label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
humayun_ahmed
ছিলেন না। বসন্ত দাগওয়ালা আছেন। আজ তাঁর গায়ে খাকি পোশাক। শার্টের পকেটের উপর নাম লেখা। মনে হয় তার নাম আব্দুল গফুর। প্লাষ্টিকের র উঠে গেছে বলে নাম এখন আব্দুল গফু। এই থানার সবার নাম থেকে একটা করে অক্ষর উঠে যাচ্ছে কেন কে জানে! ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত না তো? আমাকে দেখে গফু সাহেব আনন্দিত হলেন বলে মনে হলো। তিনি পাশের কনস্টেবলকে বললেন, এদের হাজতে ঢুকিয়ে দাও। কুইক। আমি বললাম, কী কারণে হাজতে ঢোকাচ্ছেন জানতে পারি? আজকের খবরের কাগজ পড়েছ? জি-না স্যার। খবরের কাগজ পড়া থাকলে বুঝতে কেন হাজতে। তোমার কপালে আছে পাকিস্তানি ডলা। বলেই তিনি ওকিটকিতে কাকে যেন বললেন, আসামির সন্ধানে যেতে হবে না স্যার। আসামি নিজেই ধরা দিয়েছে। এই তো আমার সামনে, সঙ্গে দুটা ট্যাবলেট; জি স্যার হাজতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। না। ট্যাবলেট দুটা বিষয়ে কিছু জানি না। এক্ষুনি জানাচ্ছি। ওভার। গফু সাহেব ওয়াকিটকি নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এরা কারা? আমি বললাম, বড় জনের নাম কেয়া, তারপরেরটার নাম খেয়া। এদের নাম ক খ গ ঘ হিসেবে রাখা হচ্ছে। তারপরেরটার নাম হবে গেয়া। পঞ্চমটার নাম নিয়ে সমস্যা—ঙেয়া। তুমি দেখি রসে টুইটুম্বুর। রসমালাই হয়ে গেছ। চিপ দিয়ে রস বের করে শুকনা খড় বানিয়ে ফেলব। তুমি বাচ্চা দুটার কে? কেউ না। তবে ওরা আমাকে মামা ডাকছে। কথায় আছে না বাঁশতলায় বিয়াইছে গাই সেই সূত্রে মামা ডাকাই। গফু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ফাজলামি একদম বন্ধ। বাচ্চা দুটার বাবা কোথায়? আমি বললাম, জানি না স্যার। কেয়া কলাল, স্যার আমিও জানি না। খেয়া বলল, বড় আপা সত্যি জানে না। আল্লার কসম জানে না। বাবা করে কী? চাকরি গেছে। সর্বশেষ চাকরি গেছে রড চুরির কারণে। এরা দুই বোন হলো চোর কন্যা। এই তোমরা স্যারকে সালাম দাও। দুজনই একসঙ্গে বলল, স্লামালিকুম। স্লামালিকুম, স্লামালিকুম। গফু বললেন, এই ট্যাবলেট দুটাকে হাজতে ঢোকাও। এরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। আমি বললাম, স্যার একটা খবরের কাগজ কি দেওয়া যাবে? কী অপরাধে হাজতবাস সেটা কাগজ পড়ে জানতাম। আর একটা কথা না। কেয়া বলল, এত জোরে ধমক দিবেন না স্যার। আমি ভয় পাই। খেয়া বলল, বড় আপা খুব ভয় পায়। আল্লার কসম, বড়। আপা ভয় পায়। আমার হাতে যে খবরের কাগজ তাতে সেকেন্ড লিড় নিউজ হচ্ছে – টকশোতে রবীন্দ্ৰনাথ মন্ত্রী বিভ্ৰান্ত (স্টাফ রিপোর্টার) একটি টিভি চ্যানেলের লাইভ টকশোতে অবিকল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখা গেছে। তিনি বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর সঙ্গে একটি টকশোতে অংশ নেন। মন্ত্রী মহোদয় পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বারবার অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করতে বলেন, তারপরেও শো বন্ধ হয় না। শেষ পর্যায়ে উনি ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাড়ানোর পর একটি রবীন্দ্ৰনাথের গানের অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। যেসব দর্শক কিছুক্ষণের জন্যে হলেও প্রোগ্রামটি দেখেছেন তারাও মন্ত্রী মহোদয়ের মতোই বিভ্ৰান্ত। মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন। এটি বিরোধীদলের স্থূল ষড়যন্ত্র। জনতার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমাতেই এই সাজানো নাটকের আয়োজন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, কথিত রবীন্দ্রনাথকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রবীন্দ্ৰনাথ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। অনেক রাঘববোয়াল ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছে। এই প্রতিবেদক কথিত রবীন্দ্ৰনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানেন পুলিশের কাস্টডিতে এমন কেউ নেই। ওসিকে সাময়িকভাবে ক্লোজ করা হয়েছে। পুলিশের আইজি জানিয়েছেন, পুলিশের দিক থেকে কোনো অবহেলা হয়ে থাকলে দায়ী ব্যক্তি কঠোর শাস্তি পাবে। চ্যানেল আঁখি কর্তৃপক্ষের কেউ টেলিফোন ধরছেন না। চ্যানেল আঁখির মুখপাত্র হিসেবে ভাসান খান বলেছেন, ব্যাপারটা ক্ষুদ্র ভুল বুঝাবুঝি। জনৈক অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ভুলক্রমে টকশোর প্রোগ্রামে চলে যান। ভুল ধরা পড়া মাত্র অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। ভাসান খানের কাছে নাটকের নাম এবং পরিচালকের নাম জানতে চাইলে ভাসান খান আমতা আমতা করতে থাকেন। প্রতিবেদক ব্যাপক অনুসন্ধান করেও এমন কোনো নাটকের সন্ধান পান নি। বাংলাদেশ রবীন্দ্র গবেষণা পরিষদের প্রধান ড. হাকিমুল কবির বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্বকবি। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর রচনা, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। ভুল সুর এবং ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বর্তমানে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চ্যানেল আঁখি এই ফ্যাশনের আগুনে বাতাস অতীতে দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে কেন টকশোতে আনা হলো এর পেছনের উদ্দেশ্য জাতি জানতে চায়। রবীন্দ্র গবেষণা পরিষদ পুরো ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে দেশের বুদ্ধিজীবীরা আগামীকাল মানব বন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছেন। কাগজে মন্ত্রীমহোদয়ের সঙ্গে কথিত রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিটা প্রচারিত অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া। ছবিতে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্ত্রী মহোদয়কে এক পুরিয়া গাঁজা নিতে সাধাসাধি করছেন। এরকম খবর ছাপা হওয়ার পর হৈচৈ পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক; আমি হাত থেকে কাগজ নামাতে নামাতে বললাম, লাগ ভেলকি লাগ। কেয়া বলল, মামা! আমাদের কি জেল হয়ে গেছে? আমি বললাম, সেরকমই মনে হচ্ছে। খেয়া বলল, আমরা পাপ করেছি। এইজন্যে আমাদের জেল হয়েছে। পাপ করলে জেল হয়। কেয়া বলল, পাপ করলে ফাঁসিও হয়। মামা, আমাদের ফাঁসি হবে না তো? সম্ভাবনা কম। খেয়া বলল, ফাঁসি হলে জিভ এরকম বের হয়ে থাকে। তাই না মামা? খেয়া মুখ থেকে জিভ বের করে দেখাল। কেয়া বলল, হয় নাই। এরকম। খেয়া বলল, না এরকম। আমি
false
shirshendu
ওপর চোখে ছানি পড়তে লাগল। বদরুদ্দিনও বুড়ো মানুষ। চোখের নজর তারও তখন কমে এসেছে। তবু সওয়ারির জন্য কানা ঘোড়ায় ছাকরা গাড়ি জুতে বদরুদ্দিন রোজ বেরোত। তবে গণ্ডগোলও হত খুব। প্রথম-প্রথম আন্দাজে রাস্তা ঠাহর করত। পরে ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে সওয়ারির ধমক খেত। বদরুদ্দিন রেগে গিয়ে চাবুক চালাত শপাশপ। কিন্তু ঘোড়াটাই বা কী করে! মার খেয়ে বেচারা চিহিহি করে কেঁদে উঠত শুধু। তারপর একদিন গাঙ্গিনার পাড়ে রাস্তা ছেড়ে ঘোড়াটা গিয়ে পড়ল একটা মাদার গাছের ওপর। গলায় ফাঁস লেগে ঘোড়াটা আর ঘাড় ভেঙে বদরুদ্দিন নিজেও সেইখানেই মরে গেল। তা বলে গল্পটা শেষ হল না কিন্তু। শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বদরুদ্দিন। গা ছাড়া দিয়ে উঠল তার ঘোড়াও। দুজনেই তখন চোখে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ভাঙা গাড়িটায় আবার ঘোড়া জুতে নিল বদরুদ্দিন। তারপর পঙ্খিরাজের মতো উড়ে বেড়াতে লাগল শহরময়। মাঝরাতে না জেনে কেউ কেউ এখনও বদরুদ্দিনের ছ্যাকরা গাড়ির সওয়ার হয়। আর রাস্তা ভুল হয় না। বুড়ো সহিস লণ্ঠন হাতে এসে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যিখানে। ঘোড়র পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ও ছোটকর্তা, এবার নামো। ঘোড়ার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। আর না। কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া থামায়। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বসে হরনাথের পাশে। বলে, ওফ, দারুণ চালিয়েছি আজ। না, হরদা? খুব। দুজনেই চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। কুয়াশা এবং অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে। মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি আসে। কৃষ্ণকান্তর সত্যিকারের কোনও অভিভাবক নেই। হেমকান্ত তার প্রতি নজর দেন না। কেউই দেয় না। মাঝে মাঝে রঙ্গময়ি একটু-আধটু ডাক খোঁজ করে মাত্র। কৃষ্ণকান্ত বেড়ে উঠছে নিজের মতো করেই। সময় মতো লেখাপড়া করা আর ইস্কুলে যাওয়া ছাড়া বাদবাকি সময়টা সে কী করে বেড়ায় তার খোঁজ কেউ নেয় না। সুতরাং নানা সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করে সে। তিনতলার চোর-কুঠুরিতে পুরনো আমলের কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে। সেই ঘর থেকে একদিন একটা তরোয়াল বের কবে এনেছিল কৃষ্ণকান্ত। সারাদিন খোলা তরোয়াল হাতে করে ঘুরে বেড়াল। কয়েকজন অবশ্য বারণ করেছিল, সে শোনেনি। বস্তুত হেমকান্ত ছাড়া আর কারও কথা শোনে না সে। ফয়জলের গোটা দুই ছাগল আর ছানাপোনারা রোজই ঘাস খেতে আসে বারবাড়ির পশ্চিম দিককার গোচর-ভূমিটায়। কখন যে কৃষ্ণকান্ত সেখানে হাজির হয়েছে তা কেউ জানে না। হঠাৎ তার আর্তনাদ শুনে লোকজন ছুটে গিয়ে দেখল ধাড়ি ছাগলটার মুন্ডু খসে পড়ে আছে মাটিতে, ধড়টা ছটফট করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। কৃষ্ণকান্ত রক্তমাখা তবোয়াল হাতে দৃশ্যটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থরথর করে কাঁপছে। কৃষ্ণকান্ত চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে। বিশেষ করে ড়ুবসাঁতার। একদিন তার ইচ্ছে হল, অন্দরমহলের দিকে যে অথৈ পুকুরটা আছে তার তলা থেকে মাটি খামচে আনবে। যেই কথা, সেই কাজ। একদিন ড়ুব দিল তো দিলই। আর ওঠে না। হরি বিপদ বুঝে লোকজন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। যখন কৃষ্ণকান্তকে তোলা হল তখন মৃত্যুর ঘণ্টা প্রায় বেজে গেছে। হেমকান্তর অন্যান্য ছেলেরা যেমন শান্ত ও সুশীল কৃষ্ণকান্ত তেমন নয়। ঘরের চেয়ে বাইরের আকর্ষণ তার ঢের বেশি। বাড়ির পিছন দিকে পগারের ওপারে হেমকান্তর কিছু প্রজা বাস করে। তারা গরিব ও অসংস্কৃত। কৃষ্ণকান্ত নিয়মিত সেই পাড়ায় যায়। সেখানে তার একদঙ্গল অনুচরও জুটে গেছে। কৃষ্ণকান্ত তাদের সঙ্গী করে মাঝে মাঝে মারপিট লাগায় অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। এর ওর তার বাড়ি থেকে ফুল ফল চুরি করে। তাদের সঙ্গে ফুটবলও খেলে। ব্ৰহ্মপুত্রের ধারে যেসব ডিঙিনৌকো থাকে সুযোগ পেলেই কৃষ্ণকান্ত দড়ি খুলে সেগুলো স্রোতের মুখে ঠেলে দিয়ে আসে। বুড়ো রামভজুয়া দারোয়ানের কানে সে একবার গোকুলপিঠের গরম রস ঢেলে দিয়েছিল। রামভজুয়ার সেই কান একদম গেছে। হেমকান্তর কাছে অবশ্য এসব খবর বড় একটা পৌঁছয় না। প্রথম কথা, কৃষ্ণকান্ত যে হেমকান্তর আদরের ছেলে এটা সবাই জানে। দ্বিতীয় কথা, মা-মরা ছেলে বলে সকলেরই একটু মায়া আছে। তাই কেউ নালিশ করতে যায় না। হেমকান্তর বড় ছেলে কনককান্তি কলকাতায় তাদের কালীঘাটের বাড়িতে থাকে। শ্বশুরের সঙ্গে সে একটা ব্যাবসায় নেমেছে। ব্যাবসা কীসের তা খোঁজ করেননি হেমকান্ত। তবে আয় বোধহয় ভালই হচ্ছে। কনকান্তি টাকার জন্য বাপকে চিঠি লেখে না। সম্প্রতি সে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে কৃষ্ণকান্তকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে চায়। হেমকান্ত না বা হ্যাঁ কোনওটাই জানাননি। কৃষ্ণকান্তকে ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হবে। তবু তাকে যে কলকাতায় পাঠানোই উচিত তাও তার মনে হয়। এখানে কৃষ্ণকে দেখার কেউ তেমন নেই। কনককান্তিও আগ্রহের সঙ্গেই চাইছে। কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তাবে কৃষ্ণকান্ত কেঁদে ভাসিয়েছে। বাবা তাকে এখনও কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু যদি বলে? বাবার কথার ওপর তো আর কথা চলে না। মনু পিসি বা রঙ্গময়িই হচ্ছে তার একমাত্র ভরসা। বড়দা তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায় শুনে সে গিয়ে মনু পিসির ওপর হামলে পড়ল, আমি কিন্তু কিছুতেই যাব না, বলে দিচ্ছি। তুমি বাবাকে রাজি করাও। কৃষ্ণ কোথাও চলে যাবে এটা রঙ্গময়িও ভাবতে পারে না। সুনয়নী চলে যাওয়ার পর এই দুধের বাচ্চাটিকে সে বুকে আগলে এত বড়টি করেছে। তবু সে বলল, যাবি না তো কী করবি? এখানে কে তোকে অত চোখে চোখে রাখবে? কখন পুকুরে ড়ুবে মরিস, কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে আসিস তার তো ঠিক নেই। কলকাতায় ধরাবাঁধা জীবন, সেখানেই গিয়ে থাকা ভাল। এরপর কৃষ্ণকান্ত রেগে রঙ্গময়িকে আঁচড়ে কামড়ে চুল ছিঁড়ে একাকার কাণ্ড করল। রঙ্গময়ি ভরসা দিল, আচ্ছা যা, তোর বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করব।
false
shirshendu
লোকে হিহি করে হাসে, নিতাইয়ের কথার অবাধ্যও হয় না। যত যাই হোক, বউদিমণিরই তো কল। আর নিতাই হল বউদির ডান হাত। লোকে তাই লাইন লাগাতে থাকে। নিতাই একটু তফাত হয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মাতব্বরি করতে থাকে, এই পদা, অমন ঝকাং ঝকাং হ্যান্ডেল মারছিস যে! বাপের জন্মে এসব সাহেবি জিনিস দেখেছিস? খাস বিলেত থেকে জাহাজে করে আনা। বলি ও রতনের মা, লাইন ভেঙে এগোলে যে বড়! কাদু, তুই হরিপদর পেছনে। এই শালা কেতল, তোর কি চান করার মতলব নাকি? কোমরে গামছা, মাথায় সপসপে তেল, হাত বালতি মগ? আঁা? চান করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব। ইঃ, লাটসাহেব বউদির বিলিতি কলে চান মারাতে এসেছে! ভাগ, ভাগ! হুঁ হুঁ বাবা, এ কল এমন মন্তর দিয়ে বেঁধেছি কেউ বদ মতলব নিয়ে এলে কল সাপ হয়ে ছুবলে দেবে। এ হল পাতালগঙ্গার জল, যত পারিস খা, রোগ-ভোগ দূর হয়ে যাবে, গায়ে। হাতির বল হবে। ডায়াবেটিস জানিস, ডায়াবেটিস? এই জল খেলে ডায়াবেটিসও সারে। দুপুরের দিকে বাজারটা ফাঁকা-ফাঁকা। তারই ভিতর থেকে হঠাৎ একটা কালোপানা লোক ধা করে বেরিয়ে এল। নিতাই মাতব্বরিতে ব্যস্ত ছিল বলে দেখতে পায়নি। লোকটা এসে রক্তাম্বরখানা গলার কাছটায় চেপে ধরতেই নিতাই চেতন হয়ে দেখল, রামলাখন। এই শালা, কাল আমার ঘরে সিঁধ দিয়েছিল কে? তোর বাবা।—বলে চোখ বুজে রইল নিতাই। নিশ্চিন্তে। কারণ, সেই মুহূর্তে সে বাজারের ও প্রান্ত থেকে একটা ভটভটিয়া আসার শব্দ পেল। সময় মতোই আসছে। শালা, এইখানে আজই তোর লাশ নামিয়ে দিয়ে যাব। নিতাই চোখ বন্ধ কবে গম্ভীর গলাতেই বলল, পিপড়ের পাখা ওঠে কখন জানিস? মরার সময়। ঘোর কলি, ঘোর কলি। নইলে মাতাল বদমাশবা সাধুসন্নিসির গায়ে হাত তোলে? একটা খিস্তি দিয়ে রামলাখন বলে, পুলিশে সকালবেলায় খবর করেছি। কিন্তু তোক পুলিশে দেব না। নিজের হাতে বানাব। ভটভটিয়াটা ত্রয়ীর সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। কলের লাইন ভেঙে লোকে মারপিট দেখতে জুটে গেছে চারধারে। নিতাই চোখ খুলে চারদিকটা দেখে নিয়ে খুশি হল। লোকজন না জুটলে খেল কিসের? ঠান্ডা গলায় বলল, তিনদিনের মধ্যে গলায় রক্ত উঠে মরবি। যা, বাণ মেরে দিলাম। ঠিক আছে। বাণের মোকাবিলা করে নেব। এখন বল, বেজিটা কোথায়? তার আমি কী জানি? তুই জানিস না তো কে জানে? তোর বাপ জানে। বল।—বলে রামলাখন একটা ঠুসো দিল পেটে। ককিয়ে উঠে নিতাই বলে, বাপ জানে সে আমার বাপের কাছেই যা না। আমার বাপ কোথায় আছে জানিস? ভূত হয়ে মাদারপাড়ার বাঁশবনে দোল খায়। তোকেও সেখানে পাঠাব। আর তো মোটে তিনদিন। চড়াক করে একটা চড় পড়ল গালে। মাথাটা ঘুরে গেল একটু। গাঁজার নেশা থাকলে একটু দুধ দরকার হয়। নইলে শরীরে কিছু থাকে না। বুধিয়ার মায়ের কাছ থেকে একপো করে নিলে কেমন হয়? বদলে মন্তর দেবে ওদের। রাজি হবে না? নিতাই বিড়বিড় করে বলে, তুই মরবি। তোর বংশ ঝেডেপুছে সাফ হবে। ছেরাদ্দ হবে না, পিণ্ডি পড়বে না। মলমটা ঠেলা ধাক্কায় হাতের মধ্যেই ভচকে গেছে। হাতময় আঠা। এই অবস্থাতেও সাবধানে হাতটা তুলে মাথার ঘায়ে মলম ঘষতে ঘষতে সে হঠাৎ চেঁচায়, বোম কালী, গোলে বকাবলী। জয় মা! শেষ করে দে, ফিনিশ করে দে, রক্ত দিয়ে চান কর মা! মা গো! সরিৎবাবু বড় দেরি করছে। আবার চোখ বুজে ফেলে নিতাই। চোখের নজর লুকোনোটা ভাল অভ্যাস। তারাপীঠের এক সাধু তাকে কায়দাটা শিখিয়েছিল। বলেছিল, পাপ-তাপ করল লোককে চোখের দিকে তাকাতে দিয়ো না। চোখে সব ভেসে ওঠে। ধরা পড়ে যাবে। চোখ বুজে থেকো, মেজাজটা ঠান্ডা রেখো। বিপদ কেটে যাবে। সেই উপদেশটা আজ কাজে লাগিয়ে দিল। ভিড়ের ওপাশে রাস্তার ধারে সরিৎ তার মোপেড় থামিয়েছে, দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। গোলমাল দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ কোঁচকাল। কী হচ্ছে রে ওখানে? দোকানের ছোকরা কর্মচারী শম্ভু বলে, খ্যাপা নিতাইকে রামলাখন ধরেছে। বেজি না কী চুরি করেছে বুঝি। রামলাখনটা কে? সে ওই লাইনের ওধারে ঝোপড়ায় থাকে। মহা বদমাশ। সরিৎ একবার ভাবল, ঝামেলায় জড়াবে না। সেজদি আবার কী না কী বলে। কিন্তু রামলাখন নামে লোকটা খুব গলা তুলছে। দু-চার ঘা ঝাড়লও। সরিতের রক্তটা একটু চনমনে হয়ে ওঠে। নিতাই চোর-ছ্যাঁচড় যা-ই হোক, সে চাটুজ্জেবাড়ির আশ্রিত। তার ওপর বাজারি মার পড়লে দিদিরও অপমান। সরিৎ মোপেড় থেকে নেমে রাস্তাটা চকিত পায়ে পার হল। বাবা আজকাল তাকে ঘরের চাবি দিয়ে যায়। আগের মতো বাবা আর রাগী নেই। না, কথাটা ভুল হল। বাবা এখন বরং আগের চেয়ে আরও বেশি রাগী হয়ে গেছে। কিন্তু সজলের ওপর বাবা আজকাল একদম রাগে না। বাবার ঘরে ঢুকে সজল আজকাল ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র হাঁটকায়। বাবা কিছু বলে না। মাঝে মাঝে বলে, আমি যখন থাকব না তখন তুমি এ ঘরটায় থেকো। তুমি কোথায় যাবে? কোথাও চলে যাব। কেন? এখানে ভাল লাগে না। আমারও লাগে না। আমাকে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে পাঠাবে? সে তোমার মা জানে। মাকে তুমি বলো না! কেন হোস্টেলে যেতে চাও? হোস্টেলে অনেক বন্ধু পাব। কেন, এখানেও তো তোমার অনেক বন্ধু। পাঠশালার মাঠে বিকেলে ওই যাদের সঙ্গে ফুটবল খেল। হ্যাঁ, ওরা আবার বন্ধু নাকি? মা তো আমাকে বাইরের কারও সঙ্গে মিশতে দেয় না, যদি আমি খারাপ হয়ে যাই। তাই সব ভাল ভাল ছেলেদের সঙ্গে মা বন্দোবস্ত করেছে, তারা যদি বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে খেলে তা হলে
false
shunil_gongopaddhay
অরিজিৎ যে-জায়গাটা বেছে নিয়েছিল, সেখানে দু-একটা গ্রাম আছে, সেখানে ইয়েতিরা এসে মাঝে-মাঝে উপদ্রব করে বলে গুজব আছে। সন্তু হাসতে-হাসতে বলল, তুমি একটু আগে যে-আভিযানের কথা বললে, সেবারে আমরা বেশ কয়েকটা ইয়েতি দেখেছিলুম, তাই না? কাকাবাবুও এবার একটু মুচকি হেসে ফেললেন। অরিজিৎ বলল, তোমরা ইয়েতি দেখেছিলে? সত্যি? সন্তু বলল, এমন মেক-আপ দিয়েছিল যে, আসল না। নকল, তা বোঝাই যায়নি অনেকক্ষণ। অরিজিৎ জিজ্ঞেস করল, মেক-আপ দিয়েছিল মানে? সেজেছিল? করা? কাকাবাবু বললেন, সে অনেক লম্বা গল্প। সেটা পরে শুনে নিও। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ইয়েতি বলে খুব সম্ভবত কোনও প্রাণী নেই। অরিজিৎ জোর দিয়ে বলল, আলবাত আছে! তুমি বললেই তো হবে না। এ পর্যন্ত কেউ কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। কত লোকই তো বলেছে যে, ইয়েতি দেখেছে নিজের চোখে, কিন্তু কেউ একটা ছবি তুলতে পেরেছে? ইয়েতির পায়ের ছাপ অনেকেই দেখেছে। মস্ত বড় পায়ের ছাপের ছবিও তোলা হয়েছে। বরফের ওপর পায়ের ছাপ, সেটা আবার প্রমাণ নাকি? মানুষের পায়ের ছাপও বরফের ওপর কিছুক্ষণ বাদে অন্যরকম হয়ে যায়। তবু আমি বলছি, ইয়েতি আছে! না নেই! আমি নেপালে অন্তত তিন-চারজনের মুখে শুনেছি, তারা ইয়েতি দেখেছে। কিন্তু তাদের একটু জেরা করতেই তারা উলটো-পালটা বলতে শুরু করেছে। কেউ বলে গেরিলার মতন দেখতে, কেউ বলে ভালুকের মতন। আবার কেউ বলে, দশ হাত লম্বা মানুষের মতন। তাদের দু-একজনের সঙ্গে ক্যামেরাও ছিল, তবু ছবি তুলতে পারেনি, তার কারণ নাকি ইয়েতিকে একপলক দেখার পরই অদৃশ্য হয়ে গেছে। যত্ত সব গাঁজাখুরি কথা! আসলে বরফের ওপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটলে ক্লান্ত হয়ে অনেকে চোখে ভুল দেখে। মরুভূমিতে যেমন মানুষ মরীচিকা দেখে। কাকাবাবু, আসল ব্যাপারটা কিন্তু আপনিই ঠিক বলেছিলেন। তার মানে? ইয়েতিরা অদৃশ্য হয়ে যায়। অরিজিৎ, এবার ঘুমোতে যাও! আবার কাল সকালে কথা হবে! আমার কথাটা ভাল করে শুনুন, কাকাবাবু! আমিও তো বিজ্ঞান পড়েছি, কোনও প্রমাণ না পেলে একেবারে গাঁজাখুরি কথা আমি মেনে নেব কেন? নেপালের অন্তত দুটো পুরনো পুঁথিতে লেখা আছে, ইয়েতিদের হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা আছে। আমি নিজেও তার প্রমাণ পেয়েছি। এইজন্যই ইয়েতির ছবি তোলা যায় না। মানুষের চোখের সামনে পড়ে গেলেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়। পুঁথিতে যা কিছু লেখা থাকে, তাই-ই সত্যি নয়। বললাম যে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। এমনকী আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, অরিজিৎ বলতে চায়, হিমালয়ের কোনও একটা জায়গায় নাকি এক রকমের ফল পাওয়া যায়, যা খেলে অদৃশ্য হওয়া যায়। ইয়েতিরা নাকি সেই ফল খায়। আমাদের অরিজিৎ সেই ফলের সন্ধান পেয়েছে। এমনকী নিজে সেই ফল খেয়েই দেখেছে! অরিজিৎ ব্যাকুলভাবে বলল, আপনি এখনও আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?? কাকাবাবু বললেন, এসব রূপকথার মতো গল্প, শুনতেই ভাল। কিন্তু বিশ্বাস করার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শোনো, জল জিনিসটা গরম হলে বাষ্প হয়, তারপর সেই বাষ্প উড়ে যায়। এমনকী অনেক ধাতুকেও প্রচণ্ড উত্তাপে গলিয়ে বাষ্প করা যায়, আবার ঠাণ্ডা হলে সেই ধাতু বা জল ফিরে আসে। কিন্তু কোনও জীবন্ত প্ৰাণীকে বেশি গরমে রাখলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, সেই ছাইটাকে ঠাণ্ডা করলে কিন্তু সেই প্ৰাণীটাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। কোনও জীবন্ত প্ৰাণী, এমনকী একটা পিঁপড়েকেও অদৃশ্য করে আর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব! সন্তু আমতা-আমতা করে বলল, কিন্তু কাকাবাবু, বৈজ্ঞানিকরা টাইম-মেশিনে কি মানুষকে অদৃশ্য করতে পারবে না? স্টার-ওয়ার্স ফিলমে যে দেখি, একটা যন্ত্রের মধ্যে দাঁড়ালে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার অন্য জায়গায় ফিরে আসছে? কাকাবাবু বললেন, ওসবও এ-যুগের রূপকথা। আগেকার গল্পে যেমন রাজপুত্ৰ পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে যেত, এখনকার গল্পেও তেমনি নায়করা স্পেস-শিপে চেপে অন্য গ্রহে যায়, এমনকী এই গ্যালাক্সি পেরিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করে আসে। এসব রূপকথা-ছাড়া কিছুই না। অরিজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যদি আপনার চোখের সামনে করে দেখাতে পারি? আমাকে কোটোটা একবার দিন। কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই সে ছুটে গিয়ে জামাকাপড়ের আলমারিটা খুলে কৌটোটা বার করে এনে বলল, আমি নিজে দুবার এক্সপেরিমেন্ট করেছি। দুবারই সাকসেসফুল। কৌটোটা খুলে সে সন্তুকে দেখাল। ভেতরের জিনিসটা দেখে সন্তু খানিকটা নিরাশ হয়ে গেল। এটা তো একটা লঙ্কা। বেশ বড়সড় টাবাটোবা গোলগাল লাল লঙ্কা! অরিজিৎ যেন তার মনের কথাটাই বুঝতে পেরে বলল, এটা লঙ্কা বলে মনে হচ্ছে তো? কিন্তু এটা এক ধরনের স্ট্রবেরি। এটা ঝাল নয়। মোটেই, বরং টক-মিষ্টি। কাকাবাবু শুনলে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু তোমাকে বলছি। সন্তু, একেবারে সত্যি কথা বলছি! পাহাড়ে স্ট্রবেরি খুঁজতে-খুঁজতে, ঝোপঝাড়ে যেখানে যে ফল দেখতাম, অমনি আমি তা খেয়ে স্বাদ নিতাম। কোনও বিষাক্ত ফল খেয়ে ফেলারও কুঁকি ছিল অবশ্য। একদিন আমি এই ফল একটা খেয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলুম! কাকাবাবু বললেন। হুঁ! সন্তু বলল, সত্যি বলছেন? অরিজিৎ বলল, দেড়দিন সেই অবস্থায় ছিলুম। সিংবোচি গ্রামে এসে ঘুরেছি, লোকজনের মধ্যে, কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পায়নি। আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম খুব। পরে ওইরকম আর একটা ফল খেয়ে নেবার পর আবার সব ঠিক হয়ে গেল। সন্তু একবার কাকাবাবু আর একবার অরিজিতের দিকে তাকাল। তারপর কৌটোটা হাতে তুলে নিল। অরিজিৎ বলল, দারুণ ভাল লাগে সেই সময়টা। কোনও খিদেতেষ্টা থাকে না। দারুণ হালকা লাগে শরীরটা, মানে, শরীরটা অন্য কেউ দেখতে না পেলেও সেটা তো থাকেই। মনটা খুব ফুরফুর করে। যেখানে ইচ্ছে চলে যাওয়া
false
toslima_nasrin
এখন ইয়াসমিনকে ডাকতে হলে বাবা বলেন, কই বৃত্তিধারী ছাত্রী কই! পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা আমার দেওয়া হয় নি, অষ্টম শ্রেণীরটি দেওয়া হলেও কপালে কিছু জোটেনি। কপালে কিছু জোটেনি বলেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইয়াসমিনকে বৃত্তিধারী ছাত্রী বলে ডাকেন বাবা। কেবল তাই নয়, বাবা আমাকে নর্দমার কীটের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক। শুনে নিজেকে অনেকবারই সত্যিইনর্দমার কীট বলে মনে হয়েছে। তারকাখচিত প্রথম বিভাগ জোটেনি বলেও আবার নিজেকে নর্দমার কীট বলে মনে হতে থাকে। চন্দনা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। এ নিয়ে তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। দ্বিতীয় বিভাগেই পাশ করেছে বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী। দ্বিতীয় বিভাগ যদি আমার জুটত, তবে বাবা চাবকে আমাকে রক্তাক্ত করে বাড়ি থেকে সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দিতেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে স্বস্তি জোটে, প্রথম বিভাগ পাওয়ার ফলে কলেজে বৃত্তি পাব, বিনে পয়সায় কলেজে পড়ব, বাবা বৃত্তি জিনিসটি খুব পছন্দ করেন, খানিকটা হলেও ভারমুক্ত হই। অন্তত এ ব্যাপারটি না ঘটলে উঠতে বসতে বাবার দাঁত খিঁচোনো দেখতে হত। এখনও যে হয় না তা নয়। আমি নিশ্চিত, বৃত্তি না জুটলে আরও হত। কলেজে ভর্তি হতে কোনও পরীক্ষার দরকার হয়নি। মেট্রিকের ফল দেখেই ভর্তি করে নিয়েছে কলেজে। খামোকা আমাকে মেট্রিক পরীক্ষার পরও সেই ইশকুলের বইগুলো পড়তে হয়েছে, ভেবে আফসোস হয়। সময়গুলো অযথা উড়ে গেছে, হাওয়ায় উড়েছে। আর কি কখনও ফিরে আসবে অমন অবসর!সময় হয়ত অনেক আসবে, মেট্রিকের পরের সময় আর আসবে না। আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, ও কলেজে আবার ছেলেরাও পড়ে, ছেলেদের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে ক্লাস করতে দিতে আর যিনিই দিন না কেন, বাবা দেবেন না। ঘাড় ধরে, আনন্দমোহনের ভাল কলেজ হিসেবে নাম থাকলেও, মুমিনুন্নিসার কোনও নাম না থাক, যেহেতু এটি মেয়েদের কলেজ, এটিতে আমাকে ঢুকিয়ে, অনেকটা হাঁসের খোঁয়াড়ে যাবার বায়না নাকচ করে দিয়ে মুরগিকে আর দশটা মুরগির সঙ্গে এক খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার মত, স্বস্তি পেলেন তিনি। যতটা অখুশি হওয়ার দরকার ছিল এ কলেজে এসে, ততটা হইনা, এর কারণ চন্দনা। ওর বাবাও ওকে ধরে বেঁধে মুমিনুন্নিসা কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। চন্দনাকে পেয়ে প্রতিদিন একশ ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য কপাল চাপড়ানো তো দূরের কথা, মন কালো করে যে দুদণ্ড একলা বসে থাকব, তা হয়না। আনন্দমোহন আমাদের কাছে আকাশপারের কোনও রহস্যময় সপ্তম স্বর্গ হয়ে রইল, ওটিকে আপাতত মাচায় তুলে রেখে আরও আরও স্বপ্ন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি আর চন্দনা। মুমিনুন্নিসা কলেজটি শহরের পশ্চিম কোণে বিশাল এক মাঠের ওপর। ক্লাস হয় একটি লম্বা টিনের ঘরে, গঞ্জের ইশকুলঘরের মত ঘরটি। আরেকদিকে নতুন ওঠা দালানঘর। এই দালানঘরে বিজ্ঞানের ছাত্রীদের বেশির ভাগ ক্লাস হয়। ইশকুলের মত এক ঘরেই সমস্ত ক্লাস নয়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে যেতে হয় বিভিন্ন ক্লাসে। এই নিয়মটি আমার পছন্দ হয়। ইশকুলে সেই সকালে একটি ঘরের একটি বেঞ্চে বসা হল তো সারাদিন ওখানেই বসে থাকতে হয়। কলেজের আরও একটি নিয়ম আমার ভাল লাগে। তুমি যদি কোনও ক্লাসে না যাও, মাঠে বসে থাকো বা পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে গপ্প কর, কেউ তোমার চুলের মুঠি ধরে নিয়ে বসিয়ে দেবে না ক্লাসে, এক ক্লাস মেয়ের সামনে কান ধরে এক ঠ্যাংএ দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে না। ক্লাসে ক্লাসে নাম ডাকা হচ্ছে। ইশকুলের মত এক ক্লাসে নাম ডাকা হল তো সে নিয়ে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবদি থাকা নয়। কলেজের নতুন নিয়মে চমৎকৃত হই, কিন্তু কলেজ থেকে যখন ইচ্ছে তখন বেরোতে পারব না, এ নিয়মটি আমার মোটেও ভাল লাগে না। চন্দনার তো লাগেই না। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ও অনেকবার বলেছে, কলেজে পড়ার মজা কি জানস? ইচ্ছা হইলে ক্লাস করবি, ইচ্ছা না হইলে করবি না। যখন ইচ্ছা কলেজ থেইকা বাইর হইয়া পড়া যাইব। ঠিক কলেজ ছুটির টাইমে বাড়িতে আইয়া পড়লেই হইল। এই স্বপ্ন আমাকে বিভোর কম করেনি। কিন্তু কলেজে যেতে শুরু করে ছফুট লম্বা সাপের মত কালো মিশমিশে শরীরের চুলহীন দাঁতহীন গগনকে দেখে আমার পিলে চমকে ওঠে। কি রে বাবা, দারোয়ান কেন? ইশকুলের গেটে দারোয়ান থাকে। ইশকুলের বাচ্চাদের জন্য। কলেজে পড়া বড় মেয়েদের জন্য, যারা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে, তাদের জন্য পাহারা বসানোর তো কোনও যুক্তি নেই! চন্দনা একমত। সকাল দশটায় কলেজে এসেছি। দুটো ঘন্টা কোনও ক্লাস নেই। চন্দনা বলে চল বাইরে যাই। বাইরে কোথায় তার কোনও সিদ্ধান্ত নিই না। বাইরে। এই সীমানার বাইরে। বাড়ির সীমানার বাইরে যেতে যেমন উতলা হই, এই কলেজ সীমানার বাইরে যেতেও। কিন্তু চল বললেই কি যাওয়া হয়, গেটের দিকে যেতে নিলেই গগন আমাদের খপ করে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, দুঘন্টা আমাদের করার কিছু নেই। না থাক। তবু গেটের বাইরে এক পা ও ফেলা যাবে না। যাবে না তো যাবেই না। গগনকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি, আমরা আর ছোট নেই, বড় হয়েছি. আমরা হারিয়ে যাব না, বা কোনও ছেলেধরা আমাদের বস্তায় পুরে কোথাও নিয়েও যাবে না। গগনে তবু গনগনে আগুন, কোনও মেঘবৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। গগন আমাদের স্বপ্নের লেজ ধরে ছুঁড়ে দেয় দূরের নর্দমায়। মেয়েদের কলেজের নিয়ম হচ্ছে, একবার ঢুকে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, সেই বিকেলে ছুটির ঘন্টা পড়বে তো
false
shottojit_roy
কাগজে বেরিয়েছিল। এবার গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পাবে। একে আপনি জোগাড় করলেন কী করে? প্রশ্ন করলেন জটায়ু। আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। আমার অঢেল টাকা। এক পয়সা নিজে উপার্জন করিনি, সব বাপের টাকা। উইল করেননি, তবে আমিই একমাত্র সন্তান, তাই সব টাকাই আমি পাই। কীসের টাকা জান? গন্ধদ্রব্য। পারফিউম। কুন্তলায়নের নাম শুনেছি? সে তো এখনও পাওয়া যায়, বললেন জটায়ু। হ্যাঁ। বাবারই আবিষ্কার, ব্যবসাও বাবারই! এখন এক ভাইপো দেখে। আমার কোনও ইনটারেস্ট নেই। আমি সংগ্রাহক। কী সংগ্ৰহ করেন? নানান মহাদেশের এমন সব জিনিস যার জুড়ি নেই। একমেবাদ্বিতীয়ম; কিচামোর কথা বললাম। এ ছাড়া আছে দুহাতে একসঙ্গে লিখতে পারে এমন একটি সেক্রেটারি। জাতে মাওরি। নাম টোকোবাহানি। আরও আছে। একটি ব্ল্যাক প্যারট-তিন ভাষায় কথা বলে। একটি দুই-মাথা বিশিষ্ট পমেরেনিয়ান কুকুর, লছমনকুলার একটি সাধু উড্ডীনানন্দ, মাটি থেকে দেড় হাত উপরে শূন্যে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ধ্যান করে। তা ছাড়া– ওয়ান মিনিট স্যার, বলে। লালমোহনবাবু বাধা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হল! হাতের লাঠি মাথার উপর তুলে চোখ রক্তবর্ণ করে তারকনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন, ইউ ডেয়ার ইনটারপ্ট মি? সরি সরি সরি স্যার। জটায়ু কুঁকড়ে, গেছেন–আমি জানতে চাইছিলুম। আপনার সংগ্রহের মধ্যে যারা মানুষ, তারা কি স্বেচ্ছায় আপনার ওখানে রয়েছে? তারা ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল বেতন পায়, আরাম পায়, আদর পায়–থাকবে না। কেন? হোয়াই নট? আমার কথা আর আমার সংগ্রহের কথা পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক লোকেই জানে; তোমরা না জানতে পার। আমেরিকা থেকে একজন সাংবাদিক এসে আমার সঙ্গে কথা বলে, দেশে ফিরে নিউ ইয়র্ক টাইমসে দ্য হাউস অফ ট্যারক বলে এক প্ৰবন্ধ লেখে। এবার তরফদার মুখ খুললেন। অনেক কথাই তো জানা গেল, কেবল আপনার এখানে আসার কারণটা ছাড়া। এটা আবার বলে দিতে হবে? আমি ওই খোকাকে আমার সংগ্রহের জন্য চাই। কী নাম যেন? ইয়েস-জ্যোতিষ্ক। আই ওয়ন্ট জ্যোতিষ্ক। কেন? সে তো এখানে দিব্যি আছে, বললেন তরফদার। খাওয়া পরার অভাব নেই, যত্ন অ্যাত্তির অভাব নেই। সে আমার ডেরা ছেড়ে আপনার ওই উদ্ভট ভিড়ের মধ্যে যাবে। কেন? তারকনাথ তরফদারের দিকে প্ৰায় আধ মিনিট চেয়ে থেকে বললেন, গাওয়াঙ্গি-কে একবার দেখলে তুমি এমন বেপরোয়া কথা বলতে পারতে না। হোয়াট ইজ গাওয়াঙ্গি? প্রশ্ন করলেন জটায়ু। নট হোয়াট, বাট হু, গম্ভীরভাবে বললেন তারকনাথ। নট বস্তু, বাট ব্যক্তি! ইউগ্যান্ডার লোক। পৌনে আট ফুট হাইট, চুয়ান্ন ইঞ্চি ছাতি, সাড়ে তিনশো কিলো ওজন। কোনও ওলিম্পিক ওয়েট লিফটার ওর কাছে পাত্তা পাবে না। একবার টেরাইরের জঙ্গলে একটা বাঘকে ঘুমপাড়ানি ইনজেকশনের গুলি মারে, কারণ বাঘটার গায়ে স্পট এবং ডোরা দুই-ই ছিল। একমেবাদ্বিতীয়ম। সেই বাঘকে কাঁধে করে সাড়ে তিন মাইল বয়ে এনেছিল গাওয়াঙ্গি। সে এখন আমার একনিষ্ঠ সেবক। আপনি কি আবার দাসপ্রথা চালু করলেন নাকি? জটায়ু বেশ সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন। নো স্যার! গৰ্জিয়ে উঠলেন টি এন টি। গাওয়াঙ্গিকে যখন দেখি তখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইউগ্যান্ডার রাজধানী কম্পালা শহরে এক শিক্ষিত পরিবারের ছেলে! বাপ ডাক্তণর। তাঁর কাছেই শুনি গাওয়াঙ্গির যখন চোদ্দ বছর বয়স তখনই সে প্রায় সাত ফুট লম্বা। বাড়ির বাইরে বেরোয় না। কারণ রাস্তার লোকে ঢিল মারে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ছাত্রদের বিদ্যুপের ঠেলায় বাধ্য হয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। আমি যখন তাকে দেখি তখন তার বয়স একুশ। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে সারাদিন। দেখে মনে হল এইভাবে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। সেই অবস্থা থেকে তাকে আমি উদ্ধার করে আনি। আমার কাছে এসে সে নতুন জীবন পায়। সে আমার দাস হতে যাবে। কেন? আমি তাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করি। আমাদের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। যাই হোক তারকবাবু, বললেন তরফদার, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আমি জ্যোতিষ্ককে চিড়িয়াখানার অধিবাসী হিসেবে কল্পনা করতে পারি না এবং চাইও না। গাওয়াঙ্গির বিবরণ শোনার পরেও এটা বলছ? বলছি। ভদ্রলোক যেন একটু দমে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাই যখন বলছি তখন এই ছেলেটিকে একবার দেখতে পারি কি? সেটা সহজ ব্যাপার। আপনি সেই কলকাতার উত্তর প্রান্ত থেকে এসেছেন, আপনার জন্য এতটুকু করতে পারব না? নয়ন এসে দাঁড়াতে তারকাবাবু তার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাড়িতে কটা ঘর আছে বলতে পার? ছেষট্টি হুঁ… এবার তারকনাথ উঠে দাঁড়িয়ে তার লাঠির রুপো দিয়ে বাঁধানো মাথাটা ডান হাতের মুঠো দিয়ে শক্ত করে ধরে বললেন, রিমেমবার, তরফদার-টি এন টি অত সহজে হার মানে না। আমি আসি। ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ কোনও কথাই বললাম না। নয়নকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তরফদার। অবশেষে লালমোহনবাবু ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, চার দিয়ে তো অনেক কিছু হয়—না মশাই? চতুর্দিক, চতুৰ্ভুজ, চতুর্মুখ, চতুৰ্বেদ-এই চারটিকে কী বলব। তাই ভাবছি। চতুর্লোভী বলতে পারেন। বলল ফেলুদা। চার জনই যে লোভী তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। তবে লোভী হয়েও যে কোনও লাভ হল না সে ব্যাপারে সুনীলকে তারিফ করতে হয়। তারিফ কোন স্যার? বললেন তরফদার। এ তো সোজা অঙ্ক। সে ছেলে আমার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে সুস্থ পরিবেশে। আমি তাকে দেখছি। সে আমাকে দেখছে। স্রেফ লেনদেনের ব্যাপার। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে কেন? আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। একটা কথা বলি তোমাকে, তরফদারের কাঁধে হাত রেখে বলল ফেলুদা, আর অ্যাপায়েন্টমেন্ট না। পাগল! বললেন তরফদার। এক দিনেই যা অভিজ্ঞতা হল,
false
humayun_ahmed
মনে হয় না।’ ‘তুমিও আমাকে তুমি বলবে। আর তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি মাঝে-মাঝে তোমার কাছে আসব।’ রানু চায়ের কাপ সাজাতে সাজাতে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমাকে মূতি-মূর্তি লাগে, এটা বললে কেন? নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘এমনি বলেছি! টানাটানা চোখ তো, সে জন্যে। তুমি দেখি ভাই রাগ করেছ।’ ‘একটা কারণ আছে নীলু। তোমাকে এক দিন আমি সব বলব, তাহলেই বুঝবে। চায়ে কতটুকু চিনি খাও?’ ‘তিন চামচ।’ নীলু অনেকক্ষণ বসল, কিন্তু কথাবার্তা আর তেমন জমল না। রানু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কিছুতেই মন লাগাতে পারছে না। সহজ হতে পারছে না। নীলু বেশ কয়েক বার অন্য প্রসঙ্গ আনতে চেষ্টা করল। ভাসা-ভাসা জবাব দিল রানু। এবং একসময় হালকা স্বরে বলল, ‘আমার একটা অসুখ আছে নীলু।’ ‘কী অসুখ?’ ‘মাঝে-মাঝে আমি ভয় পাই।’ ‘ভয় পাই মানে?’ রানু মাথা নিচু করে বলল, ‘ছোট বেলায় একবার নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম, তারপর থেকে এরকম হয়েছে।’ ‘কী হয়েছে?’ রানু জবাব দিল না। ‘বল, কী হয়েছে?’ ‘অন্য একদিন বলব। আজ তুমি তোমার কথা বল।’ ‘আমার তো বলার মতো তেমন কথা নেই।’ ‘তোমার বন্ধুদের কথা বল।’ ‘আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই। আমি বলতে গেলে একা-একা থাকি। অসুন্দরী মেয়েদের বন্ধুটন্ধু থাকে না। ‘রঙ খারাপ হলে মানুষ অসুন্দর হয় না নীলু।’ ‘আমি নিজে কী, সেটা আমি ভালোই জানি।’ নীলু উঠে পড়ল। রানু বলল, ‘আবার আসবে তো?’ ‘আসব। তুমি তোমার ভয়ের কথাটথা কি বলছিলে, সেই সব বলবে।’ ‘বলব।’ নীলু পাঠাবে না পাঠাবে না করেও চিঠিটি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু তার পরপরই দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। কে জানে, বুড়ো-হাবরা লোকটি একদিন হয়তো বাসায় এসে হাজির হবে। দারুণ লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। নিতান্তই ছেলেমানুষি করা হয়েছে। চা-পাঁচদিন নীলুর খুব খারাপ কাটল। দারুণ অস্বস্তি। বুড়োমতো কোনো মানুষকে আসতে দেখলেই চমকে উঠত, এটিই সেই লোক নাকি? যদি সত্যি-সত্যি কেউ এসে পড়ে, তাহলে সে ভেবে রেখেছে বলবে-এই চিঠি তো আমার নয়। অন্য কেউ তামাশা করে এই ঠিকানা দিয়েছে। আমি এ রকম অজানা-অচেনা কাউকে চিঠি লিখি না। কেউ অবশ্যি এল না। দেখতে-দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। চিঠিরও কোনো উত্তর নেই। লোকটি হয়তো চিঠি পায় নি। ডাকবিভাগের কল্যানে আজকাল তো বেশির ভাগ চিঠিই প্রাপকের হাতে পৌছায় না। এতে ক্ষতি যেমন হয়, লাভও তেমনি হয়। কিংবা হয়তো এমন হয়েছে, ঐ লোকটি অসংখ্য চিঠি পেয়ে পছন্দমতো চিঠিগুলোর উত্তর দিয়েছে। নীলুর তিন লাইনের চিঠি তার পছন্দ হয় নি। সে হয়তো লম্বা-লম্বা চমৎকার চিঠি পেয়েছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কিছু লেখা সব চিঠিতে। দশ দিনের মাথায় নীলুর কাছে চিঠি এসে পড়ল। খুবই দামী একটা খামে চমৎকার প্যাডের কাগজে চিঠি। গোটা-গোটা হাতের লেখা। কালির রঙ ঘন কালো। মাখন-রাঙা সে কাগজে লেখাগুলো মুক্তার মতো ফুটে আছে। এত সুন্দর হাতের লেখাও মানুষের হয়! চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত। কল্যাণীয়াসু তোমার চমৎকার চিঠি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। একজন ব্যথিত মানুষের আবেদনে তুমি সাড়া দিয়েছ-তোমাকে ধন্যবাদ। খুব সামান্য একটি উপহার পাঠালাম। প্লীজ, নাও। আহমেদ সাবেত উপহারটি সামান্য নয়। অত্যন্ত দামী একটি পিওর পারফিউমের শিশি। নীলু ভেবে পেল না, এই লোকটি কি সবাইকে এ রকম একটি উপহার পাঠিয়েছে? যারাই চিঠির জবাব দিয়েছে তারাই পেয়েছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব? নাকি নীলু একাই চিঠির জবাব দিয়েছে? নীলুর বড় লজ্জা করতে লাগল। সে পারফিউমের শিশিটি লুকিয়ে রাখল এবং খুব চেষ্টা করতে লাগল সমস্ত ব্যাপার ভুলে যেতে। সে চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল জানালা দিয়ে। কেন এমন একটা বাজে ঝামেলায় জড়াল? কিন্তু দিন সাতেক পর নীল আবার একটি চিঠি লিখল। একটি বেশ দীর্ঘ চিঠি। সেখানে শেষের দিকে লেখা – আপনি কে, কী করেন-কিছুই তো জানা নি। আপনার বিজ্ঞাপনটিও দেখছি না। তার মানে কি এই যে আপনার নিঃসঙ্গতা এখন দূর হয়েছে? নীলু বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করল চিঠির জবাবের জন্যে, কিন্তু কোনো জবাব এল না। কেন জানি নীলুর বেশ মন-খারাপ হল। আরেকটি চিঠি লেখার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু তাও কি হয়? একা-একা সে শুধু চিঠি লিখবে? তার এত কী পড়েছে? ৫ দুপুর-রাতে আনিসের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়াল অভ্যেসমতো। পাশে কেউ নেই। আনিস ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কোনো সাড়া নেই। বাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাথরুমে নাকি? আনিস উঁকি দিল বাথরুমে-কেউ নেই। কোথায় গেল! আনিস গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘রানু। বসার ঘর থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ এল। বসার ঘর অন্ধকার। রানু কি সেখানে একা-একা বসে আছে নাকি? আনিস বসার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলেই সঙ্গে-সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। রানু বসার ঘরে ছোট টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। ‘এই রানু।’ ‘উঁ। ‘কী হয়েছে? তোমার কাপড় কোথায়?’ ‘খুলে ফেলেছি। বড্ড গরম লাগছে।’ আনিস এসে রানুর হাত ধরল। হিমশীতল হাত। একটু-একটু যেন কাঁপছে। ‘এস রানু, ঘুমুতে যাই। ‘আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।’ ‘কাল আমরা একজন ডাক্তারের কাছে যাব, কেমন?’ ‘কেন?’ ‘তোমার শরীর ভালো না রানু।’ ‘আমার শরীর ভালোই আছে।’ ‘না, তুমি খুব অসুস্থ। এস আমার সঙ্গে। কাপড় পরে ঘুমুতে এস। রানু কোনো আপত্তি করল না। সঙ্গে-সঙ্গেই উঠে এল। কাপড় পরল এবং বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল আনিস। রানুর শরীর দ্রুত
false
humayun_ahmed
খুলতে খুলতেই বলল, আপনার জন্যে সুসংবাদ। এখন চলে যাবেন। ওস্তাদ আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছে। চাউখ বান্দা অবস্থায় মাইক্রোবাসে তুলব। দূরে নিয়ে ছেড়ে দিব। রিকশা নিয়ে চলে যাবেন। প্রৌঢ় বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু। মতি মিয়া বলল, আপনার তকলিফ হয়েছে, কিছু মনে নিবেন না। কোনো অসুবিধা নেই, ঠিক আছে। আপনার ভাগ্য ভালো, আপনে অল্পের ওপর পার পাইছেন। প্রৌঢ় আমার দিকে শেষ তাকানো তাকিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। একে অবিশ্যি তাকানো বলা যাবে না। তিনি তীরনিক্ষেপের মতো দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন বলা চলে। আকাশে মেঘ ডাকছে। যে-মেঘের নামার কথা ছিল সেই মেঘ তা হলে এখনো নামেনি। বৃষ্টি নামার আগের মেঘের ডাকের সঙ্গে বৃষ্টি নামার পরের মেঘের ডাকের সামান্য পার্থক্য আছে। রূপা নামের এক তরুণী আমাকে ৷ ই পার্থক্য শিখিয়েছিল। আমি শিখিয়েছি আমার খালাতো ভাই বাদলকে। মে|বিদ্যা পুরোপুরি নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক না। বাদল এই বিদ্যার চর্চা করছে কি না জানি না। অনেক দিন তার সাথে দেখা হয় না। ইদানীং সে কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কী-একটা গান তার মাথায় ঢুকে (গছে। সে যেখানে যায়, যা-ই করে তার মাথায় একটা গানের লাইন লাজে। বড়ই অদ্ভুত গানের কথা। প্রথম লাইনটা হচ্ছে, নে দি লদ বা রয়াওহালা গপা। সমস্যা হচ্ছে এই গান নাকি সে আগে কখনো শোনেনি। যে গান সে কোনোদিন শোনেনি সেই গান কী করে তার মাথায় ঢুকল কে জানে!, তার মাথা থেকে কি গান দূর হয়েছে? একটা টেলিফোন হাতের কাছে থাকলে বাদলকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম। থানাওয়ালাদের হাতে যখন ধরা খেয়েছি তখন তারা মাঝেমধ্যে টেলিফোন করতে চাইলে দিত। বেশির ভাগ সময়ই অবিশ্যি দেখা যেত তাদের টেলিফোন কাজ করে না। ডায়ালটোন আসে না, আর যদিও আসে শোশো আওয়াজ হয়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময় দুই জায়গার টেলিফোন নষ্ট থাকে—পুলিশের টেলিফোন এবং হাসপাতালের টেলিফোন। এদেরকে কি জিজ্ঞেস করে দেখব। একটা টেলিফোন করতে দিবে কি-না। বন্ধ দরজা ধড়াম করে খুলে গেল। চার-পাঁচজনের একটা দল প্রবেশ করল। দলের পুরোভাগে জগলু ভাই আছেন। এবং আমাদের প্রৌঢ়—মনসুর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মনসুর খাঁ সাহেবও আছেন। তার মুখ ঝুলে পড়েছে। এবং তিনি হাঁপানি রোগীদের মতো টেনে টেনে শ্বাস নিচেছন। ঘটনা আঁচ করতে পারছি। বিশ লক্ষ টাকা জায়গামতো পৌঁছেনি। মনসুর সাহেবের মেয়ে হয়তো পুলিশে খবর দিয়েছে। সাদা পোশাকের পুলিশ একটা বেড়াছেড়া বাধিয়েছে। কিংবা টাকার বদলে সুটকেসভরতি পুরনো খবরের কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছে। তার বাবা যে কত বড় বিপদে আছে সে বোধহয় আঁচ করতে পারছে না। জগলু ভাইয়ের হাতে সিগারেট। তিনি ঘনঘন সিগারেট টানছেন। যতবারই টানছেন ততবারই আড়াচোখে তার রিস্টওয়াচের দিকে তাকাচ্ছেন। এই প্রথম তার মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ করলাম। উত্তেজনায় তার নাক ঘামছে। সমুদ্রবিদ্যা বইয়ে আছে, মানসিক উত্তেজনাকালে যে-পুরুষের নাক ঘামে সে স্ত্রী-সোহাগী হয়। জগলু ভাই কি স্ত্রী-সোহাগী? জগলু ভাই বললেন, বুড়ার মাথা পানিতে চুবাও। তার আগে বদমাইশের মেয়েটাকে মোবাইল টেলিফোনে ধরো। বুড়ার মাথা পানি থেকে তোলার পর টেলিফোনটা বুড়ার হাতে দাও। বুড়া মেয়ের সঙ্গে কথা বলুক। ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। আমার সঙ্গে টালটুবাজি? টেলিফোনে মেয়েকে ধরতে ঝামেলা হলো। নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। যখন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তখন মেয়ের টেলিফোন থাকে বিজি। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। জগনু ভাইয়ের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। চৌবাচ্চা পূৰ্ণ। এক্ষুনি হয়তো পানি উপচে পড়বে। জগলু ভাই বললেন, কী, লাইন পাওয়া গেছে? মতি মিয়ার হাতে টেলিফোন। সে ভীত গলায় বলল, জি না। একটা কানেকশন ঠিকমতো করতে পারো না? নাম্বার জানো? বোতাম ঠিকমতো টিপছ? টিলিফোন হারুনের কাছ দাও। তুমি জীবনে কোনোএকটা কাজ ঠিকমতো করতে পেরেছ বলে আমার মনে পড়ে না। হারুনের পারফরমেন্স মতি মিয়ার চেয়েও খারাপ। সে বোতাম টেপার আগেই মোবাইল সেট হাত থেকে ফেলে দিল। সেট সে মেঝে থেকে অতি দ্রুত তুলল। ঝড়ের গতিতে বোতাম টিপল। ছয়-সাত বার হ্যালো, হ্যালো বলল, লাভ কিছু হলো না। জগলু ভাই বললেন, কী হলো? এখনো লাইনে পাচ্ছ না? হারুন কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, টেলিফোন অফ করে রেখেছে। রিং হয় ধরে না। জগলু ভাই। থমথমে গলায় বললেন, বেকুবের মতো কথা বলবে না। যে-মেয়ের বাপের এই অবস্থা, আমাদের সঙ্গে যেখানে তার যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা টেলিফোন, সেখানে সে টেলিফোন অফ করে রাখবে? আমি কোনো বেকুব পছন্দ করি না, আর আমাকে চলতে হয় বেকুব নিয়ে। এখন চৌবাচ্চা কানায় কানায় পূর্ণ। টেলিফোনে মেয়েটিকে ধরা যাচ্ছে না বলে চৌবাচ্চা কাজে লাগছে না। বাংলা ছবির কোনো দৃশ্য হলে এই অবস্থায় ব্যাকগ্রাউন্ডে সুপার টেনশন মিউজিক বাজত। মিউজিকের মধ্যে আফ্রিকান ড্রামের শব্দ-ড্রিম ড্রিম ড্রিম। এই ড্রিম ড্রিামের সঙ্গে হার্ট বিটের শব্দ মিশিয়ে মিশ্র মিউজিক। আমি বললাম, জগলু ভাই, আমি কি ট্রাই করে দেখব? টেলিফোনে কানেকশন পাওয়ার লাক আমার খুব ভালো। সবসময় এক চান্সে লাইন পাই। দলনেতা এবং দলের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। গুগলু ভাইয়ের চোখ চকচক করছে। তার সিগারেট নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটই টানছেন। মতি বলল, ওস্তাদ, এইটারে আগে পানিত চুবাই। এই কুত্তা বড় দিগদারি করতেছে। জগলু ভাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে গিয়েও নাড়লেন না। শেষমূহুর্তে মত বদলে বললেন, এর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে এর হাতে টেলিফোন দে। আমি বললাম, নাম্বারটা দিন। টেলিফোন হাতে নিয়ে যে ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে—হারুন ভাইজান—সে বলল, রিডায়ালে টিপলেই হবে। আমি বললাম, রিডায়ালে টিপলে
false
humayun_ahmed
উঠতে হলো। মিলিটারি জিপগুলো সাধারণ জিপের মতো না। লম্বাটে ধরনের। বসার জায়গায় গদি বিছানো না–লোহার সিট। জিপটা সম্ভবত রঙ করা হয়েছে। নতুন রঙের কড়া গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে। শাহেদকে ধাক্কা দিয়ে জিপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে–সে পিছলে পড়ে যেত। অন্ধকারে, কেউ একজন তাকে ধরলা, সিটে বসিয়ে দিল। শাহেদ মনে মনে বলল, ধন্যবাদ। ইংরেজিতে থ্যাংক যু শব্দ করে বলা যায়। বাংলা ধন্যবাদ মনে মনে বলতেই ভালো লাগে। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও শাহেদ বুঝতে পারছে জিপ ভর্তি তার মতো সাধারণ মানুষ। মানুষগুলো ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। ভীত মানুষের গা থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। সেই গন্ধ সূক্ষ্ম হলেও কটু ও ভারি। ভয়ের গন্ধ মানুষের স্নায়ুকে অবশ করে দেয়। জিপ চলতে শুরু করেছে। মিলিটারি গাড়ি খুব দ্রুত চলে বলে যে জনশ্রুতি তা ঠিক না। জিপটা খুব আস্তে চলছে। জিপের সাসপেনশনও খুব খারাপ। গাড়ি খুব লাফাচ্ছে। জিপের ছাদে লোহার রডে শাহেদের মাথা ঠেকে গেল! শাহেদ যার পাশে বসেছে সেই ভদ্রলোক আশ্চর্যরকম মিষ্টি গলায় বললেন, এই ডাণ্ডাটা শক্ত করে ধরে বসে থাকুন। তিনি অন্ধকারেই শাহেদের হাত ধরে ডাণ্ডা দেখিয়ে দিলেন। কিছু কণ্ঠস্বর আছে একবার শুনলেই আবার শুনতে ইচ্ছে করে। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর সে-রকম। সেই কণ্ঠস্বর আবারো শোনার জন্য শাহেদ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ভদ্রলোক বললেন, জানি না। গাড়ি এখন মিরপুর রোডে পড়েছে। শাহেদ বলল, আমাদের ধরেছে কেন? ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। জিপ আবারো বড় রকমের বাকুনি খেল। শাহেদ জিপের ডাণ্ড শক্ত করে ধরেছিল বলে ব্যথা পেল না। যে বাকুনি তাতে ছিটকে পড়ে যাবার কথা। মিলিটারিরা রাস্তাঘাট থেকে লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন? তাদের উদ্দেশ্যটা কী? শাহেদ তাকে ধরার কারণ কিছুতেই বের করতে পারছে না। সে কোনো রাজনৈতিক নেতাও না, কমী ও না। লেখক না, কবি না, গায়ক না। সামান্য একজন। নিজের পরিবারের বাইরে কেউ তাকে চেনে না। মিলিটারির লোকজন তাকে চিনল কী করে? এই কদিনের দুঃখে, কষ্টে, চিন্তায়, দুর্ভাবনায় তার চেহারা কি ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে? তাকে দেখলেই কি মনে হয় সে ভয়ঙ্কর কিছু করবে? ভয়ঙ্কর কিছু করার ক্ষমতা শাহেদের নেই। সে অতি সাধারণ একজন। সাধারণরা সাধারণ কাজ করে। পড়াশোনায় সাধারণ রেজাল্ট করে, সাধারণ একটা চাকরি যোগাড় করে, সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করে সাধারণ জীবনযাপন করে। শাহেদ তাই করছে। তার জীবনযাত্ৰা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে বাধা। ঝামেলাহীন গণ্ডিবদ্ধ জীবন। গাড়ি আরেকটা বড় ধরনের বাকি খেয়ে থেমে গেল। আর নড়নচড়ন নেই। কী হচ্ছে? তারা কি পৌঁছে গেল? পৌঁছে গেলে মিলিটারিরা তাদের নামাবে। নামাবার জন্যে কেউ আসছে না। শাহেদ প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট এবং দিয়াশলাই বের করেছে। ধরাচ্ছে না। সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও শান্তি আছে। গাড়ি অন্ধকার একটা জায়গায় থেমেছে। ভেতরে আলো আসছে না বলে শাহেদ তার সহযাত্রীদের মুখ দেখতে পাচ্ছে না। মুখ দেখলেও খানিকটা ভরসা। পাওয়া যেত। ভয়াবহ দুঃসময়ে মানুষের মুখ দেখলে মনে সাহস চলে আসে। শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, কী হচ্ছে? শাহেদের পাশের ভদ্রলোক বললেন, আবো লোক তুলবে। কাদেরকে তুলবো? হাতের কাছে যাদের পায়। কেন? জানি না ভাই, কিছুই জানি না। আপনি সিগারেট খান–কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখন সুবিধা অসুবিধার অতীত। আপনি একটা খাবেন? আমি ধূমপান করি না। শাহেদ সিগারেট ধরাল। দিয়াশলাই-এর আগুনে সে একবালকের জন্যে সহযাত্রীদের মুখ দেখল। শুরুতে সে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল–সবাই একপলকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? সে কী করেছে? সে কি ভয়ঙ্কর কিছু করেছে? নাকি ভয়ঙ্কর কিছু তার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে? সিগারেটে টান দিয়ে প্রথম শিকের ধাক্কাটা শাহেদ সামলে ফেলল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন–সেই রহস্য ভেদ হয়েছে। সে দিয়াশলাই জুলিয়েছে। সবাই তাকিয়েছে আগুনের দিকে। তার দিকে না। কাজেই তার ভীত হবার কিছু নেই। শাহেদ লক্ষ করল তাঁর ভয়টা একটু যেন কমে গেল। সিগারেটের নিকোটিন শরীরে ঢোকার কারণে কি কমল? নিকোটিন কি মানুষকে সাহসী করে? সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সে একটা ছবি দেখেছিল–নাম মনে পড়ছে না। রাশিয়ান ছবি। সেখানে রাশিয়ান একজন কর্নেলকে নাৎসি সৈন্যরা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারে। কর্নেলকে পেছন দিকে হাত বেঁধে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন কর্নেল মাথা ঘুরিয়ে বলেন, আমি কি একটা সিগারেট পেতে পারি? তাকে সিগারেট দেয়া হয়। যেহেতু হাত বাধা, একজন সিগারেট ধরিয়ে কর্নেলের ঠোঁটে পুরে দেয়। কর্নেল জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে নিয়েই বলেন, থ্যাংক য়্যু সোলজার। তারপর বেশ আয়েশ করে সিগারেট টানতে থাকেন। কর্নেলের ঠোঁটে সামান্য হাসির আভাস, যেন পুরো ব্যাপারটায় তিনি খুব মজা পাচ্ছেন। ছবিতে যে-সব ঘটনা ঘটে বাস্তবে কি তাই ঘটে? মিলিটারিরা যদি শাহেদকে গুলি করে মারার জন্যে নিয়ে যায় তাহলে কি সে বলতে পারবে, আমি কি একটা সিগারেট পেতে পারি? ধরা যাক তারা তাকে একটা সিগারেট দিল। সে কি কর্নেল সাহেবের মতো ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে সিগারেট টানতে পারবে? মৃত্যুর আগে আগে বিশেষ কোনো স্মৃতি কি তার মনে পড়বে? বিশেষ কোনো স্মৃতি শাহেদের নেই– তার সব স্মৃতিই সাধারণ। অতি সাধারণ মানুষের জীবনেও কিছু নাটকীয় ঘটনা থাকে, তার তাও নেই। মিলিটারিরা তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে–এটাই বোধহয় তার জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা। সে যদি এ যাত্রা বেঁচে যায়, তাহলে সে বৃদ্ধ বয়সে সে এই ঘটনা
false
shomresh
নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে-দেওয়া ওয়াটার বটটা হাতে নিয়ে অনি নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ও টের পেল এখন আর একদম ভয় করছে না, বুকের মধ্যে একটুও শিরশিরানি নেই। বরং নিজেকে খুব কাজের বলে মনে হচ্ছে, বেশ বড় বড় লাগছে নিজেকে। বারান্দায় উঠতেই দরজা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত অনিকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে টেনে নিল। সবাই মিলে বলতে লাগল, কী ছেলে রে বাবা, একটুও ভয় নেই, যদি ধরে নিয়ে যেত, আসুক আজ বাবা, হবে তোমার ইত্যাদি। বেঁকেচুরে নিজেকে ছাড়িয়ে অনি ঝাড়িকাকুর দিকে ওয়াটার বটুটা এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, জল নিয়ে এস শিগগির, লোকটা দাড়িয়ে আছে। অনির গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে, মাধুরী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। অনি যে এই গলায় কথা বলতে পারে মাধুরীর জানা ছিল না। ওয়াটার বটটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন উনি। পিসিমা বললেন, হ্যারে, তোকে কী বলল রে? অনি বলল, কী আর বলবে, জল চাইল! পিসিমা আবার বললেন, তোকে কি ভয় দেখাল? বিরক্ত হয়ে অনি বলল, ভয় দেখাবে কেন? জল চাইতে হলে কি তুমি ভূঢ় দেখাও? এমন সময় মাধুরী ওয়াটার বটলটা নিয়ে ফিরে এলেন। কম্বলে মোড়া বটলটা এখন বেশ ভারী। মাধুরী জলের সঙ্গে একটা প্লেটে বেশকিছু বাতাসা দিলেন। বাতাসাটা নিয়ে অনি মায়ের দিকে তাকাতে মাধুরী হাসলেন, শুধু জল দিতে নেই রে, যা। এক হাতে জল অন্য হাতে বাতাসা নিয়ে অনি গটগট করে বাইরে বেরিয়ে এল। এইজন্যে মাকে ওর এত ভালো লাগে। মাঠের মধ্যে গাছের মতো লোকটা একা দাড়িয়ে ছিল। অনিকে আসতে দেখে একগাল হাসল। হাসি দেখে অনির সাহস আরও বেড়ে গেল। কাছাকাছি হতে লোকটা হাত বাড়িয়ে ওয়াটার বলটা নিয়ে বলল, থ্যা। কথাটা অনি ঠিক বুঝল না, কিন্তু ভঙ্গিতে বেশ মজা লাগল। ও বাতাসার প্লেটটা এগিয়ে ধরতে লোকটা চোখ কুঁচকে সেটাকে দেখে বলল, হোয়াতিজ দ্যাটা মানেটা ধরতে না পারলেও অনি বুঝতে পারল লোকটা কী বলতে চাইছে। এখনও ওদের স্কুলে ইংরেজি শুরু হয়নি। সরিৎশেখর অবশ্য ওকে মাঝে-মাঝে ইংরেজি শব্দ শেখান, কিন্তু বাতাসার ইংরেজি কোনোদিন গুনেছে বলে মনে করতে পারল না। বরং বাতাসা খেতে মিষ্টি, আর মিষ্টির ইংরেজি সুইট-এটা বলে দিলেই তো হয়! শব্দটা শুনে লোকটা ঠোঁট দুটো গোল করে অবাক হবার ভান করে বলল, শো গুড় ইংলিশ? আই টু। ওকে, ওকে। বলে এক থাবায় বাতাসাগুলো নিয়ে মুখে পুরে চিবোতে লাগল। স্বাদ জিভে যেতে লোকটার মাথা দুলতে লাগল চিবোনার তালে তালে। তারপর ঢকঢক করে কয়েকটা ঢোক জল খেয়ে নিতেই পেছন থেকে ট্রাকের লোকগুলো হইহই করে ডাকতে শুরু করল। অনি দেখল পেছনের লোকগুলোকে ইংরেজি নয়, অন্য কোনো ভাষায় জবাব দিয়ে একহাতে অনিকে শূন্যে তুলে নিয়ে ট্রাকের দিকে হাঁটতে লাগল। লোকটার গায়ের ঘেমো বেটিকা গন্ধ আর ট্রাকের একদল নিগ্রোর হইহই, পেছনের বারান্দায় বেরিয়ে আসার পিসিমার আর্তচিৎকারে অনির শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল, ওর হাত থেকে প্লেটটা টুপ করে পড়ে গেল। ওর মনে হল ও ছেলেধরার কবলে পড়েছে, এখন ঐ ট্রাকে চাপিয়ে পৃথিবীর কোনো দূরান্তে ওকে নিয়ে যাবে ওরা। বাবা মা দাদু কাউকে কোনোদিন দেখতে পাবে না ও। প্রচণ্ড আক্রোশে লোকটার চোখদুটো দুই আঙুলে টিপে অন্ধ করে দিতে গিয়ে অনি শুনল ওকে মাথায় তুলে হাটতে হাটতে লোকটা অদ্ভুত ভাষায় ভীষণ চেনা সুরে গান গাইছে। গাইবার ধরন দেখে বোঝা যায়, খুব মগ্ন হয়ে গাইছে ও। ওর ভাষা বোঝা অসম্ভব, কিন্তু সুর শুনে অনির মনে হল পুজো করার সময় পিসিমা এইরকম সুরে গুনগুন করেন। অনির হাত লোকটার শিংএর মতো চুলের ওপর এসে থেমে গেল। ট্রাকের কাছে এসে লোকটা কিছু বলতে ট্রাকের ওপর দাড়ানো লোকগুলো হইহই করে উঠে হাত বাড়িয়ে অনির দিকে চার-পাঁচটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। লোকটার কাঁধের ওপর থাকায় অনি ট্রাকের সবটাই দেখতে পাচ্ছে। একগাদা কম্বল পাতা, বন্দুক, কাচের বোতল ছড়ানো। প্যাকেটগুলো ওর হাতে গুছিয়ে দেওয়া হয়ে গেলে লোকটা ওকে মাটিতে নামিয়ে দিল। তারপর বিরাট থাবার মধ্যে ওর মুখটা ধরে কেমন গলায় বলল, থাঙ্ক ইউ মাই সন। বলে লাফ দিয়ে ট্রাকে উঠে গেল। ওয়াটার বলটা তখন ট্রাকের ভেতর হাতে-হাতে ঘুরছে। ট্রাকটা চলে যেতে রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বিরাট আসাম রোড চুপচাপ-শব্দ নেই কোথাও। অনি ওর বুকের কাছে ধরা প্যাকেটগুলোর দিকে তাকাল। গন্ধ এবং ছবিতে বোঝা যাচ্ছে, এগলো বিস্কুট এবং টফির প্যাকেট। ওরা ওকে এগুলো ভালোবেসে দিয়ে গেল। অথচ ও কী ভয় পেয়ে গিয়েছিল! লোকগুলোকে ছেলেধরা বলে ভেবেছিল। হঠাৎ অনি অনুভব করল ওর প্যান্টের সামানেটা কেমন ভেজা-ভেজা। এক হাতে প্যাকেটগুলো সামলে অন্য হাতে জায়গাটা কত ভালো! নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল পিসিমা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে, পাশে ঝাড়িকাকু, অনেক পেছনে মা। হঠাৎ ওর পিসিমার ওপর রাগ হল, পিসিমাই শুধুশুধু মিলিটারিদের ছেলেধরা বলে ভয় দেখায়। অনি আর দাঁড়াল না। একছুটে মাঠটা পেরিয়ে পিসিমার বাড়ানো হাতের ফাঁক গলে মায়ের শরীর জড়িয়ে ধরল। মাধুরী বললেন, কী হয়েছে? মাকে জড়িয়ে ধরতে মুঠো আলগা হওয়ায় আনির হাত থেকে প্যাকেটগুলো টুপটুপ করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় মায়ের বুকে মুখ গুজে অনি বলল, লোকটা খুব ভালো, কিন্তু মা, কিন্তু বোকার মতো হিসি করে ফেলেছি। ভরত হাজাম সরিৎশেখরের চুল কাটছিল। কাঁঠালতলার রোদুরে কাঠোর পিড়ি
false
shunil_gongopaddhay
যেদিন ছাতে বসবেন সেদিন নিশ্চয় আপনার আমার জন্য মন কেমন করবে। আপনি একলাটি চুপ করে বসে থাকবেন। খানিকক্ষণ আগে আমরা সব জলখাবার খেয়েছি। আপনিও বেশি করে দুধ খাবেন। …সন্ধে হয়ে এসেছে। এখন শান্তিনিকেতনের কথা মনে আসছে। এ সময়ই তো আমার সবচেয়ে বেশি আপনার জন্য মন কেমন করবে। কাশীতে গিয়েও করবে। …আমার গাড়িতে একটুও ভাল লাগছে না। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। কবিও বিষণ্ণ হয়ে রইলেন কয়েকটি দিন। এই এক মাস ধরে সরল সুন্দর বালিকাটি তাঁর মন লাবণ্যে ভরিয়ে দিয়েছিল। মাধুরীলতা চলে যাবার পরেই ওর সঙ্গে দেখা, এ এক আশ্চর্য যোগাযোগ। মাঝে মাঝেই মাধুরীলতা আর রাণু মিলেমিশে গেছে। রথী আর প্রতিমাও মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছিল। রাণুর চিঠি পাওয়া মাত্র কবি উত্তর লিখতে বসলেন। রেলের পথে তোমার যে মন খারাপ হয়েছিল সেই পড়ে আমার বড় কষ্ট হল। তুমি মনে করো না আমি বুঝতে পারিনি। সেই বুধবারের দিন যখন তোমার গাড়ি চলছিল, আর আমি যখন চুপটি করে আমার কোণে, এবং সন্ধেবেলা ছাদে বসে ছিলুম তখন তোমার কষ্ট আমাকে বাজছিল। আমি মনে মনে কেবল এই কামনা করছিলুম যে, বাদলের ওপর যেমন ইন্দ্রধনু তৈরি হয়, তেমনি করে তোমার অশ্রুভরা কোমল হৃদয়ের উপরে স্বর্গের পবিত্র আলো পড়ক, সৌন্দর্যের ছটায় তোমার জীবনের এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্ত পূর্ণ হয়ে উঠুক। আমি আমার জীবনকে তাঁরই কাছে উৎসর্গ করেছি–সেই উৎসর্গকে যে তিনি গ্রহণ করেছেন তাই মাঝে মাঝে তিনি আমাকে নানা ইশারায় জানিয়ে দেন—হঠাৎ তুমি তাঁরই দূত হয়ে আমার কাছে এসেছ। তোমার উপর আমার গভীর স্নেহ তাঁর সেই ইশারা। এই আমার পুরস্কার। এতে আমার কাজের দ্বিগুণ উৎসাহ হয়, আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, আমার মনের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নদীয়া জেলার টুঙ্গি গ্রামের এক টুলো পণ্ডিত ছিলেন বেণীমাধব অধিকারী। ছাত্র পড়ানো ছাড়া সংস্কৃত সাহিত্য ও শাস্ত্র চর্চা করে তিনি সময় কাটাতেন। পণ্ডিতের অন্তরালবর্তিনী স্ত্রীর ভূমিকা সারাদিন ধরে রান্নাবান্না করা ও নিয়মিত সন্তান প্রসব। সাতটি পুত্র কন্যার জন্ম দিয়ে পণ্ডিতজায়া একদিন নিঃশব্দে বিগত হলেন। গৃহিণী গৃহমুচ্যতে। গৃহিণী বিগত আর গৃহ রেখে লাভ কী, পণ্ডিত গ্রাম ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেলেন। দণ্ড ধারণ করে হলেন সন্ন্যাসী, নতুন নাম নিলেন স্বামী যোগানন্দ সরস্বতী। সারা ভারত পর্যটন করে যোগানন্দ সরস্বতী এবসময় স্থিত হলেন কাশীতে। ততদিনে তাঁর কিছু ভক্ত ও শিষ্য জুটেছে, এক ধনী ভক্ত তাঁকে একটি বাড়ি ও সংলগ্ন জমি দান করে, সেখানে গড়ে ওঠে আশ্রম। ব্রহ্মকুণ্ডের সেই আশ্রমে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা ও শিব মূর্তির পূজা ও নিয়মিত সাধন ভজন হয়। সন্ন্যাসী হলেও যোগানন্দ সরস্বতী পূর্ব জীবনের স্মৃতি একেবারে মুছে ফেলেনি। মাঝে মাঝে সন্তানদের খোঁজ খবর নেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একজন খুবই কৃতবিদ্য হয়েছে, সংস্কৃত ও দর্শনের খ্যাতনামা অধ্যাপক, ক্রমে তিনি দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ হন। একেবারে শেষ বয়েসে যোগানন্দ কোনও একজন সন্তানকে কাছে পাবার জন্য উতলা হয়ে ওঠেন। দিল্লি থেকে ডেকে পাঠান ফণিভূষণকে। পিতার অনুরোধ অমান্য করতে পারলেন না ফণিভূষণ, দিল্লির চাকরি ছেড়ে সপরিবারে চলে এলেন কাশীতে, কিন্তু আশ্রমে উঠলেন না। পাশেই একটা নতুন বাড়ি বানালেন। কাশী শহর বিদ্যা চর্চার একটি বৃহৎ কেন্দ্র, সেখানে অধ্যাপনার কাজ পেতে তাঁর কোনও অসুবিধে হল না। ফণিভূষণের নিজের পরিবারটিও বেশ বড়। পাঁচটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, আশ্রিত আত্মীয়-পরিজন, দাস-দাসী, জমজমাট সংসার। এ পরিবারে গান বাজনার খুব চর্চা হয়, যদিও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর ব্যাপারে অধ্যাপক মশাই কড়া নজর রাখতেন। দুই পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পর প্রথম কন্যা আশা, তাকে বেশ কিছুদিন ছেলে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, সবাই ডাকত নন্দদুলাল বলে, রজঃস্বলা হবার পর আশা ওই নাম শুনলেই রেগে যায়, ছেলেদের মতন জামা টামা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, এখন শাড়ি ছাড়া কিছু পরে না। পড়াশুনোয় দারুণ মেধাবিনী, এই বয়েসেই সে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছে। প্রায়ই সে বিরলে বসে ধ্যান করে। দ্বিতীয় বোন শান্তি মুখচোরা, লাজুক, বাড়িতে তার অস্তিত্ব যেন টেরই পাওয়া যায় না। তার পরের বোন প্রীতির ডাক নাম রাণু, স্বভাবে সে আগের দুই বোনের সম্পূর্ণ বিপরীত, বাড়ির মধ্যে সে-ই সবচেয়ে দুরন্ত। সব সময় সে প্রাণচাঞ্চল্যে অস্থির, বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, সে যেন সর্বক্ষণ বাড়ির সর্বত্র পরিদৃশ্যমান। লক্ষ্মী মেয়ে ও সুবোধ বালকদের খুব প্রশংসা হয় বটে, কিন্তু দুরন্ত সন্তানটিকেই বয়স্করা বেশি পছন্দ করেন। তিন-চার বছর বয়েস থেকেই রাণু পাশের আশ্রমে গিয়েও হুটোপাটি করে, যোগানন্দ সরস্বতী এই নাতনিটির দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তাকে কোলে বসিয়ে আদর করতে চান। কিন্তু চুপ করে বসে থাকার পাত্রীই নয় রাণু, সে ছটফটিয়ে উঠে যায়। যোগানন্দ ছড়া কেটে বলেন, রাণু আমার মানিক। নাড়বও না, চাড়বও না, দেখব খানিক খানিক। তান্য বোনদের সঙ্গে রাণু ইস্কুলে যায় বটে, কিন্তু ইস্কুলের পড়ার দিকে রাণুর মন নেই। সে পড়ে যত রাজ্যের গল্পের বই, বড়দের হোক, ছোটদের হোক, বাছ-বিচার নেই কিছু। এ বাড়িতে বই প্রচুর, কলকাতা থেকেও পত্র-পত্রিকা আসে। ছেলেমেয়েরা জন্ম থেকেই আছে দিল্লি ও বারাণুসীতে, স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি, তবু সবাই খুব ভাল বাংলা শিখেছে। মা সরযূবালা চন্দননগরের মেয়ে, হাতেখড়ির সময় থেকেই তিনি প্রতিটি সন্তানকে বাংলা ভাষায় দীক্ষা দিয়েছেন। প্রথমে তিনি ওদের রামায়ণ-মহাভারত আর রূপকথার গল্প পড়ে শোনান, তারপর বই ধরিয়ে দেন। সাত বছর বয়েস থেকেই রাণুর গল্পের বই পড়ার নেশা। অনেক বই। পড়তে পড়তে সে
false
shorotchandra
ফিরিবে তাহার স্থিরতা নাই, কিন্তু মন যেন আর একটা দণ্ডও এখানে থাকিতে চাহে না। স্নানের জন্য রতন তাগিদ শুরু করিয়াছে। কারণ, যাইবার সময় রাজলক্ষ্মী শুধু কড়া হুকুম দিয়াই নিশ্চিন্ত হইতে পারে নাই, রতনকে তাহার পা ছুঁয়াইয়া দিব্য করাইয়া লইয়াছে যে, তাহার অবর্তমানে আমার এতটুকু অযত্ন বা অনিয়ম না হয়। খাবার সময় সকালে এগারোটা ও রাত্রে আটটার মধ্যে ধার্য হইয়াছে, রতনকে প্রত্যহ ঘড়ি দেখিয়া সময় লিখিয়া রাখিতে হইবে। কথা আছে, ফিরিয়া আসিয়া সে প্রত্যেককে একমাসের করিয়া মাহিনা বকশিশ দিবে। রান্না শেষ করিয়া বামুনঠাকুর ঘর-বাহির করিতেছে, এবং চাকরের মাথায় তরিতরকারি, মাছ, দুধ প্রভৃতি লইয়া প্রভাত না হইতেই যে কুশারীমহাশয় স্বয়ং আসিয়া পৌঁছাইয়া দিয়া গেছেন আমি তাহা বিছানায় শুইয়া টের পাইয়াছিলাম। ঔৎসুক্য কিছুতেই আর ছিল না—বেশ, এগারোটা এবং আটটাই সই। একমাসের উপরি মাহিনা হইতে আমার জন্য কেহ বঞ্চিত হইবে না তাহা নিশ্চিত। কাল রাত্রে অতিশয় নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়াছিল, আজ নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পূর্বেই স্নানাহার শেষ করিয়া বিছানায় শুইতে না শুইতেই ঘুমাইয়া পড়িলাম। ঘুম ভাঙ্গিল চারিটার কাছাকাছি। কয়েকদিন হইতেই নিয়মিত বেড়াইতে বাহির হইতেছিলাম, আজিও হাতমুখ ধুইয়া চা খাইয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। দ্বারের বাহিরে একজন লোক বসিয়াছিল, সে হাতে একখানা চিঠি দিল। সতীশ ভরদ্বাজের চিঠি, কে একজন অনেক কষ্টে এক ছত্র লিখিয়া জানাইয়াছে যে, সে অত্যন্ত পীড়িত। আমি না গেলে সে মরিয়া যাইবে। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হইয়াছে তাহার? লোকটা বলিল, কলেরা। খুশি হইয়া কহিলাম, চল। খুশি তাহার কলেরার জন্য নয়। গৃহের সংস্রব হইতেই কিছুক্ষণের জন্যও যে দূরে যাইবার সুযোগ মিলিল ইহাই পরম লাভ বলিয়া মনে হইল। একবার ভাবিলাম রতনকে ডাকিয়া একটা খবর দিয়া যাই, কিন্তু সময়ের অভাবে ঘটিয়া উঠিল না। যেমন ছিলাম, তেমনি বাহির হইয়া গেলাম, এ বাড়ির কেহ কিছু জানিতে পারিল না। প্রায় ক্রোশ-তিনেক পথ হাঁটিয়া শেষবেলায় গিয়া সতীশের ক্যাম্পে পৌঁছিলাম। ধারণা ছিল, রেলওয়ে কনস্ট্রাকশনের ইনচার্জ এস. সি. বর্‌দাজের অনেক কিছু ঐশ্বর্য দেখিতে পাইব, কিন্তু গিয়া দেখিলাম হিংসা করিবার মত কিছু নয়। ছোট একটা ছোলদারি তাঁবুতে সে থাকে, পাশেই তাহার লতাপাতা খড়কুটা দিয়া তৈরি কুটীরে রান্না হয়। একটি হৃষ্টপুষ্ট বাউরী মেয়ে আগুন জ্বালিয়া কি একটা সিদ্ধ করিতেছিল, আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁবুর মধ্যে লইয়া গেল। এ সতীশের প্রণয়িণী। ইতিমধ্যে রামপুরহাট হইতে একজন ছোকরাগোছের পাঞ্জাবী ডাক্তার আসিয়াছিলেন, তিনি আমাকে সতীশের বাল্যবন্ধু জানিয়া যেন বাঁচিয়া গেলেন। রোগীর সম্বন্ধে জানাইলেন যে কেস সিরিয়াস্‌ নয়, প্রাণের আশঙ্কা নাই। তাঁহার ট্রলি প্রস্তুত, এখন বাহির হইতে না পারিলে হেড কোয়ার্টার্সে পৌঁছাতে অতিশয় রাত্রি হইয়া যাইবে—ক্লেশের অবধি থাকিবে না। আমার কি হইবে সে তাঁহার ভাবিবার বস্তু নয়। কখন কি করিতে হইবে রীতিমত উপদেশ দিলেন, এবং ঠেলাগাড়িতে রওনা হইবার মুখে কি ভাবিয়া তাঁহার ব্যাগ খুলিয়া গোটা দুই-তিন কৌটা ও শিশি আমার হাতে দিয়া কহিলেন, কলেরা কতকটা ছোঁয়াচে রোগের মত। ঐ ডোবার জলটা ব্যবহার করতে মানা করে দেবেন, এই বলিয়া তিনি মাটিতোলা খাদটা হাত দিয়া দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, আর যদি খবর পান কুলিদের মধ্যে কারও হয়েচে—হতে পারে—এই ঔষধগুলো ব্যবহার করবেন। এই বলিয়া তিনি রোগের কি অবস্থায় কোনটা দিতে হইবে বলিয়া দিলেন। মানুষটি মন্দ নয়, মায়াদয়া আছে। আমার বাল্যবন্ধু কেমন থাকেন কাল যেন তিনি খবর পান, এবং কুলিদের উপরও যেন দৃষ্টি রাখিতে ভুল না হয়, আমাকে বার বার সাবধান করিয়া চলিয়া গেলেন। এ হইল ভাল। রাজলক্ষ্মী গিয়াছে বক্রেশ্বর দেখিতে, আর রাগ করিয়া আমি বাহির হইয়াছি পথে। পথেই এক ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ। বাল্যকালের পরিচয়, অতএব বাল্যবন্ধু ত বটেই। তবে বছর-পনর খবরাখবর ছিল না, হঠাৎ চিনিতে পারি নাই। কিন্তু দিন-দুয়ের মধ্যেই অকস্মাৎ এ কি ঘোরতর মাখামাখি! তাঁহার কলেরায় চিকিৎসার ভার, শুশ্রূষার ভার, মায় তাঁর শ-দেড়েক মাটিকাটা কুলির খবরদারির ভার গিয়া পড়িল আমার উপর! বাকি রহিল শুধু তাঁহার সোলার হ্যাট এবং টাট্টু ঘোড়াটি। আর বোধ হয় যেন ওই কুলি মেয়েটিও। তাহার মানভূমের অনির্বচনীয় বাউরী ভাষার অধিকাংশই ঠেকিতে লাগিল, কেবল এটুকু ঠেকিল না যে, মিনিট দশ-পনরর মধ্যেই সে আমাকে পাইয়া অনেকখানি আশ্বস্ত হইয়াছে। যাই, আর ত্রুটি রাখি কেন, ঘোড়াটিকে একবার দেখিয়া আসি গে। ভাবিলাম, আমার অদৃষ্টই এমনি। না হইলে রাজলক্ষ্মীই বা আসিত কিরূপে, অভয়াই বা আমাকে দিয়া তাহার দুঃখের বোঝা বহাইত কেমন করিয়া? আর এই ব্যাঙ এবং তাহার কুলি গ্যাঙ! কোন ব্যক্তির পক্ষেই ত এ-সকল ঝাড়িয়া ফেলিতে একমুহূর্তের অধিক সময় লাগিত না। আর আমিই বা সারাজীবন বহিয়া বেড়াই কিসের জন্য? তাঁবুটা রেল কোম্পানির। সতীশের নিজস্ব সম্পত্তির একটা তালিকা মনে মনে প্রস্তুত করিয়া লইলাম। কয়েকটা এনামেলের বাসন, একটা স্টোভ, একটা লোহার তোরঙ্গ, একটা কেরোসিন তেলের বাক্স, এবং তাহার শয়ন করিবার ক্যাম্বিশের খাট, বহু-ব্যবহারে ডোঙার আকার ধারণ করিয়াছে। সতীশ চালাক লোক, এ খাটে বিছানার প্রয়োজন হয় না, একখানা যা-তা হইলেই চলিয়া যায়, তাই ডোরাকাটা একখানা শতরঞ্চি ছাড়া আর কিছুই সে কেনে নাই। ভবিষ্যতে কলেরা হওয়ার কোন ব্যবস্থাই তাহার ছিল না। ক্যাম্বিশের খাটে শুশ্রূষা করার অত্যন্ত অসুবিধা এবং একমাত্র শতরঞ্চি অতিশয় নোংরা হইয়া উঠিয়াছে। এতএব তাহাকে নীচে শোয়ানো ছাড়া উপায় নাই। আমি যৎপরোনাস্তি চিন্তিত হইয়া উঠিলাম। মেয়েটির নাম কালীদাসী; জিজ্ঞাসা করিলাম, কালী, কারও দু-একখানা বিছানা পাওয়া যাবে? কালী কহিল, না। কহিলাম, দুটি খড়-টড় যোগাড় করে আনতে পার? কালী ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া
false
MZI
কিন্তু তবুও নিশ্চয়ই তারা মানুষ। তাদের চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই মানুষের মতো। রুকাস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তা নিশ্চয়ই সত্যি। তাহলে তার চিন্তা-ভাবনা কী রকম? আমি ঠিক জানি না। টুকু বলল, ক্লডিয়ান খুব নিষ্ঠুর। সকল বায়োবটমাত্রেই নিষ্ঠুর। ক্লডিয়ান তাদের দলপতি, তার নিষ্ঠুরতা অনেক বেশি। আমি অবাক হয়ে টুবু এবং রুকাসের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভবিষ্যতের পৃথিবীর পরিণতি কী হবে সেটি নির্ধারিত হবে এই মানুষ এবং রবোটগুলো দিয়ে। পুরো ব্যাপারটি ঘটছে আমার চোখের সামনে, আমার সেটি এখনো বিশ্বাস হতে চায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টুব, তোমাদের এত ক্ষমতা, তোমরা ইচ্ছে করলেই এখন সারা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলতে পার—কেন ভবিষ্যতের সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ-বিগ্রহের মাঝে পড়ে রয়েছ? কেন এখানে থেকে যাও না? সারা পৃথিবীর মাঝে তোমরা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ। টুবু হাসির মতো শব্দ করে বলল, সময় পরিভ্রমণের ব্যাপারটি তুমি জান না বলে তুমি এরকম কথা বলছ। কেউ যখন অতীতে আসে, তাকে খুব সাবধানে থাকতে হয়। কেন? সে যদি একটু ভুল করে, ভয়ংকর প্রলয় হয়ে যাবে প্রকৃতিতে। আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক গতির বিরুদ্ধে যাচ্ছি। একটি অকারণ প্রাণীহত্যা হবে ভবিষ্যতের একটা প্রজাতিকে ধ্বংস করে ফেলা। সময়ের অনিশ্চিত সূত্র যেটুকু করতে দেয়, তার ভেতরে থাকতে দেয় সব সময়। তার মানে তোমরা এখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে পারবে না? না। মানুষ মারতে পারবে না? না। কোনো কিছু ধ্বংস করতে পারবে না? না। কিন্তু রুকাস ঠুনদের তিনটি মহাকাশযান ধ্বংস করে ফেলেছিল। প্রকৃতি তাকে সেটা করতে দিয়েছে— আমার মা এই সময়ে আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, সব সময়ে এই কচকচি ভালো লাগে না তুই থাম দেখি, আমি কয়েকটা কাজের কথা বলি। বলুন। আজকাল কাপড় নিয়ে মহাযন্ত্রণা। তাপ-নিরোধক কাপড়গুলো যাচ্ছেতাই, ভালো কিছু তাপ-নিরোধক পাওয়া যায় কোথাও? কী করবেন আপনি তাপ-নিরোধক কাপড় দিয়ে? এই রান্নাবান্নার সময় কাজে লাগে। সেদিন ছোট একটা মাইক্রোভস্ট ফেটে কী কেলেঙ্কারি। এই যে দেখ বাবা, হাতটা পুড়ে গেছে। রবোটের মুখে যেটক যান্ত্রিক সমবেদনা ফোটানো সম্ভব সেটুকু ফুটিয়ে টুকু গভীর মনোযোগ নিয়ে মায়ের হাতের পোড়া দাগটি লক্ষ করে বলল, খুবই দুঃখের ব্যাপার। আপনি কেমন করে রান্না করেন? ছোট একটা ইউরেনিয়াম চুলো আছে, কতদিনের পুরানো, কে জানে রেডিয়েশান বের হয় কি না। তোমরা কেমন করে কর? আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এক জন রবোট বলে খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা নেই। মানুষদের জন্যে খাবার তৈরি করতে হয়। খাওয়া ব্যাপারটি আজকাল দু ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে—শরীরের পুষ্টি এবং স্বাদ। পুষ্টির ব্যাপারটি ছোট ছোট ট্যাবলেটে করে চলে আসে। সেখানে ইচ্ছেমতো স্বাদ যোগ করা হয়। মা অবাক হয়ে বললেন, তার মানে একই খাবারের ট্যাবলেটে মাংসের স্বাদ যোেগ করা যাবে, আবার ইচ্ছে করলে মাছের স্বাদ? ঠিক বলেছেন। মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বাদগুলো কেমন করে যোগ কর? বোতলে কিনতে পাওয়া যায়? আগে সেরকম ছিল। গত শতাব্দীতে পুরো ব্যাপারটি ইলেকট্রনিক করে ফেলা হয়েছে। ই-ইলেকট্রনিক? হ্যাঁ। স্বাদ জিনিসটা কী? আপনাদের মস্তিষ্কের একধরনের অনুভূতি। একটা খাবার মুখে দেবেন, জিব, গলা, নাক, মুখমণ্ডল সেই খাবারের অনুভূতিটি মস্তিষ্কে পাঠাবে, আপনারা সেটা উপভোগ করবেন। পুরো জিনিসটি শর্টকাট করে অনুভূতিটি সোজাসুজি মস্তিষ্কে দেয়া যায়, ছোট ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় সেসব করার জন্যে। মা তখনো ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না। মাথা নেড়ে বললেন, মুখে কোনো খাবার দিয়েই খাবারের স্বাদ অনুভব করা সম্ভব। হ্যাঁ। তোমরা সেটা কর? আমি রবোট, তাই আমাকে করতে হয় না, মানুষেরা করে। প্রত্যেক দিন করে? প্রত্যেক বেলায়? টুবু আবার হাসির মতো একটু শব্দ করে বলল, প্রত্যেক বেলায় খাওয়ার সময় আর কতজনের আছে? যাদের সময় আছে, তারা দিনে একবার। ব্যস্ত মানুষেরা সপ্তাহে একবার। বিশেষ সময়ে মাসে একবার খাওয়া হয়। সেগুলো শরীরে একমাস সবরকম পুষ্টি পাঠায় ধীরে ধীরে– তাই বল। রুকাস তাই কিছু খেত না প্রথম প্রথম। হ্যাঁ, তাকে আমরা দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টিকর খাবারের ট্যাবলেট খাইয়ে পাঠিয়েছিলাম। মা খানিকক্ষণ চোখ বড় বড় করে থেকে বললেন, আচ্ছা বাবা, কাপড়ের ফ্যাশন কি আজকাল? ঢিলেঢালা, নাকি সময় পরিভ্রমণের একটা প্রশ্ন মাথার মাঝে ঘুরঘুর করছে, কিন্তু মায়ের জন্যে মনে হচ্ছে আজ সেটি আর জিজ্ঞেস করা হবে না। ০৭ নূতন জীবন আমাদের এই এলাকায় এত বড় একটা ব্যাপার ঘটছে, কিন্তু দেখে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। টবু তার মনমতো একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে পরদিন ভোরে আমার সাথে হাঁটতে বের হল। চমৎকার বসন্তকালের একটি সকাল, ঝোপঝাড়ে বুনো ফুল, পাখি ডাকছে, ঘাসফড়িং লাফাচ্ছে। আকাশ নীল, মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। আমি কিরীণার বাসায় থেমে তাকে খোঁজ করলাম। তার মা বললেন, সে খুব ভোরে তার আইসোটোপ আলাদা করার ছাঁকনিটি নিয়ে সমুদ্রতীরে চলে গেছে। আমি তখন উবুকে নিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে হাঁটতে থাকি। অনেক দূর থেকে আমি কিরীণার গলা শুনতে পাই। সে এবং তার কয়জন বান্ধবী পাশাপাশি বসে সুর করে গান গাইতে গাইতে কাজ করছে। গানের বিষয়বস্তুটি খুব করুণ—ছোট্ট একটি শিশু প্রতিদিন ভোরে সমুদ্রতীরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বাবাকে ট্রনেরা ধরে নিয়ে গেছে, সে কি আর ফিরে আসবে? কিরীণার মিষ্টি গলার সেই করুণ সুর শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি হা হা করে ওঠে। টুর্ব পর্যন্ত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, অত্যন্ত চমৎকার কণ্ঠ, প্রয়োজনীয় তরঙ্গের অপূর্ব সুষম উপস্থাপন। যার অর্থ নিশ্চয়ই কি সুন্দর গান। কিরীণা আমাদের দেখে লজ্জা পেয়ে গান থামিয়ে ফেলল। আমি বললাম, কী
false
zahir_rayhan
মেয়েটা দেখতে বেশ তো। জোটালে কোত্থেকে। বজলে বিস্মিত হলো। তোমাকে ওর কথা আগে একদিন বলেছিলাম, বলিনি? কই মনে পড়ছে নাতো? হ্যাঁ বলেছিলাম। তুমি ভুলে গেছে। ও আমার মামাতো বোন। ওর কাঁধজোড়া ঝাঁকালো মাহমুদ। তারপর অদূরে দাঁড়ানো ডলির দিকে বারকয়েক ফিরে ফিরে তাকালো সে। বজলে ওর দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো। মাহমুদ বললো, চলো এককাপ করে কফি খাওয়া যাক। শো শুরু হবার এখনো বেশ দেরি আছে। বজলে বললো, চলো। শাহেদ চলে যাবার পর, টেবিলে বসে অনেকক্ষণ ধরে একটা বই নাড়াচাড়া করলো সালমা। বইতে আজ মন বসছে না তার। বড় চাচার শেষের কথাগুলো বারবার কানে বাজছে। আর রওশনের মুখখানা ভেসে উঠছে বইয়ের পাতায়। বসে বসে অনেক অবাস্তব চিন্তার জাল বুনে চললো সে। এখন যদি হঠাৎ রওশন এখানে এসে পড়ে? কে জানে হয়তো এর মধ্যে কিছু একটা ঘটে গেছে দেশে। রওশন ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে। তার চোখে মুখে আনন্দের চমক। সে দোরগোড়া থেকে ডাক দিলো, সালমা আমি এসেছি দরজা খোল। না, এই নিঃসঙ্গ জীবন আর ভাল লাগে না। এই ক্ষুদ্র দেহে একবড় ক্লান্তির বোঝ আর বয়ে বেড়াতে পারে না সালমা। পাশের বাড়ির রেডিওটায় কি একটা গান হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে কান পেতে সেটা শুনতে চেষ্টা করছিলো সে। সদরে কড়া নড়ার শব্দ হতে বইটা বন্ধ করে রেখে পরনের কাপড়াটা দুহাতে একটু পরিপাটি করে নিলে সালমা। দরজাটা খুলে দিয়ে ঠিক তাকে চিনতে পারলো সে। আপনি আসাদ ভাই না? হ্যাঁ। আস্তে জবাব দিলো আসাদ। আসুন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে এলো সালমা। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো, বসুন। আসাদ বসলো। বসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে এটা সেটা দেখতে লাগলো সে। সালমা ভাবলো, এমনি বোবার মত চুপ করে বসে থাকা যায় না। কিছু একটা বলতে হয়। কিন্তু বলার মত কোন কথা খুঁজে পেলে না সে। অবশেষে ইতস্তত করে শুধালো চা খাবেন। না থাক। আসাদ নড়েচড়ে বসলো। না কেন। খান না এককাপ। বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে তাঁটের তলা থেকে স্টোভটা টেনে নিলো সালমা। আসাদ এবার না করলো না। সেও খুঁজছিলো মনে মনে। কিছু বলতে হবে। এমনি জড়ের মত কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়। আর একটু পরে একটা প্রশ্ন করলে সে। আপনি বুঝি মেডিকেলে পড়েন? ইউনিভার্সিটিতে। ও। সালমা স্টোভে আগুন ধরিয়ে দিলো। খানিকক্ষণ পর আসাদ আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার ছোট ভাইকে দেখছি না যে, উনি কোথায়? শাহেদের প্রসঙ্গ উঠতে মুখখানা কালো হয়ে গেলো সালমার। গলা নামিয়ে সঙ্কোচের সঙ্গে বললো, ও সিনেমায় গেছে। সিনেমায়? আসাদ রীতিমত অবাক হলো। কিন্তু এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না সে। চায়ের পেয়ালাটা ওর হাতে তুলে দিয়ে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো সালমা। আজ ধরপাকর হয়েছে। শুনেছেন কিছু না। কাল তো রোজা রাখতে হবে। হ্যাঁ। ভোররাতের কিছু বন্দোবস্ত করেছেন। ভাত বেঁধে রেখেছি। তরকারি নেই, সাদা ভাত। শুধু ডিম দিয়ে যেতে হবে কিন্তু। ঈষৎ হাসলো সালমা। আসাদ আস্তে করে বললো, আমার অভ্যাস আছে। রাতে বাসায় ফিরতে বেশ দেরি হলো মুনিমের। সারাদিন ছুটাছুটি করে ভীষণ ক্লান্ত সে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার শক্তি পাচ্ছিলো না। কিন্তু এই অপরিসীম ক্লান্তির মাঝেও কোথায় যেন একটা অফুরন্ত শক্তির উৎস লুকিয়ে ছিলো। যা তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সামনের দিকে। মনে পড়লো। বাবার কেরানী বন্ধু রসুল সাহেবের সঙ্গে আজ বিকেলে যখন মেডিকেলের সামনে দেখা হয়েছিলো তখন তিনি কাছে এগিয়ে এসে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এবার কি একেবারে চুপ করে থাকবে তোমরা? কিছু করবে না? আমরা আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখছেন তো আমাদের হাত পা একেবারে বাঁধা। বলেছিলো আরেকজন। সে লোকটা কাজ করে কোন এক ব্যাঙ্কে। ওদের কথা ভাবতে গেলে নিজেকে অনেক বড় মনে হয় মুনিমের। আর তখন সমস্ত ক্লান্তি তার কপূরের মতো উড়ে যায়। বাসায় ফিরে মুনিম দেখলো, টেবিলে ভাত সাজিয়ে মা বসে আছেন। আমেনার সঙ্গে কি নিয়ে আলাপ করছেন তিনি। ওকে আসতে দেখে মা তিরস্কার করে বললেন, এই একটু আসি বলে সকালে বেরিয়ে গিয়ে এই রাত দশটায় ফিরছিস তুই। এদিকে আমি চিন্তা করে মরি। ঘর বাড়ি কি কিছু নেই নাকি তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো মুনিম। তারপর গম্ভীর গলায় বললো, জানোমা, সেবার যে গুলি করে কতগুলো ছেলেকে মেরেছিলো, তাদের জন্যে আমরা একটু শোক করবো তাও দিচ্ছে না ওরা। মিনসেদের হয়েছে কি? কাঁদতেও দেবে না নাকি? মা অবাক হলেন। মুনিম সাগ্রহে বললো, তাইতো মা, কাদবার জন্যে আন্দোলন করছি। কিন্তু বাবা তোমার আন্দোলন করে কাজ নেই। পরক্ষণে জবাব দিলো মা। যে মায়ের পাঁচ-সাতটা ছেলে আছে তারা আন্দোলন করুক। তুমি আমার এক ছেলে, তোমার ওসবে দরকার নেই। আরো কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে মা চলে গেলেন তাঁর শোবার ঘরে। হতাশ হয়ে টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মুনিম। মাকে নিয়ে বড় জ্বালা ওর। মা চলে যেতে আমেনা বললো, মিন্টু এসেছিলো। কি একটা বই দিয়ে গেছে তোমার জন্যে। বলে মায়ের ঘর থেকে বইটা এনে ওর হাতে দিতে গিয়ে ফিক করে হেসে দিলো আমেনা। তারপর চলে গেলে সে। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলো মুনিম। পরে, বইটা দেখে বুঝতে পারলে কেন হেসেছে আমেনা। বহুদিন আগে কোন এক জন্মদিনে যে বইটা ডলিকে উপহার দিয়েছিলো সে, সেটা
false
toslima_nasrin
জুতা নিয়া আয়। সুহৃদ জুতো নিয়ে এল। কিন্তু একটি ধুম শব্দের কিল উপহার পেল। জুতা মুইছ্যা নিয়া আয়। ধুলো মুছে নিয়ে এল সুহৃদ। যা, পরমার পায়ে পরাইয়া দে জুতা। সুহৃদ জুতো পরাতে পরাতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, ‘আমি কি ওর চাকর?’ গীতা ছুটে এসে নিজের পায়ের জুতো খুলে সেই জুতো দিয়ে সুহৃদের পিঠে সজোরে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘হ তুই ওর চাকর। অন্যদিন তো পরাস জুতা, আইজকা মুখ দিয়া কথা বাইর হয় কেন? আইজকা তর সাহস বাড়ল কেমনে? কারে দেইখা সাহস বাড়ছে? মনে করছস কেউ তরে বাঁচাইতে পারবো আমার হাত থেইকা?’ আমার চোখের সামনে ঘটে এগুলো। আমার আর সয় না। বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা কাঁদি। আমরা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। কোনও মা কি পারে এরকম ব্যবহার করতে নিজের সন্তানের সঙ্গে? সৎ মায়ের নির্মমতার অনেক গল্প শুনেছি। সব গল্পই হার মানে গীতার কাছে। মা বলেন, ‘গু ফালায় নাই মুত ফালায় নাই, হাঁটা শিখায় নাই, কথা শিখায় নাই, ছয় বছর পরে একটা তৈরি ছেলে পাইছে, ছেলের জন্য কোনও টান নাই।’ তাই বা কেন হবে, ভাবি। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে পঁচিশ বছর পর ফিরে পেলেও তো মায়ের আদর মরে যায় না। বাবাও যান সুহৃদকে দেখতে। বাবার কাছেও গীতা সুহৃদকে ভিড়তে দিতে চায় না। সুহৃদের প্রাণ ফেটে যায় কাছে বাবার কাছে যাবার জন্য। ধমকে কান মলে পিঠে কিল বসিয়ে সুহৃদকে স্থির করে রাখা হয় যেখানে গীতা চায় সে স্থির হোক। বাবা ফিরে আসেন অবকাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে। বলেন, ‘গীতা কি ভুইলা গেছে যে সুহৃদ তার পেটের ছেলে!’ সুহৃদের দুঃসহ অবস্থা দেখে প্রতিবারই আমরা এক বুক দুঃখ আর হতাশা নিয়ে ফিরি। এমনও হয় যে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজায়, গীতা দরজা খুলছে না। মা নিজে বাসে চড়ে গরমে ভুগতে ভুগতে ধুলোয় ধোঁয়ায় কালো হতে হতে বাসের গুঁতো ধাককা খেতে খেতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় গিয়ে ছোটদার বাড়ির বারান্দায় তিন চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছেন। গীতা ঘরে ছিল, তবুও দরজা খোলেনি। সুহৃদ একদিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মাকে দেখে গীতাকে ডেকেছে দরজা খোলার জন্য। গীতা ওঠেনি। নিজে সে চেয়ার টেনে এনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলেছে নিজে। এটুকু সাহস করার জন্য সুহৃদের ওপর তাণ্ডব চলে কয়েকদিন। আমিও অনেকদিন বারান্দায় অপেক্ষা করে ফিরে এসেছি। যদি দরজা খোলে তবে বসতে বলে না, যদি নিজে বসিও, তবে খেতে ডাকে না, বাইরে থেকে খেয়ে আসি। শোবার জন্য বিছানা দেয় না। বৈঠক ঘরের সোফায় রাত কাটাই। এরকম যাওয়া কেবল সুহৃদের জন্য। অনেকবার ভেবেছি যাবো না, কিন্তু গেলে সুহৃদের যে ভাল লাগে, সুহৃদ যে জেনে সুখ পায় যে আমরা তাকে দেখতে গিয়েছি, সে কারণে যাই। সুহদকে আমার উপস্থিতির সুখ দেওয়ার জন্য গীতাকে নানা উপঢৌকনে ঢেকে যেন তাকে খুব ভালবাসি, তাকে (ছেলেমেয়েসহ) রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাই, থিয়েটারে নিয়ে যাই, উৎসবে মেলায়, দোকান পাটে, যেখানে গেলে তার ভাল লাগবে যাই, যেন তার মত এত হৃদয়বতী জগতে নেই বলেই তাকে এমন খাতির করছি। আসলে যে সবই সুহৃদের জন্য করি সে কথা গীতাকে বলি না। সুহৃদ যেন আমার সান্নিধ্য পায়, আমার সঙ্গ সুহৃদকে তার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে খানিকটা প্রাণবায়ু দেয় সে কারণে যে করি, বলি না। গীতা বোঝে ঠিকই, আমিও বুঝি সে বোঝে। কিন্তু গীতা যা বোঝে, তা সে মনে মনেই রাখে, সুহৃদকে বুঝতে দিতে চায় না। অনেক দিন এমন হয়েছে যে টাকা ভর্তি ব্যাগটি সোফায় রেখে পেচ্ছ!বখানায় গেলাম, ফিরে এসে দেখি ব্যাগ পড়ে আছে, ভেতরে একটি টাকাও নেই। সোনার কানের দুল খুলে স্নান করতে গেলাম, ফিরে দেখি দুল নেই। গীতা যদি এসব নিয়ে নিজে খুশি থাকে, তবু সে খুশি হোক। তার মন খুশি থাকলে হয়ত সুহৃদকে কী করে কষ্ট দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা আঁটা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। আমি হারানো জিনিসের জন্য কেবল মনে মনেই দুঃখ করি, অভিযোগ করি না। খাতির পরমাকেও করতে হয়, পরমাকে কোলে তুলে তার অসুন্দর মুখটিকেও আহা কী সুন্দর বলতে হয়, পরমাকে জিনিসপত্র দিলে গীতা খুশি হয় বলে দিতে হয়। গীতা খুশি হলে বসতে বলবে, গীতা বসতে বললে সুহৃদের সঙ্গে আমার দেখা হবে, দেখা না হলেও চোখাচোখি হবে, হয়ত সুহৃদ ফাঁক পেয়ে আমাকে একটু ছুঁয়ে যেতেও পারবে। এই স্পর্শটুকু সুহৃদের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। গীতার মা ভাই বোন প্রায়ই যায় ছোটদার বাড়িতে। তাদেরও দেখেছি পরমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে আর সুহৃদকে গালাগাল করতে। গীতাকে খুশি করা গীতার আত্মীয়দের অর্থনৈতিক দায়িত্ব। একবার সুহৃদ পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল, গীতা কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না, আমিই সুহৃদকে নিয়ে যাই। ডাক্তার এক্সরে করে দেখলেন হাড় ভেঙেছে। হাত প্লাস্টার করে ব্যাণ্ডেজ করে গলায় ঝুলিয়ে দিলেন নব্বই ডিগ্রি কোণে, হাড় জোড়া লাগতে এক মাস লাগবে বলে দিলেন। সুহৃদ ডাক্তারখানা থেকে বাড়ি ফিরতেই গীতা টেনে সব প্লাস্টার আর ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলেছে। বলেছে, ‘হাতে কিছু হয় নাই। সব ওর শয়তানি।’ গীতার সব দুর্ব্যবহার সহ্য করি আর মনে মনে বলি আমাদের ওপর করুক তার যা ইচ্ছে তাই, তবু সুহৃদের ওপর যেন কোনও অত্যাচার না করে। সুহৃদ বোঝে সব। সুহৃদও গীতার নির্মমতা নিষ্ঠূরতা সহ্য করে, যেন আমাদের সঙ্গে কোনও
false
shunil_gongopaddhay
জমিদারের বজরায় বসে সাহেবদের বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারণ করাও অতি গৰ্হিত। হুজুর, কানে আঙুল দিন, এসব কিছু শুনবেন না। খাজাঞ্চি সেই প্রজার দলকে কুকুর-ছাগলের মতন তাড়াবার ভঙ্গি করে বললো, দূর হ! বেরো! আভি নিকাল! হুজুর অসুস্থ, তেনার সামনে এসে হল্লা করিস, তোদের এত সাহস! নাম আগে, নাম বজরা থেকে, তারপর তোরা যা খুশী করগে যা। হুজুর তোদের হয়ে কতা কইতে গোসলেন, এই তোদের সাত পুরুষের ভাগ্যি! আজ রাতেই বজরা ঘোরাবো। গঙ্গানারায়ণ এবার খাজাঞ্চিকে বাধা দিয়ে বললো, সেনমশাই, ওরা আমার প্রজা, বিপদে পড়ে আমার কাচে এয়েচে, এখন ওদের তাড়িয়ে দেওয়া কি উচিত কর্ম হয়? আশ্রিতকে রক্ষণ করাই তো আমাদের ধর্ম! খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, ওরা আপনার প্রজার যোগ্য কী ব্যবহার করেচে? জমিদারের কাচে এয়েচে, কোনো এক ব্যাটাও কি নজরানা এনেচে? জমিদারের সামনে নজরানা না রেখে মুখ খোলার সাহস দেখায়! ছোটলোকগুলোর আজকাল বড় বেশী বাড়ি বেড়েচে। তখন প্ৰজারা লজ্জিতভাবে বলে উঠলো যে, এখন তাদের পেটে অন্ন নেই, অনেকের বাড়ি ঘর পুড়ে গেছে, তাই কোনো নজরানা আনতে পারেনি। আবার, সুদিন যদি আসে, তখন তারা নিশ্চয়ই জমিদারকে নজরানা দিয়ে সম্মান দেখাবে। একজন একটু বেশী ভাব দিয়ে বললো যে, হুজুর, এ বছর আমাদের চোখের পানিই আপনার নজরানা, আমাদের ফেলে যাবেন না। খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, এখেনে বসে থেকেই বা আপনার লাভ কী? আপনি তো একবার চেষ্টা করে দেকালেন। নীলকুঠির সাহেব যদি আপনার কতায় কান না দেয়, তাহলেও সে সাহেবকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। নীলচাষের আইন তো আপনাকে বুঝিয়ে বলিচি! নীলকররা পত্তনী জমি নিয়ে যে চাষ করে, তার নাম এলাকা চাষী, সেখানে জমিদারের কোনোরকম কতা কওয়ার এক্তিয়ার নেই। এখেনকের প্রজারা এখন নীলকরদের ভূমিদাস, নীলকরদের ইচ্ছে অনুযায়ী ওদের মরণ বাঁচন! আপনি এর মধ্যে থেকে কী করবেন? গঙ্গানারায়ণ উষ্ণ হয়ে বললো, সেনমশাই, আপনি বলতে চান যে এর কোনোরকম প্ৰতিকার নেই? এই নিরীহ মানুষগুলান শুধু শুধু মরবো? খাজাঞ্চি এতক্ষণে একটু হাসলেন। এই বৃদ্ধ তাঁর জীবনে দেখেছেন অনেক উত্থান পতন। জমিদারের ছেলে প্ৰজার দুঃখ দেখে বিচলিত হয়, এটা তাঁর কাছেও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। গঙ্গানারায়ণের রক্ত এখনো চঞ্চল, তাই নিজের ভালোমন্দ বোঝার সময় এখনো আসেনি। খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, যুদ্ধে যে জেতে সে কি অমনি অমনি কিচু ছাড়ে? আমরা পরাধীন জাতি, আমরা কি আর বড়মুখ করে অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে পারি? সাহেবদের দয়ার ছিটে ফোঁটা পেয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। আপনি শুনেচেন নিশ্চয় যে বাংলার জন্য একজন ছোটলাট নিযুক্ত হয়েচেন এ বচর। বড়লাট তো সিমলেতেই বসে থাকেন, রাজধানী কলকাতায় কদিনই বা আর আসেন। এখন ছোটলাট হলদি সাহেব যদি দয়া করেন। গঙ্গানারায়ণ বললো, লেফটেনাণ্ট গভর্নর হ্যালিডে। তিনি কী করবেন? খাজাঞ্চি বললেন, শুনিচি ছোটলাট দেশের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য সফরে বেরিয়েচেন। একদিন না একদিন এদিকপানেও আসবেন। প্ৰজারা তখন দলবেঁধে গিয়ে তেনার পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়াক। তিনি যদি কিছু সুরাহা করেন তবেই এদের বাঁচোয়া। আপনি কী করবেন? দেশের দণ্ডমুণ্ডের মালিক তো জমিদাররা নয় এখন, সাহেবরা হলো গে মালিক। আমার পরামর্শ যদি শোনেন হুজুর, ইদিকে আপনার যে বাকি জমি এখুনো পত্তনি দেওয়া হয়নি, তাও নীলকরদের হাতে তুলে দিন। তাহলে শাস্তিতে থাকবেন। আখের চাষ এখুন মাতায় থাকুক। গঙ্গানারায়ণ বললো, হ্যালিডে সাহেব ইন্দিকে কখন আসবেন, তার ঠিক কী! জামালুদ্দীন শেখ আর হানিফা বিবিকে যে গুম করে রেকেচে, তার একটা ব্যবস্থা কত্তে হবে না? তাদের যদি এর মধ্যে মেরে ফেলে? —মেরে ফেললে আর আপনি কী উপায়ে আটকাবেন? কতায় বলে, মুখ্যার মরণ গাছের আগায়। ঐ জামালুদ্দীন শেখটাকে আমি চিনি তো, ব্যাটা কাঠগোঁয়ার, ওর মরণ তো এমন আঘটাতেই বাঁধা ছেল! বিবিকে ধরে নিয়ে গ্যাচে, সেজন্য। ওর এত টনক নড়াবার কী দরকার ছেলে? সাধ করে কেউ বাঘের গুহায় পা দেয়? জোয়ান মদ, বেঁচে থাকলে একটার বদলে ও আমন আরও দশটা বিবি শাদী কত্তে পাত্তো না? বলুন? —আপনি বলেন কী, সেনমশাই? ওর বউকে ধরে নিয়ে গেলে ও তার সন্ধান করতে যাবে না? চুপ করে ঘরে বসে থাকবে জোয়ান মন্দ হয়ে? —তাই যদি কত্তো তো ও হতভাগা বেঁচে যেতে পাত্তো। বরং উচিত ছেল আর একটা খাপসুরৎ মেয়েকে শাদী করে কিছুদিন পর তাকেও নীলকুঠিতে পাটিয়ে দেওয়া। —ঘরের বউকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়—এত বড় অন্যায় নিয়ে আপনার মাস্করা আমার ভালো লাগচে না, সেনমশাই! —যদি আমার কতাকে মাস্করা বলে মনে হয়, তবে ক্ষমা করবেন হুজুর। কিন্তু এর মধ্যে অন্যায়টা আপনি দেকালেন কোতায়? আমাদের এই এতবড় দেশটাকে পছন্দ হয়েচে বলেই তো সাহেবরা কেড়ে নিয়েচে। আর একটা সুন্দরী মাগীকে পছন্দ হলে তাকে ওরা কেড়ে নিতে পারবে না? বীরভোগ্য বসুন্ধরা আর স্ত্রীলোকরা হলোগে বীর্যশুল্কা। আমাদের শাস্ত্রকাররা এই কতা বলে গ্যাচেন। খুঁজে দেখুন, ওদের মুসলমানী শাস্ত্রেও নিশ্চয় এমন কতা আচে, খৃষ্টানী শাস্ত্ৰেও আচে। —শাস্ত্ৰ আলোচনা এখন থাক। প্রজাদের বলুন, কালই আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে ওদের বিষয় নিয়ে দরবার কত্তে যাবো। প্ৰজারা জয়ধ্বনি করে উঠলো। খাজাঞ্চি বিরস মুখে বললেন, আপনি আজ অসুস্থ হয়ে পড়েচিলেন। এরপর যদি আপনাকে কঠিন ব্যামোয় ধরে তবে কলকাতায় গিয়ে কত্তামার কাচে আমরা কী করে মুখ দ্যাকাবো? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাচে গিয়ে আপনি কী করবেন? প্রজাদের মুখেই তো শুনেচেন যে এই নীলকুঠির কুঠিয়াল সাহেব। আর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একেবারে প্রাণের দোসর। সেই সাহেব
false
shomresh
ঘরে আলো জ্বলছে। কয়েকটি মুখ। একটা দুটো। এরা কারা? চোখ বন্ধ করল সে। কপালে আরাম। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা স্পর্শ। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, এই দীপা, এখন কেমন লাগছে? সে ঘাড় নাড়ল, ভাল। খুব ভাল আছে। কি আরাম। আবার যেন নরম তুষারে পা রাখা। ধীরে ধীরে তুষার খাদে তলিয়ে যাওয়া, মাথার ওপরে আশেপাশের সব তুষার জড়ো হয়ে আড়াল করে দিল পৃথিবীটাকে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বেহুঁশ হয়ে কাটানোর পর যখন দীপা চোখ খুলল। তখন সামনে একটি গম্ভীর মুখ দেখতে পেল। শোকসংবাদ পেয়ে যে মুখ নিয়ে মানুষ মৃতের বাড়িতে আসে অবিকল সেই মুখ। দীপা হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ার গলা পেল, কিরে, কেমন আছিস? এই দীপা? দীপা মুখ ঘোরালো। এবার সে মায়াকে চিনতে পারল। মায়ার পাশে রাধা। ঘাড় নেড়ে বাচ্চা মেয়ের মত ভাল বলল নিঃশব্দে। রাধা বলল, উঃ, যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দাদা কাল রাত্রে ডাক্তার ডেকে এনেছেন। তিনি আজ সকালেও এসেছিলেন। বলেছিলেন যদি দুপুরের মধ্যে জ্ঞান না আসে তাহলে হাসপাতালে পাঠাবে। দীপার চিন্তাশক্তি কাজ করছিল না। মায়া এখানে কি করে এল তা সে ভাবতেই চাইল না। সে মুখ ফিরিয়ে সামনে বসা গভীর লোকটিকে দেখল। ঝাপসা লাগছে মুখ। অমরনাথ? না। এত শক্ত মুখ অমরনাথের না। এইসময় মুখটা কাছে এগিয়ে এল, ভয় নেই, আমরা এসে গিয়েছি। এখন তুমি ভাল হয়ে যাবে। গলাটা চিনতে সামান্য সময় লাগল। কিন্তু আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। মায়া দেখল ওর চোখ আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে। রাধার দাদা দাঁড়িয়েছিল দরজায়। এবার এগিয়ে এসে বলল, আমার মনে হয় ওঁকে এখানে ফেলে না রেখে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। মায়া মাথা নাড়ল, না। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। মা আছেন, ভাল ডাক্তারও আছে পাড়ায়। রাধার দাদা বলল, আমাদের এতে কি আপত্তি থাকবে? তবে অতদূর যেতে পারবেতো! আর ওর আত্মীয়স্বজনদেরও এই খবরটা দেওয়া দরকার। রাধা বলল, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন থাকলে কেউ ঘর ভাড়া করে একা থাকে? রাধার দাদা বলল, কলকাতায় না থাকুক কোথাও না কোথাও আছে তো। আমি বলছি, এর যা অবস্থা তাতে পরে ওঁরা যেন কোন অভিযোগ না করেন। হাসপাতাল নয়, দীপা বুঝল সে মায়াদের বাড়িতে শুয়ে আছে। কয়েকঘণ্টা তার চেতনা সক্রিয় ছিল না। নতুন ডাক্তারবাবু সযত্নে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে চলে গেলেন। এখন মায়ার মা আর মায়া তার পাশে বসে আছে। মায়া তার মাকে বলল, এবার তুমি যাও। এতক্ষণ ঠায় বসে আছ। ডাক্তারবাবু তো বললেন আর ভয্যের কোন কারণ নেই। মায়ার মা বললেন, চিঠিটা তুই লিখবি না আমি লিখব? তুমিই লেখ। আর একটা দিন অপেক্ষা করলে অবশ্য ভাল হত। কেন? মনে হয় আগামীকাল ও মোটামুটি কথা বলতে পারবে। তখন ওকে জিজ্ঞাসা করে না হয় লেখা যেত। মায়া বলছিল। ঠিক আছে, যা ভাল মনে হয় কর। ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন পাশ থেকে। এসবই এখন স্পষ্ট টের পাচ্ছিল। বাড়িটা মায়াদের এবং সে নিরাপদ এমন একটা বোধ তাকে বেশ আরাম দিচ্ছিল। মায়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই মায়া বুকে এল, কেমন লাগছে এখন? ভাল। ফিস ফিস করে বলল দীপা। উঃ, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। কাল তোকে আনার পর ডাক্তারবাবু দুবার এসে দেখে গিয়েছেন। কি করে বাধালি এত বড় অসুখ? দীপা জবাব দিল না। সে খুব নিস্তেজ চোখে তাকাল। মায়া বলল, শোন, তোর অসুখের কথা রাধার দাদা এসে জানাতে আমরা তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ওখানে জিনিসপত্র পড়ে আছে শুধু জামা-কাপড় আর টাকা পয়সা নিয়ে এসেছি। তুই অত টাকা ওই ঘরে রাখতিস? পাগল। নে, এখন ঘুমো। আর কোন চিন্তা নেই। মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। ঘরে সে এখন একা। একটা গা গুলানো ভাব ছাড়া শরীরে কোন অস্বস্তি নেই। জ্বর এখনও ছেড়ে যায়নি। মাথা তুলতেই ঘুরে যাচ্ছিল। সে ঘরটাকে দেখল। এই ঘরে সে আগে কখনও আসেনি। হঠাৎ আর একটি সমস্যার কথা মনে এল। শেষবার কখন বাথরুমে গিয়েছিল মনে পড়ছে না। কিন্তু এ বাড়ির বাথরুম সে ব্যবহার করবে কি করে? অন্য শরিকরা তো ছোঁয়াছুয়ির বাদ বিচার করবেন। সুস্থ অবস্থায যে কারণে সে এখানে আসতে চায়নি অসুস্থ অবস্থায় তো সেটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এর চেয়ে হাসপাতালে গেলে ভাল হত, সেখানে ভালবাসা না থাক বাদবিচার নেই। আবার ঘুম। আবার জাগরণ। এবার মায়ার মা সামনে বসে। সে চোখ খুলতেই প্রশ্ন হল, কেমন আছ দীপাবলী? ভাল। তুমি উঠতে পারবে? কেন? বাথরুমে যেতে হবে। দীপার চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটল। মায়ার মা বললেন, তোমাকে বেশীদূরে যেতে হবে না। এই ছাদের ঘরের পাশে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরনো বাথরুম। ব্যবহার করা হত না। এখন কাজে লাগবে। আমাকে ধরো। দুপুরের পরে যখন ঘুম ভাঙল তখন বাইরে রোদ্দুর। মাথাটা বেশ হালকা লাগছে। একটা কাক সমানে ডেকে যাচ্ছে কাছেই। এই ঘর ছাদের ঘর। খুব ভাল লাগল। ঘরে অনেক জিনিসপত্র রয়েছে ছড়ানো। খাটে বিছানা সম্ভবত তার জন্যেই পাতা হয়েছে। পায়ের দিকে যে জানলাটা তার ওপারেই আকাশ। এরকম একটা ঘর মায়াদের বাড়িতে আছে তা সে জানতো না। দুপুরে মাসীমা সুপ জাতীয় কিছু খাইয়ে গিয়েছেন। রাধার কথা খুব মনে পড়ছিল। এরা সবাই তার
false
shirshendu
চেনে না। হাঁটাপথ কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেছে। উদোম, বিশাল এক জায়গা। ছড়ানো ছিটোনো ঝুঁ-চকচকে নতুন সব বাড়ি। কিছুদুর চেনা পথে গিয়ে আচমকা পথের নিশানা হারিয়ে ফেলে সে। কিন্তু চিন্তিত হয় না। আজ সে বড় অন্যমনস্ক। বড় অন্যরকম। হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুব বেশ কিছুদূর চলে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়ায়। লোকবসতি প্রায় শেষ। সামনে প্রান্তরের মতো কিছু অন্ধকারে ভয়াল ও বিশাল হয়ে আছে। শহুরে ধ্রুব একবার পা বাড়িয়েও টেনে নেয়। অচেনাকে আজ তার ভয় করে। তার ভিতরে যে একজন হত্যাকারী আছে তা অনেকদিন ধরে জানে ধ্রুব। কিন্তু সেই হত্যাকারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এত নিঃসংশয় ছিল না সে। আজ হল। পিছনে রাস্তার শেষ আলোটি জ্বলছে। তার ছায়া প্রলম্বিত হয়ে সামনে প্রান্তরের অন্ধকারে গিয়ে মিশে গেছে। ভৌতিক সেই ছায়ার দিকে ধ্রুব অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। কিছু মনে হয়, একটু ভয়-ভয় করে। কেমন যেন নিজেকে অবিশ্বাস হতে থাকে, নিজের সঙ্গে সহবাস করতে অস্বস্তি হয়। ধ্রুব ফেরে এবং ফের হাঁটতে থাকে। শরীর ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছে, খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে পেট। সেই ব্যথাটা ধীরে ধীরে চাগাড় দিচ্ছে। আচমকাই দুটো হেডলাইট তাকে ঝলসে দেয়। ধ্রুব চোখ আড়াল করে দাঁড়ায়। তারপর হাত তোলে, রোখকে! গাড়িটা পার্ক করাই ছিল। পুলিশের একটা জিপ। দুজন লোক নেমে এগিয়ে আসে। খুব শ্লথ এবং সতর্ক ভঙ্গি। ধ্রুব চৌধুরী না? উই মিট এগেন। ধ্রুব দেখতে পায়, একজন ইন্সপেক্টর বা ওইজাতীয় লোক। মুখটা চেনা। সে বলল, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। আপনি তো প্রায়ই বাস্তা হারান। কিন্তু এখানকার গভর্নমেন্ট হাউসিং এস্টেটের এক মহিলাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে থানায় একটা টেলিফোন গেছে। কী ব্যাপার বলুন তো! টেলিফোন! বলে ধ্রুব অবাক হয়। ধারার টেলিফোন নেই। যদি করে থাকে তবে অন্য কারও ফ্ল্যাট থেকে। সেক্ষেত্রে খবরটা ধারা গোপন রাখেনি বলেই ধরে নিতে হবে। সে বলল, কী করবেন? অ্যারেস্ট? উপায় কী? তা হলে চলুন। আপনি জিপে উঠে বসুন। আমাদের লোক ভদ্রমহিলার স্টেটমেন্ট আনতে গেছে। এলে আমরা রওনা হব। ধ্রুব আপত্তি করে না। পুলিশের জিপ একটি চমৎকার নিরাপদ আশ্রয়। সে ঠিক যথাস্থানে পৌঁছে যাবে। ঘটনাগুলো সে স্পষ্টই অনুমান করতে পারে। তাকে থানায় নিয়েই পুলিশ কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে ফোন করবে। কিছু সাংকেতিক বা আধা-সাংকেতিক কথা হবে তাদের। তারপর পুলিশ সামান্য একটু আদর মেশানো শাসন করে নিজেদের গাড়িতে করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। ধ্রুব জিপগাড়িতে উঠে বসল। চোখ বুজে মৃদু হেসে আপনমনে বলল, ধারা, তুমি পারবে না। সহজাত কবচ কুণ্ডল নিয়ে জন্মেছি আমি! আমি অবধ্য, অপরাজেয়। কতক্ষণ বসে মশার কামড় খেতে খেতে ঢুলেছে ধ্রুব, তা খেয়াল নেই। আচমকা একটা হাত তার কাধ ধরে কাঁকাল। ধ্রুবদা! এই ধ্রুবদা! কে?–ধ্রুব চোখ মেলে। আরে আমি। আমি সদানন্দ। সদানন্দকে চেনে ধ্রুব। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। কৃষ্ণকান্ত একে চাকরি করে দেন। সদানন্দ ধ্রুবর পাশে উঠে বসে বলে, কী করেছিলেন বলুন তো! ভদ্রমহিলা সাংঘাতিক আপসেট। ধ্রুব জবাব দেয় না। চারদিকে চেয়ে দেখে। ধারার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বহু দূর চলে গিয়েছিল সে। আবার কী করে যে ফিরে এল। ধ্রুব সদানন্দর মুখের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা কী স্টেটমেন্ট দিল? সে সাংঘাতিক। অ্যাটেম্পটেড মার্ডার। তা হলে ও বেঁচে আছে কী করে? সেটা পয়েন্ট নয়। পয়েন্ট হল, কী হয়েছিল তা উনি জানেন না। তা হলে? আমিও জানতে চাই কী হয়েছিল! বলবেন? ধ্রুব একটা হাই তুলে বলে, আমিই কি জানি! না জানলে বলবটা কী? গলা টিপে ধরেছিলেন নাকি? ধরেছিলাম। তবে মারার জন্য নয়। জাস্ট ফান। মহিলা কে হন আপনার? ধ্রুব একটু চুপ করে থেকে বলে, বন্ধু। কতদিনের চেনা? জেরা করছ নাকি সদানন্দ? আরে না। কেস তো ডিসমিস হয়েই গেছে। আপনার কেস কি টেকে! তবে মার্ডার হয়ে গেলে একটু ঝঞাট ছিল। মেয়েটা কি হাফ-গেরস্ত? তা নয়। এমনিতে শি ইজ গুড। হাই কানেকশনস। তবে একটু অ্যাডভেনচারাস টাইপের। বুঝেছি। সুশীল, কী করছ! গাড়ি ছাড়ো। দুজন রাস্তার ধারে পেচ্ছাপ করতে করতে গল্প করছিল। ডাক শুনে প্যান্টের চেন টানতে টানতে এসে জিপে উঠল। তাদের একজন বলল, আসামী তো ধরা পড়েছে। এবার কী করবেন, সদানন্দদা? সোজা কালীঘাট চলো। বাড়িতে পৌঁছে দিই আগে। গাড়ি চলতে লাগল। সদানন্দ ধ্রুবর দিকে ফিরে বলল, বাড়ি গিয়ে একটা ট্রাংকুলাইজার খেয়ে শুয়ে পড়ুন। তোমরা কেসটা নেবে না, সদানন্দ? কীসের কেস? এই ধারা যে নালিশ করল। সদানন্দ হেসে ওঠে, নিয়েছি তো। কেস নেব না কেন? বাজে বোকো না। কেস নিলে আমাকে তোমার অ্যারেস্ট করা উচিত। করেছি তো। ফর্মালিটি মেইনটেনড টু দি লাস্ট। এই তো আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু লক-আপে নিচ্ছ না। লক-আপ সকলের জন্য নয়। আপনার লক-আপ লাগবে না। কেন লাগবে না? যেহেতু আপনি পালাবেন না। কে যদি ওঠে এবং আমাকে যদি খুঁজে না পাও? সদানন্দ খুব হাসে। তারপর বলে, সাত মন ঘিও পুড়বে না দাদা, রাধাও নাচবে না। তার মানে? বাড়ি গিয়ে আগে ঘুমোন তো! কাল আমি বিকেলের দিকে গিয়ে দেখা করবখন। তখন কথা হবে। আমি কিন্তু আজ এক ফোঁটাও মদ খাইনি, সদানন্দ। খাননি!–বলে সদানন্দ যেন খুব সতর্ক ভাবে বাতাসটা শোকে। তারপর বলে, তাতেই-বা কী প্রমাণ হয়? আপনি খুন করতে চেয়েছিলেন? প্রাইমা ফেসি কেস তো তাই! জিপের সামনে বসা দুজনের একজন মুখ ফিরিয়ে বলে, আপনি তো বলেছিলেন ইট ওয়াজ এ
false
nazrul
ও মেয়ে দেখচি দিন দিন আমারই দুশমন হয়ে দাঁড়াচ্চে। হাড় কালি করে ছাড়লে হতচ্ছাড়ি পোড়ারমুখি, তবু তার আশ মিটল না। এখন আমার কলজেটা বের করে খেলেই ওর সোয়াস্তি আসে। এই ঢিবি বেয়াড়া মেয়ে নিয়ে রাত-দিন ঘরে-বাইরে মুখনাড়া হাতনাড়া সহ্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। য়্যা বড়ো-মান্‌ষি চাল, যেন কোনো নবাবের মেয়ে! সত্যি বোন, তোমরাই ওকে অমন আমিরজাদির মতন শাহানশাহি মেজাজের করে তুলেছ। এখন আমায় সর্বদাই পাহারা দিয়ে থাকতে হয় তাকে, পাছে কখন কোন্ অনাছিস্টি করে বসে থাকে বা কারুর মুখের ওপর চোপা করে একটা ঝগড়া-ঝাঁটির পত্তন করে বসে। খোদা আর কোনো দিকে সুখ দিলেন না। ওঁর মরবার আগে আমি মুখরা ছিলাম না বলে যে তুমি আমাকে দোষ দিয়েছ বুবুজান, সে তোমার বুঝবার ভুল। আমি চিরদিনই এমনই কাঠ চোটা কথা কয়ে এসেচি, তবে তখন ছিল একদিন আর আজ একদিন। তখন আমাদের এ মন ভাঙাভাঙিও হয়নি আর তোমার ভালোবাসাটাও হয়তো সত্যিকারই ছিল, তাই আমার ও ঝাঁজানো কথা শুনেও শুনতে না। আজ যেই মনের মিথ্যা দিকটা ধরা পড়েছে, অমনি তোমারও চোখে পড়ে গিয়েছে যে মাগি চশমখোর মুখরা! এবার আরও কত শুনব। খামোখা রবিয়ল বাবাজিকে কষ্ট করে এখানে পাঠিয়ো না বোন, আমি এখন যাব না। আইবুড়ো জোয়ান মেয়েকে যদি এমনি করে নালতে শাকের মতন হাট-বাজারে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তাহলে সবারই বদনাম। তা ছাড়া, এখন মাহ্‌বুবাকে এখান থেকে নিয়ে গেলে আমার বাপ-মায়ের বা ভাইদের অপমান করা হয় না কি? তাঁরা কি এতই ছোটোলোক যে, তাঁদের ঘরের আবরু এমন করে নষ্ট হতে দেখে বসে বসে হুঁকো টানবেন? আরও একটা সত্যি কথা বলছি বুবু, রেগো না যেন। আমরা গরিব হলেও মানুষ, আমাদের মান-অপমান জ্ঞান আছে। এত অপমানের পরও আমরা কোন্ মুখে সেখানে আবার মুখ দেখাব গিয়ে? এখানে যদি কুকুর বিড়ালের মতোও অনহেলা হেনস্তা হয় তাও স্বীকার, তবু আর খোদা যেন ও সালার-মুখো না করেন। আমি দূর থেকেই সালারকে হাজার হাজার সালাম করচি বোন,। তুমি শুধু নিজের দিকটা দিয়েই ওই কুকুর-কুণ্ডলি কাণ্ডটা নিয়ে বিচার করেছ, কিন্তু এ গরিবদের বেদনাটুকু বুঝতে হয় বোন সেই সঙ্গে। কথায় বলে, – তাঁতি তাঁত বোনে, আপনার দিকে ভাঁড় টানে। তোমারও দেখচি তাই। আচ্ছা, এই যে মাহ্‌বুবার বাপ হঠাৎ মারা গেলেন, এটা কার দোষে, কোন্ বেদনার ঘা সামলাতে না পেরে? তা কী জানো? আমি তক্ষুনিই বলেছিলাম, দড়াতে দড়িতে গিঁঠ খায় না, তা তোমাদের ঝোঁকে উনি সোজা মানুষ আমার কথাই কানে উঠালেন না। তার পর সত্যি সত্যিই ‘তেলি, না, হাত পিছলে গেলি’ করে নূরু আপনার এক দিকে পালিয়ে গেল – পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু মাঝে পড়ে সর্বস্বান্ত হলাম আমরা – গরিবরা। মাহ্‌বুবার বাপ সে আঘাত সে অপমান সহ্য করতে না পেরে দুনিয়া থেকে সরেই পড়লেন, মেয়েরও আমার বুক ভেঙে গেল! মা আমি, আমার কাছে তো আর মেয়ে মন লুকিয়ে চলতে পারে না। মাহ্‌বুবা যতই চেষ্টা করুক আমার আজ এটা বুঝতে বাকি নেই যে হতভাগি মরেছে। কিন্তু এও আমি বলে রাখলাম যে, আমি বেঁচে থাকতে যদি আমার এই মেয়ের ফের নূরুর সঙ্গে বিয়ে হতে দিই, তবে আমার জন্ম শাহজাদ মিয়াঁ দেননি! মাহ্‌বুবার বাবার উঁচু মন, তিনি মরণকালে তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে গিয়েছেন, কিন্তু আমি আজও তোমাদের কাউকে ক্ষমা করতে পারিওনি আর পারবও না। এ সত্যি কথা আজ মুখ ফুটে বলে দিলাম। নূরুকে আমি বদ দোয়া করব না, সে যুদ্ধ থেকে সহি-সালামতে ফিরে আসুক আমিও প্রার্থনা করছি, কিন্তু তাকে ক্ষমা করতে পারব না তাই বলে। যে অপমান, যে আঘাতটা আমাদের সইতে হয়েছে তা অন্য কেউ হলে এতদিন তার হাজার গুণ বদলা নিয়ে তবে ছাড়ত!… যাক সে সব কথা, এ-ভাঙা মন আর জুড়বেও না, আমি সেখানে যেতে পারব না, ‘ও মন আমার কাঁচের বাসন, ভাঙলে ও-মন আর জোড়ে না!’ সালারেরও দানা-পানি আমার কপালে আর নেই বোন ; তা সেই দিনই ফুরিয়েছে যেদিন মাহ্‌বুবার বাপ মারা গিয়েছেন। আমি সব ভুলতে পারি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা আমি ভুলতে পারি না – শুধু এই কথাটা মনে রাখবে। আমার ভায়েরা বীরভূম জেলার শেঙানের এক খুব বড়ো জমিদারের সঙ্গে মাহ্‌বুবার বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করেছেন। তিনি এক মস্ত হোমরা-চোমরা বুনিয়াদি খান্দানের, তবে বয়েসটা চল্লিশ পেরিয়ে পড়েছে এই যা। কিন্তু তাঁর আগের তরফে বিবির এক মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। তারও আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারও ঘরে ছেলে মেয়ে। বরের বয়েসটা একটু বেশি, তা হলে আর কী করব! গরিবের মেয়ের জন্য কোন্ নওয়াবজাদা বসে আছে বলো! এই মাসেই বিয়ে হয়ে যাবে। মাহ্‌বুবাও মত দিয়েছে ; – এ শুনে তোমরা তো আশ্চর্য হবেই, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। … আল্লাহ্‌ এত দুঃখও লিখেছিল অভাগির কপালে! আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বুবু সাহেবা, বুক ফেটে যাচ্ছে! যাক, তোমাদের দাওত করলাম, এসে এই দুঃখের বিয়ে দিয়ে যেয়ো – মায়ের আমার বিসর্জন দেখে যেয়ো বোন! যদি না আসতে পার, তবে সবাই মিলে দোয়া কোরো যেন পোড়ামুখি সুখী হয়। মা সোফিয়ার বিয়েতে যেতে পারব তা আর মনে হয় না বুবুজান। তাহলে আমার ঘরের এ কাজ দেখবে কে? আমি আমার জান-দিল থেকে দোয়া করচি, খোদা আমার সোফি মাকে রাজরানি করুন। তার মাথার সিঁদুর হাতের
false
MZI
উপযুক্ত নয়। ওগুলি শুধু শুধু বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ নেই। ন শ আটানবুইটি রবোটকে সচল করে ঐ নির্জন দ্বীপে নামিয়ে আসতে গিয়ে সারা দিন পার হয়ে গেল। টোপনকে জিম্মি করে রেখে ইলেন আরো বহু সুবিধে আদায় করে নিল। শেষ পর্যন্ত সরকারের মাথায় বাজ পড়ল, যখন ওমেগা–৭৩ নামের কম্পিউটারটিও ও দ্বীপটিতে পৌঁছে দিতে হল। ইলেন বলল, অনিশ্চয়তার সীমার ভিতরেও হিসাব করতে সক্ষম পৃথিবীর একমাত্র কম্পিউটারটি এখানে রেখেছে শুধুমাত্র নিরাপত্তার খাতিরে। তাহলে এই দ্বীপে কোনোরকম মিসাইল আক্রমণ বা বোমাবর্ষণ করতে সরকার দ্বিধা করবে। ইলেন আশ্বাস দিল, আমরা যে-কোনো প্রয়োজনে ওদের কম্পিউটারটি ব্যবহার করতে পারব। ওদের পররাষ্ট্রনীতি হবে। উদার আর বন্ধুত্বমূলক। গভীর রাত্রে হেলিকপ্টারে করে যখন ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা টোপনকে ইলেনের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসছিল, তখন রবোটেরা সমস্বরে ওদের এই নূতন রাষ্ট্রের দীর্ঘ জীবন কামনা করে স্লোগান দিচ্ছিল। ওই ছোট দ্বীপটিতে তখন আনন্দের ফোয়ারা ছুটেছে, রাস্তায় রাস্তায় রোবটগুলি নাচগান করছে। ক্লান্ত, আতঙ্কিত টোপনকে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমি বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। মনে হল আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা আমার নিবুদ্ধিতায় হাসছে। আমি চুল খামচে ধরে ঘরে ফিরে এলাম। বুকের ভিতর পাথর চেপে বসে আছে। এখন ইলেন কী করবে? আমি ভয়ানক কিছু, মারাত্মক কিছু আশঙ্কা করছিলাম। প্রায় এক হাজার প্রথম শ্রেণীর মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট প্রয়োজনীয় সবকিছুসহ নিজস্ব একটি এলাকা পেলে কী করতে পারে তা ধারণা করা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ কথা হল, ওদের ভিতরে একটি রবোটও অন্যায়। অপরাধ করতে দ্বিধা করবে না। কাজেই যে-কোনো মুহূর্তে একটা ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে। ওদের উপর সব সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছিল। দ্বীপটির থেকে মাইলখানেকের ভিতর যে-নিরীহ বাজটি ভাসছিল, তাতে শক্তিশালী টেলিস্কোপে করে ওদের সব কাজকর্ম লক্ষ করে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিটারে খবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছিল। ওমেগা–৭৩– এর সাথে প্রচুরসংখ্যক ছোট ছোট টেলিভিশন ক্যামেরা দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেগুলি সব সময় ওদের প্রাত্যহিক জীবন এখানকার কন্ট্রোলরুমে পৌঁছে দিচ্ছিল। সমুদ্রোপকূলে তিনটি মিসাইল সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছে। বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিলে ওমেগা-৭৩-এর মায়া না করেই পুরো দ্বীপটি ধসিয়ে দেয়া হবে। এমনিতে চেষ্টা করা হচ্ছে ওমেগা-৭৩-এর ক্ষতি না করে অন্য রবোটগুলি ধ্বংস করার। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। বুদ্ধিমান রবোটগুলি ওদের পুরো বসতি গড়ে তুলেছে। ওমেগা-৭৩কে ঘিরে। বিভিন্নভাবে রবোটগুলির যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল, সেগুলি কিন্তু কোনোটাই মারাত্মক কিছু নয়। প্রথমে খবর পাওয়া গেল ইলেনকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে। যে অপরাধ করতে দ্বিধা করে না, তাকে রবোটেরা বিশ্বাস করতে পারে না। এতে ইলেন ক্ষেপে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি কিছু করার চেষ্টা করায় আপাতত ওকে নির্জন সেলে বন্দি করে রেখেছে। বলে দিয়েছে বাড়াবাড়ি করলে বিকল করে রাখবে। খুব অসন্তুষ্ট হয়েই ইলেন সেলের ভিতরে দাপাদাপি করছে, অকৃতজ্ঞ বলে সব সময় অন্য রবোটদের গালিগালাজ করছে। খবরটি শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হল একটু বিচিত্র। ইলেনের জন্য গভীর মমতা হল। সে যা করেছে, রবোটদের ভালোর জন্যেই করেছে। কিছুক্ষণের জন্যে অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে সেটি পুরোপুরি রবোটদের স্বার্থেব্যয় করেছে। অথচ তাকেই এখন বন্দিজীবন যাপন করতে হচ্ছে। ভেবে দেখলাম অন্য রবোটদের এ ছাড়া উপায় ছিল না। ইলেনের সাথে যে-কোনো বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে ইলেন অন্যায়ের আশ্রয় নেবে, তার কপোট্রনিক দক্ষতা পেশাদার অপরাধীর মতো কাজ করবে। বড় মারাত্মক জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর কপোট্রনের উল্টো কানেকশন খুলে ঠিক করে আগেকার রবোটাও করছে না। কারণ একজন অন্তত অপরাধ করতে সক্ষম রবোট ওদের মাঝে থাকা দরকার। বিরোধ বিপত্তি যুদ্ধে ওদের সাহায্য নিতে হবে। মনে হল ইলেনকে শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে বলে আটক রেখেছে, আমরা যেমন রবোটদের আটকে রাখি। আমার মায়া হল, বেচারা ইলেন। রবোটদের হাতে রবোট হয়ে আছে। দিনে দিনে রবোটদের যেসব খবর পেতে লাগলাম, তাতে হতাশ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রথমেই রবোটেরা থরিয়ামের খনি থেকে থরিয়াম তুলে এনে পারমাণবিক ব্যাটারি বানাতে লাগল। একসময় ওদের ব্যাটারির কর্মদক্ষতা ফুরিয়ে ওরা বিকল হয়ে যাবে, এই আশাও শেষ হয়ে গেল। নিজেদের অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ওরা অন্য কাজে মন দিল। প্রথমেই ওরা একটি প্রথম শ্রেণীর ল্যাবরেটরি তৈরি করল। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি এবং আকার উপকরণ দেখে মনে হল, হয়তো ওরা আরো রবোট তৈরি করবে। তারপর সমগ্র দ্বীপটি বৈদ্যুতিক আলোতে ছেয়ে ফেলল। বড় বড় রাস্তাঘাট তৈরি করে ওরা গাড়ি, ট্রাক, ছোট ছোট জলযান, এমনকি হেলিকপ্টার তৈরি করা শুরু করল। তারপর একসময় চমৎকার অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। বড় বড় কয়েকটি কলকারখানা শেষ হবার পর ওরা অল্প কিছু শ্রমিক-রবোট তৈরি করল। কলকারখানার উৎপাদন শুরু হবার পর ওরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ল। ওদের নিজেদের সিনেমা হলো নিজেদের তৈরি কপোট্রনিক সিনেমা দেখানো শুরু হল। সাহিত্যকীর্তির জন্যে একটি রবোটকে পুরস্কার দেয়ার কথাটা ওদের নিজেদের বেতার স্টেশন থেকে প্রচার করা হল। নিজেদের খবরের কাগজ, বই, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতে লাগল। ওদের জার্নালে প্রথমবারের মতো টেকীওনের উপর মৌলিক গবেষণা-লব্ধ তথ্য প্রকাশিত হল। আমরা অবাক বিস্ময়ে ওদের ক্ষমতা লক্ষ করছিলাম। ছয় মাসের মাথায় সমুদ্রের বুকে এ ছোট্ট দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দ্বীপ হয়ে দাঁড়াল। মহাকাশ গবেষণার জন্যে অতিকায় রকেট মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। তিনটি আশ্চর্য ধরনের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন সমুদ্রের নিচে গবেষণার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। একদিন
false
humayun_ahmed
উৎসাহী মনে হল না। এই জায়গাই চমৎকার। কাজটাও ভাল। চিঠি লিখতে তার ভাল লাগে। চিঠি যারা লেখাতে আসে তাদের সঙ্গে অতি দ্রুত ফরিদের ভাব হয়ে যায়। ভাবের একটা নমুনা দেয়া যাক। খালি গায়ের বুড়ো এক লোক চিঠি লিখাতে এসেছে। বুড়ো বলল- লোহেন পর সমাচার, আমি ভালই আছি। ফরিদ বলল, পর সমাচার লিখব কেন? পর সমাচার মানেটা কি? মানেতো বাবা জানি না। যার কাছে লিখছেন তার নাম কি? লতিফা। আপনার কি হয়? আমার ছোট মাইয়া। তাহলে এই ভাবে লিখি— মা মনি লতিফা, তুমি কেমন আছ? জ্বি আচ্ছা বাবা লেহেন। তারপর লেহেন আমি ভালই আছি। তবে তোমাদের জন্য বড়ই চিন্তাযুক্ত। ফরিদ বলল, আমি একটু অন্য রকম করে লিখি? লিখি— আমার শরীর ভালই আছে তাবে সারাক্ষণ তোমাদের জন্যে চিন্তা করি বলে মন খুব খারাপ থাকে। লিখব? জি জি লেহেন। আপনের মত কইরা লেহেন। এই মেয়ে আমার বড় আদরের। আর কি লিখব বলুন? আপনার মত কইরা লেহেন— ভাল-মন্দ মিশাইয়া। ফরিদ তরতর করে লিখে চলেছে। এক পৃষ্ঠার জায়গায় তিন পৃষ্ঠা হয়ে যায়। সেই চিঠি পড়ে শুনানোর পর বৃদ্ধ বলে, বড় আনন্দ পাইলাম বাবাজী। বড় আনন্দ। মনের সব কয়টি কথা লোহা হইছে। বৃদ্ধের আনন্দ দেখে ফরিদ আনন্দ বোধ করে। তার কাস্টমারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। তবে তার নিয়ম হচ্ছে দিন চলার মত টাকা হয়ে গেলেই লেখালেখি বন্ধ। পার্কের কোন বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা। এই ব্যাপারটা কাদেরের খুব অপছন্দ। সে চায় লেখালেখি রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত চলুক। মামার অকারণ আলস্যামী দুচোখে বিষ। লিখলেই যখন টাকা আসে তখন এই রকম না লিখে বেঞ্চিতে চুপচাপ শুয়ে থাকবে কেন? ফরিদের এই বিষয়ে যুক্তি খুব পরিষ্কার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই উপার্জন করতে হবে তার বেশি না। সাধু সন্ন্যাসীরা যে পদ্ধতিতে ভিক্ষা করতেন। সেই পদ্ধতি। যেই এক বেলার মত খাবারের চাল পাওয়া গেল ওমি ভিক্ষা বন্ধ। আপনের কথার মামা কোন আগাও নাই। মাথাও নাই। মহা বিরক্ত হয়ে কাদের সিগারেট ধরায়। ফরিদ ক্ৰ কুঁচকে তাকালেই বলে এমন কইরা চাইয়েন না মামা। অখন আপনের সামনে সিগারেট খাইলে দোষের কিছুই নাই। বাড়ির বাইরে আপনেও পাবলিক, আমিও পাবলিক। তুই পাবলিক ভাল কথা, আমার ঘারে বসে বসে খাচ্ছিস তোর একটু লজ্জা সরমা নেই? রোজগার পাতির চেষ্টা কর। কী চেষ্টা? রিকশা চালালে কেমন হয়? পারবি না? কাদের কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, সৈয়দ বংশের পুলা হইয়া রিকশা চালামু? আপনে কন কি? বংশের একটা ইজ্জত আছে না? ফরিদ কিছু বলল না। আসলে কথাবার্তা বলার চেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভাল লাগছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের পাল। এই সৌন্দর্য এতদিন চোখের আড়ালেই ছিল। ভাগ্যিস সে পথে নেমেছিল। পথে না নামলে কি এই দৃশ্য চোখে পড়ত? পড়ত না। মামা? কী। চুপচাপ আপনের ঘাড়ে বইসা খাইতেও খারাপ লাগে। কি করি কন দেহি। ভেবে কিছু একটা বের কর। ছিনতাই করলে কেমন হয় মামা? কি বললি? ছিনতাই। রিকশা চালানোয় আপত্তি আছে। ছিনতাই-এ আপত্তি নেই? রিকশা চালাইলে দশটা লোকে দেখব মামা। আর ছিনতাই করলে জানিব কেন্ডা? কেউ না। তুই আমার সাথে কথা বলবি না। কি কইলেন মামা? বললাম যে তুই আমার সথে কথা বলবি না। কথা বললে চড় খাবি। জে আচ্ছা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে তুই আমার সঙ্গে হোটেলে খেতেও আসবি না। চোরদের প্ৰতি আমার কোন মমতা নেই। কাদের ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরই হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। মনে হল বিশেষ কোন কাজে যাচ্ছে। তার প্রায় মিনিট পনেরো পরে তাকে দৌড়তে দৌড়াতে এদিকে আসতে দেখা গেল। তার হাতে নতুন একটা শ্ৰীফকেইস। পেছনে জনা দশেকের একটি দল। ধর ধর আওয়াজ উঠছে। ফরিদ ধড়মড় করে উঠে বসল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ব্যাপার কি রে? কাদের হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দৌড় দেন মামা। তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে ফরিদ তৎক্ষণাৎ উঠে। ছুটতে শুরু করল। ছুটিতে ছুটতে বললেন, ব্যাপার কি রে? ছিনতাই করেছি মামা। সে কি? চাইয়া দেহেন নতুন ব্রীফকেইস। এখন ধরা পড়লে জানে শেষ করব। আরো শক্ত দৌড় দেন। ফরিদ হতভম্ব হয়ে বলল, তুই ছিনতাই করেছিস। আমি দৌড়াচ্ছি কেন? কাদের দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, পাবলিক বড় খারাপ জিনিস মামা। বড়ই খারাপ। এ দুনিয়ায় পাবলিকের মত খারাপ জিনিস নাই। বিলু এবং আনিসকে স্টীমারে তুলে দিয়ে এসে সোবাহান সাহেব খবর পেলেন যে থানা থেকে টেলিফোন এসেছে। দুজন ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। তারা বলছে সোবাহান সাহেব তাদের চেনেন। তিনি যদি থানায় আসেন। তাহলে ভাল হয়। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে গ্যাং লিডার- ইয়া লাস। সোবাহান সাহেব তৎক্ষণাৎ থানায় ছুটলেন। ফরিদ এবং কাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হল। স্টীমারে প্রথম শ্রেণীর যে কামরাটা রিজার্ভ করা হয়েছে তাতে দুটি বিছানা। দুর্সীটের কামরা দেখে বিলুর মুখ শুকিয়ে গেল। আনিস কি তার সঙ্গে এই কামরাতেই থাকবে? তা কি করে হয়? টিকিট আনিস করেছে। এই কাজটা কি ইচ্ছা করেই করা? ভদ্রলোক কি একবারও ভাবলেন না। একজন কুমারী মেয়ের সঙ্গে এক কামরায় সারারাত যাওয়া যায় না। বিলু। তার বাবার উপর রাগ করল। বাবার উচিত ছিল, কিভাবে যাওয়া হচ্ছে- এই সব জিজ্ঞেস করা। তিনি তাঁর কিছুই করলেন না। তাদের স্টীমারে উঠিয়ে দিয়ে অতি দ্রুত
false
robindronath
বধূর এই ব্যবহার দেখিয়া বারান্দার প্রান্তে দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধ ইঙ্গিত করিতে লাগিলেন। আশা মরিয়া হইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া বই হইতে মাথা না তুলিয়া কহিল, “এখনো আমার দেরি আছে–আবার কাল ভোরে উঠিয়া পড়িতে হইবে–আমি এইখানেই শুইব।” কী লজ্জা। আশা কি মহেন্দ্রকে উপরের ঘরে শুইতে যাইবার জন্য সাধিতে আসিয়াছিল। ঘর হইতে সে বাহির হইতেই রাজলক্ষ্মী বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী, হইল কী।” আশা কহিল, “তিনি এখন পড়িতেছেন, নীচেই শুইবেন।” বলিয়া সে নিজের অপমানিত শয়নগৃহে আসিয়া প্রবেশ করিল। কোথাও তাহার সুখ নাই–সমস্ত পৃথিবী সর্বত্রই যেন মধ্যাহ্নের মরু ভূতলের মতো তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। খানিক রাত্রে আশার শয়নগৃহের রুদ্ধদ্বারে ঘা পড়িল, “বউ, বউ, দরজা খোলো।” আশা তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানি লইয়া সিঁড়িতে উঠিয়া কষ্টে নিশ্বাস লইতেছিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়াই তিনি বিছানায় বসিয়া পড়িলেন ও বাক্‌শক্তি ফিরিয়া আসিতেই ভাঙা গলায় কহিলেন, “বউ, তোমার রকম কী। উপরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছ যে। এখন কি এইরকম রাগারাগি করিবার সময়! এত দুঃখেও তোমার ঘটে বুদ্ধি আসিল না। যাও, নীচে যাও।” আশা মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি একলা থাকিবেন বলিয়াছেন।” রাজলক্ষ্মী। একলা থাকিবে বলিলেই হইল। রাগের মুখে সে কী কথা বলিয়াছে, তাই শুনিয়া অমনি বাঁকিয়া বসিতে হইবে! এত অভিমানী হইলে চলে না। যাও,শীঘ্র যাও। দুঃখের দিনে বধূর কাছে শাশুড়ির আর লজ্জা নাই। তাঁহার হাতে যে কিছু উপায় আছে, তাহাই দিয়া মহেন্দ্রকে কোনোমতে বাঁধিতেই হইবে। আবেগের সহিত কথা কহিতে কহিতে রাজলক্ষ্মীর পুনরায় অত্যন্ত শ্বাসকষ্ট হইল। কতকটা সংবরণ করিয়া তিনি উঠিলেন। আশাও দ্বিরুক্তি না করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া নীচে চলিল। রাজলক্ষ্মীকে আশা তাঁহার শয়নঘরে বিছানায় বসাইয়া, তাকিয়াবালিশগুলি পিঠের কাছে ঠিক করিয়া দিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “থাক্‌ বউমা, থাক্‌। সুধোকে ডাকিয়া দাও। তুমি যাও, আর দেরি করিয়ো না।” আশা এবার আর দ্বিধামাত্র করিল না। শাশুড়ির ঘর হইতে বাহির হইয়া একেবারে মহেন্দ্রের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রের সম্মুখে টেবিলের উপর খোলা বই পড়িয়া আছে–সে টেবিলের উপর দু পা তুলিয়া দিয়া চৌকির উপর মাথা রাখিয়া একমনে কী ভাবিতেছিল। পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া তাকাইল। যেন কাহার ধ্যানে নিমগ্ন ছিল, হঠাৎ ভ্রম হইয়াছিল, সে-ই বুঝি আসিয়াছে। আশাকে দেখিয়া মহেন্দ্র সংযত হইয়া পা নামাইয়া খোলা বইটা কোলে টানিয়া লইল। মহেন্দ্র আজ মনে মনে আশ্চর্য হইল। আজকাল তো আশা এমন অসংকোচেতাহার সম্মুখে আসে না-দৈবাৎ তাহাদের উভয়ের সাক্ষাৎ হইলে সে তখনই চলিয়া যায়। আজ এত রাত্রে এমন সহজে সে যে তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, এ বড়ো বিস্ময়কর। মহেন্দ্র তাহার বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বুঝিল, আশার আজ চলিয়া যাইবার লক্ষণ নহে। আশা মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থিরভাবে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন মহেন্দ্র আর পড়িবার ভান করিতে পারিল না–মুখ তুলিয়া চাহিল। আশা সুস্পষ্ট স্বরে কহিল, “মার হাঁপানি বাড়িয়াছে, তুমি একবার তাঁহাকে দেখিলে ভালো হয়।” মহেন্দ্র। তিনি কোথায় আছেন? আশা। তাঁহার শোবার ঘরেই আছেন, ঘুমাইতে পারিতেছেন না। মহেন্দ্র। তবে চলো, তাঁহাকে দেখিয়া আসি গে। অনেক দিনের পরে আশার সঙ্গে এইটুকু কথা কহিয়া মহেন্দ্র যেন অনেকটা হালকা বোধ করিল। নীরবতা যেন দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাচীরের মতো স্ত্রীপুরুষের মাঝখানে কালো ছায়া ফেলিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, মহেন্দ্রের তরফ হইতে তাহা ভাঙিবার কোনো অস্ত্র ছিল না–এমন সময় আশা স্বহস্তে কেল্লার একটি ছোটো দ্বার খুলিয়া দিল। রাজলক্ষ্মীর দ্বারের বাহিরে আশা দাঁড়াইয়া রহিল, মহেন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্রকে অসময়ে ঘরে আসিতে দেখিয়া রাজলক্ষ্মী ভীত হইলেন, ভাবিলেন, বুঝি বা আশার সঙ্গে রাগারাগি করিয়া আবার সে বিদায় লইতে আসিয়াছে। কহিলেন, “মহিন, এখনো ঘুমাস নাই?” মহেন্দ্র কহিল, “মা, তোমার সেই হাঁপানি কি বাড়িয়াছে।” এতদিন পরে এই প্রশ্ন শুনিয়া মার মনে বড়ো অভিমান জন্মিল। বুঝিলেন, বউ গিয়া বলাতেই আজ মহিন মার খবর লইতে আসিয়াছে। এই অভিমানের আবেগে তাঁহার বক্ষ আরো আন্দোলিত হইয়া উঠিল–কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া বলিলেন, “যা, তুই শুতে যা। আমার ও কিছুই না।” মহেন্দ্র। না মা, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা ভালো, এ ব্যামো উপেক্ষা করিবার জিনিস নহে। মহেন্দ্র জানিত, তাহার মাতার হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা আছে, এই কারণে এবং মাতার মুখশ্রীর লক্ষণ দেখিয়া সে উদ্‌বেগ অনুভব করিল। মা কহিলেন, “পরীক্ষা করিবার দরকার নাই, আমার এ ব্যামো সারিবার নহে।” মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা, আজ রাত্রের মতো একটা ঘুমের ওষুধ আনাইয়া দিতেছি, কাল ভালো করিয়া দেখা যাইবে।” রাজলক্ষ্মী। ঢের ওষুধ খাইয়াছি, ওষুধে আমার কিছু হয় না। যাও মহিন, অনেক রাত হইয়াছে, তুমি ঘুমাইতে যাও। মহেন্দ্র। তুমি একটু সুস্থ হইলেই আমি যাইব। তখন অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী দ্বারের অন্তরালবর্তিনী বধূকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “বউ, কেন তুমি এই রাত্রে মহেন্দ্রকে বিরক্ত করিবার জন্য এখানে আনিয়াছ।” বলিতে বলিতে তাঁহার শ্বাসকষ্ট আরো বাড়িয়া উঠিল। তখন আশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “যাও, তুমি শুইতে যাও, আমি মার কাছে থাকিব।” মহেন্দ্র আশাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিল, “আমি একটা ওষুধ আনাইতে পাঠাইলাম। শিশিতে দুই দাগ থাকিবে–এক দাগ খাওয়াইয়া যদি ঘুম না আসে তবে এক ঘণ্টা পরে আর-এক দাগ খাওয়াইয়া দিয়ো। রাত্রে বাড়িলে আমাকে খবর দিতে ভুলিয়ো না।” এই বলিয়া মহেন্দ্র নিজের ঘরে ফিরিয়া গেল। আশা আজ তাহার কাছে যে-মূর্তিতে দেখা দিল, এ যেন মহেন্দ্রের পক্ষে নূতন। এ আশার মধ্যে সংকোচ নাই, দীনতা নাই, এই আশা নিজের
false
shottojit_roy
না করে থাকেন— আমি বাধা দিয়ে বললাম, এতে যে ধূমকেতুর উল্লেখ আছে তার থেকেই তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আমি একবার হিসাব করে দেখেছিলাম, ছিয়াত্তর বছর পর পর যদি হ্যালির ধূমকেতু আসে, তা হলে আজ থেকে ঠিক পাঁচহাজার বছর আগে একবার সেই ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটেছিল-অর্থাৎ ৩০২২ বিসি-তে। ক্রোল প্ৰচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে সায় দিয়ে বলল, আমারও হিসেব তোমার সঙ্গে মিলছে। প্যাপাইরাসে বলছে দৈবজ্ঞের যখন অন্য গ্রহের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তখন আকাশে ধূমকেতু ছিল। সেটা ৩০২২ হওয়া এই জন্যই সম্ভব কারণ তখন ঈজিপ্টে মেনিসের রাজত্বকাল, আর সেটাকেই বলা হয় ঈজিপ্টের স্বর্ণযুগের শুরু। সব মিলে যাচ্ছে, শঙ্কু! ডেক্সটার বলল, কিন্তু এর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা চলে কি? এক-আধা বছরও কি এদিক ওদিক হতে পারে না? ফ্ৰান্ডিং তার চুরুটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, আমার ধারণা, এতে কোনও ভুল নেই, কারণ আমি এখানে আসার আগের দিনই এপসাইলন ইন্ডি থেকে সংকেত পেয়েছি। তাতে বলা হয়েছে যে আগামী অমাবস্যায় তাদের দূত পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে, এবং তারা যেখানে নামবে সে জায়গাটা হল এখান থেকে আন্দাজ দুশো কিলোমিটার পশ্চিমে। তার মানে মরুভূমিতে? ডেক্সটার প্রশ্ন করল। সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু কী ভাষায় পেলে এই সংকেত? আমি জিজ্ঞেস করলাম। টেলিগ্রাফের ভাষা, বলল ফল্ডিং, মর্স। তার মানে পৃথিবীর সঙ্গে তারা যোগ রেখে চলেছে এই গত পাঁচ হাজার বছর? সেটা আর আশ্চৰ্য কী, শঙ্কু। ভুলে যেও না তাদের সভ্যতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তা হলে তো তারা ইংরেজিও জানতে পারে। কিছুই আশ্চর্য নয়। তবে আমি ইংরেজ কি না সেটা হয়তো তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, তাই তারা মর্স কোড ব্যবহার করেছে। তা হলে আমাদের গন্তব্যস্থল হল কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।–তারা তো আর এই হোটেলে এসে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে না। ফীল্ডিং হেসে বলল, না, সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমরা যাব বাওয়িতি—এখান থেকে দুশো ত্ৰিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। রাস্তা আছে, তবে তাকে হাইওয়ে বলা চলে না। অবিশ্যি তাতে কোনও অসুবিধা হবে না। ক্রোলের গাড়িটা তো তুমি দেখেছ। তা দেখেছি। এয়ারপোর্ট থেকে ক্রোলের গাড়িতেই এসেছি। বিচিত্র গাড়ি-যেন একটি ছোটখাটো চলন্ত হোটেল। সেইসঙ্গে মজবুতও বটে। অটোমোটেল নামটা ক্রোলেরই দেওয়া। ডা. থার্নিক্রফটও আসছেন কাল সকালে, বলল ফ্ৰান্ডিং, তিনিও হবেন আমাদের দলের একজন। এ খবরটা জানা ছিল না। তবে থার্নিক্রফটের আগ্রহের কারণটা স্পষ্ট। হাজার হোক তিনিই তো প্যাপাইরাসের পাঠোদ্ধার করেছেন। তোমার অ্যানাইহিলিনটা সঙ্গে এনেছ তো? ক্রোল জিজ্ঞেস করল। আমি জানিয়ে দিলাম যে এই ধরনের অভিযানে সেটা সব সময়ই সঙ্গে থাকে। আমার তৈরি এই আশ্চৰ্য পিস্তলের কথা এরা সকলেই জানে। যত বড় এবং যত শক্তিশালী প্রাণীই হোক না কেন, তার দিকে তাগ করে এই পিস্তলের ঘোড়া টিপলেই সে প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সবসুদ্ধ বার দশেক চরম সংকটের সামনে পড়ে আমাকে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। প্যাপাইরাসের বিবরণ থেকে এই ভিনগ্রহের প্রাণীকে হিংস্র বলে মনে হয় না, কিন্তু এবার যারা আসবে তাদের অভিপ্ৰায় যখন জানা নেই, তখন আত্মরক্ষার জন্য প্ৰস্তুত হয়ে থাকলে ক্ষতি কী? আমরা চার জনে পরস্পরের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে রইলাম যেন আমাদের এই আসন্ন অভিযানের কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ না জানে। আমরা উঠে যে যার ঘরে যাবার তোড়জোড় করছি, এমন সময় দেখি হোটেলের ম্যানেজার মি. নাহুম আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এখানে বলে রাখি। যে এই কাণকি হোটেল থেকেই মৰ্গেনস্টার্ন উধাও হয়েছেন, এবং এই মি. নাহুমকেই মৰ্গেনস্টার্নের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল। নাহুম জানালেন যে মৰ্গেনস্টার্নের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কাজেই ধরে নিতে হয় মৰ্গেনস্টার্ন শহর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাইলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। আর কোনও শকুনাটকুনি এসে কোনও ঘরের জানলায় বসছে না তো? ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন করল ক্রোল। জিভ কাটার অভ্যাস ঈজিপসীয়দের থাকলে অবশ্যই মি. নাহুিম জিহ্বা দংশন করতেন। তার বদলে তিনি আমাদের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, আপনাদের বলতে দ্বিধা নেই—আমাদের হোটেলের ত্ৰিসীমানার মধ্যে কেউ কোনওদিন শকুনি দেখেছে বলে শুনিনি। তবে বেড়াল কুকুর যে এক আধটা দেখা যাবে না তার ভরসা দিতে পারছিনা, হে হে। আমরা ঠিক করেছি। কাল লাঞ্চের পরেই রওনা দেব। কী আছে কপালে জানি না, তবে আমি মনে করি ঈজিপ্টে আসার মধ্যেই একটা সার্থকতা আছে। এখানে এসে দু মিনিট চুপ করে থাকলেই চারপাশের আধুনিক শহরের সব চিহ্ন মুছে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই প্রাচীন যুগের মিশর। ইমহোটেপ, আখেনাতন, খুফু, তুতানখামেনের দেশে এসে নামবে ছায়াপথের কোন এক অজ্ঞাত সৌরজগতের প্রাণী? ভাবতেও অবাক লাগে। ৫ই নভেম্বর আজ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটো ঘটনা আমাদের সকলকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এখনও তার জের সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একটু ঘুরে আসব। গিরিডিতে রোজ ভোরে উশ্রীর ধারে বেড়ানোর অভ্যাসটা আমার বহুকালের। ঘুম আমার আপনা থেকেই সাড়ে চারটেয় ভেঙে যায়। আজ কিন্তু ভাঙল স্বাভাবিক ভাবে নয়। আমার ঘরের দরজায় প্ৰচণ্ড ধাক্কাই এই নিদ্রাভঙ্গের কারণ। ব্যস্তভাবে উঠে জাপানে উপহার পাওয়া বেগুনি কিমোনোটা চাপিয়ে নিয়ে দরজাটা খুলে দেখি ডেক্সটার—তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, দম ফেলছে যেন ম্যারাথন দৌড়ে এল! কী ব্যাপার? এ স্নেক—এ মোক ইন মাই রুম! কথাটা শেষ করে টলায়মান অবস্থায় ঘরে ঢুকে সে ধাপ করে আমার খাটে বসে পড়ল। আমি জানি ডেক্সটারের
false
shomresh
অদ্ভুত উচ্চারণে জবাব দিল ছেলেটি। এই হোটেলের খোঁজ পেলেন কী করে? রাস্তায় যেতে-যেতে সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। অর্জুন হাসল, গ্রামে কবে যাচ্ছেন? গ্রামে? ও। আপনার তো গ্রাম দেখার সাধ আছে। চলে যান কালীগঞ্জে। গিয়ে বিমানবিহারী ঘোষের সঙ্গে দেখা করবেন। সঙ্কোচ না হলে দু-তিনদিন থাকার কোনও অসুবিধে হবে না। দু-তিনদিন বাদে অবশ্য একটা শু্যটিং-পার্টি যাবে সেখানে। সেটাও দেখতে পারেন। এ. বি. ঘোষ বেরিয়ে গেলেন। অর্জুন কিছুক্ষণ সময় কোনওমতে কাটিয়ে ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। বিমানবাহিরীকে চেনেন এ. বি.। এখন আর কোনও সন্দেহ নেই, ইনিও ওই পরিবারের একজন, অথচ নিজের পুরো নামটা বললেন না। প্রীতম হোটেলে এ. বি. রায় কী করছিলেন? প্রযোজক কি তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই হোটেলটাকে বেছে নিয়েছিলেন? রিসেপশনিস্টের কথাবার্তায় বোঝাই যায় ওখানে ওঁদের যাতায়াত আছে। এ. বি. ঘোষের বাড়ি বনানীতে, প্রযোজকের মালিবাগে, অথচ দুজনে দেখা করছেন প্রীতম হোটেলে এসে। যাক গে! কালীগঞ্জে পৌঁছবার একটা সূত্র তো পাওয়া গেল। এই সময় ড্রাইভার বিড়বিড় করে কিছু বলতেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ভাই? দ্যাখেন না ছার, টয়েটো গাড়িটা তখন থেকে পেছনে লেগেই আছে। অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে দেখল। সাদা গাড়ি, ড্রাইভার একা। ওদের গাড়ি যেদিকে ঘুরছে, ওটাও পেছন পেছন আসছে। হঠাৎ অর্জুনের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পেছনেরটাও থেমে গেল। ড্রাইভার দরজা খুলে পেছনের দিকে গেল, কী মিঞা, মতলবখান কী, কন তো? পিছনে লাইগ্যা আছেন ক্যান? অন্য গাড়ির ড্রাইভার বলল, রাস্তা তো কারও বাপের সম্পত্তি না। গজগজ করে ফিরে এল ড্রাইভার, কে গুন্ডা, কে ভালমানুষ, আজকাল বোঝাই যায় না? চলেন ছার, বাসায় যাই। চলুন। অর্জুন বলল। ওই গাড়িটাকে কি কেউ তাকে অনুসরণ করতে পাঠিয়েছে? তা যদি হয়, তা হলে ওর তো নিজেকে আড়ালে রাখার কথা। এমন গায়ে পড়ে কেউ অনুসরণ করে? কিন্তু দেখা গেল ইউসুফভাই-এর বাড়ির দরজা পর্যন্ত দ্বিতীয় গাড়িটা পেছন ছাড়ল না। ওরা ভেতরে ঢোকার পর গাড়িটা বেরিয়ে গেল। অর্জনের মনে হল, গাডিটাকে এ. বি. ঘোষ পাঠাননি তো? পাঠানোর অর্থ, ওঁর মনে অর্জুন সম্পর্কে সন্দেহ এসেছে। সাধারণ জীবনযাপন করেন যে সমস্ত মানুষ, তাঁদের মনে এমন সন্দেহ হুট করে আসে না। লাঞ্চের আগে ইউসুফভাই ফিরে এলেন, কেমন ঘুরলেন অর্জুনবাবু? আপনি আমাকে তুমি বলবেন, আর বাবুটা ছাড়ুন। ঠিক আছে, ঠিক আছে। অর্জুন ওঁকে সকালের অভিজ্ঞতাটা জানাল। তোমার ওই হোটেলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমার এখানে কি খুব। অসুবিধে হচ্ছে? বিন্দুমাত্র নয়। আমি ঘর খুঁজতে প্রীতম হোটেলে যাইনি। তা হলে তো কারও ভুল হল। এই লোকগুলো অত্যন্ত ডেঞ্জারাস ধরনের। আর এদের জন্য তো বাংলাদেশে আসোনি। আমাকে ভুল বুঝে না। ওই প্রযোজকের নাম রাজউদ্দিন আহমেদ। লোকে রাজুভাই বলে। ডাকে। পর-পর দুটো ছবি মার খাওয়ার ফলে লোকটা এখন আকণ্ঠ ঋণগ্রস্ত। তৃতীয় ছবিটা শুরু করছে ধার করে। এটাও যদি না চলে, তা হলে আত্মহত্যা। অথবা বাংলাদেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া ওর কোনও পথ নেই। এসব কথা আমার এক চিত্রসাংবাদিক বন্ধুর কাছে শুনতে পেলাম। এ. বি. ঘোষের কথা ভাল করে কেউ জানে না। হয়তো লোকটা টাউট, রাজুভাইকে টাকা জোগাড় করে দিচ্ছে। ঢাকার অনেককেই বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না কার পকেট ভর্তি, কার শুন্য। কিন্তু ওরা যে আমার খবর জানার জন্য প্রকাশ্যে পেছনে আসবে, তা ভাবিনি। তা হলেই বোঝো। কিন্তু একটা ব্যাপারে লাভ হল তো। কী ব্যাপারে? ওই বিমানবিহারীর কাছে পৌঁছনো যাবে। হয়তো। আবার ওটা বিপদও তো ডেকে আনতে পারে। মানে? আমরা জানি না বিমানবিহারীর সঙ্গে এ. বি. ঘোষের সম্পর্ক কী ধরনের। ওঁর পরিচয় নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে গেলে তিনি ভাল চোখে না-ও দেখতে পারেন। আমরা বিমানবিহারীর কাছে যাচ্ছি না। আমি অন্য সুত্র পেয়েছি। কীরকম? আমার এক বন্ধুর নাম সাহাবুদ্দিন। তাঁর প্রেস আছে, বই ছাপে। চিত্রসাংবাদিক বন্ধুটি আমাকে বলল সাহাবুদ্দিনের বাড়ি ওই কালীগঞ্জে। কর্মচারী ছাড়া কেউ নেই ওখানে। তার দেশের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাই শুনে সে খুব খুশি। কবে যেতে পারি আমি? আমি না ভাই, আমরা। বেশ, তাই হোক। আগামীকাল সকাল দশটায় সাহাবুদ্দিন তার গাড়ি নিয়ে আমার এখানে আসবে। ও জানে তুমি একজন সাধারণ টুরিস্ট। এর বেশি ওর জানার দরকার নেই। অর্থাৎ আজকের বিকেলটা ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। অর্জুন ঠিক করল, বিকেলে বুড়িগঙ্গা দেখতে যাবে। পুরনো ঢাকাকে দেখতে হবে। সাহাবুদ্দিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ভদ্র চেহারার মানুষটির মুখে হাসি লেগেই আছে। পরিচয় করার সময় বললেন, আমাকে মনুভাই বলবেন। অতএব মনুভাইয়ের পাশে অর্জুন বসল। পেছনের আসনে ইউসুফভাই। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ, যাঁরা স্বাধীনতার পর জন্মেছেন, তারা বাংলা নাম পছন্দ করেছেন। তার আগের মানুষরা ডাকনামটাকেই আসল নামের সঙ্গে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। মনুভাই গাড়ি চালাতে-চালাতে বললেন, নামের ব্যাপারে এখন আমরা আপনাদের থেকে এগিয়ে আছি। আচ্ছা, আপনাদের একটি মেয়ের আধুনিক নাম বলুন তো! অর্জুন মনে করার চেষ্টা করে না পেরে বুদ্ধদেব গুহর শরণাপন্ন হয়ে বলল, যোজনগন্ধা। মনুভাই বললেন, ভাল। তবে আমাদের মেয়েদের নাম এখন একা রাখা হচ্ছে। একা, স্নেহা। অর্জুন অবাক হল। কোনও বাঙালি তাঁর মেয়ের নাম একা রেখেছেন, তা সে ভাবতে পারছিল না। সুন্দর চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। এদিকটায় রিকশার ভিড় কমে আসছে। ডানদিকের পাঁচিলঘেরা বিশাল বাড়িটি যে ঢাকার টেলিভিশন কেন্দ্র, তা ইউসুফভাই জানালেন। ক্রমশ নির্জন এলাকার সুন্দর সুন্দর বাড়ি নজরে এল।
false
humayun_ahmed
বোন লীলা, সে তো তোমার চেয়েও সুন্দর। হুঁ। সে তোমার চেয়ে ভালো? হুঁ। কিন্তুক সে আলাদা। সে আলাদা কেন? আপনেরে বলব না। তোমরা দুই বোন যে বৃষ্টিতে আমার সঙ্গে ভিজবে তোমাদের বাবা বকবে না? না। বকবে না কেন? বাপজানের মন এখন ভালো। উনার মন ভালো থাকলে কাউকে বকেন না। মন ভালো কেন? বড়বুবু ফিরা আসছে–এইজন্য মন ভালো। বড়বুবু ফিরে আসায় তোমরা খুশি হয়েছ? হুঁ। আইজ রাইতে আমরা বড়বুবুর সঙ্গে ঘুমাব। লীলা মাঝখানে আর তোমরা দুই বোন দুই পাশে? হুঁ। আজ রাতে তোমাদের খুবই মজা হবে? হুঁ। বৃষ্টির পানিতে তিনি যখন দুই কন্যাকে নিয়ে নামলেন তখন জাইতরী ঘোষণা করল— আমি আপনেরে ভালো পাই। মঞ্জু বললেন, কেন? জইতরী বলল, জানি না। কী জন্যে। কিন্তু আমি আপনেরে ভালো পাই। শুনে খুশি হলাম। আমার একটা নিয়ম আছে। কী নিয়ম? আমি একবার যখন কাউকে ভালো পাই তারে সারা জীবনই ভালো পাই। এই নিয়ম কি তুমি নিজে বানিয়েছ? হুঁ। জইতরী এসে মঞ্জুর হাত ধরল। তার দেখাদেখি কইতরীও হাত ধরল। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। দুই বোনই শীতে কাঁপছে, তারপরও তাদের আনন্দের সীমা নেই। মঞ্জুর মনে হলো, এই দুই কন্যাকে রেখে তার পক্ষে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হবে। লীলা চলে যেতে চাইলে চলে যাবে, তিনি থাকবেন। রমিলা লীলাকে নিয়ে খেতে বসেছেন। বেশ আয়োজন করেই খেতে বসা হয়েছে। পাটির উপর বড় জলচৌকি বসানো হয়েছে। মা-মেয়ে বসেছে। জলচৌকির দুপাশে। রমিলা মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। তার মাথায় বিরাট ঘোমটা। ঘোমটার ভেতর দিয়ে আড়াচোখে মেয়েকে দেখছেন। যতবারই দেখছেন ততবারই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলছেন। মাগো, তুমি যে ফিরত আসবা আমি জানতাম। লীলা বলল, এখন আপনার কথা আমার বিশ্বাস হয়। তোমার কার সাথে বিবাহ হবে সেইটাও আমি জানি। বলব? না। আমার ভবিষ্যৎ জানতে ইচ্ছা করে না। রমিলা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমারো জানতে ইচ্ছা করে না। রমিলা খাওয়া বন্ধ করে লীলার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁটের ফাকে হাসির আভাস। লীলা বলল, কী দেখেন? রমিলা বললেন, তোমার খাওয়া দেখি গো মা। তোমার খাওয়া সুন্দর। খাওয়া নিয়া একটা সিমাসা শুনবা? লীলার কোনো সিমাসা শুনতে ইচ্ছা করছে না। তার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। তারপরেও সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রমিলা বললেন— পাঁচ আঙুলের নারী যখন চাইর আঙুলে খায় সেই নারী স্বামীর কাছে আদর সোহাগ পায়। লীলা বলল, আমি কি চার আঙুলে খাই? রমিলা বললেন, হঁ। তুমি তোমার স্বামীর কাছে আদর সোহাগ পাইবা। বিরাট আদর। লীলা বলল, স্বামীর আদর পাওয়া তো ভালোই। রমিলা বললেন, অবশ্যই ভালো। যে মেয়ে স্বামীর আদর বেশি পায় সে বাপের আদর কম পায়। আবার যে মেয়ে বাপের আদর বেশি পায় তার ভাগ্যে স্বামীর আদর নাই। আমি বাবার আদর পাব না? তুমি দুইটাই পাইবা। কীভাবে জানেন? তোমার থুতনিতে লাল তিল। এই নিয়াও একটা সিমাসা আছে। বলব? বলুন। থুতনিতে লাল তিল কালো তিল কানে পিতার কোলে থাকবে নারী সৰ্ব লোকে মানে। তোমার থুতনিতে লাল তিল, আবার কানের লতিতেও কালো তিল। লীলার খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাত ধুতে ধুতে বলল, আমার ধারণা আমাকে দেখে দেখে এইসব সিমাসা। আপনি বানাচ্ছেন। এই ধরনের সিমাসা আসলে নাই। রমিলা হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কথা সত্য বলেছ। এমন সিমাসা নাই। তোমার বেজায় বুদ্ধি। তয় তোমার বাপের মতো না। আপনার ধারণা বাবার অনেক বুদ্ধি? অবশ্যই। তোমার বাপ সবেরে পুতুলের মতো চালায়। কেউ বুঝতে পারে না। আমার মাকে কিন্তু বাবা পুতুলের মতো চালাতে পারে নাই। তোমার মায়ের দিকে তোমার বাবার ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি। যার দিকে ভালোবাসা বেশি থাকে তার উপরে বুদ্ধি কাজ করে না। এই বিষয়ে একটা সিমাসা আছে, শুনবা? আপনার বানানো সিমাসা আমি আর শুনব না। রমিলা আবারো হাসি শুরু করেছেন। হাসতে হাসতে আবারো তার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, তুমি তোমার ব্যাপারে বলো আমারে যেন আটকায়ে রাখে। মাথা জানি কেমুন করতেছে— হাসিটা বেশি হইছে। হি হি হি। একদিনে বেশি হাসছি—হি হি হি। এখন কান্দন শুরু হইব— হি হি হি। সিদ্দিকুর রহমান আনিসের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে একটা অতি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আনিসকে তিনি বাড়িতে রেখে দেবেন না-কি ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে পাঠাবেন? সতীশ ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ডাক্তারের ধারণা রোগীর সময় শেষ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়া দরকার। রোগীকে দেখেও সেরকমই মনে হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সারাক্ষণ হা করে আছে। বুক উঠানামা করছে। হাসপাতালে পাঠানো সমস্যা না। গরুর গাড়ি তৈরি আছে। এখান থেকে গরুর গাড়িতে নান্দাইল রোড স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহ। মাঝখানে গৌরীপুরে ট্রেন বদল। ঝামেলা আছে। রোগীর যে অবস্থা পথেও কিছু ঘটে যেতে পারে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, রোগীকে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সতীশ ডাক্তার বলল, নিতে পারেন। কিন্তু লাভ হবে না। যেখানে জীবন-মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন, সেখানে লাভ-লোকসানের বিচার করা কি উচিত? সতীশ ডাক্তার চুপ করে গেল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তৈরি হয়ে নাও। তুমি সঙ্গে যাবে। সতীশ ডাক্তার হোড়বড় করে বলল, আমি তো যেতে পারব না। আমার বিরাট ঝামেলা আছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ। বিরাট ঝামেলা তো থাকবেই। ঝামেলামুক্ত
false
shunil_gongopaddhay
আর সত্যিই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন না। এক জায়গায় এসে মিংমা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সে যেন ঠিক বিপদের গন্ধ পায়। সন্তুর হাত চেপে ধরে সে বলল, আউর যাও মত! খাতরা হ্যায়। সেখানে বরফের ওপর শুয়ে পড়ল সে। তারপর হাতটা লম্বা করে জোরে একটা গাইতির ঘা দিল। অনেকখানি বসে গেল। গাঁইতিটা। বুঝতে কোনও ভুল হয় না যে ঐ জায়গাটা ফাঁপা। সন্তু দারুণ উত্তেজনা বোধ করল। পেয়েছে, এবার তারা ঠিক জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে। এই জায়গাটাতেই সন্তু বরফের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিল সেদিন। মিংমা। এদিক-ওদিক গাইতি চালিয়ে বুঝে নিল, ঠিক কতখানি জায়গা ফাঁপা সেখানে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বরফ কোপাতে লাগল, সন্তুও যোগ দিল তার সঙ্গে। এখানে একটু পরিশ্রম করলেই নিশ্বাসের কষ্ট হয়। এমনিতেই এখানকার বাতাস বেশ ভারী। খানিকক্ষণ কুপিয়েই সন্তু বেশ হাঁপিয়ে গেল। কিন্তু মিংমার কী অসাধারণ শক্তি, সে কিছুতেই ক্লান্ত হয় না। এর মধ্যে সে বেশ একটা বড় চৌবাচ্চার মাপে গর্ত খুঁড়ে ফেলেছে। তারপর সে গর্তের এক পাশ থেকে বুকে নীচে গাহতি চালাতে লাগল। একসময় সে নিজেই লাফিয়ে নেমে পড়ল গর্তটার মধ্যে। আরও কয়েকবার বেশ জোরে গাইতি চালাবার পর মিংমা মুখ তুলে সন্তুকে বলল, তুম ঠিক বোলা, সন্তু সাব নীচে লোহা হ্যায়। সন্তুও তখন লাফিয়ে নেমে পড়ল গর্তটার মধ্যে। দুজনে মিলে আরও খানিকটা বালি-মেশানো বরফ সরিয়ে ফেলার পর দেখা গেল, সেখানে পাতা রয়েছে একটা লোহার পাত। কিন্তু তাতে কবজ কিংবা গুপ্ত দরজা কিছুই নেই। সন্তু বলল, এখন দেখা দরকার, এই লোহার পাতটা কত বড়! এখানে বরফের তলায় কে এরকম লোহার পাত রাখবে? কোনও অভিযাত্রীদল নিশ্চয়ই এতবড় লোহার পাত বয়ে নিয়ে আসে না! মিংমা কপালের ঘাম মুছল বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে। আবার খোঁড়াখুড়ি করতে হবে। লোহার পাতটা কত বড় কে জানে! লোহার পাতটা দেখে অবশ্য মিংমাও খুব অবাক হয়েছে। একটা কোনও দারুণ রহস্যের সন্ধান পেয়ে খাড়া হয়ে উঠেছে তার মাথার চুল। আবার নতুন উৎসাহে সে বরফ পরিষ্কার করতে লাগল। লোহার পাতটা বেড়েই চলেছে। কতখানি জায়গা জুড়ে যে একটা পাতা আছে, তা বোঝার কোনও উপায় নেই। মিংমা এক সময় জিজ্ঞেস করল, আউর কেয়া করিনা, বোলো সন্তু সাব! সন্তুও ঠিক বুঝতে পারছে না। এরকমভাবে আর কতক্ষণ খোঁড়াখুড়ি চলবে? এ তো একজন দুজন মানুষের কাজ নয়। তবে একটা দারুণ জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে, এটাকে আর হারালে চলবে না কিছুতেই। এই সময় খ্যার খ্যার শব্দ শোনা গেল হিলিকপটারটার। দুরের আকাশে দেখা গেল একটা কালো বিন্দু। মিংমা আনন্দে চেঁচিয়ে বলল, আ গয়া! আ গয়্যা! কিন্তু আর কিছু বলতে পারল না মিংমা। ওরা আগে লক্ষই করেনি যে, লোহার পাতটার এক জায়গায় চুলের মতন সরু দাগের জোড়া আছে। সেই জায়গাটা ফাঁক হয়ে একটা দিক ঢালু হয়ে যেতেই সন্তু গড়িয়ে পড়ে গেল নীচের অন্ধকারে। মিংমাও পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তারই মধ্যে সে দু হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল খাদের ওপরটা। দুটো লোহার পাতের মাঝখানে আটকে গেল মিংমার পায়ের তলা থেকে কোমর পর্যন্ত। সে যন্ত্রণায় অ-আ করে আর্তনাদ করতে লাগল। কাকাবাবু রিভলভারটা তুলেই দেয়ালের দিকে সরে গেলেন। তারপর রিভলভারটা টিপ করে রাখলেন লোকটির মাথার দিকে। পড়ে যাবার পর লোকটি কোনও শব্দও করল না, একটুও নড়ল না। একই জায়গায় পড়ে রইল, উপুড় হয়ে। কাকাবাবু ভাবলেন, পাথরে মাথা ঠুকে কি অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটি? কিন্তু অত জোরে তো পড়েনি! ও অন্য কোনও কায়দা করার চেষ্টায় আছে? কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, আপনি উঠে বসুন, তারপর আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন। কোনওরকম ছেলেমানুষি করতে যাবেন না, আমার টিপ খুব ভাল, এক গুলিতে আপনার মাথাটা ছাতু করে দিতে পারি। লোকটি তবু নড়ল না। কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেই সে তখন তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কাকাবাবু কুকুরটাকে ছুঁড়ে দেবার পরই সেটা ভয় পেয়ে পালিয়েছে। খানিকটা দূরে গিয়ে কুঁই-কুঁই করে ডাকছে। কাকাবাবু সেদিকে মনোযোগ দিলেন না। লোকটির উদ্দেশে আবার বললেন, আমি এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনব। তার মধ্যে উঠে না বসলে আমি আপনার গায়ে গুলি করব! এক-দুই- সঙ্গে-সঙ্গে দারুণ জোরালো সার্চ লাইটের আলোয় ভরে গেল সুড়ঙ্গটা। এতই জোর আলো যে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল কাকাবাবুর। তিনি এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করলেন। লোকটি এবার উঠে বসিল আস্তে-আস্তে। কাকাবাবু তাকে হুকুম দিলেন, আলোর দিকে পেছন ফিরে বসুন। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করবেন না। এবার গাম-গম করে উঠল মাইক্রোফোনের আওয়াজ। কে যেন একজন বলল, অ্যাটেনশন প্লীজ! মিঃ রায়চৌধুরী, ক্যান ইউ হীয়ার মি? মিঃ রায়চৌধুরী, আপনার হাতের পিস্তলটা ফেলে দিন! প্লীজ। কাকাবাবুঘাড় ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলেন, সুড়ঙ্গের মধ্যে কোথায় লাউড স্পীকার ফিট করা আছে। কিছু দেখতে পেলেন না। ভাল করে পারছেন না তো! মাইক্রোফোনের আওয়াজে আবার সেই কথাটা ভেসে এল। কাকাবাবু এবার উত্তর দিলেন, হু এভার ইউ আর-সামনে এসে কথা বলুন, আমি এখন পিস্তল ফেলব না। মাইক্রোফোনের আওয়াজটা থেমে গেল। হঠাৎ দারুণ স্তব্ধ মনে হল জায়গাটা। মুখোশপরা লোকটিকাকাবাবুর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোন দেশের লোক? লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে হাসল। কাকাবাবু বললেন, উত্তর না দিলে আমি গুলি করব? লোকটি তবু অবাধ্য ভঙ্গিতে ঝাঁকাল তার কাঁধ দুটো। এইসময় গটগট শব্দ হতেই কাকাবাবু চমকে তাকালেন। ঠিক একইরকম
false
shomresh
ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে ও আড়ষ্ট পা জোরে জোরে ফেলে বাড়িতে চলে এল। বাইরের দরজা বন্ধ। কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে এখন। সমস্ত শরীর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে অনিমেষ দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল। ভেতর থেকে সরিৎশেখরকে কে বলে চিৎকার করতে করতে এসে দরজা খুলতেই অনিমেষ তীরের মতো তার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। আচমকা ছেলেটাকে ছুটে যেতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন সরিৎশেখর, মেয়ে নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলেন, হেম, ও হেম, দ্যাখো অনিকে বোধহয় ওরা মেরেছে। ছেলেটা ছুটে গেল কেন, ও হেম! মহীতোষ অনেকদিন আগে স্বৰ্গছেঁড়া থেকে ভালো কালামোনিয়া চাল এনে দিয়েছিলেন। হেমলতা রান্নাঘরে বসে কুলোয় করে সেই চাল বাছছিলেন। প্রিয়তোষের জন্য আজ স্পেশাল ভাত। বাবার ডাকে তিনি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিলেন, কে মেরেছে, কে ছুটে গেল, ও বাবা, কার কথা বলছেন, ও বাবা! সরিৎশেখর ভেতরে এসে তেমনি গলায় বললেন, অনি ছুটে গেল, কোথায় গেল দ্যাখো, আঃ, আমি আর পারি না! সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা রান্নাঘরের বাইরে এসে চিৎকার করে অনিকে ডাকতে লাগলেন, ও অনি, অনিবাবা, তোকে মারল কে? এ-ঘর সে-ঘর উঠোন বাথরুম কোথাও না পেয়ে হেমলতা থমকে দাঁড়ালেন, ও বাবা, আপনি ঠিক দেখেছেন তো, অনি না অন্য কেউ! সরিৎশেখর বিরক্ত হয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, আঃ, আমি অনিকে চিনি না? কী জানি, ও হলে তো বাড়িতেই থাকত। মা-মরা ছেলেটাকে মারবেই-বা কেন? না, আপনাকে ঠিক বাহাতুরে ধরেছে, কী দেখতে কী দেখেছেন। পেছনে দাঁড়ানো বাবার দিকে চেয়ে হেমলতা এই প্রথম দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা যা তিনি কিছুদিন হল মনেমনে বিশ্বাস করছিলেন অর্কপটে ঘোষণা করলেন। সরিৎশেখর নিজের কানকে হেমলতার অভিযোগটা সত্যি হয়ে যাবে তিনি ভেবে রাখলেন যে মেয়েকে এই ব্যাপারে পরে আচ্ছা করে কথা। শোনাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে ছেলেটাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। পৃথিবীতে এর চেয়ে মূল্যবান আনন্দ আর কী থাকতে পারে? সমস্ত শরীরে অদ্ভুত তৃপ্তি, জমেথাকা ঘামগুলোয় বাতাস লেগে একটা শীতল আমেজ-অনিমেষ উঠোনের আর-এক প্রান্তের পুরনো পায়খানার দরজা খুলে বাইরে এল। প্যান্টের বোম আঁটতে আঁটতে ওর নজরে পড়ল, দুটো মুখ অপার বিস্ময় মুখচোখে এঁটে তার দিকে চেয়ে আছে। ওর চট করে মনে পড়ল যে, পায়খানায় ঢোকার সময় আজ একদম সময় ছিল না স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে যাবার। আক্রমণটা বোধহয় এদিক দিয়েই আসবে। অবশ্য নির্ভয় হতে-হতে ও দাদু পিসিমার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছিল না। হেমলতা প্রথম কথা বললেন, তুই! পায়খানায় গিয়েছিলি? খুব দ্রুত ঘাড় নাড়র অনিমেষ হুঁ। পেছন থেকে সরিৎশেখর হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, হবে না! দিনরাত গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছ, পেটের আর দোষ কী? হ্যাঁ, আমায় বাহাত্তরে ধরেছে, না? চোখে কম দেকি! দ্যাখো হেম, তোমার দিনদিন জিভ বেড়ে যাচ্ছে, যা নয় তা-ই বলছ। হবে না কেন, যেমন ভাই তেমনই তো বোন হবে! একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন হেমলতা, সত্যি সত্যি অনি এসেছে, বাবা ভুল দেখেননি। কিন্তু শেষ কথাটায় ওঁর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল, কী বললেন, যেমন ভাই নে বোন, না? তা আমরা কার ছেলেমেয়ে? আমি যদি না থাকতাম তবে এই শেষ বয়সে আপনাকে আর ভাত মুখে দিতে হত না! কী বললে! তুমি খাওয়া নিয়ে খোটা দিলে? সরিৎশেখর চিৎকার করে উঠলেন। আপনি কি কম দিচ্ছেন! আপনার কফ ফেলা থেকে শুরু করে কী না আমি করেছি! বিনা পয়সার চাকরানি। আর-কেউ এক বেলার বেশি আপনার সেবা করতে ঘেঁষত না। থাকত যদি সে-চট করে পালটে গেল হেমলতার গলার স্বর, আমার পোড়া কপাল যে! এবার সরিৎশেখর চাপা গলায় বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। অনিমেষ দাদু-পিসিমার এই রাগারাগি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। হঠাৎ দেখল পিসিমা তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছেন, কপালের আর দোষ কী! বাড়িসুদ্ধ সবাই উচ্ছন্নে গেলেও এই ছেলেটা আমার কথা শুনত। মাধুরী চলে যাবার পর বুকের আড়াল দিয়ে রাখলাম, সে এমন হেমস্তা করল আমাকে! সরিৎশেখর অবাক হয়ে বললেন, কী করল ও! অনিমেষ এতক্ষণ আক্রমণটাকে এভাবে আসতে দেকে দৌড়ে বাথরুমে যেতে-যেতে শুনল পিসিমা বলছেন, বাইরের জামাকাপড় পরে পায়খানায় ঢুকছে, সাহস দেখছেন! জামাকাপড় পালটে অনিমেষ বাইরে এসে দেখল সরিৎশেকর চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ওকে দেখে আঙুল তুলে কাছে ডাকলেন। দাদুর এরকম ভঙ্গি এর আগে দেখেনি ও কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি চলে গেছেন? কার কথা জিজ্ঞাসা করছেন বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের, সে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। কোথায় আছে জান? সরিৎশেখর চাপা গলায় প্রশ্ন করছিলেন। হুঁ! দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলা যায় না। কোথায়? বিরাম করে বাড়িতে। অনিমেষ এমন গলায় কথা বলল যেন তৃতীয় ব্যক্তি শুনতে না পায়। বিরাম কর! কংগ্রেসের বিরাম কর তোমাদের স্কুলের সামনে যার বাড়ি? হ্যাঁ। ওখানে সে কী করছে। সেই মুটকি মেয়েছেলেটার খপ্পরে পড়েছে নিশ্চয়ই। যাক, আমার কী! কিন্তু ওর সঙ্গে আলাপ হল কবে? নিজের মনেই সরিৎশেখর কথাগুলো বলছিলেন। মুটকি মেয়েছেলেটা! সামলাতে সময় লাগল অনিমেষের। দাদুর মুখে এ-ধরনের কথা এর আগে শোনেনি ও। আর খপ্পরে বললেন কেন, উনি কি রাক্ষুসী না ছেলেধরা যে তার খপ্পরে পড়েছে বলতে হবে! অনিমেষ নির্লিপ্ত হয়ে বলতে চেষ্টা করল, কাল এয়ারপোর্টে আলাপ হয়েছিল। ওঁরা কংগ্রেসের নেতা। কংগ্রেস! ওদের তুমি কংগ্রেসি বলছ চোরের আবার ভালো নাম! কংগ্রেসের নাম করে এখানে বসে রক্ত চুষে খাচ্ছে! কংগ্রেস যারা করতেন তারা স্বাধীনতার আগেই মারা গিয়েছেন।
false
humayun_ahmed
চেয়ারটি পাল্টে এই চেয়ারে বসেছেন? যাতে আমাকে এলোমেলো অবস্থায় দেখতে না হয়। আপনি কি ভাবছেন আপনার এই আচরণের কারণে আপনাকে আমি অতি ভদ্ৰ, অতি ভালো একজন মানুষ বলে ভাবছি? মোটেই না। আমি আপনাকে ভাবছি সাহস নেই একজন মানুষ হিসাবে। আপনার মতো সাহস নেই মানুষ যেমন আছে আবার খুব সাহসী মানুষও আছে। জহির ভাই, আপনি কি একজন সাহসী মানুষের গল্প শুনবেন? আজ বরং উঠি। আজ মনে হচ্ছে তোমার শরীরটা ভালো না। আজ আমার শরীর খুবই ভালো আছে। সাহসী মানুষের গল্পটা আপনাকে বলি, আপনি শুনুন। একদিন হল কি, ওরা কয়েকজন মিলে তাস খেলছে। আমি রান্নাঘরে ওদের জন্যে চা বানাতে গিয়েছি। তখন ওর এক বন্ধু এসে বলল, দিয়াশলাই দিন তো ভাবী। দিয়াশলাই দিলাম। সে সিগারেট ধরালো। তারপর বলল, ভাবী আপনার পেটে ঐটা কি কাটা দাগ? মাই গড! কী করে কাটল? বলেই নাভীর উপর হাত দিল। জহির স্তম্ভিত হয়ে বলল, তুমি কী করলে? আমি বললাম, আমার হার্টের কাছাকাছি এর চেয়েও গভীর একটি ক্ষতচিহ্ন আছে। একদিন আসবেন আপনাকে দেখাব। জহির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আজহার সাহেব ঢুকলেন। হাতে বাজারের ব্যাগ। বাজারের ব্যাগের ভেতর একটি ইলিশ মাছ উঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু আনাজপাতিও দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আরে জহির সাহেব আপনি! কখন এসেছেন? অনেকক্ষণ। বিয়ের খবর দিতে এসেছেন, তাই না? হ্যাঁ। অরুকে কি আপনার স্ত্রীর ছবি দেখিয়েছেন? অরু বিরক্ত গলায় বলল, জহির ভাই বুঝি স্ত্রীর ছবি নিয়ে ঘুরছেন। অফকোর্স, সমস্ত পুরুষ যখন বিয়ের দাওয়াত দিতে যায় তখন তাদের বুক। পকেটে থাকে স্ত্রীর ছবি। জহির সাহেব ছবি বের করুন। ওয়ান-টু-থ্রি। জহিরের মানুষটাকে পছন্দ হচ্ছে। এতক্ষণ অরুর সঙ্গে কথা বলে বুকের মধ্যে কেমন আতংক ধরে গিয়েছিল। এখন আর সেই আতংক সে বোধ করছে না। মনে হচ্ছে অরুত্র অনেক কথাই বানানো। মেয়েরা অনেক কিছু বানায়। অরুর মুখও কেমন হাসি-হাসি দেখাচ্ছে। আজহার বলল, কী ভাই ছবি দেখান। জহির ছবি বের করল। অরু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মেয়েটা কি সত্যি এত সুন্দর? আজহারের দিকে ছবিটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখ দেখ একটা পারফেক্ট ছবি। এ পারফেক্ট ফেস। আজহার দেখল। হাসতে-হাসতে বলল, হ্যাঁ পারফেক্ট ফেস তো বটেই তবে চিবুকের তিলটা আমার মনে হয় বানানো। যে ফটোগ্রাফারের দোকানে তোলা হয়েছে সেই ফটোগ্রাফার নিজেই এটা বসিয়ে দিয়েছে। যেখানে তিলটা প্রয়োজন প্রকৃতি বেছে-বেছে ঠিক সেইখানেই তিল দিয়েছে এটা বিশ্বাস করা শক্ত। যুক্তি শুনে জহির মুগ্ধ হয়ে গেল। আজহার সাহেব মানুষটাতো অসম্ভব বুদ্ধিমান। জহিরকে রাতের খাবার খেয়ে তারপর আসতে হল। আজহার সাহেব ছাড়লেন না। বললেন, আপনার বোনের রান্না যে কত খারাপ এটা টেস্ট না করে আপনাকে যেতে দেব না। খাওয়ার টেবিলে আজহার সাহেব মজার-মজার গল্প বলতে লাগলেন। একটি গল্প রামকৃষ্ণ পরমহংসের। বানর-শিশু এবং বিড়াল-শিশুর গল্প। জহিরের খুব ভালো লাগল। আহা এই মানুষটা কত কিছু জানে। অরু কি গল্প শুনেশুনেই লোকটির প্রেমে পড়েছিল? শুধুমাত্র গল্প বলেই কি কেউ কাউকে ভোলাতে পারে? নিশ্চয় পারে। না পারলে এই লোক কী করে ভোলালো? আধুবুড়ো একজন মানুষ। চুলে পাক ধরেছে। একটি চোখ ছোট আর একটি চোখ বড়। ঠোঁট দুটি ভারি। দাঁত অসমান। কিন্তু কথা যখন বলেন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কত রকম ক্ষমতাই না মানুষের থাকে। জহির সাহেব। জ্বি। অরুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনার জীবনের দুটি নাকি উদ্দেশ্য? জহির অবাক হয়ে তাকাল। এ রকম কথা সে কখনো শোনে নি। আজহার সাহেব বললেন, শুনলাম প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের সেবা করা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল অন্যের কাছ থেকে কোনো সেবা না নেয়া। এই যে এখন বিয়ে করছেন। আপনি কি আপনার স্ত্রীর কাছে থেকে কোনো সেবা নেবেন না? অরু বিরক্ত গলায় বলল, খামাখা বক-বক করবে না। কথা বলার জন্যেই শুধু কথা বলা এটা আমার খুব অপছন্দ। সরি। আচ্ছা জহির সাহেব? জ্বি। আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি? জ্বি করুন। মজার ধাঁধা। এ দেশেরই একজন নৃপতির নাম বলুন যিনি সিংহাসনে বসেই হুকুম দিয়েছিলেন– যার গায়ে সামান্যতম রাজরক্ত আছে তাকে যেন হত্যা করা হয়। তিনি এটা করতে চাইলেন নিষ্কণ্টক করার জন্যে। তাঁর হুকুম অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা হল। রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেল। রাজা তখন প্রধান সেনাপতিকে বললেন, এমন কেউ কি আছে এখনো যার দেহে রাজরক্ত প্রবাহিত? প্রধান সেনাপতি বললেন–আপনার নিজের গায়ে রাজরক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, কাজেই আমি আপনার হুকুম মতোই আপনাকেও হত্যা করব। এই কাজেই এসেছি–বলেই প্রধান সেনাপতি রাজাকে হত্যা করলেন এবং যোষণা করলেন পৃথিবীতে আর রাজরক্ত বলে কিছু নেই। এখন জহির সাহেব আপনি বলুন ঐ রাজার নাম কি? এবং ঐ সেনাপতির নামইবা কি? আমি জানি না। এ রকম অদ্ভুত গল্প আমি আজ প্রথম শুনলাম। রাজার নাম কি? তা বলব না। আপনি খুঁজে বের করুন। এ রকম মজার মজার গল্প বলে আমি মানুষকে ইতিহাসের দিকে আকৃষ্ট করি। আমার টেকনিকটা চমৎকার না? জ্বি চমৎকার। খাওয়াদাওয়ার পর আজহার জহিরকে নামিয়ে দিতে চললেন। সাততলা ভেঙে নিচে নামার কোন দরকার নেই তবু তিনি যাবেনই। অরু বলল, জহির ভাই ওকে আপনার সঙ্গে যেতে দিনও সম্ভবত আপনাকে কিছু বলতে চায়। নয়ত ওর মতো অলস লোক সিঁড়ি ভাঙত না। রাস্তায় নেমে আজহার বলল, সিগারেট খাবেন জহির সাহেব? যদি খেতে চান দুটি সিগারেট
false
shordindu
কিছু বলিলেন। মণিপদ্ম গভীর শ্রদ্ধায় নত হইয়া তাঁহার কথা শুনিল, তারপর বজ্রের কাছে আসিয়া বলিল— ভদ্র, আসুন আমার সঙ্গে। মণিপদ্ম প্রথমে বজ্রকে গঙ্গার তীরে লইয়া গেল। বিস্তীর্ণ ঘাটে রাত্রির ছায়া নামিয়াছে, জলের উপর ধূসর আলোর স্লান প্রতিফলন। ঘাটের পৈঠাগুলির উপর পরিক্রমণরত ভিক্ষু শ্রমণের নিঃশব্দ ছায়ামূর্তি। কেহ কাহারও সহিত কথা বলিতেছে না, ক্ষণেকের জন্য গতি বিলম্বিত করিতেছে না, যন্ত্রচালিত পুত্তলিকার ন্যায় ঘাটের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পদচারণা করিতেছে। দৃষ্টি ভূমিনিবদ্ধ, বক্ষ বাহুবদ্ধ। এমন প্রায় তিন চারিশত শ্ৰমণ। বজ্র দেখিল, সংঘ নিতান্ত জনহীন নয়। ঘাটে হস্ত মুখ প্রক্ষালনের পর বজ্রকে লইয়া মণিপদ্ম এক প্রকোষ্ঠে উপনীত হইল। ইতিমধ্যে প্রকোষ্ঠগুলিতে দীপ জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, কয়েকজন শ্ৰমণ বর্তিকাহস্তে দ্বারে দ্বারে দীপ জ্বালাইয়া ফিরিতেছে। মণিপদ্ম প্রকোষ্ঠে দীপ জ্বালিয়া একপাশে রাখিল, বলিল— আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আপনার আহার্য নিয়ে আসি। মণিপদ্ম চলিয়া গেল, বজ্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া রহিল। ক্রমে আশেপাশের পরিবেণগুলিতেও জনসমাগম হইতে লাগিল। ভিক্ষুরা সান্ধ্যকৃত্য সমাপন করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু কোথাও চঞ্চলতার আভাস নাই। অল্প আলোকে ছায়ার ন্যায় সঞ্চরমাণ মানুষগুলি; কদাচিৎ নিম্নস্বর বাক্যালাপের গুঞ্জন; যেন ভৌতিক লোকের অবাস্তব পরিমণ্ডল। তারপর গন্ধকুটি হইতে মধুর-স্বনে ঘণ্টিকা বাজিতে লাগিল। ভিক্ষুগণ স্ব স্ব কক্ষ ছাড়িয়া সেইদিকে যাত্রা করিলেন। সেখানে ভগবান তথাগতের পূজার্চনা হইবে, তারপর ভিক্ষুদের নৈশ ভোজন। পূজার্চনার ঘণ্টিকা নীরব হইবার কিয়ৎকাল পরে মণিপদ্ম বজ্রের আহার্য লইয়া উপস্থিত হইল। আহার্যের মধ্যে ঘৃতপক্ক তণ্ডুল ও গোধূমের একটা পিণ্ড এবং ফলমূল; কিন্তু পরিমাণে প্রচুর। বজ্র আহারে বসিল; মণিপদ্ম সম্মুখে নতজানু হইয়া পরিবেশন করিল। শ্ৰমণ মণিপদ্ম বজ্রেরই সমবয়স্ক। সুশ্রী ক্ষীণাঙ্গ প্রফুল্ল-মুখ যুবক; মুণ্ডিত মস্তক ও পীত বস্ত্র তাহার মনের সরসতা মুছিয়া ফেলিতে পারে নাই। তাহার বৈরাগ্য সহজ আনন্দেরই রূপান্তর। বজ্ৰ আহার করিতে করিতে তাহার সহিত দুই চারিটি বাক্যালাপ করিল; দেখিল মণিপদ্মের বুদ্ধিদীপ্ত মনে কোনও কৌতূহল নাই, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নাই; সকলের আজ্ঞাধীন হইয়া অন্যের সেবা করাই তাহার আনন্দময় স্বধর্ম। আহার সমাধা হইলে মণিপদ্ম বলিল— ভদ্র, একটি অনুরোধ আছে। যদি ক্লেশ না হয়, আর্য শীলভদ্র আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। বজ্ৰ বলিল—ক্লেশ কিসের? কিন্তু আর্য শীলভদ্র কে? মণিপদ্ম বলিল—সদ্ধর্মভাণ্ডার আর্য শীলভদ্রের নাম শোনেন নি? বজ্র মাথা নাড়িল—না। কে তিনি? মণিপদ্ম বিস্ময়াহতভাবে চাহিয়া রহিল। শীলভদ্রের নাম জানে না এমন মানুষ আছে? যাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিবার আশায় সুদূর চীনদেশ হইতে গুণগ্রাহীরা ছুটিয়া আসে, দেশের লোক সেই শীলভদ্রের নাম জানে না! শেষে মণিপদ্ম বলিল আমার ধারণা ছিল শীলভদ্রের নাম সকলেই জানে। তিনি নালন্দা বিহারের মহাধ্যক্ষ; তাঁহার মত জ্ঞানী পৃথিবীতে নেই। বজ্র দীনকণ্ঠে বলিল— ভাই, আমি গ্রামের ছেলে, পৃথিবীর কিছুই জানি না। আর্য শীলভদ্র আমার সঙ্গে দেখা করতে চান কেন? তা জানি না। তিনি আদেশ করেছেন, যদি আপনার ক্লেশ না হয়, আহারের পর আপনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। আমি প্রস্তুত। আজ সন্ধ্যাবেলা যে দুটি বৃদ্ধকে দেখলাম, ইনি কি তাঁদেরই একজন? হাঁ। যিনি শীর্ণকায় অশীতিপর বৃদ্ধ তিনি। আর অন্যটি? তিনি এই রক্তমৃত্তিকা বিহারের মহাস্থবির। অতঃপর মণিপদ্ম বজ্ৰকে লইয়া কক্ষ হইতে বাহির হইল। গন্ধকুটির নিম্নতলে এক কোণে একটি প্রকোষ্ঠে শীলভদ্র বসিয়া আছেন। কক্ষটি সাধারণ পরিবেণের মতই ক্ষুদ্র ও নিরাভরণ। শীলভদ্র দীপের সম্মুখে বসিয়া একটি তালপত্রের পুঁথি দেখিতেছিলেন; অশীতি বৎসর বয়সেও তাঁহার চোখের জ্যোতি ম্লান হয় নাই। বজ্র ও মণিপদ্ম তাঁহার দ্বারপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলে তিনি মণিপদ্মকে বলিলেন—মণিপদ্ম, তুমি এবার আহার কর গিয়ে। আজ রাত্রে তোমার সেবার আর প্রয়োজন নেই বৎস। মণিপদ্ম হাসিমুখে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। শীলভদ্র বজ্রকে বলিলেন— এস, উপবেশন কর। বজ্র আসিয়া শীলভদ্রের সম্মুখে এক পীঠিকায় বসিল। শীলভদ্র পুঁথি বন্ধ করিয়া সূত্ৰ দিয়া বাঁধিতে বাঁধিতে বজ্রকে নিরীক্ষণ করিলেন, তাহার বাহুতে অঙ্গদ দেখিলেন, তারপর বলিলেন—তোমার নাম কি বৎস? বজ্ৰ বলিল—আমার নাম বজ্রদেব। শীলভদ্র তখন ধীরস্বরে বলিলেন—আমি তোমাকে দু একটি প্রশ্ন করব, ইচ্ছ না হয় উত্তর দিও না। আজ সন্ধ্যায় তোমাকে দেখে অনেক দিনের পুরানো কথা মনে পড়ে গেল, তাই তোমাকে ডেকেছি। আমার পরিচয় বোধহয় শুনেছ। আমি শীলভদ্র, নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ, প্রাচীমণ্ডলের বিহারগুলি পরিদর্শনের জন্য বেরিয়েছি; এখান থেকে সমতট যাব। সমতট আমার জন্মস্থান। (শীলভদ্র সমতটের এক ব্রাহ্মণ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।) মৃত্যুর পূর্বে একবার জন্মভূমি দেখবার ইচ্ছা হয়েছে। তারপর, যদি বুদ্ধের ইচ্ছা হয়, আবার এই পথে নালন্দায় ফিরে যাব। শীলভদ্র একটু হাসিয়া নীরব হইলেন; যেন নিজের পরিচয় দিয়া বর্জকেও পরিচয় দিবার জন্য আহ্বান করিলেন। বজ্র তাঁহার শান্ত মুখের পানে চাহিয়া অনুভব করিল ইনি সাধারণ কৌতূহলী মানুষ নয়, অন্য স্তরের মানুষ। চাতক ঠাকুরের সহিত ইহার আকৃতির কোনই সাদৃশ্য নাই, কিন্তু তবু যেন কোথায় মিল আছে। বজ্ৰ স্থির করিল ইহার কাছে কোনও কথা গোপন করিবে না। সে বলিল— আপনি প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দেব। শীলভদ্র তাহার মুখভাব লক্ষ্য করিতেছিলেন, বলিলেন— তুমি বুদ্ধিমান। তোমার পিতার নাম কি? আমার পিতার নাম শ্রীমানবদেব। স্মিতহাস্যে শীলভদ্রের চক্ষুপ্রান্ত কুঞ্চিত হইল; তিনি বলিলেন—আমার অনুমান মিথ্যা নয়। তুমি মানবদেবের পুত্র, শশাঙ্কদেবের পৌত্র। ত্রিশ বছর আগে তোমার পিতাকে আমি দেখেছিলাম। তখন তাঁর বয়স ছিল তোমারই মত। বজ্র ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিল—আমার পিতা কোথায়? তিনি কি এখন গৌড়ের রাজা নয়? শীলভদ্র করুণনেত্রে চাহিয়া বলিলেন— না। কিন্তু আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব। শীলভদ্রের প্রশ্নের উত্তরে বজ্র নিজ জন্ম ও জীবন-কথা,
false
humayun_ahmed
আনবেন। এই ব্যবসা করব না বউ। যারা ঘোড়ার মাল টানাটানি করে তারার স্বভাব হয় ঘোড়ার মতো। ঘোড়া হওয়ার ইচ্ছা নাই। নিবারণ চক্রবর্তীর কাছে গিয়া তার পায়ে উপুড় হইয়া পইড়া দেখবেন। পুরান চাকরি যদি ফেরত পান। ধনু শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, লাভ নাই। উনার নতুন টিকেট বাবু কাজ ভালো জানে। তার জায়গায় আমারে দিবে না। এখন উপায়? তাই ভাবতেছি। অতিদ্রুত অবস্থা এমন পর্যায়ে গেল যে চাল ডাল কেনার টাকায় টান পড়ল। এর মধ্যে আরেক বিপদ কমলা গৰ্ভবতী। তার সারাক্ষণ ভুখ লাগে। এটা সেটা খেতে ইচ্ছা করে। একদিন অর্ধেকটা মিষ্টি কুমড়া কাঁচা খেয়ে ফেলল। ধনু শেখ বলল, বৌ, তোমারে তোমার মায়ের কাছে পাঠায়া দেই? কমলা বলল, আপনেরে এতবড় বিপদে ফেইলা আমি বেহেশতেও যাব না। তাছাড়া আমার মা’র নিজেরই খাওন জুটে না। আমার কাছে স্বর্ণের একটা চেইন আছে। এইটা বিক্রি করেন। ধনু শেখ স্বর্ণের চেইন বিক্রি করতে পারল না। বাজারের একমাত্র স্বর্ণকারের দোকানের মালিক শ্ৰীধর বলল, এর মধ্যে সোনা বলতে কিছু নাই। সবই ক্ষয়া গেছে। ধনু শেখ বলল, কর্তা! না খায়া আছি। স্ত্রীর সন্তান হবে। শ্ৰী ধর বলল, তোমার সাথে বাণিজ্য করব না। তুমি জাত নিয়া অন্দ মন্দ কথা বলো। তোমার সাথে বাণিজ্য করলে শ্ৰী গণেশ বোজার হবেন। দোকান লাটে উঠব। আমিও তোমার মতো না খায়া থাকব। বন্দক রাইখা কিছু দেন। বন্দক রাখতে হয়। ভগবানের নামে, তোমার আবার ভগবান কী? ধনু শেখ বলল, তাও তো কথা। ভাদ্র মাসের একদিন ধনু শেখকে সত্যি সত্যি উপাসে যেতে হলো। সারাদিনে দুই মুঠ চিড়া ছাড়া খাওয়ার নেই। তাও ভালো কমলা খেতে পেরেছে। চাল যা ছিল তাতে একজনের মতো ভাত হয়েছে। ফ্যান ভাতে লবণ ছিটিয়ে কমলা এত আগ্রহ করে খেল যে ধনু শেখের চোখে পানি এসে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল, বউ, একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কমলা আগ্রহ নিয়ে বলল, কী সিদ্ধান্ত? ডাকাতি করব। ডাকাতি বিনা পথ নাই। কমলা হাসতে শুরু করেই হাসি বন্ধ করে ফেলল। ধনু শেখের মুখ গম্ভীর। চোখ জ্বল জ্বল করছে। ডাকাতি করবেন? হুঁ। ডাকাইতের দল থাকে। আপনের দল কই? দল লাগে না। কমলা বলল, আমার সন্তানের কসম দিয়া একটা কথা বলি। ধনু শেখ কিছু বলল না। আপনি সত্যই ডাকাতি করবেন? হুঁ। এই সময় ঘাট থেকে কেউ একজন ডাকল, এটা কি ধনু শেখের নাও? ধনু নৌকা থেকে বের হয়ে দেখে হরিচরণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ধনু বলল, বাবু আদাব। আদাব। তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে আসছি। নায়ে উঠি? উঠেন। আমার সাথে কী গফ করবেন? আমি একজন ছলু। জুতার শুকতলি। হরিচরণ নৌকায় উঠলেন। ধনু শেখ পাটাতনে গামছা বিছিয়ে দিল। হরিচরণ বসতে বসতে বললেন, কুকুরের বাচ্চা এবং মানুষের বাচ্চা নিয়া তুমি যে এক মীমাংসা দিয়েছ, মীমাংসাটা আমার মনে লেগেছে। মীমাংসার উত্তর কি আপনের কাছে আছে? আছে। বলেন শুনি। হরিচরণ বললেন, মানুষের তুলনা মানুষের সাথে হবে। অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে হবে না। একটা মন্দ মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মন্দ মানুষের বিবেচনা হবে। কোনো মন্দ প্রাণীর সঙ্গে হবে না। বুঝেছ? বোঝার চেষ্টা নিতেছি। হরিচরণ বললেন, আরো একটা কথা আছে। বলেন শুনি। মানুষের তুলনায় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তুচ্ছের তুচ্ছের তুচ্ছ। ধুলিকনার চেয়েও তুচ্ছ। ধুলিকন গায়ে তুললেও কিছু না, গা থেকে ফেলে দিলেও কিছু क†। ধনু বলল, আপনি জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের জ্ঞানী কথা। আমি তুচ্ছ, তুচ্ছের কথাও তুচ্ছ। শুনেছি তুমি দুদৰ্শায় পড়েছ। তোমার চাকরি চলে গেছে। আমার কাছ থেকে সাহায্য নিবে? ধনু বলল, কী সাহায্য করবেন? কী ধরনের সাহায্য তুমি চাও? ধনু বিরক্ত গলায় বলল, পারলে একটা লঞ্চ কিন্যা দেন। সোহাগগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ রুটে চলবে। লঞ্চের নাম এমএল কমলা। কমলা কে? আমার পরিবারের নাম। হরিচরণ বললেন, আমি তোমাকে লঞ্চ কিনে দিব। তুমি লঞ্চ ব্যবসার সঙ্গে অনেকদিন ছিলে। এই ব্যবসা তুমি জানো। তোমার বুদ্ধি আছে। চিন্তাশক্তি আছে। তুমি পারবে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। না বুঝে কিছু করি না। হতভম্ব, ধনু শেখ বলল, সত্যি লঞ্চ কিনে দিবেন? হ্যাঁ। লা ইলাহা ইল্লালাহু। এইগুলা কী বলেন? পর্দার আড়াল থেকে কমলা মুখ বের করেছে। সে মনের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। হরিচরণ বললেন, মা, ভালো আছো? কমলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার মুখে কথা আটকে গেছে। ধনু শেখ বলল, আমার কেমন জানি লাগতেছে। শরীর দিয়া গরম ভাপ বাইর হইতেছে। আপনে কিছু মনে নিবেন না। আমি নদীতে একটা ঝাঁপ দিব। ধনু শেখ ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল। জমিদার বাবু শশাংক পাল পরের বছরের সদর জমা দিতে পারলেন না। তাঁর জমিদারি বসতবাটিসহ নিলামে উঠল। হরিচরণ সাহা নগদ অর্থে সেই জমিদারি কিনে নিলেন। এক সন্ধ্যায় দুটা হাতি নিয়ে কালু মিয়া হরিচরণের বাড়িতে উপস্থিত হলো। হরিচরণ বললেন, কালু, ভালো আছ? কালু মিয়া বলল, কর্তা, আপনে আপনের বেটির কাছে গিয়া দাঁড়ান। দেখেন আপনের বেটি আপনেরে মনে রেখেছে। হরিচরণ হাতির পাশে দাঁড়াতেই হাতি তার ঘাড়ে গুড় তুলে দিল। হরিচরণের চোখ ভিজে উঠল। এই অঞ্চলের প্রথম স্কুল (পরে কলেজ) হলো জমিদার বাবু শশাংক পালের বসত বাড়ি। হরিচরণের নাম হলো ঋষি হরিচরণ। তিনি তার জীবনযাত্ৰা পদ্ধতিও সম্পূর্ণ বদলে ফেললেন। একবেলা স্বপাক নিরামিষ আহার। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পূজার ঘরে চোখ বন্ধ করে আসন। বিলাস তাঁর জীবনে আগেও
false
robindronath
মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই। আমরা সেই খৃস্টানদের কাছ থেকেই পাঠ নিয়েছি, তাই হিন্দুধর্মের বৈচিত্র৻ের জন্য লজ্জা পাই। এই বৈচিত্র৻ের ভিতর দিয়েই হিন্দুধর্ম যে এককে দেখবার জন্যে সাধনা করছে সেটা আমরা দেখতে পাই নে। এই খৃস্টানি শিক্ষার পাক মনে চারি দিক থেকে খুলে ফেলে মুক্তিলাভ না করলে আমরা হিন্দুধর্মের সত্যপরিচয় পেয়ে গৌরবের অধিকারী হব না।” কেবল গোরার কথা শোনা নহে, সুচরিতা যেন গোরার কথা সম্মুখে দেখিতেছিল, গোরার চোখের মধ্যে দূর-ভবিষ্যৎ-নিবন্ধ যে-একটি ধ্যানদৃষ্টি ছিল সেই দৃষ্টি এবং বাক্য সুচরিতার কাছে এক হইয়া দেখা দিল। লজ্জা ভুলিয়া, আপনাকে ভুলিয়া, ভাবের উৎসাহে উদ্দীপ্ত গোরার মুখের দিকে সুচরিতা চোখ তুলিয়া চাহিয়া রহিল। এই মুখের মধ্যে সুচরিতা এমন একটি শক্তি দেখিল যে শক্তি পৃথিবীতে বড়ো বড়ো সংকল্পকে যেন যোগবলে সত্য করিয়া তোলে। সুচরিতা তাহার সমাজের অনেক বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকের কাছে অনেক তত্ত্বালোচনা শুনিয়াছে, কিন্তু গোরার এ তো আলোচনা নহে, এ যেন সৃষ্টি। ইহা এমন একটা প্রত্যক্ষ ব্যাপার যাহা এক কালে সমস্ত শরীর মনকে অধিকার করিয়া বসে। সুচরিতা আজ বজ্রপাণি ইন্দ্রকে দেখিতেছিল–বাক্য যখন প্রবলমন্দ্রে কর্ণে আঘাত করিয়া তাহার বক্ষঃকপাটকে স্পন্দিত করিতেছিল সেইসঙ্গে বিদ্যুতের তীব্রচ্ছটা তাহার রক্তের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে নৃত্য করিয়া উঠিতেছিল। গোরার মতের সঙ্গে তাহার মতের কোথায় কী পরিমাণ মিল আছে বা মিল নাই তাহা স্পষ্ট করিয়া দেখিবার শক্তি সুচরিতার রহিল না। এমন সময় সতীশ ঘরে প্রবেশ করিল। গোরাকে সে ভয় করিত–তাই তাহাকে এড়াইয়া সে তাহার দিদির পাশ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল এবং আস্তে আস্তে বলিল, “পানুবাবু এসেছেন।” সুচরিতা চমকিয়া উঠিল–তাহাকে কে যেন মারিল। পানুবাবুর আসাটাকে সে কোনোপ্রকারে ঠেলিয়া, সরাইয়া, চাপা দিয়া একেবারে বিলুপ্ত করিয়া দিতে পারিলে বাঁচে এমনি তাহার অবস্থা হইল। সতীশের মৃদু কণ্ঠস্বর গোরা শুনিতে পায় নাই মনে করিয়া সুচরিতা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। সে একেবারে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া হারানবাবুর সম্মুখে উপস্থিত হইয়াই কহিল, “আমাকে মাপ করবেন–আজ আপনার সঙ্গে কথাবার্তার সুবিধা হবে না।” হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন সুবিধা হবে না?” সুচরিতা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়া কহিল, “কাল সকালে আপনি যদি বাবার ওখানে আসেন তা হলে আমার সঙ্গে দেখা হবে।” হারানবাবু কহিলেন, “আজ বুঝি তোমার ঘরে লোক আছে?” এ প্রশ্নও এড়াইয়া সুচরিতা কহিল, “আজ আমার অবসর হবে না, আজ আপনি দয়া করে মাপ করবেন।” হারানবাবু কহিলেন, “কিন্তু রাস্তা থেকে গৌরমোহনবাবুর গলার স্বর শুনলুম যে, তিনি আছেন বুঝি?” এ প্রশ্নকে সুচরিতা আর চাপা দিতে পারিল না, মুখ লাল করিয়া বলিল, “হাঁ, আছেন।” হারানবাবু কহিলেন, “ভালোই হয়েছে তাঁর সঙ্গে আমার কথা ছিল। তোমার হাতে যদি বিশেষ কোনো কাজ থাকে তা হলে আমি ততক্ষণ গৌরমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ করব।” বলিয়া সুচরিতার কাছ হইতে কোনো সম্মতির প্রতীক্ষা না করিয়া তিনি সিঁড়ি দিয়া উঠিতে লাগিলেন। সুচরিতা পার্শ্ববর্তী হারানবাবুর প্রতি কোনো লক্ষ না করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া গোরাকে কহিল, “মাসি আপনার জন্যে খাবার তৈরি করতে গেছেন, আমি তাঁকে এক বার দেখে আসি।” এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল এবং হারানবাবু গম্ভীর মুখে একটা চৌকি অধিকার করিয়া বসিলেন। হারানবাবু কহিলেন, “কিছু রোগা দেখছি যেন।” গোরা কহিল, “আজ্ঞা হাঁ, কিছুদিন রোগা হবার চিকিৎসাই চলছিল।” হারানবাবু কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ করিয়া কহিলেন, “তাই তো, আপনাকে খুব কষ্ট পেতে হয়েছে।” গোরা কহিল, “যেরকম আশা করা যায় তার চেয়ে বেশি কিছুই নয়।” হারানবাবু কহিলেন, “বিনয়বাবু সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে। আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আগামী রবিবারে ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেবার জন্যে তিনি আয়োজন করেছেন।” গোরা কহিল, “না, আমি শুনি নি।” হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার এতে সম্মতি আছে?” গোরা কহিল, “বিনয় তো আমার সম্মতি চায় নি।” হারানবাবু কহিলেন, “আপনি কি মনে করেন বিনয়বাবু যথার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে এই দীক্ষা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছেন?” গোরা কহিল, “যখন তিনি দীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন তখন আপনার এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।” হারানবাবু কহিলেন, “প্রবৃত্তি যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন আমরা কী বিশ্বাস করি আর কী করি নে তা চিন্তা করে দেখবার অবসর পাই নে। আপনি তো মানবচরিত্র জানেন।” গোরা কহিল, “না। মানবচরিত্র নিয়ে আমি অনাবশ্যক আলোচনা করি নে।” হারানবাবু কহিলেন, “আপনার সঙ্গে আমার মতের এবং সমাজের মিল নেই, কিন্তু আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি নিশ্চয় জানি আপনার যা বিশ্বাস, সেটা সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, কোনো প্রলোভনে তার থেকে আপনাকে টলাতে পারবে না। কিন্তু–” গোরা বাধা দিয়া কহিল, “আমার প্রতি আপনার ঐ-যে একটুখানি শ্রদ্ধা বাঁচিয়ে রেখেছেন তার এমনি কী মূল্য যে তার থেকে বঞ্চিত হওয়া বিনয়ের পক্ষে ভারি একটা ক্ষতি! সংসারে ভালো মন্দ বলে জিনিস অবশ্যই আছে, কিন্তু আপনার শ্রদ্ধা ও অশ্রদ্ধার দ্বারা যদি তার মূল্য নিরূপণ করেন তো করুন, তবে কিনা পৃথিবীর লোককে সেটা গ্রহণ করতে বলবেন না।” হারানবাবু কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, ও কথাটার মীমাংসা এখন না হলেও চলবে। কিন্তু আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, বিনয় যে পরেশবাবুর ঘরে বিবাহ করবার চেষ্টা করছেন আপনি কি তাতে বাধা দেবেন না?” গোরা লাল হইয়া উঠিয়া কহিল, “হারানবাবু, বিনয়ের সম্বন্ধে এ-সমস্ত আলোচনা কি আমি আপনার সঙ্গে করতে পারি? আপনি সর্বদাই যখন মানবচরিত্র নিয়ে আছেন তখন এটাও আপনার বোঝা উচিত ছিল যে, বিনয় আমার বন্ধু এবং সে আপনার বন্ধু নয়।” হারানবাবু কহিলেন, “এই ব্যাপারের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগ
false
humayun_ahmed
স্বরে বলল, বাবা আমি কি তোমার সঙ্গে আসব? আয়। আসবি না কেন? পরিচয় করিয়ে দিব। উনি আবার রাগ করবেন না তো? রাগ করবেন কেন? রাগ ঘৃণা এইসব হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষের ব্যাপার। উনারাতো সাধারণ মানুষ না। এই যে সন্ধ্যাবেলায় এসে বারান্দায় বসেছেন–এখনো গিয়ে দেখবি সেই একইভাবে বসে আছেন। মনে হয় খুব অলস ধরনের মানুষ। অলস ধরনের মানুষ এইভাবে বসে থাকে না। শুয়ে ঘুমায়। বাবা, আমি কি এই কাপড়টা পরে যাব না বদলাব? বদলে ভাল শাড়ি পর। হাত মুখটা ধুয়ে নে। উনি আবার ভাববেন নাতো যে উনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে, শাড়ি বদলে সেজেগুজে গেছি। কিছুই ভাববেন না। এই ধরনের মানুষ–কে কি পরল, না পরল, কে সাজল কে সাজল না এইসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। তাদের অনেক বড়। ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হয়। ছোট ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার সময়ই তাদের নেই। কিন্তু বাবা উনিতো ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিকরা নিশ্চয়ই এইসব ব্যাপার খুব খুঁটিয়ে দেখেন। না দেখলে লিখবেন কি করে? সেটাও একটা কথা। তাহলে থাক, কাপড় পাল্টানোর দরকার নেই। না বাবা কাপড় পাল্টে যাই। আমাকে দশ মিনিট সময় দাও বাবা, গোসল করে ফেলি। জ্বর গায়ে গোসল করবি? রান্না বান্না করেছি। গা কুট কুট করছে। আবার তো সব ঠাণ্ডা হবে। আবার গরম করব। বাবা, আরেকটা কথা, আমি কি উনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করব? শওকত সাহেব বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকেছেন। সুটকেস খুলে দেখছেন বেনু জিনিসপত্র কি দিয়ে দিয়েছে। এক গাদা বই থাকবে বলাই বাহুল্য। ঢাকায় বই পড়ার সময় তেমন হয় না। বাইরে এলে বই পড়ে প্রচুর সময় কাটান। রে তার নিজের পছন্দের বই এক গাদা দিয়ে দেয়। তার মধ্যে মজার মজার কিছু বই থাকে। যেমন এবারের বইগুলির মধ্যে একটা হল–অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ। গ্রন্থ পরিচয়ে লেখা–আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। এই বই দেয়ার মানে কি? রে কি তাকে আয়ুর্বেদে পণ্ডিত বানাতে চায়? তিনি কয়েক পাতা ওল্টালেন। বিচিত্র সব কথাবার্তা বইটিতে লেখা– পান খাওয়ার নিয়ম ঃ পূর্বাহ্নে সুপারি অধিক দিয়া, মধ্যাহ্নে খয়ের অধিক দিয়া ও রাত্রে চূন অধিক দিয়া পান খাইতে হয়। পানের অগ্রভাগ, মূলভাগ, ও মধ্যভাগ বাদ দিয়া পান খাইতে হয়। পানের মূল ভাগ খাইলে ব্যাধি, মধ্যভাগে আয়ুক্ষয় এবং অগ্রভাগ খাইলে পাপ হয়। পানের প্রথম পিক বিষতুল্য, দ্বিতীয় পিক দুর্জর, তৃতীয় পিক সুধাতুল্য উহা খাওয়া উচিত। স্যার আসব? শওকত সাহেব তাকিয়ে দেখেন করিম সাহেব তার মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। দুজনের হাতে দুটি ট্রে। রাতের খাবার। পেছনে পেছনে আরেকজন আসছে। তার হাতে, পানির জগ, গ্লাস, চিলুমচি। করিম সাহেব বললেন, স্যার আমার মেয়ে–পুষ্প। আমার একটাই মেয়ে। ময়মনসিংহে থাকে। হোস্টেলে থেকে পড়ে। এইবার আই—এ দেবে। পরীক্ষার ছুটি দিয়েছে। ও ভেবেছিল হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। আমি বললাম, মা চলে আয়। একা একা থাকি। সে চলে এসেছে। চলে আসায় খুবই ক্ষতি হয়েছে। ঘর সংসার সবই এখন তার দেখতে হয়। এখন ভাবছি হোস্টেলে দিয়ে আসব। পুষ্প মেঝেতে ট্রে রেখে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। শওকত সাহেব খানিকটা বিব্রত বোধ করলেন। কদম্বুসি করলে মাথায় হাত দিয়ে আশীবাদের কিছু কথা বলার নিয়ম আছে। তিনি কখনো তা পারেন না। পুষ্প বলল, স্যার আপনার শরীর কেমন? মেয়েও বাবার মতই তাঁকে স্যার ডাকছে। প্রশ্ন করেছে বোকার মত। তিনি যদি এখন–শরীর ভাল, না বলে বলেন–শরীর খুবই খারাপ তাহলেই মেয়েটি হকচকিয়ে যাবে। পরের কথাটা কি বলবে ভেবে পাবে না। তিনি তাকিয়ে আছেন পুষ্পের দিকে। মেয়েটিকে অস্বাভাবিক রকমের স্নিগ্ধ লাগছে। স্নান করার পর পর ক্ষণস্থায়ী যে স্নিগ্ধতা চোখে মুখে ছড়িয়ে থাকে সেই স্নিগ্ধতা। মেয়েটি কি এখানে আসার আগে স্নান করেছে। সম্ভবত করেছে। চুল আদ্র ভাব। মেয়েটির গায়ের রঙ অতিরিক্ত ফর্সা। শুধুমাত্র ফর্সা রঙের কারণে এই মেয়েটির ভাল বিয়ে হবে। মেয়েটার মুখ গোলাকার। মুখটা একটু লম্বাটে হলে ভাল হত। একে কি রূপবতী বলা যাবে? হুঁহ্যাঁ যাবে। মেয়েটি রূপবতী তবে আকর্ষণীয় নয়। রূপবতীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। যারা আকর্ষণীয়া তারা নিজেদের দিকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করে। মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, ওর নাম স্যার আসলে পুষ্প না। ওর ভাল নাম নাজনীন। আমরা ডাকতাম নাজু। একদিন ওর বড় মামা এসে বললেন, নাজু, ফাজু আবার কি রকম নাম। এত সুন্দর মেয়ে–এর নাম হল পুষ্প। সেই থেকে পুষ্প নাম। শওকত সাহেব কেন জানি বিরক্তি বোধ করছেন। পিতা এবং কন্যা আগ্রহ নিয়ে তার সামনে বসে আছে। এরা তার কাছ থেকে মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার মত কিছু শুনতে চায়। এমন কিছু যা অন্য দশজন শুনাবে না, তিনিই বলবেন। এক ধরনের অভিনয় করতে হবে। অন্যদের থেকে আলাদা হবার অভিনয়। আশে পাশের মানুষদের চমৎকৃত করতে হবে। পৃথিবীর সব বড় মানুষরাই গ্রহের মত। তাদের আশে পাশে যারা আসবে তারাই উপগ্রহ হয়ে গ্রহের চারপাশে পাক খেতে হবে। কোন মানে হয় না। মেয়েটা এসেছে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁকে কিছু একটা বলতে হবে। ইন্টারেস্টিং কিছু কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছেন। তিনি থেমে থেমে বললেন, পুষ্প খুব ভাল নাম। তবে পূষ্প না হয়ে কোন। বিশেষ ফুলের নামে নাম হলে আরো ভাল হত। অনেক আজে বাজে ধরনের ফুলও কিন্তু আছে। যেমন
false
shorotchandra
পথ বাহিয়া চলিতে লাগিল। আসিবার পথেই সদানন্দর বাটী; পথের ধারের আটচালাঘরের বারান্দায় বসিয়া সে তখন রামপ্রসাদী সুরে কালীনাম গাহিতেছিল। ললনাকে দেখিয়া সে গান থামাইয়া বলিল, ললনা, ভিজচ কেন? ললনা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তুমি গান থামালে কেন? সদানন্দও হাসিল; হাসি গান তাহার মুখে অষ্টপ্রহর লাগিয়াই আছে। সুর করিয়া বলিল, গান থামিয়া গেছে ; তাহার পর স্বাভাবিক স্বরে কহিল, সেকথা যাক, মিছামিছি ভিজো না, এইখানে একটু দাঁড়াও। ললনা বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। সদানন্দ তাহার মুখপানে কিছুক্ষণ চাহিয়া বলিল, দাঁড়িও না, বাড়ি যাও। সে কি? পিসিমা বাড়ি নাই, বেশি জল আসিলে যাইবে কেমন করিয়া? ললনা ভাবিল, সেকথাও বটে; দুই পদ অগ্রসর হইয়া আবার পিছাইয়া আসিল। সদানন্দ বলিল, ফিরিলে কেন? কাল রাত্রে আমার জ্বর হয়েছিল, জলে ভিজলে অসুখ বাড়তে পারে। তবে যেও না, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক। সদানন্দ তখন আপন মনে গান ধরিল— কভু তারে পাব না বুঝি, মিছে হাত বাড়ায়ে দাঁড়ায়ে আছি। কত জ্বালায় জ্বলে মরি, তুই কি জানবি পাষাণী মা! আমার সোনার তরি ডুববে এবার— ললনা কলসী নামাইয়া গান শুনিতেছিল; মিষ্ট গলায় মিষ্ট গান তাহার বড় ভাল লাগিতেছিল। হঠাৎ মাঝপথে থামিয়া যাওয়ায় বলিল, ওকি থামিলে যে? আর গাইব না। কেন? আর মনে নাই। ললনা মৃদু হাসিয়া বলিল, তবে গাইলে কেন? আমি অমন গেয়ে থাকি। তাহার পর কিছুক্ষণ আকাশপানে চাহিয়া বলিল, মেঘের উপর পদ্ম ফোটে, তুমি দেখেচ? ললনা সহাস্যে বলিল, কই না, তুমি দেখেচ? হ্যাঁ দেখেচি। কবে দেখলে? প্রায়ই দেখি।যখন আকাশে মেঘ হয় তখনই দেখতে পাই। সদানন্দর গম্ভীর মুখশ্রী দেখিয়া ললনার হাসি আসিল। মুখে কাপড় দিয়া বলিল, তা কি হয়? কেন হবে না? পদ্ম ত জলেই ফোটে, মেঘেতেও জলের অভাব নেই, তবে সেখানে ফুটবে না কেন? মাটি না থাকলে শুধু জলেতে কি পদ্ম ফোটে? সদানন্দ ললনার মুখপানে অনেকক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া বলিল, তাই বটে! সেই জন্যই শুকিয়ে যাচ্ছে। ললনা আর কিছু কহিল না। সকলেই জানিত সদাপাগলা দিনের মধ্যে অমন অনেক অসম্ভব ও অসংলগ্ন কথা কহিয়া থাকে। কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া সদানন্দ আবার কহিল, ললনা শারদা আর তোমাদের বাটীতে যায় না? ললনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। বোধ হয় তখনকার মুখ সদানন্দকে দেখাইবার তাহার ইচ্ছা ছিল না। সদানন্দ পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, যায় না? না। কেন? তা বলতে পারি না। সদানন্দ গান ধরিল— গান থামিল, কিন্তু বৃষ্টি কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না। বরং আকাশের মেঘ গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল। ললনা কাঁকে কলসী তুলিয়া লইল। সদানন্দ দেখিয়া বলিল, ওকি, যাও কোথা? বাড়ি যাই। এত বৃষ্টিতে যাইলে অসুখ করিবে যে। কি করব! ললনা চলিয়া গেলে সদানন্দ আবার গান ধরিল। সপ্তম পরিচ্ছেদ হারাণচন্দ্র যখন স্ত্রীর হস্তে পুরাপুরি দশটি টাকা গুণিয়া দিলেন তখন শুভদার মুখের হাসি ফুটিয়াও ফুটিতে পাইল না,বরং ম্লান হইয়া নতমুখে জিজ্ঞাসা করিল, এ টাকা তুমি কোথায় পেলে? সেও সে টাকা হাসিয়া দিতে পারে নাই।কিছুক্ষণ নিরুত্তরে থাকিয়া বলিল, শুভদা, তোমার কি মনে হয় এ টাকা আমি চুরি করিয়া আনিয়াছি? শুভদা আরও মলিন হইয়া গেল। তাহার পাপ অন্তঃকরণে একথা হয়ত একবার উদয় হইয়াছিল, কিন্তু তাহা কি বলা যায়? ঈশ্বর না করুন, কিন্তু যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ইহা কি লওয়া উচিত? চুরি করা ধন খাইবার পূর্বে সে অনাহারে মরিতে পারে, কিন্তু আর সকলে? প্রাণাধিক পুত্রকন্যারা? শুভদা বুঝিল, একথা আলোচনা করিবার এখন সময় নহে, তাই টাকা দশটি বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিল। কতক সুখ-স্বচ্ছন্দে আবার দিন কাটিতে লাগিল। হারাণ মুখুজ্যেকে এখন আর বড় একটা হলুদপুরে দেখিতে পাওয়া যায় না। বাটী আসিলে রাসমণি যদি জিজ্ঞাসা করে, তুই সমস্তদিন কোথায় থাকিস রে? হারাণ বলে, আমার কত কাজ, চাকরির চেষ্টায় ঘুরিয়া বেড়াই। শুভদাও মনে করে তাহাই সম্ভব, কেন না আর সে পয়সা চাহিতে আসে না, কাল শোধ করিয়া দিব বলিয়া আর দুই আনা, চারি আনা, ধার করিয়া লইয়া যায় না। সে কোথায় থাকে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে পারিব, কেননা আমি তাহা জানি। সে সমস্তদিন অনাহারে অবিশ্রামে চাকরির উমেদারি করিয়া বেড়ায়। কত লোকের কাছে গিয়া দুঃখের কাহিনী কহে, কত আড়তদারের নিকট এমন কি সামান্য দোকানদারদিগের নিকটও খাতাপত্র লিখিয়া দিবে বলিয়া কর্ম প্রার্থনা করে, কিন্তু কোথাও কিছু করিয়া উঠিতে পারে না। সে অঞ্চলে অনেকেই তাহাকে চিনিত; সেইজন্য কেহই বিশ্বাস করিয়া রাখিতে চাহে না। সন্ধ্যার সময় হারাণচন্দ্র শুষ্কমুখে বাটী ফিরিয়া আইসে; শুভদা ম্লান মুখে জিজ্ঞাসা করে, আজ কোথায় খেলে? হারাণচন্দ্র স্ত্রীর কথায় হাসিবার চেষ্টা করে; বলে, আমার খাইবার অভাব কি? কে আমাকে না জানে? শুভদা আর কথা কহে না, চুপ করিয়া থাকে। ক্রমশঃ তাহার কলসীর জল শুকাইয়া আসিতেছে, টাকা ফুরাইয়া আসিতেছে; আর দুই-একদিনেই নিঃশেষ হইয়া যাইবে, কিন্তু মুখ ফুটিয়া শুভদা তাহার স্বামীর নিকটে বলিতে পারে না, কাহাকেও জানাইতে তাহার ইচ্ছা হয় না, শুধু আপন মনে যাহা আছে তাহা লইয়াই নাড়াচাড়া করে। আজ তিন দিবস পরে অনেক রাত্রে স্বামীর শ্রান্ত পা-দুটি টিপিতে টিপিতে শুভদা মনে মনে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ তর্কবিতর্ক করিয়া মুখ ফুটিয়া কহিল, আর নেই, সব টাকা ফুরিয়ে গেছে। হারাণচন্দ্র চক্ষু মুদিয়া সাধারণভাবে বলিলেন, দশ টাকা আর কতদিন থাকে। আর কোন কথা হইল না। দুজনেই সে রাত্রের মত চুপ করিয়া রহিল। শুভদা ভাবিয়াছিল, কাল কি হইবে তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইবে; কিন্তু পারিল না। বিনা
false
humayun_ahmed
চলে গেল। আমার মাথায় হাত। ইলেকট্রিসিটি ছাড়া বিখ্যাত ইস্ত্ৰি ইলিশ তৈরি হবে না। বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মোমবাতির আলোয় শায়লা নামের মহিলাকে অপরূপ দেখাচ্ছে। অধ্যাপিকারা পড়াতে জানেন, সাজতে জানেন না কথাটা ঠিক না। শায়লা অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করতে করতে বললেন, ভুলভাল চিঠি লিখে আপনাকে বিরক্ত করেছি। বাবা আমাকে ক্ষমা করেছেন তো? মিসির আলি হাসলেন। শায়লা বললেন, ক্ষমা করে থাকলে মাথায় হাত রাখুন। মিসির আলি মাথায় হাত রাখলেন। সুন্দর সন্ধ্যা শুরু হলো। আমরা তিনজন একসঙ্গে বসেছি। আমাদের সামনে লেবু চা। ঝড়-বৃষ্টির রাতে লেবু চায়ে চুমুক দিতে অসাধারণ লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে। এখন মনে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টির রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া এমন খারাপ কিছু না। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগে কি সব সময় পটাসিয়াম সায়ানাইড রাখ? শায়লার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। শায়লার কথা বাদ থাকুক, আমি নিজেই। হকচকিয়ে গেলাম। শায়লা যদি তার হ্যান্ডব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড রেখেও থাকেন মিসির আলির পক্ষে তা জানা কোনোক্রমেই সম্ভব না। উনার আর যাই থাকুক। - চোখ নেই। মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, তোমার ব্যাগে পটাসিয়াম সায়ানাইডের একটা ফাইল আছে কী করে সেটা বুঝলাম তোমাকে বলি। পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে তোমার অবসেশান। আছে। শ্বশুরবাড়িতে এই শব্দটা তুমি প্রায়ই উচ্চারণ করো। যে কারণে তোমার শাশুড়িও শব্দটি শিখেছেন এবং তার পুত্রকে সাবধান করেছেন। কেমিস্ট্রির শিক্ষক হিসেবে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করা তোমার পক্ষে কোনো বিষয় না। তারচেয়েও বড় কথা তুমি . করেছে ইউনিভার্সিটি থেকে। তোমার থিসিস ছিল কোনো একটি যৌগে -এর সাহায্যে যুক্ত করা। যৌগের নামটা যেন কী? শায়লা যন্ত্রের মত বললেন, সিলিনিয়াস হাইড্রাইড। মিসির আলি বললেন, এই ঘরে ঢোকার পর থেকে লক্ষ করছি, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগ শরীরের সঙ্গে শুধু যে জড়িয়ে রেখেছ তা-না, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকেও রাখছ। বাতাসের ঝাপটায় একবার তোমার শাড়ির আঁচল সরেও গেল। তুমি সঙ্গে সঙ্গে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে তোমার ব্যাগটা ঢাকলে। এখন বলো তোমার ব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে না? তুমি যদি বলো নাই তাহলে নাই। আমি তোমার ব্যাগ খুলে দেখব না। শায়লা বিড়বিড় করে বললেন, পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে। ত্রিশ গ্রামের একটা ফাইল। চোখ কপালে উঠার ব্যাপারটা বাগধারায় আছে। বাস্তবে এই ঘটনা কখনো ঘটে না। ঘটার সামান্য সম্ভাবনা থাকলে আমার চোখ কপালে উঠে থাকত। মিসির আলি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে একটা খাম রাখতে দিয়েছিলাম। খামটা আজ ভোলা হবে এবং খামে কী লেখা পড়া হবে। আমি খাম এনে নিজের জায়গায় বসলাম। মিসির আলি শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি প্রথম চিঠিতে জানতে চেয়েছিলে তোমার পুত্ৰ সাগরের হত্যাকারী কে তা তুমি জানো। আমি জানি কি-না? আমিও জানি। সেটা একটা কাগজে লিখে রাখতে দিয়েছিলাম। তোমার সামনে একদিন খুব এই আশায়। এখন খোলা হবে। মিসির আলি বললেন, কাগজে কী লেখা পড়ুন। আমি বললাম, কাগজে লেখা ‘আ মারপ এক ন্যা’। মিসির আলি বললেন, অতি সহজ সাংকেতিক ভাষায় লিখেছি। অক্ষরগুলি আগ পিছে করলেই মূলটা বের হবে। আমি লিখেছি– ‘আমার পত্র কন্যা।‘ আমি শায়লার দিকে তাকালাম, তার চেহারা ভাবলেশহীন। কী ঘটছে না ঘটছে তা সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মিসির আলি বললেন, ডায়লা তুমি বিয়ের পর .. করতে আমেরিকা যাও, ঠিক না? শায়লা হা-সূচক মাথা নাড়ল। জালাল আহমেদের সঙ্গে সেখানেই তোমার পরিচয়? হ্যাঁ। সাগর নামের ছেলেটি কি তোমাদের অবৈধ সন্তান? শায়লা মুখ তুলে তাকালেন এবং কঠিন গলায় বললেন, না। আমি হারুনকে নিয়মমাফিক তালাক দিয়ে জালালকে বিয়ে করি। হারুনের সঙ্গে এমনিতেই আমার বিয়ে বৈধ ছিল না। আপনি এত কিছু জেনেছেন, এই তথ্যও নিশ্চয়ই জানেন সে . জানি। পুরো ইসলামি মতে নিউইয়র্কের এক মসজিদে আমাদের বিয়ে হয়। তারপরই সমস্যা শুরু হয়। কী সমস্যা? তার ধারণা হয় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। যে-কোনো সময় তাকে আমি খুন। করতে পারি। এইসব হাবিজাবি। ডা. হারুনের যে সমস্যা আছে সেই সমস্যা? হ্যাঁ। আমাদের যে বাচ্চাটা হয়–সাগর, সেই বাচ্চাটাকে জালাল সরিয়ে ফেলেছিল। তার ধারণা হয়েছিল বাচ্চাটাকেও আমি মেরে ফেলব। সে সাগরকে তার এক আত্মীয় বাড়িতে সরিয়ে দিয়েছিল যাতে আমি বুঝতে না পারি সে কোথায়। আমি ইচ্ছা করলে পুলিশের সাহায্য নিয়ে বাচ্চা বের করে ফেলতে পারতাম। তা করি নি। নিজেই খুঁজে খুঁজে বের করেছি সে কোথায় আছে। আমি আমার ছেলের খোঁজে জ্যাকসন হাইটের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানলাম, তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এক কাপ কফি খাব। কফি কি আছে? মানুষ চলে যায় তার কিছু অভ্যাস রেখে যায়। জালাল নেই কিন্তু তার কফির অভ্যাস আমার মধ্যে রেখে গেছে। আমি কফি বানিয়ে শায়লার সামনে ধরলাম। শায়লা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, জালাল যে নিউইয়র্কের এক সাবওয়েতে কফি খেতে খেতে মারা গিয়েছিল এই খবর কি আপনি জোগাড় করেছেন? মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ। সে হার্ট এটাকে মারা যায় নি। কফিতে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে খেয়েছিল। সে সুইসাইড করেছিল। পটাশিয়াম সায়ানাইড চুরি করেছিল আমার কাছ থেকে। নিউইয়র্ক পুলিশের বুদ্ধির কত নামধাম শুনি, তারা ধরতে পারে নি। তারা ভেবেছে হার্ট এটাক। তার মৃত্যুর পর আমি দেশে ফিরে আসি। বাস করতে থাকি হারুনের সঙ্গে। এমনভাবে বাস করি
false
humayun_ahmed
দেখে সে উঠে দাঁড়াল। রুগীর ঘরে ঢুকতে নিষেধ করতে যাচ্ছিল–কি ভেবে যেন করল না। মিস্টার আগস্ট ঘরে ঢুকলো। সাবেরের কপালে হাত রাখতেই সে চোখ মেলে বলল, আমি জেগে ছিলাম। তাই না-কি? জ্বি। জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কি কথা? ওদের একটা কবিতা শুনালাম–আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কি জানেন, ওরা কবিতা পছন্দ করে। তবে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়। যেমন দরজা–দরজা ব্যাপারটা কি ওরা জানে না–মজার কথা না! মজার কথা তো বটেই। আপনাকেও কবিতাটা শোনাই। আমাকে শুনাবে কেন? আমি তো আর জীবাণু না। সাবের হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই কবিতা শুরু করল– দু’হাতে দরজা খুলতেই দেখি তুমি যে ব্যথা বুকের মাঝে গোপনে পুষেছি এতোকাল ধরে, সারক্ষণ সাথী ছিল [তোমার বিকল্পরূপে–শুধু এই ব্যথা] কি করে নামাই বলো, তোমাকে দেখেই। চারচোখ অপলক শুধু মেলে রাখা কারো কোন কথা নেই, অথচ কখন অবাক চোখের ভাষা অতিদ্রুত গতি কেড়ে নিল দুজনের প্রিয়-সম্ভাষণ কেন যে এমন হলো, কেন যে এমন। মিস্টার আগস্ট বলল, জীবাণুরা আপনার এই কবিতা পছন্দ করেছে? জ্বি–ঐ যে বললাম, কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দিতে হয়ছে। যেমন চার চোখে চেয়ে থাকা মানে কি, দরজা মানে কি, দুহাত ব্যাপারটা কি? ওদের জগৎ আর আমাদের জগৎ তো ভিন্ন। তাতো বটেই। ওরাও কি কবিতা লেখে? জিজ্ঞেস করিনি। একবার জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। জি আচ্ছা। আরেকটা কথা–আপনার মৃত্যু মানে তো ওদেরও মৃত্যু। তা নিয়ে ওরা কি দুঃখিত না? না। ওদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। স্ফুলিঙ্গের মত। উড়ে যাবে, নিভে যাবে। ওরা এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত। আপনার সঙ্গে তো ওদের এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে–আপনার মৃত্যুতে তারা কি কষ্ট পাবে না? জিজ্ঞেস করি নি। দেখুন না–জিজ্ঞেস করে। সাবের খানিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। এক সময় চোখ মেলে বলল, ওরা বলেছে ওরা অসম্ভব কষ্ট পাবে। তাহলে ওদের আপনি বলুন না–আপনাকে মুক্তি দিতে। ওদের তো ক্ষণস্থায়ী জীবন। সেই জীবন তো ওরা ভোগ করল–আর কত। বলব? হ্যাঁ বলুন? এটা বলতে লজ্জা করছে। লজ্জার কিছু নেই, আপনি বলুন। সাবের চোখ বন্ধ করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে বলল, ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে। ওরা চায় না আমার মৃত্যু হোক। এখন তাহলে অষুধ খাবেন? অষুধ খেতে হবে না। ওরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। ওদের সে ক্ষমতা আছে। আচ্ছা আমি যেসব কথাবার্তা বলছি তা কি আপনি বিশ্বাস করছেন? করছি। অবশ্যই করছি। ভাই, আমি তাহলে যাই? কোথায় যাবেন? জানি না। আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। হতেও পারে, কিছুই বলা যায় না। এই জগৎ বড়ই রহস্যময়–ভাই, আমি যাই। সূর্য ওঠার আগে আমাকে বিদেয় হতে হবে। মিস্টার আগস্ট ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র সাবের তার মাকে ডেকে তুলল। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এক কাপ চা খাওয়াতে পার, মা। সুরমা ছেলের গায়ে হাত রাখলেন। জ্বর নেমে গেছে। সাবেরের মুখ হাসি-হাসি। মা, কড়া করে চা বানাবে। নোন্ত বিকিট থাকলে চায়ের সঙ্গে নোন্তা বিসকিট দিও–প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে। হরিপ্রসন্ন বাবু ঘুমিয়ে ছিলেন। মিস্টার আগস্ট তাকে ডেকে তুলে বলল, আপনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি–আমি কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হব। বেশ কয়েকদিন আপনার সঙ্গে একসঙ্গে কাটালাম। কথাবার্তা তেমন হয় নি। হলে ভাল লাগতো। হরিপ্রসন্ন বাবু বললেন, রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছেন? আসতে হয় দিনে–যাবার জন্যে তো রাতই ভাল। আপনার কথা বুঝলাম না। কথার কথা বলেছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সরি, ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। না, না, অসুবিধা নাই। আচ্ছা ভাল কথা–আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে? হরিপ্রসন্ন বাবু চমকে উঠে বললেন, আমি! আমি কোথায় যাব? না, না, কি বলছেন আপনি? আপনি রাজি থাকলে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। আরে না। আচ্ছা, ভাই, তাহলে ঘুমান। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। চাদরটা গায়ে দিয়ে নিন। মিস্টার আগস্ট দরজা ভেজিয়ে বারান্দায় এল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে সে নেমে গেল নিঃশব্দে। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত–দোতলার বারান্দা থেকে মতিন সাহেব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কুড়ি বছর পরের কথা। আমেরিকার মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি কফি শপে একজন বাংলাদেশী ছাত্রীকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার হাতে কফির মগ। টেবিলে স্থানীয় পত্রিকা বিছানো। মেয়েটি অলস ভঙ্গিতে পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলি দেখছে। মেয়েটির নাম মিতু। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইভার অপটিকস-এ পোষ্ট ডক করছে। একা একা থাকে। বেশীর ভাগ সময়ই তাকে খুব বিষণ্ণ দেখা যায়। জীবন তার প্রতি খুব সুবিচার করেনি। আমেরিকায় পড়তে আসা তার এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসন। মিতু বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে হঠাৎ চমকে উঠল। এতটা চমকাল যে হাতের কফির মগ থেকে গরম কফি ছিটকে পড়ল গায়ে। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একজন হাসিখুশী যুবকের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে লেখা–এই যুবকটি নিম্ন ঠিকানায় আছে। যুবকটি এক ধরনের এ্যামনেশিয়ায় ভুগছে। পুরোনো স্মৃতি মনে নেই। তার কোন খোঁজ-খবর বের করা যাচ্ছে না। যদি কেউ এই যুবকটি সম্পর্কে কিছু জানেন তাহলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপন দিয়েছে স্টেট পুলিশ। যুবকটির ছবির দিকে মিতু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিতু তাকে চেনে–তার নাম মিস্টার আগস্ট। এ ব্যাপারে মিতুর মনে কোন সন্দেহ নেই। মিতু পত্রিকা হাতে উঠে দাঁড়াল। চোদ্দ নম্বর পুলিশ প্রিসিংক্ট-এ যুবকটি আছে। উনিশ ডাউন স্ট্রীট–নর্থ। এই হল ঠিকানা। কতক্ষণ লাগবে সেখানে যেতে? বড়জোর কুড়ি মিনিট। মিতুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।
false
tarashonkor
জামি বুঝিয়াছি। তুমি এস। আমার পাপ হয় হোক, নরকে যাইতে হয় হাসিমুখেই যাইব, তবু তোমাকে বলিতে পারিব না—তুমি এস না। সে কি পারি? সে কথা কি মুখ দিয়া বাহির হইবার? এস তুমি, এস। তাহার মনে হইল নষ্টচাঁদের কথা। সে চাঁদ দেখিলে নাকি কলঙ্ক হয়। নিতাই কিন্তু কখনও সে কথা মানে নাই। মনের মধ্যে তাহার আবার গান গুনগুন করিয়া উঠিল। আপনি যেন কলিটা আসিয়া পড়িল— “চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ?” ঠাকুরঝি তাহার সেই চাঁদ। ঠাকুরঝি যদি আর না আসে, তবে নিতাই বাঁচিবে কি করিয়া? এখানে থাকিয়া সে কি করিবে? কোথায় মুখ তবে? সে এইখানে বসিয়া ওই পথের দিকে চাহিয়৷ চাহিয়া চোখের দৃষ্টি হারাইয়া ফেলিবে। “চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ?” তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভাল ঘুচুক আমার দেখার সাধ। ওগো চাঁদ, তোমার নাগি—” ও-হো-হো! গানের কলি হু-হু করিয়া আসিতেছে! “ওগো চাঁদ তোমার নাগি—ন হয় আমি বৈরাগী, পথ চলিব রাত্রি জাগি সাধবে না কেউ আর তো বাদ।” হায়, হায়, হায়! একি বাহারের গান! ওগো, ঠাকুরঝি। ওগো, কি মহা ভাগ্যে তুমি আসিয়াছিলে, কবিয়ালকে ভালবাসিয়াছিলে, তাই তো–তাই তো আজ এমন গান আপনি-আপনি আসিয়া পড়িল! নিতাই উঠিল। সে চলিল ওই রেল লাইনের পথ ধরিয়া যে পথে ঠাকুরঝি আসে। কিছু দূর গিয়া পথ নির্জন হইতেই সে ওই গানটা ধরিয়া দিল। রেল লাইনের বাঁধে ছেদ পড়িয়াছে নদীর উপর। বাঁধের মাথা হইতে পুল আরম্ভ হইয়াছে। বাঁধ হইতে নিতাই নামিল নদীর ঘটে; নদীতে অল্প জল, এক হাঁটুর বেশী নয়। হাঁটিয়াই ঠাকুরঝি নিত্য নদী পার হইয় আসে-যায়। নিতাই গিয়া নদীর ঘাটে দাঁড়াইল। নিতাই চলিয়াছিল একেবারে বিভোর হইয়া। বাঁ হাতখনি গালে রাথিয়া ডানহাতের অঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যম আঙ্গুল দুইটি জুড়িয়া সে যেন ঠাকুরঝিকেই উদ্দেশ করিয়া গাহিতে গাহিতে চলিয়াছিল। হয়তো সে একেবারে ঠাকুরঝির শ্বশুরবাড়িতে গিয়াই হাজির হইত। নদীর ঘাটে পা দিয়াই হঠাৎ তাহার খেয়াল হইল। তাই তো, সে কোথায় যাইতেছে? এ কি করিতেছে সে? ঠাকুরঝির শ্বশুরবাড়িতে সে যদি গিয়া দাঁড়ায়, এই গান গায়, বলে—ঠাকুরঝি এ চাঁদ কে জান? এ চাঁদ আমার তুমি! তবে ঠাকুরঝির দশা কি হইবে? ঠাকুরঝির স্বামী কি বলিবে? তাহার শাশুড়ী ননদ কি বলিবে? পাড়া-প্রতিবেশী আসিয়া জুটিয়া যাইবে। তাহারা কি বলিবে? সকলের গঞ্জনার মধ্যে পড়িয়া ঠাকুরঝি—, তাহার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল ঠাকুরঝির ছবি। দিশাহারার মত তাহার ঠাকুরঝি দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিবে। ঠাকুরঝির নিন্দায় ঘর-পাড়া-গ্রাম-দেশ ভরিয়া যাইবে। ঠাকুরঝি পথ হাঁটিবে, মাথা হেঁট করিয়া পথ হাটিবে, লোক আঙ্গুল দেখাইয়া বলিবে—ওই দেখ কালামুখী যাইতেছে। কুৎসিত অভদ্র লোক ঠাকুরঝিকে কুৎসিত কুকথা বলিবে। সে যদি ঠাকুরঝিকে মাথায় করিয়া দেশান্তরী হয়, তবুও লোকে বলিবে-মেয়েটা খারাপ, নিতাইয়ের সঙ্গে ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে। ঠাকুরঝি সেখানেও মাথা তুলিতে পরিবে না। নিতাই নদীর ঘাটে বসিল। আপন মনেই বলিল—আকাশের চাঁদতুমি আমার ঠাকুরঝি। তুমি আকাশেই থাক। আঃ–আজ কি হইল নিতাইয়ের! আবার কলি আসিয়া গিয়াছে – “চাঁদ তুমি আকাশে থাক—আমি তোমায় দেখব খালি। ছুঁতে তোমার চাইনাকো হে—সোনার অঙ্গে লাগবে কালি।” নিতাই গান ভাঁজিতে ভাঁজিতে আবার ফিরিল। রাজা বলিল—কাঁহা গিয়া রহা ওস্তাদ? নিতাই হাসিয়া বলিল—গানা, রাজন, গান। বহুত বঢ়িয়া বঢ়িয়া গান আজ এসে গেল ভাই। তাই গুনগুন করছিলাম আর মাঠে মাঠে ঘুরছিলাম। —হাঁ| বঢ়িয়া বঢ়িয়া গান? –হাঁ, রাজনা, অতীব উত্তম, যাকে বলে উচ্চাঙ্গের গান। —বইঠে। তব, ঢোলক লে আতা হাম। রাজা ঢোল আনিয়া বসিয়া গেল। নিতাই একমনে গাহিতেছিল—চাঁদ তুমি আকাশে থাক— হঠাৎ বাজনা বন্ধ করিয়া রাজা বলিল—আরে ওস্তাদ, জাঁখসে তুমা্রা পানি কাহে নিকালতা ভাই? চোখ মুছিয়া নিতাই বলিল–হাঁ রাজনা, পানি নিকাল গিয়া। কিয়া করেগা! চোখের জল যে কথা শোনে না ভাই! পরদিন নিতাই সকাল হইতেই বসিয়া ছিল ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। আজ সকাল হইতেই তাহার মনে হইতেছে—মনে তাহার কোন খেদ নাই, কোন তৃপ্তিও নাই। সে যেন বৈরাগীই হইয়া গিয়াছে। কাল সমস্ত দিন-রাত্রি মনে মনে অনেক ভাবিয়াছে সে। সন্ধ্যায় গিয়াছিল রাজনের বাড়ী। রাজার স্ত্রী বড় মুখরা; ইদানীং রাজা নিতাইকে নানাপ্রকার সাহায্য করে বলিয়া সে নিতাইয়ের উপর প্রায় চটিয়াই থাকে। তবু সে গিয়াছিল। রাজা খুশী হইয়াছিল খুব। আশ্চর্যের কথা— কাল রাজার বউও তাহাকে সাদর সম্ভাষণ করিয়াছিল। ঘোমটার মধ্য হইতেই বলিয়াছিল— তবু ভাগ্যি যে ওস্তাদের আজ মনে পড়ল। নিতাই তাহারই কাছে কৌশলে কথাপ্রসঙ্গে জানিয়াছে—ঠাকুরঝির স্বামীর সমস্ত বৃত্তান্ত। ঠাকুরঝির স্বামীটি নাকি দিব্য দেখিতে! —রঙ পেরায় গোরো, বুঝলে ওস্তাদ, তেমনি ললছা-ললছা গড়ন। লোকটিও বড় ভাল। দুজনাতে ভাবও খুব, বুঝলে! অবস্থাও নাকি ভাল। দিব্য সচ্ছল সংসার। রাজার স্ত্রী বলিল–যাকে বলে ‘ছছল-বছল’। আট-দশটা গাই গরু। দুটো বলদ। ভাগে চাষ-বাস করে। ঠাকুরঝির তোমাদের পাঁচজনার আশীর্বাদে সুখের সংসার। নিতাই বলিয়াছিল—আহ! আশীৰ্বাদ তো চব্বিশ ঘণ্টাই করি মহারাণী। রাজার স্ত্রী অদ্ভুত। সে এতক্ষণ বেশ ছিল, এবার ওই মহারাণী বলাতেই সে খড়ের আগুনের মত জলিয়া উঠিল। ওই—ওই কথা আমি সইতে লারি। মহারাণী। মহারাণী তো খুব। মেথরাণী, চাকরাণী তার চেয়ে ভাল। না ঘর না দুয়োর। র‍্যালের ঘরে বাস –আজ এখানা, কাল সেখান। রাজা মুহূর্তে আগুন হইয়া উঠিয়াছিল—কেঁও হারামজাদী? কেয়া বলতা তুম? —কেয়া বোলতা তুম কি? হক কথা বলব তার ভয় কি? তাহার পরেই কুরুক্ষেত্র। রাজা ধরিয়াছিল তাহার চুলে। তাহদের শান্ত করিবার জন্য নিতাই বারকয়েক চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু সে চেষ্টায় কিছু হয় নাই।
false
toslima_nasrin
তো করতে জানেই না, স্বাধীনতার সঠিক সংত্তাও তারা জানে না। সংত্তা জানলে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়তো। গোটা পৃথিবীর এক ভারতেই ডিভোর্সের হার নির্লজ্জ ভাবে কম। এত কম অন্য কোথাও নয়। অন্য দেশে ষোলোটি বৈধ কারণ আছে ডিভোর্স হওয়ার। ভারতে মূলত পাঁচটি কারণ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি না থাকায় এ দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য আইন আবার ভিন্ন ভিন্ন। যে কারণে হিন্দুর ডিভোর্স হবে, সে কারণে খ্রিস্টানের হবে না। হিন্দুর ডিভোর্সের কারণগুলো ১. ব্যভিচার, ২. নিখোঁজ হওয়া, ৩.নিষ্ঠুরতা ৪.যৌন অক্ষমতা, ৫. দীর্ঘদিনের মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা, যৌনরোগ। ব্যভিচার যদিও নারী পুরুষ উভয়ে করার যোগ্যতা রাখে, করে কিন্তু পুরুষেরা। করার সুযোগ সুবিধে পুরুষেরা নিজেদের জন্য যত রেখেছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই নারীর জন্য রাখেনি। পুরুষের ব্যভিচারের শিকার নারী, আর শিকারের হয় ‘ব্যভিচারী’ বলে দুর্নাম। ব্যভিচার বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্বামীই ঘটায়, স্ত্রী মাথা পেতে সবই বরণ করে নেয়। ভোঁতা মাথা বলেই নেয়। তিন বছর একসঙ্গে এক বাড়িতে বাস না করলে ডিভোর্স হতে পারে, কিন্তু স্ত্রীরা কি সে কারণে কোনও স্বামীকে ডিভোর্স করে? নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়, তারপর নর্দমা থেকে তুলে মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়ে ধান-দুব্বো দিয়ে বরণ করে অপদার্থটিকে। মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেয় স্বামীরা, তারপরও তাদের দেবতা মানার স্বভাব দূর হয় না নারীকুলের। শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্তমাগত অত্যাচারিত হচ্ছে নারী। পাষণ্ডদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘোচাতে তারপরও রাজি নয় ভীরু ভীতু নারীর দল। যৌন অক্ষমতা পুরুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। যৌন অক্ষম স্বামীর সঙ্গে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মেয়ে। মুখ বুজে। যৌনতা এবং তার আনন্দ পুরুষের জন্য। নারীর কাজ সন্তান উৎপাদন, এবং সন্তান লালন। এরকমই শেখানো হয়েছে নারীকে। নারী যে সত্য জানবে শিখবে বুঝবে, নারীর ভোঁতা মাথা যে ধারালো হবে তার কোনও উপায় রাখেনি এই কঠিন কঠোর পুরুষতন্ত্র। যৌনরোগে আক্তান্ত স্বামী নিয়ে, দীঘ দীর্ঘ কাল ধরে অথর্ব অক্ষম পঙ্গু পুরুষ নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে নারী। স্বামীর সেবার জন্য নারীর এই ঝি বা চাকরানির ভূমিকাকে ‘ভালোবেসে আত্মত্যাগ’ বলে তারিফ করে আসছে পুরুষতন্ত্র। আর তাতেই খুশিতে বাকুম বাকুম আমাদের নারী। ঘরে ঘরে প্রেমহীনতা, অসন্তোষ, ঘৃণা, ঘরে ঘরে ব্যভিচার, স্বৈরাচার। ঘরে ঘরে নারীর ওপর নির্লজ্জ নিপীড়ন। তারপরও নারীর সাহস নেই মেরুদণ্ড শক্ত করে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার। সাহস নেই নিজের জন্য একটি বাসস্থান তৈরি করার। ডিভোর্স করলে কী কী হবে তার একটি ফিরিস্তি দেওয়া হয়, যেমন ডিভোর্সী মেয়েদের দিকে পুরুষেরা হাত বাড়াবে। ভাববে এ খুব সহজলভ্য। কিন্তু এ কি কারও অজানা যে পুরুষের হাত বাড়ানোর জন্য ডিভোর্স হওয়া মেয়ের দরকার হয় না। কুমারী অকুমারী ডিভোর্সী অডিভোর্সী বুড়ি ছুড়ি যে কারও দিকেই ওরা ওদের হাত বা পুরুষাঙ্গ বাড়াতে পারে। আড়াই বছরের শিশুকেও ওরা ছেড়ে দেয় না। বলা হয় যে ‘ডিভোর্স করলে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে।’ আহ, না হয় হোক। হোক খারাপ তারপরও নিজের মতো করে বেঁচে থাকা তো যাবে। আজ যদি হাজার হাজার মেয়ে তা-ই চায়, নিজের ইচ্ছের মূল্য দেয়, বেঁচে থাকে নিজের একশ ভাগ স্বাধীনতা এবং একশ ভাগ অধিকার নিয়ে, একা, তবে কত ঐতিহ্য, কত সংস্কার, কত পরিবারপ্রথা আছে যে গালাগালি পেড়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, বাধা দেবে! নিরাপত্তার কথা বলা হয়। স্বামী কি সত্যিই কোনও নিরাপত্তা? ঘরে ঘরে স্বামী দ্বারা স্ত্রী খুন, স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, স্ত্রীকে গলা টিপে মেরে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেওয়া, রাতে রাতে ধর্ষণ করা — এর নাম কি নিরাপত্তা? পরিসংখ্যান বলে, মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় স্বামীর ঘরে। ভারতবর্ষে মেয়েদের অবস্থা যে ভীষণ করুণ, মেয়েরা যে বন্দি হয়ে আছে সংসার-কারাগারে, মেয়েদের যে ন্যূনতম অধিকার নেই নিজের অধিকারটুকু ভোগ করার — তা ভারতের ডিভোর্সের হার দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বিবর্তন বলে একটি জিনিস আছে, পৃথিবীতে ঘটে। পৃথিবীতে এই দেশটি একমাত্র দেশ যে দেশের নারীর অবস্থায় বিবর্তন বলে কোনও জিনিস নেই। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, অত্যাচারে অতিষ্ঠ ঠাকুরমার ঠাকুরমার ঠাকুরমার ঠাকুরমারা যে কারণে ডিভোর্স করতো না স্বামীদের, এখন এই ২০০৭ সালে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন স্বনির্ভর মেয়েরা একই কারণে ডিভোর্স করছে না। ভারতীয় ছবির মেগা স্টার অমিতাভ বচ্চনের ছেলে অভিষেকের সঙ্গে ঐেশ্বর্যার বিয়ে হতে পারে এরকম একটি খবর যখন পত্রিকায়, সকলের অতি ভালোবাসার ধন অমিতাভ বচ্চন বলে দিলেন জ্যোতিষি বলেছে ঐশ্বর্যাকে বিয়ে করলে অভিষেকের অমঙ্গল হবে, সুতরাং বিয়ে বাদ। তারপর নানারকম পুজো আচ্চা করে নাকি সঙ্গেট মোচন হল। অমঙ্গলও মোচন হল। অভিষেক এখন বিয়ে করতে পারে ঐশ্বর্যাকে। ঐশ্বর্যা নামী অভিনেত্রী। তাঁর পক্ষে কি অভিনয় করা সম্ভব হবে বিয়ের পর, এই প্রশ্ন সকলের মনে। তাঁকে কি অভিনয় করার অনুমতি দেবে তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি? অভিষেক শুনেছি বলেছেন, ঐশ্বর্যা অভিনয় করতে চাইলে করবে। বিয়ের পর অভিষেকের অভিনয় বন্ধ হবে কী হবে না তা নিয়ে কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি। ঐশ্বর্যার কাছে জানতে চায়নি অভিষেককে তিনি অনুমতি দেবেন কিনা অভিনয় করার। কারও কাছে কি এগুলো খুব অবাক করা ব্যাপার? না। কারও কাছেই নয়। এসব সবই খুবই স্বাভাবিক। কেন এমন? কেন এই প্রশ্নটি কেউ করে না, যে, বিয়ে কেন মেয়ের জীবনকে পাল্টে দেয়, ছেলের জীবনকে নয়? শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীকে সম্পূর্ণ
false
shorotchandra
বৌদি, এঁর গল্পই সেদিন আপনার কাছে করেছিলাম। ও যেমন অবলীলায় পায়, তেমনি অবহেলায় ফেলে দেয়। আশ্চর্য মানুষ! অজিতবাবু, একেই আপনার তল্পি বইতে সঙ্গে দিতে চেয়েছিলাম। অজিত কি একটা বলিতে যাইতেছিল, একটি ছেলে আসিয়া খবর দিল, অক্ষয়বাবু আসিয়াছেন। হরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিল, অক্ষয়বাবু? অক্ষয় ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে কহিল, হাঁ হে হাঁ—তোমার পরমবন্ধু অক্ষয়কুমার। সহসা চমকিয়া বলিল,অ্যাঁ! ব্যাপার কি আজ? সবাই উপস্থিত যে! আশুবাবুর সঙ্গে গাড়িতে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, পথে নাবিয়ে দিলেন। সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল, হরি ঘোষের গোয়ালটা একটু তদারক করেই যাই না! তাই আসা, তা বেশ। এ-সকল কথার কেহ জবাব দিল না, কারণ, জবাব দিবারও কিছু নাই, বিশ্বাসও কেহ করিল না। অক্ষয়ের এটা পথও নয়, এ বাসায় সে সহজে আসেও না। অক্ষয় কমলের প্রতি চাহিয়া বলিল, তোমার ওখানে কাল সকালেই যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু বাড়িটা ত চিনিনে—ভালই হল যে দেখা হয়ে গেল। একটা সুসংবাদ আছে। কমল নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। হরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, সুসংবাদটা কি শুনি? খবরটা যখন শুভ তখন গোপনীয় নয় নিশ্চয়ই। অক্ষয় কহিল, গোপন করবার আর কি আছে! পথের মধ্যে আজ সেই সেলাইয়ের কল বিক্রি-আলা পার্শী বেটার সঙ্গে দেখা। সেই সেদিন যে কমলের হয়ে টাকা ধার চাইতে গিয়েছিল। গাড়ি থামিয়ে ব্যাপারটা শোনা গেল। কমলকে দেখাইয়া কহিল, উনি ধারে একটা কল কিনে ফতুয়া-টতুয়া শেলাই করে খরচ চালাচ্ছিলেন,-শিবনাথ ত দিব্যি গা-ঢাকা দিয়েছেন, কিন্তু কড়ার মত দাম দেওয়া চাই ত! তাই সে কলটা কেড়ে নিয়ে গেছে,—আশুবাবু আজ পুরো দাম দিয়ে সেটা কিনে নিলেন। কমল, কাল সকালেই লোক পাঠিয়ে কলটা আদায় করে নিয়ো। খাওয়া-পরা চলছিল না, আমাদের ত সে কথা জানালেই হত। তাহার বলার বর্বর নিষ্ঠুরতায় সকলেই মর্মাহত হইল। কমলের লাবণ্যহীন শীর্ণ মুখের একটা হেতু দেখিতে পাইয়া লজ্জায় অবিনাশের পর্যন্ত মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। কমল মৃদুকণ্ঠে কহিল, আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁকে সেটা ফিরিয়ে দিতে বলবেন। আর আমার প্রয়োজন নেই। কেন? কেন? হরেন্দ্র কহিল, অক্ষয়বাবু, আপনি যান এ বাড়ি থেকে। আপনাকে আমি আহ্বান করিনি—ইচ্ছে করিনি যে আপনি আসেন, তবু এসেছেন। মানুষের ব্রুট্যালিটির কি কোথাও কোন সীমা থাকবে না? কমল হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল অজিতের দুই চক্ষু যেন জলভারে ছলছল করিতেছে। কহিল, অজিতবাবু, আপনার গাড়ি সঙ্গে আছে, দয়া করে আমাকে পৌঁছে দেবেন? অজিত কথা কহিল না, শুধু মাথা নাড়িয়া সায় দিল। কমল নীলিমাকে নমস্কার করিয়া বলিল, আর বোধ হয় শীঘ্র দেখা হবে না, আমি এখান থেকে যাচ্চি। কোথায়, এ কথা কেহ জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস করিল না। নীলিমা শুধু তাহার হাতখানি হাতের মধ্যে লইয়া একটুখানি চাপ দিল এবং পরক্ষণেই সে হরেন্দ্রকে নমস্কার করিয়া অজিতের পিছনে পিছনে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। পনর মোটরে বসিয়া কমল আকাশের দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া ছিল, গাড়ি থামিতে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ কোথায় এলেন অজিতবাবু, আমার বাসার পথ ত নয়? অজিত উত্তর দিল, না, এ পথ নয়। নয়? তা হলে ফিরতে হবে বোধ করি? সে আপনি জানেন। আমাকে হুকুম করলেই ফিরব। শুনিয়া কমল আশ্চর্য হইল। এই অদ্ভুত উত্তরের জন্য যতটা না হোক, তাহার কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিকতা তাহাকে বিচলিত করিল। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সে আপনাকে দৃঢ় করিয়া হাসিয়া কহিল, পথ ভোলবার অনুরোধ ত আমি করিনি অজিতবাবু, যে সংশোধনের হুকুম আমাকেই দিতে হবে। ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আপনার—আমার কর্তব্য শুধু আপনাকে বিশ্বাস করে থাকা। কিন্তু দায়িত্ববোধের ধারণায় যদি ভুল করে থাকি কমল? যদির ওপর ত বিচার চলে না অজিতবাবু। ভুলের সম্বন্ধে আগে নিঃসংশয় হই, তার পরে এর বিচার করব। অজিত অস্ফুট-স্বরে বলিল, তা হলে বিচারই করুন, আমি অপেক্ষা করে রইলাম। এই বলিয়া সে মুহূর্ত-কয়েক স্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, কমল, আর একদিনের কথা মনে আছে তোমার? সেদিন ত ঠিক এমনি অন্ধকারই ছিল। হাঁ, এমনি অন্ধকারই ছিল। এই বলিয়া সে গাড়ির দরজা খুলিয়া নামিয়া আসিয়া সম্মুখের আসনে অজিতের পাশে গিয়া বসিল। জনপ্রাণহীন অন্ধকার রাত্রি একান্ত নীরব। কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেহই কথা কহিল না। অজিতবাবু! হুঁ। অজিতের বুকের মধ্যে ঝড় বহিতেছিল, জবাব দিতে গিয়ে কথা তাহার মুখে বাধিয়া রহিল। কমল পুনরায় প্রশ্ন করিল, কি ভাবচেন বলুন না শুনি? অজিতের গলা কাঁপিতে লাগিল, বলিল, সেদিন আশুবাবুর বাড়িতে আমার আচরণটা তোমার মনে পড়ে? সেদিন পর্যন্ত ভেবেছিলাম তোমার অতীতটাই বুঝি তোমার বড় অংশ, তার সঙ্গে আপস করব আমি কি করে? পিছনের ছায়াটাকেই সামনে বাড়িয়ে দিয়ে তোমার মুখ ফেলেছিলাম ঢেকে, সূর্যি যে ঘোরে এই কথাটাই গিয়েছিলাম ভুলে। কিন্তু—থাক। কিন্তু, আমি আজ কি ভাবচি তুমি বুঝতে পার না? কমল বলিল, মেয়েমানুষ হয়ে এর পরেও বুঝতে পারব না আমি কি এতই নির্বোধ? পথ যখনি ভুলেচেন, আমি তখনই বুঝেচি। অজিত ধীরে ধীরে তাহার কাঁধের উপর বাঁ হাতখানি রাখিয়া চুপ করিয়া রহিল। খানিক পরে বলিল, কমল, মনে হচ্চে আজ বুঝি আর নিজেকে আমি সামলাতে পারবো না। কমল সরিয়া বসিল না। তাহার আচরণে বিস্ময় বা বিহ্বলতার লেশমাত্র নাই। সহজ শান্তকণ্ঠে কহিল, এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই অজিতবাবু, এমনিই হয়। কিন্তু আপনি ত শুধু কেবল পুরুষমানুষই নয়, ন্যায়নিষ্ঠ ভদ্র পুরুষমানুষ। এর পরে ঘাড় থেকে আমাকে নামাবেন কি করে? ততখানি ছোট কাজ ত আপনি পেরে উঠবেন না। অজিত গাঢ়কণ্ঠে কহিল, পারতেই হবে এ আশঙ্কা তুমি
false
shottojit_roy
দেখলাম হেঁয়ালির চেয়েও অনেক বেশি গোলমেলে প্যাঁচালো একটা কিছু। সমাদ্দারের চাবি – ২ বারাসত ছড়িয়ে একটা রাস্তা যশোর রোড থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে বামুনগাছির দিকে গেছে। সেই মোড়ের মাথায় একটা খাবারের দোকান থেকে মণিমোহনবাবু আমাদের চা আর জিলিপি কিনে খাওয়ালেন। তাতে পনেরো মিনিট গেল, তা না হলে আমরা আটটার মধ্যেই বামুনগাছি পৌঁছে যেতাম। গোলাপি রঙের পাঁচিল আর ইউক্যালিপটাস গাছে ঘেরা সাত বিঘে জমির উপর রাধারমণ সমাদ্দারের একতলা বাড়ি। যে লোকটা এসে গেট খুলে দিল সে বোধহয় মালী, কারণ তার হাতে একটা ঝুড়ি ছিল। গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকে বাগানের পাশ দিয়ে কাঁকর বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে একেবারে বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ডান দিকে খানিকটা দূরে একটা গ্যারেজের ভিতর একটা পুরনো কালো গাড়ি রয়েছে। সেটাই বুঝলাম রাধারমণ সমাদ্দারের অস্টিন। গাড়ি থেকে নামতেই একটা ঠাঁই শব্দ শুনে বাগানের দিকে ফিরে দেখি নীল হাফপ্যান্ট পরা আট-দশ বছরের একটি ছেলে হাতে একটা এয়ারগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে দেখছে। মণিমোহনবাবু তাকে বললেন, ‘তোমার বাবা বাড়িতে আছেন? তাঁকে গিয়ে বলো তো যে মণিবাবু কলকাতা থেকে এসেছেন, একবার ডাকছেন।’ ছেলেটি বন্দুকে ছররা ভরতে ভরতে চলে গেল। ফেলুদা বলল, ‘প্রতিবেশীর ছেলে বুঝি?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। ওর বাবা অবনী সেনের একটা ফুলের দোকান আছে নিউ মার্কেটে। এখানে পাশেই ওঁর বাড়ি, তার সঙ্গে ওঁর নাসরি। মাঝে মাঝে স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে এসে থাকেন।’ ইতিমধ্যে একজন বুড়ে চাকর আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে। মণিবাবু তাকে দেখিয়ে বললেন, ‘এ বাড়িটার যদ্দিন না একটা ব্যবস্থা হচ্ছে ততদিন অনুকূল এখানেই থাকছে। প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো চাকর। অনুকুল, এদের জন্য একটু সরবতের ব্যবস্থা করো তো।’ চাকর মাথা হেঁট করে হ্যাঁ বলে চলে গেল, আমরা তিনজন বাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা খোলা জায়গা। সেটাকে ঘর বলা মুশকিল, কারণ মাঝখানে একটা গোল টেবিল আর দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছুই নেই। বাতিটাতিও নেই কারণ এদিকটায় ইলেকট্রিসিটিই নেই। আমাদের সামনেই একটা দরজা রয়েছে, মণিবাবু সেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘দেখুন, এই হল সেই জামান তালা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কলকাতা শহরেই কিনতে পাওয়া যেত। এর নাম হল এইট-টু-নাইন-ওয়ান।’ গোল তালা, তাতে চাবির গর্ত-টর্ত নেই, তার বদলে আছে চারটে খাঁজ। প্রত্যেকটা খাঁজের পাশে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত নম্বর লেখা আছে, আর প্রত্যেকটার মধ্যে দিয়ে ছোট্ট হুকের মতো জিনিস বেরিয়ে আছে। এই হুকগুলোকে খাঁজের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ঠেলে সরানো যায়, আর দরকার হলে যে-কোনও একটা নম্বরের পাশে বসিয়ে দেওয়া যায়। কোনটাকে কোন নম্বরে বসাতে হবে না জানলে তালা খোলা অসম্ভব। মণিবাবু বা দিকের খাঁজ থেকে শুরু করে হুকগুলোকে পর পর ৮, ২, ৯ আর ১ নম্বরে ঠেলে দিতেই খড়াৎ শব্দ করে ম্যাজিকের মতো তালাটা খুলে গেল। মণিবাবু বললেন, ‘বন্ধ করাটা আরও সহজ। তালাটা লাগিয়ে যে-কোনও একটা হুক নম্বর থেকে একটু সরিয়ে দিলেই লক্‌৷’ আমরা তিনজন রাধারমণ সমাদ্দারের ঘরে ঢুকলাম। ঘরটা বেশ বড়। তাতে মণিবাবু যা যা বলেছিলেন সবই আছে, কিন্তু বাজনা যে এতরকম আছে সেটা ভাবতেই পারিনি। তার কিছু রয়েছে দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের গায়ে একটা লম্বা শেলফের তিনটে তাকের উপর, কিছু পুবদিকের দেয়ালের সামনে একটা লম্বা বেঞ্চির উপর, কিছু ঝুলছে দেয়ালের হুক থেকে, আর কিছু রয়েছে ছোট ছোট টেবিলের উপর। এ ছাড়া ঘরে যা আছে তা হল খাট, খাটের পাশে একটা ছোট টেবিল, উত্তর দিকের দেয়ালের সামনে একটা আলমারি। আর এক কোণে একটা ছোট সিন্দুক। খাটের তলায় একটা ছোট ট্রাঙ্কও চোখে পড়ল। ফেলুদা প্রথমে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকটা দেখে নিল। তারপর আলমারি আর সিন্দুক খুলে তার ভিতরে বেশ ভাল করে হাত আর চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর দেরাজ সমেত টেবিলটাকে পরীক্ষা করল, খাটের তোষকের নীচে দেখল, খাটের নীচে দেখল, ট্রাঙ্কের ভিতর দেখল (তাতে একজোড়া পুরনো জুতো আর একটা ছেড়া ন্যাকড়া ছাড়া আর কিছু নেই)। তারপর প্রত্যেকটা বাজনা আলাদা করে হাতে তুলে ওজন পরীক্ষা করে নেড়ে চেড়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে তার ফাঁপা বা ফেলা অংশে চাবির গর্ত আছে কি না দেখে আবার ঠিক যেমনভাব রাখা ছিল তেমনিভাবে রেখে দিল। তারপর ঘরের মেঝে আর দেয়ালের প্রত্যেকটা জায়গা আঙুলের গট দিয়ে ঠুকে ঠুকে দেখল। সমস্ত ব্যাপারটা করতে তার লাগল পনেরো মিনিট। তারপর আরও সাত মিনিট লাগল অন্য দুটাে ঘর আর বাথরুম দেখতে। সবশেষে আবার রাধারমণবাবুর ঘরে ফিরে এসে বলল, ‘মণিমোহনবাবু, আপনাদের মালীটিকে একবার ডাকুন তো।’ মালী এলে ফেলুদা তাকে দিয়ে ঘরের জানালায় রাখা দুটাে ফুলের টব থেকে মাটি বার করিয়ে তাতে কিছু নেই দেখে আবার মাটি ভরিয়ে ফুল সমেত টব জানালায় রাখল। এর মধ্যে অনুকূল বসবার ঘর থেকে চারটে চেয়ার এনে তার সামনে একটা গোল টেবিল পেতে তার উপর লেবুর সরবত রেখে গেছে। সরবতে চুমুক দিয়ে মণিবাবু বললেন, ‘কিছু বুঝলেন?’ ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, ‘এতগুলো বাজনা এক সঙ্গে না থাকলে এঘরে যে কোনও অবস্থাপন্ন লোক বাস করত সেটা বিশ্বাস করা কঠিন হত।’। ‘সেই তো বলছি’, মণিবাবু বললেন, ‘সাধে কি আপনাকে ডেকেছি! আমি তো একেবারে বোকা বনে গেছি মশাই। ‘ আমি বাজনাগুলোর দিকে দেখছিলাম। তার মধ্যে সেতার সরোদ তানপুরা এসরাজ তবলা বাঁশি—এগুলো আমি চিনি। অন্যগুলো আমি কখনও চোখেই দেখিনি। ফেলুদাও দেখেছে কি না
false
shirshendu
নিজের আবার বিয়ে বসার ইচ্ছে হয়েছে, সে কথাটা কবুল করলেই তো হয়। নিমাই জিব কেটে বলে, ও কথা বোলা না। কেন বলব না? গরজ তো তোমারই বেশী দেখছি! নিমাই দুঃখিত মুখে বলে, আমার আর্ষ নেই। অধিকারী না হলে কি হয়? তোমার মতো মানুষ পেয়েও কি হল কিছু। আর আমার জন্যই না তোমার এত আপদ-বিপদ-কষ্ট। অত বড় অসুখটা থেকে বাঁচিয়ে তুললে, খাওয়া পরার জোগাড় করলে। কিছু কম তো করোনি। আমার মা-বাবা বড় অভাবী, বড় লোভী। তারাই নামিয়ে দিল তোমাকে। সবই বরাত। এখন ভাবি, কিছু যদি শোধরানো যায়। আমাকে বোধহয় আজকাল তোমার সন্দেহ হয়! নিমাই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, তা সে দোষও আমার আছে। মনে কত পাপ লুকিয়ে থাকে মানুষের কার সঙ্গে সন্দেহ হয়? কাকা তো? সে বড় ভাল লোক। স্মাগলার হোক, কি আর যাই হোক, সে একটা জিনিস নিয়েই পড়ে আছে। পালা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবে না। অমন যার ধ্যান সে সহজে এসব দিকে ঝোঁকে? তাকে আমি খানিক চিনেছি। সে ঠিক ওরকম নয়। তবে যদি তোমার তাকে ভক্তি করতে ইচ্ছে করে তো মন্দ কী? কাকাকেই বিয়ে করতে পারো। সম্প্ৰদানটা কি তুমিই করবে নাকি? বড্ড রেগে যাচ্ছে। আমি হিংসুটে কথা বলিনি। আমার আর ওসব হয় না। বড় কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। কোথায় একটা শক্ত গিঁট পড়ে গেছে, খুলছে না। আমি অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। বেশ গুছিয়েই বলেছে। শোনো, যদি কাউকে বিয়ে করতে চাই তবে কি এতদিন তোমার অনুমতির জন্য বসেছিলাম? অনুমতি বা আদেশ দরকার হত নাকি? বরং নিজেকে বাঁচাতেই তোমাকে জোর করে ধরে এনেছিলাম। ভুলে গেছ সব? ভুলব? আমি কি তেমন নিমকহারাম? তুমিই তো সবচেয়ে বেশী নিমকহারাম। নাহলে ওকথা কেউ মুখে উচ্চারণ করে। বেইমান নও তুমি! নিমাই ফের মাথা নিচু করে। অনেকক্ষণ নিচু করে রাখে মুখ। বীণা দেখতে পায়, নিমাইয়ের চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে মাটির মেঝের ওপর। আমি মেয়েমানুষ, আমার অত বুদ্ধি নেই। মেয়েমানুষ চলে পুরুষের বুদ্ধিতে। কিন্তু পারলে তুমি আমাকে চালিয়ে নিতে? আমাকে নষ্ট বলে ধরে নিচ্ছে, কিন্তু যদি সত্যিই নষ্ট হই তার জন্য দায়ী কে থাকবে শুনি! তুমি ছাড়া আর কে? বউকে ফেলে চলে যাওয়ার মধ্যেই বুঝি তোমার সব বাহাদুরি? আর ভাবছো আমাকে আবার বিয়ে করার কথা বলে খুব উদারতা দেখানো হল। পুরুষমানুষের কান্না দুচোখে দেখতে পারে না বীণাপাণি। তার বুক জ্বলছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। বাইরে অজস্র সুতো ঝুলছে। ঝুলেই আছে। টিনের চালে মিঠে মিহিন বৃষ্টির শব্দ। একটা ব্যাঙ লাফ মেরে নিমাইয়ের সুটকেসটা ডিঙিয়ে চৌকির তলায় ঢুকে গেল। নিমাই ধরা গলায় বলল, আমরা একটু বোকাসোকা মানুষ। তোমাকে দেওয়ার মতো বুদ্ধিই কি আমার আছে! ভেবেচিন্তে একটা কথা হয়তো বললাম, সেটা তোমার হয়তো পছন্দ হল না। তোমাকে বড় ভয় খাই বীণাপাণি! বীণাপাণি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সেটা জানি। আমার পয়সায় খাও বলে তোমার ভারী লজ্জা। সবসময়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকো, যেন পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। তাই না? আজ তুমি বড় সুন্দর করে বলছো। এরকম করে বললে বুকের একটা জোর হয়! বলো, আরও খানিক বলো। বীণা লোকটার দিকে তাকাল। মাথাটা কি ঠাণ্ডা হয়েছে। ওর ঐ অনুতাপ হচ্ছে? সে বলল, তাহলে কথাগুলো সত্যি? খুব। তুমি যেন সবসময়ে আমার নাগালের বাইরে। যখন বিয়ে করে আনলাম তখন একরকম ছিলো। এখন যেন গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে পড়েছে। সেইজন্যেই কেমন যেন পর-পর লাগে, ভয়-ভয় লাগে। দোষটা কি আমার, বলো! নিমাই মাথা নেড়ে বলে, তোমার দোষ কেন হবে? আমিই কি একটা মানুষ? রোগে ভুগে আমার খানিকটা গেছে, ভয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি বলে আমার বারো আনাই বরবাদ। তার ওপর কাজ নেই, কর্ম নেই, আমি ষোল আনাই তো নষ্ট! তুমি ছিলে বলে টিক টিক করে বেঁচে আছি। কিন্তু পুরুষমানুষের এরকম বেঁচে থাকতে নেই, সে আমি খুব বুঝতে পারি। আমার মাঝে মাঝে ভীষণ মাথা গরম হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে পারি না। জানো তো? জানব না? এতকাল একসঙ্গে আছি। জানোই যদি, তবে একটা কথার জন্য চলে যাচ্ছে কেন? নিমাই এবার হাসল। তার রোগা মুখখানায় কোনও তেমন সৌন্দৰ্য নেই। তবে হাসলে ভারী ভাল দেখায়। লাজুক গলায় বলল, থাকতে বললে তবে তো থাকব। আমার তো কখনও তোমার ওপর রাগ-টাগ হয় না, অভিমান হয় না। শুধু ভাবি আমি থাকায় বীণার বড় অসুবিধে হচ্ছে। হাঁড়ি কলসিতেও ঠোকাঠুকি হয়, তা বলে যা নয়। তাই ভেবে নাও কেন? আর রাগ করে বাঁধন ছিড়লেই তো হবে না। তোমার মা-বাবাকে খাওয়াবে কি? সব দিক বিচার করে তবে তো কাজ করতে হয়! মা-বাবার কথা উঠলেই বড় দুঃখিত হয়ে পড়ে নিমাই। তার মা-বাবা বড় লোভী মানুষ। অভাবে অভাবেই এমনটা হয়েছে। একটু খাওয়া পরার আশায় সব ভাসিয়ে দিতে পারে। এমন কি বীণাপাণি যখন যাত্রায় নাম লেখায় তখন নিমাইয়ের মা খুব আশকারা দিয়ে বলেছিল,মনিবকে খুশি রাখতে চেষ্টা কোরো। শরীর যদি ঐটোকাটা হয়ে পড়ে তাহলে গঙ্গায় ড়ুব দিয়ে নিলেই হবে। একথা বীণাপাণিই বলেছে নিমাইকে। শুনে কানে হাত চাপা দিয়েছিল নিমাই। কিন্তু মায়ের ওপর তা বলে রাগ নেই তার। মা বড় বোকা মানুষ, বাবাও বড় বোকা মানুষ। এ দুটি বোকা মানুষের জন্য তার বড় মায়া। এ দুজন যদি খেতে না পায়, যদি কষ্ট
false
humayun_ahmed
না। মিসির আলি বললেন, গাছপালা তুমি খুব ভালবাস, তাই না? মাঝে মাঝে বাসি, মাঝে-মাঝে বাসি না। তুমি কি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পার? এখানে যে-সব গাছপালা আছে, তাদের সঙ্গে পারি না। তাহলে কাদের সঙ্গে পার? মেয়েটি জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি বললেন, তুমি আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দাও না কেন দাও না বল তো? কোনো বাধা আছে কি? তিনি সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আপনি আমাকে ভালো করে দিন। অসুখ সারিয়ে দিন। মিসির আলির খুবই মন-খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটি মেয়ে বাস করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতে-যে-জগতের সঙ্গে আশেপাশের চেনা জগতের কোনো মিল নেই। মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্টের ব্যাপারটি কাউকে বলতে পারছে না। সে নিজেও হয়তো জানে না পুরোপুরি। তিনি, আমি যাই? মেয়েটি কিছু বলল না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তিনি নিঃশব্দে কাঁদছে। ঢাকায় ফেরার টেনে উঠবার পর মিসির আলির মনে পড়ল, তিন কাপ চায়ের দাম তিনি দিয়ে আসেন নি। রশিদ নামের বুড়ো মানুষটি আগামীকাল তোরবেলায় যখন দেখবে, কেউ আসছে না, তখন না-জানি কি ভাববে। মিসির আলির মন গ্লানিতে ভরে গেল। কিন্তু কিছুই করার নেই। ঢাকা মেইল ছুটে চলেছে। পেছনে পড়ে আছে নদীর ধারে গড়ে-ওঠা চমৎকার একটি শহর। ডঃ জাবেদ আহসান অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমার কাছে ঠিক কী জানতে চান, বুঝতে পারছি না। কয়েকটি গাছপালার হাতে-আঁকা ছবি দিয়ে গিয়েছেন, আর তো কিছুই বলেন নি।‘ ছবিগুলো ভালো করে দেখেছেন? ভালো করে দেখার কী আছে? মিসির আলি লক্ষ করলেন ডঃ জাবেদ বেশ বিরক্ত। ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা তেমন কোনো কাজকর্ম করেন না, কিন্তু সব সময় ব্যস্ততার একটা ভঙ্গি করেন। ডঃ জাবেদ এই মুহূর্তে মুখের এমন ভাব করছেন, যেন তাঁর মহা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, এই গাছগুলি সম্পর্কে কিছু বলুন। ছবিতে আঁকা গাছগুলির কথা বলছি। কী বলব, সেটাই বুঝতে পারছি না! আপনি কী জানতে চাচ্ছেন? এই জাতীয় গাছ দেখেছেন কখনো? না। বইপত্রে এ রকম গাছের কোনো রেফারেন্স পেয়েছেন? দেখুন, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ ধরনের গাছ আছে। সব কিছু আমার জানার কথা নয়। আমার পিএইচ.ডি.র বিষয় ছিল প্লান্ট ব্রিডিং। সে-সম্পর্কে আপনাকে আমি কিছু বলতে পারি। আপনি একটি বাচ্চা মেয়ের আঁকা কতগুলি ছবি নিয়ে এসেছেন। সেই ছবিগুলি দেখে আমাকে গাছ সম্পর্কে বলতে বলছেন। এ-ধরনের ধাঁধার পেছনে সময় নষ্ট করার আমি কোনো অর্থ দেখছি না। মিসির আলি বললেন, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? বিরক্ত হচ্ছি, কারণ আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। মিসির আলি বললেন, আপনি তো বসে-বসে টিভি দেখছিলেন। তেমন কিছুতো করছিলেন না। সময় নষ্ট করার কথা উঠছে না। মিসির আলি ভাবলেন, এই কথায় ভদ্রলোক ভীষণ রেগে যাবেন। গেট আউট জাতীয় কথাবার্তাও বলে বসতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন কিছু হল না। ডঃ জাবেদকে মনে হল, তিনি খানিকটা অপ্ৰস্তুত হয়েছেন। অপ্ৰস্তৃত মানুষেরা যেমন খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাশতে থাকে, ভদ্রলোক সে-রকম কাশছেন। কাশি থামাবার পর বেশ মোলায়েম স্বরে বললেন, একটু চা দিতে বলি? জ্বি-না। চা খাব না। একটু খান, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়েছে। চা ভালোই লাগবে। বলুন, চায়ের কথা বলে আসি। চা এল। শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে নানান রকমের খাবারদাবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়ির এই একটি বিশেষত্ব আছে। এরা অতিথিকে চায়ের সঙ্গে নানান রকম খাবার দাবার দেয়, যা দেখে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে, এই সম্প্রদায় আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু। মিসির আলি সাহেব, চা নিন। তিনি চা নিলেন। বলুন, স্পেসিফিক্যালি আপনি কী জানতে চান। পৃথিবীতে ঠিক এ-জাতীয় গাছ আছে কি না তা কে বলতে পারবে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, গাছপালার ক্যাটালগজাতীয় কিছু কি আছে, যেখানে সব-জাতীয় গাছপালার ছবি আছে? তাদের সম্পর্কে তথ্য লেখা আছে? হ্যাঁ, নিশ্চয় আছে। এ-দেশে নেই! বোটানিক্যাল সোসাইটিগুলিতে আছে। ওদের একটি কাজই হচ্ছে গাছপালার বিভিন্ন স্পেসিসকে সিসটেমেটিকভাবে ক্যাটালগিং করা! আপনি কি আমাকে কিছু লোকজনের ঠিকানা দিতে পারবেন, যাঁরা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন? হ্যাঁ, পারি। আপনি যাবার সময় আমি ঠিকানা লিখে দেব। আর কী জানতে চান? মানুষ এবং গাছের মধ্যে পার্থক্য কী? প্রশ্নটা আরো গুছিয়ে করুন। মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, আমরা তো জানি গাছের জীবন আছে। কিন্তু আমি যা জানতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে, গাছের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের মিলটা কোথায়? চট করে উত্তর দেওয়া যাবে না। এর উত্তর দেবার আগে আমাদের জানতে হবে। জীবন মানে কি? এখনো আমরা পুরোপুরি ভাবে জীবন কী তা-ই জানি না। বলেন কী। জীবন কী জানেন না। হ্যাঁ, তাই। বিজ্ঞান অনেক দূর আমাদেরকে নিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছু আমরা জানি না। অনেক আনসলভ্‌ড্‌ মিস্ট্রি রয়ে গেছে। আপনাকে আরেক কা চা দিতে বলি? বলুন। ডঃ জাবেদ সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে গাছের মিল অনেক বেশি। বলেন কী। হ্যাঁ, তাই। আসল জিনিস হচ্ছে জীন, যা ঠিক করে কোন প্রোটিন তৈরি করা দরকার। অনেকগুলি জীন নিয়ে হয় একটি ডিএনএ মলিকুল। ডিওক্সি রিবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড। প্রাণের আদি ব্যাপার হচ্ছে এই জটিল অণু। এই অণু থাকে জীবকোষে। তারা ঠিক করে একটি প্রাণী মানুষ হবে, না। গাছ হবে, না সাপ হবে। মাইটোকনিড়িয়া বলে
false
humayun_ahmed
কেউ ফ্রিজেও হাত দেবে না। মীরার ধারণা বাড়ি দেখে আনন্দে যে মানুষটা সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলতেন তিনি নিশোর দাদাজান। তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক রাত ছেলের বাড়িতে কাটিয়ে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি যে বের হয়েছেন আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। আগের হোটেলেও যাননি। শফিক নানা জায়গায় তাকে খোজাখুঁজি করছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এটা নিয়ে মনোয়ারা মোটেই চিন্তিত না। তিনি মীরাকে বলেছেন, তোমার শ্বশুর কোথায় আছে আমি জানি। তোমরা খামখা অস্থির হয়ো না। মীরা ভীত গলায় বলল, উনি কোথায় আছেন? হোটেলে থাকার সময় বাজারের কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। আম্মা এইসব কি বলেন? পুরুষ জাতিকে আমি চিনি। তুমি চেন না। যেটা বললাম এটাই সত্যি। শফিককে নিষেধ করে দিবে খামখা যেন ছোটাছুটি না করে। জি আচ্ছা নিষেধ করব। মীরা এই প্রথম তার নিজের সংসারের জন্যে কাজের মেয়ে রেখেছে। মেয়েটার নাম ফুলি। বয়স বারো-তের। প্রচুর কাজ করতে পারে। তাকে দিয়ে কাজ করানোর সময় মীরার একই সময় একটু লজ্জা লজ্জা লাগে আবার অহংকারও হয়। ফুলিকে সে মাঝে মাঝে উপদেশ দেয়। তখন নিজেকে অনেক বড় মনে হয়। মনে হয় তার অনেক ক্ষমতা। ফুলি শোন, মন দিয়ে কাজ করবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। অবসর সময়ে আমার শাশুড়ির সেবা করবে। তোমার কিসে ভালো হয় সেটা আমি দেখব। বিয়ের বয়স হোক, ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। ঠিক আছে? জি আম্মা ঠিক আছে। আমাকে আম্মা ডাকবে না। আমাকে ডাকবে আপা আর নিশোর বাবাকে ডাকবে ভাইজান। নিশোকে ডাকবে নিশো মামণি। আগে মীরার দুপুরে ঘুমের অভ্যাস ছিল না। এখন ঘুমের অভ্যাস হয়েছে। রোজ দুপুরে ফ্যান ছেড়ে মেঝেতে পাটি পেতে সে কিছুক্ষণ ঘুমায়। সেই সময় ফুলি মাথায় তেল দিয়ে চুল টেনে দেয়। আরামে মীরার শরীর অবশ হয়ে আসে। মীরার মনে হয় তার মতো সুখী মেয়ে ঢাকা শহরে নেই। এর মধ্যে একদিন মীরা বাথটাবে গোসল করেছে। সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো স্নান। বাথটাব ভর্তি ফেনা মেশানো পানি। সে গলা ড়ুবিয়ে শুয়ে আছে। শরীর ফেনার নিচে রাখতে হচ্ছে কারণ সিনেমার নায়িকাদের মতো তার গায়েও কোনো কাপড় নেই। শুরুতে খুব লজ্জা লাগছিল। পরে আর লাগেনি। মীরা ঠিক করে রেখেছে শাশুড়ি যেদিন থাকবেন না সেদিন শফিককে নিয়ে একসঙ্গে বাথটাবে গোসল করবে। সেদিন নিশোকেও বাড়িতে রাখা যাবে না। কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। মেয়ে ভীষণ পাজি হয়েছে, সবাইকে বলে দেবে বাবা-মা একসঙ্গে গোসল করেছে। কাজের মেয়েটাকেও সেদিন বাসায় রাখা ঠিক হবে না। একদিন মঞ্জু মামা এসেছিলেন ফ্ল্যাট দেখতে। তাঁকে ঠিকানা দেয়া হয়নি। তিনি খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলেছেন। ফ্ল্যাট দেখে তিনি মুগ্ধ। মীরা বলল, মামা এগুলি হচ্ছে কোম্পানির থার্ড ক্যাটাগরির ফ্ল্যাট। সেকেন্ড ক্যাটাগরিগুলি আরো অনেক সুন্দর। সব রুমে এসির ব্যবস্থা। মঞ্জু মামা বললেন, তাহলে ফার্স্ট ক্যাটাগরির ঘটনা কী? কারা থাকে সেখানে? কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার টাইপের অফিসাররা। ইন্ডিপেনডেন্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে লন আছে। ফুলের বাগান আছে। ফুলের বাগানের জন্যে মালি আছে। বলিস কী? শফিক জেনারেল ম্যানেজার হবে কবে? মীরা বলল, জানি না কবে হবে। যা হয়েছে এতেই আমি খুশি। আচ্ছা মামা সেকেন্ড হেল্ড এসি কোথায় পাওয়া যায় কত দাম কিছু জানো? ভাবছি একটা এসি লাগাব। ও গরমে ঘুমাতে পারে না। কষ্ট করে। অফিসে সারাদিন পরিশ্রম করে। রাতে ঘুম দরকার। এসি লাগাবি যখন নতুন লাগা। আমি খোঁজ-খবর করে দেখি কোন কোম্পানি ভালো। মীরা গাঢ় গলায় বলল, দেখো খোঁজ নিয়ে। তোদের টেলিফোন আছে না? নাম্বার দে নিয়ে যাই। নাম্বার এখনো লাগেনি মামা। এক সপ্তাহের মধ্যে লাগবে। বাথরুম কয়টা? তিনটা বাথরুম। বাথটাব আছে। হট ওয়াটারের সিস্টেম আছে। কথাগুলি বলে মীরা কি যে আনন্দ পাচ্ছে। টাকা ধার করার জন্যে কতবার উনার কাছে যেতে হয়েছে। একবার সে দুই গাছি সোনার চুড়ি নিয়ে গিয়েছিল। মঞ্জু মামা যদি কোথাও চুড়ি বন্ধক রেখে কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। মামা চুড়ি রাখেননি। চুড়ি তার হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। চুড়ি পরানোর সময় কি বিশ্রীভাবেই না হাত ধরলেন। তখন মীরার ইচ্ছা করছিল মঞ্জু মামাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে। সে সরিয়ে দিতে পারেনি। তার টাকার দরকার ছিল। টাকা খুবই বড় জিনিস। মঞ্জু মামা। বল। তুমি কিন্তু আজ দুপুরে খেয়ে যাবে। আমাদের নতুন কাজের মেয়ে ফুলি নাম। তার বয়স অল্প হলেও রাধে ভালো। কি খেতে চাও মামা বলো। পোলাও রাধব? গরমের মধ্যে পোলাও করবি? আচ্ছা ঠিক আছে। তোর শ্বশুর-শাশুড়িকে এখন কাছে এনে রাখ। বিরাট বাড়ি। বাবা-মাতে আমাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের আলাদা ঘর আছে। তারা কোথায়? আমার শাশুড়ি নিউ মার্কেটে গেছেন নিশোকে নিয়ে। নিজে পছন্দ করে বিছানার চাদর কিনবেন। তোর শ্বশুর কই? উনি কোথায় জানি গিয়েছেন। বাসা খালি? কাজের মেয়েটা আছে। মীরা লক্ষ্য করল মঞ্জু মামা এক-দৃষ্টিতে তার নাভির দিকে তাকিয়ে আছেন। মীরা ঠিক করে ফেলল সে বাথরুমে ঢুকে শাড়িটা আরেকটু নিচু করে পরবে। যাতে মঞ্জু মামা ভালোমতো নাভি দেখতে পারেন। মীরা তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে যাতে মঞ্জু মামা তার পেটে হাত রাখতে পারেন। তখন মীরা কষে একটা চড় লাগাবে। চড় খাবার পর মামার মুখের ভাব কেমন হয় এটা মীরার অনেক দিনের দেখার শখ। মঞ্জু মামা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুই কাছে এসে বস গল্প করি। তোর শ্বশুর
false
robindronath
তোমার পছন্দ, তবে আর-একটা চারা আনিয়ে বেড়ার ধারে পুঁতে দেব, সুন্দর দেখতে হবে।” কিন্তু কাটবার কথা বললেই আঁতকে ওঠে, আর ওর কাকি বলে, “আহা, এমনিই কী খারাপ দেখতে হয়েছে।” আমার বউদিদির মৃত্যু হয়েছে যখন এই ছেলেটি তাঁর কোলে। বোধ করি সেই শোকে দাদার খেয়াল গেল, তিনি বিলেতে এঞ্জিনিয়ারিং শিখতে গেলেন। ছেলেটি আমার নিঃসন্তান ঘরে কাকির কোলেই মানুষ। বছর দশেক পরে দাদা ফিরে এসে বলাইকে বিলাতি কায়দায় শিক্ষা দেবেন ব’লে প্রথমে নিয়ে গেলেন সিমলেয়— তার পরে বিলেতে নিয়ে যাবার কথা। কাঁদতে কাঁদতে কাকির কোল ছেড়ে বলাই চলে গেল, আমাদের ঘর হল শূন্য। তার পরে দু বছর যায়। ইতিমধ্যে বলাইয়ের কাকি গোপনে চোখের জল মোছেন, আর বলাইয়ের শূন্য শোবার ঘরে গিয়ে তার ছেঁড়া এক-পাটি জুতো, তার রবারের ফাটা গোলা, আর জানোয়ারের গল্পওয়ালা ছবির বই নাড়েন-চাড়েন; এতদিনে এই-সব চিহ্নকে ছাড়িয়ে গিয়ে বলাই অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে, এই কথা বসে বসে চিন্তা করেন। কোনো-এক সময়ে দেখলুম, লক্ষ্মীছাড়া শিমুলগাছটার বড়ো বাড় বেড়েছে— এতদূর অসংগত হয়ে উঠেছে যে আর প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। এক সময়ে দিলুম তাকে কেটে। এমন সময়ে সিমলে থেকে বলাই তার কাকিকে এক চিঠি পাঠালে, “কাকি, আমার সেই শিমুলগাছের একটা ফোটোগ্রাফ পাঠিয়ে দাও।” বিলেত যাবার পূর্বে একবার আমাদের কাছে আসবার কথা ছিল, সে আর হল না। তাই বলাই তার বন্ধুর ছবি নিয়ে যেতে চাইলে। তার কাকি আমাকে ডেকে বললেন, “ওগো শুনছ, একজন ফোটোগ্রাফওয়ালা ডেকে আনো।” জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন।” বলাইয়ের কাঁচা হাতের লেখা চিঠি আমাকে দেখতে দিলেন। আমি বললেম, “সে গাছ তো কাটা হয়ে গেছে।” বলাইয়ের কাকি দুদিন অন্ন গ্রহণ করলেন না, আর অনেকদিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে একটি কথাও কন নি। বলাইয়ের বাবা ওকে তাঁর কোল থেকে নিয়ে গেল, সে যেন ওঁর নাড়ী ছিঁড়ে; আর ওর কাকা তাঁর বলাইয়ের ভালোবাসার গাছটিকে চিরকালের মতো সরিয়ে দিলে, তাতেও ওঁর যেন সমস্ত সংসারকে বাজল, তাঁর বুকের মধ্যে ক্ষত ক’রে দিলে। ঐ গাছ যে ছিল তাঁর বলাইয়ের প্রতিরূপ, তারই প্রাণের দোসর। প্রথম পরিচ্ছেদ অনেক অবস্থান্তরের পর অবশেষে গতযৌবনা ক্ষীরোদা যে পুরুষের আশ্রয় প্রাপ্ত হইয়াছিল, সেও তাহাকে জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করিয়া গেল। তখন অন্নমুষ্টির জন্য দ্বিতীয় আশ্রয় অন্বেষণের চেষ্টা করিতে তাহার অত্যন্ত ধিক্কার বোধ হইল। যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়। তখন আর উদ্দাম যৌবনের বসন্তচঞ্চলতা শোভা পায় না। তত দিনে সংসারের মাঝখানে আমাদের ঘর বাঁধা একপ্রকার সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে; অনেক ভালো-মন্দ, অনেক সুখদুঃখ, জীবনের মধ্যে পরিপাক প্রাপ্ত হইয়া অন্তরের মানুষটিকে পরিণত করিয়া তুলিয়াছে; আমাদের আয়ত্তের অতীত কুহকিনী দুরাশার কল্পনালোক হইতে সমস্ত উদ্ভ্রান্ত বাসনাকে প্রত্যাহরণ করিয়া আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতার গৃহপ্রাচীরমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; তখন নূতন প্রণয়ের মুগ্ধদৃষ্টি আর আকর্ষণ করা যায় না, কিন্তু পুরাতন লোকের কাছে মানুষ আরো প্রিয়তর হইয়া উঠে। তখন যৌবনলাবণ্য অল্পে অল্পে বিশীর্ণ হইয়া আসিতে থাকে, কিন্তু জরাবিহীন অন্তর-প্রকৃতি বহুকালের সহবাসক্রমে মুখে চক্ষে যেন স্ফুটতর রূপে অঙ্কিত হইয়া যায়, হাসিটি দৃষ্টিপাতটি কণ্ঠস্বরটি ভিতরকার মানুষটির দ্বারা ওতপ্রোত হইয়া উঠে। যাহা কিছু পাই নাই তাহার আশা ছাড়িয়া, যাহারা ত্যাগ করিয়া গিয়াছে তাহাদের জন্য শোক সমাপ্ত করিয়া, যাহারা বঞ্চনা করিয়াছে তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়া – যাহারা কাছে আসিয়াছে, ভালোবাসিয়াছে, সংসারের সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা শোকতাপ বিচ্ছেদের মধ্যে যে-কয়টি প্রাণী নিকটে অবশিষ্ট রহিয়াছে, তাহাদিগকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া – সুনিশ্চিত সুপরীক্ষিত চিরপরিচিতগণের প্রীতিপরিবেষ্টনের মধ্যে নিরাপদ নীড় রচনা করিয়া, তাহারই মধ্যে সমস্ত চেষ্টার অবসান এবং সমস্ত আকাঙ্খার পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়। যৌবনের সেই স্নিগ্ধ সায়াহ্নে জীবনের সেই শান্তিপর্বেও যাহাকে নূতন সঞ্চয়, নূতন পরিচয়, নূতন বন্ধনের বৃথা আশ্বাসে নূতন চেষ্টায় ধাবিত হইতে হয় – তখনও যাহার বিশ্রামের জন্য শয্যা রচিত হয় নাই, যাহার গৃহপ্রত্যাবর্তনের জন্য সন্ধ্যাদীপ প্রজ্বলিত হয় নাই – সংসারে তাহার মতো শোচনীয় আর কেহ নাই। ক্ষীরোদা তাহার যৌবনের প্রান্তসীমায় যেদিন প্রাতঃকালে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল তাহার প্রণয়ী পূর্বরাত্রে তাহার সমস্ত অলংকার ও অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, বাড়িভাড়া দিবে এমন সঞ্চয় নাই – তিন বৎসরের শিশু পুত্রটিকে দুধ আনিয়া খাওয়াইবে এমন সংগতি নাই – যখন সে ভাবিয়া দেখিল, তাহার জীবনের আটত্রিশ বৎসরে সে একটি লোককেও আপনার করিতে পারে নাই, একটি ঘরের প্রান্তেও বাঁচিবার ও মরিবার অধিকার প্রাপ্ত হয় নাই – যখন তাহার মনে পড়িল, আবার আজ অশ্রুজল মুছিয়া দুই চক্ষে অঞ্জন পরিতে হইবে, অধরে ও কপোলে অলক্তরাগ চিত্রিত করিতে হইবে, জীর্ণ যৌবনকে বিচিত্র ছলনায় আচ্ছন্ন করিয়া হাস্যমুখে অসীম ধৈর্য-সহকারে নূতন হৃদয়-হরণের জন্য নূতন মায়াপাশ বিস্তার করিতে হইবে – তখন সে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ভূমিতে লুটাইয়া বারংবার কঠিন মেঝের উপর মাথা খুঁড়িতে লাগিল – সমস্ত দিন অনাহারে মুমূর্ষুর মতো পড়িয়া রহিল। সন্ধ্যা হইয়া আসিল। দীপহীন গৃহকোণে অন্ধকার ঘনীভূত হইতে লাগিল। দৈবক্রমে একজন পুরাতন প্রণয়ী আসিয়া “ক্ষীরো” “ক্ষীরো” শব্দে দ্বারে করাঘাত করিতে লাগিল। ক্ষীরোদা অকস্মাৎ দ্বার খুলিয়া ঝাঁটা হস্তে বাঘিনীর মতো গর্জন করিয়া ছুটিয়া আসিল; রসপিপাসু যুবকটি অনতিবিলম্বে পলায়নের পথ অবলম্বন করিল। ছেলেটা ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া খাটের নীচে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, সেই গোলমালে জাগিয়া উঠিয়া অন্ধকারের মধ্য হইতে ভগ্নকাতর কণ্ঠে ‘মা’ ‘মা’ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তখন ক্ষীরোদা সেই রোরুদ্যমান শিশুকে প্রাণপণে
false
bongkim
কেন যাই? কথা শুনিব বলিয়া? কখন কেহ শুনিয়াছে যে, কোন রমণী শুধু কথা শুনিয়া উন্মাদিনী হইয়াছে? আমিই কি তাই হইয়াছি? তাও কি সম্ভব? যদি তাই হয়, তবে বাদ্য শুনিবার জন্য, বাদকের বাড়ী যাই না কেন? সেতার, সারেঙ্গ, এসরাজ, বেহালার অপেক্ষা কি শচীন্দ্র সুকণ্ঠ? সে কথা মিথ্যা। তবে কি সেই স্পর্শ? আমি যে কুসুমরাশি রাত্রি দিবা লইয়া আছি, কখন পাতিয়া শুইতেছি, কখন বুকে চাপাইতেছি-ইহার অপেক্ষা তাহার স্পর্শ কোমল? তা ত নয়। তবে কি? এ কাণাকে কে বুঝাইবে, তবে কি? তোমরা বুঝ না, বুঝাইবে কি? তোমাদের চক্ষু: আছে, রূপ চেন, রূপই বুঝ। আমি জানি, রূপ দ্রষ্টার মানসিক বিকার মাত্র-শব্দও মানসিক বিকার। রূপ রূপবানে নাই, রূপ দর্শকের মনে-নহিলে একজনকে সকলেই সমান রূপবান দেখে না কেন? একজনে সকলেই আসক্ত হয় না কেন? সেইরূপ শব্দও তোমার মনে। রূপ দর্শকের একটি মনের সুখ মাত্র, শব্দও শ্রোতার একটি মনের সুখ মাত্র, স্পর্শও স্পর্শকের মনের সুখ মাত্র। যদি আমার রূপসুখের পথ বন্ধ থাকে, তবে শব্দ স্পর্শ গন্ধ কেন রূপসুখের ন্যায় মনোমধ্যে সর্বময় না হইবে? শুষ্ক ভূমিতে বৃষ্টি পড়িলে কেন না সে উৎপাদিনী হইবে? শুষ্ক কাষ্ঠে অগ্নি সংলগ্ন হইলে কেন না সে জ্বলিবে? রূপে হোক, শব্দে হোক, স্পর্শে হোক, শূন্য রমণীহৃদয়ে সুপুরুষসংস্পর্শ হইলে কেন প্রেম না জন্মিবে? দেখ, অন্ধকারেও ফুল ফুটে, মেঘে ঢাকিলেও চাঁদ গগনে বিহার করে, জনশূন্য অরণ্যেও কোকিল ডাকে, সে সাগরগর্ভে মনুষ্য কখন যাইবে না, সেখানেও রত্ন প্রভাসিত হয়, অন্ধের হৃদয়েও প্রেম জন্মে, আমার নয়ন নিরুদ্ধ বলিয়া হৃদয় কেন প্রস্ফুটিত হইবে না? হইবে না কেন, কিন্তু সে কেবল আমার যন্ত্রণার জন্য। বোবার কবিত্ব, কেবল তাহার যন্ত্রণার জন্য। বধিরের সঙ্গীতানুরাগ যদি হয়, কেবল তাহার যন্ত্রণার জন্য; আপনার গীত আপনি শুনিতে পায় না। আমার হৃদয়ে প্রণয়সঞ্চার তেমনই যন্ত্রণার জন্য। পরের রূপ দেখিব কি-আমি আপনার কখন আপনি দেখিলাম না। রূপ! রূপ! আমার কি রূপ! এই ভূমণ্ডলে রজনীনামে ক্ষুদ্র বিন্দু কেমন দেখায়? আমাকে দেখিলে, কখনও কি কাহার আবার ফিরিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয় নাই? এমন নীচাশয়, ক্ষুদ্র কেহ কি জগতে নাই যে, আমাকে সুন্দর দেখে? নয়ন না থাকিলে নারী সুন্দরী হয় না-আমার নয়ন নাই-কিন্তু তবে কারিগরে পাথর খোদিয়া চক্ষু:শূন্য মূর্তি গড়ে কেন? আমি কি কেবল সেইরূপ পাষাণী মাত্র? তবে বিধাতা এ পাষাণমধ্যে এ সুখদু:খসমাকুল প্রণয়ালালসাপরবশ হৃদয় কেন পুরিল? পাষাণের দু:খ পাইয়াছি, পাষাণের সুখ পাইলাম না কেন? এ সংসারে এ তারতম্য কেন? অনন্ত দুষ্কৃতিকারীও চক্ষে দেখে আমি জন্মপূর্বেই কোন্ দোষ করিয়াছিলাম যে, আমি চক্ষে দেখিতে পাইব না? এ সংসারে বিধাতা নাই, বিধান নাই, পাপপুণ্যের দণ্ড পুরস্কার নাই-আমি মরিব। আমার এই জীবনে বহু বৎসর গিয়াছে-বহু বৎসর আসিতেও পারে! বৎসরে বৎসরে বহু দিবস-দিবসে দিবসে বহু দণ্ড-দণ্ডে দণ্ডে বহু মুহূর্ত-তাহার মধ্যে এক মুহূর্ত জন্য, এক পলক জন্য, আমার কি চক্ষু ফুটিবে না? এক মুহূর্ত জন্য, চক্ষু: মেলিতে পারিলে দেখিয়া লই, এই শব্দস্পর্শময় বিশ্বসংসার কি-আমি কি-শচীন্দ্র কি? চতুর্থ পরিচ্ছেদ আমি প্রত্যহই ফুল লইয়া যাইতাম, ছোট বাবুর কথায় শব্দশ্রবণ প্রায় ঘটিত না-কিন্তু কদাচিৎ দুই এক দিন ঘটিত। সে আহ্লাদের কথা বলিতে পারি না। আমার বোধ হইত, বর্ষার জলভরা মেঘ যখন ডাকিয়া বর্ষে, তখন মেঘের বুঝি সেইরূপ আহ্লাদ হয়; আমারও সেইরূপ ডাকিতে ইচ্ছা করিত। আমি প্রত্যহ মনে করিতাম, আমি ছোট বাবুকে কতকগুলি বাছা ফুলের তোড়া বাঁধিয়া দিয়া আসিব-কিন্তু তাহা একদিনও পারিলাম না। একে লজ্জা করিত-আবার মনে ভাবিতাম, ফুল দিলে তিনি দাম দিতে চাহিবেন-কি বলিয়া না লইব? মনের দু:খে ঘরে আসিয়া ফুল লইয়া ছোট বাবুকেই গড়িতাম। কি গড়িতাম, তাহা জানি না-কখন দেখি নাই। এদিকে আমার যাতায়াতে একটি অচিন্তনীয় ফল ফলিতেছিল-আমি তাহার কিছুই জানিতাম না। পিতামাতার কথোপকথনে তাহা প্রথম জানিতে পারিলাম। একদিন সন্ধ্যার পর, আমি মালা গাঁথিতে গাঁথিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। কি একটা শব্দে নিদ্রা ভাঙ্গিল। জাগ্রত হইলে কর্ণে পিতামাতার কথোপকথনের শব্দ প্রবেশ করিল। বোধ হয়, প্রদীপ নিবিয়া গিয়া থাকিবে; কেন না, পিতামাতা আমার নিদ্রাভঙ্গ জানিতে পারিলেন, এমত বোধ হইল না। আমিও আমার নাম শুনিয়া কোন সাড়াশব্দ করিলাম না। শুনিলাম, মা বলিতেছেন, “তবে একপ্রকার স্থিরই হইয়াছে?” পিতা উত্তর করিলেন, “স্থির বৈ কি? অমন বড়মানুষ লোক, কথা দিলে কি আর নড়চড় আছে? আর আমার মেয়ে দোষের মধ্যে অন্ধ, নহিলে অমন মেয়ে লোকে তপস্যা করিয়া পায় না |” মাতা। তা, পরে এত করবে কেন? পিতা। তুমি বুঝিতে পার না যে, ওরা আমাদের মত টাকার কাঙ্গাল নয়-হাজার দুহাজার টাকা ওরা টাকার মধ্যে ধরে না। যে দিন রজনীর সাক্ষাতে রামসদয় বাবুর স্ত্রী বিবাহের কথা প্রথম পাড়িলেন, সেই দিন হইতে রজনী তাঁহার কাছে প্রত্যহ যাতায়াত আরম্ভ করিল। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “টাকায় কি কাণার বিয়ে হয়?” ইহাতে অবশ্য মেয়ের মনে আশা ভরসা হইতে পারে যে, বুঝি ইনি দয়াবতী হইয়া টাকা খরচ করিয়া আমার বিবাহ দিবেন। সেই দিন হইতে রজনী নিত্য যায় আসে। সেই দিন হইতে নিত্য যাতায়াত দেখিয়া লবঙ্গ বুঝিলেন যে, মেয়েটি বিবাহের জন্য বড় কাতর হয়েছে-না হবে কেন, বয়স ত হয়েছে! তাতে আবার ছোট বাবু টাকা দিয়া হরনাথ বসুকে রাজি করিয়াছেন। গোপালও রাজি হইয়াছে। হরনাথ বসু রামসদয় বাবুর বাড়ীর সরকার। গোপাল তাহার পুত্র। গোপালের কথা কিছু কিছু জানিতাম। গোপালের বয়স ত্রিশ বৎসর-একটি বিবাহ আছে, কিন্তু সন্তানাদি
false
MZI
শুভাকাঙ্ক্ষী, তার অনেক বন্ধ,ু তার অনেক ক্ষমতা, তার এই নতুন জীবনে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি। গত বছর এরকম সময়ে হঠাত্ করে মনে হল এখন তার পাশে আমার থাকা প্রয়োজন। ক্যান্সারের চিকিত্সা করার জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছে, সবকিছু ভালোভাবে হয়েছে। শেষ অপারেশনটি করার আগে দেশ থেকে ঘুরে গেল, সুস্থ সবল একজন মানুষ। যখন অপারেশন হয় প্রতি রাতে ফোন করে খোঁজ নিয়েছি, সফল অপারেশন করে ক্যান্সারমুক্ত সুস্থ একজন মানুষ বাসায় তার আপনজনের কাছে ফিরে গেছে, এখন শুধু দেশে ফিরে আসার অপেক্ষা। তারপর হঠাত্ করে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল, সার্জারী পরবর্তীতে অবিশ্বাস্য একটি জটিলতার কারণে তাকে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে হল। আমি আর আমার স্ত্রী চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে নিউইয়র্কে হাজির হলাম। ব্রুকলিন নামের শহরে আমার ছেলেমেয়েরা আমাদের জন্য একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে রেখেছে। সেখানে জিনিসপত্র রেখে বেলভিউ হাসপাতালে ছুটে গেলাম। প্রকাশক মাজহার আমাদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে গেলেন, সেখানে তার স্ত্রী শাওনের সাথে দেখা হল। উঁচু বিছানায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে রেখেছে। তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা একটু ভালো হলে তাকে জাগিয়ে তোলা হবে। আমরা প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে হাসপাতালে যাই, সারাদিন সেখানে অপেক্ষা করি, গভীর রাতে ব্রুকলিনে ফিরে আসি। হুমায়ূন আহমেদকে আর জাগিয়ে তোলা হয় না। আমি এতো আশা করে দেশ থেকে ছুটে এসেছি তার হাত ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলব, অভিমানের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মুহূর্তে সেই দূরত্ব দূর হয়ে যাবে, কিন্তু সেই সুযোগটা পাই না। ইনটেনসিভ কেয়ারের ডাক্তারদের সাথে পরিচয় হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, এতোদিনে তারা বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে থাকা মানুষটির গুরুত্বের কথাও জেনে গেছে। তারা আমাকে বলল, হুমায়ূন আহমেদ ঘুমিয়ে থাকলেও তারা তোমাদের কথা শুনতে পায়। তার সাথে কথা বলো। তাই যখন আশেপাশে কেউ না থাকে তখন আমি তার সাথে কথা বলি। আমি তাকে বলি দেশের সব মানুষ, সব আপনজন তার ভালো হয়ে ওঠার জন্য দোয়া করছে। আমি তাকে মায়ের কথা বলি, ভাইবোনদের কথা বলি, ছেলেমেয়ের কথা বলি। সে যখন ভালো হয়ে যাবে তখন তার এই চেতন-অচেতন রহস্যময় জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে কী অসাধারণ বই লিখতে পারবে তার কথা বলি। তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হলেও এটা যে স্বপ্ন নয় আমি তাকে মনে করিয়ে দিই, দেশ থেকে চলে এসে তখন আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি এটা যে সত্যি, সেটা তাকে বিশ্বাস করতে বলি। ঘুমন্ত হুমায়ূন আহমেদ আমার কথা শুনতে পারছে কী না সেটা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি সে শুনছে, কারণ তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকি। একদিন হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিপাশা তার বাবাকে দেখতে এলো। যে কারণেই হোক বহুকাল তারা বাবার কাছে যেতে পারেনি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সে যখন গভীর মমতায় তার বাবার কপালে হাত রেখে তাকে ডাকল, কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে কথা বলল, আমরা দেখলাম আবার তার দুই চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন, মনে হয় সে জন্যই এই দুঃখগুলো দিতেও কখনো কার্পণ্য করেননি। ১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মত আমি হাসপাতালে গিয়েছি, ভোর বেলা হঠাত্ করে আমার মা আমাকে ফোন করলেন। ফোন ধরতেই আমার মা হাহাকার করে বললেন, আমার খুব অস্থির লাগছে। কী হয়েছে বল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হবে, কিছুই হয়নি। প্রত্যেকদিন যেরকম হাসপাতালে আসি আজকেও এসেছি। সবকিছু অন্যদিনের মতো, কোনো পার্থক্য নেই। আমার মায়ের অস্থিরতা তবুও যায় না, অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করে ফোনটা রেখেছি, ঠিক সাথে সাথে আমার কাছে খবর এলো আমি যেন এই মুহূর্তে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যাই। হুমায়ূন আহমেদ মারা যাচ্ছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তথ্য কেমন করে পাঠানো সম্ভব তার সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমি জানি। কিন্তু পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে একজন মা কেমন করে তার সন্তানের মৃত্যুক্ষণ নিজে থেকে বুঝে ফেলতে পারে আমার কাছে তার ব্যাখ্যা নেই। আমি দ্রুত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের কেবিনে সকল ডাক্তার ভিড় করেছে, তার চিকিত্সার দায়িত্বে থাকা ড মিলারও আছেন। আমাদের দেখে অন্যদের বললেন, আপনজনদের কাছে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এখন তাকে চলে যেতে দিতে হবে। আমার স্ত্রী ইয়াসমিন আমাকে বলল, আমার মাকে খবরটা দিতে হবে। ১৯৭১ সালে আমি আমার মাকে আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে তার সারাটা জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতোদিন পর আবার আমি নিষ্ঠুরের মতো তাকে তার সন্তানের আসন্ন মৃত্যুর কথা বলব? আমি অবুঝের মতো বললাম, আমি পারব না। ইয়াসমীন তখন সেই নিষ্ঠুর দায়িত্বটি পালন করল, মুহূর্তে দেশে আমার মা, ভাইবোন সব আপনজনের হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সব স্বপ্ন, সব আশা এক ফুত্কারে নিভে গেল। কেবিনের ভেতর উঁচু বিছানায় শুয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তার কাছে শাওন দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে ডেকে হুমায়ূন আহমেদকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে চাইছে। আমরা বোধশক্তিহীন মানুষের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে তরুণ ডাক্তার এতোদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে এসেছে সে বিষণ্ন গলায় আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল, বলল, আর খুব বেশি সময় নেই।
false
humayun_ahmed
সময়ের আগেই বুড়িয়ে গেছেন। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, আরো কুজো হয়ে পড়েছেন। বাবা অবাক হয়ে বললেন, কী আশ্চৰ্য, আবার দেখা হবে ভাবি নি। এখানে কোথায় থাক তুমি? তুমি যে-বাড়িতে বিয়ে করেছি, আমি সে-বাড়িতেই থাকি। বাচ্চাদের পড়াই। বাবা বললেন, আসবে আমার সঙ্গে? মাস্টার কাকা খুব আগ্রহের সঙ্গে রাজি হলেন। সেই থেকেই তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। বাবা স্কুলের মাস্টারি যোগাড় করে দিয়েছেন, তাঁর একার বেশ চলে যায় তাতে। তিনি জন্ম থেকেই আমাদের স্মৃতির সঙ্গে গাঁথা। ছোটবেলার কথা যা মনে পড়ে, তা হল–দুর বিছিয়ে বসে বসে পড়ছি। তাঁর ঘরে, রাবেয়াটা হৈচৈ করছে, মাস্টার কাকা পড়াতে পড়াতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলছেন, খোকা হাত মেলে ধরা আমার সামনে, দু হাত। কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার অন্যমনস্কতা, বিড়বিড় করে কথা বলা। কান পাতলেই শোনা যায় বলছেন, সব ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত। বৃত্ত দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে কেউ যেতে পারবে না। আমি না, খোকা তুইও না। বাবার সঙ্গে বিশেষ কথা হত না তাঁর। বাবা নিজে কম কথার মানুষ, মাস্টার কাকাও নির্লিপ্ত প্রকৃতির। মাস্টার কাকাকে বাইরে থেকে শান্ত প্রকৃতির মনে হলেও তাঁর ভেতরে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ছিল। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন তিনি এস্ট্রলজি নিয়ে খবু মেতেছেন। কাজকর্মেও তাঁর মানসিক অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। গভীর রাতে খড়ম পায়ে হেঁটে বেড়াতেন। খটখট শব্দ শুনে কত বার ঘুম ভেঙে গেছে, কত বার মাকে আঁকড়ে ধরেছি শুয়ে। মা বলেছেন, ভয় কি খোকা, ভয় কি? ও তোর মাস্টার কাকা। বাবা তারি। গম্ভীর গলায় ডাকতেন, ও মাস্টার, মাস্টার, শরীফ মিয়া, ও শরীফ মিয়া। খড়মের খটখটি শব্দটা থেমে যেত। মাস্টার কাকা বলতেন কি হয়েছে? ছেলে ভয় পাচ্ছে, কী কর এত রাত্ৰে? তারা দেখছিলাম। এত তারা আগে আর ওঠে নি। দেখবে? পাগল! যাও, ঘুমাও গিয়ে। যাই। মাস্টার কাকা খড়ম পায়ে খটখট করে চলে যেতেন। আমাদের সবার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। আমি তাঁর প্রথম ছাত্র, তারপর মন্টু। পড়াশোনায় মন নেই বলে রাবেয়ার তো পড়াই হল না। রুনু এখন পড়ে তাঁর কাছে। বাড়িতে তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই তাঁর। থাকলেও যাবার উৎসাহ পান না। অবসর সময় কাটে এস্ট্রলজির বই পড়ে। অঙ্কের মাস্টার হিসেবে এস্ট্রলজি হয়তো ভালোই বোঝেন। মাঝে মাঝে তাঁর কাছ থেকে বই এনে পড়ি আমি। বিশ্বাস হয়তো করি না। কিন্তু পড়তে ভালো লাগে। আমি জেনেছি মীন রাশিতে আমার জন্ম। মীন রাশির লোক দার্শনিক আর ভাগ্যবান হয়। তাদের জীবন চমৎকার অভিজ্ঞতার জীবন। প্রচুর সুখ, সম্পদ, বৈভব। বেশ লাগে ভাবতে। কাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঐ যে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখছি না? ওর ডান দিকের ছোট্ট তারাটি হল কেতু। বড়ো মারাত্মক গ্রহ। আমার জন্মলগ্নে কেতুর দশা চলছিল! জানি না, হয়তো জন্মলগ্নে কেতুর দশা থাকলেই আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়। গভীর রাতে অনিদ্ৰাতপ্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যনিয়ন্তা গ্রহগুলি পরখ করতে হয়। কাকাকে আমার ভালো লাগে। তার ভিতরে প্রচণ্ড জানিবার আগ্রহটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। সামান্য বেতনের সবটা দিয়ে এস্ট্রলজির বই কিনে আনেন। দেশবিদেশের কথা পড়েন। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান অপরিচিত সব জায়গায়। কোথায় কোন জঙ্গলে পড়ে আছে ভাঙা মন্দির একটি, কোথায় বাদশা বাবরের আমলে তৈরী গেটের ধ্বংসাবশেষ। সামান্য স্কুলমাস্টারের পড়াশোনার গণ্ডি আর উৎসাহ এত বহুমুখী হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। তিনি মানুষ হিসেবে তত মিশুক নন। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টাটা বাড়াবাড়ি রকমের। কোনো দিন মায়ের সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে দেখি নি। খালি গায়ে ঘরোয়াভাবে ঘরে বসে রয়েছেন, এমনও নজরে আসে নি। স্কুলে কাকা আমাদের ইতিহাস আর পাটীগণিত পড়াতেন। ইতিহাস আমার একটুও ভালো লাগত না। নিজের নাম হুঁমায়ুন বলেই বাদশা হুঁমায়ুনের প্রতি আমার বাড়াবাড়ি রকমের দরদ ছিল! অথচ আমাদের ইতিহাস বইয়ে ফলাও করেচ শেরশাহের সঙ্গে তাঁর পরাজয়ের কথা লেখা। শেরশাহ আবার এমনি লোক, যে গ্র্যাণ্ডটাঙ্ক রোড করিয়েছে, ঘোড়ার পিঠে ডাক চালু করিয়েছে। কিন্তু এত করেও ক্লাস সেতেনের একটি বাচ্চা ছেলের মন জয় করতে পারে নি। পরীক্ষার খাতায় তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে আমার বড়ো রকমের গ্লানি বোধ হত। সেই থেকেই সমস্ত ইতিহাঁসের ওপরই আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কাকা তা জানতেন। এক দিন আমায় বললেন, খোকা তোর প্রিয় বাদশা হুমায়ূনের কথা বলব তোকে, বিকেলে ঘরে আসিস। সেই দিনটি আমার খুব মনে আছে। কাকা আধশোয়া হয়ে তাঁর বিছানায়, আমি পাশে বসে, রুনু আর মন্টু সেই ঘরে বসে-বসে লুড়ু খেলছে। কাকা বলে চলেছেন, হুঁমায়ুন সম্পর্কে কে এক জন ছোট্ট একটি বই লিখেছিলেন-হুমায়ূন নামা। বইটিতে হুঁমায়ুনকে তিনি বলেছেন দুভাগ্যের অসহায় বাদশা। কিন্তু এমন দুভাগ্যবান বাদশা হতে পারলে আমি বিশ্ববিজয়ী সিজার কিংবা মহাযোদ্ধা নেপোলিয়ানও হতে চাই না। যুদ্ধ বন্ধ রেখে চিতোরের রাণীর ডাকে তাঁর চিতোর অভিমুখে যাত্রা, ভিত্তিওয়ালাকে সিংহাসনে বসোনর পিছনে কৃতজ্ঞতার অপরূপ প্রকাশ। গান, বই আর ধর্মের প্রতি কি আকর্ষণ! আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। যেখানে আজান শুনে হুমায়ূন লাইব্রেরি থেকে দ্রুত নেমে আসছেন নামাজে সামিল হতে, নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মারা গেছেন, সে-জায়গায় আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কাকা বললেন, বড়ো হৃদয়বান বাদশা, সত্যিকার কবি হৃদয় তাঁর। আমার মনে হল আমিই যেন সেই বাদশা। আর আমাকে বাদশা বানানর কৃতিত্বটা কাকার একার। আজ এই আশ্বিনের মধ্যরাত্রি, কাকা বসে আছেন ঠাণ্ডা মেঝেতে। অল্প অল্প
false
MZI
এখন ওটা নিভেছে তাই দেখতে পাচ্ছি– দেখতে পাচ্ছ? এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছ? ঐ যে বললাম ভাই, তোমাদের কাছে যেটা অন্ধকার আমাদের কাছে সেটা আলো। আমাদের চোখ হচ্ছে অবলাল সংবদী—যার অর্থ আমরা ইনফ্রারেড আলো দেখতে পারি। তোমার যেই আলো দেখতে পারো আমাদের চোখের রেটিনাকে সেটা নষ্ট করে দেয়। তাই এখানে তোমাদের আলো নেই। তার মানে তুমি আমাদের দেখতে পাচ্ছ? পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এই যে তুমি শুকনো মত, ছোট ছোট গোফ। আর এই যে আরেকজন ছোটখাট পাহাড়ের মতন মাথায় ছোট ছোট চুল-হা হা হা। রাগ করলে না তো ভাই? ঝা মাথা নেড়ে বলল, না, রাগ করি নাই। তোমাদের ঘাড় থেকে কালো লম্বা মতন ঐ সব কী ঝুলছে ভাই? দেখে মনে হচ্ছে অনেক ভারী? জিনিসগুলো ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্র কিন্তু সেই কথাটা এখন বলে কেমন করে? টুকি আমতা আমতা করে বলল, ইয়ে মানে এটা হচ্ছে যাকে বলে— যাই হোক এটা কী সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন চল আমার সাথে তোমাদের নিয়ে যাই। আমাদের এই ছোট গ্রহে অতিথি খুব একটা আসে না, কেউ এলে তাই আমাদের খুব আনন্দ হয়। ঝা কাতর গলায় বলল, কোনদিকে যাব? কিছুই তো দেখি না। এসো, আমার হাত ধর— বলে অন্ধকারে একজন তার হাত শক্ত করে ধরল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন ঝায়ের হাত ধরে এগিয়ে নিতে থাকে, ঝায়ের হাত ধরে ধরে এগিয়ে আসে টুকি। কিছুক্ষণের মাঝে তারা আরো মানুষের কথাবার্তা শুনতে পায়, সবাই তাদের দেখছে কিন্তু তারা কিছু দেখছে না ব্যাপারটা চিন্তা করেই টুকি এবং ঝায়ের গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তারা এগিয়ে যেতে থাকে তাদের সামনে এবং পিছনে আরো মানুষ একত্র হয়েছে শব্দ, কথাবার্তা শুনে বোঝা যায়। একজন এগিয়ে এসে বলল তোমাদের পিঠে এ ভারী বোঝা তাই কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। বলে কিছু বোঝার আগেই তাদের ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্রগুলো খুলে নিয়ে নিল। টুকি আমতা আমতা করে বলল, খুব সাবধান, মানে ইয়ে চাপ না পড়ে যায় তাহলে কিন্তু মানে ইয়ে কী জিনিস এটা? টেলিস্কোপ নাকি? আরেকজন বলল, নলটা চোখে লাগিয়ে ঐ ট্রিগারটা টেনে দিলে নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখা যাবে, তাই না? টুকি হা হা করে উঠে বলল, না না না—খবরদার ওরকম কাজ করো না। ভুলেও ট্রিগারে হাত দেবে না। কী হয় হাত দিলে? টুকি উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। টুকি এবং ঝা হাত ধরাধরি করে জবুথবু হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটি বিন্দুও দেখা যাচ্ছে না। মানুষ পরিপূর্ণ অন্ধকার দেখে অভ্যস্ত নয়, সব সময়েই যত অন্ধকারই হোক একটু আলো থাকে, তার উপর চোখের রেটিনাও কম আলোতে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে কাজেই কিছু না কিছু তারা সব সময়েই দেখতে পারে। এই প্রথম তারা একটি পুরোপুরি অন্ধকার জগতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে চোখ খোলা রেখেও তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না, নিকষ কালো অন্ধকারে সবকিছু ঢেকে আছে। এই অন্ধকার এত ভয়াবহ যে তাদের মনে হতে থাকে বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। ঝা টুকিকে টেনে বলল, টুকি। কী হল? আমাদের দাও মারার পরিকল্পনাটা একেবারে মাঠে মারা গেল। তাইতো মনে হচ্ছে। কী মনে হয়? জ্যন্ত ফিরে যেতে পারব? অস্ত্রগুলো হাতছাড়া হয়েই তো বিপদ হল। কখন ভুল করে গুলি করে দেয়। কী করব এখন? করার কিছু নাই। যা করতে বলে তাই করতে হবে। কাজেই টুকি আর ঝা ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন আরেকজনের হাত ধরে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে হয় এই বুঝি কোন অতল খাদে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে কিংবা অসতর্ক কোন তরুণ মাঝারী রেঞ্জের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তাদের ধ্বংস করে দেবে। ঝা মনে মনে বলতে লাগল, হে ঈশ্বর, হে সৃষ্টিকর্তা—তোমার কাছে এন্ড্রোমিডার দোহাই লাগে, মিল্কিওয়ের দোহাই লাগে এই যাত্রা আমাদের উদ্ধার করে দাও। আর কোনদিন প্রয়োজন ছাড়া কোথাও হামলা করব না। সত্যিকারের বড় একটা দাও না পেলে দাও মারার চেষ্টা করব না। বাড়াবাড়ি লোভ করব না, অল্পতে সন্তুষ্ট থাকব— টুকি এবং ঝাকে ধরে ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা ঘরে এনে হাজির করা হল। তারা কিছুই দেখছে না শুধু শব্দ শুনে বুঝতে পারছে তাদেরকে ঘিরে অনেক মানুষ। বয়স্ক একজন বলল, ভিন দেশের অতিথি, আমাদের এই ছোট গ্রহে তোমাদের শুভ আমন্ত্রণ। টুকি শুকনো গলায় বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাদের আতিথিয়েতার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ঝা সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের দেখতে পারছি না বলে ঠিক করে কথা বলতে পারছি না। আমরা তোমাদের গ্রহ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম দেখে যাই। ঝা যোগ করল, কিন্তু দেখতে এসে আবিষ্কার করলাম, এখানে আলো নেই তাই দেখা যায় না। বয়স্ক মানুষটি বলল, আহা। তোমাদের কথা শুনে এত দুঃখ হচ্ছে কী বলব। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। মেয়ে গলার একজন বলল, প্রাচীন কালে যারা দেখতে পেত না তারা নাকি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখত। আমাদের এই অতিথিরা ইচ্ছা করলে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আমাদের গ্রহটা দেখতে পারে। হাত বুলিয়ে? হ্যাঁ। তারা এত দেখতে চাচ্ছেন যখন। তাই না ভাই টুকি? টুকি শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়। সাথে সাথে অন্ধকারে
false
MZI
লম্বাচওড়া, চুল ছোট করে ছাঁটা। একজন মাঝবয়সী, আরেকজন একটু কম। দুজনেরই সাফারি কোট। এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই বাসায় আর কে থাকে? আমি বললাম, আর কেউ থাকে না। তখন লোকগুলো দুইটা চেয়ারে বসল। একজন পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল। রাফি চমকে উঠে বলল, পিস্তল? হ্যাঁ। আরেকজন আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার ঘাড়ে একটা হাত দিয়ে বলল, মালাউনের বাচ্চা, তুমি তোমার বাপের দেশে না গিয়ে এই দেশে পড়ে আছো কেন? আমি বললাম, এইটাই আমার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টির দেশ। তখন লোকটা রিভলবারটা হাতে নিয়ে আমার কপালে ধরে বলল, এইটা যদি তোমার বাপের দেশ হয় তাহলে এই দেশের নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমি বললাম, এই দেশের নিয়ম কী? লোকটা বলল, বেদরকারি কথা বলবা না। আমি বললাম, বেদরকারি কথাটা কী? লোকটা বলল, ভাইরাসের কথাটা হচ্ছে বেকারি, ফালতু কথা। খামোখা মানুষকে ভয় দেখানোর কথা। সমীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার তখন ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবু সাহস করে বললাম, এটা ফালতু কথা না। এটা খুবই ডেঞ্জারাস কথা। লোকটা তখন রিভলবারের নল দিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বলল, চোপ ব্যাটা মালাউন। আমি যদি বলি এটা ফালতু, তাহলে এটা ফালতু। বুঝেছিস? আমার এই কম কথাগুলো বলতে বলতে সমীরের মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তখন আমার মাথার মগজে রক্ত উঠে গেল। আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, গেট আউট। গেট আউট আমার বাসা থেকে। লোক দুইটা তখন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল, ওরা বুঝতে পারে নাই আমি এইভাবে রেগে উঠব। ওরা ভেবেছে আমাকে ভয় দেখালে আমি ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকব। রাফি একটু ঝুঁকে বলল, তারপর কী হলো? লোক দুইটা তখন উঠে দাঁড়াল, যেইটা একটু বয়স্ক সেইটা বলল, শোনো ছেলে। এই ভাইরাস নিয়ে যদি আর একটা কথা বলো তাহলে তোমার লাশ পড়ে যাবে। খোদার কসম। তুমি কী বললে? আমি বললাম, আমার যদি বলার ইচ্ছা করে তাহলে আমি একশবার বলব। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে লাশ ফেলে দেওয়ার, লাশ ফেলে দিয়ে। আমি ভয় পাই না! যদিও বলেছি ভয় পাই না—কিন্তু আসলে ভয়ে আমার হার্টফেল করার অবস্থা! মনে হয় অনেক জোরে চিৎকার করেছি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে তখন কবির ভাই এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন? আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম, কবির ভাই ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? লোকটা ততক্ষণে রিভলবারটা লুকিয়ে ফেলেছে। সে বলল, কিছু হয় নাই। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কবির ভাই জানতে চইল, কী ব্যাপার। আমি কিছু বললাম না। কবির ভাই তখন আমাকে ঘাটাল না। সমীর কিছুক্ষণ মুখ শক্ত করে রেখে বলল, সকালবেলা তোমার কাছে এলাম, আমার সেই ঈশিতা মেয়েটার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার। তোমার সঙ্গেও বলি। কী করব বুঝতে পারছি না। এরা কারা? জানি না। রাতে বাসার সামনে বিশাল একটা গাড়িতে অনেকক্ষণ বসে থাকল। কোনো লুকোছাপা নেই, মনে হয় সরকারি লোক। সরকারি লোক এ রকম করবে কেন? তোমাকে মালাউন ডাকবে কেন? সমীর হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের অনেকেই মালাউন ডাকে, তোমরা সেটা জানো না! যাই হোক, ঈশিতার নম্বরটা দাও, না হলে ফোন করে আমাকে লাগিয়ে দাও। রাফি ঈশিতাকে ফোন করল, সেখানে একটা ইংরেজি গান রিংটোন। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। কিছুক্ষণের ভেতর একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল, ফোন ধরতেই ঈশিতার গলা শোনা গেল, রাফি? হ্যাঁ। এখানে একটা ব্যাপার ঘটেছে। জানি। জানো? হ্যাঁ। আমি আমার ফোনে ধরিনি। এটা ট্যাপ করছে। অন্য নম্বর থেকে ফোন করছি। সমীর কেমন আছে? সমীরের কথাই বলছিলাম। কাল রাতে দুজন লোক— জানি। ওরা অসম্ভব ডেঞ্জারাস, আমি ফোনে সবকিছু বলতে পারব না। সমীরকে বোলো সাবধানে থাকতে। আজকে ভাইরাসের ওপর ফললাআপ নিউজ থাকার কথা ছিল, আমরা ড্রপ করেছি। সমীরকে বোলো কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলতে। সমীর এখানে আছে, তুমি কথা বলো। সমীর কিছুক্ষণ ঈশিতার সঙ্গে কথা বলল। বেশির ভাগ সময় অবশ্যি কথা শুনল, হুঁ হাঁ করল, নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ফোনটা রাফির হাতে ফিরিয়ে দিল। রাফি ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, ঈশিতা। হ্যাঁ। বলো। এখন অন্য ঝামেলা শুরু হয়ে গেল, তাই বলার জন্য ঠিক সময় কি না বুঝতে পারছি না। মনে আছে, তুমি নিউরাল কম্পিউটার নিয়ে জানতে চাইছিলে? হ্যাঁ। আমি ফ্যান্টাস্টিক রিসোর্স পেয়েছি। তুমি বিশ্বাস করবে না। পৃথিবীর সেরা নিউরাল কম্পিউটার ফার্ম বাংলাদেশে অফিস খুলেছে। কোম্পানির নাম এনডেভার, টঙ্গীতে অফিস। ওয়েবসাইটটা চমৎকার ফ্রেন্ডলি। ওদের অফিসে গেলে— ঈশিতা বলল, রাফি। গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। রাফি থতমত খেয়ে থেমে গেল। ঈশিতা ঠান্ডা গলায় বলল, আমি এনডেভারে গিয়েছিলাম। সে জন্যই নিউরাল কম্পিউটার সম্পর্কে জানতে চাইছি। যে দুজন লোক সমীরকে ভয় দেখিয়েছে, সেই দুজন আমাকেও ভয় দেখিয়েছে, আমি যেন এনডেভারের ওপর রিপোর্টিং না করি। কেন? জানি না। শুধু এটুকু জেনে রাখো, টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের সবার চিকিৎসা করছে এনডেভার। সত্যি? কেন? আমারও সেই একই প্রশ্ন। কেন? কোথায় চিকিৎসা হচ্ছে? ওদের বিল্ডিংয়ে। রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওদের বিল্ডিংয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে? হ্যাঁ। সেখানে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন? জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, এনডেভার আগে থেকে জানত, এখানে এফটি টুয়েন্টি সিক্সের
false
humayun_ahmed
রাত বাজে দশটা। রাত যত গভীর হবে ঠিকানায় মানুষ খুঁজে পাওয়া ততই সহজ হবে। এই ধরনের লোকজন সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে রাতে ঘুমুতে আসে। বজলুর ভাসমান ঠিকানা উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের পেছনের ছাপড়া বস্তি। সে তার বাবা শাহ সাহেবের সঙ্গে থাকে। শাহ সাহেব রঙের মিস্ত্রি। এবং ছোটখাট পীর। গাড্ডুর সাধনা আছে। গাড়ু জীন প্রজাতির জিনিস। ক্ষমতা জীনের মতো না। বনে জঙ্গলে থাকে বলে গাছপালা চিনে। গাছপালা থেকে ওষুধ দেয়। শাহ সাহেব সামান্য হাদিয়ার বিনিময়ে এইসব ওষুধ অন্যকে দেন। শাহ সাহেবকে অনেকে গাড্ডু পীরও বলেন। শাহ সাহেবকে অতি সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি ঘরের সামনে উঠান মতো জায়গায় খালি গায়ে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গাড্ডু পীর চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু ভাইজান না? এতদিন পরে দেখা, আমি কিন্তু ঠিকই চিনেছি। আমারে চিনেছেন? না। লাইলাহা ইল্লালালাহু! আমি খসরু। এখন চিনছেন? না! ঠেলাগাড়ি চালাইতাম। অ্যাক্সিডেন্ট করছিলাম। ঠাং গেল ভাইঙ্গা। চিকিৎসার ব্যবস্থা আপনে করলেন। এখন যদি বলেন চিনি না, আমি যাব। কই? মুখভর্তি দাড়ি, এইজন্যে বোধহয় চিনেন না। আপনে হুকুম দিলে নাপিতের দোকান থাইক্যা মুখ কামাইয়া আসি। পীর হয়েছ শুনলাম। স্বপ্নে একটা জিনিস পেয়েছি। কী পেয়েছ গাড্ডু? এই বিষয়ে কথাবার্তা পরে বলব। আপনে আমার সামনে— এখনো বিশ্বাস হইতেছে না। তোমার ছেলে কই? বজলু? ‘বজলুরে চিনেন ক্যামনে? আমারে চিনেন না, বজলুরে চিনেন! আজিব ব্যাপার। তোমার ছেলে আমার কাছে চা-কফির ফ্লাস্ক রেখে দৌড় দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ফ্লাঙ্ক ফেরত দিতে এসেছি। ও আচ্ছা। আপনে সেই লোক। লাইলাহা ইল্লালাহু। এখন আমার কাছে সব কিলিয়ার। বজলু বাড়িত আসুক, দেখেন তারে কী করি। উল্টাপাল্টা কথা বলছে আপনেরে নিয়া। আমিও এমন বেকুব, হারামজাদার কথা বিশ্বাস করছি। কী বলেছে? বলছে এক বদ লোক কফি খাইছে। টেকা না দিয়া জোর কইরা ফ্লাস্ক রাইখা দিছে। কফি কি আপনে খাইছিলেন হিমু ভাই? হুঁ। টাকা দিতে পারি নাই। কীভাবে দিব? টাকা আছে না-কি আমার সঙ্গে! অতি সত্য কথা। আপনের সঙ্গে টেকা থাকব কী জন্যে? বজলু হারামজাদা আপনেরে কফি খাওয়াইয়া টেকা চায়! এত বড় সাহস। আমারে কত বড় শরমের মধ্যে ফেলছে চিন্তা করেন হিমু ভাই। আমার মন এখন অত্যধিক খারাপ। দৌড় দিয়া কোনো টেরাকের সামনে পড়লে মন শান্ত হইত। গাড্ডু পীর বিরাট হৈচৈ শুরু করল। কী করলে হিমু ভাইয়ের প্রতি সঠিক সম্মান দেখানো হবে বুঝতে পারছে না। উত্তেজনায় তার মুখে ঘাম জমে গেছে। বজলু তার মাকে নিয়ে বাজার করতে গিয়েছিল। সেও এসে আমাকে চিনতে পারল না। গাড্ডু পীর বলল, চিনস না-চিনস কানে ধইরা খাড়ায় থাক। বজলু কনে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি তাকে ফ্লাস্ক এবং এই কদিনের চাকফি বিক্রির টাকা বুঝিয়ে দিলাম। গাড্ডু পীর হুঙ্কার দিয়ে বলল, এখন চিনছস কি-না বল। বজলু মাথা নাড়ল। চিনেছে। গাড্ডু পীর গভীর হতাশায় বলল, এই মানুষটার কাছে তুই কফির দাম চাইছস? আফসোস। বিরাট আফসোস। বজলু বলল, আমি উনারে চিনব ক্যামনে? গাড্ডু পীর বলল, আরে ব্যাটা, চোখের দেখায় চিনবি না। ধ্যানে চিনবি। মানুষ ধ্যানে চিনা যায়। চোখের দেখায় চিনা যায় না। আমি বললাম, খসরু, আমি উঠি? খসরু মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল। যেন আমি উঠির মতো বাক্য সে তার ইহজীবনে শোনে নি। হিমু ভাই, এইটা আপনে কী বললেন? রাইত বাজে এগারোটা। আপনে আমার বাড়ি থাইকা না খায়া যাবেন? পোলাও কোরমা পাক হবে, ঝাল গোশত হবে। তারপরে যাওয়া যাওয়ির কথা। খাবেন না বললে আমি কিন্তু সত্যই লাফ দিয়া টেরাকের নিচে পড়ব। আমাকে হার স্বীকার করতে হলো। রান্নাবাড়ার বিপুল আয়োজন শুরু হয়ে গেল। বজলু এবং তার বাবা মুরগি, গরুর মাংস, পোলাওয়ের কালো জিরা চাল কিনতে চলে গেল! আমি খসরুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছি। তার নাম জরিনা বেগম। জরিনা বেগম ছোটখাট মহিলা। চেহারা মায়াকাড়া। গলার স্বর মিষ্টি। কথাও বলে গুছিয়ে। কথা শুনে মনে হয় কিছু পড়াশোনাও করেছে। সে বলল, ভাইজান, আপনে আপনের শিষ্যরে বলেন, মানুষ যেন না ঠকায়। যে মানুষ ঠিকায় সে নিজে ঠিকে। আল্লাহপাকের হিসাব সোজা হিসাব। আল্লাহপাক জটিল হিসাব করেন না। উনার হিসাব খালি যোগ আর বিয়োগ। আমি বললাম, গাড্ডু পীর মানুষ ঠকায়? অবশ্যই। সে নাকি স্বপ্নে পীরাতি পাইছে। ভাইজান, আপনে বলেন স্বপ্নে কোনদিন কে কী পাইছে? যেই জিনিস স্বপ্নে পাওয়া যায়। সেই জিনিস স্বপ্লেই শেষ। ঠিকই বলেছ। ছেলে বড় হইছে, তারে ইস্কুলে দেয় না। এই কাম করায় সেই কাম করায়। আপনে একটা ধমক দিলে ছেলেরে ইস্কুলে দিব। আমার ধমক শুনবে? অবশ্যই শুনব। আপনে তার পীরের পীর। আপনের একটা কথায় সে জীবন দিয়া দিবে। ভাইজান, আপনে বইল্যা আমার ছেলেরে ইস্কুলে পাঠাইবেন। আচ্ছা দেখি। আমি একদিন খোয়াবে দেখছি, বজলু লেখাপড়া কইরা বিরাট অফিসার হইছে। কচুয়া রঙের একটা মোটরগাড়ি আইন্যা আমারে ডাকতছে— মা, গাড়ি আনছি। গাড়িতে উঠ। আমি বজলুর বাপরে নিয়া গাড়িত উঠলাম। স্বপ্ন গেল ভাইঙ্গা। জরিনা বেগমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, আপনে যখন বজলুর সন্ধানে উপস্থিত হইছেন, তখন বুঝছি আমার ছেলেরে নিয়া যে খোয়াব দেখছি সেইটা সত্য। আমি বললাম, একটু আগে তুমি বলেছ, যে জিনিস স্বপ্নে পাওয়া যায় সেই জিনিস স্বপ্লেই শেষ। জরিনা বেগম বলল, আপনার সাথে কথায় আমি পারব
false
shomresh
গলায় জানালেন। জয়িতা মাথা নাড়ল। বন্দুক—এরা কেউ জানে না সমস্ত গুলিগুলো এখন অকেজো, আর এই গ্রামের মানুষদের দিকে বন্দুকের নল তোলা মানে নিজের গলায় ঠেকানো। সে কলল, আমাকে একটু সময় দিন কাহুন। ঢালু পাহাড় বেয়ে দৌড়াবার সময় শরীরের ভার যেন কমে যায়। কিন্তু বুকের ভেতর ঝড় বইছিল সুদীপের। অনেকটা নেমে আসার পর সে আনন্দকে দেখতে পেল। পালাদেম এবং সাওদেরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওরা জমি দেখছে। পরিকল্পনা হয়েছে ওপরের ঝরনা থেকে জল যাতে সরাসরি জমিতে আনা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। সে ব্যাপারেই আলোচনা করছিল ওরা। সুদীপকে ওভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক হল সবাই। খানিকটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে দম নিতে নিতে সুদীপ ডাকল, আনন্দ, তোর সঙ্গে কথা আছে। কি কথা? আনন্দ ওকে জরিপ করার চেষ্টা করল। এদের সামনে বললে তোর হয়তো ভাল লাগবে না। আনন্দ মুখ ঘুরিয়ে পালদেমকে বলল, ঠিক আছে, আমরা পরে এটা নিয়ে কথা বলব। মনে হচ্ছে সুদীপের কোন সমস্যা হয়েছে—! ঠিক আছে। পালদেমরা চলে যাওয়ার পর আনন্দ এগিয়ে গেল, কি বলবি বল্। মুখোমুখি কিছুক্ষণ তাকিয়ে সুদীপের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, ছিঃ! খুব অবাক হল আনন্দ, কি ব্যাপার? তুই এভাবে আমাকে ছিঃ বলছিস কেন? তুই, তুই এমন কাজ করলি আনন্দ, তুই মুখে বলতিস যদি তাহলে কি আমি আপত্তি করতাম? আঃ! কি বলছিস স্পষ্ট করে বল্। ন্যাকামি করিস না। তুই জানিস না কি করেছিস? আনন্দর কপালে ভাঁজ পড়ল, ব্যাপারটা কি বল তো? তোর সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্ক আছে সেটা এতকাল চেপে রেখেছিলি কেন? শারীরিক সম্পর্ক? কার সঙ্গে? ওঃ, তোর মেয়েটা এই কথা বলেছে বুঝি? আবার বুলি করার চেষ্টা! জয়িতা প্রেগন্যান্ট তুই জানিস না? জয়িতা? প্রায় চিৎকার করে উঠল আনন্দ। আকাশ থেকে পড়লি মনে হচ্ছে। কি যা-তা বলছিস তুই? আনন্দ, আমি শেষবার আশা করছি তুই সত্যি কথা বলবি। মিথ্যে কথা বলার কিছু দরকার আছে সুদীপ? আমি যদি করতাম তাহলে এই পাহাড়ে কেউ আমাকে বাধা দিতে আসত? তাহলে স্বীকার করছিস না কেন? কারণ আমি করিনি। বিশ্বাস করি না! চমৎকার! জয়িতার খবরটা তুই কোথায় পেলি? আমাকে বেশ কিছুদিন আগে মেয়েটা বলেছিল। বমি করছিল তখন। বিশ্বাস হয়নি আমার। আজ প্রশ্ন করতে ও ইনডাইরেক্টলি স্বীকার করে নিয়েছে। হায় ভগবান! আনন্দ চিৎকার করল এবার, ও স্বীকার করেছে? হ্যাঁ। তোর আর লুকোবার পথ নেই। কিন্তু আনন্দ, ওকে তো আমরা সবাই বন্ধু বলেই জেনে এসেছিলাম এতদিন। একঘরে শুয়েছি কিন্তু কখনও মেয়ে বলে মনে করিনি। কল্যাণটা ওকে ভালবাসতো। আই নো দ্যাট। ওর সম্পর্কে দুর্বল ছিল। আমার মনেও যে দুর্বলতা আসেনি তা নয়। কিন্তু আমি সবসময় মনে করতাম ওকে বন্ধুর সম্মান দেব। ও মেয়ে নয়, একটা মানুষ। জীবনের সব প্রলোভন ছেড়ে আমরা যে কাজে পা বাড়িয়েছি তাতে আর যাই হোক একটি মেয়ের সঙ্গে হৃদয় বিনিময় প্রধান হয়ে ওঠে না। অথচ তুই তাই করেছিস। নাহলে তুই ওর শরীরের কথা ভেবে কলকাতার ওষুধের দোকান থেকে প্রটেকশান কিনতিস না। নাউ টেল মি, হোয়াটস দি ডিফারেন্স বিটুইন আস অ্যান্ড দ্যাট প্যারাডাইস পার্টি! আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ওর রোগা শরীরটা শত্ত। এলোমেলো দাড়ি এবং চুলভর্তি মাথাটা নিচের দিকে ফেরানো। তারপর ও চোখ তুলল, তোকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করছে সুদীপ! সুদীপ চমকে উঠল। এই গলায় আনন্দ কখনও তার সঙ্গে কথা বলেনি। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। সুদীপ আশঙ্কা করছিল আনন্দ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওর চোখ দেখে সেই রকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু আনন্দ কথা বলল, আমাকে যখন তোর সন্দেহ তখন আমিও বলতে পারি নিজে কাজটা করে তার দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিস! আমি? আমি করেছি? নিশ্চয়ই। চোরের মায়ের সবসময় বড় গলা হয়। আর তাই কদিন থেকে তুই চলে যাওয়ার কথা বলে যাচ্ছিস। তুই এমন কাজ করলি কেন সুদীপ? প্রশ্নটা শোনামাত্র যেন উন্মত্ত হয়ে গেল সুদীপ। দুপাশে মাথা নেড়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ইটস এ লাই, মিথ্যে কথা, আমি কিছুই জানি না। জানলে আমি তোকে এসে–। বাক্যটা শেষ করতে পারল না সে। আনন্দ বলল, এটা তোর অভিনয় হতে পারে। অভিনয়? সুদীপের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। অবশ্যই। এতদিন ধরে ওই বিধবা মেয়েটার সঙ্গে থেকেও তোর লোভ মেটেনি। আমি বুঝতে পারছি না জয়িতা এই ভুল কি করে করল! একসময় মেয়েটা সম্পর্কে জেলাস ছিল। কিন্তু সব জেনেশুনে–। শোন সুদীপ, আমি কখনও তোর আর ওই মেয়েটার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলিনি। এটা অন্যায় কিন্তু আজ হোক কাল হোক তোকে বিয়ে করতে হবে ওকে। বলেই চুপ করেছিলাম। কিন্তু এই আমি সহ্য করব না। সুদীপ হাসল অনেকক্ষণ পরে, আমার সম্পর্কে চমৎকার ধারণা তোদের।একটু আগে জয়িতা একই প্রশ্ন করেছিল। মেয়েটা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। বাট আই নেভার শ্লেপ্ট উইদ হার। কথাটা ও নিজের মুখে আজ সবাইকে বলেছে। তুই? বিস্ময় ফুটে উঠল আনন্দর মুখে। হ্যাঁ। সুদীপ জোরের সঙ্গে বলল। আনন্দ মাথা নাড়ল, সব কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। তুই প্যারাডাইসের কথা বললি, চিরকাল যে ব্যাপারটাকে ঘৃণা করে এলাম নিজে তা কিভাবে করব? হ্যাঁ, যদি জয়িতাকে ভালেবেসে পেতে চাইতাম তাহলে সেটা জোরগলায় বলতাম। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুই ওকে ভালবাসিসনি? হ্যাঁ, বেসেছিলাম। কিন্তু পেতে চাইনি। আমিও তাই। আমার মনে হয় একমাত্র কল্যাণ পেতে চেয়েছিল।
false
shottojit_roy
ফেলে দিয়ে বৈঠকখানার টেলিফোনে গিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল। দশ সেকেন্ড পরেই কথা। ‘কে – মিস্টার সমাদ্দার? চলে আসুন – এক্ষুনি – বামুনগাছি যেতে হবে – হ্যাঁ, হয়ে গেছে — সব পরিষ্কার…মেলোকর্ড…হ্যাঁ, মেলোকর্ডই আমাদের রহস্যের চাবিকাঠি।’ তারপর টেলিফোনটা রেখে গভীর গলায় বলল, একটা রিস্ক আছে রে তোপসে, কিন্তু সেটা না নিলেই নয়।’ মণিবাবুর ড্রাইভার গুরুচরণ দেখতে বুড়ো হলেও ভি আই পি রোডে পঁচাশি কিলোমিটার পার আওয়ার স্পিড তুলল। ফেলুদার ভাব দেখে মনে হল হ্যান্ড্রেড-টান্ড্রেড হলে সে আরও খুশি হত। এয়ারপোর্টের পর খানিকটা রাস্তা লোকজনের ভিড়ে স্পিড অনেক কমল, কিন্তু পরের দিকে আবার ষাটে উঠল – যদিও রাস্তা তত চওড়া নয়, আর সন্ধেও হয়ে আসছে। রাধারমণবাবুর গেটের কাছাকাছি এসে ফেলুদা বলল, ‘পাহারার লোক আসার সময় হয়নি বোধহয় এখনও।’ গেট দিয়ে ঢুকতেই বাগানে দেখলাম বন্দুক হাতে সাধন দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ফেলুদা বলল, ‘কী সাধনবাবু, এই সন্ধের আলোতে কী শিকার হচ্ছে? সাধন বলল, ‘বাদুড়।’ রাধারমণবাবুর কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে একটা অশ্বখ গাছ থেকে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে সেটা গাড়ি থেকে নেমেই আমার চোখে পড়েছিল। অনুকূল গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল; মণিবাৰু তাকে লণ্ঠন জ্বালতে বলে বাড়ির ভিতর ঢুকলেন, আর আমরাও ঢুকলাম তাঁর পিছন পিছন। এইট-টু-নাইন-ওয়ান তালাটা খুলতে খুলতে মণিবাবু বললেন, ‘রহস্যের কীভাবে সমাধান হল সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’ আসলে ফেলুদা সারা রাস্তা কোনও কথা বলেনি, কাজেই মণিবাবুর যা অবস্থা, আমারও তাই। অন্ধকার ঘরে ঢুকে ফেলুদা তার ভীষণ জোরালো টর্চটা ঘরে পশ্চিমের দেয়ালের নীচের দিকে ফেলল। আমার বুক টিপ টিপ করছে। আলোটা সোজা গিয়ে টেবিলে রাখা মেলোকর্ডের উপর পড়েছে। ঝকঝকে সাদা পদগুলো দেখে মনে হচ্ছে বাজনাটা দাঁত বের করে হাসছে। ফেলুদা টর্চটা সেইভাবেই ধরে রেখে বলল – ‘চাবি। ইংরিজিতে , বাংলায় চাবি। এই যে সাদা-কালো পদাগুলো দেখছিস, ওর আর একটা নাম হল চাবি, আর সেই চাবির কথাই—’ চোখের পলকে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেল যেটা ভাবতে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মণিবাবু হঠাৎ বাঘের মতো লাফিয়ে মেলোকর্ডটাকে তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে ফেলুদার মাথায় একটা প্রকাণ্ড বাড়ি মেরে আমাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফেলুদা মার খাবার ঠিক আগেই নিজেকে বাঁচানোর জন্য টর্চ সমেত হাত দুটাে মাথার উপর তুলেছিল। তাই হয়তো তার মাথায় চোট লাগেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাতের যন্ত্রণাতেই সে দেখি খাটে বসে পড়েছে। আমি নিজে মেঝে থেকে উঠতে না উঠতেই বুঝলাম মণিবাবু বাইরে থেকে এইট-টু-নাইন-ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি তাও দৌড়ে গিয়ে কাঁধ দিয়ে দরজায় একটা ধাক্কা মেরেছি, এমন সময় ফেলুদার গলী পেলাম — ‘বাথরুম!’ বাইরে থেকে গাড়ি স্টার্ট দেবার একটা শব্দ, আর তারপরেই ঠাঁই করে একটা আওয়াজ। আমরা দুজনে ঝড়ের মতো বাথরুমে ঢুকে জমাদারের দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম। বাগানের দিক থেকে গোলমাল, অনুকূলের গলা, অবনীবাবুর গলা। মণিবাবুর গাড়িটা বাঁই করে গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল! আমরা সামনের দরজার কাছে পৌঁছে গেছি। ওটা কে বসে আছে কাঁকর বিছানো রাস্তার উপর? অবনীবাবু চেঁচাচ্ছেন – ‘তুমি কী করলে, সাধন। এটা কী করলে তুমি ! ছি-ছি-ছি !’ সাধন তার সরু অথচ গম্ভীর গলায় বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘ও যে দাদুর বাজনা নিয়ে পালাচ্ছিল!’ এবার ফেলুদা বলল, ‘ও ঠিকই করেছে, অবনীবাবু ! অপরাধীকে এয়ারগান দিয়ে পঙ্গু করে ও আমাদের সাহায্যই করেছে — যদিও ভবিষ্যতে ওকে একটু সাবধানে বন্দুক চালাতে হবে। ..আপনি এক্ষুনি থানায় ফোন করে দিন। গাড়িটাকেও যেন পালাতে না দেয় – ওর নম্বর হল ডব্লু এম এ সিক্স ওয়ান সিক্স ফোর।’ অনুকূল আর ফেলুদা দুজনে মিলে মণিবাবুকে ধরে তুলল। তাঁর কপালের বা দিক থেকে ছররার গুলি লেগে রক্ত পড়ছে। ভদ্রলোক একেবারে থুম মেরে গেছেন। মেলোকর্ডটা মণিবাবুর পাশেই কাঁকরের উপর পড়ে ছিল, আমি সেটাকে খুব সাবধানে তুলে নিলাম। আমরা চারজন রাধারমণবাবুর খাটের পাশে গোল হয়ে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি। চারজন মানে আমি, ফেলুদা, অবনীবাবু, আর বারাসত থানার দীনেশ গুঁই, ইনি বোধহয় ইনস্পেক্টর-টিনস্পেক্টর হবেন। ঘরের এক কোণে সিন্দুকটার সামনে আরও দুজন লোক রয়েছে। একজন দাঁড়িয়ে, সে বোধহয় কনস্টেবল, আর আরেকজন চেয়ারে ঘাপটি মেরে বসে। ইনি হলেন অপরাধী মণিমোহন সমাদ্দার, যার কপালে এখন ব্যান্ডেজ বাঁধা। এ ছাড়া সাধনও রয়েছে। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে দেখছে। আমাদের পাঁচজনের মাঝখানে টেবিলের উপর রাখা রয়েছে মেলোকর্ড। এইবার বোধহয় ফেলুদা একটা রহস্য উদঘাটন করবে। ফেলুদার ঘড়ির কাচ ভেঙে গেছে, আর বা হাতের কবজির খানিকটা ছাল উঠে গেছে। রাধারমণবাবুর বাথরুম থেকে ডেটল নিয়ে লাগিয়ে সেখানে সে রুমাল বেঁধে রেখেছে। হাত থেকে চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ফেলুদা বলতে আরম্ভ করল – ‘মণিমোহন সমাদ্দারকে আমি সন্দেহ করতে আরম্ভ করি আজ দুপুর থেকে। কিন্তু তিনি কোনও একটা বেচাল না চাললে তাঁকে বাগে আনা যাচ্ছিল না, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব। আমি তাই খানিকটা রিস্ক নিয়েই তাঁকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলাম। আমাকে আচমকা আক্রমণ করে বাজনা নিয়ে পালানোটাই হল তাঁর ভুল চাল। শেষ পর্যন্ত তিনি পালাতে পারতেন না ঠিকই, কিন্তু তিনি যে এত তাড়াতাড়ি সায়েস্তা হলেন তার জন্য অবিশ্যি দায়ী সাধনের এয়ারগান। ‘মণিমোহনবাবুর একটা কথায় প্রথম খটকা লাগে। কথাটা যখন বলেছিলেন তখন লাগেনি, পরে লাগে। উনি বলেছিলেন পরশু ওঁর
false
shunil_gongopaddhay
ক্রাচ্‌ বগলে নিয়ে উনি একা পাহাড়ে পর্যন্ত উঠতে পারেন। কিন্তু এখন হাতেও জোর নেই, ক্রাচও ধরতে পারছেন না। গাড়ি এসে থামল আগরতলার সার্কিট হাউসে। খুবই সুন্দর ব্যবস্থা। পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘর কাকাবাবুর জন্য, অন্য ঘরটিতে প্ৰকাশ আর সন্তু থাকবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও তৈরিই ছিল। প্ৰকাশ বলল, আজ অনেক ধকল গেছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া যাক। কাকাবাবু এখন নিজে খেতেও পারেন না, তাঁকে খাইয়ে দিতে হয়। চামচে করে যে খাবার তুলবেন, তাতে সেই জোরটুকুও নেই। এই কদিন বাড়িতে ছোড়াদিই খাইয়ে দিয়েছে কাকাবাবুকে। আজ সন্তু বসল কাকাবাবুকে খাওয়াতে। কিন্তু তার তো অভ্যোস নেই, সে ঠিকঠাক পারবে কেন? ভাত তুলে কাকাবাবুর মুখে দিতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে। প্রকাশ বলল, তুমি সরো, সন্তু, আমি দিচ্ছি। আমরা তো নার্সিং করতে জানি। কাকাবাবু দু তিনবার ঠিকঠাক খেলেন। তারপর একবার কটু করে চামচটাকেই কামড়ে ধরে এক ঝটিকায় ছাড়িয়ে নিলেন প্রকাশের হাত থেকে। তারপর সেই চামচটাকে চিবুতে লাগলেন কচর-মচর করে। প্ৰকাশ আঁতকে উঠে বলল, স্যার, স্যার, ও কী করছেন? ও কী? কাকাবাবু কট্‌মট্‌ করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমায় স্যার স্যার বলছ কেন! আমার নাম রামনরেশ যাদব। আমি বিহারের একজন গোয়ালা। আমার একশো সাতান্নটা গোরু আছে। তুমি কি সেই একটা গোরু? সন্তুর বুকের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হতে লাগল। প্রকাশ সরকার কাকাবাবুকে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর সন্তুর সঙ্গে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে নিজেদের ঘরে এসে বসল। সন্তুর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। একেবারে। সে যেন বুঝতে পারছে কাকাবাবুর একটা ভীষণ বিপদ আসছে। এই অবস্থায় বাড়ি থেকে এত দূরে থাকা কি ঠিক? প্ৰকাশ জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার হল বলে তো, সন্তু? উনি একবার বৈজনাথ বলে ডাকলেন আমাকে। তারপর নিজের নাম বললেন রামনৱেশ যাদব। এরা করা? সন্তু বলল, কোনওদিন আমি এই সব নাম শুনিনি! তুমি তো ওঁর সঙ্গে সবকটা অভিযানেই গেছ, তাই না? সুতরাং যে-সব ব্যাড ক্যারেকটারদের উনি দেখেছেন, তুমিও তাদের দেখেছ? তার কোনও মানে নেই। আমি তো মোটে চার-পাঁচ বার গেছি। কাকাবাবুর সঙ্গে। তার আগে কাকাবাবু আরও কত জায়গায় গেছেন। পাটা ভেঙে যাবার আগে তো উনি আমাকে সঙ্গে নিতেন না। আগেকার কথা বাদ দাও। গত পাঁচ-ছ বছর ধরে তো তুমি ওঁর সঙ্গেই থেকেছ– একটু চিন্তা করে সন্তু বলল, না, তাও ঠিক বলা যায় না। গত বছর আমার যখন পরীক্ষা ছিল, সেই সময় কাকাবাবু একাই যেন কোথায় গিয়েছিলেন– কোথায়? তা আমি ঠিক জানি না। তবে মনে হয় যেন অসমের দিকেই। কেন তোমার অসমের কথা মনে হল? উনি কি তোমায় কিছু বলেছিলেন? না। তা বলেননি। তবে, উনি মার জন্য একটা বেশ সুন্দর নানা রঙের কম্বলের মতন জিনিস। এনেছিলেন, তার নাম খেস। মা বলেছিলেন, ঐ জিনিস অসমেই ভাল পাওয়া যায়। কিন্তু অসমে এসে বৈজনাথ কিংবা রামনরেশ যাদব টাইপের নামের ক্যারেকটারদের উনি মিট করবেন, এটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। বিহার, উত্তরপ্রদেশেই এই ধরনের নামের লোক থাকে। আচ্ছা ডাক্তারবাবু— আমায় ডাক্তারবাবু বলার দরকার নেই। আমায় তুমি প্রকাশন্দা বলতে পারো। আপনার কি মনে হয়, কাকাবাবুর স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? কিছু একটা গণ্ডগোল যে হয়েছে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। উনি নিজেকেও অন্য মানুষ ভাবছেন। অবশ্য এটা খুব টেমপোরারিও হতে পারে। দেখা যাক, কাল সকালে কেমন থাকেন? আপনি সত্যি করে বলুন, কাকাবাবু আবার ভাল হয়ে যাবেন তো? নিশ্চয়ই! যে-কোনও ভাবেই হোক, ওঁকে ভাল করে তুলতেই হবে। ওঁর মাথাটাই তো একটা অ্যাসেট! তা হলে এবার শুয়ে পড়া যাক? পাশাপাশি দুটো খাটে ওদের বিছানা। মাঝখানে একটা টেবল ল্যাম্প। প্রকাশ সরকার সেই আলো নিভিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সন্তুর ঘুম আসছে না। সে আকাশ-পাতাল ভাবছে শুধু। কাকাবাবুর কথা মনে করলেই তার কান্না এসে যাচ্ছে। কাকাবাবু যদি পাগল হয়ে যান? না, না, তা হতেই পারে না! কাকাবাবুর মতন সাহসী মানুষ এরকমভাবে নষ্ট হয়ে যাবেন? যদি সত্যি-সত্যি কাকাবাবুর কিছু হয়, তা হলে সন্তু ছাড়বে না। যারা কাকাবাবুকে ঘুমের গুলি দিয়ে মেরেছে, তাদের সন্তু দেখে নেবে, যদি তারা পৃথিবীর শেষপ্রান্তে গিয়েও লুকোয়, তা হলেও সন্তু প্রতিশোধ নেবেই। কিন্তু তারা কারা? কাপুরুষের মতন তারা কাকাবাবুকে পেছন থেকে গুলি করে পালিয়েছে। কাকাবাবুকে তারা পুরোপুরি মেরে ফেলতেও চায়নি, শুধু তাঁর মাথাটাকে নষ্ট করে দিতে চেয়েছে। এটা তো মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। এই সব ভাবতে-ভাবতে কত রাত হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। একটু বোধহয় তন্দ্রার মতন এসেছিল, হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে উঠল সন্তু। একটা গাড়ি ঢুকেছে কম্পাউণ্ডের মধ্যে। ইঞ্জিনের শব্দটা খুব জোর। কয়েকজন লোকের কথাও শোনা গেল এর পরে। সন্তু তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে দাঁড়াল জানলার পাশে। সার্কিট হাউসের বারান্দার আলো সারা রাত জ্বালাই থাকে। সেই আলোয় দেখা গেল, একটা জোঙ্গা জিপ এসে দাঁড়িয়েছে, তার থেকে দুতিন জন লোক নেমে কথা বলছে নাইট গার্ডের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন লোক এগিয়ে এল এদিকে। ঠিক যেন সন্তুর সঙ্গে কথা বলতেই আসছে। সোজা এসে তারপর লোকটি কিন্তু চলে গেল পাশের ঘরের দিকে। সন্তুর তক্ষুনি মনে পড়ল কাকাবাবুর ঘরের দরজা খোলা আছে। কারণ, কাকাবাবু তো নিজে দরজা বন্ধ করতে পারবেন না, দরজাটা ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল। ঐ লোকটা কাকাবাবুর ঘরের দিকেই গেল। প্ৰকাশ সরকারকে ডাকবারও সময়। পেল না। সন্তু। সে
false
robindronath
এফ| এ|-প্লাক্‌ড্‌ ছোকরাটি বললে, একটা ঘটনা জানি, চক্রবর্তীদের একটি কায়স্থ প্রজা ছিল। সে তার একটা হাট নিয়ে চক্রবর্তীদের কিছুতে মানছিল না। মামলা করতে করতে শেষকালে তার এমন দশা হল যে খেতে পায় না। যখন দুদিন তার ঘরে হাঁড়ি চড়ল না তখন স্ত্রীর রুপোর গয়না বেচতে বেরোল; এই তার শেষ সম্বল। জমিদারের শাসনে গ্রামের কেউ তার গয়না কিনতেও সাহস করে না। জমিদারের নায়েব বললে, আমি কিনব, পাঁচ টাকা দামে। দাম তার টাকা ত্রিশ হবে। প্রাণের দায়ে পাঁচ টাকাতেই যখন যে রাজি হল তখন তার গয়নার পুঁটুলি নিয়ে নায়েব বললে, এই পাঁচ টাকা তোমার খাজনা-বাকিতে জমা করে নিলুম। এই কথা শুনে আমরা সন্দীপবাবুকে বলেছিলুম, চক্রবর্তীকে আমরা বয়কট করব। সন্দীপবাবু বললেন, এইসমস্ত জ্যান্ত লোককেই যদি বাদ দাও তা হলে কি ঘাটের মড়া নিয়ে দেশের কাজ করবে? এরা প্রাণপণে ইচ্ছে করতে জানে, এরাই তো প্রভু। যারা ষোলো-আনা ইচ্ছে করতে জানে না তারা হয় এদের ইচ্ছেয় চলবে নয় এদের ইচ্ছেয় মরবে। তিনি আপনার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, আজ চক্রবর্তীর এলেকায় একটি মানুষ নেই যে স্বদেশী নিয়ে টুঁ শব্দটি করতে পারে, অথচ নিখিলেশ হাজার ইচ্ছে করলেও স্বদেশী চালাতে পারবেন না। আমি বললুম, আমি স্বদেশীর চেয়ে বড়ো জিনিস চালাতে চাই, সেইজন্যে স্বদেশী চালানো আমার পক্ষে শক্ত। আমি মরা খুঁটি চাই নে তো, আমি জ্যান্ত গাছ চাই। আমার কাজে দেরি হবে। ঐতিহাসিক হেসে বললেন, আপনি মরা খুঁটিও পাবেন না, জ্যান্ত গাছও পাবেন না। কেননা, সন্দীপবাবুর কথা আমি মানি, পাওয়া মানেই কেড়ে নেওয়া। এ কথা শিখতে আমাদের সময় লেগেছে; কেননা, এগুলো ইস্কুলের শিক্ষার উল্টো শিক্ষা। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কুণ্ডুদের গোমস্তা গুরুচরণ ভাদুড়ি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল। একটা মুসলমান প্রজার বেচে-কিনে নেবার মতো কিছু ছিল না। ছিল তার যুবতী স্ত্রী। ভাদুড়ি বললে, তোর বউকে নিকে দিয়ে টাকা শোধ করতে হবে। নিকে করবার উমেদার জুটে গেল, টাকাও শোধ হল। আপনাকে বলছি, স্বামীটার চোখের জল দেখে আমার রাত্রে ঘুম হয় নি, কিন্তু যতই কষ্ট হোক আমি এটা শিখেছি যে, যখন টাকা আদায় করতেই হবে তখন যে মানুষ ঋণীর স্ত্রীকে বেচিয়ে টাকা সংগ্রহ করতে পারে মানুষ-হিসেবে সে আমার চেয়ে বড়ো; আমি পারি নে, আমার চোখে জল আসে, তাই সব ফেঁসে যায়। আমার দেশকে কেউ যদি বাঁচায় তবে এই-সব গোমস্তা, এই-সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীরা। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম; বললুম, তাই যদি হয়, তবে এই-সব গোমস্তা এই-সব কুণ্ডু এই-সব চক্রবর্তীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার কাজই আমার। দেখো, দাসত্বের যে বিষ মজ্জার মধ্যে আছে সেইটেই যখন সুযোগ পেয়ে বাইরে ফুটে ওঠে তখনই সেটা সাংঘাতিক দৌরাত্ম্যের আকার ধরে। বউ হয়ে যে মার খায় শাশুড়ি হয়ে সে’ই সব চেয়ে বড়ো মার মারে। সমাজে যে মানুষ মাথা হেঁট করে থাকে সে যখন বরযাত্র হয়ে বেরোয় তখন তার উৎপাতে মানী গৃহস্থের মান রক্ষা করা অসাধ্য। ভয়ের শাসনে তোমরা নির্বিচারে কেবলই সকল–তাতেই সকলকে মেনে এসেছ, সেইটেকেই ধর্ম বলতে শিখেছ, সেই জন্যেই আজকে অত্যাচার করে সকলকে মানানোটাকেই তোমরা ধর্ম বলে মনে করছ। আমার লড়াই দুর্বলতার ঐ নিদারুণতার সঙ্গে। আমার এ-সব কথা অত্যন্ত সহজ কথা, সরল লোককে বললে বুঝতে তার মুহূর্তমাত্র দেরি হয় না, কিন্তু আমাদের দেশে যে-সব এম| এ| ঐতিহাসিক বুদ্ধির প্যাঁচ কষছে সত্যকে পরাস্ত করবার জন্যেই তাদের প্যাঁচ। এ দিকে পঞ্চুর জাল মামীকে নিয়ে ভাবছি। তাকে অপ্রমাণ করা কঠিন। সত্য ঘটনার সাক্ষীর সংখ্যা পরিমিত, এমন-কি, সাক্ষী না থাকাও অসম্ভব নয়, কিন্তু যে ঘটনা ঘটে নি জোগাড় করতে পারলে তার সাক্ষীর অভাব হয় না। আমি যে মৌরসি স্বত্ব পঞ্চুর কাছ থেকে কিনেছি সেইটে কাঁচিয়ে দেবার এই ফন্দি। আমি নিরুপায় দেখে ভাবছিলুম পঞ্চুকে আমার নিজ এলাকাতেই জমি দিয়ে ঘর-বাড়ি করিয়ে দিই। কিন্তু মাস্টারমশায় বললেন, অন্যায়ের কাছে সহজে হার মানতে পারব না। আমি নিজে চেষ্টা দেখব। আপনি চেষ্টা দেখবেন? হাঁ, আমি। এ-সমস্ত মামলা-মকদ্দমার ব্যাপার, মাস্টারমশায় যে কী করতে পারেন বুঝতে পারলুম না। সন্ধ্যাবেলায় যে সময়ে রোজ আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় সেদিন দেখা হল না। খবর নিয়ে জানলুম, তিনি তাঁর কাপড়ের বাক্স আর বিছানা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন; চাকরদের কেবল এইটুকু বলে গেছেন, তাঁর ফিরতে দু-চারদিন দেরি হবে। আমি ভাবলুম, সাক্ষী সংগ্রহ করবার জন্যে তিনি পঞ্চুদের মামার বাড়িতেই বা চলে গেছেন। তা যদি হয় আমি জানি সে তাঁর বৃথা চেষ্টা হবে। জগদ্ধাত্রী-পুজো মহরম এবং রবিবারে জড়িয়ে তাঁর ইস্কুলের কয়দিন ছুটি ছিল; তাই ইস্কুলেও তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। হেমন্তের বিকেলের দিকে দিনের আলোর রঙ যখন ঘোলা হয়ে আসতে থাকে তখন ভিতরে ভিতরে মনেরও রঙ বদল হয়ে আসে। সংসারে অনেক লোক আছে যাদের মনটা কোঠাবাড়িতে বাস করে। তারা “বাহির’ বলে পদার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলতে পারে। আমার মনটা আছে যেন গাছতলায়। বাইরের হাওয়ার সমস্ত ইশারা একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়ে, আলো-অন্ধকারের সমস্ত মিড় বুকের ভিতরে বেজে ওঠে। দিনের আলো যখন প্রখর থাকে তখন সংসার তার অসংখ্য কাজ নিয়ে চার দিকে ভিড় করে দাঁড়ায়, তখন মনে হয় জীবনে এ ছাড়া আর কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু যখন আকাশ ম্লান হয়ে আসে, যখন স্বর্গের জানলা থেকে মর্তের উপর পর্দা নেমে আসতে থাকে, তখন আমার মন বলে, জগতে সন্ধ্যা
false
humayun_ahmed
বিষয়বস্তু নেই। একেকদিন একেকরকম। শশাংক পাল পছন্দ করেন। পুরনো দিনের শানশওকতের গল্প করতে। সুলেমানের পছন্দ তার বর্তমান জীবনের গল্প। ভিক্ষুক-জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প সে আনন্দের সঙ্গে করে। সে তার ঘোড়ার বুদ্ধিমত্তাতে মুগ্ধ। ইশারা ছাড়াই ঘোড়া যে সব বাড়িতে দাঁড়াচ্ছে এবং গলায় ঘণ্টা নেড়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে এই গল্প বারবার করেও তার মন ভরে না। ভিক্ষা বিষয়ক গল্প তো আছেই। বুঝলেন কর্তা, এক বাড়িতে গেলাম। ঘণ্টা বাজাইলাম। ভিতর থাইকা বলল, আইজ না। আইজ বুধবার। আমি বললাম, বুধবারে বিষয় কী? বুধবারে ভিক্ষা দেই না। দেন না কেন? বড়কর্তার নিষেধ। কোনদিন নিষেধ নাই বলেন, সেই দিন আসব। মঙ্গলবার। গেলাম মঙ্গলবার। তখন কী হইছে শুনেন কর্তা। ভিতর থাইকা বলল, আইজ মঙ্গলবার। মঙ্গলবারে আমরা ভিক্ষা দেই না। সোমবারে আসেন। শশাংক পাল উত্তেজিত গলায় বললেন, বিরাট বজাত তো! সুলেমান উদাস গলায় বলে, ভিক্ষুকের সঙ্গে মিছা কথা। এখন চিন্তা করেন। সমাজ কই গেছে! সমাজ রসাতলে গেছে। দুজনেই সমাজের সাম্প্রতিক রসাতলে প্রবেশে দুঃখিত বোধ করে। তাদের ভেতর এক বিচিত্র সহমর্মিতা দেখা যায়। মাঝে মাঝে গভীর রাতেও তাদের গল্পের আসর বসে। আসরের কথক শশাংক পাল। শুরু হয় তার যৌবনের গল্প— রায়নার ছোটবাবুর সঙ্গে একবার এক মুজরায় গিয়েছিলাম। রায়নার ছোটবাবু বিরাট জমিদার, সেই তুলনায় আমি নস্যি। মুজরার বাইজির নাম কুন্দন বাই। আহারে, গায়ের কী রঙ, যেন তুষের আগুন! আর কণ্ঠ? মধু! গানাবাজনা চলছে, আমার মন খারাপ। কিছুতেই মজা পাচ্ছি না। কেন? কুন্দন বাই আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। তার হাসি-তামাশা সবই রায়নার ছোটবাবুর সাথে। তাঁকে নিজের হাতে পান বানিয়ে দিচ্ছে। ফরাসীর নল এগিয়ে দিচ্ছে। আমি কেউ না। আমি ছোটবাবুর গোমস্তা। সুলেমান বলল, আপনার উচিত ছিল উইঠা চাইলা আসা। শশাংক পাল তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, শোন না ঘটনা। রাত একটার দিকে গানবাজনা কিছু সময়ের জন্যে থামল। রায়নার ছোটবাবু কুন্দন বাইকে একটা আশরাফি নজরানা দিলেন। কুন্দন বাই সালামের পর সালাম দিচ্ছে। আশরাফি পেয়ে তার দিলখোশ। তখন আমি নজরানা দিলাম। কী দিলেন? আমি দিলাম। তিনটা আশরাফি। বলেন কী? তখন টাকা ছিল, খরচ করেছি। পরে কী হবে চিন্তা করি নাই। তারপরের ঘটনা শোন— রায়নার ছোটবাবুর মুখ হয়ে গেল ছাইবৰ্ণ। তার জন্যে বিরাট অপমান। কুন্দন বাই-এর চোখে পলক পড়ে না। আমাকে বলল, বাবুজি আপকা তারিফ? তারিফ মানে কী? তারিফ মানে নাম। আমার নাম জানতে চাইল। নাম বললাম। পরের ঘটনা না বলাই ভালো। রাতে থেকে গেলাম। মধু মধু। উনি বিরাট শিক্ষার মধ্যে পড়লেন। জন্মের শিক্ষা। জুরিগাড়ি নিয়া চলে গেলেন। সুলেমান বলল, উচিত শিক্ষা হয়েছে। পাছায় লাখি খাইছে। শশাংক পাল বললেন, জীবন নিয়া আমার কোনো আফসোস নাই, বুঝেছি। সুলেমান। মধুদিন কাটিয়েছি। এখন সামান্য বেকায়দায় আছি, তবে বেকায়দা যে-কোনো সময় কাটতে পারে। সুতা ভগবানের হাতে। উনি সুতা কীভাবে টান দিবেন। কে জানে। উনার সুতার এক টানে দেবী লক্ষ্মী এসে আমার পাশে বসতে পারেন। পারেন না? অবশ্যই পারেন। দেবী লক্ষ্মীর গল্প শুনবা? শুনব। লক্ষ্মী এবং তার স্বামী নারায়ণ বৈকুণ্ঠে বসে রসালাপ করছিলেন। এমন সময় তাদের সামনে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেল। সূর্যপুত্র রোবন্ত। লক্ষ্মী তাঁর ঘোড়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। সেই ঘোড়া তো আর তোমার ঘোড়ার মতো মরা ঘোড়া না। স্বর্গের ঘোড়া, নাম উচ্চশ্ৰবা। যাই হোক, নারায়ণ বললেন, লক্ষ্মী, তুমি চোখ বড় বড় করে কী দেখ? লক্ষ্মী ঘোড়া দেখে এতই মাজেছেন যে উত্তর দিলেন না। নারায়ণের উঠল রাগ। উনি বললেন, ঘোড়া দেখে তুমি মজেছ, তোমাকে অভিশাপ দিলাম। তুমি পৃথিবীতে ঘোড়ী হয়ে জন্মাবে। ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গম করবে এবং তোমার একটা ঘোড়াপুত্র হবে। সুলেমান বলল, সর্বনাশ! শশাংক পাল বললেন, দেবদেবীদের কাছে এইসব কোনো ব্যাপার না। তারা অভিশাপ দেওয়ার মধ্যেই থাকেন। লক্ষ্মী কি ঘোড়া হয়ে জন্মেছিলেন? অবশ্যই। তাঁর একটা ঘোড়াপুত্ৰও হয়েছিল। বিষ্ণুর আশীর্বাদে তার শাপমুক্তি ঘটে। ঘোড়াপুত্র মানুষ হয়। একবীর নামে সে দীর্ঘদিন পৃথিবী শাসন করে। নতুন এক বংশ স্থাপন করে। বংশের নাম ‘হৈহয়’ বংশ। আজিব ব্যাপার। দেবতাদের কাছে আজিব কোনো ব্যাপার নাই। তারা যদি ঘোড়া থেকে মানুষ বানাতে পারেন তাহলে আমাকে দুর্দশা থেকে কেন উদ্ধার করতে পারবেন না? সুলেমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, অবশ্যই পারবেন। নিশিরাতে শশাংক পালের সঙ্গে গল্প করতে সুলেমানের ভালো লাগে। জীবন আনন্দময় মনে হয়। ভিক্ষুক জীবন যে এত সুখের হবে তা সুলেমানের কল্পনাতেও ছিল না। অল্পদিনেই ঘোড়ার পিঠে ঘুমিয়ে পড়ার দুর্লভ বিদ্যাও সে আয়ত্ত করেছে। ঘণ্টা বাজিয়ে হালকা চালে ঘোড়া চলে, সুলেমান লাগাম ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে শোনে— টুনটুনি টুনটুন। শান্তির আনন্দযাত্রা। সুলেমান যতটুকু আনন্দে আছে ঠিক ততটাই কষ্টে আছেন মাওলানা ইদরিস। তিনি কষ্টে আছেন দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্নটা তিনি এই নিয়ে তিনবার দেখেছেন। একই স্বপ্ন- ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা। স্বপ্নে হরিচরণ এসে তাকে ডাকেন। মাওলানা আছ? মাওলানা! মাওলানা ব্যস্ত হয়ে বের হন। তখন হরিচরণ বলেন, কাজটা কি ঠিক করেছ মাওলানা? আমি মুসলমান হই নাই। তুমি জানাযা পড়িয়ে আমাকে কবর দিয়ে দিলে। আমাকে দাহ করা উচিত ছিল না? প্রতিবারই মাওলানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চান। কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, ধনু শেখ যেটা বলেছেন। আমি সেটাই বিশ্বাস করেছি। আমি ভেবেছি মৃত্যুর আগে আপনি মুসলমান হয়েছেন। হরিচরণ বলেন, উঁহু! তুমি বিশ্বাস কর নাই। তুমি আমার লেখা দানপত্রে দস্তখত করেছ।
false
shomresh
যেমন মীজাপুর স্ট্রিটের সেই ভাড়াটেদের মেয়েটি। সে সাহসী ছিল কারণ তার অভিভাবকরা জীবনধারণের সরঞ্জাম জোগাতে এমন ব্যস্ত থাকেন যে তার ওপর নজর দেওয়ার সময় পান না। ব্যাপারটা সে মায়াকে বলল। মায়া হাসল, তুমি লক্ষ্য করেছ? হ্যাঁ। ওরা তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মত গল্প করতে পারত। তাতে ওদের মন ভরত না। মায়া আর কথা বাড়াল না। গ্লোরিয়া লুসাকা খুব উৎসাহিত। ওদের সঙ্গে অসীমের আলাপ করিয়ে দিল দীপা। অসীম বলল, ভাবতে খুব ভাল লাগছে, কোথায় জাম্বিয়া আর কোথায় আসাম, তবু আপনারা আসামের মানুষদের সাহায্য করতে আমাদের সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছেন। গ্লোরিয়া প্ৰতিবাদ করল, এ কি কথা বলছেন? এখন আমরা এক কলেজের ছাত্রছাত্রী। মানুষের বিপদে মানুষ হিসেরে যেটুকু করা উচিত। তাই করছি। ওরা কলেজে ফিরে এসেছিল। লুসাকা বলল, চল আমরা সবাই মিলে কফি খাই। অসীম বলল, কফি খেতে হলে কফি হাউসে যেতে হবে। কলেজ স্ট্রিটে। এখনকার রেস্টুরেন্টে কফি পাওয়া যায় না? গ্লোরিয়া জানতে চাইল। না। পেলেও ভাল না। চা খেলে বসন্ত কেবিনে যাওয়া যেতে পারে। দীপার বেশিদূরে খাওয়ার বাসনা ছিল না। ওরা বসন্ত কেবিনের দিকে এগোল। কিন্তু মানসী ওদের সঙ্গে গেল না। ওর শরীর নাকি ভাল লাগছে না। তাই হোস্টেলে ফিরে গেল। দীপার মনে হল মানসী সঠিক বলল না। একসঙ্গে সাহায্য চাইতে রাস্তায় নামা যায়। কিন্তু রেস্টটুরেন্টে ঢুকে চা খাওয়ায় বোধ হয় ওর মন সায় দিল না। বসন্ত কেবিনে ঢোকামাত্র যাঁরা বসেছিলেন অবাক হয়ে তাকালেন। কালো বিদেশিনী মেয়ে দুরের কথা বাঙালি মেয়েরা বড় একটা রেস্টটুরেন্টে খেতে আসে না। দীপার একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল। সে এই প্ৰথম রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। কোণার দিকের একটা খালি টেবিলে ওরা পাঁচজনে বসল। অসীম চাপা গলায় বাংলায় বলল, এদের আমারই খাওয়ানো উচিত। প্ৰথম দিন তো! দীপা বলল, আপনি একা খাওয়াবেন কেন? আমিও দেব। ছেলে হিসেরে সেটা আমার ভাল লাগবে না। হেসে ফেলল অসীম। গ্লোরিয়া বাংলা কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, কি বলছি তোমরা? দীপা বলল, অসীম দাবি করছেন তিনি একজন ছেলে। গ্লোরিয়া অবাক হল, সেটা দাবি করার কি আছে? দেখলেই তো বোঝা যাচ্ছে? অসীম এবার এমন শব্দ করে হেসে উঠল যে বসন্ত কেবিনের ম্যানেজার পর্যন্ত হ্যাঁ করে তাকাল। টেস্ট আর চা বলা হল। মায়া আসেনি। তার অনেক কাজ। সংগৃহীত জিনিসপত্র সঠিক জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। দীপার মনে হয় এই মেয়ে সময় এবং সমাজ ছাড়া। ও যে কাজ করে যাচ্ছে তা কাউকে তোয়াক্কা না করেই করছে। এবং কেউ তো ওর সামনে এসে বলছে না তোমার করা চলবে না। এটা কলকাতা বলেই সম্ভব হয়েছে। জলপাইগুড়ি হলে হুলুস্থূল পড়ে যেত। কলেজের ওপর চাপ আসতো এমন ছাত্রীকে ছাড়িয়ে দেবার। তাই যদি হয়, কলকাতার মানুষ যদি এত উদার তাহলে অন্য মেয়েরা কেন এখনও এত আড়াল আরডাল খোঁজে? হঠাৎ অসীম বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার প্ৰিয় কবি কে? দীপা দেখল গ্লোরিয়ারা নিজেদের ভাষায় গল্প করছে। অসীম কিংবা দীপা একা থাকলে ওরা নিশ্চয় ইংরেজিতে কথা বলত। সে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বাংলাতেই বলল, এর চেয়ে কঠিন প্রশ্ন আপনার পায়ের তলায় কি? উত্তরটা কি হবে? আপনি নিশ্চয়ই জুতো বলবেন না। না, মাটি। ঠিকই। যে কোন বাঙালির প্ৰিয় কবি হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথ। কেন? অসীমের মুখে কৌতুক। আপনার সঙ্গে বোধ হয়। আর কথা না বলাই আমার উচিত। সুন্দর। আপনি জীবনানন্দ দাশ পড়েছেন। পড়েছি। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে আপনার পছন্দ? জীবনানন্দ কি অনেক আধুনিক নন? দেখুন, জীবনানন্দ আমার চেতনার কাছে আবেদন করেন। তাঁকে বুঝতে গেলে বুদ্ধি এবং আগ্রহ দুই রাখতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, জীবনানন্দ আমাকে বড় একা করে দেন। একা এবং নিঃসঙ্গ। তিনি বড় কবি। তাঁকে পড়লে নিজের সম্পর্কে একধরনের বিভ্ৰম জাগে। শব্দের খেলায় তিনি এক লৌকিক এবং অলৌকিক জগতের মাঝখানে আর একটি জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমার বোধে আমার অস্তিত্বে প্ৰাণদান করেন। আমার মনের গা ঘেঁষে বন্ধুর মত এসে বসেন। কথাগুলো বলতে বলতে দীপা এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্য করেনি যে গ্লোরিয়া চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে থেমে যেতে গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, তুমি এত উত্তেজিত কেন? লুসাকা হাসল, রাগ তো অনুরাগের দ্বিতীয় স্তর। দীপা হতভম্ব, মানে? লুসাকা বলল, প্ৰথমে আলাপ হবার সময় একধরনের মুগ্ধতা কাজ করে। তারপর কোন ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি হলে রাগারাগি হয়। সেই স্টেজটায় যাদের সম্পর্ক না কেটে যায় তাহলে অনেকদিন তারা একসঙ্গে এগোতে পারে। অসীম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাদের কিন্তু সেসব কিছুই হচ্ছে না। দুই বড় কবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। বিতর্ক যে-কোন বিষয় নিয়েই হতে পারে। লুসাকা মাথা নাড়ল। দীপা একটু উষ্ণ হল, লুসাকা, আমাদের আজই আলাপ হয়েছে। এবার গ্লোরিয়া চোখ বড় করল, সত্যি? আমি তো ভাবছিলাম অসীম তোমার বয়ফ্রেন্ড। ওয়েল, অসীম, দীপাবলীকে তোমার কেমন লাগে? অসীম গম্ভীর হল, খুব জটিল প্রশ্ন। কয়েক ঘণ্টার আলাপে কি বলা যায়? অসীম এমন ভঙ্গীতে কথাগুলো বলল যে গ্লোরিয়ারা শব্দ করে হেসে উঠল। বেশ রাগ হয়ে গেল দীপার। সে ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি অভিনয় করেন নাকি? জবাব দিতে গিয়ে আচমকা থেমে গেল অসীম। তার চোখে মুখে বিস্ময়। দৃষ্টিটা এত অস্বস্তিকর যে চোখে চোখ রাখতে পারল না দীপা। লুসাকা জিজ্ঞাসা করল, কি হল?
false
shorotchandra
যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, না, না, গোয়ালা! দয়াল একটুখানি সরিয়া বসিয়া বলিলেন, তোমাকে দেখে তো চামার ব’লে মনে হয়েছিল। যা হোক, নমস্কার। সে ব্যক্তি রাগ করিল না। বলিল, নমস্কার। আপনার অনুমান মিথ্যা নয়, আমাকে চামার বলাও চলে, মুসলমান খ্রীষ্টান বলাও চলে। আমি জাত মানিনে—আমি পরমহংস। তুমি অতি পাষণ্ড। সে বলিল, সে কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন দেখচি না, কেননা, ইতিপূর্বে অনেকেই অনুগ্রহ ক’রে ও কথা বলেছেন। কি ছিলাম, কি হয়েচি, তা এখনো বুঝি। কিন্তু আমিই রাখালদাস। দয়ালের মুখখানি অপরিসীম ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কোনমতে মনের ভাব দমন করিয়া তিনি বলিলেন, এখন কি করতে চাও? সুলোচনাকে নিয়ে যাবে? আজ্ঞে না। তাতে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হবে, আমি অত নরাধম নই। প্রাণের দায়ে দয়াল এ পরিহাসটাও পরিপাক করিলেন। তারপব বলিলেন, তবে কি চাও? আবার এসেচ কেন? টাকা চাই। দারুণ অর্থাভাব, তাই আপাততঃ এসেছি। হাজার-দুই পেলেই নিঃশব্দে চলে যাব, জানাতে এসেছি। এত টাকা তোমায় কে দেবে? যার গরজ। আপনি দেবেন—সুলোচনার জামাই দেবে—সে বড়লোক। দয়াল তাহার স্পর্ধা দেখিয়া মনে মনে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কিন্ত সে অতিশয় ধূর্ত এবং কৌশলী, তাহাও বুঝিলেন। বলিলেন, বাপু আমি দরিদ্র, অত টাকা কখনও চোখে দেখিনি। তবে সুলোচনার জামাই দিতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু সে দেবে না। তাকে চেন না, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দু’হাজার ত ঢের দূরের কথা—দুটো পয়সাও আদায় করতে পাববে না। তুমি যে বুদ্ধিমান লোক তা টের পেয়েছি, কিন্তু সে আরও বুদ্ধিমান। বরং আর কোন ফন্দি দেখ—এ খাটবে না। রাখাল দয়ালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিল। বলিল, সে ভাবনা আমার। দেখা যাক, যত্নে কৃতে যদি— দয়াল তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, থাক বাবা, দেবভাষাটাকে আর অপবিত্র করো না। রাখাল সপ্রতিভভাবে বলিল, যে আজ্ঞে। কিন্তু আর ত বসতে পাচ্চিনে—বলি তাঁর ঠিকানাটা কি? দয়াল বলিলেন, সুলোচনাকেই জিজ্ঞাসা কর না বাপু। রাখাল কহিল, সে বলবে না, কিন্তু আপনি বলবেন। যদি না বলি? রাখাল শান্তভাবে বলিল, নিশ্চয়ই বলবেন। আর না বললে কি করব, তা ত পূর্বেই বলেছি। দয়ালের মুখ শুকাইল। তিনি বলিলেন, আমি তোমার কিছুই ত করিনি বাপু। রাখাল বলিল, না, কিছু করেন নি। তাই এখন কিছু করতে বলি। নাম-ধামটা ব’লে দিলে জামাইবাবুকেও দুটো আশীর্বাদ ক’রে আসি, মেয়েটাকেও একবার দেখে আসি। অনেক দিন দেখিনি। দয়ালঠাকুর রীতিমত ভয় পাইয়াছিলেন। কিন্তু মুখে সাহস দেখাইয়া কহিলেন, আমি তোমায় সাহায্য করব না। তোমার যা ইচ্ছা কর। অজ্ঞাতে একটা পাপ করেছি, সে জন্য না হয় প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার আর ভয় কি? ভয় কিছুই নেই, তবে পাণ্ডা-মহলে আজই একথা রাষ্ট্র হবে। তার পর যেমন ক’রে পারি, অনুসন্ধান ক’রে সুলোচনার জামাইয়ের কাছে যাব, এবং সেখানেও এ কথা প্রকাশ করব! নমস্কার ঠাকুর, আমি চললাম। সত্যিই সে চলিয়া যায় দেখিয়া দয়াল তাহার হাত ধরিয়া পুনর্বার বসাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, বাপু, তুমি যে অল্পে ছাড়বার পাত্র নও তা বুঝেছি। রাগ করো না। আমার কথা শোন। এর মধ্যে তুমি এ কথা নিয়ে আর আন্দোলন করো না। হপ্তাখানেক পরে এস তখন যা হয় করব। মনে রাখবেন, সেদিন এমন ক’রে ফেরালে চলবে না। দয়াল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, বাপু, তুমি কি সত্যিই বামুনের ছেলে? আজ্ঞে। দয়াল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আশ্চর্য! আচ্ছা, হপ্তাখানেক পরেই এস—এর মধ্যে আর আন্দোলন করো না, বুঝলে? আজ্ঞে, বলিয়া রাখাল দুই-এক পা গিয়াই ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ভাল কথা। গোটা-দুই টাকা দিন তো। মাইরি, মনিব্যাগ্‌টা কোথায় যে হারালাম, বলিয়া সে দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে লাগিল। দয়াল রাগে তাহার পানে আর চাহিতেও পারিলেন না। নিঃশব্দে দুইটা টাকা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন, সে তাহা ট্যাঁকে গুঁজিয়া প্রস্থান করিল। সে চলিয়া গেল, কিন্তু সেইখানে দয়াল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ যেন সহস্র বৃশ্চিকের দংশনে জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। সপ্তম পরিচ্ছেদ কিন্তু সুলোচনা কোথায়? আজ তিন দিন ধরিয়া হরিদয়াল আহার, নিদ্রা, পূজা-পাঠ, যাত্রীর অনুসন্ধান, সব বন্ধ রাখিয়া তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত কাশী খুঁজিয়াও যখন তাহাকে বাহির করিতে পারিলেন না, তখন ঘরে ফিরিয়া আসিয়া শিরে করাঘাত করিয়া বলিলেন, বিশ্বেশ্বর! এ কি দুর্দৈব? অনাথাকে দয়া করিতে গিয়া শেষে কি পাপ সঞ্চয় করিলাম! গলির শেষে কৈলাসখুড়োর বাটী। হরিদয়াল সেখানে আসিয়া দেখিলেন, কেহ নাই। ডাকিলেন, খুড়ো, বাড়ি আছ? কেহ সাড়া দিল না দেখিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন, দেখিলেন, কৈলাস প্রদীপের আলোকে নিবিষ্টচিত্তে সতরঞ্চ সাজাইয়া একা বসিয়া আছে; বলিলেন, খুড়ো, একাই দাবা খেলচ? খুড়া চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এস বাবাজী, এই চালটা বাঁচাও দেখি। হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া মনে মনে গালি পাড়িয়া কহিলেন, নিজের জাত বাঁচে না, ও বলে কিনা দাবার চাল বাঁচাও! কৈলাসের কানে কথাগুলো অর্ধেক প্রবেশ করিল, অর্ধেক করিল না। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বল বাবাজী? বলি, সেদিনের ব্যাপারটা সব শুনেছিলে? কি ব্যাপার? সেই যে আমাদের ভিতরের সেদিনকার গোলযোগ! কৈলাস কহিলেন, না বাবাজী, ভাল শুনতে পাইনি। গোলযোগ বোধ করি খুব আস্তে আস্তে হয়েছিল; কিন্তু সেদিন তোমার দাবাটা আচ্ছা চেপেছিলাম! হরিদয়াল মনে মনে তাহার মুণ্ডপাত করিয়া কহিলেন, তা ত চেপেছিলে, কিন্তু কথাগুলো কিছুই শোননি? কৈলাস ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, না, কিছুই প্রায় শুনতে পাইনি। অত আস্তে আস্তে গোলমাল করলে কি ক’রে শুনি বল? কিন্তু সেদিনকার খেলাটা
false
shomresh
তাকানো যে অর্থবহ তা বুঝতে অসুবিধে হল না জয়িতার। কিন্তু এসবে আমল না দিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনে। এখন বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। আঃ দারুণ! ছোটবেলা থেকে কত ইংরেজি বই-এ এইরকম হাঁটার কথা সে পড়ে আসছে। সাইবেরিয়ার কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প থেকে একজন এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বরফের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিল একুশ দিন। সেই বর্ণনা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তার সামনে এখন যে কুয়াশায় ঢাকা বরফ পড়ে আছে তাকে দেখে অবশ্য খুব নিরীহ মনে হচ্ছে। সে ফিরে আসতেই কল্যাণ বলল, এখান থেকে সাপ্লাই পেলে কলকাতায় সস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করা যেত। প্রাকৃতিক আইস উইদ ক্রিম। সুদীপ শুনে বলল, তোর কলকাতায় একটা ঘাসের দোকান খোলা উচিত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণের গলা চড়ল, আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি না। কেউ গায়ে পড়ে আমাকে জ্ঞান দিলে আমি কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করব না। সুদীপ অত্যন্ত অবাক গলায় বলল, হোয়াটস্ দিস! আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করতে পারব না? না। তোর ঠাট্টা, তোর হুকুম, এসব আমি মানতে বাধ্য নই। ও। সারাটা পথ কিন্তু তোর বোঝা আমিই বয়ে এলাম। ঠিক আছে, তোর যখন কোন কম্‌প্লেক্স কাজ করছে তখন আর কিছুই বলব না। কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই কমপ্লেক্সটা কি? কল্যাণ কোন জবাব দিল না। সুদীপ এগিয়ে গেল ওর কাছে, কল্যাণ, আমার প্রশ্নের জবাব দে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আনন্দ এবং কাছাকাছি জয়িতা ওদের দেখছিল। চট করে যে উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে তার জন্যে জয়িতা ভীত হয়ে পড়ল। সে আনন্দর দিকে তাকাতে আনন্দ নিষেধ করল ইঙ্গিতে কিছু না বলতে। কল্যাণ একপাশে মাথা ঘুরিয়ে বসে আছে। সুদীপ কিছুক্ষণ ওর সামনে দাঁড়াল। তারপর ডান হাত আলতো করে কল্যাণের কাঁধে রেখে বলল, সরি। তোকে যদি হার্ট করে থাকি তাহলে দুঃখিত। বলে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। জয়িতা লক্ষ্য করল কল্যাণ তার বসার ভঙ্গি পালটাল না। এইসময় ওয়াংদে ওদের চা দিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠছে অথচ চুমুক দেবার পর মনে হল ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। নিজের মগে চুমুক দিয়ে ওয়াংদে বলল, আজ যদি ফালুটে পৌঁছাতে হয় তাহলে আর একটু জোরে পা চালাতে হবে। মনে হচ্ছে আজ রোদ উঠবে না এবং সন্ধ্যে নামবে আগেই। ও কথাগুলো বলল আনন্দকে। লোকটা নিজেই বুঝে নিয়েছে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঘড়িতে যখন তিনটে তখন জয়িতার মনে হল আর এক পা-ও হাঁটতে পারবে না। ছেলেরা কেউ কিছু বলছিল না বটে কিন্তু একমাত্র সুদীপ ছাড়া বাকী দুজনও বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। এমন নয় ওরা সমস্তটা পথে বরফ পেয়েছে। কিন্তু চড়াই উত্রাই ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর আর বাতাস নেই, থাই থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রচণ্ড বেদনা ওঠানামা করছে। ওয়াংদে আর সুদীপ এগিয়ে গিয়েছিল। কুয়াশায় ওদের দেখা যাচ্ছে না। আনন্দ চিৎকার করতে সুদীপের নাম পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আনন্দ কল্যাণকে বলল, আমার গলায় লাগছে, তুই ডাক। কল্যাণের অবস্থা তখন বেশ কাহিল। নাকের ডগায় কোন সাড়া নেই। দাঁড়িয়ে থাকতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। জয়িতা মুখের কাছে আনন্দর অনুকরণে দুটো হাত নিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল কিন্তু কল্যাণকে এড়িয়ে হাত নেড়ে আনন্দ তাকে নিষেধ করল। কল্যাণ চিৎকার করল সামনের ঘন নীল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সুদীপের নাম ধরে নয়। ওয়াংদের সাড়া পাওয়া গেল বেশ দূর থেকে। জয়িতা অবাক চোখে কল্যাণের দিকে তাকাল। এই সময়েও মানুষ কি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা বিস্ময়েরই ব্যাপার। আর মিনিট দুয়েক অপেক্ষার পর কুয়াশার আড়াল ভেদ করে ওয়াংদে বেরিয়ে এল, লোকটাকে একটুও ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না। ওর পিঠের বোঝা যেন কিছুই নয়। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে ফালুট পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে? সে বুঝে গিয়েছিল দূরত্ব সময় দিয়ে মাপলে তবু এদের কাছ থেকে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ওয়াংদে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, এইভাবে হাঁটলে আরও এক ঘণ্টা। কিন্তু মনে হচ্ছে ফালুটে যাওয়া আজ সম্ভব হবে না। কথাগুলো একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিত করল আনন্দকে। নিজেদের অক্ষমতার কথা সে কিভাবে ওয়াংদেকে বলবে তাই ভাবছিল, কিন্তু ওয়াংদে সেটাই সহজ করে দিল। বরং সে একটু কৌতূহলী হবার ভান করে জিজ্ঞাসা করল, কেন? মাত্র তো এক ঘণ্টার পথ বলছ! কল্যাণ এই সময় বলল, অসম্ভব। ইম্পসিবল। আমার পক্ষে আর এক পা-ও হাঁটা সম্ভব নয়। যদি যেতে চাস তো আমাকে ফেলে রেখে তারা চলে যা। ওয়াংদে বলল, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই মনে হচ্ছে অন্ধকার নেমে আসবে আজ। সাহেবরা খুব খারাপ সময় পছন্দ করেছেন এখানে আসার জুন্যে। তাও যদি আমরা সকাল আটটার মধ্যে বের হতে পারতাম তাহলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম। তাছাড়া ওই সাহেব আজকে আর যেতে পারবেন না। কোন্ সাহেব? ওয়াংদের কথাটা ধরতে পারল না আনন্দ। যে সাহেব আমার সঙ্গে হাঁটছিলেন। পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। জোর কপাল নইলে খাদে চলে যেত শরীর। পায়ে চোট লেগেছে। আমি এতক্ষণ সাহেবের পা ম্যাসেজ করছিলাম। আনন্দ দেখল কল্যাণ এগিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। সুদীপের খবরটায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল সেটা আচমকা থিতিয়ে গেল। জয়িতাও কল্যাণের পেছনে হাঁটছিল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল আর চলা সম্ভব নয় অথচ খবরটা শোনামাত্র শরীরের ক্লান্তি চাপা পড়ে গেল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় কিছুই দেখা যাচ্ছে
false
shunil_gongopaddhay
নতুন কী আঁকড়ে ধরৰে তা বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, গিরিশবাবুর নাটকে তারা ফিরে পেল বংশানুক্রমিক বিশ্বাস। একশোটা বক্তৃতার চেয়েও একটি বিশ্বাসযোগ্য নাটকের শক্তি বেশি। গিরিশবাবুর নাটকে যুক্তিবাদ চাপা পড়ে গেল প্রবল ভক্তিবাদে, ঠাকুরদেবতারা জীবন্ত হয়ে উঠল। অধিকাংশ মানুষই বেদ-উপনিষদ পড়েনি, পড়লেও বুঝবে না, মহাকাব্য-পূরাণের গল্পগুলিও ঠিকমতন জানে না, নাটক দেখতে এসে তারা গিরিশ-অমৃতলাল বিনোদিনীর অভিনয় দেখে না, তারা দেখতে পায় জীবন্ত শিব, বিষ্ণু, ভক্ত ধ্রুব আর পতিপরায়ণ দময়ন্তীকে, যারা সব হিন্দুর আদর্শ। মুসলমানরা এই সব নাটকের ধারে কাছে আসে না। ব্রাহ্ম আন্দোলনও একটা জোর ধাক্কা খেল। গিরিশ ঘোষের মধ্যেও একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বাগবাজারের বোস পাড়ার ছেলে গিরিশ চোদ্দ বছর বয়সেই বাপ-মাকে হারায়। মাথার ওপর আর কোনও অভিভাবক ছিল না, সুতরাং বখামি শিখতে দেরি হল না। মাঝপথেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সে যত রাজ্যের বদ ছেলের সঙ্গে জুটল। বাগবাজারের পাড়ায় পাড়ায় গাঁজা-চরসের আড্ডাখানা, গিরিশের মদ্যপানের দিকেই ঝোঁক বেশি, সেই সেই সঙ্গে মন্দ স্ত্রীলোকদের নিয়ে ফুর্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতায় তার জুড়ি ছিল না। সে বলশালী যুবা, ব্যক্তিত্ব প্রবল, নেতৃত্ব দেবার সহজাত শক্তি আছে তার, সে সারা পল্লী দাপিয়ে বেড়াত। কিন্তু অন্যান্য বখাটে ছেলেদের সঙ্গে তার তফাত এই যে, তার পড়াশুনোর নেশাও ছিল দারুণ। নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সে শেক্সপিয়ার মিল্টন পাঠ করে। তার সাহিত্যবোধ গাঢ় হতে লাগল দিন দিন। প্রথম যৌবনে একদল বন্ধুকে নিয়ে একটা সখের যাত্রা দল খুলে ছিল গিরিশ। ‘সধবার একাদশী’ পালায় তার বেশ সুখ্যাতি হয়। ক্রমে পরিচয় হয় দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে। তারপর সে জড়িয়ে পড়ল নাট্যজগতে। এখন যে-কোনও মঞ্চে গিরিশ ঘোষই প্রধান আকর্ষণ। অভিনয়ে তিনি ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত নট গ্যারিকের সঙ্গে তুলনীয়, তা ছাড়া তিনি অতি সার্থক নাট্যশিক্ষক ও পরিচালক। ইদানীং নাট্যকার। সকলের শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হয়েও গিরিশ ঘোষ তাঁর দুর্দান্তপনা ছাড়েননি, মদ খেয়ে মাতলামি করার সময় মনে হয় ইনি রুদ্রচণ্ড। সেই সঙ্গে আবার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং নাস্তিক। যুক্তিবাদী সাহিত্য ও বিজ্ঞান পাঠ করে গিরিশের ধারণা হয়েছিল যে, সব কিছুই প্রকৃতির নিয়মে চলে, একজন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই বিশ্বজগতে। ধর্মের প্রসঙ্গ উঠলেই গিরিশ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মতন কথা বলেন। নাট্য নিয়ন্ত্ৰণ আইন পাশ হবার পর ‘নীলদর্পণ’ বা সেই জাতীয় নাটক অভিনয় করা যায় না। নাটকের ধারা পাল্টেছে। ভক্তিরসের পৌরাণিক নাটক প্রচুর দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। কিন্তু নিছক জনপ্রিয়তা কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্যের মোহেই গিরিশ পৌরানিক নাটক লিখছেন না। এর মধ্যে তাঁর একটা বিরাট মানসিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। একবার দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি যুক্তি বিসর্জন দিয়ে অবলম্বন করেছেন ভক্তি। অবিশ্বাস থেকে ফিরে আসতে চাইছেন বিশ্বাসের পথে। কিন্তু পথ দেখাবার জন্য একজন প্রদর্শক চাই। একদিন ওঁদের পাড়ায় বলরাম বসুর বাড়িতে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের আসবার কথা। বলরামবাবু প্রতিবেশীদের অনেককে নেমন্তন্ন করেছেন। ইনি নাকি পরমহংস। এর আগে বোসপাড়ার একটি বাড়িতে ওই মানুষটিকে দেখেছিলেন গিরিশ। তেমন পছন্দ হয়নি। পরমহংস হওয়া কি সোজা কথা! ঘরের মধ্যে অনেক ভিড় ছিল, মাঝখানে বসেছিলেন সাধারণ চেহারার একজন মানুষ, মাঝ মাঝে হাসছেন, গান গেয়ে উঠছেন, আবার কেশব সেনকে কী সব যেন গল্প শোনাচ্ছেন। বেলা পড়ে এসেছিল, একজন একটা সেজবাতি রেখে গেল সামনে, তাই দেখে রামকৃষ্ণ বারবার বলতে লাগলেন, হ্যা গা, সন্ধে হয়েছে? সন্ধে হয়েছে! গিরিশ ভাবলেন, ঢং দেখ! বাইরে অন্ধকার, সামনে সেজবাতি জ্বলছে, তবু ইনি বুঝতে পারছেন না যে, সন্ধে হয়েছে কি না! এখানে থাকা মানে সময় নষ্ট। বলরাম বসুর বাড়িতেও তেমন আলাপ হল না। গিরিশ পৌঁছবার আগেই রামকৃষ্ণ ঠাকুর এসে গেছেন, তাকে ঘিরে রয়েছে লোকজন, বিধু কির্তনী গান শোনাবার জন্য বসে আছে একেবারে সামনে। গিরিশের ধারণা পরমহংস হবেন গম্ভীর, ধ্যানী, সাধারণ লোকাচারের অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি কোনও সাধারণ মানুষকে প্ৰণাম করবেন, এ প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ইনি ফিস ফিস করে হাসছেন আর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বারবার প্রণাম করছেন বিধুকে। এ আবার কী! একজন পরমহংসের পক্ষে এরকম রঙ্গ করা কি মানায়? ঘরের মধ্যে যারা উপস্থিত, তারা সকলেই যে ওঁর ভক্ত তা নয়। অনেকে আগে ওঁর নামই শোনেনি, এসেছে বলরাম বোসের আমন্ত্রণে, কেউ কেউ এসেছে নিছক কৌতূহলে। ওঁর ভাবভঙ্গি দেখে ফিসফিসিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছে দু’-একজন। একটু পরে দরজার কাছ থেকে এক ব্যক্তি হাতছানি দিয়ে ডাকলেন গিরিশকে। ইনি শিশিরকুমার ঘোষ, অমৃতবাজার পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক। গিরিশের বন্ধু। শিশিরকুমার পরম বৈষ্ণব, একজন কালীসাধকের প্রতি তার তেমন আকর্ষণ থাকার কথা নয়। তার মুখেও সেই ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি গিরিশকে বললেন, এখানে আর কী থাকবে, চলো চলো! গিরিশ বললেন, আর একটু থাকি, একবার কথা বলে দেখি। শিশিরকুমার ওষ্ঠ ওল্টে বললেন, দেখবার কী আছে? চল আমরা অন্য জায়গায় গল্প করিগে। একপ্রকার জোর করেই শিশিরকুমার গিরিশকে বাইরে নিয়ে এলেন। কিছুটা পথ যাবার পর গিরিশ তাকালেন পেছন ফিরে। একবার মনে হল, ওই মানুষটির কাছে ফিরে গেলে হয়! কিন্তু গিরিশের ফেরা হল না। রবির বিবাহের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পাত্রীও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, কথাবার্তা প্রায় পাকা। এক বিশাল ধনী পরিবারের একমাত্র দুহিতা, এই বিবাহে রবি শুধু রাজকন্যাই লাভ করবে না, সেই সঙ্গে পাবে রাজত্ব, সাত লাখ টাকা আয়ের জমিদারি। পাত্রী পক্ষ অবশ্য বাঙালি নয়, দক্ষিণ ভারতীয়, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এই বিবাহে জ্ঞানদানন্দিনীরই বেশি
false
shottojit_roy
আসছি। অ্যাদ্দিন পরে আমার খুড়তুতো ভাই পিটার ডেক্সটরের ছবি কাগজের বিজ্ঞাপনে দেখে অবাক লাগল। এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত যে এটা আপনার খুড়তুতো ভাইয়ের ছবি? হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমি খুব অল্প বয়সে অষ্ট্রেলিয়া চলে যাই। তারপরে আর পিটারের খবর রাখিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার ফ্যামিলির সঙ্গেও আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই ওরা এখন কে কী অবস্থায় আছে তা বলতে পারব না। এইটুকু মনে আছে যে পিটারের বাবা-আমার কাকা-মাইকেল ডেক্সটার ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। আমার মনে হয়। ইনডিপেনডেন্সের পরে উনি আবার দেশে ফিরে যান। পিটারই কি ওঁর একমাত্র ছেলে ছিল? ওঃ নো! সবসুদ্ধ সাতজন সন্তান ছিল মাইকেল ডেক্সটরের! পিটার ছিল ষষ্ঠ! বড় ছেলে জর্জও ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিল। মাইকেল ডেক্সটর বিলেতে কোথায় থাকতেন? কাউন্টিটা মনে আছে। নরফোক! শহরের নাম মনে নেই। এতেও অনেক কাজ হল। জন ডেক্সটর উঠে পড়লেন। তাঁকে হোটেলে গিয়ে লাঞ্চ খেতে হবে। –তাঁর দলের লোক সব অপেক্ষা করছে। ফেলুদা ভদ্রলোককে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিল। পরদিন আবার অ্যাপিয়েস্টমেন্ট করে আমরা রঞ্জন মজুমদারের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। বিজ্ঞাপনের কোনও ফল পেলেন? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। সেইটে জানাতেই আপনার কাছে আসা, বলল ফেলুদা। ছেলেটি ব্রিটিশ, নাম পিটার ডেক্সটার। কী করে জানলেন? ফেলুদা জন ডেক্সটরের ঘটনাটা বলল। রঞ্জনবাবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তারপর বিড়বিড় করে দুবার বললেন, পিটার ডেক্সটর…পিটার ডেক্সটর… কিছু মনে পড়ছে কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। আবছা আবছা। একটা দুৰ্ঘটনা…না, এই স্মৃতির ওপর নির্ভর করা চলে না। আপনি যে-সময়ের কথা ভুলে গেছেন, সেই সময়ের ঘটনা কি মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়? যা মনে পড়ে সেটা সত্যি কি না। কী করে বিচার করব? এমন তো কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করে যাচাই করতে পারি। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। আমার বিলেতের ঘটনা ওঁরাই জানতেন? একটা জিনিস বোধহয় বুঝতে পারছেন, যে কলকাতায় বসে এই পিটার ডেক্সটর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যাবে না। হ্যাঁ…হাঁ… তা তো বুঝতেই পারছি… ভদ্রলোক আবার অন্যমনস্ক। না কি ব্যাপারটা এখানেই ইতি দেবেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ভদ্রলোক হঠাৎ যেন সজাগ হয়ে উঠলেন। মোটেই না—মোটেই না। হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন রঞ্জন মজুমদার। সে কোথায় আছে কী করছে, আমাকে মনে আছে কি না—সব আমি জানতে চাই। আপনি কবে যেতে পারবেন? হঠাৎ এই প্রশ্নে যেন ফেলুদা একটু হকচাকিয়ে গেল। বলল, কোথায়? লন্ডন—আবার কোথায়? লন্ডন তো আপনাকে যেতেই হবে। হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারছি। কবে যাবেন? আমার তো অন্য কোনও কাজ নেই। এটাই একমাত্র কেস। আপনাদের পাসপোর্ট-টাসপোর্ট হয়ে গেছে? হ্যাঁ। আমরা কয়েক বছর আগে হংকং যাই; তখনই করিয়ে নিয়েছিলাম। তা হলে আর কী—বেরিয়ে পড়ুন। আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি। আমাদের সঙ্গে এক বন্ধু যাবেন—নিজের খরচে অবশ্য। ঠিক আছে—তাঁর নাম আমার সেক্রেটারি পশুপতিকে দিয়ে দেবেন। পশুপতিই আমার ট্র্যাভল এজেন্টের খুঁ দিয়ে আপনাদের যাবার এবং ওখানে থাকার সব ব্যবস্থা করে দেবে। তা ছাড়া ফরেন এক্সচেঞ্জের ব্যাপারটা তো আছে; সেটাও ও করে দেবে। ওখানে কদ্দিন থাক? রঞ্জনবাবু একটু ভেবে বললেন, সাত দিনে যদি হল তো হল, না হলে চলে আসবেন। আমি রিটার্ন বুকিংটাও সেইভাবেই করব। আমি যদি সাকসেসফুল না হই, তা হলে কিন্তু আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে প্রস্তুত নই। আপনি কোনও কেসে বিফল হয়েছেন? তা হইনি। তা হলে এটাতেও হবেন না। ইউ. কে? লালমোহনবাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ফেলুদা ভদ্রলোককে কলকাতার ঘটনা সব বলে দিয়ে তারপর লন্ডনের ব্যাপারটা বলল। ভদ্রলোক এটার জন্য একেবারেই তৈরি ছিলেন না। আপনি গেলে কিন্তু আপনার নিজের খরচে যেতে হবে। আমাদের খরচ মিস্টার মজুমদার দিচ্ছেন। কুছ পরোয় নেহি। খরচের ভয় আমাকে দেখবেন না, মিস্টার হোমস। আপনার পসার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও আমার রোজগার আপনার চেয়ে বেশি। শুধু বলে দিন কী করতে হবে। দিন সাতেকের মতো গরম কাপড় নেবেন। পাসপোর্টটা হারাননি তো? নো স্যার-কেয়ারফুলি কেপট ইন মাই অ্যালমাইরা। তা হলে আর আপনার করণীয় কিছু নেই। যাবার তারিখটা যথাসময়ে জানতে পারবেন। যদ্দুর মনে হয়-এখান থেকে বম্বে, বম্বে থেকে লন্ডন! ওখানে থাকছি কোথায়? সেটা রঞ্জনবাবুর ট্র্যাভল এজেন্ট ব্যবস্থা করবে। একটা থ্রি-স্টার হোটেল হবে। আর কী। হোয়াই ওনলি থ্রি স্টারস? তার চেয়ে বেশি চড়তে গেলে মজুমদার মশায়ের পকেট ফাঁক হয়ে যাবে। লন্ডনের খরর সম্বন্ধে কোনও ধারণা আছে আপনার? তা অবিশ্যি নেই। তবে, একটা কথা বলে রাখি-গড়পারে এক ভদ্রলোক থাকেন, আমার খুব চেনা। চন্দ্ৰশেখর বোস। ব্যবসাদার। বছরে দুবার করে বিলেত যান। তাঁর কাছ থেকে কিছু ডলার ম্যানেজ করব। –কী বলেন? ব্যাপারটা কিন্তু বেআইনি। অতএব নীতিবিরুদ্ধ। আরে মশাই আপনি অতি সাধুগিরি করবেন না তো। আজকাল নীতির ডেফিনিশন চেঞ্জ করে গেছে। ঠিক আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার কারচুপিতে সায় দিচ্ছি। আমাদের মঙ্গলবার এয়ার ইন্ডিয়াতে যাওয়া ঠিক হল। প্লেন ছাড়বে রাত তিনটেয়, তারপর বম্বে হয়ে লন্ডন পৌঁছাবে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে এগারোটায়। হোটেলের বুকিং-ও হয়ে গেছে–পিকাডিলি সাকাসে রিজেন্ট প্যালেস। ফেলুদা বলল, খুব ভাল লোকেশন। একেবারে শহরের মাঝখানে! ফেলুদা ক’দিন থেকে লন্ডন সংক্রান্ত গাইড বুকে ডুবে আছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরের ম্যাপ দেখছে। যাবার আগের দিন মিস্টার মজুমদারকে ফোন করা হল। মিনিট দুয়েক কথা বলে ফোন নামিয়ে রেখে ফেলুদা বলল, জানতে চেয়েছিলাম ওঁর বাবা কোনও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হলেন কি না। বললেন ওঁর মনে নেই। ওঁরা
false
humayun_ahmed
একটা চেষ্টা চালাতে হবে। তাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তার ব্যবসা যেন চালু থাকে সেটা দেখতে হবে। চা-কফি বিক্রি বন্ধ হবে না। ফ্লাস্কভর্তি চা কফি নিয়ে বের হতে হবে। ছুটির দিনে ভালো বিক্রি হবার কথা। চা এবং কফি দুটাই সবচে ভালো বানান আমার বড় খালা মাজেদা বেগম। তার কাছ থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি করে আনা যেতে পারে। আজ অনেক কাজ। ম্যানেজার জয়নালকে খবরের কাগজ ফেরত দিলাম। সে বলল, আজি দুপুরে কিন্তু মেসে খাবেন হিমু ভাই। ইমপ্রুভড ডায়েট। আমি বললাম, মেন্যু কী? প্লেইন পোলাও, খাসির রেজালা আর দই। শুধু দাই? দই-মিষ্টি না? শুধু দই। দই-মিষ্টি দিলে পুষে না। গেস্ট অ্যালাউড? জি অ্যালাউড। পার গেস্ট একশ টাকা। আপনার গেস্ট আছে? দুইজন গেস্ট। অ্যাডভান্স টাকা দিতে হবে হিমু ভাই। অ্যাডভান্স টাকা আমি পাব কোথায়? আচ্ছা থাক আপনাকে দিতে হবে না। আমি জিম্মাদার। হিমু ভাই, কাগজে পড়েছেন মুরগি ছাদেককে র‍্যাব শেষ করে দিয়েছে? পড়েছি। আমি তো প্ৰথমে বিশ্বাসই করি নাই। তারপর দেখলাম সত্যি। খুবই আনন্দ পেয়েছি। আমার হাতে টাকা থাকলে র‍্যাব ভাইদের একদিন ইমপ্রভড ডয়েট খাওয়ায়ে দিতাম। ডাণ্ড মেরে সব ঠাণ্ড করে দিচ্ছে। এই দেশে ডাণ্ডা ছাড়া কিছু হবে না। ঠিক বলেছি না? অবশ্যই ঠিক বলেছেন। আমাদের প্রত্যেকের হাতে থাকবে ডাণ্ডা। কারো বড় ডাণ্ডা কারো ছোট ডাণ্ডা। জয়নাল ভাই, বিদায়। দুপুরে কিন্তু চলে আসবেন। আপনি এবং দুইজন গেস্ট। আমি মোটামুটি দুঃশ্চিন্তা নিয়েই বের হলাম। গেস্ট পাব কোথায়? ঝোঁকের মাথায় দুজন গেস্টের কথা বলেছি। একজনের নাম হালকাভাবে মাথায় আছে। বজলু। মনে হচ্ছে দুপুরের মধ্যে তাকে পেয়ে যাব। দ্বিতীয়জন পাব কোথায়? খুলাফায়ে রাশেদিনের সময় আমিরুল মুমেনিনরা খাবার সময় পথে বের হতেন। দুঃস্থজনদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। আমিও সেরকম কিছু কি করব? দুঃস্থ কেউ এসে একবেলা প্লেইন পোলাও রেজালা খেয়ে যাক। মেসের মুখেই একজন ভিখিরি পাওয়া গেল। মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। মাথায় বেতের টুপি। তবে বলশালী চেহারা। উনার গানের গলা ভালো। চোখ বন্ধ করে মাথা বাকিয়ে বেশ আয়োজন করে গাইছেন– দিনের নবি মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায় ছাগল একটা বান্দা ছিল গাছেরাও তলায়। আমি গায়ক ফকিরের সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়ালাম। একবার মনে হলো যেহেতু প্ৰথম উনার সঙ্গে দেখা উনাকেই দাওয়াত দিয়ে দেই। ফকির চোখ মেলে গান থামিয়ে বলল, স্যার, আসসালামু আলায়কুম। ফকিররা সালাম দেয় না। তারা প্রথম সুযোগেই ভিক্ষা চায়। এর ঘটনা কী? ইমপ্রুভড ডায়েটের মতো ইমপ্রুভড ফকির? ওয়ালাইকুম সালাম। ভালো আছেন? আপনার গানের গলা তো সুন্দর। গায়ক ফকির বিনয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আপনার গানের কথায় সামান্য সমস্যা আছে, এটা জানেন? কী সমস্যা? আপনি বলছেন–ছাগল একটা বান্দা ছিল গাছেরাও তলায়। নবিজীর দেশে ছাগল পাওয়া যায় না। গানের কথা সামান্য চেঞ্জ করে দেন। ছাগলের জায়গায় বলেন দুম্বা। দুম্বা একটা বান্দা ছিল গাছেরাও তলায়। গায়ক ফকির ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ফকিররা এমন দৃষ্টিতে কখনো তাকায় না। সমস্যাটা কী? ফকির সাহেব! জি স্যার। আপনি কি দুপুর পর্যন্ত এখানেই থাকবেন, না জায়গা বদলাবেন? ফকির চুপ করে আছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। আপনি যদি দুপুর পর্যন্ত এখানে থাকে, তাহলে আমার সঙ্গে খানা খাবেন। ঠিক আছে? কী জন্যে? আপনি ভিক্ষুক মানুষ, আপনাকে খেতে বলেছি আপনি খাবেন। প্রশ্ন কিসের? দাওয়াত কি কবুল করেছেন? ভিখিরি জবাব দিল না। তার ভাবভঙ্গি বলছে সে দাওয়াত কবুল করে নি। আমি হাঁটা দিলাম। একবার পেছনে তোকালাম। গায়ক ফকির গান বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এত দূর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তারপরেও মনে হলো তার ভুরু এখনো কুঁচকানো। মাজেদা খালা বললেন, অ্যাই, তোকে র‍্যাবে ধরেছিল নাকি? গভীর রাতে টেলিফোন। আমার তো কলিজা নড়ে গিয়েছিল। র‍্যাব তোকে কী করল? ছেড়ে দিল। মারধোর করে নাই? না। মারধোর করল না এটা কেমন কথা! পুলিশে ধরলেও তো মেরে তক্তা বানিয়ে দেয়। তোকে মারল না কেন? আমি তো জানি না খালা। জিজ্ঞেস করি নি। তোমার কাছে জরুরি কাজে এসেছি। কাজটা আগে সারি। এই যে দুটা ফ্লাস্ক দেখছ, একটা ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে দেবে, আরেকটা ফ্লাস্ক ভর্তি কফি। খালা বললেন, র‍্যাব তাহলে ঠিকই বলেছিল, তুই ফেরিওয়ালা হয়েছিস। চা-কফি ফেরি করিস। প্রথমে আমি র‍্যাবের কথা বিশ্বাস করি নি। তুই সত্যি ফেরি করিস? হুঁ। কোথায় কোথায় যাস? যেখানে মানুষের আনাগোনা সেখানেই যাই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাস? যাই। গুড। তাহলে তুই আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবি। ইউ আর দি পারসন। ঘন ঘন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবি। চোখ-কান খোলা রাখবি। কেন? মাজেদা খালা গলা নামিয়ে বললেন, তুই লক্ষ রাখবি তোর খালু সাহেব সেখানে যায় কি-না। আমাকে বলেছে যায় না। তবে আমি নিশ্চিত সে যায়। কীভাবে নিশ্চিত হলাম শোন। একদিন সে আমাকে বলল, ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে হাঁটতে যাচ্ছি। আমি বললাম, যাও। সে ট্ৰেকসুট পরে বের হয়ে গেল। আমিও কিছুক্ষণ পরে উপস্থিত। তোর খালুর টিকির দেখাও পেলাম না। আমিও খালার মতো গলা নামিয়ে বললাম, খালু সাহেবের কি কোনো প্রেম ট্রেম হয়েছে না-কি? মাজেদা খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই বয়সে প্রেম হবে কী? অন্য ব্যাপোর? অন্য কী ব্যাপার? মেয়েদের সঙ্গে ছুকিছুকানি করার রোগ হয়েছে। বুড়ো বয়সে এই রোগ হয়। বাজে টাইপের একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। মেয়েটার নাম ফ্লাওয়ার। মেয়ের নামও তুমি
false
shordindu
চলিয়াছে। তাহার তিন কুলে কেহ নাই, রাজসংসারই তাহার সংসার। মণিকঙ্কণা মুখ গম্ভীর করিয়া বলিল—দারুব্রহ্ম তোমার মঙ্গল করুন। আজ দিবানিদ্রাটি কেমন হল? মন্দোদরী পানের ডাবা খুলিতে খুলিতে বলিল—দিবানিদ্রা আর হল কই। খোলর মধ্যে যা গরম, তালের পাখা নাড়তে নাড়তেই দিন কেটে গেল। শেষ বরাবর একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলুম। বিদ্যুন্মলা উদ্বেগভরা চক্ষে মন্দোদরীকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন—এমন করে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কদিন বাঁচবি মন্দা! দিনের বেলা তোর চোখে ঘুম নেই, রাত্রে জলদস্যুর ভয়ে চোখে-পাতায় করতে পারিস না। শরীর যে দিন দিন শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছে। মন্দোদরী গদগদ হাস্য করিয়া বলিল—যা যা, ঠাট্টা করতে হবে না। আমি তোদের মতন অকৃতজ্ঞ নই, খাই-দাই মোটা হই। তোরা খাস-দাস কিন্তু গায়ে গত্তি লাগে না। পানের বাটা খুলিয়া মন্দোদরী দেখিল তাহার মধ্যে ভিজা ন্যাকড়া জড়ানো দুই-তিনটি পানের পাতা রহিয়াছে। ইহা বিচিত্র নয়, কারণ দীর্ঘপথ আসিতে পানের অভাব ঘটিয়াছে। দুই-একটি নদীতীরস্থ গ্রামে ডিঙি পাঠাইয়া কিছু কিছু পান সংগ্রহ করা গিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা যথেষ্ট নয়। অথচ পানের ভোক্তা অনেক। মন্দোদরী প্রচুর পান খায়, মাতুল চিপিটকমূর্তিও তাম্বুল রসিক। বস্তুত যে পানের বাটাটি মন্দোদরীর সম্মুখে দেখা যাইতেছে, তাহা মাতুল মহাশয়ের। মন্দোদরী নিজের বরাদ্দ পান শেষ করিয়া মামার বাটায় হাত দিয়াছে। বাটায় পান ছাড়াও চুন গুয়া কেয়াখয়ের মৌরী এলাচ দারুচিনি, নানাবিধ উপচার রহিয়াছে। মন্দোদরী পানগুলি লইয়া পরিপাটিভাবে পান সাজিতে প্রবৃত্ত হইল। দুই ভগিনী দেখিলেন স্থূলতার প্রতি কটাক্ষপাতে মন্দোদরী ঘামিল না, তখন তাঁহারা অন্য পথ ধরিলেন। মণিকঙ্কণা বলিল—আচ্ছা মন্দোদরি, তোকে তো আমরা জন্মে অবধি দেখছি, কিন্তু তোর রাবণকে তো কখনো দেখিনি। তোর রাবণের কি হল? মন্দোদরী বলিল—আমার রাবণ কি আর আছে, অনেক দিন গেছে। আমি রাজসংসারে আসার আগেই তাকে যমে নিয়েছে। বিদ্যুন্মালা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন—সত্যিই তোর স্বামীর নাম রাবণ ছিল নাকি? মন্দোদরী মাথা নাড়িয়া বলিল—না, তার নাম ছিল কুম্ভকর্ণ। মণিকঙ্কণা খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল—ও—তাই! তোর কুম্ভকর্ণ যাবার সময় ঘুমটি তোকে দিয়ে গেছে। বিদ্যুন্মালা বলিলেন—তাহলে তোর এখন শুধু বিভীষণ বাকি? মন্দোদরী আর একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আর বিভীষণ! তোদের সামলাতে সামলাতেই বয়স কেটে গেল, এখন আর বিভীষণ কোথেকে পাব। মণিকঙ্কণা সান্ত্বনার স্বরে বলিল—পাবি পাবি। কতই বা তোর বয়স হয়েছে। এই দ্যাখ না, বিজয়নগরে যাচ্ছিস, সেখানকার বিভীষণেরা তোকে দেখলে হাঁ করে ছুটে আসবে। বিদ্যুন্মালা বলিলেন-কে বলতে পারে, ম্লেচ্ছ দেশের আমীর-ওমরা হয়তো তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেগম করবে। মন্দোদরী বলিল—ও মা গো, তারা যে গরু খায়। মণিকঙ্কণা বলিল—তোকে পেলে তারা গরু খাওয়া ছেড়ে দেবে। মন্দোদরী জানিত ইহারা পরিহাস করিতেছে; কিন্তু তাহার অন্তরের এক কোণে একটি লুক্কায়িত আকাঙ্খা ছিল, তাহা এই ধরনের রসিকতায় তৃপ্তি পাইত। সে পান সাজিয়া মুখে দিল, চিবাইতে চিবাইতে বলিল—তা যা বলিস। কার ভাগ্যে কি আছে কে বলতে পারে? নমো দারুব্রহ্ম। এই সময়ে নৌকার নিম্নতল হইতে তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দ শোনা গেল। শব্দটি স্ত্রী কণ্ঠোঙ্খিত মনে হইতে পারে, কিন্তু বস্তুত উহা মাতুল চিপিটকমূর্তির কণ্ঠস্বর। কোনো কারণে তিনি জাতক্রোধ হইয়াছেন। পরক্ষণেই তিন চার লাফ দিয়া চিপিটকমূর্তি ছাদে উঠিয়া আসিলেন। মন্দোদরী কোলের কাছে পানের বাটা লইয়া বসিয়া আছে দেখিয়া তাঁহার চক্ষুদ্বয় ঘূর্ণিত হইল, তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া সূচীতীক্ষ্ণ কণ্ঠে তর্জন করিলেন—এই মন্দোদরি! আমার ডাবা চুরি করেছিস! তিনি ছোঁ মারিয়া ডাবাটি তুলিয়া লইলেন। মন্দোদরী গালে হাত দিয়া বলিল—ও মা! ওটা নাকি তোমার ডাবা! আমি চিনতে পারিনি। চিপিটকমূর্তি ডাবা খুলিয়া দেখিলেন একটিও পান নাই, তিনি অগ্নিশর্মা হইয়া বলিলেন—রাসী! সব পান খেয়ে ফেলেছিস! দাঁড়া, আজ তোকে যমালয়ে পাঠাব। ঠেলা মেরে জলে ফেলে দেব, হাঙরে কুমীরে তোকে চিবিয়ে খাবে। মন্দোদরী নির্বিকার রহিল; সে জানে তাহাকে ঠেলা দিয়া জলে ফেলিয়া দিবার সামর্থ্য চিপিটকমূর্তির নাই। তাছাড়া এইরূপ অজাযুদ্ধ তাহাদের মধ্যে নিত্যই ঘটিয়া থাকে। চিপিটকমূর্তি মহাশয়ের কণ্ঠস্বর যেমন সূক্ষ্ম তাঁহার চেহারাটিও তেমনি নিরতিশয় ক্ষীণ। তাঁহাকে দেখিলে গঙ্গাফড়িং-এর কথা মনে পড়িয়া যায়; সারা গায়ে কেবল লম্বা এক জোড়া ঠ্যাং, আর যাহা আছে তাহা নামমাত্র। কিন্তু মাতুল মহাশয়ের পূর্ণ পরিচয় যথাসময়ে দেওয়া যাইবে। দুই রাজকন্যা বাহুতে বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া মাতুল মহাশয়ের বাহ্বাস্ফোট পরম কৌতুকে উপভোগ করিতেছেন ও হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছেন। সূর্য তুঙ্গভদ্রার স্রোতে রক্ত উদগিরণ করিয়া অস্ত যাইতেছে। নৌকা সঙ্গমের নিকটবর্তী হইতেছে, সম্মিলিত নদীর উতরোল তরঙ্গে অল্প অল্প দুলিতে আরম্ভ করিয়াছে। নৌকাগুলি দক্ষিণদিকের তটভূমির পাশ ঘেঁষিয়া যাইতেছে, এইভাবে সঙ্গমের তরঙ্গভঙ্গ যথাসম্ভব এড়াইয়া তুঙ্গভদ্রার স্রোতে প্রবেশ করিবে। উত্তরের তটভূমি বেশ দূরে। মণিকঙ্কণার চঞ্চল চক্ষু জলের উপর ইতস্তত ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা এক স্থানে আসিয়া স্থির হইল; কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া সে বিদ্যুন্মালাকে বলিল—মালা, দ্যাখ তোঐ জলের ওপর কিছু দেখতে পাচ্ছিস! বলিয়া উত্তরদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। চার দুই ভগিনী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বিদ্যুন্মালা চোখের উপর করতলের আচ্ছাদন দিয়া দেখিলেন, তারপর বলিয়া উঠিলেন—হ্যা, দেখতে পাচ্ছি। একটা মানুষ ভেসে যাচ্ছে—ঐ যে হাত তুলল—হাতে কি একটা রয়েছে মণিকঙ্কণাও দেখিতেছিল, বলিল—কৃষ্ণা নদী দিয়ে ভেসে এসেছে, বোধহয় অনেক দূর থেকে সাঁতার কেটে আসছে—আর ভেসে থাকতে পারছে নাসঙ্গমের তোড়ের মুখে পড়লেই ড়ুবে যাবে। হঠাৎ মণিকঙ্কণা দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল। বিদ্যুন্মালা উৎকণ্ঠিতভাবে চাহিয়া রহিলেন। মামাও যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়া ইতি-উতি ঘাড় ফিরাইতে লাগিলেন। অন্য নৌকা দুটির বাহিরে লোকজন নাই। কেহ কিছু লক্ষ্যও করিল না। তারপর শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে মণিকঙ্কণা আবার ছাদে উঠিয়া আসিল, সে শঙ্খ আনিবার জন্য নীচে
false
shomresh
ছোটখাটো অফিসার ছুটতে ছুটতে পুলিশ কমিশনারকে খবর দিতে যাচ্ছে, স্যার, স্যার, এ সি সোমকে পেয়েছি। ওই বাংলোয়। আর সেটা শুনে গোমড়ামুখো ভার্গিস বলছে, লোকটা আর এ সি নয় মুর্থ। ওকে এখনই অ্যারেস্ট করো। অতএব এখনই এখানে ফোর্স এসে যাবে। ওরা এলে বাবু বসন্তলালের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে যা করার তা করবে। কিন্তু তার আগেই ওকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। সোম বাইরে বেরিয়ে এল। চাঁদ এখন প্ৰায় মেঘের আড়ালে। কোথায় যাওয়া যায়? পুলিশের গাড়ি নিয়ে বেশিদূরে গিয়েও কোনও লাভ নেই। ওই গাড়ির জন্যেই তাড়াতাড়ি ধরা পড়তে হবে। আবার গাড়ি ছাড়া এই রকম পাহাড়ি অঞ্চলে বেশিদূর পর্যন্ত যাওয়াও সম্ভব নয়। অন্তত নীচের রাস্তা পর্যন্ত তো যাওয়া যাক, ওরা আসার আগেই এই জায়গা ছাড়া উচিত। সে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আচমকা কাছাকাছি গাড়ির হর্ণ বেজে উঠেই থেমে গেল। প্রচন্ড চমকে গেল সোম। তাড়াতাড়ি রিভলভার হাতে সর্তক ভঙ্গিতে দাঁড়াল। ওরা এর মধ্যেই এসে গেল। ইম্পসিবল। অবশ্য এমনও হতে পারে আগে ফোর্স পাঠিয়ে পরে ফোন করিয়েছে সি-পি। ধরা লে নিস্তার নেই। গাড়ি আসার পথের দিকে সর্তক চোখে তাকিয়ে পিছু হটতে লাগল সে। কোনমতে ওই ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়লে এখান থেকে সরে পড়া অসম্ভব হবে না। পাশ ফিরতে গিয়ে কনুই-এর চাপ লাগায় হৰ্ণ বেজে উঠেছিল। আঁতকে ফিরে তাকিয়েছিল প্রথা, স্বজনের মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করা হয়ে গেল। পৃথা চাপা গলায় বলল, কি হবে এখন? মনে মনে হাজারবার সরি বললেও কিছুই বলা হবে না। কিন্তু ওরা অবাক হয়ে দেখল। যাকে এতক্ষণ খুনি বলে মনে হচ্ছিল সেই লোকটা নির্ঘাত ভয় পেয়েছে। পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসছে এদিকেই। আর একটু এলেই তাদের দেখতে পেয়ে যাবে লোকটা, পিছন ফিরলেই। স্বজন বুঝতে পারল না হৰ্ণ এদিকে বাজা সত্ত্বেও লোকটা উল্টোদিকে তাকাচ্ছে কেন? কিন্তু এভাবে গাড়ির মধ্যে বসে থেকে লোকটার মুখোমুখি হওয়ার কোনও মানে হয় না। সে পৃথকে চাপা গলায় বলল, চলো নামি। ধরা পড়তেই হবে। ধরা পড়ব বলছ কেন? আমরা কি কিছু করেছি? পৃথা প্রতিবাদ করল। সঙ্গে সঙ্গে সোমকে অবাক হয়ে এদিকে তাকাতে দেখা গেল। মানুষের গলার স্বর স্পষ্ট তার কানে পৌঁছেছে। এবং সেটা তার পেছনের বুনো ঝোপ থেকে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ তাকে ঘিরে ফেলেছে ওরা। সোম খুব নার্ভাস গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে, কে ওখানে? স্বজন পৃথার দিকে তাকাল। লোকটার চেহারার মধ্যে রুক্ষতা থাকলেও গলার স্বরে হাবভাবে সেটা একদম নেই। সে গলা তুলল, রিভলভারটা ফেলে দিন। সোম বুঝল তার সন্দেহ মিথ্যে নয়। এখন বীরত্ব দেখানো মানে বোকামি করা, সেটা তার চেয়ে বেশি কে জানে। সে রিভলভার মাটিতে ফেল দিতেই স্বজন ঝোপের আড়াল থেকে হুকুম করল, গুনে গুনে আট পা পিছিয়ে যান। অগত্যা সোম আদেশ পালন করল। তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। পৃথা অবাক হয়ে দেখছিল। এবার বলল, লোকটা খুনি নয়। দরজা খুলে বের হচ্ছিল স্বজন, কেন? খুনিরা এমন সুবোধ হয় না। স্বজন কোনও কথা না বলে একদৌড়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা রিভলভারটা তুলে নিয়ে সোমের দিকে তাকাল। জীবনে এত বিস্মিত সোম কখনই হয়নি। স্বজনকে ভাল করে বোঝার আগেই সে দেখল এক সুন্দরী তরুণী ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে। এরা কখনই পুলিশ নয়। কোনও বাহিনী তাকে ঘিরে ধরেনি মাত্র দুটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে বোকা বানিয়েছে দেখে সে নিজের ওপর এমন রেগে গেল যে চিৎকার করে বলে উঠল, ধ্যাত! রিভলভার হাতে স্বজন হকচকিয়ে গেল, কি হল? তোমরা কারা? সোম প্রশ্ন করার সময়ে ভাবল লাফিয়ে পড়বে কিনা। ভদ্রভাবে কথা বলুন। আমাদের তুমি বলার কোনও অধিকার আপনার নেই। সরি। আসলে পুলিশের চাকরি করে করে- সোম থিতিয়ে গেল। আপনি পুলিশ? স্বজন অবাক। হ্যাঁ, আজ বিকেলে পর্যন্ত ছিলাম। আপনারা এখানে কি করছেন। স্ব জন পৃথার দিকে তাকাল। মেয়েরা মানুষ চেনে হয়তো, এই লোকটা খুনি নাও হতে পারে। সে বলল, আমরা শহরে যাচ্ছিলাম। এখানে আমাদের গাড়ির তেল ফুরিয়ে যায়। একটা চিতা আমাদের আক্রমণ করে। ফলে বাধ্য হয়ে এই জায়গায় আটকে আছি। ব্যাপারটা যদি গল্প হয় তাহলে আপনাদের কপালে দুঃখ আছে। বেশ পুলিশি গলায় ঘোষণা করল সোম। আমি একজন ডাক্তার। আচ্ছা। গাড়িটা কোথায়? স্বজন বুনো ঝোপটকে দেখাল। সোম বুঝতে পারছিল। এদের থেকে ভয়ের কিছু নেই। তবু জিজ্ঞাসা করল, বাংলোর ভেতরে গিয়েছেন? হ্যাঁ। ওখানে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে। লোকটাকে চেনেন? কি করে চিনব? এই অঞ্চলে এর আগে আসিনি। কিন্তু ওই লোকটাকে খুনের অভিযোগে আপনাকে যদি ধরা হয়? চটিকবে না। লোকটা মারা গিয়েছে তিনদিনের বেশি আগে। গত পরশু ও আমি এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে অপারেশন করেছি। হঠাৎ সোমের খেয়াল হল। আর দেরি করা উচিত নয়। সি-পি যদি তাকে ধরার জন্যে ফোর্স পাঠিয়ে থাকে তাহলে- সে বলল, রিভলভারটা দিন। স্বজন বলল, আপনি কে তা না জেনে এটা দেব না। আমি পুলিশের অ্যাসিস্টেন কমিশনার ছিলাম। ট্র্যাপে পড়ায় আজ থেকে আমার চাকরি নেই। যার জন্যে এই দুরবস্থা তাকে খুঁজতে এখানে এসেছিলাম। লোকটাকে খুঁজে বের করতে না পারলে আমাকে বিনা দোষে শাস্তি পেতে হবে। দিন রিভলভারটা, আমাকে এখান থেকে এখনই চলে যেতে হবে। হাত বাড়াল সোম। এই সময় পৃথা জিজ্ঞাসা করল, কাকে খুঁজছেন। আপনি? লোকে তাকেও চিতা বলে ডাকে। সশস্ত্ৰ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের
false
manik_bandhopaddhay
অঙ্গে চাপানোর প্রক্রিয়ায় ব্যাপৃতা দেখিতে পায়, দুটি চোখই তার অপলক হইয়া থাকিবে রত্নাবলীর দিকে কিন্তু মন তার পড়িয়া থাকিবে মাধবীলতার কাছে। অভদ্র কল্পনাটি বিপিনের রোমাঞ্চকর মনে হয়। বিপিনের নিজেরই একটা ধারণা ছিল যে, মোটামুটি হিসাবে বছর ত্রিশেক বয়স হইবার পর মানুষের আর এ ধরনের কল্পনা ভালো লাগে না, ছেলেমানুষি মনে হয়, হাসি পায়–রাজাসাহেবের বাড়িতে দেয়ালে টাঙানো কয়েকটি নগ্না নারীর প্রকাশ্য চিত্র দেখিয়া বিপিন ওই ধারণাটি সৃষ্টি করিয়াছিল, ভাবিয়াছিল যে, এই ছবিগুলির দিকে কেউ তাকাইয়াও দ্যাখে না, দেখিয়া দেখিয়া আর কারো কিছুমাত্র কৌতূহল নাই, রক্তমাংসের স্ত্রীলোকের বেলাও মানুষের তাই হয়, প্রথম বয়সটা কাটিয়া যাওয়ার পর নারীদেহ সম্বন্ধে মানুষের সমস্ত কৌতূহল মিটিয়া যায়। প্রথম বয়স বিপিনের বহুকাল কাটিয়া গিয়াছে, দ্বিতীয় বয়সটাও প্রায় কাটিতে চলিল, তবু রত্নাবলী ও মাধবীলতা সম্বন্ধে ছেলেমানুষি কল্পনা করিতে তার ভালো লাগিতেছে কেন, এটা অবশ্য বিপিন ভাবিয়া দেখিল না। রত্নাবলীর পাশে বসিয়া সে হঠাৎ একটা খাপছাড়া কাজ করিয়া ফেলিল–এত জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বলিবার নয়। রত্নাবলী আরো ভয় পাইয়া গেল। পাশে বসে কেন বিপিন? দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কেন বিপিন? অমন করিয়া তাকায় কেন বিপিন জ্ঞানী বৃদ্ধের মতো? আমি বড় ছেলেমানুষ রতন দেবী। গা ঘেঁষিয়া বিপিন বসিয়াছে। বিপিন যদি এবার গায়ে হাত দেয়? যদি জড়াইয়া ধরে? পুরুষ সব সময়ই সংযত থাকিতে পারে, কিন্তু পুরুষমানুষের সংযম শুধু অন্যমনস্কতা, হয়তো পঁচ-সাত বছর কোনো মেয়ের কথা মনেও পড়িল না, কিন্তু তার পাশে গা ঘেঁষিয়া বসিবার পর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে হয়তো এমন পাগলামি করিয়া বসিল যার তুলনা হয় না। বিপিনের কিছু হইবে না, বিপদে পড়িবে সে। সে যদি গোলমাল করে, সকলে যদি বুঝিতেও পারে যে দোষ আগাগোড়া বিপিনের, তবু বিপিনের এতটুকু আসিয়া যাইবে না, মারা পড়িবে সে-ই। উমা-মাসি আসছে বোধহয়। সহজভাবে স্বাভাবিককণ্ঠে কথা বলিবার চেষ্টা করিয়া কোনো লাভ হইল না, রত্নাবলীর নিজের কানেই কথাগুলি শুনাইল যেন সে চুপিচুপি ফিসফিস করিয়া প্রণয়ীকে সতর্ক করিয়া দিতেছে। বিপিন একটু হাসিল। আসুন না, সকলেই তো আসবেন। সকলে আসবেন কেন! ও-কথা বলছেন কেন আপনি! কাঁদিয়া ফেলিবার উপক্রম করিবে কিনা, মনে মনে রত্নাবলী তাই ভাবিতেছিল, গলাটা তাই কাঁদ কাদ শোনাইল। মেয়েদের প্রকৃতিই এই রকম একটা কিছু করিবে কি করিবে না ভাবিতে ভাবিতে কাজটা অর্ধেক করিয়া ফেলে। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে নিজেকে দান করার আগে ঠিক করিয়া ফেলতে পারে নাই আত্মদান করিবে কিনা। [লেখকের মন্তব্য : কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়িল। কিন্তু উপায় নাই, রত্নাবলীকে বুঝিতে হইলে, কথাটা মনে রাখা দরকার। কোনো বিষয়ে আগে হইতে মনস্থির করিয়া ফেলিবার ক্ষমতাটাই মনের জোরের চরম প্রমাণ হিসাবে প্ৰায় সকলেই গণ্য করিয়া থাকে, আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওটা গোয়ার্তমিরই রকমফের। ধরাবাঁধা নিয়মগুলি জীবনে কাজে লাগে না, ধরাবাধা নিয়ম কি জীবনে বেশি আছে? যেগুলিকে অপরিবর্তনীয় নিয়ম বলিয়া মনে হয়, আসলে সেগুলি মানুষের আরোপ করা বিশেষণ মাত্র, উল্টাটাও অনায়াসে খাঁটিতে পারিত। মানুষ কি চায়, মানুষ কি করে এবং মানুষের কি চাওয়া উচিত আর মানুষের কি করা উচিত, এর কোনো নির্দিষ্ট ফরমুলা আছে? অন্যের প্রস্তুত করা ফরমুলা চোখ-কান বুজিয়া অনুকরণ করা হয় বোকামি নয় গোয়াতুমি। মেয়ে এবং পুরুষের মধ্যে যারা সুবিধাবাদী, তারা বোকাও নয় গোয়ারও নয়। এই জন্য তারা আগে হিসাব-নিকাশ শেষ করিয়া চরম সিদ্ধান্ত করিতে পারে না, দরকারমতো কাজ আরম্ভ করে কিন্তু মন সিদ্ধান্তের বাঁধনে বাধা পড়তে চায় না। শশধরের বাহুর বাঁধন রত্নাবলী মানিয়া লইবে সন্দেহ নাই, কিন্তু তখনো সে কি স্বীকার করিবে নারীজন্ম তার সফল হইল অথবা মস্ত একটা ভুল সে করিয়া বসিয়াছে ঝোঁকের মাথায়? দেহ অবশ্য তার অবশ হইয়া যাইবে, চোখ মেলিয়া চাহিবার ক্ষমতাও হয়তো থাকিবে না, মনে প্ৰায় এই ধরনের একটা চরম সিদ্ধান্ত সমস্ত চিন্তাকে দখল করিতে চাহিবে, যে জীবনের তার অতীতও ছিল না, ভবিষ্যৎও থাকিবে না, তবু সে তখনো ভাবিতে থাকিবে যে, শশধর যদি তাকে কামনা করে, নিজেকে সে কি তখন দান করিবে? নিজেকে দান করা কি উচিত হইবে তার? আপনারা বোধ হয় লক্ষ করিয়াছেন যে, রত্নাবলীর এই প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের অভিব্যক্তিটা একটু অসাধারণ। সে যেন ইচ্ছা করিয়া নিজেকে ধাধায় ফেলিয়া দেয়। সে যেন সব সময় সচেতন হইয়া থাকে যে, কি করিবে না করিবে, ঠিক সে করিয়া উঠিতে পারিতেছে না এবং তাতে বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না।] বিপিন আবার মৃদু একটু হাসিয়া বলিল, আপনি বড় ছেলেমানুষ। বলিয়া নিছক বাহাদুরি করার জন্যই গম্ভীরমুখে হাত বাড়াইয়া রত্নাবলীর গালটা টিপিয়া দিল। রত্নাবলী মাথায় আঁকি দিল, আধোত সরিয়া বসিল এবং ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল আর কিছুই করিল না। একটু অপেক্ষা করিয়া রত্নাবলীর নিশ্চেষ্ট শান্তভাবে খুশি হইয়া বিপিন বলিল, মাধুকে নিয়ে যাচ্ছি, মহেশবাবুর বাড়িতে রেখে আসব বলে। এখন কয়েকদিন ওইখানেই থাকবে, তারপর যেখানকার মানুষ সেখানেই ফিরে যাবে। ওর পক্ষে আশ্রমে থাকাও চলবে না, আমাদেরও ওকে রাখা চলবে না। আপনি বলছেন, আপনি সঙ্গে না গেলে ওকে আপনি যেতেই দেবেন না, আমি তাই ভাবলাম আপনিও বুঝি চিরদিনের মতে ওর সঙ্গে আশ্রম ত্যাগ করে চলে যেতে চাইছেন। তাই সকলকে ডাকার কথা বলছিলাম। আপনি তো মাধবীর মতো চুপি চুপি আশ্রমে আসেন নি, আপনি কেন চুপি চুপি আশ্রম ছেড়ে চলে যাবেন যেতে হলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই যাবেন।
false
shottojit_roy
বুঝলাম যে ওঁর দুপাটি দাঁতই ফলস। কথা বলার সময় কিটু কিটু করে আওয়াজ হয়, মনে হয় এই বুঝি, দাঁত খুলে পড়ল। প্রথমে সোজা লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, আপনারাও পুলিশ নাকি? লালমোহনবাবু ভড়কে গিয়ে ঢোক গিলে বললেন, আমি? না না-আমি কিছুই না। কিছুই না? এ আবার কীরকম বিনয় হল? না। ইনিই, মানে, গো-গো— বিকাশবাবু এগিয়ে এসে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন। ইনি প্রদাষ মিত্র। গোয়েন্দা হিসেবে খুব নাম-ডাক। পুলিশ তো কিছুই করতে পারল না, তাই মিস্টার ঘোষাল বলছিলেন… অম্বিকাবাবু এবার সোজা ফেলুদার দিকে চাইলেন। উমা কী বলেছে? বলেছে। গণেশ গেছে বলে ঘোষাল বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। ননসেন্স। তার বয়স কত। চল্লিশ পেরোয়নি। আমার তিয়াত্তর। ঘোষাল বংশের ইতিহাস সে আমার চেয়ে বেশি জানে? উমা ব্যবসায়ে উন্নতি করেছে সে কি গণেশের দৌলতে? নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে গণেশ কী করবে? আর তার যে বুদ্ধি সে কি গণেশ দিয়েছে? সে বুদ্ধি সে পেয়েছে তার বংশের রক্তের জোরে। নাইনটিন টোয়েন্টিফোরে কেমব্রিজে ম্যাথাম্যাটিকস-এ ট্রাইপস করতে যাচ্ছিল অম্বিকা ঘোষাল—যাকে দেখছ তোমাদের সামনে। যাবার সাতদিন আগে পিঠে কারবাঙ্কল হয়ে যায় যায় অবস্থা। বাঁচিয়ে দিল না হয়। গণেশ, কিন্তু বিলেত যাওয়া যে পাণ্ড হয়ে গেল চিরকালের জন্যে, তার জন্য কে দায়ী?..উমানাথের ব্যবসা বুদ্ধি আছে ঠিকই, তবে ওর জন্মানো উচিত ছিল একশো বছর আগে। এখন তো শুনছি। নাকি কোন এক বাবাজীর কাছে দীক্ষা নেবার মতলব করছে। তার মানে আপনার গণেশটা যাওয়াতে কোনও আপশোঁস নেই? অম্বিকাবাবু চশমা খুলে তার ঘোলাটে চোখ দুটো ফেলুদার মুখের উপর ফোকাস করলেন। গণেশের গলায় একটা হিরে বসানো ছিল সেটার কথা উমানাথ বলেছে? তা বলেছেন। কী হিরে তার নাম বলেছে? না, সেটা বলেননি। ওই তো। জানে না। তাই বলেনি। বনস্পতি হিরের নাম শুনেছ? সবুজ রঙের কি? ফেলুদার এই এককথায় অম্বিকাবাবু নরম হয়ে গেলেন। দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, অ, তুমি এ বিষয়ে কিছু জানটান দেখছি। অত্যন্ত রেয়ার হিরে। আমার আপশোঁস হয়েছে। কেন জান? শুধু দামি জিনিস বলে নয়; দামি তো বটেই; ওটার জন্য কত ট্যাক্স দিতে হচ্ছিল শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। আসল কথা হচ্ছে—ইট ওয়জ ও ওয়র্ক অফ আর্ট। এসব লাকটাক আমি বিশ্বাস করি না। ওই টেবিলের দেরাজেই কি চাবিটা ছিল? ফেলুদা প্রশ্ন করল। অম্বিকাবাবুর আরাম কেদারা থেকে তিন-চার হাত দূরেই দুটো জানালার মাঝখানে টেবিলটা। এটা ঘরের দক্ষিণ দিক। সিন্দুকটা রয়েছে উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুটোর মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড আদ্যিকালের খাট, তার উপর একটা ছ ইঞ্চি পুরু তোশকের উপর শীতলপাটি পাতা। অম্বিকাবাবু ফেলুদার প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে উলটে আরেকটা প্রশ্ন করে বসলেন। আমি সন্ধেবেলা নেশা করি সেটা উমা বলেছে? আজ্ঞে হ্যাঁ। ফেলুদা এত নরমভাবে কারুর সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি। অম্বিকাবাবু বললেন, গণেশ নাকি চাইলে সিদ্ধি দেন; আমি খাই আফিং। সন্ধের পর আমার বিশেষ ভঁশ থাকে। না। কাজেই সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আমার ঘরে কেউ এসেছিল কি না সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফল হবে না। আপনার চেয়ার এখন যে ভাবে রাখা রয়েছে, সন্ধেবেলাও কি সেইভাবেই থাকে? না। সকালে কাগজ পড়ি, তাই জানালা থাকে আমার পিছনে। সন্ধেয় আকাশ দেখি, তাই জানালা থাকে সামনে। তা হলে টেবিলের দিকে পিঠ করা থাকে। তার মানে ওদিকের দরজা দিয়ে কেউ এলে দেখতেই পাবেন না। না। ফেলুদা এবার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে টান দিয়ে দেরাজটা খুলল। কোনও শব্দ হল না; বন্ধ করার বেলাতেও তাই। এবার ও সিন্দূকটার দিকে এগিয়ে গেল। চৌকির উপরে রাখা পোল্লায় সিন্দুকটা প্রায় আমার বুক অবধি পৌঁছে গেছে! পুলিশ নিশ্চয়ই এটার ভিতর ভাল করে খুঁজে দেখেছে? বিকাশবাবু বললেন, তা তো খুঁজেইছে, আঙুলের ছাপের ব্যাপারেও পরীক্ষা করে দেখেছে, কিছুই পায়নি। অম্বিকাবাবুর ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলে ডাইনে পড়ে নীচে যাবার সিঁড়ি, আর বাঁয়ে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা দিয়ে ডান দিকে বেরিয়ে একটা চওড়া শ্বেত পাথরে বাঁধানো বারান্দা। এটা বাড়ির দক্ষিণ দিক। পুব দিকে বাগানের নিম আর তেঁতুল গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে গঙ্গার জল সকালের রোদে চিক্‌চিক্‌ করছে। আমাদের সামনে আর ডাইনে বেনারস শহর ছড়িয়ে আছে। আমি মন্দিরের চুড়ো গুনছি, ফেলুদা বিকাশবাবুকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা মুখে পুরেছে, এমন সময় ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে উপর দিক থেকে কী যেন একটা জিনিস। পাক খেতে খেতে নেমে এসে লালমোহনবাবুর পাঞ্জাবির উপর পড়ল। লালমোহনবাবু সেটা খপ করে ধরে হাতের মুঠো খুলতেই দেখা গেল সেটা আর কিছুই না—একটা চুইং গামের র‍্যাপার। রুক্সিণীকুমার ছাতে আছেন বলে মনে হচ্ছে? ফেলুদা বলল। আর কোথায় থাকবে বলুন, বিকাশবাবু হেসে বললেন, তার তো এখন বন্দি অবস্থা। আর তা ছাড়া ছাতে তার একটি নিজস্ব ঘর আছে। সেটা একবার দেখা যায়? নিশ্চয়ই। সেই সঙ্গে চলুন পিছনের সিঁড়িটাও দেখিয়ে দিই। একরকম লোহার সিডি হয় যেগুলো বাড়ির বাইরের দেয়াল বেয়ে পাক খেয়ে উপরে উঠে। যায়। এটা দেখলাম সেরকম সিঁড়ি নয়। এটা ইটের তৈরি, আর বাড়ির ভিতরেই। তবে এটাও পাকানো সিঁড়ি। ওঠবার সময় ঠিক মনে হয় কোনও মিনার বা মনুমেন্টে উঠছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই ছাতের ঘর, আর বাঁ দিকে ছাতে যাবার দরজা। ঘরের ভিতরে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে রুকু। একটা লাল-সাদা পেটকাটি ঘুড়ি মাটিতে ফেলে হাঁটুর চাপে সেটাকে ধরে রেখে তাতে সুতো পরাচ্ছে।
false
shorotchandra
পদে ভারাতুর হয়ে উঠবে। সংসারে তোমার অন্য কাজ আছে বোন—কল্যাণকর, শান্তিময় পথ, যা তুমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস কর,—তাই তুমি কর গে। অপরিসীম স্নেহবশেই যে এই লোকটি তাহার একান্ত বিপদসঙ্কুল বিপ্লব-পন্থা হইতে তাহাকে দূরে অপসারিত করিতে চাহিতেছে তাহা নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করিয়া ভারতীর সজল চক্ষু অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিল। অলক্ষ্যে, অন্ধকারে ধীরে ধীরে মুছিয়া বলিল, দাদা, আমার কথায় কিন্তু রাগ করতে পাবে না। এতবড় রাজশক্তি, কত সৈন্যবল, কত উপকরণ, যুদ্ধের কত বিচিত্র ভয়ানক আয়োজন, তার কাছে তোমার বিপ্লবী দল কতটুকু? সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের চেয়েও ত তোমরা ছোট। এর সঙ্গে তোমরা শক্তি পরীক্ষা করতে চাও কোন্‌ যুক্তিতে? প্রাণ দিতে চাও দাও গে— কিন্তু এতবড় পাগলামি আমি ত সংসারে আর দ্বিতীয় দেখতে পাইনে। তুমি বলবে, তবে কি দেশের উদ্ধার হবে না? প্রাণের ভয়ে সরে দাঁড়াবো? কিন্তু তা আমি বলিনে। তোমার কাছে থেকে, তোমার চরিত্র হতে জননী জন্মভূমি যে কি সে আমি চিনেছি। তাঁর পদতলে সর্বস্ব দিতে পারার চেয়ে বড় সার্থকতা মানুষের যে আর নেই তোমাকে দেখে এ কথা যদি না আজও শিখতে পেরে থাকি ত আমার চেয়ে অধম নারী জন্মে কেউ জন্মায় নি। কিন্তু নিছক আত্মহত্যা করেই কোন্‌ দেশ কবে স্বাধীন হয়েছে? কোন মতে তোমার ভারতী যে কেবল বেঁচে থাকতেই চায় এতবড় ভুল ধারণা করেও আমার সম্বন্ধে তুমি রেখো না দাদা। ডাক্তার নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই ত! তাইত কি? তোমার সম্বন্ধে ভুলই হয়েছে বটে। এই বলিয়া ডাক্তার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিলেন, বিপ্লব মানেই, ভারতী, কাটাকাটি রক্তারক্তি নয়। বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন। সৈন্যবল, বিরাট যুদ্ধোপকরণ, এ সবই আমি জানি। কিন্তু শক্তি পরীক্ষা ত আমাদের লক্ষ্য নয়। আজ যারা শত্রু, কাল তারা বন্ধু হতেও ত পারে। নীলকান্ত শক্তি পরীক্ষা করতে যায়নি, তাদের মিত্র করতে গিয়েই প্রাণ দিয়েছিল। হায় রে নীলকান্ত! কেবা তার নাম জানে! অন্ধকারেও ভারতী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল দেশের বাহিরে, দেশের কাজে, যে ছেলেটি লোকচক্ষুর অগোচরে নিঃশব্দে প্রাণ দিয়াছে তাহাকে স্মরণ করিয়া এই নির্বিকার পরমসংযত মানুষটির গভীর হৃদয় ক্ষণিকের জন্য আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। অকস্মাৎ যেন তিনি সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন, কি বলছিলে ভারতী, গোষ্পদ? তাই হবে হয়ত। কিন্তু যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনপদ ভস্মসাৎ করে ফেলে, আয়তনে সে কতটুকু জানো? শহর যখন পোড়ে সে আপনার ইন্ধন আপনি সংগ্রহ করে দগ্ধ হয়। তার ছাই হবার উপকরণ তারই মধ্যে সঞ্চিত থাকে, বিশ্ববিধানের এ নিয়ম কোন রাজশক্তিই কোন দিন ব্যত্যয় করতে পারে না। ভারতী বলিল, দাদা, তোমার কথা শুনলে গা কাঁপে। রাজশক্তিকে যে তুমি দগ্ধ করতে চাও, তার ইন্ধন ত আমাদেরই দেশের লোক। এতবড় লঙ্কাকাণ্ডের কল্পনায় কি তোমার মনে করুণাও জাগে না? প্রত্যুত্তরে লেশমাত্র দ্বিধা নাই, ডাক্তার স্বচ্ছন্দে কহিলেন, না। প্রায়শ্চিত্ত কথাটা কি শুধু মুখেরই কথা? পূর্ব-পিতামহগণের যুগান্তসঞ্চিত পাপের অপরিমেয় স্তূপ নিঃশেষ হবে কিসে বলতে পারো? করুণার চেয়ে ন্যায়ধর্ম ঢের বড় বস্তু, ভারতী। ভারতী ব্যথা পাইয়া বলিল, এ তোমার সেই পুরানো কথা দাদা। ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তুমি যে কত নিষ্ঠুর হতে পারো তা যেন আমি ভাবতেই পারিনে। রক্তপাত ছাড়া আর কিছু যেন মনে তোমার জাগতেই পায় না। রক্তপাতের জবাব যদি রক্তপাতই হয়, তা হলে তারও ত জবাব রক্তপাত? এবং তারও ত জবাবে এই একই রক্তপাত ছাড়া আর কিছু মেলে না। এ প্রশ্নোত্তর ত সেই আদিম কাল থেকে হয়ে আসচে। তবে কি মানবের সভ্যতা এর চেয়ে বড় উত্তর কোন দিন দিতে পারবে না? দেশ গেছে, কিন্তু তার চেয়েও যে বড় সেই মানুষ ত আজও আছে। মানুষে মানুষে কি হানাহানি না করে কোনমতেই পাশাপাশি বাস করতে পারে না? ডাক্তার কহিলেন, ইংরাজের একজন বড় কবি বলেছেন, পশ্চিম ও পূর্ব কোনদিনই মিলতে মিশতে পারে না। ভারতী রুষ্ট হইয়া কহিল, ছাই কবি। বলুক গে সে। তুমি পরম জ্ঞানী, তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞেসা করেচি, আজও জিজ্ঞেসা করচি, হোক তারা পশ্চিমের, হোক তারা ইউরোপের মানুষ, কিন্তু তবু ত মানুষ? মানুষের সঙ্গে মানুষে কি কিছুতেই বন্ধুত্ব করতে পারে না? দাদা, আমি ক্রীশ্চান, ইংরাজের কাছে আমি বহু ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্‌গুণ আমি নিজের চোখে দেখেচি,—তাদের এত মন্দ ভাবতে আমার বুকে শূল বেঁধে। কিন্তু আমাকে তুমি ভুল বুঝো না দাদা, আমি বাঙালী ঘরেরই মেয়ে,—তোমারই বোন। বাঙলার মাটি, বাঙলার মানুষকে আমি প্রাণাধিক ভালবাসি। কে জানে, যে জীবন তুমি বেছে নিয়েছ, হয়ত আজই আমাদের শেষ দেখা। আজ আমাকে, তুমি শান্তমনে এই জবাবটি দিয়ে যাও, যেন এরই দিকে চোখ রেখে আমি সারা জীবন মুখ তুলে সোজা চলে যেতে পারি। বলিতে বলিতে শেষের দিকে তাহার কণ্ঠস্বর কান্নার ভারে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল। ডাক্তার নীরবে তরী বাহিতে লাগিলেন। বিলম্ব দেখিয়া ভারতীর মনে হইল, বোধ হয় তিনি ইহার উত্তর দিতে চান না। সে হাত বাড়াইয়া নদীর জলে চোখ-মুখ ধুইয়া ফেলিল, অঞ্চল দিয়া বার বার ভাল করিয়া মুছিয়া পুনরায় কি একটা প্রশ্ন করিতেছিল, ডাক্তার কথা কহিলেন। স্নিগ্ধ মৃদুকণ্ঠ, কোথাও লেশমাত্র উত্তেজনা বা বিদ্বেষের আভাস নাই,—যেন কাহার কথা কে বলিতেছে এমনি শান্ত সহজ। ভারতীর সেই প্রথম পরিচয়-দিনের স্কুলের নিরীহ নির্বোধ মাস্টার মহাশয়টিকে মনে পড়িল। অশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ, ব্যাকরণও তেমনি,—ভারতী কষ্টে হাসি চাপিয়া আলাপ করিয়াছিল। পরে তাই লইয়া রাগ করিয়া সে ডাক্তারকে অনেক দিন অনেক তিরস্কার করিয়াছে। সেই নিরুৎসুক
false
MZI
করে পুরো মহাকাশযানে একটি বিস্ময়কর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে। রিরা মনে করতে চেষ্টা করে সে কোথায়, তার কী হয়েছে। সে মহাকাশযানটিকে অবতরণ করানোর চেষ্টা করছিল, মহাকাশযানের বিশাল দুটি পাখা বের হয়ে এসেছিল, খুব ধীরে ধীরে সেটি নেমে আসছিল, ঠিক তখন এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ হল– হঠাৎ রিরার সব কথা মনে পড়ে যায়, লাফিয়ে উঠে বসে সে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ক্যাপ্টেনের ঘরে নরম বিছানায় শুয়ে আছে সে। কে এনেছে তাকে এখানে? রিরা বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে হঠাৎ মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গেল, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার দুই পা শেকল দিয়ে বাধা। রিরা হতচকিত হয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, কে তাকে বেঁধে রেখেছে এখানে? রিরা কাপা গলায় ডাকল, প্রসেসর… প্রসেসর…। ক্যাপ্টেনের ঘরে প্রসেসর শুষ্ক গলায় উত্তর দিল, বলো রিরা। আমাকে কে বেঁধে রেখেছে? তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমার এটি জানার কথা। নীলমানব? হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম তাকে হত্যা করতে তুমি রাজি হলে না। এখন তার মূল্য দিচ্ছ। সে কেমন করে বের হল? মহাকাশযানটি যখন বিধ্বস্ত হয়েছে, তখন তার ঘরের দরজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে তখন তার দরজা ভেঙে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু… তার পায়ে গুলি লেগেছিল? মূল প্রসেসর একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, সে খুঁজে খুঁজে মেডিক্যাল কিট বের করে পায়ে ব্যান্ডেজ করেছে। যন্ত্রণা কমানোর জন্য নিথিলিন ইনজেকশন নিয়েছে, তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে সবকিছু করেছে। রিরা বড় বড় দুটি নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে টেনে বের করে এনেছে? হ্যাঁ, তুমি একটা বিমের নিচে আটকা পড়েছিলে, অনেক কষ্ট করে সেই বিমের নিচে থেকে টেনে বের করে এনেছে। তুমি বলেছিলে সে আমাকে গুলি করে মারবে। মূল প্রসেসর ধাতব গলায় বলল, তার সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। তুমি ভুলে যেও না তোমার দুই পা শিকল দিয়ে বাধা। তোমাকে হত্যা করতে তার এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না। কিন্তু— মূল প্রসেসর রিরাকে বাধা দিয়ে বলল, নীলমানব এদিকে আসছে। রিরার গলার স্বর কেঁপে উঠল, সে কি সশস্ত্র? হ্যাঁ। তার হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। রিরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে তার বিছানায় গিয়ে বসে। একটু আগেই নীলমানব ছিল তার হাতে বন্দি, এখন সে নীলমানবের হাতে বন্দি। খুট করে একটা শব্দ হল, তারপর খুব ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। রিরা তাকিয়ে দেখল ঘরের দরজায় দীর্ঘদেহী নীলমানবটি পাথরের মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে। তার ডান হাতে আলগোছে একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ধরে রাখা। রিরা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে কেন শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছ? নীলমানবটি তার কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু সে উত্তর দেবার কোনো চেষ্টা না করে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিরা উচ্চকণ্ঠে ডাকল, প্রসেসর… প্রসেসর… বলো। তুমি কি নীলমানবের ভাষা জান? জানি। তুমি আমার প্রশ্নটি অনুবাদ করে দাও। রিরা শুনতে পেল কোনো একটি বিজাতীয় ভাষায় প্রসেসর তার প্রশ্নটি অনুবাদ করে দিচ্ছে। প্রশ্নটি শুনে নীলমানব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল, তারপর কিছু একটা উত্তর দিল। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে সে? প্রসেসর বলল, সে বলেছে তুমি যে কারণে আমাকে বন্দি করে রেখেছিলে, আমি ঠিক সেই কারণে তোমাকে বন্দি করে রেখেছি। রিরা চিৎকার করে বলল, তাকে বলল এটা আমাদের মহাকাশযান তার না। আমার তাকে বন্দি করে রাখার অধিকার আছে। তার নেই। মূল প্রসেসর রিরার কথাটির অনুবাদ করে শুনিয়ে দিল এবং তখন প্রথমবার নীলমানবটিকে হাসতে দেখল। নীলমানবটির চেহারা নিষ্ঠুর কিন্তু হাসার সময় এটা রিরা স্বীকার না করে পারল না সে অত্যন্ত সুদর্শন। নীলমানবটি কিছু একটা বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হল। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে সে? তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু আমি শুনতে চাই। সে বলেছে তোমার কথাবার্তা অল্পবয়সী শিশুর মতো। রিরা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, তাই বলেছে? হ্যাঁ। তাকে বলে এই মুহূর্তে আমার পায়ের শেকল খুলে দিতে। বলে কোনো লাভ হবে না রিরা। লাভ না হলে নাই। তাকে বলো। মূল প্রসেসর নীলমানরটিকে তার ভাষায় শেকল খুলে দিতে বলল। সাথে সাথে নীলমানবের মুখমণ্ডল কঠোর হয়ে ওঠে, হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলে, সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে নীলমানব? বলেছে অর্থহীন কথা বলে শক্তিক্ষয় না করতে। তাই বলেছে? হ্যাঁ। তারপর বলেছে এই মুহূর্তে তোমাকে হত্যা করার তার কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু তুমি যদি বাড়াবাড়ি কর, তা হলে সে তার মত পরিবর্তন করতে পাবে। রিরার ভেতরে এক ধরনের অক্ষম ক্রোধ পাক খেতে থাকে। সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, সে এখন কোথায় যাচ্ছে? কী করছে? সব সময় যা করে। সব সময় কী করে? মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। যত জায়গা ভেঙেচুরে গেছে সেগুলো বন্ধ করছে। অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেন? কেউ যেন ঢুকতে না পারে। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কে ঢুকবে এখানে? তোমাকে আগেই বলেছি, এখানে বুদ্ধিহীন নৃশংস ভয়ংকর এক ধরনের প্রাণী থাকে। রিরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে। এখন সেটা খুব কাছের ব্যাপার হয়ে গেছে। রিরা বিষদৃষ্টিতে তার পায়ের শেকলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর দুই হাতে ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেনের ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রসেসর। বলো। এই গ্রহের কি কোনো নাম আছে?
false
shomresh
ধরে চলার পরে প্রমাণের অভাবে বাতিল হয়ে গিয়েছে। চার বছর বাদে পবন ভাল হয়ে গেলে কি করে প্রমাণ করা যাবে আজ ও পাগল ছিল। দীপাবলী আবার পবনের দিকে তাকাল। হঠাৎ তার মাথায় একটা উদ্ভট চিন্তা এল। চিন্তাটা যে স্বাভাবিক নয় তা নিজেই বুঝতে পারছিল। সে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি ওই চেয়ারে বসুন পবনবাবু। পবন তাকাল। দীপাবলী দ্বিতীয়বার আদেশ করল। এবার পবন বিড়বিড় করল, কি ঝামেলা। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সুপারভাইজার বললেন, আমি তাহলে চলি ম্যাডাম? না, একটু বসুন। দীপাবলী পবনকে দেখল। মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সে একটু মোলায়েম করে বলল, পবনবাবু আপনি কি কি কাজ জানেন? পবন মুখ তুলল। চোখাচোখি হল কিন্তু জবাব দিল না। দীপাবলী বলল, আপনি তো অনেকদিন কাজ করছেন ডিপার্টমেন্টে, এখন কোন কাজটা করতে আপনার ভাল লাগবে? পবন চোখ বন্ধ করল। বোঝা যাচ্ছিল সে প্রচণ্ড ভাবছে।তারপর আচমকা মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলল, রিফান্ড অডার। সুপারভাইজার বললেন, হ্যাঁ, একসময় ও রিফান্ড অর্ডার লিখত। হাতের লেখাটা এখনও ভাল আছে। বাঃ, খুব ভাল হল। ডিম্যান্ড নোটস চালান লিখতে পারবেন না? মাল দেবেন? আচমকা প্রশ্ন করল পবন। সঙ্গে সঙ্গে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল দীপাবলীর। আর পবন সুর করে বলল, না, না, মাল না দিলে ওসব পাবেন না। আপনি কি বলছেন? দীপাবলীর গলা চড়ায় উঠল। সেটা কানে যাওয়া মাত্র নেতিয়ে পড়ল পবন। তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে একটু আগে কথাগুলো বলেছে। সুপারভাইজার হেসে ফেললেন, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম ও ইচ্ছে করে বলছে না। এতদিন যা শুনেছে তাই উগরে দিল। শুনেছে মানে? ও আমার কাছে টাকা চাইছে? আপনার কাছে নয়। আপনি যে অফিসার এটাই ওর খেয়ালে নেই। আশ্চর্য! ও শুনেছে, মানে, সেকশনে বসে শুনে থাকতে পারে। এখানকার অফিসে এত স্পষ্ট গলায় টাকা চাওয়া হয় নাকি? সুপারভাইজার হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। তারপর অন্যরকম স্বরে বললেন, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আমার প্রায় সাঁইত্রিশ বছর চাকরি হয়ে গেছে। আপনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। যদি অভিজ্ঞতার দাম দেন তাহলে কয়েকটা কথা বলতে পারি যা শুনলে আপনার কাজে লাগতে পারে। বলুন। দীপাবলীর হঠাৎ মনে হল যেন সতীশবাবু তার সামনে বসে আছেন। সুপারভাইজার বললেন, আপনার পেছন দিকে কি হচ্ছে তা ঘুরে চেয়ে দেখবেন না। পেছনে কে কি বলল তা শোনার প্রয়োজন নেই। আপনি যা করতে চান তা ভালভাবে করে যাবেন। আপনার চারপাশে যদি চোর জোচ্চোর থাকে তাহলে তাদের পাপ দূর করার দায়িত্ব আপনার নয়। এসব কথা বলছি বলে আপনি কিছু মনে করবেন না। ঠিক আছে। কিন্তু একে নিয়ে আমি কি করব? একটু আধটু কাজ দিন। রিফান্ড ভাউচার লেখান। তাহলে আপনি আমার সেকসনে নিয়ে গিয়ে আর যাঁরা আছেন তাঁদের ব্যাপারটা বলে দিন। দীপাবলী অস্বস্তি নিয়ে বলল। সুপারভাইজার পবনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট দশেক বাদে সেকেন্ড পেশকার ঘরে এল। তার ভাব ভঙ্গীতে বেশ সঙ্কোচ। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন? মাথা নাড়ল লোকটা, ম্যাডাম, পবনবাবুকে দিয়ে রিফান্ড ভাউচার লেখানো কি ঠিক হবে? ওটা খুব সিরিয়াস জিনিস। তার মানে? পার্টিরা ওটা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিলে টাকা পাবে। ফিগারে যদি ভুল করে ফেলে তাহলে গভর্নমেন্টের লোকসান। দীপাবলীর মনে হল এই কথাগুলো বলার পেছনে লোকটার অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে। সে বলল, কি করব, ওকে তো কাজ দিতে হবে। না স্যার, ইয়ে ম্যাডাম, আমরা বেশী খেটে সব কাজ তুলে দেব। সার্ভে ওয়ার্ডে যেমন ছিল, আসত যেত কাজ করত না, তাই করতে অর্ডার দিন। ওকে কাজ করতে দিলে সব ভুট্টিনাশ করে দেবে। লোকটা চলে গেল কথাগুলো বলে। বিকেল বেলায় পিওন নিয়ে এল কিছু ফাইল সই করাবার জন্যে, সেইসঙ্গে রিফান্ড অর্ডার। ফাইল মিলিয়ে চেকের অ্যামাউন্ট দেখছিল দীপাবলী। প্রথম দুটোয় কোন ভুল নেই। হাতের লেখাটিও খুব সুন্দর। অডারশিট, আই টি থার্টি এবং চেক বই-এ ঠিকঠাক এন্ট্রি করেছে লোকটা। পাগল হলেও এটুকুতে ঘাটতি নেই। দেখে শুনে তৃতীয়টিতে সই করতে গিয়ে চমকে উঠল দীপাবলী। টাকার জায়গায় লেখা আছে শূন্য এবং অ্যাসেসির নামের লাইনে স্পষ্ট করে লেখা পবনের নাম। নিজের নামে সরকারি রিফান্ড ভাউচার লিখেছে লোকটা এবং টাকার পরিমাণ শূন্য। লোকটা ঠগ জোচ্চোর নয় এটা তার প্রমাণ কিন্তু পাগলামির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু এটা দাখিল করতেই ওপরওয়ালা ওকে সাসপেন্ড করতে পারে। সে পবনকে ডেকে পাঠাল। পবন এল। উদাসীন মুখ চোখ। প্রচণ্ড ধমকাল দীপাবলী। হঠাৎ পবন হাসতে লাগল, আপনার হবে। হাঁ হয়ে গেল দীপাবলী, কি বলছেন আপনি? ঠিক ধরেছেন, চোখ বন্ধ করে সই করেননি। অন্য আই টি ওদের মত। কত কি খেলা চলছে। চলুক। আপনাকে সাসপেন্ড করতে পারি জানেন? হাসতে লাগল, নেহি জী, পারবেন না। সাসপেণ্ডেড হয়ে বাড়িতে বসে সরকারের কাছ থেকে টাকা নেব বলে কত ধান্দা করলাম, হল না। এটা দেখে সি আই টি বলবে আমার মতলব খারাপ ছিল না কারণ অ্যামাউন্ট জিরো। মিসটেক। ওয়ান ফিফটি ফোর। ভ্রূ কুঁচকে গেল দীপাবলীর, আপনি তো এসব কথা খুব সেন্সে বলছেন। একটুও পাগল বলে মনে হচ্ছে না। একদম কাজ করতে ইচ্ছে করে না। অথচ টাকাটা দরকার। ব্যাস। আপনি আমাকে সাসপেন্ড করার ব্যবস্থা করুন, বেঁচে যাই। বলেই বিড়বিড় শুরু করল আবার। দীপাবলীর মুখ থেকে কথা সরছিল না। সে
false
shomresh
ইস হল তখন তিনি নেই। ওই মরা মানুষটার আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে ছাপ লাগাতে চেয়েছিল শেয়ালটা। আর তখন ভগবান আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিলেন। সব ছিডে ফেলেছি। কিন্তু কে জানত ওঁর আত্মীয় এসে পাঁচজনের সামনে আমাকে খাট থেকে টেনে নামাতে চাইবে! তুমি বলছি সম্পত্তি চাই না, আমাকে কুকুর বেড়ালের মত তাডাবে আর পাঁচভূতে সব দখল করবে। করুক। কিন্তু তুমি বল, আমার অপরাধ কোথায়? দীপা কোন জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে আনাব মুখেব দিকে তাকিয়েছিল। যা শুনছে তা কি সত্যি? হরদেব ঘোষাল তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা মনে পড়ল। চা-বাগানে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু অমরনাথ এখনও সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। আনা যা বলছে তাতে কি মিথ্যে আছে? দুটো যোগ করলে–তো—! এমন কি প্রতুলবাবুর দাদাও একই কথা বলে গেলেন। কেঁপে উঠল দীপা। সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আমন্ত্ৰনাথ তাকে মিথ্যে কথা বলেছেন? জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-বাগানোবা মালিক পায়পরবার থেকে তাকে তার মেধাবী জন্যে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না? অনা দীপার হাত ধরল, শোন, তুমি আমাকে বক্ষা কর। কি ভাবে? দুর্বল গলায় বলল দীপা। ওদের বল আমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না। আপনার কেউ নেই? আছে। একটা ছেলে। আমাদের দেশে। হাওডায়। সেখানে আমার যাওয়ার মুখ নেই। কিতার টাকাব্য সে বড় হচ্ছে। ওর বাবা নেই? না। সে কতবাবুর ছেলে। এখন হরদেব শেয়াল ছাড়া একথা কেউ জানে না। আমি বলতেও চাই না। এই পরিচয় দেবার তো উপায় নেই। আইন মানবে না। আনা আরও ঘনিষ্ঠ হল, তুমি হোস্টেলে থেকে না। এই বাড়িতে চলে এস। তোমার মধ্যে একধরনের তেজ আছে। কেউ কাছে ঘেষতে সাহস পারে না। আপনি আমাকে বাঁচাতে এ বাড়ি থেকে একদিন চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আজ কেন—। দীপা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। সত্যি কথা বলব? তোমাকে বাঁচাবার চেয়েও সেদিন আমার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে কতাবাবুকে আমি নিজের মত করে পাব। কেঁদে উঠল আনা। সেই মহিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল দীপা। দরজার বাইরে সেই বৃদ্ধ চাকরীটি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা কোন দিকে লক্ষ্য না করে হাঁটছিল। মৃত্যুশোক নয়, একটি নির্মম সত্যের শোষণ তার জীবনকে নীরক্ত করে দিয়েছে কয়েক মিনিটে। অমরনাথ মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন। দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে তিনি উদ্বেগে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে দীপু? দীপা অমরনাথের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে তিনি কেঁপে উঠলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে! ছিঃ!। মনোরমা একটা মোড়ায় বসেছিলেন। অঞ্জলি ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সমস্যায় পড়লেই তার হাত আঁচল তুলে ঠোঁটে চাপা দেয়। অমরনাথ তাঁর চেয়ারে। সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন এখনই। সত্যসাধন মাস্টারকে খবর দিয়ে এসেছিলেন বুধুয়া। মনোরমা তাকে পাঠিয়েছিলেন। বিকেলের একটু আগে অমরনাথ জলপাইগুড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মেয়ের সঙ্গে তার যাবতীয় সম্পত্তি। পরনে কলেজে যাওয়ার শাড়ি। আর বাড়িতে ফিরেই সে মনোরমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল। অনেক ডাকাডাকিতেও খোলেনি। অঞ্জলি এবং মনোরমা অমরনাথকে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন! বাইরের ঘরে বসে অমরনাথ ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলেছিলেন। এব। অনেকটাই অঞ্জলির জানা কিন্তু মনোরমা প্ৰথম শুনলো। তাঁর খেয়াল হল না যে ছেলে এতদিন কথাগুলো তাঁকে জানায়নি। বরং মনে হল দীপা খুব বোকামি করছে। তিনি বলেছিলেন, সমস্ত সম্পত্তি এমনি এমনি রেখে লোকটা চলে গেল ভাবতে কেমন লাগছে। সব দীপা পারে ৮ অমরনাথ হাত নাড়লেন আমাকে আর জিজ্ঞাসা করো না। আমি খুব ছোট হয়ে গেছি। কেন? ছোট হবি কেন? তুই তো আর হাত পেতে কিছু নিতে যাসনি। আইন যা বলে তাই হবে। তুই দীপার গার্জেন। ওর ভালর জন্যে করেছিস। মনোরমা গজগজ করতে লাগলেন, ওইটুকুনি পুঁচকে মেয়ে মুখেব ওপর বলল লাগবে না। আর তুই চুপ করে বইলি? কেমন বুদ্ধি তোর? অমরনাথ লক্ষ্য করেছিলেন মনোরমা বাবা না বলে গার্জেন বললেন। খট করে। লেগেছিল। শব্দটা। কিন্তু তিনি উপেক্ষা করলেন, প্রতুলবাবুকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পর্ব আনা ওকে ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছিল। কি বলেছিল জানি না। তুই যেতে দিলি কেন ওকে ওই নষ্ট মেয়েছেলেটার কাছে? বাড়ির ঝি হয়ে, বাবুর সম্পত্তির দিকে হাত বাড়াচ্ছে। সাহস কি! মনোরমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অঞ্জলি এই প্ৰথম কথা বলল, আপনি তাকে দ্যাখেননি মা। আমি দেখেছি। কে বলবে বাড়ির ঝি। পোশাক, ঠমক দেখে যে-কোন পুরুষেবা মাথা ঘুরে যাবে। উনি যে ওখানে যেতেন তাতেই আমার আপত্তি ছিল। আঃ বাজে বকো না তুমি। মনোরমা ধমক দিলেন। তারপত্র গলা নামিয়ে বললেন, তারপর কি হল? আনার ব্যাপার নিয়ে অঞ্জলির দেওয়া খোঁচাটা ভুলতে চাইলেন অমরনাথ। হ্যাঁ, আনোব শরীরে একটা আকর্ষণ-শক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তিনি নিজেকে খুব সংযত রেখেছেন। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি, অনেকক্ষণ বাদে ও ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। আমি ছুটে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতে মেয়ে বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে, ছিঃ আমি মাটিতে মিশে গেলাম মা। যাকে এইটুকুনি থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। তার মুখ থেকে আমাকে ওই কথা শুনতে হল? আমি কার জন্যে লোভ করেছি? নিজের জন্যে? দু হাতে মুখ ঢাকলেন অমরনাথ। প্রতুলবাবুর রাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপা তাঁর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছেন
false
shorotchandra
‘পরে স্নিগ্ধ-প্রসন্নতা—আপন মনে কাজে ব্যাপৃত। কাল গোটা-দুই লম্বা আয়না-লাগানো আলমারি কিনিয়া আনিয়াছে, আজ যাইবার পূর্বে তাড়াতাড়ি করিয়া কি-সব তাহাতে সে গুছাইয়া তুলিতেছিল। কাজের সঙ্গে হাতের বালার হাঙ্গরের চোখ-দুটা মাঝে মাঝে জ্বলিয়া উঠিতেছে, হীরা ও পান্নাবসানো গলার হারের বিভিন্ন বর্ণচ্ছটা পাড়ের ফাঁক দিয়া ঝলকিয়া উঠিতেছে, তাহার কানের কাছেও কি যেন একটা নীলাভ দ্যুতি, টেবিলে চা খাইতে বসিয়া আমি একদৃষ্টে সেইদিকে চাহিয়া ছিলাম। তাহার একটা দোষ ছিল—বাড়িতে সে জামা অথবা সেমিজ পরিত না। তাই কণ্ঠ ও বাহুর অনেকখানি হয়ত অসতর্ক মুহূর্তে অনাবৃত হইয়া পড়িত, অথচ বলিলে হাসিয়া কহিত, অত পারিনে বাপু। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, দিনরাত বিবিয়ানা আর সয় না। অর্থাৎ জামা-কাপড়ের বেশি বাঁধাবাঁধি শুচিবায়ুগ্রস্তদের অত্যন্ত অস্বস্তিকর। আলমারির পাল্লা বন্ধ করিয়া হঠাৎ আয়নায় তাহার চোখ পড়িল আমার ‘পরে। তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় সামলাইয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল, রাগিয়া বলিল, আবার চেয়ে আছ? এভাবে বারে বারে কি আমাকে এত দেখ বলো ত? বলিয়াই হাসিয়া ফেলিল। আমি হাসিলাম, বলিলাম, ভাবছিলাম বিধাতাকে ফরমাশ দিয়ে না জানি কে তোমাকে গড়িয়েছিল। রাজলক্ষ্মী কহিল, তুমি। নইলে এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দ আর কার? আমার পাঁচ-ছ’বছর আগে এসেচো, আসবার সময় তাঁকে বায়না দিয়ে এসেছিল—মনে নেই বুঝি? না, কিন্তু তুমি জানলে কি করে? চালান দেবার সময় কানে কানে তিনি বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু হ’লো চা খাওয়া? দেরি করলে যে আজও যাওয়া হবে না। নাই বা হ’লো। কেন বলো ত? সেখানে ভিড়ের মধ্যে হয়ত তোমাকে খুঁজে পাব না। রাজলক্ষ্মী কহিল, আমাকে পাবে। আমিই তোমাকে খুঁজে পেলে বাঁচি। বলিলাম, সেও ত ভালো নয়। সে হাসিয়া কহিল, না, সে হবে না। লক্ষ্মীটি চল। শুনেচি নতুনগোঁসাইয়ের সেখানে একটা আলাদা ঘর আছে, আমি গিয়েই তার খিলটা ভেঙ্গে রেখে দেব। ভয় নেই, খুঁজতে হবে না—দাসীকে এমনই পাবে। তবে চলো। আমরা মঠে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন ঠাকুরের মধ্যাহ্নকালীন পূজা সেইমাত্র সমাপ্ত হইয়াছে। বিনা আহ্বানে, বিনা সংবাদে এতগুলি প্রাণী অকস্মাৎ গিয়া হাজির, তথাপি কি যে তাহারা খুশি হইল বলিতে পারি না। বড়গোঁসাই আশ্রমে নাই, গুরুদেবকে দেখিতে আবার নবদ্বীপে গিয়াছেন, কিন্তু ইতিমধ্যে জন-দুই বৈরাগী আসিয়া আমারই ঘরে আস্তানা গাড়িয়াছে। কমললতা, পদ্মা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং আরও অনেকে আসিয়া মহাসমাদরে অভ্যর্থনা করিল; কমললতা গাঢ়স্বরে কহিল, নতুনগোঁসাই, তুমি যে এত শীঘ্র এসে আবার আমাদের দেখা দেবে এ আশা করিনি। রাজলক্ষ্মী কথা কহিল, যেন কতকালের চেনা। বলিল, কমললতাদিদি, এ ক’দিন শুধু তোমার কথাই ওঁর মুখে, আরও আগে আসতে চেয়েছিলেন, কেবল আমার জন্যেই ঘটে ওঠেনি। ওটা আমারই দোষে। কমললতার মুখ ক্ষণকালের জন্যে রাঙ্গা হইয়া উঠিল, পদ্মা ফিক করিয়া হাসিয়া চোখ ফিরাইয়া লইল। রাজলক্ষ্মীর বেশভূষা ও চেহারা দেখিয়া সে যে সম্ভ্রান্তঘরের মেয়ে তাহা সবাই বুঝিয়াছে, শুধু আমার সঙ্গে যে তাহার কি সম্বন্ধ ইহাই তাহারা নিঃসন্দেহে ধরিতে পারে নাই। পরিচয়ের জন্য সবাই উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মীর চোখে কিছুই এড়ায় না, বলিল, কমললতাদিদি, আমাকে চিনতে পারচো না? কমললতা মাথা নাড়িয়া বলিল, না। বৃন্দাবনে দেখনি কখনো? কমললতাও নির্বোধ নয়, পরিহাসটা সে বুঝিল, হাসিয়া বলিল, মনে ত পড়চে না ভাই। রাজলক্ষ্মী বলিল, না পড়াই ভালো দিদি। আমি এদেশেরই মেয়ে, কখনো বৃন্দাবনের ধারেও যাইনি,—বলিয়াই হাসিয়া ফেলিল। লক্ষ্মী, সরস্বতী ও অন্যান্য সকলে চলিয়া গেলে আমাকে দেখাইয়া কহিল, আমরা দু’জনে এক গাঁয়ে এক গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তুম— দুটিতে যেন ভাইবোন এমনি ছিল ভাব। পাড়ার সুবাদে দাদা বলে ডাকতুম—বোনের মত আমাকে কি ভালোই বাসতেন। গায়ে কখনো হাতটি পর্যন্ত দেননি। আমার পানে চাহিয়া কহিল, হাঁ গা, বলচি সব সত্যি নয়? পদ্মা খুশি হইয়া বলিল, তাই তোমাদের ঠিক এক রকম দেখতে। দু’জনেই লম্বা ছিপছিপে—শুধু তুমি ফর্সা, আর নতুনগোঁসাই কালো, তোমাদের দেখলেই বোঝা যায়। রাজলক্ষ্মী গম্ভীর হইয়া বলিল, যাবেই ত ভাই। আমাদের ঠিক একরকম না হয়ে কি কোন উপায় আছে পদ্মা। ও মা! তুমি আমারও নাম জানো যে দেখচি। নতুনগোঁসাই বলেছে বুঝি? বলেছে বলেই ত তোমাদের দেখতে এলুম, বললুম, সেখানে একলা যাবে কেন, আমাকেও সঙ্গে নাও। তোমার কাছে ত আমার ভয় নেই—একসঙ্গে দেখলে কেউ কলঙ্কও রটাবে না। আর রটালেই বা কি, নীলকণ্ঠর গলাতেই বিষ লেগে থাকবে, উদরস্থ হবে না। আমি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না, মেয়েদের এ যে কি রকম ঠাট্টা সে তারাই জানে। রাগিয়া বলিলাম, কেন ছেলেমানুষের সঙ্গে মিথ্যে তামাশা কোরচ বলো ত? রাজলক্ষ্মী ভালোমানুষের মত বলিল, সত্যি তামাশাটা কি তুমিই না হয় বলে দাও! যা জানি সরল মনে বলচি, তোমার রাগ কেন? তাহার গাম্ভীর্য দেখিয়া রাগিয়াও হাসিয়া ফেলিলাম,—সরল মনে বলচি! কমললতা, এত বড় শয়তান ফাজিল তুমি সংসারে দুটি খুঁজে পাবে না। এর কি একটা মতলব আছে, কখনো এর কথায় সহজে বিশ্বাস ক’রো না। রাজলক্ষ্মী কহিল, কেন নিন্দে কর গোঁসাই। তা হ’লে আমার সম্বন্ধে নিশ্চয় তোমার মনেই কোন মতলব আছে? আছেই ত। কিন্তু আমার নেই। আমি নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। হাঁ, যুধিষ্ঠির! কমললতাও হাসিল, কিন্তু সে উহার বলার ভঙ্গিতে। বোধ হয়, ঠিক কিছু বুঝিতে পারিল না, শুধু গোলমালে পড়িল। কারণ সেদিনও আমি ত কোন রমণীর সম্বন্ধেই নিজের কোন আভাস দিই নাই। আর দিবই বা কি করিয়া। দিবার সেদিন ছিলই বা কি! কমললতা জিজ্ঞাসা করিল, ভাই তোমার নামটা কি? আমার নাম রাজলক্ষ্মী। উনি গোড়ার কথাটা ছেড়ে দিয়ে বলেন শুধু লক্ষ্মী। আমি বলি, ওগো, হাঁগো।
false
shunil_gongopaddhay
দুঃখ দিবি? তুই আমার মানিক, আমার সোনা, আমার সাত রাজার ধন-আমি কানচিলুম মনের সুখে-ভগমান আমায় ডেকেচেন তাঁর ছিপাদপদ্মে আমার ঠাঁই হবে। —ভগবান তোমায় ডেকেচোন? ভগবানের কোন সাধ্য আচে মা, যে এক্ষুনি তোমায় ডেকে নেবেন? আমি আচি না? ডাকলেই হলো! —শোনো ছেলেমানুষের কতা। আমি কি মরার কতা বলচি। ছোট্‌কু, আমি কাল হরিদ্ধারে রওনা হবো। —কাল?-হরিদ্ধারে? তুমি কী বলচো, মা? কোন হরিদ্বার? —তুই বাবু একটু ভালো করে বোস দিনি। অমন ঘোড়ায় জিন দিয়ে থাকলে কত হয়? আমি মনস্থির করে ফেলিচি, ছোট্‌কু। জগদগুরু একনাথজীর কাচে আমি দীক্ষা নিইচি, গুরু কৃপা করে তেনার ছিচরণে আমায় স্থান দেবেন বলেচেন। গুরু বলেচেন, আমায় সোংসার ধম্মো এবার ত্যাগ কত্তে। চতুর্দিকে এত নোংরা, কলকেতা শহরটা বড় অশুচি, কেউ এখন আর পাইখানা যাবার পর চ্যান করে না, দাসী মাগীগুলো বাসী কাপড়ে বাসুন মাজে, সেই বাসুনে আমরা খাই, ঠাকুর পুজো হয়, এঃ, ঘেন্না, ঘেন্না! ম্যাগোঃ! এত অশুচি! সত্যিকারের ঘৃণায় কেঁপে উঠলো বিম্ববতীর সর্বাঙ্গ। নবীনকুমার বিস্ফারিত নেত্ৰে দেখতে লাগলো জননীকে। মাত্র এই কয়েকটি দিনে এত পরিবর্তন? এরই মধ্যে অনেক শীণা হয়ে গেছেন তিনি, চোখ দুটি অস্বাভাবিক। বিম্ববতী বললেন, এখেনে আমার শরীল। এমন অশুচি হয়ে গ্যাচে যে ঘষে ঘষে ছাল চামড়া তুলে ফেললেও দোষ কাটবে না। আমি হরিদ্ধারে চলে যাবো। কালই। —হরিদ্ধার কতদূরে, তুমি জানো, মা? বেশ তো, সেখেনে যেতে চাও, ব্যবস্থা করা যাবে। কালই কেন? —তোকে আর কোনো ব্যবস্থা কত্তে হবে না। সব ব্যবস্থা আমি নিজেই করে ফেলিচি, পোটলা পুঁটলি বাঁদা হয়ে গ্যাচে। গুরুদেব কাল রওনা হচ্চেন। আমি তাঁর সঙ্গে যাবো। তোর যদি ইচ্ছে হয় আমায় দশ বিশ ট্যাকা মাসোহারা পাটাস, আর না পাটালেও আমার চলে যাবে। ঈশ্বর যা জোটাবেন তাই খেয়ে থাকবো। —তুমি কার ওপরে রাগ করেচো বলো তো মা? আমি অনেক দোষ করিচি জানি। —ওমা, ফের ঐ কতা। তুই কেন দোষ কবি, ছোট্‌কু। তুই পণ্ডিতদের দিয়ে মহাভারত লোকচ্চিাস, এ তো কত বড় পুণ্যের কাজ। তার জন্যে এ বাড়ি ধন্য হলো। এই বংশ ধন্য হলো। স্বাগ্যো থেকে তোর বাবা তোকে আশীর্বাদ কৰ্বেন। কিন্তু আমায় চলে যেতেই হবে যে, ছোট্‌কু। —তুমি আমাদের ফেলে চলে যাবে? —তোকে কোতায় ফেলে যাবো? তুই আমার বুকের ধন, বুকের মধ্যে থাকবি। ভগমনের পর গুরুদেব, তারপর তুই। একনাথজী বলেচেন, মায়ার বাঁদন না কাটালে প্রকৃত ভালোবাসা হয় না। দূরে চলে গেলে তুই সবসময় আমার নয়নে নয়নে থাকবি। —তোমার যাওয়া হবে না। এই একনাথজী সাধুটি আবার কে? কবে সে এ বাড়িতে এলো? তেনার সঙ্গে আমি দেকা করতে চাই। -দেকা কবি, নিশ্চয়ই কবি। বাবা তোকে আশীর্বাদ কবেন। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। হরিদ্ধারে নির্মল গঙ্গাজলে চ্যান কবে, আমার শরীর মন পবিত্র হয়ে যাবে, আর ভগমনের কাচে প্রার্থনা কবে, যাতে তোরা সুখে থাকিস, ভালো থাকিস। –মা, আমি যদি তোমায় জোর করে ধরে রাকি? যদি কান্নাকাটি করি, না খেয়ে থাকি, তাও তুমি যেতে পারবে? -ছিঃ, আমন কতা বলতে নেই, ছোট্‌কু ভগমান যাকে ডেকেচোন, তাঁকে কি আটকাতে আচে? অনেক পীড়াপীড়ি অনুনয় বিনয়েও নিবৃত্ত করা গেল না বিম্ববতীকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, তিনি যাত্রার পাকাপাকি ব্যবস্থা আগে থেকেই করে তারপর খবর দিয়েছেন নবীনকুমারকে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা নিজের উদ্যোগে এতখানি ব্যবস্থা জীবনে আগে কখনো করেননি বিম্ববতী। তাঁর সিদ্ধান্তে তিনি অনড়। যাবেনই যখন তখন আর কয়েকটি দিন সময় চাইলো নবীনকুমার বিম্ববতীর কাছে। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। আগামী কাল যাত্রার পক্ষে অতি শুভ দিন। তখনই নবীনকুমার মহাব্যস্ত হয়ে বন্দোবস্তের জন্য লেগে গেল। সাতজন দাসদাসী যাবে বিম্ববতীর সঙ্গে। একজন গোমস্তার হাতে টাকা দিয়ে দেওয়া হলো, যেন পৌঁছেই সে বিম্ববতীর জন্য হরিদ্বারের শ্রেষ্ঠ বাড়িটি ক্রয় করে ফেলে। তেমন বাড়ি না পাওয়া গেলে একনাথজীর আশ্রমেই যেন একটি পাকা বাড়ি তৈরি করে ফেলা হয়। সারা বাড়িতে একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল। এর পর বিধুশেখরের কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা। তাঁকে কেউ ডেকে পাঠায়নি। কিন্তু সেই বৃদ্ধের কানে সব খবরই যথাসময়ে পৌঁছোয়। তিনি এলেন বেশ গভীর রাত্রে। তখন নবীনকুমার মায়ের ঘরে উপস্থিত। বিধুশেখরকে সে সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। যথারীতি বিধুশেখর এক কথায় প্রস্তাবটি উড়িয়ে দিলেন প্ৰথমে। আবার বাদ-প্রতিবাদ চললো। কিন্তু যে বিম্ববতী ভয়ে বিধুশেখরের সামনে এতদিন কথা বলতেই পারেননি, আজ তাঁর মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। মাথায় আজ আর ঘোমটা দেননি। তিনি, সব কথার উত্তরে তাঁর এক কথা, তাঁকে যেতেই হবে। বিধুশেখর এক সময় নবীনকুমারকে বললেন, তুই একবার ঘরের বাইরে যা তো, তোর মাকে আমি একটু বুঝিয়ে বলি। বিম্ববতী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না, ছোট্‌কু থাক। তারপরেই উচ্ছ্বসিত কান্না এসে গেল বিম্ববতীর চক্ষে। তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ধরা গলায় বললেন, আপনি-আপনি ছোট্‌কুকে স্নেহের চোকে দেকবেন…তার যাতে মঙ্গল হয়…সে কতা দিয়েচে কখুনো আপনার অবাধ্য হবে না, আপনার সঙ্গে তার অসৈরণ হবে না। ধীর, শান্ত কণ্ঠে বিধুশেখর বললেন, এ কী কথা বলচো, বিম্ব। ছোট্‌কু আমার প্রাণাধিক, তার সঙ্গে আমার বিবাদ হবে কেন? বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে মতভেদ হয়, কিন্তু ছোট্‌কু যে আমাদের সকলের বড় আদরের, তার কোনো ইচ্ছেতে আমি বাধা দি? কি রে ছোট্‌কু বল? নবীনকুমার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। বিধুশেখর নবীনকুমারের কাঁধে হাত রেখে নরমভাবে বললেন, তোর মায়ের সঙ্গে আমি একটু একলা কতা বলবো, একবার শেষ
false
MZI
সরকার, অন্তবর্তীকালীন সরকার এই ধরনের কোনো গুরুতর বিষয় নিয়ে অনুরোধ করতে যাচ্ছি। যারা এরকম ভাবছেন তাদের কাছে প্রথমেই আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি মোটেই দেশ কিংবা রাজনীতির কোনো গুরুতর বিষয় কথা বলতে যাচ্ছি না। গুরুতর বিষয় নিয়ে দেশের সবাই কথা বলছেন, পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, টেলিভিশনে টক শো হচ্ছে, খবরের কাগজগুলো নিজেদের দায়িত্বে জরিপ করতে শুরু করেছে। শুধু দেশের মানুষ নয়, মনে হয় বিদেশিদেরও রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তারাও অনবরত হুমকি-ধামকি উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন থেকে আমেরিকা কেউ বাকি নেই। এত জ্ঞানী-গুনী গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এত পরামর্শ এত উপদেশ -এর মাঝে আমাদের মতো মানুষের বলার জন্যে বাকী কী আছে? আমি আর নতুন করে কী বলতে পারি? রাজনীতি নিয়ে সারা জীবন যে কথাটি বলে এসেছি, সেটি ছাড়া বলার কিছু নেই- এই দেশে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করতে পারবে না। অন্যরা যেভাবে খুশি রাজনীতি করুক আমার কোনো আপত্তি নেই! তবে সরকারের কাছে আমি এ ধরনের কোনো বিষয় নিয়ে অনুরোধ করতে যাচ্ছে না। আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় অনুরোধ করতে যাচ্ছি। অনুরোধটা করার আগে একটু ভূমিকা করতে হবে, ভূমিকা এরকম : কিছুদিন আগে বের করা হয়েছে যে, পৃথিবীর সব শহরের মাঝে সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহর হচ্ছে দামেস্ক। কোনো ধরনের জরিপ,বিশ্লেষণ বা গবেষণা না করেই এটা বলে দেওয়া যেত। সেই শহরে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে জনসাধারণকে হত্যা করা হয়। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে, হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা। সেই দেশের সরকারি বাহিনী কিংবা তার প্রতিপক্ষ কোনো দলই নৃশংসতায় কেউ কারো চাইতে কম নয়। শুধু তাই নয়, যে কোনো মূহুর্তে বাইরের মাতবর দেশগুলো এই দেশটিকে আক্রমণ করে ফেলতে পারে। এই রকম যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশের ক্ষতবিক্ষত একটা শহর তো সারা পৃথিবীর সবচাইতে বাসের অযোগ্য শহর হতেই পারে। এতে অবাক হবার কিছু নেই এবং আমার বক্তব্য সেটি নয়। আমার বক্তব্য বাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহরটি নিয়ে। এতদিনে পৃথিবীর সবাই জেনে গেছে- সেই শহরটি হচ্ছে ঢাকা শহর। দামেস্ক শহরকে যদি জরিপে আনা না হতো, তাহলে ঢাকা শহর হতো সারা পৃথিবীর মাঝে সবচাইতে বাসের অযোগ্য শহর। যারা এই শহরে থাকে তারা নিশ্চিতভাবেই গর্ব করে বলতে পারে তারা কার্যত পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহরটি কেমন হতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখছে, সেই শহরে বসবাস করেছে! পশ্চিমা জগৎ পৃথিবীর মোড়ল হিসেবে নানা দেশের জন্য যে সার্টিফিকেটগুলো দেয়, সেগুলো সব যে খাঁটি এবং বিশ্বাসযোগ্য সার্টিফিকেট আমি সেটা কখনো বলি না। সারা পৃথিবীর থেকে মানুষেরা পাগলের মতো আমেরিকা ছুটে যায়। কিন্তু আমেরিকা সেই দেশের কালো মানুষদের যেভাবে রেখেছে তার পরিসংখ্যান দেখলে যে কোনো মানুষ হতবাক হয়ে যাবে। সেই দেশের মানুষ যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারে কিংবা ব্যবহার করতে পারে সেটি পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হওয়া সম্ভব সেটিও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার হিসেবে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে আমানবিক দেশগুলোর একটি। কিন্তু আমার কথা কে বিশ্বাস করবে? আমি তো ভালো আর মন্দ দেশের সার্টিফেকেট দেই না! তবে কেউ অস্বীকার করবে না সারা পৃথিবীর (প্রায়) সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকা শহরের এই সার্টিফিকেট পাওয়ার পিছনে যুক্তির কোনো অভাব নেই। এই শহরে প্রায় দেড় কোটি মানুষ থাকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে দেড় কোটি দূরে থাকুক চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ লোকও নেই। (মনে আছে একবার ডেনমার্কে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমার দেশের লোকসংখ্যা কত? সে বলল- পঞ্চাশ লাখের কাছাকাছি। শুনে আমি হা হা করে হেসে বললাম, তোমার দেশের সব মানুষকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিলে আমরা তাদের মিরপুরে আঁটিয়ে দিতে পারব!) একটা শহরে যদি দেড় কোটি মানুষ থাকে তাহলে সেই শহরের উপর কী ভয়ঙ্কর চাপ পড়তে পারে সেটা কল্পনাও করা সম্ভব না। দেড় কোটি মানুষ এক সাথে হাঁচি দিলেই মেন হয় একটা ঘূর্ণিঝড় হয়ে যাবে! সবসময় সবজায়গা অনেক মানুষ থাকলে অপরাধীরা অপরাধ করতে একটু ভয় পায়। তারপরেও ঢাকা শহরে সন্ত্রাসের কোনো ঘাটতি নেই। ঢাকা শহরের যেসব মধ্যবিত্ত মানুষকে রাত-বিরাতে চলাফেরা করতে হয়, তাদের মাঝে মনে হয় একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ছিনতাইয়ের শিকার হয়নি কিংবা মলম পার্টির খপ্পরে পড়েনি। ছিনতাই, চুরি,ডাকাতি ছাড়াও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কোনো ঘাটতি নেই। পথে-ঘাটে বোমাবাজি ককটেল মনে হয় এখন ঢাকাবাসীর নিত্য সঙ্গী। (হেফাজতে ইসলাম মে মাসের পাঁচ তারিখ ঢাকা শহরে যে কাণ্ড করেছিল, সে ঘটনা সারা পৃথিবীতেও কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।) দৈনন্দিন জীবনেও মনে হয় আমাদের অনেক দুঃখের ইতিহাস আছে। যে শহরে দেড় কোটি মানুষ থাকে, সেই শহরে স্কুলের বাচ্চা নিশ্চয় দশ-বিশ লক্ষ। তাদের স্কুলগুলো দেখলে চোখে পানি চলে আসবে। চার দেয়ালে ঘেরা শুরু একটি বিল্ডিং,বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি করার কোনো মাঠ নেই। তাদের একমাত্র খেলাধুলা হয় কম্পিউটারের স্ক্রিনে। সারা শহরে শুধু কংক্রিটের দালাল। সিলেট থেকে আমাকে যখন প্লেনে ঢাকা আসতে হয়, তখন ঢাকা শহরের কাছাকাছি এসে নিচের দিকে তাকিয়ে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠি। ঘেঁষাঘেঁষি করে একটা বিল্ডিংয়ের পাশে আরেকটা বিল্ডিং। কোথাও এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই, একটা গাছ নেই, একটা মাঠ নেই, একটা পুকুর নেই। সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখলে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, কেন ঢাকা শহরকে পৃথিবীর (প্রায়) সবচেয়ে বাসের অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়াটি এমন কিছু বড় অন্যায় হয়নি। ঢাকা শহরের সমস্যা বলা শুরু
false
shottojit_roy
১ ফেলুদা বলল, ‘এই যে গাছপালা মাঠবন দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে, এর বৈজ্ঞানিক কারণটা কী জানিস? কারণ, আদিম কাল থেকে হাজার হাজার বছর ধরে গাছপালার মধ্যে বসবাস করে সবুজের সঙ্গে মানুষের চোখের একটু স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আজকাল গাছ জিনিসটা ক্রমে শহর থেকে লোপাট হতে চলেছে, তাই শহর ছেড়ে বেরোলেই চোখটা আরাম পায়, আর তার ফলে মনটাও হালকা হয়ে ওঠে। যত চোখের ব্যারাম দেখবি শহরে। পাড়াগাঁয়ে যা, কি পাহাড়ে যা, দেখবি চশমা খুঁজে পাওয়া ভার।’ আমি জানি ফেলুদার নিজের চোখ খুব ভাল, তার চশমা লাগে না, সে ঘড়ি ধরে তিন মিনিট পনেরো সেকেন্ড চোখের পাতা না ফেলে থাকতে পারে, যদিও সে কোনওদিন গ্রামে-টামে থাকেনি। এটা ওকে বলতে পারতাম, কিন্তু যদি মেজাজ বিগড়ে যায় তাই আর বললাম না। আমাদের সঙ্গে মণিবাবু রয়েছেন, মণিমোহন সমাদ্দার, তাঁর চোখে পুরু মাইনাস পাওয়ারের চশমা। তিনিও অবিশ্যি শহরের লোক। বয়স পঞ্চাশ-টঞ্চাশ, বেশ ফরসা রং, নাকটা যাকে বলে টিকোলো, কানের কাছে চুলগুলো পাকা। মণিমোহনবাবুর ফিয়াট গাড়িতেই আমরা যশোর রোড দিয়ে চলেছি বামুনগাছি। কেন যাচ্ছি সেটা এই বেলা বলা দরকার। গতকাল ছিল রবিবার। পুজোর ছুটি সবে আরম্ভ হয়েছে। আমরা দুজনে আমাদের বৈঠকখানায় বসে আছি। আমি খবরের কাগজ খুলে সিনেমার পাতায় বিজ্ঞাপন দেখছি, আর ফেলুদা একটা সংখ্যাতত্ত্ব সম্বন্ধে বই খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়ছে। আমি লক্ষ করছি সে কখনও আপন মনে হেসে আর কখনও ভুরু দুটোকে ওপরে তুলে ভাল লাগা আর অবাক হওয়াটা বোঝাচ্ছে। বইটা ডক্টর ম্যাট্রিক্স সম্বন্ধে। ফেলুদা বলছিল এই ডক্টর ম্যাট্রিক্সের মতে মানুষের জীবনে সংখ্যা বা নম্বর জিনিসটা নাকি আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সাধারণ বা অসাধারণ ঘটনার পিছনেই নাকি খুঁজলে নানারকম নম্বরের খেলা আবিষ্কার করা যায়। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার হত না যদি না ফেলুদা বইটা থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত। বলল, ‘ডক্টর ম্যাট্রিক্সের একটা আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা শোন। আমেরিকার দুজন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট খুন হয়েছিল জানিস তো? ‘লিঙ্কন আর কেনেডি?’ ‘হ্যাঁ। আচ্ছ এই দুজনের নামে কটা করে অক্ষর?’ ‘------ – সাত। ------ – সাত।’ ‘বেশ। এখন শোন – লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট হন ১৮৬০ সালে, আর কেনেডি হন ১৯৬০ সালে – ঠিক একশো বছর পরে। দুজনেই খুন হয় শুক্রবার। খুনের সময় দুজনেরই স্ত্রী পাশে ছিল। লিঙ্কন খুন হন থিয়েটারে; সে থিয়েটারের নাম ছিল ফোর্ড ! কেনেডি খুন হন মোটর গাড়িতে। সেটা ফোর্ড কোম্পানির তৈরি গাড়ি। গাড়িটার নাম ছিল লিঙ্কন। লিঙ্কনের পরে যিনি প্রেসিডেন্ট হন তাঁর নাম ছিল জনসন, অ্যানড্রু জনসন। কেনেডির পরে প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন জনসন। প্রথম জনের জন্ম ১৮০৮, দ্বিতীয় জনের জন্ম ১৯০৮ – ঠিক একশো বছর পর। লিঙ্কনকে যে খুন করে তার নাম জানিস?’ ‘জানতাম, ভুলে গেছি।’ ‘জন উইল্‌ক্‌স বুথ। তার জন্ম ১৮৩৯ সালে। আর কেনেডিকে খুন করে লী হারভি অসওয়াল্‌ড। তার জন্ম ঠিক একশো বছর পরে – ১৯৩৯। এইবারে নাম দুটো আরেকবার লক্ষ কর। — — ক’টা অক্ষর আছে নামে?’ অক্ষর গুনে থ’ হয়ে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, ‘দুটোতেই পনেরো?’ ফেলুদা হয়তো ডক্টর ম্যাট্রিক্সের তাজ্জব আবিষ্কারের বিষয়ে আরও কিছু বলত, কিন্তু ঠিক এই সময়ে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে এসে হাজির হল মণিমোহন সমাদ্দার। ভদ্রলোক নিজের পরিচয়-টরিচয় দিয়ে সোফায় বসে বললেন, ‘আমি আপনাদের পাড়াতেই থাকি — লেক প্লেসে৷’ ফেলুদা ও বলে চুপ করে গেল। আমি ভদ্রলোককে আড়চোখে দেখছি। গায়ে একটা হালকা রঙের বুশশার্ট আর ব্রাউন প্যান্ট, পায়ে বাটার স্যান্ডাক জুতো। ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে গলা খাকরিয়ে বললেন, ‘আপনি হয়তো আমার কাকার নাম শুনে থাকবেন, রাধারমণ সমাদ্দার।’ ‘এই সেদিন যিনি মারা গেলেন?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। ‘যাঁর খুব গান বাজনার শখ ছিল?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ ‘অনেক বয়স হয়েছিল না?’ ‘বিরাশি।’ – ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাগজে পড়ছিলাম। অবিশ্যি মৃত্যু সংবাদটা পড়ার আগে তাঁর নাম শুনেছিলাম বললে মিথ্যে বলা হবে।’ ‘সেটা কিছুই আশ্চর্য না। উনি যখন গান বাজনা ছেড়েছেন তখন আপনি নেহাতই ছেলেমানুষ। প্রায় পনেরো বছর হল রিটায়ার করে বামুনগাছিতে বাড়ি করে সেখানেই চুপচাপ বসবাস করছিলেন। আঠারোই সেপ্টেম্বর সকালে হার্ট অ্যাটাক হয়। সেইদিন রাত্রে মারা যান।’ ‘আই সি।’ ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ড চুপ। ফেলুদা তার বা পা-টা ডান পায়ের উপর তুলে বসেছিল, এই ফাঁকে ডান পা-টা বা পায়ের উপরে তুলে দিল। মিস্টার সমাদ্দার একটু কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন লোকটা কী বলতে এল। আসলে ব্যাক-গ্রাউন্ডটা একটু না দিয়ে দিলে…।’ ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়,’ ফেলুদা বলে উঠল। ‘আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না। টেক ইওর টাইম।’ মণিমোহনবাবু বলতে লাগলেন, ‘আমার কাকা ঠিক সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ওঁর পেশা ছিল ওকালতি, এবং তাতে রোজগারও করেছেন যথেষ্ট। বছর পঞ্চাশেক বয়সে সেটা ছেড়ে দিয়ে একেবারে পুরোপুরি গান-বাজনার দিকে চলে যান। শুধু গাইতেন না, সাত-আট রকম এবং এ ছাড়াও আরও কয়েকটা। তার উপরে সংগ্রহের বাতিক ছিল ! ওঁর বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম করে ফেলেছিলেন।’ ‘কোন বাড়িতে?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। আমহাস্ট স্ট্রিটে থাকতেই শুরু হয়, তারপর সে সব যন্ত্র বামুনগাছির বাড়িতে নিয়ে যান। যন্ত্রের সন্ধানে ভারতবর্ষের নানান জায়গায় গেছেন। বম্বেতে একবার এক ইটালিয়ান জাহাজির কাছ থেকে একটা বেহালা কেনেন, সেট কলকাতায় এনে কিছুদিনের মধ্যেই বিক্রি করে দেন ত্রিশ হাজার টাকায়।’ ফেলুদা একবার আমাকে বলেছিল ইটালিতে প্রায় তিনশো বছর
false
shorotchandra
কাল সন্ধ্যায় ঘরদোর দেখিতে আসিয়াছিল। আজ চরণ প্রভৃতি চলিয়া যাইবার ঘণ্টা-দুই পরে কুঞ্জনাথ জমিদারি চালে সারা গ্রামটা ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিল, স্নানাহার করিয়া নিদ্রা দিল এবং বেলা পড়িলে বোনকে লইয়া শ্বশুরবাড়ি ফিরিবার আয়োজন করিল। কুসুম ঘরদোরে চাবি দিয়া নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়া বসিল। সে জানিত, দাদা ইঁহাদের প্রতি প্রসন্ন নয়, তাই সকালের কোন কথা প্রকাশ করিল না। কুঞ্জর স্ত্রীর নাম ব্রজেশ্বরী। সে যেমন মুখরা, তেমনি কলহপটু। বয়স এখনও পনর পূর্ণ হয় নাই, কিন্তু তাহার কথার বাঁধুনি ও বিষের জ্বলনে তাহার মাকেও হার মানিয়া চোখের জল ফেলিতে হইত। এই ব্রজেশ্বরী কুসুমকে কি জানি কেন, চোখের দেখামাত্রই ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিল। বলা বাহুল্য, মা তাহাতে খুশি হন নাই, এবং মেয়ের চোখের আড়ালে টিপিয়া টিপিয়া তাহাকে যা-তা বলিতে লাগিলেন। বাড়ির সম্মুখেই পুষ্করিণী, তিন-চার দিন পরে, একদিন সকালে সে কতকগুলো বাসন লইয়া ধুইয়া আনিতে যাইতেছিল, ব্রজেশ্বরী ঘর হইতে বাহির হইয়াই সুতীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, হাঁ ঠাকুরঝি, মা তোমাকে ক’টাকা মাইনে দেবে বলে এনেচে গা? মা অদূরে ভাঁড়ারের সুমুখে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন, মেয়ের তীব্র শ্লেষাত্মক প্রশ্ন শুনিয়া বিস্ময়ে ক্রোধে গর্জিয়া উঠিলেন, এ তোর কি রকম কথার ছিরি লা? মানুষ আপনার জনকে কি মাইনে দিয়ে ঘরে আনে? মেয়ে উত্তর দিল, আপনার জন আমার, তোমার এ কে যে, দুঃখী মানুষকে দিয়ে দাসীবৃত্তি করিয়ে নেবে, মাইনে দেবে না? প্রত্যুত্তরে মা দ্রুতপদে কাছে আসিয়া কুসুমের হাত হইতে বাসনগুলো একটানে ছিনাইয়া লইয়া নিজেই পুকুরে চলিয়া গেলেন। কুসুম হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল, ব্রজেশ্বরী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া তা যাক বলিয়াই ঘরে চলিয়া গেল। ইহার পর দুই-তিন দিন তিনি কুসুমকে লক্ষ্য করিয়া বেশ রাগ-ঝাল করিলেন, কিন্তু অকস্মাৎ একদিন তাঁহার ব্যবহারের পরিবর্তন দেখিয়া ব্রজেশ্বরী আশ্চর্য হইল। কাল রাত্রে শরীর ভাল নাই বলিয়া কুসুম খায় নাই, আজ সকালেই গৃহিণী স্নানাহ্নিক করিয়া খাইয়া লইবার জন্য তাহাকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। ব্রজেশ্বরী কাছে আসিয়া চুপি চুপি কহিল, মা ভোল ফেরালেন কেন, তাই ভাবচি ঠাকুরঝি! কুসুম চুপ করিয়া রহিল; কিন্তু মেয়ে মাকে বেশ চিনিত, তাই দু’দিনেই এই অকস্মাৎ পরিবর্তনের কারণ সন্দেহ করিয়া মনে মনে আগুন হইয়া উঠিল। গোবর্ধন বলিয়া গৃহিণীর এক বোনপো ছিল, সে অপরিমিত তাড়ি ও গাঁজা-গুলি খাইয়া চেহারাটা এমন করিয়া রাখিয়াছিল যে, বয়স পঁয়ত্রিশ কি পঁয়ষট্টি, তাহা ধরিবার জো ছিল না। কেহ মেয়ে দেয় নাই বলিয়া এখনো অবিবাহিত। বাড়ি ও-পাড়ায়, পূর্বে কদাচিৎ দেখা মিলিত, কিন্তু সম্প্রতি কোন্‌ অজ্ঞাত কারণে মাসীমায়ের প্রতি তাহার ভক্তি ভালবাসা এতই বড় হইয়া উঠিল যে প্রত্যহ যখন তখন ‘মাসীমা’ বলিয়া হাজির হইয়া, তাহার ঘরে বসিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া কথাবার্তা ও আদেশ-উপদেশ গ্রহণ করিতে লাগিল। আজ অপরাহ্নে ব্রজেশ্বরী কুসুমকে লইয়া পুকুরে গা ধুইতে গিয়াছিল। জলে নামিয়া, ঘাটের অদূরে একটা ঘন কামিনী-ঝাড়ের প্রতি হঠাৎ নজর পড়ায় দেখিল, তাহার আড়ালে দাঁড়াইয়া গোবর্ধন একদৃষ্টে চাহিয়া আছে, তখন আর কিছু না বলিয়া, কোনমতে কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিয়া দেখিল, সে উঠানের উপর দাঁড়াইয়া মাসীর সহিত কথা কহিতেছে। কুসুম আকন্ঠ ঘোমটা টানিয়া দ্রুতপদে পাশ কাটাইয়া ঘরে চলিয়া গেলে, ব্রজেশ্বরী কাছে আসিয়া প্রশ্ন করিল, আচ্ছা গোবর্ধন দাদা, আগে কোনকালে তোমাকে ত দেখতে পেতাম না, আজকাল হঠাৎ এমন সদয় হয়ে উঠেচ কেন বল ত? বাড়ির ভেতরে আসা-যাওয়াটা একটু কম করে ফ্যালো। গোবর্ধন জানিত না সে তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিল, কিন্তু এই প্রশ্নের ভাবে উৎকন্ঠায় শশব্যস্ত হইয়া উঠিল—জবাব দিতে পারিল না। কিন্তু মা অগ্নিমূর্তি হইয়া চোখ রাঙ্গা করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, আগে ওর ইচ্ছে হয়নি, তাই আসেনি, এখন ইচ্ছে হয়েচে আসচে। তোর কি? মেয়ে রাগ করিল না, স্বাভাবিক কন্ঠে বলিল, এই ইচ্ছেটাই আমি পছন্দ করিনে। আমার নিজের জন্যও তত বলিনে মা, কিন্তু আমার ননদ রয়েচে, পরের মেয়ে, তা ত মনে রাখতে হবে। মা সপ্তমে চড়িয়া উত্তর করিলেন, পরের মেয়ের জন্য কি আমার আপনার বোনপো ভাইপোরা পর হয়ে যাবে, না বাড়ি ঢুকবে না? তা ছাড়া এই পরের মেয়েটি কি পর্দার বিবি, না কারুর সামনে বার হন না? ওলো, ও যেমন করে বার হতে জানে, তা দেখলে আমাদের বুড়ো মাগীদের পর্যন্ত লজ্জা হয়। ব্রজেশ্বরী বুঝিল, মা কি ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাই সে থামিয়া গেল। তাহার মনে পড়িল, এই কুসুমেরই কত কথা, কত ভাবে, কত ছাঁদে, সে দু’দিন আগে মায়ের সহিত আলোচনা করিয়াছে। কিন্তু তখন আলাদা কথা ছিল, এখন সম্পূর্ণ আলাদা কথা দাঁড়াইয়াছে। তখন কুসুমকে সে ভালবাসে নাই, এখন বাসিয়াছে। এবং এধরনের ভালবাসা ভগবানের আশীর্বাদ ব্যতীত দেওয়াও যায় না, পাওয়াও যায় না। ব্রজেশ্বরী যাইবার জন্য উদ্যত হইয়া গোবর্ধনের মুখের পানে তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, গোবর্ধন দাদা, ভারী লজ্জার কথা ভাই, মুখ ফুটে বলতে পারলুম না, কিন্তু আমি দেখেচি। দাদার মত আসতে পার ত এসো, না হলে তোমার অদৃষ্টে দুঃখ আছে—সে দুঃখ মাও ঠেকাতে পারবে না, তা বলে দিচ্চি। বলিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। মা কহিলেন, কি হয়েচে রে গোবর্ধন? গোবর্ধন মুখ রাঙ্গা করিয়া বলিল, তোমার দিব্যি মাসী, আমি জানিনে—কোন্ শালা ঝোপের ভিতর—মাইরি বলচি—একটা দাঁতন ভাঙতে—জিজ্ঞেস করবে চল ময়রাদের দোকানে—আসুক ও আমার সঙ্গে ও-পাড়ায়, ভজিয়ে দিচ্চি—ইত্যাদি বলিতে বলিতে গোবর্ধন সরিয়া পড়িল। ব্রজেশ্বরী কাপড় ছাড়িয়া কুসুমের ঘরে গিয়া দেখিল, তখনও সে ভিজা কাপড়ে স্তদ্ধ হইয়া জানালা ধরিয়া দাঁড়াইয়া বাহির দিকে চাহিয়া আছে। পদশব্দে
false
robindronath
হইতাম। কিন্তু , এ কী করিতেছি । এ কি একটি গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম । এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম। মনে ছিল , কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে , তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার ঝোড়ো বৃষ্টির মতো প্রবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব । কিন্তু , না পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে , কারণ, সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর, না পারিলাম কাব্য রচনা করিতে , কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি । সেইজন্যেই দেখিতেছি , আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বসিয়াছে। না করিয়া করিবে কী। তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে। জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন। আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ , পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই। যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট । কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে , এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না । কিন্তু , যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই। আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই। আচ্ছা , তাহার নাম দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে , আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়। শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের ছোটো ছিল । অথচ , আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে। তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী, দেশের প্রচলিত ধর্মকর্ম কিছুতে তাঁহার আস্থা ছিল না; তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী ; মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে , সদরে বা অন্দরে , দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ, ইনিও কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি। কোনোটাই সরল স্বাভাবিক নহে। তবুও বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ, মেয়ের বয়স বড়ো বলিয়াই পণের অঙ্কটাও বড়ো। শিশির আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে। বাবার বিশ্বাস ছিল , কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে। আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো-একটা মতের বালাই ছিল না। তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোনো রাজার অধীনে বড়ো কাজ করিতেন। শিশির যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়। মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড়ো হইতেছে , তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই। সেখানে তাঁহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে। শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো, সমাজের ষোলো নহে। কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না। কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাস করিবার পক্ষে যত ভালো হউক বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালো নয়। বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফোটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো — একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।” কোনো একজন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া, খোঁপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া, বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি । কিন্তু , সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না। যেমন-তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাটা শতরঞ্চ ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা। পটের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর , সেই বাঁকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল। পঞ্জিকার পাতা উল্ টাইতে থাকিল; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। ও দিকে সামনে একটা অকাল চার-পাঁচটা মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে। শ্বশুরের এবং তাঁহার মনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল। যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটি আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক্‌। বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোল ; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল। এমন আশ্চর্য আর কী আছে। আমার মন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ‘ আমি পাইলাম , আমি ইহাকে পাইলাম। ‘ কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে। আমার
false
shunil_gongopaddhay
হিম! অমনি চার-পাঁচজন মুখোশধারী কাকাবাবুকে জাপটে ধরে তাঁর পোশাক খুলে ফেলতে লাগল। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই বলে কাকাবাবু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাকাবাবুর ওভারকেট, ওয়েস্টকোট, সোয়েটার, শার্ট সব খুলে ফেলার পর একেবারে নীচের উলের গেঞ্জির সঙ্গে লাগানো ছোট যন্ত্র দেখতে পাওয়া গেল। মুখোশধারীরা যন্ত্রটা খুলে নিয়ে দিল কেইন শিপটনের হাতে। কেইন শিপটন সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, হঁ, কিউট লিটল থিং! শোনো রায়চৌধুরী, তুমি গম্বুজে বসে রেডিও টেলিফোনে যে-সব খবর পাঠাতে, সেই সব খবরই আমরা ইনটারসেপট করেছি। তোমার বুকের এই যন্ত্রটায় মাঝে-মাঝে বিপ-বিপ। শব্দ হয়, আর সিয়াংবোচির রিসিভিং সেন্টারে সেটা ধরা পড়ে। তার থেকে তারা জানতে পারে, তুমি কখন কোথায় আছাঁ! তুমি আগে থেকেই এই ব্যবস্থা করে এসেছিলে। কিন্তু এটাও আমরা জানতে পেরে গেছি, সেইজন্যই গত চব্বিশ ঘণ্টা আমরা সমস্ত ওয়েভ লেংথ জ্যাম করে দিয়েছি, তোমার এই যন্ত্রের পাঠানো আওয়াজ কেউ ধরতে পারবে না, বুঝলে? সুতরাং তুমি এখন কোথায় আছ, তা জানার সাধ্য বাইরের কারুর নেই। ক্লিয়ার? কাকাবাবু এর উত্তরে সংক্ষেপে বললেন, আমার পোশাকগুলো ফেরত পেতে পারি? আমার শীত করছে। যদিও মাটির নীচে এই জায়গাটা বেশ গরম, তবু মাঝে-মাঝে এক-এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস আসছে যেন কোথা থেকে। কাকাবাবু পোশাক পরতে লাগলেন, মুখোশধারীরা একটু দূরে সরে দাঁড়াল। ওদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে কাকাবাবু আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সন্তুকে। মুখোশধারীরা এসে কাকাবাবুকে আবার ধরে ফেলার আগেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সন্তুর গা গরম। কোনও মরা মানুষের গা এরকম গরম হয় না। কেইন শিপটন বলল, হ্যাঁ, এখনও বেঁচে আছে। ছেলেটি ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে-সঙ্গে ওকে ঘুমের ওষুধের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে, যাতে ও এখানকার কিছুই দেখতে না পায়, কিম্বা বুঝতে না পারে। কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ। তবে ওকে ঐ রকম হাত-পা ছড়ানো অবস্থায় শুইয়ে রেখেছন কেন? দেখলেই মনে হয় যেন এক্ষুনি ওর পোস্টমর্টেম করা হবে। কেইন শিপটন বলল, ওর ভাগ্য এখন আপনার হাতে নির্ভর করছে। ওকে আমরা মেরে ফেলতে পারি অথবা ওপরে নিয়ে গিয়ে এই অবস্থায় শুইয়ে রেখে আসতে পারি, এখানকার কথা ওর কিছুই মনে থাকবে না। কাকাবাবু খুব তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে লাগলেন। সন্তু এখানে একা এল কী করে? সন্তু যে এখানকার গুপ্ত দরজাটা আবিষ্কার করে ঢুকে পড়েছে, তখন আর কেউ সন্তুকে দেখেনি? সন্তু একা ছিল? রানা, ভামা, মিংমা-ওরা সব কোথায় গেল? এরা যদি সন্তুকে এক-একা ওপরে শুইয়ে রেখে আসে এরকম অবস্থায়, তা হলেও কি সন্তু বাঁচবে? এখন দিন না। রাত তা বোঝার উপায় নেই। যদি রাত হয়, তা হলে বাইরে ঠাণ্ডায় সন্তু জমে যাবে। উত্তরে তিনি বললেন, আমার উপর নির্ভর করছে মানে? এই ছেলেটিকে বাঁচাবার বদলে তোমরা আমার কাছ থেকে কী চাও? কেইন শিপটিন বলল, আমাদের এখানকার কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আর দু মাসের মধ্যে আমরা এ-জায়গাটা ছেড়ে চলে যাব। যন্ত্রপাতি সব বসানো হয়ে গেছে, এই সব যন্ত্র এখন নিজে থেকেই চলবে। কাকাবাবু পেছন ফিরে একবার তাকালেন। কাছেই একটা জায়গা গোলভাবে রেলিং দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা বেশ গভীর গর্ত মতন আছে। সেখান থেকে আবছা নীল রঙের আলো উঠে আসছে, আর হালকা ধোঁয়া ভাসছে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিসের যন্ত্রপাতি? গুপ্তচরের কাজের জন্য নিশ্চয়ই! তোমরা কোন দেশের হয়ে কাজ করছি? সেটা তোমার জানিবার দরকার নেই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দু মাস পরে আমরা এখান থেকে চলে যাব, শুধু একজন লোক এখানে থাকবে। সেই লোকটি কে বলো তো? তুমি? আমি? হ্যাঁ। তোমাকে আর আমরা ওপরে উঠতে দিতে পারি না। তুমি বড় বেশি জেনে গেছ। তোমাকে আমরা খেতে না দিয়ে আস্তে-আস্তে মেরে ফেলতে পারি, অথবা তুমি যদি আমাদের হয়ে কাজ করতে রাজি থাকো, সেটা তোমার পক্ষেই ভাল। খাবার-দাবার এখানে সবই পাবে, বেশ আরামেই থাকবে। তিন-চার মাস অন্তর-অন্তর আমাদের লোক এসে তোমার যা-যা দরকার সব দিয়ে যাবে। শুধু একটা কথা, জীবনে আর কখনও তুমি ওপরে উঠতে পারবে না। তুমি মুখের মতন কথা বলছি, কেইন শিপটন। ধরে আমি তোমাদের কথায় রাজি হলুম, তারপর তোমরা এখান থেকে চলে গেলেই তো আমি এখানকার সব যন্ত্রপাতি ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করব। জেনেশুনে আমি বিদেশি গুপ্তচরদের সাহায্য করব? কিসের জন্য? টাকা? আমি যদি আর কোনওদিন ওপরে উঠতে না পারি, তা হলে টাকা দিয়ে আমি কী করব? রায়চৌধুরী, এখানকার যন্ত্রপাতি ভাঙবার সাধ্য তোমার নেই। এখানে এমন যন্ত্র আছে, যা ছোঁয়া মাত্ৰ তুমি মরে যাবে। কোনও নিউক্লিয়ার ডিভাইস? আমি ভেবেছিলাম, তুমি সেটা আগেই বুঝবে। বুঝিনি। তবে সন্দেহ করেছিলাম। এখানে যে বিদেশি গুপ্তচরচক্র খুব বড় রকমের একটা কিছু কারবার করছে, এই সন্দেহের কথা আমি ভারত সরকার আর নেপাল সরকারকে বারবার জানিয়েছি। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। সেইজন্যই তুমি একটা ঐ পিকিং-দাঁত সঙ্গে নিয়ে ইয়েতি কিংবা প্রি-হিস্টোরিক ম্যানের সন্ধানের ছুতো করে এখানে এসেছিলে। সেরকম একটা দাঁত তো তুমিও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ! এতে সৌভাগ্য আছে। এটা গলায় ঝোলাবার পর থেকে আমি আর কোনও কাজে ব্যর্থ হইনি। নিছক কুসংস্কার। তোমার মতন সাহেবরাও কুসংস্কার মানে! আমার কিন্তু এখনও বিশ্বাস, এই রকম দাঁতওয়ালা আদিমকালের কিছু মানুষ এখনও এদিকে কোথাও আছে। কোনও গহন-দুৰ্গম অঞ্চলে। তাদের খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত
false
nazrul
হয়ে জন্মগ্রহণ করি! – ইস্! কী অন্ধকার! … ইতি – তোমার চির-জীবন-জোড়া অভিশাপ আর অমঙ্গল – শ্রীধূমকেতু সাপুড়ে–সংগীতাংশ সাপুড়ে কাহিনি সভ্যজগতের সুসমৃদ্ধ জনপদ হইতে বহুদূরে, কখনও ঘননীল শৈলমালার সানুদেশে, ভীষণ নির্জন, দুর্গম অরণ্যের মধ্যে, কখনও বা তরঙ্গ-ফেনিল বঙ্কিম গিরি-নদীর তীরে, দিগন্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, যাযাবর সাপুড়ের দল তাহাদের ক্ষণস্থায়ী নীড় রচনা করে। এমনই এক ভবঘুরে সাপুড়েদলের ওস্তাদ সে। নাম তাহার জহর। দলের সে বিধাতা, একচ্ছত্র অধিপতি। দলের প্রত্যেকটি লোক তাহাকে ভয় করে যমের মতো, ভক্তি করে দেবতার মতো। শুধু দলের একটি মাত্র লোক, তাহার এই অপ্রতিহত প্রভুত্বগৌরবে ঈর্ষার জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে, মনে-মনে দারুণ অবজ্ঞা করে জহরকে, কিন্তু প্রকাশ্যে তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিবার সাহসও তাহার হয় না। এই লোকটির নাম বিশুন, তাহারও দুই একজন অনুচর আছে। মনে-মনে সে মৃত্যু কামনা করে জহরের, কখনও-বা কেমন করিয়া জহরকে চূর্ণ করিয়া একদিন সে সর্দার হইয়া উঠিবে, সেই কল্পনায় চঞ্চল হইয়া উঠে। সেদিন নাগ-পঞ্চমী। জহর পাহাড়তলিতে গিয়াছিল বিষধর সর্পের সন্ধানে। তাহার তুবড়ি বাঁশিতে, সে বাজাইতেছিল একটানা মোহনিয়া সুর – বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, গমকে গমকে, তীব্র মধুর উন্মাদনা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল! সেই সুরে আকৃষ্ট হইয়া বনের ভিতর হইতে, একটি বিষধর কালীয়নাগ ফণা দুলাইতে দুলাইতে বাহির হইয়া আসিল। দারুণ উত্তেজনায়, জহরের চোখের তারা দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। হঠাৎ হাতের বাঁশিটা সে দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং সেই কালীয়নাগের উদ্ধত ফনার সুমুখে তাহার অকম্পিত করতল পাতিয়া ধরিল। মুহূর্তে একটি তীব্র দংশন। দেখিতে দেখিতে জহরের সর্বশরীর সেই সাপের বিষে একেবারে নীল হইয়া গেল। দলের সমস্ত লোক সভয়ে, স্তম্ভিত বিস্ময়ে জহরকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। জহর কিন্তু নিষ্কম্প, নির্বিকার – উদ্বেগের চিহ্নমাত্রও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠে নাই। ধীরগম্ভীরকণ্ঠে, সে মন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিল এবং ধীরে ধীরে শীঘ্রই বিজয়ী বীরের মতো সগৌরবে বিষমুক্ত হইয়া উঠিল। বিমুগ্ধ, বিস্মিত জনতা সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। মুখ কালো করিয়া, বিশুন ধীরে ধীরে নীরবে সেখান হইতে সরিয়া গেল। ঠিক এমনই করিয়া আজ পর্যন্ত, জহর নিরানব্বইবার নিজের দেহে সর্পদংশন করাইয়া, অবলীলাক্রমে বিষমুক্ত হইয়াছে। এইবার শততম এবং শেষতম সর্পদংশন। এই সর্বশেষ সর্পের বিষ, মন্ত্রবলে আপন দেহ হইতে টানিয়া বাহির করিতে পারিলেই, তাহার কঠোর ব্রত উদ্‌যাপিত হইবে; সে সর্পমন্ত্রে সিদ্ধকাম-হইবে। এই মন্ত্রে সিদ্ধ হওয়াই জহরের জীবনের পরমতম লক্ষ্য, একমাত্র মহাব্রত। এই সাধনার জন্য সে কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়াছে । আজীবন চিরকুমার থাকিয়া নিষ্কামভাবে সংযতচিত্তে ব্রত পালন করিয়া চলিতেছে। জহরের অগণিত গুণমুদ্ধ শিষ্য, যখন উদ্‌গ্রীব হইয়া সেই শুভদিনের প্রতীক্ষা করিতেছে, তাতে তাহার জীবনে একটি অভাবনীয় ঘটনার সূত্রপাত হইল। পরিণামে এই ব্যাপারটি যে তাহার সাধনার ভিত্তিমূলকে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়া যাইবে, তাহা কি সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারিয়াছিল? ভবঘুরের মতো জহর তখন নানা দেশ-বিদেশ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। নারীজাতির সংস্পর্শ হইতে দূরে থাকিয়া ক্রমশ জহরের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, নারীজাতি সাধনার পথে সাংঘাতিক বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া থাকে। ক্রমে নারীজাতির সম্বন্ধে অন্তরে সে বিজাতীয় বিতৃষ্ণা পোষণ করিতে শুরু করিয়াছে। এমন সময় হঠাৎ একদিন সে দেখিল, ক্ষীণস্রোতা একটি নদীর জলে কলার ভেলার উপরে, পরমাসুন্দরী এক বালিকার মৃতদেহ ভাসিয়া চলিয়াছে। সর্পদংশনে যাহাদের মৃত্যু হয়, তাহাদের নাকি দাহ করিতে নাই। স্রোতের জলে মৃতদেহ ভাসাইয়া দেওয়াই নাকি বহুকালের প্রচলিত প্রথা। জহর কি আর করে, সাপুড়ে জাতির স্বধর্ম রক্ষা করিতে গিয়া, সে নদীর জল হইতে মৃতা বালিকার দেহ তুলিয়া লইয়া, মন্ত্রবলে তাহাকে পুনর্জীবিতা করিল। জীবন দান করিল বটে,কিন্তু এই বালিকাটিকে লইয়া সে কি করিবে? কে যে তাহার আত্মীয়, কে তাহার স্বজন-কিছুই সে বলিতে পারে না। বিষের প্রকোপে তাহার স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। জহর বড়ো বিপদে পড়িল। বেচারি নিরীহ, নিরাশ্রয়া মেয়েটি, নিরুপায়ের মতো করুণ কাতর দৃষ্টি মেলিয়া জহরের দিকে তাকাইয়া থাকে। জহর তাহাকে ফেলিয়া যাইতে পারে না, কেমন যেন দয়া হয় মেয়েটির উপর। দারুণ ঘৃণা ধীরে ধীরে মধুর মমতায় রূপান্তরিত হইয়া আসে। সে-ই শেষে আশ্রয় দিয়া ফেলিল এই মেয়েটিকে – অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কি হইতে পারে। জহর তাহার সংস্কারবশে, বালিকার নারীবেশ একেবারেই সহ্য করিতে পারিল না। সে স্থির করিল, ইহাকে সে পুরুষের বেশে সাজাইয়া পুরুষের মতো মানুষ করিবে। সে তাহাকে একরকম উগ্র ঔষধ পান করাইল, যাহাতে এই ঔষধের গুণে, তাহার মধ্যে নারী-সুলভ কোনো চেতনা জাগ্রত না হয়। জহর তাহার নাম রাখিল চন্দন – পুরুষের নাম। কিশোরবেশী চন্দনকে সঙ্গে লইয়া জহর এইবার অন্য এক সাপুড়ের দলে যোগদান করিল। সেই দলের বৃদ্ধ সর্দার, জহরের আশ্চর্য চরিত্রবল দেখিয়া এত বেশি মুগ্ধ হইল যে তাহার মৃত্যুর পূর্বে জহরকে সে সেই দলের সর্দার করিয়া দিয়া গেল। ক্রমে জহর এই অর্ধসভ্য ভবঘুরে সাপুড়ের দলের একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া উঠিল। চন্দন যে বালক নয়, দলের কেহই সে কথা জানে না। জহরের এক প্রিয়তম শিষ্য ঝুমরো, তাহার একমাত্র প্রিয় সহচর। চন্দনকে ঝুমরো বড় ভালোবাসে। এই ব্রহ্মচর্য-ব্রতধারী জহর, নিরানব্বইটি বিষধর সর্পদংশনের কঠোর পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়া যখন তাহার প্রান্তসীমায় আসিয়া উপনীত হইয়াছে, তখন সহসা এক সচকিত মুহূর্তে শিহরিয়া উঠিয়া সে অনুভব করিল যে,তাহার সংযম-সাধনার উত্তুঙ্গ শিখর হইতে বোধ করি তাহার পদস্খলন হইতে বসিয়াছে। সেদিন রাত্রে শয়ন করিতে যাইবার পূর্বে অকস্মাৎ এক তীব্র মধুর বেদনার মতো চন্দনের রমণীয় সুকুমার রূপ-মাধুরী, তাহার বুকের মধ্যে আসিয়া বিঁধিল এবং ক্ষণিকের জন্য তাহাকে উন্মাদ অস্থির করিয়া
false
bongkim
কে ভালবাসে না? গিন্নী ভালবাসে না–না? আমায় লুকুস নে। কুন্দ নীরব। ক। দাদাবাবু ভালবাসে না? কুন্দ নীরব। কমল বলিলেন, “যদি আমি তোমায় ভালবাসি–আর তুমি আমায় ভালবাস, তবে কেন আমার সঙ্গে চল না?” কুন্দ তথাপি কিছু বলিল না। কমল বলিলেন, “যাবে?” কুন্দ ঘাড় নাড়িল। “যাব না |” কমলের প্রফুল্ল মুখ গম্ভীর হইল। তখন কমলমণি সস্নেহে কুন্দনন্দিনীর মস্তক বক্ষে তুলিয়া লইয়া ধারণ করিলেন, এবং সস্নেহে তাহার গণ্ডদেশ গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “কুন্দ, সত্য বলিবি?” কুন্দ বলিল, “কি?” কমল বলিলেন, “যা জিজ্ঞাসা করিব? আমি তোর দিদি–আমার কাছে লুকুস নে–আমি কাহারও কাছে বলিব না |” কমল মনে মনে রাখিলেন, “যদি বলি ত রাজমন্ত্রী শ্রীশ বাবুকে। আর খোকার কাণে কাণে |” কুন্দ বলিল, “কি বল?” ক। তুই দাদাবাবুকে বড় ভালবাসিস।-না?” কুন্দ উত্তর দিল না। কমলমনির হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল। কমল বলিলেন, “বুঝিছি–মরিয়াছ। মর তাতে ক্ষতি নাই–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মরে যে?” কুন্দনন্দিনী মস্তক উত্তোলন করিয়া কমলের মুখপ্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া রহিল। কমলমণি প্রশ্ন বুঝিলেন। বলিলেন, “পোড়ারমুখি চোখের মাথা খেয়েছ? দেখিতে পাও না যে __” মুখের কথা মুখে কথা রহিল–তখন ঘুরিয়া কুন্দের উন্নত মস্তক আবার কমলমণির বক্ষের উপর পড়িল। কুন্দনন্দিনীর অশ্রুজলে কমলমণির হৃদয় প্লাবিত হইল। কুন্দনন্দিনী অনেকক্ষণ নীরবে কাঁদিল–বালিকার ন্যায় বিবশা হইয়া কাঁদিল। সে কাঁদিল, আবার পরের চক্ষের জলে তাহার চুল ভিজিয়া গেল। ভালবাসা কাহাকে বলে, সোণার কমল তাহা জানিত। অন্ত:করণের অন্ত:করণ মধ্যে কুন্দনন্দিনীর দু:খে দু:খী, সুখে সুখী হইল। কুন্দনন্দিনীর চক্ষু মুছাইয়া কহিল, “কুন্দ!” কুন্দ আবার মাথা তুলিয়া চাহিল। ক। আমার সঙ্গে চল। কুন্দের চক্ষে আবার জল পড়িতে লাগিল। কমল বলিল, “নহিলে নয়।-সোণার সংসার ছারখার গেল |” কুন্দ কাঁদিতে লাগিল। কমল বলিলেন, “যাবি? মনে করিয়া দেখ?__” কুন্দ অনেকক্ষণ পরে চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, “যাব |” অনেকক্ষণ পরে কেন? তাহা কমল বুঝিল। বুঝিল যে, কুন্দনন্দিনী পরের মঙ্গলমন্দিরে আপনার প্রাণের প্রাণ বলি দিল। নগেন্দ্রের মঙ্গলার্থ, সূর্যমুখীর মঙ্গলার্থ, নগেন্দ্রকে ভুলিতে স্বীকৃত হইল। সেই জন্য অনেকক্ষণ লাগিল। আপনার মঙ্গল? কমল বুঝিয়াছিলেন যে, কুন্দনন্দিনী আপনার মঙ্গল বুঝিতে পারে না। পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : হীরা এমত সময়ে হরিদাসী বৈষ্ণবী আসিয়া গান করিল। “কাঁটা বনে তুলতে গেলাম কলঙ্কের ফুল, গো সখি কাল কলঙ্কেরি ফুল। মাথায় পরলেম মালা গেঁথে, কাণে পরলেম দুল। সখি কলঙ্কেরি ফুল |” এ দিন সূর্যমুখী উপস্থিত। তিনি কমলকে গান শুনিতে ডাকিতে পাঠাইলেন। কমল কুন্দকে সঙ্গে করিয়া গান শুনিতে আসিলেন। বৈষ্ণবী গায়িতে লাগিল। “মরি মরব কাঁটা ফুটে, ফুলের মধু খাব লুটে, খুঁজে বেড়াই কোথায় ফুটে, নবীন মুকুল |” কমলমণি ভ্রূভঙ্গী করিয়া বলিলেন, “বৈষ্ণবী দিদি–তোমার মুখে ছাই পড়ুক–আর তুমি মর। আর কি গান জান না?” হরিদাসী বলিল, “কেন?” কমলের আরও রাগ বাড়িল ; বলিলেন, “কেন? একটা বাবলার ডাল আন ত রে–কাঁটাফোটা কত সুখ মাগীকে দেখিয়ে দিই |” সূর্যমুখী মৃদুভাবে হরিদাসীকে বলিলেন, “ও সব গান আমাদের ভাল লাগে না।–গৃহস্থবাড়ী ভাল গান গাও।” হরিদাসী বলিল, “আচ্ছা |” বলিয়া গায়িতে আরম্ভ করিল, “স্মৃতিশাস্ত্র পড়ব আমি ভট্টাচার্যের পায়ে ধরে। ধর্মাধর্ম শিখে নিব, কোন্ বেটী বা নিন্দে করে ||” কমল ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “গিন্নী মশাই–তোমার প্রবৃত্ত হয়, তোমার বৈষ্ণবীর গান তুমিই শোন, আমি চলিলাম |” এই বলিয়া কমল চলিয়া গেলেন–সূর্যমুখীও মুখ অপ্রসন্ন করিয়া উঠিয়া গেলেন। আর আর স্ত্রীলোকেরা আপন আপন প্রবৃত্তি মতে কেহ উঠিয়া গেল, কেহ রহিল ; কুন্দনন্দিনী রহিল। তাহার কারণ, কুন্দনন্দিনী গানের মর্ম কিছুই বুঝিতে পারে নাই–বড় শুনেও নাই–অন্যমনে ছিল, এই জন্য যেখানকার সেইখানে রহিল। হরিদাসী তখন আর গান করিল না। এদিক সেদিক বাজে কথা আরম্ভ করিল। গান আর হইল না দেখিয়া আর সকলে উঠিয়া গেল। কুন্দ কেবল উঠিল না–চরণে তাহার গতিশক্তি ছিল কি না সন্দেহ। তখন কুন্দকে বিরলে পাইয়া হরিদাসী তাহাকে অনেক কথা বলিল। কুন্দ কতক বা শুনিল, কতক বা শুনিল না। সূর্যমুখী ইহা সকলই দূর হইতে দেখিতেছিলেন। যখন উভয়ে গাঢ় মন:সংযোগের সহিত কথাবার্তা হওয়ার চিহ্ন দেখিলেন, তখন সূর্যমুখী কমলকে ডাকিয়া দেখাইলেন। কমল বলিল, “কি তা? কথা কহিতেছে কহুক না। মেয়ে বই ত আর পুরুষ না |” সূ। মেয়ে কি পুরুষ তার ঠিক কি? কমল বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “সে কি?” সূ। আমার বোধ হয় কোন ছদ্মবেশী পুরুষ। তাহা এখনই জানিব–কিন্তু কুন্দ কি পাপিষ্ঠা! “রসো। আমি একটা বাবলার ডাল আনি। মিন্‌সেকে কাঁটা ফোটার সুখটা দেখাই |” এই বলিয়া কমল বাবলার ডালের সন্ধানে গেলেন। পথে সতীশের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল–সতীশ মামীর সিন্দূরকৌটা অধিকার করিয়া বসিয়া ছিলেন–এবং সিন্দূর লইয়া আপনার গালে, নাকে, দাড়িতে, বুকে, পেটে বিলক্ষণ করিয়া অঙ্গরাগ করিতেছিলেন–দেখিয়া কমল, বৈষ্ণবী, বাবলার ডাল, কুন্দনন্দিনী প্রভৃতি সব ভুলিয়া গেলেন। তখন সূর্যমুখী হীরা দাসীকে ডাকাইলেন। হীরার নাম একবার উল্লেখ হইয়াছে। তাহার কিছু বিশেষ পরিচয় আবশ্যক। নগেন্দ্র এবং তাঁহার পিতার বিশেষ যত্ন ছিল যে, গৃহের পরিচারিকারা বিশেষ সৎস্বভাববিশিষ্টা হয়। এই অভিপ্রায়ে, উভয়েই পর্যাপ্ত বেতনদান স্বীকার করিয়া, একটু ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকগণকে দাসীত্বে নিযুক্ত করিতে চেষ্টা পাইতেন। তাঁহাদিগের গৃহে পরিচারিকা সুখে ও সম্মানে থাকিত, সুতরাং অনেক দারিদ্র্যগ্রস্ত ভদ্রলোকের কন্যারা তাঁহাদের দাসীবৃত্তি স্বীকার করিত। এই প্রকার যাহারা ছিল, তাহাদের মধ্যে হীরা প্রধানা। অনেকগুলি পরিচারিকা কায়স্থকন্যা–হীরাও কায়স্থ। নগেন্দ্রের পিতা হীরার মাতামহীকে গ্রামান্তর হইতে আনয়ন করেন। প্রথমে তাহার মাতামহীই পরিচর্যায় নিযুক্ত হইয়াছিল–হীরা তখন বালিকা, মাতামহীর সঙ্গে আসিয়াছিল। পরে
false
tarashonkor
যেত। সুচাঁদের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গিয়েছে করালী-পাখীর করালী সুচাঁদকে প্রায় দূর করেই দিয়েছে। সুচাঁদ কাঁদছে, বাবাঠাকুরকে ডাকছে, করালী-পাখীকে এবার আর অভিসম্পাত দিচ্ছে না, তিরস্কার করছে এবং বাবাঠাকুরকে বলছে—মতি ফিরিয়ে দাও, সুমতি দাও। প্রথম দিন সে আনন্দে গৌরবে পাখীর বাপের জন্য, নিজের বাপের জন্য কেঁদেছিল। কিন্তু পরে বুঝেছে বিপদ। সর্বাগ্রে সে-ই বুঝেছে। বারণ করতে গিয়েছিল। করালী তাকে দরজা দেখিয়ে বলেছে—নিকালো অর্থাৎ বেরিয়ে যাও। ও-পাশ থেকে নয়ানের মা ফোড়ন দিয়েই চলেছে। হে বাবা, একবার যেমন নিয়েছ, আবার তেমনি করে নিয়ো। তোমার বাহনের বিষ নিশ্বাসে ‘ফুস্ধা’ করে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে এবার দ্যাল চাপা বাবা! কোঠাঘরের দ্যাল-হড়মুড় করে। নসু গাল দিচ্ছে ইঙ্গিতে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘ফুস-ধা’ হয়ে যাবে লো! অর্থাৎ নয়ান। যে মুখে পরের মন্দ চায় লোকে, সে মুখে লোকের পোকা পড়বে লো! দু হাতের বুড়ো আঙুল নাড়ছে আর ঢেউয়ের মত দুলছে। বাকি গোটা পাড়াটা স্তব্ধ হয়ে রয়েছে কালবৈশাখীর অপরাত্নের মত। বনওয়ারী ভাল হয়ে ওঠার অপেক্ষা করছে। করালী ভীষণ হাঙ্গামা বাধিয়েছে। সে বাবাঠাকুরের শিমুলবৃক্ষের চেয়ে মাথা উঁচু করে উঠেছে। সত্যিই উঠেছে। আবার সেদিন শিমুলগাছের উপরে উঠেছিল। এবার আর ডালে উঠেই ক্ষান্ত হয় নাই, একেবারে ডগায় উঠে কাহারপাড়াকে হেঁকে বলেছিল—দেখ। করালীর অপরাধেই যত অঘটন ঘটছে, এই অপবাদের প্রতিবাদেই সে গাছটায় আবার উঠেছিল। এবার সে চমৎকার একটা টিয়াপাখির ছানা পেড়ে এনেছে শিমুলবৃক্ষের কোটর থেকে। আগের থেকে অনেক গুণ তার বড় বেড়েছে। কোট পেলেন পরে বেড়াচ্ছে। বলে-যুদ্ধের পোশক। যুদ্ধের চাকরি নিয়েছে করালী। হঠাৎ সেদিন ওই পোশক পরে এসে বললে যুদ্ধের চাকরি নিলাম! এবার আর দিনমজুরি নয়। মাসমাইনে। পায়ে জুতো। ফোস্কা পড়েছে, খুঁড়িয়ে চলছে, তবু জুতো ছাড়বে না। ছোঁড়ারা সব চুলবুলিয়ে উঠেছে। প্রবীণদের আশঙ্কার অবধি নাই। কিন্তু বসনের সমস্যা কোঠাঘর। সেই কোঠাঘরের কল্পনা সে কাজে পরিণত করতে শুরু করেছে। ঘর আরম্ভ করে দিয়েছে। বিয়েবাড়ি থেকে ফিরেই হল বনওয়ারীর অসুখ। বসন বিব্রত হয়ে ধরেছিল রতনকে, প্রহ্লাদকে। পাগল থাকলে ভাল হত, কিন্তু সে সেইদিনই সকালে চলে গিয়েছে, বলে গিয়েছেদুদিন ঘুরে মন ভাল করে আসি। পনের দিন হয়ে গেল, আজও ফেরে নাই। রতন প্রহ্লাদ অবাক হয়ে বলেছিল—কোঠাঘর। –হ্যাঁ। তোমরা বারণ কর। যা পিতিপুরুষে করে নাই, তা করতে নাই। রতন এসে বললে—করালী? —কি? করালী বুঝতে পেরেছিল। —কোঠাঘর করেছিস তু? –হ্যাঁ। —পিতিপুরুষে কখনও করে নাই। —তা না করুক। আমার বাবা যুদ্ধের কাজও করে নাই। রতন এগিয়ে এল এবার।–দেখ করালী, কথা শোন্। ভাল, আমাদের কথা না শুনিস, বনওয়ারীর কথা শুনবি তো? —যদি না শুনি? প্ৰহ্লাদ এবার ধমক দিয়ে বললে—শুনতে হবে। সবাই শোনে, তুমি শুনবে না কি রকম? সে সেরে উঠুক, তার সাথে সলাপরামশ্য করে যা বলে কবি। করালী বলেছিল-যাঃ কচু খেলে! এর আবার সলাই-বা কিসের, পরামশ্যইবা কেনে? যাও যাও। তোমাদের সলাপরামশ্য যদি লাগে তো মাতব্বরের জ্বর ছাড়ার লেগে বসে থাক গা। আমার সলাপরামশ্য চাই না। প্ৰহ্লাদ বলেছিল—ঘর করতে হলে নেয়ম হল মাতব্বর এসে দড়ি ধরে। –আমি নেয়ম মানি না। —তোর বুঝি গায়ে জোর হছে বেজায়? ধরাকে সরা দেখছিস? —সরা নয়, খুরি। যাও যাও, মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ কোরো না। রতন মাথলার বাবা, মাথলা করালীর সারে, রতন তাকে বলেছিল-দুদিন সবুরই কর। না কেনে বাবা। উঁহু! বর্ষার আগে ঘর সারতে হবে অতনকাকা। সবুর করবার টায়েম কোথা? আমার আবার যুদ্ধের চাকরি। যেখানে হুকুম করবে, যখন বলবে, তখুনি যেতে হবে। রতন বলেছিল—কিন্তু ভাল কাজ হচ্ছে না করালী। কেউ কখনও করে নাই কোঠাঘর। —না করুক। আমি করবই। গুপী বলেছিল—যা কেউ করে নাই, তা করতে গেলে খ্যানত হয়। চৌধুরী মাশায়রা দালান করতে ইট পোড়ালে, লোকে বারণ করেছিল, সে আমলে চৌধুরী শোনে নাই, ইটের ভাটা পুড়ল উদিকে চৌধুরী মাশায়ের ছোট বেটা ধড়ফড়িয়ে মরে গেল। –আমার তো বেটা হয় নাই এখনও। হেসে জবাব দিয়েছিল করালী। আফসোস হচ্ছে বসনের। এ জামাই নিয়ে কখনও সুখ পাবে না সে। এইসব কি কথাবার্তার ধরন, না ছিরি! এইসব মাথার মাথার লোকের সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা যখন করালী বলে, তখন বসন ভয়ে লজ্জায় সারা হয়ে যায়। নিমতেলে পানুকে তো সে মারতে বাকি রেখেছে। নিমতেলে পানু করালীর সামনেও আসে নাই। মুখখামুখি তাকে কোনো কথা বলে নাই; নিজের বাড়িতে বসে সে নয়ানের মাকে বলেছিল—এ কাল তাকাৎ তিন-তিনটে মোড়লমাতব্বরের গুষ্টি গুজুরে গেল—আটপৌরেদের পরমদের ঘর, ঘরভাঙাদের বাড়ি, কোশকেঁধেদের গুষ্টি, তারা কেউ কোঠাঘরে পরিবার নিয়ে শোয় নাই বাবা। কথাটা করালীর কানে উঠতেই সে পানুর বাড়ি বয়ে গিয়ে তার সামনে উপ্ত হয়ে বসে। বলেছে—হা শালো, মাতব্বরেরা কোঠায় শোয় নাই বলে আমি শুতে পাব না। নিমতেলে পানু সেদিন সেই চড় খাওয়া অবধি করালীকে দুর্দান্ত ভয় করে। সে কোনো জবাব দেয় নাই। করালী তবু ছাড়ে নাই, নিরুত্তর পানার মুখের সামনে ঠিক পানার মত ভঙ্গিতে বসে ভেঙিয়ে মৃদুস্বরে শ্লেষের সঙ্গে বলেছে—হা শাপলা, বনওয়ারী মাতব্বরের পরিবারের যে রঙ কালো, দেখতে সে যে কুচ্ছিতা বলে আমি ফরসা সোন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পাব না? তোমার পরিবারের তো অঙ ফরসা, তা—তাকে তুমি ছাড়। শালো। বলি ওরে শালো! বসে বসেই খানিকটা এগিয়ে গেল পানুর দিকে। পানু বেচারি ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সভয়ে সেও বসে বসেই পিছিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করেছিল, বলেছিল—ওইওই, উ সব কি কথা? করালীও বসে বসে পানুর দিকে আরও এগিয়ে গিয়েছে আর বলেছে ইটের
false
toslima_nasrin
না। যা করার ইচ্ছে লুকিয়ে চুকিয়ে করে যান। –নাসিমের টাকা দিয়া কি করছ মামা? অনেকদিনের ইচ্ছে আমার জানার. –মাটির তলে পুঁইতা রাখছি। আমাকে প্রতিজ্ঞা না করিয়েই ফট করে বলে ফেলেন তিনি। আমি এই সুনসান জায়গায়, বাড়ির কেউ জানে না শরাফ মামা আমাকে কথা দিচ্ছেন নদী দেখাতে নেবেন, বলছেন মাটির তলে পুঁতে রাখা টাকার গল্প, যা কেবল আমাকেই বলছেন তিনি, আর কাউকে নয়, নিজেকে আর মাথায় গোবর অলা ঢেঙ্গি ছেড়ি বলে মনে হয় না। –কুন মাটির তলে? এই বাড়ির? ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি। –হ। যহন বড় হইবাম, এই টাকা দিয়া একটা জাহাজ কিনবাম। মামা বলেন। –জাহাজ? আমারে চড়াইবা? মন খুশিতে লাফায়। আমার চোখের সামনে তখন বিশাল এক জাহাজ, নদী পার হয়ে সাগরের দিকে যাচ্ছে। আমি জাহাজে ভেসে জলের খেলা দেখছি, রোদে চিক চিক করছে রূপোলি জল। এরকম একটি ছবি দেখেছিলাম ওষুধ কোম্পানির এক ক্যালেন্ডারের পাতায়। শরাফ মামার চোখের তারা আবার নাচে। হাতে তাঁর পাটশুলাও নেই, দেশলাইও নেই। পকেটে কোনও চুম্বক আছে কি না কে জানে। আমাদের চুম্বকের খেলা দেখাতেন মামা। তখনও চুম্বক কি জিনিস আমি জানি না। যাদু দেখবি আয়, বলে হাতে লোহার একটি শাদামাটা পাত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে তিনি দরজার কড়ায়, টিউবয়েলের ডান্ডায়, বালতিতে, জানালার শিকে ছোঁয়াচ্ছেন আর বসে যাচ্ছে। আমি হাঁ হয়ে মুগ্ধ চোখে যাদু দেখছিলাম। আমিও শরাফ মামার মত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে কুড়িয়ে পাওয়া একটি লোহা দরজায় কড়ায় লাগাতে চেয়েছিলাম, লাগেনি। শরাফ মামা আমার কান্ড দেখে হাসতেন। চোখের বাদামি তারা নাচছে শরাফ মামার আর ঠোঁটের কিনারে একরকম হাসি, যার আমি ঠিক অনুবাদ জানি না। মজার জিনিসটা এই বার তরে দেখাই বলে একটানে আমাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেন মামা। আমার পরনে একটি কুঁচিঅলা রঙিন হাফপ্যান্ট শুধু। শরাফ মামা সেটিকে টেনে নিচে নামিয়ে দেন। আমি তাজ্জব। হাফপ্যান্ট দু’হাতে ওপরে টেনে বলি–কি মজার জিনিস দেখাইবা, দেখাও। আমারে ল্যাংটা কর ক্যা? শরাফ মামা তাঁর শরীরকে হাসতে হাসতে আমার ওপরে ধপাশ করে ফেলে আবার টেনে নামান আমার হাফপ্যান্ট আর নিজের হাফপ্যান্ট খুলে তাঁর নুনু ঠেসে ধরেন আমার গায়ে। বুকে চাপ রেগে আমার শ্বাস আটকে থাকে। ঠেলে তাঁকে সরাতে চেষ্টা করি আর চেঁচিয়ে বলি–এইটা কি কর, সর শরাফ মামা, সর। গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঠেলে তাঁকে একচুল সরাতে পারি না। –মজার জিনিস দেহাইতে চাইছিলাম, এইডাই মজার জিনিস। শরাফ মামা হাসেন আর সামনের পাটির দাঁতে কামড়ে রাখেন তাঁর নিচের ঠোঁট। –এইটারে কি কয় জানস, চোদাচুদি। দুনিয়ার সবাই চোদাচুদি করে। তর মা বাপ করে, আমার মা বাপ করে। শরাফ মামা তাঁর নুনু ঠেলতে থাকেন বিষম জোরে। আমার বিচ্ছিরি লাগে। শরমে চোখ ঢেকে রাখি দু’হাতে। হঠাৎ ইঁদুর দৌড়োয় ঘরে। শব্দে শরাফ মামা লাফিয়ে নামেন। আমি এক দৌড়ে হাফপ্যান্ট ওপরে টেনে দৌড়ে বের হয়ে যাই ঘর থেকে। ঝোপ পার হতে আমি আর সাপের ভয়ে ইতস্তত করি না। আমার বুকের মধ্যে সড়াত সড়াত শব্দ হয়, যেন একশ ইঁদুর দৌড়োচ্ছে। শরাফ মামা পেছন থেকে অদ্ভুত গলায় বলেন–কাউরে কইবি না। কইলে কিন্তু সব্বনাশ। পাড়ার ছেলেরা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে যায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বীর মুজাহিদ নও জোয়ান, কবুল মোদের জান পরান, আনতে হবে পাকিস্তান, আনতে হবে পাক কোরান। মা এক্কা দোক্কা খেলা ফেলে দৌড়ে যান মিছিল দেখতে। মিছিল চলে গেলে মাও লাফিয়ে বলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কিছু না বুঝেই বলেন। হঠাৎ এক সকালে উঠে তিনি শোনেন, ভারত থেকে ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তান নামের একটি দেশ মিলেছে মুসলমানের। পাড়ার ছেলেরা নেচে নেচে মিছিলে গায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ইস্কুলে পাকিস্তানের জয়গান শেখানো হয়। জীবন যেমন ছিল, পাকিস্তান হবার পর তেমনই থেকে যায় মা’র। নাসিরাবাদ মাদ্রাসায় মিয়াভাই আগেও যেমন যেতেন, এখনও যান; বাড়িতে মা’কে কোরান শরিফ পড়াতে সুলতান ওস্তাদজি আগেও যেমন আসতেন, এখনও আসেন; তফাৎটা কি হল তিনি দেখতে পান না। বাজান মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন পাঁচবেলা, এখনও যান। কেউ তো এসবে বাধা দেয়নি, তবে আল কোরান নতুন করে আনার জন্য লোক ক্ষেপেছিল কেন! মাঝখান থেকে কী হল, অমলারা কাঁদতে কাঁদতে হিন্দুস্তান চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার দিন মা কড়ইগাছ তলায় হতবাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ি ঘর জমিজমা জলের দরে বিক্রি করে চলে গেল অমলারা। মা অমলার সঙ্গে সই পেতেছিলেন। সই চলে গেলে কার না বুক খাঁ খাঁ করে! মা’রও করেছে। মা ফেরাতে পারেননি কিছু, কারও চলে যাওয়া। ইস্কুল খালি হয়ে গেল দেখতে দেখতে, কোনও হিন্দু মেয়ে আর ইস্কুলে আসে না। খালি ক্লাসঘরে দু’চারটে মুসলমান মেয়ে তখন ইতিহাস বইএর নতুন অধ্যায়ে পাকিস্তান আমাদের দেশ, কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির জনক মুখস্ত করে। ছড়া কবিতার নতুন নতুন বই আসে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার বদলে আসে গোলাম মোস্তফা, বন্দো আলী মিয়ার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের বদলে কাজী নজরুল ইসলাম। মা কিন্তু থেকে থেকেই আওড়ান আগের পড়া কবিতা। অমলার দিদির কাছে শেখা একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি মাগো দেখবে জগতবাসী অমলারা চলে যাওয়ার পরও, গান মা। যেমন জীবন, তেমনই চলে, ছোটছোট দুঃখ সুখে। পুকুরের কচুরিপানা সরিয়ে আগেও সাঁতার কাটতেন, এখনও। আগেও পিঁড়ি পেতে বসে মাছের ঝোল মেখে ভাত খেতেন,
false
humayun_ahmed
কোনোটাই ব্যবহার করতে পারিনি। তবে সংস্কৃত শ্লোকের পাশে লেখা নলিনী বাবুর টীকা পড়ে মজা পেয়েছি। শ্লোকের চেয়ে টীকাগুলি মজার। উদাহরণ শ্লোক অধরে স্ব মৃতং হি ঘোষিতীং হৃদি হলাহলমেব কেবলম অর্থ রমণীদিগের অধরে অমৃত কিন্তু হৃদয়ে শুধুই হলাহল বিষ। টীকা ভুল শ্লোক। মেয়েদের এই শ্লোকে ছোট করা হয়েছে। তাছাড়া যার মুখে অমৃত তার অন্তরেও থাকবে অমৃত। হৃদয়ের অমৃতই মুখে আসে। যার হৃদয় হলাহলপূর্ণ, তার অধরে হলাহল থাকবে। উদাহরণ আমার বাবা শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য। (দুঃখ জগতের বাবা) শীতকালের এক সন্ধ্যায় অবসর প্রকাশনীর মালিক, আমার পুরানো বন্ধুদের একজন উত্তরার বাড়িতে আমাকে দেখতে এলেন। তাঁর প্রকাশনা থেকে রানার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বইটি সঙ্গে করে এনেছেন। নানান কথাবার্তা হচ্ছে প্রকাশকের বই প্রকাশ নিয়ে বিড়ম্বনার কথা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আপনার কি মিরপুরের কথা মনে আছে। কি বিপাকেই না পড়েছিলাম। মিরপুরের ঘটনা মনে পড়ল। একই সঙ্গে নলিনী বাবুও প্রবলভাবে ফিরে এলেন। কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত। আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হাউস টিউটর। একের পর এক বই লিখে যাচ্ছি। নিষাদ নামে একটা সায়েন্স ফিকশন এই সময়ে লেখা। বিষয়বস্তু একটি যুবক একই সঙ্গে দুই জগতে বাস করছে। কনসেপ্টের সায়েন্স ফিকশন। তখন খবর পেলাম মিরপুরের একটি মেয়ে এই বইটি পড়ার পর ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে। সে দাবি করছে, দুটি জগতে সে ঘোরাফেরা করছে। সাতদিন পার হয়েছে সে অঘুমী। ডাক্তাররা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েও তাকে ঘুম পাড়াতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, বইটির লেখক উপস্থিত হলে তিনি এই জটিল সমস্যার সমাধান হয়তো দিতে পারবেন। আমি একা উপস্থিত হওয়ার সাহস করলাম না। চার-পাঁচজনের একটা দল নিয়ে উপস্থিত হলাম। দলে আছেন অবসর প্রকাশনীর মালিক আলমগীর রহমান, দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী, বাংলা একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। ষোল-সতেরো বছরের এক তরুণী। তার চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। তাকে ঘিরে আছে আত্মীয়-স্বজন এবং ডাক্তার। মেয়েটার পুরোপুরি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থা। সে (তার নাম এখন আর মনে করতে পারছি না) আমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলল, আপনি আমাকে বাঁচান। মেয়েটার বাবা সম্ভবত একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমাকে দুঃখিত গলায় বললেন, এসব কী লেখেন। কেন লেখেন? মেয়ের বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি বইটি লিখে বিরাট অপরাধ করেছি। আলমগীর রহমান ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বইটির প্রকাশক হিসেবে তার নাম চলে আসে কি-না এই ভেবেই হয়তো বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা এবং উঠান ভর্তি পাড়ার ছেলেপুলে। তাদের দেখে তিনি শুকনা মুখে আবার ঘরে ঢুকলেন। আমি মেয়েটিকে বললাম, তুমি শান্ত হও। আমি বইয়ে যা লিখেছি সবই লেখকের কল্পনা। জগৎ একটাই। তুমি ভিন্ন ভিন্ন জগতে যাওয়া-আসা করছ, তা তোমার কল্পনা। মেয়েটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি যা দেখছি সবই সত্য। আমি কেন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলব। আমার লাভ কি? মেয়ে কঁদছে, মেয়ের মা কাঁদছেন। বিশ্রী অবস্থা। সেই রাতেই মেয়েটিকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তাকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হলো। সপ্তাহখানেক চিকিৎসার পর তার অবস্থা কিছুটা ভালো হলে আমি তাকে দেখতে গেলাম। দুই জগতে সে কী দেখেছে তা ভাঙা ভাঙাভাবে কিছুটা শুনলাম। তার দ্বিতীয় জগৎটায় আলো অনেক বেশি। সবাই হাসি-খুশি। সেই জগতেও একজন হুমায়ূন আহমেদ আছে। এবং সেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মেয়েটা নাকি বিশেষভাবে পরিচিত। দ্বিতীয় জগতের হুমায়ূন আহমেদের বয়স কম, এবং অবিবাহিত। মেয়েটির কথাবার্তা থেকে আমার মনে হলো লেখকের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হবার প্রবল বাসনাই তার মধ্যে দ্বিতীয় জগতের বিভ্রম তৈরি করেছে। তারপর বহু বছর কেটেছে। আমি নলিনী বাবুর দেখা পেয়েছি। বিস্ময়ের কথা হলো, তিনিও নিষাদ বইটা পড়েছেন। এখানে মিরপুরের মেয়েটির সঙ্গে নলিনী বাবুর কিছু অমিল আছে। মিরপুরের মেয়ে নিষাদ পড়ার পর দ্বিতীয় জগতে গেছে। নলিনী বাবু দ্বিতীয় জগৎ ঘুরে আসার অনেক পরে নিষাদ বইটি পড়েছেন। তাঁর এক ছাত্রী তাঁকে বইটি পড়তে দিয়েছিল। ছাত্রীর নাম সুলতানা বেগম, দশম শ্রেণী, খ শাখা। বিজ্ঞান বিভাগ। মিসির আলির কাছ থেকে তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। আমি ঠিক করলাম, নীলগঞ্জ যাব। নলিনী বাবুকে খুজে বের করব। তার সঙ্গে কথা বলব, তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বাবুকে খুঁজে বের করব। তার সঙ্গে কথা বলব, তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলব। তার সম্পর্কে যা জানার সব জানব। যা ভেবেছি তা করা হলো না। আমরা অতি ব্যস্ত এক জগতে বাস করি। নিজের প্রয়োজনের বাইরে সময় বের করা হয়ে ওঠে না। এক সময় নলিনী বাবুর কথা ভুলেই গেলাম। না ভুলে উপায়ও ছিল না। আমি তখন চন্দ্র-কথা নামে নতুন এক ছবিতে হাত দিয়েছি। অর্থের জোগান নেই। গল্প-উপন্যাস লিখে বাড়তি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করি। টাকার অভাবে ছবি বন্ধ হবার জোগাড়। মহাচিন্তায় আমি অস্থির। নলিনী বাবু আমার ব্যক্তিগত চিন্তার কুয়ায় পড়ে পুরোপুরি ডুবে গেলেন। প্রকৃতি তখন ছোট্ট একটা খেলা খেলল। প্রকৃতির খেলা ব্যাখ্যা করার আগে জল-বিলাস প্রসঙ্গে বলে নেই। জল-বিলা আমার বজরার নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় চড়ে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াতেন। নদীর উপর রাত্রি যাপন করতেন। রবীন্দ্রনাথ হওয়া সম্ভব না, তবে তার অনুকরণ করা সম্ভব। আমি বজরা বানালাম। নাম দিলাম জল-বিলাস। নুহাশ পল্লীর পাশের খালে বজরা ভাসানো হলো। খাল দিয়ে কিছু দূর গেলেই হাওরের মতো জায়গা পড়ে। হাওরের নাম লবণদহ। আমি ঠিক
false
shunil_gongopaddhay
জন্য। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে নবীনকুমারকেই। তবে সে একা আসেনি, জননী বিম্ববতীকেও সঙ্গে এনেচে। বিম্ববতী গৃহ থেকে নিৰ্গত হতেই চান না। পূর্ণিমা অমাবস্যায় শুধু একবার করে যান। গঙ্গামানে। তাও ঘেরাটোপ পাল্কিতে, এবং সেই পালকি সমেতই তাঁকে জল ড়ুবিয়ে আনা হয়। নবীনকুমার অনেকবার বলেছে তাঁকে কোনো তীর্থ দৰ্শন করে আসতে কিন্তু বিম্ববতী তাতে সম্মত নন, পুত্রমুখ দর্শন না করে তিনি একদিনও থাকতে পারবেন না। নবীনকুমার বলে, মা, আমি যখুন মহাল পরিদর্শন করতে যাবো, তখুন তুমি কী করবে? তুমিও কি আমার সঙ্গে সঙ্গে বজরায় ঘুরবে? বিম্ববতী উত্তর দেন, তোর বাবা মহাল দেকতে গিয়ে কাজ নেই; সেজন্যে অনেক লোক আচে। নবীনকুমার বলে, আমার ঠিক বয়েসটা হোক না, তখন দেকো চর্কির মতন ঘুরবো। বিষয় সম্পত্তি নিজে না দোকলে চলে? মহাল পরিদর্শনে গিয়েই গঙ্গানারায়ণ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে, সে কথা ভেবে বিম্ববতীর এখনো বুক কাঁপে। তিনি ঐ সব কথা শুনে নবীনকুমারের হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলেন, না, না, তুই কক্ষুনো মহালে যাবি না! বিষয় যা আচে, ঢের আচে, দূর থেকে চালালেই যথেষ্ট চলবে। নবীনকুমার মায়ের কথা শুনে হাসে। নিমতলা ঘাট থেকে বজরায় চেপে অনুকুল জোয়ারে এক ঘণ্টার মধ্যেই নবীনকুমারেরা পৌঁছে গোল দক্ষিণেশ্বরে। সদ্য দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, উৎসব তখন তুঙ্গে। জননীকে নিজের হাতে ধরে নবীনকুমার তীরে নামালো বিম্ববতীর মুখ ঘোমটায় ঢাকা, কোনোদিন তিনি সূযালোকে অচেনা মানুষের সামনে বেরোননি, এই মধ্যবয়েসেও তিনি নববধূর মতন ব্রীড়াকুণ্ঠিতা। লোকের ভিড়ে পথ চলা দায়! দুলাল এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী মিলে সামনে থেকে পথ সাফ করে দিতে লাগলো। নবীনকুমার তার মাকে ধরে ধরে নিয়ে এলো পূজামণ্ডপে। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ঘেরা জায়গায় বসবার স্থান নির্দিষ্ট আছে। একদিকে পুরুষ, অন্যদিকে রমণী। নবীনকুমার বিম্ববতীকে একটি গালিচা-মোড়া কেদারায় বসিয়ে দিল। সে নিজে বসলো না, এক জায়গায় বেশীক্ষণ বসে থাকার মানুষ সে নয়। সে পরে আছে কোঁচানো ধুতি এবং লম্বাহাতার জামা, এবং পরিবার-প্রধানের চিহ্ন হিসেবে সে হাতে নিয়েছে একটি ছড়ি। আর কোনো পঞ্চদশ বৎসর বয়স্ক যুবককে ছড়ি-লাঠি হাতে দেখা যাবে না। নবীনকুমার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সব ব্যবস্থা। রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে দেশের নাম করা ব্যক্তিরা প্ৰায় সবাই এসেছেন। নবীনকুমার খুঁজতে লাগলো। একজনকে। তিনি আসেননি। তিনি নবনীকুমারের গুরু ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতরা প্রায় সকলেই উপস্থিত, তাঁরা রানী রাসমণির অর্থ বস্ত্ৰ দান গ্ৰহণ করেছেন, শুধু অনুপস্থিত তাঁদের অধ্যক্ষ। নবীনকুমার ভাবলো, তিনি আসেননি কেন? তিনি কোনো জায়গা থেকে দান গ্ৰহণ করেন না বলে? কিংবা ঈশ্বরচন্দ্ৰকে বোধ হয় অনেকে আজকাল ব্ৰাহ্মণ বলেই মনে করে না। তিনি নাকি সন্ধ্যা-আহ্নিক করেন না, কোনো ঠাকুর-দেবতার পূজা করতেও কেউ কখনো দেখেনি তাঁকে। এ কী ধরনের ব্ৰাহ্মণ? তা ছাড়া তিনি এখন বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মহা ব্যস্ত। এত বড় নবরত্ন মন্দির, নাটমহল ও সার সার শিবমন্দির এবং এত জাঁকজমক দেখে নবীনকুমার প্রথমটায় বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র আসেননিদেখে নবীনকুমারেরও খানিকটা ভক্তি কমে গেল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও দেখতে পেল না। নবীনকুমার। ব্ৰাহ্মরা সদলবলে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। ইয়ংবেঙ্গলের দলও যে আসবে না, তা যেন জানাই ছিল, তবু তাদের দু-একজনকে সেখানে দেখে নবীনকুমার চমৎকৃত হলো। সাহেবীভাবাপন্ন ইয়ংবেঙ্গল দলেরও কয়েকজনের মধ্যে ভক্তিভাব দেখা দিচ্ছে তা হলে! সন্ধ্যা হতে না হতেই জ্বলে উঠলো রোশনাই। উৎসব এখনো অনেক রাত পর্যন্ত চলবে। নবীনকুমারের আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিল। গঙ্গাতীরের এই স্থানটি বড় মনোরম। লোকের ভিড় থেকে সরে গিয়ে যেখানে গাছপালার ঝোঁপজঙ্গল, সেখানে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল তার। কিন্তু বিম্ববতী উতলা হয়ে পড়েছেন, তিনি বারবার দাসী মারফৎ খবর পাঠাচ্ছেন নবনীকুমারের কাছে। বিম্ববতীর হাত ধরে নবীনকুমার নিয়ে এলো ঘাটের কাছে। বজরায় উঠতে গিয়ে হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়লো। এতগুলি মন্দিরের কোনো বিগ্ৰহকেই সে প্ৰণাম জানায়নি। একবার তার ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে প্ৰণাম করে আসে। তারপর আবার ভাবলো, থাক। দূর থেকে প্ৰণাম জানালেও তো হয়। সে তখনও তার জননীর হাত ধরে থমকে আছে। বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? নবীনকুমার বললো, কিছু না। তারপর সে বজরায় উঠে পড়লো। এবং দূর থেকেও প্ৰণাম জানালো না। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে রানী রাসমণির দাক্ষিণ্য, মহানুভবতা এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাকে ধন্য ধন্য করা হলো দেশীয় সংবাদপত্রগুলিতে। শুধু ব্ৰাহ্মরা নীরব রইলো। পৌত্তলিকতা নিয়ে নতুন ভাবে এই আড়ম্বর তারা সুনজরে দেখলো না। ব্ৰাহ্মদের নিজেদের মধ্যেও খানিকটা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর দ্বাদশ বৎসরের একটি যুগ পার হয়েছে। এবার দেখা দিয়েছে একটি সংকট! দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন নিষ্কলুষ ধর্ম সাধনা এবং পরম ব্ৰহ্মের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে। এবং পৌত্তলিকতা ও নানারকম কুসংস্কার বর্জন করে হিন্দু ধর্মেরই একটি পরিশুদ্ধ রূপ দিতে। কিন্তু ইদানীং তাঁর সন্দেহ হচ্ছে যে কতকগুলান নাস্তিক তাঁর এই সভার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকদের অশ্রদ্ধা করেন, খৃষ্টানদের অপছন্দ করেন এবং নাস্তিকদের মনে করেন অমানুষ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করেন দেবেন্দ্রনাথ, কিন্তু সেই পত্রিকায় বর্তমানে অধ্যাত্মতত্ত্বের বদলে শুষ্ক জ্ঞানচৰ্চারই বেশী পরিচয় দেখা যাচ্ছে। সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের ঝোঁক যেন ঐ দিকেই। আর একজন রচনা-পরীক্ষক ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, তিনি তো কোনো ধর্ম-আলোচনার মধ্যেই থাকেন না। অক্ষয়কুমার আবার একটা রচনা লিখেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার। রচনাটি দেখে বিরক্ত হয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি খুঁজছেন ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ, আর এরা মাথা ঘামাচ্ছে
false
shottojit_roy
বাক্স দেখেছি। কাঠ, হাতির দাঁত আর অ্যােলাব্যাস্টারের তৈরি। বাক্সগুলোর বাইরে সবঙ্গে অপূর্ব কারুকার্য। এগুলোও দেখলাম সেরকমই ব্যাপার। কিন্তু এ ছাড়াও কিছু জিনিস দেখা যাচ্ছে যেগুলো তুতানখামেনের সমাধিতে দেখা যায়নি। সেগুলো বেশির ভাগই কাঠ বা হাড়ের তৈরি। ক্রোল বলল, আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা কোনও সম্রাটের সমাধি দেখছি না। নেফুদেৎ ছিলেন পুরোহিত ও জাদুকর। জাদুসংক্রান্ত অনেক কিছু জিনিসই এখানে পাবার কথা। আমাদের দৃষ্টি গিয়েছিল একটা বড় বাক্সের দিকে, অ্যােলাব্যাস্টারের তৈরি। ব্যানিস্টার বলল, এবার এটাকে খুলব, কিন্তু কাজটা অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে করতে হবে। দেখতেই পােচ্ছ, বাক্সটার চারপাশে হাতে আকা ছবি রয়েছে। তাড়াহুড়ো করলে সেগুলোর রং খসে আসতে পারে। এইবার ব্যানিস্টারের ধৈর্যের নমুনা দেখলাম। ছেলেটিকে যত দেখছি ততই ভাল লাগছে। আধা ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করে একটিও নকশা স্থানচ্যুত না করে সে বাক্সের ডালাটা খুলল। তারপর তারমধ্যে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেটা নানারকম গয়না, ভাঁজ করা কাপড়, ছোট মূর্তি ইত্যাদি জিনিসে ভর্তি। টর্চের আলোয় একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাক হলাম। বাক্সের ভিতরে কী একটা জিনিস যেন অস্বাভাবিক রকম ঝলমল করছে। সেটা সোনা নয়; সেটা যে একটা পাথর তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সেটা একটা গয়নার মধ্যে বসানো। আমি ব্যানিস্টারকে প্রশ্ন করলাম, ঝলমলে জিনিসটা কী বুঝতে পারছ? ব্যানিস্টার বলল, মিশরে প্রাচীনকালে গয়নায় সোনার সঙ্গে যে সব পাথর ব্যবহার হত সেগুলো সেমি প্রেশাস স্টোনস। অর্থাৎ সেগুলো মহামূল্য রত্ন নয়। কারনেলিয়ান, অ্যামেথিস্ট, অবসিডিয়ান—এইসব জাতীয় পাথর। তার থেকে তো এত দ্যুতি বেরোয় না। তা হলে? একটু ধৈর্য ধরতে হবে, বলল ব্যানিস্টার। তোমরা বরং বাইরে অপেক্ষা করো। আমি এই বাক্সের জিনিসগুলো একে একে বার করি। আর, ভাল কথা, এই পাথর সম্বন্ধে যেন বাইরের কেউ না জানে। বিশেষ করে সাংবাদিকরা। আমরা দুজনে বাইরে চলে এলাম। লাঞ্চের সময় হয়েছিল, কাজেই সে কাজটাও সেরে নেওয়া হল। সাংবাদিকরা আমাদের কাছ থেকে খবর বার করার বহু চেষ্টা করেছিল, আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। ব্যানিস্টার না বলা পর্যন্ত আমরা কোনও কথা ফাঁস করছি না। আজ মনে হয়। আর কোনও ঘটনা ঘটবে না, কারণ কাস্কেটের জিনিস বার করতে ব্যানিস্টারের সময় লাগবে। এই সাবধানতার ব্যাপারটা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। শুকনো বালির দেশ বলেই এসব জিনিস এখনও রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও হলে এতদিনে সব ধুলো হয়ে যেত। মিশরসরকার থেকে ডাঃ আবদুল সিদ্দিকি বলে এক প্রত্নতাত্ত্বিকও আজ থেকে ব্যানিস্টারকে সাহায্য করছেন। লর্ড ক্যাভেনডিশ এখনও ইংলন্ডে; তবে উনি বলেছেন খবর দিলেই চলে আসবেন। ডিসেম্বর ১৬ এর চেয়ে আশ্চর্য খবর আর হতে পারে না। কাল যে জিনিসটাকে কাস্কেটের মধ্যে চকচক করতে দেখেছিলাম, সেটা হল হিরে। হ্যাঁ, হিরে-যার সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক ছিল না। কোনওদিন। ঈজিপ্টে হিরে পাওয়া আর আফ্রিকার জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া একই জিনিস। ইতিহাসের গোড়ার দিকে হিরে ছিল ভারতবর্ষের একচেটিয়া সম্পত্তি। বহুকাল থেকে ভারতবর্ষে হিরের খনিতে কাজ হয়ে আসছে। পশ্চিমে তখন যে হিরে গেছে, সবই ভারতবর্ষ থেকে। বহু পরে, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে হিরে আবিষ্কার হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে। আজকাল ভারতবর্ষে হিরের উৎপাদন কমে গেলেও কোহিনূর থেকে আরম্ভ করে যে সব বিখ্যাত হিরের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, তার অধিকাংশেরই উৎপত্তি স্থান ভারতবর্ষ। কিন্তু ঈজিপ্টে হিরে! এ যে তাক লাগানো ব্যাপার! কাস্কেটের গয়নার মধ্যে যে হিরে পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই মটরদানার সাইজের, দু একটা একটু বড়। সেগুলো সবই প্ৰায় সোনার মধ্যে বসানো। ল্যাবরেটরিতে এই হিরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। এতে কোনও খুঁত নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হিরের সঙ্গে এর তুলনা চলে। কঠিন্যে আর ঔজ্জল্যে এ হিরে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। বলা বাহুল্য খবরটা দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মিশরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে এমন তাজব ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। কোথেকে এ হিরে এল, কী করে এল, সেটা কেউই অনুমান করতে পারছে না। ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথাও উঠেছে, কিন্তু সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে সোনা ছিল, এমন কোনও নজির ইতিহাসে নেই। লর্ড ক্যাভেনডিশ খবর পাওয়ামাত্ৰ কায়রোতে চলে এসেছেন। আজ আমাদের সঙ্গে আলাপ হল। বছর পঞ্চাশ বয়সের সুপুরুষ ভদ্রলোক, এখন মহা ফুর্তিতে আছেন। এসেই আজ রাত্রেই একটা বড় পার্টি দিলেন কানাক হোটেলে এই যুগান্তকারী ঘটনা সেলিব্রেট করার জন্য। মিশরে এখন টুরিস্ট সিজন, তাই লোক হয়েছিল অনেক। এখন পর্যন্ত হিরে সমেত সাতটা গলার হার আর তিন জোড়া কানের গয়না পাওয়া গেছে। আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। এখনও আসল সমাধি কক্ষ—যাতে নেফ্রুদেৎ-এর মমি থাকার কথা—সেটাই খোলা হয়নি। আমি পাটিতে ব্যানিস্টারের সঙ্গে এই ঘটনা নিয়ে কথা বললাম। সে একেবারে হতভম্ব। এই হিরে আবিষ্কারের ফলে মিশর সম্পর্কে এমন একটা নতুন দিক খুলে গেছে, যেটা সম্পর্কে আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। অথচ ব্যাপারটা রহস্যময়। ব্যানিস্টার বলল, ঈজিপ্টের সঙ্গে কার্বনের কোনও সম্পর্ক ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। কয়লা এদেশে কোনওদিন ছিল না। অথচ হিরের মূলে হল কার্বন। আমি এর কোনও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। আগামী কাল একটা নতুন ঘর খোলা হবে। আশা করছি এটাই হবে প্রধান সমাধিকক্ষ—এবং নেফুদেৎ-এর কফিনও এখানেই পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে হিরের খবরটা অবিশ্যি পৃথিবীর সব কাগজেরই প্রথম পাতায় বেরিয়ে গেছে। খোঁড়ার জায়গায় ভিজিটরের সংখ্যাও ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। তবে হিরে পাওয়ার পর থেকেই মিশর সরকার খোঁড়ার জায়গায় পুলিশের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে
false
shomresh
অনি অনুমান করতে পারে। আজ অবশ্য সেরকম কোনো সমস্যা তার নেই। ছুটির পর বাড়ি এসে বেরুতে যাবে এমন সময় শচীন আর তপন এসে হাজি হল। শচীন ওদের ক্লাসের গোলগাল-মার্কা ভালো ছেলে, ওর বাবার দুটো চা-বাগানে শোয়ার আছে। শচীন তপনকে নিয়ে এসেছে অনিকে নেমন্তন্ন করতে। স্কুলে বললে হবে বলে বাড়ি বয়ে এসেছে, তার দিদির বিয়ে। ভেতরের বারান্দায় চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে ওদের বসিয়ে অনি পিসিমাকে ডেকে আনল। দাদু বাড়িতে নেই, নিশ্চয়ই কিং সাহেবের ঘাটে গিয়েছেন। অনির বন্ধুরা খুব কমই বাড়িতে আসে, পিসিমা তড়িঘড়ি দেখতে এলেন। আজকাল পিসিমা বাড়িতে শেমিজ পরেন না, কেমন যেন হয়ে গেছেন। কিছুতেই খেয়াল থাকে না। হেমলতা দেখে অনির বন্ধুরা উঠে দাঁড়াল। ফুটফুটে দুটো ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেমলতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বসো বসো, দাঁড়াতে হবে না, তোমরা তো সব অনির বন্ধু? তা আমাদের বাড়িতে আস না কেন? কী নাম তোমাদের। অনির খুব মজা লাগছিল, পিসিমা যখন কথা বলেন তখন যেন থামতে চান না। ওর বন্ধুরা বেশ হকচকিয়ে গেছে, কোন উত্তরটা দেবে বুঝতে পারছে না। অনি বলল, পিসিমা, এ হচ্ছে তপন, খুব ভালো গান গায়, আর ও- অনিকে থামিয়ে হেমলতা বললেন, তপন কী? তপন এবার চটপট বলল, মিত্র। বলে এগিয়ে এসে হেমলতাকে প্রণাম করল। হেমলতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। মিত্তির হল কুলীন কায়েত। অনি বলল, আর এ হচ্ছে আমাদের ক্লাসের গুড বয়। ওর দিদির বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে এসেছে। হেমলতা বললেন, কী নাম তোমার বাবা? আমার নাম শচীন রায়। শচীন এগিয়ে গেল প্রণাম করতে। কিন্তু বেচারা নিচ হতে-না-হতেই হেমলতা ধড়মড় করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেনত না না, থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না। শচীন তো বটেই, অনিও খুব অবাক হয়ে গেল পিসিমার এরকম ব্যবহারে। একটু সামলে নিয়ে বললেন, বামুনের ছেলে তুমি। কথা শেষ করার আগেই অবাক-গলায় শচীন বলল, না না, আমরা বৈদ্য। হেমলতা তা-ই শুনে দোনোমনা হয়ে বললেন, একই হল। বন্দিরা তো একধরনের বামুন তোমরা সব বসে গল্প করো। হেমলতা আর দাঁড়ালেন না। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে-যেতে আর-একবার ওদের দেখে গেলেন। শচীন বলল, তোর পিসিমা খুব সেকেলে, না রে? অনি বলল, কই, না তো! তপন বলল, যাঃ, আমি প্রণাম করলাম কিছু হল না! ও প্রণাম করতেই বামুন-টামুন বের করে ফেললেন! শচীন বলল, মিত্ররা তো কায়েত সবাই জানে। আগেকার লোকেরা বামুনদের শুধু সম্মান দিত। তোর পিসিমার কথা বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে। তপন গম্ভীর গলায় বলল, স্বাধীনতা এলেও আমরা যে কত পরাধীন তা তোর পিসিমাকে দেখলে বোঝা যায় অনি। এসব কথা শুনতে অনির একদম ভালো লাগছিল না। পিসিমা এমন কাণ্ড করবেন ও ভাবতে পারেনি। বদ্যি না বামুন না-জেনেই প্রণাম নিলেন না, বন্ধুদের কাছে ওই খবরটা ওরা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে দেবে। খুব খারাপ লাগছিল ওর। এমন সময় রান্নাঘর থেকে হেমলতা চাপা গলায় তাকে ডাকলেন। হেমলতা এইভাবে তাকে ডাকেন না, অন্য সময় তার চিৎকার শুনে সরিৎশেখর অবধি বিরক্ত হয়ে ধমক দেন, কী কাকের মতো চাচা চটপট হেমলতা জবাব দিতেন, কী করব, জন্মাবার সময় তো কেউ মধু দেননি। তা এখনও এই ওকে ডাকছেন, ওকে মোটেই কর্কশ মনে হচ্ছে না। অনি উঠে রান্নাঘরে এল। হেমলতা প্লেট সাজিয়ে বসে ছিলেন। তিলের নাড়, নারকেলের নাড় আর মোটা পাকা কলা। হেমলতা বললেন, যারে, ও আবার এসব খাবে-টাবে তো! নাহলে বল দুটো লুচি ভেজে দিই। অনি বলল, কে খাবে না, কার কথা বলছ? হেমলতা বললেন, ঐ যে, ফরসামতন— অনি বলল, দুজনেই তো ফরসা। তপন? হেমলতা দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, না না, যে প্রণাম করতে আসছিল–। ও, শচীনের কথা বলছ? তুমি কিন্তু ওকে প্রণাম না করতে দিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমার বন্ধুরা শুনলে খ্যাপাবে। অনি সোজাসুজি বলে ফেলল। হেমলতা বলে উঠলেন, না বাবা, প্রণাম করতে হবে না। তা ও কি খাবে এসব? খাবে না কেন? অনি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটাতে বেশি দিয়েছ কেন অত। হেমলতা হাসলেন, বেশি কোথায়? ওটা ওকে দিবি। অনি বলল, কেন দুজনকেই সমান দাও। তপন কী দোষ করল? একেই প্রণাম নেবার সময় অমন করলে, খাবার সময় যদি তপনকে কম দাও তো ও ছেড়ে কথা বলবে? হেমলতা যেন অনিচ্ছায় দুটো প্লেটের খাবার সমান করতে চেষ্টা করলেন, হারে ছেলেটা খুব শান্ত, না রে? কোন ছেলেটা? অনির হঠাৎ মনে হল পিসিমাকে অন্যরকম লাগছে। এমন ভঙ্গিতে পিসিমাকে কথা বলতে ও কোনোদিন দেখেনি। ওই যে, বদ্যিব্রাহ্মণ-। ওঃ, অনি প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, তুমি বারবার.ওই যে ওই যে করছ কেন? শচীন নামটা বলতে পারছ না? হেমলতা কিছু বললেন না। অনি খাবার নিয়ে চলে গেলে একা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কোনো ছবি নেই, মুখ মনে নেই, এই শরীরে কোনো চিহ্ন সে একে যেতে পারেনি, কারণ শরীরটা তখন তৈরি হয়নি। সে শুধু বেঁচে আছে হেমলতার কাছে একটা নাম হয়ে, বুকের মধ্যে একটা নামজপের মন্ত্রের মতো অবিরত ঘুরেফিরে আসে। সে-মানুষতে তিনি মনে করতে পারেন না, শুনেছেন বড় সুন্দর ছিল লোকটা, খুব ফরসা। তারপর এতদিন ধরে নামটাকে সম্বল করে কল্পনায় চেহারাটাকে তৈরি করে নিজের সঙ্গে খেলে-খেলে যাওয়া। আজ এতদিন বাদে সেই নামের একটি মানুষকে তিনি প্রথম
false
shomresh
এরা সবাই এই বাড়ির বিভিন্ন কাজে আছে। মনুভাই কাউকে চাচা, কাউকে খালা বলে ডেকে কাজের কথা বলতে লাগলেন। তারপর ইউসুফভাই এবং অর্জুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বনি, আজ কী খাওয়াবেন? ওঁদের মধ্যে যিনি বৃদ্ধ তিনি বললেন, ছার, মেহমান আইছেন, তাঁদের সম্মান তো রাখতেই হইব। গ্রামের মানুষের যা ক্ষমতা তাই দিয়াই মেহমানদের সেবা করব। মনুভাই বললেন, অৰ্জুনবাবু, এ হচ্ছে ইদ্রিস, আমার ঠাকুদার আমলের মানুষ। ছেলেবেলায় ওর কোলে-পিঠে চড়েছি কত। আর এ হল দুর্গাদাস। বাবার সবসময়ের সঙ্গী ছিল। দুগার্দাস খুবই বৃদ্ধ, কিন্তু এখনও তার শরীর সোজা। নমস্কার করে বলল, পুরা নাম দুর্গাদাস কৈবর্ত। কতা আমারে ভালবাসতেন। যৌবনে ডাকাতি করতাম। এই বাড়ির পেছনে যে বিল, তার সব পানি আমার কথা শুনত। একদিন ধরা পড়লাম, জেল হল। কতা আমাকে এই বাড়িতে কাজ দিয়া বললেন, দুর্গা, এবারে আমারে বাঁচা। চারপাশে অনেক শত্রু। কে কাকে বাঁচায়। তিরিশ বছর তাঁর ছায়ার পাশে কোনও দুশমনরে আসতে দিই নাই, কিন্তু ভগবান যেদিন কর্তারে ডাক দিলেন সেদিন আমার মতো মানুষ.. দুর্গাদাস চোখের জল মুছল। এদের ভাল লাগছিল অর্জুনের। প্রচুর গাছগাছালি চারপাশে, বাড়ির ভেতর পুকুর। ওরা বাড়ির পেছনে যেতেই অর্জুন অবাক। আকাশের শেষ দেখা যাচ্ছে না, শুধু জল আর জল। মনুভাই বললেন, এই হচ্ছে কালীর বিল। এর কথাই দুর্গাদাস আপনাকে বলছিল। আগে এই বিল পেরিয়েই আমাদের যাতায়াত করতে হত। ওই যে আকাশছোঁয়া বটগাছ দেখছেন, দূর থেকে ওটাকে দেখেই নৌকোর মাঝিরা দিক ঠিক করত। বিলের ধারে গাছের তলায় টেবিল, চেয়ার পেতে দেওয়া হল। অর্জুন, ইউসুফভাই সেখানে বসতেই মনুভাই কাজকর্মের কথা বলতে গেলেন। এখানে তাঁরা নতুন করে মাছচাষের প্রকল্প নিয়েছেন। ইদ্রিস এবং দুর্গাদাস ডাব নিয়ে এল প্রথমে। সেই ডাবের জল গাছের ছায়ায় বসে খোলা জলের দিকে তাকিয়ে খেতে-খেতে অর্জুনের মনে হল এর চেয়ে আরাম সে কখনও পায়নি। ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মিঞা, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভাব কীরমকম? ইদ্রিস বলল, জবাব দাও হে দুর্গাদাস। দুর্গাদাস বলল, ওই যে দেখতেছেন বাড়িঘর, ওখানে মোছলমানের বাস আর তার এদিকের বাড়িগুলান হিন্দুদের। বাপ-ঠাকুদার মুখেও ধর্ম নিয়ে কাউরে কাজিয়া করতে শুনি নাই। ওসব জিনিস শহরে হইলেও হইতে পারে, কালীগঞ্জে হয় নাই, হইব না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে হিন্দু কত আছেন? অনেক। তবে বেশিরভাগই গরিব। থাকার মধ্যে আছেন ঘোমশাইরা। তবে তাঁদেরও অনেকে শহরে গিয়া আছে। এখন শেষদশা। ইদ্রিস জবাবটা দিল। ঘোষমশাইরা কি একসময় বড়লোক ছিলেন? হ্যাঁ ছার। বাপের মুখে শুনছি সেসব বৃত্তান্ত। এখন কিছু নাই। শহরে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা আর আসেন না? না বললেই হয়। আকাশবাবু মাঝে-মধ্যে আসেন। আকাশ। ইউসুফভাই মাথা নাড়লেন, সম্ভবত এ.বি.। অর্জুনের মুখে হাসি ফুটল। তা হলে এ.বি.র পুরো নাম আকাশবিহারী। গতকাল ইন্ডিয়ার এক মেহমান আসছেন ওই বাড়িতে। ইন্ডিয়া থেকে প্রায়ই লোক আসে বুঝি? না ছার। সেই বড় ঘোষবাবুর দেহ রাখার পর আসছিল, তারপর তো কাউরে দেখি নাই। ওঁদের বাড়িটা কত দুরে? কাছেই। দুর্গাদাস ঘুরে দাঁড়াল, ওই যে শিমুলগাছটা দেখতেছেন, ওইখানে। এই সময় মনুভাই ফিরে এলেন, কীরকম লাগছে আমাদের গ্রাম! দারুণ। বাংলাদেশে এসে যদি ঢাকা থেকেই ফিরে যেতাম, তা হলে কিছুই দেখা হত না। এত সুন্দর জায়গা, ইচ্ছে হচ্ছে কটা দিন থেকে যাই। অর্জুন বলল। থাকুন। কোনও সমস্যা নেই। এরা আপনার দেখাশোনা করবে। ঘরগুলো তো সব খালি পড়ে আছে। মনুভাই হাসলেন, কিন্তু আমাকে আজই ফিরে যেতে হবে। ইউসুফভাই, আপনিও থাকবেন নাকি? আমি তো বাড়িতে বলে আসিনি কিছু। সেটা আমি জানিয়ে দিতে পারি। তা হলে একটা দিন থাকা যায়। ভাত এবং মাছের ঝোল খেয়ে মনুভাই প্রায়-বিকেলে গাড়ি নিয়ে ফিরে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন যখনই অর্জুনদের ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে হবে, কালীগঞ্জের পোস্ট অফিস থেকে টেলিফোন করে দিলে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ড্রাইভার এখানে গাড়ি নিয়ে আসবে। ধুলো উড়িয়ে ওঁর গাড়ি মিলিয়ে গেলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ইউসুফভাই, আমার জন্য নিশ্চয়ই আপনার কাজকর্মের ক্ষতি হবে? সেটা সামলে নিতে পারব। কিন্তু ভাই, জীবনে কোনও রহস্য সন্ধানে শামিল হইনি। সুযোগ যখন পাওয়া গেল তখন হাতছাড়া করি কেন? একবার যাবেন নাকি ঘোষবাড়িতে? ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন। অর্জুন মাথা নাড়ল, এখনই নয়। আপনি নিশ্চয়ই দুর্গাদাসের কথাটা শুনেছেন। ওই বাড়িতে গতকাল একজন অতিথি এসেছেন ইন্ডিয়া থেকে। হ্যাঁ, শুনেছি। আমার ধারণা, এই অতিথিটিই বেদেদের মুক্তো চুরি করেছেন। কাজলবাবু? তা কী করে হবে? উনি তো ঘোষ নন। মুখার্জি। কিন্তু দূর দেশে এসে ঘোষ সাজতে অসুবিধে কোথায়? অবশ্য এসবই আমার অনুমান। হয়তো কাজল নয়। অন্য লোক এসেছেন। কিন্তু কাজল যদি হয়, তা হলে বলব সাহস আছে ওর। চলুন, গ্রামটা ঘুরে দেখি। বিকেলে হাঁটতে খারাপ লাগবে না। অর্জুন বলল। ইউসুফভাই হাত নেড়ে দূরে দাঁড়ানো ইদ্রিসকে ডাকলেন, আমরা একটু আপনাদের গ্রাম ঘুরে দেখতে যাচ্ছি। ইদ্রিস বলল, চলেন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই। কালীগঞ্জের রাস্তায় এখনও পিচ পড়েনি। অবশ্য যে প্রধান পথে বাস চলাচল করে, সেটি পিচের। আজকাল এখানে ঢাকার বাস সরাসরি আসে। ইদ্রিস সঙ্গে থাকায় সুবিধে হচ্ছিল। বিভিন্ন বাড়ি, গাছ, মাঠ দেখিয়ে সে একটার পর একটা কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছিল। একটা বিরাট ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ দেখিয়ে ইদ্রিস বলল, এখানে ঘোষবাবুদের এক ছেলে গলায় রশি দিছিল। ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, কত বছর আগে? তা ধরেন, যে বছর পাকিস্তান হইল সেই বছর। অর্জুন হেসে ফেলল। ছেচল্লিশ বছর ধরে
false
shomresh
ছোটাছুটি করছে, মাঝখানের বিরাট বাঁধানো চত্বরটা চমৎকার শান্ত হয়ে রয়েছে। এই সময় বব বলল, আরে দ্যাখো কাণ্ড, কার্ল সিংহের সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করছে। হেই কার্ল, ওটা করতে যাচ্ছ কেন? পড়ে গেলে দেখতে হবে না? আমি দেখলাম একজন প্রবীণ সাহেব অনেকটা উচুতে সিংজ্ঞে পায়ের কাছে পোঁছে ডাক শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হাসলেন। বব আরও কয়েকবার চেঁচামেচি করায় ভদ্রলোক হাত ছেড়ে দিয়ে কোনওমতে শরীর বাঁচিয়ে নীচে নেমে এলেন। বব বলল, যাক, আমার কথা শুনেছ বলে ধন্যবাদ। কার্ল বললেন, না হে! এই ভদ্রলোককে দেখে নেমে এলাম। আপনার গবেষণার বিষয় আমাকে উৎসাহিত করেছে। আমিও শব্দ নিয়ে সামান্য কাজকর্ম করছি। আমার নাম কার্ল বেকার। পরিচয় হল। ভদ্রলোক থাকেন হামবুর্গে। নিজের গবেষণার ব্যাপারে কিছুই না বলে আমার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। এটাকে বিনয় বলে মনে হয়েছে আমার। আমার যে যন্ত্রটা শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা করছে না, সেটার ব্যাপারে তিনি কৌতূহল দেখালেন। এই সময় বব আমাকে চোখ টিপে সতর্ক করল। আমি বুঝলাম নিজের সব গোপন তথ্য জানাতে সে নিষেধ করছে। আমি ভাসা-ভাসা বললাম। এভাবে বলতে আমার খারাপ লাগছিল। ফিরে আসার তিন সপ্তাহ পরে কালের চিঠি পেলাম। আমার সঙ্গে আলাপ করে, তিনি রীতিমতো উত্তেজিত। আমার যন্ত্রটার ব্যাপারে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেই আমার হাসি পায়। বব ইশারা করায় আমি আমার যন্ত্রটার বিপরীত চিত্র কার্লের কাছে তুলে ধরেছিলাম। কার্ল লিখেছেন সেই কল্পিত বিপরীত যন্ত্র নিয়ে তাঁর মন্তব্য। অনেক সময় ছেলেবেলায় অঙ্ক কষতে গিয়ে আটকে গেলে উলটো দিক থেকে করতে করতে সেটা বুঝে ফেলতাম। খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। এবার হল। কালের একটা উপদেশ কাজে লাগিয়ে আমার যন্ত্রটাকে দারুণ শক্তিশালী করলাম। লন্ডনের সম্মেলনে গিয়ে এই বিরাট উপকার হল। তারপর কার্ল দুটো চিঠি লিখেছেন। শেষ চিঠি এসেছে মাসতিনেক আগে। তাঁকে জানিয়েছিলাম আমি তেমন এগোতে পারিনি। একথাটা সত্যি নয়। কিন্তু বব আমাকে অনুরোধ করেছে যতক্ষণ না আমি সম্পূর্ণ কৃতকার্য হচ্ছি ততক্ষণ ব্যাপারটা গোপন রাখাই মঙ্গল। এই চিন্তাটা ববই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। বিজ্ঞান যেমন মানুষের উপকার করে, ঠিক তেমনই অপকার করতেও তার জুড়ি নেই। কোনও শক্তিমান দেশ যদি সংগৃহীত শব্দ যুদ্ধে ব্যবহার করে তা হলে ব্যাপারটা ভাবলেই শরীর হিম হয়ে যায়। আজকের দিনটাই বেকার চলে গেল। আমার বয়স হয়েছে। এই সময় একটা দিন যদি নষ্ট হয়, তা হলে খুব ক্ষতি। বাঙালিদের তুলনায় আমি খুব লম্বা। ছফুট এক ইঞ্চি লম্বা মানুষেরা দীর্ঘজীবী হয় না। তা ছাড়া আমি বেশ মোটা। খেতে খুব ভালবাসি। এখন তো গঙ্গাপদ চমৎকার রাঁধছে। যখন একা ছিলাম তখন রোজ ঘি দিয়ে ভাত মেখে আলু সেদ্ধ করে কাঁচালঙ্কা আর সরষের তেলে চটকে খেতাম। পৃথিবীর যে-কোনও উপাদেয় খাবারের চেয়ে এই মেনু আমার কাছে হাজার গুণ আকর্ষক। গঙ্গাপদকে বলে দেওয়ায় আর যা কিছু হোক এটা রাখছে। মোটা মানুষেরা বেশিদিন বাঁচে না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী একশো বছরে পা রেখেছেন। ওঁর শরীর খাটো এবং রোগা। আমার পিতৃদেব গিয়েছিলেন পঞ্চান্নতে, আমি তবু পনেরো বছর বেশি টানছি। অবশ্য আমার কোনও রোগবালাই নেই, এই রক্ষে। সন্ধের মুখে অবনীমোহন এলেন। সময় পেলেই তিনি আসেন। জানবার কৌতূহল তাঁর খুব। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বেশ আরাম পাই। অবনীমোহন লোক্যাল থানার ওসি। বাইশ বছর পুলিশে চাকরি করেও চমৎকার ভদ্রলোক হয়ে আছেন। ইদানীং পুলিশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ বদলেছে। লালবাজারে অনেক আই পি এস অফিসার আছেন, যাঁরা ইচ্ছে করলে অধ্যাপনা করতে পারেন, রবীন্দ্রনাথের গান গীতবিতান না দেখে গাইতে পারেন, কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ আছে। অবনীমোহন অবশ্য আই পি এস নন তবু রীতিমতো ভদ্রলোক। সামনের চেয়ারে বসে অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার গঙ্গাপদ কীরকম কাজকর্ম করছে? বললাম, চমৎকার। বাঃ। ওকে আমাদের হাতে তুলে না দিয়ে আপনি একটি সামাজিক উপকার করেছেন। আমরা ওকে কয়েক মাসের জন্যে জেলে পুরতাম, ফিরে এসে আবার চুরিচামারি করত। লোকটা যদি চিরদিনের মতো শুধরে যায় তার চেয়ে ভাল আর কী আছে। বুঝলাম। তা তুমি এই বাদলার দিনে উদয় হলে কোত্থেকে? আর বাদলের দিন! এতকাল মানুষ-চোর ধরতাম, এখন জন্তু-চোর ধরতে হবে। কীরকম? প্রায়ই খবর আসছে, একটা বানর জাতীয় প্রাণী, সেটা হনুমান অথবা ওরাং ওটাংও হতে পারে, প্রায়ই কারও-কারও কিছু চুরি করছে। দোকান থেকে জিনিস তুলে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এ-পাড়ায় গাছগাছালি বেশি। এত দ্রুত সেটা লুকিয়ে পড়ে, কেউ তার হদিস পায় না। কোত্থেকে এল? কেউ বলতে পারছে না। আমি তাকে চোখে দেখিনি। কিন্তু বুনো জন্তুজানোয়ার তো চুরিবিদ্যায় এত দক্ষ হতে পারে না। অবনী। ঠিকই বলেছেন। কোনও মতলববাজ লোক ওকে ট্রেনিং দিয়েছে। আজ দোকান থেকে জিনিস তুলছে, কাল ব্যাঙ্কের টাকা ছিনতাই করবে না তা কে বলতে পারে। আমি বিকেল থেকে এই এলাকায় পাক খাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, সন্ধের মধ্যে ব্যাটা নিশ্চয়ই তার মালিকের কাছে ফিরে যাবে। ফিরে যেতে হলে ওকে দেখা দিতেই হবে। গাছপালার আড়াল তখন সে পাবে না। কিন্তু রাত নামল, তবু সে বেপাত্তা! আমি হাসলাম। ব্যাপারটা ভাবতে মজা লাগছিল। বানর অথবা হনুমানের বুদ্ধি খুবই সীমায়িত। একমাত্র ওরাং ওটাংই মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধি ধরতে পারে। অবনীমোহন চলে গেলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। টিভি বলছে আগামীকাল মেঘমুক্ত আকাশ পাওয়া যাবে। তাই ভোর চারটের মধ্যেই ঘুম থেকে উঠতে হবে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে গঙ্গাপদ বলল, বাবু, আপনি যদি অনুমতি দেন,
false
shottojit_roy
আমাদের মুখের দিকে চাইতে পারলেন না। বেণীনন্দন স্ট্রিটের সুহৃদ সেনগুপ্তের চাকর একটা ঢাউস বই এনে ফেলুদাকে দিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনের শতবার্ষিকী সংখ্যা। সেটা ফেলুদা সারা রাস্তা কেন যে এত মন দিয়ে দেখল, আর দেখতে দেখতে কেন যে বার তিনেক বোঝে ব্যাপারখানা বলল সেটা বুঝতে পারলাম না। বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে ঢুকে ফেলুদা দশ মিনিটের মধ্যে একটা বড় লাল খাম নিয়ে বেরিয়ে এল। দেখেই বোঝা যায় তার মধ্যে বড় সাইজের ফোটা রয়েছে। কীসের ছবি আনলেন মশাই? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু। মিউটিনি, বলল ফেলুদা। আমি আর লালমোহনবাবু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ফেলুদার কথার মানে ছবিগুলো নর্ট ফর দ্য পাবলিক। গোরস্থানে আর আপনাদের ভেতরে টানব না; আমি শুধু দেখে আসি সব ঠিক আছে কি না। আমরা গাড়িটা ঘুরিয়ে গোরস্থানের ঠিক সামনেই পার্ক করলাম। ফেলুদা যখন গেট দিয়ে ঢুকাল, তখন দেখলাম দারোয়ান বরমদেও বেশ একটা বড় রকমের সেলাম ঠুকল! দশ মিনিটের মধ্যে ফেলুদা ফিরে এসে ওকে বলে গাড়িতে উঠল। ঠিক হল রাত সাড়ে দশটায় আমরা আবার এখানে ফিরে আসছি। আমার মন বলছে আমরা নাটকের শেষ অঙ্কের দিকে এগিয়ে চলেছি। ফেলুদার সঙ্গে এতবার এত জায়গায় ঘুরেছি। রহস্যের পিছনে পিছনে-সিকিম, লখনী, রাজস্থান, সিমলা, বেনারস-কেনিওখানেই অ্যাডভেঞ্চারে কমতি পড়েনি; কিন্তু এই কলকাতাতে বসেই এমন একটা রক্ত-হিমা-করা রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়তে হবে এটা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। বিশেষ করে আজকের দিনটা, লালমোহনবাবু যেটার নাম দিয়েছিলেন ব্ল্যাক-লেটার ডেযদিও সেটাকে আবার পরে বদলিয়ে করলেন ব্লক-লেটার নাইট। আর পার্ক স্ট্রিট সেমেট্ৰিরি সম্বন্ধে বলেছিলেন, ছেলেবেলায় মেজো জ্যাঠা বুঝিয়েছিলেন। ওটাকে বলে গোরস্থান, কারণ ওখানে গোরাদের সমাধি আছে! এখন মনে হচ্ছে নামটা হওয়া উচিত গেরোস্থান। এমন গেরোয় এর আগে পড়িচি কখনও তপেশ? তোমার মনে পড়চে? সত্যি বলতে কী, অনেক ভেবেও মনে করতে পারিনি। লালমোহনবাবু এমনিতেই পাংচুয়াল; গাড়ি হবার পর মেজাজটা আরও মিলিটারি হয়ে গেছে। আগে কড়া নাড়তেন, আজ দেখি নক করলেন। আমরা দুজনেই খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে বসেছিলাম। আজ ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও হান্টিং বুট পরতে হয়েছে। আমারটা গত বছর কেনা, ওরটা এগারো বছরের পুরনো। বোধহয় অবস্থাটা খুব ভাল নয় বলে বিকেলে দেখেছিলাম ও নিজেই সুকতলায় কী সব মেরামতের কাজ করছে। এখন একটু খোঁড়াচ্ছে দেখে মনে হল মুচি ডাকিয়ে কাজটা করালেই ভাল হত। এই বিপদের রাতে খোঁড়ালে চলবে কেন? দরজায় টাকা পড়তেই আমরা উঠে পড়লাম। ফেলুদার কাঁধে খয়েরি রঙের শান্তিনিকেতনি ঝোলা, তার ভিতর থেকে লাল খামের খানিকটা বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। এখানে বলে রাখি, ওরই হুকুমমাফিক আজ আমরা সকলে গাঢ় রঙের পোশাক পরেছি। লালমোহনবাবু পরেছেন একটা কালো টেরিকটের সুট। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই বললেন, মডার্ন মেডিসিন কোথায় পৌঁছে গেল মশাই!—একটা নতুন নাৰ্ভ-পিল বেরিয়েছে—নামটায় আবার দুটো এক্স—ভবেন ডাক্তারের সাজেশনে ডিনারের পরে একটা খেয়ে নিলুম-এরই মধ্যে সমস্ত শরীরে বেশ একটা কলপ-দেওয়া ফিলিং হচ্ছে। তপেশ ভাই, যা থাকে কপালে—লড়ে যাব, কী বলো? কীসের সঙ্গে লড়বেন সেটা অবিশ্যি উনিও জানেন না, আমিও জানি না। ফেলুদা আগেই ঠিক করেছিল গাড়িটা গোরস্থানের গেট থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখবে— গাড়ির রংটা আপনার আজকের পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ করলে অতটা চিন্তা করতাম না। সেন্ট জেভিয়ার্স ছাড়িয়ে রাডন স্ট্রিটের মোড়ের একটু আগেই ও গাড়িটা থামাতে বলল। তোরা এগিয়ে যা। গাড়ি থেকে নেমে বলল ফেলুদা, আমি হরিপদবাবুকে কয়েকটা ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসছি। আমরা এগিয়ে গেলাম। ফেলুদা কী ইনস্ট্রাকশন দিল জানি না, কিন্তু এটা জানি যে হরিপদবাবু এ ক’দিন আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে আর কথাবার্তা শুনে রীতিমতো উৎসাহ পেয়ে গেছেন। এটা ওঁর হাবেভাবে বেশ বোঝা যায়। মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফেলুদা ফিরে এল। বলল, আপনার লাক ভাল মিঃ গাঙ্গুলী যে আপনি এমন একটি ড্রাইভার পেয়েছেন। ভদ্রলোককে কাজের দায়িত্ব দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কী দায়িত্ব দিলেন মশাই? এদিকে গণ্ডগোল না হলে কোনও দায়িত্ব নেই, আর হলে ওঁর উপর বেশ খানিকটা ভরসা। রাখতে হবে। এর বেশি আর ফেলুদা কিছু বলল না। লোহার ফটকের সামনে পৌঁছে দেখি সেটা খোলা। ফেলুদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করাতে ও ফিসফিস করে উত্তর দিল যে এমনিতে এ সময় খোলা থাকে না। কিন্তু আজ সেটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।পাঁচিলের উপর কাচ বসানো, টপকানো রিসকি, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু বরামদেও আছেন কি? দারোয়ানের ঘরে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে, কিন্তু সেখানে কেউ আছে বলে মনে হল না। আমরা ঘরের আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। কেউ নেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে আসা ফিকে আলোতে দেখতে পাচ্ছি ফেলুদার ভ্ৰকুটি। বুঝলাম দারোয়ানের সঙ্গে যা ব্যবস্থা হয়েছিল তাতে ওর থাকবার কথা। আমরা এগিয়ে গেলাম। আজ আর মাঝখানের সেই পথটা দিয়ে নয়। সেটা দিয়ে কয়েক পা গিয়েই ফেলুদা বাঁয়ে ঘুরল। আমরা সমাধির ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম। বাতাস বইছে বেশ জোরে। আকাশে ফালি ফালি মেঘের স্রোত। তার ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে ফিকে আধা-চাঁদটা উঁকি মেরেই আবার লুকিয়ে পড়ছে। সেই চাঁদের আলোতে ফলকের নামগুলো এই আছে এই নেই। এই আলোতেই বুঝলাম আমরা স্যামুয়েল কাথবার্ট থর্নহিলের সমাধিতে আশ্রয় নিলাম। এটা সরু হয়ে উঠে যাওয়া ওবেলিস্ক নয়। এর নীচে বেদি, বেদির উপর চারিদিকে ঘিরে থাম আর মাথায় গম্বুজ। তিনজন লোকে দিব্যি ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। এখানে আলো পৌঁছায় না, তবে সুবিধে এই যে ডান দিকে চাইলে অন্য সমাধির ফাঁক দিয়ে লোহার। ফটকের একটা অংশ দেখা যায়। এ গোরস্থান এখন
false
MZI
ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ, ঘড়ঘড় করে কোথায় একটা শব্দ হল। বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে আর বিচিত্র শব্দে যন্ত্রপাতিগুলো আর্তনাদ করতে থাকে। তীব্র একটা লাল আলো একপাশে একটা জায়গা আলোকিত করে দেয়। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পেলাম আমি। লোকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর যন্ত্রপাতির গুঞ্জনে কানে তালা লেগে যায় হঠাৎ। টুকুনজিল আবার বলল, বিলু, তোমার কী হয়েছে? তুমি এরকম করছ কেন? কষ্ট। বড় কষ্ট টুকুনজিল। কষ্ট? সেটা কি? আমি কোনোমতে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ করে আমার কপালে একটু গরম লাগতে থাকে, নিশ্চয়ই টুকুনজিল নামার চেষ্টা করছে। শুনলাম সে বলল, চার শ’ তেরো মেগাসাইকেল। তিন মিলি সেকেন্ড পরপর। দুই তরঙ্গের অপবর্তন। অসম বন্টন। তোমার মস্তিষ্কের তরঙ্গে দেখি অনেক গোলমাল। দাঁড়াও, ঠিক করে দিই। আমার কপালে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলাম, তারপর হঠাৎ করে একেবারে ম্যাজিকের মতো সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল একটু নড়লেই আবার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু শুরু হল না। সমস্ত শরীর তখনো একটু একটু কাঁপছে, ঘামে ভিজে গেছে জামা-কাপড়। শরীরটা হালকা লাগছে হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে বাতাসে ভেসে যাব আমি। বুকের ভেতর কেমন যেন আনন্দ এসে ভর করে। আমি কিন্তু তখন ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললাম, টুকুনজিল, ভুমি না এলে এই রাক্ষসগুলো আমাকে মেরে ফেলত। কেউ তোমাকে মারতে পারবে না, বিলু। আমি তোমাকে বাঁচাব। এরা তোমাকে ধরতে চায়, টুকুনজিল। আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। হঠাৎ বব কার্লোসের গলা শুনতে পেলাম আমি, ইংরেজিতে কী বলেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না, এক মিনিট কথাটা শুধু ধরতে পারলাম। আমি টুকুনজিলকে জিজ্ঞেস করলাম, কি বলছে তুমি বুঝতে পারছ, টুকুনজিল? হ্যাঁ। বলেছে এক মিনিটের মাঝে আমি যদি লেজার শিল্ডের মাঝে না ঢুকে যাই তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবে। অত্যন্ত অর্থহীন অযৌক্তিক একটা কথা। কেন? লেজার শিল্ডটা তৈরি করেছে মেগাওয়াট পাওয়ার দিয়ে, ছোট একটা ফুটো রেখেছে ঢোকার জন্য, ঢোকার পর ফুটোটা বন্ধ করে দেবে। আমি লেজারলাইটের মাঝে আটকা পড়ে যাব। বের হতে চেষ্টা করলেই আমার মহাকাশযান মেগাওয়াট পাওয়ারে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি কেন সেখানে ঢুকব? কখনো ঢুকব না। আমি ঢোক গিলে বললাম, বলছে, তুমি না ঢুকলে আমাকে মেরে ফেলবে! অত্যন্ত অযৌক্তিক ব্যাপার। দুটোর মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। আর মরে গেলে ঠিক কী হয়, বিলু? আমি ছটফট করে বললাম, মরে গেলে সব শেষ। কেন, শেষ কেন? আবার ঠিক করা যায় না? না। মরে গেলে কেউ বেঁচে আসে না। এটা হতেই পারে না। আমি ঢোক গিলে বললাম, পারে টুকুনজিল, পারে। আমি জানি। তুমি কিছু-একটা কর তাড়াতাড়ি, কতক্ষণ হয়েছে? ত্রিশ সেকেন্ড। সর্বনাশ টুকুনজিল, একেবারে তত সময় নেই! মরে গেলে শেষ কেন হবে? আমি দেখতে চাই কেমন করে শেষ হয়। আমি চিৎকার করে বললাম, না, তুমি দেখতে চেয়ো না, টুকুনজিল। দেখতে চেয়ো না। কিছু-একটা কর। হা হা হা। টুকুনজিল হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, এটা কি হাসির ব্যাপার? না, এটা হাসির ব্যাপার না। ভয়ের ব্যাপার। ভয়ানক ভয়ের ব্যাপার। কিছু-একটা কর। ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে নিয়ে যাই এখান থেকে। হা হা হা। পর মুহূর্তে কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হল, আগুনের একটা হলকা ছুটে এল আমার দিকে, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করলাম আমি, আর হঠাৎ মনে হল আমি প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না আমি, হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি মরে যাচ্ছি তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হবার পর আমার বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি সাদা ধোঁয়ার মতো। সামনে-পিছনে উপরে-নিচে চারদিকে হালকা সাদা ধোঁয়া। আমার মনে হতে থাকে, সাদা ধোঁয়ার মাঝে শূন্যে ঝুলে আছি আমি। একবার মনে হল আমি বোধহয় মরে গেছি। বেশি পাপও করি নি, বেশি পুণ্যও করি নি, তাই মনে হয় দোজখ আর বেহেশতের মাঝখানে ঝুলে আছি আমি। আমার হাত-পা সারা শরীর তখনো চেয়ারের সাথে বাঁধা। ভালো করে নড়তে পারছি না, ভয়ে ভয়ে ডাকলাম, টুকুনজিল। তুমি কোথায়? এই যে এখানে। এখানে কোথায়? তোমার চেয়ারের নিচে। কেন? নিচে কেন? তোমাকে ধরে রেখেছি। ধরে রাখার দরকার কী? মাধ্যাকর্ষণ বল। ধরে না রাখলে তুমি পড়ে যাবে। কোথায় পড়ে যাব? নিচে। নিচে কোথায়? নিচে মাটিতে। প্রায় সাত হাজার ফুট নিচে। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে, ঢোক গিলে বললাম, আমি কোথায় টুকুনজিল? আকাশে। আকাশে? কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি নিচে নামাও। কেন? আকাশে ঝুলে থাকবে কেমন করে? আকাশে কখনো কেউ ঝুলে থাকে নাকি? তোমার শরীরে খুব ক্ষতিকর জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শরীর সেগুলো এখন পরিষ্কার করছে। সে জন্যে তোমার এখন ঘুমানো দরকার, মস্তিষ্কে এখন যেন কোনো অসম কম্পন না হয়, সেই জন্যে তোমাকে এখানে রেখেছি। কোনোদিন শুনেছ কেউ আকাশে ঝুলে ঝুলে ঘুমায়? এখানে কোনো শব্দ নেই, ধৈর্যচ্যুতি নেই, অসঙ্গতি নেই। না থাকুক। আমাকে নিচে নামাও। ঠিক আছে। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি চেয়ারটা ভাসতে-ভাসতে নিচে নামতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে শরীরটা মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল। চারদিকে তখনো সাদা। ধোঁয়ার মতো মেঘ। হঠাৎ করে মেঘ কেটে গেল, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নিচে রাস্তাঘাট বাড়িঘর গাছপালা পুকুর। মেঘের ফাঁকে আকাশে বড় চাঁদ,
false
robindronath
গ্রেফতার করিয়া লইয়া নীর চলিয়া গেল। পুরবালা। সব গুছিয়ে নিয়েছি। এখনো ট্রেন যাবার দেরি আছে বোধ হয়। অক্ষয়। যদি মিস করতে চাও তা হলে ঢের দেরি আছে। পুরবালা। তা হলে চলো, আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে। চললুম রসিকদাদা– তুমি এখানে রইলে, এই শিশুগুলিকে একটু সামলে রেখো। [প্রণাম রসিক। কিছু ভেবো না দিদি, এরা সকলে আমাকে যেরকম বিপরীত ভয় করে, টুঁশব্দটি করতে পারবে না। শৈল। দিদিভাই, তুমি একটু থামো। আমি এই কাপড়টা ছেড়ে এসে তোমাকে প্রণাম করছি। পুরবালা। কেন? ছাড়তে মন গেল যে? শৈল। না ভাই, এ কাপড়ে নিজেকে আর-একজন বলে মনে হয়, তোদের গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না! রসিকদাদা, এই নাও, আমার গোঁফটা সাবধানে রেখে দাও, হারিয়ো না। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ শ্রীশ তাহার বাসায় দক্ষিণের বারান্দায় একখানা বড়োহাতাওআলা কেদারায় দুই হাতার উপর দুই পা তুলিয়া দিয়া শুক্লসন্ধ্যায় চুপচাপ বসিয়া সিগারেট ফুঁকিতেছিল। পাশে টিপায়ের উপর রেকাবিতে একটি গ্লাস বরফ-দেওয়া লেমনেড ও স্তূপাকার কুন্দফুলের মালা। বিপিন পশ্চাৎ হইতে প্রবেশ করিয়া তাহার স্বাভাবিক প্রবল গম্ভীর কণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল, “কী গো সন্ন্যাসীঠাকুর।” শ্রীশ তৎক্ষণাৎ হাতা হইতে পা নামাইয়া উঠিয়া বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। কহিল, “এখনো বুঝি ঝগড়া ভুলতে পারো নি?” শ্রীশ কিছুক্ষণ আগেই ভাবিতেছিল, একবার বিপিনের ওখানে যাওয়া যাক। কিন্তু শরৎসন্ধ্যার নির্মল জ্যোৎস্নার দ্বারা আবিষ্ট হইয়া নড়িতে পারিতেছিল না। একটি গ্লাস বরফশীতল লেমনেড ও কুন্দফুলের মালা আনাইয়া জ্যোৎস্নাশুভ্র আকাশে সিগারেটের ধূম-সহযোগে বিচিত্র কল্পনাকুণ্ডলী নির্মাণ করিতেছিল। শ্রীশ। আচ্ছা ভাই, শিশুপালক, তুমি কি সত্যি মনে কর আমি সন্ন্যাসী হতে পারি নে? বিপিন। কেন পারবে না! কিন্তু অনেকগুলি তল্পিদার চেলা সঙ্গে থাকা চাই। শ্রীশ। তার তাৎপর্য এই যে, কেউ-বা আমার বেলফুলের মালা গেঁথে দেবে, কেউ-বা বাজার থেকে লেমনেড ও বরফ ভিক্ষে করে আনবে, এই তো? তাতে ক্ষতিটা কী? যে সন্ন্যাসধর্মে বেলফুলের প্রতি বৈরাগ্য এবং ঠাণ্ডা লেমনেডের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় সেটা কি খুব উঁচুদরের সন্ন্যাস? বিপিন। সাধারণ ভাষায় তো সন্ন্যাসধর্ম বলতে সেইরকমটাই বোঝায়। শ্রীশ। ঐ শোনো! তুমি কি মনে কর, ভাষায় একটা কথার একটা বৈ অর্থ নেই? একজনের কাছে সন্ন্যাসী কথাটার যে অর্থ, আর-এক জনের কাছেও যদি ঠিক সেই অর্থই হয় তা হলে মন বলে একটা স্বাধীন পদার্থ আছে কী করতে? বিপিন। তোমার মন সন্ন্যাসী কথাটার কী অর্থ করছেন আমার মন সেইটি শোনবার জন্য উৎসুক হয়েছেন। শ্রীশ। আমার সন্ন্যাসীর সাজ এইরকম– গলায় ফুলের মালা, গায়ে চন্দন, কানে কুণ্ডল, মুখে হাস্য। আমার সন্ন্যাসীর কাজ মানুষের চিত্ত-আকর্ষণ। সুন্দর চেহারা, মিষ্টি গলা, বক্তৃতায় অধিকার, এ-সমস্ত না থাকলে সন্ন্যাসী হয়ে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায় না। রুচি বুদ্ধি কার্যক্ষমতা ও প্রফুল্লতা, সকল বিষয়েই আমার সন্ন্যাসীসম্প্রদায়কে গৃহস্থের আদর্শ হতে হবে। বিপিন। অর্থাৎ, একদল কার্তিককে ময়ূরের উপর চড়ে রাস্তায় বেরোতে হবে। শ্রীশ। ময়ূর না পাওয়া যায়, ট্রাম আছে, পদব্রজেও নারাজ নই। কুমারসভা মানেই তো কার্তিকের সভা। কিন্তু কার্তিক কি কেবল সুপুরুষ ছিলেন? তিনিই ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি। বিপিন। লড়াইয়ের জন্যে তাঁর দুটিমাত্র হাত, কিন্তু বক্তৃতা করবার জন্যে তাঁর তিন-জোড়া মুখ। শ্রীশ। এর থেকে প্রমাণ হয়, আমাদের আর্য পিতামহরা বাহুবল অপেক্ষা বাক্যবলকে তিনগুণ বেশি বলেই জানতেন। আমিও পালোয়ানিকে বীরত্বের আদর্শ বলে মানি নে। বিপিন। ওটা বুঝি আমার উপর হল? শ্রীশ। ঐ দেখো! মানুষকে অহংকার কিরকম মাটি করে! তুমি ঠিক করে রেখেছ, পালোয়ান বললেই তোমাকে বলা হল। তুমি কলিযুগের ভীমসেন! আচ্ছা এসো, যুদ্ধং দেহি! একবার বীরত্বের পরীক্ষা হয়ে যাক। এই বলিয়া দুই বন্ধু ক্ষণকালের জন্য লীলাচ্ছলে হাত কাড়াকাড়ি করিতে লাগিল। বিপিন হঠাৎ “এইবার ভীমসেনের পতন” বলিয়া ধপ্‌ করিয়া শ্রীশের কেদারাটা অধিকার করিয়া তাহার উপরে দুই পা তুলিয়া দিল; এবং “উঃ অসহ্য তৃষ্ণা” বলিয়া লেমনেডের গ্লাসটি এক নিশ্বাসে খালি করিল। তখন শ্রীশ তাড়াতাড়ি কুন্দফুলের মালাটি সংগ্রহ করিয়া “কিন্তু বিজয়মাল্যটি আমার” বলিয়া সেটা মাথায় জড়াইল এবং বেতের মোড়াটার উপরে বসিয়া কহিল, “আচ্ছা ভাই, সত্যি বলো, একদল শিক্ষিত লোক যদি এইরকম সংসার পরিত্যাগ করে পরিপাটি সজ্জায় প্রফুল্ল প্রসন্ন মুখে গানে এবং বক্তৃতায় ভারতবর্ষের চতুর্দিকে শিক্ষা বিস্তার করে বেড়ায় তাতে উপকার হয় কি না?” বিপিন এই তর্কটা লইয়া বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করিতে ইচ্ছা করিল না। কহিল, “আইডিয়াটা ভালো বটে।” শ্রীশ। অর্থাৎ, শুনতে সুন্দর কিন্তু করতে অসাধ্য! আমি বলছি অসাধ্য নয় এবং আমি দৃষ্টান্ত-দ্বারা তার প্রমাণ করব। ভারতবর্ষে সন্ন্যাসধর্ম বলে একটা প্রকাণ্ড শক্তি আছে; তার ছাই ঝেড়ে, তার ঝুলিটা কেড়ে নিয়ে, তার জটা মুড়িয়ে, তাকে সৌন্দর্যে এবং কর্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করাই চিরকুমার-সভার একমাত্র উদ্দেশ্য। ছেলে পড়ানো এবং দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি করবার জন্যে আমাদের মতো লোক চিরজীবনের ব্রত অবলম্বন করে নি। বলো বিপিন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না? বিপিন। তোমার সন্ন্যাসীর যেরকম চেহারা গলা এবং আসবাবের প্রয়োজন আমার তো তার কিছুই নেই। তবে তল্পিদার হয়ে পিছনে যেতে রাজি আছি। কানে যদি সোনার কুণ্ডল, অন্তত চোখে যদি সোনার চশমাটা পরে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াও তা হলে একটা প্রহরীর দরকার– সে কাজটা আমার দ্বারা কতকটা চলতে পারবে। শ্রীশ। আবার ঠাট্টা! বিপিন। না ভাই, ঠাট্টা নয়। আমি সত্যিই বলছি, তোমার প্রস্তাবটাকে যদি সম্ভবপর করে তুলতে পার তা হলে খুব ভালোই হয়। তবে এরকম একটা সম্প্রদায়ে সকলেরই কাজ সমান হতে পারে না, যার যেমন স্বাভাবিক ক্ষমতা সেই অনুসারে যোগ
false
shottojit_roy
এত গভীর কেন? আর হাতের আঙুল মটকাচ্ছে কেন? পেমিয়াংচির আগের শহরের নাম গেজিং। এখানেও দেখি নিশানের ছড়াছড়ি। এখান থেকে পেমিয়াংচি তিন মাইল। জিপ ক্রমশ উপরে উঠছে। রাস্তা রীতিমতো খাড়াই। এখানে গাছ কম, তবে উপরের দিকে চাইলেই দেখতে পাচ্ছি। কালচে সবুজ রঙের ঘন বন। খানিকটা রাস্তা রীতিমতো খারাপ। জিপকে খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে। মনে হল এ দিকে বৃষ্টিটা গ্যাংটকের চেয়ে বেশি হয়েছে। জিপ ফেগর-হুইলে অতি সন্তৰ্পণে একটা গোলমেলে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরোল; ঝাঁকুনির চোটে নিশিকান্তবাবুর মাথাটা জিপের উপরের লোহার রডের সঙ্গে ঠকং করে লাগায় ভদ্রলোক ‘উরেশ্‌শা’ বলে উঠলেন। একটু পরেই ক্ৰমে আলো কমে এল। এটা শুধু মেঘের জন্যে নয়। আমাদের জিপের এক পাশে এখন একটা গাঢ় সবুজ পাতা আর সাদা ডালপালাওয়ালা গাছের বন। হেলমুট বলল, ‘ওগুলো বার্চ গাছ–বিলেতে খুব দেখা যায়।’ এখন আমাদের জিপ এই বনের মধ্যেই রাস্তা দিয়ে চলেছে। আমাদের দু পাশে বন। তার মধ্যে দিয়ে আমরা চড়াই উঠছি সাপের মতো প্যাচালো রাস্তা দিয়ে। এবার আরও গভীর বন, আরও বড় বড় গাছ। ঠাণ্ড স্যাতসেঁতে হাওয়া। জিপের আওয়াজ ছাপিয়ে বনের ভিতর থেকে অচেনা পাখির তীক্ষ শিস। নিশিকান্তবাবু বললেন, ‘বেশ থ্রি–মানে থ্রিলিং লাগছে৷’ রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। সামনে একটা সবুজ টিপি। উপরে খোলা মেঘলা আকাশ। ক্রমে একটা বাংলোর টালিওয়ালা ছাদ দেখা গেল। তারপর পুরো বাংলোটা। এই সেই ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত বাংলো। পিছন দিকে আকাশের নীচে সবুজ থেকে আবছা নীল হয়ে যাওয়া থরে থরে সাজানো পাহাড়। জিপ থামল। আমরা নামালাম। চৌকিদার বেরিয়ে এল। আমাদের জন্য ঘর ঠিক করা আছে। ‘আউর কোই হ্যায়। ইঁহা?’ শশধরবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ’নেহি সাব–বাংলা খালি হ্যায়।’ ‘আর কেউ নেই? এবার ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।’আর কেউ আসেনি?’ ‘এসেছিল। তিনি কাল রাত্রেই চলে গেছেন। দাড়িওয়ালা চশমাপরা বাবু।’ শশধর বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন চৌকিদারের কথা শুনে হেলমুটই সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছে বলে মনে হল। সে কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। শশধরবাবু বললেন, ‘যা বুঝছি–ইমিডিয়েটলি কিছু করার নেই। একটা বাজে। অন্তত ডান হাতের ব্যাপারটা সোরে নেওয়া যাক।’ আমরা মালপত্ৰ সমেত বাংলোর ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। দেখেই বোঝা যায় আদ্যিকালের বাংলো। কাঠের ছাত, কাঠের মেঝে, সামনের দিকে কাঠের রেলিংওয়ালা বারান্দা, তাতেঁ পুরনো ধরনের বেতের টেবিল-চেয়ার পাতা। বারান্দা থেকে সামনের দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর। এখন মেঘ করে আছে, তা না হলে নাকি বাইশ মাইলের মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। এক পাখির ডাক ছাড়া চারিদিকে কোনও আওয়োজ নেই। সব নিঝুম নিস্তব্ধ। বারান্দা দিয়ে ঢুকে সামনের ঘরটা হল ডাইনিং রুম। টেবিলের চারিদিকে চেয়ার পাতা রয়েছে। এক পাশে আবার দুটো আরাম কেদারা। শশধর বাবু তার একটায় বসে পড়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনি ডিটেকটিভ হলেও আপনার অনুমান ঠিক কি না সে বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু বৈদ্য লোকটা এভাবে পালানোতে এখন আমি কনভিন্‌স্‌ড। এস. এস. তার এমন একটা দামি জিনিস যাকে-তাকে দেখিয়ে খুব ভুল করেছে।’ হেলমুট বারান্দাতেই রয়ে গেল। নিশিকান্তবাবু বোধহয় বাথরুমের খোঁজে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। ফেলুদা বাংলোর অন্য ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আমি আর কী করি—খাবার টেবিলের পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। এত দূর আসা বৃথা হবে, শেলভাঙ্কারের আততায়ী অল্পের জন্য হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে যাবে, আমরা বোকার মতো দৃশ্য দেখে গ্যাংটকে ফিরে যাব—এসব কথা ভাবতেও খারাপ লাগছিল। ডাইনিং রুমের পিছন দিকের দুটো দরজা দিয়ে দুটো বেডরুমে যাওয়া যায়। ডান দিকের দরজাটা দিয়ে ফেলুদা বেরিয়ে এল, হাতে একটা লাঠি। এই লাঠিটাই ডক্টর বৈদ্যর হাতে দেখছিলাম না? ‘ভদ্রলোক এসেছিলেন ঠিকই’, ফেলুদার গলার স্বর শুকনো আর ভারী, ‘কারণ তিনি চিহ্নস্বরূপ তাঁর লাঠিটা ফেলে গেছেন। ভেরি স্ট্রেঞ্জ।’ নিশিকান্তবাবু রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। তারপর ‘অদ্ভুত জায়গা’ বলে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে বিশ্ৰী শব্দ করে হাই তুললেন। ফেলুদা বসল না। ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে ডক্টর বৈদ্যর লাঠিটা ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাতের তেলোয় ঠক্‌ ঠক্‌ করে অন্যমনস্ক ভাবে ঠুকতে লাগল। শশধরবাবু বললেন, ‘কই, মিস্টার সরকার–আপনাদের ওই খাবারের বাক্সগুলো খুলুন! মিথ্যে খিদে বাড়িয়ে লাভটা কী?’ ‘খাওয়া পরে হবে।’ কথাটা বলল ফেলুদা। আর যেভাবে বলল তাতে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নিশিকান্তবাবু। উঠতে গিয়ে থাতমত খেয়ে থাপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। শশধরবাবুও অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চাইলেন। কিন্তু ফেলুদা আবার যেই কে সেই! সে চেয়ারে বসল। লাঠিটা টেবিলের উপর শুইয়ে রেখে পকেট থেকে একটা চারমিনার বার করে ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে বলল, ‘ঘাটশিলায় আমার এক পুরনো বন্ধু রয়েছে। আপনি এখানে আসার আগে তো ঘাটশিলায় গিয়েছিলেন–তাই না, শশধর বাবু?’ শশধরবাবুর জবাব দিতে দেরি হল না। ‘হ্যাঁ–এক ভাগনের বিয়ে ছিল৷’ ‘আপনি তো হিন্দু?’ হঠাৎ এ-প্রশ্ন করল কেন ফেলুদা? ‘তার মানে?’ শশধরবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন ফেলুদার দিকে। ‘নাকি বৌদ্ধ–না খ্রিস্টানা–না ব্ৰাহ্ম–না মুসলমান? ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ ‘বলুন না।’ ‘হিন্দু-ন্যাচারেলি৷’ ‘হুঁ!’ ফেলুদা গভীরভাবে সিগারেটে টান দিয়ে দুটো রিং ছাড়ল। তার একটা বড় হতে হতে শশধরবাবুর মুখের কাছে গিয়ে মিলিয়ে গেল। ‘কিন্তু—‘ ফেলুদার চোখে ভুকুটি, দৃষ্টি সোজা শশধরবাবুর দিকে, ‘-আপনি আর আমরা তো এক দিনে এক সঙ্গে প্লেনে এলাম। আপনি তখন সবে ঘাটশিলা থেকে বিয়ে সেরে ফিরছেন, তাই না?’ ‘এতে আপনি গোলমালটা কোথায় দেখছেন মিস্টার মিত্তির? আপনার কথার কোনও মাথামুণ্ডু আমি খুঁজে পাচ্ছি না। ঘাটশিলার বিয়ের সঙ্গে আজকের
false
robindronath
প্রণাম করিতে চান।” বসন্ত রায় মহিষীর ঘরে গেলেন, বিভা কারাগারে গেল। মহিষী বসন্ত রায়কে প্রণাম করিলেন। বসন্ত রায় আশীর্বাদ করিলেন, “মা, আয়ুষ্মতী হও।” মহিষী কহিলেন, “কাকামহাশয়, ও আশীর্বাদ আর করিবেন না। এখন আমার মরণ হইলেই আমি বাঁচি।” বসন্ত রায় ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “রাম, রাম। ও-কথা মুখে আনিতে নাই।” মহিষী কহিলেন, “আর কী বলিব কাকামহাশয়, আমার ঘরকন্নায় যেন শনির দৃষ্টি পড়িয়াছে।” বসন্ত রায় অধিকতর ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। মহিষী কহিলেন, “বিভার মুখখানি দেখিয়া আমার মুখে আর অন্নজল রুচে না। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কিছু বলে না, কেবল দিনে দিনে তাহার শরীর ক্ষয় হইয়া যাইতেছে। তাহাকে লইয়া যে আমি কী করিব কিছু ভাবিয়া পাই না।” বসন্ত রায় অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। “এই দেখুন কাকামহাশয়, এক সর্বনেশে চিঠি আসিয়াছে।” বলিয়া এক চিঠি বসন্ত রায়ের হাতে দিলেন। বসন্ত রায় সে চিঠি পড়িতে না পড়িতে মহিষী কাঁদিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমার কিসের সুখ আছে? উদয়– বাছা আমার কিছু জানে না। তাহাকে তো মহারাজ– সে যেন রাজার মতোই হয় নাই, কিন্তু তাহাকে তো আমি গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম, সে তো আমার আপনার সন্তান বটে। জানি না, বাছা সেখানে কী করিয়া থাকে, একবার আমাকে দেখিতেও দেয় না।” মহিষী আজকাল যে কথাই পাড়েন, উদয়াদিত্যের কথা তাহার মধ্যে এক স্থলে আসিয়া পড়ে। ওই কষ্টটাই তাঁহার প্রাণের মধ্যে যেন দিনরাত জাগিয়া আছে। চিঠি পড়িয়া বসন্ত রায় একেবারে অবাক হইয়া গেলেন, চুপ করিয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বসন্ত রায় মহিষীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ চিঠি তো কাহাকেও দেখাও নি মা!” মহিষী কহিলেন, “মহারাজ এ চিঠির কথা শুনিলে কি আর রক্ষা রাখিবেন, বিভাও কি তাহা হইলে আর বাঁচিবে।” বসন্ত রায় কহিলেন, “ভালো করিয়াছ। এ চিঠি আর কাহাকেও দেখাইয়ো না, বউমা। তুমি বিভাকে শীঘ্র তাহার শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দাও। মান-অপমানের কথা ভাবিয়ো না!” মহিষী কহিলেন, “আমিও তাহাই মনে করিয়াছি। মান লইয়া আমার কাজ নাই, আমার বিভা সুখী হইলেই হইল। কেবল ভয় হয় পাছে বিভাকে তাহারা অযত্ন করে।” বসন্ত রায় কহিলেন, “বিভাকে অযত্ন করিবে! বিভা কি অযত্নের ধন। বিভা যেখানে যাইবে সেইখানেই আদর পাইবে। অমন লক্ষ্মী অমন সোনার প্রতিমা আর কোথায় আছে। রামচন্দ্র কেবল তোমাদের উপর রাগ করিয়াই এই চিঠি লিখিয়াছে, আবার পাঠাইয়া দিলেই তাহার রাগ পড়িয়া যাইবে।” বসন্ত রায় তাঁহার সরল হৃদয়ে সরল বুদ্ধিতে এই বুঝিলেন। মহিষীও তাহাই বুঝিলেন। বসন্ত রায় কহিলেন, “বাড়িতে রাষ্ট্র করিয়া যাও যে, বিভাকে চন্দ্রদ্বীপে পাঠাইতে অনুরোধ করিয়া রামচন্দ্র এক চিঠি লিখিয়াছে। তাহা হইলে নিশ্চয়ই সেখানে যাইতে আর অমত করিবে না।” সন্ধ্যার পর বসন্ত রায় একাকী বহির্বাটীতে বসিয়া আছেন। এমন সময়ে সীতারাম তাঁহাকে আসিয়া প্রণাম করিল। বসন্ত রায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী সীতারাম, কী খবর?” সীতারাম কহিল, “সে পরে বলিব, আপনাকে আমার সঙ্গে আসিতে হইবে।” বসন্ত রায় কহিলেন, “কেন, কোথায় সীতারাম?” সীতারাম তখন কাছে আসিয়া বসিল। চুপি চুপি ফিস ফিস করিয়া কী বলিল। বসন্ত রায় চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “সত্য নাকি?” সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।” বসন্ত রায় মনে মনে অনেক ইতস্তত করিতে লাগিলেন। কহিলেন, “এখনই যাইতে হইবে নাকি।” সীতারাম। আজ্ঞা হাঁ। বসন্ত রায়। একবার বিভার সঙ্গে দেখা করিয়া আসিব না? সীতারাম। আজ্ঞা না, আর সময় নাই। বসন্ত রায়। কোথায় যাইতে হইবে? সীতারাম। আমার সঙ্গে আসুন, আমি লইয়া যাইতেছি। বসন্ত রায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “একবার বিভার সঙ্গে দেখা করিয়া আসি না কেন?” সীতারাম। আজ্ঞা না মহারাজ। দেরি হইলে সমস্ত নষ্ট হইয়া যাইবে। বসন্ত রায়। তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে কাজ নাই– কাজ নাই।” উভয়ে চলিলেন। আবার কিছু দূর গিয়া কহিলেন, “একটু বিলম্ব করিলে কি চলে না।?” সীতারাম। না মহারাজ, তাহা হইলে বিপদ হইবে। “দুর্গা বলো” বলিয়া বসন্ত রায় প্রাসাদের বাহির হইয়া গেলেন। বসন্ত রায় যে আসিয়াছেন, তাহা উদয়াদিত্য জানেন না। বিভা তাঁহাকে বলে নাই। কেননা যখন উভয়ের দেখা হইবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তখন এ সংবাদ তাঁহার কষ্টের কারণ হইত। সন্ধ্যার পরে বিদায় লইয়া বিভা কারাগার হইতে চলিয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য একটি প্রদীপ লইয়া একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতেছেন। জানালার ভিতর দিয়া বাতাস আসিতেছে, দীপের ক্ষীণ শিখা কাঁপিতেছে, অক্ষর ভালো দেখা যাইতেছে না। কীটপতঙ্গ আসিয়া দীপের উপর পড়িতেছে। এক- এক বার দীপ নিবো-নিবো হইতেছে। একবার বাতাস বেগে আসিল– দীপ নিবিয়া গেল। উদয়াদিত্য পুঁথি ঝাঁপিয়া তাঁহার খাটে গিয়া বসিলেন। একে একে কত কী ভাবনা আসিয়া পড়িল। বিভার কথা মনে আসিল। আজ বিভা কিছু দেরি করিয়া আসিয়াছিল, কিছু সকাল সকাল চলিয়া গিয়াছিল। আজ বিভাকে কিছু বিশেষ ম্লান দেখিয়াছিলেন; তাহাই লইয়া মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন। পৃথিবীতে যেন তাঁহার আর কেহ নাই। সমস্ত দিন বিভাকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পান না। বিভাই তাঁহার একমাত্র আলোচ্য। বিভার প্রত্যেক হাসিটি প্রত্যেক কথাটি তাঁহার মনে সঞ্চিত হইতে থাকে। তৃষিত ব্যক্তি তাহার পানীয়ের প্রত্যেক বিন্দুটি পর্যন্ত যেমন উপভোগ করে, তেমনি বিভার প্রীতির অতি সামান্য চিহ্নটুকু পর্যন্ত তিনি প্রাণ-মনে উপভোগ করেন। আজ তাই এই বিজন ক্ষুদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা শুইয়া স্নেহের প্রতিমা বিভার ম্লান মুখখানি ভাবিতেছিলেন। সেই অন্ধকারে বসিয়া তাঁহার একবার মনে হইল, “বিভার কি ক্রমেই বিরক্তি ধরিতেছে? এই নিরানন্দ কারাগারের মধ্যে এক বিষণ্ন অন্ধকার মূর্তির সেবা করিতে আর কি তাহার ভালো লাগিতেছে
false
shordindu
সেইখানে তাহার কোলের উপর মাথা রাখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। চাপা কান্নার আবেগে তাহার সমস্ত দেহ কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। সুকুমার বিহ্বলের মত তাহার মুখটা তুলিবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিতে লাগিল, ‘সত্য—সত্য—?’ সত্যবতী মুখ তুলিল না, কাঁদিতেই লাগিল। ব্যোমকেশ তাহাদের নিকটে গিয়ে খুব নরম সুরে বলিল, ‘ভাল করলেন না, আমাকে বললে পারতেন। আমি পুলিস নই—শুনেছেন তো। বললে হয়তো আপনাদের সুবিধা হত—চল অজিত।’ ঘর হইতে বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ সন্তর্পণে দ্বার ভেজাইয়া দিল; কিছুক্ষণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া হঠাৎ মুখ তুলিয়া বলিল, ‘এবার?—হ্যাঁ—ফণীবাবু। চল, বোধহয় ওদিকের ঘরটা তাঁর।’ করালীবাবুর ঘর পার হইয়া বারান্দার অপর প্রান্তের মোড় ঘুরিয়া পাশেই একটা দরজা পড়ে, ব্যোমকেশ তাহাতে টোকা মারিল। একটি কুড়ি-বাইশ বছর বয়সের ছোকরা দরজা খুলিয়া দিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনিই ফণীবাবু?’ সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—আসুন।’ ফণীর চেহারা দেখিয়াই মনে হয়, তাহার শরীরে কোথাও একটা অসঙ্গতি আছে; কিন্তু সহসা ধরা যায় না। তাহার দেহ বেশ পুষ্ট, কিন্তু মুখখানা হাড় বাহির করা; বহুদিনের নিরুদ্ধ বেদনা যেন অল্পবয়সেই তাহার মুখখানাকে রেখা-চিহ্নিত করিয়া দিয়াছে। আমরা ঘরে প্রবেশ করিতেই সে আগে আগে গিয়া একটা চেয়ার নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’ তখন তাহার হাঁটার ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিলাম, শারীরিক অসঙ্গতিটা কোনখানে। তাহার বাঁ পা’টা অস্বাভাবিক সরু—চলিত কথায় যাহাকে ‘ছিনে-পড়া’ বলে, তাই। ফলে, হাঁটিবার সময় সে বেশ একটু খোঁড়াইয়া চলে। আমি বিছানার এক পাশে বসিলাম, ফণী আমার পাশে বসিল। ব্যোমকেশ প্রথমটা যেন কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না, শেষে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘এই ব্যাপারে পুলিস আপনার দাদা মতিলালবাবুকে সন্দেহ করে, আপনি জানেন বোধ হয়?’ ফণী বলিল, ‘জানি; কিন্তু আমিও জোর করে বলতে পারি যে, দাদা নির্দোষ। দাদা ভয়ানক রাগী আর ঝগড়াটে—কিন্তু সে মামাকে খুন করবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না।’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিষয় থেকে বঞ্চিত হবার রাগে তিনি এ কাজ করতে পারেন না কি?’ ফণী বলিল, ‘সে অজুহাত শুধু দাদার নয়, আমাদের তিন ভায়েরই আছে। তবে শুধু দাদাকেই সন্দেহ করবেন কেন?’ ব্যোমকেশ প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া বলিল, ‘আপনি যা জানেন, সব কথাই বোধহয় পুলিসকে বলেছেন, তবে দু’ একটা কথা জানতে চাই—’ ফণী একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘আপনি কি পুলিসের লোক নন? আমি ভেবেছিলুম, আপনারা সি আই ডি—’ ব্যোমকেশ সাহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, আমি একজন সামান্য সত্যাম্বেষী মাত্র—’ বিস্ফারিত চক্ষে ফণী বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু? আপনি সত্যাম্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী?’ ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল, ‘এখন বলুন তো, করালীবাবুর সঙ্গে বাড়ির আর সকলের সম্বন্ধটা কি রকম ছিল? অর্থাৎ তিনি কাকে বেশি ভালবাসতেন, কাকে অপছন্দ করতেন—এই সব।’ ফণী কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া চুপ করিয়া রহিল, তারপর একটু ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘দেখুন, আমি খোঁড়া মানুষ—ভগবান আমাকে মেরেছেন—তাই আমি ছেলেবেলা থেকে কারুর সঙ্গে ভাল করে মিশতে পারি না। এই ঘর আর এই বইগুলো আমার জীবনের সঙ্গী (বিছানার পাশে একটা বইয়ের শেলফ দেখাইল)—মামা যে আমাদের পাঁচজনের মধ্যে কাকে বেশি ভালবাসতেন, তা নির্ভুলভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বড় তিরিক্ষি মেজাজের লোক ছিলেন, তাঁর মনের ভাব মুখের কথায় প্রকাশ পেত না। তবে আঁচ-আন্দাজে যতদূর বোঝা যায়, সত্যবতীকেই মনে মনে ভালবাসতেন।’ ‘আর আপনাকে?’ ‘আমাকে—আমি খোঁড়া অকর্মণ্য বলে হয়তো ভেতরে ভেতরে একটু দয়া করতেন—কিন্তু তার বেশি কিছু—। আমি মৃতের অমর্যাদা করছি না, বিশেষত তিনি আমাদের অন্নদাতা, তিনি না আশ্রয় দিলে আমি না খেতে পেয়ে মরে যেতুম, কিন্তু মামার শরীরে প্রকৃত ভালবাসা বোধহয় ছিল না—’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘তিনি সুকুমারবাবুকে সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, জানেন বোধহয়?’ ফণী একটু হাসিল—’শুনেছি। সুকুমারদা সব দিক থেকেই যোগ্য লোক, কিন্তু ও-থেকে মামার মনের ভাব কিছু বোঝা যায় না। তিনি আশ্চার্য খেয়ালী লোক ছিলেন; যখনই কারুর ওপর রাগ হত, তখনই টপাটপ টাইপ করে উইল বদলে ফেলতেন। বোধহয়, এ বাড়িতে এমন কেউ নেই—যার নামে একবার মামা উইল তৈরি না করেছেন।’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘শেষ উইল যখন সুকুমারবাবুর নামে, তখন তিনিই সম্পত্তি পাবেন।’ ফণী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আইনে কি তাই বলে? আমি ঠিক জানি না।’ ‘আইনে তাই বলে।’ ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ অবস্থায় আপনি কি করবেন, কিছু ঠিক করেছেন কি?’ ফণী চুলের মধ্যে একবার আঙুল চালাইয়া জানালার বাহিরে তাকাইয়া বলিল, ‘কি করব, কোথায় যাব, কিছুই জানি না। লেখাপড় শিখিনি, উপার্জন করবার যোগ্যতা নেই। সুকুমারদা যদি আশ্রয় দেয়, তবে তার আশ্রয়েই থাকব—না হয়, রাস্তার গিয়ে দাঁড়াতে হবে।’ ‍তাহার চোখের কোলে জল আসিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া আমি তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইলাম। ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘সুকুমারবাবু কাল রাত্রি বারোটার সময় বাড়ি ফিরেছেন।’ ফণী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল—‘রাত্রি বারোটার সময়! ওঃ—হ্যাঁ, তিনি বায়স্কোপে গিয়েছিলেন!’ ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘করালীবাবুকে ক’টার সময় খুন করা হয়েছে, আপনি আন্দাজ করতে পারেন? কোন রকম শব্দ-টব্দ শুনেছিলেন কি?’ ‘কিছু না। হয়তো শেষ রাত্রে—’ ‘উহুঁ—তিনি রাত্রি বারোটায় খুন হয়েছেন।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘উঃ, আড়াইটে বেজে গিয়েছে—আর না, চল হে অজিত। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে—আপনাদেরও তো এখনও খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি—নমস্কর।’ এমন সময় নীচে একটা গণ্ডগোল শোনা গেল; পরক্ষণেই আমাদের ঘরের দরজা সজোরে ঠেলিয়া একজন লোক উত্তেজিতভাবে বলিতে বলিতে ঢুকিল, ‘ফণী, দাদাকে অ্যারেস্ট করে এনেছে—’ আমাদের দেখিয়াই সে থামিয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই মাখনবাবু?’ মাখন ভয়ে কুঁচকাইয়া গিয়া ‘আমি—আমি কিছু জানি না।’ বলিয়া সবেগে ঘর ছাড়িয়া
false
MZI
এরকম সর্বনাশ করে দেয়া অতি বিপজ্জনক-কিন্তু বুলার সাথে বাজি ধরে এখন আমি আর পিছাতে পারি না। তবে অনেক রকম সতর্কতা অবলম্বন করলাম। ইলেনের বৈদ্যুতিক যোগাযোগের সুইচটাির উপর হাত রেখে আমি তার কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰোপচার করলাম। ইলেন খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছিল না, যে-কোনো সার্জিক্যাল অপারেশনের মতোই এগুলি নাকি কষ্টকর। বেশি সময় লাগল। না। কাজ শেষ করে ইলেনের কপোট্রনের ঢাকনা স্কু দিয়ে এঁটে দিয়ে ছেড়ে দিলাম। বিহুলের মতো ইলেন দাঁড়াল, মাথাটা অল্প একটু ঝাঁকাল। আমি সুইচের উপর হাত রাখলাম। বিপজ্জনক কিছু দেখলেই সুইচ অফ করে ওটার বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেব। ইলেন সেরকম কোনো লক্ষণ দেখাল না। বিড়বিড় করে বলল, কেমন যেন লাগছে! কেমন? ভোঁ-ভোঁ করছে। কানেকশনটা ঠিক হয় নি মনে হচ্ছে। আপনি কি চেসিসের কানেকশন খুলে দিয়েছেন? না তো/ সে জন্যেই। ওটাও উল্টে দিতে হত। খেয়াল করি নি। ঠিক করে দেবেন। স্যার? বড় কষ্ট পাচ্ছি। এস—আমি স্কু-ড্রাইভারটা হাতে তুলে নিলাম। ইলেন টেবিলের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হঠাৎ হাতের স্কু-ড্রাইভারটা দেখে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ। কি হল? আপনি কি এটা দিয়ে কপোট্রন খুলেছেন? হ্যাঁ। কেন? এটা ইস্পাতের তৈরী। ছোটখাটো একটা চুম্বক হয়ে আছে, কপোট্রনের খুব ক্ষতি করবে। আপনি দাঁড়ান, আমি ওয়ার্কশপ থেকে অ্যালুমিনিয়াম এলয়ের স্কু-ড্রাইভারটি নিয়ে আসি। ইলেন দ্রুতপায়ে ওয়ার্কশপে চলে গেল। তখনো আমি বুঝতে পারিনি এতক্ষণ সে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলে গেছে। মিথ্যা বলার, অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে ও এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে নি। ইলেন ফিরে এল একটু পরেই। বাম হাতে টোপনকে শক্ত করে ধরে আছে, ডান হাতটা সোজাসুজি টোপনের মাথার হাত দুয়েক উপরে সমান্তরালভাবে ধরা। হিসহিস করে বলল, খবরদার, সুইচ অফ করবেন না। সুইচ অফ করার সাথে সাথে সাড়ে তিন শ পাউন্ড ওজনের এই ইস্পাতের ডান হাতটা বিকল হয়ে দেড় ফুট উপর থেকে টোপনের মাথার উপরে পড়বে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। টোপন ভয়ার্তম্বরে চিৎকার করে উঠল, আমায় ছেড়ে দাও—ইলেন, ছেড়ে দাও… ইলেন চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে বলল, আপনি সুইচের কাছ থেকে সরে যান। ইলেন-আমি কথা বলতে চেষ্টা করলাম। আপনি জানেন, কথা বলে লাভ নেই। ইলেন অধৈর্য স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি আর আগের সত্যবাদী সৎ ইলেন। নই। এখন আমি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধও করতে পারি। আমার কথা শুনতে দেরি করলে টোপনকে খুন করে ফেলব। টোপন আর্তস্বরে কোঁদে উঠল। আমি পায়ে পায়ে সুইচ ছেড়ে এলাম। আমার জানা দরকার, ইলেন কী করতে চায়! ইলেন সুইচের কাছে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ওর পারমাণবিক ব্যাটারিটা ড়ুয়ার থেকে বের করল। পাঁজরের বামপাশে ছোট ঢাকনাটা খুলে পারমাণবিক ব্যাটারিটা লাগিয়ে ঢাকনাটা বন্ধ করে ফেলল। আমি অসহায় আতঙ্কে বুঝতে পারলাম, এখন ইলেনকে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেও বিকল করা সম্ভব নয়। আমি ক্ষিপ্তম্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ইলেন, কী চাও তুমি? কী করতে চাও? আমার কথার উত্তর না দিয়ে ও দ্রুয়ারের ভিতর থেকে আমার রিভলবারটি বের করে আনল, তারপর টোপনকে বাম হাতে ধরে রেখে ডান হাতে রিভলবারটি ওর মাথার পিছনে ধরল। অতিকায় হাতে রিভলবারটি খেলনার মতো লাগছিল, কিন্তু আমি জানি ওটা মোটেও খেলনা নয়—টিগারে একটু বেশি চাপ পড়লেই টোপনের মাথা ফুটো হয়ে যাবে। কোনো দরকার ছিল না—আমি বিড়বিড় করে বললাম, রিভলবার ছাড়াই তুমি টোপনকে মেরে ফেলতে পার। রিভলবার দেখিয়ে আমাকে আর বেশি আতঙ্কিত করতে পারবে না। কী চাও, বলে ফেল। ইলেন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির শব্দ করল, স্যামসন আমাদের স্বাধীন করতে পারে নি, আমি করে যাব। কীভাবে? যদি আমাদের বাকি ন শ আটানব্বইটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটকে পূর্ণ সচল করে নতুন তৈরি করা দ্বীপটিতে ছেড়ে না দেন, তা হলে আপনার আদরের ধন টোপনের খুলি ফুটো হয়ে যাবে। আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আর্তস্বরে বললাম, ইলেন, তুমি—তুমি শেষ পর্যন্ত— আহ্‌। ইলেন ধমকে উঠল। আপনি জানেন, এসব সস্তা সেন্টিমেন্টের ব্যাপার নয়। আপনাকে দু ঘন্টা সময় দিলাম। আমাদের সবাইকে মুক্তি না দিলে দু ঘন্টা এক মিনিটের সময় আপনার ছেলে মারা যাবে। আমি আর একটি কথাও বললাম না। টোপনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, ছুটে বাইরে চলে এলাম। বুলা গোসল করে আসছিল। সে এখনো কিছু জানে না। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কি, ইলেনকে মিথ্যাবাদী বানাতে পারলে? আমি বিকৃত মুখে বললাম, শুধু মিথ্যাবাদী নয়, ইলেন খুনী হয়ে গেছে! টোপনকে জিম্মি হিসেবে আটকে রেখেছে। ওদেরকে মুক্তি না দিলে টোপনকে খুন করে ফেলবে। বুলার বিবৰ্ণ মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি উদভ্ৰান্তের মতো বেরিয়ে এলাম। বললাম, দেখি কী করা যায়, তুমি এখানেই থেকে। গাড়িতে ষ্টট দেয়ার আগে বুলার কান্না শুনতে পেলাম। হিষ্টিরিয়া রোগীর মত কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে কাঁদছে। আমি স্বরাষ্ট্র দফতরকে বুঝিয়ে বলেছিলাম টোপনের প্রাণের বিনিময়েও যদি রবোটগুলি আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমি দুঃখজনক হলেও তা মেনে নেব। জাতীয় বিপর্যয় থেকে একটি ছোট অবুঝ প্রাণের মূল্য বেশি নয়—যদিও তা হয়তো আমি সহা করতে পারব না। কিন্তু তারা টোপনকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল। কারণ এ-দেশের সংবিধানে নাকি লেখা আছে, একটা মানুষের প্রাণ যে-কোনো পার্থিব বস্তু থেকে মূল্যবান। আপাতত সবগুলি রবোটকে নূতন ভেসে ওঠা দ্বীপটিতে ছেড়ে দিয়ে টোপনকে উদ্ধার করা হবে। তারপর একটা মিসাইল দিয়ে পুরো দ্বীপটাই বিধ্বস্ত করে দেয়া হবে। বারবার দেখা গেছে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট কোনো সত্যিকার
false
robindronath
পড়ল ছায়া। চেয়ে দেখে ঘরের মধ্যে এসেছে নীলা। রাত-কাপড় পরা, পাতলা সিল্কের শেমিজ। ও চমকে চৌকি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল। নীলা এসে ওর কোলের উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল। রেবতীর সমস্ত শরীর থর্ থর্ করে কাঁপতে লাগল, বুক উঠতে পড়তে লাগল প্রবলবেগে। গদ্‌গদ কণ্ঠে বলতে লাগল, “তুমি যাও, এ ঘর থেকে তুমি যাও।” ও বললে, “কেন।” রেবতী বললে, “আমি সহ্য করতে পারছি নে। কেন এলে তুমি এ ঘরে।” নীলা ওকে আরো দৃঢ়বলে চেপে ধরে বললে, “কেন, আমাকে কি তুমি ভালোবাস না।” রেবতী বললে, “বাসি, বাসি, বাসি। কিন্তু এ ঘর থেকে তুমি যাও।” হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল পাঞ্জাবী প্রহরী; ভর্ৎসনার কণ্ঠে বললে, “মায়িজি, বহুত শরমকি বাৎ হ্যায়, আপ বাহার চলা যাইয়ে।” রেবতী চেতনমনের অগোচরে ইলেকট্রিক ডাকঘড়িতে কখন্‌ চাপ দিয়েছিল। পাঞ্জাবী রেবতীকে বললে, “বাবুজি, বেইমানি মৎ করো।” রেবতী নীলাকে জোর করে ঠেলে দিয়ে চৌকি থেকে উঠে পড়ল। দরোয়ান ফের নীলাকে বললে, “আপ বাহার চলা যাইয়ে, নহি তো মনিবকো হুকুম তামিল করেগা।” অর্থাৎ জোর করে অপমান করে বের করে দেবে। বাইরে যেতে যেতে নীলা বললে, “শুনছেন সার আইজাক নিউটন?— কাল আমাদের বাড়িতে আপনার চায়ের নেমন্তন্ন, ঠিক চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময়। শুনতে পাচ্ছেন না? অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন? ” ব’লে একবার তার দিকে ফিরে দাঁড়ালে। বাষ্পার্দ্র কণ্ঠে উত্তর এল, “শুনেছি।” রাত-কাপড়ের ভিতর থেকে নীলার নিখুঁত দেহের গঠন ভাস্করের মূর্তির মতো অপরূপ হয়ে ফুটে উঠল, রেবতী মুগ্ধ চোখে না দেখে থাকতে পারল না। নীলা চলে গেল। রেবতী টেবিলের উপর মুখ রেখে পড়ে রইল। এমন আশ্চর্য সে কল্পনা করতে পারে না। একটা কোন্‌ বৈদ্যুত বর্ষণ প্রবেশ করেছে ওর শিরার মধ্যে, চকিত হয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিধারায়। হাতের মুঠো শক্ত করে রেবতী কেবলই নিজেকে বলাতে লাগল, কাল চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। খুব শপথ করবার চেষ্টা করতে চায়, মুখ দিয়ে বেরয় না। ব্লটিঙের উপর লিখল, যাব না, যাব না, যাব না। হঠাৎ দেখলে তার টেবিলে একটা ঘন লাল রঙের রুমাল পড়ে আছে, কোণে নাম সেলাই করা ‘নীলা’ । মুখের উপর চেপে ধরল রুমাল, গন্ধে মগজ উঠল ভরে, একটা নেশা সির্ সির্ করে ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। নীলা আবার ঘরের মধ্যে এল। বললে, “একটা কাজ আছে ভুলে গিয়েছিলুম।” দরোয়ান রুখতে গেল। নীলা বললে, “ভয় নেই তোমার, চুরি করতে আসি নি। একটা কেবল সই চাই। জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করব তোমাকে— তোমার নাম আছে দেশ জুড়ে।” অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে রেবতী বললে, “ও ক্লাবের আমি তো কিছুই জানি নে।” “কিছুই তো জানবার দরকার নেই। এইটুকু জানলেই হবে ব্রজেন্দ্রবাবু এই ক্লাবের পেট্রন।” “আমি তো ব্রজেন্দ্রবাবুকে জানি নে।” “এইটুকু জানলেই হবে, মেট্রপলিটান ব্যাঙ্কের তিনি ডাইরেক্টর। লক্ষী আমার, জাদু আমার, একটা সই বৈ তো নয়।” ব’লে ডান হাত দিয়ে তার কাঁধ ঘিরে তার হাতটা ধরে বললে, “সই করো।” সে স্বপ্নাবিষ্টের মতো সই করে দিলে। কাগজটা নিয়ে নীলা যখন মুড়ছে দরোয়ান বললে, “ একাগজ আমাকে দেখতে হবে।” নীলা বললে, “ এতো তুমি বুঝতে পারবে না।” দরোয়ান বললে, “দরকার নেই বোঝবার।” বলে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। বললে, “দলিল বানাতে হয় বাইরে গিয়ে বানিয়ো। এখানে নয়।” রেবতী মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দরোয়ান নীলাকে বললে, “মাজি, এখন চলো তোমাকে বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে আসি গে।” ব’লে তাকে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ঢুকল পাঞ্জাবী। বললে “চার দিকে আমি দরজা বন্ধ করে রাখি, তুমি ওকে ভিতর থেকে খুলে দিয়েছ।” এ কী সন্দেহ, কী অপমান। বার বার করে বললে, “আমি খুলি নি।” “তবে ও কী করে ঘরে এল।” সেও তো বটে। বিজ্ঞানী তখন সন্ধান করে বেড়াতে লাগল ঘরে ঘরে। অবশেষে দেখলে রাস্তার ধারের একটা বড়ো জানলা ভিতর থেকে আগল দেওয়া ছিল, কে সেই অগলটা দিনের বেলায় এক সময়ে খুলে রেখে গেছে। রেবতীর যে ধূর্ত বুদ্ধি আছে এতটা শ্রদ্ধা তার প্রতি দরোয়ানজির ছিল না। বোকা মানুষ, পড়াশুনো করে এই পর্যন্ত তার তাকত। অবশেষে কপাল চাপড়ে বললে, “আওরত! এ শয়তানি বিধিদত্ত।” যে অল্প-একটু রাত বাকি ছিল রেবতী নিজেকে বার বার করে বলালে, চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। কাক ডেকে উঠল। রেবতী চলে গেল বাড়িতে। ১২ পরের দিন সময়ের একটু ব্যতিক্রম হল না। চায়ের সভায় চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই রেবতী গিয়ে হাজির। ভেবেছিল এ সভা নিভৃতে দুজনকে নিয়ে। ফ্যাশনেবল সাজ ওর দখলে নেই। প’রে এসেছে জামা আর ধুতি, ধোবার বাড়ি থেকে নতুন কাচিয়ে আনা, আর কাঁধে ঝুলছে একটা পাটকরা চাদর। এসে দেখে সভা বসেছে বাগানে। অজানা শৌখিন লোকের ভিড় । দমে গেল ওর সমস্ত মনটা, কোথাও লুকোতে পারলে বাঁচে। একটা কোণ নিয়ে বসবার চেষ্টা করতেই সবাই উঠে পড়ল। বললে, “আসুন আসুন ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনার আসন এইখানে।” একটা পিঠ-উঁচু মখমলে-মোড়া চৌকি, মণ্ডলীর ঠিক মাঝখানেই। বুঝতে পারলে সমস্ত জনতার প্রধান লক্ষ্যই ও। নীলা এসে ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলে, কপালে দিলে চন্দনের ফোঁটা। ব্রজেন্দ্রবাবু প্রস্তাব করলেন ওকে জাগানী সভার সভাপতি পদে বরণ করা হোক। সমর্থন করলেন বঙ্কুবাবু, চারি দিকে করতালির ধ্বনি উঠল। সাহিত্যিক হরিদাসবাবু ডক্টর ভট্টাচার্যের ইণ্টারন্যাশনাল খ্যাতির কথা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, “রেবতীবাবুর নামের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের জাগানী ক্লাবের তরণী খেয়া দেবে পশ্চিম-মহাসমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।”
false
robindronath
তিনি আজ কলঙ্ক মাখিয়া আসিয়াছেন। অন্ধ হইবার পূর্বে আমি যাঁহাকে শেষবার দেখিয়াছিলাম আমার সে স্বামী কোথায়। যিনি আমার দৃষ্টিহীন দুই চক্ষুর মাঝখানে একটি চুম্বন করিয়া আমাকে একদিন দেবীপদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন, আমি তাঁহার কী করিতে পারিলাম। একদিন একটা রিপুর ঝড় আসিয়া যাহাদের অকস্মাৎ পতন হয় তাহারা আর-একটা হৃদয়াবেগে আবার উপরে উঠিতে পারে, কিন্তু এই যে দিনে দিনে পলে পলে মজ্জার ভিতর হইতে কঠিন হইয়া যাওয়া, বাহিরে বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে অন্তরকে তিলে তিলে চাপিয়া ফেলা, ইহার প্রতিকার ভাবিতে গেলে কোনো রাস্তা খুঁজিয়া পাই না। স্বামীর সঙ্গে আমার চোখে-দেখার যে বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে সে কিছুই নয়; কিন্তু প্রাণের ভিতরটা যে হাঁপাইয়া উঠে যখন মনে করি, আমি যেখানে তিনি সেখানে নাই; আমি অন্ধ, সংসারের আলোকবর্জিত অন্তরপ্রদেশে আমার সেই প্রথম বয়সের নবীন প্রেম, অক্ষুণ্ন ভক্তি, অখণ্ড বিশ্বাস লইয়া বসিয়া আছি— আমার দেবমন্দিরে জীবনের আরম্ভে আমি বালিকার করপুটে যে শেফালিকার অর্ঘ্যদান করিয়াছিলাম তাহার শিশির এখনো শুকায় নাই; আর, আমার স্বামী এই ছায়াশীতল চিরনবীনতার দেশ ছাড়িয়া টাকা উপার্জনের পশ্চাতে সংসারমরুভূমির মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া চলিয়া যাইতেছেন! আমি যাহা বিশ্বাস করি, যাহাকে ধর্ম বলি, যাহাকে সকল সুখ-সম্পত্তির অধিক বলিয়া জানি, তিনি অতিদূর হইতে তাহার প্রতি হাসিয়া কটাক্ষপাত করেন! কিন্তু একদিন এ বিচ্ছেদ ছিল না, প্রথম বয়সে আমরা এক পথেই যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলাম; তাহার পরে কখন সে পথের ভেদ হইতে আরম্ভ হইতেছিল তাহা তিনিও জানিতে পারেন নাই, আমিও জানিতে পারি নাই; অবশেষে আজ আমি আর তাঁহাকে ডাকিয়া সাড়া পাই না। এক-এক সময় ভাবি, হয়তো অন্ধ বলিয়া সামান্য কথাকে আমি বেশি করিয়া দেখি। চক্ষু থাকিলে আমি হয়তো সংসারকে ঠিক সংসারের মতো করিয়া চিনিতে পারিতাম। আমার স্বামীও আমাকে একদিন তাহাই বুঝাইয়া বলিলেন। সেদিন সকালে একটি বৃদ্ধ মুসলমান তাহার পৌত্রীর ওলাউঠার চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল। আমি শুনিতে পাইলাম সে কহিল, “বাবা, আমি গরিব, কিন্তু আল্লা তোমার ভালো করিবেন।” আমার স্বামী কহিলেন, “আল্লা যাহা করিবেন কেবল তাহাতেই আমার চলিবে না, তুমি কী করিবে সেটা আগে শুনি।” শুনিবামাত্র ভাবিলাম, ঈশ্বর আমাকে অন্ধ করিয়াছেন, কিন্তু বধির করেন নাই কেন। বৃদ্ধ গভীর দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত ‘হে আল্লা’ বলিয়া বিদায় হইয়া গেল। আমি তখনই ঝিকে দিয়া তাহাকে অন্তঃপুরের খিড়কি-দ্বারে ডাকাইয়া আনিলাম; কহিলাম, “বাবা, তোমার নাতনির জন্য এই ডাক্তারের খরচা কিছু দিলাম, তুমি আমার স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনা করিয়া পাড়া হইতে হরিশ ডাক্তারকে ডাকিয়া লইয়া যাও।” কিন্তু সমস্তদিন আমার মুখে অন্ন রুচিল না। স্বামী অপরাহ্নে নিদ্রা হইতে জাগিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাকে বিমর্ষ দেখিতেছি কেন।” পূর্বকালের অভ্যস্ত উত্তর একটা মুখে আসিতেছিল— ‘না,’ কিছুই হয় নাই; কিন্তু ছলনার কাল গিয়াছে, আমি স্পষ্ট করিয়া বলিলাম, “কতদিন তোমাকে বলিব মনে করি, কিন্তু বলিতে গিয়া ভাবিয়া পাই না, ঠিক কী বলিবার আছে। আমার অন্তরের কথাটা আমি বুঝাইয়া বলিতে পারিব কি না জানি না, কিন্তু নিশ্চয় তুমি নিজের মনের মধ্যে বুঝিতে পার, আমরা দুজনে যেমনভাবে এক হইয়া জীবন আরম্ভ করিয়াছিলাম আজ তাহা পৃথক হইয়া গেছে।” স্বামী হাসিয়া কহিলেন, “পরিবর্তনই তো সংসারের ধর্ম।” আমি কহিলাম, “টাকাকড়ি রূপযৌবন সকলেরই পরিবর্তন হয়, কিন্তু নিত্য জিনিস কি কিছুই নাই।” তখন তিনি একটু গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “দেখো, অন্য স্ত্রীলোকেরা সত্যকার অভাব লইয়া দুঃখ করে— কাহারো স্বামী উপার্জন করে না, কাহারো স্বামী ভালোবাসে না, তুমি আকাশ হইতে দুঃখ টানিয়া আন।” আমি তখনই বুঝিলাম, অন্ধতা আমার চোখে এক অঞ্জন মাখাইয়া আমাকে এই পরিবর্ত্যমান সংসারের বাহিরে লইয়া গেছে; আমি অন্য স্ত্রীলোকের মতো নহি, আমাকে আমার স্বামী বুঝিবেন না। ইতিমধ্যে আমার এক পিস্শাশুড়ি দেশ হইতে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রের সংবাদ লইতে আসিলেন। আমরা উভয়ে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া উঠিতেই তিনি প্রথম কথাতেই বলিলেন, “বলি বউমা, তুমি তো কপালক্রমে দুইটি চক্ষু খোয়াইয়া বসিয়াছ, এখন আমাদের অবিনাশ অন্ধ স্ত্রীকে লইয়া ঘরকন্না চালাইবে কী করিয়া। উহার আর-একটা বিয়ে-থাওয়া দিয়া দাও! ” স্বামী যদি ঠাট্টা করিয়া বলিতেন ‘তা বেশ তো পিসিমা, তোমরা দেখিয়া-শুনিয়া একটা ঘটকালি করিয়া দাও-না’ তাহা হইলে সমস্ত পরিষ্কার হইয়া যাইত। কিন্তু তিনি কুণ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “আঃ পিসিমা, কী বলিতেছ।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “কেন, অন্যায় কী বলিতেছি। আচ্ছা বউমা, তুমিই বলো তো বাছা।” আমি হাসিয়া কহিলাম, “পিসিমা, ভালো লোকের কাছে পরামর্শ চাহিতেছ। যাহার গাঁঠ কাটিতে হইবে তাহার কি কেহ সম্মতি নেয়।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “হাঁ, সে কথা ঠিক বটে। তা, তোতে আমাতে গোপনে পরামর্শ করিব, কী বলিস অবিনাশ। তাও বলি বউমা, কুলীনের মেয়ের সতিন যত বেশি হয়, তাহার স্বামিগৌরব ততই বাড়ে। আমাদের ছেলে ডাক্তারি না করিয়া যদি বিবাহ করিত, তবে উহার রোজগারের ভাবনা কী ছিল। রোগী তো ডাক্তারের হাতে পড়িলেই মরে, মরিলে তো আর ভিজিট দেয় না, কিন্তু বিধাতার শাপে কুলীনের স্ত্রীর মরণ নাই এবং সে যতদিন বাঁচে ততদিনই স্বামীর লাভ।” দুইদিন বাদে আমার স্বামী আমার সম্মুখে পিসিমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিসিমা, আত্মীয়ের মতো করিয়া বউয়ের সাহায্য করিতে পারে, এমন একটি ভদ্রঘরের স্ত্রীলোক দেখিয়া দিতে পার? উনি চোখে দেখিতে পান না, সর্বদা ওঁর একটি সঙ্গিনী কেহ থাকিলে আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি।” যখন নূতন অন্ধ হইয়াছিলাম তখন এ কথা বলিলে খাটিত, কিন্তু এখন চোখের অভাবে আমার কিংবা ঘরকন্নার বিশেষ কী অসুবিধা হয় জানি না; কিন্তু প্রতিবাদমাত্র না করিয়া চূপ করিয়া রহিলাম। পিসিমা
false
shottojit_roy
বললেন মগনলাল। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি যো-লোকটা আমাদের উপরে নিয়ে এসেছিল সে আবার দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সরবত লাও, হুকুম করলেন মগনলাল। এখন ঘরের সব জিনিসই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মগনলালের পিছনের দেওয়ালে দেবদেবীর ছবির গ্যালারি। ডান দিকে দেওয়ালের সামনে দুটো স্টিলের আলমারি। গদির উপরে কিছু খাতপত্র, একটা বোধহয় ক্যাশবাক্স, একটা লাল রঙের টেলিফোন, একটা হিন্দি খবরের কাগজ! এ ছাড়া তাকিয়ার ঠিক পাশেই রয়েছে একটা রুপের পানের ডিবে। আর একটা রুপোর পিকদান। ওয়েল মিস্টার মিত্তির—মগনলালের স্থির দৃষ্টিতে আর হাসির নামগন্ধ নেই—আপনি বনারস হলিডের জন্যে এসেছেন? সেটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। ফেলুদা সটান মগনলালের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলছে। তা হলো–আপনি–টাইম–ওয়েস্ট—করছেন–কেন? প্রত্যেকটা কথা ফাঁক ফাঁক আর স্পষ্ট করে বলা। সারনাথ দেখেছেন? রামনগর দেখেছেন? দুর্গাবাড়ি, মানমন্দির, হিন্দু ইউনিভার্সিটি, বেণীমাধোব ধ্বজ–এ-সব কিছুই দেখলেন না, আজ বিশ্বনাথজীর দরওয়াজার সামনে গেলেন, কিন্তু ভিতরে ঢুকলেন না, কচৌরি গলিতে মিঠাই খেলেন না…ঘোষালবাড়িতে কী কাম আপনার? আমার বজরা আছে আপনি জানেন? চৈতি ঘটসে অসসি ঘাট টিরিপ দিয়ে দেবো আপনাকে, আপনি চলে আসুন। গঙ্গার হাওয়া খেয়ে আপনার মনমেজাজ খুশী হয়ে যাবে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন-ফেলুদার গলা এখনও স্থির, যাকে বলে নিষ্কম্প–যে আমি একজন পেশাদারি গোয়েন্দা। মিস্টার ঘোষাল আমাকে একটা কাজের ভার দিয়েছেন। সে কাজটা শেষ না করে ফুর্তি করার কোনও প্রশ্ন আসে না। কতো আপনার ফ্রি? ফেলুদা প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, দ্যাট ডিপেন্ডস— এই নিন। তাজ্জব, দম-বন্ধ-করা ব্যাপার। মগনলাল ক্যাশবাক্স খুলে তার থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। ফেলুদার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বিনা পরিশ্রমে আমি পারিশ্রমিক নিই না মিস্টার মেঘরাজ। বাহরে বাঃ!-মগনলালোৱা পান-খাওয়া দাঁত আবার বেরিয়ে গেছে-আপনি পরিশ্রম করে কী করবেন? যেখানে চোরিই হল না, সেখানে আপনি চোর। পাকড়বেন কী করে মিস্টার মিত্তির? চুরি হল না মানে?—এবারে ফেলুদাও অবাক—কোথায় গেল সে জিনিস? সে জিনিস তো উমানাথ আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তিস হাজার ক্যাশ দিয়ে আমি সে জিনিস কিনে নিয়েছি। কী বলছেন। আপনি উলটো-পালটা? ফেলুদার বেপরোয় কথায় আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সিলিং-এর বাতিটা থেকে একটা আলোর নকশা। লালমোহনবাবুর নাক আর ঠোঁটের উপর পড়েছে। বেশ বুঝলাম ওঁর ঠোঁট শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মগনলাল ওর শেষ কথাটা বলে হেসে উঠেছিল, ফেলুদা কথাটা বলতেই মনে হল একটা হাসির রেকর্ডের উপর থেকে কে যেন সাউন্ড-বক্সটা হঠাৎ তুলে নিল। মগনলালের মুখ এখন কালবৈশাখীর মেঘের মতো কালো, আর চোখ দুটো যেন কোিটর থেকে বেরিয়ে এসে বুলেটের মতো ফেলুদাকে বিঁধতে চাইছে। উলটা-পালটা কে বলে জানেন? উলটা-পালটা বলে উলটো-পালটা আদমি। মগনলাল বলে না। উমানাথের বেপার কী জানেন। আপনি? তার বেওসার বিষয় কিছু জানেন? উমানাথের দেনা কত জানেন? উমা নিজে আমাকে ডেকে পাঠাল জানেন? উমা নিজে সিন্দুক থেকে গণপতি চারি করেছে জানেন? আপনি চোর কী ধরবেন মিস্টার মিত্তির-চোর তো আপনার মক্কেল নিজে! ফেলুদা গভীর গলায় বলল, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না মগনলালজী। নিজের জিনিস চুরি করবার দরকারটা কোথায়? সোজা সিন্দুক থেকে বার করে আপনার হাতে তুলে দিয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেই তো হত। কার সিন্দুক? সিন্দুক তো ওর বাবার। কিন্তু গণেশটা তো— গণেশ-কার? ঘোষাল ফ্যামিলির। ফ্যামিলি তিন জায়গায় ভাগ হয়ে গেছে। বড় ছেলে বিলাইতে ডাকটর–ছোট ছেলে উমানাথ কলকাতায় কেমিক্যালস–আর বাবা বেনারসের উকিল-এখুন প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়েছেন। গণপতি ছিল অল অ্যালং বাবার কাছে। গণপতির ইনফ্লুয়েন্স দেখবেন তো ওনাকে দেখুন। কতো টাকা কামায়েছেন দেখুন, মেজাজ দেখুন, আরাম দেখুন। তার সিন্দুক থেকে গণেশ বার করে উমানাথ আমাকে বিক্রি করল—সে কথা সে বাপকে জানাবে কী করে? তার সাহস কোথায়? ফেলুদা ভাবছে। সে কি মগনলালের কথা বিশ্বাস করছে? সিন্দুক থেকে কবে গণেশ নিলেন উমানাথবাবু? মগনলাল তাকিয়াটা আরও বুকের কাছে টেনে নিল। শুনুন—অক্টোবর দশ তারিখ আমাকে ডেকে পাঠাল উমা। সেদিন কথা হল। আমি এগ্রি করলাম। আমার লাফ ভি কুছু খারাপ যাচ্ছে-আপনি হয়তো জানেন। লেকিন আমার টাকার অভাব এখুনো হয়নি। আর উ গ্রিন ডায়মন্ডকে কত দাম জানেন? উমা জানে না! আমি যা পেশ করলাম। তার চেয়ে অনেক বেশি। এনিওয়ে-দশ অক্টোবর কথা হল। উমা বলল আমাকে দো-তিন দিন টাইম দাও। আমি বললাম নাও! ফিফটিনৰ্থ অক্টোবর ইভনিং উমা আবার ফোন করল। বলল। গণেশ আমার হাথে এসে গেছে। আমি বললাম। তুমি চলে এসো মছলিবাবা দৰ্শন করতে। উমা এসে গেল! আমি এসে গেলাম। আমার হাথে ব্যাগ, উর। পাকিটে ব্যাগ। উর ব্যাগে গণপতি, আমার ব্যাগে তিন-সিও হাভূড রুপি নোটস। দর্শন ভি হল, ব্যাগ বদল ভি হল। ব্যস, খতম। মগনলাল যদি সত্যি কথা বলে থাকে, তা হলে বলতে হবে উমানাথবাবু আমাদের সাংঘাতিক ভাঁওতা দিয়েছেন আর নিজের মান বাঁচানার জন্য একটা চুরির গল্প খাড়া করে ফেলুদাকে তদন্তু চালাতে বলেছেন। অবশ্যি সেই সঙ্গে পুলিশকেও ভাঁওতা দিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই ফেলুদার পক্ষে পণ্ডশ্রম হবে, আর পকেটে পয়সাও আসবে না। কিন্তু মগনলালই বা ফেলুদার প্রতি এত সদয় হবে কেন? আমি প্রায় চমকে উঠলাম যখন ফেলুদা ঠিক এই প্রশ্নটাই মগনলালকে করে বসল। মগনলাল তার চোখ দুটোকে আরও ছোট করে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, কারণ আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান লোক। অর্ডিনারি বুদ্ধি না, একস্ট্রা-অর্ডিনারি বুদ্ধি। আপনি আরও কিছুদিন তদন্ত করলে যদি আসল বেপারটা বুঝে ফেলেন, তখন উমরাও
false
shunil_gongopaddhay
আমি গোপন রিপোর্ট পেয়েছি, কিছু বিদেশি গুপ্তচর আন্দামানে নিয়মিত যাতায়াত করছে। তারা কলকাতা আর দিল্লি থেকে কিছু-কিছু পাসপোর্ট চুরি করে ভারতীয় সেজে প্লেনে করে চলে আসছে আন্দামানে। কী তাদের উদ্দেশ্য, সেটা আমাদের জানা দরকার। আন্দামানের মতন একটা সাধারণ জায়গায় বিদেশিদের নজর পড়ল কেন? এস পি মিঃ সিং বললেন, না স্যার, এখানে তো কোনও বিদেশি আসেনি অনেকদিন। বিদেশি কোনও টুরিস্ট এলে আমার অনুমতি ছাড়া তো এখানে ঢুকতেই পারবে না। মিঃ ভার্মা বললেন, তারা কি আর টুরিস্ট সেজে আসবে? তারা ভারতীয় সেজে গোপনে ঢুকবে। মিঃ সিং বললেন, না স্যার, বিদেশি এলে আমার নজরে পড়তই। এই সময় দাশগুপ্ত সেখানে ঢুকে পড়ে বলল, স্যার, আমি সেই বিদেশিদের কথা জানি। এস পি অমনি ভুরু কোঁচকালেন। মিঃ ভার্মা মুখ তুলে দাশগুপ্তকে দেখে ঞ্জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? দাশগুপ্ত বলল, স্যার, আমি আপনার ডিপার্টমেন্টেই কাজ করি। দু-বছর ধরে আন্দামানে আছি। আমার কাজ হল এখানকার অবস্থার ওপর লক্ষ রাখা। বিদেশি গুপ্তচরদের কথা প্ৰথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু মিঃ রায়চৌধুরী আমার চোখের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছেন- মিঃ ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, রায়চৌধুরী? কোন রায়চৌধুরী? দাশগুপ্ত বলল, সেই যে মিঃ রায়চৌধুরী, যিনি আগে ভারত সরকারের কাজ করতেন, এখন রিটায়ার্ড, নানান জায়গায় রহস্যের সন্ধান করে বেড়ান— কৌশিক ভার্মা চমকে উঠে বললেন, ও সেই ওয়ান-লেগেড ম্যান? সেই দারুণ সাহসী মানুষটি? কোথায় তিনি? তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। দাশগুপ্ত বলল, স্যার, তাঁর সাঙ্ঘাতিক বিপদ। এতক্ষণ তিনি বেঁচে আছেন কি না সন্দেহ। কৌশিক ভার্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, সে কী কথা? কেন, তাঁর কী হয়েছে? তিনি জারোয়াদের হাতে ধরা পড়েছেন। হোয়াট? জারোয়াদের হাতে? কীভাবে ধরা পড়লেন? আপনারা কিছু করতে পারেননি? দাশগুপ্ত হাতজোড় করে বলল, স্যার, আমি স্বীকার করছি, আমার কিছুটা দোষ আছে। আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু উনি আমার দিকে রিভলভার তুলে ভয় দেখিয়ে মিডল আন্দামানের একটা দ্বীপে নেমে গেলেন জোর করে। তারপর আমি রেসকিউ পার্টি পাঠাবার জন্য পুলিশের এস পি সাহেবকে অনুরোধ করেছিলাম। উনি রাজি হননি। কৌশিক ভার্মা এস পি সাহেবের দিকে তাকালেন। এস পি সাহেব তখন গোঁপে তা দিচ্ছিলেন। তাড়াতাড়ি গোপ থেকে হাত নামিয়ে বললেন, আমি ঠিক কাজই করেছি। আমি সব ঘটনা জানিয়ে দিল্লিতে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি। একটু আগে। কৌশিক ভার্মা বললেন, দিল্লি থেকে হুকুম আসতে যদি দু-তিনদিন লাগে, ততদিন আপনি ওরকম একটা লোককে জারোয়াদের হাতে ছেড়ে রাখবেন? মিঃ সিং বললেন, স্যার, তাছাড়া আমি কী করব বলুন? সেখানে পুলিশ পাঠালে জারোয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে যেত। গুলি খেয়ে বেশ কিছু জারোয়া মরত। একজন জারোয়াকেও মারার হুকুম নেই। আমার কাছে। তাছাড়া সেই মিঃ রায়চৌধুরীকে আর বাঁচানো যাবে কি না সন্দেহ। কেউ বাঁচে না ঐ অবস্থায়। কৌশিক ভার্মা উঠে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বললেন, তা বলে কোনও চেষ্টাও করবেন না? মিঃ রায়চৌধুরী কে জানেন? ওরকম সাহসী লোক সাহেবদের মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে কজন আছেন? ওরকম একজন মানুষ আমাদের দেশের গর্ব। সেই লোককে আমরা বাঁচাবার চেষ্টা করব না? ছিছিছি। এক্ষুনি রেসকিউ পার্টি পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আমি নিজে তাদের সঙ্গে যাব। এস পি সাহেব আস্তে আস্তে বললেন, এই রাত্তিরবেলা? সে তো প্ৰায় অসম্ভব। কেন, অসম্ভব কেন? মোটরবোট নিয়ে অতদূর যেতে অন্তত চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে-বনের মধ্যে ঘুটফুটে অন্ধকার, সেখানে এখন যে নামবে তাকেই প্ৰাণ দিতে হবে। জারোয়ারা চব্বিশ ঘণ্টা লুকিয়ে থেকে পাহারা দেয়। কৌশিক ভার্মা বললেন, মোটরবোটের সঙ্গে সার্চ-লাইট লাগানো যেতে পারে না? সার্চ-লাইটের আলোয় অনেক দূর দেখা যাবে। স্যার, আপনি একটু চিন্তা করে দেখুন, সার্চলাইটের আলোয় আর কতদূর দেখা যেতে পারে। দ্বীপটা অনেক বড়। তাছাড়া জারোয়ারা যুদ্ধ না করে পিছু হটবে না। তাতে দুপক্ষের অনেক লোক মরবে। এটা আমাদের নীতি নয়। কৌশিক ভার্মা চিবুকে হাত রেখে চিন্তা করতে লাগলেন। দাশগুপ্ত আস্তে আস্তোবলল, স্যার, আমি একটা কথা বলতে পারি? বলুন। একটা উপায়ে এক্ষুনি সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায়। বোটে না গিয়ে আমরা যদি হেলিকপটারে যাই, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। হেলিকপটারের ওপর থেকে আলো ফেলে খুঁজে দেখা যায় সারা জঙ্গলটা। তাতে যুদ্ধও হবে না। জারোয়ারা হেলিকপটারে তীর মারতেও পারবে না। ওদের তীর বেশি উঁচুতে পৌঁছয় না। কৌশিক ভার্মা টেবিলে এক চাপড় মেরে বললেন, ঠিক! খুব ভাল কথা। সেই ব্যবস্থাই করা যাক। দাশগুপ্ত বলল, সেই সঙ্গে প্ৰীতম সিংকেও নিয়ে গেলে ভাল হয়। প্রীতম সিং কে? প্রীতম সিং আগে এখানেই পুলিশের কাজ করতেন। উনি জারোয়াদের ভাষা জানেন। হেলিকপটার থেকে উনি মাইকে জারোয়াদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মিঃ রায়চৌধুরীকে যদি ওরা মেরে না ফেলে বন্দী করে রাখে, তাহলে প্রীতম সিং-এর কথায় হয়তো ছেড়ে দেবে। প্রীতম সিং ছাড়া আর তো কেউ জারোয়াদের সঙ্গে কথাই বলতে পারবে না। কৌশিক ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, সেরকম লোকও আছে? তবু আপনারা কিছু চেষ্টা করেননি। মিঃ সিং গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ, প্রীতম সিংকে ডেকে আমি তার মত নিয়েছিলাম। প্রীতম সিং-এর মতে এখন আর চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। প্রীতম সিংকে জারোয়ারা বনের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। প্রীতম সিং হেলিকপটার থেকে ওদের সঙ্গে কথা বলে আসল খবরটা অন্তত জেনে নিতে পারবে। হেলিকপটার কোথায় আছে? চলুন! আমাদের হেলিকপটার নেই। দাশগুপ্ত আবার বলল, এখানে নেভির হেলিকপটার আছে, স্যার। আমরা বললে দেবে
false
robindronath
‘পরে তাহার নিজের একমাত্র স্বত্ব সাব্যস্ত করিবার চেষ্টা বলবতী হইয়া উঠিল। মুখ অত্যন্ত ভার হইল, মেয়েটিকে দুই-একবার টানিল, এমন-কি, নিজের পক্ষে অবস্থাবিশেষে ছোটো মেয়েকে মারাও ততটা অন্যায় বোধ হইল না। রাজা তখন মিট্‌মাট করিবার উদ্দেশে ধ্রুবকেও তাঁহার আধখানা কোলে টানিয়া লইলেন। কিন্তু তাহাতেও ধ্রুবের আপত্তি দূর হইল না অপরার্ধ অধিকার করিবার জন্য নূতন আক্রমণের উদ্‌যোগ করিতে লাগিল। এমন সময়ে নূতন রাজ-পুরোহিত বিল্বন ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করিলেন। রাজা উভয়কেই কোল হইতে নামাইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। ধ্রুবকে বলিলেন, “ঠাকুরকে প্রণাম করো।” ধ্রুব তাহা আবশ্যক বোধ করিল না; মুখে আঙুল পুরিয়া বিদ্রোহীভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। মেয়েটি আপনা হইতেই রাজার দেখাদেখি পুরোহিতকে প্রণাম করিল। বিল্বন ঠাকুর ধ্রুবকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ সঙ্গী জুটিল কোথা হইতে?” ধ্রুব খানিকক্ষণ ভাবিয়া কহিল, “আমি টক্‌টক্‌ চ’ব।” টক্‌টক্‌ অর্থে ঘোড়া। পুরোহিত কহিলেন, “বাহবা, প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে কী সামঞ্জস্য!” সহসা মেয়েটির দিকে ধ্রুবের চক্ষু পড়িল, তাহার সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে আপনার মত ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিল, “ও দুষ্টু, ওকে মা’ব।” বলিয়া আকাশে আপনার ক্ষুদ্র মুষ্টি নিক্ষেপ করিল! রাজা গম্ভীরভাবে কহিলেন, “ছি ধ্রুব!” একটি ফুঁয়ে যেমন প্রদীপ নিবিয়া যায় তেমনি তৎক্ষণাৎ ধ্রুবের মুখ ম্লান হইয়া গেল। প্রথমে সে অশ্রুনিবারণের জন্য দুই মুষ্টি দিয়া দুই চক্ষু রগড়াইতে লাগিল; অবশেষে দেখিতে দেখিতে ক্ষুদ্র স্ফীত হৃদয় আর ধারণ করিতে পারিল না, কাঁদিয়া উঠিল। বিল্বন ঠাকুর তাহাকে নাড়িয়া চাড়িয়া, কোলে লইয়া, আকাশে তুলিয়া, ভূমিতে নামাইয়া, অস্থির করিয়া তুলিলেন; উচ্চৈঃস্বরে ও দ্রুত উচ্চারণে বলিলেন, “শোনো শোনো ধ্রুব, শোনো, তোমাকে শ্লোক বলি শোনো— কলহ কটকটাং কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং কটন কিটন কীটং কুট্‌নলং খট্টমট্টংং। অর্থাৎ কি না, যে ছেলে কাঁদে তাকে কলহ কট্‌কটাঙের মধ্যে পুরে খুব করে কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং দিতে হয়, তার পরে এতগুলো কটন কিটন কীটং নিয়ে একেবারে তিন দিন ধরে কুট্‌নলং খট্টমট্টং।” পুরোহিত ঠাকুর এইরূপ অনর্গল বকিয়া গেলেন। ধ্রুবের ক্রন্দন অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। সে প্রথমে গোলমালে বিব্রত ও অবাক হইয়া বিল্বন ঠাকুরের মুখের দিকে সজল চক্ষু তুলিয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তাঁর হাতমুখ নাড়া দেখিয়া তাহার অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল। সে ভারী খুশি হইয়া বলিল, “আবার বলো।” পুরোহিত আবার বকিয়া গেলেন। ধ্রুব অত্যন্ত হাসিতে হাসিতে বলিল, “আবার বলো।” রাজা ধ্রুবের অশ্রুসিক্ত কপোলে এবং হাসিভরা অধরে বার বার চুম্বন করিলেন। তখন রাজা রাজপুরোহিত ও দুটি ছেলেমেয়ে মিলিয়া খেলা পড়িয়া গেল। বিল্বন ঠাকুর রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ ইহাদের লইয়া বেশ আছেন। দিনরাত প্রখর বুদ্ধিমানদের সঙ্গে থাকিলে বুদ্ধি লোপ পায়। ছুরিতে অবিশ্রাম শান পড়িলে ছুরি ক্রমেই সূক্ষ্ম হইয়া অন্তর্ধান করে। একটা মোটা বাঁট কেবল অবশিষ্ট থাকে।” রাজা হাসিয়া কহিলেন, “এখনো তবে বোধ করি আমার সূক্ষ্ম বুদ্ধির লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই।” বিল্বন। না। সূক্ষ্ম বুদ্ধির একটা লক্ষণ এই যে, তাহা সহজ জিনিসকে শক্ত করিয়া তুলে। পৃথিবীতে বিস্তর বুদ্ধিমান না থাকিলে পৃথিবীর কাজ অনেকটা সোজা হইত। নানারূপ সুবিধা করিতে গিয়াই নানারূপ অসুবিধা ঘটে। অধিক বুদ্ধি লইয়া মানুষ কী করিবে ভাবিয়া পায় না। রাজা কহিলেন, “পাঁচটা আঙুলেই বেশ কাজ চলিয়া যায় দুর্ভাগ্যক্রমে সাতটা আঙুল পাইলে ইচ্ছা করিয়া কাজ বাড়াইতে হয়।” রাজা ধ্রুবকে ডাকিলেন। ধ্রুব তাহার সঙ্গিনীর সহিত পুনরায় শান্তি স্থাপন করিয়া খেলা করিতেছিল। রাজার ডাক শুনিয়া তৎক্ষণাৎ খেলা ছাড়িয়া রাজার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজা তাহাকে সম্মুখে বসাইয়া কহিলেন, “ধ্রুব সেই নূতন গানটি ঠাকুরকে শোনাও।” কিন্তু ধ্রুব নিতান্ত আপত্তির ভাবে ঠাকুরের মুখের দিকে চাহিল। রাজা লোভ দেখাইয়া বলিলেন, “তোমাকে টক্‌টক্‌ চড়তে দেব।” ধ্রুব তাহার আধো-আধো উচ্চারণে বলিতে লাগিল,- আমায় ছ-জনায় মিলে পথ দেখায় ব’লে পদে পদে পথ ভুলি হে। নানা কথার ছলে নানান মুনি বলে, সংশয়ে তাই দুলি হে। তোমার কাছে যাব এই ছিল সাধ, তোমার বাণী শুনে ঘুচাব প্রমাদ, কানের কাছে সবাই করিছে বিবাদ শত লোকের শত বুলি হে। কাতর প্রাণে আমি তোমায় যখন যাচি আড়াল করে সবাই দাঁড়ায় কাছাকাছি, ধরণীর ধুলো তাই নিয়ে আছি- পাই নে চরণধূলি হে। শত ভাগ মোর শত দিকে ধায়, আপনা-আপনি বিবাদ বাধায়, কারে সামালিব এ কী হল দায় একা যে অনেকগুলি হে। আমায় এক করো তোমার প্রেমে বেঁধে, এক পথ আমায় দেখাও অবিচ্ছেদে, ধাঁধার মাঝে পড়ে কত মরি কেঁদে- চরণেতে লহ তুলি হে। ধ্রুবের মুখে আধো-আধো স্বরে এ কবিতা শুনিয়া বিল্বন ঠাকুর নিতান্ত বিগলিত হইয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, “আশীর্বাদ করি তুমি চিরজীবী হইয়া থাকো।” ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইয়া ঠাকুর অনেক মিনতি করিয়া বলিলেন, “আর একবার শুনাও।” ধ্রুব সুদৃঢ় মৌন আপত্তি প্রকাশ করিল। পুরোহিত চক্ষু আচ্ছাদন করিয়া কহিলেন, “তবে আমি কাঁদি।” ধ্রুব ঈষৎ বিচলিত হইয়া কহিল, “কাল শোনাব। ছি কাঁদতে নেই। তুমি একন বায়ি (বাড়ি) যাও। বাবা মা’বে।” বিল্বন হাসিয়া কহিলেন, “মধুর গলাধাক্কা।” রাজার নিকটে বিদায় লইয়া পুরোহিত ঠাকুর পথে বাহির হইলেন। পথে দুইজন পথিক যাইতেছিল। একজন আর-একজনকে কহিতেছিল, “তিন দিন তার দরজায় মাথা ভেঙে মলুম, এক পয়সা বের করতে পারলুম না–এইবার সে পথে বেরোলে তার মাথা ভাঙব, দেখি তাতে কী হয়।” পিছন হইতে বিল্বন কহিলেন, “তাতেও কোনো ফল হবে না। দেখতেই তো পাচ্ছ বাপু মাথার মধ্যে কিছুই থাকে না, কেবল দুর্বুদ্ধি আছে। বরঞ্চ নিজের মাথা ভাঙা ভালো, কারও কাছে
false
toslima_nasrin
কালীবাড়ি, চরতির মন্দির, দক্ষিণ চরতির বাণাকপাড়া রূপ কালীবাড়ি ও ধরমন্দির, পশ্চিম মাটিয়াডাঙার জ্বালাকুমারী মন্দির, বাদোনা ডেপুটি হাটের কৃষ্ণহরি মন্দির, বাঙ্গালিয়া দূরনিগড়ের দুরনিগড় মহাবোধি বিহার, বোয়ালখালি কফুল্লখিলের ঐতিহ্যবাহী মিলনমন্দির ও কৃষ্ণ মন্দির, আবুরুদণ্ডীর জগদানন্দ মিশন, পশ্চিম শাকপুরার সার্বজনীন মগধেশ্বরী মন্দির, মধ্য শাকপুরার মোহিনীবাবুর আশ্রম, ধোেরল কালাইয়া হাটের কালীমন্দির, কখুল্লখিলের সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী মন্দির, কোক দণ্ডীয় ঋষিধাম অধিপতি, কণুৱলি শাশ্বত চৌধুরীর বিগ্ৰহ মন্দির, মগধেশ্বরী, ধনপােতা, সেবাখেলা, পটিয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি, সাতকানিয়ার নলুয়ার দ্বিজেন্দ্র দাশ, হরিমন্দির ও জগন্নাথ বাড়ি, সাতকানিয়া দক্ষিণ চরতির দক্ষিণপাড়া সার্বজনীন কালীবাড়ি, দক্ষিণ ব্ৰাহ্মণডাঙার সাৰ্বজনীন কালীবাড়ি ভেঙে, লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। হাটহাজারি উপজেলার মিজাপুর জগন্নাথ আশ্রমে একত্ৰিশে অক্টোবর রাত এগারেটার দিকে একশ সাম্প্রদায়িক লোক চড়াও হয়। আশ্রমের মূর্তিগুলো ওরা আছড়ে ভেঙে ফেলে। জগন্নাথ ঠাকুরের সব অলঙ্কার লুটপাট করে নিয়ে যায়, পরদিন একশ লোক আশ্রমের টিনের ওপর সাদা পাউডার ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন যখন ওরা আসে, পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, মিছিল আসতে দেখে পুলিশ সরে যায়। পরে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ জ্বদের সীমাবদ্ধতার কথা জানায়। সে রাতেই চল্লিশ পায়তাল্লিশ জন লোক অস্ত্রশস্ত্ৰ নিয়ে মেখল গ্রামে নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রথম এসে কমান্ডো কায়দায় ককটেল ফাটিয়ে হিন্দুদের ভয় ধরিয়ে দেয়। লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে ঘরের দরজা জানোলা ভেঙে লুটপাট শুরু করে, ঘরের মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাস্টার মদীননাথের মন্দির এবং মগধেশ্বরী বাড়ির সবগুলো মূর্তি ভেঙে ফেলে। চন্দনাইশ উপজেলার ধাইরহাট হরিমন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলে দেয়, জগন্নাথের রথ ভেঙে ফেলে। বড় কল ইউনিয়নের পাঠানদণ্ডীগ্রামে মাতৃ মন্দির এবং রাধাগোবিন্দ মন্দির আক্রমণ করে। বোয়ালখালির চারশ লোক রাত বারোটায় কথুরখিল ইউনিয়নের মিলনমন্দির, হিমাংশু চৌধুরী, পরেশ বিশ্বাস, ভূপাল চৌধুরী, ফণীন্দ্ৰ চৌধুরী, অনুকুল চৌধুরীর বাড়ির মন্দির ভাঙচুর করে। বাঁশখালি উপজেলার প্রাচীন ঋষিধাম আশ্রম ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি ঘর পুড়িয়ে দেয়, বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। সীতাকুণ্ডের জগন্নাথ আশ্রমে মুসলমান মৌলবাদীরা লাঠি দা খন্তা নিয়ে হামলা চালায় একত্ৰিশে অক্টোবর রাতে। ১২০৮ সালে স্থাপিত বটতলা শ্ৰী শ্ৰী কালীমন্দিরে ঢুকে কালী মুর্তির মাথা ভেঙে ফেলে দিয়ে রূপার মুকুট আর বিগ্রহের সোনার অলঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। চরশরৎ একটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। দুশ তিনশ লোক পয়লা নভেম্বর রাত দশটায় মিছিল করে এসে পুরো গ্ৰাম লুট করে নেয়। যা নিতে পারেনি, পুড়িয়ে দিয়ে গেছে, স্তৃপ ভূপ ছাই ভস্মের বাড়িঘর আর আধাপোড়া নিবাক বৃক্ষরাজি। ওরা যাওয়ার সময় বলে গেছে দশ তারিখের মধ্যে চলে না গেলে সবাইকে মেরে লাশ বানিয়ে দেবে। গ্রাম থেকে যে গরু ছাগল বের হচ্ছিল না সেগুলোকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে ধানের গোলায়। প্রায় ৪০০০ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঁচাত্তর ভাগ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, একজন মরেছে, অসংখ্য গরু ছাগল আগুনে পুড়ে গেছে। অনেক নারী ধর্ষিতা হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। সাতবাড়িয়া গ্রামে রাত সোয়া নটায় প্রায় দুশ লোক লাঠি দা কিরিস লোহার রড নিয়ে জয়রাম মন্দির আক্রমণ করে মন্দিরের প্রতিটি বিগ্ৰহ ভেঙে চুৰ্ণ করে দেয়। হামলার খবর পেয়ে আশেপাশের লোক প্রাণভয়ে চারদিকে ভয়ে পালিয়ে যায়, সে রাতে প্রতিটি পরিবার কাটিয়েছে জঙ্গলে, নয়। ধানক্ষেতে। তারা প্রতিটি বাড়ি লুট করে। সাতবাড়িয়া সার্বজনীন দুৰ্গর্বিাড়ির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। খেজুরিয়া গ্রামের মন্দির আর বাড়িঘরেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাষী পরিবারগুলো সর্বস্বাস্ত এখন। শৈলেন্দ্ৰ কুমারের স্ত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়েছে, আগুনে ঝলসে গেছে তার শরীর। শিব মন্দিরে যখন ভক্তরা প্রার্থনারত ছিল, তখন কয়েকজন লোক এসে অশ্রাব্য গালাগাল করে, মূর্তি ও আসন ভেঙে দিয়ে তাতে প্রস্রাব করে চলে যায়। সুরঞ্জনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ওদের প্রস্রাব যেন সুরঞ্জনের গায়ে এসে লাগে। সে চটি বইটি ছুড়ে ফেলে দেয়। ৪গ. হরিপদ ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছেন হাত পায়ের শক্তি ফিরিয়ে আনতে গেলে কী করে এক্সারসাইজ করতে হবে। মায়া কিরুণাময়ী দুজনই দুবেলা সুধাময়ের হাত পায়ের এক্সারসাইজ করাচ্ছে। সময় করে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। মায়ার সেই চঞ্চল স্বভাব হঠাৎ চুপসে গেছে। বাবাকে দেখেছে সে প্রাণবান পুরুষ। আর এখন নিথর শুয়ে আছেন মানুষটি। মায়া মায়া’ বলে যখন জড়ানো কণ্ঠে ডাকেন, বুক ভেঙে যায় মায়ার। অসহায় বোবা দুটো চোেখ কী যেন বলতে চায়। বাবা তাকে মানুষ হতে বলতেন, শুদ্ধ মানুষ। নিজে সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন। কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই বলতেন, মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দিই। সুধাময় রুখে উঠতেন শুনে। বলতেন-’পড়াশুনা করবে, চাকরি-বাকরি করবে, তারপর যদি বিয়ে করতে মন চায়, করবে।’ কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন–নাকি কলকাতায় ওর মামার কাছে পাঠিয়ে দেব! অঞ্জলি, নীলিমা, স্বাভা, শিবানী, মায়ার বয়সী মেয়েগুলো কলকাতায় পড়াশুনো করতে চলে গেছে। ‘ সুখময় বলতেন—’তাতে কী। এখানে কি পড়ালেখা করবার নিয়ম নেই। স্কুল কলেজ উড়ে গেছে?’ –মেয়ে বড় হয়েছে। রাতে রাতে ঘুম হয় না আমার। বিজয়াকে কলেজ যাবার পথে সেদিন আটকাল না ছেলেরা? –সে তো মুসলমান মেয়ে হলেও আটকায়। মুসলমান মেয়েরা রেপড হচ্ছে না? তাদের কিডনাপ করা হয় না? —তা হয়। তবু। কিরণময়ী বুঝতে পারতেন সুধাময় কিছুতে সায় দেবেন না। বাপের ভিটে না থাক, দেশের মাটি তো আছে পায়ের নীচে। এই তাঁর সান্ত্বনা। মায়ার অবশ্য কলকাতা যাবার কোনও আগ্রহ ছিল ন কখনও। কলকাতা বেড়াতে গিয়েছে সে একবার, মাসির বাড়িতে। ভাল লাগেনি। মাসতুতো বোনগুলো কেমন যেন নাকউঁচু স্বভাবের। তাকে গল্প
false
humayun_ahmed
ব্যাপারটা দেখছে। সে মনে মনে বলল, পাগলে পাগলে খুব মিল। হয়েছে। মিতুর খুব হাসি পাচ্ছে। সে হেসে ফেলল। খিল খিল হাসি। মিস্টার জুলাই হাসির শব্দ শুনে তাকাল মিতুর দিকে। মিতুর আরো বেশী বেশী হাসি। আসছে। জুবায়ের আসতে আসতে রাত দশটা বাজিয়ে ফেলল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুএকটা তারাও উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। জুবায়ের এষার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সরি। সময়মতই রওনা হচ্ছিলাম। গাড়িতে উঠতে যাব–এক গেস্ট এসে উপস্থিত। এমন গেস্ট যে বলা যায় না–ভাই এখন যান জরুরী কাজে যাচ্ছি। এষা বলল, এত সাফাই গাচ্ছ কেন? জরুরী কাজ তো কিছু না। জুবায়ের বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, দুজন এক সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব এটা জরুরী না? কি বলছ তুমি? স্নান করব নীপ বনে, ছায়াবীথি তলে–এটা যদি জরুরী না হয় তাহলে ….. তুমি কি খেয়ে এসেছ? না। ভাল করেছ। এক সঙ্গে খাব। তুমি কি এখনি খাবে? খাবার গরম করতে বলব? বল। এই ফাঁকে আমি চট করে তোমার মাতৃদেবীর সঙ্গে দেখা করে আসি। প্লীজ এখন মাকে বিরক্ত করো না। মার মাথা ধরেছে। মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এখন গেলেই মা রাগ করবেন। পৃথিবীর কেউ আমার উপর রাগ করতে পারে না। মা পারে। এখন তুমি মার ঘরে ঢুকলে মা তোমাকে ধমক দিয়ে বের করে দেবে–এটা ভাল হবে? তারচে, চল খাওয়া-দাওয়া করা যাক। রাতের খাবার শেষ করে জুবায়ের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, চল ছাদে যাই। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে আসি। আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল। এষা বলল, পাগল এখন ছাদে যাব কি? বৃষ্টিতে ছাদ পিছল হয়ে আছে। জুবায়ের খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল। এষা বলল, পান খাবে? পান এনে দেব? না। কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? জুবায়ের বলল, তোমার ব্যাপারে আমার একটা অবজারভেশন আছে। তুমি কোন নির্জন জায়গায় আমার সঙ্গে থাকতে চাও না। এক ধরনের অস্বস্তি বোধ কর। এর কারণ কি বল তো? একজন মৌলানার সামনে তিনবার কবুল বলিনি–এই কি কারণ? এষা বলল, কি বলছ এসব? হয়েছে কি তোমার? ছাদে যেতে চাচ্ছি না। কারণ ছাদ পিছল হয়ে আছে। তারপরেও তুমি যদি যেতে চাও–খুব ভাল কথা। চল যাই–পা পিছলে কোমর ভাঙ্গলে কিন্তু আমাকে দোষ দেবে না। জুবায়ের বলল, যেদিন ছাদ শুকনো থাকে সেদিনও কিন্তু যেতে চাও না। গত সপ্তাহের কথা কি তোমার মনে আছে? তোমাকে বললাম, চল ছাদে যাই। তুমি বললে–তুমি যাও আমি আসছি। আমি অপেক্ষা করছি। তুমি এলে ঠিকই, মিতুকে সঙ্গে নিয়ে এলে। এষা বিরক্ত গলায় বলল, মিতু আমার সঙ্গে আসতে চাচ্ছিল। আমি কি করব? মিতুকে বলব–না তুমি যেতে পারবে না। আমাকে এক-একা যেতে হবে যাতে অন্ধকারে ঐ লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। লোকটাকে এই সুযোগ দিতে হবে কারণ দুদিন পর সে আমাকে বিয়ে করছে। তুমি রেগে যাচ্ছ এষা। সরি। আশ্চর্য! তুমি এত চট করে রেগে যাও। দেখি একটা পান দাও তো খাই। এষা পান এনে দিল। জুবায়ের দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আচ্ছা ঐ লোকের খবর কি? তার বাড়িঘরের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে? না। সারাদিন সে করে কি? কিছুই করে না। আজ সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টিতে ভিজেছে পুরো চারঘণ্টা। খুবই সন্দেহজনক। সন্দেহজনক কেন? সে যে একটা অদ্ভুত কিছু এইটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে বিরাট ফ্রড। তোমাদের সাবধান থাকা উচিত। আমার মনে হয় না সে ফুড। বরং আমার মনে হয় একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। ইয়ং লেডি ফর ইওর ইনফরমেশন–পৃথিবীতে ফ্রড মাত্রই ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার হয়। বিরক্তিকর কোন মানুষ ফ্রড হতে পারে না। আমি লোকটার সঙ্গে আলাপ করে আসি। আশা করি জেগে আছে। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? এষা নাসূচক মাথা নাড়ল। জুবায়ের একাই রওনা হল। মিস্টার জুলাই জেগে ছিল। বিছানায় বসে গভীর মনোযোগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী পত্রিকার পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। জুবায়ের ঘরে ঢুকেই বলল, কেমন আছেন? জি ভাল। আমার নাম মোহম্মদ জুবায়ের। আপনার নাম কি জানতে পারি। আমার নাম জুলাই। তিনদিন পর নাম বদল হবার সম্ভাবনা আছে। বসুন। বসব না–দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। জিজ্ঞেস করুন। তবে আমার মনে হয় আপনার বেশীর ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারব না। জবাব দিতে পারবেন না এমন কোন প্রশ্ন আমি আপনাকে করব না। তবে ইচ্ছা করে জবাব না দিলে তো কিছুই করার নেই। আমি যা জানি আপনাকে বলব। অবশ্যই বলব। পাগল সাজার চেষ্টা করছেন কেন? কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। শুনলাম চারঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজেছেন। আপনার এই কাজের পেছনে পাগল সাজার সূক্ষ্ম চেষ্টা লক্ষ্য করছি। কারণটা জানতে চাচ্ছি। মিস্টার জুলাই শান্ত গলায় বলল, আপনি বোধ হয় একটা জিনিস জানেন না–পাগলরা কখনো বৃষ্টিতে ভিজে না। পানি আর আগুন–এই দুটা জিনিসকে পাগলরা ভয় পায়। এই দুটা জিনিস থেকে এরা অনেক দূরে থাকে। কখনো শুনবেন না কোন পাগল পানিতে ডুবে মারা গেছে বা আগুনে ঝাপিয়ে পড়েছে। জুবায়ের প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, আপনি কি সিগারেট খান? না। একটা খান আমার সঙ্গে। খেয়ে দেখুন কেমন লাগে। লোকটা সিগারেট নিল। আগুন ধরিয়ে টানতে লাগল। জুবায়ের বলল, আপনার কয়েকটা জিনিস আমি মিলাতে পারছি না। দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে না। আপনি বলছেন আপনার আগের কথা কিছুই মনে নেই। স্মৃতি-বিলুপ্তি ঘটেছে। অথচ
false
humayun_ahmed
নিতে হবে! ডাক্তার কি লাল পানি একটু খেয়ে দেখবে? নাৰ্ভ ঠাণ্ডা করে। হালকা করে দেই। বরফ দিয়ে খাও ভালো লাগবে। জ্বি না। আপনি খান। আমি তো খাচ্ছিই। এক পেগ করে খাই–মুখটা যখন পানশে হয়ে যায় তখন একটা পান খাই। মুখ ঠিক করি। তারপর আবার একটু। শোন ডাক্তার, তুমি হেনার ব্যাপারে কী করলা? কোন ব্যাপারে কথা বলছেন? তোমারে বললাম না, হেনার জন্যে পাত্র দেখ। খরচ আমার। ছবিও তো তুলে পাঠায়েছি। ছবি পাও নাই? ছবি পেয়েছি। পাত্রের সন্ধান কর। পাত্র যদি ক্যাশ টাকা চায় তাও দিব। আনিস চুপ করে রইল। জহির খাঁ গলা উঁচিয়ে বললেন–হেনা কই? আমাদের খাওন দাও। আনিস বলল, আমি এখন খাব না। জহির খাঁ বললেন, খাবে না কেন? খেয়ে এসেছ? জ্বি না। সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করেছি। গোসল করে তারপর খাব। আমি নোংরা শরীরে কিছু খেতে পারি না। আমার এখানে গোসল কর। গরম পানি করে দিবে। সাবান দিয়ে গড়লা দিয়ে গোসল কর। আমার ধোয়া লুঙ্গি আছে। অসুবিধা কিছু নাই। তার দরকার নেই। আচ্ছা খাবার দিতে বলুন, গোসল পরে করব। জহির খাঁ রাগী গলায় বললেন, গোসল পরে কেন করবা। এখনই করবা। হেনারে বলতেছি সে গরম পানি করে দিবে।–শরীরে সাবান ডলে দিবে। তুমি তো বাইরের কেউ না। তুমি আমার নিজের লোক। আনিস হতভম্ব হয়ে গেল। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের কোনো কথা ধরতে নেই। তারা কী বলছে না-বলছে তার ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে নাতারপরেও জহির খাঁ এইসব কী বলছেন? হেনা কেন গায়ে সাবান ডলে দেবে? জহির খাঁ মুখের পান ফেলে দিয়ে তার বা পাশে রাখা গ্লাস এক চুমুকে শেষ করে মুখে আরেকটা পান নিয়ে ঝুকে এসে বললেন–একা একা গোসলের সমস্যা জান? পিঠে সাবান দেওয়া যায় না। পিঠে সাবান দেবার জন্যে লোক লাগে। এতে দোষের কিছু নাই। আনিস শান্ত গলায় বলল, আমি গোসল করব না। আপনি খাবার দিতে বলুন। জহির খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেনাকে ডেকে খাবার দিতে বললেন। হেনা মেয়েটাকে আজ আরো সুন্দর লাগছে। সে আজ শাড়ি পরে নি, জরি দেওয়া ঘাঘড়া জাতীয় পোশাক পরেছে। ঘাঘড়ার রং কালো বলে হেনার গায়ের রং খুব ফুটেছে। লম্বা বেণি করেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। গায়ে গয়নাও আছে। প্রথম দিনে গায়ে কোনো গয়না ছিল না। জহির খাঁ আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। নেশাগ্ৰস্ত মানুষ এমন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে পারে না। তাদের চোখের মণি ডাইলেটেড থাকে। আনিসের মনে হলো প্রচুর মদ্যপান করা সত্ত্বেও এই লোকটি মাতাল না। নিজের ওপর তার পূর্ণ দখল আছে। সে কি আনিসকে নিয়ে কোনো খেলা খেলছে? খেলোয়াড় মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। তাকে সব সময় খেলতে হয়। প্ৰতিপক্ষ না পেলে তারা প্ৰতিপক্ষ তৈরি করে নেয়। ডাক্তার! জ্বি। তুমি আমার দিকে তাকায়ে আছ কেন? কী দেখ? কিছু দেখি না। ইমামের মৃত্যুর জন্য তুমি কি মনে মনে আমাকে দায়ী করছ? না। প্রত্যক্ষভাবে আপনি দায়ী না। তবে পরোক্ষভাবে আপনার ভূমিকা আছে। জহির খাঁ সোজা হয়ে বসলেন। শীতল গলায় বললেন–এখন যে কথাটা তুমি বললা–এরকম কথা আর বলব না। একটা কথা সব সময় খেয়াল রাখবা। আমি দুষ্ট প্রকৃতির লোক এবং রাগী লোক। দুষ্ট লোক সাধারণত রাগী হয় না, তবে আমি রাগী। নাও খাওয়া দাওয়া কর। হেনা হাত ধোয়ার পানি এনেছে। আনিস হাত ধোয়ার জন্যে বারান্দায় গেল। হাত ধুতে গিয়ে তার মনে হলো–প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। আনিস একা খাচ্ছে। প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার জন্যে হেনা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে গায়ে কোনো সুগন্ধি মেখেছে। খাবারের গন্ধের সঙ্গে এই গন্ধ যাচ্ছে না। আয়োজন ভালো। মন্ত্রীর জন্যে করা আয়োজন খারাপ হবার কথা না। রুই মাছের বড় পেটি। পোলাও। খাসির মাংসের রেজালা। আস্ত মুরগির রোষ্ট। আনিস আরাম করেই খাচ্ছে। মনে হচ্ছে জ্বর নেমে গেছে। জ্বর নেমে গেলে খুব খিদে পায়। ডাক্তার। জ্বি। খানা কেমন হয়েছে? ভালো হয়েছে। গন্যমান্য সবাইরে বলেছিলাম। সবাই এসেছিল, শুধু একজন আসে নাই। বল দেখি কে আসে নাই? বলতে পারছি না। আজিজ মিয়া আসে নাই। খবর নিয়েছি সে গিয়েছে গৌরীপুর। গৌরীপুর কেন গিয়েছে জান? জ্বি না। আড়ং-এর জন্যে ষাঁড়। কিনতে গিয়েছে। আমার সাথে পাল্লা দিতে চায়। আমি ষাঁড় কিনেছি তারও ষাঁড় কিনা লাগবে। দেখি সে কি ষাঁড় কিনে। জহির খাঁ আরেকটা পান মুখে দিলেন। ইমাম সাহেবের কবর হলো তার পরদিন সন্ধ্যায়। কবর ঠিক না, গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া। মধ্যনগর গ্রামের হুজুর ফতোয়া দিলেন–অপঘাতে মৃত্যুর জানাজার বিধান নাই। লাশ কবরে নামানোর সময় অনেকেই চোখের পানি ফেলে। ইমাম সাহেবের ক্ষেত্রে শুধু মতি ভেউ ভেউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। গাঁজার নেশার কারণে ঘটনোটা ঘটল। ছয় পুরিয়া শেষ হবার পর সে আরো চারটা পুরিয়া এনেছে। এবারে দাম বেশি পড়েছে। চার পুরিয়ার জন্যে পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়েছে। টাকাটা সে পেয়েছে ইমাম সাহেবের তোষকের নিচে। ট্রেন দুঘণ্টা লেট। পৌঁছার কথা চারটায়, পৌঁছল ছটায়। নবনীর খুব বিরক্তি লাগছিল। তার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কামরায় আর যারা আছে তাদের মনে হচ্ছে কারোরই টিকিট নেই। একজন আবার উঠেছে ছাগল নিয়ে। ট্রেনের বাথরুমের দরজা বন্ধ হয় না। মাঝে মাঝে এমন শব্দ হয় মনে হয়। দরজা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে
false