত সমস্ত খায়, তবে আমার শ্বশুর এ-সব পছন্দ করেন না, আর—আমাদের মেয়েমানুষের ত— একদিন এমনি একটা খাওয়া-ছোঁয়ার ব্যাপার লইয়া মৃণালের সহিত তাহার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল। সেদিনও সে যে-কারণে নিজেকে শাসন করিতে পারে নাই, আজও সে তেমনি একটা অন্তর্জ্বালায় আত্মবিস্মৃত হইয়া গেল, এবং মেয়েটির কথা শেষ না হইতেই রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, আপনাকে বিব্রত করতে আমি চাইনে, আপনি স্বচ্ছন্দে ফিরে এসে আপনার জায়গায় বসুন; বলিয়া চক্ষের নিমিষে চা এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য জানালা দিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। মেয়েটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে চাহিয়া কাঠের মত বসিয়া রহিল, তাহার পরে একেবারে সম্পূর্ণ মুখ ফিরাইয়া বসিয়া আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। বোধ করি, সে ইহাই ভাবিল, এতক্ষণের এত আলাপ, এত কথাবার্তার যে বিন্দুমাত্র মর্যাদা রাখিল না, না জানি সে এ অশ্রু দেখিয়া আবার কি একটা করিয়া বসিবে। কিছুক্ষণের
false
shunil_gongopaddhay
ভুজং ভাজুং দেয়। বিয়ে দিলে ছেলে পর হয়ে যায়। নবীনকুমারের বিবাহের ছাঁ মাসের মধ্যেই বিম্ববতী অনুভব করলেন, তাঁর বুকের ধন ছোটকু আর তাঁর বাধ্য নেই। নবীনকুমারের পত্নী কৃষ্ণভামিনীর বয়েস মাত্র আট বৎসর, ঐ বয়েসী বধুরা সাধারণত পিত্ৰালয়ে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণভামিনী তার খেলার পুতুল, তাকে সর্বক্ষণ নবীনকুমারের কাছে চাই। শুধু তাই নয়, এতকাল সে মায়ের পাশে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। এখন নবীনকুমার বিবাহিত পুরুষ, সে অবিকল কোনো বয়স্ক ব্যক্তির মতন নিজেই ব্যবস্থা করে পৃথক কক্ষে তার খেলার সঙ্গিনীকে নিয়ে রাত্রিযাপন করে। এখন প্রতি রাত্রে বিম্ববতীর বুক নিদারুণভাবে খালি খালি লাগে, তাঁর ঘুম আসে না। নবীনকুমার অন্যান্য ব্যাপারেও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। সে মায়ের অনুমতি না নিয়েই এখন বাড়ির বাইরে যায়। বিম্ববতী তাকে নিষেধ করতে গিয়ে বার বার হার মেনেছেন। নবীনকুমার মুখের ওপর জানিয়ে দেয়,আমি তো আর দুধের বাছটি নেই মা, যে কাবুলি মেওয়াওয়ালারা ঝোলায় পুরে নিয়ে যাবে আর গরম কড়ার ওপর উল্টো করে বুলিয়ে রেকে নাক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বার কর্বে! নবীনকুমারকে এখন সর্বব্যাপারে তাল দিচ্ছে দিবাকর। মনে মনে সে মতলব এঁটে রেখেছে যে এই ছোটবাবুটিকে একবার খরচের হাত ধরিয়ে দিতে পারলেই হয়। অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক এই বালক, একবার এ খরচ শুরু করলে পারিষদরাই তো তার মোটা ভাগ পাবে। বাবু রামকমল সিংহ ছিলেন দিলাদরিয়া মানুষ, তাঁর আমলে দিবাকরের বিলক্ষণ দশ টাকা উপরি রোজগার হতো। তিনি অকালে গত হওয়ায় দিবাকর বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। বিধুশেখরের তীক্ষ্ণ নজর হিসাবপত্রের দিকে। আর গঙ্গানারায়ণ তো কলেজে-পড়া ম্লেচ্ছভাবাপন্ন ছোঁড়া। তার সেরকম বুনিয়াদি উঁচু নজরই নেই যে পাঁচ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা ব্যয় করবে। আরে, কলকাতা শহরে বাবু সমাজে দুহাতে টাকা না ওড়ালে যে মান থাকে না, লোকে আড়ালে ছা ছ্যা করে, সে জ্ঞানই হলো না গঙ্গানারায়ণের। দিবাকরের খুব আশা নবীনকুমারের মতি এদিকে ফেরানো যাবে। গত মাসে নবীনকুমার নিজে গিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছে। বিম্ববতীর আপত্তিতে সে কৰ্ণপাত করেনি, এবং বিধুশেখরেরও আপত্তি জানাবার মতন আর কোনো যুক্তি নেই। হিন্দু কলেজে হীরা-বুলবুল পর্ব সমাপ্ত হয়েছে, বিতাড়িত হয়েছে চন্দ্রনাথ, এখন আর বেশ্যাপুত্রের সংসর্গে থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। হিন্দু কলেজে আবার আস্তে আস্তে ফিরে আসছে প্রাক্তন ছাত্ররা বড়ঘরের ছেলেরাও। ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন সাহেবের নতুন কলেজের যতই রবরবা হোক, তবু হিন্দু কলেজ কতদিনের ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বাপ-কাকারা যেখানে পড়েছে, অনেক ছাত্র সেখানেই পড়তে চায়। কলেজ থেকেই নবীনকুমার শুনে এসেছে মহাপুরুষের কাহিনী। ছাত্ররা সবাই বলাবলি করছিল ঐ কথা। ক্লাসে তো এই সব গল্পই হয়। পুনর্গঠিত হিন্দু কলেজে আগেকার সেই শৃঙ্খলা আর নেই। কোনো কিছু একবার ভাঙলে ঠিক মতন জোড়া লাগানো শক্ত। আগে হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়াই ছিল একটি কঠিন ব্যাপার। বংশ পরিচয়, বিত্ত এবং মেধার পরিচয় না নিয়ে কোনো ছাত্রকে গ্ৰহণ করা হতো না। হীরা, বুলবুল পর্বচুকে যাবার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তোষামোদ করে ছাত্রদের ডেকে এনেছেন। এই সুযোগে অনেক অগা বগা দুঃশীল বালকও ঢুকে পড়েছে ছাত্র সেজে। পড়াশুনোর বদলে ক্লাসের মধ্যে এখন হই হট্টগোলই হয় বেশী। এই পরিবেশটি নবীনকুমারের বেশ পছন্দ। অতি অল্প দিনেই সে সদার গোছের হয়ে উঠেছে ক্লাসের মধ্যে। নানাপ্রকার দুষ্ট আমোদে সে উস্কানি দেয়। শিক্ষক যখন ক্লাসে থাকেন না। তখন কক্ষটি হয়ে ওঠে একটি হট্টমেলা। ছেলেরা কেউ শ্যামা পাখির মতন শিস দেয়, কেউ পায়রার মতন বকম বকম করে, কেউ ঘোড়া সেজে চার পায়ে ছোটে, কেউ বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করে দেখায়, আর নবীনকুমার এইসব উপভোগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে হাসে। এক একদিন এক একরকম হুজুগের গল্প শোনা যায়। যেমন একদিন জলখাবার ছুটির সময় কাশীপুর অঞ্চল নিবাসী এক ছোঁকরা বললো, জানিস, কাল বৈকালে পাকপাড়ার লালাবাবুদের বাড়িতে কী হয়েচে? একদল মাতাল গোরা লালারাজাদের বাড়িতে এসে হামলে পড়ে চার পাঁচজন দারোয়ানকে বিশায় বিদে গিয়েচে! অমনি অন্য ছাত্ররা রই রই করে উঠলো। একজন কিছু বললে অন্য কেউ তার প্রতিবাদ করবেই। একজন বললো, পাকপাড়ায় কী হয়েচে, তা তুই জানলি কী করে রে? কাশীপুরের ছাত্র বললো, আমি সন্ধেবেলা ঐ পথ দিয়ে যাচ্চিালুম, নিজের চোকে দেকিচি! আর একজন বললো, পাকপাড়ায় মাতাল গোরা আসবে কোতা থেকে? কাল সন্ধেবেলা চরস খেয়েচিলি নিশ্চয়? অন্য একজন কাশীপুরীর সমর্থনে বললে, কেন, দমদমা থেকে ময়দানের কেল্লায় তো গোরারা হরদমই যাতায়াত কর্চে। আর তারা তো সর্বক্ষণই মাতাল হয়ে থাকে। অন্য কয়েকজন একসঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল, নবীনকুমার তাদের থামিয়ে দিয়ে বললো, আঃ, দাঁড়া না, তারপর কী হলো শুনি। রাজারা কী কল্লেন? কাশীপুরী বললো, রাজারা ভয় পেয়ে হাসন হোসেন বলতে বলতে বুক চাপড়ে দৌড়ে পুরোনো এক পাতকের মধ্যে সেদিয়ে প্রাণরক্ষা কল্লেন। নবীনকুমার বললো, রাজারা পাতকোর মধ্যে সেঁধুলো কী করে, গিরগিটি নাকি? অমনি হাসির গরুরা পড়ে গেল। আর একটি ছাত্র বললো, আরো তা নয়, তা নয়। আসল কতটা আমি জানি, আমার বড়দাদার কাচে শুনিচি। রাজাদের বাড়ির সামনের গাচে একটা কাগ বসেছেল, এক সাহেব শিকারী বন্দুকের তাক ঠিক আছে কিনা দেকবার জন্য সেই কাগটাকে যেই মারলো অমনি রাজাদের দারোয়ান তেড়ে তাকে মাত্তে গেল… তাকে থামিয়ে দিয়ে আর একজন বললো, ধোৎ, যতসব বাজে কতা! আমাদের পাশের বাড়ির কতা, আমি জানি না, তোরা জানিস! নবীনকুমার সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো, তুই লালারাজাদের পাশের বাড়ি থাকিস?
false
toslima_nasrin
আর চিন্তা নাই। ওই বাড়ির সবারই ঈমান মজবুত। এক একটি দিন যায় আর শরাফ মামাকে, ফেলুমামাকে, মা’কে জিজ্ঞেস করি–কই, দজ্জাল ত আইল না! মা বলেন–যে কোনও সময় আইব। তালই সাব কইছে শুনলাম দজ্জাল আওনের পরই কেয়ামত অইব। — কেয়ামত অইলে কী হইব মা? মা’কে জিজ্ঞেস করলে — কী আর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–ইসরাফিল শিঙ্গায় ফুঁ দিব। পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইব। আল্লাহর সৃষ্টি এই আসমান জমিন কিছুই আর থাকব না। পৃথিবী কি করে ধ্বংস হবে তা অনুমান করে নিয়েছিলাম। আকাশ এসে চাপ দেবে পৃথিবীর ওপর, বাড়ি ঘরগুলো সব চ্যাপ্টা হয়ে যাবে, মানুষ মরতে থাকবে পিঁপড়ের মত। বিশাল বিশাল কড়ই গাছ, নিম গাছ, নারকেল গাছ, খেজুর গাছ সব মাটির তলায় ডেবে যাবে। দজ্জালের ঈমান পরীক্ষায় বাঁচলেও কেয়ামতে মরতেই হবে। আমরা নানির বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে আগে, ফজলিখালা নতুন খবর নিয়ে আসেন সোনার গয়না পরা হারাম। শুনে বাড়ির মেয়েমানুষেরা যার যার সোনার গয়না খুলে রাখল। হাশেম মামার বিয়ে হয়েছে সবে। নতুন বউ গা ভরা গয়না পরে বসে থাকেন। পাড়ার বউঝিরা এসে ঘোমটা সরিয়ে বউএর মুখ দেখে যায়। — পারুল, সোনার গয়না খুলে রাখ। শেষ জমানা চলে আসছে। এ সময় গয়না গাটি পরলে আল্লাহ গুনাহ দেবেন। বলে ফজলিখালা নিজেই হাশেম মামার বউএর গা থেকে গয়না খুলে যেন মরা ইঁদুর হাতে নিচ্ছেন এমন করে গয়নার লেজ ধরে ফেলে রাখলেন দূরে। হাশেম মামা বলেছিলেন–ছোটবু, নতুন বউএর গা থেইকা গয়না গাটি খুলা নাকি অমঙ্গল জানতাম! ফজলিখালা চিকন গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন–মঙ্গল অমঙ্গলের তুই কি বুঝস হাশেম! পরশু রাতে আব্বাজি নবীজিকে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নের মধ্যেই নবীজি বলেছেন সোনার গয়না শরীরের যে অংশে পরা থাকবে, সে সব অংশ দোযখের আগুনের পুড়বে। নানি ফজলিখালাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–তর গয়নাগুলা কই রাখছস? ফজলিখালা তসবিহ জপতে জপতে বললেন–গয়না দিয়ে কি হবে মা, ওগুলো হুমায়রার আব্বা বিক্রি করতে নিয়ে গেছে। নানির কপালে ভাঁজ পড়েছিল দুটো। বছর গড়ালো, পীর বাড়িতে সোনার গয়না পরা হালাল হয়ে গেছে। খোলা বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে মা’র দুঃখি মুখের দিকে তাকিয়ে বলি– সোনার গয়না পরা ত হারাম! পীর বাড়ির সবাই না সোনার গয়না পরা ছাইড়া দিছিল! মা আমার উত্তর দেন না। এমন চোখ করে তাকান যেন সত্যি সত্যি শয়তান ভর করেছে আমার ওপর। আমি নই, যা কিছুই বলছি আমি, বলছে শয়তান। এর কিছুদিন পর, মাতৃ জুয়েলার্স থেকে বাকিতে একজোড়া অনন্ত বালা নিয়ে আসেন মা। জুয়েলার্সের মালিক বাবার বন্ধু মানুষ। মা বলে আসেন বাবাই গয়নার দাম কিস্তিতে কিস্তিতে দিয়ে দেবেন। ক. মসজিদ থেকে শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে এলে পকেটে বাতাসা থাকত নানার। খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হলুদ চাকতি। জুম্মার পর মসজিদে বাতাসার দেওয়ার নিয়ম। পুকুর ঘাটের কাছে নানাকে দেখে বাড়ির ছোটরা, আমি ফেলু মামা, ছটকু ইয়াসমিন নানার কাছে দৌড়ে গিয়ে বাতাসা নিয়ে আসতাম। নানা বাড়ির ছোটদের প্রতি সদয় হলেও বড়দের প্রতি নন। আমাদের বাতাসা বিলিয়ে বাড়ি গিয়ে তিনি বড়দের হাড় মাংস জ্বালাতেন। জ্বালাতেন শব্দটিই নানি ব্যবহার করেন, যখন এই লাডি লইয়া আয়, কেডা কেডা মসজিদে যাস নাই ক। পিডাইয়া শ্যাষ কইরা ফালাইয়াম–বলে বাড়ি মাথায় তুলতেন নানা। ছেলেদের অন্তত জুম্মা পড়তে মসজিদে যেতে হবে, মেয়েদের যেহেতু মসজিদে যাওয়ার বিধান নেই, নামাজ পড়বে ঘরে। মেয়েরা ঘরের বাইরে যাক, ক্ষতি নেই, যেতে হবে বোরখা পরে। নানা জুম্মার দিন খানিকটা আলস্য করেন, এ তাঁর চিরকালের স্বভাব। মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরের ভাতঘুমটি দেওয়ার আগে তাঁর হিশেব করা চাই কে কে ফাঁকি দিল, কোন ছেলে মসজিদে যায়নি এবং কোন মেয়ে বাড়িতে নেই, বাইরে সে মেয়ে বোরখা পরে গিয়েছে কি না। এত প্রশ্নে নানি অতিষ্ঠ হতেন। ঘুমিয়ে ওঠার পর নানা আবার ভাল মানুষ। লুঙ্গি কষে বেঁধে ডান হাত লুঙ্গির তলে রেখে বাঁ হাত নেড়ে নেড়ে যেন বাতাস সরাতে সরাতে, হেঁটে চলে যান নতুন বাজার। কে বাড়ি নেই, কে আছে, খোঁজ আর করেন না। বিকেলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলে সাত লোকের সঙ্গে কথা হবে, ওই আকর্ষণ নানাকে আর বাড়িতে রাখে না। এক নানি ছাড়া বাড়ির কোনও বয়ষ্ক মেয়ে স্বেচ্ছায় বোরখা পরেন না। রুনু খালা ঝুনু খালা বোরখা হাত ব্যাগে ভরে বাইরে বেরোন, পুকুরঘাট থেকে ছটকু বা কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন নানা বাড়ি আছেন কি না, নেই জানলে তো ঢুকে গেলেন বাড়ি, আর থাকলে পড়শি কারও বাড়িতে অপেক্ষা করেন, নানা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে খবর পাঠানো হয়, খালারা বাড়ি ঢোকেন; অপেক্ষা না সইলে ব্যাগের বোরখা গায়ে চাপিয়ে আসেন। নানা এক বড়মামাকেই মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন, বাকি ছেলেমেয়েদের ইস্কুল কলেজে। নানার কড়া আদেশ ছিল, অবশ্য কেবল ছেলেদের বেলায়, বিদ্যা অমূল্য ধন, পড়ালেখায় যেন গাফিলতি না হয় কারও। মেয়েদের বেলায় মাইয়া মানষের অত নেকাপড়া করন লাগব না। রুনু খালা বিএ অবদি পড়েছেন, নানা ক’দিন পরপরই তাঁর বিয়ের ঘর আনেন, রুনু খালা মুখে ধুলো কালি মেখে চুল উস্কোখুস্কো বানিয়ে ছেলে পক্ষের সামনে আসেন যেন কারও তাঁকে পছন্দ না হয়। সুলেখার মা প্রায়ই নানির খাটে বসে শাদা পাতা মুখে পুরে বলেন–রুনুরে কি বাড়ির খুঁডি বানাইবাইন? বিয়া দেইন না কেন এহনও? ঈদুন আর ফজলির ত কি সুন্দর বিয়া হইয়া গেল। নানি পানের খিলি বানাতে বানাতে বলেন–লেহাপড়া আরও
false
tarashonkor
পরশু রাত্রে পাতু মুচির ছেলেটা মরিয়াছে। পাতুর স্ত্রীর অনেক বয়স পর্যন্ত সন্তানসন্ততি হয় নাই—দুই বৎসর আগে ওই সন্তানটিকে সে কোলে পাইয়াছিল। পাড়া-প্রতিবাসীরা বলে–ওটি এগ্রামের বাসিন্দা হরেন ঘোষালের সন্তান। শুধু পাড়া-প্রতিবাসীরাই নয়—পাতুর মা, দুর্গা, ইহারাও বলে। ঘোষালের সঙ্গে স্ত্রীর গোপন প্রণয়ের কথা পাতুও জানে। আগে যখন পাতুর চাকরান জমি ছিল—ঢাকের বাজনা বাজাইয়া সে দু-পয়সা রোজগার করি, তখন পাতু ছিল বেশ মাতব্বর মানুষ, তখন ইজ্জত-সম্ভ্রমের দিকে কঠিন দৃষ্টি ছিল। দুর্গার মন্দ স্বভাবের জন্য তখন সে গভীর লজ্জা বোধ করিত—দুর্গাকে সে কত তিরস্কার করিয়াছে; কখনও কখনও প্রহারও করিয়াছে। তখন তাহার স্ত্রীও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাতুর প্রতি ছিল তাহার গভীর ভয়, আসক্তিও ছিল; দিবারাত্রি হৃষ্টপুষ্টাঙ্গী বিড়ালীর মত বউটা ঘরের কাজ করিয়া ঘুরঘুর করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত। সে সময় তাহার শাশুড়ি-পাতুর মা পুত্রবধূর যৌবন ভাঙাইয়া গোপনে রোজগার করিবার প্রত্যাশায় বউটিকে অনেক প্রলোভন দেখাইয়াছিল, কিন্তু তখন বউটি কিছুতেই রাজি হয় নাই। তাহার পর পাতুর জীবনে শ্রীহরি ঘোষের আক্ৰোশে আসিল একটা বিপর্যয়। জমি গেল, পাতু বাজনার ব্যবসা ত্যাগ করিল, শেষে দিনমজুরি অবলম্বন করিল। এই অবস্থার মধ্যে কেমন করিয়া যে পাতু বদলাইয়া গেল—সে পাতুও জানে না। এখন ঘরে চাল না থাকিলে দুর্গার কাছে চাল লইয়া, পয়সা লইয়া—দুর্গাকে সে শাসন করা ছাড়িল। তারপর একদিন তাহার মা বলিল—দুগ্‌গা কঙ্কণায় যায় এতে (রাতে), তু যদি সঁতে যাস পাতু—তবে বক্‌শিশটা বাবুদের কাছে তুই-ই তো পাস্। আর মেয়েটা যায়, কোনোদিন আত (রাত) বিরেতে—যদি বেপদই ঘটে তবে কি হবে? মায়ের প্যাটের বুন তো বটে। দুর্গাকে সঙ্গে করিয়া বাবুদের অভিনয়ের আসরে পৌঁছাইয়া দিতে গিয়া-পাতুর ওটাও বেশ অভ্যাস হইয়া গেল। এই অবসরে একদিন প্ৰকাশ পাইল, তাহার স্ত্রীও ওই ব্যবসায়ে রত হইয়াছে। ঘোষাল ঠাকুরকে সন্ধ্যার পর পাড়ার প্রান্তে নির্জন স্থানে ঘুরিতে দেখা যায় এবং পাড়া হইতে পাতুর বউকেও সেইদিকে যাইতে দেখা যায়। একদিন পিতুর মা ব্যাপারটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া হঠাৎ একটা কলরব তুলিয়া ফেলিল-দুর্গা বলিল—চুপ কর মা, চুপ কর, ঘরের বউ, ছিঃ! পাতু মাকেও চুপ করিতে বলিল না বউটাকেও তিরস্কার করিল না—নিজেই নীরবে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। বউটা ভয়ে সেদিন বাপের বাড়ি পলাইয়া গিয়াছিল; কয়েকদিন পরে পাতুই নিজে গিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিয়াছিল। কিছুদিন পর পাতুর স্ত্রী এই সন্তানটি প্রসব করিল। পাড়ার লোকে বলাবলি করিল ছেলেটা ঘোষাল ঠাকুরের মত হইছে বটে। রংটা এতটুকু কালো দেখাইছে।… পাতুও ছেলেটার দুষ্টবুদ্ধি দেখিয়া কতদিন বলিয়াছে—বামুনে বুদ্ধির ভেজাল আছে কিনা, বেটার ফিচুলেমি দেখ ক্যানে!—বলিয়া সে সন্দেহে হাসিত। ছেলেটাকে ভালবাসিত সে। হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে ছেলেটা শেষ হইয়া গেল। দুর্গাও ছেলেটাকে বড় স্নেহ করিত; সে ডাক্তার দেখাইয়াছিল। জগনকে যতবার ডাকিয়াছে—নগদ টাকা দিয়াছে, নিয়মিত ঔষধ খাওয়াইয়াছে, তবু ছেলেটা বাঁচিল না। আশ্চর্যের কথা—পাতুর স্ত্রী ততটা কাতর হইল না, যতটা কাতর হইল পাতু। পাতু তাহার মোটা গলায় হাউ-বাউ করিয়া কাঁদিয়া পাড়াটাকে পর্যন্ত অধীর করিয়া তুলিল। বিপদের রাত্রে সতীশ আসিয়া তাহাকে ধরিয়া বসাইল—সান্ত্বনা দিল। বাউরি ও মুচিপাড়ার মধ্যে সতীশ মোড়ল মানুষ, ঘরে তাহার হাল আছে—দুই মুঠা খাইবার সংস্থান আছে। সেই মনসার ভাসানের দলের মাতব্বর, ঘেঁটুর দলের মূল গায়েন রকমারি গান বাধে; এজন্য হরিজনপল্লীর লোক তাহাকে মান্যও করে। সেই ছেলেটার সঙ্কারের ব্যবস্থা করিল। পরদিন সকালে সে পাতুকে ডাকিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেল, তারপর দেবু পণ্ডিতের আসরে লইয়া গেল। দেবুর আসর এখন সর্বদাই জমজমাট হইয়া আছে। নিজ গ্রামের এবং আশপাশ গ্রামের বার-তের হইতে আঠার-উনিশ বছরের ছেলের দল সর্বদা আসিতেছে যাইতেছে, কলরব করিতেছে। তিনকড়ির ছেলে গৌর তাহাদের সর্দার। পাতুও কয়েকদিন এখানকার কাজে খাঁটিতেছে। ছেলেদের সঙ্গে সে কস্তা ঘাড়ে করিয়া ফিরিত। গ্রাম-গ্রামান্তরে মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করিয়া বহিয়া আনিত। এই বিপদের দিনে সাহায্য-সমিতি হইতে পাতুর পরিবারের জন্য চালের বরাদ্দও হইয়া গেল। কথাটা তুলিল সতীশ। দেবু কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া ছিল। সতীশ কথাটা তুলিতেই সে সচেতন হইয়া উঠিল, বলিলহা হ্যাঁ, নিশ্চয়, পাতুর ব্যবস্থা করতে হবে বৈকি। নিশ্চয়। সাহায্য-সমিতি হইতে পাতুর খোরাকের চালের ব্যবস্থা দেবু করিয়া দিয়াছে। চালটা লইয়া আসে দুর্গা। সকালে উঠিয়াই জামাই-পণ্ডিতের বাড়ি যায়। বাহির হইতে ঘরকার যতখানি মার্জনা এবং কাজকর্ম করা সম্ভব দেবুর বাড়িতে সে সেইগুলি করে; সাহায্য-সমিতির চাল মাপে। সকালে গিয়া দুপুরে খাওয়ার সময় ফেরে, খাওয়াদাওয়া সারিয়া আবার যায়—ফেরে সন্ধ্যার পর। সে এখন সদাই ব্যস্ত। বেশভূষার পারিপাট্যের দিকে দৃষ্টি দিবার অবকাশ পর্যন্ত নাই। সকালে উঠিয়াই সে দেবুর বাড়ি গিয়াছে। পাতুর মা দাওয়ায় বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া নাতির জন্য কাঁদিতেছে,পাতুর মায়ের অভিযোগ সকলের বিরুদ্ধেই। সে বিনাই বিনাইয়া কাঁদিতেছে, দুর্গার পাপে তাহার এই সর্বনাশ ঘটিয়া গেল। ওই পাপিনী বউটা—ব্রাহ্মণের দেহে পাপ সঞ্চার করিয়া সে মহাপাপ সঞ্চয় করিয়াছে, সেই পাপে এত বড় আঘাত তাহার বুকে বাজিল। গোয়ার-গোবিন্দ পাষণ্ড পাতু দেবস্থলে বাজনা বাজানো ছাড়িয়ছে, সেই দেব-রোষে তাহার নাতিটি মরিয়া গেল। সমস্ত গ্রামখানা পাপে ভরিয়া উঠিয়াছে—তাই ময়ূরাক্ষীর বাঁধ ভাঙিয়া আসিল কালবন্যা-তাই দেশ জুড়িয়া মড়কের মত আসিয়াছে এই সর্বনাশা জ্বর গ্রামের পাপে সেই জ্বরে তাহার বংশধর গেল—তাহার স্বামী-কুল, পুত্র-কুল আজ নির্বংশ হইতে বসিল। পাড়ায় এখানে-ওখানে আরও কয়েকটা ঘরে কান্না উঠিতেছে। পাতু বাড়ির পিছনে একা বসিয়া কাঁদিতেছিল। আজ সতীশ আসে নাই, অন্য কেহও ডাকে নাই, সে-ও কোথাও যায় নাই। পাতুর মা হঠাৎ কান্না বন্ধ করিয়া উঠিয়া আসিল। পাতুর মুখের সামনে বসিয়া হাত নাড়িয়া বলিল—আর সব্বনাশ করিস না বাবা,
false
robindronath
আমি আমার অতৃপ্তি বুকে নিয়েই সামনে চলে যাব। মেজোরানীদিদি এসে বললেন, ঠাকুরপো, তোমার বইগুলো সব বাক্স ভরে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে যে চলল মানে কী বলো তো। আমি বললুম, তার মানে ঐ বইগুলোর উপর থেকে এখনো মায়া কাটাতে পারি নি। মায়া কিছু কিছু থাকলেই যে বাঁচি। কিন্তু এখানে আর ফিরবে না নাকি? আনাগোনা চলবে, কিন্তু পড়ে থাকা আর চলবে না। সত্যি নাকি? তা হলে একবার এসো, একবার দেখো’সে কত জিনিসের উপরে আমার মায়া।– এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি ছোটোবড়ো নানা রকমের বাক্স আর পুঁটলি। একটা বাক্স খুলে দেখালেন, এই দেখো ঠাকুরপো, আমার পান-সাজার সরঞ্জাম। কেয়াখয়ের গুড়িয়ে বোতলের মধ্যে পুরেছি; এই-সব দেখছ এক-এক-টিন মসলা। এই দেখো তাস, দশ-পঁচিশও ভুলি নি, তোমাদের না পাই আমি খেলবার লোক জুটিয়ে নেবই। এই চিরুনি তোমারই স্বদেশী চিরুনি, আর এই– কিন্তু ব্যাপারটা কী মেজোরানী? এ-সব বাক্সয় তুলেছ কেন? আমি যে তোমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছি। সে কী কথা? ভয় নেই ভাই, ভয় নেই, তোমার সঙ্গেও ভাব করতে যাব না, ছোটোরানীর সঙ্গেও ঝগড়া করব না। মরতেই হবে, তাই সময় থাকতে গঙ্গাতীরের দেশে আশ্রয় নেওয়া ভালো। ম’লে তোমাদের সেই নেড়া-বটতলায় পোড়াবে সে কথা মনে হলে আমার মরতে ঘেন্না ধরে, সেইজন্যেই তো এতদিন ধরে তোমাদের জ্বালাচ্ছি। এতক্ষণ পরে আমার এই বাড়ি যেন কথা কয়ে উঠল। আমার বয়স যখন ছয় তখন ন বছর বয়সে মেজোরানী আমাদের এই বাড়িতে এসেছেন। এই বাড়ির ছাদে দুপুরবেলায় উঁচু পাঁচিলের কোণের ছায়ায় বসে ওঁর সঙ্গে খেলা করেছি। বাগানের আমড়াগাছে চড়ে উপর থেকে কাঁচা আমড়া ফেলেছি, তিনি নীচে বসে সেগুলি কুচি-কুচি করে তার সঙ্গে নুন লঙ্কা ধনেশাক মিশিয়ে অপথ্য তৈরি করেছেন। পুতুলের বিবাহের ভোজ উপলক্ষে যে-সব উপকরণ ভাঁড়ার-ঘর থেকে গোপনে সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল তার ভার ছিল আমারই উপরে, কেননা ঠাকুরমার বিচারে আমার কোনো অপরাধের দণ্ড ছিল না। তার পরে যে-সব শৌখিন জিনিসের জন্যে দাদার ‘পরে তাঁর আবদার ছিল সে আবদারের বাহক ছিলুম আমি; আমি দাদাকে বিরক্ত করে করে যেমন করে হোক কাজ উদ্ধার করে আনতুম। তার পরে মনে পড়ে, তখনকার দিনে জ্বর হলে কবিরাজের কঠোর শাসনে তিন দিন কেবল গরম জল আর এলাচদানা আমার পথ্য ছিল; মেজোরানী আমার দুঃখ সইতে পারতেন না, কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে খাবার এনে দিয়েছেন, এক-একদিন ধরা পড়ে তাঁকে ভর্ৎসনাও সইতে হয়েছে। তার পরে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখদুঃখের রঙ নিবিড় হয়ে উঠেছে; কত ঝগড়াও হয়েছে; বিষয়ব্যাপার নিয়ে মাঝে মাঝে অনেক ঈর্ষা সন্দেহ এবং বিরোধও এসে পড়েছে; আবার তার মাঝখানে বিমল এসে পড়ে কখনো কখনো এমন হয়েছে যে মনে হয়েছে, বিচ্ছেদ বুঝি আর জুড়বে না। কিন্তু তার পরে প্রমাণ হয়েছে, অন্তরের মিল সেই বাইরের ক্ষতের চেয়ে অনেক প্রবল। এমনি করে শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি সত্য সম্বন্ধ দিনে দিনে অবিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে উঠেছে; সেই সম্বন্ধের শাখাপ্রশাখা এই বৃহৎ বাড়ির সমস্ত ঘরে আঙিনায় বারান্দায় ছাদে বাগানে তার ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে সমস্তকে অধিকার করে দাঁড়িয়েছে। যখন দেখলুম মেজোরানী তাঁর সমস্ত ছোটোখাটো জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স বোঝাই করে আমাদের বাড়ির থেকে যাবার মুখ করে দাঁড়িয়েছেন, তখন এই চিরসম্বন্ধটির সমস্ত শিকড়গুলি পর্যন্ত আমার হৃদয়ের মদ্যে যেন শিউরে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারলুম কেন মেজোরানী, যিনি ন বছর বয়স থেকে আর এ পর্যন্ত কখনো এক দিনের জন্যেও এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাটান নি, তিনি তার সমস্ত অভ্যাসের বাঁধন কেটে ফেলে অপরিচিতের মধ্যে ভেসে চললেন। অথচ সেই আসল কারণটির কথা মুখ ফুটে বলতেই চান না, অন্য কত রকমের তুচ্ছ ছুতো তোলেন। এই ভাগ্যকর্তৃক বঞ্চিতা পতিপুত্রহীনা নারী সংসারের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র সম্বন্ধকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চিত অমৃত দিয়ে পালন করেছেন, তার বেদনা যে কত গভীর সে আজ তাঁর এই ঘরময় ছড়াছড়ি বাক্স-পুঁটুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে যত স্পষ্ট করে বুঝলুম এমন আর কোনোদিন বুঝি নে। আমি বুঝেছি টাককড়ি ঘরদুয়ারের ভাগ নিয়ে, ছোটোখাটো সামান্য সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে, বিমলের সঙ্গে আমার সঙ্গে তাঁর যে বারবার ঝগড়া হয়ে গেছে তার কারণ বৈষয়িকতা নয়; তার কারণ তাঁর জীবনের এই একটিমাত্র সম্বন্ধে তাঁর দাবি তিনি প্রবল করতে পারেন নি, বিমল কোথা থেকে হঠাৎ মাঝখানে এসে একে ম্লান করে দিয়েছে, এইখানে তিনি নড়তে-চড়তে ঘা পেয়েছেন, অথচ তাঁর নালিশ করবার জোর ছিল না। বিমলও একরকম করে বুঝেছিল আমার উপর মেজোরানীর দাবি কেবলমাত্র সামাজিকতার দাবি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর; সেইজন্যে আমাদের এই আশৈশবের সম্পর্কটির ‘পরে তাঁর এতটা ঈর্ষা। আজ বুকের দরজাটার কাছে আমার হৃদয় ধক্‌ ধক্‌ করে ঘা দিতে লাগল। একটা তোরঙ্গের উপর বসে পড়লুম; বললুম, মেজোরানীদিদি, আমরা দুজনেই এই বাড়িতে যেদিন নতুন দেখা দিয়েছি সেইদিনের মধ্যে আর-একবার ফিরে যেতে বড়ো ইচ্ছে করে। মেজোরানী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না ভাই মেয়েজন্ম নিয়ে আর নয়! যা সয়েছি তা একটা জন্মের উপর দিয়েই যাক, ফের আর কি সয়? আমি বলে উঠলুম, দুঃখের ভিতর দিয়ে যে মুক্তি আসে সেই মুক্তি দুঃখের চেয়ে বড়ো। তিনি বললেন, তা হতে পারে, ঠাকুরপো, তোমরা পুরুষমানুষ, মুক্তি তোমাদের জন্যে। আমরা মেয়েরা বাধতে চাই, বাঁধা পড়তে চাই; আমাদের কাছ থেকে তোমরা সহজে ছাড়া পাবে না গো। ডানা যদি মেলতে
false
humayun_ahmed
অন্ধকার। গেট তালাবন্ধ। ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত হচ্ছেন। শহরের লোকজনের অবিশ্বাস দেখে বিরক্ত। গেটে তালা দেওয়ার দরকার কী? অনেকক্ষণ গেট ধরে ধাক্কাধাব্ধি এবং উচু গল্পায় শাহেদ শাহেদ বলে চিৎকারের পর ঘরের ভেতরে বাতি জুলল। অপরিচিত একজন লোক দরজা খুলে বের হয়ে এসে বললেন, কে? লোকটা লম্বা ও ফর্সা। গলার স্বর মেয়েলি। গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে তিনি ভয় পেয়েছেন। আপনি কে? আমি ইরতাজউদ্দিন। নীলগঞ্জ থেকে আসছি। এসিসটেন্ট হেডমাস্টার, আরবি ও ধর্ম শিক্ষক। নীলগঞ্জ হাইস্কুল। কাকে চান? শাহেদের কাছে এসেছি। আমি শাহেদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছি। গোস্তাকি মাফ হয়। আসসালামু আলায়কুম। লোকটি এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখন দরজার আড়ালে চলে গেলেন। তবে দরজা খোলা, লোকটাকে এখনো দেখা যাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক তিনি ভয় পাচ্ছেন। তাকে দেখেও লোকজন ভয় পেতে পারেএই চিন্তাটা ইরতাজউদ্দিনকে পীড়িত করছে। কী করে তিনি লোকটার ভয় ভাঙাবেন তাও বুঝতে পারছেন না। লোকটা সালামের জবাব দেয় নাই। এটা তো ঠিক না। সালাম হচ্ছে শান্তির আদান-প্ৰদান। শাহেদ নামে কেউ এই বাড়িতে থাকেন না। থাকেন না মানে? উনি চলে গেছেন। আমি নতুন ভাড়াটে। কোথায় গেছে জানেন? না। কেউ কি জানে? আমি জানি না কেউ জানে কি-না। ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করার উপক্রম করেছেন। ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, ভাইসাহেব, আপনি একটু আসবেন। এদিকে। গোটটা খুলবেন? কেন? আমার সঙ্গে একটা রাজহাঁস ছিল, ঐটা আপনাকে দিয়ে যেতাম। রাজহাঁস? শাহেদের বাচ্চার জন্যে এনেছিলাম। এত রাতে এই হাঁস নিয়ে কোথায় ঘুরব? হাঁসটা আপনি গ্রহণ করলে আমার উপকার হয়। অন্যের হাঁস। আমি খামাখা রাখব কেন? আপনার ঘরেও নিশ্চয়ই বাচ্চা-কাচ্চা আছে, তারা খুশি হবে। ভদ্ৰলোক দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলেন। দরজার ফাঁকে তার স্ত্রীর মুখ দেখা যাচ্ছে। তিনিও কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন হাঁসটার দিকে। ইরতাজউদ্দিন ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, এই রাজহাঁসটা আর জিনিসগুলি রাখলে আমি খুশি হবো। অস্বস্তি বোধ করার কিছুই নেই! হাঁসটা নিয়ে আমি বিপদে পড়েছি। দরজার ফাঁকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের অপরূপ রূপবতী একটি কিশোরীর মুখ দেখা গেল। মেয়েটির নাম রত্নেশ্বরী, সে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে; রত্নেশ্বরী বড়ই অবাক হয়েছে। তার জীবনে এমন বিস্ময়কর ঘটনা আর ঘটে নি। রাতদুপুরে সাধু সাধু চেহারার এক লোক এসে তাদের রাজহাঁস দিতে চাচ্ছে। আগামীকাল ক্লাসে গল্পটা কীভাবে বলবে, তা ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। গল্পটা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। সন্ন্যাসী ধরনের এই লোকটার একটা ছবি তুলে রাখতে পারলে ভালো হতো! রত্নেশ্বরী ফিসফিস করে তার মাকে বলল, মা, এই হাঁসটা কি আমরা রাখব? রত্নেশ্বরীর মা নিচু গলায় বললেন, জানি না। দেখি তোর বাবা কী বলেন। ভদ্রলোক কে মা? জানি না। ইরতাজউদ্দিন সাহেব রত্নেশ্বরীর বাবার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ছোট মেয়েটা কি আপনার কন্যা? বড়ই মিষ্টি চেহারা। কী নাম তোমার মা? রত্নেশ্বরী জবাব দেয়ার আগেই তার বাবা বললেন, আপনি এখন যান। আমরা হাঁস-ফাস কিছু রাখব না। ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা না রাখলেন, গোটটা খুলুন। আমার বাথরুমে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন। রত্নেশ্বরীর বাবা বললেন, গেট খোলা যাবে না। আমার কাছে গেটের চাবি নাই। কথা সত্যি না। চাবি ঘরেই আছে–ওয়ারড্রোবের উপর রাখা আছে। রত্নেশ্বরীর মা ফিসফিস করে বললেন, খুলে দাও না। বেচারা বুড়ো মানুষ। রত্নেশ্বরীর বাবা চাপা গলায় বললেন, যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। যাও, ভেতরে যাও। স্ত্রী-কন্যাকে ভেতরে ঢুকিয়ে তিনি শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বারান্দার বাতির সুইচ ভেররে। ভেতর থেকে সুইচ নিভিয়ে দিয়ে বারান্দা অন্ধকার করে দেয়া হলো। ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যথা ও বিস্ময়ে তিনি খানিকটা কাতর। এরা এমন করল কেন? মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য মমতা থাকবে না! গেটের উপর দিয়ে তিনি রাজহাঁসটা ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন। হাঁসটা থাকুক। মুড়ির টিন পুটলা-পুটলি সঙ্গে নিয়েই বা কী হবে? রিকশাওয়ালাটা থাকলে তাকে দিয়ে দেয়া যেত। থাকুক পুটলা-পুটলি গেটের সামনে। অভাবী লোকজন এসে নিয়ে যাবে। বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। তবু ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বন্ধ দরজা আবার খুলে যাবে। পরীর মতো দেখতে কিশোরী মেয়েটা তাকে বলবে, আপনি ভেতরে আসুন। মা আপনাকে ভেতরে আসতে বলেছে। রাজহাঁসটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি হাঁসটাকে বললেন, যাই রে। রাজহাঁস কুৎসিত একধরনের শব্দ করল। সম্ভবত তাকে যাবার অনুমতি দিল। ইরতাজউদিনের মনে হলো, যে পাখি যত সুন্দর তার কণ্ঠস্বর তত কুৎসিত। যেমন ময়ূর। সে দেখতে সুন্দর কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কর্কশ। একমাত্র ব্যতিক্রম কাক। সে নিজে অসুন্দর, তার কণ্ঠস্বরও অসুন্দর। টিপটপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অসহ্য গরমের পর বৃষ্টিটা ভালো লাগছে। ইরতাজউদ্দিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন আঠালো ভাব। শরীরের যে জায়গায় পড়ছে। সেখানটাই আঠা আঠা হয়ে যাচ্ছে। তিনি গলি থেকে বের হলেন, বৃষ্টিও থেমে গেল। বড় রাস্তায় আবারো একটা মশাল মিছিল। এই মিছিলটিা আগেরটার চেয়ে ছোট। না-কি আগের মিছিলটাই ঘুরে এসেছে? ইরতাজউদ্দিন মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। যেন তিনি মিছিলের একজন। এই মিছিল কোন দিকে যাচ্ছে তিনি জানেন না। তিনি নিজে কোথায় যাবেন তাও জানেন না। পল্লী অঞ্চল হলে যে-কোনো একটা বাড়িতে গিয়ে বিপদের কথা বললেই আশ্রয় পাওয়া যেত। তারা অজ্বর পানি দিত। ভাত-ডালের ব্যবস্থা করত।
false
shomresh
তাড়িয়ে দিয়েছে কেন? ছোটমা দুচোখ তুলে ওকে দেখল, তাড়িয়ে দিয়েছে কে বলল? আমার সঙ্গে ঝাড়িকাকুর দেখা হয়েছিল। অনির অমন জেদ ধরে যাচ্ছিল। ছোটমা কি ওকে খুব বাচ্চা ভেবেছে। এভাবে কথা লুকিয়ে যাচ্ছে কেন? এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না, আমি বলতে পারব না। তুমি আমাকে বন্ধু বলেছিলে না। ছোটমা কোনো উত্তর দিল না। উঁচু করে রাখা দুটো হাঁটুর ওপর গাল রেখে চুপ করে রইল। অনি বলল, বাবা আগে এমন ছিল না, মা থাকতে বাবা একদম অন্যরকম ছিল। খুব গাঢ় গলায় ছোটমা বলল, কী জানি! বোধহয় আমি খারাপ, তাই। উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল অনি, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। হঠাৎ ঝট করে উঠে বসল ছোটমা, বেশ, আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমার খুশি তাই বলছি। কেন? মিত্যে কথা বললে-। অনি কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কেউ অন্যায় করছে এবং এরকম জেদের সঙ্গে স্বীকার করছে-কখনো দেখেনি সে। খুব কাটা-কাটা গলায় ছোটমা বলল, উনি যা করছেন করুন তবু আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমার পেটে বিদ্যে নেই যে রোজগার করব। ভাইদের কাছে গলগৃহ হয়ে থাকার চেয়ে এখানে। অপমান সহ্য করা অনেক সুখের। নিজের জন্যে মিথ্যে বলতে হবে, আমাকে আর প্রশ্ন করবে না তুমি। অনি চুপ করে গেল। ছোটমার কথাগুলো বুঝে উঠতে সময় লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল এতক্ষণ ও যেভাবে কথা বলেছে সেটা ঠিক হয়নি। জলপাইগুড়িতে প্রথম পরিচয়ের দিন যাকে বন্ধু এবং নিজের চৌহদির মধ্যে বলে মনে হয়েছিল, এখন এই রাত্রে তাকে ভীষণ অচেনা বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু ছোটমা তাকে একটা মুখ সত্যের মুখোমখি দাড় করিয়ে দিয়েছে। বাবার এইসব কাজ, কাজ না বলে অত্যাচার বলা ভালো, ছোটমাকে মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে তার ভাইদের কাছে গিয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে। ছোটমা যদি লেখাপড়া শিখত তা হরে চাকরি করতে পারত সেটাও সম্ভব নয়। আচ্ছা, আজ যদি বাবা তাকে। সঙ্গে সঙ্গে অনি যেন চোখের সামনে সরিৎশেখরকে দেখতে পেল, পেয়ে বুকে বল এল। দাদু জবিত থাকতে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু দাদুকে আজকাল কেমন অসহায় লাগে মাঝে-মাঝে, পিসিমার সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে প্রায়ই চা কথা-কাটাকাটি হয়। হোক, তবু তার দাদু আছে, কিন্তু ছোটমার কেউ নেই। ও গম্ভীর গলায় বলল, তুমি চিন্তগা কোর না আমি পাশ করে চাকরি করলে তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকবে। বাবা কিছু করতে পারবে না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছোটমা বলল, ছি! বাবাকে কখনো অসম্মানের চোখে দেখতে নেই, ভুল বুঝতে পারলে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। অনি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, বাবার বিরুদ্ধে কিছু বললেই ছোটমা একদম সমর্থন করে না কেন? ছোটমা উঠে মিটসেফ থেকে একটা বিরাট জামবাটি বের করে ওর সামনে এনে রাখল, তোমার জন্যে করেছি। বাড়িতে তো আর দুধ হয় না, অনেক কষ্টে এটুকু যোগাড় করতে পেরেছি। অনি দেখল জামবাটির বুক-টইটম্বুর পায়েসের ওপর কিমিসগুলো ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে আছে, একটা তেজপাতা তিনভাগ শরীর ড়ুবিয়ে কালো মুখ বের করে আছে। চোখাচোখি হতে ছোটমা বলল, ভালো না হলেও যেতে হবে অনি, দিদির মতো হয়নি আমি জানি। অনি হাসল, ছোটমা সেই প্রথম দিনের কথাটা এখনও মনে রেখেছে। এ-বেলা একদম নিরামিষ, তোমার খেতে অসুবিধে হবে খুব। ছোটমার কথা শুনে হাসল অনি, এতখানি পায়েস পেলে আমার কোনো খাবারের আর দরকার নেই। একটা চা-চামচ দিয়ে ধারের দিকে একটু পায়েস নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, ফাইন! তারপর চোখ বুজে সেটাকে ভালোভাবে গলাধঃকরণ করে বলল, পিসিমার চেয়ে একটু কম ভালো হয়েছে, তবে মায়ের চেয়ে অনেক ভালা। পিসিমা ফার্স্ট, তুমি সেকেন্ড, মা থার্ড। অনির কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল ছোটমা। সারাদিন এবং এই একটু আগেও যে-অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, ছেলেটা খেতে আরম্ভ করার পর থেকে সেটা টুপ করে চলে গেল। যে যা ভালাবাসা তাকে সেটা তৈরি করে খাওয়াতে যে এত ভালো লাগে এর আগে এমন করে জানা ছিল না। কী তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে ছেলেটা। আর এই সময় প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ উঠল, কেউ যেন মনের সুখে দরজায় লাথি মারছে। খেতে-খেতে চমকে উঠে অনি বলল, কিসের শব্দ? ছোটমার খুশির মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল যেন, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে কোনোরকমে বলে গেল, তুমি খাও, আমি আসছি। শব্দটা থামছে না, ঘড়ির আওয়াজের মতো বেজে যাচ্ছে। তারপর দরজা খোলার শব্দ হতে একটা হুঙ্কার এদিকে ভেসে এল। খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অনি সোজা হয়ে উঠ দাঁড়াল, তারপর একছুটে বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ছোটমার ঘরে একটা ছোট্ট ডিমবাতি জ্বলছে, এত অল্প আলো যে চলতে অসুবিধে হয়। মায়ের ছবির ঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়াল। ও। বাবা কথা বলছেন, জড়িয়ে জড়িয়ে, কোনো কথার শেষটা ঠিক থাকছে না, কোথায় আড়া। মারছিলে, আমি দুঘন্টা ধরে নক করছি খেয়াল নেই, এ্যা? ছোটমা বলল, অনিকে খেতে দিচ্ছিলাম। অনি? হু ইজ অনিঃ মাই সন? সন বড় না ফাদার বড়, অ্যাঁ? আমার আসবার সময় কেন দরজায় বসে থাকনি, অ্যাঁ? ছোটমা খুব আস্তে বলল, কাল ছেলেটা চলে যাবে, আজকের রাতটায় এসব না করলেই নয়? জ্ঞান দিচ্ছ? সেদিনকার ছুঁড়ি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে, অ্যাঁ! বিনে পয়সায় মা হয়েছে, মাগিরি দেখাছ ভালো, ভালো। মাধু গিয়ে আচ্ছা প্রতিশোধ নিয়েছে। নইলে একটা বাঁজা মেয়েছেলে কপালে জুটল! গলাটা টলতে টলতে মায়ের ঘরে চলে এল,
false
shordindu
তোমাদের বললাম। যদি বিনা যুদ্ধে কার্যসিদ্ধি হয় তাই ভাল, কিন্তু যদি যুদ্ধ করতেই হয় তাতে আমার অমত নেই। এখন তোমরা বল তোমাদের অভিপ্রায় কি? বিগ্রহ নিবক রহিলেন, অনঙ্গও কথা বলিল না; যোগদেব একটা কিছু বলি বলি করিয়া থামিয়া গেলেন। শেষে কেহ কিছু বলিল না দেখিয়া জাতবর্মা বলিলেন—মহারাজ, আপনাকে মন্ত্রণা দেবার স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু অবস্থা যেরূপ দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় যুদ্ধ ছাড়া যৌবনশ্রীকে উদ্ধার করা যাবে না। এবং যদি যুদ্ধই করতে হয় তবে যত শীঘ্র সম্ভব প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। শ্বশুর মহাশয় এখন একটু বিপাকে পড়েছেন, চেদিরাজ্য আক্রমণের এই প্রকৃষ্ট সুযোগ। ঈষৎ হাসিয়া নয়পাল প্রশ্ন করিলেন—কিরূপ বিপাক? জাতবর্মা বলিলেন—স্বয়ংবর সভায় যে-সব মিত্র রাজা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছেন, তাঁদের ধারণা চেদিরাজ তাঁদের হাস্যাস্পদ করেছেন। এখন আপনি চেদিরাজ্য আক্রমণ করলে তাঁরা কেউ সাহায্য করতে আসবেন না। শ্বশুর মহাশয় ভয় পেয়ে আপনার হাতে যৌবনশ্রীকে অর্পণ করতে পারেন। নয়পাল প্রফুল্ল হইয়া বলিলেন—যথার্থ বলেছ। একথা আমার মনে উদয় হয়নি। হয়তো যুদ্ধ করবার প্রয়োজন হবে না, হুঙ্কারেই কাজ হবে। বৎস জাতবর্মা, আমি তোমার প্রতি বড় প্রীত হয়েছি। তুমি তোমার পিতার সুপুত্র বটে। আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও। এইবার সচিব যোগদেব প্রথম কথা বলিলেন, জাতবর্মাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন—ক্ষমা করবেন, একটি প্রশ্ন আছে। মগধ যুদ্ধযাত্রা করলে আপনি সঙ্গে থাকবেন তত? জাতবর্মা অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন, নয়পালের দিকে চাহিয়া বলিলেন—মহারাজ, অন্তর্যামী জানেন আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধাভিযানে যোগ দিতে কত উৎসুক। শ্বশুর মহাশয় যেরূপ ব্যবহার করেছেন তাতে তাঁর প্রতি তিলমাত্র সহানুভূতি আমার নেই। কিন্তু আমি স্বাধীন নই, মাথার উপর পিতৃদেব আছেন। আমি দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর কাছে সব নিবেদন করব। তিনি ন্যায়বান পুরুষ, অন্যায়ের পক্ষ কদাপি অবলম্বন করবেন না। ভাল। আমি তাঁকে পত্র লিখব, তারপর তাঁর ইচ্ছা।–নয়পাল ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন—আর একটা কথা। আমি লক্ষ্মীকর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে মাতা যৌবনশ্রীর কোনও অনিষ্ট সম্ভাবনা নেই? জাতবর্মার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন—মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ যদি আপনার প্রতি বিদ্বেষবশত নিজের কন্যার অনিষ্ট করেন তবে তাঁর মত নরাধম ভূ-ভারতে নেই। অতঃপর আরও কিছুক্ষণ আলোচনা হইল। যোগদেব কনিষ্ঠ সচিব হইলেও রাজার পারিবারিক মন্ত্রণায় যোগ দিতেন; বিশেষত এই ব্যাপারের সহিত আরম্ভ হইতেই তাঁহার একটা যোগসূত্র স্থাপিত হইয়াছিল। তিনি এখন সমস্ত করণীয় কর্মের ভার লইলেন। স্থির হইল চেদিরাজ্যে দূত পাঠানো হইবে, সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধযাত্রার উদ্যোগ হইবে। দৌত্য যদি বিফল হয় তখন নয়পাল যুদ্ধযাত্রা করিবেন। বজ্রবর্মা যদি তাঁহার সহযাত্রী হন ভাল, নচেৎ একাই যুদ্ধে যাইবেন। মগধ এখন আর সে-মগধ নাই সত্য, কিন্তু একেবারে মরিয়া যায় নাই। সাত দিন মগধের আতিথ্য উপভোগ করিয়া জাতবর্মা ও বীরশ্রী আবার নৌকায় উঠিলেন। যাত্রার পূর্বে মহারানী বীরশ্রীর কণ্ঠে মহামূল্য রত্নহার পরাইয়া দিলেন। নয়পাল জাতবর্মাকে মণিমাণিক্যখচিত অঙ্গদ ও শিরস্ত্রাণ দিলেন। প্রণামকালে বীরশ্রী মহারানীকে বলিলেন—মা, আমরা আবার আসব। এবার যৌবনাকে নিয়ে আসব। মহারানী সজল নেত্রে তাঁহার ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন—এস। অষ্টম পরিচ্ছেদ এক। স্বয়ংবরে আমন্ত্রিত রাজারা লক্ষ্মীকর্ণকে গালি দিতে দিতে স্বরাজ্যে ফিরিয়া গিয়াছেন। ত্রিপুরী নগরীতে বহু জন সমাগমে যে সংখ্যাস্ফীতি ঘটিয়াছিল তাহা আবার সহজ অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। নগরীর ব্যবসায়ী ও বিলাসিনীরা দুঃখিত, শান্তিপ্রিয় গৃহস্থেরা আনন্দিত। জল্পকেরা স্বয়ংবর সম্পর্কে নানা সম্ভব অসম্ভব কাহিনী পরস্পরকে শুনাইতেছে এবং শুনিতেছে। মোটের উপর নগরীর অবস্থা স্বাভাবিক। রাজভবনের অবস্থা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয়। রাজমাতা অম্বিকা দেবী নিজ শয্যায় অনড় হইয়া পড়িয়া আছেন; আগে দুই একটি কথা বলিতেন এখন তাহাও বলেন না, কেবল দুঃস্বপ্নভরা চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকেন। গভীর রাত্রে প্রদীপের আলোকে তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয় তিনি উৎকর্ণ হইয়া চঞ্চলা রাজলক্ষ্মীর ক্রম-বিলীয়মান পদধ্বনি শুনিতেছেন। প্রাসাদের অন্যত্র যৌবনশ্রী নিজ কক্ষে অবরুদ্ধা আছেন। দ্বারে রঙ্গিণী প্রহরিণী। একাকিনী রাজকন্যা, দিন কাটে তো রাত কাটে না। তিনি বেণী খুলিয়া আবার বয়ন করেন; আবার খোলেন, আবার বয়ন করেন। পাচিকা অন্ন রাখিয়া যায়, কখনও আহারে বসেন, কখনও বসেন না। কক্ষে কালিদাসের কয়েকটি পুঁথি আছে, তাহাই খুলিয়া নাড়াচাড়া করেন। মেঘদূতের দুই চারিটি শ্লোক পড়েন, রঘুবংশের অজবিলাপ পড়েন, কুমারসম্ভবের রতিবিলাপ পড়িতে পড়িতে সহসা পুঁথি বন্ধ করিয়া শয্যায় শয়ন করেন। চক্ষু মুদিয়া শয্যায় পড়িয়া থাকেন। বাতায়নের বাহিরে বপপীহ পাখিটা আম্রকানন হইতে বুক-ফাটা স্বরে ডাকে—পিয়া পিয়া পিয়া! মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মানসিক অবস্থা বোধ করি সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক। যত দিন যাইতেছে অপমান ও লাঞ্ছনার শেল ততই গভীরভাবে তাঁহার মর্মে প্রবেশ করিতেছে। মন্ত্রীরা তাঁহাকে ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে অনুরোধ করিতেছেন, কিন্তু বিশেষ ফল হইতেছে না। তিনি পণ করিয়াছেন মগধের কুকুরবংশকে নির্বংশ করিবেন, পালবংশে বাতি দিতে কাহাকেও রাখিবেন না। মন্ত্রণাসভায় এইরূপ আস্ফালন করিতে করিতে হঠাৎ ছুটিয়া গিয়া তিনি দেখিয়া আসিতেছেন, মেয়েটা পলাইয়াছে কিনা। যদিও রাজপুরী ঘিরিয়া কঠিন প্রহরা বসিয়াছে, প্রহরীদের চক্ষু এড়াইয়া একটি ইন্দুরেরও বাহির হইবার উপায় নাই, তবু মহারাজ নিজ চক্ষে না দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছেন না। মন্ত্রীরা তাঁহাকে বুঝাইতেছেন, মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিতে হইলে পরিপূর্ণরূপে সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত হইয়া যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। স্বয়ংবর সংক্রান্ত ব্যয়বাহুল্যের ফলে রাজকোষের অবস্থা ভাল নয়; এক্ষেত্রে একা যুদ্ধযাত্রা না করিয়া যদি কোনও মিত্র রাজাকে সহযাত্রী রূপে পাওয়া যায় তাহা হইলে সব দিক দিয়া মঙ্গল। সম্প্রতি মগধের বিরুদ্ধে একাকী যুদ্ধযাত্রা করিয়া যে ব্যাপার ঘটিয়াছে তাহার পুনরভিনয় বাঞ্ছনীয় নয়। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের ওইখানেই সবচেয়ে বেশি ব্যথা। তিনি ক্রোধে লাফাইতে লাগিলেন। গড্ডলচূড়ামণি
false
bongkim
ব্রাহ্মণকুলকলঙ্ক ব্যোমকেশের জন্য হেমচন্দ্রের কাছে অবিশ্বাসিনী হইবে? না, তা কখনই হইতে পারে না। আর একদিন হেমচন্দ্র মথুরা হইতে গুরুদর্শনে যাইতেছিলেন; মথুরা হইতে এক প্রহরের পথ আসিয়া হেমচন্দ্রের পীড়া হইল। তিনি এক পান্থনিবাসে পড়িয়া রহিলেন; কোন প্রকারে এ সংবাদ অন্ত:পুরে মৃণালিনীর কর্ণে প্রবেশ করিল। মৃণালিনী সেই রাত্রিতে এক ধাত্রীমাত্র সঙ্গে লইয়া রাত্রিকালে সেই এক যোজন পথ পদব্রজে অতিক্রম করিয়া হেমচন্দ্রকে দেখিতে আসিলেন। যখন মৃণালিনী পান্থনিবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি পথশ্রান্তিতে প্রায় নির্জীব; চরণ ক্ষতবিক্ষত – রুধির বহিতেছিল। সেই রাত্রিতেই মৃণালিনী পিতার ভয়ে প্রত্যাবর্তন করিলেন। গৃহে আসিয়া তিনি স্বয়ং পীড়িতা হইলেন। হেমচন্দ্রের তাহাও মনে পড়িল। সেই মৃণালিনী নরাধম ব্যোমকেশের জন্য তাঁহাকে ত্যাগ করিবে? সে কি অবিশ্বাসিনী হইতে পারে? যে এমন কথায় বিশ্বাস করে, সেই অবিশ্বাসী-সে নরাধম, সে গণ্ডমূর্খ। হেমচন্দ্র শতবার ভাবিতেছিলেন, “কেন আমি মৃণালিনীর পত্র পড়িলাম না? নবদ্বীপে কেন আসিয়াছে, তাহাই বা কেন জানিলাম না?” পত্রখণ্ডগুলি যে বনে নিক্ষিপ্ত করিয়াছিলেন, তাহা যদি যেখানে পাওয়া যায়, তবে তাহা যুক্ত করিয়া যতদূর পারেন, ততদূর মর্মাবগত হইবেন, এইরূপ প্রত্যাশা করিয়া একবার সেই বন পর্যন্ত গিয়াছিলেন; কিন্তু সেখানে বনতলস্থ অন্ধকারে কিছুই পায়েন নাই। বায়ু লিপিখণ্ডসকল উড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। যদি তখন আপন দক্ষিণ বাহু ছেদন করিয়া দিলে হেমচন্দ্র সেই লিপিখণ্ডগুলি পাইতেন, তবে হেমচন্দ্র তাহাও দিতেন। আবার ভাবিতেছিলেন, “আচার্য কেন মিথ্যা কথা বলিবেন? আচার্য অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ-কখনও মিথ্যা বলিবেন না। বিশেষ আমাকে পুত্রাধিক স্নেহ করেন-জানেন, এ সংবাদে আমার মরণাধিক যন্ত্রণা হইবে, কেন আমাকে তিনি মিথ্যা কথা বলিয়া এত যন্ত্রণা দিবেন? আর তিনিও স্বেচ্ছাক্রমে এ কথা বলেন নাই। আমি সদর্পে তাঁহার নিকট কথা বাহির করিয়া লইলাম-যখন আমি বলিলাম যে, আমি সকলই অবগত আছি-তখনই তিনি কথা বলিলেন। মিথ্যা বলিবার উদ্দেশ্য থাকিলে, বলিতে অনিচ্ছুক হইবেন কেন? তবে হইতে পারে, হৃষীকেশ তাঁহার নিকট মিথ্যা কথা বলিয়া থাকিবে। কিন্তু হৃষীকেশই বা অকারণে গুরুর নিকট মিথ্যা বলিবে কেন? আর মৃণালিনীই বা তাহার গৃহ ত্যাগ করিয়া নবদ্বীপে আসিবে কেন?” যখন এইরূপ ভাবেন, তখন হেমচন্দ্রের মুখ কালিমাময় হয়, ললাট ঘর্মসিক্ত হয়; তিনি শয়ন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসেন; দন্তে অধর দংশন করেন, লোচন আরক্ত এবং বিস্ফারিত হয়; শূলধারণ জন্য হস্ত মুষ্টিবদ্ধ হয়। আবার মৃণালিনীর প্রেমময় মুখমণ্ডল মনে পড়ে। অমনি ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় শয্যায় পতিত হয়েন; উপাধানে মুখ লুক্কায়িত করিয়া শিশুর ন্যায় রোদন করেন। হেমচন্দ্র ঐরূপ রোদন করিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার শয়নগৃহের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল। গিরিজায়া প্রবেশ করিল। হেমচন্দ্র প্রথমে মনে করিলেন, মনোরমা। তখনই দেখিলেন, সে কুসুমময়ী মূর্তি নহে। পরে চিনিলেন যে, গিরিজায়া। প্রথমে বিস্মিত, পরে আহ্লাদিত শেষে কৌতূহলাক্রান্ত হইলেন। বলিলেন, “তুমি আবার কেন?” গিরিজায়া কহিল, “আমি মৃণালিনীর দাসী। মৃণালিনীকে আপনি ত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু আপনি মৃণালিনীর ত্যাজ্য নহেন। সুতরাং আমাকে আবার আসিতে হইয়াছে। আমাকে বেত্রাঘাত করিতে সাধ থাকে, করুন। ঠাকুরাণীর জন্য এবার তাহা সহিব, স্থির সঙ্কল্প করিয়াছি |” এ তিরস্কারে হেমচন্দ্র অত্যন্ত অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “তোমার কোন শঙ্কা নাই। স্ত্রীলোককে আমি মারিব না। তুমি কেন আসিয়াছ? মৃণালিনী কোথায়? বৈকালে তুমি বলিয়াছিলে, তিনি নবদ্বীপে আসিয়াছেন; নবদ্বীপে আসিয়াছেন কেন? আমি তাঁহার পত্র না পড়িয়া ভাল করি নাই। গি। মৃণালিনী নবদ্বীপে আপনাকে দেখিতে আসিয়াছেন। হেমচন্দ্রের শরীর কণ্টকিত হইল। এই মৃণালিনীকে কুলটা বলিয়া অবমানিত করিয়াছেন? তিনি পুনরপি গিরিজায়াকে কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় আছেন?” গি। তিনি আপানর নিকট জন্মের শোধ বিদায় লইতে আসিয়াছেন। সরোবরতীরে দাঁড়াইয়া আছেন। আপনি আসুন। এই বলিয়া গিরিজায়া চলিয়া গেল। হেমচন্দ্র তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন। গিরিজায়া বাপীতীরে, যথায় মৃণালিনী সোপানোপরি বসিয়া ছিলেন, তথায় উপনীত হইল। হেমচন্দ্রও তথায় আসিলেন। গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণী! উঠ। রাজপুত্র আসিয়াছেন |” মৃণালিনী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। উভয়ে উভয়ের মুখ নিরীক্ষণ করিলেন। মৃণালিনীর দৃষ্টিলোপ হইল; অশ্রুজলে চক্ষু পূরিয়া গেল। অবলম্বনশাখা ছিন্ন হইলে যেমন শাখাবিলম্বিনী লতা ভূতলে পড়িয়া যায়, মৃণালিনী সেইরূপ হেমচন্দ্রের পদমূলে পতিত হইলেন। গিরিজায়া অন্তরে গেল। দশম পরিচ্ছেদ : এত দিনের পর! হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে হস্তে ধরিয়া তুলিলেন। উভয়ে উভয়ের সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন। এতকাল পরে দুইজনের সাক্ষাৎ হইল। যে দিন প্রদোষকালে, যমুনার উপকূলে নৈদাঘানিলসন্তাড়িত বকুলমূলে দাঁড়াইয়া, নীলাম্বুয়ীর চঞ্চল-তরঙ্গ-শিরে নক্ষত্ররশ্মির প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতে করিতে উভয়ে উভয়ের নিকট সজলনয়নে বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার পর এই সাক্ষাৎ হইল। নিদাঘের পর বর্ষা গিয়াছে, বর্ষার পর শরৎ যায়, কিন্তু ইঁহাদিগের হৃদয়মধ্যে যে কত দিন গিয়াছে, তাহা কি ঋতুগণনায় গণিত হইতে পারে? সেই নিশীথ সময়ে স্বচ্ছসলিলা বাপীতীরে, দুইজনে পরস্পর সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন। চারি দিকে সেই নিবিড় বন, ঘনবিন্যস্ত লতাস্রগ্ল‍বিশোভী বিশাল বিটপীসকল দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সম্মুখে নীলনীরদখণ্ডবৎ দীর্ঘিকা শৈবাল-কুমুদ-কহ্লার সহিত বিস্তৃত রহিয়াছিল। মাথার উপরে চন্দ্রনক্ষত্রজলদ সহিত আকাশ আলোকে হাসিতেছিল। চন্দ্রালোক-আকাশে, বৃক্ষশিরে, লতাপল্লবে, বাপীসোপানে, নীলজলে-সর্বত্র হাসিতেছিল। প্রকৃতি স্পন্দহীনা, ধৈর্যময়ী। সেই ধৈর্যময়ী প্রকৃতির প্রাসাদমধ্যে, মৃণালিনী হেমচন্দ্র মুখে মুখে দাঁড়াইলেন। ভাষায় কি শব্দ ছিল না? তাঁহাদিগের মনে কি বলিবার কথা ছিল না? যদি মনে বলিবার কথা ছিল, ভাষায় শব্দ ছিল, তবে কেন ইহারা কথা কহে না? তখন চক্ষুর দেখাতেই মন উন্মত্ত-কথা কহিবে কি প্রকারে? এ সময় কেবলমাত্র প্রণয়ীর নিকটে অবস্থিতিতে এত সুখ যে, হৃদয়মধ্যে অন্য সুখের স্থান থাকে না। যে সে সুখভোগ করিতে থাকে, সে আর কথার সুখ বাসনা করে না। সে সময়ে এত কথা বলিবার থাকে যে, কোন্ কথা আগে বলিব, তাহা কেহ স্থির করিতে পারে না।
false
humayun_ahmed
বলল, ম্যাজিক আমার ভালো লাগে না। আমি দেখব না। রূপাও বলল, তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, সে কিছু দেখবে না। মিনু বলল, পাগলামি করো না তো রূপা। এসো। এমন চমৎকার একটা ছেলে আর তুমি মুখ শুকনো করে আছ? কী কাণ্ড! শাড়ি বদলে একটা ভালো শাড়ি পর। রূপা বলল, বেনাবসি পরব? বেনারসি তো পরবেই। কয়েকটা দিন পর। আপাতত সুন্দর একটা শাড়ি পাব। নীল সিস্কের শাড়িটা পর। নিজেকে সুন্দর কবে সাজিয়ে দেখতে যাব? সাজা তো অপরাধ না। আমার ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া ভাবি বিশ্বাস কর, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। এসে তো তুমি। আমাদের তরুণ মাজিসিয়ান সাহেব তোমার মাথা ধরা সারিয়ে দেবেন। আর যদি সারাতে না পারেন তাহলে আমার কাছে অ্যাসপিরিন আছে। গ্ৰহরা যেমন নক্ষত্ৰকে ঘিরে রাখে তানভিরকে তেমনি সবাই ঘিরে আছে। আসরের মধ্যমণি হয়ে সে বসে আছে নক্ষত্রের মতোই। তার সামনে একটা খবরের কাগজ। এই কাগজ দিয়েই ম্যাজিক দেখানো হবে। আপাতত গল্প-গুজব হচ্ছে। কথক তানভির একা। বাকি সবাই মুগ্ধ শ্রোতা। রূপা শাড়ি বদলেছে। চুল বেঁধেছে। মিনু খুব হালকা করে রূপার চোখে কাজলও দিয়েছে। তার প্রয়োজন ছিল না। রূপাকে এমনিতেই ইন্দ্রাণীর মতো দেখায়। তানভিরের গল্প বলার কৌশল চমৎকার। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাচ্ছে। এত সহজে যে মাঝে মাঝে মনে হয় সব গল্প বোধহয় সাজানো। নম্বর দেয়া আছে কোন গল্পের পর কোনটি বলা হবে। সে রূপার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘদিনের চেনা মানুষের মতো বলল, রূপা তুমি কি মোনালিসার ছবি দেখেছ? রূপা হকচকিয়ে গেল। নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষ পরিচিতের ভঙ্গিতে কথা বললে হকচকিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। দেখেছ মোনালিসার বিখ্যাত ছবি? জি। অরিজিনাল নিশ্চয়ই দেখ নি–রিপ্ৰডাকশান দেখেছি। দেখারই কথা। পৃথিবীর অন্য কোনো ছবি এত খ্যাতি পায় নি। এত লক্ষ কোটি বার অন্য কোনো ছবির রিপ্রডাকশনও হয় নি। বলা যেতে পারে মোনালিসা হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচে খ্যাতনামা মহিলা। অফকোর্স ছবির মহিলা। এখন বলো দেখি এই মহিলার বিশেষত্ব কী? চোখ। উঁহু, চোখ না। যদিও সবাই চোখ চোখ বলে মাতামাতি করে। তবু আমার মনে হয়। অন্য কিছু। কী তা-কি জানো? না। মোনালিসার ভুরু নেই। এই জগদ্বিখ্যাত মহিলার জগদ্বিখ্যাত চোখের ভুরু নেই। কী, ব্যাপারটা অদ্ভুত না? রূপা কিছু না বললেও মনে মনে স্বীকার করল ব্যাপারটা অদ্ভুত। তানভির হাসতে হাসতে বলল, আমার কথা বোধহয় ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমি হাতে-নাতে প্রমাণ করে দিচ্ছি। আমার মানিব্যাগে মোনালিসাব পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি আছে। তানভির মানিব্যাগ থেকে ছবি বের করল। ছবি সবার হাতে হাতে ফিরছে। সবাই চোখ কপালে তুলে বলেছে–তাই তো! তাই তো। রূপাব একটু মন খারাপ লাগছে। কারণ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এই মানুষটির প্রতিটি গল্প সাজানো। সাজানো বলেই মানিব্যাগে মোনালিসার ছবি রেখে দেয়া। আচ্ছা, এখন শুরু হবে ম্যাজিকের খেলা। এখানে একটা খবরের কাগজ আছে। সবার সামনে কাগজ কেটে আমি দুখণ্ড করব, তারপর জোড়া দেব। জহির বলল, আমি কাটতে পারি? না-কি ম্যাজিসিয়ানকেই কাটতে হবে? যে কেউ কাটতে পারবে। মিনু বলল, রূপা কাটুক, রূপা। রূপা কাগজ কাটল। কাটা কাগজ রুমাল দিযে। ঢাকা হলো। রূপা ভেবেছিল রুমাল উঠাবার পর দেখা যাবে কাগজ জোড়া লেগেছে। রুমাল উঠাবার পর দেখা গোল কাগজের টুকরোগুলো নেই। সেখানে সুন্দর একটা কাগজের ফুল। সোবাহান সাহেবের মতো মানুষও চেচিয়ে বললেন, অপূর্ব, অপূর্ব অপুর্ব! আসর ভাঙল রাত বারোটায়। রূপা ঘুমোতে গিয়ে দেখল জেবা এখনো জেগে। মশারি ফেলে মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছে। রূপা বিক্ষিত হয়ে বলল, এখনো জেগে? হুঁ। কেন? ঘুম আসছে না? না। রূপা হালকা গলায় বলল, আমরা সুন্দর ম্যাজিক দেখলাম। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে তোমারও ভালো লাগত। এসো এখন ঘুমানো যাক। ঘুমানোর আগে কি পানি খাবে? বাথরুমে যাবে? না। বাতি নিভিয়ে রূপা মশারির ভেতর ঢুকতেই জেবা বলল, ফুপু ঐ লোকটা তোমাকে পছন্দ করেছে। খুব বেশি পছন্দ করেছে। এখন সবাই মিলে ঐ লোকটার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে। রূপা হালকা গলায় বলল, দিলে দিবে। কী আর করা। জেবা রূপার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, এখন থেকে এই বাড়িতে দুটা দল হলো। ঐ লোকটাব একটা দল। সবাই সেই দলে। আর তোমার একার একটা দল। তোমাল দলে শুধু আছি আমি একা। রূপা বলল, কী সব অদ্ভুত কথা যে তুমি বলো। এখন ঘুমাও তো। জেলা বলল, আমি মোটেও অদ্ভুত কথা বলছি না। আমি যে অদ্ভুত কথা বলছি না তুমি তাও জানো। খুব ভালো করে জানো। কাঁপা বলল, ঘুমাও তো জোরা। প্লিজ ঘুমানোর চেষ্টা করি! আচ্ছা। জেবা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। রূপা ঘুমোতে পারল না। রাত জাগা তার অভ্যাস হয়ে ছে? জেগে থাকতে খারাপও লাগছে না। তক্ষক ডাকছে। গভীর বাতে তক্ষকগুলি অন্যািরকম কবে ডাকে। দিনে তাদের ডাক এক রকম, বাতে অন্য রকম। স্যারকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি নিশ্চয়ই চমৎকার কোনো ব্যাখ্যা দেবেন। স্যারকে একটা ধাঁধাও জিজ্ঞেস কবিতে হবে। তব্দে ধাঁধা জিজ্ঞেস করলে উনি খানিকটা হকচকিয়ে যান এবং এমন অস্থিবি বোধ করেন যে রূপারই খারাপ লাগে। একবার সে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, স্যার বলুন তো এটা কী–আমবাগানে টুপ করে শব্দ হলো। একটা পাকা আম গাছ থেকে পড়েছে। যে দুজন শুনল সে দুজন গেল না। অন্য দুজন গেল।। যে দুজন গেল সে দুজন দেখল
false
toslima_nasrin
লেখক আমি, নিশ্চয়ই আমি এমন কোনও আপত্তিকর বই লিখেছি, যেটির কারণে মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে। সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল স্যাটানিক ভার্সেসএর কারণে। আমার ফতোয়াও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও বইয়ের কারণেই। লজ্জা বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সে অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু সাংবাদিকরা পাকামো করে পাঠকের জানার তৃষ্ণা মেটাতে লজ্জাকে ফতোয়ার কারণ হিসেবে কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লজ্জা কি মৌলবাদীদের ক্ষেপে ওঠার মূল কারণ? মোটেও না। ওরা তো ক্ষেপেই ছিল। ক্ষেপে আগুন হয়ে ছিল, সরকারের লজ্জা নিষিদ্ধের ঘি ওদের আগুনে গিয়ে পড়েছে। তাই ফতোয়া। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কিছু না করার ঘি ওদের আগুন আরও বেশি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই দেশ জুড়ে আন্দোলন। পেঙ্গুইন লজ্জা ছেপেছে, সে চলে। কারণ লজ্জার কাহিনী যদিও সম্পূর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিতে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ যেহেতু ঘটে, পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না গল্পটি। কিন্তু জার্মান পাঠক বা ফরাসি পাঠক লজ্জার কী বুঝবে! আমি বিরক্ত কণ্ঠে প্রকাশকদের প্রশ্ন করি, ‘আপনারা কি জানেন লজ্জা বইটি কি নিয়ে?’ ‘না, তা জানি না।’ ‘এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যপার। প্রচুর তথ্য আছে। আপনাদের পাঠকের এসব পড়তে ভাল লাগবে না। উপন্যাস হিসেবে এটি ভাল কোনও বই নয়।’ ‘সে নিয়ে আপনি মোটেও ভাববেন না। অনুগ্রহ করে আমাদের অনুমতি দিন।’ ‘আমি এমন কোনও বই এখনও লিখিনি যেটি বিদেশে অনুবাদ হতে পারে। এখানকার সমাজের সমস্যা নিয়ে লিখি। কোনও বই আন্তর্জাতিক মানের নয়। আমি ভাল কোনও বই লিখি আগে, তারপর দেব আপনাদের।’ ‘সে না হয় ছাপব, যা লিখবেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা লজ্জা ছাপতে চাইছি।’ ‘কেন, লজ্জা কেন?’ ‘লজ্জা তো বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। লজ্জার জন্যই তো ফতোয়া।’ ‘না, লজ্জার জন্য আমাকে ফতোয়া দেওয়া হয়নি। লজ্জা বের হওয়ার আগে থেকেই আন্দোলন করছে মৌলবাদীরা। নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরে ফতোয়া দিয়েছে। লজ্জা বের হওয়ার পর ছ মাস চলেছে এখানে। কোনও মৌলবাদী লজ্জা নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি।’ ‘তবুও আমরা লজ্জাই ছাপতে চাই।’ ‘এ বই আপনাদের ওখানে চলবে না।’ ‘সে আমরা বুঝব। লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি তো দিন। আমরা অগ্রিম রয়্যালটি দেব।’ রিয়্যালটি কোনও ব্যপার নয়। ব্যপার হচ্ছে পাঠকের আগ্রহ। এখানকার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা নিয়ে ওখানে আগ্রহ থাকার কথা নয়।’ ‘খুব আগ্রহ আছে। আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এসব আমরা দেখব।’ নাছোরবান্দা। ফ্রান্সের এডিশন দ্য ফামের মিশেল ইডেল দিনে তিনবেলা ফোন করেন, ‘তসলিমা আপনি তো নারী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন। এখানে আমাদের সংগঠনও দীর্ঘবছর ধরে একই সংগ্রাম করে আসছি। আমরা আপনার জন্য এখানে আন্দোলন করছি। আপনি আমাদের লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি দিন। আমরা কনট্রাক্ট ফরম পাঠাচ্ছি। আপনি সই করে দিন।’ ‘দেখুন, লজ্জা বইটি নারী স্বাধীনতার ব্যপার নয়। নারী বিষয়ে আমার কিছু বই আছে। আপনারা দেখুন, ওর মধ্যে একটি ছাপা যায় কি না। যদিও আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের মেয়েদের সমস্যাগুলো আদৌ ওখানে..’ ‘সে নিয়ে ভাববেন না। আমরা অন্য দেশের মেয়েদের সমস্যা জানতে চাই খুব। কিন্তু ওগুলোও ছাপবো। লজ্জা আগে ছাপবো।’ ‘লজ্জা ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। আগে পড়ে দেখুন ওটি, ছাপার যোগ্য কি না। আমি কিন্তু জানি যে আপনি পড়ার পর ছাপতে রাজি হবেন না।’ ‘না বলব! বলছেন কি? আমরা লজ্জা বইটা পাওয়ার জন্য এমন আকুল হয়ে বসে আছি।’ ‘কি আছে ওতে বলুন তো?’ ‘ওতে ইসলামের সমালোচনা করেছেন। তাই তো মুসলমানরা ক্ষেপেছে।’ আমি তিক্ত গলায় বলি, ‘সম্পূর্ণ ভুল। কোনওরকম ইসলামের সমালোচনা নেই ওতে।’ ‘দেখুন তসলিমা, আমরা ধর্ম বিশ্বাস করি না। আমাদের কাছে সব ধর্মই এক রকম। সব ধর্ম দ্বারাই মেয়েরা নির্যাতিত।’ ‘সে কথা তো আমিও মনে করি।’ ‘আপনি মনে করবেন না যে ইসলামের সমালোচনা বলে আমরা ছাপতে চাইছি বই। একজন নারীবাদী লেখিকা সুদূর বাংলাদেশে কি বই লিখেছে, যার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে, সরকার সেই বই নিষিদ্ধ করেছে। আমরা সেই বই পড়তে চাই। আমাদের পাঠক চাইছে পড়তে।’ ‘আবারও বলছি লজ্জার জন্য ফাঁসি চাইছে না কেন। ফাঁসি চাইছে ইসলাম বিষয়ে আমার মন্তব্যের জন্য।’ ‘ওই হল। আপনার লেখার জন্য ফাঁসি তো চাইছে দিতে!’ চলছেই। যত চলছে তত আমি অপ্রতিভ বোধ করছি। ফরাসি দুই প্রকাশক, মিশেল ইডেল আর ক্রিশ্চান বেস দুজনই লজ্জা ছাপার জন্য আমার অনুমতি নেবেনই নেবেন। আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে দুজনের মধ্যে। দুজনেই কনট্রাক্ট ফরম পাঠিয়ে দিলেন। মিশেল ইডেল আমাকে দিতে চেয়েছিলেন পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অগ্রিম। ক্রিশ্চান বেস বলছেন তিনি তিরিশ হাজার ফ্রাঁ দেবেন। প্রতিদিন ফোন আসে ফ্রান্স থেকে, আমি কণ্ঠ শুনেই পালাই। লজ্জা আমার জন্যই বড় একটি লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী লাভ ফরাসি পাঠকদের এখানের ভোলার গ্রামে বা মানিকগঞ্জের কোনও এক অজপাড়াগাঁয়ে কি ঘটেছে তা জেনে! ক্রিশ্চান বেস হঠাৎ হঠাৎ পালিয়ে যাওয়া আমাকে খপ করে ধরে বলতে থাকেন ‘তসলিমা আপনি লেখক। অনেক প্রকাশক আছে ঝড় ওঠে যে বইটি নিয়ে সে বইটি ছেপে তারা লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু আপনাকে আমরা সম্মান করি লেখক হিসেবে। আমরা ভাল লেখকের বই ছাপি, সে বই বিক্রি হোক বা না হোক। হঠাৎ নাম হওয়া কোনও লেখকের একটি বই হুজুগে ছাপা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীর বড় বড় লেখকের বই ফরাসিতে আমরা ছাপছি। আপনি যে অন্য ফরাসি প্রকাশকের কথা বলছেন, সেই প্রকাশক নারীবাদী বই ছাপে, আপনার লজ্জা
false
humayun_ahmed
মানুষ না। একজন অসুস্থ মানুষ বলেই কল্পনাটাকে বাস্তব মনে হচ্ছে। মুনিয়া! মুনিয়া পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। আমাকে ডাকবেন ময়ূরী। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। রুস্তম মোমবাতি জ্বালিয়ে খাতা খুলল। তার কাছে খুবই ভালো লাগছে যে, মুনিয়া কাছেই শুয়ে আছে। ময়ূরী। জি স্যার। একটু কাছে আসো তো। ময়ূরী সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। রুস্তম বলল, কিছুক্ষণের জন্য তোমার হাতটা ধরব। রুস্তম ময়ূরীর হাত ধরেছে। হাত ধরে রাখতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। কল্পনার মেয়ের হাত ধরা যায় না। কিন্তু সে তো হাত ধরতে পারছে। রুস্তম বলল, আমার বোন সামিনার বাচ্চা হবে। বলেন কি! ছেলে না মেয়ে? ছেলে না মেয়ে জানায়নি। আমার ধারণা যমজ মেয়ে হবে। স্যার জানেন যমজ বাচ্চার আমারও খুব শখ। যমজ বাচ্চা মানুষ করা কঠিন আছে। তোমার স্বামীকে সাহায্য করতে হবে। ভালো কথা! তোমার স্বামীর নামটা তো জানা হলো না। জেনে কি হবে স্যার? তাও ঠিক, জেনে কি হবে! ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। মোমবাতির শিখা কাপছে। যে কোনো সময় নিভে যাবে। রুস্তম বলল, মুনিয়া! তুমি ভালো মেয়ে। স্যার আমি জানি। আমার দুলাভাইও কিন্তু ভালো মানুষ। দুঃখে ধান্ধায় ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে। আহা বেচারা! ঝাপটা বাতাসে মোমবাতি নিভে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মুনিয়া বলল, আপনি ভয় পাবেন না স্যার। আমি আপনার কাছেই আছি। আমি জানি তুমি কাছে আছ। আগে আমি অন্ধকার ভয় পেতাম এখন পাই না। অন্ধকার ভয় পেতেন কেন স্যার? এটা খুবই লজ্জার কথা। আমি কাউকে বলিনি। ডাক্তার রেণুবালাকেও বলিনি। লজ্জার কথা বলে বেড়াতে হয় না। বলতে ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না। তোমাকে বলতে সমস্যা নেই। কারণ তুমি কেউ না। স্যার এটা কি বললেন? আমি ময়ূরী। আমি ময়ূরী ভাবছি বলেই তুমি ময়ূরী। আমি যদি ভাবি তুমি দিনা তাহলেই তুমি দিনা হয়ে যাবে। আপনার স্ত্রী দিনা? হুঁ। যার ভালো নাম মদিনা? হুঁ। ম কেটে সে হয়েছে দিনা। আমিও আমার নামের ম কেটে ফেলে দেব। আমি হয়ে যাব ময়ূরী। বাহ্! তোমার তো অনেক বুদ্ধি। হুঁ। উনাকে আমি কি ডাকব? তাকে তোমার কিছু ডাকতে হবে না। তার সঙ্গে তোমার কখনো দেখা হবে না। আপনি চাইলেই হবে। আপনার দুপাশে আমরা দুজন বসে থাকব। রুস্তম বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। আর তখনই কারেন্ট চলে এলো। ঘরে ঝলমলে উজ্জ্বল আলো। ময়ূরী কোথাও নেই। রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে। ঘণ্টাখানিক সাইকেলে চক্কর দেবে। সাইকেলে চক্কর দেওয়া মানে ব্যালেন্স রাখা। ব্রেইন ব্যস্ত থাকে ব্যালেন্স রাখতে। কাজেই সে আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়ার সময় পায় না। সাইকেলে উঠলে হাওয়ায় ভেসে থাকার অনুভূতি হয়, সেটাও খারাপ না। মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী কি হাওয়ায় ভাসার কল্পনা করে? একটা কুকুর বা একটা ভেড়া কি অবসর সময়ে কখনো ভাবে, সে হাওয়ায় উড়ছে? সাইকেল চালিয়ে রুস্তম ঘরে ফিরল। বারান্দার বেতের চেয়ারে গম্ভীর মুখে চশমা পরা এক বালক বসে আছে। তার হাতে অদ্ভুত এক খেলনা। কাঠির মাথায় কাঠঠোকরা পাখি। পাখিটাকে ছেড়ে দিলেই সে কাঠি টুকরাতে ঠুকরাতে নিচে নামতে থাকে। রুস্তম কি ছেলেটাকে কল্পনায় দেখছে? মনে হয় না। চশমা পরা গম্ভীর মুখের কোনো ছেলে তার কল্পনায় নেই। রুস্তম বলল, তুমি কে? ছেলে ইংরেজিতে জবাব দিল। মাই নেম ইজ নো। বেঙ্গলি নো। এখানে তোমাকে কে এনেছে? আমাদের ড্রাইভার নিয়ে এসেছে। আমি এক ঘণ্টা থাকব। এক ঘণ্টার মধ্যে পনেরো মিনিট চলে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে? সাইকেল চালাচ্ছিলাম। মেড পারসন সাইকেল চালাতে পারে না। তোমাকে কে বলেছে? আমি জানি। কারণ আমার অনেক বুদ্ধি। তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ? ইউ আর মাই ড্যাড। কিভাবে চিনলে? মার ঘরে তোমার তিনটা ছবি আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে হেডশেক করবে? করব। রুস্তম হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত ধরল। হঠাৎ করেই রুস্তমের চোখে পানি এসে গেল। ছেলে গম্ভীর গলায় বলল, তুমি মেড পারসন না। মেড পারসন শুধু হাসতে পারে, কাঁদতে পারে না। তোমার ডাকনাম না। ভালো নাম কী? ভালো নাম বিভাস। বিভাস অর্থ সূর্য। । সূর্য পৃথিবী থেকে কত দূরে জানো? জানি না। সূর্য পৃথিবী থেকে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। স্কুলে শিখিয়েছে? হ্যাঁ। আমি রাইম মিলাতে পারি, তুমি কি পারো? ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বলো। বিভাস বলল, আমার নাম বিভাস। পানিতে ভাসছে একটা হাঁস। বিভাসের সঙ্গে হাঁসের রাইম। রুস্তম বলল, মনে হয় আমি পারব। বিভাস বলল, আমি একটা করে সেনটেন্স বলব, তুমি রাইম করবে। ঠিক আছে? হ্যাঁ ঠিক আছে। রুস্তম বলল, বিভাস বলল, তুমি খুব ভালো রাইম করতে পারো। তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হয়েছ? খুব খুশি হয়েছি। মা বলেছিল, তুমি কোনো কিছুতেই খুশিও হও না, আবার দুঃখও পাও না। রুস্তম বলল, আমি খুশি হই আবার দুঃখও পাই। তবে দুঃখ পেলেও কাউকে বুঝতে দেই না। আনন্দে থাকার চেষ্টা করি। আমার ডাক্তার আমাকে সবসময় আনন্দে থাকতে বলেছে। তুমি কি এখন আনন্দে আছ? হ্যাঁ। তুমি কি আমাকে এক পিস কাগজ আর কলম দিতে পারবে? পারব। কী করবে? ছবি আঁকবে? না টা লিখব। আগে যেটা লিখেছিলাম, সেটা ভুল ছিল। পারবে। তার বাবাকে লেখা বিভাসের রচনাটা এই রকম– . . . , . . . . . . . . বিভাস এক
false
nihar_ronjon_gupta
পাওয়া গেল না মিঃ ডিবরাজের। সিজারের কুদ্ধ গর্জন আর একবার শোনা গেল। তারপরই হঠাৎ যেন সব স্তব্ধ। কিরীটী তবু এগিয়ে যায়। হঠাৎ ঐ সময় রাত্রির স্তব্ধতাকে দীর্ণ করে পর পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ইন্সপেক্টার মিঃ রামিয়াও ততক্ষণে তার পিস্তলটা মুঠোয় চেপে ঐদিকে ছুটে আসছেন। গাছগাছালিতে একেবারে জায়গাটা যেন বেশী দুর্ভেদ্য। মাথার উপর আবছা আলো থাকলেও নিবিড় গাছ-গাছালির জন্য ঐ জায়গাটায় একটা আবছা আলোছায়া। ভাল করে নজরে পড়ে না। কিরীটী তথাপি এগিয়ে যায়। হঠাৎ সামনে পড়ল একটা দীঘি। দীঘির চারপাশে বড় বড় ঘাস গজিয়েছে। দুরে সীমানায় তারের বেড়া। কিরীটী এদিক-ওদিক তাকায়, কিন্তু কোথাও মিঃ ডিবরাজকে দেখতে পায় না। কুকুরের ডাকও আর শোনা যাচ্ছে না তখন। কেবল একটানা ঝিঁঝির ডাক। হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, ডানদিকের ঝোপ থেকে কে একজন বের হয়ে আসছে। কে? মিঃ ডিবরাজ না? হ্যাঁ, তিনিই— মিঃ ডিবরাজ? দুপা এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ডাকল। মিঃ রায়? সিজার-সিজার কোথায়? আসুন। ভাঙা গলায় মিঃ ডিরাজ জবাব দিলেন। কোথায়? ! ? কে? সিজার। ডিবরাজের সঙ্গে এগিয়ে গেল কিরীটী সামনের দিকে কিছুটা। একটা পাম-ট্রির নীচে এগিয়ে এসে মিঃ ডিবরাজ বললেন, ঐ যে— কিরীটী দেখল, সিজারের দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। কিরীটী আরও এগিয়ে গেল। নীচু হয়ে দেখল। চাঁদের আলোয় এবারে তার নজরে পড়ল, মৃত সিজারের পেটে একটা লোহার সরু শলার মত কি বিঁধে আছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিরীটী সিজারের মৃতদেহ থেকে শলাটা টেনে বের করে চাঁদের আলোয় চোখের সামনে তুলে ধরল। দেড়বিঘৎ পরিমাণ, লোহার শলা নয়—একটা তীর, অগ্রভাগটা সামান্য চেপ্টা, কিন্তু ছুঁচলো। কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে বিষের তীর এটা— বিষের তীর! ডিবরাজ শুধালেন। হ্যাঁ, খুব সম্ভব তীরের ফলায় কোন তীব্র মারাত্মক বিষ মাখানো ছিল, যে বিষের ক্রিয়াতেই আপনার সিজারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মৃত্যু হয়েছে। চলুন, আর এখানে থেকে কি হবে, ভিতরে চলুন। মিঃ ডিবরাজকে নিয়ে কিরীটী পশ্চিম দিককার বারান্দায় ফিরে এল। মিঃ রামিয়া আর কৃষ্ণা দুজনেই বারান্দায় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কি হয়েচে ড্যাডি? কৃষ্ণা শুধায়। কৃষ্ণা, সিজার মারা গেছে! কান্না-ধরা-গলায় মিঃ ডিবরাজ বললেন। মারা গেছে? হ্যাঁ। কী করে? কিরীটী হাতের তীরটা তুলে ধরে বললে, এই বিষাক্ত তীরে। কোথা থেকে এল এটা? সম্ভবত রক্তমুখী ড্রাগনের কোন অনুচরেরই কাজ এটা। কিরীটী বললে। রক্তমুখী ড্রাগন! হ্যাঁ কৃষ্ণা, মিঃ ডিবরাজ ভাঙা গলায় বললেন, তোমাকে জানাইনি, রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে চিঠি দিয়েছে কবে? কখন? দিনকয়েক আগে। আহারে আর কারুরই রুচি ছিল না। সবাই খাদ্যবস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল যেন। সিজারের আকস্মিক মৃত্যুর বিষণ্ণতা যেন সকলের মনকেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। কিরীটী একসময়ে বললে, সিজার থাকলে তাদের সুবিধা হবে না, তাই তারা সিজারকে হত্যা করেছে মিঃ ডিবরাজ! আর আমার সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়। মিঃ ডিবরাজ বললেন। মিঃ রামিয়া বললেন, ভয় পাবেন না মিঃ ডিবরাজ-আমাদের প্রহরা কাল থেকে আরো কড়া হবে। কিরীটী কোন কথা বলে না, চুপ করে কি যেন ভাবে। কৃষ্ণাও চুপচাপ একেবারে। অনেক রাত্রে ওরা বিদায় নিল। পরের দিন রাত্রে। রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে। ফোনের একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দে সর্বপ্রথম কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে যায়। ব্যাপার কি? এত রাত্রে কার ফোন? পাশের ঘরেই ছিলেন জীবনবাবু-তারও ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তিনি রিসিভারটা তুলে নিলেন, হ্যালো, কে-মিঃ রামিয়া! কিরীটীকে ডেকে দেব? জরুরী? হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি দিচ্ছি। কিরীটী তার নামটা পাসের ঘরে কানে যেতেই শয্যা থেকে উঠে মধ্যবর্তী দরজাটা দিয়ে জীবনবাবুর শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল, কে ফোন করছে জীবন? তোমার ফোন। ইনসপেক্টার মিঃ রামিয়া— কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরল, কে মিঃ রামিয়া, আমি কিরীটী। কি—কি বললেন? ওপাশ থেকে তখন মিঃ রামিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চলেছেন, এইমাত্র ডিবরাজের সামনে যে প্রহরীরা প্রহরায় ছিল তারা আমাকে ফোন করেছে-তিনি খুন হয়েছেন কখন? কি করে হল? জানি না—আমি সেখানে যাচ্ছি-আপনি কি আসবেন? নিশ্চয়ই যাব। তাহলে প্রস্তুত থাকুন, যাবার পথে আমি তুলে নিয়ে যাব। কিরীটী চটপট প্রস্তুত হয়ে নেয়। সুব্রত ও রাজুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সব শুনে তারাও বললে যাব। কিরীটী বললে, না, সকলেই আমরা যাব না। তোরা থা—আমি একাই যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে তোদর জানাব। সুব্রত বললে, কিন্তু কিরীটী– ডাঃ ওয়াং-সেই হলুদ শয়তানের যতটুকু পরিচয় পেয়েছি, তার খরদৃষ্টি নিশ্চয়ই সর্বক্ষণ আমাদের ওপরে আছে। কেবল ডিবরাজকেই হয়ত হত্যা করেনি শয়তানটা, আমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে কিনা ইতিমধ্যে সেখানে একটা কে জানে! যদি একটা কিছু ঘটেই দুর্ঘটনা–তোরা বাইরে থাকলে হয়ত কাজে লাগতে পারবি-পুলিস-চীফ মিঃ বন্দরনায়ককে সঙ্গে সঙ্গে জানাবি ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই তিনি সবরকম সাহায্যই করবেন। সুব্রত আর রাজু আপত্তি করল না। কিরীটী পকেটে একটা শক্তিশালী পেনসিল টর্চ, একটা পাকানো কর্ড, একটা ছুরি ও অ্যানিয়া লোশনের একটা ছোট শিশি নিয়ে নিল। বাইরে ঐ সময় মিঃ রামিয়ার গাড়ির হর্ন শোনা গেল। চললাম—অ্যালার্ট থাকিস! কিরীটী বের হয়ে গেল। ঘুমন্ত জনহীনপ্রায় রাস্তা ধরে ভিক্টোরিয়া পার্কটার দিকে মিঃ রামিয়ার গাড়ি পঞ্চাশ মাইল স্পীডে ছুটে চলেছিল। কিরীটী শুধায়, আপনার প্রহরী আর কোন সংবাদ দিয়েছে? না। কিরীটী বললে, দোষটা আমারই মিঃ রামিয়া, আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার আস্ফালন যে নিষ্ফল নয়, দুর্বলের বহ্রারম্ভ নয় জানা উচিত ছিল আমার—তাহলে হয়ত আজকের দুর্ঘটনা ঘটত না। কিন্তু এ যে সত্যিই এক ভয়াবহ বিভীষিকার সৃষ্টি করল হলুদ
false
shomresh
চেপে এখানে আসার আগে বড় রাস্তায় পৌঁছলে বিশ্বরেকর্ড হয়ে যাবে দৌড়নোর। কথাটায় যুক্তি আছে। তা ছাড়া গুরুং মিস্টার থাপাকে চিনতে পারেনি বটে কিন্তু ওই বেঁটে লোকটা তো চিনতে পারে। গাড়ি দুটো তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ঝোপের মধ্যে বসেই ওরা দেখল গাড়ি দুটো ওদের পেছন দিয়ে ওপরে উঠে গেল। মিস্টার থাপা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ওরা কোথায় গেল এইটেই জানা গেল না। ওরা তো আমাদের ঠিকানাটা বলত না! এই যে ছেলে দুটো এল, ওরাও কি ডাকাতি করে? সেটাই স্বাভাবিক। বড় রাস্তায় পৌঁছতেই ভ্যানটা আচমকা থেমে গেল পাশে, এ কী! দাদা, আপনি? আরে! তোমার এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল? তাড়াতাড়ি? এর মধ্যে ঘণ্টা চারেক চলে গেছে জানেন? মাধব কার্শিয়াং থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ফিরছে। ভ্যান ভর্তি। মাধব, তুমি একটু নেমে আসতে পারবে? নিশ্চয়ই। গাড়ি একপাশে করে প্যাসেঞ্জারদের কিছু বুঝিয়ে সে চলে এল অর্জুনের কাছে। নিচু গলায় বলল, বড়বাবুকে নিয়ে এখানে? চিনতে পেরেছ? চিনব না? আমার কথা একটু বলে দেবেন যাতে কেস না নেয়? বলে দেব। কিন্তু তোমার কাছে একটা উপকার চাই। আদেশ করুন। তুমি আজ গুরুং-এর দোকানে একটা প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছ মনে আছে? মানাভাই তোমাকে দিয়েছিল। আর বলবেন না দাদা। শিলিগুড়ি থেকে ওঠার সময় পেছনে বসা একটা প্যাসেঞ্জার এমন ঝামেলা করছিল যে, যাওয়ার সময় ওই প্যাকেটটা দিতে একদম ভুলে গিয়েছি। এখন দেব। প্যাকেটটা দেখতে পারি? মাধব গাড়ির দিকে ছুটে গেল। ফিরে এল একটা বড় খাম হাতে। অর্জুন বলল, মানাভাই বলেছিল প্যাকেট, এটা তো খাম। এটাই দিয়েছিল দাদা। অর্জুন ঝটপট খাম খুলে ফেলল। গোটা পাঁচেক কাগজ। ইংরেজিতে ছাপা কোনও কিছুর জেরক্স। পড়ে বিষয় জানার সময় হাতে নেই, দ্রুত পাতা উলটে গেল সে। পেছনের পাতার কোণে লেখা, টু থার্টি পি এম, সিংলা বাংলো। এই কথাটার মানে কী? সে মাধবকে জিজ্ঞেস করল, সিংলা বাংলো বলে কোনও বাড়ি কি এখানে আছে? না দাদা, আমি জানি না। দোকানে গুরুংয়ের বাবা আছেন। ওকে যখন এই খামটা দিতে যাবে তখন জিজ্ঞেস করবে সিংলা কোথায়? ঠিক আছে। কিন্তু খামটা তো ছিঁড়ে ফেলেছ? বলবে ছিঁড়ে গিয়েছে। মাথা নেড়ে চলে গেল মাধব তার গাড়ি নিয়ে। মিস্টার থাপা বললেন, খবরটা দিতে ওকে আবার ফিরে আসতে হবে। তার চেয়ে চলুন এগিয়ে যাই। ওরা হাঁটছিল। একটু এগোতেই মিস্টার থাপার ভ্যানটাকে দেখতে পাওয়া গেল। ওপর থেকে ধীরে ধীরে নামছে। অর্জুন বলল, উঠে পড়ুন। রাস্তায় মাধবকে ধরে নেব। ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মাধব। ঠিক গুরুং-এর দোকানের সামনেই সে ভ্যানটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এতক্ষণ আটকে থাকায় ভ্যানের যাত্রীরা এবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছে। জিপটাকে পাশে আনতেই মাধব এগিয়ে এল, আধ কিলোমিটার নেমে বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে গেলে সিংলা পড়বে! এবার আমি যাই দাদা? ঠিক আছে। খামটা ছেড়া দেখে কিছু বলেনি? আমার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে দিল বুড়ো। ভাল করে দেখল না পর্যন্ত। চলিঃ দ্রুত ভ্যানে উঠে নেমে গেল মাধব। ঘড়ি দেখল অর্জুন। আড়াইটে বেজে গেছে। এইসব পাহাড়ে দিন শেষ হয় খুব তাড়াতাড়ি। সে ড্রাইভারকে একটু জোরে চালাতে অনুরোধ করল। পুলিশের ড্রাইভারকে এরকম অনুরোধ করলে কী হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেল অর্জুন। ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটছিল, এই গাছটা সামনে চলে আসছে, এই সরে যাচ্ছে। আধ কিলোমিটার পথ ফুড়ুত করে ফুরিয়ে যেতেই অর্জুন চিৎকার করে বলল, এবার বাঁ দিকের রাস্তা ধরে আস্তে চলুন। মিস্টার থাপা বললেন, জেরক্সের পেছনে ওই লেখাটা তো অন্য কোনও কারণেও লেখা হতে পারে। তাই না? ঠিকই। কিন্তু আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই, ওরা কোথায় গেল তাও জানতে পারছি না। সিংলা বলে যখন একটা জায়গা আছে তখন তার বাংলোটা দেখে আসা যাক। এই সময় পেছনে বসা একটি সেপাই জানাল, খানিকটা দূরে আর-একটা গাড়ি আসছে। এই রাস্তা পাকা নয়। বেশ সরু এবং পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলেছে। দুটো বড় গাড়ি পাশাপাশি হলে অনেক জায়গায় আটকে যাবে। অর্জুন তেমন একটা জায়গায় পৌঁছে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে যান। পেছনের গাড়ির লোকদের একটু দেখুন মিস্টার থাপা। মিনিটখানেকের মধ্যে পেছন থেকে হর্নের আওয়াজ ভেসে এল। খুব তাড়া থাকলে লোকে ওইভাবে হর্ন বাজায়। অর্জুন বলল, আমি নামব না। আপনারাই দেখুন। কিন্তু তার আগেই পেছনের গাড়ির আরোহী নেমে এসে বেশ কর্কশ গলায় গাড়ি সরাতে বলছে। একজন সেপাই জবাব দিল, পুলিশের গাড়ি দেখছেন না? পুলিশের গাড়ি বলে কিনে নিয়েছ নাকি? এটা পাহাড়, শিলিগুড়ি নয়। এই জিপ তো শিলিগুড়ির। মিস্টার থাপা নেমে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ শিলিগুড়ির। ও, আপনি! এখানে আপনাকে দেখতে পাব ভাবিনি। আপনি এখানে কী করছেন? এই একটু পারিবারিক কাজে যাচ্ছিলাম। অর্জুন বুঝতে পারল গলাটা মানাভাইয়ের। জিপের সামনের সিটে বসে থাকায় সে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু লোকটা এখানে এসেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই দেরি করে এসেছে। জেরক্সের পেছনে লেখা ছিল আড়াইটে। সার। গাড়িটা একটু সরালে আমরা বেরিয়ে যেতে পারি। আপনি তো সিংলা বাংলোয় যাচ্ছেন? না, মানে, আপনি..! আপনার কোনও চিন্তা নেই, আমরাও সেখানে যাচ্ছি। না, না, আমি এক রিলেটিভের বাড়িতে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ড্রাইভার দু-তিনবার ইচ্ছে করে ফস স্টার্ট দিচ্ছিল। শব্দ করে থেমে যাচ্ছিল এঞ্জিন। এবার অর্জুনের ইঙ্গিতে এঞ্জিন চালু করল। মিস্টার থাপা বললেন, ওই যে, গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। এদিকটায় আমি কখনও আসিনি। আপনি আসুন
false
nihar_ronjon_gupta
শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়ে জয়ন্ত বলে, এই যে আমরা এসে গিয়েছি। জয়ন্ত চৌধুরীর কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর নজরে পড়লো—সিঁড়ির শেষ সরু একটা ল্যাণ্ডিং আর তার পরেই বন্ধ একটা দরজা। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে জয়ন্ত চৌধুরী দরজার ফোকরে চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। সরু একফালি বারান্দা সামনেই। আসুন! কিরীটী এগিয়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী পুনরায় আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলে। বারান্দাটা অন্ধকার। একটু এগুতেই বাড়ির পশ্চাৎভাগ চোখে পড়ল। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ির পশ্চাৎভাগে বাগান—তার মধ্যে মধ্যে যে খোলা জায়গা, সেই সব জায়গা জুড়ে সব তাঁবু পড়েছে। তাঁবুতে তাঁবুতে আলো জ্বলছে। বাগানের মধ্যে ওই সব তাঁবু কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে। বড়মার জন্মতিথি উৎসবের জন্য সব তাঁবু খাটানো হয়েছে, আসুন। বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সামনেই একটা বন্ধ দরজার গায়ে ঠক ঠক করে কয়েকটা মৃদু টোকা দিল জয়ন্ত চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজাটা খুলে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী আহ্বান জানাল, আসুন মিস্টার রায়। কিরীটী ভেতরে পা দিল। পায়ে চপ্পল থাকলেও পায়ের তলায় একটা নরম কোমল স্পর্শ পায় কিরীটী। দামী পুরু কর্পেটে পা যেন ড়ুবে গিয়েছে। উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। ঘরের মধ্যে। সেই আলোতেই ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল। কিরীটী। মনে হল তার ঘরটা বসবার ঘর। চারদিকে পুরনো আমলের ভারী ভারী সব সোফা ও কাউচ। গোটা দুই আধুনিক ডিভানও আছে সেই সঙ্গে। জানলায় জানলায় সব হাফ গোলাপী রঙের পর্দা ও ভারি পর্দা ঝুলন্ত ক্রীম রঙের। ঘরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ ও আরামদায়ক-কিরিটী চেয়ে দেখলো ঘরের মধ্যে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলছে। পাশেই একজন বয়স্ক দাসী দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ই ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল। তার দিকে তাকিয়েই জয়ন্ত প্রশ্ন করল, সুরতিয়া, বড়মা কোথায়? আপনারা বসুন, রাণীমা গোসলঘরে ঢুকেছেন—গোসল হয়ে গেলেই আসবেন। অদ্ভুত মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠস্বর যেন সুরতিয়ার। কথা তো বলল না, কিরীটীর মনে হল, যেন সে গান গেয়ে উঠল। কারো সামান্য কথাও এমন মিষ্টি সুরেলা হতে পারে এ যেন কিরীটীর ধারণার বাইরে এবং সেই কারণেই বোধ হয় সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সুরতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সুরতিয়ার বয়স হয়েছে। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও দেহের গড়নটি কিন্তু ভারি চমৎকার। এবং এখনো বেশ আটসঁটি। মুখের কোথায়ও যেন এখনো বয়সের ছাপ তেমন পড়েনি। বেশভুষা, রাজপুতানী মেয়েদের মত। সুরতিয়া ওদের বসতে বলে মধ্যবতী দরজাপথে অন্তৰ্হিত হল। বসুন মিস্টার রায়। কিরীটী বসে না। ঘরের দেওয়ালে যে খানতিনেক বড় বড় অয়েল-পেন্টিং ছিল, সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওই অয়েল-পেন্টিংগুলো কাদের? কিরীটীর প্রশ্নে জয়ন্ত চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে একটি ছবির সামনে দাঁড়াল এবং বললে— এ হচ্ছে রায় বাহাদুর হরপ্রসাদ ব্যানার্জির তৈলচিত্র। দক্ষিণ দিককার দেওয়ালে ওটা চিত্রাঙ্গদা দেবীর মা-সারদা দেবী। আর ওই যে উত্তরের দেওয়ালে উনি আমাদের বড় জেঠামশাই জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী। ওদের কথাবাতাঁর মধ্যে চিত্রাঙ্গদা দেবী ঘরে এসে ঢুকলেন। চিত্রাঙ্গদা দেবীর দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়। গায়ের রঙটা একেবারে টকটকে গৌর। মুখের ও দেহের গঠনটি যেন সত্যিই অনিন্দনীয়। পরনে শ্বেতশুভ্র দামী সিল্কের থান। অনুরূপ ফুলহাতা ব্লাউজ গায়ে। সম্পূর্ণ নিরাভরণা। কিন্তু তথাপি তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। চোখে সোনার ফ্রেমের সৌখীন চশমা। চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। বাঁ হাতে একটা সাদা হাতাঁর দাঁতের বাঁটওয়ালা লাঠি। গত কয়েক বছর ধরে বাতে ভুগছেন, বেশী হাঁটা-চলা করতে পারেন না। এবং হাঁটাচলা যতটুকু করেন, তাও ওই লাঠির সাহায্যেই।– বড়মা! জয়ন্ত চৌধুরীই সসম্রামে ডাকে। চিত্রাঙ্গদা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে চেয়েছিলেন। বড়মা, ইনিই মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী কথাটা শেষ করে—মানে, অর্জন মিশ্র। নমস্কার। হাত তুলে নমস্কার জানালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়। বসুন। বসো জয়ন্ত। সকলেই উপবেশন করে, মুখোমুখি সোফায়। জয়ের কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই সব কথা, মিস্টার মিশ্র? হ্যাঁ। আপনি অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি মিস্টার মিশ্র। বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী জয়ন্তর দিকে তাকালেন ঃ ওরা যেন কোন রকম অসুবিধা না হয়, তুমি কিন্তু দেখো জয়ন্ত। আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। বড়মা। জয়ন্ত বলে। তুমি কটা দিন এখানে থাকাছ তো? চিত্রাঙ্গদা দেবী শুধালেন। উৎসব পর্যন্ত আছি। কেন, কটা দিন বেশি থাক না? না বড়মা, ঐ সময় আমার পক্ষে বেশি দিন থাকা— জয়ন্ত চৌধুরীর কথা শেষ হল না, সুরতিয়া এসে ঘরে ঢুকল, রাণীমা! কি? ভু কুঁচকে তাকালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে। সুধন্য এসেছে। কে-কে এসেছে? সুধন্য। বললাম, রাণীমা এখন ব্যস্ত আছেন, দেখা হবে না। কিন্তু কিছুতেই আমার কথা শুনছে না সুরতিয়ার কথা শেষ হল না, খোলা দরজাপথে একজন এসে ঘরে ঢুকে পড়ল ঐ সময়। সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গে গিয়ে আগস্তুকের ওপর পড়ে। আগস্তুকের চেহারা ও বেশভূষা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রোগা পাতলা চেহারা। এককালে গায়ের রঙটা হয়ত অত্যন্ত ফর্সাই ছিল, এখন কেমন যেন তামাটে বর্ণ হয়েছে। একমাথা ঝাঁকড়া ঝাকড়া চুল-লালচে তৈলহীন রুক্ষ। কতকাল যে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই কে জানে! ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ, উন্নত নাসা, ঠোঁট দুটো একটু পুরু। মুখভর্তি খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ও দাড়ির রঙ তামাটে। পরনে একটা কালো গরম প্যান্ট ও গায়ে গলাবন্ধ খয়েরি রঙের গরম কোট। হাতে একটা ফেল্ট ক্যাপ। পায়ে বুট জুতো। নমস্তে রাণীমা। আগন্তুকই প্রথমে কথা
false
humayun_ahmed
খুশি খুশিও লাগছে। আমি খুশি এইজন্যেই খুশি খুশি লাগছে। যে খুশি তার চেহারায় আলাদা সৌন্দর্য চলে আসে এইজন্যে সুন্দর লাগছে। মীরা উঠে দাঁড়াল। শেফা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আপা চলে গেলেই ভালো। সে মন্ত্রটা মুখস্থ করে ফেলতে হবে— আয় জলি বাঁয় জলি জলির নামে মন্ত্র বলি। জলিটা কী? জল জলের নামে মন্ত্র বলা হচ্ছে? আচ্ছা এই মন্ত্রে যে জায়গায় মাছের কথা বলা হয়েছে সেখানে সে যদি মাছ না বলে কচ্ছপ বলে তাহলে কি মাছের বদলে কচ্ছপ ধরা পড়বে? সে যদি বলে, মীর পীরের দোহাই লাগে সুতার আগায় কচ্ছপ লাগে।। দেলোয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং একদিন কচ্ছপের নাম বলে মন্ত্রের জোরটা পরীক্ষা করতে হবে। আজহার সাহেব তার প্রিয় জায়গায় বসে আছেন। জলপাই গাছের বাঁধানো বেদীতে। একটু আগে কোকিল ডাকছিল। কোকিলের ডাক শুনে তার মনটা খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে দুই মেয়ের কেউ তার পাশে নেই। মেয়েরা থাকলে কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতেন। ঢাকা শহরে পাখির ডাক মানে তো কাকের ডাক। কোকিলের ডাক এরা তো বোধহয় শুনেইনি। আজহার সাহেব দেখলেন মীরা তার দিকে আসছে। ইস মেয়েটা যদি আর দশ মিনিট আগে আসত। তবে কোকিলটা আশেপাশেই আছে, আবারো নিশ্চয়ই ডাকবে। মীরা বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, বাবা এই জায়গাটা কি তোমার খুব পছন্দের? আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, হুঁ। মা তুই দশ মিনিট আগে এলে ভালো হত। আজহার সাহেব সাধারণত মেয়েদের তুমি বলেন। তার মন যখন দ্রবীভূত থাকে তখনই শুধু তুই বলেন। দশ মিনিট আগে এলে কী হত? কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতাম। ঢাকা শহরে এই জিনিস কোথায় পাবি? কী বলছ তুমি বাবা। সব কোকিল তো ঢাকা শহরে। তার মানে? ঢাকা শহর ভর্তি কাক। কোকিলদের ডিম পাড়তে হয় কাকের বাসায়। কাজেই কোকিলদের ভালো না লাগলেও তারা এখন ঢাকা শহরে বাস করে। আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তোর কথাতো মা ফেলে দিতে পারছি না। ফেলে দিও না, তোমার ব্যাগে ভরে রেখে দাও। মীরা বাবার পাশে বসল। তার মুখ হাসি-হাসি। আজহার সাহের মেয়েকে এমন হাসিখুশি অবস্থায় কখনো দেখেন নি। তার খুবই ভালো লাগল। মেয়েটা কোনো একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, এখন মনে হয় সমস্যাটা কেটে গেছে। প্রথম যৌবনের সমস্যা অবশ্যি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হুট করে সমস্যাগুলি আসে আবার হুট করে চলে যায়। মীরা! জ্বি বাবা। আজ মনে হয় তোর মনটা খুব ভালো। আমার মন সব দিনই ভালো থাকে। আমি ভাব করি যে মন খারাপ। কেন? এম্নি। গত কয়েকদিন তোকে দেখে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তোর মাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি মীরার কী হয়েছে। মা কী বলেছে? যা সে জবাব দেয়নি। পাশ কাটিয়ে গেছে। মীরা হাসতে হাসতে বলল, পাশ কাটানোর ব্যাপারে মা খুব ওস্তাদ। আজহার সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তবে একটা প্যাকেট সব সময় সঙ্গে রাখেন—হঠাৎ হঠাৎ খুব ইচ্ছা হলে সিগারেট ধরান। এখন খুব ইচ্ছা হচ্ছে। মীরা বলল, বাবা তুমি আমাকে কতটুকু পছন্দ কর? আজহার সাহেব বললেন, এটা আবার কেমন প্রশ্ন। পছন্দ কি দাঁড়িপাল্লায়। মাপা যায় যে মেপে বলে দিলাম এতটুকু পছন্দ। পছন্দ কোয়ান্টিফাই করা যায় না। তারপরও বলা যায়। উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যায়। আচ্ছা তোমার জন্যে। ব্যাপারটা সহজ করে দিচ্ছি। তুমি একদিন লোকমুখে জানতে পারলে যে আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি তখন কী করবে? বিশ্বাস করব না। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি। মানুষের কথায় আমি বিশ্বান করব কেন? আচ্ছা ধর আমিই তোমাকে বললাম। বললাম যে বাবা আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি। তখন তুমি কী করবে? আমাকে ঘৃণা করবে? ঘৃণা করব কেন? পাপকে মৃণা করতে হয়, পাপীকে না। এইসব হল বই এর বড় বড় কথা। বইএর কথা পড়তে ভালো লাগে। বই এর বাইরে আর ভালো লাগে না। আমি একটা খুন করে ফেললাম তারপরও তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না? আজহার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, সব কিছুই নির্ভর করছে অবস্থার উপর। খুন কেন করলি, কোন অবস্থায় করলি তার উপর। নিউ ইংল্যান্ডে একটা খুনের মামলা হয়েছিল। চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল তারপরেও খুশি বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। মামলাটা পুরোপুরি আমার মনে নেই। যতটুকু মনে আছে তোকে বলি। ভেরি ইন্টারেস্টিং। প্লিজ বাবা মামলার গল্প শুরু করবে না। মামলার গল্প শুনতে ভালো লাগে না? অসহ্য লাগে বাবা। বমি এসে যায়। অসহ্য লাগবে কেন? মানুষের জীবনের বিচিত্র অংশটা ধরা পড়ে কোর্টে। মানুষের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড যে কোন পর্যায় যেতে পারে তার… আজহার সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। কোকিল ডেকে উঠল। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বললেন, কোকিলের ডাক শুনলি? হ্যাঁ শুনলাম। পাখিদের মধ্যে কোন পাখির ডাক তোর সবচে ভালো লাগে? কোনো পাখির ডাকই ভালো লাগে না। পাখির ডাকাডাকি করে পাখিদের জন্যে। মানুষের ত ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। ঘুঘুর ডাক তোর কাছে ভালো লাগে না? না। তুমি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ঘুঘুর ডাক ভালো না-লাগাটা বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে শাস্তিযোগ্য। অপরাধ?। আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। মেয়ে দুটাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। নিজের মেয়ে বলে এখন আর তাদের মনে হয় না। মনে হয় অন্য বাড়ির মেয়ে।
false
shomresh
লোকগুলোকে কি অৰ্জন কিনে রেখেছে? দীপাবলী জবাব দিল না। অর্জুন আর কথা বাড়াল না। জিভে শি বাজাতে বাজাতে জিপ চালাতে লাগল দ্রুতগতিতে। যেন যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়ে খুশী হল। সদর হাসপাতালে শমিতকে ভর্তি করে দেওয়া হলে ডাক্তার বললেন লু লেগে শরীর। অসুস্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে শরীরের ওপর দীর্ঘদিনের অত্যাচার ছিল। হাসপতালের খাতায়। নামধাম লেখানোর সময় অর্জুনপাশে ছিল। ঠিকানার জায়গায় এসে একটুও দ্বিধা না করে দীপাবলী নিজের ঠিকানা দিল। যে ভর্তি করছে তার সঙ্গে রুগীর সম্পর্কে জায়গায় লিখল আত্মীয়। অর্জুন একটু চুপচাপ দেখল। শহরে আসার পরও অর্জুন তার মুখের আবরণ খোলনি। যদিও এখানে গরম কম নয় কিন্তু কাউকেই এই বেশে দেখা যাচ্ছে না। অর্জুনের এই নিয়ে কোন ভাবনাই নেই। বিকেলের আগে কোন খবর পাওয়া যাবে না শমিতের ব্যাপারে, এই অবস্থায় ওরা হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ম্যাডাম, এবার তো আমার চলে যাওয়া উচিত কিন্তু তবু একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। দীপাবলী তাকাল। খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। বিকেলে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে ফিরবেন কি করে? ফিরে যাব। অদ্ভুত গলায় জবাব দিল দীপাবলী। অৰ্জুন বুঝল অবহেলা প্রকট না হলে এমন গলায় কথা বলা যায় না। আপনি এখন কোথায় যাবেন? দেখি! আচ্ছা, চলি, নমস্কার। অৰ্জুন হঠাৎ যেন ঝাঁকুনি দিয়ে শরীরটাকে চালু করল। সে যখন বেশ কয়েক পা এগিয়ে যাচ্ছে তখন দীপাবলী তাকে ডাকল, শুনুন, একটু দাঁড়িয়ে যাবেন? পেছন ফিরল অর্জুন। ওর মুখ যেহেতু দেখার উপায় নেই তাই অভিব্যক্তি বোঝা গেল। না, ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপাবলী কাছে গেল, আপনি অনেক উপকার করেছেন। কি বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। ধন্যবাদের দরকার নেই এখন। ঠিক সময়ে ওটা আদায় করে নেব। মানে? অৰ্জুন নায়েক সম্পর্কে কিছু তো জেনেছেন। বিনা স্বার্থে আমি কোন কাজ করি না। এই যে এসব করলাম তার পেছনে কিছু কারণ আছে। কি কারণ? আপনার হাতে কিছু সরকারি ক্ষমতা আছে। সামান্য হলেও আছে। সেটুকু কাজে না লাগালে আমার অসুবিধে হতে পারে। অবাক হবেন না, আমার চরিত্ৰ এটাই। আপনি এভাবে বলবেন জানলে আপনার উপকার নিতাম না। না নিলে আপনার আত্মীয়কে বাঁচানো মুশকিল হতে ম্যাডাম। সেটা আমার সমস্যা ছিল। নিশ্চয়ই। তবে মানুষের জীবনের চেয়ে দামী আর কি হতে পারে! সেটাও আমি বুঝতাম। যাক, এখন তো ভেবে লাভ নেই। আপনি আমার কাছ থেকে উপকার নিয়েছেন এটাই সত্যি। আমি উপকার চাইলে কি আর না বলতে পারবেন? কি চান আপনি? দীপাবলীর মুখে রক্ত জমল। খেতে। হেসে উঠল অর্জুন। মানে? সকালে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছিলাম। এখন দুপুর শেষ হতে চলেছে। পেটে কিছু নেই। খাওয়াবেন? আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না! আমিও নিজেকে বুঝতে পারি না বেশীর ভাগ সময়। সেই চেষ্টাও আর করি না। কিন্তু খিদে বা শরীরে ব্যথা পেলে বেশ টের পাই। আপনিও তো সকাল থেকে কিছু খাননি। না খেয়ে থাকলে ওই ভদ্রলোকের অসুখ যদি সেরে যায় তাহলে অবশ্য অন্য কথা। অর্জুন। সেই হাসিটা হাসল। ঠোঁট কামড়ালে দীপাবলী। লোকটাকে খাইয়ে দিলে যদি দায়মুক্ত হওয়া যায় তালে–সেটা এখনই করা উচিত। সে বলল, আমি এখানকার কিছু জানি না, কোথায় ভাল খাবার পাওয়া যায় বলুন। অৰ্জুন বলল, আসুন। জিপে ওঠার সময় একটু ইতস্তত করছিল দীপাবলী। অৰ্জুন বলল, ম্যাডাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে পেছনে বসুন। কেন? চমকে উঠল দীপাবলী। তার মনের কথা লোকটা টের পেল? আমার পাশে আপনাকে জিপে দেখলে চেনা পাবলিক গল্প তৈরী করবে। পচা আলুর পাশে থাকলে ভাল আলুও নষ্ট হয়ে যায়। দীপাবলী ড্রাইভারের পাশে সিটে উঠে বসল। বসে বলল, আমি যতক্ষণ অন্যায় না। করছি ততক্ষণ বদনামের ভয় করি না। অর্জুন কথা না বলে ইঞ্জিন চালু করল। শহরের ঠিক মাঝখানে একটা সিনেমা হলের পাশে জিপ দাঁড় করিয়ে বলল, আপনি একটু বসুন আমি আগে দেখে আসছি। সে নেমে গেল। রাস্তাঘাট এখনও শূন্য। সম্ভবত ছায়া না ঘনালে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। দীপাবলীর হঠাৎ মনে হল ডি এম এই শহরে আছেন। নেখালির ব্যাপার নিয়ে যে পরিকল্পনা সে গতকাল এস ডি ওর অফিসে রেখে এসেছিল তা কি তিনি আজ ডি এমের অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন? মন্তব্যসহ পাঠানোটাই নিয়ম। একবার খোঁজ নিলে ভাল হয়। ডি এম জানলে ওগুলো রাইটার্স বিল্ডিং-এ তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে। অৰ্জুন বেরিয়ে এল হোটল থেকে। জিপের পাশে এসে বললে, ম্যাডাম, কপাল মন্দ বলে মনে হচ্ছে। এদের লাঞ্চ শেষ। মিষ্টিটিষ্টি খেয়ে ম্যানেজ করা যেতে পারে। আপনি খাবেন। না ম্যাডাম, স্বভাব ব্ৰত-উদযাপন নেই। ব্ৰত উদযাপন? ওই বিধবা মহিলারা যা করে থাকেন। তাহলে তো আপনাকে খাওয়াতে পারছি না আমি। যা করছেন তার জন্যে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি নামছি। দীপাবলী জিপ থেকে নেমেই দেখতে পেল একটা রিক্সাওয়ালা রিক্সা নিয়ে সিনেমাহলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অৰ্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে আমিই হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারতাম। আমি হাসাপাতলে নয়, ডি এমের অফিসে যাচ্ছি। দীপাবলী এগিয়ে গেল। ডি এমের অফিসে পৌঁছাতেই বড়বাবু তাকে সসম্ভ্ৰমে বসতে বলে জানালেন, স্যার মিটিং করছেন। খবর দিচ্ছি। কিন্তু আপনার কি হয়েছে? আমার? কেন? খুব রুক্ষ লাগছে। মনে হচ্ছে ঝামেলার মধ্যে আছেন। তা আছি। কিসের মিটিং? শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ে। কম্যুনাল দাঙ্গা বাধার চান্স আছে। আমাকে হুকুম দিয়েছেন কেউ যেন বিরক্ত না করে। আপনার
false
shomresh
করিনি! ঝাড়িকাকু বলল; তা হোক, তবু তোর যাওয়া ভালো। কিন্তু তুমি যাচ্ছ না কেন? ঝাড়িকাকুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনিমেষের এইভাবে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। এবার ঝাড়িকাকু হেসে ফেলল, যতই পাশ কর বাবা, তুই এখনও ছেলেমানুষ আছিস। ওরে, আমি যে বাঙালি নই তা এই বাগানের সব কুলি জানে। আমাকে কিছু বলবে না। অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গে ও একদম ভুলে গিয়েছিল যে ঝাড়িকাকু বাঙালি নয়। অবশ্য একথা ওকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন ওর নিজেরই অবিশ্বাস হচ্ছিল, সেইসঙ্গে ওর মনে একটা বিষণ্ণতা কোথা থেকে চলে এল। নিজে বাঙালি নয় এই কথাটা কি ঝাড়িকাকু এতকাল সযত্নে লালন করে এসেছে মনেমনে? তা হলে এই বাড়ির মানুষ হয়ে যায় কী করে? কেন বাবার সমস্যা নিয়ে ঝাড়িকাকু কষ্ট পেয়েছিল। অনিমেষ বুঝতে পারল না। কিন্তু একথাটা ঠিক, বাঙালি নয় বলে ঝাড়িকাকু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছে আজকে। হয়তো এই কারণেই আজ বাড়িটা রক্ষা পেয়ে যাবে। কোনো-কোনো সময় দুর্বলতাই মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে থাকে। এতদিন বাদে স্বৰ্গছেঁড়ায় এক, অথচ এখনই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কী যে সব ব্যাপার হয়ে যায়। অনিমেষ যেন অতিকষ্টে বারান্দায় উঠে এল। ততক্ষণে ছোটমা একটা বিরাট ব্যাগ নিয়ে এদিকে চলে এসেছে। না, বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যাওয়া হবে না। সেটা ভেতর থেকে বন্ধ করে এদিকের দরজা দিয়ে যাওয়া হবে যাতে বাইরে থেকে কেউ চট করে বুঝতে না পারে কেউ বাড়িতে নেই। অনিমেষের সীতার ঠাকুমার কথা মনে হল। যদি সবাই চলে যায় কোয়ার্টার ছেড়ে কত বাচ্চাকাচ্চা এইসব কোয়ার্টারে নিশ্চয়ই আছে। ও ছোটমাকে হাত নেড়ে বিড় কিদরজা দিয়ে একছুটে বাইরে এল। আর আসতেই একটু অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। মাঠ পেরিয়ে বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে বাবুরা ছেলে মেয়ে বউদের সঙ্গে নিয়ে আসাম রোডের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। অনেককেই ও চিনতে পারছিল-কেউ-কেউ নতুন। সীতার বাবা-মাকে দেখতে পেল না সে এই দলের মধ্যে। ওরা আসাম রোডের ওপর উঠে বাজারের পথে বাঁক ঘুরতেই অনিমেষ ফিরল। ছোটমা ততক্ষণে উঠোনে নেমে এসেছেন। পেছনে বাবা। বাবার হাতে সুটকেস। অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে ছোটমার হাত থেকে ব্যাগটা নিতেই ছোটমা বলল, ঠাকুরকে ফেলে রেখে যাচ্ছি-জল-বাতাসাও পাবেন না। মহীতোষ হাঁটতে হাঁটতে বললেন, রাখো তো তোমার ঠাকুর। বেঁচে থাকলে তোমরা অনেক জল-বাতাসা দেবার সুযোগ পাবে। ছোটমা হঠাৎ সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠল, তোমরা সত্যি কী করেছ ওদের বলো তো যে এখন প্রাণের ভয় পাচ্ছ? মহীতোষ বিরক্ত হলেন, আঃ, এখন বকবক না করে পা চাও তো। খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে আসতে আসতে অনিমেষ বলল, অন্য বাবুর সবাই একটু আগে চলে গেছে, শুধু ঠাকুমাদের দেখলাম না। ছোটমা বললেন, সে কী! কী হবে! ওঁর পক্ষে তো যাওয়াও অসম্ভব। একবার খোঁজ নিলে হয় না? বিয়েবাড়ির সব অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। মহীতোষ হতাশ ভঙ্গি করলেন। ঝাড়িকাকু পেছন পেছন আসছিল, কথাটা শুনে বলল, তোমরা যাও, আমি দেখছি। বিয়েবাড়ি শব্দটা কানে যেতেই অনিমেষ কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। আচ্ছা, যদি সীতারা যাবার আগই রাগী কুলিরা এসে পড়ত? তা হলে সীতা কি নতুন বেনারসি পরে বাবার সঙ্গে একটু-আগে-দেখা বাবুদের মতো দৌড়ে পালাত? মহীতোষ আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। ঝাড়িকাকুকে সীতাদের বাড়ির দিকে এগোতে দেখে অনিমেষ ছোটমার সঙ্গে বাবার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল। ছোটমা বললেন, যা-ই বল বাপু, এই কুলিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বাবুরা ভালো ব্যবহার করত না, নাহলে পালাবার কথা মনে আসবেই-বা কেন? কথাটাকে মনেমনে সমর্থন করে অনিমেষ পেছন থেকে বাবার শরীরটাকে লক্ষ করল, এই মুহূর্তে অত বড় মানুষটাকে কেমন অসহায়-অসহায় দেখাচ্ছে। মহীতোষ ঘাড় ফিরিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমেষ চট করে ডানদিকে মাঠের শেষপ্রান্তে ফ্যাক্টরিতে যাবার রাস্তার দিকে তাকাল। হইহই শব্দটা জলস্রোতের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে এখন। ক্রমশ কালো কালো মাথাগুলো দেখা গেল। অসহায়ের মতো ওরা আসাম রোডের দিকে তাকাল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই কুলিরা নিশ্চয়ই ওদের ফেলবে। কার। এখন ওরা ঠিক মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে, সামান্য যে-কজন রাস্তার মুখে গেটের সামনে পৌঁছেছে তার অনেক অনেক গুণ বেশি লোক যে এখনও আড়ালে রয়েছে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না ওদের। মহীতোষ দৌড়ে স্ত্রী-পুত্রদের কাছে এসে হতাশ গলায় বললেন, তখন থেকে তাড়া দিচ্ছি তোমরা শুনলে না। এখন কপালে কী আছে কে বলতে পারে! সব বাবু চলে গেল সময়মতো-! কয়েক পা হেঁটে আসতেই ওদের বাড়ির সামনের ক্লাবঘরটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মধ্যিখানে। এই সময় মাদলের শব্দ শুনতে পেল। অনিমেষ দেখল ছোটমার মুখ একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এখনই দ্রুত পা চালিয়ে আসাম রোডে উঠে যাওয়া উচিত। অবশ্য কুলিরা যদি আক্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকে তা হলে ওরা এই মুহূর্তে যত দূরত্বেই থাক ছোটমাকে নিয়ে। ওদের হাতের নাগালের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা যে রীরিক আঘাত করবে এমন তো নাও হতে পারে। হয়তো চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে ক্রোধ প্রকাশ করবে। তারপর বুঝিয়ে বললে বুঝতেও পারে। ওদের বাড়িতে আসবার আগে সীতাদের বাড়ি কুলিদের সামনে পড়বে–সীতার মাবাবা-ঠাকুমা তো বাড়িতেই আছেন। খুব দ্রুত এসব কথা চিন্তা করে অনিমেষ বাবাকে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো বাড়িতেই ফিরে যাই। মহীতোষও বোধহয় সেরকম চিন্তা করছিলেন, কথাটা শুনে দ্রুত খিড়কির দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। অনিমেষ হাঁটতে
false
robindronath
কুণ্ড মহাক্রুদ্ধ হইয়া আসিয়া তাহার বাপকে কহিল, “আমি এখনই চলিলাম।” বাপ যজ্ঞনাথ কুণ্ড কহিলেন, “বেটা অকৃতজ্ঞ, ছেলেবেলা হইতে তোকে খাওয়াইতে পরাইতে যে ব্যয় হইয়াছে তাহা পরিশোধ করিবার নাম নাই, আবার তেজ দেখ-না।” যজ্ঞনাথের ঘরে যেরূপ অশনবসনের প্রথা তাহাতে খুব যে বেশি ব্যয় হইয়াছে তাহা নহে। প্রাচীনকালের ঋষিরা আহার এবং পরিচ্ছদ সম্বন্ধে অসম্ভব অল্প খরচে জীবন নির্বাহ করিতেন ; যজ্ঞনাথের ব্যবহারে প্রকাশ পাইত, বেশভূষা-আহারবিহারে তাঁহারও সেইরূপ অত্যুচ্চ আদর্শ ছিল। সম্পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করিতে পারেন নাই ; সে কতকটা আধুনিক সমাজের দোষে এবং কতকটা শরীররক্ষা সম্বন্ধে প্রকৃতির কতকগুলি অন্যায় নিয়মের অনুরোধে। ছেলে যতদিন অবিবাহিত ছিল সহিয়াছিল, কিন্তু বিবাহের পর হইতে খাওয়া-পরা সম্বন্ধে বাপের অত্যন্ত বিশুদ্ধ আদর্শের সহিত ছেলের আদর্শের অনৈক্য হইতে লাগিল। দেখা গেল, ছেলের আদর্শ ক্রমশই আধ্যাত্মিকের চেয়ে বেশি আধিভৌতিকের দিকে যাইতেছে। শীতগ্রীষ্ম-ক্ষুধাতৃষ্ণা-কাতর পার্থিব সমাজের অনুকরণে কাপড়ের বহর এবং আহারের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতেছে। এ সম্বন্ধে পিতাপুত্রে প্রায় বচসা হইতে লাগিল। অবশেষে বৃন্দাবনের স্ত্রীর গুরুতর পীড়াকালে কবিরাজ বহুব্যয়সাধ্য এক ঔষধের ব্যবস্থা করাতে, যজ্ঞনাথ তাহাতেই কবিরাজের অনভিজ্ঞতার পরিচয় পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে বিদায় করিয়া দিলেন। বৃন্দাবন প্রথমে হাতে পায়ে ধরিল, তার পরে রাগারাগি করিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না। পত্নীর মৃত্যু হইলে বাপকে স্ত্রীহত্যাকারী বলিয়া গালি দিল। বাপ বলিলেন, “কেন, ঔষধ খাইয়া কেহ মরে না ? দামী ঔষধ খাইলেই যদি বাঁচিত তবে রাজাবাদশারা মরে কোন্ দুঃখে। যেমন করিয়া তোর মা মরিয়াছে, তোর দিদিমা মরিয়াছে, তোর স্ত্রী তাহার চেয়ে কি বেশি ধুম করিয়া মরিবে।” বাস্তবিক, যদি শোকে অন্ধ না হইয়া বৃন্দাবন স্থিরচিত্তে বিবেচনা করিয়া দেখিত, তাহা হইলে এ কথায় অনেকটা সান্ত্বনা পাইত। তাহার মা, দিদিমা কেহই মরিবার সময় ঔষধ খান নাই। এ বাড়ির এইরূপ সনাতন প্রথা। কিন্তু আধুনিক লোকেরা প্রাচীন নিয়মে মরিতেও চায় না। যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন এ দেশে ইংরাজের নূতন সমাগম হইয়াছে, কিন্তু সে সময়েও তখনকার-সেকালের লোক তখনকার-একালের লোকের ব্যবহার দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া অধিক করিয়া তামাক টানিত। যাহা হউক, তখনকার-নব্য বৃন্দাবন তখনকার-প্রাচীন যজ্ঞনাথের সহিত বিবাদ করিয়া কহিল, “আমি চলিলাম।” বাপ তাহাকে তৎক্ষণাৎ যাইতে অনুমতি করিয়া সর্বসমে কহিলেন, বৃন্দাবনকে যদি তিনি কখনো এক পয়সা দেন তবে তাহা গোরক্তপাতের সহিত গণ্য হইবে। বৃন্দাবনও সর্বসমক্ষে যজ্ঞনাথের ধনগ্রহণ মাতৃরক্তপাতের তুল্য পাতক বলিয়া স্বীকার করিল। ইহার পর পিতাপুত্রে ছাড়াছাড়ি হইয়া গেল। বহুকাল শান্তির পরে এইরূপ একটি ছোটোখাটো বিপ্লবে গ্রামের লোক বেশ একটু প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। বিশেষত যজ্ঞনাথের ছেলে উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হওয়ার পর সকলেই নিজ নিজ শক্তি অনুসারে যজ্ঞনাথের দুঃসহ পুত্রবিচ্ছেদদুঃখ দূর করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সকলেই বলিল, সামান্য একটা বউয়ের জন্য বাপের সহিত বিবাদ করা কেবল একালেই সম্ভব। বিষেশত তাহারা খুব একটা যুক্তি দেখাইল; বলিল, একটা বউ গেলে অনতিবিলম্বে আর-একটা বউ সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু বাপ গেলে দ্বিতীয় বাপ মাথা খুঁড়িলেও পাওয়া যায় না। যুক্তি খুব পাকা সন্দেহ নাই; কিন্তু আমার বিশ্বাস, বৃন্দাবনের মতো ছেলে এ যুক্তি শুনিলে অনুতপ্ত না হইয়া বরং কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইত। বৃন্দাবনের বিদায়কালে তাহার পিতা যে অধিক মনঃকষ্ট পাইয়াছিলেন তাহা বোধ হয় না। বৃন্দাবন যাওয়াতে এক তো ব্যয়সংক্ষেপ হইল, তাহার উপরে যজ্ঞনাথের একটা মহা ভয় দূর হইল। বৃন্দাবন কখন তাঁহাকে বিষ খাওয়াইয়া মারে, এই আশঙ্কা তাঁহার সর্বদাই ছিল। যে অত্যল্প আহার ছিল তাহার সহিত বিষের কল্পনা সর্বদাই লিপ্ত হইয়া থাকিত। বধূর মৃত্যুর পর এ আশঙ্কা কিঞ্চিৎ কমিয়াছিল, এবং পুত্রের বিদায়ের পর অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ হইল। কেবল একটা বেদনা মনে বাজিয়াছিল। যজ্ঞনাথের চারি-বৎসর-বয়স্ক নাতি গোকুলচন্দ্রকে বৃন্দাবন সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল। গোকুলের খাওয়া-পরার খরচ অপোকৃত কম সুতরাং তাহার প্রতি যজ্ঞনাথের স্নেহ অনেকটা নিষ্কণ্টক ছিল। তথাপি বৃন্দাবন যখন তাহাকে নিতান্তই লইয়া গেল তখন অকৃত্রিম শোকের মধ্যেও যজ্ঞনাথের মনে মুহূর্তের জন্য একটা জমাখরচের হিসাব উদয় হইয়াছিল- উভয়ে চলিয়া গেলে মাসে কতটা খরচ কমে এবং বৎসরে কতটা দাঁড়ায়, এবং যে টাকাটা সাশ্রয় হয় তাহা কত টাকার সুদ। কিন্তু তবু শূন্য গৃহে গোকুলচন্দ্রের উপদ্রব না থাকাতে গৃহে বাস করা কঠিন হইয়া উঠিল। আজকাল যজ্ঞনাথের এমনি মুশকিল হইয়াছে, পূজার সময়ে কেহ ব্যাঘাত করে না, খাওয়ার সময় কেহ কাড়িয়া খায় না, হিসাব লিখিবার সময় দোয়াত লইয়া পালায় এমন উপযুক্ত লোক কেহ নাই। নিরুপদ্রবে স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া তাঁহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। মনে হইল যেন মৃত্যুর পরেই লোকে এইরূপ উৎপাতহীন শূন্যতা লাভ করে ; বিশেষত বিছানার কাঁথায় তাঁহার নাতির কৃত ছিদ্র এবং বসিবার মাদুরে উক্ত শিল্পী-অঙ্কিত মসীচিহ্ন দেখিয়া তাঁহার হৃদয় আরো অশান্ত হইয়া উঠিত। সেই অমিতাচারী বালকটি দুই বৎসরের মধ্যেই পরিবার ধুতি সম্পূর্ণ অব্যবহার্য করিয়া তুলিয়াছিল বলিয়া পিতামহের নিকট বিস্তর তিরস্কার সহ্য করিয়াছিল; এক্ষণে তাহার শয়নগৃহে সেই শতগ্রন্থিবিশিষ্ট মলিন পরিত্যক্ত চীরখণ্ড দেখিয়া তাঁহার চক্ষু ছল্ছল্ করিয়া আসিল; সেটি পলিতা-প্রস্তুত-করণ কিংবা অন্য কোনো গার্হস্থ্য ব্যবহারে না লাগাইয়া যত্নপূর্বক সিন্দুকে তুলিয়া রাখিলেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যদি গোকুল ফিরিয়া আসে এবং এমন-কি, বৎসরে একখানি করিয়া ধুতিও নষ্ট করে তথাপি তাহাকে তিরস্কার করিবেন না। কিন্তু গোকুল ফিরিল না এবং যজ্ঞনাথের বয়স যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক শীঘ্র শীঘ্র বাড়িয়া উঠিল এবং শূন্য গৃহ প্রতিদিন শূন্যতর হইতে লাগিল। যজ্ঞনাথ আর ঘরে স্থির থাকিতে পারেন না। এমন-কি, মধ্যাহ্নে যখন সকল সম্ভ্রান্ত লোকই আহারান্তে নিদ্রাসুখ লাভ করে যজ্ঞনাথ
false
robindronath
ছুটে গিয়ে ঝরনার মধ্যে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে আমি স্নান করেছি।” এই কথা বলতে বলতে অচিরা ডাক দিলে, “দাদু।” অধ্যাপক তাঁর পড়া ফেলে রেখে কাছে এসে মধুর স্নেহে বললেন, “কী দিদি।” “তুমি সেদিন বলছিলে না, মানুষের সত্য তার তপস্যার ভিতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়ে উঠছে?— তার অভিব্যক্তি বায়োলজির নয়।” “হাঁ, তাই তো আমি বলি। পৃথিবীতে বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার ভিতর দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরো তপস্যা সামনে আছে, আরো স্থূলত্ব বর্জন করতে হবে, তবে সে হবে দেবতা। পুরানে দেবতার কল্পনা আছে, কিন্তু অতীতে দেবতা ছিলেন না, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে, মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।” “দাদু, এইবার তোমার আমার কথাটা চুকিয়ে দিই। কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।” আমি উঠে পড়ে বললুম, “তা হলে আমি যাই।” “না, আপনি বসুন। দাদু, তোমার সেই কলেজের যে অধ্যক্ষপদ তোমার ছিল, সেটা আবার খালি হয়েছে। সেক্রেটারি খুব অনুনয় ক’রে তোমাকে লিখেছেন সেই পদ ফিরে নিতে। তুমি আমাকে সব চিঠি দেখাও, কেবল এই চিঠিটাই দেখাও নি। তাতেই তোমার দুরভিসন্ধি সন্দেহ করে ঐ চিঠিটা চুরি করে দেখেছি।” “আমারই অন্যায় হয়েছিল।” “কিচ্ছু অন্যায় হয় নি। আমি তোমাকে টেনে এনেছি তোমার আসন থেকে নীচে। আমরা কেবল নামিয়ে আনতেই আছি।” “কী বলছ দিদি।” “সত্যি কথাই বলছি। বিশ্বজগৎ না থাকলে বিধাতার হাত খালি হয়, ছাত্র না থাকলে তোমার তেমনি। সত্যি কথা বলো।” “বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করেছি কিনা তাই—” “তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! তুমি , তুমি আচার্য। তোমার জ্ঞানের সাধনা নিজের জন্যে নয়, অন্যকে দানের জন্যে। দেখেন নি নবীনবাবু, মাথায় একটা আইডিয়া এলে আমাকে নিয়ে পড়েন, দয়ামায়া থাকে না; বারো-আনা বুঝতে পারি নে; নইলে আপনাকে নিয়ে বসেন, সে আরো শোচনীয় হয়ে ওঠে। আপনার মন যে কোন্‌ দিকে, বুঝতেই পারেন না, ভাবেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের দিকে। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই, কিন্তু বাছাই করে নিতে ভুলো না।” অধ্যাপক বললেন, “ছাত্রই তো শিক্ষককে বাছাই করে, গরজ তো তারই।” “আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। সম্প্রতি আমার চৈতন্য হয়েছে, যিনি শিক্ষক তাঁকে গ্রন্থকীট করে তুলছি। এমনি ক’রে তপস্যা ভাঙি নিজের অন্ধ গরজে। সে কাজ তোমাকে নিতে হবে, এখনই যেতে হবে সেখানে ফিরে।” অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো অচিরার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অচিরা বললে, “ও, বুঝেছি, তুমি ভাবছ আমার কী গতি হবে। আমার গতি তুমি। ভোলানাথ, আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয়, তা হলে দিদিমা দি সেকেণ্ডের আমদানি করতে হবে, তোমার লাইব্রেরি বেচে তাঁর গয়না বানিয়ে দেবে, আমি দেব লম্বা দৌড়। অত্যন্ত অহংকার না বাড়লে এ কথা তোমাকে মানতেই হবে, আমাকে না হলে একদিনও তোমার চলে না। আমার অনুপস্থিতিতে পনেরোই আশ্বিনকে পনেরোই অক্টোবর ব’লে তোমার ধারণা হয়, যেদিন বাড়িতে তোমার সহযোগী অধ্যাপকের নিমন্তন্ন, সেইদিনই লাইব্রেরি ঘরে দরজা বন্ধ ক’রে নিদারুণ একটা ইকোয়েশন কষতে লেগে যাও। গাড়িতে চ’ড়ে ড্রাইভরকে যে ঠিকানা দাও সে ঠিকানায় আজও বাড়ি তৈরি হয় নি। নবীনবাবু মনে করছেন আমি অত্যুক্তি করছি.।” আমি বললুম, “একেবারেই না। কিছুদিন তো ওঁকে দেখছি, তার থেকেই অসন্ধিগ্ধ বুঝেছি, আপনি যা বলছেন তা খাঁটি সত্য।” “আজ এত অলুক্ষণে কথা তোমার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে কেন। জান নবীন, এইরকম যা-তা বলবার উপসর্গ ওর সম্প্রতি দেখা দিয়েছে।” “সব লক্ষণ শান্ত হয়ে যাবে, তুমি চলো দেখি তোমার কাজে। নাড়ি আমার ফিরে আসবে। থামকে প্রলাপ-বকুনি।” অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার কী পরামর্শ নবীন।” উনি পণ্ডিত মানুষ ব’লেই জিয়লজিস্টের বুদ্ধির ’পরে ওঁর এত শ্রদ্ধা। আমি একটুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললুম, “অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।” অচিরা উঠে দাঁড়িয়ে পা ছুঁয়ে আমাকে প্রণাম করলে। আমি সংকুচিত হয়ে পিছু হঠে গেলুম। অচিরা বললে, “সংকোচ করবেন না, আপনার তুলনায় আমি কেউ নই। সে কথাটা একদিন স্পষ্ট হবে। এইখানেই শেষ বিদায় নিলুম। যাবার আগে আর কিন্তু দেখা হবে না।” অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সে কী কথা দিদি।” “দাদু, তুমি অনেক কিছু জানো, কিন্তু অনেক কিছু সম্বন্ধে তোমার চেয়ে আমার বুদ্ধি অনেক বেশি, সবিনয়ে এ কথাটা স্বীকার করে নিয়ো।” আমি পদধূলি নিয়ে প্রণাম করলুম অধ্যাপককে। তিনি আমাকে বুকে আলিঙ্গন ক’রে ধরে বললেন, “আমি জানি সামনে তোমার কীর্তির পথ প্রশস্ত।” এইখানে আমার ছোটো গল্প ফুরল। তার পরেকার কথা জিয়লজিস্টের। বাড়ি ফিরে গিয়ে কাজের নোট এবং রেকর্ডগুলো আবার খুললুম। মনে হঠাৎ খুব একটা আনন্দ জাগল— বুঝলুম একেই বলে মুক্তি। সন্ধ্যাবেলায় দিনের কাজ শেষ ক’রে বারান্দায় এসে বোধ হল— খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছে পাখি, কিন্তু পায়ে আছে এক টুকরো শিকল। নড়তে চড়তে সেটা বাজে। ৪.১০.৩৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬ দাদামশায়, সেদিন তুমি যে আরো-সত্যির কথা বলছিলে, সে কি কেবল পরীস্থানেই দেখা যায়। আমি বললুম, তা নয় গো, এ পৃথিবীতেও তার অভাব নেই। তাকিয়ে দেখলেই হয়। তবে কিনা সেই দেখার চাউনি থাকা চাই। তা, তুমি দেখতে পাও? আমার ঐ গুণটাই আছে, যা না দেখবার তাই হঠাৎ দেখে ফেলি। তুমি যখন বসে বসে ভূগোল-বিবরণ মুখস্থ কর তখন মনে পড়ে যায় আমার ভূগোল পড়া। তোমার ঐ ইয়াংসিকিয়াং নদীর কথা পড়লে চোখের সামনে যে-জ্যোগ্রাফি খুলে যেত তাকে নিয়ে এক্‌জামিন পাস করা চলে না। আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সারি সারি উট চলেছে রেশমের বস্তা নিয়ে। একটা উটের পিঠে আমি পেয়েছিলুম জায়গা। সে
false
shorotchandra
দান করিল, এবং মদের বোতল, মাংস এবং আনুষঙ্গিক আরও একটা বস্তুর গোপন ইঙ্গিত করিয়া এতবড় আশার বাণী শুনাইতেও ইতস্ততঃ করিল না যে, পুরুষের ভাগ্যের সীমা যখন দেবতারাও নির্দেশ করিতে পারেন না, তখন হুজুরের নজরে পড়িলে নন্দীমশায়ের অদৃষ্টেও কেন যে একদিন সদরের নায়েবী পদ মিলিবে না, এমন কথা কেহই জোর করিয়া বলিতে পারে না। অনতিকাল মধ্যেই এককড়ি যখন জনকয়েক লোক, গোটা-দুই আলো এবং সামান্য কিছু ফলমূল সংগ্রহ করিয়া লইয়া বিশ্বম্ভরকে সঙ্গে করিয়া শান্তিকুঞ্জের ভাঙ্গা গেটের সম্মুখে উপস্থিত হইল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। দেখিল ,ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ডালপালা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া পথটাকে চলনসই করা হইয়াছে; তথাপি এই বনময় অন্ধকার পথে সহসা প্রবেশ করিতে বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও ভরসা হইল না। এবং প্রবেশ করিয়াও পা ফেলিতে প্রতিপদেই তাহাদের গা ছমছম করিতে লাগিল। বিঘা-দশেক ভূমি ব্যাপিয়া এই বন, সুতরাং পথও অল্প নহে, তাহা অতিক্রম করিবার দুঃখও অল্প নহে। কোথাও একটা দীপ নাই, কেবল চাতালের একধারে যেখানে বাহকেরা পালকি নামাইয়া রাখিয়া একত্র বসিয়া ধূমপান করিতেছে তাহারই অদূরে একখণ্ড জ্বলন্ত শুষ্ককাষ্ঠ হইতে কতকটা স্থান যৎকিঞ্চিৎ আলোকিত হইয়াছে। খবর পাইয়া ভৃত্য আসিয়া এককড়িকে একটা ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। সমস্ত কক্ষ মদের গন্ধে পরিপূর্ণ, এককোণে মিটমিট করিয়া একটা মোমবাতি জ্বলিতেছে এবং অপরপ্রান্তে একটা ভাঙ্গা তক্তপোশের উপর বিছানা পাতিয়া বীজগাঁয়ের জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী বসিয়া আছেন। লোকটা অত্যন্ত রোগা এবং ফরসা; বয়স অনুমান করা অতিশয় কঠিন, কারণ উপদ্রবে অত্যাচারে মুখখানা শুকাইয়া যেন একেবারে কাঠের মত শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। সম্মুখে সুরাপূর্ণ কাঁচের গেলাস এবং তাহারই পার্শ্বে বিচিত্র আকারের একটা মদের বোতল প্রায় শেষ হইয়াছে। বালিশের তলা হইতে একটা নেপালী কুকরির কিয়দংশ দেখা যাইতেছে এবং তাহারই সন্নিকটে একটা খোলা বাক্সের মধ্যে একজোড়া পিস্তল সাজান রহিয়াছে। এককড়ি ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনিব কহিলেন, তোমার নাম এককড়ি নন্দী? তুমিই এখানকার গোমস্তা? ভয়ে এককড়ির হৃৎপিণ্ড দুলিতেছিল, সে অস্ফুট কম্পিতকন্ঠে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুজুর! সে ভাবিয়া আসিয়াছিল এইবার এই বাড়ির কথা উঠিবে, কিন্তু হুজুর তাহার কোন উল্লেখ করিলেন না, শুধু জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কাছারির তসিল কত? এককড়ি বলিল, আজ্ঞে, প্রায় হাজার-পাঁচেক টাকা। হাজার-পাঁচেক? বেশ আমি দিন-আষ্টেক আছি, তার মধ্যে হাজার-দশেক টাকা চাই। এককড়ি কহিল, যে আজ্ঞে। তাহার মনিব বলিলেন, কাল সকালে তোমার কাছারিতে গিয়ে বসব—বেলা দশটা-এগারোটা হবে—তার পূর্বে আমার ঘুম ভাঙ্গে না। প্রজাদের খবর দিও। এককড়ি সানন্দে মাথা নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে। কারণ ইহা বলা বাহুল্য যে খাজনার অতিরিক্ত টাকা আদায়ের গুরুভারে এককড়ি আপনাকে নিরতিশয় প্রপ্রীড়িত বা বিপন্ন জ্ঞান করে নাই। সে পুলকিত-চিত্তে কহিল, আমি রাত্রের মধ্যেই আজ চতুর্দিকে লোক পাঠিয়ে দেব যেন কেউ না বলতে পারে সে সময়ে খবর পায়নি। জীবানন্দ মাথা হেলাইয়া সম্মতি দান করিলেন, এবং মদের পাত্রটা মুখে তুলিয়া সমস্তটা এক চুমুকে পান করিয়া সেটা ধীরে ধীরে রাখিয়া দিতে দিতে বলিলেন, এককড়ি, তোমাদের এখানে বোধ করি বিলিতী মদের দোকান নেই! তা না থাক, যা আমার সঙ্গে আছে তাতেই এ ক’টা দিন চলে যাবে, কিন্তু মাংস আমার রোজ চাই। এককড়ি প্রস্তুত হইয়াই ছিল, কহিল, এ আর বেশী কথা কি হুজুর, মা চন্ডীর সরেস মহাপ্রসাদ আমি রোজ হুজুরে দিয়ে যাবো। হুজুর খুশী হইয়া কহিলেন, বেশ, বেশ। তার পরে বোতল হইতে কতকটা সুরা পাত্রে ঢালিয়া তাহা পান করিলেন, এবং মুখ মুছিতে মুছিতে বলিলেন, আরও একটা কথা আছে এককড়ি। এককড়ির সাহস বাড়িতেছিল, কহিল, আজ্ঞে করুন? তিনি মুখের মধ্যে গোটা-দুই লবঙ্গ ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, দেখ এককড়ি, আমি বিবাহ করিনি—বোধ হয় কখনো করবও না। এককড়ি মৌন হইয়া রহিল। তখন এই মদ্যপ ভূস্বামী একটা শুষ্কহাস্য করিয়া কহিলেন, কিন্তু তাই বলে আমি ভীষ্মদেব—বলি মহাভারত পড়েচ ত? আর ভীষ্মদেব সেজেও বসিনি—শুকদেব হয়েও উঠিনি—বলি, কথাটা বুঝলে ত এককড়ি? ওটা চাই। এককড়ি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল, মুখ ফুটিয়া জবাব দিতে পারিল না; কিন্তু যে নির্লজ্জ উক্তিতে জমিদারের গোমস্তার পর্যন্ত লজ্জা বোধ হয়, এ কথা যিনি অবলীলাক্রমে উচ্চারণ করিলেন, তিনি ইহা গ্রাহ্যও করিলেন না। কহিলেন, অপর সকলের মত চাকরকে দিয়ে এ-সব কথা বলাতে আমি ভালবাসি নে, তাতে ঠকতে হয়। আচ্ছা, এখন যাও। আমার বেহারাদের খাওয়া-দাওয়ার যোগাড় করে দিও; ওরা তাড়িটা আস্‌টাও বোধ করি খায়। সেদিকেও একটু নজর রেখো। আচ্ছা যাও। এককড়ি মাথা নাড়িয়া সায় দিয়া আর একদফা ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল; হুজুর হঠাৎ ডাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, এ গাঁয়ে দুষ্ট বজ্জাত প্রজা কেউ আছে জানো? এককড়ি ফিরিয়া দাঁড়াইল। এইখানে তাহার অনেকদিনের একটা পুরাতন ক্ষত ছিল—মনিবের প্রশ্নটা ঠিক সেইখানেই আঘাত করিল। কিন্তু বেদনাটাকে সে একটা সংযমের আবরণ দিয়া নিরুৎসুককণ্ঠে কহিল, আজ্ঞে না, তা এমন কেউ—শুধু তারাদাস চক্কোত্তি—তা সে হুজুরের প্রজা নয়। তারাদাসটা কে? এককড়ি কহিল, গড়চণ্ডীর সেবায়েত। এই সেবায়েতদিগের সহিত জমিদারি সংস্পর্শে এককড়ির অনেক কলহ-বিবাদ হইয়া গেছে, কিন্তু সেজন্য তাহার বিশেষ কোন ক্ষোভ ছিল না; কিন্তু বৎসর-দুই পূর্বে একটা পাকা কাঁঠাল গাছ লইয়া যে লড়াই বাধে, সে জ্বালা তাহার যায় নাই। কারণ কাঁঠালের তক্তাগুলা ছিল তাহার নিজের বাটীর জন্য এবং সেই হেতু শেষ পর্যন্ত তাহাকেই নতি স্বীকার করিয়া গোপনে মিটমাট করিয়া লইতে হয়। এককড়ি কহিতে লাগিল, কি করব হুজুর, সদরে আরজি করে সুবিচার পাই নে—দেওয়ানজী গেরাহ্যিই করেন না, নইলে চক্কোত্তিকে
false
shottojit_roy
শহর দেখার উদ্দেশ্যে নয়। পৌনে আটটার সময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম.। দুজন নয়, তিনজন। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গ নিলেন। আমি এর মধ্যে দু-একবার ভদ্রলোককে দুশমন হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই এত হাসি পেল যে বাধ্য হয়ে সেটা মন থেকে দূর করতে হল। সার্কিট হাউসের দিকটা নিরিবিলি আর খোলামেলা হলেও শহরটা গিজগিজে। প্রায় সব জায়গা থেকেই পুরনো পাঁচিলটা দেখা যায়। সেই পাঁচিলের গায়ে দোকানের সারি, টাঙ্গার লাইন, লোকের থাকবার বাড়ি আর আরও কত কী! পাঁচশো বছর আগেকার শহরের চিহ্ন আজকের শহরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমরা এ-দোকান সে-দোকান দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছি। ফেলুদা কিছু একটা খুঁজছে সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝলাম না। লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, হাজরা কীসের ডাক্তার বলুন তো? আজ আবার টেবিলে মিস্টার ট্রটার কী-সব বলছিলেন… ফেলুদা বলল, হাজরা একজন প্যারাসাইকলজিস্ট। প্যারাসাইকলজিস্ট? লালমোহনবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। সাইকলজির আগে যে আবার প্যারা বসে সেটা তো জানতুম না মশাই। টাইফয়েডের আগে বসে সেটা জানি। তার মানে কি হাফ-সাইকলজি–প্যারা-টাইফয়েড যেমন হাফ-টাইফয়েড? ফেলুদা বলল, হাফ নয়, প্যারা মনে হচ্ছে অ্যাবনরম্যাল। মনস্তত্ত্ব ব্যাপারটা এমনই ধোঁয়াটে; তার মধ্যেও আবার যে দিকটা বেশি ধোঁয়াটে, সেটা প্যারাসাইকলজির আন্ডারে পড়ে। আর জাতিস্মরের কথা কী যেন বলছিলেন? মুকুল ইজ এ জাতিস্মর। অন্তত তাই বলা হয় তাকে। লালমোহনবাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেল। আপনি প্লটের অনেক খোরাক পাবেন, ফেলুদা বলল, ছেলেটি পূর্ব জন্মে দেখা একটা সোনার কেল্লার কথা বলে। আর সে নাকি একটা বাড়িতে থাকত। যার মাটিতে গুপ্তধন পোঁতা ছিল। আমরা কি সেই সবের খোঁজে যাচ্ছি নাকি মশাই? লালমোহনবাবুর গলা ঘড়ঘড়ে হয়ে গেছে। আপনি যাচ্ছেন কি না জানি না, তবে আমরা যাচ্ছি। লালমোহনবাবু রাস্তার মাঝখানে দু হাত দিয়ে খপ করে ফেলুদার হাত ধরে ফেলল। মশাই–চানস্ অফ এ লাইফটাইম। আমায় ফেলে ফস করে কোথাও চলে যাবেন না–এইটেই আমার রিকোয়েস্ট। এর পরে কোথায় যাব এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। লালমোহনবাবু কী জানি ভেবে বললেন, মিস্টার ট্রটার কি আপনাদের সঙ্গে যাবেন নাকি? কেন? আপনার আপত্তি আছে? লোকটা পাওয়ারফুলি সাসপিশাস্‌! রাস্তার একধারে একটা জুতোওয়ালা বসেছে, তার চারিদিকে ঘিরে নাগরার ছড়াছড়ি। এখানকার লোকেরা এই ধরনের নাগরাই পরে। ফেলুদা জুতোগুলোর সামনে দাঁড়াল। পাওয়ারফুল তো জানি। সাসপিশাস্‌ কেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। কাল গাড়িতে যেতে যেতে খুব বাক্‌তাল্লা মারছিল! বলে–ট্যাঙ্গানিকায় নাকি নেকড়ে মেরেছে নিজে বন্দুক দিয়ে। অথচ আমি জানি যে, সারা আফ্রিকার কোনও তল্লাটে নেকড়ে জানোয়ারটাই নেই। মার্টিন জনসনের বই পড়েছি আমি–আমার কাছে ধাপ্পা! আপনি কী বললেন?? কী আর বলব? ফস করে মুখের ওপর তো লায়ার বলা যায় না! দুজনের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে বসে আছি। আর লোকটার ছাতি দেখেছেন তো? কমপক্ষে ফাির্টফাইভ ইঞ্চেজ। আর রাস্তার দুধারে দেখচি ইয়া ইয়া মনসার ঝোপড়া-কনট্র্যাডিক্ট করলুম, আর অমনি কোলপাঁজ করে তুলে নিয়ে যদি ওই একটা ঝোপড়ার পেছনে ফেলে দিয়ে চলে যায়-ইন নো টাইম মশাই শকুনির স্কোয়াড্রন এসে ল্যান্ড করে ফিস্টি লাগিয়ে দেবে। আপনার লাশে কটা শকুনের পেট ভরবে বলুন তো। হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ… ফেলুদা ইতিমধ্যে পায়ের স্যান্ডেল খুলে নাগরা পরে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। লালমোহনবাবু বললেন, ভেরি পাওয়ারফুল শুজ–কিনছেন নাকি? একটা পরে দেখুন না, ফেলুদা বলল। ভদ্রলোকের পায়ের মাপের মতো ছাট জুতো অবিশ্যি দোকানে ছিল না, তাও তার মধ্যে যে জোড়াটা সবচেয়ে ছোট, সেটা পরে তিনি প্ৰায় আঁতকে উঠলেন। এ যে গণ্ডারের চামড়া মশাই! এ তো গণ্ডার ছাড়া আর কারুর পায়ে সুট করবে না। তা হলে ধরে নিন রাজস্থানের শতকরা নব্বই ভাগ লোক আসলে গণ্ডার। দুজনেই নাগরা খুলে যে যার জুতো পরে নিল। দাকানদারও হাসছিল। সে বুঝেছে, আমরা এগিয়ে চললাম। একটা পানের দোকান থেকে বেদম জোরে রেডিয়োতে ফিল্মের গানের আওয়াজ বেরোচ্ছে। মনে পড়ে গেল। কলকাতার পুজো-প্যান্ডেলের কথা। এখানে পুজো নেই, আছে। দশের। কিন্তু তার এখনও অনেক দেরি। আরও কিছুদূর এগিয়ে ফেলুদা একটা পাথরের তৈরি জিনিসের দাকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটার চেহারা বেশ ভদ্র, নাম সোলাঙ্কি স্টোর্স। বাইরে কাচের জানালার পিছনে সুন্দর সুন্দর পাথরের ঘটি বাটি গেলাস পাত্ৰ সাজানো রয়েছে। ফেলুদা একদৃষ্টি সেগুলোর দিকে চেয়ে আছে। দোকানদার দরজার মুখটাতে এগিয়ে এসে আমাদের ভিতরে আসতে অনুরোধ করল। ফেলুদা জানালার দিকে দেখিয়ে বলল, ওই বাটিটা একবার দেখতে পারি? দোকানদার জানালার বাটিটা না বার করে ভিতরের একটা আলমারি থেকে ঠিক সেই রকমই একটা বাটি বার করে দিল। সুন্দর হলদে রঙের পাথরের বাটি। আগে কখনও এ রকম জিনিস দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এটা কি এখানকার তৈরি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। দোকানদার বলল, রাজস্থানেরই জিনিস, তবে যোধপুরের নয়। তবে কোথাকার? জয়সলমীর। এই হলদে পাথর শুধু ওখানেই পাওয়া যায়। আই সি… জয়সলমীর নামটা আমি আবছা শুনেছি। জায়গাটা যে রাজস্থানের ঠিক কোনখানে সেটা আমার জানা ছিল না। ফেলুদা বাটিটা কিনে নিল। সাড়ে নটা নাগাত টাঙ্গার ঝাঁকুনি খেয়ে সকালের ডিম-রুটি হজম করে আমরা সার্কিট হাউসে ফিরলাম। মন্দার বোস বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাদের হাতে প্যাকেট দেখে বললেন, কী, কিনলেন? ফেলুদা বলল, একটা বাটি। রাজস্থানের একটা মেমেন্টো রাখতে হবে তো। আপনার বন্ধু তো বেরোলেন দেখলাম। কে, ডক্টর হাজরা? নটা নাগাত বেরিয়ে যেতে দেখলাম একটা ট্যাক্সি করে। আর মুকুল? সঙ্গেই গেছে। বাধ হয় পুলিশে রিপোর্ট করতে গেছেন। কালকের
false
shomresh
খুলতে খুলতে পরিতোষকে বলতে শুনল অনি, ও বড়দি, আজ তোমার হাতের রান্না খাব। হেমলতা কোনো উত্তর দিলেন না। পরিতোষ কান পেতে উত্তরটা শোনার চেষ্টা করে না পেয়ে যেন খুশি হল। অনি দেখল জ্যাঠামশাই জেঠিমার দিকে একটা চোখ কুঁচকে হাসলেন। জামাটা খুলতেই অনির চোখ বড় হয়ে গেল। জ্যাঠামশাইয়ের গেঞ্জিটা ছিঁড়ে ফেটে একাকার। দু এক জায়গায় সেলাই করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পিসিমা বলেন গেঞ্জি সেলাই করে পরলে লক্ষ্মী চলে যায়। জ্যাঠামশাই কী করে ওটা পরেন। জ্যাঠামশাই পায়ের ওপর পা দিয়ে বললেন, দিদির রান্না কোনোদিন খাওনি তো, আহা, মাইরি তোমরা রাঁধতে জান না। জেঠিমা খিঁচিয়ে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, রান্না করার মতো জিনিস কোনোদিন এনেছ যে রাঁধব। শুনলে গা জ্বলে যায়। হঠাৎ জ্যাঠামশাই বলে উঠলেন, যাও না, দিদিকে একটু সাহায্য করো। একা একা বাঁধছেন, দুই-একটা পদ তৈরি করে নিজের কৃতিত্ব দেখাও। জেঠিমা হতচকিত হয়ে বোধহয় রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন, এমন সময় পিসিমার গলা ভেসে এলে, কাউকে আসতে হবে না। রাস্তার কাপড়ে এ-বাড়িতে কেউ রান্নাঘরে ঢোকে না। বাথরুমে জল আছে, বাচ্চাটাকে একবারে স্নান করিয়ে দিতে বল। ভদ্রলোকের মতন দেখতে হোক। কথাটা শুনে জেঠিমার মুখ বেঁকে যেতে দেখল অনি। জ্যাঠামশাই চট করে উঠে দাঁড়ালেন, সেই ভালো, যাও, মন দিয়ে সাবান মেখে স্নান করে নাও। আমি বরংছোঁড়াটার কাছ থেকে লেটেস্ট খবর নিই গে। জ্যাঠামশাইকে এদিকওদিকে তাকাতে দেখে অনি চুট করে বাগানের ভিতরে চলে গেল। ইদানীং ঝোপঝাড় বেশি হয়ে গেছে বলে সরিৎশেখর লোক লাগিয়ে বাগান সাফ করার কথা বলেন। লোক পাওয়া আজকাল মুশকিল বলেই এখনও পরিষ্কার হয়নি। অনি এই সুযোগটাকে কাজে লাগাল। জ্যাঠামশায়ের মুখোমুখি হতে ওর একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। লোকটাকে অত্যন্ত বদ মনে হচ্ছে ওর। খেতে বসে অবাক হয়ে গিয়েছিল অনি। একটা লোক এত ভাত খেতে পারে? একসঙ্গে খেতে চায়নি ও, পিসিমা তাগাদা দিয়ে স্নান করিয়ে বসিয়েছেন। বাচ্চাটার খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল। তাকে বড়ঘরের মেঝেতে বিছানা করে ঘুম পাড়িয়ে আসা হয়েছে। পরিতোষ স্নান করে সরিৎশেখরের একখানা ধুতি লুঙ্গির মতন জড়িয়েছে। হেমলতা এতক্ষণ সেটা লক্ষ করেননি। অনির বারংবার তাকানো দেখে বুঝতে পারলেন, তুই বাবার ধুতি পরেছিস? পরিতোষ খেতে-খেতে বলল, সিম্পল রান্না অথচ কী টেস্ট, আহা! হ্যাঁ, কী বললে? ধূতি? আমার পায়জামার চেহারা দেখেছ তুমি কোনোদিন কম পাজামা আমাকে পরতে দেখেছ। দিস ইজ লাইফ। বুঝলে! খেয়ে উঠে ধুতি ছেড়ে রাখবি। একেই তোদের ঢুকতে দিয়েছি বলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি, তারপর যদি এসব জানতে পারে–কথাটা শেষ করলেন না হেমলতা। পরিতোষ দিদির দিকে তাকাল, মাইরি দিদি, এটা কি মুসলমানদের তালাক যে ত্যজ্যপুত্র বললাম আর সমস্ত সম্পর্ক চুকে গেল? তুমি বুকে হাতে দিয়ে বলো তো, আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে কষ্ট হয় না? হেমলতা একবার অনির দিকে তাকিয়ে বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললেন, কিন্তু বাবা বলেন যে দুষ্ট ক্ষত হতে হলে সেটা বাড়তে না দিয়ে যদি হাতটা কেটে ফেলতে হয় তা-ই ভালো, শরীর বাঁচে। অদ্ভুতভাবে হাসল পরিতোষ। তারপর বলল, আর-একটু ভাত দেবে? কম পড়বে না তো? হেমলতা ভেতর থেকে ভাত এনে দিতে পরিতোষ বলল, ব্যাপারটা কী জান, তোমরা চিরকাল হাতটা কেটে ফেলার কথাই ভেবেছ, ওষুধ দিয়ে হাতটা সারিয়ে তোলার কোনো চেষ্টাই করনি। তুমি কি ভেবেছ আমি পাষাণ? আমার মনের মধ্যে তোমাদের কথা আসে না? আমরা সব ভুলে যেতে পারি, কিন্তু ছেলেবেলার কথা কি ভুলে যেতে পারি। হেমলতা বললেন, এসব কথা এখন থাক। জ্যাঠামশাই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, জেঠিমা বলে উঠলেন, দিদি যখন বলছেন, তখন আর কথা বাড়াচ্ছ কেন? জেঠিমা স্নান করেছেন, কিন্তু সেই আগের কাপড়ই তার পরনে। কথাটা সঙ্গে সঙ্গে যেন মেনে নিলে জ্যাঠামশাই, ঠিক আছে, থাক। আমাকে আর-একটু আমড়ার টক দাও। খাওয়াদাওয়ার পর অনি নিজের ঘরে চলে এল। এখন জ্যাঠামশাইকে অনেকটা জানা হয়ে গেছে। মুখ-হাত ধোওয়ার সময় জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যে ওঁরা হলদিবাড়িতে আছেন এখন। দাদু যে-ট্রেনে শিলিগুড়ি থেকে আসবেন তাতেই ওদের উঠতে হবে যদি যেতে হয়। না হলে কাল সকালে। ট্রেন আছে-রাতটা থেকে যেতে হয়। পিসিমা সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, সে-চিন্তা যেন ঘুণাক্ষরে মাথায় না আসে, বিকেলের অনেক আগেই ওদের চলে যেতে হবে। কথাটা শোনার পর থেকে অনি ভাবছিল স্টেশনে যদি মুখোমুখি দেখা হয় তা হরে দাদু ওদের চিনতে পারবেন কি না। জ্যাঠামশাইয়ের চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, দাড়ি রেখেছেন, তবু দাদু ঠিক চিনে ফেলবেন। কিন্তু তারপর কী হবে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনি এইসব ভাবছে, তখন দরজা খুলে পরিতোষ মাথা বাড়াল, বাঃ, বেশ ঘটা তো! অনি তড়াক করে উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল, পড়াশুনা কেমন হচ্ছে। কোনোরকমে অনি বলল, ভালো। খারাপ হবার কথা নয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ বাবা-আমার ছেলেটাকে দেখেছ। পেট পুরে খাবার দিতেই পারি না তো-পড়াশুনা করাব-সত্মা কেমন চিজ শহরের মেয়ে তো? অনির একটা পেনসিল টেবিল থেকেই তুলে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে জ্যাঠামশাই এমনভাকেকথা বলে যাচ্ছিল যে অনি ঠিক তাল রাখতে পারছিল না। শেষের কথাটা না ধরে অনি বলল, সত্য। জ্যাঠামশাই বলল, আরে তোমার বাবা বিয়ে করেনি? আমি শালা চিন্তাই করতে পারি না, এত বড় ছেলে যার সে কী করে বিয়ে করে-তা বাবার এই বউ তোমার সত্য হল না? তুমি কী বলে ডাক? ছোটমা।
false
robindronath
নিতান্ত ভীরু ছিল না, অল্পক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া অবশেষে একপ্রকার বাহ্যিক সাহস ও মৌখিক উপহাসের স্বরে কহিল, “তুই কোথা হইতে মাগী। তোর মরণ নাই নাকি।” রুক্মিণী কট্‌মট্‌ করিয়া খানিকক্ষণ সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল– তখন সীতারামের প্রাণটা তাহার কণ্ঠের কাছে আসিয়া ধুক্‌ ধুক্‌ করিতে লাগিল। অবশেষে রুক্মিণী সহসা বলিয়া উঠিল, “বটে। তোদের এখনও সর্বনাশ হইল না, আর আমি মরিব!” উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া কহিল, “যমের দুয়ার হইতে ফিরিয়া আসিলাম। আগে তোকে আর যুবরাজকে চুলায় শুয়াইব, তোদের চুলা হইতে দু মুঠা ছাই লইয়া গায়ে মাখিয়া দেহ সার্থক করিব– তার পরে যমের সাধ মিটাইব। তাহার আগে যমালয়ে আমার ঠাঁই নাই।” রুক্মিণীর গলা শুনিয়া সীতারামের অত্যন্ত সাহস হইল। সে সহসা অত্যন্ত অনুরাগ দেখাইয়া রুক্মিণীর সহিত ভাব করিয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। খুব যে কাছে ঘেঁষিয়া গেল তাহা নহে, অপেক্ষাকৃত কাছে আসিয়া কোমল স্বরে কহিল, “মাইরি ভাই, ওইজন্যই তো রাগ ধরে। তোমার কখন যে কী মতি হয়, ভালো বুঝতে পারি না। বল্‌ তো মঙ্গলা, আমি তোর কী করেছি। অধীনের প্রতি এত অপ্রসন্ন কেন? মান করেছিস বুঝি ভাই? সেই গানটা গাব?” সীতারাম যতই অনুরাগের ভান করিতে লাগিল, রুক্মিণী ততই ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার আপাদমস্তক রাগে জ্বলিতে লাগিল– সীতারাম যদি তাহার নিজের মাথার চুল হইত, তবে তাহা দুই হাতে পট্‌পট্‌ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতে পারিত। সীতারাম যদি তাহার নিজের চোখ হইত, তবে তৎক্ষণাৎ তাহা নখ দিয়া উপড়াইয়া পা দিয়া দলিয়া ফেলিতে পারিত। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল কিছুই হাতের কাছে পাইল না। দাঁতে দাঁতে লাগাইয়া কহিল, “একটু রোসো; তোমার মুণ্ডপাত করিতেছি।” বলিয়া থর্‌থর্‌ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বঁটির অন্বেষণে পাশের ঘরে চলিয়া গেল। এই কিছুক্ষণ হইল– সীতারাম গলায় চাদর বাঁধিয়া রূপক অলংকারে মরিবার প্রস্তাব উত্থাপিত করিয়াছিল, কিন্তু রুক্মিণীর চেহারা দেখিয়া তাহার রূপক ঘুরিয়া গেল এবং চৈতন্য হইল যে সত্যকার বঁটির আঘাতে মরিতে এখনো সে প্রস্তুত হইতে পারে নাই, এই নিমিত্ত অবসর বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ কুটিরের বাহিরে সরিয়া পড়িল। রুক্মিণী বঁটিহস্তে শূন্যগৃহে আসিয়া ঘরের মেজেতে সীতারামের উদ্দেশে বার বার আঘাত করিল। রুক্মিণী এখন মরিয়া হইয়াছে। যুবরাজের আচরণে তাহার দুরাশা একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে– তাহার সমস্ত উপায় সমস্ত উদ্দেশ্য একেবারে ভূমিসাৎ হইয়াছে। এখন রুক্মিণীর আর সেই তীক্ষ্ণশাণিত হাস্য নাই, বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নাই, তাহার সেই ভাদ্র মাসের জাহ্নবীর ঢলঢল তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস নাই– রাজবাটীর যে-সকল ভৃত্যেরা তাহার কাছে আসিত, তাহাদের সহিত ঝগড়া করিয়া তাহাদিগকে গালাগালি দিয়া ভাগাইয়া দিয়াছে। দেওয়ানজির জ্যেষ্ঠ পুত্রটি সেদিন পান চিবাইতে চিবাইতে তাহার সহিত রসিকতা করিতে আসিয়াছিল, রুক্মিণী তাহাকে ঝাঁটাইয়া তাড়াইয়াছে। এখন আর কেহ তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারে না। পাড়ার সকলেই তাহাকে ভয় করে। সীতারাম কুটির হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ভাবিল, মঙ্গলা যুবরাজের পলায়ন-বৃত্তান্ত সমস্তই অবগত হইয়াছে; অতএব ইহার দ্বারাই সব ফাঁস হইবে। সর্বনাশীকে গলা টিপিয়া মারিয়া আসিলাম না কেন। যাহা হউক, আমার আর যশোহরে একমুহূর্ত থাকা শ্রেয় নয়। আমি এখনই পালাই। সেই রাত্রেই সীতারাম সপরিবারে যশোহর ছাড়িয়া রায়গড়ে পলাইল। শেষরাত্রে মেঘ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল, আগুনও ক্রমে নিবিয়া গেল, যুবরাজের মৃত্যুর জনরব প্রতাপাদিত্যের কানে গেল। শুনিয়া তৎক্ষণাৎ প্রতাপাদিত্য বহির্দেশে তাঁহার সভাভবনে আসিয়া বসিলেন। প্রহরীদের ডাকাইয়া আনিলেন, মন্ত্রী আসিল, আর দুই-একজন সভাসদ আসিল। একজন সাক্ষ্য দিল, যখন আগুন ধু ধু করিয়া জ্বলিতেছিল, তখন সে যুবরাজকে জানালার মধ্য হইতে দেখিয়াছে। আর-কয়েকজন কহিল, তাহারা যুবরাজের চীৎকার শুনিতে পাইয়াছিল। আর-একজন যুবরাজের গৃহ হইতে তাঁহার গলিত দগ্ধ তলোয়ারের অবশিষ্টাংশ আনিয়া উপস্থিত করিল। প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুড়া কোথায়?” রাজবাটী অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া পাইল না। কেহ কহিল, “যখন আগুন লাগিয়াছিল, তখন তিনিও কারাগারে ছিলেন।” কেহ কহিল, “না, রাত্রেই তিনি সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, গৃহদাহে যুবরাজের মৃত্যু হইয়াছে ও তাহা শুনিয়াই তিনি তৎক্ষণাৎ যশোর ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।” প্রতাপাদিত্য এইরূপ যখন সভায় বসিয়া সকলের সাক্ষ্য শুনিতেছেন, এমন সময়ে গৃহদ্বারে এক কলরব উঠিল। একজন স্ত্রীলোক ঘরে প্রবেশ করিতে চায়, কিন্তু প্রহরীরা তাহাকে নিষেধ করিতেছে। শুনিয়া প্রতাপাদিত্য তাহাকে ঘরে লইয়া আসিতে আদেশ করিলেন। একজন প্রহরী রুক্মিণীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কী চাও?” সে হাত নাড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “আমি আর কিছু চাই না– তোমার ওই প্রহরীদিগকে, সকলকে একে একে ছয় মাস গারদে পচাইয়া ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াও, এই আমি দেখিতে চাই। ওরা কি তোমাকে মানে, না তোমাকে ভয় করে!” এই কথা শুনিয়া প্রহরীরা চারিদিক হইতে গোল করিয়া উঠিল। রুক্মিণী পিছন ফিরিয়া চোখ পাকাইয়া তীব্র এক ধমক দিয়া কহিল, “চুপ কর মিন্‌সেরা। কাল যখন তোদের হাতে-পায়ে ধরিয়া, পই পই করিয়া বলিলাম, ওগো তোমাদের যুবরাজ তোমদের রায়গড়ের বুড়া রাজার সঙ্গে পালায়, তখন যে তোরা পোড়ারমুখোরা আমার কথায় কান দিলি নে? রাজার বাড়ি চাকরি কর, তোমাদের বড়ো অহংকার হইয়াছে, তোমারা সাপের পাঁচ পা দেখিয়াছ! পিঁপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “যাহা যাহা ঘটিয়াছে সমস্ত বলো।” রুক্মিণী কহিল, “বলিব আর কী। তোমাদের যুবরাজ কাল রাত্রে বুড়া রাজার সঙ্গে পলাইয়াছে!” প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঘরে কে আগুন দিয়াছে জান?” রুক্মিণী কহিল, “আমি আর জানি না! সেই যে তোমাদের সীতারাম। তোমাদের যুবরাজের সঙ্গে যে তার বড়ো পিরিত, আর কেউ যেন তাঁর কেউ নয় সীতারামই যেন তাঁর সব। এ-সমস্ত সেই সীতারামের কাজ। বুড়া রাজা, সীতারাম আর তোমাদের যুবরাজ,
false
shordindu
পদ পড়িয়া গিয়াছে, সেকাল মিলনোৎকণ্ঠিত নবযৌবনা নাগরী যখন সন্ধ্যাসমাগমে ভবনশীর্ষে উঠিয়া কেশপ্রসাধনে প্রবৃত্ত হইতেন, তখন তাঁহার স্বর্ণমুকুরে যে উৎফুল্ল-উৎসুক স্মিত-সলজ্জ মুখের প্রতিবিম্ব পড়িত, তাহা এ কালেও আমরা সহজে অনুমান করিতে পারি। চিরন্তনী নারীর ঐ মূর্তিটিই শুধু শাশ্বত-যুগে যুগান্তরে অচপল হইয়া আছে। কেবলমাত্র ঐ নিদর্শন দ্বারাই তাঁহাকে সেই নারী বলিয়া চিনিয়া লইতে পারি। কিন্তু অন্য বিষয়ে—? সে যাক। প্রসাধনরতা সুন্দরীর দ্রুত অধীর হস্তে গজদন্ত-কঙ্কতিকা কেশ কর্ষণ করিয়া চলিতে থাকে। ক্ৰমে দুটি একটি উন্মুলিত কেশ কঙ্কতিকায় জড়াইয়া যায়; প্রসাধনশেষে সুন্দরী কঙ্কতিকা হইতে বিচ্ছিন্ন কেশগুচ্ছ মুক্ত করিয়া অন্যমনে দুই চম্পক-অঙ্গুলীর দ্বারা গ্ৰন্থি পাকাইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। ক্ষুদ্র কেশগ্রন্থি অবহেলার লক্ষ্যহীন বায়ুভরে উড়িয়া কোন বিস্মৃতির উপকূলে বিলীন হইয়া যায়, কে তাহার সন্ধান রাখে? তেমনই, বহু বহু শতাব্দী পূর্বে একদা কয়েকটি মানুষের জীবন-সূত্র যেভাবে গ্রন্থি পাকাইয়া গিয়াছিল, ইতিহাস তাহার সন্ধান রাখে না। মহাকালভুজগের যে বক্ষচিহ্ন একদিন ধরিত্রীর উপর অঙ্কিত হইয়াছিল, তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে। মৃন্ময়ী চিরনবীনা, বৃদ্ধ অতীতের ভোগ-লাঞ্ছন সে চিরদিন বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিতে ভালবাসে না। নিত্য নব নব নাগরের গৃহে তাহার অভিসার। হায় বহুভতুকা, তোমার প্রেম এত চপল বলিয়াই কি তুমি চিরযৌবনময়ী? দুই সহস্ৰ বৎসরেরও অধিক কাল হইল, যে কয়টি স্বল্পায়ু নর-নারীর জীবনসূত্র সুন্দরীর কুটিল কেশকুণ্ডলীর মতো জড়াইয়া গিয়াছিল, তাহদের কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি। লিখিতে বসিয়া একটা বড় বিস্ময় জাগিতেছে। জন্মজন্মান্তরের জীবন তো আমার নখদপণে, সহস্ৰ জন্মের ব্যথা-বেদনা আনন্দের ইতিহাস তো এই জাতিস্মরের মস্তিষ্কের মধ্যে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে, তবু যতই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমার বিগত জীবনের আলোচনা করি না কেন, দেখিতে পাই, কোনও না কোনও নারীকে কেন্দ্ৰ করিয়া আমার জীবন আবর্তিত হইয়াছে; জীবনে যখনই কোনও বৃহৎ ঘটনা ঘটিয়াছে, তখনই তাহা এক নারীর জীবনের সঙ্গে জড়াইয়া গিয়াছে। নারীদ্বেষক হইয়া জন্মিায়াছি, কিন্তু তবু নারীকে এড়াইতে পারি নাই। বিস্ময়ের সহিত মনে প্রশ্ন জাগিতেছে—পৃথিবীর শত কোটি মানুষের জীবন কি আমারই মতো? ইহাই কি জীবনের অমোঘ অলঙ্ঘনীয় রীতি? কিংবা-আমি একটা সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম? ন্যুনাধিক চব্বিশ শতাব্দী পূর্বের কথা। বুদ্ধ তথাগত প্রায় শতাধিক বর্ষ হইল নির্বাণ লাভ করিয়াছেন। উত্তর ভারতে চারিটি রাজ্য—কাশী কোশল লিচ্ছবি ও মগধ। চারিটি রাজ্যের মধ্যে বংশানুক্রমে অহি-নকুলের সম্বন্ধ স্থায়িভাব ধারণ করিয়াছে। পাটলিপুত্রের সিংহাসনে শিশুনাগবংশীয় এক অশ্রুতকীর্তি রাজা অধিরূঢ়। শিশুনাগবংশের ইতিবৃত্ত পুরাণে আদ্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে লিপিবদ্ধ হইতে পায় নাই, তশত্রুর পর হইতে কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তাহার কারণ, অমিতবিক্রম অজাতশত্রুর পর হইতে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের অভু্যদয় পর্যন্ত মগধে এক প্রকার রাষ্ট্রীয় বিপ্লব চলিয়াছিল। পিতাকে হত্যা করিয়া রাজ্য অধিকার করা শিশুনাগরাজবংশের একটা বৈশিষ্ট্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, বিপুল রাজপরিবারের মধ্যে সিংহাসনের জন্য হানাহানি অন্তর্বিবাদ সহজ ও প্রকৃতিসিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। বংশের একজন শক্তিশালী ব্যক্তি রাজাকে বিতাড়িত করিয়া নিজে সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন, ইহার কিছুকাল পরে পূর্ববর্তী রাজা শক্তি সংগ্ৰহ করিয়া আবার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করিলেন—এইভাবে ধারাবাহিক শাসন-পারম্পর্য নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। বলা বাহুল্য, প্রজারাও সুখে ছিল না। তাহারা মাঝে মাঝে মাৎস্যন্যায় করিয়া রাজাকে মারিয়া আর একজনকে তাহার স্থানে বসাইয়া দিত। সেকালে প্রকৃতিপুঞ্জের সহিষ্ণুতা আধুনিক কালের মতো এমন সর্বংসহা হইয়া উঠিতে পারে নাই, প্রয়োজন হইলে ধৈর্যের শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া যাইত। তখন শ্ৰীমন্মহারাজের শোণিতে পথের ধূলি নিবারিত হইত, তাঁহার জঠর-নিষ্কাশিত অন্ত্র দ্বারা রাজপুরী পরিবেষ্টিত করিয়া জিঘাংসু বিদ্রোহীর দল প্রতিহিংসা চরিতার্থকরিত। সে যাক। পুরাণে শিশুনাগবংশীয় মহারাজ চণ্ডের নাম পাওয়া যায় না। চণ্ডের প্রকৃত নাম কি ছিল তাহাও লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। মহিষের মতো আকৃতির মধ্যে রাক্ষসের মতো প্রকৃতি লইয়া ইনি। কয়েক বৎসর মগধে রাজত্ব করিয়াছিলেন। তার পর—কিন্তু সে পরের কথা। রাজ-অবরোধে এক দাসী একটি কন্যা প্রসব করিয়াছিল। অবশ্য মহারাজ চণ্ডই কন্যার পিতা; সুতরাং সভাপণ্ডিত নবজাত কন্যার কোষ্ঠী তৈয়ার করিলেন। কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিত বলিলেন—শ্ৰীমন, এই কন্যা অতিশয় কুলক্ষণা, প্রিয়জনের অনিষ্টকারিণী—সাক্ষাৎ বিষকন্যা। ইহাকে বর্জন করুন। সিংহাসনে আসীন মহারাজের বন্ধুর ললাটে ভীষণ ভ্রূকুটি দেখা দিল; পণ্ডিত অন্তরে কম্পিত হইলেন। স্পষ্ট কথা মহারাজ ভালবাসেন না; স্পষ্ট কথা বলিয়া অদ্যই সচিব শিবমিশ্রেীর যে দশা হইয়াছে, তাহা সকলেই জানে। পণ্ডিত স্থলিত বচনে বলিলেন—মহারাজ, আপনার কল্যাণের জন্যই বলিতেছি, এ কন্যা বর্জনীয়া। কিন্তু মহারাজের ভ্রূকুটি শিথিল হইল না। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—কোন প্রিয়জনের অধিক অনিষ্ট হওয়া সম্ভব? পণ্ডিত পুনরায় কোষ্ঠী দেখিলেন, তারপরে ভয়ে ভয়ে বলিলেন—উপস্থিত পিতা-মাতা সকলেরই অনিষ্ট-সম্ভাবনা রহিয়াছে। মঙ্গল সপ্তমে ও শনি অষ্টমে থাকিয়া পিতৃস্থানে পূর্ণদৃষ্টি করিতেছে। কে কোথায় দৃষ্টি করিতেছে তাহা জানিবার কৌতূহল মহারাজের ছিল না। তাঁহার মুখে স্ফরিত-বিদ্যুৎ বৈশাখী মেঘ ঘনাইয়া আসিল। মহারাজের সাম্যদৃষ্টির সম্মুখে অপরাধী ও নিরপরাধের প্রভেদ নাই—অশুভ বা অপ্রীতিকর কথা যে উচ্চারণ করে সেই দণ্ডাহঁ। এ ক্ষেত্রে শনি-মঙ্গলের পাপদৃষ্টির ফল যে জ্যোতিষাচার্যের শিরে বর্ষিত হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? পণ্ডিত প্ৰমাদ গণিলেন। সভা-বিদূষক বটুকভট্ট সিংহাসনের পাশে বসিয়াছিল। সে খর্বকায় বামন, মস্তকটি বৃহদাকার, কণ্ঠস্বর এরূপ তীক্ষ্ণ যে, মনে হয় কর্ণের পটহ ভেদ করিয়া যাইবে। পণ্ডিতের দুরবস্থা দেখিয়া সে সূচ্যগ্রসূক্ষ্ম কণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, বলিল—বিষকন্যা! তবে তো ভালই হইয়াছে, মহারাজ! এই দাসীপুত্রীকে সযত্নে পালন করুন। কালে যৌবনবতী হইলে ইহাকে নগর-নটির পদে অভিষিক্ত করিবেন। আপনার দুষ্ট প্রজারা অচিরাৎ যম-মন্দিরে প্রস্থান করিবে। বটুকভট্টকে রাজ-পাৰ্ষদ সকলেই ভালবাসিত, শুধু তাহার বিদূষণ-চাতুর্যের জন্য নয়, বহুবার বহু বিপন্ন সভাসদকে সে রাজরোষ হইতে উদ্ধার করিয়াছিল। তাহার কথায় মহারাজের ভ্রূগ্রন্থি ঈষৎ উন্মোচিত হইল, তিনি বামহস্তে বটুকের কেশমুষ্টি ধরিয়া তাহাকে শূন্যে তুলিয়া ধরিলেন। সূত্রাগ্রে
false
shunil_gongopaddhay
অনেকেই উপস্থিত। গতকালের বিবাহ বাসরের নানান ঘটনার উল্লেখ করে ওরা খুব আমোদ করতে লাগলো। গঙ্গানারায়ণ সুরা পান করে না। সেইজন্য বন্ধুদের জন্য সে সুরার কোনো বন্দোবস্ত রাখেনি। কিন্তু রাজনারায়ণ ছটফট করছে। ইদানীং রাজনারায়ণ প্ৰায় মধুরই মত অতি সুরাপায়ী হয়ে উঠেছে। সে আগেই খানিকটা পান করে এসেছে, তাই বারবার বলছে, গেলাস কোতায়? ব্র্যাণ্ডি কোতায়? শুদু মুখে কি গপ্পো হয়? তোরাও যামন! এই গঙ্গা, তোর বাপের ভাঁড়ার থেকে দু পাঁচ বোতল ব্র্যাণ্ডি নিয়ে আয় না! কথা ঘোরাবার জন্য গঙ্গানারায়ণ প্রশ্ন করলো, হাঁ রে, মধু কোথায় রে! সে এলো না? সে কালও আসেনি। রাজনারায়ণ ঠোঁট উল্টে বললো, মধু গোল্লায় গেছে! কেন বাওয়া, মধু আসেনি বলে কি আমাদের ব্র্যাণ্ডি দেওয়া হবে না? গঙ্গানারায়ণ অন্যদের দিকে ফিরে ঈষৎ দুঃখিত স্বরে বললো, মধুকে এত করে আমি বলে এইচিলাম, তবু সে এলো না? বেণী বললো, মধুর কতা এখন আর নাই বা শুনলি! শুভ কাজের মধ্যে আবার অশুভ জিনিস টেনে আনা কেন? গঙ্গানারায়ণ ক্ষুব্ধ হলো। নানা রকম বয়াটোপনা করলেও দুরন্ত স্বভাবের মধুকে সে ভালোবাসে। মধু যে কবি, সে বায়রন-মিল্টনের সমগোত্রীয়, সেইজন্য অনেক কিছুই তাকে মানায়। বেণী মধুকে পছন্দ করে না, সব সময় টক্কর লড়তে চায়, তা গঙ্গানারায়ণ জানে। মধুর নাম উঠতেই অন্যরা যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেছে মনে হলো। আবার নতুন কী কাণ্ড করেছে মধু? একমাত্র গৌরদাসকে প্রশ্ন করলেই ঠিক জানা যাবে, গৌরদাস মধুর প্রাণের দোসর এবং সে অযথা মিথ্যে ভাষণ করে না। —গৌর, মধুর কী হয়েচে রে? গৌরের ফর্সা মুখখানিতে স্নান ছায়া। সে অন্যমনস্ক। খুব আস্তে আস্তে থেমে থেমে সে বললো, তোকে কাল ইচ্ছে করেই খবরটা দিইনি, গঙ্গা! মধু বাড়ি থেকে পালিয়েচে। মধু খৃষ্টান হবার জন্য পাদ্রীদের কাচে গিয়ে লুকিয়েচে! রাজনারায়ণ জড়িত কণ্ঠে বললো, যে সে পাদ্রী নয় বাবা! একেবারে লাট পাদ্রী। লর্ড বিশপ যাঁকে বলে। তিনি আবার মধুকে ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে ঠাসে রেখেচোন। আর কেল্লার কত্তা ব্রিগেডিয়ার পৌনি নিজে পাহারা দিচ্চেন মধুকে! এবার মধু গেল, তাকে আর পাবি না কোনোদিন! গঙ্গানারায়ণ বললো, কেল্লার মধ্যে? বলিস কী? বঙ্কু বললো, মধুর বাবা লাঠিয়াল পাইক আনিয়েচেন যে,। পুলিসের হাত থেকে মধুকে তিনি কেড়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেল্লার গোরাদের সঙ্গে তো আর তিনি লড়াই দিতে পারবেন না। স্বয়ং সেনাপতির তীবে রয়েচে সে। মধু নিজেই এই ফন্দী এটে বাপের ওপর এক হাত নিয়েচে! —মধুকে জোর করে সেখানে ধরে রাখেনি তো? ভূদেব গম্ভীর স্বরে বললো, না, আমি আর গৌর দেখা করতে গোসলাম মধুর সঙ্গে। –তারপর? –আমার সঙ্গে অবশ্য সে দেখা করে নাই। সে নিজেই অনিচ্ছা প্ৰকাশ করেছিল, না পাদ্রীরাই আমাদের ভাগিয়ে দিল, তা জানি না। পরে গৌর একবার এক গেসলো, ওর সঙ্গে দেখা হয়েচে। গঙ্গানারায়ণ গৌরের দিকে তাকালো। গৌর নিশ্চয় মধুর সমস্ত গোপন কথা জানে। মধু গৌরের সঙ্গে দেখা করবে না, এ কখনো হতেই পারে না। ভূদেব সঙ্গে গিয়েছিল বলেই বোধহয় মধু আগের দিন ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে দেখা করেনি। গোঁড়া নীতিবাগিশ, ভূদেবকে বন্ধুরা অনেকেই ডরায়। গৌর বললো, আমার সঙ্গে দেখা হয়েচে বটে, কিন্তু আমাকে সে বিশেষ কথা বলতেই দেয়নি। নিজের উচ্ছ্বাসেই সে ডগোমগো। আমি একবার শুধু কইলাম, মধু, তুই বাপ মায়ের মনে এমন দুঃখও দিতে পারলি? তোর মা যে মূচ্ছিতা হয়ে রয়েচেন, অন্ন-জল ত্যাগ করেচেন, তাতে মধু আমার ওষ্ঠে আঙুল দিয়ে বললো, চুপ চুপ, ওসব কথা কোস না এখন! আমার মন অ্যাখুন। পরমপিতার পায়ে আশ্রয় নেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আচে। এই উপলক্ষে আমি একটা হিম রচেঁচি সেটা বরং তোকে শোনাই। তোর্কে না শোনানো পর্যন্ত আমার তৃপ্তি নেই! ভাই, তারপর মধু যে পদ্যটা পড়ে শোনালো, মধুর লেখা অত খারাপ। ইংরেজি পদ্য আমি কখনো পড়িনি বা শুনিনি! সে একেবারে ভক্তিতে জ্যাবজেবে আর আমাদের ধম্মো যে কত খারাপ, সেই কতা। গঙ্গানারায়ণ বললো, কিন্তু মধুর মুখে এমন খৃষ্টভক্তির কথা তো আগে কখনো শুনিনি! বরং থিয়োডোর পাকারের বই পড়ার পর তার মধ্যে একটু নাস্তিক নাস্তিক ভোবই দেকোঁচলুম। বেণী বললো, আরো মধু কেরেস্তান হচ্চে কি আর শুধু ভক্তিতে? এর মধ্যে অন্য কোনো মতলব আচে। ও তো এক পা বিলেতের দিকে বাড়িয়েই ছেল, এবার পাদ্রীরা ওকে বিলেতে পাঠাবে। গঙ্গানারায়ণ বললো, মধুকে বাড়ি থেকে পালাবার এই বুদ্ধি দিল কে? কৃষ্ণমোহন বাড়ুজ্যেই নিশ্চয়ই ওর কানে মন্তোর দিয়েচেন। বঙ্কু বললো, এই ক্যাটি কেষ্টর জ্বালায় আর পারা গেল না। নিজে তো জাত খুইয়েচেই, আবার কচি কচি ছেলেদের ধরে ধরে কেরেস্তান করাচ্চে! সাহেবদের পা-চাটা নচ্ছার কোথাকার! ভূদেব বললো, শুধু শুধু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের দোষ দিও না। তিনি নিজ বিশ্বাস লয়ে আছেন। মধুর বাবা তেনাকে চেপে ধরায় তিনি তো সাফ বলে দিয়েচেন, আপনার পুত্র তো দুধের বাছাটি নয়! রীতিমতন লেকাপড়া শিখে সাবালক হয়েচে, তার কি নিজের কোনো বুদ্ধি ভাষ্য নাই? আপনার ক্ষমতা থাকে তাকে ঠেকান!…আমার কী মনে হয় জানো, মধুদের পাড়ায় যে নবীন মিত্তির বলে একটা ছোঁড়া আছে না? সেই ছোঁড়াই মধুকে ফুসলেছে! ছোঁড়া তো অনেক আগেই খৃষ্টান হয়েছে। আমি অনেকবার শুনিছি, সেই ছোঁড়া মধুকে বলছে, খৃষ্টান হলেই বিলেত যেতে পারবে! রাজনারায়ণ বললো, আরে না, ওসব কিচু না! মধু খেষ্টান হয়েচে হিন্দু বে করবে না বলে! হিন্দুর মেয়েগুলো লেকাপড়া শেখে না। তেমন মেয়েকে
false
MZI
সবচেয়ে জটিল প্রোগ্রাম বসিয়ে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি— নীষা বাধা দিয়ে বলল, লুকাস, সময় বেশি নেই। আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে কিছুক্ষণের মাঝে। হা, ঠিক বলেছ। কিম জুরান, শুরু করুন। আমি আবার লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক। ক্রুগো কম্পিউটার আবার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই। লুকাস মাথা নেড়ে বলল, না, এটা ঠিক আগের মতো। এটা নয়। আমি দুই, তিন, চার চেষ্টা করে যখন পাঁচ লিখলাম, লুকাসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলল, হ্যাঁ, উত্তর দিতে পিকো সেকেণ্ডের লক্ষ ভাগের তিন ভাগ দেরি হল। শব্দগুলো এসেছে একটু অন্যরকমভাবে। তার মানে প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে পাঁচ। চমৎকার। আমি বললাম, আমি মানুষ, কাজেই আমার লিখতে অনেক দেরি হয়, তোমরা কেউ কর, অনেক তাড়াতাড়ি হবে। বুঝতে পারছ, জিনিসটা খুব সহজ। এই সময়ে সু এসে ঢুকে বলল, পুলিস আর মিলিটারি আমাদের ঘিরে ফেলতে আসছে। আমাদের এখনি পালাতে হবে। লুকাসকে বেশি বিচলিত দেখা গেল না। শান্ত গলায় বলল, আমাকে মিনিটখানেক সময় দাও। গোপন সংকেতটা বের করে নিই। আর সবাই বাইরে গিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা কর। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি লুকাসের আঙুল বিদ্যুৎগতিতে টার্মিনালের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, যে-জিনিসটা বের করতে আমার প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছিল, লুকাস সেটা শেষ করল ছেচল্লিশ সেকেণ্ডের মাথায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন এবারে পালাই। আমরা ছুটে বের হয়ে আসি। দুটি গাড়িতে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। লুকাস হালকা স্বরে বলল, মনে রেখো আমাদের সাথে দু’ জন মানুষ রয়েছে, কিম জুরান আর নীষা। তাদেরকে সাবধানে রেখো। জানই তো তাদের শরীরের ডিজাইন বেশি সুবিধের নয়, একটা বুলেট বেকায়দা লাগলেই তারা শেষ হয়ে যায়। হাসতে হাসতে কয়েকটা রবোট্রন সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দেয়। আমি নীষার পাশে গিয়ে বসি, সাথে সাথে গাড়ি দু’টি একপাক ঘুরে গুলির মতো বেরিয়ে যায়। আমি অনুভব করলাম, নীষা আমার হাতে হাত রেখে আস্তে একটা চাপ দিল। রক্তমাংসের মানুষ। আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি। ছোট একটা ঘরে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন মানুষ এবং রবোট বসে আছে, মানুষ বলতে অবশ্যি দু’ জন, আমি আর নীষা। ঘরটিতে আবছা অন্ধকার, সামনে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুকাস। আপাতত লুকাস কথা বলছে, অন্যেরা শ্রোতা। সে টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে দিতে বলল, তোমরা সবাই জান অনেকগুলো কারণে আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনেক এগিয়ে এনেছি। ক্ৰগো কম্পিউটারের উপর আরো মাসখানেক পরে যে-আঘাত হানার কথা ছিল, সেটা হানা হবে আজ রাতে। তার গোপন সংকেত বের করে আনা হয়েছে। বের করতে সময় লেগেছে ছেচল্লিশ সেকেণ্ড। বিস্ময়ের একটা মৃদু গুঞ্জন উঠে থেমে যায়। এক জন হাত তুলে জিজ্ঞেস করে, কী করে বের করলে এত তাড়াতাড়ি? কিম জুরানের একটা সহজ উপায় আছে, এটা বের করে তিনি একবার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। যারা এখনো কিম জুরানকে চেন না, তাদের জন্যে বলছি, নীষার পাশে ধূসর কাপড় পরে যে মধ্যবয়স্ক লোকটি বসে আছেন, তিনি কিম জুরান। সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং অস্বস্তিতে আমার কান লাল হয়ে উঠল। সৌভাগ্যক্রমে লুকাস আবার কথা শুরু করে, কিম জুরানের পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ, কিন্তু আমি এখন সেটা ব্যাখ্যা করছি না, কারণ আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমাদের আজ রাতের পরিকল্পনা খুব সহজ। পরিকল্পনাটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, হার্ডওয়ার আক্রমণ এবং সফটওয়ার আক্রমণ। অন্যভাবে বলা যায়, সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারকে বাইরে থেকে আক্রমণ করা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে ভেতর থেকে আক্রমণ করা। দু’টি আক্রমণই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি ছাড়া অন্যটি সফল হতে পারবে না। সরাসরি আক্রমণটি আসলে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। আমি এটার নেতৃত্ব দেব। আমার দরকার প্রায় পনের জন দক্ষ রবোর্টুন, যারা সামরিক পি-৪৩ ট্রেনিং পেয়েছে। কতজন আছ তোমরা হাত তোল। রবোট্রনেরা হাত তোলে এবং গুনে দেখা যায় তাদের সংখ্যা বারজন। লুকাস একটু চিন্তিতভাবে বলে, একটু কম হয়ে গেল, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ সারাদিনে আমরা যাদের হারিয়েছি তারা থাকলে কোনো কথা ছিল না। যাই হোক, আরো তিনজন রবোট্রন দুরকার, বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গণিতবিদ হলে ভালো হয়। কারা যেতে চাও হাত তোল। প্রায় গোটা সাতেক হাত ওঠেলুকাস তাদের মাঝে থেকে সুসহ আরো দু’ জনকে বেছে নেয়। সু জিজ্ঞেস করে, আমাদের কী করতে হবে? যুদ্ধ। কিন্তু কীভাবে? সেটা আমি বলে দেব। মোটামুটি জেনে রাখ, ক্রুগোর একটা ভবন আছে শহরের দক্ষিণ দিকে, সেখানে সরাসরি আক্রমণ করে ঢুকে যেতে হবে। ভবনের ভেতরে ক্রুগোর মূল ইলেকট্রনিক্স রয়েছে। সেটা অত্যন্ত সুরক্ষিত, পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তার দরজা খোলার জন্যে আমাদের ক্রুগোর গোপন সংকেতের প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, আমরা যখন ভবনের মূল অংশের দরজা পর্যন্ত যাব, তখন যেন দরজা খোলা থাকে। সেই দায়িত্ব নিতে হবে দ্বিতীয় দলটির। এর নেতৃত্ব দেবে ইলেন। ইলেন আপত্তি করে বলল, আমার দুটি হাতই উড়ে গেছে, এখনো সারানোর সময় পাই নি। আমাকে ঠিক নেতৃত্বে না রেখে সাহায্যকারী হিসেবে রাখ। লুকাস মাথা নাড়ে, না। আমি এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে চাই, যার অভিজ্ঞতা সব থেকে বেশি। আর তোমার হাত ব্যবহার করতে হবে না, কপোট্রনের সাথে সরাসরি টার্মিনালের যোগাযোগ করে দেয়া হবে। বেশ, তাই যদি তোমার ইচ্ছে। তোমার দলের দায়িত্ব সময়মতো ক্রুগো কম্পিউটারকে
false
humayun_ahmed
এসে দাঁড়িয়েছেন। দরজার একটা জানালা সামান্য খোলা। খোলা জানালায় শীতের বাতাস ঢুকছে। প্রবল হাওয়ায় সিগারেট টানা মুশকিল, তবে তার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। রেলের এটেনডেন্ট জানালার পাশে বসার জন্যে সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিয়েছে। তিনি এটেনডেন্টের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা করছে এখনি তাকে কিছু বখশিস দেন। পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলে কেমন হয়? পাঁচশ টাকা এমন কিছু টাকা না। সাত ডলারেরও কম। বিশ ডলার বখশিস তাঁকে প্রায়ই দিতে হয়। টাকাটা এখনি দিয়ে দেয়া দরকার। নামার সময় তড়িঘড়ি করে নামবেন। বখশিস দিতে ভুলে যাবেন। চেয়ারে বসতে বসতে রশীদ সাহেব বললেন, বাবা, তোমার নাম কি? এটেনডেন্ট বলল, স্যার, আমার নাম বসির। তোমার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার জন্যে পাঁচশ টাকা বখশিস স্যাংসান করেছি। আমার মনে না থাকলেও তুমি চেয়ে নেবে। এতে দোষের কিছু নাই। এই ট্রেনে যাত্রী সর্বমোট কত জন আছে বলতে পারবে? আন্দাজ করে বললেও হবে। বসির বলল, আন্দাজ করা লাগবে না। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব স্যার। সবতো টিকেটের যাত্রী। টিকেটের হিসাব গার্ড সাহেবের কাছে আছে। সঠিক সংখ্যাটা বল। একটু সময় লাগবে। ধরেন এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা সময় তোমাকে দিলাম। স্যার, আপনার কিছু কি লাগবে? চা বা কফি। চা-কফি কিছু লাগবে না। আমি রাত নটার সময় দুই থেকে তিন পেগ হুইস্কি খাব। হুইস্কি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তুমি একটা গ্লাস দেবে। বরফ কি দিতে পারবে? পারব স্যার। বুফে কারে ফ্রিজ আছে। ভেরি গুড। স্যার, আপনার সিগারেট কি লাগবে? আপনার হাতের প্যাকেটটা তো মনে হয় শেষের দিকে। সিগারেট লাগবে না। সঙ্গে অনেক আছে। আমি রোস্টেড সিগারেটে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আমেরিকার বাইরে যখন যাই স্যুটকেস ভর্তি সিগারেট নিয়ে যাই। বসির, আমার রুমমেট মেয়েটি কোথায় জান? বুফে কারে দেখেছিলাম। তাকে কিছু বলব? কিছু বলতে হবে না। বেচারী মনে হয় এক কামরায় আমার সঙ্গে যেতে সংকোচ বোধ করছে। এই কারণেই বাইরে বাইরে ঘুরছে। উনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে স্যার। তিন নম্বর কামরায়। আপনার সঙ্গে একজন ডাক্তার থাকবেন। ভেরি গুড। বৃদ্ধ বয়সে হাতের কাছে ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রশীদ সাহেব হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরালেন। বসির এখনো কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই মুহূর্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুড়ো মানুষটার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা সে নেবে না। কিছুতেই না। এমন একটা সিদ্ধান্ত সে কেন নিয়েছে নিজেই বুঝতে পারছে না। কোনো কারণ ছাড়াই বুড়ো মানুষটাকে তার ভাল লাগছে। বসির। জি স্যার। আমি একুশ বছর পর দেশে এসেছি। ভালো করেছেন। মোটেই ভালো করিনি—আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি অচেনা এক দেশে ঘুরছি। এরকম কেন মনে হচ্ছে তাও বুঝছি না। একা এসেছেন স্যার? ম্যাডামকে নিয়ে আসেন নাই? বিয়ে করি নি। ম্যাডাম পাব কোথায়? পোস্ট ডক করার সময় স্পেনের এক মেয়ের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় হয়েছিল। মেয়েটিকে প্রপোজ করেছিলাম। সে রাজিও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়নি। মেয়ের নাম ইয়েনডা। সে স্ট্যাটিসটিকসের ছাত্রী ছিল। বসির বলল, বরফের ব্যবস্থা কি স্যার এখন করব? রশীদ সাহেব বললেন, এখন না। রাত ঠিক নটায়। সময়ের ব্যাপারে আমি খুব পার্টিকুলার। যদিও জানি সময় বলে কিছু নেই। সময় আমাদের কাছে একটা ধারণা মাত্র। তার বেশি কিছু না। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার বলে কিছু নেই। বসির বলল, স্যার, আমি খোঁজ নিয়ে আসি ট্রেনে মোট যাত্রী কতজন। যাও। জানালাটা বন্ধ করে দিন স্যার। ঠাণ্ডা লাগবে। ঠাণ্ডা লাগবে না। আমি ঠাণ্ডার দেশের মানুষ। ইয়েনডার কথা মনে পড়ায় রশীদ উদ্দিন হঠাৎ সামান্য বিষণ্ণ বোধ করছেন। ইয়েনডার সঙ্গে দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার আছে। এমট্রেকের অবজারভেশন ডেকে মুখোমুখি বসে দুজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন। পাশ দিয়ে চলে গেছে . একটা বিখ্যাত গান আছে না রকি মাউন্টেইন নিয়ে– . কে গেয়েছে গান টা? চিত্রা বুফে কারে ডাক্তার আশহাবের মুখখামুখি বসে আছে। সহজ ভাবেই গল্প করে যাচ্ছে। অপরিচিত জনের সঙ্গে কথা বলার অস্বস্থি কাজ করছে না। তাদের টেবিল থেকে একটু দূরে কয়েকজন যুবক প্রাণখুলে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন মনে হয় ওস্তাদ গল্পকার। কিছুক্ষণ পর পর সে একটা গল্প করছে। আশপাশের সব বন্ধুরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গল্পকার ছেলেটির গায়ে নীল রঙের স্যুয়েটার। টকটকে লাল রঙের একটা মাফলারে সে কান ঢেকেছে। তাকে দেখে থ্রি ডাইমেনশনাল বাংলাদেশের পতাকার মতো লাগছে। চিত্রার ইচ্ছা করছে বাংলাদেশী ঐ পতাকার কাছে গিয়ে বলে——আপনাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসতে পারি? গল্প শুনব। অনেকদিন আমি হাসি না। আপনার গল্প শুনে হাসব। ইচ্ছা করলেও কাজটা তার পক্ষে সম্ভব না। লিলি থাকলে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঐ টেবিলে চলে যেত। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলত—আমাকে জায়গা দিন তো। জোকস শুনব। আমি নিজেও শুনাব। আশহাব বলল, আপনার কি মনে হচ্ছে আমার মাকে রুমমেট হিসেবে নিতে পারবেন? চিত্রা বলল, কেন পারব না? মা কিন্তু অনেক বিরক্ত করবে। রাতে ঘুমুতে দেবে না। উদ্ভট সব ভূতের গল্প শুরু করবেন। সব ভূত উনি নিজেই দেখেছেন। চিত্রা বলল, মায়ের উপর আপনার কি কোনো রাগ আছে? আশহাব বলল, আছে। মা হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার কাছে অন্যের মতামতের কোনো মূল্য নেই। আমার ডাক্তার হবার কোনো ইচ্ছা ছিল না। অন্যের রোগের উপর আমি বেঁচে থাকব ভাবতেই খারাপ লাগে। মার জন্যে আমাকে ডাক্তারি পড়তে হয়েছে। আমার বাবার একটা গল্প শুনলেই
false
toslima_nasrin
হয় এমন কোনও দৃশ্য না দেখি। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকি, সজোরে যুক্ত করে রাখি ঠোঁটজোড়া, যেন কোনও শব্দ আমার মুখ ফুটে না বেরোয়। এরপর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। রুদ্র আমার চিৎকারের মুখে দুহাত চেপে বলে, আরেকটু সহ্য করলেই হয়ে যাবে, এইতো হয়ে এল। লক্ষ্মীটি আরেকটু সহ্য কর। আরেকটু। রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে সে তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথরখানি সরাতে। থরথর করে কাপঁ ছে আমার উরু, উরু থেকে কাপঁ ন সঞ্চারিত হয় সারা শরীর। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। রুদ্র ঘেমে উঠেছে কিন্তু হাল ছাড়ছে না। পথে কোনও বাধা সে মানবে কেন, যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, সামনে সোনার খনি, ওই খনি তার হাতের মুঠোয় চাই। নিজেই নিজের মখু দুহাতে চেপে রেখেছি। হাত ফুঁড়ে যেই না বেরিয়ে চায় কিছু রুদ্র শাড়ির আঁচল গুজে দেয় মুখে, যেন এই রাতের একটি কণাও আমার চিৎকারে না ভেঙে পড়ে। না কিছুই ঘটছে না, আমি কোনও যনণ্ত্রা পাচ্ছি না, এই যে নিম্নাঙ্গ, এ আমার নয়, এ আমার শরীরের কোনও অংশ নয়। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে থাকা এ কোনও অবশ হয়ে থাকা শরীর। ধরা যাক আমাকে পেথিডিন দেওয়া হয়েছে। রক্তে থায়োপেনটাল সোডিয়াম ঢুকিয়ে আমাকে অচেতন করা হয়েছে। শরীরের সমস্ত কষ্ট আমার উবে গেছে। মাথার ওপর সিলিংপাখা বনবন করে ঘুরছে, আমার অচেতন শরীর তবু ঘেমে উঠছে। শাড়ির আঁচল, হাত, ঠোঁট দাঁতের কামড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। রুদ্র বাধা বিঘ্ন যা কিছু ছিল সব সরিয়ে সোনার খনির দিকে আমার ভেতর বাহির চুরমার করে ঢুকে যায়। রুদ্র নেমে যায় ওপর থেকে। একদিকে দেয়াল আরেকদিকে রুদ্র, আমার শক্তি নেই কোনও দিকে একবিন্দু নিজেকে সরাই। স্থির হয়ে আছি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখছি যেন আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরলে আমি টের পাই আমি কোনও পোস্ট অপারেটিভ রুমেও নই, আমি রূপসা নদীর ঘোলা জলে শুয়ে আছি। আমার শরীর ভাসছে জলের ওপর। চারদিকে কেউ নেই, একা আমি। এত একা কোনওদিন বোধ করিনি। যেন আমার কেউ নেই, কোনওকালে ছিল না। আমার বাবা নেই, মা নেই। আমার কোনও ভাই বোন নেই। আমার কোনও বন্ধু নেই, কোনও প্রেমিক নেই, কোনও স্বামী নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই কোথাও যাওয়ার। আমি রূপসার জলের ওপর ভেলার মত ভেসে কোথাও যাচ্ছি আমি জানি না। যখন শক্তি জোটে নিজেকে তোলার, তুলে আমি নামতে যাই বিছানা থেকে, পথ জুড়ে পাহাড়ের মত একটি বাধা, সেটি রুদ্র। বলি, যেতে দাও। এই প্রথম আমি রুদ্রকে সম্বোধন করি। রুদ্র পথ ছেড়ে দিলে আমি নেমে পেচ্ছাবখানা খুঁজতে থাকি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে। নিম্নাঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাঁসের মত হাঁটতে থাকি জলহীন ডাঙার অন্ধকারে। পেচ্ছাবখানায় পেচ্ছাব নয়, রক্ত বয়ে যায়, রূপসার জলের দিকে যায়। আর্তনাদের শক্তি আমার নেই। গোঙাতে থাকি অসহ্য যনণ্ত্রায়। পরদিন রুদ্র যখন বেরিয়ে যায় আমাকে ফেলে, আমার আবারও একা লাগতে থাকে। আমি ঠিক বুঝে পাই না কি র্কতব্য আমার। শ্বশুরের পা টেপা, শাশুড়ির উকুন বাছা, তেষ্টা পেলে পানিটা এগিয়া দেওয়া, গোসলের সময় গামছাটা, নামাজের সময় জায়নামাজটা! আমাকে কি ঘোমটা মাথায় রান্নাঘরে ঢুকতে হবে রান্না করতে, যেহেতু এ বাড়ির বউ আমি! আমাকে কি রান্নাঘরের পিড়িতে বসে পেঁয়াজটা রসুনটা অন্তত কেটে দিতে হবে! হাঁসের মত হেঁটে রান্নাঘরে ঢুকি। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর, মাটির মেঝেয় মাটির চুলো, চুলোর আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে, যেন আলাউদ্দিনের প্রদীপ থেকে ওঠা ধোঁয়া, ইচ্ছে করে এক্ষুনি ধোঁয়া থেকে দৈত্য বেরিয়ে আমাকে বলে দিক, কি করা উচিত আমার, ভাত তরকারি রান্না করব, নাকি রুদ্রর ভাইবোনদের ইশকুলের পড়া দেখিয়ে দেব, বলে দিক বাড়ির মানুষগুলো আমি কি করলে খুশি হবে, বলে দিক কি করলে বলবে বউটি বড় লক্ষ্মী, বড় ভাল। দৈত্যের দেখা পেতে আমি ধোঁয়ার দিকে এগোই। রান্নাঘরে যেই না মাথা গলিয়ে দিই, বীথি বলে, এখানে ঢুকছো কেন? ধোঁয়ায় টিকতে পারবে না। কি করছ তোমরা দেখি। দৈত্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে বলি, আমি কি কিছু করব! বীথি হাসে, রুদ্রর আর সব ভাই বোনেরাও হাসে। আমার অস্বস্তি হতে থাকে। আমাকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় বসতে হবে, কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, বললে কি কথা বলতে হবে এসব আমি জানি না। আমার একা লাগে। আমি চাই দ্রুত রাত নেমে আসুক, তখন আমি জানি, আমাকে কি করতে হবে, তখন আমাকে শুতে হবে, ঘুমোতে হবে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে বীথি বলে, তুমি গোসল করে নাও! পরে পানি ফুরিয়ে যাবে। এখন কি করতে হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গোসলখানায় ঢুকে দেখি দরজা আছে, কিন্তু দরজায় কোনও ছিটকিনি নেই। সংকোচে বেরিয়ে আসি। দেখে বীথি হাসতে হাসতে বলে, নিশ্চিন্ত মনে গোসল করে নাও তো, কেউ ঢুকবে না। আমার গোসল হয়, কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে হয় না। বারবার খসে যেতে থাকা আঁচলটি বারবার মাথায় তুলে দিতে দিতে, আঁচলের কোণ টেনে আঁচলকে মাথা থেকে খসতে না দিয়ে, নিশ্চিন্ত হয়ে, শুয়ে থাকা শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রুগ্ন কণ্ঠে তাঁর ন ছেলেমেয়ের মধ্যে বাড়িতে উপস্থিত সাতজনের একজনকে, এই তর বৌদিরে বসতে দে বলে আপাতত আমাকে
false
nazrul
মনে পড়ল, এই গানটাই তোর মুখে হাজারবার শুনেছি এবং আজও কচি গলার সুরে তা শুনলাম, কিন্তু সেসময় তোর কণ্ঠে যে গভীর বেদনার আভাস ফুটে উঠত, জনম-জনম অতৃপ্ত থাকার ব্যথা-কান্না যে শিহরণ-ভরা মূর্ছনার সৃজন করত, তা এ বালিকার সরল কণ্ঠের সহজ সুরে পাই না। এই কথাটি মনে হতেই তোর সজল কাজল-আঁখির-আকুল-কামনা-ভরা চিঠিটা আর একবার পড়তে বড্ড ইচ্ছে হল। আজ এই নিশীথ রাতে তোর মেঘলা দিনের লেখা চিঠিটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, চিঠিটা প্রথম দিন পেয়ে কেন এমন অভিভূত হইনি। সেদিন বুঝি চারিদিককার কোলাহলে তোর প্রাণের গভীর কথা আমায় তলিয়ে বুঝতে দেয়নি, শুধু ওতে যে মুক্ত হাসির স্বচ্ছ ধারাটুকু আছে, সেই ধারার কলোচ্ছ্বাসই আমার মন ভুলিয়েছিল। আজ যেন কোন্ গুণীর পরশে সহসা আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গিয়েছে আর তোর মর্মের মর্মস্থলেরও নিষ্করুণ চিত্র দেখতে পেয়েছি। তাই আজ বুঝেচি ভাই, এ কী অকরুণ নিরেট হাসি তোর! কান্না সওয়া যায়, কিন্তু বেদনাতুরের মুখে এই যে কুলিশ-কঠোর হিম হাসি, এ যে জমাট শক্ত অশ্রু-তুহিন! এ যে পাথরও সইতে পারে না। যার প্রাণে আছে, বেদনার অনুভূতি আছে, যে এমনি নীরব রাতে একা বসে কোনো স্নেহহারার এমনি নীরস শুষ্ক হাসি শুনেছে, সেই বোঝে এ হাসি কত দুর্বিষহ! তাই আজ তোর চিঠিটা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর অনেক দূর পর্যন্ত তোলপাড় করে উঠতে লাগল! একটি ছোট্ট প্রদীপ জ্বালিয়ে এই আঁধার বিভাবরীতে আমার সামনের বাতায়ন দিয়ে যতদূর দেখা যায় দেখতে চেষ্টা করচি আর ভাবচি – হায় তোর জীবনের রহস্যটা এই অন্ধকার-নিপীড়িত নিশীথের চেয়েও নিবিড় কৃষ্ণ পর্দায় আবৃত! সে বধির-যবনিকা চিরে তোর অন্তরের অনন্ত দিগ্‌মণ্ডলের সন্ধান নিতে যাচ্ছি আমার এই ঘরের প্রদীপটির মতোই ক্ষীণ কালো শিখা নিয়ে। তাই বুঝি অন্তরঙ্গ সখা হয়েও তোর ওই অথই মনের থই পেলাম না, অসীম হিয়ার সীমারেখা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারলাম না। ও মন কেবলই আমাকে আকাশের মতো প্রতারিত করেছে; যখনই মনে করেছি – ওই ওইখানেই গাঙের পারে আকুল আকাশ আর উদাস মাঠে চুমোচুমি হয়েচে, তখনই আমি প্রতারিত হয়েছি। সেই মিলন-সীমায় পদাঙ্ক আঁকতে যতই ছুটে গিয়েচি, ততই সে দিকের শেষ দূরে – আরও দূরে সরে গিয়েছে। কোথায় এ বাঁধন-হারা দিগ্‌বলয় কার অসীম আকাশের মোহানা, তা কে জানে! আমরা নিয়তই বাঁধন-বাঁধার ডোর সৃজন করে ওই অসীমতাকে ধরবার চেষ্টা করছি, আর দুষ্ট চপল শশক-শিশুর মতো সে ততই এক অজানা বনের গহন-পথের পানে ছুটে চলেছে! সে দুরন্ত-শিশু নেমে আসে কখনও মাঠের ধারে গাঁয়ের পাশে, কখনও গাঙ পারিয়ে আমলকি-ছায়া-শীতল ঝরনা-তীরে, আবার কখনও শাল-পিয়াল আর পলাশবনের আলো-ছায়ায়। একটি পাতাঝরার শব্দ শুনেই সে চমকে উঠে অনেক দূরে গিয়ে তার চটুল চোখের নীল চাউনি ইশারায় ভ্রান্ত পথিককে ডাকতে থাকে। তোর নিরুদ্দিষ্ট উদাসীন মন অমনই সে-কোন্ এক আবছায়া ভরা অচিন অসীমের পানে যে ছুটেচে, তা তুইই জানিস ; তোর এই কান্ডারিহীন হিয়ার তরি যে কোন্ অকূলের কূল লক্ষ করে এমন খাপছাড়া পথে পাড়ি দিয়েছে, তা কোনো মাঝিই জানে না। আমি ভাবচি, হয়তো এ নিরুদ্দেশ যাত্রীর দুঃসাহসী ডিঙাখানি ওই দুই অসীমের মোহানাতেই গিয়ে জয়ধ্বনি করবে, না হয়, কোথাও ঘূর্ণি-আবর্তে পড়ে হঠাৎ ডুবে যাবে, নয়তো কোন্ চোরা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডিঙার বাঁধন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে! ভবিষ্যৎটা আমি নির্দয়ভাবেই কল্পনা করলাম, কারণ আমি জানি নির্মম সত্য তোর কাছে কোনোদিন অপ্রিয় লাগেনি, এবারেও আমার এসব বেহুদা কথায় রাগবিনে বা দুঃখ পাবিনে আশা করি। তোর সজল কাজল-আঁখি প্রেয়সী যে কোন্ কোকাফ মুল্লুকের পরিজাদি, তাই ভেবে আমি আকুল হচ্চি। শ্রীমতী মাহ্‌বুবা খাতুনই সে সৌভাগ্যবতী কিনা, সে সম্বন্ধে এখনও আমি সন্দেহ-দোলায় দুলচি। তাহলে তুই আগে মত দিয়ে পরে বিয়ের কদিন আগে তাকে কেন এমন করে এড়িয়ে ত্যাগ করে গেলি? তোর এ এড়িয়ে-যাওয়ার দু রকম মানে হতে পারে; প্রথম, হয়তো তাকে ভালোবাসিসনি, – দ্বিতীয়, হয়তো তাকে মন দিয়ে ফেলেছিলি বলেই নিজের এই দুর্বলতা ধরা পড়ার ভয়ে এমন করে ভেসে গেলি। কোনটাতো সত্য? আমার বোধ হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটাই ঘটা খুব সম্ভব আর স্বাভাবিক। তুই আমার এইসব মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ দেখে আমায় ঔপন্যাসিক ঠাউরাসনে যেন। সকলের পক্ষে যেটার অন্তরে উদয় হওয়া স্বাভাবিক, আমি কেবল সেইটাই যতটা প্রকাশ করা যায়, ভাষার বাঁধন দিয়ে আগলাবার চেষ্টা করচি। মাহ্‌বুবার অবস্থা আমি নিজে কিছু না দেখলেও বুবুজান যেরকম করে বলছিলেন, তাতে মর্মর দেউলেরও বুক ফেটে যাওয়ার কথা। অবশ্য তিনি সব কথা খুলে বলতে পারছিলেন না আমার কাছে ; কিন্তু ওই বাধো-বাধোভাবে কথাটা চাপতে গিয়েই সেটার গোপন তত্ত্ব যতটা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল, তাতে আমি হলফ করে বলতে পারি যে, সে বেচারির নরম বুকে তোর ভালোবাসার ‘খেদং তির’ বড়ো গভীর করে বিঁধেচে! এ নিদারুণ শায়কের বিষ তার রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়েচে! বুঝি সে অভাগির আর রক্ষে নেই। বুবুজানও এই ভেবে একরকম অস্থির হয়েই পড়েচেন। তাঁর ভয়ের আদত কারণ বোধ হয়, তিনি মনে করেন যে, মৌন বুকের এই বধির চাপা ভালোবাসার গভীরতা যেমন বেশি, মারাত্মকও তেমনই। এই গভীর বেদনাই তাকে হত্যা করে ছাড়বে। … এইসব নানান দিক দেখে আমার আর ইচ্ছে হয় না ভাই যে বিয়ে করি। আমার অন্তরঙ্গ সখার বুভুক্ষু আঁখির আগে আমি নিজের ভালোবাসার ক্ষুধা মেটাব, আর সে শুধু গোবিসাহারার তপ্ত বালুকায় দাঁড়িয়ে ছাতি-ফাটা পিয়াস নিয়ে তেষ্টায় বুক ফেটে মরবে, এমন স্বার্থপরের
false
humayun_ahmed
বেতন যা পাই তাতে ফ্যামিলি নিয়ে ঢাকায় থাকা যায় না। আমি একটা ঘর সাবলেট নিয়ে একা থাকি। এই মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে থাকে? একে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। চিকিৎসা হচ্ছে? বদরুদ্দিন চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আপনার মেয়ের নাম কী? ওর নাম কুসুম। আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। বদরুদ্দিনের হাতে একটা গ্লাস এবং চামচ। গ্লাসে সম্ভবত শরবত জাতীয় কিছু আছে। তিনি চামচে করে মেয়ের মুখে শরবত দেয়ার চেষ্টা করছেন। মেয়েটা শরবত খেতে চাচ্ছে না। আমি বললাম, ভাই শুনন,আপনার মেয়েটার মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে—চলুন মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। না। না কেন? আমি কারো দয়া নেই না। দয়া বলছেন কেন? বলুন সাহায্য। আমি কারোর সাহায্যও নেই না। শুনন ভাই—এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে সাহায্য নিতে হয় এবং সাহায্য করতে হয়। . আমি আপনাকে চিনি না, জানি না—কেন আপনি খামাখা বিরক্ত করছেন? মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে, আপনি তার কষ্ট কমাবার চেষ্টা করবেন না? আমি আমার সাধ্যমতো করেছি। যেটা আমার সাধ্যের বাইরে সেটা আমি করব না। বদরুদ্দিন সাহেব—সততা একসময় রোগের মতো হয়ে দাঁড়ায়। সবসময় দেখা যায় সৎ মানুষরা ভয়ানক অহঙ্কারী হয়। এরা নিজেদেরকেই শুধু মানুষ মনে করে, অন্যদের করে না।আপনি নিজে যেমন কারোর সাহায্য নেন না—আমি নিশ্চিত, আপনি কাউকে সাহায্যও করেন না। করেছেন, কাউকে কেনো সাহায্য? আমি আমার নিজের মতো থাকি। নিজের মতো থাকার জন্যে তো আপনাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি। আপনি কে? আমার নাম হিমু। বাইরে ঠাণ্ডা আছে। মেয়েটাকে একটা গরম কাপড় পরান। আমারা তাকে ভালো কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব। আবার যদি না বলেন—তিনতলা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব। অসুস্থ মেয়েটি তার বাবাকে চমকে দিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, কুসুম, তুমি কি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে? হুঁ। তোমার ব্যথা কি এখন একটু কমেছে? হুঁ। আপনি কে? আমার নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়। মেয়েটি আবারো হেসে উঠল। মনে হচ্ছে সে অতি অল্পতেই হেসে ফেলে। বদরুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, হাসপাতালে কুসুমকে নিয়ে লাভ হবে না। ওর একটা অপারেশন দরকার। ডাক্তাররা বলছেন এই অপারেশন এখানে হয় না। আগে কখনো হয় নি। আগে হয় নি বলে কোনোদিন হবে তা তো না। এবার হবে। মেয়েটার গরম কাপড় নেই? বদরুদ্দিন লাল রঙের একটা সুয়েটার বের করে আনলেন। মেয়েটা আনন্দিত মুখে চুল আঁচড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কোথাও বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিলাম। বড় ক্লিনিক বলেই বোধহয় শুধু টাকারই খেলা। ভর্তি করাবার সময়ই সাতদিনের টাকা এডভান্স দিতে হয়। এই সঙ্গে ডাক্তার এবং ওষুধের বিল বাবদ দেড় হাজার টাকা। পকেটে আছে দুটা কুড়ি টাকার নোট। একটা পাঁচ টাকার নোট। দ্রুত টাকার যোগাড় করতে হবে। জরুরি সময়ের একমাত্র ভরসা হচ্ছে রূপা। টেলিফোনে তাকে পাওয়া গেলে হয়। ক্লিনিকের রিসিপশান থেকে টেলিফোন করতে হলেও এডভান্স টাকা দিতে হয়। শহরের ভেতর প্রতি কল পাঁচ টাকা। মানুষের রোগ নিয়ে ব্যবসা কত প্রকার ও কী কী হতে পারে তা ক্লিনিকওয়ালাদের মতো ভালো কেউ জানে না। হ্যালো রূপা? হুঁ। কুকুরছানাটা যে পাঠিয়েছিলাম সে কেমন আছে? ভালো আছে। পছন্দ হয়েছে তো? হ্যাঁ,পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হয়েছে। এটা কিন্তু নেড়ি কুকুর না। বিদেশী কুকর—পুডল। শুনে আনন্দি হলাম। এখন তুমি দয়া করে একটা কাজ করো—কুকুরের দাম বাবদ চার হাজার টাকা পাঠিয়ৈ দাও। আমি লোক পাঠাচ্ছি। লোক পাঠাতে হবে না। তুমি কোথায় আছ বলো—আমি নিজেই টাকা নিয়ে আসছি। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। রূপা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। রূপার এখানে আসতে আসতেও আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। এই ফাঁকে আমি সটকে পড়ব। রূপার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। কুসুমের জায়গা হয়েছে রুম নাম্বার ৮-এ। বেশ বড় রুম। টিভি পর্যন্ত আছে। কুসুম তার শরীরের তীব্র ব্যথা অগ্রাহ্য করে তার কেবিনের সাজসজ্জা দেখছে। তার চোখে গভীর বিস্ময়। ডাক্তার সাহেব ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়েছেন। ডাক্তার সাহেবের মুখ শুকানো। মনে হচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি ইনজেকশনটা দিলেন। আমি বললাম,রোগী কেমন দেখছেন ডাক্তার সাহেব তিনি রসকষহীন গলায় বললেন, বাইরে আসুন, বলছি। আমরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনারা লষ্ট কেইস নিয়ে এসেছেন। এই মেয়ের বাঁচার কোন আশা নেই। এর হার্ট পুরোপুরি ড্যামেজড। এ যে কীভাবে বেঁচে আছে সেটাই একটা রহস্য। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, জগতটাই রহস্যময় ডাক্তার সাহেব। তবে আপনাকে একটা উপদেশ দেই। লষ্ট কেইস ধরে নিয়ে কোনো রোগীর চিকিৎসা করবেন না। চিকিৎসকরা চিকিৎসা শুরু কররেন ‘ ধরে, ’ ধরে না। ভেবেছিলাম আমার কথায় ডাক্তার রাগ করবেন। তিনি রাগ করলেন না। চিন্তিত মুখে আবার মেয়েটির কাছে ফিরে গেলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত বোধ করছি। এই মেয়েটিকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। রূপা চলে আসছে। যা করার সে-ই করবে। টাকা না দিয়েই ক্লিনিক ছেড়ে চলে যাচ্ছি—এটা ক্লিনিকের লোক পছন্দ করছে না। একজন এসে টাকা দেবে—এই সত্য বিশ্বাস করতে তারা প্রস্তুত নয়। ম্যানেজার জাতীয় এক ভদ্রলোক বললেন, আপনি বসুন নারে ভাই। চা পানি খান। উনি আসলে চলে যাবেন। আমি বললাম, আমার কথার উপর ভরসা হচ্ছে না ? ছিঃ ছিঃ কী বলেন, ভরসা হবে না কেন ? জামিন হিসেবে একজন রোগী তো আছেই। টাকা-পয়সা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ঝামেলা
false
humayun_ahmed
তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব। পীর সাহেব বললেন, এই দুনিয়ায় কিসিম দুইটা। জ্বিন এবং ইনসান। বুঝায়। বলার কিছু নাই। আমি বললাম, আপনার স্ত্রীর ক্যামেরায় কি জিনের ছবি উঠেছে? উঁহু, আমার ছবি উঠেছে। জ্বিন আমার রূপ ধরে তার ঘরে ঢুকেছে। জিনের এই ক্ষমতা আছে। আপনারা দুজন এখন যান, এশার নামাজের সময় পার হয়ে গেছে। এখন নামাজ আদায় করব। সামান্য দেরি হয়েছে। ওসি সাহেবের কানে ফায়ারিং হবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। ফায়ারিং এখনো হয় নাই। মন বলতেছে নামাজে দাঁড়াব আর ফায়ারিংটা হবে। জ্বিন কফিলের বদমাইসি। একটা মজার জিনিস দেখতে চাই, সে আমারে দেখতে দিবে না। তৃষ্ণা বলল, ফায়ারিং কী? ইনার কথাবার্তা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাতাসের প্রবল ধাক্কায় লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়ে গেল। পীর কুতুব বিকট ধ্বনি দিলেন-আল্লাহু আকবর! ঝপাং শব্দ হলো, পীর কুতুবি ওসি সাহেবকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুলিশদের মধ্যে যে ব্যাপক চাঞ্চল্য আশা করেছিলাম, তা দেখা গেল না। একজন শুধু পানিতে ছয় ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোও নিভে গেল। টর্চ বৃষ্টির পানিতে ভিজেছে। কিছুক্ষণ আলো দিয়ে সে নিভে যাবে এইটাই নিয়তি। ঘটনার আকস্মিকতায় তৃষ্ণা হতভম্ব। সে বিড়বিড় করে বলল, এরা তো ড়ুবে যাবে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পীর কুতুবি ড়ুববেন না। তিনি ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মোহনা পার হবেন। ওসি সাহেব ড়ুবে যাবেন। আমার ধারণা এর মধ্যে ড়ুবেও গেছেন। তৃষ্ণা বিড়বিড় করে বলল, কী সর্বনাশ! আমি বললাম, সর্বনাশ তো বটেই। তোমার কাজিও কিন্তু ভেসে চলে যাচ্ছে। কাজি যার গৈ। কাজি যার গৈ। যারা গৈ যারা গৈ করছি কেন? যারা গৈ হচ্ছে ভেসে চলে যাচ্ছে। তাতে তোমার এত আনন্দ কেন? মুসলমানদের বিয়েতে কাজিও লাগে না। আমি বইতে পড়েছি কবুল কবুল বললেই হবে। তৃষ্ণর কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির শব্দ হলো। পুলিশ চারজন লাফ দিয়ে উঠল। তাদের মুখ ফ্যাকাসে। গুলি কী বস্তু পুলিশ সবচেয়ে ভালো জানে। গুলির শব্দে আতঙ্কে তারাই সবার আগে অস্থির হয়। তৃষ্ণা বলল, গুলি কোথায় হয়েছে? পুলিশের একজন বলল, আমার বন্দুক থেকে মিস ফায়ার হয়ে গেছে ম্যাডাম। তৃষ্ণা বলল, আপনা-আপনি গুলি হয়ে গেছে মানে কী? মানুষ মারা যেতে পারত। যার বন্দুক থেকে গুলি হয়েছে সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আল্লাহপাকের হুকুম ছাড়া কারও মৃত্যু হবে না। আপা। চিন্তার কিছু নাই। আমরা তাকিয়ে আছি কুতুবির দিকে। কুতুবি কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চের আড়ালে চলে গেলেন। পুলিশদের একজন হাঁপ ছাড়ার মতো করে বলল, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা! লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এখন আতর মিয়ার হাতে। তার ক্ষমতার উৎস ভীত এবং ক্ষুধার্ত যাত্রী। বিপদে মানুষের ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তি কমতে থাকে। লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়েছে, যে-কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। সেদিকে নজর না দিয়ে যাত্রীরা খেতে বসে গেছে। আজ রাতের খাওয়া ফ্রি। আতর মিয়ার সে রকমই নির্দেশ! খাওয়া নিয়ে ভালো হৈচৈ হচ্ছে। নতুন করে ডিম ভাজা হচ্ছে। অনেকেই ডিম ভাজা খাবে। কাঁচামরিচে ঝাল নাই কেন—এই নিয়েও তৰ্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বেঞ্চে সবার জায়গা হয় নি। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতে প্লেট নিয়ে খাচ্ছে! মুরগির গিলা-কলিজার একটা লুকানো হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই নিয়ে উল্লাস হচ্ছে। যাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, তারাও এক হাতা করে গিলা-কলিজা নিচ্ছে। এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফাঁসির আসামিরাও শেষ খাবার আগ্রহ নিয়ে খায়। কোন আইটেম কীভাবে রাঁধতে হবে তাও বলে দেয়। সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ মাছ অল্প আঁচে কড়া করে ভাজতে হবে। মাছ থেকে যে তেল উঠবে সেই তেল এবং সরিষার তেল আলাদা করে বাটিতে দিতে হবে। ইলিশ মাছের সঙ্গে রসুনের কোয়া থাকতে হবে। ক্ষমতাচুত রুস্তম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার দৃষ্টি আতর মিয়ার দিকে। আতর মিয়া তার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আবার পকেটে রেখে দিয়েছে। রুস্তম বুঝতে পারছে না পিস্তলটা আসল নাকি খেলনা। আজকাল খেলনা পিস্তলগুলি অবিকল আসলের মতো বানাচ্ছে। হাতে না নেওয়া পৰ্যন্ত আসল নকল বোঝার উপায় নেই। রুস্তমের কাছে মনে হচ্ছে নকল। নকল না। হলে পকেটে লুকিয়ে রাখত না। সারাক্ষণ হাতে রাখত। নতুন কোনো চাল দিয়ে আতর মিয়ার হাত থেকে ক্ষমতা কীভাবে নেওয়া যায় তা-ই রুস্তমের একমাত্র চিন্তা! মাথায় তেমন কোনো বুদ্ধি আসছে না। লঞ্চের রেস্টুরেন্টের সামনে কিছু জায়গা খালি করা হয়েছে। এটাই এখন মঞ্চ বাঁ জনতার আদালত। মঞ্চে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আতর মিয়া। আতর বলল, ভাইব্রাদার সবাই মন দিয়ে শুনেন। আমরা মহা বিপদে আছি। মাইনাস টু ফর্মুলা ঘটে গেছে। পীর সাহেব এবং ওসি সাহেব পানিতে পড়ে গেছেন। আপনারাও প্রস্তুত হয়ে যান। লঞ্চ অচল। শুরু হয়েছে ঝড়। এই ঝড় এখনো পাতলা। পাতলা ভাব থাকবে না। ঘন হবে। একতলায় বড় বড় সেগুন কাঠের টুকরা আছে। সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করবেন। দুজন দুজন করে একটা টুকরা বেছে নিবেন। হামলা হামলি বন্ধ। এক টুকরা পানিতে ফেললাম, পঞ্চাশজন তাতে ঝাপায়ে পড়বেন—তা হবে না। ক্লিয়ার? কেউ কোনো শব্দ করল না। রুস্তম বলল, আমার একটা কথা আছে। আতর বলল, কী কথা? আপনি এক নির্দেশ দিবেন, সেই নির্দেশে সবাই কাজ করবে তা তো হবে না। একটা কমিটি হবে। নির্দেশ যাবে কমিটির মাধ্যমে। কমিটিটা করবে। কে? জনগণ করবে। কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে একজন থাকবে, বিএনপির একজন থাকবে। সুশীল সমাজ থেকে
false
tarashonkor
সে তোমার কন্যে মা। তাকে একবার আনতে হবে আমাদের এই নাগলোকে। মা বললেন–বাবা, না। তা হয় না। নরে-নাগে বাস হয় না। বিধাতার নিষেধ। আমি বরং তাকে বর দেব এইখান থেকে, ধনে-ধানে সুখে স্বচ্ছন্দে স্বামী-পুত্রে তার ঘর ভরে উঠুক। নাগেরা বললে–না মা, তা হবে না। তা হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নাগেদের বলবে নেমকহারাম। মা বললেন—তবে আন। নাগেরা নরের রূপ ধরলেন, বণিক-বউয়ের যমজ মাসতুতো ভাই সাজলেন, সেজে এসে দোরে দাঁড়ালেন মাউই গো, তাউই গো, ঘরে আছ? সঙ্গে ভার-ভারোটায় নানান দ্রব্য। —কে? কে তোমরা? —তোমাদের বেটার বাউয়ের মাসতুতো ভাই। দূর দেশে থাকতাম। দেশে এসে খোঁজ নিয়ে দিদিকে একবার নিতে এলাম। –ও মাগো! বাপকুলে পিসি নাই মা-কুলে মাসি নাই শুনেছিলাম, হঠাৎ মাসতুতো ভাই এল কোথা থেকে? –বললাম তো, দূর দেশে বাণিজ্য করতাম, ছেলেবয়স থেকে দেশ ছাড়া, তাই জান না। বলে নামিয়ে দিলেন ভার-ভারোটায় হাজারো দ্রব্য। কাপড়চোপড় আভরণ গন্ধ–নানান দ্রব্য। মণিমুক্তার হার পর্যন্ত। এবার চুপ করলে বুড়োবুড়ি। কেউ যদি না হবে তবে এত দ্রব্য দেবে কেন? জিনিস তো সামান্য নয়! এ যে অনেক! আর তাও যেমন-তেমন জিনিস নয়—এ যে মণি মুক্তো সোনা রুপো। নাগেরা বললেন—আমরা কিন্তু দিদিকে একবার নিয়ে যাব। –নিয়ে যাবে? না বাবু, তা হবে না। –হতেই হবে। ওদিকে বণিক-বধূ কাঁদতে লাগলেন–আমি যাবই। শেষে বুড়োবুড়িকে রাজি হতে হল। নগেরা বেহারা ভাড়া করলে, পাকি ভাড়া করলে, বণিক-বউকে পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে চলল। কিছু দূরে এসে বেহারাদের বললে—এই কাছে আমাদের গ্রাম, ওই আমাদের বাড়ি। আর আমাদের নিয়ম হল–কন্যা হোক বউ হোক, এইখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে হবে। ভাল করে বিয়ে করলেন। দেখিয়ে দিলেন কাছের গ্রামের রাজবাড়ি। বেহারারা খুশি হয়ে চলে গেল। তখন নগেরা বললেন–দিদি, আমরা তোমার মাসতুতো ভাইও নই, মানুষও নই। আমরা হলাম সেই দুটি নাগ, যাদের তুমি বাঁচিয়েছিলে। বড় করেছিলে। মা-বিষহরি তোমার বৃত্তান্ত শুনে খুশি হয়েছেন। তোমাকে নাগলোকে নিয়ে যেতে বলেছেন, আমরা তোমাকে সেইখানে নিয়ে যাব। মায়ের বরে তুমি বঁটুলের মত ছোটটি হবে, তুলোর মতন হালকা হবে, আমাদের ফণার উপর ভর করবে, আমরা তোমাকে আকাশ-পথে নিয়ে যাব নাগলোকে। তুমি চোখ বোজ। মনে হল আকাশ-পথে উড়ছেন। তারপর মনে হল, কোথাও যেন নামলেন। নাগরা বললে—এইবার চোখ খোল। চোখ খুললেন। সামনে দেখলেন, মা-বিষহরি পদ্মফুলের দলের মধ্যে শতদলের মত বসে। আছেন। অঙ্গে পদ্মগন্ধ, পদ্মের বরন। মুখে তেমনি দয়া। মা বললেন মা, নাগলোকে এলে, থাক, দুধ নাড় দুধ চাড়, সহস্ৰ নাগের সেবা কর। সব দিক পানে চেয়ো মা, শুধু দক্ষিণ দিক পানে চেয়ো না। নির্জনে দ্বিপ্রহরে গল্প বলতে বলতে বেদের মেয়েটার মনে ও চোখে যেন স্বপ্নের ছায়া নেমে এসেছিল। ওই ব্ৰতকথা গল্পের ওই স্বজনহীনা কন্যাটির বিষধরকে আপনজন জ্ঞানে অ্যাঁকড়ে ধরার মত এই মেয়েটিও যেন শিবরামকে অ্যাঁকড়ে ধরার কল্পনায় বিভোর হয়ে উঠেছে। শিবরামের মনেও সে স্বপ্নের ছোঁয়া লাগল। তিনি বললেন হ্যাঁ, শবলা। ওই বেনেবেটি আর নাগেরা যেমন ভাই-বোন হয়েছিল, আমরাও তেমনি ভাই-বোন হলাম। শুনে শবলা হাসলে। এ হাসি শবলার মুখে কল্পনা করা যায় না। মনে হল শবলা বুঝি কাদবে এইবার। সে কিন্তু কদল না, কাদলেন শিবরাম, গোপনে চোখের জল মুছে বললেন—তা হলে কিন্তু তোমাকে আমি যা দেব নিতে হবে। –কি? শিবরাম বের করলেন দুটি টাকা। বললেন—বেশি দেবার তো সাধ্য আমার নাই। দুটি টাকা তুমি নাও! তুমি আমাকে বিদ্যাদান করলে, এ হল দক্ষিণা। গুরুদক্ষিণা দিতে হয়। গুরু-দক্ষিণা কথাটা শুনে চপলা মেয়েটার সরস কৌতুকে হেসে গড়িয়ে পড়ার কথা। শিবরাম তাই প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন হেসে গড়িয়ে পড়ে শবলা বলবেও মা গ! মুই তুমার গুরু হলাম। দাও—তবে দাও। দক্ষিণে দাও। শিবরামের অনুমান কিন্তু পূর্ণ হল না। এ কথা শুনেও সেয়েটা হাসলে না। স্থিরদৃষ্টিতে একবার তাকালে শিবরামের দিকে, তারপর তাকালে টাকা দুটির দিকে। শিবরামের মনে হল, চোখের দৃষ্টিতে রুপোর টাকা দুটোর ছটা বেড়েছে, সেই ছটায় দৃষ্টি ঝকমক করছে। তবু সে স্থির হয়ে রইল। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বললে–না। লিতে লারব ধরমভাই। লিলে বেদেকুলের ধরম যাবে। তুমাকে ভাই বুলেছি, ভাই বলা মিছা হবে। উ লিতে লারব। টাকা তুমি রাখ। শিবরাম বললেন-আমি তোমাকে খুশি হয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া, ভাই কি বোনকে টাকা দেয় না? –দেয়! ইয়ার বাদে যখুন দেখা হবে দিয়ো তুমি। মুই লিব। সকল জনাকে গরব করা দেখিয়ে বেড়াব, বুলব—দে গো দেখু, মোর ধরমভাই দিছে দে। তারপর বললে—বেদের কন্যে কালনাগিনী বইন তুমার আমি। আমি তুমারে ভুলতে লারব, কিন্তুক ধন্বন্তরি, তুমি তো ভুল্যা যাবা। দাম দিয়া জিনিস লিয়া দোকানিরে কে মনে রাখে কও? জিনিসটা থাকে, দোকানিটারে ভুল্যা যায় লোকে। আমি তোমারে বিনা দক্ষিণায় বিদ্যা দিলম, এই বিদ্যার সাথে মুইও থাকলম তুমার মনে। দাঁড়াও তুমাকে মুই আর একটি দব্য দিব। মেয়েটা অকস্মাৎ ভাবোচ্ছ্বাসে উথলে উঠেছে বর্ষাকালের হিজল বিলের নদীনালার মত। অ্যাঁটসট করে বাধা তার বুকের কাপড়ের তলা থেকে টেনে বের করলে তার গলার লাল সুতোর জড়ি-পাথর-মাদুলির বোঝা। তার থেকে এক টুকরো শিকড় খুলে শিবরামকে বললে—ধর। হাত পাত ভাই। পাত হাত। শিবরাম হাত পাতলেন। শিকড়ের টুকরাটা তার হাতে দিয়ে বেদের মেয়ে বললে ইয়ার থেকে বড় ওষুদ বেদের কুলের আর নাই ধন্বন্তরি। লাগের বিষের অম্রোে, মা-বিষহরির দান। —কি এ জড়ি? কিসের মূল? বেদের মেয়ে হাসলে একবার। বললে—সি কইতে তো বারণ আছে ধরমভাই।
false
shomresh
আজ কলেজে এসে শুনি ছুটি হয়ে গেছে। ওর জন্যে। বাড়ি চলে যেতে হবে বলে কয়েকটা মেয়ের কি দুঃখ। একজন বলল, নিগ্রোরা খুব সেক্সি হয়। তাই ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একজন দুজন হলে ওর কিছু হত না। তুমি ভাব দীপা, মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা এরা বলে গেল? দীপার মনে পড়ে গেল, তুমি অসীমকে দেখেছি? হ্যাঁ। গেটে দাঁড়িয়েছিল। তোমাকে কিছু বলেছে? না তো! কেন? নাঃ, এমনি। আধঘণ্টা থেকে রাধা চলে গেলে দীপা পোশাক পাল্টালো। আজ সকাল থেকেই খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারে চলে গিয়েছে। মাথা এবং শরীরে একটা ভারী অনুভূতি যেন ঝুলে রয়েছে একভাবে। কিছু ভাল লাগছে না, কিছু না। কলকাতায় নভেম্বরে শীত নামে না। কিন্তু বাতাসে টান এসে যায়। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে এই দুপুরবেলাতেও সেরকম বাতাসের স্পর্শ পেল দীপা, পেয়ে আরাম লাগল। কলেজের দিকে হাঁটছিল সে। এখন অসীমের সেখানে থাকার কথা নয়। ছুটি হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। অসীম কোথায় থাকতে পারে এমন স্পষ্ট ধারণা তার নেই। অথচ সকাল থেকে ওর কথা একবারও মনে আসেনি। অসীম কলেজে অপেক্ষা করবে। ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিল। অথচ দীপার ক্রমশ মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে অসীমের দেখা পাওয়া তার খুব দরকার। কেন, কি জন্যে, তা জানা নেই, ওর পাশে একটু হাঁটলেই মনের ভার দ্রুত কমে যাবে এমন একটা বোধ হচ্ছিল। আচ্ছা, অসীম যদি গতকাল গ্লোরিয়ার সঙ্গে গ্রামের নির্জনে থাকত। তাহলে একই কাণ্ড করতে পারত? বাধা তো অনাত্মীয় ছেলের চবিত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। হেসে ফেলল দীপা। উদ্ভট ভাবনা। অসীম কখনও এমন কাজ করতে পারে না। কলেজের গেট বন্ধ, সামনে কেউ নেই। কসমসেব সামনে কিছু ছেলে আড্ডা মারছে। দীপা চুপচাপ পেরিয়ে এল। অসীমকে কোথায় পাওয়া যায় ৮ খুব আফসোস হচ্ছিল তার। ঠিক সময়ে কলেজে গেলেই সে ওর দেখা পেত। এতবড় শহরে অসীমকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। হেদুয়ার মুখে ফিরে এসে দীপা যখন অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখনই পেছন থেকে গলা ভেসে এল, কফি খাবে? চমকে ফিরে তাকাতেই অসীম হাসল। দীপা বিস্ময় এবং খুশিতে একাকার হল, তুমি? দাঁড়িয়েছিলাম। এতক্ষণ? দীপা কি বলবে স্থির করতে পারছিল না, তারপর মনে হতেই বলল, যাঃ, হতেই পারে না। একটু আগে আমি এখান দিয়ে কলেজে গিয়েছি। দেখেছি। মিটিমিটি হাসছিল অসীম। দেখেছ? আর তুমি আমাকে ডাকোনি? হা হয়ে গেল দীপা। দেখছিলাম তুমি আমাকে খুঁজেছ কিনা? কি দেখলে? মুখটা যখন কালো হয়ে গেল তখন বুঝলাম যা বোঝার। তুমি তো খুব নিষ্ঠুর। আর তুমি? এতক্ষণ ধরে কেউ দাঁড়াবে যখন আন্দীে আসবে কিনা তার ঠিক নেই। কলেজ তো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছে। তাহলে তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার মন বলছিল তুমি আসবেই। দীপার মনে হচ্ছিল তার শরীর একটু হালকা হয়ে গেল। সে বলল, জানো, কাল রাত্রে যখন গ্লোরিয়ার খবর পেলাম তখন আমার সব সাদা হয়ে গিয়েছিল। ওরকম একটা মেয়ে দুম করে মরে গেল? মানুষ এত নৃশংস হয়? আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি দীপা। মেয়েটার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই, প্রথম প্রথম ওর অনেক আচরণ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না, পৃথিবীর দুটো আলাদা দেশের মানুষের আচরণ তো উল্টো হবেই। কিন্তু ওর কথাবার্তায় আমি একসময় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল এদেশের মেয়েরা অনেক বাড়তি অভ্যাস অকারণে বয়ে নিয়ে চলেছে। এদেশের মেয়েরা কেন করব। এই প্রশ্নটা এখনও করতেই শেখেনি। সেকি। তুমি তো জ্ঞানদোনন্দিনী ঠাকুরের ভক্ত। তিনি তো সত্তর আশি বছর আগে দারুণ দারুণ কাণ্ড করেছেন। করেছেন। কিন্তু সেটা এদেশের মেয়েকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি, উনি তাঁর পরের প্রজন্মের ছেলেদের প্রশংসা পেয়েছেন। ছেলেরা যেন একটু অনুকম্পা দেখিয়ে বলে, উঃ, কি তেজী মেয়ে ছিলেন। অসীম জবাব দিল না। কসমসের সামনে থেকে রকবাজদের জমায়েতটা এবার এগিয়ে আসছে ট্রাম লাইনের দিকে। উল্টো ফুটপাত থেকেই ওরা সিটি দিতে পারে, মন্তব্য ছুডাতে পারে। সে বলল, এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা যাক। তুমি খাওয়া-দাওয়া করেছ? হাঁটা শুরু করে দীপা বলল, না। ভাল লাগছিল না। সে কি! চল, কিছু খাবে। এই ট্রামটায় ওঠো। ট্রামে? কোথায়? চলই না। ওরা ট্রামে উঠল। দুপুরের এইসময়ে ট্রামে বেশী যাত্রী নেই। লেডিস সিটি ছেড়ে দীপা এগিয়ে গিয়ে বসতেই এক প্রৌঢ় বললেন, পেছনে লেডিস সিটি খালি। দীপা মুখ ঘুরিয়ে বলল, তাতে কি? এটার গায়ে কি জেন্টস সিটি লেখা আছে। লোকটি থাতমত হয়ে মুখ ফেরাল। অসীম দীপার। পাশে বসে বলল, চমৎকার। এত বাজে কথা গায়ে পড়ে বলতে ভালও লাগে লোকের। দীপা বলল। চল, কফিহাউসে গিয়ে কিছু খেয়ে সময় কাটিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবে। ও হো আজ যা তোমার মনের অবস্থা তাতে মায়ের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে? দীপা মাথা নাড়ল, না। আমি আগে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার সঙ্গে? অসীম অবাক। দীপা নিচু গলায় জবাব দিল, আমার জীবন সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি? তিনতলার ব্যালকনির একেবারে শেষ টেবিলটা খালি পেয়ে গিয়েছিল অসীম। সরু এক ফালি প্যাসেজের মত জায়গায় পর পর টেবিল পাতায় যে ফ্যানটির দরকার হয়েছে তার অবস্থান ওই টেবিলের শেষে। ফলে ঝড়ের মত হাওয়ায় দীপার চুল উডিয়ে দিচ্ছিল বারে বার। নাজেহাল হয়ে সে বলল, আমি এদিকে মুখ করে বসব। ওরা চেয়ার বদল করল। টেবিলে
false
shomresh
না। ওরা একসঙ্গে ছিল কিনা। শমিত সেটা বুঝতে পেরে বলল, এসো, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি শেফালী দত্ত। অ্যামেচারে অ্যাক্টিং করেন। অফিস ক্লাব। আর এ হল দীপা। কলেজে পড়ে। শেফালী মুখ ফিরিয়ে হাসল। নমস্কারের চেষ্টা করল না। দীপা চুপ করে রইল। শমিত বলল, চল, কফি খাই। দীপা মাথা নাড়ল, না। আপনারা যান। আমি এইমাত্ৰ ভাত খেয়ে আসছি। শমিত বলল, আমি গিয়েছিলাম শেফালী দেবীর বাড়িতে। যদি এই তিনটে শো করে দেন। গিয়ে শুনলাম। ওই অফিসে রিহার্সাল দিতে এসেছেন। বলে এলাম। আর আসা মাত্র এখানেই দেখা হয়ে গেল। তাহলে তো আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। আরও বাড়ল। মানে? উনি তিনটের বেশী রিহার্সাল দিতে পারবেন না। আর চার শো তিরিশ দিতে হবে,। একটা কথা। ওঁকে বোঝাতে পারছি না যে আমরা ফুর্তি করার জন্যে নাটক করছি না। এই সময় শেফালী কথা বলল। গলার স্বর বেশ মোটা, আমি চলি। দেরি হয়ে গেছে। যদি আপনার পোষায় তাহলে আজ রাত্রে বাড়িতে খবর দেবেন। শেফালী চলে গেল। ফসা কিন্তু শুকনো চেহারা। মুখে পুরু পাউডার। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, এনারা মাসে কাটা শো করেন? জানি না। চার পাঁচ ছটা হবে। অফিস ক্লাবে ওরা বেশী টাকা পান। আগে অফিসের নাটকে ছেলেরা মেয়ে সাজতো। এখন এরা সুযোগ পাচ্ছে। তাই যারা একটু ভাল করে তাদের ডিম্যাণ্ড বাড়ছে। ক্লান্ত গলায় বলল শমিত। কিন্তু আমায় ডাকলেন কেন? তোমার কি মনে হয় সময় দিতে পারবে না? সময় দেবার প্রশ্ন নয়। আসলে পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে আমার এলেমের ওপর। কোনদিন নাটক করিনি, সে-ভাবে নাটক দেখিনি। নাটক নিয়ে একটুও পড়াশুনা নেই। একদম নভিস। আমি। এক্ষেত্রে প্রথমেই বড় চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে একটা হাস্যকর কিছু করে ফেলা নিবোধের ব্যাপার হবে। তুমি আত্মবিশ্বাস পাচ্ছ না? এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে একদিন। তাহলে আর কি করা যাবে। নিঃশ্বাস ফেলল শমিত, শো তিনটে ক্যানসেল করে দিতে হবে। ধার করে টাকা এনে শেফালিকে দিয়ে হয়তো করাতে পারতাম। কিন্তু তাতে না ভরতো মন আর কল শো করারও কোন মানে থাকত না। দীপার খুব খারাপ লাগতে আরম্ভ করল। শমিতের অন্যসময়ের কথাবার্তার সঙ্গে এখন কোনও মিল নেই। ভেঙ্গে না পড়লে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে না। সে জিজ্ঞাসা করল, টাকার কথা না হয় বাদ দিলাম, আপনি যে আমাকে করতে বলছেন আমি তো এই ভদ্রমহিলার ধারে কাছে যেতে পারতাম না। উনি তো প্রফেশনাল। শমিত মাথা নাড়ল, আমি ভেবেছিলাম তুমি যদি সিনসিয়ার হও তাহলে তোমার এই স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গীটাকেই কাজে লাগাব। অভিনয় মানে গলা কাঁপিয়ে সুর করে কথা বলা নয়। চরিত্রটি যে-কথা বলছে তার মানে বুঝে সেই মত প্ৰকাশ করতে হবে। শুধু কথায় নয়, মঞ্চে যতক্ষণ চরিত্রটি থাকবে তার যেভাবে চলাফেরা করা উচিত, হাত-পা নাড়া উচিত সেই ভাবটাকেই স্পষ্ট করতে হবে। চেষ্টা করবে? দীপা হেসে ফেলল, জানি না কি হবে। কিন্তু আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে রিহার্সাল করতে অসুবিধে হবে না? একটু হবে। তবে তোমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে ছেড়ে দের যাতে দশটার আগে বাড়ি ফিরে যেতে পার। শুধু শো-এর দিন একটু অ্যাডজাস্ট করতে হবে। শমিতের মুখের চেহারা পাল্টে যাচ্ছিল। খুব উজ্জ্বল লাগছিল ওকে, আজ চলে এস। আমি তো টিউশনিতে যাচ্ছি। কখন ছাড়া পারে? সাড়ে ছটা। সাড়ে পাঁচ করে। ছটা থেকে তোমাকে নিয়ে বসব। কথা ছিল বিডন স্ট্রীট আর সেন্ট্রাল এভিন্যুর মোড়ে শমিত অপেক্ষা করবে। লাবণ্যকে পড়িয়ে দীপা ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে রিহার্সাল রুম। রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে ঢুকে মাঝারি ঘর। দশজন ছেলে এর মধ্যে এসে গিয়েছে সেখানে। শমিত বলল, এ হচ্ছে দীপা, মায়ার বন্ধু। আজ ওকে নিয়ে বসব। যদি দীপা পারে তাহলে কল শোগুলো হবে নইলে নয়। চা খাবে? দীপা মাথা নাড়ল। ঘরে সতরঞ্চি পাতা। শমিতের সামনে সেখানেই সে হাঁটু মুড়ে বসল। ঘরের অন্য ছেলেরা তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল দীপার। এই সময় মনে হচ্ছিল এখানে আর একজন মহিলা থাকলে সুবিধে হত। সময় নষ্ট করল না। শমিত। নাটকের খাতা খুলে বলল, দীপা প্ৰথমে আমি তোমাকে চরিত্রটা কি, তার অভ্যোস চলাফেরা মানসিকতা কি রকম বলে নিই। তারপর এই নাটকে তার ভূমিকা কি এবং কোন সমস্যায় সে পড়েছে? শোনার পর তোমার যদি প্রশ্ন করার কিছু থাকে করতে পার। দীপা মাথা নাড়ল। শমিত শুরু করল। ওর বলার ধরন এত সহজ এবং স্পষ্ট যে সেই মেয়েটির ছবি পরিষ্কার হয়ে উঠল। দীপার সামনে। চুপচাপ সে শুনে গেল। শমিত শেষ করে জানতে চাইল, বুঝতে অসুবিধে হল? না। কিন্তু– দীপা চুপ করে গেল। হ্যাঁ। বল। প্ৰব্লেমটা কি? এই মেয়ে কাঁদবে না কেন? কারণ ভেঙ্গে পড়তে সে পারে না। তার আত্মমর্যাদায় লাগবে। ঠিকই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর কাঁদা উচিত। ওহে, দীপা, যেসব মেয়ে অল্পে কেঁদে ভাসায় ও তাদের দলে নয়। আমি জানি বাংলা নাটকের দর্শক স্টেজে কান্না দেখতে ভালবাসে কিন্তু আমরা–। মাঝপথেই থামিয়ে দিল দীপা। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। শমিত হাত তুলতে ওরা থেমে গেল। শমিত বলল, আমাদের এখানে ডিসিপ্লিনটা মেনে চলা হয়। যে সময়ে দলে আসতে বলা হয় তারপরে এলে সেদিন বাইরে থাকতে হবে। কেউ কথা বললে তাকে সেটা
false
humayun_ahmed
আছে। হুমায়ূন স্ত্রীর হাত ধরে এগুচ্ছেন। যত দ্রুত সম্ভব আগুনের পাশে দাঁড়াতে হবে। ঝড়ের গতি আরও বাড়ছে। হুমায়ূন হতাশ গলায় বললেন, হামিদা বানু, আমি এই জীবন আর টানতে পারছি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ছেড়েছুড়ে পবিত্র মক্কা শরীফে চলে যাব। হামিদা বানু বললেন, পরাজিত মানুষের মতো কথা বলছেন? আমি তো পরাজিত মানুষই। পারস্যের ভেতর দিয়ে আমি মক্কা চলে যাব। আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে না। আমি একা যাব। বৈরাম খাঁ। জাহাঁপনা, আমি আপনার কথা শুনছি। পারস্য-সম্রাট কি তাঁর রাজ্যের ভেতর দিয়ে আমাকে মক্কা যেতে দেবেন? অবশ্যই দেবেন। তবে এই চিন্তা। আপাতত বন্ধ রাখুন। আসুন আগুনের পাশে যাই। পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প এবং রাজ্যহারা হুমায়ূন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। পারস্য-সম্রাট তাঁর জাঁকজমক দেখিয়ে হুমায়ূনকে অভিভূত করতে চাইছেন। অপূর্ব বেশভূষায় সজ্জিত খোজারা পুষ্পবৃষ্টি করল। সামরিক বাদ্যবাজনা হচ্ছে। ঘোড়সওয়ার বাহিনী সালাম জানিয়েছে। এগিয়ে আসছে হন্তীবাহিনী। চারদিকের হইচইয়ের মধ্যে হুমায়ূনকে দীনহীন দেখাচ্ছে। শাহ তামাস্প বললেন, তৈমুরের বংশধর সম্রাট বাবরের পুত্র হিন্দুস্থানের অধিপতির এই দশা কেন? হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইদের কারণে এই দশা। সিংহাসনে বসেই ভাইদের হত্যা করলেন না কেন? সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। শাহ তামাস্প বললেন, সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না বলেই কেউ সম্রাট, কেউ পথের ভিক্ষুক। আপনি আমার কাছে কী চান? হুমায়ূন বললেন, আমি আপনার করুণা চাই না। আমি শুধু পারস্যের ভেতর দিয়ে মক্কা চলে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছি। আমি যতদূর জানি আপনি সুন্নী মতাবলম্বী। ঠিকই জানেন। আমার স্ত্রী হামিদা বানু শিয়া। আপনার স্ত্রী চাইলেই মক্কা যেতে পারবেন। আপনাকে মক্কা যেতে হলে শিয়া মতাবলম্বী হতে হবে। আপনি হয়তো জানেন না, আমি পারস্য সুন্নিমুক্ত করার পরিকল্পনা করেছি। যেসব সুন্নি শিয়া-মতবাদ গ্রহণ করছে না তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। হুমায়ূন বললেন, আমাদের নবিজি। (দঃ) বিদায় হজের ভাষণে ধর্মবিষয়ে সহনশীল হতে বলেছেন। তামাস্প বললেন, এই ধরনের কোনো কথা হযরত আলী বলেন নি। আমরা শিয়ারা হযরত আলীর মতামতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যাই হোক, এখন আমি ধর্মবিষয়ে আলোচনায় উৎসাহী না। পথশ্রমে আপনি ক্লান্ত। ক্লান্তি দূর করুন। সন্ধ্যাবেলা আপনার সম্মানে রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। আপনার শিয়া-মতবাদ গ্ৰহণ বিষয়ের আলোচনা তখন হবে। আপনার পরিধেয় বস্ত্রের যে অবস্থা তা পরে রাজকীয় ভোজসভায় যেতে পারবেন না। আপনার জন্যে পোশাক সরবরাহ করা হবে। হুমায়ূন বিষণ্ণ মনে তাঁর জন্যে খাটানো তাঁবুতে ঢুকলেন। হামিদা বানুর জন্যে আলাদা তাঁবু খাটানো হয়েছে। তামাস্প’র হেরেমের নারীরা তার দেখভাল করছে। শাহ তামাস্প নিজের তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর সামনে দমীহ নামের পারস্যের বিখ্যাত সুরা। মাঝে মাঝে তিনি সুরার পাত্রে চুমুক দিচ্ছেন। বৈরাম খাঁকে ডেকে আনা হয়েছে। বৈরাম খাঁ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁকে বসার অনুমতি দেওয়া হয় নি। আপনি হুমায়ূনের প্রধান সেনাপতি? জি আলামপনা। আপনাকে দেখে প্রধান সেনাপতি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি মেষপালক। আপনার কথায় সম্মানিত বোধ করছি। আমাদের নবিদের সবাই কোনো-না-কোনো পর্যায়ে মেষপালক ছিলেন। আপনি শিয়া মতাবলম্বী? জি জাহাঁপনা। আপনার মাথায় শিয়াদের লম্বা টুপি নেই কেন? মাথার চুলও তো শিয়াদের মতো কাটা না। রাজকীয় ভোজসভায় আপনি উপস্থিত থাকবেন, তখন যেন মাথায় শিয়াদের টুপি থাকে। বৈরাম খাঁ বললেন, এই কাজটা আমি মহান সম্রাট হুমায়ূনের অনুমতি ছাড়া করতে পারব না। তামাস্প কঠিন গলায় বললেন, আপনার মহান সম্রাট হুমায়ূন নিজেই শিয়া টুপি পরে ভোজসভায় আসবেন। তাঁকে পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে এই টুপিও পাঠানো হয়েছে। বৈরাম খাঁ বললেন, আমার সম্রাট ভোজসভাতে যদি মাথা ন্যাড়া করে আসেন, আমি মাথা ন্যাড়া করেই যাব। আপনার মতো এত অনুগত সেনাপ্রধানের কারণেই হয়তো হুমায়ূন সব কয়টি যুদ্ধে হেরেছেন। শুনেছি প্ৰাণে বাঁচার জন্যে হুমায়ূনকে কয়েকবার পানিতেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তখন আপনি নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সাঁতার কেটেছেন? বৈরাম খাঁ বলল, এই সৌভাগ্য আমার হয় নি। তামাস্প হাত ইশারায় বৈরাম খাঁকে চলে যেতে বলে পানিপাত্রে মনোযোগ দিলেন। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত দেখাচ্ছে। ভোজসভায় পারস্য সাম্রাজ্যের শানশওকত দেখানোর সব চেষ্টাই শাহ তামাস্প করেছেন। বিশাল তাঁবুতে ভোজসভা বসেছে। চারদিক আলো ঝলমল করছে। নর্তকী এবং বাদ্যযন্ত্রীরা প্ৰস্তুত। সম্রাটের ইশারা পেলেই গানবাজনা শুরু হবে। রান্না হচ্ছে দুটি আলাদা রন্ধনশালায়। একটিতে পারস্যের রান্না। অন্য রন্ধনশালায় হিন্দুস্থানি বাবুর্চি তৈরি করছে খোসাকা পোলাও। শাহ তামাস্প এবং হুমায়ূন মুখোমুখি বসেছেন। তামাস্পের সঙ্গে তাঁর আমীর এবং সেনাপতিরা। হুমায়ূনের সঙ্গে তার চারজন আমীর এবং বৈরাম খাঁ। হুমায়ূন শাহের পাঠানো শিয়া টুপি পরেন নি। শাহ তাতে খুব অসন্তুষ্ট এমন মনে হচ্ছে না, বরং তাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শাহের নির্দেশে হুমায়ূনের সামনে একটি সোনার থালা রাখা হলো। থালায় মহামূল্যবান মণিরত্ন। শাহ বললেন, পারস্যের পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। ভোজসভায় উপহার বিনিময়ের রেয়াজ আছে। তবে আপনার অবস্থা আমরা অনুমান করতে পারছি। আপনার কাছ থেকে উপহার হিসেবে শুভেচ্ছা পেলেই আমরা সন্তুষ্ট। শাহের উপস্থিত আমীররা এ কথায় হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কারও কারও ঠোঁটে বিন্দ্ররূপের হাসি দেখা গেল। হুমায়ূন বললেন, মহামান্য শাহ তামাস্পের জন্যে আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। এই উপহার গ্রহণ করলে আমি এবং আমার সঙ্গীরা আনন্দিত হব। হুমায়ূন সবুজ রেশমি রুমালে ঢাকা একটি পাথর এগিয়ে দিলেন। শাহ তামাস্প রুমাল খুলে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহুর্ত তাঁর মুখে কোনো কথা ফুটল না। শাহের আমীররা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে নিচুস্বরে ফিসফিস শুরু হলো। তামাস্প বললেন, এইটিই কি সেই বিখ্যাত কোহিনূর? বৈরাম খাঁ বললেন,
false
humayun_ahmed
জানে হয়ত চেঁচিয়েই কাদবে। একটি অত্যন্ত রূপসী মেয়ে কাঁদছে। দৃশ্যটি কল্পনায় চমৎকার কিন্তু বাস্তবে কুৎসিত। বেশ কিছু সুন্দরী মেয়েকে তিনি কাঁদতে দেখেছেন। তার কাছে কখনও ভাল লাগেনি। নবী বলল, আমি ঠিক স্টেডি ফিল করছি না। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আজ রাতটা আপনার ঘরে কাটিয়ে দেয়া যাবে? যাবে। আসুন। নবী গাড়ি লক করে দোতলায্য উঠে এল খুব সহজভাবেই বলল, কাউকে বলুন গরম পানি করে দিতে, আমি একটা হট সাওয়ার নেব। একটা স্যান্ডউইচ বা এই জাতীয় কিছু দিতে বলুন। ভাল কথা, আমার শোবার ঘরে কিছু কাগজ রাখবেন। মাঝেমধ্যে শেষ রাতের দিকে আমার লিখতে ইচ্ছা করে। ওসমান সাহেব মৃদু হাসলেন। উপহাসের হাসি কিনা ঠিক ধরা গেল না। ওসমান সাহেব। বলুন। আসুন। একটা কাজ কবা যাক ২ সায়েন্স ফিকশনের যে আইডিয়ােটা আপনাকে বললাম তার ওপর আপনি একটি লেখা তৈরি করুন। আমিও একটি করি। কেন? কে আইডিয়া কেমন খেলাতে পারে। তাই দেখা, এর বেশি কিছু নয়। আপনি যা ভাবছেন তা না। আমি কী ভাবছি? আপনি ভাবছেন এটা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপার। তা নয়। এ দেশে আমি কাউকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, আপনার বিছানা তৈরি আছে, আসুন ঘর দেখিয়ে দিই। নবী রুক্ষ স্বরে বলল আপনি কী আমার ওপর বিরক্ত? না, আমি সহজে বিরক্ত হই না। তাহলে আমার আইডিয়া নিয়ে আপনি লিখতে চান না? না। ওসমান সাহেব ঘুমুতে গেলেন অনেক রাতে। নবী প্রচুর ঝামেলা করল। গরম পানি দিয়ে গোসল করল। চা খেল। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হো হো করে হাসল নিজউ কিভাবে দেয় দেখেছেন? চাচার হাতে ভাতিজা খুন। চাচার হাতে খুন লিখলেই তো বুঝা যায় ভাতিজা খুন। হয়েছে। কী দরকার ভাতিজা খুন লেখা। খবরের কাগজ পড়া শেষ হবার পর সে টেলিফোন নিয়ে বসল। রাত তখন দেড়টা। এই গভীর রাতে কাকে যেন ঘুম থেকে তুলে ধমকাতে শুরু করল। পরীক্ষণেই অন্য কাউকে টেলিফোন করে মজার মজার সব কথা বলে খুব হাসতে লাগল। ওসমান সাহেব জেগে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। ঘুমের অনিয়ম হয়েছে। সারারাত হয়ত জেগে থাকতে হবে। একা একা জেগে থাকা একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। পাশের কামরায় নবী অবশ্যি এখনও জেগে। কী সব খুটিখাট করছে তবু একা একাই লাগছে নিজেকে। তিনি মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। মশারির ভেতর সিগারেট খাওয়া রানু খুব অপছন্দ করত। কিন্তু এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার আছে ধোঁয়া আটকে থাকে মশারির ভেতর। যেন সাদা মেঘ চারপাশে জমতে শুরু করেছে। বিশাল মেঘের টুকরো নয় ছোট্ট একটি নিজস্ব মেঘ। এবং এটিকে তৈরি করেছেন নিজেই। ওসমান সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন ঠিক এই মুহূর্তে এ শহরে কতজন মানুষ জেগে আছে। জেগে আছে না বলে বলা য়াক ঘুমুতে পারছে না। চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। একদল জেগে আছে ক্ষুধার যন্ত্রণায়। অন্য আরেক দল রোগ যন্ত্রণায়। বাকিরা সবাই সৌখিন নিশি যাপনকারী। তিনি, নবী সাহেব এবং মনিকা। মনিকা নিশ্চয়ই জেগে আছে। এবং নবীর কথা অনুযায়ী ধরে নিতে হয় খুব কান্নাকাটি করছে। এখনও কী কাঁদছে? মেয়েদের কান্নার ব্যাপারে তার একটা মজার অবজারভেশন আছে। কিশোরীরা কাঁদে লুকিয়ে। যুবতীরা কাঁদে প্রকাশ্যে। প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধর আশপাশে বেশ কিছু মানুষজন না থাকলে কাঁদতেই পারে না। রানু তাঁর এ কথায় খুব রেগে গিয়েছিল। থমথমে মুখে বলেছিল, কী ভাব তুমি মেয়েদের মেয়েদের ছোট করে দেখবার একটা প্রবণতা আছে তোমার মধ্যে। এর মধ্যে ছোট করে দেখবার কী আছে তিনি বুঝতে পারেননি। রানুর হঠাৎ রেগে যাওয়া দেখে দুঃখিত ও লজ্জিত হয়েছেন। রানু কখন থেকে তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে? বিয়ের পর পরই কী? দীর্ঘদিন পাশাপাশি থাকলে দুজনের ভেতরে ক্রমে ক্রমে ভালবাসা জনাতে থাকে। তাদের মধ্যে সে রকম হয়নি। রানু তাঁর প্রতিটি ব্যাপারে বিরক্ত হতে শুরু করল গোড়া থেকেই। মশারির ভেতরে মেঘ তৈরি করছ? এই সব হালকা ধরনের কথা বলে আমাকে ভুলাতে চাও কেন? বল, তোমার আলসী লাগছে। ওসমান সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। রাত প্ৰায় শেষ হয়ে আসছে, চারটা দশ বাজে। কিছুক্ষণের ভেতর আকাশ ফর্সা হতে শুরু করবে। তিনি বসার ঘরে এলন। নবীর দরজা হাট খরে খোলা। সে এই শীতেও খালি গায়ে চেয়ারে বসে দ্রুত লিখছে। চমৎকার একটি দৃশ্য। তিনি দীর্ঘদিন কিছু লিখতে পারছেন না। নবী চোখ তুলে একবার দেখল। অত্যন্ত সহজ গলায় বলল, সায়েন্স ফিকশনটা নামিয়ে দিচ্ছি। ভাল। আজ সারাদিন চালাব। ননস্টপ, ফ্লো এসে গেছে। কাইন্ডলি কফির ব্যবস্থা করুন। কফি নেই। চা খেতে পারেন। হোক। চা-ই হোক। তিনি নিজেই চা বানাতে গেলেন। হাতের কাছে কিছুই পাওয়া গেল না, চিনির পট, দুধের কৌটা। কিছুই নেই। সংসার অগোছালো হয়ে গেছে। অগোছালো এবং অপরিচ্ছন্ন। রান্না ঘরের বেসিনের উপর রাতের থালাবাটি পড়ে আছে। টক টক একটা গন্ধ ছাড়ছে। আকবরের মাকে আজ কিছু কড়া কড়া কথা বলতে হবে। কী ওসমান সাহেব। আপনার চা কোথায়? একটু দেরি হবে। আকবরের মা উঠুক। ঘুম থেকে। ডেকে তুলুন না। ডেকে তুললেই হয়। নবী উঠে এসে উঁচু গলায় ডাকতে লাগল, এ্যাই এ্যাই। আকবরের মা ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জলদি চা বানাও। তুরন্ত। চা বানানো হয়ে গেলে গরম পানি করবে। আই উইল টেক এনাদার
false
tarashonkor
করেছে। রিনাকে তাকে পেতেই হবে। জীবনের যে-কোনো মূল্যে রিনাকে তার চাই। ধৰ্ম-জাতি-প্রতিষ্ঠা—সব, সব দিতে পারে সে। রিনা জানে না, রেভারেন্ড আরনেস্ট তাকে শান্তি দিতে পারবেন না। পারেন না। তাঁর ধর্মও পারে না। শান্তি-সুখ-আনন্দ-তৃপ্তি সব আছে তার তাকে পাওয়ার মধ্যে। জীবনের সুখ, জীবনের শান্তি যেমন ভোগের মধ্যে বস্তুর মধ্যে নেই—তেমনি জীবনকে ছেড়ে দিয়ে আদর্শবাদের বা ধর্মের আচার আচরণ মন্ত্ৰ জপ ত্যাগ বা কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্যেও নেই। শুধু কায়ার মধ্যেও নেই আবার কায়া বাদ দিয়ে মায়ার মধ্যেও নেই। কায়া-মায়া মাখামাখি এই জীবন। জীবনের কাম্য যদি কোথাও থাকে তবে সে জীবনের মধ্যেই আছে। রিনা, তুমি যা চাও তা আমার মধ্যে, আমি যা চাই তা তোমার মধ্যে। রূপ রস বৰ্ণ গন্ধ স্বাদ মন মাধুর্য স্নেহ প্রেম সান্ত্বনা, এই তো জীবনের কামনা। এ আছে জীবনের মধ্যেই। আর কোথাও নেই—আর কোথাও নেই। সে বেরিয়ে পড়েছিল আবার। আর দেরি নয়। একবার গিয়েছিল সে ব্রাউনের কাছে, পলির কাছে। আমি ক্রিস্টান হওয়া ঠিক করেছি, মিস্টার ব্রাউন!। ব্রাউন কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর উঠে এসে তার হাত ধরে বলেছিল, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, গুপ্টা! কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আশা করি রিনার সঙ্গে বিয়েতে কোনো অমত থাকবে না আপনার? নিশ্চয়ই না। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সম্মতি দেব। রিনা আঘাতে মর্মাহত হয়ে আসানসোল গেছে। সে থাকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। আজই আমি যাচ্ছি চার্চে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, যদি বল। ব্রাউনের সাহায্যে তার ধর্মান্তর গ্ৰহণ অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছিল। ধৰ্মান্তর গ্রহণের পর ব্রাউন বলেছিল, ইউ রান আপ টু রিনা। ব্রিং হার ব্যাক। পলি বলেছিল, সে কাঁদতে কাঁদতে গেছে। আসুক সে হাসিমুখে। কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, কাল যাব। ফিরে গিয়েছিল তার বাসায়। তার আগের দিন সে নতুন বাসা করেছে ধর্মতলায়। রিনাকে নিয়ে সংসার পিতবার মত বাসা। যেখানে ছিল, ক্রিস্টান হবার পর আর সেখানে থাকতে চায় নি। নিষ্ঠুরভাবে আঘাত দেবে প্রতিবেশীরা। মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। ধর্ম যদি ঈশ্বর দেয়, তবে এমন অনুদার কেন? প্রেমহীন করে কেন মানুষকে? এক মুহূর্তে এতকালের প্রতি স্নেহ সব মুছে গেল? সব মুছে গেল? ঈশ্বর কি প্রেমহীন, প্রীতিহীন, স্নেহহীন? সে কি বিদ্বেষপরায়ণ? সে আঘাত করে? মনটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। ধর্ম সে মানে না। ঈশ্বরকে সে নেই বলেই ধ্রুব জানে। তবু হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ক্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে কেমন যেন হয়ে গেল মনটা। সারাটা রাত বারান্দায় ডেক-চেয়ারে বসে রইল। নিউ টেস্টামেন্টখানা নিয়ে পড়বার চেষ্টা করল। মন লাগল না। রিনার ছবি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মন তখন আবার উৎসাহে ভরে উঠেছে। সারা রাত রিনার সঙ্গে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে। সে উঠল। আসানসোল আসানসোলে যাবে সে। রিনা। সকালের রোদ যেন সোনার ঝলক বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবী মাটির। পৃথিবী কঠিন। সূর্যের আলো সোনা নয়, বড় উত্তপ্ত। মানুষের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ তার আত্মপ্রবঞ্চনায়। নিজেকে সে যত বঞ্চনা করেছে তার চেয়ে বেশি বঞ্চনা আর কেউ করে নি। অলীককে সত্য বলে ধারণা করে তার পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে একদিন সে মুখ থুবড়ে পড়ে হাহাকার করে মরে। সেই অলীকের মোহে সোনাকে বলে মাটি। মুখের খাদ্য ঠেলে দিয়ে উপবাসে নিজেকে পীড়িত করে। রিনার যে দৃষ্টি, সেই স্তম্ভিত-বিস্ময়ে-ভরা মুখ আজও তার মনে পড়ে। সে আসানসোলে মিশনে এসে রিকে সামনেই পেয়েছিল। রেভারেন্ড আরনেস্টের বাঙলোর সামনে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কৃষ্ণেন্দু উল্লাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে ডেকেছিল দূর থেকে, রিনা! রিনা! রিনা চমকে উঠেছিল। অস্ফুট স্বরে বলেছিল, কৃষ্ণেন্দু? হ্যাঁ, রিনা। আমি কাল ব্যাপাটাইড্ৰড হয়েছি। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আর কোনো বাধা নেই। তুমি আমার। ইউ আর মাইন। রিনার বিচিত্র রূপান্তর ঘটতে লাগল। কৃষ্ণেন্দু তার হাত ধরতে গিয়ে থমকে গেল। রিনা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। নিষ্পলক দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে, তার মুখের উপরেই নিবদ্ধ, তবু যেন সে তাকে দেখছে না, যৌবনমাধুর্যে অপরূপ তার মুখখানিতে কী লেখা যেন ফুটছে; কপালে, তে, দুটি ঠোঁটে ক্ষীণ রেখায় স্তম্ভিত বিস্ময়ের সঙ্গে আরও দুর্বোধ্য কিছু যেন ফুটে উঠেছে সমস্ত কিছুতে। তার মধ্যে আশ্চর্য দৃঢ়তা এবং আশ্চর্য আরও কিছু। মহিমাঃ হ্যাঁ, তাই। ধীরে ধীরে রিনা বলেছিল, ক্রিস্টান হয়েছ? আমার জন্য? হ্যাঁ, রিনা। তোমার ধর্ম, তোমার ঈশ্বর ত্যাগ করেছ? ছি! ছি! রিনা, কী বলছ? তুমি বুঝতে পারছ না? কী ভয়ানক! রিনা! আমি তোমার জন্য জীবন দিতে পারি! রিনা! লাইফ ইজ মর্ট্যাল! জীবন নশ্বর। একদিন তা যাবেই। অসংখ্য জীবন অহরহ যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু, ইচ্ছে করে মানুষ মরছে, বিষ খাচ্ছে, গলায় দড়ি দিচ্ছে। মানুষ মানুষকে মেরে নিজে মরছে। কৃষ্ণেন্দু, সেদিন এখান থেকে কিছু দূরে হাজারিবাগে একজন বাঘ মারতে গিয়ে বাঘের হাতে মরেছে! জন ক্লেটনও হয়ত কোনো যুদ্ধে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ দেবে। বাধ্য হয়ে দেবে। এমন জীবন দেওয়াটা নেশার ধর্ম কৃষ্ণেন্দু। আমার প্রভু জীবন দিয়েছিলেন, ঈশ্বরের জন্য, ধর্মের জন্য। তুমি আমার জন্যে তোমার সেই ধৰ্ম, তোমার বিশ্বাসের ঈশ্বরকে ত্যাগ করলে কৃষ্ণেন্দু! ফর এ গার্ল? ফর দিস আইজ অব মাইন হুইচ ইউ সো অ্যাডোর– কৃষ্ণেন্দু প্রথমটায় বিচলিত হয়ে গিয়েছিল রিনার এই আকস্মিক আক্রমণে। এ রিকে সে এই প্রথম দেখছে। ধৰ্মান্ধতায় উগ্র উন্মাদ! সে নিজেকে সংবরণ করে এবার বাধা দিয়ে বলেছিল, ডোন্ট বি সিলি, রিনা। সিলি? প্ৰদীপ্ত হয়ে উঠেছিল রিনা। দৃঢ়স্বরে কৃষ্ণেন্দুও বলেছিল, ইয়েস,
false
shottojit_roy
বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। ছায়াটা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে। সিগারেট মুখে গোঁজার পর আরেকটা জিনিস বার করল পকেট চাপড়িয়ে। লাইটার। এবার লাইটারটা জ্বালানো হল। বাঁ হাতে। তোরা দুজন দেখবার জায়গাগুলোর কিছু আজ সকালেই দেখে নে, পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় বলল ফেলুদা। —আমার আরেকবার থানায় যাওয়া দরকার। ট্রান্সপোর্ট তো সান ট্র্যাভেলস থেকে পেয়ে যাবি। আর কিছু না হাক, স্বয়ম্ভু, পশুপতিনাথ ও পাটনটা ঘুরে আয়। এক’দিনের পক্ষে এই তিনটেই যথেষ্ট। রেস্টোর‍্যান্ট থেকে বেরিয়ে সামনেই দেখি মিঃ বাটরা। একেই বলে টেলিপ্যাথি। ভদ্রলোক হাসিমুখে তিনজনকেই গুড মর্নিং জানালেন বটে, কিন্তু সে হাসি টিকল না। দ্যাট ম্যান ইজ ব্যাক হিয়ার, গভীরভাবে বললেন মিঃ বাটরা।কাল বিকেলে নিউ রোডেরই এক জুয়েলারি শপ থেকে ওকে বেরোতে দেখেছে আমাদের আপিসের এক ছোকরা। সে ছোকরা কি ভেবেছিল আপনি হঠাৎ পোখরা থেকে ফিরে এসেছেন? বাটরা একটু হেসে বললেন সেখানে একটা সুবিধে আছে। আমার যমজ ভাইটি একটু উগ্র রং-এর জামাকাপড় পছন্দ করে। কাল পরেছিল একটা শকিং পিংক পুলোভার আর একটা সবুজ শার্ট। আমাকে যারা চেনে তারা কখনও ওকে দেখে আমি বলে ভুল করবে: না। যাই হাক, আমি আজ শুনেই পুলিশে জানিয়েছি ব্যাপারটা। এক সাব-ইনস্পেকটর আছে, তাকে আমি ভাল করে চিনি। তিনি কী বললেন? যা বলল তাতে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। বলল পুলিশ এ লোক সম্বন্ধে জানে। ওদের সন্দেহ লোকটা কোনও স্মাগলিং র‍্যাকেটের সঙ্গে জড়িত। তবে, কোনও পাওয়ারফুল, ধনী লোক ওর পিছনে থাকায় পুলিশ ওকে বাগে আনতে পারছে না। তা ছাড়া লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা বেচাল চালছে, ততক্ষণ পুলিশের ওত পেতে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু আপনার নিজের যে অসুবিধে হচ্ছে সেটা বললেন না? কুকীরিটা কিন্তু সে আপনার নামেই কিনেছিল। বাটরা বললেন, আপনার কথাটা মনে করেই ওদের জিজ্ঞেস করলাম যে লোকটা তার ক্রাইমের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপাতে পারে কি না। তাতে ওই সাব-ইনস্পেকটর হেসেই ফেলল। বলল, মিঃ বাটরা, ডোন্ট থিংক দ্য নেপাল পোলিস আর সে স্টুপিড। যাক, তা হলে আপনি এখন খানিকটা হালকা বলুন। মাচ রিলিভ্‌ড, মিঃ বাটরা। আমি বলি কী, আপনারাও একটু রিল্যাক্স করুন। প্রথম বার কাঠমাণ্ডুতে এসে স্রেফ একটা ক্রিমিন্যালের পিছনে ঘুরে বেড়াবেন, সেটা কি ভাল হবে? আপনি একটা দিন ফ্রি রাখুন। এই জন্যে বলছি কী, আমাদের কোম্পানি একটা নতুন ফরেস্ট বাংলো করেছে রাপ্তি ভ্যালিতে, ইন দ্য তেরাইজ! এ রিয়েলি ওয়ান্ডারফুল স্পট। আপনি বিকেলে বলবেন, আমি পরদিন সকালে আপনার ট্রানসপার্ট অ্যারেঞ্জ করে দেব। চাই কী, আমি ফ্রি থাকলে আপনাদের সঙ্গে চলেই আসব। কী বলেন? তেরাই শুনেই আমরা মনটা নেচে উঠেছে। লালমোহনবাবুর চোখ চকচক। তবু ভাল যে ফেলুদা কথা না দিলেও ব্যাপারটা বাতিল করে দিল না। আপনি শূকর-সরণির ঘটনাটা চেপে গেলেন কেন? ভদ্রলোক চলে যাবার পর জটায়ু প্রশ্ন করলেন। তার কারণ, বলল ফেলুদা, তদন্তের সর্ব কথা সব্বাইয়ের কাছে ফাঁস করে দেওয়াটা আপনার গোয়েন্দা-হিরো প্রখর রুদ্রের অভ্যাস হলেও, প্ৰদোষ মিত্রের নয়; বিশেষ করে যে ব্যক্তির সঙ্গে সর্বসাকুল্যে আড়াই ঘণ্টার আলাপ, তার কাছে তো নয়ই। বুঝলাম, বললেন জটায়ু। জানলাম; শিখলাম। সকালের আর একটা ঘটনা হল-যে-বাঙালি ভদ্রলোকটির সঙ্গে কাল এসেই আলাপ হল, যাঁর নাম আজ জানলাম বিপুল ভৌমিক-তাঁর সঙ্গে দেখা হল মিঃ বাটরাকে বিদায় দিয়ে দোতলায় ওঠার সময়। এটা কী চিনতে পারছেন? ভনিত না করেই হাতের একটা বোতল ফেলুদার দিকে তুলে ধরে প্রশ্নটা করলেন ভদ্রলোক। বোতল আমার চেনা, বিশেষ করে তার ভিতরের লাল রঙের ওষুধটার জন্য। কাশির ওষুধ, আমাদের বাড়িতে সব সময়ই থাকে। বেন্যাড্রিল একস্‌পেকটোর‍্যান্ট। চিনতে তো পারছি, বলল ফেলুদা, কিন্তু রংটা তো— আপনি রঙে তফাত পাচ্ছেন? সেটা বোধহয় আপনাদের বিশেষ ক্ষমতা। আমি পাচ্ছি গন্ধে। ভদ্রলোক ক্যাপ খুলে বোতলটা ফেলুদার নাকের সামনে ধরলেন। আপনার ঘ্রাণশক্তি তো খুবই প্রখর, বেশ তারিফের সঙ্গে বলল ফেলুদা। —তফাত আছে, তবে খুবই সূক্ষ্ম। অন্তত একটি ইন্দ্ৰিয় তো জোরদার হওয়া চাই, বললেন বিপুলবাবু, আপনি চারমিনার খেয়েছেন না একটু আগে? আমি দেখিনি খেতে, কিন্তু গন্ধ পাচ্ছি। কেমন, ঠিক তো? ঠিক তো বটেই। কিন্তু আপনি বোতল নিয়ে চললেন কোথায়? ফেরত দোব। পয়সা ফেরত নোব, বললেন বিপুলবাবু, ছাড়ব না। একি ইয়ার্কি পেয়েছে? কোন দোকান? আইডিয়াল মেডিক্যাল স্টোর্স ইন্দ্ৰ চক। আপনাকে বললাম না সেদিন, ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেতাই কারবার হচ্ছে? মিস্ক পাউডারে খড়ি মিশিয়ে দেয়, জানেন? শিশুদের পর্যন্ত বাঁচতে দেবে না এরা। মিঃ বাটরাকে গাড়ির কথা বলে দিয়েছিলাম, সাড়ে নটায় একটা জাপানি টয়োটা এসে হাজির। আমরা যখন বেরোচ্ছি তখন ফেলুদা টেলিফোন ডিরেকটরি নিয়ে পড়েছে। বলল এ অঞ্চলের ওষুধের দোকানগুলোর নাম নোট করে নিচ্ছে। একই শহরে স্বয়ম্ভুনাথের মতো বৌদ্ধস্তৃপ আর পশুপতিনাথের মতো হিন্দু মন্দির—এ এক কাঠমাণ্ডুতেই সম্ভব। পশুপতিতে তপেশ, তুমি দৃশ্য দেখো বলে আমাকে ফেলে রেখে মন্দিরে ঢুকে পূজো দিয়ে ফোঁড়া-টোটা কেটে এলেন লালমোহনবাবু। মন্দিরটা কাঠের তৈরি, দরজাগুলো রূপের আর চুড়োটা সোনা দিয়ে বাঁধানো। গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমেই যেটা সামনে পড়ে সেটা হল পাথরের বেদিতে বসানো সোনায় মোড়া বিশাল নন্দীর মূর্তি। চাতাল দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যায় নীচ দিয়ে বাগামতী নদী বয়ে যাচ্ছে, সেখানেই শ্মশান। নদীর ওপারে পাহাড়। স্বয়ম্ভুতে যেতে হলে গাড়ি প্যাঁচালো পাহাড়ি পথ দিয়ে উপরে উঠে একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। বাকি পথ সিঁড়ি দিয়ে
false
shorotchandra
বলিনে। কিন্তু এ ঠিক সত্যি-মিথ্যের কথা নয় বাবা। সমাজ যাকে শাস্তি দিয়ে আলাদা করে রেখেচে, তাকে ২৫৬ জবরদস্তি ডেকে আনা যায় না। সমাজ যাই হোক, তাকে মান্য করতেই হবে। নইলে তার ভাল করবার মন্দ করবার কোন শক্তিই থাকে না—এ-রকম হ’লে ত কোনমতে চলতে পারে না রমেশ! ভাবিয়া দেখিলে রমেশ এ কথা যে অস্বীকার করিতে পারিত তাহা নহে; কিন্তু এইমাত্র নাকি বাহিরে এই সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের ষড়যন্ত্র এবং নীচাশয়তা তাহার বুকের মধ্যে আগুনের শিখার মত জ্বলিতেছিল—তাই সে তৎক্ষণাৎ ঘৃণাভরে বলিয়া উঠিল, এ গাঁয়ের সমাজ বলতে ধর্মদাস, গোবিন্দ—এঁরা ত? এমন সমাজের একবিন্দু ক্ষমতাও না থাকে, সেই ত ঢের ভাল জ্যাঠাইমা! জ্যাঠাইমা রমেশের উষ্ণতা লক্ষ্য করিলেন; কিন্তু শান্তকণ্ঠে বলিলেন, শুধু এরা নয় রমেশ, তোমার বড়দা বেণীও সমাজের একজন কর্তা। রমেশ চুপ করিয়া রহিল। তিনি পুনরপি বলিলেন, তাই আমি বলি, এঁদের মত নিয়ে কাজ করো গে রমেশ! সবেমাত্র বাড়িতে পা দিয়েই এদের বিরুদ্ধতা করা ভাল নয়। বিশ্বেশ্বরী কতটা দূর চিন্তা করিয়া যে এরূপ উপদেশ দিলেন, তীব্র উত্তেজনার মুখে রমেশ তাহা ভাবিয়া দেখিল না; কহিল, তুমি নিজে এইমাত্র বললে জ্যাঠাইমা, নানান্‌ কারণে এখানে দলাদলির সৃষ্টি হয়। বোধ করি, ব্যক্তিগত আক্রোশটাই সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া, আমি যখন সত্যি-মিথ্যে কারো দোষ-অপরাধের কথাই জানিনে, তখন কোন লোককেই বাদ দিয়ে অপমান করা আমার পক্ষে অন্যায় । জ্যাঠাইমা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, ওরে পাগলা, আমি তোর গুরুজন, মায়ের মত। আমার কথাটা না শোনাও ত তোর পক্ষে অন্যায়। কি করবো জ্যাঠাইমা, আমি স্থির করেচি, আমি সকলকেই নিমন্ত্রণ করবো। তাহার দৃঢ়সঙ্কল্প দেখিয়া বিশ্বেশ্বরীর মুখ অপ্রসন্ন হইল; বোধ করি বা মনে মনে বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, তা হলে আমার হুকুম নিতে আসাটা তোমার শুধু একটা ছলনামাত্র। জ্যাঠাইমার বিরক্তি রমেশ লক্ষ্য করিল, কিন্তু বিচলিত হইল না। খানিক পরে আস্তে আস্তে বলিল, আমি জানতুম জ্যাঠাইমা, যা অন্যায় নয়, আমার সে কাজে তুমি প্রসন্নমনে আমাকে আশীর্বাদ করবে। আমার— তাহার কথাটা শেষ হইবার পূর্বেই বিশ্বেশ্বরী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু এটাও ত তোমার জানা উচিত ছিল রমেশ যে, আমার সন্তানের বিরুদ্ধে আমি যেতে পারব না? কথাটা রমেশকে আঘাত করিল। কারণ, মুখে সে যাই বলুক, কেমন করিয়া তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ কাল হইতে এই জ্যাঠাইমার কাছে সন্তানের দাবি করিতেছিল, এখন দেখিল, এ দাবির অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর আপন সন্তানের দাবি জায়গা জুড়িয়া আছে। সে ক্ষণকালমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়াই উঠিয়া দাঁড়াইয়া চাপা অভিমানের সুরে বলিল, কাল পর্যন্ত তাই জানতুম জ্যাঠাইমা! তাই তোমাকে তখন বলেছিলুম, যা পারি আমি একলা করি, তুমি এসো না; তোমাকে ডাকবার সাহসও আমার হয়নি। এই ক্ষুণ্ণ অভিমান জ্যাঠাইমার অগোচর রহিল না। কিন্তু আর জবাব দিলেন না, অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিক পরে রমেশ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই বলিলেন, তবে একটু দাঁড়াও বাছা, তোমার ভাঁড়ার-ঘরের চাবিটা এনে দিই, বলিয়া ঘরের ২৫৭ ভিতর হইতে চাবি আনিয়া রমেশের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে গভীর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া চাবিটা তুলিয়া লইয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল। ঘণ্টাকয়েক মাত্র পূর্বে সে মনে মনে বলিয়াছিল, আর আমার ভয় কি, আমার জ্যাঠাইমা আছেন। কিন্তু একটা রাত্রিও কাটিল না, তাহাকে আবার নিশ্বাস ফেলিয়া বলিতে হইল, না, আমার কেউ নেই—জ্যাঠাইমাও আমাকে ত্যাগ করেছেন। চার বাহিরে এইমাত্র শ্রাদ্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে। আসন হইতে উঠিয়া রমেশ অভ্যাগতদিগের সহিত পরিচিত হইবার চেষ্টা করিতেছে–বাড়ির ভিতরে আহারের জন্য পাতা পাতিবার আয়োজন হইতেছে, এমন সময় একটা গোলমাল হাঁকাহাঁকি শুনিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া ভিতরে আসিয়া উপস্থিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আসিল। ভিতরে রন্ধনশালার কপাটের একপাশে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের বিধবা মেয়ে জড়সড় হইয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং আর একটি প্রৌঢ়া রমণী তাহাকে আগলাইয়া দাঁড়াইয়া ক্রোধে চোখ-মুখ রক্তবর্ণ করিয়া চীৎকারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির করিতেছে। বিবাদ বাধিয়াছে পরাণ হালদারের সহিত। রমেশকে দেখিবামাত্র প্রৌঢ়া চেঁচাইয়া প্রশ্ন করিল, হাঁ বাবা, তুমি গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি, যত দোষ কি এই ক্ষেন্তি বামনির মেয়ের? মাথার ওপর আমাদের কেউ নেই বলে কি যতবার খুশি শাস্তি দেবে? গোবিন্দকে দেখিয়াই কহিল, ঐ উনি মুখুয্যেবাড়ির গাছ-পিতিষ্ঠের সময় জরিমানা বলে ইস্কুলের নামে দশ টাকা আমার কাছে আদায় করেন নি কি? গাঁয়ের ষোল আনা শেতলা-পুজোর জন্যে দুজোড়া পাঁঠার দাম ধরে নেন নি কি? তবে? কতবার ঐ এক কথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান শুনি? রমেশ ব্যাপারটা কি, কিছুতেই বুঝিতে পারিল না। গোবিন্দ গাঙ্গুলী বসিয়াছিল, মীমাংসা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার রমেশের দিকে একবার প্রৌঢ়ার দিকে চাহিয়া গম্ভীর গলায় কহিলেন, যদি আমার নামটাই করলে ক্ষ্যান্তমাসি, তবে সত্যি কথা বলি বাছা! খাতিরে কথা কইবার লোক এই গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়, সে দেশসুদ্ধ লোক জানে। তোমার মেয়ের প্রাশ্চিত্যও হয়েচে, সামাজিক জরিমানাও আমরা করেছি—সব মানি। কিন্তু তাকে যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি! মরলে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু– ক্ষ্যান্তমাসি চীৎকার করিয়া উঠিল, ম’লে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে করে পুড়িয়ে এসো বাছা—আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোটভাজ যে ঐ ভাঁড়ারঘরে বসে পান সাজচে, সে ত আর বছর মাস-দেড়েক ধরে কোন্‌ কাশীবাস করে অমন হলদে রোগা শলতেটির মত হয়ে ফিরে এসেছিল শুনি? সে বড়লোকের বড় কথা বুঝি?
false
shorotchandra
দিল। তিনি চক্ষের পলকে বিগলিতচিত্তে শশব্যস্তে উঠিয়া বলিলেন, হাঁ দিদি, ডাকছিলুম বৈ কি! অনেকগুলো টাকা বাইরে রয়েছে, তাই নীলাকে বললুম, যা মা, তোর খুড়ীমাকে একবার ডেকে আন, টাকাগুলো তুলে ফেলুক। এই নাও-বলিয়া তিনি শৈলর প্রসারিত ডান হাতের উপর নোট কয়খানি ধরিয়া দিলেন। শৈল আঁচলে-বাঁধা চাবি দিয়া সিন্দুক খুলিয়া ধীরে-সুস্থে টাকা তুলিতে লাগিল, চাহিয়া চাহিয়া নয়নতারার অসহ্য হইয়া উঠিল। তথাপি ভিতরের চাঞ্চল্য কোনমতে দমন করিয়া, একটুখানি শুষ্ক হাসি হাসিয়া কহিল, তাই তোমার দেওর কাল আমাকে বললেন, দিদি, ‘জাঠতুত-খুড়তুত ভাই নয়, মায়ের পেটের বড় ভাই। তাঁর খাব না, পরব না ত আর যাব কোথায়? তবু, মাসে মাসে এমনি পাঁচশ-ছ’শ টাকা করেও যদি দাদাকে সাহায্য করতে পারি ত অনেক উপকার! কি বল দিদি? সিদ্ধেশ্বরীর হাসিমুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। তিনি কোন উত্তর না দিয়া শৈলর পানে চাহিয়া রহিলেন। নয়নতারা বোধ করি তাঁহার গাম্ভীর্যের হেতু অনুমান করিতে পারিল না। কহিল, শ্রীরামচন্দ্র কাঠবিড়াল নিয়ে সাগর বেঁধেছিলেন। তাই তিনি যখন-তখন বলেন, বড়বোঠান মুখ ফুটে যেন কারো কাছে কিছু চান না; কিন্তু তাই বলে কি নিজেদের বিবেচনা থাকবে না? যার যেমন শক্তি, কাজ ক’রে তাকে সাহায্য করা ত চাই। নইলে বসে বসে শুধু গুষ্টিবর্গ মিলে খাবো, বেড়াবো, আর ঘুমোবো, তা করলে কি চলে? তোমারও ত হরি-মণির জন্যে কিছু সংস্থান করে যাওয়া চাই! আমাদের জন্যে সর্বস্ব উড়িয়ে দিলে ত তোমার চলবে না। ঠিক কিনা, সত্যি বল দিদি? সিদ্ধেশ্বরী মুখ ভার করিয়া বলিলেন, তা সত্যি বৈ কি! শৈল সিন্দুক বন্ধ করিয়া সুমুখে আসিয়া সেই চাবিটা তাহার রিং হইতে খুলিয়া সিদ্ধেশ্বরীর বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া নীরবে চলিয়া যাইতেছিল, সিদ্ধেশ্বরী ক্রোধে আগুন হইয়া উঠিলেন, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া তীক্ষè-ধীরভাবে কহিলেন, এটা কি হ’লো ছোটবৌ? শৈল ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ক’দিন ধরেই ভেবে দেখেছিলুম দিদি, ও চাবি আমার কাছে রাখা আর ঠিক নয়। অভাবেই মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়, আমার অভাব চারিদিকে-মতিভ্রম হতে কতক্ষণ, কি বল মেজদি? নয়নতারা কহিল, আমি ত তোমার কোন কথাতেই নেই ছোটবৌ, আমাকে মিছে কেন জড়াও? সিদ্ধেশ্বরী প্রশ্ন করিলেন, মতিভ্রমটা এতদিন হয়নি কেন, শুনতে পাই কি? শৈল কহিল, একটা জিনিস হয়নি বলে যে কখনো হবে না, তার মানে নেই। এমনি ত তোমাদের শুধু আমরা খাচ্চি, পরচি। না পারি পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে, না পারি গতর দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু তাই বলে কি চিরকাল করা ভালো? সিদ্ধেশ্বরী রুদ্ধ রোষে মুখ রাঙ্গা করিয়া কহিলেন, এত ভাল কবে থেকে হলি লা? এত ভালমন্দর বিচার এতদিন তোদের ছিল কোথায়? শৈল অবিচলিত-স্বরে বলিল, কেন রাগ করে শরীর খারাপ করচ দিদি? তোমারও আর আমাদের নিয়ে ভাল লাগচে না, আমার নিজেরও আর ভাল লাগচে না। ক্রোধে সিদ্ধেশ্বরীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। নয়নতারা তাঁহার হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, দিদির না হয় ভাল না লাগতে পারে, সে কথা মানি, কিন্তু তোমার ভাল লাগচে না কেন ছোটবৌ? শৈল ইহার জবাব না দিয়াই বাহির হইয়া যাইতেছিল, সিদ্ধেশ্বরী চেঁচাইয়া ডাকিয়া বলিলেন, বলে যা পোড়ারমুখী, কবে তুই বিদায় হবি-আমি হরির নোট দেব! আমার সোনার সংসার ঝগড়া-বিবাদে একেবারে পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে দিলি। মেজবৌ কি মিছে বলে যে, কোমরের জোর না থাকলে মানুষের এত তেজ হয় না?কত টাকা আমার তুই চুরি করেচিস, তার হিসেব দিয়ে যা। শৈল ফিরিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ-চোখ অগ্নিকাণ্ডের মত মুহূর্তকালের জন্য প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু, পরক্ষণেই সে মুখ ফিরাইয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। সিদ্ধেশ্বরী ছিন্ন-শাখার ন্যায় শয্যাতলে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, হতভাগীকে আমি এতটুকু এনে মানুষ করেছিলুম মেজবৌ; সে আমাকে এমনি করে অপমান করে গেল! কর্তারা বাড়ি আসুন, ওকে আমি উঠানের মাঝখানে যদি না আজ জ্যান্ত পুঁতি ত আমার নাম সিদ্ধেশ্বরী নয়। সাত সিদ্ধেশ্বরীর স্বভাবে একটা মারাত্মক দোষ ছিল-তাঁহার বিশ্বাসের মেরুদণ্ড ছিল না। আজিকার দৃঢ়নির্ভরতা কাল সামান্য কারণেই হয়ত শিথিল হইতে পারিত। শৈলকে তিনি চিরদিন একান্ত বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু, দিন-কয়েকের মধ্যেই নয়নতারা যখন অন্যরূপ বুঝাইয়া দিল, তখন তাঁহার সন্দেহ হইতে লাগিল যে, কথাটা ঠিক যে, শৈলর হাতে টাকা আছে, এই টাকার মূল যে কোথায় তাহাও অনুমান করা তাঁহার কঠিন হইল না। তথাপি সে যে স্বামী-পুত্র লইয়া এই শহর অঞ্চলে স্বতন্ত্র বাসা করিয়া কোনমতেই থাকিতে সাহস করিবে না ইহাও তিনি জানিতেন। রাত্রে বড়কর্তা তাঁহার বাহিরের ঘরে বসিয়া, চোখে চশমা আঁটিয়া, গ্যাসের আলোকে নিবিষ্টচিত্তে জরুরী মকদ্দমার দলিলপত্র দেখিতেছিলেন, সিদ্ধেশ্বরী ঘরে ঢুকিয়া একেবারেই কাজের কথা পাড়িলেন। বলিলেন, তোমার কজকর্ম করে লাভটা কি, আমাকে বলতে পার? কেবল শুয়ারের পাল খাওয়াবার জন্যেই কি দিবারাত্রি খেটে মরবে? গিরীশের খাওয়ার কথাটাই বোধ করি শুধু কানে গিয়াছিল। মুখ না তুলিয়াই কহিলেন, না আর দেরি নেই। এইটুকু দেখে নিয়েই চল খেতে যাচ্ছি। সিদ্ধেশ্বরী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, খাওয়ার কথা তোমাকে কে বলচে! আমি বলচি, ছোটবৌরা যে বেশ গুছিয়ে নিয়ে এবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্চেন। এতদিন যে তাদের এত করলে, সব মিছে হয়ে গেল সে খবর শুনেচ কি? গিরীশ কতকটা সচেতন হইয়া বলিলেন, হুঁ, শুনেচি বৈ কি। ছোটবৌমাকে বেশ করে গুছিয়ে নিতে বল। সঙ্গে কে কে গেল-মণিকে-মকদ্দমার কাগজাদির মধ্যে অসমাপ্ত কথাটা এইভাবে থামিয়া গেল। সিদ্ধেশ্বরী ক্রোধে চেঁচাইয়া উঠিলেন-আমার একটা কথাও কি তোমার কানে তুলতে নেই? আমি কি বলচি, আর তুমি কি জবাব দিচ্চ?
false
humayun_ahmed
দুজনে পুকুরে নেমেছিলেন। রানু কিছুতেই নামতে চাচ্ছিল না। তিনি প্রায় জোর করে তাকে রাজি করিয়েছিলেন। তার পর সে আর উঠে আসতে চায় না। যত বার তিনি বলে, রানু চল; উঠা যাক। রানু ততবারই বলে, আর একটু, আর একটু। সুখের উপকরণ চারদিকে ছাড়ানো থাকে। আমরা প্রায় সময়ই তা বুঝতে পারি না! হঠাৎ এক সময় তার দেখা পাই এবং অভিভূত হয়ে পড়ি। অপলা পুকুরে গোসল করতে যাবে বলে ঠিক করল। ফুলির মা। আপত্তি করবার চেষ্টা করছে। ভর সন্ধ্যায় খোলা চুলে পুকুরে নামা ঠিক না। কিন্তু তার আপত্তি গ্রাহ্য হয়নি। টগরও তার খালামণির সঙ্গে পুকুরে নামবে। সেও নাকি সাঁতার কাটবে। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওসমান সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে একটি হারিকেন হাতে পুকুর ঘাটে এসেছেন। জলে নেমেছে টগর এবং অপলা। ফুলি পানিতে পা ডুবিয়ে পুকুর ঘাটে বসে আছে। ওসমান সাহেব বললেন, বেশি দূর যেও না অপলা। আমাকে নিয়ে ভয় নেই দুলাভাই। আমি চমৎকার সাঁতার জানি। আপনি টগরকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান। ওর ঠাণ্ডা লাগবে। তুমি না উঠলে ও উঠবে না। আমি এখানে অনেকক্ষণ থাকব। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত উঠবে না। ওসমান সাহেব মৃদু হাসলেন। কিছু বললেন না। বিশেষ ঘটনা কি মানুষের জীবনে বারবার ফিরে আসে? ঠিক অপলার মত গলায়। রানুও তো একদিন এই কথাই বলেছিল। সেদিন তিনি অবশ্যি রানুর পাশে ছিলেন। আজ ছাতা মাথায় একটি কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৃতি কি একই ঘটনা বিভিন্ন রকমভাবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে? এ রকম একটি ঘটনা কি আবার তাঁর জীবনে ঘটবে? অসম্ভব নয়। একদিন হয়ত টগরের ভালবাসার একটি মেয়ে এ রকম বৃষ্টির রাতে পুকুরে নামবে এবং অবিকল রানুর মত গলায় বলবে–বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি উঠব না, তিনি দূর থেকে শুনে ফেলবেন। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, অপলা গ্রামে বসে বসে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম। কি সেটা? গাছের যৌবন বার বার ফিরে আসে। কিন্তু মানুষের যৌবন মাত্র একবার। কথা শেষ হওয়া মাত্র জোর বৃষ্টি শুরু হল। টগর মহানন্দে হাততালি দিল। অপলা ভেবে রেখেছিল সে দু’দিন থাকবে, শুক্র ও শনি। খুব বেশি হলে তিন দিন। সোমবার ড. মাইতির ক্লাস। ঐ ক্লাসটি ধরতেই হবে। এ্যাবসেন্ট করলে তিনি নামের পাশে দাগ রাখেন এবং পরের দিন এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর কারোরই জানা থাকে না। প্রশ্নতেই শেষ নয় শান্ত মুখে এমন সব বলেন যা শুনলে ক্লাস ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। যেমন রীতাকে একদিন বললেন, ডাক্তার যে তোমাকে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার হাবভাব ডাক্তারের মত নয়, বিরহী প্রেমিকের মত। বুঝতে পারছি? এখন তুমি আমাকে বল, তোমার ডান হাতের কজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাড়টির কী নাম। উঁচু গলায় বল যেন সবাই শুনতে পায়। রীতা কোনোমতে বলল, আমি জানি না। স্যার। বলেই সে বসে পড়ল এবং খুব ঘামতে লাগল। মাইতি স্যার বললেন, তোমাকে কিন্তু এখনো আমি বসতে বলিনি। কেউ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বসে পড়লে আমার খারাপ লাগে। কাজেই তোমাকে আমি এখন এমন প্রশ্ন করব যার উত্তর তোমার জানা আছে বলে আমার ধারণা। বল, প্ৰেম এবং ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য কী? ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। এই হচ্ছে মাইতি স্যার। তার ক্লাস মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অপলা রোববার ভোরে বেশ সহজভাবেই বলল, আজ ঢাকা না গেলে কেমন হয় রে টেগরি? টগর গম্ভীর হয়ে বলল, ভাল হয়। কিন্তু মাইতি স্যার যে আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। সবার সামনে কাদিয়ে ছাড়বে। চিনিস তো না তাঁকে। শরীরটা ভাল লাগছে না। কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছে, দেখ তো গায়ে হাত দিয়ে। অপলার গা নদীর জলের মতো শীতল কিন্তু টগর উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, উফ খুব জ্বর তো। যা, সুটকেস খুলে কাপড় বের করে ফেল। আগামী সোমবারের আগে ঢাকা গিয়ে পৌঁছলেই হবে। তোর আবার মন খারাপ লাগছে না তো? না। মার জন্যে কান্না আসছে না? না। একটু ও না? টগর তার জবাবে হেসে ফেলল। এবং পরীক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল। সম্ভবত মনে করল, হাসাটা ঠিক নয়। মার জন্যে কিছুটা হলেও মন খারাপ করা দরকার। কিন্তু তার সত্যি সত্যি মার কথা মোটেও মনে পড়ছে না। বরং মার কাছে ফিরে যেতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছিল। বাবা তার সঙ্গে খুব কথা-টথা বলে না। তবু তাকেই কেন জানি বেশি ভাল লাগে। এর কারণ কী সে প্রায়ই ভাবে। পরশু রাতে আপলাকে জিজ্ঞেস করল। অনেক ইতস্তত করে বলল খালামণি, বাবা বেশি ভাল, না মা? দুজনই ভাল। মন রাখা কথা। টগর বিশ্বাস করেনি। দু’জন লোক সমান সমান ভাল হতে পারে না। একজন একটু বেশি ভাল হলে অন্য জন একটু কম ভাল হবে। তাই নিয়ম। অপলা হাই তুলে বলল, কে বেশি ভাল, কে কম ভাল এসব দিয়ে কী করবি? কিছু করব না। কিছু না করলে ঘুমো। নাকি বাবার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছে করে? না না। মনে হচ্ছে করে, আয় রেখে আসি। অপলা সত্যি সত্যি তাকে রেখে আসতে গেল। টগর লক্ষ্য করেছে অপলা খালামণি যা বলে। সঙ্গে সঙ্গে তা করে। অন্য কোনো মেয়ে হলে, আয় রেখে আসি বলেও রেখে আসার কোনো রকম লক্ষণ দেখাত না। এবং এক সময় বড় বড়
false
shirshendu
করে না। প্রীতমও কোনওদিন এরকম কোনও প্রস্তাব মুখ ফুটে করতে পারেনি। প্রীতম বলে, যা খেতে দেবে তাই খাব। কোনও বায়না নেই তো? প্রীতম স্নিগ্ধ হেসে বলে, না। কোনওদিন বায়না করেছি? বলো! বিলু হাসে না। ভ্রু কুঁচকে কেমন একটু আনমনা হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময় প্রীতমের মনে হতে থাকে, এবার বিলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। নিশ্চয়ই ফেলবে। কিন্তু বিলুর দীর্ঘশ্বাস নেই। কোনওদিনই দীর্ঘশ্বাস ফেলে না বিলু। প্রীতম বলে, আজকাল ডিমে বড় আঁশটে গন্ধ লাগে। আজ আমি ডিম খাব না। এই তো বায়না করছ! করো না বলে? এটা তো না খাওয়ার বায়না। একে বায়না বলে না। এটাও বায়না।—বিলু বলল, কিন্তু হাসল না। অথচ এরকম কথায় একটু হাসাটাই কি নিয়ম নয়? বিলু বলল, ঠিক আছে, মাখন দিয়ে ডিমের পোচ করে দিচ্ছি, তা হলে অতটা আঁশটে গন্ধ লাগবে না। দাও। আর জানালার কাছে ইজিচেয়ারটা পেতে দাও। একটু বাইরেটা দেখি। বিলু লোহার ইজিচেয়ারটা পেতে দেয়, ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বসায়, সযত্নে গলা পর্যন্ত চাপা দিয়ে দেয়। প্রীতম বিলুর দিকে চেয়ে বলে, সকালে উঠে রোজ একটু ফিটফাট হয়ে নাও না কেন? চুল উড়ছে, সিদুর লেপটে আছে, ওরকম চেহারা দেখতে কি ভাল? আমার এখন সাজবারই সময় কিনা! প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বলে, কেন? তোমার কি দুঃসময় চলছে? তবে কি সুসময়? তাও নয়। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি সব হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছ। বিলু মৃদু স্বরে আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, হাল ছাড়ার কী আছে! ঘরে রুগি থাকলে কার সাজতে ইচ্ছে করে বলো তো! প্রীতম ঘুনঘুনে নেই-আঁকড়া স্বরে বলে, না, ওরকম দেখতে ভাল লাগে না। ওভাবে কখনও আমার সামনে এসো না। আমার খারাপ লাগে। আচ্ছা।-বলে বিল চলে যায়। জানালা দিয়ে কিছুই দেখার নেই প্রীতমের। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে রাস্তা দেখা যায় না। শুধু কয়েকটা বাড়ির তিন বা চারতলা আর আকাশ দেখা যায়। কিন্তু প্রীতমের কোনও অন্যমনস্কতা নেই। যেটুকু দেখে সেটুকুই যথাসাধ্য চেতনা আর প্রখর অনুভূতি দিয়ে গ্রহণ করে অভ্যন্তরে। বিলু খাবার নিয়ে আসে। প্রীতমের গলায় বাচ্চাদের মতো একটা ন্যাপকিনের বিপ বেঁধে দেয়। তারপর পাশে একটা টুলে বসে আস্তে আস্তে খাইয়ে দেয় তাকে। খাওয়া জিনিসটা বরাবরই প্রীতমের কাছে খুব বিরক্তিকর ছিল। খেতে হবে বলেই তার খাওয়া। বরাবর সে খায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং খুব তাড়াতাড়ি। বিলু এখন তা হতে দেয় না। প্রীতমও বুঝেছে খাওয়াটা খুবই জরুরি ব্যাপার। যদি বেঁচে থাকতে হয়, যদি লড়াই চালাতে হয়, তবে যথেষ্ট রসদের দরকার। প্রীতম মুখ ফিরিয়ে বলে, আজকাল আমার খাওয়া কি খুব বেড়ে গেছে বিলু? অন্য বউ হলে বলত, ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কি বলতে আছে? বিলু গম্ভীর মুখে বলল, আরও একটু বাড়লে ভাল হয়। প্রীতম লক্ষ করল, বিলুর চুল এখনও রুক্ষ, এলোমেলো, কপালে সিঁদুর লেপটানো। এ নিয়ে আর বলতে গেলে সকালের নরম-সরম বিলু আর নরম-সরম থাকবে না। রেগে যাবে, ঠান্ডা কঠিন এক ব্যবহার দিয়ে সারাদিন প্রতিবাদ জানিয়ে যাবে। খাওয়া শেষ হলে প্রীতম মুখ তুলে ফের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। ও-ঘরে লাবু ঘুম ভেঙে মাকে ডাকতে থাকে, মা! ও মা! মা! ও মা! মা! ও মা! ঠিক নামতা পড়ার মতো। বিলু বোধহয় বাথরুমে। সাড়া দিচ্ছে না। কিন্তু যতক্ষণ না সাড়া দেবে ততক্ষণ এক সুরে, এক গলায় একঘেয়ে ডেকেই যাবে লাবু। মেয়েকে পারতপক্ষে ডাকে না প্রীতম। বড় মায়া। এই বাসায় এই এক পুকুর ভালবাসার ড়ুবজল অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। বড় গভীর জল। একবার পা বাড়ালে তলিয়ে যেতে হবে। এখন ভালবাসায় ভেসে যেতে নেই। মন নরম হবে, মৃত্যুভয় এসে যাবে তবে। প্রীতম তাই কান কাড়া করে মেয়ের ডাক শোনে, কিন্তু নিজে তাকে ডাকে না বা সাড়াও দেয় না। লাবুর সঙ্গে তার এখন আড়ি। ঝি-টা বাড়িতে নেই, দোকানে গেছে। প্রীতম লাবুর ওই অবিকল পাখির স্বরের ডাক সইতে পারছে না। ছটফট করে ভিতরটা। আপনা থেকেই শরীরটা দাঁড়িয়ে পড়তে চায়। সরু হাত তুলে সে কপাল টিপে ধরার এক অক্ষম চেষ্টা করে। বাথরুম থেকে বন্ধ দরজা ভেদ করে বিলুর ক্ষীণ স্বর এল এই সময়ে, আসছি-ই। লাবু শোনে এবং চুপ করে। মেয়েটা কেমন একরকম হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে চায় না। সারাদিন খাওয়া নিয়ে বিলু ওকে মারে, বকে। বিলুকে ভয়ও পায় ভীষণ, আবার অবাধ্যতাও করে যায় অনবরত। মার খেলে মায়ের কাছ থেকে সরে যায় না, পালায় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অসহায় ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে। যত ভাববে তত মায়ার পলি জমবে মনের মধ্যে। তাই প্রাণপণে নিজের অনুভূতির অন্য জগৎ জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে প্রীতম। আগে উদাস ছিল প্রীতম, এখন সে অনেক অনুভূতিপ্রবণ হয়েছে। কীটপতঙ্গ জীবাণুদের জগৎকে সে আজকাল স্পষ্ট টের পায়। বাড়িময় যেসব আরশোলা ওড়ে, যে একটা-দুটো ইঁদুর বা ছুঁচো আনাগোনা করে তাদের গতিবিধি, সময়জ্ঞান ও চরিত্র সম্পর্কে সে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে ইদানীং। একটা দুধের শিশু বেড়াল অনেক তাড়া খেয়েও এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে নাছোড়বান্দা হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাকে দু চোখে দেখতে পারত না প্রীতম। এখন সেই বেড়ালটা বড় হয়েছে। সারাদিন পাড়া বেড়ায়, কিন্তু মাঝে মাঝে এসে প্রীতমকে দেখা দিয়ে যায় ঠিকই। আর রোজ রাতে নিয়মিত এসে প্রীতমের খাটের তলায় শুয়ে থাকে। কখন শুতে আসবে
false
shottojit_roy
একেবারে ল্যাবরেটরিতে ডেকে পাঠালাম। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই নাক সিঁটকিয়ে বললেন, আপনি কি হিং-এর কারবার ধরেছেন নাকি? পরমুহুর্তেই রোবুর দিকে চোখ পড়তে নিজের চোখ গোল গোল করে বললেন, ওরে বাস-ওটা কী? ওকি রেডিও, না কলের গান, না কী মশাই? অবিনাশবাবু এখনও গ্রামোফোনকে বলেন কলের গান, সিনেমাকে বলেন বায়স্কোপ, এরোপ্লেনকে বলেন উড়োজাহাজ। আমি ওঁর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ওকেই জিজ্ঞেস করুন না। ওটা কী। ওর নাম রোবু। রোবুস্কোপ? রোবুস্কোপ কেন হতে যাবে? বলছি না। ওর নাম রোবু! আপনি ওর নাম ধরে জিজ্ঞেস করুন। ওটা কী জিনিস, ও ঠিক জবাব দেবে। অবিনাশবাবু কী জানি বাবা এ আপনার কী খেলা বলে যন্ত্রটার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কী হে রোবু? রোবুর মুখের গর্ত থেকে পরিষ্কার উত্তর এল, আমি যান্ত্রিক মানুষ। প্রোফেসর শঙ্কুর সহকারী। ভদ্রলোকের প্রায় ভিরমি লাগার জোগাড় আর কী। রোবু কী কী করতে পারে শুনে, আর তার কিছু কিছু নমুনা দেখে অবিনাশবাবু একেবারে ফ্যাকাশে মুখ করে আমার হাত দুটো ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বুঝলাম এবার তিনি সত্যিই ইমপ্রেসড। আজ একটা পুরনো জামান বিজ্ঞানপত্রিকায় প্রোফেসর বোৰ্গোল্টের লেখা রোবো সম্বন্ধে একটা প্ৰবন্ধ হঠাৎ চোখে পড়ে গেল। উনি বেশ দেমাকি মেজাজেই লিখেছেন যে, যান্ত্রিক মানুষ তৈরির ব্যাপারে জামানরা যা কৃতিত্ব দেখিয়েছে, তেমন আর কোনও দেশে কেউ দেখায়নি। তিনি আরও লিখেছেন যে, যান্ত্রিক মানুষকে দিয়ে চাকরিবাকারের মতো কাজ করানো সম্ভব হলেও, তাকে দিয়ে কাজের কাজ বা বুদ্ধির কাজ কোনওদিনই করানো যাবে। প্রোফেসর বোর্গোল্টের একটা ছবিও প্রবন্ধটার সঙ্গে রয়েছে। প্রশস্ত ললাট, ভুরু দুটো অস্বাভাবিক রকম ঘন, চোখ দুটো কোটরে ঢোকা, আর থুতনির মাঝখানে একটা দু ইঞ্চি আন্দাজ লম্বা। আর সেই রকমই চওড়া প্ৰায় চারকোনা কালো দাড়ির চাবড়া। ভদ্রলোকের লেখা পড়ে আর তাঁর চেহারা দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহটি আরও বেড়ে গেল। ২৩ শে মে আজ সকালে হাইডেলবার্গ পৌঁছেছি। ছবির মতো সুন্দর শহর, ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থিতির জন্য প্রসিদ্ধ। নেকার নদী শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে, পেছনে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বনে ঢাকা পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর রয়েছে হাইডেলবার্গের ঐতিহাসিক কেল্লা। শহর থেকে পাঁচ মাইল বাইরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রোফেসর পিমারের বাসস্থান। সত্তর বছরের বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক আমাকে যে কী খাতির করলেন তা বলে বোঝানো যায় না। বললেন, ভারতবর্ষের প্রতি জামানির একটা স্বাভাবিক টান আছে জান বোধ হয়। আমি তোমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য দর্শন ইত্যাদির অনেক বই পড়েছি। ম্যাক্স মুলার এসব বইয়ের চমৎকার অনুবাদ করেছেন। তাঁর কাছে আমরা বিশেষভাবে ঋণী। তুমি একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক হয়ে আজ যে কাজ করেছ, তাতে আমাদের দেশেরও গৌরব বাড়ল। রোবুকে তার সাইজ অনুযায়ী একটা প্যাকিংকেসে খড়, তুলো, করাতের গুড়ো ইত্যাদির মধ্যে খুব সাবধানে শুইয়ে নিয়ে এসেছিলাম। পমারের তাকে দেখার জন্য খুবই কৌতূহল হচ্ছে জেনে আমি দুপুরের মধ্যেই তাকে বাক্স থেকে বার করে ঝেড়ে পুছে পমারের ল্যাবরেটরিতে দাঁড় করলাম। পামার এ জিনিসটি নিয়ে এত গবেষণা এত লেখালেখি করলেও নিজে কোনওদিন রোবো তৈরি করেননি। রোবুর চেহারা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। বললেন, এ যে তুমি দেখছি আঠা, পেরেক, আর স্টিকিং প্লাস্টার দিয়েই সব জোড়ার কাজ সেরেছা! তুমি বলছি। এই রোবো কথা বলে, কাজ করে? পমারের গলায় অবিশ্বাসের সুর অতি স্পষ্ট। আমি একটু হেসে বললাম, আপনি ওকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওকে প্রশ্ন করুন না। পমার রোবুর দিকে ফিরে বললেন, ? (তুমি কী কাজ কর?) রোবু স্পষ্ট গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে উত্তর দিল, , (আমি আমার মনিবের কাজে সাহায্য করি, আর অঙ্কের সমস্যার সমাধান করি)। পমার রোবুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, শঙ্কু, তুমি যা করেছ, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার কোনও তুলনা নেই। বোর্গেল্টের ঈর্ষা হবে। এর আগে বোর্গেল্ট সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। হঠাৎ পমারের মুখে তাঁর নাম শুনে একটু চমকেই গেলাম। বোৰ্গল্টও কি নিজে কোনও রোবো তৈরি করেছেন নাকি? আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পমার বললেন, বোর্গেল্ট হাইডেলবার্গেই আছে-আমারই মতো নির্জন পরিবেশে, তবে নদীর ওপারে। আমার সঙ্গে আগে যথেষ্ট আলাপ ছিল—বন্ধুত্বই বলতে পারো। একই স্কুলে পড়েছি বার্লিনে—তবে ওর চেয়ে আমি তিন বছরের সিনিয়র ছিলাম। তারপর আমি হাইডেলবার্গে এসে ডিগ্ৰী পড়ি। ও বার্লিনেই থেকে যায়। বছর দশেক হল ও এখানে এসে ওদের পৈতৃক বাড়িতে রয়েছে। উনি কি নিজে রোবো তৈরি করেছেন? অনেকদিন থেকেই লেগে আছে—কিন্তু বোধ হয় সফল হয়নি। মাঝে তো শুনেছিলাম ওর মাথাটা একটু বিগড়েই গেছে। গত ছমাস ও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। আমি টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কয়েকবার, প্রতিবারই ওর চাকর বলেছে বোর্গেল্ট অসুস্থ। ইদানীং আর ফোনটোন করিনি। আমি এসেছি সেটা কি উনি জানেন? তা তো বলতে পারি না। তুমি আসছি। সেকথা এখানকার কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে আমি বলেছি—তাদের সঙ্গে তোমার দেখাই হবে। খবরের কাগজের লোকও কেউ কেউ জেনে থাকতে পারে। বোর্গেল্টকে আর আলাদা করে জানাবার প্রয়োজন দেখিনি। আমি চুপ করে রইলাম। দেয়ালে একটা কুকু ক্লকে কুক কুক করে চারটে বাজল। খোলা জানালার বাইরে বাগান দেখা যাচ্ছে; তারও পিছনে পাহাড়। দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। পমার বললেন, রাশিয়ার ষ্ট্ৰেগোনাফ, আমেরিকার প্রোফেসর স্টাইনওয়ে, ইংলন্ডের ডাঃ ম্যানিংস—এঁরা সকলেই রোবো তৈরি করেছেন। জামানিতেও তিন-চারটে রোবো তৈরি
false
shunil_gongopaddhay
করা যেতে পারে। সে ইচ্ছে করলে, মানে, তার পক্ষেই আংটিটা নেওয়া সবচেয়ে সুবিধেজনক। জোজো ফস করে রেগে উঠে বলল, কী, আপনি আমাকে আংটি-চোর বলছেন? আমাদের বাড়িতে ওরকম কত আংটি আছে আপনি জানেন? কত রাজা-মহারাজারা এসে আমার বাবাকে উপহার দেন। হিরের আংটি, মুক্তোর আংটি, চুনি-পান্নার আংটি। আমাদের বাথরুমেও ওসব আংটি গড়াগড়ি যায়। কর্নেল বললেন, তোমাদের বাড়িতে অনেক আংটি, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বাথরুমে আংটি গড়াগড়ি যায় কেন? জোজো বলল, আমার মা নতুন নতুন আংটি পরেন। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে আংটি খুলে রাখেন, আর পরে নিতে ভুলে যান। ওগুলো সেখানেই পড়ে থাকে। কর্নেল বললেন, ও। জোজো এবার আঙুল তুলে বলল, আপনাকেও সন্দেহ করা যেতে পারে। আপনিও আমাদের ঘরে এসে বসেছিলেন। কর্নেল বললেন, এটা ঠিক বলেছ। খুব বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। আমাকে তো সন্দেহ করা যেতেই পারে। আমি তো ইচ্ছে করলেই আংটিটা টপ করে পকেটে ভরে নিতে পারতাম! তিনি নিজের হাতটা কোটের পকেটে ভরলেন। তারপর ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে হাতটা আবার বের করে বললেন, এই দ্যাখো! আমিই নিয়েছিলাম। কেন বলো তো? সন্তু অস্ফুটভাবে বলল, ক্রিপটোম্যানিয়াক! কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, না, না, ক্রিপটোম্যানিয়াক মানে তো যারা কোনও দরকার না থাকলেও গোপনে অন্যের জিনিস নিয়ে নেয়, আমি তা নই! আমি আংটিও পরি না। এটা নিয়েছিলাম, যাতে তোমাদের আরও দু-তিনদিন এখানে আটকে রাখা যায়। কাল অত করে অনুরোধ করলাম, তোমাদের কাকাবাবু কিছুতেই থাকতে রাজি হলেন না। ভেবেছিলাম, এরকম একটা দামি জিনিস হারালে নিশ্চয়ই অনেক খোঁজাখুঁজি করবেন, পুলিশে খবর দেবেন। এমনকী, বুনো ছেলেটাকে সন্দেহ করলে ইন্দৌরও যেতে রাজি হতে পারেন। এখন তো দেখছি, ইনি একজন মহাপুরুষ! এক লাখ-দেড় লাখ টাকা দামের একটা জিনিস হারিয়ে গেল কিংবা চুরি হল, তাও উনি গ্রাহ্যই করলেন না? পুলিশে খবর দিলেন না? কাকাবাবু হেসে বললেন, মহাপুরুষ টহাপুরুষ কিছু নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে আমি জানি, আংটি চুরি গেলে পুলিশ কোনও দিনই তা খুঁজে দিতে পারে না। শুধু শুধু আর এখানে বসে থেকে লাভ কী? আর, ওই বুনোকে আমি কিছুতেই সন্দেহ করতাম না। যে কথা বলতে পারে না, অর্থাৎ মিথ্যে কথাও শেখেনি। যারা মিথ্যে কথা বলতে শেখে না, তারা চুরিও করে না। কর্নেল বললেন, তা বোধহয় ঠিক। যাই হোক, চলেই যখন যাচ্ছেন, আপনাকে দু-একটা খবর দিই। কাল আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে আমি একবার থানায় গিয়েছিলাম। মোহনকুমার লোকটা ভাল নয়, ঘুষটুষ খায়। যাই হোক, ওর কাছ থেকে আমি সুরজ সিংহের ঠিকানা নিয়ে নিলাম। কারণ, ওই বুনো ছেলেটা কেমন থাকেটাকে, তা আমার একবার দেখে আসার ইচ্ছে আছে। ইন্দৌরের পুলিশ কমিশনার সুজনপ্রসাদ আমার বিশেষ বন্ধু। কাল রাত্তিরেই তাকে ফোন করে বললাম, সে যেন ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে একটু খোঁজখবর নেয়। প্রথম প্রথম কিছু প্রবলেম তো হতেই পারে, পুলিশ যদি সাহায্য করে…। কাকাবাবু বললেন, এটা আপনি ভালই করেছেন। কর্নেল বললেন, আজ সকালেই সুজন প্রসাদের ফোন পেয়েছি। সে বলল, ইন্দৌর শহরে সুরজ সিংহ নামে কোনও ব্যবসায়ী নেই, যে ঠিকানা সে দিয়ে গিয়েছে, ওই নামে ইন্দৌর কোনও রাস্তা নেই। সবটাই মিথ্যে। জোজো বলল, ও মা, তা হলে ওরা বুনোকে কোথায় নিয়ে গেল? কর্নেল বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, ও লোকটা বুনোর কাকা নয়। জোজো বলল, আমারও একবার তাই মনে হয়েছিল। কাকাবাবু বললেন,যাঃ! ওই বয়সের কত গরিবের ছেলে রাস্তায় থাকে, ভাল করে খেতে পায় না, কেউ কি তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়? তবে এই ছেলেটার জন্য কেন একজন লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এত দূর ছুটে আসবে? হয়তো ঠিক ইন্দৌর নয়, কাছাকাছি অন্য কোনও শহরে ওদের বাড়ি। কর্নেল বললেন, সুরজ সিংহ আপনাকে কোনও কার্ড দিয়েছে? কাকাবাবু বললেন, না। আমিও চাইনি। পুলিশের কাছেই তো ঠিকানা রেখে গিয়েছে। আপনার বন্ধু সুজনপ্রসাদকে আবার খোঁজ নিতে বলুন। সন্তু বলল,দমদম কিংবা বরানগরে যারা থাকে, তারাও তো বাইরে এসে বলে, কলকাতায় থাকি। সেইরকম সুরজ সিংহরাও বোধহয় ইন্দোরের আশপাশে কোথাও…। কর্নেল বললেন, অত তাড়াহুড়ো করে ছেলেটাকে নিয়ে গেল, ইন্দৌর ঠিকানাটা মিলছে না, তাই কীরকম যেন রহস্যজনক লাগছে। কাকাবাবু বললেন, সব কিছুর মধ্যে এমন রহস্য খুঁজে লাভ নেই। ছেলেটা ভালই থাকবে আশা করি। আমাদের তো এর বেশি আর কিছু করার নেই। চল রে সন্তু। এবার আমাদের বেরোতে হবে। কর্নেল বললেন, আপনাদের কিন্তু আবার এখানে আসতে হবে। অনেক কিছুই তো দেখা হল না। কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। দেখা যাক, আবার কবে হয়। আপনি কলকাতায় গেলে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবেন। তখন অনেক গল্প হবে। কর্নেল একে একে সন্তু আর জোজোকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। তারপর কাকাবাবুর হাত ধরে বললেন, আবার দেখা হবে। ভাল থাকবেন? কলেজ থেকে ফিরে সন্তু দেখল, কাকাবাবুর ঘরে দুজন ফরসা বিদেশি বসে আছেন, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। নিশ্চয়ই কোনও দেশ থেকে কাকাবাবুকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। এরকম আজকাল আসছে অনেকেই। কাকাবাবু সহজে যেতে চান না। বিদেশে তাঁর থাকতে ইচ্ছে করে না বেশি দিন। সন্তুর আজ ব্যাডমিন্টন কম্পিটিশনের খেলা আছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছটার সময়। সে একটু পরেই বেরিয়ে গেল। সে ফেরার পর কাকাবাবু তাকে ডেকে বললেন, কী রে, তোর খেলার রেজাল্ট কী হল? সন্তু বলল, জিতেছি। এবার সেমিফাইনাল। পরশু দিন আবার খেলা। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেমিফাইনালে কার সঙ্গে খেলতে হবে? সন্তু বলল, একটি জাপানি ছেলে। জুনিয়র গ্রুপে
false
robindronath
আছে। যেখানে দাবি করা চলে সেখানে ভিক্ষা করা কেন। আদর যে কাড়িয়া লইতে পারেন। কী বলেন মহেন্দ্রবাবু।” মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফূর্তি হইতেছিল না। বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর-কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে? বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম তাহাই প্রচুর। বিনোদিনী। ঠাট্টা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না। রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিল–মহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল না–সম্পূর্ণ যোগ দিল। প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়–তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।” বিহারী কহিল, “তাই না কি। তবে কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তাঁর সামনে নাই গেলাম।” মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে, তাহা সে মনে করে নাই। বিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে। সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মাপ করিতে হইবে।” বিনোদিনী। কেন, বিহারীবাবু। বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেন। তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব। বিনোদিনী। সে কি হয়, বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্যে কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না। এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ মলান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল। বিহারী ক্ষণকালের জন্যে মনে করিল, “মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।” সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি যাইবে বলিয়া ধরিয়া বসিয়াছে।” মহেন্দ্র কহিল, “কেন মা, এখানে তাঁর কি অসুবিধা হইতেছে।” রাজলক্ষ্মী। অসুবিধা না। বউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থবয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশি দিন থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে। মহেন্দ্র ক্ষুদ্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল?” বিহারী বসিয়া ছিল–মহেন্দ্র তাহার প্রতি ভর্ৎসনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, “কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল; বিনোদিনী বোধ হয় তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে।” স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল। ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই!” উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!” বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই।” মহেন্দ্র কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা।” আশা কহিল, “তবে কেন এমন করিয়া আমাদের মন কাড়িয়া লইলে।” সেদিন কিছুই স্থির হইল না। বিনোদিনী কহিল, “না ভাই, কাজ নাই, দুদিনের জন্য মায়া না বাড়ানোই ভালো।” বলিয়া ব্যাকুলচক্ষে একবার মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। পরদিন বিহারী আসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, যাবার কথা কেন বলিতেছেন। কিছু দোষ করিয়াছি কি-তাহারই শাস্তি?” বিনোদিনী একটু মুখ ফিরাইয়া কহিল, “দোষ আপনি কেন করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ।” বিহারী। আপনি যদি চলিয়া যান তো আমার কেবলই মনে হইবে, আমারই উপর রাগ করিয়া গেলেন। বিনোদিনী করুণচক্ষে মিনতি প্রকাশ করিয়া বিহারীর মুখের দিকে চাহিল–কহিল, “আমার কি থাকা উচিত হয়, আপনিই বলুন-না।” বিহারী মুশকিলে পড়িল। থাকা উচিত, এ কথা সে কেমন করিয়া বলিবে। কহিল, “অবশ্য আপনাকে তো যাইতেই হইবে, না-হয় আর দু-চার দিন থাকিয়া গেলেন, তাহাতে ক্ষতি কী।” বিনোদিনী দুই চক্ষু নত করিয়া কহিল,”আপনারা সকলেই আমাকে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন-আপনাদের কথা এড়াইয়া যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন–কিন্তু আপনারা বড়ো অন্যায় করিতেছেন।” বলিতে বলিতে তাহার ঘনদীর্ঘ চক্ষুপল্লবের মধ্য দিয়া মোটা মোটা অশ্রুর ফোঁটা দ্রুতবেগে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। বিহারী এই নীরব অজস্র অশ্রুজলে ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “কয়দিনমাত্র আসিয়া আপনার গুণে আপনি সকলকে বশ করিয়া লইয়াছেন, সেইজন্যই আপনাকে কেহ ছাড়িতে চান না–কিছু মনে করিবেন না বিনোদ-বোঠান, এমন লক্ষ্মীকে কে ইচ্ছা করিয়া বিদায় দেয়!” আশা এক কোণে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিল, সে আঁচল তুলিয়া ঘনঘন চোখ মুছিতে লাগিল। ইহার পরে বিনোদিনী আর যাইবার কথা উত্থাপন করিল না। ১৭ মাঝখানের এই গোলমালটা একেবারে মুছিয়া ফেলিবার জন্য মহেন্দ্র প্রস্তাব করিল, “আসছে রবিবারে দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক।” আশা অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল। বিনোদিনী কিছুতেই রাজি হইল না। মহেন্দ্র ও আশা বিনোদিনীর আপত্তিতে ভারি মুষড়িয়া গেল। তাহারা মনে করিল, আজকাল বিনোদিনী কেমন যেন দূরে সরিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে। বিকালবেলায় বিহারী আসিবামাত্র বিনোদিনী কহিল, “দেখুন তো বিহারীবাবু, মহিনবাবু দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিতে যাইবেন, আমি সঙ্গে যাইতে চাহি নাই বলিয়া আজ সকাল হইতে দুইজনে মিলিয়া রাগ করিয়া বসিয়াছেন।” বিহারী কহিল, “অন্যায় রাগ করেন নাই। আপনি না গেলে ইঁহাদের চড়িভাতিতে যে কাণ্ডটা হইবে, অতিবড়ো শত্রুরও যেন তেমন না হয়।” বিনোদিনী। চলুন-না বিহারীবাবু। আপনি যদি যান, তবে আমি যাইতে রাজি আছি। বিহারী। উত্তম কথা। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, কর্তা কী বলেন। বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর এই বিশেষ পক্ষপাতে কর্তা গৃহিণী উভয়েই মনে মনে ক্ষুণ্ন হইল। বিহারীকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে মহেন্দ্রের অর্ধেক উৎসাহ উড়িয়া গেল। বিহারীর উপস্থিতি বিনোদিনীর পক্ষে সকল সময়েই অপ্রিয়, এই কথাটাই বন্ধুর মনে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য মহেন্দ্র ব্যস্ত–কিন্তু অতঃপর বিহারীকে আটক করিয়া রাখা অসাধ্য হইবে। মহেন্দ্র কহিল, “তা বেশ তো, ভালোই তো। কিন্তু বিহারী, তুমি যেখানে যাও একটা হাঙ্গামা না করিয়া ছাড় না। হয়তো সেখানে পাড়া হইতে রাজ্যের ছেলে জোটাইয়া বসিবে, নয় তো কোন্‌ গোরার সঙ্গে মারামারি বাধাইয়া দিবে–কিছু বলা যায় না।” বিহারী মহেন্দ্রর আন্তরিক অনিচ্ছা বুঝিয়া মনে মনে হাসিল–কহিল, “সেই তো সংসারের
false
humayun_ahmed
সমুদ্র আরো বেশি সুফলদায়ক। এমরান সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। ছুটির ফর্ম আনতে বললেন। আখলাক সাহেবকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের ঘর থেকে বেরুতে হলো। আখলাক সাহেব খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। এই সাত দিন তিনি ঘরে বসে থেকে কী করবেন? পাহাড় সমুদ্র এইসব বিষয়ের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। মিলিদের সঙ্গে একবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলেন, সমুদ্রের গর্জন শুনে মাথা ধরে গেল। রাতে আর ঘুম আসে না। গাদাখানিক পানি দেখার মধ্যে লোকজন কী মজা পায় কে জানে। তিনি টিচার্স কমন রুমে এসে বসলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন সবাই যেন কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। শামসুদিন সাহেব গলাখাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন আখলাক সাহেব? ভালো। সাত দিনের ছুটি নিয়েছেন শুনলাম? হুঁ। সমুদ্র দেখতে যাচ্ছেন? আখলাক সাহেব ভেবে পেলেন না। তাঁর ছুটির খবরটা ইতিমধ্যে জানাজানি হলো কীভাবে! তিনি তো কাউকে কিছু বলেন নি। শামসুদিন সাহেব বললেন, আপনার হামাগুড়ি থিওরি শুনলাম। অসাধারণ। বৈপ্লবিক বলা যেতে পাবে। আপনার সে-রকম মনে হচ্ছে? অবশ্যই মনে হচ্ছে। থিওরি অব রিলেটিভিটির পর এমন বৈপ্লবিক ধারণা আর আসে। নি। কে কী বলবে না বলবে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। লোকে আপনাকে পাগল ভাবলেও আপনি কেয়ার করবেন না। গ্যালিলিও যখন বললেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন অনেকেই তাঁকে পাগল ভেবেছিলেন। মহান থিওরিব প্রচারকরা সবসময়ই পাগল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। গ্রেট ট্র্যাজেডি। দবিরুদ্দিন বললেন, আপনার থিওরি আমার কাছেও গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। শুধু একটাই সমস্যা আমাদের দুজোড়া করে জুতা লাগবে। পায়ের জন্যে এক জোড়া, আবার হাতে পরার জন্যে আরেক জোড়া। হাতে পরা জুতার অন্য একটা নাম থাকা দরকার। হুতা নাম দিলে কেমন হয়? পায়েরটা জুতা আর হাতেরটা হুতা। আখলাক সাহেবের সন্দেহ হলো এরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে। তাঁর মন বিষন্ন হলো। তিনি কাউকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করেন না। তারা কেন তাকে নিয়ে করবে? শামসুদ্দিন বললেন, শুধু হাতের জুতা থাকলেই হবে না হাঁটুর জন্যেও কিছু একটা দরকার। হামাগুড়ি দেয়ার সময় হাঁটু মাটিতে লাগে। চামড়া বা প্লাস্টিকের টুপি জাতীয় কিছু লাগবে হাঁটুর জন্যে। এইসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। দবিরুদ্দিন বললেন, আর একটা বড় সমস্যার কথা আপনারা চিন্তাই করছেন না। ঈদের সময় রাস্তা-ঘাটের ভিড় লক্ষ করেছেন? চারপায়ে হাঁটলে অনেকখানি জায়গা নিয়ে নেবে। ভিড়ের অবস্থাটা হবে কী? শামসুদিন বললেন, এর একটা ভালো দিকও আছে। ছোট বাচ্চাকাচ্চারা ঘোড়ার মতো পিঠে বসে থাকবে। এরা ঘ্যানঘ্যান করবে না। আনন্দে থাকবে। ঘোড়ার পিঠের হাতির হাওদার মতো একটা হাওদা থাকলে বাচ্চারা পড়ে যাবে না। বেল্ট দিয়ে হাওদা কোমরের সঙ্গে বাধা থাকবে। আখলাক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। এইসব কথাবার্তা শুনতে তাঁর আর ভালো লাগছে না। আগামী সাত দিন তাঁর কিছু করার নেই–ভাবতেই খারাপ লাগছে। বাসায় ফিরতেও ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা লোকজন কি তাঁকে পাগল ভাবতে শুরু করেছে? পাগলের কোনো আচরণ কি তিনি করছেন? মনে হয় না তো। অবশ্যি তিনি কোনো পাগলকে ভালোভাবে লক্ষ করেন নি। ছোটবেলায় মামার বাড়িতে একটা পাগল আসত। তাকে দেখে দৌড়ে ঘরে পালাতেন। তার আচার আচরণ ভালো মতো দেখা হয় নি। একটা বড় ভুল হয়েছে। এখন থেকে পাগল দেখলে খুব ভালো করে লক্ষ করতে হবে। দূর থেকে লক্ষ করা। কাছে যাওয়া যাবে না। তিনি কুকুর এবং পাগল এই দুই জিনিসকে বড়ই ভয় পান। আখলাক সাহেব রাত ঠিক নটায় ভাত খান। রাতে আমিষ খান না। সামান্য ভাত, একটা ভাজি আর ডাল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয় বলে কোথায় যেন পড়েছিলেন। তিনি তা মেনে চলছেন। মোতালেব ভাত নিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখল আখলাক সাহেব বিছানার উপর চারপায়ে ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। ঘোড়া যেভাবে কোমর নাড়ায় তিনিও মাঝে মাঝে সেভাবেই কোমর নাড়াচ্ছেন। মোতালেব বলল, আফনের কী হইছে? কিছু হয় নি। আফনে ঘোড়া হইছেন ক্যান? আখলাক সাহেব ঠিক হয়ে বিছানায় বসলেন। তিনি যে হামাগুড়িব মতো কবছিলেন নিজেও বুঝতে পারেন নি। ব্যাপারটা ঠিক হয় নি। নিজের উপরই রাগ লাগছে। মোতালেব আবার বলল, আফনের কী হইছে? বললাম তো কিছু হয় নি। এটা হচ্ছে এক ধরনের ব্যায়াম। চিন্তা শক্তি বাড়াবার ব্যায়াম! ো আইচ্ছা। এখন থেকে এই ব্যায়াম তুইও কববি। রোজ দুঘণ্টা করে। মোতালেবের মুখ হা হয়ে গেল। আখলাক সাহেব উৎসাহিত গলায় বললেন–তোর ব্রেইন বলে তো কোনো পদার্থ নেই। এক বৎসর চেষ্টা করে অক্ষর জ্ঞান করাতে পারলাম না। এই ব্যায়ামের পরে দেখবি ফটাফট অক্ষর শিখে ফেলবি। আজ থেকেই শুরু কর। মোতালেবকে খুব আগ্রহী মনে হলো না। বরং তাকে চিন্তিত মনে হলো। তবে আখলাক সাহেব খুবই আগ্রহ বোধ করছেন। ভূত যা বলছে তা সত্যি কিনা তা পরীক্ষা করার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। মোতালেব! জি খালুজান। সকালে এক ঘণ্টা আর সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা দুঘণ্টা চারপায়ে থাকবি। জি আইচ্ছা। আখলাক সাহেব খেতে বসেছেন। আরাম করে খাচ্ছেন। মোতালেব বিমর্ষ মুখে তাঁর খাওয়া দেখছে। আখলাক সাহেব বললেন, চারপায়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। ইচ্ছা করলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবি। চারপায়ে যাবি। মাইনষে পাগল কইব। আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, পাগল বলবে কেন? এর মধ্যে পাগল বলার কী আছে? উলট পালটা কাম করলে লোকে পাগল কয়। আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, উলটা পালটা কাজ মানে কী? এই ধরেন।
false
humayun_ahmed
চিন্তা মাথায় ঢুকতে দেয়া যাবে না। যিনি তার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে–সুপুরুষ একজন মানুষ। মাথার চুল পেকে গেছে, এই নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। চুলে কলপ দেন না। ভদ্রলোক এখন সামান্য ঝুঁকে আসছেন। এখন কি প্রশ্ন করবেন? তোমার নাম মতিন উদ্দিন খান পাঠান? জি স্যার। নামের শেষে দুটা পদবি সচরাচর দেখা যায় না। স্যার, আমার নামটা রেখেছিলেন আমার বাবার পীর সাহেব। পীর সাহেবের দেশ ইউপিতে–সেখানে মনে হয় এই ধরনের নাম রাখা হয়। তোমার পড়াশুনা কতদূর? ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাস করেছি। এমএ করার ইচ্ছা ছিল। টাকা পয়সা জোগাড় হয় নি। (আবার উত্তরে ভুল হয়ে গেল। টাকা-পয়সা জোগাড় হয় নি কথাটার মধ্যে ফকির ভাব আছে। করুণা প্রার্থনা। আমাকে দয়া কর, ভিক্ষা দাও টাইপ প্রার্থনা।) অনার্সের রেজাল্ট কী? রেজাল্ট ভালো না। সেকেন্ড ক্লাস। নিচের দিকে। শব্দটার মানে জানো? জি-না স্যার। , এ ধরনের শব্দ পাও নি? জি-না। মতিন পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেল। সামান্য একটা শব্দের মানে না জানার জন্যে চাকরি হবে না, এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। বড় বড় দুর্ঘটনা অতি সামান্য কারণে ঘটে। মতিনের বড় মামা কলা খেতে খেতে নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার থেকে ফিরছিলেন। নিজের ছুড়ে ফেলা কলার খোসায় পা পিছলে তিনি উল্টে পড়ে গেলেন। লোকজন ধরাধরি করে তুলল, তিনি বসা অবস্থা থেকে আবার পড়ে গেলেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দেখে বললেন, মারা গেছে। তোমার নামটা তো অনেক বড়। ছোট করে কী ডাকা যায় বলো তো? মতিন ডাকতে পারেন স্যার। মতিন তোমার ডাকনাম? জি-না, আমার ডাকনাম মতি। তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমার স্ত্রী চলে আসবে, তখন দুজনে মিলে তোমার সঙ্গে কথা বলব। এর মধ্যে চা খাও। আমি তোমাকে চা দিতে বলে দিচ্ছি। স্যার, আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার, বড়টা না, ছোটটা। অফকোর্স। যে চা নিয়ে আসবে সে তোমাকে বাথরুম দেখিয়ে দেবে। ফিল ফ্রি। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মতিনের ইচ্ছা করছে নিজেকেই নিজে লাথি মারে। উনার সঙ্গে বাথরুম নিয়ে এত কথা বলার কিছুই ছিল না। উনি তো চলেই যাচ্ছেন। উনি চলে যাওয়া মানেই ফাকা ঘর। তখন সে দারোয়ান, বয় বাবুর্চি টাইপ যে-কোনো একজনকে বলতে পারত–ভাই, আপনাদের বাথরুমটা কোন দিকে? আমার হাত-মুখ ধোয়া দরকার। তা না বলে সে বলেছে, আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। বড়টা না, ছোটটা। বাথরুমে গিয়ে সে কী করবে সেটা তার ব্যাপার এত ব্যাখ্যা কেন? তবে এখনো পুরোপুরি নিরাশ হবার মতো ঘটনা ঘটে নি। মূল ইন্টারভিউ বেগম সাহেবের অ অপেক্ষা করছে আসল চাবিকাঠি নিশ্চয়ই তার হাতে। রাজা দেশ চালালেও চাবি থাকে রানীর কাছে। অবশ্যি রানী দেশ চালালে চাবি তাঁর কাছেই থাকে। তারা কখনো রাজাকে চাবি দেন না। রানীরা চাবি হাতছাড়া করেন না। মতিনের জন্য চা এসেছে। মাঝারি সাইজের কাচের ট্রেতে চায়ের কাপ। ট্রে এবং চায়ের কাপের মধ্যে যোগাযোগ আছে। যে ডিজাইনের ট্রে, একই ডিজাইনের চায়ের কাপ। এত সুন্দর লাগছে দেখতে! মতিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সব সৌন্দর্য ক্ষমতাবানদের হাতে চলে যাচ্ছে। মহান কোনো শিল্পী অপূর্ব কোনো ছবি আঁকলেন, সেই ছবির স্থান হলো গার্মেন্টসের মালিকের বসার ঘরে। বেয়ারা টাইপ লোকটি চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, স্যার, আসেন আমার সঙ্গে। মতিন অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব? বড় সাহেব বলেছিলেন, আপনি বাথরুমে যাবেন। ও আচ্ছা আচ্ছা। গুড। চল যাই। তোমার নাম কী? লোকটি নাম বলল না। বিরক্ত মুখে সে হাঁটছে। মতিন তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। অতি ধনবানদের কাজের লোকরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনায় যায় না। ব্যাপারটা মতিনের মনে ছিল না। মনে থাকলে নাম জানার ঝামেলায় যেত না। বাথরুম দেখে মতিনের চোখ ঝলসে গেল। এমন একটা সুন্দর জায়গায় ছোট বাথরুম করা গেলেও বড় বাথরুম করা সম্ভবই না। মতিন কাজ সারলো। চোখে-মুখে পানি দিল। বাথটাবের এক কোনায় বসল। এ জাতীয় বাথরুমে আবার আসার সুযোগ নাও আসতে পারে। সুযোগটা কাজে লাগানো দরকার। যেখানে সে বসেছে সেখানে কাচের জারে একগাদা সাবান। কোনোটা মাছের মতো, কোনোটা ফুলের মতো। একটা সাবান পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা খুব কি অন্যায় হবে? সাবানের হিসাব কি তাদের কাছে আছে? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে চায়ে চুমুক দেয়া দরকার। চায়ের কথা মনে হতেই মতিনের সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বাথরুমের কোথাও লেখা নেই–নো স্মোকিং। একটা সিগারেট ধরিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দেয়া যায় না? বাথরুম গান্ধা হয়ে যাবে? বাথরুম তো গান্ধা হবার জন্যেই। কমোডে যে জিনিস ফেলা হয় তা থেকে নিশ্চয়ই কর্পূরের সুবাস বের হয় না! মতিন সিগারেট ভেবে প্যান্টের পকেট থেকে যে জিনিস বের করল তার নাম মোবাইল সেট। মোবাইল টেলিফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াবার মতো আর্থিক অবস্থা মতিনের না। এই বস্তুটি তাকে দিয়েছে নিশু। নিশু তার সঙ্গেই পড়তো। মতিন ছিটকে বের হয়ে এসেছে, নিশু বের হয় নি। সে এমএ শেষ করেছে। এখন তার ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা হচ্ছে। সে ফনেটিক্সে পিএইচডি করবে। নিশুকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই সে ফাটাফাটি ভালো ছাত্রী। অনার্স, এমএ দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস। নিশুর সঙ্গে মিনিটখানিক কথা বললে কেমন হয়? এক মিনিটে চা আর কতটা ঠাণ্ডা হবে? হলে হবে। হ্যালো নিশু! তুমি কোথায়? আমি টাট্টিখানায়। টাট্টিখানায় মানে? টাট্টিখানা কী? টাট্টিখানা শব্দটি প্রায় লুপ্ত। এটা কোনো তৎসম শব্দ না। আদি
false
shunil_gongopaddhay
কেন? –জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে তো–সকলের নেশা হলে মুশকিল! —তাও হিসেব করে রেখেছিস! হিসেবগুলো একটু ভুলে যা না একদিন। জঙ্গলের মধ্যে ফিরলে কি হবে? রবি চৌধুরী সঙ্গে আছে, কোনো ভয় নেই। ফেরা-পথের দৃশ্য অন্যরকম। জ্যোৎস্নায় সমস্ত বন ধুয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর এক প্রান্তে এখন সত্যকার নিস্তব্ধতা! বুবির বেশি নেশা হয়েছে, সে স্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ইংরিজি গান গাইছে দীর্ঘ গলায়; হঠাৎ গান থামিয়ে উৎফুল্লাভাবে দাবি জানালো, আয় সঞ্জয়, তোতে আমাতে নাচি। –দেখবি, নাচবো দেখবি? ফাঁকা রাস্তায় অসীম খানিকটা ছুটে এগিয়ে গেল, তারপর ওদের দিকে ফিরে টুইষ্ট নাচতে লাগলো। সেই জ্যোৎস্নায়, দুপাশে নীরব বৃক্ষ দর্শক, চওড়া রাস্তায় অসীমের আবছা মূর্তিটা খানিকটা অলৌকিক দেখাতে লাগলো, রবি ওর নাচে সুর দিচ্ছে। শেখর হাততালি দিয়ে তাল দিতে দিতে বললো, আঃ, খুব ভালো লাগছে রে; তুই ঠিক বলেছিল অসীম, এই জঙ্গল থেকে আর বাইরে যাবো না! এখানে যে কদিন আছি, জঙ্গলের মধ্যেই থাকবো, আর মহুয়া খাবো। পরের দিনই ওদের অবশ্য একবার শহরে যেতে হলো। প্রথমদিন ঠাণ্ডা কুয়োর জলে স্নান করার পর সঞ্জয়ের একটু সর্দি লেগেছে–ওষুধ কেনা দরকার। নেশা করলে পরের দিন ভোরে অসীমের মাথা ধরে-তার অ্যাসপিরিন লাগছে। তা ছাড়াও ওদের খেয়াল হয়েছিল ওরা কেউ চিরুনি আনে নি, একজন কেউ আনবেই–এই ভেবে কেউই নিজে চিরুনি আনে নি। রবির চুল চাপ বাঁধা, কোঁকড়ানো, তার চিরুনি না থাকলেও চলে, শেখরের স্বভাব যখন-তখন বাঁ হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে চিরুনির মতন চালানো, কিন্তু অসীম ও সঞ্জয়ের চুল অবাধ্য বিশেষত সঞ্জয় যথেষ্ট শৌখিন প্রকৃতির যতবার সে মুখ ধোয়–ততবারই চুল আঁচড়ে নেওয়া তার চাই, সুতরাং চিরুনি একটা দরকারই। খবরের কাগজ পড়ার ইচ্ছে অবশ্য কারুরই নেই, কিন্তু মাদ্ৰাজ টেস্ট্রে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ইন্ডিয়া হারালো কি জিতলো, সে খবরটা অন্তত না জানলে চলে না। তা ছাড়া, সকালবেলা চায়ের সঙ্গে ডিম সেদ্ধ খাওয়া বহুদিনের অভ্যাস, দুদিন ডিম না পেয়ে ওরা উসখুস করছে। অসীমের মত এই যে, রান্না নিয়ে বেশি ঝঞ্ঝাট করার মানে হয় না বটে, কিন্তু গরম ভাতের সঙ্গে খানিকটা মাখন পেলে যে-কোনো জিনিসই সুখাদ্য হয়ে উঠবে। একটা মাখনের টিন কিনলে খুব ভালো হয়। সিগারেটের স্টক রাখা দরকার। চৌকিদার রীতিলালের বউয়ের খুব অসুখ, সে লোকটা খুব বিব্রত হয়ে আছে। উলুন ধরাচ্ছে, চা বানিয়ে দিচ্ছে, বাথরুমের ট্যাঙ্কে জল ভারছে ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝেই সে রেললাইনের ওপারে নিজের গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।। লিখা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে সব সময়, যে-কোনো হুকুম তামিল করার জন্য উদ্‌গ্রীব, কিন্তু রবির ধারণা লোকটা বড্ড বেশি চোর, ওকে দিয়ে সব জিনিস আনানো উচিত নয়। ডাকবাংলোর পেছন দিকে ফাঁকা মাঠ, সেখান দিয়ে বাজার ও স্টেশন সর্ট-কাট হয়। চা খাবার পর কিছুক্ষণ আলস্য করে, ওরা সবাই শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। যার যা দরকার একেবারেই কিনে আনা ভালো। দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম অবশ্য ওরা সবাই এনেছে, কিন্তু আজ সকালে দাড়ি কামাবার ইচ্ছে কারুরই দেখা গেল না। এই জঙ্গলের মধ্যে আর কে দেখতে আসছে—দরকার কী ওসব ঝামেলার। সঞ্জয় অবশ্য নিজের ধারালো গালে দুএকবার হাত বুলালো, কিন্তু চুল আঁচড়ানোই যাচ্ছে না। যখন— আবার সেই নোংরা বাজার, রেডিওর চিল্লানি, হোটেলের ভালো-ভালো গন্ধ। সেইসব কৌতূহলী চোখ, নীল ড়ুমো ড়ুমে মাছি। রাস্তার কাদা শুকিয়ে এসেছে, কিন্তু তাতে বহু মানুষের পায়ের ছাপা আঁকা। টিনের মাখন পাওয়া গেল না।অতিরিক্ত হলদেটে রঙের স্থানীয় মাখন। কিনতে হলো–অত্যন্ত বেশি দাম দিয়ে। চিরুনি জুটলো প্লাস্টিকের সস্তা চিরুনি! একটা দোকান থেকে দশ প্যাকেট সিগারেট কিনতে–সে দোকানের সব সিগারেটই শেষ হয়ে গেল। চটের থলেতে বিছিয়ে গুচ্ছের আলু-পেঁয়াজ-কুমড়ো-পটল নিয়ে বসেছে দুএকজন, কিন্তু ডিমের কোনো দেখা নেই। মঙ্গলবারের হাট ছাড়া ডিম অসম্ভব। একটা হোটেলের সামনে তারের ঝুড়িতে ডিম ঝোলানো রয়েছে, কিন্তু সে ডিম আলাদা বিক্রি হবে না, সুতরাং ওরা সেখান থেকেই চারটি ডিম সিদ্ধ খেয়ে নিলে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, জঙ্গলের শান্ত আবহাওয়া ছেড়ে এই নোংরা বাজারে এসে ওরা কেউ খুশি হয় নি। তবু, তৎক্ষণাৎ ফিরে যাবার পক্ষেও একটা কিছু অতৃপ্তি রয়ে যাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা চলে এলো স্টেশনের পাশে। সেই বটগাছতলার বাঁধানো বেদিতে আজও দশ বারোটা সঁওতাল মেয়ে খালি ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। পরস্পর জটলা ও হাসাহাসি করছিল, ওদের দেখে থেমে গেল। অসীম বললো, আশ্চর্য দেখ, এখন প্রায় দশটা বাজে, আজিও ওরা এখানে বসে আছে। কে ওদের কাজ দেবে বুঝতে পারি না। রবি জবাব দিলো, সবাই কি আর কাজ পায়, হয়তো দুএকজন কাজ পায়। –কাল ভোরবেলা যে-কজন দেখেছিলাম, আজ এত বেলাতেও তো প্রায় সেই কজন দেখছি! –তুই গুণে রেখেছিলি বুঝি? –না, ঐ যে নীলপাড় শাড়ি পরা ফচকে মেয়েটা সবার সামনে বসে আছে, কালও তো ওকে দেখেছিলুম। আমার কাজ দেবার হলে আমি ওকেই প্রথমে কোনো কাজ দিতুম। –তাই দে না। কোনো একটা কাজের ছুতো খানিয়ে নে? –মন্দ বলিস নি, এদের কয়েকজনকে দিয়ে ডাকবাংলোয় আর একটা ঘর তুলে নিলে হয়। –ডাকবাংলোয় কেন? জঙ্গলের মধ্যে যে-ভাঙা বাড়িগুলো দেখলুম, সেগুলো নিশ্চয়ই বেওয়ারিস, সেগুলোই ওদের দিয়ে সারিয়ে আমরা নিয়ে নিলে পারি! মেয়েগুলো হাসি ও কথা থামিয়ে ওদের দিকে চেয়ে আছে। ওরা ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলো। সাঁওতাল মেয়েদের বয়েস ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু পনেরো থেকে পঁয়ত্ৰিশের মধ্যে বয়েস সবার নিশ্চিত। নীলপাড় শাড়ি পরা মেয়েটির বয়েসই কম
false
humayun_ahmed
কি সত্যি কথা বলছে? না তাকে খুশি করার জন্যে বাক্য তৈরি করছে। তাই নাকি? হ্যাঁ। যেদিন যেদিন বাবার চিঠি আসে। আমি আগে আগে বলে দেই। এই জন্যেই না বিশ্বাস করেছে। তুমি কেমন আছ সুমি? ভালো আছি। তোমার নতুন স্যার কেমন? ভালো। আমার চেয়ে ভালো? হুঁ। তোমার ধারণা আমি বেশি ভালো না? আপনি তো ভালো পড়াতে পারতেন না। ও আচ্ছা। আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন? না রাগ করি নি। শোন সুমি আমি তোমার জন্যে একটা বই নিয়ে এসেছি। ইংরেজি বই? না, বাংলা। পথের পাঁচালী। সত্যজিত রায়ের? না। সত্যজিত রায় তো ছবি বানিয়েছিলেন–এটা মূল বই বিভূতিভূষণের লেখা। বাংলা গল্পের বই পড়তে আমার ভালো লাগে না। হাসান বইটি বাড়িয়ে দিল। সুমি বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাল না। সে পা দোলাচ্ছে এবং হাসানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। হাসছ কেন সুমি? এমনি হাসছি। তোমার পরীক্ষা কবে? পরীক্ষা দেরি আছে। আপনি এত রোগা হয়ে গেছেন কেন স্যার? রোগা হয়ে গেছি নাকি? হুঁ। আপনার খুব জ্বর হয়েছিল তাই না? জুর অবশ্যি হয়েছিল। তুমি জানলে কীভাবে? সুমি জবাব দিল না। আগের মতো রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল এবং পা দোলাতে লাগল। ট্রেতে করে শিঙাড়া এবং চা নিয়ে সুমির মা ঢুকলেন। এটি একটি বিশেষ ভদ্রতা। অন্য সময় কাজের মেয়ে আসে। হাসান সাহেব কেমন আছেন? জ্বি ভালো। আপনার ছাত্রী আজ সকালেই বলছিল। আপনি আসবেন। হাসান চুপ করে রইল। সুমির মা বসতে বসতে বললেন, আপনার জন্যে আপনার ছাত্রী খুব ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার সঙ্গে আপনার গল্প করবে। আমাকে নিয়ে গল্প করার মতো তেমন মালমসলা তো তার কাছে নেই। গল্প করার জন্যে। ওর কোনো মালমসলা লাগে না। বানিয়ে বানিয়ে সে অনেক কিছু বলতে পারে। আপনার ছবিও সে এঁকেছে। সেগুলো কি দেখেছেন? জ্বি না। সুমি স্যারকে তোমার ছবি দেখাও। না। না কেন? ছবিগুলো তো সুন্দর হয়েছে। এনে দেখাও। না। সুমি পা দোলানো বন্ধ করে উঠে চলে গেল। তার জন্যে আনা বইটিও নিয়ে গেল না। ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে রইল অনাদরে। সুমির মা বললেন, আপনার ছাত্রী যে কীসে রাগ করে কীসে রাগ করে না তা বুঝা খুব মুশকিল। এখন রাগ করে উঠে গেল। রাগ করল কেন? একমাত্র সেই জানে কেন। হাসান সাহেব চা খান। আপনি এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। সামনের মাসে সুমির বাবা আসবেন—তখন আপনাকে খবর দেব। আপনি এসে আমাদের সঙ্গে একবেলা ডালভাত খাবেন। জ্বি আচ্ছা। আজ উঠি? একটু বসুন সুমিকে ডেকে নিয়ে আসি। ওকে হ্যালো বলে যান। জানি না সে আসবে কি না। সুমি এল না। তবে সুমির মা প্ৰথমবারের মতো আর একটা ভদ্রতা করলেন। ড্রাইভারকে বললেন–হাসানকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। ড্রাইভার বিরক্ত হলো–গাড়িতে চড়ার যোগ্য নয় মানুষকে গাড়িতে চড়তে দেবার ব্যাপারে ড্রাইভারদের খুব অনগ্ৰহ থাকে। বাজছে মাত্র আটটা। এখন বাসায় ফিরে হবে কী? ছাত্র অবস্থায় বাসায় ফেরার একটা তাড়া থাকে। বই নিয়ে বসতে হবে। এখন সেই তাড়া নেই। এম.এ. পরীক্ষাটা দিয়ে দেখলে হয়। সাহসে কুলৈাচ্ছে না। তারপরেও মনে হয় দেয়া উচিত। তখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে তাকে বলা যাবে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। কী করেন? ‘আমি কিছু করি না’ বলা খুব কষ্টের। ড্রাইভার বিরক্ত গলায় বলল, আপনে যাবেন কই? হাসান বলল, কোথাও যাব না। তোমার যেখানে ইচ্ছা আমাকে নামিয়ে দিতে পার। আপনার বাসা কোন দিকে? বাসা অনেক দূর। এতদূর আমাকে নিয়ে যাবার মতো ধৈর্য তোমার নেই–কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দাও। ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল। হাসান নেমে গেল। ড্রাইভারের সঙ্গে সামান্য রসিকতা করলে কেমন হয়? পকেট থেকে ছেড়া ন্যাতন্যাতে একটা এক টাকার নোট যদি ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলা হয়–এই নাও বকশিশ। ড্রাইভারের চোখমুখের ভাব কেমন হবে? যত ইন্টারেস্টিংই হোক চোখমুখের ভাব দেখাটা ঠিক হবে না। বেকারদের অনেক কিছু নিষিদ্ধ। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে রসিকতা। বেকারদের কিছু ধর্ম আছে। তাদের সেই ধর্ম পালন করতে হয়। হাসানের স্কুল জীবনের বন্ধু জহিরের মতে বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ (১) কচ্ছপ বৃত্তি। সব সময় কচ্ছপের মতো নিজেকে খোলসের ভেতর লুকিয়ে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে মাথা বের করে চারপাশ দেখে আবার টুক করে মাথা ঢুকিয়ে ফেলা। (২) গণ্ডার বৃত্তি। চামড়াটাকে গণ্ডারের চামড়ার মতো করে ফেলা। কোনো কিছুই যেন গায়ে না লাগে। গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও ক্ষতি হবে না। (৩) প্যাচা বৃত্তি। কাজকর্ম সবই রাতে। গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হবে রাত এগারটা থেকে বারটার দিকে যখন বেশিরভাগ মানুষ শুয়ে পড়ে। (৪) কাক বৃত্তি। কাকের মতো যেখানে যা পাওয়া যাবে তাই সোনামুখ করে খুঁটিয়ে খেয়ে ফেলা। কোনো অভিযোগ নেই। বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ যে মেনে চলে সে আদর্শ বেকার। তার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাও হবে না। হাসানের নিজের ধারণা সে একজন আদর্শ বেকার। আদর্শ বেকার রাত এগারটার আগে বাসায় ফেরে না। রাত এগারটা পর্যন্ত হাসানের করার কিছু নেই। জহিরের কাছে যাওয়া যায়। জহির থাকে। আগামসি লেনের এক মেসে; রাত বারটার আগে তাকে পাওয়া যাবে না। বারটা পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করা যায়। অনেকদিন জহিরের সঙ্গে দেখা হয় না। জহিরের ‘প্রোজেক্ট বাংলা হোটেলে’ কিছু টাকা দিয়ে আসা যায়। গত কয়েক মাসে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া
false
shottojit_roy
উনি কোনও সাধুবাবাকে এক্সপেক্ট করছিলেন না। কোথায় বসেছিলেন? বেয়ারা বলল, বৈঠকখানায়। আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন? হ্যাঁ। আমার নাম করেছিলেন? বেয়ারা তাতেও বলল হ্যাঁ। তাজ্জব ব্যাপার! হঠাৎ কী মনে করে ধীরুকাকা ঝড়ের মতো শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর গোদরেজ আলমারি খোলার শব্দ পেলাম। আর তার পরেই শুনলাম ধীরুকাকার চিৎকার— সর্বনাশ! বাবা, আমি আর ফেলুদা প্রায় একসঙ্গে হুড়মুড় করে ধীরুকাকার ঘরে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি উনি আংটির কৌটোটা হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। কৌটোর ঢাকনা খোলা, আর তার ভিতরে আংটি নেই। ধীরুকাক কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে ধপ করে তাঁর খাটের উপর বসে পড়লেন। পরদিন সকালে পরদিন সকালে মনে হল যে শীতটা একটু বেড়েছে, তাই বাবা বললেন গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে নিতে। বাবার কপালে ভ্রূকুটি আর একটা অন্যমনস্ক ভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম যে উনি খুব ভাবছেন। ধীরুকাকাও কোথায় জানি বেরিয়ে গেছেন—আর কাউকে কিছু বলেও যাননি। কালকের ঘটনার পর থেকেই কেবল বললেন—শ্ৰীবাস্তবকে মুখ দেখাব কী করে? বাবা অবিশ্যি অনেক সাস্তুনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। বিকেল বেলা সন্ন্যাসী সেজে চোর এসে তোমার বাড়ি থেকে আংটি নিয়ে যাবে সেটা তুমি জানবে কী করে। তার চেয়ে তুমি বরং পুলিশে একটা খবর দিয়ে দাও। তুমি তো বলছিলে ইনস্পেক্টর গরগরির সঙ্গে তোমার খুব আলাপ আছে। এও হতে পারে যে ধীরুকাকা হয়তো পুলিশে খবর দিতেই বেরিয়েছেন। সকালে যখন চা আর জ্যামরুটি খাচ্ছি, তখন বাবা বললেন, ভেবেছিলাম আজ তোদের রেসিডেন্সিটা দেখিয়ে আনব, কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে আজকের দিনটা যাক। তোরা দুজনে বরং কোথাও ঘুরে আসিস কাছাকাছির মধ্যে। কথাটা শুনে আমার একটু হাসিই পেয়ে গেল, কারণ ফেলুদা বলছিল ওর একটু পায়ে হেঁটে শহরটা দেখার ইচ্ছে আছে, আর আমিও মনে মনে ঠিক করেছিলাম ওর সঙ্গে যাব। আমি জানতাম শুধু শহর দেখা ছাড়াও ওর অন্য উদ্দেশ্য আছে। আমি সন্ধেবেলা থেকেই দেখছি ওর চোখের দৃষ্টিট মাঝে মাঝে কেমন জানি তীক্ষ হয়ে উঠছে। আটটার একটু পরেই আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। গেটের কাছাকাছি এসে ফেলুদা বলল, তোকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি—বক্‌ বক্‌ করলে বা বেশি প্রশ্ন করলে তোকে ফেরত পাঠিয়ে দেব। বোকা সেজে থাকবি, আর পাশে পাশে হাটবি। কিন্তু ধীরুকাক যদি পুলিশে খবর দেন? তাতে কী হল? ওরা যদি তোমার আগে চোর ধরে ফেলে? তাতে আর কী? নিজের নামটা চেঞ্জ করে ফেলব। ধীরুকাকার বাড়িটা যে রাস্তায় সেটার নাম ফ্রেজার রোড। বেশ নির্জন রাস্তাটা। দুদিকে গেট আর বাগান-ওয়ালা বাড়ি, তাতে শুধু যে বাঙালিরা থাকে তা নয়। ফ্লেজার রোডটা গিয়ে পড়েছে ডাপলিং রোডে, লখ্‌নৌতে একটা সুবিধে আছে—রাস্তার নামগুলো বেশ বড় বড় পাথরের ফলকে লেখা থাকে। কলকাতার মতো খুঁজে বার করতে সময় লাগে না। ডাপ্‌লিং রোডটা যেখানে গিয়ে পার্ক রোডে মিশেছে, সেই মোড়টাতে একটা পানের দোকান দেখে ফেলুদা হেলতে দুলতে সেটার সামনে গিয়ে বলল, মিঠা পান হ্যায়? মিঠা পান? নেহি, বাবুজি। লেকিন মিঠা মাসাল্লা দেকে বানা দেনে সেকতা। তাই দিজিয়ে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বাংলা দেশ ছাড়লেই এই একটা প্রবলেম। পানটা কিনে মুখে পুরে দিয়ে ফেলুদা বলল, হ্যাঁ ভাই, আমি এ-শহরে নতুন লোক। এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনটা কোথায় বলতে পার? ফেলুদা অবিশ্যি হিন্দিতে প্রশ্ন করছিল, আর লোকটাও হিন্দিতে জবাব দিয়েছিল, কিন্তু আমি বাংলাতেই লিখছি। দোকানদার বলল, রামকিষণ মিসির? রামকৃষ্ণ মিশন। শহরে একজন বড় সাধুবাবা এসেছেন, আমি তাঁর খোঁজ করছি। শুনলাম তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে উঠেছেন। দোকানদার মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে কী জানি বলে বিড়ি বাঁধতে আরম্ভ করে দিল। কিন্তু দোকানের পাশেই একটা খাটিয়ায় একটা ইয়াবড় গোঁফওয়ালা লোক একটা পুরনো মরচে ধরা বিস্কুটের টিন বাজিয়ে গান করছিল, সে হঠাৎ ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করল, কালো গোঁফদাড়িওয়ালা কালো চশমা পরা সাধু কি? তাই যদি হয় তা হলে তাকে কাল সন্ধেবেলা টাঙ্গার স্ট্যান্ড কোথায় বলে দিয়েছিলাম। কোথায় টাঙ্গার স্ট্যান্ড? এখান থেকে পাঁচ মিনিট। ওই দিকে প্রথম চৌমাথাটায় গেলেই সার সার গাড়ি দাঁড়ানো আছে দেখতে পাবেন। শুক্রিয়া! শুক্রিয়া কথাটা প্রথম শুনলাম। ফেলুদা বলল ওটা হল উর্দুতে থ্যাঙ্ক ইউ। টাঙ্গা স্ট্যান্ডে পৌঁছে সাতটা টাঙ্গাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করার পর আট বারের বার সাতান্ন নম্বর গাড়ির গাড়োয়ান বলল যে গতকাল সন্ধ্যায় একজন গেরুয়াপরা দাড়িগোঁফওয়ালা লোক তার গাড়ি ভাড়া করেছিল বটে। কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে সাধুবাবাকে?—ফেলুদা প্রশ্ন করল। গাড়োয়ান বলল, ইস্টিশান। স্টেশন? হাঁ। কত ভাড়া এখান থেকে? বারো আনা। কত টাইম লাগবে পৌঁছুতে? দশ মিনিটের মতো। চার আনা বেশি দিলে আট মিনিটে পৌঁছে দেবে? টিরেন পাকাড়ন হ্যায় কেয়া? টিরেন বলে টিরেন। বঢ়িয়া টিরেন—বাদশাহী এক্সপ্রেস! গাড়োয়ান একটু বোকার মতো হেসে বলল, চলিয়ে—আট মিনিটমে পৌঁছা দেঙ্গে! গাড়ি ছাড়বার পর ফেলুদাকে একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেই সাধুবাবা কি এখনও বসে আছেন স্টেশনে আংটি নিয়ে? এটা বলতে ফেলুদা আমার দিকে এমন কট্‌মটু করে চাইল যে আমি একেবারে চুপ মেরে গেলাম। কিছুক্ষণ যাবার পর ফেলুদা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করল, সাধুবাবার সঙ্গে কোনও মালপত্তর ছিল কি? গাড়োয়ান একটুক্ষণ ভেবে বলল, মনে হয় একটা বাক্স ছিল। তবে, বড় নয়, ছোট। হুঁ। স্টেশনে পৌঁছে টিকিট ঘরের লোক, গেটের চেকার, কুলি-টুলি এদের কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বাঙালি; তিনি বললেন, আপনি কি পবিত্ৰানন্দ ঠাকুরের কথা বলছেন? যিনি দেরাদুনে থাকেন? তিনি তো তিনদিন হল সবে এসেছেন। তাঁর
false