label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
humayun_ahmed
আজ এগারটার সময় একটা জরুরি অ্যাপায়েন্টমেন্ট আছে। শুধু আজ না, আগামী এক সপ্তাহ তোমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। তুমি বিছানায় শুয়ে রিলাক্স করবে। গল্প করবে। বইটই পড়বে। আজ এগারটায় যে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট সেটা ক্যানসেল করা যাবে না। সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করা যায় না। মৃত্যুর সঙ্গে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেটাকেও পেছনের ডেটে সরানোর জন্য আছি আমরা— ডাক্তাররা। সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিন্তু ক্যানসোল হয় না। আজ হয় না একদিন হবে। মানুষ অমরত্বের কৌশল জেনে যাবে। এজিং প্রসেস—বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াটা জানার চেষ্টা হচ্ছে–যেদিন মানুষ পুরোপুরি জেনে যাবে ব্যাপারটা সেদিনই দেখবে মৃত্যু জয় করার চেষ্টা শুরু হবে। ভালো। তিন হাজার সনের মানুষের অমর হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হিশামুদ্দিন সহজ গলায় বললেন, তিন হাজার সনের মানুষ তাহলে খুব দুঃখী মানুষ। মৃত্যুর আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত। চিত্ৰলেখা অবাক হয়ে বলল, মৃত্যুর আবার আনন্দ কী? হিশামুদিন হাসিমুখে বললেন, আনন্দ তো মা আছেই। আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনো এত সুন্দর লাগত না। তুমি ফিলোসফারদের মতো কথা বলছি বাবা। আর বলব না। ক্ষিধে লেগেছে নাশতা দিতে বল। আর শোন দুধ সিরিয়েল খাব না। দুধ-চিড়া খাব। দুধ-চিড়াও না–দই-চিড়া। পানিতে ভিজিয়ে চিড়াটাকে নরম করে টক দই, সামান্য লবণ, কুচিকুচি করে আধটা কাচামরিচ. এটা হচ্ছে আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার। তুমি যেভাবে বলছ আমারও খেয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এক কাজ করলে কেমন হয়। আগামীকাল আমরা এই নাশতাটা খাব–আজ আমার মতো খাও। আচ্ছা। আমি চলে যাচ্ছি, রহমতউল্লাহ ঠিক দশটার সময় দুটা ট্যাবলেট দেবে তুমি হাসিমুখে খেয়ে নেবে। আচ্ছা হাসিমুখেই খাব। হিশামুদ্দিন সাহেব নাশতা খেলেন। রহমতউল্লাহ তাকে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। সাধারণত তিনি তার নাশতা বা খাবার একা একা খান। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে। আজো লাগছে। কিন্তু তিনি কিছু বলেন না। রহমতউল্লাহ। জ্বি স্যার। কাল দই-চিড়া খাব। জ্বি আচ্ছা স্যার। দই-চিড়া আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার। জ্বি আচ্ছা। হিশামুদিনের ভুরু কঁচকে গেল। তিনি ঠিক কথা বলছেন না। দই-চিড়া তার বাবার প্রিয় খাবার না। গরিব মানুষদের কোনো প্রিয় খাবার থাকে না। খাদ্যদ্রব্য মাত্রই তাদের প্রিয়। তার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিছু খেতে পারতেন না। তখন বলেছিলেন, দই-চিড়া দে। দই-চিড়া বলকারক, খেতেও ভালো। সেই দই-চিড়ার ব্যবস্থা হয় নি। তার বাবার বিচিত্র ধরনের অসুখ হয়েছিল। অসহ্য গরম লাগত। কাপড় ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাওয়া করেও সেই গরম কমানো যেত না। রাতে ঘরে ঘুমোতে পারতেন না। বারান্দায় হাওয়া বেশি খেলে বলে বারান্দায় শুইয়ে রাখা হতো। এক রাতে অবস্থা খুব খারাপ হলো। কবিরাজের কাছ থেকে মকরধ্বজ এনে খাওয়ানো হলো। সেই ওষুধের নাকি এমনই তেজ যে খাওয়ামাত্র মরা রোগী লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। মকরধ্বজ খাওয়ার পর তার অবস্থা আরো খারাপ হলো, তিনি ছটফট করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে ছটফটানি কমত–তিনি তখন বলতেন— আমার শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। আরো জোরে হাওয়া কর। আরো জোরে। রাত দুটার দিকে তার জুলুনি বোধহয় একটু কমল। তিনি ক্লান্তভঙ্গিতে বললেন-আজ মৃত্যু হবে কি না বুঝতে পারছি না। চাঁদনী রাত ছিল। মরণ হলে খারাপ ছিল না। শরীরের জ্বলুনিটা কমত। জ্বলুনি আর সহ্য হয় না। দুৰ্ভগাদের কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় না। তার শেষ ইচ্ছাও পূর্ণ হয় নি। তিনি মারা যান। পরের রাতে। সে রাতে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। চাদ বা তারা কোনোটাই ছিল না। আচ্ছা তিনি কি তার বাবাকে গ্লামারাইজড করছেন না? একটা দুষ্ট প্রকৃতির লোককে দুঃখী, মহৎ এবং সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা আসলে সে রকম না। তার বাবা ছিলেন চোর, অসৎ প্রকৃতির মানুষ, সৰ্বরকম দায়িত্ব জ্ঞানহীন একজন দুর্বল মানুষ। দুর্বল মানুষদের চরিত্রও দুর্বল থাকে। তার চরিত্রও দুর্বল ছিল। তার খারাপ পাড়ায় যাতায়াত ছিল। খারাপ পাড়ার একটি মেয়েকে তিনি বিয়েও করেছিলেন। সেই মেয়েকে তিনি অবশ্যি ঘরে আনেন নি। তবে সেই নষ্ট মেয়ের গর্ভের একটি সন্তানকে ঘরে স্থান দিয়েছিলেন। এই ঘটনা চিত্ৰলেখাকে বলা হয় নি, হাসানকেও বলা হয় নি। তিনি পাশ কাটিয়ে গল্প বলছেন। এটা ঠিক হয় নি। রহমতউল্লাহ! জ্বি স্যার। তুমি হাসানকে একটু খবর দাও। জ্বি আচ্ছা স্যার। পান দিতে বল। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে। জর্দা ছাড়া পান। জ্বি দিচ্ছি। একটা পাতলা চাদর আমার গায়ে দিয়ে দাও। শীত লাগছে। ফ্যান বন্ধ করে দিব স্যার? ফ্যান বন্ধ করতে হবে না। হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করলেন। বেশ ভালো ঠাণ্ডা লাগছে। তার বাবা মৃত্যুর সময় অসহ্য গরমে ছটফট করেছেন। আর তিনি নিজে হয়তো শীতে কাপতে কাঁপতে মারা যাবেন। তার বাবার কোনো সাধই পূর্ণ হয় নি। তার নিজের প্রতিটি সাধ পূর্ণ হয়েছে। তিনি যদি চান তার মৃত্যু হবে জোছনা দেখতে দেখতে তাহলে হয়তো-বা কৃষ্ণপক্ষের রাতেও পূৰ্ণচন্দ্ৰ দেখা যাবে। স্যার! হুঁ। পান এনেছি স্যার। পান খাব না নিয়ে যাও। আরেকটা পাতলা চাদর গায়ে দাও। শীত বেশি লাগছে। জ্বি আচ্ছা স্যার। তোমার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তুমি চলে যাও। রহমতউল্লাহ চলে গেল না। ঘরে থেকে বের হয়ে গেল ঠিকই। তবে দাড়িয়ে রইল দরজার ওপাশে। মনে হয় তার প্রতি চিত্ৰলেখার এ ধরনের নির্দেশ আছে। হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করে আছেন।
false
shunil_gongopaddhay
কী বস্তু? রাধারমণ বললেন, তত্ত্ববোধিনী ব্ৰাহ্মদের একটি নামকরা পত্রিকা। ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রবাবু তার মালিক, কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সবাই পত্রিকাটি পড়ে। কৈলাস সে পত্রিকার একজন কর্মী। কৈলাসচন্দ্র বললেন, তা ছাড়া আমি এখানে মির্জা মহম্মদের বাড়িতে অতিথি, তার ভাই ঢাকা শহরে পুলিশের একজন কর্তা। ওঁরাও সব জানেন। আমার গলা কাটলে ইংরেজ ফৌজ চলে আসবে। রাধারমণ বললেন, আহা, ওটা কথার কথা। মহারাজ উত্তেজনার বশে বলে ফেলেছেন। আসলে মহারাজ কারুকে কখনও কঠিন শাস্তি দেন না। কিন্তু কৈলাস, তুমি আমাদের বৃথা ভয় দেখাচ্ছ। আগেই তো সব মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মহারাজ বীরচন্দ্রের দাবি স্বীকৃত হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাহাদুর মহারাজের কাছ থেকে নজরানা নিয়েছেন, আবার নতুন কোনও ফ্যাকড়া বার করলেও তাঁরা মানবেন কেন? কৈলাসচন্দ্ৰ মহারাজের সঙ্গে কথা বলার সময় একবারও গলা চড়াননি, বিনীত ভঙ্গিটি রেখেছিলেন, এবার রাধারমণের দিকে ফিরে গর্জে উঠে বললেন, নজরানা দিলেই সত্যটা মিছে হয়ে যাবে? পরলোকগত মহারাজের আপনি ঔরসজাত সন্তান থাকতেও রাজা হবে…রাজা হবে এক…রাজা হবে অন্য একজন! বিয়ের আয়োজন বন্ধ করো ঘোষজা, উকিল-মোক্তার ডাকো। তোমাদের আমি কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই! বীরচন্দ্র প্রথম থেকেই ক্ৰোধে ফুঁসছিলেন, এর মধ্যে আবার তাঁর বুক ভরে গেল অভিমানে। কোনও শিশু যখন আঁকাবাঁকা ছবি আঁকে কিংবা গাছের একটা শুকনো ডালকে মূর্তি মনে করে বাবা-মাকে দেখবার জন্য ছুটে আসে, কিন্তু তারা মনোযোগ দেন না, তারিফ করেন না, তখন সেই শিশুর যেমন অভিমান হয়, বীরচন্দ্রেরও প্রায় সে রকম কান্না এসে গেল। তাঁকে কেউ বুঝল না। এই দুর্বল ত্রিপুরা রাজ্যটিকে তিনি নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেন না, তারা কর ফাঁকি দিলে তিনি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেন না। তাঁর পাইক-বরকন্দাজরা কোনও স্ত্রীলোকের ওপর অত্যাচার করলে কঠিন শান্তি পায়। কেউ তাকে এ জন্য মর্যাদা দেবে না? একটা অপদার্থ, দুর্বল, ছোকরা তাঁর বদলে সিংহাসনে বসবে? মনোমোহিনীকে বিবাহ করবার জন্য তিনি শরীর-মনে প্রস্তুত হয়ে আছেন, তার ঠিক আগেই এই উৎপাত! এখানে অনেকেই যেন এই বিবাহটা পুরোপুরি পছন্দ করছে না। কেন? তিনি আর একটি বিবাহ করতে চাইলে কার কী ক্ষতি? রাজা হয়ে তিনি এই একটা সামান্য সাধও মেটাতে পারবেন না? অন্য রাজাদের মতন তিনি কি দু’তিনটি হারেম বানিয়েছেন? মনোমোহিনীকে বিয়ে করলে তাঁর বৈধ রানীর সংখ্যা হবে মাত্র আটজন। এই বংশেরই এক রাজা প্রতি মাসে একটি বিবাহ করতেন। নিজেকে প্ৰাণপণে সংযত করে তিনি কৈলাসচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার সম্পর্কে আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলে? বলতে বলতে থেমে গেলে? কৈলাসচন্দ্ৰ মহারাজের দিকে না ফিরে রাধারমণের দিকেই তীব্ৰ চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলখাল্লার ভেতর থেকে সাদা রঙের লেফাফাটি বার করে দোলাতে দোলাতে বললেন, তোমরা ভাবছ আমি ধাপ্পা দিতে এসেছি? মোক্ষম একটা অস্ত্র এসেছে আমাদের হাতে, নতুন প্রমাণ। শোনো, শুনে নাও! রাজা বীরচন্দ্ৰ এক জারজ সন্তান। তাঁর জন্মের সময় তাঁর মা ছিলেন কুমারী। এটা উনি নিজে না জানতে পারেন, কিন্তু দলিল আছে। সিংহাসনে বসার হক নেই ওঁর। এ কথা শুনেও বীরচন্দ্ৰ বিচলিত হলেন না। তিনি শান্তভাবে বললেন, এটা নতুন কোনও প্রমাণ নয়। এ কথা আমি জানি। আমার জন্মের পর আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য। ত্রিপুরার আইনে এই বিবাহ অসিদ্ধ নয়, পূর্বজাত পুত্ৰও বারবার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আমার সব কিছুই বৈধ। কৈলাসচন্দ্ৰ এবার রাজার দিকে ফিরে বললেন, বৈধ কি না তা আদালতেই প্রমাণিত হবে। আপনার অন্য দুই বড় ভাইদের নামে জারজ অপবাদ দিয়েই তাদের সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, মনে নেই? চক্ৰধ্বজ, নীলকৃষ্ণরা আজ সর্বস্বান্ত। গুরু বিপিনবিহারীকে আপনি জেলের মধ্যে দগ্ধে মেরেছেন! এই মুহূর্তে বীরচন্দ্রের ক্রোধের অগ্নি ও অভিমানের বাষ্প মিশে গিয়ে আগ্নেয়গিরির লাভার মতন বিস্ফোরিত হল। তিনি কৈলাসের দিকে মুষ্টি তুলে বললেন, পা-চাটা কুক্কুর! বেল্লিক! তোর বাপ-পিতামহ আমাদের বংশের নুন খায়নি? তুই নিমকহারামের মতন এমন কথা বলতে পারলি? একটুখানি সরে গিয়ে কৈলাসচন্দ্র বললেন, আমার বাপ- আপনার বংশের নুন খেয়েছে তা ঠিক। কিন্তু আপনার নুন কেউ খায়নি। সেইজন্যই তো আমি এই বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারীর প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছি! রাধারমণ ওঁদের দুজনের মাঝখানে চলে এসে কৈলাসচন্দ্রের কাঁধে হাত রেখে বললেন, কৈলাস, তুমি নিশ্চয়ই শুধু আমাদের ভয় দেখাতে আসোনি। তোমার অন্য উদ্দেশ্য আছে। কত চাও? কৈলাসচন্দ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ঘুষ? জানি, ঘুষ-তঞ্চকতা-ফেরেববাজিতে দেশ ছেয়ে গেছে, গোল্লায় গেছে সব নৈতিকতা, তোমরাও এ সবের মধ্যে ডুবে আছ। তাই সব মানুষকেই তোমাদের মতন ভাব। তুমি যে এই কথাটা বললে, সে জন্য তোমাকেও ছাড়ব না, এই মামলায় জড়িয়ে তোমাকে দিয়েও জেলের ঘানি ঘোরাব। ছিঃ, ঘোষের পো, ছিঃ! একটা কথা জেনে রেখো, ঘুষের লোভ দেখিয়ে ব্ৰাহ্মদের বশ করা যায় না। ব্ৰাহ্মরা সত্যের পূজারী, তারা লোভ, বিলাসিতা, মাৎসর্যের অনেক ঊর্ধ্বে। সগৰ্বে মাথা তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন কৈলাসচন্দ্র। বীরচন্দ্রের কাঁধ দুটি ঝুলে পড়েছে। তিনি আর কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। রাধারমণ এবার আক্রমণোদ্যত সিংহের মতন শরীর ঝাড়া দিলেন। কৈলাস এতক্ষণ ধমকের সুরে কথা বলেছে, তিনি যথাযোগ্য উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু কৈলাসচন্দ্ৰকে এইভাবে জয়ীর মতন চলে যেতে দেওয়া যায় না। তিনি হেঁকে বললেন, ওহে নব্য ব্ৰাহ্ম কৈলাস, তুমি আমার আর একটি কথা শুনে যাও। তুমি খুব বারফট্টাই করলে, কিন্তু বেশ কিছু ব্রাহ্মের মহত্ত্বের মুখোসের আড়ালে আমি তাদের লোভী, অর্থ গৃধু, স্বার্থপর, ঈর্ষাপরায়ণ মুখ দেখেছি!
false
shomresh
বয়স হচ্ছে তো! শরীরে একটা না একটা রোগ লেগেই থাকে। তা অমরনাথবাবুকে বলে আমি এসেছিলাম। দীপাবলীর ব্যাপারে কোন চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। এত ভাল রেজাল্ট করেছে যে মেয়ে—। এই সময় অঞ্জলি বলল, ওই তো উনি এসে গিয়েছেন। অমরনাথ তখন দরজায়। বসার ঘরে রমলা সেনকে ঘিরে অঞ্জলি আর দীপা বসে আছে। মনোরমা সেখানে নেই। ছেলে দুটোর স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি। রমলা সেন দুই হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার মশাই। মেয়ের গর্বে নিশ্চয়ই খুব গর্বিত। আরে, কি চেহারা হয়েছে আপনার? এত তাড়াতাড়ি চুলটুল পেকে গেল কেন? কি ভাই অঞ্জলি, যত্ন আত্তি করছ না কেন? কি করব! অঞ্জলি হাসার চেষ্টা করল, দিনরাত শুধু ভবিষ্যতের চিন্তা করে। আর ওই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকেই শরীর ভাঙ্গছে। অমরনাথ চেয়ারে বসলেন, তোমার কলেজে ভর্তি হবার ফর্ম এনেছি। রমলা সেন মাথা নাড়লেন, ওমা, আমরা তো এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি দীপাবলী শিলিগুড়ি কলেজে পড়বে। আমার কাছে থাকবে। কলেজে বাড়িতে আমিই থাকব, কোন চিন্তা নেই। আপনাদের। হতভম্ব হয়ে গেলেন অমরনাথ। হয়তো আজ সকালে এই প্ৰস্তাব শুনলে তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু দীপা কারো বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ছে জানার পর প্রতুলবাবু কি—! তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, এত বড় ব্যাপারে তো এক কথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আমি ভেবে দেখি। রমলা সেনের মুখ গম্ভীর হল। অঞ্জলি বলল, এতে ভেবে দ্যাখ্যার কি আছে। উনি দীপাকে মেয়ের মত ভালবাসেন। এতদিন ধরে চিঠিতে উৎসাহ দিয়েছেন। ওঁর কাছে থাকলে মেয়ে আরও ঠিক থাকবে। রমলা বললেন, না, না। আমার কাছে না থাকলে দীপাবলী যে ঠিক থাকবে না এটা বললে ওকে অসম্মান করা হবে। অমরনাথ বললেন, আমি যখন বলছি ভাবতে হবে তখন নিশ্চয়ই তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। আপনারা গল্প করুন। আমার মান-খাওয়া কিছু হয়নি। অমরনাথ মাথা নেড়ে চেয়ার ছেড়ে ভেতরে চলে এলেন। তাঁর সামনে এখন মনোরমা। তিনি ভেতরে, ঘরের খাটের ওপর বসেছিলেন। ছেলেকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছেন, বউমার কোনদিন আকেল হবে না। চাপা গলায় বললেন মনোরমা, তুই যে এক কথায় রাজী হয়ে যাসনি এটা ভগবানের আশীর্বাদ। ওর কাছে থাকলে তো দীপা ম্লেচ্ছপনা শিখবে। অমরনাথ জবাব না দিয়ে আলমারির কাছে চলে গেলেন। যথারীতি পাল্লা খোলা। শুধু লকারে তালা বন্ধ করে চাবিটা পাশেই রাখা আছে। অমরনাথ লকার খুলে চেক এবং ব্যাঙ্কের ফর্ম রেখে দিলেন। তার পরেই কি ভেবে ব্যাঙ্কের ফর্ম বের করে নিয়ে কলেজেব ফর্মের সঙ্গে রাখলেন। এই সময় অঞ্জলি ঘরে এল। তাকে দেখে মনোরমা ভেতরে চলে গেলেন। অঞ্জলি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? অমরনাথ জবাব দিলেন না। অঞ্জলি বলল, তুমি ওভাবে চলে এলে কেন? অমরনাথ বললেন, খুব খিদে পেয়েছে। স্নানও করতে হবে। তাহলে লকার খুলে কি করছ। জরুরী কিছু রাখছি। অমরনাথ জামা খুলতে খুলতে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। প্রাইভেট। তুমি রান্নাঘরে খাবার দিয়েই চলে এস না। উনি বাইরের ঘরে বসে কথা বলছেন। আশ্চর্য। প্রথম যেদিন এসেছিলেন সেদিন মুখ গোমড়া করে ছিলে। অমরনাথ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, খাবার দাও। বাইরের ঘরে বসে রমলা সেন বললেন, আমি তোমাকে কোন সাজেশন দের না। সায়েন্স নেবে কিনা তুমিই ঠিক করবে। তবে যাই নাও মনে রেখো। ভবিষ্যতে ওই পড়াটা যেন কাজে লাগে। আমি ইংরেজি নিয়ে পড়তে চাই। সেটা তো ইন্টার মিডিয়েটে সম্ভব না। গ্র্যাজুয়েশনের সময় তুমি অনার্স নিতে পার। চট করে ভেবে ফেলো না কি করবে। সময় আছে। আমি কলেজে পড়াতে চাই বড় হলে। পড়বার মত যোগ্য হলে বল। বড় তো হয়েই গিয়েছ। কিন্তু কেন পড়াতে চাও? এখন পর্যন্ত এই প্রফেসনেই মেয়েরা নিরাপদ বলে? ছেলেরা যেসব চাকরি করছে তা করতে চাইবে না কেন? আমাদের সমযে সুযোগ ছিল না তেমন, স্বাধীন ভারতবর্ষে মেয়েরা শুধু মাস্টারি করার জন্যে পড়াশুনা করবে। এই ব্যাপারটা আমি মানতে পারি না। অনেক দেরি হয়ে গেল। তোমার বাবা এখন নিশ্চয়ই মানখাওয়া করবেন। অঞ্জলিকে ডাকো, তাকে বলে যাই। রমলা সেন ঘড়ি দেখলেন। তাহলে আপনাকে জানাবো কি করে? কি ব্যাপারে? শিলিগুড়িতে গেলে—। ও হো। সোজা চলে যাবে। ওতে আবার জানানোবা কি আছে। হয় বাড়ি নয় কলেজে থাকব। বইগুলো তুলে রেখে দাও। ববীন্দ্রনাথের সব কবিতা ওতে আছে। পড়ে মনে রাখবে। সমস্ত জীবন। পাশেই ছোট ছোট কবিতার বই-এর স্তুপের ওপর হাত রাখলেন রমলা সেন। মাথা নেড়ে ভেতরে এল দীপা। অমরনাথ তখনও বাথরুমে। রান্নাঘরে এসে সে বলল, উনি চলে যাচ্ছেন। তোমাকে ডাকছেন। অঞ্জলি ভাতের হাঁড়িতে হাত দিয়েছিল। একটু অপ্ৰস্তৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বুধুয়াকে পদখেছিস? দীপা মাথা নাড়ল, না। রান্নাঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে দ্রুত চলে এল অঞ্জলি। যতটা শোভনভাবে বিদায় দেওয়া সম্ভব ততটাই শোভনতা বজায় রাখল সে। অস্টিন গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র দীপা জিজ্ঞাসা করল, বাবার কি হয়েছে মা? কেমন গম্ভীরভাবে কথা বলছিল। অঞ্জলি ঠোঁট ওল্টালো। তারপর মনে পড়ে যাওয়ায় রান্নাঘরে ছুটল। রাত তখন একটা। অঞ্জলি গালে হাত দিয়ে বসেছিল। খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে এগারোটা নাগাদ অমরনাথ কথা শুরু করেছিল। প্রায়-বিকেলে রান্নাঘরে কথা বলার সুযোগ হয়নি। অমরনাথ খেতে বসামাত্ৰ মনোরমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অঞ্জলি শেষ পর্যন্ত বলল, টাকাটা তুমি নিলে? টাকা নয় চেক। না ভাঙালে কোন মূল্য নেই। অমরনাথ বললেন। পঞ্চাশ হাজার? সে আডচোখে চেকটাকে দেখল। লকার থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন অমরনাথ
false
shottojit_roy
গাড়িটা বেশ নতুনই। সদরজির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাইরে বেরেলাম। টায়ার চেঞ্জ করার হ্যাঁঙ্গাম আছে, অস্তুত পনেরো মিনিটের ধাক্কা। চ্যাপটা টায়ারের দিকে চোখ যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পাংচারের কারণটা বুঝতে পারলাম। রাস্তার অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে অজস্র পেরেক। সেগুলো দেখেই বোঝা যায় যে, সদ্য কেনা হয়েছে। আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সিং সাহেব দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা কথা বলল, যেটা অবিশ্যি বইয়ে লেখা যায় না। ফেলুদা কিছুই বলল না, শুধু কোমরে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল। লালমোহনবাবু একটা পুরনো জাপান এয়ার লাইনসের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি ধরনের সবুজ খাতা বার করে তাতে খসখস করে পেনসিল দিয়ে কী জানি লিখলেন। নতুন টায়ার পরিয়ে, ফেলুদার কথামত্তো রাস্তা থেকে পেরেক সরিয়ে, যখন আবার রওনা হচ্ছি, তখন ঘড়িতে পীনে দুটো। ফেলুদা ড্রাইভারকে বলল—একটু রাস্তার দিকে নজর রেখে চালাবেন সদরেজি-আমাদের পেছনে যে দুশমন লেগেছে সে তো বুঝতেই পারছেন। এদিকে বেশি আস্তে গেলে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে, কাজেই গুরুবচন সিং ষাট থেকে নামিয়ে চল্লিশে রাখলেন স্পিডোমিটার। সত্যি বলতে কী, রাস্তার উপর চোখ রাখতে গেলে ঘণ্টায় দশ-পনেরো মাইলের বেশি স্পিড তোলা চলে না। প্রায় একশো ষাট কিলোমিটার অর্থাৎ একশো মাইলের কাছাকাছি এসে সর্বনাশটা আর এড়ানো গেল না। এবার কিন্তু পেরেক না, এবার পিতলের বোর্ড পিন। আন্দাজে মনে হয় প্রায় হাজার দশোক পিন বিশ-পঁচিশ হাত জায়গা জুড়ে ছড়ানো রয়েছে। বুঝতেই পারলাম যে, টায়ার ফাঁসি নেওয়ালারা কোনও রিস্ক নিতে চাননি। আর এটাও জানি, গুরুবচন সিং-এর ক্যারিয়ারে আর স্পেয়ার নেই। চারজনেই আবার গাড়ি থেকে নামলাম। সিং সাহেবের স্বভাব দেখে মনে হল, মাথায় পাগড়ি না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই মাথা চুলকোতেন। ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, পোকরান টাউন হ্যাঁয় ইয়া গাঁও হ্যাঁয়? টাউন হ্যাঁয় বাবু। কিতনা দূর ইঁহাসে? পঁচিশ মিল হোগা। সর্বনাশ!…তব্‌ আভি হোগা কেয়া? গুরুবচন বুঝিয়ে দিল যে, এ লাইনে যে ট্যাক্সিই যাক না কেন, সেটা তার চেনা হবেই। এখানে অপেক্ষা করে যদি সেরকম ট্যাক্সি একটা ধরা যায়, তা হলে তাদের কাছ থেকে স্পেয়ার চেয়ে নিয়ে তারপর পোকরানে গিয়ে পাংচার সারিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সে রকম ট্যাক্সি যাবে কি না, আর গেলেও, সেটা কখন যাবে! কতক্ষণ আমাদের এই ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! পাঁচটা উট আর তার সঙ্গে তিনটি লোকের একটা দল আমাদের পাশ দিয়ে যোধপুরের দিকে চলে গেল। লোকগুলোর প্রত্যেকটার রং একেবারে মিশকালো। তার মধ্যে আবার একজনের ধবধবে সাদা দাড়ি আর গালপাট্টা। তারা আমাদের দিকে দেখতে দেখতে চলেছে। দেখেই বোধহয় লালমোহনবাবু একটু ফেলুদার দিক ঘেঁষে দাঁড়ালেন। সব্‌সে নজ্‌দিক কোন্‌ রেল স্টেশন হ্যাঁয়? ফেলুদা বার্ড পিন তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল। আমরাও অন্য গাড়ির কথা ভেবে এই সৎকাৰ্যটায় হাত লাগিয়েছিলাম। সাত-আট মিল হোগা রামদেওরা। রামদেওরা… রাস্তা থেকে বোর্ড পিন সরানো হলে পর, ফেলুদা তার ঝোলা থেকে ব্র্যাড্‌শ টাইম টেবল বার করল। একটা বিশেষ পাতা ভাঁজ করা ছিল, সেখানটা খুলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, লাভ নেই। তিনটে পঁয়তাল্লিশে যোধপুর থেকে সকালের ট্রেনটা রামদেওরা পৌঁছনার কথা। অৰ্থাৎ সে গাড়ি নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাদের ছড়িয়ে চলে গেছে। আমি বললাম, কিন্তু রাত্রের দিকে আর একটা ট্রেন যায় না জয়সলমীর? হুঁ। কিন্তু সেটা রামদেওরা পৌঁছবে ভোর রাত্তিরে-তিনটে তিপন্ন। এখান থেকে এখন হাঁটা দিলে রামদেওরা পৌঁছতে ঝাড়া দু ঘণ্টা। সকালের ট্রেনটা ধরার যদি আশা থাকত, তা হলে হেঁটে যাওয়াতে একটা লাভ ছিল। অন্তত পোকরানটা পৌঁছনো যেত। এই মাঠের মাঝখানে… লালমোহনবাবু এই অবস্থার মধ্যেও হেসে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, যাই বলুন মশাই, এ সব সিচুয়েশন। কিন্তু উপন্যাসেই পাওয়া যায়। রিয়েল লাইফেও যে এ রকমটা— ফেলুদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ভদ্রলোককে থামতে বললেন। চারিদিকে একটাও শব্দ নেই, সারা পৃথিবী যেন এখানে এসে বোবা হয়ে গেছে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা ক্ষীণ আওয়াজ-ঝুক্‌-ঝুক্‌ ঝুক্‌-ঝুক্‌ ঝুক্‌-ঝুক্‌ ঝুক্‌-ঝুক্‌… ট্রেন আসছে। পোকরানের ট্রেন। কিন্তু লাইন কোথায়? শব্দের দিকে একদৃষ্টি চেয়ে থেকে হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল। ধোঁয়া। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম টেলিগ্রাফের পোল। জমিটা ঢালু হয়ে গেছে। তাই বোঝাই যায় না। পিছনের লাল মাটির সঙ্গে লাল টেলিগ্ৰাফ-পোল মিশে প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। আকাশে মাথা উচিয়ে থাকলে আগেই চোখে পড়ত। দৌড়ো! ফেলুদা চিৎকারটা দিয়েই ধোঁয়া লক্ষ্য করে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। আর আমার পিছনে জটায়ু। আশ্চর্য। ভদ্রলোক ওই লিক্‌পিকে শরীর নিয়ে এমন ছুটতে পারেন, তা আমি ভাবতে পারিনি। আমাকে ছাড়িয়ে প্রায় ফেলুদাকে ধরে ফেলেন আর কী! পায়ের তলায় ঘাস, কিন্তু সে ঘাসের রং সবুজ নয়—একেবারে তুলোর মতা সাদা। তার উপর দিয়ে পড়ি-কি-মারি ছুটি দিয়ে আমরা ঢালুর নীচে লাইনের ধারে পৌঁছে দেখি, ট্রেনটা আমাদের একশো গজের মধ্যে এসে পড়েছে। ফেলুদা এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে এক লাফে একেবারে লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে দুটো হাত মাথার উপর তুলে হই-হই করে নাড়তে আরম্ভ করে দিল। ট্রেন এদিকে হুইসল দিতে আরম্ভ করেছে, আর সেই হুইসল ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে জটায়ুর চিৎকার—, রোক্‌কে, রোক্‌কে, হল্ট, হল্ট, রোক্‌কে ।… কিন্তু কে কার কথা শোনে। এ ট্রেন যদিও ছোট, কিন্তু মার্টিন কোম্পানির ট্রেনের মতো নয় যে, মাঝ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত দেখালে বাসের মতো থেমে যাবে। প্রচণ্ড হুইসলামারতে মারতে স্পিড বিন্দুমাত্র না কমিয়ে ট্রেনটা
false
humayun_ahmed
মুখ নিয়ে বলল, বড় সাব আপনেরে ডাকে। প্রণব বিরক্ত হয়ে বললেন, কানাকানি করতেছ কেন? উনি আমারে ডাকেন এইটা গোপন কোনো কথা না। মেয়েছেলে কানে কথা বলতে পছন্দ করে। তুমি মেয়েছেলে না। ভাদু আনন্দিত গলায় বলল, অত্যধিক সত্য কথা। সে মেয়েছেলে না। প্রণব বলল, এই বেকুব, সব কথায় কথা বলবি না। ভাদু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বারান্দার ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। পাশেই মোড়া পাতা। এতক্ষণ মোড়ায় লাইলী বসে ছিলেন। উনি উঠে যাওয়াতে মোড়া খালি। প্রণব মোড়ায় বসতে বসতে বলল, স্যার আমাকে ডেকেছেন? হুঁ। সীতা মেয়েটার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রণব বলল, সীতা কে? হাবীব বিরক্ত হয়ে বললেন, সাত খণ্ড রামায়ণ নিজে লিখে এখন বলো সীতা কে? সীতা নারায়ণ চক্রবর্তীর মেয়ে যাকে উদ্ধারের জন্যে তুমি আমার পায়ে ধরলা। প্রণব লজ্জিত গলায় বলল, ভুলে গেছি। হাবীব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন মেয়েটার কী ব্যবস্থা করবে করো। প্রণব বলল, আমি কী ব্যবস্থা করব? মেয়ের বাবা-মা ব্যবস্থা করবে। হাবীব বললেন, মেয়েটার বাবা-মা কোনো ব্যবস্থা নিবে না। মেয়ের কারণে তারা পতিত হয়েছে। মেয়ে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে ছিল। টানবাজার কী জানো? না। বেশ্যাপল্লী। যে মেয়ে বেশ্যাপল্লীতে ছিল, তোমাদের সমাজে তার জায়গা নাই। কথা কি ঠিক? প্রণব বলল, মেয়েটা আছে কোথায়? থানা হাজতে। ওসি সাহেব মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তারা মেয়েকে নিবে না। এখন তুমি বলো কী করা যায়? প্রণব বলল, আমি কী বলব স্যার? আমি বাক্যহারা হয়েছি। আমি ওসি সাহেবকে বলেছি মেয়েটাকে আমার এখানে দিয়ে যেতে। রাত এগারোটার দিকে আসবে। তুমি মেয়েটাকে চেম্বারে বসাবে। তুমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। যা বলার আমি বলব। আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে এখন কোনো কথা বলব না। তাকে চলে যেতে বলবে। চেম্বারে সব ক’টা দরজা-জানালা বন্ধু। একটা দরজা খোলা। সেখানে পর্দা দেওয়া। বাইরের বাতাসে পর্দা কাঁপছে। টেবিলে রাখা দুটা মোমবাতির শিখাও কাঁপছে। মোমবাতি ছাড়া ঘরে একটা হারিকেনও আছে। কারেন্ট নেই। মোমবাতি এবং হারিকেনের আলোয় অন্ধকার কমছে না। সীতা চাদরে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। তার চোখে আতঙ্ক ছাড়া কিছু নেই। মাঝে মাঝে সে কাঁপছে। তার দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। দমকা বাতাসে একটা মোমবাতি নিভে গেল। সীতা প্রবলভাবে কাপল এবং অস্ফুট শব্দ করল, আর তখনই হাবীব ঢুকলেন। তোমার নাম সীতা? সীতা জবাব দিল না। তার দৃষ্টি এখনো মোমবাতির শিখার দিকে। তোমার বাবা মা তোমাকে নিতে রাজি না–এই খবর পেয়েছ? সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, তুমি আমার এখানে থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নাই। থাকবে? সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, আমার একটা বুদ্ধি শোনা, কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাও। হিন্দুর গায়ে যতটা দোষ লাগে, মুসলমানের লাগে না। মুসলমান হবে? সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, তোমার বয়স অল্প। মাঝে মাঝে অল্প বয়সে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব আগামী বুধবার আসবেন। তার কাছে তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবা। তোমার নতুন একটা নাম লাগবে। তোমার নাম দিলাম হোসনা। হোসনা শব্দের অর্থ সৌন্দর্য। তোমার চেহারা সুন্দর, এই জন্যেই হোসনা নাম। বাতাসে দ্বিতীয় মোমবাতিটাও নিভে গেল। সীতা আবারও চমকে উঠে অস্ফুট শব্দ করল। শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব এসেছেন। তিনি রোজা ছিলেন। সন্ধ্যাবেলা ইফতার করে মাগরেবের নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে ঘোষণা করলেন এশার নামাজের পর বেতরের নামাজ পড়বেন। তারপর হিন্দু কন্যাকে মুসলমান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কন্যাকে বড়ইপাতা ভেজানো পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। নখ কাটতে হবে। সীতাকে গোসল দেওয়া হলো। সে জলচৌকিতে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। পীরসাহেব সীতার সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টাও করলেন। তিনি একতরফা বললেন, সীতা শুধু শুনে গেল। কোরানপাঠ শিখবে। রোজ ফজরের নামাজের পর পাক কোরান পাঠ করবে। কোরানপাঠ শিখে নিবে। হায়াজ নেফাসের পর অপবিত্র চুল সব ফেলতে হবে। একটা চুল থাকলেও শরীর শুদ্ধ হবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে পীরসাহেব গলা নামিয়ে আরও কিছু কথা বললেন! সবই অত্যন্ত অশ্লীল কথা। কোনোভাবেই একটি মেয়েকে বলা যায় না। পীরসাহেব অবলীলায় বলে গেলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নোংরা কথাগুলি বলে আনন্দ পাচ্ছেন। এশার নামাজের পর হাজেরা বিবি ভীষণ হৈচৈ শুরু করলেন। হাবু রে, হাবু রে, হাবু রে। হাবীব মার কাছে গেলেন। শান্তগলায় বললেন, মা, তোমার সমস্যা কী? হাজেরা বিবি বললেন, সমস্যা আমার না। সমস্যা তোর। শুনলাম নটিপাড়ার এক হিন্দু নটি মেয়ে তুই নিয়া আসছস। তারে এখন মুসলমান বাইনতাছস। নটির আবার হিন্দু-মুসলমান কী? নটি হইল নটি। মা চুপ করো। আমি চুপ করব না। তুই চুপ কইরা আমার কথা গুন। শম্ভুগঞ্জের বদ পীরটারে হাছুনের বারি দিয়া বিদায় কর। কেন? এই পীররে অনেক দিন ধইরা আমি লক্ষ করছি। হে মেয়েছেলের চোখের দিকে কোনো সময় তাকায় না। তাকায় বুকের দিকে। মা! তোমার যন্ত্রণায় আমি অস্থির। তুই আমার যন্ত্রণায় অস্থির না। আমি তোর যন্ত্রণায় অস্থির। তুই এক্ষণ বুনিচাটা পীর বিদায় করবি। কতবড় হারামজাদা! চউখ দিয়া বুনি চাটে। মেয়েটা কি সফুরা? ফরিদের বউ! কিছুক্ষণের জন্যে হাবীব বিভ্রান্ত হলেন। ভ্রান্তি কাটতে সময় লাগল না। মেয়েটা সফুরাই। হলুদ চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। চাদর থেকে হলুদ আভা পড়েছে মুখে। সামান্য আলোছায়া কী করতে পারে ভেবে হাবীব যথেষ্ট বিস্ময় বোধ করলেন। সফুরা রূপবতী,
false
toslima_nasrin
পারি, তা প্রমাণ করার পরও ধারণাটি ঘোচে না। ওই পড়ার নেশাতে অন্যরকম একটি জগত তৈরি হয় আমার আর চন্দনার। শিক্ষক শিক্ষিকার বা ক্লাসের মেয়েদের ব্যক্তিগত কোনও প্রেম বিরহের খবর বাতাসের সঙ্গে বা বাতাসের আগে আমাদের কানে আসে না, মাঝপথে কোথাও থমকে থাকে। আমাদের বাতাস তখন ভারি পার্বতীর কান্নায়, রাজলক্ষ্মীর নগ্ন পদধ্বনিতে, চারুলতার নিঃসঙ্গতায়, বিমলার দ্বিধায়। বাতাস যে সবসময় ভারি হয়েই থাকে তা নয়, মাঝে মধ্যে অমল হাসিতে আবার অমলিন হয়ে ওঠে, আবার ফুরফুরে। আমাদের লাইব্রেরিয়ান সাইদুজ্জামানের ঠোঁটে তেমন একটি অমল হাসি খেলে প্রায়ই। মাঝে মাঝে আমাদের ইসলামিয়াত পড়ান তিনি, এই একটি বিষয়ের জন্য ইশকুলে কোনও শিক্ষক নেই, যে শিক্ষকের যখনই অবসর থাকে, ইসলামিয়াত পড়াতে ক্লাসে আসেন। ইসলামিয়াত ক্লাসে সাইদুজ্জামানের হাসি নিখাদ আকর্ণবিস্তৃত। তাঁর হাসির মূল্য আছে, কারণ এ ক্লাসটি অন্য যে কোনও ক্লাসের চেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণী পাল বাংলা পড়াতে এসে ঠোঁটে মোনালিসার হাসি ঝুলিয়ে রাখেন, সাহিত্যের রস আস্বাদনের সময় ওরকম একটি হাসির প্রয়োজন আছে। সুরাইয়া বেগমও তাঁর উঁচু উঁচু দাঁতের হাসিতে রজনীগন্ধার সুগন্ধ ছড়ান। হাসিতে কি সুগন্ধ ছড়ায়? চন্দনা বলে, ছড়ায়। অংকের শিক্ষক বাংলার পাঁচের মত মখু করে ক্লাসে আসেন, ক্লাস থেকে বেরোন, সে মানায়। সাইদুজ্জামানের হাসির প্রশ্রয়ে ইসলামিয়াত ক্লাসে বসে আকাশের দিকে অন্যমন তাকিয়ে থাকলেও বা খাতা ভরে পদ্য লিখলেও বা পেচ্ছাব পায়খানা করতে গিয়ে বা জল খেতে গিয়ে পাঁচ মিনিটের জায়গায় আধঘন্টা কাটিয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না। সাইদুজ্জামান ইসলামিয়াত পড়ানো রেখে গল্প করে সময় কাটান বেশি,তাঁর গল্পগুলো নেহাত নিরস নয়, তবে বারবারই তিনি বলেন বিষয় হিসেবে ইসলামিয়াত একেবারে ফেলনা নয়, ফেলনা নয় কারণ এটিতে নম্বর ওঠে, সূরা ফাতিহা ঠিকঠাক লিখে দিতে পারলে বা আসমানি কিতাবের চারটে নাম বলতে পারলেই দশে দশ। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নে নম্বর যদি কম পাওয়া যায়, প্রথম বিভাগে পাশ করার ভরসা হল ইসলামিয়াত, খাটাখাটনি ছাড়াই নম্বর। ক্লাসের মুসলমান মেয়েদের জন্য ইসলামিয়াত পাঠ্য, হিন্দুদের জন্য সনাতন ধর্ম শিক্ষা, সারা ইশকুলে হিন্দু ধর্ম পড়াবারও কোনও শিক্ষক নেই, কল্যাণী পাল হিন্দু বলে তাঁকে প্রায়ই ওই ক্লাসে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়, ছাত্রীদের তিনি বলেন, খামোকা ধর্মের পেছনে সময় নষ্ট না করে অঙ্ক বিজ্ঞান নিয়ে থাকো, ওতে কাজ হবে। হিন্দু মেয়েরা ধর্ম ক্লাসে বিরাট এক ছুটি পেয়ে যায়, অঙ্ক বিজ্ঞানের পেছনেও সময় নষ্ট না করে মাঠে খেলতে চলে যায়, নয়ত আড্ডা পেটায় খালি ক্লাস-ঘরে। চন্দনা যেহেতু বৌদ্ধ, ওরও বেরিয়ে যাওয়ার কথা ক্লাস থেকে, হিন্দু ধর্মের শিক্ষকই নেই, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক থাকার তো কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ও ঠায় বসেই থাকে ইসলামিয়াত ক্লাসে, গল্পের বইয়ে ডুবে, নয়ত কবিতায়। আমি ওর পাশে বসে না দিতে পারি মন ইসলামিয়াতে, না পারি সাইদুজ্জামানের নাকের ডগায় নীহাররঞ্জন গুপ্ত খুলতে। অতঃপর আঁকিবুকি কর, ছড়া লেখ। সাইদুজ্জামান কামান দাগান, ধর্মের ঘোড়া স্কন্ধে চাপান হাবিজাবি কন যেখানে যা পান কাশি তো আছেই, আবার হাপাঁন মাথায় একটি টুপিও লাগান কোরান হাদিস মানেন নাকি মানার ভান? সাইদুজ্জামানকে তুলোধুনো করে আমারই পরে দুঃখ লেগেছে, রীতিমত শার্টপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক, কোনও টুপি তার চাঁদি স্পর্শ করেনি, তাঁকে কেন এই হেনস্থা! আসলে এ সাইদুজ্জামান বলে কথা নয়, যে কাউকে নিয়েই এমন হতে পারে, টেংরা মাছের মত দেখতে কাউকে বিশাল হাঁমখু বোয়ালও নির্বিঘ্নে বানানো চলে। বিশেষ করে চন্দনার আশকারা পেলে। বাংলার শিক্ষক সুরাইয়া বেগম হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছেন, পেছনে চন্দনা আর আমি দুটো পিপঁ ড়ের মত, চন্দনা ফিসফিসিয়ে বলছে—ওলো সুরাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, মখু ঘুরাইয়া আমি যোগ করছি—আর কত হাঁটো, বেলা তো গেল কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দনা শেষ করে, যেতে যেতে গেল ফুরাইয়া। আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনের শিক্ষকমণ্ডলী যে ছোটখাট ব্যাপার নয় তা জেনেও আমাদের ছড়া কাটা, যদিও প্রকাশ্যে কিছুই নয় সবই নিভৃতে-নির্জনে-নিরালায়, থেমে থাকে না। অন্য ইশকুলে বি এ পাশ নেবে, আবাসিকে ঢুকতে হলে হতে হবে এম এ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে যা হতে হয়। এই বিদ্যায়তনের শিক্ষক শিক্ষিকা কেউ এ শহরের নয়, দূর দূর শহর থেকে আসা, বেশির ভাগই ঢাকা থেকে। শিক্ষককুলের বাড়িঘর সবই ইশকুলের ভেতর। এক একজন শিক্ষকের জন্য এক একটি বাড়ি, বাড়ির সামনে মাঠ, পেছনে বাগান। যখন এ ইশকুলটি বানানো হয়, তখন কেবল শিক্ষককুলের জন্যই আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না, ছাত্রীকুলের জন্যও ছিল। বাধ্যতামূলক আবাসিকতা। প্রায় ক্যাডেট কলেজের মত করে এই ইশকুলটির আগপাস্তলা গড়ার স্বপ্ন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে, তাই এই শহরেই তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে রাবেয়া মেমোরিয়াল নামে এই আবাসিক ইশকুলটি তিনি বানাতে শুরু করেছিলেন প্রায় একশ একর জমির ওপর, হাওড় বিল সব ভরে। তারপর তো পাকিস্তান গেল, গভর্নর গেল, একাত্তরে বোমারু বিমান শহরে চক্কর খেয়ে রাবেয়া মেমোরিয়ালের একাকি দাঁড়িয়ে থাকা আধখেঁচড়া ইশকুল-দালানে বোমা ফেলে অনেকখানি ধসিয়ে ফেলল। যুদ্ধের পর ধস সরিয়ে অবশিষ্ট দালানটুকু সারাই করে চুনকাম করে রাবেয়া মেমোরিয়াল নাম তুলে দিয়ে আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন বসিয়ে এটি চালু করা হল,ওই একই নকশায় বলা যায়, আবাসিকের নকশা, কিন্তু শিক্ষককুল দ্বারা আবাসিক ব্যবস্থা সম্ভব হলেও ছাত্রীকুল দ্বারা হল না। একটি নতুন দেশের পক্ষে অত বিশাল আয়োজনে সবকিছু করা সম্ভব হয়নি, তবু যা হয়েছে তাই বা কম কিসে! ছাত্রীদের ইশকুলের সীমানায় বাধ্যতামূলক করা হল না,
false
humayun_ahmed
চায় না। একদিন এরকম গল্প চলছে, মা এসে ফট করে মীরার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে কানে ধরলেন। ওপাশ থেকে মিষ্টি মিষ্টি গলায়। একটা ছেলে কথা বলছে। মা টেলিফোন রেখে বজ্ৰকণ্ঠে বললেন, মীরা। এ হারামজাদা কে? কে এই হারামজাদা? আর অরুণাইবা কে? মীরা ছুটে পালিয়ে গেল। আমরা মীরার কাণ্ডকারখানায় হলাম বিস্মিত, মার বুদ্ধি দেখে হলাম চমৎকৃত। মীরা অবশ্যি কিছুদিন বেশ যন্ত্রণা দিল। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। আমাদের কাজের ছেলেকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়ে দশটা ঘুমের ট্যাবলেটও কিনে আনল। মা শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, ঠিক আছে, ঐ ছেলের সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব। বি.এটা পাস করুক। ঐ ছেলে বি.এ পরীক্ষায় কম্পার্টমেন্টাল পেয়ে যাওয়ায় আমাদের অ হয়ে গেল। মীরার প্রেম বাতাসে উড়ে গেল। কম্পার্টমেন্টাল পাওয়া ছেলেদের প্রতি মেয়েদের প্রেম থাকে না। যাই হক, পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রাতে নিচে খেতে গিয়ে দেখি, ছোট চাচার ব্যাপারটা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছে। মীরা বলছে, আমি যা আগেই সন্দেহ করেছিলাম। ইদানীং কেমন সেজেগুজে আসছিল। এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা। সমিতা এ বাড়িতে সব সময় নার্সের পোশাক পরে আসে। বাড়তি কোনো রকম সাজসজ্জা তার নেই। সে আসে, নিজের মনে কাজ করে যায়। তাকে নিয়ে আমার বোনেরা যেসব কথাবার্তা বলে তা হচ্ছে কী দেমাগ। চার পয়সা দামের নার্সের এত দেমাগ হয় কী করে। তাও যদি চেহারাটা ভালো হত। আবলুস কাঠের মতো গায়ের রং। ঠোঁট দুটা পুরুষদের ঠোঁটের মতো মোটা। এসব কথার কোনোটাই সত্যি নয়, সমিতার গায়ের রং কালো এবং ঠোঁট দুটাও মোটা, তবু এই মেয়ের দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে হয়। মীরা এবং ইরা যে এত কথা বলে তার কারণ সম্ভবত ঈৰ্ষা। খাবার টেবিলে ছোট চাচাকে নিয়েই আলাপ চলতে লাগল। টেবিলে আছি শুধু আমরা অর্থাৎ মীরা, ইরা এবং বাবা। মা খাবার-দাবার এগিয়ে দিচ্ছেন এবং রাগে গন গন করছেন। মীরা-ইরা কিছুক্ষণ পর পর বলছে, এরকম একটা কুৎসিত কাজ কী করে করল। নার্স বিয়ে করে ফেলল–ছিঃ! এক পর্যায়ে বাবা বললেন, থা তো। একটা ব্যাপার নিয়ে এত কথা! বিয়ে যে করেই ফেলেছে এমন তো নাও হতে পারে। এই নিয়ে আর কোনো ডিসকাসন যেন না হয়। সঙ্গে সঙ্গে সবাই থেমে গেল। কোন কারণ ছাড়াই আমরা বাবাকে বেশ ভয় পাই। এর মধ্যে মাও আছেন। তিনি ভয় পান সবচে বেশি। বাবা ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, এসব হচ্ছে পারিবারিক স্ক্যান্ডেল। ধামাচাপা দিতে হবে। মা ক্ষীণ গলায় বললেন, বিয়ে করে বসে আছে, এই জিনিস তুমি ধামাচাপা দেবে কিভাবে? বাবা এমন ভঙ্গিতে মার দিকে তাকালেন যেন মার মুখতায় তিনি খুবই বিস্মিতবোধ করছেন। এই দৃষ্টিটি তিনি কোত্থেকে শিখেছেন কে জানে, তবে খুব ভালো শিখেছেন। এই দৃষ্টির মুখোমুখি আমাদের প্রায়ই হতে হয় এবং আমরা খুবই সংকুচিত বোধ করি। বাবা হাত ধোবার জন্যে উঠতে উঠতে বললেন, সমস্যা যেমন আছে, সমস্যার সমাধানও আছে। আসগরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। জাজ সাহেব ফাঁসির হুকুম দিয়ে এজলাস থেকে নেমে গেলেন এরকম ভঙ্গিতে বাবা নিজের ঘরে রওনা হলেন। আমি ছোট চাচাকে খবর দিতে গেলাম। ছোট চাচা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। বারান্দায় আলো নেই বলে তাঁর মনের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে বসে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে মন আলো নেই। যাদের মন হাসি-খুশি তারা বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকতে পারে না। কী করছ চাচা? কিছু করছি না। আঁধারের রূপ দেখছি। আচ্ছা, তুই কী বিয়ে নিয়ে কিছু বলেছিস? আমি সমিতাকে বিয়ে করে ফেলেছি এই জাতীয় কিছু? বলেছি। ছোট চাচা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভালই করেছিস। বিয়ে করে ফেললে কী রিএ্যাকশন হবে এ্যাডভান্স জানা গেল। তোমাকে বাবা ডাকছেন। কেন? কোর্ট মার্শাল হবে বলে মনে হচ্ছে। বলে আয় ঘুমিয়ে পড়েছি। খাওয়া-দাওয়া করেছ? আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তোক ভাবতে হবে না। তুই একটা কাজ কর তো—ছোট চাচীর ঘরে যা। কী কবর ঘরে গিয়ে? দেখে আয় সে ব্যাপারটা শুনেছে কি না। আমার মনে হয় শুনেন নি। মনে হওয়া-হওয়ি না-তুই জেনে আয়। আমি ছোট চাচীর ঘরের দিকে রওনা হলাম। তাঁর ঘরে ঢোকার অনেক সমস্যা আছে খালি পায়ে ঢুকতে হয়। ছোট চাচী দিনের মধ্যে সতের বার মেঝেতে পা ঘষে ঘষে দেখেন বালি কিচমিচ করছে কি না। ছোট চাচীর ভাষায় তিনি পৃথিবীর সবকিছু সহ্য করতে পারেন, তবে, মেঝেতে বালি থাকলে তা সহ্য করতে পারেন না। ছোট চাচীর ঘরে আসবাবপত্রও তেমন নেই। কারণ, শোবার ঘরে তিনি আসবাবপত্র সহ্য করতে পারেন না, তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। তাঁর প্রকাণ্ড ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা খাট। একপাশে গোল একটা টেবিল। সেই গোল টেবিলের মাঝখানে কাচের ফুলদানিতে দুটা গোলাপ। এই গোলাপ আসে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে। ছোট চাচীর বাবা রিটায়ার্ড জাজ হামিদুর রহমান সাহেব বর্তমানে গগালাপের চাষ করেন। ঢাকা শহর গোলাপ সমিতির তিনি সহ-সভাপতি। তাঁর বাগানে একান্নটা গোলাপের গাছ আছে। তিনি প্রতিদিন বাগানের গোলাপ তাঁর চার মেয়ের বাসায় দুটা করে পাঠান। সাইকেলে করে একটা শুটকো লোক গোলাপ দিয়ে যায়। এমনভাবে দেয় যেন সাত রাজার ধন দিয়ে যাচ্ছে। একবার আমার হাতে দিয়ে বলল, একটু কেয়ারফুলি ধরুন ভাই। আমি বললাম, কেন? বিষাক্ত না কি? লোকটা অত্যন্ত বিরক্ত হল। পুরো ব্যাপারটা কেন জানি আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। রিটায়ার্ড জাজ হামিদুর রহমান সাহেবের
false
humayun_ahmed
নয়। তবে শিক্ষামূলক প্রবন্ধ, প্রবন্ধের নাম–‘নারী জাগরণের প্রয়োজনীয়তা ও অপ্ৰয়োজনীয়তা’। শিরোনামটি তার খাতার ওপর লেখা। প্ৰবন্ধ শেষ হবার পর ঠিক করবেন কোন শিরোনামটা শেষ পর্যন্ত যাবে। বাকি তিনটি শিরোনাম হলো– ১. আমার চক্ষে নারী। ২. বেগম রোকেয়া থেকে মাদার তেরেসা। ৩. হে নারী। এখন রাত বাজছে সাড় আটটা। টিভিতে বাংলা খবর শেষ হয়ে গেছে। নৃত্যের তালে তালে’ নামের নাচের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। মতিনউদ্দিন টিভির সামনেই বসে আছেন। তবে টিভি দেখছেন না বা শুনছেনও না। টিভির সাউন্ড অফ করে দেয়া আছে। টিভির বাংলা সংবাদ মতিনউদ্দিন সাহেব সব সময় শোনেন। কর্মহীন লোকরা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকতে ভালোবাসে এবং এটাকে তার প্ৰধান দায়িত্বের একটি বলে মনে করে। মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু যে টিভির সংবাদ শোনেন তা না, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও শোনেন। আগে রেডিও পিকিঙের এক্সটারনাল সার্ভিস শুনতেন। ইদানীং শোনেন না, কারণ তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বেছে বেছে আজকের দিনটাতেই মতিনউদ্দিন টিভির খবর শুনলেন না। নারী বিষয়ক প্ৰবন্ধে অতিরিক্ত মনোযোগ দেবার কারণে এই ঘটনাটা ঘটল। আজ টিভি শুনলে তিনি বড় রকমের বিস্ময়ে অভিভূত হতেন। কারণ আজ এস.এস.সি.র রেজাল্ট হয়েছে। টিভিতে তার মেজো কন্যা নাদিয়া মেহজাবিন-এর নাম বলা হয়েছে। আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় থেকে নাদিয়া মেহজাবিন আটটি লেটার নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ছেলে ও মেয়ে সবার মধ্যে প্রথম হয়েছে। রাত দশটায় সুরাইয়া স্বামীর ঘরে ঢুকলেন। মতিনউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, এখন ভাত খাব না। তোমরা খেয়ে নাও। আমি যখন লেখালেখির কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি তখন আমাকে খাওয়াদাওয়ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত করবে না। এই কথাটা কতবার বলতে হবে? সুরাইয়া বললেন, আজ এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। আটটার বাংলা সংবাদে বলেছে। মতিনউদ্দিন স্ত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁপানির শব্দ শুনলেন। তাকিয়ে দেখলেন দরজা ধরে নাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে ফোঁপাচ্ছে এবং তার চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে। মেয়েদের চরিত্রের এই দুর্বলতায় তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। মাত্র টিভিতে রেজাল্ট ডিক্লেয়ার করেছে। পাস-ফেল জানতে জানতে আরো দুদিন–এর মধ্যেই নাকের জলে চোখের জলে একাকার। তার রাগ উঠে গেল। তিনি প্রবন্ধের স্বার্থে রাগ সামলাবার চেষ্টা করলেন। মাথায় রাগ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী জটিল প্ৰবন্ধ লেখা যায় না। মতিনউদ্দিন গাখীর গলায় বললেন–গাধা মেয়ে কাঁদছ কেন? সুরাইয়া নিজেও কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–তোমার মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে। আটটা লেটার পেয়েছে। কী বললে? ওদের ক্লাসের হেডমিস্ট্রেস এসেছেন। মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। স্কুল থেকে দুজন টিচারও এসেছেন। নাদিয়া ফার্স্ট হয়েছে? কী বলছি। এইসব! সে ফার্স্ট হবে কী জন্যে? সুরাইয়া এইবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে বললেন–আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি নিজে একটু নাদিয়ার হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বল। আমার মাথা যেন কেমন করছে। উনাদের চা-টা দাও। আমি যাচ্ছি। ফলস নিউজ হতে পারে। হয়তো নাদিয়ার নামে নাম একটা মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে বেকুব হেডমিসট্রেস মনে করেছে তোমার মেয়ে। টিভিতে ওদের স্কুলেরও নাম বলেছে। বাংলাদেশ টিভির নিউজের কোনো মূল্য আছে? মূল্য থাকলে আমরা ব্যাটারি পুড়িয়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনি? পাঞ্জাবিটাতে ইন্ত্রি দিয়ে দুটা ডলা দিয়ে দাও-আমি দেখছি ব্যাপার কী? অল্পতে অস্থির হয়ে না। অস্থির হবার মতো কিছু নাই। বোঝাই যাচ্ছে ফলিস নিউজ। রাত এগারটার ভেতর মতিনউদ্দিন জেনে গেলেন ঘটনা সত্যি। মিষ্টি নিয়ে নাদিয়ার বড়ফুফু চলে এসেছেন। নাদিয়ার স্কুলের কিছু বান্ধবী এসেছে। আশপাশের বাসার কিছু মহিলা এসেছেন। সবকটা পত্রিকা অফিস থেকে লোক এসেছে। বাবা-মা দুপাশে মেয়ে মাঝখানে এইভাবে ছবি তোলা হবে। মতিনউদ্দিন রাজি হলেন না। তিনি বিনীত গলায় বললেন, ভাই আমি আমার মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওদের দিকে কোনোদিন লক্ষ করি নি। আজ যদি মেয়েকে সাথে নিয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপাতে দেই সেটা খুবই অন্যায় হবে। মেয়ে তার মাকে নিয়ে ছবি তুলুক। সেটাই হবে ঠিক এবং শোভন। মতিন সাহেব কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হলেন। মেয়ের জন্যে কোনো একটা উপহার। কিনতে ইচ্ছে করছে। এত রাতে দোকানপাট সব বন্ধ থাকার কথা। তারপরেও চেষ্টা করে দেখা। কিছু কিছু দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। একটা ভালো হাতঘড়ি কি পাওয়া যাবে? মেয়েটা ঘড়ি ছাড়া পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। পরীক্ষার জন্যে ঘড়িটা প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এই মেয়ে মুখফুটে তা বলে নি। ভালো একটা ঘড়ির কত দােম পড়বে কে জানে। তার কাছে এত টাকা নেই। টাকা। যা ছিল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ছ সাত শ’র বেশি হবে না। এই টাকায় ভালো ঘড়ি হবে না। একটা কলম কিনে দেয়া যায়। কলামটা নিশ্চয়ই সে খুব যত্ন করে রাখবে। তার ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তখন তাদের সে কলমটাি দেখিয়ে বলবে–আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। যেদিন আমার এস.এস.সি’র রেজাল্ট হলো সেই রাতে বাবা কিনে নিয়ে এসেছেন। শাড়ি কাপড়ের একটা দোকান খোলা পাওয়া গেল। মতিনউদ্দিন মেয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনে ফেললেন। সাড়ে ছয় শ টাকা দাম। হাফসিল্ক। শাড়ির রঙ গাঢ় কমলা। রঙটা মতিনউদ্দিনের খুব পছন্দ হলো। তিনি ইতস্তত করে দোকানিকে বললেন, আমার মেয়ে শ্যামলা এই শাড়িটাতে তাকে মানাবে তো? দোকানি শাড়ি প্যাক করতে করতে বলল, একটা পেত্নীকে যদি এই শাড়ি পড়িয়ে দেন তাকে লাগবে রাজকুমারীর মতো। আরো দশটা দোকান দেখেশুনে কিনতে পারতাম। কিন্তু জিনিসটা আজই দরকার। আমার মেয়ের জন্য উপহার। ওর এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। ছেলেমেয়ে সবার
false
humayun_ahmed
ঝুলায়েছেন। রোজ হাশর পর্যন্ত তাকে এইভাবে ঝুলে থাকতে হবে। রোজ হাশর কী? রোজ হাশর হল মহাবিচারের দিন। মহাবিচার কী? মহাবিচার হল আল্লাহপাকের বিচার…. উনার বিচারকে ভয় পাবার কিছু নাই। উনি দয়ালু বিচারক। অপরাধ করলেও উনি ক্ষমা দিয়ে দেন। সবাই তাঁর কাছে মাফ পায়। নামেই তিনি বিচারক, আসলে তিনি ক্ষমারক। ক্ষমারক কী? যিনি ক্ষমা করেন। তিনিই ক্ষমারক। বৃদ্ধ শুভ্রর সকল প্রশ্নের জবাবই হয়ত দিতেন, কিন্তু তিনি এক বর্ষাকালে অসুখে পড়ে গেলেন। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সর্দি জ্বর। বৃষ্টি পানি বৃদ্ধদের সহ্য করে না। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগেছে। পরে দেখা গেল ব্যাপার তারচেয়েও জটিল। এক সময় ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন ক্যানসার। বৃদ্ধ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে শয্যা গ্রহণ করলেন। এবং তিনটি জিনিশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন— মৃত্যু জর্দা ভর্তি পান এবং শুভ্র জর্দা দিয়ে পান তাঁর জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন শেষ সময়ে দয়াপরবশ হয়ে কেউ হয়ত মুঠো ভর্তি জর্দা দিয়ে এক খিলি পান বানিয়ে তাকে দেবে। শুভ্ৰকে তার কাছে আসতে দেয়া হবে না, এটা কখনো ভাবেন নি। দিনের পর দিন তিনি খবর পাঠাতেন— পাঁচ মিনিটের জন্যে কি শুভ্ৰকে তার কাছে পাঠানো যায়। মাত্ৰ পাঁচ মিনিট। তিনি ছেলেটার সঙ্গে দুটা কথা বলবেন। এর বেশি কিছু না। জাহানারা ক্যানসার রোগীর কাছে ছেলেকে পাঠানোর চিন্তা এক সেকেন্ডের জন্যেও মনে স্থান দিলেন না। অবোধ শিশু মৃত্যুর ভয়াবহ রূপ দেখে ভয় পাবে। কী দরকার? শৈশবের ভয় চিরস্থায়ী হয়ে যায়। মানুষের মনে নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। জটিলতার ভেতর দিয়ে যাবার কোনো দরকার নেই। শুভ্ৰ জানতেও পারল না। মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধ কী গভীর মমতা নিয়েই না তার জন্যে দিনের পর দিন প্ৰতীক্ষা করেছে। শুভ্ৰ আজ অফিসে আসবে এই খবরটা অফিসের সবাই জানে। ঝাড়ুদার সকালবেলা একবার অফিসে ঝাড়ু দিয়েছিল। এগারেটার দিকে আবার অফিস ঝাড়ু দিয়ে ফেলল। মোতাহার সাহেবের খাস কামরা শুধু যে ঝাঁট দেয়া হয়েছে তাই নয়, পুরো এক কোটা এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জানালা এবং দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। বড় বড় ফুল তোলা রঙিন পর্দাঁ। অফিসের কর্মচারীরাও আজ একটু ফিটফাট হয়ে এসেছে। আজ একটা বিশেষ দিন। অফিসের মালিকানা বদল হচ্ছে। ছোট সাহেব অফিসে বসবেন। কে জানে আগের চেয়ে সব কিছু হয়ত অনেক ভালভাবে চলবে। অন্তত আশা করতে তো দোষের কিছু নেই। মোতাহার সাহেবের ঘরে শুভ্ৰ বসেছে। এসি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসিতে গ্যাস নেই বলে শো শো শব্দই হচ্ছে, ঘর ঠাণ্ড হচ্ছে না। শুভ্রর সামনে খালি একটা গ্লাস। গ্রাসের পাশে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। বোতলটা ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। বোতলের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমছে। দেখতে ভাল লাগছে। শুভ্র এমনভাবে বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বোতলের গায়ে পানি জমার অপূর্ব দৃশ্য সে অনেকদিন দেখে নি। শুভ্রর সামনে ম্যানেজার ছালেহ উদ্দিন বসেছেন। তাঁর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শুভ্ৰ কদিন থেকেই ম্যানেজারের দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করছে। কিছু জিজ্ঞেস করে নি। ছালেহ উদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছোট বাবু চা বা কফি খবো? শুভ্ৰ পানির বোতল থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল, না। অফিসের সবাইকে ডাকি। সবার সঙ্গে কথা বল। কথা বলার দরকার কী? দরকার আছে। সবাই অপেক্ষা করে আছে তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। আপনাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন? চিন্তার অনেক কারণ আছে। কারণগুলি বলুন শুনি। অনেক টাকা বাইরে। আদায় বন্ধ। কেন? বড় সাহেব মারা গেছেন, সবাই ভাবছে ব্যবসা শেষ। বাবার কী কী ব্যবসা ছিল? ইটের ভাটা আছে, আর ট্রান্সপোটের ব্যবসা কিছুদিন করেছেন। এখন বন্ধ। চারটা ট্রাক ছিল, তিনটা স্যার থাকতেই বিক্রি হয়ে গেছে। কনস্ট্রাকশানের ব্যবসা মাঝে করেছেন। স্যারের ব্যবসাবুদ্ধি ভাল ছিল না। স্যারের একটা ব্যাপার ছিল লোকজন পছন্দ করতেন। তিনি থাকতেন নিজের মত কিন্তু চাইতেন। অনেক পুনু আশেপাশে থাকবে। রোজ নটার আগে অফিসে আসতেন থাকতেন। এতক্ষণ কী করতেন? আমি যে চেয়ারে বসে আছি সেই চেয়ারে বসে থাকতেন? চেয়ারে বসে থাকতেন। বিছানায় শুয়ে থাকতেন। তিনি ঝামেলা পছন্দ করতেন না। শুভ্ৰ পানির বোতল খুলে গ্লাসে পানি ঢালিল। তার পানির তৃষ্ণা হয় নি। কিন্তু ভরা পানির বোতল দেখে এক চুমুক পানি খেতে ইচ্ছা করছে। ম্যানেজার সাহেব! বল, কী বলবা। ছোটবেলায় আমি প্ৰায় এই অফিসে আসতাম। জানি। বুড়ো এক ভদ্রলোক আমাকে স্কুল থেকে অফিসে নিয়ে আসতেন। ভদ্রলোক খুব জর্দা খেতেন। আপনি কি ঐ বুড়ো ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছু জানেন? না। বাবার অফিসেই চাকরি করতেন। অফিসের পুরনো কর্মচারীরা হয়ত জানবে। কিংবা অফিসে রেকর্ডপত্রও থাকতে পারে। একটু খোঁজ করে দেখবেন? আজই দেখবেন। কারণটা কী? কোনো কারণ নেই এমনি খোঁজ করা। ও আচ্ছা। বাবার অফিসে অনেক দিনের পুরনো কর্মচারী কারা আছেন? কেউ নেই। স্যারের একটা স্বভাব হল বেশিদিন কাউকে চাকরিতে রাখতেন না। স্যার বেঁচে থাকলে আমার চাকরিও থাকত না। বাবার মৃত্যু তাহলে আপনার জন্যে ভালই হয়েছে। ছিঃ ছিঃ এইসব কী বল? আমি ঠাট্টা করছি। আপনি এখন ঘর থেকে যান। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব। দুপুরে আমি অফিসেই খাব। ব্যাংকের হিসাবপত্র দেখবে বলেছিলে ক্যাশিয়ারকে আসতে বলব? না। দুপুরের পর। আচ্ছা। দুপুরে কী খাবে? বাবা কী খেতেন? স্যারতো দুপুরে কিছু খেতেন না। কয়েক টুকরা পেপে, একটা টেষ্ট বিসকিট এক কাপ চা। আমিও তাই খাব। বাবার জীবন ধারণ
false
humayun_ahmed
নি। সারা রাতই আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে কাটিয়েছি। অথচ যে-বাবা কোনোদিন অপ্রয়োজনে সত্য কথাটিও বলেন নি, তিনি কেন এমন অনর্গল মিথ্যা বলে চলেন, ভেবে পাই না। রাবেয়া এক দিন বলছিল, মা মারা যাবার পর বাবা খুব ফ্রী হয়েছেন। তার মানে? মানে আর কি, মনে হয়। বাবা মার সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেন নি। তুই কী সব সময় বাজে বকিস? আহা এমনি বললাম। কে বলেছে বিশ্বাস করতে? বিশ্বাস না করলে অবশ্যি চলে, কিন্তু বিশ্বাস না করাই—বা যায় কী করে? কিন্তু মার মতো মেয়ে তেইশ বছর কী করে মুখ বুজে এইখানে কাটিয়ে দিয়েছেন ভেবে পাই না। বাবা মার সঙ্গে হাস্যকর আচরণ করতেন। যেন মনিবের মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেয়া প্রিয় খানসামা এক জন। ভালোবাসার বিয়ে হলে এ রকম হয় না। সেখানে অসামঞ্জস্য হয়, অশান্তি আসে, কিন্তু মূল সুরটি কখনো কেটে যায় না। অথচ যতদূর জানি ভালোবেসেই বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। কিছুটা খালা বলেছেন, কিছু বলেছেন বাবা, রাবেয়াও বলেছে কিছু কিছু (সে হয়তো শুনেছে মার কাছ থেকেই)। সব মিলিয়ে এ ধরনের চিত্র কল্পনা করা যায়। শিরিন সুলতানা নামের উনিশ বছরের একটি মেয়ে সূর্য ওঠার আগে ছাদে বসে হারমোনিয়ামে গলা সাধাত ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মে। সাতটার দিকে গানের মাস্টার শৈলেন পোদার আসতেন গান শেখাতে। তিনি আধাঘণ্টা থাকতেন। এই সমস্ত সময়টা আজহার হোসেন নামের একটা গরিব আশ্রিত ছেলে কান পেতে অপেক্ষা করত। ছাদের চিলেকোঠার ঘরটায়, সেখানেই সে থাকত। এক দিন মেয়েটি কীএকটি গান গাইল যেন, খুব ভালো লাগল ছেলেটির। বেরিয়ে এসে কুণ্ঠিতভাবে বলল, আরেক বার গান না। মাত্র এক বার। থেকে। লজ্জিত ছেলেটি অপরাধী মুখে আরো দু বছর কাটিয়ে দিল চিলেকোঠার ঘরটায়। এই দু বছরে শিরিন সুলতানার সঙ্গে তার একটি কথাও হয় নি। শুধু দেখা গেল, দু জনে বিয়ে করে দেড় শ টাকা ভাড়ার একটা ঘুপচি ঘরে এসে উঠেছেন। কী করে এটা সম্ভব হল, তা আমার কাছে একটি রহস্য। রাবেয়ার কাছে জানতে চাইলে সে বলত, আমি জানি, কিন্তু বলব না। কেন? এমনি। কী করবি শুনে? জানতে ইচ্ছে হয় না? বলব তোকে একদিন। সময় হোক। সেই সময়ও হয় নি। জানাও যায় নি কিছু। অথচ খুব জানতে ইচ্ছে করে। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে দুপুর বারোটায় একটা ক্লাস ছিল। একটার দিকে শেষ হল। দুপুরে রিকশা পাওয়ার আশা কম। সব রিকশাওয়ালা একসঙ্গে খেতে যায় কি না কে জানে? অল্প হাঁটতেই ঘামে শার্ট ভিজে ওঠার যোগাড়। ভীষণ রোদ। রাস্তার পিচ গলে স্যাণ্ডেলের সঙ্গে আঠার মতো এটে যাচ্ছিল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করব কি না যখন ভাবছি, তখনি মেয়েলি গলা শোনা গেল, খোকা ভাই, ও খোকা ভাই। তাকিয়ে দেখি কিটকি। সিনেমা হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাইকে সচকিত করে বেশ জোরেসোরেই ডাকছে। কানে পায়রার ডিমের মতো দুটো লাল পাথর। চুলগুলো লম্বা বেণী হয়ে পিঠে ঝুলছে। কামিজ সালোয়ার সবই কড়া হলদে।-লাল নকশাকাটা। সুন্দর দেখাচ্ছিল, মুখটা লম্বাটে, পাতলা বিস্তৃত ঠোঁট। আমি বললাম, কিরে, তুই সিনেমা দেখবি নাকি? হুঁ, ইয়েলো স্কাই। একা এসেছিস? না, আমার এক বন্ধু আসবে বলেছিল, এখনো আসল না। দেড়টা বেজে গেছে, এখুনি শো শুরু হবে। টিকিট কেটে ফেলেছিস? হ্যাঁ। দে আমার কাছে, বিক্রি করে দি একটা। তুই দেখ একা-একা। আপনি দেখেন না। আমার সঙ্গে, আপনার তো কোনো কাজ নেই। আসেন না। আরে, পাগল নাকি? বাসায় গিয়ে গোসল করব, ভাত খাব। আহা, এক দিন একটু দেরি হলে মরে যাবেন না। একা একা ছবি দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে। আসেন না, দেখি। খুব ভালো ছবি। প্লীজ বলুন, হ্যাঁ। কিটকির কাণ্ড দেখে হেসে ফেলতে হল। বললাম, চল দেখি, ছবি ভালো না এ লে। কিন্তু মাথা ভেঙে ফেলব। দু জন সিঁড়ি দিয়ে উঠছি দোতলায়, কিটকি হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, দেখুন তো, কী মুশকিল হল। আবার কি? আমার বন্ধুটা এসে পড়েছে। ঐ যে নামছে রিকসা থেকে। খাটো করে ঐ মেয়েটি নাকি; লাল ওড়না? হুঁ। ভালোই হয়েছে। দেখ তোরা দু জনে, আমায় ছেড়ে দে। না-না, আসেন এই পোস্টাব বোর্ডটার আড়ালে চলে যাই। না দেখলেই চলে যাবে। তুই যা আড়ালে, আমাকে তে। স্মার চেনে না। আহা, আসেন না। কোন দিকে গেছে? দোতলায় খুঁজতে গেছে হয়তো। কেমন গাধা মেয়ে দেখেছেন? সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছি, এসেছে দেড়টায়। ছবিটা সত্যি ভালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে গেলাম। তবে ইটালিয়ান ছবি যেমন হয়–করুণ রসের ছড়াছড়ি। ছবির সুপুরুষ ছেলেটি বিয়ে করেছে তার প্রেমিকার বড় রোনকে। খবর পেয়ে প্রেমিকা বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। সেটাই দেখাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখি কিটকি নিজেই মুখে আধখানা রুমাল গুঁজে কান্নার দুরন্ত বেগ সামলাচ্ছে। চোখের পানিতে চিকচিক করছে গাল। পাশে বসা এক গোবেচারা তরুণ পর্দা ছেড়ে কিটকিকেই দেখছে অবাক হয়ে। আমি বললাম, কি রে কিটকি, কী ব্যাপার? কিছু না। আয় আয়, ছবি দেখতে হবে না। কী মুশকিল। কান্নার কী হল! তোর তো কিছু হয় নি। কিটকির হাত ধরে হল থেকে বেরিয়ে এলাম। আলোয় এসেই লজ্জা পেয়ে গেল সে। তুই একটা পাগল। বলেছে আপনাকে। আর একটা বাচ্চা খুকি। আর আপনি একটা বুড়ো। তুই ভারি ভালো মেয়ে কিটকি। তোর কান্না দেখে আমার এত ভালো লেগেছে। ভালো হবে না বলছি। আইসক্রীম খাবি কিটকি? ন্‌-না।
false
shorotchandra
আবশ্যক নেই, তিনি আপনিই আসবেন। ও-ঘরে লোক আছে ত? হাঁ দিদিমণি, দু’জন বসে আছে। ডাক্তার আবার কখন আসবেন? সন্ধ্যার আগেই আসবেন। বলে গেছেন আর ভয় নেই। চিকিৎসকেরা অভয় দিয়ে গেছেন বন্দনার এইটুকুই সান্ত্বনা। এছাড়া তাহার কি-ই বা করিবার আছে! বন্দনা গিয়া পিতাকে দ্বিজদাসের পীড়ার সংবাদ দিল, কিন্তু বেশি বলিল না। তিনি সেইটুকু শুনিয়াই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন,—কৈ আমি ত কিছুই জানতে পারিনি? না, আমাদের ঘুম ভাঙ্গানো কেউ উচিত মনে করেনি। কিন্তু সেটা ত ভালো হয়নি! বন্দনা চুপ করিয়া রহিল, তিনি ক্ষণেক পরে নিজেই বলিলেন, টিকিট কিনতে পাঠান হয়েছে, গাড়ি রিজার্ভ হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ায় ত দেখচি একটু বিঘ্ন ঘটল। বন্দনা বলিল, কেন বিঘ্ন হবে বাবা, আমরা থেকেই বা তাঁদের কি উপকার করবো? না, উপকার নয়, কিন্তু তবু— না বাবা, এমনি করে কেবলি দেরি হয়ে যাচ্চে, আর তুমি মত বদলিয়ো না। এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া আসিল। বেলা পড়িয়া আসিতেছে, বন্দনার ঘরে ঢুকিয়া অন্নদা মেঝের উপর বসিল। তাঁহাদের যাত্রা করিতে তখনও ঘণ্টা-দুয়েক দেরি। বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, দ্বিজুবাবু ভাল আছেন? হাঁ দিদি, ভাল আছে, ঘুমুচ্চে। বন্দনা কহিল, আমাদের যাবার সময়ে কারও সঙ্গে দেখা হলো না। একজনের তখনো হয়ত ঘুম ভাঙবে না, আর একজন যখন বাড়ি এসে পৌঁছবেন তখন আমরা অনেক দূর চলে গেছি। অন্নদা সায় দিয়া বলিল, হাঁ, বড়দাদাবাবু আসবেন প্রায় নটা রাত্তিরে। একটু পরে কহিল, তিনি এসে পড়লে সবাই বাঁচি। সকলের ভয় ঘোচে। কিন্তু ভয় ত কিছু নেই অন্নদা! অন্নদা বলিল, নেই সত্যি, কিন্তু বড়দাদাবাবুর বাড়িতে থাকাই আলাদা জিনিস দিদি। তখন কারও আর কোন দায়িত্ব নেই, সব তাঁর। যেমন বুদ্ধি, তেমনি বিবেচনা, তেমনি সাহস, আর তেমনি গাম্ভীর্য! সকলের মনে হয় যেন বটগাছের ছায়ায় বসে আছি। সেই পুরাতন কথা, সে বিশেষণের ঘটা। মনিবের সম্বন্ধে এ যেন ইহাদের মজ্জাগত হইয়াছে। অন্য সময় হইলে বন্দনা খোঁটা দিতে ছাড়িত না, কিন্তু এখন চুপ করিয়া রহিল। অন্নদা বলিতে লাগিল, আর এই দ্বিজু! দুই ভায়ে যেন পৃথিবীর এ-পিঠ ও-পিঠ। বন্দনা আশ্চর্য হইয়া কহিল কেন? অন্নদা বলিল, তা বৈ কি দিদি। না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে ঝঞ্ঝাট, না আছে গাম্ভীর্য। বৌদি বলেন, ও হচ্চে শরতের মেঘ, না আছে বিদ্যুৎ, না আছে জল। উড়ে উড়ে বেড়ায়, ব্যাপার যত গুরুতর হোক, হেসে খেলে ও কাটাবেই কাটাবে। না গৃহী না বৈরিগী, কত খাতক যে ওর কাছে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লিখিয়ে নিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে তার হিসেব নেই। বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই রাগ করেন না? করেন না? খুব করেন। বিশেষ মা। কিন্তু ওকে পাওয়া যাবে কোথায়? কিছুদিনের মতো এমন নিরুদ্দেশ হয় যে বৌদি কান্নাকাটি শুরু করে দেন, তখন সবাই মিলে খুঁজে ধরে আনে। কিন্তু এমন করেও ত চিরদিন কাটতে পারে না দিদি, ওরও বিয়ে হবে, ছেলেপুলে হবে, তখন যে এ ব্যবস্থায় একেবারে দেউলে হতে হবে! বন্দনা কহিল, এ কথা তোমরা ওঁকে বলো না কেন? অন্নদা কহিল, ঢের বলা হয়েছে, কিন্তু ও কান দেয় না। বলে, তোমাদের ভাবনা কেন? দেউলেই যদি হই বৌদিদি ত আর দেউলে হবে না, তখন সকলে মিলে ওঁর ঘাড়ে গিয়ে চাপবো। বন্দনা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি কি বলেন? অন্নদা কহিল, দেওরের ওপর তাঁর আদরের শেষ নেই। বলেন, আমরা খাবো আর দ্বিজু উপোস করবে নাকি? আমার পাঁচ শ টাকা আয় ত আর কেউ ঘুচোতে পারবে না, আমাদের গরিবী-চালে তাতেই চলে যাবে। বড়বাবু তাঁর লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে সুখে থাকুন আমরা চাইতে যাবো না। শুনিয়া বন্দনার কি যে ভালো লাগিল তাহার সীমা নাই। যে বলিয়াছে সে তাহারই বোন। অথচ যে সমাজে, যে আবহাওয়ার মধ্যে সে নিজে মানুষ, সেখানে এ কথা কেহ বলে না, হয়ত ভাবিতেও পারে না। বলার কখনো প্রয়োজন হয় কিনা তাই বা কে জানে। কিন্তু অন্নদা যাহা বলিতেছিল সে যেন পুরাকালের একটা গল্প। ইহারা একান্নবর্তী পরিবার, কেবল বাহিরের আকৃতিতে নয় ভিতরের প্রকৃতিতে। অন্নদা এখানে শুধু দাসী নয়, দ্বিজদাসের সে দিদি। কেবল মৌখিক নয়, আজও সকল কথা তাহার ইহারই কাছে। এই অন্নদার বাবা এই পরিবারের কর্মে গত হইয়াছে, তাহার ছেলে এখানে মানুষ হইয়া এখানেই কাজ করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেছে। অন্নদার অভাব নাই, তবু মায়া কাটাইয়া তাহার যাইবার জো নাই। এই সমৃদ্ধ বৃহৎ পরিবারে অনুবিদ্ধ এমন কতজনের পুরুষানুক্রমের ইতিহাস মিলে। দয়াময়ীর অবাধ্য সন্তান দ্বিজদাসও কাল বলিয়াছিল, তাহার মা, দাদা, বৌদি, তাহাদের গৃহদেবতা, অতিথিশালা সমস্ত লইয়াই সে,—তাহাদের হইতে পৃথক করিয়া বন্দনার কোনদিন তাহাকে পাইবার সম্ভাবনা নাই। তখন বন্দনা অস্বীকার করে নাই বটে, তবু আজই এ কথার যথার্থ তাৎপর্য বুঝিল। কথা শেষ হয় নাই, অনেক কিছু জানিবার আগ্রহ তাহার প্রবল হইয়া উঠিল, কিন্তু বাধা পড়িল। চাকর আসিয়া জানাইল রায়সাহেব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন, ছ’টা বাজিয়াছে। যাত্রা করিবার সময় একঘণ্টার বেশি নাই। প্রস্তুত হইবার জন্য বন্দনাকে উঠিতে হইল। যথাসময়ে রায়সাহেব নীচে নামিলেন, নামিতে নামিতে মেয়ের নাম ধরিয়া একটা হাঁক দিলেন, বন্দনার কানে আসিয়া তাহা পৌঁছিল। অন্যায় যতবড় হউক, অনিচ্ছা যত কঠিন হউক যাইতেই হইবে। বারংবার জিদ করিয়া যে ব্যবস্থা নিজে ঘটাইয়াছে তাহার পরিবর্তন চলিবে না। ঘর হইতে যখন বাহির হইল এই কথাই সর্বাগ্রে মনে হইল, ভবিষ্যতে যতদূর দৃষ্টি যায় কোনদিন কোন ছলেই এখানে ফিরিয়া আসার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু তাহার অনেক
false
humayun_ahmed
বার টোকা দিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তৃতীয় বার টোকা দেয়। ছেলেদের এত ধৈৰ্য নেই। আনিস দরজা খুলে দিল। একটি মেয়েই দাঁড়িয়ে আছে, মালিশা। দিনের আলোয় তাকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। তার উপর সে বেশ সাজগোজ করেছে। কাঁধে লাল টকটকে ভেলভেটের ব্যাগ। সোনালি চুলগুলিকে লম্বা বেণী করে কাঁধের দু পাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাতের আলোয় যতটা অল্পবয়েসী মনে হয়েছিল, এখন অবশ্যি সে-রকম লাগছে না। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছি? তা পারছি। তুমি মালিশ। মালিশা গিলবার্ড। আমি কি তেতিরে এসে বসতে পারি? হ্যাঁ, পার! মেয়েটি ঘরে ঢুকেই বলল, তুমি সন্ধ্যাবেলা ফ্ৰী আছ? কেন বল তো? আমি তোমাকে কোনো একটি ভালো রেস্টুরেন্ট নিয়ে যেতে চাই। আজ আমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মালিশা। ধন্যবাদ। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? আনিস ইতস্তত করতে লাগল। তোমার ইচ্ছা না হলে যেতে হবে না। আনিস বলল, কোথায় যেতে চাও? আমার পকেটে চল্লিশ ডলার আছে। এর মধ্যে হয়, এরকম কোনো রেস্টুরেন্ট। মেক্সিকান খাবার তোমার পছন্দ হয়? সেগুলি বেশ সস্তা। মেক্সিকান খাবার আমার খুব পছন্দ। তোমাকে খুব একটা ভালো রেস্টুরেন্টে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু কী করব বল? রোজগারপাতি নেই। হাইস্কুল পাস করি নি। কাজেই রেস্টুরেন্টের ওয়েটেস আর বেবিসিটিং-এর বেশি কিছু পাই না। চল্লিশ ডলার জমাতে হলে আমাকে দু মাস রোজ আট ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। আনিস বলল, তুমি যদি কিছু মনে না কর, তাহলে আমি বরং ডিনারটা কিনি। মালিশা হেসে ফেলল। এখন আমার অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু শিগগিরই আমি মাল্টিমিলিওনিয়ার হচ্ছি। কাজেই টাকা খরচ করতে মায়া লাগে না আমার। আনিস বলল, মিলিওনিয়ার সত্যি সত্যি হচ্ছে তুমি? ইউ বেট। আমার মা ডলারের বস্তার উপর শুয়ে আছে। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, যদি বিষটিষ খাইয়ে দিই। আমিও বুড়িকে ভজিয়ে রাখছি। প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিই–মা, তোমার শরীর কেমন আছে? ঠিকমতো ওষুধপত্র খাচ্ছ তো? গরমের সময় অবশ্যই হাওয়াই থেকে ঘুরে আসবে। হা হা হা। আনিস হেসে ফেলল। মালিশ বলল, বুড়ো—বুড়ি হলেই মানুষ এরকম হয়ে যায়। ডলারই তখন প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। জীবন দিয়ে ডলার আগলে রাখে। আমার মতে পঞ্চাশের ওপর বয়স হলেই তাকে ঘাড় ধরে একটা নির্জন দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসা উচিত। না-না, আমি খুব সিরিয়াস। জান তুমি, আমার মারা কত টাকা আছে? আন্দাজ করতে পারে? না। মা দু নম্বর বিয়ে করে এক জন পোল ব্যবসায়ীকে। তার হচ্ছে সী কার্গোর ব্যবসা। আমার স্টেপফাদার মারা যাবার পর সবকিছু আমার মা পেয়েছে। তার মধ্যে আছে রাজপ্রসাদের মতো দুটি বাড়ি। একটি ফ্লোরিডাতে, অন্যটি বোহেমিয়া আইল্যাণ্ডে। মা সবকিছু বিক্রি করে ডলার বানিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করেছে। নিজে গিয়ে উঠেছে ওল্ড হোমে। সস্তায় থাকা-খাওয়া যায়। বিশ্বাস করতে পার? বিশ্বাস করা কঠিন। আমি তারই মেয়ে। আর দেখ, চল্লিশটি ডলার খরচ করতে আমার গায়ে লাগছে। আনিস দেখল, মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। আমেরিকান মেয়ে কাঁদবে না ঠিকই। এরা মাচকাতে জানে না। আনিস বলল, ছটার আগে নিশ্চয়ই তুমি খেতে যাবে না? কফি খাও একটু! কফিতে দুধ চিনি নাও তুমি? দু চামচ চিনি। দুধ চাই না। আনিস কফি বানাতে বানাতে বলল, মিলিওনিয়ার যখন হবে, তখন এত টাকা খরচ করবে কীভাবে? প্রথমেই প্লাস্টিক সার্জারি করব। আমার বুক দুটি বড়োই ছোট। সিলিকোন রাগ দিয়ে বড়ো করব। আমাকে দেখে অবশ্যি বোঝা যায় না, আমার বুক এত ছোট। আমি অন্য ধরনের ব্রা ব্যবহার করি। ফোম ব্ৰা। ও আচ্ছা। এই ব্রাতে ছোট বুকও খুব এটাকটিভ মনে হয়। ব্রা খুললেই তুমি হতাশ হবে। দেখতে চাও? না, না ঠিক আছে, বিশ্বাস হচ্ছে তোমার কথা। তাছাড়া আমার নাকটাও বেশি ভালো না। মনে হয় অনেকখানি ঝুলো আছে। তাই না? আমার তো মনে হয় না। তোমার সৌন্দর্যবোধ নেই, তাই বুঝতে পারছি না।–নাকটা অল্প একটু তুলে দিলেই সব বদলে যাবে। কেমন বদলাবে? যেমন ধর, তখন যদি তোমাকে বলি–ব্রা খুললেই দেখবে আমার বুক দুটি টাইনি, তুমি দেখতে চাও? তুমি বলবে–তাই নাকি? কই দেখি তো? আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মালিশা, তুমি বেশ বুদ্ধিমতী! আমার মায়েরও তাই ধারণা। মা বলেন–বুড়ো বয়সে কোনো ধনী মহিলার উচিত নয় তার মেয়েকে কাছে রাখা, বিশেষ করে সে মেয়ে যদি আমার মতো ইন্টেলিজেন্ট হয়। কফি কেমন হয়েছে মালিশা? ভালো। আরেক কাপ নেবে? দাও। তোমার নাম কিন্তু আমি জানি না। আনিস। তুমি কি ইণ্ডিয়ান? না, বাংলাদেশ হচ্ছে আমার দেশ। সেটা আবার কোথায়? ইণ্ডিয়ার পাশে ছোট একটা দেশ। সেখানেও কি ইণ্ডিয়ার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ থালা হাতে খাবারের জন্যে ঘুরে বেড়ায়? কোথায় শুনেছ এসব? আগে বল সত্যি কিনা। ডাস্টবিনের পাশে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বসে। থাকে।–কখন কেউ এসে খাবার ফেলবে সেই আশায়। বল, সত্যি নয়? নাকি তোমার স্বীকার করতে লজ্জা লাগছে? আনিস ইতস্তত করে বলল, সত্যি নয়। বড়ো বড়ো অভাব হয়েছে। সে তো পৃথিবীর সব দেশেই হয়েছে। ইউরোপে হয় নি? আমেরিকাতেও তো ডিপ্রেসন হয়েছে। আনিস, তুমি রেগে যাও কেন? তোমাকে রাগাবার জন্যে আমি বলি নি। তোমরা যা ভাব, দেশটি মোটেই সে-রকম নয়। মালিশা ঠোঁট চেপে হাসল। পরমুহুর্তে ভালোমানুষের মতো বলল, ইলেকট্রিসিটি আছে? এসব জিজ্ঞেস করছ কেন? কারণ, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছা না হলে বলবে না। আনিস গম্ভীর মুখে বলল, না মালিশা, ইলেকট্রিসিটি-ফিটি নেই। গাড়ি ফাড়িও
false
humayun_ahmed
কুঁড়েঘর। তিনি একর জমি নিয়ে ছোট্ট মাটির ঘর। খড়ের ছাদ। আধুনিক কুঁড়েঘরের এক ফ্যাশন ইদানীং চালু হয়েছে। মাটির দেয়াল, খড়ের ছাদের ভেতর থাকে কার্পেট। এয়ারকুলার বিজবিজ করে চলে। বাথরুম হয় মার্বেল পাথরের। কুঁড়ে ঘর নিয়ে এক ধরনের রসিকতা। মোবারক সাহেব তা করেন নি। তার ঘরে বড় একটা চৌকি পাতা। চৌকির উপর হোগলার পাটি–মাথার নিচে দেয়ার জন্যে শক্ত বালিশ। এ বাড়িতে কোনো টেলিফোন নেই। তিনি ইলেকট্রসিটিও আনেন নি। সন্ধ্যার পর হারিকেন জ্বলে। দর্শনীয় কোনো বাগানও করা হয় নি। কেনার সময় গাছগাছড়া যা ছিল এখনো তাই আছে। তিনি শুধু তাঁর জমিটা কংক্রিটের পিলার এবং শক্ত কাটা তারের বেড়া দিয়ে আলাদা করেছেন। বাড়ির গেটে পাহারাদার আছে। বছরে দু’একবার শুধু রাত কাটাতে আসেন। রাত নটা-দশটার দিকে এসে ভোরবেলা চলে যান। একাই আসেন। পাহারাদার দু’জন গেটে তালা দিয়ে চলে যায়। আজ একা আসেন নি। মিতুকে সঙ্গে এনেছেন। পাজেরো জিপ তাদের নামিয়ে চলে গেছে। মোবারক সাহেব গেটের দারোয়ান দু’জনকেও চলে যেতে বলেছেন। তারা এখনো যায় নি। মোবারক সাহেবের মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে তারা যাবে। রাতটা থাকবে জয়দেবপুরে। ভোরবেলা এসে গেটের তালা খুলবে। মিতু হকচাকিয়ে গেছে। তার চারদিকে ঘোর অন্ধকার। জোনাকি পোকা জ্বলছে-নিভছে। আলো বলতে জোনাকি পোকার আলো। মোবারক সাহেব হালকা গলায় বললেন, ভয় লাগছে? মিতু বলল, না। ভয় লাগার কিছু আছে কি? সাপ আছে। বর্ষাকাল তো–খুব সাপের উপদ্ৰব। মোবারক সাহেবের হাতে ছোট একটা পেনসিল টর্চ। টর্চ ছোট হলেও আলো তীব্ৰ। তিনি আলো ফেললেন। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা। জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। সেখানে ইট বিছানো। মোবারক সাহেব টর্চ নিভিয়ে ফেললেন–ঘন অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল। দারোয়ান দু’জন জিসিনপত্র রেখে চলে এসেছে। কুঁড়েঘরে আলো জ্বেলে এসেছে। জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে। মোবারক সাহেব টৰ্চটা মিতুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি চলে যাও। আমি ওদের বিদেয় করে আসছি। মোবারক সাহেব ভেবেছিলেন মিতু বলবে–আমার একা যেতে ভয় লাগছে। আমি অপেক্ষা করি। দু’জন একসঙ্গে যাব। মিতু তেমন কিছু বলল না। টর্চ হাতে এগিয়ে গেল। তিনি দারোয়ানদের বিদেয় করলেন। গোটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন সিগারেট আছে কিনা। সিগারেট আছে। কয়েকদিন হলো সিগারেট বেশি খাওয়া হচ্ছে। তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। আকাশ মেঘলা বলে তারার আলো নেই। চাঁদ উঠবে রাত তিনটার দিকে। কাজেই রাত তিনটা পর্যন্ত এমন ঘন অন্ধকার থাকবে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে না। এই অঞ্চলের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বিখ্যাত। এরা ডাকা বন্ধ করেছে এর অর্থ হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। বৃষ্টি শুরুর আগে আগে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক বন্ধ করে দেয়। জোনাকি পোকারাও তাদের আলো নিভিয়ে ফেলে। জোনাকি পোকারা অবশ্যি তাদের আলো এখনো নিভায় নি। কাজেই বৃষ্টি শুরু হতে একটু দেরি আছে। এইসব তথ্য তিনি তাঁর কুঁড়েঘরে রাত্রি যাপন করে শিখেছেন। তাঁর শেখার ক্ষমতা ভালো। তিনি দ্রুত শিখতে পারেন। তার পর্যবেক্ষণ শক্তিও ভালো। লেখালেখির ক্ষমতা থাকলে তিনি ভালো লেখক হতে পারতেন। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তবু তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটি ঘরের ভেতর কী করছে কে জানে। তার কি উচিত না উদ্বিগ্ন হয়ে একবার বারান্দায় এসে দাঁড়ানো? মেয়েটি তাঁকে পছন্দ করছে না। কিন্তু একদিন করবে। অবশ্যই করবে। মেয়েটির শরীর তিনি কিনে নিয়েছেন। আত্মা শরীরেই বাস করে। একদিন সেই আত্মাও তিনি কিনতে পারবেন। বেঁচে থাকার জন্যে একটি শুদ্ধ ও সুন্দর আত্মার তাঁর খুব প্রয়োজন। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন–তারা দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি নামবে। আজ রাতে কোনো এক সময় ঘনবর্ষণ হবে। ঠিক কখন হবে তা বলা যাচ্ছে না। মানুষকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয় নি। সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মানুষের চেয়ে অনেক নিম্নশ্রেণীর পশুপাখিকে, কীটপতঙ্গকে। গাছদের কি দেয়া হয়েছে? অবশ্যই দেয়া হয়েছে। তার ধারণা, প্রতিটি গাছ জানে কখন বৃষ্টি হবে। তাঁর এই বাগানবাড়ির প্রতিটি গাছ অপেক্ষা করছে…। সরসর শব্দ করে তাঁর ডান দিকের ঝোপে কী যেন চলে গেল। সাপ হতে পারে। বৃষ্টির আগে আগে তারা জায়গা বদল করে নিচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে যখন সাপের গর্ত ভর্তি হয়ে যায় তখন তারা কী করে? তারা নিশ্চয়ই বৃষ্টির পানিতে ডুবে বসে থাকে না? মোবারক সাহেব ঘরের দিকে এগোলেন। টর্চলাইটটা হাতে থাকলে হতো। অন্ধকারে কোথায় পা ফেলতে কোথায় ফেলছেন কে জানে। এক জায়গায় পানি জমে ছিল। তিনি পানিতে পা ফেলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে ফেললেন। কুঁড়েঘরের বারান্দায় বড়ো বালতি ভর্তি পানি। পানির উপর মগ ভাসছে। একপাশে সাবানদানিতে সাবান। তিনি উঠানে উঠে সহজ স্বরে ডাকলেন, মিতু হারিকেন নিয়ে এস তো। মিতু হারিকেন হাতে পাশে এসে দাঁড়াল। মগে করে আমার পায়ে পানি ঢাল। কাঁদায় পা দিয়ে ফেলেছি। মিতু পানি ঢালছে। মোবারক সাহেব বললেন, আমার বাগানবাড়ি পছন্দ হয়েছে? হয়েছে। মনে হচ্ছে না জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে? মিতু জবাব দিল না। মোবারক সাহেব বললেন, আমার মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে, তখন এখানে আসি। আজ তো একা আসেন নি। না, আজ অবশ্যি একা আসি নি। এখানে এক রাত্রি যাপন করতে কেমন লাগে তা আমি জানি। দুজনে কেমন লাগে তা জানি না। এই জন্যেই তোমাকে নিয়ে এসেছি। দু’জনে মিলে অন্ধকার দেখব, ইন্টারেস্টিং সব গল্প করব। আমি অসংখ্য অদ্ভুত গল্প জানি। সবচে’ বেশি জানি ভূতের গল্প। ভূতের গল্প তোমার
false
humayun_ahmed
রোগীটির যে মনোবিকার ঘটেছে, সেটা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু না। একে বলে ডিলিউশান। তার ধারণা হয়েছে, সে হিমু নামক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ডিলিউশান কেন হয়েছে? ডিলিউশান তৈরির নানা কারণ থাকতে পারে। রোগীর সঙ্গে ভালোমতো কথা না বলে তা বলা যাবে না। তবে আমরা সবাই কিছু না কিছু ডিলিউশন নিয়ে বাস করি। বিরাট বড় মিথ্যাবাদীর মনেও ডিলিউশন তৈরি হয় যে সে মিথ্যাবাদী না, সত্যবাদী। যা বলছে সবই সত্যি বলছে। এই জিনিস দূর করার উপায় কী? শরীরের রোগের চিকিৎসা ডাক্তাররা ওষুধপত্র দিয়ে করেন। শরীরের রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ আছে। সেখানে মনের রোগ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না। একেক জনের জন্য এই রোগ একেক রকম। চিকিৎসার ধরনও সেই জন্যই নানা রকম। যে ডিলিউশানে ভুগছে, প্রথমে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। যে সাইকিয়াট্রিস্ট এই কাজটা পারবেন, তিনিই শুধু রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন। আপনি সেই বিশ্বাস অর্জন কীভাবে করবেন? শুভ্ৰ নামধারী যে ডিলিউশানে ভুগছে আমি তা স্বীকার করে নেব। সে যখন বলবে, আমি হিমু। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব। অবশ্যই তুমি হিমু। ভালো কথা, আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো হিমু জিনিসটা কী? আমিও ঠিকমতো জানি না জিনিসটা কী। অসুবিধা নেই, আমি জেনে নেব। তারপর অগ্রসর হব সেই পথে। চলুন, আপনাকে নিয়ে যাই। না, আপনারা কেউ যাবেন না। আমি একা তার সঙ্গে কথা বলব। আজমল হোসেন বললেন, শুভ্রর কাছে যাওয়ার আগে আরেকটা ছোট্ট কথা বলি। শুভ্ৰ পানিতে নামার পর থেকে এ বাড়িতে কিছু ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, তার কি কোনো ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে? অবশ্যই আছে। কেউ যখন ডিলিউশানে আক্রান্ত হয় তখন তার ছায়া আশপাশের সবার ওপর খানিকটা হলেও পড়ে। যেকোনো একটা ভৌতিক ঘটনার কথা বলুন, আমি তার ব্যাখ্যা দেই। আজমল হোসেন বললেন, আমার নিজের কথাই বলি। আমি দুপুরবেলা এক স্লাইস রুটি আর একটা কলা খাই। আমাকে এই ঘরে খাবার দিয়ে গেছে। আমি ঘরেই আছি। ঘর থেকে বের হইনি। হঠাৎ দেখি কলা-রুটি কোনোটাই নেই। উধাও। কলার খোসাটা শুধু পড়ে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কলা এবং রুটি আপনি নিজেই খেয়ে ফেলেছেন। বাসার ঝামেলায় আপনার মন ছিল বিক্ষিপ্ত। কখন খেয়েছেন সেটা ভুলে গেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের ভাষায় একে বলে সাময়িক এমনেশিয়া। আমি নিজেই খেয়েছি? অবশ্যই। যদি ভাত-মাছ খেতেন। হাতে ঝোল লেগে থাকত। সেখান থেকে বুঝতে পারতেন। আপনি নিজেই খাবারটা খেয়েছেন। যেহেতু খাবারটা ছিল শুকনা, হাতে কিছু লেগে ছিল না। আপনার ধারণা আমি নিজে খেয়ে তুলে গেছি? ব্যাখ্যা তো দিলাম। ব্যাখ্যা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না? আপনি যা বলছেন তা হতে পারে। শুভ্ৰকে পানি থেকে তুলতে আপনার কতক্ষণ লাগবে। আধঘণ্টার বেশি লাগার তো কথা না। অবস্থাটা দেখি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যাবেন না। প্লিজ। কেউ যেন উঁকিঝুঁকিও না দেয়। সাইকিয়াট্রিস্ট এম শামসুল হক পিএইচডি কলঘরে ঢুকে একটা ধাক্কার মতো খেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অল্পবয়সী একটা ছেলে চৌবাচ্চার পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে। অথচ দেখা যাচ্ছে থলথলে মোটাসোটা এক বৃদ্ধ বসে আছে। বৃদ্ধের মাথার সব চুল সাদা। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কেমন আছেন? জি জনাব, ভালো আছি। কতক্ষণ আছেন। পানিতে? অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি? রকিবউদ্দিন ভূইয়া। সাইকিয়াট্রিস্টের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি শুনেছেন পেশেন্টের নাম শুভ্ৰ। এখন পেশেন্ট বলছে তার নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। এ রকম অবশ্য হয়। ডিলিউশনের পেশেন্ট নিজের নাম নিয়েও বিভ্রান্ত হয়। একেক সময় নিজেকে একেক রকম কল্পনা করে। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, হিমু বলে কাউকে চিনেন? হিমু নাম শুনেছেন? আগে কোনো দিন শুনি নাই। পানিতে নামার পরে শুনেছি। সাইকিয়াট্রিস্ট মনে মনে হাসলেন। রোগ কতদূর অগ্রসর হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পানিতে নেমেই সে হিমুর সন্ধান পেয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর মতো গলায় বললেন, হিমু সম্পর্কে কিছু বলুন শুনি। রকিবউদ্দিন বললেন, পানিতে নামেন তারপর বলব। দুইজন দুই জায়গায় থেকে কীসের কথা? পানিতে নামতে বলছেন? হুঁ। নেমে দেখেন আরাম লাগবে। শরীর হালকা হয়ে যাবে। শরীরের ভিতরই বাস করে মন। যেহেতু শরীর হালকা সেই কারণে মনও হবে হালকা। এইসব কি আপনার কথা? জি না। হিমুর কথা। হিমুর আরো অনেক কথা জানি। পানিতে নামেন বলব। শুভ্ৰ থাকলে সে গুছিয়ে বলতে পারত। সে কিছুক্ষণ আগে উঠে গেল। সাইকিয়াট্রিস্ট আবারো মনে মনে হাসলেন। ডিলিউশানের গতি-প্রকৃতি ধরা পড়ছে। এখন এই লোক শুভ্রের নাম নিচ্ছে। শুভ্ৰ উঠে গেছে, সে বসে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীকে প্যাচে ফেলাবার ভঙ্গিতে বললেন। শুভ্র? শুভ্ৰ কে? সে হিমু। শুভ্ৰ, হিমু আর আপনি একই মানুষ, না? চট করে জবাব দেবেন না। ভেবেচিন্তে বলুন। জি না। এক মানুষ হব কেন? আমি যদি বলি আপনি শুভ্র আবার আপনিই হিমু। পানির এক রূপ বরফ, আরেক রূপ বাম্প। আপনি সাপ আবার আপনিই ওঝা। আপনি বললে তো হবে না। আমি কী, সেটা আমি জানি। না, আপনি জানেন না। যাই হোক বুঝিয়ে বলছি। বুঝিয়ে বলার আগে পানিতে নামেন। তারপর যত ইচ্ছা বুঝান। নামছি। নামছি। আজমল হোসেন ইজিচেয়ারে বি॥ম ধরে বসে আছেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি খবর পেয়েছেন। শুভ্ৰ পানি থেকে উঠেছে। নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট নেমে পড়েছে পানিতে। সে পানিতেই আছে। পরিশিষ্ট [টগরের লেখা ডায়েরির অংশ] আমাদের বাড়িতে যে ভৌতিক উপদ্রব হয়েছিল তার রহস্য ভেদ হয়েছে। সব করেছে নীলু। সে মার কাছে স্বীকার
false
humayun_ahmed
বিরক্ত করছে না। সাপরাও সম্ভবত তাকে বিরক্ত করবে না। বাড়ির দারা ঠিক আছে। ইদারা তেমন ভাঙে নি। ইদারার পানিও ভাল। ইদারার বাঁধানো অংশে বসে থাকতে রাশেদের ভাল লাগে। তার বাবা যখন বাড়ি থাকতেন বেশির ভাগ সময় এই জায়গায় বসে থাকতেন। মন ভাল থাকলে রাশেদের সঙ্গে গল্প করতেন, ও বাবা রাশেদ! আমার দাদা অর্থাৎ তোমার বড় বাবা জ্বীন সাধক ছিলেন এটা জান? না। তাঁর পালা একটা জ্বীনের মৃত্যু হয়েছিল। দাদাজান মানুষের মতো তারে কবর দেন। কোথায়? বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল আছে, সেইখানে পাকা কবর আছে। কবরের গায়ে আরবিতে লেখা তালিব। মনে হয় এইটাই জ্বীনের নাম। কবর দেখতে চাইলে একদিন নিয়া যাব। অজু করে যেতে হয়। যেতে চাও? চাই। আচ্ছা একদিন নিয়া যাক। এই জ্বীন দাদাজানরে টাকা-পয়সা আইন্যা দেয়। তিনি পাকা ঘর তুলেন। শুনেছি ঘর তুলতেও জ্বীন সাহায্য করেছে। এইসব কি সত্য বাবা? জানি না। রাশেদ এসেছে শুনে তার দূর সম্পর্কের চাচা হাকিম উদ্দিন দ্বিতীয় রাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দেখা করতে এসেছেন। ধমক দিয়ে বলেছেন, ভাইস্তা ব্যাটা তোমার কি মাথা খারাপ হইছে? চল আমার সাথে আমার বাড়িত থাকবা। এইখানে থাকলে সাপে কাটব। বাড়িভর্তি সাপ। গত বিষুদবারে এই বাড়ির উঠানে সাপে কাটছে। রাশেদ বলল, ব্যবস্থা নিয়েছি চাচা। কার্বলিক এসিড দিয়েছি। দুটা হারিকেন সারারাত জ্বলে। মশারি কিনেছি, রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। এই বাড়িতে থাকা আমার জন্যে বিশেষ প্রয়োজন। প্রয়োজনটা কি? আমি একটা মিরাকলের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বাড়িতে থাকলেই মিরাকলটা ঘটবে। অন্য কোধাও থাকলে ঘটাবে না। মিরাকল জিনিসটা কি? অসম্ভব কোনো ঘটনা। যা হবার কথা না তা হওয়া। ভাত খাইবা কই? সেটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ব্যবস্থা কে করব? আসমান থাইকা টিফিন কেরিয়ার হাতে নিয়া ফিরিশতা নামব? যদি নামে সেটাও হবে একটা মিরাকল। হাকিম উদ্দিন বললেন, যেতে না চাও জোর করে নিব না। তিন বেলা খাওয়া আমি পাঠাব। তোমার নেংটা কালে তোমাকে দেখেছি, এখন এত বড় হইছ। শুনছি বড় ডাক্তারও না-কি হইছ। আমার শূলবেদনা আছে। ডাক্তার কবিরাজ অনেক করাইছি, ফায়দা হয় নাই। শূলবেদনার একটা চিকিৎসা দিয়া যাবা। রাশেদ হাসতে হাসতে বলল, আমি নকল ডাক্তার চাচা। রোগ-ব্যাধির ডাক্তার না। লেখাপড়ার ডাক্তার। ও আচ্ছা। তোমার কি কি জিনিস লাগবে বল। বাড়িতে গিয়া পাঠাব। ফুটফরমাশ খাটার জন্য একজন আসবে তার নাম ইয়াসিন। চোখে চোখে রাখবা, বিরাট চোর। চাচা আমার কিছু লাগবে না। শুধু যদি বইপত্র কিছু থাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি পড়ার কিছু নিয়ে আসি নি। রাতে কিছুক্ষণ বই না পড়লে আমার ঘুম আসে না। বইপত্র কই পাব? বাড়িতে লেখাপড়ার কোনো কারবারই নাই। বিষাদসিন্ধু থাকতে পারে। বিষাদসিন্ধু পড়বা? হ্যাঁ পড়ব। সাদা কাগজ পাঠাতে পারবেন? এইটা পারব। কাগজ কলম সবই আছে। যে বাড়িতে লেখাপড়া নাই, সেই বাড়িতে কাগজ কলম থাকে। যাই হোক, শখ কইরা থাকতে আসছ। পূর্ব পুরুষের বাস্তুভিটা। থাক এক রাইত। তারপর আমার এইখানে চইল্যা আসবা। আমি ঘর ঠিক কইরা রাখব। পল্লী বিদ্যুতের লাইন নিয়েছি। মাঝে মধ্যে পাখা চলে। যে গরম পড়েছে। পাখা ছাড়া গতি নাই। রাশেদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ঘুমুতে যাবার আগে বিষাদসিন্ধু পড়ছে। তার চাচা বিষাদসিন্ধু ছাড়াও মহুয়া সুন্দরীর কাহিনী এবং চল্লিশ আউলিয়ার কেরামত নামের দুটি বই পাঠিয়েছেন। কাগজ কলম পাঠিয়েছেন। রাশেদ বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চিঠি লিখছে। চিঠি লেখা হচ্ছে রূপা ব্যানার্জিকে। এক নাগারে লিখছে না। থেমে থেমে লিখছে। কারণ পাশাপাশি সে ঢাকার রূপাকেও চিঠি লিখছে। রাশেদের খুব ইচ্ছা দুটা চিঠিই যেন একই রকম হয়। সামান্য উনিশ বিশ হতে পারে। বেশি না। রূপা (ব্যানার্জি) কেমন আছ? আমি পালিয়ে আছি। এমন জায়গায় পালিয়েছি যে তুমি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তুমি আমার জীবনে শনি গ্রহের মত উপস্থিত হয়েছ। তুমি ভয়ংকরভাবে আমার প্রেমে পড়েছ এটা আমি জানি। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না। তুমি কি জান আমার প্রতিটি দুঃস্বপ্নে তুমি থাক। রূপা (ঢাকা) কেমন আছেন? আমি পালিয়ে আছি। এমন জায়গায় পালিয়েছি যে একটু চেষ্টা করলেই আপনি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবেন। আপনি আমার জীবনে ধ্রুবতারার মত এসেছেন। আমি ভয়ংকভাবে আপনার প্রেমে পড়েছি এটা আপনি জানেন না। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না। আপনি কি জানেন আপনাকে প্রায়ই আমি স্বপ্নে দেখি। এই ধরনের চিঠি হুড়হুড় করে লেখা যায় না। সময় লাগে। রাশেদ সময় দিচ্ছে। দুটা চিঠির কোনটাই সে পাঠাবে না। তারপরেও আগ্রহ করে সে কেন চিঠি লিখছে তাও জানে না। ইয়াসিন তার জন্যে তিনবেলা খাবার নিয়ে আসছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল প্রতিবেলাতেই পোলাও থাকছে। সকালের নাশতাতেও পোলাও। যদিও রাশেদের চাচা বলে দিয়েছেন ইয়াসিন বিরাট চোর। তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি তবে সে অতি কর্মঠ একজন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একদিনে ঝোপঝাড় কেটে বাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলেছে। সে একা কাজ করছে না, একজন এসিসটেন্টও জুটিয়েছে। রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছানো হয়েছে। এখন আর কাদা ভেঙে বাড়িতে ঢুকতে হবে না। পুকুরের ঘাট মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। কচুরিপানা তুলে ফেলায় পুকুরের টলটলে পানি বের হয়েছে। রাশেদ বলল, ইয়াসিন তোমার মত কর্মী
false
shunil_gongopaddhay
আমি দেখছি। সন্তু নিজে বাথরুমে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল। আগেকার আমলের বাথরুম। বেশ বড়। তবু টর্চের আলোয় সবটাই দেখা যায়। কেউ সেখানে লুকিয়ে বসে নেই। একটা মাত্র জানলা, তাও বন্ধ। সন্তু বলল, কই রে, ভিতরে তো কেউ নেই। জোজো বলল, আমি স্পষ্ট শুনেছি, আমার নাম ধরে ডাকছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, তুই বুঝি… সন্তু বলল, ওটা তোর মনের ভুল। আগে থেকেই ভয় পেলে এরকম হয়। ঠিক সঙ্গে সঙ্গে বিরাট জোরে শোনা গেল, হাচ্চো! হাচ্চো। সেই হাঁচির শব্দ শুনে সন্তু পর্যন্ত কেঁপে উঠল। শব্দটা ঠিক দরজার কাছে, অথচ কেউ নেই সেখানে। নিজেকে সামলে নিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল, কে? কেউ আছে এখানে? এবারে শোনা গেল একটা অদ্ভুত গলায় গানের মতো, আয় আয় কাছে আয়, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই! সন্তুকে ছেড়ে দিয়ে জোজো মারল এক দৌড়। সন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে টর্চের আলোয় দেখল বারান্দাটা। কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। তবু গলা শোনা যাচ্ছে। তবে কি সত্যিই অশরীরী? এবার সাধারণ মানুষের মতো গম্ভীর গলায় শোনা গেল, যত সব উটকো ঝামেলা। কেন আসে এরা? অ্যাই, তুই এখানে কী চাস? সন্তু কোনওক্রমে বলল, কিছু না। আর তার সাহসে কুলেল না। সেও এবার জোরে পা চালিয়ে ফিরে গেল হলঘরে। জোজো ততক্ষণে চোখ বড় বড় করে হাত-পা নেড়ে সব বলতে শুরু করেছে। বাদশা বলল, বাথরুমে লোকের গলা শোনা যাচ্ছে? তা কী করে হয়? আজ সারা বাড়ি খুব ভাল করে সার্চ করে দেখা হয়েছে, কিছু নেই। বাইরে থেকেও কেউ আসতে পারবে না। সন্তু বলল, আমিও তো নিজের কানেই শুনলাম। বাদশা বলল, আমি দেখে আসছি নিজে। কাকাবাবু মিটিমিটি হাসছেন। তিনি বললেন, যাও, কিছুই দেখতে পাবে না। ওরা ফিরে এল মিনিটদশেক পরে। তিনজনেই গলার আওয়াজ শুনেছে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি। কোথাও কারও লুকোনোর কোনও জায়গাই নেই। অশরীরী ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী কী বলছিল বলো তো? সন্তু আর জোজো দুজনেই শুনিয়ে দিল কথাগুলো। দ্বিতীয়বার অন্য রকম কথা। দুজন মানুষ কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কাকাবাবু বললেন, আয় আয় কাছে আয়, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই, এটা তোমরা চিনতে পারলে না? গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমায় ভূতের রাজার গান। যে-গানটা গেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজে। স্পেশ্যালভাবে রেকর্ড করায় গলাটা অন্যরকম শুনিয়েছে। সেই ভূতের রাজার গান এখানকার ভূতেরা শিখে নিয়েছে। জোজো বলল, কাকাবাবু, ব্যাপারটা তা হলে কী হচ্ছে? সত্যি ভূত আছে? কাকাবাবু কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই আবার একটা গান শোনা গেল। প্রথমে মনে হল, অনেক দূর থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। তারপর খুব কাছে আর জোরে। কোনও মেয়ের গলা, কিছুটা নাকি-নাকি। আবার গানের আওয়াজটা দূরে চলে গেল। জোজো কাকাবাবুর গা ঘেঁষে এসে বলল, ওরে বাবা, এসব কী? কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুমি ভূতের গান শুনতে চেয়েছিলে। তোমার ব্যাগে লিখে রেখেছিলে, এবার যাচ্ছি শিমুলতলায়/গান শুনব ভূতের গলায়। ভূতেরা সেটা পড়ে নিয়ে তোমায় গান শোনাচ্ছে। গানটা আবার শোনা গেল বেশ কাছে। একবার ডান দিক থেকে, পরে একবার বাঁ দিকে। কথাগুলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেকটা এই রকম : ভুলভুলাইয়া ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, ছঁররা মাঁরি ঘুমের গাড়ি, কঁড়কঁড়াত ফঁরফড়াত, আঁমার বাড়ি, আঁমার বাড়ি, যা রে ছাঁড়ি যারে ছাঁড়ি… কাকাবাবু বললেন, ভূতের গান হিসেবে খুব সুবিধের নয়। ওগো মেয়ে, আর-একটা ভাল গান শোনাও না! গানটা হঠাৎ থেমে গেল। বাদশা ব্যাকুলভাবে বলল, কাকাবাবু, এসব কী হচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। অথচ আপনি হালকাভাবে নিচ্ছেন। আমাদের একটু বুঝিয়ে দিন প্লিজ! গানটা কোথা থেকে আসছে। কাকাবাবু বললেন, বোঝাতে গেলে যদি জ্ঞানের কথা হয়ে যায়? জোজো কাকাবাবুর একটা হাঁটু ধরে বলল, কাকাবাবু, আমাকে ক্ষমা করুন। তখন ওই কথাটা আমার বলা উচিত হয়নি। হঠাৎ বলে ফেলেছি! সন্তু কড়া গলায় বলল, এই জোজো, কান ধর! কাকাবাবু জোজোকে বুকে টেনে নিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে। বললেন, না, না, ওসব কিছু করতে হবে না। জোজোকে আমি কত ভালবাসি। ওর যা মনে এসেছে, তাই তো বলেছে। বলবে না কেন? মুশকিল হচ্ছে কী, আমি তোদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশতে চাই। কিন্তু আমার বয়স যে অনেক বেশি। তাই মাঝে মাঝে ওসব কথা বেরিয়ে আসে। মনে হয়, আমি যা জানি, তা তোদেরও জানা উচিত। বাদশা বলল, আমাদের সেসব শুনতে ভাল লাগে। এখন কী হচ্ছে, আপনি বলুন। কাকাবাবু বললেন, তোমার যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, তা হলে এসব কিছুই অলৌকিক বলে মনে হয় না। সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যদি মানুষের কথা শোনা যায়, কিংবা গান ভেসে আসে, অথচ কাউকে চোখে দেখা যায় না, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই তো? জোজো বলল, বাথরুমে একজন আমার নাম ধরে ডাকল, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, অথচ সে আমাকে দেখছে! কাকাবাবু বললেন, না, তা নয়। মনে করো, তুমি ঘরে বসে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনছ। তা বলে কি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানেই বসে থাকতে হবে? কত লোকই তো আলাদা আলাদা জায়গায় বসে তার গান শোনে। বাদশা বলল, সে তো রেডিয়ো-টিভিতে, কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারে। আমরা অনেক খুঁজে দেখেছি, সেরকম কিছু নেই। কাকাবাবু বললেন, নেই, কিন্তু আছে। জোজো বলল, ফিসফাস কথা, গানটা একবার কাছে, একবার দূরে… কাকাবাবু বললেন,
false
humayun_ahmed
টুনটুনি গম্ভীর গলায় বলল, আপনার নাম কী? খলিলুল্লাহ শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমার নাম অরণ্য। ছবি তোলার পর কী হবে জানেন? না। লেখাপড়া সেশন। আপনাকে অক্ষর শেখাব। ঠিক আছে? হুঁ। দুটা বা তিনটা অক্ষর মিলে মিশে যখন শব্দ হবে তখন খুব মজা পাবেন। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। একটা অক্ষর হলো ক, একটা ল। এই দুটা অক্ষর মিলে মিশে হয় কল। খলিলুল্লাহ বলল, কলা কীভাবে হয়? টুনটুনি অবাক হয়ে বলল, বা আপনার তো ভালো বুদ্ধি। আকার বলে আমাদের বাংলা ভাষায় একটা জিনিস আছে। যে-কোন অক্ষরের সঙ্গে আকার যুক্ত হলে আ এসে লাগে। লর সঙ্গে আকার যুক্ত হলে হয় লা। বলুন দেখি ক এর সঙ্গে আকার যুক্ত হলে কী হয়? কা। এই তো পেরেছেন। এখন বলুন কলা কীভাবে হবে? ক, আর সঙ্গে ল, ল-এর সঙ্গে আকার। আপনি খুব দ্রুত লেখাপড়া শিখতে পারবেন। এখন চলুন ফটোসেশনে। ফটোসেশন কী? ফটোসেশন হলো ছবি তোলার কর্মকাণ্ড। আমার হাতে যে ক্যামেরাটা দেখছেন এই ক্যামেরাটা সাধারণ ক্যামেরা না। এর নাম ডিজিটাল ক্যামেরা। আমার একটা ম্যাকিনটস কম্পিউটার আছে। ডিজিটাল ক্যামেরায় আপনার ছবি তুলে কম্পিউটারের মেমোরিতে দিয়ে দেব। দেখতে আপনার খুব মজা লাগবে। আপনি যে সবুজ সার্ট পরে আছেন ইচ্ছা করলেই আমি ছবিতে সবুজ সার্টের রঙ বদলে দিতে পারব। আপনার চোখের কালো মণিগুলি নীল করে ফেলতে পারব। চোখের মণি নীল করলে কী হয়? আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মনে হয় খানিকটা সমুদ্র চোখে চলে এসেছে। আমার মার চোখের মণির রঙ ছিল হালকা নীল। খলিলুল্লাহ ছবি তোলার জন্যে সুইমিং পুলের পাশে চেয়ারে বসেছে। টুনটুনি চোখের সামনে ক্যামেরা ধরেছে। অটো ফোকাস ক্যামেরা। ক্যামেরা নিজেই ফোকাল লেংথ ঠিক করে জানান দেবে—সব ঠিক আছে, সাটারে চাপ দাও। ক্যামেরায় সবুজ বাতি জ্বলছে। টুনটুনি সাটারে টিপ না দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল-আশ্চর্য তো আপনার চোখের মণি হালকা নীল। আমি আগে কেন লক্ষ করি নি? আমার ধারণা ছিল আপনার চোখের মণি কালো। এখন দেখছি নীল। খলিলুল্লাহ হাসছে। টুনটুনি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় খলিলুল্লাহর দশটা ছবি তুলল। জালাল খাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছিল সন্ধ্যায়। তিনি এসেছেন রাত নটায়। পিটার নিকলস-এর একটা বই পড়ছিলেন— . বই হাত থেকে নামাতে পারছিলেন না বলে এত দেরি। বই-এর শেষ দুটা পাতা গাড়িতে বসে পড়েছেন। জালাল খাঁর বয়স পঞ্চাশ। এই বয়সে মানুষের মাথায় কাঁচাপাকা চুল থাকে। জালাল খাঁর মাথার সব চুল পাকা। টকটকে গৌরবর্ণের একজন মানুষ যার মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মতো ধবধবে সাদা চুল। পৃথিবীতে সবচে বেশি সংখ্যক বই পড়েছেন এই সূত্রে মানুষটার নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ যেতে পারত। কিন্তু গিনেস বুকওয়ালাদের এ ধরনের কোনো ক্যাটাগরি নেই। মাহতাব সাহেব বললেন, তুই কি আইসি এনেছিস? জালাল খাঁ বললেন, কীসের আইসি? মাহতাব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কীসের আইসি মানে? তোকে না। বললাম, একজন মানুষকে টেস্ট করা হবে। জালাল খাঁ বললেন, তোকে তো খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে। এত উত্তেজিত কেন? এত উত্তেজিত হবার মতো কিছু পৃথিবীতে ঘটে না। এটম বোমা পড়ার ঘটনা এই পৃথিবীতে মাত্র দুবার ঘটেছে। তোকে আনাই হয়েছে লোকটাকে পরীক্ষা করার জন্যে। পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার ব্যবস্থা করা আছে। আমার একটা ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার আছে। নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়েস রেকর্ড হয় না। সেটা এনেছি। তোর মিস্ত্রিকে সেটা ঠিক করতে দেয়া হবে। তুই শান্ত হ। ডাক তাকে। তার আগে ব্রিফিং দেলোকটার ব্যাপারটা কী? সে কি ভিলেজ ইডিয়ট? ভিলেজ ইডিয়ট মানে? সব গ্রামে একজন থাকে মহানিৰ্বোধ। তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। সে যখন হঠাৎ কিছু বুদ্ধির পরিচয় দেয় তখন হৈচৈ পড়ে যায়। সেরকম না তো? না, সেরকম না। লোকটা নির্বোধ না। পড়াশোনা কিছুই জানে না। তার। জীবিকা হলো মাটি কাটা। জালাল খাঁ বললেন, তোর কথা বুঝতে পারছি নালোকটার যদি যন্ত্রপাতি ঠিক করার জাদুকরি ক্ষমতা থাকে তাহলে সে মাটি কাটবে কেন? সে একটা ওয়ার্কশপ দিয়ে দুহাতে টাকা কামাবে। এটা সে কেন করছে না? মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই ডেকে জিজ্ঞেস কর কেন করছে না। আমি রহস্যভেদ করতে পারছি না বলেই তোক ডেকেছি। জালাল খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, জানি না তোর কী হয়েছে। তুই খুবই উত্তেজিত। উত্তেজনায় তোর কথাবার্তাও জড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক তোর মিস্ত্রিকে। কথা বলি। মাহতাব সাহেব বন্ধুকে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে বসলেন। বারেককে পাঠালেন খলিলুল্লাহকে আনতে। বিশেষ করে বলে দিলেন খলিলুল্লাহর সঙ্গে টুনটুনি যেন না আসে। টুনটুনি সারাক্ষণ খলিলুল্লাহর সঙ্গে লেগে আছে—এটা মাহতাব সাহেবের ভালো লাগছে না। লাইব্রেরি ঘরে খলিলুল্লাহর বসার জন্যে একটা টুল রাখা হলো। টুলের সামনে দুটা সোফা। একটিতে মাহতাব সাহেব, অন্যটিতে জালাল খাঁ। রীতিমতো ভাইবা পরীক্ষা। খলিলুল্লাহকে দেখে মাহতাব উদ্দিন চমকে উঠলেন। এ কে? এ তো খলিলুল্লাহ না। এ অন্য কেউ। কী সুন্দর চেহারা! মুখের চামড়ায় রোদে পোড়া ভাব নেই। মেয়েদের চামড়ার মতো কমনীয় চামড়া। চোখের মণির রঙ নীলাভ। এটা অবশ্যি সবুজ রঙের শার্ট পরার কারণে হতে পারে। সার্টের সবুজ রঙ পড়েছে চোখের মণিতে। আগে লোকটা কুঁজো হয়ে দাঁড়াত, এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে না। বরং কৌতূহলী চোখে জালাল খাঁকে দেখছে। জালাল খাঁ বিস্মিত হয়ে চাপা গলায় মাহতাব সাহেবকে বললেন, এই কি তোর সেই খলিলুল্লাহ? মাহতাব সাহেব বললেন, হুঁ। মাটি কাটা যার
false
robindronath
দেখিলে বলো তো। যদি তোমাদের মনে হয় শরীরের জন্য আমার কিছু করা আবশ্যক, আমাকে বলো-না কেন? আমি কি কখনো তোমার কোনো কথায় ‘না’ বলিয়াছি বাবা?” শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা দ্বিগুণ আর্দ্র শুনাইল। অন্নদা ব্যস্ত ও ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “কখনো না মা। তোমাকে কখনো কিছু বলিতেও হয় নাই; তুমি আমার মা কিনা, তাই তুমি আমার অন্তরের কথা জান–তুমি আমার ইচ্ছা বুঝিয়া কাজ করিয়াছ। আমার একান্ত মনের আশীর্বাদ যদি ব্যর্থ না হয়, তবে ঈশ্বর তোমাকে চিরসুখিনী করিবেন।” হেম কহিল, “বাবা, আমাকে কি তোমার কাছে রাখিবে না?” অন্নদা। কেন রাখিব না? হেম। যতদিন না দাদার বউ আসে অন্তত ততদিন তো থাকিতে পারি। আমি না থাকিলে তোমাকে কে দেখিবে? অন্নদা। আমাকে দেখা। ও কথা বলিস নে মা। আমাকে দেখিবার জন্য তোদের লাগিয়া থাকিতে হইবে, আমার সে মূল্য নাই। হেম কহিল, “বাবা, ঘর বড়ো অন্ধকার, আলো আনি।” বলিয়া পাশের ঘর হইতে একটা হাত-লন্ঠন আনিয়া ঘরে রাখিল। কহিল, “কয়দিন গোলমালে সন্ধ্যাবেলায় তোমাকে খবরের কাগজ পড়িয়া শোনানো হয় নাই। আজকে শোনাইব।” অন্নদা উঠিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, একটু বোসো মা, আমি আসিয়া শুনিতেছি।” বলিয়া যোগেন্দ্রের কাছে গেলেন। মনে করিয়াছিলেন বলিবেন–আজ কথা হইতে পারিল না, আর-এক দিন হইবে। কিন্তু যেই যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইল বাবা? বিবাহের কথা বলিলে?” অমনি তাড়াতাড়ি কহিলেন, “হাঁ বলিয়াছি।” তাঁহার ভয় ছিল, পাছে যোগেন্দ্র নিজে গিয়া হেমনলিনীকে ব্যথিত করিয়া তোলে। যোগেন্দ্র কহিল, “সে অবশ্য রাজি হইয়াছে?” অন্নদা। হাঁ, একরকম রাজি বৈকি। যোগেন্দ্র কহিল, “তবে আমি অক্ষয়কে বলিয়া আসি গে?” অন্নদা ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “না না, অক্ষয়কে এখন কিছু বলিয়ো না। বুঝিয়াছ যোগেন, অত বেশি তাড়াতাড়ি করিতে গেলে সমস্ত ফাঁসিয়া যাইবে। এখন কাহাকেও কিছু বলিবার দরকার নাই; আমরা বরঞ্চ একবার পশ্চিমে বেড়াইয়া আসি গে, তার পরে সমস্ত ঠিক হইবে। যোগেন্দ্র সে কথার কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল। কাঁধে একখানা চাদর ফেলিয়া একেবারে অক্ষয়ের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল। অক্ষয় তখন একখানি ইংরাজি মহাজনী হিসাবের বই লইয়া বুক-কীপিং শিখিতেছিল । যোগেন্দ্র তাহার খাতাপএ টান দিয়া ফেলিয়া কহিল, “ও-সব পের হইবে, এখন তোমার বিবাহের দিন ঠিক করো।” অক্ষয় কহিল, “বল কী!” পরদিন হেমনলিনী প্রত্যুষে উঠিয়া যখন প্রস্তুত হইয়া বাহির হইল তখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাঁহার শোবার ঘরের জানালার কাছে একটা ক্যাম্‌বিসের কেদারা টানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। ঘরে আসবাব অধিক নাই। একটি খাট আছে, এক কোণে একটি আলমারি, একটি দেয়ালে অন্নদাবাবু পরলোকগতা স্ত্রীর একটি ছায়াপ্রায় বিলীয়মান বাঁধানো ফোটোগ্রাফ–এবং তাহারই সম্মুখের দেয়ালে সেই তাঁহার পত্নীর স্বহস্তরচিত একখণ্ড পশমের কারুকার্য। স্ত্রীর জীবদ্দশায় আলমারিতে যে-সমস্ত টুকিটাকি শৌখিন জিনিস যেমনভাবে সজ্জিত ছিল আজও তাহারা তেমনি রহিয়াছে। পিতার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া পাকা চুল তুলিবার ছলে মাথায় কোমল অঙ্গুলিগুলি চালনা করিয়া হেম বলিল, “বাবা, চলো আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া লইবে। তার পরে তোমার ঘরে বসিয়া তোমার সেকালের গল্প শুনিব–সে-সব কথা আমার কত ভালো লাগে বলিতে পারি না।” হেমনলিনী সম্বন্ধে অন্নদাবাবুর বোধশক্তি আজকাল এমনি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে যে, এই চা খাইতে তাড়া দিবার কারণ বুঝিতে তাঁহার কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। আর কিছু পরেই অক্ষয় চায়ের টেবিলে আসিয়া উপস্থিত হইবে; তাহারই সঙ্গ এড়াইবার জন্য তাড়াতাড়ি চা খাওয়া সারিয়া লইয়া হেম পিতার কক্ষে নিভৃতে আশ্রয় লইতে ইচ্ছা করিয়াছে, ইহা তিনি মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন। ব্যাধভয়ে ভীত হরিণীর মতো তাঁহার কন্যা যে সর্বদা ত্রস্ত হইয়া আছে, ইহা তাঁহার মনে অত্যন্ত বাজিল। নীচে গিয়া দেখিলেন, চাকর এখনো চায়ের জল তৈরি করে নাই। তাঁহার উপরে হঠাৎ অত্যন্ত রাগিয়া উঠিলেন; সে বৃথা বুঝাইবার চেষ্টা করিল যে, আজ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই চায়ের তলব হইয়াছে। চাকররা সব বাবু হইয়া উঠিয়াছে, তাহাদের ঘুম ভাঙাইবার জন্য আবার অন্য লোক রাখার দরকার হইয়াছে, এইরূপ মত তিনি অত্যন্ত নিঃসংশয়ে প্রচার করিলেন। চাকর তো তাড়াতাড়ি চায়ের জল আনিয়া উপস্থিত করিল। অন্নদাবাবু অন্যদিন যেরূপ গল্প করিতে করিতে ধীরে-সুস্থে আরামে চা-রস উপভোগ করিতেন আজ তাহা না করিয়া অনাবশ্যক সত্বরতার সহিত পেয়ালা নিঃশেষ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হেমনলিনী কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বাবা, আজ কি তোমার কোথাও বাহির হইবার তাড়া আছে?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “কিছু না, কিছু না। ঠাণ্ডার দিনে গরম চাঞ্চটা এক চুমুকে খাইয়া লইলে বেশ ঘামিয়া শরীরটা হালকা হইয়া যায়।” কিন্তু অন্নদাবাবুর শরীরে ঘর্ম নির্গত হইবার পূর্বেই যোগেন্দ্র অক্ষয়কে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। আজ অক্ষয়ের বেশভূষায় একটু বিশেষ পারিপাট্য ছিল। হাতে রুপাবাঁধানো ছড়ি, বুকের কাছে ঘড়ির চেন ঝুলিতেছে–বাম হাতে একটা ব্রাউন কাগজে-মোড়া কেতাব। অন্যদিন অক্ষয় টেবিলের যে অংশে বসে আজ সেখানে না বসিয়া হেমনলিনীর অনতিদূরে একটা চৌকি টানিয়া লইল; হাসিমুখে কহিল, “আপনাদের ঘড়ি আজ দ্রুত চলিতেছে।” হেমনলিনী অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিল না, তাহার কথার উত্তরমাত্র দিল না। অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেম, চলো তো মা, উপরে। আমার গরম কাপড়গুলা একবার রৌদ্রে দেওয়া দরকার।” যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, রৌদ্র তো পালাইতেছে না, এত তাড়াতাড়ি কেন? হেম, অক্ষয়কে এক পেয়ালা চা ঢালিয়া দাও। আমারও চায়ের দরকার আছে, কিন্তু অতিথি আগে।” অক্ষয় হাসিয়া হেমনলিনীকে কহিল, “কর্তব্যের খাতিরে এতবড়ো আত্মত্যাগ দেখিয়াছেন? দ্বিতীয় সার ফিলিপ-সিড্‌নি।” হেমনলিনী অক্ষয়ের কথায় লেশমাত্র অবধান প্রকাশ না করিয়া দুই পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া এক পেয়ালা যোগেন্দ্রকে দিল ও অপর পেয়ালাটি অক্ষয়ের অভিমুখে ঈষৎ একটু ঠেলিয়া দিয়া অন্নদাবাবুর মুখের
false
shottojit_roy
একটা সুইচ। ভদ্রলোক সেটা টিপতেই শব্দ সমেত রঙিন ছবি উবে গেল। ওয়েল, মিঃ মিটার? আমরা দুটো সোফায় ভাগ করে বসেছি, আমার পাশে লালমোহনবাবু। এতক্ষণে ভদ্রলোকের মুখটা খানিকটা স্পষ্ট। বিশেষ বদল হয়নি চেহারায়। ধুতিটা এখনও ছাড়েননি, তবে শেরওয়ানিটায় জাত কাটারের ছাপ রয়েছে, আর বোতামগুলো হিরের হলেও হতে পারে। সবচেয়ে বদল হয়েছে পরিবেশে; বেনারসের গলির বাড়ির গদি, আর ফাইভ-স্টার হোটেলের রয়েল সুইটে আকাশ পাতাল তফাত। এবার রিয়েল হলিডে তো? তার কি আর জো আছে, একপেশে হাসি হেসে বলল ফেলুদা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভনে, জানেন তো? এখানে কী ধান ভানবেন আপনি মিঃ মিত্তর? মগনলালের সামনে রূপের ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে পাশের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিলেন। টি আর কফি? বেস্ট দাৰ্জিলিং টি পাবেন এই হোটেলে। চা-ই হোক। রুম সার্ভিস ডায়াল করে তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফোন রেখে আবার ফেলুদার দিকে চাইলেন মগনলাল। ইন্ডিয়াতে আপনি হিরো-বিগ ডিটেকটিভ। কাঠমাণ্ডু ইজ ফরেন কান্ট্রি মিঃ মিত্তর। এখানে জান-পেহচান আছে কি আপনার? এই তো একজন পুরনো আলাপী বেরিয়ে গেল! মগনলাল হালকা হাসি হাসলেন। দুজনের দৃষ্টি পরস্পরের দিক থেকে সরছে না। আপনি কি সারপ্রাইজড্‌ হলেন আমাকে দেখে? তা একটু হয়েছি বইকী? একটা চারমিনার ধরিয়ে দুটো রিং ছেড়ে জবাব দিল ফেলুদা।আপনি হাজাতের বাইরে দেখে নয়; ওটা আপনার কাছে কিছুই না। অবাক হচ্ছি। আপনার কর্মক্ষেত্র বদলেছে দেখে। হোয়াই? বনারস হালি প্লেস, কাঠমাণ্ডুভি হালি প্লেস। ওখানে বিশ্বনাথজি, ইখানে পস্পতিনাথজি। একই বেপার, মিঃ মিত্তর। যেখানে ধরম, সেখানেই আমার করম। কী বলেন, আঙ্কল? হেঁঃ হেঁঃ। বুঝলাম হাসি ফুটলেও, কথা ফোটার অবস্থা এখনও হয়নি জটায়ুর। করমের কথা যে বলছেন, সেটা কি ওষুধ সংক্রান্ত কোনও কাজ? আমার শিরদাঁড়ায় একটা শিহরন খেলে গেল। বাঘের সামনে পড়ে ধরনের বেতোয়াক্কা ব্যবহার একমাত্র ফেলুদার পক্ষেই সম্ভব। ওসূদ? মগনলাল যেন আকাশ থেকে পড়লেন।হায়ার্ট ওসূদ মিঃ মিত্তর? সূদের কারবার আমার একটা আছে ঠিকই, লেকিন ওসূদক কেয়া মতলব? তা হলে আপনি এখানে কী করছেন সেটা জানতে পারি কি? সার্টেনলি! লেকিন ফেয়ার এক্সচেঞ্জ হোনা চাই। বেশ। আপনি বলুন। আমিও বলব। আমার বেপার ভেরি সিম্পল মিঃ মিত্তর। আমি আর্টের কারবারি সেটা তো আপনি জানেন, আর নেপালে যে আর্টের ডিপো, সেটাও আপনি নিশ্চয়ই জানেন। ফেলুদা চুপ। লালমোহনবাবু দ্রুত নিশ্বাস ফেলছেন। এবার আপনার বেপার বলুন। ফেয়ার এক্সচেঞ্জ। আপনি সব কথা খুলে বলেছেন বলে মনে হয় না, বলল ফেলুদা, তবে আমার কথা আমি খুলেই বলছি। আমি এসেছি একটা খুনের তদন্ত করতে। খুন? খুন। ইউ মিন দ্য মার্ডার অফ মিঃ সোম? আমি থ। ফেলুদাও থ কি না বোঝার উপায় নেই। লালমোহনবাবু শীত লাগার ভাব করে দাঁতে দাঁত চাপলেন সেটা লক্ষ করলাম। হোটেলের ভিতরের টেমপারেচারটা এমনিতেই একটু কমের দিকে। ক্যাসিনোতে লোকের ভিড়ের জন্য বলে বোধহয় ঠাণ্ডা লাগেনি। আপনি ঠিকই ধরেছেন মগনলালজি, বলল ফেলুদা, মিস্টার অনীকেন্দ্ৰ সোম। চা এল। মগনলালের আদেশে নতুন ট্রে থেকে শুধু তিনটে কাপ-ডিশ আর টি-পট রেখে পুরনোটা থেকে টি-পাট আর মগনলালের ব্যবহার করা পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল বেয়ারা। আমার বিশ্বাস, ফেলুদা বলে চলল, সোম ভদ্রলোকটি এখানকার কোনও ব্যক্তির কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। তাই তাকে খতম করে ফেলা হল। মগনলাল চা ঢালছেন আমাদের জন্য। ওয়ান? টু? মগনলালের হাতে চিনির পাত্ৰ। কিউব শুগার। ওয়ান, আমি বললাম, কারণ প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছিল। ওয়ান? এবার জটায়ুকে প্রশ্ন। আমি জানি জটায়ুর মাথায় এল এস ডি ঘুরছে, আর ঘুরছে সেই লোকটার কথা, যে সিঁড়ি নামছে ভেবে সাত তলার ছাতের কার্নিশ থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। টু? থ্রি? নো, নো। নো শুগার? নো। লালমোহনবাবু মিষ্টির ভক্ত, চায়ের দু চামচের কম চিনি হলে চলে না, তাও নো বলছেন। ই কেমন কথা হল মোহনবাবু? আপনার রসগুল্লা খাওয়া চেহারা, শুগারে নো করছেন কেন? আমি নিয়েছি বলেই বোধহয় ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত সাহস পেলেন। ও-কে। ওয়ান। ফেলুদারও একটা। উঠে গিয়ে যে যার চা নিয়ে এসে আবার বসলাম। ফেলুদা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আগের কথার জের টেনে বলল–আমার বিশ্বাস মিঃ সোম জানতে পেরেছিলেন যে এখানে একটা গৰ্হিত করবার চলেছে। সে ব্যাপারে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। একটা উদ্দেশ্য ছিল আমার সঙ্গে দেখা করা। তার আগেই তাকে খুন করা হয়। আপনি যখন খুনের ব্যাপারটা জানেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আপনি এ ব্যাপারে জড়িত কি না। মগনলাল ভাসা ভাসা চোখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ ফেলুদার দিকে চেয়ে রইলেন। আমাদের হাতে ধরা পেয়ালা থেকে ভুরিভুর করে হাই ক্লাস চায়ের গন্ধ বেরোচ্ছে; আমু আল্লাল্লমাহনবাবু এই অবস্থাতেই চুমুক না দিয়ে পারলাম না। জগদীশ! মগনলাল হঠাৎ হাঁকটা দেওয়াতে চমকে উঠেছিলাম। বসবার ঘরের দু দিকেই যে আরও ঘর আছে সেটা এসেই বুঝেছিলাম। এবার মগনলালের পিছনের একটা দরজা খুলে একজন লোক এসে আমাদের ঘরে ঢুকলা। সঙ্গে সঙ্গে কিড়িং করে যে শব্দটা হল সেটা লালমোহনবাবুর হাতের পেয়ালা কেঁপে গিয়ে পিরিচের সঙ্গে লাগার শব্দ। জগদীশ নামে যে ভদ্রলোকটি মগনলালের পিছনে এসে দাঁড়ালেন, তিনি হলেন বাটরা নাম্বার টু। কাছ থেকে দেখে বাটরার সঙ্গে সামান্য তফাতটা বুঝতে পারছি। এনার চোখ একটু কটা, কানের দু পাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে, হয়তো শরীরে মাংসও কিছুটা বেশি। আরেকটা বড় তফাত হল, এর চাহনিতে মিশুকে ভাবটা নেই। ইনাকে
false
nihar_ronjon_gupta
দারোয়ান শুয়ে পড়ে। তুই যেমনি মোটা তেমনি তোর বুদ্ধিটাও দিন দিন মোটাই হয়ে যাচ্ছে। এত করে বলি রোজ রাত্রে অতগুলো রুটি গিলিস না তা শুনাবি নাতো আমার কথা, খা, কত খাবি খা। এরপর নামটাও দেখবি হয়ত মনে করতে পারছিস না। সুধীর বললে। তারপর যতীনের পিঠে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে স্নেহকরুণ স্বরে বললে, আচ্ছা রাত্রে দেখবি কেমন ‘চিচিং ফাক’ তৈরী করে রেখেছি। আশ্রমে থাকবার ব্যবস্থাটা ওদের ভালই। ইংরাজী ‘’ অক্ষরের মত বাড়িটা, মাঝখানে প্রশস্ত আঙ্গিনা।–তার ওদিকে সুপারিনটেনডেন্ট সিংহীর কোয়ার্টার। তার পিছনে রান্না ঘর-খাবার ঘর ও চাকরীদের মহল। বাড়িটার পূর্ব দিকে গঙ্গা, ছোট ছোট সব পাটিশন দেওয়া ঘর। এক একটি ঘরে দুজন করে ছেলে থাকে। সুধীরের ঘরে থাকে সুধীর ও ভিখু। পলায়ন সেদিন রাত্রে দুপুরের কথামত আশ্রমের খাওয়া দাওয়া চুকে গেলে সকলে পিছু পিছু এসে সুধীরের ঘরে প্রবেশ করল। সুধীর সকলকে ঘরে ঢুকিয়ে ভিতর থেকে দরজাটা এঁটে দিল। গঙ্গার দিককার জানালাটায় পরপর পাঁচটা লোহার শিক খাড়া করে বসান, তারই একটা শিক ঈষৎ উপর দিকে একটু ঠেলে নীচের দিকে টানতেইজানালার কাঠের ফ্রেম থেকে খুলে এল। সকলে বিস্ময়ে এতক্ষণ একদৃষ্টি তাকিয়ে সুধীরের কাণ্ড-কারখানা দেখছিল। সুধীর ওদের দিকে ফিরে হাসতে হাসতে বললে, দেখলি কেমন চিচিং ফাঁক। ছুরি দিয়ে কাঠ কুরে কুরে ফ্রেমের গর্ত বাড়িয়ে সুধীর শিক খোলবার উপায় করেছিল। এইবার এই জানলা পথে সবাই আমরা বাইরে যাবো, সুধীর বলে। প্রকাশ করে তার মতলব! সকলে তখন সেই শিকের ফাঁক দিয়ে একে একে বাইরে গেল। নিঃশব্দে নীচে হয়ে প্রাচীরের গা ঘেসে সকলে আশ্রমের সীমানা পার হয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার আলোয় চারিদিক যেন স্বপ্নময়। গঙ্গায় তখন জোয়ার দেখা দিয়েছে। জোয়ারের টানে গঙ্গার ঘোলাটে জল সাদা সাদা ফেনা ছড়িয়ে কলকল ছলছল করে দুপাড় ভাসিয়ে ছুটছে। খানিকটা দূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল কয়েকটা জেলে ডিঙ্গি পাড়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে খোঁটার গায়ে বাঁধা। জোয়ারের জলে ছোট ছোট ডিঙ্গিগুলো হেলছে আর দুলছে। সামনেই অল্প দূরে জেলেদের বাড়ি। বঁশের মাচানের গায়ে জাল শুকাচ্ছে। সুধীর আস্তে আস্তে নীচু গলায় বললে, চুপ, সব গোলমাল করিসনে। জেলেরা টের পেলে কিন্তু আর রক্ষা রাখবে না। তোরা সব আস্তে আস্তে গঙ্গার পাড় দিয়ে খানিকটা এগিয়ে যা, আমি নৌকা খুলে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তোদের তুলে নেব’খন। পরিপূর্ণ চাঁদের রূপালী আলো গঙ্গার জলের বুকে অসংখ্য ঢেউয়ের গায়ে গায়ে যেন অপূর্ব স্বপ্ন মাধুরী রচনা করে। সুধীর নিঃশব্দে একটা ডিঙ্গি খুলে নিয়ে এগিয়ে গেল একটু দূরে। সবাই এসে জমায়েত হয়েছিল একটু দূরে। সুধীর একে একে সকলকে ডিঙ্গিতে তুলে নিল। সুধীর হালে বসল। আর দুজন দাঁড় টানতে লাগল। জোয়ারের টানে নৌক সামনের দিকে এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝে গঙ্গাবক্ষের শীতল হাওয়া এসে চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে যায়। হঠাৎ সুধীর সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা এমনি করে নৌকা বেয়ে আমরা যদি দুরে—অনেক দূরে পালিয়ে যাই। আর আশ্রমে কোন দিনও না ফিরি কেমন হয় বল তো– সুধীরের কথায় সকলের মুখ যেন ভয়ে চুপসে এতটুকু হয়ে যায়। গোবৰ্দ্ধন ভয়ে ভয়ে বলে, ওসব কী কথা সুধীর? সিংহী সাহেব তাহলে আর কাউকে জ্যান্ত রাখবে না। সুধীর হাসতে হাসতে জবাব দেয়, কোথায় থাকবে তখন সিংহী, আমাদের নাগাল পেলে তো? পরেশ একটু পেটুক, ঢোক গিলে প্রশ্ন করলে, পালিয়ে যে যাবে কারও কাছে তো পয়সা নেই, খাবে কি ক্ষিধে পেলে? কেন? নদীর জল আর হাওয়া। অন্নান বদনে সুধীর জবাব দিল। তারপর হাসতে হাসতে বললে, ভয় নেইরে। পালাব না। সত্যি বলছিস? পরেশ শুধায়। হ্যাঁ, আর সত্যিই পালাতে যদি কোনদিন হয়ই, তবে একই পালাব সেদিন, তোদের ল্যাজে বেঁধে পালাবো না। আশ্রম থেকে পালাবার কথা যে এমনি কথায় কথায় বলছিল সুধীর তা নয়। সত্যিই আশ্রমে ঐ সিংহীর অত্যাচারে ও যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। কেবলই মনে হতো। ওর আশ্রম থেকে পালিয়ে যায়। যে দিকে দুচোখ চলে যায়। কথাটা কিন্তু চাপা রইল না। রাত্রে আশ্রম থেকে পালিয়ে গিয়ে নৌকায় বেড়ানোর কথা কেমন করে না জানি সিংহীর কানে গিয়ে উঠল। পরের দিন সিংহীর ঘরে যখন সকলের ডাক পড়ল, সকলের বুকই ভয়ে দুর দূর করে কেঁপে উঠল। ভয়ে সকলের মুখ চুপসে আমসির মত হয়ে গেল। শুধু নির্বিকার সুধীর। তার যেন কিছুই নেই। গোবৰ্দ্ধন এসে শুকনো গলায় বললে, কি হবে সুধীর? বে শী আর কি হবে? কয়েকটা দিন অন্ধকার ঘরে বাস ও পিঠের উপর কয়েকটি করে বেত্ৰাঘাত! সকলে যথা সময়ে বলির পাঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে সিংহীর ঘরের দিকে রওনা হলো। সিংহী নিজের ঘরে ক্রুদ্ধ সিংহের মতই হাতদুটো পিছন করে পায়চারি করছিল। সকলে ঘরে ঢুকতে সিংহী ওদের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বললে, সব সার বেঁধে দাঁড়াও। প্ৰথমে বিকাশের পালা। তার পিঠের উপর জোরে জোরে কয়েক ঘা বেত পড়তেই সে যন্ত্রণায় কেঁদে উঠলো। সহসা এমন সময় সুধীর সিংহীর সামনে এসে গভীর স্বরে বললে, ওদের কোন দোষ নেই। স্যার। সব দোষ আমার। আমিই ওদের পরামর্শ দিয়ে। আশ্রমের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম, মারতে হয় আমায় মারুন। সিংহী ত্রুকুটি করে সুধীরের দিকে তাকাল, তারপর ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, ও, তুই পালের গোদা —জানতাম, আমি জানতাম। সিংহী নির্মম ভাবে সুধীরের সর্বাঙ্গে সজোরে বেত চালাতে লাগল। সুধীর একটি শব্দ পর্যন্ত করলে না। প্ৰায়
false
robindronath
হইল এক। সে অমলকে রচনায় উৎসাহ দেয়, অমলের সঙ্গে সাহিত্যালোচনা করে, কিন্তু মন্দার তো সে উদ্দেশ্য আদবেই নয়। মন্দা নিঃসন্দেহই সরল যুবককে মুগ্ধ করিবার জন্য জাল বিস্তার করিতেছে। এই ভয়ংকর বিপদ হইতে বেচারা অমলকে রক্ষা করা তাহারই কর্তব্য। অমলকে এই মায়াবিনীর মতলব কেমন করিয়া বুঝাইবে। বুঝাইলে তাহার প্রলোভনের নিবৃত্তি না হইয়া যদি উলটা হয়। বেচারা দাদা! তিনি তাঁহার স্বামীর কাগজ লইয়া দিন রাত খাটিয়া মরিতেছেন, আর মন্দা কিনা কোণটিতে বসিয়া অমলকে ভুলাইবার জন্য আয়োজন করিতেছে। দাদা বেশ নিশ্চিন্ত আছেন। মন্দার উপরে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। এ-সকল ব্যাপার চারু কী করিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া স্থির থাকিবে। ভারি অন্যায়। কিন্তু আগে অমল বেশ ছিল, যেদিন হইতে লিখিতে আরম্ভ করিয়া নাম করিয়াছে সেই দিন হইতেই যত অনর্থ দেখা যাইতেছে। চারুই তো তাহার লেখার গোড়া। কুক্ষণে সে অমলকে রচনায় উৎসাহ দিয়াছিল। এখন কি আর অমলের ’পরে তাহার পূর্বের মতো জোর খাটিবে। এখন অমল পাঁচজনের আদরের স্বাদ পাইয়াছে, অতএব একজনকে বাদ দিলে তাহার আসে যায় না। চারু স্পষ্টই বুঝিল, তাহার হাত হইতে গিয়া পাঁচজনের হাতে পড়িয়া অমলের সমূহ বিপদ। চারুকে অমল এখন নিজের ঠিক সমকক্ষ বলিয়া জানে না; চারুকে সে ছাড়াইয়া গেছে। এখন সে লেখক, চারু পাঠক। ইহার প্রতিকার করিতেই হইবে। আহা, সরল অমল, মায়াবিনী মন্দা, বেচারা দাদা। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ সেদিন আষাঢ়ের নবীন মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘনীভূত হইয়াছে বলিয়া চারু তাহার খোলা জানালার কাছে একান্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া কী একটা লিখিতেছে। অমল কখন নিঃশব্দপদে পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল তাহা সে জানিতে পারিল না। বাদলার স্নিগ্ধ আলোকে চারু লিখিয়া গেল, অমল পড়িতে লাগিল। পাশে অমলেরই দুই-একটা ছাপানো লেখা খোলা পড়িয়া আছে; চারুর কাছে সেইগুলিই রচনার একমাত্র আদর্শ। “তবে যে বল, তুমি লিখতে পার না! ” হঠাৎ অমলের কণ্ঠ শুনিয়া চারু অত্যন্ত চমকিয়া উঠিল; তাড়াতাড়ি খাতা লুকাইয়া ফেলিল; কহিল, “তোমার ভারি অন্যায়।” অমল। কী অন্যায় করেছি। চারু। নুকিয়ে নুকিয়ে দেখছিলে কেন। অমল। প্রকাশ্যে দেখতে পাই নে বলে। চারু তাহার লেখা ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। অমল ফস্‌ করিয়া তাহার হাত হইতে খাতা কাড়িয়া লইল। চারু কহিল, “তুমি যদি পড় তোমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি।” অমল। যদি পড়তে বারণ কর তা হলে তোমার সঙ্গে জন্মের মত আড়ি। চারু। আমার মাথা খাও ঠাকুরপো, পোড়ো না। অবশেষে চারুকেই হার মানিতে হইল। কারণ, অমলকে তাহার লেখা দেখাইবার জন্য মন ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল, অথচ দেখাইবার বেলায় যে তাহার এত লজ্জা করিবে তাহা সে ভাবে নাই। অমল যখন অনেক অনুনয় করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল তখন লজ্জায় চারুর হাত-পা বরফের মতো হিম হইয়া গেল। কহিল, “আমি পান নিয়ে আসি গে।” বলিয়া তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে পান সাজিবার উপলক্ষ করিয়া চলিয়া গেল। অমল পড়া সাঙ্গ করিয়া চারুকে গিয়া কহিল, “চমৎকার হয়েছে।” চারু পানে খয়ের দিতে ভুলিয়া কহিল, “যাও, আর ঠাট্টা করতে হবে না। দাও, আমার খাতা দাও।” অমল কহিল, “খাতা এখন দেব না, লেখাটা কপি করে নিয়ে কাগজে পাঠাব।” চারু। হাঁ, কাগজে পাঠাবে বৈকি! সে হবে না। চারু ভারি গোলমাল করিতে লাগিল। অমলও কিছুতে ছাড়িল না। সে যখন বারবার শপথ করিয়া কহিল, “কাগজে দিবার উপযুক্ত হইয়াছে” তখন চারু যেন নিতান্ত হতাশ হইয়া কহিল, “তোমার সঙ্গে তো পেরে ওঠবার জো নেই! যেটা ধরবে সে আর কিছুতেই ছাড়বে না! ” অমল কহিল, “দাদাকে একবার দেখাতে হবে।” শুনিয়া চারু পান সাজা ফেলিয়া আসন হইতে বেগে উঠিয়া পড়িল; খাতা কাড়িবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, তাঁকে শোনাতে পাবে না। তাঁকে যদি আমার লেখার কথা বল তা হলে আমি আর এক অক্ষর লিখব না।” অমল। বউঠান, তুমি ভারি ভুল বুঝছ। দাদা মুখে যাই বলুন, তোমার লেখা দেখলে খুব খুশি হবেন। চারু। তা হোক, আমার খুশিতে কাজ নেই। চারু প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়াছিল সে লিখিবে–– অমলকে আশ্চর্য করিয়া দিবে; মন্দার সহিত তাহার যে অনেক প্রভেদ এ কথা প্রমাণ না করিয়া সে ছাড়িবে না। এ কয়দিন বিস্তর লিখিয়া সে ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। যাহা লিখিতে যায় তাহা নিতান্ত অমলের লেখার মতো হইয়া উঠে; মিলাইতে গিয়া দেখে এক-একটা অংশ অমলের রচনা হইতে প্রায় অবিকল উদ্‌ধৃত হইয়া আসিয়াছে। সেইগুলিই ভালো, বাকিগুলা কাঁচা। দেখিলে অমল নিশ্চয়ই মনে মনে হাসিবে ইহাই কল্পনা করিয়া চারু সে-সকল লেখা কুটি কুটি করিয়া ছিঁড়িয়া পুকুরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে, পাছে তাহার একটা খণ্ডও দৈবাৎ অমলের হাতে আসিয়া পড়ে। প্রথমে সে লিখিয়াছিল ‘শ্রাবণের মেঘ’। মনে করিয়াছিল, ‘ভাবাশ্রুজলে অভিষিক্ত খুব একটা নূতন লেখা লিখিয়াছি।” হঠাৎ চেতনা পাইয়া দেখিল জিনিসটা অমলের ‘আষাঢ়ের চাঁদ’-এর এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। অমল লিখিয়াছে, “ভাই চাঁদ, তুমি মেঘের মধ্যে চোরের মতো লুকাইয়া বেড়াইতেছ কেন।’ চারু লিখিয়াছিল, ‘সখী কাদম্বিনী, হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া তোমার নীলাঞ্চলের তলে চাঁদকে চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছ’ ইত্যাদি। কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চারু রচনার বিষয় পরিবর্তন করিল। চাঁদ, মেঘ, শেফালি, বউ-কথা-কও, এ সমস্ত ছাড়িয়া সে ‘কালীতলা’ বলিয়া একটা লেখা লিখিল। তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পুকুরটির ধারে কালীর মন্দির ছিল; সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র স্মৃতি, সেই জাগ্রত ঠাকুরানীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গ্রামে চিরপ্রচলিত প্রাচীন গল্প–– এই-সমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল। তাহার আরম্ভ-ভাগ অমলের লেখার ছাঁদে কাব্যাড়ম্বরপূর্ণ হইয়াছিল,
false
humayun_ahmed
বাতি নিভিয়ে তারা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নিচে জরীর বিদায়ের আয়োজন চলছে। রাত হয়েছে। দশটা। বরযাত্রীরা আর এক মিনিটও দেরি করতে চায় না। কিন্তু ক্রমাগতই দেরি হচ্ছে। কনে—বিদায় উপলক্ষে খুব কান্নাকাটি হচ্ছে। জরীর মা দু বার ফিট হয়েছেন। জরীকে ধরে রেখেছেন। বর-কনেকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হবে। জরী শেষ বারের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে–তার ছবি! ভাড়া-করা ফটোগ্রাফার ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডে লাগিয়ে অধৈৰ্য হয়ে অপেক্ষা করছে। বর এসে দাঁড়িয়ে আছে কখন থেকে। কনের দেখা নেই। জরীকে বার বার ডাকা হচ্ছে। ঘরের সব ঝামেলা চুকিয়ে জরী যখন বারান্দায় ছবি তোেলবার জন্যে রওয়ানা হয়েছে, তখনি হোসেন সাহেব বললেন, জরী, আনিসের সঙ্গে দেখা করে যাও। তার সঙ্গে আর দেখা নাও হতে পারে। জরী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। হোসেন সাহেব বরকে বললেন, তুমি আর দু মিনিট অপেক্ষা কর। এ বাড়ির একটি ছেলে খুবই অসুস্থ, জরী তার সাথে দেখা করে যাক। যদি বলেন, তবে আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে। না, তোমার কষ্ট করতে হবে না। তুমি একটু অপেক্ষা কর। এস জারী। জরীর সঙ্গে অনেকেই উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু হোসেন সাহেব বারণ করলেন, দল-বল নিয়ে রোগীর ঘরে গিয়ে কাজ নেই। আনিসের ঘর অন্ধকার। বাইরে বিয়েবাড়ির ঝলমলে আলো। সে-আলোয় আনিসের ঘরের ভেতরটা আবছা আলোকিত। জারী ভেতরে এসে দাঁড়াল। হালকা একটি সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে। জরী কী সেন্ট মেখেছে কে জানে। সে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু স্বরে ডাকল, আনিস ভাই, আনিস ভাই। কেউ সাড়া দিল না। হোসেন সাহেব বললেন, বাতি জ্বালাব, জরী? না, না দুলাভাই। জরী নিচু হয়ে আনিসের কপাল স্পর্শ করল। ভালোবাসার কোমল স্পর্শ, যার জন্যে একটি পুরুষ আজীবন তৃষিত হয়ে থাকে। হোসেন সাহেব বললেন, ছিঃ জরী, কাঁদে না! এস আমরা যাই! ঘরের বাইরে বড়োচাচা দাঁড়িয়ে ছিলেন। জরী তাঁকে জড়িয়ে ধরল। তিনি বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে মা। ফি আমানুল্লাহ, ফি আমানুল্লাহ। নিচে তুমুল হৈচৈ হচ্ছিল। জরী নামতেই তাকে বরের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। ক্যামেরাম্যান বলল, একটু হাসুন! সবই বলল হাস জরী, হাস, ছবি উঠবে। জরীর চোখে জল টলমল করছে, কিন্তু সে হাসল। আনিসের ঘুম যখন ভাঙল, তখন কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। জারী কি চলে গিয়েছে নাকি? উঠোনে সারি সারি আলো জ্বলছে। গেটের বাতিগুলি জ্বলছে–নিভছে। তার বিছানার খানিকটা অংশ বারান্দার বাতিতে আলোকিত হয়ে রয়েছে। আনিস ঘাড় উঁচু করে জানালা দিয়ে তাকাল। না, বরের গাড়ি এখনো যায় নি। জরী এখনো এই বাড়িতেই আছে! যাবার আগে দেখা করতে এখানে আসবে নিশ্চয়ই। আনিস তখন কী বলবে ভেবে পেল না। খুব গুছিয়ে কিছু একটা বলা উচিত, যাতে জরীর মনের সব গ্রানি কেটে যায়। কিন্তু আনিস কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারে না। জরীকে বিয়ের সাজে কেমন দেখাচ্ছে কে জানে? আনিস হয়তো দেখে চিনতেই পারবে না। জারী কি হুঁট করে তাকে সালাম করে বসবে নাকি? এই একটি বিশ্ৰী অভ্যেস আছে তার। ঈদের দিন কথা নেই, বার্তা নেই, সেজেগুজে এসে টুপ করে এক সালাম। কিছু বললে বলবে–সিনিওরিটির একটা ভ্যালু আছে না? তারপরই খিলখিল হাসি। আনিস অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। বরযাত্রীরা তৈরি হয়েছে বিদায় নিতে। সবাই জরীকে ধরাধরি করে উঠোনে নিয়ে এল। রাজ্যের লোক সেখানে এসে ভিড় করেছে। যাবার আগে সবাই একটু কথা বলবে। দুএকটি কী আচার-অনুষ্ঠানও আছে। আনিস জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। বরের সাজান গাড়ি ব্যাক করে আরো পিছনে আনা হচ্ছে। গাড়িতে উঠতে যেন কনেকে হাঁটতে না হয়। উপর থেকে জরীর ঝলমলে লাল শাড়ির খানিকটা চোখে পড়ে। খুব আগ্রহ নিয়ে আনিস সেদিকে তাকিয়ে রইল। যাবার আগে জারী নিশ্চয়ই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবে। আনিস, আনিস। কে? আমি টিংকুমণি। আমি এসেছি। এস এস। তোমার ব্যথা কমেছ? কমেছে। আচ্ছা। সারা দিনের ক্লান্তিতে মেয়েটির মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো। আজ কেউ তার দিকে নজর দেবার সময় পায় নি। আনিস তাকে কাছে টেনে নিল। জানালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ টিংকু। জরী চলে যাচ্ছে। টিংকু সে-কথায় কান দিল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি ব্যথা পেয়েছি, হাত ভেঙে গেছে। আহা আহা! একটু হাতি-হাতি খেলবে টিংকু? না, আমার ঘুম পাচ্ছে। ছোট ছোট হাতে আনিসের গলা জড়িয়ে ধরে টিংকু কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পডল। ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। বাড়ির আলোগুলি নিভে যেতে লাগল। বাগানের গোলাপ আর হাস্নুহেনা-ঝাড় থেকে ভেসে এল ফুলের সৌরভ। অনেক দূরে একটি নিশি-পাওয়া কুকুর কাঁদতে লাগল। তারও অনেক পরে আকাশে একফালি চাঁদ উঠল। তার আলো এসে পড়ল নিদ্রিত শিশুটির মুখে। জ্যোৎস্নালোকিত একটি শিশুর কোমল মুখ, তার চারপাশে কী বিপুল অন্ধকার। গভীর বিষাদে আনিসের চোখে জল এল। যে-জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের–মানুষের সাথে তার কোনো কালেই দেখা হয় না। নলিনী বাবু .. (২০১০) কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ। সংসারোহয় মতিব বিচিত্রঃ। কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ। তত্ত্বৎ চিন্তায় তদিদং ভ্রাতঃ ॥ কে তোমার স্ত্রী এবং কে তোমার পুত্র? এই সংসারের ব্যাপার অতিশয় বিচিত্র। তুমি কাহার এবং কোথা হইতেই বা আসিয়াছ, হে ভ্রাতঃ! এই নিগূঢ় তত্ত্ব চিন্তা কর। ভূমিকা বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে। সম্পর্কের গল্পের পাশাপাশি, সম্পর্কের
false
MZI
ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে। সেটা আর করা লাগবে না। টেস্ট হয়ে গেছে।” “মানে?” “কাছাকাছি যখন বাজ পড়ে তার আগে আগে সেই জায়গায় এক ধরণের ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হয়। তোর বাসায় সেই ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী হয়েছিল, ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাট; সেই ইলেকট্রিক ফিল্ডের মাঝে যখন ঢুকেছে তখন নিশ্চয়ই এনার্জি রিলিজ করতে শুরু করেছে।” আমি মিঠুনের কোনো কথাই বুঝতে পারলাম না, তাই বোকার মতন মাথা নাড়লাম। মিঠুন জোরে জোরে চিন্তা করতে লাগল, “কিন্তু এনার্জিটা আসে কোথা থেকে?” আমিও ভান করলাম এনার্জিটা কোথা থেকে আসে সেটা নিয়ে আমারও খুব চিন্তা হচ্ছে। মিঠুন বিড় বিড় করতে করতে বলল, “এক হতে পারে ই ইকুয়েলস টু এমসি স্কয়ার। তুই তাহলে এর অর্থ চিন্তা করতে পারিস?” আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না তারপরও জিনিষটা নিয়ে ভাবছি এরকম ভাণ করে মাথা নাড়লাম। মিঠুন বলল, “তার অর্থ এমন একটা জিনিস পেয়েছি সেটা দিয়ে সাংঘাতিক সব কাজ করে ফেলা যাবে। পৃথিবীর মানুষ চিন্তাও করতে পারবে আমাদের কাছে কী আছে।” আমি বললাম, “তোর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এর কথা এখন কাউকে বলা যাবে না।” “হ্যাঁ। এখন আমাদের কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে এর কথা বলা যাবে না। তার আগে পুরোটা আমাদের এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখতে হবে।” জিজ্ঞেস করলাম, “কখন করবি?” “আজকেই।” আমি মাথা নাড়লাম, “মিঠুন বলল, দেরী করতে পারব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।” সত্যিকারের স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা যখন ইচ্ছে বের হতে পারে না কিন্তু আমাদের মহব্বতজান স্কুলে এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি আর মিঠুন স্কুল ছুটির দুই পিরিওড আগে ফুড়ত করে বের হয়ে গেলাম কেউ লক্ষও করল না। আমাদের বাসায় যাবার আগে মিঠুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোর বাসায় ব্যাটারী আছে?” আমি মাথা চুলকালাম, বললাম “থাকলেও এখন তো খুঁজে পাব না।” “টেলিভিশনের রিমোট আছে?” “আছে।” “তাহলেই ব্যাটারী পেয়ে যাব। এখন দরকার দুই টুকরা তার।” “পুরানো একটা টেবিল ল্যাম্প আছে।” মিঠুন হাতে কিল দিয়ে বলল, “গুড়! এখন দরকার এলুমিনিয়াম ফয়েল। পান বিড়ি সিগারেটের দোকানে পেয়ে যাব।” রাস্তার পাশে ছোট একটা পান, বিড়ি সিগারটের দোকান থেকে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট চেয়ে নিলাম তার ভেতরে খানিকটা রাংতা পাওয়া গেল। মিঠুন খুশি হয়ে মাথা নাড়ল, এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য তার যা কিছু দরকার তার সবকিছু হয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে বাসায় এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। মিঠুনের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে রিমোটের ব্যাটারি দুটো খুলে নিলাম। ভালই হয়েছে আন্তু এখন বাসায় নেই, যতক্ষণ বাসায় থাকেন সোফায় আশায়া হয়ে টিভি দেখেন তখন রিমোট খুলে ব্যাটারি নেয়া এতো সোজা হত না। পড়ার ঘর থেকে আমার পুরানো টেবিলে ল্যাম্পটা নিয়ে নিলাম তারপর মিঠুনকে নিয়ে ছাদে আমার চিলেকোঠায় হাজির হলাম। মিঠুন ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা রাখা বাক্সটা নিয়ে সাবধানে সেটা খুলল, ভেতরে জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে, একদিকে পুড়ে একটা বড় গর্ত পর্যন্ত হয়ে গেছে। মিঠুন সাবধানে শিশিটা বের করে একবার নেড়ে দেখল, ভেতরে কিছু দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় শিশিটাতে কিছু একটা আছে। মিঠুন শিশিটার দুই পাশে দুই টুকরা রাংতা ল্যাপ্টে লাগিয়ে নেয়। তারপর টেবিল ল্যাম্প থেকে দুই টুকরা তার ছিড়ে নিয়ে উপরের প্লাস্টিক সরিয়ে ভেতরের তার বের করে নেয়। দুইটা তার শিশির দুই পাশের রাংতার সাথে প্যাচিয়ে নিয়ে সে শিশিটা মেঝেতে রাখল। তারপর আমাকে বলল, রিমোটের ব্যাটারিগুলো বের করতে। আমি ব্যাটারি দুটো বের করার পর মিঠুন সাবধানে তারের দুই মাথা ব্যাটারির দুই পাশে লাগাতেই তুলকালাম একটা কাণ্ড ঘটল। শিশিটার ছিপিটা গুলির মতো উপরে ছুটে গেল আর শিশির ভেতর থেকে জ্বলন্ত নীলাভ আলোয় একটা শিখার মতো লকলকে কিছু একটা বের হয়ে ছাদে আঘাত করল। পুরো ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমরা রেডি হবার সময় পর্যন্ত পেলাম না কোনোমতে তার ব্যাটারি খুলে ছিটকে সরে গেলাম। কানেকশন ছুটে যেতেই সেই লকলকে শিখাটা সুড়ৎ করে শিশির ভেতরে ঢুকে গেল। মিঠুনের চোখ চকচক করতে থাকে। কোনোমতে নিশ্বাস আটকে বলল, “প্লাজমা!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “প্লাজমা কী?” “ কোনো গ্যাস যখন আয়োনাইজ হয়, সেটাকে বলে পাজমা।” “আয়োনাইজ মানে কী?” “গ্যাসের ইলেকট্রনকে যখন ছুটিয়ে নেয় তখন বলে আয়োনাইজ হওয়া। “ইলেকট্রন কেন ছুটে যাচ্ছে?” “কোনো এক ধরনের শক্তি বের হচ্ছে সেই শক্তি ছুটিয়ে দিচ্ছে।” মিঠুন জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “সাধারণত লো প্রেসারে জমা তৈরী হয়। এখানে গ্যাসের স্বাভাবিক চাপেই হয়ে যাচ্ছে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে কী?” “তার মানে প্রচণ্ড এনার্জি বের হচ্ছে।” “সেটা ভালো না খারাপ?” “সেটা ফ্যান্টাস্টিক।” মিঠুন চোখ বড় বড় করে বলল, “সেটা অসাধারণ।” ব্যাটারি লাগালে কী হতে পারে সেটা যেহেতু জেনে গেছি তাই এর পরে আরেকটু সাবধানে কানেকশন দেয়া হলো, আবার শিশির ভেতর থেকে জীবন্ত প্রাণীর মত লকলকে প্লাজমা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বের হয়ে আসে, সারা ঘরে ওষুধের মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। প্লাজমাটা ছাদে যেখানে গিয়ে ধাক্কা খেল সেখান থেকে প্যালেস্তারা খসে পড়ল। মিঠুন সেটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। কয়েকবার এক্সপেরিমেন্ট করে মিঠুন সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল। তারপর শিশিটা আবার বন্ধ করে বাক্স রেখে দেয়। বাক্সে রাখার আশা এবার সে রাংতা দিয়ে ভালো করে মুড়ে নেয় তাহলে লাল ইলেকট্রিক ফিল্ড ঢুকতে পারবে না। আশপাশে বাজ পড়লেও সমস্যা নেই। স্কুল ছুটির পর আমরা বাসায় যাচ্ছি, কোর্টের কাছাকাছি কিছু একটা দেখে
false
MZI
কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, স্যার তাই পুরো খবরটা পড়ে শশানালেন। আমি রেডিওতে যেটা শুনেছি মোটামুটি সেই খবরটাই, তবে খুঁটিনাটি আরো কিছু বর্ণনা আছে। আমেরিকার এক মানমন্দিরের ডিরেক্টরের কথা আছে, অস্ট্রেলিয়ার একজন মহাকাশবিজ্ঞানীর কথা আছে। সবাই বলেছে যে তারা মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে সত্যি একটি রহস্যময় মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছিল। তার সাথে নাকি যোগাযোগও করা হয়েছিল। মহাকাশযানটি দেখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, বেশ কয়েকটি কত্রিম উপগ্রহ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে রাডার দিয়ে চেষ্টা করা। হয়েছে, পৃথিবীর সব টেলিস্কোপ দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মহাকাশযানটি পৃথিবীতে নামার চেষ্টা করেছিল, হয়তো ঠিকমতো নামতে পারে নি, হতে পারে কোনোভাবে বিধ্বস্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যে–এলাকায় সেটা বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন, তার মাঝে বাংলাদেশ, বার্মা, ভিয়েতনাম, প্রশান্ত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চল রয়েছে। পুরো এলাকায় খুব খোঁজাখুজি হচ্ছে। আশ্চর্যজনক কিছু দেখলে সাথে সাথে কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা বলা হয়েছে। সারা ক্লাস খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। স্যার পায়চারি করতে করতে বললেন, চিন্তা করতে পারিস, যদি সত্যি সত্যি অন্য একটা গ্রহ থেকে একটা প্রাণী এসে হাজির হয় তাহলে কী মজাটাই হবে? দেখতে কেমন হবে বলে মনে হয় তোদের? লিটন বলল, আমি সেদিন একটা সিনেমা দেখেছিলাম, স্যার। সেখানে দেখিয়েছিল, দেখতে খুব ভয়ঙ্কর। স্যার বললেন, সিনেমা তো গাঁজাখুরি, আসলে কেমন হবে? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম, বুদ্ধিমান প্রাণীরা দেখতে নাকি মানুষের মতনই হওয়ার কথা। বড় একটা মগজ থাকবে তার কাছাকাছি থাকবে চোখ, দূরত্ব বোঝার জন্যে সবসময় হতে হবে দুটো চোখ– হাত? আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটা কিছু বলে নি। কিন্তু কিছু ধরার জন্য আঙুল না হয় গুড় থাকতে হবে। স্যার মাথা নাড়লেন, ঠিকই বলেছিস। কোন গ্রহ থেকে আসছে তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে। সেই গ্রহ কত বড়, মাধ্যাকর্ষণ বল কত বেশি, বাতাস আছে কি নেই, থাকলে কি কি গ্যাস আছে, এইসব। কী মনে হয় তোদের? প্রাণীটা কি হাসিখুশি হবে, নাকি বদরাগী? লিটন বলল, বদরাগী হবে, স্যার। মহাকাশের প্রাণী সবসময় খুব ডেঞ্জারাস হয়। সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে। টিভিতে একটা সিনেমা দেখিয়েছিল— স্যার বললেন, ধুর। সিনেমা সবসময় গাঁজাখুরি হয়। আমার মনে হয় প্রাণীটা হবে খুব মিশুক। কদুর থেকে পন্ধিবীতে বেড়াতে এসেছে ভেবে দেখ। সে যদি মিশুক না হয় তাহলে কে মিশুক হবে? পুরো ক্লাস স্যারের সাথে একমত হল। স্যার খানিকক্ষণ হেঁটে আবার বললেন, তারপর চিন্তা করে দেখ, পৃথিবীটা কত সুন্দর, সেই মহাকাশের প্রাণী দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষের সাথে যখন তার পরিচয় হবে তখন মনে হয় সে পৃথিবী ছেড়ে যেতেই চাইবে না। কী বলিস তোরা? আমরা সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। স্যার বাচ্চা মানুষের মতো ছটফট করতে করতে বললেন, কিন্তু মহাকাশযানটাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? বিজ্ঞানীরা সেটাকে দেখতে পেল না কেন? লিটন বলল, আমি একটা বইয়ে পড়েছি, বোমা ফেলার জন্যে প্লেন তৈরি করেছে যেটা নাকি রাডারে দেখা যায় না। সেরকম কিছু– স্যার চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু সেটা তো যুদ্ধ করার প্লেন। মহাকাশের একটা প্রাণী কি যুদ্ধ করতে আসবে? লিটন বলল, আমি যে সিনেমাটা দেখেছি— তারিক বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু টেলিস্কোপ দিয়েও তো দেখতে পারে নাই। স্যার মাথা নাড়লেন, তা ঠিক। তা ঠিক। মাহবুব বলল, অদৃশ্য কোনো জিনিস দিয়ে হয়তো তৈরি। অদৃশ্য জিনিস তো কিছু নেই, স্যার মাথা নাড়লেন, যেখান থেকেই আসুক সেটা তৈরি হতে হবে একই জিনিস দিয়ে, যে-এক শ’ চারটা মৌলিক পদার্থ আছে, তার বাইরে তো কিছু থাকতে পারে না। ক্লাসে সবচেয়ে যে কম কথা বলে, সুব্রত, আস্তে আস্তে বলল, এমন কি হতে পারে যে মহাকাশের প্রাণী সাইজে অনেক ছোট হয়, পিঁপড়ার মতো, কিংবা আরো ছোট, যে খালিচোখে দেখা যায় না? সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। স্যার নিজেও হাসতে হাসতে ধমক দিলেন সবাইকে, হাসছিস কেন তোরা বোকার মতো? হাসছিস কেন? ছোট তো হতেই পারে— হাসতে হাসতে হঠাৎ আমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে চমকে উঠলাম। আমার সেই বিচিত্র পোকাটার কথা মনে পড়ল আর হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সুব্রত ঠিকই বলেছে, বিজ্ঞানীরা সেটাকে দেখতে পায় নি, কারণ সেটা অনেক ছোট, আমি সেটাকে পেয়েছি, পেয়ে হোমিওপ্যাথিক শিশির মাঝে আটকে রেখেছি। চিৎকার করে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠছিলাম, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। স্যার একটু অবাক হয়ে বললেন, কি রে বিলু, কিছু বলবি? না না না, স্যার। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ইয়ে, মানে—বলছিলাম, মহাকাশের প্রাণী তো ছোট হতে পারে। পারে না, স্যার? পারবে না কেন? অবশ্যি পারে। সব প্রাণীরই যে আমাদের মতো সাইজ হতে হবে কে বলেছে? ডাইনোলোর কত বড় ছিল, জীবাণু কত ছোট। কাজেই একটা প্রাণীকে কত বড় হতে হবে তার তো কোনো নিয়ম নেই। স্যার আরো কি কি বললেন, কিন্তু আমি কিছু শুনছিলাম না। আমার বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডে ঢাকের মতো শব্দ করছে, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, হাত অল্প অল্প কাঁপছে। আমি সত্যিই কি মহাকাশের সেই প্রাণীটাকে ধরেছি? বাসায় গিয়ে সেই প্রাণীটাকে আবার দেখতে হবে, কিন্তু স্কুল ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছিলাম না, তাই অঙ্ক ক্লাসে পেট চেপে কোঁ কোঁ করে স্যারকে বললাম,
false
shunil_gongopaddhay
দেকা করেননি। —তিনি কারুর সঙ্গে দেকা করেন না। তাঁর সঙ্গেই অন্যদের দেকা করতে হয়। —ও, তাই? তোমার পতি দেবতাটি দেকচি সত্যিই দেবতা। গভীর সমুদ্রের নির্মল নীল জলের মতন দুটি চক্ষুতারকা নবীনকুমারের দু চোখের ওপর ন্যস্ত করে কুসুমকুমারী বললো, ফের একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে, তাঁকে দেকে যাবেন। তাঁকে লোহার শিকলি দিয়ে বেঁধে রাকতে হয় তো, সেইজন্য তিনি কোতাও যেতে পারেন না। একটু থেমে নিষ্কম্প অম্লান কণ্ঠে কুসুমকুমারী আবার বললো, তিনি এখন বদ্ধ উন্মাদ, কেউ কাচে গেলে মারেন। নবীনকুমার থমকে গেল। এমন কিছু শুনতে হবে সে আশা করেনি। এই রকম একটা ফুটফুটে বালিকার স্বামী উন্মাদ! সে রোগের যে চিকিৎসা নেই। হ্যাঁ, এরকম একটা কথা নবীনকুমার আগেও শুনেছিল বটে। কিছু তো একটা বলতে হবে, তাই অন্য কিছু আর খুঁজে না পেয়ে নবীনকুমার বললো, আহা, তোমার তো খুব দুঃখ! —বলতে পারেন, জগতে সুখী কে? সেদিন বিদ্যোৎসাহিনী সভায় নবীনকুমার বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগলো। এই সভায় তার অনেক দায়িত্ব। সে সম্পাদক, উদ্বোধনী ভাষণ তাকেই দিতে হয়, সেদিনকার বক্তার পরিচয় এবং বক্তৃতার বিষয়ের সারমর্ম ঘোষণা করাও তার দায়িত্ব। প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিরা যেমন এই সভায় আসেন তেমনি আসে কৃষ্ণকমল ভটাচাষ, হরীশ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল ইত্যাদি প্রকৃত উৎসাহী নব্য যুবকেরা। ইংরেজ পণ্ডিত ও শিক্ষকরাও আসেন। সভায় উপস্থিত অভ্যাগত বৃন্দের জন্য ভূরিভোজেরও ব্যবস্থা থাকে, সে দায়িত্ব দুলালের ওপর, নবীনকুমারকেও সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। তবু আজ নবীনকুমারের মন ক্ষণে ক্ষণে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কুসুমকুমারীর মুখ। এক সময় নবীনকুমার কিছু না ভেবেই মেয়েটির একটি নাম দিয়েছিল বনজ্যোৎস্না। তখন নবীনকুমার ধারাবাহিকভাবে কালিদাসের নাটক ও কাব্যগুলি পাঠ করছিল, শকুন্তলা নাট্যের ঐ নামটি তার বড় পছন্দ হয়েছিল। কুসুমকুমারীর নীল রঙের চোখের দৃষ্টিতে সত্যিই যেন অরণ্য-জ্যোৎস্নার আভা আছে। ঐটুকু মেয়ে কেমন শান্ত নিরুত্তাপভাবে বললো, বলতে পারেন, জগতে সুখী কে? এই বয়সেই কুসুমকুমারী দুঃখকে চিনেছে। তার স্বামী বদ্ধ উন্মাদ, তার সামনে পড়ে আছে অনন্ত দুঃখময় জীবন। সেদিন সভায় কার্ক প্যাট্রিক সাহেব সমাজনীতি ও বিবেকের যুক্তি এই শিরোনামায় একটি ইংরেজি সন্দর্ভ পাঠ করলেন। সেটি নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনার পর প্ৰিয়মাধব বসু নামে আর একজন ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিধবাদের বিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন করছেন, তার সমর্থনে বাংলায় বক্তৃতা করতে লাগলেন। নবীনকুমার আজ কথাবার্তাও বিশেষ বলছে না। শেষোক্ত আলোচনা শুনতে শুনতে তার মনে হলো, বিধবাদের পুনর্বিবাহ তো চালু হওয়া উচিত বটেই, কিন্তু কুসুমকুমারীর কী হবে? বদ্ধ উন্মাদরা আর সুস্থ হয় না কোনো ব্যক্তির স্ত্রী যদি বদ্ধ উন্মদিনী হয়, সে ব্যক্তি স্বচ্ছন্দে আর একটি বিবাহ করতে পারে। তাহলে কুসুমকুমারী পারবে না কেন! নবীনকুমার নিজে এক সময় সচেতন হলো। এ সব কী উৎকট চিন্তা তার মাথায় ঢুকছে। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত বিধবাদের মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করতে চাইছেন বলে কি দেশটা একেবারে বিলাত হয়ে যাবে নাকি! উন্মাদ হোক আর কুষ্ঠরোগগ্ৰস্ত হোক, হিন্দু নারীর স্বামীই একমাত্র অবলম্বন। পরাশরের নষ্টে মৃতে প্ৰব্ৰজিতে ইত্যাদি শ্লোকের মধ্যে উন্মাদ বিষয়ে কিছু নেই। কুসুমকুমারীকে সারাজীবন ঐ উন্মাদ স্বামীর সঙ্গেই থাকতে হবে। তবু তার ঐ কথাটা কানে বাজে, বলতে পারেন, জগতে সুখী কে? সভা যখন শেষ হয়ে এসেছে, সেই সময় নবীনকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মান্যবরগণ, আমি একটি নিবেদন রাখিতে চাই। সকলে উৎকৰ্ণ হলো। নবীনকুমারের প্রস্তাবটি এই যে, বাংলাভাষার উন্নতিকল্পে বিদ্যাৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে জনসাধারণের মধ্যে প্ৰবন্ধ প্ৰতিযোগিতার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? কোন একটি বিষয় ঘোষণা করে দেওয়া হবে। সেই বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ প্ৰবন্ধ লেখককে পুরস্কার দেওয়া হবে কিছু টাকা। এর ফলে শিক্ষিত লোকে বাংলাভাষায় লিখতে আগ্রহী হবে। সকলেই এ প্ৰস্তাব সমর্থন করলেন। নবীনকুমার জানালো যে তবে আজই একটি প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হোক। শ্রেষ্ঠ প্ৰবন্ধ লেখককে সে নিজে দুই শত টাকা পুরস্কার দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। প্ৰবন্ধ প্ৰতিযোগিতার বিষয়টি কী হবে? এক মুহুৰ্তও চিন্তা না করে নবীনকুমার বললো, বিষয়টি হোক, এ জগতে সুখী কে? সভার শেষ প্রান্ত থেকে দীর্ঘকায়, খড়্গনাশা এক প্রৌঢ় উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সাধু! সাধু! এ অতি উত্তম প্রস্তাব। আর বিষয়টিও বড় উপযুক্ত। এ জগতে সুখী কে? এ বড় গূঢ় কতা। এই ব্যক্তিটি রাইমোহন। তার চেহারা ও বেশবাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সে কুঁচোনো ধুতির কোঁচার ডগার মুখটি হাতে ধরে থাকে না, গায়ে দেয় না এণ্ডির বেনিয়ান, চোখে নেই সুর্মা, হাতে নেই গোড়ের মালা। তাকে দেখলে আর সেই আগেকার বেশ্যাবাড়ির নিশাচর বলে চেনা যায় না। তার চেহারা ও পোশাক এখন বিদ্বজন সমাগমে যোগ দেবার উপযুক্ত, মাথার বাবরি চুল ছোট তেল চুকচুক করে আচড়ানো, কাঁধে চাদর। গুরুগভীর বক্তৃতা শোনার জন্য রাইমোহন এখন নিয়মিত এসে বসে থাকে। তাছাড়া সে এখানে তার উপস্থিতির কিছুটা গুরুত্বও আদায় করে নিয়েছে। বিদ্যোৎসাহী সমিতি থেকে যে নাটক অভিনয়ের মহলা চলছে, সেই বেণীসংহার নাটকে কয়েকটি গীত সংযোজন করার কথা উঠেছিল। রাইমোহনই সেজন্য তিনটি গান রচনা করে সুরও দিয়েছে। সে গান প্ৰশংসা পেয়েছে সকলের। রাইমোহন এগিয়ে এসে নবীনকুমারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, বড় উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন আপনি! আপনার দ্বারা এ দেশের মহদোপকার হবে। দুশো টাকা পুরস্কার! এ আপনার স্বৰ্গত পিতার উপযুক্ত পুত্রের মতনই হয়েচে বটে! সাধু সাধু! সোহাগবালার ব্যাধিটি বড় বিচিত্র। মানুষের স্থূলত্বেরও তো একটা সীমা আছে, কিন্তু সোহাগবালার ক্ষেত্রে সব কিছুই
false
shordindu
কে? রট্টা আর কোনও কথা না বলিয়া স্মিতমুখে আকাশের পানে চাহিলেন, চক্ষু দুটি তন্দ্রাচ্ছন্ন, যেন কোন্ অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিতেছে। সুগোপা কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া শেষে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—মহারাজ যে কী করিতেছেন তিনিই জানেন। হঠাৎ কাহাকেও কিছু না। বলিয়া চষ্টন দুর্গে গিয়া বসিয়া আছেন। এদিকে বসন্তঋতু নিঃশেষ হইয়া আসিল। কি জন্য গিয়াছেন তুমি কিছু জানো? রট্টা বলিলেন—চষ্টনের দুর্গাধিপ কিরাত পত্র লিখিয়াছিল, কয়েকটি চৈনিক শ্ৰমণ বুদ্ধের পবিত্র বিহারভূমি দর্শন করিবার মানসে ভারতে আসিয়াছেন, তাঁহারা পাটলিপুত্র যাইবেন; পথে কয়েকদিনের জন্য চষ্টন দুর্গে বিশ্রাম করিতেছেন। তাই শুনিয়া মহারাজ অহৎ সন্দর্শনে গিয়াছেন। সুগোপা মাথা নাড়িয়া বলিল—বিশ্বাস হয় না, কিরাতটা মহা ধূর্ত, ছল করিয়া মহারাজকে নিজ দুর্গে লইয়া গিয়াছে—নিশ্চয় কোনও দুরভিসন্ধি আছে। হয়তো নিভৃতে পাইয়া চাটুবাক্যে মহারাজকে দ্রবীভূত করিয়া তোমার পাণিপ্রার্থনা করিবে। তুই কিরাতকে দেখিতে পারিস না। তা পারি না। শুনিয়াছি এই বয়সেই সে ঘোর অত্যাচারী—অতিশয় দুর্জন। শিকারে কিন্তু তার অব্যর্থ লক্ষ্য। অব্যর্থ লক্ষ্য হইলেই সজ্জন হয় না। বাজপাখি কি সজ্জন? কিরাত চমৎকার মিষ্ট কথা বলিতে পারে। যে পুরুষ মিষ্ট কথা বলে, তাহাকে বিশ্বাস করিতে নাই। তোর মালাকর বুঝি তোকে কেবলই গালি দেয়? সুগোপা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল—পরিহাস নয়। কিরাত তোমার পায়ের দিকে তাকাইবার যোগ্য নয়, কিন্তু সে তোমাকে পাইবার আকাঙ্খা পোষণ করে। আমি জানি, তোমার জন্যে সে পাগল। রট্টা অল্প হাসিলেন, তারপর গম্ভীর হইয়া বলিলেন—শুধু আমার জন্য নয় সুগোপা, এই বিটঙ্ক রাজ্যটার জন্যও সে পাগল। কিন্তু ও কথা যাক। রাত্রি গভীর হইয়াছে, তুই এবার গৃহে যা। তাই যাই, তুমিও ক্লান্ত হইয়াছ। একে সারাদিন বনে বনে মৃগয়া, তার উপর চোরের উৎপাত—জলসত্র হইতে এতটা পথ হাঁটিয়া আসিতে হইয়াছে। মানুষ ঘোড়া চুরি করে এমন কথা জন্মে শুনি নাই। আর কী স্পর্ধা রাজকন্যার ঘোড়া চুরি! দেখিয়াই বুঝিয়াছিলাম লোকটা ভাল নয়। নিজের লাঞ্ছনার কথা স্মরণ করিয়া সুগোপার রাগ একটু বাড়িল—দুবৃত্ত বিদেশী তস্কর। এখন যদি তাহাকে একবার পাই— কি করিস? শুলে দিই। আমিও। এখন যা, চোরের উপর রাগ করিয়া পতি-দেবতাকে আর কষ্ট দিস না। সে হয়তো হাঁ করিয়া তোর পথ চাহিয়া আছে, ভাবিতেছে তোকেও চোরে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। মালাকরের সে ভয় নাই, তিনি জানেন আমাকে চুরি করিতে পারে এমন চোর জন্মায় নাই। তিনি এখন কোন শৌণ্ডিকালয়ে পড়িয়া অপ্সরী কিন্নরীর স্বপ্ন দেখিতেছেন। যাই, তাঁহাকে খুঁজিয়া লইয়া গৃহে ফিরিতে হইবে তো। প্রত্যহই বুঝি তাই করিতে হয়? হাঁ। সুগোপা মৃদু হাসিল—মালাকর লোকটি মন্দ নয়, আমাকে ভালও বাসে। কিন্তু মদিরা-সুন্দরীর প্রতি প্রেম কিছু অধিক। যাই, সপত্নীগৃহ হইতে পতি-দেবতাকে উদ্ধার করিয়া নিজ গৃহে আনি গিয়া। হাসিতে হাসিতে সুগোপা বিদায় লইল। তখন মধ্যরাত্রি হইতে অধিক বিলম্ব নাই। পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মদিরা ভবন রাজপুরী হইতে বাহির হইতে গিয়া সুগোপা দেখিল তোরণদ্বার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এমন প্রায়ই ঘটে, সেজন্য সুগোপার গতিবিধি বাধাপ্রাপ্ত হয় না। সে প্রতীহারকে গুপ্তদ্বার খুলিয়া দিতে বলিল। কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রতীহারের মনে তখন কিঞ্চিৎ রস-সঞ্চার হইয়াছিল। সে নিজের দ্বিধা-বিভক্ত চাপদাড়িতে মোচড় দিয়া একটা আদিরসাশ্রিত রসিকতা করিয়া ফেলিল। সুগোপাও ঝাঁঝালো উত্তর দিল। সেকালে আদিরসটা গোরক্ত ব্রহ্মরক্তের মত অমেধ্য বিবেচিত হইত না। তোরণের কবাটে একটি চতুষ্কোণ দ্বার ছিল, বাহির হইতে চোখে পড়িত না। সুগোপার ধমক খাইয়া প্রতীহার তাহা খুলিয়া দিল, বলিল—ভাল কথা, দেবদুহিতার ঘোড়াটা মন্দুরায় ফিরিয়া আসিয়াছে। সবিস্ময়ে সুগোপা বলিল—সে কি! আর চোর? মুণ্ড নাড়িয়া প্রতীহার বলিল—চোর ফিরিয়া আসে নাই। তুমি নিপাত যাও।—দেবদুহিতাকে সংবাদ পাঠাইয়াছ? যবনীর মুখে দেবদুহিতার নিকট সংবাদ গিয়াছে, এতক্ষণে তিনি পাইয়া থাকিবেন। সুগোপা অনিশ্চিত মনে ক্ষণেক চিন্তা করিল, তারপর সন্তর্পণে ক্ষুদ্র দ্বার দিয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল। প্রতীহার কৌতুকসহকারে বলিল—এত রাত্রে কি চোরের সন্ধানে চলিলে? হাঁ। প্রতীহার নিশ্বাস ফেলিল—ভাগ্যবান চোর! দেখা হইলে তাহাকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিও। তাই দিব। চোরের সংসর্গে রাত্রিবাস করিলে তোমার রস কমিতে পারে। সুগোপা দ্বার উত্তীর্ণ হইল। প্রতীহার ছাড়িবার পাত্র নয়, সে উত্তর দিবার জন্য দ্বারপথে মুখ বাড়াইল। কিন্তু সুগোপা তাহার মুখের উপর সজোরে কবাট ঠেলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে নগরের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। সুগোপা যতক্ষণ মদিরাগৃহে পতি অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে, সেই অবকাশে আমরা চিত্রকের নিকট ফিরিয়া যাই। কপোতকূটে প্রবেশ করিয়া চিত্ৰক উৎসুক নেত্রে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে চলিল। নগরীর শোভা দেখিবার আগ্রহ তাহার বিশেষ ছিল না। প্রথমে ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে হইবে, প্রায় এক অহোরাত্র কিছু আহার হয় নাই। কটিবন্ধন দৃঢ় করিয়া জঠরাগ্নিকে দীর্ঘকাল ঠেকাইয়া রাখা যায়, ক্লেশ যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহা সহ্য করিতে হইয়াছে; কিন্তু দৃত প্রসাদাৎ এখন আর ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। পথে চলিতে চলিতে শীঘ্রই একটি মোদক ভাণ্ডার তাহার চোখে পড়িল। থরে থরে বহুবিধ পান্ন সজ্জিত রহিয়াছে—পিষ্টক লড়ু ক্ষীর দধি কোনও বস্তুরই অভাব নাই। মেদমসৃণ-দেহ মোদক বসিয়া দীর্ঘ খর্জুর শাখা দ্বারা মক্ষিকা তাড়াইতেছে। মোদকালয়ে বসিয়া চিত্ৰক উদরপূর্ণ করিয়া আহার করিল। একটি বালক পথে দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মিষ্টান্ন নিরীক্ষণ করিতেছিল, চিত্ৰক তাহাকে ডাকিয়া একটি লড়ু দিল। উৎফুল্ল বালক লড়ু খাইতে খাইতে প্রস্থান করিলে পর, সে জল পান করিয়া গাত্রোত্থান করিল, ভোজ্যের মূল্যস্বরূপ শশিশেখরের থলি হইতে একটি ক্ষুদ্র মুদ্রা লইয়া মোদককে দিল, তারপর তৃপ্তি-মন্থর পদে আবার পথে আসিয়া দাঁড়াইল। গৃহদ্বারে তখন দুই একটি বর্তিকা জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে; গৃহস্থের শুদ্ধান্তঃপুর হইতে ধূপ কালাগুরুর গন্ধ বাতাসে ভাসিতেছে, প্রদীপ-হস্তা পুরনারীগণ বদ্ধাঞ্জলি হইয়া গৃহদেবতার অর্চনা
false
shomresh
যাব। …। ও ভেবেছিল পিসিমা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন, তাই প্রশ্ন করেনি, নিজের ইচ্ছাটা জানিয়েছিল। কিন্তু ও অবাক হয়ে দেখল পিসিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর বললেন, জামাপ্যান্ট পালটে একটা গামছা নিয়ে যা। কেউ চলে গেলে প্রতিবেশীর শুশানবন্ধু হওয়া উচিত। এই প্রথম পিসিমা এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দাদুর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলেন না। গামছা নিয়ে একটা পুরনো শার্ট গায়ে চাড়িয়ে অনি বারান্দায় এসে দাঁড়ানো দাদুর শরীরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে এল। সুনীলদাকে নিয়ে ওরা এতক্ষণ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে দাদু যেন কিছু বললেন পেছন থেকে, কিন্তু তা শোনার জন্য অনিমেষ অপেক্ষা করল না। টাউন ক্লাবের পাশের রাস্তায় শুশানযাত্রীদের ধরে ফেলল। ওরা তেরাস্তার মোড়ে আসতেই অনিমেষ খাটিয়ার পাশে চলে এল। ওপাশের হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তা দিয়ে কয়েকজন ফুল নিয়ে এদিকে আসছিল, তাদের দেখে শুশানযাত্রীরা থামল। যে চার-পাঁচজন এসেছিল তারা ফুলগুলো সুনীলদার বুকে ছড়িয়ে দিতেই একজন বলে উঠল, সুনীল রায়-তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না। চাপা গলায় অদ্ভুত অভিমান নিয়ে বলে-ওঠা এই বাক্যটির জন্য যেন এতক্ষণ সবাই অপেক্ষা করছিল। প্রত্যেকটি মানুষের বুকের এই কথাটা একজনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে সবার মুখ খুলে গেল। চলতে চলতে একজন চাপা গলায় বলল, সুনল রায়-তোমায় আমরা বাকি কণ্ঠগুলো দৃঢ় ভঙ্গিতে পূরণ করল, ভুলছি না, ভুলব না। এই স্বপ্নের মতো জ্যোত্যায়-চুবানো শহরের পথ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে অনিমেষের বুকের মধ্যে অদ্ভুত শিহরন জাগল। আজ রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে না। চন্দ্রদেব তাঁর সবটুকু সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েছেন, কারণ সুনীলদা শেষযাত্রায় চলেছে। শহরের পথে-পথে যারা জানত না এসবের কিছু তারাও উৎসুক হয়ে এবং কিছুটা শ্রদ্ধার সঙ্গে ওদের দেখছিল। শোকযাত্রা: ক্রমশ মিছিলের আকার নিয়ে নিল। অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলে যাচ্ছিল, ভুলব না, ভুলব না। কেন, সে ভুলবে না এই মুহূর্তে ভাববার অবকাশ তার নেই। দিনবাজারের পুল পেরিয়ে বাজারের সামনে দিয়ে ওরা বেগুনটুলির রাস্তায় এসে পড়ল। এতক্ষণ অনিমেষ চুপচাপ হেঁটে আসছিল, এখন চলতে চলতে একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একে ও সুনীলদার কাছে দুএকদিন যেতে দেখেছে। এতক্ষণ সুনীলদাকে কাঁধে নিয়েছিল বলে ওকে লক্ষ করেনি অনিমেষ। সুনীলদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল এর সেদিন। সুনীলদা বলেছিল, পার্লামেন্টরি গণতন্ত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বড়লোরে গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পালটে বড়লোকদের বাঁচাবার জন্য তাদের প্রয়োজনেই এর সৃষ্টি। ছেলেটি বলেছিল, তা হলে আমরা সেটা সমর্থন করেছি কেন? কেন আপনি প্রকাশ্যে তা বলেন? বলার সময় এলে নিশ্চয় বলব। ফোঁড়া না পাকলে অপারেশন করা হয় না। সুনীলদার এই কথা নিয়ে ওদের তর্ক উত্তপ্ত হয়েছিল। অনিমেষ তার সবটা মাথায় রাখতে পারেনি। এখন হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি নিজের মনে বলল, আশ্চর্য, রমলাদি আসেননি! রমলাদি। অনিমেষ মহিলাকে মনে করতে পারল। ওই যে হাতকাটা প্রৌঢ় নরম চেহারার মানুষটি পেছন পেছন হেঁটে আসছেন। তার চেয়ে রমলাদি অনেক বেশি শক্ত হয়ে ছোটকাকার সঙ্গে কথা বলেছিলেন সেই রাত্রে। দলের ছেলে কেউ নিহত হলে কর্মীরা সবাই আসবেই, অতএব স্বাভাবিক কারণেই রমলাদি না আসায় এই ছেলেটিকে ক্ষুন্ন হতে দেখল অনিমেষ। না, একবারও হরিধ্বনি দেয়নি কেউ। এতক্ষণ দমবন্ধ-করা পরিবেশে ওকে না-ভোলার অঙ্গীকার করা হচ্ছিল, হঠাৎ গলাগুলো পালটে গেল। কে যেন চাচাল, লং লিভ সুনীল রায়–লং লিভ লং লিভ। সুনীল রায়ের হত্যাকারীর কালোহাত খুঁড়িয়ে দাও, ভেঙ্গে দাও। হত্যা করে আন্দোলন বন্ধ করা-যায় না, যাবে না। সুনীল রায়কে মারল কারা-কংগ্রেসিরা জবাব দিও। শেষ স্লোগান কানে যেতে থমকে দাঁড়াল অনিমেষ।.ওরা হঠাৎ কী বলতে আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে কংগ্রেসিরা আসছে কী করে! সুনীলদাকে কি কংগ্রেসিরা মেরেছে? কংগ্রেসি মানে ভবানী মাস্টার, হরবিলাসবাবু, কংগ্রেসি মানে বন্দেমাতরম্। আবার চট করে ছোটকাকার মুখ মনে পড়ে গেল ওর, ছোটকাকা কি কংগ্রেসি এখব? ছোটকাকার কাছে লিভারভার থাকে যে! মিছিলটা ওকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন পরে হরবিলাসবাবুর নামটা মনে পড়তেই ওর মনটা কেমন করে উঠল। হরবিলাসবাবুকে সে শহরে আসার পর দেখেছে। এখন আর রাজনীতি করেন না তিনি। প্রথমে নিশীথবাবু পর্যন্ত ওঁর খবর বলতে পারেনি। কংগ্রেস অফিসে আসেন না। এককালে স্বাধীনতা আন্দোলনে এই জেলায় সবচেয়ে যে-মানুষ আলোড়ন তুলেছিলেন, তার কথা। আজ আর কারও মনে নেই। অনিমেষ এক বিকেলে তাকে ডি সি অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিল। ভীষণ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, শরীর ভেঙে পড়েছে আর দারিদ্র্যের ছাপ পোশাক থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ লোভ হয়েছিল সেদিন ছুটে গিয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু যদি চিনতে না পারেন, যদি ভুলে গিয়ে থাকেন সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের সকালে স্বৰ্গছেঁড়ায় তিনি কোন বালককে কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তা হলে? হরবিলাসবাবু ওর সামনে দিয়ে ক্লান্তপায়ে চলে গেলেন, দমবন্ধ করে অনিমেষ দেখল তিনি ওকে চিনতে পারলেন না। চাপা আক্ষেপের মতো দূরে-মিলিয়ে-যাওয়া মিছিলটা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। স্কুলের মাঠে একদিন সিনেমা দেখিয়েছিল ওদের। চেন বেঁধে বিরাট এক দুর্ধর্ষ জন্তুকে নিয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল তাতে। প্রচণ্ড আক্রোশে সে গজরাচ্ছিল, অথচ বন্দি থাকায় সেই মুহূর্তে তার কিছুই করার ছিল না। অনিমেষের মনে হল এই মিছিলটা যেন সেইরকম। এখন রাত কটা কে জানে! কিন্তু একটুও ক্লান্তি লাগছে না ওর। এদিকটায় দোকানপাট কম এবং সেগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চাঁদটা এখন হেলতে মাথার ওপর এসে টুপির মতো বসে আছে। এই নির্জন রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে ওর কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। দুপাশে লোকজন নেই, মাঝে-মাঝে এক-আধটা সাইকেল-রিকশা দ্রুত
false
shomresh
থিতিয়ে যাবেন চূড়ান্ত জয় হয়ে গেল ভেবে। তার কিছুদিন পরে শুরু হবে আসল খেলা। শরীরের শেষবিন্দু রক্ত সক্রিয় থাকতে সেই খেলায় সে হার মেনে নেবে না। বারো বছর বয়সে নেওয়া প্ৰতিজ্ঞাটা আজও তাকে মাঝে মাঝে উম্মাদ করে তোলে। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে শহরে পড়তে আসত। ওরা। গ্রাম থেকে বেরিয়ে পাকদন্ডি দিয়ে ওঠানামা করতে করতে শহরের স্কুল ঠিক সময়েই পৌঁছে যেত। স্কুলটা ছিল গরিব ছেলেমেয়েদের জন্যে। কথাটা সেই সময়েই ওরা শুনেছিল। ত্ৰিভুবন ভাবত বাবা মা গরিব হলে তাদের ছেলেমেয়েকে গরিব বলা হয় কেন? গরিব হওয়া যদি দোষের হয় তাহলে ছেলেমেয়েরা কেন দোষী হবে? পড়াশুনায় ভাল ছিল সে, কিন্তু দেখতে ভাল ছিল অনেক বেশি। সবাই তার দিকে প্ৰশংসার চোখে তাকাত আর সেটা উপভোগ করতে তার মন্দ লগত না। ত্ৰিভুবনের বাবা ছিলেন সাধারণ একজন চাষি। ভুট্টা এবং কফি চাষ করে কোনও মতেই সংসার চলত না বলে একটা দোকান খুলেছিলেন গ্রামে। মা বসতেন। সেই দোকানে। ধার দিয়ে দিয়ে দোকানটাকে ফাঁকা করে ফেলেছিলেন বাবা। আর যাই হোক ব্যবসা করার বুদ্ধি তার ছিল না। বরং ও ব্যাপারে মা ছিলেন অনেক আটসটিও। দোকান খোলার পরই মা বাবার মধ্যে ঝগড়া হতে দেখেছে সে। একবার শহরে মাল কিনতে গিয়ে বাবা আর ফিরে এলেন না। অনেক চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাওয়া গেল না। হাল ছেড়ে দেননি মা। নিজেই দোকান চালাতেন, লোক দিয়ে চাষ করাতেন। তার মা সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু একা হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও পুরুষকে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। একবার পুলিশ বাহিনী গ্রামে এল। ওরা গ্রামে এলেই যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। শুধু গ্রাম-প্রধানকে হাতজোড় করে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। বাহিনীর ক্যাপ্টেন গ্রাম-প্রধানের কাছে খাবার দাবার চাইল। তার ব্যবস্থা হল। তখন তার নজর পড়ল মায়ের মুদির দোকানের ওপর। সরাসরি এসে লোকটা মায়ের কাছে মদ কিনতে চাইল। মা খুবই বিনীত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল যে তিনি মদ বিক্রি করেন না। লোকটা হা হা করে হাসল, পাহাড়ে মুদির দোকান। অথচ লুকিয়ে লুকিয়ে মদ বিক্রি করে না বন্দুক দিয়ে ছবি আঁকার মতো ব্যাপার। ওসব গল্পো ছেড়ে বোতল বের করো। গ্রামপ্ৰধান মায়ের হয়ে বলতে এসে প্রচন্ড ধমক খেল। শেষ পর্যন্ত অসহায় হয়ে মা প্ৰাণের দায়ে গ্রামে যেসব ঘরে চোলাই হয় তাদের দ্বারস্ত হলেন। কিছুটা মদ জোগাড় করে ক্যাস্টেরকে দিয়ে বললেন, এর বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেন লোকটা আর বেশি এগোয়নি। কিন্তু দলটিা চলে যাওয়ামাত্র গ্রামের লোকজন গোলমাল পাকানো শুরু করল না। একজন মেয়ে হয়ে পুলিশের মদ খাইয়েছে, এটা যে কত বড় সামাজিক অপরাধ তা সবাই মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল। বাধ্য হয়ে গ্রাম প্রধান বিচারের আসর বসাল। তাতে রায় দেওয়া হল গ্রামের সবাইকে এক বেলা ভারপেট খাইয়ে দিতে হবে। ব্যাপারটা মায়ের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিল।ওটা করতে গেলে দোকানে আর একটা কণাও থাকবে না। ত্ৰিভুবন তখন ছোট। তার প্রতিবাদ করার শক্তিও হয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে যখন কদিন ধরে গ্রামে বেশ হইচই হচ্ছে তখন দ্বিতীয় পুলিশ বাহিনী এল। মানুষজন যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করলেও মা তার দোকানে চুপচাপ বসে ছিলেন। এই দলের ক্যাপ্টেন লোকটা নিষ্ঠুর চেহারার। গ্রামপ্রধানকে ডেকে বলল, এই সুন্দরী মেয়েটা একা দোকান চালায় নাকি? গ্রামপ্রধান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। ওর স্বামী হারিয়ে গেছে। বাঃ। এখন কার সঙ্গে আছে? ওর ছেলে সঙ্গে থাকে। খুব ভাল কথা। ওকে বলো আজ রাতে আমরা এই গ্রামে থাকছি। আর আমি ওর অতিথি হব। যেন ভাল করে যত্ন করে। নইলে তোমাদের গ্রাম থেকে জনাদশেক ধরে নিয়ে যেতে হবে। তখন জোর করে জোয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিনিপয়সায় সরকারি কাজ করানো হত। কাজ শেষ করে যারা ফিরে আসত তারা বাকি জীবনটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামপ্রধান বিরস মুখে মায়ের কাছে এলে মা চিৎকার করে বললেন, আমি কি রাস্তার মেয়ে যে যাকে তাকে ঘরে তুলব। গ্রামপ্রধান মিনমিন করে বলল, তুমি শুধু একটু যত্ন করো, তোমাকে যে শান্তি দেওয়া হয়েছে তা মাপ করে দেওয়া হবে। কাউকে খাওয়াতে হবে না। ক্যাপ্টেন কথাটা শুনতে পেয়েছিল, বাঃ, এর পর শাস্তিটাস্তিও চাপানো হয়েছে দেখছি। এত সুন্দর মেয়েকে কোন শালা শাস্তি দেয়, অ্যা। কাউকে খাওয়াতে হবে না, শুধু আমাকে খাওয়ালেই চলবে। লোকটা কথা বলতে বলতে দোকানে উঠে মায়ের কাধে হাত রাখতে যেতেই মা ওকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারলেন। লোকটা টাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়ে গিয়ে আচমকা স্থির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পুলিশরা ছুটে গেল দোকানে। ক্যাপ্টেনকে ধরাধরি করে তুলতেই দেখা গেল তাঁর পিঠ থেকে গলগল করে রক্ত পরছে আর সেখানে একটা বঁটির ফলা অনেকটা বিধে রয়েছে। ক্যাপ্টেনের সহকারী ঝটপট মাকে চুলধরে টেনে নীচে নামাতেই ত্ৰিভুবন আড়াল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপীয়ে পড়ল, মারছ কেন? আমার মাকে মারছ কেন তোমরা? মা তো কিছু করেভি। ওই লোকটাই মাকে মারতে গিয়েছিল। ছেড়ে দাও–। ওরা ত্ৰিভুবনকে তুলে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আছাড় খাওয়া মাত্র ত্ৰিভুবনের মনে হল পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেছে। যখন জ্ঞান ফিরল। তখন পুলিশেরা গ্রামে নেই। উঠে বসে সে শুনতে পেল ক্যাপ্টেনের মৃতদেহের সঙ্গে ওরা তাঁর মাকেও ধরে নিয়ে গেছে। সে শুন্য দোকানটার
false
robindronath
বেশি হইয়াছে ; এখন মনে করি, ক্ষতি কী। আমার তো বিপুল বিষয় আছে, আমার কিসের অভাব। যাহার কিছু নাই, সে যদি অহংকার করিয়া সুখী হয়, তাহাতে আমার তো সিকি পয়সার লোকসান নাই, বরং সে বেচারার সান্ত্বনা আছে। ইহাও দেখা গিয়াছে, আমি ব্যতীত আর কেহ কৈলাসবাবুর উপর রাগ করিত না। কারণ এত বড়ো নিরীহ লোক সচরাচর দেখা যায় না। ক্রিয়াকর্মে সুখে দুঃখে প্রতিবেশীদের সহিত তাঁহার সম্পূর্ণ যোগ ছিল। ছেলে হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকেই দেখা হইবামাত্র তিনি হাসিমুখে প্রিয়সম্ভাষণ করিতেন-যেখানে যাহার যে-কেহ আছে সকলেরই কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া তবে তাঁহার শিষ্টতা বিরাম লাভ করিত। এইজন্য কাহারও সহিত তাঁহার দেখা হইলে একটা সুদীর্ঘ প্রশ্নোত্তরমালার সৃষ্টি হইত-“ভালো তো? শশী ভালো আছে ? আমাদের বড়োবাবু ভালো আছেন? মধুর ছেলেটির জ্বর হয়েছিল শুনেছিলুম, সে এখন ভালো আছে তো ? হরিচরণবাবুকে অনেককাল দেখি নি, তাঁর অসুখবিসুখ কিছু হয় নি ? তোমাদের রাখালের খবর কী। বাড়ির এঁয়ারা সকলে ভালো আছেন ?” ইত্যাদি। লোকটি ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাপড়চোপড় অধিক ছিল না, কিন্তু র্মেজাইটি চাদরটি জামাটি, এমনকি বিছানায় পাতিবার একটি পুরাতন র‌্যাপার, বালিশের ওয়াড়, একটি ক্ষুদ্র সতরঞ্চ, সমস্ত স্বহস্তে রৌদ্রে দিয়া, ঝাড়িয়া, দড়িতে খাটাইয়া, ভাঁজ করিয়া, আলনায় তুলিয়া, পরিপাটি করিয়া রাখিতেন। যখনই তাঁহাকে দেখা যাইত তখনই মনে হইত যেন তিনি সুসজ্জিত প্রস্তুত হইয়া আছেন। অল্পস্বল্প সামান্য আসবাবেও তাঁহার ঘরদ্বার সমুজ্জ্বল হইয়া থাকিত। মনে হইত যেন তাঁহার আরো অনেক আছে। ভৃত্যাভাবে অনেক সময় ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া তিনি নিজের হস্তে অতি পরিপাটি করিয়া ধুতি কোঁচাইতেন এবং চাদর ও জামার আস্তিন বহু যতে¦ ও পরিশ্রমে গিলে করিয়া রাখিতেন। তাঁহার বড়ো বড়ো জমিদারি ও বহুমূল্যের বিষয়সম্পত্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু একটি বহুমূল্য গোলাপপাশ, আতরদান, একটি সোনার রেকাবি, একটি রুপার আলবোলা, একটি বহুমূল্য শাল ও সেকেলে জামাজোড়া ও পাগড়ি দারিদ্র্যের গ্রাস হইতে বহু চেষ্টায় তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। কোনো-একটা উপলক্ষ উপস্থিত হইলে এইগুলি বাহির হইত এবং নয়নজোড়ের জগদ্বিখ্যাত বাবুদের গৌরব রক্ষা হইত। এ দিকে কৈলাসবাবু মাটির মানুষ হইলেও কথায় যে অহংকার করিতেন সেটা যেন পূর্বপুরুষদের প্রতি কর্তব্যবোধে করিতেন ; সকল লোকেই তাহাতে প্রশ্রয় দিত এবং বিশেষ আমোদ বোধ করিত। পাড়ার লোকে তাঁহাকে ঠাকুরদামশাই বলিত এবং তাঁহার ওখানে সর্বদা বিস্তর লোকসমাগম হইত ; কিন্তু দৈন্যাবস্থায় পাছে তাঁহার তামাকের খরচটা গুরুতর হইয়া উঠে এইজন্য প্রায়ই পাড়ার কেহ না কেহ দুই-এক সের তামাক কিনিয়া লইয়া গিয়া তাঁহাকে বলিত, “ঠাকুরদামশায়, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখো দেখি, ভালো গয়ার তামাক পাওয়া গেছে।” ঠাকুরদামশায় দুই-এক টান টানিয়া বলিতেন, “বেশ ভাই বেশ তামাক।” অমনি সেই উপলক্ষে ষাট-পঁয়ষট্টি টাকা ভরির তামাকের গল্প পাড়িতেন ; এবং জিজ্ঞাসা করিতেন, সে তামাক কাহারও আস্বাদ করিয়া দেখিবার ইচ্ছা আছে কি না। সকলেই জানিত যে যদি কেহ ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে নিশ্চয় চাবির সন্ধান পাওয়া যাইবে না অথবা অনেক অন্বেষণের পর প্রকাশ পাইবে যে, পুরাতন ভৃত্য গণেশ বেটা কোথায় যে কী রাখে তাহার আর ঠিকানা নাই-গণেশও বিনা প্রতিবাদে সমস্ত অপবাদ স্বীকার করিয়া লইবে। এইজন্যই সকলেই এক বাক্যে বলিত, “ঠাকুরদামশায়, কাজ নেই, সে তামাক আমাদের সহ্য হবে না, আমাদের এই ভালো। শুনিয়া ঠাকুরদা দ্বিরুক্তি না করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতেন। সকলে বিদায় লইবার কালে হঠাৎ বলিয়া উঠিতেন, “সে যেন হল, তোমরা কবে আমার এখানে খাবে বলো দেখি ভাই।” অমনি সকলে বলিত, “সে একটা দিন ঠিক ক’রে দেখা যাবে।” ঠাকুরদামশায় বলিতেন, “সেই ভালো, একটু বৃষ্টি পড়ুক, ঠাণ্ডা হোক, নইলে এ গরমে গুরুভোজনটা কিছু নয়।” যখন বৃষ্টি পড়িত তখন ঠাকুরদাকে কেহ তাঁহার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করাইয়া দিত না ; বরঞ্চ কথা উঠিলে সকলে বলিত, “এই বৃষ্টিবাদলটা না ছাড়লে সুবিধে হচ্ছে না।” ক্ষুদ্র বাসাবাড়িতে বাস করাটা তাঁহার পক্ষে ভালো দেখাইতেছে না এবং কষ্টও হইতেছে এ কথা তাঁহার বন্ধুবান্ধব তাঁহার সমক্ষে স্বীকার করিত, অথচ কলিকাতায় কিনিবার উপযুক্ত বাড়ি খুঁজিয়া পাওয়া যে কত কঠিন সে বিষয়েও কাহারও সন্দেহ ছিল না-এমন কি, আজ ছয়-সাত বৎসর সন্ধান করিয়া ভাড়া লইবার মতো একটি বড়ো বাড়ি পাড়ার কেহ দেখিতে পাইল না-অবশেষে ঠাকুরদামশায় বলিতেন, “তা হোক ভাই, তোমাদের কাছাকাছি আছি এই আমার সুখ। নয়নজোড়ে বড়ো বাড়ি তো পড়েই আছে, কিন্তু সেখানে কি মন টেঁকে।” আমার বিশ্বাস, ঠাকুরদাও জানিতেন যে, সকলে তাঁহার অবস্থা জানে এবং যখন তিনি ভূতপূর্ব নয়নজোড়কে বর্তমান বলিয়া ভান করিতেন এবং অন্য সকলেও তাহাতে যোগ দিত তখন মনে মনে বুঝিতেন যে, পরস্পরের এই ছলনা কেবল পরস্পরের প্রতি সৌহার্দবশত। কিন্তু আমার বিষম বিরক্তি বোধ হইত। অল্প বয়সে পরের নিরীহ গর্বও দমন করিতে ইচ্ছা করে এবং সহস্র গুরুতর অপরাধের তুলনায় নির্বুদ্ধিতাই সর্বাপেক্ষা অসহ্য বোধ হয়। কৈলাসবাবু ঠিক নির্বোধ ছিলেন না, কাজে কর্মে তাঁহার সহায়তা এবং পরামর্শ সকলেই প্রার্থনীয় জ্ঞান করিত। কিন্তু নয়নজোড়ের গৌরবপ্রকাশ সম্বন্ধে তাঁহার কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান ছিল না। সকলে তাঁহাকে ভালোবাসিয়া এবং আমোদ করিয়া তাঁহার কোনো অসম্ভব কথাতেই প্রতিবাদ করিত না বলিয়া তিনি আপনার কথার পরিমাণ রক্ষা করিতে পারিতেন না। অন্য লোকেও যখন আমোদ করিয়া অথবা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নয়নজোড়ের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে বিপরীত মাত্রায় অত্যুক্তি প্রয়োগ করিত, তিনি অকাতরে সমস্ত গ্রহণ করিতেন এবং স্বপ্নেও সন্দেহ করিতেন না যে, অন্য কেহ এ-সকল কথা লেশমাত্র অবিশ্বাস করিতে পারে। আমার এক-এক সময় ইচ্ছা করিত, বৃদ্ধ
false
humayun_ahmed
একটা ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ ধরা পড়ল। ডাক্তাররা আমার আয়ু বেঁধে দিলেন তিন বছর। এইসব খবর তোমাকে দিলাম না। শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিলাম। আসমানী? জ্বি। তুমি মিরাক্যলে বিশ্বাস কর? মিরাকল অর্থাৎ-বাংলা শব্দটা মনে পড়ছে …. অবিশ্বাস্য ধরনের কিছু বলতে পার। বিশ্বাস করি। আমি করতাম না। এখন করি। কারণ পৃথিবীর যে অল্পকিছু লোক ক্যান্সার জয় করেছে আমি তাদের একজন। আজ আমার শরীরে কোনো ক্যান্সার নেই। আজ আমি একজন সুস্থ মানুষ। বলতে-বলতে লোকটি বাঁ হাত আসমানীর কোলের ওপর রেখে আসমানীর দিকে তাকিয়ে হাসল। আসমানী বলল, আপনি দয়া করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান। আপনি তো এ্যাকসিডেন্ট করবেন। আসমানী? জ্বি। আমি জহির সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি তাঁর কাছে নতজানু হয়ে তোমাকে প্রার্থনা করেছি। মানুষটির হৃদয় দেখে আমি মুগ্ধ। তিনি কী বলেছেন শুনতে চাও? ধরা গলায় আসমানী বলল, না, উনি কি বলবেন আমি জানি। রাত প্ৰায় দশটা। জহির রান্না বসিয়েছে। তেলটা খারাপ। প্রচুর ধোঁয়া হচ্ছে। জহিরকে বার-বার চোখ মুছতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে বুঝি খুব কাঁদছে। আসলেই তাই। ধোঁয়া ছাড়াই জহিরের চোখ বারবার ভিজে উঠছে। অরুর শরীরটা খুব খারাপ। আজ তৃতীয় দিন। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত ব্লিডিং হচ্ছে। ছব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। আরও দিতে হবে। আজ সন্ধ্যায়, ডাক্তাররা বলেছেন অবস্থা ভালো না। জহির সারাদিন পাশে বসে ছিল। একসময় অরু বলল, এত মন খারাপ করে আমার পাশে বসে থাকবেন না। আমার পাশে বসতে হলে হাসিমুখে বসতে হবে। জহির বলল, আমি তোমার মতো কথায়-কথায় হাসতে পারি না। ইচ্ছা করেন না তাই পারেন না। ইচ্ছা করলেই পারবেন। জহির বলল, সত্যি করে বল তো তোমার কি খারাপ লাগছে না? অরু ক্লান্ত গলায় বলল, নিজের জন্য লাগছে না, বাচ্চাটার জন্য লাগছে। এত সুন্দর পৃথিবীর কিছুই সে দেখবে না? না দেখেই মরে যাবে? চুপ করে শুয়ে থাক অরু। বেশি কথা বলা বারণ। জহির ভাই, আসমানী কি তার স্বামীর সঙ্গে চলে যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? হ্যাঁ। কিছু বলেছিল? না। অরু বলল, আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ জহির ভাই। কেন বল তো? এই মেয়েটি জনম জনম আপনার জন্য কাঁদবে। এত বড় সৌভাগ্য কজন পুরুষের হয় বলুন? বড্ড ধোঁয়া হচ্ছে। জহির রান্নাঘর থেকে বারান্দায় চলে এল। অবাক হয়ে দেখল বারান্দার রেলিং ধরে আজহার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আকাশের দিকে। জহিরকে দেখেই বললেন, অরুর খুব শখ ছিল তার মেয়ের নাম রাখবে রাত্রি কেন জানেন? কারণ রাত্রি কখনো সূর্যকে পায় না। অবশ্য তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই, কেননা তার আছে অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি। আজহার সাহেব চাদরে চোখ মুছতে-মুছতে বললেন, ভাই আপনাকে একটা খারাপ খবর দিতে এসেছি। আপনি মনটাকে শক্ত করুন। উৎসর্গ কন্যা লীলাবতীকে এই উপন্যাসের নায়িকা লীলা। আমার মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। লীলাবতী কোনোদিন বড় হবে না। আমি কল্পনায় তাকে বড় করেছি। চেষ্টা করেছি ভালোবাসায় মাখামাখি একটি জীবন তাকে দিতে। মা লীলাবতী! নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। ———– ভালোবাসা কী? .–আইনস্টাইন .–শোয়েডিঞ্জার (কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জনক) ভালোবাসাই ঈশ্বর।–ম্যাথমেটিশিয়ান অ্যাবেল ————- ০১. আজ বুধবার। বুধবার হলো মুহিবের মিথ্যাদিবস। মিথ্যাদিসে রাত এগারোটা উনষাট মিনিট পর্যন্ত সে মিথ্যা কথা বলে। তার এই ব্যাপারটা একজন শুধু জানে। সেই একজনের নাম লীলা। লীলার বয়স একুশ। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। বিষয় ইংরেজি সাহিত্য। লীলার সবই সুন্দর। চেহারা সুন্দর, চোখ সুন্দর, মাথার কোঁকড়ানো চুল সুন্দর। ক্লাসে তার একটা নিক নেম আছে— সমুচা। এমন রূপবতী একটা মেয়ের নাম সমুচা কেন সেটা একটা রহস্য। নাম নিয়ে লীলার কোনো সমস্যা নেই। সে বন্ধুদের টেলিফোন করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, আমি সমুচা বলছি। মুহিবের বয়স ত্রিশ। গায়ের রঙ কালো। বেশ কালো কালো ছেলেদের ঝকঝকে সাদা দাঁত হয়। মুহিবের দাঁত ঝকঝকে সাদা। পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট কোম্পানি একবার তাকে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্যে সিলেক্ট করেছিল। ডিরেক্টর সাহেব তাকে দেখে বললেন, এই ছেলের চেহারায় তো কোনো মায়া নেই। চোখ এক্সপ্রেশনলেস। একে দিয়ে হবে না। মুহিব বলল, স্যার, আপনাদের তো মায়ার দরকার নেই। আপনাদের দরকার দাঁত। আমার দাঁত দেখুন। আমি আস্ত সুপারি দাঁত দিয়ে ভাঙতে পারি। একটা সুপারি অনুন, দাঁত দিয়ে ভেঙে দেখাচ্ছি। দশ সেকেন্ডের মামলা। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে দাঁত দিয়ে সুপারি ভাঙ। ফাজিল ছোকরা। মুহিব বিএ পাশ করেছে আট বছর আগে। একবারে সম্ভব হয় নি। দুবার পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ডিভিশন পেয়েছে। রেজাল্ট বের হবার পর মুহিবের বাবা (আলাউদ্দিন আহমদ) ছেলেকে বললেন, বিএ-তে থার্ড ডিভিশন ফেলের চেয়েও খারাপ। কেউ রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলে বলবি, ফেল করেছি। মুহিব বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা। আলাউদ্দিন বললেন, থার্ড ক্লাসের সার্টিফিকেটটা হাতে আসলে ছাগলকে কাঠালপাতার সঙ্গে খেতে দিবি। থার্ড ক্লাস সার্টিফিকেট ছাগলের খাদ্য। মুহিব বলল, ছাগল কোথায় পাব? আলাউদ্দিন বললেন, খুঁজে বের করবি ঢাকা শহরে ছাগলের অভাব আছে? মুহিব বলল, জি আচ্ছা। আলাউদ্দিন বললেন, সকালে আমার সামনে। খবরদার পড়বি না তোর মুখ দেখে দিন শুরু হওয়া মানে দিনটাই নষ্ট। নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবি। আমি ঘর থেকে বের হলে রিলিজ হবি। মনে থাকবে? থাকবে। এখন সামনে থেকে তার সঙ্গে কথা বলা মানে আয়ুক্ষয়। মুহির বাবার সামনে থেকে বের
false
humayun_ahmed
গেছেন। সম্রাট বানিয়ে বানিয়ে জাদুকরের খেলা নিয়ে লিখবেন তা মনে হয় না। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজসভায় (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ) ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নিজেও ছিলেন। তিনিও তার আত্মজীবনীতে বোপ ট্রিকের কথা লিখে গেছেন। তাঁর লেখায় একটি মজার তথ্য আছে। যে সাতজন জাদুকর সেদিন রাজসভায় অদ্ভুত সব জাদু দেখিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন বাঙালি। -র ভাষায় । সম্প্রতি আমার হাতে একটি বই এসেছে (জাদুবিদ্যার মাধ্যমে আপনাআপনি আসে নি, আমি নিউইয়র্ক থেকে কিনেছি), নাম . লেখকের নাম । লেখক ২৫০ পৃষ্ঠার বই লিখে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন রোপ ট্রিক নামের কোনো কৌশল ভারতবর্ষে ছিল না। পুরো বিষয়টি কল্পনাবিলাসী ব্রিটিশদের বানানো। আমি বইটির যুক্তির সঙ্গে একমত হব কি না বুঝতে পারছি না। অকারণে অদ্ভুত এক জাদু নিয়ে মিথ তৈরি হয় না। জুয়েল আইচের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। তিনিও এর সঙ্গে একমত। তারও ধারণা এটা মিথ। সাধারণ মানুষ মিথ তৈরি করতে ভালোবাসে বলেই মিথ তৈরি হয়। জাদুকর পি সি সরকারকে নিয়েও এরকম একটা মিথ আছে। মিথটা এরকম— হলভর্তি দর্শক। সাতটার সময় শো শুরু হওয়ার কথা। পি সি সরকার আসছেন না। তিনি এক ঘণ্টা পর রাত আটটায় উপস্থিত হলেন। দর্শকরা চেঁচাচ্ছে, এক ঘণ্টা লেট। এক ঘণ্টা লেট। পি সি সরকার বললেন, লেট হব কেন? আপনারা ঘড়ি দেখুন। সবাই দেখল, তাদের প্রত্যেকের ঘড়িতে সাতটা বাজে। বলা হয়ে থাকে ঘড়ির এই মিথ ছড়ানোর পেছনে পি সি সরকারের নিজের ভূমিকা আছে। এই মিথ ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে তার উপর চড়াও হয়েছিল। গল্পটা বলা যেতে পারে। পি সি সরকার রঙ্গমঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন। হলভর্তি মানুষ। হঠাৎ দর্শকদের একজন বলল, আমরা ঘড়ির ম্যাজিকটা দেখতে চাই। পি সি সরকার ভান করলেন যেন শুনতে পান নি। তিনি তাঁর জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন। দর্শকদের গুঞ্জন শুরু হলো। এক পর্যায়ে সব দর্শকই বলল, আমরা ঘড়ির জাদু দেখব। অন্য জাদু না।। পি সি সরকারকে জাদু প্রদর্শনী বন্ধ করতে হলো। মিথ হিসেবে পরিচিত ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিকে ফিরে যাই। লাসভেগাসের এক জাদু অনুষ্ঠানে আমি ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক দেখেছি। জাদুকরের নাম মনে নেই। চমৎকার । স্টেজে জাদু দেখানো আর পথেঘাটে জাদু দেখানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক পথেঘাটে দেখানো হতো। আমার দাদাজান মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ দাবি করেন দড়ির জাদুর এই খেলা তিনি শম্ভুগঞ্জের হাটের দিন অনেকের সঙ্গে দেখেছেন। দাদাজান মাদ্রাসার শিক্ষক, কঠিন মৌলানা। মিথ্যা কথা তিনি বলবেন তা কখনো হবে না। তারপরও আমার ধারণা তিনি মিথ্যা বলেছেন। এই ধারণার পিছনে কারণ ব্যাখা করি। দাদাজান গল্প করেছেন আমার সঙ্গে। আমার বয়স তখন পাট কিংবা ছয়। শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বানিয়ে গল্প বলা যেতে পারে। তিনি আমার সঙ্গে একদিন মৎস্যকন্যা দেখার গল্পও করলেন। জেলেদের জালে এক মৎস্যকন্যা ধরা পড়ল। তার কোনো হাত নেই। গাত্রবর্ণ নীল। সে শুশুকের মতো ভোঁস ভোস শব্দ করছিল। মৎস্যকন্যা বলে কিছু নেই। কাজেই মৎস্যকন্যার গল্পটি বানানো। যিনি একটি বানানো গল্প করতে পারেন তিনি আরও বানানো গল্প করতে পারেন। বাকি থাকল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী। এই সম্রাট ডুবে থাকতেন মদ, আফিং এবং চরসের নেশায়। নেশাগ্রস্ত একজন মানুষ কী দেখতে কী দেখেছেন কে জানে! প্রাচীন ভারত ছিল জাদুবিদ্যারই দেশ। বেদেরা জাদু দেখাত, সাধুসন্ন্যাসীরা জাদু দেখাতেন। জাদুর দেশ কামরূপ কামাক্ষা নিয়ে গল্পগাঁথা এখনো চালু। যেসব বিদেশী পর্যটক ভারতবর্ষে এসেছিলেন, মার্কোপোলো ( } তাঁদের একজন। তিনি কাশ্মিরের এক জাদুকরের কথা লিখেছেন, যিনি আবহাওয়া পরিবর্তন করতে পারতেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনকে অন্ধকার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, যা মার্কোপোলো নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। (মার্কোপোলো তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে অনেক আজগুবি কথা লিখে গেছেন। তাঁর বক্তব্য বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর আজগুবি কাহিনীর উদাহরণ : আন্দামানে তিনি একদল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। আচার-আচরণও কুকুরের মতো। তার প্রকাশ্যে যৌনক্রীড়া করে। আবহাওয়া পরিবর্তনকারী জাদুকর এই বাংলাদেশে কিন্তু এখনো আছে। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষায় তাদের ব্যবহার করা হয়। তারা ফকির নামে পরিচিত। এমন একজনের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। তিনি কিছু মন্ত্র বলেছেন, যা আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। আমার স্মৃতিশক্তি মোটামুটি ভালো হলেও বৃতিশক্তি একেবারেই নেই। ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রের প্রথম দুটি লাইন মনে আছে—আলী কালী লালী ত্রিভুবন খালি। মন্ত্রের আলী কি হযরত আলী (রঃ)? কালী কি হিন্দু দেবী? আমি জানি না। লালী কি খালির সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্য? মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীতে ভারতীয় জাদুকরদের অদ্ভুত সব জাদুর কথা আছে। শূন্যে ভেসে থাকা তার একটি। ইবনে বতুতা একবার জাদু দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন এই তথ্যও উল্লেখ আছে। আমারও একবার ম্যাজিক দেখে জ্ঞান হারাবার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শৈশবের গল্প। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। সুযোগ পেলেই একা একা শহরে হেঁটে বেড়াই। মূল আকর্ষণ সিনেমা হলের পোস্টার। একদিন দিলশাদ সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। অদ্ভুত ম্যাজিক। কাঠের এক তার সঙ্গে গা লাগিয়ে দুহাত যীশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ ভঙ্গিতে তুলে এক মায়াকাড়া চেহারার বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরীটির দশ-বার ফুট দূরত্বে চোখ বাঁধা অবস্থায় ম্যাজিশিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতভর্তি চুরি। তিনি বালিকাটির দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুরি ছুড়ে মারছেন। ছুরি বালিকার গা ঘেঁষে বিধে যাচ্ছে, বালিকাটির গায়ে লাগছেন না। তাকে ঘিরে ছুরির বলয় তৈরি হলো। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ম্যাজিক। সেদিনই আমি প্রথম ম্যাজিকের প্রেমে পড়ি। ছুরি ছুড়ে মারার এই
false
toslima_nasrin
নিরন্তর। এই ঝগড়া, এই দ্বন্দ্ব এই মারামারি সত্যিকার অর্থে নারীতে নারীতে নয়, পুরুষে এবং নারীতে। একদল নারী নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে, আরেক দল অধিকারের পক্ষে। একদল পুরুষের পক্ষে, আরেক দল নারীর পক্ষে। ‘মেয়েরা মেয়েদের শত্রু’, এই বাক্যটি পুরুষের তৈরি, এবং একে জনপ্রিয় করার পেছনে পুরুষের আছে বিরাট অবদান। পুরুষ কি পুরুষের শত্রু নয়? হিসেব যদি হয় কে কার শত্রু বেশি, মেয়েরা মেয়েদের যত, তার চেয়ে শতগুণ পুরুষেরা পুরুষদের। এক মেয়ে যখন আরেক মেয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলে, পুরুষেরা খুশি হয়। সেই মেয়েটিকে খুব বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমতী বলে মনে করে। কোনও মেয়ের স্বল্প পোশাক, তার ছেলেবন্ধু, তার পুরুষগমন ইত্যাদি নিয়ে নিন্দা যখন মেয়েরা করে, পুরুষেরা আনন্দ পায়। কারণ এ তাদেরই কথা, মেয়েদের মুখ দিয়ে বলতে শোনে এই যা। মেয়েগুলো তাদেরই মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকা, তাদেরই কপি। কিন্তু ফিমেইল কপি। ফিমেইল বলে আনন্দ বেশি হয়। অন্য কোনও পুরুষ যদি মেয়ের নিন্দা করে, তাতে আনন্দ এত বেশি হয় না। ফিমেইল বলে যে আনন্দ, সেটা অনেকটা যৌনানন্দের মতো। ‘বাড়ির পরিচারিকারা পুরুষের চেয়ে নারী দ্বারা অত্যাচারিত হয় বেশি’ — বেশ জনপ্রিয় একটি অভিযোগ, পুরুষেরা যখন অত্যাচার করে পরিচারিকাদের, তা নিয়ে তত কথা হয় না, নারী হলেই ছি ছি ছ্যাঁ ছ্যাঁ। নারী তো নিয়ন্ত্রিত। নারীর নিয়ন্ত্রণ করার বেশি কিছু নেই। তাই তার নিচে যে আছে, যে পরিচারিকা তাকেই সে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এতে পরিতৃপ্তি কিছুটা হলেও পায়। কিছুটা হলেও তার উচ্চতাকে সে অনুভব করতে পারে। পরিচারিকার জায়গায় পরিচারক হলেও ওই একই ব্যাপার ঘটে। স্বামীর ধর্ষনেচ্ছা যদি পরিচারিকাকে দেখে জাগে, তবে স্ত্রী পরিচারিকাকেই অত্যাচার করে, স্বামীকে নয়। এখানেও সবলকে না পিটিয়ে দুর্বলকে পিটিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করতে হয় নারীদের। সবলকে পেটানোর শক্তি এখনও তারা অর্জন করেনি। নারীকে লজ্জাবতী মায়াবতী, করুণাময়ী স্নেহময়ী ইত্যাদি বিশেষণ এতকাল ধরে এত দেওয়া হচ্ছে যে, লোকে ভুলে যায় নারী রক্তমাংসের মানুষ, পুরুষের মতো অত যুদ্ধবাজ, হিংসুক, প্রতিশোধপরায়ণ, সংকীর্ণমনা, বদ, বদমাশ, নিষ্ঠুর, নির্মম, ভয়ংকর, হিংস্র, নীচ, অশ্লীল, কুটিল না হতে পারলেও নারী কিছুটা তো হতে পারে। নারী তো মানুষ! পুরুষের সঙ্গে এতকাল থেকে কিছুই কি শেখেনি! বাসে যেভাবে দুটাকার পকেটমারকে পুরুষেরা পিটিয়ে লাশ বানায়, তেমন ভাবে নারীরা পেটাতে না পারলেও, একেবারেই যে কাউকে পারেনা পেটাতে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। নারীর নিষ্ঠুরতা দেখে কেন লোকে শংকিত হয়! যেহেতু নারীর কাছ থেকে আশা করা হয় যা প্রচার হয় তা, যে, নারী মাত্রই মমতাময়ী! যেহেতু এই ধারণা মস্তিষ্কে গাঁথা, তাই নিষ্ঠুরতা আগাগোড়া অপ্রত্যাশিত। তাই পুরুষের নিষ্ঠুরতা সইতে পারলেও নারীর নিষ্ঠুরতা অসম্ভব সওয়া! নারীর স্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের জন্য যে সংগ্রাম, তা একটি আদর্শের জন্য সংগ্রাম। এই আদর্শে নারী বিশ্বাসী হতে পারে, পুরুষেরা অবিশ্বাসী হতে পারে। আবার এর উল্টোও হয়। নারী এই আদর্শে বিশ্বাস একেবারেই করে না, কিন্তু পুরুষেরা করে। (পুরুষেরা যারা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম, বিশ্বাসী হলেও স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্তিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুকের সংখ্যা আরও কম।) বিষয়টি নারী সম্পর্কিত হলেও এ কখনই লিঙ্গের ব্যাপার নয়, এ আদর্শের ব্যাপার। সুতরাং আমার নারী-অধিকার বিষয়ক লেখাগুলো যদি সব নারীর পছন্দ না হয়, তবে তো বিস্ময়ের কিছু নেই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এত আহম্মক নয় যে সব নারীকে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে সচেতন করে তুলবে এবং তাদের স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করা মাত্র নারীরা হাত তুলে সমর্থন জানাবে। পরাধীন হয়ে থাকতে থাকতে বেশির ভাগ নারীই পরাধীনতাকে আশ্রয় বলে মনে করে, পরাধীনতার লোহার দেওয়ালের ফুটো গলে যে আলোটুকু আসে, ওটুকুই রোত্রুর তাদের, ওটুকুই স্বাধীনতা। ওটুকুতেই তৃপ্ত তারা। আমি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি, এটা অনেক মেয়ের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। অনেকসময় মেয়েদের স্বাধীনতা বিষয়ে আমি যা বলি, তা মেয়েরা যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি পুরুষেরা বোঝে। বোঝে, কারণ, স্বাধীনতা ভোগ করে পুরুষ অভ্যস্ত, স্বাধীনতার অর্থ তারা তাই জানে। পুরুষেরা আমার লেখার বিরুদ্ধে বলে, কারণ তারা ঠিক জানে আমি কী বলতে চাইছি। নারীরা আমার লেখার বিরুদ্ধাচরণ করে, করে, কারণ তারা ঠিক জানে না আমি কী বলতে চাইছি। দুজনের বিরোধীতার ভাষাটা এক, কারণটা ভিন্ন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ভিকটিম। এ কথা যেমন ঠিক, নারী আত্মঘাতী এটাও ঠিক। আজ যদি নারীরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো, আত্মপরিচয়ের সংকটমোচনে নিজেরা বিচ্ছিন্ন না থেকে সংগঠিত হতো, নারীর সঙ্গে নারীর যোগাযোগ যদি আরও বেশি হত, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যদি বাড়তো, যদি তারা আন্তরিকভাবে পরস্পরের হাতে সহযোগিতার হাত রাখতো, নারীর ক্ষমতায়নে এক নারী আরেক নারীর পাশে দাঁড়াতো, তবে চিড় ধরতো অথবা চুর চুর করে ভেঙে পড়তো পুরুষতন্ত্র। বাসযোগ্য হত জগৎ। ‘অনুরণন’ এবং ‘বং কানেকশান’ নামের দুই অত্যাধুনিক ছবিতে পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই দুটো বাংলা ছবি নিয়ে হৈ চৈ শহরে। চারদিকে বিজ্ঞাপন। লেখালেখি। পরিচালক এবং অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার। বাংলা ছবিতে প্রচুর ইংরেজি সংলাপ দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে ছবিগুলো শিক্ষিত এবং সচেতন শ্রেণীর জন্য, আধুনিক মনের মানুষদের, এবং নতুন প্রজন্মের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ছেলেমেয়েদের, যারা এক বাক্য বাংলা বললে পাঁচ বাক্য ইংরেজি বলে। উচ্চবিত্ত হলে অবশ্য বাংলা উচ্চারণ খুব বিচ্ছিরি রকম হওয়া চাই। অস্বীকার করার উপায় নেই নাগরিক নবীন নবীনাদের চাল চলন চেহারা এমনই।
false
shottojit_roy
সেটা শুনলে হয়তো বাঘেরও চিন্তা হবে। ভদ্রলোক আমাদের খাতির-টগতির করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা প্ৰকাণ্ড বৈঠকখানায় বসানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা ওঁর লেখার প্রশংসা করে বলল, আমি শুধু ঘটনার কথা বলছি না— সেগুলো তো খুবই অদ্ভুত— আমার মনে হয় সাহিত্যের দিক দিয়েও আপনার লেখার আশ্চর্য মূল্য আছে। বেয়ারা আমের শরবত এনে আমাদের সামনে শ্বেতপাথরের নিচু টেবিলের উপর রেখেছিল, মহীতোষবাবু আসুন বলে সেগুলোর দিকে দেখিয়ে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বললেন, অথচ জানেন, আমি সবে এই বছর চারেক হল কলম ধরেছি। আসলে লেখাটা বোধহয় রক্তে ছিল! আমার বাপ-ঠাকুরদা দুজনেই সাহিত্যচৰ্চা করেছেন। অবিশ্যি তার আগে বিশেষ কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। আমরা রাজপুতানার লোক, জানেন তো? ক্ষত্ৰিয়। এক কালে মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। পরে মানুষ ছেড়ে জানোয়ার ধরেছি। এখন অবিশ্যি বন্দুক ছেড়ে একরকম বাধ্য হয়েই কলম ধরেছি। উনি কি আপনার ঠাকুরদা? আমাদের বাঁদিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিং-এর দিকে দেখিয়ে ফেলুদা প্রশ্নটি করল। হ্যাঁ, উনিই আদিত্যনারায়ণ সিংহরায়। একখানা চেহারা বটে। জ্বলজ্বলে চোখ, পঞ্চম জর্জের মতো দাড়ি আর গোঁফ, বা হাতে বন্দুক ধরে ডান হাতটা আলতো করে একটা টেবিলের উপর রেখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে সোজা চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। ঠাকুরদার সঙ্গে বঙ্কিমের চিঠি লেখালেখি ছিল, জানেন? ঠাকুরদা। তখন কলেজে পড়েন। বঙ্গদর্শন বেরোচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্ৰ লিখলেন দেবী চৌধুরানী। আর সেই সূত্রেই ঠাকুরদা চিঠি দিলেন বঙ্কিমকে। দেবী চৌধুরানী তো এই অঞ্চলেরই গল্প— তাই না? ফেলুদা প্রশ্ন করল। তা তো বটেই, মহীতোষবাবু বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এই যে তিস্তা নদী পেরিয়ে এলেন, এই তিস্তাই হল গল্পের ত্রিস্রোতা নদী–যাতে দেবীর বজরা ঘোরাফেরা করত। অবিশ্যি বৈকুণ্ঠপুরের সে জঙ্গল আর নেই; সব চা-বাগান হয়ে গেছে। গল্পে যে রংপুর জেলার কথা বলা হয়েছে, একশো বছর আগে আমাদের এই জলপাইগুড়ি সেই রংপুরের ভেতরেই পড়ত। পরে যখন পশ্চিম ডুয়ার্স বলে নতুন জেলা তৈরি হল, তখন জলপাইগুড়ি পড়ল তার মধ্যে, আর রংপুর হয়ে গেল আলাদা। আপনারা শিকার আরম্ভ করলেন কবে? প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু! মহীতোষবাবু হেসে বললেন, সে এক গল্প। আমার ঠাকুরদার খুব কুকুরের শখ ছিল, জানেন। ভাল কুকুরের খবর পেলেই গিয়ে কিনে আনতেন। এইভাবে জমতে জমতে পঞ্চাশটার উপর কুকুর হয়ে গিয়েছিল আমাদের (বাড়িতে। দিশি বিলিতি ছোট বড় মাঝারি হিংস্র নিরীহ কোনওরকম কুকুর বাদ ছিল না। তার মধ্যে ঠাকুরদার যেটি সবচেয়ে প্রিয় ছিল সেটি একটি ভুটিয়া কুকুর। আমাদের এদিকে জল্পেশ্বরের শিবমন্দির আছে জানেন তো? এককালে সেই মন্দিরকে ঘিরে শিবরাত্রির খুব বড় মেলা বসত। সেই মেলায় বিক্রির জন্য ভুটিয়ারা তাদের দেশ থেকে কুকুর আনত। ইয়া গাবদা গৰ্ব্বদা লোমশ কুকুর। ঠাকুরদা সেই কুকুর একটা কিনে পোষেন। সাড়ে তিন বছর বয়সে সেই কুকুর চিতাবাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারায়। ঠাকুরদার তখন জোয়ান বয়সী। রেখ চাপল বাঘের বংশ ধ্বংস করে শোধ তুলবেন। বন্দুক এল। বন্দুক ছোঁড়া শেখা হল। ব্যস. দেড়শোর উপর শুধু বড় বাঘই মেরেছেন ঠাকুরদা। তাঁর বাইশ বছরের শিকারি জীবনে। তা ছাড়া আরও অন্য কত কী যে মেরেছেন তার হিসেব নেই। আমার আপনি? এ প্রশ্নটাও করলেন লালমোহনবাবু। আমি? মহীতোষবাবু হেসে ঘাড় কত করে ডান দিকে চেয়ে বললেন, বলো না হে শশাঙ্ক। একটি ভদ্রলোক কখন যে ঘরে ঢুকে এক পাশে চেয়ারে এসে বসেছেন তা টেরই পাইনি। টাইগার? মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন নতুন ভদ্রলোকটি, তুমি লিখছ তোমার শিকার কাহিনী, তুমিই বলো না! মহীতোষবাবু এবার আমাদের দিকে ফিরে বললেন, খ্রি। ফিগারসে পৌঁছতে পারিনি, সেটা ঠিকই, তবে তার খুব কমও নয়। বাঘ মেরেছি একাত্তরটা, আর লেপার্ড পঞ্চাশের উপর। মহীতোষবাবু নতুন ভদ্রলোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ইনি হচ্ছেন্ন শশাঙ্ক সানাল। আমার বাল্যবন্ধু। আমার কাঠের কারবারটা ইনিই দেখাশোনা করেন। বন্ধু হলে কী হবে, চেহারায় আর হাবভাবে আশ্চর্য বেমিল। শশাঙ্কবাবু লালমোহনবাবুর মতো বেঁটে না হলেও, পাঁচ ফুট সাত-আট ইঞ্চির বেশি নন, গায়ের রং মাঝারি, কথাবার্তা বলেন নিচু গলায়, দেখলেই মনে হয় চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মানুষ। কোথাও নিশ্চয়ই দুজনের মধ্যে মিল আছে, যেটা এখনও টের পাওয়া যাচ্ছে না। নইলে বন্ধুত্ব হবে কী করে? তড়িৎবাবুর কাছে একটা ম্যান-ইটারের কথা শুনছিলাম, সেটার আর কোনও খবর আছে কি? জিজ্ঞেস করলে ফেলুদা। মহীতোষবাবু একটু নড়েচড়ে বসলেন। ম্যান-ইটার বললেই তো আর ম্যান-ইটার হয় না। আমি থাকলে দেখে ঠিক বুঝতে পারতাম। তবে যে জানোয়ারেই খেয়ে থাক, সে আর দ্বিতীয়বার নরমাংসের প্রতি লোভ প্রকাশ করেনি। ফেলুদা একটু হেসে বলল, যদি সত্যিই ম্যান-ইটার বেরোত, তা হলে আপনি অন্তত সাময়িকভাবে নিশ্চয়ই কলম ছেড়ে বন্দুক ধরতেন। তা ধারতাম। বইকী; আমারই এলাকায় যদি নরখাদক বাঘ উৎপাত আরম্ভ করে তবে তাকে শায়েস্তা করাটা তো আমার ডিউটি! আমাদের শরবত খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মহীতোর্ষবাবু বললেন, আপনারা ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিচ্ছে, আপনারা স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে নিন। বিকেলের দিকে আমার জিপে করে আপনাদের একটু ঘুরিয়ে আনবে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা আছে, হরিণ-টরিণ চোখে পড়তে পারে, এমনকী হাতিও। তড়িৎ, যাও তো, এঁদের ট্রোফি রুমটা একবার দেখিয়ে সোজা নিয়ে যাও এঁদের ঘরে। ট্রোফি রুম মানে বাঘ ভালুক বাইসন হরিণ কুমিরের চামড়া আর মাথায় ভরা একটা বিশাল ঘর। ঘরের মেঝে আর দেওয়ালে তিল ধরার জায়গা নেই। এতগুলো জানোয়ারের জোড়া জোড়া পাথরের চোখ চারিদিক থেকে আমাদের দিকে
false
shunil_gongopaddhay
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, চোপ! সার্কাসে চাকরি করছিলে, তা ছেড়ে এই বাজে খেলায় যোগ দিতে তোমাকে কে বলেছে? কত টাকা পাবে? উঠে দাঁড়াও! কাকাবাবু ক্রাচটা তার বুকের উপর থেকে সরিয়ে নিলেন। সে জেদির মতো বলল, না, উঠব না। এখানেই আমার ডেডবডি পড়ে থাকবে। কাকাবাবু আবার ধমক দিয়ে বললেন, ওঠো বলছি! সে বলল, না উঠলে আপনি কী করবেন? মারবেন তো? মারুন! হেরে গিয়ে আমি দয়া চাই না। কাকাবাবু বললেন, তুমি কী চাও বা না চাও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মানুষ খুন করা আমার কাজ নয়। তুমি যদি না ওঠো, তা হলেও আমি তোমায় প্রাণে মারব না। পায়ে গুলি করব। তুমি চিরকাল খোঁড়া হয়ে থাকবে আমার মতো। সেটা ভাল হবে? ছেলেটি এবার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। কাকাবাবু বললেন, যাও, তোমার কর্নেল ধ্যানচাঁদকে গিয়ে বলো, আজই এই খেলা শেষ করে দিতে। ওর ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমি মোটেই দায়ী নই। তবু আমি হাজারবার ক্ষমা চাইতে রাজি আছি। ছেলেটি বলল, ওসব বলে আর লাভ নেই। একবার এ-খেলা শুরু হলে হেস্তনেস্ত না হলে থামে না। কর্নেল আপনাকে খুন করবেনই। আপনি যদি আমাকে আজ ছেড়েও দেন, তা হলেও আমি আবার আপনাকে মারবার চেষ্টা করব। কাকাবাবু বললেন, এ যে দেখছি, মহা পাজি ছেলে। তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তবে একটুআধটু শাস্তি তো দেওয়া যেতেই পারে। আমার একটা নিয়ম আছে, যে আমার গায়ে হাত তোলে, তাকে আমি কিছু না-কিছু শাস্তি দিই। তুমি আমার গলায় ফাঁস পরিয়েছ, তার জন্য তোমাকে দু-তিনটে থাপ্পড় অন্তত খেতেই হবে। তিনি ছেলেটির চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। তারপর তাকে থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। চেয়ে রইলেন তার চোখের দিকে। গলার আওয়াজ শুনেই তার একটু সন্দেহ হয়েছিল, এখন ওর চোখ দুটো দেখে কাকাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, ছেলে তো নয়, এ যে দেখছি একটি মেয়ে! সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ, মেয়ে, তো কী হয়েছে? মেয়েরা অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারে না? মেয়েরা এখন সব পারে। কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। মেয়েরা সব পারে। এমনকী, মানুষ খুন করতেও পারে। কিন্তু আমি এখনও ওল্ড ফ্যাশৰ্ড। আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে পারি না। তোমাকে যে দু-তিনটে থাপ্পড় মারব ভেবেছিলাম, তা তো আর হচ্ছে না। তা হলে কি আমি তোমায় এমনি এমনি ছেড়ে দেব? মেয়েটি বলল, থাপ্পড় মারতে পারবেন না কেন? মারুন। তারপর আমিও আপনার নাকে এখন একটা ঘুসি মারব? ওরে বাবা, তেজ আছে দেখছি! শোনো, আমি তোমার সম্পর্কে কী ঠিক করলাম। যদি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও, তা হলে তোমাকে এখনই ছেড়ে দেব। আর যদি উত্তর না দিতে চাও, তা হলে আমার গলার ফাসটা খুলে তোমার গলায় পরিয়ে দেব, তারপর তোমাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে আমি চলে যাব। কোনটা চাও? আপনার কী প্রশ্ন, শুনি আগে। তোমার নাম কী? তুমি আমার নাম জানো। অথচ আমি তোমার নাম জানি না, এতে কথাবার্তা বলা যায় না। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার আপত্তি নেই। আমার নাম লায়লা। সুন্দর নাম। তুমি ছেলে সেজে এসেছ কেন? বেশ করেছি। অনেক মেয়েই তো আজকাল প্যান্ট-শার্ট পরে। তুমি সার্কাসে কাজ করো? করতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। সার্কাসের কাজ ছেড়ে তুমি এই কর্নেল ধ্যানচাঁদের সঙ্গে কুৎসিত কাজে যোগ দিয়েছ কেন? সে তোমাকে বেশি টাকা দিচ্ছে? টাকার জন্য নয়। উনি একসময় আমার মাকে একটা খুব বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তোমার মাকে বাঁচিয়েছেন, সেটা খুব ভাল কাজ। মহৎ কাজ। কিন্তু কেউ একটা মহৎ কাজ করার পর যদি একটা খুব খারাপ কাজ করে, কোনও মানুষকে মারতে চায়, তা হলে সে আরও খারাপ লোক হয়ে যায়। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই মানুষের মতো কাজ, আর বিনা কারণে কাউকে খুন করলে সে আর মানুষ থাকে না। জঙ্গলের হিংস্র পশুদের সঙ্গে তার তফাত কী? আপনাকে আর উপদেশ ঝাড়তে হবে না। শুনুন মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি আজ আমাকে ছেড়ে দিলেন কিংবা দয়া করলেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমি যে-কোনও জায়গায়, আবার আপনাকে ধরব। আপনাকে মেরে ফেলা হবেই, এটা সোজাসুজি বলে দিলাম। এটাই আমার ডিউটি। ঠিক আছে, আবার চেষ্টা করে দেখো। সেবারেও যদি না পারো, তখন আমি তোমাকে ধরে ফেললে, কিন্তু আর ছাড়ব না। তখন তোমার হাত-পা বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটা সার্কাসের দলে ভরতি করে দেব। সেখানে তুমি দড়ির উপর ডিগবাজি খাবে। সেখান থেকে যাতে তুমি পালাতে না পারো, সে ব্যবস্থাও করা হবে। এখন যাও, দৌড়োও! আমার চোখের সামনে আর থেকো না! লায়লা সত্যিই এক দৌড় লাগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা বাড়ির আড়ালে। কাকাবাবু এবার খুব সাবধানে গলার ফসটা খুললেন। জিনিসটা খুবই সাংঘাতিক। দড়ির মধ্যে আবার একটা লোহার রিং, তাতে আবার খাঁজকাটা। দড়িটা ধরে জোরে টানলেই গলার মধ্যে একেবারে চেপে বসে যাবে। এই জিনিসটা কাকাবাবু সঙ্গে নিয়ে যেতে চান না। সন্তুদের কাছে ধ্যানচাদের হুমকির কথা কিছুই বলেননি। আজ সকালের এই ঘটনার কথাও তিনি চেপে যাবেন। ওরা এখানে বেড়ানো আর ভূত নিয়ে মজা করার মেজাজে আছে। কী দরকার তা নষ্ট করার! এটা এখানে ফেলে গেলেও কেউ না-কেউ পেয়ে যাবে। সে এটা ব্যবহারও করতে পারে। কাকাবাবু ফাঁসটা হাতে নিয়ে ফিরতে লাগলেন। আসবার পথে তিনি একটা বড় পুকুর দেখেছিলেন। সেটার কাছে এসে
false
bongkim
আমি কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম, রাধারাণী কে? কামাখ্যা বাবুর পুত্র সবিস্তারে পরিচয় দিতে বোধ হয় অনিচ্ছুক ছিলেন; কেবল বলিলেন, ‘আমাদিগের কোন আত্মীয়ার কন্যা |’ যেখানে তাঁহাকে অনিচ্ছুক দেখিলাম, সেখানে আর অধিক পীড়াপীড়ি করিলাম না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলাম, রাধারাণী কেন রুক্মিণীকুমারের সন্ধান করিয়াছিলেন, শুনিতে পাই কি? যদি প্রয়োজন হয় ত বোধ করি, আমি কিছু সন্ধান দিতে পারি। আমি এই কথা বলিলে, তিনি বলিলেন, ‘কেন রাধারাণী রুক্মিণীকুমারকে খুঁজিয়াছিলেন, তাহা আমি সবিশেষ জানি না; আমার পিতৃঠাকুর জানিতেন; বোধ করি, আমার ভগিনীও জানিতে পারেন। যেখানে আপনি সন্ধান দিতে পারেন বলিতেছেন, সেখানে আমার ভগিনীকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে হইতেছে |’ এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। প্রত্যাগমন করিয়া তিনি আমাকে যে পত্র দিলেন, সে পত্র আপনাকে দিয়াছি। তিনি আমাকে সেই পত্র দিয়া বলিলেন, আমার ভগিনী সবিশেষ কিছু ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বলিলেন না, কেবল এই পত্র দিলেন, আর বলিলেন যে, এই পত্র লইয়া তাঁহাকে স্বয়ং রাজপুরে যাইতে বলুন। রাজপুরে যিনি অন্নসত্র দিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বলিবেন। আমি সেই পত্র লইয়া আপনার কাছে আসিয়াছি। কোন অপরাধ করিয়াছি কি?” রাধারাণী বলিলেন, “জানি না। বোধ হয় যে, আপনি মহাভ্রমে পতিত হইয়াই এখানে আসিয়াছেন। আপনার রাধারাণী কে, তাহা আমি চিনি কিনা, বলিতে পারিতেছি না। সে রাধারাণীর কথা কি, শুনিলে বলিতে পারি, আমা হইতে তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যাইবে কি না |” রুক্মিণী সেই রথের কথা সবিস্তারে বলিলেন, কেবল নিজদত্ত অর্থ বস্ত্রের কথা কিছু বলিলেন না। রাধারাণী বলিলেন–“স্পষ্ট কথা মার্জনা করিবেন। আপনাকে রাধারাণীর কোন কথা বলিতে সাহস হয় না; কেন না, আপনাকে দয়ালু লোক বোধ হইতেছে না। যদি আপনি সেরূপ দয়ার্দ্রচিত্ত হইতেন, তাহা হইলে আপনি যে ভিখারী বালিকার কথা বলিলেন, তাহাকে অমন দুর্দশাপন্না দেখিয়া অবশ্য তার কিছু আনুকূল্য করিতেন। কই, আনুকূল্য করার কথা ত কিছু আপনি বলিলেন না?” রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আনুকূল্য বিশেষ কিছুই করিতে পারি নাই। আমি সেদিন নৌকাপথে রথ দেখিতে আসিয়াছিলাম–পাছে কেহ জানিতে পারে, এই জন্য ছদ্মবেশে রুক্মিণীকুমার রায় পরিচয়ে লুকাইয়া আসিয়াছিলাম–অপরাহ্নে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় বোটে থাকিতে সাহস না করিয়া একা তটে উঠিয়া আসিয়াছিলাম। সঙ্গে যাহা অল্প ছিল, তাহা রাধারাণীকেই দিয়াছিলাম; কিন্তু সে অতি সামান্য। পরদিন প্রাতে আসিয়া উহাদিগের বিশেষ সংবাদ লইব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রে আমার পিতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া তখনই আমাকে কাশী যাইতে হইল। পিতা অনেক দিন রুগ্ন হইয়া রহিলেন, কাশী হইতে প্রত্যাগমন করিতে আমার বৎসরাধিক বিলম্ব হইল। বৎসর পরে আমি ফিরিয়া আসিয়া আবার সেই কুটীরের সন্ধান করিলাম–কিন্তু তাহাদিগকে আর সেখানে দেখিলাম না |” রা। একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিতেছে। বোধ হয়, সে রথের দিন নিরাশ্রয়ে, বৃষ্টি বাদলে, আপনাকে সেই কুটীরেই আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। আপনি কতক্ষণ সেখানে অবস্থিতি করিলেন? রু। অধিকক্ষণ নহে। আমি যাহা রাধারাণীর হাতে দিয়াছিলাম, তাহা দেখিবার জন্য রাধারাণী আলো জ্বলিতে গেল–আমি সেই অবসরে তাহার বস্ত্র কিনিতে চলিয়া আসিলাম। রা। আর কি দিয়া আসিলেন? রু। আর কি দিব? একখানি ক্ষুদ্র নোট ছিল, তাহা কুটীরে রাখিয়া আসিলাম। রা। নোটখানি ওরূপে দেওয়া বিবেচনাসিদ্ধ হয় নাই–তাহারা মনে করিতে পারে, আপনি নোটখানি হারাইয়া গিয়াছেন। রু। না, আমি পেন্চসিলে লিখিয়া দিয়াছিলাম, “রাধারাণীর জন্য |” তাহাতে নাম স্বাক্ষর করিয়াছিলাম, “রুক্মিণীকুমার রায় |” যদি সেই রুক্মিণীকুমারকে সেই রাধারাণী অন্বেষণ করিয়া থাকে, এই ভরসায় বিজ্ঞাপনটি তুলিয়া রাখিয়াছিলাম। রা। তাই বলিতেছিলাম, আপনাকে দয়ার্দ্রচিত্ত বলিয়া বোধ হয় না। যে রাধারাণী আপনার শ্রীচরণ দর্শন জন্য–এইটুকু বলিতেই–আ ছি ছি রাধারাণী! ফুলের কুঁড়ির ভিতর যেমন বৃষ্টির জল ভরা থাকে, ফুলটি নীচু করিলেই ঝরঝর করিয়া পড়িয়া যায়, রাধারাণী মুখ নত করিয়া এইটুকু বলিতেই, তাহার চোখের জল ঝরঝর করিয়া পড়িতে লাগিল। অমনই যেদিকে রুক্মিণীকুমার ছিলেন, সেই দিকের মাথার কাপড়টা বেশী করিয়া টানিয়া দিয়া সে ঘর হইতে রাধারাণী বাহির হইয়া গেল। রুক্মিণীকুমার বোধ হয়, চক্ষের জলটুকু দেখিতে পান নাই, কি পাইয়াই থাকিবেন, বলা যায় না। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ বাহিরে আসিয়া, মুখে চক্ষে জল দিয়া অশ্রচিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া, রাধরাণী ভাবিতে লাগিল। ভাবিল, ইনিই ত রুক্মিণীকুমার। আমিও সেই রাধারাণী। দুইজনে দুইজনের জন্য মন তুলিয়া রাখিয়াছি। এখন উপায়? আমি যে রাধারাণী, তা উহাকে বিশ্বাস করাইতে পারি–তার পর? উনি কি জাতি, তা কে জানে। জাতিটা এখনই জানিতে পারা যায়। কিন্তু উনি যদি আমার জাতি না হন! তবে ধর্মবন্ধন ঘটিবে না, চিরন্তনের যে বন্ধন, তাহা ঘটিবে না, প্রাণের বন্ধন ঘটিবে না। তবে আর উঁহার সঙ্গে কথায় কাজ কি? না হয় এ জন্মটা রুক্মিণীকুমার নাম জপ করিয়া কাটাইব। এতদিন সেই জপ করিয়া কাটাইয়াছি, জোয়ারের প্রথম বেগটা কাটিয়া গিয়াছে–বাকি কাল কাটিবে না কি?” এই ভাবিতে ভাবিতে রাধারাণীর আবার নাকের পাটা ফাঁপিয়া উঠিল, ঠোঁট দুখানা ফুলিয়া উঠিল–আবার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। আবার সে জল দিয়া মুখ চোখ ধুইয়া টৌয়ালিয়া দিয়া মুছিয়া ঠিক হইয়া আসিল। রাধারাণী আবার ভাবিতে লাগিল,–“আচ্ছা! যদি আমার জাতিই হন, তা হলেই বা ভরসা কি? উনি ত দেখিতেছি–বয়:প্রাপ্ত–কুমার, এমন সম্ভাবনা কি? তা হলেনই বা বিবাহিত? না! না! তা হইবে না। নাম জপ করিয়া মরি, সে অনেক ভাল–সতীন সহিতে পারিব না। “তবে এখন কর্তব্য কি? জাতির কথাটা জিজ্ঞাসা করিয়াই কি হইবে? তবে রাধারাণীর পরিচয়টা দিই। আর উনি কে, তাহা জানিয়া লই; কেন না, রুক্মিণীকুমার ত ওঁর নাম নয়–তা
false
shottojit_roy
কেনার তাদিগ বেশি, লোকের পকেটে পয়সাও নিশ্চয়ই বেশি। লালমোহনবাবু বেশ সাহেবি কায়দায় কসমোপোলিটান কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কলিমুদ্দির দোকানের সামনে এসে পড়লাম। এ দোকানও চেনা, সালাম বাবু বলে কলিমুদি তার কাজে লেগে গেল। দিব্যি লাগে দু হাতে ঠোঙা ধরে ঝাঁকিয়ে মেশানার ব্যাপারটা। আর সেই সঙ্গে টাটুকী, নোনতা, জিভে-জল আনা গন্ধ। আমি গরম ঠোঙাটা হাতে নিয়েছি, এমন সময় দেখি ওয়ালেট থেকে টাকা বার করতে গিয়ে কী যেন একটা দেখে ফেলুদা একেবারে স্ট্যাচু। কারণটা স্পষ্ট। আমাদের পাশ দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যে লোকটা এই মুহূর্তে মার্কেটের আরও ভিতর দিকে চলে গেল, সে হল মিঃ বাটরার ভূপলিকেট। টুইনস, চাপা গলায় মন্তব্য করলেন জটায়ু। সত্যি, যমজ ছাড়া এ রকম হুবহু মিল কল্পনা করা যায় না। তফাত শুধু শার্টের রঙে। এরটা গাঢ় নীল। হয়তো কাছ থেকে সময় নিয়ে দেখলে আরও তফাত ধরা পড়ত, কিন্তু সেও নিশ্চয়ই খুবই সূক্ষ্ম। অবিশ্যি আরেকটা তফাত এই যে ইনি ফেলুদাকে আদপেই চেনেন না। এতে অবাক হবার কিছু নেই, ফেরাপথে রওনা দিয়ে বলল ফেলুদা, মিঃ বাটরার একটি যমজ ভাই থেকে থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সে আপনার নীলগিরি, বিন্ধ্য, আরাবলী, ওয়েস্টার্ন ঘাটুস—যাই বলুন না কেন, পাহাড়ের মাথায় যদি বরফ না থাকে তাকে আমি পাহাড়ই বলব না। এবার পুজোয় পাহাড়ে যাবার কথাটা ক দিন থেকেই হচ্ছিল। নতুন উপন্যাস বেরিয়ে গেছে, লেখার তাগিদ নেই, তাই লালমোহনবাবু তার সেকেন্ড হ্যান্ড সবুজ অ্যাম্ব্যাসাডারে রোজই বিকেলে আসছেন আডিডা দিতে। কাশ্মীরটা আমাদের কারুরই দেখা হয়নি, কিন্তু ওখানকার অকটোবরের শীত সহ্য হবে না সেটা বোধহয় নিজেই বুঝতে পেরে লালমোহনবাবু দু-একবার কাশ কাশ করে থেমে গেছেন। একটা অ্যাটলাস পড়ে আছে সামনের টেবিলে চা-ডালমুটের পাশে, সেটা খুলে বোধহয় ভারতবর্ষের ম্যাপটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল ভদ্রলোকের, এমন সময় কলিং বেল। শ্ৰীনাথ আমাদের বাড়িতে চোদ্দ বছর কাজ করছে, তাই মিঃ বাটরা এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে আরেক পেয়ালা চা এসে গেল। আপনার কি কোনও যমজ ভাই আছে? বাটরা কপালের ঘাম মুছে রুমালটা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু। মিঃ বাটরার ভুরু যে কতটা ওপরে উঠতে পারে, আর তলার ঠোঁট যে কতটা নীচে নামতে পারে সেটা এই এক প্রশ্নেই বোঝা গেল। আপনারা.আপনারা কী করে…? আপনার সঙ্গে দেখা হবার মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই নিউ মার্কেটেই তাকে দেখেছি আমরা, বলল ফেলুদা। মিস্টার মিটারা – চেয়ারে প্রায় এক হাত এগিয়ে এসে হাতলে একটা জবরদস্ত চাপড় মেরে বললেন মিঃ বাটরা—আই অ্যাম দি ওনলি চাইলন্ড অফ মাই পেরেন্টস। আমার ভাইবোন কিছু নেই। তা হলো–? সেজন্যেই তো আপনার কাছে এলাম মিঃ মিটরা। এক উইকি হল এই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছে। ফ্রম কাঠমাণ্ডু। আমি কাঠমাণ্ডুর একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করি।–সান ট্র্যাভেলস-আই অ্যাম দ্য পি আর ও। আমাকে কাজের জন্য ক্যালকাটা বোম্বাই দিল্লি যেতে হয় মাঝে মাঝে। আমার অফিসের কাছে একটা ভাল রেস্টোরাল্ট আছে-ইন্দিরা-সেখানেই লাঞ্চ করি আমি এভরি ড়ে। লাস্ট ম্যানডে গেছি।-ওয়েটার বলছে, আপনি তো আধঘণ্টা আগে লাঞ্চ করে গেলেন, আবার কী ব্যাপার?–বুঝুন। মিঃ মিটরা। আরও দু-একজন চেনা লোক ছিল, তারাও বলল আমাকে দেখেছে। দেন। আই হ্যাঁড টু টেল দেম-কী আমি আসিনি। তখন ওয়েটার বলে কী, ওর সাসপিশন হয়েছিল, কারণ যে লোক খেতে এসেছিল, হি হাড় এ ফুল লাঞ্চ, উইথ রাইস অ্যান্ড কারি অ্যান্ড এভরিথিং; আর আমি খাই স্রেফ স্যান্ডউইচেজ অ্যান্ড এ কাপ অফ কফি। মিঃ বাটরা দম নিতে থামলেন। আমরা তিনজনেই যাকে বলে উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমোহনবাবু বেশি মনোযোগ দিলে মুখ হাঁ হয়ে যায়, এখনও সেই অবস্থা! মিঃ বাটরা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন। আমি কলকাতায় এসেছি। পরশু, সানডে। কাল সকলে হোটেল থেকে বেরোচ্ছি-আমি আছি গ্র্যান্ডে—ফ্র্যাঙ্ক রসে যাব টু বাইসাম অ্যাসপিরিন। আপনি জানেন বোধহয়, হোটেলের ভিতরেই একটা কিউরিওর দোকান আছে? সেইটের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ শুনি ভিতর থেকে আমায় ডা মিঃ বাটরা, প্লিজ কাম ফর এ মোমেন্ট!—কীি ব্যাপার? গোলাম ভিতরে। সেলসম্যান একটা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দেখাচ্ছে। বলে-মিঃ বাটরা, আপনার এই নোটটা জাল নৌট, নো ওয়াটারমার্ক, প্লিজ। চেঞ্জ ইট —আমার তো মাথায় বাজ পড়ল মিঃ মিটরা! আমি তো দোকানে চুকিইনি! অ্যান্ড দে ইনসিসটেড, কি আমি গেছি আধা ঘণ্টা আগে, আর আমি ওই একশো টাকার নোট দিয়েছি ওদের, অ্যান্ড আই বট এ কুকরি! কুকরি? মানে, নেপালি ছুরি? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু। বুঝুন কী ব্যাপার। আমি থাকি কাঠমাণ্ডুতে; কলকাতায় এসে গ্র্যান্ড হোটেলের দোকান থেকে আমি নেপালের জিনিস কিনব কেন? নেপালে তো ও জিনিস আমি হাফ প্রাইসে পাব? আপনাকে নোটটা বদলে দিতে হল? ফেলুদা প্রশ্ন করল। অনেকবার বললাম, যে আই অ্যাম নট দ্য সোম পারসন। শেষকালে এমন ভাবে আমার দিকে চাইতে লাগল যেন আমি আইদার পাগল, অর ফোর টোয়েন্টি; এ অবস্থায় কী করা যায়, বলুন! হুঁ… ফেলুদা ভাবছে। হাতটা সাবধানে বাড়িয়ে চারমিনারের ডগা থেকে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ছাইট অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে বলল, আপনি বেশ অসহায় বোধ করছেন সেটা বুঝতে পারছি। আমার রেগুলার প্যানিক হচ্ছে, মিঃ মিটরা। সে যে কখন কী করবে তার ঠিক কী? খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, বলল ফেলুদা। —আপনার কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হত যদি না আমরা নিজের চোখে সে লোককে দেখতাম। কিন্তু
false
shorotchandra
আমাকে ভিতরে আনিয়া বসাইল। তাহার পরে কাহারো মুখে কথা নাই—দুজনেই চুপচাপ। আমি প্রথমে কথা কহিলাম। বলিলাম, রোহিণীদা, আর কেন এখানে! চলুন আমার সঙ্গে। রোহিণী জিজ্ঞাসা করিল, কেন? বলিলাম, এখানে আপনার কষ্ট হচ্চে, তাই। রোহিণী কিছুক্ষণ পরে কহিল, কষ্ট আর কি! তা বটে! কিন্তু এ-সকল বিষয়ে ত আলোচনা করা যায় না। কতই-না তিরস্কার করিব, কতই-না সৎপরামর্শ দিব ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছিলাম, সব ভাসিয়া গেল! এত বড় ভালবাসাকে অপমান করিতে পারি—নীতিশাস্ত্রের পুঁথি আমি এত বেশি পড়ি নাই। কোথায় গেল আমার ক্রোধ, কোথায় গেল আমার বিদ্বেষ! সমস্ত সাধুসঙ্কল্প যে কোথায় মাথা হেঁট করিয়া রহিল, তাহার উদ্দেশও পাইলাম না। রোহিণী কহিল, সে প্রাইভেট টিউশানিটা ছাড়িয়া দিয়াছে; কারণ তাহাতে শরীর খারাপ করে। তাহার অফিসটাও ভাল নয়—বড় খাটুনি। না হইলে আর কষ্ট কি! চুপ করিয়া রহিলাম। কারণ এই রোহিণীর মুখেই কিছুদিন পূর্বে ঠিক উল্টা কথা শুনিয়াছিলাম। সে ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া পুনরায় বলিতে লাগিল, আর এই রাঁধাবাড়া, অফিস থেকে ক্লান্ত হ’য়ে এসে ভারি বিরক্তিকর। কি বলেন শ্রীকান্তবাবু? বলিব আর কি! আগুন নিবিয়া গেলে শুধু জলে যে ইঞ্জিন চলে না, এ ত জানা কথা। তথাপি সে এই বাসা ত্যাগ করিয়া অন্যত্র যাইতে রাজী হইল না। কল্পনার ত কেহ সীমানির্দেশ করিয়া দিতে পারে না, সুতরাং সে কথা ধরি না, কিন্তু অসম্ভব আশা যে কোনভাবেই তাহার মনের মধ্যে আশ্রয় পায় নাই, তাহা তাহার কয়টা কথা হইতে বুঝিতে পারিয়াছিলাম। তবুও যে কেন সে এই দুঃখের আগার পরিত্যাগ করিতে চাহে না, তাহা আমি ভাবিয়া পাইলাম না বটে, কিন্তু তাহার অন্তর্যামীর অগোচর ছিল না যে, যে হতভাগ্যের গৃহের পথ পর্যন্ত রুদ্ধ হইয়া গেছে, তাহাকে এই শূন্য ঘরের পুঞ্জীভূত বেদনা যদি খাড়া রাখিতে না পারে, ত ধূলিসাৎ হইতে নিবারণ করিবার সাধ্য সংসারে আর কাহারও নাই। বাসায় পৌঁছিতে একটু রাত্রি হইল। ঘরে ঢুকিয়া দেখি, এক কোণে বিছানা পাতিয়া কে একজন আগাগোড়া মুড়ি দিয়া পড়িয়া আছে। ঝিকে জিজ্ঞাসা করায় কহিল ভদ্দরলোক। তাই আমার ঘরে! আহারাদির পরে এই ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ হইল। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। বছর-চারেক পরে নিরুদ্দিষ্ট ছোট ভাইয়ের সন্ধান মিলিয়াছে। তাহাকেই ঘরে ফিরাইবার জন্য নিজে আসিয়াছেন। তিনি বলিলেন, মশাই, গল্পে শুনি, আগে কামরূপের মেয়েরা বিদেশী পুরুষদের ভেড়া ক’রে ধরে রাখত। কি জানি, সেকালে তারা কি করত; কিন্তু একালে বর্মামেয়েদের ক্ষমতা যে তার চেয়ে একতিল কম নয়, সে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আরও অনেক কথা কহিয়া, তিনি ছোট ভাইকে উদ্ধার করিতে আমার সাহায্য ভিক্ষা করিলেন। তাঁহার এই সাধু উদ্দেশ্য সফল করিতে আমি কোমর বাঁধিয়া লাগিব, কথা দিলাম। কেন, তাহা বলাই বাহুল্য। পরদিন সকালে সন্ধান করিয়া ছোট ভাইয়ের বর্মা-শ্বশুরবাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, বড় ভাই আড়ালে রাস্তার উপর পায়চারি করিতে লাগিলেন। ছোট ভাই উপস্থিত ছিলেন না, সাইকেল করিয়া প্রাতঃভ্রমণে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছিলেন। বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ী নাই, শুধু স্ত্রী তাহার একটি ছোট বোন লইয়া এবং জন-দুই দাসী লইয়া বাস করে। ইহাদের জীবিকা বর্মা-চুরুট তৈরি করা। তখন সকালে সবাই এই কাজেই ব্যাপৃত ছিল। আমাকে বাঙ্গালী দেখিয়া এবং সম্ভবত তাহার স্বামীর বন্ধু ভাবিয়া সমাদরের সহিত গ্রহণ করিল। ব্রহ্ম-রমণীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী; কিন্তু পুরুষেরা তেমনি অলস; ঘরের কাজকর্ম হইতে শুরু করিয়া বাহিরের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সমস্তই মেয়েদের হাতে। তাই লেখাপড়া তাহাদের না শিখিলেই নয়। কিন্তু পুরুষদের আলাদা কথা। শিখিলে ভাল, না শিখিলেও লজ্জায় সারা হইতে হয় না। নিষ্কর্মা পুরুষ স্ত্রীর উপার্জনের অন্ন বাড়িতে ধ্বংস করিয়া বাহিরে তাহারই পয়সায় বাবুয়ানা করিয়া বেড়াইলে, লোকে আশ্চর্য হয় না। স্ত্রীরাও ছি-ছি করিয়া, ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করিয়া অতিষ্ঠ করিয়া তোলা আবশ্যক মনে করে না। বরঞ্চ ইহাই কতকটা যেন তাহাদের সমাজে স্বাভাবিক আচার বলিয়া স্থির হইয়া গেছে। মিনিট-দশেকের মধ্যে ‘বাবুসাহেব’ দ্বিচক্রযানে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গে ইংরাজি পোশাক, হাতে দু-তিনটা আঙটি, ঘড়ি-চেন—কাজকর্ম কিছুই করিতে হয় না—অথচ অবস্থাও দেখিলাম বেশ সচ্ছল। তাঁহার বর্মা-গৃহিণী হাতের কাজ রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া টুপি এবং ছড়িটা হাত হইতে লইয়া রাখিয়া দিল। ছোট বোন চুরুট, দেশলাই প্রভৃতি আনিয়া দিল, দাসী চায়ের সরঞ্জাম এবং অপরে পানের বাটা আগাইয়া দিল। বাঃ—লোকটাকে যে সবাই মিলিয়া একেবারে রাজার হালে রাখিয়াছে! লোকটার নাম আমি ভুলিয়া গিয়াছি। বোধ হয় চারু-টারু এমনি কি-একটা যেন হইবে। যাক্‌ গে, আমরা নাহয় তাঁকে শুধু বাবু বলিয়াই ডাকিব। বাবু প্রশ্ন করিলেন, আমি কে। বলিলাম, আমি তাঁর দাদার বন্ধু। তিনি বিশ্বাস করিলেন না। বলিলেন, আপনি ত কলকেতিয়া, কিন্তু আমার দাদা ত কখনো সেখানে যাননি। বন্ধুত্ব হ’ল ক্যামনে? কেমন করিয়া বন্ধুত্ব হইল, কোথায় হইল, কোথায় আছেন ইত্যাদি সংক্ষেপে বিবৃত করিয়া তাঁহার আসিবার উদ্দেশ্যটাও জানাইলাম এবং তিনি যে ভ্রাতৃরত্নের দর্শনাভিলাষে উদ্‌গ্রীব হইয়া আছেন, তাহাও নিবেদন করিলাম। পরদিন সকালেই আমাদের হোটেলে বাবুটির পদধূলি পড়িল, এবং উভয় ভ্রাতায় বহুক্ষণ কথাবার্তার পরে তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন। সেই হইতেই দুই ভাইয়ের কি যে মিল হইয়া গেল—সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই, বাবুটি দাদা ডাক দিয়া যখন তখন আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন এবং ফিসফিস মন্ত্রণা, আলাপ-আপ্যায়ন, খাওয়া-দাওয়ার আর অবধি রহিল না। একদিন অপরাহ্ণে দাদাকে ও আমাকে চা-বিস্কুট ভোজন করিবার নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করিয়া গেলেন। সেই দিন তাঁহার বর্মা-স্ত্রীর সহিত আমার ভাল করিয়া আলাপ হইল। মেয়েটি অতিশয় সরল, বিনয়ী, এবং ভদ্র। ভালবাসিয়া স্বেচ্ছায় ইহাকে বিবাহ করিয়াছে এবং সেই অবধি বোধ করি একদিনের জন্যেও
false
nihar_ronjon_gupta
হয়ে গেল। ডলি দত্ত বের হয়ে যাবার পর চট্টরাজ কিরীটীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন– রায়সাহেব একবার আমার অফিসে আসতে পারেন? কিরীটী বলল, সন্ধ্যার পর যাব। ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কিরীটী তখুনি বেরুবার জন্যে প্রস্তুত হল। একবার সুশীল চক্রবর্তীর ওখানে যেতে হবে। কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, বেরুচ্ছ নাকি? -হ্যাঁ, একবার সুশীলের ওখানে যাব। —যেতে হবে না দাদা, আমি এসে গিয়েছি–বলে হাসতে হাসতে সুশীল চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। —আরে এসো এসো সুশীল, তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। —বৌদি, কফি— কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সুশীল বললেন, আপনার অনুমানই ঠিক দাদা, ওগুলো হাসিস সিগারেট– —তোমাকে যে বলেছিলাম মালঞ্চর ঘরটা আর একবার ভাল করে সার্চ করতে? –করেছি। কিন্তু ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বা পেথিডিন অ্যাম্পুল তো পেলাম না। —হিসেব যে মিলছে না ভায়া। কিরীটী যেন একটু চিন্তিত। —কি ভাবছেন দাদা! সুশীল চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেন, কিসের কি হিসেব আবার মিলছে না? –ভাবছি তাহলে পেথিডিন অ্যাম্পুল বা একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ পাওয়া গেল কেন? যে পেথিডিন অ্যাডিক্টেড তার ঘরে ঐ দুটি বস্তু থাকবে না তা তো হতে পারে। তবে কি হত্যাকারী কাজ শেষ হয়ে যাবার পর ঐ দুটি বস্তু ঘর থেকে নিয়ে গিয়েছে? তাই যদি হয় তো, আমরা দুটো -য়ে পৌঁছাতে পারি সুশীল। –কি কনক্লশন? প্রথমত, হত্যাকারী নয়, সে মালঞ্চর বিশেষ পরিচিতের মধ্যেই একজন, এবং দ্বিতীয়ত, মালঞ্চ যে পেথিডিন অ্যাডিক্টেড, সেটা সে ভাল করেই জানত, এবং সেটা তার পক্ষে সুবিধাই হয়েছিল। সুশীল চক্রবর্তী কিরীটীর ইঙ্গিতটা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেন বলেন, তাহলে তো ঐ পরিচিত পাঁচজনের মধ্যেই একজন— –হ্যাঁ, মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত মল্লিক, তার বাবু সুরজিৎ ঘোষাল, দীপ্তেন ভৌমিক এবং ডাঃ সমীর রায়, তার পেয়ারের চোরাই কারবারের পার্টনার ও শ্রীমতী ডলি দত্তকিরীটী বললে। কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন সুশীল চক্রবর্তী। –এখন কথা হচ্ছে সুশীল, ওরা সকলেই মালঞ্চর বিশেষ পরিচিত জন হলেও ওরা সকলেই কি জানত যে মালঞ্চ পেথিডিন অ্যাডিক্টেড—এক ডাক্তার ছাড়া? –একসঙ্গে মেলামেশা, একই সূত্রে বাঁধা, একই ইন্টারেস্ট-ওদের সকলের জানাটাই ততা স্বাভাবিক দাদা —কি জানি, হতেও পারে। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সুরজিৎ ঘোষালকে অনায়াসেই ঐ লিস্ট থেকে করা যেতে পারে আপাতত। –কেন? –হাজার হলেও মালঞ্চ সুরজিৎ ঘোষালের কিপিংয়ে ছিল, সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই সুরজিৎ ঘোষালকে ব্যাপারটা জানতে দেবে না, বিশেষ করে সুরজিৎ ঘোষাল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যা জানা গিয়েছে, মদ তো দূরের কথা, ভদ্রলোক স্মোক পর্যন্ত করেন না! মালঞ্চ সম্পর্কে তার চরিত্রের ঐ বিশেষ দুর্বলতাটুকু ছাড়া সত্যিই তিনি একজন যাকে বলে ভদ্রলোক। আজকের সো-কল্ড সোসাইটির কোন ভাইস-ই তার ছিল না। সেদিক দিয়ে বাকী চারজন তোমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত সুশীল।… —ঐ চারজনের মধ্যে কাকে আপনি —সুশীল, মাকড়সার জালে চার-পাঁচটা বিষাক্ত মাকড়সা বিচরণ করছে, এবং ঐ প্রত্যেকটি মাকড়সার ক্ষেত্রেই মালঞ্চকে হত্যা করার যথেষ্ট মোটিভ থাকতে পারে। কাজেই এই মুহূর্তে ওদের চারজনের মধ্যে বিশেষভাবে একজনকে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত হবে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ, সার্কামস্টাসিয়াল এভিডেন্স যাকে বলে, তার দ্বারাই একমাত্র ওদের একজনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা চলতে পারে, অন্য কাউকে নয়। অবিশ্যি বোঝা যাচ্ছে ওরা সকলেই একটা চোরাকারবার চালাত এবং প্রত্যেকেরই ঐ হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে যেমন যাতায়াত ছিল তেমনি ছিল আরো একটা মিটিং প্লেস, ঐ নাইট ক্লাবটি, সেক্ষেত্রে ওদেরই কেউ একজন হত্যাকারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হত্যাকারী বললেই তো হবে না, আপাতদৃষ্টিতে ওদের প্রত্যেকের মোটিভ থাকলেও ঐ সঙ্গে তোমাকে ভাবতে হবে ওদের মধ্যে সে রাত্রে কার পক্ষে মালঞ্চকে হত্যা করা সবচাইতে বেশী সম্ভব ছিল, অর্থাৎ -র দিক থেকে কার উপরে বেশী সন্দেহ পড়ে। তার ওপর করে তুমি যদি এগুতে পারো তাহলেই দেখবে ঐ হত্যারহস্যের কাছাকাছি তুমি পৌঁছে গেছ। হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আরো প্রমাণ চাই, অতএব তোমায় কিছুটা সুতো ছাড়তে হবে—আরো সুতো, তবেই বিরাট কাতলাকে তুমি বঁড়শীতে গাঁথতে পারবে। পরের দিনই সুশীল চক্রবর্তী সকাল আটটা নাগাদ লেক রোডে দীপ্তেন ভৌমিকের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন। দিনটা ছিল রবিবার। লিফটে করে ওপরে উঠে ফ্ল্যাটের কলিং বেলের বোম টিপতেই দরজা খুলে গেল। —ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা মধ্যবয়সী ভৃত্যশ্রেণীর একটি লোক দরজাটা খুলে বলল, কাকে চান? –এখানে দীপ্তেন ভৌমিক থাকেন? —হ্যাঁ। কি নাম বলব সাহেবকে? —বল একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান, বিশেষ জরুরী প্রয়োজন। –বসুন, আমি সাহেবকে খবর দিচ্ছি। তবে রবিবার তো, সাহেব কারো সঙ্গেই দেখা করেন না, আপনার সঙ্গেও দেখা করবেন কিনা জানি না। —একটা কাগজ দাও, আমি আমার নাম লিখে দিচ্ছি— সুশীল চক্রবর্তীর দিকে একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিল বেয়ারা। সুশীল চক্রবর্তী কাগজটিতে নিজের নাম লিখে দিলেন। বেয়ারা কাগজটা নিয়ে চলে গেল। বেশ বড় সাইজের একটি হলঘর, ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট পাতা, বেশ দামী, নরম পুরু কার্পেট। সুন্দরভাবে সাজানো ঘরটি, সোফা সেট, বুককেস, ডিভান, কাঁচের শো কেসে ইংরাজী বাংলা সব বই। দেওয়ালে দীপ্তেন ভৌমিকেরই একটি রঙীন বড় ফটো, জানালা দরজায় দামী পর্দা। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরনে স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে গাউন জড়ানো, মুখে সিগারেট, বের হয়ে এলেন দীপ্তেন ভৌমিক। –আপনি মিঃ চক্রবর্তী? দীপ্তেন প্রশ্ন করল, কি প্রয়োজন আমার কাছে? –বসুন, বলছি। –একটু তাড়াতাড়ি সারতে হবে কিন্তু মিঃ চক্রবর্তী, আমাকে এখুনি আবার একটু বেরুতে হবে। —হিন্দুস্থান রোডের মার্ডার কেসটার ব্যাপারে আপনাকে পুলিসের তরফ থেকে
false
tarashonkor
ভিড় বাড়িতেছে। যাত্রীর দল এখানে-ওখানে জিনিসপত্র মোট-পোটলা লইয়া বসিয়া আছে দাঁড়াইয়া পাঁচজনে জটলা করিতেছে। দুই-চারিজনের চেনামুখও দেবু দেখিতে পাইল। তাহারা সকলেই সদরের লোক; কেহ উকিল, কেহ মোত্তার, কেহ ব্যবসায়ী। দেবু তাহাদের চেনে। সে আমলে দেবুরও মনে হইত, ইহারা সব মাননীয় ব্যক্তি, তাই তাহার মনে পরিচয়ের একটা ছাপ রাখিয়া গিয়াছে। দেবুকে তাহারা চেনে না! হঠাৎ নজরে পড়িল, কঙ্কণার একজন জমিদারবাবুও রহিয়াছেন। দিব্য শতরঞ্জি পাতিয়া প্ল্যাটফর্মের উপরেই আসর জমাইয়া ফেলিয়াছেন, গড়গড়ায় নল দিয়া তামাক টানিতেছেন। ভদ্রলোকের সে আমলের চালটি এখনও ঠিক আছে। যেখানেই যান, গড়গড়া তাকিয়া সঙ্গে যায়—আর গঙ্গাজলের কুঁজা। গঙ্গাজল ছাড়া উনি অন্য কোনো জল খান না। নিয়মিত কাটোয়া হইতে একদিন অন্তর গঙ্গাজল আসে। সেকালে দেবু এই গঙ্গাজলপ্রীতির জন্য ভদ্রলোককে খাতির করিত। যাই হোক, তাহার ওই। নিষ্ঠাটুকু তিনি বজায় রাখিয়াছেন। সে তখন ভাবিত, গঙ্গাজলের ফল কোনো কালেও ফলিবে না। সে আজ হাসিল। –আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? দেবু মুখ ফিরাইয়া দেখিল—তাহার পাশেই দাঁড়াইয়া আছে সস্তা সাহেবি পোশাক-পরা একজন ভদ্রলোক। সাহেবি পোশাক হইলেও ভদ্রলোকটিকে আধময়লা ধুতি-জামা-পরা বাঙালি ভদ্রলোকের মতই মনে হইল, নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানুষ। দেবু বলিল—আমাকে বলছেন? –আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার বাড়ি কি শিবকালীপুর? –হ্যাঁ। কেন বলুন তো? দেবু আন্দাজ করিল, লোকটি গোয়েন্দা বিভাগের লোক। –আপনার নাম বোধহয় দেবনাথ ঘোষ? –হ্যাঁ। দেবুর স্বর রূঢ় হইয়া উঠিল। –একবার এদিকে একটু আসবেন? –কেন? –একটু দরকার আছে। –আপনার পরিচয় জানতে পারি? –নিশ্চয়। আমার নাম জোসেফ নগেন্দ্র রায়। আমি ক্রিস্টান। এখানেই এককালে বাড়ি ছিল কিন্তু পাঁচ-ছ বছর হল আসানসোলে বাস করছি। কাজও করি সেইখানে। এখানে এসেছিলাম আত্মীয়দের বাড়ি, আজ ফিরে যাচ্ছি আসানসোলে। আমার স্ত্রী বললেন– উনি আমাদের পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষ। আপনার কথা তার কাছে অনেক শুনেছি। আপনার জেল এবং ডিটেনশনের সময়ও খবর নিয়েছি এখানে। আজ বুঝি রিলিজড হলেন? দেবু অবাক হইয়া গেল, কিছুই সে বুঝিতে পারি না, শুধু বলিল–হ্যাঁ। —আমার স্ত্রী একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। –আপনার স্ত্রী। –হ্যাঁ। দয়া করে একবার আসতেই হবে। ওই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। দেবু দেখিল—একটি দীর্ঘাঙ্গী শ্যামবৰ্ণ মেয়ে জুতা পায়ে আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে ধবধবে পরিষ্কার একখানি মিলের শাড়ি পরিয়া তাহাদের দিকেই চাহিয়া আছে। পাশেই তাহার আঙুল ধরিয়া আড়াই-তিন বছরের ছোট একটি ছেলে। তাহার খোকনের মত। মেয়েটিকে দেখিয়াই দেবুর মনে বিস্ময়ের চমক লাগিল। কে এ! এ তো চেনা মুখ! বড় বড় চোখে উজ্জ্বল নিৰ্নিমেষ দৃষ্টি, এই টিকলো নাক—ও যে তাহার অত্যন্ত চেনা! কিন্তু কে? অত্যন্ত চেনা মানুষ অপরিচিত আবেষ্টনীর মধ্যে নূতন ভঙ্গিতে অভিনব সজ্জায় সাজিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যার মধ্যে চাপা পড়িয়া গিয়াছে তাহার নাম ও পরিচয়। বিস্মিত স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া দেবু অগ্রসর হইয়া চলিয়াছিল, মেয়েটিও কয়েক পা আগাইয়া আসিল—বোধহয় ঘনিষ্ঠ মুখোমুখি দাঁড়াইতে বিলম্ব তাহার সহ্য হইতেছিল না। হাসিয়া মেয়েটি বলিল—মিতে! পদ্ম! কামার-বউ! দেবুর বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। অপরিসীম বিস্ময়ে সে পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সেই পদ্ম? চোখে জ্বলজ্বল অসুস্থ দৃষ্টি, শঙ্কিত সন্তর্পিত অপরাধীর মত পদক্ষেপ, জীৰ্ণ কাপড়, শীর্ণ দেহ, কণ্ঠস্বরে উন্মা, তিক্ততা, কথায় উগ্রতা—সেই কামার-বউ? পদ্ম আবার বলিল—মিতে! ভাল তো? দেবু আত্মস্থ হইয়া বলিল—মিতেনী? তুমি! –হ্যাঁ। চিনতে পার নি—না? দেবু স্বীকার করিল–না, চিনতে পারি নি। চিনেছি, মন বলছে চিনি, হাসি চেনা, টানা চোখ চেনা, লম্বা গড়ন চেনা—তবু ঠাহর করতে পারছিলাম না–কে। পদ্মের মুখ অপূর্ব আনন্দের হাসিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল—সে শিশুটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া বলিল—আমার ছেলে। এক মুহূর্তে দেবুর চোখে জল ভরিয়া উঠিল। কারণ সে জানে না। চোখ দুইটা যেন স্পর্শকাতর, রস-পরিপূর্ণ ফলের মত পদ্মের ওই দুইটি শব্দের ছোঁয়ায় ফাটিয়া গেল। পদ্মই আবার বলিল–ওর নাম কি রেখেছি জান? দেবু বলিল–কি? –ডেভিড দেবনাথ রায়। পাশ হইতে নগেন রায় বলিল—আপনার নামে নাম রাখা হয়েছে। উনি বলেন ছেলে আমাদের পণ্ডিতের মত মানুষ হবে। দেবু নীরবে হাসিল। পদ্ম দেশের লোকের খবর লইতে আরম্ভ করিল; প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল দুর্গার কথা। দেবু বলিল—ভালই থাকবে। আমি তো আজ তিন বছর পর ফিরছি মিতেনী! পদ্ম বলিল-লক্ষ্মী পুজোর দিন দুর্গার কথা মনে হয়। লক্ষ্মী তো আমাদের নাই; কিন্তু আমাদের জমি আছে, ধান উঠলে নতুন চাল ঘরে এলে পিঠে করি, সে দিন মনে হয়। ষষ্ঠীর দিনে মনে হয়। ষষ্ঠীর কথা মনে পড়ে। দেবু হাসিল। আনন্দে তাহার বুক যেন ভরিয়া গিয়াছে। পদ্মের এই রূপ দেখিয়া তাহার তৃপ্তির আর সীমা নাই।… —এই এই ঘণ্টি মারো, ট্রেন আতা হ্যায়।… দেবু ফিরিয়া দেখিলনীল প্যান্টালুন ও জামা গায়ে একজন লোক লাইন ক্লিয়ারের লোহার গোল ফ্রেমটা হাতে করিয়া চলিয়াছে, মুহূর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল অনি-ভাইকে। সে কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করিতে পারি না, বলিল অনি-ভাই মধ্যে ফিরে এসেছিল। মিতেনী। পদ্ম স্থিরদৃষ্টিতে দেবুর দিকে চাহিয়া রহিল। দেবু বলিল—সে কলকাতায় মিস্ত্রির কাজ করে অনেক টাকা নিয়ে এসেছিল।… বাধা দিয়া পদ্ম বলিলতার কথা থাক্ মিতে। তোমাদের সে কামার-বউ তো এখন আমি নই। তাহার কথা শুনিয়া দেবু আশ্চর্য হইয়া গেল। পদ্মের কথাবার্তার ধারাসুদ্ধ পাল্টাইয়া গিয়াছে। পদ্ম বলিল—সে দুঃখ-কষ্ট—অভাবের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে—সুখের মুখ দেখেছে। শুনে আমার আনন্দ হল। কিন্তু আমি এই সবচেয়ে সুখে আছি পণ্ডিত। আমার খোকন—আমার ঘর-পণ্ডিত, অনেক দুঃখে আমি গড়ে তুলেছি। পরকাল?—বলিয়াই সে হাসিয়া বলিল পরকাল আমার মাথায় থাক্। এ কালেই আমি স্বর্গ পেয়েছি। আমার খোবন!—বলিয়া সে ছেলেটিকে বুকে চাপিয়া ধরিল।
false
humayun_ahmed
আমাকে পছন্দ করেন কি-না আমি জানি না। মনে হয় করেন না। কারণ তিনি কখনোই আমার বার্থডেতে কোনো কার্ড পাঠান নি। এই নিয়ে আমি মোটেও মন খারাপ করি না। কারণ তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ। তাঁকে দিন-রাত ছবি আঁকতে হয়। আমি আমার বাবাকে তিনটা কার্ড পাঠিয়েছি। তিনটা কার্ডের ছবি আমি নিজে এঁকেছি। একটাতে ছিল ক্রিসমাস ট্রি। আরেকটা ছবিতে আমি মাছ মারতে লেক ইওনিতে গিয়েছি। অন্য কার্ডটা শুধু ডিজাইন। কার্ডগুলো পাঠাতে আমার খুবই লজ্জা লাগছিল। কারণ, আমার বাবা কত ভালো ছবি আঁকেন। আর আমি তো ছবি আঁকতেই পারি না। আমি যখন রঙ দেই, তখন একটা রঙের সঙ্গে আরেকটা রঙ মিশে কেমন যেন হয়ে যায়। যদি কখনো বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাহলে আমি তার কাছ থেকে ছবি আঁকা শিখব। আমার আঁকা তিনটা কার্ডের কোনোটাই শেষপর্যন্ত বাবাকে পাঠানো হয় নি, কারণ আমার মা বাবার ঠিকানা জানতেন না। মার কোনো দোষ নেই, কারণ বাবার স্বভাব হচ্ছে দুদিন পর পর বাড়ি বদলানো। বড় বড় শিল্পীরা এরকমই হয়। ভ্যানগ নামের শিল্পীর কোনো বাড়ি-ঘরই ছিল না। আমাদের আর্ট টিচার মিস সুরেনসন বলেছেন— ভ্যানগগ তার প্রেমিকাকে নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন। আমি মনে মনে খুব হেসেছি। কাটা কান কি কাউকে উপহার হিসেবে দেয়া যায়? আমি শব্দ করে হাসি নি কারণ শব্দ করে হাসলে মিস সুরেনসন রাগ করেন। রাগ করলেও আমাদের সবার উচিত শব্দ করে হাসা এবং শব্দ করে কাদা। কারণ তাতে আমাদের লাংস পরিষ্কার থাকে। এই কথাটা আমাদেরকে বলেছেন আমাদের গেম টিচার। আমি যদিও কোনো গেম পারি না, তারপরেও আমি গেম টিচারকে খুব পছন্দ করি। তাকে সবাই ডাকে কনি। কিন্তু তার নাম রিচার্ড বে হাফ। আমি গেম টিচারকে আমার বাবার কথা বলেছি। তিনি বলেছেন–তোমার বাবা তো একজন অতি ভালোমানুষ। তার সঙ্গে আমি দেখা করতে দেখা করা সম্ভব না। কারণ বাবা তো আর আমেরিকায় থাকেন না। বাবা যদি আমেরিকায় থাকতেন তাহলে আমি অবশ্যই বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দিতাম। বাবাকে বলতাম, তুমি মিস্টার কনির একটা পোট্রেট এঁকে দাও। পোট্রেট করার সময় তার গালের কাটা দাগটা মুছে দিও। এই কাটা দাগটা উনি পছন্দ করেন না। মিস্টার কনি আমাকে বলেছেন বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে কখনো মন খারাপ করতে নেই। তুমি দূর থেকে তোমার বাবাকে ভালোবাসবে। তোমার বাবাও দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসবেন। যখন তোমাদের দেখা হবে তখন দেখবে তোমার এবং তোমার বাবার ভালোবাসার মধ্যে রেসলিং শুরু হবে। সব রেসলিং-এ একজন হারে একজন জিতে। এই রেসলিং-এ দুজনই জিতবে। মিস্টার কনি এত মজার মজার কথা বলেন! মজা করে কথা বললেও তিনি আসলে খুবই জ্ঞানী। শওকত তার ছেলের লেখা রচনা অতি দ্রুত একবার শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করল। প্রথমবার পড়তে কোনো সমস্যা হয় নি, দ্বিতীয়বার পড়তে খুব কষ্ট হলো। এক একটা লাইন পড়ে, চিঠি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। কোনো পরিবারে একজন কেউ কানে কম শুনলে বাকি সবাই জোরে কথা বলে। আনিকাদের বাড়ির কেউই কানে কম শোনে না, তারপরেও সবাই জোরে কথা বলে। মনে হয় এ বাড়ির লোকজন সবাই সারাক্ষণ ঝগড়া করছে। শওকত আনিকার কাছে এসেছে। সে বসেছে বারান্দায় পেতে রাখা চৌকিতে। কলাবাগানে মোটামুটি আধুনিক একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় তোষকবিহীন চৌকি পেতে রাখা সাহসের ব্যাপার। আনিকাদের সে সাহস আছে। চৌকিটা বাড়তি বিছানা হিসেবে কাজ করে। হঠাৎ কোনো অতিথি এসে পড়লে চৌকিতে ঘুমুতে দেয়া হয়। পরিবারের কোনো সদস্য রাগ করলে এই চৌকিতে ঝিম ধরে বসে থাকে। আনিকা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমাদের এই চৌকিটার নাম রাগ-চৌকি। তুমি যদি কখনো রাত দুটা-তিনটার সময় আসো, তাহলে দেখবে কেউ না কেউ রাগ করে চৌকিতে বসে আছে। শওকত বলেছিল, দুজন যদি একসঙ্গে রাগ করে, তখন কী হয়? দুজন পাশাপাশি বসে থাকে? আনিকা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার কি ধারণা বাড়িতে আমরা সব সময় ঝগড়া করি? আমাদের সম্পর্কে তোমার এত খারাপ ধারণা? তাদের সম্পর্কে শওকতের ধারণা খুব যে উঁচু তা না। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে সবার মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকার কথা। অথচ শওকত আধঘণ্টা বসে থেকে চড়-থাপ্পড়ের শব্দ শুনেছে। কান্নার শব্দ শুনেছে। আনিকার বাবার গর্জন কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! আমি অবশ্যই তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! যাকে পুঁতে ফেলার কথা বলা হচ্ছে, তার নাম মিতু। আনিকার ছোটবোন। মিতু এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। গত পরশু রাতে সে বাসায় ফিরে নি। বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে বান্ধবীর বাসায় থেকে গেছে। পরদিন জানা গেছে বান্ধবীর জন্মদিন ছিল না। বান্ধবীর বাসায় মিতু থাকে নি। অপরাধ অবশ্যই গুরুতর। শওকত অবাক হয়ে দেখল, কিছুক্ষণের মধ্যে সব স্বাভাবিক। আনিকার বাবা মতিয়ুর রহমান টিভি ছেড়েছেন। সেখানে তারা চ্যানেলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে স্ত্রীকে ছবি দেখার জন্যে ডাকছেন। এই ভদ্রলোক একা কোনো ছবি দেখতে পারেন না। ছবি দেখার সময় তার আশেপাশে সবসময় কাউকে না কাউকে লাগে। এক সময় দর্শকের সন্ধানে তিনি বারান্দায় উঁকি দিয়ে শওকতকে দেখে বললেন, তুমি কখন এসেছ? শওকত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বেশিক্ষণ হয় নি। তুমি চুপি চুপি বারান্দায় এসে বসে থাকবে এটা কেমন কথা! তোমাকে চা-টা দিয়েছে? জি। আনিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে? জি দেখা
false
humayun_ahmed
আপসেট ছিলেন। তিনি চলে যাবার আগে আপনার চেহারার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বলে গিয়েছিলেন যদি আপনাকে আমি বের করতে পারি তা হলে দারুণ একটা উপহার পাব। তার পর থেকে আমি পথে বের হলেই হলুদ পাঞ্জাবি-পরা কাউকে জিজ্ঞেস করি— আপনার নাম কি হিমালয়? ভালো কথা, আপনি আসলেই হিমালয় তো?’ ‘হু— আমিই হিমালয় ।’ “প্রমাণ দিতে পারেন?” ‘পারি— আপনার বাবা যে-বইটা কিনেছিলেন তার নাম- .’ বাবা বলেছিলেন- আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ। আমার কাছে অবিশ্যি তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। ‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ ‘গুলশানের দিকে যাচ্ছি।’ গাড়ির ভেতরে এসি দেয়া- শরীর শীতল হয়ে আসছে। ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি জেগে থাকতে । ঘুম আনার জন্যে মানুষ ভেড়ার পাল গোণে। ঘুম না-আসার জন্যে কিছু কি গোণার আছে? ভয়ংকর কোনো প্রাণী গুনতে শুরু করলে ঘুম কেটে যাবার কথা । আমি মাকড়সা গুণতে শুরু করলাম । একটা মাকড়সা, দুটা মকড়সা, তিনটা- চারটা, পাচটা । সর্বনাশ! পঞ্চাশটা আবার ব্ল্যাক উইডো মাকড়সা- কামড়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু! এত গোণাগুণি করেও লাভ হলো না । মারিয়াদের বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন আমি গভীর ঘুমে অচেতন। মারিয়া এবং তাদের ড্রাইভার দুজন মিলে ডাকাডাকি করেও আমার ঘুম ভাঙাতে পারছে না। মারিয়াদের পরিবারের সঙ্গে এই হচ্ছে আমার পরিচয়ের সূত্র। মারিয়ার বয়স তখন পনেরো। সেদিনই সে প্রথম শাড়ি পরে। শাড়ির রঙ বলেছি কি? ও হ্যাঁ, আগে একবার বলেছি। আচ্ছা আবারও বলি, শাড়ির রঙ জলসত্রের মেয়েদের শাড়ির মতো আকাশি নীল । ঘুম ভেঙে দেখি চোখের সামনে হুলস্থূল ধরনের বাড়ি। প্রথম দর্শনে মনে হলো বাড়িতে আগুন ধরে গেছে। বুকে একটা ছোটখাটো ধাক্কার মতো লাগল। পুরো বাড়ি বোগেনভিলিয়ার গাঢ় লাল রঙে ঢাকা । হঠাৎ ঘুম ভাঙায় ফুলের রঙকে আগুন বলে মনে হচ্ছিল । মারিয়া বলল, বাড়ির নাম মনে করে রাখুন- চিত্ৰলেখা। চিত্ৰলেখা হচ্ছে আকাশের একটা তারার নাম । আমি বললাম, ও আচ্ছা। ‘আজ বাড়িতে কেউ নেই। মা গেছেন রাজশাহী ।’ আমি আবারও বললাম, ও আচ্ছা। ‘আপনি কি টাকাটা নিয়ে চলে যাবেন, না একটু বসবেন?’ ‘টাকা নিয়ে চলে যাব।’ ‘বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন না?’ ‘না ।’ ‘তা হলে এখানে দাঁড়ান।’ আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা আগ্রহ করেই আমাকে এতদূর এনেছে, কিন্তু আমাকে বাড়িতে ঢোকানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমি তাতে তেমন অবাক হলাম না। আমি লক্ষ করেছি বেশিরভাগ মানুষই আমাকে বাড়িতে ঢোকাতে চায় না। দরজার ওপাশে রেখে আলাপ করে বিদায় করে দিতে চায়। রাস্তায়-রাস্তায় দীর্ঘদিন লোকজনদের কেউ ঘরে ঢোকাতে চায় না। রাস্তা-ভাবের লোক রাস্তাতেই ভালো । কবিতা আছে না– বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। আমি সম্ভবত রাস্তাতেই সুন্দর। ‘হিমালয় সাহেব!’ আমি তাকালাম। বাড়ির ভেতর থেকে মারিয়া ইন্সটিমেটিক ক্যামেরা-হাতে বের হয়েছে। বের হতে অনেক সময় নিয়েছে, কারণ সে শাড়ি বদলেছে। এখন পরেছে স্কার্ট। স্কার্ট পরায় একটা লাভ হয়েছে। মেয়েটা যে অসম্ভব রূপবতী তা পরিস্কার হয়ে গেছে। শাড়িতে যেমন অপূর্ব লাগছিল স্কার্টেও তেমন লাগছে। দীর্ঘ সময় গেটের বাইরে রোদে দাড়িয়ে থাকার কষ্ট মেয়েটাকে দেখে একটু যেন কমল । ‘আপনি সূর্যকে সামনে রেখে একটু দাঁড়ান। মুখের উপর সানলাইট পড়ুক । আপনার ছবি তুলব। বাবাকে ছবির একটা কপি পাঠাতে হবে। ছবি দেখলে বাবা বুঝবেন যে, আমি আসল লোকই পেয়েছিলাম।’ ‘হাসব?’ ‘হ্যাঁ, হাসতে পারেন।’ ‘দাঁত বের করে হাসব, না ঠোঁট টিপে?’ ‘যেভাবে হাসতে ভালো লাগে সেভাবেই হাসুন । আর এই নিন টাকা ।’ মারিয়া একশো টাকার দুটা নোট এগায়ে দিল। দুটাই চকচকে নোট। বড়লোকদের সবই সুন্দর। আমি অল্প যে-ক’জন দারুণ বড়লোক দেখেছি তাদের কারও কাছেই কখনো ময়লা নোট দেখিনি। ময়লা নোটগুলি এরা কি ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে ইন্ত্রি করে ফেলে? নাকি ডাক্টবিনে ফেলে দেয়? ‘আমি আপনার বাবাকে একশো টাকা দিয়েছিলাম।’ বাবা বলে দিয়েছেন যদি আপনার দেখা পাই তা হলে যেন দুশো টাকা দিই। কারণ, গ্রন্থসাহেব বই-এ গুরু নানক বলেছেন- দুগুণা দত্তার চৌগুণা জুজার। দুগুণ নিলে চারগুণ ফেরত দিতে হয়। বাবা সামনের মাসের ১৫ তারিখের পর আসবেন । আপনি তখন এলে খুশি হবেন। আর বাবার সঙ্গে কথা বললে আপনার নিজেরও ভালো লাগবে।’ ‘আমার ভালো লাগবে সেটা কী করে বলছেন?’ ‘অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বাবার সঙ্গে যে পাচ মিনিট কথা বলে সে বারবার ফিরে আসে ।” ‘ও আচ্ছা ।’ ‘ও আচ্ছা বলা কি আপনার মুদ্রাদোষ? একটু পরপর আপনি ও আচ্ছা বলছেন।’ ‘কিছু বলার পাচ্ছি না বলে “ও আচ্ছা” বলছি।’ ‘বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসবেন তো?’ ‘আসব।’ ‘আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে- যে-প্রশ্নের জবাব আপনি জানেন না— সেই প্রশ্ন বাবার জন্যে নিয়ে আসতে পারেন। আমার ধারণা, আমার বাবা এই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব প্রশ্নের জবাব জানেন।’ আমি যথাসম্ভব বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বললাম-ও আচ্ছা! মারিয়া বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বাড়ির দারোয়ান গেট বন্ধ করে মোটা মোটা দুই তালা লাগিয়ে দিয়ে জেলের সেন্ট্রির মতো তালা টেনে টেনে পরীক্ষা করতে লাগল। আমি হাতের মুঠোয় দুটা চকচকে নোট নিয়ে চৈত্রের ভয়াবহ রোদে রাস্তায় নামলাম। মারিয়া একবারও বলল না–কোথায় যাবেন বলুন, গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে। বড়লোকদের ঠাণ্ডা গাড়ি মানুষের চরিত্র খারাপ করে দেয়- একবার চড়লে শুধুই চড়তে ইচ্ছা করে। ফিরতে ইচ্ছা করছে না । আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো আষাঢ় মাসে। বৃষ্টিতে ভিজে
false
nazrul
আমার মনে হচ্চে যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। যেদিন চিঠিটা পাই, সেদিনকার রগড়টা শোন আগে। তারপর সব কথা বলচি‌! – পরশু বিকেলে তোর ওই বিন্দে দূতী মহাশয়া যখন আমাদের বাড়ির দোরে শুভ পদার্পণ করচেন, তখন দেখি, এক পাল দুষ্টু ছেলে তার পিছু নিয়েচে আর সুর-বেসুরের আওয়াজে চিৎকার করচে, ‘আকাশে সরষে ফোটে, গোদা ঠ্যাং লাফিয়ে ওঠে!’ আর বাস্তবিকই তাই – ছেলেদেরই বা দোষ কী! বুড়ির পায়ে যে সাংঘাতিক রকমের দুটি গোদ, তা দেখে আমারই আর হাসি থামে না। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যে, আল্‌বোর্জ-পাহাড়-ধ্বংসী রুস্তমের গোর্জের মতো এই মস্ত ঠ্যাং দুটো বয়ে এই মান্ধাতার আমলের পুরানো বুড়ি এত দূর এল কী করে! ভাগ্যিস বোন, ভাইজি তখন দলিজে বসে এসরাজটা নিয়ে ক্যাঁ কোঁ করছিলেন, নইলে এসব পাখোয়াজ ছেলেরা বুড়িকে নিশ্চয়ই সেদিন ‘কীচকবধ’ করে দিত। মাগি রাস্তা চলে যত না হয়রান হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেরেশান হয়েছিল ওই ছ্যাঁচড় ছেলে-মেয়ের দঙ্গলকে সপ্তস্বরে পূর্ণ বিক্রমে গালাগালি করাতে আর ধূলা-বালি ছুঁড়ে তাদের জব্দ করবার বৃথা চেষ্টায়। ঘরে এসে যখন সে বেচারি ঢুকল, তখন তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠচে, ভিজে ঢাকের মতো গলা বসে গেছে! ভাবিজি তাড়াতাড়ি তাকে শরবত করে দেন, মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে তেল দিয়ে পাখা করে দেন, তবে তখন বেচারির ধড়ে জান আসে! ওর সে সময়কার অবস্থা দেখে আমার এত মায়া হতে লাগল! কিন্তু কী করি, আমি তো আর বেরোতে পারিনে ভাই, কেউ আর আমায় অচেনা লোকের কাছে বের হতে দেয় না। ভাইজান বলেন বটে, কিন্তু তাঁর কথা কেউ মানে না। ও নিয়ে আমি কত কেঁদেছি, ঝগড়া করেছি ওঁদের কাছে। লোকে আমায় দেখলে বোধ হয় আমার ‘উচকপালি’ ‘চিরুনদাঁতি’র কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে! না? যাক, – আমি প্রথমে তো তাকে দেখে জানতে পারিনি যে, সে তোদের শাহপুর থেকে আসচে। পরে ভাবিজির কাছে শুনলাম যে, সে তোদের ওখান থেকে জবরদস্ত একখানা চিঠি নিয়ে এসেচে। ভাবিজি প্রথমে তো কিছুতেই চিঠি দিতে চান না, অনেক কাড়াকাড়ি করে না পেরে শেষে যখন জানলাটায় খুব জোরে জোরে মাথা ঠুকতে লাগলাম আর ভাইজান এসে ওঁকে খুব এক চোট বকুনি দিয়ে গেলেন, তখন উনি রেগে চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আমার দিকে। আমার তখন খুশি দেখে কে! রাগলেনই বা, ওঃ উনি রাগলে আমার বয়েই গেল আর কী! তাই বলে আমার চিঠি ওইসব বেহায়া ধাড়িকে পড়তে দিই, – আবদার! এইসব কলহ-কেজিয়া করতেই সাঁঝ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে দোর বন্ধ করে তোর চিঠিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম খানিকটা পড়ে আর পড়তে পারলাম না। আমারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসছিল। আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই মনে ভাবচিস হয়তো যে, আমি এখানে খুবই সুখে আছি। তা নয় সই, তা নয়। তোকে ছেড়ে আমার দিনগুলো যে কীরকম করে কাটচে, তা যদি তুই জানতিস, তাহলে এত দুঃখেও তোর আমার জন্যে কষ্ট হত। আমি যে তোদের ওই শূন্যপুরী ঘরটার দিকে তাকালেই কেঁদে ফেলি বোন! আমাদের ঘরের সব কিছুতেই যে তোর ছোঁয়া এখনও লেগে রয়েছে। তাই মনে হয়, এখানের সকল জিনিসই তোকে হারিয়ে একটা মস্ত শূন্যতা বুকে নিয়ে হা-হা করে কাঁদচে। সেই সঙ্গে আমারও যে বুক ফেটে যাওয়ার জো হয়েছে! – পোড়া কপাল তোর! মামার বাড়িতেও এই হেনস্থা, অবহেলা! যখন যার কপাল পোড়ে, তখন এমনই হয়। তোর পোড়ারমুখি আবাগি মামানিদের কথা শুনে রাগে আমার গা গিসগিস করচে! ইচ্ছে হয়, এই জাতের হিংসুটে মেয়েগুলোর চুল ধরে খুব কষে শ-খানিক দুমাদ্দম কিল বসিয়ে দিই পিঠে, তবে মনের ঝাল মেটে! জানি, ও দেশের মেয়েরা ওইরকম কোঁদুলে হয়। দেখেছিস তো, ও পাড়ার শেখদের বউ দুটো? বাপরে বাপ, ওরা যেন চিলের সঙ্গে উড়ে ঝগড়া করে! মেয়ে তো নয়, যেন কাহারবা! তোদের কথা শুনে মা, ভাবিজি, ভাইজান কত আপশোশ করতে লাগলেন। তোদের উঠে যাওয়ার সময় মা এত করে বুঝালেন তোর মাকে, তা খালাজি কিছুতেই বুঝলেন না। কেন বোন, এও তো তাঁরই বাড়ি! মা-জান সেদিন তোদের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন, আর কত আর্‌মান করতে লাগলেন যে, আমি তো তাদের নিজের করতে চাইলাম, আর জানতামও চিরদিন নিজের বলেই, তা তারা আমাদের এ দাবির তো খাতির রাখলে না। মাহ্‌বুবাকে তো নিজের বেটিই মনে করতাম, তা ওর মা ওকেও আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কী করি, জোর তো নেই!…এই রকম আরও কত আক্ষেপের কথা! এখানে ফিরে আসবার জন্যে মাও ফের চিঠি দেবেন খালাজিকে, আজ ওই নিয়ে ভাইজানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তোর পায়ে পড়ি ভাই, তুই যেন কোনো ল্যাঠা লাগাসনে আর ওরই সাথে। বরং খালাজিকে বুঝিয়ে বলিস, যাতে তিনি থির হয়ে সব কথা ভালো করে বুঝে দেখেন। সত্যি করে বলচি ভাই, তোকে ছেড়ে থাকলে আমি একদম মরে যাব। এই কদিনেই আমার চেহারা কীরকম শুকিয়ে গেচে, তা যদি আসিস, তখন নিজে দেখবি। ভাইজান বলছিলেন, তিনি নিজেই যাবেন পালকি নিয়ে তোদের আনতে। তাই আমার কাল থেকে এত আনন্দ হচ্চে, সে আর কী বলব! এখন, এ-কদিন ধরে যে তোর জন্যে খুবই কান্নাকাটি করেছিলাম, তা মনে হয়ে আমার বড্ড লজ্জা পাচ্চে। সত্যি সত্যিই, ভাবিজি যে বলেন, আমার মতো ধাড়ি মেয়ের এত ছেলেমানুষি আর কাঁদাকাটা বেজায় বাড়াবাড়ি, তাতে কোনোও ভুল নেই। এখন তুই ফিরে আয়
false
robindronath
হইত না, ছোটো দুটি ভাইবোনের মুখ দেখিলে তবে তাঁহার প্রভাত হইত। প্রতিদিন তাহাদিগকে ফুল তুলিয়া দিয়া তবে তিনি স্নান করিতেন। দুই ভাইবোনে ঘাটে বসিয়া তাঁহার স্নান দেখিত। যেদিন সকালে এই দুটি ছেলেমেয়ে না আসিত, সেদিন তাঁহার সন্ধ্যা-আহ্নিক যেন সম্পূর্ণ হইত না। হাসি ও তাতার বাপ মা কেহ নাই। কেবল একটি কাকা আছে। কাকার নাম কেদারেশ্বর। এই দুটি ছেলেমেয়েই তাহার জীবনের একমাত্র সুখ ও সম্বল। এক বৎসর কাটিয়া গেল। তাতা এখন মন্দির বলিতে পারে, কিন্তু এখনও কড়াই বলিতে বলাই বলে। অধিক কথা সে কয় না। গোমতী নদীর ধারে নাগকেশর গাছের তলায় পা ছড়াইয়া তাহার দিদি তাহাকে যে-কোনো গল্পই করিত, সে তাহাই ড্যাবাড্যাবা চোখে অবাক হইয়া শুনিত। সে গল্পের কোনো মাথামুণ্ডু ছিল না; কিন্তু সে যে কী বুঝিত সেই জানে; গল্প শুনিয়া সেই গাছের তলায়, সেই সূর্যের আলোতে , সেই মুক্ত সমীরণে, একটি ছোটো ছেলের ছোটো হৃদয়টুকুতে যে কত কথা কত ছবি উঠিত তাহা আমরা কী জানি। তাতা আরেকোনো ছেলের সঙ্গে খেলা করিত না, কেবল তাহার দিদির সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো বেড়াইত। আষাঢ় মাস। সকাল হইতে ঘন মেঘ করিয়া রহিয়াছে। এখনও বৃষ্টি পড়ে নাই, কিন্তু বাদলা হইবার উপক্রম দেখা যাইতেছে। দূরদেশের বৃষ্টির কণা বহিয়া শীতল বাতাস বহিতেছে। গোমতী নদীর জলে এবং গোমতী নদীর উভয় পারের অরণ্যে অন্ধকার আকাশের ছায়া পড়িয়াছে। কাল রাত্রে অমাবস্যা ছিল, কাল ভুবনেশ্বরীর পূজা হইয়া গিয়াছে। যথাসময়ে হাসি ও তাতার হাত ধরিয়া রাজা স্নান করিতে আসিয়াছেন। একটি রক্তস্রোতের রেখা শ্বেত প্রস্তরের ঘাটের সোপান বাহিয়া জলে গিয়া শেষ হইয়াছে। কাল রাত্রে যে এক-শো-এক মহিষ বলি হইয়াছে তাহারই রক্ত। হাসি সেই রক্তের রেখা দেখিয়া সহসা একপ্রকার সংকোচে সরিয়া গিয়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কিসের দাগ বাবা!” রাজা বলিলেন, “রক্তের দাগ মা!” সে কহিল, “এত রক্ত কেন!” এমন একপ্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল “এত রক্ত কেন”, যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল, “এত রক্ত কেন!” তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন। বহুদিন ধরিয়া প্রতিবৎসর রক্তের স্রোত দেখিয়া আসিতেছেন, একটি ছোটো মেয়ের প্রশ্ন শুনিয়া তাঁহার মনে উদিত হইতে লাগিল, “এত রক্ত কেন!” তিনি উত্তর দিতে ভুলিয়া গেলেন। অন্য মনে স্নান করিতে করিতে ঐ প্রশ্নই ভাবিতে লাগিলেন। হাসি জলে আঁচল ভিজাইয়া সিঁড়িতে বসিয়া ধীরে ধীরে রক্তের রেখা মুছিতে লাগিল, তাহার দেখাদেখি ছোটো হাত দুটি দিয়া তাতাও তাহাই করিতে লাগিল। হাসির আঁচলখানি রক্তে লাল হইয়া গেল। রাজার যখন স্নান হইয়া গেল, তখন দুই ভাইবোনে মিলিয়া রক্তের দাগ মুছিয়া ফেলিয়াছে। সেইদিন বাড়ি ফিরিয়া গিয়া হাসির জ্বর হইল। তাতা কাছে বসিয়া দুটি ছোটো আঙুলে দিদির মুদ্রিত চোখের পাতা খুলিয়া দিবার চেষ্টা করিয়া মাঝে মাঝে ডাকিতেছে, “দিদি!” দিদি অমনি সচকিতে একটুখানি জাগিয়া উঠিতেছে। “কী তাতা” বলিয়া তাতাকে কাছে টানিয়া লইতেছে; আবার তাহার চোখ ঢুলিয়া পড়িতেছে। তাতা অনেক ক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া দিদির মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, কোনো কথাই বলে না। অবশেষে অনেক ক্ষণ পরে ধীরে ধীরে দিদির গলা জড়াইয়া ধরিয়া দিদির মুখের কাছে মুখ দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, “দিদি, তুই উঠবি নে?” হাসি চমকিয়া জাগিয়া তাতাকে বুকে চাপিয়া কহিল, “কেন উঠব না ধন!” কিন্তু দিদির উঠিবার আর সাধ্য নাই। তাতার ক্ষুদ্র হৃদয় যেন অত্যন্ত অন্ধকার হইয়া গেল। তাতার সমস্ত দিনের খেলাধুলা আনন্দের আশা একেবারে ম্লান হইয়া গেল। আকাশ অত্যন্ত অন্ধকার, ঘরের চালের উপর ক্রমাগতই বৃষ্টির শব্দ শুনা যাইতেছে, প্রাঙ্গণের তেঁতুল গাছ জলে ভিজিতেছে, পথে পথিক নাই। কেদারেশ্বর একজন বৈদ্যকে সঙ্গে করিয়া আনিল। বৈদ্য নাড়ি টিপিয়া অবস্থা দেখিয়া ভালো বোধ করিল না। তাহার পরদিন স্নান করিতে আসিয়া রাজা দেখিলেন, মন্দিরে দুইটি ভাইবোন তাঁহার অপেক্ষায় বসিয়া নাই। মনে করিলেন, এই ঘোরতর বর্ষায় তাহারা আসিতে পারে নাই। স্নান-তর্পণ শেষ করিয়া শিবিকায় চড়িয়া বাহকদিগকে কেদারেশ্বরের কুটিরে যাইতে আজ্ঞা দিলেন। অনুচরেরা সকলে আশ্চর্য হইয়া গেল, কিন্তু রাজাজ্ঞার উপরে আর কথা কহিতে পারিল না। রাজার শিবিকা প্রাঙ্গণে গিয়া পৌঁছিলে কুটিরে অত্যন্ত গোলযোগ পড়িয়া গেল। সে গোলমালে রোগীর রোগের কথা সকলেই ভুলিয়া গেল। কেবল তাতা নড়িল না, সে অচেতন দিদির কোলের কাছে বসিয়া দিদির কাপড়ের এক প্রান্ত মুখের ভিতর পুরিয়া চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। রাজাকে ঘরে আসিতে দেখিয়া তাতা জিজ্ঞাসা করিল, “কী হয়েছে?” উদ্বিগ্নহৃদয় রাজা কিছুই উত্তর দিলেন না। তাতা ঘাড় নাড়িয়া নাড়িয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল, “দিদির নেগেছে?” খুড়ো কেদারেশ্বর কিছু বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, “হাঁ, লেগেছে।” অমনি তাতা দিদির কাছে গিয়া দিদির মুখ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়া গলা জড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি, তোমার কোথায় নেগেছে?” মনের অভিপ্রায় এই যে, সেই জায়গাটাতে ফুঁ দিয়া , হাত বুলাইয়া, দিদির সমস্ত বেদনা দূর করিয়া দিবে। কিন্তু যখন দিদি কোনো উত্তর দিল না তখন তাহার আর সহ্য হইল না–ছোটো দুইটি ঠোঁট উত্তরোত্তর ফুলিতে লাগিল, অভিমানে কাঁদিয়া উঠিল। কাল হইতে বসিয়া আছে, একটি কথা নাই কেন! তাতা কী করিয়াছে যে, তাহার উপর এত অনাদর! রাজার সম্মুখে তাতার এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া কেদারেশ্বর অত্যন্ত শশব্যস্ত হইয়া উঠিল। সে বিরক্ত হইয়া তাতার হাত ধরিয়া অন্য ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। তবুও দিদি কিছু বলিল না। রাজবৈদ্য আসিয়া সন্দেহ প্রকাশ করিয়া গেল। রাজা সন্ধ্যাবেলায় আবার হাসিকে দেখিতে আসিলেন। তখন বালিকা প্রলাপ বকিতেছে।
false
toslima_nasrin
করে ঘুরে বেড়াব, কখন প্রিয় প্রিয় কবিদের সঙ্গে কলকাতায় জমিয়ে আড্ডা দেব, এই তাড়া। লোকটি আমার পাসপোর্ট থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকান। আবার পাসপোর্টে চোখ, আবার আমার মুখে। এরপর পকেট থেকে একটি ছোট কাগজ বের করে একবার কাগজে চোখ, আরেকবার পাসপোর্ট। লোকটি আমাকে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যান ইমিগ্রেশনের কোনও বড় কর্তার ঘরের দিকে। বড় কর্তা আর লোকটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কিছু কথা বলেন। কি কথা বলেন কে জানে! আমার পাসপোর্ট নিয়ে কি কথা বলার থাকতে পারে! পাসপোর্টে যে ছবি, সে তো আমারই ছবি। পাসপোর্টে যে নাম ঠিকানা সে তো আমারই নাম ঠিকানা। তবে কিসের এত কানাকানি কথা! লোকটি ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চাকরি করেন? হ্যাঁ করি। কোথায়? ঢাকা মেডিকেলে। বিদেশে যাওয়ার পারমিশান আছে আপনার? বিদেশে যেতে আবার কারও পারমিশান লাগে নাকি! লোকটি আমাকে বলেন না কার পারমিশান লাগে। কেবল বলেন, অনুমতি না থাকলে আপনার যাওয়া হবে না। আমরা বড় কর্তার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ঘটনা কি। ঘটনা কি তিনিও বুঝিয়ে বলেন না। বড় কর্তার সামনের তিনটে চেয়ারে আমরা বসি। আমি, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী। পেছনে দাঁড়িয়ে রবিউল হুসাইন। দরজার বাইরে বাকি কবিরা। বড় কর্তার বোধহয় মায়া হয় আমাদের দেখে। কত চোর ছেঁচড় গুণ্ডা বদমাশকে পার করে দিচ্ছেন তিনি, অথচ যে মানুষ দল বেঁধে কবি সম্মেলনে যাচ্ছে, তাকে আটকাতে হচ্ছে। তিনি আমাদের দিকে একটি টেলিফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওপর থেকে কেউ ফোনে অর্ডার করলে আমরা ছেড়ে দেব।’ টেবিলে দুটো টেলিফোন ছিল। আরেকটি টেলিফোন ঘন ঘন বাজছে, বড় কর্তা রিসিভার কানে নিয়ে ঘন ঘনই বলছেন, ‘জি সার উনি এখানেই, জি স্যার আমার সামনেই বসে আছে, জি স্যার যেতে দেওয়া হচ্ছে না, জি স্যার ঠিক আছে।’ বড় কর্তা কি আমার কথা বলছেন ফোনের ওপারের স্যারকে! আমার সন্দেহ হয়, তিনি আমার কথাই বলছেন। ওই স্যারটি নিশ্চয়ই আগে থেকেই কোনও আদেশ দিয়ে রেখেছেন যেন আমাকে যেতে বাধা দেওয়া হয়। এদিকে বেলাল চৌধুরী আর শামসুর রাহমান ওপরের মানুষগুলোকে এক এক করে খুঁজছেন মরিয়া হয়ে। সে যে কী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বেলাল চৌধুরী বললেন, ‘হেলথ সেক্রেটারি আমাদের বন্ধু, তাঁকে একবার পাওয়া গেলে কোনও সমস্যা নেই।’ বার বার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। বেলাল চৌধুরী আইজির নম্বরে ফোন করেন, আইজি নেই। শামসুর রাহমান তাঁর এক মন্ত্রী বন্ধুকে ফোন করেন, তিনি ঢাকার বাইরে। সময় দ্রুত এগোচ্ছে। উড়োজাহাজে উঠে গেছে সব যাত্রী। কবির দলটি কেবল বাকি। মনকে বলছি, স্থির হও, দুর্যোগ কেটে যাবে। কিন্তু মন কিছুতে স্থির হচ্ছে না। সময় যাচ্ছে, নির্দয় সময় সামান্য করুণা করছে না আমাদের। টেলিফোনে আঙুলের অনবরত সঞ্চালনের পর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল কবি ইমরান নূরকে। তিনিই স্বাস্থ্য সচিব। ওপরের লোক। স্বস্তির একটি শ্বাস ফেলি আমরা। আমাদের ঠোঁট থেকে উড়ে যাওয়া হাসিটি চকিতে ফিরে আসে। শামসুর রাহমান বললেন, ‘আমরা কলকাতা যাচ্ছি, কিন্তু তসলিমাকে যেতে দিচ্ছে না, আপনি এদের বলে দিন যেন ওকে যেতে দেয়। আপনি বলে দিলেই হবে।’ ইমরান নূর কথা বলতে চাইলেন বড় কর্তার সঙ্গে। সাংকেতিক কথা কি না জানি না, আমাদের কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না কি কথা তাঁরা বলেন। বড় কর্তা কথা শেষ করে শামসুর রাহমানকে দিলেন রিসিভার। ইমরান নূর জানিয়ে দিলেন, ‘তসলিমার যাওয়া হচ্ছে না।’ ‘কেন যাওয়া হচ্ছে না?’ ‘দেশের বাইরে যেতে গেলে পারমিশান লাগবে সরকারের।’ ‘সেটা আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি এখন এদের বলে দিলে কি হয় না?’ ‘না হয় না।’ ‘কিছুতেই কি হবে না? দেখুন একটু চেষ্টা করে হয় কি না।’ ‘হয় না।’ শামসুর রাহমানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বেলাল চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। আমার সামনে দুলে উঠলো ইমিগ্রেশন অফিসারের ঘরটি, ঘরের দেয়াল, দুলে উঠলো পুরো বিমান বন্দর, দুলে উঠল স্বপ্ন সুখ। আমাকে আর সামনে পা বাড়াতে দেওয়া হয় না। উড়োজাহাজ তখন ছাড়ছে ছাড়ছে প্রায়। ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে বাকি যাত্রীরা এখনই যেন জাহাজে উঠে যান। বেলাল চৌধুরী বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘আমি থেকে যাই, আমি আর তসলিমা পরে আসছি। শামসুর রাহমান বললেন, না আপনি যান, আমি থেকে যাই, ঝামেলা মিটিয়ে আজ বিকেলের ফ্লাইটে না হয় আমরা যাবো।’ ওঁদের কথায় আমার চোখে জল চলে আসে। আমি বাস্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলি, ‘আমার জন্য দেরি করবেন কেন? আপনারা চলে যান। আমি আসছি পরে।’ অধৈর্য হয়ে উঠছে বাকি কবিরা। কবিদের কারও কারও বিষণ্ন মুখ, কারও বা প্রসন্ন মুখ। সরকারি চাকরি করা আর কোনও কবিকে এই হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে না। কারও জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। কেবল আমার জন্য প্রয়োজন। দলের মধ্য থেকে রফিক আজাদ শামসুর রাহমানের হাত ধরে ‘আসুন তো, প্লেন ছেড়ে দিচ্ছেঞ্চ বলে টেনে নিয়ে যান সামনে। বেলাল চৌধুরী বলে গেলেন, ‘এক্ষুনি তুমি ইমরান নূরের অফিসে চলে যাও, দেখ কি করতে বলে, করে, আজ বিকেলের ফ্লাইটেই চলে এসো। আজ যদি সম্ভব না হয়, তবে কাল সকালের ফ্লাইটে যে করেই হোক এসো।’ আমাকে পেছনে রেখে দলের সবাই উড়োজাহাজের দিকে এগোতে লাগলেন। শামসুর রাহমান বার বার করুণ চোখে তাকাচ্ছিলেন পেছনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে। আমি একা দাঁড়িয়ে। দলের শেষ মানুষটি যখন অদৃশ্য হয়ে যায়,
false
humayun_ahmed
আপনি, এত বড় লেখক। অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমি একবার ভেবেছিলাম স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্রদের নিয়ে আসি। শওকত সাহেব আঁৎকে উঠলেন। কি ভয়াবহ কথা। এই বিপদজনক মানুষটিই কি তার কেয়ার টেকার হিসাবে থাকবে? মনে হচ্ছে প্রথম দিনেই জীবন অতিষ্ট করে তুলবে। স্যার, স্টেশন মাস্টার সাহেব এক কাপ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। চলেন যাই। চা এখন খেতে ইচ্ছা করছে না। একটা চুমুক দিবেন। না হলে মনে কষ্ট পাবে। এরা বিশিষ্ট লোকতো কখনো দেখে না। আপনার নামও শোনে নাই। বই পড়াতো দূরের কথা। দোষ নাই কিছু। অজ পাড়া গা জায়গা। স্যার আসেন। জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা করবেন না। লোক লাগিয়ে দিয়েছি। এরা নৌকায় নিয়ে তুলে ফেলবে। নৌকায় যেতে হয় না-কি? জি। বেশী সময় লাগে না। দেড় থেকে দুঘন্টা। বাতাস আছে। পাল তুলে দিব–সাঁ সাঁ করে চলে যাব। স্যার চলেন। চটা খেয়ে আসি। শওকত সাহেব বিরক্ত মুখে রওনা হলেন। মোটাসোটা থলথলে ধরনের স্টেশন মাস্টার সাহেব বিনয়ে প্রায় গলে পড়ে। যাচ্ছেন। তাঁর চোখে দেব দর্শন জনিত আনন্দের আভা। তিনি তার চেয়ার শওকত সাহবের জন্যে ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা টুলে বসেছেন। অন্য একটা টুলে। চায়ের কাপ, একটা পিরিচে দুটো নিকি। অন্য আরেকটা পিরিচে বানানো পান, পানের পাশে একটা সিগারেট এবং ম্যাচ। আয়োজনের অভাব নেই। কিছু না বললে খারাপ দেখা যায় বলেই শওকত সাহেব বললেন, কি ভাল? জি স্যার ভাল। একটু দোয়া রাখবেন। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি আজ নয় বছর। বদলির জন্যে চেষ্টা কম করি নাই। অনেক ধরাধরি করেছি–লাভ হয় নাই। মফস্বল থেকে চিঠি গেলে এরা স্যার ফেলে দেয়। খাম খুলে পড়েও না। প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য শওকত সাহেব বললেন, স্টেশন ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট একটা গাছ দেখলাম। কি গাছ এটা? এটা স্যার শিরীষ গাছ। গত বৈশাখ মাসে ঐ গাছের ডাল ভেঙ্গে স্টেশন ঘরের উপরে পড়ল। ঘর জখম হয়ে গেল। বৃষ্টি বাদলা হলে ঘরে পানি ঢুকে। রিপেয়ার করার জন্য এই পর্যন্ত দুটা চিঠি লিখেছি–কোন লাভ নাই। ওদের স্যার মফস্বলের জন্য আলাদা ফাইল আছে। চিঠি গেলেই ঐ ফাইলে রেখে দেয়। খুলেও পড়ে না। স্যার, সিগারেটটা ধরান, আপনার জন্য আনিয়েছি। শওকত সাহেব সিগারেট ধরলেন। স্টেশন মাস্টার বললেন, গোল্ড লীফ ছাড়া ভাল কিছু পাওয়া যায় না। বেনসন আনতে পাঠিয়েছিলাম। পায় নাই। মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। দামী সিগারেট খাওয়ার লোক কোথায়? সবাই হত দরিদ্র। শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই অঞ্চলের সবাই বেশী কথা বলে? যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই কথা বলছে। অনবরত কথা বলছে। ভাগ্যিস মোফাজ্জল করিম সাহেব নেই। তিনি নৌকার খোঁজ খবরে গেছেন। তিনি থাকলে দুজনের মধ্যে কথা বলার কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত। মোফাজ্জল করিম সাহেব সম্ভবত জিততেন। মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলায় কেউ পারে না। স্যার কত দিন থাকবেন এখানে? ঠিক করিনি। পনেরো বিশ দিন থাকব। শুনলাম, নির্জনে একটা লেখা শেষ করার জন্য এসেছেন? শওকত সাহেব দীৰ্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। নির্জনতার যে নমুনা শুরু হয়েছে খুব বেশী ভরসা করতে পারছেন না। স্যার পান খেলেন না? পান আমি খাই না। থ্যাংক ইউ। আমি বাইরে একটু দাঁড়াই। বাইরে দাঁড়ায়ে কি দেখবেন স্যার, কিছুই দেখার নাই। শীতকালে তাও একটু হাঁটাহাঁটি করা যায়–বর্ষাকালে অসম্ভব। কাঁচা রাস্তা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। দিনরাত বৃষ্টি। খাওয়া খাদ্য কিছু নাই। ইলিশ মাছ এক জিনিস দুই বছরে চোখে দেখি নাই। তরকারীর মধ্যে আছে উঁটা, পুই শাক আর ঝিঙ্গা। এই তিন জিনিস কত খাওয়া যায় বলেন? পটল এক জিনিস কেউ চোখেও দেখে নাই। অথচ শহর বন্দরে এই জিনিস খাওয়ার লোক নাই। শওকত সাহেব স্টেশন ঘর থেকে বের হয়ে এলেন আর তখনি কেঁপে বৃষ্টি এল। শিরীষ গাছের ঘন পাতায় বৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। কতক্ষণ এ রকম থাকবে কে জানে। শওকত সাহেব মুগ্ধ হয়ে গাছ, বৃষ্টি এবং দূরের মাঠ দেখতে লাগলেন। সামনের অনেকখানি ফাঁকা। দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া যায়। শহরের সঙ্গে গ্রামের এই বোধ হয় তফাৎ। শহরে দৃষ্টি আটকে যায়। গ্রামে আটকায় না। ছাতা মাথায় মোফাজ্জল করিমকে হন হন করে আসতে দেখা যাচ্ছে। পায়ের জুতা জোড়া খুলে তিনি হাতে নিয়ে নিয়েছেন। প্যান্ট ভাজ করে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিয়েছেন। শওকত সাহেব আঁৎকে উঠলেন, তাকেও কি এইভাবে যেতে হবে? বৃষ্টির জোর খুব বেড়েছে। শিরীষ গাছের একটি মাত্র ডালে ছসাতটা কাক বসে বসে ভিজছে। অন্য ডালগুলি কঁকা। কাকরা কি একটি বিশেষ ডাল বৃষ্টির সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে। এই ডালটার নিশ্চয়ই কোন সুবিধা আছে। স্টেশন মাস্টার সাহেবও ছাতা হাতে বের হয়েছেন। তিনি নিজেই ছাতা মেলে শওকত সাহেবের মাথার উপর ধরলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, এই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে খুব কম করে হলেও সাতদিন থাকবে। শওকত সাহেব বললেন, একটা মজার জিনিস দেখুনতো। এতগুলি ভাল থাকতে কাকরা সবাই একটা ডালে বসে আছে কেন? পশু পাখির কি স্যার কোন বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? একজন একটা ডালে বসছে। গুষ্ঠিশুদ্ধা সেই ডালে গিয়ে বসছে। স্যার ভিতরে চলেন। বৃষ্টিতে ভিজতেছেন। আপনি ছাতাটা আমার হাতে দিয়ে চলে যান। বৃষ্টি দেখতে আমার ভালই। লাগছে। একদিন দুদিন লাগবে স্যার। তারপর দেখবেন যন্ত্ৰণা। গ্রামদেশে সবচে খারাপ সময় হইল বর্ষাকাল। মোফাজ্জল করিম সাহেব একটা চায়ের দোকানে দাড়িয়ে কি যেন কিনলেন, তারপর আবার যেদিক থেকে এসেছিলেন
false
robindronath
লাবণ্যের নিজের কৃতিত্ব যে খুব বেশি ছিল তাহাও নহে– কিন্তু নূতন-আলাপী মাত্রকেই এটা দেখাইতে হইবে সেটা ধরা কথা। পরেশ প্রথম প্রথম আপত্তি করিতেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষ্ফল জানিয়া এখন আর আপত্তিও করেন না। এই পশমের টিয়াপাখির রচনানৈপুণ্য লইয়া যখন বিনয় দুই চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত করিয়াছে তখন বেহারা আসিয়া একখানি চিঠি পরেশের হাতে দিল। চিঠি পড়িয়া পরেশ প্রফুল্ল হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “বাবুকে উপরে নিয়ে আয়।” বরদা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে?” পরেশ কহিলেন, “আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু কৃষ্ণদয়াল তাঁর ছেলেকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করবার জন্যে পাঠিয়েছেন।” হঠাৎ বিনয়ের হৃৎপিণ্ড লাফাইয়া উঠিল এবং তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। তাহার পরক্ষণেই সে হাত মুঠা করিয়া বেশ একটু শক্ত হইয়া বসিল, যেন কোনো প্রতিকূল পক্ষের বিরুদ্ধে সে নিজেকে দৃঢ় রাখিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠিল। গোরা যে এই পরিবারের লোকদিগকে অশ্রদ্ধার সহিত দেখিবে ও বিচার করিবে ইহা আগে হইতেই বিনয়কে যেন কিছু উত্তেজিত করিয়া তুলিল। ১০ খুঞ্চের উপর জলখাবার ও চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া চাকরের হাতে দিয়া সুচরিতা ছাতে আসিয়া বসিল এবং সেই মুহূর্তে বেহারার সঙ্গে গোরাও আসিয়া প্রবেশ করিল। সুদীর্ঘ শুভ্রকায় গোরার আকৃতি আয়তন ও সাজ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিল। গোরার কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ, পরনে মোটা ধুতির উপর ফিতা বাঁধা জামা ও মোটা চাদর, পায়ে শুঁড়তোলা কটকি জুতা। সে যেন বর্তমান কালের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান বিদ্রোহের মতো আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার এরূপ সাজসজ্জা বিনয়ও পূর্বে কখনো দেখে নাই। আজ গোরার মনে একটা বিরোধের আগুন বিশেষ করিয়াই জ্বলিতেছিল। তাহার কারণও ঘটিয়াছিল। গ্রহণের স্নান-উপলক্ষে কোনো স্টীমার-কোম্পানি কাল প্রত্যুষে যাত্রী লইয়া ত্রিবেণী রওনা হইয়াছিল। পথের মধ্যে মধ্যে এক-এক স্টেশন হইতে বহুতর স্ত্রীলোক যাত্রী দুই-এক জন পুরুষ অভিভাবক সঙ্গে লইয়া জাহাজে উঠিতেছিল। পাছে জায়গা না পায় এজন্য ভারি ঠেলাঠেলি পড়িয়াছিল। পায়ে কাদা লইয়া জাহাজে চড়িবার তক্তাখানার উপরে টানাটানির চোটে পিছলে কেহ বা অসম্‌বৃত অবস্থায় নদীর জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছে; কাহাকেও বা খালাসি ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে; কেহ বা নিজে উঠিয়াছে, কিন্তু সঙ্গী উঠিতে পারে নাই বলিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িতেছে– মাঝে মাঝে দুই-এক পসলা বৃষ্টি আসিয়া তাহাদিগকে ভিজাইয়া দিতেছে, জাহাজে তাহাদের বসিবার স্থান কাদায় ভরিয়া গিয়াছে। তাহাদের মুখে চোখে একটা ত্রস্তব্যস্ত উৎসুক সকরুণ ভাব; তাহারা শক্তিহীন, অথচ তাহারা এত ক্ষুদ্র যে, জাহাজের মাল্লা হইতে কর্তা পর্যন্ত কেহই তাহাদের অনুনয়ে এতটুকু সাহায্য করিবে না ইহা নিশ্চয় জানে বলিয়া তাহাদের চেষ্টার মধ্যে ভারি একটা কাতর আশঙ্কা প্রকাশ পাইতেছে। এইরূপ অবস্থায় গোরা যথাসাধ্য যাত্রীদিগকে সাহায্য করিতেছিল। উপরের ফার্‌স্ট ক্লাসের ডেকে একজন ইংরেজ এবং একটি আধুনিক ধরনের বাঙালিবাবু জাহাজের রেলিং ধরিয়া পরস্পর হাস্যালাপ করিতে করিতে চুরুট মুখে তামাশা দেখিতেছিল। মাঝে মাঝে কোনো যাত্রীর বিশেষ কোনো আকস্মিক দুর্গতি দেখিয়া ইংরেজ হাসিয়া উঠিতেছিল এবং বাঙালিটিও তাহার সঙ্গে যোগ দিতেছিল। দুই-তিনটি স্টেশন এইরূপে পার হইলে গোরার অসহ্য হইয়া উঠিল। সে উপরে উঠিয়া তাহার বজ্রগর্জনে কহিল, “ধিক্‌ তোমাদের! লজ্জা নাই!” ইংরেজটা কঠোর দৃষ্টিতে গোরার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল। বাঙালি উত্তর দিল, “লজ্জা! দেশের এই-সমস্ত পশুবৎ মূঢ়দের জন্যই লজ্জা।” গোরা মুখ লাল করিয়া কহিল, “মূঢ়ের চেয়ে বড়ো পশু আছে– যার হৃদয় নেই।” বাঙালি রাগ করিয়া কহিল, “এ তোমার জায়গা নয়– এ ফার্‌স্ট ক্লাস।” গোরা কহিল, “না, তোমার সঙ্গে একত্রে আমার জায়গা নয়– আমার জায়গা ঐ যাত্রীদের সঙ্গে। কিন্তু আমি বলে যাচ্ছি আর আমাকে তোমাদের এই ক্লাসে আসতে বাধ্য কোরো না।” বলিয়া গোরা হন হন করিয়া নীচে চলিয়া গেল। ইংরেজ তাহার পর হইতে আরাম-কেদারায় দুই হাতায় দুই পা তুলিয়া নভেল পড়ায় মনোনিবেশ করিল। তাহার সহযাত্রী বাঙালি তাহার সঙ্গে পুনরায় আলাপ করিবার চেষ্টা দুই-একবার করিল, কিন্তু আর তাহা তেমন জমিল না। দেশের সাধারণ লোকের দলে সে নহে ইহা প্রমাণ করিবার জন্য খানসামাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মুরগির কোনো ডিশ আহারের জন্য পাওয়া যাইবে কিনা। খানসামা কহিল, “না, কেবল রুটি মাখন চা আছে।” শুনিয়া ইংরেজকে শুনাইয়া বাঙালিটি ইংরেজি ভাষায় কহিল, “ সম্বন্ধে জাহাজের সমস্ত বন্দোবস্ত অত্যন্ত যাচ্ছেতাই।” ইংরেজ কোনো উত্তর করিল না। টেবিলের উপর হইতে তাহার খবরের কাগজ উড়িয়া নীচে পড়িয়া গেল। বাবু চৌকি হইতে উঠিয়া কাগজখানা তুলিয়া দিল, কিন্তু থ্যাঙ্ক্‌স্‌ পাইল না। চন্দননগরে পৌঁছিয়া নামিবার সময় সাহেব সহসা গোরার কাছে গিয়া টুপি একটু তুলিয়া কহিল, “নিজের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত– আশা করি আমাকে ক্ষমা করিবে।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি যে সাধারণ লোকদের দুর্গতি দেখিয়া বিদেশীকে ডাকিয়া লইয়া নিজের শ্রেষ্ঠতাভিমানে হাসিতে পারে, ইহার আক্রোশ গোরাকে দগ্ধ করিতে লাগিল। দেশের জনসাধারণ এমন করিয়া নিজেদের সকলপ্রকার অপমান ও দুর্ব্যবহারের অধীনে আনিয়াছে, তাহাদিগকে পশুর মতো লাঞ্ছিত করিলে তাহারাও তাহা স্বীকার করে এবং সকলের কাছেই তাহা স্বাভাবিক ও সংগত বলিয়া মনে হয়, ইহার মূলে যে-একটা দেশব্যাপী সুগভীর অজ্ঞান আছে তাহার জন্য গোরার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল; কিন্তু সকলের চেয়ে তাহার এই বাজিল যে, দেশের এই চিরন্তন অপমান ও দুর্গতিকে শিক্ষিত লোক আপনার গায়ে লয় না– নিজেকে নির্মমভাবে পৃথক করিয়া লইয়া অকাতরে গৌরব বোধ করিতে পারে। আজ তাই শিক্ষিত লোকদের সমস্ত বই-পড়া ও নকল-করা সংস্কারকে একেবারে উপেক্ষা করিবার জন্যই গোরা কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ লাগাইয়া ও একটা নূতন অদ্ভুত কটকি চটি কিনিয়া পরিয়া বুক ফুলাইয়া ব্রাহ্ম-বাড়িতে আসিয়া দাঁড়াইল। বিনয়
false
humayun_ahmed
কিছুক্ষণ পিটপিট করে লোকটির দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার আসল নাম কি জহির? লোকটি বলল, একসময় নাম জহির ছিল। এখন লাবুস। লাবুস নামই ভালো। সবেরে এই পরিচয় দিবা। জহির পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নাই। তা বাবা তুমি দেশান্তরী ছিলা, সেইটাই তো ভালো ছিল। আবার কেন এসেছ? একটা কাজ সমাধা করার জন্যে এসেছি। কাজ সমাধা করে চলে যাব। ভালো, খুবই ভালো। যাতায়াতের খরচ আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা নাই। তা বাবা কী কাজ সমাধা করার জন্যে আসছ? আপত্তি না থাকলে তুমি আমারে বলে। আমি আমার মাকে খুন করতে আসছি। তার নাম জুলেখা। শশাংক পাল বললেন, তাকে চিনি। ভালোমতো চিনি। তাকে খুন করার বাসনা হওয়া স্বাভাবিক। আমি তার পুত্র হলে আমিও এই কাজ করতাম। সে বান্ধবপুরে নাই। কলিকাতায় থাকে। কলিকাতায় গিয়া খোঁজ নাও। রাহাখরচ আমি দিতেছি। আপনি কেন দিবেন? খুশি হয়ে দেব। তোমার পিতার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে, সেই দাবিতে দিব। তাছাড়া আমার শরীর খারাপ। দুই একদিনের মধ্যে জংলি এক চিকিৎসা শুরু করব। মারি না বাঁচি নাই ঠিক। কিছু দান খয়রাত এই কারণে করতে মন চায়। তোমারে দুইশ’ টাকা দেই। এত টাকা! আচ্ছা যাও, আরো বাড়ায়া দিলাম। আড়াইশ’। তুমি আজই রওনা দিয়ে দাও। ফাল্গুন মাসের দুই তারিখ মহা ধুমধামে উরশ শুরু হয়েছে। লালসালুর কাপড় দিয়ে পুরো অঞ্চল ঘিরে দেয়া হয়েছে। শত শত আগরবাতি জ্বলছে। দূর থেকে আতরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চে দু’জন মাওলানা বসে আছেন। তৃতীয় একজন মাওলানার আসার কথা, তিনি এখনো এসে পৌঁছান নি। শিন্নি গ্ৰহণ করার আলাদা জায়গা করা হয়েছে। গরু শিনি দেয়া নিষেধ (হরিচরণ নাকি স্বপ্নে এরকম নির্দেশই দিয়েছেন) বলেই খাসি, মুরগি, হাঁস আসছে। একজন একটা মহিষ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মহিষের বিষয়ে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে, আরো আসছে। হরিচরণের বাড়ির সামনেও কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। কারণ শশাংক পাল অদ্ভুত চিকিৎসা শুরু করেছেন। তার ধারণা এই চিকিৎসায় ফল হবে। শশাংক পাল নগ্ন হয়ে হরিচরণের বাড়ির সামনের শিউলি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। তিনঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দর্শনার্থীরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে কিছুটা ভীত। সাহস করে কেউ কাছে আসছে না। শশাংক পাল সবাইকে ধমকাচ্ছেন— ভাগো। ভাগো। নেংটা মানুষ এর আগে কোনোদিন দেখো নাই? বদের দল। মওলানা ইদরিসও দেখতে গেলেন। তার চোখে পানি এসে গেল। আহা বেচারা! তিনি ক্ষীণস্বরে বললেন, একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলে হয় না? শশাংক পাল ধমকে উঠলেন, ঢাকাঢাকি চলবে না, জংলি চিকিৎসার এইটাই १छ्झ। মাওলানা বললেন, কিছু আরাম কি বোধ হচ্ছে? শশাংক পাল বললেন, এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। বিষ পিঁপড়ায় কামড়াচ্ছে, এর একটা উপকার থাকতেও পারে। বৃষ্টি হলে কী করবেন? ভিজতে হবে, কিছু করার নাই। বাদ জংলিগুলা এই চিকিৎসা বের করেছে। থাপড়ায় এদের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার ছিল। শশাংক পাল চোখ বন্ধ করলেন। কথা বলে নষ্ট করার সময় তার নেই। গাছের কাছে প্রার্থনায় যেতে হবে। হে বৃক্ষ! আমাকে রোগমুক্ত কর। নগ্ন একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে। মাওলানা অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছেন। মানুষটার জন্যে তার হঠাৎ করে বড় মায়া লাগছে। সন্ধ্যার আগেই বৃষ্টি নামল। শশাংক পাল ভিজছেন। মাওলানাও ভিজছেন। শশাংক পাল মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার ঘটনা। কী? আপনি কেন ভিজতেছেন? যান, বাড়িতে যান। মাওলানা তারপরেও বসে রইলেন। রাতের অন্ধকারে কুপকূপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কে একজন মাওলানা ইদরিসের বাড়িতে ঢুকেছে। কালো বোরকায় তার শরীর ঢাকা। মুখ খোলা, তবে মুখ ছাতায় ঢাকা। মহিলা বাড়িতে উঠে বাতি জ্বালাল। উঠানে রাখা কলসির পানিতে পায়ের কাদা মুছতে মুছতে নিচু গলায় গাইল— যমুনায় জল নাই গো জল নাই যমুনায় আইজ রাধা কোনবা গাঙে যায়। মহিলা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এসেছেন। তিনি পুঁটলি খুলে নতুন শাড়ি বের করলেন। শাড়ির রঙ কমলা। তিনি আয়নায় নিজেকে দেখে সামান্য হাসলেন। আর তখনি ছপছপ শব্দ তুলে উঠানে মাওলানা এসে দাঁড়ালেন। অভ্যাস মতো ডাকলেন, বউ! বাড়ির ভেতর থেকে পরিষ্কার জবাব এলো, কী? মাওলানা চমকে উঠলেন। চমকে উঠার কোনো কারণ নেই। স্ত্রী ঘরে আছে, ডাকলে সে তো জবাব দেবেই। কিন্তু… মাওলানা বললেন, বৌ একটা ঘটনা ঘটেছে। ‘কী ঘটনা?’ বলে বাড়ির ভেতর থেকে জুলেখা বের হয়ে এলো। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ভেতরে আসেন, বলেন ঘটনা। কী? মন দিয়া শুনি। মাওলানা অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না। জুলেখা বলল, এইভাবে তাকায়া কী দেখেন? মাওলানা বিড়বিড় করে বললেন, বউ, আমার মাথায় কী জানি হয়েছে। জুলেখা বলল, আমি খবর পেয়েছি। এখন আমি আপনার সঙ্গে আছি। আপনার মাথা আমি ঠিক করে দিব। ইশ, কী ভিজাই না ভিজেছেন! গরম পানি করে দেই, সিনান করেন। মাওলানা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সময় সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ, ১৯৩৯, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জার্মানির বিরুদ্ধে। পৃথিবী অপেক্ষা করছে আর এক মহাযুদ্ধের জন্যে। মানবজাতি অপেক্ষা পছন্দ করে না। তারপরেও তাকে সবসময় অপেক্ষা করতে হয়। ভালোবাসার জন্যে অপেক্ষা, ঘৃণার জন্যে অপেক্ষা, মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা, আবার মুক্তির জন্যে অপেক্ষা। শশাংক পাল যেমন গাছ জড়িয়ে ধরে অপেক্ষা করেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফাঁসির দড়ির দিকে তাকিয়ে বিপ্লবীরাও অপেক্ষা করেন। অপেক্ষাই মানবজাতির নিয়তি। [প্রথম খণ্ড সমাপ্ত] মধ্যাহ্ন – দ্বিতীয় খণ্ড
false
shirshendu
ধাক্কা খেয়েছিল। ওই সাতিক অবস্থাতেও বাচ্চাটার জন্য হাত বাড়িয়েছিল হেমাঙ্গ। কিন্তু পারেনি। মাথাটা অন্ধকার হয়ে গেল নিজের অজান্তে। বচ্চাটা কি বেঁচে আছে? বোধ হয় না। এইসব ঘটনায় বাচ্চারাই তো আগে মরে। চারদিনের দিন গলায় স্বর এল তার। রাওয়াত! তুমি কি করে জানলে যে আমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? রাওয়াত মাথা নেড়ে বলে, কি করে জানব? জানতাম না তো। তুমি আসবে বলে খবরও দাওনি। তবে অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার খবর পেয়ে আমরা অনেকেই চলে এসেছিলাম স্পটে। এই পথে আমাদের চেনাজানা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবসময়ে যাতায়াত করে। এসে রেসকিউতে হাতও লাগিয়েছিলাম। ঠিক পঁচিশ জনের পর তোমাকে তোলা হয়। কতজন মারা গেছে? একত্ৰিশ জন। আরও দু-চারটে যাবে। আমার অবস্থা কেমন? ইউ আর ওকে। দিল্লিতে নিতে পারলে মাথাটা স্ক্যান করা যেত। আমি কোথায়? হরিদ্বার। খুব রিস্ক নিয়ে এতদূর এনেছি। কিন্তু না আনলে মুশকিল ছিল। আমি বাঁচব? বেঁচে গেছ। থ্যাংক গড। তুমি যাচ্ছিলে কোথায়? আমার কাছে? হ্যাঁ। সরি হেমাঙ্গ। ভেরি সরি। আমার কপালটাই খারাপ। এই ঘটনার পর তুমি আর বোধ হয় কোনওদিনই আমার ওখানে যাবে না? কে বলল? নিশ্চয়ই যাবো। আচ্ছা। নাউ টেক রেস্ট। আমার ইনজুরি কতটা? কিছু ফ্র্যাকচার আছে। ব্যাস। এনি ভাইটাল উড? না না। ভয়ে আর জানতে চাইল না হেমাঙ্গ। চোখ বুজে থেকে বলল, অ্যাকসিডেন্টের সময় একটা বাচ্চা আমার বুকে এসে পড়েছিল। বোধ হয় বাচেনি। একটু বিস্মিত গলায় রাওয়াত বলল, একটি বাচ্চার কথা বলছ? দু-আড়াই বছর বয়স? তা জানি না। ওই ভয়ংকর অবস্থায় কিছু ভাল করে দেখেছি নাকি? অবাক কাণ্ড হল, তোমাকে যখন বের করা হয় তখন তোমাব দুহাতে একটা বাচ্চা ধরা ছিল। সে বেঁচে গেছে। বেঁচে গেছে? খুব আশ্চর্যভাবে। লোকে তো ধরে নিয়েছিল ওটা তোমারই বাচ্চা। আমি তাদের ভুল ভাঙাই। তবে বাচ্চার মা বাঁচেনি। আমি কিভাবে বাঁচলাম রাওয়াত? ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভাই। একটা পাথরের চাঙড়ে আছড়ে পড়ে বাসটা দুখন্ড হয়ে যায়। একটা খন্ড গড়িয়ে নিচে চলে গিয়েছিল। ওটায় যারা ছিল কেউ বাচেনি। তুমি পিছনের পোরশনে ছিলে বলে বেঁচে গেছ। এখন বলো, তোমার বাড়িতে কী খবর পাঠাবো! তারা হয়তো চিন্তা করছে। একটু চিন্তা করে হেমাঙ্গ বলল, বাড়িতে অ্যাকসিডেন্টের খবর দেওয়া ঠিক হবে না। বরং আমার পার্টনারদের জানিয়ে দাও। আমার জিনিসপত্র কিছুই কি পাওয়া যায়নি? এখানে লুটপাট বিশেষ হয় না। পাহাড়ি লোকেরা এখনও ততটা খারাপ হয়ে যায়নি। তোমার একটা সুটকেস ছিল কি? ইনিশিয়াল মিলে যাচ্ছে, চারকোল ব্ল্যাক রঙের? হ্যাঁ। দরকারি কাগজপত্র আছে। ঠিক আছে। আর কিছু? আমার রিকভারি হতে কত সময় লাগতে পারে? ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে দেখব। ইট উইল টেক টাইম। সেক্ষেত্রে আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া যাবে কি? মে বি আফটার সাম টাইম। তার আগে তোমাকে দিল্লিতে শিফট করা দরকার। ফর দি স্ক্যান। ব্যথা আর ব্যথা! আর অবসন্নতা। আর হতাশা। আর নিঃসঙ্গতা। হেমাঙ্গ সারা দিন স্থবিরের মতো পড়ে থাকে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। ডাক্তার বা নার্স কিছু বলতে চায় না। সে অনুমান করে, তার বাঁ হাত আর বাঁ পা ভেঙেছে। সম্ভবত গোটা দুই পাঁজরও। মাথার ব্যান্ডেজ থেকে অনুমান সেখানকার চোটও সামান্য নয়। অনেক রক্তপাত হয়ে থাকবে, নইলে শরীরের এই অবসন্ন হত না। রাওয়াত, আমাকে কি রক্ত দেওয়া হয়েছে? অফ কোর্স। ইউ ব্লেড লাইক হেল। শঙ্কিত হেমাঙ্গ বলে, সেই রক্ত কি এইচ আই ভি ফ্রি? আজকাল ব্লাড থেকে কত এইডস্ হয় তুমি জানো? রাওয়াত হাসল, চিন্তা কোরো না। তোমার রক্তের গ্রুপ ইজি, আমি তোমাকে রক্ত দিয়েছি। আর দুজন বন্ধুকে ধরে এনেছিলাম। তাদের কারও এইডস নেই। হেমাঙ্গর তবু একটু অস্বস্তি রয়ে গেল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে একজনের কথা মনে পড়ছে। ভাবতে ভাল লাগছে। যদি অ্যাকসিডেন্টে মরে যেত তাহলে কী করত ও? কাদত নাকি? মন খারাপ করত? তা হয়তো করত। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে যেতে এবং তাকে ভুলে যেতে কতই বা সময় নিত। দিন সাতেক বাদে একটানা অ্যাম্বুলেন্সে দিল্লি নিয়ে আসা হল তাকে। দুজন পার্টনার কলকাতা থেকে উড়ে এসেছে তার জন্য। খুব ভাল একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল তাকে। স্ক্যানে তেমন কিছু ধরা পড়ল না। বাচ্চা ছেলের মতো সে মাঝে মাঝেই বলতে লাগল, বাড়ি যাবো। পার্টনার দাশগুপ্ত বলল, বাড়ি বলতে তো গর্চা। সেখানে কে দেখবে তোমাকে? যা অবস্থা করেছ, বেশ কিছুদিন নার্সিং দরকার। না দাশগুপ্ত, এভাবে হবে না। তোমরা আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাও। তোমার মায়ের পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা শকিং হবে। আমরা এঁকে অ্যাকসিডেন্টের খবর দিইনি। শুধু বলেছি অফিসের জরুরি কাজে আটকে গেছে, ফিরতে দেরি হবে। হেমাঙ্গ চোখ বুজে গভীর ক্লান্তির সঙ্গে বলল, শোনো দাশগুপ্ত, রিকভারির জন্য মানসিক স্বস্তিও দরকার। এখানে আমার ভীষণ একা লাগছে। আমাকে নিয়ে যাও। কিন্তু এখনও যে তুমি বিছানা থেকে উঠতে পারছ না। ট্রেচারেই নেবে। দাশগুপ্ত একটু ভাবিত মবে বিদায় নিল। রাওয়াত কর্ণপ্রয়াগে ফিরে গিয়েছিল। আবার এল। বলল, আরে ভাই, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সাত আটটা দিন থাকো। তারপর একটু ফিটনেস এসে গেলে যেও। একটা সত্যি কথা বলবে রাওয়াত? কী? আমার কোনও ভাইটাল ইনজুরি হয়নি তো? হয়তো আমি টের পাচ্ছি না। আরে না ভাই। হলে টের পেতে না? আমার কোমরে একটা ব্যান্ডেজ রয়েছে। আগে বুঝতে পারিনি। আমার স্পইনাল কর্ড ভাঙেনি তো? উঃ, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। ইউ
false
humayun_ahmed
তীর সামৰ্থ্য নেই। বিয়ে করার মত সাহস যখন জাহেদের আছে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে প্রতিপালনের ক্ষমতাও তার আছে। জাহেদ যদি তীর কথা না শুনে বউ নিয়ে এখানে উঠে তাহলে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাবে। জাহেদ চুপ করে শুনে গেল। কিছ. বলল না। মিজান সাহেব কিছু শোনার জন্যেও অপেক্ষা করলেন না। এটা তার স্বভাব না। তিনি নিজের কথা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন। নিঃশব্দে সিগারেট শেষ করে ঘুমুতে গেলেন। আজ সারাদিন জাহেদের খুব পরিশ্রম হয়েছে। বিছানায় শুয়ে পড়ামাত্র ঘুম এসে যাওয়ার কথা কিন্তু ঘুম এল না। সে সারা রাত জেগে কাটাল। শেষ রাতে তন্দ্রার মধ্যে কেয়াকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল। জলিল সাহেব সেই দুঃস্বপ্নে কেয়াকে বৌ বৌ করে ডাকছেন। শুভ্র তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। বিছানার পাশে রেখে সে বাথরুমে ঢুকেছিল চোখে পানি দিতে। বাথরুম থেকে বের হয়ে সে গেল বারান্দায়। বারান্দায় এ-মাথা থেকে ও—মাথা পর্যন্ত দুবার হাঁটল। ঠিক সন্ধ্যায় চশমা ছাড়া পৃথিবীকে দেখতে তার ভাল লাগে। সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। চারদিক অন্ধকার। এই অন্ধকারে বাতি জ্বলে উঠছে। চশমা ছাড়া এই বাতিগুলিকে অনেক উজ্জ্বল এবং ছড়ানো মনে হয়। শুভ্রর ইচ্ছা করছিল আরো খানিকক্ষণ হাঁটতে, কিন্তু সময় নেই। আজ জাহেদের বিয়ে। সন্ধ্যা মেলাবার পরপর বরযাত্রী রওনা হবে। শুভ্র বরযাত্রীদের একজন। সে মাইক্রোবাস নিয়ে যাবে। তার দেরি করার সময় নেই। শুভ্র ঘরে ঢুকাল। চশমা খুঁজে পেল না। বিছানার পাশে এই সপ্তাহের টাইম পত্রিকা পাতা খোলা অবস্থায় আছে। পত্রিকার পাশে এক প্যাকেট ক্যাসো নাট। প্যাকেট খোলা হয়নি। বালিশের নিচে তার নাটবুক এবং পেনসিল। সবই আছে, চশমা নেই। শুভ্ৰ তার শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করল। চশমা হারালে তার এ রকম হয়। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিজেকে এত অসহায় লাগে! মনে হয় অচেনা অজানা দেশের হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে সে হারিয়ে গেছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কথা বলতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারে অসংখ্য মানুষ তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সে যেমন ওদের দেখতে পাচ্ছে না, ওরাও তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে ওদের কাছে অদৃশ্য মানব। শুভ্ৰ আতংকিত গলায় ডাকল, মা! মা! রেহানা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন। শুভ্ৰ ভাঙা গলায় বলল, আমার চশমা খুঁজে পাচ্ছি না, মা। তার চিৎকার শুনেই বুঝেছি। শান্ত হয়ে বস তো এখানে। চশমা যাবে কোথায়? ঘরেই আছে। চশমার তো পাখা নেই যে উড়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাবে। বালিশের কাছে রেখেছিলাম। বালিশের কাছে রাখলে, বালিশের কাছেই আছে। রেহানা বিছানায় কোন চশমা দেখলেন না। খাটের নিচে পড়েছে বোধহয়। তিনি দ্রুত খাটের নিচটা দেখে নিলেন। শুভ্র বলল, মা, পাওয়া গেছে? পাওয়া যাবে। তুই চুপ করে বসে থাক তো। ঘামতে শুরু করেছিস। সন্ধ্যা মেলাবার সঙ্গে সঙ্গে বরযাত্রী রওনা হবে। চশমা এক্ষুণি পাওয়া যাবে। তুই যথাসময়ে যেতে পারবি। তাছাড়া বরযাত্রী কখনা সময়মত রওনা হতে পারে না। এক ঘণ্টা-দুঘণ্টা দেরি হবেই। মা, তুমি কথা বলে সময় নষ্ট করছ। আমার খুব অস্থির লাগছে। শুভ্রর আসলেই খুব অস্থির লাগছে। অন্যসময় এতটা অস্থির লগত না। কারণ তখন শুভ্ৰ জানত জরুরি অবস্থার জন্যে দুটা চশমা কাবার্ডে লুকানো আছে। আজ সেই চশমা দুটি নেই। শুভ্রর চোখ আরো খারাপ হওয়ায়–ঐ চশমা দুটিতে নতুন গ্লাস লাগানোর জন্যে দোকানে পাঠানো হয়েছে। ভেরিলকি লেন্স লাগানো হবে। এক সপ্তাহ সময় লাগবে। মা, পাওয়া গেছে? এখনো পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। চশমা খুলে রেখে তুই কোথায় কোথায় গিয়েছিস বল তো? কোথাও যাই নি। বাথরুমে গিয়ে চোখে পানি দিয়েছি। তাহলে চশমা বাথরুমেই আছে। তুই হাতে করে নিয়ে বেসিনের উপর রেখে চোখে পানি দিয়েছিস। তারপর চশমার কথা ভুলে গেছিস। রেহানা বাথরুমে ঢুকলেন। চশমা সেখানে নেই। তিনি রারান্দায় গেলেন। বারান্দায় ছোট একটা টেবিল আছে। শুভ্ৰ মাঝে মাঝে ঐ টেবিলে চশমা রেখে ভুলে যায়–আজও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। বারান্দার টেবিলে কিছু নেই। তিনি আবার শোবার ঘরে ঢুকলেন। চিন্তিত এবং ব্যথিত মুখে শুভ্র বসে আছে। তার ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শুভ্র বলল, কি হবে মা! কিছু হবে না। পাওয়া যাবে। তুই আমার সঙ্গে বারান্দায় এসে বস তো দেখি। আর আমরা দুজন চা খাই। আমি কাজের লোকদের বলছি। ওরা খুঁজে দেবে। আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে না, মা। তুই এত অল্পতে অস্থির হাস কেন বল তো? চশমা ছাড়া আমি অন্ধ। অন্ধ হওয়াটা কি খুব অল্প? ইস ঘেমৌ-টেমে একেবারে কি হয়েছিস! আয় আমার সঙ্গে। তিনি শুভ্রকে হাত ধরে বারান্দায় এনে বসলেন। দোতলা থেকে একতলায় নেমে বাবুচকে বললেন খুব ভাল করে দুইেকাপ চা বানাতে। কাজের মেয়ে শাহেদা এবং কাজের ছেলে তোতামিয়াকে দাতলায় এসে শুভ্ৰকে চশমা খুঁজে দিতে বললেন। এ রকম কখনো করা হয় না। এ বাড়ির কাজের লোকদের কখনো দোতলায় আসতে দেয়া হয় না। ওদের কর্মকাণ্ড একতলাতেই সীমাবদ্ধ। দোতলার যা কাজ রেহানাই করেন। তাঁর শূচিবায়ুর মত আছে। শুভ্র বলল, কটা বাজে মা? খুব বেশি বাজে নি। মাত্র ছটা। তুই কাপড় পরে তৈরি হয়ে থাক। ড্রাইভারকে বলি মাইক্রোবাস বের করে রাখতে। তুই আমার সঙ্গে বসে চা খাঁ। বোকা ছেলে! এত অল্পতে এমন নাভস হলে চলে? আমার দেরি হলে জাহিদ খুব অস্থির হয়ে পড়বে। আজ ওর বিয়ে। আজ কি ওকে অস্থির করা উচিত? তোর দেরি দেখলে ও অস্থির হবে কেন?
false
shordindu
লৌহ-গুটিকা প্রবিষ্ট করাইয়া আবার কাপাসখণ্ড দিয়া মুখ বন্ধ করিল। বলিল—মহারাজ, কামান তৈরি। এখন আগুন দিলেই গুলি বেরুবে। রাজা বলিলেন—দাও আগুন। বলরাম একটি অগ্নিমুখ নারিকেল রঞ্জু সঙ্গে আনিয়াছিল, সে কলসীর দিকে লক্ষ্য স্থির করিয়া কামানের পিছন দিকে অগ্নিস্পর্শ করিল। অমনি সশব্দে কামান হইতে গুলি বাহির হইয়া পঞ্চাশ হাত দূরের তিনটি কলস চূর্ণ করিয়া দিল। রাজা সহর্যে বলরামের স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন—ধন্য! আজ থেকে অর্জুনের মত তুমিও আমার ভৃত্য হলে। —এই লঘু কামান আমি নিলাম। ছয় সন্ধ্যার পর কুমার কম্পনের নূতন প্রাসাদ দীপমালায় সজ্জিত হইয়াছিল। প্রাসাদের তোরণশীর্ষে একদল বাদ্যকর মধুর বাদ্যধ্বনি করিতেছিল। গৃহপ্রবেশের শুভমুহূর্ত সমাগত। প্রাসাদে এখনো পুরস্ত্রীগণের শুভাগমন হয় নাই। কেবল কয়েকজন ষণ্ডামার্ক ভৃত্য আছে; আর আছে স্বয়ং কুমার কম্পন। অতিথিরা একে একে আসিতে লাগিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় বেশি নয়, মাত্র দ্বাদশ জন। কুমার কম্পন পরম সমাদরের সহিত সকলকে গোষ্ঠাগারে বসাইলেন। তাঁহার মুখের অম্লান হাসির উপর মনের আরক্ত ছায়া পড়িল না। দ্বাদশজন সমবেত হইলে কুমার কম্পন বলিলেন—আমি মানস করেছি আমার গৃহের প্রত্যেকটি কক্ষে একটি করে অতিথিকে ভোজন করাব। তাহলে আমার সমস্ত গৃহ পবিত্র হবে। অতিথিরা হর্ষ জ্ঞাপন করিলেন। কুমার কম্পন একজনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন—জীমূতবাহন ভদ্র, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনি আগে আসুন। বয়োজ্যেষ্ঠ জীমূতবাহন ভদ্র গাত্রোত্থান করিয়া কুমার কম্পনের অনুসরণ করিলেন। বাকি সকলে বসিয়া নিজ নিজ বয়সের তুলনামূলক আলোচনা করিতে লাগিলেন। কুমার কম্পন অতিথিকে একটি কক্ষে লইয়া গেলেন। বহু দীপের আলোকে কক্ষটি প্রভান্বিত, শঙ্খশুভ্র কুট্টিমের উপর শ্বেতপ্রস্তরের পীঠিকা, পীঠিকার সম্মুখে নানাবিধ অন্নব্যঞ্জনপরিপূর্ণ থালি। দুইজন ভৃত্য অদূরে দাঁড়াইয়া আছে, একজনের হাতে ভৃঙ্গার ও পানপাত্র, অন্য ভৃত্য চামর লইয়া অপেক্ষা করিতেছে। কুমার কম্পন অতিথিকে বলিলেন—আসন গ্রহণ করুন ভদ্র। ভদ্র পীঠিকায় উপবিষ্ট হইলেন। কুমার কম্পন বলিলেন—অগ্রে ফলাম্নরস পান করুন ভদ্র। ভৃত্য পানপাত্রে পানীয় ঢালিয়া ভদ্রের হাতে দিল, ভদ্র পানপাত্র মুখে দিয়া এক নিশ্বাসে পান করিলেন। পাত্র ভৃত্যের হাতে প্রত্যর্পণ করিয়া তিনি ক্ষণকাল স্থির হইয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে পাশের দিকে ঢলিয়া পড়িলেন। কুমার কম্পন অপলক নেত্রে অতিথিকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন; তাঁহার মুখে চকিত হাসি ফুটিল। অব্যর্থ বিষ, বিষবৈদ্য যাহা বলিয়াছিল তাহা মিথ্যা নয়। তিনি ভৃত্যদের ইঙ্গিত করিলেন, ভৃত্যেরা অতিথির মৃতদেহ ধরাধরি করিয়া পিছনের দ্বার দিয়া প্রস্থান করিল। কুমার কম্পনের মস্তকে ধীরে ধীরে হত্যার মাদকতা চড়িতেছে, চোখের দৃষ্টি ঈষৎ অরুণাভ হইয়াছে। তিনি অন্য অতিথিদের কাছে ফিরিয়া গেলেন, মধুর হাসিয়া বলিলেন—ভদ্র কুমারাঙ্গা, এবার আপনি আসুন। কুমারাপ্পা মহাশয় গাত্রোত্থান করিলেন। এইভাবে কুমার কম্পন একটির পর একটি করিয়া দ্বাদশটি অতিথির সকার করিলেন। এই কার্য সমাপ্ত করিতে একদণ্ড সময়ও লাগিল না। কুমার কম্পনের মাথায় রক্তের নেশা পাক খাইতেছে, তিনি চারিদিক রক্তবর্ণ দেখিতেছেন, সমস্ত দেহ থাকিয়া থাকিয়া অসহ্য অধীরতায় ছটফট করিয়া উঠিতেছে। রাজা এখনো আসিতেছে না কেন! তবে কি আসিবে না! যদি না আসে? গৃহে ভৃত্যেরা ছাড়া অন্য কেহ নাই। অন্য কেহ আসিবে না। যাহারা আসিয়াছিল তাহারা নিঃশেষিত হইয়াছে। বাকি শুধু রাজা। রাজা যদি কিছু সন্দেহ করিয়া থাকে সে আসিবে না। লক্ষ্মণ মল্লপও আসে নাই, হয়তো লক্ষ্মণ মল্লপই রাজাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছে! কুমার কম্পনের মাথার মধ্যে রক্তস্রোত তোলপাড় করিতেছিল, অধিক সূক্ষ্ম চিন্তা করিবার শক্তি তাঁহার ছিল না। রাজা যদি না আসে আমিই তাহার কাছে যাইব। সে এই সময় একাকী বিরামকক্ষে থাকে। যদি বা লক্ষ্মণ মল্লপ সঙ্গে থাকে তবে একসঙ্গে দুজনকেই বধ করিব। ভৃত্যদের সাবধান করিয়া দিয়া কুমার কম্পন একটি ক্ষুদ্র ছুরিকা কটিবস্ত্রে বাঁধিয়া লইলেন; তারপর গৃহ হইতে বাহির হইলেন। তোরণশীর্ষে মধুর বাদ্যধ্বনি চলিতে লাগিল। তোরণের বাহিরে আসিয়া একটা কথা কুমার কম্পনের মনে পড়িল, তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন। বৃদ্ধ পিতা বিজয়রায়। সে কনিষ্ঠ পুত্রকে দেখিতে পারে না, সে যদি বাঁচিয়া থাকে তবে নানা অনর্থ ঘটাইবে। সুতরাং তাহাকেই সবাগ্রে বিনাশ করা প্রয়োজন। রাজ-পিতা বিজয়রায়ের ভবন অধিক দূর নয়, কুমার কম্পন সেইদিকে চলিলেন। বিজয়রায়ের ভবন পাহারার ব্যবস্থা নামমাত্র, ভবন-দাসীর সংখ্যাও বেশি নয়; বৃদ্ধ ঘটা-চটা ভালবাসেন না। তোরণদ্বারের কাছে দুইজন প্রহরী বসিয়া দুইজন ভবন-দাসীর সঙ্গে রসালাপ করিতেছিল; কুমার কম্পনকে দেখিয়া তাহারা সন্ত্রস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। কুমার কম্পন পিতৃভবনে কখনো আসেন না। তিনি কোনো দিকে ভূক্ষেপ না করিয়া ভবনে প্রবেশ করিলেন। ভৃত্যেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পুত্র পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন, ইহাতে আশঙ্কার কথা কিছু নাই, তাহারা ভাবিতে লাগিল শিষ্টাচারের কোনো ত্রুটি হইল কিনা। ভবনের দ্বিতলে বসিয়া বিজয়রায় তখন এক নূতন মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিতেছিলেন। যবচূর্ণ শক্ত তালের রসে মাখিয়া পিণ্ডীরের সহিত থাসিয়া পাক করিলে উত্তম নাড় হয় কিনা পরীক্ষা করিতেছিলেন। এমন সময় কম্পন গিয়া দাঁড়াইলেন। বিজয়রায় মুখ তুলিয়া ভ্রূকুটি করিলেন, বলিলেন—কম্পন! কী চাও? কুমার কম্পন উত্তর দিলেন না, ক্ষিপ্রহস্তে কটি হইতে ছুরিকা লইয়া পিতার বক্ষে আঘাত করিলেন। ছুরিকা পঞ্জরের অন্তর দিয়া হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করিল। বিজয়রায় চিৎ হইয়া পড়িয়া গেলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কেবল একটি এস্ত-বিস্মিত শব্দ বাহির হইল—অধম! তারপর তাঁহার অক্ষিপটল উল্টাইয়া গেল। কম্পন তাঁহার বক্ষ হইতে ছুরিকা বাহির করিয়া আবার কটিতে রাখিলেন। পিতার মুখের পানে আর চাহিলেন না, দ্রুত নামিয়া চলিলেন। সূর্যাস্তকালে অর্জুন অভ্যাসমত সভাগৃহের প্রাঙ্গণে আসিয়াছিল। অভ্যাসবশতই লাঠি দুটি তাহার সঙ্গে ছিল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, মহারাজ সভাভঙ্গ করিয়া দ্বিতলে প্রস্থান করিলেন। তবু অর্জুন প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করিতে লাগিল। রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কোনো নিমিত্ত ছিল না, রাজা তাহাকে আহ্বান
false
tarashonkor
হও কংগ্রেস-কমিটির প্রেসিডেন্ট। ডেটিনিউ যতীনবাবু বলেন–না, দেবুবাবু হবেন প্রজা-সমিতির প্রেসিডেন্ট। —ছিরে পাল এখন গণ্যমান্য লোক। একটা গুড়গুড়ি কিনেছে, চণ্ডীমণ্ডপে শতরঞ্জি পেতে একটা তাকিয়া নিয়ে বসে। বেটা আবার গোমস্তা হয়েছে, গায়ের গোমস্তাগিরি নিয়েছে। একে মহাজন, তারপর হল গোমস্তা, সর্বনাশ করে দিলে গাঁয়ের! জমিদারের এখন অবস্থা খারাপ, শ্ৰীহরির টাকা আছে, আদায় হোক না হোক, সমস্ত টাকা শ্ৰীহরি দিবে—এই শর্তে জমিদার শ্ৰীহরিকে গোমস্তাগিরি দিয়াছে। শ্ৰীহরি এখন এক ঢিলে দুই পাখি মারিতেছে। বাকি খাজনার নালিশের সুযোগে লোকের জমি নিলামে তুলিয়া আপন প্রাপ্য আদায় করিয়া লইতেছে সুদে-আসলে। সুদ-আসল আদায় হইয়াও আরও একটা মোটা লাভ থাকে। গণেশ পালের জোত নিলাম হইয়া গিয়াছে, কিনিয়াছে শ্ৰীহরি; এখন গণেশের অবশিষ্ট শুধু কয়েক বিঘা কোফা জমি। সর্বস্বান্ত তারিণীর ভিটাটুকুও শ্রীহরি কিনিয়াছে; এখন সেটা উহার গোয়ালবাড়ির অন্তর্ভুক্ত। তারিণীর স্ত্রীটা সেটেলমেন্টের একজন পিয়নের সঙ্গে পলাইয়া গিয়াছে। তারিণী মজুর খাটে; ছেলেটা থাকে জংশনে, স্টেশনে ভিক্ষা করে। পাতু মুচির দেবোত্তর চাকরান জমি উচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে। তাহার জন্য নালিশ-দরবার করিতে হয় নাই, সেটেলমেন্টেই সে-জমি জমিদারের খাস খতিয়ানে উঠিয়া গিয়াছে। পাতু নিজেই স্বীকার করিয়াছিল, সে এখন আর বাজায় না, বাজাইতেও চায় না। অনিরুদ্ধের জমি নিলামে চড়িয়াছে। অনিরুদ্ধ এখন মদ খাওয়া ভবঘুরের মত বেড়ায় দুর্গার ঘরেও মধ্যে মধ্যে যায়। তাহার স্ত্রীও পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল। এখন অনেকটা সুস্থ। দুর্গার যোগাযোগেই দারোগা ডেটিনিউ রাখিবার জন্য অনিরুদ্ধের ঘরখানা ভাড়া লইয়াছে। ওই ভাড়ার টাকা হইতেই এখন তাহাদের সংসার চলে। দেবু বলিল–কামার-বউকে আজ দেখলাম শাঁখ বাজাচ্ছিল। জগন বলিল–হ্যাঁ, এখন একটু ভাল আছে। একটু কেন, যতীনবাবু আসার পর থেকেই বেশ একটু ভাল আছে। ঠোঁট বাঁকাইয়া সে একটু হাসিল। হরেন চাপা গলায় বলিল—মেনি মেন সে বুঝলে কিনা—যতীনবাবু অ্যান্ড কামার-বউ— দেবু বিশ্বাস করিতে পারি না, সে তিরস্কার করিয়া উঠিল—ছিঃ হরেন! কি যা-তা বলছ! –ইয়েস; আমিও তাই বলি, এ হতে পারে না। যতীনবাবু কামার-বউকে মা বলে। তারপর আবার সে বলিল যতীনবাবু কিন্তু বড় চাপা লোক। বোমার ফরমুলা কিছুতেই। আদায় করতে পারলাম না। হরিশ এবং ভবেশ আসায় তাদের আলোচনা বন্ধ হইল, কিছুক্ষণ পরে সে উঠিয়া গেল। হরিশ বলিলবাবা দেবু, সন্ধেবেলায় একবার চণ্ডীমণ্ডপে যেয়ো। ওখানেই এখন আমরা আসি তো। শ্ৰীহরি বসে পাঁচজনকে নিয়ে। আলো, পান, তামাক সব ব্যবস্থাই আছে। শ্ৰীহরি এখন নতুন মানুষ। বুঝলে কিনা! ভবেশ বলিল, হ্যাঁ, দুবেলা চায়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছে আমাদের শ্ৰীহরি, বুঝেছ কিনা? দেবু তাদের নিকট হইতে আরও অনেক খবর শুনিল। গ্রামের পাঁচজনকে লইয়া উঠিবার-বসিবার সুবিধার জন্যই শ্ৰীহরি পৃথক পাঠশালা-ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে। জমিদার তরফ হইতে জায়গার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে সে-ই। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার সে, সে-ই দেওয়ালের খরচ মঞ্জুর করাইয়াছে; নিজে দিয়াছে নগদ পঁচিশ টাকা। তা ছাড়া চালের কাঠ, খড়, দরজা-জানালার কাঠও যে দিয়াছে শ্ৰীহরি। দুই বেলা এখন চণ্ডীমণ্ডপে মজলিস বসে দেখিয়া শ্ৰীহরির বিপক্ষ দলের লক্ষ্মীছাড়ারা হিংসায় পাটু পাটু হইয়া গেল। তাহারা নানা নিন্দা রটনা করে। কিন্তু তাহাতে শ্ৰীহরির কিছু আসে যায় না। তাহার গোমস্তাগিরির অসুবিধা করিবার জন্যই তাহারা প্রজা-সমিতি গড়িয়াছে, কংগ্রেস কমিটি খাড়া করিয়াছে। দেবু যেন ওসবের মধ্যে না যায়। তারা নাপিত আরও গৃঢ় সংবাদ দিল। জমিদার এ গ্রামখানা পত্তনি বিলি করিবে কি না ভাবিতেছে। শ্ৰীহরি গিলিবার জন্য হাঁ করিয়া আছে। পত্তনি কায়েম হইলে, শ্ৰীহরি বাবা বুড়োশিবের অর্ধসমাপ্ত মন্দিরটা পাকা করিয়া দিবে, চণ্ডীমণ্ডপের আটচালার উপর তুলিবে পাকা নাটমন্দির। শ্ৰীহরির বাড়িতে এখন একজন রাঁধুনী, একজন ছেলে পালন করিবার লোক। তারাচরণ পরিশেষে বলিলই যে হরিহরের দুই কন্যে যারা কলকাতায় ঝি-গিরি করতে গিয়েছিল—তারাই। বুঝলেন তার মানে রীতিমত বড়লোকের ব্যাপার, দুজনকেই এখন ছিরু রেখেছে। বুঝলেন, একেবারে আমীরী মেজাজ। হরিহরের ছোট মেয়েটা যখন এইএ-ই রোগা, শণফুলের মত রঙ। ক্রমে শোনা গেল কলকাতায়—বুঝলেন? অর্থাৎ মাতৃত্ব-সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করিয়াছিল মেয়েটি। তাই গ্ৰাম্য-সমাজ তাহাদিগকে পতিত করিল। কিন্তু শ্রীহরি দয়া করিয়া আশ্রয় দিয়াছে; তাহারই অনুরোধে সমাজ তাহাদের টি মার্জনা করিয়াছে; তারা বলিল-দু-দুটো মেয়ের ভাত-কাপড়, শখ-সামগ্ৰী তো সোজা কথা নয়, দেবু-ভাই। বৃদ্ধ চৌধুরী শুধু আপন সংসারের সংবাদ দিলেন, দেবুর জেলের সুখ-দুঃখের সংবাদ লইলেন। পরিশেষে আশীৰ্বাদ করিলেন পণ্ডিত, তুমি দীর্ঘজীবী হও। দেখ, যদি পার বাবা তবে শ্রীহরির সঙ্গে ডাক্তারের, আর বিশেষ করে কর্মকারের মিটমাট করিয়ে দাও। অনিরুদ্ধ লোকটা নষ্ট হয়ে গেল। এরপর সর্বনাশ হয়ে যাবে। কথাটার অর্থ ব্যাপক। রামনারায়ণ আসিয়া বলিল ভাল আছ দেবু-ভাই? আমার মা-টি মারা গিয়েছেন। বৃন্দাবন দোকানি বলিলচালের ব্যবসায় অনেক টাকা লোকসান দিলম দেবু-ভাই। যারা চালের ব্যবসা করেছিল তারা সবাই দিয়েছে। জংশনের রামলাল ভকত তো লালবাতি জ্বেলে দিল। বৃদ্ধ মুকুন্দ একটি খোকাকে কোলে করিয়া দেখাইতে আসিয়াছিল, আমাদের সুরেন্দ্রের ছেলে, দেখ বাবা দেবু। মুকুন্দের পুত্র গোবিন্দ, গোবিন্দের পুত্র সুরেন্দ্র, সুতরাং সুরেন্দ্রের ছেলে তাহার প্রপৌত্র। সন্ধ্যার মুখে নিজে আসিল শ্ৰীহরি। শ্ৰীহরি এখন সম্ভ্ৰান্ত লোক। লম্বা চওড়া পেশি-সবল যে জোয়ান চাষী নগ্নদেহে কোদাল হাতে ঘুরিয়া বেড়াইত, দুর্দান্ত বিক্ৰমে দৈহিক শক্তির আস্ফালন করিয়া ফিরিত, সামান্য কথায় শক্তি প্রয়োগ করিত, জোর করিয়া পরের সীমানা খানিকটা আত্মসাৎ করিয়া লইত, কর্কশ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিত—সে-ই গ্রামের প্রধান ব্যক্তি, তাহার অপেক্ষা বড় কেহ নাই, সেই ছিরু পালের সঙ্গে এই শ্ৰীহরির কোনো সাদৃশ্য নাই। শ্ৰীহরি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানুষ! তাহার পায়ে ভাল চটি, গায়ে ফতুয়ার উপর চাদর; গম্ভীর সংযত মূৰ্তি, সে এখন গ্রামের গোমস্তা—মহাজন। বলিতে গেলে সে এখন গ্রামের অধিপতি। –দেবু-খুড়ো রয়েছ
false
shomresh
ভোটর বাক্সে কাগজ ফেলে নিশ্চিন্তে ঘরের কোণায় জায়গা খুঁজেছে। দেশটার দায়দায়িত্ব দুটো রাজনৈতিক দলের ওপরে দিয়ে তারা জেনে গিয়েছে কিছু করার নেই। যে তাদের পাইয়ে দেবে সেই দলই ব্যালটটা পাবে। মাঝে মাঝে আবেগের হাওয়ায় অবশ্য ভাসাভাসি চলে কিন্তু স্বার্থ শব্দটার বাইরে আর কিছুর কথা জনসাধারণ ভাবতে রাজী নয়। ক্রমশ এই স্বার্থ শব্দটার ক্ষেত্রও ছোট হয়ে আসছে। এখনও পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে নিজেরটা বাঁচাও-এর মধ্যে সীমিত আছে। কদিন পরে পাশের ঘরে মা বাবা পুড়ে মরলে সে নিজের শরীরটাকে বাঁচাতে আগে ছুটবে। এই পরিস্থিতিতে নবগঠিত পার্টি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বেশ কিছু অচলায়তনকে ধাক্কা দেওয়া রক্তগরম করা শব্দাবলী একত্রিত করে ছাপা একটি লিফলেট ওদের হাতে পড়েছিল। ওরা বিস্মিত হয়েছিল কিছু মানুষ এ ব্যাপারটা নিয়ে সক্রিয় ভাবনা ভাবছেন এবং খুব গোপনে সংগঠন গড়ে তুলছেন। এরপরেই আনন্দর সঙ্গে পার্টির যোগাযোগ হয়। আনন্দ প্রায় নিয়মিত যাওয়া আসা করত। বাকি তিনজন ছিল অনিয়মিত। এর পিছনে কোন নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। শুধু একটি জনসভায় উপস্থিত থেকে ওরা কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার পর ওদের মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। সেইসঙ্গে দ্বিধা। ওরা স্থির করে নেয়, আনন্দই যোগাযোগ রাখবে। ওদের ধারণা হচ্ছিল এখন কোন অবস্থাতেই পার্টির পক্ষে সাহসী হওয়া সম্ভব নয়। এমন একজন নেতা পার্টিতে নেই যাকে জনসাধারণ বিশ্বাস করবে। অতএব আরও বিশদভাবে পরবর্তী কার্যাবলী লক্ষ্য করা দরকার বলে ওদের মনে হয়েছিল। কল্যাণ এবার সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, ঠাকুরপুকুরে তোর কে থাকে? কাফি দূরের রিলেটিভ। বুড়ি আমাকে পছন্দ করে বলে মনে হয়। তা করুক। কিন্তু এর সঙ্গে তোর গ্রামের কি সম্পর্ক? প্রশ্নটা আনন্দর উদ্দেশ্যে। আনন্দ হাসল, এই নিয়ে আলোচনা করার জন্যে আমরা এখানে এসেছি। তার আগে আমি প্রত্যেককে একটি প্রশ্ন করছি। যে কাজ করব বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে কারও কোন দ্বিধা বা ভয় নেই তো? কল্যাণ মাথা নাড়ল, প্রশ্নই ওঠে না। সুদীপ বলল, এই প্রশ্নটাই নিরর্থক। জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল, এই প্ল্যানটার কথা এখন পর্যন্ত কজন মানুষ জেনেছে? আনন্দ বলল, দমদমে কাল তিনজন ছিল আর ধর, আমরা ছাড়া আর চারজন জানে। কিন্তু নট ইন ডিটেলস। আমি স্পটটাও বলিনি তবে ওরা জানে আমরা চারজন একসঙ্গে আছি, দ্যাটস অল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, এই চারজনের কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে? আনন্দ মাথা নাড়ল, না, সেরকম হওয়ার চান্স খুব কম। তাছাড়া তোদের সঙ্গে কথা বলেই আমি গিয়েছিলাম। কখনও কখনও তো বিশ্বাস করতে হয়। জয়িতা বলল, এই বিশ্বাসটা যেন আমাদের খুব বড় দাম দিতে বাধ্য না করে। আনন্দ চট করে প্রশ্ন করল, তুই কি ভয় পাচ্ছিস সঙ্গে আসতে? মোটই না। হেসে উঠল জয়িতা, আবার সেইসব বস্তাপচা শব্দগুলো যেন তোরা বলতে শুরু করিস না। তোরা যা করতে পারবি আমিও তাই পারব। এইভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে মরতে আর মরা দেখতে ভাল লাগে না। ভবিষ্যতের কথা যদি ভেবে ভয় পেতাম তাহলে তো নিজের ক্যারিয়ার গোছাতাম রে। তবে এখন থেকে আমাদের চারজনের বাইরে কোন কথা আর কাউকে বলার দরকার নেই। কারও কাছে কিছু যখন পাওয়া যাবে না–। সুদীপ গুনগুন করল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে–। আনন্দ চাপা গলায় বলল, বি সিরিয়াস সুদীপ! গান থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে সুদীপ বলল, আই অ্যাম অলওয়েজ সিরিয়াস। তারপরেই দূরের এক টেবিলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, কিরে, তোদের পত্রিকা বেরিয়েছে? ওপাশ থেকে একটি ছেলে হাত নেড়ে না বলল। জয়িতা বলল, চমৎকার নমুনা। সুদীপ হাসল, যদি কেউ আমাদের লক্ষ্য করে তাহলে এখন ভাববে আমরা স্রেফ আড্ডা মারছি। এতক্ষণ যা গম্ভীর মুখে তোরা কথা বলছিলি যে দেখলেই সন্দেহ হত। আনন্দ বলল, ঠিক আছে। আর ফালতু কথা নয়। শোন, আমরা বিকেলের বাস ধরে ডায়মন্ডহারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হব। ওখানে পৌঁছতে হবে এমন সময় যাতে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসে। তোরা সবাই আমার বাড়িতে চলে আসবি। আমার এক বন্ধু ড্রাইভারি করে, মানে একসঙ্গে আমরা স্কুলে পড়তাম, তাকে বলব গাড়ি আনতে। সেই গাড়ি নিয়ে জয়িতা আর সুদীপ প্যারাডাইসে পোঁছে যাবি। সুদীপ মাথা নাড়ল, আর একজন উইটনেস থাকছে না? আনন্দ বলল, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি। কিন্তু আমাদের একটা গাড়ি দরকার। সুদীপ বলল, আমি গাড়ি চালাতে পারি। কাউকে কিছু বলার কোন দরকার নেই। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি পাবি কোথায়? সুদীপ হাসল, পেয়ে যাব। রাস্তায় এত গাড়ি আর একটা গাড়ি পাব না? আমি তো আজ আনন্দর সঙ্গে যাচ্ছি, হালচাল দেখে ওটা ঠিক করে আসব। আনন্দ বলল, ধর, তোর কিছু হল? হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। আনন্দর প্রশ্নটা নিয়ে সুদীপ অবশ্য বিব্রত হচ্ছিল না। কারণ তার ঠোঁটে হাসি লেগেই ছিল। জয়িতা বলল, আমি চালাব তাহলে। আনন্দ খুশী হল, বেশ তাহলে একটা ঝামেলা চুকল। গাড়িটা কিভাবে পাওয়া যায় তা আজ আমরা দেখে আসব। এবার কেন সুদীপের আত্মীয়ের বাড়ির কথা বলছি সে প্রসঙ্গে আসছি। সুদীপের কাছ থেকে শুনেছি যে ওই বাড়িতে ভদ্রমহিলা একা থাকেন। বেশ বড় বাড়ি। জায়গাটা কলকাতার কাছেই আবার আমাদের গ্রাম থেকে সোজা চলে আসা যায়। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা ওই বাড়িতে শেল্টার নিতে পারি। কিন্তু এসবই নির্ভর করছে সুদীপ কিভাবে ওর আত্মীয়াকে ম্যানেজ করবে তার ওপর। যদি তিনি রাজী হন তাহলে যতদিন না সবকিছু ঠাণ্ডা হচ্ছে ততদিন আমরা নিশ্চিন্ত। সুদীপ বলল,
false
humayun_ahmed
পাকস্থলী ধৌতকরণ প্রক্রিয়ায় তার বিকার যে দূর হচ্ছে তা না। বরং আরো বাড়ছে। শিবশংকর তার আবিষ্কারের বিষয়টা চিঠি লিখে দু’জনকে জানিয়েছে। একজন তার বাবা মনিশংকর। অন্যজন বিখ্যাত মানুষ— শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনিশংকর পুত্রের চিঠির জবাব সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়েছেন। তিনি পুত্রের মানসিক অবস্থা নিয়ে যে দুশ্চিন্তগ্রস্ত তা তাঁর চিঠিতে বোঝা যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন– বাবা শিবশংকর, তোমার পত্র পাঠ করিয়া দুঃখিত এবং চিন্তিত হইয়াছি। তোমাকে একা রাখা ঠিক হয় নাই। তোমার আশেপাশে আমার থাকা উচিত ছিল। আমি নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত বলিয়া তাহা পারি নাই। ইহা আমার ব্যর্থতা। তুমি প্রমাণ করিয়াছ প্রার্থনা = ০, কিন্তু বাবা আজ তুমি যে বাঁচিয়া আছ তার মূলে আছে প্রার্থনা। তোমার আরোগ্য সাধনের সমস্ত চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয় তখন হরিচরণ বাবু প্রার্থনার মাধ্যমে তোমার জীবন রক্ষা করেন। এই কাহিনী বান্ধবপুরের সকলেই জানে। তুমিও নিশ্চয়ই এই বিষয়ে অবগত আছ। এখন আমার আদেশ, তুমি মাথা হইতে এই ধরনের উদ্ভট এবং ক্ষতিকর চিন্তা পরিত্যাগ করিবে এবং কায়মনে পাপচিস্তার জন্যে ভগবানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিবে। গোপীবাবুর কাছে শুনিলাম তোমার শরীর ভালো যাইতেছে না। আমি বিশেষ চিন্তাযুক্ত। মন্ত্রপূত একটি শক্তিকবজ পাঠাইলাম। ভক্তি সহকারে গলায় ধারণ করবে। যেন অন্যথা না হয়। ইতি তোমার চিন্তাযুক্ত পিতা শ্ৰী মনিশংকর রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠির জবাব এলো না। শিবশংকর তা আশাও করে না। বড় মানুষদের কাছে সবাই চিঠি লেখে। এত চিঠির জবাব দেয়া সম্ভব না। মন্ত্রপূত মাদুলির গুণেই হোক কিংবা পাকস্থলী ধৌতকরণ চিকিৎসার কারণেই হোক শিবশংকরের রোগ খানিকটা সেরেছে। পালা জ্বর বন্ধ হয়েছে। সে আগের মতো ঘুরতে বের হচ্ছে। হরিচরণের কবরের পাশে বেড়ে ওঠা আমগাছের চারদিকে রুটিন করে ঘুরছে। এই কাজটা করতে কেন জানি ৩।- ভালো লাগে। নিজেকে তখন ইলেকট্রন মনে হয়। ইলেকট্রন যেমন অ্যাটমো নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরে সেও সেরকম ঘুরছে। আমগাছটা যেন নিউক্লিয়াস। প্রোটন এবং নিউট্রন। বেলা কম হয় নি, দশটার ওপরে বাজে। শিবশংকর আমগাছের চারদিকে ঘুরছে। তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, কারণ ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। এই বৎসরটা মনে হয় কুয়াশার বছর। শ্রাবণ মাস শুরু হয়েছে। টানা বৃষ্টি হবার কথা। তার বদলে কুয়াশা। কথায় আছে— ‘মেঘের দিনে কুয়াশা, রাজকপালও ধুয়াশা।’ বড় কোনো দুর্ঘটনা অবশ্যই ঘটবে। শিবশংকর নিজের মনে আছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলছে, . . হঠাৎ সে শুনল অতি মিষ্টি সুরে কেউ যেন কথা বলল, আপনার কী হয়েছে? শিবশংকর দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে কিশোরী এক মেয়ে বের হয়ে এলো। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় ঘোমটার মতো করে দেয়া ওড়না। মেয়েটির গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর। বড় বড় চোখ। চোখের মণি ঘন কৃষ্ণবর্ণ। মুখ গোলাকার। নাক সামান্য চাপা। কুয়াশার ভেতর মেয়েটাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মতো। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা মুসলমান। মেয়েটা আবার বলল, আপনার কী হয়েছে? শিবশংকর বিব্রত গলায় বলল, কিছু হয় নাই তো। চক্কর দিচ্ছেন কেন? এমি। এটা আমার খেলা। মেয়েটি বলল, ছোট বাচ্চারা এরকম খেলে। আপনি কি ছোট বাচ্চা? শিবশংকর বলল, তুমি বান্ধবপুরের? মেয়েটি বলল, আমার নাম আতর। আমি ধনু শেখের মেয়ে। কোলকাতায় থাকো? হুঁ। জাপানিরা বোমা ফেলবে এইজন্যে চলে এসেছি। স্কুলে পড়? হুঁ। বেগম রোকেয়ার স্কুলে। কোন ক্লাসে? ক্লাস এইট। তুমি ছাত্রী কেমন? ভালো না। ক্লাস সেভেনে একবার ফেল করেছি। আমেরিকা কে আবিষ্কার করেছেন জানো? জানি। কলম্বাস। শুধু কলম্বাস বলা ঠিক না। বলা উচিত ক্রিক্টোফার কলম্বাস। ভাস্কো দা গামা কে জানো? জানি না। আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কি বেলারানি? বেলারানি কে? বেলারানি আমাদের ইংরেজি। আপা। শুধু প্রশ্ন করেন। কেউ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে বলেন, . আমরা উনাকে কী ডাকি জানেন? আমরা ডাকি মিসেস গোটরানি। তার একটা ছেলে আছে। হাবাগোবা। নাম অক্ষয়। আট বছর বয়স। একদিন স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাকে বললাম, এই তোর নাম কী? সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আততায় বাবু। শিবশংকর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কী সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে। যেন শিবশংকর তার অনেক দিনের চেনা কেউ। মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিটাও কী সুন্দর! হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। অভিনয়ও করছে। তোতলামির অভিনয় করে কী সুন্দর বলল— আততায় বাবু। শিবশংকর বলল, তুমি তো আমার নাম জিজ্ঞেস করলে না। আতর বলল, আমি সবাইকে চিনি। আপনাকেও চিনি। আপনি মনিশংকর চাচার ছেলে শিবশংকর। আপনি গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। হয়েছে না? হয়েছে। আমি এখন যাই। অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলে ফেলেছি। আল্লাহ আমাকে পাপ দিকে। শিবশংকর তাকিয়ে আছে। আতর নামের মেয়েটা ছোট ছোট পা ফেলে। দ্রুত যাচ্ছে। শিবশংকরের কাছে মনে হলো, হাঁটার মধ্যেও এই মেয়ের নাচের ভঙ্গি আছে। মেয়েটির ওপর থেকে এক মুহুর্তের জন্যে সে চোখ ফেরাতে পারল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্যে তার একটু লজ্জাও লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে বান্ধবপুরের সবাই তাকে দেখছে। ধনু শেখ অনেক বেলায় নাশতা খেতে বসেছেন। বাটিভর্তি মুরগির মাংস এবং চালের আটার রুটি। তার হজমের সমস্যা হচ্ছে। যা খান কিছুই হজম হয় না। বুক জ্বালাপোড়া করে। কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। কোলকাতার কবিরাজ আয়ুৰ্বেদশাস্ত্রী মিশ্র ঠাকুর চিকিৎসা করছেন। গুরুপাক খাবার সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিয়েছেন। নিষেধ মানা ধনু শেখের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ধনু শেখ খেতে বসেছেন উঠানের জলচৌকিতে। চায়ের কাপে ওষুধ তৈরি করা আছে। খাওয়া শেষ করেই ওষুধ খাবেন। ওষুধ
false
robindronath
করতে হয় না।” পথিকদ্বয় শশব্যস্ত ও অপ্রতিভ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিল। বিল্বন কহিলেন, “বাপু, তোমারা যে কথা বলছিলে সে কথাগুলো ভালো নয়।” পথিকদ্বয় কহিল, “যে আজ্ঞে ঠাকুর, আর অমন কথা বলব না।” পুরোহিত ঠাকুরকে পথে ছেলেরা ঘিরিল। তিনি কহিলেন, “আজ বিকালে আমার ওখানে যাস, আমি আজ গল্প শোনাব।” আনন্দে ছেলেরা লফালাফি চেঁচামেচি বাধাইয়া দিল। বিল্বন ঠাকুর এক-একদিন অপরাহ্নে রাজ্যের ছেলে জড়ো করিয়া তাহাদিগকে সহজ ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক গল্প শুনাইতেন। মাঝে মাঝে দুই-একটি নীরস কথাও যথাসাধ্য রসসিক্ত করিয়া বলিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু যখন দেখিতেন ছেলেদের মধ্যে হাই তোলা সংক্রামক হইয়া উঠিতেছে তখন তাহাদের মন্দিরের বাগানের মধ্যে ছাড়িয়া দিতেন। সেখানে ফলের গাছ অসংখ্য আছে। ছেলেগুলো আকাশভেদী চীৎকার-শব্দে বানরের মতো ডালে ডালে লুটপাট বাধাইয়া দিত–বিল্বন আমোদ দেখিতেন। বিল্বন কোন্‌ দেশী লোক কেহ জানে না। ব্রাহ্মণ, কিন্তু উপবীত ত্যাগ করিয়াছেন। বলিদান প্রভৃতি বন্ধ করিয়া একপ্রকার নূতন অনুষ্ঠানে দেবীর পূজা করিয়া থাকেন–প্রথম প্রথম তাহাতে লোকেরা সন্দেহ ও আপত্তি প্রকাশ করিয়াছিল, কিন্তু এখন সমস্ত সহিয়া গিয়াছে। বিশেষত বিলবনের কথায় সকলে বশ। বিল্বন সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়া সকলের সঙ্গে আলাপ করেন, সকলের সংবাদ লন, এবং রোগীকে যাহা ঔষধ দেন তাহা আশ্চর্য খাটিয়া যায়। বিপদে আপদে সকলেই তাঁহার পরামর্শমতে কাজ করে–তিনি মধ্যবর্তী হইয়া কাহারও বিবাদ মিটাইয়া দিলে বা কিছুর মীমাংসা করিয়া দিলে তাহার উপরে আর কেহ কথা কহে না। এই বৎসরে ত্রিপুরায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল। উত্তর হইতে সহসা পালে পালে ইঁদুর ত্রিপুরার শস্যক্ষেত্রে আসিয়া পড়িল। শস্য সমস্ত নষ্ট করিয়া ফেলিল, এমন-কি, কৃষকের ঘরে শস্য যত কিছু সঞ্চিত ছিল তাহাও অধিকাংশ খাইয়া ফেলিল–রাজ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল। দেখিতে দেখিতে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইল। বন হইতে ফলমূল আহরণ করিয়া লোকে প্রাণধারণ করিতে লাগিল। বনের অভাব নাই, এবং বনে নানাপ্রকার আহার্য উদ্ভিজ্জও আছে। মৃগয়ালব্ধ মাংস বাজারে মহার্ঘ মূল্যে বিক্রয় হইতে লাগিল। লোকে বুনো মহিষ, হরিণ, খরগোশ, সজারু, কাঠবিড়ালি, বরা, বড়ো বড়ো স্থলকচ্ছপ শিকার করিয়া থাইতে লাগিল–হাতি পাইলে হাতিও খায়–অজগর সাপ খাইতে লাগিল–বনে আহার্য পাখির অভাব নাই–গাছের কোটরের মধ্যে মৌচাক ও মধু পাওয়া যায়–স্থানে স্থানে নদীর জল বাঁধিয়া তাহাতে মাদক লতা ফেলিয়া দিলে মাছেরা অবশ হইয়া ভাসিয়া উঠে, সেই-সকল মাছ ধরিয়া লোকেরা খাইতে লাগিল এবং শুকাইয়া সঞ্চয় করিল। আহার এখনো কোনোক্রমে চলিয়া যাইতেছে বটে, কিন্তু অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। স্থানে স্থানে চুরি-ডাকাতি আরম্ভ হইল; প্রজারা বিদ্রোহের লক্ষণ প্রকাশ করিল। তাহারা বলিতে লাগিল, “মায়ের বলি বন্ধ করাতে মায়ের অভিশাপে এই-সকল দুর্ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে।” বিল্বন ঠাকুর সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তিনি উপহাসচ্ছলে কহিলেন, “কৈলাসে কার্তিকগেণেশের মধ্যে ভ্রাতৃবিচ্ছেদ ঘটিয়াছে, কার্তিকের ময়ূরের নামে গণেশের ইঁদুরগুলো ত্রিপুরার ত্রিপুরেশ্বরীর কাছে নালিশ করিতে আসিয়াছে।” প্রজারা এ কথা নিতান্ত উপহাস ভাবে গ্রহণ করিল না। তাহারা দেখিল, বিল্বন ঠাকুরের কথামত ইঁদুরের স্রোত যেমন দ্রুতবেগে আসিল তেমনি দ্রুতবেগে সমস্ত শস্য নষ্ট করিয়া কোথায় অন্তর্ধান করিল–তিন দিনের মধ্যে তাহাদের আর চিহ্নমাত্র রহিল না। বিল্বন ঠাকুরের অগাধ জ্ঞানের সম্বন্ধে কাহারও সন্দেহ রহিল না। কৈলাসে ভ্রাতৃবিচ্ছেদ সম্বন্ধে গান রচিত হইতে লাগিল, মেয়েরা ছেলেরা ভিক্ষুকেরা সেই গান গাহিতে লাগিল, পথে ঘাটে সেই গান প্রচলিত হইল। কিন্তু রাজার প্রতি বিদ্বেষভাব ভালো করিয়া ঘুচিল না। বিল্বন ঠাকুরের পরামর্শমতে গোবিন্দমাণিক্য দুর্ভিক্ষগ্রস্ত প্রজাদের এক বৎসরের খাজনা মাপ করিলেন। তাহার কতকটা ফল হইল। কিন্তু তবুও অনেকে মায়ের অভিশাপ এড়াইবার জন্য চ-গ্রামে পার্বত্য প্রদেশে পলায়ন করিল। এমন-কি, রাজার মনে সন্দেহের উদয় হইতে লাগিল। তিনি বিল্বনকে ডাকিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, রাজার পাপেই প্রজা কষ্ট পায়। আমি কি মায়ের বলি বন্ধ করিয়া পাপ করিয়াছি? তাহারই কি এই শাস্তি?” বিল্বন সমস্ত কথা একেবারে উড়াইয়া দিলেন। তিনি কহিলেন, “মায়ের কাছে যখন হাজার নরবলি হইত, তখন আপনার অধিক প্রজাহানি হইয়াছে, না এই দুর্ভিক্ষে হইয়াছে?” রাজা নিরুত্তর হইয়া রহিলেন কিন্তু তাঁহার মনের মধ্য হইতে সংশয় সম্পূর্ণ দূর হইল না। প্রজারা তাঁহার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছে, তাঁহার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিতেছে, ইহাতে তাঁহার হৃদয়ে আঘাত লাগিয়াছে, তাঁহার নিজের প্রতিও নিজের সন্দেহ জন্মিয়াছে। তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “কিছুই বুঝিতে পারি না।” বিল্বন কহিলেন, “অধিক বুঝিবার আবশ্যক কী। কেন কতকগুলো ইঁদুর আসিয়া শস্য খাইয়া গেল তাহা নাঞ্চই বুঝিলাম। আমি অন্যায় করিব না, আমি সকলের হিত করিব, এইটুকু স্পষ্ট বুঝিলেই হইল। তার পরে বিধাতার কাজ বিধাতা করিবেন, তিনি আমাদের হিসাব দিতে আসিবেন না।” রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি গৃহে গৃহে ফিরিয়া অবিশ্রাম কাজ করিতেছে, পৃথিবীর যতটুকু হিত করিতেছ ততটুকুই তোমার পুরস্কার হইতেছে, এই আনন্দে তোমার সমস্ত সংশয় চলিয়া যায়। আমি কেবল দিনরাত্রি একটা মুকুট মাথায় করিয়া সিংহাসনের উপরে চড়িয়া বসিয়া আছি, কেবল কতকগুলো চিন্তা ঘাড়ে করিয়া আছি–তোমার কাজ দেখিলে আমার লোভ হয়।” বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ, আমি তোমারই তো এক অংশ। তুমি ওই সিংহাসনে বসিয়া না থাকিলে আমি কি কাজ করিতে পারিতাম? তোমাতে আমাতে মিলিয়া আমরা উভয়ে সম্পূর্ণ হইয়াছি।” এই বলিয়া বিল্বন বিদায় গ্রহণ করিলেন, রাজা মুকুট মাথায় করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। মনে মনে কহিলেন, “আমার কাজ যথেষ্ট রহিয়াছে, আমি তাহার কিছুই করি না। আমি কেবল আমার চিন্তা লইয়াই নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। সেইজন্যই আমি প্রজাদের বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারি না। রাজ্যশাসনের আমি যোগ্য নই।” মোগল-সৈন্যের কর্তা হইয়া নক্ষত্ররায় পথের মধ্যে তেঁতুল-নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে বিশ্রাম
false
zahir_rayhan
ও ঘর থেকে আমের ডাক শোনা যায়, টুনি বিবি কই গেলা, খাইতে আহ! আহি, বলে সেখান থেকে চলে যায় টুনি। আজকাল রাতের বেলা আমেনার ঘরে শোয় মকবুল। টুনি থাকে পাশের ঘরে। আগে, ফাতেমা আর ও দুজনে এক সঙ্গে থাকতো। মাসখানেক হলো ফাতেমা বাপের বাড়ি গেছে। এখন টুনি একা। রাতের বেলা ইচ্ছেমত যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ালেও ধরবার উপায় নেই। রাত জেগে মাছ ধরাটা ইদানীং একটা নেশা হয়ে গেছে ওদের। ঘুঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের এ পুকুর থেকে অন্য পুকুরে জাল মেরে বেড়ায় ওরা। হাতে একটা টুকড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে টুনি। জালে ওঠা মাছগুলো ওর মধ্যে ভরে রাখে। পর পুকুরের মাছ ধরতে গিয়ে সমস্ত সময় সজাগ থাকতে হয় ওদের। চারপাশে দৃষ্টি রাখতে হয়। একদিন প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলো দুজনে। জমীর মুন্সির বড় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলো সেদিন। আকাশে চাঁদ ছিলো কিন্তু চাদনী ছিলো না। কালো মেঘে ছেয়ে ছিলো পুরো আকাশটা। এক হাঁটু পানিতে নেমে জালটাকে সন্তর্পণে ছুঁড়ে দিয়েছিলো সে। পুকুরের মাঝখানটাতে। শব্দ হয় নি মোটেও। কিন্তু পুকুর পাড় থেকে জোর গলায় আওয়াজ শোনা গেল, কে, কে জাল মারে পুকুরে? এক হাঁটু পানি থেকে নীরবে এক গলা পানিতে নেমে গেলো মন্তু। টুনি ততক্ষণে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। জমীর মুন্সির হাতের টর্চটা বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল পুকুরের এপার থেকে ওপারে। মনে মনে বার বার খোদাকে ডাকছিলো মন্তু, খোদা তুমিই সব। একটু পরে পাড়ের ওপর থেকে টুনির চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, এই উইঠা আহ। মুন্সি চইলা গেছে। বলে খিল খিল করে হেসে উঠে সে। ওর হাসির শব্দে রাগে সমস্ত দেহটা জ্বালা করে উঠেছে মন্তুর। এমন সময়ে মানুষ হাসতে পারে? তারপর থেকে আরো সাবধান হয়ে গেছে মন্তু। গনু মোল্লার কাছ থেকে তিন আনা পয়সা খরচ করে একটা জোরদার তাবিজ নিয়েছে সে। রাতে বিরাতে গাঁয়ের পুকুরে মাছ ধরে বেড়ানো, বিপদ আপদ কখন কি ঘটে কিছুতো বলা যায় না। আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো। সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে, বাজুর ওপরে বাঁধা তাবিজটাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিলো মন্তু। তারপর বুনো লতার ঝোপটাকে দুহাতে সরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলো সে। টুনি পেছন থেকে বললো, বারে, অত জোরে হাঁটলে আমি চলি কি কইরা? মন্তু জালটাকে গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, আস্তে আহ, তাড়া কিসের? টুনি বলে বারে, আমার বুঝি ডর ভয় কিছুই নাই। যদি সাপে কামড়ায়? সাপের কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ একটা অ্যাঁধি সাপ ফোঁস করে উঠে সরে যায় সামনে থেকে। অ্যাঁতকে উঠে দুহাত পিছিয়ে আসে মন্তু। ভয় কেটে গেলে থুতু করে বুকের মধ্যে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দেয় সে। পেছনে টুনির দিকে তাকিয়ে বলে, বুকে থুক দাও তাইলে কিছু অইবো না। কোন রকম বিতর্কে না এসে নীরবে ওর কথা মেনে নেয় টুনি। কপালটা আজ মন্দ ওদের। অনেক পুকুর ঘুরেও কিছু চিংড়ি গুঁড়ো ছাড়া আর কিছু জুটল না। মাছগুলো কেমন যেন সেয়ানা হয়ে গেছে। পুকুরের ধারে কাছে থাকে না। থাকে গিয়ে একেবারে মাঝখানটিতে, এতদূর জাল উড়িয়ে নেয়া যায় না। টুনি বলে থাক, আইজ থাউক, চলো বাড়ি ফিইরা যাই। জালটাকে ধুয়ে নিয়ে মন্তু আস্তে বলে, চলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুলো হাতটা কোলে নিয়ে বসে বসে আবুল আর হালিমার ঝগড়া দেখছিলো মকবুল। অনেকক্ষণ কি একটা বিষয় নিয়ে তর্ক চলছে ওদের মধ্যে। দাওয়ায় বসে বসে যা মুখে আসছে ওকে বলে যাচ্ছে আবুল। হালিমাও একেবারে চুপ করে নেই। উঠানে একটা লাউয়ের মাচা বাধতে বাঁধতে দুএকটা জবাবও দিচ্ছে সে মাঝে মাঝে। মকবুল হাতের ব্যথায় মৃদু কাতরাচ্ছিলো আর পিটপিট চোখে তাকাচ্ছিলো ওদের দিকে। হঠাৎ দাওয়া থেকে ছুটে এসে মূহুর্তে হালিমার চুলের গোছাটা চেপে ধরলো আবুল। তারপর কোন চিন্তা না করে সজোরে একটা লাখি বসিয়ে দিলো তলপেটে। উঃ মাগো, বলে পেটটা দুহাতে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লো হালিমা। রাগে তখন ফোপাচ্ছে আবুল, আমার ঘরের ভাত ধ্বংস কইরা রাস্তার মানুষের লগে পিরীত। জানে খতম কইরা দিমু না তোরে। কাইটা রাস্তায় ভাসায় ডিমু না। বলে আবার ওর চুলের গোছাতে হাত দিতে যাচ্ছিলো আবুল, বুড়ো মকবুল চিৎকার করে উঠলো, খবরদার আবুইল্যা, তুই যদি বউ-এর গায়ে আরেকবার হাত তুলছস তাইলে ভালো অইবো না কিন্তুক। আমার ঘরণীর গায়ে আমি হাত তুলি কি যা ইচ্ছা তাই করি, তুমি কইবার কে, অ্যাঁ? পরক্ষণে আবুল জবাব দিলো, তুমি যখন তোমার ঘরণীরে তুলা পেড়া কর তহন কি আমরা বাধা দেই? অমন কোণঠাসা উত্তরের পর আর কিছু বলার থাকে না মকবুলের। শুধু জুলন্ত দৃষ্টিতে এক নজর ওর দিকে তাকালো মকবুল। আবুল তখন ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে চলেছে হালিমাকে। ভেতরে নিয়ে ঝাঁপি বন্ধ করে মনের সুখে মারবে। ওর ইচ্ছে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো হালিমা। তাই মাটি অ্যাঁকড়ে ধরে গোঙাতে লাগলো সে, ওগো তোমার পায়ে পড়ি। আর মাইরো না, মইরা যামু। চুপ, চুপ, তীব্র গলায় ওকে শাসিয়ে ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেয় আবুল। হেঁচকা টানে ওর পরনের হেঁড়া ময়লা শাড়িটা খুলে নিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। তালি দেয়া পুরান ব্লাউজটা অ্যাঁটসাঁট করে বাঁধা ছিলো টেনে সেটাও খুলে ফেলে আবুল। তারপর দু’পায়ে ওর নগ্ন দেহটাকে প্রচণ্ডভাবে মাড়াতে থাকে সে। বেড়ার সঙ্গে পুরান একটা ছড়ি
false
MZI
ভিতরে সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। সোনালি চুলের রিশা বলল, কখনো যদি বিয়ের কথা ভাব আমাকে জানিও, আমি এখনো কুমারী। সারা ঘরে আবার হাসির শব্দ শোনা যায়। ০৪ দুই ঘণ্টা পর মহাকাশযানটি নামহীন গ্রহটিতে অবতরণ করল কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই। মহাকাশযানটি অবতরণ করার জন্যে যে জায়গাটি বেছে নিয়েছিল তার থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযানের ইঞ্জিনঘরে সুহান তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তার পায়ের কাছে মূর্তির মতো বসেছিল ট্ৰিনি। স্থির চোখে তাকিয়েছিল সুহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে। দেখে মনে হতে পারে বুঝি গভীর ভালবাসায়। কিন্তু ট্ৰিনি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে কোনো ভালবাসা নেই। মহাকাশযান সুহানের হাতে একটি বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্রটি সে নিজে তৈরি করেছে। একটি ধাতব নলের সাথে একটি হাতল লাগানো। নলের মাঝে সে খানিকটা বিস্ফোরক রেখে তার সামনে ছোট একটি বুলেট রাখে। বুলেটের মাঝে থাকে চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক। হাতলের সাথে একটা ট্রিগার লাগানো আছে। ট্রিগারটি টেনে ধরার সাথে সাথে বিস্ফোরকে ছোট একটি বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ আঘাত করে। বুলেটটি ছুটে যায় সাথে সাথে। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার পর চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরকে ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ হয়। অস্ত্রটিতে নতুন করে বিস্ফোরক ভরে সহান বহু দূরে একটি পাথরের দিকে তাক করে দাঁড়ায়। ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান, তুমি অযথা সময় নষ্ট করছ। কেন? এই অস্ত্রটি দিয়ে তুমি কখনো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। কেন? কারণ এর মাঝে দৃষ্টিবদ্ধ করার জন্যে কোনো লেজাররশ্মি নেই। লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যে কোনো মেগা কম্পিউটার নেই। তোমার হাতে যেটা রয়েছে সেটা একটি খেলনা। সুহান তীক্ষ্ণ চোখে দূর পাথরটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খেলনা দিয়ে খেলতে ভালবাসি। এটি শুধু খেলনা নয়, এটি একটি বিপজ্জনক খেলনা। তুমি এর মাঝে চার মাত্রার বিস্কোরকে তৈরী একটা বুলেট রেখেছ। এটি তোমার হাতে বিস্ফোরিত হবার সম্ভাবনা তের দশমিক চার। এই গ্রহে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল চার দশমিক নয়। তুমি আমাকে শুধু শুধু জ্বালাতন করছ। সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরল। তার ত্রাতের অস্ত্রটি থেকে ভয়ঙ্কর একটা শব্দ করে বুলেটটি বের হয়ে যায়। দূরে একটি বিক্ষেরণ হয়। তার লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে। ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে বলেছি, তুমি এটা দিয়ে কখনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে না। এক শ বার পারব। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে বুলেটটা নিচে নেমে আসছে। লক্ষ্যবস্তুর একটু উপরে তাক করলে— তোমার যুক্তি হাস্যকর। অস্ত্র মাত্রই এই ধরনের হিসেব করতে পারে। তোমার খালি চোখে আন্দাজ করে নিশানা করা পুরোপুরি অর্থহীন। সময় এবং শক্তির অপচয়। সবচেয়ে বড় কথা—এটি বিপজ্জনক। হোক বিপজ্জনক। আমি এভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে চাই। খালি চোখে আন্দাজ করে। হাতের স্পর্শে। কেন? আমার ইচ্ছে। ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান শুনতে পায়, তার মাথা থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। ট্ৰিনি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনশীল করে কিছু একটা শোনার বা দেখার চেষ্টা করছে। নিজে থেকে তাকে কিছু বলল না বলে সুহান কিছু জিজ্ঞেস করল না। সুহান তার অস্ত্রটিতে বিস্ফোরক ভরে আবার সেখানে একটি বুলেট ঢুকিয়ে নেয়। ভালো করে দেখে সে আবার দুই হাতে অস্ত্রটি তুলে ধরে দূরে তাক করে, আগের বার যেখানে তাক করেছিল এবারে তার থেকে একটু উপরে। সমস্ত ইন্দ্রিয় একাগ্র করে সে লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাকায়। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে এক ঝলক কালো ধোঁয়ায় তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ধোয়াটা সরে যেতেই সে অবাক হয়ে দেখে, লক্ষ্যবস্তুর পাথরটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সুহান আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল, ট্ৰিনি তখনো সামনে তাকিয়ে আছে। তার সংবেদনশীল চোখে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। তার সংবেদনশীল শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। সুহান খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনি। বল। আমি এইমাত্র আমার অস্ত্রটি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছি। ও। তুমি শুনে অবাক হলে না? কী ব্যাপার? তুমি কী দেখছ। না, কিছু না। সুহান শব্দ করে হেসে বলল, তুমি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তোমার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা সম্ভব নয়। তুমি যখন চেষ্টা কর সেটা আমি খুব সহজে ধরে ফেলি। ট্ৰিনি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি মোটেই মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করছি না। আমি কিছু দেখছি না। তুমি কি কিছু দেখার চেষ্টা করছ? আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই। সুহান আবার শব্দ করে হেসে ফেলে বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষি রবোট! তোমার ভিতরে একেবারে কোনোরকম জটিলতা নেই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কাল রাত থেকে তুমি খুব বিচিত্র রকম ব্যবহার করছ। আমার কাছে তুমি কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছ। ট্ৰিনি কোনো কথা বলল না, যার অর্থ সত্যিই সে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। সুহান বলল, আমি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারি তুমি আমার কাছে কী লুকানোর চেষ্টা করছ। করব? না। সুহান আবার হেসে ফেলল। বলল, ঠিক আছে, তুমি থাক তোমার গোপন কথা নিয়ে। সে আবার তার বিচিত্র অস্ত্রটি নিয়ে তার মাঝে বিস্ফোরক ভরতে থাকে। এটি তার একটি নতুন খেলা। ট্ৰিনি বহুদূরে তাকিয়ে তার সংবেদনশীল চোখটি আরো সংবেদনশীল করে ফেলে। মাটিতে সে কুড়ি হার্টজ তরঙ্গের উপর সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ এবং নব্বই
false
shomresh
বিশু খোকন তার সঙ্গে পড়েছে। একই স্কুল থেকে পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। ছেলেদের সিট পড়েছিল। অবশ্য আলিপুরদুয়ারে। কিন্তু তার বিয়ের পর আর ওরা নিজে থেকে কথা বলতে আসেনি। যেভাবে দীপা নিজেকে গুটিযে নিয়েছিল তাতে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করছিল ওরা। আজ দীপার ইচ্ছে হল ওদের সঙ্গে কথা বলতে। অবশ্য এই কয় বছরে ওরা অনেক বড় হয়ে গেছে। দুজনেরই গোঁফ বেরিয়েছে, দাড়ি গজিয়েছে হালকাভাবে। হাফ প্যান্ট পরা ছেড়ে দিয়েছে এখন। তার ওপর বাজার কলোনি, এলাকার পূর্ববঙ্গের কিছু ছেলে এখন ওদের বন্ধু হয়েছে। এই এখন যে তিনজন ওদের সঙ্গে সাইকেলে আছে তারা চা-বাগানের কেউ নয়। দুজনই তাদের এক ক্লাস নিচে পড়ে। দেখে মনে হয় পড়াশুনা ছাড়া সবকিছু করে। তিনজন সঙ্গে থাকায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু সেটাকে কাটিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে। চটপট পা চালিয়ে সিঁড়ি টপকে সে চিৎকার করল। এই বিশু! প্ৰায় একই সঙ্গে থেমে গেল পাঁচটা সাইকেল। বিশু আর খোকন পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করল। বাকি তিনজনের চোখে কৌতূহল। আসাম বোডের দিকে পা বাড়িয়ে দীপার খেয়াল হল অনেক পেছনে বারান্দায় বসে থাকা দুই মহিলার কথা। অঞ্জলির যতটা হবে না মনোরমার বুকের মধ্যে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঝড় উঠে গেছে। এইসময় দূরে একটা বাস দেখা গেল। দীপা গলা তুলেই বলল, একপাশে সরে আয়, বাস আসছে, চাপা পড়বি। স্পষ্টত দুটো ভাগ হয়ে গেল দলটি। নতুন তিনজন চলে গেল ওপাশে, খোকন আর বিশু দীপার কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল। খোকনই প্রথম কথা বলল, তুই আমাদের সঙ্গে কথা বলছিস? তই তো মনে হচ্ছে। কেমন পরীক্ষা দিলি তোরা? একরকম। খোকন জবাব দিল। তুই? বিশুর দিকে তাকাল দীপা। কিছু বলবি তুই? বিশু বেশ কঠোর মুখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল দীপার মাথায়। সে বলল, অনেকদিন থেকেই একটা কথা খুব ভাবছিলাম। আচ্ছা বলতো, বিয়ের পর আমি যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলাম তখন তোরা ওরকম কেঁদে উঠলি কেন? প্রশ্নটা শোনামাত্র কেমন বোকা হয়ে গেল বিশু। খোকন হেসে ফেলল। শেষপর্যন্ত বিশু বলল, অনেকদিন আগের কথা, ভুলেই গিয়েছি। ওমা, তাই? আমাকেও ভুলে গিয়েছিস তোরা? তোকে কি করে ভুলব! তুই স্কুল ছাড়া বাড়ি থেকে বের হাতিস না। আমাদের কারো সঙ্গে কথা বলতিস না, তাই। খোকন কথা শেষ করল না। এবার বিশু বলল, ডাকলি কেন? এমনি। হঠাৎ ভাবলাম আজ জিজ্ঞাসা করি সেই রাত্ৰে কেঁদেছিলি কেন? ভুলে গিয়েছিস যখন তখন আর মনে করে কি লাভ! এইসময় খোকন বলল, অ্যাই দাখ, সবাই দেখছে। শোনামাত্র দীপা এবং বিশু মুখ ঘুরিয়ে দেখল মাঠের ওপাশে কোয়ার্টার্সগুলোর বারান্দায় বারান্দায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে এদিকে দেখছে। যেন এরকম অবাক কাণ্ড অনেকদিন তারা দাখেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? খোকন জবাব দিল, এমনি ঘুরছি। রাস্তার ওপারে তিনটি ছেলে তখনও দাঁড়িয়ে। ওদের ভঙ্গীতে নায়ক নায়ক ভাব। দীপা জিজ্ঞাসা করল, তোদের বন্ধু ওরা? খোকনই জবাব দিল, হ্যাঁ, ও হল সুভাষ, মাঝখানে গোবিন্দ আর ডানদিকে অজয়। তুই ওদের আগে দেখিসনি? দীপা জবাব দিল না। ওর খুব ইচ্ছে করছিল এদের সঙ্গে আসাম রোড ধরে বেড়াতে। কিন্তু তিনটি অপরিচিত ছেলে থাকায় যাওয়াটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না। তার ওপর একইদিনে রঙিন শাড়ি পরে রাস্তায় বেরিয়ে এদের সঙ্গে কথা বলাটাই অনেকখানি হয়ে গিয়েছে। মনোরমা এবং অঞ্জলির পক্ষে আর হজম করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সে বলল, যা তোবা। কাল সকাল দশটায় আসব। মাঠে থাকিস। কথা শেষ করেই দীপা ফিবল! এবং সত্যসাধন মাস্টারকে দেখতে পেল। তাঁকে দেখেই সম্ভবত বিশুরা আর দাঁড়াল না। দীপা অপেক্ষা করল মানুষটির জন্যে। কাছে এসে সত্যসাধনের চোখ বড় হয়ে গেল, তুমি রঙিন শাড়ি পরছ? কথা না বলে দুবার মাথা নাড়ল দীপা। বিস্ময়টা কেটে গিয়ে হাসি ফুটল সত্যসাধন মাস্টারের মুখে বিদ্রোহীর জয় হইল নাকি? এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আজই প্ৰথম পারলাম। দেখছেন না, ওপাশের কোয়ার্টার্সগুলোর বারান্দায় ভিড় জমে গিয়েছে। তাই তো। আসলে কি জানো, অভ্যাস। অভ্যাসের চাকর মানুষ। আমিও তার ব্যতিক্রম না। সত্যি কথা বলি, আমিও খুব কনজারভেটিভ। এক একটা থিওরি মাথার মধ্যে এমন বইস্যা যায় যে অন্য চিন্তা আসে না! কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল লাইফে যদি সেই প্ৰব্লেম আসে তাহলে দেখি থিওরিটা ভুল। একেবারে ভুল। শোন দীপা, এখন বলি পোশাক হইল মনের প্রতিফলন। তোমার মন চাইলে রঙিন পরবা, না চাইলে পরবা না। আপনি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন? হুঁ। একটু আলি আইস্যা পড়ছি। তোমার বাবা তো আসে নাই এখনও? না। তাতে কী আছে চলুন না দীপা মাস্টারমশাইকে ছাড়তে চাইছিল না। তিনি সঙ্গে থাকলে আর যাই হোক মনোরমা কিংবা অঞ্জলি আপাতত মুখে কুলুপ ঐটে থাকবেন। বাইরের লোক বাড়ির লোক ব্যাপারটা মনোরমা খুব মানেন। আর এই সময় যদি অফিস থেকে অমরনাথ ফিরে আসেন তাহলে দীপা ম্যানেজ করে নিতে পারবে। সিঁড়ি টপকে মাঠে নামতে নামতে সত্যসাধন বললেন, এই ছেলেগুলা তোমারে কি কইতেছিল? অত্যন্ত বাদ। থার্ড ডিভিসন পাইবে কি না। সন্দেহ। দীপা হেসে ফেলল। সত্যসাধন রেগে গেলেন, হাস কেন? বদ বললেন কেন? বদ না? লেখাপড়ায় মন নাই শুধু বাপের পয়সায় সিগারেট ফোঁকে। ওরা সিগারেট খায়? অবাক হয়ে গেল দীপা। মাথা নাড়লেন সত্যসাধন, এ ম্যান ইজ নোন বাই দ্যা কোম্পানি হি কিপস। খারাপ আলুর সঙ্গে ভাল আলু রাখলে সেইটাও
false
bongkim
তারা এমনই কুচরিত্রের লোক যে, তাদের মুখ দেখিলেও পাপ আছে। আপনার বন্ধুবর্গ ডিনরের পর যে ভাষায় কথাবার্ত্তা কন-শুনিতে পাইলে খানসামারাও কাণে আঙ্গুল দেয়। আপনি যাদের বাড়ী মুরগি মাটনের শ্রাদ্ধ করিয়া আসেন, পৃথিবীতে এমন কুকাজ নেই যে, তাহারা ভিতরে ভিতরে করে না। তাহাতে আপনার চরিত্রের জন্য কোন ভয় নাই,-আর আমি গরিবের মেয়ে, একখানা বাঙ্গলা বই পড়িলেই গোল্লায় যাব? উচ্চ। আমরা হলেম ; তোমরা হলে ভার্য্যা। অত পট পট কর কেন? কইমাছ ছাঁকা তেলে পড়েছ নাকি? তা যা হোক, একবার এই বইখানা একটু পড় না। উচ্চ। (শিহরিয়া ও পিছাইয়া) আমি ও সব ছুঁয়ে করি না। ভার্য্যা। কাকে বলে? উচ্চ। ও সব ছুঁয়ে হাত ময়লা করি না। ভার্য্যা। তোমার হাত ময়লা হবে না, আমি ঝাড়িয়া দিতেছি। (ইতি পুস্তকখানি আঁচল দিয়া ঝাড়িয়া মুছিয়া স্বামীর হস্তে প্রদান। মানসিক ময়লা ভয়ে ভীত উচ্চশিক্ষিতের হস্ত হইতে পুস্তকের ভূমে পতন।) ভার্য্যা। ও কপাল! আচ্ছা, তুমি যে বইখানাকে অত ঘৃণা করচো, কই-তোমার ইংরেজরাও তত করে না। ইংরেজরা নাকি এই বইখানা তরজামা করিয়া পড়িতেছে। উচ্চ। ক্ষেপেছ? ভার্য্যা। কেন? উচ্চ। বাঙ্গলা বই ইংরেজিতে তরজমা? এমন আষাঢ়ে গল্প তোমায় কে শোনায়? বইখানা ত নয়? তা হলে তরজমা করান সম্ভব। কি বই ওখানা? ভার্য্যা। বিষবৃক্ষ। উচ্চ। সে কাকে বলে? ভার্য্যা। বিষ কাহাকে বলে জান না? তারই বৃক্ষ। উচ্চ। বিষ-এক কুড়ি। ভার্য্যা। তা নয়-আর এক রকমের বিষ আছে জান না? যা তোমার জ্বালায় আমি একদিন খাব। উচ্চ। ওহো! ! ! তারই গাছ-উপযুক্ত নাম বটে-ফেল! ফেল! ভার্য্যা। এখন, গাছের ইংরেজি কি বল দেখি? উচ্চ। ভার্য্যা। এখন দুটো কথা এক কর দেখি? উ। ! ওহো! বটে! বটে! বলিয়া একখানি ইংরেজি বইয়ের কথা কাগজে পড়িতেছিলাম বটে। তা সেখানা কি বাঙ্গলা বইয়ের তরজমা? ভার্য্যা। তোমার বোধ হয় কি? উচ্চ। আমার ছিল যে, একখানা ইংরেজি বই, তারই বাঙ্গলা তরজমা হয়েছে। তা যখন ইংরেজি আছে, তখন আর বাঙ্গলা পড়বো কেন? ভার্য্যা। পড়াটা ইংরেজি রকমেই ভাল-তা কেতাব নিয়েই হোক, আর গেলাস নিয়েই হোক। তা তোমাকে ইংরেজি রকমেই পড়িতে দিতেছি। এই বইখানা দেখ দেখি। এখানা ইংরেজির তরজমা-লেখক নিজে বলিয়াছেন। উচ্চ। ও সব বরং পড়া ভাল। কি ইংরেজি বইয়ের তরজমা না ? ভার্য্যা। ইংরেজি নাম আমি জানি না। বাঙ্গলা নাম ছায়াময়ী। উচ্চ। ছায়াময়ী? সে আবার কি? দেখি (পুস্তক হস্তে লইয়া) , ভার্য্যা। (টিপি টিপি হাসিয়া) তা ওখানা ভাল বুঝিতে পারি না-পোড়া বাঙ্গালির মেয়ে, ইংরেজির তরজমা বুঝি এত বুদ্ধি ত রাখিনে-ওটা তুমি আমায় বুঝিয়ে দেবে? উচ্চ। তার আর আশ্চর্য্য কি? অর্থাৎ তিনি তে করেন। ভার্য্যা। ফুটন্ত সুন্দরীকে পালিশ করেন? এত বড় কবি? উচ্চ। কি পাপ! মানে চৌদ্দ। ভার্য্যা। চৌদ্দ সুন্দরীকে পালিশ করেন? তা চৌদ্দই হোক, আর পনেরই হোক, সুন্দরীকে আবার পালিশ করা কেন? উচ্চ। বলি চৌদ্দ সেঞ্চুরীতে বর্ত্তমান ছিলেন। ভার্য্যা। তিনি চৌদ্দ সুন্দরীতে বর্ত্তমান থাকুন, আর চোদ্দ শ সুন্দরীতেই বর্ত্তমান থাকুন, বইখানা নিয়ে কথা। উচ্চ। আগে অথরের লাইফটা জানতে হয়। তিনি নগরে জন্মগ্রহণ করিয়া সেখানে বড় বড় করিতেন। ভার্য্যা। পোর্টম্যাণ্টো হলদে করিতেন। আমাদের এই কালো পোর্টম্যাণ্টোটা হলদে হয় না? উচ্চ। বলি বড় বড় চাকরি করিতেন। পরে ও দিগের বিবাদে- ভার্য্যা। আর হাড় জ্বালিও না। বইখানা একটু বুঝাও না। উচ্চ। তাই বুঝাইতেছিলাম। অথরের লাইফ না জানিলে বই বুঝিবে কি প্রকারে? ভার্য্যা। আমি দুঃখী বাঙ্গালির মেয়ে, আমার অত ঘটায় কাজ কি? বইখানার মর্ম্মটা বুঝাইয়া দাও না। উচ্চ। দেখি, বইখানা কি রকম লিখেছে দেখি। (পরে পুস্তক গ্রহণ করিয়া প্রথম ছত্র পাঠ) “সন্ধ্যা গগনে নিবিড় কালিমা” তোমার কাছে অভিধান আছে? ভার্য্যা। কেন, কোন্ কথাটা ঠেকল? উচ্চ। গগন কাকে বলে? ভার্য্যা। গগন বলে আকাশকে। উচ্চ। “সন্ধ্যা গগনে নিবিড় কালিমা”-নিবিড় কাকে বলে? ভার্য্যা। ও হরি! এই বিদ্যাতে তুমি আমাকে শিখাবে? নিবিড় বলে ঘনকে। এও জান না? তোমার মুখ দেখাতে লজ্জা করে না? উচ্চ। কি জান-বাঙ্গলা ফাঙ্গলা ও সব ছোট লোকে পড়ে, ও সবের আমাদের মাঝখানে চলন নেই। ও সব কি আমাদের শোভা পায়? ভার্য্যা। কেন, তোমরা কি? উচ্চ। আমাদের হলো -ও সব বাজে লোকে লেখে-বাজে লোকে পড়ে-সাহেব লোকের কাছে ও সবের দর নেই- তে কি ও সব চলে? ভার্য্যা। তা মাতৃভাষার উপর পালিশ-ষষ্ঠীর এত রাগ কেন? উচ্চ। আরে, মা মরে কবে ছাই হয়ে গিয়েছেন-তাঁর ভাষার সঙ্গে এখন আর সম্পর্ক কি? ভার্য্যা। আমারও ত ঐ ভাষা-আমি ত মরে ছাই হই নাই। উচ্চ। , , -তোমার খাতিরে একখানা বাঙ্গলা বই পড়িব। কিন্তু একখানা বৈ আর নয়! ভার্য্যা। তাই মন্দ কি? উচ্চ। কিন্তু এই ঘরে দ্বার দিয়ে পড়্‌ব-কেহ না টের পায়। ভার্য্যা। আচ্ছা তাই। (বাছিয়া বাছিয়া একখানি অপকৃষ্ট অশ্লীল এবং দুর্নীতিপূর্ণ অথচ সরস পুস্তক স্বামীর হস্তে প্রদান। স্বামীর তাহা আদ্যোপান্ত সমাপন।) ভার্য্যা। কেমন বই? উচ্চ। বেড়ে। বাঙ্গালায় যে এমন বই হয়, তা আমি জানিতাম না। ভার্য্যা। (ঘৃণার সহিত) ছি! এই বুঝি তোমার পালিশ-ষষ্ঠী? তোমার পালিশ- ষষ্ঠীর চেয়ে আমার চাপড়া-ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী অনেক ভাল। রামবাবু , শ্যামবাবু, রামবাবুর স্ত্রী (পাড়াগেঁয়ে মেয়ে) রামবাবু ও শ্যামবাবুর প্রবেশ (রামবাবুর স্ত্রী অন্তরালে) শ্যামবাবু । গুড্ মর্ণিং রামবাবু-হা ডু ডু? রামবাবু। গুড্ মর্ণিং শ্যামবাবু-হা ডু ডু। [উভয়ে প্রগাঢ় করমর্দ্দন] শ্যামবাবু । , রামবাবু। [শ্যামবাবুর তথাবিধ কথাবার্ত্তর জন্য অন্যত্র প্রস্থান।
false
humayun_ahmed
তুই তুই করে বলছে। তবে একটা হাত পকেটে ঢুকেছে। মনে হচ্ছে রাজস্থানী বস্তু বের হবে।) কি, কথা বলস না কেন, প্রমাণ চাস? আমি বললাম, প্রমাণ সবাই চায়। পাকিস্তানী মিলিটারী প্রমাণ চেয়েছে। হিন্দু না মুসলমান এই প্ৰমাণ। অনেককেই লুঙ্গি খুলে যন্ত্রপাতি দেখাতে হয়েছে। ড্রাইভার ভীত গলায় বলল, ভাইজান, এইখানে কিছু করবেন না; যা করায় বাইরে নিয়া করেন। সোহাগ রাজস্থানী ছুড়ির বোতাম টিপে যাচ্ছে— জিনিস বের হচ্ছে না। আমি বললাম, নষ্ট হয়ে গেছে না-কি? সোহাগ আগুন চোখে তাকাল। আমি বললাম, নষ্ট জিনিস পকেটে রাখা ঠিক না। তারপর আবার করেছেন টিপা টিপি। এই জিনিস পকেটে রাখবেন, হঠাৎ আপনা আপনি খুলে যাবে— পুট করে আপনার বিচি একটা খুলে পড়ে যাবে। তখন সবাই আপনাকে ডাকবে এক বিচির সোহাগ। ড্রাইভার মহাচিন্তিত গলায় বলল, হিমু ভাই, এইসব কি বলেন? আপনি কারে কি বলতেছেন নিজেও জানেন না। সোহাগ বলল, জানবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জানবে। যদি না জানে আমি পিতা-মাতার সন্তান না; আমি জারজ সন্তান। ড্রাইভার সোহাগের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে ঝামেলা চায় না। গাড়ির তেল, ব্যাটারি, টায়ার এসব মাঝে মাঝে চুরি করে সে জীবনটা পার করে দিতে চায়। ঘরে ঢুকে দেখি পল্টু স্যার বই নিয়ে বসে গেছেন। তাঁর মুখ প্রশান্ত। যে লেখক এই বইটি লিখেছেন তিনি দেখলে আরাম পেতেন। অবশ্যই তার কাছে মনে হতো তার লেখক স্বার্থক। স্যার, চা বাঁ কফি কিছু লাগবে? লেবুর সরবত করে দেব? ক্লান্তি দূর হবে। তাহলে করে দাও। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি লেবু নেই। আমি স্যারকে বললাম, স্যার, ঘরে লেবু নেই; লেবু ছাড়া লেবুর সরবত করে দেব? দাও। লেবুর সরবত দিয়ে চেষ্টা করতে থাক লকারটা খুলতে পার কিনা। রিং ঘুরাতে থাক। এক সময় না এক সময় খুলবেই। সাতটা মাত্র সংখ্যা। আমার ধারণা অতি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু লকারে আছে। কী আছে মনে করতে পারছি না। আমি লকারের রিং ঘুরাচ্ছি। শুরু করেছি ০ দিয়ে— ০০০০০০০ ০০০০০০১ ০০০০০১১ ০০০০১১১ এতো দেখি ভয়াবহ ব্যাপার। মোট কতবার ঘুরালে একবার না একবার বিশেষ সংখ্যাটা চলে আসবে। তাই বা কে জানে। বাদলকে জিজ্ঞেস করলে পাওয়া যাবে। অঙ্ক তার কাছে ছেলেখেলা। আমি রিং ঘুরিয়েই যাচ্ছি। রানু টাকা নিয়ে এসেছে। সবটা আনতে পারেনি, এক হাজার তিনশ টাকা এনেছে। টাকার সঙ্গে প্লাষ্টিকের দুটা আইসক্রিমের বাটি। একটা বাটিতে মোরগা-পোলাও, অন্য বাটিতে ফিরনী। দুটাই সে নিজে রান্না করেছে। আমার ধারণা ঐ দিনের খাবারটা ফেরত দিতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মেয়ে ঋণ রেখে মরে যাওয়া টাইপ না। রানু বলল, আপনি এই বাড়ির কে বলুনতো। আমি দারোয়ানকে বললাম, হিমু সাহেবের ফ্ল্যাটে যাব। দারোয়ান চেনে না। আমি এই বাড়ির চাকরী। ভদ্র ভাষায় গৃহভৃত্য। বাবু কহিলেন, বুঝেছি উপেন টাইপ। আমাকে চেনার কথা না। চাকরের পরিচয়ে ফ্ল্যাটের পরিচয় না। রানু বলল, আপনি কেন সব সময় আমার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলেন? ঐ যে বুড়ো মানুষটা ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছেন, তিনি আপনার কে হন? মুনিব হন। উনি মুনিব, আমি ভৃত্য। অসম্ভব। উনি আপনার বাবা। আমি চেহারা দেখেই বুঝেছি। কথাবার্তার এই পর্যায়ে পল্টু স্যার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। এবং চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, হিমু, বাবুই পাখি তালগাছ ছাড়া অন্য কোথাও বাসা বাঁধে না? জ্বি না, স্যার। যদি সব তালগাছ কেটে ফেলা হয়, তখন ওরা কোথায় বাসা বাঁধবে? ওরা একটা সমস্যায় তো পড়বেই। অন্য কোনো গাছে ট্রাই করবে। কোন গাছ? আমার ধারণা, সুপারি গাছে প্ৰথম চেষ্টা করবে। পল্টু স্যার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, জিনিসটা অদ্ভুত না? বাবুই পাখিদের তালগাছেই বাসা বাঁধতে হবে? গভীর কোনো চিন্তার বিষয় এর মধ্যে আছে। চিন্তার বিষয়তো আছেই। ঐ মেয়ে কে? স্যার, আমাদের বাবুর্চি। পল্টু স্যার খুবই অবাক হয়ে বললেন, আমাদের বাবুর্চি আছে, জানতাম নাতো! নিজেদের বাবুর্চি আছে, অথচ আমরা হোটেল থেকে খাবার এনে খাচ্ছি কেন? আমি বললাম, আজই এপিয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। সে তার রান্নার স্যাম্পলও নিয়ে এসেছে। দুপুরে আপনাকে খেতে দেব। মোরগা-পোলাও আর ফিরনী। খেয়ে যদি আপনার পছন্দ হয়, সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পারমানেন্ট। পল্টু স্যার বললেন, এক বেলার রান্না খেয়ে তার রন্ধনশৈলী বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি বললাম, তাহলে এক সপ্তাহ রাঁধুক এক সপ্তাহ পরে বিবেচনা করা হবে। মেয়েটার নাম কি? স্যার, আপনিই জিজ্ঞেস করুন। আমি রানুর দিকে তাকালাম। সে আমাদের কথাবার্তায় পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। অতি বুদ্ধিমতীরাও বিভ্ৰান্ত হবে। প্লটু স্যার হাতের বই বন্ধ করে চোখের চশমা ঠিক করলেন। চশমা ঠিক করা মানে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা। পল্টু স্যার গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় এই কাজটা করেন। নাম কি বল! রানু। রান্না কোথায় শিখেছ? মার কাছে শিখেছি। মনে কর তুমি কৈ মাছের ঝোল রান্না করছ। সাধারণ লবণ দিয়ে রান্না করলে যে স্বাদ হবে, বিট লবণ দিয়ে রান্না করলেও কি একই স্বাদ হবে? বিট লবণ দিয়ে যে মাছের ঝোল রান্না করা যায় এটাই আমি জানি না। কোন রান্নাটা তুমি ভাল পোর। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল। পল্টু স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু, চট করে একটা ইলিশ মাছ নিয়ে এসো। আমারো হঠাৎ করে কেন জানি ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে। বাবুর্চির চাকরি পার্মানেন্ট হবে কি-না তা ইলিশ মাছের ডিম রান্নার উপর নির্ভর
false
toslima_nasrin
দুষ্টু ও। ভারি দুষ্টু।’ সৈযদ হক আমার ঘাড়ে চাপড় দিয়ে বললেন। নৌসেনার বাড়ির লোক, এমনকী পড়শিরাও বললেন, সৈয়দ হককে তাঁরা টেলিভিশনে দেখেছেন। বিশাল ভোজনউৎসবে বসেও ওই এক কথা, টেলিভিশনে কবে কে তাঁকে দেখেছেন। একজনই কেবল সদর্পে ঘোষণা করলেন, তিনি তাঁর একটি বই পড়েছেন, বইয়ের নাম ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’। নাম শুনে আমি চমকে উঠি, চমকে উঠি কারণ এটি শামসুর রাহমানের বই! লক্ষ্য করি তিনি প্রতিবাদ করছেন না, বলছেন না যে এটি তাঁর লেখা বই নয়। একবার শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আগের মত চোখ টিপলেন। তিনি, দেখে আমার মনে হয়, সবকিছুতেই খুব মজা পাচ্ছেন। দিন খুব বেশি না থাকলে বুঝি এই হয়, প্রতিটি মুহূর্তে বাঁদর নাচিয়ে আনন্দ করতে হয়। আনন্দ খুব বেশিক্ষণ করা সম্ভব হয় না তাঁর, বারবারই তিনি স্নানঘরে দৌড়োন। খাওয়া শেষে আমি ও ঘর হয়ে আসতে গেলে দেখি স্নানঘর ভেসে যাচ্ছে বমিতে। বেসিনগুলোয় উপচে উঠছে যা তিনি খেয়েছিলেন। নির্যাস নিস্ক্রান্ত হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু অসুস্থ হয়ে তিনি যে কাত হয়ে আছেন কোথাও, তা নয়, বরং একটি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন ঠোঁটে, যে হাসিটির আমি কোনও অনুবাদ করতে পারিনি। আমাদের জন্য কাপ্তাইএর নৌঅতিথিশালায়, খামোকা দুটো ঘর নিয়ে টাকা খরচা করার কোনও মানে নেই বলে, কন্যার সঙ্গে একঘরে শুতে পিতার কোনও সংকোচ নেই বলে, সৈয়দ হক একটি ঘরই নিয়েছেন। ঘরটি বড়, ঘরটির দুদিকে দুটি বিছানা, হলে কী হবে, আমার ভয় হয় ঘরটিতে ঢুকতে। সৈয়দ হক মদ খেয়ে পুরো মাতাল। মাতালের সঙ্গে এক ঘরে রাত্রিযাপন করার ঝুঁকি নিতে আমার সাহস হয় না। এর পেয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় কিংবা গাছের তলে চট বিছিয়ে শুতে দিলে স্বস্তি পেতাম। নিজেকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে পাঠাই ঘরে, যেন সৈয়দ হক আদৌ মদ খাননি, আমি যে তাঁর কন্যা এ কথা মিথ্যে নয় আমি তাঁর কন্যাই এমন একটি বিশ্বাসের আবরণে নিজেকে ঢেকে নিজের মধ্যে স্বতস্ফূর্ত গতি সঞ্চার করে সোজা নিজের বিছানায় কাঁথার তলে আপাদমস্তক ঢুকিয়ে ফেলি। গরমে কেউ কাঁথায় গা ঢাকে না, কিন্তু আমার উপায় নেই, কাঁথাটিই কোনও অঘটনের হাত থেকে বর্ম হয়ে আমাকে বাঁচাবে বলে মনে হতে থাকে। কাঁথা আমি শক্ত করে চেপে ধরে রাখি কোনও দস্যু এসে যেন কেড়ে নিতে না পারে। বুকের দপদপ শব্দ শুনছি আর ভয় হচ্ছে এই বুঝি খেলারাম এলেন হাঁটি হাঁটি পা পা করে শরীফার বিছানার কাছে। ‘তুমি কি ঘুমিয়ে গেছ?’ আমি নিরুত্তর থাকি। নিরুত্তর, যেন ঘুমোচ্ছি, ঘুমোতে থাকা মানুষ কারও প্রশ্ন শুনতে পায় না। আমিও তাঁর কোনও প্রশ্ন শুনিনি। আমি স্থির হয়ে থাকি, মৃত কাঠ হয়ে পড়ে থাকি বিছানায়। আলগোছে অন্ধকারে কাঁথা সামান্য সরিয়ে, যেন ঘুমের মধ্যে হাত নড়ে কাঁথাকে সরিয়ে দিয়েছে সামান্য, দেখি তিনি ধীরে ধীরে হাঁটছেন ঘরে। কেন হাঁটছেন, কেন তিনি ঘুমোচ্ছেন না! কী চান তিনি, আমাকে ঢাকা থেকে এতদূর নিয়ে আসার নিশ্চয়ই তাঁর কোনও উদ্দেশ্য আছে। অতিথিশালায় অনেকগুলো ঘর খালি পড়ে থাকার পরও, নৌসেনা ভদ্রলোকটি দুজনের জন্য দুটো ঘরের ব্যবস্থা করতে চাওয়ার পরও তিনি আমাকে কন্যা বানিয়ে একঘরে ঢুকিয়েছেন কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই, আমার বিশ্বাস হয় না। সারারাত বুকের ধুকপুকুনি শুনি, সারারাত ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি আর সারারাত তাঁর জেগে থাকার, তাঁর হাঁটার, তাঁর বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলার শব্দ শুনে যাই। মফস্বলি মেয়ে ঢাকার বড় লেখকের আচার ব্যবহারের কোনটি আসল কোনটি নকল কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সকালে সোজা বিমান বন্দর, সোজা ঢাকা, তিনি গুলশানের কাছে নেমে গেলেন, আমি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে নয়াপল্টন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মঞ্চ থেকে আনাড়ি অভিনেষনী নেমে এলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে না তো কী! তিনি বাড়ি অবদি বেবি ট্যাক্সি নিলেন না, স্ত্রী বা চেনা কেউ যদি আমার সঙ্গে তাঁকে দেখে ফেলে, তবে তাঁর বিপদ হবে বলে! মেয়েমানুষের সঙ্গে ফষ্টি নষ্টি করে এসেছেন, এরকম কথা হবে বলে! তিনি সম্ভবত কথা এড়িয়ে চলতে চান, তাই আড়ালে আবডালে সারতে চান এরকম দুচারটে অভিসার। সম্ভবত আমাকে দিয়ে যা আশা করেছিলেন তা হয়নি বলে তিনি ক্ষুব্ধ, নিজের ওপর নিশ্চয়ই তাঁর রাগ হচ্ছে, এতগুলো টাকা বেহুদা খরচ হওয়ায় তাঁর আক্ষেপ হচ্ছে। খেলারাম খেলে যা উপন্যাসে বাবর আলী তাঁর অল্প বয়স্ক প্রেমিকাকে সহজে পেতে চায়নি, নানা কৌশল করে, দেশের এক কোণ থেকে আরেক কোণে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে তবেই কাজ সেরেছে। সৈয়দ হকের ভেতরে কোথাও কি তাঁর নিজেরই গড়া চরিত্র বাবর আলী বাস করে গোপনে! আমার এই প্রথম মনে হয়, করে। ফেরার পথে সারাক্ষণই তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন, তাঁকে দেখতে লাগছিল অল্প চেনা কোনও লোকের মত, যেন আমার কেবল মুখ চেনেন তিনি অথবা নাম শুনেছেন, এর বেশি কিছু নয়। জানি না এ তাঁর আমাকে সঙ্গে নিয়ে কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় মনোকষ্টের কারণে কী না। অথবা তিনি আনমনে তাঁর লেখার কথা ভাবছেন। অথবা বিমানে লোকদের তিনি খুব একটা জানতে দিতে চাননা যে তিনি তাঁর অর্ধেক বয়সী একজন অনাত্মীয়ার সঙ্গে ভ্রমণ করছেন। আমার অবয়বে আমি জানি লেশমাত্র চিহ্ন ছিল না আমি যে তাঁকে একশ ভাগ বিশ্বাস করছি না তার, আমি তাঁর উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে সামান্য হলেও সংশয় প্রকাশ করছি। না বোঝার ভান করা আমার স্বভাবের অন্তর্গত, বিশেষ করে কোনও অস্বস্তিকর সময়ে।
false
shomresh
গুলি করার। গুলি না করা ওগুলো চলে গেল। যখন তখন বোঝা যাচ্ছে ওদের চোখ এড়ানো গেছে। সোম উঠল। সামনেই হেনা, হাসছে। বলল, আপনার তো বেশ ট্রেনিং আছে দেখছি! না, মানে, মনে হল। যেন বিড়বিড় করল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু এগোতেই ঝরনাটাকে দেখা গেল। পাহাড়ের বুক থেকে নেমে ছায়াছায়া নির্জনে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। সোম বলল, বাঃ কী সুন্দর! আপনার খিদে পেয়েছে? প্রশ্নটা শোনামাত্র খিদে পেয়ে গেল সোমের। কাল বিকেল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। সারাক্ষণ টেনশন থেকে খাওয়ার কথা মনেও আসেনি। এখন জল, নির্জনতা এবং ওই প্রশ্নে মনে হল খেতে পেলে আর কিছুই চাইত না সে। প্রশ্নটা করেই নিজেই উত্তর দিল হেনা, পেলে কিছুই পাবেন না এখানে। তবে! সে সোমের দিকে তাকাল, আপনার কাছে রিভলভার আছে? অজান্তেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেই মনে মনে খেপে গেল সোম নিজের ওপরে। রিভলভারের কথা স্বীকার করল কেন? সাধারণ মানুষের সঙ্গে রিভলভারথাকে নাকি! গর্দভ। তাহলে একটা পথ আছে। ওই দেখুন, বেশ মোটাসোটা ডাহুক। গুলি করে যদি মারতে পারেন, তাহলে আগুন জ্বেলে রোস্ট করে দিতে পারি! হেনা হাসল। সংকোচ হচ্ছিল সোমের রিভলভারটা বের করতে। সার্ভিস রিভলভারটাকে দেখলে হেনা কি চিনতে পারবে? সে মৃদু আপত্তি করল, গুলি ছুঁড়লে শব্দ হবে না? হলে হবে। ওপাশে ধোঁয়ায় মাথার ওপর হেলিকপ্টার, কেউ শুনলে ভাববে পুলিশের শুলি। এদিকে আর আসবে না তাহলে। হেনা বলল। সোম ডাহুকটাকে দেখল। কমসে কম এককেজি ওজন হবে। হেলিকপ্টারের আওয়াজে বোধহয় একটু ভয় পেয়ে গেছে। সে হেনার দিকে তাকাল। খিদেটাকে বড্ড বেশি মনে হচ্ছে এখন। যা হয় হবে। আগে তো খেয়ে নিই, মনে মনে ভাবল সে। সে রিভলভার বের করে তাগ করল। ডাহকটা মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকাল। সোম ট্রিগার টিপতেই কানফাটানো আওয়াজ হল। কিছু পাখি উড়ে গেল আকাশে শব্দ করে আর ডাহুকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল যেখানে বসেছিল। হেনা বলল, বাঃ, আপনার টিপ তো দারুণ বলে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনল পাখিটাকে। সোম খুশি হল। একসময় সে ফোর্সে বেস্ট শুটার ছিল। আওয়াজটা তখনও কানে লেগে ছিল। সোম আকাশে নজর করল। হেলিকপ্টার আপাতত নেই। কিন্তু কাজটা বেশ বোকার মতই করেছে। পুলিশের পক্ষে ওটা গুলির শব্দ তা বুঝতে অসুবিধে হবে না। নিন, ছাড়ান। আমি আগুন জ্বালার ব্যবস্থা করি। হেসে পাখিটাকে সোমের হাতে তুলে দিল। এ ব্যাপারে সোমের কিঞ্চিৎ অভ্যাস ছিল যৌবনের শুরুতে। সেটা মনে করে সে হাত লাগাল। মেয়েটা ইতিমধ্যে শুকনো ডালপালা জোগাড় করে আগুন জ্বলিয়েছে। ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেটা লক্ষ করে সোম বলল, দুর থেকে দেখলে লোকে ভাববে এখানেও গোলমাল হচ্ছে। কেন? হেনা তাকাল। আপনার আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভালই তো। গুলির শব্দ, আকাশে ধোঁয়া, কেউ এদিকে আসবে না। কিন্তু একটু ভুল হয়ে গেল। ওরা যখন ডাহুকের সেকা মাংস আরাম করে চিবোচ্ছে তখন জঙ্গলের মধ্যে চারজন মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্ৰ। হেনার ঠিক পেছনে গাছের আড়ালে ওরা। চোখ বন্ধ করে খাবারের স্বাদ না নিলে সোম হয়তো কিছুটা দেখতে পেত। হেনা জিজ্ঞাসা করছিল, আপনি সবসময় রিভলভার নিয়ে ঘোরেন? সবসময় নয়। এবারই আসার সময় মনে হল সঙ্গে রাখা ভাল। সোমা হাড় চিবোচ্ছিল। এদেশে কোনও রকম আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখা অপরাধ, ধরা পড়লে দশ বছর জেল। তুমি না ধরিয়ে দিলে পুলিশের সাধ্য নেই আমাকে ধরে। আমাকে আপনি চেনেন না, একটু আগে আলাপ হল, হঠাৎ এত বিশ্বাস হয়ে গেল কি করে? কাউকে কাউকে প্রথম দেখেই এরকম মনে হয়। আপনার রিভলভারটা একবার দেখব? নিশ্চয়ই। পাশে রাখা রিভলভারটা সোম তুলে দিল হেনার হাতে। হেনা ওটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জঙ্গলে দাঁড়ানো লোকগুরো হেনার মুখ দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেল। সোমকে বিস্মিত করে ওরা বেরিয়ে এল সামনে। দেখামাত্র সোম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু হেনা বলল, আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা আমার বন্ধু। সোমের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তার রিভলভার এখন হেনার হাতে। অসহায় চোখে সে লোকগুলোকে দেখল। একজন হেনাকে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। বাকিরা পাথরের মত সোমের সামনে দাঁড়িয়ে। এখান থেকে পালাবার কোনও পথ নেই। যে লোকটা হেনার সঙ্গে কথা বলছে সে উত্তেজিত, তুমি এখানে কেন? গ্রামে ধোঁয়া উঠেছিল বলে তোমার গ্রামে যাচ্ছিলাম। ওখানেও গোলমাল মনে হল। হ্যাঁ। আজ সবজায়গায় পুলিশ হানা দিয়েছে। কিন্তু এই লোটাকে কোথায় পেলে? রাস্তায় আলাপ হল। লোকটাকে তুমি চিনকে পেরেছ? হ্যাঁ। কিন্তু ও নিজেকে ত্ৰিভুবনের ভাই বলে পরিচয় দিয়েছে। ইন্ডিয়ায় থাকে, ত্ৰিভুবনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। পুলিশ দেখলে ওকে ধরবে বলে শহরে ঢুকতে পারছে না। বাজে কথা, মিথ্যে কথা। লোকটা গর্জে উঠল। অ্যাস্তে কথা বল। ব্যাপারটা যে আমরা জানি তা ওকে বোঝাবার দরকার নেই। কি বলছ তুমি? লোকটা আমাদের ওপর কি অত্যাচার করেছে তা মনে নেই? আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে কোনও গোলমাল হয়েছে ওর। কিছুই হয়নি। সব ভাঁওতা। দ্যাখো ওর পেছনে হয়তো পুলিশ আসছে। না। সেটা হলে এতক্ষনে টের পেতাম। আগে ওর সম্পর্কে খবর জোগাড় করো। যদি কোনও গোলমাল না থাকে তাহলে ব্যবস্থা নিতে অসুবিধে হবে না। আমি এখনই পাঠাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণে ও কোথায় থাকবে? তোমাদের গ্রামের কি অবস্থা। অল ক্লিয়ার। পুলিশ চলে গিয়েছে। সেখানেই চলো। হেনা ফিরে এসে সোমের সামনে দাঁড়াল, আপনার রিভলভার দেখে আমার বন্ধুরা খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছে। আমাদের
false
shomresh
সঙ্গে সারাদিন এখানে মদ খেয়েছো? কে বলল? সেই বাবু তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছে? এটাই তো ঠিক কথা। অৰ্জুন নায়েকের লোক তুমি। তুমি জানোনা অর্জুনবাবু কেন কুয়ো খোঁড়া বন্ধ করেছে? কেন এদের ক্ষতি করছ তুমি? লোকটা মিইয়ে যাচ্ছিল। তার সমস্ত শক্তি সে ইতিমধ্যে খরচ করে ফেলেছে। হঠাৎ দারোগা বললেন, ম্যাডাম, সরকার কি এদের জন্যে এখনই ওসব জিনিসের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? দীপাবলী মাথা নাড়ল, না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। দারোগা ব্যস্ত হলেন, চলুন ম্যাডাম, এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। এমনকি সতীশবাবুও বললেন, এদের উত্তেজনা না কমা পর্যন্ত কথা বলা যাবে না। পুরোটা পথ নির্বাক ফিরে এল দীপাবলী। নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় দারোগা বললেন, তাহলে আমি এস পি-কে জানাই ব্যাপারটা? জানান। দীপাবলী দরজায় ধাক্কা মারতেই তিরি সেটা খুলল। সতীশবাবু তখনও দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকিয়ে দীপাবলী বলল, অমার পক্ষে আর এই চাকরি করা সম্ভব নয় সতীশবাবু, আমি রেজিগনেশন দেব। মেমসাহেব চাকরিতে এমন হয়। হয় হোক। ভাল করতে গিয়ে বদনাম নিতে রাজি নই। অনেক হয়েছে। আপনি এখন বাড়ি যান। ভেতরে চলে গেল সে। তারপর কাগজ কলম বের করে নিজের পদত্যাগপত্র লিখল গুছিয়ে। এই দেশের প্রশাসনব্যবস্থাকে তীব্র আক্রমণ করল সে। হ্যারিকেনের আলোয় নিজের নাম সই করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিতেই তিরি এসে দাঁড়াল সামনে, দরজা কি খুলব? কেন? কে এসেছে? বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল দীপাবলী। নিচু স্বরে তিরি জবাব দিল, দাদাবাবু! নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না দীপাবলী। চাপা গলায় প্রশ্ন করল, কোন দাদাবাবু? কি বলছিস তুই? হ্যাঁ; ওই দাদাবাবু, হাসপাতাল থেকে এসেছে, আমি জানলা দিয়ে দেখলাম। তিরির মুখে কি খুশী? কিন্তু গলার স্বর যেন সারাদিনের থেকে আলাদা। দীপাবলী বলল, তুই রান্না করতে যা, আমি দেখছি। আমার রান্না হয়ে গিয়েছে। তিরি মাথা নাড়ল। ও। তুই ভেতরে যা। তিরি যতক্ষণ ভেতরের উঠোনের দিকে চলে না গেল ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দীপাবলী। তারপর শব্দ করে পা ফেলে বাইরের ঘরের বন্ধ দরজার কাছে। এসে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কে ওখানে? আমি, শমিত। স্বরে দুর্বলতা স্পষ্ট, আর দাঁড়াতে পারছি না। দরজা খুলল দীপাবলী, তারপর গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, কি ব্যাপার? দুদিনেই লোকটার চেহারা পাল্টে গিয়েছে। তবু হাসার চেষ্টা করল, এলাম। কেন? এখানে কেন? মানে? আমি বলে এসেছিলাম অন্য কোথাও চলে যেতে। ও। কিন্তু আমার জিনিসপত্র তো পড়ে আছে এখানে। সেটা আগামীকাল হাসপাতালে পৌঁছে যেত। আগামীকাল তো আমাকে হাসপাতালে পেতে না। শমিত এগিয়ে এল, আমি আজ দুপুরেই হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি। চলে এসেছেন মানে? ওরা আপনাকে ছেড়ে দিল? না। নিজে নিজেই চলে এলাম। সেকি! পালিয়ে এসেছেন? আর শুয়ে থাকতে ভাল লাগছিল না। কিন্তু এখন–। এখন কি? একটু না বসতে পারলে–, শরীর ঠিক লাগছে না। আমি বুঝতে পারছি ঠিক করছি না, হয়ত ভিলেনের মত আচরণ করছি, কিন্তু করে ফেলার পর তো আর শোধানো যায় না। ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, এই ঘরেই থাকবেন। কিন্তু আজকের এই রাতটা। কাল সকালে আপনাকে এখানে দেখতে চাই না আমি। দীপাবলী সরে দাঁড়াল। কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে একটু হাঁপালো শমিত। দীপাবলী যখন দরজা বন্ধ করছে তখন শুনতে পেল, কেন? আমার ইচ্ছে। কিন্তু আমি তো কোন অন্যায় করিনি। উত্তর না দিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে দীপাবলী বলল, আমি লোকাল থানায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসাটা অপরাধ। আশ্চর্য! থানায় খবর দেবার কি হয়েছে। আমি তো সকালেই চলে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ করতে গিয়েও পারল না দীপাবলী। ভদ্রতা শেষতক আড়াল করল। ঘরে ঢুকে খানিক আগে লেখা পদত্যাগপত্রটা যত্ন করে রেখে দিল। আসলে ও এখন কি করবে বুঝতে পারছিল না। সে ভেতরের দরজার দিকে তাকাল, তিরিকে দেখা যাচ্ছে না। দীপা, দীপা? দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে মাঝখানের দরজায় দাঁড়াল, প্লিজ, আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন না, আমার নিজেকে অপবিত্র লাগছে। যাঃ বাবা। কি ফিল্ম করছ বল তো? ফিল্ম? অফকোর্স। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সত্যি কথা হল আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সকালে মনে হল বেশ ভাল আছি কিন্তু নার্সকে বলে কাজ হল না তাই চলে এসেছি। মানছি না বলে আসা ঠিক হয়নি কিন্তু তাই বলে তুমি বাংলা-ফিল্মী সংলাপ বলবে, এ কেমন কথা। আমি কিছুই বলতে চাই না। আপনি আপনার মত আজকের রাতটা থাকুন। কিন্তু দোহাই, আমাকে আর জ্বালাতন করবেন না! আমি কথা বলা মনে তোমাকে জ্বালাতন করা? এই সরলসত্য না বোঝার তো কোন কারণ নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। সেটা আপনার সমস্যা। দীপাবলী চলে এল দরজা থেকে। এসে নিজের খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট দশেক চুপচাপ। পায়ের শব্দ হল। তিরি খাটের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, খাবার দেব? না। আর খাবার ইচ্ছে নেই। তুই খেয়ে নিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়। কথাগুলো শোনার পরেও খানিক দাঁড়িয়ে তিরি ভেতরে চলে গেল। এবং তখনই বইরের ঘর থেকে ডাক ভেসে এল, দীপা, দীপা, এই দীপা! শুয়ে শুয়েই গলা তুলল দীপা, বলুন! এভাবে কথা বলা যায়? আমি কি ভেতরে যাব? দীপাবলী উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, কি বলছেন? আমার খুব খিদে পেয়েছে। আর কিছু? যা বলার একবারে বলে ফেলুন। না, মানে, ও বুঝতে পেরেছি। আমি সারাদিন গ্রামে কাটিয়েছিলাম বলে
false
shorotchandra
ময়লা কাপড়গুলা ভাঁজ করিয়া একটা তোরঙ্গে তুলিতেছিল, কহিল, আজ আমরা যাবো। সে তো আজ নয় দিদিমণি। যাবার কথা যে কাল। না, আজই যাওয়া হবে। এই কথা বলিয়া সে কাজ করিতেই লাগিল, মুখ তুলিল না। অন্নদা একমুহূর্তে মৌন থাকিয়া বলিল, আপনি উঠুন, আমি গুছিয়ে দিচ্চি। আপনার কষ্ট হচ্চে! কষ্ট দেখবার দরকার নেই, নিজের কাজে যাও তুমি। এ বাড়ির সমস্ত লোকের প্রতি যেন তাহার ঘৃণা ধরিয়া গেছে। হেতু না জানিলেও একটা যে রাগারাগির পালা চলিতেছে অন্নদা তাহা জানিত। হঠাৎ মা কাল বাড়ি চলিয়া গেলেন, আজ বন্দনাও তেমনি হঠাৎ চলিয়া যাইতে উদ্যত। কিন্তু রাগের বদলে রাগ করা অন্নদার প্রকৃতি নয়, সে যেমন সহিষ্ণু তেমনি ভদ্র, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, আমার দোষ হয়ে গেছে দিদিমণি, আজ সময়ে আমি উঠতে পারিনি। বন্দনা মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, আমি ত তার কৈফিয়ত চাইনি অন্নদা, দরকার হয় তোমার মনিবকে দিও। দ্বিজুবাবু তাঁর ঘরেই আছেন, তাঁকে বলো গে। এই বলিয়া সে পুনরায় কাজে মন দিল। বন্দনা পিতার একমাত্র সন্তান বলিয়া একটুখানি বেশী আদরেই প্রতিপালিত। সহ্য করার শক্তিটা তাহার কম। কিন্তু তাই বলিয়া কটু কথা বলার কুশিক্ষাও তাহার হয় নাই এবং হয়ত এতবড় কঠোর বাক্য সে জীবনে কাহাকেও বলে নাই। তাই বলিয়া ফেলিয়াই সে মনে মনে লজ্জা বোধ করিতেছিল, এমনি সময়ে অন্নদাই সলজ্জ মৃদুকণ্ঠে কহিতে লাগিল, ডাক্তাররা চলে গেলেন, ফরসা হয়েছে দেখে ভাবলুম আর শোবো না, শুইনিও, কিন্তু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসতে কি করে চোখ জড়িয়ে এলো, কোথা দিয়ে বেলা হয়ে গেল টের পেলুম না। মনিবের কথা বলচেন দিদিমণি, কিন্তু আপনিও কি আমার মনিব নয়? বলুন ত, এ অপরাধ আর কখনও কি আমার হয়েছে? উঠুন আমি গুছিয়ে দিই। শেষের দিকে কথাগুলো বোধ হয় বন্দনার কানে যায় নাই, অন্নদার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, ডাক্তাররা চলে গেলেন মানে? অন্নদা কহিল, কাল রাত্তিরে দ্বিজুর ভারী অসুখ গেছে। এখানে এসে পর্যন্তই ওর শরীর খারাপ, কিন্তু গ্রাহ্য করে না। কাল মা’দের নিয়ে বাড়ি যাবার কথায় আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, মা যেন না জানতে পারেন, কিন্তু দাদাকে বলে আমার যাওয়াটি মাপ করে দাও অনুদিদি, আজ যেন আমি উঠতে পারচি নে এমনি দুর্বল। ওকে মানুষ করেছি, ওর সব কথা আমার সঙ্গে। ভয় পেয়ে বললুম, সে কি কথা? শরীর খারাপ ত লুকোচ্চো কেন? ওর স্বভাবই হলো হেসে উড়িয়ে দেওয়া, তা সে যত গুরুতরই হোক। তেমনি একটুখানি হেসে বললে, তুমি ওদের বিদেয় করো না দিদি, তার পরে আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠবো। ভাবলুম, মার সঙ্গে ওর বনে না, কোথাও সঙ্গে যেতে চায় না, এ বুঝি তারই একটা ফন্দি। তাই কিছু আর বললুম না। বড়দাদাবাবু ওঁদের নিয়ে চলে গেলেন। তার পরে সমস্ত দিনটা ও শুয়ে কাটালে, কিছু খেলে না। দুপুরবেলা গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, দ্বিজু, কেমন আছ? বললে, ভাল আছি। কিন্তু ওর চেহারা দেখে তা মনে হলো না। ডাক্তার আনাতে চাইলুম, দ্বিজু কিছুতে দিলে না, বললে, কেন মিছে দাদার অর্থদণ্ড করাবে দিদি, তোমার অপব্যয়ের কথা শুনলে গিন্নী রাগ করবেন। মায়ের উপর এ অভিমান ওর আর গেল না। সমস্ত দিন খেলে না, বিছানায় শুয়ে কাটালে, বিকেলে গিয়ে জিজ্ঞেসা করলুম, দ্বিজু, শরীর যদি সত্যিই খারাপ নেই তবে সমস্ত দিন শুয়ে কাটাচ্ছোই বা কেন? ও তেমনি হেসে বললে, অনুদিদি, শাস্ত্রে লেখা আছে শুয়ে থাকার মত পুণ্য কাজ জগতে নেই, এতে কৈবল্য মেলে। একটু পারত্রিক মঙ্গলের চেষ্টায় আছি। তোমার ভয় নেই। সব তাতেই ওর তামাশা, কথায় পারবার জো নেই, রাগ করে চলে এলুম কিন্তু ভয় ঘুচলো না। ও একখানা বই টেনে পড়তে শুরু করে দিলে। অন্নদা একটু থামিয়া বলিতে লাগিল, রাত্রি বোধ করি তখন বারোটা, আমার দোরে ঘা পড়ল। কে রে? বাইরে থেকে জবাব এলো, অনুদিদি আমি। দোর খোলো। এত রাত্রে দ্বিজু ডাকে কেন, ব্যস্ত হয়ে দোর খুলে বেরিয়ে এলুম,—দ্বিজুর এ কি মূর্তি! চোখ কোটরে ঢুকেছে, গলা ভাঙ্গা, শরীর কাঁপচে,—কিন্তু তবু হাসি। বললে, দিদি, মানুষ করেছিলে তাই তোমার ঘুম ভাঙ্গালুম। যদি চোখ বুজতেই হয় তোমার কোলেই মাথা রেখে বুজবো। এই বলিয়া অন্নদা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার কান্না যেন থামিতে চাহে না এমনি ভিতরের অদম্য আবেগ। আপনাকে সামলাইতে তাহার অনেকক্ষণ লাগিল, তারপরে কহিল, বুকে করে তাকে ঘরে নিয়ে গেলুম, কিন্তু যেমন কাট বমি তেমনি পেটের যন্ত্রণা—মনে হলো রাত বুঝি আর পোহাবে না, কখন নিশ্বাসটুকু বা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদের খবর দেওয়া হলো, তাঁরা সব এসে পড়লেন, ফুঁড়ে ওষুধ দিলেন, গরম জলের তাপ-সেঁক চলতে লাগলো—চাকররা সব জেগে বসে—ভোরবেলায় দ্বিজু ঘুমিয়ে পড়লো। ডাক্তাররা বললে আর ভয় নেই। কিন্তু কিভাবে যে রাতটা কেটেছে দিদিমণি, ভাবলে মনে হয় বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখেচি—ও-সব কিছুই হয়নি! এই বলিয়া অন্নদা আবার আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিল। বন্দনা আস্তে আস্তে বলিল, আমি কিছুই জানতে পারিনি, আমাকে তুললে না কেন অন্নদা? অন্নদা কহিল, সকালে ঐ একটা অশান্তি গেলো, আর তোমাকে ব্যস্ত করলুম না দিদিমণি। নইলে দ্বিজু বলেছিল। বন্দনা এ প্রসঙ্গ ছাড়িয়া দিল, কহিল, দ্বিজুবাবু এখন কেমন আছেন? অন্নদা কহিল, ভালো আছে, ঘুমোচ্চে। ডাক্তাররা বলে গেছেন, হয়ত সন্ধ্যার আগে আর ঘুম ভাঙ্গবে না। বড়বাবু এসে পড়লে বাঁচি দিদি। তাঁকে কি খবর দেওয়া হয়েছে? না। দত্তমশাই বললেন
false
shomresh
কি হতে যাচ্ছে? আঙুলে কানের পাশের ফোলা জায়গাটা স্পর্শ করল সুদীপ। জয়িতার চাপে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টেডভ্যাক নিয়ে ওষুধ লাগাতে হয়েছে। ব্যান্ডেজটা নিশ্চয়ই খুব দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। কিরকম, তাকে কি ডাকাত ডাকাত মনে হবে কারও? ও যদি এখন এই মুহূর্তে চিৎকার করে বলে, দেখুন মশাই আমিই একজন ডাকাত যাদের কথা আপনারা বলছেন তাহলে এই ট্রামের লোকগুলো কি তাকে বিশ্বাস করবে? ধর্মতলায় নেমে হাঁটতে লাগল সুদীপ। এখন প্রায় এগারোটা। অফিসযাত্রীদের ভিড় এখন চারপাশে। সাধারণত দশটায় অফিসগুলো চালু হওয়ার কথা। কিন্তু ট্রামে-বাসে বারোটা পর্যন্ত অফিস-টাইম শব্দটা চালু থাকে। সুদীপের সামনেই একটি মধ্যবয়সী লোক হাতে রেক্সিনের ছোট ব্যাগ নিয়ে হাঁটছিল। এগুলোকে টিপিক্যাল কেরানিব্যাগ বলা হয়। ওপর থেকে টিফিনবাক্সটার সাইজ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সময় যেন ওর সামনে পড়ে আছে এমন ভঙ্গিতে লোকটি হাঁটছিল। বহুতল বাড়িটার সামনে এসে সুদীপ লক্ষ্য করল লোকটি সেখানেই ঢুকছে। সামনেই লম্বা কাউন্টার। সেখানে কেউ নেই। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। লোকটি লাইনের শেষে দাঁড়াতেই সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রেইড করে যারা গয়নাগাটি নিয়ে আসেন তাদের ডিপার্টমেন্টটা কোথায়? লোকটি ছোট চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, লাইনে দাঁড়ান, বলে দেব। রাক্ষসের পেটেও বোধহয় এত জায়গা থাকে না, লিফটে দাঁড়িয়ে মনে হল সুদীপের। ভাগ্যিস সব ফ্লোরে থামছে না! হঠাৎ সুদীপ শুনল, নেমে ডানদিকে। বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক পা এগিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। পুরো ধর্মতলাটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দোতলা বাসগুলোকেই ছোট দেখাচ্ছে, মানুষজন লিলিপুট। অনেক উঁচু থেকে দেখলে বোধহয় এইরকম সুন্দর দেখায়। খুঁজে খুঁজে অফিসটাকে বের করল সুদীপ। অফিসার ভদ্রলোক চমৎকার। বসতে বলে প্রশ্ন করলেন, অবনী তালুকদার আপনার কে হন? উনি আমার বাবা। আমার মা মারা গিয়েছেন। আপনারা মায়ের গহনাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। বাবা বলছেন তিনি সেগুলো এখনও ফেরত পাননি। কথাটা সত্যি কিনা জানতে এসেছি। বাবার কথা অবিশ্বাস করছেন কেন? করার কারণ আছে। দেখুন, এটা অবনীবাবু এবং সরকারের ব্যাপার। এক্ষেত্রে আপনি থার্ড পার্টি। আপনাকে আমরা আইনত জানাতে পারি না। ওঁর অ্যাসেসমেন্ট কোথায় হয় জানেন? না, উনি আমাকে বলেননি। কিন্তু সোনাগুলো তো আমার মায়ের। হতে পারে। তবে যেহেতু ওইসব আনডিসক্লোজড ওয়েলথ অবনীবাবুর বাড়িতে পাওয়া গিয়েছে এবং সত্যিকারের কোন মালিক যদি প্রমাণ দেখাতে না পারেন তাহলে আমরা অবনীবাবুর সম্পদ হিসেবেই ধরব। আয়কর আইনে যা যা ব্যবস্থা নেবার তা নেওয়া হবে। তবে আমি আপনাকে আনঅফিসিয়ালি জানাচ্ছি, কিছু কিছু জিনিস আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। ডিটেলস জানতে চাইলে আপনাকে পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করতে হবে। অফিসারের কাছ থেকে বাবার যেখানে অ্যাসেসমেন্ট হয় সেখানকার ঠিকানা নিয়ে সুদীপ বাইরে বের হল। কয়েকতলা ভেঙে নির্দিষ্ট তলায় আসতেই ও থমকে দাঁড়াল। অবনী তালুকদার হেঁটে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে ফাইল বগলে একটা লোক। লোকটা যেন কিছু চাইছে আর অবনী ঘাড় নেড়ে খুব সম্মতি দিয়ে যেতে যেতে একটা ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন। দরজার ওপরে টাঙানো ফলক থেকে নাম পড়ল সুদীপ। গতকাল অবনী তালুকদারকে যে অবস্থায় সে দেখে এসেছিল তাতে একবারও মনে হয়নি আজ উনি সুস্থ হয়ে মামলা করতে আসতে পারেন। একটু বাদেই সেই ফাইলবাহক বেরিয়ে এল। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আজকে কেস আছে? সুদীপ মাথা নেড়ে না বলতে লোকটি বিরক্ত হল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমার বাবা ভেতরে গেছেন তাই। বাবা? অবনীবাবু আপনার বাবা? হ্যাঁ। অহো, নমস্কার নমস্কার। আপনাদের কেসটা খুব কঠিন তবে ছাড় পেয়ে যাবেন। আমাদের এই সাহেবের মনটা নরম। একটু চেপে ধরলেই হয়ে যাবে। আমি তো বললেই ফাইল এনে দিই। লোকটি কৃতার্থ হয়ে হাসল। আমাদের বাড়িতে যে সার্চ হয়েছিল তার ফাইলটা কোথায়? সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল সুদীপ। ও বাবা, ওই ফাইল সাহেবের আলমারিতে। সাহেব ছাড়া কেউ হাত দেয় না। বসুন না। কথা বলতে বলতে আর একজনকে দেখেছিল, লোকটি এবার সেইদিকে ছুটল। সুদীপ একটু ইতস্তত করল। তারপর আলতো করে দরজায় চাপ দিতেই অবনী তালুকদারের গলা শুনতে পেল, না রায়সাহেব, সৎভাবে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি একটু রাজী হয়ে যান দেখবেন অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি কি বলতে চাইছেন? উই ক্যান ওয়ার্ক টুগেদার। অবনী তালুকদারের কণ্ঠস্বর রহস্যময়। অফিসার কিছু বলতে গিয়ে গলা তুললেন, কে, কে ওখানে? সুদীপ দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকতেই ভদ্রলোক উত্তেজিত হলেন, না বলে ঢুকলেন কেন? কে আপনি? সুদীপ দেখল অবনী তালুকদারের মুখ সাদা হয়ে গেছে। এমন অবাক বোধহয় জীবনে হননি তিনি। সে হেসে বলল, আপনি বলে দিন আমি কে। অবনী ঠোঁট চাটলেন, আমার ছেলে। তার গলার স্বর ফ্যাসফেসে শোনাল। ও। অফিসার ইঙ্গিত করলেন একটা চেয়ার দেখিয়ে বসার জন্যে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন অবনী তালুকদার, স্যার, আজকে আমি চলি। আমাকে আর একটা ডেট দিন। কেন? হঠাৎ ডেট চাইছেন? আমি কেসটা আর ঝুলিয়ে রাখতে চাই না। প্লিজ স্যার! তুমি—তুমি, একটু বাইরে দাঁড়াবে? কেন? সুদীপ হাসল। ঠিক আছে স্যার। আমি পরে দেখা করব। কাগজপত্র তুলে অবনী তালুকদার বাইরে বেরিয়ে যেতেই সুদীপ তাকে অনুসরণ করল। সেই জানলাটা যেখান থেকে সুন্দর কলকাতা দেখা যায় সেখানে। পোঁছে অবনী উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, এখানে এসেছ কেন? কি চাই? আপনিই আসতে বলেছিলেন। আমি? কই কখন? হোয়াট ড়ু ইউ ওয়ান্ট? আমার মায়ের গহনা। উঃ, সেটা এদের কাছে
false
robindronath
আর উঠল না। ৪ এই বাদলায় আমাদের পাড়ার মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে। তার বোন এসে তাকে বললে, ‘মা ডাকছে।’ সে কেবল সবেগে মাথা নাড়ল, তার বেণী উঠল দুলে। কাগজের নৌকো নিয়ে তার ভাই তার হাত ধ’রে টানলে; সে হাত ছিনিয়ে নিলে। তবু তার ভাই খেলার জন্যে টানাটানি করতে লাগল; তাকে এক থাপড় বসিয়ে দিলে। ৫ বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে। আদিযুগে সৃষ্টির মুখে প্রথম কথা জেগেছিল জলের ভাষায়, হাওয়ার কণ্ঠে। লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে সেই স্মরণ-বিস্মরণের অতীত কথা আজ বাদলার কলস্বরে ঐ মেয়েটিকে এসে ডাক দিলে। ও তাই সকল বেড়ার বাইরে চলে গিয়ে হারিয়ে গেল। কত বড়ো কাল, কত বড়ো জগৎ, পৃথিবীতে কত যুগের কত জীবলীলা! সেই সুদূর— সেই বিরাট, আজ এই দুরন্ত মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো মেঘের ছায়ায়, বৃষ্টির কলশব্দে। ও তাই বড়ো বড়ো চোখ মেলে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, যেন অনন্তকালেরই প্রতিমা। ভাদ্র ১৩২৬ কাঞ্চীর রাজা কর্ণাট জয় করতে গেলেন। তিনি হলেন জয়ী। চন্দনে, হাতির দাঁতে, আর সোনামানিকে হাতি বোঝাই হল। দেশে ফেরবার পথে বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে রাজা পুজো দিলেন। পুজো দিয়ে চলে আসছেন— গায়ে রক্তবস্ত্র, গলায় জবার মালা, কপালে রক্তচন্দনের তিলক; সঙ্গে কেবল মন্ত্রী আর বিদূষক। এক জায়গায় দেখলেন, পথের ধারে আমবাগানে ছেলেরা খেলা করছে। রাজা তাঁর দুই সঙ্গীকে বললেন, ‘দেখে আসি, ওরা কী খেলছে।’ ২ ছেলেরা দুই সারি পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার সঙ্গে কার যুদ্ধ।’ তারা বললে, ‘কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর।’ রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার জিত, কার হার।’ ছেলেরা বুক ফুলিয়ে বললে, ‘কর্ণাটের জিত, কাঞ্চীর হার।’ মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর হল, রাজার চক্ষু রক্তবর্ণ, বিদূষক হা হা ক’রে হেসে উঠল। ৩ রাজা যখন তাঁর সৈন্য নিয়ে ফিরে এলেন, তখনো ছেলেরা খেলছে। রাজা হুকুম করলেন, ‘এক-একটা ছেলেকে গাছের সঙ্গে বাঁধো, আর লাগাও বেত।’ গ্রাম থেকে তাদের মা-বাপ ছুটে এল। বললে, ‘ওরা অবোধ, ওরা খেলা করছিল, ওদের মাপ করো।’ রাজা সেনাপতিকে ডেকে বললেন, ‘এই গ্রামকে শিক্ষা দেবে, কাঞ্চীর রাজাকে কোনোদিন যেন ভুলতে না পারে।’ এই বলে শিবিরে চলে গেলেন। ৪ সন্ধেবেলায় সেনাপতি রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। প্রণাম করে বললে, ‘মহারাজ, শৃগাল কুকুর ছাড়া এ গ্রামের কারো মুখে শব্দ শুনতে পাবে না।’ মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজের মান রক্ষা হল।’ পুরোহিত বললে, ‘বিশ্বেশ্বরী মহারাজের সহায়।’ বিদূষক বললে, ‘মহারাজ, এবার আমাকে বিদায় দিন।’ রাজা বললেন, ‘কেন!’ বিদূষক বললে, ‘আমি মারতেও পারি নে, কাটতেও পারি নে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।’ বৈশাখ ১৩২৯ লোকটি নেহাত বেকার ছিল। তার কোনো কাজ ছিল না, কেবল শখ ছিল নানা রকমের। ছোটো ছোটো কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে সে ছোটো ছোটো ঝিনুক সাজাত। দূর থেকে দেখে মনে হত যেন একটা এলোমেলো ছবি, তার মধ্যে পাখির ঝাঁক; কিম্বা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, সেখানে গোরু চরছে, কিম্বা উঁচুনিচু পাহাড়, তার গা দিয়ে ওটা বুঝি ঝর্ণা হবে কিম্বা পায়ে-চলা পথ। বাড়ির লোকের কাছে তার লাঞ্ছনার সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে পণ করত পাগলামি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পাগলামি তাকে ছাড়ত না। ২ কোনো কোনো ছেলে আছে সারা বছর পড়ায় ফাঁকি দেয়, অথচ পরীক্ষায় খামকা পাস করে ফেলে। এর সেই দশা হল। সমস্ত জীবনটা অকাজে গেল, অথচ মৃত্যুর পরে খবর পেলে যে, তার স্বর্গে যাওয়া মঞ্জুর। কিন্তু নিয়তি স্বর্গের পথেও মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। দূতগুলো মার্কা ভুল করে তাকে কেজো লোকের স্বর্গে রেখে এল। এই স্বর্গে আর সবই আছে, কেবল অবকাশ নেই। এখানে পুরুষরা বলছে ‘হাঁফ ছাড়বার সময় কোথা?’ মেয়েরা বলছে, ‘চললুম ভাই, কাজ রয়েছে পড়ে।’ সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না ‘সময় অমূল্য’। ‘আর তো পারা যায় না’ বলে সবাই আক্ষেপ করে, আর ভারি খুশি হয়। ‘খেটে খেটে হয়রান হলুম’ এই নালিশটাই সেখানকার সংগীত। এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, কোথাও খাপ খায় না। রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে চলে, তাতে ব্যস্ত লোকের পথ আটক করে। চাদরটি পেতে যেখানেই আরাম করে বসতে চায়, শুনতে পায়, সেখানেই ফসলের খেত, বীজ পোঁতা হয়ে গেছে। কেবলই উঠে যেতে হয়, সরে যেতে হয়। ৩ ভারি এক ব্যস্ত মেয়ে স্বর্গের উৎস থেকে রোজ জল নিতে আসে। পথের উপর দিয়ে সে চলে যায় যেন সেতারের দ্রুত তালের গতের মতো। তাড়াতাড়ি সে এলো-খোঁপা বেঁধে নিয়েছে। তবু দু-চারটে দুরন্ত অলক কপালের উপর ঝুঁকে প’ড়ে তার চোখের কালো তারা দেখবে ব’লে উঁকি মারছে। স্বর্গীয় বেকার মানুষটি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চঞ্চল ঝর্নার ধারে তমাল গাছটির মতো স্থির। জানলা দিয়ে ভিক্ষুককে দেখে রাজকন্যার যেমন দয়া হয়, একে দেখে মেয়েটির তেমনি দয়া হল। ‘আহা তোমার হাতে বুঝি কাজ নেই?’ নিশ্বাস ছেড়ে বেকার বললে, ‘কাজ করব তার সময় নেই।’ মেয়েটি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলে না। বললে, ‘আমার হাত থেকে কিছু কাজ নিতে চাও?’ বেকার বললে, ‘তোমার হাত থেকেই কাজ নেব ব’লে দাঁড়িয়ে আছি।’ ‘কী কাজ দেব?’ ‘তুমি যে ঘড়া কাঁখে করে জল তুলে নিয়ে যাও তারই একটি যদি আমাকে দিতে পারো—’ ‘ঘড়া নিয়ে কী হবে? জল তুলবে?’ ‘না, আমি তার গায়ে চিত্র
false
shomresh
করতে দিতে হয়। এইগুলো আমরা সবাই মেনে চলি। ও দীপা লজ্জা পেল। ঠিক আছে, এবার বল। হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি মেয়েটি সবার সামনে কেঁদে পড়তে পারে না। কিন্তু ও কাঁদবে ভেতরে ভেতরে। যদি তেমন কোন সুযোগ থাকে যখন মঞ্চে ও একা তখন এক মুহূর্তের জন্যেও যদি দর্শক সেই ভেতরের কান্না দেখতে পান তাহলে খুব ভাল হবে। শমিত মুখ ঘুরিয়ে ঘরের কোণায় তাকাল, সেখানে সুদীপ বসেছিল, চুপচাপ। শমিতের সঙ্গে চোখাচে্যুখি হতেই বলল, উনি খুব ভাল বলেছেন। কিন্তু মুশকিল হল পরের দৃশ্যে ঘটনা অন্যদিকে বয়ে গেছে। তা যাক। দীপার আইডিয়োটা আমার ভাল লাগছে। আমরা নাটক করছি। দর্শকের জন্যে। দর্শককে যদি বুঝতে না দিই চরিত্রটির মনের চেহারা কি তাহলে ঠিক কাজ হবে না। দেখা যাক কোন নতুন দৃশ্য বের করা যায় কিনা। থ্যাঙ্ক ইউ দীপা, তুমি ব্যাপারটা ভেবেছ বলে খুশী হলাম। রাত আটটায় তাকে ছুটি দিল শমিত। এর মধ্যে পুরো নাটকটা গড়গড় করে পড়ে গিয়েছে সে। একবার দেখা ছিল তাই বুঝতে অসুবিধে হল না। শেষ আধা ঘণ্টায় ওর হাতে খাতা দিয়ে শমিত বলল, তুমি মেয়েটির সংলাপ বল। দেখে দেখেই বলবে। আমাদের মুখস্থ আছে। সংলাপে চোখ রেখে দীপা আবিষ্কার করল তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কান গরম হয়ে উঠল। বসে বসেই শামিতরা যেখানে সংলাপ শুরু করল সেখানে মেয়েটি নেই। হয়তো দীপকে তৈরী হতে সময়টা দিল। কিন্তু দীপার মনে হল কথা বলতে গেলেই গলায় স্বর ফুটবে না। তার জায়গা এসে গেলেও সে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ। অন্য সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা মুখ তুলল, আমি এটা নিয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে যদি তৈরী হয়ে এসে বলি? বিরক্ত হল শমিত, তার জন্যে অনেকটা সময় পরে পারে। এখন যা বললাম। তাই কর। দীপার খেয়াল হল শমিতকে প্রশ্নটা করার সময় তার গলা আটকে যায়নি। কিন্তু একটু যেন কাঁপুনি এসেছিল। আবার নতুন করে পড়া শুরু হল। তিনটে পুরুষ-চরিত্র কথা বলছে। হঠাৎ হাত তুলল। শমিত, বাসব। হোয়াট ইজ দিস? ভুল হল? রোগা মত একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করল। আমি হাজারবার বলেছি কারো গলা নকল করবে না। কটা শো করেছ। এর মধ্যে? এখনও নিজের গলায় কথা না বললে তো মুশকিল। ছেলেটি মাথা চুলকে বলল, তাহলে এসে গিয়েছে। আসে কেন? এর কোন ক্ষমা নেই। কিন্তু। যার গলা নকল করছ, সেটা তাঁকেই মানায়। অন্য কেউ বললে ক্যারিকেচার বলে মনে হয়। আমি কিন্তু পরের বার এটা মেনে নেব না। নাও, আবার আরম্ভ কর। দীপা ব্যাপারটা ধরতে পারল না। যদিও ছেলেটির সংলাপ বলার ধরনের সঙ্গে ওর কথা মাত্র কোন মিল নেই। সংলাপ একটা সুর আনছিল। আবার বলা শুরু হল। পর পর চোখ রেখে নিজের জায়গায় এলে দীপা : আপনি জানেন না, জানার আগ্রহও যখন হয়নি তখন আপনাকে নিজে থেকে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। এরকম নাটুকে ভাষায় কথা বলছ কেন? শমিত জিজ্ঞাসা করল। নাটক! তার আলাদা কোন ভাষা থাকে নাকি। নাটক তো জীবন থেকেই নেওয়া। কিন্তু জীবন মানেই নাটক নয়। মানছি। কিন্তু আমি আমার কথা বলছি। বেশ। তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। হ্যাঁ, এবার বল, তোমার কষ্ট কি? কি তোমার দুঃখ? আমি সব জানতে চাই। কি আশ্চর্য। আমি খামোক আপনাকে আমার কথা বলতে যাব কেন? হঠাৎ একটা হাততালি বাজল। দীপা খাতা থেকে চোখ সরাল। শমিত বলল, গুড। এই তেজটা চাই। উইদ দিস ডিগনিটি। দীপা তোমার গলা ঠিক আছে কিন্তু রেওয়াজ করতে হবে। রেওয়াজ? দীপা অবাক। হ্যাঁ। শুধু গায়কদের গলা ঠিক করার জন্যে রেওয়াজ করতে হয় এই ধারণা ভুল। অভিনয়ের জন্যেও ওটা দরকার। তোমার গলার স্বর মিষ্টি এবং পরিষ্কার। কিন্তু গলায় কাজ আনতে গেলে অনুশীলন দরকার। বাড়িতে সঞ্চয়িতা আছে? আছে। বিদায় অভিশাপ আর কর্ণকুন্তী সংবাদ রোজ সকালে জোরে জোরে পড়বে। গলা যতটা তুললে কষ্ট হয় না ভেঙ্গে পড়ে না ততটা তুলে অর্থ অনুযায়ী সংলাপ বলবে। যেখানে বেস ভয়েস দরকার সেখানে সামান্য নিচে গলা নামারে। পড়ার সময় মনে রাখবে চরিত্রটি যে কথা বলছে তার ভেতরের আবেগ যেন তোমার বলায় স্পষ্ট হয়। দীপা হেসে বলল, পাড়ার লোকজন চলে আসবে যে। বিরক্ত হল শমিত, প্রথম দিন আসবে, হয়তো দ্বিতীয় দিনেও কিন্তু তারপর আর আসবে না। সবাই জেনে যাবে তুমি অনুশীলন করছ। কোনদিন হারমোনিয়াম বাজিয়েছ? না। সেই সুযোগ পাইনি। ঠিক আছে, আপাতত দরকার নেই। তোমার দেরি হয়ে গেছে তুমি যেতে পার। আর হ্যাঁ, কাল ছটায় আসবে। ঠিক ছটা। আমাকে কি রোজ আসতে হবে? এমন নির্বোধের মত প্রশ্ন যেন কখনও শোনেনি শমিত, না এলে তুমি পারবে কি করে? মাত্র তো দুঘণ্টা, বাইশ ঘণ্টা অন্য কাজ করো। নাটক হবে দলগত শিল্প। প্রত্যেকে সমান ছন্দে বাজবে। তাল কেটে গেলেই বুলি। তোমাকে এই চরিত্রে নিয়ে আমি বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছি। দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা রিহার্সাল দিলে হয়তো একটা আদল পেতাম। কি আর করা যাবে। অখুশী মনে কথাগুলো বলল শমিত। দীপা বলতে যাচ্ছিল, আমি কিন্তু যেচে আপনার কাছে আসিনি, আপনি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছেন। যেহেতু কথাটা বলা মানে পরিবেশটাকে নষ্ট করা তাই সে উঠে দাঁড়াল। শমিত বলল, সুদীপ ওকে বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছে দিতে হবে। না, না। কোন দরকার নেই। বাজে বকো না। প্রথম দিন কেউ যাক।
false
nihar_ronjon_gupta
বুঝে পায় না, কোন সান্ত্বনার বাণী তার মুখ থেকে বের হয় না। আরও দিন পনেরো কেটে গেল। রীণার মৃতদেহের সন্ধান করতে পারেনি পুলিস, যেমন পারেনি পুরীতে মানসীর মৃতদেহের কোন সন্ধান। মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটাও নিয়ে পরবর্তীকালে যেমন শরদিন্দু আর মাথা ঘামায়নি, তেমনি রীণার মৃত্যুর ব্যাপারটাও বোধ করি অনিবার্য একটা দুর্ঘটনা বলে শরদিন্দু মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মানসীর ঐ আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেননি একজন, তিনি মানসীর বাবা পরেশ নন্দী। একটা সন্দেহের কুয়াশা যেন ক্রমশ তার মনের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠতে থাকে। মানসী ছিল ভাল সাঁতারু। কলেজ জীবনে সে তার সাঁতারের কৃতিত্ব স্বরূপ অনেক কাপ মেডেল পেয়েছিল। সেই মানসী পুরীর সমুদ্রে স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাবে—কথাটা যেন মন থেকে কিছুতেই পরেশ নন্দী মেনে নিতে পারছিলেন না। কেমন যেন ব্যাপারটা রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হত তার কাছে। মনে হত মানসীর মৃত্যুর মধ্যে কোথাও একটা কোন রহস্য আছে নিশ্চয়ই। এমনি যখন মনের অবস্থা পরেশ নন্দীর, হঠাৎ একজনের কথা তার মনে পড়ল। মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছু তিনি শুনেছিলেন কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। অবশেষে অনেক ভেবে সাহসে ভর করে একদিন তিনি গড়িয়াহাটায় তার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিরীটী রায়। কিরীটী বাড়িতেই ছিল। প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে সবে ফিরেছে কিরীটী। বসবার ঘরে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতাটা ওলটাচ্ছিল কিরীটী, জংলী এসে বললে, একজন বুড়ো বাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। বুড়ো বাবু? কিরীটী বলল, তুই বললি না কেন কারও সঙ্গে আমি দেখা করি না? বলেছি, কিন্তু শুনছে না যা এই ঘরে নিয়ে আয়। একটু পরে জংলীর সঙ্গে পরেশ নন্দী এসে ঘরে ঢুকলেন, পরনে একটা ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল। রায়মশাই, আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল বলে আমি বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু আপনি ছাড়া কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না ভেবেই বসুন। কোথা থেকে আসছেন? পরেশ নন্দী তার নাম-ধাম বললেন। আমার কাছে কি দরকার বলুন তো পরেশবাবু? কিরীটী শুধাল। আমার যা বলবার যদি একটু ধৈর্য ধরে শোনেন রায়মশাই অনুগ্রহ করে— বেশ বলুন! পরেশ নন্দী, তখন মানুসীর কাহিনী আদ্যোপান্ত বলে গেলেন ধীরে ধীরে। আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না নিশ্চয়ই নন্দীমশাই যে আপনার মেয়েটি জলে ড়ুবে মরতে পারে! কিরীটী বলল সবকিছু শুনে। না। আমার মনে হয় তার যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে জলে ড়ুবে, তাহলে সে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। সমুদ্রে কখনও আপনার মেয়ে সাঁতার কেটেছে? না। তাহলে ব্যাপারটা তো আকস্মিক দুর্ঘটনাও হতে পারে নন্দীমশাই। পরেশ নন্দী বললেন, হতে যে পারে না তা নয়। কিন্তু তবুও মনকে প্রবোধ দিতে পারছি। তাছাড়া একটা কথা ভেবে দেখুন রায়মশাই-শরদিন্দু আবার বিবাহ করল দেড় বৎসরের মধ্যে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাগ্যেও অনুরূপ ব্যাপার ঘটল। আবার সেই সমুদ্র– আচ্ছা নন্দীমশাই, শরদিন্দুবাবু দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করলেন—সেই রীণা না কি নাম মেয়েটির—তার পরিচয় কিছু জানেন? কার মেয়ে—কোথায় বিয়ে করলেন তাকে উনি? না, সেসব কিছুই আমার জানা নেই হয়তো সুকুমার জানে। সুকুমার মানে শরদিন্দুবাবুর জ্ঞাতিভাই, যিনি এই বাড়িতেই থাকেন? হ্যাঁ। একটা কথা রায়মশাই কথাটা আমি বলিনি এখনও, কিন্তু বোধ হয় আপনার জানা দরকার, আমার মেয়ে মানসীর সঙ্গে ঐ ছেলেটির একটু যেন হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল একসময় ভালোবাসা? বলতে পারেন। আপনার মেয়ের বিবাহের পূর্বে না পরে? পূর্বে। তবু আপনি শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন কেন? সে কথা তো পূর্বেই আপনাকে বলেছি শরদিন্দু এক সময় আমার মালিক ছিল—তারপর হঠাৎ অকালে শরদিন্দু আমাকে রিটায়ার করাবার জন্য জেদ প্রকাশ করল-মানসী সেকথা জেনে প্রতিবাদ জানাতে যায় শরদিন্দুর কাছে শরদিন্দু ওকে দেখে মুগ্ধ হয়—বিবাহের প্রস্তাব দেয় আমার কাছে, সেই সঙ্গে একটা লোভনীয় পেনসনের লোভ দেখায়। চাকরি গেলে আমার আর্থিক অবস্থার কি হবে ভেবে আমি মানসীকে অনুরোধ জানাই বিবাহে সম্মত হতে। মানসী আমায় অত্যন্ত ভালোবাসত—সে সব কথা শুনে প্রথমটার গুম হয়ে রইল—তারপর একটু পরে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে বাবা। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, আচ্ছা বিবাহের পর শরদিন্দু কি ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল—মানে তার স্ত্রীর পূর্বরাগের কথা? বোধ হয় জেনেছিল। আপনি জানলেন কি করে? মানুর ডাইরি থেকে— ডাইরি? হ্যাঁ, মানুর একটা ডাইরি ছিল—মধ্যে মধ্যে যে ডাইরি লিখত। সেই ডাইরিটা এখনও আমার কাছে আছে। আপনি পেলেন কি করে সেই ডাইরি? ও যেবারে পুরী যায়, তার দুদিন আগে আমার কাছে এসেছিল—বোধ হয় সেই সময়ই ডাইরিটা তার পড়ার টেবিলে বইয়ের মধ্যে রেখে যায়—তার মৃত্যুর পর একদিন তার পড়ার টেবিলের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ ডাইরিটা পাই—ওর পুরী যাওয়ার তিন দিন আগে রাত্রে ডাইরির শেষ পাতা লেখা। আপনি আমাকে একবার ডাইরিটা পড়াতে পারেন নন্দীমশাই? কাল এনে দেব। তাই দেবেন, আগে আমি ডাইরিটা পড়ে দেখি, ডাইরির মধ্যে যদি এমন কিছু পাইযাতে করে আপনার সংশয়টা যুক্তিযুক্ত মনে হয় পরেশ নন্দী বললেন, বেশ, তাই পড়ে দেখুন কালই আমি দিয়ে যাব। ডাইরিটা—পরেশ নন্দী কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে পরেশ নন্দী এসে মানসীর ডাইরিটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সনের একটা পুরাতন ডাইরি। সেই ডাইরির পাতার মধ্যে মধ্যে মানসী ডাইরি লিখেছে। রাত্রে বসবার ঘরের সোফাটায় বসে কিরীটী ডাইরির পাতাগুলি ওলটাচ্ছিল। প্রথম তারিখ ১৯৬৩ সনের ৬ই জুলাই। প্রথমে বেশ অনেকগুলো খালি পাতার পর বোধ হয় ঐ ডাইরি লেখা শুরু। মানসী লিখছে, মাত্র
false
shordindu
মাঝে ছিন্ন হইয়া যাইতেছিল, আবার যুক্ত হইয়া আপন পথে চলিতেছিল। ক্লান্ত দেহ যতই নিদ্রার অতলে ড়ুবিয়া যাইতে চাহিতেছিল, আজিকার বহু ঘটনাবিদ্ধ মন ততই সচেতন থাকিবার চেষ্টা করিতেছিল। নিদ্রা ও জাগরণের মধ্যে এইরূপ দ্বন্দ্ব চলিতেছিল, এমন সময় চিত্রকের চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া উঠিল। তাহার মনে হইল কে যেন অতি লঘু করস্পর্শে তাহার মুখে হাত বুলাইয়া দিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে সে কাহাকেও দেখিতে পাইল না; প্রথমে মনে হইল হয়তো চর্মচটিকার পাখার স্পর্শ; ইহারা সূচীভেদ্য অন্ধকারে নিঃশব্দে উড়িয়া বেড়ায়, স্পর্শেন্দ্রিয়ের দ্বারা বাধাবন্ধ অনুভব করিয়া গতি পরিবর্তন করিতে পারে। হয়তো চর্মচটিকাই হইবে। কিন্তু যদি চর্মচটিকা না হয়? যদি জীবন্ত কোনও প্রাণীই না হয়? চিত্রকের মেরুযষ্টির ভিতর দিয়া একটা শিহরণ বহিয়া গেল। সে অন্ধকারে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সতর্কভাবে বসিয়া রহিল। আবার তাহার মুখের উপর লঘু করাঙ্গুলির স্পর্শ হইল, যেন কেহ অঙ্গুলির দ্বারা তাহার মুখাবয়ব অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিতেছে; তাহার গণ্ডে তীক্ষ্ণ নখের আঁচড় লাগিল। চিত্রক প্রস্তুত ছিল, সে ক্ষিপ্র হস্ত সঞ্চালনে অদৃশ্য স্পর্শকারীকে ধরিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কিছুই ধরিতে পারিল না। যে স্পর্শ করিয়াছিল সে সরিয়া গিয়াছে। চিত্ৰক তখন উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল—কে? কে তুমি? কয়েক মুহূর্ত পরে তাহার সম্মুখের অন্ধকারে গভীর নিশ্বাস পতনের শব্দ হইল। চিত্রকের সর্বাঙ্গের রোম কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সে কম্পিতস্বরে বলিল—কে তুমি? যদি মানুষ হও উত্তর দাও। কিছুক্ষণ নীরব। তারপর অদূরে অস্ফুট শব্দ হইতে লাগিল। চিত্রক উৎকর্ণ হইয়া শুনিল। মানুষের কণ্ঠস্বরই বটে, কিন্তু শব্দগুলির কোনও অর্থ হয় না। যেন স্বপ্নের ঘোরে কেহ অস্পষ্ট অর্থহীন আকুতি প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে। মনুষ্য বুঝিয়া চিত্রক আবার স্বস্থ হইল। সে বলিল—শব্দ শুনিয়া মনে হইতেছে তুমি মানুষ। স্পষ্ট করিয়া বল, কে তুমি? দীর্ঘকাল আর কোনও শব্দ নাই। চিত্রকের মনে হইল, সে বুঝি কল্পনায় শব্দ শুনিয়াছিল, সমস্তই এই কুহকময় অন্ধকারের ছলনা। তাহার স্নায়ুপেশী আবার শক্ত হইতে লাগিল। এ কিরূপ মায়া? অলৌকিক মায়া? আমি বন্দিনী…বন্দিনী…. না, মানুষের কণ্ঠস্বর—ছলনা নয়। কথাগুলি অতি দ্বিধাভরে কথিত হইলেও স্পষ্ট। বক্তা যেন আরও নিকটে আসিয়াছে। চিত্ৰক বলিল—বন্দিনী? তুমি নারী? হাঁ। নিশ্চিন্ত হইলাম। ভাবিয়াছিলাম তুমি প্রেতযোনি। তুমি কে? চিত্ৰক হাসিল—আমিও বন্দী। তুমি কত দিন বন্দী আছ? কতদিন—জানি না। এখানে দিন রাত্রি নাই, মাস বর্ষ নাই— কণ্ঠস্বর মিলাইয়া গেল। চিত্ৰক বলিল—তুমি আমার কাছে এস। ভয় নাই, আমি তোমার অনিষ্ট করিব না। কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন হইল—তুমি কি হূণ? না, আমি আর্য। তখন অদৃশ্য রমণী কাছে আসিয়া চিত্রকের জানুর উপর হাত রাখিল, চিত্ৰক তাহার হস্ত স্পর্শ করিয়া দেখিল, কঙ্কালসার হস্ত, শীর্ণ অঙ্গুলির প্রান্তে দীর্ঘ নখ। তাহার জানুর উপর হস্তটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। চিত্ৰক বলিল—উপবিষ্ট হও। আমাকে ভয় করিও না, আমিও তোমারই মত অসহায়। মনে হয় দীর্ঘকাল বন্দিনী আছ। তুমি অন্ধকারে দেখিতে পাও? অল্প। তোমার বয়স কত? এতক্ষণে রমণী যেন অনেকটা সাহস পাইয়াছে, সে সোপানের উপর উপবেশন করিল। যখন কথা কহিল তখন তাহার কথা আরও স্পষ্ট ও সুসংলগ্ন শুনাইল। যেন সে দীর্ঘকাল কথা না বলিয়া কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিল, আবার ক্রমশ সুসঙ্গত বাশক্তি ফিরিয়া পাইতেছে। রমণী বলিল—আমার বয়স কত জানি না। যখন বন্দিনী হই তখন কুড়ি বছর বয়স ছিল। কে তোমাকে বন্দিনী করিয়াছিল? হূণ। হূণ? কোন হূণ? রমণী থামিয়া থামিয়া বলিতে লাগিল—একটা কদাকার খর্বকায় হূণ। রাজপুরী হুণেরা আক্রমণ করিয়াছিল। আমি ছিলাম রাজপুত্রের ধাত্রী…আমি রাজপুত্রকে স্তন্যদান করিতেছিলাম এমন সময় হুণেরা রাজ-অবরোধে প্রবেশ করিল…তাহারা রাজপুত্রকে আমার কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া তলোয়ারের উপর লোফালুফি করিতে লাগিল, একটা কদাকার হূণ আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল– সর্বনাশ। এ যে পঁচিশ বছর আগের কথা! তুমি পঁচিশ বছর বন্দিনী আছ? পঁচিশ বছর?…তা জানি না। …কদাকার হূণটা আমাকে টানিতে টানিতে স্তম্ভগৃহে লইয়া আসিল…নির্জন স্তম্ভগৃহে আমি তাহার হাত ছাড়াইবার অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু…স্তম্ভগৃহের দেয়ালে একটা গুপ্তদ্বার ছিল, কেমন করিয়া খুলিয়া গিয়াছিল..হূণটা আমাকে এই অন্ধকারে ঠেলিয়া দিয়া গুপ্তদ্বার বন্ধ করিয়া দিল— তারপর? তারপর আর জানি না…সেই অবধি এই রন্ধ্রের মধ্যে আছি। রন্ধ্র বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, কিন্তু বাহির হইবার পথ নাই…সেই হূণটা মাঝে মাঝে খাদ্য ফেলিয়া দিয়া যায়, তাহাই খাই…হূণটা আমাকে অন্ধকারে দেখিতে পায় না তাই ধরিবার চেষ্টা করে না– চিত্ৰক পূর্বে মোঙের কাহিনীর কিছু অংশ শুনিয়াছিল, এখন রমণীর বৃত্তান্ত শুনিতে শুনিতে পঁচিশ বৎসর পূর্বের হূণ উৎপাতের চিত্র যেন অস্পষ্টভাবে দেখিতে পাইল। রমণীর জন্য তাহার অন্তরে সমবেদনার উদয় হইল, সে অন্ধকারে তাহার হস্তে হস্ত রাখিয়া বলিল—হতভাগিনি! তোমার স্বজন কি কেহ ছিল? রমণী সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল। স্বামী ছিল—একটি কন্যা ছিল— হয়তো তাহারা বাঁচিয়া আছে। কাল প্রাতে আমি বাহির হইব। যদি প্রাণে বাঁচি তোমার উদ্ধারের চেষ্টা করিব। তোমার নাম কি? পৃথা। ভাল, পৃথা, আমি এবার একটু নিদ্রা দিব, রাত্রি বোধহয় প্রভাত হইতে চলিল। কাল প্রাতে সম্ভবত শূলেই চড়িতে হইবে। কিন্তু একটা উপায় চিন্তা করিয়াছি, হয়তো রক্ষা পাইতেও পারি। তুমি কে, তাহা তো বলিলে না। আমি চোর। তুমি কি রাত্রে ঘুমাও না? কখন ঘুমাই কখন জাগিয়া থাকি বুঝিতে পারি না। তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া থাকিব। সপ্তম পরিচ্ছেদ – মুক্তি চোর ধরার উত্তেজনায় সুগোপার রাত্রে ঘুম হয় নাই। ভোর হইতে না হইতে সে রাজপুরীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজকুমারী রট্টা তখনও শয্যা ত্যাগ করেন নাই; শয়ন মন্দিরের দ্বারে যবনী প্রতিহারীর পাহারা। সুগোপা কিন্তু যবনীর নিষেধ
false
humayun_ahmed
কিছু কমাবে। অ্যাডভান্স লাগবে না। রকিবকে নিয়ে দেখে এসে মনস্থির করুন। বাহ্, ফাসক্লাস চা হয়েছে। আপনি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন কেন, বসুন। ভাবি মনে হচ্ছে একটু স্বস্তি পেলেন। এখন ভাবছেন লোকটা রঙ্গ-তামাশা করতে আসে নি। ঠিক করে বলুন তো, তাই ভাবছিলেন না? পুষ্প ফ্যাকাসেভাবে বলল, জ্বি-না। না বললেও বিশ্বাস করব না। চোখমুখ কেমন সাদা হয়ে গেছে। ভাবি চলি। এখুনি যাবেন? যদি যেতে নিষেধ করেন যাব না। সুন্দরী মহিলার নিষেধ অগ্রাহ্য করব এত বড় বোকা আমি না। তবে আজ না ভাবি। ড্রাইভারকে আজ সকাল-সকাল ছেড়ে দিতে হবে। চলি, কেমন? ও আচ্ছা, বাড়ির ঠিকানা তো দেওয়া হয় নি। কাগজ-কলম আনুন। মিজান ঠিকানা লিখে সত্যি-সত্যি চলে গেল। যাবার আগে বলল, বেয়াদপি হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন ভাবি। আর রকিবকে আমি খবর দিয়ে দেব যাতে সকালসকাল অফিস থেকে ফেরে। আজই দেখে আসবেন। দেরি করবেন না। বাড়ির খুব ক্রাইসিস। রকিব পাঁচটার আগেই ফিরল। চা খেয়েই বাড়ি দেখতে বেরুল। সঙ্গে পুষ্প। বাবুকে নিয়ে নিশাত এখনন ফেরে নি। রকিব বিরক্ত মুখে বলল, কার-না-কার কাছে বাচ্চা দিয়ে দাও! আগ্রহ করে নিতে চাইলেন। আগ্রহ করে কেউ বাচ্চা নিতে চাইলেই বাচ্চা দিয়ে দেবে? চেন না, জান না! চিনব না কেন? বাবু খুব খুশি হয়ে গেছে। গাড়িতে চড়তে খুব পছন্দ করে। গাড়ি নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না। গাড়ি নিয়ে যাওয়া একটা বড় কথা নাকি? মিজানকে বললেই গোটা দিনের জন্য গাড়ি দিয়ে দেবে। খুবই মাই ডিয়ার লোক। বন্ধুদের জন্য খুব ফিলিং। দেখ না নিজে কেমন বাড়ি খুঁজে বের করল। হার্ট অব দা টাউনে। কেমন বাড়ি কে জানে। বাড়ি ভালোই হবে। ওর রুচি ভালো। এলেবেলে জিনিস দেখবে না। দুটি বাড়ির মধ্যে টিনের বাড়িটা পুষ্পের খুব মনে ধরল। কী ছিমছাম। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে অল্প খানিকটা জায়গা। এর মধ্যে দুটা কামিনী গাছ, একটা পেঁপে গাছ এবং একটা কাঁঠাল গাছ। বড়-বড় কাঁঠাল ধরে আছে। রান্নাঘরের পাশে ছোট একটা স্টোররুম আছে। বাড়ির মেঝে কালো সিমেন্টের। তাকালেই কেমন ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব আসে। রকিব বলল, মন্দ নয়, কী বল? নেওয়া যায় না? খুব নেওয়া যায়। সুন্দর বাড়ি। খুব সুন্দর। গরমে কষ্ট পাবে। টিনের ছাদ। টিনের ছাদের বাড়ি রাতের বেলা আরাম হয়। ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তা ছাড়া কেমন। সুন্দর বারান্দা। তুমি বিকালে বরান্দায় বসে চা খাবে। রকিব শব্দ করে হেসে উঠল। হাসছ কেন? বারান্দায় চা খাওয়ার মধ্যে কী আছে? নিশাত আপারা বারান্দায় চা খায়। দেখতে কী ভালো লাগে। বারান্দা তো তোমারও আছে, তুমি বসে খেলেই পার। মেঝেতে বসে-বসে খাব? আমাদের কি এঁদের মতো চেয়ার-টেবিল আছে? হবে, সব হবে। ধীরে ধীরে হবে। আগামী জুন মাস নাগাদ একটা প্রমোশনের কথা আছে। সত্যি? হুঁ। তেলাতেলির ব্যাপার আছে। ঐটা করতে হবে ভালোমতো। কর। সবাই যখন করছে। করব তো বটেই। তৈল কাহাকে বলে, কত প্ৰকার ও কী কী এখন ব্যাটারা বুঝবে। রকিব সিগারেট ধরিয়ে মহা সুখে টানতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে বাড়ি তারও পছন্দ হয়েছে। পুষ্প মনে-মনে বাড়ি সাজাতেও শুরু করেছে। সুন্দর করে পর্দা দেবে। কয়েকটা বেতের চেয়ার কিনবে। বাসনপত্র কিনবে। জমানো টাকার কিছুটা সে খরচ করবে। একটা ফ্যান কিনতে হবে। সিলিং ফ্যানের কী রকম দাম কে জানে। বলতে গেলে এই প্রথম তার নিজের সংসার। বিয়ের পর দু বছর কাটল শ্বশুরের সঙ্গে ময়মনসিংহে। রকিব আসত সপ্তাহে-সপ্তাহে। কী কষ্ট বেচারার। খাওয়ার কষ্ট। একাএকা থাকার কষ্ট। ঢাকায় ফিরে যাবার সময় কী যে মন-খারাপ করত। পুষ্প। কি? বাইরে খাবে? কোথায়? কোনো একটা রেস্তোরাঁয়? কী যে তুমি বল। চল যাই। মাঝেমধ্যে একটু বাইরে খাওয়া দরকার। রোজ-রোজ ঘরের খাওয়া একঘেয়ে হয়ে যায়। চল, নানরুটি আর কাবাব খাই। মাত্র তো সন্ধ্যা! এখন নানরুটি আর কাবাব খাবে? নিউ মার্কেটে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি, তারপর না-হয় যাব। আর বাবু? বাবুর কী হবে? কী আর হবে? যারা নিয়েছে তারা দেখবে। মজা বুঝক। ভবিষ্যতে তা হলে আর নেবে না। নিউ মার্কেটে তারা বেশ খানিকক্ষণ ধুরল। ঠাণ্ডা পেপসি খেল। পুষ্পকে খুবই অবাক করে দিয়ে রকিব একটা শাড়ি কিনে ফেলল। নীল ফুলের ছাপ দেওয়া সুতি শাড়ি। এতেই আনন্দে পুষ্পের চোখে পানি এসে যাবার মত হল। পুষ্প বলল, বাবুর জন্যে কিছু কিনবে না? কোন খেলনাটেলনা? আরে, ও খেলনার কী বোঝে। খেলনার সময় হোক, কিনে দেব। নিশাত ঘুমন্ত পল্টুকে তার বিছানায় শুইয়েছে। জহির বলল, নিচে একটা অয়েলক্লথ দরকার না? আমার তো মনে হচ্ছে বিছানা ভাসিয়ে দেবে। নিশাত বলল, অয়েলথ এখন পাব কোথায়? ওর বাবা-মার আক্কেলটা দেখ না। রাত নটা বাজে, এখনো ট্রেস নেই। দুজনে মিলে বেড়াচ্ছে। সুযোগ হয় না বোধহয়। তোমাকে কফি করে দেব? না। খুব কঠিন স্বরে না বললে। তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ? রাগ করব কেন? এই যে পরের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা করছি। তা কিছুটা অবশ্যি করছ। তোমার যখন এত শখ–লেট আস হ্যাভ অ্যা বেবি। ওটা তো তেমন কঠিন কিছু না। নিশাত কিছু বলল না। জহির বলল, আমি অবশ্যি এখনন আমাদের অরিজিন্যাল প্ল্যানে বিশ্বাসী। প্রথম পাঁচ বছর ঝামেলাহীন জীবন। দু জন শুধু থাকব, ঘুরে বেড়াব। এক জন অন্য জনকে ভালোমতো জানব………. এখনন আমাকে জানতে পার নি? না। কোন জিনিসটা জানবার বাকি আছে? তোমার মুডের ব্যাপারটা জানি না। অতি
false
shorotchandra
পিষিয়া মারিয়াছিল, এবং সেই সাতশ’ রাক্ষসী মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করিতে করিতে পদভরে সমস্ত পৃথিবী মাড়াইয়া গুঁড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, এও যেন তেমনি কোথায় কি-একটা বিপ্লব বাধিয়াছে; তবে রাক্ষসী সাতশ’ নয়, শতকোটি; উন্মত্ত কোলাহলে এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে। আসিয়াও পড়িল। রাক্ষসী নয়—ঝড়। তবে এর চেয়ে বোধ করি তাদের আসাই ঢের ভাল ছিল। এই দুর্জয় বায়ুর শক্তি বর্ণনা করা ত ঢের দূরের কথা, সমগ্র চেতনা দিয়া অনুভব করাও যেন মানুষের সামর্থ্যের বাহিরে। জ্ঞান-বুদ্ধি সমস্ত অভিভূত করিয়া শুদ্ধমাত্র এমনি একটা অস্পষ্ট অথচ নিঃসন্দেহ ধারণা মনের মধ্যে জাগিয়া রহিল যে, দুনিয়ার মিয়াদ একেবারে নিঃশেষে হইতে আর বিলম্ব কত! পাশেই যে লোহার খুঁটি ছিল, গলার চাদর দিয়া নিজেকে তাহার সঙ্গে বাঁধিয়া ফেলিয়া ছিলাম, অনুক্ষণ মনে হইতে লাগিল, এইবার ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আমাকে সাগরের মাঝখানে উড়াইয়া লইয়া ফেলিবে। হঠাৎ মনে হইল, জাহাজের গায়ে কালো জল যেন ভিতরের ধাক্কায় বজ্‌বজ্‌ করিয়া ক্রমাগত উপরের দিকে ঠেলিয়া উঠিতেছে। দূরে চোখ পড়িয়া গেল—দৃষ্টি আর ফিরাইতে পারিলাম না। একবার মনে হইল এ বুঝি পাহাড়, কিন্তু পরক্ষণেই সে ভ্রম যখন ভাঙ্গিল তখন হাত জোড় করিয়া বলিলাম, ভগবান! এই চোখ-দুটি যেমন তুমিই দিয়াছিলে, আজ তুমিই তাহাদের সার্থক করিলে। এতদিন ধরিয়া ত সংসারে সর্বত্র চোখ মেলিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু তোমার এই সৃষ্টির তুলনা ত কখনও দেখিতে পাই নাই। যতদূর দৃষ্টি যায়, এই যে অচিন্তনীয় বিরাটকায় মহাতরঙ্গ মাথায় রজতশুভ্র কিরীট পরিয়া দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে, এত বড় বিস্ময় জগতে আর আছে কি! সমুদ্রে ত কত লোকই যায় আসে; আমি নিজেও ত আরও কতবার এই পথে যাতায়াত করিয়াছি; কিন্তু এমনটি ত আর কখনও দেখিতে পাইলাম না। তা ছাড়া চোখে না দেখিলে, জলের ঢেউ যে কোন গতিকেই এত বড় হইয়া উঠিতে পারে, এ কথা কল্পনার বাপের সাধ্যও নাই কাহাকেও জানায়। মনে মনে বলিলাম, হে ঢেউ-সম্রাট্‌! তোমার সংঘর্ষে আমাদের যাহা হইবে সে ত আমি জানিই; কিন্তু এখনও ত তোমার আসিয়া পৌঁছিতে অন্ততঃ আধ মিনিটকাল বিলম্ব আছে, সেই সময়টুকু বেশ করিয়া তোমার কলেবরখানি যেন দেখিয়া লইতে পারি। একটা জিনিসের সুবিপুল উচ্চতা ও ততোধিক বিস্তৃতি দেখিয়াই কিছু এ ভাব মনে আসে না; কারণ তা হইলে হিমালয়ের যে-কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গই ত যথেষ্ট। কিন্তু এই যে বিরাট ব্যাপার জীবন্তের মত ছুটিয়া আসিতেছে সেই অপরিমেয় গতিশক্তির অনুভূতিই আমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল। কিন্তু সমুদ্রজলে ধাক্কা দিলে যাহা জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিতে থাকে, সেই জ্বলা নানা প্রকারের বিচিত্র রেখায় ইহার মাথার উপর খেলা করিতে না থাকিলে, এই গভীরকৃষ্ণ জলরাশির বিপুলত্ব এই অন্ধকারে হয়ত তেমন করিয়া দেখিতেই পাইতাম না। এখন যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূরই এই আলোকমালা, যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদীপ জ্বালিয়া এই ভয়ঙ্কর সুন্দরের মুখ আমার চক্ষের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করিয়া দিল। জাহাজের বাঁশী অসীম বায়ুবেগে থরথর করিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া বাজিতেই লাগিল; এবং ভয়ার্ত খালাসীর দল আল্লার কর্ণে তাহাদের আকুল আবেদন পৌঁছিয়া দিতে গলা ফাটাইয়া সমস্বরে চিৎকার করিতে লাগিল। যাঁহার শুভাগমনের জন্য এত ভয়, এত ডাক-হাঁক, এত উদ্যোগ-আয়োজন—সেই মহাতরঙ্গ আসিয়া পড়িলেন। একটা প্রকাণ্ডগোছের ওলট-পালটের মধ্যে হরবল্লভের মত আমারও প্রথমটা মনে হইল, নিশ্চয়ই আমরা ডুবিয়া গেছি, সুতরাং দুর্গানাম করিয়া আর কি হইবে! আশেপাশে, উপরে-নীচে চারিদিকেই কালো জল। জাহাজ-সুদ্ধ সবাই যে পাতালের রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইতে চলিয়াছি, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এখন ভাবনা শুধু এই যে, খাওয়া-দাওয়াটা তথায় কি জানি কিরূপ হইবে। কিন্তু মিনিটখানেক পরে দেখা গেল, না—ডুবি নাই, জাহাজ-সুদ্ধ আবার জলের উপরে ভাসিয়া উঠিয়াছি। অতঃপর তরঙ্গের পর তরঙ্গেরও আর শেষ হয় না, আমাদের নাগরদোলা-চাপারও আর সমাপ্তি হয় না। এতক্ষণে টের পেলাম, কেন কাপ্তেনসাহেব মানুষগুলোকে জানোয়ারের মত গর্তে পুরিয়া চাবি বন্ধ করিয়াছেন। ডেকের উপর দিয়া মাঝে মাঝে যেন জলের স্রোত বহিয়া যাইতে লাগিল। আমার নীচে হাঁস-মুরগিগুলা বার-কতক ঝট্‌পট্‌ করিয়া এবং ভেড়াগুলা কয়েকবার ম্যা-ম্যা করিয়া ভবলীলা সাঙ্গ করিল। আমি শুধু তাহাদের উপরতলা আশ্রয় করিয়া লোহার খুঁটি সবলে জড়াইয়া ধরিয়া ভবলীলা বজায় করিয়া চলিলাম। কিন্তু এখন আর-একপ্রকারের বিপদ জুটিল। শুধু যে জলের ছাট ছুঁচের মত গায়ে বিঁধিতে লাগিল, তাই নয়, সমস্ত জামা-কাপড় ভিজিয়া প্রচণ্ড বাতাসে এমনি শীত করিতে লাগিল যে, দাঁতে-দাঁতে ঠক্‌ঠক্‌ করিয়া বাজিতে লাগিল। মনে হইল জলে ডোবার হাত হইতে যদিবা সম্প্রতি নিস্তার পাই, নিমোনিয়ার হাত হইতে পরিত্রাণ পাইব কিরূপে? এইভাবে আরও কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিলে যে পরিত্রাণ পাওয়া সত্যই অসম্ভব হইয়া পড়িবে, তাহা নিঃসংশয়ে অনুভব করিলাম। সুতরাং যেমন করিয়া হোক্‌, এ স্থান পরিত্যাগ করিয়া এমন কোথাও আশ্রয় লইতে হইবে, যেখানে জলের ছাট বল্লমের ফলার মত গায়ে বেঁধে না। একবার ভাবিলাম, ভেড়ার খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলে কিরূপ হয়? কিন্তু তাই বা কতটুকু নিরাপদ? তার মধ্যে যদি সেইরূপ লোনা জলের স্রোত ঢুকিয়া পড়ে ত নিতান্তই যদি-না ম্যা-ম্যা করি, মা-মা করিয়াও অন্ততঃ ইহলীলা সমাপ্ত করিতে হইবে। শুধু এক উপায় আছে। জাহাজের পার্শ্ব-পরিবর্তনের মধ্যে ছুট দিবার একটু অবকাশ পাওয়া যায়; অতএব এই সময়টুকুর মধ্যে আর কোথাও গিয়া যদি ঢুকিয়া পড়িতে পারি, হয়ত বাঁচিতেও পারি। যে কথা, সেই কাজ। কিন্তু খাঁচা হইতে অবতরণ করিয়া তিনবার ছুটিয়া ও তিনবার বসিয়া যদিবা সেকেণ্ড ক্লাস কেবিনের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলাম, দ্বার বন্ধ। লোহার কপাট হাজার ঠেলাঠেলিতেও পথ দিল না। সুতরাং আবার সেই পথ তেমনি করিয়া অতিক্রম করিয়া ফার্স্ট ক্লাসের দোরগোড়ায় আসিয়া হাজির হইলাম। এবার ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন
false
shorotchandra
খুশী হবে না—একটা হাঙ্গামা বেধে যাবে। মাতঙ্গী ভৈরবীর গোটা-পাঁচেক ভৈরব ছিল, এবং তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর নাকি হাতে গোনা যেতো না। কি বলেন শিরোমণিমশাই, আপনি ত এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তি, জানেন ত সব? এই বলিয়া তিনি শিরোমণি অপেক্ষা রায়মহাশয়ের প্রতি বিশেষ করিয়া কটাক্ষপাত করিলেন। এ প্রশ্নের কেহ উত্তর দিবে কি, সকলে যেন বুদ্ধি-বিহ্বল হইয়া গেল। জমিদারের কণ্ঠস্বর সোজা না বাঁকা, বক্তব্য সত্য না মিথ্যা, তাৎপর্য বিদ্রূপ না পরিহাস, তামাশা না তিরস্কার, কেহ ঠাহর করিতেই পারিল না। সম্মুখের বারান্দা ঘুরিয়া একজন ভদ্রবেশধারী শৌখিন যুবক প্রবেশ করিল। হাতে তার ইংরেজী বাংলা কয়েকখানা সংবাদপত্র এবং কতকগুলা খোলা চিঠিপত্র। জীবানন্দ দেখিয়া কহিলেন, কি হে প্রফুল্ল, এখানেও ডাকঘর আছে নাকি? আঃ—কবে এইগুলো সব উঠে যাবে? প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে ঠিক। গেলে আপনার সুবিধে হতো। কিন্তু সে যখন হয়নি তখন এগুলো দেখবার কি সময় হবে? জীবানন্দ কিছুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ না করিয়া কহিলেন, না, এখনও হয় না, অন্য সময়েও হবে না।কিন্তু অনেকটা বাইরে থেকেই উপলব্ধি হচ্চে। এই যে হীরালাল-মোহনলালের দোকানের ছাপ। পত্রখানি তাঁর উকিলের, না একেবারে আদালতের হে? ও খামখানা তো দেখচি সলোমন সাহেবের। বাবা, বিলিতী সুধার গন্ধ কাগজ ফুঁড়ে বার হচ্ছে। কি বলেন সাহেব, ডিক্রি জারি করবেন, না এই রাজবপুখানি নিয়ে টানাহেঁচড়া করবেন—জানাচ্চেন? আঃ—সেকালের ব্রাহ্মণ্যতেজ যদি কিছু বাকী থাকতো ত এই ইউদি-বেটাকে একেবারে ভস্ম করে দিতাম। মদের দেনা আর শুধতে হতো না। প্রফুল্ল ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, কি বলচেন দাদা? থাক থাক, আর একসময়ে আলোচনা করা যাবে। এই বলিয়া সে ফিরেতে উদ্যত হইতেই জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, আরে লজ্জা কি ভায়া, এঁরা সব আপনার লোক, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, এমনকি, মণি-মাণিক্যের এ-পিঠ ও-পিঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না। তা ছাড়া তোমার দাদাটি যে কস্তুরী-মৃগ; সুগন্ধ আর কতকাল চেপে রাখবে ভাই! টাকা! টাকা! এর নালিশ আর তার নালিশ, অমুকের ডিক্রি আর তমুকের কিস্তিখেলাপ—ওহে, ও তারাদাস, সে-দিনটা নেহাত ফসকে গিয়েছিল, কিন্তু হতাশ হয়ো না ঠাকুর, যা করে তুলেচি, তাতে মনস্কামনা তোমার পূর্ণ হতে খুব বেশী বিলম্ব হবে বলে আশঙ্কা হয় না। প্রফুল্ল, রাগ করো না ভায়া, আপনার বলতে আর কাউকে বড় বাকী রাখিনি, কিন্তু এই চল্লিশটা বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারবো বলেও ভরসা নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ, নোট-টোট জাল করতে পারে এমন যদি কাউকে যোগাড় করে আনতে পারতে হে— প্রফুল্ল অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াও হাসিয়া ফেলিল, কহিল, দেখুন, সবাই আপনার কথা বুঝবেন না, সত্য ভেবে যদি কেউ— জীবানন্দ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, যদি কেউ সন্ধান করে আনেন? তা হলে ত বেঁচে যাই প্রফুল্ল। রায়মশায়, আপনি ত শুনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনার জানাশুনা কি এমন কেউ— রায়মহাশয় ম্লানমুখে অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, বেলা হয়ে গেল, যদি অনুমতি করেন ত এখন আমরা আসি। জীবানন্দ ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া কহিলেন, বসুন, বসুন, নইলে প্রফুল্লর জাঁক বেড়ে যাবে। তা ছাড়া, ভৈরবীর কথাটাও শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি যাও বললেই কি সে যাবে? রায়মহাশয় না বসিয়াই সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, সে ভার আমাদের। কিন্তু আর কাউকে ত বহাল করা চাই। ও ত খালি থাকতে পারে না। এবার অনেকেই জবাব দিল, সে ভারও আমাদের। জীবানন্দ নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, যাক বাঁচা গেল, এবার সে যাবেই। এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাসের ভার একা ভৈরবী কেন, স্বয়ং মা-চণ্ডীও সামলাতে পারবেন না, তা বোঝা গেল। আপনাদের লাভ-লোকসান আপনারাই জানেন, কিন্তু আমার এমন অবস্থা যে টাকা পেলে আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। নতুন বন্দোবস্তে আমার কিছু পাওয়া চাই। ভাল কথা, কেউ দেখ্‌ত রে, এককড়ি আছে না গেছে? কিন্তু গলাটা যে এদিকে শুকিয়ে একেবারে মরুভূমি হয়ে গেল। বেহারা আসিয়া প্রভুর ব্যগ্রব্যাকুল শ্রীহস্তে পূর্ণপাত্র দিয়া খবর দিল, সে সদরে বসিয়া খাতা লিখিতেছে। হুজুরের আহ্বানে ক্ষণেক পরে এককড়ি আসিয়া যখন সসম্ভ্রমে এক পাশে দাঁড়াইল, জীবানন্দ শুষ্ককণ্ঠ আর্দ্র করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সেদিন ভৈরবীকে যে কাছারীতে তলব করেছিলাম, কেউ তাঁকে খবর দিয়েছিলে? এককড়ি কহিল, আমি নিজে দিয়েছিলাম। তিনি এসেছিলেন? আজ্ঞে না। না কেন? এককড়ি অধোমুখে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। জীবানন্দ উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিলেন, তিনি কখন আসবেন জানিয়েছিলেন? এককড়ি তেমনি অধোমুখে থাকিয়াই অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, এত লোকের সামনে আমি সে কথা হুজুরে পেশ করতে পারব না। জীবানন্দ হাতের শূন্য গ্লাসটা নামাইয়া রাখিয়া হঠাৎ কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এককড়ি, তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না, না? না। কেন? এবার প্রত্যুত্তরে যদিচ এককড়ি তাহার জমিদারি কায়দাটা সম্পূর্ণ ছাড়িল না, কিন্তু সবাই শুনিতে পায় এমনি সুস্পষ্ট করিয়াই কহিল, তিনি আসতে পারবেন না, এ কথা যত লোক দাঁড়িয়েছিল সবাই শুনেচে। বলেছিলেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যেবুদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে। আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে। সহসা মনে হইল জমিদারের এতক্ষণের এত রহস্য, এত সরল ঔদাস্য, হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও তরল কণ্ঠস্বর চক্ষের পলকে নিবিয়া যেন অন্ধকার হইয়া গেল। ক্ষণকাল পরে শুধু আস্তে আস্তে কহিলেন, হুঁ। আচ্ছা, তুমি যাও। প্রফুল্ল, সেই যে কি একটা চিনির কোম্পানি হাজার বিঘে জমি চেয়েছিল, তাঁদের কোন জবাব দিয়েছিলে? আজ্ঞে না। তা হলে লিখে দাও যে জমি তারা পাবে। দেরি করো না। না, দিচ্চি লিখে, এই বলিয়া সে এককড়িকে সঙ্গে লইয়া প্রস্থান করিল। আবার কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত
false
humayun_ahmed
কি আহার গ্রহণ করে? মানুষ যেমন রাজনীতি বিষয়ে আসক্ত তারাও কি তাই? তাদের মধ্যেও কি বিএনপি-আওয়ামী লীগ (কথা প্রসঙ্গে বলছি) আছে? তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা কেমন? আমাদের যেমন উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাদেরও কি আছে? তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি লালদল, নীলদল, শাদাদলে বিভক্ত? তাদের ছাত্ররাজনীতির অবস্থা কী? মানুষদের যেমন মৃত্যু আছে, ভূতদেরও কি আছে? মৃত্যুর পর তারা কোথায় যায়? বিখ্যাত লেখক পরশুরামের একটি লেখায় পড়েছি— মৃত্যুর পর ভূতরা মার্বেল হয়ে যায়। পরশুরাম সাহেবের ভালো নাম রাজশেখর বসু, তিনি চলন্তিকা নামক ডিকশনারির প্রবক্তা। শিক্ষাগত জীবনে তিনি রসায়নশাস্ত্রে .. তার মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব কীভাবে বলেন যে, মৃত্যুর পর ভূত মার্বেল হয়ে যায় তা আমার চিন্তার বাইরে। যাই হোক, ভূত বিষয়ের সমস্ত প্রাপ্ত ধারণা দূর করার জন্যেই আমি লেখনি হাতে নিয়েছি। প্রথম মুদ্রণে কিছু তথ্যগত ভুল হয়তো থাকবে। দ্বিতীয় মুদ্রণে সমস্ত ভুলভ্রান্তি দূর করা হবে। আবু করিম খাতা বন্ধ করে বললেন, তোমার কাজের ছেলে রফিক ফিরে এসেছে বলেছিলে। সে কি আছে? না আবারো চুরি করে ভেগেছে? সে এখনো আছে। তাকে রাতে রান্না করতে বলবে। আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে ডিনার 4951 আচ্ছা। ভালো কথা! তোমার ঐ কাজের ছেলে রফিক। সেও কি ভূত ভাইবোনকে দেখে? না-কি তুমি একাই দেখ? রফিক ব্যাপারটা খেয়াল করছে না। হমড়ু ডমরুও চাচ্ছে না সবাই তাদের বিষয়টা জানুক। তবে তুমি যদি যাও অবশ্যই ওদের দেখবে। ওরা তোমার ভক্ত। তোমার বানানো আমিষ আচার খেয়েছে তো। তাছাড়া আমি ওদের তোমার কথা বলে রাখব। আবু করিম বললেন, তোমার বিষয়ে আমি অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করছি। যাই হোক, আজ রাতেই সব ফয়সালা হবে। এখন বাসায় চলে যাও। আমাকে ঠাণ্ডা মাখায় পিপীলিকা ক্রন্দন নিয়ে চিন্তা করতে দাও। গোটা পঞ্চাশেক পিঁপড়া পাওয়া গেলে সন্ধ্যার মধ্যে পিঁপড়া আচার বানিয়ে ফেলতে পারতাম। পিঁপড়া আবার দুরকম লাল পিঁপড়া। কালো পিঁপড়া। কোন পিঁপড়ায় আচার ভালো হয় তাও বুঝতে পারছি না। ভালো দুঃশ্চিন্তায় পড়েছি। সানাউল্লাহ রাতের খাবারের ভালো আয়োজন করলেন। আবু করিমের পছন্দ খিচুড়ি, বেগুন ভাজি। সঙ্গে খাটি ঘি দুই চামচ। তিনি নিরামিশাষি। খিচুড়ি, বেগুন ভাজি এবং ঘিয়ের ব্যবস্থা করলেন। সঙ্গে ডিমের ঝোল করা হলো। আবু করিম ডিম না খেলেও ডিমের ঝোল বা গরুর মাংসের ঝোল খান। হমড়ুর সঙ্গে অতিথি প্রসঙ্গে আলাপ করলেন। তাকেও যথেষ্ট উৎসাহী মনে হলো। শুধু ডমরু বলল, বাবা, উনার সামনে যাব না। আমার লইজ্যা করে। সানাউল্লাহ বললেন, লইজ্যা না মা। শব্দটা হচ্ছে লজ্জা। বলো লজ্জা করে। বঁলব নাঁ। আমি বঁলব নাঁ। সানাউল্লাহ বললেন, তোমরা যখন ভূতদের ভাষায় কথা বলবে তখন তোমাদের মতো বলবে। মানুষের ভাষায় কথা বললে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ করতে হবে। এবং নাকি উচ্চারণ করাই যাবে না। তোমার ভাই হমড়ুকে দেখ। সে তো নাকে কোনো কথাই বলে না। হমডু বলল, যে বেড়াতে আসবে তাকে কী ডাকব? সানাউল্লাহ বললেন, স্যার ডাকবে। উনি একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং আচার উদ্ভাবক। আচার জগতের মুকুটহীন সম্রাট বললেও কম বলা হয়। এখন নতুন এক আচার বানানোর চেষ্টায় আছেন। শেষ পর্যন্ত যদি বানাতে পারেন হৈচৈ পড়ে যাবে। পিঁপড়ার আচার। নাম পিপীলিকা ক্রন্দন। আমাদের দেশে এই আচার চলবে না। তবে চায়নিজরা হামলে পড়বে। টনকে টন সাপ্লাই যাবে। ভালো কথা হমডু, চায়নায় ভূত আছে? জানি না তো। নাক চেপা কোনো চায়নিজ ভূতকে কখনো দেখ নি? না। সানাউল্লাহ বললেন, তোমরা বলতে পারবে না। তোমাদের বাবা-মা অবশ্যই পারবেন। তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। ভূপর্যটক ভূত থাকার কথা। হিউ-এনসাং টাইপ। হমডু, জামা-জুতা পরে রেডি হয়ে থাক। আমার বন্ধু ঘরে চুামাত্র ভূতদের ভাষায় বলবে, ভূত সমাজের পক্ষ থেকে আমার সালাম গ্রহণ করুন। ভূতদের ভাষায় এটা কী হবে? হমছু বলল, কিঁউইইই। সানাউল্লাহ মুগ্ধ গলায় বললেন, এত বড় একটা সেনটেন্স এক শব্দে শেষ? ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমি আপনাকে দেখে বিরক্ত হয়েছি ভূত ভাষায় এটা কী হবে? হমডু বলল, একটা ই কম হবে। কিঁউইই। আপনাকে দেখে রাগ লাগছে— এর ভূত ভাষা কী? হমড়ু বলল, আরেকটা ই কমে যাবে। কিঁউই। সানাউল্লাহ বললেন, সবগুলি ই যদি ফেলে দেই। যদি বলি, কিঁউ তার মানে? হমড়ু বলল, এর মানে বন্ধু। সানাউল্লাহ বললেন, অসাধারণ। আমার বন্ধু ঘরে ঢুকামাত্র আমি বলব, কিঁউ। আর তুই বলবি, কিঁউইইই। সে শুরুতেই যাবে ভড়কে। সানাউল্লাহ বন্ধুকে ভড়কাবার সুযোগ পেলেন না। রাত দশটায় আবু করিমের ড্রাইভার এসে বলল, স্যার অসিতে পারবেন না। তিনি মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বমি এবং দাস্ত হচ্ছে। পিঁপড়ার একটা আচার বানিয়েছিলেন। সেই আচার তরকারির চামচে এক চামচ খাবার পর থেকে এই অবস্থা। আমাকেও খেতে বলেছিলেন। আমি খেতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে খাই নাই। স্যার, আমার উপর ময়মুরুব্বির দোয়া আছে। সানাউল্লাহ বললেন, আমি এক্ষুনি বন্ধুকে দেখতে যাচ্ছি। হমডুকেও সঙ্গে নেব। এই হমডু। রেডি হয়ে যাও। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কার সঙ্গে কথা বলেন স্যার? সানাউল্লাহ বললেন, একটা ভূতের বাচ্চা বিপদে পড়ে আমার আশ্রয়ে আছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আমি তো কিছু দেখি না স্যার। দেহধারণ করে না বলেই দেখছ না। দেহধারণ করলেই দেখবে। ভোমার সঙ্গে গাড়ি আছে না? আমাদের নিয়ে চলো। ড্রাইভার বলল, আপনার হাসপাতালে যাওয়া ঠিক হবে না স্যার। ঠিক হবে না কেন? স্যারের অসুখের খবর পেয়ে শায়লা ম্যাডাম
false
toslima_nasrin
আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনপাড়ায় এক হিন্দু গৃহবধূকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। পিরোজপুরের কালীবাড়ি দেবার্চনা কমিটির কালী মন্দির, মনসা মন্দির, দুর্গা মন্দির, শীতল মন্দির শিব মন্দির, নারায়ণ মন্দির, পিরোজপুর মদনমোহন বিগ্রহের মন্দির, আখড়াবাড়ি, রায়েক্লাঠি কালীবাড়ির মন্দির, কৃষ্ণনগর রাইরাসরাজ সেবাশ্রম, ডুমুরতলা শ্ৰীশুরু সংঘের আশ্রম মন্দির, দক্ষিণ ডুমুরতলার সুরেশ সাহার বাড়ির কালী মন্দির, ডুমুরতলার নরেন সাহা বাড়ির মনসা মন্দির, রমেশ সাহার বাড়ির মনসা মন্দির ও বসতবাড়ি, ডুমুরতলা বারোর কালী মন্দির, সুচরণ মণ্ডল, গৌরাঙ্গ হালদার, হরেন্দ্রনাথ সাহা, নরেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িল্লমন্দির, ডুমুরতলা হাই স্কুলের পাশে কালী মন্দির, রানীপুর পঞ্চদেবীর মন্দির, হুলারাহাট সার্বজনীন দুৰ্গ মন্দির ও কার্তিক দাসের কাঠের দোকান, কলাখালি সনাতন আশ্ৰৱল কালী মন্দির, জুজখোলা গৌরগোবিন্দ সেবাশ্রম, হরিসভার সনাতন ধর্মমন্দির, রনজিৎ শীলের বাড়ির কালী মন্দির, জুজখোলা বারোয়ারি পূজামণ্ডপ, গাবতলা স্কুলের পাশে সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, কৃষ্ণনগর বিপিন হালদারের বাড়ির মন্দির, নামাজপুর সার্বজনীন কালী মন্দির, কালিকাঠি বিশ্বাস বাড়ির মন্দির ও মঠ, লাইরি কালী মন্দির, স্বরূপঠি থানার ইন্দের হাট সার্বজনীন মন্দির, ইন্দের হাট কানাই বিশ্বাসের বাড়ির দুর্গ মন্দিরবানকুল সাহার সিনেমা হল, অমল গুহর বাড়ির দুর্গ মন্দির, হেমন্ত শীলের বাড়ির মন্দির, মঠবাড়িয়া থানার যাদব দাসের বাড়ির কালী মন্দির জ্বালানো হয়। সৈয়দপুর মিস্ত্রী পাড়ায় শিব মন্দিরও ভাঙা হয়। নড়াইল জেলার রতডাঙ্গা গ্রামে সাৰ্বজনীন মন্দির, বারোর ঘোনা সার্বজনীন মন্দির, কুডুলিয়ার সার্বজনীন শ্মশানঘাট, নিখিল চন্দ্ৰ দে’র পারিবারিক মন্দির, কালীপদ হাজরার পারিবারিক মন্দির, শিবুপ্রসাদ পালের পারিবারিক মন্দির, বাদন গ্রামের দুলাল চন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্র লস্করের বাড়ির মন্দির, তালতলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের বৈদ্যনাথ সাহা, সুকুমার বিশ্বাস, পাগলা বিশ্বালে পারিবারিক মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির ও লোহাগড়া থানার দৌলতপুর পূর্বপাড়া নারায়ণ জিউ মন্দির ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়। খুলনায় দশটি মন্দিল্লী ভেঙেছে। পাইকপাড়ার রাডুলি, সোবনাদাশ। আর বাকা গ্রামে চার-পাঁচটি মন্দির ভাঙচুহু কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করা হয়। রূপসা থানার তালিমপুর এলাকায় দুটো মন্দির-ভেঙে দেওয়া হয়। পাশের হিন্দু বাড়িগুলো লুট করা হয়। দীঘলিয়া আর সেন✉ট এলাকায় আটই ডিসেম্বর রাতে তিনটি মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেনীর সহদেবপুর গ্রামে একদল মিছিলকারী তেরোটি বাড়িতে হামলা চালায়। ছাগল-ইয়ার জয়পুর গ্রামে হামলা হওয়ায় বিশজন আহত হয়েছে। লাঙ্গলবোয়া গ্রাম থেকে মোয়াজেম হোসেনের নেতৃত্বে দুশ লোক গোবিন্দপ্ৰসাদ রায়ের বাড়িতে হামলা চালাম্বী কমল বিশ্বাস নামে একজন গুরুতর আহত হয়। সম্ভবত মারা যাবে। বিরূপাক্ষ, নয়ন, দেবব্রত, সুরঞ্জনের সামনে বসে গলগল করে ভাঙচুরের বমি করে। সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটি কথাও সে এতগুলো ভাঙনের গল্প শুনবার পরও উচ্চারণ করে না। এরা কেউ জানে না কেবল ভোলা চট্টগ্রাম পিরোজপুর সিলেট কুমিল্লার হিন্দু বাড়ি লুট হয়নি, টিকাটুলির এই বাড়ি থেকে লুট হয়ে গেছে মায়া নামের একটি চমৎকার মেয়ে, মেয়েমানুষ তো অনেকটা সম্পদের মত, তাই সোনাদানা ধনসম্পদের মত মায়াকেও তুলে নিয়ে গেছে ওরা। –কি ব্যাপার সুরঞ্জন কথা বলছি না কেন? হয়েছে কি তোমার? দেবব্রত প্রশ্ন করে। –মদ খেতে চাই। পেট ভরে মদ খাওয়া যায় না আজ? –মদ খাবে? –হ্যাঁ খাব ৷ — টাকা আছে আমার পকেটে, কেউ গিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে এস। –বাড়িতে বসে খাবে? তোমার বাবা মা? –গুল্লি মারো বাবা মা। আমি খেতে চাইছি, খাব। বিরূ যাও, সাকুরা পিয়সি কোনও একটাতে পাবে। –কিন্তু সুরঞ্জনদা… –এত হেসিটেট করো না তো, যাও। ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ ভেসে আসে। –কাঁদে কে? মাসিমা? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে। –হিন্দু হয়েছে যখন, না কেঁদে উপায় আছে? চুপ হয়ে যায় তিন যুবক। হিন্দু তো ওরাও, ওরাও অনুভব করে মাসিমাকে কাঁদতে হয় কেন। প্রত্যেকের বুকের মধ্য থেকে বোবা কান্না ঠেলে ওঠে। বিরূপাক্ষ টাকা নিয়ে দ্রুত চলে যায়, ফেন চলে গেলেই সে সকল বেদনা থেকে মুক্তি পাবে। যেমন সুরঞ্জন মুক্তি পেতে চাইছে মদ খেয়ে। বিরূপাক্ষ চলে যেতেই সুরঞ্জন প্রশ্ন করে–আচ্ছা দেবব্রত, মসজিদ পোড়ানো যায় না? –মসজিদ? তোমার কি মাথা-ট্যাথা খারাপ হয়ে গেছে? —চল আজ রাতে ‘তারা মসজিদ’ পুড়িয়ে ফেলি। দেবব্রত বিস্মিত চোখে একবার সুরঞ্জনের দিকে, একবার নয়নের দিকে তাকায়। —আমরা দু কোটি হিন্দু আছি, চাইলে বায়তুল মোকাররমটাকেও তো পুড়িয়ে ফেলতে পারি। —তুমি তো কখনও নিজেকে হিন্দু বলনি। আজ বলছ কেন? –মানুষ বলতাম তো, মানবতাবাদী বলতাম। আমাকে মুসলমানেরা মানুষ থাকতে দেয়নি। হিন্দু বানিয়েছে। –তুমি খুব বদলে যােচ্ছ সুরঞ্জন। –সে আমার দোষ নয়। –মসজিদ ভেঙে আমাদের কি লাভ? আমরা কি আর মন্দির ফিরে পাব? দেবব্রত চেয়ারের ভাঙা হাতলে নখ ঘষতে ঘষতে বলে। –না পাই, তবু আমরাও যে ভাঙতে পারি। আমাদেরও যে রাগ আছে তা একবার জানানো উচিত নয়? বাবরি মসজিদ সাঁড়ে চারশ বছরের পুরনো মসজিদ ছিল। চৈতন্যদেবের বাড়িও তো পাঁচশ বছরের পুরনো ছিল। চার-পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য কি এ দেশে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না? আমার সোবহানবাগ মসজিদটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। গুলশান এক নম্বরের মসজিদটা সৌদি আরবের টাকায় করা। চল ওটা দখল করে মন্দির বানিয়ে ফেলি। –কী বলছি তুমি সুরঞ্জন? পাগলই হয়েছ বটে। তুমি না। আগে বলতে ‘মন্দির ও মসজিদের জায়গায় দিঘি কেটে নধর পতিহাঁস ছেড়ে দেব? –কেবল কি তাই বলতাম, বলতাম, গুঁড়ো হয়ে যাক ধর্মের দালানকোঠা, পুড়ে যাক অন্ধাগুনে মন্দির মসজিদ গুরুদয়ারা গির্জার ইট, আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর সুগন্ধ ছড়িয়ে বড় হোক মনোলোভা ফুলের বাগান, বড় হোক শিশুর ইস্কুল, পাঠাগার। মানুষের কল্যাণের জন্য
false
humayun_ahmed
গল্প, ভূত-প্রেত, অশরীরী, ভিনগ্রহের মানুষ এইসব। আমাকে হাবিজাবি লেখক অবশ্যই বলা যেতে পারে। নলিনী বাবু ..তে আমাদের অতি পরিচিত কাঠামোর মোড়কে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অদেখা ভুবনের গল্প বলতে চেয়েছি। সালভাদর দালি নিশি স্বপ্নকে ছবিতে নিয়ে এসেছেন, আমি চেষ্টা করেছি নিশি স্বপ্ন গদ্যে নিয়ে আসার। তবে এই রচনা অবশ্যই সুররিয়েলিস্টিক রচনা না। সুররিয়েলিস্টিক জগতের ছায়ায় রিয়েলিস্টিক রচনা। আমি কি বলতে চেয়েছি তা কি বুঝাতে পেরেছি? মনে হয় না। যাই হোক, কি আর করা। চেষ্টা তো করেছি। নলিনী বাবু ..র জগতে সবাইকে নিমন্ত্রণ। হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লী, গাজীপুর ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ০১. ‘আমি নীলগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক’ বলেই ভদ্রলোক আমার পা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়ালেন। আমি খপ করে তার হাত ধরলাম। বয়স্ক একজন মানুষ, মাথার সব চুল ধবধবে সাদা। তিনি আমার পা স্পর্শ করবেন কেন? পা ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা এমনিতেই আমার অপছন্দ। আমার নাম নলিনী ভট্টাচার্য। আপনি বসুন। বিশেষ কোনো কাজে কি এসেছেন? আজ্ঞে না। আমি লেখক দেখতে এসেছি। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভালো করে লেখক দেখুন। আমিও আপনাকে দেখি। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি। বেঁটেখাটো মানুষ। বড় বড় চোখ। চোখের মণিতে বিস্ময়বোধ। ব্রাহ্মণরা বেশিরভাগ সময় গৌরবর্ণের হন। ইনার গায়ের রঙ কালো। ভদ্রলোকের বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি পরেছেন। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ধুতি ছেড়ে দিয়েছে। দুর্গাপূজার সময় কিছু ধুতি পরা মানুষ দেখা যায়। ধুতি নিয়ে তাদের খানিকটা সংকোচিত এবং বিব্রতও মনে হয়। নলিনী ভট্টাচার্যের পোশাকের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি ধুতির সঙ্গে জুতা-মোজা পরেছেন। জুতা জোড়া বেশ ভারী এবং ধুতির সঙ্গে যাচ্ছে না। আপনি কি সবসময় জুতা পরেন? পরি। অস্বস্তি লাগে না? নলিনী বাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, অস্বস্তি লাগবে কেন? আমি বললাম, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। গরুর প্রতি ভক্তি আপনাদের মজ্জাগত। গরুকে দেবতার মতো দেখা হয়। দেবতার চামড়ায় বানানো জুতা পরতে অস্বস্তি লাগার কথা। নলিনী বাবু বিব্রত গলায় বললেন, আপনি এই কথা প্রথম বললেন। আমি এর আগে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি। বাকি জীবন আমি আর জুতা পরব না। আপনাকে, কথা দিচ্ছি। ভাই আমি কথার কথা বলেছি। আপনি সত্য ভাষণ করেছেন। ভদ্রলোকের বিব্রত ভাব দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম। মানুষকে বিব্রত করা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তারপরও এ ধরনের কাজ আমি প্রায়ই করি। অপরিচিত মানুষ, যারা প্রথমবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, তাদের সঙ্গেই বেশি করি মাসখানেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এসেছিল। সে কিছু কবিতা লিখেছে, আমাকে দেখাতে এসেছে। আমি বললাম, আমি গদ্য লেখক, কবিতা বুঝি না। সে বিনয়ী গলায় বলল, না বুঝলেও পড়ে দেখুন। আমি বললাম, তোমার নাম কী? সে বলল, যূপকাষ্ঠ। ছদ্মনাম? জি স্যার। ছদ্মনাম কেন? কবি হিসেবে আসল নামটা যায় না। আসল নাম কী? আহম্মদ মিখাইল। ফেরেশতা মখাইল (আঃ) এর নামে নাম। আমি বললাম, যুপকাষ্ঠের চেয়ে আহম্মদ মিখাইল নাম অনেক সুন্দর। তারপরও ফেরেশতার নামের সঙ্গে মিলিয়ে মানুষের নাম হওয়া ঠিক না। কেন স্যার? মানব সম্প্রদায়ের অবস্থান ফেরেশতাদের অনেক উপরে। ফেরেশতাদের যে প্রধান তাকে বলা হয়েছিল মানুষকে কুর্নিশ করতে। জানো না? জানি স্যার। শোনো যূপকাষ্ঠ বাবু, তুমি বিদায় হও। ছেলেটা লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়ার পর মনটা খুবই খারাপ হলো। এই ব্যবহারটা না করলেও হতো। কেন এ রকম করি? লেখক হিসেবে আমার মধ্যে কি অহঙ্কার দানা বাঁধতে শুরু করেছে? না-কি পুঁটি মাছ হয়ে যাচ্ছি? প্রকাণ্ড রুই মাছ গভীর পানিতে বাস করে। চলনে ধীরস্থির। পুঁটি মাছ গণ্ডুষ পানিতেও ফরফর করে। সংস্কৃত বলে ফরফরায়তে– গণ্ডুষ জল মাত্রেন সফরি ফরফরায়তে। যা-ই হোক, নলিনী বাবুর কাছে ফিরে যাই। তিনি পকেট থেকে পানের ছোট্ট বাহারি কৌটা বের করে পান মুখে দিয়েছেন। জর্দার গন্ধ আসছে। আঙ্গুলের ডগায় চুন নিয়ে বসে আছেন। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক পানবিলাসী। আমি বললাম, আপনার লেখক দেখা শেষ হয়েছে? তিনি জবাব দিলেন না। সুন্দর করে হাসলেন। আমি বললাম, আপনি আমার কয়টা বই পড়েছেন? তিনি বললেন, একটা। আমি কোনো লেখকের একটার বেশি বই পড়ি। আপনার পড়েছি মিসির আলি। শরৎবাবুর চরিত্রহীন, যাযাবরের দৃষ্টিপাত। রবিবাবুর নৌকাডুবি পড়া শুরু করেছিলাম, একত্রিশ পৃষ্ঠা পড়ার পর বইটা চুরি হয়ে গেল। বাকিটা পড়া হয় নাই। আমি বললাম, সব লেখকের একটা করে বই পড়েন কেন? তিনি বললেন, হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্য সব ভাত টিপতে হয় না। একটা ভাত টিপলেই হয়। আমার ভাত কি সিদ্ধ হয়েছে? নলিনী বাবু জবাব দিলেন না। তবে তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমার ভাত সিদ্ধ হয়নি। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না। আমি বললাম, ভাই আমার একটু কাজ আছে। আপনি আরেক দিন আসুন, তখন কথা হবে। নলিনী বাবু বললেন, আপনি ভদ্রভাবে আমাকে বিদায় করতে চাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছি। একটা ছোট্ট রসিকতা করে চলে যাব। আগে না শুনে থাকলে মজা পাবেন। অঙ্কের ক্লাসে ছাত্রদের বিনোদন দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রসিকতা করি। তারা হো হো করে হাসে। খুবই মজা লাগে। একটা বলব? বলুন। এক লোক জীবনে প্রথম ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছে। সে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করল, বলটা নিয়ে ওরা কী করছে? পাশের জন বলল, গোল করার চেষ্টা করছে। সে বিস্মিত হয়ে বলল, বলটা তো গোলই আছে। আর কিভাবে গোল করবে? নলিনী বাবুগল্প শেষ করে বললেন, জোকটা বেশ হাসির, যে শুনে সেই হাসে
false
toslima_nasrin
তা চাও না? যে কোনওদিন তো ওরে মাইরা ফেলবে! নিজে যা বিশ্বাস কর, কর। আমার মেয়েরে তুমি নষ্ট বানাইও না। ওরে কুবুদ্ধি দিয়া যাও, আর ও এইসব লেখে। তুমি ওরে কুবুদ্ধি দিয়া দিয়া কোরানের বিরুদ্ধে, আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখাইছ।’ আমি বলি, ‘আমি নষ্ট হইয়াই রইছি। আমারে নতুন কইরা নষ্ট বানানির কিছু নাই।’ বড়মামা মলিন মুখে বলেন, ‘আমি তো আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ কথা কই নাই। যারা আল্লাহ নিয়া ব্যবসা করে, তারা কয় খারাপ কথা। তারা আল্লাহরে অসৎ কাজে ব্যবহার করে।’ সেদিন বড়মামার চা খাওয়া হয়নি। কথা ছিল ভাত খাবেন, ভাতও খাওয়া হয়নি। কাজ আছে বলে ভর দুপুরে বেরিয়ে গেলেন। এরপর বড়মামা এলে মা আগেই সতর্ক করে দেন যেন আমার সঙ্গে কোরান হাদিস বিষয়ে কোনও কথা না বলেন তিনি। একদিন বড়মামা এলেন শুক্রবারে। মাথায় একটি টুপি ছিল, সেটি খুলে, মার সামনে পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, ‘আজকাল মসজিদে নামাজ পরার জন্য জায়গাই পাওয়া যায় না। এত ভিড়।’ মা নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মসজিদ থেইকা আইলা?’ বড়মামা বলেন, ‘হ। জুম্মাহ পইরা আইলাম।’ শুনে মার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুখে মধুর একটি হাসি। আমি জোরে হেসে উঠি। বড়মামা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘হাসস কেন? হাসির কি হইল? আমি তো পাঁচবেলা নামাজ পড়ি।’ এবার আরও জোরে হাসি। মা বলেন, ‘নাসরিনডার যে কি হইব? ওর তো দোযখেও জাগা হইব না। মানুষ তো শুধরায়। মেবাইএর মত মানুষ যদি নিজের ভুল বুঝতে পাইরা তওবা কইরা নামাজ ধরতে পারে। তাইলে তুই কেন তওবা এখনও করস না?’ মা সেদিন বড়মামাকে বেশ আদর করে ভাত মাছ খাওয়ান। খাওয়ার পর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বড় মামা উঁকি দেন আমার লেখার ঘরে। ঢুকে জোরে জোরে বলেন, ‘কি, সারাক্ষণ লেখা নিয়া থাকলেই চলবে! স্পেশালাইজেশনের জন্য তো গাইনিটাই ভাল। ডাক্তারি বিদ্যাটা এমন একটা বিদ্যা যেইটা দিয়া মানুষের সেবা অনেক বেশি করতে পারবি!’ ‘ওই লেখাপড়া আমার আর হবে না।’ বলে আমি উদয় হওয়া একটি প্রশ্ন প্রায় করতে নিচ্ছিল!ম যে, ‘মোহাম্মদ মককা জয় করার পর যে আবদুল্লাহ নামের একটা লোকরে কতল করছিল, সেইটা কি সেই আবদুল্লাহ যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদের আয়াত সংশোধন করত? আল্লাহর বাণী আবার সংশোধনের দরকার পড়ে কেন, এই প্রশ্নটা তার মনে জাগছিল বইলা যে পরে ইসলাম ত্যাগ করছিল?’ প্রশ্ন করার সুযোগ হয় না আমার। মা ঢোকেন। উদ্ভাসিত মুখ মার। বলেন, ‘মেবাই তুমি একটু নাসরিনরে বোঝাও ও যেন নামাজ শুরু করে।’ বড়মামা বলেন, ‘হ। নামাজ ত পড়া উচিত। এখন তো হাঁটাচলা বেশি হয় না ওর। নামাজ পড়লে শরীরের ব্যয়ামটা তো অন্তত নিয়মিত হয়।’ কথাটি মার পছন্দ হয় না। মা আমাকে নামাজ পড়তে বলেন, কিন্তু কোরান যখন পড়ি, তিনি আঁতকে ওঠেন। টেবিলে ওপরে কোরান খোলা, এই একটু উঠে ও ঘরে গেলাম তো ফিরে এসে দেখি কোরান নেই, বিছানায় শুয়ে কোরান পড়ছি, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভাঙলে দেখি বিছানায় কোরানটি নেই। শেষ পর্যন্ত কোরান উদ্ধার করি মার আলমারি থেকে। তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। ‘কোরান শরীফ লুকাইয়া রাখো কেন?’ ‘কোরান শরীফ পড়ছ কেন এত?’ সংশয়াপন্ন মার কপালে দুটো ভাঁজ। ‘বাহ, কোরান পড়া তো ভাল। সওয়াব হয়।’ ‘তুই তো আর সওয়াবের জন্য পড়ছ না।’ মা বিরক্ত-কণ্ঠে বলেন। হাসতে হাসতে বলি, ‘ছি ছি আর কইও না। আল্লাহ যদি জানেন যে তুমি কোরান পড়তে কাউরে বাধা দিতাছ তাইলে তোমারে হাবিয়া দোযখে নিক্ষেপ করবেন তিনি।’ মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘না হয় আমি হাবিয়া দোযখে যাই, তুই বেহেসতে যাওয়ার চেষ্টা কর।’ ‘ওইটা চিন্তা কইর না। আল্লাহর সাথে কনটাক্ট হইছে আমার। বেহেসতের ব্যবস্থা পাককা। সেইদিন আল্লাহ আমারে জানাইলেন যে জান্নাতুল ফেরদাউসের লিস্টে চার নম্বরে আমার নাম।’ ‘তাইলে তো ভাল। বেহেসতে যদি নাম থাকে।’ ‘হ। তুমি তো দোযখের আগুনে পুড়তে থাকবা, আর আমি বেহেসতে। আল্লাহর কাছে তোমারে বেহেসতে আনার জন্য আমার তদবির করতে হবে।’ মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, বলেন, ‘নাসরিন তর পায়ে পড়ি কোরানের বিরুদ্ধে আর কিছু লিখিস না। কোরান তো তরে কিছু করে নাই। মোল্লারা করতাছে মোল্লাদের বিরুদ্ধে লেখ।’ আমি সরে যাই মার কান্নার কাছ থেকে। মাকে প্রায়ই দেখি জায়নামাজে বসে মোনাজাতের হাত তুলে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে করতে ফুঁপোচ্ছেন। একদিন বিড়বিড়ের কাছে কান পেতে শুনি, বলছেন, ‘আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে কাফের বানাইও না। আল্লাহ তুমি আমারে মেয়েটারে কাফেরের সঙ্গ থেকে মুক্ত কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের বেহেসত নসীব কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে সুমতি দাও, জ্ঞান দাও। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের হৃদয় মোহর করে দিও না।’ মার জন্য মায়া হয় আমার। সেই যে বিমানবন্দরে আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিল পুলিশের লোকেরা আর আমাকে বলে দিল পরদিন যেন পাসপোর্ট ফেরত নিই মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিস থেকে, পরদিন সেই আপিসে গিয়ে যখন আমার পাসপোর্ট চাইলাম, লোকেরা কিসের পাসপোর্ট কোন পাসপোর্ট, বলে দিল, কিছুই জানে না। পরদিন আবার গেলাম। তখনও পাসপোর্টের খবর নেই। পরদিন আবার। ‘আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাবার কথা এখান থেকে। আমার পাসপোর্টটা দিন।’ ‘পাসপোর্ট ওপরে আছে। ওখান থেকে পাঠালেই আপনি নিয়ে যেতে পারবেন।’ ‘ওপরে মানে? কোন ওপরে?’ মাথার ওপরে কাঠের তাকে কয়েক টন কাগজের দিকে তাকাই। ‘আরে না, এই ওপরে না, এই ওপরে না।’ ‘তাহলে কোন ওপরে?’ লোকটি
false
MZI
করে বা না করেই বা কি! আস্তে আস্তে বেশ একটা শোরগোল ওঠে, লোকজন কথাবার্তা বলতে থাকে উত্তেজিত স্বরে, আর তার মাঝে হঠাৎ নান্টুর রিনরিনে গলার স্বর শোনা গেল, পীর সাহেবের জোচ্চুরি, পীর সাহেবের জোচ্চুরি, পীর সাহেবের জোচ্চুরি— ম্যাজিকের মতো সবাই চুপ করে যায়, পীর সাহেব পর্যন্ত তাঁর যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে থেমে যান। সবাই ঘুরে তাকায় নান্টুর দিকে। নিজের কানকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। কয়েক মুহূর্তে সমস্ত ঘর একেবারে কবরের মতো নীরব, নিঃশ্বাস ফেললে শোনা যায় এরকম। নান্টু ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকায় একবার, দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, সম্ভবত বাকি দশ টাকার লোভে একটা কাগজ বের করে সে কাছাকাছি এক জনকে এগিয়ে দেয়, একসাথে কয়েকজন ঝুকে পড়ে সেই কাগজের উপর, সেখানে বড় বড় করে লেখা, “পীর সাহেবের জোচ্চুরি।” তার নিচে দু’টি প্রশ্ন, “কেন আজ পীর সাহেব পেরেকের বিছানায় শুইতে পারিলেন না?” এবং “কেন আজ পীর সাহেব আগুনের উপর হাঁটিতে পারিলেন না?” প্রশ্নগুলোর নিচে ছোট ছোট হাতের লেখায় প্রশ্ন দুটির উত্তর। বেশ কয়েকজন কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসে নান্টুর দিকে, নান্টু সাহস করে বিলি করতে শুরু করে। এক জন দু’জন করে বেশ কয়েকজন পীর সাহেবের জোচ্চুরির বিবরণ পড়া শুরু করে। দরবারে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে যায়, মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় যে পীর সাহেব একটা জোচ্চোর। হঠাৎ করে সবাই নান্টুকে ঘিরে ধরে এক কপি জোচ্চুরির বিবরণের জন্যে। আমি সবিস্ময়ে দেখি নান্টু হঠাৎ মুখে একটা গাম্ভীর্য এনে হাতের কাগজগুলো বুকে চেপে ধরেছে। লোকজন তাকে ভিড় করে রেখেছে, কিন্তু সে কাগজ হাতছাড়া করছে না, এক জন চাইতেই বলল, পাঁচ টাকা করে দাম, আজকে স্পেশাল রেট দুই টাকা। লোকটি বলল, আগে তো এমনিতেই দিচ্ছিলি— নান্টু গম্ভীর গলায় বলল, সেইটা হল বিজনেস ট্যাকটিস। নদী মে খাল মিরচা মে ঝাল। নিতে চাইলে নেন না হয় রাস্তা দেখেন, আমার অন্য কাস্টমারের রাস্তা আটকাবেন না। আমি সবিস্ময়ে দেখি, লোকজন পকেট থেকে টাকা বের করে কাগজ কিনে নিচ্ছে, এক জন দেখলাম দুটো কেনার চেষ্টা করল। কিন্তু নান্টু একটার বেশি কাউকে দিল না। দেখতে দেখতে কাগজ শেষ হয়ে যায়। নান্টু খুচরো টাকার বান্ডিল দুই হাতে ধরে রাখে। সবগুলো টাকা রাখার মতো বড় পকেট তার প্যান্টে নেই। পীর বাবার সাগরেদরাও এক কপি “পীর বাবার জোচ্চুরি” কিনে এনে পড়তে শুরু করেছে। শেষ করার আগেই দেখা গেল তারা হঠাৎ পিছনের দরজা দিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত জনতা দৌড়ে তাদের ধরে ফেলল, পীর বাবা অবশ্যি পালানোর চেষ্টা করেন নি। পায়ে বড় বড় ফোস্কা বেরিয়ে গেছে। শরবতের গামলায় পা ড়ুবিয়ে বসে আছেন। কেউ তাঁকে কোলে করে না নিলে এখান থেকে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সাগরেদদের নিজেদের জান নিয়ে টানাটানি, এখন কে এই দু’মণি লাশ নিয়ে টানাটানি করবে? যে সমস্ত ভক্ত মুরীদেরা একটু আগেই পীর বাবার পায়ের তলায় চুমো খাবার জন্যে মারামারি করছিলেন, এখন তাঁরাই পীর বাবাকে তাঁর সাগরেদদের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়েছেন। নেহায়েত বয়স্ক মানুষ, এছাড়া কিল-ঘুষি যে ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পীর বাবার দাড়িটি নকল কি না দেখার জন্যে কৌতূহলী দর্শকরা মাঝে মাঝেই একটা হ্যাচকা টান দিয়ে যাচ্ছিল, এতেই পীর বাবার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা! আমার সাংবাদিক বন্ধুটি দায়িত্বশীল মানুষ, এখানে এসেই আমার পরিকল্পনাটি ধরে ফেলেছিল, তখন-তখনি সে পুলিশে খবর দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। পুলিশ এখনো এসে পৌঁছায় নি, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবে। পীর বাবা আর তাঁর সাগরেদরা তাহলে একটা শক্ত পিটুনি থেকে রেহাই পাবেন! আমি আর সফদর আলী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে আসি। সাংবাদিক বন্ধু শেষ পর্যন্ত থাকতে চান। খুব নাকি একটা জমকালো খবর হবে। নান্টুকে সরানো গেল না, কোনোমতে তার বাকি দশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলাম। সে তখন বিরাট এক জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা বক্তৃতা দিচ্ছে। বক্তৃতাটি এরকম : আমাকে স্যার বললেন, পীর বেটাকে তো ধরিয়ে দিতে হয়, কিন্তু বিপদের আশঙ্কা আছে। আমি বললাম, নদী মে খাল মিরচা মে ঝাল। বিপদের ভয় আমার নাই, হায়াত-মউত খোদার হাতে। ভালো কাজে জান দিতে হলে দিতে হয়। স্যার বললেন, বাপকা বেটা, চল তাহলে ঠিক করি কী করা যায়। তারপর আমি আর স্যার এককাপ চা আর একটা সিগারেট নিয়ে বসি আমি তো আর পাষণ্ড নই, কী ভাবে এরকম জমাট গল্পে বাধা দিই? পরদিন ইচ্ছা করেই অফিসে একটু সকাল সকাল হাজির হলাম, মোড় থেকে খবরের কাগজ কিনে এনেছি কয়েকটা। এসে দেখি আমার আগেই অন্যেরা হাজির। সবাই সুলতান সাহেবের টেবিলে হুঁমড়ি খেয়ে পড়েছে। খবরের কাগজের শেষ পৃষ্ঠায় “ভণ্ডপীরের দুর্ভোগ” নামে মস্ত বড় ফিচার ছাপা হয়েছে সেখানে। কাল না যে হ্যান্ডবিলটা বিলি করেছে তার পুরোটা ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার নিজের হাতে লেখা, গর্বে আমার বুক প্রায় দুই আঙুল ফুলে ওঠে। খবরের কাগজে কোথাও অবশ্যি আমার বা সফদর আলীর নাম নেই। ইচ্ছা করেই গোপন করা হয়েছে। পীর সাহেবের কোনো অন্ধ ভক্ত বা কোনো সাগরেদ আবার পিছে লেগে যাবে সেই ভয়ে। হ্যান্ডবিলের প্রথমে পেরেকের বিছানায় শোওয়া এবং আগুনের ওপর হাঁটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখা। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে লিখেছি, যেন পড়ে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, মনে হয় ভালোই লিখেছি, কারণ যে-ই পড়েছে সে-ই সবকিছু বুঝে
false
zahir_rayhan
কতকগুলো মেয়ে থাকে। আহা অমন উসখুস করছো কেন, পুরোটা শুনে নাও না। তুমি নিজে তো আর কিছু করছো না, তোমার কী এলো গেলো। তুমি তো শুধু বকরা ধরে আনবে। নগদানগদি টাকা। মেয়ের দালালি করতে বলছো আমায়? বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলো শওকত। বুড়ো আহমদ হোসেন ঘোঁত করে উঠলো। এইতো এবার মুখ খারাপ করতে হয় আমার। আরে বাবা, যে-শালারা এসব কাজ করে বেড়ায় তারা লেখাপড়ায় তোমার চাইতে কম না, অনেক বেশি। নিজেকে কী অমন কেউকেটা ভাবো যে কাজটা নিতে লজ্জা করছে? আর এই ছুঁড়িগুলো, এরা তোমার ওই নালা-খন্দ খেকে কড়ি আনা নয়। সব ভদ্র ঘরের মেয়ে। স্কুল-কলেজে পড়ে। ঘর-সংসার করে। ইচ্ছে করলে কোনোদিন তুমি নিজেও গিয়ে দু-এক রাত শুয়ে আসতে পারো ওদের সঙ্গে। তোমার কী? টাকা রোজগার হলেই হলো। ওরাও তো টাকার জন্যেই করছে এসব। চলি এবার! এই অস্বস্তিকর প্রস্তাবের নাগাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার না মনটা আঁকুপাকু করছে শওকতের। সে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস। পছন্দ হলো না তো। বুড়ো আহমদ হোসেন শুয়োরের মতো ঘোঁতঘোঁত করে বললো, তা পছন্দ হবে কেন। যাও মার্থার কাছেই যাও, গিয়ে মার্থার ঠোঁট চোষো গিয়ে, তাতেই পেট ভরবে। আমার কাছে এসে আর পেনপেন কোরো না। ঘুষি মেরে একদম নাকের ডগা গুঁড়ো করে দেবো। শেষের কথাগুলো একতের মনে গেলো না। ততক্ষণ রাস্তায় নেমে গেছে সে। মার্থার কাছেই যাবে সে। হ্যাঁ, মার্থার কাছে। মার্থা ওকে ঘৃণা করবে। করুক। ওর কাছে মাফ চাইবে সে। বলবে, আমাকে ক্ষমা করে দাও মার্থা। আমি না-বুঝে অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি যা ভাবছো আমি তা নই। সারাটা জীবন আমি দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। এক কাজ ছেড়ে অন্য কাজ নিয়েছি। কোথাও শান্তি পাইনি। আমি তোমার কাছে শুধু একটু শান্তি পেতে গিয়েছিলাম। আর কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিলো না। মার্থা, তুমি কেন আমাকে কাছে টেনে নিলে না মার্থা। মার্থা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে। ক্রেতাদের সঙ্গে সেই আগের মতো হেসে-হেসে কথা বলছে সে। তেমনি সহজ। স্বাভাবিক। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখলো শওকত। বিকেলে আসতে বলেছিলো সে। এখন রাত। যে-লোকটার আসার কথা ছিলো সে বোধহয় এসে চলে গেছে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবলো। ভাবতে গিয়ে কাল রাতের কথা আবার মনে হলো ওর। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ের রাক্ষস এলে গ্রাস করতে চাইলো ওকে। পা কাঁপলো। মার্থা ব্যাগঝিম করে উঠলো। বুকটা ধুকধুক করছে। মার্থা কাউন্টার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। ওর মনে হলে এখনি একটা দৌড় দিয়ে পালাতে পারলে বেঁচে যায় সে। কিন্তু, মার্থা সোজা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। কী ব্যাপার, ভেতরে না গিয়ে এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? চলো। মার্থার গলার স্বর আর মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে অনেকটা আশ্বস্তু হলো শওকত? ভেতরে যেতে যেতে মার্থা আবার বললো, এত দেরি করে এলে কেন, ভদ্রলোক তোমার জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। বসো এখানে। বসো এখানে। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আবার কাউন্টারে চলে গেলো মার্থা। রাতকানা লোকটা চশমার ফাঁকে বারকয়েক তাকালো ওর দিকে। কেমন যেন একটা সন্দেহের দৃষ্টি যেন এক একটা মস্তবড় অন্যায় করে ফেলেছে। আর ওই রাতকানা লোকটাকে সব বলে দেয়নি তো? নইলে লোকটা গোঁফের নিচে অল্পঅল্প করে হাসছে আর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে কেন ওকে। পা থেকে মার্থা পর্যন্ত। এসো। কতক্ষণ পরে মনে নেই, মার্থা এসে ডাকলো ওকে। ওর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো শওকত। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, মার্থা আজ সেজেছে। বিয়ের আগে সেই বেকারীতে আসার সময় যেমন সাজতো সে, তেমনি। হঠাৎ যেন বয়সটা অনেষ্ক কমে গেছে ওর। রাস্তায় নেমে কিছুদূর পথ কোনো কথা বললো না মার্থা। ওকে বেশ গম্ভীর মনে হলো। শওকত ভাবলো, আর দেরি না করে এই পথচলার ফাঁকে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে হয়। মার্থা অকস্মাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো, তোমার করিটা বোধহয় হবে না। হবে না? ওর কথাটারই যেন প্রতিক্তি করলো শওকত। মার্থা বললো, হোতো। এখনো হয়। ওর কথায় যদি আমি রাজি হয়ে যাই। কে জানে হয়তো মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকলে সব জায়গায় এমনি আদর-সোহাগ পাওয়া যায়। শওকত ভাবলো। কী কথা? শওকতের দম বন্ধ হয়ে এলো। মার্থা বললো, থাক, নাইবা শুনলে। শওকত গুনে ছাড়বে। বললো, বলোই না। মার্থা বললো, লোকটা আমাকে দিন কয়েকের জুন্যে ওর সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যেতে বলছিলো। কেন? মার্থা ম্লান হাসলো। তোমাকে চাকরি দেয়ার জন্যে। ততক্ষণে একটা সেলুনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। শওকত বললো, এখানে কী? মার্থা ওর মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, মুখের দাড়িগুলো কত লম্বা হয়ে গেছে। একবার আয়নায় গিয়ে দেখো। চলো, শেভ করে নাও। এখন, এই রাতে? হ্যাঁ, এখন, যাও ঢোকো। মার্থার চোখেমুখে শাসানের ভঙ্গি। ভালোই লাগলো শওকতের, কাল রাতের কথা হয়তো ভুলে গেছে মার্থা। খোদা, ওকে সব ভুলিয়ে দাও। সেলুনের লোকগুলো টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখছে মার্থাকে। হাতজোড়া কোলে নিয়ে মার্থা এককোণে চুপচাপ বসে। যে-লোকটা ওর মুখে সাবান ঘষছে তার যেন কোনো তাড়া নেই। অফুরন্ত অবসর। অথচ এর আগে যখন সেলুনে দাড়ি কামাতে এসেছে সে, তখন লোকগুলো এত তাড়াহুড়ো করেছে যে, অর্ধেকটা দাড়ি থেকে গেছে মুখে। ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে পাওনা চুকিয়ে দিলো মার্থা, তারপর আবার রাস্তায় নেমে এলো ওরা। মার্থা বললো, আজ আর বাসায় ফিরে গিয়ে রান্নাবান্না করতে পারবো না। চলো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে
false
humayun_ahmed
সময় রনির মনে হয়, আসল বাবা-মা থাকলে কী করতেন? তারা নিশ্চয় রনিকে আলাদা ঘরে রাখতেন না। আর রাখলে খুব বেশি ভয় পেলে কেউ-না কেউ তার সঙ্গে ঘুমুতে আসতেন। হয় মা আসতেন, কিংবা বাবা আসতেন। আসল বাবা-মা দুজনের ছবিই রনির স্ক্রাপ-বুকে আছে। রনি ছবির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে দুজনের কে তার সঙ্গে ঘুমুতে আসতেন। মার ছবিটা খুবই হাসিখুশি। হাসির মধ্যেই দুষ্টু দুষ্টু ভাব। হ্যাঁ, মা তো আসতই। তবে মা তার সঙ্গে থাকতে এলে সমস্যাও হতো। যে-রকম দুষ্ট দুষ্ট চেহারা, নিশ্চয়ই খুবই দুষ্টামি করত। তাকে ঘুমুতে দিত না। কাতুকুতু দিত। চুল টানত। ঘুমে যখন তার চোখ জড়িয়ে আসত, তখনো গল্প করত। মার ছবি দেখেই মনে হয়, এই মহিলা গল্প করায় ওস্তাদ। বাবার চেহারাটা আবার গম্ভীর ধরনের। চোখে চশমা। ভুরু সামান্য কুঁচকানো। গম্ভীর ধরনের মানুষ আবার ভেতরে ভেতরে হাসিখুশি হয়। হাসিখুশি ভাবটা তারা প্রকাশ করে না। বাবা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে ঘুমুতো। তবে ঘুমুবার আগে নানান উপদেশ দিত–পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই। কাজেই ভূতের ভয়ে অস্থিত হওয়া কোনো কাজের কথা না। তাদের ছেলেমেয়েদের আদর আদর গলায় উপদেশ দিতে পছন্দ করে। স্কুলে সে দেখেছে মোটা-মিঠুর বাবা মেয়েকে স্কুল থেকে নিতে এসেই উপদেশ শুরু করেন। আদর আদর গলায় উপদেশ। রনি যে এখন একেবারে একা ঘুমায় তা-না। ইদরিস মিয়া রনির ঘরের বাইরে বিছানা পেতে ঘুমায়। তার মাথার কাছে থাকে একটা মশার কয়েল, পায়ের কাছে থাকে আরেকটা কয়েল। ইদরিস মিয়া সারাক্ষণ কথা বলে। দিনের বেলা তো কথা বলেই, রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কথা বলে। ইদরিস মিয়া হলো রনির পাহারাদার। সে এ বাড়িতে রনি ঠিকমতো আছে কি-না, তার যত্ন ঠিক হচ্ছে কি-না, রনির নকল বাবা-মা তাকে অনাদর করছে কি-না সে এইসব লক্ষ করে এবং রনির দাদার কাছে রিপোর্ট করে তাকে রাখাই হয়েছে এই কাজে। ইদরিস মিয়ার ভাবভঙ্গি স্পাইদের মতো। রনির সঙ্গে কথা বলার সময় গলা নিচু করে কথা বলে, যেন ষড়যন্ত্র করছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকায়। এই সময় ইদরিসকে ইঁদুরের মতো দেখায়। টম এন্ড জেরির ইঁদুর। জেরি। রনির খুব হাসি পায়। সে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে। ইদরিস তখন কথাও বলে ইঁদুরের মতো কিচকিচ করে নিচ্চিন্ত থাকেন ভাইজান, সব হিসাবের মধ্যে আছে। আপনার ওপর নজর খালি আমি একলা রাখতেছি না। আরো লোকজন রাখতেছে। অনেকের নজর আছে। আমার ওপর এত নজর রাখার দরকার কী? আছে, দরকার আছে। বিষয়সম্পত্তি, টাকাপয়সা সবই তো আপনের। আপনের পিতা লিখিতভাবে দিয়ে গেছেন। সেই সম্পত্তিও পাঁচ-দশ টাকার সম্পত্তি না। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। গুলশানে যে সাততলা দোকানতার ভাড়াই মাসে ত্রিশ লাখ। বিবেচনা করেন অবস্থা। ত্রিশ লাখ মানে কত মিলিয়ন? মিলিয়ন ফিলিয়ন জানি না ভাইজান, এইটা জানি বেশুমার টাকা। বেশুমার। বেশুমার। বেশুমার টাকা মানে কী? অত কিছু জানি না ভাইজান। একটা জিনিস জানি আমার কাজ আপনেরে চউক্ষে চউক্ষে রাখা। রাইতে যে আপনের ঘরের সামনে শুইয়া থাকি–আপনে কি ভাবেন ঘুমাই? ঘুমাই না, জাগনা থাকি। দুই চউক্ষের পাতা ফেলি না। কিন্তু আমি যে নাক ডাকার শব্দ পাই? এইটা কল্পনা। শিশু-মনের কল্পনা। তয় আমার একটা বিষয় আছে। জাগনা অবস্থায়ও আমার নাক ডাকে। বড়ই আজিব। মাঝে মাঝে রনির দাদা, আসগর আলি, রনিকে দেখতে আসেন। এমন রাগী বুড়ো মানুষ রনি তার জীবনে দেখে নি। ধমক না দিয়ে সহজভাবে এই বুড়ো কোনো কথা বলতে পারে না। তার গা দিয়ে সিগারেটের কড়া গন্ধ আসে। এত কড়া গন্ধ যে রনির বমি আসার মতো হয়। তিনি রনির সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলেন, এটাও রনির পছন্দ না। কথা বলার সময় খামচি দেয়ার মতো রনির কাঁধ ধরে রাখেন। রনির ব্যথা লাগে, তারপরও সে কিছু বলে না। তুই কেমন আছিস? ভালো। এরা তোকে মারধর করে? কারা মারবে? আবার কারা? যাদের সঙ্গে আছিস তারা? না তো। ঠিক করে বল। চড় থাপ্পড়, ধাক্কা? না। মারধোর করলে বা বকা দিলে, কোনোরকম অবহেলা করলে আমাকে বলবি। কোর্টে পিটিশন করে তোর কাস্টডি নিয়ে নেব। বুঝতে পারছিস? পারছি। আমার তো ধারণা তোকে মারে। তুই ভয়ে বলছিস না। ভয়ের কিছু নাই। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো দিচ্ছে? হুঁ। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও সাবধান। যদি দেখিস তোকে তারা গোপনে কোনো শরবত খেতে দিচ্ছে, তাহলে খাবি না। নিতান্তই যদি খেতে ইচ্ছা হয় আগে ইদরিসকে এক চামুক খাওয়াবি। কেন? আরে এই গাধাকে নিয়ে দেখি যন্ত্রণায় পড়লাম। বিষ-টিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে, এইজন্যে। মেরে ফেলবে কেন? মেরে ফেলবে না তো কী করবে? কোলে বসিয়ে চুমু খাবে? তুই দেখি তোর বাবার মতোই বেকুব হয়েছিস। তোর বাবা ছিল বেকুব নাম্বার ওয়ান, আর তুই হলি বেকুব নাম্বার টু। বাবাকে বেকুব বলবেন না দাদাজান। বেকুবকে বেকুব বলব না? না। এইটুকু বাচ্চা কেমন ধমক দিয়ে কথা বলে! আছাড় দিয়ে ভুঁড়ি গালায়ে দেব। তোর বাবা যখন তোর মতো ছিল, সেও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলত। একদিন শূন্যে তুলে দিলাম আছাড়। মট করে পাটকাঠি ভাঙার মতো একটা শব্দ হয়েছে। তারপর দেখি কজির নিচে হাড় ভেঙে হাত ঝুলছে। দাদাজান, তুমি দুষ্টলোক। অবশ্যই দুষ্টলোক। এই দুনিয়ায় কোনো ভালো লোক নাই। যা আছে। সবই দুষ্ট। রনি জানে তাকে নিয়ে নানান সমস্যা আছে। কয়েকবারই তাকে কোর্টে যেতে হয়েছে। সে কার সঙ্গে থাকবে এই নিয়ে
false
tarashonkor
কিছু আছে, কিন্তু ভল্লারাই সংখ্যায় প্রধান। পূর্বকালে দেখুড়িয়ার ভল্লারাই ছিল পঞ্চগ্রামের বাহুবল। আজ দুইশত বৎসরের অধিককাল তাহারা লুঠেরা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মানুষ কয়টি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। মধ্যে মধ্যে মৃদুস্বরে কয়েকটি কথা হইতেছে, আবার চুপ হইয়া যাইতেছে। ওদিকে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সেই দূরে একই স্থানে জ্বলিতেছে মশালের আলোটা। দেবু না থাকিলে ইহারা অবশ্য আপন বুদ্ধিমত যাহা হয় করিত। দেবুর প্রতীক্ষাতেই সকলে চুপ করিয়া আছে। সতীশ বাউরি বলিলপণ্ডিত মশায়? –হুঁ। –হাঁক মারি? হাঁক মারিলে জাগ্ৰত মানুষের সাড়া পাইয়া নিশাচরের দল চলিয়া যাইতে পারে। অন্তত এ গ্রামের দিকে আসিবে না বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু উহারা যদি মাতিয়া উঠিয়া থাকে, তবে আর মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া এ গ্রাম বাদ দিয়া অপর কোনো প্রসুপ্ত পল্লীর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবে। ভূপাল বলিল—ঘোষ মশায়কে একটা খবর দি পণ্ডিত মশায়, কি বলেন? —শ্ৰীহরিকে? –আজ্ঞে হ্যাঁ। বন্দুক নিয়েছেন, বন্দুক আছে। কালু শেখ আছে ঘোষ মশায়ের বাড়িতে। তা ছাড়া ঘোষ মশায় ঠিক বুঝতে পারবেন—এ কীর্তি কার। বলিয়া ভূপাল একটু হাসিল। শ্ৰীহরি ঘোষ এখন গ্রামের পত্তনীদার; সে এখন গণ্যমান্য ব্যক্তি। কিন্তু এককালে সে যখন ছিরু পাল বলিয়া খ্যাত ছিল, তখন দুর্ধর্ষপনায় সে ওই নিশাচরদেরই সমকক্ষ ছিল। অনেকে বলেচাষ এবং ধান দান করিয়া জমিদার হওয়ার অসম্ভব কাহিনীর অন্তরালে ওই সব নিশাচর সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কাহিনী লুক্কায়িত আছে। সে আমলে ছিরু নাকি ডাকাতির বামালও সামাল দিত। অনিরুদ্ধ কর্মকারের ধান কাটিয়া লওয়ার জন্য একবার মাত্রই তাহার ঘরখানা তল্লাশ হয় নাই, তাহারও পূর্বে আরও কয়েকবার এই সন্দেহে তাহার ঘর-সন্ধান। হইয়াছিল। এখন অবশ্য সে জমিদার প্রভাবশালী ব্যক্তি, এখন শ্ৰীহরি আর এইসব সংস্রবে থাকে না; কিন্তু সে ঠিক চিনিতে পারিবে—এ কাহার দল। হয়ত দুর্দান্ত কালু শেখকে সঙ্গে লইয়া বন্দুক হাতে নিঃশব্দে আলো লক্ষ্য করিয়া অন্ধকারের মধ্যে অগ্রসর হইয়া, এক সময় হঠাৎ বন্দুক। দাগিয়া দিবে। দেবু বলিল—এ রাত্রে দুর্যোগে তাকে আবার কষ্ট দিয়ে কাজ নাই ভূপাল। তার চেয়ে এক কাজ কর। সতীশ, তুমি তোমাদের পাড়ার নাগরা নিয়ে, নাগা পিটিয়ে দাও; কটা নাগরা আছে তোমাদের? –আজ্ঞে, দুটো। —বেশ। তবে দুজনে দুটো নাগরা নিয়ে গায়ের এ-মাথায় আর ওমাথায় দাঁড়িয়ে পিটিয়ে দাও। নাগরার শব্দ–-বিশেষ করিয়া বর্ষার রাত্রে নাগরার শব্দ এ অঞ্চলে আসন্ন বন্যার বিপদজ্ঞাপন সংকেত ধ্বনি। ময়ূরাক্ষীর বন্যায় বধ ভাঙিলে এই নাগরার ধ্বনি ওঠে; পরবর্তী গ্রাম জাগিয়া ওঠে; সাবধান হয়, তাহারাও নাগরা বাজায়—সে ধ্বনিতে সতৰ্ক হয় তাহার পরবর্তী গ্রাম। ডাকাতি হইলেও এই নাগরাধ্বনির নিয়ম ছিল এবং আছে। কিন্তু সব সময়ে এ নিয়ম প্রতিপালিত হয় না। গ্রামে ডাকাত পড়িয়া গেলে তখন সব ভুল হইয়া যায়। তা ছাড়া নাগরা। দিলেও ভিন্ন গ্রামে লোক জাগে বটে, কিন্তু সাহায্য করতে আসে না। কারণ পুলিশ-হাঙ্গামায় পড়িতে হয়, পুলিশের কাছে প্রমাণ দিতে হয় যে সে ডাকাতি করিতে আসে নাই, ডাকাত ধরিতে আসিয়াছিল। নাগরার কথাটা সতীশদের ভালই লাগিল। সতীশ সঙ্গে সঙ্গে দলের দুজনকে পাঠাইয়া। দিল। কিন্তু ভূপাল ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল ঘোষ মশায় বোর্ডের মেম্বর লোক। খবরটা ওঁকে না দিলে ফৈজতে পড়তে হবে আমাকে। শ্ৰীহরিকে সংবাদ দিতে দেবুর মন কিছুতেই সায় দিল না। একটুখানি নীরব থাকিয়া বলিল—চল, আমরাই আর একটু এগিয়ে দেখি। –না, আর এগিয়ে যেও না। স্ত্রীলোকের দৃঢ়তাব্যঞ্জক চাপা কণ্ঠস্বরে সকলে চমকিয়া উঠিল। দেবুও চমকিয়া উঠিল,-গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে নারীকন্ঠে কে কথা বলিল? বিলু! বিলুর অশরীরী আত্মা। আবার নারীকণ্ঠ বলিয়া উঠিল—বিপদ হতে বেশিক্ষণ লাগে না জামাই। দেবু এবার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল—কে? দুর্গা? –হ্যাঁ। সমস্বরেই প্রায় সকলে প্ৰশ্ন করিয়া উঠিল—দুগ্‌গা? –হ্যাঁ। বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই সে রসিকতা করিয়া বলিল ভয় নাই, পেত্নী নই, মানুষ, আমি দুগ্‌গা। –তুই কখন্ এলি? দুর্গা বললি সতীশদা থানাদারকে ডাকলে, পাড়ায় ডাকলে, আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে থাকতে নারলাম, ওই সতীশদাদাদের পিছু পিছু উঠে এলাম। —বলিহারি বুকের পাটা তোমার দুগ্‌গা! ভূপাল ঈষৎ শ্লেষভরেই বলিল। —বুকের পাটা না থাকলে, থানাদার, রাত-বিরেতে পেসিডেনবাবুর বাংলোতে নিয়ে যাবার জন্য কাকে পেতে বল দেখি? বকশিশই তোমার মিলত কি করে? আর চাকরির কৈফিতই বা কাটাতে কি করে? কথাটার মধ্যে অনেক ইতিহাসের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট; ভূপাল লজ্জিত হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। ঠিক এই মুহূর্তেই গ্রামের দুই প্রান্তে নাগরা বাজিয়া উঠিল। দুর্যোগময়ী স্তব্ধ রাত্রির মধ্যে ড়ুগড়ুগড়ুগ ধ্বনি দিগৃদিগন্তে ছড়াইয়া পড়িল। দেবু হাঁক দিয়া উঠিল—আ—আ–হৈ! সঙ্গে সঙ্গে সকলেই হাঁক দিয়া উঠিল সমস্বরে—আ-আ-আ—হৈ! আ—হৈ!। দূরে অন্ধকারের মধ্যে যে আলোটা বাতাসে কাঁপিয়া যেন নাচিতেছিল—সে আলোটা অস্বাভাবিক দ্রুততায় কাঁপিয়া উঠিল। আবার দেবু এবং সমবেত সকলে হাঁক দিয়া উঠিল—আহৈ আহৈ! ওদিকে গ্রামের ভিতরে ইহারই মধ্যে সাড়া জাগিয়া উঠিল। স্পষ্ট শোনা যাইতেছে স্তব্ধ রাত্রে পরস্পর পরস্পরকে ডাকিতেছে। একটা উচ্চ কণ্ঠের প্রহরা-ঘোষণার শব্দ উঠিল। এ শব্দটা শ্ৰীহরির লাঠিয়াল কালু শেখের হাক! ওদিকে নাগরা দুইটা ড়ুগড়ুগ শব্দে বাজিয়াই চলিয়াছে। এবার দূরে মাঠের বুকে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলন্ত আলোটা হঠাৎ নিম্নমুখী হইয়া অকস্মাৎ যেন। মাটির বুকের ভিতর লুকাইয়া গেল। স্পষ্ট বুঝা গেল মশালের আলো কেহ জলসিক্ত নরম মাটির মধ্যে খুঁজিয়া নিভাইয়া দিল। ওদিকে আরও দূরে আরও একটা নাগরা অন্য কোথাও, সম্ভবত বালিয়াড়া দেখুড়িয়ায় বাজিয়া উঠিল। এতক্ষণে দেবু বলিল এবার তুমি ঘোষ মহাশয়কে খবর দিয়ে এস ভূপাল। কাজ কি কৈফিয়তের মধ্যে গিয়ে! পিছন হইতে কাহার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিলভূপাল! হারিকেনের আলোও একটা আসিতেছে। ভূপাল চমকিয়া
false
MZI
একটা জিনিস কিনে এনেছি সেটা ব্যবহার করে একটা অস্ত্র তৈরি করতে চাই। কী রকম অস্ত্র? আমি কিছু একটা ভাবব আর সেই ভাবনার সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। কিছু বিস্ফোরক দরকার খুব ছোট আকারের। তার সাথে থাকবে ডেটনেটর। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা থাকবে আমার মাথায়, হেলমেট থেকে খুলে সোজাসুজি সেটা আমার করোটিতে বসিয়ে নিতে চাই, সহজে যেন ধরা না পড়ে। বিস্ফোরকগুলি তুমি কোথায় লাগাতে চাও? আমি একটু ইতস্তুত করে বললাম, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে। লেন চমকে উঠে আমাকে আকড়ে ধরল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলছ তুমি? আমি মাথা নাড়লাম, ঠিকই বলছি। বুড়ো লী হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাহলে একটা পরিকল্পনা আছে! না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার সত্যিকার অর্থে কোনো পরিকল্পনা নেই। এটা এক ধরনের সাবধানতা। লেন আর্ত স্বরে বলল, না, না–এটা হতে পারে না বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে আমি তোমাকে কিছু করতে দেব না– বুড়ো লী সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, লেন, তোমার এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমার কাছে চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট বিস্ফোরক রয়েছে, সিরিঞ্জে দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে কিছু করা হবে না। তাই বলে শরীরের মাঝে বিস্ফোরক? আমি লেনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, বাচ্চাগুলিকে ধ্বংস করার জন্যে আমি তাদের হৃদপিন্ডে বিস্ফোরক লাগাচ্ছি না, লাগাচ্ছি তাদের বাঁচানোর জন্যে। পুরো ব্যাপারটা তুমি শুনলেই বুঝতে পারবে। এস আমার সাথে আমি তোমাকে বলি। বুড়ো লীয়ের রবোটটা দেখতে অত্যন্ত কদাকার হলেও কাজকর্মে খুব চৌকস। আমি কী করতে চাই ব্যাপারটা জেনে নেবার পর সে কাজে লেগে গেল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা নিয়ে খানিকটা কাজ করতে হল। আমার মস্তিষ্কের দু-ধরনের তরঙ্গের সাথে সেটাকে টিউন করা হল। যখনই আমি একটি বিশেষ পদ্ধতিতে মিথ্যা কথা বলব প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে যখন আমি বিশাল দুটো প্রাইম সংখ্যাকে মনে মনে গুণ করার চেষ্টা করব তখন। প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি রাখা হল খাবারের ক্যাপসুল, তথ্য ক্রিস্টাল কমিউনিকেশান্স মডিউল এ ধরনের আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারী জিনিসের মাঝে। দ্বিতীয় ধরনের বিস্ফোরকগুলি অত্যন্ত ছোট সিরিঞ্জ দিয়ে ছটফটে আটটি শিশুর শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটির আকার ছোট করে নিয়ে আসা হল এবং বুড়ো লীয়ের রবোট আমার করোটির উপরে সেটা অস্ত্রোপাচার করে বসিয়ে দিল। সবশেষে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে আমার ক্ষত নিরাময় করে দেয়া হল, মাথার ভেতরে একটা ভোতা যন্ত্রণা ছাড়া আর কোথাও তার কোনো প্রমাণ রইল না। সমস্ত কাজ শেষ করে বুড়ো লীয়ের ঘরে ফিরে এসে দেখি সে তার ঘরে একটা ছোট ভোজ সভায় আয়োজন করেছ। কিছু বিশেষ খাবার এবং বিশেষ পানীয় তার আশে পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাজ শেষ। যা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার এখন খুব সাবধানে কথা বলতে হবে। যখনই আমি একটা মিথ্যা কথা বলব ঠিক তখনই আমাদের সাথে রাখা কোনো একটি টাইমার চালু হয়ে যাবে। ঠিক দুই সেকেন্ডের মাঝে যদি দ্বিতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে ফুড ক্যাপসুলের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবে। যদি তিন সেকেন্ডের মাঝে তৃতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে তথ্য ক্রিস্টালে, চার সেকেন্ডের মাঝে হলে কমিউনিকেশান্স মডিউলে। বুড়ো লী খিক খিক করে হেসে বলল, শেষ পর্যন্ত জোর করে নিজেকে সত্যবাদী তৈরি করে নিলে? হ্যাঁ। অনেকটা সেরকম। বুড়ো লী ভাসমান খাবার এবং পানীয়ের বোতলগুলি নিজের কাছে ধরে রাখতে রাখতে বলল, এসো, আমাদের বিদায়ের সময়টা স্মরণীয় করে রাখা যাক, অনেকদিন থেকে এই খাবারগুলি বাঁচিয়ে রেখেছি বিশেষ কোনো মুহূর্তের জন্যে। আমি এবং লেন কোনো কথা বললাম না। লী সাবধানে বোতলের মুখ খুলে এক ঢোক পানীয় খেয়ে কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন আমরা ডকিং স্টেশনে এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পেলাম। বুড়ো লী মুখ মুছে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ওরা এসে গেছে। ঘরটির একপাশে চতুষ্কোন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটি নিজে নিজে চালু হয়ে গেল এবং আমরা দেখতে পেলাম একটি ভাসমান যান স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভেতর থেকে দশটি নানা আকারের রবোট বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি রবোটের পায়ের নিচে থেকে এক ধরনের জেট বের হচ্ছে, ভরশূন্য পরিবেশে স্বচ্ছন্দে চলাচল করার জন্যে এই রবোটগুলি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসেছে। বাই ভার্বালের সবচেয়ে শেষ আরোহী সোনালি চুলের একটি মেয়ে। তার পিঠে একটি জেট প্যাক বাধা, হাতে ভয়ংকর দর্শন একটি অস্ত্র। বুড়ো লী হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিহা বল। রোবট আর মানুষের এই দলটি এখানে প্রবেশ করার আগে তোমাদের একটা কখা বলতে চাই। কী কথা? বহুঁ বহুকাল আগে পৃথিবীতে বঙ্গোপসাগরের উপকুলে এক বুদ্ধিমান জাতি দাবা নামে একটা খেলা আবিষ্কার করেছিল। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে আটটি করে মোট চৌষট্টি ঘরের দুকে ষোলটি সাদা এবং মোলটি কাল গুটি নিয়ে খেলা হত। সেই খেলায় আমি জানি। আমি সেই খেলা খেলেছি। চমৎকার। বহুঁ প্রাচীন কালে হিসাব নিকাশ করার জন্যে কম্পিউটার নামক একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল, মানুষ সেই কম্পিউটারে দাবা খেলা শুরু করেছিল। এখনো তথ্য প্রক্রিয়ার যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেখানেও দাবা খেলা হয়। এই সব যন্ত্রপাতি মানুষ থেকে হাজারগুণ কী লক্ষগুণ বেশি দক্ষতা নিয়ে দাবা। খেলতে পারে। তোমার কী মনে হয় এইসব যন্ত্রপাতিক দাবা খেলায় হারানো সম্ভব? সম্ভব।
false
bongkim
উহার যাহা ছিল, তাহা পাইয়াছি। এখন উহাকে ছাড়িয়া দে |” আর একজন দস্যু বলিল, “ছাড়িয়া দেওয়া যাইবে না। ব্রাহ্মণ তাহা হইলে এখনই একটা গোলযোগ করিবে। আজকাল রাণা রাজসিংহের বড় দৌরাত্ম্য–তাঁহার শাসনে বীরপুরুষে আর অন্ন করিয়া খাইতে পারে না। উহাকে এই গাছে বাঁধিয়া রাখিয়া যাই |” এই বলিয়া দস্যুগণ মিশ্র ঠাকুরের হস্ত পদ এবং মুখ তাঁহার পরিধেয় বস্ত্রে দৃঢ়তর বাঁধিয়া, পার্বদতের সানুদেশস্থিত একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষের কাণ্ডের সহিত বাঁধিল। পরে চঞ্চলকুমারীদত্ত রত্নবলয় ও পত্র প্রভৃতি লইয়া ক্ষুদ্র নদীর তীরবর্তীক পথ অবলম্বন করিয়া পার্বকতন্তরালে অদৃশ্য হইল। সেই সময়ে পার্বততের উপরে দাঁড়াইয়া একজন অশ্বারোহী তাহাদিগকে দেখিল। তাহারা, অশ্বারোহীকে দেখিতে পাইল না, পলায়নে ব্যস্ত। দস্যুগণ পার্ব তীয়া প্রবাহিণীর তটবর্তীন বনমধ্যে প্রবেশ করিয়া অতি দুর্গম ও মনুষ্যসমাগমশূন্য পথে চলিল। এইরূপ কিছু দূর গিয়া, এক নিভৃত গুহামধ্যে প্রবেশ করিল। গুহার ভিতর খাদ্যদ্রব্য, শয্যা, পাকের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত ছিল। দেখিয়া বোধ হয়, দস্যুগণ কখন কখন এই গুহামধ্যে লুকাইয়া বাস করে। এমন কি, কলসীপূর্ণ জল পর্যরন্ত ছিল। দস্যুগণ সেইখানে উপস্থিত হইয়া তামাকু সাজিয়া খাইতে লাগিল এবং একজন পাকের উদ্যোগ করিতে লাগিল। একজন বলিল, “মাণিকলাল, রসুই পরে হইবে। প্রথমে মালের কি ব্যবস্থা হইবে, তাহার মীমাংসা করা যাউক |” মাণিকলাল বলিল, “মালের কথাই আগে হউক |” তখন আশরফি কয়টি কাটিয়া চারি ভাগ করিল। এক এক জন এক এক ভাগ লইল। রত্নবলয় বিক্রয় না হইলে ভাগ হইতে পারে না–তাহা সম্প্রতি অবিভক্ত রহিল। পত্র দুইখানি কি করা যাইবে, তাহার মীমাংসা হইতে লাগিল। দলপতি বলিলেন, “কাগজে আর কি হইবে–উহা পোড়াইয়া ফেল |” এই বলিয়া পত্র দুইখানি সে মাণিকলালকে অগ্নিদেবকে সমর্পণ করিবার জন্য দিল। মাণিকলাল কিছু কিছু লিখিতে পড়িতে জানিত। সে পত্র দুইখানি আদ্যোপান্ত পড়িয়া আনন্দিত হইল। বলিল, “এ পত্র নষ্ট করা হইবে না। ইহাতে রোজগার হইতে পারে |” “কি? কি?” বলিয়া আর তিন জন গোলযোগ করিয়া উঠিল। মাণিকলাল তখন চঞ্চলকুমারীর পত্রের বৃত্তান্ত তাহাদিগকে সবিস্তারে বুঝাইয়া দিল। শুনিয়া চৌরেরা বড় আনন্দিত হইল। মাণিকলাল বলিল, “দেখ, এই পত্র রাণাকে দিলে কিছু পুরস্কার পাইব |” দলপতি বলিল, “নির্বোখধ! রাণা যখন জিজ্ঞাসা করিবে, তোমরা এ পত্র কোথায় পাইলে, তখন কি উত্তর দিবে? তখন কি বলিবে যে, আমরা রাহাজানি করিয়া পাইয়াছি? রাণার কাছে পুরস্কারের মধ্যে প্রাণদণ্ড হইবে। তাহা নহে–এ পত্র লইয়া গিয়া বাদশাহকে দিব–বাদশাহের কাছে এরূপ সন্ধান দিতে পারিলে অনেক পুরস্কার পাওয়া যায়, আমি জানি। আর ইহাতে__” দলপতি কথা সমাপ্ত করিতে অবকাশ পাইল না। কথা মুখে থাকিতে থাকিতে তাহার মস্তক স্কন্ধ হইতে বিচ্যুত হইয়া ভূতলে পড়িল। চতুর্থ পরিচ্ছেদ : মাণিকলাল অশ্বারোহী পার্বাতের উপর হইতে দেখিল, চারি জনে একজনকে বাঁধিয়া রাখিয়া চলিয়া গেল। আগে কি হইয়াছে, তাহা সে দেখে নাই, তখন সে পৌঁছে নাই। অশ্বারোহী নি:শব্দে লক্ষ্য করিতে লাগিল, উহারা কোন্ পথে যায়। তাহারা যখন নদীর বাঁক ফিরিয়া পার্ববতন্তরালে অদৃশ্য হইল, তখন অশ্বারোহী অশ্ব হইতে নামিল। পরে অশ্বের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল, “বিজয়! এখানে থাকিও–আমি আসিতেছি–কোন শব্দ করিও না |” অশ্ব স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার আরোহী পাদচারে অতি দ্রুতবেগে পর্বতত হইতে অবতরণ করিলেন। পর্বলত যে বড় উচ্চ নহে, তাহা পূর্বে ই বলা হইয়াছে। অশ্বারোহী পদব্রজে মিশ্র ঠাকুরের কাছে আসিয়া তাঁহাকে বন্ধন হইতে মুক্ত করিলেন। মুক্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে, অল্প কথায় বলুন |” মিশ্র বলিলেন, “চারি জনের সঙ্গে আমি একত্র আসিতেছিলাম। তাহাদের চিনি না–পথের আলাপ; তাহারা বলে ‘আমরা বণিক |’ এইখানে আসিয়া তাহারা মারিয়া ধরিয়া আমার যাহা কিছু ছিল, কাড়িয়া লইয়া গিয়াছে |” প্রশ্নকর্তাা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি কি লইয়া গিয়াছে?” ব্রাহ্মণ বলিল, “একগাছি মুক্তার বালা, কয়টি আশরফি, দুইখানি পত্র |” প্রশ্নকর্তাি বলিলেন, “আপনি এইখানে থাকুন। উহারা কোন্ দিকে গেল, আমি দেখিয়া আসি |” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আপনি যাইবেন কি প্রকারে? তাহারা চারি জন, আপনি একা |” আগন্তুক বলিল, “দেখিতেছেন না, আমি রাজপুত সৈনিক |” অনন্ত মিশ্র দেখিলেন, এই ব্যক্তি যুদ্ধব্যবসায়ী বটে। তাহারা কোমরে তরবারি এবং পিস্তল, এবং হস্তে বর্শা। তিনি ভয়ে আর কথা কহিলেন না। রাজপুত, যে পথে দস্যুগণকে যাইতে দেখিয়াছিলেন, সেই পথে, অতি সাবধানে তাহাদিগের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বনমধ্যে আসিয়া আর পথ পাইলেন না, অথবা দস্যুদিগের কোন নিদর্শন পাইলেন না। তখন রাজপুত আবার পর্ব তের শিখরদেশে আরোহণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ ইতস্তত: দৃষ্টি করিতে করিতে দেখিলেন যে, দূরে বনের ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, চারি জনে যাইতেছে। সেইখানে কিছুক্ষণ অবস্থিতি করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ইহারা কোথায় যায়। দেখিলেন, কিছু পরে উহারা একটা পাহাড়ের তলদেশে গেল, তাহার পর উহাদের আর দেখা গেল না। তখন রাজপুত সিদ্ধান্ত করিলেন যে, উহারা হয় ঐখানে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে–বৃক্ষাদির জন্য দেখা যাইতেছে না; নয়, ঐ পর্ব ততলে একটি গুহা আছে। গুহামধ্যে মনুষ্যের কথাবার্তা শুনিতে পাইলেন। এই পর্যতন্ত আসিয়া রাজপুত কিছু ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। উহারা চারি জন–তিনি একা; এক্ষণে গুহামধ্যে প্রবেশ করা উচিত কি না? যদি গুহাদ্বার রোধ করিয়া উহারা চারি জনে তাঁহার সঙ্গে সংগ্রাম করে, তবে তাঁহার বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এ কথা রাজপুতের মনে বড় অধিকক্ষণ স্থান পাইল না–মৃত্যুভয় আবার ভয় কি? মৃত্যুভয়ে রাজপুত কোন কার্যর হইতে বিরত হয় না। কিন্তু দ্বিতীয় কথা এই যে, তিনি গুহামধ্যে প্রবেশ করিলেই তাঁহার হস্তে দুই একজন অবশ্য মরিবে;
false
manik_bandhopaddhay
বৈষ্ণব–ভক্তিমোর্গ পোষাল না। এবার তাই জোরালো সাধনা ধরেছি। বাবা বলেন।–’ ‘বাবা কে?’ ‘আমার গুরুদেব। শ্ৰীমৎ স্বামী মশালবাবা!–নাম শোন নি? দিবারাত্রি মশাল জ্বেলে সাধন করেন।’ মালতী যুক্ত কর কপালে ঠেকাল। আনন্দ বলল, ‘কারণ খাওয়া যদি ধর্ম মা, আমি সেদিন একটু খেতে চাইলাম বলে মারতে উঠেছিলে কেন? কাল থেকে আমিও পেট ভরে ধর্ম করব মা।’ হেরম্ব ভাবে : আনন্দ একথা বলল কেন? সে কারণ খায় না। আমাকে এ কথা শোনাবার জন্যে? মালতী বলল, ‘করেই দেখিস!’ ‘তুমি কর কেন?’ ‘আমার ধর্ম করবার বয়স হয়েছে। তুই একরাত্তি মেয়ে, তোর ধর্ম আলাদা। আমার মতো বয়স হলে তখন তুই এসব ধর্ম করবি, এখন কি? যে বয়সের যা। তুই নাচিস্, আমি নাচি?’ আনন্দ হেসে বলল, ‘নেচো না, নোচে। নাচতে তো বাপু একদিন। এখনো এক একদিন বেশি করে কারণ খেলে যে নাচটাই নাচো-’ ‘তোর মতো বেয়াদব মেয়ে সংসারে নেই আনন্দ!’ মালতীর পরিবর্তন হেরম্ব বুঝতে পারছিল না। সে মোটা হয়েছে, তার কণ্ঠ কৰ্কশ, তার কথায় ব্যবহারে কেমন একটা নিলাজ রুক্ষতার ভাব। আনন্দের মধ্যস্থতা না থাকলে মালতীর মধ্যে সত্যবাবুর মেয়ের কোনো চিহ্নই খুঁজে না পেয়ে হেরম্ব হয়তো আজ আরো একটু বুড়ো, আরো একটু বিষাদগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। কুড়ি বছরের পুরোনো গৃহত্যাগের ব্যাপারটার উল্লেখ মালতী নিজে থেকেই করেছিল, দ্বিধা করে নি, লজ্জা পায় নি। এটা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে দশ বছরের মধ্যে একদিনের লজ্জাতুরা নববধূ যদি সকলের সামনে স্বামীকে বাজারের ফর্দ দিতে পারে, মালতীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা কুড়ি বছর পরে তুচ্ছ হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। কিন্তু তার, পরিচয় পাবার পরেও কারণ না এনে দেবার জন্য অনাথকে সে তো অনুযোগ পর্যন্ত করেছিল! আনন্দের সঙ্গে তর্ক করে মদকে কারণ নাম দিয়ে ধর্মের নামে নিজেকে সমর্থন করতেও তার বাধে নি। মালতী এভাবে বদলে গিয়েছে কেন? তার ছেলেবেলার রূপকথার অনাথ আজো তেমনি আছে, মালতীকে এভাবে বদলে দিল কিসে? আনন্দ আর একবারও হেরম্বের দিকে তাকায় নি। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে তাকে না দেখে হেরম্বের উপায় ছিল না। ওর সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা তার মনে এসেছে যে, মালতীর পরিবর্তন যদি বেশি। দিনের হয় আনন্দের চরিত্রে হয়তো ছাপা পড়েছে। আনন্দের কথা শুনে, হাসি দেখে, মালতীর দেহ দিয়ে নিজেকে অর্ধেক আড়াল করে ওর বসবার ভঙ্গি দেখে মনে হয় বটে যে, সত্যবাবুর মেয়ের মধ্যে যেটুকু অপূর্ব ছিল, যতখানি গুণ ছিল, শুধু সেইটুকুই সে নকল করেছে; মালতীর নিজের অর্জিত অমার্জিত রুক্ষতা তাকে স্পর্শ করে নি। কিন্তু সেইসঙ্গে এই কথাটাও ভোলা যায় না যে, যে আবহাওয়া মালতীকে এমন করেছে আনন্দকে তা একেবারে রেহাই দিয়েছে। মালতীর উপর হেরম্বের রাগ হতে থাকে। এমন মেয়ে পেয়েও তার মা হয়ে থাকতে না পারার অপরাধের মার্জনা নেই। মালতী আর যাই করে থাক হেরম্ব বিনা বিচারে তাকে ক্ষমা করতে রাজি আছে, মদ খেয়ে ইতিমধ্যে সে যদি নরহত্যাও করে থাকে। সে চোখ-কান বুজে তাও সমর্থন করবে। কিন্তু মা হয়ে আনন্দকে সে যদি মাটি করে দিয়ে থাকে, হেরম্ব কোনোদিন তাকে মার্জনা করবে না। খানিক পরে অনাথ বেরিয়ে এল। স্নান সমাপ্ত করে এসেছে। ‘আমার আসন কোথায় রেখেছি মালতী?’ মালতী বলল, ‘জানি না। হ্যাঁগা, স্নান যদি করলে আরতিটা আজ তুমিই করে ফেল না? বড় আলসেমি লাগছে আমার।’ অনাথ বলল, ‘আমি এখুনি আসনে বসব। আরতির জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না।’ ‘একজনকে বাড়িতে ডেকে এনে এমন নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারলে আসনে বসব? কে তোমার অতিথিকে আদর করবে শুনি? স্বার্থপর আর কাকে বলে! সন্ধ্যা হতেই-বা। আর দেরি কত, এ্যাঁ?’ অনাথ তার কথা কানে তুলল না। এবার আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার আসন কে সরিয়েছে আনন্দ?’ ‘আমি তো জানিনে বাবা?’ অনাথ শান্তভাবেই মালতীকে বলল, ‘আসনটা কোথায় লুকিয়েছ, বার করে দাও মালতী। আসন কখনো সরাতে নেই এটা তোমার মনে রাখা উচিত ছিল।‘ মালতী বলল, ‘তুমি অমন কর কেন বল তো? বোস না। এখানে—একটু গল্পগুজব কর! এতকাল পরে হেরম্ব এসেছে, দুদণ্ড বসে কথা না কইলে অপমান করা হবে না?’ হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলতে গেল, ‘আমি —’ কিন্তু মালতী তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমাদের ঘরোয়া কথায় তুমি কথা কয়ো না হেরম্ব।’ হেরম্ব আহত ও আশ্চর্য হয়ে চুপ করে গেল। অনাথ তার বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, ‘আমি অপমান করব কল্পনা করে তুমি নিজেই যে অপমান করে বসলে মালতী! কিছু মনে কোরো না হেরম্ব। ওর কথাবার্তা আজকাল এরকমই দাঁড়িয়েছে।‘ হেরম্ব বলল, মনে করার কি আছে!’ মালতীর মুখ দেখে হেরম্বের মনে হল তাকে সমালোচনা করে এভাবে অতিথিকে মান না। দিলেই অনাথ ভালো করত। অনাথ বলল, ‘আমার চাদরটা কোথায় রে আনন্দ?’ ‘আলিনায় আছে–মার ঘরে! এনে দেব?’ ‘থাক। আমিই নিচ্ছি গিয়ে। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ হল না বলে অনাদর মনে করে নিও না হেরম্বা। আমার মনটা আজ একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে। আসনে না বসলে স্বস্তি পাব না।?’ হেরম্ব বলল, ‘তা হোক মাস্টারমশায়! আর একদিন কথাবার্তা হবে।‘ মালতী মুখ গোঁজ করে বসেছিল। এইবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাদর দিয়ে হবে কি?’ অনাথ বলল, ‘পেতে আসন করব। আসনটা লুকিয়ে তুমি ভালোই করেছ মালতী। দশ বছর ধরে ব্যবহার করে আসনটাতে কেমন একটু মায়া বসে গিয়েছে। একটা জড় বস্তুকে মায়া করা থেকে তোমার দয়াতে উদ্ধার পেলাম।’
false
humayun_ahmed
স্মার্ট মেয়ে হিসেবে লীনার বলা উচিত ছিল— স্যার চলুন আমরা একটা ক্যাব নিয়ে চলে যাই। তা না বলে সে ঢোঁক গিলছে। ঢোঁক গেলার মত প্রশ্ন তো না। পি এ-র প্রধান দায়িত্ব বসের মেজাজের দিকে লক্ষ্য রাখা। তার সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা করা। তা না করে সে খাতাপত্র নিয়ে জড়ভরতের মতো বসে আছে। হাসান বলল, লীনা কটা বাজে দেখ তো। লীনা আবারো ঢোঁক গিলল। তার হাতে ঘড়ি নেই। সবদিন ঘড়ি থাকে, শুধু আজই নেই। ঘড়ি পরতে ভুলে গেছে। সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠেছে তখন তার মা দোতলার বারান্দায় এসে বলেছেন, লীনা তুই ঘড়ি ফেলে গেছিস। লীনা বলেছে, থাক লাগবে না। এটা না করে সে যদি রিকশা থেকে নেমে ঘড়িটা নিয়ে আসত। তাহলে সময় বলতে পারত। হাসান বলল, তোমার ঘড়ি নেই? না স্যার। ঘড়ি কিনে নাও না কেন? ঘড়ি ছাড়া কি চলে। এই সময়ে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘড়ি দেখতে হয়। ঘড়ি তো এখন সস্তা। তিনশ চারশ টাকায় সুন্দর সুন্দর ঘড়ি পাওয়া যায়। লীনা চুপ করে রইল। তার বলা উচিত ছিল, স্যার আমার ঘড়ি আছে। আজ তাড়াহুড়া করে অফিসে এসেছি বলে ঘড়ি আনতে ভুলে গেছি। এইসব কিছু না বলে সে মনে মনে ইয়া মুকাদ্দেমু, ইয়া মুকাদ্দেমু পড়ছে। বিপদে পড়লে আল্লাহর এই নাম জপলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। তারা তো এখন বিপদেই পড়েছে। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি আটকে আছে। অন্য কোনো সময় হলে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তেমন বিপদজনক হত না। কয়েকজন টোকাই এনে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গ্যারাজে নিয়ে যাওয়া যেত। আজকের ঘটনা অন্য, ইয়াকুব সাহেবের অফিস থেকে বলা হয়েছে— পাঁচটা থেকে দুটার মধ্যে আসতে হবে। এই সময়ের মধ্যে এলেই স্যারের সঙ্গে দেখা হবে। ইয়াকুব সাহেবের কাছ থেকে বড় একটা কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা। কাজটা পাওয়া খুব দরকার। লীনাদের আফিসে গতমাসে হাফ-বেতন হয়েছে। এই মাসে হয়তো বেতনই হবে না। হাসান স্যারের দিকে তাকালে লীনার খুবই মায়া লাগে। মানুষটা চারদিক থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। গত তিনমাস অফিসের ভাড়া দেয়া হয়নি। ইলেকট্রিসিটি বিল দেয়া হয়নি। টেলিফোন বিল দেয়া হয়নি। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে লীনা প্রথম যে-কাজটা করে তা হল টেলিফোন রিসিভারটা তুলে কানে দেয়। ডায়েল-টোন আছে কি-না তার পরীক্ষা। ডায়াল-টোন থাকা মানে– অফিস এখনো বেঁচে আছে। লীনা! জ্বি স্যার। কী করা যায় বল। লীনা কী বলবে? তার মাথায় কিছুই আসছে না। তার এই ভেবে খারাপ লাগছে যে মানুষটাকে সে সাহায্য করতে পারছে না। চল গাড়ি ফেলে রেখে বেবীটেক্সি নিয়ে চলে যাই। এর উত্তরেও লীনা কিছু বলতে পারল না। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি ফেলে গেলে কী হয় কে জানে। গাড়ির মালিকদেরই এটা ভালো জানার কথা। লীনাদের গাড়ি নেই। তার কোনো আত্মীয়স্বজনদেরও গাড়ি নেই। লীনার ছোটমামী একবার একটা পুরনো ট্রাক কিনেছিলেন। কথা ছিল তিনি সবাইকে ট্রাকে নিয়ে সাভার যাবেন। সেষ্টা হয়নি। কারণ ট্রাক কেনার সাতদিনের মাথায় এক্সিডেন্ট করে সেই ট্রাক একটা মানুষ মেরে ফেলল। ছোটমামা ট্রাক বিক্রি করে দিলেন। লীনা? জি স্যার। শেষ চেষ্টা করে দেখি। গাড়ি ঠেলতে হবে। পারবে না? পারব স্যার। তুমি একী পারবে না। আরো কয়েকজন জোগাড় কর। লীনা লোক জোগাড় করার জন্যে ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়ে রিকশার ধাক্কা খেয়ে হাত কেটে ফেলল। টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু লীনা খুবই আনন্দিত যে এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা স্যার দেখেননি। তিনি গাড়ির বনেট খুলে কী যেন করছেন। স্যার ব্যাপারটা দেখলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। লীনা কাকে বলবে গাড়ি ঠেলতে? আর বলবেই বা কীভাবে? ভাই আমাদের গাড়িটা একটু ঠেলে দেবেন? কোন ধরনের লোকদের এই কথা বলা যায়? লীনা আবারো ইয়া মুকাদ্দেমু পড়তে লাগলো। তারা মতিঝিলে পৌঁছল ছটা সতেরো মিনিটে। সেক্রেটারি টাইপ এক লোক শুকনো মুখে বলল, আপনাদের তো পাঁচটার মধ্যে আসার কথা। হাসান বলল, দেখতেই পাচ্ছেন, কথামতো আসতে পারিনি। স্যার কি আছেন না চলে গেছেন? স্যার আছেন। তবে সময়ের পর স্যার কথা বলেন না। কথা বলেন না কেন–গলায় কোনো প্রবলেম? কথা বলতে কষ্ট হয়? ফেরেনজাইটিস? সেক্রেটারি রাগীচোখে তাকিয়ে আছে। লীনা অনেক কষ্টে হাসি চেপে আছে। বেশিক্ষণ হাসি চাপতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। অথচ এখন তার হাসির সময় না। কাজটা তারা পাচ্ছে না। সেক্রেটারি লীনার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন যদি তিনি লীনার হাসি দেখে ফেলে তাহলে খুব সমস্যা হবে। লীনা অফিসঘর দেখতে লাগল। কী সুন্দর সাজানো অফিস। সবকিছু ঝকঝক করছে। একেক জনের বসার জায়গা কাচ দিয়ে ঘেরা। প্রত্যেকের সামনে একটা করে কম্পিউটার এরকম একটা কাচের ঘর যদি লীনার থাকত। হাসান তার পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, আপনাদের এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়? সেক্রেটারি বলল, না। সিগারেট খেতে হলে বারান্দায় গিয়ে খেতে হবে। আপনাদের বস ইয়াকুব সাহেব তো সিগারেট খান। তিনিও কি বারান্দায় গিয়ে খান? আপনি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছেন কেন? হাসান বলল, আমি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছি কারণ আমরা একই গোত্রের। উনি একটা কোম্পানির মালিক, আমিও একটা কোম্পানির মালিক। যত ছোট কোম্পানি, হোক না কেন আমি মালিক তো বটেই। দ্বিতীয় যুক্তি আরো কঠিন—— আমরা দুজনই হমোসেপিয়ান। মানবসম্প্রদায়ের সদস্য। এমন না যে উনি মানুষ আর আমি মানুষ। লীনা হাসি চেপে রাখতে পারল না। তার এত আনন্দ লাগছে।
false
humayun_ahmed
ঘাম জমল। এর মানে কী? তিনি কি মারা যাচ্ছেন? দরজার বাইরে কি আজরাইল এসে দাঁড়িয়েছে? আজরাইলের চেহারা দেখতে কেমন? সবার ধারণা তার চেহারা হবে কুৎসতি। কিন্তু তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজরাইল হবে সুপুরুষ যুবা। আজরাইল হচ্ছে ফেরেশতা। তাঁকে আল্লাহ কেন কুৎসিত করে বানাবেন? কোমরের কাছে ব্যথার মত হচ্ছিল। সুচ ফুটানোর মত ব্যথা। ব্যথাটা দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। হাত-পা অসাড় হয় গেল। যেন কয়েকজন মিলে একটা শীতল ভারী পাথর পায়ের উপর দিয়ে দিয়েছে। এই পাথর নাড়ানোর সাধ্য তার নেই। মৃত্যু কি এ রকম? শরীরে পাথর বসানো দিয়ে এর শুরু? প্রচণ্ড ভারী একটা পাথর পায়ের উপর নিয়েই তিনি কাত অবস্থা থেকে চিৎ হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় পাথরটা গড়িয়ে পড়ে যাবার কথা। তা পড়ে নি। বরং পাথরটা আরো ভালমত বসেছে। তাঁর মন বলছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা ভারী পাথর তাঁর বুকের উপর দিয়ে দেয়া হবে। তিনি বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন। বুকের উপর ভারী পাথরের কারণে তা পারবেন না। তিনি যতই নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন পাথর ততই চেপে বসবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর মৃত্যু হবার কথা না। ভাই পাগলা পীর তাকে স্পষ্ট করে বলেছে— তোর মৃত্যু একসিডেনে। একসিডেন মানে এক্সিডেন্ট। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রকম এক্সিডেন্ট? রোড এক্সিডেন্ট না অন্য কিছু? ভাই পাগলা পীর মিচিকি মিচিকি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অন্য কিছু। অনেক রক্ত বাইর হইব বুঝছস। রুক্তের মইধ্যে তুই সিনান করবি। মোতাহার সাহেব চিন্তিত এবং ভীত গলায় বলেছিলেন, হুজ্বর আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। ভাই পাগলা পীর পিচ করে একদলী থুথু ফেলে বললেন, দূর ব্যাটা আমি দেয়া করি না। আর দোয়া কইরা কোনো ফয়দা নাই। আল্লাহপাক তাঁর চিকন কলম দিয়া তোর কপালে যা লেখছেন। তাই হইব। তোর কপালে যদি লেখা থাকে মিত্যুর আগে গরম রক্ত দিয়া সিনান, তাইলে তাই হইব। দোয়া না করলেও হইব। করলেও হইব। খামাখা সময় নষ্ট কইরা ফয়দা কী? ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। তিনি মারা যাচ্ছেন। কাজেই তিনি পীর সাহেবকে গিয়ে বলতে পারবেন না— হুজ্বর আপনের কথা সত্য হয় নাই। আমার মৃত্যু হয়েছে বিছানায়। সবাই বলে ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা কখনো মিথ্যা হয় না। এইবার কেন হচ্ছে? তাঁর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। তিনি এই তৃষ্ণাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন। মৃত্যুর আগে আগে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার মত হয়, কিন্তু তখন পানি খাওয়া যায় না। পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, পানি তিতা লাগে। মোতাহার সাহেব তাঁর স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। একজন ডাক্তার ডাকা দরকার। হাসপাতালে তাকে নেবার প্রয়োজন হতে পারে। ড্রাইভার কি আছে? এই ড্রাইভারের চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। রাতে তার একতলায় কোণার ঘরষ্টীয় শুয়ে ঘুমানোর কথা। তিনি খবর পেয়েছেন প্রায়ই সে তা করে না। বাইরে রাত কাটিয়ে ফজরের নামাজের সময় উপস্থিত হয়। আজও হয়ত সে নেই। হাসপাতালে তিনি যেতে চান না। তাঁদের পরিবারের একটা ধারা আছে। এই পরিবারের মানুষ যদি হাসপাতালে যায় তাহলে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে না। মোতাহার সাহেবের বাবা ফিরেন নি। তাঁর বড় ভাই ফিরেন নি। কাজেই হাসপাতালে যদি যেতেই হয় কিছু জরুরি কথা ফিসফিস করে হলেও বলে যেতে হবে। শুভ্ৰকে একটা কথা বলা দরকার। শুভ্ৰ যেন তার উপর রাগ না। করে। তাকে ঘৃণা না করে। সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পুত্র এবং কন্যার ঘৃণা সহ্য করা যায় না। যে ব্যক্তিকে তাহার পুত্র এবং কন্যা ঘৃণা করে দোজখের অগ্নিও তাহাকে ঘৃণা করে। কথাটা কে বলেছে? কার কাছ থেকে শুনেছেন? ভাই পাগলা পীর সাহেবের কাছ থেকে? ভাই পাগলা পীর সাহেব মজার মজার কথা বলেন। দোজখের প্রসঙ্গে বলতেন— দূর ব্যাটা। দোজখের আগুন দোজখের আগুন। সব দোজখে আগুন আছে না-কি? আগুন নাই এমন দোজখও আছে। ঠাণ্ডী দোজখ। বড়ই ঠাণ্ডা। সেই দোজখের নাম জাহীম। বড়ই ভয়ংকর সেই ঠাণ্ডা দোজখ। জাহিম দোজখবাসী চিৎকার কইরা কী বলে জানস? বলে ওগো দয়াল আল্লা। দয়া করি আমারে কোনো আগুনের দোজখে নিয়া পুড়াও । মোতাহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে ভাই পাগলা পীর বলেছিলেন- দোজখের নামগুলি মুখস্ত করে রাখ, তুইতো সেইখানেই যাবি। হি-হি হি। আশ্চর্যের ব্যাপার সাতটা দোজখের নাম তাঁর ঠিকই জানা–জাহান্নাম, হাবিয়া, সাক্কার, হুতমাহ, সায়ীর, জাহীম, লাজা। বেহেশতের নামগুলির মধ্যের শুধু দুটার নাম জানেন- জান্নাতুল ফেরদাউস এবং জান্নাতুল মাওয়া। মোতাহার সাহেবের উপর আরেকটা ভারী পাথর চাপানো হয়েছে। এই পাথর আগেরটার মত না। এর ওজন বাড়ে কমে। যখন কমে তখন মনে হয়— ওজনহীন একটা পাথর বুকে নিয়ে থাকা কতই না আনন্দের। মোতাহার সাহেব লক্ষ করলেন জাহানারা ঘরে ঢুকছেন। জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে কফির মগ। শোবার আগে তিনি মগ ভর্তি কফি খান। এই অভ্যাস আগে ছিল না। কোন পত্রিকায় পড়েছেন যাদের অনিদ্রা রোগ আছে, শোবার আগে কফি খেলে তাদের সুনিদ্রা হয়। জাহানারার অনিদ্রা রোগ আছে। মােতাহার সাহেবের মনে হল তাঁর মৃত্যুর পর জাহানারার অনিদ্রা রোগ সেরে যাবে। বিছানায় যাবার আগে তাকে গোসল করতে হবে না। তিনটা চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে না, মগ ভর্তি কফি খেতে হবে না। কফির গন্ধ মোতাহার সাহেবের নাকে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রবল কষ্টের মধ্যেও গন্ধটা ভাল লাগছে। ইশ
false
humayun_ahmed
তো কেউ জানতে চায় না। তারপরেও বলতাম। কিন্তু দেখি মেয়ে আর মেয়ের মা দুই জনই খুশিতে বাকবাকুম। তাঁর গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো খানিকটা ঢাললেন। আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, এটা পঞ্চম পেগ। আমার লিমিট হচ্ছে সাত। সাতের পর লজিক এলোমেলো হয়ে যায়। সাতের আগে কিছুই হয় না। আমি বললাম, ফুপা এক মিনিট। আমি টেলিফোনটা রিনকির ঘরে দিয়ে আসি। ও কোথায় যেন টেলিফোন করবে। ফুপা মুখ বিকৃত করে বললেন, কোথায় করবে বুঝতে পারছ না? ঐ মার্বেলের কাছে করবে। টেলিফোন করে করে অস্থির করে তুলল। আমি রিনকিকে টেলিফোন দিয়ে এসে বললাম, আপনি কী জানি জরুরি কথা বলবেন। ও হ্যাঁ জরুরি কথা, বাদল সম্পর্কে। জি বলুন। ও তোমাকে কেমন অনুকরণ করে সেটা লক্ষ্য করেছ? তুমি তোমার মুখে দাড়িগোঁফের চাষ করছ–কর। সেও তোমার পথ ধরেছে। আজ তুমি হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে এসেছ, আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি, কাল দুপুরের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবি কিনবে। আমি কি ভুল বললাম? না, ভুল বলেন নি। তুমি যদি মাথা কামাও , আমি সিওর ব্যাটা কাল মাথা কামিয়ে ফেলবে। এরকম প্রভাব তুমি কী করে ফেললে আমাকে বল। . আমার জানা নেই ফুপা। ভুলটা আমার। মেট্রিক পাস করে তুমি যখন এলে আমি ভালোমনে বললাম, আচ্ছা থাকুক। মা-বাপ নেই–ছেলে একটা আশ্রয় পাক। তুমি-যে এই সর্বনাশ করবে তাতো বুঝি নি ! বুঝতে পারলে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম। আমি জেনেশুনে কিছু করি নি। তাও ঠিক । জেনেশুনে তুমি কিছু করনি। আই ডু এগ্রি। তোমার লাইফস্টাইল তাকে আকর্ষণ করেছে। তুমি ভ্যাগাবন্ড না অথচ তুমি ভাব কর যে তুমি ভ্যাগান্ড। জোছনা দেখানোর জন্যে চন্দ্রায় এক জঙ্গলের মধ্যে বাদলকে নিয়ে গেলে। সারারাত ফেরার নাম নেই। জোছনা কি এমন জিনিস যে জঙ্গলে বসে দেখতে হবে? বল তুমি। তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই। শহরের আলোয় জোছনা ঠিক বোঝা যায় না। মানলাম তোমার কথা। ভালো কথা, চন্দ্রায় গিয়ে জোছনা দেখ। তাই বলে সারারাত বসে থাকতে হবে? রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোছনা কীভবে বদলে যায় সেটাও একটা দেখার মত ব্যাপার। শেষরাতে পরিবেশ ভৌতিক হয়ে যায়। তাই নাকি? জি। তাছাড়া জঙ্গলের একটা আলাদা এফেক্ট আছে। শেষ রাতের দিকে গাছগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। তোমার কথা বুঝলাম না। গাছগুলো জীবন্ত হয় মানে? গাছ তো সব সময়ই জীবন্ত। জি-না। ওরা জীবন্ত, তবে সুপ্ত। খানিকটা জেগে ওঠে পূর্ণিমারাতে। তাও মধ্যরাতের পর থেকে। জঙ্গলে না গেলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। আপনি একবার চলুন-না নিজের চোখে দেখবেন। দিন-তিনেক পরেই পূর্ণিমা। দিন-তিনেক পরেই পূর্ণিমা? জি। এইসব হিসাব নিকাশ সবসময় তোমার কাছে থাকে? জি। একবার গেলে হয়। বলেই ফুপা গম্ভীর হয়ে গেলেন। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি আমাকে পর্যন্ত কনভিন্সড করে ফেলেছিলে। মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। অবশ্যি এটা সম্ভব হয়েছে নেশার ঘোরে থাকার জন্যে। তা ঠিক। কিছু মানুষ ধরেই নিয়েছে তারা যা ভাবছে তাই ঠিক। তাদের জগৎটাই একমাত্র সত্যি জগৎ। এরা রহস্য খুজবে না। এরা স্বপ্ন দেখবে না। চুপ কর তো। আমি চুপ করলাম। ফুপা রাগী-গলায় বললেন, তুমি ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরবে আর ভাববে বিরাট কাজ করে ফেলছ। তুমি যে অসুস্থ্ এটা তুমি জানো? ডাক্তার হিসেবে বলছি–তুমি অসুস্থ্। . ফুপা আপনি নিজেও কিন্তু অসুস্থ্ হয়ে পড়ছেন। বেশি খাচ্ছেন। আপনি বলছেন আপনার লিমিট সাত। আমার ধারণা এখন নয় চলছে। তোমার কাছে সিগারেট আছে? আছে। দাও। তিনি সিগারেট ধরালেন। খুকখুক করে কাশলেন। ফুপাকে আমি কখনও সিগারেট খেতে দেখি নি। তবে মদ্যপানের সঙ্গে সিগারেটের ঘনিষ্ট সর্ম্পক আছে এ রকম শুনেছি। হিমু। জি। রাস্তায় রাস্তায় ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে তুমি যদি আনন্দ পাও-তুমি অবশ্যি তা করতে পারো। . কিন্তু আমার ছেলেও তা করবে তাতো হয় না। ও কি তা করছে নাকি? এখনও শুরু করেনি। তবে করবে। দুই বছর তুমি ওর সঙ্গে ছিলে। একই ঘরে ঘুমিয়েছ। এই দুই বছরে তুমি ওর মাথাটা খেয়েছ। তুমি আর এ বাড়িতে আসবে না। জি আচ্ছা । আসব না। ঠিক আছে। এই বাড়ির ত্রিসীমানায় যদি তোমাকে দেখি তাহলে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল তুলে ফেলব। আপনার নেশা হয়ে গেছে ফুপা। পিটিয়ে ছাল তোলা যায় না। আপনার লজিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ফুপার সিগারেট নিভে গেছে। সিগারেটে অনভ্যস্ত লোকজন সিগারেটে আগুন বেশিক্ষণ ধরিয়ে রাখতে পারে না। আমি আবার তার সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। ফুপা বললেন, তোমাকে আমি একটা প্রপোজাল দিতে চাই । একসেপ্ট করবে কি করবে না ভেবে দেখ। কী প্রপোজাল? তোমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে চাই। . আমার হাতে একটা চাকরি আছে। আহামরি কিছু না। তবে তোমার চলে যাবে। বেতন কত? ঠিক জানি না। তিন হাজারের কম হবে না। বেশিও হতে পারে। তেমন সুবিধার চাকরি বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। ভিক্ষা করে জীবন যাপন করার চেয়ে কি ভালো না? না । ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। প্রাচীন ভারতের সাধু-সন্ন্যাসীদের সবাই ভিক্ষা করতেন। বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার একটা বড় অঙ্গ হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। এরা অবশ্যি ভিক্ষা বলে না। এরা বলে মাধুকরী। আমার কাছে লেকচার ঝাড়বে না। ফুপা আমি কি তাহলে উঠব? যাও ওঠ। শুধু একটা জিনিস বল–যে
false
shunil_gongopaddhay
আমরাও এগিয়ে গেলুম খানিকটা। প্রায় কুড়িজন পুলিশ মিলে বয়ে নিয়ে এল আটজন ঘুমন্ত বন্দীকে। আমি চমকে উঠলুম তাদের মধ্যে প্রথমেই সাধুবাবাকে দেখে। ধীরেনদা বললেন, ইশ, সাধুবাবা পর্যন্ত লোভ সামলাতে পারেননি? কাকাবাবু বললেন, ইনি আসল সাধুবাবা নন। আগের বার এসে দেখেছিলাম দুজন সাধুকে। ও ছিল চেলা। আসল বড় সাধুবাবা কাশীতে তীর্থ করতে গেছেন। পুলিশের অফিসার বললেন, আরও তিনজনকে চিনতে পারা গেছে। একজন মিউজিয়ামের দারোয়ান, একজন পুলিশের লোক, আর এই যে গোঁফওয়ালাটিকে দেখছেন, এ সেই কুখ্যাত ডাকাত রামকুমার পাধি, খুনগুলো সম্ভবত এই করেছে। ভোজালি দিয়ে মুণ্ডু কেটে ফেলা এর স্টাইল। ওর নামে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা আছে। কাকাবাবু বললেন, আর সবাইকেও চিনতে পারবেন ঠিকই। সবই এক জাতের পাখি। এদের একটু চাপ দিলেই জানতে পারবেন, কোথায় এরা সুন্দরলালের ছেলে প্ৰেমকিশোরকে আটকে রেখেছে। সম্ভবত প্ৰেমকিশোরের মুখ থেকেই এরা প্রথমে ব্যাপারটা জানতে পারে। তার কী সাঙ্ঘাতিক পরিণতি! পুলিশ অফিসারটি বললে, স্যার, আপনি যে অসাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে এরকমভাবে ওদের ধরতে আমাদের সাহায্য করবেন… কাকাবাবু সে-কথা না-শুনে মিংমার দিকে ফিরে বললেন, কই রে, তৈরি হল না এখনও? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। এখন ভাল করে এক কাপ চা খেতে চাই। দুপাশে ধুধু করা মাঠ, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। কোনও বাড়িঘর তো দেখাই যাচ্ছে না, মাঠে কোনওরকম ফসল নেই, গাছপালাও প্রায় নেই বলতে গেলে। অনেক দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। এই অঞ্চলটাকে ঠিক মরুভূমি বলা যায় না, ভাল বাংলাতে এইরকম জায়গাকেই বলে ঊষর প্রান্তর। রাস্তাটা অবশ্য বেশ সুন্দর, মসৃণ, কুচকুচে কালো যত্ন করে বাঁধানো। গাড়ি চলার কোনও ঝাঁকুনি নেই, রাস্তার দুপাশে কিছু দেখারও নেই, তাই সবারই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ি যে চালাচ্ছে, তাকে তো চোখ মেলে থাকতেই হবে, রঞ্জন সেইজন্য নস্যি নিচ্ছে মাঝে-মাঝে। আকাশে একটুও মেঘের চিহ্ন নেই, মধ্য গগনে গনগন করছে সূর্য। মাঝে-মাঝে দু-একটা লরি ছাড়া এ রাস্তায় গাড়ি চলাচলও নেই তেমন। সামনের সিটে বসে আছেন কাকাবাবু। চলন্ত গাড়িতেও তিনি বই পড়ছিলেন, একসময় হাত তুলে বললেন, খাবার জল আর আছে, না ফুরিয়ে গেছে? পেছনের সিটের মাঝখানে বসেছে রঞ্জনের স্ত্রী রিঙ্কু, তার দুপাশে জোজো আর সন্তু। দুজনেই জানলার ধার চেয়েছিল, কিন্তু এখন ঘুমে ঢুলছে। রিঙ্কু সোজা হয়ে জেগে বসে আছে, তার কোলের ওপর একটা ম্যাপ ছড়ানো। রঞ্জন এর আগে দু-তিনবার ভুল করে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, রিঙ্কুই। প্রত্যেকবার তাকে গাড়ি ঘোরাতে বলেছে। কাকাবাবুর কথা শুনে রিঙ্কু পায়ের কাছ থেকে ওয়াটার বলটা তুলে নেড়েচেড়ে বলল, শেষ হয়ে গেছে! আমাদের আরও দুটো-তিনটে জলের বোতল আনা উচিত ছিল। ওরা বেরিয়েছে বাঙ্গালোর থেকে খুব ভোরে। সেখানকার আবহাওয়া খুব সুন্দর, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, পথে যে এত গরম পড়বে সেকথা তখন মনে আসেনি। কাকাবাবু বললেন, একটা কোনও নদী-টদিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এদিকে। রঞ্জন বলল, এর পর যে পেট্রোল-পাম্প পড়বে, সেখানে আমরা জল খাব, গাড়িও জল-তেল খাবে। কাকাবাবু বললেন, এ-তল্লাটে কোনও পেট্রোল-পাম্প আছে কি? শুধুই তো মাঠের পর মাঠ দেখছি! রিঙ্কু বলল, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, আর ১৪ কি… না, না, দাঁড়ান, হিসেব করে বলছি, উ, ইয়ে, প্রায়, তিন ক্রোশ পরে একটা বড় জায়গা আসছে, এর নাম চিত্ৰদুগা! সেখানে গাড়ির পে.. মানে তেল আর খাবার-টাবার পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই! রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, তিন ক্রোশ? কতক্ষণ লাগবে, পনেরো মিনিটে মেরে দেব! তোমরা সবাই এরই মধ্যে এত ঝিমিয়ে পড়ছ কেন, চিয়ার আপ! সন্তু ঘুমজড়ানো গলায় বলল, রঞ্জনদা দুবার, কাকাবাবু এবার? রঞ্জন বলল, এই রে, বিচ্ছুটা সব শুনছে? আমি ভেবেছিলুম ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি! সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করে কী যেন লিখল, তারপর আবার চোখ বুজল। রঞ্জন বলল, আরে, এ-ছেলে দুটো এত ঘুমোয় কেন? আমরা কত ভাল-ভাল জিনিস দেখছি। সন্তু চোখ না খুলেই বলল, কিছু দেখার নেই। রঞ্জন বলল, একটু আগে রাস্তা দিয়ে দুটো ছোট-ঘোট বাঘ চলে গেল। এখন যতি দেখতে পাচ্ছি, একটা, দুটো, তিনটে… কাকাবাবু, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? কাকাবাবু বললেন, আরে, তাই তো রঞ্জন কি ম্যা… ইয়ে জাদুবিদ্যে জানে নাকি? সত্যিই তো হাতি? কাকাবাবুর কথা শুনে সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসল। কোনও সন্দেহ নেই, সোজা রাস্তাটার অনেক দূরে গোটাতিনেক হাতি দেখা যাচ্ছে। সন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল জোজোকে। জোজো সামনের দিকে চেয়েই বলল, ওয়াইন্ড এলিফ্যান্টস! সন্তু পকেট থেকে ছোট খাতাটা বার করতে করতে বলল, জোজো এক! রঞ্জন বলল, এই ধুধু-করা মাঠের মধ্যে বন্য হস্তী আসিবে, ইহা অতিশয় অলীক কল্পনা। আমার মনে হয়, এই হস্তীযুথ বিক্রয়ের জন্য হাটে লইয়া যাওয়া হইতেছে। সন্তু, একটা হাতি কিনবি নাকি? গাড়িটা আরও কাছে আসবার পর দেখা গেল হাতিগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু লোজনও আছে, কয়েকজন সানাই বাজাচ্ছে। মাঝখানের হাতিটায় একজন প্যান্ট-কোট পরা লোক বসে আছে, তার গলায় অনেকগুলো মালা, মাথায় সাদা রিবনো পাগড়ি। রিকু বলল, ওমা, বর যাচ্ছে! সন্তু জিজ্ঞেস করল, বউ কোথায়? প্যান্ট-কোট-পরা বর হয় নাকি? রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, হয়। এখানে এরা সুট পরে, পাগড়ি মাথায় দিয়ে বিয়ে করতে যায়। এই লোকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। রিকু বলল, এদের দিনের বেলায় বিয়ে হয়। বাঙালিদের বিয়ের মতন আলোটালো জ্বালার খরচ নেই! জোজো বলল, এরা হচ্ছে গোন্দ নামে একটা ট্রা… মানে, উপজাতি। এদের মধ্যে নিয়ম আছে, হতির বিয়ে দেওয়া খুব ধুমধাম করে। আজ
false
bongkim
বুদ্ধি খরচ করিয়া শৈবলিনীকে প্রতাপের গৃহে আনিয়া তুলিল, প্রতাপের সেরূপ অনুমতি ছিল না। তিনি রামচরণকে বলিয়া দিয়াছিলেন, পাল্কী জগৎশেঠের গৃহে লইয়া যাইও। রামচরণ পথে ভাবিল—“এ রাত্রে জগৎশেঠের ফটক খোলা পাইব কি না? দ্বারবানেরা প্রবেশ করিতে দিবে কি না? জিজ্ঞাসিলে কি পরিচয় দিব? পরিচয় দিয়া কি আমি খুনে বলিয়া ধরা পড়িব? সে সকলে কাজ নাই; এখন বাসায় যাওয়াই ভাল ।” এই ভাবিয়া সে পাল্কী বাসায় আনিল। এদিকে প্রতাপ, পাল্কী চলিয়া গেল দেখিয়া, নৌকা হইতে নামিলেন। পূর্বেই সকলে তাঁহার হাতের বন্দুক দেখিয়া, নিস্তব্ধ হইয়াছিল—এখন তাঁহার লাঠিয়াল সহায় দেখিয়া কেহ কিছু বলিল না। প্রতাপ নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া আত্মগৃহাভিমুখে চলিলেন। তিনি গৃহদ্বারে আসিয়া দ্বার ঠেলিলে, রামচরণ দ্বার মোচন করিল। রামচরণ যে তাঁহার আজ্ঞার বিপরীত কার্য করিয়াছে, তাহা গৃহে আসিয়াই রামচরণের নিকট শুনিলেন। শুনিয়া কিছু বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, “এখনও তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া জগৎশেঠের গৃহে লইয়া যাও। ডাকিয়া লইয়া আইস।” রামচরণ আসিয়া দেখিল,—লোকে শুনিয়া বিস্মিত হইবে—শৈবলিনী নিদ্রা যাইতেছেন। এ অবস্থায় নিদ্রা সম্ভবে না। সম্ভবে কি না, তাহা আমরা জানি না,—আমরা যেমন ঘটিয়াছে, তেমনি লিখিতেছি। রামচরণ শৈবলিনীকে জাগরিতা না করিয়া প্রতাপের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “তিনি ঘুমাইতেছেন—ঘুম ভাঙ্গাইব কি?” শুনিয়া প্রতাপ বিস্মিত হইল—মনে মনে বলিল, চাণক্য পণ্ডিত লিখিতে ভুলিয়াছেন; নিদ্রা স্ত্রীলোকের ষোল গুণ। প্রকাশ্যে বলিলেন, “এত পীড়াপীড়িতে প্রয়োজন নাই। তুমিও ঘুমোও—পরিশ্রমের একশেষ হইয়াছে। আমিও এখন একটু বিশ্রাম করিব ।” রামচরণ বিশ্রাম করিতে গেল। তখনও কিছু রাত্রি আছে। গৃহ—গৃহের বাহিরে নগরী—সর্বত্র শব্দহীন, অন্ধকার। প্রতাপ একাকী নিঃশব্দে উপরে উঠিলেন। আপন শয়নকক্ষাভিমুখে চলিলেন। তথায় উপনীত হইয়া দ্বার মুক্ত করিলেন—দেখিলেন, পালঙ্কে শয়ানা শৈবলিনী। রামচরণ বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিল যে, প্রতাপের শয্যাগৃহেই সে শৈবলিনীকে রাখিয়া আসিয়াছে। প্রতাপ জ্বালিত প্রদীপালোকে দেখিলেন যে, শ্বেত শয্যার উপর কে নির্মল প্রস্ফুটিত কুসুমরাশি ঢালিয়া রাখিয়াছে। যেন বর্ষাকালে গঙ্গার শ্বেত-বারি-বিস্তারের উপর কে প্রফুল্ল শ্বেত-পদ্মরাশি ভাসাইয়া দিয়াছে। মনোমোহিনী স্থির শোভা! দেখিয়া প্রতাপ সহসা চক্ষু ফিরাইতে পারিলেন না। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া, বা ইন্দ্রিয়-বশ্যতা প্রযুক্ত যে, তাঁহার চক্ষু ফিরিল না এমত নহে—কেবল অন্যমনবশতঃ তিনি বিমুগ্ধের ন্যায় চাহিয়া রহিলেন। অনেকদিনের কথা তাঁহার মনে পড়িল—অকস্মাৎ স্মৃতিসাগর মথিত হইয়া তরঙ্গের উপর তরঙ্গ প্রহত হইতে লাগিল। শৈবলিনী নিদ্রা যান নাই—চক্ষু মুদিয়া আপনার অবস্থা চিন্তা করিতেছিলেন। চক্ষু নিমীলিত দেখিয়া, রামচরণ সিদ্ধান্ত করিয়াছিল যে, শৈবলিনী নিদ্রিতা। গাঢ় চিন্তাবশতঃ প্রতাপের প্রথম প্রবেশের পদধ্বনি শৈবলিনী শুনিতে পান নাই। প্রতাপ বন্দুকটি হাতে করিয়া উপরে আসিয়াছিলেন। এখন বন্দুকটি দেয়ালে ঠেস দিয়া রাখিলেন। কিছু অন্যমনা হইয়াছিলেন—সাবধানে বন্দুকটি রাখা হয় নাই; বন্দুকটি রাখিতে পড়িয়া গেল। সেই শব্দে শৈবলিনী চক্ষু চাহিলেন—প্রতাপকে দেখিতে পাইলেন। শৈবলিনী চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলেন। তখন শৈবলিনী উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “এ কি এ? কে তুমি?” এই বলিয়া শৈবলিনী পালঙ্কে মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। প্রতাপ জল আনিয়া, মূর্ছিতা শৈবলিনীর মুখমণ্ডলে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন—সে মুখ শিশির-নিষিক্ত-পদ্মের মত শোভা পাইতে লাগিল। জল, কেশগুচ্ছসকল আর্দ্র করিয়া, কেশগুচ্ছসকল ঋজু করিয়া, ঝরিতে লাগিল—কেশ, পদ্মাবলম্বী, শৈবালবৎ শোভা পাইতে লাগিল। অচিরাৎ শৈবলিনী সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হইল। প্রতাপ দাঁড়াইলেন। শৈবলিনী স্থিরভাবে বলিলেন, “কে তুমি? প্রতাপ? না, কোন দেবতা ছলনা করিতে আসিয়াছ?” প্রতাপ বলিলেন, “আমি প্রতাপ ।” শৈ। একবার নৌকায় বোধ হইয়াছিল, যেন তোমার কণ্ঠ কাণে প্রবেশ করিল। কিন্তু তখনই বুঝিলাম যে, সে ভ্রান্তি। আমি স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে জাগিয়াছিলাম, সেই কারণে ভ্রান্তি মনে করিলাম। এই বলিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া শৈবলিনী নীরব হইয়া রহিলেন। শৈবলিনী সম্পূর্ণরূপে সুস্থিরা হইয়াছেন দেখিয়া প্রতাপ বিনাবাক্যব্যয়ে গমনোদ্যত হইলেন। শৈবলিনী বলিলেন, “যাইও না ।” প্রতাপ অনিচ্ছাপূর্বক দাঁড়াইলেন। শৈবলিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখানে কেন আসিয়াছ?” প্রতাপ বলিলেন, “আমার এই বাসা ।” শৈবলিনী বস্তুতঃ সুস্থিরা হন নাই। হৃদয়মধ্যে অগ্নি জ্বলিতেছিল—তাঁহার নখ পর্যন্ত কাঁপিতেছিল—সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়াছিল। তিনি, আর একটু নীরব থাকিয়া, ধৈর্য সংগ্রহ করিয়া পুনরপি বলিলেন, “আমাকে এখানে কে আনিল?” প্র। আমরাই আনিয়াছি। শৈ। আমরাই? আমরা কে? প্র। আমি আর আমার চাকর। শৈ। কেন তোমরা এখানে আনিলে? তোমাদের কি প্রয়োজন? প্রতাপ অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, বলিলেন, “তোমার মত পাপিষ্ঠার মুখ দর্শন করিতে নাই। তোমাকে ম্লেচ্ছের হাত হইতে উদ্ধার করিলাম,—আবার তুমি জিজ্ঞাসা কর, এখানে কেন আনিলে?” শৈবলিনী ক্রোধ দেখিয়া ক্রোধ করিলেন না—বিনীতভাবে, প্রায় বাষ্পগদ্গদ হইয়া বলিলেন, “যদি ম্লেচ্ছের ঘরে থাকা এত দুর্ভাগ্য মনে করিয়াছিলে—তবে আমাকে সেইখানে মারিয়া ফেলিলে না কেন? তোমাদের হাতে ত বন্দুক ছিল ।” প্রতাপ অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “তাও করিতাম—কেবল স্ত্রীহত্যার ভয়ে করি নাই; কিন্তু তোমার মরণই ভাল ।” শৈবলিনী কাঁদিল। পরে রোদন সম্বরণ করিয়া বলিল,—“আমার মরাই ভাল—কিন্তু অন্যে যাহা বলে বলুক—তুমি আমায় এ কথা বলিও না। আমার এ দুর্দশা কাহা হতে? তোমা হতে। কে আমার জীবন অন্ধকারময় করিয়াছে? তুমি। কাহার জন্য সুখের আশায় নিরাশ হইয়া কুপথ সুপথ জ্ঞানশূন্য হইয়াছি? তোমার জন্য। কাহার জন্য দুঃখিনী হইয়াছি? তোমার জন্য। কাহার জন্য আমি গৃহধর্মে মন রাখিতে পারিলাম না? তোমারই জন্য। তুমি আমায় গালি দিও না ।” প্রতাপ বলিলেন, “তুমি পাপিষ্ঠা, তাই তোমায় গালি দিই। আমার দোষ! ঈশ্বর জানেন, আমি কোন দোষে দোষী নহি। ঈশ্বর জানেন, ইদানীং আমি তোমাকে সর্প মনে করিয়া, ভয়ে তোমার পথ ছাড়িয়া থাকিতাম। তোমার বিষের ভয়ে আমি বেদগ্রাম ত্যাগ করিয়াছিলাম। তোমার নিজের হৃদয়ের দোষ—তোমার প্রবৃত্তির দোষ! তুমি পাপিষ্ঠা, তাই আমার দোষ দাও। আমি তোমার কি করিয়াছি?” শৈবলিনী গর্জিয়া উঠিল—বলিল, “তুমি কি করিয়াছ?
false
zahir_rayhan
সময় না মাঝে মধ্যে, একটু হৈ-চৈ করতো। আমি নিষেধ করে দেয়ার পর থেকে কেউ এসে বলুক দেখি আমার কোন বউয়ের গলার আওয়াজ কেমন? তিন বউ নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে হাসলো। জোহরা খাতুন বললেন, একি, তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন। আমেনার ঘরটা ঝেড়ে মুছে ঠিক করে দাও। আমার আলমারিতে ধোয়া চাদর আছে একটা বের করে দিও। আর শোন, মশারীর কি হবে? এক কাজ করো, আমার মশারীটাই না হয় ওকে টাঙ্গিয়ে দাও। আমাকে মশায় খায় না। তিনজন একদিকে চললে কেন। একজন রান্নাঘরে যাও। আবদুলের বউটার অসুখ। কাজকর্ম সবু পড়ে আছে। একটু পরে আমার বাচ্চা-কাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়বে। ওদের সময়মত খাইয়ে দিও। এসো ভাবী, তুমি তো আর এ বাড়িতে কোনদিন আসনি, চলো সবার ঘরদোর দেখবে। একে একে মামীকে সবার ঘরে নিয়ে গেলেন জোহারা খাতুন। সব ঘব দেখালেন। গোলাপত্র! চেয়ার টেবিল। বাক্স দেরাজ। এগুলো সব ছেলেরা নিজেদের রোজগার থেকে কিনেছে। উনি তো বেশ কবছর হলো। পেনসন নিয়েছেন। তারপর থেকে ঘর সংসারের যাবতীয় খরচ ছেলেরাই চালাচ্ছে। আল্লা ওদের রুজি-রোজগারে আরো বরকত দিক। কথা হলো কি ভাৰী, ছেলেপিলেদের বাপ মা এত কষ্ট করে মানুষ করে কেন বুড়ো বয়সে একটু আরামে থাকবে সে জানো তো, আল্লায় দিলে সে আরাম আমরা পেয়েছি। জোহরা খাতুনের চোখেমুখে পরিতৃপ্তির হাসি। মেয়ে আমেনাকে কোলের কাচ্ছে টেনে এনে বসালেন তিনি। তার গায়ে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে শুধালেন। জামাই কেমন আছে? ভালো। তোমাকে একা পাঠালো। সঙ্গে এলো না কেন? কেমন করে আসবে। ছুটি পেলে তো? বড় সাহেব ছুটি দিতে চায় না। ও না থাকলে অফিসের সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় কিনা তাই! সেই কবে থেকে আসার জন্যে ছটফট করছি। একা আসবো, সাহস হয় না। শেষে মফিজ মামারা আসছেন শুনে বললাম, আমি ওদের সঙ্গে চলে যাই, তুমি ছুটি পেলে পৱে এসো। জামাই কি বললো। বলবে আবার কি। চলে আসবো শুনে মুখখানা কালো হায়ে গেলো। জানো মা, ও না আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও কোথাও থাকতে পারে না। কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় রাঙা হলো আমেনা। ছি ছি এথা বললো সে। এটা ঠিক হয় নি। বুড়ো গিন্নী নিজেও মুহূর্তের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সহসা বললেন, হ্যারে, তুই কাপড়-চোপড় ছাড়বিনে? যা হাতমুখ ধুয়ে নে। দূর থেকে এসেছিল। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করগে যা। এক গ্লাস দুধ এনে দেবো, খাবি? না মা। দুধ খেলে আমার এক্ষুণি বমি হয়ে যাবে। মায়ের সামনে থেকে সরে গেলো মোমেন ও চলে গেলে মামীর দিকে তাকিয়ে জোহরা খাতুন মৃদু হাসলেন। বললেন: এখনো একেবারে বাচ্চা রয়ে গেছে। কার সামনে যে কি কথা বলতে হয় কিছু জানে না। ওটা এই ছোটবেলা থেকেই এ রকম। পানের বাটাটা এবার সামনে টেনে নিলেন তিনি। তারপর আবার সংসারের নানা মোলাপের মাঝখানে হারিয়ে গেলেন। আমেনার দিকে চেয়ে চেয়ে তিন বউ মুখ টিপে হাসলো। বড় বউ বললো : কিরে মাস? ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখখানা অনা দিকে সরিয়ে নিলো আমেনা। জানি না। তিন বউ ওকে তিন দিক থেকে হেঁকে ধরলো। বল না! বল নারে। ইস্ বিয়ে হতে না হতেই আমি কিন্তু ঠিক বলে দিতে পারবো। কচু! আমেনা মুখ ভেংচালো। বড় বউ বললো : জামাই তোকে খুব আদর করে তাই না? মেজ বউ বললো : বিয়ের সময় তো খুব হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছিলি এখন কেমন লাগছে আঁ। ছোটবউ বললো—এই মিনা শোন। বলে আমেনার মুখটা কাছে টেনে এসে চাপা-স্বরে কানে কানে বললো। শফি ভাই বিয়ে করেছে। কবে? আমেনা চমকে উঠলো যেন। এই তো গত মাসে। কোথায়? কোথায় ঠিক জানি না, শুনেছি বাড়ির কাছে, টাঙ্গাইলে। বউটা নাকি ভীষণ সুন্দর দেখতে। ও। আমেনা কেমন যেন ফেকাসে হয়ে গেলো। জোহরা খাতুন এসে তিন বউকে ডাক দিলেন। এই তোমরা এসো, বাচ্চাদের খাওয়ার পাট চুকিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। তারপর বুড়োরা খাবে। আমেনা ছোট বউকে তার কাছে রেখে দিলো। তোমরা যাও মা, ছোট ভাবী আমার কাছে এখন থাকুক। একটু গল্প করবে। মা আর দুই বউ চলে যেতে আমেনা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলো সে। তারপর ধীরে ধীরে বললো। পুরুষ মানুষগুলো ভীষণ স্বার্থপর তাই না ভাবী? ছোট বড় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালো। বললো, বিয়ের পর এই তো সেদিন আমাদের এখানে এসেছিলো শফি ভাই। আমিও ছাড়িনি। বেশ করে শুনিয়ে দিয়েছি! কি শুনিয়েছো? উঠে আবার বসলো আমেনা। কি কমিয়েছো, বলো না ভাবী? বললাম। আপনি একটা এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ। খুবতো লম্বা লম্বা কথা বলতেন, মিনাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি এ পৃথিবীতে আর কাউকে চিন্তা করতে পারি না। ওকে না পেলে সারা জীবন আমি আর বিয়ে করবো না। এখন? কি হলো? শুনে কি বললো? আমেনার গলার স্বরে ঈষৎ উত্তেজনা। ছোট বউ জবাব দিলো। কি আর বলবে। বলার মুখ আছে। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বললো না? না। আমেনা নীরবে কিছুক্ষণ হোট বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। আসলে আমি একটা বোকা মেয়ে ভাবী। কেমন করে ওর ফাঁদে পা দিয়েছিলাম ভেবে দেখ তো। সম্পর্কে মামাতো ভাই। তাই বাড়ির মধ্যে আসা যাওয়া আর মেলামেশায় কোন বাধা ছিলো না। তুমি তো সব জানো ভাবী। প্রথম প্রথম
false
shottojit_roy
ফেলে দিয়ে গেছে।’ ‘বলেন কী!’ আমার কিন্তু কথাটা শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। নিশিকান্তবাবুর ঘর হল আমাদের পাশের ঘর; ওটাও হোটেলের পিছন দিকে। আমাদের আর ওর ঘরের জানালার বাইরে দিয়ে একই বারান্দা গেছে, আর সেই বারান্দায় ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। ‘এটা রাখতে পারি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ‘স্বছ্‌–মানে স্বচ্ছন্দে। কিন্তু কী লিখেছে, সেটার একটা ইয়ে না করা অবধি…’ ‘সেটা আর এমন কী কঠিন। তিব্বতি ভাষা-জানা লোকের তো অভাব নেই এখানে। আর কিছু না হোক–টিবেটান ইনস্টিটিউট তো আছে।’ ‘হাঁ। সেই আর কী৷’ ‘তবে আর কী। আপনি চিন্তা করছেন কেন? এটা হুমকি বা শাসনি গোছের একটা কিছু, সেটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই। নাকি আছে?’ নিশিকান্তবাবু চমকে উঠে। তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বললেন, ‘সার্টেনলি নট!’ ‘এমনও তো হতে পারে যে এটায় বলা হয়েছে–তোমার মঙ্গল হোক বা তুমি দীর্ঘজীবী হও।’ ‘তা তো বটেই। অবিশ্যি, মানে হঠাৎ, কথা নেই বাতা নেই, আশীর্বাদটাই বা করবে কেন–হেঁ হেঁ।’ ‘হুমকিরও কোনও কারণ নেই বলছেন?’ ‘না না। আমি মশাই যাকে বলে নট ইন সেভেন, নট ইন ফাইভ।’ ফেলুদা বেয়ারাকে চা আর ডিমা-রুটি অডার দিয়ে বলল, ‘যাক গে—এ নিয়ে আর ভাববেন না। আমরা তো পাশের ঘরেই রয়েছি। আপনার কোনও চিন্তা নেই৷’ ‘বলছেন?’ আজ সকালে এই প্রথম ভদ্রলোকের অনেকগুলো দাঁত এক সঙ্গে দেখা গেল। ‘আলবৎ। চা খেয়েছেন?’ ‘এবার খাব আর কী৷’ ‘পেট ভরে ব্রেকফাস্ট করুন। রোদ উঠেছে। দুপুরে লামা-নাচ দেখার প্রোগ্রাম আছে। কুছ পরোয় নেহি।’ ‘আপনাকে যে কী বলে থ্যা—‘ ‘থ্যাঙ্কস দিতে হবে না। আপনার চেকটি যেন খোয়া না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।’ জিপি ঠিক সময়ই হাজির হল। আমরা উঠতে যাব, এমন সময় দেখি আরেকটা জিপ বাংলোর দিক থেকে আসছে। নম্বরটা দেখে কেমন জানি চেনা মনে হল। 463, ওহো—এই নম্বরের গাড়িই তো সেই নেপালি ড্রাইভার চালাচ্ছে, যে অ্যাক্সিডেন্ট থেকে পার পেয়েছিল। এবার নীল কোট পরা ড্রাইভারকে দেখতে পেলাম, আর তার পাশেই বসে–ওমা, এ যে শশধরবাবু। ভদ্রলোক আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘আমির কাছ থেকে খবরের জন্য ওয়েট করছিল। বৃষ্টির বহর দেখে ভয় হচ্ছিল রাস্তা বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।’ ‘নাঃ। অবিশ্যি নেহাত বেগতিক দেখলে ঠিক করেছিলাম। ভায়া কালিম্পং চলে যাব৷’ ‘ওই ড্রাইভারই তো শেলভাঙ্কারের গাড়ি চালাচ্ছিল—তাই না?’ শশধরুবাবু হেসে উঠলেন।’আপনি তো তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন দেখছি। ইয়েস-ইউ আর রাইট। আমি ওকে ডেলিবারেটলি বেছে নিয়েছি। প্রথমত, গাড়িটা নতুন; দ্বিতীয়ত-বাজ কখনও একই জায়গায় দুবার পড়ে না, জানেন তো?’ শশধরবাবু দ্বিতীয়বার গুডবাই করে বাজারের রাস্তা দিয়ে নীচের দিকে চলে গেলেন। আমরা আমাদের জিপে উঠলাম। ড্রাইভারকে বলাই ছিল কোথায় যাবে, তাই আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে রওনা দিয়ে দিলাম। ডাকবাংলোর কাছাকাছি গিয়ে একবার উপরের দিকে চেয়ে দেখলাম হেলমুটকে দেখা যায় কি না। কাউকেই দেখতে পেলাম না। কাল কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না, আর আজ আকাশে এক টুকরো মেঘও নেই। বাঁ দিকে শহর অনেক দূর পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। একটা বাড়ি দেখে ইস্কুল বলে মনে হল, কারণ তার সামনেই একটা চারকোেনা খোলা জায়গা, আর তার দুদিকে দুটো খুদে খুদে সাদা গোলপোস্ট। এখনও ইস্কুলের সময় হয়নি, না হলে ইউনিফর্ম পরা খুদে খুদে ছেলেদেরও দেখা যেত। আরও কিছু দূর গিয়ে একটা চৌমাথা পড়ল। ডান দিকে একটা পান-সিগারেটের দোকান, মাঝখানে পুলিশ, বা দিকে একটা রাস্তা পিছনে নীচের দিকে চলে গেছে। সামনের দিকে রাস্তাটা দু ভাগ হয়ে গেছে। একটার মুখে একটা গোট—তাতে লেখা ইন্ডিয়া হাউস-সেটা পাহাড় বেয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। আমরা নিলাম অন্য রাস্তাটা, যেটা সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মিনিট খানেক চলার পরেই রাস্তার ডান পাশে পাহাড়ের গায়ে পাথরের ফলকে খোদাই করে বড় বড় অক্ষরে লেখা দেখলাম–নর্থ সিকিম হাইওয়ে। ফেলুদা একটা অচেনা গান গুনগুন করে গাইছিল, সেটা থামিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে রাস্তা কিতনা দূর তক গিয়া?’ ড্রাইভার বলল রাস্তা গেছে চুংথাম পর্যন্ত। সেখানে আবার দুটো রাস্তা আছে, যার একটা গেছে। লাচেন, আরেকটা লিচুং।। দুটোরই নাম শুনেছি, দুটোরই হাইট না হাজার ফুটের কাছাকাছি, আর দুটোই নাকি অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। ‘রাস্ত ভাল?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ‘তা ভাল, তবে পানি হোনেসে কভি কভি বিগড় যাত৷’ ‘ল্যান্ডক্সাইড হয়?’ ‘হাঁ বাবু। রাস্তা তোড় যাতা, বিরিজ তোড় যাতা, ট্রাফিক সব বন্ধ হো যাত৷’ শহর ছাড়তে বেশি সময় লাগল না। একটা আমি ক্যাম্প পেরোতেই একেবারে নিরিবিলি জায়গায় এসে পড়লাম! এখন নীচের দিকে তাকালে পাকা বাড়ির বদলে ফসলের খেত দেখা যাচ্ছে। এখন ভুট্টা হয়েছে, ধানের সময় ধান হয়৷ পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে করা খেত–ভারী সুন্দর দেখতে। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে মাইল পোস্ট পড়ছে, তবে তাতে সব কিলোমিটারে লেখা। প্রথম প্রথম অসুবিধে হচ্ছিল, তারপর মনে মনে হিসেব (৫ মাইল = ৮ কিলোমিটার) করে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেল। দশ কিলোমিটার ছাড়িয়ে কিছু দূরে গিয়ে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার বলল, এই হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গা। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। এতক্ষণ গাড়ির শব্দে যেটা বুঝতে পারিনি, সেটা এবার বুঝতে পারলাম। রাস্তা থেকে অনেকখানি নীচে খাদের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, তার একটা সর সর শব্দ আছে, আর আছে মাঝে মাঝে কে জানে কদুর থেকে ভেসে আসা নাম-না-জানা পাহাড়ে পাখির শিস। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আমরা
false
MZI
করে হেসে উঠল না, কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ভালবাসার কোনো মেয়ে আছে সুহান? না নেই। কেন নেই? আমি ক্যাটাগরি-বি মানুষ। ক্যাটাগরি-বি মানুষের খুব দুঃখ। তাদের স্বপ্ন দেখতে নেই। ভালবাসার মেয়ে থাকতে নেই। কারো স্বপ্নকে নষ্ট করতে নেই। রিয়ানা চোখ বড় বড় করে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান বলল, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি রিয়ানা? না সুহান, আজকে নয়। তুমি আমাকে কী প্রশ্ন করবে আমি জানি। আরেকদিন জিজ্ঞেস করো। কিন্তু এটা তো একটা স্বপ্ন। আরেকদিন তো এই স্বপ্ন আমি দেখব না। সেই স্বপ্নে তুমি থাকবে না। তুমি যদি চাও তা হলে তুমি আবার এই স্বপ্ন দেখতে পাবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? সেটা সম্ভব। কারণ এটা অন্যরকম স্বপ্ন। সত্যি? সত্যি। রিয়ানা সুন্দর করে হাসল, বলল, এটা হবে তোমার আর আমার স্বপ্ন। তুমি দেখতে চাইলেই এই স্বপ্নটা দেখতে পারবে। তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ? হ্যাঁ আমি কথা দিচ্ছি। রিয়ানার চোখে-মুখে হঠাৎ এক ধরনের ব্যস্ততার ছাপ ফুটে ওঠে, সে সুহানের হাত ধরে বলল, সুহান আমাদের সময় নেই। তাড়াতাড়ি এস। কোথায়? এস আমার সাথে। সুহান রিয়ানার সাথে হাঁটতে থাকে। একটা পোশাকের দোকান, তার পাশে একটা ভাস্কর্যের দোকান, তারপরে একটা ক্যাফে। বাইরে টেবিল, টেবিলকে ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার। সেখানে তরুণ-তরুণীরা বসে কফি খাচ্ছে, নিচু গলায় কথা বলছে, হাসছে। রিয়ানা বলল, ওই ক্যাফেটার নাম ক্যাফে অর্কিড়। নামটা মনে থাকবে? হ্যাঁ। এই যে খালি টেবিলটা দেখছ, তুমি এখানে বস সুহান। সুহান খালি টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। রিয়ানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি? তুমি বসবে না? হ্যাঁ বসব। কিন্তু তোমার সাথে না। অন্যখানে। কেন রিয়ানা? আমার সাথে নয়, কেন? কারণ আছে সুহান। কী কারণ? সেই কারণটি আরেকদিন বলব। সুহান ব্যাকুল হয়ে বলল, আরেকদিন কেন? আজকে কেন নয়? ঠিক তখন সুহানের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল, তার কাছাকাছি একন ডাক্তার এবং দুজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার তার ওপর ঝুঁকে বলল, তুমি স্বপ্ন দেখছিলে? হ্যাঁ দেখছিলাম। তুমি কেমন করে জান? তোমার আরইএম হচ্ছিল। মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার আরইএম হয়। ও। ডাক্তার আরো একটু ঝুঁকে পড়ল, বলল, তুমি কী স্বপ্ন দেখছিলে সুহান? সুহান ডাক্তারের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে এই মানুষটার কৌতূহলটাকে তার অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হতে থাকে। তার ভেতরে বিচিত্র একটা ক্রোধ জেগে উঠতে থাকে কিন্তু তাকে তার ক্রোধটাকে গোপন রাখতে হবে। ভেতরকার সত্যি কথাটাও তার গোপন রাখতে হবে। ডাক্তার তার কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিছু একটা তাকে বলতে হবে। সুহান বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি একটা সার্কাস। সার্কাস? হ্যাঁ। সার্কাস। কী হচ্ছে সেই সার্কাসে? সার্কাসে একটা মানুষ অনেকগুলো সিংহকে নিয়ে খেলছে। স্বপ্নে কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? হ্যাঁ বলেছে। কে বলেছে? কী বলেছে? ডাক্তারের চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে। সিংহগুলো। সিংহগুলো আমাকে বলেছে। ডাক্তারের চোখ-মুখের উৎসাহ একটু থিতিয়ে যায়, ইতস্তত করে বলে, সিংহ কি কখনো কথা বলে? সুহান হাসার ভঙ্গি করল, বলল, স্বপ্নের ব্যাপার! স্বপ্নের কি কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি? স্বপ্নে সিহুঁ কথা বলে। হাতি ওড়ে। তা ঠিক। সুহান বলল, সিংহগুলো কী বলছে শুনতে চাও? ডাক্তারের উৎসাহ এতক্ষণে অনেক কমে এসেছে, তবুও জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে? বলেছে, আমরা সকালে ক্যাটাগরি-বি মানুষের কলজে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। দুপুর বেলা খাই তাদের কিডনি। ডাক্তার এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান বলল, সিংহগুলো ডিনারের সময় কী খেতে চায় জান? ডাক্তার মাথা নাড়ল, বলল, নাহ! শুনে কাজ নেই। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা কর। সুহান আবার চোখ বুজল। তার মাথার মাঝে আবার অসংখ্য মানুষের কথার শব্দ ভেসে আসে। সে জোর করে তার মাথা থেকে কথাগুলো সরিয়ে দেয়। হঠাৎ করে তখন তার রিয়ানার কথা মনে হল। কী অসম্ভব বাস্তব এই স্বপ্নটুকু। এখনো মনে হচ্ছে স্বপ্ন নয় সত্যি। কী বিচিত্র এই স্বপ্নটুকু। কী আশ্চর্য! সুহান রিয়ানার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেল। ০৬ সুহানকে তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে দিল না–তাকে শহরের ভেতরে একটা ছোট অ্যাপার্টমেনে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। সে একজন তুচ্ছ ক্যাটাগরি-বি মানুষ, তার জন্য এত আয়োজনের কারণটুকু সে জানতে চেয়েছিল, সঠিক উত্তরটুকু কেউ দিতে পারল না। ভাসা ভাসা ভাবে শুনতে পেল যে তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরীর এই দায়িত্বটার একটা অন্য ধরনের গুরুত্ব রয়েছে—তাকে সঠিক নিরাপত্তা দেওয়া এখন সরকারের দায়িত্বের মাঝে এসে পড়েছে। সুহান খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাল না। সে এখনো দূর্বল। মাথার ভেতরে সব সময়ে মানুষের কোলাহল, তার কী হয়েছে সে এখনো বুঝতে পারে নি। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে মানুষের কথা শুনতে পায় তা নয়, সে আবিষ্কার করেছে সে অন্যরকম একটা মানুষ হয়ে গেছে। ধীরলয়ের সঙ্গীত সে একেবারেই পছন্দ করত না, এখন মাঝে মাঝে সেটা শুনতে তার বেশ ভালো লাগে। হঠাৎ হঠাৎ তার মাঝে খুব বড় পরিবর্তন হয়, সে কিছুক্ষণের জন্য একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়। একদিন সকালে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল—সে মধ্যযুগের সকল চিত্রশিল্পীর নাম জানে। কিছুক্ষণ পর সে নামগুলো ভুলে গেল। মাঝখানে একবার তার মনে হল সে মানুষের রোগের চিকিৎসা করতে পারবে—সব রোগের চিকিৎসা সবকিছুই সে জানে। এই
false
shunil_gongopaddhay
এখন ফিরে গিয়ে এখানে মাচা বাঁধার খবর কাউকে না দিতে পারে। কাকাবাবু বললেন, বাঃ, ভাল ব্যবস্থা। বড়ঠাকুর বললেন, আমি যতদূর সম্ভব সাবধানে সব ব্যাপারটা গোপন রেখেছি। আমরা যে এখানে আজ আসব, তা কারও জানার কথা নয়। কাকাবাবু, আপনি যা-যা বলেছেন, সব মানা হয়েছে। শুধু একটা ব্যাপার আপনাকে জানানো হয়নি। সেটা আমাকে মানতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে। কাকাবাবু বললেন, সেটাও আমি জানি। এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য আনা হয়েছে তো? বড়ঠাকুর বললেন, আপনি জেনে গেছেন? মুখ্যমন্ত্রী আপনার প্ল্যানটা সব শুনেছেন। তার পর বললেন, আপনারা এই কজন সেখানে রাত্রে থাকবেন, আপনাদের প্রাণের দায়িত্ব কে নেবে? স্মাগলারদের কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র থাকে। আর্মি দিয়ে জায়গাটা ঘিরিয়ে রাখুন। তাই এক ব্যাটেলিয়ন আর্মি আসছে। এরা গাভোয়ালি সৈন্য, খুব বিশ্বাসী, এখানকার ভাষাই বোঝে না। এরা আবার ক্যামোফ্লেজ জানে। গায়ে, মাথার সঙ্গে গাছের ডালপালা বেঁধে এমনভাবে জঙ্গলে মিশে যাবে যে ওদেরও গাছ বলে মনে হবে। আমাদের শচীনকে ওদের কম্যান্ডারের সঙ্গে রাখা হয়েছে, সে সব বুঝিয়ে দেবে। কাকাবাবু বললেন, ওদের কমান্ডারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এখান থেকে আধ মাইল দূরে ওরা নিঃশব্দে ছড়িয়ে থাকবে। আমার নির্দেশ না পেলে ওরা নড়বে না, কিছুই করবে না। বড়ঠাকুর বললেন, তা হলে আমরা এখন ওপরে উঠে পড়ি? কাকাবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, সূর্য অস্ত যেতে এখনও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি আছে। আপনারা এখানে দাঁড়ান, আমি একটু ঝিলটার চারপাশ দেখে আসি। কাকাবাবু রাধেশ্যাম বড়ুয়ার ঘোড়াটা সঙ্গে এনেছেন, সেটাতে চড়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। এই ঝিলটা অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড় হলেও তিনদিকের পাড় বেশ উঁচু, কেউ নামতে গেলে গড়িয়ে পড়ে যাবে। এক দিকটা ঢালু। এর সুবিধে এই যে, এই এক দিকটায় নজর রাখলেই চলবে। ফিরে এসে কাকাবাবু বললেন, এই বার শুরু হবে আমাদের কঠিন পরীক্ষা। যে যার মাচায় উঠে বসে থাকব, কিন্তু কতক্ষণ যে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। হয়ত ওরা আসবে ভোরবেলা। এর মধ্যে আমাদের ঘুমোলে চলবে না, একটাও কথা বলা যাবে না। শুধু ঠায় বসে থাকা। প্রত্যেকের সঙ্গে খাবারের প্যাকেট থাকবে, তাও খেতে হবে নিঃশব্দে। সন্তু আর জোজো একসঙ্গে থাকলে কথা বলে ফেলতে পারে, তাই ওদের এক মাচায় দিচ্ছি না। সন্তু থাকবে তপনের সঙ্গে, আর জোজো রাজ সিংয়ের মাচায় থাকবে। তপন রায় বর্মণ জিজ্ঞেস করল, চোরাশিকারিদের দেখতে পেলে আমরা কি গুলি চালাব? কাকাবাবু বললেন, না, না, খবদার গুলি-টুলি চালাবে না। চুপ করে বসে থাকবে। তপন বলল, ওরা যদি গণ্ডার মারতে শুরু করে, তা দেখেও আমরা চুপ করে থাকব? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাও চুপ করে থাকবে। আমরা বন্দুক এনেছি শুধু আত্মরক্ষার জন্য। ওরা যদি আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়, যদি আমাদের আক্রমণ করতে আসে, তা হলেই শুধু আমরা গুলি চালাব। এরা অতি সাঙ্ঘাতিক মানুষ। অনেক টাকার লোভে একেবারে মরিয়া হয়ে গেছে। আমাদের এমনভাবে থাকতে হবে, যাতে ওরা আমাদের অস্তিত্ব কিছুতেই টের না পায়। ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে তিনি ঘোড়াটাকে বাঁধলেন গাছের সঙ্গে, তারপর বললেন, তোমরা সবাই যে যার মাচায় উঠে পড়ো। মনে থাকে যেন, একটাও কথা নয়। আমার শুধু একটা কাজ বাকি আছে। একটা ঝোলা ব্যাগ থেকে তিনি বের করলেন দু খানা জুতোর বাক্সের সমান একটা কাগজের বাক্স। তার থেকে বেরলো সাদা ধপধপে একটা ফেভিকলের বাক্স। চতুর্দিক সেলোটেপ দিয়ে এমনভাবে আটকানো, যাতে একটুও হাওয়া কিংবা জল ঢুকতে না পারে। বড়ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? কাকাবাবু বললেন, এটা আমি আর্মির কাছ থেকে জোগাড় করেছি। বড়ঠাকুর বললেন, কী আছে এর মধ্যে? কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, সেটা যথাসময়ে জানতে পারবেন। খানিকটা কৌতূহল টিকিয়ে রাখা ভাল, তাই না? কাকাবাবু সেই বাক্সটা ভাসিয়ে দিলেন ঝিলের জলে। যে-কটা গাছে মাচা বাঁধা হয়েছে, সেখানে একটা করে দড়ির সিঁড়িও ঝোলানো আছে। যাতে জুতো পরেই ওঠা যায়। এই শীতের মধ্যে খালি পায়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কাকাবাবু মাচায় উঠে দড়ির সিঁড়িটা গুটিয়ে নিলেন। একপাশে রইল রাইফেল, অন্যপাশে খাবারের প্যাকেট। মাচার ওপর গদি পাতা আছে, বেশ আরামেই বসা যাবে। এর পর শুধু প্রতীক্ষা। কাকাবাবু অন্য মাচাগুলোর দিকে তাকালেন। কোন-কোন গাছে মাচা বাঁধা হয়েছে তা তিনি জানেন, তবু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যেক মাচা প্রায় দু তলা সমান উঁচু, কোনও জন্তুও এত দূর থেকে মানুষের গন্ধ পাবে না। শীতকাল বলে একটা সুবিধে হয়েছে, হঠাৎ সাপ-টাপ এসে পড়বে না গায়ে। ডালটনগঞ্জে একবার জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার সময় গায়ের ওপর দিয়ে সাপ চলে গিয়েছিল। আকাশের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার তাড়াতাড়ি নেমে আসে, ওপর দিকটায় আরও কিছুক্ষণ আলো থাকে। উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকঝাঁক পাখি। ঝিলের মাঝখানে কয়েকটা শাপলা ফুটে আছে, সেখানে ওড়াউড়ি করছে কিছু ফড়িং আর প্রজাপতি। সব মিলিয়ে বাতাসে একটা সুন্দর শান্ত ভাব। কাকাবাবু ভাবলেন, জঙ্গল এত সুন্দর, তবু মানুষ এখানে বন্দুক নিয়ে ঢোকে। অকারণে প্রাণিহত্যা করে। এমনকী, মানুষকেও মারে। হিংসার বিষনিশ্বাস ছড়ায়। আজকেই কত খুনোখুনি হবে কে জানে! প্রথম যে বুনো শুয়োরের পালটা এল, তাদের বেশ স্পষ্টই দেখতে পাওয়া গেল। ওরা দুলে-দুলে দৌড়য় আর ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করে। ঝিলের ধারে গিয়ে চকচক করে খানিকটা জল খেল, আবার দল বেঁধে দুলতে-দুলতে চলে গেল। যেন সময় নষ্ট করতে পারবে না, খুব তাদের জরুরি কাজ আছে। কাকাবাবু লক্ষ করলেন, শুয়োরগুলো ঢালু দিকটা দিয়েই এল
false
shunil_gongopaddhay
পরিবারের তিন পুরুষের তিনি গুরুদেব, যদিও বহুকাল আসেননি, সম্প্রতি বদরিকাশ্রম থেকে তিনি সমতলে নেমে এসেছেন। সেই গুরুদেবকে নিয়ে যাগযজ্ঞের খুব ধুমধাম চলছিল, হঠাৎ একদিন আরতির ধুনুচির আগুন লেগে গেল তাঁর দাড়িতে। ভয়ে ও যন্ত্রণায় গুরুদেব নিজেই তাঁর দাড়ি ধরে টান দিতেই সবটা উপড়ে এল। তখন বোঝা গেল, তার দাড়ি নকল। রসিক ছোকরারা তাঁর জটা ধরে টানাটানি করতেই বেরিয়ে পড়ল দিব্যি তেরি কাটা চকচকে মাথা। তাঁর ভুরুতেও চকখড়ি। অবিলম্বে আবিষ্কার করতে বিলম্ব হল না। ওই ছদ্ম গুরুদেব আসলে ওই তেলী বাড়ির এক পুত্রবধূর পিসতুত দাদা। বধূটির সঙ্গে আগে থেকেই তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল, সেই টানে সে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও চলে এসেছিল। গুরুদেবের ছদ্মবেশ ধরে সে এমন ভাব দেখাত যেন সে নারী-পুরুষের তফাতই বোঝে না। কিন্তু মামাতো বোনটির সেবা নেবার ছলে সে কয়েকবার তার সঙ্গে শয্যায় মিলিত হয়েছে। এ নিয়ে কয়েকদিন খুব হইচই চলল, ধনী বাড়ির কুৎসা সব সময়ই খুব মুখরোচক হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতের বন্ধুরা তর্ক করতে লাগল, ভণ্ড সাধুটিকে না হয় বিচারের জন্য আদালতে পেশ করা হয়েছে, কিন্তু ওই নববধূটির বরাতে কী আছে? সেই রমণীটি সত্যিই অপরাধিনী কিনা, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে কী ভাবে? এই বিতর্ক এখনও চলছে। অন্যান্য বাড়িতেও কিছু কিছু গুরুদেবের ওপর হেনস্থা শুরু হয়ে গেছে। একজন গুরুদেবের সত্যিকারের কাঁচাপাকা দাড়ি পরীক্ষায় ছলে টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে কয়েকটি কলেজ পড়ুয়া যুবক। এই ব্যাপারটি একটি হুজুগ হিসেবে গণ্য হতে পারে, কিন্তু ভরত তার মাস্টারমশাইয়ের সামনে এই কাহিনী বিবৃত করার যোগ্য মনে করল না। শশিভূষণ আবার বললেন, ব্ৰাহ্মরা যেন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে, তাই না। ভরত, তুই কোনও ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করিস নাকি? ভরত বলল, না, আমাকে টানে না। শশিভূষণের আমলে ছাত্ররা কোনও না কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হত। নিছক কলেজ। আর বাড়ি, এইটুকু গণ্ডির মধ্যে তারা আবদ্ধ থাকত না। সেই জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কোথায় যাস তুই? ভরত বলল, আমি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় মাঝে মাঝে লেকচার শুনতে যাই। শশিভূষণ বললেন, হুঁ, ডাক্তার সরকারের সঙ্গে আমাকেও একবার দেখা করতে হবে। তুই দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ সাধুকে দেখেছিস নাকি? ইন্ডিয়ান মিরার কাগজে প্রায়ই ওঁর কথা লেখে। ভরত বলল, হ্যাঁ দাদা গত মাসে পরপর দুবার গেছি আমার এক বন্ধুর সাথে। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও কথা হয়নি, ওঁর মুখের গল্প শুনেছি, গ্ৰাম্য লোকের ভাষায় কথা বলেন, সব ঠিক বুঝি না। তবে ওখানে নরেন নামে একটি ছেলেকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার থেকে বয়েসে বেশ কিছুটা বড়। কিন্তু সে যেন এক জ্যোতিষ্ক। সে কোনও কিছুই যাচাই না করে মেনে নেয় না। এমনকি প্রায়ই রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে যাচাই করে। শশিভূষণ বললেন, নরেন? কোন বাড়ির ছেলে। ভরত বলল, তা আমি ঠিক জানি না। তার নাম নরেন দত্ত, শুনেছি সিমলেপাড়ার দিকে থাকে। শশিভূষণ বললেন, এবার কলকাতায় থাকব। এখন আস্তে আস্তে সকলের সঙ্গে চেনাপরিচয় হবে। সকালে এক প্রস্থ বাড়ি দেখা হয়, তারপর দুপুরের দিকে ওরা দু’জন আহারাদির জন্য ফেরে। ভরতের এখন গ্ৰীষ্ম অবকাশ, তাই কলেজে যাবার দায় নেই। শশিভূষণের মহল আলাদা হলেও কৃষ্ণভামিনী তাঁকে নিজের কাছে বসিয়ে খাদ্য পরিবেশন করেন। শশিভূষণ সেখানেও সঙ্গে নিয়ে যান ভরতকে। পাশাপাশি পাত পাত হয় দু’জনের। এতদিন পর্যন্ত এ বাড়ির অন্দরমহলে ভরতের প্রবেশ-অধিকার ছিল না, এখন ভরতের গতিবিধি অবাধ। ভরত সম্পর্কে শশিভূষণের মেজদাদার অনেক অভিযোগ আছে, কিন্তু এখন তিনি তা উত্থাপন করেন না। ভরতের প্রতি শশিভূষণের দুর্বলতা দেখে তিনি নিরস্ত হন। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে বেশ কিছুটাকা ঋণ চাইবেন বলে মনস্থ করেছেন মণিভূষণ। দুই মহলে যাতায়াতের পথে ভূমিসূতার সঙ্গে এখন প্রায়ই দেখা হয় ভরতের। কথা হয় না বিশেষ। দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে চায়। ভূমিসূতার দৃষ্টির আড়ালে যে বিষণ্ণতা, তা অনুভব করে ভরত প্রতিবারই ভাবে, এই দুঃখী মেয়েটিকে সে আর দুঃখ পেতে দেবে না, কথা দিয়েছে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ সে এখনও কিছু চিন্তা করে নি। শশিভূষণ এসে পড়ায় সব কিছু মুলতুবি আছে। ভূমিসূতার আস্তে আস্তে একটু সাহস বেড়েছে, সে আবার গোপনে গোপনে ভরতের ঘরে আসে। অবশ্য যখন ভরত থাকে না। সে আসে বই পড়ার টানে, বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভরতের ঘরের সব কিছু গুছিয়ে রাখে নিপুণ হাতে। ভরত সে কোমল হস্তের স্পর্শ টের পায়। এখন আর সে বিরক্ত হয় না। টেবিলের ওপর একটি ছোট্ট রেকাবিতে সুপুরির কুচি ও মৌরি ভাজা রেখে গেছে ভূমিসূতা। ভরত সেদিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, হঠাৎ তার গলার কাছে একটু বাষ্প জমে যায়। ভূমিসূতাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এতদিন তার কল্পনায় ভবিষ্যতের কোনও স্পষ্ট ছবি ছিল না, এখন তার একটি আকাঙ্খাই প্রতিদিন স্বপ্ন হয়ে আসে, স্বপ্নটি ফুলের মত একটু একটু করে পাপড়ি মেলেছে। এ স্বপ্নের কথা এখনও জানানো হয়নি। সেরকম সুযোগ পাওয়া যায়নি। অবশেষে সার্কুলার রোডেই একটি বাড়ি পছন্দ হয়। দেড় বিঘে জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, মধ্যে বাগান ও পুরনো বড় বড় গাছ রয়েছে, গৃহখানি দুটি ভাগে বিভক্ত। সামনের অংশটি দোতলা, মোট ছ’খানি ঘর আছে, একতলার তিন দিকেই টানা বারান্দা। পিছনের দিকটি সামনের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান সরঞ্জামে নির্মিত, ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের মেঝে, প্রতি ঘরের জানলায় কাচ ও কাঠের দুরকম পাল্লা। বাড়িটির এ
false
humayun_ahmed
করবেন। তার উপর একটা বই লেখা হবে। সেই বই কিনে আমি পড়ব। আমার এতেই হবে। এর বেশি সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। আরেকটা কথা-আপনি আবার ভাবছেন না তো আমার এই গল্প বানোয়াট গল্পী? আপনাকে বিভ্ৰান্ত করার জন্যে উদ্ভট একটা গল্প কেঁদেছি? একবার আপনার মাথায় এই ব্যাপারটা ঢুকে গেলে আপনি মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়বেন না। এমনও হতে পারে যে কাগজগুলি ডাক্টবিনে ফেলে দেবেন। আমার প্রধান দায়িত্ব আপনাকে বিশ্বাস করানো-আমি যা বলছি, সত্যি বলছি। আমার কাছে যা সত্যি অন্যের কাছে হয়তো নয়। সত্য একেক জনের কাছে একেক রকম। . তাই না? আমি যে সত্যি বলছি সেটা কী করে প্রমাণ করব? আমি জানি না। আমি আপনার হৃদয়ের মহত্ত্বের কাছে সমৰ্পণ করছি এবং আশা করছি আমাকে বিশ্বাস করবেন। আজ এই পর্যন্তই লিখলাম। মাথা ধরেছে—এখন আর লিখতে পারছি না। আপনার ঠোঁটে কি এখন মৃদু একটা হাসির রেখা? সাইকিয়াট্রিস্টরা মাথা ধরেছে বাক্যটা শুনলেই নড়েচড়ে বসেন। তাদের ভাবটা হচ্ছে–এইবার পাওয়া গেছে মাথায় সমস্যা বলেই মাথা ধরা। আমেরিকার একজন সাইকিয়াট্রিস্টর কাছে গিয়েছিলাম। আমি যাই নি–আমার যাবা। আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ কথা বলার পরই গম্ভীর গলায় ফললেন, ইয়াং লেডি, তোমার কি প্রায়ই মাথা ধরে? আমি বললাম–হ্যাঁ। ভদ্রমহিলার ঠোঁটে আনন্দের হাসি দেখা গেল। ভাবটা হচ্ছে- . তারপর অসংখ্য প্রশ্ন, সবই মাথা ধরা নিয়ে। কখন মাথা ধরে? রাতে বেশি, না দিনে? মাথা ধরার সময় কি চোখ জ্বালা করে? কান লাল হয়ে যায়? মাথা ধরার তীব্ৰতা কেমন? কতক্ষণ থাকে? তখন কি পানির পিপাসা হয়? আমি যখন বললাম, ম্যাডাম আমার মাথা ধরাটা খুবই স্বাভাবিক ধরনের। মাঝে মধ্যে মাথা ধরে-প্যারাসিটামল খাই, কিংবা গরম চা খাই। মাথা ধরা সেরে যায়। অদ্রমহিলা তাতে খুব হতাশ হলেন। আপনিও কি হতাশ হচ্ছেন? এমনিতে আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক মানুষ। আমি আমার মৃত মাকে দেখতে পেতাম এই অস্বাভাবিকতাটা ছোটবেলায় ছিল-বেশি দিনের জন্যে কিন্তু না। খুব বেশি হলে সাত কিংবা অ্যাট মাস। হঠাৎ একদিন সব আগের মতো হয়ে গেল। ছোট মার আসা বন্ধ হল। আমি কিছুদিন প্রবল হতাশায় কাটালাম। ছোটদের হতাশা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তবে তার স্থায়িত্বও কম হয়। শিশুদের প্রবল শোক এবং প্রবল হতাশা কাটিয়ে ওঠার সহজাত ক্ষমতা থাকে। আমিও হতাশ কাটিয়ে উঠলাম। ধীরে ধীরে সব আগের মতো হয়ে গেল। অবিশ্যি ছোট মা আসা পুরোপুরি বন্ধ করলেন তাও না। তিনচার মাস পরপর হঠাৎ চলে আসতেন। আমি তখন বলতাম, এতদিন আস নি কেন? তিনি বলতেন-আসার পথ ভুলে যাই। মনে থাকে না। আমার জীবন যাপন স্বাভাবিক হলেও আমি বড় হচ্ছিলাম নিঃসঙ্গতায়। আমার চারপাশে কেউ ছিল না। আমার নিঃসঙ্গতা দূর করলেন নীতু আন্টি। তিনি আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন। আরো পরিষ্কার করে বলি-বাবা তাকে বিয়ে করলেন। আচ্ছা। আপনি কি বাবার ওপর বিরক্ত হচ্ছেন? কেমন মানুষ, একের পর এক বিয়ে করে যাচ্ছে! দয়া করে বিরক্ত হবেন না। আমার বাবা অসাধারণ একজন মানুষ। এই যা মাথা ধরা নিয়ে অনেকক্ষণ লিখে ফেললাম। আচ্ছা আপনার কি এখন মাথা ধরেছে? কেন জিজ্ঞেস করলাম জানেন। ধরুন। আপনি একজনের সঙ্গে কথা বলছেন! যার সঙ্গে কথা বলছেন তার প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই দেখবেন আপনারও মাথা ধরেছে। কোনো কারণ ছাড়াই ধরেছে। এটা বহুল পরীক্ষিত একটা ব্যাপার। আমি অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি! আপনিও করে দেখতে পারেন। এবার আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। বলুন তো কোন প্রাণীর দুটা লেজ? খুব সহজ! একটু চিন্তা করলেই পেয়ে যাবেন। মিসির আলি পড়া বন্ধ করলেন। তিনি অনেক ভেবেও বের করতে পারলেন নাকোন প্রাণীর দুটা লেজ। একবার টিকটিকির কথা মনে হয়েছিল। টিকটিকির একটা লেজ খসে গেলে আরেকটা গজায় সেই অর্থে টিকটিকিকে দুই লেজের প্রাণী কি বলা যায়? না-টিকটিকি হবে না। উত্তরও কোথাও দেয়া নেই। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলেই উত্তরটা জানা যাবে। দেখা হবার সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো তেমন কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। কারণ মেয়েটিকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা তিনি করছেন না। বয়সের কারণে তাঁর ভেতর এক ধরনের আলস্য কাজ করা শুরু করেছে। আশপাশের জগৎ সম্পর্কে উৎসাহ কমে যাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ। আত্মার মৃত্যু হলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটে। কোনো কিছুই মনকে আকৃষ্ট করে না। আত্মার মৃত্যু হয়েছে কি হয় নি তা বের করার একটা সহজ পদ্ধতির কথা তিনি জানেন। বৃষ্টি কেটে যাবার পর আকাশে যখন রঙধনু ওঠে সেই রঙধনুর দিকে তাকিয়ে যে চোখ নামিয়ে নেয় এবং দ্বিতীয়বার তাকায় না, তার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। আকাশে রঙধনু না উঠলে তিনি তাঁর আত্মার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না। মৃত আত্মাকে জীবনদান করারও কিছু পদ্ধতি আছে। সবচে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে শিশুদের সঙ্গে মেশা। শিশুরা সব সময় তাদের আশপাশের মানুষদের তাদের আত্মা থেকে খানিকটা ধার দেয়। সমস্যা হচ্ছে শিশুদের মিসির আলি তেমন পছন্দ করেন না। এদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। শিশুরা সুন্দর-অসম্ভব সুন্দর। যে কোনো বড় সৌন্দর্যকে দেখতে হয় দূর থেকে। যত দূর থেকে দেখা যায় ততই ভালো। কুৎসিত জিনিস দেখতে হয় কাছ থেকে, সুন্দর জিনিস দূর থেকে। এটা যেন কার কথা? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি কি দুর্বল হতে শুরু করেছে? ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মস্তিষ্ক তার মেমোরি সেলে জমিয়ে রাখা
false
toslima_nasrin
ধান্দাই ত আসল। ধান্দাতেই তো পয়সা। বেতন আর কত পাই! ছোটদা ঠোঁট ওল্টান। শোন, গীতার কাছে কিন্তু কোনওদিন কইস না এই মেয়ের কথা। কেন, কি হইব কইলে? উপায় নাই। আমি কোনও মেয়ের সাথে কথা কইলে গীতা কোনওদিন সহ্য করে নাই। সর্বনাশ হইয়া যাবে জানলে। ছোটদা সে দিনই চলে যান ঢাকায়। তাঁর ময়মনসিংহে আসার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল গীতাদের পিয়নপাড়ার বাড়িতে টাকা দিয়ে যাওয়া। ওখানে ভাঙা টিনের ঘর ভেঙে দিয়ে এখন দালান তোলা হচ্ছে। বাবা আগের মত প্রতাপ নিয়েই আছেন। বড়দাদা মারা যাওয়ার পর বড়দাদার নামে যত জমি বাবা কিনেছিলেন, নিজের এবং ভাইদের নামে সমান ভাগ করে দেবেন উদ্দেশ্য নিয়ে যখন গ্রামে গিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য ভ্রাতা রিয়াজউদ্দিন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সিরাজউদ্দিনকে সঙ্গী করে বাবার মাথা মুলি বাঁশের আঘাতে ধরাতলে ফেলে ফের যদি গ্রামমুখো হন তবে জীবন নিয়ে আর ফিরতে হবে না হুমকি দিয়ে শহরের আপদকে শহরে বিদেয় করেন। বাবা বাড়ি ফিরে সাতদিন যত না শরীরের তার চেয়ে বেশি মনের অসুখে ভগু তে থাকেন। সারা জীবন আমি এ কি করলাম হায় হায় করেন, মা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ওদের ভালর জন্যই তো করছেন, এখন আর পস্তাইয়া কি হইব! শরীর সারে বাবার, মনের হাহারবও দূর হয়। জমির নেশা ধাঁ করে ছুটে এসে আবার তাঁকে কামড়ে ধরে। নানির বাড়ির পাশে কড়ইতলা, তার সামনে বিশাল খোলা মাঠ, ছোটবেলায় যে মাঠে আমরা গোল্লাছুট ডাংগুলি চোর চোর ক্রিকেট ইত্যাদি রাজ্যির খেলা খেলতাম, যে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম, বস্তির মেয়েরা গোসল করত কাপড় ধুতো, মাঠের কিনারে বেড়ার যত ঘর ছিল সব কিনে নিয়ে ভেঙে চুরে বুজে সাফ করে পঁচিশটি বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন বাবা। দেয়াল তুলে দিয়েছেন রজব আলী কলোনির চারদিকে। দেয়াল তুলতে গিয়ে নানির বাড়ি থেকে বেরোবার রাস্তা গেছে বন্ধ হয়ে। নানি অনুযোগ করেন। কি গো নোমানের বাপ, রাস্তা যে বন্ধ কইরা দিলাইন! বাবা নানিকে কৈফিয়ত দেন না। কেবল আকুয়ায় জমি কিনে তাঁর আশ মেটে না। অবকাশের দেয়াল ঘেঁষা বাড়ির মালিক প্রফুল্ল ভট্টাচার্য মরে যাওয়ার পর যেদিন টপু করে তাঁর বউটিও মরে গেলেন, একটিই মেয়ে বোম্বে থাকে, সে মেয়ে মায়ের সৎকার করতে আসেনি, ঘর বাড়ি জিনিসপত্র জায়গাজমির দায়িত্ব নিতেও না, বাবা তক্কে তক্কে রইলেন প্রফুল্লর জমিটি সস্তায় কারও কাছ থেকে কিনতে পারেন কি না। বাবার তক্কে তক্কের মাথায় চাটি মেরে একদিন পরিমল সাহা প্রফুল্লর বাড়িতে বাস শুরু করলেন। প্রফুল্লর উত্তরাধিকারি জমি নিতে আসেনি, অনাত্মীয় প্রতিবেশি পরিমল সাহা প্রফুল্লর জায়গা দখল করে নিয়ে, বাবার বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে নতুন ঘর তোলার স্পর্ধা দেখিয়েছে। কেন তুলবে ঘর, বাবা পরিমলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। মা বলেন, এ তো আর এমন না যে আপনের জায়গার উপরে ঘর তুলছে, আপনের কোনও ক্ষতি করছে! খামাকা মানুষের বিরুদ্ধে লাগেন কেন! বাবার কটমট করে তাকানো চোখের দিকে তিক্ততা ছুঁড়ে দেন,ছোটলোকের পয়সা হইলে মানুষরে আর মানুষ জ্ঞান করে না। মা ঠিক বলেননি, বাবা কিন্তু কিছু মানুষকে নিজের ভাইয়ের ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাইদের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। আমানউদদৌলা গফরগাওঁ এ চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, গফরগাওঁ থেকে নেত্রকোনা বদলি হয়ে ওখানেও আরেকটি বিয়ে করেছেন। ভাইদের একাধিক বিয়েতে বাবার কোনও আপত্তি নেই। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহে এলে চেম্বারে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমানউদদৌলা, চাকরি বাকরি কেমন চলছে, টাকা পয়সা কেমন রোজগার হচ্ছে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন বাবা, কখনও তাঁর বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন না। আমানউদদৌলার ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া করার সমস্ত খরচ দিচ্ছেন। প্রতি মাসেই আমানউদদৌলার বড় বউ এসে ছেলেমেয়ের ইশকুল কলেজের বেতন, মাস্টারদের বেতন, বই খাতা কেনার টাকা, বাড়িভাড়া এমনকি খাওয়ার দাওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে যান বাবার কাছ থেকে। বংশ প্রতিপালনে বাবার কোনও না নেই। হাসিনাকে বিএডএমএড পাশ করিয়ে ইশকুলের শিক্ষিকা বানানোর জন্য বাবার অতি-আবেগ দেখে মা একদিন বলেছিলেন, ছেলের বউএর লাইগা এত যে করতাছেন, ইয়াসমিনের কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াডাও তো ঠিক মত দেন না! মানুষ তো নিজের মেয়ের জন্য করে, মেয়ে বাদ দিয়া ছেলের বউরে লইয়া পড়ছেন কেন? বাবা ধমকে থামান মাকে, ছেলের বউ লেহাপড়া শিইখা নাম করলে কার লাভ? ইশকুল কলেজের মাস্টার হইলে কার লাভ? মাইনষে কি কইব হাসিনা মমতাজ অমুক ইশকুল বা অমুক কলেজে মাস্টারি করে? কইব ডাক্তার রজব আলীর ছেলের বউ মাস্টারি করে। ছেলের বউ আইছে আমার বংশে, মেয়ে ত যাইব গা পরের বংশে। মার গলায় ধিক্কারের সুর ওঠে, বংশ বংশ বংশ। বংশ ধুইয়া পানি খাইবাইন? আপনের মেয়ের আপনের প্রতি যে দরদ, সেই দরদ কি ছেলের বউএর কাছ থেইকা পাইবাইন? নিজের নামের কথা এত ভাবেন, নিজের বউরে যে কিছু দেন না, এই সব যদি মানুষে জানে, আপনের নাম কই যাইব? মার প্যাঁচাল শোনার জন্য বাবা অপেক্ষা করেন না। তিনি চেম্বারে চলে যান রোগী দেখতে। তাঁর অনেক রোগী। আলাদা চেম্বার করার পর থেকে কিছু কিছু বাঁধা মেয়ে-রোগী নিয়ে চেম্বারের দরজা বন্ধ করতে শুরু করেছেন। মা একদিন বাবার পছন্দের গাজরের হালুয়া বানিয়ে বাটিতে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চেম্বারে, বাবা যেন রোগি দেখার ফাঁকে হালুয়াটুকু খান। চেম্বারের বন্ধ দরজায় টোকা দিয়েছেন অনেকক্ষণ। টোকার পর
false
MZI
আসতে যে কোনো কারণ লাগে না – বরং উল্টোটাই সত্যি, দেশ ত্যাগী হওয়ার পিছনে ভালো কারন থাকা দরকার সেটা কাকে বোঝাব? প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ই-মেইল ইন্টারনেট আবিষ্কার হয়নি, ডজন হিসেবে টিভি চ্যানেল ছিলো না, টেলিফোন অনেক মূল্যবান বিষয় ছিল, মায়ের ফোন ছিল না থাকলেও আমার তাকে নিয়মিত ফোন করার সামর্থ্য ছিল না। যোগাযোগ ছিলো চিঠিতে – চিঠি লিখলে সেটা দেশে আসতে লাগতো দশ দিন, উত্তর আসতে লাগতো আরো দশ দিন। মেল বক্সে দেশ থেকে আসা একটা চিঠি যে কী অবিশ্বাস্য আনন্দের বিষয় ছিল সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। সেই সময়ে আমার মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন। আমি জানি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে প্রতি সপ্তাহে আমার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। আমার মা তার গুটি গুটি হাতের লেখায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাসার খবর দিয়েছেন, ভাইবোনদের খবর দিয়েছেন, আত্নীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন, এমন কী দেশের খবরও দিয়েছেন। আমার প্রবাস জীবনে দেশ কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আমার মায়ের চিঠির কারনে। কয়েক বছর পর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও পিএইচডি করতে আমেরিকা এসেছিল, তখন আমার মা প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি লিখতেন – একটি আমাকে আরেকটি আমার ভাইকে। আমার মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো বাঁচিয়ে রাখিনি – এখন চিন্তা করে খুব দুঃখ হয়। যদি চিঠিগুলো থাকতো তাহলে সেটি কী অসাধারণ দলীল হতো আমি সেটি চিন্তাও করতে পারি না। আমার মা খুবই সাধারণ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন – অন্তত আমরা সবাই তাই জানতাম। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন আমাদের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পরনের কাপড় নেই, তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই আমার মায়ের একটা সংগ্রামী নূতন রুপ আবিষ্কার করলাম। আমরা ভাইবোনেরা সবাই লেখাপড়া করছি – কিছুতেই লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না তাই বাবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স আর পেনশনের অল্প কিছু টাকার উপর ভরসা করে ঢাকায় স্থায়ী হলেন। কী ভয়ংকর সেই সময়, এখন চিন্তা করলেও আমার ভয় হয়! বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের জন্যে আমার মা একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন। আমি পত্রিকায় কার্টুন আঁকি – গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করি, এভাবে কোনোমতে টিকে আছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাশ করে একটা চাকরী পাবে সবাই সেই আশায় আছি। এরকম সময় আমি একদিন হঠাৎ করে বলাকা সিনেমা হলের নিচে একটা বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলী আবিষ্কার করলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম তিনশ টাকা! (এখনকার টাকায় সেটি নিশ্চয়ই দশ বারো হাজার টাকার সমান হবে!) এতো টাকা আমি তখনো একসাথে হয়তো ছুয়েও দেখিনি। এই বইয়ের সেট আমার ধরা ছোয়ার বাইরে। তবু আমি বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখি, লোভে আমার জিভে পানি এসে যায়। যাই হোক বিকালবেলা বাসায় ফিরে এসেছি, ভাইবোনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি তখন মানিক গ্রন্থাবলীর সেটটার কথাই শুধু ঘুরে ফিরে বলছি, কী অপূর্ব সেই বইগুলো, দেখে কেমন লোভ হয় কিছুই বলতে বাকী রাখি নি। আমার মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কতো দাম?” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তিনশ টাকা।” আমার মা বললেন, “আমি তোকে তিনশ টাকা দিচ্ছি, তুই কিনে নিয়ে আয়।” আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের পরিবারের তখন যে অবস্থা তখন প্রত্যেকটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করা হয়। তার মাঝে আমার মা আমাকে তিনশ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন এরকম ভয়ংকর একটা বিলাসিতার জন্যে? “মানিক গ্রন্থাবলী” কিনে আনার জন্যে? টাকাটা কোথা থেকে দিচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে বই কিনে ফেলার পর সংসারের কোন চাকাটা অচল হয়ে পড়বে আমার সেইসব জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো! আমি তার কিছুই করিনি। মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম, ভয়ে বুক ধুকধুক করছে, এর মাঝে যদি কেউ সেই বইগুলো কিনে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে? বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখলাম বইগুলো তখনো আছে। আমি টাকা দিয়ে লোভীর মতো মানিক গ্রন্থাবলীর পুরো সেট ঘাড়ে তুলে নিলাম। আহা কী আনন্দ! বাসার সবাই বই পড়ে, তাই সেই আনন্দ শুধু আমার একার নয়, সবার। কেউ তখন বাসায় এলে বিচিত্র একটা দৃশ্য আবিষ্কার করতো, ঘরের একেক কোনায় একেকজন বসে, শুয়ে, আধাশোয়া হয়ে, কাত হয়ে, সোজা হয়ে মানিক গ্রন্থাবলী পড়ছে! তারপর বড় হয়েছি, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক কিছু কিনতে হয়, অন্য অনেকের মতো আমিও কিনেছি। আমেরিকা থাকতে শো রুম থেকে নূতন গাড়ী কিনে ড্রাইভ করে বাসায় এসেছি, ঝকঝকে নূতন বাড়ীও কিনেছি – কিন্তু সেই মানিক গ্রন্থাবলী কেনার মত আনন্দ আর কখনো পাইনি, আমি জানি কখনো পাব না। এটি আমার জীবনের ঘটনা, যারা আমার মায়ের কাছাকাছি এসেছে তাদের সবার জীবনে এরকম ঘটনা আছে। কাউকে কিছু কিনে দিয়েছেন, কাউকে অর্থ সাহায্য করেছেন, কাউকে চিকিৎসা করিয়েছেন, কাউকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন কিংবা কাউকে শুধু আদর করেছেন, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। আমরা যখন আমেরিকা থাকি তখন একবার তাঁকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলাম। আমেরিকা দেখে আমার মা খুবই অবাক, তাঁর শুধু একটাই প্রশ্ন, “মানুষ জন কোথায় গেল?” আমরা তাঁকে বোঝাই, মানুষ জন কোথাও যায়নি – যাদের দেখছেন তারাই আমেরিকার মানুষ!
false
shomresh
বলতে পারেন এমন মানুষও তো নেই তার আশেপাশে। শেষপর্যন্ত ভদ্রমহিলা বললেন যেহেতু এটা কলোনি, সবাই সবাইকে চেনে, তাই অনামীয় কোন পুরুষকে সঙ্গে আনা ঠিক নয়। দীপা যে একা থাকবে তা লোকে জেনে গেছে। এরই মধ্যে। অনামীয় কোন পুরুষ এলে কথা উঠবে। মনে পাপ না থাকলেও ঝামেলা ডেকে এনে লাভ কি! দীপা শক্ত হয়ে গেল। সে কার সঙ্গে মিশবে, কে তার কাছে আসবে তা কলোনির লোকেরা ঠিক করে দেবে? সে কি শিশু? কোন ছেলের ক্ষেত্রে কেউ এমন কথা বলত? রাধার মা সম্ভবত বুঝলেন দীপার মনের কথা। বোঝানোর ভঙ্গীতে তিনি বললেন যে মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই যে শমিত এসেছে তার মনের ভেতরে কি আছে তা কেউ জানে? আত্মীয়তা হল একটা বেড়ার মত যা কিছু চেরা স্রোতকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখে। আর দীপারা তো তাঁর মত পরাধীন নয়, বাইরে যাচ্ছে, তা বাইরের মানুষকে বাইরে রাখলেই হয়, ঘরে আনার দরকার কি। সে যখন আত্মীয় নয়। তা ছাড়া দীপা যে ঘর ভাড়া নিয়েছে তার বাড়িওয়ালা যদি আপত্তি করে কেউ আসার জন্যে তাহলে ঘর ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমতীর কাজ হবে না। আগে নিজের স্বাৰ্থ সামলে রাখো তারপর অন্য ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে যাও। একেই কি বলে অ্যাডজাস্টমেণ্ট? আধুনিক মানুষের যেটা শেখা সবচেয়ে জরুরী? এক্ষেত্রে বিদ্রোহ করলে বাড়িওয়ালা তাকে ঘর ভাড়া নাও দিতে পারেন। সে কোন অন্যায় করছে না জেনেও এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া কি ঠিক হবে? দীপা গম্ভীর হয়ে আছে দেখে রাধার মা বললেন, এখানে তো তুমি একা থাকরা না। আমরা আছি। বাইরের বন্ধুদের যদি বাসায় না আনো তাহলে কি এমন ক্ষতি? না, তেমন কিছু ক্ষতি নেই। তার বেঁচে থাকার পক্ষে ব্যাপারটা জরুরীও নয়। অতএর এক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টমেণ্ট করলে কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তার। দীপা বাইরে বেরিয়ে এল। এসে দেখল একগাদা কুচো এবং রাধাকে গল্প শোনাচ্ছে শমিত। সবাই খুব মন দিয়ে শুনিছে। এই সময় রান্নাঘর থেকে চা এল। গল্প শেষ হলে চা খেতে খেতে শমিত জিজ্ঞাসা করল, তোমার নতুন ঘর-প্ৰবেশ কখন হবে? দেখে যাব নিশ্চয়ই! না। আপনার দেখা হবে না। কারণ আমি এখন যাচ্ছি না ওখানে। কেন? অসুবিধে আছে। দেরি হবে একটু। চায়ের কাপ প্লেট নিচে নামিয়ে রেখে শমিত বলল, তাহলে চলি। অনেক পথ এক যেতে হবে। লণ্ড ওয়ে টু গো। আপনি কিন্তু এখনও বলছেন না কেন এসেছিলেন? শমিত ঘুরে দাঁড়াল, দীপা, আমাদের দলে নাটক করবে? মায়া পারছে না, এই তিনটে শো করা দলের জন্যেই খুব জরুরী। আমি? বুকে হাত রাখল। দীপা, আপনাকে যদি বলা হয় প্লেন চালাবেন, পারবেন? কোন প্ৰস্তুতি নেই, কোন অনুশীলন নেই, মন তৈরি নেই, এত সোজা? এরকম কথা যে ভাবতে পারে সে কিন্তু সাধারণ নয়। তা ছাড়া আমার বাসস্থান থেকে আপনার রিহার্সালরুমের দূরত্ব ভাবুন! হুম। শমিত আর দাঁড়াল না। তার বিশাল শরীর সোজা হেঁটে যাচ্ছিল। রাধা বলল, কিরকম যেন, না? সবার সঙ্গে মেলে না। মনে মুখে কোন ঢাকাঢাকি নেই। হঠাৎ দীপার খুব রাগ হয়ে গেল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, এখন তো ও চলে গিয়েছে। এবার আমি জিনিসপত্র নিয়ে আমার ঘরে যেতে পারি তো? কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব। এই সংসার নিজের, একদম একার। অথচ বাজার করা থেকে আরম্ভ করে বাসনামাজা সবই আছে। এসব করতে গিয়ে বেশ নেশাও ধরে। সময় কিভাবে বয়ে যায় টের পাওয়া যায় না। প্রথম রাত্রে রাধাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। কলকাতার হোস্টেলের ঠাকুরের রান্না খেয়ে মুখে যে অরুচি হয়েছিল তা এক রাত্রেই দূর হয়ে গিয়েছিল। রাধার মা চমৎকার রান্না করেন। অজলিও খারাপ রাঁধে না। তার রান্না খেতে অসুবিধে হয় না, ভালই লাগে। কিন্তু রাধার মায়ের রান্না খেয়ে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা প্ৰায় শিল্পের পযায়ে চলে গিয়েছে। অমরনাথ প্রায়ই বলতেন পূর্ববঙ্গের মহিলারা পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের চেয়ে চমৎকার রাঁধেন। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু রাধার মায়ের রান্না সে অনেককাল মনে রাখবে। প্ৰথম সকালে বাজার করে রান্না করার সময় ভাগ্যিস রাধা সঙ্গে ছিল। স্টেভ ধরিয়ে রান্না করতে সে বেশ হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলি তাকে কোনদিন রান্না করতে দেয়নি। মন দিয়ে লেখাপড়া কর, তাতেই আমি কৃতাৰ্থ হব। এই ধরনের কথা বলত। হোস্টেলে আসার পর তো সেই প্রশ্ন ওঠে না। শুধু দেখার চোখ দিয়ে যেটুকু, ভাত সেদ্ধ আর মাছ কিংবা ডিমের ঝোল। কখনও সেদ্ধর বদলে ভাজা। দুঃসাহসী হলে কোন কোন দিন খুব খারাপ, স্বাদের তরকারি। একরেলায় রান্না করে দুবেলায় খাওয়া। প্রথমদিকে রান্না শেষ করতে প্ৰায় দুপুর। দেখা গেল। রাধা তার চেয়ে অনেক পটু এ ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েদের যে-সহজাত প্ৰবণতা আছে তা থেকেই ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। রাত্রে একা থাকতে ঠিক ভয় নয়, অস্বস্তি হচ্ছিল। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে সামান্য শব্দ হলেই এক ধরনের উৎকণ্ঠা হচ্ছিল। অন্য সময় অস্বস্তি। যেন এই মাত্র কেউ এসে দরজায় শব্দ করবে। রাধার মা বলেছিলেন প্রয়োজন মনে করলে সে রাধাকে নিয়ে শুতে পারে। দীপা রাজি হয়নি। তার জন্য রাধা কেন কষ্ট করবে। আর ঘর ভাডা নিয়ে যে একা থাকতে চাইছে তার কারো ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। রাতে শুয়ে দীপা ভাবছিল, সব ভাল, শুধু রান্নার পর বাসনপত্ৰ হাঁড়ি ধোয়ার ব্যাপারটা না থাকলে ঠিক হত। রাধা বলেছিল সে ইচ্ছে করলে একটা কাজের লোক রাখতে
false
shunil_gongopaddhay
কন্যা প্রতিভার বিয়ের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। ‘বাল্মকী প্রতিভা’র সেই প্রতিভা এখন অনেক বড় হয়েছে, বয়েস প্রায় একুশ। লেখাপড়ায় সে যেমন ভালো, তেমনই তার গানের গলা। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী এই বিশেষণ এমন মেয়েকেই মানায়। হেমেন্দ্রনাথ এই মেয়ের বিয়ে দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি, প্রতিভাকে অনবরত লেখাপড়া শিখিয়ে যাওয়াতেই যেন শুধু তার উৎসাহ। এমন কি প্রতিভা একটু বড় হবার পর বাড়ির অন্য ছেলেদের সঙ্গেও তাকে মিশতে দিতেন না হেমেন্দ্রনাথ। হেমেন্দ্রনাথ আর নেই, এখন তাঁর ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিতে হবে অন্য ভাইদেরই। রবির ধারণা আশুর সঙ্গে প্রতিভাকে খুবই মানাবে। কিন্তু দুটি বাধা আছে। প্রতিভা সাবালিকা হয়েছে, এখন তার পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব আছে। তা ছাড়া উভয় পক্ষই ব্ৰাহ্মণ হলেও ঠাকুররা রাঢ়ী শ্রেণীর আর চৌধুরীরা বারেন্দ্র। রাঢ়ী-বারেন্দ্রের মধ্যে বিবাহের চল নেই। রবির মতে অবশ্য জাত-পাতের এই সব সূক্ষ্ম বিভেদ অর্থহীন। কিন্তু বাবামশাইয়ের কী মত পাওয়া যাবে! আশুর বাবারও মত নেবার প্রয়োজন আছে। আরও একটা বাধা আছে। আশুর বাবা এমন সুপাত্রের জন্য নিশ্চয়ই অনেক যৌতুক ও পণ চাইবেন। দেবেন্দ্রনাথ অনেক হিন্দু রীতিনীতি মানলেও পণপ্রথার ঘোর বিরোধী। নাতনীর বিবাহে তিনি অবশ্যই দু হাত ভরে যৌতুক দেবেন, কিন্তু পাত্র-পক্ষের কোনও দাবি থাকলে বেঁকে বসবেন। রবি একদিকে আশুকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনল। বসাল তিনতলায় নিজের মহলে। মৃণালিনী এমনিতেই বাইরের লোকের সামনে বিশেষ আসতে চায় না, এখন তার শরীরে গর্ভলক্ষণ স্পষ্ট, এখন পরপুরুষের নজরে আসার প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিভাকে ডেকে আনা হয়েছে কেক-পেস্ট্রি চা পরিবশনে সাহায্য করার জন্য। লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে প্রতিভা কথাবার্তায় অত্যন্ত সপ্রতিভ, অন্য মেয়েদের মতন সে অপরিচিতদের সামনে লজ্জায় বাক্যহারা হয়ে যায় না। রবি গান-বাজনার প্রসঙ্গ তুলে প্রতিভাকেও যোগ দেওয়ালো সেই আলোচনায়। বাংলা গান তো বটেই, বিলিতি সঙ্গীতও বেশ ভালো জানে প্রতিভা। একবার আশুদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বেশ নাকাল হয়েছিল রবি। কৃষ্ণনগরে গান-বাজনার খুব চর্চা আছে, শিক্ষিত ভদ্ৰ ব্যক্তিরা প্রায় সবাই মাৰ্গ সঙ্গীত বোঝে। সব জায়গাতেই রবিকে গান গাইতে অনুরোধ করা হয়, সেখানে গান শুরু করেছিল রবি। রামকেলি রাগে ‘জিন ছুঁয়া মোরি বেঁয়া নগরওয়া’ এই হিন্দি গান ভেঙে সে গাইছিল ‘বাঁশরী বাজাতে চাহি বাঁশরী বাজিল কই’। রামতনু লাহিড়ির ছেলে সত্য লাহিড়ির বাড়িতে বসেছিল সেই আসর। রবির গানটি শেষ হবার পর একজন হঠাৎ মন্তব্য করেছিল, হ্যাঁ, বাঁশরী তো অনেকেই বাজাতে চায়, কিন্তু বাজাতে চাইলেই কী বাঁশরী বাজে? বাঁশরী বাজাতে গেলে ভালো করে তালিম নিতে হয়! সে মন্তব্য শুনে হেসে উঠেছিল অনেকে। ওইসব শ্রোতারা রাগ সঙ্গীতে তান কর্তব শুনতে অভ্যস্ত। মিড় নেই, গমক নেই, হলক তান নেই, সাদামাটা সুরে গান আবার গান নাকি! ওদের ধারণা হয়েছিল, রবি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কিছু না শিখেই গাইতে বসেছে। সেই প্ৰসঙ্গ তুলে রবি বলেছিল, ভাই আশু, কলকাতার তুলনায় তোমাদের কৃষ্ণনগরের মানুষ অনেক পিছিয়ে আছে। বিশুদ্ধ রাগ সঙ্গীত ছাড়া কি গান হয় না! নানা ধরনের সুর মিশিয়েও তো কাব্য সঙ্গীত হতে পারে। কীর্তন কিংবা রামপ্রসাদী গানেও তো তানের বাড়াবাড়ি নেই, কথাগুলিই আসল। রামপ্রসাদ তো তোমাদের ওদিককারই লোক। আশু বলেছিল, গোঁড়ারা মানতে চায় না। রামপ্রসাদী বা কীর্তন কি বড় আসরে মর্যাদা পায়! অনেকে ভাবে ওসব মাঠ-ঘাটের গান। রবি বলল, খোলা মাঠের গানেরও কি মর্যাদা কম! বাংলার মাঝিরা যে ভাটিয়ালি গায়, রাখালরা বাঁশিতে যে সুর ধরে, তা কি আমাদের মন টানে না! রাগের বিশুদ্ধতা ধরে বসে থাকলে নতুন নতুন সুরের সৃষ্টি হবে কী করে? কথায় কথায় এদেশি সুরের সঙ্গে বিলিতি সুরের সংমিশ্রণের কথাও উঠল। উদাহরণ হিসেবে রবি কয়েকখানা গান শোনাতে বলল প্রতিভাকে। প্রতিভা গিয়ে পিয়ানোতে বসল। তারপর প্রতিভা একটার পর একটা গেয়ে যাচ্ছে, আর আশু যেভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তাতে রবি যেন একটা ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পেল। কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতিমান ব্যারিস্টার হয়ে উঠেছে আশু, যেমন তার প্রতিপত্তি তেমনিই অর্থাগম হচ্ছে প্রচুর, আর প্রতিভা সেই ব্যারিস্টারের উপযুক্ত গৃহিণী। সান্ধ্য পার্টিতে সে আমন্ত্ৰিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এইরকম ভাবে পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে শোনাবে। প্রতিভা ও আশু যে পরস্পরকে পছন্দ করেছে তা জানতে দেরি হল না রবির। এরপর সে চুঁচুড়ায় গিয়ে বাবামশাইয়ের কাছে কথাটা পড়ল। দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে। রবি ঘটকালি করছে! তাঁর পুত্রদের কার কী যোগ্যতা তা সঠিক বোঝেন দেবেন্দ্রনাথ। রবির ব্ৰহ্মসঙ্গীত রচনার প্রতিভায় দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছেন তিনি। কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় এ ছেলে যে তার অন্য সব ভাইদের ছাড়িয়ে যাবে, তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। জমিদারির কাজও কিছু কিছু শিখছে রবি। কিন্তু ঘটকালি করাও যে রবির পক্ষে সম্ভব, তা তিনি চিন্তা করেননি। কবিরা তো শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়ে দেয়, অন্য কোনও বিয়ে নিয়ে কি তারা মাথা ঘামায়! প্রতিভাকে যে এতদিন বিয়ে না দিয়ে অরক্ষণীয় করে রাখা হয়েছে, তার জন্য বেশ বিরক্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি নানান প্রশ্ন করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাত্রটির নিজের যোগ্যতা ও বংশপরিচয়ের কথা জানতে লাগলেন। তারপর অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনি হঠাৎ বললেন, এ তো খুবই উপযুক্ত প্রস্তাব। তিনি রাঢ়ী-বারেন্দ্রর প্রশ্ন তুললেন না, পাত্রের পিতার বৈষয়িক অবস্থা জানতে চাইলেন না, এ ছেলেটি যে পরম বিদ্বান, এটাই যেন তাঁকে আকৃষ্ট করল সবচেয়ে বেশি। তিনি রবিকে বললেন, যত শীঘ্র পার ব্যবস্থা করো। আমার আশীর্বাদ
false
toslima_nasrin
প্রয়োজনে নারী কোনও পেল না ফসল। কোথাও ভরসা দিলে বিনিময়ে সরাসরি পেতে চায় দেহ, দ্বিপদী জীবনের ভিড়, কোথাও মানুষ নেই, সকলে অচল। শরীরের ঘ্রাণ পেলে শেয়াল শকুনগুলো নখর বসায়, উপোসের আয়ু বাড়ে, অভাবের বানে ভাসে সুফলা সংসার। খড়কুটো আঁকড়িয়ে জীবন বাঁচালো নারী উজানের জলে, দাঁড়াবার মাটি নেই, তুমুল তুফানে নদী ভাঙে দুই পার। গলায় রুমাল বেঁধে শহরতলির ছেলে ভোলায় নারীকে, ঝোপের আড়ালে নারী প্রেম শিখে পার করে নিদ্রাহীন রাত, ধং্ব সের আগুন দেখে ভালোবেসে গলে যায় মোমের মতন, প্রেমিকের হাত ধরে অবুঝ কিশোরী মেয়ে ফেলে যায় জাত। ছলাকলা পৃথিবীর কিছুই জানে না নারী, অবাক দুচোখ! সুদূরে পালিয়ে দেখে ছেলের মুখোশ খুলে বিকট আদল, কোথাও স্বজন নেই, আটকা পড়েছে এক সুচতুর ফাঁদে, প্রেমান্ধ যুবতী মেয়ে শেখেনি চিনতে হয় কি করে আসল। আঁধার গলিতে ছেলে চড়াদামে বিক্রি করে রূপসী শরীর, সমাজের উঁচুমাথা তাবৎ বিজ্ঞেরা দেয় কপালের দোষ, শরীরের মাংস নিয়ে রাতভর হাট বসে, দরদাম চলে, আমাদের বোন ওরা, টাকার বদলে দেয় খানিকটা তোষ। আমার দেশের নারী গলিত শবের মত নর্দমায় ভাসে, ভয়াল রাতের গ্রাস আকাঙক্ষা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে রাখে বিষ, সজোরে হাত পা বেঁধে সেই বিষ কে ঢেলেছে এইসব মুখে? মরণের জ্বালা এরা পোহাতে জীবনভর পৃথিবীতে আসে? আরও নারীর মখু চোখে ভাসে আমার, আরও নারী আমাকে কাঁদাতে থাকে। কোলের বাচ্চাটা কাঁদে, পুঁজ ও পাঁচড়া ভরা ঘিনঘিনে দেহ, বুকে তার দধু নেই, বেকার রমণী চায় ঘরে ঘরে স্নেহ, শ্রমের জীবন চায়, বিনিময়ে ভাত চায় রাতে, সন্তানের শিক্ষা চায়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেতে চায় হাতে। এ হাতে কে দেবে চাবি, ওই চাবি কোন ঘরে, কে রাখে লুকিয়ে? অসুখে অভাবে ভুগে সন্তানেরা ফি বছর মরছে শুকিয়ে। মাস মাস স্বামী জোটে, গোখরা সাপের মত ফণা তুলে চায়, সোমত্থ শরীরে তারা সন্তানের বিষ ঢেলে গোপনে পালায়। ওই চাবি কোন ঘরে? পেতে চায় নারী খুব সিন্দুকের স্বাদ, আসলে একাকী নয়, দল বেঁধে যেতে হয় ভাঙতে প্রাসাদ। ইচ্ছে হয় প্রতিদিন এমন করে নারীর কষ্টগুলো লিখি, প্রতিদিন লিখি। কিন্তু জটিল চিকিৎসাশাস ্ত্র উড়িয়ে নিতে থাকে সমস্ত সময়। কলেজ থেকে ক্লাস করে বিকেলে বাড়ি ফিরে খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতেই আবার সময় হাসপাতালে যাওয়ার। প্রতিদিন নারী নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকা সম্ভব হয় না। এ তো টেবিলে বসে বই পড়া নয় আর, যে, বই থেকে মাঝে মাঝে চোখ সরিয়ে অন্য কিছুতে দিতে পারি। দৌড়োতে হয় হাসপাতালে। দিনেও যেমন, রাতেও তেমন। রোগী টিপে পরীক্ষা করতে হয়, এভাবেই পড়া। বইপড়া বিদ্যেয় ডাক্তার হওয়া যায় না, রোগী পড়তে হয়। মেডিসিনে যেমন রাজিব আমাদের বাড়তি ক্লাস নেন, গাইনি বিভাগে নেন হীরা, হীরা দীর্ঘদিন থেকে আছেন এই স্ত্রীরোগ আর প্রসুতিবিদ্যা বিভাগে, নিজে তিনি বড় কোনও ডিগ্রি নেননি, কিন্তু গাইনি বিদ্যায় তিনি এক নম্বর, কাটা ছেঁড়ায় তাঁর মত দক্ষ অনেক অধ্যাপকও নন। হীরা রোগিও পান প্রচুর। অনেকে বলে স্বয়ং জোবায়েদ হোসেনের চেয়ে হীরার প্র্যাকটিস ভাল। তা হয়ত বাড়িয়ে বলে, কিন্তু কলেজের সহযোগি অধ্যাপক সহকারি অধ্যাপক রেজিস্টার ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্টএর চেয়ে হীরার ভাল কামাই এ নিয়ে সন্দেহ নেই কারও। মেডিসিনে না হয় প্রভাকর পুরকায়স্থ আছেন, বাঘ নন তিনি যাই হন। জোবায়েদ হোসেনকে দেখে বাঘে ছাগলে একঘাটে জল খায়, এমন ভয়ঙ্কর। সার্জারির এনায়েত কবির যেমন। কোনো ধমক লাগানো বা দাঁত খিঁচিয়ে কিছু বলার দরকার হয় না, এ দুজনের উপস্থিতিই যথেষ্ট ছাত্রছাত্রীদের হাড় ঠাণ্ডা করে দেওয়ার জন্য।জোবায়েদ হোসেন ছফুট লম্বা, চোখে চশমা, ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট পরনে, লম্বা একটি এপ্রোন, খুলনার উচ্চারণে কথা বলেন, যখন ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ড ঘোরেন, পেছনে একগাদা ডাক্তার আর ছাত্রছাত্রী, যেন ভগবান হাঁটছেন, পেছনে পয়গম্বরবৃন্দ (ডাক্তার), শাগরেদবৃন্দ (ছাত্র-ছাত্রী)। কিন্তু নিজেকে যখন হাঁটতে হল জোবায়েদ হোসেনের, মনে হয়নি আমি তাঁর শাগরেদ,যেন বিচারের অপেক্ষায় থাকা আসামি। বিচারের সময় সামনে, পরীক্ষা সামনে। কি কারণে আমি জানি না, আমাকে নজরে রাখেন তিনি। অধ্যাপকদের নজর দু প্রকার, এক খারাপ, দুই ভাল। নজরে পড়ার পর ঠিক বুঝে পাই না, এ ঠিক কোন ধরনের নজর। কখন কোন ক্লাসে দেরি করে এসেছি, প্রসবকক্ষে কতগুলো প্রসব ঘটিয়েছি এসব তাঁর মুখস্ত একরকম। আচমকা স্ত্রীরোগসম্পর্কিত জটিল কোনও প্রশ্ন করে বসেন যে কোনো জায়গায়, ওয়াডের্, করিডোরে, অপারেশন থিয়েটারে, প্রসবকক্ষে। আমাকে তটস্থ থাকতে হয়, ক্লাস শেষ হলে জোবায়েদ হোসেন যে পথে যান তার আশপাশ দিয়েও আমি হাঁটি না। দূর থেকে তাঁকে দেখলে দ্রুত আমার গতি এবং গন্তব্য দুইই পরিবর্তন করি তাঁর মুখোমুখি না হওয়ার জন্য। মুখোমুখি হওয়ার একটি বিপদ আছে, অবশ্য না হওয়ারও বিপদ আছে। মুখোমুখি হলে তিনি আচমকা প্রশ্ন করতে পারেন, যার উত্তর, আমি নিশ্চিত নই আমার বিদ্যের ঝুড়িতে আছে। আর না হওয়ার বিপদটি হচ্ছে তিনি কোনো একদিন বলে বসতে পারেন এ মখু তো সচারচর দেখা যায় না হাসপাতালে, তার মানে পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছ। মুখ চিহ্নিত হওয়ার ভাল দিক যতই থাক, আমি এড়িয়ে চলি তাঁর ছায়া। অন্য ছাত্রছাত্রীরা দূর থেকে তাঁকে দেখলে শথ্ল পায়ে এপ্রোনটি টেনে টুনে এমনকি কোনো বই খুলে সে বইয়ের দিকে চোখ বুলোতে বুলোতে এগোয়, আর জোবায়েদ হোসেন কাছাকাছি হলে একটি সালাম ঠুকে দেয়। এটি করার কারণটি হচ্ছে ছাত্র বা ছাত্রীটি যে ক্লাসে কেবল নয় করিডোরেও পড়ছে এবং আদব কায়দাও
false
shottojit_roy
বটে, কিন্তু তার পরে তো… ফেলুদা এবার ছুটিল সিঁড়ির দিকে, পিছনে আমি আর লালমোহনবাবু। উঠোন পেরিয়ে সোজা খিড়কি দিয়ে বাইরে বাগানে হাজির হলাম। এখনও ভাল করে সূর্য ওঠেনি। অল্প কুয়াশাও যেন রয়েছে, কিংবা জমে থাকা উনুনের ধোঁয়া। গাছের পাতাগুলো শিশিরে ভেজা, পায়ের নীচে ঘাস ভেজা। পাখি ডাকছে-কাক, শালিক, আর আরেকটার নাম জানি না। আমরা বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে থমকে থেমে গোলাম। দশ হাত দূরে একটা কাঁঠাল গাছের গুড়ির ধারে নীল পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা একজন লোক পড়ে আছে। ওই পোশাক আমি চিনি; ওই চটিটাও চিনি। ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে দেখেই একটা আতঙ্ক আর আক্ষেপ মেশানো শব্দ করে পিছিয়ে এল। ও মশাই। লালমোহনবাবু আঙুল দিয়ে কিছু দূরে মাটিতে একটা জায়গায় পয়েন্ট করে কথাটা বললেন। জানি। দেখেছি, বলল ফেলুদা, ওটা ছোবেন না। ওটা দিয়েই জীবনবাবুকে খুন করা হয়েছে। ঝোপের ধারে পড়ে রয়েছে। কোণে পাথর বাঁধা একটা গামছা। ভোলানাথবাবুও বেরিয়ে এসেছেন, আর দেখেই বুঝছেন কী হয়েছে। ‘সর্বনাশ’ বলে মাথায় হাত দিয়ে প্রায় যেন ভিরমি লাগার ভাব করে তিন হাত পেছিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। এখন বিচলিত হলে চলবে না ভোলানাথবাবু, আপনি চলে যান ভদ্রলোকের সঙ্গে। এখানে পুলিশের ঘাঁটিতে গিয়ে খবর দিন। দরকার হলে শহর থেকে দারোগা আসবে। কেউ যেন লাশ বা গামছা না ধরে। কিছুক্ষণ আগেই এ কীর্তিটা হয়েছে। সে লোক হয়তো এখনও এ তল্লাটেই আছে। আর—ভাল কথা—মল্লিকমশাই যেন খুনের কথাটা না জানেন। ফেলুদা দৌড় দিল পশ্চিম দিকের পাঁচিল লক্ষ্য করে, সঙ্গে সঙ্গে আমিও। এ দিকের পাঁচিলের একটা জায়গা ধসে গিয়ে দিব্যি বাইরে যাবার পথ হয়ে গেছে। আমরা দুজনে টপকে বাইরে গিয়ে পড়লাম। ফেলুদার চোখ চারিদিকে ঘুরছে, এমনকী জমির দিকেও। আমরা এগিয়ে গেলাম। একশো গজের মধ্যে অন্য কোনও বাড়ি নেই, কারণ এটা সেই শর্টকাটের বাঁশবন। কিন্তু ওটা কী? একটা ভাঙা মন্দির। নিশ্চয় সেই বাদুড়ে কালী মন্দির। মন্দিরের পাশে একজন লোক, আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। কবিরাজ রসিক চক্রবর্তী।কী ব্যাপার? এত সকালে? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। আপনি খবর পাননি বোধহয়? কী খবর? মল্লিকমশাই— অ্যাঁ! কবিরাজের চোখ কপালে উঠে গেছে। আপনি যা ভয় পাচ্ছেন তা নয়। মল্লিকমশাই সুস্থই আছেন, তবে তাঁর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। আর জীবনবাবু খুন হয়েছেন—তবে এ খবরটা আর মল্লিকমশাইকে দেবেন না। রসিকবাবু ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেলেন। আমরাও ফেরার রাস্তা ধরলাম; খুনি পালিয়ে গেছে। পাঁচিল টপকে বাগানে ঢুকে এগিয়ে যেতেই তিন নম্বর বিস্ফোরণ। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। একি স্বপ্ন না। সত্যি? কাঁঠাল গাছের নীচটা এখন খালি। জীবনবাবুর লাশ উধাও। ঝোপের পাশ থেকে ঠগীর ফাঁসটাও উধাও। লালমোহনবাবু একটা গোলঞ্চ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছেন। কোনওরকমে ভদ্রলোক মুখ খুললেন। ভোলানাথবাবু পুপ্ৰ—পুলিশে খবর দিতে গেলেন, আমি আপনাদের খুঁজতে এসে দেখি… এসে দেখলেন লাশ নেই? ফেলুদা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল। না! ফেলুদা আবার দৌড় দিল। এবার পশ্চিমে নয়, পুবে। পুবের দেয়ালে ফাঁক নেই, কিন্তু উত্তরে আছে। কালকের সেই গর্ত—আজ দেখলাম সেটা একটা আম গাছের নীচ—আর পিছনেই ফাঁক। বড় ফাঁক, প্ৰায় একটা ফটক বললেই চলে। আমি আর ফেলুদা বাইরে বেরেলাম। দশ হাতের মধ্যেই একটা পুকুর, জলে টুইটম্বর। এই পুকুরেই যে ফেলা হয়েছে লাশ তাতে সন্দেহ নেই। আমরা ফিরে গিয়ে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠলাম দোতলায়। ও জীবন, ও বাবা জীবন!—ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন—এই যেন দেখলাম জীবনকে, গোল কোথায় ছেলেটা? গাল তোবড়ানো, চুল ছোট করে ছাঁটা, থান পরা আশি বছরের বুড়ি, ঘোলাটে চশমা পরে নিজের ঘর ছেড়ে বারান্দার এদিকে চলে এসেছেন। অ্যাদ্দিন গলা শুনেছি, আজ প্রথম দেখলাম ঠাকুমাকে। ফেলুদা এগিয়ে গেল।জীবনবাবু একটু বেরিয়েছেন। আমার নাম প্ৰদোষ মিত্র। আপনার কী দরকার আমাকে বলতে পারেন। তুমি কে বাবা? আমি জীবনবাবুর বন্ধু। তোমাকে তো দেখিনি। আমি দুদিন আগে এসেছি কলকাতা থেকে। তুমিও কলকাতায় থাকো? আজ্ঞে হ্যাঁ। কিছু বলার ছিল আপনার? বুড়ি হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। ঘাড় উঁচু করে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে বললেন, কী বলার ছিল সে আর মনে নেই বাবা, আমার বড্ড ভোলা মন যে! আমরা ঠাকুমাকে আর সময় দিলাম না। তিনজনে গিয়ে ঢুকলাম শ্যামলালবাবুর ঘরে। রসিকবাবু ইতিমধ্যে এসে হাজির হয়েছেন; তিনি শ্যামলালবাবুর নাড়ি ধরে বসে আছেন। জীবন কোথায় গেল? এখনও কেমন জানি অসহায় ভাব করে কথা বলছেন ভদ্রলোক। বুঝলাম রসিকবাবু জীবনবাবুর মৃত্যু সংবাদটা শ্যামলালবাবুকে দেননি। আপনি তো চাইছিলেন তিনি কলকাতায় ফিরে যান, বলল ফেলুদা। ও চলে গেল! কীসে গেল? পালকিতে? পালকিতে তো আর সবটুকু যাওয়া যায় না। কাটায়া থেকে ট্রেন ছাড়া গতি নেই। গোরুর গাড়ি বা ডাক গাড়িতে যাওয়া আজকের দিনে যে সম্ভব নয় সেটা নিশ্চয়ই বোঝেন। তুমি আমাকে বিদ্যুপ করছ? শ্যামলালবাবুর গলায় যেন একটু অভিমানের সুর। শুধু আমি কেন? ফেলুদা বলল, গ্রামের সবাই করে। আপনি যা করছেন তাতে আপনার তো নয়ই, কারুরই লাভ বা মঙ্গল হচ্ছে না। আপনার নিজের কী হল সেটা তো দেখলেন। সড়কির বদলে বন্দুকধারী একজন ভাল পাহারাদার থাকলে আর এ কাণ্ডটা হত। না। বৈদ্যুতিক শক-এর চেয়ে এ শকটা কি কিছু কম হল? যে-যুগ চলে গেছে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না মল্লিকমশাই। আশ্চর্য, আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন, কিন্তু সেটা হল না। ফেলুদার কথার উত্তরে একটি কথাও বললেন না। তিনি, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন।
false
bongkim
হইয়া দেবসেবায় বা ব্রাহ্মণভোজনে লাগে -তাহাদিগেরই ফলজন্ম বা মনুষ্যজন্ম সার্থক। কোনটি সুপক্ক হইয়া, বৃক্ষ হইতে খসিয়া পড়িয়া মাটিতে পড়িয়া থাকে, শৃগালে খায়। তাহাদিগের মনুষ্যজন্ম বা ফলজন্ম বৃথা। কতকগুলি তিক্ত, কটু বা কষায়-কিন্তু তাহাতে অমূল্য ঔষধ প্রস্তুত হয়। কতকগুলি বিষময়-যে খায়, সেই মরে। আর কতকগুলি মাকাল জাতীয়-কেবল দেখিতে সুন্দর। কখন কখন ঝিমাইতে ঝিমাইতে দেখিতে পাই যে, পৃথক্ পৃথক্ সম্প্রদায়ের মনুষ্য পৃথক জাতীয় ফল। আমাদের দেশের এক্ষণকার বড়মানুষদিগের মনুষ্যজাতিমধ্যে কাঁটাল বলিয়া বোধ হয়। কতকগুলি খাসা খাজা কাঁটাল, কতকগুলির বড় আটা, কতকগুলি কেবল ভুতুড়িসার, গরুর খাদ্য। কতকগুলি ইঁচোড়ে পাকে, কতকগুলি কেবল ইঁচোড়েই থাকে, কখন পাকে না। কতকগুলি পাকিলে পাকিতে পারে, কিন্তু পাকিতে পায় না, পৃথিবীর রাক্ষস-রাক্ষসীরা ইঁচোড়েই পাড়িয়া দালনা রাঁধিয়া খাইয়া ফেলে। যদি পাকিল ত বড় শৃগালের দৌরাত্ম্য। যদি গাছ ঘেরা থাকে ত ভালই। যদি কাঁটাল উঁচু ডালে ফলিয়া থাকে, ভালই; নহিলে শৃগালেরা কোনমতে উদরসাৎ করিবে। শৃগালেরা কেহ দেওয়ান, কেহ কারকুন, কেহ নাএব, কেহ গোমস্তা, কেহ মোছায়েব, কেহ কেবল আশীর্ব্বাদক। যদি এ সকলের হাত এড়াইয়া, পাকা কাঁটাল ঘরে গেল, তবে মাছি ভন্ ভন্ করিতে আরম্ভ করিল। মাছিরা কাঁটাল চায় না, তাহারা কেবল একটু একটু রসের প্রত্যাশাপন্ন। এ মাছিটি কন্যাভারগ্রস্ত, উহাকে এক ফোঁটা রস দাও,-ওটির মাতৃদায়, একটু রস দাও। এটি একখানি পুস্তক লিখিয়াছে, একটু রস দাও,-সেটি পেটের দায়ে একখানি সম্বাদ-পত্র করিয়াছে, উহাকেও একটু রস দাও। এ মাছিটি কাঁটালের পিসীর ভাশুর-পুত্রের শ্যালার শ্যালীপু্ত্র-খাইতে পায় না, কিছু রস দাও। সে মাছিটির টোলে পৌনে চৌদ্দটি ছাত্র পড়ে, কিছু রস দাও। আবার এদিকে কাঁটাল ঘরে রাখাও ভাল না-পচিয়া দুর্গন্ধ হইয়া উঠে। আমার বিবেচনায় কাঁটাল ভাঙ্গিয়া, উত্তম নির্জ্জল দুগ্ধের ক্ষীর প্রস্তুত করিয়া, কমলাকান্তের ন্যায় সুব্রাহ্মণকে ভোজন করানই ভাল। এ দেশের সিবিল সার্ব্বিসের সাহেবদিগকে আমি মনুষ্যজাতিমধ্যে আম্রফল মনে করি। এ দেশে আম ছিল না, সাগরপার হইতে কোন মহাত্মা এই উপাদেয় ফল এ দেশে আনিয়াছেন। আম্র দেখিতে রাঙ্গা, রাঙ্গা, ঝাঁকা আলো করিয়া বসে। কাঁচায় বড় টক-পাকিলে সুমিষ্ট বটে, কিন্তু তবু হাড়ে টক যায় না। কতকগুলো আম এমন কদর্য্য যে, পাকিলেও টক যায় না। কিন্তু দেখিতে বড় বড় রাঙ্গা রাঙ্গা হয়, বিক্রেতা ফাঁকি দিয়া পঁচিশ টাকা শ’ বিক্রয় করিয়া যায়। কতকগুলি আম কাঁচামিটে আছে -পাকিলে পানশে। কতকগুলো জাঁতে পাকা। সেগুলি কুটিয়া নুন মাখিয়া আমসী করাই ভাল। সকলে আম্র খাইতে জানে না। সদ্য গাছ হইতে পাড়িয়া এ ফল খাইতে নাই। ইহা কিয়ৎক্ষণ সেলাম-জলে ফেলিয়া ঠাণ্ডা করিও-যদি জোটে, তবে সেই জলে একটু খোশামোদ-বরফ দিও-বড় শীতল হইবে। তার পরে ছুরি চালাইয়া স্বচ্ছন্দে খাইতে পার। স্ত্রীলোকদিগকে লৌকিক কথায় কলাগাছের সহিত তুলনা করিয়া থাকে। কিন্তু সে গেছো কথা। কদলীফলের সঙ্গে ভুবনমোহিনী জাতির আমি সৌসাদৃশ্য দেখি না। স্ত্রীলোক কি কাঁদি কাঁদি ফলে? যাহার ভাগ্যে ফলে ফলুক-কমলাকান্তের ভাগ্যে ত নয়। কদলীর সঙ্গে কামিনী-গণের এই পর্য্যন্ত সাদৃশ্য আছে যে, উভয়েই বানরের প্রিয়। কামিনীগণের এ গুণ থাকিলেও কদলীর সঙ্গে তাঁহাদিগের তুলনা করিতে পারি না। পক্ষান্তরে কতকগুলি কটুভাষী আছেন, তাঁহারা ফলের মধ্যে মাকাল ফলকেই যুবতীগণের অনুরূপ বলেন। যে বলে, সে দুর্ম্মুখ- আমি ইঁহাদিগের ভৃত্যস্বরূপ; আমি তাহা বলিব না। আমি বলি, রমণীমণ্ডলী এ সংসারের নারিকেল। নারিকেলও কাঁদি কাঁদি ফলে বটে, কিন্তু (ব্যবসায়ী নহিলে) কেহ কখন কাঁদি কাঁদি পাড়ে না। কেহ কখন দ্বাদশীর পারণার অনুরোধে, অথবা বৈশাখ মাসে ব্রাহ্মণসেবার জন্য একটি আধটি পাড়ে। কাঁদি কাঁদি পাড়িয়া খাওয়ার অপরাধে যদি কেহ অপরাধী থাকে, তবে সে কুলীন ব্রাহ্মণেরা। কমলাকান্ত কখন সে অপরাধে অপরাধী নহে। বৃক্ষের নারিকেলের ন্যায় সংসারের নারিকেলের বয়োভেদে নানাবস্থা। করকচি বেলা উভয়েই বড় স্নিগ্ধকর -নারিকেলের জলে স্নিগ্ধ হয়-কিশোরীর অকৃত্রিম বিলাস-লক্ষণ-শূন্য প্রণয়ে হৃদয় স্নিগ্ধ হয়। কিন্তু দুই জাতীয়,-ফলজাতীয় এবং মনুষ্যজাতীয়, নারিকেলের ডাবই ভাল। তখন দেখিতে কেমন উজ্জ্বল শ্যাম -কেমন জ্যোতির্ম্ময়, রৌদ্র তাহা হইতে প্রতিহত হইতেছে-যেন সে নবীন শ্যাম শোভায় জগতের রৌদ্র শীতল হইতেছে। গাছের উপর কাঁদি কাঁদি নারিকেল, আর গবাক্ষপথে কাঁদি কাঁদি যুবতী, আমার চক্ষে একই দেখায় -উভয়ই চতুর্দ্দিক আলো করিয়া থাকে। কিন্তু দেখ-দেখিয়া ভুলিও না -এই চৈত্র মাসের রৌদ্র, গাছ হইতে পাড়িয়া ডাব কাটিও না-বড় তপ্ত। সংসারশিক্ষাশূন্য কামিনীকে সহসা হৃদয়ে গ্রহণ করিও না-তোমার কলিজা পুড়িয়া যাইবে। আম্রের ন্যায়, ডাবকেও বরফ-জলে রাখিয়া শীতল করিও-বরফ না জোটে, পুকুরের পাঁকে পুঁতিয়া রাখিয়া ঠাণ্ডা করিও-মিষ্ট কথায় না করিতে পার, কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তীর আজ্ঞা, কড়া কথায় করিও। নারিকেলের চারিটি সামগ্রী -জল, শস্য, মালা আর ছোবড়া। নারিকেলের জলের সঙ্গে স্ত্রীলোকের স্নেহের আমি সাদৃশ্য দেখি। উভয়ই বড় স্নিগ্ধকর। যখন তুমি সংসারের রৌদ্রে দগ্ধ হইয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, গৃহের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম কামনা কর, তখন এই শীতল জল পান করিও-সকল যন্ত্রণা ভুলিবে। তোমার দারিদ্র-চৈত্রে বা বন্ধুবিয়োগ-বৈশাখে-তোমার যৌবন-মধ্যাহ্নে বা রোগতপ্ত-বৈকালে, আর কিসে তোমার হৃদয় শীতল হইবে? মাতার আদর, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভক্তি, ইহার অপেক্ষা জীবনের সন্তাপে আর কি সুখের আছে? গ্রীষ্মের তাপে ডাবের জলের মত আর কি আছে? তবে, ঝুনো হইলে জল একটু ঝাল হইয়া যায়। রামার মা ঝুনো হইলে পর, রামার বাপ ঝালের চোটে বাড়ী ছাড়িয়াছিল। এই জন্য নারিকেলের মধ্যে ডাবেরই আদর। নারিকেলের শস্য, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। করকচি বেলায় বড় থাকে না; ডাবের অবস্থায় বড় সুমিষ্ট, বড় কোমল; ঝুনোর বেলায় বড় কঠিন, দন্তস্ফুট করে কার সাধ্য? তখন ইহাকে গৃহিণীপনা বলে। গৃহিণীপনা রসাল বটে, কিন্তু দাঁত
false