label
stringclasses
6 values
text
stringlengths
1.57k
117k
is_valid
bool
1 class
mk
মোদির সফরে নতুন আশা 'বঙ্গবন্ধু নে বাংলাদেশ বানায়া, আউর উনকো বেটি নে বাংলাদেশ কো বাঁচায়া' (বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বানিয়েছেন, আর তাঁর মেয়ে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছেন)- ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নয়া দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাক্ষাৎ করতে গেলে এ কথাটি বলেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ৯ দিন পর ২৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথম বৈঠকেও একই কথা বলেন মোদি।গত বছর মে মাসে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতে বিজেপি সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের প্রতি তাঁর নীতি কেমন হয় সে নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় ছিল ঢাকা। তবে সেই শঙ্কা কাটতে বেশি সময় লাগেনি। বরং স্থল সীমান্ত চুক্তি সই হওয়ার প্রায় ৪১ বছর পর মোদির নেতৃত্বে পুরো ভারত এক হয়ে সেই চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর ঘিরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু হওয়ার আশা করছে ঢাকা। সফরসূচি এখনো চূড়ান্ত না হলেও দুই দেশের মধ্যে আগামী ৬ ও ৭ জুন নিয়েই কথা হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে সফর পুরোপুরি কাজে লাগাতে জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে ঢাকা।কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মোদির সফরকালে ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে চায় বাংলাদেশ। দুই দেশ এখন ওই সব চুক্তি, প্রটোকল ও এমওইউ চূড়ান্ত করার কাজ করছে। ভারত চায়, বাংলাদেশ তথা পুরো অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে মোদির বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সূত্র মতে, বাংলাদেশে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে মোদির সফরকালে আগ্রহ দেখাতে পারে ভারত। তবে বিষয়টি কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর বলে অনেকে মনে করেন। ভারত এ সফরের সময় নতুন করে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ বাড়তেও পারে।সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মোদির আসন্ন সফরকালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ তার প্রত্যাশার কথা জানাবে। ভারতের দিক থেকেও আগামী দিনগুলোয় ওই চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস আসতে পারে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দুই দেশের বেশ পুরনো ইস্যু। ৪১ বছর পর মোদির নেতৃত্বে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারত উদ্যোগ নিয়ে দেখিয়েছে, সদিচ্ছা থাকলে সমস্যা অনেক জটিল হলেও তার যৌক্তিক সমাধান সম্ভব। স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বাধা কেটে যাওয়ার পর বাংলাদেশ আশা করছে, তিস্তা চুক্তিও শিগগিরই সই হবে। দুই দেশের পুরনো সমস্যার জট যখন খুলতে শুরু করেছে তখন সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে চাইছে উভয় পক্ষই।সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, চলতি সপ্তাহে চীন, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর শেষে বাংলাদেশ সফরসূচি চূড়ান্ত করবেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহেই মোদি আসছেন বলে আভাস দিয়েছে ভারতীয় সূত্রগুলো। গত বছর মে মাসে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করার সময়ই প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর কয়েক দিন পরই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েও শেখ হাসিনা যেতে পারেননি পূর্বনির্ধারিত জাপান সফরের কারণে। তবে সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরপর বৈঠকে স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মতো অমীমাংসিত বিষয়গুলো তোলা হলে তা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন মোদি। পরে গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে এবং নভেম্বরে নেপালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকেও মোদি তাঁর আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন।কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, মোদি বাংলাদেশ সফরে আসতে আগ্রহী হলেও পারছিলেন না ঝুলে থাকা বিভিন্ন ইস্যুর কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মোদি বলেছেন যে তিনি খালি হাতে আসবেন না। শেষ পর্যন্ত ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করানোর মাধ্যমে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে মোদি বাংলাদেশের চার দশকের ও ছিটমহলবাসীর প্রায় সাত দশকের প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে চলেছেন। সেই সঙ্গে তিস্তা চুক্তির সই করার বিষয়েও তিনি উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেওয়ার নতুন পথের খোঁজ মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।মোদির সম্ভাব্য সফরের প্রস্তুতি ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিক দেখতে ভারতের একটি অগ্রবর্তী দল এরই মধ্যে ঢাকায় এসে রাষ্ট্রাচার প্রধানসহ সফরসম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলেছে। অন্যদিকে ঢাকায়ও মোদির আসন্ন সফর নিয়ে গত সোমবার এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে সফরসংশ্লিষ্ট ১৫টি মন্ত্রণালয় ও তিনটি বিভাগের সচিব এবং ১০টি দপ্তরের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।জানা গেছে, ওই বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফরকালে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মোদি ঢাকায় এলে তাঁর হাতে বাজপেয়ির সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হতে পারে।সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে যারা ভারতে পালিয়ে আছে তাদের গ্রেপ্তার, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ পথে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বেনাপোল-পেট্রাপোলে যৌথ জরিপ ও সীমানা খুঁটি নির্দিষ্টকরণ, বন্দরে বিধিনিষেধ, বিনিয়োগ বাড়ানো, স্থলবন্দরে কর্মদিবসের সুসংগঠন, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) বিনিয়োগে ভারতের আগ্রহ, ৮০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণরেখা পর্যালোচনা এবং ২০ কোটি মার্কিন ডলারের আর্থিক সহায়তা অনুমোদন নিয়ে আলোচনা হয় আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের কারাগারে আটক ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়াকে সে দেশে ফেরত পাঠানো, জেলা প্রশাসক অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে বৈঠক, যৌথ আইনি সহায়তা, এনএলএফটির অপহরণ করা ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানো, দণ্ডিত আসামিদের হস্তান্তর, ভারতে পলাতক আসামিদের ফেরত আনা, মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন জিনিসের চোরাচালান বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ, মানবপাচার প্রতিরোধে চুক্তি, জাল মুদ্রা প্রতিরোধবিষয়ক চুক্তি, দুই দেশের কোস্টগার্ডের মধ্যে চুক্তি, সারদা পুলিশ একাডেমিতে তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণাগার স্থাপন, ভেড়ামারা-বহরমপুর গ্রিড থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হস্তান্তর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি, ত্রিপুরার পালাটানায় ফেজ-২ থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ত্রিপুরার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে সরবরাহ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং নেপাল ও ভুটান থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনা, গ্যাস অনুসন্ধান, নুমালিগড় থেকে পাইপলাইনে ডিজেল ও পেট্রোলিয়াম সরবরাহ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ত্রিদেশীয় গ্যাসলাইন স্থাপন, পারমাণবিক জ্বালানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়নবিষয়ক সহযোগিতা, বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠক, বিএসটিআইয়ের পণ্যমানে ভারতের স্বীকৃতি না পাওয়া, আরো সীমান্তহাট স্থাপন, ভারতে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়।বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে ঋণচুক্তি, পাট ও বস্ত্র খাতে সহযোগিতা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মৎস্য ও কৃষি খাতে সহযোগিতা, যৌথ কর্মশালা, গবেষণা প্রকল্প, খাদ্য নিরাপত্তা, বায়ো-ইনফরমেটিক্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ, চামড়া নিয়ে গবেষণা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সহযোগিতা চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ও উপ-আঞ্চলিকবিষয়ক সহযোগিতা, রেলযোগাযোগ, সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের সংস্কার কাজের জন্য ভারতকে বাংলাদেশের অনুরোধ, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যেই কাস্টম ও ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু, দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চালু, বিরল-রাধিকাপুর রেল সংযোগ স্থাপন, রহনপুর-সিঙ্গাবাদ ও শাহজাদপুর-মহিশ্মশান রেল সংযোগ, চিলাহাটি-চেংড়াবান্ধা রেল সংযোগ, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, ফেনী-বিলোনিয়া রেল যোগাযোগ স্থাপন, খুলনা-মংলা রেললাইন সংস্কার এবং বাংলাদেশ-ভারত কনটেইনার সার্ভিস নিয়ে আলোচনা হয়।সূত্র মতে, যশোরের সিঙ্গিয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিং স্টেশন, ঈশ্বরদীতে মাল্টিমোডাল এক্সচেঞ্জ, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস সার্ভিস, কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস, বাংলাদেশ-ভূটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটর যন্ত্রাংশবিষয়ক চুক্তি, আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক, ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরায় আড়াই লাখ টন খাদ্যশস্য পরিবহন, আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের (আইসিটি) উন্নয়নও আলোচনাসূচিতে ছিল। এ ছাড়া কার্গো কনটেইনার স্থানান্তর, পিআইডাব্লিউটিটির মাধ্যমে জাহাজে ক্রু ও যাত্রী পরিবহন, মংলাবন্দরে ড্রেজিং, মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ভারতের প্রবেশাধিকার, আশুগঞ্জ নদীবন্দর উন্নয়নে ভারতের আগ্রহ, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল্ কম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ভারত সঞ্চার নিগাম লিমিটেডের চুক্তি, পানি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ৩৮তম বৈঠক, গঙ্গা বাঁধ, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, ফেনী নদীর পানির স্রোত যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ, অন্যান্য আন্তনদীর পানি ভাগাভাগি, টিপাইমুখ প্রকল্প, আন্তনদী সংযোগ, সীমান্তবর্তী শহর ও নদীতীর রক্ষা, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ড্রেনেজ প্রকল্প, বন্যা পূর্বাভাস, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, খুলনা ও সিলেটে ভারতের সহকারী হাইকমিশন স্থাপন, ভারতে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট টিভির সম্প্রচার চালু, শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশ ভবন স্থাপন, বাংলাদেশে ভারতের স্টেট অব দি আর্ট কালচারাল সেন্টার, ভারত পক্ষ থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্র ভবন স্থাপন, উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের পরিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতীয় সৈন্যদের সম্মাননা, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার (জেএমআই) সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অশনোগ্রাফির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমওইউ সইয়ের মতো বিষয়ও ছিল বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে। মেহেদী হাসান এর লেখা থেকে..
false
mk
বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশক আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন ৫১ বছর পূর্ণ হয়, তখন ১৯৭১ সালের ৭ ও ২৬ মার্চ জাতীয় জীবনে সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত 'মুক্তি ও স্বাধীনতা' সংগ্রামের নিমিত্ত 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা' এবং 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা'র জন্য বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার নিজের এবং বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনকারী ঐতিহাসিক মুহূর্ত আবির্ভূত হয়েছিল '৭১-এ। এ ধরনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত বাঙালি জাতির জীবনে আর কখনো আসেনি, যা '৭১-এ এসেছিল। এ মুহূর্তের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবন জেল-জুলুম, নির্যাতন ভোগ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এ মুহূর্তের জন্য তিনি তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এ মুহূর্তের জন্য বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল। '৭১ সালটি প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির 'ডিফাইনিং মোমেন্ট' হিসেবে গণ্য।বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের কর্মকা- স্মরণ করাই হচ্ছে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রকৃত উপায়। বর্তমান লেখায় বঙ্গবন্ধুর জীবনে '৭১-এর কিছু অংশ আলোচনা করা হচ্ছে। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সমগ্র জীবন বাঙালি জাতির 'মুক্তি ও স্বাধীনতা'র লক্ষ্যে উৎসর্গের কারণে জনগণ তাকে প্রথমে 'বঙ্গবন্ধু' এবং পরে 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি' বিশেষণে ভূষিত করেছে। জন্মের পর থেকেই তিনি তার দেশ, সমাজ ও মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, বিশ্বাস-আস্থা এ সব কিছু একান্ত আপনজনের মতো করে উপলব্ধি এবং জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করেছেন। এ জন্য তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে এবং তিনি বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। জনগণের প্রয়োজনে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে পারার কারণে তিনি তার জনগণের কাছ থেকে গভীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে, তার জন্মের ৫০ বছর পর তার জন্মভূমি বাংলাদেশের ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির পুরোটাই তার নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় নির্ধারিত হয়েছে। '৭১-এর মার্চের ঘটনাবলি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তান সৃষ্টির মূল দলিল হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের লাহোরে সে সময়ের নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এ দিনটিকে সমগ্র পাকিস্তানে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে 'পাকিস্তান দিবস' হিসেবে পালিত হতো। কিন্তু '৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি তৎকালীন (পূর্ব) বাংলায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গিয়েছিল। সে সময়ের (পশ্চিম) পাকিস্তানে ২৩ মার্চ 'পাকিস্তান দিবস' হিসেবে পালিত হলেও, (পূর্ব) বাংলায় পালিত হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে স্টানলি উলপার্টের বই 'জুলফি অব পাকিস্তান'-এ উলি্লখিত একটি পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। উলপার্ট বলছেন, মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার ৩১তম বছর পূর্তি উৎসব হিসেবে '৭১-এর মার্চের ২৩ তারিখটি পশ্চিম পাকিস্তানে উদ্যাপিত হয়েছিল, যেটি প্রতি বছর পাকিস্তান দিবস হিসেবে স্মরণ করা হতো। কিন্তু সেই সকালে ঢাকার বেশির ভাগ সংবাদপত্রে 'বাংলাদেশের মুক্তি' শিরোনাম দিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করা হয়েছিল। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বার্তা সনি্নবেশিত হয়েছিল, 'আমাদের দাবি ন্যায়সংগত এবং সে কারণে জয় আমাদেরই', এটি শেষ হয়েছিল 'জয় বাংলা' বলে।'পাকিস্তান দিবসে' '৭১-এর ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তৎকালীন (পূর্ব) বাংলায় প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় ধানম-ি ৩২ নাম্বার সড়কে অবস্থিত তার বাসভবনে বিশাল জনসমাবেশে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, 'তাদের ন্যায্য ও বৈধ দাবি-দাওয়া অর্জনের জন্য আমাদের জনগণ রক্ত দিতে শিখেছে এবং তদের বাধা দেয়ার জন্য যে কোনো হস্তক্ষেপ, নির্যাতন এবং শক্তিপ্রয়োগ, সোজা কথায়, হবে একটি ব্যর্থ চেষ্টা।''৭০-এর নির্বাচনের সময় প্রকাশিত 'দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি' শিরোনামে একটি প্রচারপত্রে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)'র প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো '৭০-এর ৪ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দারা ইয়াহিয়া খানকে সহকর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তার গোপনে ধারণকৃত একটি টেপরেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের বলছেন, উলপার্ট উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ 'আমার লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা; নির্বাচনের পরে আমি লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) টুকরো টুকরো করে ফেলব। একবার নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে কে আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে?'লত '৭১-এর ৭ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেলস সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :অর্থাৎ এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান :কিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পেঁৗছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করন। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর এ বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।'৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন। এর বিপরীতে ওই তারিখেই অর্থাৎ '৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।'৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান অপারেশন সার্চলাইটের কার্যক্রম শুরু করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, জগন্নাথ হল প্রভৃতি স্থানে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা শুরু হয়েছিল। বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বলা সত্ত্বেও তার ধানম-ি ৩২ নাম্বার সড়কের বাসভবন ছেড়ে যাননি। এরপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। ধানম-িতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ভোর রাত ১টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ২৬ মার্চ তাকে বিমানে করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কারাগারে বন্দি করে রাখার জন্য। '৭১ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লায়ালপুর কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুর বিচার করে। একাত্তরের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।৭১ সালের ২৩ আগস্ট, সোমবার বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি হেডলাইন ছিল 'পাকিস্তান : মুজিব'স সিক্রেট ট্রায়াল'। এখানে বলা হয়েছে, 'যদিও বিচারের ব্যাপারে সব কিছুই ছিল গোপন রহস্যাবৃত, গত সপ্তাহে জানা গেছে যে, রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে, টেক্সটাইল নগরী লায়ালপুরে একটি নতুন, এক তলা লাল ইটের তৈরি দালানে বিচারকাজ হয়েছে। ইসলামাবাদের উৎসগুলো দাবি করছে যে, মুজিবকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে বাঙালি বিদ্রোহীদের চেষ্টাকে প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর গোপনীয়তা প্রয়োজন। আরো কারণ হচ্ছে ইয়াহিয়া মুজিবকে একটি পাবলিক প্লাটফরম দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। শেখ যখন ১৯৬৮ সালে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, যেটিও ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিদ্রোহের কারণে, তখনো বিচার প্রক্রিয়া ব্যাপক-বিস্তৃত সরকারবিরোধী প্রতিবাদের কারণে বাতিল করা হয়েছিল। পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একজন পরিদর্শককে বঙ্গবন্ধুর সাজা সম্পর্কে বলেছিলেন, ব্রিটেনের সংবাদপত্র দ্য সানডে টেলিগ্রাফে '৭২ সালের ৯ জানুয়ারি 'শেখ মুজিব ফ্লাইস অ্যান্ড সিস হিথ, প্লিয়া ফর হেল্প' শিরোনামে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়। এ সংবাদটির উপশিরোনাম ছিল, 'জেলর হিড শেখ'। এ রিপোর্টে বলা হয়, 'একজন বাংলাদেশি অফিসিয়াল গত রাতে লন্ডনে বলেছেন যে, একজন জেলরের সাহায্যে শেখ মুজিবুর রহমান সাজা এড়িয়েছিলেন। তিনি (সেই জেলর) জানতেন যে ইয়াহিয়া খান তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবেন, এবং তিনি তখন শেখকে তার ব্যক্তিগত কোয়ার্টারে দুই দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন।' বাংলাদেশ ডেলিগেশনের একজন মুখপাত্র ক্লারিজেস হোটেলে (লন্ডনে বঙ্গবন্ধু যে হোটেলে ছিলেন) বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে শেখকে যে কারাগারে রাখা হয়েছিল সেখানের সিমেন্টের মেঝেতে একটি কবর খনন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল যে সাজা কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত করা ইয়াহিয়ার স্কোয়াড মিথ্যা দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, যাতে দেখানো হয়েছে যে শেখকে অক্টোবরের শেষ দিকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।দেশ যখন ঐতিহাসিক বিজয়ের আনন্দে ভাসছিল তখনো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিল এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কখন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যবর্তন করবেন। '৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রয়টার্স পরিবেশিত একটি বার্তায় বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি অপ্রকাশিত গন্তব্যের দিকে রওনা দিয়েছে। তবে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টাব্যাপী কোনো ফলোআপ নিউজ ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ অশেষ ভীতি ও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সব শেষে জানা গেল যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডন পেঁৗছেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনে নীরবতা ভেঙে রেডিও পাকিস্তান সে দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর রওনা দেয়ার কথা প্রচার করল। এতে বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানিয়েছেন। লন্ডন হয়ে বাংলাদেশ যাওয়ার পথে '৭২ সালের ৯ জানুয়ারি সাইপ্রাসের নিকোশিয়ায় একটি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে দেখা গিয়েছিল। যখন খবর পাওয়া গেল যে, বঙ্গবন্ধু নিরাপদে লন্ডন পেঁৗছেছেন তখন সমগ্র দেশ বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল। লন্ডন পেঁৗছেই তিনি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ঢাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। এ সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লক্ষ্নৌ থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।লন্ডন থেকে যখন ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিলি্ল বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন, এ সময় মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য তিনি ভারতের জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবে এ সময়ও তিনি তার দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অনুভূতি সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তখনো বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়াটাই যে প্রধানতম প্রয়োজন এ কথা বলতে বঙ্গবন্ধু ক্ষণিকের জন্যও ভুলে যাননি। সুতরাং সাক্ষাতের প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য কবে ফিরিয়ে নেয়া হবে?' সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দিয়েছিলেন, 'আপনি যখনই বলবেন, তখনই তা করা হবে।' এরপর বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে আসেন।ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৫৬
false
rg
বইমেলার ডায়েরি (৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।। প্রথম শুক্রবারেই বইমেলায় উপচে পড়া ভিড়!!! !!! গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার প্রথম শুক্রবার। বইমেলা শুরু হয়েছিল সকাল এগারোটায়। চলেছে রাত নয়টা পর্যন্ত। সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ছিল শিশু প্রহর। শিশুদেরজন্য ছিল চিত্রাঙ্গন প্রতিযোগিতা। এবার শিশু প্রহরে শিশুরা একটু কম এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিএনপির ডাকা অবরোধ ও হরতালের কারণে শুক্রবার-শনিবার বাচ্চাদের স্কুল খোলা থাকছে। তাই অনেক অভিভাবকের ইচ্ছে থাকলেও বাচ্চাদের নিয়ে শিশু প্রহরে আসতে পারেনি। যথারীতি বইমেলায় ঢোকার সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢু মারলাম। পাঠসূত্র এবারের বইমেলায় যে সকল নতুন বই প্রকাশ করছে সেগুলোর প্রডাকশান মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পাঠসূত্রের নির্বাহী প্রকাশক তনুজা আকবর জানালেন, স্টলের দুই পাশে বড় বড় দুই প্রকাশক থাকায় পাঠসূত্র এবার বইপ্রেমীদের অনেকের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাঠসূত্রের ডানপাশে পরেছে পাঞ্জেরী আর বামপাশে দিব্যপ্রকাশ। ফলে বড় প্রকাশকদের স্টলে যে পরিমাণ বইপ্রেমীরা ভিড় করছে, তার খেসারত দিতে হচ্ছে পাঠসূত্রকে। ছেট প্রকাশকদের জন্য এমন বিড়াম্বনার বিষয়টি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করা উচিত। বইমেলায় যেহেতু জায়গা সংকুলান নেই। সুতরাং প্যাভেলিয়ন যেমন আলাদা আলাদা জায়গায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, বড় প্রকাশকদেরও বইমেলার উদ্যানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেওয়া উচিত। নইলে ছোট প্রকাশকদের অনেক ভালো বই, অনেক সময় বইপ্রেমীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান কেবল বাংলা একাডেমি করতে পারে। বারোটায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে গিয়ে নন্দনের স্টল খুলে বসতেই আসলেন গবেষক ও লেখক রণোদীপম বসু। রণোদা বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেন। রণোদা আমার গল্পের বই 'পঞ্চভূতেষু' কিনলেন। কিছুক্ষণ পর আসলেন নীলসাধু। আসলেন কামরুল ভাই (কামরুল ইসলাম)। রণোদা আবার ছবি তোলার জন্য বেড়িয়ে গেলেন। রণোদা জানালেন, আজ বইমেলায় এসেছেন মূলত ছবি তুলতে। নীলসাধুও আজ ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছেন।কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম শিল্পী চারু পিন্টু, লেখক ও হরিজন গবেষক জয়শ্রী বীথি'র সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিলেন চিরনীল দম্পতি নীলসাধু ও শিমুল মাসুদ। নীলসাধু আমাদের চারজনের ছবি তুললেন। আমরা চা খাওয়ার জন্য একাডেমির বাইরের রাস্তায় আসার পথে দেখা হল শাকুর ভাইয়ের (লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও স্থপতি শাকুর মজিদ) সঙ্গে। শাকুর ভাইয়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরেই দেখা হল রিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে (অভিনেতা শাহরিয়ার খান রিন্টু)। রিন্টু ভাই পুরো পরিবার নিয়ে বইমেলায় এসেছেন। ন্যান্সি ভাবী জোর করে গরম পিঁয়াজো খাওয়ালেন। রিন্টু ভাইদের সঙ্গে আড্ডায় জড়িয়ে পিন্টু আর বীথিকে হারিয়ে ফেললাম। ওরা আগেই রাস্তায় বের হয়েছে। আমরা রিন্টু ভাইয়ের মেয়ে রোদেলার অনুরোধে, ছবি তুলতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছি। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন কবির ভাই। জাহাঙ্গীর ফেরদৌস কবির। কবির ভাই জানালেন তার শ্বশুর বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ। আমরা বাকেরগঞ্জের গল্প করলাম বাইরে এসে চা খেতে খেতে। আসার পথে রোদেলা বায়না ধরল মুখোশ কিনবে। মেলার ধুলো থেকে বাঁচার জন্য নাক বাঁচানোর মুখোশ বিক্রি করছিলেন লোকটি। ওনার বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনটি বেশ চমৎকার। 'ধুলো বালি খাবেন না। ধুলো বালি খাবেন না'। সবার মুখের সামনে মুখোশটি একবার ঘুরিয়ে যখনই এই শ্লোগান দিচ্ছেন, 'ধুলো বালি খাবেন না। পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা। ধুলো বালি খাবেন না'। যা রোদেলার খুব ভালো লাগলো। ন্যান্সি ভাবি সবাইকে মুখোশ কিনে দিলেন। আহা, ধুলো বালি খাবেন না। আমরা চা খেতে খেতে আসল লিমন। নাট্যনির্মাতা, নাট্যকার ও অভিনেতা ফরহাদ লিমন। এবার বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে লিমনের নিরীক্ষাধর্মী মঞ্চনাটক সমগ্র-১। ন্যান্সি ভাবী জানালেন, শুক্রবার বাচ্চাদের স্কুল খোলা থাকায় আজ শিশু প্রহর ধরতে পারলেন না। হরতাল অবরোধ থাকায় এখন শুক্রবার ও শনিবার বাচ্চাদের স্কুল খোলা থাকছে। আমরা চা খেতে খেতে দেখলাম মুহূর্তে মেলায় ঢোকার লাইন দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে গেছে। রিন্টু ভাই ও ন্যান্সি ভাবী বললেন, এই লাইন ঠেলে আর ভেতরে ঢুকবেন না। লিমন আর আমি আবার একাডেমি প্রাঙ্গনে ঢুকে নন্দনের স্টলে বসলাম। লিমনকে বললাম, তুই কিছুক্ষণ দোকানদারি কর। আমি একটু আড্ডা দেই। লিমন বলল, দাদা আমার কিন্তু দোকানদারিতে খুব ভালো ভাগ্য। লিমন ওর বাবার অনেক পুরানো দিনের গল্প শোনালো। আসলেই লিমনের ব্যবসা ভাগ্য খুব চমৎকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও একটা বই বিক্রি করল। উত্তরবঙ্গ সিরিজ। আমি আড্ডা দিতে আবার শিল্পী চারু পিন্টুর সঙ্গে যোগ দিলাম। পিন্টু আর বীথি জানাল, আমি চায়ের দোকান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ওরা আবার মেলায় ঢুকে পড়েছে। এই সময় আমাদের আড্ডায় যোগ দিলেন আটলান্টা থেকে আসা কবি ও পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক রুদ্রশংকর, জ্যোতি ও মণি। রুদ্রদা আমাকে তার প্রেমের কবিতা ও তার কবিতা নিয়ে প্রকাশিত আবৃত্তির সিডি 'অচেনা হাতে' গিফট করলেন। রুদ্রদা চা খেতে চাইলেন। বললাম, লম্বা লাইন। চা খেতে বাইরে গেলে ভেতরে ঢুকতে অনেক সময় লাগবে। পিন্টু বলল, বাংলা একাডেমি কেন্টিনে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা চার পরিবর্তে কফি পেলাম। কফি শেষ করে ফেরার পথে দেখা হল লাকী ভাইয়ের সঙ্গে। কবি জায়েদ হোসাইন লাকী। লাকী ভাই আমাতে তার কবিতার বই 'ভালোবাসা উড়ে যায় পাখির ডানায়' গিফট করলেন। বইটি প্রকাশ করেছে জয়তী পাবলিকেশানস। নন্দনের স্টলে ফিরে এসে আমি রুদ্রশংকরকে দিলাম আমার গল্পের বই 'পঞ্চভূতেষু'। কিছুক্ষণ পর আসলেন লেখক দম্পতি কুমার চক্রবর্তী ও মনিকা চক্রবর্তী। মনিকা নানান অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। মনিকার এবার একটি নভেলা প্রকাশ পাচ্ছে শুদ্ধস্বর থেকে। 'যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্রঝিনুক'। বন্ধুরা মনিকার নভেলা সংগ্রহ করতে পারো। বন্ধু কবি আলফ্রেড খোকনের কবিতার এক ভক্ত খোকনের দুইটা বই 'সাধারণ কবিতা' ও 'মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ' কিনে নিলেন। আরেক ভদ্রলোক এসে কিনে নিলেন আমার গল্পের বই 'পঞ্চভূতেষু'। আজ বেচাবিক্রি ভালো। ভারী চমৎকার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বইয়ের দোকানদারি করতে এসে। ভাবছি, এই অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে একটা বই লিখব। একাডেমি প্রাঙ্গন থেকে নন্দনের স্টল বন্ধ করে উদ্যানে আসলাম। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। ছুটির ঘণ্টা বাজে বাজে। মাধবদার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে মেলা থেকে বের হয়ে শাহবাগ এসে পেলাম কবি জাফর আহমেদ জাফর, কবি ফিরোজ এহতেশাম ও টাইগার দোয়েলকে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে দোয়েল, ফিরোজ আর আমি এক বাসে চড়লাম।..................................৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ঢাকা
false
hm
হাসির গল্প হাসি নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। মানুষ ছাড়া আর কেউ হাসে না। এই নিয়ে আজিমভের একটা জটিল গল্প আছে, দ্য জোকস্টার ... আছে অসমঞ্জবাবুর কুকুরকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের গল্প। আমার গল্প হাসিকে নিয়ে। না, হাসি কোন বালিকার নামও নয়। তাকে নিয়ে আমার গোপন আশনাইয়ের রগরগে গল্পও বলবো না। আমি বলবো সেই হাসির কথা, যা আমরা মুখ খুলে সশব্দে হাসি। তবে শুরুতে একটা হাসির গল্প বলি। এক লোক মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, হঠাৎ খুঁজে পেলো এক চেরাগ। তুলে ঘষা দিতেই বেরিয়ে এলো দৈত্য। যে কোন হুকুম তামিল করবে সে। লোকটা বললো, আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। দৈত্য বললো, তথাস্তু, আমার পিছু পিছু আসুন। এই বলে বালির ওপর হাঁটা ধরলো সে। কিছুদূর হেঁটে চটেমটে লোকটা বললো, আমি আরো জলদি জলদি বাড়ি ফিরতে চাই। দৈত্য বালির ওপর দৌড় শুরু করে বললো, তথাস্তু, আমার পিছু পিছু দৌড়ান। যাঁরা এই গল্প পড়ে হাসলেন, তাদের এবার জিজ্ঞেস করি, কেন হাসলেন? কোন জায়গায় এসে হাসলেন? যাঁরা হাসেননি, তাঁদেরও বলি, কেন হাসলেন না? হাসির রহস্য কিছুটা ভেদ করেছেন ভিলায়ানুর রামাচন্দ্রন। মস্তিষ্কবিশারদ। মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথেই হাসির রহস্যজড়িত, এই ধরে নিয়ে এগিয়েছেন তিনি। আর মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের ধাপ বহু, বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন গতি আর দিকে টেনে নিয়ে গেছে আমাদের মস্তিষ্ককে। কেউ যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তারপর ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে ওঠে, আমরা অনেকেই হেসে উঠবো। কিন্তু সেই লোক যদি পড়ে গিয়ে মাথা ফাটায় বা অজ্ঞান হয়ে যায়, আমরা হাসবো না, বরং ছুটে যাবো সাহায্য করতে। হাসির রহস্যের একটা আবছা সমাধান আছে এখানেই। হাসিকে ফলস অ্যালার্ম সিগনাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রামাচন্দ্রন। দলবদ্ধ বৃক্ষচারী পূর্বপুরুষের আমল থেকেই সম্ভবত হাসির সূত্রপাত। বিপদ দেখলে সংকেত দেয়া প্রায় সব দলবদ্ধ প্রাণীর আচরণে গাঁথা, কিন্তু যদি সংকেত দেয়ার পর দেখা যায়, বিপদটা আসলে বিপদ নয়? সেক্ষেত্রে আরেকটি সংকেত দিয়ে দলের বাকিদের জানিয়ে দিতে হবে, আগের সংকেত ভুল ছিলো। ফলস অ্যালার্ম ভাইয়োঁ, ভয়ের কিছু নাই, চরে খাও। এই ফলস অ্যালার্মের সংকেত আমাদের ভেতরে সেই থেকে বিদ্ধ হয়ে আসছে। সময়ের সাথে এর কিসিম পাল্টে গেছে, মৌখিক ভাষার বিকাশের পর হয়তো এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু এরই সাথে আমাদের চেতনায় ফলস অ্যালার্ম ঠাঁই করে নিয়েছে অন্যভাবে। আমরা আবিষ্কার করেছি এক নতুন জিনিস, হাস্যরস। উদ্ভট কোন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রত্যাশিত বিপদ যখন প্রাপ্তিতে নিছক সাদামাটা চেহারা নিয়ে আসে, তখন সেই ফলস অ্যালার্মের সংকেত আমরা দিয়ে উঠি, চেতনার গভীর থেকে। হাসির গল্পটা খুব একটা হাসির বোধহয় হলো না। উৎসাহীরা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন রামাচন্দ্রনের দ্য ইমার্জিং মাইন্ড বইটা। আর বোনাস হিসেবে রইলো মস্তিষ্ক নিয়ে তাঁর একটা বক্তৃতার ভিডিও। হাসুন সবাই প্রাণ খুলে।
false
hm
ছায়াগোলাপ ফেসবুকে যারা ঢোকে, তাদের কি কাজকাম নাই? প্রশ্নটা মাঝে মাঝে সশব্দে করে ফেলি, বউ অন্য ঘর থেকে তখন ইস্রাফিলের শিঙার মতো সুরে কী যেন বলে। পুরোটা বুঝতে পারি না, মনে হয় সায় দেয়। ফেসবুকে লোকজনকে ফালতু কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য চতুর লোকজন কত কারিকুরি বার করেছে, দেখে মাঝে মাঝে তাজ্জব হয়ে যাই। একটা কম্পিউটারের সামনে বসে কোনো নিরস চেহারার ছেলে, হয়তো সাতদিন ধরে গোসল করে না, দাঁত মাজে না এক মাস ধরে, বগলে অশ্বত্থের চারা হয়তো গজিয়ে গেছে, মড়াপচা গন্ধ গায়ে, সে-ই হয়তো বানিয়ে বসেছে ফুল উপহার দেয়ার অ্যাপ্লিকেশন। কী বুদ্ধি ব্যাটাদের। বসে বসে ক্লিক করো আর লোকজনকে ফুল উপহার দাও। আসল ফুল হলে একটা কথা ছিলো, এগুলো হচ্ছে ফুলের ভূত, হাতে আঁকা টাকার মতো। ফুল যদি কোনো ঈশ্বর বানিয়ে থাকে, সেই ব্যাটার চেয়ে হয়তো কম খাটেনি প্রোগ্রামার ছোকরা, কিন্তু ফুলের আত্মার দিকে চোখ না দিয়ে বলদাটা শুধু রূপটাই দেখেছে। আর যাদের কোনো কাজ নেই খাওয়াদাওয়ার পর, তারা বসে বসে ফেসবুকে ঢুকে এই অ্যাপ্লিকেশনে মাউস দিয়ে গুঁতাগুঁতি করে একে ওকে ফুল পাঠায়। প্রোগ্রামার বিদেশী, তাই ফুলগুলিও ফিরিঙ্গি। বাঙালিরা সেই ম্লেচ্ছ নামের লিস্ট থেকে চেনা ফুলের ইংরেজি নাম খোঁজে, তাই হয়তো আমার নোটিফিকেশনে শুধু গোলাপের আগমনী সংবাদ। বউ অন্য ঘরে বসে মনোযোগ দিয়ে কী একটা হিন্দি অনুষ্ঠান দেখছে। একটা ঘড়ঘড়ে পুরুষ কণ্ঠ বলছে, ইস বাচ্চে কি পিতা ম্যায় হুঁ! যন্ত্রপাতির অসীম করুণায় তার দাবী ছড়িয়ে পড়ছে সাত আসমানে, ম্যায় হুঁ ম্যায় হুঁ ম্যায় হুঁ! পরিস্থিতি খুবই জমজমাট, বাচ্চার বাপের পরিচয় নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলছে, বউ এখন টিভি ফেলে ঘরে ঢুকবে না, এমন মনকলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে নোটিফিকেশনে ক্লিক করে গোলাপবিলাসিনীর প্রোফাইলটা খুললাম। মেয়েটা গত এক মাস ধরে গোলাপ পাঠিয়ে যাচ্ছে। অবিরত। ওর কি আর কোনো কাজ নাই? কিংবা আর কেউ নাই গোলাপ পাঠানোর? আমাকে কেন? আর দিবিই যদি তো এই ভূতগোলাপ কেন? একদিন ভালোমতো সেজেগুজে একটা তোড়া নিয়ে আয় বাসায়, ডালভাত খেয়ে যা, বউয়ের সাথে বসে বেওয়ারিশ হিন্দি সিরিয়ালের বাপের আহাজারি শুনে যা। নোটিফিকেশনের পাতাটা পুরোটা খোলার পর হঠাৎ করেই আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ে আমার। আগে খেয়াল করিনি। কে এক পুরুষও আমাকে গোলাপ পাঠাচ্ছে এক মাস ধরে। মেজাজটা খারাপই হয় এবার। প্রথম গোলাপের তারিখটা দেখি। গত মাসের বারো তারিখ। আজ সাত তারিখ। বারো তারিখ থেকে ঐ মেয়েটাও গোলাপ পাঠানো শুরু করেছে। ব্যাটাছেলেটা মেয়েটার মতো অনর্গল না পাঠালেও মাঝে মধ্যে একটা দু'টো পাঠিয়েছে দেখা যাচ্ছে। কে রে তুই শালা, বিবাহিত লোককে গোলাপ পাঠাস? ঘরে বাপভাই নাই? ক্লিক করে প্রোফাইলটা খুলে এবার নামটা চোখে পড়ে আমার। ওহ। মারুফ কাজী। হাল্লার পো, তুই আবার আমাকে গোলাপ পাঠাস ক্যান রে? মারুফ কাজী আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। প্রাণোচ্ছ্বল লোক। একটু মেয়েলি ভাব আছে, ওড়না টোড়না পরে কুর্তার সাথে, কিন্তু সেটা সম্ভবত সঙ্গদোষে। দিনরাত মেয়েদের সাথেই তার ওঠবোস। মেয়েরাও তাকে ঘিরে থাকে, দেখেছি। সম্ভবত, কবিতার গুণে। কবিতা জিনিসটা আমি হজম করতে পারিনি কখনো, যেটাই গিলতে চেয়েছি. মার্গপথে বেরিয়ে গেছে। মারুফ কাজী কবিতা শুধু গেলেইনি, চিবিয়ে রসমজ্জা হজম করে বাদুড়ের মতো যত্রতত্র কবিতা ওগড়াতে ওগড়াতে একেবারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বাঁধিয়ে রেখেছে। শাহবাগে গিয়ে আবৃত্তির সিডি কিনতে গেলে তার খোমাটা কাভারে দেখতে হবেই। ছেলেদের কবিতা, মেয়েদের কবিতা, সব কিছুতেই সে আছে ঈশ্বর আর ব্যাকটিরিয়ার মতো। কবিতা আমি বুঝি না, কিন্তু এ কথা বুঝি, বেশ টেনে টেনে কবিতা আবৃত্তি করতে পারলে, সিডি বার করে ফেলা যায়, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় ওড়না পরে মাইক কাঁপিয়ে তোলা যায়। আর মেয়েদের পটানো তো অবশ্যই যায়। গোলাপের ভূত মারুফ কাজীর পাশাপাশি এই হাস্যোজ্জ্বল রূপবতী তরুণীটির কাঁধে কিরামান কাতেবিনের পেছনের বেঞ্চে বসে আছে দেখে একটা আঁশটে সন্দেহ হলো প্রথমেই। মেয়েটি দেখতে বেশ। প্রোফাইলের ছবিটি দেখে বোঝা যায়, সে দীর্ঘাঙ্গিনী, নির্মেদ। তার হাসিটিও তার আত্মাকেই ধারণ করেছে। কান পেতে শুনলাম, হিন্দি সিরিয়ালে বাচ্চার মালিকানা নিয়ে নারীপুরুষের কলহ চলমান। বউ যখন দূরে, তখন এই গোলাপের রহস্যে একটু টোকা দিয়ে দেখা যায়। অনলাইন বন্ধুদের তালিকায় মেয়েটির নাম জ্বলজ্বল করছিলো তখন, সামিরা মেহের, ক্লিক করে লিখলাম, "গোলাপের নিচে চাপা পড়ে তো মারা যাচ্ছি!" প্রত্যুত্তর এলো, "হিহি।" চোঙামুখো মানুষকে আমি ভালোবাসি না, আর দেখেছি, যারা মন খুলে হাসতে জানে না, তারা এই অক্ষরের আলাপেও হাসির অক্ষর লিখতে পারে না। হাসতে জানা মানুষ নিরাপদ মনে হয়, হাসতে জানা নারী নিরাপদতর, এবার নির্ভার মনে লিখি, "ঘটনা কী? কে গো তুমি?" উত্তর আসে, "আমি সামিরা।" সেই থেকে শুরু হয়। ফুলের স্রোত থামে না। আমার বউটাও কোনো হিন্দি সিরিয়াল মিস করে না, লোডশেডিং হলে ভোরে উঠে পুনর্প্রচারে আবার দ্যাখে, কোন শাশুড়ি কোন পুত্রবধুর একশো কোটি রূপির কাগজের গুদামে গুণ্ডা লাগিয়ে আগুন ধরিয়েছে, কার কোলের শিশুর পিতা কাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সামিরার সাথেও তাই আলাপ আস্তে আস্তে সরু খাল ধরে কীর্তনখোলায় এসে পড়ে। সামিরা হাসতে জানে বলেই বোধহয় বেশিক্ষণ গোপন রাখে না কথাটা, দ্বিতীয়বার চেপে ধরতেই একটা হাসিমুখ পাঠায়। সম্মতিরই লক্ষণ বলে চিনে নিই স্মাইলিটাকে। হ্যাঁ, মারুফ কাজীর প্রেমে সে আচ্ছন্ন। মারুফ কাজীর ফেসবৌকেয় দেয়ালে আধ ঘন্টা পর পর নতুন নতুন প্রেম গদোগদো কবিতার চরণ, আর সামিরার দেয়ালে এক ঘন্টা পর পর নতমুখ কোনো তরুণীর তৈলচিত্র দেখে ধারণাটা এতই পোক্ত হয়েছিলো যে ইতিবাচক উত্তর না এলেও সেটা পাল্টাতো না, কিন্তু সামিরা ত্রস্তা হরিণীর মতো আড়াল খোঁজে না, সে শাবকের সরলতা নিয়ে প্রশ্নের দাঁতে নিজের গলা পেতে দেয়। হ্যাঁ, মারুফ কাজীকে ভালোবাসে সে। ভালো লাগে মেয়েটির সাহসী স্বীকারোক্তিটুকু, আবার খারাপও লাগে, কারণ মারুফ কাজী বিবাহিত, বহুদিন ধরেই। ব্যাটার বিয়ের হলুদে বন্ধুর ছোটো ভাই হিসেবে কিছু শ্রমও দিয়েছিলাম। হতভাগার কোনো শালি নেই, মামাতো চাচাতো শালিও না। এরকম কালাহারি মরুভূমিতে পদ্ম হয়ে প্রস্ফুটিতা তার স্ত্রী, আর গোটা বংশ ভর্তি ছেলেছোকরা। গায়ে হলুদটাই লস হয়েছিলো পুরো। রাগটা ঝাড়তে ইচ্ছা হয় সামিরার ওপরই, কিন্তু খারাপ লাগাটা কাটে না, কারণ সামিরা নিজেও বিবাহিতা। কান পেতে শুনি, বউ মজে আছে হিন্দি সিরিয়ালে, কীবোর্ডে আমার আঙুল ফিসফিসিয়ে টাইপ করে, "কেমন হয়ে গেলো না ব্যাপারটা?" সামিরা একটু চুপ করে থেকে লেখে, "কী করবো? ভালো লাগে তো!" বিবাহিত বুকটায় একটু ব্যথা লাগে। সামিরার দুঃখে নয়, নিজের দুঃখেও নয়, মারুফ কাজীর গায়ে হলুদে তার নেই-শালিদের অনুপস্থিতির জন্যেও নয়, ঐ ভালোলাগার কথা শুনেই। ভালোবাসতে ভালো লাগে যাদের, তাদের কেবলই দেখি আহত হতে। ঘূর্ণিঝড়ে তাদেরই চাল উড়ে যায়, বাজ পড়ে তাদেরই গরু মরে, ভূমিকম্পে তাদের ঘাড়েই হুড়মুড় করে এসে পড়ে ছয়তালা দালান। সামিরার ছবির হাসিটার জন্যে দুঃখ পাই, দুঃখ পাই তার আলাপের টুকরো টুকরো মূক হাসিমুখগুলোর জন্যে। টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল কখনও শেষ হবার নয়, আর আমার বউও যতদিন দেহে রবে প্রাণ, ততদিন লড়ে যাবে, তাই সামিরার গোলাপগুলো জমতে থাকে আমার নোটিফিকেশনের পৃষ্ঠায়। তার খোঁজ নিই, খোঁজ নিই তার হাসিমুখের। সামিরার গোলাপগুলো মলিন হয় না, কিন্তু একদিন দেখি তার দেয়ালে আর সেই নতমুখ তরুণীদের ছবিগুলো নেই। তার বদলে টুকরো টুকরো কথা লেখা, সেগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার। একটু আশঙ্কা হয়, মারুফ কাজীর দেয়ালে গিয়ে দেখি, কিন্তু সেখানে কবিতার আমাশয় সগর্জনে বহমান। সামিরার গোলাপ ঠিকই পাই, জানতে চাই, "কী হলো?" উত্তর আসে মলিন মুখের স্মাইলিতে। বিস্তারিত জানতে চাই, সামিরা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, "ও একটা প্রবঞ্চক।" প্রবঞ্চক কথাটা বড় কঠিন, মানেও মনে পড়তো না, কিন্তু সামিরার খালি দেয়াল, মারুফ কাজীর অক্ষুণ্ণ কবিতার স্রোত, আর ঐ বিষণ্ণ মুখের এক টুকরো স্মাইলির ফ্রেমে শব্দার্থ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বলি, "কেন?" সামিরা উত্তর দেয়, "আমাকে আর ভালোবাসে না। এখন অন্য আরেকজনকে গোলাপ দেয়, অন্য আরেকজনের জন্যে কবিতা লেখে।" শিশুর মতো অভিমান মনে হয়, কিন্তু অভিমানী সকলেই তো শিশু, ঐটুকু উত্তরাধিকার তো সে শৈশব থেকে বহন করে চলতেই পারে। জানতে চাই, "কে?" জানতে পারি, সুমনা মোস্তফা নাম সেই প্রবাসিনীর, মারুফ কাজীর নতুন কবিতার স্টক অর্গলমুক্ত বর্ষার জলের মতো সেইদিকে ধাবিত। মারুফ কাজীর দেয়ালে সেই মেয়েটির হাসিমুখ দেখতে পাই, দেখতে পাই আরেকটি সামিরাকে, দেখতে পাই আরেকটি পরিতৃপ্ত হরিণশাবককে। সামিরা কাঁদে, একটি কোলন, একটি একাকী কোট মার্ক, একটি প্রথম বন্ধনী এঁকে, কিন্তু আমি তার কান্নার শব্দ যেন শুনি বউয়ের হিন্দি সিরিয়ালে হোটেল ব্যবসায় দুইশো কোটি রূপি লস খাওয়া শাশুড়ির কান্নাকে ছাপিয়ে। সামিরা কাঁদে, কারণ তার নিজের সংসারটুকু চুরমার হয়ে গেছে সেই ভালোবাসতে ভালো লাগার রোগে। সামিরার পুরুষটি জানে, সামিরা সশরীরের ভালোবাসে মারুফ কাজী নামের একটি লোককে। তারা আর একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে না, পারতপক্ষে মুখোমুখি হয় না, সামিরা সেই লোকটির জন্যে রান্না করে না, কারণ সেই লোকটি সামিরার রান্না মুখে দেয় না, তারা দু'জন দুই ঘরে রাতে অন্ধকার ঘরে শুয়ে ভিন্ন মানুষের কথা ভাবে। সামিরা ভাবে মারুফ কাজীর কথা, সামিরার পুরুষ কার কথা ভাবে, সামিরা জানে না। জানতে চাই, মারুফ কাজীও তো বিবাহিত। যদিও তার শালি নেই, নচ্ছাড়টা জাতির কোনো কাজেই এলো না। সামিরা এ কথা জেনে কেন ... ? সামিরার উত্তরটা আসার আগেই বুঝে যাই। এর কোনো উত্তর তো হয় না। ভালো লাগার পেছনে তো এত হিসাব থাকে না। সামিরার গোলাপগুলি মলিন হয় না, শুধু একটু একটু করে সামিরাকে মলিন হতে দেখি। হিন্দি সিরিয়াল চলতে থাকে, বউ রাজত্ব করে টিভির আওয়াজ যতদূর যায় ততদূরের সমস্ত বর্গফুট নিয়ে, কিন্তু সামিরাকে অনলাইনে দেখি না। পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবে বউকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে একা হয়ে যাই, বউ তার গোটা দুয়েক বান্ধবী খুঁজে পেয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকার হুকুম দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তার স্মরণশক্তির দৌর্বল্যের ওপর ভরসা করে একটু ডানে বামে যাই। আর চারুকলায় একটি নিভৃত কোণে দেখা হয়ে যায় মারুফ কাজীর সঙ্গে। যথারীতি তার সঙ্গে তার নিজ স্ত্রী নয় এমন একটি রমণী। দীর্ঘাঙ্গিনী, সুকেশা, মুখটি মলিন। এ-ই হয়তো নতুন শিকার, সেই সুমনা মোস্তফা। সম্ভাষণ জানাতেই মারুফ কাজী একটু চমকে ওঠে, বলে, কীরে বাবু, কেমন আছিস? তোর বউ কই? মহা বিরক্ত লাগে। আমার বউ দিয়ে তুই কী করবি ব্যাটা লম্পটেশ? তোর নিজের বউ কই? সঙ্গে এটা কাকে নিয়ে ঘুরঘুর করছিস? কিন্তু মুখে বলি, "এই তো।" দীর্ঘাঙ্গিনী এবার হাসে একটু কষ্টে, বলে, "চিনতে পারেন?" হাসিটাকে চিনি ভালো করেই, হাসির মালকিনকে চিনতে পেরে এবার চমকে উঠি। এ কী হাল সামিরার? কৃশ হাসিটি আবার পায়ে পায়ে পিছিয়ে হারিয়ে যায় কোনো অন্ধকারে, প্রশ্নের জবাবে সামিরা শুধু বলে, "এই তো, ঝামেলা যাচ্ছে আর কি।" দেখতে পাই, মারুফ কাজীর হাত সে শক্ত করে চেপে ধরে আছে, তার নখগুলো সাদা হয়ে আছে। যুগলটি বেশিক্ষণ থাকে না সেখানে, মারুফ কাজী ত্রস্তপায়ে চলে যায় কোথায় যেন। আর আমার বউও কোত্থেকে আবার চলে আসে, "য়্যাই, তোমাকে না বললাম দাঁড়িয়ে থাকতে?" বউগুলো শুধু দাঁড়া করিয়ে রাখতে চায়। পরের দিনটা ব্যস্ত গিয়েছিলো, অফিস থেকে ফিরেছিলাম একটু দেরিতে, চায়ের কাপ হাতে ফেসবুক খুলে পেলাম দুঃসংবাদটা। মেসেজে মেসেজে ভরে গেছে ইনবক্স। আত্মহত্যা করেছে সামিরা। পুরনো গল্প। ফ্যানের সাথে ওড়না, সেই ওড়নার সাথে একটি অভিমানী শিশু। খবরের কাগজেও এসেছে সে দুঃসংবাদ। বড় দুঃখ পাই। বউ আমার বাষ্পমাখা চোখ দেখে ছুটে আসে। তাকে কী করে বোঝাই, সামিরার সাথে পরিচয় কেমন, কীভাবে? আরেকটি নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে কোনো বেগ পেতে হয় না, কিন্তু আমার সাথে একটি হাসিমুখ আর গোলাপস্রোতের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা বড় জটিল। সামিরা আমার বন্ধু নয়, প্রেমাস্পদাও নয়। প্রতিদিন যে চড়ুই সকালে ডেকে ঘুম ভাঙায়, একদিন সে হঠাৎ আর না এলে যে বেদনা অনুভব করি আমরা, সেই চড়ুইয়ের মতোই সামিরা বেদনা জাগিয়ে তুলেছে কেবল। মারুফ কাজীর দেয়াল খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, সে আর নেই ফেসবুকে। নাম ধরে খুঁজেও তাকে পাই না, যেন সে কখনো ছিলোই না। যথার্থ লম্পটের মতো সে নিরুদ্দেশ। তারপর কয়েকদিন অনেক বেকার কথা ঘুরপাক খায় নিষ্কর্মা বাঙালির ফেসবুকের দেয়ালে। সামিরার দেয়ালের নানা অর্ঘ্য দিয়ে আসে তার বন্ধুরা, তাকে খবরের কাগজ পড়ে চিনেছে এমন আবেগখোর অপদার্থের দল। তারপর আবার আস্তে আস্তে উত্তাপ পড়ে আসে, সামিরার দেয়ালে আর নতুন লতাগুল্ম গজায় না। আজ ফেসবুকে নিজের দেয়াল সাফ করতে গিয়ে এক এক করে নিষ্ঠুরের মতো সাফ করলাম সামিরার পাঠানো সব ক'টি গোলাপ। কেবল একটি রেখে দিলাম। থাকুক। সকল চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল কাকতালমাত্র।
false
rn
শেষ বিকেলে মৃত্যু (বুল ফাইট) কী অদ্ভুত, 'মৃত্যু' খেলাকে কেন্দ্র করে! অসম্ভব রকমের ভয়ংকর এক খেলা, একপক্ষের মৃত্যুতেই কেবল যার ইতি! স্পেনের জাতীয় খেলা বুল ফাইট। গ্রীকরা বুল ফাইটিং এর উদ্ভাবক। স্প্যানিশ'রা বুল ফাইটিং খেলাকে পরিনত করেছে শিল্পে। পশু প্রেমীদের হাজারো আপত্তি উপেক্ষা করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বুলফাইট। খুনের উৎসব । সাধারনত শেষ বিকেলেই আয়োজন করা হয়ে থাকে ফাইটের। খেলা শুরুর আগে প্রতিটা পশুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রাগিয়ে দেয়া হয় এবং কোনো খাবার খেতে দেয়া হয় না। খেলা শেষে পশুটিকে হত্যা করা হয়। হত্যার মধ্যে দিয়ে খেলা শেষ হয়। মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকে মারামারি দেখতে বড্ড পছন্দ করে। কেন, কে জানে? গত বছর এক জরিপে বলা হয়েছে- ৬৫ শতাংশ জনতা এই নির্দয় খেলাটি আজকাল পছন্দ করে না। বুল ফাইট ওদের জাতীয় খেলা বলা যেতে পারে। যেমন ওরা ফুটবল-পাগল তেমনি ওরা ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত। গত একমাস ধরে আমি ইউটেবে বার বার ফুল ফাইট দেখছি। আমার মনে হচ্ছে, খেলার নামে ‘বোকা’ পশুকে নিষ্ঠুরতম পন্থায় নিধন করার এই আনন্দোল্লাসকে ‘সভ্যতার অসভ্যতা’ বলা যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এ ধরনের কোন নির্মম খেলা পছন্দ করি না। বহু স্পেনীয়র মতে, বুল ফাইটিং কেবলমাত্র খেলা নয় এটি একটি প্রাচীন ‘শিল্প’।অতীতে বাংলাদেশে ষাঁড়ের লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলারূপে প্রচলন ছিল। লড়াই করার জন্য ষাঁড় গরু আলাদাভাবে লালন পালন করা হতো। এর দ্বারা হাল চাষ বা অন্য কোন ধরণের কাজ করা হতো না। ষাঁড়টিকে মোটাতাজা করা হতো শুধু লড়াই করার জন্য। শুকনো মৌসুমে গ্রামের বাজারে ঢোল পিটিয়ে ষাঁড়ের লড়াই দেখার আমন্ত্রন জানানো হতো। বুলফাইটিং কি, তা কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বুলফাইটিং স্পোর্ট কিনা, তা নিয়ে বহুকাল যাবৎ বিতর্ক চলছে। স্পেনের ক্যাটালোনিয়া প্রদেশে বুলফাইটিং নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ পর্তুগালে বুলফাইটিং চলে, তবে রক্ত না ঝরিয়ে। একটা ঘটনা বলি- সুদূর আমেরিকা থেকে ২০ বছরের তরুণ বেঞ্জামিন ঘুরতে গিয়েছিল স্পেনে। সেখানে গিয়ে সে যায় ষাঁড়ের সঙ্গে দৌড় বা 'বুল রানিং' দেখতে। তারপর সে ঠিক করে বুল ফাইটিংয়ে অংশ নেবে। সেইমত সে ঢুকে পড়ে ষাঁড়দের উত্ত্যক্ত করে ছুটতে থাকে। দৌড়নোর নিয়মকানুন সেভাবে জানা ছিল না তার, হঠাত্ই একটা ষাঁড় তাঁর দিকে ছুটে আসে, পালাতে গিয়ে পড়ে যায় সে। নিজের বাগে পেয়ে উন্মক্ত ষাঁড় বারবার তাকে মাটিতে ফেলে সিং দিয়ে গুঁতোতে থাকে। সেখানে অচৈত্য হয়ে পড়ে সে। কোনওরকম একজন তাঁকে উদ্ধার করে আনে। অনেকেই ভেবেছিলেন এই মার্কিন পর্যটক হয়তো মারা গিয়েছেন। কিন্তু পরে দেখা যায় সে তখনও বেঁচে। ততক্ষণাত্‍ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তাঁকে এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সবাই হাল ছেড়ে দিলেও ডাক্তররা শেষ চেষ্টা করেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জটিল অপারেশেনর পর তার অবস্থা বিপদমুক্ত হয়। সেই তরুণের সঙ্গে আরও তিন বিদেশী পর্যটক আহত হয়েছিলেন। তাঁরাও সুস্থ আছেন।স্পেন ইউরোপ মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। এর রাজধানী মাদ্রিদ। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৫১তম দেশ। প্রধান আয় হয় পর্যটন তারপর কৃষিকাজ।
false
ij
None শ্বেত পাথরের পেয়ালায় আনার রঙের ফালুদা। তাতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বাদশা আকবর বললেন, ফুপু, তুমি বাবার জীবনকাহিনীটি লেখ না। আমি লিখব? বাদশা আকবরের ঠিক সামনে বসা গুলবদন বেগম-এর মাঝবয়েসী গুলাবী গন্ডদেশে যেন রং ছড়াল। মুগল হেরেমের এই কক্ষে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে। তাতে গুলবদন বেগম-এর ঐশ্বর্যময়ী রূপ থেকে রূপালি আভা ছড়িয়েছে। হ্যাঁ, তুমি লিখবে। বাদশা আকবর বললেন। তুমি কত সুন্দর করে আমাদের ছেলেবেলায় গল্প শোনাতে-কেন তোমার মনে নেই? আমরা যখন কাবুলে ছিলাম। পুরনো দিনের কথা ওঠায় গুলবদন বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ভাইয়ের এই ছেলেটি তিনি ভারি স্নেহ করেন। হিন্দুস্থানের কত বড় বাদশাহ, অথচ বিন্দুমাত্র অহংকার নেই, একেবারে সেই ছেলেবেলার মতোই আছে। গুলবদন বেগম বললেন, আচ্ছা লিখব। এত করে যখন বলছিস। গুলবদন বেগম ভাইয়ের ছেলেকে আশ্বাস দিলেন। আরও কিছুক্ষণ পর জরুরি সংবাদ পেয়ে আকবর প্রস্থান করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠেছে। এক রাজস্থানী বাঁদি এসে সেজ বাতি জ্বেলে দিয়ে গেল। গুলবদন বেগম লিখতে বসলেন। বুকে চাপা কান্না টের পেলেন। কত কথা, কত স্মৃতি। এখন বুক চিড়ে সে সব কথার উত্থান হবে। কষ্ট তো হবেই। সে কালের রীতি অনুযায়ী প্রথম পাতায় দীর্ঘ শিরোনাম লিখলেন:“ আহওয়াল হুমায়ুন পাদশাহ জামাহ কারদম গুলবদন বেগম বিনতে বাবুর পাদশাহ আম্মা আকবর পাদশাহ।” পরে এটিই ‘হুমায়ুননামা’ বা ‘দি হিস্ট্রি অভ হুমায়ুন’ নামে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। গুলবদন বেগম ভাইয়ের জীবনীটি সহজ সরল ভাষায় লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। লিখতে লিখতে সহসা বাবার কথা মনে পড়ে গেল। গুলবদন বেগম এর বাবা সম্রাট বাবর (১৪৮৩/১৫৩০) ‘বাবরনামা’ লিখেছিলেন । সে বইটিও সম্রাট বাবর সহজসরল ভাষায় লিখেছিলেন ... ... গুলবদন বেগম এর বাবা বাবর ভারতবর্ষে মুগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পিতার দিক থেকে তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের সঙ্গে সর্ম্পকিত ছিলেন বাবর। তিনি ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিস্থানের খোকন্দে জন্মগ্রহন করেন। বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জা ফরগানার অধিপতি ছিলেন। বাবর তাঁর পিতার মৃত্যুর পর অল্প বয়েসে ক্ষমতা লাভ করেন। তবে বারবার ক্ষমতা চ্যূত হলে মধ্য এশিয়া ত্যাগ করেন এবং কাবুল জয় করেন। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ উপাধি গ্রহন করেন। ওই বছরের ১৭ মার্চ বাবর এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন কাবুলে জন্মগ্রহন করেন। যা হোক। এরপর মধ্য এশিয়ায় কর্তৃত্ব করতে চাইলে ব্যর্থ হন। ভারতবর্ষ জয়ের চেষ্ট া করেন। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল জয় করেন। এরপর ১৫২২ সালে কান্দহার জয় করেন। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুগল বংশের সূচনা করেন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবর মৃত্যুবরণ করেন। বাবর এর মৃত্যুর সময় তাঁর একমাত্র কন্যা গুলবদন বেগম-এর বয়স ছিল ৮ বছর। এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন-এর বয়স ২২। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবরের মৃত্যুর পর আগ্রায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুমায়ুনের মুগল বংশের শাসনভার গ্রহন করেন। এবং অবিলম্বে পশ্চিমে স্থানীয় মুসলিম অধিপতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। পূর্বদিকেও উদীয়মান আফগান নেতা শেরখান শক্তি শালী হয়ে উঠছিলেন। ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে শেরখান-এর জন্ম; পিতার নাম হাসান খান শূর। শেরখান বিহারের অর্ন্তগত সাসারামের জায়গিরদার। যা হোক। শেরখান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের এক যুদ্ধের পর বিহারের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এবং ক্রমান্বয়ে ১৫৩৮ সালে গৌড় (সে সময়কার বাংলার রাজধানী) দখল করেন। এতে হুমায়ুন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি সসৈন্য পূর্বদিকে অগ্রসর হলেন। হুমায়ূন গৌড়ে প্রবেশ করেন। (গুলবদন বেগম এসব ঘটনাই লিখেছেন হুমায়ুননামায় ...) ...বাংলাপিডিয়ায় কে. এম করিম লিখেছেন: “সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানীর নতুন নামকরণ করেন ‘জান্নাতাবাদ’ এবং হুমায়ুন এখানে ছয়মাস অবস্থান করেন। ” ...তৎকালীন গৌড়ের অবস্থান বর্তমান পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলায় গঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়ে। বাংলা হুমায়ুনের কাছে বেহেস্তের মতন মনে হয়েছিল। কাছেই গঙ্গা। রাজশাহীর মতই মালদহে প্রচুর আম ফলে। মুগল বাদশা হুমায়ুন বাংলার কিছু হলেও অপার-মর্ম টের পেয়েছিলেন ... ‘জান্নাতাবাদ’ -এর বাংলা স্বর্গনগর ... ওদিকে চতুর আফগান শেরখান বিহার পুনরুদ্ধার করে পশ্চিমে অনেক দূর এগিয়ে যায়। জান্নাতাবাদে কিছু সৈন্য রেখে সম্রাট হুমায়ুন পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসা নামক স্থানে পৌঁছেন। শেরখান এর সৈন্যবাহিনী হঠাৎই মুগল সৈন্য দের ওপর আক্রমন করে বসে । মুগল সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে যায়, চতুর্দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। সম্রাট হুমায়ুন পরাজিত হন। শেরখান ‘শেরশাহ’ উপাধি ধারণ করে নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক বলে পরিচয় দেন । এরপর আফগান সৈন্যরা মুগল প্রতিরোধ ধ্বংস করে দিয়ে বাংলা দখল করে। শেরশাহ ভারতবর্ষে শূর বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ওদিকে হুমায়ুন প্রতিশোধের পথ খুঁজছিলেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধেও হুমায়ুন পরাজিত হন এবং দিল্লির সিংহাসন ত্যাগ করেন। শেরশাহ আফগান সালতানাত পুনরুদ্ধার করেন। এরপর সম্রাট হুমায়ুন প্রায় ১৫ বছর গৃহহীন যাযাবরের জীবন যাপন করেন। সিন্ধুর মরু এলাকায় ঘুরছেন। এ সময়ই ১৩ বছর বয়েসি হামিদা বানু বেগম নামে এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে যান। সেই কিশোরীর সঙ্গেই বিয়ে হয় হতভাগ্য সম্রাটে (এরকম অভূতপূর্ব বিষয়ই লিখেছেন সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম ) ... ১৫৪২ সালে হামিদা বানু বেগম অমরকোটে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। সেই ছেলের নাম রাখা হয় আকবর। পুত্রের জন্মের পর সম্রাট হুমায়ুনের ভাগ্য যেন বদলে যেতে থাকে। তিনি পারস্যের দিকে অগ্রসর হন। পারস্যের শাহ তখন তামাস্প ... তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে আন্তরিক ভাবে গ্রহন করেন, সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দেন;...এর পর হুমায়ুন আফগান বাহিনীকে পরাজিত করেন দিল্লি ও আগ্রা পুনর্দখল করেন। তবে সাম্রাজ্য সংহত করার জন্য দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেননি । ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এক গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। লিখতে লিখতে কত কথা মনে পড়ে যায় ... গুলবদন বেগম-এর জন্ম কাবুলে ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে । যখন ভারতবর্ষে এলেন তখন বয়স ৬। ১৭ বছর বয়েসে বিবাহ। স্বামী চাগতাই মুগল- খিজির খাজা খান। একটি ছেলেও হয়েছিল। ভাই হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের সময় গুলবদন বেগম কাবুলে ছিলেন-সেই সময়টা হেরেমেই কেটেছে। হুমায়ুন দিল্লি ও আগ্রা পুনর্দখল করার পর গুলবদন বেগম আগ্রায় ফিরে আসেন নি। ফিরে এলেন আকবরের শাসন যখন আরম্ভ হয়, তখন। আকবর হুমায়ুনের মৃত্যুর দু বছর পর শ্রদ্ধেয় ফুপুর ভরনপোষনের দায়িত্ব গ্রহন করে আগ্রায় নিয়ে আসেন। হজ্জব্রত পালন বাদে গুলবদন বেগম-এর বাকি জীবন আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে কেটেছিল। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ। হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশে গুলবদন বেগম-এর অন্যান্য মুগল নারীদের সঙ্গে ৩ হাজার মাইল দূলংঘ্য পাহাড় ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি পাড়ি দেন। হারেমের অভিজাত মহিলারা এরকম কষ্টকর যাত্রা এর আগে করেনি। হজ্জব্রত পালনের ব্যবস্থা বাদশাহ আকবরই করে দেন। ফুপুরকে দান করার জন্য প্রচুর ধনরত্ন দান করেন। গুলবদন বেগম প্রায় চার বছর মক্কা-মদিনায় কাটান। সে সময় তাঁর এই সফর নিয়ে আলোরন উঠেছিল। সিরিয়া ও এবং তুরস্ক থেকে দানসামগ্রী গ্রহন করতে লোকে ছুটে গিয়েছিল তাঁর কাছে। ফেরার পথে এডেন বন্দরে নৌদূর্ঘটনায় পড়েন। অবশেষে যাত্রার ৭ বছর বাদে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায় ফেরেন। এসব কথাই সহজ সরল ভাষায় লিখেছিলেন। বাবা লিখে ছিলেন বাবরনামা। সুযোগ্য কন্যা সে রীতিই অনুসরন করেছেন। সে কালে লেখায় অলংকারিক ভাষা প্রয়োগ করা হত, গুলবদন বেগম সেসব বর্জন করেন। তিনি কেবল হুমায়ুনের শাসনামলের কালপঞ্জী রচনা করেন নি, হেরেমজীবনের কথাও লিখেছেন। হুমায়ুননামায় গুলবদন বেগম ১৫৫২ সাল অবধি সম্রাট হুমায়ুনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা লিখেছেন। এর চার বছর পর সম্রাট হুমায়ুনের দিল্লির পুরান কিল্লার সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যু হয়। হুমায়ুননামা ষোড়শ শতকের একমাত্র মুগল অভিজাত নারীর রচনা। গুলবদন বেগম নামাজ রোজা বাদেও গরীব দুঃখীর পাশে ছিলেন। নিয়মিত দান করতেন। এই অসাধারণ নারীর মৃত্যু হয় ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্র“য়ারি মাসে । বয়স তখন আশি। জ্বর হয়েছিল। বাদশাহ আকবর-এর মা হামিদা বানু বেগম মৃত্যুকালে গুলবদন বেগম এর পাশে ছিলেন। গুলবদন বেগম তাঁকে অস্ফুটস্বরে বললেন, আমি চলে গেলাম। তোমরা বেঁচে থাক। হামিদা বানু বেগম উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন। স্বয়ং বাদশাহ আকবরও উচ্চস্বরে রোদন করেছিলেন। ফুপুর খাটিয়া বহন করেছিলেন। (আকবর বাদশা নদী পাড় হওয়ার সময় মা (হামিদা বানু বেগমের ) পালকি বহন করতেন। (রবীন্দ্রনাথ এ তথ্যটি উল্লেখ করেছেন) অনেক শেখার আছে আমাদের এই সিংহহৃদয়ের বাদশার কাছ থেকে ...) ফুপুর মৃত্যুর দু বছর পর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যু ঘটে । আসলে গুলবদন বেগম ছিলেন কবি । কবিতা লিখেছিলেন তুর্কি ও ফারসি ভাষায়। তবে সে কবিতা পাওয়া যায়নি। যা হোক। গুলবদন বেগম ছিলেন স্বশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা। পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। উপরোন্ত তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল, গভীর জ্ঞান ছিল সমরবিদ্যা সম্বন্ধে । তবে পিতা বাবর সম্বন্ধে ‘হুমায়ুননামায়’ তেমন কিছু লেখেননি। এর কারণ হয়তো বাবরের মৃত্যুর সময় গুলবদন বেগম এর বয়স ছিল ৮। মুগল হেরেমের নারীদের কাছ থেকে শোনা নানা কথা হুমায়ুননামায় উল্লেখ করেছেন, এতে লেখা প্রাণবন্ত হয়েছে। আর, মুগল হেরেমের খুঁটিনাটি বর্ননা তো ছিলই। ‘হুমায়ুননামা’ ফরাসি ভাষায় রচিত। তবে মূলগ্রন্থে ফারসি ও তুর্কি শব্দাবলির মিশ্রণ ছিল। হুমায়ুননামার এক মাত্র কপিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ . এস বেভারেজ গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তিনি ভালোবেসে গুলবদন বেগম এর নাম দিয়েছেন: Princess Rosebud! আজ আমরা জানি, গুলবদন বেগম এর হৃদয়খানিও ছিল গোলাপের মতোই সুন্দর। তথ্য: বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট। হুমায়ুননামা পড়তে চাইলে ... সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৪:২৩
false
rg
আবারো দর্শকদের মুগ্ধ করলো পালাকারের 'বাংলার মাটি বাংলার জল' ৭ জানুয়ারি ২০১৫, বুধবার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'র জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হল পালাকার প্রযোজিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকের চব্বিশতম শো। নাটকটি রচনা করেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা দিয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এটি একটি পালাকার প্রযোজনা। ইতোমধ্যে পালাকার 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকটির কলকাতায় দুটি শো করেছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে বিশেষ করে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সময়কালে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পূর্ববঙ্গে পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার জন্য শিলাইদহ-শাহজাদপুর ও পতিসরে অবস্থান করেন, তখন তাঁর অল্প বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখতেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে 'ছিন্নপত্র' নামে পরিচিতি পায়। সেখানে মোট চিঠির সংখ্যা ২৪৪। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোকেই অনুসঙ্গ হিসেবে নিয়ে নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন নাটক 'বাংলার মাটি বাংলার জল'। ছিন্নপত্রের বেশির ভাগ চিঠি রবীন্দ্রনাথ তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখলেও, তিনি আসলে চিঠিগুলো লিখেছেন নিজেকেই। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ভারতীয়দের চরিত্রের দুটি দিক আছে—গৃহী এবং সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসীর জন্য তিনি আসলে এসব লিখেছেন। সেই চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথ আসলে কী লিখেছেন? লিখেছেন পূর্ববঙ্গের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পদ্মা নদী ও চরের কথা, শান্ত-শ্যামল পল্লী ও বাংলার সহজ-সরল মানুষের কথা, সবুজে ঘেরা পৃথিবী ও অসীম আকাশের কথা, এক ঋতু থেকে অপর ঋতুতে, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-গোধূলীতে রূপ বদল করা প্রকৃতির কথা। নিজের বোটে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রনাথ পল্লীর সহজ-সরল মানুষ, নিরন্ন কৃষক আর প্রজাদের দেখে দেখে যে ভাবনা তাঁর অন্তরে তখন খেলা করেছিল, তার সবই তিনি ছিন্নপত্রের পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন। এই ঘুরে বেড়ানোর কারণে মূলত জমিদার পরিবারের বাইরে যে জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো তা বাকি জীবন রবীন্দ্রনাথ অন্তরে গভীর ভাবে লালন করেছেন। মূলত কবির মানসপটে এই দেখাই তাঁর অন্তরচক্ষুকে খুলে দিয়েছিল। পদ্মার রূপ বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, '...হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিণে, গোধুলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধুসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।...' বাংলার রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '... ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে... মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম?... ...স্বর্গ আর কী দিত জানি না, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত!... ...আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।... ...আমরা হতভাগারা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে... আমি এই পৃথিবীকে বড় ভালোবাসি।...' একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '......শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর- ধু ধু করছে- কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়- আবার অনেক সময়ে বালি’কে নদী বলে ভ্রম হয়।... গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি।... ...পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে পাণ্ডুরতা। আকাশ শূণ্য এবং ধরণীও শূণ্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূণ্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূণ্যতা। এমনতর desolation কোথায়ও দেখা যায় না।......হঠাৎ পশ্চিমে মুখ ফেরাবামাত্র দেখা যায় স্রোতোহীন ছোট নদীর কোল, ও পারে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটির। সন্ধ্যাসূর্যালোকে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো। ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি এবং আর এক-পারে প্রলয়।... পদ্মায় ভয়াল ঝড়কে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাধ লিখেছেন, '...কাল পনের মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিমে ভয়ানক মেঘ করে এল। খুব গাঢ় আলুথালু রকমের মেঘ, তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে উঠেছে।... ...গাছগুলো হাউহাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের মতো ফণা তুলে তালে তালে নৃত্য আরম্ভ করে দিলে।... ..কালকের সে যে কী কাণ্ড সে আর কী বলব! বজ্রের যে শব্দ সে আর থামে না- আকাশের কোন্‌খানে যেন একটা আস্ত জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বোটের খোলা জানালার উপর মুখ রেখে প্রকৃতির সেই রুদ্রতালে আমিও বসে বসে মনটাকে দোলা দিচ্ছিলাম। সমস্ত মনের ভিতরটা- যেন ছুটি-পাওয়া স্কুলের ছেলের মতো বাইরে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল।... ' পূর্ণিমার অপরূপ শোভা বর্ণনায় রবীন্দ্রনাধ লিখেছেন, '...কোজাগর পূর্ণিমার দিন নদীর ধারে ধারে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম- আর মনের মধ্যে কথোপকথন চলছিল; ঠিক ‘কথোপকথন’ বলা যায় না, বোধ হয় আমি একলাই বকে যাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপ্‌চাপ করে শুনে যাচ্ছিল।... ...কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী বলব! কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না; ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্‌ ঝিক্‌ করছে।... ...মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূণ্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্পেই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে। আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের ‘তেপান্তরের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু ধু করছে। ... আমি সেই মুমূর্ষ পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম।... ' গ্রামীণ-পল্লী'র সৌন্দর্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '...আমার সামনে নানারকম গ্রাম্য দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো আমার দেখতে বেশ লাগে। ঠিক আমার জানলার সুমুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গুটিতিনেক খুব ছোট ছোট ছাউনি মাত্র- তার মধ্যে মানুষের দাঁড়াবার জো নেই। ঘরের বাইরেই তাদের সমস্ত গৃহকর্ম চলে।... ...অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে... যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।... ..এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না। বাইরের জগতের একটা সজীব প্রভাব ঘরে অবাধে প্রবেশ করে। ...আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে গন্ধে সবুজহিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে কত গল্পের ছাঁচ তৈরি হয়ে ওঠে!... ...বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের- বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর- সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। ...কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।...আমার এই সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্ট্‌মাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম।... ...যখন ভেবে দেখি এ জীবনে কেবলমাত্র ৩২ টি শরৎকাল এসেছে এবং গেছে, তখন ভারি আশ্চর্য বোধ হয়! অথচ মনে হয়, আমার স্মৃতিপথ ক্রমশই অস্পষ্টতর হয়ে অনাদিকালের দিকে চলে গেছে।... ...এই বৃহৎ মানসরাজ্যের উপর যখন মেঘমুক্ত সুন্দর প্রভাতের রৌদ্রটি এসে পড়ে তখন আমি যেন আমার এক মায়া-অট্টালিকার বাতায়নে বসে এক সুদূর বিস্তৃত ভাবরাজ্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি এবং আমার কপালে যে বাতাসটি এসে লাগতে থাকে সে যেন অতীতের সমস্ত অস্পষ্ট মৃদু গন্ধপ্রবাহ বহন করে আনতে থাকে।... ' চরাচরের অপরূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '...আমি আলো ও বাতাস এত ভালোবাসি! গেটে (Goethe) মরবার সময় বলেছিলেনঃ More light! ...আমার যদি সে সময় কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার থাকে তো আমি বলিঃ More light and more space! ......অনেকে বাংলাদেশকে সমতলভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না।... ...চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর কোথায় আছে!... ...কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যা হোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হয়, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। ...গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে।... ' শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '...এই সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যের মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর-এক চৌকির উপর পা দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুন্‌গুন্‌ করে গান করছি। ...রামকেলি প্রভৃতি সকালবেলাকার সুরের একটু আভাস লাগবামাত্র এমন একটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারি দিককে বাষ্পাকুল করছে যে এইসমস্ত রাগিণীকে সমস্ত আকাশের সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্ছে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র।... ...এখানে আমি একলা খুব মুগ্ধ এবং ত গত চিত্তে অর্ধনিমীলিতনেত্রে গেয়ে থাকি এবং পৃথিবীটা একটি সূর্যকরোজ্জ্বল অতি সুক্ষ্ম অশ্রুবাষ্পে আবৃত হয়ে, সাতরঙা ইন্দ্রধনু-রেখায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দেয়।... ' ইন্দিরা দেবীকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, '...তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি। ...তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।... ' রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে আসেন তখন তাঁর ছিল বয়স মাত্র সাতাশ বছর। দীর্ঘ আট বছর পূর্ববঙ্গের রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের বাড়িতে তখন ডাক পৌঁছে দিতেন গগণ। গগণ হরকরা। যিনি লালনের একজন ভাবশিষ্য। বাড়ি বাড়ি ডাক পৌঁছে দিতে দিতে তিনি গান করতেন। ভারী মরমীয়া কণ্ঠ ছিল তাঁর। গগণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তখন ভারী এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবসর পেলেই গগণ এসে রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়ে যেতেন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...রবীন্দ্রনাথের গানটি গগণের কাছে শোনা 'আমি কোথায় পাব তারে..গানটির একই সুরে লেখা। নাটকে চরিত্রটি করেছেন দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ। প্রজাদের দুঃখ রবীন্দ্রনাথকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। এ নিয়ে ইংরেজদের শাসনের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। তিনি তখন কৃষকদের জন্য নানান সমাজকল্যান মূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মূলত ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন বাংলাদেশের স্রষ্ঠা। যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সহজ-সরল মানুষগুলোর দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের এক অভিন্ন চিত্র তিনি ছিন্ন ছিন্ন লেখায় ভিন্ন ভিন্ন চিঠিতে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ গান লেখায় মনযোগী হয়েছিলেন। লিখেছেন এমন অসংখ্য গান, '... ...ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা– আন্‌মনা যেন দিক্‌বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা॥ যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্‌ খেয়ালির কোন্‌ আনন্দে সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা॥ যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে, তার হাতে দিই আমার ছন্দ–কোথা যায় কে জানে সে। লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়, চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা॥ ...' নির্দেশক আতাউর রহমান 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের অনেক চিত্রকে নানাভাবে এক্সপারিমেন্ট করেছেন। প্রতিটি শোতেও রয়েছে নানান মাত্রার নতুন নতুন এক্সপারিমেন্ট। নাটকে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শামীম সাগর। নাট্যমহলে যিনি এখন এই চরিত্রে মনলোভী অভিনয়ের জন্য সবার কাছেই পরিচিত। আতাউর রহমান ডাকঘরের রতন আর পোস্টমাস্টারকেও নাটকে হাজির করেছেন। নাটকে পোস্টমাস্টার চরিত্রটি করেছেন আমিনুর রহমান মুকুল। রতনের কাছ থেকে যখন পোস্টমাস্টার বিদায় নেয়, সেই দৃশ্য দর্শকের অন্তরকে সত্যি সত্যিই ভিজিয়ে দেবার মত। রতন চরিত্রটি করেছেন রোদ। নাটকে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে শর্মী মালা এক নতুন সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন। যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাশাপাশি বরুণ চরিত্রে অনিকেত পাল বাবু আমাদের কাছে পুরাণের সৌম্য পৌরুষকে হাজির করেন। মাভৈ মাভৈ... রবীন্দ্রনাথ ওই সময়কালে রচনা করেছিলেন তাঁর 'সমাপ্তি', 'ছুটি', 'পোস্টমাস্টার', 'ক্ষুধিত-পাষাণ', 'চিত্রাঙ্গদা' প্রভৃতি রচনাগুলো। যা ছোটো ছোটো দৃশ্যে নির্দেশক 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে দৃশ্যায়ন করেছেন। নাটকে অন্যান্য বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, শাহরিয়ার খান রিন্টু, দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ, সেলিম হায়দার, ফাহমিদা মল্লিক শিশির, মোহাম্মদ আলী পারভেজ, লিয়াকত লিকু, ইউসুফুল হক শুভ, জাহিদ হাসান, রাশেদ খান মেনন, আরিফুল হক চঞ্চল, প্রণব দাশ বাবু, রনি খান, ইমরান হোসেন, রোদ, অরিত্র প্রমুখ। নাটকে সেট ডিজাইন ও কোরিওগ্রাফি করেছেন অনিকেত পাল বাবু। আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন নাসিরুল হক খোকন। সঙ্গীত নির্দেশনা দিয়েছেন অজয় দাশ। কস্টিউম ডিজাইন করেছেন লুসি তৃপ্তি গোমেজ। এছাড়া 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে নির্দেশকের প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন পালাকারের অধিকারী আমিনুর রহমান মুকুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এটি একটি পালাকার প্রযোজনা। ....................................... ৮ জানুয়ারি ২০১৫ ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৩:১৩
false
fe
প্রথাভাঙার প্রগতি ও লেখালেখির প্রতিপক্ষ প্রথাভাঙার প্রগতি ও লেখালেখির প্রতিপক্ষফকির ইলিয়াস=========================================শনি ও রোববার নিউইয়র্ক মহানগরী বেশ সরগরম থাকছে। নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে- ‘আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা’র ২৪তম আয়োজন। এ উপলক্ষে অনেক সুধীজন নিউইয়র্ক আসছেন। এই মেলা উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট চিন্তক, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এবারের বইমেলায় ২৪ মে রোববার বিকেল পাঁচটায় একটা সেমিনার আছে, যার বিষয় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। এই সেমিনারটি সঞ্চালনার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সেমিনারে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. অনুপম সেন, রামকুমার মুখোপাধ্যায় ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন মুক্তচিন্তক, সমাজ বিশ্লেষক যোগ দেবেন বলে আশা করছি। বলা দরকার, বুদ্ধির মুক্তি বিষয়টি চলমান সময়ে গোটা বিশ্বেই একটি খুব দরকারি বিষয়। একই সঙ্গে বহুল আলোচিত-সমালোচিত অধ্যায়ও বটে। তার কারণ হলো, ফ্রিডম অব ইন্টেল্যাকচুয়ালিটির নামে বিশ্বে এই সময়ে যা ঘটছে, তা কতটা গ্রহণীয় কিংবা কতটা বর্জনীয়, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। বিশেষ করে যে ভাবনা কিংবা উসকানি হানাহানির জন্ম দেয়- তা নিয়ে রশি টানাটানি কতটা যুক্তিযুক্ত, কথা উঠছে সেটা নিয়েও।বুদ্ধির মুক্তি বিষয়ে তথ্য কোষ আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে- তার দিকে একটু তাকানো দরকার। মুক্ত জ্ঞান চর্চা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি প্রগতিবাদী আন্দোলনের লক্ষ্যে ১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেনের (১৮৯৭-১৯৩৮) নেতৃত্বে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার যোগ ছিল নিবিড়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। ঠিক সাড়ে চার বছরের মাথায় ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র সম্মিলিতভাবে মুসলিম হল মিলনায়তনে (আজকের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) সভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠন। বলা দরকার সংগঠনের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ ও ‘সাহিত্য’ শব্দ দুটি যুক্ত থাকলেও এটি কেবল মুসলমানদের জন্য ও রসসাহিত্য চর্চার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই চেতনাগত দিক থেকে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। সুতরাং অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও এটি ছিল উন্মুক্ত দ্বার। আর সাহিত্যচর্চা বলতে এরা মুখ্যত বুঝেছিলেন চিন্তাচর্চা, যদিও তাদের কেউ কেউ রসসাহিত্যের চর্চাও করেছিলেন।এদের মাধ্যমেই মূলত এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। সাহিত্য সমাজের মূল বাণী ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। এই কথাটি সংগঠনটির বার্ষিক মুখপত্র ‘শিখা’র শিরোনামের নিচে লেখা থাকত। তখন শিখা পত্রিকায় যারা লিখতেন তারা ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামে পরিচিত ছিলেন। মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশের পর ‘শিখা’ বন্ধ হয়ে যায়। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সারথি আবুল ফজল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামের প্রবন্ধে ‘শিখা’ সম্পর্কে বলেছেন : ‘শিখার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখাচিত্র ছিল। একটি খোলা কুরআন শরিফ। মানববুদ্ধির আলোর স্পর্শে কুরআনের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এ ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তারা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কুরআনকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানববুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গোড়া থেকেই গোঁড়ারা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল। চিন্তার ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থের বুনিয়াদ সবচেয়ে শক্ত। এরপর এরা রীতিমতো বিরুদ্ধতা করতে লাগলেন আমাদের’।এই বিরুদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিনের মুক্তি আন্দোলনের সংগঠকরা। তাদের প্রেরণার উৎস ছিলেন (১) মোস্তফা কামাল (১৮৮৫-১৯৩৮), ২) রাজা রামমোহন (১৭৭৪-১৮৩৩), ৩) ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), ৪) রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), ৫) প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), ৬) নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬), ৭) হযরত মুহম্মদ (সা.) (৫৭০-৬৩২), ৮) শেখ সাদী (১১৭৫-১২৯২), ৯) গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২), ১০) রোমা রোলাঁ (১৮৬৮-১৯৪৪)। কাজী আবদুল ওদুদের একটি লেখায় ওই সব মনীষী মহাপুরুষ কেন তাদের প্রেরণাস্থল, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে।বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মূল প্রবর্তক, অধ্যাপক আবুল হুসেনের জীবনকাল অর্ধশতাব্দীরও কম, মাত্র ৪২ বছর। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর তার অকাল মৃত্যু ঘটে। বাংলার মুসলমান সমাজে যে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা বিরাজমান ছিল, সেসব দূরীকরণই ছিল এ আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ধর্মবিশ্বাস, পর্দাপ্রথা, সুদ গ্রহণ নৃত্যগীত ইত্যাদি সম্পর্কে আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতেন। সাহিত্য সমাজের বিভিন্ন সভায় পঠিত এবং শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে তাদের চিন্তা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটত। কলকাতার দ্য বেঙ্গলি পত্রিকা সাহিত্য সমাজের এই আদর্শকে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শিবনারায়ণ রায় এটাকে ‘বৌদ্ধিক আন্দোলন’ (ইন্টেল্যাকচুয়াল মুভমেন্ট) নামে অভিহিত করেন।বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী কাজী আবদুল ওদুদ ( ১৮৯৪-১৯৭০) এক প্রবন্ধে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। এসব থেকেই এক সময় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ অভিধাটি প্রচলিত হয়। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র মূল প্রবক্তা আবুল হুসেন একাধিক প্রবন্ধে ইসলাম ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করেই বলেন যে, কালের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে সত্যকে জানতে হবে। বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে জানা এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে জানার মধ্যে পার্থক্য আছে। গোঁড়ামি পরিহার করে যুগের আলোকে প্রয়োজনে শরিয়তের পরিবর্তনের পক্ষেও তিনি মত প্রকাশ করেন।কাজী মোতাহার হোসেন একটি প্রবন্ধে মুসলিম পরিবারের সঙ্গীতাদি ললিতকলা চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেন, সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ছাড়া সমাজ মানসের উৎসর্গ সাধিত হয় না। শিখা গোষ্ঠীর এসব বক্তব্য তৎকালীন ঢাকার রক্ষণশীল সমাজ মেনে নেয়নি। যার ফলে আবুল হুসেনকে জবাবদিহি করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে চাকরি ও ঢাকা ছাড়তে হয়। ১৯৩১ সালে তার ঢাকা ত্যাগের ফলে আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং ১৯৩৮ সালের পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।এখানে আরো বলা প্রয়োজন, ঢাকার রক্ষণশীল স¤প্রদায় আবুল হুসেনের কিছু বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। লেখালেখির বাইরে এর প্রতিফলন ঘটে অন্তত দুটি ঘটনায়। ১৯২৮ সালের আগস্টে তাকে ও কাজী আবদুল ওদুদকে আপস রফার জন্য বলিয়াদির জমিদার কাজেম উদ্দিন সিদ্দিকীর ঢাকার বাড়িতে ডাকা হয়েছিল। সেখানে দুজনকেই লিখিতভাবে ‘কৈফিয়ত’ দিতে হয়েছিল। পরের বছর ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর কেবল আবুল হুসেনকে ডাকা হয়েছিল নবাববাড়ি আহসান মঞ্জিলে। চাপের মুখে এখানে তিনি ‘ক্ষমাপত্র’ লিখে দিতে এবং সে পত্র সাধারণ্যে প্রচার করতে ‘স্বেচ্ছায় অনুমতি’ দিতে বাধ্য হন। ইতিহাসে দেখা যায় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা রক্ষণশীলদের দ্বারা চিরকালই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলার মুসলমান সমাজেও আলাদা কিছু ঘটেনি। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কর্মযোগী বলে অভিহিত আবুল হুসেন এ ইতিহাস জানতেন না তা নয়, কিন্তু এও তিনি জানতেন যে অন্ধ গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত করা ছাড়া তন্দ্রাচ্ছন্ন কোনো সমাজকে জাগানো যায় না।এই যে জাগানোর প্রক্রিয়া তা এখনো চলছে। বাংলাদেশে আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ এর ঝাণ্ডা ধরে এগিয়েছেন। আহমদ শরীফ লিখেছেন, “আমার লেখার একমাত্র লক্ষ্য লৌকিক, অলৌলিক, শাস্ত্রিক, সামাজিক, নৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুরনো বিশ্বাস-সংস্কারের ও নীতিনিয়মের দেয়াল ভাঙা।” সেক্যুলারিজমের সংক্ষিপ্ততম সংজ্ঞায়ন করেছেন তিনি এভাবে- “ধর্মের তথা শাস্ত্রের সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক অস্বীকৃতিই সেক্যুলারিজম। সমাজ ও রাষ্ট্র ধর্ম সম্পর্কে থাকবে সর্ব প্রকারে উদাসীন, শাস্ত্রাচার সম্বন্ধে সমাজ থাকবে নীরব নিষ্ক্রিয়, রাষ্ট্র থাকবে অজ্ঞ-উদাসীন।”ধর্মপ্রাণ ও আস্তিকদের সম্পর্কে আহমদ শরীফ লিখেছেন, “শাস্ত্রমানা মানুষমাত্রই স্বধর্মকে সত্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ বলে জানে ও মানে। সে জন্য প্রত্যেক আস্তিক মানুষ ভিন্নধর্ম ভুল বা মিথ্যা বলে জানে, অবজ্ঞেয় ও পরিহাস্য বলে ও ভাবে। বাঙলায় তথা ভারতেও হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মধ্যেই নয় শুধু, স্বধর্মীয় বৃহৎ কাঠামোর মধ্যেও বিভিন্ন উপমত, স¤প্রদায় এবং আচারও তেমনি অবজ্ঞা-উপহাস পায় ভিন্ন মতের ও আচারের দলের কাছে।”প্রথাভাঙার জন্য প্রগতিকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে যুগে যুগে। কিন্তু চলমান সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণির লেখক প্রথাভাঙার নামে সংঘাতের দিকে এগোচ্ছেন।একটা বিষয় বলা দরকার- ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। সেই সনদ মতে এর সদস্য সব দেশ সম্মত হয় এই মর্মে যে, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, স¤প্রদায়, জাতি, তথা মানবতার বিপক্ষে কেউ দাঁড়াবে না। তাহলে কথা হচ্ছে, প্রথাভাঙার নামে কোটি কোটি মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ে কুঠারাঘাত করার অধিকার কে দিচ্ছে কাকে?দেখা যাচ্ছে, অনলাইন-অফলাইনের এই চলমান সময়ে, যার যা ইচ্ছে লিখছে যত্রতত্র। এই লেখা থেকে কেউ কেউ ব্যক্তিগত ফায়দাও নিতে চাইছে। আমি মুক্তচিন্তার প্রগতিবাদী তুখোড় লেখক এমন অভিধা কামাবার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। এরপরে তারা সেটাকে পুঁজি করে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় বাগাবার ধান্ধাও করছে। সামাজিক সংঘাতটা আসছে এমন মাঠ থেকেই।এদের অনেকেই কিন্তু আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ পড়েওনি। বিশ্বসাহিত্যের প্রথাভাঙার প্রগতিবাদীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। সুইডেন কিংবা জার্মান-ফ্রান্স, ইউরোপ-আমেরিকাকে টার্গেট করে যারা অনলাইনের প্রগতিবাদী সেজেছেন- তারা আসলে কি করছেন, তা ভাবার বিষয়। মানুষ শান্তি চায়। সব ধর্মই শান্তির কথা বলেছে। এখন সেই মীমাংসিত ধর্ম বিষয়গুলোকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে কি প্রথাভাঙা সম্ভব? এই প্রশ্নটি আসছে খুব সঙ্গত কারণে। বিশ্বের সর্বত্র এখন চলছে গলাধাক্কা কাল। যারা শাসক, এরাও কারণে-অকারণে ধর্মকে কটাক্ষ করে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন। ফ্রান্সের মেয়র রবার্ট চার্ডন স¤প্রতি বলেছেন- ২০২৭ সালের দিকে ফ্রান্সে ইসলাম নিষিদ্ধ হবে। টুইটারে এমন দাবি করায় বরখাস্ত করা হয়েছে তাকে। রবার্ট চার্ডন ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ভেনেলেসের মেয়র। ১৪ মে তিনি নিজের টুইটার একাউন্টে লিখেছেন, ইসলাম ধর্ম ২০২৭ সালের ১৮ অক্টোবরের মধ্যে ফ্রান্সে নিষিদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেন, যারা এ ধর্ম পালন করেন, তাদের উচিত এখনই সীমান্তের দিকে চলে যাওয়া। তিনি আরো লিখেছেন, ফ্রান্সের উচিত ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে রচিত আইনসমূহ বাতিল করে দেয়া। এ আপত্তিকর টুইটগুলো নিয়ে মুহূর্তেই তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়। এসব কোনো সভ্যতার অংশ হলো? না- এরা গায়ে পড়েই সংঘাত বাধাতে চাইছেন।বাংলাদেশে ব্লুগারদের হত্যা করা হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মকে আঘাত করা কাজ দুটি এখন আলোচিত বিষয়। এই ফাঁকে ছদ্মনামে একটি গোষ্ঠী কোনো দায় না নিয়েই যাচ্ছেতাই লিখছে। এই ছদ্মনামগুলো তো চরম মৌলবাদীদেরও হতে পারে। যারা রাষ্ট্র, সমাজ, শাসনব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে তুলতে চাইছে। সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? মনে রাখা দরকার এরা পার পেলে তারা ক্রমশ প্রগতিবাদী রাজনীতিকদের ওপর হামলে পড়বে। আজ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে নানা অপপ্রচার শুরু হয়েছে। এটা কারা করছে? কি তাদের গোপন মতলব- তা সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে। মনে রাখা দরকার, এই অধ্যাপক আওয়ামী লীগের গঠনমূলক সমালোচনাই করেন। আর এমন সমালোচকদের সহ্য করার ক্ষমতা শেখ হাসিনার সরকারকে অর্জন করতেই হবে। না হলে মৌলবাদীরা এই দেশকে আবার ২০০১-২০০৫ এ-ই ফিরিয়ে নিতে কসুর করবে না।বাংলা ভাষায় দেশে বসে কিংবা বিদেশে থেকে যারা প্রথাভাঙার নামে অত্যন্ত অশালীন, অমার্জিত, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে লিখছেন- তাদের ব্যাপারে প্রজন্মকে সজাগ হতে হবে। অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করা অত্যন্ত অমানবিক, গর্হিত কাজ। এর মাধ্যমে সমাজে রক্তপাত, হানাহানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে। একজন পরিশুদ্ধ মানুষ কোনো নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেন না। লেখালেখির নামে একজন লেখক ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ হবেন কেন?আমরা বিনির্মাণ চাই। আমরা সুবিচার-সুনীতি চাই। আমরা ধর্মীয়-সামাজিক-পরিবেশিক স¤প্রীতি চাই। মানবতা প্রতিষ্ঠায় এর কোনো বিকল্প এখনো বিশ্বে গড়ে উঠেছে বলে আমার মনে হয় না। মত-চিন্তার স্বাধীনতা প্রকাশের নামে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়া তো প্রকৃত কোনো লেখকের কাজ হতে পারে না।----------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৩ মে ২০১৫
false
ij
লালনের দোহাই মনুষ্যজীবন জীবন দীর্ঘ; দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। তথাপি জীবনবাদী বাংলার পথে পথে এভাবেই নেচে নেচে জীবনের বন্দনা করেন বহূদর্শী প্রাজ্ঞ বাউলেরা ...দুঃখময় জীবনকে সুন্দর বলাই তো ধর্ম। ১. জীবনবাদী একটি গান লালনের বহুলশ্রুত জীবনবাদী গানটি এইরকম- এমন মানব-জনম আর কি হবে মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে। অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই। দেবদেবতাগন করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে। কত ভাগ্যের ফলে না জানি, মন রে পেয়েছ এই মানব তরণী; বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় যেন ভরা না ডোবে। এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার অধীন লালন তাই ভাবে ২.আবহমান বাংলা এই অসাধারণ গানটি লালন ঠিক কবে লিখেছিলেন? আজ আর তা জানার উপায় নাই। তবুও দিনক্ষণটি ১৮৫০ সালের এদিক-ওদিক ধার্য করি। যদিও প্রমাণ হাতে নাই। তবু আশা করি আমার এই প্রচেস্টায় বাংলার সাধু সমাজে অযাথা গুঞ্জন উঠবে না। যা হোক। ‘এমন মানবজনম’ গানটির কথা ও সুর আমার এতই সমকালীন মনে হয় যে কী বলব। আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়: বাংলা বাদে অন্য দেশের ১৮৫০ সালের গান কেমন? ইংরেজি গানের কথাই ধরি। এভাবেই কি প্রমাণিত হয় না যে বাংলা আবহমান? অথচ, একদল লোক আজ আবহমান বাংলার ধারনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ, একদল লোক আজ বাউলে আবহমান ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ধিক। ৩. নবনীতার গল্প ‘এমন মানবজনম’ গানটি আজ বহুদূর ব্যাপৃত হয়ে রয়েছে। গত দেড়শ বছর ধরে কত গুণী শিল্পী যে গাইলেন জীবনবাদী এ গানটি। বাংলার তরুনদের মধ্যে গাইলেন হালের নবনীতা চৌধুরী । নবনীতা, আপনারা কমবেশি জানেন, বর্তমানে বি বি সি-র বাংলা বিভাগে কর্মরত। সেই সূত্রে বাস করছেন লন্ডন শহরে। এই গানটি সেখানেও পৌঁছে গেছে নবনীতার প্রিয় একটি পছন্দের গান বলে। একটা সময় ছিল; যখন - লালনের গানের সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না নবনীতার। পড়াশোনা শেষ করে একুশে টিভিতে জয়েন করল নবনীতা: ‘দেশজুড়ে’ অনুষ্ঠানটির নাম তো শুনেছেন আপনারা? তো, সেই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেল। কাজের সূত্রেই যেতে হয়েছিল গ্রামবাংলার অতি নিভৃত প্রান্তরে। সে সময়ই এক বাউলের মুখে বাউল গান শুনে কী যেন ভালো লাগল। ভীষন বিষন্ন হয়ে পড়লেন নবনীতা। মনের ভিতর ভীষন তোলপাড়। “এই রকম গান তো আগে শুনিনি। এতকাল আমি তাহলে কি শুনেছি? এই গান না শুনেই মরে যেতাম। ইশ!” তারপর বাউল গান নিয়ে নবনীতার খোঁজ খবর শুরু হল। অনেক বাউল গান সংগ্রহ করে শুনলেন। লালনের নাম আগেই শুনেছিলেন, শুনছিলেন লালনের নির্বাচিত কয়েকটি গানও। বাউল জগতের আরও গভীরে ঢুকে পেয়ে গেলেন ‘এমন মানবজনম আর কি হবে’ নামে জীবনের বন্দনাকারী এই গানটি। শুনে বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে গেলেন নবনীতা। ১৮৫০ সালের গান। ইংরেজি গান তো তখন ... সেই সময়কার ইংরেজি গান শুনে ইংরেজরা আজ বুঝবে না। আর আমরা ... বাংলা ও লালনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল নবনীতার। ঠিক করলেন গান গাইবেন। লালনের গান। ২০০৭-এ বার করলেন একটি লালনগীতির অ্যালবাম। নবনীতা আজও গুনগুন করে গান লালনের গান। লন্ডনে। কাজেই, তখন বলছিলাম, লালনের এই গানটি আজ বহুদূর ব্যাপৃত হয়ে রয়েছেন। ৫. শিল্পের মানে এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন, তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন। বাংলায় ঠিক ইউরোপের মতন দর্শন বা ফিলসফি গড়ে ওঠেনি কখনও। বাংলার দর্শনকে বলা হয় ভাব। আমার মনে হয় যে এই দুটি চরণই বাংলার ভাবের ভিতটি রচনাকারী করে দিয়েছে। সবিনয়ে আরও জানাতে চাই-বাঙালির অলিখিত সংবিধানটিও কিন্তু লালনের একটি হিতকারী গানের প্রারম্ভ দুটি চরণ। ভবে মানুষগুরু নিষ্টা যার সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার- এ সবই আবেগের কথা। তবে বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য। ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে ছেলেবেলায় দেখেছি পাড়ার এক দুধর্ষ মাস্তানকে কালো পিচ রাস্তার ওপর সাদা রঙের আলপনা আঁকতে। আপনারাও জানেন যে- এমতরো বিচিত্র দৃশ্য অনত্র বিরল। তাই বলছিলাম-বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য। ‌'মাধুর্যভজন' অর্থ শিল্পের সাধনা। নিৎসে একবার বলেছিলেন-Atr is the proper task of life. লালন নিৎসে এঁরা হচ্ছেন সমগোত্রী। আর আমরা তাদের নাবালক শিষ্যমাত্র। আমরা কেবল এই মহাজনদের মন জানার চেষ্টা করতে পারি। ৬. নিরঞ্জন কে? নিৎসে ঈশ্বর মানতেন না। লালনও সে সংশয় প্রকাশ করে একটা গানে বলেছেন- সবাই কি হবে ভবে ধর্মপরায়ন? এই গানটার শেষ কটা চরণ এরকম- ধর্মকর্ম আপনার মন করে ধর্ম সব মোমিনগন; লালন বলে কর ধর্ম প্রাপ্তি হবে নিরঞ্জন। নিরঞ্জন যে কে-সেই ভাবনায় জীবনভর আচ্ছন্ন ছিলেন লালন। ৭. নিরঞ্জন-এর রঞ্জিত প্রকাশ? তবে নিরঞ্জন যিনিই হোক না কেন- তিনি যে মাধুর্যের উৎস সে নিয়ে সন্দেহ নেই মনে। এ জগতে কত যে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য। যেমন-ম্লান আলোর নির্মল ভোর, ঝিরঝির বাতাস, শিউলি ফুলের গন্ধ, শিশিরসিক্ত ঘাস, একটা নিরব নদী, তার মৌন বিস্তার ... মানবজন্ম পেয়েই তবে পঞ্চ ইনিদ্রয়ে ঝরে ঝরে পড়ে ঝরে ঝরে পড়ে এমন আমোদ। তখন ...তখন মনে হয়- কত ভাগ্যের ফলে না জানি, মন রে পেয়েছ এই মানব তরণী; তবে মানবজন্ম সহজ নয়। কেননা- দেবদেবতাগন করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে। ৮. হেগেলের দোহাই তবে মানুষ-রুপ নিরাকার নিরঞ্জনই গঠন করলেন কিনা -তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান এক অনিবার্য বিবর্তনের কথা বলে; রেডি মেড কিছু গড়ার কথা বলে না। বিশ্বজগৎ নিরঞ্জন-এর রঞ্জিত প্রকাশ বললে হাস্য করে।তা হলে? তা হলে ম্লান আলোর নির্মল ভোর, ঝিরঝির বাতাস, শিউলি ফুলের গন্ধ, শিশিরসিক্ত ঘাস, একটা নিরব নদী, তার মৌন বিস্তারের কি মানে? অতএব, দার্শনিক হেগেলের শরণাপন্ন হই না কেন। হেগেল একবার বলেছিলেন, যা কিছু আছে সবই পরমের দিকে বিবর্তিত হইতেছে। কে পরম? লালনের সাঁই? অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই। ৯. লালনের দোহাই সবই যখন পরমের দিকে বিবর্তিত হইতেছে এবং সে বিবর্তন যেহেতু আজও শেষ হয়নি;কাজেই সে বিবর্তন-উত্তর সত্যাসত্যে না পৌঁছেই এ দুটি চরণ আজ নির্দ্বিধায় গাওয়া যায়- এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন, তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন। কেননা- এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার অধীন লালন তাই ভাবে ... এই হচ্ছে লালনের দোহাই। উৎসর্গ: নৃপ অনুপ। সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১২ দুপুর ১২:৫৬
false
hm
উদোর পিণ্ডি লোডশেডিং নিয়ে আমি একটা বিস্তৃত সিরিজ লেখার পরিকল্পনা করেছি। কিছু তথ্য চেয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছি না বলে শুরুও করা যাচ্ছে না, তাই দুয়েকটা উপসর্গ নিয়ে আলাপ করার জন্যে এ পোস্ট লিখছি। মনে করুন, আপনার একটা চৌদ্দশো সিসির গাড়ি আছে। এটার এনজিনের ক্ষমতা একশো হর্স পাওয়ারের একটু বেশি। আপনার গাড়ির এনজিন [পেট্রল বা সিএনজি] একটা জীবাশ্ম-জ্বালানি খায়, খেয়ে খানিকটা কাজ করে, আর খানিকটা ঢেঁকুর তোলে। গাড়ির কাজ তো সেই একটাই, চলা, কতখানি সে চলতে পারে, সেটারই একটা পরিমাপ হচ্ছে ঐ একশো হর্স পাওয়ার। হর্সপাওয়ার বা কিলোওয়াট, এগুলো সবই হচ্ছে কোনো একটা যন্ত্রের কাজ করার বা তাপ উৎপাদন করার হার। একশো হর্স পাওয়ার মোটামুটি পঁচাত্তর কিলোওয়াটের সমান। আপনার গাড়ির এনজিনটা খুলে এর শ্যাফটটা আমি যদি একটা জেনারেটরের শ্যাফটের সাথে একটা কাপলার দিয়ে জোড়া লাগাই, তাহলে সেই জেনারেটরটা মোটামুটি সত্তর থেকে বাহাত্তর কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক পাওয়ার উৎপাদন করতে পারবে। যদি জানতে চান, কয়েক কিলোওয়াট পাওয়ারের হিসেব মিলছে না কেন, তাহলে তার উত্তর হচ্ছে, কোনো যন্ত্রই শতকরা একশো ভাগ "দক্ষ" নয়। প্রতিটি রূপান্তরের সময় সে কিছুটা অপচয় করে। বৈদ্যুতিক জেনারেটরগুলো বেশ এফিশিয়েন্ট হয়, কিন্তু তারপরও সম্পূর্ণ তো নয়। একই কথা খাটে এনজিনের বেলায়ও। গাড়ির এনজিন বৈদ্যুতিক জেনারেটরের তুলনায় নিতান্তই অদক্ষ একটা যন্ত্র। আপনার গাড়ির এনজিনটা মেরেকেটে ২৫% দক্ষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে, আপনি ওকে যে জ্বালানি খাওয়াচ্ছেন, তার চারভাগের তিনভাগই সে হেগেপেদে নষ্ট করে. আর একভাগ দিয়ে সে কাজের কাজ [অর্থাৎ চলা, গাড়ির এসি চালানো, এফএমরেডিওর ব্যাটারি চার্জ করা ইত্যাদি] করে। ঐ যে চার ভাগের তিনভাগ, সেটা দিয়ে সে প্রথমে গা গরম করে, তারপর রেডিয়টর দিয়ে ছড়িয়ে দেয় আশপাশের বাতাসে। এর অর্থ হচ্ছে, ঐ পঁচাত্তর কিলোওয়াট কাজের কাজ করতে গিয়ে সে চারপাশ গরম করতে থাকে দুইশো পঁচিশ কিলোওয়াট হারে। দুইশো পঁচিশ কিলোওয়াট বেশ বড়সড় একটা অঙ্ক, যেমন ধরুন আপনি এই হারে কোনোকিছু গরম করতে পারলে এক লিটার পানি থেকে এক লিটার বাষ্প পাবেন ১১ সেকেণ্ডের মাথায়। গাড়ির রেডিয়েটরে পানি গরম হয়ে বাষ্প বেরুতে দেখেছেন তো অনেকেই, তাই না? এবার চলুন বিআরটিএর ওয়েবসাইটে ঢুকি। বাংলাদেশের সরকারি ওয়েবসাইট, কাজেই অতীব জঘন্য জিনিস, দরকারি প্রায় কোনো কিছুই পাবেন না, পাবেন কেবল দুটো রিপোর্ট, তার মধ্যে একটা হচ্ছে ঢাকা শহরে রেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যা নিয়ে পিডিয়েফ রিপোর্ট। চলুন ওটাই দেখি। যদিও ঢাকায় অন্য জেলায় নিবন্ধন করা গাড়িও চলে আরো আটাশ হাজারের মতো, কিন্তু এই লিস্ট ধরেই এগোই চলুন। অনেক কিসিমের গাড়ি পাবেন, সেগুলোর একেকটার সিসি [ডিসপ্লেসমেন্ট ভলিউম বলি আমরা এটাকে, একটা এনজিনের সিলিন্ডারগুলোর ভেতরে পিস্টনগুলো মোট কতখানি ভলিউম জুড়ে নড়াচড়া করে, তার মাপ, এটি এনজিনের ব্রেক পাওয়ারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত] একেকরকম, অর্থাৎ তার এনজিনের ক্ষমতাও একেকরকম, কাজেই তাদের গা গরম করার ক্ষমতাও একেকরকম। মোটামুটি আন্দাজ করতে পারবেন তার পরও। হিসাব করে আসুন দেখি, ঢাকায় রেজিস্টার্ড এই গাড়িগুলো সব ক'টা মিলে কী হারে তাপ উৎপাদন করতে পারে। সব গাড়ি মিলে কী হারে তাপ উৎপাদন করে জানেন? এক লক্ষ মেগাওয়াট [Others নামে একটা ক্যাটেগোরি ছিলো, সেটাকে গোণায় ধরিনি]। তবে সব গাড়ি তো আর একসাথে চলে না। যে কোনো মুহূর্তে মনে করুন মোট গাড়ির ১০ শতাংশের এনজিন চালু। তাহলেও প্রতি মুহূর্তে, সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ঢাকা শহরে দশ হাজার মেগাওয়াট হারে তাপ ছড়াচ্ছে গাড়িগুলো। যদি বুঝতে চান, এটা কেমন, কল্পনা করুন, দশ হাজার লিটার পানি থেকে দশ হাজার লিটার বাষ্প পাচ্ছেন আপনি আড়াই সেকেন্ডের মাথায়। মে মাসের কোনো এক তপ্ত দুপুরে কারওয়ান বাজারে জ্যামের মধ্যে এসে দাঁড়ান, টের পাবেন, ঐ গরমটা কেবল রোদ থেকে আসছে না, আরও আসছে হাজার হাজার চলমান এনজিন থেকেও। ঢাকা অনেক বড় শহর, এই তাপ ছড়িয়ে পড়ছে তাই বাতাসে আর কংক্রিটে। দু'টোই তাপ ধরে রাখে, বাতাস অনেক কম, কংক্রিট অনেক বেশি। সেই ধরে রাখা তাপ আশপাশে ছড়িয়ে দেবার সুযোগও পায় না কংক্রিট, অন্তত রাত দশটা পর্যন্ত। রাত দশটার পর যখন গাড়িঘোড়ার ভিড় কমে যায়, এই জমিয়ে রাখা তাপ কংক্রিটের শহর ঢাকা আবার বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। যাদের গাড়ি আছে, তারা অনেকেই বাসায় এসি চালান। গাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা ঘরে যখন পা দেন, তখন বিদ্যুৎ থাকলে, তারা আবার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে পড়েন। এসি চালানো মানে ঘরের গরমটুকুকে বাইরে বার করে দেয়া। ফলাফল, তার ঘর ঠাণ্ডা, বাতাস আরেকটু গরম, যে বাতাসটাকে তিনি নিজেই প্রয়োজনের চেয়ে একটু গরম করে এসেছেন গাড়ি চালানোর ফলে। এখন মনে করুন, আপনার গাড়িও নাই, এসিও নাই। ভানুর কৌতুকের সেই মিঠুকে মিষ্টি করে বলার মতো, নারে মিঠু, আমাগো থার্মোমিটারও নাই,বার্নলও নাই। আপনিও আমার মতো পাবলিক বাসে চড়েন, ফ্যান আর হাতপাখা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন গ্রীষ্মকে। আপনার কাছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কৌতুককর মনে হবে না। আপনার বাতাসকে অন্য লোকে গাড়ি চালিয়ে গরম করে দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত [বাসে চড়েন বলে আপনিও বাতাস গরম করেন, কিন্তু সেটার মাথাপিছু দায় বেশ খানিকটা কম], সেটা ঠাণ্ডা করতে যে বিদ্যুৎটুকু আপনার দরকার, সেটাও বড় গ্রাসে খেয়ে নিচ্ছে এসির মালিক। আপনি দাবি করতে পারেন, এ থেকে উত্তরণের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন, তার একটা বড় অংশ গাড়ি আর এসির মালিকদের বহন করতে হবে। পারেন না? উত্তরণ নিয়ে পরে আবার কিছু বকবক করবো, কিন্তু তার আগে আমার কিছু তথ্য প্রয়োজন ছিলো, বৈদ্যুতিক বিল সংক্রান্ত। আপনাদের সেই উদোর পিণ্ডিগুলোর অপেক্ষায় বুধোর ঘাড় পেতে রইলাম।
false
rg
কোটা নিয়ে কিছু খোটা ।। রেজা ঘটক বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা হবার কারণে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রধান। আবার দল ক্ষমতায় থাকলে তিনি প্রধানমন্ত্রী। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সুযোগ্যা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাই তিনি দলের প্রধান, আবার দল ক্ষমতায় গেলে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী। এই কোটা পদ্ধতিতে আগামীতে জয় বা তারেক জিয়াও একই রাস্তায় হাঁটবেন। কোটা পদ্ধতির আড়ালে যাকে বলা যায় অঘোষিত রাজতন্ত্র। অথচ পাশের দেশ ভারতে রাজীব গান্ধীর সুযোগ্যা স্ত্রী হয়ে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হলেও তিনি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মানমোহন সিংহকে। এটা করে সোনিয়া গান্ধী গোটা ভারতের কাছে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এখন রাহুল গান্ধীকে রাজনীতিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। রাজনীতিতে ঝানু হলে আগামীতে ভারতের জনগণ চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু বাংলাদেশে? শেখ হাসিনার সামনে এবার সেই সুযোগ ছিল। দল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জনের পর একটি সর্বদলীয় শক্তিশালী সরকার গঠন করে অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করে দিলে বাংলাদেশের মানুষ একজন নতুন শেখ হাসিনাকে পেতো। আমরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। উল্টো এমন সব আবলু-হাবলু-গাবলু-রে নিয়ে কেবিনেট গঠন করলেন যে, সাড়ে চার বছরের মধ্যে সেই নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা আগামী নির্বাচনে একটি নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে!! কারণ, আবলু-হাবলু-গাবলুদের দিয়ে যা অর্জন করা যায় তা দেশের মানুষ দেখেছে। এ টিমকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে বি-টিম, সি-টিম, ডি-টিম দিয়ে দেশ চালালে যা হবার কথা তাই হয়েছে। এখন সরকারের বাকি আর তিন মাস। এই তিন মাসে সাড়ে চার বছরের ভুল সংশোধন করে দলকে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র এখন এ-টিমের সাইড প্লেয়াররা। তারাও কতোটা পারবে এই সরকারের সাড়ে চার বছরের দুর্বল নের্তৃত্বের সীমাহীন দৌরাত্মকে সামাল দিতে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। খালেদা জিয়ার দুই পুত্রের কার্যাকলাপ সম্পর্কে দেশের মানুষ সবই জানে। নতুন করে বলার কিছু নেই । কিন্তু ভোটের হিসাব আলাদা। যুদ্ধাপারাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণ-জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ছিল একটি স্বতস্ফূর্ত বিস্ফোরণ। সেই আন্দোলনকে দলীয় লেবাস দিতে গিয়ে বা সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্বল অদূরদর্শী নের্তৃত্বের কারণে শাপলা চত্বরে একটি এন্টি মুভমেন্ট রাতারাতি গজিয়ে উঠলো। হেফাজতে ইসলামের পেছনে জামায়াতে ইসলাম এবং বিএনপি কলকাঠি নাড়লেও এখন রাজনৈতিক ময়দানে সবচেয়ে বড় ভয়ংকর শক্তি হেফাজতে ইসলাম। গুজব রটিয়ে হোক, মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে হোক আর বেহেসতের টিকিটের হাতছানিতে হোক, পাঁচ সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনে ৫-০ গোলে তারা আওয়ামী লীগকে পরাজিত করেছে। কোটা পদ্ধতির কারণেই এখন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর মুখে সবাই বলেন স্থানীয় প্রশাসন সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করে। কিভাবে এটা সম্ভব? যে কিনা দলীয় প্রার্থী, তারা নির্বাচনে বিজয়ী হলে তো প্রথমেই দলীয় পাণ্ডাদের টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি জায়েজ হয়ে যাবে। স্থানীয় প্রশাসন আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি হলে কিভাবে স্থানীয় প্রশাসন শক্তিশালী হবে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থানীয় প্রশাসন শক্তিশালী মানে হল দলীয় নেতাকর্মীকে দিয়ে নির্বাচন করানো। তখন আর কাজের কাজটা কিছুই হয় না। কারণ এরা সারা বছর চুরি চামারি করবে। চাঁদা তুলবে। টেন্ডারবাজি করবে। দখল করবে। খুন গুম করবে। কারণ, কেন্দ্রে দলের ক্ষমতা। আবার বিরোধী দলের কেউ স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হলে তার জন্য কেন্দ্র থেকে কোনো বরাদ্দ নেই। তখন তার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার নিয়ম। বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে দেশে যেভাবে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেই পরিবেশ যদি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হত তাহলে দেশ আনেক আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হত। কলেজে ভর্তিতে কোটা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা। সরকারি চাকরিতে কোটা। কোটায় কোটায় গোটা বাংলাদেশ ফুটা হয়ে গেছে। সরকারি চাকরিতে ১০% জেলা কোটা, ১০% মহিলা কোটা, ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ৫% উপজাতি কোটা আর অবশিষ্ট ৪৫% মেধা কোটা। অর্থ্যাৎ মেধাবীদের যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও সুযোগ আছে মাত্র শতকরা ৪৫ ভাগ। বাকি শতকরা ৫৫ ভাগ দুর্বল অযোগ্য মেধাহীন কোটায় উদর পিণ্ডি হয়। এভাবে একটা দেশ সময়ের তুলনায় পিছিয়ে যায়। মেধাবীদের যারা যোগ্য সম্মান দিতে পারে না সেদেশে মেধা শূণ্য করার জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার দরকার নেই। এমনিতেই জাতি মেধা শূণ্য হয়ে যাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীরা যে পরিমাণ মেধাবীদের হত্যা করেছে, তারচেয়ে বেশি মেধাবীদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বিগত ৪২ বছরের তামাশার রাজনীতির মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে ব্রেন ড্রেইন হয়ে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশের মেধাবী সন্তানরা পড়ান। কারণ, তাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই নিজেরাই বিশ্ববাজারে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে নিজেদের ড্রেইন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সুযোগ্য অদক্ষ অপরিপক্ক অদূরদর্শী মেধাহীন দুর্বল নের্তৃত্বের তামাশার তাবেদারীতে বন্দি। কারণ ওই রাজনৈতিক কোটা। এমপি মারা গেলে তার ছেলে বা মেয়ে এমপি নমিনেশান পায় দল থেকে। ওই এলাকায় সারা বছর যারা দলের কাজ করেন তারা সব ভেউ। তারা দলীয় নের্তৃত্বের কাছে কেবল সংগঠনের প্রয়োজনে নেতা। সর্বশেষ কিশোরগঞ্জে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সংসদীয় আসন শূণ্য হলে সেখানে রাষ্ট্রপতি'র সুযোগ্য পুত্রকে সাংসদ বানিয়ে আনার মাধ্যমে রাজনৈতিক কোটাকে আরো শক্তিশালী করার সর্বশেষ উদাহরণ। বৈষম্য লালন পালন করে আপনারা গাইবেন শোষণমুক্ত সমাজের গান!! আহারে আমার শ্যাম, সেই গানে সুর করবে কেঠায়? ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে শতকরা ৫০ ভাগের উপরে কোটা বন্ধের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধুমাত্র কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন আদালতে অনেক মামলা ঝুলে আছে। অনেক মামলা রায়ের অপেক্ষায় আছে। ভারতের সরকারি চাকরির নিয়ম কানুন আর বাংলাদেশের সরকারি চাকরির নিয়ম কানুন প্রায় হুবহ এক। বৃটিশদের কলোনি ছিলাম বলে তাদের অনেক আইন কানুন আমরা আমাদের দেশের সঙ্গে মানান সই হোক আর হোক হুবহু তাই দিয়ে দেশ চালাচ্ছি। কারণ, মেধাবীরা তো সংসদে যাচ্ছে না। ওই আইন কে বানাবে? যারা সংসদে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছে, তাদের মেধাশূণ্য বানানো আইনে অনেক ফাঁক ফোকর রয়ে যাচ্ছে। আদালতের কাঠগড়ায় সেই আইনের ফাঁক গলিয়ে দুর্ধর্ষ আসামীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। আর সেই কোটা পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে কোটা এখন ৫৫% করেছে। আগামীতে মুক্তিযুদ্ধের নাতি-নাতনি কোটা আসবে। আরে ভাই, মুক্তিযোদ্ধারা কেউ আপনার কাছে কোটার দাবি নিয়ে যায় নি। আপনি মনগড়া একটা চালিয়ে দিছেন। সেটা হাজার বছর ধরে চলতে পারে না। দেশের সকল অঞ্চলের উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা সরকারের দায়িত্ব। কোটা পদ্ধতিতে এলাকার কোনো উন্নয়ন হয় না। এমন কি প্রায় বছরই জেলা কোটা পূরণ না হবার হাজার হাজার উদাহরণ আছে। তবু কোটার পক্ষে রাজনৈতিক নের্তৃত্বের দুর্বলতা। কারণ, নিজেরাও তো কোটার জোরে গাদ্দারি করছেন। বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলে কোটা নেই? কোন দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা আছে? এক কথায় নেই। তারা কিভাবে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ঠিক করবে? এক কথায় কোন দিন করবে না। আরেক কথায় কোন দিন এদের দিয়ে তা করা সম্ভব না। নতুন প্রজন্মকে এখন দায়িত্ব নিয়ে এসব বৈষম্য দূর করতে বলিষ্ঠ নের্তৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে হাজার বছরে বাংলাদেশ কোটা পদ্ধতির খপ্পরে পড়ে মেধাহীন হয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত সেই তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিনত হবে। সো, সময় থাকতে সাধু সাবধান। সকল ধরনের কোটা পদ্ধতির যতো দিন না অবসান না হবে, ততো দিন সমাজ থেকে রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য দূর হবে না। কোটা পদ্ধতি একটি সাময়িক সমাধান। আর আমাদের মেধাহীন নের্তৃত্ব সেই কোটা পদ্ধতিকে বছরের পর বছর বাড়িয়ে অর্ধেকেরও উপর নিয়ে গেছে। শতকরা ৫ ভাগ কোটা চালু রাখা যেতে পারে টোটাল সরকারি চাকরি বিধিতে। কোনো মতেই শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সেই হিসেবে বাংলাদেশ খারাপ কাজে আরেকটি বিশ্ব রেকর্ড অর্জন করেছে। যারা মুক্তিযোদ্ধ করলো তাদের সবাইকেই তো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো টানাহেচড়া করে বিতর্কিত করে ফেলেছে। আসল সার্টিফিকেট জাল সার্টিফিকেট নকল সার্টিফিকেট দিয়ে গোটা মুক্তিযোদ্ধাদের কলংকিত করা হয়েছে। এখন অনেক রাজাকারের মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আছে। আবার অনেক আসল এবং খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট তুলতে যায় নি। অথবা তার নামে আসলেই কোনো সার্টিফিকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কে সার্টিফিকেট দেওয়ার মালিক? তাকে সেই ক্ষমতা কে দিল? গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের পছন্দের সবাই একবাক্যে সার্টিফিকেট পেয়ে যান। যারা তাদের অপছন্দের তারা যুদ্ধ করলেও পাবেন না। এমপি সাহেবের যারা কাছের মানুষ তারা তো বাড়ি বসেই সার্টিফিকেট পেয়ে যান। আর যারা খাঁটি দিলে যুদ্ধ করেছিল তারা অনেকই সার্টিফিকেট চাইতে যায় নি। তাদের কি হবে? বছর বছর সুযোগ সুবিধা তো ঘরে তুলছে তথাকথিত ওই সার্টিফিকেট ধারীরা। মেধাশূণ্য রাজনৈতিক নের্তৃত্ব দিয়ে এরকম হাজার হাজার সার্টিফিকেট বিলি করা সম্ভব কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এমন কি সঠিক ইতিহাস পর্যন্ত তাদের দিয়ে লেখানো সম্ভব না। আজকে কোটা পদ্ধতির ধুয়া তুলে মেধাশূন্য রাজনৈতিক নের্তৃত্ব আমাদের মহান জাতীয় সংসদে নারী কোটায় যাদের সাংসদ বানিয়েছেন, তাদের মুখের বুলি শুনে তো দেশবাসীর বাংলা ভাষা ভুলে যাবার উপক্রম। শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া কাদের নমিনেশান দিয়ে নারী কোটায় এমপি বানালেন? তাদের কথাবার্তার শ্রী দেখে তো তাদের আমাদের আইনপ্রণেতা হিসেবে মেনে নিতে বিবেকে লাগে। আমরা তো তাদের ভোট দিয়ে এমপি বানাই নি। কোটি টাকা খরচ করে সংসদে তারা আমাদের কি কথা শোনান? মেধাশূণ্য রাজনৈতিক নের্তৃত্ব দিয়ে এইসব খুব সহজে করা সম্ভব। এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের রাজনীতিতে আসতে হবে। দুর্বল রাজনৈতিক নের্তৃত্ব থেকে বেড়িয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শি নের্তৃত্বকে সেই ভার নতুন প্রজন্মকেই নিতে হবে। মাত্র ৪২ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান এরা ধ্বংস করে ফেলেছে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন প্রজন্মকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম ৫০ বছর এরা ধ্বংস করবে। নতুন প্রজন্মকে পরের ৫০ বছরে তা তীলে তীলে গড়ে তুলতে হবে। ২০২১ সালে আমরা যে ধ্বংসস্তূপ নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী পালন করব, স্বাধীনতার জন্ম শতবার্ষিকীতে নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই একটি শক্তিশালী নতুন বাংলাদেশ উপহার দেবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। যেখানে হরতাল থাকবে না। সহিংসতা থাকবে না। দুর্নীতি থাকবে না। দলীয় স্বজনপ্রীতি থাকবে না। চাঁদাবাজী থাকবে না। টেন্ডারবাজী থাকবে না। কথায় কথায় খুন গুম থাকবে না। প্রাইমারি স্কুলে শিশুদের পড়াবে মেধাবী শিক্ষকরা। শিশুদের জন্য স্কুলের বাইরে কোনো পড়াশুনা থাকবে না। শিশুদের মনের সৃজনশীলতা বাড়াতে বাড়িতে গাদা গাদা বই এবং হোম ওয়ার্ক একটি বিশাল চাপ। শিশুর মনের বিকাশ ঠিক মতো হয় না এই পড়ার চাপে। বেশি নম্বর তুলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া যাবে না। শিক্ষক হওয়ার মতো গুনাগুন যার মধ্যে আছে সেই শিক্ষক হবেন। বাজারে ব্যবসায়ীরা খাদ্যে আর ফরমালিন দেবেন না। মরা মুরগির মাংস বিক্রি করবেন না। বর্ষাকালে রাস্তা খোড়াখুড়ি হবে না। সেবা প্রদান কারী সংস্থার মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয় থাকবে। দলীয় কন্ট্রাকটর দিয়ে কাজ হবে না। প্রফেশনাল টিম সেই কাজগুলো করবে। গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি রেডি্ও থাকবে। সত্যিকারের একটি সোনার বাংলা গড়ে তুলবে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। আমরা ৫০ বছরে যা পারব না, নতুন প্রজন্ম পরবর্তী ৫০ বছরে তা করে বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে। এটাই আমি নিশ্চিত করেই স্বপ্ন দেখি। তখন দেশে কোনো কোটা পদ্ধতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। কেবল দুর্বল ভঙ্গুর অদূরদর্শী মেধাহীন রাজনৈতিক নের্তৃত্বেরই এসব সাময়িক কুইক রেন্টাল বা কোটা প্রয়োজন হয়। নতুন প্রজন্মের তা প্রয়োজন হবে না। ২০২১ সালের মধ্যে বর্তমানে যারা রাজনীতি করছেন, তাদের অবসরে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যার কোনো বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মের হাতে আগামী ৫০ বছরের দায়িত্ব দিন। তাদের এই আট বছর আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতাটুকু দিয়ে তাদের প্রশিক্ষিত করুন। দেখবেন আপনারা জীবিত থাকা অবস্থায়ই নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যায়। চোখের সামনে দেখতে পাবেন। আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতে চাই, ২০২১ সালের পর দশ বছরে আপনারা ঠাওর করতে পারবেন নতুন প্রজন্ম কি করবে। ২০৩১ সালে নতুন প্রজন্মের কাছে আপনারা একটা হিসাব নিয়েন। ২০১৩ থেকে ২০২১ এই ৭ বছর আপনারা নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিন। রাজনৈতিক ভাবে দক্ষ করে তুলুন। তারপর ২০২১ সালে আপনারা দয়া করে সবাই অবসরে যান। আপনাদের আছে করজোড়ে এই মিনতী। নতুন প্রজন্মকে এখন থেকেই সকল বিষয় চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে কর্ম পদ্ধতি ঠিক করে আগাতে হবে। কোটা পদ্ধতি বাতিলের নামে আমরা আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করতে পারি না। তাদের যথাযথ সম্মান দেখানোই আমাদের কাজ। সেই সম্মান কোটা দিয়ে আসবে না। খোটা দিয়েও আসবে না। নিরব অবদান রেখেই সেই সম্মান দেখাতে হবে। রাজনীতি থেকে যারা অবসরে যাবেন, তাদেরও আমরা সঠিক ভাবে সম্মান করব। আর যারা অবসর নেবেন না তারা নিজেদের অদূরদর্শীতায় এমনিতেই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। কালের ইতিহাসের কলমটি বড় নির্মম। সেই কলমে আপনাদের সকল অপকর্ম খোদাই করা রয়ে যাবে। সো, কোটা নিয়ে আমরা যেনো আর বাড়াবাড়ি না করি, সেই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। আগামী ৭ বছরের মধ্যে এই কোটা শতকরা ৫ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে বর্তমান রাজনৈতিক নের্তৃত্বকেই। নইলে আগামী ৫০ বছরের জন্য যে নতুন প্রজন্মের কাঁধে আপনারা একটি তলাবিহীন বাংলাদেশ চাপিয়ে দিতে চাইছেন, সেটি আমরা মানবো না। সো, মেইক কমিউন অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর পিপল অ্যান্ড কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ। সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৫৩
false
ij
ভাবছি, কর্পোরেটের আগ্রাসনে কেউ কবিতা না-লিখলে এ জগৎ থেকে ঈশ্বর তার তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেবেন কিনা! যা দেখছি তাই কি কবিতা না? এই মেয়েটির অপূর্ব পূজো পূজো ভঙ্গিমাটি কবিতা না? এর আত্যন্তিক বাঙালিয়ানা। একে কর্পোরেট কতটা বদলে দিতে পারে? কতটা ইউরোপীয় করে তুলতে পারে কর্পোরেট একে? শাড়িটা ছিঁড়ে স্কাট পরাতে পারে? জানি, একপক্ষ বলবেন: মানুষের স্বাধীনতায় আস্থা রাখুন। এই মেয়েটির যা খুশি তাই পরার স্বাধীনতা আছে। অন্যপক্ষ বলবেন, সে তো মানলাম। কিন্তু, সেজন্য বাঙালিয়ানা ছাড়তে হবে! কি সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে দেখতে। ঠিক যেন জীবনানন্দের রুপসী বাংলার মতন। ঠিক যেন এক খন্ড বাংলাদেশ। এ মেয়ে জিন্সের প্যাট পরবে কি! ভাবছিলাম, কর্পোরেটের আগ্রাসনে কেউ কবিতা না-লিখলে এ জগৎ থেকে ঈশ্বর তার তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেবেন কিনা! কথাটা আজ মনে হল মুযীয মাহফুজের একটি মন্তব্য থেকে। তিনি কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন, কর্পোরেটের শীতল আগ্রাসন নিয়েও । কী কবিতার ভবিষ্যৎ -কী কবির ভবিষ্যৎ- এসব প্রশ্ন তাঁকে ভীষণ তাড়িত করছে। তাঁর উদ্বেগ আমাকেও ছুঁলো। তাই তো কী কবিতার ভবিষ্যৎ -কী কবির ভবিষ্যৎ। কর্পোরেটের আগ্রাসনে কেউ কবিতা না-লিখলে এ জগৎ থেকে ঈশ্বর তার তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেয় তো? আবার আমার এও মনে হল। কর্পোরেট মানে কাঁচামাল। কাঁচামাল মানে কৃষকের উৎপাদন, তার বাঁচা মরা। আবার এক পক্ষ বলবেন, শতকরা কত ভাগ কাঁচামাল কেনা হয় এদেশের কৃষকদের কাছ থেকে? সবই তো বাইরে থেকে আসে। যে পেস্ট দিয়ে রোজ দাঁত মাজছেন দেখেন যে ওটার টিউবে ম্যানিলা লেখা। তাই তো। কাঁচামাল! কৃষক! সাম্রাজ্যবাদ! কর্পোরেট! ...মাথা কেমন টলে ওঠে। বাদ দেন।এইসব কর্পোরেট-সাম্রাজ্যবাদ ভুলে আসুন কবিতা পাঠ করি। “বনলতা সেন।” বাংলায় না-ইংরেজিতে। কর্পোরেটের শাসন তো। Long I have been a wanderer of this world, Many a night, My route lay across the sea of Ceylon somewhat winding to The seas of Malaya. I was in the dim world of Bimbisar and Asok, and further off In the mistiness of Vidarbha. At moments when life was too much a sea of sounds, I had Banalata Sen of Natore (now Bangladesh) and her wisdom. I remember her hair dark as night at Vidisha, Her face an image of Sravasti as the pilot, Undone in the blue milieu of the sea, Never twice saw the earth of grass before him, I have seen her, Banalata Sen of Natore. When day is done, no fall somewhere but of dews Dips into the dusk; the smell of the sun is gone off the Kestrel's wings. Light is your wit now, Fanning fireflies that pitch the wide things around. For Banalata Sen of Natore. For thousands of years I roamed the paths of this earth, From waters round Ceylon in dead of night to Malayan seas. Much have I wandered. I was there in the gray world of Asoka And Bimbisara, pressed on through darkness to the city of Vidarbha. I am a weary heart surrounded by life's frothy ocean. To me she gave a moment's peace-Banalata Sen from Natore. Her hair was like an ancient darkling night in Vidisa, Her face, the craftsmanship of Sravasti. As the helmsman, His rudder broken, far out upon the sea adrift, Sees the grass-green land of a cinnamon isle, just so Through darkness I saw her. Said she, "Where have you been so long?" And raised her bird's-nest-like eyes-Banalata Sen from Natore. At day's end, like hush of dew Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings. When earth's colors fade and some pale design is sketched, Then glimmering fireflies paint in the story. All birds come home, all rivers, all of this life's tasks finished. only darkness remains, as I sit there face to face with Banalata Sen. কবিতার অনুবাদ কবির নিজের। সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:০১
false
rg
রামকিংকর বাইজ- এ পারসোনালিটি স্ট্যাডি বাই ঋত্বিক কুমার ঘটক !!! মৃত্যুর মাত্র সাত মাস আগে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ঋত্বিক কুমার ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) শান্তি নিকেতনে চারদিনের এক শুটিং যজ্ঞ করলেন। ইচ্ছে ছিল বিখ্যাত ভাস্কর ও পেইন্টার রামকিংকর বাইজ (১৯০৬-১৯৮০) -এর উপর একটি ডকুমেন্টারি বানাবেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই ডকুমেন্টারি অসমাপ্ত রেখেই ঋত্বিক মারা যায়। ঋত্বিকের সেই অসমাপ্ত ডকুমেন্টারির ফুটেজগুলো পরবর্তী সময়ে জোড়া দিয়ে 'রামকিংকর বাইজ- এ পারসোনালিটি স্ট্যাডি' নামে ৩০ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়। ঋত্বিক যেভাবে চিত্রনাট্য করেছিলেন এই ডকুমেন্টারিটি সেভাবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রথমে একটা বড় হোয়াইট স্ক্রিন। তার উপর হঠাৎ চারপারশ থেকে নানান রঙের এক বর্ণালী এসে তাক লাগিয়ে দেয়। কারো হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ঋত্বিক কেন সাদা স্ক্রিনে এভারে মগ ভর্তি বিভিন্ন রঙ ছুড়ে ছুড়ে পর্দা রঙিন করলেন? দর্শক যদি একটু ধৈর্য ধরেন তাহলে পরের মিনিটেই আপনি জবাবটা পেয়ে যাবেন। যেখানে বিভিন্ন এঙ্গেলে রামকিংকনের করা ভাস্কর্যংগুলোকে দেখা যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন তানপুরার সঙ্গে মাদল বাজতে থাকে। ঋত্বিক কি বৃষ্টি নামাতে চাইছিলেন? নইলে এক একটি ভাস্কর্যের মুখমণ্ডলের ক্লোজ ছাপিয়ে ক্যামেরা যখন অন্য একটি ভাস্কর্যকে তাড়া করছিল, তখন হঠাৎ সেতার কেন মিউজিক লিড করতে থাকবে? রামকিংকনের ভাস্কর্য রমনীর মুখ, পরিবার, শিশুর মুখ, প্রিয় কুকুর, গান্ধীজি, একটার পর একটা ভাস্কর্য যেতে থাকে। আবার সেই রঙ লাগানো স্ক্রিন। ঋত্বিক সেখানে লিখে রেখেছেন, দ্য রিভার, দ্য আনডুলেটিং ল্যান্ডস্কেপস, দ্য ভিলেজ ইটিস। তারপর আমরা দেখতে পাই পাখির কলকাকলির সাথে বাঁশি বাজছে আর নদীর এপার থেকে ওপারের দূরের গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সেখানের মাটির ঘরের পেছনে গরুর গাড়ি, দুষ্টু পঞ্চ বালকের ভো দৌড়, যাদের পেছন পেছন সেই প্রিয় কালো কুকুর ভোলাও যাচ্ছে। ওরা কি দেখার মত তাজ্জব কিছুর সন্ধান পেতেই এভাবে ছুটছে? নইলে ভোলাকেও অত উৎসাহী লাগল কেন? নাকি ঋত্বিক এখানে রামকিংকনের ছেলেবেলাকে নির্দেশ করেছেন? দুষ্টু বালকদের ছত্রভঙ্গ হবার সাথে সাথে ভোলা একটু কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ভোলা আবার পেছন ফিরে ক্যামেরায় লুক দেয়। তারপর ভোলা আবার সামনে দৌড়াতে থাকে। এরপর আমরা দেখি সুবিশাল কাশবন। এখানে ঋত্বিক লিখেছেন যে, ছেলেমেয়রা কলা ভবন থেকে বের হয়ে আসছিল। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল আর্ট। এরা ক্যমেরা থেকে ফ্রেমআউট হলে আমরা কলা ভবনের দিকে অগ্রসর হই। আর তারপর ক্যামেরা প‌্যান করে ম্যুরাল ধরতে শুরু করি। এই ম্যুরালটি অনেক শিল্পীর একসঙ্গে করা একটি কাজ। রামকিংকর মূলত যাদের নির্দেশনায় ছিলেন। শিল্পী নন্দলাল বসু'র কিছু কাজ এরমধ্যে ছিল। তারপর আমরা ক্যামেরায় ম্যুরালগুলোর ডিটেইল ধরা শুরু করলাম। এর কোনোটা আর্যযুগের, কোনোটা দ্রাবিঢ়যুগের। কোনোটা আবার ঐশ্বরিয়ান, মিশরীয়, পারশ্য বা মহেঞ্জদাড়োযুগের কাজ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে তা স্পষ্ট করে বোঝানো হবে। গান্ধীজির ভাস্কর্যটির নানা অ্যাঙ্গেলে শুট করলাম। এরপর গান্ধীজির ভাস্কর্যের সামনেই ঋত্বিক রামকিংকরের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। ঋত্বিক: কিংকরদা গান্ধীজির পায়ে এই যে নরকংকালের মুন্ডুগুলো, এর মানেটা কি? রামকিংকর: ওটার মানে সহজেই যুগযুগান্তর ধরে ওই লোকগুলা পায়ের তলায় পড়ে আছে। আজকে সেই বুড়োর পায়ের তলায় সেই স্কালপচার দেখানো হয়েছে। ঋত্বিক: কারেক্ট। এরপর সেই মুণ্ডুগুলোর ক্লোজ শট থেকে আমরা আসি একযুগল কৃষক দম্পতির কাছে। ঋত্বিক: আচ্ছা কিংকরদা এই ছবিটা, এই মুর্তিটা কিসের? রামকিংকর: ওরা কুলি। ওরা রাইসমিলে কাজ করে। ওরা খাবারের হুইসেল শুনে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু ওদের কাপড় শুকানোর মত অত সময় কোথায়? তাই অনেকে কাপড়টা শুকায় না, কাপড় শুকাতে শুকাতে এভাবে দৌড়ে তারা খাবার খেতে যায়। এই হচ্ছে ব্যাপারটা...হা হা হা..... রামকিংকরের বামহাতে একটা মাতাইল আর ডানে হাতে গামছা। ঋত্বিকের দিকে ঘুরে কথা শেষ করে তিনি প্রাণখুলে হাসতে থাকেন। ঋত্বিক: এটা হচ্ছে এর আর্ট? রামকিংকর: হ্যা হ্যা এটাই...হা হা হা.... ঋত্বিক: এই হল ঘটনা? রামকিংকর: এই ঘটনা হা হা হা... ঋত্বিকের সেই ডকুমেন্টারি দেখা যাবে এই লিংক-এ https://www.youtube.com/watch?v=mtErm-QeEMM ......................................... ঢাকা ৮ এপ্রিল ২০১৫ সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ ভোর ৬:৪০
false
rn
তোমরা যারা লেখক হতে চাও এযুগের প্রধান সমস্যাই হলো- কেউ ভালো মানূষ হতে চায় না। আমি কারো মুখে আজ পর্যন্ত শুনিনি- কেউ বলেছে- 'আমি ভালো মানূষ হতে চাই।' সবাই বলে, আমি ডাক্তার হবো, আমি লেখক হবো, আমি একজন ভালো ফোটোগ্রাফার হবো, আমি হেন হবো, আমি তেন হবো। এখন কথা হলো- তুমি ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও বা লেখক হও- কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি যদি একজন ভালো মানূষ না হও- তাহলে তো ভাই সমস্যা। তোমার ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নাই। তুমি একজন মুদি দোকানদার হও- কিন্তু একজন ভালো মানূষ হও। সহজ সরল সত্য কথা হলো- আমাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা একজন লেখকের চেয়ে একজন ভালো মানূষ খুব বেশি দরকার। ভালো মানূষেরাই পারে সচ্ছভাবে দেশকে ভালোবাসতে, দেশের মানূষকে ভালোবাসতে। সর্বোপরি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যাই হোক, আমার আজকের আলোচনার বিষয় হলো- 'লেখক'। আমি মনে করি- একজন লেখক হবে সহজ সরল ভালো মানুষ। তার মধ্যে কোনো লোভ থাকবে না, কোনো হিংসা থাকবে না, কোনো কুটিলতা থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হলো- আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি- মানুষ লেখক হওয়ার জন্য হা করে বসে আছে। প্রতু বইমেলাতে দু'টা চারটা বই বের করতে পারলেই যেন জাতে ওঠা যায়। বইমেলা এলে কিছু লোক পাগল হয়ে যায়। তারা লিখতে শুরু করে নানান বিষয় নিয়ে। খুব'ই সস্তা লেখা। তাদের দিয়ে কোনো দিনই মহান সাহিত্য লেখা সম্ভব নয়। তাদের মন-মানসিকতা ভয়াবহ নোংরা, তারা ভয়াবহ কুটিল এবং জটিল। তারা দালাল এবং তারা ভন্ড। এখন, এই সমস্ত লোক যদি লেখক হয় বা নিজেকে লেখক দাবী করে তাহলে তো সমস্যা। -এই সমস্ত তথাকথিত লেখকদের দিয়ে জাতি কি পাবে? খোঁজ করলে জানা যাবে তাদের ১০টা ১২টা করে বই বের হয়ে গেছে। তারা জোর করেই পরিচিত জনদের দিয়ে বই কেনায়। তারা কথায় কথায় নিজেকে লেখক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তাদের অত্যাচারে ফেসবুকে ঢুকা যায় না। ইনবক্সে হাতজোর করে তাদের বই কেনার জন্য। একজন দালাল, একজন ভন্ড অথবা একজন লোভী মানুষ কি করে লেখক হয়? একজন লেখক অনেক বড় ব্যাপার। তাদের অনেক দায়-দায়িত্ব। উইকিপিডিয়াতে লেখা আছে- 'যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ সৃষ্টিশীল কোন লেখনী কিংবা লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন, তিনিই লেখকরূপে গণ্য হয়ে থাকেন।' একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর তো কাউকে ফুলটাইম লেখাজীবি হিসেবে দেখি না। সবার বুঝা উচিত- আপনি ভালো হলে আপনার এ ভালো হওয়ার সুফল শুধু আপনি একাই উপভোগ করবেন না, করবে আপনাকে ঘিরে চারপাশে যারা আছে তারা সবাই। কাজেই আগে ভালো মানুষ হন। তাহলে আপনাকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যাবে। শুধু আশে পাশের মানুষের কাছ থেকে সস্তা বাহবা পাওয়ার জন্য বই বের করে লেখক নাম নিয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু আপনাদের টাকা নষ্ট।কথায় বলে - গাইতে গাইতে গায়ক, লিখতে লিখতে লেখক। কিন্তু ব্যাপারটা কী এতো সহজ? লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইলে মনে লালিত স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে হবে। এ জন্য পাড়ি দিতে হবে সাফল্যের দুর্গম সিড়ি। যার জন্য জানা থাকা চাই প্রয়োজনীয় সব বিষয়। ঠিক আছে আপনারা লেখালেখি করেন। কিন্তু সবাই নামী দামী হইতে চায় কিন্তু আসল যে কাজ ভালো মানুষ সেটা হতে চায় না কেউই! সবার মনের আশা ধরে নিলাম পুরন হলো সবাই বিশাল নামী দামী লোক হলো কিন্তু ভালো মানুষ না হলে তার কি মুল্য??? যারা ভালো, আদর্শবান, শ্রেষ্ঠ মানুষ তাদের জীবনের সৌন্দর্যের আলোতেই আলোকিত হয় পরিবার, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব। তারা সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রের মণিমুক্তাতুল্য অমূল্য রত্ন, যারা হবে সকলের জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, মডেল বা আদর্শ। নব্য লেখকদের কাছে আমার অনুরোধ আপনারা প্রচুর পড়াশোনা করেন। প্রচুর। বই পড়ে-পড়ে আগে ভালো মানুষ হোন। অনেক অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেন। তারপর লিখতে শুরু করেন। যদি আপনার লেখার মান ভালো হয়- তাহলে আপনাকে বই বের করে ধারে ধারে ঘুরতে হবে না, প্রকাশককে তেল দিতে হবে না। বড় ভাইদের ধরতে হবে না। সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:২৫
false
rg
বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৫ মিশন টিম টাইগার্স ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। মোট ১৪টি দল ১৪ টি ভ্যানুতে খেলবে। ১৪টি দলকে মোট দুইটি পুলে ভাগ করা হয়েছে। খেলা শুরু হবে ১৪ ফেব্রয়ারি ২০১৫। আর ফাইনাল খেলা হবে ২৯ মার্চ ২০১৫। খেলা শুরু হবে ওভাল-এ আর ফাইনাল খেলায় টুর্নামেন্ট শেষ হবে মেলবোর্নে। পুল-এ তে আছে ৭টি দল। দলগুলো হল- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ড। আর পুল-বি তে আছে ৭টি দল। দলগুলো হল- সাউথ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রতি পুল থেকে সেরা চারটি দল দ্বিতীয় রাউন্ডে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে। পুল-এ থেকে সেরা চারটি দল। আর পুল-বি থেকে সেরা চারটি দল। এ১ বনাম বি৪, এ২ বনাম বি৩, এ৩ বনাম বি২, এ৪ বনাম বি১। পরবর্তী রাউন্ডে প্রতি গ্রুপ থেকে সেরা দুইটি দল পরবর্তী রাউন্ডে সেমি-ফাইনাল খেলবে। কিউএফ১ বনাম কিউএফ৩ এবং কিউএফ২ বনাম কিউএফ৪। সেমি-ফাইনালের সেরা দল দুইটি ফাইনাল খেলবে। বাংলাদেশের পুল-এ তে গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো হল- ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, মানুকা ওভাল, ক্যানবেরা: বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্তান, বাংলাদেশ সময় রাত ০৯.৩০টা, ০৩.৩০ জিএমটি। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ব্রিসবেন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, উলুংগাবা, ব্রিসবেন: বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ সময় রাত ০৯.৩০টা, ০৩.৩০ জিএমটি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড: বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকা, বাংলাদেশ সময় রাত ০৯.৩০টা, ০৩.৩০ জিএমটি। ৫ মার্চ ২০১৫, সেক্সটন ওভাল: বাংলাদেশ বনাম স্কটল্যান্ড, বাংলাদেশ সময় ভোর ০৪.০০টা, ২২.০০ জিএমটি। ৯ মার্চ ২০১৫, অ্যাডিলেট ওভাল: বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ সময় রাত ০৯.৩০টা, ০৩.৩০ জিএমটি। ১৩ মার্চ ২০১৫, সেডন পার্ক, হেমিলটন: বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ সময় রাত ০৭.০০টা, ০১.০০ জিএমটি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হবার পর ১৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে শেষ হবে প্রথম রাউন্ডের খেলা। ১৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে শুরু কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ড। ২১ মার্চ ২০১৫ কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ড শেষ হচ্ছে। ২৪ মার্চ প্রথম সেমি-ফাইনাল আর ২৬ মার্চ দ্বিতীয় সেমি-ফাইনাল। ২৯ মার্চ ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ডে মোট ছয়টি ম্যাচ খেলবে। এই ছয়টি ম্যাচ খেলার পর যদি সাত দলের মধ্যে অন্তত সেরা চার-এ পৌঁছানোর যোগ্যতা অর্জন করে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে অর্থ্যাৎ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। যেখান থেকে সরাসরি নকআউট পর্যায়ের খেলা শুরু। বাংলাদেশের প্রথম মিশন হওয়া উচিত প্রতিটি ম্যাচকে আলাদাভাবে বিবেচনায় নেওয়া এবং প্রতিটি ম্যাচেই জেতার টার্গেট। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। কারণ এবার এই দুই দেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজক দেশ। তারা ঘরের মাঠে খেলবে। সেখানে আমরা সর্বোচ্চ ঢেলে খেলতে হবে। আমাদের দ্বিতীয় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি শ্রীলংকা ও ইংল্যান্ড। আমাদের দ্বিতীয় মিশন হবে অন্তত এই দুইটি দলের একটির বিরুদ্ধে আমরা মরণপন খেলব। এই দুইটি খেলার একটি আমাদের যে কোনো কৌশলে সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখিয়ে জিততে হবে। আমাদের তৃতীয় ও সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বি স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তান। এমনিতে এই দুইটি দলের চেয়ে কাগজে কলমে আমরা শক্তিশালী। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যে কোনো দলই যে কোনো দিন তাদের সেরা নৈপুন্য প্রদর্শন করে ম্যাচে জিততে সক্ষম। তাই এই দুইটি ম্যাচকে কোনোভাবেই হালকা ভাবে দেখার সুযোগ নেই। কোনো দলকেই দুর্বল দল মনে করার কোনো কারণ নাই। তাই সর্বোচ্চ নৈপুন্য প্রদর্শন করেই ম্যাচ জিততে হবে। আমরা যদি অন্তত তিনটি ম্যাচ জিততে পারি, তাহলে কোয়ার্টার ফাইনালে যাবার জন্য আমাদের দরজা মোটামুটি খোলা থাকবে। চারটি ম্যাচ জিতলে তো আমরা অবশ্যই কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বোরগোড়ায় পৌঁছে যাবো। তবে আমরা যদি পাঁচটি ম্যাচ জিততে পারি, তাহলে আমরা নিশ্চিত কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছাবো। যদিও আমার চাওয়া টাইগার্স ছয়টি ম্যাচেই জিতুক। তেমন যদি হয়, অন্তত এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট মিশনকে আমরা মাথায় নিয়ে নাচবো। কারণ, এরপর আমাদের সামনে থাকবে মাত্র তিনটি ম্যাচ। আমাদের যে জিনিসটি মাথায় রাখতে হবে, আমরা আসলে মোট নয়টি ম্যাচ খেলার টার্গেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড এসেছি। মাত্র নয়টি ম্যাচ। এই নয়টি ম্যাচকে নয় দিন, সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে আমাদের ম্যাচ স্টাটেজি সেট করতে হবে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ছয়টি ম্যাচ। এই ছয়টি ম্যাচ আমরা ছয়দিনে আমাদের সর্বোচ্চ নৈপুন্য প্রদর্শন করে লড়াই করে জিততে চাই। এটাই হওয়া উচিত সবচেয়ে লক্ষ্য। আমরা যদি অনাকাঙ্খিতভাবে কোনো দলের কাছে হেরে যাই, আমাদের মনোবল যেনো ভেঙে না যায়। মনে করতে হবে আমরা সম্পূর্ণ নতুন আরেকটি ম্যাচ খেলতে নামছি। আর নতুন ম্যাচটি জেতার মত সামর্থ আমাদের আছে। শুধু আমাদের সেরা নৈপুন্য, সেরা দলীয় পারফর্মানেন্সটা দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা চারটি ম্যাচ জিততে পারলে অন্যরা আমাদের কঠিন ভাবে হিসাবে নেবে। আমাদের হিসাবে নেওয়া মানে আমরাও বিশ্বকাপ ক্রিকেট কাপের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ থেকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দিকে অধীর আগ্রহ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। আমাদের মাসরাফি-বাহিনীকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ অন্তর দিয়ে ভালোবাসে। আমরা বিশ্বাস করি, টিম টাইগার্স, আমাদের গর্ব। টিম টাইগার্স আমাদের বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার এই সময়ের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। আমরা বুক ভরে শ্বাস নেব। টিম টাইগার্সের এক একটি জয়কে আমরা নানান রূপ ও বৈচিত্রে উদযাপন করব। আমরা আনন্দে ভেসে যেতে চাই। টিম টাইগার্স আমাদের বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে আবার এক সারিতে এক মাঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ করার সুযোগ করে দেবে। যেখানে সকল রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, কোনো শ্রেণী-বর্ণ থাকবে না। আমরা যেখানে সবাই টাইগার্স। আমরা যেখানে সবাই বাংলাদেশ। আমরা সবাই যেখানে বাংলাদেশী। টিম টাইগার্সের জন্য, মাসরাফি-বাহিনীর জন্য অন্তর থেকে ভালোবাসা। টিম টাইগার্স ১. মাসরাফি বিন মোর্তাজা (অধিনায়ক) ২. সাকিব-আল হাসান (সহ-অধিনায়ক) ৩. মুশফিকুর রহিম (উইকেটরক্ষক, ব্যাটসম্যান) ৪. তামিম ইকবাল (ব্যাটসম্যান) ৫. আনামুল হক (ব্যাটসম্যান, অতিরিক্ত উইকেটরক্ষক) ৬. মোমিনুল হক (ব্যাটসম্যান) ৭. মোহাম্মদউল্লাহ (অলরাউন্ডার) ৮. নাসির হোসেন (অলরাউন্ডার) ৯. সাব্বির রহমান ১০. রুবেল হোসেন (বোলার) ১১. আল-আমিন হোসেন (বোলার) ১২. তাইজুল ইসলাম ১৩. আরাফাত সানি ১৪. সৌম্য সরকার ১৫. তাসকিন আহমেদ টিম টাইগার্স জয়তু। জয়তু টিম টাইগার্স। .................................... ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৫১
false
hm
তোমার ঘরে বাস করে কারা ... এক চৌধুরীর বাড়িতে যাবার জন্যে দুলাল কয়েকদিন ধরেই ঘ্যাঙাচ্ছিলো। চৌধুরী নাকি কী একটা নতুন রেসিপি পেয়েছেন গরুর মাংস রান্না করার। আমাদের নিমন্ত্রণ। চৌধুরীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ মানেই পেঁয়াজ-রসুন-আদা কাটা, মশলা বাটা, খাটাখাটনির চূড়ান্ত। তবে রান্নার নিন্দা করা যাবে না। খাবারের পাশাপাশি যেসব গল্প পরিবেশিত হয়, সেগুলি গুলগল্প হলেও মুখরোচক। দুলালের আগ্রহ যে কোনটার দিকে বলা মুশকিল। আজ হাতে কিছুটা সময় আছে বলে আমি নিমরাজি হয়েছি, তবে দুলালকে রিকশা ভাড়া দিতে হবে। দুলাল এ শর্তে রাজি, যদি চৌধুরীর বাড়িতে ঢোকার আগের গলিতে চায়ের দোকানে ওকে চা খাওয়াই। চৌধুরীর বাড়ির আগের গলির চায়ের দোকানে আমরা দীর্ঘদিন ধরে চা খেয়ে আসছি, কখনো ব্যাটাকে চায়ের দোকানের ভেতরে বসতে দেখিনি। আজ ভেতরে ঢুকেই ঘাবড়ে গেলাম। বড় বেঞ্চের পুরোটা দখল করে বসে আছেন চৌধুরী, উল্টোদিকে দু'জন গোবেচারা চেহারার ভদ্রলোক। তিনজনের সামনেই চায়ের কাপ। চৌধুরী যেন আমাদের দেখেও দেখলেন না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে স্মিত মুখে উল্টোবর্তী এক বেচারাকে বললেন, "বুঝলেন খান সাহেব, বড় বিচিত্র আমাদের এ পৃথিবী। তাই চোখ কান খোলা রাখতে হয়। উঁচিয়ে রাখতে হয় নাকটাকে। সুযোগ পেলেই জিভ দিয়ে চেটে এই পৃথিবীর স্বাদ নিতে হয়।" খান সাহেব দেখলাম জিভ দিয়ে শুকনো ঠৌঁট ভেজাচ্ছেন। বিচক্ষণ লোক। জিভের নাগালের বাইরের পৃথিবীকে চেটে দেখতে যাওয়া একটা বিপজ্জনক কর্ম, তা তিনি ভালোই জানেন মনে হলো। চৌধুরী এবার খানের পার্শ্ববর্তীর দিকে তাকিয়ে এক বিকট নোবেলজয়ী হাসি উপহার দিলেন। "পর্যবেক্ষণ! পর্যবেক্ষণ বড় জরুরি, বুঝলেন সৈয়দ?" সৈয়দ গোমড়া মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শুধু। আমরা আলগোছে পাশের টেবিলে বসে চায়ের ফরমাশ দেই। চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, "পর্যবেক্ষণেরও নানা সহি কায়দা আছে। সঠিক পন্থা অবলম্বন করলে আজ ভূঁইয়াকে এভাবে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকতে হতো না। ঝামেলাটা ঐ ছোকরা আর ছেমরির ওপর দিয়েই যেতো।" একটা গল্পের গন্ধ পেয়ে দুলাল দেখি নড়েচড়ে বসেছে। অ্যাকশন আর রোমান্স, দু'টোই আছে দেখা যাচ্ছে। চৌধুরী উদাস গলায় বললেন, "শুধু হাড্ডি ভাঙলে একটা কথা ছিলো, নিজের বাড়ির ছাদে তিন তিনটা বডি এভাবে পাওয়া গেলো ... লোকে কী বলবে?" সৈয়দ শুকনো গলায় বললেন, "পুলিশ তো সবাইকে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে!" চৌধুরী সোৎসাহে বললেন, "তা তো বেড়াবেই! পুলিশের কাজই হচ্ছে বেড়ানো। হুমকি টুমকি দিয়েই তারা কোনমতে করে খাচ্ছে।" খান সাহেব মিনমিন করে বললেন, "ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণে কী সমস্যা ছিলো যেন বলছিলেন?" চৌধুরী বললেন, "বলিনি, এখন বলবো। দাঁড়ান, তার আগে আরো চা দিতে বলি। ... অ্যাই, এই দুই টেবিলে পাঁচ কাপ চা দিয়ে যা!" দুলাল হাসিমুখে বললো, "হেঁ হেঁ হেঁ ... ভালো আছেন তো, না?" দুই "ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণের প্রথম সমস্যা হচ্ছে, এখানে বাড়ি বানানোর আগে সে পড়শিদের যাচাই করে দেখেনি।" চৌধুরী নতুন চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে চুমুক দিলেন। "যার বাড়ির গায়ে গা ঘেঁষে সে বাড়ি বানিয়েছে, সেই মামুন ব্যাটা মস্তবড় বদমাশ।" সৈয়দ আর খান, দু'জনেই দেখলাম ইতিবাচক সাড়া দিলেন এ কথায়। "যদি মামুনের বাড়ির পাশে তিনি বাড়ি না বানাতেন, আজ এ সমস্যায় ভূঁইয়াকে পড়তে হতো না।" চৌধুরী রায় ঘোষণা করলেন। দুলালটা ফস করে বলে বসলো, "কিন্তু ক্যান? মামুন কী করসে?" চৌধুরী দুলালের বালখিল্যতায় যেন করুণা বোধ করলেন, সেকেন্ড দশেক জুলজুলিয়ে দুলালের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, "কী করেছে? মামুন কী করেছে জানতে চান? শুনুন তবে! মামুন দু'টো বিয়ে করেছে!" আমি আর দুলাল একে অপরের মুখ দেখি। জনৈক মামুন দু'টো বিয়ে করায় কেন জনৈক ভূঁইয়াকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, সেই সমীকরণ আর পরের লাইনে নিয়ে যেতে পারি না আমরা, ইজ ইকুয়েল টু জিরো লিখেই বসে থাকতে হয়। খান দেখি মাথা নাড়ছেন, "মামুন লোকটা ভালো না। বড় বখাটে। শুনেছি আগে গুন্ডা ছিলো।" চৌধুরী বললেন, "ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণের এটাও একটা ত্রুটি। সে মোটেও খেয়াল করতে পারেনি যে সে দুই বউওয়ালা এক লোকের বাড়ির পাশে বাড়ি বানিয়ে বাস করতে যাচ্ছে।" দুলাল চায়ের কাপ না ধরা হাতটা দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। ওর জিজ্ঞাসা আমার মনেও, মুখ ফসকে বলে ফেললাম, "সেটা ঠিক কিভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়?" চৌধুরী বাঘের হাসি হাসলেন। "যখন জানতেই চাইলেন, তখন বোঝা গেলো, পর্যবেক্ষণের সেই শক্তি আপনার মধ্যেও নেই! ... আছে! উপায় আছে! তবে তার জন্যে চাই ইচ্ছা। ভূঁইয়ার মধ্যে আদপে সেই ইচ্ছা ছিলো কি না, সেটাই প্রশ্ন। আমাকে দেখুন।" বুক চিতিয়ে বসলেন তিনি। "বাড়ি ভাড়া নেবার আগে দু'পাশে দুই পড়শি দেখে নিয়েছি। এই যে খান সাহেব, নিরীহ ভালোমানুষ। এই যে সৈয়দ সাহেব, আরেক ভদ্দরলোক।" খান আর সৈয়দ দু'জনেই লজ্জা লজ্জা ভাব করে চায়ের কাপে ফড়াৎ করে চুমুক দিলেন। দুলাল বললো, "কিন্তু ভূঁইয়া সাহেবের হইসেটা কী?" চৌধুরী বললেন, "গত পরশু সন্ধ্যায় ভূঁইয়ার ছাদে তিনটা বডি পাওয়া গেছে। তিনটাই ভাঙা।" আমি জানতে চাইলাম, "ভূঁইয়া তার মধ্যে একটা বডি?" চৌধুরী ইতিবাচক হাসি দিলেন। "বাকি দু'জনের একজন হচ্ছে মওদুদ, আরেকজন মরিয়ম।" দুলাল চা নামিয়ে বলে, "এরা কারা?" চৌধুরী আবারও চায়ের ফরমায়েশ দেন। "মওদুদ ভূঁইয়ার বাড়ির চিলেকোঠার ভাড়াটিয়া। পেশায় ছাত্র। আর মরিয়ম হচ্ছে ঐ ব্যাটা বদ মামুনের কোন এক স্ত্রীর খালাতো বোন। পেশায় ছাত্রী।" কেমন যেন ঘোরালো হয়ে ওঠে ব্যাপারটা। দুলাল বলে, "আচ্ছা! এইবার একটু একটু বুঝতে পারসি! মওদুদ আর মরিয়মের মধ্যে মনে হয় ...।" চৌধুরী মিটিমিটি হেসে মাথা নাড়েন। "একটু মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিলো। ঠিক ধরেছেন। কিভাবে বুঝলেন?" দুলাল থতমত খেয়ে বলে, "মতপার্থক্য? কীসের মতপার্থক্য?" চৌধুরী একটি ভুরু ওপরে তোলেন দ্য ফল গাই-তে দেখা লী মেজরস এর ভঙ্গিতে। "অহ! আন্দাজে ঢিল মেরেছিলেন।" দুলাল মরিয়া হয়ে বলে, "মওদুদ আর মরিয়মের মধ্যে প্রেম ছিলো না?" খান সাহেবও দুলালের প্রশ্নকে সমর্থন যোগান। "সে কী চৌধুরী সাহেব, মওদুদ আর মরিয়মের মধ্যে প্রেম ছিলো না?" চৌধুরী মাথা নাড়েন। "উঁহু।" সৈয়দ বলেন, "কিন্তু পুলিশের নাকি সেরকমই ধারণা?" চৌধুরী বলেন, "পুলিশের পর্যবেক্ষণক্ষমতা খুবই কাঁচাস্তরের। অবশ্য তারা ঘটনার পর এসে হাজির হয়, আর কতটুকুই বা আশা করা যায় পুলিশের কাছ থেকে? তবে পুলিশকেও হার মানিয়েছে আমাদের ভূঁইয়া, বাড়ি বানানোর আগে খেয়াল করেনি যে পড়শি বদমায়েশ মামুনটার একটা ডাঁসা শালি আছে!" দুলাল সোৎসাহে বলে, "শালি? ডাঁসা?" চৌধুরী গম্ভীর হয়ে বলেন, "বাড়ি বানানোর আগে ভূঁইয়া এ-ও খেয়াল করেননি যে মামুন ব্যাটার বাড়িটা ছ'তালা, আর তাঁর বাড়ি হবে মোটে তিনতালা। এই তিনটি তালার তফাৎ যে কত মর্মান্তিক হতে পারে, তা আঁচ করা ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণ শক্তিতে কুলোয়নি।" আমি চুপচাপ চা খাই। দুলালটা উসখুস করে, বলে, "মরিয়ম কীসে পড়ে?" চৌধুরী বললেন, "ভূঁইয়া আরও খেয়াল করেনি, যে মামুন বদমায়েশটার দু'টো বউ থাকার পরও সে মাঝে মাঝেই বাইরে রাত কাটায়।" সৈয়দ খুক খুক করে কাশলেন। চৌধুরী পরোয়া করলেন না। "সামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকলে এরকম একটা লোকের বাড়ির পাশে মানুষ কখনো বাড়ি বানায়?" খান সাহেব কী যেন বলেন বিড়বিড় করে। চৌধুরী বললেন, "ভূঁইয়া না হয় পরের বাড়ির লোকজনের পরোয়া না-ই করলো, কিন্তু তার নিজের যে একটা দামড়া ছেলে আছে, আক্কাস, তার কথা তো অন্তত মাথায় রাখা উচিত ছিলো, নাকি?" দুলাল একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়। "আক্কাসের কী হইসে?" চৌধুরী চায়ের কাপে বিলম্বিত লয়ে চুমুক দ্যান। "আক্কাসের কিছুই হয়নি। আপাতত একটু মন খারাপ।" দুলাল মাথা নাড়ে। "হ, বাপ পঙ্গুতে ভর্তি, পোলার মন তো একটু খারাপ হইবোই ...।" চৌধুরী হাসেন ঠা ঠা করে। "উঁহুহুহু! আক্কাস ভূঁইয়া বংশের কলঙ্ক। বাপ পঙ্গুতে ভর্তি হয়েছে বলে ওর মন মোটেও খারাপ নয়, দরকার পড়লে সে-ই বাপকে পেঁদিয়ে পঙ্গুতে পাঠাতে পারে! যে হারে লাই দিয়ে তাকে মাথায় তোলা হয়েছে!" আমি বলি, "আক্কাসের মন তাহলে খারাপ কেন?" চৌধুরী বলেন, "মরিয়মের জন্যে, আবার কেন!" এবার যেন কিছুটা স্পষ্ট হয় ছবিটা। দুলালের মন বোধহয় খারাপ হয়েছে আক্কাসের সাথে মরিয়মের একটা কিছু আছে বলে, সে গোমড়া মুখে বলে, "বদমাইশ পোলা!" চৌধুরী গরম গলায় বলেন, "তিনতালা বাড়ির তৃতীয় তলার এক পাশে ইয়া বড় এক ঘর নিয়ে আক্কাস থাকে। ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণ শক্তি বলে কিছু থাকলে কিছুতেই ঐ ঘরে আক্কাসকে থাকতে দিতেন না তিনি।" দুলাল আবারও হাত ঢোকায় গল্পে। "ক্যান? ঐ ঘরে কী হইসে?" চৌধুরী বলেন, "ঐ ঘরের বরাবর ঘরটা কার, আন্দাজ করুন দেখি?" সৈয়দ উত্তেজনায় ঝুঁকে পড়েন। "মরিয়মের?" চৌধুরী প্রসন্ন হাসেন। "ব্রাভো! এই তো চাই ব্রাদার! এরকম চোখা চোখ থাকতে হবে। দেখুন, এই দুই ইয়াংমেনকে এই তরুণ বয়সেই কেমন ভূঁইয়ামো পেয়ে বসেছে! ওদের জন্য বড় মায়া হয় আমার! একটা অযথা জেনারেশন ...।" রাগে চাঁদি জ্বলতে থাকে, কিছু বলি না। চৌধুরী আড়চোখে আমাদের পর্যবেক্ষণ করে আবার গল্পে ফিরে যান। "শুধু মরিয়মের ঘর হলে সমস্যা ছিলো না। মরিয়মের ঘরের জানালা আবার আক্কাসের ঘরের বারান্দার দিকে ফেরানো।" দুলাল শিউরে ওঠে। "উই মা!" খান সাহেব গোঁ গোঁ করে ওঠেন। "উচ্ছন্নে গেলো, সমাজটা উচ্ছন্নে গেলো!" চৌধুরী হাসেন। "ওদিকে ভূঁইয়ার ভাড়াটিয়া পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতাও খারাপ। এতো লোক থাকতে বেছে বেছে পালোয়ান এক ছোকরাকে চিলেকোঠা ভাড়া দিয়েছেন। মওদুদ কলেজে থাকতে ভারোত্তলন করতো। শটপুটেও প্রাইজ পেয়েছে। রোজ সকালে উঠে সে ল্যাঙোট পড়ে ডনবৈঠক করে ছাদে। সারা গায়ে কিলবিল করছে মাসল। ভূঁইয়া সাহেবের বাড়িতে একবার চোর ঢুকেছিলো, মওদুদ চিবিয়ে তার একটা কান ছিঁড়ে নিয়েছে শুনেছি।" দুলাল আঁতকে ওঠে। চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন, "ভূঁইয়া যদি খেয়াল করতেন, যে পাশের বাড়ির চারতালায় নচ্ছাড় মামুনের ছোট বউয়ের মহল, তাহলে কি ওরকম একটা মাসলম্যানকে চিলেকোঠা ভাড়া দিতেন? কক্ষণো না!" গল্প আবারও গুলিয়ে যায়। চৌধুরী বকে যান। "মামুন তার কোন বউকেই ঠিকমতো সময় দেয় না। সে হয় বাড়ির বাইরে রাত কাটায়, নয়তো দারোয়ান মকবুলের বউ সখিনাকে দিয়ে গায়ে তেল মালিশ করায়।" খান সাহেব মুখ কুঁচকে বলেন, "ছি ছি ছি, ঘেন্না!" চৌধুরী কাপটা নামিয়ে রাখেন টেবিলের ওপর ঠক করে। "কিন্তু মামুনের দুই বউ, বড় বউ জুবাইদা আর ছোট বউ জুলেখা, দু'জনেই তো মানুষ, নাকি? তাদেরও তো মন বলে একটা বস্তু আছে, নাকি?" দুলাল ঘন ঘন মাথা নাড়ে, "ঠিক, ঠিক!" চৌধুরী বলেন, "ভূঁইয়ার পর্যবেক্ষণশক্তি এতো কম বলেই এইরকম সব ঘটনা ঘটতে পারলো।" দুলাল বলে, "কীরকম সব ঘটনা?" চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "এই পাড়ায় প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা কারেন্ট চলে যায়। ঘন্টা দুইয়ের জন্য।" আমি গলা খাঁকারি দিই। চৌধুরী উদাস হয়ে বলেন, "যখন কারেন্ট থাকে না, টিভি দেখা যায় না, মনটা উদাস লাগে, তখন তো একটা কিছু করা দরকার, নাকি?" সৈয়দ সাহেবও দেখি কাশছেন। চৌধুরী বলেন, "মওদুদ অ্যাথলেট মানুষ, তাই সে মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে পড়ে। সেখান থেকে চারতলায় জুলেখার কাছে যায়।" দুলাল গাধাটা বলে, "ক্যান?" চৌধুরী বিষদৃষ্টিতে দুলালকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন, তারপর বলেন, "হয়তো সুডোকু খেলে!" দুলাল থতমত খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চৌধুরী বলতে থাকেন, "মরিয়মের জীবনটাও আক্কাসের মতোই নিঃসঙ্গ, তাই সে-ও মাঝে মাঝে কারেন্ট চলে গেলে ছাদে হাঁটতে যায়। তারপর মুড থাকলে পাইপ বেয়ে আক্কাসের বারান্দায় এসে নামে।" দুলাল মুষড়ে পড়ে একেবারে। "মরিয়মও সুডোকু খেলে?" চৌধুরী কাঁধ ঝাঁকান। "খেলতেই পারে। সুডোকু খুব ইন্টারেস্টিং খেলা। বিশেষ করে কারেন্ট চলে গেলে!" আমি ঘটনা আঁচ করতে পারি কিছুটা। "এতদিন ধরে মওদুদ আর মরিয়মের মধ্যে কোন ট্র্যাফিক জ্যাম হয়নি। দু'জনেই পাইপ খালি পেয়েছে আসা যাওয়ার পথে। গত পরশু দিন একটু সমস্যা হয়েছিলো। মওদুদ পাঁচতালা বরাবর উঠে পড়েছে, ওদিকে মরিয়ম মোটে ছয়তালার ছাদ থেকে নেমে পাঁচতালা বরবার পৌঁছেছে।" খান সাহেব মাথা নাড়েন। "ছি ছি ছি, ঘেন্না!" চৌধুরী সাহেব ভুরু কোঁচকান। "মওদুদ চোরের কান কামড়ে ছিঁড়ে ফেললেও এমনিতে খুব ভদ্রলোক, বিশেষ করে মেয়েদের সে খুব তমিজের সাথে দেখে। আর মরিয়ম পাইপ বেয়ে ওঠানামা করলেও বাস্তবে খুব ভদ্র মেয়ে।" দুলাল বললো, "তো?" চৌধুরী বললেন, "মওদুদ ফিসফিসিয়ে বললো, "লেডিজ ফার্স্ট!" সৈয়দ হাঁ করে শুনতে থাকেন। চৌধুরী বেঞ্চে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর কনুই রাখেন। "লেডিজ ফার্স্ট বললেই তো আর হয় না। মরিয়ম কিভাবে মওদুদের মতো একটা দুইমনী লাশকে ডিঙিয়ে নিচে নামবে? সে বলে, "মওদুদ ভাই, আমি কার্নিশে নামছি, আপনি আগে যান।" দুলাল বলে, "কন কী?" চৌধুরী বলেন, "মওদুদ রাজি হয় না, সে বলে, না, আমি কার্নিশে নামি, তুমি আগে যাও।" আমি বিরসমুখে বলি, "পেহলে আপ সিচুয়েশন!" চৌধুরী উদ্ভাসিতমুখে বলেন, "এগজ্যাক্টলি! কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। মরিয়ম মওদুদকে রাস্তা ছেড়ে দেবেই, আর মওদুদও প্রাণ থাকতে মরিয়মকে পরে যেতে দেবে না।" দুলাল বলে, "তারপর?" চৌধুরী হঠাৎ নিচুকণ্ঠে বললেন, "গল্পে আরো দু'টো ক্যারেক্টারের নাম বলেছি। বলুন তো এরা কারা?" খান সাহেব সাগ্রহে বলেন, "আমি বলি, আমি বলি!" চৌধুরী বলেন, "ওহ প্লিজ, গো অ্যাহেড!" খান সাহেব ভুরু কুঁচকে জিভ কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবেন। তারপর বলেন, "দারোয়ান মকবুল, আর তার বউ সখিনা।" চৌধুরী মৃদু, রহস্যময় হাসেন। তারপর বলেন, "আংশিক সঠিক। আপনাকে পাঁচ নাম্বার দেয়া হলো। কিন্তু ফটকা মামুনের বড় বউ জুবাইদার কথা ভুলে যাবেন না!" দুলাল চমকে ওঠে। "ক্যান, উনি আবার কী করসে?" চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। "পাড়ায় কারেন্ট গেলে কি আর জুবাইদার ঘর রওশন থাকে? তার ঘরেও তো তখন অন্ধকার।" দুলাল এবার সটান দাঁড়িয়ে যায়। "উনিও সুডোকু খ্যালে?" ভাঙা গলায় শুধায় সে। চৌধুরী ফরাসী কায়দায় কাঁধ ঝাঁকান। "খেলতেই পারে। খেলাটা খুব জনপ্রিয়, জানেন না বোধহয়?" আমি গম্ভীর হয়ে বলি, "উনি কার সাথে খেলেন? মকবুল?" চৌধুরী স্মিত হাসেন। "আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আছে। ছাইচাপা আগুনের মতো। আরো চর্চা করতে হবে আর কি! ঠিক ধরেছেন। মকবুল লোকটা দারোয়ান হলে কী হবে, বেশ হ্যান্ডসাম। তাই সে মাঝে মাঝেই কারেন্ট চলে গেলে তিনতালায় যায় আর কি।" দুলাল বলে, "কিন্তু মরিয়ম আর মওদুদের কী হইলো?" চৌধুরী গলা খাটো করে বলেন, "মকবুল হ্যান্ডসাম হতে পারে, কিন্তু চোরছ্যাঁচড়ের সাথে কী যেন একটা কানেকশন আছে, বুঝলেন? কী করবে বেচারা, দারোয়ান তো! চোরের সাথে খাতির না হয়েও উপায় নাই। দুষ্ট লোকে বলে," গলা আরো নামিয়ে আনেন তিনি, "মওদুদ যে চোরটার কান চিবিয়ে ছিঁড়ে নিয়েছিলো, সে নাকি মকবুলের খালাতো ভাই হয়!" দুলাল স্তম্ভিত হয়ে যায়, আমি কাপে চুমুক দিই। সৈয়দ খানিক ভেবে বলেন, "চোরে দারোয়ানে মাসতুতো ভাই!" চৌধুরী হাসেন। "হা হা হা, বেশ বলেছেন। ... তো, আমাদের মকবুল আমাদের মওদুদের ওপর বেশ অনেকদিন ধরেই ক্ষ্যাপা। আর চোরদের সাথে মিশে মিশে তার মনটাও একটু পুলিশ পুলিশ ... সেদিন সেই ঘুটঘুটে সন্ধ্যায় তিনতালায় ডিউটি না দিয়ে মকবুল ছাদে উঠে এসেছিলো মওদুদকে পাকড়াও করার জন্যে। হাতে একটা গাঁটালো লাঠি।" সৈয়দ সাহেব বলেন, "বলেন কী?" চৌধুরী বিষণ্ণ মুখে বলেন, "আর আমাদের ভূঁইয়া সাহেব, কী আর বলবো, লোকটা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তো নাই-ই, পর্যবেক্ষণ জ্ঞানটাও নাই। আশেপাশে নানা কথা চালাচালি হয়, তো তিনি গত পরশুদিন ওরকমই কিছু একটা শুনে হয়তো একেবারে সরজমিন পর্যবেক্ষণ করতে ছাদে গিয়ে হাজির।" আমার কাছে এবার বাকিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। চৌধুরী বলেন, "ওদিকে পাঁচতলা বরাবর মওদুদ আর মরিয়ম ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে ব্যস্ত, মকবুল হতচ্ছাড়াটা এসেই বসিয়েছে এক ঘা। আর নিচ থেকে ভূঁইয়া সাহেবও হেঁকে উঠেছেন, "বলি হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ?" সৈয়দ সাহেব বললেন, "হুঁ, আমিও শুনেছি এই হাঁক।" চৌধুরী বললেন, "সামান্য লাঠির ঘায়ে মূর্ছা যাবার পাত্র নয় মওদুদ। বরং লাঠিই ওর গায়ে লেগে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা চৌদ্দ আনা। কিন্তু ভূঁইয়া সাহেবের হাঁক শুনে বেচারার মধ্যবিত্ত আত্মা একেবারে টলে গেলো, বুঝলেন? ওদিকে মরিয়মের গায়েও লাঠির বাড়ি পড়েছে, পাইপ থেকে তার হাত ফসকে গেছে। দু'জনে মিলে জড়াজড়ি করে একেবারে নিচে ভূঁইয়া সাহেবের ওপর গিয়ে পড়েছে।" দুলাল শিউরে ওঠে, "বলেন কী?" চৌধুরী মাথা নাড়েন। "মওদুদের ওজন কমসে কম পঁচাশি কেজি হবে। মরিয়মকে যা দেখেছি এপাশ ওপাশ থেকে, তার ওজনও কেজি পঞ্চাশেক হবে। একশো পঁয়তিরিশ কেজি ওজনের দুইজন সুডোকু খেলোয়াড় কুড়িফুট ওপর থেকে গায়ের ওপর পড়লে আমি আপনি টেঁসে যাবো, কিন্তু ভূঁইয়া ঘুষখোর সরকারী লোক, এন্তার গোস্ত গায়ে, তাই কয়েকটা হাড্ডি ভেঙেছে শুধু। আর এমন একটা শক অ্যাবজরবার ছিলো বলেই মওদুদ আর মরিয়মও জানে বেঁচে গেছে, চোটটা কয়েকটা হাড্ডির ওপর দিয়ে গেছে শুধু।" আমার আর সহ্য হয় না, কাপটা নামিয়ে রেখে বলি, "আপনি এসব জানলেন কিভাবে?" চৌধুরী গম্ভীর হয়ে বলেন, "পর্যবেক্ষণ!" আমি বলি, "সেটাই কিভাবে করলেন, জানতে চাই!" চৌধুরী বললেন, "কারেন্ট চলে গেলে বারান্দায় বসে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করি আর কি! রীতিমতো সিনেমা।" দুলাল মুখ কুঁচকে বলে, "কিন্তু আপনের বাড়ি তো রাস্তার উল্টাদিকে! দৃশ্য না হয় দেখলেন, কথাবার্তা শুনলেন কেমনে?" চৌধুরী কঠোর মুখে বলেন, "মামুনের বাড়ির পাঁচতলায় কে থাকে জানেন?" দুলাল ভড়কে গিয়ে বলে, "না। কে থাকে?" চৌধুরী বলেন, "মামুন নিজে। কারেন্ট চলে গেলে সে কী করে জানেন?" দুলাল ভয়ে ভয়ে বলে, "সুডোকু?" চৌধুরী বলেন, "সে সখিনাকে ডেকে এনে পিঠে তেলমালিশ করায়। মওদুদ আর মরিয়মের আলাপসালাপ হচ্ছিলো তার একেবারে জানালার পাশেই। সবকিছুই সে শুনতে পেয়েছে।" দুলাল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, "মামুন আপনাকে এসব কথা জানিয়েছে?" চৌধুরী বললেন, "হুমম! কত্তবড় বদ লোকটা, ভাবতে পারেন? তবে পর্যবেক্ষণ শক্তি আছে ভালোই। যেভাবে খুঁটিনাটিসহ বললো, আমি শুনে একটু বিস্মিতই হয়েছি। শুধু বাইনোক্যুলার হাতে আমাকে দেখতে পায়নি বলে কিছু গোঁজামিল দেবার চেষ্টা করছিলো আর কি ...।" আমি বললাম, "আপনি বাইনোক্যুলার দিয়ে এসব পর্যবেক্ষণ করেন নাকি?" চৌধুরী হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়লেন। "চলুন চলুন, অনেক পেঁয়াজ কাটতে হবে আজকে, বুরবকশাহী বিরিয়ানি রান্না হবে ...।" . . এ গল্পটি ২০১০ এ প্রকাশিত গল্প সংকলন ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প"-তে অন্তর্ভুক্ত
false
rn
টুকরো টুকরো সাদা মিথ্যা- ২৮ দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি- বারবি আমার আগে ঘুম থেকে উঠে বসে আছে।সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সুন্দর একটা মুখ দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। একটা মেয়ে এত সুন্দর হয় কি করে ! বারবি বলল- এইভাবে বদমাশ লোকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন ? যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি নাস্তা রেডী করছি। আমি বললাম-বারবি ডল নিয়ে দুনিয়াজোড়া মাতামাতি। পৃথিবীর আনাচকানাচে প্রায় প্রতিটি দেশেই বারবি ডল শিশুদের খেলনার একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে।শিল্পী নিকোলাই ল্যাম প্রমাণ করেছেন, বারবির মতো হওয়া অসম্ভব। দুইজন মিলে সকালে নাস্তা করলাম- রুটি আর ডিম ভাজা। বারবি নিজের হাতে বানিয়েছে। মনে হলো- রুটি আর ডিম ভাজা পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার। নাস্তা শেষ করে আমি আমেরিকান এম্বাসিতে ফোন করলাম। বারবি পাসপোর্ট হারিয়ে যাবার কথা জানালাম। আমেরিকার কোনো নাগরিক কোনো সমস্যা পড়লে- সেই সমস্যা সমাধান করার জন্য আমেরিকান এম্বাসি অস্থির হয়ে পড়ে। এম্বাসিকে থেকে বলল- তারা খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করবে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ খুব পিছিয়ে। বারবিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। আমি এখন পর্যন্ত বারবি'র কাছে জানতে চাইনি- সে কেন বাংলাদেশে এসেছে। আমার কাছে সবচেয়ে বড় হচ্ছে- অসাধারন সুন্দরী একটি মেয়ে আমার সাথে আছে। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।বারবি'কে নিয়ে গেলাম রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে। বারবি'র হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললাম- খাও। আমি এই দোকান থেকে প্রতিদিন চা খাই। চায়ের দোকানের মালিক শামছু ভাই আমাকে বললেন- ভাই, এত সুন্দর মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। এই মেয়েকে কি আপনি বিবাহ করছেন ? শামছুর কথার উত্তর না দিয়ে আমি খুব কঠিন ভাব নিয়ে আকাশে তাকালাম। শামছু বলল- গুল্লু ভাই, আমি কি এই মেয়ের সাথে একবার হাত মিলাতে পারি? আমি বললাম অবশ্যই। আমি বারবি'কে বললাম- বারবি, এই চায়ের দোকানের মালিকের নাম হচ্ছে শামছু, সে তোমাকে মনে করছে বেহেশতের হুর।তাই, শামছুর খুব ইচ্ছা সে বেহেশতের হুরের সাথে হ্যান্ড শেক করবে। বারবি শামছুর সাথে হ্যান্ড শেক করলো। শামছু বলল- আপনে যদি আজ দুপুরে আমার সাথে দুইটা ডাল-ভাত খান খুব খুশি হবো। বারবি শামছুর কথা কিছুই বুঝল না। আমি শামছুর কথা বারবিকে বুঝিয়ে বললাম। বারবি'কে দেখে চায়ের দোকানে ছোট খাটো একটা ভীড় লেগে গেছে। আমি বারবি'কে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বারবি'কে নিয়ে গেলাম সেগুন বাগিচা মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে। বারবি খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার চোখে এক আকাশ বিস্ময়। মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর নিয়ে আমি বারবিকে বললাম- বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ১৯৯৬ সালের ২২ শে মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ বস্তু আছে এই জাদুঘরে ।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ভাণ্ডার এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সেন্টার। একাত্তরের ভয়াবহ গণহত্যার বাস্তবতা বিশ্বসমাজের কাছে মেলে ধরা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আহরণ ও সহায়তা গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে আসছে ২০০৮ সাল থেকে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবছর সংবাদপত্রের জন্য একজন এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের জন্য একজনকে এই পদক প্রদান করা হয়। পুরস্কারের অর্থ-মূল্য এক লক্ষ টাকা।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইট্স্ অব কনসান্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।যাদুঘর ভ্রমন শেষে বারবি'র চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এই প্রথম আমি কারো চোখে পানি দেখে এক আকাশ আনন্দ পেলাম। একটি বিদেশী মেয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জেনে কাঁদছে! মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর থেকে বের হয়ে- বারবি বলল- তোমরা এক মহান জাতি।বারবি'কে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শহীদ মিনার। শহীদ মিনার দেখে বারবি মুগ্ধ। শহীদ মিনার কি- তা আমি বারবি'কে বুঝিয়ে বললাম- শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে রাত্রির মধ্যে তা সম্পন্ন করে।২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। বারবি'র চোখে-মুখে এক আকাশ বিস্ময়! তারপর আমি বারবি'কে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতাল দেখে বারবি পরপর দুইবার বমি করলো এবং আমাকে বলল- এত নোংরা হাসপাতাল আমি আমার জীবনে দেখিনি। আমি বললাম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হাসপাতালও আমাদের আছে। এপোলো, স্কয়ার ইবনেসিনা এবং ইউনাইটেড ইত্যাদি। কিন্তু এসব হাসপাতালের খরচ অনেক। সাধারন মানুষ এইসব হহাসপাতালের ধারে-কাছে যেতে পারে না। দুপুর তিনটায় বারবিকে নিয়ে পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলে কাচ্চি খেলাম। তারপর লাচ্ছি। বারবি বলল- এই দেশে না আসলে অনেক কিছু জানা থেকে বঞ্চিত হতাম। আমি বললাম- তুমি যদি এই দেশে তিন মাস থাকো- তারপর তুমি আর এই দেশ থেকে যেতে পারবে না। এই দেশ এবং এই দেশের মানুষ তোমাকে চুম্বুকের মতন টানবে। বারবি বলল- এরপর আমরা কোথায় যাবো? আমি বললাম একটা মাজার দেখাবো। গোলাপ শাহ মাজার। ভন্ডামি কত প্রকার ও কি কি নিজ চোখে দেখবে, চলো। মাজারের কর্ম কান্ড দেখে বারবি বলল- তোমাদের সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন ? আমি বারবির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম- মৃত ব্যক্তি - সে যত বড় বুজুর্গ-ই হোক না কেন, মানুষের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেনা। মাজার অবশ্যই সবচেয়ে খারাপ ধর্ম ব্যবসা গুলোর মধ্যে একটি!দুর্বল ঈমানের অধিকারী মানুষদের বিভ্রান্ত করে ব্যবসা করছে এক শ্রেনীর ভন্ড ,প্রতারক ।মাজার নয়, মাজার শরিফ! পীরদের আকর্ষণীয় কলেমা হল: ‘নারী-পুরুষ হয়ে দরবারে এসো না! ভক্ত হয়ে এসো।’ অর্থাৎ দরবার শরীফ নারী-পুরুষের নেশা/ঘেঁষার অবাধ নিরাপদ বিচরণ কেন্দ্র। সুতরাং যুবক ও ধনাঢ্য ভক্তদের উত্তরোত্তর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়; আর এটুকু নিরাপদ বাড়তি ভোগের জন্য গুরু-পীরের বাড়তি কেরামতির প্রচারণাও চালাতে হয়। রাত দশটায়- ভোলা ভাইয়ের বিরানী খেয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। বারবি খুব ক্লান্ত। সে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। আমি নীচে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। হঠাত বারবি বলল- এই গাল্লু আমার খুব পেট ব্যাথা করছে। আমি বললাম- হঠাত পেট ব্যাথা কেন ? বারবি বলল- প্রতিমাসে তিন চার দিন আমার পেট ব্যাথা করে। আমি বললাম- উন্নত দেশে থাকো। ভালো ডাক্তার দেখাও না কেন ? বারবি বলল- তুমি এত বোকা কেন ? এই ব্যাথা সব মেয়েরই করে। আমি বললাম- কি আজিব কথা ! এই পেট ব্যাথার কি চিকিৎসা নাই? বারবি বলল- আজ সারাদিন তুমি আমাকে শহীদ মিনার নিয়ে বললে, যাদুঘর নিয়ে বললে, মাজার নিয়ে বললে, এখন আমি তোমাকে পেট ব্যাথা নিয়ে বলল- তুমি চুপ করে শোনো। বারবি বলল- প্রতি চন্দ্রমাস পরপর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে তাকেই ঋতুচক্র বলে।পিরিয়ড নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিকভাবেই এই মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হয় আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা বন্ধও হয়ে যায়। আমি বললাম- বারবি, এটা হচ্ছে ইশ্বরের শাস্তি। বারবি বলল- চুপ করো তো, আমার খুব পেট ব্যাথা করছে। বেচারির জন্য মায়া লাগছে। আমি বললাম- বারবি, আমি যদি তোমার পেটে হাত রাখি- তাহলে তোমার ব্যাথা অনেকখানি কমে যাবে। বারবি বলল- সত্যি। আচ্ছা, রাখো হাত পেটে। আমি এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে বারবি'র পেটে হাত রাখলাম। কিছুক্ষন পর মনে হলো- বারবি'র পেটের ব্যাথা কমেছে। সে এখন আরাম করে ঘুমাচ্ছে। কি মায়াময় একটা মুখ! আমার খুব ইচ্ছা করল- বারবি'র কপালে একটা চুমু খাই।সকালে পুলিশ এসে বারবিকে ধরে নিয়ে গেল। বারবি আন্তজাতিক চোরাচালানি ব্যাসার সাথে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে বারবি এক দেশ থেকে আরেক দেশে নেশাদ্রব্য জিনিস আদাম প্রদান করে থাকে। আমি অনেক কষ্ট পেলাম। আমার অনেক রাগ হলো। সারাদিন না খেয়ে থাকলাম। এত সুন্দর একটা মেয়ে কেন- এই রকম জীবন বেছে নিলো!
false
fe
মুকুলের জন্য শোক _ মাহবুব হাসান লেখক মুহম্মদ জুবায়ের এর ডাকনাম ছিল মুকুল। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবি মাহবুব হাসান মুকুলের জন্য শোক / মাহবুব হাসান ======================= ঘুমের ভেতর টেলিফোন বাজছে। সেলফোন। তাকিয়ে দেখি ফিরোজ সারোয়ারের ফোন। সরো কেন এত সকালে? সেহরি খেয়ে ভোরের নামাজ পড়ে শুয়েছিলাম। ঘুমটা গাঢ়ই ছিল বোধহয়। সকাল পৌনে ৯টায় ওকে রিং করলাম। কিরেঃ। আমার গলা ভারি, ঘুমঘোরে। সরো বলল, বাবা-মায়ের মৃত্যু শোক পাইনি। বন্ধুদের মৃত্যুশোকে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। জুবায়ের আর নেই! জুবায়ের আর নেই, মাত্র তিনটি শব্দ ঝাঁকালো আমাকে। বুক থেকে কান্নারা ধেয়ে আসছে সিডরের বেগে। আমি শুধু বলতে পারলাম, বলিস কি? সরো কান্নায় ভাঙতে ভাঙতে বলল দিদার এইমাত্র জানাল। ঘণ্টাদুয়েক আগেঃ। আমি আর কোন কথা উচ্চারণ করতে পারলাম না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেলফোন নিয়ে। মুহাম্মদ জুবায়ের, আমার বন্ধু, গল্পকার, ঔপন্যাসিক আর সার্ত্রের ইন্টিমেট-এর অনুবাদক। মৃত্যু তাকে খুবলে খেলো সুদূর ডালাসে। সেই শহরে চলে গিয়েছিল মুকুল বাংলা ভূমি ছেড়ে কর্মসংস্থানে। সেখানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে জুবায়ের, আমাদের মুকুল কয়েক বছর সিঙ্গাপুরে ছিল। সেই দিনগুলোতে একবার ঢাকায় দেখা হয়েছিল আমাদের। দেখা হোক বা না হোক, মুকুল সব সময় ছিল আমাদের সঙ্গে। ফোনে, ই-মেইলে প্রায় নিয়মিত কথা হতো। ওর এবং আমাদের বন্ধু অতিরিক্ত আইজি নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা একদিন বলল জুবায়ের ফিরে আসতে চায়। দেশে এসে কি করবে? আমি হাসতে হাসতে বললাম, পুলিশে ঢুকিয়ে দাও। আমার সঙ্গে সোহরাব হাসানও ছিল, বলল কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েঃ। কিশোর বলল কি যে বলো না! ওকে দিয়ে হবে না। কিশোর ঠিকই বলল ওকে দিয়ে হবে না। খুব মুডি মানুষ মুকুল। জেদিও। ইত্তেফাকে কাজ করেছিল জুবায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময়ই। পরে স্টাফ রিপোর্টারও হয়েছিল বোধহয়। কিন্তু কাজটি বেশিদিন করেনি মুকুল। কাজ নিয়েছিল নান্দনিক অ্যাডফার্মে। ‘নান্দনিক’ কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আর শরফুদ্দীন আহমদের যৌথ ক্রিয়েশন। আমরা নিয়মিতই আড্ডা মারতে যেতাম নান্দনিকের নর্থ-সাউথ রোডের অফিসে। ওখানে কাজ করতে করতেই শাহীন ভাবীর সঙ্গে ওর ফোনে পরিচয় আর ভাব জন্মে। পরিণয়ের মাধ্যমে প্রেম পর্বটি শেষ হয়। একবার আমাকে বললেন, মাহবুব আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেন। হেসে বলি কেমন করে। ম্যানেজ করেন। ও তখন বাইক চালায় দুরন্ত গতিতে। ওর বাইকে টাঙ্গাইলে গেলাম, বাসায়। ম্যানেজ করলাম পাঁচ হাজার টাকা। ফার্মগেটে ওভারব্রিজের পশ্চিমদিকে কয়েকটি দোকানের ছোট একটি সে ভাড়া নিল। আমরা দল বেঁধে যাই ওর কারবারের জায়গায়। বার্গার-টার্গার আর কোমল পানীয় বিক্রি করছেন ক্রেতাদের হাসিমুখে। আমাদেরও খাওয়াচ্ছেন অকাতরে। খাওয়ার কথা যখন উঠল, তাহলে আরও কিছু সত্য লিখি। সেই জীবনালেখ্য অনুভবযোগ্য করে তুলতে পারব না হয়তো, একটা রেখাচিত্র দিতে পারব মাত্র। ছাত্রাবস্থায় অর্থকষ্টে কেটেছে আমার। পকেটে পয়সা না থাকলে খালি পেটে থাকতে হতো। সেই তিয়াত্তর, চুয়াত্তর, পঁচাত্তর, ছিয়াত্তর, সালের কঠিন দিনগুলোতে আমাকে খাইয়েছে অকাতরে বেশ কয়েক বন্ধু, মুকুল তাদের একজন। বাবা ছেলেকে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত। সরোর ভাইয়েরা ওকে টাকা, না হলে চাল পাঠায়। কতদিন যে সরোর জহুরুল হক হলের রুমে রান্না করে খেয়েছি আমরা। কত রাত যে আমরা আড্ডা মেরে কাটিয়েছি রেজিস্ট্রি বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠের ঘাসের গালিচায়। আমি মুহসীন হলে, সরো জহুরুল হক হলে, মুকুল সূর্যসেন হলে। মুকুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ফারুখ ফয়সালের কল্যাণে। ওরা বগুড়ার বন্ধু। ফারুখ আমাদের সঙ্গে বাংলায়, মুকুল ইংরেজিতে পড়ে। ফারুখ সেই সময়ই অসম্ভব পরিশ্রমী-কর্মঠ, চালাক-চতুর আর বিদেশিনীদের সঙ্গে পাবলিক রিলেশনসে ওস্তাদ। খাওয়া, না খাওয়ার সেই জীবন-সংগ্রামে ফারুখ, মুকুল ছাড়াও আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবী ছিল এবং আজও আছে তারা ভালো বন্ধু হয়ে। যেমন আমাকে সাংবাদিকতায় নিয়ে আসে মিনা। সানাউল্লাহ নূরীর বড় মেয়ে কিশোর বাংলায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমার অর্থকষ্টের জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। মুকুল হলের ডাইনিং থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার নিয়ে আসত ওর রুমে। আমরা ভাগাভাগি করে খেতাম। সেই জীবন। মানুষের সেই জীবন, শালিকের, দোয়েলের মতো ভেসে উড়ে গেছে। সেই কষ্টের, সংগ্রামের জীবনের পরতে পরতে জমে আছে তিতা, নুন, মিষ্টি, বাতাস আর ভালোবাসা। সেই জীবন আর কোনদিন ফিরে পাব না যখন খাবারের নিশ্চয়তা ছিল না। যখন একবেলা খেতে কাজী সালাহউদ্দিনের বাসায় কিংবা আলেয়া চৌধুরী হিরার কাছে চলে যেতাম। হাসান হাফিজ, রেজোয়ান সিদ্দিকী, শান্তি, মিলন, সিরাজুল ইসলাম, বুলবুল চৌধুরী, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, জুবেরী আরও অসংখ্য বন্ধু জড়িয়ে আছে সেই জীবনযুদ্ধের সত্যযাত্রায়। এ যেন এক থালায় খাবারের মতো, মাখামাখি জীবন। বছর ৮/৯ আগে এক ভোরে ফোনে একজন বলল, এই যে কবি। বলেন তো আমি কে? গলা শুনে চিনতে পারি না। গলার স্বর অনেকটাই ভাঙা, হাস্কি। কেবল কথা বলার ভঙ্গিমাটা যেন চেনা চেনা লাগছে। বললাম না। তা পারবেন কেন। আপনি তো-তো, চিনলাম তো বলার সঙ্গে সঙ্গে, মুকুল ঠিক হচ্ছে না। কোথায় আপনি। বলল ডালাসে। আমি ভাবলাম মজা হচ্ছে। মুকুলই জানাল শহীদ কাদরীর অসুস্থতার কথা। কাদরীর দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে নিয়মিত ফোনালাপ হয়। ডালাস টু বোস্টন। সেখানে আমাদের আরও দুই বন্ধু থাকেন। বদিউজ্জামান নাসিম ভাই, আর লিটন ভাই। নাসিম ভাইয়ের সঙ্গেও মুকুলের নিয়মিত যোগাযোগ। বোধহয় ফারুখ ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। ফারুখ থাকে কানাডার অটোয়াতে। আর পৃথিবীব্যাপী ওর যাতায়াত। মিডিয়া ট্রেনার হিসেবে বেশ খ্যাতি ওর। মুকুল প্রায়শই চাকরি ছাড়ে, আবার ধরে। যুগান্তরে এসে আমি ওকে বললাম লেখেন। ও আত্মকথনমূলক লেখা লিখতে থাকল। কিছুদিন চলার পর, যখন ওর বেশ সুনাম হয়েছে তখন ওর বেকারত্ব ঘুচল। লেখাও পাঠানো বন্ধ হল। আবার বেকার হল মুকুল আবার লেখা শুরু করল। এভাবে বেশকিছু লেখা হয়েছে। মাঝে মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে লিখত। আমি মাস দুয়েক আগে যুগান্তর সাহিত্যের দায়িত্ব নেয়ায় ঘাড়ে চাপল ঈদ সংখ্যা। ই-মেইলে বললাম লেখা পাঠান। ও পাঠাল শামসুর রাহমানের ওপর একটি রচনা। সেটি ছাপালাম রাহমানের মৃত্যু দিবসের কয়েকদিন পর ২২ আগস্ট। লিখলাম ঈদ সংখ্যার জন্য গল্প পাঠান। ফিরতি মেইলের হেডিং গল্প পাঠালাম। আমি খুশি। ওর গল্পের আলাদা স্বাদ। চিঠিটা এক লাইনের, গল্প লিখতে পারলে তো পাঠাবো। এরপর একদিন ফোনে পেল আমাকে বাসায়। বলল গতকাল ফোন করছিলাম কোথায় থাকেন? বলে নাই। আমাকে রিনি বলতে ভুলে গেছে। বলল সরোকে বলবেন আমাকে যেন ফোন করে। যত টাকা বিল হবে আমি পাঠিয়ে দেব। আমি সে কথা সরোকে বলিনি। ওটাই আমার সঙ্গে মুকুলের শেষ কথা। এরপর একদিন সোহরাব হাসান বলল জুবায়ের নাকি হাসপাতালে। বোস্টন থেকে নাসিম ই-মেইল করেছে। খুলে পড়লাম। ওর জন্য সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন নাসিম। আমরা ফোন করলাম বোস্টনে। আরও কিছু জানলাম। পরের দিন আমার মেইলেও পেলাম জুবায়েরের রোগ ও চিকিৎসা বিষয়ক কথা। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম আমার আত্মার বন্ধুর জন্য। ঈদ সংখ্যার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু আফজাল হোসেন, ওকে একটি কপি দিতে গেছি ওর ধানমণ্ডির অফিসে সন্ধ্যায়। সেখানে স্বপন দত্তর সঙ্গে দেখা। ও জানাল ঝর্নার নতুন নম্বর। পুরনো নম্বরে ঝর্না-রনজুকে পাই না আমি। ফোন নিলাম ঝর্নার। কথা বললাম মুকুলের অবস্থা সম্পর্কে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। মুকুলের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও কম আগে। হায়! কে জানত ওই রাতের শেষে ভোরবেলায়ই সরো হদয় ভাঙা গলায় জানাবে আরও একটি বন্ধু হারানোর শোককথা। ------------------------------------------------------------ দৈনিক যুগান্তর । ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সকাল ৯:০৩
false
mk
কার টাকায় জঙ্গিবাদ দেশের সব জঙ্গি সংগঠনের পেছনে জামায়াত রয়েছে বলে মনে করেন কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামী নেতা। তাঁরা জঙ্গিবাদে মদদদাতা জামায়াতকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘ইসলামের আলোকে জঙ্গি ও সন্ত্রাস মোকাবিলায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এমন মত প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপপরিষদ গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজন করে।গোলটেবিল আলোচনায় শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রধান ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘দেশের সব জঙ্গি সংগঠনের পেছনে রয়েছে জামায়াত। এই সংগঠন এখন আন্ডারগ্রাউন্ডেও সুবিধা নিচ্ছে, বাইরেও সুবিধা নিচ্ছে।’সরকারের উদ্দেশে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘আপনারা এখনো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে লজ্জা পাচ্ছেন কেন? অনেকের ধারণা, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। আমি বলি, তা কি এখনো বাকি আছে?’জামায়াতকে উত্খাত না করলে বাংলাদেশকে পবিত্র করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেন, ‘মওদুদী কিভাবে তরুণদের ব্রেনওয়াশ করতে পারতেন, তা আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি। ওই সময় কাদের মোল্লা, মুজাহিদ তরুণ ছিলেন। মওদুদীর দর্শন কিভাবে তাদের হিংস্র বানিয়ে ফেলল তা আমরা দেখেছি। এখনো সেই দর্শন তরুণদের ব্রেনওয়াশ করে হিংস্র বানাচ্ছে।’তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘বাংলাদেশে লাখ লাখ আলেম-ওলামা ও হাজার হাজার ওয়াজিন আছেন। ওয়াজিনরা ইসলামের নাম নিয়ে ওয়াজ নসিহত করে যাচ্ছে। তারা কারা, তারা সরকারবিরোধী কি না? তারা জামায়াতের অনুসারী কি না? তারা যদি কোরআন-সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ওয়াজ করে তাহলে এটা বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে দিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নজিবুল বশর বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও লাখ লাখ আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ কোথাও এক জায়গায় মিলিত হতে বা বসতে চায়। এ ব্যাপারে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে এটা করা উচিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে সরাসরি দায়ী পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত। জড়িত জামায়াতে ইসলামীর প্রেতাত্মারা। এরা জেএমবি-হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে জঙ্গি তত্পরতায় লিপ্ত। তাই সবাই মিলে এ সমস্যা থেকে দেশকে উত্তরণ ঘটাতে এগিয়ে আসতে হবে।’ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মেসবাহ উর রহমান চৌধুরী জঙ্গিবাদের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে সরাসরি দায়ী করে বলেন, ‘জামায়াতকে ছোট করে দেখলে হবে না। দোস্তি করলে হবে না। তাদের টাকায় বিলবোর্ড টাঙানো ঠিক হবে না। এরা নেই কোথায়? এমনকি এরা সাংবাদিকদের মধ্যেও আছে।’ তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণায় একটি সেল গঠন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ঠাঁই হবে না। কারণ যারা জিহাদের নামে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের লাশ নেওয়ার লোকও নেই। এমনভাবেই দেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করে।’অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপপরিষদের চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম। পরিচালনা করেন, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও উপপ্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:৫৭
false
ij
আজকের বই; শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের _এই হেমন্তে।_ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। যার শব্দপ্রয়োগ ও বাক্যবিন্যাসে রয়েছে এমন এক নরম মেদুর স্বাদ, এমন এক ধরনের মায়ামমতা, এমন কী নিষ্ঠুর দৃশ্যের বর্ননাতেও ... ফি-বছর অক্টোবর মাসের শুরুতে আমি প্যান্টের পকেটে শ পাঁচেক টাকা নিয়ে আমাদের বহুতল থেকে বেরিয়ে সকালের ঝরঝরে রোদের ভিতর রিক্সা -বাস-গাড়ির ভিড় এড়িয়ে সতর্ক হয়ে ২০০ ফুট একটা রাস্তা পেরুই। রাস্তার ওপারে এই এলাকার একটি চমৎকার বইয়ের দোকান। সময় নষ্ট না করে সব কটা পূজো সংখ্যা কিনে ফেলি। বুকের প্রচন্ড ধুকধুকানি নিয়ে তারপর আবার রাস্তা পেরিয়ে আমাদের বহুতলের ফ্ল্যাটে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বইয়ের প্যাকেট ছিঁড়ে ফেলি। তারপর ‘আনন্দমেলাটা’ হাতে তুলে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে যার লেখা প্রথমেই পড়তে শুরু করি- তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ২ বাংলার বিক্রমপুর জেলা যে ক’জন বিশিষ্টজনের জন্ম দিয়ে ধন্য হয়ে আছে তাদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন। কথাটা এই জন্য বলা যে- যারা কেবল হ্যারি পটার পড়েন, যাদের পূজাসংখ্যা আনন্দমেলায় শীর্ষেন্দুর লেখা কিশোর উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য আজও হয়নি, তারা যদি মনে করেন যে সমকালীন বিশ্বে দুনিয়াজোড়া কিশোরকিশোরীদের মন জয় করার ক্ষমতা একমাত্র রাওলিংসই রাখেন- তাদের এখনও অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। আজ যদি সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, তাহমিমা আনাম আর মাসকাওয়াত আহসান মিলে শীর্ষেন্দুর লেখা সব কিশোর উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করে লন্ডন-নিউইয়ক থেকে প্রকাশ করেন -তারপরও শীর্ষেন্দুর নাম কোনও দিনই হ্যারি পটারের লেখিকার সমান হবে না। কেননা তাঁর অধিকাংশ লেখার প্রেক্ষাপটই পশ্চিম বাংলার গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর; সৈয়দ শামসুল হক যাকে যথার্থই বলেন-বিশাল বাংলা। বিশাল বাংলার আমোদ-কুকহ-বিস্ময় কদাপি অন্য ভাষায় অনুবাদ করে বোঝানো সম্ভব নয়। আমরা যখন বলি ‘আম বাগান’; তখন আম বাগানটি কেবল ‘ম্যাঙ্গে গ্র“ভ’ বাদেও অনেক কিছুই বোঝায়। একমাত্র বাঙালি ছাড়া ওই অনেক কিছু অন্যরা বুঝবে না। এ জন্যই বাংলাকে অন্য কারও বোঝার কথা না। ওদের কাছে রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে টেগর। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ মানে- মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে ... ... ... কাজেই, ইংরেজি অনুবাদ সত্ত্বেও শীর্ষেন্দুর কিশোর ক্লাসিকের কারিশমা দুনিয়াজোড়া কিশোরকিশোরীদের বোঝার কথা নয়। অথচ, হ্যারি পটারের প্রেক্ষপট পরিচিত হওয়ায় চিনের কিশোরীরাও তা বোঝে। এ কারণেই, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ ওদের টানার কথা নয়। কাজেই, শীর্ষেন্দু আজও দু বংলাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছেন। ৩ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ট এই লেখকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর; বিক্রমপুরে। অন্য একটি সূত্রমতে শীর্ষেন্দুর জন্ম অবশ্য ময়মনসিংহ। আমাদের দেশে তো লেখকের জীবদ্দশায় লেখকের প্রামাণ্য জীবনী লেখার চল নেই। সে কারণে এমন সব ভুলভ্রান্তি হতেই থাকবে। যা হোক। শীর্ষেন্দুর বাবার ছিল রেলের চাকরি। রেলের চাকরি বদলীর চাকরি। যে কারণে শীর্ষেন্দুর ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্ববাংলায় নানা জায়গায়; আর সেই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর লেখা কিশোর উপন্যাসে। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র পেক্ষপট পশ্চিমবাংলার এক মফঃস্বল শহর হলেও কোথাও যেন ছেলেবেলার পূববাংলা উঁিক দেয় । এভাবেই দুই বাংলা একাকার হয়ে আছে শীর্ষেন্দুর লেখায়। ৪ শীর্ষেন্দু আই এ পাশ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে । ( কুমিল্লার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া কলেজ কি না বলতে পারছি না। কারণ ওই একই, আমাদের দেশে লেখকের জীবদ্দশায় লেখকের প্রামাণ্য জীবনী লেখার চল নেই। ) সেই শৈশব থেকেই বাংলা ভাষাকে বরাবরই ভালোবাসতেন শীর্ষেন্দু। কাজেই, পরিনত বয়েসে আইন কি রসায়ন কি প্রকৌশল বিদ্যায় না-পড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখান থেকেই এম এ করে বেরুলেন যথাসময়ে। অবশ্য তারও বহু আগে থেকেই লেখালেখির সঙ্গে এই আড়ি এই ভাব সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গিসল শীর্ষেন্দুর। ৫ ‘ঘুনপোকা’ শীর্ষেন্দুর প্রথম উপন্যাস। প্রথম লেখাই রাতারাতি হিট। এ রকম সৌভাগ্য ক’জন লেখকের ভাগ্যে জোটে? ঘুনপোকা হিট হওয়ার কারণ আছে। গল্প লেখার সব কায়দায় শীর্ষেন্দুর জানা আছে। তিনি বিলক্ষণ জানেন কী ভাবে গল্প বলতে হয়। এই পৃথিবীতে নানা জাতি, নানা তাদের আচার নীতি প্রথা।একটা ব্যাপারে সবাই অভিন্নহৃদয়। গল্প সবাই শুনতে ভালোবাসে। কাজেই, ভালো গল্প লিখিয়েরা সমাজে জনপ্রিয় হন। শীর্ষেন্দু তাদেরই একজন। ৬. শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে নবীন লেখকদের দুটি বিষয় শেখার আছে বলে মনে করি। ১/ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে-আমি আমার মনের ভাবটা কী ভাবে লিখে প্রকাশ করব সেটাই আমার মূল সমস্যা। লেখার পর পাঠকপ্রতিক্রিয়ার আমার তেমন উৎসাহ নেই। ২/ মনের ভাবটিকে প্রকাশ করার জন্য নিজস্ব এক ভাষার সৃষ্টি। ৭. শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষাটি কী রকম শক্তিশালী ও একই সঙ্গে স্বাদু হতে পারে - এই ‘এই হেমন্তে’ নামে ছোট লেখাটি তারই এক অনন্য উদাহরণ। এই বইটি নির্বাচনের কারণ-নিজের কথা লিখেছেন শীর্ষেন্দু। আর, ছেলেবেলার নানা কথা রয়েছে এতে। ৮. বর্তমানে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত আছেন। Click This Link সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৫৮
false
hm
ঈস্টার দ্বীপ ০৩ ঈস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলি মোয়াই নামে পরিচিত, আর যে বিশাল প্ল্যাটফর্মের ওপর মূর্তিগুলি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বলা হয় আহু। ঈস্টারে প্রায় তিনশো আহু আছে, যার বেশির ভাগই ছোটখাটো আর মূর্তিশূন্য, ১১৩টা আহুতে মূর্তি আছে, যার মধ্যে ২৫টা রীতিমতো বিশাল। ঈস্টার দ্বীপের প্রতিটি অঞ্চলেই এক থেকে পাঁচটা করে বিশাল আহু রয়েছে। প্রায় সবগুলি সমূর্তি আহুই সৈকতসংলগ্ন, প্রতিটি মূর্তির মুখ দ্বীপের দিকে ফেরানো। কোন মূর্তিই সমুদ্রমুখী নয়প্রশ্ন ১। ঈস্টার জুড়ে নির্মিত আহু আহু চতুষ্কোণাকৃতির প্ল্যাটফর্ম, যার চারপাশটা ব্যাসল্ট পাথরের চাঁই দিয়ে ঘেরা, আর মাঝে ভর্তি নুড়ি। কিছু কিছু আহুর (যেমন আহু ভিনাপু) দেয়াল দেখলে ইনকা স্থাপত্যের কথা মনে পড়তে পারে, যা দেখে থর হেয়ারডাল দক্ষিনামেরিকার সাথে ঈস্টারের যোগসূত্র খুঁজেছিলেন। তবে ঈস্টারের আহুর দেয়ালগুলির আস্তর কেবল পাথরের, ভরাট পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি নয়, যেমনটা ইনকা দেয়ালগুলি। ঈস্টারের এই এক একটা দেয়ালের আস্তরের ওজন ১০ টন (ইনকা দেয়ালে এক একটা টুকরোর ওজন আরো বেশি, যেমন সাকসাহুয়ামান দুর্গে ৩৬১ টন পর্যন্ত)। এক একটা আহু গড়ে ১৩ ফিট উচ্চতার, কোন কোন আহু ৫০০ ফিট চওড়া। আহুগুলির ওজন ৩০০ টন থেকে ৯,০০০ টন পর্যন্ত। আহুর পেছনে রয়েছে আরো এক বিচিত্র জিনিস, দেহভস্ম সংরক্ষণাগার, যেখানে হাজার হাজার মানুষের দেহের ভস্ম ও অন্যান্য অংশ রয়েছে। মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রে গোটা পলিনেশিয়ায় ঈস্টারই একমাত্র ব্যতিক্রম, অন্যান্য সব দ্বীপে মৃতদেহ সাধারণত সমাধিস্থ করা হয়। আহু আর মোয়াই, দুই-ই এখন ধূসর, তবে অতীতে আহুগুলি সাদা, হলুদ আর লাল রং দিয়ে সজ্জিত ছিলো। মোয়াইয়ের পাথরগুলি ছিলো হলুদ। ধারণা করা হয়, মোয়াইগুলি পূর্বপুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রত্নতাত্ত্বিক জো অ্যান ভ্যান টিলবার্গ ৮৮৭টি মোয়াই লিপিবদ্ধ করেছেন, যার অর্ধেকই আছে রানো রারাকুর "কারখানায়"। এক একটা আহুতে ১ থেকে ১৫টা করে মোয়াই স্থাপন করা হয়েছে। আহুর ওপর স্থাপিত সব মোয়াই-ই রানো রারাকু জ্বালামুখের খনির পাথর, যাকে বলা হয় টাফ, দিয়ে তৈরি, তবে দ্বীপের অন্যান্য জায়গায় মোট ৫৩টি মোয়াই পাওয়া গেছে, যেগুলো টাফের পরিবর্তে অন্য পাথর (ব্যাসল্ট, লাল স্কোরিয়া, সাদা স্কোরিয়া আর ট্র্যাকাইট) দিয়ে তৈরি। সাধারণ একটা মোয়াইয়ের উচ্চতা গড়ে ৪ মিটার, আর ওজন ১০ টন। স্থাপিত মোয়াইগুলির মধ্যে সবচেয়ে উঁচুটির নাম পারো, উচ্চতা ১০ মিটার, আর ওজন ৭৫ টন। পারোর চেয়ে সামান্য বেঁটে একটি মোয়াই আছে আহু টোঙ্গারিকিতে, যার ওজন ৮৭ টন। আহু হাঙ্গা তে তেঙ্গা-তে পারোর চেয়ে ইঞ্চি কয়েক উঁচু একটি মোয়াইকে বয়ে নিয়ে যেতে পারলেও সেটিকে স্থাপনের সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলো ঈস্টারবাসীরা, যার ফলে সেটি টাল খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো। রানো রারাকু-তে আরো বিশাল সব অসমাপ্ত মোয়াই পড়ে আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উঁচুটি ২৩ মিটার উঁচু আর ২৭০ টন ওজনের। এরিখ ফন দানিকেনের মতো ভিনগ্রহীপন্থীদের কাছে ঈস্টারের এই বিশাল মূর্তিগুলিকে অপার্থিব মনে হয়েছিলো, যে ধারণা সমর্থনের জন্য তাঁরা নানা আজগুবি তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। তবে পলিনেশিয়াতে এমন নির্মাণের আরো প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। অনেকটা আহুর মতোই প্ল্যাটফর্ম ছড়িয়ে আছে পলিনেশিয়ায়, যাদের বলা হয় মারায়ে। পিটকেয়ার্ন দ্বীপে, যেখান থেকে ঈস্টারের আদি বসতিদাররা যাত্রা শুরু করেছিলো বলে অনুমান করা হয়, এমন তিনটি মারায়ে রয়েছে। তবে মারায়েগুলি ব্যবহার করা হতো মন্দিরের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। মার্কেসাস আর অস্ট্রাল দ্বীপপুঞ্জে বড়সড় পাথরের মূর্তি রয়েছে, যেগুলি লাল স্কোরিয়া আর টাফ দিয়ে তৈরি। তাহিতিসহ অন্যান্য দ্বীপে রয়েছে কাঠের মূর্তি। ঈস্টারের মূর্তিনির্মাণ সংস্কৃতি ভুঁইফোঁড় কিছু নয়, পলিনেশিয়ার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা। মূর্তিগুলি ঠিক প্রথম কবে গড়া হলো, তা জানা একটু মুশকিল, কারণ পাথরের রেডিওকার্বন ডেটিং করা যায় না। এ কারণে পরোক্ষ কালনির্ণয় পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে, যেমন আহুতে পাওয়া অঙ্গারের রেডিওকার্বন টেস্ট, অবসিডিয়ান-হাইড্রেশন পদ্ধতিতে কাটা অবসিডিয়ানের কাল নির্ণয়, বাতিল মূর্তির নির্মাণশৈলী (বাতিলগুলিকে প্রাচীনতর ধরা হয়) আর আহুর বিভিন্ন নির্মাণ পর্যায়। তবে একটি পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট, সেটি হচ্ছে সময়ের সাথে মোয়াইগুলির উচ্চতা বেড়েছে (তবে ওজন সবসময় বাড়েনি), আর বিশালতম আহু কয়েক দফায় নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের ভেতর দিয়ে গেছে, সময়ের সাথে আরো বড় হয়েছে। ধরা হয়, ১০০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আহুগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। এ তারিখকে সমর্থন যুগিয়েছে জে. ওয়ারেন বেক এবং তাঁর সহকর্মীদের চালানো একটি পরীক্ষায়, যেটিতে মোয়াইগুলির চোখে ব্যবহৃত প্রবালের আর আহু সাজানোর জন্য ব্যবহৃত শৈবালের কালনির্ণয় করা হয়েছে রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে সরাসরি নির্ণয় করা হয়েছে, আনাকেনা সৈকতে আহু নাউ নাউয়ের প্রথম নির্মাণ শুরু হয়েছে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, আর শেষ দফা শেষ হয়েছে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে। ধারণা করা হয়, শুরুর দিকের আহুগুলিতে কোন মোয়াই ছিলো না, পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে দেখা মারায়ে-র মতো ছিলো সেগুলি। যেসব মোয়াইকে শুরুর দিকের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলি ছিলো ছোটখাটো, গোলগাল আর আরো বেশি মনুষ্যসদৃশ, টাফ ছাড়াও বিভিন্ন আগ্নেয় পাথর দিয়ে সেগুলি তৈরি, আর পরবর্তীতে আহুর পুনর্নির্মাণে সেগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে মশলা হিসেবে। শেষমেশ ঈস্টারবাসীরা রানো রারাকুর টাফ পাথরকেই খোদাইয়ের কাজে বেছে নিয়েছিলো, কারণ এই পাথর খোদাইয়ের জন্যে সবচেয়ে ভালো। প্রচন্ড শক্ত ব্যাসল্টের চেয়ে অনেক সহজে খোদাই করা যায় টাফ, আবার লাল স্কোরিয়ার চেয়ে অনেক বেশি মজবুত। সময়ের সাথে রানো রারাকুর কারখানার মোয়াইগুলি আরো বড় হয়েছে, আরো চতুষ্কোণাকৃতির হয়েছে, আরো বেশি শৈলীযুক্ত হয়েছে সেগুলিতে, আর প্রায় গণহারে নির্মিত হয়েছেঅনেকটা ওবেলিস্কের মেনহির তৈরির মতো। তবে প্রতিটি মূর্তিই দেখতে অন্যগুলির চেয়ে একটু ভিন্ন। সময়ের সাথে মূর্তির আকারবৃদ্ধি থেকে অনুমান করা যায়, এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের মোয়াই নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিলো। পরবর্তীকালের একটি সংযোজন ছিলো পুকাও, লাল পাথরের তৈরি একটি খন্ড, যা মূর্তিগুলির মাথায় স্থাপন করা হতো। পারো-র মাথার পুকাওটির ওজন বারো টন। প্রশ্ন জাগতে পারে, কী করে ঈস্টারবাসীরা ১২ টন ওজনের একটা জিনিস কোন ক্রেন বা যন্ত্রপাতি ছাড়া ১০ মিটার উঁচু একটা মূর্তির মাথায় বসালো? এ প্রশ্নের উত্তরে ভিনগ্রহীদের মারদাঙ্গা প্রযুক্তি এনে হাজির করেছিলেন ফন দানিকেন, তবে উত্তরটা আরো পানসে, মোয়াই আর পুকাও, দু'টোই একসাথে উত্তোলিত। কেন এই গোদা গোদা মূর্তিগুলি বানিয়ে তার মাথায় লাল পাথরের এই পুকাও বসানো হলো? ধারণা করা হয়, এই পুকাওগুলি সর্দারদের মাথায় লাল পালকের উষ্ণীষের প্রতিনিধিত্ব করে। পলিনেশিয়া জুড়েই লাল রঙের বড় কদর, স্প্যানিয়ার্ডরা যখন প্রথম বিভিন্ন ক্যারিবীয় দ্বীপে পা রাখে, তখন দ্বীপবাসী তাদের জাহাজ, তলোয়ার, বন্দুক বা আয়না দেখে ততটা পাত্তা দেয়নি, যতোটা দিয়েছিলো তাদের পরনে লাল কাপড় দেখে। পুকাওগুলি তৈরি হয়েছে লাল স্কোরিয়া পাথর দিয়ে, ঈস্টারে কেবল একটা জায়গাতেই তা পাওয়া যায়, পুনা পাউ নামের এক জ্বালামুখে। সেখানেও অনেক অসমাপ্ত পুকাও পড়ে আছে। মোয়াইগুলির মাথায় পুকাও চাপানোর অন্যতম কারণ হতে পারে, ফুটাঙ্গি দেখানো। কোন গোত্র হয়তো ৯ মিটার উঁচু কোন মোয়াই খাড়া করেছে, তো অন্য কোন গোত্র ১০ মিটার উঁচু একটা মোয়াই এনে তার মাথায় পুকাও চাপিয়ে বলেছে, দ্যাখ ব্যাটারা, পারলে এরচে ভালো কিছু কর! কিন্তু সারা পলিনেশিয়াতেই তো কমবেশি প্ল্যাটফর্ম আর মূর্তি তৈরির চল ছিলো, কেবল ঈস্টার দ্বীপেই এরকম আখাম্বা ইশটাইলে মূর্তি বানানোর হুজুগ উঠেছিলো কেন? কোন দুঃখে তারা এমন খরুচে, কঠিন, জটিল কাজে হাত দিয়েছিলো? জ্যারেড ডায়মন্ড এ প্রশ্নের উত্তরে চারটি সম্ভাব্য যুগপৎ কারণ নির্দেশ করেছেন। খোদাইয়ের জন্য টাফ পাথরের উপযোগিতা। অন্যান্য পাথরের চেয়ে এ পাথর খোদাইয়ের কাজে এতো বেশি সরেস যে যেকোন খোদাইকারী হাতের নাগালে এ পাথর পেলে খোদাইয়ের কাজে লেগে যাবে। পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপগুলির বাসিন্দারা কয়েক দিন সাগরে কাটালেই অন্য কোন দ্বীপে গিয়ে হাজির হতে পারে, তাই তারা তাদের সময় আর শক্তি ব্যয় করেছে সেসব প্রতিবেশী দ্বীপে বাণিজ্য, হানাদারি, অভিযান, বসতিস্থাপন কিংবা দ্বীপান্তরে। পক্ষান্তরে, ঈস্টারের বাসিন্দারা এসব করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলো, কারণ বাইরের দুনিয়া থেকে ঈস্টার একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিলো। পলিনেশিয়ার কোন দ্বীপের সর্দার যখন ফুটাঙ্গি দেখানোর জন্য তার পড়শীর ওপর হামলা করে, সেখানে ঈস্টার দ্বীপের সর্দার তেমন কিছু করতে না পেরে আরো বড় একটা মূর্তি খাড়া করে। পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপ ঈস্টারের মতো সমতল বা মৃদুবন্ধুর নয়, রীতিমতো গভীর খাদ আর খাড়া পাহাড় দিয়ে ভাগ করা। যে কারণে বিভিন্ন দ্বীপে প্রায়শই সামাজিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি, একেক উপত্যকা একেক গোত্রের অদীনে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছে, সম্পদের বন্টনও তাই ছিলো অনেকখানি বিষম। তুলনামূলকভাবে ঈস্টারে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো এর সমতল ভূপ্রকৃতির সুবাদে, যার ফলে সব অঞ্চলের গোত্রগুলিই রানো রারাকুর টসটসে টাফ পাথরের নাগাল পেয়েছে মূর্তি খোদাইয়ের জন্য। সম্পদের ওপর অবাধ (?) অধিকারের কারণেই হয়তো মূর্তি নির্মাণ ব্যাপারটি প্রতিযোগিতায় রূপ নিতে পেরেছেমন্তব্য ১। রাজনৈতিক কোন্দল থাকলে কেবল টোঙ্গারিকি অঞ্চল, যে অঞ্চলে কি না রানো রারাকু অবস্থিত, হয়তো মূর্তি বানানোর ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতো, কিংবা অন্য অঞ্চল হয়তো "পাড়ায় আহিস খালি" গোছের হুমকি দিয়ে তাদের ওপর দিয়ে মূর্তি পরিবহনে বাধা দিতো। শেষ কারণটা হচ্ছে, মূর্তি গড়ে পোষাতো, ব্যাপারটা আদপেই সম্ভব ছিলো, কারণ মূর্তি বানানোর কাজে নিয়োজিত লোকদের উঁচু ভূমির পাথুরে বাগানের ফসল দিয়ে খাওয়ানো যেতো। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ঈস্টারের আদিবাসীরা কোন যন্ত্রপাতি ছাড়া কী করে মূর্তিগুলি খাড়া করলো? ছবিসূত্র। প্রশ্ন ১ কেন? মন্তব্য ১ পূজার সময় পশ্চিমবাংলার টিভি চ্যানেলে উপভোগ করার মতো একটা জিনিস হচ্ছে দশভূজার হরেক রকমের মূর্তি। পাড়ায় পাড়ায় পূজার প্যান্ডেল, কোন পাড়ায় কত বেশি জৌলুসময় মূর্তি গড়ে তোলা যায় তার একটা বাহারী প্রতিযোগিতা। সুপুরির দুর্গা, ঝিনুকের দুর্গা, পুঁতির দুর্গা, ইত্যাদি হরেক রকম দুর্গার রীতিমতো প্রদর্শনী হয় তখন। পশ্চিমবাংলার মূর্তির কারিগরেরা যেখানে প্রতিযোগিতায় একজন আরেকজনকে টেক্কা দেবার জন্যে (আসলেই এমন প্রতিযোগিতা হয় নিশ্চয়ই) আশ্রয় নিয়েছেন শৈলীবোধের, দর্শনইন্দ্রিয়কে মোহিত করার জন্যে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন উপকরণ, কাহিনী, ভঙ্গি। কিন্তু ঈস্টারদ্বীপের মূর্তির কারিগরদের ওপর হয়তো সর্দারদের নন্দনবোধই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। "পাশের ওদেরটার চে বড় বানাবি" গোছের হুকুমই হয়তো চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকতে পারে বেচারাদের ওপর। ফলে, প্রতিযোগিতাটি মানদন্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে আকারকে।
false
hm
পাঠ প্রতিক্রিয়া: "যখন ক্রীতদাস: স্মৃতি '৭১" আশা মানুষকে শুধু সামাজিক সংকোচেই ফেলে না, তার আত্মাকে সঙ্কুচিতও করে। স্বাভাবিক একটি দিনে মানুষ যতোটা ঋজু, যতোটা প্রসারিত, যতোটা বলিষ্ঠ ও আকাশপ্লাবী, বিপন্ন দিনে আশার ভারে সে ততোটাই ধ্বসে পড়ে ভেতরের দিকে, ততোটাই কুঁচকে যায়, ততোই দুর্বল ও আড়ালকাতর হয়ে ওঠে। বিপদ কেটে গেলে সেই আশাঘটিত অন্তঃস্ফোরণের স্মৃতি মানুষের মনে এক অবাঞ্ছিত ভার হয়ে থাকে। কেউ সে স্মৃতি এড়িয়ে চলেন, কেউ অস্বীকার করেন, কেউ বিকৃতি ঘটান, কেউ মুখোমুখি হন। শেষোক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে সাহস প্রয়োজন। নাজিম মাহমুদের এই বইটিতে সে সাহসের সরল ও অকপট প্রকাশ আছে। প্রচ্ছদ আমরা প্রতিদিনের জীবনে যাদের সান্নিধ্যে আসি, তাদের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই হয়তো প্রকৃত বীর। আমাদের বাকিরা হয়তো ভীতু সম্প্রদায়ের লোক, কিন্তু এ সত্যটির মুখোমুখি যাতে হতে না হয়, সে চেষ্টায় আমরা সবসময়ই থাকি। যেমন বলশালী কোনো বেয়াদপ পার্শ্ববর্তী দুর্বলের ওপর চড়াও হলে আমরা সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিই, যাতে আপন গর্দানটিকে বিপন্ন করে সাহসের অনুপস্থিতির কাঁটাটি আমাদের অন্তরে এসে না বেঁধে। এই ভীরুতা আমাদের দিনান্তের আয়েশ নিশ্চিত করে, নিশ্চিন্তে নিজের বুদবুদের ভেতরে ফিরে আমরা আপন ব্যাঘ্রহীন কোটরের শেয়াল রাজার মুকুটের ভার মাথায় নিতে পারি। এই ভীরুতা আমাদের আপন বাগানের উৎকলিত পুষ্প। কিন্তু যদি দিনের পর দিন এই ভীরুতায় আমাদের বাধ্য করা হয়, তখন আমাদের আচরণ কেমন হবে? সাহসী হতে না চাওয়া, আর সাহসী হতে না পারার ভেতরে এক ভীষণ দুর্গম প্রশ্নসংকুল ব্যবধান রয়েছে। আমাদের ভেতরে যারা শিক্ষিত কিন্তু পেলব, সামাজিক কিন্তু দায়ভারাক্রান্ত, ইচ্ছুক কিন্তু অসমর্থ, তারা এই বাধ্যতার মূল্য কী করে পরিশোধ করেন? "যখন ক্রীতদাস: স্মৃতি ৭১" বইটি নাজিম মাহমুদ এই প্রশ্নের উত্তরেই যেন সাজিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বশংবদদের সহিংস নিয়ন্ত্রণে সেনানিবাসে পরিণত হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত যাপিত সঙ্কুচিত প্রায়বন্দী জীবনের স্মৃতিচারণ উঠে এসেছে বইটির বেশিরভাগ জুড়ে। সে জীবন যেন স্বাভাবিক মনুষ্যত্বের একতলা ছেড়ে বন্দী ও মনুষ্যত্ব-অস্বীকৃত শত্রুর পরিচয়ের পাতালঘরে আশ্রিত, আর আশার দুর্দম ভারে সঙ্কুচিত। লেখকের কলম যাত্রা শুরু করেছে একাত্তরে বহু বুদ্ধিজীবীর হত্যাকাণ্ডের পেছনে সক্রিয়ভাবে কলকাঠি নাড়া দালাল সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের সান্নিধ্যের স্মৃতিচারণ দিয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য হোসায়েনের রাতারাতি বদলে যাওয়া চরিত্রের ভেতর থেকেই যেন একাত্তরের দেশের রাতারাতি পাল্টে যাওয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। যে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হচ্ছেন, রাতারাতি তিনিই পরিণত হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী সেনাকর্তা কর্নেল তাজের সুবোধ অনুচরে, পাক সেনাদের কাছে তালিকা করে চিনিয়ে দিচ্ছেন, কে ভাই কে দুশমন। ঢাকায় পঁচিশে মার্চের পৈশাচিক গণহত্যা শুরুর পর প্রায় হপ্তা তিনেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিকামী বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। মধ্য এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি সেনারা সেখানে পাকাপাকিভাবে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে। সাময়িক পলায়নের পর উপাচার্য হোসায়েনের রেডিওবার্তায় বিভ্রান্ত হয়েই লেখক সপরিবারে ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং বরণ করেন এক প্রায়বন্দীর জীবন। এক সহকর্মীর মুখে তিনি সে জীবনকে প্রশ্নের আকারে চিনতে শেখেন, এ জীবন মৃত্যুর চেয়েও নিকৃষ্ট। বাঙালি হয়ে পাকিসেনা শাসিত ও পরিবেষ্টিত সেই জীবনের বর্ণনায় এমন অদ্ভুত সব উপাখ্যান উঠে এসেছে, যার বিশদ বর্ণনায় গেলে হয়তো লেখকের কলম খানিকটা সরসতা হারাতো। হয়তো সে কথা মাথায় রেখেই বেশ কিছু প্রসঙ্গে তাঁর কলম নীরব ছিলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন বাঙালি সক্রিয়ভাবে পাকি সেনাদের সহযোগিতা করেছেন, নামগুলো সব আমরা এ বইতে পাই না। হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী জীবন লেখককে এই পরোক্ষ আপোষে প্ররোচিত করেছে। কিন্তু এই অনুল্লেখ বইটিকে খুব বেশি দুর্বল করেনি। জীবনে গল্পের পরিবর্তে সত্যই আগন্তুক হিসেবে বারবার আমাদের সামনে আসে, বইটিতেও সত্য ঘটনাগুলো গল্পের চেয়ে বেশি নাড়া দিয়ে যায়। শিক্ষকতা করতে এসে যে মানুষগুলো পাকি সেনাদের সামনে কুঁচকে ছোটো হয়ে থাকেন, এক একটি অদ্ভুত ঘটনার ভেতরে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষণ আবিষ্কার করতে থাকেন, দালাল সহকর্মীর কাছ থেকে নিজের আশাকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে আবার প্রাণরক্ষার তাগিদে তার দুয়ারেই উপস্থিত হন আশার ভেলায় ভেসে, এমনি শ্বাসরূদ্ধকর সব উপাখ্যান বর্ণিত বইটির পাতায় পাতায়। সে সব উপাখ্যান পড়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি, চার দশক পরও আমাদের সমাজে একাত্তর অনুরণিত হয়ে চলছে প্রায় একই ছন্দে। যেমন, যে ভাষায় দৈনিক প্রথম আলো জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের "দুর্বৃত্ত" লিখে আবছা করে দেয়, সেই একই ভাষায় একাত্তরের নভেম্বরে রোকেয়া হলে গণধর্ষণ চালানো পাকিস্তানি সেনাদের সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসা উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বলেছিলেন, সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীরা রোকেয়া হলে প্রবেশ করেছিলো। কী অদ্ভুত সাদৃশ্য উভয় ঘটনার দুষ্কৃতী ও তাদের দোসরদের মধ্যে! একাত্তরের স্মৃতিচারণ পাঠ আমাদের জন্য কেন জরুরি? যে কারণে আয়নায় নিজের ছায়া দেখা জরুরি। নাজিম মাহমুদের একাত্তরের জীবন আমরা বর্তমানে যে যাপন করছি না, সে কথাই কি কেউ খুব জোর দিয়ে বলতে পারি? একবার আপনারে চিনতে পারলে অচেনারে চেনার কাজটা সহজ হয়ে যায়। আর নিজেকে চেনার আয়না অপরের জীবনে খণ্ডিত হয়ে ছড়িয়ে থাকে। সে আয়না সংগ্রহের জন্য গ্রন্থপাঠের চেয়ে উত্তম সুযোগ আর হয় না। বইটির কলেবর স্ফীত না হলেও তার স্বাস্থ্য অটুট, বাহুল্য নেই বললেই চলে, এক বসায় পড়ে শেষ করার মতো। নাজিম মাহমুদ নিজের সেই বন্দীরূপকে ক্রীতদাস হিসেবে পাঠকের কাছে পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে, একাত্তরের নাজিম মাহমুদ এক আশাখনির শ্রমিক। দুর্গম সে খনিতে তিনি প্রতিদিন পর্বত চূর্ণ করছেন কণিকারূপী আশার সন্ধানে। সে শ্রম তাঁকে প্রতিনিয়ত গ্লানি আর শ্রান্তির ভারে ন্যুব্জ করলেও পরাজিত করতে পারেনি। একাত্তরকে আমি যোদ্ধার চোখে দেখেছি, পলাতকের চোখে দেখেছি, দালালের চোখে দেখেছি, কিন্তু আশার ভারবাহী অগণিত প্রায়বন্দী মানুষের চোখে দেখার সুযোগ খুব বেশি হয়নি। এ বইটি সে সুযোগ করে দিয়েছে। সকলকে বইটি সংগ্রহ করে নিজে পড়তে ও অপরকে পড়াতে অনুরোধ করি। বইটি যারা পড়বেন, একটু কষ্ট করে গুডরিডস.কমে বইটির ভুক্তিতে নিজের পাঠ প্রতিক্রিয়া আর রেটিং যোগ করে দেবেন।
false
ij
ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ _ একজন ‘আসাফির বিলা আজনিহা’ বা ডানাশূন্য চড়ুই ___ মাহমুদ দারবিশ। একজন কবি। একজন ফিলিস্তিনি কবি। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ । ফিলিস্তিনের এই জাতীয় কবির অধিকাংশ কবিতায় এক মর্মান্তিক আর্তনাদ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। সে আর্তনাদ কবির হারানো মাতৃভূমিটি জন্য। গত শতকের চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কবির মাতৃভূমিটি দখলদার বেজন্মাদের দ্বারা অধিকৃত হয়ে গেছে এবং অত্যন্ত অমানবিক পদ্ধতিতে উৎখাত করা হয়েছে হাজার বছর ধরে কবির মাতৃভূমিতে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি জনগনকে। আমৃত্যু এই মর্মান্তিক ঘটনাটির জন্য কবির দুঃখবোধ ছিল আতীব্র। গভীর । আসুন আমরা কবির দুঃখে শামিল হই। অতঃপর বলি যে, কবি মাহমুদ দারবিশ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। গত বছর, অর্থাৎ, ২০০৮ সালের ৯ আগাষ্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। হার্টে সমস্যা ছিল কবির। ১৯৮৪ সালে একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। ‘৯৮ সালেও একবার অপারেশন হয়েছিল। যাহোক। জীবদ্দশায় দারবিশ হয়ে উঠেছিলেন ফিলিস্তিনি জনগনের একান্ত নিঃশ্বাস, আশাআকাঙ্খার প্রতীক। কারণ, অনুভব করে সবাই কিন্তু সে অনুভবের শব্দরুপ দিতে সক্ষম মাত্র অল্প ক’জন। বলপূর্বক নির্বাসন ও ফেলে আসা জন্মভূমির প্রতি আতীব্র আকর্ষনের সাক্ষী দারবিশ স্বয়ং। পরিবারসহ তিনিও উৎখাত হয়েছিলেন, যখন জিয়নবাদী বেজন্মারা ফিলিস্তিনের অন্তস্থলে তাদের কালো রোমশ থাবা বাড়াল । কবি অবশ্য পরে তাঁর জন্মভিটেয় ফিরে এসেছিলেন । জন্মভূমিটি ততদিনে আগ্রাসী জিয়নবাদীদের দ্বারা অধিকৃত। লাঞ্ছিত। এসব মানসিক পীড়ন, মনোকষ্ট ও নানাবিধ টানাপোড়েনের ফলে দারবিশের পক্ষে কবি হয়ে ওঠাই ছিল অনিবার্য। মানসিক উদ্বাস্তু দারবিশ হয়ে উঠেছিলেন ‘আসাফির বিলা আজনিহা’ বা ডানাশূন্য চড়ুই ... ফিলিস্তিনের গালিলি প্রদেশ । এর পশ্চিমে আল বিরওয়া নামে একটি গ্রাম; সে গ্রামেই ১৩ মার্চ ১৯৪১ সালে মাহমুদ দারবিশ এর জন্ম। বাবার নাম সালিম দারবিশ। ছিলেন মুসলিম ভূস্বামী। মুসলিম বলার কারণ? তৎকালে ফিলিস্তিনের পশ্চিম গালিলি প্রদেশে খ্রিস্টানসহ অন্য অনেক জাতও বাস করত। কবির মায়ের নাম হওরিয়া। কবির মায়ের নাকি তেমন শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। পিতামহের কাছে হাতেখড়ি বালক দারবিশ এর । সে কথা ‘আইডেন্টটিটি কার্ড’ নামে বিশ্ববিখ্যাত কবিতা পাঠে জানা যায়। আমার পিতামহ ছিলেন চাষী, নীল রক্তের উচ্চবংশের নন। বই পড়তে শেখার আগেই যিনি আমাকে সূর্যের অহংকার শিক্ষা দিয়েছিলেন। বেজন্মাদের রাষ্ট্রটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রোথিত হলে দারবিশ পরিবারটি চলে আসে লেবানন । ১ বছর পর আবার ফিলিস্তিনের আক্কায় চলে আসে। দারবিশ পরিবার ফিরে আসার কারণ কি? লেবানন তো মুসলিম অধূষিত রাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞেস করুন। ওরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। হিন্দু অধূষ্যিত পশ্চিমবাংলা ১ কোটি বাঙালির আশ্রয় দিয়েছিল ১৯৭১ এ যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম। রোহিঙ্গা মুসলিমদের আমরা বাংলাদেশি মুসলিমরা মনে করি দস্যু! তাহলে ধর্মের চেয়ে কি জাত বড়? এই প্রশ্নটি নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবা যায়। আক্কা জায়গাটি পূর্বে ফিলিস্তিনের অর্ন্তভূক্ত হলেও বর্তমানে উত্তর ইজরাইলে। জায়গাটির অবস্থান পশ্চিম গালিলি প্রদেশে। ওখানকারই আল বিরওয়া নামে একটি গ্রামে জন্মেছিলেন দারবিশ। এখানকারই একটি জায়গার নাম দেইর আল আসাদ। সেখানেই সেটল করে দারবিশ পরিবার। হাই স্কুলে ভরতি হয় বালক। পিতামহ শেখান সূর্যের অহঙ্কার। দিন যায়। ফিলিস্তিনের আদিবাসীদের ওপর ভূঁইফোড় ইহুদিদের লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করে কিশোর। কিশোরের কবিতায় সেসব উঠে আসে। কিশোরের বয়স এখন উনিশ। হাইফায় চলে যায় সে। তো, হাইফা কোথায়? উত্তর ইজরাইলের সর্ববৃহৎ নগর হাইফা। নগরটিকে ইজরাইলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বন্দরনগীরও বলা চলে। যা হোক। কবিতা লেখা চলছিল। ‘ডানাশূন্য চড়ুই’ (আসাফির বিলা আজনিহা) কাব্যগ্রন্থটি ছেপে বার করল তরুণ কবি। ১৯৭০। ইজরাইল ছাড়লেন দারবিশ। গন্তব্য সোভিয়েত ইউনিয়ন। (ইস্, কতদিন পরে লিখলাম শব্দ দুটো। সোভিয়েত ইউনিয়ন। এককালে মোহজাল ছড়াত শব্দ দুটো!) বছর খানেক মস্কো ইউনিভাসিটিতে পড়াশোনা করলেন। (সাবজেক্ট জানতে পারিনি।) ভাল লাগছিল না মস্কোয়। একাকীত্ব আর বরফ। মন পড়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যে। লেবাননের উদ্দেশে উড়োজাহাজে উঠলেন। আশ্চর্য় এক অভিজ্ঞতা হল প্লেনে। একজন নাইজিরিয় যাত্রীর মুখে শুনলেন শেখ মুজিব এর কথা। তাঁর অনবদ্য নেতৃত্বে বাঙালিরা নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছেন। সে কাহিনী শুনতে শুনতে দারবিশের চোখ জলে ভরে ওঠে । আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপঞ্জি সে জানত। বাঙালি এই রাজনীতিবিদকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে দারবিশ। সব সময় মুজিব-এর একটা ছবি কাছে রাখে। মাঝে মাঝে বার করে দেখে। প্রেরণা পায়। বাঙালিরা পারলে আমরা পারব না কেন! প্লেনের চেয়ারে বসে এক সময় ঘুম পায়। ঘুমিয়ে পড়ল দারবিশ। স্বপ্নে মুজিব এলেন। বললেন, ওহে, দারবিশ । আমি নিহত হব দেখো । কেন! দারবিশ চমকে ওঠে। আপনি নিহত হবেন কেন? আমি সময় নিয়ে খেলতে জানি। যারা সময় নিয়ে খেলতে জানে তারা শেষ পর্যন্ত নিহত হয়। মুজিব বললেন। ওহ! গম্ভীর কন্ঠে মুজিব বললেন, দারবিশ। বলুন। বাঁচো কি মর-ঐতিহাসি দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না। এ মহাকালের নির্দেশ। মনে রাখবা, ঈশ্বরের কাছে না, তুমি তোমার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তরুণ কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লেবানন থেকে মিশরে যায় দারবিশ। ওখানে ছিলেন ইয়াসের আরাফাত। তিনি তরুণ কবিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তোমরা ভিতরে আগুন আছে দারবিশ। তোমাকে আমরা চাই। ঐতিহাসি দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না। দারবিশ পি এল ও তো যোগ দিতে সম্মত হলেন। নতুন কি লিখেছ? পড়। ইয়াসের আরাফাত বললেন। আমার নতুন কবিতার নাম ‘৪৮ নং শিকার’। দারবিশ বলল। পড়। একটি পাথরের ওপর মরে পড়েছিল সে । তারা ওর বুকে পেয়েছিল চাঁদ ও লন্ঠন। ক’টা মুদ্রা তারা পেয়েছিল ওর পকেটে । দিশলাই ও ট্রাভেল পারমিট। ওকে চুমু খেল ওর মা তারপর বছরখানেক কাঁদল। কাঁটা বিধেঁছিল ওর চোখে কালো কাঁটা। ওর ভাইটা বেড়ে উঠেছিল কাজের খোঁজে গিয়েছিল শহরে। তাকেও পাঠানো হয়েছিল কারাগারে । কেননা ওর ট্যাভেল পারমিট ছিল না। ও বহন করছিল ডাস্টবিন পরিত্যক্ত বাক্স বহন করছিল রাস্তায় হে আমার মাতৃভূমির সন্তানেরা এভাবেই মরে গিয়েছিল চাঁদ। হু হু করে কেঁদে ফেললেন ইয়াসের আরাফাত। তরুণ কবিটি হোটেল কক্ষের বাইরে চলে আসে। সময়টা ১৯৭৩। মায়ের মুখ কতদিন দেখি না। ইজরাইল রওনা হল দারবিশ। জন্মস্থান তো ওখানেই। ইজরাইলি কর্তৃপক্ষ তরুণ কবিকে পশ্চিম গালিলি প্রদেশে প্রবেশ করতে দেয় নাই। অবশ্য ১৯৯৫ সালে রামাল্লায় সেটল করার অনুমতি পান কবি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি ফিলিস্তিনি নগর রামাল্লা । রামাল্লায় এসে দারবিশের ভালো লাগল না। নিজেকে মনে হল নির্বাসিত । এখানকার কোনও কিছুই যেন পশ্চিম গালিলি প্রদেশের সেই আল বিরওয়া গ্রামে মতো নয়। দারবিশের অনুভূতি উপলব্ধি করতে ‘আমি ওখান থেকে এসেছি’ কবিতাটি পাঠ করা যাক। আমি ওখান থেকে এসেছি এবং আমার আছে স্মৃতি জন্মেছি, মরণশীলেরা যেভাবে জন্মায়, আমার মা আছে আর আছে অনেকগুলি জানালার ঘর ভাই আছে আমার, আছে বন্ধু, আর আছে শীতল জানালাসহ কারাকক্ষ। আমার আছে ঢেউ, যে ঢেউ সমুদ্রচিল দ্বারা লাঞ্ছিত, আমার রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, আর আছে অতিরিক্ত একটি ঘাস। আমার আছে চাঁদ, যে চাঁদ শব্দের কিনার থেকে দূরে, আর অনেক পাখি, আর অবিনশ্বর জলপাই গাছ। তরবারি সক্রিয় হওয়ার পূর্বেই এ ভূখন্ডে হেঁটেছি আমি । আমি ওখান থেকে এসেছি। আমি আকাশের মায়ের কাছে আবৃত্তি করি আকাশ যখন আকাশ তার মায়ের জন্য কাঁদে। আর আমি কাঁদি ফিরতি মেঘের জন্য আমার উপলব্ধির তরে। আমি শিখেছি রক্তের দরবারে কথারা প্রশংসার যোগ্য আমি তাই নিয়ম ভাঙতে পারি। প্রতিটি শব্দই আমি শিখেছি আর সেসব ভেঙে শিখেছি একটি শব্দ বানাতে: জন্মভূমি ... দারবিশ লিখতেন ধ্রুপদী আরবিতে। প্রতিবাদসরূপ সম্ভবত, কিংবা ঐতিহ্যের প্রতি প্রেম। দারবিশের কবিতায় কয়েক জন আরবি কবি বাদেও ফরাসি কবি র‌্যঁবো এবং মার্কিন কবি গিনসবার্গ এর প্রভাব লক্ষনীয়। সেকথা স্বীকারও করেছেন দারবিশ। দারবিশ এর জীবনে আরেকজন প্রভাব বিস্তারকারী কবি হলেন ইয়েহুদা আমিচাই। ইনি একজন হিব্রু ভাষার কবি । দারবিশ লিখেছেন, তাঁর (ইয়েহুদা আমিচাই) কবিতা আমার জন্য চ্যালেঞ্জসরূপ । কেন? বিকজ উই রাইট অ্যাবাউট দ্যা সেইম প্লেস। দারবিশের এই কথাটা ভাবার মতো। ঢাকার ক’জন পড়য়ার মুখে আমি অনেক আগেই ইহুদি গল্পকার-ঔপন্যাসিক আমোস ওজ এবং কবি ইয়েহুদা আমিচাইয়ের নাম শুনেছি। একটা ওয়েবসাইটে ইয়েহুদা আমিচাই এর এই কবিতাখানি পেলাম। যদি তোমায় ভুলে যাই জেরুজালেম তাহলে আমার অধিকারও তুমি ভুলে যেও। আমার অধিকারও ভুলে যেও আর আমার চলে যাওয়া মনে রেখ। আমার চলে যাওয়া মনে রেখ আর তোমার দান ভুলে যেও আর প্রধান ফটকের কাছে তোমার মুখটি খুলে রেখ। জেরুজালেমকে আমি মনে রাখব আর ভুলে যাব যাবতীয় অরণ্যবন, আর আমার প্রেম মনে রাখবে তোমায় ওর চুল খুলবে, বন্ধ করবে আমার জানালা ভুলে যাবে আমার অধিকার ভুলে যাবে আমার চলে যাওয়া। কাজেই ইয়েহুদা আমিচাই সর্ম্পকে দারবিশের কথাটি (উই রাইট অ্যাবাউট দ্যা সেইম প্লেস) আমাদের ভাবিয়ে তোলে । আরেকজন কবির গভীর প্রভাব ছিল দারবিশের ওপর। ইনি হলেন ইরাকি কবি বদর শাকির আল সাঈয়াব। এঁর “সং ইন অগাস্ট” কবিতাটি আমার সংগ্রহে আছে। “সং ইন অগাস্ট” কবিতায় ব্যবহৃত ‘তামমুজ’ শব্দটির ব্যাখ্যা আবশ্যক, নৈলে কবিতাখানি দুর্বোধ্য ঠেকবে। তামমুজ ছিলেন প্রাচীন ব্যাবিলনের কৃষিদেবতা। এবার ইরাকি কবি বদর শাকির আল সাঈয়াব এর “সং ইন অগাস্ট” কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন পাঠ করা যাক। দিগন্তরেখায় মরে যাচ্ছে তামমুজ । তার রক্ত মিশেছে গোধূলির রঙে আবাছা গুহায়। অন্ধকার এক কালো অ্যাম্বুলেন্স। রাত্রি, একঝাঁক নারী। কাজল, কালো পোশাক। রাত্রি, এক বিশাল তাঁবু। রাত্রি, একটি অবরুদ্ধ দিন। ইরাকি কবি বদর শাকির আল সাঈয়াব এর ক্ষমতা এই ৮ লাইনেই প্রকাশ পেয়েছে। এবং শেষ লাইনটি (রাত্রি, একটি অবরুদ্ধ দিন ... ) লক্ষ্যনীয়। শাকির আল সাঈয়াব প্রভাবিত করেছেন দারবিশকে। স্বাভাবিক। দারবিশ দু-বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন । প্রথম স্ত্রী রানা কাব্বানি ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। ২য় স্ত্রী ছিলেন একজন মিশরিয় অনুবাদক। হায়াত হেনি। কোনও বিয়েই অবশ্যি টেকেনি। অধিকৃত মাতৃভূমির জন্য অত্যধিক উদ্বেগ কি কবির বৈবাহিক জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল? ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ঠেলে দেওয়ার আগে এসব বিবেচনায় আনেনি সংকীর্ণদৃষ্টির প্রতারক ইউরোপীয়গন? সন্তানাদি ছিল না দারবিশ এর। এ তথ্য আরও সূক্ষ্ম কিছুর ইঙ্গিত দেয়। সব মিলিয়ে দারবিশ এর কবিতার বই তিরিশ। গদ্যের আটটি। কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দারবিশ এর কাব্যসমগ্রর নাম, ‘জলপাই পাতা।’ এখানেই গ্রথিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে লিখিত বিশ্ববিখ্যাত কবিতা, ‘আইডেন্টটিটি কার্ড’। লিখে রাখ! আমি একজন আরব, আর আমার আইডেন্টটিটি কার্ড নম্বর পঞ্চান্ন হাজার, আর আমি আট সন্তানের পিতা আর আগামী গ্রীষ্মের পর নয় নম্বরটি আসছে । তুমি কি রেগে যাবে? পুরো কবিতাটি এখানে দারবিশ জীবনভর ছিলেন এক ডানাশূন্য চড়–ই বা আসাফির বিলা আজনিহা। এ তাঁর ব্যাক্তিগত অনুভূতি। তথাপি বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য ফিলিস্তিনি তরুণদের যুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা । ‘আইডেন্টটিটি কার্ড’ কবিতায় লিখেছেন, তবে যদি আমি ক্ষুধার্ত হই আমি জবরদখলকারির মাংস খাব কাজেই সাবধান আমার ক্রোধ ও ক্ষুধা সর্ম্পকে সচেতন হও। কেননা, আমরা জানি কোনওরকম দয়ামায় না দেখিয়ে দৈত্যকে বধ করতেই হয়। একাত্তরে বাঙালিরা যেরকম পশ্চিমা পাক-দৈত্য বধ করেছিল। বিভেদকামী ইউরোপীয় নেতৃবর্গের প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম রাষ্ট ‘ইজরাইল’ আরব-রক্ত-পিপাসু দৈত্য ছাড়া আর কিছুই না! যদিও মানবতাবাদী দারবিশ বারবার বলতেন, আমি ইজরাইলপ্রেমিক নই বটে, তবে আমি ইহুদিদের ঘৃনা করি না। কেবলমাত্র একজন সৎ কবির পক্ষেই এরকম করে বলা সম্ভব! উৎসর্গ : মাঠশালা। একজন দারবিশ-ভক্ত। সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ৭:২৯
false
ij
সোলন_ এথেনিয় গনতন্ত্রের জনক। সোলন নাকি একবার বলেছিলেন: “কোনও জীবিত মানুষকেই সুখি বলো না।” কে সোলন? সোলন ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন আইনপ্রনেতা। কবিতাও লিখতেন। সোলনের সময়কাল: খ্রিস্টপূর্ব ৬৩৮ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৮। ওই সময়কালকে বলা হয় গ্রিসের ইতিহাসের আর্কাইক যুগ। ওই আর্কাইক যুগের এথেন্সের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও নৈতিক অধপতনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছিলেন সোলন। এ কারণে,এথেন্সের গনতন্ত্রের জনক তাঁকেই বলা হয়। ষষ্ট শতকের গ্রিস সম্বন্ধে ইউরোপীয় পন্ডিতদের জ্ঞান সীমিত বলেই সোলন সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানও সীমিত। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে কবিতা লেখার পাশাপাশি যুবা বয়েসে যথেস্ট ভ্রমন করেছিলেন সোলন। অন্তত সোলন যে লিডিয়া রাজ্যে গিয়েছিলেন সেরকম প্রমাণ আছে। তো, কোথায় ছিল লিডিয়া? বর্তমানে যে অঞ্চলটি তুরস্ক বা এশিয়া মাইনর- প্রাচীন লিডিয় রাজ্যটি ছিল সেখানেই। ক্রোসাস নামে এক অত্যন্ত ধনশালী সম্রাট শাসন করতেন রাজ্যটি। ক্রোসাস-এর ধনসম্পদের পরিমান এতই বেশি ছিল যে তা রীতিমতো প্রবাদে পরিনত হয়েছিল। তো, পারস্য রাজ্যটি ছিল লিডিয়ার দক্ষিণ-পুবে। সেই পারস্যের সম্রাট সাইরাস আক্রমন করে বসলেন লিডিয়া। যুদ্ধে ক্রোসাস পরাজিত হলেন। হওয়ারই কথা। ধনসম্পদ নিয়ে সুখভোগে ডুবে ছিলেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কথা খেয়াল করেন নি,খেয়াল করেন নি পারস্যের উত্থানের কথা। তো, সাইরাসের সৈন্যরা তাকে বন্দি করল। পরিবারসমেত ক্রোসাসকে পুড়িয়ে মারার জন্য শুকনো কাঠের স্তুপ জড়ো করল। সে কালের নিষ্ঠুরতা তেমনই বিভৎস ছিল! আগুন জ্বলে উঠেছে। ক্রোসাস আর্তনাদ করে উঠলেন, কোনও জীবিত ব্যাক্তিকেই সুখি বল না। সাইরাস কাছেই ছিলেন। কথাটা সম্ভবত সাইরাসের কানে গিয়েছিল। তিনি হাত তুলে সৈন্যদের নিরস্ত করলেন। সৈন্যরা জ্বলে-ওঠা আগুন নিভিয়ে দিল। ক্রোসাসকে কাছে আসার নির্দেশ দিলেন সাইরাস। ক্রোসাস কাছে এলেন। সাইরাস বললেন, আপনি তখন কি বলছিলেন? ক্রোসাস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি আর বলব। আমার এমনই পোড়া কপাল। ধনসম্পদ কত সুখিই না ছিলাম, এখন পুড়ে মরতে হবে। সে তো বুঝলাম। কিন্তু আপনি তখন কি বলছিলেন? সাইরাস বিরক্ত হয়ে বললেন। ক্রোসান বলল, বলছিলাম কোনও জীবিত ব্যাক্তিকেই সুখি বলো না। কেন? সাইরাস বিস্মিত। ক্রোসাস তখন বলল, অনেক অনেক দিন আগের কথা। এথেন্স নগর থেকে সোলন নামে একজন যুবক এসেছিল এই লিডিয়া রাজ্যে। তার আগে নানা রাজ্য ঘুরেছিল সোলন। মিশরে গিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে আমার এত ধনসম্পদ দেখছ, এমনটা আর কোথাও দেখেছ? সোলন বলল, না। আমি তখন বললাম, আমার মতো সুখি ব্যাক্তি সে আর কোথাও দেখেছে কি না।তখন সোলন বলল, একমাত্র মৃতরাই সুখি। কোনও জীবিত মানুষকে সুখি বলা ঠিক হবে না। সোলনের কথাই ঠিক। ধনসম্পদ কত সুখিই না ছিলাম, এখন পুড়ে মরতে হবে। আমার এমনই পোড়া কপাল। ক্রোসাস আর্তনাদ করে উঠলেন। সাইরাস কী যেন ভাবলেন। গভীর চিন্তামগ্ন দেখাল তাঁকে। ক্ষানিকক্ষন বাদে বললেন, না। আপনাকে পুড়ে মরতে হবে না। আপনি মুক্ত। সাইরাসের কথায় লিডিয়রাজ হয়তো বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, পারস্যরাজ সাইরাস-এর পক্ষে সে রকম মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই সম্ভব। কেননা, ইতিহাসে সাইরাসের পরিচয় সাইরাস দ্য গ্রেট হিসেবে। ইহুদিরা সাধারণত তাদের সম্প্রদায়ের বাইরে কারোর প্রশংসা করে না। একমাত্র সাইরাসের নামটি রয়েছে ওল্প টেস্টামেন্টে একজন দয়ালু শাসক হিসেবে! কাজেই, সাইরাসকে সাইরাস দ্য গ্রেট বলা হয়। যেমন, অশোক। যেমন, আকবর। ভাবলে অবাক লাগে-সোলনের একটি উক্তি কী ভীষন প্রভাব ফেলেছিল পারস্যরাজের ওপর । সলোন কবি ছিলেন বলেই হয়তো ওমন অমোঘ বাক্য বলতে বা লিখতে পারতেন। অবশ্য, তাঁর রচনার ভগ্নাংশ মাত্র পাওয়া গিয়েছে। সোলন অবশ্য কবিতা লিখতেন তাঁর রাজনৈতিক মত প্রচার করার জন্য। মানে প্রোপাগান্ডা চালাতে সাহিত্যকে ব্যবহার করতেন। তা হলেও তিনি সুখি সুন্দর এথেন্স দেখতে চেয়েছিলেন। তখন বললাম না যে তিনিই এথেনিয় গনতন্ত্রের জনক। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া বিউরি; আ হিস্ট্রি অভ গ্রিস। সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৩৮
false
fe
কোকো কাহিনি __ হাসান ফেরদৌস কোকো কাহিনিহাসান ফেরদৌস দৈনিক প্রথম আলোআপডেট: ০০:০৬, জানুয়ারি ৩০, ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ ৫৭ Like ৮৩ আরাফাত রহমান কোকোর জন্য মায়ের শোকআরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে যে রকম মাতম দেখছি, তাতে রীতিমতো আঁতকে উঠেছি। কোনো পত্রিকায় দেখিনি কেউ দুই লাইন লিখে ব্যাখ্যা করেছেন যে তিনি মালয়েশিয়ায় পড়ে ছিলেন কেন? কী অসুখে কোকো মারা গেলেন, তারও কোনো বিবরণ পড়িনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই ছেলে যে আইন থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, কেউ সে কথা ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করেনি। তাঁর নামে জেলে ঢোকানোর হুকুমনামা ছিল; কই, সে কথাও কেউ সবিস্তারে জানায়নি।সত্য লুকানোর এ কাজে বিরোধী জোট আগ্রহী হবে তা বুঝি, কিন্তু দেশের পত্রপত্রিকার এতে কী স্বার্থ, তা তো আমার মাথায় আসে না।যাঁরা জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, কোকো রহমান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র ব্যবসায়ী-রাজনীতিক, যাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নিজ গরজে আদালতে মামলা করেছে এবং সেই মামলার বিবরণ সবিস্তারে সবাইকে জানিয়েছে। অভিযোগ, তহবিল তছরুপ। মার্কিন বিচার বিভাগের করা অভিযোগ অনুযায়ী, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ৩০ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন কোকো। ২০০৯ সালে করা এই মামলায় বলা হয়েছে, জার্মানির সিমেন্স এজি ও চীনের চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে দুটি বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে কোকো তাঁর মায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাজ এ দুই কোম্পানিকে জুটিয়ে দিয়েছেন। চায়না হার্বারের জন্য যে কাজ তিনি জুটিয়ে দেন, সেটি ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন জেটি নির্মাণ। অন্যদিকে, সিমেন্স জুটিয়েছিল মোবাইল টেলিফোনের একটি ব্যবসা।তারা যে ঘুষের মাধ্যমে সরকারি কাজ জোটানোর চেষ্টা করেছে, সে কথা সিমেন্স এজি ও তার বাংলাদেশি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্বীকার করে সব দায়ভার মেনে নিয়েছে। মার্কিন বিচার বিভাগের কাছে তারা স্বীকার করে যে ২০০১ সালের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত তারা মোট ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ মার্কিন ডলার ঘুষ দিয়েছে। এই ঘুষের টাকা প্রথমে জমা পড়ে একটি মার্কিন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পরে সেখান থেকে তা পাচার হয়ে যায় সিঙ্গাপুরে কোকোর অ্যাকাউন্টে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে ঘুষ দিয়ে দেশে বা বিদেশে কাজ আদায়ের চেষ্টা অবৈধ। এই মর্মে একটি আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। টাকাটা যেহেতু মার্কিন ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হয়েছে, ফলে তা মার্কিন এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত। সে কারণেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এই টাকা পাচারের ঘটনাটি তদন্ত করে।এই মামলার পুরো বিবরণ যাঁরা পড়তে আগ্রহী, তাঁরা দয়া করে মার্কিন বিচার বিভাগের নিম্নলিখিত ওয়েবসাইট ভ্রমণ করুন: (Click This Link)বলাবাহুল্য, বুদ্ধি করে টাকাটা যদি মোনাকো, সুইজারল্যান্ড বা সাইপ্রাসের কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হতো, কোকো হয়তো বিপদে পড়তেন না। বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কোকোরা এভাবে নিজেদের গরিব দেশ থেকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার বিদেশের ব্যাংকে পাচার করে থাকেন। এই হিসাব আমার মনগড়া নয়, বিশ্বব্যাংকের।কোকোর পাচার করা টাকার কিয়দংশ পরে বাংলাদেশ সরকার সিঙ্গাপুর সরকারের সহায়তায় উদ্ধারে সক্ষম হয়। উদ্ধারকৃত অর্থের মোট পরিমাণ ২৬ লাখ ৬১ হাজার ৭০ ডলার। কোকোর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়েছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ আদালত কোকোকে তাঁর অনুপস্থিতিতে ছয় বছরের জেলসহ তাঁর পাচার করা ২০ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। এই মামলা যখন আদালতে ওঠে, বিএনপির তরফ থেকে যথারীতি বলা হয়েছিল, এ সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই তাঁর বিরুদ্ধে কেন মামলা করবে, আর সিঙ্গাপুরই বা কেন অন্যের পাচার করা টাকা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে, তার কোনো ব্যাখ্যা দলের কর্তাব্যক্তিরা দেশের মানুষের জ্ঞাতার্থে হাজির করেননি।বাংলাদেশের বিশেষ আদালত যদিও কোকোকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সরকার যে সেই চেষ্টা আন্তরিকভাবে করেছে, তারও কোনো প্রমাণ নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের অনুমতি নিয়েই কোকো চিকিৎসার নামে প্রথমে আসেন থাইল্যান্ডে। অনুমান করি, পাচার করা টাকা ফেরত দেওয়ার পরও তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিস্তর রেস্ত/ জমা ছিল। থাইল্যান্ডে তাঁকে যে জামাই আদরে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে, সে কথা মনে হয় না। থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায়। বউ-বাচ্চা নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে দেশে তিনি বহাল তবিয়তেই ছিলেন। মোটেও লুকিয়ে-ছাপিয়ে থাকেননি। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে তাঁর তবিয়তের সর্বশেষ বুলেটিন দেশবাসীকে জানিয়েছেন।এ তো গেল হাতেনাতে ধরা পড়া এক অপরাধ। কোকোর অন্য কম প্রকাশিত ও প্রচারিত অপরাধ ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ঘিরে। এই ভদ্রলোক জীবনে পেশাদারি ক্রিকেট খেলেননি, কিন্তু ক্রিকেট ব্যাপারটা যে টাকা বানানোর একটা কারখানা, তিনি সেটা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। মায়ের দোয়া নিয়ে তিনি এই বোর্ডের অবৈতনিক উপদেষ্টার পদটি অলংকৃত করেন এবং পরে সেই বোর্ডের ‘ডেভেলপমেন্ট কমিটি’র প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে কয়েক বছর কোকো ও তাঁর বান্ধবেরা এখানে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পান, সে সময় ক্রিকেট বোর্ড হয়ে উঠেছিল তাঁদের খাস তালুক।এহেন কোকোর মৃত্যুর পর ঢাকায় তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছে। পত্রিকায় ও টিভির পর্দায় সেই ঢল দেখেছি আমি। একজন প্রমাণিত অর্থ পাচারকারী ও জেল পলাতক আসামি, তাঁকে মহানায়কের সম্মানে চিরবিদায় জানাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। মৃত মানুষের নামে নাকি মন্দ বলতে নেই। কিন্তু সত্য কীভাবে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, সে বুদ্ধি তো আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আসছে না।বস্তুত, কোকোর এই মহানায়কসুলভ সম্মানে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। দুর্নীতিকে আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়েছি। আমরা ধরেই নিয়েছি, যাঁরা ক্ষমতায় বসেন, তাঁরা ও তাঁদের বশংবদেরা ইচ্ছেমতো গৌরী সেনের মাল পকেটে ঢালবেন, আমরা দেশের মানুষ স্মিত হেসে তা দেখেও না দেখার ভান করব। নির্বাচনের সময় এলে সেই তস্করদেরই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাব।কথায় বলে, যেমন দেশ তেমন তার নেতা। আমার তবু ভাবতে ইচ্ছা করে, এমন একটা সময় আসবে, যখন চোরকে আমরা জেলে ঢোকাব, মসনদে বসাব না। যত দিন তা না হচ্ছে, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় আমাদের স্থান মিলবে না।হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
false
rg
শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান নিয়ে কিছু কথা___ বাংলা গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একজনই। খুব ছোটবেলা থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতে ভালো লাগত। এখনও সমান ভালো লাগে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান আমার কাছে এখনো একেবারে টাটকা লাগে। তাজা লাগে। ভরাট গলায় অমন গায়কি বাংলা গানে খুব বিরল। শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা। কিংম্বা মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছে ডাকে। একটির চেয়ে অন্যটি এখনো খুব জনপ্রিয়। প্রথম যৌবনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া করলে তিনি হয়তো প্রকৌশলী এইচ মুখার্জী হতেন। কিন্তু তিনি সঙ্গীতের জন্য পড়ালেখা ত্যাগ করলেন। ভবানিপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে ছাত্র থাকাকালে স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রাইজ বিতরনের সময় প্রতিবছর গান হতো। কিন্তু কোনো বছরই হেমন্তকে গান গাইতে ডাকে না। সে জন্য হেমন্ত'র তখন খুব মন খারাপ। হেমন্ত তখন সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র (মানে ক্লাস নাইন)। তখন একদিন তাঁর বাল্যবেলার বন্ধু কবি সুভাস মুখোপাধ্যায় বললেন, চল, আজ তোরে রেডিওতে নিয়ে যাব। তো দু'জনে মিলে রেডিওতে গেলেন। আকাশ বাণীতে যাবার পর গানের অডিশান হল। অডিশানে হেমন্ত পাস করলেন। তখন গান গাওয়া ছিল ছোটদের জন্য রীতিমত অপরাধ। বাবার অনুমতি নিয়ে বাইরে যেতে হতো। পড়াশুনা ছাড়া অন্যকিছু করাই তখন অপরাধ। অনেক কষ্টে বাবার অনুমতি নিয়ে রেডিওতে গান গাইতে যেতেন হেমন্ত। সঙ্গে থাকতেন বন্ধু সুভাস মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান প্রথম রেডিওতে রেকর্ড করা হয়। ১৯৩৭ সালে মেট্রিক পাশ করার পর নানা জায়গায় গান রেকর্ড করার জন্য সুভাস মুখোপাধ্যায় হেমন্তকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কেউ গান রেকর্ড করতে চাইল না। তখন পরিবার থেকে হেমন্তকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করানো হল। সে বছরই তাঁর গ্রামোফোনে প্রথম গানের রেকর্ড হল। এ কাজে সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন বন্ধু কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়। প্রথম রেকর্ড আধুনিক গান- জানিতে যদি গো তুমি, পাষাণে কি ব্যথা আছে, গোপন বাণীটি তারই, তোমার পরশ যাছে। এ গান শিখেছিলেন শৈলেন দাসগুপ্তের কাছে। দ্বিতীয় গান- তোমারে চাহিয়া প্রিয়, বুঝিনু বিফল চাওয়া...। তারপর অজয় ভট্টাচার্যের লেখা শৈলন দাসগুপ্তের সুরে হেমন্ত গাইলেন, রজনীগন্ধা ঘুমাও ঘুমাও আজ এ রাতে, ঘুমের দেশের গান ভেসে আসে মধুবাতে...। তারপর হেমন্ত নিজে সুর করলেন, কথা কইও নাকো শুধু শোনো, যেন বাতাসে পাঠালো কোনো অলকপুরীর ফুল গন্ধা, অশ্রুলিপি কোনো ছন্দা। এই গান সম্ভবত ১৯৩৯ বা ১৯৪০ সালের দিকে রেকর্ড করা হয়। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা গানের অনুষ্ঠান করত। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছেলেরা ডাকল। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কিন্তু হেমন্তকে মঞ্চে ডাকছে না। হেমন্ত সুভাসকে সঙ্গে নিয়ে দর্শক সারিতে বসে আছেন। ওটা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পাবিলক অনুষ্ঠান। তো হঠাৎ সবাই চিৎকার করে বলল, এসে গেছে, এসে গেছে, পঙ্কজদা এসে গেছে। পঙ্কজ মল্লিক। ওই সময় স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আইডল হল পঙ্কজ মল্লিক, শচিন দেববর্মণ, কেসি দে এঁরা। তো যে অনুষ্ঠানে স্বয়ং পঙ্কজ মল্লিক এসেছেন, সেখানে হেমন্ত'র গান আর কে শুনবে? হৈ হৈ করে সবাই ছুটল পঙ্কজ মল্লিককে দেখতে। হেমন্ত-সুভাসও ছুটলেন। পরে ওই অনুষ্ঠানে হেমন্ত'র আর গান গাওয়া হল না। লাভের মধ্যে পঙ্কজ মল্লিকের গান শোনা হল। শৈলেশ দাসগুপ্তর সুরে হেমন্ত ১৯৩৩ সালে প্রথম গান, 'আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন' রেকর্ড করেন। এ গানটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তারপর ১৯৩৭ সালে কলাম্বিয়ার জন্য নরেশ ভট্টাচার্যের লেখা, শৈলেন দাসগুপ্তর সুরে, 'জানিতে যদি গো তুমি' ও 'বলো গো বলো মোরে' হেমন্তের গাওয়া গান দুটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছর তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার জন্য গান রেকর্ড করলেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যান্থে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম প্লেব্যাক করলেন 'নিমাই সন্ন্যাস' ছবিতে। তারপর সুরকার হিসেবে হেমন্ত গান করলেন 'পূর্বরাগ' ও 'অভিযাত্রী' ছবিতে। হেমন্ত বাবু গানে সুর করার আগে ছবিতে নায়ক বা নায়িকা কি কাপড় পড়ে, কোটপ‌্যান্ট পড়ে না ধূতি পড়ে, শাড়ি পড়ে না গাউন পড়ে, কোথায় থাকে, গ্রামে না শহরে, লেখাপড়া কেমন জানে, ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই গানে সুর করতেন। যেমন 'প্রিয়তমা' ছবিতে হেমন্ত সুর করলেন যে গানে, স্মরণের ওই বালুকা বেলায় চরণ চিন্থ আঁকি, তুমি চলে গেছো দূরে, বহুদূরে, শুধু পরিচয়টুকু রাখি। দীপ নিভে যায়, মালা তো শুকায়। নয়নের জল নয়নে লুকায়। একি অবহেলা, একি তবে ওগো আলেয়ার মত ফাঁকি। তুমি চলে গেছো দূরে, বহুদূরে, শুধু পরিচয়টুকু রাখি। তখন খুব হিট করেছিল গানটি। আজও এই গান অনেকের ভালো লাগে। আজকালকার সুরকারদের মধ্যে সেরকম কোনো তাড়না দেখা যায় না। ১৯৪৪ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন। হেমন্ত তখন শৈলেন দাসগুপ্তের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। তো একদিন শৈলেন বাবু বললেন, জানো, রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি আছে। কিন্তু কারো কাছেই তেমন সহসলভ্য ছিল না। তখনো হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিছুই জানেন না। তখন আজকের মত কোনো স্বরবিতান ছিল না। তখন কাগজে/পত্রিকায় নতুন নতুন রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি প্রকাশ পেত। সেই স্বরলিপি থেকে শৈলেন দাসগুপ্ত হেমন্তকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন। তারপর হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত যা শিখেছেন, সবই স্বরলিপি দেখে দেখে। প্রথম দিকে শৈলেন দাসগুপ্ত'র কাছে শিখলেও পরে নিজে নিজে স্বরলিপি দেখে শিখেছেন। পঙ্কজ মল্লিক হেমন্তকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। 'কেন পান্থ এ চঞ্চলতা' এবং 'আমার আর হবে না দেরি' গান দুটি তখন অনাদি ঘোষের প্রশিক্ষণে তিনি শিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই গান দুটি হেমন্তের কণ্ঠে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। 'আমার আর হবে না দেরি' দিয়েই রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্তের আবির্ভাব। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকারকে বাংলা গানে প্রথম পরিচয় করান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি লতাকে দিয়ে করালেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। 'মধু গন্ধে ভরা' রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে লতা'র বাংলা গানে হেমন্ত'র হাত ধরেই প্রবেশ। ১৯৪৭ সালে বাংলা গানের একটি যুগসন্ধিকাল। সে বছর হেমন্ত গাইলেন গাঁয়ের বধূ। আইপিটিএ তে তখন সলিল চৌধুরী গান শেখান। হেমন্ত তখন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দিলেন। তো সলিল বলল, হেমন্তদা একটা গান করেছি, কিন্তু পুরোটা হয়নি। হেমন্ত বলল, শোনাও। সলিল শোনালেন, গাঁয়ের বধূ। সেই গান পরে হেমন্ত'র কণ্ঠে রেকর্ড হল। কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়। জীবনের মধু মাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা, শিশির ভেঁজা কাহিনী শোনাই শোনো। তারপর হেমন্ত গাইলেন, রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে, রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার রানার চলেছে রানার। রাত্রির পথে, পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার। কাজ নিয়েছে নতুন খবর আনার, রানার রানার রানার। তারপর গাইলেন, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা, অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি, জন্মে দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন, অবাক কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন। অবাক পৃথিবী অবাক করলে আরো, দেখিয়েই সে জন্ম লইকো কারো। তারপর হেমন্ত একে একে সলিল চৌধুরীর সুর করা গান গাইতে থাকলেন। পালকি চলে, জোয়ারের গান। হেমন্ত যার কাছেই গান শিখতে যান, সবাই বলেন, তোমার ওইসব আধুনিক গান গাওয়া ছাড়তে হবে। কিন্তু হেমন্ত বলল, আমি ছাড়ি কি করে? আমি ওসব করে খাই। তাই ধ্রুপদি গান হেমন্ত'র শেখা হয়নি। কিন্তু ধ্রুপদি সঙ্গীত শিল্পী আমির খাঁ ছিলেন হেমন্তের গানের ভক্ত। আমির খাঁ সাহেব বলতেন, গান হল তাই, যে সুর লাগাতে জানে, তাইই গান। ওস্তাদি গান হলেই কি গান হল? যার সুর নেই তাল নেই, সে আবার কি গান গাইবে? যে, যে কোনো গানে সুর লাগাতে জানে, তাল জানে, ছন্দ জানে, সে যদি সুর ঠিকমত লাগিয়ে প্রজেন্ট করতে পারে, দিলে লাগাতে পারে, মনে লাগাতে পারে, সে ফোক সঙও গান, আধুনিক গানও গান, সব গানই গান। হেমন্ত ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের এই কথাগুলো খুব মানতেন।হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন হিন্দি গান গাইতে শুরু করলেন, তখন পরিচিতি শুরু হল হেমন্ত কুমার নামে। ১৯৪১ সালে কমল দাসগুপ্তের সুরে হেমন্ত প্রথম হিন্দি গান গাইলেন। ফাইয়াজ হাশমি নামে এক পাকিস্তানী গীতিকারের লেখা, কিতনা দুখা ভুলায়া তুমনে পিয়ারি, মির জখমি দিলকে রাখ করো, আপনাকো মালে হাত। প্রিতম কিউ ঘাবারায়ে হো, বাসে উসকে ইতানি সবদারে মিটানা তুমনে পিয়ারি। এসব গানকে ঠিক গজল বলা হতো না, গীত বলা হতো। হিন্দি গীত। এছাড়া তিনি গাইলেন কমল দাসগুপ্তের সুরে, ফাইয়াজ হাস্মির কথায়ে 'ও প্রীত নিভানেভালি'। যা তখন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৫১ সালে 'আনন্দমঠ' ছবিতে হেমন্ত প্রথম হিন্দি গান করেন। হেমেন দাসগুপ্ত হেমন্তকে নিয়ে গেলেন বোম্বে হিন্দি ছবিতে গান করার জন্য। তারপর এস মুখার্জি তাঁর ছবির গানের জন্য হেমন্তকে রেখে দিলেন বোম্বেতে। তখন 'সাত্রে' ছবির জন্য গান গাইলেন হেমন্ত। নাইয়ে চল হোগা, না তারে রাহেঙ্গে, মাগার হাম হামেশা, তুমার হে রাহেঙ্গে। তখন এই গান খুব হিট করেছিল। তারপর শচিন দেববর্মণের সঙ্গীত নির্দেশনায় হেমন্ত যতগুলো গান করলেন, সবগুলোই খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এ রাত এ চাঁদনি ফির কাহা, সোম যা দিল কি দাস কাহা। পেরো কে সাঁকোতে, ছৈ ছৈ চাঁদনি, তেরেকা আলুমে খৈ খৈ চাঁদনি, অর ছোড়ে দেউমেরে ঝাট লোয়ে যাইওকি। রাত কি বাহার কি....। এরপর হেমন্ত গাইলেন 'নাগিন' ছবিতে। তারপর 'সাপমোচন', 'অসমাপ্ত', 'পলাতক', সহ অনেক বিখ্যাত বাংলা ও হিন্দি ছবিতে একেএকে গান করলেন। বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনের গান গেয়ে, যত ভাবি ভুলে যাব, মন মানে না। সাপমোচন ছবির বিখ্যাত গান। 'শেষ পর্যন্ত' ছবিতে হেমন্ত গাইলেন, এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু, একটি সে নাম আমি লিখেছিনু, আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে যেনো মুছিয়া দিলাম। কেন তবে বারেবার ভুলে যাই, আজ মোর কিছু নাই, ভুলের এ বালুচরে যে বাসর বাঁধা হল, জানি তার নেই কোনো দাম। এই সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে আমি মুছিয়া দিলাম। হেমন্তের কী অপূর্ব গায়কি এই গানে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 'নীল আকাশের নীচে' বাংলা ছবিটি প্রডিউস করেছিলেন। সেখানে হেমন্ত গেয়েছিলেন, নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী, আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ, তুমি দেখেছ কি? আকাশ, আকাশ, শুধু নীল, ঘন নীল, নীল আকাশ। সেই নীল মুছে দিয়ে আসে রাত, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, তুমি দেখেছ কি। তুমি রাতের সে নিরবতা দেখেছ কি? শুনেছ কি রাত্রির কান্না। বাতাসে বাতাসে বাজে, তুমি শুনেছ কি। নিবিঢ়, আঁধার নেমে আসে ছায়া ঘন কালো রাত, কলরব কোলাহল থেমে যায়, নিশিত প্রহরী জাগে, তুমি দেখেছ কি। এই বেদনার ইতিহাস শুনেছ কি? দেখেছ কি মানুষের অশ্রু? শিশিরে শিশিরে ঝরে, তুমি দেখেছ কি। ১৯৫৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পূর্ব আফ্রিকা ও ইউরোপ সফর করেন। ১৯৬৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যামাইকায় তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। জ্যামাইকার আকাশ থেকে বিমান নামা থেকে শুরু করে গোটা অনুষ্ঠান সরাসরি টেলিভিশনে রিলি করা হয়েছিল তখন। রেডইন্ডিয়ানরা হেমন্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলছিলেন, ইন্ডিয়া ছুঁয়ে দেখছি। ভারত থেকে হেমন্ত-ই প্রথম কোনো শিল্পী জ্যামাইকায় গান গাইতে গেয়েছিলেন। ওখানকার একটি গ্রামে তিনি গান গেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ানরা সবাই হেমন্তকে দেখার জন্য খুব ভিড় করেছিল। আয়োজকদের একজন বলেছিল, তার দাদুর বয়স ৮৫ বছর। তিনি হেমন্তকে দেখতে চান। তিনি তখন হাসপাতালে ছিলেন। হেমন্ত না গেলে তিনি হাসপাতাল থেকে ছুটে আসবেন। পরে হেমন্ত হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ও হিন্দি গানের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, গুজরাটি, মারাঠি, অহমিয়া, পাঞ্জাবি ভাষায় গান গেয়েছেন। লতা মুঙ্গেশকারের মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় হেমন্তের একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। মাছ ধরা জেলেরা ও মাঝিমাল্লারা এই গান করে। ওরা বলে খল্লু গীত। হোল্লো রে নাকুয়া হো আল্লো হে রামা। মে দোল কারা, দোল কারা দরিয়া চা রাজা। ঘার পানিয়া ভারী, বাংলানা দারকো এ দা। ভূপেন হাজারিকার কাছে তিনি শিখেছিলেন অহমিয়া গান। প্রায় ৫৫ বছর টানা গান করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯২০ সালের ১৬ জুন শিল্পী হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের জন্ম বারাণসীতে। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে‌ তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে আসে। ছোটবেলা কাটে তিন ভাই এক বোনের সাথে। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। ছোটভাই অমল মুখপাধ্যায় কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তাছাড়া তিনি ১৯৬০ এর দশকে কিছু গানও গেয়েছেন। বোন নীলিমাও গান জানতেন। ১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিয়ে করেন বেলা মুখপাধ্যায়কে। ১৯৪৩ সালে বাংলা ছায়াছবি 'কাশিনাথ' এর সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তিনি আর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করলেন না। হেমন্ত-বেলার দুই সন্তান। পুত্র জয়ন্ত ও কন্যা রাণু। রাণু মুখপাধ্যায় ১৯৬০-৭০ এ গান গাইতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় বাংলা গানগুলোর মধ্যে আছে-পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো, ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়, মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলোনা, আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি, এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার…শুধু দুজনে, মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো, রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে, আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে, আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা, বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ, কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো, ওলিরও কথা শুনে বকুল হাসে...প্রমুখ। ১৯৮৮ সালে 'লালন ফকির' ছবির জন্য হেমন্ত শেষ গান করেন কোনো ছবিতে। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। ঢাকায় তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার গ্রহন করেন। এছাড়া একটি কনসার্টে গান করেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে সকালে তার দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক হয়। সেদিন সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে প্রখ্যাত এই শিল্পী কলকাতার একটি নার্সিং হোমে মারা যান। যতদিন বাংলা গান থাকবে, ততদিন আমরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভরাট গলার গান মনে রাখব। .................................১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ঢাকা
false
rg
মূলা নিবেন ভাই, মূলা!!! রেজা ঘটক মূলা নিবেন ভাই, মূলা!!! রেজা ঘটকআগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের সামনে কিছু মূলা ঝুলানো হবে। সেই মূলার দাম ভারী চড়া। নজর না রাখলে দিতে হবে ৫ বছরের আকাল খরা। চলুন মূলাগুলোর সঙ্গে একটু পরিচয় হই:১. আমাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে আমরা একটা নয়, দুই দুইটা পদ্মা সেতু করে দেব ইনশা আল্লাহ২. আমাদের আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলে আমরা যুদ্ধপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া এই মেয়াদে শেষ করার চেষ্টা করব৩. আমাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে আমরা বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করব৪. আমাদের ভোট দিলে আমরা ঢাকার যানজট মুক্ত করব ইনশা আল্লাহ৫. আমাদের ভোট দিলে শুধুমাত্র ইউনিয়নে নয়, গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় হাসপাতাল ক্লিনিক বানাব৬. আমাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে এনে বিচার করব৭. আমাদের ক্ষমতায় বসালে আমরা ভারতের সঙ্গে সকল নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায় করব৮. আমাদের ক্ষমতায় বসালে ঢাকায় মেট্রোরেল বানাব৯. আমাদের ক্ষমতায় বসালে যাত্রাবাড়ি প্লাইওভারের কাজ শেষ করে যান চলাচল সহজ করব১০. আমাদের ক্ষমতায় আনলে চালের দাম ১০ টাকা করব১১. আমাদের ভোট দিলে মেয়েদের মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া ফ্রি করব১২. আমাদের ভোট দিলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করব১৩. আমাদের ভোট দিলে চাকরির বয়স সীমা ৬৫ বছরে উন্নীত করব১৪. আমাদের ভোট দিলে বয়স্কভাতা দ্বিগুন করব১৫. আমাদের ভোট দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা তিনগুন করব১৬. আমাদের ভোট দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতীনাতনিদের পড়ালেখা অবৈতনিক করব১৭. আমাদের ভোট দিলে দেশের সকল সম্পদ সংরক্ষণ করব১৮. আমাদের ভোট দিলে দেশের তেল গ্যাস কয়লা রক্ষা করব১৯. আমাদের ভোট দিলে সমুদ্র সীমার গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেব২০. আমাদের ভোট দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় যাবে২১. আমাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে আমরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখবএই ২১ মূলা নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী মেনোফেস্টো করা হবে। আর যদি আমজনতা সেই মূলা গিলে হাসিমুখে ভোট দিয়ে আসেন তাহলে যেসব বাঁশ পাবেন সেগুলো এবূপ:১. চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকা২. তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে ৭বার বাড়ানো হবে৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে পারবে কিন্তু কমবে না৪. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সারা বছরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে৫. মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের কাজ না৬. গোপনে গ্যাস বিক্রি করা হবে ভারত আর চীনের কাছে৭. কয়লা দেওয়া হবে বৃটেনকে৮. সমুদ্রবন্দর দেওয়া হবে আমেরিকাকে৯. ঐতিহাসিক জিনিসপত্র মূল্যবান ধাতবমুদ্রা, কষ্টিপাথর, ভাস্কর্য ইত্যাদি প‌্যারিসে প্রদর্শনের নাম করে ফ্রান্সকে দেওয়া হবে১০. অনেক বিদেশী বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোটি টাকা খরচ করে পুরস্কার ও মেডেল দেওয়া হবে। তারা জীবিত না থাকলে তাদের বংশধরদের দেওয়া হবে।১১. দলীয় লোকদের সকল ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য করা হবে। ১২. নেতানেত্রীদের স্ত্রীদের সবগুলো শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ করা হবে১৩. সংসদে নারীদের আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৬০ করা হবে১৪. বিসিএস পরীক্ষায় কেবল দলীয় সনদধারীদের নিয়োগ দেওয়া হবে১৫. পুলিশ প্রশাসনে দলীয় লোকদের আত্মীয়স্বজন সাড়ে সাত লাখ থেকে দশ লাখ টাকায় ঢুকতে পারবে১৬. সকল জেলার ডিসি হবেন দলীয় ডেপুটি সেক্রেটারিগণ১৭. সকল জেলার এসপি হবেন দলীয় ক্যাডারগণ১৮. ঢাকার পুলিশ কমিশনার হবেন টেবিলের তলার বাজেট যার যত বেশি তিনি১৯. আগামীতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ নয় স্কুলেও দলীয় ছাত্রনীতি চালু করা হবে২০. এমপি, মন্ত্রীদের বেতনভাতা মাত্র তিন দফায় তিনলাখ করে বাড়ানো হবে২১. আর দলীয় নমিনেশান পেতে মিনিমাম তিনটা খুন ও একটি ধর্ষণের অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবেবাদ বাকি উপর আল্লাহর ইচ্ছা। নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন একটা প্রতীকী খরচের দোহাই আগের মত দেবে কিন্তু বাস্তবে একজন প্রধান দলীয় প্রার্থীর খরচ করতে হবে মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ টাকা। যিনি কোটি টাকা খরচ করতে পারবেন তিনি পাবেন মন্ত্রণালয়ের মহান দায়িত্ব। আর তারপর সবাইকে নিয়ে সোনার বাংলা শাসন করা হবে। মূলা নিবেন ভাই. মূলা? হরেক রকম মূলা আছে। আপনার কোন টাইপ লাগবে কন, ঝুঢ়িতে সব টাইপের মূলা আছে। লাল মূলা। নীল মূলা। গলুদ মূলা। সাদা মূলা। কালো মূলা। বেগুনী মূল। আমনের যে রঙের চাই আমরা সেই রঙ তাৎক্ষণিক করে দেই। মূলা লাগবে মূলা। হরেক রকম মূলা আছে। ফুরানোর আগে লইয়া লন, ভাই। মূলা লাগবে, মূলা। এই যে ভাই, মূলা আছে। এই যে বোন, মূলা, আছে। মা খালারা মূলা আছে। হরেক রকম মূলা। আগে লইলে আগে পাইবেন, মূলা। মূলা লাগবে ভাই মূলাআআআআআ......
false
fe
পদত্যাগই শেষ কথা নয় মি_ জেনারেল ! জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মি. মইন উ আহমেদ। কেন এই পদত্যাগ তা দেশবাসী আঁচ করতে পারছেন কিছুটা হলেও। আমার অগ্রজ প্রতিম সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার একটা কলাম লিখেছিলেন ১৭ এপ্রিল ২০০৯ শুক্রবার দৈনিক সংবাদে।লেখাটি এখানে তুলে দিলাম। -------------------------------------------------------------- ফুটবলের জয়, নৈতিকতার পরাজয় বিভুরঞ্জন সরকার ---------------------------------------------------------------- প্রথমে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়েছে। যা দেখছি ঠিক তো, যা শুনছি ঠিক তো? হ্যাঁ, ঠিকই আছে। কোন ভুল নেই। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের পাশে বসে আছেন বসুরা গ্রুপের বিতর্কিত-সমালোচিত চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, যিনি শাহ আলম নামে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে গত ১২ এপ্রিল তিনি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই খবর প্রচার হয়েছে ওই দিনই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে পরের দিন সব জাতীয় দৈনিকে। চুক্তি অনুযায়ী বসুরা গ্রুপের পক্ষ থেকে বাফুফেকে দুটি খেলার মাঠ দেওয়া হবে। মোট ২০ বিঘা জমির দুটি মাঠের বাজারমল্য প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া জেলা পর্যায়ে ফুটবলের উন্নতির জন্য বসুরার পক্ষ থেকে তিন বছরে সাড়ে চার কোটি টাকা নগদ সহায়তাও দেয়া হবে বাফুফেকে। বিরাট খবর। বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের খবর আর কি হতে পারে! সে জন্য বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন উল্লসিত হতেই পারেন। ফুটবলপ্রেমীরাও নিশ্চয়ই এই খোশখবরে পুলকিত। কিন্তু সবাই কি খোশদিলে এই খবরকে খোশ আমদেদ জানাতে পারছেন? নাকি মনে করা হচ্ছে যে, শাহ আলম নামের ব্যক্তির সঙ্গে বাফুফে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে জাতির মুখেই চুনকালি মেখে দিয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদের কাছে এই চুক্তি স্বাক্ষরের খবর কোনভাবেই আনন্দের নয়, বিষাদের। তাছাড়া ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের উপস্খিতি অনেকেরই মনোকষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। গত আড়াই বছরে আমাদের কাছে সেনাপ্রধানের যে ইমেজ গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে এই ঘটনাটি একেবারেই বেমানান। এটা সবারই জানা যে, ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পেছনে জেনারেল মইন উ আহমেদের রয়েছে একটি বড় ভূমিকা। বলা যায় ১/১১-এর প্রধান রূপকার তিনি। সেনাপ্রধানের নিজের লেখা বই পড়েও পাঠকের মনে তার ভূমিকা সম্পর্কে কোন সংশয় থাকে না। ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে দেশকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। দেশের মধ্যে দুর্নীতির যে মহামারীর মতো বিস্তার ঘটেছে, সে সম্পর্কে কারও মনে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্নীতির মুলোৎপাটনের জন্য যে কিছু করা সম্ভব এটা যেন সবাই ভুলতে বসেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই ভুল ভাঙাতে কিছুটা সহায়তা করেছিল। স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া, দুর্নীতির অভিযোগে অসংখ্য রাঘব-বোয়াল আটক করা ইত্যাদি ঘটনা দেশের মানুষের মনে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে শুরু করেছিল। আমরা সবাই জানি, দুর্নীতি রাতারাতি দর করা যাবে না। এর সঙ্গে জড়িত অনেকে এবং অনেক কিছু। কিন্তু দুর্নীতির লাগাম যে টেনে ধরা সম্ভব­ সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে দুর্নীতিবাজের অবস্খান যে পর্যায়েরই হোক না কেন, তারা যে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে না­ এটা মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল। দেশের মানুষের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের জাগরণ বা সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের অবস্খান খুব শক্ত বলেই দেশবাসীর মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি সে সময় তার একাধিক বক্তৃতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। ফলে জেনারেল মইনকে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের পাশে দেখে অনেকেই বিস্মিত এবং হতবাক হয়েছেন! বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান সম্পর্কে সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে কোন আপডেট তথ্য নেই­ এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। একথা ঠিক যে, বসুরা গ্রুপ দেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। অনেক ধরনের ব্যবসার সঙ্গে তারা জড়িত। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্খানের সুযোগ হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে। একই সঙ্গে এটাও হয়তো সত্য যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আমলে হাওয়া ভবন কানেকশনে এই গ্রুপ বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমের ইমেজ মোটেও ক্লিন নয়, তার সম্পদের সিংহভাগই হয়তো বৈধ উপায়ে উপার্জিত হয়নি। তিনি অনেক কর ফাঁকি দিয়েছেন এবং এই তথ্যগুলো দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে জেনেছে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, যখন জেনারেল মইনকে মনে করা হতো ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করার গোড়ার দিকেই বসুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন। তার নামে পরবর্তী সময়ে ১২টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় তার ১০ বছর সাজাও হয়েছে। বসুরা গ্রুপেরই একজন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সাব্বিরকে হত্যা করা হয় ২০০৬ সালের জুলাই মাসে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুসানে বের হয় যে, শাহ আলম ও তার পুত্র সাফায়েত সোবহান সানবীর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হাওয়া ভবন এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে ৫০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে রফা করা হয়েছিল। শাহ আলম এবং তার পুত্রসহ মোট ৭ জন সাব্বির হত্যা মামলায় আসামি। হত্যাকাণ্ডসহ বসুরা গ্রুপের নানা কীর্তিকাহিনীর খবর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদপত্রের পাঠকমাত্রেরই এগুলো জানা। আরও জানা ছিল যে, শাহ আলম এবং তার পরিবারের সদস্যরা কেউ দেশে নেই, পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক! ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, যিনি প্রায় দুই বছর পালিয়ে ছিলেন, তিনি আকস্মিকভাবে ঘটা করে জনসম্মুখে হাজির হলেন ১২ এপ্রিল বাফুফের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে সেনাপ্রধানের উপস্খিতিতে। বিষয়টি খটকা লাগার মতোই। একে হালকা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শাহ আলম কি দেশের মধ্যে পালিয়ে ছিলেন নাকি বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন? যদি বিদেশে গিয়ে থাকেন তাহলে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি কবে, কীভাবে, কাদের সহায়তায় নির্বিঘ্নে দেশে ফিরলেন? ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, আইন-শৃখলা বাহিনী কারই কি এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য নেই? আমাদের দেশের সদাসতর্ক এতো এতো মিডিয়াও কিছুই জানতে পারল না? সেনাবাহিনী প্রধান চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্খিত ছিলেন সম্ভবত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে। এটা একটি পর্বনির্ধারিত কর্মসচি। অর্থাৎ কার সঙ্গে কি বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে এটা তিনি জানতেন। তাহলে বসুরা গ্রুপের মতো একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নতির জন্য এ ধরনের সহায়তা নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত কিনা এ প্রশ্ন কি সেনা প্রধানের মনে একবারও হয়নি? দুর্নীতি ও অপরাধ দমনের জন্য এতদিন তিনি যেসব কথা বলেছেন তা কি এখন ‘কথার কথা’ বলে মানুষের কাছে মনে হবে না? পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, সরকারের কেউ নাকি এই চুক্তির ব্যাপারে আগে কিছুই জানতেন না। এমনকি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকেও কিছুই জানানো হয়নি। তাজ্জব কি বাত! সবকিছুতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু কোন কিছুই কি সরকারের অজ্ঞাতে হওয়া ভাল? বাংলাদেশে ফুটবলের দুর্দিন দর করতে হবে। ফুটবলের উন্নতি করতে হবে। এ জন্য চাই টাকা। টাকা ছাড়া ভাল কিছু করা যায় না। এসব নিয়ে বিতর্ক নেই। কিন্তু টাকার উৎস জানা না থাকা কি ভাল লক্ষণ? টাকা সংগ্রহের জন্য কোন নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করা হবে না? ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত, দণ্ডিতদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফুটবলের সুদিন এলেও গোটা দেশ যে আবার ভয়াবহ দুর্দিনের মুখোমুখি হবে সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? হায়! আমরা সবসময় এমন একচোখে এবং একদিকে দেখি কেন? বসুরা গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে সাফাই গেয়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। তিনি বলেছেন, আমি রাজনীতি করি না, রাজনীতি বুঝিও না। (রাজনীতি না বুঝলেই বুঝি দুর্নীতিবাজ-অপরাধীর সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়?) বসুন্ধরা দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠান। তারা দেশে অনেক ধরনের ব্যবসা করে। ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত কি-না, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি ফুটবলের উন্নয়নের স্বার্থে তাদের কাছে গিয়েছি। কাজী সালাউদ্দিনের মনে কোন গ্লানি নেই, তিনি মোটেও বিব্রত নন। বসুরা গ্রুপের কাছ থেকে টাকা পাওয়াকে তিনি ফুটবলের জন্য বড় জয় বলে মনে করছেন। সে জন্যই বলতে পেরেছেন, আমাকে তো কেউ তালিকা দিয়ে বলেনি কার কাছ থেকে টাকা নেয়া যাবে, কার কাছ থেকে নেওয়া যাবে না। যদি এমন বিধিনিষেধ থাকত তাহলে আমি সেটা অবশ্যই মানতাম। ... বসুন্ধরার সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারটা সমীচীন হয়েছে কিনা, এ প্রশ্ন যদি ওঠে তাহলে আমি ওই বিতর্কেই যাব না। সেনাবাহিনী প্রধানকে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কেন উপস্খিত করা হয়েছিল সে বিষয়ে কাজী সালাউদ্দিনের বক্তব্য : ‘এই চুক্তির সময় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি একটা কারণেই। বসুরার সঙ্গে আমাদের চুক্তিটা জেলার ফুটবল উন্নয়নে, আর জেলায় ফুটবল খেলতে গেলে মাঠ দরকার। সব মাঠ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে। আমি চিন্তা করলাম এনএসসির চেয়ারম্যান চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এবং প্রেস কনফারেন্সে উপস্খিত থাকলে মাঠ পেতে সুবিধা হবে।’ (প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৯)। ফুটবলপ্রেমী কাজী সালাউদ্দিন যেমন তার সুবিধার কথা চিন্তা করে কাজ করেছেন, তেমনি বসুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমও নিশ্চয়ই তার সুবিধার কথা চিন্তা করেই ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্খিত হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধানকে পাশে বসিয়ে ফুটবলের জন্য বদান্যতা দেখিয়ে যদি ফৌজদারি মামলা থেকে রেহাই পেতে সুবিধা হয় তাহলে সে সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলে আইন যে স্বাভাবিক গতিতে চলে না, সে অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক আছে। ফুটবলের উন্নতির জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে জমি এবং টাকা দান বা অনুদান নিয়ে কাজী সালাউদ্দিন হয়তো ভাবছেন যে তিনি একটি বড় বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু এতে যে সামগ্রিকভাবে আমাদের সবারই নৈতিক অবস্খান দুর্বল হয়েছে অর্থাৎ নৈতিকতার পরাজয় ঘটেছে সেটা সম্ভবত তিনি বিবেচনায় নিতে পারছেন না। আমাদের আফসোস এটাই যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বসুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোটা অংকের দানদক্ষিণার বিনিময়ে কাউকে ‘বশ’ করে সেনাপ্রধানের পাশে বসে ছবি তোলার সুযোগ না পেলেও দিনবদলের সরকারের আমলে তা কত সহজেই তা পেয়ে গেলেন। এক বছরেই যে গ্রুপের ৫৬৭ কোটি টাকার সম্পদ বাড়ে, সেই গ্রুপ যদি কাউকে ২০০ কোটি টাকা দান করে নানা ধরনের সমস্যা-সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পায় তাহলে তো তাদের কোন ক্ষতি নেই। ফুটবলে টাকা ঢেলে বিনিময়ে আরও কত শত বা হাজার কোটি টাকার সম্পদ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে, এ প্রশ্ন সম্ভবত কাউকেই করা যাবে না। করলে ফুটবলের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ################################### সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭
false
hm
গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও বিউটি পার্লার রহস্য ১, ঝাকানাকা সচরাচর যা করেন, তা-ই করলেন। একটি ভুরু আরেকটি থেকে ইঞ্চি দুয়েক ওপরে তুলে ফেললেন। কীভাবে, সে এক রহস্য। বোধ করি আরিজোনার মরুভূমিতে লী মেজরসের কাছে মাসদুয়েক ভুরুকুংফু শিক্ষারই ফল। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি সেই একখানা উত্তোলিত ভুরুর ঘায়ে ঘায়েল হয়ে বললেন, "স্যার, আমাদের সোর্স মোটামুটি পাকা খবর এনেছে। বদরু বিটকেলটা একটা ব্যাটাছেলেদের বিউটি পার্লারে গিয়ে সেঁধিয়েছে। আমরা আশপাশটা জোর কর্ডন করে ফেলেছি স্যার। ছাদের ওপরেও লোক নজর রাখছে। বদরুর সাধ্য নেই এবার সটকায়!" ঝাকানাকা একটা রূপার কাঠিদানি থেকে একটা প্লাস্টিকের আগায় তুলো জড়ানো কানকাঠি তুলে চোখ বুঁজে কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, "সব পাকা আসলে পাকা নয়। মাঝেমধ্যে কাঁচা জিনিসের ওপর নাহক কেমিক্যাল চড়িয়ে সেটাকে পাকানো হয়। যেমন ধরুন, কলা। মধুপুরে গেলে দেখবেন কলা পাকানোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। সেখানে মুখে গামছা আর কাঁধে সিলিণ্ডার নিয়ে দিনমান নিতান্ত কাঁচা কলার কাঁদিতে কেমিক্যালের কলঙ্ক ছিটিয়ে চলছে লোকে। আপনার সোর্সের পাকা খবর কি নিজে থেকেই পেকেছে, নাকি কোনো আলকেমির বিটলেমিতে পেকেছে?" কিংকু চৌধারি মুষড়ে পড়ে বললেন, "স্যার, নিজে থেকে পেকে ওঠা, নাকি গায়ের জোরে পাকানো, সেটা দেখার মতো পাকা চোখ তো আমার নেই। আমি তো এখনও নিতান্ত কচি!" ঝাকানাকা বিস্ফারিত চোখে কিংকু চৌধারিকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, "ওহ! তো আমাকে কি যেতেই হবে? মুখে বললে চলবে না?" কিংকু চৌধারি হাতের লাঠিটা দাঁতে কামড়াচ্ছিলো, সে চমকে উঠে বললো, "সে কী স্যার! খবরটা যদি সত্যি হয়, তাহলে? কোনোভাবে যদি আটক বদরু পালিয়ে যায়? বহু কষ্টে ছয়টি মাস তার পেছনে টিকটিকি লেলিয়ে শেষমেশ একটা খবর পাওয়া গেছে স্যার ... আপনি না গেলে যদি সে পালায়, তবে তো বড় কেলেঙ্কারি হবে!" ঝাকানাকা বিরক্ত হয়ে বললেন, "চলুন তাহলে, লুঙ্গি পরেই যাই। কাপড় পাল্টে প্যান্ট পরতে আলসেমি লাগছে।" কিংকু চৌধারি ইতস্তত করে বললো, "কিন্তু স্যার ... যদি বদরু সত্যিই ওখানে থেকে থাকে, আর যদি মনে করুন কোনো কারণে আপনাকে ধরুন গিয়ে বড় কোনো অ্যাকশনে যেতে হয় ... সমস্যা হবে না?" ঝাকানাকা গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "আমার লুঙ্গির গিঁট সুইস ব্যাঙ্কের লকারের তালার মতো জনাব কিংকু! সামান্য বদরুকে দরকার পড়লে দুয়েকটা কাম্পুচিয়ার কুংফু প্যাঁচে ফেলে আলুভর্তা বানাতে গিয়ে যদি এই গিঁট খুলে যায়, তাহলে ক্যাম্নে কী?" ২. জ্যামে কাটানো এক ঘন্টা সময় ঝাকানাকা মন দিয়ে কিংকু চৌধারির কথা শুনলেন। বদরুর খবর জুগিয়েছে এক ধুরন্ধর ইনফরমার। দীর্ঘ ছ'টি মাস সাধনা করে অবশেষে সে বদরুর খোঁজ পেয়েছে। তার কথামতো, আজ বদরু একেবারে কোটটাই পরে কর্পোরেট কর্তাদের মতো চেহারা বানিয়ে ঢুকেছে বনানীর এক ব্যাটাছেলেদের বিউটি পার্লারে। "নাম কী ঐ বিউটি পার্লারের?" ঝাকানাকা শুধালেন। "খুবই নামকরা বিউটি পার্লার স্যার। গোটা বাংলাদেশে তাদের শাখা প্রশাখা ছড়ানো। ছেলে মেয়ে সকলেই তাদের বিউটি পার্লারে গিয়ে সাজগোজ করে, শরীর ম্যাসাজ করায়, হাতের পায়ের নখ ঘষামাজা করে। তারা না থাকলে গোটা বাংলাদেশই আজ কুচ্ছিত রোমশ শূর্পনখা দিয়ে ভরে যেতো স্যার!" কিংকু চৌধারি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে। ঝাকানাকা আবার জিজ্ঞাসা করেন, "নাম কী?" কিংকু গদগদ গলায় বলে, "লালিমা পাল, স্যার! ওদের স্লোগান শুনেছেন নিশ্চয়ই রেডিও টিভিতে, আপনার লালিমা আমরা পালি?" ঝাকানাকা নড়েচড়ে বসে বলেন, "ঐ যে আনিস কার্লমার্ক্সের সাজগোজের দোকান? সে তো বেশ কেষ্টুবিষ্টু লোক। সারাক্ষণই হিল্লিদিল্লি করে বেড়ায়, বড়বড় লোকজনের সাথে ওঠবোস করে। ব্যাটার সাথে বদরুর কোনো গোপন লেনদেন নেই তো আবার?" কিংকু চৌধারি চমকে উঠে বললেন, "সে কী বলছেন স্যার! আনিস কার্লমার্ক্সের সাথে কেন বদরুর বিজনেস থাকবে?" ঝাকানাকা বললেন, "হুমমম! তা আমি তো জানতাম আনিস কার্লমার্ক্সের ক্লায়েন্ট সব মেয়েরা। বদরু সেখানে ঢুকলো কী করে?" কিংকু চৌধারি বললো, "না স্যার, বনানীর এই ব্রাঞ্চটা ছেলেদের জন্যে। এটার নাম আসলে লালিমা পাল (পুং) ।" ঝাকানাকা আড়চোখে কিংকুকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বললেন, "আপনি খুব খোঁজ খবর রাখেন দেখি! আপনারও যাতায়াত আছে নাকি ওখানে?" কিংকু হেঁ হেঁ করে হেসে বললো, "মাঝেমধ্যে যাই স্যার, ফেসিয়াল করাতে। চোরছ্যাঁচ্চড় পিটিয়ে যখন গা হাত পা ব্যথা হয়ে যায়, তখন স্পা করাতে যাই স্যার। বড় আরাম!" ঝাকানাকা গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "হুমমমমম! তা বদরুর ছদ্মবেশের কোনো ছবি তুলতে পারেনি আপনার টিকটিকি?" কিংকু চৌধারি বললো, "ছবি সে তোলার মওকা পায়নি স্যার। বদরুর অটোরিকশার ড্রাইভার সেজে বসেছিলো তো, তাই। অটোরিকশা চালাতে চালাতে প্যাসেঞ্জারের ছবি তোলার মতো এলেমদার টিকটিকি সে নয় স্যার। তাছাড়া, বদরু নাকি কোথাও ঢোকে এক চেহারা নিয়ে, বেরোয় অন্য চেহারা নিয়ে। ছবি তুলেই বা লাভ কী বলুন?" ঝাকানাকা বললেন, "আপনারা কর্ডন করছেন কীভাবে?" কিংকু চৌধারি সগর্বে বললেন, "এলিমেন্টারি, স্যার! বাইরের লোককে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি না, আর ভেতরের লোককে বাইরে বেরোতে দিচ্ছি না!" ঝাকানাকা বললেন, "এ নিয়ে গণ্ডগোল হবে না?" কিংকু চৌধারি বললেন, "কড়া হুকুম দিয়ে এসেছি স্যার। বাইরে থেকে কেউ গিয়ানজাম করলেই লাঠিপেটা করতে বলেছি। আর ভেতর থেকে কেউ জোর করে বেরোতে চাইলে রাবার বুলেট মেরে বসিয়ে দেয়া হবে।" ঝাকানাকা বললেন, "তার মানে ভেতর একগাদা লোকের মধ্যে বদরু গা ঢাকা দিয়ে আছে?" কিংকু চৌধারি উৎফুল্ল গলায় বললো, "ঠিক তাই স্যার ... যদি খবরটা পাকা হয়!" ৩. লালিমা পাল (পুং) এর সামনে গাড়ি থেকে নেমে ঝাকানাকা দেখলেন, বিরাট শোরগোল হচ্ছে। কঠোর চেহারার এক ঝাঁক পুলিশ লালিমা পাল (পুং) এর তিনতলা কমপ্লেক্স ঘেরাও করে রেখেছে, আর বাইরে স্লোগান দিচ্ছে হরেক রকম চেহারার লোক। ভিড় ঠেলে এগিয়ে ঝাকানাকা গর্জে উঠলেন, "হচ্ছে কী এখানে? এতো হাউকাউ কীসের?" সুবেশী এক মাঝবয়েসী লোক বললেন, "ফ্যাসিবাদী পুলিশ আমাদের পার্লারে ঢুকতে দিচ্ছে না! এদিকে রাত ন'টায় আমার একটা দাওয়াত আছে! ফেসিয়াল করাতে না পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনারা কি জানেন না, ভেতরে বাংলাদেশের সবচে বড় বিটকেল বদরু খাঁ আছে? তাকে পাকড়াও করার আগ পর্যন্ত এই পার্লার অফ লিমিটস! আপনারা অন্য কোথাও সাজগোজ করুনগে যান!" এক তরুণ ফুঁপিয়ে উঠে বললো, "আমার আজ স্পা করানোর কথা! প্রতি ওয়েন্সডে স্পা করাতে না পারলে আমার ডোপামিন ব্যালান্সে সমস্যা হয়!" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? ডোপামিন দিচ্ছি রোসো! য়্যাই কে আছেন, এই ছিঁচকাঁদুনেগুলোর পেছনে দ্যান তো এক পশলা ডলা!" এক কনস্টেবল লাঠি উঁচাতেই লোকজনের ভিড় চটজলদি পাতলা হয়ে গেলো। ঝাকানাকা গটগটিয়ে পার্লারের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। পার্লারের ভেতরে এক উত্তেজনাময় পরিস্থিতি। চার পাঁচজন লোক সেখানে মারমুখো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোয়ালে পরে, তাদের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে এক স্যুটপরা টেকো ভদ্রলোক, আর গালে হাত দিয়ে হাপুস কাঁদছে সিকিউরিটির উর্দি পরা এক তরুণ। ঝাকানাকা বাজখাঁই গলায় বললেন, "কী ব্যাপার? এতো হট্টগোল কীসের? আর এ কী, আপনারা নেংটো কেন? জামাকাপড় কই?" তোয়ালে পরা এক গুঁফো যুবক গর্জে উঠলো, "আপনিই বা কে? এখানে কী চান?" কিংকু চৌধারি এগিয়ে গিয়ে হাতের বেত একবার বাতাসে ঘুরিয়ে বললেন, "ইনি গোয়েন্দা ঝাকানাকা। আমি দারোগা কিংকু চৌধারি। আর এটা আমার হাতের বেত, এখনও এর কোনো নাম রাখিনি। এখন সবাই চুপ। আমরা জিজ্ঞেস করবো, আপনারা উত্তর দেবেন। বাড়তি কথা বললে ধরে হাজতে নিয়ে অ্যায়সা প্যাঁদান প্যাঁদাবো যে এক মাস এইখেনে পড়ে পড়ে মাসাঝ করাতে হবে দুই শিফটে।" গুঁফো যুবক ঢোঁক গিলে চুপ করে গেলো। মাঝবয়সী এক হাফটেকো ভদ্রলোক তোয়ালের গিঁট এক হাতে ধরে রেখে অন্যহাত আকাশের দিকে উঁচিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন, "খসে পড়বে! লালিমা পাল পুঙের ইঁটকাঠ সব খসে পড়বে! আল্লার গজব পড়বে! লা'নত পড়বে!" ঝাকানাকা বললেন, "কী হয়েছে?" হাফটেকো ভদ্রলোক বললেন, "গোয়েন্দা সাহেব, দেখুন এদের কাণ্ড! এদের কাছে আমরা আসি একটু সেবা নিয়ে চাঙা হতে, আর এরা কিনা ঘরে লুকানো ক্যামেরা দিয়ে আমাদের নেংটুস ছবি তুলে রাখে!" ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে তাকালেন স্যুটপরা ফুলটেকো ভদ্রলোকের দিকে ফিরে বললেন, "আপনিই কি ম্যানেজার?" ভদ্রলোক ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে বললেন, "হ্যাঁ!" ঝাকানাকা বললেন, "ব্যাপার কী? নেংটুস ছবির কথা শুনছি যে?" ভদ্রলোক বললেন, "ইয়ে, এটা এটা ভুল বোঝাবুঝি আসলে ...।" ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দোলানো এক মহান তোয়ালেপরা যুবক গর্জে উঠলো, "সিসিটিভি ফিট করে আমাদের নেংটুপুটুস অবস্থা ভিডিও করে রাখিস, আবার বলছিস ভুল বোঝাবুঝি? তবে রে!" হাবিলদার-ছাঁট দেয়া এক প্রৌঢ় দুই হাতে তোয়ালে আঁকড়ে ধরে হুঙ্কার দিলেন, "পুরা বাড়ি জ্বালায়া দিবাম!" চুলে ঝুঁটিবাঁধা এক চশমাপরা তরুণ সন্তর্পণে এগিয়ে এসে করমর্দন করলো ঝাকানাকার সাথে। "আমি আপনার খুব ফ্যান! আপনার সব গল্প পড়েছি স্যার! আপনি পেঁদিয়ে যতগুলো রহস্যের গিঁট ছাড়িয়েছেন, প্রত্যেকটাই আমার প্রায় মুখস্থ স্যার! প্লিজ, এদের একটু কড়কে দিন। ঐ যে মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে তাতারদের কাছে শেখা তাতারী চিমটি, ওটা একটু মেরে দিন স্যার এই বদমাশদের! এরা স্যার স্পা এর ঘরে ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে মক্কেলদের নেংটু ছবি তুলে রাখে!" ঝাকানাকা গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "ঐ সিকিউরিটির জামা পরা ছোকরা কাঁদছে কেন?" ফুলটেকো ম্যানেজার গুঁফো যুবককে দেখিয়ে বললেন, "স্যার, এই যে ইনিই কাশেমকে শুধুশুধু বিনা উস্কানিতে চটকানা মেরেছেন স্যার!" গুঁফো যুবক আবারও গর্জে উঠলো, "এই হতভাগা রিসেপশনে বসে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যামেরা দিয়ে আমাদের নেংটুপুটুস ছবি তুলে রাখবে আর আমি চটকানা মারবো না তো কী মারবো? কোলে তুলে থুতনি নেড়ে দেবো?" ঝাকানাকা কিংকু চৌধারিকে বললেন, "ভেতরটা সার্চ করে ফেলুন এক রাউণ্ড। আমি দেখছি এদিকে।" কিংকু চৌধারি বেত দুলিয়ে চলে গেলেন পার্লারের ভেতরে। হাফটেকো ভদ্রলোক বললেন, "গোয়েন্দা সাহেব, আপনি এক্ষুণি এদের অ্যারেস্ট করুন। এদের নামে য়্যায়সা কড়া মামলা দেবো যে সারাটা জীবন জেলের নুডলস খেতে হবে!" ঝাঁকড়া চুলের যুবক বললো, "জেলে নুডলস খেতে দেয় নাকি?" হাফটেকো ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, "দেয় না?" বাটিছাঁট প্রৌঢ় বললেন, "জেলে রুটি খেতে দেয় রে ভাই, রুটি! গমের চোকলাশুদ্ধু রুটি! লোহার মতো শক্ত!" ঝুঁটিবাঁধা তরুণ বললো, "আপনি কী করে জানেন?" বাটিছাঁট প্রৌঢ় চুপ করে গেলেন। কিংকু চৌধারি মুশকো এক লোকের কানে ধরে বেরিয়ে এলেন একটা ঘর থেকে। "স্যার, এ হচ্ছে এখানকার মালিশক, এর নাম কোবরা। দারুণ মাসাঝ করতে পারে স্যার। শরীরটা একদম চনমনা হয়ে যায়। কোমায় চলে যাওয়া রোগীকেও কোবরা মাসাঝ করে চাঙা করে তুলেছে স্যার!" কোবরা ভ্যাবলা চোখে আশপাশটা দেখে বললো, "স্যার আমি এইসবের মধ্যে নাই। মালিশ করি বেতন নেই। এরচে বেশি কিছু আমি জানি না।" ঝাকানাকা ইঙ্গিতে কিংকুকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, "ম্যানেজার আর সিকিউরিটির লোক দু'টোকে চেনেন?" কিংকু চৌধারি ফিসফিস করে বললেন, "চিনি তো স্যার! দুইজনই অনেকদিন ধরে চাকরি করছে এখানে।" ঝাকানাকা বললেন, "আর কোবরাকে যে চেনেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তারমানে বাকি পাঁচজনের মধ্যে একজন বদরু।" কিংকু কড়া চোখে পাঁচ তোয়ালে পরা মূর্তিকে দেখে নিয়ে বললো, "এক রাউণ্ড প্যাঁদাবো নাকি স্যার?" ঝাকানাকা বললেন, "মনে হয় না তার দরকার পড়বে। দাঁড়ান দেখছি।" পার্লারের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সফেদ পাঞ্জাবি পায়জামা আর মাথায় ফুন্নি টুপি পরা এক ভদ্রলোক। মুখে মেহেদীরাঙানো দাড়ি, হাতে পলা বসানো আংটি আর তসবি। তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো জিন্স আর গেঞ্জি পরা এক যুবক। "সালাম আলাইকুম। আমি আনিস কার্লমার্ক্স।" ঝাকানাকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। "আর এই যে, এ হচ্ছে দৈনিক কচুবনের সাংবাদিক, নিখিল মন্তাজ। নিখিল, খাতাকলম খুলে কাজে লেগে যান।" ঝাকানাকা গম্ভীর গলায় বললেন, "আপনার প্রতিষ্ঠানে গোপন ক্যামেরার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, জানেন?" আনিস কার্লমার্ক্স দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, "এটা আসলে ভুল বোঝাবুঝি।" গুঁফো যুবক এগিয়ে গিয়ে রিসেপশনের ওপর থেকে একটা সিডি খামচা দিয়ে তুলে নিয়ে ওপরে উঁচিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলরো, "এই সিডি ভর্তি আমাদের নেংটুস অবস্থায় জামা পাল্টানোর ভিডিও, আর আপনি বলছেন ভুল বোঝাবুঝি?" কিংকু চৌধারি বললেন, "হুমমম?" আনিস কার্লমার্ক্স বললেন, "না না জেন্টলমেন, আপনারা ভুল বুঝছেন। এই ক্যামেরা সিকিউরিটির জন্যে বসানো হয়েছে। সেদিন আমাদের এই ব্রাঞ্চ থেকে কে বা কাহারা ফার্স্ট ন্যাশনাল আরব এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের সিওও-র আন্ডারওয়্যার চুরি করে পালিয়েছে। আমি থানায় ডায়রি করেছি, কিন্তু পুলিশ আজ পর্যন্ত ঐ জাঙ্গিয়া উদ্ধার করতে পারেনি। আমি নিরুপায়। আপনাদের জাঙ্গিয়ার নিরাপত্তা দেয়া আমার কর্তব্য, নাহলে আমার রোজগার হালাল হবে কী করে? সেজন্যেই এই ক্যামেরা বসানো। প্লিজ ভুল বুঝবেন না।" কিংকু চৌধারি নিচু গলায় ঝাকানাকাকে বললেন, "ফ্রান্সের গোঁগোঁ কোম্পানির জাঙ্গিয়া স্যার, একেবারে লোগো বসানো আসল জিনিস। ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঐ জাঙ্গিয়ার ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করেন। বড় শখের জিনিস! উনি এই জাঙ্গিয়া উদ্ধারের জন্যে উপরমহলে জোর হুড়ো দিয়েছেন, একেবারে মন্ত্রী পর্যন্ত। সিআইডি তদন্ত করছে স্যার, শুনেছি এফবিআইও আসতে পারে।" ঝাকানাকা বললেন, "হুমমম!" ঝাঁকড়া চুলের বাবরী যুবক দাঁত খিঁচিয়ে বললো, "জাঙ্গিয়ার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে জাঙ্গিয়ার আশপাশের সবকিছুর নিরাপত্তার যে চৌদ্দটা বাজিয়ে দিলেন, তার কী হবে? এইসব ফালতু কথা মানি না, মানবো না!" আনিস কার্লমার্ক্স দুই হাত তুলে বললেন, "জেন্টলমেন! আসুন এই ভুল বোঝাবুঝি আর না বাড়াই। দিন, সিডিটা কাশেমকে দিন, ও এটাকে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে। আর আসুন, আমরা আমার রুমে গিয়ে বসি, একটু কফিটফি খাই, একটু আলাপ করি নিজেদের মধ্যে। লেটস সেটল দিস ইস্যু অ্যামিকেবলি। আমরা সবাই এখানে ভিক্টিম। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমাদের আলাপ শেষ হবার পর আমরা সবাই একমত হবো যে এটা আসলে একটা দুঃখজনক ভুল বোঝাবুঝি। তাই না নিখিল?" প্যাডে কলম চালাতে চালাতে নিখিল মন্তাজ হাসিমুখে বললো, "আবাজিগস!" পাঁচ তোয়ালে পরা মক্কেলকে নিয়ে আনিস কার্লমার্ক্স নিজের অফিস রুমে চলে গেলেন। ঝাকানাকা কাশেমের হাত থেকে সিডিটা নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লেন। কাশেম কিছু বলতে গিয়েও কিংকু চৌধারির হাতে দোদুল্যমান বেতের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো। ঝাকানাকা গভীর মনোযোগে সিডিটা পুরোটা দেখলেন। মাঝখানে কয়েকবার শুধু হুমমমমম বললেন, তারপর সিডিটা ড্রাইভ থেকে বার করে কিংকু চৌধারির হাতে দিয়ে বললেন, "আপনি কি এইখানে নিয়মিত স্পা করান?" কিংকু চৌধারি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে গিয়ে থমকে গেলো, তারপর রক্তচক্ষু মেলে কাশেমের দিকে তাকিয়ে বললো, "আপনি কি বলতে চাইছেন স্যার, এরকম সিডি আরো আছে?" ঝাকানাকা হাই তুলে বললেন, "থাকতেই পারে। আর হ্যাঁ, বদরুকে ধরে ফেলেছি।" ৪. আনিস কার্লমার্ক্সের ঘর থেকে পাঁচ মক্কেলই তুষ্টমুখে বেরিয়ে এলো, তাদের প্রত্যেকেরই একটা হাত তোয়ালের নিচে। নিখিল মন্তাজ তাদের সামনে একটা ক্যাসেট রেকর্ডার তুলে ধরলো। হাফটেকো ভদ্রলোক গলা খাঁকরে বললেন, "ইয়ে, ব্যাপারটা আসলে একটা দুঃখজনক ভুল বোঝাবুঝি। আমরা শিগগীরই একটা যৌথ বিবৃতি দিতে যাচ্ছি।" বাকি চারজন হুহুঙ্কারে সম্মতি দিলো। ঝাকানাকা এগিয়ে গিয়ে বললেন, "আপনারা আবার ঐ অফিস ঘরে গিয়ে বসুন দেখি। কথা আছে।" আনিস কার্লমার্ক্স এগিয়ে এসে অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন, "গোয়েন্দা সাহেব, তার কি আর দরকার আছে? এনাদের ছেড়ে দিন। চলুন আমি আর আপনি এই ইস্যুটা ভায়ে ভায়ে মিটিয়ে ফেলি ...।" ঝাকানাকা গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "আপনার এই পাঁচ মক্কেলের মধ্যে একজন হচ্ছে পাজির হদ্দ দাগী দস্যু বদরু খাঁ, তা ই জানেন?" আনিস কার্লমার্ক্সের চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি ঝট করে ঝাকানাকার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমি এইসবের মধ্যে নেই। যৌথ বিবৃতিটা সাইন হয়ে গেলেই আমি বাড়ি চলে যাবো!" গুঁফো যুবক তোয়ালের নিচ থেকে টাকার বাণ্ডিল ধরা হাত উঁচিয়ে গর্জে উঠলো, "এই অভিযোগের ভিত্তি কী?" কিংকু চৌধারি উত্তরে হাতের বেত উঁচিয়ে সবাইকে খেদিয়ে অফিস ঘরে ঢোকালেন। ঝাকানাকা অফিসরুমে ঢুকে আনিস কার্লমার্ক্সের আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ারে বসে ডেস্কের ওপর পা তুলে বললেন, "আজ বিকেলে বদরু ছদ্মবেশে এই পার্লারে ঢোকে। উদ্দেশ্য কী তা পরিষ্কার জানি না আমরা। হয়তো আনিস কার্লমার্ক্সের সাথে গোপন মিটিং করতে। অথবা অন্য কোনো স্যাঙাতের সাথে সাক্ষাত করতে। কিংবা নিছক কোবরার হাতে এক ঘন্টা মালিশ করাতে। কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, বদরু জানতো না যে এই পার্লারের স্পা ঘরে গোপন ক্যামেরা আছে। তাই সে যথেষ্ট সাবধান হতে পারেনি।" গুঁফো, ঝাঁকড়া, হাফটেকো, বাটিছাঁট আর ঝুঁটি চুপচাপ শুনে যায় ঝাকানাকার কথা। ঝাকানাকা বলেন, "বদরু আরো জানে না যে তার পেছনে ডানদিকে যে একটা ব্রন্টোসরাসের উল্কি আঁকা আছে, সে কথা আমরা জানি!" গুঁফো, ঝাঁকড়া, হাফটেকো, বাটিছাঁট আর ঝুঁটি, পাঁচজনই চমকে ওঠে। ঝাকানাকা মিটিমিটি হেসে বলেন, "উপস্থিত পাঁচজনই পাঁচ স্পা ঘরে ক্যামেরার কথা না জেনে নিতান্ত বেখেয়াল হয়ে তাদের জামাকাপড় পাল্টে তোয়ালে পরে মাসাঝ টেবিলের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের চারজনেরই পেছনে উল্কি আঁকা। এবং সেটা ডানদিকেই।" গুঁফো, ঝাঁকড়া, হাফটেকো, বাটিছাঁট আর ঝুঁটি, পাঁচজনই একে অন্যের দিকে তাকায় সন্দিহান চোখে। আনিস কার্লমার্ক্স বলেন, "আর পঞ্চমজন?" ঝাকানাকা বললেন, "তার পেছনটা খুঁটিয়ে দেখার জো নেই, অতিশয় রোমশ।" নিখিল মন্তাজ নোট করতে করতে বলে, "কে সে?" গুঁফো, ঝাঁকড়া, হাফটেকো, বাটিছাঁট আর ঝুঁটি, পাঁচজনই গুঞ্জন করে ওঠে। ঝাকানাকা বললেন, "সেটা বলা ঠিক হবে না।" নিখিল মন্তাজ খসখস করে নোট করে যায়। ঝাকানাকা বলেন, "বাকি চার উল্কিওয়ালার মধ্যে একজনের পেছনে আঁকা তালগাছের উল্কি!" ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দোলানো মহান যুবক অস্ফূট শব্দ করে ওঠে। ঝাকানাকা বলেন, "আরেকজনের পেছনে আঁকা মড়ার খুলির উল্কি, কিন্তু খুলির জায়গায় একটা স্মাইলি দেয়া, তার নিচে দুইটা হাড্ডি কোণাকুণি!" বাটিছাঁট প্রৌঢ় বিড়বিড় করে কী যেন বলেন। ঝাকানাকা বলেন, "আরেকজনের পেছনে উল্কি মেরে লেখা, শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা!" হাফটেকো ভদ্রলোক গুনগুন করে ওঠেন। ঝাকানাকা বললেন, "লাস্ট বাট নট লিস্ট, শেষজনের পেছনে একটা রাজহাঁসের উল্কি , সেটা পানিতে ভাসছে।" ঝুঁটিওয়ালা যুবক কেশে ওঠে। নিখিল মন্তাজ উজ্জ্বল মুখে গুঁফো যুবকের দিকে কলম বাগিয়ে ধরে, "আপনি! আপনার পেছন মাত্রাতিরিক্ত রোমশ! পাইছি!" গুঁফো যুবক গর্জে ওঠে, "খবরদার এ নিয়ে যদি কাগজে কিছু লিখেছেন, ধরে য়্যায়সা কিলান কিলাবো না!" ঝাকানাকা মিটিমিটি হেসে বলেন, "আপনারা বুঝতেই পারছেন, ব্রন্টোসরাসের উল্কির ওপর বদরু পরবর্তীতে কিছু এডিটিং করেছে। কিন্তু ব্রন্টোসরাসকে কি তালগাছ বানানো যায়?" ঝাঁকড়াচুল উৎফুল্ল মুখে বলে, "কক্ষণো না!" ঝাকানাকা বলেন, "কিংবা ধরুন, ব্রন্টোসরাসকে কি স্মাইলি রজার বানানো যায়?" বাটিছাঁট খুশি খুশি গলায় বলে, "একদমই না!" ঝাকানাকা বলেন, "ব্রন্টোসরাসের ছবি থেকে "শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা" টেক্সট কি বানানো সম্ভব?" হাফটেকো বলে, "কোয়াইট ইম্পসিবল!" ঝাকানাকা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, "কিন্তু ... একটা ব্রন্টোসরাসের ছবিতে একটু তুলি চালিয়ে সেটার গায়ে একটা ডানা আর নিচে ঢেউ খেলানো পানি বসিয়ে দিলেই কিন্তু সেটা রাজহাঁস হয়ে যায়!" সবাই এবার ঘুরে তাকায় ঝুঁটিবাঁধা তরুণের দিকে। ঝুঁটিবাঁধা তরুণ কিছু বলার জন্যে মুখ খোলে, তারপর হাল ছেড়ে দেয়। এবং সব গল্পে যা ঘটে, টিংটিঙে তরুণের ছদ্মবেশ ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ঝাড়া সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক ভীষণ মূর্তি, তারপর টেবিল ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়ে ঝাকানাকার ওপর। শুরু হয় মর্মান্তিক মারপিট। ঝাকানাকা এস্কিমো সিলশিকারীদের কাছে শেখা কায়দায় এক দারুণ কনুই বসিয়ে দ্যান বদরু খাঁর পিঠে, জবাবে বদরু খাঁ উত্তর কোরিয়ার এক নিনজা গ্রামে শেখা কিম-জং-ইল মার্কা একটা খামচি বসিয়ে দেয় ঝাকানাকার পেটে। তারপর মারামারির দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে যায়। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয় না শেষ পর্যন্ত। ঝাকানাকা ঝালাই লামার গুম্ফায় বসে ঝাড়া ছয় মাস ধরে শেখা বজ্রাদপি কঠোর এক কড়ে আঙুলের রদ্দা ঝাড়েন বদরুর কানের পেছনে, তারপর চোখের নিমিষে নিজের লুঙ্গি খুলে বদরুর মাথার ওপর গলিয়ে তার হাত শুদ্ধু দুটো গিঁট মেরে দ্যান। বদরু সেই বস্তাবন্ধনে আটকা পড়ে ছটফট করতে থাকে। সবাই প্রথমে চোখ বোঁজে। কিন্তু না, লুঙ্গির নিচে ঝাকানাকা সবসময়ই একটা হাফপ্যান্ট পরেন। কিংকু চৌধারি এগিয়ে গিয়ে ফোঁসফোঁস করতে থাকে বদরুর মাথায় বেত দিয়ে কষে একটা বাড়ি মারেন। বদরু ধুপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। আনিস কার্লমার্ক্স সুগন্ধী রুমাল বার করে কপালের ঘাম মোছেন। তারপর বলেন, "ইয়ে, গোয়েন্দা সাহেব, বদরু আমার পাঁচ লক্ষ টাকার একটা বাণ্ডিল চুরি করেছে, ওটা আমি ফেরত চাই!" নিখিল মন্তাজ মোবাইলে ফোন করে কাকে যেন, তারপর ফিসফাস করে কী যেন বলতে থাকে। ঝাকানাকা বলেন, "কিংকু সাহেব, বদরু আর এই সিডি, দুটোই আপনার জিম্মায় রইলো।" আনিস কার্লমার্ক্স অমায়িক হেসে বললেন, "খামাখা এই ভারি জিনিসটা টানাহ্যাঁচড়া করে কী লাভ গোয়েন্দা সাহেব? কত বড় বড় জেনারেল, অ্যাডমিরাল, এয়ার মার্শাল আমার এই লালিমা পাল পুঙে বছরের পর বছর ধরে ফেসিয়াল করাচ্ছে, জানেন? কেবিনেটের প্রায় সব মন্ত্রীর শালাসম্বুন্ধীরা আমার মক্কেল। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?" হাফটেকো ভদ্রলোক বলেন, "বদরুর ভাগের টাকাটা আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে, নাহলে আমরা যৌথ বিবৃতি র‍্যাটিফাই করবো না!" গুঁফো, ঝাঁকড়া আর বাঁটিছাঁট টেবিল চাপড়ে তাকে সমর্থন করে। আনিস কার্লমার্ক্স বলেন, "জেন্টলমেন! প্লিজ! লোভ করবেন না! অতি লোভে তাঁতী নষ্ট কিন্তু! খুউপ খিয়াল কইরা!" নিখিল মন্তাজ ফোন রেখে হাসিমুখে বলে, "বদি ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম। বদি ভাই বলেছেন, মানুষ যদি নিজের পেছনে উল্কি আঁকতে চায়, সেটা তার সংবিধানসম্মত অধিকার। এতে আপত্তির কোনো সুযোগ নেই। তাই আমি অফিসে ফিরে গিয়ে নিউজ পাঠিয়ে দিচ্ছি যে লালিমা পাল পুঙের ক্যামেরায় আপত্তিকর কিছু পাওয়া যায়নি। আর আপনি", গুঁফোর দিকে কলম তাক করে সে, "রোমশ ইস্যুতে আপনার সাথে আমার আলাদা আলাপ আছে।" গুঁফো যুবক ফোঁসফোঁস করে শুধু। কিংকু বিষণ্ণমুখে এসে ঝাকানাকাকে ফিসফিস করে বলে, "স্যার, এই বেটা কার্লমার্ক্সের কেমন কানেকশন দেখলেন? আবার সঙ্গে আছে কচুবন সম্পাদক বদি ভাই! মনে হয় বেটা পার পেয়ে যাবে!" ঝাকানাকা অজ্ঞান বদরুর বস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আসল পাজির হদ্দটাকে পিটিয়ে সোজা করা যায় না। আর এরাই ব্রন্টোসরাসকে রাজহাঁস বানিয়ে পার পেয়ে যায়!" ঝাকানাকার একটা ফেসবুক পেজ আছে।
false
rg
এ ট্রিবিউট টু সঞ্জীব চৌধুরী!! দেখতে দেখতে নয় বছর চলে গেল। সঞ্জীব দা নেই এখনো ভাবতে পারি না। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর আমাদের সবার প্রিয় সঞ্জীবদা, সঞ্জীব চৌধুরী না ফেরার রহস্যময় দেশে চলে গেলেন। যেখানে কেউ একবার গেলে সেই রহস্যময়তার মায়ায় আর পেছনের পৃথিবীতে ফিরে আসে না। হয়তো পেছনের পড়ে থাকা এই পৃথিবীর প্রতি অনেক টান থাকলেও কোনো এক গুপ্ত ধনের নেশায় আর কেউ ফেরে না। কারণ সবাই ততদিনে জেনে যায়, ওদের পেছন পেছন আমরাও সবাই একদিন সেখানে যাব। অ্যাডভান্স পার্টির রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আগে যারা যায়, তারা সেখানে গিয়ে অনেক কাজকর্ম এগিয়ে রাখে নিকটজনদের জন্য। হয়তো সঞ্জীবদাও সেই কাজের নেশায় ডুব মেরেছেন। আমরা তো কেউ দেখার সুযোগ পাচ্ছি না। যখন যাব, তখন আবার আড্ডায় আড্ডায় সেই ঘটনা দেখব।১৯৯৬ সালের জুন জুলাই মাস। দৈনিক ভোরের কাগজে সঞ্জীবদা তখন ফিচার পাতার দায়িত্বে। একদিন আমি সঞ্জীবদা'র কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম, দাদা আমি আপনার পাতায় লিখতে চাই। সঞ্জীবদার সামনের টেবিল জুড়ে তখন বিশাল আড্ডা চলছে। কোনো চেয়ার খালি নাই। টেবিলের বামপাশে পুরাতন পত্রিকার একটা উঁচু ঢিবি। সেই ঢিবি দেখিয়ে আমাকে বললেন, তুমি ওটার উপর বসো। প্রথম বাক্যের এই তুমিতে আমি মনে মনে এই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছি তখন থেকেই। তারপর সঞ্জীবদা কেবল অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে গেছেন বাকি জীবন। এমন দিলখোলা মানুষকে সহজে ভালোবাসতে পারা মানুষ আমি জীবনে খুব কম পেয়েছি। সঞ্জীবদা এক বিরল গোত্রের আজিব চিস ছিলেন। সঞ্জীবদার সাথে একবার যদি কেউ পরিচিত হয়েছে তো বাকি জীবন সে দাদাকে মনে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।সঞ্জীবদার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে মৃত্যুর ৫/৭ দিন আগে। একদিন বিকাল বেলা আমি ধানমন্ডি'র রাপা প্লাজা থেকে শুক্রাবাদের দিকে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। সোবহানবাগ মসজিদের সামনে থেকে রাস্তা ক্রোস করে এপার এসে দেখি সঞ্জীবদা দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, দাদা কোই যান? সঞ্জীবদা বললেন, তোমারে দেইখা খাঁড়াইলাম। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কোথায় আসছিলেন? দাদা বললেন, ডেন্টাল হোস্টেলে। তারপর শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আমরা একসাথে হেঁটে হেঁটে আসলাম। চা খেলাম। চিরুট খেলাম। টুকটাক গল্প করলাম। দাদা বললেন, লাভ রোডে আসো না ক্যান? আসবা। ওখানে ফিল্ম দেখার ব্যবস্থা আছে। জবাবে বললাম, দাদা, একদিন গেছিলাম। বিপুল আমাদের ছবি দেখাইলো। আপনি সেদিন ছিলেন না। সেদিন আমার সাথে ছিল সুমন। দাদা জিজ্ঞেস করলেন, কোন সুমন? বললাম, সুমন শামস। দাদা বললেন, হুম, ওতো ওর ফিল্মটা আমাদের ওখানে দেখাইতে চায়। কোই আর তো আসলো না। আচ্ছা, টোকনের খবর কী? টোকনের ছবি'র কী হইলো? তুমি না টোকনের সাথে ছিলা? দাদার প্রশ্নের জবাবে কইলাম, হুম। ব্ল্যাকআউটের কাজ প্রায় শেষ। রাশান কালচারাল সেন্টারে আমরা প্রিমিয়ার শো করেছি একটা। কিন্তু ফাইনাল কাট করার জন্য টোকন সামীরের সাথে আরো বসতে চায়। ফিল্মের এডিটিং কী আর শেষ হয়, দাদা!সঞ্জীবদা কইলেন, টোকনরে কইবা, আমি খুব খুশি। এ পোয়েট টার্নস টু ফিল্মমেকার। দ্যাটস এ গ্রেট নিউজ। ও মনে হয় আমার উপরে ক্ষেইপা আছে! জিগাইলাম, ক্যান? টোকনের সাথে আপনার কী হইছে? দাদা হাসি দিয়ে কইলেন, আরে কিচ্ছু না। বোঝো না, অনেক দিন দেখা হয় না। পাগলা একটা। কোই কোই বিজি থাকে। জবাবে বললাম, ব্ল্যাকআউট বানানো শুরুর পর আর কবি'র জীবন নাই দাদা। এখন এলিফ্যান্ট রোড টু গুলশান, গুলশান টু ধানমন্ডি, ধানমন্ডি টু পল্টন, পল্টন টু এলিফ্যান্ট রোড, এই করতে করতেই কখন দিন যায়!ক্যান? গুলশানে টোকনের কী? - গুলশানে এডিটর সামীরের বাসা। - আর ধানমন্ডি? - ধানমন্ডি চঞ্চলের বাসা।- চঞ্চল কী করতেছে?- চঞ্চল ব্ল্যাকআউটের সেট করছে। টাইটেল করছে।- আর পল্টন?- পল্টনে ধ্রুবদা'র বাসা।- শোনো, টোকনকে বলবা যেদিন ফ্রি থাকবে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় যেনো আমারে একটা ফোন দেয়।- আচ্ছা।- তুমি এখন এইখানে কী করবা? চলো ইস্টার্ন প্লাজা যাই?- না দাদা, বন্ধুরা আসবে। এখন আমি একটু সাইবার ক্যাফেতে বসবো।- আরে আবার আইসা পড়বা, চলো!- না, দাদা, একটু জরুরী ব্যাপার আছে।- তোমাগো কোনটা যে বেশি জরুরী! চলো, আবার চা খাই।তারপর আমরা আরেক পশলা চা খেলাম। দাদা একটা রিক্সা নিল। আমি সাকরিনের সাইবার ক্যাফেতে উঠে একটা কম্পিউটারে বসলাম। তখন আমি চুটিয়ে আড্ডা মারি এক আমেরিকান গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ক্রিস্টি। ক্রিস্টি থাকে টেনেসি। আমেরিকান হলে কী হবে! বিমানে চড়তে ক্রিস্টি খুব ভয় পায়। ঘুম থেকে উঠেই যাতে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে পায়, সেজন্যই আমি সন্ধ্যার আগেই শুক্রাবাদে হাজির থাকি। দুই আড়াই ঘণ্টা ক্রিস্টির সাথে প্রেম করে তারপর ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারে আমাদের নিয়মিত আড্ডা শুরু হয়। ধানমন্ডি নদীর পারে তখন আমাদের রেগুলার আড্ডার বয়স সাত বছর। ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের মাথায় শংকরের দিকে তখন আমার টেম্পোরারি অফিস। প্রফেসর নজরুল ইসলাম স্যারের নগর গবেষণা কেন্দ্রে। জাইকা'র সাথে আমরা তখন ঢাকার ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একটা গবেষণা করছিলাম। ঢাকার বাসা বাড়িতে যত ময়লা হয়, সেই ময়লা ডাম্পিং করে ঢাকা শহরের জন্য বিদ্যুৎ বানানো যায় কীভাবে, তাই নিয়ে সেই গবেষণা। এর আগে নজরুল স্যারের নগর বস্তির উপর এক গবেষণার কাজ মাঝপথে ফেলে রেখেই আমি ফেব্রুয়ারি মাসে লাপাত্তা হয়েছিলাম। সন্ধ্যায় টোকন ঠাকুর ফোন দিয়ে বলল, রেজা কোই আছেন? বললাম, অফিসে। কতক্ষণ থাকবেন? কয়েক মিনিট। মোস্তাফিজ নাস্তা আনতে গেছে। নাস্তা খেয়ে বেতনটা পেকেটে ঢুকাতে যতটুক সময় লাগে। জবাবে টোকন বলল, আমি ঝিনেদা থেকে এইমাত্র বত্রিশ নাম্বারে এসে ল্যান্ড করলাম। সিনেমা বানাতে হবে। আপনি চইলে আসেন। তারপর নজরুল স্যারের সেই জানুয়ারি মাসের বেতন পকেটে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে আমি ঠাকুরের সাথে সিনেমা বানাতে, ব্ল্যাকআউট বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সেপ্টেম্বর মাসে আমরা যখন রাশান কালচারাল সেন্টারে ব্ল্যাকআউটের প্রিমিয়ার শো করি, তখন নজরুল স্যারকে আমন্ত্রণ করতে গেছিলাম। নজরুল স্যার আমার উপর মোটেও রাগ করেন নাই, উল্টো খুশি হইছেন যে আমি সিনেমা বানানোর কাজে ছিলাম। পরে আবার ডেকে বললেন, সিনেমার কাজ শেষ হলে একদিন অফিসে আসো। তারপর আবার সেই ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্টের গবেষণা। গবেষণা ওয়াস্ট নিয়ে হলে কী হবে, সারা দিন কাটে আমার ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারে। বিচিত্রার অফিসে মাসুক ভাই (শিল্পী মাসুক হেলাল), রুদ্রাক্ষ (কথাশিল্পী রুদ্রাক্ষ রহমান), শেখরদা (কথাসাহিত্যিক শেখর ইমতিয়াজ), জসিম ভাই (সাংবাদিক জসিম উদ্দিন), রাজীবদা (শিল্পী রাজীব রায়) তো আছেই। সকালের হাফে আবার প্রায়ই যোগ দেন উন্মাদ শাহীন ভাই (কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব), পাভেল ভাই (ফটো জার্নালিস্ট পাভেল রহমান), শামীম ভাই (কথাশিল্পী ইমতিয়ার শামীম) ও টোকন ঠাকুর। আড্ডা তো আর ফুরায় না। বিকালের সেশনে আবার রিয়াজ (রিয়াজ হক), পুলক (পুলক বিশ্বাস), পবন (সুদত্ত চক্রবর্তী পবন), নাহিদ (মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ), নাছিম (অকাল প্রয়াত বন্ধু রেজাউল কবীর মাহমুদ নাছিম), বিপ্লব (মঈনুল বিপ্লব), রাশেদ (কবি জাফর আহমেদ রাশেদ), শামীম ভাই (ভোকা শামীম আহমেদ), বিপুদা (সত্যজিৎ পোদ্দার বিপু), রোকন (গল্পকার রোকন রহমান), খোকন (গল্পকার খোকন কায়সার), হুমায়ুন (হুময়ুন কবীর), রানা ভাই (নুরুদ্দিন রানা), খুলু (নজরুল ইসলাম), ফিরোজ (কবি ফিরোজ এহতেশাম), অলক (কবি অলক চক্রবর্তী), শাহীন (শিল্পী শাহীনুর রহমান), কল্লোল (ডা. কল্লোল চৌধুরী), রসুল ভাই (হযরত গোলাম রসুল), রাজীবদা (গল্পকার ও সাংবাদিক রাজীব নূর), মুকুল (নাট্যকার ও নির্দেশক আমিনুর রহমান মুকুল) সহ অনেকে। হুট করে ওই ধানমন্ডিতে বসেই খবর পেলাম সঞ্জীবদা চলে গেছেন। শামীম ভাই (ভোকা) ছিলেন সঞ্জীবদা'র দীর্ঘদিনের টেবিল পার্টনার। রম্য লেখক আহসান কবির আরেকজন টেবিল পার্টনার। সন্ধ্যায় যে যেখানে থাকুক। এই দুই পার্টনারের সাথে সঞ্জীবদার দেখা হবেই! শামীম ভাই ধানমন্ডিতে আমাদের সাথে আড্ডা দেওয়া শুরু করার পর থেকে সঞ্জীবদার সাথে আড্ডা একটু কম দেন। তাছাড়া সঞ্জীবদা তখন যায়যায়দিন পত্রিকায়। আর শামীম ভাই দাদার আগের কর্মস্থল ভোরের কাগজেই আছেন। সঞ্জীবদার হুট করে অমন চলে যাবার খবরে তাই আমাদের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছেন শামীম ভাই আর পাগলা টাকু আহসান কবির। এখনো এই দুই পাগলা সঞ্জীবদার কথা উঠলে হেনো গল্প নাই যা আমাদের না শুনিয়ে ছাড়েন। আহসান কবির আবার গল্প বলায় খুব ওস্তাদ। গলার ভয়েস চেইঞ্জ করে কোনটা ছফা ভাই আর কোনটা সঞ্জীবদা স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দেন। আহসান কবির রম্য লেখেন। আবার বেচারার মুখেও রম্য আর রম্যের খই ফোটে। রম্য ছাড়া কোনো গান নাই। এই ফাঁকে সঞ্জীবদাকে নিয়ে আহসান কবিরের বিখ্যাত সত্য গল্পটা একটু বলি-একবার সঞ্জীবদা গেছেন ছফা ভাই'র বাসায়। ছফা মানে হযরত আহমেদ ছফা। তো গিয়ে দেখেন প্রোফেট ছফা ভাই বাসায় পায়চারী করছেন। সঞ্জীবদাকে দেখেই বললেন, সঞ্জীব, তুমি কী আমার একটা উপকার করতে পারবা? সঞ্জীবদা জবাবে বললেন, কীসের উপকার ছফা ভাই? ছফা ভাই বললেন, আমাকে একজন ফটোগ্রাফার ম্যানেজ করে দাও। - ফটোগ্রাফার দিয়ে কী করবেন ছফা ভাই?- ছবি তোলাবো?- কার ছবি?- কার আবার? আমার!- আপনার ছবি তো যে কোনো সময় তোলা যাবে। আগে জানলে তো আমি ক্যামেরা সঙ্গে আনতাম।- তুমি ব্যাপারটা খুব হালকাভাবে নিচ্ছো সঞ্জীব?- হালকাভাবে কোথায় নিলাম? আপনি ছবি তোলাবেন। আমি তুলে দেব। বা কাউকে ডেকে তোলানোর ব্যবস্থা করবো। - তুমি বুঝতে পারছো না সঞ্জীব, ব্যাপারটা খুব জরুরী। - ছফা ভাই, আপনি একটু বসেন। শান্ত হন। আমি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতেছি। আমিও আপনার সাথে একটা জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আপনি একুট বসেন ছফা ভাই।- না আমি বসবো না। আগে তুমি আমার ছবি তোলার ব্যবস্থা করো। আমার ব্যাপারটা বেশি জরুরী, সঞ্জীব!- ছফা ভাই আপনি কিন্তু ছেলেমানুষি করতেছেন?- ছেলেমানুষি তুমি করতেছো। তুমি জানো আমার ব্যাপারটা কত সিরিয়াস?- ঠিক আছে, আগে আপনার সিরিয়াস ব্যাপারটাই বলেন, শুনি।- একটু আগে তসলিমা এসেছিল। আমি বললাম, আমার একটু শরীর খারাপ। তোমাকে বেশি সময় দিতে পারবো না আজ।-তারপর?- তারপর তসলিমা বললো, আপনি সকালে ঢাকা মেডিকেলে আমার চেম্বারে আসেন। আমি দেখে দিবানি। - তো, এখানে তো কোনো সমস্যা দেখি না। - তুমি একটা গাধা। সমস্যা না জেনেই তুমি কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছো না।- ছফা ভাই, আপনার শরীর খারাপ। তসলিমা দেখে দেবে। আপনি একা যেতে না পারলে প্রয়োজনে আমরা কেউ সঙ্গে যাবো। এখানে তো কোনো সমস্যা দেখি না।- তুমি একটা আস্তো গাধা!- আচ্ছা ছফা ভাই, খুলে বলেন তো আপনার সমস্যাটা আসলে কী?- শোনো, আমার পাছায় একটা ফোঁড়া উঠেছে। একেবারে গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। যে কারণে আমি একদম বসতে পারছি না। এখন তুমিই বলো সঞ্জীব, আমি কী তসলিমাকে আমার পাছা দেখাতে পারি? তুমি কও সঞ্জীব? তাই একজন ফটোগ্রাফার আমার খুব দরকার। পাছার ছবি তোলাবো। তারপর তসলিমাকে সেই ছবি দেবো। ব্যাপারটা তুমি এখন ক্লিয়ার?- হুম, একদম ক্লিয়ার, ছফা ভাই!আহসান কবিরের গল্প বলা শেষ হবার আগেই আমরা হেসে একেবারে গড়াগড়ি যাই। এখন ছফা ভাইও নাই। সঞ্জীবদাও নাই। দু'জনে হয়তো ওপারে বসে বসে এমন মজার সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন। আমরা যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে সঞ্জীবদা বা ছফা ভাইয়ের ঐতিহাসিক আড্ডায় আবার সামিল হবো। ততদিন আমরা কেবল সঞ্জীব দা আর ছফা ভাইকে হৃদয় দিয়ে স্মরণ করবো। এছাড়া তো আমাদের কাছে আর কোনো দাওয়া নাই! উই লাভ ইউ ছফা ভাই। উই লাভ ইউ সঞ্জীবদা। তোমরা ওই সুদূর আকাশের যে তারা হয়েই থাকো না কেন, একদিন আবার আমাদের নিশ্চয়ই দেখা হবে। অনেক আড্ডা হবে। তখন মনের কথা সব খুলে বলবো। আজ সঞ্জীবদার ৫২তম জন্মদিন। সঞ্জীবদার জন্মদিনে খুব বেশি মনে পড়ছে সঞ্জীবদাকে। এ রেড স্যালুট কমরেড। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সঞ্জীবদা বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সঞ্জীবদা তোমাকে আমরা ভুলি নাই। কোনোদিন তোমাকে ভুলতে পারবো না। ...............................১৯ নভেম্বর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:১১
false
rg
দিল্লীতে মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল!!! ভারতের দিল্লী বিধানসভায় শেষ পর্যন্ত নবাগত আম আদমি পার্টি রাজ্য সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আর মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন আম আদমি পার্টি (আপ)-র নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি ২৮ টি আসনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে দিল্লীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ৩১ টি আসনে বিজয়ী হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছিল শীর্ষে। আর মাত্র ৮ টি আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস হয়েছিল তৃতীয়। ৭০ আসনের দিল্লী বিধানসভায় বাকী তিনটি আসনে জিতেছিল জনতা দল (ইউনাইটেড) ১টি, শিরোমনি আকালি দল ১টি ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি।দিল্লীতে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা নবগঠিত আম আদমি পার্টি কিভাবে ভারতের রাজধানীতে এমন একটি অবিশ্বাস্য চমক সৃষ্টি করলো, তা আলোচনার আগে চলুন দেখে আসি কিভাবে আম আদমি পার্টির উত্থান ঘটলো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনশন প্রতিবাদ করে গোটা ভারতে একটি নতুন চমক তৈরি করেন আন্না হাজারে। জন লোকপাল আন্দোলন গোটা ভারতীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রনে একটি নতুন ধারার অহিংস আন্দোলন। যার নের্তৃত্ব দেন অন্না হজারে। কে এই অন্না হজারে?অন্না হজারে (জন্ম: ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪০) হলেন একজন ভারতীয় সমাজ সংস্কারক। তাঁর প্রকৃত নাম কিসান বাবুরাও হজারে। তিনি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আহমেদনগর জেলার রালেগন সিদ্ধি গ্রামের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য গোটা ভারতেই বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় রালেগন সিদ্ধি গ্রামটি একটি আদর্শ গ্রামে পরিণত হয়। এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে সরকারি কার্যালয়ে দুর্নীতি রোধে জন লোকপাল বিল আইনরূপে কার্যকর করার দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য অন্না হজারে আমরণ অনশনে বসেন।২০১১ সালে অন্না হজারে ভারতীয় সংসদে একটি অধিক শক্তিশালী দুর্নীতি-বিরোধী লোকপাল বিল পাস করানোর জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও কর্ণাটকের লোকায়ুক্ত এন সন্তোষ হেগড়ে, সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এবং ইন্ডিয়া অ্যাগেইনস্ট কোরাপশন আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যরা মিলে একটি বিকল্প বিলের খসড়া প্রস্তুত করেন। এই বিলটির নাম দেওয়া হয় জন লোকপাল বিল। পুরানা লোকপাল বিলের থেকে এই বিলে লোকপালদের অধিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে অন্না হজারে দিল্লির যন্তর মন্তরে আমরণ অনশন শুরু করেন। তাঁর দাবি হল সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ প্রতিনিধিত্বে একটি যৌথ কমিটি গঠন করে অধিক ক্ষমতাশালী ও অধিকতর স্বাধীন লোকপাল ও লোকায়ুক্ত নিয়োগের জন্য নতুন বিলের খসড়া প্রস্তুত করতে হবে। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর দাবি খারিজ করে দেন। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমগুলির মাধ্যমে অন্না হজারের আন্দোলনের কথা গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাঁকে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। তখন ১৫০ জন ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দেন। ওই সময় অন্না হজারে বলেছিলেন, কোনো রাজনীতিবিদকে তিনি আন্দোলনে অংশ নিতে দেবেন না। তখন মেধা পাটেকর, অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও প্রাক্তন আইপিএস অফিসার কিরণ বেদি, অন্না হজারের অনশন ও দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন। টুইটার ও ফেসবুকের মতো ইন্টারনেট সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও তখন অনেকে তাঁকে সমর্থন জানান। সেই সঙ্গে ধর্মগুরু স্বামী রামদেব, স্বামী অগ্নিবেশ ও প্রাক্তন ক্রিকেটার কপিল দেব, শেখর কাপুর, সিদ্ধার্থ নারায়ণ, অনুপম খের, মধুর ভাণ্ডারকর, প্রীতিশ নন্দী, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, প্রকাশ রাজ, আমির খান প্রমুখ বলিউড ব্যক্তিত্বরাও টুইটারের মাধ্যমে তাঁকে সমর্থন জানান। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে শরদ পাওয়ার মন্ত্রিগোষ্ঠীর দুর্নীতি পর্যালোচনা প্যানেল থেকে পদত্যাগ করেন। জন লোকপাল বিল আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে অন্না হজারের নের্তৃত্ব তখন একটি টিম অন্না গঠিত হয়। এক পর্যায়ে টিম অন্না'র অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে অন্না হজারের একটি বিষয়ে মত পার্থক্য তৈরি হয়। অন্না হজারের বক্তব্য হল, রাজনীতিতে অংশ না নিয়ে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। আর অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন যে, রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেই দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠন করতে ভূমিকা রাখতে হবে। সেই মত পার্থক্যের সূত্র ধরেই ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নের্তৃত্বে আম আদমি পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীতে যাত্রা শুরু করে। কে এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল?১৯৬৮ সালের ১৬ আগস্ট ভারতের হরিয়ানায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল জন্মগ্রহন করেন। খরগপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক পাশ করেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি টাটা স্টিল ফার্মে চাকরি করেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেবার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর কিছুদিনের জন্য তিনি কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনে কাটান। ওই সময় তিনি মাদার তেরেসা'র সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাদার তেরেসার দর্শনে দারুণভাবে উদ্ভুদ্ধ হন।১৯৯৫ সালে তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর তিনি একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেন। ২০০০ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য দুই বছরের জন্য চাকরি থেকে ছুটি নেন। ২০০৩ সালে তিনি আবার উচ্চ শিক্ষা শেষে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দিল্লী'র ইনকাম ট্যাক্সের যুগ্ম কমিশনার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিয়ে করেন সুনীতা দেবীকে। যিনি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একজন ব্যাচমেট ও ভারতের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগে কর্মরত। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন ভ্যাজিটারিয়ান।জন লোকপাল বিলের তিনি একজন অন্যতম ড্রাফটম্যান। এছাড়া গ্রাসরুট লেভেলে রাইট টু ইনফরমেশান আন্দোলনের তিনি একজন অন্যতম রূপকার। অন্না হজারের সঙ্গে মত পার্থক্যের কারণে আম আদমি পার্টি গঠনের মাধ্যমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভার নির্বাচনে তার নের্তৃত্ব আম আদমি পার্টি ২৮ টি আসনে জয়লাভ করে দিল্লী বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।৮ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে দিল্লী বিধানসভার ফলাফল ঘোষিত হয়। তখন থেকেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার নবগঠিত আম আদমি পার্টি দিল্লী'র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ৮ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের একটি সংক্ষিপ্ত টাইম লাইন এরকম: ৮ ডিসেম্বর: দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনে আম আদমি পার্টি (আপ) বিজয়ী।৯ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি (আপ) সিদ্ধান্ত নেয় যে, দিল্লী'র জনতা তাদের বিরোধী আসনে বসার রায় দিয়েছে। তাই সরকার গঠন করার দাবি তারা করবে না। ১০ ডিসেম্বর: দিল্লী বিধানসভায় সরকার গঠন করার জন্য কংগ্রেস আম আদমি পার্টিকে সমর্থণ করার ইঙ্গিত দেয়। তখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল পাল্টা বলেছিলেন, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে বরং একক বৃহত্তম দল হিসেবে বিজেপি সরকার গঠন করুক। ১১ ডিসেম্বর: কংগ্রেস বা বিজেপির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার পরিবর্তে নতুন করে ভোটে যেতে আপত্তি নেই আম আদমি পার্টি'র। ১২ ডিসেম্বর: একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে বিজেপি'র হর্ষ বর্ধনকে ডেকে পাঠালেন দিল্লির লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং। জবাবে বিজেপি জানিয়ে দেয় যে, জোড়াতালি দিয়ে তারা সরকার গঠনে আগ্রহী নয়। তারপর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল আম আদমি পার্টি (আপ)-কে ডেকে পাঠালে তারা ১৪ ডিসেম্বর লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবে বলে জানিয়ে দেয়। ১৪ ডিসেম্বর: লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের কাছে আম আদমি পার্টি (আপ) সিদ্ধান্ত নিতে ১০ দিন সময় চায়। একই সঙ্গে লোকপাল বিল, রাজধানীতে জল ও বিদ্যুৎ সঙ্কট-সহ ১৮ দফা দাবি নিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থান কি তা সুস্পষ্টভাবে জানতে চায় আম আদমি পার্টি। সেই অবস্থান জনগণকে জানানোর পর জনমত নিয়ে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানায় আম আদমি পার্টি। ১৫ ডিসেম্বর: ত্রিশঙ্কু দিল্লিতে জট খোলার কোনও আশা না দেখে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দেকে রিপোর্ট দিলেন লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সুপারিশও করেন নাজিব জং। ১৭ ডিসেম্বর: এসএমএস, ওয়েবসাইট ও জনসভার মাধ্যমে দিল্লির জনতার মতামত নেওয়ার ঘোষণা দেয় আম আদমি পার্টি। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে তাঁদের কী মত, জানতে ২৫ লক্ষ ভোটারকে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা করে দিল্লিবাসীর মত জানতে চায় আম আদমি পার্টি। ২০ ডিসেম্বর: কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে, কেজরিওয়াল মানুষের সমস্যা সমাধানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা এখন পূরণ করুন। আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আম আদমি পার্টি জবাবে জানায়, গনভোটের রায় পাওয়া না গেলেও আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ২১ ডিসেম্বর: অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন যে, দিল্লিতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস বা বিজেপি'র চেয়ে আম আদমি পার্টি বেশি ভাল কাজ করে দেখাবে।২২ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি জানায় যে, আগামিকাল দলের রাজনীতি বিষয়ক কমিটি দিল্লিবাসীর রায় সমীক্ষা করে দেখে চূড়াম্ত সিদ্ধান্ত নেবে।২৩ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি (আপ) ঘোষণা দেয় যে, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি সরকার গঠন করবে। ইতোমধ্যে ২৮ জন বিধানসভার বিজয়ী আম আদমি পার্টি'র সাংসদ অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তাদের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করেছেন। নাজিম জং-এর সঙ্গে দেখা করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরকে চিঠি লিখে সরকার গঠনের কথা জানানো হয়েছে। লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর ওই চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নির্দেশ এলেই শপথ গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হবে। আর প্রাথমিক আলোচনায় ঠিক হয়েছে যে, শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান হবে রামলীলা ময়দানেই। অর্থ্যাৎ দিল্লী রাজ্যসভায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন আম আদমি পার্টি'র নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গো অ্যাহেড ইয়াংম্যান। নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি পালনই হোক আপনার একমাত্র কর্মসূচি। জয়তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল।।
false
rg
গণতন্ত্র!!! খায় না মাথায় লয়!!! দ্বিজাতী তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে ভারত পাকিস্তান ভাগ হল। কারা করল এই ভাগ? সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা। তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? একটি জাতিগত বিবাদ যাতে এই ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী রূপ লাভ করে। তাদের সেই উদ্দেশ্য একশোভাগ সফল হয়েছে। তারপর কি হল? পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসল। এর আগে ১৯১৯ সালে হিন্দু মুসলিম আলাদা আলাদা ভোট দিয়েছিল। এবার দিল একত্রে। কিন্তু শেষ রক্ষা কি হল? ব্রিটিশ মদদপুষ্ট সামরিক জান্তা জেনারেল আইউব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। তারপর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আইউব খানের সামরিক শাসন। তারপর ইয়াহিয়া খানের সামরিত শাসন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হল বটে। কিন্তু বাঙালির ঘাড়ের উপর চেপে বসল রক্ষীবাহিনী। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনী ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। তারপর আবার জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন। তারপর ১৯৮২ সালে আবার আসলেন আরেক জেনারেল এরশাদ। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেনারেল এরশাদ সামরিক ক্ষমতায় দেশ শাসন করল।'৯০-এর গণ-আন্দোলনে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের অবসান হলেও বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে সামরিক স্বৈরশাসনের মতই দেশ শাসন করলেন। ভেতরে ভেতরে এরশাদকে নিয়ে টানাহেচড়া শুরু হল। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের কেন এতো গুরুত্ব? কারণ, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা। এরশাদের পতন হলেও সেই ভূত রয়ে গেল। তারপর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে টানাটানি। সেই টানাটানিতেও পতিতত স্বৈরাচারী এরশাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থাকল। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসলেন সেই পতিত স্বৈরাচারের সমর্থন নিয়ে। ২০০১ সালৈ আবার বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে যখন সরকার গঠন করল, তখন পতিত স্বৈরাচারী এরশাদের গুরুত্ব আওয়ামী লীগের কাছে আরো বেড়ে গেল। যে কারণে, সেই স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও ক্ষমতার পালাবদলে এরশাদ ফ্যাক্টর রয়ে গেল নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রায়।২০১৩ সালে তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো স্বৈরাচার এরশাদ একটা প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে উঠলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাকে নিয়ে রশি টানাটানি করল। আওয়ামী লীগ এরশাদকে দলে ভাগিয়ে বিএনপিকে বাধ্য করল স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে জোট পাকিয়ে থাকতে। কিন্তু জেনারেল এরশাদ তো একটা উদাহরণ, তার পেছনের শক্তির রহস্য যদি বোঝা না যায়, তাহলে তাকে জোটে ভেড়ানোর রহস্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বোঝা যাবে না। যে কারণে, আওয়ামী লীগ আবারো সেই পতিত স্বৈরাচারী এরশাদকে নিয়েই সরকার গঠন করল। মূল রহস্য সেই ব্যারাক কেন্দ্রীক ক্ষমতার কেন্দ্রে। আর সেই চালে বেগম জিয়া ভুল করেছেন। শেখ হাসিনা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের আদৌ কোনো লাভ হয়নি। মূলত গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ৪২ বছরের বাংলাদেশে এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ব্যারাক। জনগণ ভোটের নামে কিছু উৎসব নিয়েই খামাখা মেতে ওঠে। বাংলাদেশের ৪২ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম তিন বছরের রক্ষীবাহিনী, পরবর্তী ১৫ বছরের সরাসরি সামরিক শাসন, পরবর্তী বেগম জিয়া'র '৯১ থেকে ৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৬ আর শেখ হাসিনার '৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০১৩ এই ২০ বছরের নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্র তাই জনগণের জন্য কোনো সুশাসন বয়ে আনতে পারেনি। মাঝখানে ২০০৯-২০০৯ আবারো সেই ব্যারাক নির্ভর ক্ষমতা আসলে এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।তাই ২০১৪ সালে আবারো যখন জেনারেল এরশাদ প্রধানমন্ত্রী'র বিশেষ দূত হন, সেটা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। এরশাদের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়েন তাদের হাতে রাখতে এরশাদ ফ্যাক্টর বাংলাদেশে আরো অনেক দিন টিকে থাকবে। আর সেই ফাঁকে খোদ রাজনীতিতে সত্যিকারের রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে বিরল প্রজাতীতে পরিণত হচ্ছে। সেখানে জায়গা দখল করছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, সাবেক আমলা, শিল্পপতিরা। জনগণ থেকে কোনো রাজনৈতিক নেতা বের হয়ে আসছে না। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের নামে যা যা ঘটবে তার প্রায় সবটাই ওই রহস্যঘেরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু'র শুভদৃষ্টিকে ঘিরে। খামাখা সাধারণ জনগণ নানান আনন্দোলনের নামে অবাধে প্রাণ দেয় আর রাজনীতির এই গুমটরহস্যকে আরো রহস্যময় করে রাখার জন্য একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা চলে। আর বিদায় নেওয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নানান অযুহাতে ছবক মারেন, তোমাদের এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এটা হচ্ছে না, ওটা হচ্ছে না। প্রকৃত সত্য হল, দেশের মানুষ শুধু প্রকৃত শিক্ষা পেলেই আর ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে নিজেরা বিশ্লেষণ করতে পারলেই ভবিষ্যতে তখন রাজনৈতিক জনসভায় আর এতো উপস্থিতি যেমন দেখা যাবে না। তেমনি কেউ ডাক পারলেই না বুঝেই সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। মূল সমস্যা শিক্ষার অভাব। আর সেটাকে ছলেবলে কৌশলে পধ্চাৎমুখী করে রাখাই রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের প্রধান টার্গেট। আর বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে সেটা তারা বেশ সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছে। সো, ক্ষমতার চেয়ারে আর কে কোথায় কীসের ষড়যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত তা নিয়ে সাধারণ জনগণের কোনো লাভ হবে না। গণতন্ত্র যে মুর্খদের কারখানা তা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দালিলিক প্রমাণে সত্য হয়ে শোভা পাচ্ছে।
false
rn
কি লাভ হরতাল দিয়ে,গাড়ি বাসে আগুন দিয়ে_ আসুন দেশকে ভালোবাসি এই দেশে হিন্দু থাকবে, খ্রিষ্টান থাকবে, বৌদ্ধ থাকবে, মুসলমান থাকবে এবং নাস্তিকও থাকবে।এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকবো। কার কি ধর্ম সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সবার আগে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।যদিও ব্যাঙের ছাতায় ভরে গেছে দেশ! একবার আপনারা ভাবুন কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছেন ভবিষৎ প্রজন্মর জন্য ! গ্রামে শান্তি নাই, শহরে শান্তি নাই। বাসায় শান্তি নাই, এমন কি ব্লগে- ফেসবুকেও শান্তি নাই। কেন আমরা আমাদের নিজেদের শান্তি নষ্ট করছি? আসুন আমরা সবাই চেষ্টা করে দেখি- সুখে শান্তিতে বাস করতে পারি কিনা। কি লাভ হরতাল দিয়ে? গাড়ি বাসে আগুন দিয়ে? আসুন দেশকে ভালোবাসি, দেশের জন্য কিছু করি। ক্ষমতা দখলের রাজনীতির চক্রে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ আজ নিতান্তই অসহায়!ধর্মের নামে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের এক চক্রান্ত নতুন ভাবে শুরু হয়েছে। আজ থেকে ১৪৫০ বছর আগে রোমের সামন্ত রাজারা প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী খ্রিষ্টান ক্যাথলিক চার্চের যাযকদের সহায়তায় জনগনের উপর ধর্মের নামে যে অত্যাচার করে ছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল "ব্লাসফেমি"। ৯ তারিখ এইচ.এস.সি পরীক্ষা থাকাও সত্বেও বিএনপির হরতাল দিল! আল্লাহ তুমি ওদের হেদায়েত দান করো।হরতাল শব্দটার প্রতি এক আকাশ ঘৃ্না জমেছে।এতো হরতাল ডাকার মানে কি? এরা নাকি দেশের ভাল চায়।আমাদের এত কষ্ট দেবার অধিকার তাদের কে দিল ?ফকরুল, খালেদা বা হাসিনার, কথা মনে হলেই মুখে এক দলা থুত জমে যায়।হেফাজতে ইসলাম এখনও বুঝেনি- ব্লগ এবং ব্লগার কি জিনিস।স্বপ্নের বাংলাদেশে গড়তে পারে ব্লগার'রা।জামায়াতকে বাঁচাতে নামা হেফাজতের তেরো দফার নামে যে শিশুতোষ আবদারনামা উপস্থাপন করেছে তা খুবই হাস্যকর।হেফাজতে ইসলাম কোন একক রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি একটি মঞ্চ যার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনগুলো।আজকের হরতালে হেফাজতে ইসলাম রেললাইন উপড়ে ফেলেছে কারণ রেলে করে নাকি নারীরা যাতায়ত করে। হেফাজতে ইসলাম খুবই আধুনিক মন-মানসিকতার দল। তারা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করে। যেহেতু এখন ২০১৩ সাল তাই তারা ভাবল ১৩ দফাই দেই। প্রতিটি দিন হাসি দিয়ে শুরু করা, জোর করে হলেও হাসতে চেষ্টা করা— তাহলে দেখা যাবে একসময় সত্যিই অনেক ঝামেলার মধ্যেও আমরা খুশি থাকতে শিখে যাবো।বিএনপি'র নেতাদের গ্রেফতার করার কারনে তারা দুই দিন হরতাল দিল। দেশবাসী কি হরতাল চেয়েছে? তাহলে আপনাদের গুটি কয়েক নেতাকে ধরার কারনে সারা দেশের মানুষকে কষ্ট দেওয়া কেন? তাদেরকে ধরার কারনে আপনাদের বুকে কষ্ট হয়েছে- সেই কষ্টের ভাগ আমাদের দেন কেন ? আমরা কি চেয়েছি? আপনারা নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনশন করুন শহীদ মিনারে গিয়ে। দেখি কতদিন পারেন। সব দলের রাজনীতিবিদরা বয়সের বাড়ে নুয়ে পড়েছে।তাদের দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। তাদের বুদ্ধি চলে এসেছে হাঁটুর নীচে। হাঁটুর নীচের বুদ্ধি দিয়ে দেশের জন্য কিছু করা যায় না। তবে দুই একজনের কথা আলাদা।আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,রমণীদের ভাল গুণের প্রতি তাকাও। এতে তোমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসবে এবং অসদাচরণের পথ বন্ধ হবে।একটি বিষয় অপছন্দ হলে অন্যটি পছন্দ হতে পারে।’ সেই গুণটির প্রতি তাকাও। পছন্দের গুণটির প্রতি লক্ষ করে তার সাথে সদাচরণ কর। আমাদের সমাজের সব নষ্টের মূল এটাই। আমরা শুধু মন্দটাই বলি ভাল গুণের প্রতি তাকানর প্রয়োজনবোধও করি না। তাই রাসূলে আকরাম সা. বলেন, এর পরেও কি তোমরা নারীর এ ত্যাগের মূল্যায়ন করবে না? তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে না? তাদের ত্যাগের সঠিক মর্যাদা দান তোমাদের জন্য আবশ্যক।আল্লাহ তা’আলা তার নেক বান্দাদেরকে অভিনব পদ্ধতিতে পরীক্ষা করেন। যেন তারা পরীক্ষায় সফলতা লাভ করে পৌঁছে যেতে পারেন মর্যাদার শীর্ষ চূড়ায়।ভাই, হেফাজতে ইসলাম এবং আরও যত ইসলামী দল আছেন- আপনারা আন্দোলন বন্ধ করুন। হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, লংমার্চ- ইট পাটকেল নিক্ষেপ, জ্বালাও পোড়াও, টুপি-দাড়ির সাথে হাতে লাঠি মানায় না।আপনাদের হাতে মানায় জায়নামাজ এবং তসবি। আপনারা নামাজ রোজা করুন, দেশের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।লং মার্চ শব্দটি পরিচিতি পায় ১৯৩৫ সালে মাও-সে-তুং এর লং মার্চ কর্মসুচির মধ্য দিয়ে।লং মার্চ মুলত করা হয় আন্দোলন করে কোন দাবি আদায় করার জন্য।হেফাজতে ইসলাম আপনারা কি পারবেন দুই নেত্রীকে ইসলামী পোষাক পড়াতে ? ভ্রু প্লাক করা, গোলাপী লিপষ্টিক দেওয়া এবং রঙ্গীন চশমা পড়া বন্ধ করতে?এক হিন্দু দম্পতি রিকশা করে অতিক্রম করবার সময়ে হেফাজতে ইসলাম এর কিছু পিকেটার তাদের পথ রোধ করেন এবং তাদের মারধর করা হয়। মাদ্রাসার কিছু ছাত্র হেফাজতের কথায়- খুব বেশী হইচই করেছে।আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছি আমরা ? বিরোধীদল আপনারা প্রতিবাদ স্বরুপ আপনাদের গাড়ি ভাঙ্গুন, নতুন নতুন ব্রীজ তৈরী করুন, কলকারখানা স্থাপন করুন। আর যদি একটা হরতাল দেওয়া হয়, কোনো গাড়ি বাসে আগুন দেওয়া হয়, মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়,জনজীবন বিধ্বস্ত করা হয় -আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। হরতাল অথবা গাড়ি বাসে আগুন দিলে অন্তত পক্ষে ঝাড়ু জুতা দিয়ে দুই একটা দিয়ে দিবেন কপালের মধ্যে।১৬ কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবেন না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা।এই বাংলায় হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান, বৌদ্ধ এবং ব্লগার'রা তারা আমাদের ভাই- তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।কোনো দলের হয়ে যদি টেলিভিশন এবং পত্রিকা গুলো যদি সঠিক খবর প্রকাশ না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জয় বাংলা।দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমার দম বন্ধ লাগছে। কীভাবে প্রতিবাদ করব তাও বুঝতে পারছি না।
false
ij
দার্শনিক ইবনে রুশদ_ তাঁর নিগ্রহ, তাঁর সম্মান ___ ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দ। স্পেনের কর্ডোভা শহরের আলজামা মসজিদ। মসজিদটি অস্টম শতকে একটি চার্চ ছিল- কর্ডোভায় উমাইয়া বংশের স্থপতি আমির আবদুর রহমান চার্চটি কিনে মসজিদে রুপান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বর্নালী গম্বুজবিশিষ্ট বিশাল মসজিদ- তারই সামনে নতশিরে দাঁড়িয়ে আছেন কর্ডোভা নগরের একজন মুক্তমনা লেখক ও স্বাধীন চিন্তাবিদ-রুশদ। তাঁকে অত্যন্ত বিমর্ষ দেখাচ্ছে, তাঁর পরনে শতছিন্ন ময়লা পোশাক। মসজিদে যারা ঢুকছে আর বেরুচ্ছে তারা সবাই দার্শনিকের গায়ে থুতু ফেলছে! কেন? কারণ রুশদ এমন কিছু বিশ্বাস করেন, এমন কিছু লেখেন- যার সঙ্গে কর্ডোভা নগরের লোকেদের বিশ্বাসের ফারাক আশমানজমিন । যেমন রুশদী বিশ্বাস করেন- জগৎ শ্বাশত, জগৎ ঈশ্বরদ্বারা সৃষ্ট নয় । দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর নির্বিকার; কাজেই মানুষের কর্মকান্ডে ঈশ্বরের তথাকথিত স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না। আর, সমগ্র মানবজাতির জন্য রয়েছে একটিই সক্রিয় বিচারবুদ্ধি বা রিজন, রুশদ যাকে বলেছেন ‘এজেন্ট ইন্টেলেক্ট’- যে কারণে মৃত্যুর পর ব্যাক্তিগত পুনুরুর্জ্জীবন অসম্ভব; এবং দার্শনিক মত বিরোধ থাকলেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিটি দার্শনিক মতই সত্য। এই বিশ্বাসের জন্যই তাঁর এই নিগ্রহ। এই বিশ্বাসের জন্যই তাঁকে ধর্মান্ধদের চাপে কর্ডোভা নগর থেকে পার্শ্ববর্তী লোসীনিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছিল । কিন্তু, লোসীনিয়ায় কেন? ধর্মান্ধরা দাবী করেছিল, রুশদ এর পূর্বপুরুষ নাকি ঐ অঞ্চল থেকেই এসেছিল। লোসীনিয়া জায়গাটি ছিল ইহুদিঅধ্যুষিত। লোসীনিয়াবাসী অবশ্য অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গেই গ্রহন করেছিল রুশদকে । কেননা, প্রথমত: তাদের মধ্যে দর্শনের মতো স্বাধীন বিষয়ের চর্চা ছিল; দ্বিতীয়ত: তারা উপলব্দি করেছিল, ভবিষ্যতের মানুষ ইবনে রুশদকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করবে তাঁর স্বাধীন চিন্তার জন্য । স্পেনের মানচিত্র। রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের (৭৬-১৩৮) শাসনামলে ইহুদিরা জুদাহ বিদ্রোহ করেছিল; সে সময় ৫ লক্ষ ইহুদিকে জুদাহ থেকে স্পেন নির্বাসিত করা হয়েছিল। ভিসিগথরা ছিল ৫ম শতকের জার্মানিক জাতি; এরা স্পেনসহ রোমান সাম্রাজ্যের কিয়দংশ জয় করেছিল। আরব অভিযানের আগে স্পেন শাসন করত ভিসিগথরা-তারা স্পেনের ইহুদিরা ওর জুলুম করত। ইসলামের প্রথম রাজবংশ উমাইয়া ; তাদের সময়ই অষ্টম শতকে স্পেন আরবদের করতলগত হয়। ইহুদিরা স্বাগত জানিয়েছিল স্পেনে মুসলিম অভিযানে। বেরবাররা ছিল উত্তর আফ্রিকার অন্ -আরব গোত্র। উমাইয়া সৈন্যরা বেরবার দের নিয়ে স্পেন জয় করে। এরপর স্পেনের শহরগুলি মুসলিম সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সেভিল ও কর্ডোবা অন্যতম । কর্ডোবা (আরবিতে কুরতুবা) হয়ে স্পেনে মুসলিম খেলাফনের কেন্দ্র। স্পেনে মুসলিম প্রভাবিত অঞ্চলকে বলা হয় আন্দালুসিয়া। যা হোক। লোসীনিয়ায় রুশদের ওপর ধর্মান্ধদের নির্যাতন চলছিল। তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সফল হলে না। মৌলবাদীরা তাঁকে আটক করে কর্ডোভায় এনে আলজামা মসজিদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে। স্পেনের সুলতান সেসময় ইয়াকুব মনসুর । রুশকে আগে থেকেই চিনতেন, লেখক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি লোক পাঠিয়ে মোল্লাদের হাত থেকে দার্শনিকটিকে উদ্ধার করেন। রুশদের বাড়িটি আলজামা মসজিদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তাঁর পিতামহ আবদুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ (মৃত্যু ১১২৬) আলজামা মসজিদেরই ইমাম ছিলেন; প্রধান বিচারকও ছিলেন তিনি। রুশদের পরিবারটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত। রুশদের পিতা আবদুল কাশিম আহমদও ছিলেন বিশিষ্ট আলেম ও প্রধান বিচারক । বাড়ির দিকে যেতে যেতে সে সব কথাই ভাবছিলেন রুশদ। কর্ডোবা নগরের গলি, বাড়ি রুশদ এর জন্ম ৫২০ হিজরীতে (১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) । জন্মকালীন নাম ছিল: আবু ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে রুশদ। পিতা ও পিতামহ বিদ্যানুরাগী ছিলেন বলেই তাদের বাড়িটি হয়ে উঠেছিল বিদ্যালয়। দূরবর্তী স্থান থেকে ছাত্ররা এসে থাকত, পড়াশোনা করত। বাবার কাছে শৈশবেই কোরান শিক্ষা হয়েছিল রুশদের। শৈশবেই ইমাম মালিক লিখিত মোতা (ফিকা শাস্ত্র ) মুখস্ত করে ফেলেছিল মেধাবী বালকটি। তারপর পাঠ্যসূচির অর্ন্তভূক্ত হল আরবি ব্যকরণ ও সাহিত্য। কাব্যের প্রতি বাল্যকাল থেকেই ছিল তীব্র অনুরাগ । তবে কার্ল মার্কসের মতোই সে অনুরাগ বিসর্জন দিতে হয়েছিল বাস্তবতার ফেরে। (বিংশ শতাব্দীর এক প্রখ্যাত পন্ডিতের মন্তব্য) তবে দর্শনের প্রতি অনুরাগ ছিল গভীর। সেকালে স্পেনের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ছিলেন আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে বাজা। বাজার জন্ম স্পেনের সারাগোসায় হলেও কর্ডোভা নগরে এসে বাস করতেন। মৌলিক লেখা ছাড়াও বাজা অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যা লিখেছেন। তবে কম লিখেছেন বাজা । স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ছিলেন বাজা- বিশ্বাস করতেন: ‘ধর্মীয় রহস্যবাদ হৃদয়ের অন্তস্থলে যে প্রতিবিম্বকে প্রকট করে তা সত্যকে প্রকাশ না করে বরং আড়ালই করে।’ নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার কারণে বাজাকে কারাবাস ভোগ করতে হয়েছিল। তখন বলেছি, রুশদের পিতা আবদুল কাশিম আহমদ সুপন্ডিত ও প্রধান বিচারক ছিলেন-তিনি বাজাকে মুক্ত করেন। কাজেই রুশদের পারিবারিক পরিমন্ডলের উদারতার বিষয়ে আঁচ পাওয়া যায়। বাজা-র কাছেই দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন রুশদ। ১১৩৮ সালে মারা যান বাজা । বাজার অন্যতম শিষ্য ছিলেন তুফৈল (তোফায়েল?) তিনিও দার্শনিক ছিলেন, কবিতাও লিখতেন। তুফৈল-এর অনেক বিশ্বাসের একটি ছিল: ‘গূঢ়চেতনা (ইনটুইশন) দ্বারা প্রত্যক্ষ বস্তুকে শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।’ তুফৈল ও বাজার উদ্ধৃতি থেকেই আমরা উপলব্দি করতে পারি তৎকালে অর্থাৎ দ্বাদশ শতকে মুসলিম দর্শন কোন্ স্তরে পৌঁছেছিল। অথচ, এই একুশ শতকেও বাংলায় দর্শন সেভাবে সুসংগঠিত হয়ে উঠল না! অবশ্য বাংলায় দর্শন কে বলে ভাব। সে দিক দিয়ে খামতি কোনওকালেই ছিল না -তবে মূলস্রোতের আলোচনার ধারাবাহিকতার প্রয়োজন ছিল। (এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: মশিউল আলম-রচিত প্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। পৃষ্টা,৯। অবসর প্রকাশনী) একই গুরুর অধীন শিষ্যদের বলা হয় গুরুভাই । তুফৈল ছিলেন রুশদের গুরুভাই। তুফৈল ঠিকই রুশদের ভিতরকার জ্ঞানের সুপ্ত আগুন টের পেয়েছিলেন। কর্ডোভার রাজদরবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তুফৈল-এর । সুলতান তখন মনসুরের পিতা ইউসুফ। অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী সুলতান, অ্যারিস্টটলের দর্শন বিশ্লেষন করতে সক্ষম। সুলতান কে তুফৈল বললেন রুশদের লুক্কায়িত আগুন-প্রতিভার কথা। রুশদ ততদিনে পাঠ শেষ করে সদ্য অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছেন । আইনে সুপন্ডিত হলেও দর্শন ও চিকিৎশাস্ত্রেই তাঁর নাম ছড়িয়েছিল। রুশদকে রাজদরবারে নিয়ে গেলেন তুফৈল। বয়স্ক সুলতান ইউসুফ নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা আবদুল কাশিম প্রধান বিচারক ছিলেন-না? জ্বী। রুশদ মাথা নাড়ে। ভীষণ কুন্ঠা বোধ করছেন। সুলতানের সামনে এই প্রথম এলেন। বেশ। তা হলে বল ঈশ্বর নিত্য না অনিত্য? মানে মানে ... রুশদ নার্ভাস। কী উত্তর দেবে। সুতান রসিক ছিলেন। বললেন, ঠিক আছে। আচ্ছা, বল তো সেভিল নগর সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? রুশদ এবার চট করে উত্তর দিলেন, সেভিলে পন্ডিত মারা গেলে তার বইগুলি কর্ডোভায় নিয়ে আসা হয়; আর কর্ডোভায় সংগীতজ্ঞ মারা গেলে তার বাদ্যযন্ত্রগুলি নিয়ে যাওয়া হয় সেভিলে। হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন সুলতান। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, সেভিলে কাজীর পদ খালি আছে? সেভিলে যাবে কি? রুশদ রাজী। অ্যারিস্টটলের অ্যানিমা (আত্মা) পড়ছেন। ধ্বনি সম্বন্ধে কিছু ভাবনা মাথায় এসেছে। আরবসংগীত নিয়ে গবেষনায় হাত দিয়েছেন। সেভিল সংগীততীর্থ। সেখানেই গবেষনার সুবিধা। তা ছাড়া, একটা চাকরিও তো জরুরি। ১১৬৯। সেভিলে এলেন রুশদ। শুরু হল ব্যস্ত জীবন । এ প্রসঙ্গে পরে লিখেছেন, ‘সরকারি কাজে আমায় এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে শান্তচিত্তে লেখার অবসর পাইনা। তাই লেখাগুলি ক্রটিমুক্ত হচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।’ তবে ঐ বছরই অ্যারিস্টটলের প্রাণিশাস্ত্রের ব্যাখ্যা লিখে সম্পূর্ন করেন। রুশদ মূলত অ্যারিস্টটলের রচনার টীকাভাষ্যের জন্যেই বিখ্যাত। তাছাড়া তিনি নব্যপ্লোটোবাদী ব্যাখ্যার হাত থেকে অ্যারিস্টটলের দর্শনকে রক্ষা করার চেস্টা করেন। (ঘটনাটি ঘটেছিল আল ফারাবির সময়ে) ... অ্যারিস্টটলের রচনার তিন ধরনের বয়ান করেছিলেন রুশদ। ১, সংক্ষিপ্ত প্যারাফেজ বা শব্দান্তরিত প্রকাশ কিংবা বিশ্লেষন। ২, পাঠ্যের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এবং ৩, আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা। রুশদ যাই হোক। কাজীর দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে লেখা চলছিল। অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন রুশদ। কাউকে মৃত্যুদন্ড দিতে হলে বিব্রত বোধ করতেন এবং এই বিব্রত বোধ করাটা রাজনৈতিক চাপে নয়। এ প্রসঙ্গে রুশদের জীবনীকার লিখেছেন,‘তিনি এতই দয়ালু ছিলেন যে কয়েক বছর কাজীর পদে কাজ করলেও কাউকে মৃত্যুদন্ড দেননি। এ রকম কোনো অবস্থা এলে স্বয়ং বিচারকের আসন ত্যাগ করে অন্য ব্যাক্তিকে সেখানে বসাতেন।’ স্পেনের মানচিত্রে সেভিল সুলতান ইউসুফ মারা গেলেন। তাঁর ছেলে ইয়াকুব মনসুর সুলতান হলেন । পিতার মতোই অত্যন্ত জ্ঞানপিপাসু ছিলেন মনসুর । রাজদরবারেই তত্ত্বালোচনা করতেন। এদিকে, যা হয়, রুশদের সেভিলে আর ভাল লাগছিল না, কাজীগিরিও আর ভালো লাগছিল না। কাজীর পদে ইস্তফা দিয়ে কর্ডোবায় চলে আসেন রুশদ। সুলতান মনসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। রুশদের সঙ্গে কথা বলে সুলতান যাকে বলে ইপ্রেসড। তারা বন্ধু হয়ে উঠলেন। এগারো বছর রুশদকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন সুলতান মনসুর । এরই মধ্যে দর্শন গ্রন্থ ২৮টি, চিকিৎসাশাস্ত্র ২০টি, ফিকাশাস্ত্র ৬ টি, কলামশাস্ত্র ৪টি, জ্যোতিষ গণিত ৮টি, আরবী ব্যাকরণ ২টি লিখে শেষ করলেন রুশদ। প্রতিটা রচনাই লিখেছেন আরবী ভাষায়। এরপর ঘনিয়ে এল বিপদ। এর কারণ, আগেই বলেছি, রুশদের দার্শনিক বিশ্বাস হয়ে উঠেছিল গোঁড়াদের চক্ষুশূল। নবম শতক থেকেই দার্শনিক আল কিন্দি এবং আল ফারাবির মাধ্যমে ইসলামী দর্শনে গ্রিক দর্শনের প্রভাব পড়ছিল-যা গোঁড়ারা মেনে নিতে পারেনি। দার্শনিকদের ধ্বংস কামনা করে ইমাম গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১) লিখেছেন: তাহাফুতুল ফালাসিফা। (দার্শনিকদের অসংলগ্নতা বা দার্শনিকদের ধ্বংস) যে বইয়ে ইমাম গাজ্জালী দাবী করলেন, জ্ঞানের ভিত্তি মানবীয় যুক্তিবুদ্ধি নয়- ঐশি প্রত্যাদেশ। ইমাম গাজ্জালীর যুক্তির জবাব দিয়ে রুশদ লিখলেন (তাহাফুত আল- তাহাফুত অসংলগ্নতার অসংলগ্নতা বা ধ্বংসের ধ্বংস।) সে গ্রন্থে ঐশি প্রত্যাদেশের পরিবর্তে রুশদ মানবীয় যুক্তিবুদ্ধির গুরুত্ব আরোপ করলেন। ইমাম গাজ্জালীর মত খন্ডন করে রুশদ লিখলেন,‘দার্শনিকগনের সমালোচনা শুধু তিনিই করতে পারেন, যিনি আন্তরিকভাবে দর্শনের গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন (গাজ্জালী ইবনে সিনা অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ছিলেন না)। গাজ্জালীর আক্ষেপের দুটি কারণ থাকতে পারে --হয় তিনি সর্বজ্ঞ ছিলেন তাই অন্যের অজ্ঞতায় আক্ষেপ করেছেন, কিন্তু এ কাজ অসৎ ব্যাক্তিরই শোভা পায়; নয়তো তিনি স্বয়ং ছিলেন অনভিজ্ঞ, আর অনভিজ্ঞ ব্যাক্তির আক্ষেপ মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না।’ অ্যারিস্টটলের দর্শনের একটি প্রতিপাদ্য প্রকৃতির কার্যকারণের অনঢ় ও অলঙ্ঘনীয় বিধান-যা রুশদ মেনে নিয়ে ছিলেন। প্রকৃতির কার্যকারণ নিয়মকে অস্বীকার করে তাহাফুত আল ফালাসিফা গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালী লিখেছিলেন, ‘এটা মেনে নিলে ‘কেরামত’ অর্থাৎ অপ্রাকৃত ঘটনা সম্বন্ধে ভ্রান্তি সৃষ্টি হবে এবং মনে রাখা দরকার ধর্মের বুনিয়াদ এই কেরামতের উপরই নির্ভরশীল।’ আমরা এ প্রসঙ্গে রুশদ এর গুরু আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে বাজার একটি উক্তি স্মরণ করতে পারি। বাজা বিশ্বাস করতেন ‘ধর্মীয় রহস্যবাদ হৃদয়ের অন্তস্থলে যে প্রতিবিম্বকে প্রকট করে তা সত্যকে প্রকাশ না করে বরং আড়ালই করে।’ এ থেকে বোঝা যায় ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই চলছিল। যা হোক, ইমাম গাজ্জালী উত্তরে রুশদ লিখলেন, ‘ যিনি কার্যকারণ নিয়মকেই অস্বীকার করেন তাঁর এটাও স্বীকার করার প্রয়োজন নেই যে প্রতিটি সৃষ্টি ও কার্যের পিছনে একজন কর্তার হাত আছে।’ ইমাম গাজ্জালী স্পেনের মুসলিম সমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন। কাজেই স্পেনব্যাপী কাঠমোল্লারা রুশদের ওপর খেপে ভয়ানক উঠল। তাঁর বইগুলি আগুনে নিক্ষেপ করা হল। অনেকটা বাধ্য হয়েই সুলতান মনসুর রুশদের বিচার বসালেন। রুশদ যদিও ঘনিষ্ট বন্ধু, তবু তাঁর পক্ষ নিলে জনগন, ধর্মনেতা, সাধারণ সৈন্যরা আর সামন্তরা সব সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। এদের খুশি করেই তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়! যা হোক। বিচারের পর রুশদকে নির্বাসিত করা হল কর্ডোভা শহর পার্শ্ববর্তী ইহুদিঅধ্যুষিত লোসীনিয়ায়-সে কথা আগেই বলেছি। লোসীনিয়ায় মানসিক পীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন অব্যাহত থাকলে ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রুশদ। পারেননি। ইমাম গাজ্জালীর চ্যালারা তাঁকে ধরে কর্ডোভায় এনে আলজামা মসজিদ সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল হেনস্থা করার জন্য । সুলতান মনসুর নিজেও জ্ঞানের সাধক বলেই প্রবল অনুতাপে ভুগছিলেন। তিনি রুশদকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আমি আপনার বিরুদ্ধে মোল্লাতন্ত্রের সকল অভিযোগ উঠিয়ে নিচ্ছি। আপনি মরক্কো যান। মারকাশ নগরে কাজীর পদ শূন্য হয়েছে। অনুগ্রহ করে যোগ দিন। কথা দিচ্ছি, আপনার লেখা বই পোড়ানো হবে না। রুশদী আর কি বলবেন। তিনি মরক্কোর মারকাশ নগরে গেলেন। টের পেলে সময় ফুরিয়ে দ্রুত আসছে। কী অদ্ভুত কেটে গেল গোটা একটা মানবজীবন। তবে তিনি তৃপ্ত। কেননা, তিনি লেখক। জীবনে কম তো আর লেখেননি। হ্যাঁ। এখন সর্বভূতে বিলীন হওয়াই যায়। ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। ডিসেম্বর ১০; মেধাবী। দার্শনিকটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন । ২ বলা হয় রুশদ মুসলিম দর্শনের শেষ অধ্যায়, খ্রিষ্টান দর্শনের প্রথম অধ্যায়। ইহুদি দর্শনেও রুশদ-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন । স্পেনের ইহুদি দার্শনিক ইবনে মৈমুন (Maimonides); তিনিই প্রথম রুশদের মহত্ত্ব উপলব্দি করেন। এবং রুশদের প্রতি ইহুদি দার্শনিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। ইহুদি দার্শনিকরা রুশদের চিন্তার গভীরতায়, রচনাশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই ইউরোপে শিক্ষিত মহলে রুশদের লেখা প্রচার করা দায়িত্ব গ্রহন করেন। ত্রয়োদশ শতকে লাতিন ভাষায় রুশদ রচনাবলী অনুবাদ করেন প্রখ্যাত পন্ডিত মাইকেল স্কট । এরপর ইউরোপের বিদগ্ধ মহলে সাড়া পড়ে যায়। পরবর্তী শতকগুলিতে ইউরোপের ভাবজগতে রুশদ-এর বক্তব্য গভীর প্রভাব ফেলতে থাকে । এ প্রসঙ্গে বারট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: ‘পেশাদার দর্শনের অধ্যাপক ছাড়াও বিশালসংখ্যক মুক্তচিন্তার অধীকারীদের বলা হল Averroists বা রুদশবাদী ; বিশেষ করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশদের অনুরাগীর সংখ্যা ছিল ব্যাপক।’ (দ্র: হিস্ট্রি অভ ওয়েস্টার্ন ফিলসফি। পৃষ্ঠা, ৪২০) রুশদের সবচে বেশি প্রভাব পড়েছিল ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের ওপর। সম্প্রদায়টির প্রবর্তক সাধু ফ্রান্সিস (১১৮২-১২২৬) ত্রয়োদশ শতকে বিলাসিতায় নিমজ্জ্বমান পোপ ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছিলেন। যা হোক। ফারাবির মতোই রুশদের দর্শন অ্যারিস্টটল ও নব্যপ্লোটোবাদের সংমিশ্রন। যে দর্শনের প্রধান আলোচ্য সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গ। ইবনে সিনা বিশ্বাস করতেন সক্রিয় বুদ্ধিমত্তা বিশ্বজনীন ও স্বতন্ত্র্য এবং নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিমত্তা ব্যাক্তিনির্ভর এবং আত্মিক। পক্ষান্তরে রুশদ বিশ্বাস করতেন সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিমত্তা উভয়ই বিশ্বজনীন ও স্বতন্ত্র্য। এর মানে, একের মধ্যেই সব। অর্থাৎ শাশ্বত এক বিশ্বের ধারণা ছিল রুশদের। তাঁর মতে, আত্মা দুটি ভাবে বিভক্ত। (ক) ব্যাক্তিক ও (খ) স্বর্গীয়। ব্যাক্তিক আত্মা শাশ্বত নয়; প্রাথমিক স্তরে প্রতিটি মানুষ স্বর্গীয় আত্মা ধারণ করে। যে কথাটিই প্রারম্ভে আমি অন্যভাবে বলেছি- সমগ্র মানবজাতির জন্য রয়েছে একটিই সক্রিয় বিচারবুদ্ধি বা রিজন (এজেন্ট ইন্টেলেক্ট)- যে কারণে মৃত্যুর পর ব্যাক্তিগত পুনুরুর্জ্জীবন সম্ভব না। ...এসব কারণেই মধ্যযুগের খ্রিস্টান পন্ডিতেরা রুশদকে শয়তান ঠাউরেছিল। মধ্যযুগের ইতালির কবি দান্তে রচিত ‘ডিভাইন কমিডির’ কথা আমরা জানি। সে কাব্যে খ্রিষ্টীয়রাজ্যের পাপীদের ভয়ঙ্কর শাস্তির বর্ণনা রয়েছে। কাউকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে বা কাউকে বরফে ফেলে রাখা হচ্ছে। নরকে খ্রিষ্টান পাপীরা যেমন রয়েছে অখ্রিষ্টান লেখকরাও রয়েছেন। দান্তে তাদের নাম করেছেন। অ্যারিস্টটল সক্রেটিস প্লাটো গালেন যেনো সেনেকা আর ...আর আভেরস ... ইবনে রুশদ ...অথচ ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি রুশদী একেবারেই হস্টাইল (আক্রমানত্বক) ছিলেন না। কেননা, তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে মূলত কোনও বিরোধ নেই। তাঁর মতে- একই সত্যে পৌঁছবার জন্য ধর্ম ও দর্শন দুটি ভিন্নপথ মাত্র। কথটি অন্যভাবে বলা যায়: সত্যের জ্ঞান দুই প্রকার। প্রথমত: বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্য যা প্রমাণ অসম্ভব এবং যা বোঝার জন্য বিশেষ শিক্ষারও দরকার হয় না। সত্যের দ্বিতীয় জ্ঞানই হল দর্শন। যা স্বল্পসংখ্যক ব্যাক্তিরই মাত্র বোধগম্য, যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা রয়েছে, যাদের দার্শনিক শিক্ষা অর্জনের অসীম ধৈর্য রয়েছে । মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মানবজাতির ইতিহাসের দীর্ঘযাত্রার পথটি বিশ্বাস ও যুক্তির -এই দুদিকে বাঁক নিল- তার অন্যতম নির্দেশক দ্বাদশ শতকের স্পেনের মুসলিম দার্শনিক আবু ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে রুশদ। যে কারণে আজও পশ্চিমব্যাপী তাঁর আশমানতুল্য জনপ্রিয়তা ... আল ফারাবি ও ইবনে সিনার প্রদর্শিত পথ ধরে ইউরোপের জ্ঞানরাজ্যের বিশ্বাস ও যুক্তির দুটি ভিন্ন পথের দিকনির্দেশনা সুস্পস্ট করে দিয়েছিলেন রুশদ- কেবলি অন্ধবিশ্বাসের ওপর গুরুত্ব না দেওয়ায় তাঁর বইপত্র মোল্লাতন্ত্র পুড়িয়ে ফেলেছিল, যে কারণে আজও মুসলিম বিশ্বে তিনি উপেক্ষিত ... বারট্রান্ড রাসেল-এর হিস্ট্রি অভ ওয়েস্টার্ন ফিলসফি এবং রাহুল সাংকৃত্যায়নের দর্শন দিগদর্শন (প্রথম খন্ড ) অবলম্বনে। উৎসর্গ: নুভান। ইবনে রুশদ-এর এ কালের একজন একনিষ্ট ভক্ত ... সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:২৪
false
ij
গল্প_ আশ্রয় বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ড্রইংরুমে টিউবলাইট জ্বলে ছিল। আদিবা পা ঝুলিয়ে সোফার ওপর বসে ছিল। টিভি চলছিল, আদিবার চোখ টিভির দিকে, ভারি মিস্টি চেহারা মেয়েটির । নীল রঙের ফ্রক পড়েছে আজ। ফরসা গোল মুখটায় জাপানি পুতুলের মতন ভারি উজ্জ্বল আর দূত্যিময় দু’টি চোখ বসানো। অনেকদিন পর আদিবাকে দেখলাম। ওর দু-বছরের জন্মদিনে একবার এ বাড়িতে এসেছিলাম। সে সময় আদিবাকে একটা জাপানি পুতুল গিফট করেছিলাম। সে পুতুলটি কি ওর কাছে আজও আছে? না কি হারিয়ে গেছে? বয়স কত হল আদিবার ? এখনও চার হয়নি মনে হল। অথচ, এই বয়েসেই মেয়েটি এ পৃথিবীতে কেমন একা হয়ে গেল! ভাবতেই আমার বুকের ভিতরে ঠান্ডা হিমস্রোত টের পেলাম। আমার দিকে চেয়ে আদিবা অল্প হাসল। তারপর বলল, আঙ্কেল, আঙ্কেল আমাকে অগির কার্টুন এনে দাও তো।ঝুঁকে টেবিলের ওপর থেকে রিমোট তুলে নিতেই রওশন খালা ড্রইংরুমে এলেন। বয়স হলেও এখনও বেশ সুঠাম আছেন; ফরসা ধবধবে চেহারা, নীল পার সাদা শাড়ি পরেছেন, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আমাকে দেখেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আদিবা এক দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। ভারি বুদ্ধিমতি মেয়ে তো ...আমি রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিই। অনেক দিন এ বাড়িতে আসা হয় না। আজও অফিসে আমার কাজের চাপ ছিল, তা সত্ত্বেও আজ আর না-এসে পারলাম না। রওশন খালার ছোট ছেলে শাকিলের সঙ্গে স্কুল-কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি। সেই সূত্রেই শাকিলদের পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ, রওশন খালা আমার মায়ের মতন। দু-এক কথার পর রওশন খালা বললেন, তুমি তো সবই জান সজীব। আমি এখন কি করি বল তো বাবা । এ মাসেই ফরহাদের কাছে চলে যাচ্ছি। এখন মেয়েটাকে নিয়ে কি যে করি । এমন বিপদে পড়লাম ...বাচ্চার দায়িত্ব কেউই নিতে চায় না। রওশন খালার ফরসা মুখে কালো ছোপ পড়েছে। দেখে খারাপই লাগল। ফরহাদ ভাই রওশন খালার বড় ছেলে, আমেরিকা থাকে। রওশন খালা ওখানেই চলে যাচ্ছেন। ভিসার কি সমস্যা নাকি আছে, না গিয়েও উপায় নেই। এদিকে আদিবাকে নিয়ে যেতেও পারছে না। রওশন খালা বললেন, শাকিল আর জেসমিনের সব কীর্তিকান্ড শুনে ফরহাদ আর ওর বউ ওদের ওপর ভীষণ বিরক্ত। স্বাভাবিক। আমি চুপ করে থাকি। আমিও কি ওদের ওপর কম বিরক্ত। আজকাল চারিদিকে এত ঘর ভাঙছে। বিশেষ করে মিডিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের। শাকিল বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করে, বেশ নাম-ডাকও করেছে। ওর একেকটা কাজ সত্যিই দেখার মতো। তবে এটুকু বুঝেছি যে ... প্রতিভা আর প্রবৃত্তি এক জিনিস নয়। শাকিলের বউ জেসমিনকেও ওদের বিয়ে আগে থেকেই চিনতাম, মডেলিং করত জেসমিন; ওদের সম্পর্কটা টিকল না। শাকিল মাস কয়েক হল এক উঠতি মডেলকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। জেসমিনও এক মধ্যবয়েসি বিপতœীক ব্যাংকারের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে, তাকে নাকি বিয়েও করেছে। বিয়ের আগে থেকেই জেসমিন খানিকটা উড়নচন্ডী গোছের ছিল। বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই ওর । এখন এ সবের খেসারত দিচ্ছে অবুঝ মেয়েটি। জেসমিন চলে যাওয়ার আগে আদিবাকে রেখে গেছে শাশুড়ির কাছে।রওশন খালা প্রায় নিস্তেজ কন্ঠে বললেন, আদিবাকে তোমার কাছে কিছু দিন রাখ না বাবা।আমার কাছে! রওশন খালার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। হ্যাঁ, অন্তত নভেম্বর পর্যন্ত আদিবা তোমার কাছে থাকুক। তখন ফরহাদও আসবে। বিষয়সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা হবে। তখন যা হোক একটা ব্যবস্থা করব। অতি সঙ্কোচে বললাম, জানেনই তো খালা আমি একা । জানি বাবা।খালার নিরুপায় অবস্থা দেখে খারাপ লাগল। আদিবার পুতুলের মতো মুখটিও চোখে ভাসছে। কি করা যায়। বললাম, আদিবার দেখাশোনা কি আপনিই করেন? কাজের মেয়ে-টেয়ে নেই?কাজের মেয়ে আগে একটা ছিল। গত সপ্তাহে মেয়েটা দেশের বাড়ি চলে গেছে।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝলাম আদিবা সত্যিই দুঃখী। আমাকেই ওর দায়িত্ব নিতে হবে। তাছাড়া রওশন খালা আমার মায়ের মত, খালার কথা অমান্য করা কি ঠিক হবে? তবে আদিবাল দায়িত্ব নেওয়া কঠিন হবে। আমি এখনও সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারিনি বলে বিয়ে করিনি ... আদিবাকে আমি নিয়ে যাব ঠিক আছে, কিন্তু আদিবা কার কাছে থাকবে? আমি সকাল সকাল অফিস চলে যাই। সে সময় তো ফ্ল্যাট ফাঁকা হয়ে যায়। নভেম্বর মাস আসতে আরও সাত মাস বাকি ...রওশন খালার মুখের দিকে চেয়ে আমাকে আদিবার দায়িত্ব নিতে রাজী হতে হল। আদিবার ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে দিলেন রওশন খালা, মুখ থমথম করছে, হাজার হলেও মায়ের জাত তো ... আদিবাকে নিয়ে নিচে নেমে এলাম। বেশি খুঁজতে হল না, গলির মুখেই একটা সি এন জি পেয়ে গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। কলাবাগান থেকে সেগুনবাগিচা যেতে বেশ সময় লাগল। সারা পথে আদিবা চুপচাপ বসে ছিল। একবার কেবল জিগ্যেস করল, আঙ্কেল, আঙ্কেল আমরা কি অগিদের বাড়ি যাচ্ছি?আমি মিথ্যে করে উত্তর দিলাম। হঠাৎই আমার মনে হল আজ রাতে দীপা বউদির ফ্ল্যাটে দাওয়াত। দীপা বউদিরা পাশের ফ্ল্যাটের থাকে। ভারি ভালো মানুষ। ব্যাচেলার দেবরের প্রতি বউদির অগাধ টান, প্রায়ই রান্না করে এটা-ওটা খাওয়ায়, বৌদির রান্নার হাত অতুলনীয়।আজ আদিবাকে দেখে দীপা বউদি নিশ্চয়ই ভারি অবাক হয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে একটি ঝলমলে বিলবোর্ডের ওপর দু-মুহূর্তের জন্য আমার চোখ আটকে গেল। দেশের বিখ্যাত এক ডেভেলাপারের বিজ্ঞাপন; নাম:- ‘আশ্রয়’। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম- কার যে কোথায় আশ্রয় কেউ বলতে পারে না। ভাবতেই জেসমিনের মুখটা ভেসে উঠল । শ্যামলা মতন সুশ্রী একটা মুখ। আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল... মা হওয়া কেন মায়ের দায়িত্ব পালন না করতে পারলে ? প্রসব বেদনা সহ্য করে গর্ভে সন্তান ধারণ করে আবার সেই সন্তানকে ফেলে রেখে যাওয়াই-বা কেন? ভাবতেই শরীরময় কেমন এক ক্রোধ টের পেলাম। আধুনিক যান্ত্রিক জীবন কি মানুষের মৌলিক স্বভাব পালটে দিচ্ছে? রওশন খালাকে আজ কিছুটা নিষ্ঠুরও মনে হল। স্বার্থের জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। এটুকু মেয়েকে ফেলে আমেরিকা চলে যাচ্ছেন । লোড শেডিং চলছিল। সি এন জিটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামতেই আলো এল। আদিবা কেমন ঘুমে ঢলছে। ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বয়স্ক একজন কাজের লোক রাখতে হবে। কিন্তু, সেরকম বিশ্বাসী লোক কোথায় পাব? এ মুহূর্তে এরকম হাজারটা চিন্তা মাথায় খেলা করছে। দীপা বউদিদের ফ্ল্যাটের দরজটা খোলা। দরজার কাছে দীপা বউদি দাঁড়িয়ে । চমৎকার একটা লাল পার হলুদ শাড়ি পরেছে। বউদি ঠিক হাউসওয়াইফ না, সকালবেলায় বাচ্চাদের একটা স্কুলে পড়ায় । দীপা বউদির স্বামী অজিতদাও ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ, অজিতদা ব্যাংকার। দাদা-বউদি নিঃসন্তান। এ জন্য দীপা বউদি প্রায়ই আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করেন। বলেন, ভগবান আমাদের এত কিছু দিয়েছেন ... এখন যদি একটা সন্তান দিতেন ... আমার কোলে আদিবাকে দেখে দীপা বউদির মুখে চোখে বিস্ময়। বলল, ওমাঃ, এ কে সজীব? আমি কিছু বলার আগেই আদিবা ‘মা’ ‘মা’ বলে আমাকে অবাক করে দিয়ে দীপা বউদির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর আগে খেয়াল করিনি দীপা বউদির সঙ্গে জেসমিনের চেহারার অনেক মিল আছে ...
false
rn
টুকরো টুকরো সাদা মিথ্যা-৪ "আমি এখন শুধু ভাবি তোমারঅপরুপ লাবন্যময় রুপ আরআমার মৃ্ত্যুরক্ষন-হায় যদি এ দু'টোকে একই সাথে পাতেম"!রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটি আর ভাবি আমি কে?একটা সিগারেট ধরাবার পর অকারনে মনটা ভালো হয়ে যায়।এতো ভালো হয় যে শেষ সম্বল দশটা টাকা দরিদ্র বুড়োকে দিয়ে দিলাম।কাউকে কিছু দিতে পারলেই নিজেকে আমার রাজা-মহারাজা মনে হয়।কোনো কারন ছাড়াই সকালে ঘুম থেকে উঠার পর'ই খুব আনন্দ লাগছে।কিন্তু আনন্দ পাওয়ার মতো এমন কোনো কাজ'ই করিনি।তবু মনের মধ্যে একটা আনন্দ বোধ নাঁচানাঁচি করছে।আমি সিনেমার নায়ক না।আকর্ষন করার মতো আমার কিছুই নেই।কেউ আমার দিকে দৃষ্টি স্থির করে না।আমাকেই তার দিকে বারবার চোখ ফেরাতে হয়।এমন একটি মুখ,সারা জীবন মনে রাখার মতন।সবুজ রঙ্গের শাড়ি পরা মেয়েটি(যদিও নীল রঙ্গের শাড়ি পড়লে বেশী ভালো লাগতো)।সবুজ ব্লাউজ,সবুজ কানের দুল,মাথা ভরতি চুল।চুল খোলা নাকি বেনী করা আছে দূর থেকে বুঝতে পারছি না-খুব ফর্সা না,কিন্তু রোদের আলোতে মুখখানা চকচক করেছে।এই মেয়েটিই 'হিমি' কিনা চোখ বন্ধ করে মনে করতে চেষ্টা করলাম।পরক্ষনেই চোখ খুলে আর একবার মিলিয়ে নেবার জন্য আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম।আর কি আশ্চর্য চোখাচোখি হয়ে গেলো,মেয়েটির চোখে বিস্ময়,আর আমি একটূ হেসে দিলাম।এক একদিন হঠাৎ করেই মনে হয় এই পৃ্থিবীটা শুধু আমার।আমিই এই গ্রহের রাজা।খুব আনন্দ বোধ করছি।গুন গুন করে গান গাইছি-"বলো বলো কানে,শুনাও প্রানে প্রানে/ক্ষদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে সদাই ভাবনা/যা কিছু পায় হারায়ে যায়,না মানে সান্তনা/ফুরায় বেলা,ফুরায় খেলা,সন্ধ্যা হয়ে আসে-/কাঁদে তখন আকুল-মন,কাঁপে তরাসে..."।অনেক দিন এরকম আনন্দবোধ হয়নি।রহস্যটা কোথায় বুঝতে পারছি না।যে মেয়েটির নাম রেখেছি আমি-'হিমি',তার সাথে দেখা হবেই,তবে কবে তা জানি না।তাড়াহূড়োর কিছু নাই।দেখা ঠিক হবেই।নিশ্চয় দেখা হবে,মনের জোর থাকলে ব্যর্থ হবার কথা না।সম্মোহন শক্তি না থাকলে ভালোবাসার কোন মূল্য নেই।ঢাকা থেকে গাজীপুর চলে গেলাম।কোনো ঝামেলা হলো না,কেউ বাঁধা দিলো না।মানুষের সব কাজের পেছনেই এক টা কার ন থাকে।আমার ও আছে।আমি একটা খেলা খেলছি।এ খেলায় সম্পূর্ন জিৎ অথবা সম্পূর্ন হার,মাঝামাঝি কিছু নেই।আমি নিমগ্ন হয়ে আছি,নিজের বানানো জগতে ও চিন্তার মাঝে।দিন দিন আমার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।একটার পর একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে।আমি অনেক কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু করতে পারিনি আবার অনেক কিছু করতে চাইনি কিন্তু করেছি।ভুল করলেই আমার অনুসূচনা হয় এবং রাতে ঘুম আসে না।কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাকে আবার সেই একি ভুল করতে হয়।দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকার জন্য নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।আমি যা চাই- তাই'ই হবে।যেভাবে চাই সে ভাবেই হবে।আমার আছে ইচ্ছা শক্তি।দেখো সামনে আমি কি কি করি।"অন্ধকারের মতআমি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই নাআমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌছাবার সময় আছে,পৌছে অনেকক্ষন বসে অপেক্ষা করার সময় আছে"।
false
mk
লাশের রাজনীতিতে বিএনপি হেরে গেল!!! প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে পিয়াস করিমের পরিবার। সোমবার তারা ঘোষণা দিয়েছিল— বুধবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে রাখা হবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রয়াত পিয়াস করিমের মরদেহ। সেখানে তারা নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এ খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’- এর ব্যানারে শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে। একই সঙ্গে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পিয়াস করিমের মরদেহ আনা প্রতিহত করারও ডাক দেয়া হয়। এ অবস্থায় মঙ্গলবার সকালে তার ছোট ভাই জহির করিম জানান, পিয়াস করিমের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হবে না। তবে এর কারণ সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।এদিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত শহীদ মিনারে পিয়াস করিমের নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানের জন্য কোনো আবেদন পাননি বলে জানিয়েছেন ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. এমএ আমজাদ আলী। তিনি বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢুকতে দেয়া হবে না। যেহেতু কোনো আবেদন করা হয়নি, সেহেতু পিয়াস করিমের মরদেহ ঢুকতে দেব কেন?।’এদিকে বুধবার পিয়াস করিমের মরদেহ যাতে শহীদ মিনারে না আনা হয়, সেজন্য মঙ্গলবার সকাল থেকে সেখানে অবস্থান নেন ঢাবি চারুকলা অনুষদের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। ‘বিক্ষুব্ধ চারুশিল্পীবৃন্দ’র ব্যানারে তারা ‘রাজাকারভুক্ত পিয়াস করিমের লাশের ভার বইবে না শহীদ মিনার/রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’— এই স্লোগানে পথচিত্র অঙ্কনের কর্মসূচি নেয়া হয়।সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের ইভেন্টের মাধ্যমে মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে প্রতিবাদী পথচিত্র অঙ্কনের এ কর্মসূচি শুরু হয়। এতে সংহতি জানায় গণজাগরণ মঞ্চ, স্লোগান’৭১ ও গৌরব’৭১, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ প্রায় ২০টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।সেখানে উপস্থিত শিল্পী ও গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক মনিরুজ্জামান বর্তমানকে বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়কাল থেকেই চিত্রশিল্পীরা সব সময় রাজপথে ছিলেন, এখনও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। পিয়াস করিমকে বিভিন্ন সময় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে ও পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে। তার বংশ পরিচয়েও পাকিস্তানপ্রীতির প্রমাণ রয়েছে। এমন একজন লোকের মরদেহ কোনো মতেই শহীদ মিনারে আসতে পারে না।’শহীদ মিনারের উত্তর পাশের বেদিতে প্রবেশের মূল পথে আঁকা হয় প্রতিবাদী মানববন্ধনের ছবি। পাকিস্তানের তারকাখচিত জাতীয় পতাকাবৃত কফিনে রাজাকার গোলাম আযমসহ আরেকজন পিয়াস করিমের লাশ নিয়ে যাওয়ার প্রতীকী ছবি। পাশাপাশি সড়কে লেখা ‘কোনো পাকি দালালের লাশ বইবে না পবিত্র শহীদ মিনার, লাশ নিয়ে যা পাকিস্তান।’পথচিত্র অঙ্কন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রণো জানান, ‘পারিবারিক সূত্রেই পিয়াস করিম পাকিস্তানের একজন দালাল হিসেবে পরিচিত। যে শহীদ মিনারে দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে আনা হয়, সেখানের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দালালের লাশ আসতে পারে না।’ এ সময় তিনি সর্বস্তরের জনগণকে এ কর্মসূচিতে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।প্রসঙ্গত, সোমবার ভোরে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। - See more at: Click This Link
false
mk
হরতাল কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার নয় হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলার কোনো উপযোগিতা বাংলাদেশে এখন আর নেই। দুই সামরিক স্বৈরশাসকের সময়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ তাদের দুজনকেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু নব্বই দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসনের সময়ে হরতালকারীদের সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়ে কত মানুষ জীবন হারিয়েছেন তার কোনো লেখাজোখা নেই। কারণ, তারা প্রায় সবাই সাধারণ মানুষ, তাদের হিসাব কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল রাখে না। গত পাঁচ-সাত বছর আগেও দুয়েকটি পরিত্যক্ত খালি গাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া এবং রাজপথে পুলিশের সঙ্গে হরতালকারীদের কিছু ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল হরতালের সহিংস চরিত্র। কিন্তু বিগত দুই-আড়াই বছর, বিশেষ করে ২০১৩ সালের প্রথম থেকে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ফাঁসির রায় বের হওয়া শুরু হলে জামায়াতের ডাকা হরতাল এবং তাতে বিএনপির সমর্থনে হরতালকারীদের পক্ষ থেকে সরাসরি বিনা উসকানিতে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষ ও পুলিশকে টার্গেট করে আক্রমণ এবং হত্যা করা হয়। কোনো কোনো জায়গায় পুলিশের পাল্টা গুলিতে হরতালকারীদের মধ্য থেকেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই সহিংস হরতাল ও অবরোধের ভয়াবহ অমানবিক বীভৎস স্বরূপ দেখা যায় গত বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অব্যবহিত আগে। হরতাল-অবরোধকারী দলের ক্যাডার বাহিনী বাসভর্তি মানুষ, ট্রাকভর্তি অবলা প্রাণীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় খেটে খাওয়া মানুষের দোকানপাট ও আয়-রোজগারের শেষ সম্বল। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা বা ভোট রক্ষা যা-ই বলি না কেন, এমন বর্বর অমানবিক কুকর্ম যে কর্মসূচির মাধ্যমে হয় তাকে কি কোনো অজুহাতে সমর্থন করা যায়, নাকি সেটাকে আইনসিদ্ধ বলা যায়, নাকি বলা যায় গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের জন্য দেশ, রাজনীতি, উন্নয়ন, সবকিছু। সবকিছুর আগে মানুষ। গণতন্ত্র ও নিয়মতন্ত্রের কথা যখন বলবেন, তখন একজন মানুষের জীবন যেতে পারে এমন কোনো কর্মসূচি চলতে পারে না। আর কেউ যদি সশস্ত্র বিপ্লব বা যুদ্ধ করতে চান, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। মানুষকে মেরে অথবা মানুষ মারার কর্মসূচি দিয়ে যারা মুখে বলেন তারা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন চান, তখন সেটি কি শুধুই প্রহসন ও প্রবঞ্চনা নয়। মানুষ মরছে এটাই বাস্তবতা, এটাই মুখ্য। নির্দিষ্টভাবে কে দায়ী তা এখন গৌণ। কারণ, রাষ্ট্রসহ আমরা সবাই মিলে ব্যর্থ হয়েছি ওই হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে। সুতরাং মানুষকে বাঁচাতে হলে হরতালকে না বলতে হবে, বিদায় দিতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা যখন বলেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, জনকল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন, তখন তা এখন বিশ্বসেরা কৌতুকের মতো শোনায়। হরতাল বা ধ্বংসযজ্ঞের কর্মসূচি না দিয়ে বিরোধী পক্ষ ক্ষমতাসীন দলের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, অবকাঠামো, যোগাযোগ, কৃষি, খাদ্য, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তিনীতি এবং কার্যক্রম প্রসঙ্গে তথ্যমূলক কঠোর সমালোচনা করে নিজেদের আগামী দিনের কর্মসূচিকে বিশ্বাসযোগ্য আকারে তুলে ধরলে বোঝা যেত তারা জনকল্যাণ চান। কারণ, জনকল্যাণ করতে হলে এসব কর্মসূচির মাধ্যমেই করতে হবে। জনকল্যাণ কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। প্রতিটি বিষয় তথ্য-উপাত্তের সূচকে এখন মাপা যায়। একদল বলবে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি করেছি, আরেক দল বলবে সব রসাতলে গেছে। এসব বায়বীয় কথা বলার দিন শেষ। মিডিয়ার সুবাদে মাসান্তে, বছরান্তে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের উঠা-নামা সব কিছু মানুষ অঙ্কের হিসাবে দেখতে পারছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে বিগত বিএনপি সরকারের পারফরমেন্স তুলনা করতে পারছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা যা-ই বলি না কেন, সব কিছুরই প্রয়োজন আছে, তবে এর কোনোটাই শেষ কথা নয় (Not end by itself)। শেষ কথা হলো-২. মানুষের জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি। শেষ বিচারার্য এটাই। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে বলেই ১৩০ কোটি মানুষের দেশ চীনকে আমেরিকা গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে, শত উসকানি দিয়েও এক তিল নড়াতে পারেনি। ক্ষমতা কোনো দলের জন্য চিরস্থায়ী নয়। মানুষ চাইলে শান্তিপূর্ণ পথেই বিএনপি আবার ক্ষমতায় যেতে পারে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল, জনসমর্থন ও জনসন্তুষ্টি ব্যতিরেকে কলাকৌশলে তা যদি ঠেকিয়ে রাখতে চায় তাহলে সেটি বুমেরাং হবে। বিএনপির বোঝা উচিত ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে তারা নিজেরা বহু কূটকৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সময় যতই পেরুচ্ছে ততই জনমানুষকে ফাঁকি দেওয়ার দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কেউ তা পারবে না। গত ২৯ ডিসেম্বর হরতালে বিএনপির পিকেটারদের ইটের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন একজন অপার সম্ভাবনাময় জীবনের আকাঙ্ক্ষী স্কুলশিক্ষিকা শামসুন নাহার ঝর্ণা। এতিম হলো একজন শিশু, অনিশ্চিত হয়ে গেল তার ভবিষ্যৎ। মায়ের আপত্য ছায়ার অভাবে ঝর্ণা বেগমের এই শিশু যদি ভুল পথে গিয়ে পরিণত বয়সে সমাজের বোঝা হয়ে যায়, তার জন্য দায়ী হবে কে? হরতাল সমর্থক রাজনীতিবিদদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এ পর্যন্ত হরতালে যত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। শামসুন নাহার ঝর্ণা হত্যারও বিচার হবে না। কারণ, যারা হত্যা করেছে তারা সবাই একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিয়ে আদালতে তা প্রমাণ করতে পুলিশ অক্ষম। তা ছাড়া মামলা দিলে আবার হরতাল, কারণ মূল দল থেকে বলা হবে রাজনৈতিক হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের নেতা-কর্মীদের নামে। তারপর আমাদের পুলিশের নৈতিকতা ও সততা নিয়েও তো অনেক প্রশ্ন আছে। তাহলে সাধারণ মানুষের রক্ষাকবচ কোথায়? হরতাল ডাকা বা পালন করা যদি গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় হয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যান ও পালন না করাও গণতান্ত্রিক অধিকার। এ কথা ঠিক হলে হরতালকারীরা রাস্তায় নেমে পিকেটিংয়ের নামে কেন চলাচলকারী মানুষ ও যানবাহনের ওপর আক্রমণ করবে এবং আগুন দেবে। এই যদি হয়, তাহলে হরতালের ওপর মানুষের কতটুকু সমর্থন আছে তার পরিমাপ কিভাবে হবে? হরতাল সম্পর্কে আমাদের সার্বিক মানসকাঠামোর পরিবর্তন হওয়া দরকার। ঢিলেঢালা হরতাল হলে একশ্রেণির মানুষ এবং মিডিয়াকর্মীদের বলতে শুনি, হরতাল ছিল নিরুত্তাপ, নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই। অজান্তে এটা কি সহিংস হতে এক ধরনের উসকানি নয়? এক সময় পিকেটিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল হরতালের কারণ ও বিষয়ের ওপর জনমত গড়ার জন্য মানুষের কাছে লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্নভাবে আবেদন জানানো। এখন তো পিকেটিং মানে আগুন দেওয়া ও মানুষ হত্যা করা। সুতরাং সময়ের বিবর্তনে হরতালের উপযোগিতা ও আবেদন দুটিই শেষ হয়ে গেছে। মানুষের জন্য, জনগণের সম্পদ রক্ষার জন্য মিডিয়াসহ, সর্বস্তরের মানুষ, সুশীল সমাজ এবং মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সবাইকে সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে হরতালের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া যদি গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে আজকে বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে হরতালের বিরুদ্ধে তা যে কোনো পন্থায় প্রমাণ করতে চাইলে প্রমাণিত হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর গত এক বছর দেশে শান্তি বিরাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক-অর্থনৈতিক কোনো খাতই পিছনের দিকে যায়নি। সামনে আরও কতখানি যেতে পারত তা নিয়ে তর্ক হতে পারে এবং হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। নানা কারণে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বলবে গত এক বছর যে রকম শান্তি বজায় ছিল তা যেন আগামীতেও বজায় থাকে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র রক্ষা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবার ব্যাপক হারে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে। ৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার অবরোধ৩. কর্মসূচি পালনকালে রাজশাহীতে ছাত্রশিবিরের মিছিল থেকে কোনো রকম উসকানি ছাড়াই অকস্মাৎ কর্তব্যরত পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হয়। টেলিভিশনের খবরে এবং ৭ জানুয়ারিতে সব পত্রিকার প্রথম পাতায় ওই আক্রমণের ছবি সারা দেশের মানুষ দেখেছে। শিবিরের ক্যাডাররা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে, সেই অস্ত্রের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে দুইজন পুলিশ সদস্যকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও শিবির ক্যাডাররা ওই দুই পুলিশ সদস্যকে পিটাতে থাকে। অস্ত্র দুটিও ভেঙে ফেলে। পরে বিজিবির সদস্যরা এসে পুলিশকে উদ্ধার করে। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীতে একই রকম ঘটনা ঘটেছে। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের আন্দোলনের সঙ্গে যখন বিএনপি যোগ দিল তখন গাইবান্ধায় পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিয়ে বিশ্রামরত পুলিশকে তারা হত্যা করল। ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক দখলদার দেশের পুলিশের ওপরও সরাসরি কোনো আক্রমণ কোনো মিছিল-মিটিং থেকে কখনো করা হয়নি। ২০১৩ সালের আগে বাংলাদেশেও পুলিশের ওপর এমন নৃশংস আক্রমণ কেউ করেনি। কর্তব্যরত পুলিশের ওপর আক্রমণ তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ওই দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছে জামায়াত-শিবির একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে এবং ২০১৩ সালে তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতার ফাঁসির হুকুমের বিদ্বেষ ঝাড়ছে পুলিশের ওপর। এই নৃশংসতার নেপথ্যে রয়েছে এক ধরনের বর্বর রাজনৈতিক ক্রোধের তাড়না ও বহিঃপ্রকাশ। পুলিশের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক অভিযোগ থাকতে পারে। তবে একবার নির্মোহ দৃষ্টিতে ভেবে দেখুন পুলিশ ফোর্স অকার্যকর হয়ে পড়লে কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের তা কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার জন্য এতই অন্ধ যে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমা কোথায় সেটিও তারা ভুলে যান। আমার মনে হয় এর সবকিছু করা হচ্ছে একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। পুলিশের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ ও র‌্যাব বাহিনী বিলুপ্তির দাবির মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কিনা এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অকার্যকর করে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী কোনো দেশি-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা উচিত। মনে রাখা দরকার, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। একটি বাহিনীর কতিপয় সদস্যের দুষ্কর্মের জন্য সম্পূর্ণ ফোর্সের বিলুপ্তির দাবি অস্বাভাবিক, বিশ্বের কোথাও এমন উদাহরণ নেই। র‌্যাব বিলুপ্ত হলে শুধু একটি ফোর্স বিলুপ্ত হতো না, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ পুলিশ বাহিনীর নৈতিক মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ত। নৈতিক মনোবল না থাকলে সেই ফোর্সের কার্যকরিতা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। তাতে কোনো রাজনৈতিক পক্ষের কি লাভ হতো তা বলা না গেলেও, এতটুকু বলা যায়, তার জের ধরে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়াবহ উত্থান ও তৎপরতা শুরু হতো। কারণ জঙ্গিরা এরকম সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকে, যার উদাহরণ আমরা দেখেছি বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়। ধর্মান্ধ জঙ্গিরা এ দেশে সফল হতে পারবে না, এটা ঠিক। কিন্তু তাতে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ হবে, অসংখ্যক মানুষের জীবন যাবে। এখন মূল প্রশ্ন হলো পুলিশ আর কত মার খাবে? পুলিশ কর্তৃপক্ষ এখন কি করবে? পুলিশের এই মার খাওয়া দেখে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তাদের আইনগত শক্তি কোথায়, কিভাবে, কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবে তার ওপর পুলিশ সদস্যদের আত্মবিশ্বাস নেই। আমার ধারণা পুলিশ তাদের রুলস অব ইনগেজমেন্টের (ক্ষমতা বা শক্তিপ্রয়োগের বিধি) সঠিক প্রয়োগ যদি করতে পারত তাহলে পুলিশকে এমন অসহায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো না। রাজনৈতিক দলের নেতারা, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া মাঝে মাঝে এমন বক্তব্য দেন, তাতে মনে হয় মরে গেলেও নিজের জীবন, জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ শক্তি অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারবে না। এটা ঠিক নয়। রুলস অব ইনগেজমেন্ট সম্পর্কে পুলিশ সদস্যদের সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন এবং তার যথার্থ প্রয়োগের জন্য আত্মবিশ্বাস ও আস্থা তৈরির ম্যাকানিজম পুলিশের চেইন অব কমান্ডের ভেতর সর্বক্ষণ বিদ্যমান থাকা দরকার। যাতে নিজেদের ও জনগণের জানমালের রক্ষার্থে রুলস অব ইনগেজমেন্টের সর্বোচ্চ শক্তির সঠিক প্রয়োগের মুহূর্ত এলে তাদের মধ্যে যেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হয়। এখানে ৪.মাত্রা জ্ঞান ও সঠিক মুহূর্ত বুঝতে পারাটাই বড় বিষয়। এটাও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রপ্ত ও উন্নত করা যায়। যে কোনো পুলিশ অ্যাকশনের পর স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে যদি প্রমাণ হয় পুলিশ রুলস অব ইনগেজমেন্টের মধ্যেই আছে, তাহলে পুলিশের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।পুলিশ কর্তৃপক্ষ আরেকটি কাজ করতে পারেন। রুলস অব ইনগেজমেন্ট সর্বসাধারণের বোঝার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাতে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এবং মিডিয়াকর্মীরা বিষয়টি উপলব্ধি করলে রুলস অব ইনগেজমেন্ট অনুসারে অ্যাকশন নেওয়া পুলিশের জন্য সহজ হবে। আর একই সঙ্গে সেটি জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরাও জানতে পারবে এবং বুঝবে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বা পুলিশের ওপর আক্রমণ করলে তারাও নিরাপদে পার পাবে না। যত নীতি ও অধিকারের কথা বলি না কেন, দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা সবকিছুর ঊর্ধ্বে।- See more at: Click This Link
false
ij
গল্প_ নীলবর্ণের পাহাড়ের কাছে পিদিম বলল, জান রাকা রথকে না ইংরেজীতে বলে চ্যারিওট। তাই? হ্যাঁ। তা তুমি এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলে পিদিম? পিদিম বলল, আমি তো শহুরে ভূত। আমি একটা বাড়ির ছাদে থাকতাম আগে। সেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যেবেলায় পড়তে শুরু করলে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। তখনই শিখেছি। তুমি শহরে কই থাকতে? রাকা জিগ্যেস করল। পিদিম বলল, আগে ছিলাম ভূতের গলি। তারপর সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দিরের কাছে। জায়গাটা মৌচাক আর বেইলি রোডের খুবই কাছে। রাকা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, ও। আমি কিন্তু শহরে কখনও যাই নি। পিদিম বলল, আচ্ছা, একদিন আমি তোমায় শহরে নিয়ে যাব। বেশ। তাই নিয়ে যেও। রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে রথ চলেছে। মানে রাজপ্রাসাদটা এখন হাতের বাঁয়ে। পথের দুপাশে বড় বড় অনামা গাছ বলেই পথটা ছায়ায় ঢাকা। । পাতা আর ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো এসে পড়েছে নীচে। নীচে অনেক শুকনো পাতা। বাতাসে সরসর করেও উঠল। একটা চিত্রময় হরিণ চলে গেল। কাছাকাছি একটা জলস্রোতও রয়েছে মনে হল। পানির সরসর শব্দও শোনা যাচ্ছিল। সারথীবুড়ো আন্দালিব সুন্দর শিস দিচ্ছিল। সুরটা চেনা চেনা লাগল পিদিমের । সিদ্ধেশ্বরী থাকার সময়ই শুনেছে। এলাটিঙ বেলাটিঙ তেলাটিঙ চোর মাইফোর ডিফোর ফরটিফোর এককাঠি চন্দন কাঠি চন্দন বলে কা কা প্রজাপ্রতি উড়ে যা। দেখতে দেখতে রথটা প্রাসাদের পিছনে চলে এল। আসতেই তুষার ছড়ানো বিশাল এক নির্জন প্রান্তর দেখা গেল। দূরে একটা নীল রঙের আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রান্তরের ওপর দু একটা গাছ। সেই প্রান্তর আর পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ একটা আকাশ । নীল রঙের। আর সেই নীল রঙের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ । পিদিমের মনে হল যেন মেঘের মধ্যেই পরির দেশটা। কিংবা পরির দেশের আকাশে মেঘেদের রাজ্য। তারই একপাশেই তো সেই সোনারবরণ রঙধনুর মতন বাঁকানো আকাশপথটা। যেখানে চাঁদের কিরণ ঝরে ঝরে পড়ে আর তুষার প্রান্তরের হিম । ধু ধু প্রান্তরের দিকে হাত তুলে রাকা বলল, ওই দেখ। কী? রাকা বলল, ওই মাঠটাকে আমরা তুষারপ্রান্তর বলি। আর ওই যে দেখ তুষারপ্রান্তরের পিছনে একটা পাহাড় ... হ্যাঁ। আমরা ওই পাহাড়কে বলি নীলবর্নের পাহাড়। পাহাড়ে অনেক গাছপালা আছে। হ্যাঁ, সত্যিই খুব সুন্দর। পিদিম মাথা নেড়ে মন্তব্য করল। রাকা বলল, ওই যে দেখ ঝিকিমিকি নদী। হ্যাঁ, তাই তো। আর তার ওপর যে সেতুটি দেখছ, তার নাম সোনারবরন সেতু। এই নদীর চিতল মাছের কথাই আমি তোমায় বলেছিলাম। পিদিম অবাক হয়ে দেখল, নীল মখমলের মাঠের কোনে ঝিকিমিকি নদীর ওপর বাঁকানো সোনার সেতু। সেতুর দুপাশের রুপোর তৈরি ঘোড়ার মূর্তি। নদীর পাড়ে, যেখানে সেতুর শুরু, সেখানে গিজগিজে ভিড়। অবশ্য ঝিকিমিকি নদীর ওপর ভেসে থাকা নৌকাগুলি সব ছবির মতন সুন্দর। নৌকা ভরতি চিতল মাছ। সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। নদীর ওপাড়ের গাছগুলিও সুন্দর। পথগুলি কুয়াশায় ঢাকা। দূরে একটা পাহাড়। মেঘের ভিতরে চূড়াটা ডুবে আছে। পিদিম স্বীকার করতে বাধ্য হল, আমি অমনটা কখনও দেখিনি। রাকা হাসল। একটু পর ঘন্টা বাজল। রাকা বলল, সারথীদাদু ঘন্টা বাজিয়েছে, তার মানে এখন আকাশ থেকে চকোলেট পড়বে। সারথীদাদু রাস্তার ওপরে বাঁক নিলেই ঘন্টা বাজায়। আর তখনই আকাশ থেকে চকোলেট পড়ে। সত্যিই তাইই হল। পিদিম আর রাকার কোলের ওপর গুনেগুনে আটটা চকোলেট পড়ল। খাও পিদিম, দুধ আর বাদাম দেওয়া। রাকা বলল। খাচ্ছি। বলে একসঙ্গে দুটো চকলেট তুলে নিল পিদিম । রাকা বলল, সারথীদাদু, তুমি বাঁক নিলে যে? কে গেল রথে করে? বুড়োদাদু বলল, অন্ধ জ্বিন। কী সর্বনাশ! অন্ধজ্বিন। চকলেট মুখে পুড়ছিল পিদিম, থামিয়ে বলল, কেন কেন অন্ধ জ্বিনে সর্বনাশ কেন? রাকা বলল, অন্ধজ্বিন হল পরিরাজ্যের সবচে দুষ্টু একটা জ্বিন। অনেক বছর আগে জ্বিনটাকে ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল নীলবর্ন পাহাড়ের চূড়ার কয়েদখানায়। সেই ছাড়া পালিয়েছে বোধ হয়। কিন্তু আমি ভাবছি অন্ধজ্বিনটা ছাড়া পেল কী করে। পিদিম বলল, ভয় নেই। আমি আছি না। পিদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রাকা বলল, অন্ধজ্বিন আমাদের আক্রমন করতে এলে তুমি কী করবে? পিদিম চকলেট মুখে ফেলে বলল, আগে আক্রমন করতে আসুকই না। তখন দেখা যাবে। পিদিমের কথা শুনে অবাক হয়ে কিছুক্ষন পিদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রাকা। তারপর বলল, এখানে কোথাও নামবে পিদিম? পিদিম বলল, হ্যাঁ। নেমে ঘুরেফিরে দেখি। ফিরে গিয়ে আবার চিরি আর গড়ানদের গল্প বলতে হবে। নইলে ওরা বিশ্বাস করবে না আমি সত্যি সত্যি পরির দেশে এসেছিলাম। রাকা আদুরে গলায় বলল, সারথী দাদু, সারথী দাদু, রথটা একটু থামাও না। বলতেই সারথী দাদু আন্দালিব রথটা থামল। ঘোড়াগুলি চি হি হি হি করে উঠল। এসো। বলে রাকা নামল। নামছি। পিদিম বলল। ওরা রথ থেকে নেমে এসে একটা গাছের নীচে দাঁড়াল। সামনেই ঘাসের মাঠ। তারপর একটা অতল খাদের কিনারা শুরু হয়েছে। ওপারেই সেই নীলবর্ণের পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে । বরফমাখা চূড়াটা মেঘের ভিতরে ডুবে যাচ্ছে আবার মেঘ সরে গেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে অনেক গাছপালা। নীচেই অতল খাদ। ধোঁওয়া উঠছে। কী সের ধোঁওয়া রাকা? রাকা বলল, নীচে ঝিকিমিকি নদী। তার পাশে অনেক গ্রাম। সেখানকার ধোঁওয়া। ও। ওটাই কী নীলবর্ণের পাহাড়? পিদিম জিগ্যেস করল। হ্যাঁ। রাকা বলল। হঠাৎ বাঁশীর সুর শোনা গেল। ওরা চমকে তাকিয়ে দেখল বুড়োসারথী একটা বাঁশী বার করে বাজাতে শুরু করেছে। কী সুন্দর সুর। সেই সুর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দূরের ওই পাহাড়ের থেকে একটা ঈগল পাখি উড়ে এল। ঈগল পাখির নখরে ভেড়ার ছানা। মাথার ওপর দিয়ে ওটা তুষার মাঠের দিকে ঝিকিমিকি নদীর দিকে চলে গেল। রাকার মন খারাপ হয়ে গেল। ও বলল, জান পিদিম ওই নীলবর্নের পাহাড়ে অনেক নেকড়ে আছে। ওরা কামড়ে দিলে? রাকা বলল, না। কামড়াবে না। ওগুলি আসলে ছবি। ছবি! রাকা বলল, হ্যাঁ। ছবি। সত্যি না। পিদিম ভীষন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, সেটা আবার কেমন? রাকা বলল, আমি এখনও জানি না। বড় হয়ে জানব। আমি তো এখনও ছোট। বড় হলে বুঝবে? হ্যাঁ। কী করে তুমি বুঝবে যে তুমি বড় হয়ে গেছ। রাকা বলল, আমি বড় হয়ে গেলে আমার মা-ই তখন বলে দেবে যে আমি বড় হয়ে গেছি। ও। সারথীদাদু এখন বাঁশী বাজানো থামিয়ে গান ধরেছে: সারথী দাদু, সারথী দাদু, রথটা একটু থামাও না। আমাদের একটু নামাও না। গান শুনে রাকার কী হাসি। পিদিমও হাসল। হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে গেল। তো, রাকা স্বপ্ন দেখেই চলেছে। ওর স্বপ্নটা কিন্তু বেশ বড় আর মজার। সে জন্যই আমি তোমাদের ওর স্বপ্নের সবটা লিখে জানাচ্ছি। তবে একটা কথা। স্বপ্নের সবখানে রাকা নিজে নাও থাকতে পারে। যেমন একটু পর দেখা যাবে পিদিমের ভয়ানক সর্দি হয়েছে। তখন পিদিমের পাশে রাকাকে নাও দেখা যেতে পারে। কেন এমন হয়? পরিদের স্বপ্ন এমনই হয়। হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। উঠান অন্ধকার। পিদিম যে কাকের মতন করে ভিজে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই। ও পায়ে-পায়ে কাদাভর্তি উঠান পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে এল। দাওয়ার ওপাশে একটা দরজা আর সেটা ভেজানো। দরজায় উঁিক দিয়ে দেখল ঘরটা অন্ধকার। দিনটা মেঘলা বলেই। এজন্য মাটির মেঝের ওপর একটা পিদিম জ্বলে আছে। মেঝের ওপর চাটাই পাতা। সকাল বেলায় দেখা সেই সবুজ হাফ প্যান্ট পরা খালি গায়ের ছেলেটা পাটির ওপর মুখ ভার করে বসে আছে। আর ওর পাশে ছোট একটি মেয়ে বসে। মেয়েটা কাঁদছিল। চাটাইয়ের ওপর একজন মহিলা শুয়ে রয়েছে। দেখেশুনে মনে হল মহিলাটি এদেরই মা। মহিলাকে অসুস্থ মনে হল পিদিমে। ছোট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এ এ, খিদে পেয়েছে, ভাত খাব, এ এ, ভাত দাও, এ এ। অন্যদিন হলে এতক্ষনে মনোয়ার বৃষ্টি হোক আর নাই হোক হাটে দুধ বেচে চালডাল কিনে এনে রাঁধতে বসত। আজ যে কে দুধ খেয়ে গেল! তাই এখন না খেয়ে মরার দশা। ঘরে কিছু নেই। মুড়িও না। ওরা তো দিন আনে দিন খায়। ফরিদা তাই কাঁদছিল। মনোয়ার বিরক্ত হয়ে বলল, বললাম না ঘরে ভাত নেই। সকাল বেলায় দুধ চুরি করে কে যেন খেয়ে ফেলেছে। তাই দুধ বিক্রি করতে পারিনি। চালডালও কিনতে পারিনি। এই ফরিদা, কাঁদবি না বলে দিচ্ছি। এখন চুপ করে থাক। ফরিদা তবু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এ এ খিদে পেয়েছে। ভাত খাব। এ এ । ভাত দাও। এ এ। ওরে বকিস না মনো। চাটাইয়ের ওপর শুয়ে থাকা মনোয়ারের মা জমিলা দূর্বল গলায় বলল। মনোয়ার চেঁচিয়ে উঠে বলে, বকব না তো কী । একটু বুঝতে চেষ্টা করে না কী করে সংসার চালাচ্ছি। বাবা কালীগঙ্গায় ডুবে মরল। নইলে আমি ইশকুলে পড়তাম, সংসারের ঘানি টানতে হত না। বলে মনোয়ার ফুঁপিয়ে উঠল। জমিলা নিস্তেজ গলায় বলল, এসব আর বলে কী লাভ। সবই কপালের ফের। পিদিম সবকথা শুনছিল। পিদিম ভূত হলেও আসলে ও খুব ভালো ভূত। ওদের কথা শুনে ওর মনটা বিষম খারাপ হয়ে গেল। ওর বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। ইস, আমি এদের এতবড় সর্বনাশ করলাম! ভাবতেই ওর অনেক কষ্ট হতে লাগল। আমি এদের দুধ খেলাম বলেই তো এরা না-খেয়ে আছে। ইস কী অন্যায়ই না করেছি। এক্ষুনি এর একটা বিহিত করতে হবে। পিদিম ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকল। এই তুমি কে? কী চাও এখানে? মনোয়ার ছেলেটা সাহসী বলেই তেড়ে এল। পিদিম হাত তুলে বলল, আহা, থাম তো। আগে আমার কথা শুনবে তো । না শুনেই মিছিমিছি তেড়ে আসছ। মনোয়ার তবু সিদে হয়ে বসে জিগ্যেস করল, আগে বলো তুমি কে? তুমি কেন এখানে এসেছ? আরে বাবা আস্তে, আস্তে, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? দেখছ না আমি ভিজে গেছি। বলে পিদিম পাটির ওপর বসে পড়ল। ফরিদা কান্না ভুলে অবাক হয়ে পিদিমের দিকে চাইল। জমিলাও পিদিমের দিকে তাকিয়ে থাকল। পিদিম এবার চাটাইয়ের এককোণে জুত করে বসে বলল, আমার নাম পিদিম। আমি হলাম একটা সাদা ভূত। ইয়ে মানে ...মানে আমি স্বীকার করছি আজ ভোরবেলা আমিই তোমাদের গরুর দুধ সব খেয়ে ফেলেছি। সে জন্য আমি ভীষন লজ্জ্বিত ভাই। আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। স্বীকার করছি, কাজটা অন্যায় করেছি। তোমরা সব আমার জন্য না খেয়ে আছো। আমি এক্ষুনি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছি। বলেই সাঁই করে দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে গেল পিদিম। মনোয়ার আর ফরিদা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কে রে ছেলেটা? জমিলা জিগ্যেস করল। বলল তো ভূত, মা। ফরিদা বলল। ওর কান্না থেমে গেছে। খিদেও মরে গেছে। জমিলা বলল, ভূত হলেও বড় ভালো ভুত। দোষ করে ক্ষমা চাইতে এল। আবার খাবার আনতে গেল। ওকে দুপুরে খাইয়ে দেব ভাবছি। মায়ের কথাটা মনোয়ারকে মানতেই হল। যদিও মনোয়ারের এই মুহুর্তে মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ও গতকাল সন্ধ্যার কথা ভাবছিল। কাল বিকেল থেকে রাঘবদের দিঘীর পাড়ের মাঠে ঘাস খাচ্ছিল মালা। গতকাল সন্ধ্যের মুখে কারা যেন মালাকে ছেড়ে দিল। তো, ছাড়া পেয়ে মালা তো মহাখুশি। কদ্দিন ধরে ভাবছিল গড়পাড়া গ্রামটা একটু ঘুরেফিরে দেখবে। সুযোগ হয়নি। এখন হল। মালা ছাড়া পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সালমাদের আমবাগানে চলে গেল। মালার আর দোষ কী বল? যে কেউ ছাড়া পেলে তো হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে যাবেই। তখন ভর সন্ধ্যা। মনোয়ার রাঘবদের দিঘীর পাড়ে মাঠে এসে দেখল মালা নেই। ওর বুকটা ধক করে উঠল। ওর চোখে জল ভরে এল। ও রুমাল বার করে চোখ মুছে নিল। তারপর মালাকে খুঁজতে শুরু করল। কারা মালাকে ছেড়ে দিল? কারা মনোয়ারদের পথে বসাতে চায়। কারা আমাদের ক্ষতি করতে চায়? মালার দুধ বেচে কোনওমতে সংসার টিকে আছে। কী মনে করে সালমাদের বাগানের দিকে গেল। সালমার সঙ্গে ও একই ক্লাশে পড়ত। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়েছিল মনোয়ারকে। তাই সালমাকে দেখলেই ওর সঙ্কোচ হয়। পারতপক্ষে ও আমবাগানের দিকে যায় না। আজ মালার খোঁজে যেতেই হবে। কী আর করা। ওদিকে মালা যখন বকুলবাগানে উকিঁঝুঁকি মারছিল সালমা তখন বাগান থেকে পায়রাগুলিকে ঘরে তুলছিল সালমা। ও এক পলক দেখেই মনোয়ারদের গরুটাকে চিনতে পারল। ও মালার কাছে এসে মালার গলার দড়ি ধরে বলল, কী রে মালা, তোকে আবার ছাড়ল কে? মালা হাম্বা করে ডাকল। সালমা বলল, চল তোকে রেখে আসি। মনো নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তিতা আর কটূ তোকে ছেড়ে দিয়েছে না রে মালা? মালা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ। সালমাদের গ্রামে তিতা-কটূ নামে দুটি দুষ্ট ছেলে বাস করে। ওরা ভীষন দুষ্ট আর ভারি পাজী। ওরা গড়পাড়া ইশকুলে পড়লেও ঠিক মতন ইশকুলে যায় না । ইশকুল পালিয়ে সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ায়। ওদের জ্বালায় গড়পাড়া গ্রামের লোকেরা সব সময় অস্থির হয়ে থাকে। ওরা কি কি দুষ্টুমি করে? ওরা, এই ধরো পুকুর থেকে হাঁস চুরি করে, কারও ডাবগাছে উঠে ডাব চুরি করে, কারও-বা গরু-ছাগল চুরি করে নিয়ে যায় ...এই রকম কত কী করে। ওদের কিছু বলাও যায় না। বলতে গেলে তেড়ে আসে। তিতাটা লিকলিকে হলেও কটূটা আবার এই বয়েসেই বেশ দশাশই হয়ে উঠেছে। ওর গায়ের জোর সাঙ্ঘাতিক। ওর লড়াই করে পারা পারা যাবে না। কটূর প্যান্টের পকেটে একটা গুলতি থাকে, ওর হাতের টিপ ...এই তো সেদিন পেয়ারা খাওয়ার জন্য গালমন্দ করার জন্য সাহা বাড়ির নীপা সাহার সাধের কলসীটা দিল ফুটে করে। নীপা সাহা রাঘবদের দিঘীতে জল নিয়ে সাহাবাড়ি ফিরছিল, তখন। ওদের বাড়িতে নালিশ করে কোনও লাভ নেই। বাড়ির লোকেরাও ওদের ভয় করে। আর ওদের বাবা হারুন মন্ডল এ অঞ্চলের নাম করা কাঠের ব্যবসায়ী। বেশীর ভাগ সময়ই বাড়ি থাকে না। মহা ধূর্ত লোক এই হারুন মন্ডল। লোকে বলে, যেমন বাবা তেমন তার ছেলেরা। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সালমা মালার দড়ি ধরে হাঁটছিল। ততক্ষনে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সাহাদের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ বাতাসে ভাসছিল। কালীবাড়ির পাশে কাঁঠাল গাছের তলায় মনোয়ারকে দেখল সালমা। মনোয়ার মালাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সালমা গরুর দড়িটা মনোয়ার কে দিয়ে বলল, তিতে কটূর জ্বালায় দেখছি আর টেকা যাবে না। মনোয়ার বলল, কাজটা ওরাই করেছে, না? সালমা বলল, আবার কে। সন্ধে হয়ে এসেছে, চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি। মনোয়ার বলল, না না আমি একাই যেতে পারব। তোমার আসার দরকার নাই। সালমা বলল, আহা চল না। পথে আবার ও দুটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে, তখন? মনোয়ার বলল, তখন আর কী। যুদ্ধ করব। চোরের মতন এসে মালার খুঁটি তুলে দিল। কত বড় বাহাদুর। সামনাসামনি আসুক না। কষে ঘুঁষি দিয়ে দাঁত ফেলে দেব না। মনোয়ারের কথায় ভারি খুশি হল সালমা, ও বলল, ঠিকই আছে। তিতা-কটূরে একদিন শায়েস্তা করা দরকার। মনোয়ার বলল, হ্যাঁ। সালমা বলল, ওরা হারুন মন্ডলের ছেলে বলে মাথায় চড়ে বসেছে। একদিন সবাই মিলে ধরলে ওরা পার পাবে মনোয়ার বলল,তাই তো সালমা বলল, আমরা এক মামা শহরে বড় চাকরি করেন। ভাবছি মামাকে নেমতন্ন করে সব খুলে বলব। মনোয়ার বলল, তা হলে তো ভালো হয় সালমা। সালমা বলল, হ্যাঁ। তিতে-কটূদের শায়েস্তা করতেই হবে। আজ তোর গরু ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস গরুচোর দের হাতে পড়েনি। পড়লে গড়পাড়া নিয়ে হাটে বেচে দিত না? মনোয়ার কাতর স্বরে বলল, তা হলে যে কী হত। মাবোনকে নিয়ে পথে বসতাম। সালমার বাবা আফজাল মাষ্টার গড়পাড়া গাঁয়ের স্কুল শিক্ষক। খুবই ভালো মানুষ। মনোয়ারের বাবা মারা যাওয়ার পর নিয়মিত মনোয়ারদের খোঁজখবর নেন। সালমা বলল, বাবার কাছে শুনলাম তিতা-কটূর বাবা হারুন মন্ডল ঝিলিমিলি নদীর ধারে অশথর গাছটা কেটে নিতে চায়। মনোয়ার অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? সালমা বলল, হ্যাঁ। তাই তো শুনলাম। মনোয়ারের মুখে কালো ছায়া ঘনাল।ও বলল, গাছ কাটা কি ভালো সালমা? সালমা দৃঢ় স্বরে বলল, নাঃ, কক্ষনোই না। তা ছাড়া ওখানে আমার বন্ধুরা বাস করে। চিরি নামে ফিঙ্গে পাখি, কুটুস নামে কাঠবেড়ালি, গড়ান নামে একটা দাঁড়কাক। এরা সব আমার বন্ধু । গাছ কাটলে ওদের যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওরা তখন কোথায় যাবে বল্ তো? মনোয়ার কাতর স্বরে বলল, গাছ যেন না কাটে সেজন্য কিছু করা যায় না? সালমা বলল, গত কদিন ধরে তাই তো ভাবছি। কথা বলতে বলতে ওরা মনোয়ারদের বাড়ির উঠান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সালমা বাড়ি ফিরে গেল। এসবই গতকালের কথা। যদিও মনোয়ারের এই মুহুর্তে মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ও গতকাল সন্ধ্যার কথা ভাবছিল। ওদিকে এখন পিদিম মনোয়ারদের জন্য দইমিষ্টি আনার জন্য গাঁয়ের হাটের পৌঁছে গেছে। এই ফাঁকে বলে রাখি এই গ্রামের নাম গড়পাড়া। আর হাটের নাম গড়পাড়ার হাট। আজ বৃষ্টিবাদলা বলেই গড়পাড়ার হাট তেমন জমেনি। হাটের লোকজন কম। বেশির ভাগ দোকানের ঝাঁপ ফেলা। দোকান বন্ধ করে সব ঘুমোচ্ছে ভিতরে। পিদিম একটা মিষ্টির দোকানে চলে এল। দোকানের ওপর সাইনবোর্ড। তাতে লেখা: সুপ্রিয় মিষ্টান্ন ভান্ডার। পিদিমের জানার কথা না এই মিস্টির দোকানটা মধুময়রার। পিদিম দোকানে ঢুকে গেল। মিষ্টির দোকানে ঝাঁপ ফেলা। তাতে কী। পিদিমের জন্য এসব কোনও ব্যাপারই না। দেখা গেল ভিতরে একটা লোক নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। এইই হল মধুময়রার ছেলে যদুময়রা। সে মেঘলা দিন বলেই ঘুমিয়ে ছিল। তার পাশে বড় একটা কড়াইভরতি রসে ভেজানো গরম গরম রসগোল্লা। পিদিমের রসগোল্লা আবার ভীষন প্রিয়। ও ঠিক করল রসগোল্লাই নেবে। পিদিম একটা মাটির হাঁড়ি খুঁজে বার করে তাতে সের দুয়েকের মতন রসগোল্লা ভরে সাঁই করে মনোয়ারদের ঘরে চলে এল। আসলে পিদিম খুব জোরে ছুটতে পারে। বাতাসের গতিতে। আসলে ও একটা ভূত তো। সাদা ভুত। ঘরে ঢুকে পিদিম রসগোল্লার হাঁড়িটা ফরিদার সামনে রেখে লক্ষ্মী ছেলের মতন শীতল পাটির ওপর বসে হাঁড়ির মুখ খুলতে খুলতে বলল, আজ শুধু রসগোল্লাই খাও । দই আর কালোজাম অন্যদিন খাওয়াব কেমন? ফরিদা খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা। এতগুলি রসগোল¬া দেখে ওর ভাতের খিদে মরে গেল রসগোল্লা খাওয়ার খিদেটা জেগে উঠল। মনোয়ার ঝাঁঝের সঙ্গে জিগ্যেস করল, তুমি মিষ্টি কোত্থেকে আনলে পিদিম? চুরি করে আননি তো? তুমি তো আবার চুরির উস্তাদ। মনোয়ারের কথা শুনে পিদিমের কান দুটো লাল হয়ে গেল। ও মাথা নীচু করে দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। তাই তো রসগোল্লাগুলিও তো গড়পাড়া হাট থেকে ...এখন কী হবে। ইস, বারবার যে ভুল হয়ে যাচ্ছে। মাথা আবার ঝিমঝিম করবে নাতো? পিদিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, না মানে ...মানে ... ফরিদা একটা মিষ্টি তুলে মুখে দিতে যাবে এমন সময় মনোয়ার কঠিন স্বরে বলল, এই ফরিদা, একটা মিষ্টিও ছুঁবি না বল। ছিঃ! চোরই মাল ... মনোয়ার পিদিমের দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় বলল, যাও ওসব ফেরত দিয়ে এস। আমি কি এর আগে বলিনি পিদিম রসগোল্লা খেতে ভারি ভালোবাসে? এ জন্য ও মনোয়ারের কথায় কান না দিয়ে হাঁড়ি থেকে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি রসগোল্লা তুলে মুখে পুরে দিল। তারপর ঘর থেকে শাঁই করে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির ভিতর। আগের পর্বের লিঙ্ক সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ৯:৪৩
false
mk
বিএনপি সন্ত্রাসী দল_ কানাডা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রথমে যে রাজনৈতিক দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল সেটি জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। শুরুটা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের জাগদল নামে একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। সঙ্গে ছিল চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী বেশ কিছু অতি বামপন্থী দল। জিয়া নানা প্রলোভন দিয়ে তাঁর সঙ্গে নিয়েছিলেন বেশ কিছু অরাজনৈতিক সুবিধাবাদী পেশাজীবী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাকে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় যে আমলা খাদ্যসচিব ছিলেন তাঁকে জিয়া তাঁর খাদ্য উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। এতেও তিনি খুব বেশি তাঁর প্ল্যাটফর্মের ওপর আস্থাশীল হতে পারেননি। বহুদলীয় গণতন্ত্র উন্মুক্ত করে দেওয়ার নামে তিনি একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের মতো দলগুলোকেও রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। তাঁর শাসনামলে একাত্তরের জামায়াতের আমির পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আযমকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। একসময় জাগদল বিএনপিতে রূপান্তরিত হয়। বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করা বাংলাদেশে সে-ই প্রথম। এই কাজটি একসময় জিয়ার বস পাকিস্তানের ডিক্টেটর জেনারেল আইয়ুব খান করেছিলেন। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কখনো নিজের শক্তির ওপর আস্থাশীল ছিল না। সে কারণেই তাদের সব সময় জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসনির্ভর দলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। জামায়াত একটি ক্যাডারনির্ভর দল, যার রাজনৈতিক কাঠামো অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধী সংগঠন মাফিয়াদের মতো। ব্যক্তি হিসেবে জিয়া অনেক চতুর ও ধূর্ত ছিলেন। তাঁর শাসনামলে তিনি জামায়াত বা অন্যান্য আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এদের বিএনপির কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হতে দেননি। জিয়ার আর এরশাদের একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁরা দুজনই সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করতেন। তাঁরা কেউই অন্য কাউকে বিশ্বাস করতেন না। দুজনের আমলেই একটি সাক্ষীগোপাল সংসদ ছিল আর ছিল একটি মন্ত্রিসভা। কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। বেগম জিয়া তাঁর স্বামী বা এরশাদ থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি নিজে ছাড়াও তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান আর ভাই সাঈদ এস্কান্দারকেও শরিক করেছিলেন। সাঈদ এস্কান্দারের কর্মকাণ্ড তেমন একটা দৃশ্যমান না হলেও সেনাবাহিনীতে তাঁর একটা বড় প্রভাব ছিল। আর তারেক রহমান স্বনামে খ্যাত হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক সমান্তরাল একটি বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছিলেন, যা হয়ে উঠেছিল দুর্নীতি আর ষড়যন্ত্রের একটি বড় মাপের দুর্গ।তারেক রহমানের সহায়তায় খালেদা জিয়া ২০০১-০৬ মেয়াদের শাসনামলে হয়ে ওঠেন অনেকটা বেপরোয়া। এই বেপরোয়াপনায় তাঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল জামায়াত। জামায়াতের এই সখ্যের মূল কারণ ছিল জেনারেল জিয়া তাদের নিষিদ্ধ সংগঠনকে বৈধতা দিয়েছেন আর বেগম জিয়া তাদের আমির মতিউর রহমান নিজামী আর সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ মোহাম্মদ মুজাহিদ, যাঁদের দুজনই একাত্তরের প্রথম কাতারের যুদ্ধাপরাধী, তাঁদের তাঁর মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার এই মেয়াদকালে মূল ষড়যন্ত্র ছিল আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল এই ষড়যন্ত্রের এক ভয়াবহ নজির। এ বিষয়ে সংসদে ততকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ কথা বলতে চাইলে তাদের এ বিষয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং বিএনপির একাধিক সংসদ সদস্য অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে বলার চেষ্টা করেছিলেন এই গ্রেনেড হামলা খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগেরই একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। গ্রেনেড হামলার মূল নায়ক মুফতি হান্নান আদালতে স্বীকার করেছেন এই হামলার সঙ্গে তারেক রহমান ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা জড়িত ছিলেন এবং তারা হাওয়া ভবন থেকেই সব নির্দেশ পেত। চট্টগ্রামে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ল সে সম্পর্কেও বেগম জিয়াসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা অবহিত ছিলেন। বিএনপির সংসদ সদস্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী সংসদে সুযোগ পেলেই বলতেন প্রয়োজনে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানো হবে।২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি আর জামায়াতের ভরাডুবির মূল কারণ তাদের শাসনামলের পুঞ্জীভূত পাপের বোঝা। সেই নির্বাচনে স্বল্পসংখ্যক সিট পেয়ে সংসদের ভেতর তাদের সদস্যরা নিয়মিত সংসদকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছেন। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিএনপি আর জামায়াত মিলে বায়না ধরে তারা নির্বাচনে যাবে তা যদি আদালত কর্তৃক বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তাদের ইন্ধন জোগাল দেশের বেশ কিছু সুবিধাভোগী সুধী ব্যক্তি আর কৃপাধন্য মিডিয়া। সঙ্গে জুটল কয়েকটি দেশের দূতাবাস। বিএনপির পক্ষে অনেকটা ওকালতি করতে অযাচিতভাবে জাতিসংঘ আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এলেন রাজদূতরা। নির্বাচনবিষয়ক জটিলতা পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হওয়ার আগে ২০১৩ সালের ৫ মে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হেফাজতের নামে ঢাকা দখল করতে ছুটে এলো কয়েক হাজার ধর্মব্যবসায়ী। এই ধর্মব্যবসায়ীদের তাণ্ডবে একসময় মনে হলো বুঝি দুর্বৃত্তদের হাতে বাংলাদেশের রাজধানীর পতন হবে। তাদের সর্বাত্মক সমর্থন জানাল বিএনপি। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের ফলে রক্ষা পেল রাজধানী। এরপর শুরু হলো বিএনপি-জামায়াত জোটের অসাংবিধানিক পন্থায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার ভয়াবহ একতরফা পেট্রলবোমার যুদ্ধ। খালেদা জিয়া সেই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গুলশানে তাঁর রাজনৈতিক অফিসে কমান্ড বাংকার খুললেন। বললেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত না করে তিনি ঘরে ফিরবেন না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষ আর কখনো খালেদা জিয়ার পেট্রলবোমার মতো এত জীবন ও সম্পদ ধ্বংসকারী ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি। সঙ্গে তিনি সারা দেশে অবরোধও ঘোষণা করলেন। টানা ৯২ দিন খালেদা জিয়ার এই যুদ্ধ চলল। তাঁর এই যুদ্ধের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার দায়িত্ব নিল ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। পুড়ল ট্রেন আর কয়েক শ স্কুলঘর। কয়েক হাজার যানবাহনে খালেদা জিয়ার সৈনিকরা অগ্নিসংযোগ করল। প্রায় তিন শ নিরীহ মানুষ পেট্রলবোমার শিকার হয়ে প্রাণ দিল। চিরতরে পঙ্গু হলো কয়েক শ। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আসুন, একসঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। বেগম জিয়ার মন টলানো গেল না। শেখ হাসিনা সংবিধান সমুন্নত রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি ও তার মিত্রদের ছাড়া নির্বাচন করে সরকার গঠন করলেন। এটি সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে।এটি স্বাভাবিক, বেগম জিয়ার এমন পরাজয়ের পর তাঁর অনেক সৈনিক দেশত্যাগী হবে। হয়েছেও ঠিক তাই। কেউ গেল যুক্তরাজ্যে, কেউ বা যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকে ছুটল কানাডা। এসব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া অনেকটা সহজ। বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান সেই ২০০৭ সাল থেকে চিকিৎসার নামে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সপরিবারে বিলেতে আছেন। তবে দেশ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাঁর ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এমন একজন দুর্বৃত্ত মিরপুর স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আশায় গিয়েছিলেন কানাডা। প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল জুয়েলকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু পরের বছর ১৬ মে তাঁর এই অনুমোদন বাতিল করে দেয় সেই দেশের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। বাতিল করার সময় কানাডার অভিবাসন অফিসার মন্তব্য করেন, বিএনপি বর্তমানে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং ভবিষ্যতেও তাদের এমন চরিত্র বজায় থাকবে। সেই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি হরতালের নামে যেসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল তা তাদের সংজ্ঞায় পুরোদস্তুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বিষয়টি আইনগত পর্যালোচনার জন্য কানাডার ফেডারেল কোর্টে (সর্বোচ্চ আদালত) উত্থাপিত হলে শুনানি শেষে বিচারপতি হেনরি ব্রাওনা ৩২ পৃষ্ঠার এক রায়ে বিএনপির অতীতের সব কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে অভিবাসী অফিসারের সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেন অর্থাৎ এটি সে দেশের আদালতে প্রমাণিত হয় যে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল এবং তাদের কোনো কর্মী সেই দেশে এই দলের সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে তাকেও মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজীর মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে। রায় লিখতে গিয়ে বিচারক বিএনপির প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন সময় তার কর্মকাণ্ড, দলটি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পরিবেশিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে গত ২৫ জানুয়ারি।খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিএনপি যে একটি সন্ত্রাসনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে, তা কানাডার আদালতে প্রমাণিত না হলেও তেমন কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। বাংলাদেশের মানুষ তা বেশ আগে থেকেই জানে। তারা বর্তমানে শুধু এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট পেয়েছে। তাদের এই পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা শুধু নিজেদের ও জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করতে পারে। সাহাবুদ্দিন লাল্টু একসময় ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। নাসিরউদ্দিন পিন্টু ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। একসময়, সম্ভবত ১৯৯৭ সালে পিন্টু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাল্টুর কান কেটে নিয়েছিলেন। লাল্টু এখন রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে কানাডাপ্রবাসী। গত ২৩ তারিখ লাল্টু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি আজ সর্বস্বান্ত। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকার পরও একটি দল যে যারপরনাই দুর্ভোগের সীমাহীন শিকারে পরিণত হতে পারে, তার প্রমাণ বিএনপি নামের দলটি। কোনো রকমের সাংগঠনিক যোগ্যতা ছাড়াই এ দলের বড় পদগুলো দখল করে রেখে জনগণের অতিপ্রিয় দলটিকে দেউলিয়াত্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে কিছু নেতা। ...দলটিতে কার্যত নেতাকর্মীদের জন্য শীর্ষ নেতা-নেত্রীর তোষামোদি করা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। ...স্বাধীনতাবিরোধী (জামায়াত) একটি দলের সঙ্গে জোট বাঁধার কারণে দলটি আজ শুধু দেশেই নয়, বিদেশে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। সন্ত্রাসী দল না হয়েও শুধু অপপ্রচারের কাছে পরাস্ত হয়ে কানাডার মতো একটি দেশের ফেডারেল আদালতের চোখে সন্ত্রাসী পরিগণিত হওয়া কিছুতেই চাট্টিখানি কথা নয়। ...এমন একটি অপবাদ দলটিকে নিতে হতো না, যদি তারা স্বাধীনতাবিরোধী ওই দলটির সঙ্গে কোনো প্রকার রাজনৈতিক জোট না বাঁধত।’ একসময়ের ছাত্রদল প্রধান লাল্টু যখন এমন কথা বলেন, তখন বিএনপির দপ্তর সম্পাদক (অনেকের মতে আবাসিক বিবৃতি সম্পাদক) রুহুল কবীর রিজভীর মতে এ সবকিছুই সরকারের ষড়যন্ত্রের ফল। আওয়ামী লীগ যদি এতই ক্ষমতাসম্পন্ন হয় যে কানাডার আদালত পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে বিএনপির রাজনীতি করার আর কী প্রয়োজন?পেট্রলবোমা যুদ্ধের পর অনেক স্থানে বোমা বানানোর সময় ছাত্রদলের একাধিক বোমাবাজের হাত উড়ে গেছে। ২০১৪ সালে কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে তারা নিজ দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার দায়ে মামলা মাথায় নিয়ে দেশত্যাগ করেছে। বিএনপি বলেছে, তারা কানাডার আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে কানাডা দূতাবাসে যাবে। বিএনপির বোঝা উচিত, কানাডার আদালত সরকারের আজ্ঞাবহ কোনো আদালত নয়। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে। তবে রিজভী আহমেদ কানাডার আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করতে পারেন অথবা তাদের নেত্রী ঢাকায় লাগাতার অবরোধও আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন। কী উপায়ে বিএনপি তাদের বর্তমান দুরবস্থা থেকে বের হবে তা তাদের এখনই চিন্তা করতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৩১
false
fe
বর্ণবাদ ও মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ বর্ণবাদ ও মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ফকির ইলিয়াস ======================================= বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার দিকে। এগুচ্ছে মানুষ। মানুষের এই অগ্রগতিতে যতই বাধা আসছে মানুষ তা ডিঙিয়ে গেছে সাহসিকতার সঙ্গে। মানুষ জানিয়ে দিচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নের পথে কোনো অন্তরায়ই তারা মেনে নেবে না। ক’বছর আগে ব্রিটেনে একটি ঐতিহাসিক মামলার রায় মানুষকে আবারো আশান্বিত করেছিল। নেইল বোমা নির্মাণকারী এবং বর্ণবাদী ব্যক্তি ডেভিড কোপল্যান্ডকে ব্রিটিশ আদালত ছয়বার যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে। চব্বিশ বছর বয়সী ডেভিড লন্ডনের ব্রিকলেন, পশ্চিম লন্ডনে সোহো এবং ব্রিক্সটনে নেইল বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন ব্যক্তি নিহত এবং ১৩৯ জন আহত হন। ডেভিড আদালতে স্বীকার করে একটি বর্ণবাদী দাঙ্গা ঘটানোর লক্ষ্যেই সে বিস্ফোরণ ঘটায়। সে আরো বলে ওই ঘটনায় নিহত এবং আহতদের ব্যাপারে তার কোনো সমবেদনা নেই। নাজিতন্ত্রে বিশ্ববাসী ডেভিড কোপল্যান্ডের স্বপ্ন ছিল এশিয়ান, আফ্রিকানসহ সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গদের ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত করা। সেই লক্ষ্যে সে নিষিদ্ধ ন্যাশনাল সোশ্যাল মুভমেন্টের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে। ইংল্যান্ডের বর্ণবাদী বিএনপি’র (ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) সঙ্গেও ছিল তার যোগাযোগ। বর্ণবাদ বিশ্বের একটি সমস্যা। আশার কথা-তা যারা লালন করছে, তারা তা করছে সুপ্তভাবেই মনের কোণে। বিশ্বের কোথাও প্রকাশ্যে এখন আর বর্ণবাদের কোনো সমর্থন নেই। দু’চারটি দেশে যদিও বর্ণবাদের কিছুটা দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, তবে তার অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে, গোপনে। বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী মি. মার্টিন লুথার কিংকে আমি বারবার প্রণাম জানাই। তাকে সম্মান করি এজন্য যে, প্রাণ দিয়ে তিনি যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন- তা প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়ত আমিও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারতাম না। এ বিষয়ে আরো স্মরণীয় ব্যক্তিরা হচ্ছেন প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. আব্রাহাম লিংকন, লৌহ পুরুষ মি. নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই পথ ধরে আজকের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। বিশ্বের কোনো মানবধর্মই বর্ণবাদকে সমর্থন করে না। মাও সে তুংয়ের একটি বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলতেন, ‘বর্ণ, জাত, গোত্র এবং সাম্প্রদায়িক দাম্ভিকতা যে মানুষ তার অন্তর থেকে নির্মূল করতে পারবে না- সে নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়া উচিত নয়।’ বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদী মানসিকতাকে নির্মূল করার নেপথ্যে কালাকালের সমাজতন্ত্রী নেতারা একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। মার্কস, লেলিন, মাও সে তুংসহ আরো অনেক নেতা উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছেন মানুষ মানেই সব সমান। এ ক্ষেত্রে বর্ণ কোনো বিষয় হতে পারে না। মানুষ বিচার্য হতে তার কর্মগুণে। এটা অত্যন্ত আশার কথা, বিশ্বে বর্তমানে সমাজতন্ত্রের ক্রান্তিকাল চললেও গণতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক নেতারা বর্ণবাদ প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। বিশেষ করে বিশ্বের বর্তমান ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই বলছে, বর্ণবাদ-নাজিতন্ত্রের নামে কোনো অপতৎপরতা মোটেই বরদাশত করা হবে না। বর্ণবাদ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সর্বদা প্রস্তুত। ক’বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় রডনি কিং মামলা যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই মোকাবিলা করেছে। নিউইয়র্কের হার্লেস, ব্রংকস কিংবা ব্রুকলিনে যখনই সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে বর্ণবাদের প্রেতাত্মা প্রকাশিত হওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই তা দমনে এককাতারে দাঁড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা। মানব কল্যাণ, সভ্যতা এবং আধুনিকতাকে সামনে রেখে মানুষ এই যে এগিয়ে যাচ্ছে- তারপরও বর্তমান বিশ্বের কোথাও কোথাও মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর উদাহরণ দেয়া যায়। ওসব আরব দেশগুলোতে এখনো প্রভু এবং দাসপ্রথা বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনের অনেক লোক কাজ করছেন। এদের মধ্যে অনেক পেশাজীবীও রয়েছেন। কিন্তু এদের সবার সঙ্গেই অ্যারাবিয়ানদের ব্যবহার ‘দাস’-এর মতো। যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তারা ওই দেশে পৌঁছেই তাদের পাসপোর্ট, ‘কফিল’ র্অথাৎ যে আরবী তাকে ভিসা দিয়েছে তার কাছে হস্তান্তর করে দিতে হয়। বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই ওসব দেশে। গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা সে সব দেশগুলোতে রহিত। একেকজন আরবী শায়খ, তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে। মেধা, মনন, পুঁজি খাঁটিয়েও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে একজন বিদেশি স্বনামে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে না। ব্যবসা করতে হয় আরবী মালিকের নামে। মূল স্বত্বাধিকারী বিদেশিকে গলাধাক্কা দিয়ে, ভিসা বাতিল করে উড়োজাহাজে তুলে দেয় পুলিশী হেফাজতে। বিনাপুঁজিতে চমৎকার ব্যবসাকেন্দ্রটি তার করায়ত্ত হয়ে যায়। বর্ণবাদ না থাকলেও ধূর্ত সামন্তবাদের আদলে মধ্যপ্রাচ্যে এই যে অমানবিক দুর্বৃত্তপনা চলছে এর প্রতিকার দরকার। মৌলিক স্বাধীনতার প্রশ্নে সেসব দেশের নাগরিকদেরকেই জেগে উঠতে হবে। একেকজন মানুষ ‘রোবট’ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। জ্ঞানবিজ্ঞানের এই যুগে বিশ্বের মানবতাবাদী নেতাদের এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। সামন্তবাদ বর্ণবাদেরই যমজ সহোদর। তাই বর্ণবাদের পাশাপাশি সামন্তবাদ ঠেকানোও আজ অত্যন্ত জরুরি। ইংল্যান্ডের বিচারক, বর্ণবাদী ডেভিডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে যে নজির সৃষ্টি করেছিলেন- তা বিশ্বে বর্ণবাদকে আরো নিরুৎসাহিত করবে। কল্যাণকামী মানুষেরা চান, সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধেও এমন বিচার হোক বিশ্বের দেশে দেশে। -------------------------------------------------------------------- দৈনিক ডেসটিনি।ঢাকা । ১৬ মে ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০০৯ সকাল ৭:২০
false
hm
কালাইডোস্কোপ, গণরণসঙ্গীত ও বরাহশিকার ১. সচলের প্রধান অ্যানিমেটর সুজন চৌধুরীর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, বাংলা টাইপিঙে মন্থরতা। সুজন্দা টাইপিঙে আরেকটু সড়গড় হলে সম্ভবত সচলায়তনে গল্পের ঝুলি তাঁরই সবচেয়ে বড় থাকতো। তবে লেখার খামতি সুজন্দা এঁকে পুষিয়ে দ্যান অহরহই। সচলের একদম শুরু থেকেই তাঁকে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করছি নানা আঁকাআঁকির আবদার করে। প্রতিদিনের ব্যস্ততা থেকে একটু সময় বের করে সুজন্দা সেই আবদারের একটা বড় অংশ পূরণ করে আসছেন। সুজন চৌধুরী শুধু আমার কালাতো ভাই-ই নন (আমরা দু'জনেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ), আরো নানা ব্যাপারে তাঁর সাথে আমার ঐকমত্য আছে বলে অনুভব করেছি। তাই যখন সুজন্দাকে প্রস্তাব দিলাম, একটা ছোট্ট অ্যানিমেশন হাউস গড়ে তুললে কেমন হয়, সুজন্দা রাজি হতে সময় নেননি। অ্যানিমেটর হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা এক দশকেরও বেশি, তিনি রাজি হবেন না তো কে হবেন? কী নাম হবে সেই অ্যানিমেশন জোটের, যারা বানাবে নতুন ধারার বাংলা অ্যানিমেশন, যারা নতুন রঙের গল্প আর নতুন গল্পের রং যোগ করবে এই অনিশ্চিত, নতুন মাধ্যমে? অনেক তর্ক শেষে স্থির হলো, কালাইডোস্কোপ। দুই কালা-র ক্যালেইডোস্কোপ। কালাইডোস্কোপ নিয়ে আমি খুব উত্তেজিত, সুজনদা আমার চেয়ে দুনিয়া বেশি দেখেছেন বলে একটু কম উত্তেজিত। আমরা চাই, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে বাংলাভাষী টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্পের জন্যে ছোটো ছোটো সবাক অ্যানিমেটেড ফিল্মস আর অ্যানিম্যাটিক তৈরি করতে, পেশাদারিত্বের সাথে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। কতটা সফল হতে পারবো আমরা, জানি না, কিন্তু স্বপ্নভূক হয়েই তো বেঁচে আছি? সচলের সবার পরামর্শ কামনা করছি এ ব্যাপারে। হুজুগ নয়, হঠাৎ মাথায় চাপা ভূত নয়, আমরা সিরিয়াস, একটা কিছু করতে চাই। ২. স্বাধীনতার ৩৮ বছরে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিরুদ্ধে কয়টা গান লেখা হয়েছে? কেউ কি একটু বলবেন দুয়েকটা গানের কলি? গেয়ে শোনাবেন? লিঙ্ক যোগাতে পারবেন? আমার গান নিয়ে জ্ঞান অপ্রতুল, কিন্তু কান বলছে, মন বলছে, সেরকম কোনো গান আমরা লিখে উঠতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক উদ্দীপনাযোগানিয়া গান আছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গান আছে, কিন্তু এই যে বরাহশাবকের দল, এদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্যে কোনো গান কি লিখেছেন কোনো গীতিকার? কোনো সুরকার সুর করেছেন? কোনো শিল্পী গেয়েছেন? বেশি না, এমন একটা গান আমাকে দিন? এমনি করে চেয়েছিলাম অনেকের কাছে, তাঁরা দিতে পারেননি। আমি বাধ্য হয়ে একটা গান নিজে বেঁধেছি। এটা রাজাকারদের বিরুদ্ধে সক্রিয়তার মহাসমুদ্রে আমার এক ফোঁটা শিশির। গানটা নিয়ে আমি নিজে উৎফুল্ল, সারাদিন লুপে বাজিয়ে ফুল ভলিউমে শুনি আর নাচি। গানটার নাম বরাহশিকার! যারা আমার ফেসবুকবন্ধু, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন আমি বরাহশিকার নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে আসছি কয়েক সপ্তাহ ধরে। কয়েকজন বন্ধুকে পূর্ণাঙ্গ গানটা শুনিয়েছি, কয়েকজনকে আংশিক, এবং উল্লাসের সাথে জেনেছি, গানটি নিয়ে আমার উত্তেজনা তাঁদের মাঝেও সংক্রামিত হয়েছে। গানটার প্রথম স্তবকের অডিও এখন যোগ করলাম এই পোস্টে। ফুল ভলিউমে শুনে দেখুন। . . Get this widget | Track details | eSnips Social DNA . . এই গানটির সম্পূর্ণ সংস্করণ, ৩ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের অডিও ফাইলটি জানুয়ারির ১ তারিখে সচলে অবমুক্ত করা হবে। এটিকে আমরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই। এটি হোক নতুন বছরে আমাদের প্রতিজ্ঞা। এই গান গাইতে গাইতে আমরা দলবেঁধে বইমেলায় যাবো, দলবেঁধে গাইতে গাইতে ফিরবো। এটি হোক আমাদের গণরণসঙ্গীত! ৩. গানটা নেহায়েত গান হিসেবে মাথায় আসেনি। এর পেছনে একটা দীর্ঘ গল্প আছে, সেটা জানুয়ারির ১ তারিখে বলবো। গানটার নেপথ্যে যে গল্প আছে, সেই গল্পের ওপর ভিত্তি করে সুজনদা একটা অ্যানিম্যাটিক তৈরি করছেন কয়েক সপ্তাহ ধরে। আমাদের ইচ্ছা ছিলো বিজয় দিবসে আমরা এটা শেষ করে সচলে আপলোড করবো, কিন্তু সময়ে কুলায়নি। তাই একটা ট্রেলার যোগ করছি আমাদের অ্যানিমেটেড গীতিনাট্যের, যেটির নাম "বরাহশিকার!" এটি একটি লো-রেজ সংস্করণ, আকার ছোটো রাখার জন্যে অনেক কিছুই যোগ করা হয়নি। আপনাদের প্রতিক্রিয়ার আশায় রইলাম আমরা। ভিডিওটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকে। রাইট মাউজ ক্লিক করে "প্লে" আর "লুপ" নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আপাতত কালাইডোস্কোপের জন্যে একটা পেইজ খোলা হয়েছে ফেসবুকে। ফ্যান কথাটা আমার পছন্দ নয়, ফেসবুক পেইজটিতে সহযাত্রী হিসেবে আপনারা সকলে আমন্ত্রিত। ধন্যবাদ। ফলোআপঃ সম্পূর্ণ গান nc=document.getElementById("node-29295-content");mUnsel(nc);dSel(nc);/*dCtx(nc);*/ হিমু এর ব্লগ ১৫৫৬বার পঠিত
false
hm
নতুন কিসিমের চাষবাস আমাদের দেশে নতুন ব্যবসার ধারা শুরু হলে চিনির পাহাড়ের পিঁপড়ার সারির মতো সবাই একযোগে সেই ব্যবসার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৈরি পোশাক শিল্প, চিংড়ি চাষ আর আদমব্যবসা লাভজনক বলে এগুলোর স্ফীতি অন্য সব বিবেচনাকে মলিন করে দিয়েছে। শহরাঞ্চলে তৈরি পোশাকের কারখানা গজিয়ে উঠেছে শয়ে শয়ে, কৃষিজমিতে লোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ির ঘের বানানো হয়েছে, আর শ্রমবাজার বিশ্লেষণের তোয়াক্কা না করে দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে চড়া টাকা আদায় করে তাদের পাঠানো হচ্ছে এমন সব দেশে, যেখানে তাদের জীবিকানির্বাহই এক বিষম দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেশে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা। এতে করে কিছু লোক প্রচণ্ড লাভবান হচ্ছে, কিছু লোক খেয়ে পরে বাঁচতে পারছে, আবার এই ব্যবসার চাপে নাগরিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষিজমি, শক্তি ও জ্বালানি পরিস্থিতি, এসবের সাম্যাবস্থার ছকও আমূল পাল্টে গেছে। আমাদের দেশ এখন প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আমাদের দুইটা মাত্র ডিম আমরা একটা থলিতে নিয়ে পৃথিবীতে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছি। পুরুষের কাছে পরিস্থিতিটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মাঝে মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে পণ্যের বহুমুখীকরণের কথা বলছেন। কারণ এই দুই খাতে কোনো কারণে একযোগে সমস্যা দেখা দিলে আমরা বড় বিপদের মুখে পড়বো। পণ্যের বহুমুখীকরণ আমাদের জন্য সহজ নয়, কারণ আমাদের শক্তি ও জ্বালানি খাতে দুর্বলতা রয়েছে। আমরা জাহাজ নির্মাণ শিল্প নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছি, কিন্তু এই শিল্পের জন্যেও প্রয়োজন প্রচুর শক্তি। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও মূ্ল্য সংযোজনের শেষ দুয়েকটি ধাপে আমরা বিচরণ করতে পারি কেবল। আমাদের প্রয়োজন এমন কিছু পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়া, যেটি খুব শক্তিঘন নয়, কিন্তু মূল্য সংযোজন তুলনামূলকভাবে বেশি। এমন পণ্যের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিগত পণ্য (বা সেবা) বোধহয় সবচেয়ে আগে মনে পড়ে, কিন্তু এই সেক্টর নিয়ে আমাদের সব সরকারই বিস্ময়কর রকমের উদাসীন। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যে উদ্যোক্তারা আছেন, তারাও খুব একটা জোরালো কণ্ঠে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায় নিয়ে সরব নন। বিচ্ছিন্নভাবে পরিচিত কয়েকজন উদ্যোক্তাকে নানা বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি, কিন্তু সেগুলো ঠিক শিল্পোদ্যোক্তার সুবিন্যস্ত দাবি হিসেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কানে যাওয়ার মতো করে উচ্চারিত নয়। আমি এমন একটি নতুন ধারার পণ্য নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি, যেটি বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একেবারেই অস্পৃষ্ট। চীনের ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে সু্ইফ্ট পাখির বাসার স্যুপ। তারা মনে করে, এই স্যুপ খেলে শরীর ও মনের নানা উপকার হয়। সুইফ্ট একটা ছোট্টো পাখি, তার বাসা সে তৈরি করে টুকিটাকি এটাসেটার সাথে নিজের লালা মিশিয়ে (দলছুট অ্যালার্ট!)। সুইফটের লালা বাতাসের সংস্পর্শে এলে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। এই শক্ত লালার পরত দিয়েই পাখিটার বাসা তৈরি। আর এই বাসা গুলিয়ে ঝোল করে খাওয়ার জন্যে চীনের লোকজন এতই ক্ষ্যাপা যে তারা বেশ চড়া দাম দিতে রাজি আছে। চীনের বিশাল এবং ক্রমশ ধনী হয়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর এই পক্ষীনীড়ক্ষুধা মোচনের জন্যেই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ায় গড়ে উঠেছে সুইফ্টের বাসার চাষের ব্যবসা। মালয়েশিয়া বছরে দেড়শো কোটি ডলারের সুইফটের বাসা রপ্তানি করে চীনে, ইন্দোনেশিয়া করে চুরাশি কোটি ডলারের মতো। ঝোলবান্ধব বাসা বানায় যে সুইফ্ট (এয়ারোড্রামাস ফুসিফেগাস), সে ঠিক আমাদের দেশের পাখি নয়। এ পাখির আবাস শুরু হয়েছে থাইল্যাণ্ড থেকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সমস্তটা জুড়েই তারা থাকে। সুইফ্ট থাকে অন্ধকার গুহার ছাদ আর দেয়ালে বাসা বানিয়ে। পাখিটার পা খুব ছোটো বলে এরা পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না, তবে গুহার দেয়াল বা ছাদ খামচে ধরে ঝুলে থাকতে পারে। এ কারণেই মুরগির মতো করে সুইফ্ট পালন সম্ভব নয়, তার জন্যে চাই ওরকম অন্ধকার গুহার অনুকরণে বানানো বাসা। উইকিমিডিয়া কমনসের সৌজন্যে দেখুন ওরকম একটা বাসার ছবি। ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন ছোটো ছোটো দ্বীপে, গঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠেছে এমন শয়ে শয়ে সুইফ্টের বাসা। কংক্রিট দিয়ে কয়েকতালা বাসা বানিয়ে তাতে সুইফ্টকে ভুলিয়েভালিয়ে একবার ভেতরে নিতে পারলেই হলো, এরপর বাকিটা তারাই দেখভাল করবে। পাখির সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে চাই ভাবভালোবাসার উপযুক্ত পরিবেশ আর খোরাক। সুইফ্ট খায় নানারকম মাছি আর টুকিটাকি পোকা (লেপিডোপ্টেরা আর ডিপ্টেরা, প্রধানত), তাকে হাঁসমুরগিকোয়েলের মতো খাবারও যোগাতে হয় না। শুধু থাকার ব্যবস্থাটা করে দিলে সে নিজেই মাছি ধরে খেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা বড় করে একাকার অবস্থা করে ছাড়বে। সমস্যা হচ্ছে, সুইফ্ট ঝাঁক বেঁধে বাঁচে। বাড়ির ছাদে খাঁচা বানিয়ে যেভাবে মুরগি বা কোয়েল পালা যায়, সেভাবে সুইফ্ট পালা একটু মুশকিল, প্রথমত ঐ অন্ধকার গুহার মতো একখান ঘরের ব্যবস্থা তাকে করে দিতে হবে, আর দ্বিতীয়ত, সুইফ্টের ডাক বড় তীক্ষ্ন। জ্ঞাতিগুষ্টি সবাই একসঙ্গে যখন ডাকবে সন্ধ্যাবেলা, তখন প্রতিবেশীরা নিশ্চিত এসে সুইফ্টের বাসায় আগুন ধরিয়ে দেবে। সুইফ্ট অন্ধকারে থাকে বলে শব্দের সাহায্যে দিঙনির্ণয় (ইকোলোকেশন) করে, আর সে কারণে শব্দও করে প্রচুর। সুইফ্টের বাসার দাম চীনের আমদানি বাজারে প্রতি কিলোগ্রাম চারশো থেকে তিন হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয় (এক কিলোগ্রাম রূপার দাম আজ নয়শো ঊনিশ মার্কিন ডলার)। ঢাকাসহ বড় বিভাগীয় শহরে যেখানে শহর থেকে একটু দূরে আবর্জনা ফেলা হয়, সেখানে অবধারিতভাবে প্রচুর মাছি থাকে, আর পাখির ডাকে আলাদা করে বিরক্ত হওয়ার লোকও সেখানে খুব বেশি থাকার কথা নয় (একে গন্ধ, তারওপর কাকের শোরগোল), এই ডাম্প এলাকা সুইফ্টের জন্যে এক আদর্শ ফিডিং গ্রাউন্ড হতে পারে। এর আশেপাশেই গড়ে উঠতে পারে সুইফ্টের বাসার আবাদ, অর্থাৎ কংক্রিটের কয়েকতলা ফাঁকা বিল্ডিং, যাতে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস কিছুই দিতে হয় না। সুইফ্টের বাসা চাষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যদি বছরে কয়েকশো কোটি ডলার আয় করতে পারে, তাহলে এই মার্কেটে আমরাও ভাগ বসাতে পারি। উৎসাহী কোনো উদ্যোক্তা যদি এগিয়ে এসে কাজটা শুরু করেন, আর লাভের মুখ দেখেন, তার পেছনে পেছনে চিনির পাহাড়ে পিঁপড়ার মতো সারি বেঁধে আরো অনেকেই এগিয়ে আসবেন। শুরুটা করার জন্যে পক্ষীবিদ, পতঙ্গবিদ, চীনবিদ ইত্যাদি নানা বিশারদদের নিয়ে প্রারম্ভিক ব্রেইনস্টর্মিং সেরে নিতে হবে। মালয়েশিয়ায় নতুন উদ্যোক্তাদের জন্যে রীতিমতো প্রশিক্ষণ কোর্স করানো হয়, ইন্টারনেটে দেখলাম, বইপত্রও লেখা হয়েছে সুইফ্টের বাসা চাষের ওপর। এখন শুধু কয়েক জোড়া সুইফ্ট যোগাড় করে কাজ শুরু করার পালা। নিশ্চয়ই অনেক সমস্যা আছে আমার আইডিয়ায়। মন্তব্যের মাঠে ধরিয়ে দিন প্লিজ।
false
rg
বাস্তিল দুর্গ ।। রেজা ঘটক বাস্তিল দুর্গ ।। রেজা ঘটককে ওখানে? - কোথায়? - কাঁঠালবাগান।একটি ঘর- একটা দরজা, একটা জানালা, একটা ঘুলঘুলি;কে থাকে ওখানে? - কোথায়? - বিচ্ছিন্নপুর।একটা রশ্মিতে হাঁটু পর্যন্ত ভাঁজানো একটা প্যান্ট ঝুলছে,তারপাশে সদ্য ঝোলানো একটা ফ্যাট জিন্স, একটা স্কাই চেকহাফ শার্ট, কয়েকটা ফাঁকা হ্যাঙার তার মধ্যে একটা টি-শার্ট উল্টো করা,পাশে একটা লাল রুমাল, একটা অফ-হোয়াইট টি-শার্ট উল্টানো, পাশেই একটা তোয়ালে ঝুলছে তো ঝুলছে- কার জন্য? এবং কেন? কে ওখানে? - কোথায়? - অনিদ্রাপুরী।একজোড়া সু, মুখে তার ছেঁড়া মোজা, পাশে একটাবিশ কেজি’র আপেলের কার্টুন, তার ওপারে একটা প্লেট উপুর করা, একটা চিড়ার প্যাকেট, এক টুকরা আখের গুড়ের পাটালি। - খাদ্য মজুদ? না, কার্টুনের মধ্যে কিছু পুরনো গল্পের পাণ্ডুলিপিএখনো অবিক্রিত, কিছু পুরনো সংবাদপত্রের চুম্বককালেকশান, কিছু ম্যাগাজিন, কিছু বই, আর কিছু অসমাপ্ত গল্প একটা পলিথিনে মোড়ানো;কে ওখানে থাকে? - কোথায়? - দিবা ঘুমালয়।সোনালী আঁশের একটা নয়া ব্যাগ- ভিতরে কী?একটা পাটের হাতব্যাগ পুরনো অসামপ্ত গল্পে আর পুরনো পত্রিকায় ভরপুর; তার ওপরে একটা কালো ছোটব্যাগ প্রায় ফাঁকা, পকেটে কিছু পুরনো ঠিকানা আর ফোন নম্বর;তার ওপরে একটা পুরনো ট্রাভেলিং ব্যাগ- কয়েকটা পুরনো গেঞ্জি,একটা হাফ প্যান্ট আর একটা পুরনো ডায়েরিতে ভরতি- তারপরচেন দিয়ে আটকানো।কে ওখানে? - কোথায়? - বসতবাড়ি।একটা পুরনো ট্রাংক, পুরনো কাগজে মোড়ানো, তার ওপরেএকটা চেক শার্ট লন্ড্রি থেকে ফেরা, একটা হাফ প্যান্ট, একটা থ্রি কোয়ার্টার, একটা গেঞ্জি- বাসি কাগজে ঢাকা; তার পাশেএকটা মোবাইল চার্জার, কয়েকটা পুরনো সাহিত্য সাময়িকীআর একটা অসমাপ্ত গল্পের পাণ্ডুলিপি।আর ট্রাংকের ভিতরে?একগাদা অকার্যকর সনদের ফাইল, পলিথিনে মোড়ানো একগাদা পুরনো চিঠিপত্র, একটা পুরনো হাফ প্যান্টএকটা পুরনো ছবির অ্যালবাম, কিছু অসমাপ্ত গল্পের পাণ্ডুলিপিকিছু হারানো দিনের স্মৃতি, কয়েকটা চোরা বই, কয়েকটা কেনা বইআর কয়েকটা পুরনো দিনের লেখায় ভরা ডায়েরিআর ফাইল ভরতি কিছু পুরনো ম্যাগাজিনএকটা পুরনো সানগ্লাস, একটা স্কেল আর কিছু পুরনো কলমকোনটায় কালি নেই- সব স্মৃতির চিন্থ। কে ওখানে? - কোথায়? - ট্রাংকনগরি। একটা ব্যাগ, কতগুলো ফাইল অসমাপ্ত লেখায় ভরাকয়েকটা পুরনো খাতা, একটা প্লাস্টিক ফাইল- পুরনো সংবাদপত্রেভরতি, দুইটা পুরনো ডায়েরি, একটা নোট বুক, একটা ইংলিশ বই‘কমন মিসটেক ইন ইংলিশ’ আর একখানা উপন্যাস- হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড-এর ‘এরিক ব্রাইটিজ’; একটা কস টেপ, তিনটা পেন্সিল, ছয়টা কলম, একটা মার্কারএকটা মালবরো সিখারেটের খালি প্যাকেট, কিছু ভিজিটিং কার্ডএকটা প্যারিস সেন্ট, একটা ফপি ডিস্ক বক্স, তার মধ্যে একটা ফপি ডিক্স,দুইটা দিয়াশলাই, এক প্যাকেট ভাঙা গোল্ডলিফ, তার নিচে কাগজে মোড়ানো কিছু মারিজুয়ানা। পাশে একটা টুথ ব্রাশ, একটা কোলগেট ফ্যামিলি সাইজ টুথপেস্টএকটা ওয়ান টাইম রেজার, একটা কোল সেভিং ক্রিম, একটা ওষুধের প্যাকেটএকটা আইড্রপ, একটা সেভিং ব্রাশ আর একটা দিয়াশলাই।কে ওখানে? - কোথায়? - আরসিনগর।পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতা কসটেপে জোড়া দিয়ে বানানো একটা ম্যাটতার ওপরে আগে জানালার পর্দা হিসেবে ব্যবহৃত একটা প্যান্টের কাপড়কিছুটা ছেঁড়া, তার ওপরে একটা নয়া তোশক, একটা পুরনো কাঁথায় ঢাকা;তার ওপরে একটা কবিতার বই, একটা উপন্যাস- ওসামু দাজাই-এর ‘দিসেটিং সান’, একটা পুরনো ডায়েরি, একটা ব্যবহারিক বাংলা অভিধান,কয়েকটা কালের খেয়া, একটা নয়া নোট বুক থরে থরে সাজানো, তার পাশেই একটা দিয়াশলাই। এসবই একপাশে আর অন্যপাশে?একটা বোর্ডে অসমাপ্ত কিছু লেখনি, কয়েকটা শাদা পৃষ্ঠা, দুইটা পুরনোপত্রিকা, একটা কালের খেয়া, একটা নয়া ডায়েরি, পাশেই একটা গোল্ডলিফেরপ্যাকেট, ভিতরে তিনটা সিখারেট, তার ওপরে একটা দিয়াশলাই, একটা অ্যাসট্রেতার মধ্যে একটা গাঁজার গোয়া াণিক আগেই খাওয়া হয়েছে, পাশেই একটা পানির বোতল, দুইটা বাঁশের বসার মোড়া, একটার ওপরে গত সপ্তাহের স্টার ম্যাগাজিন,তার নিচে ফোরে দুই ইঞ্চি একটা পোড়া ক্যান্ডেল, একটা ১০০ ওয়াটের ফিলিপসলাইটের বাকশো - এখনো অস্থায়ী বা বিকল্প অ্যাসট্রে; পাশেই একগাদা পুরনো সংবাদপত্র- আমাদের সময়, দি ডেইলি স্টার, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক একাত্তর, সাপ্তাহিক এখন, একটা আর্ট কালেকশান- হাশেম খানের চিত্রমালা ২০০৫- মধুর গম্ভীর। কে ওখানে? - কোথায়? - চিত্রপুরী। একটা ঝাড়–, একটা ময়লার ঝুড়ি প্রায় ভরতিপাশেই এক জোড়া পুরনো বার্মিজ স্যান্ডেল।বিছানায় আর কী আছে?- একটা মোবাইল ফোন, একটা উলঙ্গ বালিশআর কাগজে মোড়ানো এক কপি ‘গুরু’- নাসির আলী মামুন-এর কালেকশান ‘সুলতান এর যতো সময়’। আর কিছু আছে ওখানে?একটা ১০০ ওয়াটের ভালব সারারাত অনাহারে জ্বলে আছে।কে ওখানে? - কোথায়? - বিছানায় শুয়ে।একটা আউলা লোক- কলম পিশে চলতে চায়, পারে না,চাকরি নেই, পকেটে টাকা পয়সা নেই, খাবার নেই;বন্ধু নেই, বান্ধবী নেই, ভাইবোন নেই, আত্মীয়স্বজন নেইমনের মানুষ হয়তো নেই! কী আছে লোকটার?অনেক হারানো গল্প, অনেক অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি,ছাপা না হওয়া অনেক কবিতা, ক্লান্ত দুটো চোখআর রাশি রাশি দীর্ঘশ্বাসে লুকানো একটা ক্ষীণকায় শরীর।কে ওখানে? - কোথায়? - অরুণালয়ে। একজন ঋণগ্রস্থ মানুষ- খবরের কাগজ, সিখারেটআর ফোন বিল যার এখনো বাকি; কয়েকজন পরিচিত লোকও টাকাপয়সা পায়, আর শুনেছি কয়েকটা পত্রিকা অফিসে লোকটার কিছু লেখক বিল পাওনা আছে,যা দিয়ে ঋৃণ শোধ হবার নয়।কে ওখানে? - কোথায়? - লিখে যাচ্ছে?আমি। এই ঘরের নতুন ভাড়াটিয়া ।৩০ এপ্রিল ২০০৬৩২/১, কাঁঠালবাগান, ঢাকা
false
ij
ইতিহাসের পাঠ_ প্রাচীন বাংলা (প্রথম পর্ব) বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের কত গর্ব,না? “এমন দেশটি কোথা ও খুজে পাবে নাকো তুমি।” তো, সব কিছুরই তো শুরু আছে। সেই রকম বাংলার শুরু কীভাবে হয়েছিল? কেমন ছিল প্রাচীন বাংলার মানুষ,জনপদ, ভূপ্রকৃতি? আসুন, সংক্ষেপে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই। তবে একটা কথা। ইতিহাসের কোনও তথ্যই চূড়ান্ত নয়। আজ যা সত্য হয়ে আছে কালই তা মিথ্যে প্রতিপন্ন হতে পারে। কাজেই,কিছুই ধ্রুব সত্য ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রাচীন বাংলায় মানুষ এসেছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে! কীভাবে? আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে একদল মানুষ পূর্ব আফ্রিকা থেকে নৌপথে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল। নৃবিজ্ঞানী ক্রিস ষ্ট্রিনজার এবং পিটার অ্যান্ডুস একটি তত্ত্ব দিয়েছেন। তত্ত্বটিকে “আউট অভ আফ্রিকা মডেল” তত্ত্ব বলে। এই তত্ত্বানুযায়ী, আধুনিক মানুষ বা হোমো সাপিয়ান্স আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়েছিল ২ লক্ষ বছর আগে। তারপর আজ থেকে ৭০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তাদেরই একদল নৌপথে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলআজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে। তাদেরই একটা দল আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে উত্তরমূখি হয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল- যাদের আমরা বলি প্রাচীন বাংলা। কত বছর আগে? সঠিক বলা যাবে না। তবে বিগত ৮/১০ হাজার বছরের মধ্যেই সম্ভবত অষ্ট্রেলিয়া থেকে অভিপ্রয়াণের ঘটনাটা ঘটেছিল। যারা অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রাচীন বাংলায় এসেছিল তারা কথা বলত অষ্ট্রিক ভাষায়। অষ্ট্রিক ভাষা কি? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠী। অষ্ট্রিকভাষী ওই মানুষগুলো দেখতে ছিল কালো, বেঁটে। চুল কোঁকড়া। অন্য একটা তত্ত্বমতে অবশ্য প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষীরা এসেছিল দক্ষিণ ভারত হয়ে। যাহোক। ওরা বাংলায় এসে কি করল? কি আর । বসবাস করতে লাগল। অনুমান করি, তখন প্রাচীন বাংলা ছিল জল ও জঙ্গলে পরিপূর্ন। তারা অরণ্যেই বসবাস করতে লাগল। ফলমূল কুড়িয়ে খেত, পশু-পাখি শিকার করত। আর উপাসনা করত। ওদের দেবতার নাম ছিল বোঙ্গা। অনেকের অনুমান এই বোঙ্গা শব্দ থেকেই বঙ্গ শব্দটির উদ্ভব। তারপর? পরে বলব। আজ এ পর্যন্তই। সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৪
false
fe
বিদায় ২০০৯, অবারিত শান্তির পথ চাওয়া বিদায় ২০০৯, অবারিত শান্তির পথ চাওয়া ফকির ইলিয়াস ======================================= আরেকটি বছর আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিল। ২০০৯ সাল গোটা বিশ্বের জন্যই ছিল বহুল আলোচিত বছর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার যাত্রা আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের যাত্রা ছিল প্রায় সমান্তরাল। প্রায় একই সময়ে ক্ষমতাসীন হন বারাক ওবামা ও শেখ হাসিনা। এ বছরটিতে বহুল আলোচিত শব্দটি ছিল 'বদলে দেয়া'। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারাই বিশ্বটাকে শান্তির পথে বদলে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এক বছর পরে অর্থাৎ ২০০৯ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে মানুষের উপলব্ধির শক্তি ধরে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে বদলে দেয়ার কাজটি খুবই কঠিন। 'বদল' কিংবা বিবর্তন এক-দু' বছরে হয় না। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস আমাদের সেই সাক্ষ্যই দেয়। তবে বদলের বীজ বপন করা যায়। অন্যায়, অনিয়মকে দমন করা যায়। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করা যায়। ২০০৯ সালে বিশ্ব নেতারা তা কতটুকু করতে পেরেছেন কিংবা আদৌ করতে চেয়েছেন কি না, সেই বিষয়টিই দেখা দরকার। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই বাংলাদেশে ঘটে যায় ইতিহাসের নির্মমতম পিলখানা হত্যাকান্ড। বিডিআর এর প্রধানসহ ষাট জনের অধিক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা নিহত হন এ ঘটনায়। কোন সহযোদ্ধা তার ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধাকে এমনভাবে খুন করতে পারে, এর নজির বোধহয় বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এমনভাবে নেই। শুধু তাই নয়, লাশ গুম, নারীর সম্ভ্রম হানি, লুটপাট, অগি্নসংযোগের নৃশংসতম ঘটনা ঘটানো হয় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে। যে শোক এখনও বহন করে চলেছে জাতি এবং বইতে হবে আজীবন। এ হত্যাযজ্ঞ এবং সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে মোকাবেলা করে মহাজোট সরকার। তীব্র প্রতিকূলতা পেরিয়ে দাঁড়াতে শুরু করে বিডিআর বাহিনী। যে নির্মমতম ঘটনার বিচারকার্য আংশিক ২০০৯ এ হলেও আসছে বছরে তা শেষ হবে বলেই আশা করছে জাতি। মহাজোট সরকার যেসব নির্বাচনী ওয়াদা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, এর অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সন্দেহাতীতভাবে পিলখানার হত্যাকান্ড এ বিচারের পথে একটি বাড়তি শোক তৈরি করে। অর্থাৎ এ ঘটনাটি না ঘটলে সরকার দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মনোযোগী হতে পারত। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা কমই ঘটে। কিন্তু দখল, টেন্ডারবাজি, সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দুর্বিষহ করে তোলে জনজীবন। যা কোনমতেই কাম্য ছিল না। সরকার সেসব দখলদারদের কড়া হাতে দমন করতে পারেনি। এদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি মাত্র আটাশটি সংসদীয় আসন নিয়ে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তেই ছিল অনঢ়। তারা খোঁড়াযুক্তি দেখিয়ে সংসদ থেকে দূরেই থেকেছে প্রায় পুরোবছর। বিএনপি খালেদা জিয়া তনয় তারেক রহমানকে দলে সম্পূর্ণভাবে স্থায়ী করার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল, সেটিই শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয় বছরের শেষ মাসটিতে। তারেক রহমান বিএনপি'র সিনিয়র ভাইস-চেয়ারপারসন নিযুক্ত হন। সে কারণে এ বছরটি ছিল বিএনপি'র জন্য সরাসরি দুর্নীতিবাজদের স্বীকৃতি দেয়ার বছর। বিএনপি ষোল বছর পর কাউন্সিল করে কাজটি সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগও সম্পন্ন করেছে তাদের কাউন্সিল। নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের উত্থান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। ত্যাগী ও বিচক্ষণ এ নেতার মূল্যায়নের পাশাপাশি একঝাঁক তরুণ নেতৃত্ব এসেছে আওয়ামী লীগে। বিতর্কিত এবং তথাকথিত সংস্কারবাদী নেতাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে কৌশলে। মোট কথা শেখ হাসিনা এ বাণীটি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, দলের মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে দলে সুবিধাজনক আসন পাওয়া যাবে না। ২০০৯ সালের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হচ্ছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের রায় প্রদান। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত, নিম্ন আদালতের রায়টিই বহাল রাখে। ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের মৃত্যুদন্ডের রায়টি বহাল থাকে। আসছে বছরে এ বিচারকার্যের রায়টি বাস্তবায়িত হবে বলেই আশা করছে জাতি। বর্তমান সরকার বারবার বলছে আসছে বছরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করবে। এজন্য পুরনো হাইকোর্ট ভবনে আদালত স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। জাতির দায়মুক্তির জন্যই ঘাতক দালাল রাজাকারদের বিচার কার্যটি জরুরি। প্রজন্ম সেই স্বপ্ন লালন করেই কাটাচ্ছে সময়। ২০০৯ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়টি ছিল জঙ্গিবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কায়রো কিংবা চীন সফরে এ বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। বারাক ওবামা তার প্রেসিডেন্ট জীবনের বর্ষপূর্তির আগেই শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এ বিষয়টিও ছিল বিশ্বে সমালোচিত বিষয়। কারণ বিশ্ব শান্তির বীজটি কি সত্যিই বপিত হয়েছে ওবামার হাতে? প্রশ্নটি ঘুরে-ফিরে এসেছে বারবার। বছরের শেষদিকে কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনটিও ছিল আলোচিত বিষয়। বলা যায়, ধনী দেশগুলোর খবরদারি বজায় রেখে, খুব ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় এ সামিট। আক্রান্ত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের কোন পূর্ণ নিশ্চয়তা তো পায়ইনি বরং ধনী ও শিল্পপ্রধান দেশগুলো বজায় রেখেছে তাদের একক কর্তৃত্ব। অথচ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং জনবহুল দেশগুলো গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের শিকার হয়ে দিনে দিনে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ বছরটি মানব কল্যাণ, বিশ্ব সভ্যতার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল তা বলার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী হুমকি তটস্থ রেখেছে বিশ্ববাসীকে। পাকিস্তানে ধর্মীয় স্থাপনা, বিদ্যালয়, বিচারালয়সহ রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর তালেবানি হামলা কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ। ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান প্রভৃতি দেশে গোত্রীয় সংঘাত শান্তির জন্য অশুভ সঙ্কেত বইয়ে দিয়েছে। অনেক প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশার বাণী নিয়ে আসছে ২০১০। বিশ্ববাসী শান্তির সপক্ষে অমীমাংসিত কাজগুলোর দ্রুত সমাপ্তি দেখতে চায়। মানুষ চায় মৌলিক স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকতে। এজন্য প্রতিটি রাষ্ট্রপক্ষেরই কাজ করা উচিত সম্মিলিতভাবে। মনে রাখা উচিত, ধর্মীয় উন্মাদনাপ্রবণ মৌলবাদ বিশ্বে এখন প্রথম এবং প্রধান সমস্যা। বারাক ওবামার আফগানিস্তান ও ইরাকে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হতাশ করেছে গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে। বৃহৎ শক্তিগুলো প্রকৃত শান্তিকামী হবে- সেটাই হোক একান্ত প্রত্যাশা। সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা। ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৯, নিউইয়র্ক। ------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ।ঢাকা। ১ জানুয়ারী ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- মার্টিন এ্যলেন সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ৮:৪৯
false
fe
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব _ এগিয়ে যাবার সমবেত প্রত্যয় আমার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমতপত্রিকার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি। আমাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছিলেন তৎকালীন সম্পাদক সৈয়দ সামাদুল হক। এই কাগজের আরেক মালিক ছিলেন বন্ধুবর নবাব উদ্দিন। একজন মেধাবী লেখক, কলামিষ্ট , নাট্যকার তিনি। তার সাড়া জাগানো কলাম ''পজেটিভ- নিগেটিভ'' অনেকেরই প্রশংসা কুড়িয়েছে।বিলেতের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক হিসেবে জনমত এর সুনাম সর্বত্র। এই কাগজটির বর্তমান সম্পাদক , নবাব উদ্দিন। একজন সংগঠক হিসেবেও তার দক্ষতা সমুজ্জ্বল। এই জনমত কাগজটি বাঙালী জাতিসত্তার চেতনা বিকাশে বিদেশে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিলেতে আরো বেশ কিছু বাংলা কাগজ রয়েছে। এর মধ্যে -সুরমা, নতুনদিন, পত্রিকা - অন্যতম। ইংল্যান্ডে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটা সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে খুব সার্থক ভাবে। কিছু সমালোচক যে নেই, তা আমি বলছি না । কিন্তু সৃজনশীল মানুষের অগ্রযাত্রাই সমুন্নত রেখেছে এই কাফেলাকে। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাচন হয়েছে সম্প্রতি। এই নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আমারই আরেক বন্ধু , সাপ্তাহিক সুরমা 'র প্রধান সম্পাদক - বেলাল আহমেদ। আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন - মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার । এখানে যে বিষয়টি না বললেই নয়,তা হচ্ছে , আমার অত্যন্ত সুহৃদপ্রতীম এই সাত্তার ভাই ছিলেন , সিলেটের প্রভাবশালী দৈনিক সিলেটের ডাক এর নির্বাহী সম্পাদক। প্রায় একদশকেরও বেশী সময় তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন খুব বিচক্ষণতার সাথে। উল্লেখ্য , আমি দৈনিক সিলেটের ডাক - এ ১৯৮৯- ১৯৯৬ সালে '' যুক্তরাষ্ট্রের রোজনামচা'' নামে একটি ধারাবাহিক কলাম লিখতাম। যা উপসম্পাদকীয় হিসেবে ১৫০ পর্বেরও বেশী ছাপা হয়েছে। আর এই অনুপ্রেরণার অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন - প্রিয় সাত্তার ভাই । তাঁর সম্পাদনায় মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের একটি চমৎকার স্মারক ১৯৯৪ সালে দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। তিনি বিবিসির সিলেট প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তরিকতার সাথে। সাত্তার ভাই এখন জনমত এর বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন, বিলাতে। নতুন এই কমিটি বেশ কিছু এজেন্ডা নিয়ে এসেছে। কিছু অসমাপ্ত কাজ তারা শেষ করতে চান। এই কমিটির সকল সদস্যদের প্রতি ফুলেল শুভেচ্ছা । Click This Link লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব এর দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচনে বেলাল আহমেদ প্রেসিডেন্ট, আব্দুস সাত্তার সেক্রেটারী -------------------------------------------------------------------- বিপুল উদ্দীপনা, আনন্দ উচছাসমূখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো লন্ডন বাংলা প্রেসকাবের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন। পূর্ব লন্ডনের ইম্প্রেশন ইভেন্টস ভেন্যূতে ২০ মার্চ শনিবার আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে লন্ডন সহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে প্রেসকাবের স্থায়ী সদস্যরা স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম পর্বে সাধারণ সভা শেষে কাব সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাপ্তাহিক সুরমা'র প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, সেক্রেটারী পদে সাপ্তাহিক জনমতের বিশেষ প্রতিনিধি, বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ও ট্রেজারার পদে একই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ পূনঃনির্বাচিত হন। উক্ত পদগুলোতে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন যথাক্রমে চ্যানেল আই এর প্রধান নির্বাহী রেজা চৌধুরী সোয়েব, বাংলাপোষ্ট সম্পাদক ব্যারিষ্টার তারেক চৌধুরী ও লন্ডন বাংলা সম্পাদক শাহ ইউসুফ (শাহজাদ)। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চ্যানেল এস চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক শেখ মোজাম্মেল হোসেইন কামাল ও সাপ্তাহিক নতুন দিন এর ডেপুটি এডিটর সৈয়দ ফারুক। বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভোট গণনা শেষে রাত ১২টার দিকে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করা হয়। লন্ডন বাংলা প্রেসকাবের নির্বাচনে অন্যান্য পদে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা হলেনঃ ভাইস প্রেসিডেন্ট - আমিরুল চৌধুরী (জনমত), এসিষ্ট্যান্ট সেক্রেটারী মোহাম্মদ জুবায়ের (চ্যানেল এস), অর্গানাইজিং সেক্রেটারী - কামাল মেহেদী (চ্যানেল এস), ইনফরমেশন এন্ড রিসার্চ সেক্রেটারী ইসহাক কাজল (জনমত), প্রেস এন্ড পাবলিসিটি - তৌহিদ আহমদ (সাপ্তাহিক বাংলাদেশ) এবং ৬ জন ইসি মেমবার নির্বাচিত হয়েছেন মতিউর রহমান চৌধুরী (সাপ্তাহিক পত্রিকা), সেলিম রহমান (বাংলা মিরর), মোহাম্মদ সোবহান (মুসলিম উইকলি), সৈয়দ আব্দুল কাদির (নতুন দিন), হাসান হাফিজুর রহমান পলক (এন টিভি) ও নিলুফা ইয়াসমিন হাসান (বেতার বাংলা)। প্রেসকাব সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার এর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় বিগত সেশনের রিপোর্ট পেশ করা হয় এবং সদস্যরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। সাধারণ সভায় সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ বলেন, আপনাদের সকলের কর্মততপরতায় লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব ইতোমধ্যেই বৃটেনের মিডিয়া জগতে মূলধারার সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয় এবং সংশ্লিষ্ট সকল মহলে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব এখন তালিকাভূক্ত সংগঠন। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এ কাব আরো মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সেক্রেটারী আব্দুস সাত্তার বলেন, মাত্র তিনটি সাপ্তাহিকীর সাথে সম্পৃক্ত হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ যে প্রেসক্লাব গঠন করেছিলেন সতেরো বছর আগে, ক্ষীণকক্ত সেই সংগঠনটি আজ এদেশে আমাদের কমিউনিটির বলিষ্ঠ কক্তস্বরে পরিণত হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে, আমাদের সেই সব বরেণ্য অগ্রপথিক আর সকল মিডিয়া হাউসের আন্তরিক এবং যৌথ প্রচেষ্টার কারনে। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ফরিদ আহমদ রেজা, নতুন দিন সম্পাদক ও সাবেক প্রেসকাব প্রেসিডেন্ট মহিব চৌধুরী, জনমত এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, বিশিষ্ট সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন, জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিন, সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী, সুরমা সম্পাদক সৈয়দ মনসুর উদ্দিন, মঞ্জুরুল আজিম পলাশ, মুসলিম পোষ্ট এর আলতাফ হোসেন, সময় সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, সাপ্তাহিক ইউরো বাংলার প্রধান সম্পাদক আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, বিশেষ প্রতিনিধি আকবর হোসেন ও ষ্টাফ রিপোর্টার বদরুজ্জামান বাবুল, দৈনিক যুগান্তর লন্ডন প্রতিনিধি গোলাম মোস্তাফা ফারুক, চ্যানেল এস সাংবাদিক কামাল মেহেদী, সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, মিলেনিয়াম সম্পাদক আহাদ চৌধুরী বাবু, এনটিভির সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান প্রমূখ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী, শিল্পী লুসি, তরুণ শিল্পী আফজাল আবুল আসাদসহ বিলেতের বিশিষ্ট শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:৪০
false
mk
যে কারণে চাকরি হারাচ্ছেন ডা_ জোবাইদা রহমান সরকারি চাকরি হারাতে যাচ্ছেন জিয়া পরিবারের সদস্য ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা খান (আইডি-৪১১৪৪)। ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে নিজ কর্মস্থলে যোগদান না করলে বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস অনুযায়ী তার চাকরির অবসান হবে। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বসবাস করছেন।লন্ডনে যাওয়ার আগেই তিনি ২০০৮ সালে ৯ এপ্রিল থেকে শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত। স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে যাওয়ার সময় তিনি কর্মস্থল থেকে তিনমাসের ছুটি নিয়ে যান। এরপর কয়েক দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্তই তার ছুটি বহাল রাখে সরকার। এরপর আরো দুই দফায় এক বছর করে মোট দুই বছর ছুটি বাড়ানোর আবেদন করলেও সরকার তা নাকচ করে। ফলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া একনাগাড়ে ৫ বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে তার চাকরির অবসান হতে যাচ্ছে। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সে দিকেই যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন গত ৪ সেপ্টেম্বর নিজ দপ্তরে এ বিষয়ে বলেন, এ মন্ত্রণালয়ে আমি সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। ফলে বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।জানা গেছে, বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের সময় গ্রেফতার করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে। অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করার উদ্দেশ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্ত্রী ডা. জোবাইদা খান ছুটি নিয়ে বিদেশ চলে যান ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। ১৯৯৫ সালে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন জোবাইদা রহমান নামে পরিচিত ডা. জোবাইদা খান। জাতীয় হƒদরোগ ইনিস্টিটিউটের কার্ডিওলজি পার্ট-৩ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে চলে যান। এর আগে একই বছরের ৯ এপ্রিল শিক্ষা ছুটির আবেদন করলে সরকার তাকে ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি মঞ্জুর করে।প্রথম দফায় ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটির আবেদন করেন ডা. জোবাইদা রহমান। সরকারি চাকরিতে এ ধরনের ছুটির আবেদনকে ‘অসাধারণ ছুটি’ বলা হয়। আর এ ধরনের ছুটি মঞ্জুর করে থাকেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব। তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ন কবীর দুইবারই ডা. জোবাইদার ছুটির আবেদন নাকচ করেন। ছুটির আবেদন নাকচ হলেও রহস্যজনক কারণে দেরিতে এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা।অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম দফায় স্বাস্থ্য সচিব ছুটির আবেদন নাকচ করেন ২০১১ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা অফিস আদেশ জারি করে এর একমাস পর ৯ মার্চে। দ্বিতীয় দফায় ছুটির আবেদন নাকচ হয় একই বছরের ১২ জুলাই অথচ অফিস আদেশ জারি হয় ২০১২ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি। আবার এসব অফিস আদেশ জারি করা হলেও অদৃশ্য কারণে তা যুক্তরাজ্যে ডা. জোবাইদা খানের কাছে বা বাংলাদেশে তার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে বা তিনি রিসিভ করেছেন এমন কোনো রেকর্ড সংশ্লিষ্ট শাখায় নেই বলে জানা গেছে।এ ছাড়াও ছুটির আবেদনে নিয়ম অনুযায়ী এ জাতীয় ছুটির কারণ ও ছুটির আবেদনকারী কর্মকর্তার বিদেশে অবস্থানের ঠিকানা থাকতে হয় কিন্তু ডা. জোবাইদার আবেদনে এ দুটোর কোনোটিই উল্লেখ ছিল না বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট শাখার সিনিয়র সহকারি সচিব নুসরাত আইরিন নিজ দপ্তরে বলেন, ওই সময় আমি এ ডেস্কের দায়িত্বে ছিলাম না। আর যা কিছু ঘটেছে তা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উর্ধŸতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই করা হয়েছে।ছুটি বিধিমালা অনুযায়ী অসাধারণ ছুটির মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি হতে পারবে না। ছুটি বিধিমালা ৯ (৩) অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে যেকোনো ছুটি অনুমোদন করতে পারে। অন্য দিকে ছুটি বিধিমালার অধ্যয়ন ছুটি সংক্রান্ত এফ আর-৮৪এর নিরীক্ষা নির্দেশনার (গ)তে বলা হয়েছে : ‘এই প্রকার ছুটির মেয়াদ সাধারণভাবে ১২ মাস। তবে বিশেষ কারণে সর্বোচ্চ ২৪ মাস পর্যন্ত এই প্রকার ছুটি মঞ্জুর করা যাইবে। কোর্সের প্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হইলে আরো ৪ মাস অর্জিত ছুটি এবং ৩২ মাস অসাধারণ ছুটি প্রদান করা যাইবে। অর্থাৎ অধ্যয়নের প্রয়োজনে ৫ বছর ছুটি প্রদান করা যাইতে পারে। ইহার অতিরিক্ত অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে বিএসআর পার্ট-১ এর ৩৪ নং বিধির আওতায় চাকরির অবসান হইবে।’বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস বিধি ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার ভিন্নরূপ কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে, বাংলাদেশে ফরেন সার্ভিসে কর্মরত থাকার ক্ষেত্র ছাড়া, অন্যত্র ছুটিসহ অথবা ছুটি ছাড়া একাধিকক্রমে ৫ বছর দায়িত্ব থেকে অনুপস্থিত থাকার পর একজন সরকারি কর্মচারীর চাকুরির অবসান ঘটবে।’এ অবস্থায় সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ মে আবারো ছুটির আবেদন করেন ডা. জোবাইদা খান। তবে সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, এবারের ছুটির আবেদনও ফাইলে ‘পুটআপ’ দেয়নি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উর্ধŸতন মহলের নির্দেশই ডা. জোবাইদা খানের আবেদন ফাইলে পুটআপ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
false
rg
জীনের বাদশাহ ।। রেজা ঘটক জীনের বাদশাহ ।। রেজা ঘটক আষাঢ়ের মেঘ গুড়ি গুড়ি জটলা পাকিয়ে আমাদের ঘিরে বসেছে স্বাধীনতা চত্বরে। উদ্যানের গাছগুলো সারাদিন আষাঢ়ের ঘন বর্ষায় স্নান করে করে এখন গা শুকিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতি যেন এখন সদ্য স্নান হওয়া এক উর্বষী বালিকা। শরীরে তার ভেঁজা ঘ্রাণ। সোডিয়াম লাইটগুলো এক লাফে জ্বলে উঠে জানান দিল রাজধানীতে এখন ঝুপ ঝুপ অন্ধকার ছাপিয়ে সন্ধ্যা নামছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা থেমে থেমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে যাচ্ছে। মৃদু বাতাস না শীত না উষ্ণ প্রকৃতি বেশ শান্ত যেন গল্প শোনার জন্য অপো করছে। আমাদের অপোর পালাও শেষ। মামু জুয়েল এসে যোগ দিল আড্ডায়। মামু জানতে চাইল মডেল হওয়ার ঘটনাটা আসলে কি? আমারেও ফোন করেছিল ওরা। আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত। তাই ওদের সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারিনি। আর আমার মনে হয়েছে ওরা কোন এ্যাড ফার্ম নয়, আমার কোন বন্ধু হয়তো দুষ্টামী করছে। আমরা মামুর কথায় হেসে তখন গড়াগড়ি। মডেল হবার ফর্মুলাটা বেশ চমৎকার। এই নিয়ে আমাদের কাছে দশজনের খবর আসল। আর একজন হলেই এগারো জনের টিম করব আমরা। এগারো জন মডেল। এগারো জন নতুন তারকা। বিল বোর্ডে সবার বড় বড় ছবি। আহ কী মজা। রাতারাতি তারকা। মামু জুয়েল বাদে নয়জনের মধ্যে চারজন মডেল হতে গিয়ে মোবাইল খুইয়েছে। যেতে পারেনি পাঁচজন। শিশির, ইভা, সাগর, শর্মী আর মিজান। মডেল হতে গিয়েছিল বরিশাল থেকে তুহিন, ছবির হাট থেকে লিমন, শ্যামলী থেকে রং আর ইস্কাটন থেকে আমাদের শুভ। এবার আমরা ফয়সালের মুখে শুনব শুভ মডেল হতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করল। সেদিন ছিল শুক্রবার। সকাল ১০ টায় শুভ’র সেল ফোনে একটা ফোন আসে। আপনি কী শুভ ভাই বলছেন? আমরা দিকবিদিক এ্যাডভারটাইজিং হাউজ থেকে বলছি। আমরা ঢাকাসহ সারা দেশে একটা কনজুমার প্রোডাক্টের বিল বোর্ডে বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল খুঁজছি। আমরা জানি, আপনি একটা নাট্যদলে কাজ করেন এবং আপনার অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। আমাদের বিল বোর্ডে বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল হিসেবে আপনাকে আমরা পছন্দ করেছি। ন্যুনতম এক বছরের জন্য আপনাকে আমরা আমাদের প্রোডাক্ট মডেল হিসাবে বাছাই করেছি। আপনি যদি মডেল হতে ইচ্ছুক হন এবং আমাদের সাথে কাজ করতে রাজী থাকেন তাহলে আজ দুপুর ১২টার মধ্যে গুলশান-২-এ চলে আসুন। শুভ তখন কিছু পাল্টা প্রশ্ন করেছিল বটে কিন্তু এমন চমকে দেবার মত একটা সুযোগ হাতছাড়া করে কীভাবে? আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে শুভ গুলশান রওনা দিল। দিকবিদিক এ্যাডের একজন মার্কেটিং অফিসার শুভকে গুলশানে রিসিপ করলেন এক ঘণ্টা পর। এবার তিনি ডিরেক্টারকে ফোন দিলেন। ডিরেক্টার জবাবে জানালেন ওনাকে উত্তরা নিয়ে আসো। আমি শুটিংয়ে আছি। মার্কেটিং অফিসার বললেন- চলুন উত্তরা, ডিরেক্টার স্যার ওখানে আছেন, ফাইনাল কথাবার্তা স্যারই বলবেন। তারপর ওরা একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব হায়ার করে। পথে মার্কেটিং অফিসার বসের সঙ্গে একবার কথা বলেন। সেই ফাঁকে তিনি জানান- আমরা ট্যাক্সিক্যাবে আসতেছি। স্যার আমার ফোনের চার্জ শেষ, এসে কথা বলব। কিছুণ পরে ডিরেক্টার স্যার স্বয়ং শুভ’র মোবাইলে ফোন করেন। হ্যা, আপনারা মাসকাট প্লাজার সামনে আসুন। আর ফোনটা আপনার সাথে থাকা আমার লোককে একটু দেন। ইতিমধ্যে ট্যাক্সিক্যাব উত্তরা রাজলীর সামনে একটু থেমেছে মার্কেটিং অফিসারের ইসারায়। কথা বলতে বলতে তিনি গাড়ির দরজা খুলে বাইরে নামেন। এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কথা বলতে বলতেই রাজলী মার্কেটের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এতোণে শুভ বুঝতে পেরেছে ঘটনা আসলে কী ঘটল! শুভ এখন বিখ্যাত মডেল। মোবাইল ফোনের তারকা মডেল। সারা দেশে বড় বড় বিল বোর্ডে শুভ’র বড় বড় ছবি। হা হা হা হা... .... .... মামু জুয়েল সব শুনে বলল- আল্লাহ বাঁচাইছে। ভাগ্যিস আমি ব্যস্ত ছিলাম, নইলে হয়তো আমিও যাইতাম। আমরা আরেক পশলা যে যার গায়ে হেসে গড়াগড়ি। মামু তুমি মডেল হবার সহজ চাঞ্চ মিস করলা? হা হা হা হা .... .... .... এরপর ইখতার জানাল যে ওই এ্যাড হাউজের সর্বশেষ শিকার আমাদের লিমন। তাই নাকী? কস কী? লিমন মানে আমাদের ডিরেক্টার কাম স্ক্রিপ্ট রাইটার অভিনেতা লিমন? লিমনের ঘটনা তো শুনিনি। ক’তো লিমনের কী হইছিল? ইখতার শুরু করল- ওইদিন লিমনের মোবাইলে ওইরকম একটা ফোন আসে। তারা জিগায়- আপনি কী লিমন ভাই বলছেন? আমরা দিকবিদিক এ্যাডভারটাইজিং হাউজ থেকে বলছি। আমরা ঢাকাসহ সারা দেশে একটা কনজুমার প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার খুঁজছি। আমরা জানি, আপনি একটা নাট্যদলে কাজ করেন এবং আপনার অভিনয় আর টিভির জন্য লেখা নাটকগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। আপনার স্ক্রিপ্ট লেখার কৌশলটা ভারী চমৎকার। আমাদের বিজ্ঞাপনের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আপনাকে আমরা পছন্দ করেছি। ন্যুনতম এক বছরের জন্য আপনাকে আমরা আমাদের প্রোডাক্ট স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসাবে পেতে চাই। আপনি যদি আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটার হতে আগ্রহী হন এবং আমাদের সাথে কাজ করতে রাজী থাকেন তাহলে বনানী আমাদের অফিসে চলে আসুন। জবাবে লিমন জানতে চায়- আপনাদের অফিসের ঠিকানা বলুন। ওপাশ থেকে জানতে চাওয়া হয়- আপনি এখন কোথায়? - আমি শাহবাগ। লিমনের জবাব। - আচ্ছা শুনুন, আপনি যদি ছবিরহাটের দিকে যান, ওখানে আমাদের একজন আছেন এখন, ওনার সাথে চলে আসতে পারেন। এরপর লিমনকে ছবিরহাট থেকে ওদের এক প্রতিনিধি ফোন করেন। তার সাথে দেখা হবার পর লিমন আর সে ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে বনানী রওনা দেয়। মহাখালী গিয়ে একইভাবে ফোন নিয়ে সটকে পরে ওত পেতে থাকা এ্যাড হাউজের সেই লোকটা। খালি হাতে ফেরৎ আসে স্ক্রিপ্ট রাইটার লিমন। আমরা আবারো হো হো করে গড়াগড়ি যাই। শিশির, শর্মী, ইভা, মিজান, সাগরও ওদের ফোন পেয়েছিল। ওরা কেউ কেউ যাবার জন্য উতলাও ছিল। কেউ কেউ সময় করতে পারেনি। কেউ কেউ পরের দিন ভুলে গেছে। তবে শিশির ডাউট করেছিল যে ওরা কোন সমস্যা করতে পারে। তাছাড়া দেখি না একবার কারা আমাকে মডেল বানাতে চায়। তাই শিশির মিজানকে ফোন করেছিল। আর মিজান জানায় সেও একই রকম ফোন পেয়েছে। সময় পেলে যেতে চেষ্টা করবে। কিন্তু শিশির বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তা করে র‌্যাবের এক অফিসারের সাথেও কথা বলেছে। র‌্যাবের ওই মহিলা অফিসার পরামর্শ দিয়েছিলেন- আপনি একা যাবেন না। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যান। আর সমস্যা দেখলে আমাদের জানাবেন। মিজানও সময় করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত শিশিরের আর যাওয়া হয়নি। এই ফাঁকে আমরা চিড়ার মোয়া আর সিখারেট খাই। আর মামু জুয়েল জানায়- এরচেয়ে জীনের বাদশাহর খবর আরো ইন্টারেস্টিং। আমরা সমোস্বরে জানতে চাই- জীনের বাদশাহ আবার ক্যাঠায় গো মামু? মামু জুয়েল শোনায়- ওইডা আমার শ্বশুরের ঘটনা। রোজ রাতে আমার শ্বশুর একজনের সাথে মোবাইলে কথা বলেন। কিছু দিন যেতে না যেতে দেখা গেল শ্বশুর আমার বদলে যাচ্ছে। ওদিকে পরিবারের সবাই তখন তাঁকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কার সাথে কথা বলেন কিছুই উনি স্বীকার করতে চান না। আমার দাদী শ্বাশুড়ি অনেক পিড়াপিড়ি করলে জবাবে শ্বশুর মশাই বলেন যে- আমি জীনের সাথে কথা বলি। শুনে আমরা সবাই আরো বিস্মিত হই। এরপর আমরা গোপনে পরিকল্পনা করে ঠিক করি- ওনার টেলিফোন কথোপকথনের সময় ঘরের সবাই ওৎ পাতব। রাত আড়াইটা। শ্বশুরের ফোন আসল। শ্বশুর মশাই মনে করেছেন আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি। উনি জীনের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। আমরা শুনতে পাচ্ছি- শ্বশুর মশাই ফোনের এপাশে শুধু বাবা বাবা করছেন। তারপর আমরা সবাই তাঁর ঘরে ঢুকলাম। আজ আপনাকে বলতে হবে কার সাথে কথা বলেন? কী নিয়ে কথা বলেন? শ্বশুর মশাই বলতে চান না। আমার দাদী শ্বাশুরি, শ্বাশুরি, আমার বৌ সবাই মিলে আমরা ওনাকে চেপে ধরলাম। আজ বলতে হবে ঘটনা কী? এরপর শ্বশুর মশাই স্বীকার করলেন যে জীনের সাথে ওনার কথা হয়। আমরা জানতে চাই কী কথা হয়? শ্বশুর মশাই বলেন- জীনের বাদশা বাংলাদেশে দুইজন লোক খুঁজে পেয়েছেন। একজন ওনার খাদেম আরেকজন আমি। আমাদের এই দুইজনকে উনি কিছু সোনার মহর দিয়ে সৌদি আরব চলে যাবেন। আমাকে উনি ওনার কথিত জায়গায় দেখা করার জন্য বলেছেন। আগামী অমাবশ্যার রাতে ওনার খাদেম যে মাজারে আছেন সেখানে আমাকে যেতে বলেছেন। আমরা জানতে চাই আর কী কী বলেছেন? শ্বশুর মশাই জানান- যাবার সময় আমাকে একটা গরু, এক মণ সিন্নির চাল আর মাজারের জন্য কিছু খরচ সঙ্গে নিতে বলেছেন। আমরা জানতে চাই- মাজারের খরচ কতো? - এক লাখ বিশ হাজার টাকা। শ্বশুর মশাইর জবাব। - আপনি কী সেখানে যেতে চান? ওনার মেয়ের প্রশ্ন। - হ্যা, আমি আগামী অমাবশ্যার রাতেই যেতে চাই। - কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আমার জানতে চাই। - ওটা বাবা তিন দিন আগে জানাবেন। - তারপর? আমাদের সমোস্বরে জিজ্ঞাসা। রোজ রাতে তাদের কথা হতে থাকে। জীনের বাদশা বলেন- কোরআন শরীফ আমার মুখস্থ। আমরা নূরের তৈরি আর তোমরা মানুষ। আল্লাহ আমাদের ভুলের জন্য একটা শাস্তি দিয়েছেন। তাই তোমাদের মত আমরা পৃথিবীতে বসবাস করতে পারিনা। আমরা আকাশে থাকি। কিন্তু আমাদেরও আল্লাহর সেবা করতে হয়। কোরআন শরীফ পড়তে হয়। নামাজ কায়েম করতে হয়। মানুষের উপকার করতে হয়। আমাদের ওপর আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ- তোমরা আসল মুসলমানকে সব সময় উপকার করবে আর আমার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। বাংলাদেশে আমি এবারের জন্য দুইজন খাঁটি মুসলমান পেয়েছি। একজন আমার সত্যিকার খাদেম। আরেকজন তুমি। আমাকে সৌদি আরবে হজ পালনে যেতে হবে। আর তার আগেই তোমাদের দুজনকে আমার সোনার মহরগুলো দিয়ে যেতে চাই। মনে রেখো- অমাবশ্যার রাতে আমার খাদেমের মাজারে তুমি আসবে। যা যা বলেছি, যেভাবে যেভাবে বলেছি সব সঙ্গে আনবে। মনে রেখো, যদি কোন ভুল করো তোমার অনেক তি হবে। তোমার বংশ নিঃবংশ হয়ে যাবে। তোমার নিজের মৃত্যুর সময় প্রচুর কষ্ট হবে। তোমার বংশে কেউ আর জীবিত থাকবে না। সবাই অপঘাতে মারা যাবে। মনে রেখো- আমি তোমার জীনের বাদশাহ। আর আমার কথা তুমি অগ্রাহ্য করলেই তোমার বিপদ। তুমি বিপদ চাও নাকি আল্লাহর পাঠানো উপঢৌকন নিতে চাও, তা তুমিই ঠিক করো। মনে রাখবা- পৃথিবীতে তোমাদের সকল কর্মকাণ্ডের একদিন বিচার হবে। আর সেদিন আমি তোমার পক্ষে নাকি বিপক্ষে সাক্ষি দিব তা তুমিই ঠিক করো হে মানব সন্তান। শ্বশুর মশাই জানতে চায়- আচ্ছা আপনি তো জীনের বাদশাহ। আপনি মোবাইলে কথা বলেন কীভাবে? জবাবে জীনের বাদশা বলেন- আজ আর কোন কথা নয়। আগামীকাল ঠিক রাত বারোটায় আমি ফোন করব। তুই আমার এই নাম্বারে এক হাজার টাকা পাঠাস। নইলে তোর অমঙ্গল হবে। আর শোন, এই ফোনটা আমার খাদেমের। উনি একটা মসজিদের ইমাম। উনি রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে যান। উনি ঘুমিয়ে গেলে আমি ওনার ফোন নিয়ে তোকে ফোন করি, বুঝলি। আরেকটা কথা তুই বিশ্বাস রাখিস- জীনেরা সবকিছু দেখতে পায়। এখন ঘুমিয়ে পড়। আর নামাজ কাযা করিস না। দুনিয়া দুই দিনের বাহাদুরি। যা এখন ঘুমা। আর ফোনে টাকা পাঠাতে ভুলিস না যেন। হক মাওলা। জীনের বাদশাহর ফোন কেটে যায়। পরদিন শ্বশুর মশাই একহাজার টাকা পাঠান ওই মোবাইলে। ঠিক রাত বারোটায় জীনের বাদশাহ আবার ফোন করেন। আমার শ্বশুর শুধু এপাশে জী বাবা, জী বাবা করতে থাকেন। শ্বশুর মশাইয়ের সুস্পষ্ট ধারণা উনি জীনের বাদশাহ-ই হবেন। পুরো কোরআন ওনার মুখস্থ। ওনেক সময় কথা না বলে উনি শুধু কোরআন তেলোআত করেন। আমরা ক্রমে উদ্বিগ্ন হতে থাকি। শ্বশুর মশাই কী পাগল হয়ে যাচ্ছেন! নইলে এইরকম আচরণ কেন করছেন? তিনি ঠিক করেছেন আগামী বুধবার অমাবশ্যা। আর ওই রাতেই তিনি সবকিছু নিয়ে রওনা হবেন। সেই অনুযায়ী উনি একট বড় গরু কিনেছেন। এক মণ চাল কিনেছেন সিন্নির জন্য। আর মাজারের খরচ বাবদ এক লাখ বিশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছেন। আমরা কেউ ওনাকে কিছু শোনাতে পারছি না। উনি যাবেন-ই যাবেন। আর ফোনে কথা বলার সময় উনি আমাদের কাউকে ফোন দিতে চান না। গত রবিবার রাতে জীনের বাদশা ফোনে শ্বশুর মশাইকে দিনাজপুরের একটা মাজারের ঠিকানা দিয়েছেন। বলেছেন ওখানে অমাবশ্যার রাতে তাকে সোনার মহর হস্তান্তর করেই তিনি সৌদি আরবে রওনা হবেন। আমরা জানতে চাই দিনাজপুরে কোন মাজারের কথা বলেছেন? আর ওখানে আপনি কীভাবে যাবেন? কীভাবে যেতে বলেছেন? জবাবে শ্বশুর মশাই বলেন- আমাকে গাবতলি থেকে বাসে উঠতে বলেছেন। যে বাসে আমি উঠব সেই বাসের নাম, সিট নম্বর আর আমার সময় সূচি ফোন করে বাবাকে জানাতে বলেছেন রওনা দেবার আগে। আমরা জানতে চাই আপনি কী যেতে চাচ্ছেন? শ্বশুর মশাইর জবাব- না গিয়ে আমার আর কোন উপায় নেই। তোমরা আল্লাহ আল্লাহ করো। আমরা আবদার করি- আমরা একবার জীনের বাদশাহর সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু শ্বশুর মশাই রাজী না। মঙ্গলবার রাত দেড়টায় জীনের বাদশাহ আবার ফোন করেন। শ্বশুর মশাই ফোন ধরে বলেন- জী বাবা, আমি ভোরেই রওনা দেব। সব কিছু ঠিক মত গুছিয়েছি। এখন আপনার দোয়ায় সকালে রওনা হব। ঠিক এই সময় আমার দাদী শ্বাশুরি চিৎকার করে ওঠেন। কীসের জীন সে? দে ফোনটা আমারে দে, আমি কথা বলব। ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ হুঙ্কার দেন- তোর ঘরে মেয়ে মানুষের কণ্ঠ কেনরে? তুই নিজের তি নিজে ডেকে আনছিস! শ্বশুর মশাই জবাব দেন- উনি আমার মা। আপনার সাথে কথা বলতে চায় বাবা। জীনের বাদশাহ জবাব দেয়- আমি মেয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলিনা বোকা। তুই নিজের তি করিস না। আমার কথা মত রওনা দে। দাদী শ্বাশুরি তখন শ্বশুর মশাইর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- তুই কোথাকার জীন আমারে ক? আমি তোর জীনের বাপ! শয়তান কোথাকার? আমারে চিনোস তুই? তোর জীন গিরি আমি পানিতে চুবাইয়া ছুডাইয়া দিমু। ফাজিল কোথাকার? ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ জবাব দেন- তুই স্ববংশ নিঃবংশ হবি। তোর ঘরে দুবলা গজাবে। তুই ধ্বংস হয়ে যাবি। ওদিকে শ্বশুর মশাই সবাইকে সাবধান করে দেন- আমরা যেন বাবার সাথে বেয়াদবি না করি। কারণ, উনি নাকি সত্যি সত্যিই জীনের বাদশাহ। কিন্তু আমার দাদী শ্বাশুরি তখন জীনের বাদশাহর সঙ্গে প্রচণ্ড গালাগালিতে লিপ্ত। এক পর্যায়ে দাদীর থেকে ফোনটা আমি নেই। জীনের বাদশাহর কাছে জানতে চাইÑ আপনি তো জীনের বাদশাহ। বলেন তো আমি কে? আমার বাড়ি কোথায়? আমি কী করি? আমি আপনার ভক্তের কে? আমি একটা আরবি বলব আপনি বাংলা অর্থ বলবেন? ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ জবাব দেন- আমি ভক্ত ছাড়া কারো সাথে কথা বলিনা। আর তুই আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছস। তুইও মরবি। তোর বউ মরবে। তোর বংশও ধ্বংস হবে। আমার সঙ্গে বেয়াদবি! আমি পাল্টা প্রশ্ন করি- দিনাজপুরে কোথায় যেতে হবে বল। তোর জীনের গুষ্ঠি আমি দেখে আসব। ফাজিল কোথাকার? ফাজলামো পাইছস? এবার জীনের বাদশার মেজাজ আরো চড়া হয়। জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- তোর কেমন মতা তুই পারলে দিনাজপুরে আয়? তোরে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া দেব শয়তান কোথাকার। জীনের সঙ্গে বেয়াদবি! ইনসানে তোর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর আমি জীনের বাদশাহকে বলি- তোর এতো মতা থাকলে পারলে ঢাকায় আয়? দেখি তোর কেমন মতা? জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- আমি ঢাকায় যাই না। তুই সাহস থাকে তো দিনাজপুরে আয়। আর শোন ফোনটা তুই আমার ভক্তকে দে। নইলে তোর এখনই রক্ত বমি শুরু হবে। আর তুই পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিন্থ হয়ে যাবি। পৃথিবীর আলো বাতাস তোর জন্য হারাম হয়ে যাবে। এরপর ফোনটা আমি আবার শ্বশুর মশাইর হাতে দেই। জীনের বাদশাহ বলেন- শোন, তুই আমার সঙ্গে বেইমানী করেছিস। তোর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তোর মেয়ে মরবে। তোর ছেলে মরবে। তোর বউ মরবে। তোর মা মরবে। তোর চৌদ্দ গুষ্ঠি মরবে। তুই মরবি। তোর ঘরে দুর্বা ঘাস গজাবে। আর শোন, তোর জন্য এখনো একটা সুযোগ আছে। তোর মাজারের খরচ এখন পাঁচ লাখ লাগবে। শ্বশুর মশাই বাবা বাবা করতে থাকেন। আর বলেন- এতো টাকা আমি কোথায় পাবো বাবা? জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- তোর টাকা আছে আমি জানি। আমাকে মিথ্যা বললে তোর আরো তি হবে। ভালো চাস তো আজ রাতেই রওনা দে। নইলে সকালেই তোর ঘরে আগুন লাগবে। তোর জন্য আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় আছে। এখন তুই ঠিক কর। কী করবি? গরু, সিন্নির চাল আর টাকা নিয়ে রওনা দিবি নাকি বংশ নিয়ে মরবি। তুই ঠিক কর। তুই ঠিক কর। তুই ইজ্জত কর। কর কর কর কর কর.. .. .. জীনের বাদশাহ ফোন কেটে দেয়। আমার শ্বশুর মশাই হায় হায় করতে থাকেন। এখন কী হবে উপায়। তাছাড়া আমরা সবাই অনেক বেয়াদবি করেছি জীনের বাদশাহর সঙ্গে। শ্বশুর মশাই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই রওনা দিতে রাজী। আমাদের কারো কথা তিনি শুনবেন না। সারা ঘরে একটা উদ্বিগ্ন। এখন কী হবে? শ্বশুর মশাই কারো কথাই আর শুনতে চাইছেন না। তিনি রেডি হচ্ছেন। সারা ঘরে একটা লংকা কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। শ্বশুর মশাই রেডি। আমরা ওনাকে যেতে দিব না। উনি যাবেন। ভোরবেলা আযান দেবার আগে আগে শ্বশুর মশাই আমাদের শত বারণ অমান্য করে জীনের বাদশাহর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আমরা ঠায় শূন্য ঘরে বসে থাকি। মামু জুয়েলের গল্প বলা শেষ হয়। আমরা অন্ধকারে সবাই চুপ মেরে যাই। আষাঢ়ের আকাশে ঘন মেঘের গুরু গম্ভীর নিরবতা। তারপর কী হল? অনেকণ নিরাবতা। এবার জুয়েল মামু অট্টহাসী দিয়ে জানায়- ওই দিন ভোরে মিরপুর থেকে জীনের বাদশাহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। জীনের বাদশা এখন র‌্যাবের বড় মডেল। ইনসানের মডেল। ২৮ জুন ২০১০ । ১৪ আষাঢ় ১৪১৭ । সোমবার গাবতলা, মগবাজার, ঢাকা। সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:০৭
false
rg
কিভাবে পালাকার নাট্যদল গঠিত হল_ কিছু সত্য কথন। পর্ব আট। রেজা ঘটক আমি নিজে কোনো দিন সত্যিকারের নাট্যকর্মী ছিলাম না, দাবীও করি না। নাটক ভালো লাগে। পালাকারের সঙ্গে জড়িত। একটু আধতু এটা ওটা করতাম। মঞ্চে অভিনয় কখনোই নয়। নাটকের একজন ভক্ত হিসেবে একজন সংস্কৃত কর্মী হিসেবে নিজেকে মনে করতাম। পালাকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনেও যে রাজনীতি আছে তা টের পেলাম। যে রাজনীতি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করলেও পরে আর করিনি নোংরা পলিটিক্স দেখার পর। সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে সেখানেও রাজনীতি দেখলাম। আসল রাজনীতির চেয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের রাজনীতি আরো ভয়াবহ, আরো হিংসা এবং জেলাসে পরিপূর্ণ। কি সেই রাজনীতি সেই আলাপে যাবার আগে চলুন একটা গান গাই- আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রচায়ায় লুকোচুরি খেলা– নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা॥ আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে– উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে, আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥ ওরে, যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে। ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে।যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি বাতাসে আজ ছুটেব হাসি,আজ, বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥পালাকারের 'ডাকঘর' প্রযোজনায় আমরা সবাই এই গানটি গাইতাম। এই গানের মধ্যে একটি সত্যিকারের মায়া আছে। কোথায় যেনো সি টেনে নিয়ে যায়? আমাদের কোথায় নিয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ এই গান দিয়ে? কবিগুরু লহো প্রণাম। তুমি সত্যিই কবিশ্রেষ্ঠা হে মহাকবি। যে মানুষটির কথা পালাকারকে সব চেয়ে বেশি মনে রাখতে হবে তাঁর নাম গোলাম সফিক। পালাকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে গোলাম সফিক নিরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। পালাকারের সকল শুভ কাজের সঙ্গে এই মানুষটি অনেক কাজ করেছেন। স্যালুট গোলাম সফিক। পালাকারের সকল অর্জনের জন্য আমিনুর রহমান মুকুলই প্রধান সৈনিক। পালাকারের সকল স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুকুলের অবদান সবচেয়ে বেশি। পালাকারের জন্ম থেকে তাই এখনো আমরা পালাকারের নের্তৃত্ব মুকুলের হাতেই রেখেছি। একমাত্র মুকুলই পালাকারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিকারী। এ বিষয়ে আমি এখনো শতকরা ১০০ ভাগ বিশ্বাস করি। আমার মতো যারা বসন্তের কোকিল তাদের দিয়ে পালাকারের আর যা হোক অন্তঃত সাংগঠিক কাজ গুছিয়ে এতোদূর আসা সম্ভব হতো না। তাই মুকুলকে আমার অন্তরের স্যালুট এবং পালাকার বলতে আমরা সবাই মুকুলকেও বুঝি আসলে। পালাকারের সকল স্বপ্ন পূরণে মুকুলই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাই পালাকার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে মুকুলের কথা না বললে বেঈমানী করা হবে। মুকুল শতকরা ১০০ ভাগ পালাকার অন্ত-প্রাণ। আর বাদ বাকি যারা এরা আসলে পালাকারের শুভাকাঙ্খী। বা পালাকারের সুহৃদ। বা পালাকারের বন্ধু। বা পালাকারের সভ্য। বা পালাকারের প্রতিনিধি। পালাকারের সর্বময় ক্ষমতাও তাই আমরা মুকুলের হাতেই সমর্পণ করেছি। কারণ স্বপ্নটি মুকুলের ছিল। আমরা সেই স্বপ্নে সামান্য সহযোগিতা করেছি মাত্র। জয়তু মুকুল। জয়তু পালাকার। পালাকার প্রথম যে নাটকটি দিয়ে পাবলিক শো করেছিল সেটির নাম ছিল 'মায়াজাল'। কিছু অতিথি শিল্পী এবং পালাকারের নাট্যকর্মীরা সেই নাটকে অভিনয় করেছিল। বন্ধু নাছিম সেই নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিল। আহা আমিন নিলয়ের সেই দিনগুলো। হাঁটতে বসতে উঠতে সারাক্ষণ আমরা নাছিমের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। নাছিম সারাক্ষণ রাজা সেজেই আমিন নিলয়ে রিহার্সাল করতো। আজ নাছিমের কথা খুব মনে পড়ছে। ২০০৪ সালের ২৬ নভেম্বর নাছিম হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেল। রেজাউল কবীর নাছিম কবিও ছিল। নাছিম রেজা নামে কবিতা লিখতো। নাছিমের হাতে লেখা কবিতাগুলো এখনো আমার কাছে আছে। নাছিমকে উৎসর্গ করে ৩২ দিলু রোডে পালাকারের কার্যালয়ে প্রথম এক সপ্তাহের একক নাট্যমেলা আয়োজন করেছিল পালাকার। মুকুল আমার কাছ থেকে নাছিমের একটা ছবি সংগ্রহ করেছিল। ছবিটি পেয়েছিলাম নাছিমের চাকরির আইডি কার্ডে। ওটাই মুকুল বড় করে একটা বিশাল সাইজের পোস্টার বানিয়েছিল। আমরা তখন ১০০ কাঁঠালবাগানের চিলেকোঠায় থাকি। রিয়াজ, মনি'দা, নাছিম আর আমি। সারা রাত নাছিম আর আমি ছাদে সিগারেট ফুকলাম আর দুনিয়ার আলোচনা করলাম। কখনো সাহিত্য। কখনো ব্যক্তিগত জীবন। কখনো প্রেম। কখনো বেকারত্ব। কখনো নীল আকাশ। কখনো রূপালী চাঁদের অলৌকিক সৌন্দর্য। কখনো মেস লাইফ। কখনো নেশার আলাপ। কখনো পেশার আলাপ। কখনো জীবন বদলে দেয়ার আলাপ। আমাদের আলাপ যেনো সেরাতে আর ফুরায় না। নাছিম কি জানতো ওটাই আমার সাথে ওর শেষ আড্ডা? ২৩ নভেম্বর ঈদ উপলক্ষে নাছিম ফেনী গেল। ডাক্তারপাড়ায় নাছিমের অসুস্থ মা, বড় ভাই আর ছোট ভাই রোমান থাকতো। নাছিমরা তিন ভাই। নাছিমকে প্রথম বিয়ে করানো হল। নাছিমের বিয়ের বয়স তখন নয় মাস। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি তখন গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরে ঢাকা-মংলা এসআরএনডিপি প্রজেক্টে এডিবি'র টাকায় বিসিএল থেকে একটি গবেষণার কাজে। দীর্ঘ ছয় মাস আমরা মংলা টু ঢাকা হাইওয়ের দু'পাশে হাইওয়েতে যাদের জমি গেছে সেইসব পারিবারের নালিশ সংগ্রহ করছিলাম। মহাসড়কে যাদের জমি গেল তারা কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেল তা জানার জন্যে এডিবি ওই রিসার্স করিয়েছিল। রাত বারোটায় নাছিম ফোন করলো। বন্ধু এখন কোথায়? টুঙ্গিপাড়া নাকি গোপালগঞ্জ? জবাবে বললাম, মোকসেদপুর। তারপর বলো কি অবস্থা? জবাবে নাছিম বললো, বিয়ে করতে রওনা হলাম। একটু পরে আকথ হবে। দোয়া করো। বললাম, মাশাল্লা। নাছিম, তুমি তো কাঁঠালবাগানের ব্যাচেলর জীবনের ইতি ঘটাতে যাচ্ছো? নাছিম বললো, আরে সেরকম কিছু না। বউ মা'র সাথে ফেনীতে থাকবে। আমি ছুটি ছাটায় এক-দু'বার ঢু মারবো। ব্যাচেলর লাইফ আগের মতোই থাকবে। মাকে সেবা যক্ন করার কেউ নাই। আমার বউ যে হবে তাকে একটা শর্ত দিয়েছি। আমার মা চলাফেরা করতে পারে না। তাকে খাওয়াতে হয়। গোসল করাতে হয়। কাপড় পড়িয়ে দিতে হয়। গত তিন বছর ধরে বিছানায় প‌্যারালাইজড। তার সেবা যত্ন যে করতে পারবে, তাকে আমি বিয়ে করবো। বড় ভাইয়ের জন্য আমরা মেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু বড় ভাই বিয়েতে এখনো রাজী না। তাই আমিই বিয়ে করতে যাচ্ছি। দোয়া করো। রাখলাম রেজা। নাছিম মনে প্রাণে ছিল সত্যিই রাজা। পকেটের চিন্তা কোনোদিন করেনি। বন্ধুদের জন্য সর্বস্ব দিতে পারতো এক নিমেষে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর তিন ছেলেকে মানুষ করেছে নাছিমের মা। আমাদের সবার মা। সেই মায়ের সেবাযত্নের জন্য নাছিম বিয়ে করলো সম্পূর্ণ অচেনা এক মেয়েকে। এক কথায়। ঢাকা থেকে বন্ধুদের মধ্যে তারেক যেতে পেরেছিল। ফেনীতে আমাদের যারা বন্ধু আহসান ওরা সবাই ছিল নাছিমের বিয়েতে। বিয়ের একদিন পর নাছিম আবার যথারীতি ঢাকায় আসলো। নাছিমের বিয়ের সময় আমরা থাকতাম ৭ কাঁঠালবাগানে। আমরা তখন রাজীব নূর, রিয়াজ, নাছিম, মনি'দা আর আমি থাকি একসাথে। ১৯ কাঁঠালবাগান ছিল আমাদের ব্যাচেলর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ১৯ কাঁঠালবাগান ডেভলপারদের দেওয়ার পর পুলক চলে গেল কাজীপাড়া। পবন ১৭ কাঁঠালবাগানে। খোকন কায়সার চট্টগ্রমে বদলি। আর মামু মাসুদ শ্যামলীতে। বিয়ে করে নাছিম ঢাকায় এসে রাজীব নূর বলার পর, রাজীব দা একটা ধমক দিল। অন্তঃত মেয়েটির জন্য নাছিম আপনার তিনটা দিন ফেনীতে থাকা উচিত ছিল। জবাবে নাছিম বলেছিল, রাজীব দা, অসুবিধা নাই, বৃহস্পতিবার আবার যাবো। রাজীব দা বলেছিল, অন্তঃত রবিবার সক্কালের আগে যেনো ঢাকায় না আসেন, নাছিম?ক্লাশ ফাইভ থেকে রিয়াজ, পুলক আর নাছিম ক্লাশফ্রেন্ড। অবশ্য তার আগে পুলক আর রিয়াজ কক্সবাজার থেকে ক্লাশ টু থেকেই ক্লাশ ফ্রেন্ড। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে রিয়াজ আর জায়েদ ছিল কমার্স কলেজে একসাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আরো বন্ধু জুটলো। মুকুল, মঈনুল বিপ্লব, নয়ন মনি চৌধুরী, নাছিম এরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমি ঢাকায় থাকলেও রিয়াজের মাধ্যমে এদের কারো কারো সঙ্গে আমার তখন থেকেই বন্ধুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে রিয়াজ ঢাকায় আসলে পুলক, উত্তম, নাহিদ, জনি, তুহিনদের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হল রিয়াজের মাধ্যমে। পুলক আর উত্তম থাকতো শুক্রাবাদ। সেখানেই ছুটির দিনে বন্ধুরা বিশাল জুয়ার আসর মেলাতো। আমি থাকতাম দর্শক। আর চা নাস্তা সিগারেট সাপ্লাই দেবার এসিসট্যান্ট। জুয়া খেলায় আমি নাহিদ বা জনি'র পক্ষে ওদের পাশে একেক দিন বসতাম। আহা যৌবনের সেই মাতাল দিনগুলি। বন্ধু নাছিম হঠাৎ হারিয়ে গেল আমাদের ছেড়ে। কিন্তু আমার স্মৃতি একটুও হারায়নি বন্ধু। গ্রিনরোডের বাসার ১৯৯৬ সাল থেকে নাছিম আমার রুমমেট কখনো বেডমেট কখনো নেশামেট কখনো খাবারমেট, কখনো খামাখা ধানমন্ডির লেকের পারে বাদাম খাওয়া ও মানুষ দেখার সহযাত্রী। বন্ধু নাছিম, তোরে খুব মিস করি রে। ২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বরের পর আর নাছিমের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ২৬ নভেম্বর নাছিম মারা গেল। তুই যেখানেই থাকিসরে বন্ধু রাজার মতো হাসিখুশি থাকিসরে। তোরে খুব মিস করছি, নাছিম।।......................চলবে......................................
false
rn
অসৎ ও ভগবান বিশ্ববিদ্যালয়ে জনৈক অধ্যাপক ক্লাস নিচ্ছিলেন । অধ্যাপক ছিলেন নাস্তিক প্রকৃতির । পড়াতে পড়াতে খানিকটা উপহাসের ঢঙ্গেই তিনি তার ছাত্রদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন--- “যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে তার সবই কি ভগবান সৃষ্টি করেছিলেন ?” সকল ছাত্র চুপ । শুধু একজন ছাত্র উত্তর দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল । ছাত্র ১ – হ্যাঁ তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন । ভগবানই সমস্ত কিছুর স্রষ্টা । অধ্যাপক ভ্রু কুঞ্চিত করে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ভগবানই সব সৃষ্টি করেছেন ?”ছাত্র ১ – হ্যাঁ স্যার, ভগবানই নিশ্চিতরূপে সবকিছু সৃষ্টি করেছে । অধ্যাপক – ভগবান যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই অসৎকেও তৈরী করেছেন, যেহেতু অসতের অস্তিত্ব রয়েছে । অতএব, আমরা যা করি আমরা তাই, কর্মের এ নীতি অনুসারে ভগবানকেও আমরা অসৎ রূপেই ধরে নিতে পারি । তাই না ?অধ্যাপকের এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক যুক্তিটি ছাত্রটি কোন উত্তর প্রদান করতে পারল না । চুপ করে গেল । সেই অধ্যাপক তখন যেন জিতে গেছেন এই মনোভাব নিয়ে বললেন, ধর্ম বিশ্বাস আসলে কতগুলো গল্পগাথা মাত্র – এই ধরনের কথা ছাত্রদের মধ্যে বলতে লাগলো । সেই সময় ক্লাসের অন্য একটি ছাত্র হাত তুলে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি ।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ।” অধ্যাপক সম্মতি দিলেন । ছাত্র ২ – স্যার, ঠান্ডার কি আদৌ কোন অস্তিত্ব রয়েছে ?অধ্যাপক – এটা আবার কি ধরণের প্রশ্ন ? নিশ্চয়ই ঠান্ডার অস্তিত্ব রয়েছে । কেন, তুমি কি কখনও ঠান্ডার অনুভব লাভ কর না ?ছাত্র ২ – প্রকৃতপক্ষে স্যার, ঠান্ডার অস্তিত্ব নেই । পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে আমরা যাকে বাস্তবে ঠান্ডা বলে মনে করি, সে হল উষ্ণতা বা তাপের অনুপস্থিতি । প্রতিটি দেহ বা বস্তুর বিচার্যের জন্য তখনই গ্রহনীয় হয় যখন তার মধ্যে শক্তি থাকে বা শক্তি তার মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয় । আর তাপ বা উষ্ণতা হল সেই বস্তু যা দেহ বা বস্তুর মধ্যে থাকে বা দেহ বা বস্তুর মধ্যে শক্তির সঞ্চার ঘটায় । চরম শূণ্যতা (-৪৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইট) হল সামগ্রিকভাবে তাপের অনুপস্থিতি । এবং সকল বস্তু সেই তাপমাত্রা নিস্ক্রিয় বা প্রতিক্রিয়া অসমর্থ হয়ে যায় । অতএব ঠান্ডার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই । আমরা এই শব্দটি সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র তাপহীনতায় আমরা কেমন অনুভব করি তা বর্ণনা করার জন্য । স্যার, অন্ধকারের কি কোন অস্তিত্ব আছে ?অধ্যাপক – নিশ্চয়ই আছে । ছাত্র ২ – স্যার, আবার আপনি ভুল করলেন । প্রকৃতপক্ষে অন্ধকারের কোন অস্তিত্ব নেই । বাস্তবে অন্ধকার হলো আলোর অনুপস্থিতি । আলোকে আমরা নিরীক্ষণ করতে পারি বা অধ্যয়ন করতে পারি, কিন্তু অন্ধকারকে পারি না । প্রকৃতপক্ষে আমরা নিউটনের রশ্মিদ্বারা (Prism) সাদা আলোকে ভেঙ্গে অনেক রঙে পরিণত করতে পারি এবং প্রতিটি রঙের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য (Wave length) অধ্যয়ন করতে পারি, পরিমাপ করতে পারি । কিন্তু আপনি অন্ধকারকে পরিমাপ করতে পারেন না । একটি সাধারণ আলোক রশ্মি অন্ধকার জগতকে ভেঙ্গে দিয়ে তা আলোকিত করতে পারে । কিন্তু আপনি কিভাবে জানবেন কোন নির্দিষ্ট জায়গাটি কতখানি অন্ধকার ? আপনি সেটা বিচার করবেন সেখানে আলোর পরিমানের উপস্থিতি বিচার করে । তাই নয় কি ? অন্ধকার শব্দটি মানুষ ব্যবহার করে, আলোর অনুপস্থিতিতে কি ঘটে তা বর্ণনা করার জন্য । এছাড়া আলাদাভাবে অন্ধকার বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই । স্যার, অসৎ’এর কি অস্তিত্ব রয়েছে । অধ্যাপক এবার কি বলবেন ঠিক ভেবে পেলেন না । অনিশ্চিত রূপে ইতস্ততঃ করে বললেন –হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি ইতিমধ্যেই তা বলেছি । আমরা প্রতিদিনিই তা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিকতা পৃথিবীর সর্বত্র কত রকমের হিংস্রতা আর অপরাধ । এগুলি অসৎ’এর প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয় । ছাত্র ২ – না, স্যার, অসতের প্রকৃতপক্ষে কোন অস্তিত্ব নেই । অসৎ হচ্ছে ভগবানের অনুপস্থিতি মাত্র । এটা ঠিক অন্ধকার বা ঠান্ডার মতো একটি শব্দ, যা মানুষ সৃষ্টি করেছে, ভগবানের অনুপস্থিতি বর্ণনা করার জন্য । ভগবান অসতকে সৃষ্টি করেনি । যখন মানুষের হৃদয়ে ভগবানের প্রতি প্রেমের উৎসারণ বা প্রকাশ ঘটে না সেই অবস্থাটিকে বর্ণনা করার জন্য মানুষ অসৎ (Evil) শব্দটি সৃষ্টি করেছে । ঠিক যেমন তাপের অনুপস্থিতিতে ঠান্ডা বা শীতলতা আসে, আলোর অনুপস্থিতিতে অন্ধকার আসে, তেমনই ভগবানের অনুপস্থিতিতে অসৎ বা অশুভের আগমন হয় । ছাত্রটির কথা শুনে সেই অধ্যাপক চুপ করে বসে থাকলেন । এতক্ষণ যে ছাত্রটি তাঁর অধ্যাপককে এত কথা বলেছিল, তার নাম কি জানেন ? এই ছাত্রটি পরবর্তীকালে এক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানিকরূপে খ্যাত হয়েছিলেন । তাঁর নাম, “অ্যালবার্ট আইনষ্টাইন”
false
rn
প্রতিদিন সবার একটি আমলকি খাওয়ার অভ্যেস করা উচিত ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে ব্যবহার করা হয়। বীজ দিয়ে আমলকির বংশবিস্তার হয়। বর্ষাকালে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। আমলকিতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ থাকায় একে ভিটামিন ‘সি’র রাজা বলা হয়। লেবু জাতীয় অন্য কোনো ফলে এত ভিটামিন ‘সি’ নেই। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আমলকিতে পেয়ারা ও কাগজি লেবুর চেয়ে ৩ গুণ ও ১০ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। আমলকিতে কমলার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি, আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ বেশি, আমের চেয়ে ২৪ গুণ এবং কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। একজন বয়স্ক লোকের প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ দরকার। দিনে দুটো আমলকি খেলে এ পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। উদ্ভিদের নাম: আমলকী স্হানীয় নাম: আমলকী/অমৃতকলা, শ্রীফল, ধাত্রী ইংরেজীতে: Phyllanthus emblice.ভেষজ নামঃ- Embilica officinalis Gaertn.ফ্যমিলিঃ Eophorbiaceaeব্যবহার্য অংশ: পাতা, ফুল ও বাকল। রোপনের সময়: বছরের সবসময় রোপণ করা যায় । উত্তোলনের সময়: যখন থেকে ফল ধরতে শুরু করে তখন থেকেই ফল আহরণ করা যায়। আবাদী/অনাবাদী/বনজ: আমলকী বনজ এবং জঙ্গলের ঔষধী উদ্ভিদ। কাঁচা আমলকী বেটে গোসলের ২/৩ ঘণ্টা পূর্বে মাথায় মেখে রোদে বসে শুকিয়ে ধুলে চুলের গোড়া শক্ত হয় ।আমলকী বাটা নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে রাত্রে ঘুম ভাল হয় ও মাথা ঠান্ডা থাকে, চুল ঝরঝরে থাকে এবং চুলের রং কালো হয় ।আমলকী বেটে তার সাথে সাদা চন্দন ভালভাবে মিশিয়ে পুরো কপালে ঘষলে মাথা ধরায় আরাম পাওয়া যায়।কাঁচা আমলকীর রস দুই ফোঁটা করে দিনে দুইবার ব্যবহার করলে তিন দিনে চোখওঠা ভাল হয় ।হার্টের রোগীরা আমলকি খেলে ধরফরানি কমবে। টাটকা আমলকি তৃষ্ণা মেতে, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বন্ধ করে, পেট পরিষ্কার করে। সংস্কৃত ভাষায় এর নাম 'আমালিকা'। আমলকী গাছ বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও চীনে দেখা যায়।এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে। আমলকির ফল, পাতা ও ছাল থেকে তৈরি পরীক্ষামূলক ওষুধে কিছু রোগ নিরাময়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে যেমন- ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, প্রদাহ এবং কিডনি-রোগ।দীর্ঘমেয়াদি কাশি সর্দি হতে উপকার পাওয়ার জন্য আমলকীর নির্যাস উপকারী।বিভিন্ন ধরনের তেল তৈরিতে আমলকি ব্যবহার হয়। আমলকি থেকে তৈরী তেল মাথা ঠান্ডা রাখে। আমলকি খেলে মুখে রুচি বাড়ে। পিত্ত সংক্রান্ত যেকোনো রোগে সামান্য মধু মিশিয়ে আমলকি খেলে উপকার হয়।প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকিতে আছে:জলীয় অংশও – ৯১.৪ মোট খনিজ – ০.৭ আঁশ – ৩.৪ খাদ্যশক্তি – ১৯ আমিষ – ০.৯ চর্বি – ০.১ শর্করা – ৩.৫ ক্যালসিয়াম – ৩৪মি:লৌহ – ১.২ ক্যারোটিন – ০ ভিটামিন বি-১ – ০.০২ ভিটামিন – ০.০৮মি:ভিটামিন সি – ৪৬৩লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলে দাঁত ও নখ ভাল রাখে।আমলকীর জুস দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখার জন্য উপকারী। ছানি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ব্রণ ও ত্বকের অন্যান্য সমস্যায় উপকারী।এক গ্লাস দুধ বা পানির মধ্যে আমলকী গুঁড়ো ও সামান্য চিনি মিশিয়ে দিনে দু’বার খেতে পারেন। এ্যাসিডিটের সমস্যা কম রাখতে সাহায্য করবে।আমলকী আপেলের মতো অভিজাত ফল নয়। আপেলের মতো নিবিড় পরিচর্যায় এটি আবাদও হয় না। জন্ম অযত্নে বন-বাদাড়ে। কিন্তু গুণের বিচারে একটি আমলকীর সমান ছয়টি আপেল।আমলকির রেসিপি-আমলকী ২৫০ গ্রাম, চিনি ১ কাপ, সিরকা আধা কাপ, আদার টুকরা ৪-৫টি, শুকনা মরিচ ২টি, লবণ পরিমাণমতো।প্রথমে টুথপিক দিয়ে আমলকী ছিদ্র করে ফিটকিরির পানিতে ১৪-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে পানি পাল্টে দিতে হবে। এবার একটি পাত্রে পানি ও লবণ দিন। একবার ফুটে উঠলে নামিয়ে পানি ঝরিয়ে সব উপকরণ একসঙ্গে দিয়ে আমলকী অল্প আঁচে সেদ্ধ করে নিন। আচার হয়ে গেলে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। এরপর বয়ামে ঢুকিয়ে রাখুন। আমলকির মোরব্বা- আমলকি—৫০০ গ্রাম, চিনি—২৫০ গ্রাম, ২টো পাতিলেবু রস, নুন—১/২ চা চামচ। প্রণালীঃ আমলকি ধুয়ে, একটা কাঠি দিয়ে সারা গায়ে ফুটো ফুটো করে, এক হাঁড়ি জলে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন, কষ বেরিয়ে যাবে। কেউ কেউ জলের সঙ্গে একটু ফিটকিরিও দেন। সকালে জল ঝরিয়ে, ধুয়ে, নুন দিয়ে তিন পেয়ালা জলে, কম আঁচে সেদ্ধ বসান। নরম হয়ে গেলে নামান। এবার দেড় কাপ জল দিয়ে চিনির রস করুন। ফুটলে গাদ তুলে ফেলে দিন। একটু পরে লেবুর রস দিন। এবার রসের মধ্যে সেদ্ধ আমলকি ঢেলে, আরো আট-দশ মিনিট ফুটিয়ে, আমলকি গলবার আগে নামিয়ে ফেলুন। ঠান্ডা হলে চওড়ামুখ বোতলে ভরে রাখুন। এফল দামে সস্তা ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। বাচ্চা থেকে শুরু করে সবারই ফল খাওয়ার আগ্রহ বাড়ানো উচিত। এতে পুষ্টি চাহিদা পূরণের সাথে বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করবে। আর অবহেলা নয়, গুণী এই বৃক্ষটির সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ে আমাদের সচেতন এবং মনোযোগী হতে হবে।
false
rn
নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী আমাদের নেই ১। রাস্তায় ঢাকনা বিহীন ম্যানহলের ভিতরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন আপনাকে ঘিরে একই ভাবে ম্যানহলের ভিতরে তাকিয়ে আছে। একটু পরে আপনি সেখান থেকে চলে যাবার পর সেখানে ছোট খাট একটা জটলা তৈরি হবে। একজন তাকিয়ে থাকবে অন্যজন তাকিয়ে আছে বলে, কেউ জানে না তারা কেন ম্যানহলের ভিতরে তাকিয়ে আছে।২। আমাদের একটা ভালো দৈনিক পত্রিকা এবং ভালো একটি টিভি চ্যানেলের খুব অভাব। যে পত্রিকা বা চ্যানেল কোনো দলের কথা বলবে না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখাবে।৩। এক ছোকরার বিয়ে করার বড়ই শখ, তার মতে এতেই তার সকল সুখ নিহিত। কিন্তু কিছুতে হয়ে ঊঠছে না। ওদের পরিবার একমাত্র শ্রী হনুমানের পূজো করে- অন্যে দেবতা সেখানে কল্কে পান না - তাই ত্রিসন্ধ্যা তারঁই পূজো করে কাকুতি-মিনতি করে, “হে ঠাকুর, আমায় একটি বউ জুটিয়ে দেও গো”। ওদিকে নিত্য এমন ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে হনুমানের পিত্তি চটে গিয়েছে। শেষটায় একদিন স্বপ্নে দর্শন দিয়ে হুঙ্কার দিলেন, “ওরে বুদ্ধু, বউ যদি জোটাতেই পারতুম, তবে আমি নিজে বিয়ে না করে confirmed bachelor হয়ে রইলুম কেন?!!৪। হাবলু কমোডে বসে তার নতুন আইফোন-৫ দিয়ে কথা বলছিল। হটাৎ তার ফোন নিচে কমোডে পড়ে গেলো। সে দুঃখে কষ্টে অনেক কান্নাকাটি করতে লাগলো। তখন হঠাৎ এক দেবতা আসলো পানি থেকে উঠে আর তাকে একটা সোনার আইফোন দিল। হাবলুর তখন কাঠুরের গল্প মনে পড়লো আর সে বলল “না এটা আমার না” । দেবতা তখন বলল, “আরে গাধা... এটা ধুয়ে তো দ্যাখ” ।৫। গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখি- আমি আমার সব প্রিয় মানুষ ছেড়ে জঙ্গলে চলে গেছি। একা একা থাকি। ক্ষুধা পেলে বন থেকে ফল-টল সংগ্রহ করে খাই। রাতে চিন্তাহীন ঘুম দেই। বনের পশুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে- তারা আমার কোনো ক্ষতি করবে না বলেছে। ছেড়ে আসা কোনো প্রিয় মানুষের কথা ইচ্ছা করেই মনে আনি না। অনেক রাত পর্যন্ত নদীর ধারে টীলার উপর বসে থাকি। আকাশের তারা দেখি। ব্যাপক আনন্দ! হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে হাজির। মেয়েটকে একটা বাঘ তাড়া করেছে- মেয়েটি আমার সামনে এসে, আমাকে বলল- বাঘ ! বাঘ ! আমাকে বাঁচান। আমি বললাম কোনো ভয় নেই- আমি আছি। আমি মেয়েটির হাত ধরলাম, মেয়েটি ভয়ে কাঁপছিল। বাঘটি এসে আমাকে দেখে চলে গেল। এমন ভাব যেন- ওস্তাদ স্যরি...ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। তারপর সারারাত মেয়েটির সাথে অনেক গল্প করলাম। মেয়েটির অনুমতি নিয়ে মেয়েটিকে অনেক আদর করলাম ।তারপর বনে আমাদের সংসার জীবন শুরু হলো। দুই বছরের মধ্যে তিনটা বাচ্চা হলো। প্রথম বছর দু'টা জমজ বাচ্চা পরের বছর একটা। খুব আন্দময় জীবন। জঙ্গলে জ্যাম নেই, লোডশেডিং এর চিন্তা নেই। চুরী, ছিনতাই এর ভয় নেই। দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বৌ এর শপিং এর ঝামেলা নেই। মোবাইল নেই। হরতাল নেই। কেউ কুপিয়ে মেরে ফেলবে এই ভয় নেই। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরি, বৌ আগুনে পুড়ে দেয়- ফরমালিন মুক্ত মাছ, আহ ! ফরমালিন মুক্ত ফল। বাচ্চা গুলোও খুব নাদুস-নুদুস হয়েছে। রাতের বেলা বৌ গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়- "ঐ পাথুরে শহর ছেড়ে সবুজ তেপান্তরে/ স্বপ্ন কিছু সাজিয়ে নিতে সুখের বন্যা ধারায়/ শেষ হবেনা কোন দিন যুগল পথচলা। " সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৯
false
rg
!! বিপ্লবী কবি বেলাল মোহাম্মদ এখন শুধুই স্মৃতি !! ২০১২ সালের ৯ মার্চ। সোমবার। বাংলা একাডেমী'র মাহবুব ভাই (গল্পকার মাহবুব আজাদ)-এর নের্তৃত্বে বকুল আপা, আমার বউ মায়া আর আমি উত্তরা গেলাম। উদ্দেশ্য, সারাদিন মাহবুব ভাইয়ের এক বন্ধু'র বাসায় (এই মুহূর্তে নামটি মনে পড়ছে না বলে দুঃখিত) সারাদিন আমরা কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে আড্ডা দেবো। একেবারে ঘরোয়া আড্ডা। তো, আমরা উত্তরা সেই ঠিকানায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর বারোটা বাজলো। গিয়ে দেখি, মাহবুব ভাইয়ের সেই বন্ধু'র বাসায় ভরপুর আড্ডা চলছে। আমাদের মতো আরো অনেকে সেই আড্ডায় আগেই সামিল হয়েছেন। কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে ওটাই ছিল আমার প্রথম ও একমাত্র আড্ডা। আর সেই আড্ডার অন্যতম আয়োজক হিসেবে মাহবুব ভাই ও তার বন্ধুর প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি'র অমর একুশে বইমেলায় আমার প্রথম উপন্যাস 'মা' প্রকাশিত হয়েছিল। বাসায় তখন পর্যন্ত একমাত্র কপি অবশিষ্ট ছিল। 'মা' উপন্যাসের সেই কপিটি আমি কবি বেলাল মোহাম্মদের জন্য সঙ্গে নিলাম। মাহবুব ভাই আর বকুল আপা'র জন্য বইয়ের কপি নেই নি বলে উত্তরা যাবার সারা পথ মাহবুব ভাই নানান খোটা দিলেন। কবি বেলাল মোহাম্মদকে আমার 'মা' উপন্যাসটি হাতে হাতে তুলে দেবার পেছনে একটি কারণ আছে। আমার 'মা' উপন্যাসে 'মুক্তিযুদ্ধের উপর' একটি অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়ে কবি বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীণ বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক কথাবার্তাও আছে। বিভিন্ন বই-পুস্তক, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে ই-মেইল যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের একটি চিত্র সেখানে আছে। সেই তথ্যগুলো নিয়ে বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আরো কথা বলে বিষয়টি আরো সঠিক ও সুস্পষ্ট করার প্রয়াস আমার মনে মনে ছিল। সেদিনের সেই আড্ডায় যা আমার কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছিল। কবি বেলাল মোহাম্মদের কাছ থেকে সেদিনের আড্ডায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একেবারের সূচনা লগ্নের যে বিষয়গুলো আমরা শুনেছিলাম তা মোটামুটি এরকম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসা থেকে ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘড়ি'র কাঁটার হিসেবে তখন ২৬ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতার ঘোষণার সেই ওয়ারলেস বার্তাটি ছিল এরকম- ''Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between E.P.R. and Police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.''বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতার ঘোষণাটি টেলিগ্রাম বার্তার মাধ্যমে চট্টগ্রাম কয়েকজন ছাত্রের কাছে পৌঁছায়। ছাত্ররা ওই বার্তাটি অনুবাদের জন্য নিয়ে যান ডক্টর মানজুলা আনোয়ার সাহেবের কাছে। ডক্টর আনোয়ার তার বার্তাটি অনুবাদ করেন। ছাত্ররা সেটি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের রেডিও স্টেশানে নিয়ে যায় প্রচার করার জন্য। কিন্তু পাক উচ্চ অথরিটির পারমিশানের অভাবে সেটি তখন প্রচার করা সম্ভব হয়নি। তখন ছাত্ররা সেই অনুবাদ বার্তা চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান সড়কে মাইকিং করেন। কবি বেলাল মোহাম্মদ তখন চট্টগ্রাম বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার। ঢাকার গণ্ডগোলের খবর শোনার পর সকালে আর তিনি আগ্রাবাদের অফিসে যান নি। তিনি তখন ছিলেন এনায়েতগঞ্জে ডা. শফির বাড়িতে। সেখান থেকে গেলেন জহুরা মার্কেটে আওয়ামী লীগের অফিসে। সেখানে কিছু তরুণরা মিলে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করলেন। কালুরঘাটে বিকল্প একটি রেডিও স্টেশান চালু করবেন বলে জানালেন। সেটি পাহারা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের কাছে সহযোগিতা চাইলেন। ক্যাপ্টেন রফিক বললেন, 'আপনারা রেডিও স্টেশান চালু করেন। আমি পাহারার ব্যবস্থা করছি।' কালুরঘাটে রেডিও স্টেশান চালু'র কাজ তখন এগিয়ে চলছে। আবুল কাশেম সন্দীপ তখন চট্টগ্রামের একটা কলেজে পড়াতেন। মাঝেমাঝে ফ্যামিলি মেম্বারের মতো থাকতেন কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রাম বেতারের কেউ নন। আবুল কাশেম সন্দীপ, বেতারের জুনিয়র অফিসার আবদুল্লাহ আল ফারুক, সুলতান আলাউন, মাহমুদ হোসেন, কবি আবদুস ছালাম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আওয়ামী লীগের এম.এ. হান্নান, বেতারের ইঞ্জিনয়ার বিভাগের কর্মী আমিনুর রহমান এবং বেলাল মোহাম্মদ এঁরা সবাই মিলে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে রেডিও অন করতে সক্ষম হলেন। তখন বঙ্গবন্ধু'র তারবার্তাটির অনুবাদ কপি প্রচার করতে লাগলেন। রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত কিছুক্ষণ পরপর বঙ্গবন্ধু'র সেই তারবার্তার অনুবাদ কপি প্রচার করেন। ওই সময় বাবর ও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজে মেজর জিয়া হেড কোয়ার্টারের বাইরে অবস্থান করছিলেন। ২৬ শে মার্চ রাতে পরিস্থিতি অবজার্ভ করার জন্য মেজর জিয়া তখন পটিয়ায় অবস্থান করছিলেন। কবি বেলাল মোহাম্মদকে তাঁর এক বন্ধু টেলিফোনে জানালেন যে ক্যাপ্টেন রফিকের চেয়েও উচ্চ পদের একজন বাঙালি আর্মি অফিসার পটিয়ায় অবস্থান করছেন। ২৭ শে মার্চ সকালে কবি বেলাল মোহাম্মদ পটিয়ায় গিয়ে তাঁর পরিচিত মানিক দারোগার মাধ্যমে মেজর জিয়াকে কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের খবর জানালেন। মেজর জিয়া তখন রেডিও স্টেশান পাহারা দেবার জন্য সৈন্যদের আগে পাঠিয়ে দিলেন। আর একটা জিপে মেজর জিয়া নিজেও রওনা দিলেন। পেছন পেছন কবি বেলাল মোহাম্মদের গাড়িও কালুরঘাট পৌঁছালো।২৭ শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে মেজর জিয়া কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি ঘোষণা দেন- “আই মেজর জিয়া অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ডু হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ।” তার আগে কয়েকবার এনাউন্স করা হয় যে, মেজর জিয়াউর রহমান একটি জরুরী ঘোষণা দেবেন। মেজর জিয়া তখন বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান না বলে শুধু মেজর জিয়া বলার জন্য। আবদুল্লাহ আল ফারুকের কণ্ঠস্বর ভালো। তাই মেজর জিয়ার ঘোষণাটি পরে তিনি আবার পাঠ করতে লাগলেন।পরিদন ২৮ শে মার্চ মেজর জিয়া আরেকটি ভাষণ লিখে আনেন। সেখানে তিনি নিজেকে রিপাবলিকের টেমপোরারি হেড উল্লেখ করেছিলেন। মেজর জিয়া'র ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ সালের সেই ঘোষণাটি ছিল এরকম- ''This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction, I have taken command as the temporary Head of the Republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours. Joy Bangla.''সারা দিনের সেই আড্ডায় যে জিনিসটি আমার কাছে পরিস্কার হয়েছিল, সেটি হল, কবি বেলাল মোহাম্মদ দাবী করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত হবার আহবান জানিয়েছিলেন। তখন থেকেই আসলে তৎকালীন গোটা পূর্ব-পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু একক নেতা এবং 'জয় বাংলা' মুক্তির স্লোগান হিসেবে সবার কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকসেনাদের পরিচালিত অপারেশান সার্চ-লাইটের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যদি বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের আগে ইপিআর-এর ওয়ালেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে নাও পারতেন, তবুও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতো। আর তা বঙ্গবন্ধুকে একক নেতা মেনেই হতো। মেজর জিয়াকে দিয়ে আমরা যে ঘোষণাটি দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, সেটা বরং সেই সময়ে মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছিল যে, আমাদের দলেও কিছু প্রশিক্ষিত বাঙালি আর্মি আছে। কবি বেলাল মোহাম্মদ বলেছিলেন যে, আমরা সবাই আসলে স্বাধীনতার ঘোষণাটির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকম প্রচারপত্রের মতো পাঠ করেছিলাম যাতে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই উদ্ধুদ্ধ হতে সাহস পায়। আর সেই বেতার ঘোষণা পাঠকদের বা বেতার ঘোষকদের হিসেব ধরলে বলতে হয় যে, মেজর জিয়া'র সিরিয়াল হবে ৯। কারণ, এর আগে আমরা অন্তঃত ৮ জন সেই ঘোষণা পাঠ করেছিলাম। মেজর জিয়া তার জীবদ্দশায় কখনো নিজেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেন নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরেও তিনি সেই দাবী কখনো করেননি। কিন্তু আরো পরে এসে মেজর জিয়ার দল বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে চাইছে। যা সত্যি সত্যিই দুঃখজনক। আর তিনি কালুরঘাট এসেছিলেন ২৭ তারিখ। আর ২৭ ও ২৮ তারিখ দুইটি ভিন্ন ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। উত্তরা থেকে আড্ডা শেষে ফেরার পথে আমার বারবার মনে পড়েছিল আবুল কাশেম সন্দীপ সাহেবের কথা। ১৯৯৩ বা '৯৪ সালের দিকে ধানমন্ডি'র গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগারে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের দুই বীরসেনানী এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসর) একে খোন্দকার (বর্তমান পরিকল্পনা মন্ত্রী) ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আবুল কাশেম সন্দীপ সাহেবকে একসঙ্গে পেয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের অনেক প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিচ্ছিলেন তাঁরা। আমি তখন আবুল কাশেম সন্দীপ সাহেবকে কালুরঘাট স্বাধীন বেতার কেন্দ্র স্থাপন ও স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম কণ্ঠস্বরটি কার ছিল? জবাবে আবুল কাশেম সন্দীপ সাহেব বলেছিলেন, আমরা তো চেষ্টা করে কোনোভাবেই রেডিও চালু করতে পারছিলাম না। আমাদের সঙ্গে দুই জন রেডিও'র ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মী ছিল। তারা কেউ আসলে তেমন ইঞ্জিনিয়ার না। আমাদের যেসব যন্ত্রপাতি লাগবে তারা আগ্রাবাদ থেকে তা খুলে এনেছিলেন। কিন্তু তা মেরামত করে রেডিও অন করা যাচ্ছিলো না। তখন আমাদের যে ঠ্যালা গাড়ির চালক ছিল, ও বললো, আমি লাগাতে পারবো। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই কেমনে পারবি? ঠ্যালা চালক বলেছিল, আপনারা যন্ত্রগুলো খোলার সময়ে আমি খেয়াল করেছি। তো ওকে একবার সুযোগ দেওয়া হল। ছেলেটি কিন্তু ঠিকঠাক যন্ত্রগুলো লাগাতে পেরেছিল। আমরা 'হ্যালো হ্যালো' বলে বারবার পরীক্ষা করছিলাম। কিন্তু কিছুই হয় না। পরে ওই ঠ্যালা চালককে বলেছিলাম, তুই চেষ্টা কর। তো ওর চেষ্টায় কাজ হলো। একটা কুকুর ওই সময় পাশ থেকে ডেকে উঠেছিল। আমরা কুকুরের কণ্ঠস্বরটি রেডিওতে শুনতে পেয়ে দৌড়ে সবাই আবার যন্ত্রের কাছে এসেছিলাম। সেই হিসেবে সেই কুকুরটি আসলে প্রথম কণ্ঠস্বর স্বাধীন বাংলা বেতারের বলে সন্দীপ সাহেব হেসে উঠেছিলেন। আর মেজর জিয়া'র ব্যাপারে আবুল কাশেম সন্দীপ সাহেবের বক্তব্যের সঙ্গে কবি বেলাল মোহাম্মদের বক্তব্য পুরোপুরি মিলে যায়। মেজর জিয়া ২৭ ও ২৮ তারিখ দুটি আলাদা ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবুল কাশেম সন্দীপ দাবী করেছিলেন যে, ২৮ তারিখে যখন মেজর জিয়া ঘোষণাটি একটু অদল বদল করেছিলেন, তখন আমি তাঁকে বাধা দিয়েছিলাম, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'ডোন্ট টক'। তখন তো বুঝি নি, এই লোক একদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তর্ক করার মুহূর্তের সেই 'ডোন্ট টক' শব্দ দুটি আমার এখনো মনে আছে।
false
rn
আসুন, জ্ঞান সঞ্চয় করি- ১ # রাজনীতি বিষয়টা এখন বুড়িগঙ্গার জলের মত হয়ে গেছে । ময়লা হতে হতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে , যে এখন দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে । খুব সম্ভবত ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির দূষণ। # কাউকে মিস করছেন? ফোনে কল করুন ! কারো সাথে দেখা করতে চান? তাকে আমন্ত্রন জানান! কাউকে কিছু বুঝাতে চান? ব্যাখ্যা করুন!একবার কাজ না হলে আবার চেষ্টা করুন!!কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? সরাসরি প্রশ্ন করুন! কারো কোনো কিছু পছন্দ হচ্ছে না?সরাসরি বলে দিন!# আইনস্টাইন এর প্রতিটি সেমিনারে-ই পিছনে বসে লেকচার শুনতে শুনতে তার ড্রাইভার একবার তাকে বলেই বসলো, আপনি তো সব জায়গায় একি লেকচার বারবার দেন, তারপর ও লোকজন আপনার লেকচার যে কেন শুনে? আমি আপনার লেকচার এতোবার শুনেছি যে এখন চাইলে আমি ই আপনার লেকচার দিতে পারি। এর পরবর্তী সেমিনারে আইনস্টাইন তার ড্রাইভারের সাথে পোষাক পরিবর্তন করে সেমিনার এর পিছনে বসে রইলেন আর তার ড্রাইভার লেকচার দিতে শুরু করলো। অত্যন্ত নিখুত ও সাবলীল ভাবে লেকচার শেষ করার পর প্রশ্ন উত্তর পর্বে এক দর্শক এমন এক প্রশ্ন করে বসলো যার উত্তর ড্রাইভারের জানা নাই। ড্রাইভারের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া "আপনি খুব-ই সহজ একটা প্রশ্ন করেছেন, আপনার প্রশ্নটা এতোই সহজ যে আমি নিশ্চিত সেমিনারের পিছনে বসে থাকা আমার ড্রাইভার-ও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে"। # রবীন্দ্রনাথ কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতন এবং সমাজ বৈষম্য নিধনকারী, পবিরর্বতনকামী নাগরিক। তিনি চেয়েছেন মানুষের মধ্যে ঐক্য ও উদার মানবিকতার প্রতিফলন ঘটুক। তিনি সমাজ বদলের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সমাজের ভেতরে মানুষের কর্মোদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। সমাজবিরোধীশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সমবেত আত্মশক্তির প্রয়োজন উপলব্ধি করেছেন সেই সময়েই। ব্যক্তি সমাজ সৃষ্টি করে, আর সমাজ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের। সমাজে সৎ অংশগ্রহণ সৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দেয়। এটা ছিল তাঁর কর্মের মূল প্রত্যয়। # আওয়ামী লীগ এর সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ যারা করে না, তাদের রাজাকার ভাবে। জামাত এর সমস্যা হলো জামাত যারা করে না, তাদের কাফের ভাবে। বিএনপি এর সমস্যা হলো কোন পক্ষে থাকলে ভালো হবে বুঝতে পারে না। জাতীয় পার্টির সমস্যা হলো স্যার (এরশাদ) কখন কি বলবে, অনুমান করতে পারে না। জনগণের সমস্যা হলো সব দল তাদের নাম ভাঙ্গাইয়া, নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। কিন্তু তারা কাউকেই কিছু বলতে পারে না। # পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র নাস্তিক দেশ হলো- আলবেনিয়া।পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশটির আয়ুস্কাল ছিল ১৯৬৭সাল থেকে ১৯৯১সাল পর্যন্ত।১৯৬৭সাল থেকে ১৯৯১সাল পর্যন্ত এই নাস্তিক দেশটিতে যারা জন্ম নিয়েছিল তারা ধর্মের ব্যপারে কিছুই জানত না। তাই তাই তারা ছিল হয় নাস্তিক নয়ত এ্যাগোনস্টিক। # অধিকাংশ মানুষ প্রেমে আত্মসমর্পণ করে। ভালবাসার এই পর্যায়ে তারা অনেক ভাল সময় কাটায়, তারা একে অপরের প্রেমে ডুবে থাকে কিন্তু কিছু সময় পরে তারা বুঝতে পারে যে তাকে আগের মত গুরত্ব প্রদান করা হয় না যেমন টা আগে দেয়া হত। তারপর সমস্যা বৃদ্ধি। এই হতাশা এবং মন আছে অবনমিত মন ঘুরে যাচ্ছে এর পর ই হতাসা তাকে গ্রাস করে নেয়। # এক মহিলা নবী করিম (সাঃ) এর চলার পথে প্রতিদিন কাঁটা দিয়ে রাখতো, একদিন দেখতে পেলেন ওনার পথে কাঁটা নাই। আমাদের প্রিয় নবী তখন চিন্তায় পড়ে গেলেন।বুড়ি হয়ত অসুস্থ , নবী বুড়ির বাড়ি গিয়ে দেখতে পেলেন যে বুড়ি অসুস্থ , নবীজী তার সেবা যত্ন করলেন। # বাংলাদেশর মানুষের এক অদ্ভুত রকমের সহনশীলতা আছে। এরা শত কষ্টেও সইতে পারে, শত দুঃখেও হাসতে পারে। অনেক বড় আঘাত বুকে নিয়েও ভুলে যেতে পারে অতীতের সব কিছু। আর সেই ভুলে যেতে পারার জন্যই রাজাকারদের সংসদেও বসতে দিয়েছে, সৈরাচার অভ্যুত্থানের পরেও সেই সৈরাচারী শাসককেও আবার নির্বাচিত করেছে। কিন্তু কতকাল সহ্য করবে ? # পশ্চিমা লেখক রুডলফ স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি নামে একটি গবেষণামূলক বই লেখেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বইটি বেস্ট সেলার বই এর তালিকায় চলে যায়। এর মধ্যে আকস্মাৎ লেখকের মৃত্যূ হলে ময়না তদন্ত করে ডাক্তার সার্টিফিকেট দেন। তাতে মৃত্যুর কারণ দেখানো হয় পুষ্টিহীনতা। এ খবর প্রচার হলে পরের সপ্তাহেই বই এর বিক্র বেস্ট সেলার থেকে ওর্স্ট সেলারে নেমে আসে। # মেঝ মেয়ে শিলা সম্পর্কে হুমায়ূনআহাম্মেদ লিখেছিলেন -তখন শীলার বয়স বারো কিংবা তেরো। সবাইকে নিয়ে লসএনজেলস গিয়েছি। হোটেলে ওঠার সামর্থ্য নেই। বন্ধুফজলুল আলমের বাসায় উঠি। আমি ক্যাম্পিং পছন্দ করি ফজলু জানে। সে বনে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করল। আমরা জঙ্গলে এক রাত কাটাতে গেলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। তাঁবুর ভেতর জড়োসড়ো হয়ে শুয়েআছি। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। দেখি, শীলা বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা, কি হয়েছে? শিলা জানায়, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। আমি বুঝলাম, এই মেয়ের কঠিন ক্লস্টোফোবিয়া। আসলেই সে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি বললাম, গরম কাপড় পরো। তাঁবুর বাইরে বসে থাকব। সে বলল, একা একা থাকতে পারব না। ভয় লাগে। কিছুক্ষণ একা থাকতে গিয়েছিলাম। আমি বললাম, আমি সারা রাত তোমার পাশে থাকব। এক পর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাল শিলা । সকাল হলো। মেয়ের ঘুম ভাঙল। সে বলল, বাবা, তুমি একজন ভাল মানুষ। # ১৩ একটি প্রাইম নাম্বার, যার অবস্থান ৬ষ্ঠ।যেমনঃ ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ।১৩ হচ্ছে একমাত্র প্রাইম নাম্বার যা কিনা দুটি ক্রমিক প্রাইম নাম্বার এর বর্গের যোগফল।যেমনঃ (২^২ + ৩^২) = ১৩ ।১৩ কে ১ থেকে ১৩ পর্যন্ত সকল প্রাইম নাম্বার দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগশেষ গুলি পাওয়া যায় তার যোগফল কত হতে পারে বলুন তো?যদি ১৩ থেকে ১ পর্যন্ত সংখ্যাগুলির কিউব (cube) পরপর পাশাপাশি লিখে যাওয়া হয় তাহলে যে বিশাল সংখ্যাটি পাওয়া যায় তা একটি প্রাইম নাম্বার হবে। # সবাই জানে, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সিগারেটের প্যাকেটের গায়েও বেশ বড় বড় করে লেখা থাকে “ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ”। কিন্তু তারপরও ধূমপায়ীরা এই সিগারেটের নেশাটা ছাড়তে পারেন না। সিগারেটে একবার টান দেওয়ামাত্রই প্রচুর পরিমাণ নিকোটিন মুহূর্তের মধ্যেই মস্তিস্কে ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু করে। নিকোটিনের অনুগুলো মস্তিস্কের রিসেপটরগুলোকে আঁকড়ে ধরে এবং ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটায়। যার ফলে ধূমপায়ীরা একটা সূখানুভূতি পেতে শুরু করে।
false
hm
মিডিয়াহাউসের মিডিয়াহাউশ বেশ কিছুদিন ধরেই কখনো জোরেসোরে, কখনো ফিসফিস করে একটা কথা বেশ চলছে, ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন করা জরুরি। প্রস্তাবটি কৌতূহলোদ্দীপক, এবং প্রস্তাবকদের নামগুলোকে এক সারিতে রেখে দেখলে, আমোদপ্রদও বটে। প্রস্তাবটি যাদের মুখ থেকে জোরেসোরে বেরোচ্ছে, তারা মূলত কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অথবা বেতনভূক কর্মী। তারা সভা-সেমিনারে ব্লগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছেন রাজনীতিকদের উদ্দেশে। তাদের সাথে থেকে কিছুটা নিচু গলায় সমর্থন জানাচ্ছেন কতিপয় বুদ্ধিজীবী নামযশোপ্রার্থী, যারা নিজেদের ব্লগ-বিশেষজ্ঞ বা সামাজিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রসাদ পান। আর নীরব সমর্থনের কাজটি করে যাচ্ছে এই ইস্যুতে নাম জড়াতে অনাগ্রহী কয়েকটি মিডিয়াদানব। আর আবদারগুলো ভেসে উঠছে ব্লগারদের নামে। একটি মিডিয়ারচিত চিত্রনাট্যে নাম ভূমিকায় কিছু ব্লগার অভিনয় করে যাচ্ছেন, যাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা দুনিয়ার তাবৎ বাংলা ব্লগারের মুখপাত্র। ব্লগিং এমনই এক মাধ্যম, যেখানে আসলে মুখপাত্রের প্রয়োজন নেই। ব্লগারদের দাবিদাওয়াগুলো তাদের লেখাতেই ফুটে ওঠে সাধারণত। ব্লগাররা নানা ইস্যুতে নানা দাবি আর আবদার তুলে ধরলেও বাংলা ব্লগে "ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন"-এর দাবি নিয়ে আমব্লগাররা সোচ্চার, এমন দৃশ্য দুর্লভ। গুটিকয়েক ব্লগার, যারা এই কিছু প্রতিষ্ঠানের স্নেহধন্য বা কৃপাধন্য বা মজুরিধন্য, তারাই মালিকের বেসুরো গলার সাথে সারিন্দা বাজাচ্ছেন। মালিক নিজের মিডিয়ায় এদের পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন বাংলা ব্লগের মুখপাত্র হিসেবে। যেন যে কয়েক হাজার লোক ব্লগিং করেন, তাদের চাপেই এরা এই দাবি তুলে ধরছেন, এমন একটা ভাব। কিন্তু ব্লগ-ফেসবুক-টুইটার তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে মিডিয়াহাউসগুলো কেন তাদের পোষ্য ব্লগারদের মাঠে নামিয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের জন্যে সারিন্দাবাদনে লিপ্ত? বাংলাভাষী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তারা নানা দুর্বলতার পরও মানুষকে এক অভূতপূর্ব ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতা মত প্রকাশের ক্ষমতা। এর অপপ্রয়োগের ছড়াছড়ি যেমন আছে, তেমনই আছে এর সঠিক প্রয়োগও। সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মাধ্যম এতদিন মানুষের এই মতের বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করতো, এবং তাদের সম্পাদনার কাঁচির সাইজে মানুষের মতজলবায়ু মানুষের সামনে তুলে ধরতো। এই মতজলবায়ুতে মতের বর্ণালী করুণভাবে সংকীর্ণ, যেখানে সাধারণ মানুষ যে কোনো ইস্যুকেই নানাদিক থেকে দেখতে ও ব্যবচ্ছেদ করতে আগ্রহী। ব্লগ বা ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ তার নিজের মতটি তুলে ধরতে আর সেটি নিয়ে তর্ক করতে পারে এখন। এটি শুধু তার সক্ষমতাই নয়, অধিকারও বটে। ভৌত গঠনবৈভিন্ন্যের কারণেই সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষের বহু মত ধারণে অসমর্থ। এই অসামর্থ্যের সাথে যোগ হয় তাদের রাজনৈতিক অভিলাষতাড়িত নিয়ন্ত্রণাকাঙ্খা, ব্যবসায়ী মনোভঙ্গিতাড়িত কাঁচিকৌশল আর কর্মীদের মেধার দীনতা। ফলে যে কোনো ইস্যুতে মানুষ সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে কাঁচা সংবাদ সংগ্রহ করলেও, পাশাপাশি নিজের মতটিও তুলে ধরে। সেই মতটি ক্ষমতাবানের জন্যে মাঝেমধ্যেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানের মন যুগিয়ে মত প্রকাশ করে না। সে তা-ই বলে, যা সে বলতে চায়। তার এই বলতে চাওয়ার পটপত্তন হিসেবে ব্লগ নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তার বক্তব্যে ত্রুটি থাকলে তার লেখার নিচে তর্কের মাঠে অন্যেরা সেই ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, তর্ক হয়, কলহ হয়, কিন্তু লড়াইটি হয় যুক্তির, তথ্যসূত্রসহ। উপরন্তু ব্লগ এখন মিডিয়ার ত্রুটিনির্দেশের কাজেও পক্ক হয়ে উঠেছে। মিডিয়ার রাজনৈতিক আর ব্যবসায়িক ক্ষমতা শুধু প্রকাশে নয়, অপ্রকাশেও। মিডিয়া যখন ভুল কথা বলে, ব্লগে তার প্রতিবাদে আমরা সত্য উঠে আসতে দেখি। মিডিয়া যখন ঠিক কথা চেপে যায়, সেটিও ব্লগে উঠে আসে। তাই ক্ষমতাবানের সাথে মতপ্রকাশ ও মতগোপনের বাজারে মিডিয়াহাউসের দরকষাকষির সুযোগ সীমিত আকারে হলেও কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। সময়ের সাথে ব্লগ আরো শক্তিশালী হবে, তখন এই দরকষাকষির সুযোগ আরো বাধাগ্রস্ত হবে। তাই সময় থাকতেই মিডিয়াহাউসগুলো "ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন" প্রণয়নে চাপ দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। আমরা কৌতূহল নিয়ে দেখি, প্রচলিত মিডিয়া (সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম) নতুন মিডিয়ার (ব্লগ-ফেসবুক-টুইটার) পৃথক সত্ত্বাটিকে স্বীকার করে, কিন্তু পৃথক চরিত্রকে নয়। তারা নতুন মিডিয়াকে দেখতে চায় প্রচলিত মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে, অথবা নখদন্তহীন হিসেবে। ব্লগ নিয়ন্ত্রণে তারা আইন চায়, তাহলে সংবাদ নিয়ন্ত্রণে আইন চায় না কেন? আমি প্রশ্ন করতে পারি, ব্লগকে কেন সংবাদপত্রের মতো হতে হবে? আইন ক্ষমতাবানকে রাষ্ট্রের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজের স্বার্থানুগ ক্ষমতাচর্চার সুযোগ করে দেয় বহু ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে আইন প্রয়োগ ও আইন তর্কের মঞ্চে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ভীতিপ্রদভাবে সীমিত। তাই সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের একটি মাধ্যমকে বিকশিত হয়ে ওঠার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, একযোগে রাজনৈতিক শক্তি ও মিডিয়াশক্তি সেটিকে লাগাম পরাতে অস্থির হয়ে উঠেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাধারণ মানুষের মতনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এরা এক অক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভও তার বাকি তিনটি স্তম্ভের মতো সাধারণ মানুষের স্বার্থ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধিতে আগ্রহী। ক্ষমতাসীন রাজনীতিক তার রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে মিডিয়াহাউসের সাথে দর কষাকষি করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে নয়। কার সঙ্গে আপোষ বা চুক্তি করবেন আপনি, যখন প্রতিটি কণ্ঠই আলাদা মানুষের? তাদের কোনো একক নেতা নেই, মুখপাত্র নেই, যাকে পিটিয়ে বা বশে এনে বাকি মুখগুলো বন্ধ করা যাবে। যখন বহু কণ্ঠ উচ্চকিত, তখন ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাবানের সাথে দরকষাকষিতে আগ্রহী মুৎসুদ্দি মিডিয়া এই বহু কণ্ঠের মুখে নিজের কথা গুঁজে দিতে চায়। ব্লগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি আর মিডিয়াশক্তির নড়াচড়া মূলত সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে সমরেখ অবস্থানে আসার নামান্তর। ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণীত হলে মতপ্রকাশের বাজারটিও তার দখলেই যায়, যার আইনের হাতের সাথে করমর্দন করার কিংবা সেই হাতের সাথে পাঞ্জা লড়ার আর্থিক সঙ্গতি আছে। সাধারণ মানুষের দুর্বলতাও ওখানেই, তার মত আছে, কিন্তু সেই মতকে সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্রের সাথে লড়ার হিম্মত নেই। এ কথা রাজনীতিকরা জানে, জানে মিডিয়াহাউসও। তাই সাধারণ মানুষের সাথে লড়তে গিয়ে তারা শুরুতেই আঘাতটা করতে চায় সেই দুর্বল গোড়ালির ওপর। মানুষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে ও চায়, মিডিয়াহাউসেরও তোয়াক্কা করে না, কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সে অসহায়। তাই রাজনীতিক ও মিডিয়াহাউসের অভিন্ন স্বার্থকে রাষ্ট্রের স্বার্থ হিসেবে হাজির করতে পারলে তাদের স্বার্থ রক্ষার কাজটি রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া যায়। ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন তাই মূলত সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের প্রবল চেহারাটির মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা। [এই লেখাটিতে আরো কিছু অংশ যোগ হবে, তথ্যসূত্রসহ। আপাতত আলোচনা চলুক।]
false
rn
কৃষ্ণ একবার কৃষ্ণ রাধার অজ্ঞাতে বিরজা নামক এক গোপীর সাথে মিলিত হন। দূতীদের মুখে রাধা এই সংবাদ পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য অগ্রসর হলে- সুদামা কৃষ্ণকে উক্ত সংবাদ দেন। কৃষ্ণ এই সংবাদ পেয়ে বিরজাকে ত্যাগ করে অন্তর্হিত হন। বিরজা এই দুখে প্রাণত্যাগ করে নদীরূপে প্রবাহিত হন। রাধা পরে কৃষ্ণের দেখা পেয়ে তাঁকে তীব্রভাবে ভৎর্‍সনা করলে- সুদামা তা সহ্য করতে না পেরে-রাধাকে তিরস্কার করেন। রাধা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুদামাকে অসুর হয়ে জন্মনোর অভিশাপ দেন। সুদামাও ক্ষুব্ধ হয়ে রাধাকে গোপী হয়ে পৃথিবীতে জন্মানোর অভিশাপ দিয়ে বলেন যে- সহস্র বত্সর কৃষ্ণবিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর তিনি পৃথিবীতে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হবেন। শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নিষ্টুরভাবে শরীর ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় এবং সারা রাতভর যৌন নিপীড়নের কারণে প্রভাতকালে দেখা গেল রাধিকার পরিহিত বস্ত্র এত বেশী রক্ত রঞ্জিত হয়ে পড়েছে যে, লোক লজ্জায় রাধিকা ঘরের বাইরে আসতে পারছেন না। তখন শ্রীকৃষ্ণ দোল পুজার ঘোষনা দিয়ে হোলি খেলার আদেশ দেন। সবাই সবাইকে রঙ দ্বারা রঞ্জিত করতে শুরু করে। তাতে রাধিকার বস্ত্রে রক্তের দাগ রঙের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। সেই থেকে হোলি খেলার প্রচলন শুরু হয়।কৃষ্ণ একজন হিন্দু আরাধ্য অবতার। (হিন্দুধর্মে অবতার বলতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে বোঝায়।)এই ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষ্ণের পূজা করে থাকে।কৃষ্ণধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিতে তাঁকে স্বয়ং ভগবান বা সর্বোচ্চ ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়।কৃষ্ণ-সংক্রান্ত উপাখ্যানগুলি মূলত লিখিত আছে মহাভারত, হরিবংশ, ভাগবত পুরাণ ও বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থে। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতেই দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে কৃষ্ণের কোনো উল্লেখ নেই। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কোনো প্রকার যৌনসংগম ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র "মানসিক যোগের" ফলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সেযুগে এই ধরনের যোগ সম্ভব ছিল। কৃষ্ণের মূর্তিগুলিতে তাঁর গায়ের রং সাধারণত কালো এবং ছবিগুলিতে নীল দেখানো হয়ে থাকে।বিষ্ণু সহস্রনামের ৫৭তম নামটি হল কৃষ্ণ ।কৃষ্ণের প্রচলিত মূর্তিগুলিতে সাধারণত তাঁকে বংশীবাদনরত এক বালক বা যুবকের বেশে দেখা যায়।একাধিক পুরাণে কৃষ্ণের জীবনকাহিনি বর্ণিত হয়েছে বা তার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ভাগবত পুরাণ ও বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থদ্বয়ে কৃষ্ণের জীবনের সর্বাপেক্ষা বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।কৃষ্ণের জন্মদিনটি কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বা জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, প্রথাগত বৈদিক ধর্ম ও তার দেবদেবীর বিরুদ্ধে কৃষ্ণের এই অবস্থান, আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে ওঠে। কৃষ্ণ ছিলেন প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ এবং মহাভারতের যুদ্ধ ও তার পরিণতিতে তাঁর প্রগাঢ় প্রভাব ছিল।কৃষ্ণের মোট ১৬১০৮ জন স্ত্রী ছিলেন যাদের মধ্যে আটজন ছিলেন তাঁর প্রধান মহিষী এবং বাকি ১৬১০০ জন ছিলেন নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধার হওয়া রমণীকুল।কৃষ্ণের পূজা হল বৈষ্ণব ধর্মের একটি অঙ্গ। বৈষ্ণব ধর্ম অনুসারে দেবতা বিষ্ণুকে পরমেশ্বর জ্ঞান করা হয়ে থাকে এবং তাঁর অন্যান্য অবতারসমূহ, তাঁদের পত্নী এবং তৎসম্বন্ধীয় গুরু ও সাধকদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হবে বলরাম, এর প্রতীক সাদা চুল। কৃষ্ণ অসংখ্য নামে খ্যাত হয়েছিলেন। এই নামগুলির মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম এখানে তুলে ধরা হলো- অঘনাশন, অচ্যুত, অনঙ্গমোহন, অনন্ত, অরিমর্দন, অরিষ্টমথন, অরিষ্টসূদন, অহিমার, অহিরিপু, কংসহা, কংসারি, কানাই, কানু, কালা, কালাচাঁদ, কালিয়া, কালীয়দমন, কালোশশী, কৃষ্ণ, কেশব, কেশিমথন, কেশিসূদন, কেষ্ট, গদাধর, গিরিধর, গিরিধারী, গোকুলনাথ, গোকুলপতি, গোকুলেশ্বর, গোপবল্লভ, গোপাল, গোপিকামোহন, গোপিকারমণ, গোপিনীবল্লভ, গোপীজনবল্লভ, গোপীনাথ, গোপীমোহন, গোপ্রে, গোবর্ধনধারী, গোবিন্দ, গোষ্ঠপতি, গোষ্ঠবিহারী, ঘনশ্যাম, জনার্দন, ত্রিভঙ্গ, ত্রিভঙ্গমুরারি, দর্পহারী, দামোদর, দেবকীনন্দন, দ্বারিকাপতি, নগধর, নটবর, ননীচোরা, নন্দদুলাল, নরনারায়ণ, নারায়ণ, নরোত্তম, নীলমণি, নীলমাধব, পদ্মঁখি, পাণ্ডবসখ, পাণ্ডবসখা, পার্থসারথী, পুণ্ডরীকাক্ষ, পীতবাস, পীতাম্বর, প্যারীমোহন, বংশীধর, বংশীধারী, বংশীবদন, বংশীবাদন, বনবিহারী, বনমালী, বনোয়ারি, বনোয়ারী, বহুবল্লভ, বালগোপাল, বাসুদেব, বিপিনবিহারী, বিশ্বম্ভর, বৃন্দাবনেশ্বর, বৃষ্ণি, ব্রজকিশোর, ব্রজদুলাল, ব্রজনারায়ণ, ব্রজবল্লভ, ব্রজমোহন, ব্রজরাজ, ব্রজসুন্দর, ব্রজেশ, ব্রজ্রে, বলানুজ, মথুরাপতি, মথুরেশ, মদনগোপাল, মদনমোহন, মধুসূদন, মাধব, মুকুন্দ, মুরলীধর, মুরলীমোহন, মুরারি, যজ্ঞেশ, যদুকুলনাথ, যশোদাদুলাল, যশোদানন্দন, যদুকুলপতি, যাদব, রসরাজ, রাখালরাজ, রাধাকান্ত, রাধানাথ, রাধাবল্লভ, রাধামাধব, রাধারঞ্জন, রাধারমণ, রাধিকামোহন, রাধিকারঞ্জন, রাধিকারমণ, রাসবিহারী, রাসেশ্বর, শকটারি, শৌরি, শ্যাম, শ্যামচন্দ্র, শ্যামচাঁদ, শ্যামরায়, শ্যামসুন্দর, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীগোবিন্দ,হরি, হৃষীকেশ।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে বর্ণিত আছে। একদা যুধিষ্ঠির মহারাজ-ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন। হে কৃষ্ণ! এই ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষীয়া একাদশীর নাম কি? এই ব্রত পালনের ফল কি? শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই ব্রত পূণ্য ফল প্রদায়িনী, স্বর্গ ও মোক্ষদায়িনী- এর মাহাত্ম্য শ্রবণে সকল পাপ বিনষ্ট হয়। এই একাদশীকে পার্শ্বেকাদশী বলা হয়। আবার এই একাদশীকে জয়ন্তী একাদশী বলা হয়। যিনি এই তিথিতে ভক্তিভরে শ্রীবামন ভগবানের পূজা করেন তিনি ত্রিলোকে পূজা পান। যিনি, কমলনয়ন কমলনয়ন শ্রীবিষ্ণুর পূজা, কমল দ্বারা করেন, তিনি নিসন্দেহে ভগবানের সমীপে গমন করেন। যে পূণ্য এই ব্রতে লাভ হয়, তাহা বাজপেয় যজ্ঞেও লাভ হয় না। এই একাদশীতে শায়িত ভগবান-অনন্ত শয্যায় পার্শ্ব পরিবর্তন করেন। বাম অঙ্গ থেকে দক্ষিণ অঙ্গে শয়ন করেন তাই এই একাদশীকে পরিবর্তিনী একদশীও বলা হয়। যুধিষ্ঠির মহারাজ বললেন, হে জনার্দন। এই সকল কথা শুনে আমার বড় সন্দেহ হয়, আপনি কিরূপে শয়ন করেন আবার কিরূপেই বা পার্শ্ব পরিবর্তন করেন। চাতুর্মাস্য ব্রত কারীর কি বিধান, আপনার শয়নকালে লোকে তখন কি করে? আপনি বলিমহারাজকে কিজন্য নাগপাশে বেধেছিলেন? হে প্রভো! এই সকল বিষয় কৃপা পূর্বক আমাকে বলুন।“জম্ম-মৃত্যু-সৃষ্টি-প্রলয় তোমার মর্জিতে সব কিছু হয় তুমি প্রভু, তুমি মহান, বৃ-পুষ্প তোমার অবদান”
false
ij
গল্প_ পাপ ও প্রণয়ের উপাখ্যান বৈদিক যুগের প্রাচীন ভারতের অবন্তী রাজ্যের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী নগর । নগরটি স্বচ্ছতোয়া বেত্রাবতী নদীর তীরে গড়িয়া উঠিয়াছিল । তৎকালীন যুগে বেত্রাবতী নদীর দক্ষিণ তীরে সুবিশাল এক আম্রকুঞ্জ ছিল; তাহার অভ্যন্তরে উজ্জয়িনী নগরের ধনিক শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর শ্বেতপাথরের প্রকান্ড অট্টালিকা। অসংখ্য সুসজ্জ্বিত কক্ষ, অলংকৃত অলিন্দ, সিঁড়ি ও স্তম্ভ সম্বলিত অট্টালিকাটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। অহোরাত্র অট্টালিকাময় অসংখ্য দাসদাসী ব্যস্তসমস্ত হইয়া ছুটিতেছে; বর্হিদ্বারের সম্মুখে গম্ভীরদর্শন প্রহরী বলরাম কৃপাণ লইয়া সর্বক্ষণ আরক্ত চক্ষে দাঁড়াইয়া আছে, প্রস্তরময় অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গনে বলিষ্ট শ্বেতবর্ণের অশ্ব সংযুক্ত ঝলমলে রথ, তাহার সম্মুখে সুবেশী সারথী- সারথীর নাম স্মারক এবং (এক্ষণে বলিয়া রাখিতেছি যে অন্তরালে থাকিয়া সারথী স্মারক এই উপাখ্যানে নির্ধারক এক ভূমিকা পালন করিবে। ) শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর মধ্যবয়েসী স্ত্রীটি অত্যন্ত পৃথলা। তাহার নাম চন্দনবালা; অতি ধর্মশীলা চন্দনবালা প্রত্যহ ধ্যান-দান করেন, পূজা-অর্চনা করেন; নিয়মিত তীর্থ দর্শনে যাইতে না পারিলেও ধবল পূর্ণিমার তিথিতে পূণ্যবতী বেত্রাবতীর স্বচ্ছতোয়া জলে অবগাহন করিয়া সংসারক্লিষ্ট শোকতাপ হরণ করেন, ধর্মীয় কৃত্যাদি পালন করেন। শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার একটি পুত্র ও একটি কন্যা। শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র বৃদ্ধ হইয়াছেন, তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্ত সম্প্রতি শ্রেষ্ঠীর আসনে আসীন হইয়াছে। অত্যন্ত করিৎকর্ম যুবক সে-অর্থশাস্ত্রের কূটকৌশল প্রয়োগ করিয়া পৈত্রিক ধন ও ধান্য যৎপরনাস্তি বৃদ্ধি করিয়া চলিয়াছে। শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার কন্যার নাম পূর্ণা । এবং এই উপাখ্যানটি তাহাকে লইয়াই। দীর্ঘাঙ্গি, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা পূর্ণা অত্যন্ত রুপবতী। তাহার দেহতনুটি নম্র এবং অনন্ত যৌবন লাবণ্যে সমস্তক্ষণ উচ্ছ্বলিত হইয়া থাকে । পূর্ণা যুগপৎ গুণবতীও বটে- আর এই কারণেই পূর্ণা আজও অনূঢ়া রহিয়া গেল কিনা এই লইয়া অবন্তী রাজ্যে কানাঘুঁষা চলিতেছে। অবন্তী রাজ্যে পূর্ণার যোগ্য পাত্র কোথায়? যাহা হউক। পূর্ণা কী এক অজ্ঞাত কারণে বিবাহের সকল প্রস্তাব ফিরাইয়া দেয়। এই কারণে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার দুশ্চিন্তার অন্ত নাই। বিবাহযোগ্যা কন্যার দায় লইয়া তাহাদের উদ্বেগময় দিন ও নির্ঘূম রাত্রি অতিবাহিত হইতেছে। দিন কতক হইল এক অরুণ কান্তি তরুণ যোগী আসিয়া বেত্রাবতীর তীরের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিয়াছে। তরুণটির পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণ পথিকের ন্যায় হইলেও তাহার আচারআচরণ সন্ন্যাসীর মতোই বটে। সুদর্শন তরুণটি নির্জন আম্রকুঞ্জে পদ্মাসনে বসিয়া যোগসাধনা করে। শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর স্ত্রী চন্দনবালা সে সংবাদ শুনিয়াছেন। তিনি চঞ্চল হইয়া উঠিয়া দাসী মল্লি¬কার মাধ্যমে প্রত্যহ রুপার থালায় তরুণের নিকটে দুধ, ফলমূলাদি ও মিষ্টান্ন পাঠাইয়া দেন। তরুণটি কৃতজ্ঞ হইয়া কিছু খায়, কিছু-বাঅভূক্ত পড়িয়া থাকে। একদিন প্রভাতে সবার অলক্ষে চন্দনবালা স্বয়ং তরুণ সমীপে উপস্থিত হইয়া শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া আসিয়াছে। সে তাহার কন্যাসম্পর্কিত যাবতীয় দুশ্চিন্তার কথা জানাইয়া আসিয়াছে। চন্দনবালাকে ‘মা’ বলিয়া সম্বধন করিয়া তরুণ পূর্ণা-সমস্যার আশু নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে বলিয়া অভয় দিয়াছে। পূর্ণাও আম্রকুঞ্জের নবাগত তরুণের যোগসাধনার কথা শুনিয়াছে। সে কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছে। নব্যসন্ন্যাসীর নিষ্কাম ধ্যানের কারণে পূর্ণার মনে কৌতূহলে উদ্রেক ঘটিয়াছিল। পূর্ণা ঠিক করিল সে তরুণ সন্ন্যাসীর নিকটে যাইবে এবং জিজ্ঞাসা করিবে নিষ্কাম হইয়া থাকা সম্ভব কি না। কেননা কামের বশেই যে নারী কূলটা হয়, দ্বিচারিণী হয়; সমাজের ধিক্কার লাভ করে। পূর্ণাও অবন্তী রাজ্যে শ্রেষ্ঠী পিতার সম্মান ধূলায় লুটাইতে বসিয়াছে-নবাগত তরুণ নিষ্কাম সন্ন্যাসব্রত লইয়া থাকে কি করিয়া। এই সমস্ত ভাবিয়া সে বিষম অস্থির হইয়া উঠিয়া। রাত্রি নির্জন হইলে পূর্ণা সকলের চক্ষু ফাঁকি দিয়া ঘুমন্ত অট্টালিকা হইতে নামিয়া আসিয়া আম্রকুঞ্জের দিকে যাইতে লাগিল। তাহার বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিবার আবশ্যক ছিল না, কেননা রাত্রীকালীন অভিসার তাহার পক্ষে নূতন কিছু নয় । রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে সারথী স্মারক সোমরসে সিদ্ধি মিশাইয়া দ্বারপাল বলরাম কে তাহা পান করাইয়া তাহাকে অচেতন করিয়া দেয়। তাহার পর পূর্ণার সহিত আম্রবনের অভ্যন্তরে একটি পরিত্যক্ত ভাঙা দেউলে মিলিত হইয়া প্রণয়ে লিপ্ত হয়। বৎসর খানেক হইল এইরূপ দুই অসম পক্ষের গোপন প্রণয় চলিতেছে। ঘটনাটি শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র কিংবা তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্তর কানে না পৌঁছাইলেও তাহা লইয়া প্রাসাদের নারীসমাজে নিষিদ্ধ প্রণয় লইয়া কানাঘুঁষা চলে। চন্দনবালা নিভৃতে কান্নাকাটি করিয়া অস্থির, অথচ, স্বামী কিংবা পুত্রকে সব কথা খুলিয়া বলিয়া সারথী স্মারক কে যে তাড়াইয়া দিবে- সে সাহস চন্দনবালার নাই। পূর্ণা শুষ্ক আম্রপত্র পায়ে দলিয়া মুচকি হাসিয়া নূতন এক অভিসারে যাইতেছিল। আষাঢ় মাস। তথাপি আকাশে মেঘ জমিয়া ছিল না, বরং আকাশ পূর্ণিমার আলোয় অতিশয় উজ্জ্বল হইয়া ছিল। বেত্রাবতীর জলে সিক্ত হইয়া আম্রকুঞ্জে মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছিল, পাতার সরসর শব্দ হইতেছিল, পাতার আড়াল হইতে কী এক পাখির পাখসাটের শব্দ পাওয়া যাইতেছিল। পূর্ণা লঘু পায়ে হাঁটিয়া আসিয়া ধ্যানমগ্ন তরুণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল । বনপুষ্পের সুগন্ধ তীব্র হইয়া উঠিল। তরুণ চোখ মেলিল, তরুণীকে দেখিল; পূর্ণিমার আলোয় পূর্ণার দীর্ঘাঙ্গী তনুটি তাহার মনে পরম বিস্ময়ের সৃষ্টি করিল। পূর্ণা বলিল, আমি পূর্ণশ্রী। বলিয়া খানিকক্ষণ নীরব থাকে।তাহার পর নীরবতা ভাঙিয়া আপনমনে বলে, কেহ কেহ আমাকে পূর্বা বলিয়াও ডাকে। তবে আমি মনে মনে আমার একখানি নাম দিয়াছি। অঞ্জনা। তরুণ খানিকক্ষণ নীরব থাকে। অঞ্জনা তাহার এক নিকট আত্বীয়ার নাম, যাহাকে ফেলিয়া সে গৃহিত্যাগ করিয়াছে। তরুণ অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেলিল, পূর্ণশ্রী তাহা জানিতে পারিল না। আম্রকুঞ্জটি বেত্রবতী নদীর পাশে বলিয়া অকস্মাৎ ছুটিয়া আসা বাতাসে পত্রালি বিশ্রস্ত হইয়া উঠিল। আম্রকাননময় আষাঢ়ী রাত্রির পারদ রঙা আলোক আরও গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে। পত্রালির আড়াল হইতে একখানি ঘুমহীন পুরুষ ময়ূর উড়াল দেয়, একখানি ক্ষুধার্ত খরগোশ সহসা আমলকীর গন্ধে সচকিত হইয়া উঠে। নিকটস্থ হরীতকী গাছের শীর্ষডালে একখানি নির্লিপ্ত প্যাঁচা বসিয়া পূর্ণাদের দেখিতেছে। তুমি আমার নিকট কেন আসিয়াছ? তরুণের কন্ঠস্বর ক্ষাণিক রুক্ষ ঠেকিল। পূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, আমি তোমার ধ্যান ভাঙিব বলিয়া আসিয়াছি। এই ক্ষণে তরুণ সামান্য বিচলিত হইয়া উঠিল। এই নিরিবিলি আম্রকাননটি তাহার ভারি পছন্দ হইয়াছে। উপরোন্ত, জীব আহার ব্যতীত টিকিয়া থাকিতে পারে না। শ্রেষ্ঠীর সহৃদয়া স্ত্রী প্রত্যহ তাহার আহারের ব্যবস্থা করেন। এইখানে সুন্দরী তরুণী আসিয়াছে, সে বারংবার আসিবে; পরিশেষে সঙ্কট তৈরি করিবে। আম্রকুঞ্জের নিরিবিলি সাধনার স্থানটি আর নির্জন হইয়া থাকিবে না। তাহাকে এখান হইতে চলিয়া যাইতে হইবে। এইসব ভাবিয়া তরুণ বিষন্ন বোধ করিল। তথাপি সে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমার ধ্যান ভাঙ্গাইবে কেন? তুমি অহোরাত্র ধ্যান করিলে আমার ঈর্ষা হয় যে। কেন? আমি ধ্যান করিলে তোমার ঈর্ষা হইবে? তুমি ধ্যান লইয়া থাক, সংসারের প্রেম লইয়া থাক না। সন্ন্যাসী তো ধ্যান লইয়াই থাকিবে। কেন? সে কি পুরুষ নয়? পুরুষ ঠিকই - তবে সে জিতেন্দ্রিয়। সন্ন্যাসী যোগবলে আপন ইন্দ্রিয়াদি জয় করিতে পারে। পূর্ণা শ্বাস টানিল। তাহার পর কহিল, আমি এই কথাটিই বুঝিতে চাই। পুরুষ কি করিয়া জিতেন্দ্রিয় হইতে পারে-তাহার কামাগ্নি হইতে সংসারের নিষ্পাপ বালিকাগনও বাঁচিতে পারে না। বলিতে বলিতে পূর্ণা বাকরুদ্ধ হইয়া আসিল। বুঝিবা তাহার বালিকাবেলার কোনও ঘটনা স্মরণ হয়; সম্ভবত সে পিতার অট্টালিকাটি ঘৃনা করে। অট্টালিকাটি একদিন সে আগুনে পোড়াইয়া দিবে, ভন্ড পুরুষের মুখোশ সে উম্মোচন করিয়া দিবে। নব্যসন্ন্যাসী তরুণ হইলেও সংসারাভিক্ত। সে পূর্ণশ্রীর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অনুমান করিতে । তাহার হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হয়। সহসা সে ঈষৎ অস্থির হইয়া উঠিয়া বলিল, পুরুষের কামাগ্নি হইতে সংসারের নিষ্পাপ বালিকাগনও বাঁচিতে পারে না বটে তবে ইহাই শেষ কথা নয়। আর্যাবর্ত্মের নানা স্থানে নিষ্পাপ বালিকাগনকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করা হয়। এই আরাধনার অধিকাংশই পুরুষের কৃত্য। বুঝিলাম। পূর্ণা বলিল। তোমার নাম জানিতে পারি কি? আমার নাম রজত। কী সুন্দর নাম। কে রাখিয়াছে? আমার মা। তোমার মায়ের নাম? অন্নপূর্ণা। তিনি বাঁচিয়া আছেন কি? না। নাই। রজত মাথা নাড়িয়া কহিল । ওহ্ , তোমার মাতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে? রজত মাথা নাড়িল। ইহাই কি তোমার সংসারত্যাগের কারণ? রজত নিশ্চুপ হইয়া থাকে। এই ক্ষণে তাহার কত কথা যে মনে পড়িল। মৎস্য রাজ্যের রাজধানী বৈরাট নগরের উপান্তে তাহার জন্ম; পিতা সোমভট্ট ছিলেন সুবর্ণবণিক। তিনি রজতের বাল্যকালেই দেহ রাখিয়াছিলেন। রজতের মা অন্নপূর্না ছিলেন অত্যন্ত মমতাময়ী, বাল্যকাল হইতেই রজত ছিল আবেগপ্রবণ, খেয়ালি ও তাহার জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল প্রবল -সে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য জানিতে চায়। ইহা তাহার মা অন্নপূর্না জানিতেন। মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যু হইল- বড়দা সায়ন সংসারের দায়িত্ম লইল। সায়ন সম্পন্ন বণিক, সার্থবাহের দল লইয়া দূরদূরান্তে চলিয়া যায়; সায়ন-এর স্ত্রীর নাম অঞ্জনা-সুন্দরী, লাস্যময়ী; ...বানিজ্যকালে সায়ন দূর রাজ্যে থাকাকালীন শূন্য বাড়িতে অঞ্জনা তাহার রুপযৌবন লইয়া আগ্রাসী হইয়া উঠে। রজত যে তাহা উপভোগ করে নাই, তাহা নয়; উদ্দাম নারীর ঘাম-শরীর ছুঁইয়া তৃপ্তি মিটাইয়াছে -তবে শ্রীঘ্রই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে ...তাহার হৃদয়ে সুদূরের ডাক-তাহা সে জানিতে চায় ...সে বৎসর খানেক হইল সংসার ত্যাগ করিয়া পথিক সাজিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ...এই সমস্ত গূহ্যকথা সে পূণ্যশ্রীকে বলিতে পারে না। মাতৃবিয়োগের কারণে সংসার ত্যাগ করে নাই। তাহার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল-সে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য জানিতে চায়। রজত বলিল, আমি জানি কেন তুমি আমার ধ্যান ভাঙ্গাইতে চাও। কেন শুনি? রজত বয়েসে নবীন। এখনও পরিপূর্ণ অর্থে সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করে নাই। সে তাহার স্বল্পকালীন বাত্যজীবনে বৈশালীর এক সাধুর মুখে যাহা শুনিয়াছিল তাহাই পূর্ণাকে বলিল। বলিল, নারী পুরুষের ধ্যান ভাঙ্গাইতে চায়- কারণ যাহাতে পুরুষ ধ্যান করিয়া প্রকৃতির গূঢ় রহস্য না জানিতে পারের। প্রকৃতির কর্ত্রী হইলেন একজন নারীহৃদয়; প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তাহাকে ‘পরমমধ্যা’ বলা হইয়াছে। তিনি সহসা নিজেকে প্রকাশিত করিবেন না, পরমমধ্যা অন্তরালেই থাকিবেন। সংসারের নিরাসক্ত পুরুষ তাহাকে জানিতে চায়। সহসা নিজেকে প্রকাশিত করিবেন না। এই কারণে নারীহৃদয় ‘পরমমধ্যা’ নারী হইয়া নারীর অভ্যন্তরে বাস করিয়া মায়াজাল বিস্তার করিয়া ধ্যান ভাঙ্গাইতে চায়। ইহাকে লীলাতত্ত্ব বলে। পূর্ণা এইসব তত্ত্বাদি জানে না। তবে সে এই সমস্ত শুনিয়া কেমন অবশ বোধ করে, তাহার শরীর কাঁপিয়া উঠে- প্রাচীন একটি জ্যোস্নার বনে সে ঘামে ভিজিয়া যাইতে থাকে। নিকটস্থ বেত্রাবতী নদী হইতে শীতল বাতাস আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে। তাহার শীত শীত করে। সে বুঝিতে পারে প্রেম ও কাম বাদেও জগতে আরও অনেক বিষয়াদি বুঝিবার অপেক্ষায় আছে। পূর্ণার সহসা স্মরণ হইল সারথী স্মারক পূর্ণার সহিত মিলনের আকাঙ্খায় আম্রবনের গহীন অভ্যন্তরে একটি পরিত্যক্ত ভাঙা দেউলে অপেক্ষা করিয়া আছে। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে সে সোমরসে সিদ্ধি মিশাইয়া দ্বারপাল বলরাম কে তাহা পান করাইয়া অচেতন করিয়া রাখিবে। এই সমস্ত ভাবিয়া পূর্ণা শিহরিত হইয়া উঠিয়া পায়ে পায়ে ফিরিয়া যাইতে থাকে। পূর্ণা চলিয়া গেলে রজত দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। সে পূর্ণাকে যতই লীলাতত্ত্ব বোঝাক না কেন সে পূর্ণার রুপ যৌবন দেখিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। সে বুঝিতে পারিল সন্ন্যাসব্রত অত্যন্ত কঠিন, ইহার সবার ললাটের লিখন নয়। বস্তুত রজত এখনও পরিপূর্ন ভাবে সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করে নাই - জীবনের গভীর তাৎপর্য লইয়া একান্ত নির্জনে ভাবিতেছে মাত্র। পরের দিন প্রভাতে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর স্ত্রী চন্দনবালা রজতের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, বৎস, তুমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করিলেও বয়েসে আমার ছোট হইবে। হাঁ। রজত মাথা নাড়িল। চন্দনবালা বলিলেন, তোমার কাছে আমার একটি নিবেদন আছে। বলুন মা। চন্দনবালা বলিলেন, আমি তোমার ভিতরে এক প্রকার অস্থিরতা লক্ষ করিয়াছি। আমার কেন যেন মনে হয় সন্ন্যাসব্রত ঠিক তোমার জন্য নহে। রজত নীরব থাকে। চন্দনবালা বলিলেন, সন্ন্যাসব্রত তোমার জীবনের লক্ষ না হইলে তুমি গৃহীজীবনে ফিরিয়া যাইতে পার। তোমরা সুবর্ণবণিক। পারিবারিক ব্যবসায় ফিরিয়া গেলেও পার। রজত নীরব থাকে। চন্দনবালা এইবার অত্যন্ত আবেগমথিত কন্ঠে বলিলেন, আমি আমার কন্যাকে তোমার নিকট অর্পন করিতে চাই। এই বিষয়ে তোমার কি মত? এই কথায় রজতের হৃদয়খানি দুলিয়া উঠিল। সে প্রতূষ্যের নি®প্রাণ আলোকে গাছপালার ফাঁকে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর শ্বেতপাথরের দ্বিতল অট্টালিকাখানি এক পলক দেখিয়া নিল। গৃহহীন ছন্নছাড়ার জীবনে অত্যধিক কষ্ঠ। পক্ষান্তরে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর অট্টালিকাখানি অত্যন্ত মনোরম ও শীতল। সে অট্টালিকায় বাস করিলে পূর্ণশ্রীর প্রেম যেমন পাইবে, দাসী মল্লিকার সেবাও পাইবে। এই সমস্ত ভাবিয়া রজত বলিল, মা, আপনার কন্যা পূর্ণশ্রী কে আমি বিবাহ করিতে সম্মত আছি। কিন্তু- কিন্তু? শ্রেষ্ঠী সম্মত হইবেন তো? আমি অর্বাচিন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমার স্বামী অর্থব হইয়াছেন, তাহার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হইয়া গিয়াছে। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্ত এ সংসারে কর্তা। জয়ন্ত সস্ত্রীক শ্বশুরালয় বৈশালী গিয়াছে। মৎস্য রাজ্যের রাজধানী বৈরাট নগরের উচ্চবংশে তোমার জন্ম। তোমার পিতা সোমভট্ট ছিলেন সুবর্ণবণিক। সে বিবাহে আপত্তি করিবে না। সে উজ্জয়িনী ফিরিায়া আসিলে বিবাহের দিনক্ষণ স্থির করিব। রজত নীরব থাকিল। বিবাহ রাত্রের পূর্বেই পূর্না নিরুদিষ্ট হইল। তাহার পূর্বে একখানি পত্র লিখিয়া গিয়াছে। সে পত্রে পূর্ণা লিখিয়াছে, প্রত্যেকে আমায় রুপবতী বলিল, গুণবতী বলিল। প্রত্যেকে আমার রুপই দেখিল, গুণই দেখিল ... কিন্তু আমার মনের গভীরে যে গভীর সন্ন্যাস বাসা বাঁধিয়াছে তাহার বৃত্তান্ত কেহই লইল না। হায়, আমি সন্ন্যাস লইব, সন্ন্যাসিনী হইব। আমি গৃহত্যাগ করিলাম। পত্রের বৃত্তান্ত শুনিয়া চন্দনবালা চাপাস্বরে বলিলেন, পাষাণী পত্রেও ছলনা করিল। বলিয়া পুত্রের দিকে জ্বলন্ত চক্ষে চাহিলেন। যেন সমস্ত সর্বনাশ সেই করিয়াছে। জয়ন্ত গম্ভীর হইয়া থাকিল। শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র অশ্র“সিক্ত হইয়া ছিলেন, তিনি বলিলেন, হায়, কত সাধ ছিল আমৃত্যু কন্যার সান্নিধ্য পাইব। মানবের প্রকৃত সরূপ কে চিনিতে পারে? জয়ন্তর স্ত্রী সুমিত্রা দাসী মল্লিকার সহিত কী লইয়া কানাকানি করিল, হাসিল, কটাক্ষ করিয়া একে অন্যের দিকে চাহিল। সব শুনিয়া রজত অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িল। তাহার পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চন্দনবালা কে বলিল, মা, পূর্ণা সন্ন্যাস নিয়াছে। আর্যাবর্ত্মের পথে পথে ঘুরিতেছে। আমি পূর্ণার সন্ধানে চলিলাম। চন্দনবালা পাথর হইয়া ছিলেন। তিনি কোনওরুপ মন্তব্য করিলেন না। তিনি আপন ভাগ্যের কথা ভাবিতে ছিলেন। এইবার শ্রেষ্ঠী পরিবারের সৌভাগ্যের দীপটি নিভিয়া যাইবে। রজত বলিল, আমি পূর্ণাকে খুঁজিব। তাহাকে ফিরাইয়া লইয়া আসিব। চন্দনবালা নিরুত্তর রহিলেন। তথাপি রজত বলিল, মা, আপনি আমাকে আর্শীবাদ করুন। আমি পূর্ণার সন্ধানে যাইতেছি। বলিয়া রজত পূর্ণাকে খুঁজিতে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর অট্টালিকা ত্যাগ করিয়াছিল। তাহার পর হাজার বছর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। রজত কি পূর্ণাকে খুঁজিয়া পাইয়াছিল? এই উপাখ্যানের লেখক তাহা কিছুমাত্র বলিতে পারে না। তবে পূর্ণার নিরুদ্দেশ হইবার পরে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর রথের সারথী স্মারকও যে গা ঢাকা দিয়াছিল তাহা ফাঁস হইয়া পড়িয়াছিল ... উৎসর্গ: কবি শিরীষ ... সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:১৩
false
rg
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের হিরের আংটি ঋতুপর্ণ ঘোষ___Rest In Peace!!! রেজা ঘটক ভারতের প্রখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ আর নেই। ৪৯ বছর বয়সে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে সাতটায় দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে নিজের বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগে ভুগছিলেন তিনি। গত কাল রাতে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারদের মতে, ঘুমের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবই কলকাতায়। প্রথমে সাউথ পয়েন্ট স্কুল, পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে শিক্ষাজীবন শেষ করেন।বাবা ছিলেন চিত্রকর ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা। মাও ছিলেন চিত্রকর। পারিবারিক সংস্তৃতিমণ্ডলে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। ছোটদের জন্য তাঁর তৈরি প্রথম ছবি ‘হিরের আংটি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ওই একই বছর তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘১৯ শে এপ্রিল’-এর জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান। তারপর একের পর এক ‘দহন’, ‘বাড়িওয়ালি’, ‘অসুখ’, ‘উত্সব’, ‘চোখের বালি’-র মতো অনন্য সাধারণ সব ছবি তিনি চলচ্চিত্রের দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। ২০১২ সালে ‘আবহমান’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মোট ১২টি জাতীয় ও বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর অভিনীত তিনটি ছবি ‘আর একটি প্রেমের গল্প’, মেমোরিজ ইন মার্চ’ এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার এই ছবিগুলি এক দিকে পেয়েছিল দর্শকদের অকুন্ঠ প্রশংসা, অন্য দিকে কুড়িয়েছিল ফিল্ম সমালোচকদের বাহবা। বিজ্ঞাপনি ছবি দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রই নয়, টেলিভিশনের উপস্থাপক হিসেবেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখারও বহু গুণমুগ্ধ ভক্ত রয়েছেন। তাঁর মনন ও চিন্তা জগতের অনেকটাই জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বেশ কয়েকটি ছবি তিনি কবিগুরুর সাহিত্য নিয়ে তৈরি করেছিলেন। যে সমস্ত পরিচালকরা বাংলা ছবির দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করেছিলেন ঋতুপর্ণ তাঁদের পুরোধা ছিলেন। তাঁর মৃত্যু নিঃসন্দেহে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি। গোটা চলচ্চিত্র জগত তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। ১৯৯৪ থেকে ২০১৩, মাত্র ১৯ বছর। এই ১৯ বছরে ঋতুপর্ণ ঘোষের মেধা এবং প্রতিভার ফসল মোট ২৩টি ছবি। প্রত্যেকটি ছবিই স্বতন্ত্র,অনবদ্য এবং যুগের সাক্ষী। ২৩টি ছবির মধ্যে ১২টি জাতীয় পুরষ্কার জয় করে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক পরবর্তী বাংলা সিনেমার নতুন এক ধারা তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিগুলো হল: ১. হীরের আংটি (১৯৯৪) ২. উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী- দেবশ্রী রায়) ৩. দহন (১৯৯৭, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ স্ক্রিন প্লে, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী- ইন্দ্রাণী হালদার, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) ৪. বাড়িওয়ালি (১৯৯৯, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী-কিরণ খের, শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী- সুদীপ্তা চক্রবর্তী) ৫. অসুখ (১৯৯৯, জাতীয় পুরস্কার- বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ সিনেমা) ৬. উৎসব (২০০০, শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার) ৭. তিতলি (২০০২) ৮. শুভ মহরত (২০০৩, জাতীয় পুরস্কার- বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সিনেমা, শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী- রাখী) ৯. চোখের বালি (২০০৩, জাতীয় পুরস্কার- শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা) ১০. কথা দেইথিল্লি মা কু (২০০৩, উড়িয়া ভাষায়) ১১. রেইনকোট (২০০৪, হিন্দি ভাষায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার) ১২. অন্তরমহল (২০০৫) ১৩. দোসর (২০০৬, জাতীয় পুরস্কার, বিশেষ জুরি পুরস্কার- প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী) ১৪. দ্য লাস্ট লিয়র (২০০৭, ইংরেজি ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার) ১৫. খেলা (২০০৮) ১৬. সব চরিত্র কাল্পনিক (২০০৮, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা) ১৭. আবহমান (২০১০, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক, বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার) ১৮. ২০১০- নৌকাডুবি (২০১০) ১৯. আরেকটি প্রেমের গল্প (২০১১) ২০. মেমোরিজ ইন মার্চ (২০১১, ইংরেজি ভাষার ছবি) ২১. সানগ্লাস (২০১২, হিন্দি ভাষার ছবি) ২২. চিত্রাঙ্গদা (২০১২, বিশেষ জুরি পুরস্কার, অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ) ২৩. সত্যান্বেষী (২০১৩) ঋতুপর্ণ ঘোষের অনান্য পুরস্কার: ১. ১৯৯৯- 'অসুখ' -এর জন্য বোম্বে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার ২. ২০০০- 'বাড়িওয়ালি'র জন্য বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে এনইটিপিএসি পুরস্কার ৩. ২০০২- 'তিতলি'-র জন্য বোম্বে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ: ১. ২০১১- আর একটি প্রেমের গল্প ২. ২০১১- মেমোরিস ইন মার্চ ৩. ২০১২- চিত্রাঙ্গদা বাংলা চলচ্চিত্র আর বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক ও অগণিত ভক্তরা আপনাকে চিরকাল মনে রাখবে দাদা। প্লিজ Rest In Peace.. ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার: সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন: AsiaSource এর Nermeen Shaikh স্থান-কাল: ঋতুপর্ণের “চোখের বালি” ২০০৩ সালের Locarno International Film Festival এ Golden Leopard পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০০৫ সালের ৯ই এপ্রিল ৩য় বার্ষিক South Asia Human Rights Film Festival উপলক্ষ্যে এশিয়া সোসাইটি সিনেমাটি প্রদর্শনের আয়োজন করে। প্রদর্শন উপলক্ষ্যে ঋতুপর্ণ নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। সে সময়ই এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়। আপনি যে ধরণের সিনেমা করেন তার পেছনে কলকাতার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে আপনার বেড়ে ওঠার প্রভাব কতটুকু বলে মনে করেন? আমার চলচ্চিত্র জীবন শুধু নয় ব্যক্তি হিসেবে আমার বর্তমান অবস্থানের উপর কলকাতার বিশাল প্রভাব আছে। আমি কিন্তু এখানে প্রভাব হিসেবে কলকাতার নাম করছি, বাংলার নয়; আর এই দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কলকাতার কথা আসলেই আমাদের মুখে দুটো নাম চলে আসে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। কিন্তু বাংলা মানে কেবল রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ না, আরও অনেক কিছু। বাংলা এমন এক প্রদেশ যা দেশভঙ্গের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেক প্রগতিশীল, তাই সেখানে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। দেশজুড়ে যে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে মুম্বাই তার দ্বারা আক্রান্ত হলেও কলকাতায় তার কোন প্রভাব পড়েনি। অনেক আগে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। এ কারণে প্রয়োজনীয় সব ধরণের অবকাঠামোই এখানে আছে। জ্ঞানের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবেও কলকাতার জুড়ি নেই। এখানে আছে: National Library যা এশিয়ার বৃহত্তম। আছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এছাড়া প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা আছে এখানে। আপনি যদি গুরুতর কোন বিষয়ে গবেষণা করতে চান এবং এর জন্য বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আপনার জন্য কলকাতার চেয়ে ভাল কোন স্থান বাংলায় নেই। এর পাশাপাশি আবার কলকাতা বর্ধিষ্ণু শহর না। এটা খুব সাধারণ, এখানে আপনি সব ধরণের লোকের সাথেই মেশার সুযোগ পাবেন। একে আমলাতান্ত্রিক শহর বলা যায় না, আবার ক্লিনিক্যাল সিটিও বলা যায় না। এখানে থাকলে এক ধরণের উষ্ণতা ও স্পন্দন অনুভব করা যায়, অনেকটা নিউ ইয়র্কের মত। লন্ডনের কিছু জায়গাও আমাকে কলকাতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এটা অবশ্যই ব্যস্ত শহর। রাস্তায় সব সময়ই পথচারীদের ভীড় লেগে আছে, একে অন্যের উপর আছড়ে পড়ছে, কেউ কেউ রাগান্বিত হয়ে ওভার-রিঅ্যাক্ট করে ফেলছে। এখানে সবাই একটু উত্তেজিত। কলকাতার মানুষেরা যখন সুখে থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে আবার যখন রাগান্বিত থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে। বাংলায় যা আছে তার সবই কলকাতায় দেখতে পাওয়া যায়, তবে সবকিছুই এখানে একটু পরিশোধিত এবং ফিল্টার করা। এজন্যই শহরটা এত মজাদার। বেড়ে ওঠার সময় কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে আপনি নিজেকে কিভাবে এবং কতটা জড়িয়েছেন? আমি বেড়ে উঠেছি কলকাতার বামপন্থী সংস্কৃতির মাঝে। আর ভারতের বাকি অংশের নেতৃত্বের আসনে ছিল ডানপন্থীরা। আমার যখন বোঝার বয়স হয়েছে (৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত) তখন থেকেই দেখে আসছি, কলকাতা বামপন্থী শহর। আমি ৩০ বছর আগের কথা বলছি। সে সময় আমরা বেশী কিছু জানতাম না। এখন তো মানুষ সবকিছুর সাথে খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে পড়ে, অল্প বয়সেই তার চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে। আমি যখন স্কুল শেষ করছি, তখন কলকাতায় মাত্র টেলিভিশন এসেছে। সুতরাং রাজনীতি নিয়ে যখন থেকে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই কলকাতায় বামপন্থীদের রাজত্ব। এখানে বাম রাজনীতি অনেক ফ্যাশনের মত। জটিলতাগুলো চিন্তা না করেই এখানকার মানুষ বামপন্থী হয়ে যায়। ভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ার সময় আমি কার্ল মার্ক্স পড়েছি এবং এ নিয়ে আমার একটা বিশেষ গবেষণাপত্রও তৈরী করতে হয়েছিল। তারপরও ঘুরেফিরে আবার সে কথায় আসতে হয়, কলকাতা অবশ্যই সত্যজিতের শহর। আমি যে ভার্সিটিতে পড়েছি সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোন শেষ ছিল না। আমার দুঃখ হয়, কেন অর্থনীতি নিয়ে পড়েছিলাম। এটা আমার কোনই কাজে আসেনি। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন পেশায়ও আমি যোগ দেইনি। এর চেয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বা ইতিহাস বা এ ধরণের কিছু পড়লে অনেক ভাল হতো। তারপরও আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন সামগ্রিকভাবে আমার ভার্সিটি জীবন নিয়ে কোন দুঃখ হয় না। কারণ সে জীবনে অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ৫ বছর কাটিয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়টা ছিল বিপ্লবী, সেখানে সবকিছুই ছিল সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। এই ভার্সিটিতে থাকার সময় আমি প্রথম ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখেছি, সত্যজিতের ছবি দেখেছি। এখান থেকেই আমার চলচ্চিত্রপ্রেমের সূচনা। জাদবপুরের নিজস্ব চলচ্চিত্র ও মঞ্চ সোসাইটি আছে। আমার প্রথম হাবিব তানভীর দর্শনও সেখানে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ৫ বছরে অনেক কিছু ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলোই আমার জীবন গড়ে দিয়েছিল। আমার বাবা ছিলেন প্রামান্য চিত্র নির্মাতা। মূলত তিনি ছিলেন চিত্রকর, পরে প্রামান্য চিত্র বানানো শুরু করেন। আমার মাও চিত্রকর ছিলেন। বাবা তার প্রথম প্রামান্য চিত্র করেছিলেন এক ভাস্করের ওপর যিনি আবার তার শিক্ষক ছিলেন। তখন আমার বয়স ১৪ বছর, বাবার সাথে শ্যুটিং এ যেতাম। তিনি ১৬মিমি হ্যান্ড-ক্র্যাক ক্যামেরা দিয়ে শ্যুটিং এর কাজ চালাতেন। ছবির এডিটিং হতো আমাদের বাসার ডাইনিং টেবিলে, সেদিন আমাদেরকে অন্য কোথাও খেতে হতো। বাবার সাথে বসে শট বাছাই করার কথা এখনও মনে পড়ে। এসবই সিনেমার জগৎটাকে আমার সামনে তুলে ধরে। ছোটবেলায়ই জানতাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে না, বিশেষ কোন যোগ্যতাও লাগে না। ১৪ বছর বয়সেই সিনেমার অনেক কিছু জানতাম। রাশ প্রিন্ট কাকে বলে? সিনেমার সম্পাদনা কিভাবে হয়? ফাইনাল প্রিন্ট কি জিনিস? মিক্সিং কখন করতে হয়? সাউন্ডের লেয়ারগুলো কি কি? কিভাবে সেগুলো মিক্স করতে হয়, কতগুলো ট্র্যাক করা সম্ভব? টেকনিক্যাল সব বিষয় আমার জানা ছিল, কারণ আমাদের বাসায়ই এসব হতো। সিংক সাউন্ড কি? ফোলি সাউন্ড কি? নন-সিংক সাউন্ডই বা কি? এর সবকিছু আমি জানতাম। একসময় আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু বাবার প্রামান্য চিত্রের বদলে গল্প বলাকে বেছে নেই। প্রামান্য চিত্রটা আমার সাথে ঠিক যেতো না। অনেক সময় বাবাকে সাহায্য করেছি, স্ক্রিপ্ট নিয়ে একসাথে আলোচনা করেছি। এটা একটা পারিবারিক বিষয়ের মত ছিল। সবাই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করতো। আমার মা চিত্রকর ছিলেন, যে ভাস্করের উপর প্রামান্য চিত্র হচ্ছে তাঁকে তিনি চিনতেন। তাই সবাই মিলে ভাল আলোচনা হতো। আমি কিছু পরামর্শ দিতাম, কিন্তু বাবা সেগুলো অধিকাংশ সময়ই গ্রহণ করতেন না। কারণ বাবা চাইতেন হার্ড-কোর ডকুমেন্টারি বানাতে। তার কথা ছিল, what has not happened has not happened. সত্যকে একটুও এদিক-ওদিক করতে চাইতেন না, সত্যের ব্যাঘাতও তিনি সহ্য করতেন না। পরে আমি বুঝেছিলাম, আমার পরামর্শগুলো সত্যকে ইন্টারাপ্ট করার মত, কিন্তু সেগুলো বাবা সত্যের বিকৃতি হিসেবে নিতেন। বাংলায় “book” এবং “film” এই দুটোর প্রতিশব্দই নাকি এক? আপনার অনেকগুলো সিনেমাও তো উপন্যাস আর ছোটগল্প থেকে করা। হ্যা, এটা ঠিক। দুটোর প্রতিশব্দই “বই”। কিন্তু আমার যদ্দুর মনে হয়, আমার সবগুলো ছবিই মৌলিক। এটা সত্য যে, রেইনকোট ও’হেনরি থেকে করা আর চোখের বালি তো সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে করা। কিন্তু যদি দেখে থাকেন তাহলে বুঝবেন, সেগুলোতে আমি অনেক পরিবর্তন এনেছি। রেইনকোট দেখলেই বুঝবেন যে এর সাথে ও’হেনরির “দ্য গিফ্ট অফ ম্যাজাই” এর খুব বেশী মিল নেই। ও’হেনরির গল্প ছিল তিন পৃষ্ঠার, আমার রেইনকোটের সাথে এর তেমন কোন মিল নেই। গল্পের কাহিনী ছিল এরকম: জিম ও ডেলা স্বামী-স্ত্রী। তারা ক্রিসমাস উপলক্ষ্য একে অপরের জন্য উপহার কিনে। ডেলা তার চুলের জন্য সবসময় tortoise-shell চিরুনী চাইতো, তার চুল ছিল অনেক লম্বা ও সুন্দর। জিম সবসময় তার ঘড়ির জন্য একটি সুন্দর চেইন চাইতো। জিম তার ঘড়ি বিক্রি করে চিরুনী কিনে বাসায় এসে দেখে, ডেলা তার চুল বিক্রি করে চেইন কিনে বসে আছে। আমার প্রথম ছবি একটা উপন্যাস থেকে করা। সেটা ছিল শিশুতোষ। আমার তৃতীয় ছবিও উপন্যাস থেকে করা যে উপন্যাসটা আবার সত্য কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয়েছিল। মোট ১১টি ছবি করেছি। রেইনকোট ছিল ১০ম, আর এটা ১১তম। এখন অন্তরমহল ছবির কাজ চলছে। এর মধ্যে আমার মাত্র চারটি ছবি উপন্যাস বা গল্প থেকে করা। যদ্দুর জানি আপনার প্রায় সব ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক আপনি নিজেই। এটা কি সত্যি? হ্যা, একইসাথে গল্পের লেখকও আমি। সব ছবিতেই আমি নিজে চিত্রনাট্য লিখি। সত্যজিৎ এমনটিই করেছেন, ঋত্বিক অধিকাংশ সময় করতেন, মৃণালও করেন। আমার মনে হয়, চিত্রনাট্যের ভাবগুলো আমার মধ্যে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। অভিনয় করার জন্য যে ধরণের কথোপকথন দরকার সেগুলো খুব দ্রুত মাথায় এসে যায়। আর যখন চিত্রনাট্য লেখার সময়ই আসলে আমি মনে মনে সিনেমার পরিকল্পনা করে ফেলি, তাই সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়। আপনার অধিকাংশ সিনেমাই তো বাংলায়? হ্যা, আসলে রেইনকোট ছাড়া আমার বাকি সব সিনেমাই বাংলা। ১১টির মধ্যে ১০ টিই। রেইনকোট আমার একমাত্র হিন্দি ছবি। কেন? অন্য ভাষায় বেশী সিনেমা বানান না কেন? কারণ বাংলা আমার মাতৃভাষা এবং কলকাতা অতোটা কসমোপলিটান না। ভারতের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কসমোপলিটান হল বোম্বে। বোম্বের লোকেরা হিন্দি বলতে পারে না, কারণ তাদের এক শহরে অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে এবং পারষ্পরিক যোগাযোগের জন্য তারা খুব মিশ্র ধরণের একটি হিন্দিকে বেছে নিয়েছে। তাই বোম্বেতে মাতৃভাষার ধারণাটা পাকাপোক্ত না। কিন্তু কলকাতায় বাংলার প্রভাব অনেক বেশী, মাতৃভাষা হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক বেশী। এখানে বাংলা সিনেমা সবাই দেখে, এ শহরের সবগুলো লাইব্রেরিতে বাংলা সিনেমা পাওয়া যায়। এর থেকে আমরা আরও একটা বিষয় খুব ভালভাবে বুঝতে পারি: মাতৃভাষায় সিনেমা নির্মাণ করেও আন্তর্জাতিক পরিচালক হওয়া সম্ভব। তাছাড়া আমি বাংলায় খুব সাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের মাতৃভাষার মূল হারিয়ে ফেলতে বসেছে। কিন্তু আমার অবস্থা সেরকম নয়, আমার বাংলার মূল খুব শক্ত। আমি বড়ও হয়েছি পারিবারিক পরিবেশে যেখানে সবার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বর্ধিত পরিবারের মধ্যেই আমার বাস। আমার শৈশব খুব উষ্ণ ছিল, সেখানেই আমার মূল, সেখানেই বাংলার সাথে আমার সম্পর্ক। ভারতে প্যারালাল বা আর্ট সিনেমার যে ট্রেডিশান চলছে আপনি কি নিজেকে তার অংশ মনে করেন? এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে: প্যারালাল সিনেমা বলতে কি বোঝায়? আর্ট সিনেমাই বা কি? এক সময় মানুষ মনে করতো, এ ধরণের বিভাজন থাকা দরকার। সব সিনেমাই মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরী করা হয় না। এটা সত্যি কথা। কিন্তু মনি কাউল ও কুমার সাহানিরা এসে এতই দুর্বোধ্য সিনেমা বানানো শুরু করলেন যে সেগুলো দেখার মত কোন দর্শকই আর রইল না। তখন নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি সিনেমায় আসতে শুরু করেছে। ভারতের গল্পভাণ্ডারের কোন শেষ নেই। এদেশের নিজস্ব গল্প, উপকথা, রূপকথা আছে। এর নিজস্ব ন্যারেটিভ ট্রেডিশন আছে। তাই হঠাৎ করে নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি কেউ গ্রহণ করেনি। তাই সেই নন-ন্যারেটিভ সিনেমাগুলোকে “আর্ট” সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। আগে সবাই সে ধরণের সিনেমা দেখতে যেত। সত্যজিতের ছবি দেখতে কারোই কোন সমস্যা ছিল না। তারা মনে করতো, এগুলোকে “বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র” (intellectual film) ডাকা যায়। যে সিনেমায় বুদ্ধিবৃত্তির (intellect) ব্যবহার আছে তাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক সিনেমা বলা যেতে পারে। কলকাতায় কিন্তু আমরা কখনোই “আর্ট” বা “প্যারালাল” শব্দটি ব্যবহার করিনি। এ ধরণের সব সিনেমাকে আমরা ইন্টেলেকচুয়াল ছবি বলতাম, এটা কেবল বলার জন্য বলা নয়, সবাই সংজ্ঞা বুঝে তারপরই সেগুলোকে ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা ডাকতো। সুতরাং যে ছবি করতে গিয়ে আপনাকে বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করতে হবে, যেটা কেবল মনোরঞ্জনের জন্য নির্মীত হবে না সেটাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ছবির শ্রেণীতে ফেলে দেয়া যায়। তার মানে এই প্রেক্ষিতে আপনি নিজেকে ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল চলচ্চিত্র ধারার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন? হ্যাঁ। অনেক সমালোচক আপনার চোখের বালির সাথে সত্যজিৎ রায়ের চারুলতার (এটাও রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে করা) মিল দেখিয়েছেন। আপনি কি আপনার এই ছবিকে সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান? না, আমি তেমনটি বলব না। তবে কিছু অংশ অবশ্যই সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট ছিল। সবাই চারুলতার থিয়েটার বাইনোকুলার আর দোলনায় দোল খাওয়া মনে রেখেছে এবং তার সাথে আমারটা মিলিয়েছে। কিন্তু চারুলতায় বাইনোকুলার একেবারে ভিন্ন কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল। চারুলতায় বাইনোকুলার ব্যবহার করা হয়েছিল উন্মুক্ত বিশ্বের দিকে একটি জানালা হিসেবে, আর চোখের বালিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইক্ষণকামের (voyeuristically) জন্য। সেই সময় এবং এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু জিনিস সাধারণ আছে। যেমন ফোর-পোস্টার বিছানা, সব বাংলা সিনেমাতেই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। থিয়েটার বাইনোকুলার পরে এসেছে বলে খুব কম সিনেমাতে এর ব্যবহার আছে। কিন্তু আমি সেটা আবার ব্যবহার করেছি। আমি অবশ্যই এমন কেউ যে সত্যজিৎ ধারায় সিনেমা বানায়। কিন্তু এটাকে আমি অস্বীকার করার চেষ্টা করি না, বরং এতে আমি খুব খুশী; আমি মনে করি বাচ্চা-কাচ্চাদের দেখতে বাবা-মার মতোই হওয়া উচিত [হাসি]। আমি অবশ্যই সত্যজিতের উত্তরসূরি, তাঁর সিনেমার মধ্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি। সত্যজিতের সাথে আমার পার্থক্যগুলো এরকম: প্রথমত, চোখের বালি রঙিন, চারুলতা রঙিন না। চারুলতার জন্য সত্যজিৎ কোন ধরণের রং বেছে নিতেন আমি জানি না। তবে চোখের বালিতে রং এর বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। the whole copperish tint with the red- এর ভূমিকা এখানে খুব বেশী। চারুলতায় কোন ধরণের রং ব্যবহার করা হতো তা আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ সিনেমা করেছেন যার নাম “ঘরে-বাইরে”। সিনেমা বা অ্যাসথেটিক পিস হিসেবে ঘরে-বাইরে একটি কমপ্লিট ডিজাস্টার। দেখা যায়, সমালোচকরা সব সময়ই চারুলতার সাথে তুলনা দেন, ঘরে-বাইরের কথা উল্লেখই করেন না। ঘরে-বাইরে উপন্যাসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ থেকে সত্যজিৎ যে সিনেমা বানিয়েছেন তা তার ভাল কাজগুলোর মধ্যে পড়ে না। আর চারুলতা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ত্রুটিহীন সিনেমাগুলোর একটি। আবেগের দিক দিয়ে চারুলতায় যে নিয়ন্ত্রণ দেখানো হয়েছে তার কোন তুলনা হয় না। শুধু আবেগ না, যেকোন দিক দিয়েই এর নিয়ন্ত্রণটা অনন্যসাধারণ। এখানে বাঙালি সংস্কৃতির অ-হিন্দু অংশকে দেখানো হয়েছে। ব্রাহ্ম ধর্ম নামে একটি ধর্ম ছিল যাতে মূর্তিপূজা ছিল না। চারুলতার কনটেক্সট এবং সমসাময়িকতা এই ব্রাহ্ম যুগের। সে যুগে সব আলোকিত ব্যক্তিই ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণভাবে সব অজ্ঞেয়বাদীরাও এই ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে চোখের বালির প্রেক্ষিত হল অভিজাত গোঁড়া হিন্দু পরিবার। এ ধরণের পরিবারের সব দোষত্রুটি আর একঘেয়ে জীবনাচার এতে ফুটে উঠেছে। যেমন, ব্রাহ্ম সমাজে বিধবাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। কিন্তু গোঁড়া হিন্দুদের মধ্যে সেটা প্রকট ছিল। এটাকে আমি চারুলতার সাথে চোখের বালির আরেকটা পার্থক্য বলব। আপনার চোখের বালি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি দিয়ে যেখানে তিনি উপন্যাসের শেষটা সম্পর্কে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন: “Ever since Chokher Bali was published, I have always regretted the ending. I ought to be censured for it” আপনি রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে কিভাবে দেখেন, আর আপনার সিনেমায় কি কোনভাবে এই বিষয়টা নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন? হ্যাঁ, কারণ সিনেমার শেষটা উপন্যাস থেকে একেবারেই আলাদা। উপন্যাসে সমাপ্তিটা বেশ হাস্যকর: হঠাৎ করেই সবাই সুখী-সুখী হয়ে যায়, পরিবারটাকে খুব ভাল মনে হতে থাকে এবং তারা দুজনেই বিনোদিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। দুই পুরুষ মহেন্দ্র ও বিহারী বলে, “ভাবী, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়েছে।” সেও তাদের ক্ষমা করে দেয়। এরপর সে বেনারসে গিয়ে তপস্বীর মত জীবনযাপন শুরু করে। সব সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, কারণ বিধবাদের সেভাবেই থাকা উচিত। দেখুন, এটা এক ধরণের serialized উপন্যাস। ঠাকুর শুরু করেছিলেন বিধবার নিষিদ্ধ আবেগ দিয়ে। এর কারণ হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা বাড়ানোর কথা আসতে পারে, কারণ ঠাকুর নিজে সাময়িকীটি সম্পাদনা করছিলেন, তার পাঠকের প্রয়োজন ছিল। উপন্যাসটা অর্ধেকের মত লেখার পরই খানিকটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং সব ব্রাহ্মরা মিলে তাকে রীতিমত ভর্তসনা করতে শুরু করে। ঠাকুর নিজে হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন ব্রাহ্ম যা নিয়ে আমি একটু আগেই বলেছি। তো ঠাকুর হিন্দুদের আবেগকে খুব বেশী নাড়াতে চাননি। এজন্যই বিনোদিনীকে সমাজের চিরন্তন নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করান। কিন্তু মৃত্যুর দুই মাস আগে যখন হারাবার কিছুই ছিল না তখন তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে, “আমি এটা কেন করেছিলাম? আমার পাঠকদেরও সন্তুষ্ট করতে পারিনি নিজেকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাহলে কেন করেছিলাম?” এ নিয়ে একটা ভাল সমালোচনাও হয়েছিল: বিনোদিনীকে যদি শেষে আজীবন নির্বাসনেই পাঠাবেন তবে তাকে দিয়ে কেন নিষিদ্ধ কাজ করালেন, কেন তার মধ্যে এত কামনার জন্ম দিলেন? এই সমালোচনা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ হয়ত বিনোদিনীকে এমনই করতে চেয়েছিলেন: তার মধ্যে আরও জীবনীশক্তি দিতে চেয়েছিলেন, আরও কামনা ও জীবনের প্রতি আরও ভালবাসা ভরে দিতে চেয়েছিলেন। হয়ত তার জীবনের পুরো চাহিদাটাকে পরিতৃপ্ত করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুই মাস আগে ঠাকুর এটা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন: “I need to be seriously criticized for it, I deserve this criticism. I should be punished for it.” আজকেও উপন্যাস পড়লে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের এমন সমাপ্তি হতে পারে না। অনেক পাঠক চেয়েছিলেন বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ে হোক। আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগে হলে বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি দেয়া যেতো। কারণ তখন বিধবা বিয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, এ নিয়ে রীতিমত প্রচার চলছিল। সবাই তখন মনে করতো, আরেকটি বিয়ে হলে সে আবার জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। এখন নারীর জীবন চালানোর জন্য কোন পুরুষের শেষ নাম, উপাধি বা কোন ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। বিনোদিনী আগে বিয়ে করেছে এবং বিয়ে তাকে কিছুই দেয়নি, এতে তার কোন সাহায্য হয়নি। একা থাকাটাই তাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে। তার অর্জন, তার শক্তি, তার হেঁয়ালিই তার সবচেয়ে বড় সহায়। সুতরাং তার পক্ষে একা থাকার শক্তি অর্জন করা সম্ভব। পরবর্তীতে চলে যাওয়ার সময় সে তার নিজের “দেশ” এর কথা লিখে। এখানে দেশ বলতে স্থায়ী ঠিকানা বোঝায় না, দেশ বলতে “স্থান” বা ডোমেইন বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিনোদিনীর জীবনের ঘটনাগুলো একসাথে ঘটছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার নারীর কোন স্থান নেই। সুতরাং নারীর কোন নিজস্ব দেশ নেই, সে যেমন তার স্বামীর নাম বহন করে তেমনি স্বামীর দেশই তার দেশ, স্বামী যে দেশের সেও সেই দেশের। কিন্তু একজন নারীর নিজস্ব দেশ থাকতে পারে। নারীর কোন নির্দিষ্ট দেশ বা কোন নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত না। পুরুষ কখনও তার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু নারী পারে। একজন স্বাধীন নারীর জন্য আমি তাই একে “দেশ” হিসেবে আখ্যায়িত করব। সিনেমার শেষে গিয়ে বিনোদিনী এই “দেশ” এর কথাই বলে। তার মানে আপনার সমাপ্তিটা মুক্তি এনে দিয়েছে, মুক্তির ভাব জাগ্রত করেছে? হ্যাঁ, আমি তাই ভেবেছিলাম। আমি অবশ্যই কোন সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি দিতে চাইনি। ন্যারেটিভ দিক দিয়ে সবকিছুর সমাধান দিয়ে দেইনি। রেইনকোট আর চোখের বালি দুটো সিনেমার সঙ্গীতই চমৎকার। গুলজারকে দিয়ে গানের লিরিক লিখিয়েছেন। না, রেইনকোটের সব গানের লিরিক আমিই লিখেছি, শুধু বিয়ের দুটো গান বাদে। Mathura nagarpati kahay tum gokoli jao, Piya tora kaisa abhiman এবং Akele hum nadiya kinare- এই তিনটি গানের লিরিকই আমার নিজের। এই গানগুলো কিন্তু হিন্দি না, আমি হিন্দি জানি না। এগুলো মৈথিলী, যা একটা মিশ্র ভাষা। সংস্কৃত, খানিকটা হিন্দি এবং ব্রজভাষা মিলে মৈথিলী হয়েছে। সঙ্গীত ও কবিতার কোন ধারাটির সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে? আমি অনেক কবিতা পড়েছি। অবশ্য, বাঙালিদের জন্য কবিতা পড়া একটা ফ্যাশনের মতো, সবাই পড়ে। সেখানে কবিতা পড়া শুরু হয় Lorca দিয়ে, এরপর আসে বামপন্থী কবিদের কবিতা। অ্যালেন গিন্সবার্গের নাম করতে হয়। তিনি কলকাতায় ছিলেন, ইংরেজিতে লিখলেও তার কবিতা দিয়ে অনেকে প্রভাবিত হয়। তারপর অবশ্যই ইলিয়াডের নাম করতে হয়। বাংলা ভাষায়ও আমাদের অনেক প্রখ্যাত কবি আছেন, তাদের কারও কবিতাই বাদ যায় না। মাও সেতুং এর কবিতাও সবাই পছন্দ করে। সুতরাং কলকাতায় কাব্য রুচির কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, মিশ্র। সঙ্গীতের কথা বললে প্রথমেই আসবে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথা। কারণ ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতায় সঙ্গীতের এই ধারাটি খুব প্রভাব বিস্তার করেছে। কলকাতার পুরাতন অভিজাত এলাকায় গেলে আপনি long-playing রেকর্ড, high-brow সঙ্গীত শুনতে পাবেন। এটাই সেখানকার ট্রেডিশান। বিখ্যাত পশ্চিমা ধারার সঙ্গীতজ্ঞরা সবাই কলকাতার, প্রথম দিককার চেলো ও বেহালা বাদকরা সবাই কলকাতার। কলকাতা থেকেই ধীরে ধীরে তা বোম্বেতে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পশ্চিমা সঙ্গীতের ট্রেডিশানে বড় হয়েছেন, পরবর্তীতে এই সঙ্গীতকেই নিজের স্বতন্ত্র ট্রেডিশানে রূপান্তরিত করেছেন। তার গানের গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনেক উপাদান পাওয়া যায়। চোখের বালির সব গানই রবীন্দ্রনাথ থেকে নেয়া হয়েছে; এগুলো প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ইন্টারল্যড। চোখের বালিতেই সেই ধারার সঙ্গীতের বিশালত্ব বোঝা যায়, এর কথা ও গভীরতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে, আর গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রভাবটাও ধরা পড়ে। আর আমি মনে করি, চোখের বালির ধ্রুপদী মান তার সঙ্গীতের কারণেই প্রকট হয়ে উঠেছে। যারা রবীন্দ্রনাথ পড়েননি তারা এই বিষয়টা ধরতে পারেন না: তিনি চোখের বালির এই চারটি চরিত্র নিয়েই একটা অপেরা লিখেছিলেন, যা প্রায় একই রকম। এই অপেরাই সিনেমাটির মিউজিক্যাল টেক্সট গঠন করেছে। যেমন টাইটেল মিউজিকটা হুবহু সেই অপেরা থেকে নেয়া হয়েছে। এতে চারটি নারী-পুরুষ প্রায় উচ্চমার্গীয় একদল সঙ্গীতজ্ঞের সাথে মিলে এক ভালবাসার খেলায় মেতে উঠেছে, অনেকটা Midsummer Night’s Dream এর মত। কিংবা ওরাকলের মত, গ্রিক কোরাসের মত, যেখানে সবাই আবেগকে গানে রূপান্তরিত করছে এবং এর মাধ্যমেই নিজেদের কাজগুলো সচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। এই গ্রিক ট্রেডিশানে কিন্তু চরিত্রগুলো মঞ্চে এসে প্রথমেই পুরো কাহিনীটা বলে দেয়, এরপর কি কি ঘটবে তাও বলে দেয়। চোখের বালিতে আসলে আমি সঙ্গীতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি, কারণ এতে তার প্রয়োজন ছিল। আমার অন্য ছবিগুলোতে কিন্তু সঙ্গীতের এত ব্যবহার নেই। যেমন রেইনকোটে ভারতের স্বদেশী খেদসূচক সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ছবি করতে গিয়ে আমরা ইচ্ছে করেই তেমন গান বেছে নিয়েছি, কারণ তার গল্প ছিল সাধারণ এবং সঙ্গীতেও তার প্রতিফলন থাকা উচিত ছিল। আপনি রায় এবং ঘটকের কথা বলেছেন। কিন্তু আর কোন কোন চলচ্চিত্র নির্মাতা দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন? নিঃসন্দেহে বারিমান (Ingmar Bergman)। এরপরেই আসবে কিয়েশলফস্কি। Bille August (Pelle the Conqueror, The Best Intentions), তার ছবি আমার খুবই ভালো লাগে। কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, আমি তার মত সিনেমা বানাতে চাই না, কিন্তু সে আমাকে মুগ্ধ করে। 'গডফাদার'কে সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা মনে করি। আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আমি কিয়ারোস্তামির পরেই জাফর পানাহি ও মোহসেন মাখমালবফের সিনেমা পছন্দ করি। অনেক সময় ওং কার-ওয়াই ও পেদ্রো আলমোদোবার আমার ফেভারিট হয়ে উঠে, তাদের ছবি অনেক সময়ই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেকটি সেরা ছবির নাম “লাইক ওয়াটার ফর চকোলেট”, আলফোনসো আরাউ এর। কিন্তু আরাউ এর পর আর কোন উল্লেখযোগ্য সিনেমা করেননি। এখন কি নিয়ে কাজ করছেন? অনেক কিছু নিয়েই। কিন্তু আমি বিশেষ করে মহাভারত নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। আর আমি মনে করি এখনই এ নিয়ে করা প্রয়োজন, কারণ অনেক সময়ই একে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যা সত্যি নয়। এটা মহাকাব্য। এর দিকেই আমার ঝোঁক সবচেয়ে বেশী। সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৩ রাত ১২:০০
false
hm
মরা মানুষের সিন্দুক ১. পিক-আপের ভেতরে কবরের নিস্তব্ধতা। এমনকি চোখ আর হাত বাঁধা খালেকও কোনো শব্দ করছে না। রুহুল আমিন আর সদরুলের মাঝে বসে আছে লোকটা। রুহুল আর সদরুল দু'জনেই পোড় খাওয়া লোক, তাদের প্রশিক্ষিত, শক্তিশালী পেশীর পাহারায় ন্যাতানো মুড়ির মতো পড়ে আছে কসাই খালেক। ইয়াকুব রাস্তার পলাতক ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখতে চেষ্টা করে খালেককে। এমন নয়, যে সে খালেককে আগে দেখেনি। ফাইলে কসাই খালেকের কয়েকটা ঝাপসা ছবি গত কুড়িদিন ধরেই মনোযোগ দিয়ে দেখেছে ইয়াকুব। গত পরশু যখন শহরতলির এক বাড়ির নড়বড়ে দরজার কবাট বুটের লাথিতে ভেঙে ভেতরে ঢুকে সাবলেট নিয়ে বসবাসরত খালেককে পাকড়াও করা হয়, ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোতে তার ভীত, উন্মত্ত, উত্তেজনায় বিকৃত চেহারা ইয়াকুব খুব কাছ থেকে দেখেছে। খালেকের এই সৌম্য, শান্ত রূপটাই কেবল দেখা হয়নি তার। কোন অস্ত্র ছিলো না খালেকের সাথে। আগুয়ান বুটের শব্দ শুনে ঘর থেকে ভীরু খরগোশের মতো ছুটে বেরিয়ে চারতালার বারান্দা থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলো সে। পারেনি। যে সদরুলের পাশে সে বসে আছে এখন, সেই সদরুল তার ঘাড়ে এক ভয়ঙ্কর চপ মেরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে তৎক্ষণাৎ। তারপর টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনে মাইক্রোবাসে তুলেছে। ইয়াকুব চোখ বোঁজে। ভাড়াটিয়া পরিবারটা এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলো প্রচণ্ড ত্রাসে। বাচ্চা মেয়েটা টুলটুলে ঘুম ঘুম চোখে দেখছিলো তাদের। খালেকের লোকজন কি পরে কোনো ক্ষতি করবে ঐ ছোট্ট পরিবারের? খালেকের লোকজন যদি তাদের ছেড়েও দেয়, পুলিশের জেরায় জেরায় কাহিল হয়েই তাদের ভবিষ্যতের একটা অনিশ্চিত দৈর্ঘ্যের টুকরো কেটে যাবে। কেন তারা কুখ্যাত আব্দুল খালেক ওরফে কসাই খালেক ওরফে মিজান ওরফে পারভেজকে বাড়িতে সাবলেট দিয়েছিলো? কেন? তারা কি জানে না, এটা কত বড় অপরাধ? ঐ ঘুম ঘুম চোখের ছোট্ট মেয়েটা কি জানে, সে কত বড় পাপী? না বোধহয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কি ক্ষমা করবে তার এই অজ্ঞতাকে? খালেক হেফাজতে ছিলো গতকাল। তার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে আছে অবশ্য অনেক আগে থেকেই। ইয়াকুব অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে খালেককে দেখেছে গতকাল। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো লাগছিলো ব্যাটাকে দেখতে। কসাই খালেক নিজ হাতে কমপক্ষে কুড়িটা খুন করেছে। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা মোট কত করেছে, সঠিক হিসাব নেই। সেই দুর্ধর্ষ খুনী খালেক একটা কেন্নোর মতো গুটিয়ে বসে ছিলো সেলের এক কোণায়, ছাদের দিকে চোখ মেলে। হেফাজতে নাস্তাপানি মন্দ দেয়া হয় না। গরম আটার রুটি, সব্জির ঘ্যাঁট, ডিমের অমলেট। এক মগ চা। মুখে দেয়নি খালেক কিছুই। নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছে আবার। দুপুরটা উপোস করিয়ে রেখে সন্ধ্যেবেলা মুরগির ঝোল দিয়ে গরম মোটা চালের ভাত দেয়া হয়েছিলো। খালেক খায়নি। ইয়াকুব আজ সন্ধ্যাবেলাতেও জিজ্ঞেস করেছে তাকে, খালেক, খাইবেন কিছু ভালোমন্দ? বিরিয়ানি? ইলিশ মাছ দিয়া ভাত? খাসির গোস্ত? খাইতে চাইলে বলেন। খালেক কেঁপে উঠেছে একবার, কিন্তু চোখ নামিয়ে নিরুত্তর বসেছিলো চুপচাপ। ইয়াকুব একটা সিগারেট ধরায়। পিক-আপ শহর ছাড়িয়ে এসেছে। মফস্বলের অন্ধকার ঘিরে ধরেছে পিক-আপকে, পেছনের পিক-আপের নির্লজ্জ হেডলাইট দু'টি জ্বলছে বেশ্যার স্তনের মতো, অন্ধকার কাঁপতে কাঁপতে সরে যাচ্ছে রাস্তার ওপর থেকে। দূরাগত হেডলাইটের আলো আর সিগারেটের মন্থর আভায় ইয়াকুব খালেককে দেখার চেষ্টা করে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কারো চেহারা দেখার মানে হয় না, যেমনটা মানে হয় না সানগ্লাস পরা অবস্থায় দেখলে। চোখ মানুষের আত্মার মিটার, সেটার কাঁটা নড়ে উঠে জানিয়ে দেয় ভেতরে কী চলছে। চোখ বাঁধা খালেক একটা অন্ধকার দাঁড়িপাল্লার মতো, তার কোন পাল্লা কোনদিকে হেলে আছে, বোঝার কী উপায়! ইয়াকুবের পাশে বসা হামজা কেশে গলা পরিষ্কার করে একবার। ইয়াকুব ঘাড় ফিরিয়ে হামজাকে দেখার চেষ্টা করে। হামজা ট্রুপের জল্লাদ। গুলি সে-ই করবে। শক্ত সমর্থ, ছোটোখাটো, অমায়িক চেহারার হামজাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, নির্বিকার মুখে গুলি করে সে হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা মানুষকে মেরে একটু তফাতে গিয়ে অফিসারের চোখের আড়ালে একটা সিগারেট ধরাতে পারে। খালেকের কণ্ঠস্বর থেকে গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে আসে। "কিছু বললেন, খালেক?" ইয়াকুব কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে। খালেক মাথা নাড়ে। পিক-আপ দুটো চলতে থাকে অন্ধকার চিরে। ২. লোকেশনটা ইয়াকুবই খুঁজে বের করেছে। পুরনো একটা পোড়ো, ভাঙা দালান আছে মাঠের এক প্রান্তে, অন্যদিক ঘন গাছের সারি, দূরে একটা প্রাইমারি স্কুল। পিক আপ দু'টোর মসৃণ গতি হঠাৎ টালমাটাল হয় রাস্তা ছেড়ে মাটির ওপরে নেমে আসায়। পিক আপ থামতেই খালেক ফুঁপিয়ে ওঠে, "স্যার, খালি জানে মারবেন না। যা চান দিবো স্যার। আমার ধানী জমি আছে অন্যের নামে। বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে আসবে আমার লোক। খালি জানে মারবেন না স্যার ...।" ইয়াকুব সিগারেটে টান দেয় চুপচাপ, সদরুল আর রুহুল আমিন তার বাঘের মতো চোখ দেখতে পায় সিগারেটের আভায়। "তুই ধানী জমি কিনলি ক্যামনে রে মাদারচোদ?" ইয়াকুব গুলির মতো প্রশ্ন করে। "আট বছর আগে তুই ছিলি গ্যারেজ মেকানিক খসরুর চামচা। ধানী জমি কিনার পয়সা পাইলি কই? বাপের গোয়া দিয়া পয়সা বাইর হয়?" খালেক ফোঁপাতে থাকে। সদরুলকে ইশারা করে ইয়াকুব, প্রচণ্ড এক চড় মারে সদরুল। "কথা বল। পয়সা বাপের গোয়া দিয়া বাইর হয়?" খালেক আবারও বলে, "স্যার, খালি জানে মারবেন না। যত টাকা লাগে ... ।" ইয়াকুবের ভুরু আবারও ইঙ্গিত দেয়, সদরুল আবারও চড় কষায়। খালেক এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। "নামাও এইটারে।" ইয়াকুবের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। খালেকের সাধ্য নাই টাকা দিয়ে রফা করার। তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে কয়েকদিন আগেই। দুই পিক আপ থেকে একে একে নামে হাতাকাটা জ্যাকেট পরা লোকজন। জ্যাকেটের পেছনে তাদের বাহিনীর নাম লেখা। প্রত্যেকের হাতেই অস্ত্র। ইয়াকুব শুধু স্মল আর্মস নিয়ে এসেছে সাথে। খালেককে টেনে হিঁচড়ে নামায় রুহুল আমিন। এই খালেককে দেখে বিশ্বাস করার উপায় নেই, এই লোক এই অঞ্চলের দুর্ধর্ষতম খুনীদের একজন। ফোঁপাচ্ছে, বিড়বিড় করছে, থরথর করে কাঁপছে তার শরীর, খালেক এখন একজন মানুষ। ইয়াকুব এই পর্যায়ে এসে কোনো খুনীকে দেখেনি। প্রত্যেকেই তখন মানুষ হয়ে যায়, চিৎকার করে, কাঁদে, অনুনয় করে, টাকার প্রলোভন দেখায়, আল্লাহর নামে জিকির করে, আসন্ন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাপড় নষ্ট করে। দুয়েকজন আদালতে বিচার চায়। খালেকও দেখা গেলো সেই পদেরই লোক। "স্যার, জানে মারবেন না স্যার। আমাকে কোর্টে তুলেন। ফাঁসি দেন। জানে মারবেন না স্যার।" "ফাঁসি দিলে জানে মরবি না?" ইয়াকুব হালকা গলায় প্রশ্ন করে। খালেক জিভ বার করে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় একবার। "স্যার, যত টাকা লাগে ...।" ইয়াকুব খসখসে গলায় বলে, "হামজা, তৈরি হও।" খালেক কুকুরের মতো গোঙাতে থাকে। "স্যার, আদালতে তুলেন আমারে। জানে মারবেন না স্যার। আল্লাহ আপনাদের হায়াত দিবে স্যার। জানে মারবেন না স্যার। আপনি মা-বাপ স্যার ...।" খালেক যাদের খুন করেছে, তারাও নিশ্চয়ই এমন কাতর অনুনয় করেছিলো জবাই হওয়ার আগে, গুলি খাওয়ার আগে। খালেক সেদিন ঈশ্বরের মতোই বধির ছিলো। ইয়াকুব দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ইঙ্গিত দেয়, সদরুল প্রচণ্ড এক লাথি মেরে খালেককে মাটিতে ফেলে দেয়। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত নিয়ে খালেক গড়িয়ে পড়ে শিশির ভেজা মাঠে। হামজা এগিয়ে যায়, তার হাতে টি-৫৬ থেমে থেমে সংক্ষিপ্ত গর্জন করে কয়েকবার। বাকিদের মধ্যে কয়েকজন আশেপাশের অন্ধকারে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছোঁড়ে। ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। একটা কাটা রাইফেল, দুইটা দেশি পিস্তল আর কয়েক রাউণ্ড গুলি পাওয়া যাবে অদূরেই। ক্যামেরা আছে ইয়াকুবের ব্যাগে, সবকিছুর ছবি তুলে রাখতে হবে। সদরুল এগিয়ে গিয়ে খালেকের মৃতদেহে বুট দিয়ে খোঁচা দেয়। তারপর হাত আর চোখ বাঁধা গামছা দুটো খুলে আনে। ইয়াকুব এগিয়ে গিয়ে টর্চ মেরে দেখে খালেকের মৃত মুখটা। এক কাতর অভিব্যক্তি সেখানে, চোখ দু'টো সামান্য খোলা। শার্টের সামনের দিকটা রক্তে ভিজে গাঢ় হয়ে আছে। ইয়াকুব চারপাশে তাকায়। দলের পনেরোজন খালেকের মৃতদেহ গোল হয়ে ঘিরে দেখে। তাদের হাতের সাব মেশিনগানগুলো নীরব প্রভুভক্ত কুকুরের মতো তাকিয়ে আছে খালেকের দিকে। ইয়াকুবের মনে হয়, খালেকের বুক যেন একটা সিন্দুকের ডালা হয়ে খুলে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে প্যাণ্ডোরার বাক্সের মতো, ভেতর থেকে আশ্চর্য সঙ্গীতের মতো পাক খেয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে দেবত্বের অনুভূতি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে আরো পনেরোজন ঈশ্বর যেন অভিষিক্ত হলো আবার, বহুতম বারের মতো, যেখানে তারাই সংহারের শিল্পী, যেখানে তাদের অস্ত্রের নিচে কসাই খালেক মানুষ খালেক আর মানুষ খালেক মরা মানুষ খালেকে পরিণত হবে রাতের পর রাতে। ভোরের পর ভোরে মাঠগুলোতে জমা হবে আরো আরো মানুষের দল, তারা ভীত চোখে দেখবে কয়েকজন সশস্ত্র ঈশ্বর আর একটি মানুষের মৃতদেহকে, শিখবে, পৃথিবীতে অনেক ঈশ্বর, আর মানুষের আদালত ঈশ্বরের আদালতের মতোই দূর, স্পর্শের বাইরে। ঈশ্বরের আকাশের নিচে এই মাঠগুলো শুধু মঞ্চ, সেখানে আর কোনো যুক্তি নেই, প্রশ্ন নেই, সাক্ষ্য নেই। ইয়াকুব টর্চ নিভিয়ে দিলো। শেষ মুহূর্তগুলোতে কোনো খুনীকেই নিধন করা হয়ে ওঠে না, তখন এসে মানুষ হয়ে যায় সকলে, যাদের জন্যে মৃত্যু ছাড়া আর কেউ ওঁত পেতে বসে থাকে না। ইয়াকুব ঘড়ি দেখে। ভোর হবে একটু পরেই। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারি গলায় সে বলে, "ইয়ো হো হো অ্যাণ্ড আ বটল অফ রাম!"
false
hm
গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও সংরক্ষিত আসনের মহিলা এম্পিদের চুলাচুলি রহস্য গোয়েন্দা ঝাকানাকা বললেন, "আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে কিংকু সাহেব! আরে রিল্যাক্স!" গোয়েন্দা বিভাগের দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি, যিনি কি না চৌদিকেই ধারালো, বিমর্ষ মুখে বলেন, "স্যার ওপর থেকে এমন হুড়ো দিচ্ছে কী আর বলবো আপনাকে! মন্ত্রী এম্পিদের ব্যাপার, বোঝেনই তো!" ঝাকানাকা হাই তুলে বললেন, "হুমমম। তা চিঠিতে কী লিখেছে বদরু খাঁ?" কিংকু চৌধারি গলা খাঁকরে বলেন, "খুব কড়া ভাষায় চিঠি লিখেছে স্যার ... ইয়ে, পড়ে শোনাবো?" ঝাকানাকা বলেন, "শোনান।" কিংকু চৌধারি খুক খুক কেশে গলা পরিষ্কার করে নেন, তারপর গামছুদ্দিন হালিমের মতো মোটা গলায় পড়তে থাকেন চিঠিটা, "বরাবর, মহাপরিচালক, সরকারী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। বিষয়ঃ হুমকি। জনাব, আচ্ছালামু আলাইকুম। আমি আপনাদের নিয়মিত দর্শক। নানারকম আইনবিরোধী কাজে প্রায়শ দেশের দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে আনাগোনা করিবার সুবাদে আপনাদের সম্প্রচার কার্যক্রমই অধুনা আমার বিনোদনের একমাত্র ভরসা। আপনারা বাংলা সিনামা দেখাইয়া থাকেন, উহা আমি ও আমার ল্যাংবোট দস্যুবৃন্দ উপভোগ করিয়া থাকি। যদিও আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকিবে শাবাহানার সিনামা কম দেখাইয়া পপিপি ও ময়ূহুরীর সিনামা অধিক দেখানোর। শাবাহানার সিনামা দেখিয়া আমার দস্যুদলের অপেক্ষাকৃত তরুণ সদস্যরা ক্রন্দনপ্রবণ হইয়া উঠিতেছে। তাহারা এদানিঙ পুলিশ ইনস্পেক্টর নায়কের সপক্ষে ও বর্বর রক্তলোলুপ নারীধর্ষণকারী লুটেরা মাতবর ভিলেনের বিপক্ষে নারা তুলিতেছে। ময়ূহুরী ও পপিপির সিনামায় প্রচুর রক্তপাত ও খুনধর্ষণ থাকে, উহা তাহাদের চরিত্র গঠনের জন্য অধিকতর উপযোগী। আপনারা কার্টুন ছবির পরিবর্তে বেওয়াচ দেখাইলে আরো আনন্দিত হইব।" কিংকু চৌধারি দম নেন। ঝাকানাকা বলেন, "বাস, এ-ই?" কিংকু বলেন, "না স্যার, আরো আছে।" এই বলে তিনি পড়ে চলেন, "কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান কিম্বা পল্লীগীতির অনুষ্ঠান আমরা তেমন দেখি না, রাতের ঐ সময়ে আমি আমার দস্যুদলের সদস্যদের নানাপ্রকার অস্ত্রচালনা ও কুংফুবিদ্যা প্রশিক্ষণ করাইয়া থাকি। প্যাকেজ নাটক চলিবার সময় তাহারা ভাত খায় আর রাত্রি দশ ঘটিকার সংবাদের পর সকাল সকাল নিদ্রার প্রস্তুতি লয়। শুধু রাত্রিকালীন প্রহরায় নিয়োজিত সান্ত্রীর ডিউটি মারিবার জন্য কয়েকজন পালা করিয়া রাত্রি জাগরণ করে।" ঝাকানাকা বলেন, "হুমমমম।" কিংকু চৌধারি পড়তে থাকেন, "কিন্তু জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলা কালে আপনার মহাপরিচালিত টেলিভিশনে জাতীয় সংসদের অভ্যন্তরের কার্যকলাপ সরাসরি সম্প্রচার করা হইয়া থাকে। ইহা আমার দস্যুদলের সদস্যদের উপর এক মারাত্মক হানিকর প্রভাব বিস্তার করিয়া চলিতেছে। তাহাদিগকে আমি প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারেই দস্যুবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় গালিগালাজ ও কটুবাক্যদি বর্ষণের উপর একটি কোর্স শিক্ষা দিয়াছি, তাহারা ব্যবহারিক শিক্ষানবিশি দস্যুতার সময় ভিক্টিমের উপর ঐসব গালাগালি প্রয়োগ করিয়া থাকে। আমি গর্বের সহিত উল্লেখ করিতে চাহি, আমার অধীনে প্রশিক্ষিত নবিশ দস্যুদের গালি খাইয়া ইতিপূর্বে জনৈক পুলিশ সুপার ও জনৈক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়াছেন। তাদৃশ ঘটনা ঘটিয়া থাকা সত্ত্বেও সংসদ অধিবেশনে কতিপয় সাংসদের গালাগালির তুবড়ি শুনিয়া আমার শিষ্যদের মধ্যে দস্তুরমতন ত্রাসের সঞ্চার হইয়াছে। বিশেষত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কয়েকজন মহিলা সাংসদ যেইরূপে কটিদেশে পরিধানের বস্ত্র প্যাঁচাইয়া তর্জনী উত্তোলনপূর্বক প্রতিপক্ষের মহিলা সাংসদদের প্রতি কলতলীয় কলহবাণী উচ্চারণ করেন, তাহা শুনিয়া এই তরুণদের চিত্তশক্তি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছে। তাহাদিগকে জনৈকা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ...।" বাধা পেয়ে থেমে যান কিংকু চৌধারি। "সংরক্ষিত বনাঞ্চল লিখেছে?" ঝাকানাকা শুধান। "হাঁ স্যার!" কিংকু চৌধারি চিঠি নাকের সামনে ধরে আরেক দফা পড়েন। "সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মহিলা সাংসদ।" ঝাকানাকা গম্ভীর হয়ে বলেন, "সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদ বলতে চেয়েছে বোধহয়।" কিংকু চৌধারি বলেন, "তা হবে ... ঐ একই কথা স্যার ... যাই হোক!" এই বলে তিনি আবার চিঠি পড়ে চলেন, "তাহাদিগকে জনৈকা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মহিলা সাংসদের হলুদবাগস্থ বাসভবনের প্রতিবেশীর বাড়িতে নৃশংস ডাকাতি করিবার আদেশ দিবার পর তাহারা আমার বাহিনীর ইনটেলিজেন্স শাখা হইতে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করিবার পর এই অভিযানে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। তাহারা আমার বরাবর একটি দরখাস্তে জানায়, মহিলা সাংসদদিগের বাড়ির দুইশো গজের অভ্যন্তরে তাহারা কোনো প্রকার অ্যাকশনে যাইতে সাহস পাইতেছে না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতেও নাকি এইরূপ কতিপয় কাপুরুষ সেনাধ্যক্ষের আদেশ অমান্য করিয়া ফিলিস্তিনে হামলা করা হইতে বিরত আছে, এই রেফারেন্সও তাহারা চিঠিতে উল্লেখ করিয়াছে। আমি তাহাদিগকে আশ্বাস দেই যে দস্যুবাহিনীর আর্টিলারি শাখার গোলন্দাজেরা তাহাদের দূর হইতে ভারি গোলাবর্ষণ করিয়া ব্যাকাপ প্রদান করিবে, তাহারা যেন অযথা ভীত না হয়। কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ অধিবেশন দেখিয়া তাহাদের মনোবল এতটাই ক্ষণভঙ্গুর যে তাহারা তাহাতেও সম্মত হইতে পারিতেছে না।" ঝাকানাকা বলেন, "হুমমমম!" কিংকু চৌধারি পড়ে চলেন, "দশ বৎসর পূর্বে এইরূপ বেয়াদবি কেউ করিলে আমি পত্র রচনার জন্য কলম টানিয়া না লইয়া একটি কালাশনিকভ টানিয়া সংশ্লিষ্ট হতভাগাদের কতল করিতাম। কিন্তু ইদানিং যোগ্য ল্যাংবোট সংগ্রহ কঠিন হইয়া পড়ায় এবং সাংবাদিক হতভাগাগুলি পদে পদে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করিয়া বিষম গিয়ানজাম করায় আমার ডেপুটিগণ আমাকে নিবৃত্ত করে এবং সমস্যার গোড়ায় হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেয়। ইনটেলিজেন্স শাখার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আপনার টেলিভিশনই আমার শিষ্যদের মানসিক দৌর্বল্যের প্রত্যক্ষ কারণ। অতএব, বিনীত নিবেদন এই যে, চিঠি হস্তগত হইবার কার্যদিবস হইতে আপনার টেলিভিশনে এই সংসদ অধিবেশনের দৃশ্যাদি সম্প্রচার করা সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করিবেন। না করিলে আপনার ও আপনার পরিবারকে প্যাঁদাইয়া লোহিত ও নীল বর্ণের সুতা বাহির করা আমার ও আমার বাহিনীর প্রশিক্ষিত দস্যুদের পক্ষে মোটেও কঠিন কার্য নহে।" ঝাকানাকা বলেন, "হুমমম!" কিংকু চৌধারি বলেন, "আমি জানি আপনি এই পত্র পাইয়া পুলিশকে ডাকিয়া কান্দিতে কান্দিতে বিচার ঠুকিবেন। তাহাদিগকে লইয়া আমি চিন্তিত নহি। আমি চিন্তিত আপনাকে লইয়া। কারণ সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী স্থানীয় পঙ্গু হাসপাতালের সবকয়টি আসনই কোনো না কোনো মারাত্মকরূপে প্রহৃত ব্যক্তি দখল করিয়া আছেন। শীঘ্রই তাহারা আরোগ্য লাভ করিবেন এমন সম্ভাবনা দেখি না। প্রহারের পর দারাপুত্রপরিবারের ভগ্নাংশগুলি লইয়া কোন হাসপাতালে ভর্তি হইবেন তাহা আমার ইনটেলিজেন্স শাখার ভারপ্রাপ্ত বদরুমেজর গবেষণা করিয়া বাহির করিতে পারে নাই ...।" ঝাকানাকা প্রশ্ন করেন, "বদরুমেজর? সে আবার কী?" কিংকু চৌধারি, "বদরু নিজের বাহিনীকে আর্মির ছাঁচে সাজিয়েছে স্যার! বদরুলেফটেন্যান্ট, বদরুক্যাপ্টেন, বদরুমেজর ... এগুলি সব পদের নাম। এই তো গ্যালো বিষুদবারেও তো দুটো বদরুক্যাপ্টেন ধরা পড়লো স্যার!" ঝাকানাকা বলেন, "হতভাগাটার তো সেইরকম বাড় বেড়েছে দেখি! তারপর কী বলছে সে?" কিংকু চৌধারি পড়ে চলেন, "আপনার হাতে সময় মাত্র চব্বিশ ঘন্টা। আমার আদেশ পালন না করিলে শরীরের হাড্ডিগুলিকে পুনরায় জোড়া লাগিবার [যদি আদৌ লাগে] আগ পর্যন্ত আলবিদা জানাইয়া রাখিতে পারেন। ইতি, আপনার একান্ত বাধ্যগত দস্যু, বদরু খাঁ।" ঝাকানাকা বলেন, "বটে? হুমমমমম! ... তা মন্ত্রী এম্পি হুড়ো দিচ্ছে কেন আপনাকে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "মহাপরিচালক সাহেব সোজা মন্ত্রী এম্পিদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে নালিশ করেছেন স্যার! আর তারা বেজায় চটেছেন। ওপরঅলাদের ডেকে কড়কে দিয়েছেন আর ওপরঅলারা কড়কাচ্ছেন আমাকে!" ঝাকানাকা বললেন, "কেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার এই মন্ত্রী এম্পিদের তো টিভিতে চেহারা দেখানোর সুযোগ তেমন একটা মেলে না। ঐ সংসদ অধিবেশনই যা ভরসা। এখন সেটাও যদি বদরু খাঁ লোকজনকে দেখতে না দেয় তাহলে ক্যাম্নেকী?" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? আর এই যে বেসরকারী চ্যানেলগুলিতে টক শো হয়? সেখানে তো রোজ দেখি দুটো করে এম্পি আসে দুই দল থেকে। সেইরকম চ্যাঁচামেচি করে।" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার ওসব টক শো দেখায় যখন তখন লোকে মাগছেলেপুলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত জেগে ওসব হট্টগোল সবাই দেখার সময় পেলে তো? সংসদ অধিবেশন তো সকাল সকাল হয়, সবাই দেখতে পায়।" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? আর তাই বুঝি হুড়ো খেয়ে এই গভীর রাতে আমার ঘুমটা পণ্ড করার জন্যে আপনি ছুটে এসেছেন?" কিংকু চৌধারি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, "কী করবো স্যার ... আপনিই আশা ভরসা!" ঝাকানাকা খবরের কাগজটা নিয়ে বললেন, "হুমমমম। তা কী নিয়ে এত গালাগালি হয় সংসদে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার গালি দেয়ার জন্যে কি আর "কী" এর অভাব পড়েছে? যখন যা মর্জি হয় তাই নিয়ে খিস্তিখেউড় হয়।" ঝাকানাকা কাগজ খুলে এক জায়গা থেকে পড়তে শুরু করেন। "আহ, আজ বিকেলেই লালকালি দিয়ে দাগিয়ে রেখেছিলাম। খুবই সঙিন পরিস্থিতি। শুনুন ... পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, অতীতে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে যথেচ্ছ লুটপাট, চুরিদারির নানা তথ্য তুলে ধরা নিয়ে কাউকাউ, চিগ্লাচিগ্লি এবং কয়েক দফা ওয়াকআউটের কারণে গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশন ছিল উত্তপ্ত। অধিবেশনে বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ উপসভাপতি মোবারেক চুন্নুকে সরকারি দল ‘চাম্পু চুট্টা" আখ্যা দেয়। আর স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সরকারি দলের শাসনামলে দেশে সাইক্লোন সৃষ্টি ও লুটপাটের অভিযোগ তোলে বিরোধী দল।" কিংকু চৌধারি বলেন, "হ্যাঁ এখন এ নিয়েই চলছে স্যার।" ঝাকানাকা পড়ে চলেন, "স্পিকার মহব্বত বৈরাগীর সভাপতিত্বে বিকেলে অধিবেশন শুরু হলে বিরোধী দলের ইমদাদ সরকার পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দেন। তিনি চুন্নু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের সমালোচনা করেন। এ সময় প্রথম দফা ওয়াকআউট করে বিরোধী দল। ইমদাদ সরকারের বক্তব্য চলাকালেই সরকারী দলের সংরক্ষিত আসনের মহিলা এম্পি মাজেদা মাশরুম এবং বিরোধী দলের খোদেজা খারতুম প্রবল চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করেন। তাদের হাউকাউয়ে সংসদের ভেতরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় এবং নবীন তরুণ কয়েকজন সাংসদ ভয়ে কেঁদে ফেলেন। সংসদের ভেতরের স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এ সময় চালু হয়ে যায় এবং সকলকেই প্রাণ হাতে বাহিরে ছুটে বেরিয়ে আসতে হয়। একে রানআউট বলা হবে না ওয়াকআউট বলা হবে এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলীয় নেতাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা কলহ শুরু হয়। এক পর্যায়ে মাজেদা মাশরুম ও খোদেজা খারতুম একে অপরের সাথে বিষম চুলাচুলিতে লিপ্ত হন। এ অবস্থায় সরকার দলীয় এম্পি বেচারাম চৌধুরি সংসদে ভীতিকর পরিস্থিতির কথা বলে স্পিকারের কাছে এ থেকে মুক্তি চান। স্পিকারের আদেশে কর্তব্যরত সারজিয়েন্ট অ্যাট আর্মস দুই লড়াকু মহিলা এম্পিদের পৃথক করেন এবং পরস্পরের হাত থেকে অপরের কয়েক গাছি চুল উদ্ধার করেন। এরপর মাজেদা মাশরুম ও খোদেজা খারতুমকে সংসদ ভবন হাসপাতাল কক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কে আগে চিকিৎসা পাবেন এ নিয়ে পুনরায় বিতর্ক শুরু হয়, এবং এক পর্যায়ে মাজেদা মাশরুম ও খোদেজা খারতুম পুনরায় চুলাচুলিতে লিপ্ত হন। কর্তব্যরত সারজিয়েন্ট অ্যাট আর্মস পুনরায় তাদের পৃথক করেন এবং পরস্পরের দাঁত থেকে প্রতিপক্ষের কানের লতির আংশিক উদ্ধার করেন। এরপর তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসায় আর কুলাবে না বলে উত্তমরূপে মাধ্যমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় সাংসদ খোদেজা খারতুমের ডান কানে ব্যান্ডেজ কেন কর্তৃপক্ষ জবাব চাই বলে বিরোধী দলীয় সাংসদরা কিছুক্ষণ স্লোগান দেন।" কিংকু চৌধারি শিউরে ওঠেন। বলেন, "স্যার, বদরুর চ্যালাপ্যালাগুলি মনে হয় এ কারণেই এত ভয় পেয়েছে। রোজ রোজ এমন হড়ড় শো দেখলে একটু তো পেগ্লে যাবেই ওরা!" ঝাকানাকা মন দিয়ে পড়তে থাকেন, "গতকাল অধিবেশনের শুরুতেই স্পিকার ইমদাদ সরকারকে ফ্লোর দিয়ে বলেন, কাউকে অসম্মান ও কটাক্ষমূলক বক্তব্য যেন কেউ এ সংসদে না দেন। কেউ যেন কাউকে চুর বৈতল প্রভৃতি না বলেন। কানাকে কানা ও খোঁড়াকে খোঁড়া বলা অনুচিত বলে তিনি ন্যায়শাস্ত্র থেকে কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন।" কিংকু চৌধারি বলেন, "স্যার স্পিকারের কথা এম্পিরা শোনে না। মাইক পেলেই হট্টগোল করে।" ঝাকানাকা পড়ে যান, "বিরতির পর গুটি গুটি পায়ে সকলে আবার ভেতরে ফেরার পর সরকারী দলের বেচারাম চৌধুরি শুরুতেই সংসদে ভীতিকর পরিস্থিতির কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘স্যার গো, আমি বিয়াপক শঙ্কিত, কারণ পেছনে বসা নারী এম্পিরা যেভাবে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে হাতপায়ের আঙুল উঁচিয়ে আলাজেহোভা বার করে চিগলাচ্ছেন, তাতে কেবল বক্তব্য সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেই চলবে না; তাদের শান্ত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাননীয় স্পিকার, সম্প্রতি আমাদের বিজ্ঞ বন ও পরিবেশমন্ত্রী জনাব শার্দুল মেহগনি বন বিভাগের পঞ্চাশ জন বনরক্ষীকে বন্য জন্তু নিশ্চলীকরণের উপর এক সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আমার মনে হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই তাদের কয়েকজনকে সংসদের ভিতরে মোতায়েন করা উচিত। চেয়ে দেখুন মাননীয় স্পিকার, দুই নারী সাংসদই কামড়ে তাদের প্রতিপক্ষের কানের লতি দুই সুতা চিবিয়ে নিয়েছেন।’ তাঁর এই বক্তব্য শেষে অবশ্য স্পিকার বলেন, ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই। পেম দিয়ে, ভালুবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করে নেব, মা কসম ঠাকুর!’ এরপর তিনি অ্যাকশন হিরো নাড়ুবেল ও মিষ্টি মেয়ে দোদোয়েল অভিনীত একটি পুরনো বাংলা সিনেমার গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, নাঞ্চাকুতে নয়, সামুরাইতে নয়, পেম পেম পেম দিয়ে মন করেছি জয়। আজ বিষুদবার বিকেল তিনটায় আবার অধিবেশন শুরু হবে।" কিংকু চৌধারি বলেন, "স্যার একটু গরম দুধ কি হরলিক্স হবে আপনার বাসায়? মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে!" ঝাকানাকা বলেন, "বদরুর পুরনো চ্যালাচামুণ্ডাদের গেরেফতার করায় সে এখন কলেজ ফেল ছেলে ছোকরা দিয়ে তার গুণ্ডাবাহিনী চালাচ্ছে বলে উড়ো খবর এসেছে কানে। তারা তো দুধের ছোক্রা, এরকম ভয়ঙ্কর কায়কারবার টিভিতে দেখলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। আপনি মহাপরিচালককে বলবেন ক্যামেরাম্যানদের দুয়েকটা অ্যাকশনের ক্লোজআপ নিতে। আর মাসখানেক এরকম চালিয়ে গেলে বদরুর বাহিনী আমরা পুরো কব্জা করে ফেলতে পারবো! তারপর দেখা যাবে হতভাগা বদরুর বদমায়েশি কোথায় যায়! এমন ইসকুরু টাইট দোবো ...!" কিংকু চৌধারি বলেন, "স্যার মহাপরিচালক মনে হয় শয্যাশায়ী। ভীষণ ভয় পেয়েছেন। এসএসএসএফ ডেকে বাসায় গেছেন।" ঝাকানাকা বললেন, "ভীতু লোকজন নিয়ে বড় মুশকিল। যাই হোক, আসুন আজকের টক শোটা দেখা যাক।" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার অনেক রাত তো হলো। আমাকে একটা বুদ্ধি বাতলান, নয়তো আমিও বাড়ি যেয়ে একটু ঘুমাই।" ঝাকানাকা বললেন, "আমার মনে হয় আজকে ষোড়শী টিভির টক শোটা দেখলে কিছু ক্লু পাওয়া যাবে!" কিংকু চৌধারি বললেন, "কেন স্যার কেন?" ঝাকানাকা খবরের কাগজ তুলে নিয়ে বিনোদন পাতা বার করে পড়লেন, "আজ রাত ন'টায় প্রচারিত হবে টক শো ষোড়শীর রাত। এতে উপস্থিত থাকবেন সংরক্ষিত আসনের মাননীয়া সরকারদলীয় সাংসদ মাজেদা মাশরুম ও মাননীয়া বিরোধীদলীয় সাংসদ খোদেজা খারতুম!" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, এনারাই না গতকাল মারপিট করেছিলেন সংসদে?" ঝাকানাকা বললেন, "হুঁ! দেখি আজ সংসদের বাইরে বেসরকারী টিভির ছোটো রিঙে তারা কেমন লড়াই করেন!" রিমোট টিপে ষোড়শী টিভিতে টিউন করতেই এক ক্ষয়াটে চেহারার উপস্থাপককে দেখা গেলো। তার চোখের চাহনি ভীরু চঞ্চল, পরনে স্যুট টাই, লাল মোজা। তিনি সন্তর্পণে একটি চেয়ারে বসা। দুই পাশে দুটি প্রকাণ্ড সিংহাসনে বসে আছেন দুই সংরক্ষিত আসনের মহিলা এম্পি। দুজনেরই দশাসই শরীর। একজনের বাম কানে, অপরজনের ডান কানে ব্যাণ্ডেজ। উপস্থাপক মিনমিনে ভেজাবেড়ালের গলায় বললেন, "সুধী দর্শক, আজ ষোড়শীর রাতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই আমি চারুবাক মুনসি। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন মাননীয়া সরকারদলীয় সাংসদ মাজেদা মাশরুম।" বাম কানে ব্যান্ডেজপরিহিতা বৃষস্কন্ধ মহিলাটি মাথা নাড়লেন। "আরও উপস্থিত আছেন মাননীয়া বিরোধী দলীয় সাংসদ খোদেজা খারতুম।" ডান কানে ব্যান্ডেজভূষিতা শালভূজ মহিলাটি বললেন, "ঘোঁৎ!" টিং করে একটা ঘন্টা বেজে ওঠে বক্সিং রিঙের মতো, দুই এম্পি গা ঝাড়া দিয়ে বসেনে। উপস্থাক ঢোঁক গিলে বললেন, "ইয়ে, মাননীয়া বিরোধী দলীয় সাংসদের কাছে জানতে চাইবো, গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে আমাদের সামনে এখন কী পথ খোলা আছে?" খোদেজা খারতুম কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে বললেন, "ধন্যবাদ চারু মিনসে! আমি শুরুতেই আমার নির্বাচনী এলাকার বিরোধী দলের ব্যালটে সিলমারা ভোটারদের শুভেচ্ছা জানাই। যারা সরকারী দলে ভোট দিয়েছেন তাদের জানাই মুর্দাবাদ! আপনাদের জন্যেই এরকম একটি ফ্যাসিবাদী জঘন্য সরকার আজ ক্ষমতায়। দেশ জাতি ধর্ম এয়ারপোর্টের নাম আজ বিপন্ন। আমাদের নেতা শহীদ চুন্নুর নাম আজ সারা দেশ থেকে মুছে ফেলার জঘন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্ত চলছে। সরকারী দল ভারতের কাছে দেশ বেচে দিতে চাইছে। সরকারী দলের নেত্রী, ভোটচোর ঢালী বিলকিস আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভারতে গিয়ে দেশটিকে আন্তর্জাতিক দরের অর্ধেক দরে বিক্রি করে এসেছেন। তাদের যৌথ ষড়যন্ত্রের কারণে গত মাসে আমার ভাইঝির বিয়ের সময় কলকাতায় শাড়ির দাম আমাদের গত সরকারের আমলের দামের প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। একটা লেহেঙ্গার দাম নিয়েছে প্রায় চল্লিশ হাজার ভারতীয় রূপি। দেশের মানুষ এই জঘন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশাসনের ষড়যন্ত্রে আজ দিশেহারা। চারিদিকে অরাজকতা। কলকাতায় বিয়ের শপিং করতে গিয়ে দরিদ্র মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশের ভিতরেও পরিস্থিতি খারাপ। আমাদের আমলে আমার বড় ছেলেকে মাসে দশ হাজার টাকা হাত খরচ দিতাম, সে এএফসি বিএফসি সিএফসিতে তার বান্ধবীকে নিয়ে খেয়ে হেসেখেলে চলতে পারতো। আর এই ইয়াজোট সরকারের আমলে দেখুন আপনারা! আমার ছোটো ছেলে বিশ হাজার টাকার এক পয়সা কম দিলে চিৎকার চেঁচামেচি হট্টগোল করে কেঁদে ভাসায়। একটা বাচ্চা ছেলে তার বান্ধবীকে নিয়ে ঢাকা শহরে খেয়ে পরে চলতে গেলে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়! কেন? এই ইয়াজোট সরকারের অপশাসনের কারণে! টেন্ডার চান্দাবাজিতে আজ জনগণ দিশেহারা। সরকারদলীয় এম্পিরা দুহাতে কামাচ্ছে। প্লট আদায় করছে। চান্দাবাজির তোল্লা আদায় করছে। আর আমরা? গ্যালোবার জমানো টাকা টিপে টিপে খরচা করছি। দুটো প্লট পেয়েছিলাম তার একটায় মাত্র ফাউন্ডেশন করতে পেরেছি, আরেকটায় বাঁশ পুঁতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছি এই জমির মালিক বেগম খোদেজা খার্তুম! ধিক সেই জাতিকে যে জাতির সংরক্ষিতাদের প্লটে বাড়িটুকু পর্যন্ত ওঠে না!" চোখে আঁচল দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। চারু মুনসি শুধরে দিতে চান, "সংরক্ষিতা নয় মাননীয়া সাংসদ, কথাটা হবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদ ...।" খোদেজা খারতুম বসা গলায় বলেন, "ধন্যবাদ চারু মিনসে! আমি এই কথা সংসদে বলতে গিয়েছিলাম। তখন এই মাজেদা মাশরুম আমাকে আবাগী বলে গালাগালি করে আক্রমণ করে। দেখুন আমার ডান কানের লতি সে চিবিয়ে দুই সুতা খেয়ে ফেলেছে। সারা দেশটা এরা খেয়ে শেষ করেছে, পেট ভরেনি, এখন আমাদের কানের লতি ধরে কামড়ায়!" চারু মুনসি বিব্রত দৃষ্টিতে তাকান মাজেদা মাশরুমের দিকে। কিন্তু মাজেদা মাশরুম ভাবলেশহীন! তিনি কিছুই বলেন না, কেবল বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন খোদেজা খারতুমের দিকে। খোদেজা খারতুম চিৎকার করে বলে চলেন, "আপনারা কোন সাহসে চুন্নু এয়ারপোর্টের নাম পাল্টাতে যান? আমাদের নেতা মরহুম চুন্নুর নাম দেশ থেকে মুছে ফেলা এত সহজ? আমার বোনের ছোটো ছেলেটার নাম চুন্নু! পারবেন ওর নাম পাল্টিয়ে মধু ঢালী রাখতে? পারবেন?" মাজেদা মাশরুম প্রকাণ্ড একটা হাই তোলেন শুধু। চারু মুনসি অস্বস্তিভরে ডানে বামে তাকান। খোদেজা খারতুম মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে মীর জুমলার কামানের মতো মুখ করে গর্জাতে থাকেন, "আপনারা বলেছেন আমার দলের নেত্রীর সোনার ছেলে মোবারেক চুন্নু নাকি চুট্টা! কোন সাহসে আপনারা তাকে চুট্টা বলেন? সে কী চুরি করেছে? সে আমাদের নেতা! সাগরের মতো বিশাল তার বুক। আমাদের প্রতিটি কর্মী মোবারেক চুন্নু বলতে অজ্ঞান। আর আপনারা তাকে গুন্ডা লাগিয়ে পিটিয়ে পোঁদের হাড় ফাটিয়ে জখম করেছেন! সে এখন সিঙ্গাপুরে, নড়তে চড়তে পারে না, পটিতে বসে হাগু করে আর দেশের জন্য কাঁদে! তাকে আপনারা চুট্টা বলেন, অথচ তার চিকিৎসার খরচ পর্যন্ত আমাদের গরীব কর্মীরা বাড়িগাড়ি বেচে চান্দা তুলে যোগাড় করছে রোজ রোজ! আমার ভাবী তার হামার গাড়িটা বেচে দিয়েছেন মোবারেক চুন্নুর চিকিৎসার জন্য, জানেন? আর জানবেন কোত্থেকে? চুরির পয়সা ঠিকমতো খরচ করার রুচি আপনাদেরে থাকলে তো? দুটো পয়সার মুখ দেখলে ট্রাক কিনে রাস্তায় নামিয়ে দ্যান আপনারা, হামার গাড়িতে চড়ার বুকের পাটা থাকলে তো!" কিমাশ্চর্যম, মাজেদা মাশরুম আবারও একটি হাই তোলেন শুধু। একটানা কথা বলে খোদেজা খারতুম হাঁপিয়ে ওঠেন, জগ তুলে পানি খান ঢকঢক করে। চারুবাক মুনসি কম্পিত গলায় বলেন, "মাননীয়া সরকারদলীয় সাংসদ, আপনি বলুন, গণতন্ত্রকে কার্যকর করে তোলার জন্যে আসলে বিরোধী দলের ভূমিকা কতটুকু?" মাজেদা মাশরুম ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলেন, "ধন্যবাদ চারু মিনসে! আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই ষোড়শী টিভির দর্শকদের। আপনার প্রশ্নটা আমি বুঝিনি, কিন্তু জাতির উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, আমাদের, এই মহিলা এম্পিদের আরো সংযত হতে হবে। কথা বলতে হবে আরো মিষ্টি করে, আরো নরম করে, আরো সুন্দর করে। এক বিঘৎ হাঁ করে ওরকম গাঁক গাঁক করে চ্যাঁচানো আমাদের শোভা পায় না ...।" খোদেজা খারতুম চিলচিৎকার করে ওঠেন, "ওরে পোড়ারমুখী, তুই কী বলতে চাস রে ছোটোলোক, আমি চ্যাঁচাই? তোর কথা ছেড়েই দিলাম, তোর দলের ঐ যে এম্পি যেটা আহাম্মদপুরে আমার পাশের বিল্ডিঙে থাকে, সেই হামিদা হারপুন যে পেত্যেক জুম্মাবার মাছের বাজারে গিয়ে মাছঅলাদের সাথে চিল্লাচিল্লি করে, তার কোনো খোঁজখবর রাখিস? এই তোদের জন্যই দেশে গণতন্ত্র নাই! আবার বলিস আমার নেত্রী মর্জিনা চুন্নু অশিক্ষিত? বলিস আমার নেতা মোবারেক চুন্নু অশিক্ষিত? অশিক্ষিত তোরা! দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ইন্টারনেটে লেখাপড়া করা যায়। আমার নেতা সিঙ্গাপুরে বসে গবেষণা করছে! তোর নেত্রীর মতো চোরাই ডক্টরেটের আড়ত নই, আর তার ছেলের মতো টুকে পাস করা আইটিকুতুব নই বলে কি আমাদের কোনো দামই নেই?" কিমাশ্চর্যম, মাজেদা মাশরুম চুপ করে কথাগুলো শোনেন কেবল। চারু মুনসি অস্বস্তিভরে তাকান তার দিকে। খোদেজা খারতুম আবারও জগ তুলে পানি পান করেন কোঁতকোঁত করে। মাজেদা মাশরুম সেই অবসরে আবারও বলেন, "যা বলছিলাম, সাংসদা যারা আছি আমরা, তাদের হতে হবে ভদ্র মিষ্টি লক্ষ্মী। সাত চড়েও আমাদের রা কাড়া চলবে না। আমরা কথা বলবো আস্তে আস্তে, এবং কদাচ বেঞ্চের ওপর উঠে চিৎকার করবো না। কান কামড়ে ছিঁড়ে নেয়া ... ও বাব্বাহ আমি ভাবতেই পারি না!" ঝাকানাকা লাফিয়ে ওঠেন, "জনাব কিংকু! এক্ষুণি ষোড়শী টিভিতে ফোর্স পাঠান! বলুন মাজেদা মাশরুমকে গ্রেফতার করতে! এটা আসল মাজেদা মাশরুম নয়, বদরু খাঁ! আর যত তাড়াতাড়ি পারেন আসল মাজেদা মাশরুমের বাড়িতে লোক পাঠান। আমার ধারণা ভুল না হলে হতচ্ছাড়া বদরু তাঁকে অজ্ঞান করে বেঁধেটেধে রেখেছে!" কিংকু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওয়্যারলেস টিপে নির্দেশ দিতে থাকেন। তারপর এক ফাঁকে বলেন, "স্যার বুঝলেন কী করে?" ঝাকানাকা হাতের তালুতে কিল মেরে বললেন, "তাকিয়ে দেখুন! টিভির এই মাজেদা মাশরুমের বাম কানে ব্যান্ডেজ!" কিংকু বোকার মতো তাকিয়ে দেখে বলেন, "তো কী হয়েছে স্যার? খোদেজা খারতুম কামড়ে দিয়েছে ... পেপারে পড়েননি?" ঝাকানাকা উত্তেজিত গলায় বললেন, "কিন্তু খোদেজা খারতুমের ব্যান্ডেজ তো ডান কানে!" কিংকু বলেন, "হ্যাঁ, পেপারে তো তা-ই লিখেছে! বিরোধী দলের সাংসদরা তা নিয়ে মিছিলও করেছে।" ঝাকানাকা বলেন, "মনে করুন, মারপিট লেগেছে। আপনার প্রতিপক্ষের ডান কান আপনি কামড়ে ধরেছেন। এ অবস্থায় সে কি পাল্টা আপনার বাম কানে কামড়ে ধরতে পারবে?" কিংকু কিছুক্ষণ মনে মনে ভেবে বাতাসে আঙুল দিয়ে ছক কেটে বলেন, "না স্যার!" ঝাকানাকা বলেন, "বদরুও সেই ভুল করেছে। মনে হয় আসল মাজেদা মাশরুমের মুখোমুখি বসে মেকআপ নিতে গিয়ে বাম ডান গুলিয়ে ফেলেছে! আজ ব্যাটাকে পেয়েছি বাগে!" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, আমি অবশ্য ভাবছিলাম, এরকম মিষ্টি মিষ্টি কথা সরকারী দলের সংরক্ষিত আসনের মহিলা এম্পিরা বলেন না দেখে আপনি হয়তো সন্দেহ করেছেন! হতচ্ছাড়াটা নিজের চ্যালাচামুন্ডাকে কনভিন্স করার জন্যে নিরীহ নখদন্তহীন মহিলা এম্পি সেজেছে কেমন দেখুন!" ঝাকানাকা কিছু বললেন না, টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলেন। সেখানে এক বিস্ময়কর দৃশ্য। মাজেদা মাশরুম আর খোদেজা খারতুম গলাগলি করে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। চারু মুনসি টাই তুলে চোখ মুছছে। প্রাসঙ্গিক সংযোজন [সমাপ্ত] . . . গোয়েন্দা ঝাকানাকা! | Promote Your Page Too [/justify]
false
hm
কৃৎ-প্রত্যয় তারেক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে কাপগুলোকে। চীনামাটির পেয়ালা, ধবধবে সাদা, তার ওপর নীলের সরু কারুকাজ। ফ্যাকাসে, মলিন, মৃত সাদা রং নয়, কাপটি যেন তার ধবল রঙেই প্রাণ পেয়েছে একটি বলাকার মতো, আর নীল নকশী বলয়টি যেন তার কণ্ঠহার। চারপাশে ঘুরঘুর করছে অন্যান্য ক্রেতারা। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বিক্রয়কেন্দ্র, ইকেয়া। ঘরের সব প্রয়োজনীয় জিনিস মেলে এখানে, ময়লা ফেলার টুকরি থেকে শুরু করে পুরো রান্নাঘর বা আস্ত শোবার ঘরের সরঞ্জাম। বিরাট সব শেলফে থরে থরে সাজানো এক একটা আইটেম। দামগুলো দেখে তারেক একটু দমে যায় শুধু, পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিসগুলোর দাম এত বেশি কেন হবে? হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেও মন সায় দেয় না তারেকের। কী লাভ? এ তো অন্যের রয়ে যাবে, তার নিজের হবে না! তারেকের বউ মুনিরা চড়ুই পাখির মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে এক একটা জিনিসের সামনে। সে মোটে পরশুদিন পা ফেলেছে এই দানবদের দেশে। তারেক আর মুনিরার বিয়ে হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে, ভিসার নানা শর্ত পূরণ করতে গিয়ে জার্মানীতে আসার আগে মুনিরা এক বছরের বিরহ উপহার দিয়েছে তারেককে। মুনিরার অবশ্য বক্তব্য উল্টোরকম, তারেক কেন এরকম পচা দেশে থাকে, যেখানে সে চাইলেই চলে আসতে পারেনি এক বছর আগে, এ নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত ছিলো না এই একটা বছরে। একটা দিন বেচারীকে বিশ্রাম করতে দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে তারেক। ইকেয়া থেকে হাত বোঝাই করে কেনাকাটা করে নিয়ে যাবে সে আজ। তাদের নতুন সংসার, হাত খুলে তারা দু'জন মিলে সাজাবে। তারেক ডাক দেয়, "মুনিরা! দেখে যাও কাপগুলো।" মুনিরা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ছুটে এলো। "কোনটা, কোনটা?" তারেক আঙুল তুলে দেখায়। "এটা কেমন হয়?" মুনিরা কাপটা হাতে নিয়ে দেখে। "এটা? এত বড় কাপ? না না না। আরো ছোট দরকার। এটা তো পুরো গোসল করার মগের মতো বড়ো! ... ঐ যে আরো ওপরে, ঐ যে হালকা সবুজের ওপর সাদার বর্ডার, ওটা দ্যাখো না!" তারেক হাত বাড়িয়ে মুনিরার নাগালের বাইরে সাজানো কাপটা নামিয়ে আনে। "কী লেখা এখানে?" মুনিরা পড়ার চেষ্টা করে। "পড়ো দেখি, কেমন জার্মান শিখেছো এতদিন ধরে!" তারেক কপট গাম্ভীর্য নিয়ে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারদের ভঙ্গিতে বুকে হাত বাঁধে। মুনিরা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "পারবো না! বিশ্রী একটা ভাষা!" তারেক হাত বাড়িয়ে কাপের মধ্যে গোঁজা কার্ডটা পড়ে। "বারো পিস কাপ আর পিরিচ, ঊনিশ ইউরো পঁয়তাল্লিশ সেন্ট।" মুনিরা মনমরা হয়ে বলে, "এত?" তারেক হাসে। "মনে মনে আটানব্বই দিয়ে গুণ করছো নাকি? তাহলে কিন্তু চলতে ফিরতে বিপদে পড়বে।" মুনিরা হাসে না। শুকনো মুখে বলে, "এই নীলটার দাম কতো দ্যাখো তো?" তারেক নীল কাপটার শেলফের দিকে তাকায়। "এটাও বারো পিস, একুশ ইউরো।" মুনিরা বলে, "তাহলে কি এই লাল সেটটা নিয়ে যাবো? এটা একটু সস্তা, ষোল ইউরো সত্তর সেন্ট, বারোটা।" তারেক বলে, "বাহ, এই তো বেশ পড়তে পারছো ! যাক, তুমি কিছুটা শিক্ষিৎ তাহলে!" মুনিরা কোন দ্বিধা না করেই কিল মারে তারেকের বাহুতে। "লাল রঙের কাপে চা দিলে খাবে কেউ?" তারেক ছোট সাইজের আরেকটা নীল সেট উল্টেপাল্টে দ্যাখে। হালকা সবুজ রঙের কাপটা তার পছন্দ হয়নি। নীল কাপটার মধ্যে নকশাটা তার খুব মনে ধরেছে। মুনিরাও জানে, নীল রং তারেকের খুব পছন্দ। তাদের শোবার ঘরের পর্দাগুলো নীল, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, কম্বলের খোল, সব নীল। "অনেক দাম পড়ে যাবে না?" মুনিরা কিন্তু-কিন্তু মুখ করে বলে। "উঁহু। ঠিকই আছে।" তারেক আশ্বস্ত করে মুনিরাকে। "চলো, ভাগেনে রাখি সেটটা।" কাগজের শক্ত মোড়কে রাখা কাপ আর পিরিচগুলোকে যত্ন করে ট্রলিতে সাজাতে শুরু করে মুনিরা। ট্রলিতে আরো দেখা যাচ্ছে একটা সসপ্যান, বড় দুটো ডেগচি, একটা কাঁচের জগ, একটা কাঠের খুন্তির সেট। "কেমন লাগছে এখানটা?" তারেক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে মুনিরাকে। "দারুণ!" উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে মুনিরা। "ইচ্ছা করছে সবকিছু কিনে নিয়ে যাই!" তারেক হাসে। ইকেয়ার ভেতরটা এত সুন্দর করে সাজানো, কোন কিছুর দরকার না থাকলেও কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে বাড়িতে ইকেয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে যায় ওদের লোকজন, ঝকঝকে মসৃণ কাগজে দামী ছাপা একেকটা ছবির বই, তাতে সুন্দর সুন্দর জিনিসের ছবি আর দাম। সেই বইয়ের ঘরগুলো দেখলে তারেকের মন খারাপ হয়। তাকে আরো অনেক পথ পেরোতে হবে ওরকম একটা ঘরের জন্য। মুনিরা আবারও তুরতুর করতে থাকে বিভিন্ন শেলফের সামনে গিয়ে। কোন কিছু পছন্দ হলে সেটা উল্টেপাল্টে দেখে সে ঝুঁকে পড়ে শেলফের গায়ে লেখা দাম পড়ার চেষ্টা করে। তারেক নিজে যেদিন প্রথম ইকেয়াতে এসেছিলো, সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। মুনিরার মতোই ভালো লেগেছিলো তার। অবশ্য তখন তার একার প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্যেই যা কিছু কেনাকাটা করার ছিলো, তখনও তার কোন আয় নেই, অনিশ্চিত একটা জীবন সামনে, দেশ থেকে সঙ্গে করে আনা সামান্য টাকার একটা অংশ দিয়ে রান্নাবান্নার জিনিস কিনেছিলো তারেক। বেছে বেছে সবচেয়ে সস্তা জিনিসটা কিনেছিলো তখন। ঢাউস খাবার প্লেট, ঠনঠনে সসপ্যান, সবচেয়ে সস্তা কম্বলের খোল। তারেকের হঠাৎ খুব ভালো লাগে আজকের এই দিনটা। তার নতুন করে সাজানোর সময় এসেছে সবকিছু, সেই সঙ্গতিও এখন তার আছে। সেই প্রথমবারের মতো ইকেয়ার শেলফগুলোর সামনে মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না তাকে আর মুনিরাকে, সবচেয়ে সস্তা জিনিসটা কিনে নিজেকে অকারণ প্রবোধ দিতে হবে না। তারেক টের পায়, সে খুব হাসছে, সুখী একজন মানুষের মতো। তার ইচ্ছা করে এখনই, এই মূহুর্তে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে ডালের চামচের দাম পড়তে থাকা মুনিরাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। মুনিরা ডালের চামচটা রাখে ট্রলিতে। "এটার দাম ভালো, নব্বই সেন্ট!" তারেক বলে, "নিউ মার্কেটে কতো হবে, বলো দেখি?" মুনিরা কিছুক্ষণ ভাবে। "উমমমম, কতো আর, চল্লিশ টাকা, খুব বেশি হলে?" তারেক হাসে মিটিমিটি। "তুমি কখনো নিউ মার্কেট থেকে ডালের চামচ কিনেছো?" মুনিরা মাথা নেড়ে হাসে। "না তো! যা লাগে আব্বা নাহলে আম্মা গিয়ে কিনে এনেছে সব সময়। আমি নিউ মার্কেট থেকে শুধু চুড়ি কিনি!" তারেক হাসে। নিউ মার্কেটে মেয়েদের সাথে গিয়ে কোন কিছু কেনাকাটা করার বড় হ্যাপা। মেয়েরা যেমন সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে একটা কিছু পছন্দ করে প্রচুর দরদাম করে কিনতে পারে, সেটা ছেলেরা পারে না বলেই তার বিশ্বাস। "তোমার উচিত ছিলো আম্মাকে নিয়ে একবার নিউ মার্কেটে গিয়ে ডালের চামচ কেনা।" তারেক হাসে নিজের মায়ের কথা মনে করে। কেনাকাটা করতে তারেকের মা বেশ ভালোবাসেন। তাঁর পছন্দ সংসারের টুকিটাকি জিনিস। সবচেয়ে ভালো জিনিসটা সম্ভাব্য সবচেয়ে কম দামে কিনে আনবেন, এটাই তাঁর কেনাকাটার লক্ষ্য। তারেক যখন কলেজে পড়ে, তখন একবার মায়ের সাথে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলো, দশ মিনিট দরাদরি করে একটা ডাল ঘুঁটুনির দাম কুড়ি টাকা থেকে পনেরো টাকায় নামিয়ে তারেকের মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তারেক অবশ্য মোচড়ামুচড়ি করছিলো, তারেকের মা সাফ বকে দিয়েছিলেন তাকে সবার সামনে, "তর তাড়াহুড়া থাকলে তুই যাগা। জিনিসপত্র কিনার সময় প্যাটপ্যাট করবি না!" তারেক অনেক পরে ধরতে পেরেছে, এই দামাদামিটা করতেই তার মা ভালোবাসেন। "কেন?" মুনিরা দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন করে। তারেক স্মৃতিচারণে ডুবে ছিলো বলে খেয়াল করেনি, বাহুতে খোঁচা খেয়ে সে আবার ফিরে আসে ইকেয়ার রান্নাবান্নার সরঞ্জামের বিভাগে। "কী কেন?" "মায়ের সাথে নিউ মার্কেটে গিয়ে কিনলে কী হতো?" মুনিরা প্রশ্ন করে বিশদভাবে। "ওহ ... নাহ, তাহলে ডালের চামচ তিরিশ টাকায় কিনতে পারতে। আম্মাকে ঠকায় এমন দোকানী ভূভারতে নেই।" "এখানে আসলে মা তাহলে মজা পাবেন না একদম।" মুনিরা হাসে। "এখানে সব কিছুর ফিক্সড প্রাইস।" তারেক ভাবে, তার মা কখনো জার্মানীতে এলে ইকেয়াতে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। এতো চমৎকার একটা কেনাকাটার জায়গা দেখলে তিনি মুগ্ধ হবেন নিশ্চয়ই। ঢাকায় নিশ্চয়ই এমন একটা জায়গা আজও খোলেনি, যেখানে বিশাল ছাদের নিচে ঘরভর্তি শুধু বিভিন্ন জিনিস শেলফে বোঝাই করা, কোন দোকানী নেই, দামাদামি হাঁকাহাঁকির প্রয়োজন নেই, শুধু তুলে ট্রলিতে রাখো আর দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ো। "তুমি নাকি কেনাকাটার সময় মা-কে খুব জ্বালাতন করো?" মুনিরা প্রশ্ন করলো। "আমি? আমি কিভাবে জ্বালাতন করবো?" তারেক ন্যাকা সাজে। "তুমি নাকি শুধু হুড়োহুড়ি করো। খালি নাকি জলদি জলদি করতে বলো?" তারেক হাসে। দেশে থাকতে কেনাকাটার কাজটায় সে বরাবরই ফাঁকি দিয়ে এসেছে। ওটা তার ভাই বা বোন বা মা বরাবর করেন। কখনোসখনো মায়ের সাথে তারেককে যেতে হয়েছে, দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করতে তার হাঁসফাঁস লাগতো। আর কেনাকাটা হতোও সব মেয়েলি জিনিস, এর বিয়েতে শাড়ি, ওর বিয়েতে ডিনার সেট, ওর জন্মদিনে বাচ্চার জন্য জামা। তারেক নিজের কেনাকাটা সব দুমদাম করে মিটিয়ে ফেলেছে সারাজীবন। এলিফ্যান্ট রোডে বাঁধা দোকান, তেত্রিশ ইঞ্চি কোমরের জিন্সের প্যান্ট, দাম কতো বললেন ... আটশো? ধুর ভাই, খামাকা সময় নষ্ট করেন। পাঁচশো। এই দুটা নিচ্ছি। এক হাজার। না, আর দিবো না। তারেক কৈফিয়ত দ্যায়, "আমার আসলে ঐ রসিয়ে রসিয়ে কেনাকাটার রসটা ঠিক ... কী বলে এটাকে ... বোঝার সুযোগ আসেনি। আম্মা তো খুব দেখেশুনে দরদাম করে কেনেন, আমার ধৈর্যে কুলায় না। ... কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?" মুনিরা বলে, "আবার কিভাবে? মা-ই বলছিলেন একদিন বিরক্ত হয়ে। বললেন জার্মানী গিয়ে দেখেশুনে সবকিছু কিনতে, তুমি ধমকাধমকি করলে উল্টে তোমাকে ধমক দিতে।" তারেক গম্ভীর মুখে বলে, "বেশ। দেখেশুনেই কেনো। কিচ্ছু বলছি না।" মুনিরা এগিয়ে যায় একগাদা পাপোষের দিকে। তারেক হঠাৎ একটু অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। একটু আগে নিজের ভালো লাগার কথা ভেবে সে হঠাৎ বুঝতে পারে, এই যে কেনাকাটা করতে আসা, খুব বেছে বেছে কেনা, দরদাম করা, এর পেছনের আনন্দটুকু অন্যরকম, শুধু খরচ করায় নয়, খরচ বাঁচানোতেও নয়। নিজের সংসারটা তিল তিল করে সাজানোর তৃপ্তিটুকু আজ কাজ করছে তার মধ্যে, তার মায়ের মনেও নিশ্চয়ই এই একই ভালোলাগাটুকু কাজ করেছে এতটা দিন। নিউ মার্কেটে পনেরো টাকা দিয়ে সেই ডাল ঘুঁটুনিটা কেনা কি শুধু দরদাম করে পাঁচটা টাকা কমানোর জন্যেই? আম্মা নিশ্চয়ই সেই সময়টুকু উপভোগ করছিলেন খুব, রোদের নিচে দাঁড়িয়ে, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে তারেকের চোখে একইরকম বিশপঁচিশটা ডাল ঘুঁটুনির মধ্যে তাঁর চোখে সেরাটা বেছে কেনার প্রত্যেকটা মূহুর্ত নিশ্চয়ই উপভোগ করছিলেন তিনি। একই রকম ভাবে তারেকের খালাতো ভাইয়ের বিয়েতে কেনা শাড়ি, চাচাতো বোনের বিয়েতে কেনা ঘড়ি ... প্রত্যেকটা জিনিস কেনার সময়ই এই যত্নটুকু, এই আনন্দটুকু কাজ করেছে তাঁর মধ্যে। তারেক প্রত্যেকবারই বিরক্ত মুখে তাগাদা দিয়েছে তাঁকে। আজ যদি কেউ তারেককে হুড়ো দিয়ে বার করে নিয়ে আসে ইকেয়া থেকে, তার কি আদৌ ভালো লাগবে? মুনিরা একটা পাপোষ নিয়ে দৌড়ে আসে। "দ্যাখো, এটাতে ভিলকমেন লেখা। দাম লেখা আট ইউরো! এটা কি ঠিক আছে?" তারেক মাথা দোলায়। "ঠিক আছে।" মুনিরা ট্রলিতে পাপোষটা রেখে আবার ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় অন্যদিকে। তারেক এগিয়ে গিয়ে পাপোষটা ভাঁজ করে রাখে ট্রলির নিচের দিকে। একটা কাপ বেরিয়ে পড়েছে প্যাকেটের ভেতর থেকে, সেটাকে আবার ভেতরে গুঁজে দেয় সে। সুন্দর সেটটা। তার সংসারের প্রথম কাপ সেট। কাপ নিয়ে একটা স্মৃতি খচ করে ওঠে তারেকের ভেতর। তার মুখের ভেতরটা নিমিষে তিক্ত হয়ে যায়। বাবা মারা যাবার কিছুদিন পর একটা কাপ তারেক ভেঙে ফেলেছিলো। মা তখন খুব মানসিক বিপর্যয়ের মুখে ছিলেন, তিনি হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিলেন, "করলি কি এইটা? ভাইঙ্গা ফালাইলি? তর আব্বার হাতের কাপটা!" তারেক সেদিন খুব তীব্রভাবে বকেছিলো মা-কে। কেন, কে জানে? হয়তো বাবার স্মৃতির সাথে জড়িত প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে মায়ের এই খুঁতখুঁতুমি দেখেই। তারেকের মা অসহায় মুখে বলেছিলেন, "এইটা একটা স্মৃতি, আমরা পয়লা পরথম কিনলাম, আমাগো সংসারের প্রথম কাপ সেট, ভাইঙ্গা ফালাইলি, আর আমি রাগ করুম না? মানুষটা নাই, জিনিসটা তো আছে!" তারেক আরো চেঁচামেচি করেছিলো সেদিন মায়ের সাথে। তারেকের মা কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিলেন। একটু পর কাপ ভাঙার ঝন ঝন আওয়াজ শুনে তারেক দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, সেই সেটের বাকি কাপ আর পিরিচ মা আছড়ে আছড়ে ভাঙছেন। তারেক কিছু বলেনি আর। মা-ও কিছু বলেননি। তারেকের বুকটা ধ্বকধ্বক করতে থাকে। মা-কে সেদিন সে যা বোঝাতে চেয়েছিলো, বোঝাতে পারেনি। তারেক শুধু বলতে চেয়েছিলো, একটা কাপের চেয়ে তারেকের নিজের মূল্য কি স্মৃতি হিসেবে বড় নয়? কাপটা ভেঙে গেছে, কিন্তু তারেক আছে, তার ভাই আর বোন আছে, তারও তো সবাই তাদের বাবার স্মৃতিই। একটা সামান্য কাপ নিয়ে কেন মা এতো রাগ করবেন? তারেকের চোখে আচমকা জল চলে আসে। সে বুঝতে পারে, সেদিন সেই ভেঙে ফেলা কাপটা আর কাপগুলোর কাছে সে কিছুই না। তার, তার ভাইয়ের, তার বোনের চেয়ে অনেক উঁচুতে বসে আছে সেই কাপটা, সেই কাপগুলো। সেই কাপগুলো যখন কিনতে বেরিয়েছিলো তার বাবা, মা-ও কি ছিলেন না সাথে? নিউ মার্কেটের কোন দোকান থেকে হয়তো বিস্তর দরদাম করে কিনেছিলেন সেই সেটটা, তাঁদের সংসারের প্রথম কাপ সেট, কত আনন্দ তার সাথে জড়ানো। তখন তারেক ছিলো না, ছিলো না তার ভাই, তার বোন, শুধু বাবা ছিলেন, মা ছিলেন, আর সেই কাপ সেটটা ছিলো। নতুন সংসার গোছানোর আনন্দটা ছিলো। আজ যেমন তারেক মুনিরাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছে ভিন দেশের দোকানে, যে গভীর আনন্দ তাকে গ্রাস করেছিলো কিছুক্ষণ আগে, সেই একই আনন্দ জড়ানো সেই ভেঙে ফেলা কাপগুলোর সাথে। তারেক মুনিরাকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত মুখ ফেরায়। মুনিরা ঝলমলে মুখে একটা ফ্লাওয়ার ভাস হাতে নিয়ে বলে, "তেরো ইউরো! সুন্দর না?" তারেক মাথা দোলায়। সুন্দর। মুনিরা সন্তর্পণে ট্রলিতে ভাসটা রেখে আবার ফিরে যায় অন্যদিকে। তারেক পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে। খুব কি দেরি হয়ে গেলো? প্রায় তেরো বছর। মাপ চাওয়ার জন্য খুব কি দেরি হয়ে গেলো? তার তো সংসার ছিলো না এতদিন, সে কিভাবে বুঝবে এই ভালোবাসার কথা? মা বুঝবেন নিশ্চয়ই। তারেক কাঁপা হাতে ডায়াল ঘোরায়। দূরে মুনিরা ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। তারেকের সংসার একটু একটু করে সেজে উঠছে ইকেয়ার রঙিন আলোয় ভরা ছাদের নিচে। [সমাপ্ত]
false
rn
রহস্য_হুমায়ূন আহমেদ (হূমায়ূন আহমেদ এর লেখা আমর সব সময়'ই ভালো লাগে।কেন ভালো লাগে জানি না।এক টা বই তিন চার বার পড়তে ও খারাপ লাগে না।লোক টা যাদু জানে!হূমায়ূন আহমেদ কে নিয়ে অনেকের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে।হূমায়ূন আহমেদ অসাধারন একজন মানূষ।আমি জানি অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না।কিন্তু আমার ভালো লাগে।যাই হোক,হুমায়ূন আহমেদের একটা ছোট গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।)রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে – সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি থামালাম। এ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?জ্বি না।এক রাত থাকেন আমার বাসায়। নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।আরে দুর! কি যে বলেন?ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?হ্যাঁ চিনি।তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন একটা নিউজ করবেন।ভালই তো। নিউজ হবার মতই খবর।আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত।আমাকে শোনালে কি হবে?আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদের কথার একটা আলাদা দাম।তাই নাকি?আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?জ্বি না।উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মুখভর্তি করে হাসলেন। টেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই।না, চা খাব না।আরে ভাই আসেন না। প্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেতে হল চায়ের দোকানে।চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? চপ?না।আরে ভাই খান না। এই এদিকে দু’টো চা দে তো। এখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন।চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটা রহস্যের কথা শুরু করলেন। নাইনটিন সিক্সটিতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেন। তার বাসার কাছে বড় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। অমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোন টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মত?ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?বিশ্বাস করব না কেন?আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছি। একদিন শোনাব আপনাকে।ঠিক আছে।বরিশালের ডিসি সাহেবও শুনেছেন। চেনেন উনাকে? আসগর সাহেব। সি এস পি। খুব খান্দানী ফ্যামিলি।না, চিনি না।ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিরাট অফিসার।তাই বুঝি?জ্বি। উনার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব খাতির-যত্ন করলেন। গুলশানের বাসা। তিন তলা। উনি থাকেন এক তলায়। ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন।ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেন। আমার মায়াই লাগলো। ইন্ডেন্টিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেন। দেখেই বুঝা যায় অভাবে পর্যুদস্ত। চোখের দুষ্টি ভরসাহারা। বয়স এখনো হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়। বিচিত্র চরিত্র।মাস খানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হল না। তার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সে সব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। নিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই না। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবে। আর ছাড়ানো যাবে না। কিন্তু তবু দেখা হল। একদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে। ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছে। কি মুসিবত।একদিন আর এড়ানো গেল না। ভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির।কি ভাই আপনি তো আর এলেন না?কাজের ব্যস্ততা …আজকে আপনাকে নিতে এসেছি।সে কি?কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন।তাই বুঝি?জ্বি। চিনেত তো শামসুল আলম সাহেব কে? দু’টো কবিতার বই বেরিয়েছে। পাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোত্স্না।তাই বুঝি?জ্বি। আমাকে দু’টো বই-ই দিয়েছেন। খুবই বন্ধু মানুষ। বাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা।ও।উনার ছোট ভাইও গল্প টল্প লেখেন। আরিফুল আলম।গেলাম তার বাসায়। ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মত দু’কামরার বাড়ি। মেজাজ খুবই খারাপ। রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্য। কত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে!ভদ্রলোক আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। মহিলার হাতের সযত্ন স্পর্শ আছে। ভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম না। এ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। খুবই অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপসী। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।আমার স্ত্রী লীনা। আর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদ। এর কথা তো তোমাকে বলেছি।লীনা হাসি মুখে বললো, জ্বি আপনার কথা প্রায়ই বলে।লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।লীনা চলে গেল ভেতরে। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছে। কয়েক দিন আগে সাপ নিয়ে একটা গল্প লিখেছে। মারাত্মক গল্প ভাই। আপনাকে পড়ে শোনাতে বলবো। আমি বললে পড়বে না। আপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন।আমি বললাম, গুণী মহিলাতো!ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব না। গানও জানে। নজরুল গীতি। ভালো গায়। বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে।তাই নাকি?জ্বি, শোনাবে আপনাকে। একটু প্রেসার দিতে হবে আর কি। আপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবে। কাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন।ঠিক আছে, করব।চা এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিস। বেশ খেতে। আমি বললাম, কিসের বড়া এগুলি? ডালের নাকি?ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, কুলের বড়া। হা-হা-হা। কত রকম অদ্ভুত রান্না যে জানে! মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হই। খেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমত্কার না?ভাল, বেশ ভাল।আরেক দিন আসবেন, চাইনীজ সুপ খাওয়াবো। চিকেন কর্ন সুপ। চাইনীজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেন। হা-হা-হা।আমি মেয়েটার লেখা একটা ছোট গল্প শুনলাম, দু’টি কবিতা শুনলাম। ভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বার বার বললেন, ইস শামসুল আলম সাহেব আসলেন না। দারুণ মিস্ করলেন, কি বলেন ভাই?রাত এগারোটার দিকে বললাম, তা হলে আজ উঠি?তক্ষকের ডাক শুনবেন না?আরেক দিন শুনব।আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলবেন না যেন ভাই। আসতেই হবে।ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। রাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?ভাল, গুণী মহিলা।ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা। ঠিক না ভাই?আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরীব মানুষ, স্ত্রীর জন্যে কিছুই করতে পারি না। কিন্তু এই সব নিয়ে লীনা মোটেই মাথা ঘামায় না। বড় ফ্যামিলির মেয়ে তো। ওদের চাল চলনই অন্য রকম।আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি।ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। যেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন।ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবে। তক্ষকের ডাক শুনতে হবে। আসবেন তো? প্লীজ।তক্ষকের ডাকের মত কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে!লেখক :হুমায়ূন আহমেদ
false
mk
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফাঃ একুশ শতকে এ দাবি সমর্থনযোগ্য নয় ভুলে গেলে ভুল হবে যে বাংলাদেশ কেবল বাঙালি আর মুসলমানের রাষ্ট্র নয়; বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। এই বহুত্ববাদী দর্শনই আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার মূল নীতি এবং এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এক ধর্মের রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা কিংবা একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ, ইতিহাস বলে, অতীতে কেবল বহু সমস্যাই পয়দা করেছে, কোনো সমাধান বাতলাতে পারেনি। আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার এই দর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান লেখায় আমরা হেফাজতে ইসলামের প্রস্তাবিত ১৩ দফা দাবি খতিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছি; পাশাপাশি দাবিগুলো পূরণ করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা বিচার করার চেষ্টা করেছি।দফা-১: সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে।জবাব: প্রথমত, বিশেষ একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা বা বিশেষ একটি ধর্মের সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত জাতি-ধর্মনির্বিশেষে লাখো শহীদের আত্মদান ও নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্র অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, কিন্তু রাষ্ট্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের কোম্পানি আইন, ব্যাংক আইন, হিন্দু আইনসহ অন্য যেসব আইন কোরআন ও সুন্নাহসম্মত নয়, সেগুলো কি বাতিল করতে হবে?দফা-২: আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।জবাব: ইসলামের অবমাননার কারণ নিয়ে স্থান-কাল-মাজহাব ভেদে মুসলমানদের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো একজন মুসলমানের দুর্নীতির সমালোচনাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এ রকম সামান্য অপরাধে ব্লাসফেমির মামলা হয়েছে বলে দৃষ্টান্ত আছে। ব্লাসফেমির অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারকালেই কারাগারে অন্য বন্দীদের হাতে নিহত হয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে।দফা-৩: কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।জবাব: শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ধর্মের অবমাননা করে কোনো স্লোগানই দেওয়া হয়নি এবং এর কোনো নেতা নিজেকে ঘোষণা করেননি যে তিনি নাস্তিক। মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি বিচ্ছিন্নভাবে তার ব্লগে ইসলাম সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য লিখে থাকলে সে অপরাধের বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ব্লগারদের সবাই সেই একক ব্যক্তির অপকর্মের জন্য দায়ী হবে।দফা-৪: ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।জবাব: অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের ‘অবাধ বিচরণ’ আর ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। সংস্কৃতি স্বতঃপরিবর্তনশীল। কমবেশি হাজার বছর আগে বাংলাদেশের জনগণ যোজন দূরের আরব দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। এককালের বিজাতীয় সংস্কৃতি, যেমন টেলিভিশন বা রেডিও বর্তমানকালে অন্যতম জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের ধর্মকর্মে মোমবাতি প্রজ্বালন করে থাকেন, মাজারে প্রজ্বালিত হয় আগরবাতি ও মোমবাতি। এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো সরকারের পক্ষে সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধ করা কি আদৌ সম্ভব? দফা-৫: ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।জবাব: এ কথা ঠিক যে, স্কুল-কলেজে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হলে মাদ্রাসা থেকে পাস করা ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সহজ হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শিক্ষাকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, কারণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের লোক বসবাস করে। রাষ্ট্রকে নারী আর পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। বাংলাদেশের যে বিপুলসংখ্যক নারী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে চলেছে, তাদের ঘরের চার দেয়ালে বন্দী করে রাখার সাধ্য কারও নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ কী পরিমাণ বেড়েছে তা কয়েক দশকের পরিসংখ্যানের তুলনা করলেই বোঝা যাবে। নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে পরোক্ষভাবে। কালের প্রবল গতি রোধ করা কোনো সরকার বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হবে না।দফা-৬: সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা, ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।জবাব: ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। সুতরাং সরকার কোনো নাগরিকের ধর্মপালনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরকারকে বরং যেকোনো নাগরিকের ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ‘মুসলিম’ হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি মহান আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। সুতরাং কে মুসলিম আর কে মুসলিম নয়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর, কোনো ব্যক্তি বা সরকারের নয়।দফা-৭: মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্য ও নানা মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।জবাব: ইসলামে উপাসনার উদ্দেশ্যে মূর্তি নির্মাণ বা চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ। ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার করে বলা দরকার।দফা-৮: জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।জবাব: এ নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু মসজিদে যখন জ্বালাও-পোড়াও চলে, মসজিদকে যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, আপত্তির প্রশ্নটি আসে তখনই।দফা-৯: রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।জবাব: ইসলামের নির্দিষ্ট কোনো পোশাক নেই, বিভিন্ন দেশের মুসলমান বিভিন্ন পোশাক পরেন।দফা-১০: পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।জবাব: যাঁরাই কোনো মানুষকে অতীতে ধর্মান্তরে বাধ্য করেছেন বা এখনো করছেন, তাঁদের সবারই শাস্তি হওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার, এই বাংলা অঞ্চলে ধর্মান্তরকরণ ঐতিহাসিকভাবে কখনোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল না। দফা-১১: রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।.... দফা-১২: সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতিদানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা। দফা-১৩: অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।জবাব: শুধু কওমি মাদ্রাসা নয়, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকের ওপরই ভয়ভীতি-নির্যাতন করা অনুচিত। গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ আদতেই বেকসুর হলে তাকে মুক্তি দেওয়া উচিত। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিমধ্যেই বিচারের তোয়াক্কা না করে একজন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে, অন্য একজনকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ফটিকছড়িতে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কারও অপরাধ যত গুরুতরই হোক না কেন, তাকে নির্বিচারে খুন করার বিধান শান্তির ধর্ম ইসলাম অবশ্যই দিতে পারে না। সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা হচ্ছে, একটি হামলার তদন্ত রিপোর্টও তারা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেনি। অন্যদিকে ব্লগারদের কারারুদ্ধ করে সরকার হঠকারিতার পরিচয় দিচ্ছে। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে ফেললে হামলাকারীরা আরও উৎসাহিত হবে।দফাভিত্তিক বিশ্লেষণের এই পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য তাই স্পষ্ট। একুশ শতকে পুরো পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি যেভাবে পাল্টাচ্ছে, সবকিছু যে মাত্রায় নিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বাস্তবতায় হেফাজতে ইসলামের দাবিসমূহ মেনে নেওয়া মানে রাষ্ট্রকে এক ধাক্কায় মধ্যযুগে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই মধ্যযুগেই ফিরে যাব? যাওয়া কি আদৌ সম্ভব, না যাওয়া উচিত?লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
false
rn
একটি চমৎকার স্বাদের মৌসুমী ফলের নাম তরমুজ কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে বড়ছড়া, হিমছড়ি, আদর্শগ্রাম, উয়াঝরনা, ইনানী হয়ে টেকনাফের দিকে গেলে নজরে পড়বে সড়কের পাশেই বিক্রি হচ্ছে নতুন ফল তরমুজ।সমুদ্রসৈকতের তীরবর্তী হিমছড়ি, বড়ছড়া, প্যাঁচারদিয়া, দরিয়ানগর এলাকায় চোখে পড়ে তরমুজের সমাহার।টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলার সমুদ্র উপকূলে এবার প্রায় ৭০০ একর জমিতে আগাম তরমুজের চাষ হয়েছে। টেকনাফসহ বিভিন্ন উপজেলার আরও ১০ হাজার একর জমিতে এখন নতুন করে তরমুজের চাষ হচ্ছে।লবণাক্ত আবহাওয়ায় উৎপাদিত বলে তরমুজ মিষ্টি হচ্ছে। নগরীর মাছের আড়তগুলো এখন দখল করে নিয়েছে তরমুজ। যেখানে ট্রলারে প্রতিদিন শত শত মণ ইলিশ আসতো ও বিক্রি হতো—এখন সেখানে তরমুজ আসছে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার তরমুজের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে হেক্টর প্রতি ৩ টন। গত বছর তরমুজের ফলন ছিল হেক্টর প্রতি ৪২টন। এবার প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৪৫টন।দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ পটুয়াখালীতে আবাদ হয়েছে। এ জেলায় ১৪ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা তরমুজ আবাদ করেছে। ভোলায় ১১ হাজার ৭৭৪ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে, বরগুনায় ৩ হাজার ১২০ হেক্টর, পিরোজপুরে ৭৫০ হেক্টর, বরিশালে ৪৭৬ হেক্টর ও ঝালকাঠীতে ৪৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। তরমুজ দক্ষিণ আফ্রিকার ফল। তবে বর্তমানে তরমুজ বাংলাদেশের নিজস্ব মৌসুমী ফলে পরিণত হয়ে গেছে।তরমুজের ভাল ফলন হয় বা তরমুজ বেশি জন্মে চরাঞ্চল এবং নদী সংলগ্ন চরের বেলে মাটি বা পলি মাটিতে। তরমুজ ভাল উৎপাদনের জন্য শুকনো আবহাওয়া এবং প্রচুর রোদ প্রয়োজন হয়।এক সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা তরমুজের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেশজুড়ে পতেঙ্গার তরমুজের আলাদা একটা খ্যাতি ছিল। তরমুজ বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী ফল। ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই তিন মাসে বাজারে প্রচুর পরিমাণে তরমুজ পাওয়া যায়।তরমুজে প্রচুর পরিমাণ লাইকোপিন পাওয়া যায়। লাইকোপিন হচ্ছে একটি লাল বর্ণ, হরিদ্রাবর্ণ রঞ্জক বিশেষ, যা টমেটো এবং বীজশূন্য ক্ষুদ্র রসালো ফলে এবং অন্যান্য ফলে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানব শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী লাইকোপিন গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী ফল তরমুজে টমেটোর চাইতে চল্লিশ গুণ বেশি।ঘন ঘন পিপাসা রোধে তরমুজ অধিক কার্যকরী। যাদের ঘন ঘন পিপাসা পায়, বিশেষ করে হৃদরোগ জনিত কারণে ঘন ঘন ও অধিক পিপাসা নিবারণে কিছু দিন তরমুজের শরবত পান করলে ভাল উপকার পাওয়া যায়। যারা রোদে কাজ করেন, বিভিন্ন কারণে রোদে সময় কাটাতে হয়, যাদের রৌদ্রের তাপজ-জনিত ডিহাইড্রেশন হয়, তা কাটাতে তরমুজের শরবত বেশ ফলপ্রদ। পুরষের বন্ধ্যাত্ব ঘুচাতে তরমুজের বীজ বেশ উপাকারী। তরমুজের বীজ খোসা ছড়িয়ে বেটে পানির সাথে মিশিয়ে শরবত বানিয়ে পান করলে শুক্রবৃদ্ধি হয়।নিয়মিত তরমুজ আহার করলে তা আপনার ত্বককে রাখে বয়সের ছাপ, বলি রেখা ও চামড়া কুচকে যাওয়া থেকে মুক্ত।তরমুজের প্রায় ৯২% হচ্ছে পানি, ফলে এটি আপনার শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রেখে ত্বককে রাখে সতেজ। যখন আপনার ত্বকে পানির ভারসাম্য স্বাভাবিক থাকে তখন কোলাজেন নামক একটি উপাদান তৈরী হয়, যা ত্বককে টানটান করে তারুণ্য বজায় রাখে।কেবল খাওয়া নয়, রূপচর্চাতেও তরমুজের ব্যবহার নানাবিধ। রোদে পোড়া ত্বকে তরমুজের রস মাখুন, দেখবেন অনেকটা আরাম লাগছে। তরমুজের শরবত- ৩০০ গ্রাম তরমুজ, বিট লবণ, চিনি, বরফ কুচি নিন, তারপর তরমুজ ভালো মতো পরিষ্কার করে কেটে রস বের করতে বেল্গন্ডারের মধ্যে নিন [এতে যেন কোনো খোসা বা বিচি না থাকে]। তাতে মিনারেল পানি, পরিমাণ মতো বিট লবণ, চিনি মিশিয়ে ২০ মিনিট ফ্রিজ এ রেখে দিন। ২০ মিনিট পর ফ্রিজ থেকে বের করে বরফ কুচি দিয়ে পরিবেশন করুন। দক্ষিন বঙ্গের একটি বড় তরমুজ হাট যশোরের রূপদিয়ার তরমুজ হাট ।রূপদিয়ার তরমুজ হাটটি সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কেনাবেচা হয়। প্রতিদিন সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাইকারি ব্যবসায়ি তরমুজ কেনা কাটা করে।রূপদিয়া বাজারে ৭ থেকে ৮টি তরমুজ পাইকারি কেনাবেচা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৯ থেকে ১০ লক্ষ টাকার তরমুজ কেনা বেচা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অধিবাসী অমৃতময় সহকর্মীদের পেটের ওপর রাখা ৪৩টি তরমুজ কাটতে সময় নেন মাত্র এক মিনিট। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যক্তি একইভাবে সর্বোচ্চ ২৭টি তরমুজ কেটে রেকর্ড গড়েছিলেন।গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের একজন কর্মকর্তা অমৃতময়ের এই কীর্তির সময় উপস্থিত ছিলেন। এক মিনিটে ৪৩টি তরমুজ কাটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি তাঁকে সনদ দেন।
false
hm
কবিতা লেখা আমার ধারণা, আমার "ড্রাইভিং সেন্স" খুব একটা মানসম্পন্ন নয়। আমি এখনো পর্যন্ত গাড়ি চালানোর চেষ্টা করিনি। শেখার সুযোগ এসেছে বহুবার, তারপরও না। মোটর সাইকেল এবং মোটরহীন সাইকেল, দু'টো নিয়েই আমি বেশ কেলেঙ্কারিয়াস দুর্ঘটনায় পড়েছি একাধিকবার। এখন যেমন বাইসাইকেল চালানোর বেশ চমৎকার সুযোগ আছে, তারপরও সাইকেল চালাই না। এই একই কারণে আমি কবিতা লিখি না। আমি কবিতা লিখতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। কবিতার ক্ষেত্রে "হয়ে ওঠা"র একটা ব্যাপার থাকে, সেটা আবার সব সময় হয়ে ওঠে না। খারাপ একটা কবিতা লিখলে, বা বলা যায়, একটা কবিতা লিখে ফেলার পর সেটা খুব একটা পদের কিছু হয়নি, তা টের পাওয়ার অনুভূতিটা অনেকটা ঝোড়ো বাতাসে লুঙ্গি উড়ে যাবার মতো। পাঠক, আপনার কি কোনদিন ঝোড়ো বাতাসে লুঙ্গি উড়ে গেছে? যদি না যায় তাহলে একটা বাজে কবিতা লিখে দেখুন। তারপরও আমি কিছুদিন কবিতা লিখেছি। এখনও মাঝে মাঝে হাওয়া অনুকূল থাকলে দু'একটা লেখার চেষ্টা করি। কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁদের মোটা দাগে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। একদল কবি, সে কারণে কবিতা লেখেন। দ্বিতীয় দলের লোকেরা (যেমন আমি) ঠিক নিজেকে সামলাতে পারেন না। কবিতার চাপ নাম্বার টু-এর মতো অনেকখানি, খুব ঝামেলায় ফ্যালে, একে নিষ্কাশিত না করলে নানা কেলেঙ্কারি হয়। পেট খারাপের সাথে তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে, এ হচ্ছে হৃদয় খারাপ হওয়া। আমি এই পোস্টে মূলত যা করতে চাইছি তা হচ্ছে বিটিভির পুনর্প্রচারের মতো। পুরনো কিছু কবিতা আবারও সম্প্রচার করা হচ্ছে। নতুন কবিতা লিখতে গেলে নতুন করে হৃদয় খারাপ হওয়া প্রয়োজন, সেটাও কুলিয়ে উঠতে পারছি না আপাতত। পুরনো কবিতা মাঝে মাঝে লোকজনকে শোনানোর দরকার হয়ে পড়ে, দীর্ঘদিন ফোনালাপের অনভ্যাস আর ব্লগের বদভ্যাসের কারণে পুনর্পোস্টের পথকেই বেছে নিচ্ছি। আমার কবিতাগুলি ২০০৩ থেকে ২০০৬ এর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে "বোকাদের পদ্য" শিরোনাম ও ক্রমিকে লেখা, সচলায়তনের ভেটেরান ব্লগাররা বহু আগেই এসব কবিতা পড়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। নতুন সচলদের বন্দুকের মুখে জিম্মি করে কবিতা পড়ানোর এই সুবর্ণ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না। তুফানে বেঁধেছি লুঙ্গি, বাতাসে কী ভয়? ১. কাকের উড্ডাল ধরে এগোলেও অযুতেক ক্রোশ দূরে আছি তবু ভাবি, এখনো শরীরজলে ডুবে সঞ্চিত নিশ্বাস ফেলি মুখ রেখে স্তনের বিষুবে একবার, বারবার .. .. ঘ্রাণ নিই নিপাট সন্তোষে৷ আমার আক্ষেপ ছোঁয়া দিয়ে যায় অযুতেক ক্রোশে৷ ২. প্রত্যেক ক্রিসমাসে স্কুলে নাটক হতো তুমি অবধারিতভাবে রাজকন্যার গুলগুল্লা রোল পেয়ে যেতে নীরব সন্তুষ্টিতে তোমার গালে বেগুনি আঁচ লাগতো, আমি দেখতাম আমার ভুরুর আড়াল থেকে। আমাকে সবাই বলতো নিয়ান্ডার্টাল হিমু নাটকের স্যার মৃদু হেসে বলতেন, কোয়াসিমোদো ... আমি তখনও জানতাম না ... নোতরদামের কুঁজো তো পড়বো স্কুল ছেড়ে যাবার পর, নইলে তখনই আঁচড়ে খামচে উঠে পড়তাম স্কুলের পাশের পুরানো চার্চটা বেয়ে। স্কুলের নাটক একেক বছর একেকটা, কিন্তু সবই লিখতেন নাটকের স্যার সেখানে রাজকন্যা আর কুৎসিত ক্রীতদাস থাকবেই কারণ তুমি পড়তে সে স্কুলে আর আমিও পড়তাম আমরা নাটক ভালোবাসতাম, দু'জনেই ...। আমি সেই ছোট্ট তোমাকে নতজানু হয়ে কুর্ণিশ করেছি, যখন আমি সেই ছোট্ট আমি ছিলাম হাঁটু গেড়ে বসে কতবার রাজকন্যার জুতোর ফিতে বেঁধেছি আমি ক্রীতদাস আমার হাতে বর্ষাতি আর টুপি সঁপে দিয়ে কত ভিনদেশি রাজপুত্র তোমার পদ্মকোরকের মতো নরম হাত নিজের মুঠোয় নিয়েছে এক এক বছর আমি সেই টুপিবর্ষাতির ভুলে যাওয়া ন্যাপথলিনের গন্ধ নতুন করে ফিরে পেয়ে চমকে দাঁড়িয়ে থেকেছি কত নাটক করলাম আমরা দু'জন কত মারপিট, অস্ত্রের হ্রেষাধ্বনি মঞ্চে গড়াগড়ি দিলো কত সুপুরুষ স্কুলপড়ুয়া আর তুমি জড়িয়ে ধরলে আরো সুপুরুষ কতো স্কুলপড়ুয়াকে আমি ক্রীতদাস ছেঁড়া পাজামার হাঁটু ময়লা করে চিনে নিলাম তোমার প্রতি বছরের নাটকের জুতোর ফিতাবিন্যাস রাজপুত্রদের বর্ষাতির বল্লরী আর, নিথর দাঁড়িয়ে থেকে, মঞ্চে, তোমাকে। সামনে ক্রিসমাস আসছে, রাজকন্যা আমি, নিয়ান্ডার্টাল হিমু, নাটকের স্যারের কোয়াসিমোদো এবার সটান মাথা উঁচিয়ে বলবো আমার ভাঙা গলায়, স্যার আমি আর নাটক করবো না। ৩. উত্তরের অন্ধকার, সকলেই ঝড় বলে তাকে শনাক্ত করেছে, আর কালবৈশাখী নাম ধরে ডাকে বিভ্রান্ত মানুষগুলো জানেনি তো এ আন্ধারী ঝড় এ সন্ধ্যায় আমাদের ব্যক্তিগত একান্ত ঈশ্বর৷ ছাদের পানির ট্যাঙ্কে থরথর লোহার সোপান বজ্রের ধমকে যত অট্টালিকা ভয়ে কম্পমান আমিই উদ্বাহু নাচি, অট্টহাস্যে বলি আয় আয় নিজেকে করেছি বলি, তুই ছাড়া আমাকে কে খায়? হাতের মুদ্রায় তোর বায়বীয় প্রতিমাকে গড়ি নৈবেদ্য চেটে যা এসে একচক্ষু ঈশ্বরসুন্দরী বজ্র হাওয়া জল তোর যা যা আছে সঙ্গে নিয়ে এসে আলিঙ্গন হয়ে যাক নিঃশর্ত উদ্দাম ভালোবেসে৷ তোকেই হেনেছি প্রেম, বায়ুস্রোত, হে নির্মাণখাকি পুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যা আমায়, মধুবৈশাখী! ৪. স্বপ্ন, নাকি জেগেই ছিলাম নাকি ও দুটোর কোনটাই নয় আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি হ্যাঁ, তোমার কবোষ্ণ বুকেই হাত রেখে বলতে পারি খুল যা সিম সিম বলে হা রে রে রে আমার দিকে তেড়ে এলো একের পর এক ছেঁড়া কাঁথায় মোড়া লাখটাকাগন্ধী কাগজের বান্ডিল বান্ডিলের কাগজ কে যে কার বুঝে উঠতে না উঠতেই আবার দশদিক কাঁপিয়ে চিৎকার ওঠে খুল যা সিম সিম আমি দেখি আমার অস্থিপঞ্জর আলিবাবার গুহার দরজার মতো হুটহাট খুলে যায় দল বেঁধে ঈভের কাঠামোর মতো নেচে বেড়ায় তারা চারপাশে আর আমি হাড়হারা হয়ে তৈমুর লঙের মতো ছটফটিয়ে ছুটে ফিরি কাগজের বান্ডিলের পিছু পিছু স্বপ্ন? নাকি জেগেই ছিলাম? নাকি ও দু'টোর কোনটাই নয়? নাকি দু'টোই সত্যি ছিলো? এই দ্বিধা আর দ্বৈরথে পড়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত তোমার বুকে হাত রাখাই সত্যি আর সত্যি হয়ে থাকে। ৫. মৃত্যু, অভিমানী বালিকা প্রেয়সী অমন নরম হাতে কচি হাঁটু শক্ত বেঁধে বসে, খোলা চুলে মুখ ঢাকো, কান্না তবু ঠেলে আসে ঠিকই তোমার আদুর পিঠ তারই ভারে কেঁপে ওঠে, কোমল সরসী --- যতো যাই --- যতো চাই, ভালোবেসে কাঁধ ছুঁয়ে বলি আর মাত্র ক'টা দিন কেটে গেলে তোমার সাথেই হাত ধরে ছুটোছুটি, বাগানোর ফুল চুরি খেলা ... অফুরন্ত সঙ্গ দেবো এত অল্পে অভিমানীকেই। বালিকা শোনেনা কথা, বাহুমূলে মুখ গুঁজে রাখে তাকে ফাঁকি দিয়ে কেন জীবনের সঙ্গে উঠি বসি? ৬. আষাঢ় আসুক, তার চলে আসা রোধের অতীত কদম্বে আপত্তি নেই, কিন্তু ভারি জল জমে যায় কাদারা থিতিয়ে গেলে হাঁটা পথে আরশিতে দেখি আমারই আষাঢ়ে মুখে আকাশের মেঘের সঙ্গীত। কোকিল নিথর আজ, ব্যাঙেদের মুশায়রা ক্ষীণ আকাশ গম্ভীর তবু সবুজ সবুজতর লাগে বারান্দার মুখোমুখি ছাদে দুটি সতেজ বালিকা আষাঢ়কে ঋদ্ধ করে তারাই --- বর্ষণে ব্রীড়াহীন। মেঘদূত! --- ভেসে যায়, তার দৌত্যে আস্থা কারো নেই --- আমার চুম্বন তুমি দিও এই মেয়ে দুটিকেই। ৭. আবারও হয়তো কোন ভেজা দিনে ছোঁয়াছুঁয়ি হবে, যতখানি শুন্যস্থান আমাদের মধ্যে টেনে আনি পার হবো কিছু তার, তুমি --- নয়তো আমি, ঠিক জানি --- তেমনই শেখায় বৃষ্টি, শ্রাবণের বৃষ্টিগ্রস্ত দিন আর --- তেমন কঠিন নয় এ প্রকৃতিক্লাস, শিক্ষণেও নেই কোন ভুল দেখি রোজ মেঘমগ্ন জল ছোঁয় ঘাসের মাস্তুল। ৮. ভেজার ইচ্ছে আমার খানিক ছিলো খুকিই তাকে উসকে অনেক দিলো আলতো হেসে আমার পাশে এসে জলের ধারা নিজের গায়ে নিলো। আকাশ তখন ভার করেছে মুখ-ই খুকি তবু তাকে দেখেই সুখী বাজের আলোর তাল মিলিয়ে হেসে বৃষ্টি মাথায় বেড়ায় ছুটে খুকি। তেপান্তরের সেই গহীনে ঠায় ভিজেই কাটে আমার বিকেল হায় বাতাস কাঁপে মেঘের ধমক শুনে খুকির হাসির দমক বেড়ে যায়। মেঘদেবতার মুড ভালো নেই বুঝি শিলের পাহাড় ছিলো কি তাঁর পুঁজি? ভীষণ বেগে পড়তে থাকে তারা। সেই তুফানে খুকিকে কই খুঁজি? হাত বাড়িয়ে ধরতে তাকে গেলে চমকে উঠে দেয় সে আমায় ঠেলে আমরা দু'জন ছুটতে থাকি দূরে পিপুল গাছ এক যেথায় বাহু মেলে। গাছের নিচে ক্ষুণ্ন মনে বসে খুকির চোখে অশ্রু পড়ে খসে বেশ তো ছিলো জলের সাথে খেলা বিগড়ে গেলো সবই ঝড়ের দোষে। থামলো শেষে ঝড়ের মাতামাতি .. .. হাওয়ার সাথে গাছের হাতাহাতি .. .. তেপান্তরে শিলের ঝিকিমিকি .. .. খুকি আমার সে উদ্ভাসের সাথী। আমি কিন্তু নিপাট সরল মনে শুধিয়েছিলেম, "শিল কুড়াতে যাবে?" খুকি ভাবলো কী তা কে বা জানে মুখ ফেরালো ভীষণ অসদ্ভাবে। .. .. শিলগুলো সব জল হয়েছে গলে খুকিও গেছে নিজের পথে চলে আমিই শুধু একলা ভেজা মনে অশ্রু শিশির মেশাই মেঘের জলে।
false
rg
ভারতের বিশ্বকাপ ক্রিকেট অভিযান !!! তৃতীয় পর্ব !!! ২০০৭ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের নবম আসর বসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোরিডার লাউডারহিল স্টেডিয়ামে একটি ম্যাচ আয়োজনের জন্য আইসিসিকে লবিং করে ব্যর্থ হয়েছিল। আইসিসি বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে বছর মোট ১৬ টি দেশ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। ১০টি টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি, ওয়ান ডে স্টাটাস পাওয়া কেনিয়া, এবং ২০০৫ সালের আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন থেকে ৫টি দলকে সুযোগ দিয়েছিল। কানাডা, স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস এবং নবাগত আয়ারল্যান্ড ও বারমুডাকে সে বছর বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ দেয় আইসিসি। মোট চারটি গ্রুপে ৪টি করে দল গ্রুপ পর্বের খেলা শুরু করে। প্রতি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুটি দল নিয়ে ৮টি দলকে দিয়ে করা হয় সুপার এইট। এ-গ্রুপে ছিল অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। বি-গ্রুপে ছিল ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও বারমুডা। সি-গ্রুপে ছিল ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া ও কানাডা। ডি-গ্রুপে ছিল পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ড। এ-গ্রুপ থেকে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা শীর্ষ দুটি দল হিসেবে সুপার এইটে যায়। বি-গ্রুপ থেকে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ সুপার এইটে যায়। কুইন্স পার্ক ওভালে ভারত প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪৯.৩ ওভারে ১৯১ রানে অলআউট হয়। জবাবে বাংলাদেশ ৪৮.৩ ওভারে ৫ উইকেটে ১৯২ রান তুলে ৫ উইকেটে জয়লাভ করে। কুইন্স পার্ক ওভালে ভারত দ্বিতীয় ম্যাচে বারমুডার বিপক্ষে ৫ উইকেটে ৪১৩ রান করে। বিরেন্দর সেবাগ ৮৭ বলে ১১৪, সৌরভ গাঙ্গুলী ১১৪ বলে ৮৯, যুবরাজ সিং ৪৬ বলে ৮৩, সচিন টেন্ডুলকার ২৯ বলে অপরাজিত ৫৭ রান করলে ভারতের রান চারশো অতিক্রম করে। জবাবে বারমুডা ৪৩.১ ওভারে ১৫৬ রানে অলআউট হয়। ভারত ২৫৭ রানে জয়লাভ করে। বিরেন্দর সেবাগ হন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। কুইন্স পার্ক ওভালে ভারত তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলংকার মুখোমুখি হয়। শ্রীলংকা প্রথমে ব্যাট করে ৬ উইকেট ২৫৪ রান করে। জবাবে ভারত ৪৩.৩ ওভারে ১৮৫ রানে অলআউট হয়। শ্রীলংকা ৬৯ রানে জয়লাভ করে। ভারত গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচের দুইটিতে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। বি-গ্রুপ থেকে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ সুপার এইটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সি-গ্রুপ থেকে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড এবং ডি-গ্রুপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নবাগত আয়ারল্যান্ড সুপার এইটে যাবার যোগ্যতা অর্জন করে। সি-গ্রুপ থেকে আগেরবারের সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়া এবং ডি-গ্রুপ থেকে পাকিস্তান বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। সুপার এইট পর্বে ৭ টি খেলার সবগুলো জিতে অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, ৫টি খেলায় জিতে ও ২টি হেরে শ্রীলংকা রানারআপ, ৫টি খেলায় জিতে ও ২টি হেরে নিউজিল্যান্ড তৃতীয় এবং ৪টি খেলায় জিতে ও ৩ টিতে হেরে দক্ষিণ আফ্রিকা চতুর্থ দল হিসেবে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সে বছর সুপার এইটের ৭ খেলার মধ্যে বাংলাদেশ কেবলমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬৭ রানে হারিয়েছিল। বাকি ৬টি ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল। সুপার এইটে বাংলাদেশ সপ্তম স্থান অধিকার করেছিল। ইংল্যান্ড পঞ্চম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ষষ্ঠ এবং আয়ারল্যান্ড অষ্টম স্থান অর্জন করে। সাবিনা পার্কে প্রথম সেমিফাইনালে শ্রীলংকা প্রথমে ব্যাট করে ৫ উইকেটে করে ২৮৯ রান। ৪১.৪ ওভারে ২০৮ রানে অলআউট হয়। শ্রীলংকা ৮১ রানে জিতে ফাইনালে যায়। সেন্ট লুসিয়ায় অপর সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৩.৫ ওভারে ১৪৯ রানে অলআউট হয়। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৩১.৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ১৫৩ রান করে ৭ উইকেটে জয়লাভ করে ফাইনালে পৌঁছায়।ব্রিজটাইনের কিংস্টন ওভালে ফাইনালের বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ ৩৮ ওভারে সেটেলড হয়। অস্ট্রেলিয়া টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৪ উইকেটে ২৮১ রান করে। এডাম গিলক্রিস্ট করেন ১০৪ বলে ১৪৯ রান। জবাবে শ্রীলংকা ২৪.৫ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ১৪৯ রান তোলার পর আবার ম্যাচে বৃষ্টি বাগড়া দেয়। তখন ডাকওয়ার্থস-লুইস পদ্ধতিতে নতুন করে শ্রীলংকার জয়ের লক্ষ্য নির্ধারন করা হয় ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। বৃষ্টি কমলে শ্রীলংকা পুনরায় ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৬ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২১৫ রান তুলতে সক্ষম হয়। ডাকওয়ার্থস-লুইস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়াকে সেই ম্যাচে ৫৩ রানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। টানা তৃতীয়বার এবং সবমিলিয়ে চতুর্থবারের মত অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জয় করে। অস্ট্রেলিয়ার এডাম গিলক্রিস্ট হন ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ আর ম্যান অব দ্য সিরিজ হন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা।২০১১ সালের দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার প্রধান আয়োজক ছিল পাকিস্তান। এছাড়া ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ সে বছর বিশ্বকাপের আয়োজক হয়। ফাইনাল, একটি সেমিফাইনাল সহ মোট ১৪টি ম্যাচ হবার কথা ছিল পাকিস্তানে। একটি সেমিফাইনাল সহ ৮ টি ম্যাচ হবার কথা ছিল ভারতে, চারটি ম্যাচ শ্রীলংকায় এবং দুইটি ম্যাচ বাংলাদেশে হবার কথা ছিল। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি হবার কথা ছিল পাকিস্তানের লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। কিন্তু বিশ্বকাপের মাঝখানে আইসিসি এক নতুন তকমা নিয়ে হাজির হল। ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলংকার জাতীয় দলের উপর টেররিস্ট হামলার অযুহাত দেখিয়ে ফাইনাল ম্যাচটি লাহোর থেকে ভারতের মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নিয়ে যায়। এভাবে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ শুরু থেকেই ভারত আইসিসির কৃপা পেতে শুরু করে।বিশ্বকাপের ওপেনিং সিরিমনি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। এছাড়া বাংলাদেশে দুইটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। একটি বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা এবং দুইটি কোয়ার্টার ফাইনাল তিনটি খেলাই ঢাকার মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। মোট ১৪টি দেশ দশম বিশ্বকাপে ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পায়। ১০টি টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি এবং ৪টি আইসিসির এসোসিয়েট মেম্বার কান্ট্রি। ২০০৯ সালে আইসিসি বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইয়িং যোগ্যতা অর্জন কারী সেই ৪টি দেশ হল কানাডা, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া ও নেদারল্যান্ডস। ৭টি দল নিয়ে দুই গ্রুপে ১৪টি দলকে ভাগ করা হয়। এ-গ্রুপে ছিল পাকিস্তান, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, কানাডা ও কেনিয়া। বি-গ্রুপে ছিল ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। গ্রুপ পর্বের ৬টি খেলার মধ্যে ভারত ৪টিতে জয় পায়। বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ভারত জয় পায়। একটি ম্যাচে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পরাজিত হয়। এছাড়া ভারত ও ইংল্যান্ডের ৩৩৮ রানের ম্যাচটি টাই হয়। যদিও সেই ম্যাচে ভারত প্রথমে ৪৯.৫ ওভারে ৩৩৮ রানে অলআউট হয়। পরে ইংল্যান্ড ৮ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে করেছিল ৩৩৮ রান। এই ম্যাচটি নিয়ে ক্রিকেট মহলে আজও রহস্য রয়ে গেল। ইংল্যান্ড জেতা ম্যাচটি কেন টাই করেছিল?এ-গ্রুপ থেকে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালের নকআউট পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। অপরদিকে বি-গ্রুপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ঢাকার মিরপুরে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪৩.৩ ওভারে ১১২ রানে অলআউট হয়। জবাবে পাকিস্তান ২০.৫ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ১১৩ রান করে ১০ উইকেটের জয় নিয়ে সেমিফাইনালে যায়। ভারতের আহমেদাবাদে দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয়। অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে ২৬০ রান করে। জবাবে ৪৭.৪ ওভারে ভারত ৫ উইকেট হারিয়ে ২৬১ রান তুলে ৫ উইকেটে জয়ী হয়ে সেমিফাইনালে যায়। ঢাকার মিরপুরে তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হয়। প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড ৮ উইকেট হারিয়ে ২২১ রান করে। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৩.২ ওভারে ১৭২ রানে অলআউট হয়। নিউজিল্যান্ড ৪৯ রানে জয় নিয়ে সেমিফাইনালে যায়। শ্রীলংকার কলম্বোতে চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড ও শ্রীলংকা মুখোমুখি হয়। প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড ৬ উইকেট হারিয়ে ২২৯ রান করে। জবাবে ৩৯.৩ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে শ্রীলংকা ২৩১ করে ১০ উইকেটে জয়ী হয়ে সেমিফাইনালে যায়। কলম্বোতে প্রথম সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড শ্রীলংকার মুখোমুখি হয়। প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড ৪৮.৫ ওভারে ২১৭ রানে অলআউট হয়। জবাবে শ্রীলংকা ৪৭.৫ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ২২০ রান তুলে ৫ উইকেটে জিতে ফাইনালে পৌঁছায়। ভারতের মোহালিতে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পাকিস্তান ও ভারত মুখোমুখি হয়। প্রথমে ব্যাট করে ভারত ৯ উইকেট হারিয়ে ২৬০ রান করে। জবাবে ৪৯.৫ ওভারে পাকিস্তান ২৩১ রানে অলআউট হয়। ভারত ২৯ রানের জয় নিয়ে ফাইনালে পৌঁছায়। মুম্বাইয়ে ফাইনালে শ্রীলংকা টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৭৪ রান করে। মহেলা জয়বর্ধনা করেন ৮৮ বলে অপরাজিত ১০৩ রান। জবাবে ভারত ৪৮.২ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ২৭৭ রান করে। ভারত ৬ উইকেটের জয় নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জয় করে। গৌতম গাম্ভীর ৯৭, অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ৭৯ বলে অপরাজিত ৯১ এবং যুবরাজ সিং ২৪ বলে অপরাজিত ২১ রান করেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং ম্যান অব দ্য সিরিজ হন যুবরাজ সিং। .....................................ঢাকা ২৭ মার্চ ২০১৫
false
mk
ফিরে দেখা ৭১_ রিয়াজ রহমান - দালাল কুটনীতিক - চিনে রাখা ভাল! ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ নামক ভুখন্ডটি তখন পাক-হানাদারদের আগ্রাসনের অধীনে। দেশের মুক্তিপাগল মানুষ কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত। আর পাকিস্থান সরকারের অধীনে চাকুরীরত অনেক বাঙ্গালী কর্তারা বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই সময় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান পাকিস্থান থেকে যুদ্ধ বিমান নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসার সময় মৃত্যুবরন করেন। এই খবরগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে অধীর আগ্রহের অক্ষেমান জনতাকে সাহসী করে তুলছিলো।সেই সময় কিছু বাঙালী কর্মকর্তা তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্যে ঢাকা ছেড়ে পাকিস্থানে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাকিস্থানের সংবাদপত্রে একটা শিরোনাম ছিল -“বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের সাহসীকতার সাথে মোকাবেলা করে দেশপ্রেমিক বাঙালি কুটনীতিকের দিল্লি ত্যাগ ও করাচীতে আগমন”।এই ‘দেশপ্রেমিক’ এর নাম হলো ‘রিয়াজ রহমান’।খবরের বিস্তারিত বিবরনে বলা ছিল - দিল্লিতে পাকিস্থানের দ্বিতীয় সচিব রিয়াজ রহমান বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের প্রবল বাঁধার মুখে কিভাবে দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ব হয়ে করাচীগামী প্লেনে চড়েছিলেন।সেই সময়ে পাকিস্থানে আটকে পড়া আরেক সেনা কর্তা মেজর জেনারেল (অব) খলিলুর রহমানের সাথে ‘দেশপ্রেমিক’ রিয়াজ রহমানের দেখা হয় উপসচিব হেদায়েত আহমেদের করাচীর বাসায়। রিয়াজ রহমানের পরিচয় পাওয়ার পর খলিলুর রহমান অত্যান্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তাদের মধ্যে সেখানে যে বাক্যালাপ হয় - তার কিছু বিবরন নীচে দেওয়া হলো :খলিলুর রহমান - আপনিই সেই রিয়াজ রহমান, যিনি সাহসিকতার সাথে দিল্লিস্থ বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের প্রচেষ্টা প্রতিহত করে নিজের দেশ করাচিতে পৌঁছেছেন সফল ভাবে?রিয়াজ রহমান এতে বিরক্ত বিভিন্ন কথা বলার এক পর্যায়ে বলে - ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখেছে ঢাকায় পাকিস্থানিরা জেনোসাইড করছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এরা কি জেনোসাইডের অর্থ জানে?’খলিলুর রহমান - জেনোসাইডের অর্থ আমিও জানি না, তবে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী ঢাকায় পঁচিশে মার্চে সেনাবাহিনী কত লোক মেরেছে?’রিয়াজ - ‘যা পত্রিকায় বলা হয়েছে তার চাইতে অনেক কম’।খলিলুর রহমান - ‘তবুও বলুন, সেই সংখ্যাটা কত হবে, দশ হাজার”?রিয়াজ - ‘না, এতো হবে না’।খলিলুর রহমান - ‘তবে হাজার দুই-এক’।খলিলুর রহমান - ‘তা, হতে পারে’।এই পর্যায়ে খলিলুর রহমান অত্যান্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং বলেন - আপনার লজ্জা করে না ‘মাত্র এই কথা বলতে দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে?’হেদায়তে হোসেন এবং উপস্থিত অন্যান্যদের হস্তক্ষেপে বিষয়টা বেশী দুর যেতে পারেনি।(২)১৯৭৩ সালে রিয়াজ রহমান “স্বাধীন বাংলাদেশের” পররাষ্ট্র দফতরে যোগদান করেন - যিনি সাফল্যের সিড়ি বেয়ে পররাষ্ট্র সচিব পদ পর্যণ্ত যান। পরে দেখি তাকে ২০০১ সালে পররাষ্ট্র প্রতি - মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন।২০০৬ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ যখন রাজনৈতিক সংঘাতের চুড়ান্ত পর্যায়ে তখন টিভিতে একজন মানুষকে যথেষ্ঠ সংক্রিয় দেখা গেছে - যিনি সদস্য বিদায়ী জামাত-বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্র উপ-মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।(৩)নতুন প্রজন্মের জন্যে এই দেশ প্রেমিকদের চিনে রাখা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন নয় কি?...................(সূত্র: পূর্বাপর ১৯৭১, পাকিস্থানি সেনা-গহ্বর থেকে দেখা - মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান (অব) - সাহিত্য প্রকাশ)
false
hm
প্যালিনকে দেখে উত্তেজিত জার্দারি দোষ দেবো না। "হকি-মম" সারাহ প্যালিনকে দেখে আমিই উত্তেজিত বোধ করি। মহিলা স্টুপিড হলেও দেখতে বেশ উষ্ণ, তাই কিছুক্ষণ পর নড়েচড়ে বসতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে একবার এক বন্ধুর সাথে তর্ক হচ্ছিলো, মানুষের ব্রেইনস অ্যাগেইনস্ট লুকস কার্ভ নিয়ে। আমার বক্তব্য ছিলো ব্রেইনস মাল্টিপ্লায়েড বাই লুকস ইকুয়ালস টু আ কনস্ট্যান্ট, হাইপারবোলিক একটা কার্ভ পাওয়া যাবে প্লট করলে, ঠিক যেমন বয়েল-ম্যারিয়ট ল, কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের চাপ আর আয়তনের গুণফল একটি ধ্রুব সংখ্যা। অর্থাৎ, মাগজিক X শারীরিক = ধ্রুবক এইচ মডেল ছবিতে কার্ভটি দেখুন। শারীরিক আবেদনের সাথে তাল মিলিয়ে মাগজিক আবেদন কমছে। বন্ধুটি তর্ক করছিলো যে এর মধ্যে যে কোন একটি ভ্যারিয়েবলের মাথায় একটি ঘাত বসাতে হবে, এবং এই ঘাতের ওপর ভিত্তি করে মানুষের শ্রেণীবিভাগ করা যাবে। ধরা যাক বন্ধুটির নাম চুদির্ভাই, এবং তার নামের আদ্যাক্ষর অনুসারেই সেই এক্সপোনেন্টকে C দিয়ে ভূষিত করা হবে, এক্ষেত্রে, মাগজিকC X শারীরিক = ধ্রুবক সি মডেল ওর ক্ষেত্রে তিনজন ভিন্ন মানুষের জন্যে তিনটি ভিন্ন কার্ভ, যেখানে তিনটি কার্ভের জন্য C এর মান যথাক্রমে ১, ১.২৫ এবং ১.৫। যাই হোক, যা বলতে চাইছিলাম, আমাদের দু'জনের বক্তব্যই কমবেশি এক ছিলো, বন্ধুটির ক্ষেত্রে নুয়্যান্স একটু বেশি যোগ করা হয়েছিলো, এ-ই যা। আমরা দু'জনই বলতে চেয়েছিলাম, সুরৎ ও জিসম খোলতাই হলে আকল কমতে বাধ্য। পাশাপাশি আক্কেলের বাম্পারফলন হলে চেহারাও বিদঘুটে হতে বাধ্য। জলজ্যান্ত সব উদাহরণ সামনে, স্টিফেন হকিংকে দেখুন, ডারউইনকে দেখুন, জর্জ বার্নার্ড শ'কে দেখুন, আমাকে আর আমার বন্ধুটিকে দেখুন! পাশাপাশি দাঁড় করান মেরিলিন মনরোকে। সালমান শাহকে। জিনা লোলোব্রিজিদাকে। কার্ভফিটিং নিয়ে আমাদের তেমন সমস্যা হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই, যারা একই সাথে দেখতে দারুণ এবং বুদ্ধিও বাহারী, তারা নিতান্তই চ-বর্গীয় প্রাণী। তাদের হিসাবে না ধরলেও চলে। তো যা বলছিলাম, শুধু তত্ত্ব কপচালেই হবে না, তত্ত্বের প্রয়োগও তো চাই। সারাহ প্যালিনের ঘটনা পড়ে মনে পড়ে গেলো সেই ব্রেইনস ভার্সাস লুকস কার্ভের কথা। মহিলা দেখতে গরম হলেও মাথা ফাঁকা। বিভিন্ন ইন্টারভিউ দেখে মনে হয়েছে বিল মার এর কথাই সত্যি, ম্যাকেইন-প্যালিন জুটি হচ্ছে দ্য ম্যাভেরিক অ্যান্ড দ্য মিল্ফ। আসিফ জার্দারি সারাহ প্যালিনকে দেখে রীতিমতো ক্ষেপে উঠেছে। নিউ ইয়র্কে প্যালিনের সাথে সম্প্রতি সাক্ষাতের পর সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। জার্দারির আক্ষরিক মন্তব্যগুলি এমনঃ “You are even more gorgeous in life...” “Now I know why the whole of America is crazy about you” এক ফোটোগ্রাফার যখন দু'জনকে দ্বিতীয়বারের মতো করমর্দন করতে বলেন ছবির খাতিরে, জার্দারি সহাস্যে জানায়, “If he is insisting, I might hug ...” ব্লগার আলতাফ খান জানাচ্ছেন, পাংশু মুখে নিজের স্ত্রীর হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তীব্র শোক জ্ঞাপনের পরপরই জার্দারি ভাইসপ্রেসিডেন্টের পদে রিপাবলিকান প্রার্থী ও আলাস্কার সুন্দরী সারাহ প্যালিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, এবং পর পর দুইবার তাঁর চোখ-ধাঁধানো রূপের প্রশংসা করেন। শাকির লাখানি ভাবছেন, জার্দারির এই আচরণ ইসলামসম্মত নয়১, আমি ভেবে পাই না, একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কিভাবে একজন অনাত্মীয়া মহিলাকে জাবড়ে ধরার কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু জার্দারি এমনকি এ-ও বলেছেন যে তাঁর এইড জোরাজুরি করলে তিনি তাঁকে (প্যালিনকে) জড়িয়ে ধরবেন, যেখানে এইড তাঁকে (জার্দারিকে) কেবল করমর্দনের কথা বলেছেন ...। আদনান সিদ্দিকী জানাচ্ছেন, গতকাল সারাহ প্যালিনের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি এবং সবক'টা দাঁত বার করে দেখিয়েছেন (নিশ্চিত নই সেগুলি খাঁটি কি না, কারণ শোনা যায় জেলে থাকার সময় সেগুলোকে উপড়ে ফেলা হয়েছিলো) ...। ... পুরো সাক্ষাতের সময় জার্দারিকে স্ত্রীর ব্যাপারে কোন শোকপ্রকাশ করতে দেখা যায়নি, যেমনটা তিনি পাকিস্তানের প্রতিটি প্রেস কনফারেন্সে করে থাকেন। ... ইউটিউবের কল্যাণে ভিডিওটা দেখতে পাবেন এখানেই। জার্দারির জন্যে সদুপদেশ দেয়া যেতে পারতো। এরপর এরকম হট ক্যান্ডিডেটদের সাথে সাক্ষাতের আগে আলি সাহাব যেন খাল্লাস হয়ে যান। মাথায় মাল নিয়ে ডিপ্লোম্যাসি না করাই ভালো। আর রিপাবলিকানরা এখন গর্ব করে বলতে পারবে, "লুক অ্যাট হার, শি ইজন্ট ইন দ্য অফিস ইয়েট, অ্যান্ড অলরেডি শি ইজ মেকিং থিংস হার্ড ফর দ্যা প্যাকিস্টানিজ!" ১ হাসতে হাসতে পেটটা ফেটে যাচ্ছে রে ভাই! ছবি সৌজন্য, টিথ ডট কম। তথ্য সৌজন্য, গ্লোবালভয়েসেসঅনলাইন।
false
fe
মমিনুল মউজদীনের মৃত্যু সংবাদ_ দৈনিক সমকাল রিপোর্ট শুক্রবার ১৬ নভেম্বর ২০০৭, / দৈনিক সমকাল -------------------------------------------------- ‘এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়’ বলে স্ত্রী-পুত্রসহ চলে গেলেন মমিনুল ================================ নিজস্বপ্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া/ সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ----------------------------------------- ‘এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়/ যেদিকে তাকাই দেখি সারাটি ভুবনময়/ আলো আর মৃত্তিকার বুকের ভিতর/ তোমার দু’চোখ/ সুরভিত শস্যময় সজল দু’চোখ।’ প্রিয় শহর ছেড়ে না যাওয়ার করুণ আকুতি যিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার কবিতার পঙ্ক্তিতে তিনি সত্যিই চলে গেলেন সুনামগঞ্জবাসীকে কাঁদিয়ে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার দীর্ঘকালীন নন্দিত চেয়ারম্যান কবি মমিনুল মউজদীন গতকাল বৃহ¯ক্সতিবার ঢাকা থেকে প্রাইভেটকারে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মর্মাšিøক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী-পুত্রসহ নিহত হন। প্রাইভেটকারের চালক কবির হোসেনও মারা গেছেন। কারে থাকা মমিনুল মউজদীনের আহত আরেক ছেলের অবস্থাও আশগ্ধকাজনক। গতকাল বেলা ১টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কুট্টিপাড়া মোড়ে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে তার প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, প্রাইভেটকারটি কুট্টিপাড়া মোড়ে একটি টে¤েক্সাকে অতিত্রক্রম করার সময় ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চেয়ারম্যানের প্রাইভেটকারটি দুমড়ে মুচড়ে যায় এবং বাসটি উল্কেল্ট রাস্টøায় উপড়ে পড়ে। ঘটনাস্ট’লেই স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী, ছেলে কহলিল জিবরান চৌধুরী ও কারচালক কবির হোসেন মারা যান। দমকলকর্মীরা কয়েকঘণ্টা চেস্টার পর প্রাইভেটকারটি কেটে মৃতদেহগুলো বের করেন। গুরুতর আহত চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীনকে ভৈরব তৈয়বুননুর হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। তার আরেক ছেলেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যšø নিহতদের মৃতদেহ সুনামগঞ্জ এসে পৌঁছেনি। তার বড় ভাইয়েরাসহ সুনামগঞ্জ পৌরসভার কমিশনাররা মৃতদেহ আনার জন্য দুর্ঘটনাস্ট’’লে গেছেন। এ ঘটনায় ১৫ জন বাসযাত্রী আহত হন। এদিকে প্রিয় চেয়ারম্যানের মৃত্যুসংবাদে সারা শহর স্টøব্ধ হয়ে পড়ে। অনেকেই আকুল কাল্পুায় ভেঙে পড়েন। সুনামগঞ্জের বু™িব্দজীবী, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী, শ্রমিক, ছাত্র, গৃহিণীÑ সর্বস্টøরের মানুষ তার অকালমৃত্যুতে শোকপ্রকাশসহ স্মৃতিচারণ করছেন। মমিনুল মউজদীন মরমী কবি দেওয়ান হাসান রাজার প্রপৌত্র। তার পিতা মরহুম দেওয়ান আনোয়ার রাজা চৌধুরী। তিনি ছোটবেলা থেকে প্রথাবিরোধী, প্রতিবাদী ও প্রচ- সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তার বাউল মন প্রকৃতি ও হাওর-বাঁওড়ের উদারতায় কবি হয়ে ওঠে সেই ছোট্ট কালেই। তাকে সুনামগঞ্জের আধুনিক কাব্য আন্দোলনের পুরোধা সংগঠক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার কাব্যগ্রন্থ ‘এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়’ প্রকাশ হয় ১৯৯৮ সালে। ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে তার কবিতা ছাপা হয় নিয়মিত। তিনি পরপর ৩ বার সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্ট’ানীয় সাংস্ট‹ৃৃতিক আন্দোলনে তিনি নেতৃÍ^ দিয়েছেন সামনের সারি থেকে। তার উদ্যোগে সুনামগঞ্জে দুইবার বিশাল আকারে হাছন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাজনীতিতে তিনি সব সময়ই ছিলেন প্রতিবাদী ধারার সঙ্গে স¤ক্সৃক্ত। তিনি জেলা জাসদ ছাত্রলীগ ও জেলা জাসদের সেক্রেরটারির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। তার মৃত্যুতে বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মাল আবদুল মুহিত, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক স¤ক্সাদক সাবেক এমপি সুলতান মোহাল্ফ§দ মনসুর, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্টø সভাপতি জহির চৌধুরী, সাধারণ স¤ক্সাদক আবদুল খালিক মায়ন, সিলেট জেলা জাসদ সভাপতি কলন্দর আলী, সাধারণ স¤ক্সাদক লোকমান আহমদ, মহানগর জাসদ সভাপতি জাকির আহমদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤ক্সাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুর রহমান চৌধুরীসহ বিএনপি, সিপিবি, জাসদ, বাসদ, গণফোরাম, সুনামগঞ্জ আইনজীবী সমিতি, চেল্ফ^ার অব কমার্স, সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাব, হিন্দু-বৌ™ব্দ-খ্রি¯দ্বান ঐক্য পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক জোট, সিলেট বিভাগ উল্পুয়ন পরিষদসহ বিভিল্পু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্ট‹ৃতিক সংগঠন শোকপ্রকাশ করে। সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:৪৪
false
hm
অ্যাটেনবুড়ো যখন ছোটো ছিলাম, তখন আগন্তুক বড়দের গৎবাঁধা প্রশ্নের মুখে পড়তাম, বড় হয়ে কী হবে? বড় হয়ে যাওয়ার পর কেউ জিজ্ঞেস করে না, বুড়ো হয়ে কী হবে? বুড়োদের ওপর আমাদের কোনো ভরসা বোধহয় নেই। মানুষ বুড়ো হয়ে একটা কিছু হবে, এই আশাবাদে হয়তো মানুষ কখনো পৌঁছানোর মতো শক্তিশালী হতে পারেনি। সেই আদিকাল থেকে, যখন আমরা শিকার করতাম আর এটাসেটা কুড়িয়ে খেতাম, দিন শেষ করতাম আগুনের পাশে গোল হয়ে ঘিরে বসে, তখন থেকেই হয়তো বুড়োরা কোনো কিছু না হওয়ারই প্রতীক। মানুষ শিশু থেকে যুবক হবে, সন্তানের জন্ম দেবে, তারপর বুড়ো হয়ে যাবে। বার্ধক্য মানুষের স্বেচ্ছা গন্তব্য নয়, অলঙ্ঘ্য পরিণতি কেবল। কেউ বুড়ো হতে চায় না বলেই হয়তো আর ভাবে না, বুড়ো হয়ে কী হবে সে। আমি অনেক বছর বেঁচে থাকতে চাই, বুড়ো হতে চাই, আর যেনতেন বুড়ো নয়, একজন অ্যাটেনবুড়ো হতে চাই। শরীর সুস্থ না থাকলে, বা মন খারাপ থাকলে নেট ঘেঁটে বিবিসির ডকুমেন্টারিগুলো খুঁজে বের করে দেখি। সেখানে ডেভিড অ্যাটেনবুড়ো জীবনের প্রতি কী প্রবল কৌতূহল আর ভালোবাসা নিয়ে আমাদের এই একলা গ্রহের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। পত্রিকায় খবর পড়ি, কোনো এক নরপশু হাসান সাঈদ সুমন তার স্ত্রীকে অন্ধ করে দিয়েছে সন্দেহের বশে, ব্লগে আর ফেসবুকে পড়ি, আরো সহস্র অমানুষ তার সমর্থনে কীবোর্ড খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন শুনি, একজন অ্যাটেনবুড়ো হেডফোন ফিসফিস করে বলছে, দেখো, আলোর জন্যে একটা গাছের কী অতুল তৃষ্ণা, সে কেমন করে আলোর দিকে বেড়ে উঠছে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি, কোথায় এক বৃষ্টিঘন জঙ্গলে আকাশ লেহনের সংকল্প নিয়ে বেড়ে উঠছে এক একটি বৃক্ষ। পরিমল জয়ধর তার কিশোরী ছাত্রীকে ধর্ষণ করে, আমাদের সমাজের মানসধর্ষকেরা হাত খুলে লিখে চলে, ঐ কিশোরীরই চরিত্র খারাপ, তার বেশভূষা ধর্ষণের আমন্ত্রণ জানায়। হেডফোনে অ্যাটেনবুড়ো বলে, দ্যাখো, নিউজিল্যাণ্ডের কোন দুর্গম পর্বতে একটা কাকাপো টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার দিকে, যেখানে সে একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে মুখ লাগিয়ে ডাকবে তার সঙ্গিনীকে, সেই ডাক বিবর্ধিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে তার একান্ত উপত্যকায়, মাদী কাকাপো, যদি বিলুপ্ত হয়ে না থাকে, তার ডাক শুনে এগিয়ে যাবে সেই পাহাড়শিখরের দিকে, আর চেষ্টা করবে তাদের এই বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিটিকে রক্ষার জন্যে। সড়ক দুর্ঘটনা হয়, আমাদের দরিদ্র চলচ্চিত্র জগতের পাঁচজন মানুষ এক লহমায় হারিয়ে যায়, আমাদের নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী গিয়ে আহত বাকিদের বলে, দোষ কিন্তু আপনাদের চালকেরই ছিলো। স্ক্রিনে দেখি, পলিনেশিয়ার দূর দ্বীপে মানুষ দেখে অনভ্যস্ত একটা পাখি কী অসীম আস্থা নিয়ে বসে আছে অ্যাটেনবুড়োর হাতে, আর বুড়োটা সেই পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলছে সেই পাখিদের গল্প, কী করে তারা অদ্ভুত কোনো শব্দ শুনলেই আকাশ ফুঁড়ে দুড়দাড় করে হাজির হয় সেই দূর দ্বীপের ঘন জঙ্গলের মাঝে এক ঘাসের চত্বরে। গল্পের মাঝেই পাখিটা নিঃশঙ্ক চিত্তে অ্যাটেনবুড়োর হাত বেয়ে তার কাঁধে উঠে পড়ে সন্তানের মতো, তারপর বাতাসে ডানা ভাসিয়ে চলে যায় তার যেখানে যাওয়ার। আমাদের একজন লেখক বইমেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আক্রান্ত হন ঘাতকের হাতে, আরেকজন লেখক তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর প্রবাস থেকে ডুকরে ওঠেন সেই হামলার সাফাই গাইতে, ব্লগে-ফেসবুকে দেখি আরো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন অমানুষের দল বলছে, মারছে ঠিকই আছে, মাইর খাওয়ার মতই কাম কর্ছে। স্ক্রিনে দেখি, হাঙ্গেরির এক বুনো নদীতে নৌকায় চুপ করে একটি দৃশ্যের অপেক্ষায় বসে আছে অ্যাটেনবুড়ো, একদিনের জন্যে সেই নদীর বুক থেকে জেগে উঠে আকাশের অধিকার দাবি করছে নিযুত মে ফ্লাই, মৃত্যুর আগে একমাত্র সঙ্গমের উদ্দেশ্যে। একটা বুনো ক্যাকটাসের গোল ডাল গড়াতে গড়াতে গিয়ে ঠেকছে মরুভূমিতে চরে বেড়ানো অ্যাটেনবুড়োর হাতে, অ্যাটেনবুড়োর পাশে বসে একটা সিলের ছানা বরফের গোল শ্বাসগর্তে অপেক্ষা করছে তার মায়ের জন্যে, দক্ষিণ মহাসাগরের পানি চিরে সূর্যের দিকে চাইছে একটা ঝিল্লিমুখো তিমি, আর তার লেজের ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে আমাদের অ্যাটেনবুড়ো, একটা সাগরসীমের গাছ টুপ করে তার একটি বীজ ভাসিয়ে দিচ্ছে নদীর বুকে, অ্যাটেনবুড়ো ফিসফিস করে বলে চলছে টেকো শকুনের অসাধারণ ঘ্রাণশক্তির কথা, গভীর বিষাদ নিয়ে বলছে প্রকৃতির বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া হলদে-কালো ডোরা ব্যাঙের বিলুপ্তির কাহিনী, পিতার ভালোবাসায় গাছের ডাল থেকে কোলে তুলে নিচ্ছে একটা গম্ভীর ক্যামেলিয়নকে। ওদিকে পত্রিকায় দেখি মন্ত্রীরা চুরি করে, হিংস্র মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলে নিরীহ মানুষকে, পুলিশ ছাত্রের পা ভেঙে দেয়, মা খুন করে সন্তানকে, শিশু ধর্ষিত হয় বৃদ্ধের হাতে, বনের পাশে তামাক আর ইঁট পোড়ানোর ভাঁটা চলে জমজমাট, একটা ঘরছাড়া বাঘ অবাক চোখে দেখে তাকে নিধনে এগিয়ে আসা হিংস্রতর মানুষকে। অ্যাটেনবুড়ো যখন চারশো মিলিয়ন বছরের পুরনো পাথরখণ্ড বুকে চেপে ধরে সেই পাথরের বুকে রেখে যাওয়া প্রাণীর শরীরের আভাস দেখিয়ে ফিসফিস করে বলতে থাকে, দেখো প্রাণ কত সুন্দর, প্রকৃতি কী গভীর মমতায় তার স্মৃতি ধরে রেখেছে, তখন আমাদের প্রধান দৈনিকে দেখি বুদ্ধিবেশ্যারা মাত্র চল্লিশ বছরের পুরনো যুদ্ধের ইতিহাস নষ্ট করে বিকল্প ইতিহাস লেখে। আমরা তো একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করতে চাওয়া জাতি হতে চেয়েছিলাম। এমন কেন হলাম, যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় টপকানো মানুষেরাই একেকটা প্রচণ্ড অমানুষ হয়ে ওঠে? যাদের শিক্ষিত হওয়ার কথা, তারাই দেখি সবচেয়ে বর্বরের মতো কথা বলে। অ্যাটেনবুড়োকে দেখি জঙ্গলে পাহাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটা ছোট্ট ফুলের কাছে নতজানু হয়ে বসে বলতে, কী করে সেই ফুল নিজে টিকে আছে, আর টিকিয়ে রেখেছে আরেকটি পতঙ্গকে। অ্যাটেনবুড়োকে মনে হয় উন্মাদে ভরা পৃথিবীতে শেষ সুস্থ লোক, শ্রোতার অভাব পরোয়া না করে বকে চলা এক উদভ্রান্ত আত্মমগ্ন গল্পদাদু, যে বছরের পর বছর ধরে বলে চলছে পৃথিবীর গল্প, প্রকৃতির গল্প, প্রাণের গল্প আর ভালোবাসার গল্প। মনে হয়, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সব বর্বরের বিনিময়ে প্রকৃতির কাছে একজন অ্যাটেনবুড়ো চেয়ে নিই আমাদের জন্য। বুড়ো হয়ে একজন অ্যাটেনবুড়ো হতে চাই। হতে না পারলেও চাওয়াটা ধরে রাখতে চাই। আমি এক স্বার্থপর বিশ্বনিন্দুক। পৃথিবীর খুব কম মানুষকেই আমি ভালোবাসি। তার মধ্যে অ্যাটেনবুড়ো একজন। এই লোকটা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে সম্পদ।
false
rn
ধাবমান কালো চোখে আলো নাচে ( ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব- দুই ) ১৯৪৭ সালটা সমস্ত বাঙ্গালীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত,বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) এবং পাকিস্তান (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ) এই চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সনে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর শেখ মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। ( এই লেখাতে আমি, একটু একটু করে দেশ ভাগ, যুদ্ধ, আন্দোলন,আবিস্কার, রাজনীতি, প্রেম, মানব জীবন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে টুকরো টুকরো কিছু আলোচনা করবো।) ফাতেমা বেগমের মেয়ের নাম, নূরজাহান বেগম। ডাক নাম নূরী। নূরী ছোটবেলা পুকুরে পড়ে গিয়েছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে জান। বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণীতে পড়তেন। বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) কে। নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহী দিতেন নূরজাহান বেগম। প্রায় ৬৩ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকা। যদিও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল পত্রিকাটা নিয়ে কিন্তু বেগম-এর উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বেগম-এর প্রথম দিকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাঁরা লেখা, ছবি সংগ্রহ করেতেন। আজ নারীরা নিজেই লেখা পাঠিয়ে দেন। 'ধাবমান কালো চোখে আলো নাচে' উপন্যাসে এই রকম অনেক জ্ঞানী গুনীদের কথা আসবে। শশীভূষন ক্লান্তিহীন ভাবে তার ডায়েরীতে লিখে চলেছেন- সমস্ত পৃথিবী জুড়েই দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে মানুষ। তাদের একটি দল হচ্ছে শাসক শ্রেণী, অন্যটি শোষিত শ্রেণী।পৃথিবীর আদিতে এই সব শ্রেণী বিভাজ্যতা ছিল না। কারণ তখন রাজা প্রজার ভেদ বুঝতে পারতো না মানুষ।পশ্চিমা দেশগুলো সভ্যতার সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। অন্ত পাঁচহাজার বছর আগে থেকে শুরু করতে পেরেছিল তারা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে যাওয়া বাঙালি ১৯৪৭ সালে কাজে পরিণত করার মতো পরস্পরবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পেরেছিল। আগেরবার বৃটিশ রাজ সেটা করতে চেয়ে এদের বিরোধিতায় সেটা পারেনি পরের বার বৃটিশদের হাতে-পায়ে ধরে সেটা করে এরা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন নিপীড়িত মেজরিটি বাঙ্গালীদের একটু সুবিধা দিতে চেয়ে বঙ্গভঙ্গ করেন। কিন্তু সংখ্যালঘু বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে দারুণ আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে কিছু জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা যে ছিলেন না তা নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে এটা বাতিল ঘোষিত হয়। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলি জনসংখ্যায় ভারসাম্য ছিল ঠিকই, কিন্তু লেখাপড়ায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এরা মুসলমানদের চাইতে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিল যা একশ' বছরের মধ্যেও অক্ষুণ্ণ থাকতো। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন অবসান করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ হয়ে ১৪ আগষ্ট পাকিস্থান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভ । ওমর আলীর হাতে পন্ডিত নেহেরু ‘ডিস্কভারি অব ইন্ডিয়া' বইটি। তিনি ৩১৪ পৃষ্ঠাটি খুব মন দিয়ে পড়ছেন। ৩১৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, ''অন্যান্য অঞ্চলে বৃটিশ শাসন ছড়িয়ে পড়ার আগে বাঙালিরা একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করে পঞ্চাশ বছর ধরে। এ কারণেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৃটিশ ভারতে ঔদ্ধত্যব্যঞ্জক ও প্রধান ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। সে সময় বাংলা শুধু বৃটিশ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল না, এদের মধ্য থেকেই প্রথম ইংরেজি শিক্ষিত দলটি বের হয় এবং বৃটিশ ছত্রছায়ায় ভারতের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা বৃটিশ শাসনকে মেনে নেয়, বশ্যতা স্বীকার করে এবং এতে অভ্যস্ত হয় ভারতের বাকি অংশের অনেক পূর্বেই।'' ওমর আলী হচ্ছেন- আমার নানা। খুবই সহজ সরল একজন মানুষ। আমার যখন দুই বছর বয়স, তখন নানা মারা যান। মার কাছ থেকে নানার অনেক গল্প শুনেছি। সেই গল্পের কিছু কিছু অংশ এই লেখাতে আসবে। জওহরলাল নেহ্‌রু সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। গঙ্গা নদীর তীরে এলাহাবাদ শহরে জওহরলাল নেহেরু জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালে। গান্ধীর দর্শন ও নেতৃত্ব জওহরলাল নেহেরুকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবে নেহেরু পরিবার তাদের ভোগ-বিলাসের জীবন ত্যাগ করেন। তখন থেকে নেহেরু খাদির তৈরি কাপড় পড়তেন। ব্যক্তিজীবনে রূচিবান পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জওহরলাল নেহ্‌রু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহেরু। তিনি মোট পাঁচবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বৃটিশ সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করায় তিনি বহুবার কারারুদ্ধ হন এবং প্রায় ১৭ বছর জেল খাটেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি প্রথম সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে ভারতের এই মহান নেতা তার নিজ কার্যালয়ে মৃত্যু বরণ করেন। জওহরলাল নেহেরু ও তার দুই বোন বিজয়া লক্ষ্মী ও কৃষ্ণা "আনন্দ ভবন" নামক বিশাল বাড়িতে পশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হযে উঠেন। তৎকালীন ভারতের সব থেকে আধুনিক স্কুলে পড়ার পর প্রায় ১৫ বছর বয়সে নেহেরু ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান। এরপর তিনি কেমব্রীজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় নেহেরু ভারতীয় ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর শাসনামলে ভারতে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়। এই সময়ে একটি ভারত-পাকিস্তান ও একটি ভারত-চীন যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ভারত-পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি করেন। লেখক হিসেবেও নেহরু বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জেলে বসেই তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজীতে লেখা তাঁর তিনটি বিখ্যাত বই- 'একটি আত্মজীবনী'(An Autobiography), 'বিশ্ব ইতিহাসের কিছু চিত্র' (Glimpses of World History), এবং 'ভারত আবিষ্কার' (The Discovery of India) চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। জওহরলাল নেহেরুও একজন রাজনীতিবীদ সুতরাং তার পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য থাকবে, কেউ শ্রদ্ধা আবার কেউ নিন্দাও জানাবে তাকে এটা অস্বাভাবিক নয়। জওহরলাল নেহ্‌রু'র সাথে বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ এর সাথে খুব মিল আছে, বলুন তো দেখি আমি কার কথা বলছি ? ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রচন্ড শীতে এক বালক রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটছে। সে জানে না তার বাবা কে, মা কে ? ক্ষুধা পেলে একটা খাবার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেউ কেউ তাকে- ফেলে দেওয়া খাবার খেতে দেয়। বালকটি মানুষের নষ্ট করা খাবার এক আকাশ আনন্দ নিয়ে রাস্তার পাশে বসে খায়। খাওয়ার সময় বালকটিকে অনেক আনন্দিত দেখা যায়। বালকটির কোনো নাম নেই। যে বালকের বাপ মায়ের ঠিক নাই- ঘটা করে কে আবার সেই বালকের নাম রাখে। তাই আমি লেখার খাতিরে বালকটিকে একটি নাম দিলাম, টারজান। টারজান নাম দেওয়ার পেছনে কারন হলো- সে খুব সহজেই যে কোনো গাছে লাফ দিয়ে উঠতে পারে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারে। এই কাজটি করতে তার কোনো ভয় হয়না। দেশ ভাগ হয়ে গেল, ইংরেজরা বিদায় নিলো- টারজান তার কিছুই জানল না, বুঝল না। টারজান এর সব চিন্তা- শুধু তিনবেলা খাবার সংগ্রহে। ইদানিং টারজানের সাথে একটা কালো রঙের কুকুর যুক্ত হয়েছে। ছোট বাচ্চা একটা কুকুর। টারজান বাচ্চা কুকুরটার নাম রেখেছে কাল্লু। কুকুরটা দেখতে কুচকুচে কালো রঙের, তাই নাম রাখা হয়েছে কাল্লু। কাল্লু সারাদিন টারজানের পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে। কাল্লুর উপর মায়া পড়ে গেছে টারজানের। টারজান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- কাল্লুকে সে পালবে। অনেক বড় করবে। এই কাল্লু একটু বড় হওয়ার পর- সহজ সরল মানুষ 'ওমর আলী' নামে একজনকে কামড় দেয়, টারজান এবং কাল্লুর কাহিনী পরে বিস্তারিত বলা হবে। সারাদিন একটানা দুশ্চিন্তায় মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষসমূহে এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ জমা হয়। শুধু দুশ্চিন্তা নয়, নিত্যদিনের যে কাজগুলো মানুষকে করতে হয় তা সুন্দরভাবে সমাধা করতে বহু কিছু চিন্তা করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রাতের বেলায় সুনিদ্রার তাৎপর্য নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে।... টাইমস অব ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে মানুষের মস্তিস্ক নিয়ে একটা আর্টিকেল ছাপিয়েছে। অলকা খুব মন দিয়ে আর্টিকেলটি দুইবার পড়ল । এই ধরনের আর্টিকেল তার বাবা শশীভূষন খুব পছন্দ করেন। যে কোনো বিষয়ের উপর বই পড়তে শশীভূষন অনেক আনন্দ পান। নতুন নতুন বিষয় জেনে শশীভুষন প্রচন্ড অবাক হোন। অলকার ধারনা তার বাবা পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় নেই- যা তিনি জানেন না। দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। উদার মতাদর্শ নিয়ে ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকার সদর দফতর ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে। বৃটিশ শাসনামলে ১৮৩৮ সালের ৩ নভেম্বর বোম্বাই টাইমস হিসেবে প্রথমে এই পত্রিকা আত্বপ্রকাশ করে। প্রথমে প্রতি শনি ও বুধবার অর্ধ সাপ্তাহিক হিসেবে বের হতো। রায় বাহাদুর নারায়ণ দিনান্ত বেলকার পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা। তখন বৃটেনের সংবাদ বেশি গুরুত্ব পেতো। ১৮৬১ সালে বোম্বে টাইমস থেকে পরিবর্তন হয়ে নামকরণ করা হয় ইন্ডিয়ান টাইমস। ভারত স্বাধীনতার পর পত্রিকাটির মালিকানা লাভ করে ডালিয়াস শিল্পগোষ্ঠী। পরে এটি জৈন গ্রুপ মালিকানা লাভ করে। পরবর্তীতে এরপর নামকরণ করা হয় টাইমস অব ইন্ডিয়া। সহজ ও সাবলীল শব্দচয়ন ও অনলাইন সংস্করণে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল সংবাদের কারণে ভারতের উচ্চ ও মধ্য শিক্ষিত ইংরেজি জানা ব্যক্তিদের মাঝে পত্রিকাটির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। জার্মানির একটি ছোট শহর উলমে এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে একজন মহান বিজ্ঞানীর জন্ম হয়। স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই অভিযোগ আসত পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছেলে, অমনোযোগী, আনমনা। ক্লাসের কেউ তার সঙ্গী ছিল না। সকলের শেষে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেন। দর্শনের বই তাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত। পনেরো বছর বয়সের মধ্যে তিনি কান্ট, স্পিনোজা, ইউক্লিড, নিউটনের রচনা পড়ে শেষ করে ফেললেন। বিজ্ঞান, দর্শনের সাথে পড়তেন গ্যেটে, শিলার, শেক্সপিয়ার। অবসর সময়ে বেহালায় বিটোফোন, মোতসার্টের সুর তুলতেন। এই মহান বিজ্ঞানী বাইশ বছর বয়সে মিলেভা নামের এক হাসিখুশি তরুনীকে বিয়ে করে ফেলেন। একদিন গভীর রাতে মিলেভা ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার স্বামী পাশে নেই। মিলেভা বিছানা থেকে নেমে দেখেন- তার স্বামী ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। মিলেভা এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে আস্তে করে স্বামীর পিঠে হাত রাখেন। স্বামী ফিস ফিস করে বললেন- ‘আমি এই বিশ্বপ্রকৃতির স্থান ও সময় নিয়ে গবেষণা করছি।’ আইনস্টাইনের এই গবেষণায় ছিল না কোনো ল্যাবরেটরি, ছিল না কোনো যন্ত্রপাতি। তার একমাত্র অবলম্বন ছিল খাতা-কলম আর তার অসাধারণ চিন্তাশক্তি। অবশেষে শেষ হলো তার গবেষণা। তখন তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। একদিন ত্রিশ পাতার একটি প্রবন্ধ নিয়ে হাজির হলেন বার্লিনের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পত্রিকা Annalen der physik-এর অফিসে। ( চলবে...) সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৫
false
fe
একটি জাতি যখন সত্যের অন্বেষণে অগ্রসর হয় একটি জাতি যখন সত্যের অন্বেষণে অগ্রসর হয় ফকির ইলিয়াস====================================কিছু কিছু সংবাদ আছে গোটা জাতিকে আশান্বিত করে। উজ্জীবিত করে। তেমনি একটি সংবাদ দেখে আমি বিশেষভাবে আপ্লুত হয়েছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের বীরউত্তম হত্যাকা- কেন বেআইনি ছিল না_ এ মর্মে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার পর রিট আবেদনের সূত্র ধরে কর্নেল তাহেরের ভাই ড. আনোয়ার হোসেন, স্ত্রী বেগম লুৎফা তাহের প্রমুখ এ রিট আবেদন করেছেন। বাদীদের পক্ষে দেশের প্রখ্যাত আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক মামলাটি পরিচালনা করছেন। ইতিহাসের গতি কোনভাবেই মিথ্যা দিয়ে চাপিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশিত হয়। হতেই হয়। তা না হলে মনুষ্য জাতি নির্ভীক চিত্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্ম সৎ সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন কর্নেল তাহের, সে তাহেরকে তথাকথিত গোপন বিচার, সামরিক কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং রায় প্রদানের পর চরম বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রায় কার্যকর করা হয়। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৫ আগস্টের নির্মমতম হত্যাকা-ের পর সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, 'সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার'। সে সময়ে বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ঘাতকচক্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ক্ষমতার পালাবদলে ডানপন্থি মৌলবাদী শক্তিকে সার্বিক পুনর্বাসনে ছিল সর্বাত্মকভাবে তৎপর। জিয়াউর রহমান প্রথমে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, যদি তা পালিত হতো তবে সৈয়দ নজরুল ইসলামই ক্ষমতাসীন হতেন। বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের তাৎক্ষণিক বন্দি করা সম্ভব হতো। ওদের বিচার হতো। কিন্তু দেখা গেল খুব দ্রুতই তার মতামত থেকে সরে আসেন জিয়াউর রহমান। হাত মেলান খুনি ডালিম-রশীদ-হুদা চক্রের সঙ্গে। যদিও ডালিম-ফারুক চক্র পরে টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছে, তারা জিয়াকে আগেই ১৫ আগস্টের ক্যুর কথা জানিয়ে রেখেছিল। ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের শাসন সেজন্যই ছিল খুব ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত কুশীলবরা বেরিয়ে এসেছিল হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে। খুনিদের বিদেশে পাঠানোর নিশ্চয়তা প্রদান করে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সব ব্যবস্থাই করতে তৎপর ছিলেন জিয়াউর রহমান। কর্নেল আবু তাহের মূলত ভয়ের কারণ ছিলেন সেই ক্ষমতালিপ্সুদের। তারা জানত তাহের বেঁচে থাকলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তারা ক্ষমতায় টিকে নাও থাকতে পারে। সে কারণেই প্রহসনের বিচারের আয়োজন করে তাহেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের হত্যা করেছিল স্বৈরশাসক জিয়া সরকার। তাহেরের সঙ্গে জিয়ার বৈরিতার প্রধান কারণ ছিল তাহের মৌলবাদী রাজাকার শক্তির সঙ্গে কোন আঁতাত মেনে নিতে চাননি। আর জিয়া সেই আঁতাতই করতে চেয়েছিলেন। যার কুফল আজও ভোগ করছে গোটা জাতি। গোটা বাংলাদেশের মানুষ। কর্নেল তাহের হত্যাকা- কেন বেআইনি ঘোষণা হবে না- তা দাবি করাটা ঐতিহাসিক এবং নৈতিক দায়িত্বও বটে। তাহের এ বাংলাদেশের গণমানুষের স্বপ্ন পূরণে ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। যুদ্ধাহত হওয়ার পরও তার উদ্যম ও স্পৃহার কোন কমতি ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ এ রিট আবেদনের রায় দেখতে চায়। দুই.মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশজুড়ে তদন্ত শুরু করেছে। এ তদন্ত টিমের একটি গ্রুপ সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়েছিল তদন্ত কাজে। সেখানে তারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের ব্যাপক চিত্র পরিলক্ষণ করেছেন। টিমের সদস্য মতিউর রহমান খুব জোর দিয়ে বলেছেন, তারা রাজাকার বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ, প্রমাণাদি পেয়েছেন। এ এলাকাটি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের এলাকা বলে পরিচিত। ওই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যায়িত করে জামায়াতের তৎকালীন মূল কর্ণধার গোলাম আযম কী করেছেন, তা সে এলাকার মানুষজনই এখন বলছেন। জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার বাহিনী জঘন্য ও নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছে বাংলাদেশে একাত্তর সালে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ রাজাকার জামায়াত বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত আমির দ্বারাই তাদের রাজনীতি চালিয়েছে গোলাম আযম প্রকাশ্যে আসার আগ পর্যন্ত। আব্বাস আলী খান ভারপ্রাপ্ত আমির থাকলেও মূলত সে গোলাম আযমই ছিলেন তাদের প্রধান নেতা। সন্দেহ নেই সে বয়োবৃদ্ধ গোলাম আযম এখনো জামায়াতের নেপথ্য কর্ণধার। 'এরা সকলেই নির্দোষ'- বলে জামায়াতের কিছু নেতা এখনো চেঁচামেচি করে গেলেও তারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য এখনো অনুতাপ প্রকাশ করছে না। বরং নানা শক্তির জোগান দিয়ে বাংলাদেশে তালেবানি মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার আসকারা দিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, একটি জাতি যখন সত্যের অন্বেষণে অগ্রসর হয় তখন কেউই তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে সেই '৪৭ সাল থেকে। করা হয়েছে '৫২ সালে। এর পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা। আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলি, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো জাঁদরেল নেতারা যা পারেননি সেই ডাকটি দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে জিয়াউর রহমান একাত্তর সালে প্রজাতন্ত্রের একজন সৈনিক ছিলেন মাত্র, সে জিয়াকে আজ যারা 'মহাঅবতার' ভাবছেন একদিন তাদের সে ভাবনাও ভেঙে চুরমার করে দেবে বাংলাদেশের আগুয়ান নবীন প্রজন্ম। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ রায় দিয়েছে ঘাতক রাজাকারদের বিচারের পক্ষে। মানুষ রায় দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষকে বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনের পক্ষে। মানুষ রায় দিয়েছে সামরিক শাসকদের সব হীন মতলবের ফরমান বাতিল করার পক্ষে। যারা ফাঁদ পেতে অন্যকে ফাঁসাতে চেয়েছিল তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটিয়েই আইনি শাসনে বাতিল হয়ে গেছে পঞ্চম সংশোধনী। সত্যের জয়, মানুষের বিজয় এভাবেই হয়। বাংলাদেশের মানুষ চায়, তাহের হত্যার হুকুমদাতাদের মরণোত্তর বিচার। বাংলাদেশের মানুষ চায়, ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের গণতান্ত্রিক পরিচর্যা। সরকারকে তাই মানুষের পক্ষেই থাকতে হবে। নিউইয়র্ক ২৫ আগস্ট ২০১০ ----------------------------------------------------------------------দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ২৭ আগস্ট ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - নাথান বেলমি
false
fe
রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে গণতন্ত্রের চেতনা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে গণতন্ত্রের চেতনা ফকির ইলিয়াস------------------------------------------------------------একটি চমৎকার যোগসূত্র। জামিনের মেয়াদ বাড়ছে আগামী সরকারের মেয়াদ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বেগম খালেদা জিয়া জামিন পেয়েছেন তিন মাসের। তারই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন ৮ মাসের। বর্তমান সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র আড়াই মাস। আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত তারা থাকবেন। এরপর নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে।বর্তমান সরকার, একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়েই বিদায় নেবে এটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যারা এদেশে রাজনীতি করেন তাদেরও এর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্খায়ই শীর্ষ রাজনীতিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। বেগম জিয়া ৩ মাসের জামিন পেয়েই বলেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আরও বেশি মামলা দেবেন। কি বিষয়ে মামলা হবে, কারা মামলা করবে এ ব্যাপারে বেগম জিয়া বেশি কিছু বলেননি। এদিকে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেই দিয়েছেন চারদলীয় জোটকে আগামী নির্বাচনে ঠেকানো যাবে না। এর সঙ্গে সমান্তরাল বিষয়টি হচ্ছে শেখ হাসিনা এখনও খালেদার মেয়াদে (অর্থাৎ এই সরকারে পটপরিবর্তনের পরবর্তী কিছুদিন পর্যন্ত) জামিন পাননি। এই দ্বিমুখী নীতি বর্তমান সরকার কেন গ্রহণ করছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয়, বর্তমান সরকারের শেষ ইচ্ছেগুলো কি!এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশে একটি মৌলবাদী চক্র ততোই সক্রিয় হয়ে উঠছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থেকে বাউল সাধন লালন সাঁইয়ের একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নিয়েছে এই সরকার, এসব মৌলবাদীদের দাবির মুখে। ভাস্কর্যটি তৈরি করছিলেন শিল্পী মৃণাল হক। এ ঘটনার পরম্পরায় আবার নানা বক্তব্য শুরু করেছে একাত্তরের পরাজিত রাজাকার আলবদর চক্র। মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী নামের সেই পুরনো রাজাকার বলেছে, বাংলাদেশে প্রতিটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে ক্রমশ।কি জঘন্য ধৃষ্টতা। পলাতক আসামি (?) আলী আহসান মুজাহিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও তার সদস্যদের বৈঠকের পরপর রাজাকার জঙ্গিবাদী চক্র যে সাহস পেয়েছে, ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার ঘটনা এরই উদাহরণ। দেশে জরুরি অবস্খা থাকার পরও এরা সমাবেশ করে ভাস্কর্য সরানোর হুমকি দেয় কীভাবে? নাকি বিশেষ ছায়া ব্যবস্খায় এসব জঙ্গিচক্রকে প্রোটেকশন দিচ্ছে বর্তমান সরকার?একটি কথা বাঙালি জাতি খুব দৃঢ়ভাবেই জানে এবং বিশ্বাস করে সৃজনশীল ভাস্কর্য জাতিসত্তার শ্রদ্ধ মননের প্রতীক। শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলাসহ এ দেশের আনাচে-কানাচে অগণিত ভাস্কর্য বাঙালি জাতির স্মৃতি জাগানিয়া শক্তি ও প্রেরণার নিদর্শন। একটি রাইফেল হাতে কোন বীর মুক্তি সেনার ভাস্কর্য দেখলে কোন পরাজিত রাজাকারের গা জ্বালা হতেই পারে। তাই বলে কি সে ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে হবে?ঠিক একইভাবে মরমীবাদ ও বাংলা সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি কৃষ্টির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফকির লালন এই বদ্বীপে প্রখর চেতনায় অসাম্প্রদায়িক মলমন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। তার সঙ্গীত সাহিত্য কর্মই শুধু নয়, তার ভাবনা বাঙালির মননকে শুদ্ধ সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণ এবং তার আদৃত হয়েছে গোটা বিশ্বের সাহিত্যমোদীর কাছে।এসব মৌলবাদী জঙ্গিরা এদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণের বিরোধিতা করেছে। এখন তারা লালনের ভাস্কর্য সহ্য করতে পারছে না। এসবের কাছে রাষ্ট্রপক্ষ নতজানু হচ্ছে বারবার। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ভমিকাও রহস্যজনক।দুইঅনেক দর কষাকষি করে শেষ পর্যন্ত নাম পাল্টেছে জামায়াত। গেল সাঁইত্রিশ বছর তাদের নাম ছিল, ‘জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ’। অনেকটা সঙ্গত কারণেই মনে করা হতো এটা ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান’-এর একটি শাখা।এখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। তারা আরও বলেছে, ‘আল্লাহর আইন চাই’ এই মুখ্য শ্লোগান পরিবর্তন করে এখন থেকে তারা বলবে ‘ইসলামের শাসন চাই’। ছাত্রশিবিরও নাকি তাদের সহযোগী সংগঠন নয়!!এর মাধ্যমে জামায়াতের মৌলিক চরিত্রের কোন পরিবর্তন হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান নেতৃত্ব বদলে তারা আদৌ অঙ্গীকারবদ্ধ কি না, তাও তাদের বর্তমান নেতৃত্ব ও বর্তমান সরকারই ভাল জানে। তবে একটা সমঝোতা না হলে পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে আলী আহসান মুজাহিদ, কীভাবে গিয়ে আদালতে হাজির হলেন তা রহস্যজনক তো বটেই। কি চমৎকার একটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনের চেতনাধারীরা। এর আলামত দেখছে দেশবাসী। দেখছে, পরাজিত শক্তির পুনর্বাসন।হরকাতুল জেহাদ নামের দলটিও নতুন নামে নিবন করছে। তাদের নেতাদেরও টিভিতে দেখলাম। তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল, চক্রান্তকারী যে বা যারাই হোক না কেন তারা বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন নামে আবির্ভত হতে পারবে। এই তা হলে ছিল ক্ষমতাসীনদের মনে? এটাই তাহলে ওয়ান-ইলেভেনের অন্যতম ফসল?বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, তাদের নিবনে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় দায়ে ফেলেই তাদের নিবন্ধিত করা হচ্ছে। না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, গণতন্ত্রের আদর্শ কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত কি কোন জোরদস্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে? একটি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ঘটনাটি মার্কিন রাজনীতিতে ব্যাপক মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অফ স্টেট) মি. কলিন পাওয়েল প্রকাশ্যে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছেন। কলিন পাওয়েল ঝানু রিপাবলিকান। তিনি মার্কিন জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। কলিন পাওয়েল বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বাঁচাতে বারাক ওবামার বিকল্প কোন নেতা এ মুহর্তে নেই। কেউ কেউ বলছেন, কলিন পাওয়েল নিজে কৃষ্ণাঙ্গ বলেই বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছেন। এ অভিযোগ খণ্ডন করে কলিন পাওয়েল বলেছেন, এটা যারা বলছে তারা হীনমন্য। তিনি তার গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে বিবেকপ্রসূত হয়েই বারাককে সমর্থন দিচ্ছেন। আর এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।বাংলাদেশে কি এমনটি কল্পনাও করা যাবে? যুদ্ধাপরাধীদের বয়কট করতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কি দাঁড়াবে এক কাতারে, না-দাঁড়াবে না। বরং সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার সুযোগ খুঁজবে। জাতীয় অস্তিত্ব এভাবেই নড়বড়ে হয়েছে বারবার রাজনীতির ভাস্করবৃত্তির কাছে। এখন ঘাতক রাজাকাররা, প্রগতিবাদীদের রাজনীতির পাঠ দিচ্ছে। উপদেষ্টা হাসান আরিফ, ডা. হোসেন জিল্লুর, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামরা পাহারা দিচ্ছেন রাজাকারদের নিরাপত্তায়! জানি না, আর দেখার কি বাকি আছে। নিউইয়র্ক, ২২ অক্টোবর ২০০৮---------------------------------------------------------------------------------দৈনিক সংবাদ। ২৪ অক্টোবর ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
false
ij
যে দ্বীপে অচর্না হয় কামি-র। Shinto beliefs and ways of thinking are deep in the subconscious fabric of modern Japanese society. The afterlife is not a primary concern in Shinto; much more emphasis is placed on fitting into this world, instead of preparing for the next. বৌদ্ধধর্ম জাপানে পৌঁছেছিল ষষ্ট শতকে। তারপর থেকেই তথাগতর ধর্মটি ওই দেশটিতে আদৃত হয়ে আছে। তার অনেক আগে থেকেই জাপানের নিজস্ব ধর্ম ছিল। শিন্টো। আজও দুটি ধর্মই পালন করে জাপানিরা। জাপানের নিজস্ব আদি ধর্ম শিন্টো। আদি ধর্মকে কি এত সহজে ভোলা যায়? বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে কি লোকায়ত উপাদান নেই? আছে। শিন্টো ধর্মের কথা হচ্ছিল। পরে এই ধর্মটিকে জাপানি শাসকগন রাষ্ট্রীয় ধর্ম করেছিল হয়েছিল। বাংলাতেও তাই হয়েছিল। পালেরা বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিল। শিন্টো ধর্মে “কামি” বা আত্মার উপাসনা করা হয়। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। আগে দেখি শিন্টো শব্দের কি অর্থ। শিন্টো শব্দটি দুটো শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে। “শিন” এবং “টো”। শিন মানে আত্মা। টো মানে পথ। সুতরাং, শিন্টো শব্দের অর্থ দাঁড়ায়: আত্মার পথ। এখানে বলে রাখা ভালো যে শিন শব্দটি কিন্তু আদৌ জাপানি শব্দ নয়-বরং চৈনিক। এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের বাংলায় কত কত উত্তর ভারতীয় শব্দ ঢুকে গেছে। লাতিন শব্দ ANIMA মানে আত্মা বা জীবন। তো, শিন্টোর আলোচনায় লাতিন কেন? বলছি। এক ধরনের বিশ্বাস এ গ্রহে প্রচলিত প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত যে- পশু উদ্ভিদ কি অন্যান্য বস্তুর ভিতরে রয়েছে প্রাণ। এই ধারনা কে বলে Animism. ওই লাতিন ANIMA শব্দ থেকেই Animism শব্দের উদ্ভব। শিন্টো,বলাবাহুল্য, অনিবার্যভাবেই এক ধরনের Animism. আবার এটি এক ধরনের শামানবাদী ধর্ম। তে, শামানবাদী ধর্ম কি? যে ধর্মে নানা রকম অর্চনার মাধ্যমে আত্মার জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় তাই শামানবাদী ধর্ম। এটিও মানবসভ্যতার অতি প্রাচীন বিশ্বাস। শিন্টোতে তাও হয়, মানে আত্মার জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখন বললাম না যে শিন্টো ধর্মে “কামি” বা আত্মার উপাসনা করা হয়। শিন্টোর শিক্ষা এই যে- এ গ্রহের সবেতে কামি রয়েছে। কামি হল, আগে বলেছি, আত্মা। এই আত্মা বা কামি রয়েছে প্রতিটি পাথরে, কাঠবেড়ালিতে; প্রতিটি জীবন্ত কি মৃত প্রাণিতে । উপরোন্ত, কামি পবিত্র ও স্বর্গীয়। শিন্টো ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য চারটি। (আসলে শিন্টোর কোনও নিয়মকানুন নেই। এসব পরে সংযোজিত হয়েছে।) ১) পরিবার ও ঐতিহ্য। এ দুটোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এটা কমন।অন্য ধর্মেও আছে। ২) প্রকৃতির প্রতি প্রেম। প্রকৃতি পবিত্র। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ মানেই কামির সঙ্গে যোগ। প্রাকৃতিক বস্তুকে পবিত্র জ্ঞান করে উপাসনা করা হয়। ( বিশ্বের চারটি প্রধান ধর্মের সঙ্গে কামিবাদীরা এখানেই পৃথক। মার্কসবাদীদের সঙ্গে কামিপন্থিদের তফাত লক্ষনীয়। সব মানুষের জন্য কল্যাণকর সমাজের জন্য মার্কসবাদীরা প্রকৃতিকে বদলাতে চায় । শিন্টোবাদীরা বলে যে, প্রকৃতি যেমন আছে তেমনই থাকুক।বিশ্বের চারটি প্রধান ধর্মে সেভাবে, মানে কবির চোখে নিরপেক্ষভাবে প্রকৃতিবন্দনা কই। যা আছে তা হল, দেখ প্রকৃতি কি জিনিস। যে এইটা বানাইছে সে কি চিজ!) ৩) সূচিতা-শুদ্ধতা: স্নান। হাত ধোওয়া। কুলি করা। শিন্টোবাদীরা এসব নিয়মিতভাবেই করে। এটাও কমন। অন্য ধর্মেও আছে। ৪) মাটসুরি। প্রতি বছর বেশ কয়েবারই কামি-কে ঘিরে উৎসব হয় ।ওটাই মাটসুরি। (আপনারা অনেকেই জাপানি কম্পেজার কিটারোর নাম শুনে থাকবেন। এঁর মাটসুরি নামে চমৎকার একটি কম্পোজিশন আছে। নেটে সার্চ করে শুনবেন। ) যা হোক। শিন্টো ধর্মের আসলে নিদিষ্ট মতবাদ নেই, পবিত্র স্থান নেই, মানে তীর্থ নেই, কোনও পবিত্র ব্যাক্তি নেই, মানে ধর্মব্যবাসা নেই, নেই নির্দিষ্ট প্রার্থনা । বরং রয়েছে কিছু শামানবাদী কৃত্য, রয়েছে কামির সঙ্গে যুক্ত হবার পদ্ধতি। ধর্মটি যেহেতু এক ধরনের Animism. সবচে জরুরি প্রশ্ন প্রাচীন জাপানের মানুষ ওভাবে ভেবেছিল কেন? কে বলতে পারে? জাপানের আদিম মানুষ চোখ মেলে প্রকৃতি দেখেছিল। জাপানের প্রকৃতি তো সুন্দর। ছেলেবেলায় আমি নীল রঙের একটি জাপানি স্ট্যাম্প দেখেছিলাম। কি এক পাহাড় ছিল। সেই নীলাভ রঙের স্মরণে আজও শিউরে উঠি। তো, আদিম জাপানিদের এমন মনে হওয়া বিচিত্র নয় যে সেই সুন্দর প্রকৃতিতে রয়ে গেছে আত্মা। কামি। সে যাই হোক। জাপানের উন্নতির সহায়ক হয়েছিল শিন্টো ধর্ম। শিন্টো ধর্ম অহেতুক পরলোকপন্থি নয়। ধর্মব্যবসায়ী নেই এতে। জগতে বাস করে জগৎকে অস্বীকার করা হয়নি কামি-অর্চনায়। শিন্টো ধর্মের এই দিকটা আমার ভালো লাগে। আমার তো শিন্টো ধর্মকেই জগতের শ্রেষ্ট ধর্ম বলে মনে হয়। হয়তো তথাকথিত সভ্যতার প্রভূত ভারে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বলে। আজকাল ভীষন নুব্জ বোধ করছি বলে। আদিম অরণ্যে ফিরে যেতে চাই বলে। এককালে নিষাদেরা যেখানে বোঙ্গা দেবতার... লিঙ্ক: http://en.wikipedia.org/wiki/ShintÅ� সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৫২
false
hm
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক মিডিয়া শিরোনাম শুনলে বিরাট প্রবন্ধের মুখচ্ছবি কল্পনায় আসতে পারে, কিন্তু শুরুতেই সে কল্পনায় কাঠি দিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রকৃতি বা তীব্রতা সম্পর্কে জানার সুযোগ আমার কম ছিলো। কারণ হিসেবে প্রথমে ছিলো যথাযথ আগ্রহের অভাব, আর মিডিয়ার দুর্লভত্ব। দেশে সিএনএন দেখার সুযোগ ছিলো, এর বাইরে কিছু নয়। ফলে খুব জরুরি কিছু ইভেন্ট ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় ছিলো না। ব্লগের কল্যাণে (হাফিংটনপোস্টের নামই করবো সবার শুরুতে) ওবামা বনাম ম্যাকেইন প্রচারাভিযানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়ার সুযোগ এসেছে। প্রার্থীদের মধ্যে কে কী নিয়ে লড়ছেন, প্রতিপক্ষের কোন রন্ধ্রটিতে আঙুল ঢোকাচ্ছেন, সে সম্পর্কে অর্ধস্বচ্ছ একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। তবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গাঢ় পেনিট্রেশনের কারণে এই প্রচারাভিযানে টেলিভিশন যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, সেটা পরিষ্কার। ফক্স, সিবিএস, কমেডি সেন্ট্রাল, এইচবিওসহ আরো কয়েকটি চ্যানেল প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা এই নির্বাচন ক্যাম্পেইনকে প্রভাবিত করে চলছে। রাজনৈতিক মেরুমুখিতা অনুযায়ী বিভিন্ন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক তাদের অনুষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিক প্রচারযন্ত্র খুলে ধরছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই আমার। তারেক রহমান বা ফালুর লুটপাটের টাকায় গড়া দু'টি টেলিভিশন চ্যানেলের আমি মুগ্ধ দর্শক ছিলাম (আহ, সেই সংবাদপাঠিকারা!), অনেক সন্ধ্যায় তারেকমুখী বা ফালুমুখী সংবাদ জুলজুলদৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছি (ওরেরে, সেই সংবাদপাঠিকারা!)। তবে মার্কিন টেলিভিশনের শক্তি এর মাত্রায়। স্যাটারডে নাইট লাইভ [এসএনএল] যেমন বহু বছর ধরে জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান, সারাহ প্যালিন উপরাষ্ট্রপতি পদে ম্যাকেইনের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই অভিনেত্রী টিনা ফে তার ইমপারসোনেশন শুরু করেছেন। দূর থেকে টিনার সাথে সারাহ প্যালিনের পার্থক্য করা একটু মুশকিলই। প্যালিনের কথায় মধ্য-পশ্চিমের টান টিনা ফে চমৎকার অনুকরণ করতে পারেন, সেইসাথে প্যালিনের শারীরভঙ্গিও তিনি রপ্ত করে ফেলেছেন। ফলে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা বা বিতর্কের পরপরই শনিবার রাতে এসএনএলে টিনা ফে এসে প্যালিনকে নির্মমভাবে পঁচান। একটি পর্বে তিনি কেটি কুরিকের সাথে সারাহ প্যালিনের সাক্ষাৎকারে ব্যবহৃত অসংলগ্ন সংলাপ প্রায় হুবহু ডেলিভার করে লোক হাসিয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে সারাহ প্যালিনের অজ্ঞতা থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত অসংবৃত বুলিগুলো (যেমন হকি-মম, জো সিক্সপ্যাক ...), সবই সেই ইমপারসোনেশনে মেশানো হয়। কেবল প্যালিনকেই পঁচানো হয় না, ওবামা, ম্যাকেইন, ক্লিনটন, হিলারি, বুশ (উইল ফ্যারেল বুশকে পঁচানোর জন্যে আসেন, এক কথায় অনবদ্য), সবাইকেই কমবেশি ধোলাই করা হয় এসএনএলে। তো সেই এসএনএলে এই ভাঁড়ামিরই একটি অংশ হিসেবে সম্প্রতি খোদ সারাহ প্যালিন (গত হপ্তায়) এবং জন ও সিন্ডি ম্যাকেইন (এ হপ্তায়) এসেছিলেন। মিডিয়ার প্রভাব কতটা সুদূরগ্রাসী হলে কোন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী একটি লোক-হাসানো অনুষ্ঠানে অন্যের লেখা বুলি আউড়ে অভিনয় করতে রাজি না হয়ে পারে না, সেটিই আমার বিস্ময়ের কারণ।
false
ij
অডেনের দু'টি কবিতা উইস্টান হিউ অডেনের জন্ম ১৯০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের ইয়র্কে। ছেলেবেলায় ইয়র্ক থেকে বার্মিংহামে চলে যান; পড়ালেখা করেন অক্সফোর্ডে। অডেনের তরুন বয়েসে লেখা কবিতায় টমাস হার্ডি, রবার্ট ফ্রস্ট, উইলিয়াম ব্লেইক, এমিলি ডিকিনসন এবং জেরাণ্ড ম্যানলি হপকিন্স-এর প্রভাব ছিল। অক্সফোর্ড থাকাকালীন তার কবিতা ব্যাপক আলোরন তুলেছিল। ১৯২৮ সালে প্রথম তাঁর কবিতা ছাপা হয়- অবশ্য ক্লোজ সার্কেলে। ১৯৩০ সালে বৃহত্তর পাঠকের জন্য তাঁর কবিতা ছাপা হয়। তাঁকে তখন বলা হয়েছিল নতুন প্রজন্মের কন্ঠসর। সে সময়টায় অডেন সমাজতন্ত্র ও ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষনে দারুন উৎসাহী ছিলেন। তারপর নানা দেশ সফর করেন। অংশ নেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে । অবশেষে ১৯৩৯ সালে মার্কিন দেশে পৌঁছে নাগরিকত্ব গ্রহন করেন। তারপর তাঁর মনোভাবও বদলে যায় ধীরে ধীরে। খ্রিস্টান ধর্মে-বিশেষ করে আধুনিক প্রোটেস্টান্ট ধর্মতত্ত্বে ঝুঁকে পড়েন। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন নাটক লিবরেটি সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধ । শেষ জীবন কেটেছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউইয়র্কে । অডেন মারা যান ১৯৭৩ সালে। ভিয়েনায়। সেপ্টেম্বর ১, ১৯৩৯ ফিফটি-সেকেন্ড স্ট্রিটের নৈশক্লাবে বসে আছি। অনিশ্চিত আর ভীত একটি অনৈতিক হীন দশকের চতুর আশা নির্বাপিত। পৃথিবীর উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল ভূমির ওপরে ঘুরছে ক্রোধ ও আতঙ্কের ঢেউ; সেপ্টেম্বর রাত্রিকে করছে আহত মৃত্যুর অনামা গন্ধ আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনের ঘোর। পন্ডিতের অব্যর্থ বিশ্লেষনই পারে লুথার থেকে বর্তমান কাল অবধি ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করতে। সংস্কৃতির এই উন্মাদনা! লিনজে কী ঘটেছিল? বিশাল এক মনোছবি আর একজন উন্মাদ ঈশ্বর! আমি এবং জনগন জানে: স্কুলে শিশুরা কী শিখছে ওদের অমঙ্গল করা হয়েছে ওরাও অমঙ্গল করবে! নির্বাসিত থুকিডিডিস জানতেন গনতন্ত্র সম্বন্ধে ভাষা কি বলতে পারে, আর, কি করে স্বৈরশাসকরা! নির্বাক সমাধির প্রতি পুরনো হাবিজাবি বলে; তাঁর বইয়ে বলা হয়েছে সবই- অপসৃত হয়েছে জ্ঞানদীপ্তির কাল! স্বভাবজাত যন্ত্রণা, অব্যবস্থপনা ও হতাশ্বাস- আমরা আবারও ভুগব । এই পক্ষপাতশূন্য বাতাসে যেখানে দৃষ্টিহীন বহুতল তাদের উচ্চতা ব্যবহার করে দাবি করছে যৌথ মানুষের শক্তির- বৃথাই প্রতিটি ভাষা বলছে তার প্রতিদ্বন্দিতামূলক অজুহাত কে চিরকাল বাঁচে বল? একটি স্নায়ূচূর্নি স্বপ্নে; যে আয়নায় দেখে সেই আয়না থেকে সাম্রাজ্যবাদের মুখ আর আর্ন্তজাতিক ভ্রান্তি। বারের দিকে মুখ করে ওদের নিত্যদিনের মতই বাতি যেন নিভে না যায় গানও বাজাতে হবে প্রথাগুলি ষড়যন্ত্র করে এই দূর্গকে রাখে অক্ষত; ঘরের আসবাব; দেখাই যাক আমরা আসলে কি, ভৌতিক অরণ্যে নিরুদ্দেশ যে রাত্রিকে ভয় পায় শিশুরা যারা সুখি বা ভালো ছিল না। দোমড়ানো জঙ্গি আবর্জনা গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির চিৎকার আমাদের আকাঙ্খার মতন ককর্স নয়: উন্মাদ নিজিৎকি যা লিখেছেন দিয়াঘহিলেভ সম্বন্ধে তা স্বাভাবিক হৃদয়ের জন্য সত্য; হাড়ের ভিতরে জন্ম নেয় ভ্রান্তি প্রতিটি নারী ও পুরুষের যা গ্রহন করতে পারবে না-তাই চায় বিশ্বজনীন প্রেম নয়- একাকী প্রেম। রক্ষণশীল অন্ধকার থেকে নৈতিক জীবনে ভিড়ের যাত্রীরা আসে, পুনরাবৃত্তি করে সকালের শপথ ‘আমি আমার স্ত্রীর কাছে সৎ থাকব, আমি আমার কাজের প্রতি মনোযোগী হব।’ আর অসহায় গর্ভনর জাগে বাধ্যতামূলক খেলা শুরু করতে: কে ওদের এখন মুক্ত করতে পারবে বধিরের কাছে পৌঁছতে কে পারবে মূকের সঙ্গে কথা কে বলতে পারবে? আমার রয়েছে কন্ঠস্বর ভাঁজ করা মিথ্যাকে ঘোচাতে করোটির রোম্যান্টিক মিথ্যে রাস্তার কামুক পুরুষ আর কর্তৃপক্ষের মিথ্যে যাদের ভবন খোঁচায় আকাশকে রাষ্ট্র বলে কিছু নেই কেউই একাকীও নয় ক্ষুধার কাচে বাছবিচার নেই জনতা কি পুলিশের- আমরা একে অন্যকে ভালোবাসব- নয়তো মরে যাব। রাত্রির নিচে অসহায় মিথ্যেয় লীন আমাদের জগৎ। তবু সবখানে তার দাগ আলোর ইঙ্গিতময় বিন্দু ঝলসে ওঠে যেখানে ন্যায়বিচার লেনদেন করে বক্তব্য। আমিও কি ওরকম করে লিখতে পারি কামের ও ধূলায় একই প্রত্যাখান ও হতাশায় বিরক্ত হয়েও দেখাব সদর্থক জ্যোতি। As I Walked Out One Evening কবিতায় ছন্দের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অডেন- As I walked out one evening, Walking down Bristol Street, The crowds upon the pavement Were fields of harvest wheat. And down by the brimming river I heard a lover sing Under an arch of the railway: 'Love has no ending. 'I'll love you, dear, I'll love you Till China and Africa meet, And the river jumps over the mountain And the salmon sing in the street, 'I'll love you till the ocean Is folded and hung up to dry And the seven stars go squawking Like geese about the sky. 'The years shall run like rabbits, For in my arms I hold The Flower of the Ages, And the first love of the world.' But all the clocks in the city Began to whirr and chime: 'O let not Time deceive you, You cannot conquer Time. 'In the burrows of the Nightmare Where Justice naked is, Time watches from the shadow And coughs when you would kiss. 'In headaches and in worry Vaguely life leaks away, And Time will have his fancy To-morrow or to-day. 'Into many a green valley Drifts the appalling snow; Time breaks the threaded dances And the diver's brilliant bow. 'O plunge your hands in water, Plunge them in up to the wrist; Stare, stare in the basin And wonder what you've missed. 'The glacier knocks in the cupboard, The desert sighs in the bed, And the crack in the tea-cup opens A lane to the land of the dead. 'Where the beggars raffle the banknotes And the Giant is enchanting to Jack, And the Lily-white Boy is a Roarer, And Jill goes down on her back. 'O look, look in the mirror, O look in your distress: Life remains a blessing Although you cannot bless. 'O stand, stand at the window As the tears scald and start; You shall love your crooked neighbour With your crooked heart.' It was late, late in the evening, The lovers they were gone; The clocks had ceased their chiming, And the deep river ran on. সেপ্টেম্বর ১, ১৯৩৯ (মূল ইংরেজি) I sit in one of the dives On Fifty-second Street Uncertain and afraid As the clever hopes expire Of a low dishonest decade: Waves of anger and fear Circulate over the bright And darkened lands of the earth, Obsessing our private lives; The unmentionable odour of death Offends the September night. Accurate scholarship can Unearth the whole offence From Luther until now That has driven a culture mad, Find what occurred at Linz, What huge imago made A psychopathic god: I and the public know What all schoolchildren learn, Those to whom evil is done Do evil in return. Exiled Thucydides knew All that a speech can say About Democracy, And what dictators do, The elderly rubbish they talk To an apathetic grave; Analysed all in his book, The enlightenment driven away, The habit-forming pain, Mismanagement and grief: We must suffer them all again. Into this neutral air Where blind skyscrapers use Their full height to proclaim The strength of Collective Man, Each language pours its vain Competitive excuse: But who can live for long In an euphoric dream; Out of the mirror they stare, Imperialism's face And the international wrong. Faces along the bar Cling to their average day: The lights must never go out, The music must always play, All the conventions conspire To make this fort assume The furniture of home; Lest we should see where we are, Lost in a haunted wood, Children afraid of the night Who have never been happy or good. The windiest militant trash Important Persons shout Is not so crude as our wish: What mad Nijinsky wrote About Diaghilev Is true of the normal heart; For the error bred in the bone Of each woman and each man Craves what it cannot have, Not universal love But to be loved alone. From the conservative dark Into the ethical life The dense commuters come, Repeating their morning vow; "I will be true to the wife, I'll concentrate more on my work," And helpless governors wake To resume their compulsory game: Who can release them now, Who can reach the deaf, Who can speak for the dumb? All I have is a voice To undo the folded lie, The romantic lie in the brain Of the sensual man-in-the-street And the lie of Authority Whose buildings grope the sky: There is no such thing as the State And no one exists alone; Hunger allows no choice To the citizen or the police; We must love one another or die. Defenceless under the night Our world in stupor lies; Yet, dotted everywhere, Ironic points of light Flash out wherever the Just Exchange their messages: May I, composed like them Of Eros and of dust, Beleaguered by the same Negation and despair, Show an affirming flame. সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১১:০২
false
fe
এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরফকির ইলিয়াস==========================================কখনো কখনো আমার কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। কলম থেমে যায়। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। হাত কাঁপে। লিখে কী হবে? কে শোনে, কে পড়ে এসব লেখা? মন খুব খারাপ হয়ে যায়। বিশিষ্ট লেখক দার্শনিক নোয়াম চমস্কিকে মনে করি। তিনি বলেন- একজন প্রকৃত লেখকের আর কোনো গন্তব্য নেই। লিখতে হবে। বলতে হবে। মানুষ একদিন সেই ডাক শুনবেই। বাংলাদেশের মর্মমূলে আঘাত হেনেছে সাভার ট্র্যাজেডি। তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ের পর এটাই দেশে বড় রকমের গার্মেন্টস হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাযজ্ঞ থামানো যেতো। ঐ রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়ার পর ঐ ভবনে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া উচিত ছিল না। তারপরও ঐ ভবনের মালিক সোহেল রানা নানা দম্ভোক্তি করেছিল মিডিয়ার সামনে। যা আমরা বিভিন্ন টিভিতে দেখেছি। ঐ গার্মেন্টসের মালিকরাই হোক, আর ভবন মালিকই হোক-এরা সকল মানুষকে ওখানে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে পারতেন। না- তারা তা করেননি। কেন করেননি? কারণ তারা এটাকে কোনো গুরুত্ব দেননি। অথচ একটি ভবনে ফাটল দেখা দিলেই তা পরিত্যক্ত ঘোষিত হবার কথা। রানা প্লাজায় যে ধ্বংসলীলা ঘটছেÑ তা রোধ করা সম্ভব হতো। যদি না বাধ্য করে শ্রমিকদের ওখানে ঢুকাতে না হতো। সেটা মালিকরা করেননি। এজন্য অবশ্যই তারা দায় এড়াতে পারেন না। এসব মর্মবিদারক ঘটনা যতোই পড়েছি, দেখেছি পাঁজরটা ভেঙে গেছে। এদেশের মানুষ কোটি টাকা চান না। তারা খেয়ে-পরে বাঁচার নিশ্চয়তা চান- সেই সুযোগটাই এখন জিম্মি করতে চাইছে একশ্রেণীর মুনাফাখোর ব্যবসায়ী।বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ঘটনা পাশ্চাত্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, শিকাগো, লন্ডন, কানাডাসহ অনেক স্থানে বিদেশীরা বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশের এই হত্যাকান্ডের ঘটনায়। যা মূলত বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই গিয়েছে। তারা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার বহন করে বলেছেন- ‘আমরা বাংলাদেশের অসহায় শ্রমিকদের রক্তমাখা পোশাক পরতে চাই না।’ একজন সভ্য মানুষের এর চেয়ে বেশি আর কী বলার থাকতে পারে? মানুষের আকুতি যে কতো মর্মস্পর্শী হতে পারে, তা আমরা দেখেছি আবারো এই সাভার হত্যাকান্ডে। টানা ১৭ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করার পর শুক্রবার দুপুরে উদ্ধারকর্মীরা সবিতা নামের একজন শ্রমিককে বের করে আনেন। তাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনলে কোনো স্বজনের দেখা না পেয়ে পোশাক শ্রমিক সবিতা (৪৫) বলেন, ‘পত্রিকায় আমার মুক্তির কথা দেখলে আমার স্বামী-সন্তান আমাকে দেখতে আসবে।’ সবিতার বাড়ি রাজশাহী জেলার মতিহার থানার বাদুরতলা (তালাইমারি) গ্রাম। স্বামী শহিদুল ইসলাম দিনমজুরের কাজ করেন। তাদের এক ছেলে হাসান ও এক মেয়ে কবিতা রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিকরা বলেছেন, একটু পানির জন্য হাহাকার করছিলেন আটকেপড়া শ্রমিকরা। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিলেট জেলার বাসিন্দা কবিতা ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। আমার ডান পাশে এক পুরুষের ওপর ভারী মেশিন পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মারা যান তিনি। রক্ত গড়িয়ে আমার পিঠ ভিজে ওঠে। পানি মনে করে মুখে দিতেই রক্তের গন্ধ পাই। পরে হাত দিয়ে আমার ব্যাগের পানির বোতল বের করি। অর্ধেক বোতল পানি ছিল। ওই পানি মুখে দিতে গেলেই ডান পাশে চাপা পড়া আরেক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিতে চায়। না দিলে খামচে জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। হাতের চামড়া তুলে রক্তাক্ত করে ফেলে।’ প্রিয় পাঠক, না আমরা কোনো কারবালার বর্ণনা শুনছি না। শুনছি, সাভারের সেই নারকীয় ঘটনার অংশ। যা তৈরি করেছে এদেশেরই কিছু পাষণ্ড, কুলাঙ্গার, নরপশু ব্যবসায়ীরা। যারা একচক্ষু হরিণের মতো কেবল নিজেদের স্বার্থই দেখছে। সাধারণ শ্রমিকরা তাদের কাছে খেলার পুতুল মাত্র। এরা জিম্মি করেছে এদেশের কোটি শ্রমজীবী মানুষকে নানাভাবে। অনেক উৎকণ্ঠার সিঁড়ি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভবনের মালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটা খবর আমাদের খুব ভাবিয়েছে। সোহেল রানা বলেছেনÑ ‘ভবনটি যে ধসে পড়বে তা আমি আগেই বুঝেছিলাম। কারণ ডোবার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটি। তারপর গার্মেন্টস মালিকরা যেভাবে ভারী মেশিন আর জেনারেটর ওপরে তুলেছেন তাতে ধসে না পড়ে উপায় ছিল না। তাই আমি নিজেও খুব বেশি সময় ভবনের নিচে থাকতাম না। আর ভবনটি যখন ধসে পড়লো তখন কিন্তু আমি ভবনের নিচেই ছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে গেছি।’ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথাই বলেছেন সাভারের আলোচিত রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা। রানা প্লাজার ১০ তলার অনুমোদন আছে উল্লেখ করে রানা বলেন, ইঞ্জিনিয়াররা যে পাইলিং করতে বলেছিল তার চেয়েও ৬ ফুট বেশি পাইলিং করা হয়েছে। কিন্তু ওপরে গার্মেন্টসগুলোর জেনারেটর ও বড় বড় মেশিন তোলার কারণেই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফাটল দেখার আগেই তিনি বুঝেছিলেন ভবনটি আর ধরে রাখা যাবে না। কিন্তু এতো বড় বিপর্যয় ঘটবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। ঘটনার আগের দিন ফাটল দেখার পর সবাই যখন ভবন থেকে চলে গেলো তখনই ভবনটি পরিত্যক্ত করা হয়। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকরা তাকে অনুরোধ করেন এখন অফিসে কাজ না করা গেলে তাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। শিপমেন্ট বাতিল হবে। এতে তাদের পথে বসতে হবে। তাই কয়েকটা দিন যেন ভবনটি চালু রাখা হয় সেই অনুরোধ ছিল গার্মেন্টস মালিকদের। তাদের অনুরোধেই পরদিন ভবন খোলা হয়। আর এখন তারা উল্টো কথা বলছেন বলে দাবি করেন রানা। সোহেল রানা এই যে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলছেন, তাতে কি নিহত-আহতদের কিছু যায় আসে? নাÑ কিছুই যায় আসে না। বাংলাদেশে দখল ও শোষণের যে হোলিখেলা চলছে তা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসবে না শ্রম জীবনে। সোহেল রানা কিভাবে বলপূর্বক এই রানা প্লাজার জায়গা দখল করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন ঐ ভূমি মালিক রবীন্দ্রনাথ সরকার। তিনি বলেন, ‘১৯৮৯ সালে বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ছোট বলিমেহের মৌজার ১৫, ১৬, ১৭ ও ২৩ নম্বর দাগের ১২৬ শতাংশ জমি কিনি। জমির মালিক ছিলেন গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু, তার ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী। এসব দাগের কিছু অংশের জমি কিনে সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক। আমার জমি মাপজোঁক করে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেই। ২০০১ সালের দিকে আবদুল খালেকের ছেলে সোহেল রানা আমার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ২৭ শতাংশ জমি দখল করে নেয়। ওই ঘটনায় একটা মামলা করি। ওর বাবা তখন বিএনপি করতেন। এর পরই আমাকে সাভারছাড়া হতে হয়। ছয়-সাত মাস বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে। সাভারে আসতে পারিনি। ঢাকায় হোটেলে হোটেলে কাটাতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতে হয়েছে। ওই সময়ে ব্যবসার চরম ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে সাভারে ফিরি। কিন্তু দখল হওয়া জায়গাটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। আমার ঘটনা সাভারে এমন কোনো লোক নেই যে জানে না। যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই পেয়ে যাবেন। আমার কাছে শুনতে হবে না।’ রবীন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘পরে ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ শুরু হয়; দেখলাম ভবনের নির্মাণকাজ খুবই খারাপ। এ ব্যাপারে সাভার পৌরসভা ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে অভিযোগ করেছিলাম। রাজউকের লোক এসে দুদিন কাজ বন্ধ রেখেছিল। পরে দেখি, আবার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ওর (রানা) সামনে বড় বড় নেতারাও পাত্তা পায় না। রাজউক তো দূরের কথা।’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার বাড়ির ওপর রানা প্লাজা ধসে পড়ায় আমার বাড়িও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। পাশেই আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গুদামের মালামালও নষ্ট হয়ে গেছে। আমার বসতবাড়িতেও ফাটল ধরেছে। ওটাতে আর বসবাস করা যাবে না। দুর্ঘটনার পর বাড়িতে গিয়ে দেখি, সব মালামাল লুট হয়ে গেছে।’ এই হলো বাংলাদেশে একজন হিন্দু নাগরিকের বর্ণনা। একজন রবীন্দ্রনাথ সরকার যে এখনো এদেশে কতো অসহায়, তা এই ঘটনা প্রমাণ করে। এই বেদনাময় মুহূর্তে অনেক কথাই লিখা যাবে। এই দেশের আপামর মানুষ সাভার ট্র্যাজেডিতে যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, নিজের জীবন বাজি রেখে যে সংগ্রাম করেছেন ও করে যাচ্ছেন- তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হরতাল প্রত্যাহার করে মানবিকতা দেখিয়েছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট এটা সময়ের দাবি ছিল। কারণ একটি দেশের মানুষ যখন চরম শোকাহত তখন হরতালের আরো বোঝা চাপিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না। সাভার ট্র্যাজেডিতে খুবই বেদনাদায়কভাবে নিহত একজন শ্রমিক শাহানার মৃত্যুর ঘটনা গোটা জাতিকে বিশেষভাবে কাঁদিয়েছে। প্রখ্যাত মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ‘সিএনএন’ শাহানাকে নিয়ে ‘শি ওয়ান্টেড টু লাইভ ফর হার সন’ শিরোনামে একটি আবেগময় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহানার অবস্থান জানার পর সংবাদ মাধ্যমগুলো উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তার কাছাকাছি পৌঁছান উদ্ধারকর্মীরা। একশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে থেকেও উদ্ধারকর্মীদের দেখে তিনি বলেছিলেন ‘অন্তত শিশু সন্তানটিকে দেখার জন্য বাঁচতে চাই আমি’। উদ্ধারকর্মীরা তাকে আশ্বাস দেন এবং খাবার, পানীয় ও অক্সিজেন সরবরাহ করেন। যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কনক্রিট কেটে তাকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন তারা। শাহানাকে উদ্ধার করতে ১০ ঘণ্টার প্রচেষ্টা শেষে দমকল বাহিনীর উদ্ধারকর্মী নুরুল হক রোববার রাতেই সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে জানান, এক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু এর মধ্যেই আরেকটি চরম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়। নুরুল হক ও তার সঙ্গে থাকা অন্য উদ্ধারকর্মীরা যখন ভেতরে ঢোকেন, তখন তারা দেখেন সেখানে ড্রিল মেশিনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে হঠাৎ আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। মুহূর্তে আগুন ভেতরে থাকা কাপড় ও দাহ্য পদার্থে ধরে গেলে ভেতরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন সুড়ঙ্গ পথে পানি ঢাললেও আগুন নেভেনি। এই আগুনই হরণ করে নেয় শাহানাকে। প্রিয় পাঠক, এর চেয়ে জাতীয় বেদনা আর কী হতে পারে! হ্যাঁ, আমরা সাভার ট্র্যাজেডির খুনিদের বিচার চাই। সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। এ বিষয়ে আমি কিছু প্রস্তাবনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে রাখতে চাই। ১। বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড ভায়োলেশনের দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করে আইন পাস করতে হবে। কারণ কেউ অবৈধভাবে ইমারত বানিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। ২। সাভার ট্র্যাজেডির সকল খলনায়ক, নেপথ্য নায়কদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। কেউ যেন বিশেষ কৃপায় কোনোভাবে পার পেয়ে না যায়। ৩। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচাতে বিশেষ টিম গঠন করে প্রতিটি কারখানা অডিটের আওতায় আনতে হবে। যারা সরকারি এবং বিজেএমইর গাইডলাইন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরা কেউই যেন, সরকারি-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে পার পেতে না পারে। কারণ আমরা জানি, এসব শিল্প মালিকদের হাত অনেক লম্বা। ৪। সাভার ট্র্যাজেডিতে যারা নিহত-আহত হয়েছেন, তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। রাষ্ট্রের মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ক্ষতিপূরণ এক কোটি টাকা করে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। খুনি ঐসব গার্মেন্টস মালিকদের সম্পত্তি বিক্রি-ক্রোক-বাজেয়াপ্ত করে এই অর্থ পাওয়া সম্ভব। ৫। আহত সকল মানুষের বিনামূল্যে সকল চিকিৎসা দিতে হবে। তাদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করে কাজ করে খাওয়ার রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজনে হুইল চেয়ারসহ যে কোনো প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জাম দিয়ে তাদের কর্মমুখী করার দরজা অবারিত করতে হবে। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছেÑ বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অন্যতম গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ। এই আয়, দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। দেশটিকে এগিয়ে নিতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে, দেশটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রিয় রাজনীতিবিদরা, দয়া করে একটিবার আপনারা দেশের উন্নয়নের কথা ভাবুন। প্লিজ, দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে এই চরম হুমকির মুখ থেকে বাঁচান।-----------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // ৪ মে ২০১৩ শনিবার
false
rn
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন ১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে। ৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্য লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে। ৪। যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ। ৫। যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর। ৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্ত্তব্য। এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না। ৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মান্, কোটেশন্ বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না। ৮। অলঙ্কার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে—ভাণ্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভাণ্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই। ৯। যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাল লাগিবে না—বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে। ১০। সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেন না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝুন। ১১। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না। ১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই। বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা। এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
false
rn
ঈশ্বরের কাছে খোলা চিঠি প্রিয়, ঈশ্বর তুমি কেমন আছো গো? আমার কথা শুনে রাগ করলে? রাগ করার কিছু নাই। সর্বময় শক্তির অধিকারী হলেও সব সময় ভালো থাকা যায় না, এ আমি বুঝি। আমি চিঠিতে কি লিখব হয়তো তুমি সবই জানো। তারপরও আমি স্পষ্ট করে কিছু কথা বলতে চাই। কিছু ব্যাপার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই। যেন তুমি একটু নড়ে-চড়ে উঠো। একটা গাছের পাতাও তোমার আদেশ ছাড়া নড়ে না। আমি জানি, ঈশ্বরকে বিশ্বাস করা অন্ধকারে ঝাপ দেওয়া নয়; কিন্তু তা হচ্ছে উজ্জ্বল আলোতে ভরা কামরাতে পা রাখা, যেখানে অনেক অনেক লোক আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে মেধাবী মানুষদের একজন আলবার্ট আইনস্টাইন । সুতরাং ইশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে তার ধারণা নিয়ে তর্ক বিতর্ক হবে এটাই স্বাভাবিক। নাস্তিকরা যেমন টানাটানি করে তেমনি ধার্মিকরাও টানাটানি করে। আইনস্টাইনের ধর্ম, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ হলে তার 'The world as I see it' বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আমার এক বন্ধুর কথা বলি, সে খুব বই পড়তে ভালোবাসে। প্রচুর বই পড়ে, প্রচুর বই কিনে এবং বই গুলোর খুব যত্ন নেয়। প্রতিটা বই কেনার পর- অনেক মায়া নিয়ে বই গুলো সেলাই করে। একদিন বিকেলে তার বাসায় গিয়ে দেখি- সে অনেক মোটা একটা বই সেলাই করছে। বইটা সেলাই করতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বইটা দুই পা দিয়ে চেপে ধরে সেলাই করছে। অনেক সময় নিয়ে সেলাই করা শেষ হলো। তারপর বইটা হাতে নিয়ে দেখলাম- এটা কোরান শরীফ। এখানে বলে রাখা ভালো- আমার বন্ধুটি ঘোর নাস্তিক। অবশ্য বর্তমানে এই বন্ধুর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমিই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই। কারন বন্ধুটিকে ধান্ধাবাজ মনে হয়। আমাদের সকল জ্ঞানই মূলতঃ বিশ্বাস, কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয়। ইশ্বর তুমি কি চোখে টিনের চশমা পড়ে বসে আছো ? তুমি কি চোখে দেখতে পাও না। নাকি পৃথিবীতে তোমার ক্ষমতা কাজ করবে না। তোমার ক্ষমতা কাজ করবে আমাদের মৃত্যুর পর। তোমার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয়- আমরা পৃথিবীতে যা খুশি করবো আর তুমি চুপ করে বসে থাকবে, কাউকে কিচ্ছু বলবে না। বলবে মৃত্যুর পর। কারন তুমি আমাদের সৃষ্টির সেরা করে তৈরি করেছো। আমাদের ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছো। কোরান দিয়েছো, হাদীস দিয়েছো। এখন যদি আমরা ভালো করি, মৃত্যুর পর ভালো ফল পাবো, আর যদি খারাপ করি- তাহলে শাস্তি পাবো। তাই তুমি চুপ করে বসে আছো। তুমি যা করার করবে মৃত্যুর পর। তার মানে- তোমার ক্ষমতা আমরা দেখতে পারবো মৃত্যুর পর। এই ব্যাপারটা আমি মানতে পারি না। আমি দেখতে চাই- তোমার অলৌকিক ক্ষমতা। মাংসের গায়ে, টোমোটোর গায়ে,গরু-ছাগলের গায়ে, আকাশে- মাটিতে মাঝে মাঝে তোমার নাম ভেসে উঠে। এটা অলৌকিকতার কিছু না। পুরোটাই ফোটোশপের কাজ। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম- বিভিন্ন যায়গায় অলৌকিক ভাবে তোমার নাম ভেসে উঠে। এটা তো আহামরি কোনো ব্যাপার না। এই নাম দিয়ে তো পৃথিবী বাসীর কোনো উপকার হয় না। দেশের সমস্যার সমাধান হয় না। দ্রব্যমূল্যের দাম কমে না। দরিদ্র মানুষ পেট ভরে তিনবেলা খেতে পায় না। মানুষের আগুনে পুড়ে মরা বন্ধ হয় না। হরতাল বন্ধ হয় না। তবে আজাইরা নাম দিয়ে আমরা করবো কি ? সামান্য চিড়া খেতে হয় পানি দিয়ে ভিজিয়ে নরম করে। মাংসের টুকরোর মধ্যে তোমার নাম দিয়ে করবো কি ? বরং আরও রাগ হয়। অলৌকিক ভাবে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দাও। তবেই না আমরা আরও বেশী আনুগত্য হবো তোমার। তোমাকে নিয়ে আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। একজন নাস্তিক আমাকে প্রমান করে দিয়েছেন- তুমি নাই। কঠিক সব লজিক দেখিয়েছেন। কাগজে কলমে অংক করে প্রমান করে দিয়েছেন- তুমি নেই। আবার একজন আস্তিক জটিল সব যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তুমি আছো। আমি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাই আস্তিক নাস্তিকের যুক্তির কাছে আমাকে হার মানতে হয়। আমি আস্তিক-নাস্তিকের ঝামেলায় যাব না। আমি চাই- শান্তি। এবং যতদিন বেঁচে থাকব আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকব। যদি তুমি থেকেই থাকো- তাহলে মারকিনিরা কিভাবে পারমানিবক বোমা বানায়। রাশিয়া ভয় দেখায় চীনকে। খারাপ লোক গুলো কিভাবে মানুষকে শাসন করে ? ভয় দেখায়? দিনে দুপুরে সবার সামনে একজনকে কুপিয়ে মেরে ফেলে। চলন্ত বাসে বোমা নিক্ষেপ করে? এই জন্যই আমি বলেছি- তুমি টিনের চশমা পড়ে বসে আছো। যে ইশ্বর মানুষের বিপদে আপদে কাজে লাগে না- সেই ইশ্বর দিয়ে মানুষ করবে কি ? পুতুল ইশ্বর আমাদের দরকার নেই। বিশ্বাসীরা নাস্তিকদের কে বলে থাকেন” আপনি ইশ্বরে বিশ্বাস করেন না আপনি কিছু জানবেন না শিখবেন ও না” প্রকৃত পক্ষে ইশ্বরের উপস্থিতি, যুক্তি বা সাক্ষ্য প্রমানাদির চেয়ে বিশ্বাসের উপর বেশী নির্ভরশীল। যুক্তিহীন বিশ্বাসীর কাছে তার বিশ্বাসের বাইরে কিছুই গ্রহনযোগ্য নয়। বিমুর্ত বিশ্বাসকে বাস্তব এবং ত্রুটিহীন বিবেচনা হয়। ইশ্বর 'The Prophets' Fraudulent Tricks' এই বইটি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারনা আছে ? প্রত্যক্ষবাদ ( positivism) ফরাসী দার্শনিক অগুস্ত কোঁত (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রবর্তিত মতবাদ যার মূল কথা বৈজ্ঞানিক তথ্যই জ্ঞানের ভিত্তি এবং সেটাই সত্যে পৌঁছনোর একমাত্র নিশ্চিত পথ। এটি দৃষ্টবাদ নামেও পরিচিত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, আবার তিনি যে নাই তাও প্রমাণ করা যায় না। বাইবেল বলে, বিশ্বাসেই এই সত্য আমাদের অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ঈশ্বর সত্যিই আছেন: “বিশ্বাস ছাড়া ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ ঈশ্বরের কাছে যে যায়, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈশ্বর আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়” । ঈশ্বর বাইবেলের মাধ্যমে নিজের মুক্তির পরিকল্পনা করেছেন৷ সেই কারণে আমাদের যতবার সম্ভব বাইবেল পড়তে হবে৷ তাতে যাকিছু বলা হয়েছে তার যথাসম্ভব আজ্ঞা পালক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷ কেননা ঈশ্বর তাঁর বাণী শোনানো লোকেদের উদ্ধার করেন: আত্মাই জীবনদায়ক, মাংস কিছু উপকারী নয়; আমি তোমদিগকে যে সকল কথা বলিয়াছি, তাহা আত্মা ও জীবন। অতএব বিশ্বাস শ্রবণ হইতে এবং শ্রবণ খ্রীষ্টের বাক্য দ্বারা হয়৷ আমি তোমার নির্দেশ কত ভালবাসি! সারা দিন আমি তা ধ্যান করি৷ঈশ্বরকে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ঈশ্বর মানুষের হৃদয় দেখার ক্ষমা রাখেন। অতএব, কোন হৃদয় সরলতা ধারণ করছে, আর কোন হৃদয় কুটিলতার-ঠকবাজির বীজ বোনা হচ্ছে তা কিন্তু ঈশ্বর পরিষ্কার দেখতে পান। ঈশ্বর চান সরল হৃদয়। ঈশ্বর বিনা কারণে কিছু করবেন সেটি আমার আশা করি কেমন করে? কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, এই জগত সংসারে ঈশ্বরই একমাত্র ‘বস্তু’ যাকে আমরা আশা করি- তিনি হবেন অন্ধ, তিনি হবেন শান্ত-সরল, নির্বিকার। এক কথায় গোবেচারা। অর্থাৎ, তিনি সবকিছু শুনবেন ঠিক, কিন্তু কোন নাড়াচাড়া করবেন না; তিনি সবকিছু শুনবেন ঠিক, কোন রাগ/রা করবেন না। তিনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুবোধ বালক হবেন। আপনার-আমার গড়পড়তা ঈশ্বর-চিন্তা কি এমনই নয়? অতএব, আপনার-আমার জীবনে ভাল কিছু হবে কেমন করে? ইন্টারনেট এ যা দেখবেন তাই বিশ্বাস করবেন না। একদল কুচক্রী ভুল তথ্য ছড়াবে। তাছাড়া মিডিয়ার কথা ভুলেও বিশ্বাস করতে যাবেন না, এরা পুরাই বদমাশ!!! এরা সত্যকে বিকৃত করে। নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতে শিখুন, ১০০ কোটি মানুষ একটা মিথ্যাকে বিশ্বাস করলেই, ঐটা সত্য নয়।" সব ধর্মকেই সঠিক মানতে হবে,কেননা একটি ধর্মকে মানা খুব বিপজ্জনক!! আমরা তাই আল্লাহকেও সত্য মানব,রাম-লক্ষণ-দুর্গা-কালী-শিবকেও সত্য মানব,জান্নাত-জাহান্নাম যেমন বিশ্বাস করব,তেমনি পুনর্জন্মকেও সত্য মানব,জিউস-হারকিউলিস দের উপাসনাও করব।ঈসা (আ) কে আল্লাহর বান্দা যেমন মানব,তেমন ঈশ্বরের পুত্রও মানব। তাহলেই পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবে।কী চমৎকার! আমি বিশ্বাস করি- ঈশ্বর মানুষের প্রার্থনা শ্রবণ করার জন্য সদা প্রস্তুত আছেন। কিন্তু সরল হৃদয়ের (কুটিলতামুক্ত) প্রার্থনাই কেবল ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে উপস্থিত হতে পারে। অন্য কোন প্রার্থনা নয়। অতএব সাবধান! হে প্রিয়জন, সাবধান!সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধি করো এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখো যিনি তোমার জীবনকে পুরো বদলে দিতে সক্ষম। সবকিছুই কোন একটি কারণেই ঘটে।তুমি কাল কেয়ামতের কঠিন মুচিবতের সময় আমাদেরকে পাকড়াও করোনা, আমাদেরকে সব যোগ্যতা দিয়ে দাও,তুমিতো রাহমানির রাহিম,তুমিতো গফুরুর রাহিম।তুমি আমাদের শেষ ভরসা।আমীন। সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩১
false
mk
শেখ হাসিনার উচ্চ শিক্ষা চিন্তা বাংলাদেশের জনমানুষের প্রতিনিধি দেশরত্ম ও জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন- স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও সাক্ষরতার হার শতভাগ নিশ্চিত হয়নি। দেশে একটি সুন্দর শিক্ষা কাঠামো বিনির্মাণে জননেত্রীর আন্তরিকতার অভাব নেই। আসলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নেত্রীর কথাগুলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনছিলাম তখন নেত্রীর জন্য মন গর্বে ভরে উঠেছিল।আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর পরই সবার জন্য শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা উন্মুক্ত করেছিলেন। এটি তার মহানুভবতা। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করে রাখতে চেয়েছিল। আজ যতটুকু অগ্রসর হয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে তা বঙ্গবন্ধুর আমলে ভিত্তিভূমি স্থাপিত হয়। মাঝখানে তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ছিয়ানব্বইতে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাজকে উন্মুক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আর গত আট বছর ধরে নিরলসভাবে শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়াস গ্রহণ করেছেন দ্বিতীয় টার্মের পুরো সময় এবং তৃতীয় টার্মের তিন বছরে উচ্চ শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে মান উন্নয়নে তার আন্তরিকতার অভাব দেখছি না। বঙ্গবন্ধু ড. কুদরত-ই-খোদাকে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন পঁচাত্তর পরবর্তী স্বৈরশাসকরা তা বন্ধ করেছেন। দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। সারাদেশে উচ্চ শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকার প্রধান বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন পাবলিক হোক কিংবা প্রাইভেট হোক। পাশাপাশি মান উন্নতকরণে তার প্রয়াসের ঘাটতি নেই। বর্তমানে দেশে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। নেত্রকোনায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শেখ হাসিনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আর জামালপুরে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হবে। আসলে এ দেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে জননেত্রীর আন্তরিকতার অভাব নেই। তিনি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করতে চান। আসলে প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে উচ্চ শিক্ষার বিকল্প নেই। তিনি সে জন্য শিক্ষায় সরকার কর্তৃক বিনিয়োগে যেমন উৎসাহী তেমনি বেসরকারী খাত থেকে বিনিয়োগ হোক এ প্রত্যাশা করেন। আর তাই শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মান উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছেন। পাশাপাশি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট চালুর ব্যবস্থা নিয়েছেন।দেশে যে জঙ্গীবাদের কিছুটা উত্থান নব্বইয়ের দশকে হয়েছিল, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় সে সময়ে দুটো স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ, বিজনেস ফ্যাকাল্টি এবং বুয়েটে ঘটেছিল। বিএনপি-জামায়াত চক্রটি ধীরে ধীরে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করেছিল। প্রফেসর ড. শামসুল হক যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ইউজিসির চেয়ারম্যান ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। সকল নিয়ম-কানুন মেনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি চমৎকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথচ বিএনপি-জামায়াত চক্রটি সেই সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল কোন কারণ ছাড়াই। যারা সেখান থেকে এমবিএ এবং মাস্টার্স ইন কম্পিউটার এ্যাপ্লিকেশন কোর্স করেছিলেন তারা কিন্তু মূল সনদ পাননি। তৎকালীন ইউজিসির চেয়ারম্যানও এ ব্যাপারে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেননি। ভাবতে অবাক লাগে নতজানু ও দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করে এ অন্যায় কাজে তৎকালীন ইউজিসি চেয়ারম্যান পার পেয়ে গেছেন। অন্য কোন দেশ হলে অবশ্যই তাকে জবাবদিহি করতে হতো। এখনও কোনভাবে সার্টিফিকেট দেয়া যায় কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য ইউজিসিকে অনুরোধ করব।শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আত্মনির্ভরশীল করতে যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের আওতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় মান উন্নতকরণ এবং আধুনিকায়নের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর আওতায় দেশব্যাপী তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা নিয়েছেন।নারী শিক্ষার সম্প্রসারণে নারী শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ জন্যই শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন যে, স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধিকাংশই বাস্তবায়নে তার সরকার তৎপর রয়েছে। স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ধারা ৪-এ সাতটি অভীষ্ট লক্ষ্য রয়েছে এবং তিনটি উপায় রয়েছে বাস্তবায়নের। তিনি তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ ধারাসমূহ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে সমাজের কল্যাণে, জনগণের উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে চলেছেন। এ জন্য তার দিকনির্দেশনায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈদেশিক অনুদাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টিয়ে দেশের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার মডেল তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য যাতে দেশের মানুষের কল্যাণে মানবসম্পদ গঠনে সাহায্য করে সে জন্য তার নির্দেশিত পথেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে অবশ্য সম্মিলিত নাগরিক সমাজ উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এসডিজি-৪ এর আলোকে কি করণীয় সে ধরনের কর্মশালা করতে পারে যাতে গত আট বছরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে শিক্ষার মান ও প্রসারজনিত কর্মকা-ের বিস্তারিত বিবরণ ফুটে ওঠে। তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষাকে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।মনে পড়ে আজ থেকে ছয় বছর আগে চাকরিনির্ভর ও বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সকলের জন্য উপযোগী চাকরিনির্ভর ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার জন্য তার সরকার নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। তার এ কথা অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ। তিনি আরও বলেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। অন্যদিকে একটি শিক্ষিত দেশ একটি উন্নত জাতি উপহার দিতে সক্ষম বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তার সরকার উচ্চ শিক্ষা সহজ করতে এক হাজার কোটি টাকার একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষার সম্প্রসারণে সত্যিকার অর্থে বেসরকারী বিনিয়োগকারী যারা কাজ করবে তাদের কর রেয়াত দেয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেছেন। বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা সরকারপ্রধানের ইচ্ছায় সম্মান জানিয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে পারেন নিঃস্বার্থভাবে বিশেষায়িত জ্ঞানের বিকাশ সাধনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ সাধন ও নৈতিকতার মান উন্নয়নে কর্মোদ্যম আগ্রহী শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রীর নিরলস কর্মকা- দেশের অগ্রযাত্রাকে সাফল্যের রূপ দিচ্ছে। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে উচ্চ মানসম্পন্ন গবেষণা যা দেশ ও জাতির মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সায়েন্স এ্যান্ড আইসিটি’ প্রকল্প থেকে ফেলোশিপের আওতায় অনুদানের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আধুনিকায়নের ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন সময় এসেছে বাণিজ্য ও অর্থনীতি শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ল্যাব ও প্রাকটিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থার করা। এ জন্য অবশ্যই বেসরকারী খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিজনেস এ্যান্ড ইকোনমিক ইনকিউবেটর চালু এবং কোর্স কারিকুলামে প্রাথমিক পর্যায়ে ন্যূনতপক্ষে ৪০% হাতে কলমে প্রতিটি বিষয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেত মুখস্থ বিদ্যায় ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে বরং পারদর্শী হচ্ছে ফটোকপিয়ার। ফেসবুক পেডাগোগি তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো স্থাপনা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের প্রথম দিকে মন্তব্য করেছেন যে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিপথে নেয়া ঠেকাতে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, জঙ্গীবাদ থেকে ছাত্র সমাজকে মুক্ত রাখতে হবে এবং তারা যেন কোন ধরনের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে না পড়ে। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জঙ্গীরা শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের বিপথে নিয়ে যায় আর এ জন্য শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তার বক্তব্যসমূহ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দেশে ক্যাম্পাস পুলিশ ও গোয়েন্দা তৈরির ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত সন্দেহভাজন জঙ্গী ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এ দেশে সরকার জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।দেশের উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে ‘কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ প্রকল্পটি ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৬ থেকে ২০২১ এর জুন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ১০০টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। হাতে-কলমে কারিগরি প্রশিক্ষণের গুরুত্ব দিয়ে বিটাকের কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্ব-কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদের নেতৃত্বে ‘পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট’ ডিগ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুরু করেছেন সেটি ব্যাংকারদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া ব্যাংকারদের পক্ষে কিংবা এনজিও ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব নয়।অন্যদিকে বিআইডিএস ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে অর্থনীতিতে উচ্চ শিক্ষা প্রদানের প্রকল্প নিয়েছেন। তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রী দিতে পারেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কৌশলী নেতৃত্ব প্রদানকারী শেখ হাসিনার দুর্বার ব্যবস্থাপনা গুণে। এক্ষেত্রে শিক্ষার বিস্তার ও মান উন্নয়ন অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং করবে। সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:০৬
false
ij
শাহ আবদুল করিম_ বঙ্গীয় ভাবসাধনার ধারাবাহিকতায়। শাহ আবদুল করিম। লোকে বলে বাউল সম্রাট। আমি বলি-করিম এমন একজন মানুষ যিনি বাংলার ভাব বাংলার প্রকাশের বাংলার লোকজ সঙ্গীতের ধারাকে আত্মস্থ করেছেন অনায়াসে; অনায়াসে ভাটি অঞ্চলের সুখদুঃখ তুলে এনেছেন গানে। নারীপুরুষের মনের কথা ছোট ছোট বাক্যে প্রকাশ করেছেন আকর্ষনীয় সুরে । আমার সবচে ভালো লাগছে এই ভেবে যে- বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম করিমের বিদগ্ধ আত্মাটির সন্ধান পেয়ে গেছে। করিমের চিন্তার যে একটি কল্যাণকর দিক রয়েছে- সেটিও নতুন প্রজন্ম বুঝে গিয়েছে। আমার আত্মতৃপ্তি এখানেই। এখন প্রয়োজন করিমকে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের ধারার সঙ্গে গ্রহিত করা। লালন যে নারীবাদী ছিলেন-তা যেমন তাঁর গান শুনলে বোঝা যায়, তেমনি লালনবিষয় ফরহাদ মজহার-এর লেখাগুলি পড়লেই বোঝা যায়। তানভীর মোকাম্মেল-এর ‘লালন’ ছবির লালনের সেই বিখ্যাত সংলাপটি আজও কানে বাজে- ‘নারী হও, নারী ভজ।’ কী অসাধারন উপদেশ। কিন্তু, এই কথার কী মানে? মানে- নারীর অনুভূতি পুরুষের হৃদয়ে সঞ্চালিত হলেই তবে জগতে শান্তি আর কল্যাণ প্রতিষ্ঠা হবে। নারী জন্মদানের ব্যথা সহ্য করতে সম্মত বলেই জগৎ ও জীবের প্রতি তার থাকে অপার করুণা। যে কারণে, বুদ্ধ ও খ্রিস্টকে তত্ত্বজ্ঞানীর নারী বলেই বোধ হতে পারে। খ্রিস্ট নারীর প্রতি পাথর ছুঁড়তে দেননি। আর, প্রাচীন বৈশালী-শ্রাবস্তীর যৌনকর্মীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈশ্বরের বদলে বুদ্ধের নাম নিতেন। তা হলে কে নারী নয়? তার ব্যাখ্যার আর কী প্রয়োজন। একুশ শতক সে নিগূঢ় রহস্যের উদ্ঘাটন করতে চলেছে বলেই মনে হয়। এখন প্রশ্ন এই - লালন কেন নারীবাদী? লালন নারীবাদী-যেহেতু বাংলা মাতৃতান্ত্রিক। তার মানে বাংলা মাতৃতান্ত্রি বলেই লালনও নারীবাদী। বাংলার অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে বাংলা ক্রমশ মাতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। যে কারণে, সেই অস্টম শতকেই নারীবাদী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগন বলছেন- এস জপহোমে মন্ডল কম্মে অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে। তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে বোধি কি লব্ ভই প্রণ বি দেহেঁ। কী এই সান্ধ্যভাষার মানে? মানে-মিছিমিছি ধর্মের অন্ধ অনুকরণ করে কী লাভ। (অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে।= সারাদিন (অনুদিন) বাহ্যিক ধর্মে আছিস।) বরং মেয়েদের নিরন্তর স্নেহ লাভ করে আলোকিত হই। লক্ষ্য করুন-স্নেহ, কাম নয়। এইই বাংলার সাধনা। বড় কঠিন; কঠিন ও নিস্কাম। অস্টম শতকের পর দশম শতক। দশম শতক ছিল অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের কাল। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বৌদ্ধ। তবে বৌদ্ধ তান্ত্রিক। কথাটা সামান্য বোঝার দরকার আছে। উত্তর ভারতের বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন বললেন-সব কিছুর উৎপত্তি শূন্য থেকে। বাংলার (এখনকার মুন্সিগঞ্জের) বৌদ্ধ দার্শনিকেরা বললেন-সব কিছুর উৎপত্তি বজ্র থেকে। বজ্র নারীরই গুণ। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে- বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি- সে কি সহজ গান। এই কবিতায় সবার অলখে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর বলছেন-অর্ধনারীশ্বর। বা, নারীরই ঈশ্বর। লালন অন্যভাবে বলেছেন- পুরুষ পরওয়ারদিগার অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার প্রকৃতি প্রপিতি আর সংসার সৃষ্টি সবজনা। এমনতরো উক্তি করতে বাংলার মনিষার কি বুক কাঁপে না? না। এবং একুশ শতক এ সকল নিগূঢ় রহস্যের উদ্ঘাটন করতে চলেছে। যা হোক। বৌদ্ধ দার্শনিকগন নারীবাদী হওয়ার কারণেই বাংলায় মধ্যযুগে তন্ত্রের উদ্ভব হল। তন্ত্র জিনিসটা আবার নারীর ভজনা না করে হয় না। যে কারণে বলা হয়েছে- সব কিছুর উৎপত্তি বজ্র থেকে। দশম শতবের পর চতুদর্শ শতক। চতুদর্শ শতকে শ্রীচৈতন্যদেব ভক্তি গানে গানে ভরিয়ে তুললেন বাংলা । তাঁর বিখ্যাত উক্তি-‘আমার অন্তরে রাধা বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।’ কে কোথায় ভেবেছে এমন? রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর যেমন নারী, তেমনি পুরুষ চৈতন্যের দেহের ভিতরে নারীরপ রাধা বাস করেন। ফলে, নারীর অনুভূতি পুরুষের হৃদয়ে সঞ্চালিত হল ফলে জগতে শান্তি আর কল্যাণ প্রতিষ্ঠা হল। (কেননা, নারী জন্মদানের ব্যথা সহ্য করতে সম্মত বলেই জগৎ ও জীবের প্রতি তার থাকে অপার করুণা।) এমন চিন্তা বাংলাতেই সম্ভব। চিন্তাটা শুরু করেছিলেন অস্টম শতকের নারীবাদী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগন-যারা আলোকিত হওয়ার জন্য নারীর স্নেহ প্রার্থনা করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের পর লালন। তাঁর কথা আর কি বলব? শুধু এইটুকু বলি, আধুনিক সময়ে, অর্থাৎ উনিশ শতকের মাঝামাঝি লালনই প্রথম লিখলেন বিশ্বের নারীবাদী গান- নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল যে জানা মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা। পুরুষ পরওয়ারদিগার অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার প্রকৃতি প্রপিতি আর সংসার সৃষ্টি সবজনা। নিগূঢ় খবর নাহি জেনে কেবা সে মায়েরে চেনে যাহার ভার দীন দুনিয়ায় দিলেন রাব্বানা। ডিম্বুর মধ্যে কেবা ছিল বাহির হইয়া কারে দেখিল লালন কয় সে ভেদ যে পেল ঘুচল দিনকানা। নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল যে জানা মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা। ২ শুরুতে বলছিলাম। শাহ আবদুল করিম লালনের সুযোগ্য শিষ্য। কেন? কারণ-শাহ্ আবদুল করিম তাঁর স্ত্রীকে মনে করতেন মুর্শিদ। ‘মুর্শিদ’ শব্দটার অর্থ-নেতা (আধ্যাত্মিক অর্থে অবশ্য)। শাহ আবদুল করিমের স্ত্রীর নাম ছিল আবতাবুন্নেছা। করিম আদর করে ডাকতেন: 'সরলা।' স্ত্রীকে ‘মুর্শিদ’ মনে করাটা সহজ নয়। অনেক শিক্ষিত আধুনিক পুরুষও এক্ষেত্রে পিছিয়ে। কেন? ঈশ্বর পুরুষ বলেই?। করিম কেন পারলেন? করিম বাউল বলেই পারলেন। বাউল বাংলার ধর্ম- বাংলা মাতৃতান্ত্রিক বলেই। আর, এই কথাগুরি বলাও সহজ না-লালন যা অনায়াসে লিখেছেন। নিগূঢ় খবর নাহি জেনে কেবা সে মায়েরে চেনে, যাহার ভার দীন দুনিয়ায় দিলেন রাব্বানা। শাহ আবদুল করিম লালনের সুযোগ্য শিষ্য বলেই- বলতে পারলেন- সরলা আমার মুর্শিদ। এবং, একুশ শতক আরও আরও নিগূঢ় রহস্যের উদ্ঘাটন করতে চলেছে বলেই মনে হয়। ৩ ১৯১৬ সালে সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে জন্মেছিলেন শাহ আবদুল করিম। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ শাহ্ আবদুল করিমের ৯৪ তম জন্মদিন। ভক্তগন প্রদীপ কোথায়? সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:২৬
false
hm
বই নিয়ে ০২ [প্রথম পর্ব] অনেক বছর আগে একমাসের জন্যে আমার প্রতিবেশিনী হিসেবে নাদিয়া নামে এক রুশ যুবতীকে পেয়েছিলাম। ব্রেয়ানস্ক নামে একটা ছোটো শহরে সে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করতো। একদিন টিভি রুমে হলিউডি লা মিজেহ্রাবলের জার্মান ডাবড সংস্করণ দেখাচ্ছে, আমি আর নাদিয়া ছাড়া আর কেউ দেখছে না সেটা। সিনেমা দেখা শেষ করে নাদিয়া মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হেসে বললো, আমেরিকানরা না পারে উপন্যাস লিখতে, না পারে সিনেমা বানাতে। কেন এমন ধারণা হলো তার, জানতে চাওয়ার পর নাদিয়া আবার চেয়ার টেনে বসে বিরাট একটা লেকচার দিলো। মার্কিন উপন্যাস সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিলো না তখন (এখনও নেই), নাদিয়া লাইব্রেরিয়ান বলে সে বেশ কিছু মার্কিন উপন্যাসের রুশ অনুবাদ পড়েছে, তার কাছে ওগুলোকে আবর্জনা মনে হয়েছে। চার-পাঁচটা চরিত্র দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে দেয়, এটাই নাদিয়ার সবচেয়ে বড় অভিযোগ। উপন্যাস লিখতে জানে কেবল রুশরা, জানালো সে। রুশ উপন্যাস নিয়েও আমার তেমন ধারণা ছিলো না (এখনও নেই)। ব্রাদার্স কারামাজভ পড়ার পরামর্শ দিলো নাদিয়া। তার মতে, একটা বই খুলে মাসখানেক ধরে যদি সেটা না-ই পড়া যায়, কুড়ি পঁচিশটা জটিল চরিত্র যদি তাতে না-ই থাকে, এক এক অধ্যায় শেষ করে যদি রাতে ঘুমানোর আগে সেগুলো নিয়ে একটু চিন্তা না করা যায়, তাহলে ওটা একটা ছাতার উপন্যাস। লা মিজেহ্রাবল? হুঁ, নাদিয়ার খারাপই লাগছে বলতে, কিন্তু ওটাও ছাতার উপন্যাস। আনা কারেনিনা পোড়ো, ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাকে হুকুম দেয় সে। এক মাস পর নাদিয়া ফিরে গেলো ব্রেয়ানস্কে। তার ঘরে এসে উঠলো আরেক নাদিয়া। সে-ও রুশ, এবং কী তাজ্জব, সে-ও লাইব্রেরিয়ান। তবে প্রথম নাদিয়া একটু বিষণ্ণ গম্ভীর ছিলো, দ্বিতীয় নাদিয়া ছটফটে। তার সাথেও আমার ভাব হয়ে গেলো (নাদিয়া নামের মেয়েদের সাথে আমার সহজে খাতির হয়ে যায়)। অলিভার টুইস্টের জার্মান ডাবড সংস্করণ দেখছি একদিন গভীর রাতে বসে, নাদিয়াও এসে বসে দেখা শুরু করলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শুনলাম একটা পরিচিত শব্দ, হুঁহ! এবার মেজাজটা খারাপই হয়ে গেলো। ঘটনা কী? রাশিয়ার সব নাদিয়াই কি লাইব্রেরিয়ান? তারা সবাই কি লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়ে? দ্বিতীয় নাদিয়ার কথা শুনে মনে হলো ঘটনা সেরকমই। তার মতে, অলিভার টুইস্ট একটা ফালতু উপন্যাস। উপন্যাস লিখতে পারে শুধু রুশরা। তাতে অনেকগুলো চরিত্র থাকে, অনেক ঘটনা থাকে, এক একটা সংলাপ নিয়ে চিন্তা করেই নাকি দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়ার হুকুম দিয়ে সে ঘুমোতে চলে যায়, অলিভার টুইস্ট একটা বিষ্ঠা, এই মত রেখে। পরে আবার জার্মানিতে এসে আরেক রুশ লাইব্রেরিয়ান নাদিয়ার সাথে আলাপ হওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নাদিয়া নামের কোনো রুশ মেয়ের সাথে বই নিয়ে আলাপ করতে যাবো না। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? বাংলা উপন্যাস নিয়ে কোনো নাদিয়ার সাথেই তেমন আলাপ হয়নি। উপন্যাসের বিস্তৃতি দিয়ে তার মহত্ত্ব বিচার করতে গেলে রুশদের সাথে আমাদের টক্কর না লাগাই মঙ্গল। ক্লাসিক উপন্যাসগুলো দিয়ে মুখ রক্ষা করা গেলেও, এখন যে কলেবরের উপন্যাস আমাদের দেশে লেখা হয়ে চলছে, সেগুলো সম্বল করে আমরা পশ্চিমবঙ্গের সাথেই কি তুলনা করতে পারবো? উপন্যাস নামে যা বিক্রি হয় আমাদের বইমেলায়, তার একটা বড় অংশ আসলে উপন্যাসিকা। প্রথম পর্বে বলেছিলাম কাগজ নিয়ে। এই কাগজের দাম আমাদের একটা অদ্ভুত কাচদেয়ালে ঘিরে ফেলছে। বইমেলায় বইগুলোর একটা ম্যাজিক দাম থাকে, প্রতি তিন চার বছর পর পর এই ম্যাজিক দামটা বাড়ে। এই সীমাটা টপকে গেলে পাঠক আর ক্রেতা হয়ে উঠতে পারে না, বইটা নেড়েচেড়ে রেখে সে চলে যায়। এই ম্যাজিক দামটা পাঁচ ফর্মার বইয়ের মূল্যের আশেপাশে। এই আকারের বই বাংলাদেশে জনপ্রিয় করেছেন যারা, প্রকাশনা শিল্পের ওপর তাদের অনেক প্রভাব। তারা প্রচুর নতুন পাঠক যেমন তৈরি করেছেন ও ধরে রেখেছেন, সেইসঙ্গে বাজারে বইয়ের গ্রহণযোগ্য একটি আকৃতিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে কেউ হুট করে একটা মোটাসোটা বই লিখে সুবিধা করতে পারবেন না। নতুন লেখকের বৃহদায়তন বই প্রায় কোনো প্রকাশকই প্রকাশে আগ্রহী হবেন না, যেহেতু ঝুঁকি বেশি, আর পুরনো লেখকরাও এই প্রতিষ্ঠিত কলেবর ছেড়ে দূরে গিয়ে তেমন একটা লেখেন না। দশ ফর্মা কেন লিখবেন, যদি পাঁচ-ছয় ফর্মা লিখেই কাজ হয়? বইয়ের বিবর্তনের ধারায় পাঁচ-ছয় ফর্মা একটা স্থিতিশীল পরিসর। যদি পাঁচ ফর্মার কম লেখা হয়, তাহলে ফন্টের আকার বাড়িয়ে, লাইন স্পেসিং বাড়িয়ে, মার্জিন বাড়িয়ে, প্রয়োজনে দুই পাতা সাদা রেখে একে পাঁচ ফর্মায় তুলে আনা হয়। গত কুড়ি বছরে আমরা এটিকে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত করে ফেলেছি কি? যুক্তি আসতে পারে, চাহিদা আছে বলেই হয়তো এমন পরিসরের উপন্যাস বা গল্পসংকলনের সরবরাহ বেশি। রুশরা মাসের পর মাস ধরে গোদা গোদা বই পড়ে বলে বাঙালিকেও সেটা করতে হবে নাকি? পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখি, সেখানে বিস্তৃত পরিসরের উপন্যাস লেখার চল বহুদিন ধরেই। সেই উপন্যাসগুলো জনপ্রিয় আর লাভপ্রদও বটে, এমনকি বাংলাদেশেও অনেকে সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশের অনেক বৃহদায়তন উপন্যাসকে ক্লাসিক জ্ঞান করে পড়েন। পশ্চিমবঙ্গে বৃহদায়তন উপন্যাস প্রকাশের পেছনেও সেখানে কাগজের কম দাম একটা বড় প্রভাবক বলে আমি মনে করি। আমাদের বইদোকানীরা কুলিকামিনের মতো করে ঐ বইগুলো পিঠে মোট বয়ে নিয়ে এনে বিক্রি করেন সারা বছর ধরে। কিন্তু যখন আমাদের বইমেলা হয়, আমাদের প্রকাশক আর লেখকেরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেই পাঁচ-ছয় ফর্মার লক্ষ্মণরেখায় বন্দী হয়ে লেখেন। ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলছি না, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। নিচে কবিতা, গল্প, উপন্যাসিকা, উপন্যাস আর মহোপন্যাসের শব্দসংখ্যার একটা তুলনামূলক লেখ দিলাম, তুলনা করে দেখুন। নন্দিত নরকে আর পদ্মা নদীর মাঝির শব্দসংখ্যা = পৃষ্ঠা সংখ্যা x লাইনসংখ্যা x গড় শব্দসংখ্যা, এই সূত্র ধরে হিসাব করা। বাকি তিনটি একেবারে গুণে বার করা। ওয়ার অ্যান্ড পিস বেছে নেয়ার কারণ, উপন্যাসের সম্ভাব্য একটি প্রান্তিক আকারের সাথে তুলনা করে দেখতে চেয়েছি। পনেরো হাজার শব্দ আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় পরিসর, এই পরিসরে প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়। যেহেতু অনেকেই কাগজের ঈদ সংখ্যায় লেখেন, ঈদ মৌসুমে তারা এই আকারের একাধিক লেখা লিখে থাকেন এবং একাধিক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এগুলোর অনেকগুলোই পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আর পশ্চিমবঙ্গে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত লেখার সংখ্যা বেশি, সেগুলো লম্বা সময় ধরে পাঠকের সামনে থাকে এবং যখন গ্রন্থিত হয়, বেশ বড় আকার নিয়েই হয়। আমাদের দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক সাময়িকীতে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেটি অল্প কয়েকটি পত্রিকায়, এবং অল্প কয়েকটি বইয়ের। লেখককে দীর্ঘ পরিসর নিয়ে লিখতে যদি পাঠক উৎসাহিত করতে না পারেন, তাহলে লেখক বড় উপন্যাস লিখবেনই বা কেন? পদ্মা নদীর মাঝির মতো আরেকটি উপন্যাস রচনা করার শ্রম কে দেবেন, কেনই বা দেবেন? বড় উপন্যাস আদৌ লেখা জরুরি কেন, এই প্রশ্নটা সামনে আসতে পারে। আমার কাছে মনে হয়, যে পরিসরটি বইমেলার অর্থনীতি, পত্রিকার কূটনীতি আর লেখক-পাঠকের যোগাযোগের অভাবের সমন্বিত ফল হিসেবে এখন জনপ্রিয় বা মান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, এই পরিসরে একাধিক চরিত্র নিয়ে বড় কোনো ঘটনাকে খুঁটিয়ে দেখা দুরূহ। কিন্তু সেই খুঁটিয়ে দেখার কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য শুধু ঘন্টাখানেক সময় কাটানোর জিনিস নয়, সাহিত্য একটা সমাজের চলার চিহ্নও। যুবক যেমন দেয়ালে নিজের শিশু হাতের ছাপ ফিরে দেখার জন্যে একদিন উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসে পুরনো বাড়িতে, সমাজকেও তেমনি একটা প্রজন্ম পর পেছনে তাকিয়ে অনেক কিছু খুঁজতে হয়। খুঁজে কিছু পাওয়ার প্রশ্ন পরে আসে, খুঁজতে চাওয়ার প্রবণতাটি প্রতি মুহূর্তে ধরে রাখতে হয়। এক পুরুষ পেরিয়ে গেছে, আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বৃত্ত লোকটিকে ক্ষমতা থেকে লাথি মেরে সরিয়েছি, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে নিজেদের পায়ের ছাপ খোঁজার প্রবণতাটিকে আমাদের সাহিত্যিকেরা নির্মাণ করতে পারেননি বলে আজও অনেক তরুণ জানে না, এরশাদ কত নির্মম ভয়ঙ্কর একটি স্বৈরশাসক ছিলো, কেমন ছিলো তার থাবার নিচে বাংলাদেশ। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সাহিত্যিকদের, তারা সেই সময়টিকে সাহিত্যে ধরে রাখতে পারেননি। পাঁচ-ছয় ফর্মার উপন্যাসে মানুষের জীবনই ধরা মুশকিল, আর সমাজের জীবন তো দূরের কথা। ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিস্ময় প্রকাশ করে গিয়েছিলেন, এত সমৃদ্ধ একটি দেশ, অথচ এর কোনো সমাজবিবরণী নেই। এক একটি পরিবার সেখানে দ্বীপের মতো বাস করে, হিন্দু মুসলিম থেকে দূরে থাকে, ধনী থাকে দরিদ্র থেকে দূরে, অতিথি অন্দরমহলবাসিনীদের কুশল জিজ্ঞাসা করতে পারেন না, অথচ প্রতিটি ধনী বা বিদ্যোৎসাহী পরিবারের রয়েছে নিজস্ব লিখিত পারিবারিক ইতিহাস। হান্টার পুরোনো খবরের কাগজ, সরকারী দলিল আর পারিবারিক ইতিহাস সংগ্রহ করে অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল রচনা করেছিলেন, আর বার বার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, এ কেমন সমাজ, যে নিজের ইতিহাস লেখে না? আমরা সেই সময় ছেড়ে দূরে চলে এসেছি ঠিকই, কিন্তু বিচ্ছিন্ন দ্বীপই রয়ে গিয়েছি। আমাদের উপন্যাসগুলোও তাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই, একটি বা দু'টি চরিত্র, দুয়েকটি নারী আর দুয়েকটি পুরুষের জোলো রোমান্টিক বৃত্তের ভেতরে পাঁচ থেকে ছয় ফর্মার ভেতরে আমাদের সাহিত্যের দায় নিষ্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। সাহিত্য কি শুধু বিনোদনই দেবে আমাদের, এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে কি উদ্ধার করবে না? প্রতিটি বইমেলাতেই আমরা হয়তো একটু একটু করে নিজেদের ইতিহাসের মুখচ্ছবি মুছে আসছি। কাগজের দামটা হয়তো শুধুই অজুহাত। বই হোক আরো বিস্তৃত, চরিত্রঘন, ঘটনাসঙ্কুল, ইতিহাসগর্ভ। বই হোক আরো সুলভ। অফসেট-হার্ডকাভারের দামী খাঁচা থেকে তার মুক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনই মুক্তি প্রয়োজন একঘেয়েমি থেকে, সমাজ সম্পর্কে নিস্পৃহা থেকে। সময়ের আত্মাকে ধারণ করতে না পারলে সে বই দিয়ে সাজানো বইমেলা আরেকটা বাণিজ্যমেলাই হবে শুধু।
false
rg
বইমেলার ডায়েরি (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) !!! ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার। আজ ১ লা ফাল্গুন। আজ বসন্ত। আজ অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে সকাল এগারোটায়। চলেছে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাংলা একাডেমি'র পুকুর পাড়ের দিকে ককটেল ফোটায় বইমেলা হঠাৎ করে আতঙ্কে শূন্য হয়ে যায়। আজ ফাল্গুনের এক তারিখে বসন্তকে বরণ করতে বইমেলায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। শাহবাগে ফুল যেমন বিক্রি হয়েছে, সে তুলনায় বই কম বিক্রি হলেও, আজ বইমেলায় তারুণ্যের জোয়ার ছিল। সেই জোয়ারে বরং এই ককটেলের শব্দে এক ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে। একাডেমির লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গনে আড্ডা কেবল জমে উঠেছিল। হঠাৎ ওই মাটি কাঁপানো শব্দে বইপ্রেমীদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যে বইমেলা ফাঁকা হতে শুরু করে। অমর একুশে বইমেলায় যারাই এই ককটেল চার্জ করুক না কেন, তাদের কদাকার অসুন্দরের চেয়ে সারাদিনের তারুণ্যের সৌন্দর্য অনেক বেশি শক্তিশালী। সৌন্দর্যই সত্য। আর মানুষ তাই ভালোবাসে। অসুন্দর কদাকার ভীরুতা মানুষ চিরকাল বর্জন করেছে, অপছন্দ করেছে, ঘৃণা করেছে। আজকের বইমেলায় দুবৃত্তদের এই অসুন্দর প্রচেষ্টাকে মানুষ ঘৃণায় উড়িয়ে দিয়ে আবারো রাত পোহালে সৌন্দর্যের কাছে যাবে মানুষ। আবারো প্রাণের বইমেলা প্রাঙ্গন মানুষের পায়ে পায়ে ভরে উঠবে। কারণ মানুষ এই সৌন্দর্যের পূজারী। দুপুর বারোটার দিকে বইমেলায় গিয়ে যথারীতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢু মেরে তারপর একাডেমি প্রাঙ্গনে বহেড়াতলায় গিয়ে নন্দনের স্টল খুলে বসি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইপ্রেমীদের আগমনে বইমেলা প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে। আজও ছুটির দিন হওয়ায় সকালটা ছিল শিশু প্রহর। ছোট্টমণিরা একাডেমি মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছে। গান করেছে। ছবি এঁকেছে। সকালটা ছিল ছোটদের দখলে। বেলা একটায় শিশু প্রহর শেষ হলে মেলা প্রাঙ্গনে তারুণ্যের জোয়ার লাগে। মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও একাডেমি প্রাঙ্গন মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে টইটম্বুর হয়ে যায়। একাডেমি'র প্রচার কেন্দ্র থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, যারা দলবেধে মেলায় এসেছেন, তারা যেন দলছুট হলে কোথায় ফের মিলিত হবেন, তা আগেই ঠিক করে নেন। কারণ, মানুষের স্রোতে আজ সত্যি সত্যিই বইমেলায় প্রাণের বান ডাকে। বর্ধমান হাউসের সামনে কুদ্দুচ ভাই আর কবি দিলদার হোসেনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট কভার করতে গিয়ে পুলিশের কাছে ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভশনের সাংবাদিক গ্রেফতার হওয়ার খবর নিয়ে। এছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে খুব দুর্বলভাবে উপস্থাপন করায় বিসিবির দক্ষতা ও পারঙ্গমতা নিয়ে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই মেলবোর্নে উপস্থাপিত বাঙালিয়ানার চেয়েও আরো উচুমানের সাংস্কৃতির সামর্থ্য ইতোমধ্যে অর্জন করেছে। একটি বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার দায়িত্ব বিসিবি একটু সচেতন হলেই করতে পারতো। কিন্তু বিসিবি দায়সারা গোছের যে বাঙালি সংস্কৃতি অস্ট্রেলিয়ায় দেখালো, তা দেশের মুখকে বরং আরো খাটো করেছে। এক কথায় মেলবোর্নে বাংলাদেশের উপস্থাপনা ছিল খুবই দুর্বল আর সাটামাটা। আমাদের ক্রিকেট যেখানে অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছে, সেখানে আমাদের সংস্কৃতিকে এভাবে দুর্বলভাবে উপস্থাপনের কোনো মানে হয় না। আমরা এর চেয়েও উন্নত কালচারাল রিপ্রেজিন্টং সামর্থ্য রাখি। যার দায় বিসিবি কোনোভাবে এড়াতে পারে না। বইমেলায় এরপর দেখা হল কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন ও কথাসাহিত্যিক রাখাল রাহার সঙ্গে। রাখাল আজ ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছে। দেখে খুব ভালো লাগল। আড্ডা দিচ্ছিলাম আলীমের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর কবি ও গবেষক রণদীপম বসুদার সঙ্গে দেখা হওয়ায় চা খেতে বাইরে গেলাম। রণদা চা শেষে উদ্যানে ঢুকলেন। আমি আবার প্রাঙ্গনে ফিরে বহেড়াতলায় গিয়ে পেলাম শাকুর ভাইকে। নির্মাতা, লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ। সঙ্গে বাপ্পী আর পলাশ। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন অপুদা আর ন্যান্সি আপা। রিন্টু ভাই আজ নাটকের রিহারসেলে ব্যস্ত। সেই সুযোগে অপুদা আর ন্যান্সি আপা পাঙ্খা লাগিয়ে বইমেলায় ঘুরছেন ফাগুনের বাতাস লাগিয়ে। ন্যান্সি আপা আর অপুদা আমার বেশ কিছু বই কিনলেন। যে কারণে আমরা আবার উদ্যানে গেলাম। আজ কিন্তু উদ্যানে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। ধুলোও ছিল প্রচণ্ড। ভিড়ের কারণে উদ্যান থেকে বের হবার আজ বিকল্প এক্সিট গেট ছিল। তবুও বাংলা একাডেমির সামনে কালীমন্দির গেটে ধাক্কাধাক্কি লেগেই ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অমর একুশে বইমেলা আয়োজন নিয়ে বাংলা একডেমি এখন পর্যন্ত ভুল পথেই হাঁটছে। দুই জায়গায় মেলা হওয়ায় এখনো বইপ্রেমীরা বিভ্রান্তে রয়েছেন। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে অনেকে আজ বইমেলায় ঢুকতে পারেনি। গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে অমর একুশে বইমেলা আয়োজন কতোটা যুক্তিযুক্ত, এটা এখনই ভাবার সময় এসেছে। এই মেলা সারা মাস জুড়ে হওয়ায়, ধীরে ধীরে এটি প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো ভাবে অগোছালো একটা জগাখিচুরি মার্কা বারোয়ারি মেলায় রূপ নেয় ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ আসতে আসতে। আমাদের গোটা জাতির জাতীয় চরিত্রেই এই অগোছালো বাঙালিয়ানা বৈশিষ্ট্যটি সুস্পষ্ট। অমর একুশে বইমেলা আয়োজনে যেহেতু বাংলা একাডেমি সকল কর্তৃত্ব পালন করে। তাই বাংলা একাডেমিকেই এর সকল ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। কিন্তু একাডেমির বয়স এখন ৬০ বছর। অমর একুশে বইমেলার বয়সও অনেক হয়েছে। চল্লিশের উপরে। অথচ যতই দিন যাচ্ছে, ততই অমর একুশে বইমেলার চেহারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে কর্পোরেট বেণিয়ার দিকে ঝুকছে। যা বইমেলার প্রকৃত সৌন্দর্যকে নষ্ট করছে। যা একাডেমি এখনো অনুভব করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। অমর একুশে বইমেলা একাডেমি প্রাঙ্গনের বাইরে আয়োজনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে আমি। একাডেমি'র ভেতরে যে জায়গা আছে, এবং দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তায় যতটুকু জায়গা, এর মধ্যেই সুন্দর পরিকল্পনা করে, আরো গোছানো বইমেলা করা সম্ভব। একাডেমির মাথায় যদি ঘিলু থাকত, তাহলে নতুন ভবনটি আরো দক্ষতার সঙ্গে বানানো যেত। নতুন ভবনটি এখন যেভাবে করা হয়েছে, সেখানে আরো উন্নত নকশা করার সুযোগ ছিল। একেবারে নিচের দুটো ফ্লোর একুশের বইমেলার জন্য খোলা রাখা যেত। পুকুরটাকে ঘিরে এবং নতুন ভবনের দুই ফ্লোর মিলে পুরো একাডেমি চত্বরে যে জায়গা, তা দিয়েই সুন্দর করে, এই মেলা আয়োজন করা যেত। এখন নতুন ভবন হয়ে যাওয়ায়, এখনো একাডেমি প্রাঙ্গনেই সুন্দর ভাবে মেলা আয়োজন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে কি কি করতে হবে? আমার পরামর্শ এরকম- ১. একাডেমি বর্তমানে বর্ধমান হাইসের পাশে যে মঞ্চটি করে, ওটাকে নতুন ভবনের সামনে পুকুর পাড়ে ট্রান্সফার করতে হবে। মঞ্চের বর্তমান জায়গাটি স্টলের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। ২. একুশে মেলায় শুধুমাত্র প্রফেশনাল মানসম্মত প্রকাশকদের জন্য স্টল বরাদ্দ দিতে হবে। ৩. বাংলা একাডেমি ছাড়া অন্যান্য সকল সরকারি, আধা সরকারি, মিডিয়া, স্পন্সর প্রতিষ্ঠান সহ বর্জ জিনিসগুলোর মেলায় স্টল দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ৪. আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যারা বইমেলায় স্টল নেয়, এরা বইমেলার সৌন্দর্য নষ্ট করার জন্য আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা। যেমন ধরুন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এদের একুশে বইমেলায় স্টল কেন, কোন যুক্তিতে দেওয়া হবে? তারা সারা বছর কি করে? মেলা উপলক্ষ্যে তাদের কি এমন প্রকাশ পায়, যা বিক্রি করার জন্য বইমেলায় থাকতে হবে??? এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে খামাখা বইমেলায় টেনে আনা হয়। এটা সরকারি আদিখ্যেতা। বাংলা একাডেমির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অদক্ষতা। ৫. লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে অন্য কোনো ধরনের প্রকাশনাকে স্টল বরাদ্দ না করা। ৬. একাডেমি মঞ্চে মাসব্যাপী যে সেমিনার করা হয়, বাংলা একাডেমির কি লজ্বাও লাগে না যে, ওই সেমিনারে যারা দর্শক বা শ্রোতা, এতোগুলো বছর কাদের তারা কি জ্ঞানগর্ভ কথামালা শোনান? এই সেমিনার চর্চা একাডেমির হলরুমেই করা যেতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই সেমিনারগুলো বাংলা একাডেমি কর্তৃক গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এক অকাল পাত্রে কন্যা দান করার মত ব্যাপার। অনেকটা উলুবনে মুক্তা ছড়ানো। যাদের মেলায় একটু বসে রেস্ট নেবার ইচ্ছে জাগে, তারাই কেবল ওই সেমিনারের চেয়ারগুলো দখল করে। ওখানে কেউ সেমিনার শুনতে বইমেলায় যায় না। এই সামান্য বিষয়টি বাংলা একাডেমি গত চল্লিশ বছরেও ধরতে পারেনি বা উপলব্ধি করতে পারেনি। যা বড়ই দুঃখের বিষয়। ৭. বিকালের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে পুকুর পাড়ে নতুন ভবনের সামনে নতুন ভাবে তৈরি করা মঞ্চে। সারা প্রাঙ্গনে সাউন্ড সিস্টেম ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কে গান গাইছে, তা না দেখলেও, তা নিজ নিজ জায়গায় বসে শোনানোর ব্যবস্থা রাখা হবে। ৮. একাডেমির তিনটি গেটই উন্মুক্ত থাকবে। দোয়েল চত্বর আর টিএসসি এলাকায় নিরাপত্তা চৌকি বা মেটাল ডিটেকটটর বসানো উচিত। কারণ গোটা রাস্তায়ও স্টল বরাদ্ধ করা উচিত। রাস্তার দুইপাশে দুই সারি স্টল। যেখানে নতুন প্রকাশকদের বা ছোট প্রকাশকদের বরাদ্দ করা যেতে পারে। ৯. অমর একুশে বইমেলা শুরু করা যেতে পারে ১ লা ফাল্গুন। আর তা শেষ হবে ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৩ তারিখে শুরু। ২১ তারিখে শেষ। সেক্ষেত্রে মেলা উদ্ধোধন করা যেতে পারে ১২ ফেব্রুয়ারি। ১০. অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মেলার প্রথম দশদিন প্রকাশকরা নতুন বই আনায় ব্যস্ত থাকেন। এই সময় বই বিক্রিও কম হয়। মেলা ২৮ দিনের বদলে ১০ দিন (১২ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি) হলে, প্রকাশকরা বইমেলা শুরু হবার আগেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আগ্রহী হবে। তখন ৯ দিন বইমেলায় বই বিক্রি করার সুযোগ পাবে। গোটা মাস জাতি বইমেলা নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছে। যা জাতীয় প্রোডাকশানকে অর্থনৈতিকভাবেও দুর্বল করছে। কারণ, এতোগুলো মানুষ গোটা মাস একই কাজে ব্যস্ত থাকছে। বিশ্বের কোথাও এমন অলস জাতি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা সিস্টেম করলে সেটায় তখন সবাই নতুন করে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। ১১. ২১ শে ফেব্রুয়ারি বরং সারা রাত বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। ২১ তারিখের বড় ভিড় এড়াতে এই কৌশল। তখন যারা সকালে যাবে, তারা আর বিকালে যাবে না। যারা সারা রাতের প্রস্তুতি নিয়ে যাবে, তারা আর দিনের বেলায় খামাখা বইমেলায় যাবে না। সেক্ষেত্রে ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টায় অমর একুশে বইমেলার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। মোদ্দাকথা, অমর একুশে বইমেলাকে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে করা, এবং উদ্যান ও প্রাঙ্গন মিলে করা একটা জগাখিচুরি বারোয়ারি মেলা করার সামিল। এটাকে পরিকল্পিত, সুন্দর, গোছানো একটা রূপে ১০ দিনে ছোট করে আনলে গোটা জাতির বরং উপকার হবে। আজ বইমেলায় অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। আজ আর আলাদা ভাবে উল্লেখ করার কিছু নেই। আড্ডায় যারা ছিলেন, এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে, তারা হলেন- কবি জুয়েল মোস্তাফিজ, কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি মামুন খান, কবি মঈন চৌধুরী, কবি জুয়েল মাজহার, কবি মুজিব মেহদী, কবি শেলী নাজ, কবি কবির হুমায়ুন, কবি খলিল মজিদ, কবি সরসিজ আলীম, কবি হানানআল আব্দুল্লাহ, কবি নীলসাধু ও শিমুল মাসুদ দম্পতি, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি সাফি সমুদ্র, লেখক ঋষি এস্তেবান, শিল্পী চারু পিন্টু, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর, লেখক তপন বড়ুয়া, কবি ও নির্মাতা আশরাফ শিশির, কবি কাবেরী রায় চৌধুরী, কবি চৈতি হক, কবি আলোড়ন খিসা, কবি সুমনা সাহা, শিল্পী শতাব্দী ভব প্রমুখ। বইমেলায় ককটেল আতঙ্কের কারণে মেলায় ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই মেলা শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু গোটা শাহবাগ জুড়ে আজ অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় আজও ছিল চরম যানজট। আগামীকালও বইমেলায় এমন উপচে পড়া ভিড় হবে, এটা এখনই বলে দেওয়া যায়। আর ২১ তারিখে তো বরাবরের মতই সবচেয়ে বেশি ভিড় হবে। রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্যাচাল কমুক বা বাড়ুক, বইমেলায় সবাই যাবে। প্রাণের মেলায় সবাই যাবে, নিরাপদে যাবে। নিরাপদে বাসায় ফিরে আসবে। এটাই হোক আজকের প্রত্যাশা। সবাই বই কিনুন। প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। সবাই ভালো থাকুন। অমর একুশে বইমেলা আয়োজন নিয়ে আমার প্রস্তাবনাগুলো (১১দফা'র) পক্ষে-বিপক্ষে আপনারা আরো যুক্তিসঙ্গত মতামত দিবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। জয়তু একুশে বইমেলা। জয়তু লেখক-প্রকাশক-পাঠক মিলনমেলা। .............................. ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৩:২৪
false
ij
গল্প_ শরমের কথা না। নূর মোহাম্মদের কপালে তার স্ত্রীটি মোটেও ভালো জোটেনি। এ কথা বলার অবশ্যই কারণ আছে। নূর মোহাম্মদ ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি। তাবলীগ জামাত করেন। প্রতি মাসে ‘নিছাব’ অনুযায়ী একবার তিন দিনের তাবলীগে যেতেই হয়; তখন পারভীন বেগম মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখতে বেরিয়ে যান। কিংবা বিরিয়ানি হাউজে ঢুকে বিরিয়ানি খান। পারভীন বেগমের একটাই মেয়ে। ফুটফুটে চেহারার ফাতেমা আখতার এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে এবং সিনেমার ভীষন পোকা। (সাকিব খানের ফ্যান )। ঘরে খবর-টবর দেখার জন্য একটা রঙীন প্যানাভিশন টেলিভিশন আছে বটে, যদিও নূর মোহাম্মদ টেলিভিশনকে বলেন ‘শয়তানের বাক্স’ ... তবে ‘বাবায়’ (নূর মোহাম্মদ) ঘরে থাকলে সেটি মা-মেয়ের তেমন দেখা হয় না। তবে মাঝে মাঝে রাতের বেলায় ঘুম না এলে অনেক রাত পর্যন্ত ‘স্টার জলসা’ দেখেন নূর মোহাম্মদ । এই নিয়ে পারভীন বেগম স্বামী ঠেস মারতেও ছাড়ে না। নূর মোহাম্মদ হাসেন। লোকটা এমনিতে ভালোই; চাকরি করেন মতিঝিলের একটি বীমা কোম্পনীতে । পারভীন বেগম জানেন, তার স্বামীর অফিসেও ভালো লাগে না, বাড়িতেও ভালো লাগে না। তাবলীগে গিয়ে তিন দিন টেনশন মুক্ত থাকেন । এই তিন দিন মা ও মেয়ে স্বাধীন ও মুক্ত জীবন উপভোগ করে। নূর মোহাম্মদ তাবলীগে চলে গেলে পারভীন বেগম ফাতেমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হন। ঘরে থাকে গৃহস্থকর্মী নাজমা। কিশোরী মেয়েটি অতি বিশ্বস্ত । তবে সব ব্যাপারে নাজমাকে মা-মেয়ে বিশ্বাস করে না। যেমন সিনেমা দেখতে যাওয়া আর বিরিয়ানি হাউজে ঢুকে বিরিয়ানি খাওয়ার কথা কখনও নাজমাকে বলে না। যাওয়ার আগে পারভীন বেগম বলেন, পুরান ঢাকায় যাইতেছি রে নাজমা। ঘরের দিকে খেয়াল রাখিস। পুরান ঢাকায় আমার এক নানীজান থাকে। সেই নানীজানের অসুখ। নানীরে দেখতে যাই। বলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যান পারভীন বেগম। নাজমাও কী কারণে মুখ টিপে হাসে। তো, এই মুহূর্তে ফাতেমা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। হাতে লন্ড্রী থেকে আনা কাপড়চোপড়। অন্য সময় লন্ড্রীতে নাজমাই যায়। তো, নাজমা এখন রান্নাঘরে। ভীষণ ব্যস্ত। তাবলীগে যাওয়ার আগে ধার দেনা করে হলেও খাওয়া-দাওয়ার বিস্তর এন্তেজাম করেন নূর মোহাম্মদ। মুরগী কমন। গরুর গোস্ত তো আছেই। ফাতেমা বলে, আম্মা, এখন নাকি তাবলীগে আব্বারা চাইনিজও খায়। পারভীন বেগম বলেন, তোর বাবায় আগে এমন ছিল না। আমারে বলাকা ছিনেমা হলে নিয়া কত বই দেখাইছে। যখন মীরপুরে ছিলাম, চিড়িয়াখানায় নিয়া কত চটপটি বাদাম খাওয়াইছে। বাবায় তাইলে এমন হইয়া গেল ক্যান?কেমনে কই ক। হয়তো টেনশনে। তোর বাবার টেনশন আবার বেশি। আমার আবার অত ভয়ডর নাই। আমরা নদীনালার দেশের মানুষ। ফাতেমা হঠাৎ বেলি ফুলের গন্ধ পেল। মুখ তুলে দেখল নাসরীন আপা নামছে। নাসরীন আপারা চারতলায় থাকে। ফাতেমা দাঁড়িয়ে পড়ল। নাসরীন আপা আজ লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরেছে। লাল ব্লাউজ । খোপায় বেলি ফুলের মালা। নাসরীর আপার স্বামী নাছির দুলাভাই কুয়েত থাকেন। ‘নাসরীন’স গার্ডেন’ নামে পাড়ায় একটি বিউটি পারলার আছে নাসরীন আপার । ফাতেমার সঙ্গে বেশ খাতির। ফাতেমাকে রূপের রানী বলে ডাকে নাসরীন আপা।ফাতেমাকে দেখে নাসরীন আপা দাঁড়াল। তারপর গাল টিপে বলল, কি রে রূপের রানী, তর হাতে কি রে?আব্বার কাপড়। আব্বায় আজ তাবলীগে যাইব। তাইলে তো তোগো তো আজ ঈদ। সিনেমা দেখতে যাবি জোনাকি হলে। কাচ্চি বিরিয়ানি খাবি ধানমন্ডি গিয়া।ওদের গোপন অ্যাভভেঞ্চারের কথা একমাত্র নাসরীন আপাই জানে। ফাতেমা হাসে।দুপুরের আগেই নূর মোহাম্মদ তাবলীগে রওনা হয়ে যান। স্বামী বেরিয়ে যেতেই মরিয়ম বেগম বোরখা পরে নিলেন। তারপর মেয়েকে নিয়ে বেরুলেন। নাজমাকে বললেন, ঘরের দিকে খেয়াল রাখিস নাজমা। ঘর খুইলা কোথাও যাবি না। আমিরুল আসলে বলবি বাসায় কেউ নাই। বলবি বিকালে আসতে। ঘরে ঢুকতে দিবি না।আইচ্ছা। বলে নাজমা হাসে।স্থানীয় মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষক মোঃ আমিরুল মোমেনিন । বাড়ি সাভার। মাদ্রাসার শিক্ষক হলে কী হবে দারুন স্মার্ট ছেলে। নূর মোহাম্মদের সঙ্গে দারুন খাতির। ‘মামা’, ‘মামা’ করে ডাকে। যখন-তখন বাড়ি আসে। পারভীন বেগম কে ‘মামী’, ‘মামী’ বলে ডাকে। ফাতেমাকে ‘বোনটি।’ পারভীন বেগম ছেলেটাকে দিয়ে এট ওটা আনায়। তবে আমিরুল গুণি ছেলে। ফ্রিজ-টেলিভিশন মেরামতের কাজ জানে। পারভীন বেগম অবশ্য আমিরুলের সঙ্গে নিভৃতে সুখদুঃখের আলাপও করেন। তবে সে রকম সুযোগ কমই মেলে। যা হোক। বরিশাল জেলার মেয়ে পারভীন বেগম, জীবনের অনেকটা বছর কেটেছে মেহেন্দীগঞ্জ; কাজেই রান্নার হাত ভালো। তবে মাঝেমধ্যে হোটেল/রেস্তোঁরার খাবার না খেলে হয়। ফাতেমাদের বাড়িটা খিঁলগাওয়ের তালতলা । গোরান টেম্পুস্ট্যান্ডের হাড়ভাঙা রোডে ‘মুক্তা বিরিয়ানি’। এই দোকানের গরুর চাপ এর বিরিয়ানি খিঁলগাও এলাকায় খুবই বিখ্যাত। বেশ স্বাদ ঝাল স্বাদ। মসলার প্রয়োগও অপূর্ব । গরুর চাপের বিরিয়ানি ৭০ টাকা প্লেট। বোরহানী গ্লাসপ্রতি ১০ টাকা । পারভীন বেগম ভূনা খিচুরী খেতেও ভালোবাসেন। আগে এই অভ্যেসটি ছিল না। ঢাকা শহরে আসার পর হয়েছে। ঢাকা শহরের সবাই জানে মতিঝিলের সুবিখ্যাত ‘ঘরোয়া হোটেল’ এর নাম। ওখানকার ভূনা খিচুরীর বেশ সুনাম। তবে দাম বেশ চড়া। ১২০ টাকা বোরহানী ২০ টাকা। তবে মরিয়ম বেগম এ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে কার্পন্য করেন না। ফাতেমার আবার পছন্দ কাচ্চি বিরিয়ানি। সে জন্য খানিকটা দূরে যেতে হয়। ধানমন্ডি ঝিগাতলা বাস্টষ্ট্যান্ড এর উলটোদিকে সুনামী রেস্তোঁরা। কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য সুবিখ্যাত । ৮৫ টাকা প্লেট। বোরহানি ফ্রি। গলিতে মা মেয়ে পাশাপাশি হাঁটছে। চড়া রোদ। ফাতেমাও বোরখা পরেছে। ফাতেমা বলল, আম্মা চল একটা সিএনজি নিয়া নিউমার্কেট যাই ।ক্যান?বলাকা সিনেমা হলে সাকিব খানের ‘অবুঝ হৃদয়’ চলতেছে। পারভীন বেগম বললেন, এখন আমার বিরানি খাইতে ইচ্ছা করতেছে। চল, আজ কে ভোলা ভাইয়ের বিরিয়ানি খাই। অবুঝ হৃদয় কালকে দেখব। নিউমার্কেটেও যাব। আমার ব্যাগ ছিঁড়া গেছে। একটা ব্যাগ কিনতে হবে।তাইলে আমারেও একজুড়া স্যান্ডেল কিন্যা দিও।আচ্ছা দিমুনে। পারভীন বেগম রিকশা ডাকেন। ‘ভোলা ভাই বিরিয়ানি’র দোকানটি খিঁলগাও রেলগেট থেকে গোড়ান এর দিকে যাওয়ার রাস্তায়। এখানে গরুর চাপ এর বিরিয়ানির প্লেট ৭০টাকা এবং বোরহানী ১৫ টাকা। রিকশায় ওঠার সময় নাসরীন আপার ‘নাসরীন’স গার্ডেন’-এর দিকে চোখ গেল। ভিতর থেকে সুন্দরী এক মহিলা বেরিয়ে আসছেন। সুন্দরী হলেও মহিল থলথলে, অবশ্য ফরসা। সম্ভবত কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবেন। ইস্ ! ম্যাডাম কি সুখী! ইচ্ছা মতন বিউটি পারলারে আসতে পারে সাজতে পারে। ফাতেমার খুব শখ বিউটি পারলারে কাজ শিখে। ও কি আর সে রকম কপাল নিয়ে জন্মেছে । একবার চুল খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল ...পিঠের ওপর আব্বার কি দুম দুম বারি ...‘ভোলা ভাই বিরিয়ানি’র দোকানে বেশ ভিড়। তবে পিছনের দিকে বসার জায়গা পাওয়া গেল। ৭০ টাকা করে গরুর চাপ এর বিরিয়ানির আর ১৫ টাকা করে বোরহানীর অর্ডার নিয়ে গেল ওয়েটার। খেতে খেতে পারভীন বেগম ফাতেমাকে জিগ্যেস করেন, লাস্টে কি হয় রে?কী সের লাস্টে কি হয়? ফাতেমা অবাক।অবুঝ হৃদয়ের লাস্টে কি হয়? ক্যান বৈশাখী তোরে কিছু বলে নাই? বৈশাখী না অবুঝ হৃদয় দেখছে। বলে পারভীন বেগম বাঁহাতে বোরহানীর গ্লাস তুলে চুমুক দেন। আহ্ ! এই না বলে সুখ ... এই না বলে শান্তি। আর ফাতেমার বাপে ...ইচ্ছা করে ...ওঃ, বৈশাখী বলছে। ফাতেমা মাথা নাড়ে। লাস্টে সাকিব খান পপির কোলে মাথা রাইখা মারা যায়।আজকে বলাকায় না গিয়া তা হইলে ভালো হইছে । ক্যান? ফাতেমা অবাক।পারভীন বেগম বলেন, আজ ভোর থেকে আমার মন ভালো। তর আব্বায় তবলীগে গেছে। আজ আমার কান্না আসত না।আমারও। বলে ফাতেমা গরুর চাপে কামড় দেয়। চারিদিকে তাকায়। সুখি মানুষ দেখে। বেরুনোর সময় ফাতেমা ভোলা ভাইয়ের বিরিয়ানির ম্যানেজারকে প্রায় ধমকের সুরে বলল, আপনারা বোরহানীর দাম ১৫ টাকা রাখেন ক্যান? ৫ টাকা কমায় রাখতে পারেন না। ‘মুক্তা বিরিয়ানি’ তে বোরহানীর দাম ১০ টাকা রাখে।বলে কি! ফাতেমার ধমক খেয়ে তো ম্যানেজারের চোখ ছানাবড়া। হাসতে হাসতে টাকা গুনতে গুনতে ফেরৎ দিতে দিতে ম্যানেজার বলে, আপা, আমাগো দোকানের বোরহানী টেস্টি বেশি। মুক্তায় পানি মিশায়।হ, পানি মিশায়। আপনারে কইছে।ম্যানেজার হাসে। পারভীন বেগম কে টাকা ফেরৎ দেয়। তারপর হাত তুলে বলে, আপা ওই দেখেন। ফাতেমা মুখ ঘুরিয়ে চেয়ে দেখে দু’জন ফরেনার আসছে। একজন কম বয়েসী তরুণী, অন্যজন মাঝবয়েসী পুরুষ। ম্যানেজার গদগদ স্বরে বলে, দেখছেন আপা, আমাগো দোকানের বোরহানীর টেস্ট করতে আসছে। গিয়া দেখেন আপা মুক্তায় ফরেনার নাই।হ। আপনারে কইছে। ধানমন্ডি ঝিগাতলার সুনামী রেস্তোঁরায় বোরহানি ফ্রি দেয়। আপনারা দিতে পারেন না?ফাতেমা ফুটফুটে বলেই ম্যানেজার বিরক্ত হয় না। বরং উৎসাহ ভরে বলে, আপনি তো জানেন না আপা, তারা ময়দা আর তেঁতুল গুলাইয়া বোরহানি বানায় আপা। সাধে কি আর দুকানের নাম দিসে সুনামী। হ। আপনারে কইছে।এ্যাই ছেড়ি! তুই এত কথা কস ক্যান! আয়! পারভীন বেগম মেয়েকে ঝারি মারেন। তারপর মেয়ের হাত ধরে টান দিয়ে ‘ভোলা ভাই বিরিয়ানি’র দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন । ফাতেমার মুখ গনগনে হয়ে ওঠে। মেয়ের রাগ ভাঙাতেই যেন ফাতেমাকে পাশে কনফেকশনারীতে নিয়ে গিয়ে একটা কোন আইসক্রীম কিনে দিলেন পারভীন বেগম। পারভীন বেগম নিজেও একটা ললি নিলেন। স্বামী নূর মোহাম্মদ এইসব ‘রঙীলা মিষ্টি বরফ’ দুই চক্ষে দেখতে পারে না। ইচ্ছা করে ... ফাতেমা রিকশায় বসে আইসক্রীম খায়। ভোলা ভাই বিরিয়ানি ও বোরহানীর প্রশংসা করে। বলে, আব্বারা তবলীগে যাইয়া কত কষ্ট কইরা রান্দে। না রাইন্দা তাবলীগের খাবার ভোলা ভাইয়ের বিরিয়ানি হাউস থেকে নিলেই তো পারে। তারা চাইনীজ খাইতে পারলে বিরানি কি দোষ করল।পারভীন বেগম হাসেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়াল। কলিং বেল চাপার পর নাজমার বদলে দরজা খুলল আমিরুল ।তুমি! পারভীন বেগম মাথায় রক্ত উঠে আসে।জ্বী। মামী। আমিরুল অতি বিগলিত স্বরে বলে।ড্রইংরুমে ঢুকতে ঢুকতে পারভীন বেগম মনে মনে বললেন, কী শরমের কথা । আমরা কেউ ঘরে নাই আর এই ছেলেটা ... নাজমায় কই ...পারভীন বেগম ফাতেমাকে বললেন, দেখ তো, নাজমা কই ।মায়ের নির্দেশ পেয়েই ফাতেমা বেশ দ্রুত পায়েই পাশের ঘরে চলে গেল। বোঝা গেল ওর ভিতরেও চাপা উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়ে গেছে। আমিরুল দরজা বন্ধ করে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন দাড়িওয়ালা তরুন। মরিয়ম বেগম দ্রুত বোরখা খুলে ফেলেন। মাঝবয়েসী ফরসা শরীরটি থলথলে হলেও চোখমুখ কাটা কাটা । মনে হয় সুলতান হারুনুর রশীদের হেরেমের সুন্দরী আরমেনীয় বাঁদি। আজ সবুজ পারের সাদা সুতির শাড়ি পরেছেন। কালো ব্লাউজ। আমিরুল অবাধ্য চোখ কালো ব্লাউজের ওপর আটকে যায়। তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের উপক্রম হয়। সে নির্দেশ মতো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বলে, গতকাল এশার ওয়াক্তে মসজিদে মোহাম্মদ মামার সঙ্গে দেখা। মোহাম্মদ মামা বললেন: টিভির সাউন্ড নাকি আপনা আপনি বেড়ে যায় । খবর -টবর দেখতে সমস্যা হয়। আজ দুপুরে অবসর পাইলাম দেখে আসলাম।ওহ্ । খবর না ষ্টার জলসা। পারভীন বেগম মুখ টিপে হাসেন। বাইরে থেকে এসেছেন। একবার বাথরুম যাওয়া দরকার। সামলে নিয়ে সোফায় মোহনীয় ভঙ্গিতে বসলেন।আমিরুলও মুখোমুখি বসে।পারভীন বেগম বললেন, তা তোমাগো শয়তানের বাক্স ঠিক হইল?জ্বী মামী। ঠিক হইছে। ১৩০ টাকার পাটস্ লাগছে।না, না টাকা দিতে হবে না। বলে আমিরুল হাসে। মামীর কন্ঠস্বর কী মোলায়েম। গলার নীচে কি মোলায়েম সাদা ... মোহাম্মদ মামাকে তার ঈর্ষা হয়। সামলে নিয়ে সে বলে, কোথায় গেছিলেন মামী? ডাক্তারের কাছে?না রে বাপ। গেছিলাম গোপীবাগ, আমার এক নানী থাকে। নানীর অসুখ।নানী এখন কেমন আছে? আমিরুলকে ভয়নক উদ্বিগ্ন দেখায়। ভালো না। শরীরের থেকে লবন কইমা যায়। ঘন ঘন মুরুব্বীদের স্বপ্ন দেখতেছে। বাঁচব না মনে হয়। ফাতেমা ঘরে ঢুকল। বোরখা খুলে এসেছে। নীল রঙের সালোয়ার-কামিজে টলটলে লাগছিল। এবার আমিরুলের অবাধ্য চোখ ফাতেমার ওপরে ঘোরে। ফাতেমা নালিশের সুরে বলল, আম্মা, শয়তানটা বাথরুমের ভিতর। গোছল করে মনে হইল। কস কী! হারামজাদী! দরজায় ধাক্কা মার। ধাক্কা মার। বাইর হইলে চা বানাইতে ক।মামী কি চা খাবেন? মোলায়েম স্বরে আমিরুল জিগ্যেস করে।হ। বাবা। বস। তুমিও খাও। এত কষ্ট কইরা টেলিভিশন ঠিক করলা। যন্ত্রপাতির দাম নিবা না। তোমারে ভালোমন্দ খাওয়াইতে পারি না, মা-বাপ ফেলাইয়া ঢাকা শহরে থাক। এই শহরে মানুষ থাকে!আমিরুল মধুর স্বরে বলে, ফাতেমা, বোনটি, যাও তো আমারে ভিতর থেকে ফ্ল্যাক্স আইন্যা দাও। আমি মোছলেমের হোটেল থেকে দুধ চা আইন্যা দেই মামী।পারভীন বেগম নরম হলেন। মোছলেমের হোটেলের দুধ চা অপূর্ব। বললেন, তাইলে বিশ টাকার পুরীও আইনো।আইচ্ছা। আমিরুল বিগলিত হয়ে বলে। বিকাল বেলা হোটেলের চা যে ডালপুরী ডুবিয়ে খেতে ভালোই লাগে পারভীন বেগম এর। স্বামী নূর মোহাম্মদ এসব বুঝতে পারে না। পারভীন বেগম ব্যাগটা তুলে নিলেন। নাও টাকা নাও।না, না মামী। টাকা লাগবে না। আমি আপনার ছেলের মতো। আমিরুল বিগলিত হয়ে বলে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমিরুল বলে। এই কথা শুনে পারভীন বেগম হাসলেন। তিনদিন পর সকাল বেলা নূর মোহাম্মদ তাবলীগ থেকে ফিরে এলেন। তার আগে মা ও মেয়ে বলাকা হল থেকে ‘অবুঝ হৃদয়’ দেখে এল। সিনেমা শুরুর মিনিট বিশেক পর ফাতেমা কাঁদতে শুরু করে।এই, তুই কান্দস ক্যান। সাকিব খান তো এখনও মরে নাই। কি সুন্দর পপিরে নিয়া নাচতেছে দ্যাখ।কান্নাভরা কন্ঠে ফাতেমা বলে, এখনও মরে নাই বইলা কি আর মরব না? বলে দুলে দুলে কাঁদে।যা হোক। নূর মোহাম্মদ সঙ্গে এক তাবলীগের সাথী নিয়ে এসেছেন। প্রতিবারই তাই করেন। এবারের সাথীটি বেশ বয়স্ক ব্যাক্তি। বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ। আমার স্ত্রীও ওইদিকের। এই বলে বৃদ্ধের সঙ্গে খাতির করেছেন। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিলেন না। বৃদ্ধ আফজাল মাষ্টার দীর্ঘদিন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কিঞ্চিৎ জমিজমাও আছে। দুই ছেলে এক মেয়ে। আগৈলঝারার এক লঞ্চ ব্যবসায়ীর সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়েছেন। দুই ছেলেই মালয়েশিয়ায় কর্মরত। বছর দুই হল স্ত্রী আরাফাত বিবি এন্তেকাল করেছেন। এখন সংসারের মোহমুক্ত হয়ে দ্বীনের পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন আফজাল মাষ্টার । নূর মোহাম্মদে সঙ্গে আল্লাই দেখা করায় দিল। এখন আল্লার দোয়ায় চোখে ছানির চিকিৎসার দায় দায়িত্ব নূর মোহাম্মদ নিলে হয়। তাবলীগ থেকে ফিরে আসার পর নূর মোহাম্মদের ধমকের মাত্রা বেড়ে যায়। আজও স্ত্রীকন্যাকে বকলেন। তুমরা বুরখা পর নাই কেন? ঘরে মুরুব্বী আসছেন। এই ফাতেমা তোর চুল দেখা যায় কেন? বুরখা পর। বুরখা পর।মা আর মেয়ে বোরখা পরতে পরতে মুখ টিপে হাসে। নূর মোহাম্মদ ভাত খেয়ে অফিস চলে যায়। সকাল এগারোটার মতো বাজে। ফাতেমা বোরখা পরে নীচে নেমে আসে। আজ নাসরীন আপার ‘নাসরীন’স গার্ডেন’-এ তেমন ভিড় নেই। আপা বসে বসে টিভি দেখছে। স্টার জলসা। আপা।কি রে রূপের রানী? তুমি মাগনা আমার একটা কাম করে দাও না।কি কাম রে?পয়সা পরে দিমু কিন্তু।এই ছেড়ি, তোর কাছে আমি পয়সা চাইছি ।ফাতেমা হাসে। এবং কাজ শেষ হলে ফাতেমা বাড়ি ফিরে আসে। মায়ের সামনে বোরখা খুলে ফেলে। মেয়ের দিকে চেয়ে পারভীন বেগম অবাক হলেও হাসলেন। জিগ্যেস করলেন, তোর বাপে জিগাইলে কি কইবি?বলব খুশকি হইছে। বলে ফাতেমা হাসে। ভারি সুন্দর লাগে ফাতেমাকে। কেমন বিদেশি বিদেশি । পারভীন বেগম নিশ্চিত - ফাতেমা মডেলিং করলে মানাত।পারভীন বেগম মুখ টিপে বললেন, মেহেমানের জন্য রুহ আফজা দিয়া শরবত বানাইছি। যা নিয়া যা। ফাতেমা বলে, আমার মাথায় এখন চুল নাই, আম্মা আমি আর বুরকা পরুম না। পারভীন বেগম হাসেন। ট্রেতে শরবতের গ্লাস নিয়ে মেহমানের ঘরে ঢুকল ফাতেমা। আফজাল মাষ্টার কী বই পড়ছিলেন। দরজায় শব্দ হতেই তাকালেন। এবং অবাক হলেন। ফাতেমা ট্রে নামিয়ে রাখে। মাথার চুল কামায়া ফেললা মা।হ। কি করুম। আপনারা আমার চুল সহ্য করতে পারেন না। অ। ফাতেমা শাদা রঙের কামিজ পরেছে। ফুটফুটে কিশোরী। ফুলের মতন নরম। আফজাল মাষ্টার ছানি পরা চোখ ফাতেমার শরীরে ঘোরাঘুরি করে।ফাতেমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ছিঃ, নানাজান, আপনাগো জ্বালায় আমার এত সুন্দর চুলগুলা কাইটা ফেললাম। আপনার এত বয়স হইছে। আপনি আমার দিকে এমন করে তাকান ক্যান? কী শরমের কথা। শেষ বয়সে পৌঁছে পুঁচকে এক মেয়ের কথায় আফজাল মাষ্টার ডাঙায় তোলা কাতলা মাছের মতন খাবি খেতে থাকেন।
false
hm
ইবরাহিমের ছুরি শাকের ভাইকে দেখে মনে হয়, ভাটার টানে তাঁর শরীর থেকে সব মেদমাংস নেমে চলে গেছে গভীর সাগরে, আর ভেতর থেকে জেগে উঠে আকাশ দেখছে তাঁর হাড়গোড়। তেমন স্বাস্থ্যবান তিনি কখনোই ছিলেন না, কিন্তু যতটুকু থাকলে একটা মানুষকে তার চেহারা ধরে চেনা যায়, তার নাম উঠে আসে মুখে, তার সবই যেন ভেসে গেছে ব্যাধির দুরন্ত টানে। অবশিষ্ট সে অস্থিবিব্রত শরীরটুকু নিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। মহুয়া ভাবী আমার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন, তার দৃষ্টির ওপাশে কী ভাবনা চলতে থাকে, আমি বুঝতে পারি না। শাকের ভাইয়ের পাশে বিছানায় বসে তিনি একটা আলতো হাত রেখেছেন শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপরে, যেভাবে টলোমলো শিশু টেবিলের নিচে ঢুকলে তার মাথার ওপর একটা হাত ভাসিয়ে রাখি আমরা; যেন সে হাতটি সরিয়ে নিলেই চোট পাবেন শাকের ভাই, ভেঙে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবেন। অসুখ শাকের ভাইয়ের কণ্ঠস্বর থেকেও প্রাণের বহুলাংশ শোষণ করে নিয়ে গেছে। তাই শাকের ভাই যখন ভাঙা গলায় বলে ওঠেন, "কেমন আছো মারুফ?", তখন চমকে উঠে ঘরে অপরিচিত কাউকে খুঁজি নিজের অজান্তেই। আমি জানি না, এ পরিস্থিতিতে এ প্রশ্নের কী উত্তর আমার দেয়া উচিত। আমি কেমন আছি আসলে? এর উত্তর কি প্রশ্নকর্তা কেমন আছে, তার ওপরও নির্ভর করে না? আমার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে, সামান্য জ্বর আছে গায়ে, সকালে কাশছিলাম। আর শাকের ভাইয়ের শরীরের দখল নিয়েছে হিংস্র ক্যান্সার, তিনি কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পর মারা যাবেন। মহুয়া ভাবীর শূন্য দৃষ্টিটুকু আমার মুখে এসে বিঁধতে থাকে, তাঁকে এড়িয়ে মুখ নিচু করে আমি বলি, "আছি, শাকের ভাই। আপনি কেমন বোধ করছেন এখন?" শাকের ভাই ভাঙা গলাতেই হাসলেন। সে হাসিতে প্রাণের ছাপ নেই, প্রাণের প্রতি পরিহাস আছে শুধু। "আমি খুব বিরক্ত বোধ করছি মারুফ। মহুয়া, মারুফকে চা দিও।" মহুয়া ভাবী মনের মধ্যে কী যেন হিসাব করেন, আমি টের পাই। হয়তো রান্নাঘরে প্লাস্টিকের যে কৌটোয় তিনি চিনি রাখেন, সেটি শূন্য পড়ে আছে। কিংবা গুঁড়ো দুধের টিনের তলানিতে বহুমূল্য কস্তুরীর মতো কিছু দুধ পড়ে আছে চা-পাগল শাকের ভাইয়ের জন্যে। কিংবা হয়তো চায়েরই বন্দোবস্ত নেই ঘরে। আমি তাই প্রয়োজনের চেয়ে দ্রুত বলে উঠি, "ভাবী, আপনি বসেন তো। চা খাবো না এখন।" কিন্তু মহুয়া ভাবী উঠে দাঁড়ান যন্ত্রের মতো, উঠে দাঁড়িয়েও একটা হাত ছুঁইয়ে রাখেন শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপর। তারপর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর মুখের সেই শূন্য অভিব্যক্তিকে পর্দার মতো সরিয়ে ফুটে ওঠে এক আহত, অপমানিত আক্রোশ। তিনি আচমকা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন, "কেন? চা খাবে না কেন?" আমি মহুয়া ভাবীর মনের ভেতরে চলমান জটিল উদ্বেগের কাছে আত্মসমর্পণ করি নীরবে। চা খেতে না চাওয়ার মধ্যেও যে খানিকটা অপমান লুকিয়ে থাকে। শাকের ভাইয়ের বাসা থেকে চা না খাওয়া কি স্বাভাবিক? ভাবী হনহন করে বেরিয়ে যান ঘর ছেড়ে। প্রথমবারের মতো মনে হয়, শাকের ভাইয়ের ঘরের দেয়ালটা একেবারে সাদা। সেই সাদা দেওয়ালে কৃষ্ণকায় চিতার মতো গুঁড়ি মেরে পড়ে থাকা কালো ঘড়িটার বুকে মৃদু টিকটিক শব্দে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যাচ্ছে একটা বেতো সেকেণ্ডের কাঁটা। শাকের ভাই আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘড়িটার দিকে চেয়ে বললেন, "রাতে খুব যন্ত্রণা করে শালা। টিক টিক, টিক টিক করে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।" আমি চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ, তারপর বলি, "নামিয়ে ফেলতে বলেন না কেন?" শাকের ভাই বিছানায় উঠে বসেন কষ্টেসৃষ্টে। "মহুয়া সময় দেখে। ঘড়ি ধরে ওষুধ খেতে হয়। ওর কাছে ঘড়িটার গুরুত্ব ওষুধে। কিন্তু আমার কাছে ওটাকে জল্লাদের মত মনে হয়। আমার সময় চলে যাচ্ছে মারুফ।" কিছু বলি না, চুপ করে বসে থাকি। মেঝেতে কীসের যেন গুঁড়ো পড়ে আছে, কয়েকটা পিঁপড়ে এসে ঘিরে ধরেছে সেটাকে। তাদের ব্যস্ততার দিকে চোখ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু চোরা চোখে শাকের ভাইয়ের দিকে তাকাই আবার। শাকের ভাই একটা হাত নাড়েন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে। "রিয়াজ এসেছিলো, বললো কনসার্ট করবে। আমি বললাম, সময় নাই তো। রিয়াজ শুধু ঘড়ি দেখে।" সরু, খনখনে গলায় হেসে ওঠেন তিনি। "আমি বললাম, আমার সময় ফুরিয়ে গেছে রিয়াজ, আর রিয়াজ গাধাটা কি না শুধু ঘড়ি দেখে।" আমি বললাম, "কনসার্ট আয়োজন করতে সাত দিনের বেশি কিন্তু লাগবে না শাকের ভাই।" শাকের ভাই চোখ বুঁজে আবার শুয়ে পড়েন বিছানার ওপর। "আমার সময় শেষ মারুফ। আরো অনেক আগে, আরো অনেক টাকা পেলে সম্ভব হতো। এখন ... আর সম্ভব না।" শাকের ভাইয়ের শোবার ঘরটা আশ্চর্য শূন্য লাগে। গত বছর এই ঘরে হল্লা করে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছি, এ বছরের শুরুতে ক্রিকেট ম্যাচের আগে শাকের ভাই ফোন করে ডেকে এনেছেন, চলে আয় ব্যাটা, একসাথে চিৎকার করি। ঘরটায় টেলিভিশন নেই, শাকের ভাইয়ের কম্পিউটার টেবিলটা ফাঁকা পড়ে আছে, তার ওপর মিহি ধূলোর আস্তর। কার যেন আঙুল দিয়ে কাটা মিহি নকশাও আছে সে ধূলোর ওপর। ব্যাংককে যাবার আগে সব বিক্রি করতে হয়েছে শাকের ভাইকে। আধচেনা লোকজন তাঁর ঘরে এসে কোলে করে তুলে নিয়ে গেছে পুরনো রঙিন টেলিভিশন, কম্পিউটার। শুধু বইভর্তি শেলফটা অক্ষত রয়ে গেছে। বই বিক্রির টাকা দিয়ে কি আর ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে বিদেশ যেতে পারবে কেউ? ব্যাংককে কেবল রোগ শনাক্ত করে ফিরতে পেরেছেন শাকের ভাই। ঐ শনাক্তযাত্রার ঢেউয়ে তাঁর সর্বস্ব সঞ্চয়, তাঁর সারা জীবন ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসারটা কাগজের নৌকোর মতো কাঁপতে কাঁপতে ভিজে টুপ করে ডুবে গেছে। শুধু যে টাকা খরচ হয়েছে, তা-ই নয়, শাকের ভাই জেনে ফিরেছেন, তাঁর আয়ু অতি ক্ষীণ সুতোয় ঝুলছে, শেষ একটা চেষ্টা করতে পারেন তিনি, সে চিকিৎসা ধারেকাছে কেবল সিঙ্গাপুরে দেয়া সম্ভব। তার খরচের সাধ্য শাকের ভাইয়ের কল্পনাতেও হয় না। একটি হাসপাতালে তিনি মানুষ হয়ে ঢুকেছিলেন, বেরিয়ে এসেছেন ক্যালেণ্ডারের পাতায় দাগ হয়ে। মহুয়া ভাবী জ্বলজ্বলে চোখে একটা ট্রে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢোকেন, তাতে এক কাপ চা আর এক বাটি ফুলকপির পকোড়া। তেলেভাজার গন্ধে আমার ভেতরে একটা ছোট্ট ক্ষিদে মস্ত হাঁ করে। শাকের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই, সেখানে কোনো বিকার নেই, একটা ক্লিষ্ট ক্ষুধামান্দ্যও তাঁর হাড়গোড়ের সাথে উঠে এসেছে মুখের অভিব্যক্তিতে। মহুয়া ভাবী কেমন একটা ঘোরলাগা মুখে একটা মোড়ার ওপর রাখেন ট্রে-টা, তারপর আবার বসেন শাকের ভাইয়ের পাশে, একই ভঙ্গিতে, একটা হাত শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপর, আলগোছে। তারপর আবার সেই পুরোনো অচেনা শূন্য চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকেন নির্নিমেষে। শাকের ভাই ভাঙা গলায় বলেন, "তুমি কোন ভালো খবর আনতে পারোনি, তাই না মারুফ?" আমি মাথা নিচু করে ফুলকপির পকোড়া তুলে কামড় দিই। মহুয়া ভাবী অসংলগ্নভাবে বলেন, "নাই? আশা নাই কোনো?" আমাদের পত্রিকায় শাকের ভাইকে নিয়ে দুটো নিউজ হয়েছে, দু'টো কলামও এসেছে, সেগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর যোগাযোগের দায়িত্বটা যেচে নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী অনেক উঁচুতে বাস করেন, তাঁর কয়েক ধাপ নিচ পর্যন্ত কেবল পৌঁছাতে পারে সাধারণ মানুষ। আমি যে সাধারণ মানুষ, সেই উপলব্ধি নিয়েই আজ ফিরেছি। চায়ের কাপে চুমুক দিই চুপচাপ, কী বলবো শাকের ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে? শাকের ভাই চুপ করে আছেন, তাই তস্করের মতো চোখ তুলে একবার তাকাই। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তাঁর চোখ দেখে। কী একটা আশা, কী একটা প্রচণ্ড আকুতি সেখানে, কী এক অসীম ছোট্ট সম্ভাবনার খড় ধরে সেখানে ভাসছে একটা মানুষের আত্মা। চোখে জল চলে আসে, দাঁতে দাঁত চেপে চায়ের কাপে আবার চুমুক দিই। এক লক্ষ টাকা দিতে পারবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল। নিশাত শাকের, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক, ফুসফুসের পেছনে মেরুদণ্ডের কাছে নীরব আততায়ী ক্যান্সার নিয়ে মারা যাচ্ছেন, তার জন্যে দেশের সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে পারেন। আর সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা করতে গেলে চল্লিশ লক্ষের মতো টাকা লাগবে। আমি মুখ খোলার পর টের পাই, কোনো শব্দ হচ্ছে না মুখে, আবার এক চুমুক চা খেয়ে বলি, "এক লক্ষ টাকা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।" মহুয়া ভাবী কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ করেন, শাকের ভাই একটা হেঁচকি তুলে সরু গলায় হাসেন শুধু। আমি বলি, "রিয়াজের কানেকশন অনেক ভালো শাকের ভাই। আর আমরা তো আছি। পরিচিতদের মধ্যে থেকে দেখছি কী পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়। আর ঈদের পর কনসার্টটা হয়ে গেলে বেশ কিছু টাকা উঠে আসবে ...।" টের পাই, নিজের কানেই কেমন খাপছাড়া শোনাচ্ছে আমার কথাগুলো। শাকের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহসই পাই না, অভিকর্ষ আমার দৃষ্টি দ্বিগুণ জোরে টেনে ধরে। শাকের ভাই ভাঙা গলায় হাসতে হাসতে বলেন, "আমাকে কে চেনে মারুফ? কনসার্টে গিয়ে যারা গান শুনবে, তারা আমাকে চেনে না তো। আমি একটা তুচ্ছ লেখক, আমি গল্প লিখি, উপন্যাস লিখি, আমার নামও জানে না অনেকে। আমার গল্পগুলো ওদের নিয়েই, কিন্তু ওরা তো সেগুলোর কথা জানে না। ওরা ঐসব কনসার্টে যাবে না মারুফ। তোমরা খামোকা আর দৌড়াদৌড়ি কোরো না।" আমি আরেকটা পকোড়া তুলে নিয়ে কামড় দিই, মহুয়া ভাবী ধরা গলায় বলেন, "এক লাখ টাকা দিবে সরকার? এত টাকা চারিদিকে, কত কোটি কোটি টাকার খবর পড়ি কাগজে, আর ওর জন্য মাত্র এক লাখ টাকা দিবে? ও কি ফকির?" আমি চুপ করে থাকি, মহুয়া ভাবী হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন। "ও কি ফকির? ও কি ভিখারি? ও কি রাস্তার কুকুর? আমার সারাটা জীবন ধরে শুনে আসলাম ও সাহিত্য করে, ও দেশের গুণীজন, সম্বর্ধনা পায়, বিশেষ অতিথি হয়, মানপত্র পায়, আর এখন লোকটা মরে যাচ্ছে ক্যান্সারে, তোমরা ওকে এক লাখ টাকা লিল্লাহ দিবা? ও কি মিসকিন? ও একটা মানুষ না? ও কিছু করে নাই তোমাদের জন্য? আমার সারাটা জীবন ধরে খালি শুনে আসলাম, টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে, সুনামটাই বড়, সম্মানটাই বড়! কোনো কিছুর লোভ করলাম না, কোনো আনন্দ করলাম না জীবনে, সাহিত্যিকের সংসার করলাম মুখ বন্ধ করে, তোমরা এই সুনাম দিলা ওকে? এই সম্মান দিলা? এক লাখ টাকা ভিক্ষা দিবা?" চামারের মতো পকোড়া খেয়ে যাই, টের পাই, একটা কিছু চিবিয়ে চললে চোখে পানি আসে না। শাকের ভাই সরু গলায় ধমক দেন, "থামো মহুয়া, থামো। থামো সোনা! এখন থামো।" মহুয়া ভাবী হুহু করে কাঁদেন, নিজের দুই হাতে মুখ ঢেকে তার ভেতরে ভেঙে গলে পড়তে থাকেন। আমি শাকের ভাইকে নিচু গলায় বলি, "শাকের ভাই, আমরা পত্রিকা থেকে সরাসরি একটা অ্যাকাউন্ট খুলে লোকজনকে ডাক দিচ্ছি। কালকেই যাবে নিউজটা। শেষের পাতায় যাবে, তিন কলাম দুই ইঞ্চি। কত পাঠক আপনার, কত মানুষ চেনে আপনাকে ... তারা আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। ঠিকই দাঁড়াবে। মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখেন। আমি বলছি, আমরা হাল ছাড়বো না।" শাকের ভাই উঠে বসে মহুয়া ভাবীর মাথায় হাত রাখেন। "মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখার বিলাসিতা আমার আর নাই মারুফ। আমার তো ব্যাংকক যাওয়ার পয়সা যোগাড় করতেই বেলুন ফুটো হয়ে গেলো। আমার বন্ধুরাই সবাই ঠিকমত পাশে দাঁড়ালো না, পাঠক এসে দাঁড়াবে? তোমাদের ঐ অ্যাকাউন্টে ছাতা পড়ে যাবে শুধু।" মহুয়া ভাবী অস্ফূট শব্দ করে কাঁদেন, ক্রমশ তাঁর কান্না আস্তে আস্তে শব্দ পায়। শাকের ভাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে অনুনয় করেন, "কাঁদে না সোনা। এইভাবে কাঁদলে হবে? কত সমস্যা সামনে ... শক্ত হও। শক্ত হও?" চুপচাপ চা খাই। শাকের ভাইয়ের দেয়ালে কালো ঘড়ির ওপর রুগ্ন কাঁটাগুলো ঘুরতে থাকে, পলেস্টীয় মন্দিরে ঘানির সাথে বাঁধা শিমশোনের মত। মনে হয় একটু পর ঐ হাতগুলো বেরিয়ে এসে এই গোটা ঘরের দৃশ্যটাকে টেনে চুরমার করে নামিয়ে আনবে মেঝেতে। শাকের ভাইয়ের মিথ্যা সান্ত্বনায় মহুয়া ভাবীর কান্নাটা আস্তে আস্তে ফিকে হয় আসে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে শুনতে পাই শাকের ভাইয়ের ডাক। "মারুফ?" আমি ত্রস্ত হয়ে বলি, "বস?" শাকের ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, "আমি কি মারা যাচ্ছি মারুফ?" শাকের ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অন্ধ কূপ দেখতে পাই, মনে হয় তার গভীরে বসে তিনি একটা হাত বাড়িয়ে রেখেছেন আমার দিকে, আমাদের দিকে। সেই কূপের ভেতরে বসা শাকের ভাই আবারও বলেন, "আমি কি মরে যাবো মারুফ?" আমি মাথা নাড়ি, কিন্তু মনের ভেতরে আরেকটা আমি বলে, হ্যাঁ শাকের ভাই! আমরা পারবো না আপনাকে বাঁচাতে। আপনার উচিত হয়নি এই দেশের সাহিত্যিক হওয়া। এখানে কেউ কাউকে টেনে তুলবে না শাকের ভাই। আপনি কেন লেখক হলেন? কেন ঠিকাদারি করলেন না? কেন কাস্টমসে চাকরি নিলেন না? কেন থানার দারোগা হলেন না? কেন জাহাজ ভাঙার ব্যবসা খুললেন না? কী বালটা পেলেন আপনি লেখক হয়ে? এই দেশে তো কেউ বইও পড়ে না। আপনি মরে যান নিশাত শাকের, আমরা আপনার লাশটা কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ শহীদ মিনারে রাখবো, সেখানে সর্বস্তরের মানুষ আসবে আপনাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। আপনাকে কবর দিয়ে অফিস ক্যালেণ্ডারে একটা তারিখ দাগিয়ে রাখবো, প্রথম কয়েক বছর আমার ক্যামেরায় তোলা আপনার কয়েকটা সাদা কালো ছবি বড় করে ছাপিয়ে সাহিত্য সাময়িকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলির লেখা ছাপাবো চার কলামে। সেখানে লিখবো, শিল্পীসাহিত্যিকদের বিপদে আপদে কাজে লাগানোর জন্য একটা তহবিল গঠন করা উচিত সরকারের, সময়োচিত পদক্ষেপ নিলে হয়তো নিশাত শাকেরের বহুপ্রজ কলম অকালে থেমে যেতো না। ওগুলো যাতে লিখতে পারি, সে সুযোগ করে দিয়ে আপনি চুপচাপ কাউকে আর জ্বালাতন না করে মরে যান শাকের ভাই। আপনি একটা দম দেয়া লাশ এখন। মরে যান। আমি উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকরে বলি, "বস, আপনি বিশ্রাম করেন। আবার আসবো আমি। চিন্তা করবেন না।" শাকের ভাই ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন কেবল, মহুয়া ভাবীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অন্যমনস্ক ভাঙা গলায় বলেন, "আচ্ছা, এসো।" আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি, হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে একটু দ্রুত বেগে। মহুয়া ভাবী আমার পেছন পেছন আসেন নাক টানতে টানতে, আমি দরজা খুলে বেরিয়ে আসি, পেছনে তিনি ছিটকিনি টেনে দেন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি দরজার সামনে, শুনতে পাই, ভেতরে ভাবী আবার কাঁদছেন, সেই কান্নার সাথে গুনগুন করে তাঁর ভেতর থেকে শব্দ আর কথা বেরিয়ে আসছে। কী বলছেন, সেটা শুনতে দেয় না দরজার কপাট। বেরিয়ে আসি শাকের ভাইয়ের নূরজাহান রোডের ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে। পরশু ঈদ, ছোটো বড় নানা মাপের গরু-খাসিতে গমগম করছে মোহাম্মদপুর এলাকা, একটু পর পর রাস্তার ওপরই ছোট্টো জটলা। লোকজনের গ্যারেজ থেকে মাঝে মধ্যে গম্ভীর হাঁক দিচ্ছে একাধিক গরু, আরো গরুর গলার দড়ি ধরে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বাড়ি ফিরছে শ্রান্ত কিন্তু উৎফুল্ল মানুষ। কে একজন জিজ্ঞেস করে, "ভাই কত নিলো?" আরেকটা কণ্ঠস্বর জবাব দেয়, "ষাইট হাজার!" পাশ দিয়ে চলতে চলতে নিচু স্বরে একজন বলে, "ঠকছে রে ঠকছে!" কয়েক হাজার বছর আগে, ইবরাহিমের ছুরির নিচে একটা ভেড়া পাঠিয়েছিলেন ঈশ্বর।
false
ij
লালন একবার বলেছিলেন_ এ দেশেতে এই সুখ হলো_ আবার কোথা যাই না জানি ___ আজ যতই গানের এই ধ্যানী মানুষটি বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের মন জয় করে নিচ্ছেন, ততই প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমনের শিকার হচ্ছেন! ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলেরা যেদিন লাঠিসোটা নিয়ে বাউল-ভাস্কর্য ভাঙ্গতে গেল- সেদিন প্রায় সারাদিনই লালনের এই গানটা আমার খুব মনে পড়েছিল- এ দেশেতে এই সুখ হলো, আবার কোথা যাই না জানি। গানটা কবে লিখেছিলেন লালন? কোন্ বিপর্যয়কর অবস্থায় লিখেছিলেন? কেন তাঁর দেশত্যাগের ইচ্ছে হয়েছিল? কারা তাঁকে মানসিক যন্ত্রনা দিয়েছিল? মূলস্রোতের নয়- বরং, ইসলামের এক বিশেষ ব্যাখ্যার বা মতবাদের অনুসারী ছিলেন লালন; যে কারণে সারাজীবনই মূলস্রোতের বিরাগভাজন হয়ে ছিলেন । নিরাকারের বদলে ভিতরের ঈশ্বররুপ সহজ মানুষ ভজতে বলেছিলেন লালন -মূলস্রোতবাদীরা বিরাগভাজন তো হবেই। ভজ মানুষের চরণদুটি নিত্য বস্তু হবে খাঁটি। এসব কথার কোনও মানে হয়! শুনি মলে পাব বেহেস্তখানা তা শুনে তো মন মানে না। এসব কথার কোনও মানে হয়! এসব গানের গূঢ় সৌন্দর্য তৎকালীন মূলস্রোতের মহাজনের বোঝেনি। বোঝার কথাও নয় শিল্পবিরোধীদে।প্রমান আছে-তৎকালীন একজন মৌলভি এই মন্তব্য করেছিল-গান হিসেবে লালনগীতি নাকি উচ্চাঙ্গের নয়। কাজেই- লালনও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন সমানে। গেয়েছিলেন- শোনায়ে লোভের বুলি, কেউ নেবে না কাঁধের ঝুলি। কিংবা বিশ্বাসীদের দেখাশোনা করে লালন এ ভূবনে ... এর মানে: তোমরা যে এত ধর্ম ধর্ম কর ...দেখব কতটুকু বিশ্বাস কর। লালনকে তাই গোঁড়াদের এত ভয়। বিশ্বাসের কথা বলে যে সব সময় বিশ্বাস-এর স্থির থাকা যায় না - ঘোর বিশ্বাসীরা সেটা ভালো করেই জানে । কাজেই, তাদের নামাজ আর "পারসোনাল মিরাজ" হয়ে ওঠে না। কাজেই, যে ধর্ম প্রচার করতে হয় অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে - সে ধর্ম প্রচারের জন্য মাঝে মাঝে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর সাহায্য দরকার হয়! আর লালন দূর থেকে বলেন- বিশ্বাসীদের দেখাশোনা করে লালন এ ভূবনে ... লালনভক্তরাও আজও তাই করছেন। করবেন। তখন বলছিলাম যে-লালন ইসলামের এক বিশেষ ব্যাখ্যার বা মতবাদের অনুসারী ছিলেন ; তাঁর পূর্বপুরুষ; সেই মহাত্মা সুফিরা মুগল সম্রাটদের ভোগবাদের তীব্র বিরোধীতা করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী: সেই শুদ্ধত্মাদের বন্য হাতির পায়ে নিচে পিষে পিষে মেরে ফেলা হয়েছিল! মাঝে মাঝে এমন সময়ও আসে। যখন লালনকে লিখতে হয়- এ দেশেতে এই সুখ হলো, আবার কোথা যাই না জানি। গানটা কবে লিখেছিলেন লালন? কোন্ বিপর্যয়কর অবস্থায় লিখেছিলেন? কেন তাঁর দেশত্যাগের ইচ্ছে হয়েছিল? কারা তাঁকে মানসিক যন্ত্রনা দিয়েছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজ আমাদের জানা। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৪৭
false
fe
বুদ্ধিজীবী ঘাতক আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত শুরু একটা শুভ সংবাদ আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই । বুদ্ধিজীবি হত্যার অন্যতম নায়ক ( মালানা ) আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত শুরু হয়েছে। এই দাবীটি অভিবাসী বাঙালীরা দীর্ঘদিন থেকে জানিয়ে আসছিলেন। অবশেষে তা শুরু হয়েছে। অন্য আরেক ঘাতক মঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধেও তদন্তের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মঈনুদ্দীন ও বর্তমানে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছে। --------------------------------------------------------------- রিপোর্ট - দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ৮ নভেম্বর ২০০৯ রোববার Click This Link বুদ্ধিজীবী ঘাতক আশরাফের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত শুরু রোজিনা ইসলাম ------------------------------------------------------ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অন্যতম নায়ক, আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন ভঙ্গের অভিযোগ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ক্রিমিনাল ডিভিশন বলছে, আশরাফুজ্জামান খান যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করেছিল তখন সে তার আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি গোপন করেছিল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ করার সময়ও বিষয়টি গোপন করা হয়েছিল। আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে পাওয়া এসব অভিযোগের তদন্তের স্বার্থে ও সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তার সম্পর্কে আরও যেসব তথ্য ও প্রমাণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে রয়েছে তা দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে এ অনুরোধ জানানো হয়। অপরাধ শাখার বিশেষ তদন্ত অফিসের পরিচালক এলি এম. রোজেনবাম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুকে এ অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন সেপ্টেম্বরে। সরকার এ অনুরোধে সাড়া দিতে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সংগ্রহ করছে। এলি রোজেনবামের চিঠিতে লেখা হয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মোহাম্মদ আশারাফুজ্জামান খান ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আশরাফুজ্জামান খান ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সদস্য এবং আলবদর বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সদস্য। আশরাফুজ্জামান আলবদর বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এই বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সরাসরি হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। চিঠিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আশরাফুজ্জামান খান এবং তার বাহিনী মিরপুরে মুনীর চৌধুরী, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, রাশিদুল হাসান, ড. ফায়জুল মহি এবং ড. মোহাম্মদ মর্তুজাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করে। আলবদর বাহিনী পূর্বদেশ'র সম্পাদক সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে তার এসব কাজের জন্য ১৯৯৭ সালের গত ২৪ সেপ্টেম্বর আশরাফুজ্জামানের নামে রমনা থানায় মামলা (নং-১১৫/১৯৯৭) করা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি (ডবিস্নউসিএফএফসি) তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে। চিঠিতে বলা হয়, 'জেনোসাইড '৭১ এন্ড একাউন্ট অফ দি কিলারস এন্ড কলাবরেটরস এবং সাউথ এশিয়া ট্রাইবুনাল (নং-২৩,৩০ ডিসেম্বর ২০০২) উল্লেখ আছে, ১৯৭১ সালের শেষ দিকে যুদ্ধাপরাধী আশরাফুজ্জামান খানের বাড়ি থেকে পাওয়া তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জনের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীর নাম লেখা ছিল। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালে হত্যা করা হয়েছে এমন বুদ্ধিজীবী এবং পরবর্তী সময়ে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি অর্থাৎ গুম করা হয়েছিল তাদের নামও ডায়েরিতে লেখা ছিল। জেনোসাইড '৭১-এ আরও উল্লেখ আছে, জামায়াতে ইসলামী এসব খুন এবং গুম হয়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়া আশরাফুজ্জামান খানের ড্রাইভার মফিজউদ্দিন সাক্ষী দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ অধ্যাপক হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল আশরাফুজ্জামান খান। চিঠিতে আশরাফুজ্জামানের তদন্ত ও অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ১৯৭১ সালে খানের যেসব কর্মকা- সম্পর্কিত সব নথিপত্র ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি রয়েছে তা দিয়ে সহায়তা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ থেকে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে সেগুলো হলো_ বাংলাদেশ থেকে পালানোর সময় যে ডায়েরিটি আশরাফুজ্জমান খান তার ৩৫০নং নাখালপাড়ার বাসায় ফেলে গিয়েছিল সে ডায়েরিটি, পূর্বদেশ সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদককে অপহরণের ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অথবা অন্যান্য মূল দলিল, আশারাফুজ্জামান খানের ড্রাইভার মফিজউদ্দিনের দেয়া জিজ্ঞাসাবাদ বা ভাষ্যের কপি, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, ডবিস্নউসিএফএফসি'র ২০০৮ সালের ৩ এপ্রিল প্রকাশিত ১ হাজার ৫৯৭ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা, ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আশরাফুজ্জামানের নামে রমনা থানায় মামলার রেকর্ড ও তথ্যাদি। এছাড়া আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কাছে যেসব তথ্য-প্রমাণ বা যেসব রেকর্ড রয়েছে তাও চাওয়া হয়েছে। যুুক্তরাষ্ট্র সরকার এসব তথ্য ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও কপি যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাসের আঞ্চলিক আইন কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের ব্যাপারে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র হার্ভি সারনোবিৎজ গতকাল 'সংবাদ'কে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সব সময় বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সহায়তা করে আসছে। এ উদ্যোগ তারই ধারাবাহিকতা। উল্লেখ্য, গত ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান অঙ্গীকারের একটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। মহাজোট সরকার গঠনের পর এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়। এর মধ্য দিয়েই নতুন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। বিচারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানরত যুদ্ধপরাধীদের খুঁজে বের করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়। সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ ভোর ৬:৩২
false
rg
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর_ সম্পর্কের নতুন দিগন্তে দুই দেশ !! দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর (১৯৮৬ সালের পর) চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করলেন। 'ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতির আলোকে চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২২ ঘণ্টার জন্য (১৪-১৫ অক্টোবর ২০১৬) বাংলাদেশ সফর করলেন। নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ২০১৩ সালে এই উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো বিনিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারী পর্যায়ে ২৭ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেসরকারী পর্যায়েও ১৩ টি চুক্তি হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের ও চীনের মধ্যে এখনো ৮৮৫ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে যে বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতির বিদ্যমান, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের পর এক্ষেত্রে খুব দ্রুত বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে বেশ ইতিবাচক ফলাফল পাবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। যা আমাদের বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতা-সক্ষম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করতে সহায়ক হবে। চীনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই রপ্তানিমুখী।তবে চীনে সরাসরি রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা রুলস অফ অরিজিন বা উৎপাদন দেশ হিসেবে স্বীকৃতির সমস্যা। বর্তমান নিয়মে চীন পণ্যের মোট ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হলে তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এটিকে কমিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ২৫ শতাংশ করার অনুরোধ করেছে। পাশাপাশি চীনের বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদনের বিষয়েও বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, চীনের ব্র্যান্ডেড পণ্য যদি তারা বাংলাদেশে উৎপাদন করে এবং সেটি আমরা চীন, ভারত এবং বিশ্বের যে ৩৯ টা দেশে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই সেখানে পাঠাতে পারি, তাহলে এটা আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সহায়ক হবে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। যদিও এসব পণ্যের খুব কমই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ দিতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। যার বেশিরভাগই অবকাঠামো খাতে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের এই বিপুল সহযোগিতা ঠিকমত বাস্তবায়ন হলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অবশ্যই কমে আসবে। তবে চীন বাংলাদেশকে কি সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেখানে কি কি শর্ত দিচ্ছে, সেসব প্রকিউরমেন্টের নীতি বা রিপেমেন্ট পিরিয়ড কেমন, এসব বিষয় এবং চুক্তিগুলো বাংলাদেশে কীভাবে কতটা সময়ের মধ্যে সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে, তার উপর সেই সুফল পুরোপুরি নির্ভর করবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এই সফরকে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, চীন বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। ৮০ সদস্যের যে সরকারি প্রতিনিধিদল নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসেছিলেন, সেই দলে ছিলেন চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছাড়াও কয়েকজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী ও একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য ওয়াং হুনিং, পলিটিক্যাল ব্যুরোর আরেক সদস্য লি ঝানসু, স্টেট কাউন্সিলর ইয়ং জেইছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনমন্ত্রী জু শাওশি, অর্থমন্ত্রী লোও জিউই, বাণিজ্যমন্ত্রী গাও হুচ্যাঙ্গ, মন্ত্রী পর্যায়ের আর্থিক ও অর্থনৈতিক অফিসের পরিচালক লিউ হি, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রধান ডিং জুইক্সিন, ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিমিংকিয়াঙ্গ, জাতীয় নিরাপত্তা ব্যুরোর মহাপরিচালক ওয়াং সাউজুন এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জুয়াইউ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে নিজের উদ্যোগে গঠিত বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের যোগদানের লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তির ফলে চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও ভারতের মধ্যে মেরিটাইম সিল্ক রোডে যোগদান করল বাংলাদেশ।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর দু’দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যার মধ্যে ১২টি ঋণ ও অবকাঠামো চুক্তি, বাকিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক। যেসব খাতে এসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ব্লু ইকোনমি, বিসিআইএম-ইসি, সড়ক ও সেতু, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ, মেরিটাইম, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প উন্নয়ন, সামর্থ্য বৃদ্ধি ও সিল্ক উন্নয়ন। এছাড়া উভয় দেশের মধ্যে বেসরকারি খাতে ১৩ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া দুই নেতা ছয়টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রকল্পগুলো হলো ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, ২. কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ, ৩. পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৪. চার স্তরের জাতীয় তথ্যভান্ডার, ৫. চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ৬. শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প।চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত উল্লেখযোগ্য সমঝোতা স্মারকগুলো হলো ১. দুর্যোগ মোকাবিলা ও হ্রাসকরণ, ২. সেতু নির্মাণ, ৩. বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা, ৪. বাংলাদেশ-চীন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই, ৫. সামুদ্রিক সহযোগিতা, ৬. দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ৭. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, ৮. জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সহযোগিতা, ৯. ইনফরমেশন সিল্ক রোড, ১০. তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সহযোগিতা এবং ১১. সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা সহযোগিতা। এছাড়া স্বাক্ষর হওয়া দুটি রূপরেখা চুক্তি হলো কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ ও দাশেরকান্দিতে সাগরকেন্দ্রিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এ দুটি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চারটি পৃথক ঋণচুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময় চারটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বক্ষরিত হয়েছে। এগুলো হলো পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, চীনের জন্য বিশেষায়িত অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে প্রশস্তকরণ প্রকল্প, ব্রডকাস্টিং লাইসেন্স প্রটোকল চুক্তি। এ ছাড়া দ্বিস্তরের পাইপলাইন-সমৃদ্ধ পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা এবং ডিপিডিসি এলাকা ও পাঁচটি টেলিভিশন স্টেশনের মধ্যে পাওয়ার সিস্টেম বর্ধিতকরণ চুক্তি।বাংলাদেশে ইতিপূর্বে সাতটি বড় বড় সেতু এবং একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। কিন্তু এবার চীন বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি করেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীন সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে তা আবারো প্রমাণিত হলো। ............................১৫ অক্টোবর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:৩৮
false
hm
গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও মিস্টার অ্যান্ড মিসেস হাফমজুর হত্যা রহস্য ১. ঝাকানাকা থমথমে মুখে গম্ভীর গলায় বললেন, "ক্রাইম সিনের এই দশা কেন?" কিংকু চৌধারি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, "আমার কিছু করার ছিলো না স্যার। ফোন পেয়ে আমরা অকুস্থলে এসে দেখি এই অবস্থা।" ঝাকানাকা ঘরের চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন, "আপনাদের কে ফোন করলো?" কিংকু চৌধারি বললেন, "সাংবাদিক শা ভা মোমেন স্যার।" ঝাকানাকা বললেন, "সে এ খবর কার কাছ থেকে পেলো?" কিংকু চৌধারি মাথা চুলকে বললেন, "কাজের বুয়া সকালে দরজায় টোকা দিতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা ভেড়ানো। সে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে ভেতরে মিস্টার আর মিসেস, দুইজনই মরে পড়ে আছে। রক্তারক্তি কাণ্ড। সে তখন কী করবে বুঝতে না পেরে ড্রাইভারকে জানায়। ড্রাইভার জানায় শা ভা মোমেনকে। শা ভা মোমেন ফোন করে আমাকে।" ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে বললেন, "আপনি এসে কী দেখলেন?" কিংকু চৌধারি গোমড়া মুখে বললেন, "আমি এসে দেখি স্যার গাবতলির গরুর হাটের মতো ভিড়। গোটা শহরের সাংবাদিকরা এই ঘরের মধ্যে স্যার গিজগিজ করছে। বাড়ির সামনে বাদামওয়ালা, চটপটিওয়ালা, চানাচুরওয়ালা, কোল্ড ড্রিঙ্কসের গাড়ির ভিড়। আমি স্যার ভিড়ের চোটে প্রথম দফা ভেতরে ঢুকতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে এক প্লেট চটপটি আর একটা কদবেলকোলা খেলাম। তারপর স্যার বহুকষ্টে ভিড় ঠেলে, দুই দফা একেওকে বেতপেটা করে তারপর স্যার ক্রাইম সিনে পৌঁছাতে পেরেছি।" ঝাকানাকা বিরক্ত হয়ে বললেন, "পৌঁছে কী দেখলেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "সবাই ডেডবডির ছবি তুলছিলো স্যার। ডেডবডির সাথেও অনেকে ছবি তুলেছে। সবাইকেই খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছিলো স্যার। শুধু সিটিয়েন বাংলার লোকেরা একটু মুখ কালো করে ছবি তুলছিলো। বাকি যেসব সাংবাদিক আছে, গাগাণ্ডু টিভি, রেডিও ঝাঞ্জাইল, দৈনিক কচুবন, এই সব কয়টার সাংবাদিকেরাই বেশ ফূর্তিতে ছিলো স্যার। দুই আঙুল উঁচিয়ে ভি দেখিয়ে লাশের সাথে ছবিটবি তুলছিলো তারা। আমি গিয়ে যখন সবাইকে এক দফা ধমক দিলাম, তখন আমার সাথেও অনেকে ছবি তুলেছে স্যার।" ঝাকানাকা বিশাল বিলাসবহুল ঘরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আসবাব পরখ করতে করতে বললেন, "বটে? তা এতো ফূর্তি কেন তাদের?" কিংকু চৌধারি বললেন, "জানি না স্যার। তবে ডেডবডির সাথে ছবি তোলা নিয়ে এক পশলা মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। নিখিল ঢাকা সাংবাদিক অ্যালায়েন্সের সদস্যরা রিপোর্টার্স উইদিন বর্ডার্সের সদস্যদের লাঠিপেটা করেছে।" ঝাকানাকা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, "লাঠিপেটা? তারা লাঠি পেলো কোথায়?" কিংকু চৌধারি মাথা চুলকে বললেন, "য়্যাঁ ... মমমম, মনে হয় ... মানে, তা জানি না স্যার। হয়তো সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিংবা হয়তো এই বাড়িতেই ছিলো?" ঝাকানাকা বললেন, "লাশের সাথে ছবি তোলার জন্যে কোনো ভদ্রলোক মারামারি করে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "না স্যার, ভদ্রলোক ছিলো না ঘরের ভেতরে। সব সাংবাদিক। তারাই বেজায় কেলো করেছে।" ঝাকানাকা গোঁফ চোমড়াতে চোমড়াতে বললেন, "বটে? তা সে ছবি দিয়ে তারা কী করবে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "মনে হয় ফেসবুকে আপ করবে স্যার। ... একটু দাঁড়ান স্যার, চেক করে দেখি।" পকেট থেকে বাহারি স্মার্টফোন বার করে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তিনি বললেন, "হ্যাঁ স্যার, অনেকেই নিজের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে আপ করেছে। কেউ কেউ টাইমলাইনের ব্যানার হিসেবে টাঙিয়েছে।" ঝাকানাকা বললেন, "সাংবাদিকরা আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে নাকি?" কিংকু চৌধারি বললেন, "হ্যাঁ স্যার। গোয়েন্দার চাকরি করলে সাংবাদিকদের সাথে তো একটু খাতির যোগাযোগ রাখতেই হয়। ... ওহ, মিস জয়তুন চুমকি দেখছি আমার সাথে তোলা ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দিয়েছেন, হেঁহেঁহেঁ!" ঝাকানাকা গম্ভীর হয়ে বললেন, "ঘরের জিনিসপত্র হাঁটকেছে কেউ?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, একবার যদি দৃশ্যটা দেখতেন। এই ঘরের ভেতরে সত্তর আশিজন মানুষ, কে কার আগে ডেডবডির সাথে ছবি তুলবে তা নিয়ে তুমুল হইচই শোরগোল কাউমাউ। আলবাত হাঁটকেছে স্যার।" ঝাকানাকা বললেন, "তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, এই যে সবকিছু ওলটপালট লণ্ডভণ্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেটা এই সাংবাদিকদের কাজ?" কিংকু চৌধারি মাথা চুলকে বললেন, "হতে পারে স্যার। আবার এমনও হতে পারে, জিনিসপত্র আগেভাগেই হাঁটকানো ছিলো, সাংবাদিকরা ওর ওপরেই এসে দাপাদাপি করেছে।" ঝাকানাকা এগিয়ে গিয়ে বিশাল বিলাসবহুল মোগলাই নকশার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বললেন, "হুমমমম। খাটের ওপর অনেকগুলো জুতোর দাগ। সাংবাদিকদের কাণ্ড?" কিংকু চৌধারি বললেন, "হ্যাঁ স্যার, অনেকেই খাটে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল।" ঝাকানাকা উল্টে পড়ে থাকা সোফা আর চেয়ার মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, "মনে হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কোনো লাভ হবে না।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কোনোই লাভ নেই স্যার। সবাই সারা ঘরে এটা ওটা হাতড়ে হিজিবিজি করে রেখেছে।" ঝাকানাকা বললেন, "আর কোনো কিছু দেখেছিলেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, কোনোকিছুই ঠিকমতো দেখতে পারিনি তখন। আমি আসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার একটা দাঙ্গা বেঁধে গেলো তো। ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্সের লোকজন হকিস্টিক দিয়ে সিনে সাংবাদিক ইউনিয়নের মেম্বারদের পেটানো শুরু করেছিলো। বড়কর্তাদের ওয়্যারলেসে সব কিছু জানালাম তখন। তারা ১৪৪ ধারা জারি না করলে আজ এখানে ঢুকতেই পারতেন না স্যার।" ঝাকানাকা শিউরে উঠে বললেন, "খুনজখম হলেই পালে পালে সাংবাদিক ক্রাইম সিনে গিয়ে কী করে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার আজকাল খুনের সিন ছাড়া খবর জমে না। রোজই স্যার চারটা পাঁচটা খুন হয়। টিভি চ্যানেলগুলোর খবর তো স্যার টিকেই আছে খুনের সিন দেখিয়ে। আমার ছোটো খালা স্যার এখন খুনের সিন না দেখলে রাতে ভাতই খেতে পারেন না। মুখে রোচে না স্যার। আর খুনের সিন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাভার করতে না পারলে পাবলিক খুব চোটপাট করে স্যার। সেদিন ঘড়িয়াল টিভি ঘেরাও করেছিলো ঢাকা টিভি দর্শক ঐক্যের লোকজন। ঘড়িয়াল টিভির স্টেশন চিফ নিয়মিত খুনের সিন খবরে দেখানোর অঙ্গীকার করে মুচলেকা দেয়ার পর তারা পিকেটিং বন্ধ করেছে।" ঝাকানাকা বিমর্ষ মুখে বললেন, "হুমমম। পরিস্থিতি খুব খারাপ।" কিংকু চৌধারি বললেন, "খুব খারাপ স্যার। সেদিন এক বিয়ের দাওয়াতে সাংবাদিক নেতারা আমাদের শাসিয়েছেন। খুন জখম কমে গেলেই তারা আমাদের বকাঝকা করেন। মাঝখানে এক হপ্তা খুব বৃষ্টিবাদল গেছে স্যার, হতভাগা খুনে গুণ্ডাগুলোও মনে হয় বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি। পাবলিক টিভি ছেড়ে খবরে খুনজখম দেখতে না পেয়ে খুব চিল্লাচিল্লি করেছে স্যার।" ঝাকানাকা ঘরের এক প্রান্তে দেয়ালে গাঁথা শেলফে রাখা বিশাল সাউণ্ড সিস্টেমের দিকে তাকিয়ে বললেন, "এটা অন করা আছে দেখি। আপনি যখন প্রথম এলেন, তখন মিউজিক চলছিলো নাকি?" কিংকু চৌধারি হতাশ মুখে বললেন, "খেয়াল করিনি স্যার। মিউজিক চললেও তো শোনার উপায় ছিলো না। কী পরিমাণ হাউকাউ যে হচ্ছিলো, যদি একবার শুনতে পেতেন!" ঝাকানাকা এগিয়ে গিয়ে বোতাম চেপে ট্রে থেকে একটা মিউজিক সিডি বার করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, লাশ দুটো পরীক্ষা করে দেখবেন না?" ঝাকানাকা বললেন, "দেখবো। আপনি এক কাজ করুন, যাদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, তাদের এক জায়গায় জড়ো করুন।" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার আমি এর মধ্যেই কয়েকজনকে টয়লেটে আটক করে রেখেছি।" ঝাকানাকা সিডিটা প্লেয়ারে ঢুকিয়ে একটা হেডফোন তুলে নিয়ে বললেন, "বটে? কারা তারা?" কিংকু চৌধারি বললেন, "কাজের বুয়া, ড্রাইভার, শা ভা মোমেন, বদি ভাই রহমান, সোবহানাল্লাহ কুংফু আর শরিয়তুন্নেসা টাইফুন স্যার।" ঝাকানাকা প্লে বাটনে চাপ দিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে চিন্তিত মুখে বললেন, "হুমমম! তা নিয়ে আসুন এক এক করে সবাইকে।" কিংকু চৌধারি যখন কাজের বুয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, তখন ঝাকানাকা গম্ভীর মুখে ঘরের ভেতর পায়চারি করছেন। কাজের বুয়া হাপুস কেঁদে বললো, "সার সার আমারে ছাইড়া দেন গো সার আমি কিছু করি নাই!" ঝাকানাকা কাজের বুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "আচ্ছা, ছেড়ে দেয়া হবে তোমাকে। কী নাম তোমার?" কাজের বুয়া আঁচলে চোখ মুছে বললো, "হানুফা খাতুন।" ঝাকানাকা বললেন, "হানুফা খাতুন, তুমি বিস্তারিত ঘটনা আমাদের খুলে বলো।" হানুফার বর্ণনা থেকে জানা গেলো, সে রাত বারোটার দিকে টিভিতে লেট নাইট টক শো লাখ কথার এক কথা দেখে ঘুমিয়ে পড়ে। লাখ কথার এক কথা সে নিয়মিত দেখে, কখনো মিস করে না। হানুফা লেখাপড়া তেমন জানে না, তবে লাখ কথার এক কথা দেখে সে দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছে। ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নিজামরুল লাখ কথার এক কথার নিয়মিত কথোয়াড়। হানুফা মনে করে, একাত্তর সালে দালালি খুনখারাপির জন্য রাজাকারদের বিচার হচ্ছে, এটা খুব খারাপ। কেন খারাপ, তা সে জানে না, তবে আসিফ নিজামরুল যখন বলেছেন খারাপ, তখন নিশ্চয়ই খারাপ। হানুফার ঘুম সাধারণত ভাঙে সকাল সাতটার দিকে। আজ তার ঘুম কিছুটা আগেই ভেঙে যায়। সে দুঃস্বপ্ন দেখছিলো, সে কারণেই সম্ভবত তার ঘুম আগে ভাঙে। স্বপ্নে সে দেখে, অধ্যাপক আসিফ নিজামরুল একটা সবুজ লুঙ্গি পরে টিভিতে দৌড়াদৌড়ি করছেন আর চিৎকার করছেন, "আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না! আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না!" ঘুম ভাঙার পর হানুফা আত্তাহিয়াতু দোয়া পড়ে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তখন তার মনে হয়, দোতলায় কোনো একটা ধস্তাধস্তি হচ্ছে। সাহেব আর বিবিসাহেবের ঘর থেকে প্রায়ই বিচিত্র সব আওয়াজ আসে, তাই সে পাত্তা না দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে, আটটার সময়। সে উঠে হুড়াহুড়ি করে নাস্তা বানায়, চা বানায়, তারপর কারো পাত্তা না পেয়ে দোতলায় শোবার ঘরে টোকা দিতে গিয়ে দেখে দরজা ভেড়ানো শুধু। সে তখন কাশি দিয়ে ডাক দেয়। কিন্তু সাহেব বা বিবিসাহেব, কারোই সাড়া মেলে না। কৌতূহলী হয়ে সে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে, মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে দুজনই। বিবিসাহেবের সারা গায়ে রক্ত। ঝাকানাকা পুরো বক্তব্য মন দিয়ে শুনে হানুফাকে বললেন, "ঘরের ভিতরে কি জিনিসপত্র এরকম উল্টোপাল্টা ছিলো?" হানুফা ঘরের ভেতরটা পুরোটা দেখে মাথা নাড়লো, "না সার। সবকিছু ঠিক ছিল। এইটা সাম্বাদিগ সাহেবদের কাম। তারা আইসা অনেক উলটপালট করছেন।" ঝাকানাকা বললেন, "আচ্ছা। হুমমমম। তা তুমি যখন ঘরে ঢুকলে, তখন কি কোনো গানবাজনার আওয়াজ পেয়েছিলে?" হানুফা বললো, "না সার। আমি ঘুম থেইকা উঠার পর কোনও আওয়াজই পাই নাই। সব চুপচাপ আছিল।" ঝাকানাকা বললেন, "হুমমমমম। আচ্ছা, ঠিকাছে। হানুফা তুমি যাও, বিশ্রাম নাও, খাওয়াদাওয়া করো। কিংকু সাহেব, একে আর পাকড়াও করে রাখার দরকার নেই। আপনি বরং ড্রাইভারকে নিয়ে আসুন।" কিংকু চৌধারি যখন ড্রাইভারকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকলেন, ঝাকানাকা তখন আতশ কাঁচ দিয়ে একটা কাঠের টুকরো পরীক্ষা করছিলেন। ড্রাইভার ফ্যাকাশে মুখে বললো, "স্যার আল্লার কিরা আমি কিচ্ছু জানি না। হানুফাবু আমারে ডাইকা আইনা লাশ দেখাইছে স্যার। আমি কিচ্ছু জানি না।" ঝাকানাকা ড্রাইভারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "টেনশন করো না। নাম কী তোমার?" ড্রাইভার গেঞ্জি তুলে চোখ মুছে বললো, "হাফিজ।" ঝাকানাকা আতশ কাঁচ দিয়ে একটা ধাতব তার পরীক্ষা করতে করতে বললেন, "বলো হাফিজ, তুমি কী দেখেছো?" হাফিজের বক্তব্য থেকে জানা গেলো, সে এ বাড়িতেই থাকে। গ্যারেজের লাগোয়াই তার ঘর। রাতে সে হাফমজুর রহমানকে হোটেল মৌতাত থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে রাত দেড়টার দিকে। সাহেব তখন মদের ঘোরে প্রায় বেহুঁশ। হ্যাঁ, তিনি প্রায়ই হোটেল মৌতাতে গিয়ে মদ্যপান করতেন। তারপর তাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে বাড়িতে আনতে হতো। তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে হাফিজ কিছুক্ষণ গভীর রাতের টক শো "শুনতে হবে" দেখে। হাফিজ শুনতে হবে নিয়মিত দেখার চেষ্টা করে। তার ডিউটি গভীর রাতে শেষ হয় বলে এই একটামাত্র টক শো-ই সে দেখার সুযোগ পায়। সমাজ গবেষক নুরুল কাপুর তার প্রিয় বক্তা। হাফিজ মনে করে, একাত্তরের রাজাকারদের বিচার ঠিকমতো হচ্ছে না। তাদের বেকসুর খালাস দিলেই একমাত্র সুবিচার সম্ভব। কেন, এতো কিছু হাফিজ জানে না। নুরুল কাপুর যখন বলেছেন সুবিচার হচ্ছে না, তখন হচ্ছে না। শুনতে হবে দেখা শেষ করে হাফিজ ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের দিকে দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নে সে দেখতে পায়, নুরুল কাপুর একটা সবুজ লুঙ্গি পরে টিভিতে চিৎকার করছেন, "আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না! আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না!" হাফিজ জেগে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে উল্টো কাতে শুয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। তার একবার মনে হয়েছিলো, দোতলায় ধস্তাধস্তির আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু সে বেশি পাত্তা দেয়নি। ওরকম আওয়াজ প্রায়ই হয়। কিন্তু তার ঘুম ঠিকমতো জমাট হওয়ার আগেই হানুফাবু চিৎকার করতে করতে তার দরজায় ধাক্কা দেয়। সে কোনোমতে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে দোতলায় গিয়ে দেখে, সাহেব আর মেমসাহেব মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছেন। মেমসাহেবের সারা গায়ে রক্ত। এরপর সে মোবাইল থেকে শা ভা মোমেন সাহেবকে ফোন করে। ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে হাফিজকে আপাদমস্তক দেখেন একবার, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, "তুমি যখন এ ঘরে ঢুকলে, তখন জিনিসপত্র কি এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো?" হাফিজ এক নজর চারপাশ দেখে নিয়ে বললো, "না স্যার! এইতান সাম্বাদিগগো কাম!" ঝাকানাকা কিছুক্ষণ পায়চারি করে বললেন, "আচ্ছা হাফিজ। তুমি যাও। বিশ্রাম নাও। তোমার কোনো ভয় নাই। কিংকু সাহেব, ওকে আর আটক করার দরকার নেই।" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, একে আর হানুফাকে এক দফা করে পিটিয়ে রাখি? এরা দুইজন ষড়যন্ত্র করে হাফমজুর আর ভিভা ম্যাডামকে কোতল করতে পারে!" ঝাকানাকা বললেন, "নাহ, পেটানোর দরকার নেই। চোখে চোখে রাখলেই হবে। আপনি বরং শা ভা মোমেনকে নিয়ে আসুন।" কিংকু চৌধারি হাফিজের পেছনে বেতের একটা মাঝারি বাড়ি দিয়ে বললেন, "নিচে যাও। এক ডাক দিলেই যেন তোমাকে পাওয়া যায়। বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ধরে ক্রসফায়ারে দিবো। নয়তো ফাঁসি।" হাফিজ পড়িমড়ি করে পালালো। ঝাকানাকা ঝুঁকে পড়ে ভিভা রহমানের রক্তাক্ত মৃতদেহ পরীক্ষা করতে লাগলেন। শা ভা মোমেন কিছুক্ষণ পর কিংকু চৌধারির সাথে ঘরে ঢুকলেন। ঝাকানাকা ভয়ানক ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আসুন জনাব শা ভা মোমেন! এ কী ... আপনার হাতে রক্ত কেন?" শা ভা মোমেন আঙুলের গাঁটে ফুঁ দিতে দিতে বললেন, "আপনার এই গুণ্ডা পুলিশ অফিসার আমাকে সোবহানাল্লাহ কুংফুর সাথে একটা চিপা টয়লেটের ভিতরে কয়েক ঘন্টা ধরে আটকে রেখেছে! আমি এর বিচার চাই!" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, এই মোমেন সাংবাদিকের সাথে কুংফু লোকটার পুরোনো শত্রুতা আছে। টয়লেটে দুইজন অনেক মারপিট করেছে স্যার!" শা ভা মোমেন চোখ গরম করে বললেন, "আমি আপনাকে শুরুতেই বললাম, আমাকে আটকে রাখতে হয় তো মাস্টার বেডরুমের টয়লেটে নিয়ে আটকে রাখুন! আপনি শুনলেন না!" কিংকু চৌধারি বললেন, "এহ, সব টয়লেট ভর্তি করে রাখলে বিপদে আপদে আমরা কোথায় যাবো?" শা ভা মোমেন বললেন, "নিচতলায় হানুফার টয়লেটেই তো যেতে পারতেন!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনার দেখছি এই বাড়ির টয়লেট সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা জনাব শা ভা মোমেন! আপনি প্রায়ই আসেন নাকি?" শা ভা মোমেন থতমত খেয়ে বললেন, "তা তো আসতে হয়ই। বসের বাড়ি। মাঝেমধ্যেই আসতে হয়।" ঝাকানাকা পায়চারি করতে করতে বললেন, "যা জানেন, খুলে বলুন। কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। করলেই প্যাঁদাবো।" শা ভা মোমেন ঢোঁক গিলে বললেন, "আমি ... আমি কী জানবো বলুন? আমি চাকরি করি, বেতন পাই, বাস।" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? আজকের ঘটনা খুলে বলুন। কখন কীভাবে কী জানলেন, সঅব।" শা ভা মোমেনের বক্তব্য থেকে জানা গেলো, গত রাতে তিনি হোটেল মৌতাতে হাফমজুর রহমানের সঙ্গে রাত একটা পর্যন্ত ছিলেন। না, শা ভা মোমেন মদ্যপান করেন না, তিনি এক বোতল কদবেলকোলা নিয়ে হাফমজুরকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। হোটেল মৌতাতে মদের সঙ্গে উন্নতমানের বাদামের চাঁট পরিবেশন করা হয়, তিনি সেটা খেতে পছন্দ করেন। হাফমজুর মদ খেতে খেতে পুরো হয়রান হয়ে পড়ার পর তিনি মোবাইলে হাফিজকে ভেতরে আসতে বলেন। তারপর দুজন মিলে হাফমজুরকে চ্যাংদোলা করে তুলে হোটেলের বাইরে বার করে গাড়িতে তুলে দেন। শা ভা মোমেন সখেদে বলেন, হাফমজুর লোকটা কী খায় কে জানে। তার ওজন কোরবানির গরুর মতো। গাবতলি থেকে গরু হাঁটিয়ে গ্রিন রোডে আনতে গেলে যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়, তার সমান পরিশ্রম হয় তাকে হোটেল থেকে বার করে গাড়িতে তুলতে। শা ভা মোমেন প্রায়ই ভাবেন, তিনি শুকনাপাতলা কোনো বস বেছে চাকরি পাল্টে চলে যাবেন সিটিয়েন বাংলা ছেড়ে। কিন্তু সেরকম বস পাওয়া খুব মুশকিল। অন্যান্য টিভি চ্যানেলের মালিকগুলিও হাফমজুরের মতোই ওজনদার। বাড়ি ফিরে শা ভা মোমেন ঘুমিয়ে পড়েন। না, রাত জেগে টক শো দেখার অভ্যাস তার নেই। সকালে মোবাইলে হাফিজের কল পেয়ে তার ঘুম ভাঙে। তিনি ব্যাপারটা জেনে নিয়ে সরাসরি কিংকু চৌধারিকে ফোন দেন। তারপর চলে আসেন এই বাড়িতে। এসে দেখেন বিপুল ভিড়। সব টিভি, রেডিও আর কাগজের লোক জড়ো হয়ে গেছে। পুলিশ ভিড় সামলানোর বদলে চানাচুরওয়ালা আর কোল্ড ড্রিঙ্কসওয়ালার গাড়ি থেকে চাঁদা তুলছে। কিংকু চৌধারিও চটপটি আর কদবেলকোলা খাচ্ছিলেন। চটপটিওয়ালা তার কাছে গোপনে বিচার দিয়েছে, কিংকু চৌধারি পয়সা দেননি। কিংকু চৌধারি ভয়ানক চটে গিয়ে বললেন, "আপনারা, এই সাম্বাদিগগুলি সবসময় তালে থাকেন আমাদের নামে উল্টাপাল্টা স্টোরি করার!" শা ভা মোমেন নাক টেনে বললেন, "আমরা সত্যকে তুলে ধরি শুধু।" ঝাকানাকা কিংকু চৌধারিকে আড়চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বললেন, "আপনি যখন এই ঘরে এলেন, তখন কী দেখতে পেলেন?" শা ভা মোমেন কপাল টিপে ধরে বললেন, "ভয়ঙ্কর দৃশ্য! বর্ণনা করা কঠিন! আমার সাংবাদিক জীবনে আমি বহু ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু এমন দৃশ্য আর দেখি নাই!" কিংকু চৌধারি গজগজ করতে লাগলেন, "যত্তোসব ফালতু নিউজ করে!" ঝাকানাকা দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, "কী দৃশ্য?" শা ভা মোমেন বললেন, "আমি দেখলাম, হাফমজুর ভাইয়ের ডেডবডির সাথে ছবি তোলার জন্য সব সাংবাদিক কিলাকিলি করছে! ছোটো বড় নারী পুরুষ হিন্দু মুসলিম ঢালী পার্টি চুন্নু পার্টি কোনো ভেদাভেদ নাই! গাগাণ্ডু টিভির নূরজাহান নানচাকুকে দেখলাম দৈনিক কচুবনের নিখিল মন্তাজকে চুল ধরে মারছে! সাংবাদিক মহাসমাজের সভাপতি ঐ ব্যাটা সোবহানাল্লাহ কুংফুকে দেখলাম রেডিও ঝাঞ্জাইলের গুলবদন পিঙ্কির সাথে লাঠালাঠি করতে। চারিদিকে আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা! এমন দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখিনি! ঐ পরিবেশে একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে হাফমজুর ভাইয়ের ডেডবডির পাশে গিয়ে ছবি তোলার কোনো সুযোগই ছিলো না। আমি তখন চিৎকার করে বললাম, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা একজন একজন করে ছবি তোলেন। যারা সিনিয়র, তাদের আগে ছবি তুলতে দিন। যারা জুনিয়র, তারা পরে আসুন। আমরা জাতির বিবেক, আমাদের পক্ষে নিজেদের মধ্যে এই মারপিট, এই লড়াই, এই সংঘর্ষ মানায় না। হে তরুণ এসো সত্যের কাফিলায়। ... এই কথা বলার পর সোবহানাল্লাহ কুংফু পিঙ্কির সাথে লাঠালাঠি বাদ দিয়ে আমাকে পিটানো শুরু করলো!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি কি ঘরে ঢুকে কোনো মিউজিক শুনতে পেয়েছিলেন?" শা ভা মোমেন থতমত খেয়ে বললেন, "মিউজিক? না কোনো মিউজিক তো শুনিনি। আর তখন যে শোরগোল হচ্ছিলো, তাতে মিউজিকের বাবারও সাধ্য নেই বাজার। হইচই চেঁচামেচি মারপিট ... প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে লড়াই করতে হয়েছে সোবহানাল্লাহ কুংফুর সাথে। মিউজিক বাজলেও আমার খেয়াল নেই।" ঝাকানাকা ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বললেন, "আপনার কী মনে হয়, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস হাফমজুরকে কে খুন করতে পারে?" শা ভা মোমেন গলা খাঁকরে বললেন, "আমি তো এতোকিছু জানি না গোয়েন্দা সাহেব। আমি চাকরি করি, বেতন পাই।" ঝাকানাকা চোখ পাকিয়ে বললেন, "বললেই হোলো? হাফমজুর আর ভিভার মতো দুইজন নামিদামি মানুষকে মারার জন্য একটা মোটিভ তো থাকতে হবে। কী সেই মোটিভ? এরা কাদের পাকা ধানে মই দিয়েছিলো? যা জানেন শিগগীর বলুন!" শা ভা মোমেন গলা খাকরে নিচু গলায় কিংকু চৌধারিকে বললেন, "ঝাকানাকা সাহেব টিভি খুব একটা দেখেন না মনে হয়?" কিংকু চৌধারি বললেন, "ওনার বাড়িতে সিটিয়েন বাংলা চ্যানেলটা ব্লক করা।" শা ভা মোমেন বললেন, "আহ, তাই তো বলি। ... না মানে, মোটিভ আর কী। ধরেন, দেশের মানুষ ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে। তারা সামান্যতেই ক্ষেপে ওঠে। মুখের কথায় যেখানে কাজ হওয়ার কথা, সেখানে কামান দাগে। এ-ই আর কী।" ঝাকানাকা বললেন, "কিছুই তো বুঝলাম না। এক এক করে বলুন। হাফমজুর কার পাকা ধানে মই দিয়েছিলো?" শা ভা মোমেন গলা নামিয়ে বললেন, "হাফমজুর ভাইয়ের কথা আমি বিস্তারিত জানি না। কিন্তু ভিভা ম্যাডামের ওপর অনেক লোক খুব ক্ষ্যাপা।" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? কারা তারা?" শা ভা মোমেন বললেন, "দুইটা কান আছে এমন যে কোনো লোককেই আপনি সন্দেহ করতে পারেন। তার সাথে যদি দুইটা চোখও তাদের থাকে, তাহলে ধরুন গিয়ে সন্দেহ আরো গাঢ় হতে পারে!" ঝাকানাকা বললেন, "আচ্ছা। হুমমম। বেশ। তা সম্প্রতি হাফমজুর বা ভিভাকে নিয়ে অস্বাভাবিক কোনো কিছু কি আপনার নজরে এসেছে?" শা ভা মোমেন গলা নামিয়ে বললেন, "হাফমজুর ভাইয়ের সাথে ভিভা ম্যাডামের কোনো কিছু নিয়ে গণ্ডগোল চলছিলো সম্ভবত। আমি একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে শুনলাম, উনি ভিভা ম্যাডামকে ফোনে ধমকাচ্ছেন।" ঝাকানাকা সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, "কী নিয়ে ধমকাচ্ছিলো?" শা ভা মোমেন বললেন, "ইয়ে, তা তো বলতে পারি না। তবে বলছিলেন, "তুমি যদি এইরকম চালিয়ে যাও, আমিও কিন্তু শুরু করে দিবো!" ... কেন এ কথা বললেন, সেটা আপনি চিন্তা করে দেখবেন!" ঝাকানাকা পায়চারি করতে করতে বললেন, "ভিভা রহমানকে এ কথা কেন বললো হাফমজুর? কী চালিয়ে যাওয়ার কথা হচ্ছে এখানে?" শা ভা মোমেন আড়চোখে ঝাকানাকাকে দেখে নিয়ে বললেন, "দেখুন, ভিভা ম্যাডাম অত্যন্ত উচ্ছল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। হাসিখুশি। দিলখোলা। সবাইকে ভালোবাসতেন। শুনেছি তার আয়োজনে বাসায় নিয়মিত আসর বসতো। অনেকে সেই আসরে আসতেন। এইসব ব্যাপারস্যাপার আর কী।" ঝাকানাকা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, "আসর? কীসের আসর?" শা ভা মোমেন চোয়াল ঘষতে ঘষতে বললেন, "গানের আসর, সম্ভবত। উনি খুব গানপাগল ছিলেন, জানেন তো।" ঝাকানাকা গলা খাঁকরে বললেন, "সেই আসর কি হাফমজুর সাহেবের উপস্থিতিতে হতো, নাকি?" শা ভা মোমেন বললেন, "না মনে হয়।" ঝাকানাকা চোখ পাকিয়ে বললেন, "এই যে আপনি নিয়মিত হোটেল মৌতাতে হাফমজুরের সঙ্গে বসে কদবেলকোলা পান করেন, আপনি জানেন না এ নিয়ে কোনো সমস্যা চলছিলো কি না?" শা ভা মোমেন বললেন, "আমি কীভাবে জানবো? উনি মদ খেয়ে ঘুরেফিরে শুধু বদি ভাই রহমানের বদনাম করতেন। ভিভা ম্যাডামের গানের আসর নিয়ে তো কোনো কথা হয়নি।" ঝাকানাকা বললেন, "সে আসরে কে বা কারা আসতো, আপনি জানেন না?" শা ভা মোমেন গলা খাঁকরে বললেন, "একদম না। আমি সাংবাদিক মানুষ। স‌ত্যকে তুলে ধরি। গুজব নিয়ে আমার কোনো কারবার নাই।" ঝাকানাকা চোখ গরম করে শা ভা মোমেনকে এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, "দেয়ালের এই ছবিটা দেখুন। এটা আগে দেখেছেন?" শা ভা মোমেন দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন, "না। এরকম ছবি আমি আগে কখনো দেখিনি। বড় অদ্ভুত!" ঝাকানাকা বিড়বিড় করে বললেন, "আমিও তাই ভাবছিলাম।" শা ভা মোমেন বললেন, "আপনি আমাকে এখন ছেড়ে দিন। আমাকে কয়েক ঘন্টা টয়লেটে আটকে রেখেছেন, আমি টয়লেটে যাওয়ার সুযোগটাও পাইনি। আমাকে রেহাই দিন, আমাকে অফিসে যেতে হবে। ফেসবুকে ছবি আপলোড করা হয়নি ... কত কাজ বাকি!" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, আমাদের নামে চটপটির টাকা মারার মতো জঘন্য নিউজ করার আগেই একে এক রাউন্ড ঠ্যাঙানোর সুযোগ দিন!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি আপাতত এই বাড়িতেই থাকুন। নিচে গিয়ে বসুন। টিভি দেখুন, চা খান। তবে জেরা এখনও শেষ হয়নি। কিংকু সাহেব, আপনি বরং বদি ভাইকে নিয়ে আসুন।" শা ভা মোমেন কিংকু চৌধারির দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে সংলগ্ন টয়লেটে ঢুকে পড়লেন। কিংকু চৌধারি বদি ভাই রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন, ঝাকানাকা আতশ কাঁচ দিয়ে একটা প্লাস্টিকের টুকরো পরীক্ষা করছেন মন দিয়ে। বদি ভাই রহমান গরম হয়ে বললেন, "আপনারা উন্নত বিশ্বের চোখে দেশকে কতটা খাটো করলেন, জানেন? প্রেসের স্বাধীনতার উপর আপনারা আলকাতরার কলঙ্ক লেপে দিয়েছেন! আমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে আপনার এই অসভ্য পুলিশের দল! আমাকে কাপড়টা পর্যন্ত ঠিকমতো পাল্টানোর সময় দেয়নি!" ঝাকানাকা বদি ভাই রহমানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বললেন, "মন্দ কী? গেঞ্জি আর পায়জামা পরে আছেন। আরামদায়ক পোশাক। গেঞ্জিতে এটা কী লেখা? হুমমম? সানডে হোক আর মানডে, রোজ পুনম পান্ডে? এই নেংটো মেয়েটিই বুঝি পুনম পান্ডে? বেশ বেশ।" বদি ভাই গর্জে উঠলেন, "আপনাদের নামে আমি এক মাস টানা স্টোরি করবো দৈনিক কচুবনে। তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল!" ঝাকানাকা বললেন, "কিংকু সাহেব, বদি ভাইকে ঘর থেকে ধরে এনেছেন কেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, এনার সাথে নিহত ভিভা রহমানের গতকাল রাতে দীর্ঘ সময় মোবাইলে কথা হয়েছে। আমরা কল রেকর্ড চেক করে দেখেছি স্যার। ইনি প্রায়ই ভিভার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন!" ঝাকানাকা হাসিমুখে বললেন, "বটে?" বদি ভাই রহমান ঝাঁঝালো গলায় বললেন, "কথা হয়েছে তো কী হয়েছে? কথা বলা কি পাপ? মানুষের সঙ্গে মানুষ কথা বলবে, সারাদিন কথা বলবে। তাই বলে আমাকে বাড়ি থেকে ধরে আনবেন নাকি?" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি কি ভিভা রহমানের গানের আসরে এসেছেন আগে?" বদি ভাই রহমান বললেন, "পাগল নাকি? আমার ঐসব গানবাজনার পেছনে খরচ করার মতো সময় নেই। আমার অনেক কাজ।" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি গতকাল রাতে কোথায় ছিলেন?" বদি ভাই রহমান গলা খাঁকরে বললেন, "এই তো একটু বাইরে ছিলাম। কেন?" ঝাকানাকা চোখ পাকিয়ে বললেন, "সব ভালোয় ভালোয় খুলে বলুন। নয়তো আপনাকে আজ সারাদিন টয়লেটে আটকে রাখা হবে সোবহানাল্লাহ কুংফু আর শা ভা মোমেনের সঙ্গে।" বদি ভাই রহমানের বক্তব্য থেকে জানা গেলো, গতকাল হোটেল মৌতাতে তিনি রাত একটা পর্যন্ত ছিলেন। অল্পস্বল্প মদ্যপান করেছেন। আরো বেশি মদ খাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু ভিভা রহমান ফোন করে ঘ্যানঘ্যান করে তার নেশায় পানি ঢেলে দেয়। হ্যাঁ, হাফমজুর আর শা ভা মোমেনও ছিলো হোটেল মৌতাতে, কাছেই আরেকটা টেবিলে। কিন্তু তাদের সাথে তার কোনো কথা হয়নি। ভিভা রহমান ফোন করেছিলো ফালতু প্যাচাল পাড়তেই। তাকে কেন দৈনিক কচুবনের প্রোগ্রামে গান গাইতে ডাকা হয় না, সেই অভিযোগ। কেন তাকে নিয়ে দৈনিক কচুবনে নিউজ হয় না, সেই অনুযোগ। বিগড়ে যাও বিগড়ে দাও কর্মসূচির ব্র্যান্ড অ্যামবাসেডর হতে চেয়ে অনেক দিন ধরেই ঘ্যানঘ্যান করে আসছিলো ভিভা রহমান। হ্যাঁ, গানের আসরেও সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে অনেকবার। বলেছে, হাফু যখন বাসায় থাকে না, তখন চলে আসবেন বদি ভাই। গান শোনাবো। কিন্তু বদি ভাই রহমান ব্যস্ত মানুষ। ভিভা রহমানের গান শোনার চেয়ে পুনম পান্ডের সাথে ফেসবুকে গল্পগুজব করাই শ্রেয়। ঝাকানাকা বললেন, "আপনি তো সাংবাদিকতার জগতে গভীর জলের অক্টোপাস। আপনার কী মনে হয়, হাফমজুর আর ভিভাকে কে খুন করতে পারে?" বদি ভাই রহমান হাই তুলে বললেন, "আমি করি নাই, এইটুকু জানি। আমি ছাড়া বাংলাদেশে আরো কোটি কোটি লোক আছে। তাদের মধ্যে কে বা কাহারা করে গেছে, সেটা আপনারা খুঁজে বের করুন।" ঝাকানাকা বললেন, "হাফমজুর আর ভিভার মৃত্যুতে কে বা কারা লাভবান হতে পারে জনাব বদি ভাই?" বদি ভাই বললেন, "তা তো জানি না গোয়েন্দা সাহেব। তবে আমি লাভবান হয়েছি, এটা বলতে পারি। আমাকে আর ভিভা রহমানের ফোনের অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। নিরিবিলি একটু মদিরা সেবন করতে পারবো। তারপর ধরেন গিয়ে শা ভা মোমেনও লাভবান হয়েছে, তাকে আর হাফমজুরকে মদের আড্ডায় সঙ্গ দিতে হবে না, সেও নিরিবিলি কদবেলকোলা খেতে পারবে। তারপর ধরেন গিয়ে সোবহানাল্লাহ কুংফু, তারও লাভ হয়েছে, সে দীর্ঘদিন হাফমজুরের সাথে সাংবাদিক সমিতির হালুয়ারুটি ভাগাভাগি নিয়ে কোন্দল করছিলো। শরিয়তুন্নেসা টাইফুনেরও লাভ হয়েছে, উনি বছরের পর বছর ধরে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাঁচাও আন্দোলন করে আসছিলেন।" ঝাকানাকা দেয়ালের ছবিটা দেখিয়ে বললেন, "এই ছবিটা দেখুন তো একবার।" বদি ভাই ছবিটা দেখে চমকে উঠে অস্ফূটে বললেন, "এ কী? এ আবার কেমন ছবি?" ঝাকানাকা বিড়বিড় করে বললেন, "আমিও সেটাই ভাবছিলাম।" বদি ভাই রহমান বললেন, "আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমি এইসব খুনজখমের কিছুই জানি না। আমার মোবাইলটা পর্যন্ত সঙ্গে আনতে দেয়নি আপনার বিটকেল পুলিশ। আজকে পুনম টুইটারে কী টুইট করলো, ফেসবুকে কী স্ট্যাটাস দিলো, কোথায় জামাকাপড় খুললো, কিছুই জানা হলো না! এই সোবহানাল্লাহ কুংফু বদমাশটাকে কত অনুরোধ করলাম, বললাম ভাই আপনার মোবাইলটা আমাকে দশ মিনিটের জন্য ধার দেন, সে দিলোই না! নরাধম আর কাকে বলে!" কিংকু চৌধারি বললেন, "না আজকে জামাকাপড় খোলেনি সে। আমি চেক করেছিলাম একটু আগে। আপনি কিছুই মিস করেননি।" বদি ভাই রহমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, "ওহ, ঠিকাছে তাহলে!" ঝাকানাকা কড়া গলায় বললেন, "আপনি নিচে গিয়ে বসুন। তবে বাড়ি ছেড়ে বেরোবেন না। কিংকু সাহেব, একে চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা করুন।" কিংকু চৌধারি সোৎসাহে বললেন, "স‌্যার, এনার পেছনে বেতপেটা করবো নাকি কয়েক ঘা?" বদি ভাই গর্জে উঠে বললেন, "খবরদার! প্রেসের স্বাধীনতায় টোকা পর্যন্ত দেবেন না!" ঝাকানাকা বললেন, "কিংকু সাহেব, আপনি ওনার প্রেসের স্বাধীনতাকে নিচে নিয়ে বসান, আর সোবহানাল্লাহ কুংফুকে নিয়ে আসুন।" সোবহানাল্লাহ কুংফু যখন ঘরে এলেন, ঝাকানাকা তখন মেঝেতে বসে কয়েকটা ভাঙা চকচকে প্লাস্টিকের টুকরো বিছিয়ে আতশ কাঁচ দিয়ে কী যেন দেখছিলেন। সোবহানাল্লাহ কুংফুর পরনে কুংফুর পায়জামা, হাতে একটা লাঠি। তিনি ঘরে ঢুকেই গর্জে উঠলেন, "এই খুন শা ভা মোমেনের কাজ! তাকে এক্ষণই ফাঁসি দিতে হবে। আমি সাংবাদিক মহাসমাজের হেড অফিসে ফোন করে দিয়েছি, তারা পাটের দড়ি নিয়ে রওনা হয়েছে। দেরি করলে চলবে না ঝাকানাকা সাহেব! ঐ শা ভা মোমেন একটা সমাজবিরোধী নরপশু!" টয়লেট থেকে শা ভা মোমেনের পাল্টা হুঙ্কার ভেসে এলো, "সাবধান কুংফু! চুকলি কেটো না! হাফমজুরের সঙ্গে তোমার গণ্ডগোল আসলে কী নিয়ে, সব ফাঁস করে দেবো কিন্তু!" সোবহানাল্লাহ কুংফু টয়লেটের দরজার সামনে ছুটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, "মানী লোকের মান নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া কোরো না শা ভা! আর একটা কথা বলেছো কি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তোমার চাঁদি ফাটাবো! আর হাগতে বসে এতো কথা কীসের, হ্যাঁ?" শা ভা মোমেনের মুহাহাহা হাসি ভেসে এলো টয়লেট থেকে। "হাফমজুর ভাইয়ের টয়লেট মোগল বাদশার সিংহাসনের মতো রে কুংফু! কী নকশা, কী বাহার! এখানে বসলে শুধু গজল গাইতে ইচ্ছা করে!" সোবহানাল্লাহ কুংফু টয়লেটের আলোর সুইচ বাইরে থেকে নিবিয়ে দিলেন। ভেতর থেকে শা ভা মোমেন গর্জে উঠলেন, "তবে রে কুংফু! ঝাড়বাতিটা নিভিয়ে দিলি কেন রে ছোটোলোক? জলদি জ্বালা, নইলে ভিভা ম্যাডামের সাথে তোর ইটিশপিটিশ দোস্তির কথা বেবাক খুলে বলে দিচ্ছি কিন্তু!" সোবহানাল্লাহ কুংফু টয়লেটের দরজায় কিল মেরে বললেন, "এখন আমার কথা বলার পালা, তুই চুপ থাক বজ্জাত!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনারা কলতলা বন্ধ করুন এখন। জনাব কুংফু, আপনার হাতে লাঠি কেন?" সোবহানাল্লাহ কুংফু বুক ফুলিয়ে বললেন, "সাংবাদিকের অধিকার আদায়ের জন্য, মাই ডিয়ার গোয়েন্দা স্যার!" কিংকু চৌধারি বললেন, "আমার তো ধারণা ছিলো সাংবাদিকের হাতে কলম থাকে!" কুংফু ঠা ঠা করে হেসে বললেন, "ঐসব ইকোনো ডিয়েক্সের যুগ বহুদিন আগেই ফৌত হয়েছে দারোগা সাহেব! যেসব ছোটো বাচ্চা এসএসসি পাশ করে সাংবাদিকতা মাত্র শুরু করেছে, তারা কলম নিয়ে ঘোরে। আমি সাংবাদিক মহাসমাজের সভাপতি, আমাকে লাঠি নিয়েই চলতে হয়। বুড়ো বয়সে কুংফু শিখে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছি, এই যে দেখুন।" ঝাকানাকা বললেন, "আপনাকে সাংবাদিকের অধিকার আদায়ের জন্য লাঠি ধরতে হচ্ছে কাদের বিরুদ্ধে?" সোবহানাল্লাহ কুংফুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তিনি মেঝেতে লাঠি ঠুকে বললেন, "যে অপশক্তি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সাংবাদিকের ওপর হামলা চালাচ্ছে! যে অপশক্তি পদে পদে সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করে দিতে চাইছে! যে অপশক্তি প্রশাসন আর সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে দেশের জনগণের কাছে সত্য প্রকাশ করতে বাধা দিচ্ছে! যে অপশক্তি মরহুম হাফমজুর আর তার গুণবতী স্ত্রী ভিভা রহমানের ডেডবডির সাথে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার খিঁচতে বারণ করছে! যে অপশক্তি ...!" টয়লেট থেকে শা ভা মোমেনের কণ্ঠ ভেসে এলো, "গাধাটা আমার বিরুদ্ধে লাঠি ধরেছে!" সোবহানাল্লাহ কুংফু লাঠিটা দুই পাক ঘুরিয়ে বললেন, "শা ভা মোমেন দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার শত্রু, সাংবাদিকের স্বাধীনতার দুশমন! ওকে ফাঁসি দিন গোয়েন্দা সাহেব! নিচে রাস্তায় দেখলাম কলাওয়ালা বসে বসে কলা বিক্রি করছে। আমি নিজের হাতে পাটের রশি কলা দিয়ে মেজে পিছলা করে দেবো, আপনারা শুধু ওকে লটকে দিন!" কিংকু চৌধারি বললেন, "আপনার লাঠিটার লাইসেন্স আছে তো?" সোবহানাল্লাহ কুংফু সগর্বে বললেন, "নেই আবার?" কুংফু পায়জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা ল্যামিনেট করা কাগজ বার করে আনলেন তিনি। কিংকু চৌধারি লাইসেন্স এক নজর দেখে বললেন, "এটা তো গত পাঁচ বছরে রিনিউ করা হয়নি দেখছি! আপনাকে লাঠি আইনে আটক করে চালান দিতে পারি, জানেন?" সোবহানাল্লাহ কুংফু গর্জে উঠলেন, "প্রেসের স্বাধীনতায় হাত লাগাবেন না দারোগা সাহেব! আপনারা কী করেন না করেন, সবই কিন্তু খোঁজ রাখি আমরা! চটপটিওয়ালা বাবুলের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমরা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আজকে সন্ধ্যার নিউজেই চালিয়ে দেবো, হ্যাঁ!" শা ভা মোমেন টয়লেট থেকে বললেন, "আমার কাছে সোবহানাল্লাহ কুংফুর অবৈধ লাঠিবাজির ফুটেজ আছে কিংকু সাহেব। চটপটি নিয়ে নিউজ করলে আমি সিটিয়েন বাংলার রাতের খবরে কুংফুর ওপর নিউজ করতে পারি।" কিংকু চৌধারি ছুটে গিয়ে টয়লেটের বাতির সুইচ অন করে দিলেন। সোবহানাল্লাহ কুংফু গজগজ করে উঠলেন, "বলেছিলাম না, প্রশাসনের সঙ্গে অশুভ আঁতাত? দেখুন গোয়েন্দা সাহেব, আপনার চোখের সামনেই দেখুন শা ভা মোমেনের কীর্তি! এভাবেই এরা সাংবাদিকতাকে বিপন্ন করে চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর!" ঝাকানাকা বললেন, "এবার বলুন, আপনি এই খুন সম্পর্কে কী জানেন? একেবারে গত রাত থেকে শুরু করুন।" সোবহানাল্লাহ কুংফু জানালেন, গত রাতে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টক শোতে ব্যস্ত ছিলেন। আসিফ নিজামরুলের সাথে লাখ কথার এক কথায় তর্ক বিতর্ক চুলাচুলি করে তার পর আবার শুনতে হবেতে নুরুল কাপুরের সাথে মত বিনিময় ও কিলাকিলি করেছেন। টক শো শেষে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইদানীং টক শোতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, সেজন্যে জিমে নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়, কুংফুর আখড়ায় যেতে হয় সকাল সকাল। সিটিয়েন বাংলা ছাড়া সব চ্যানেলেই তিনি টক শো করে থাকেন। হতভাগা হাফমজুর আর তার ল্যাংবোট শা ভা মোমেনের কারণে সিটিয়েন বাংলায় তিনি অবাঞ্ছিত। সকালে তার মোবাইলে এক সাংবাদিক ফোন করে হাফমজুর আর ভিভার মৃত্যুসংবাদ জানালে তিনি তড়িঘড়ি করে জামা না পাল্টেই কোনোমতে লাঠি আর মোবাইল সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসেন। এসে দেখেন, শা ভা মোমেন অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে ফ্যাসিবাদী আচরণে লিপ্ত। শা ভা মোমেনের ইঙ্গিতে এক চ্যাংড়া সাংবাদিক তার ওপর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে তিনি পাল্টা লাঠি ধরেন। এরপর পুলিশ চলে আসে। তারপর ১৪৪ ধারা জারি করার পর সকলে চলে যায়, কিন্তু ফ্যাসিবাদী শক্তির পেটোয়া বাহিনীর পাণ্ডা এই কিংকু চৌধারি তাকে আরো কয়েকজনের সঙ্গে টয়লেটে আটক করে। সেখানেও শা ভা মোমেন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ চালায়। ঝাকানাকা বললেন, "আপনি যখন এলেন, তখন কি ঘরে কোনো গানবাজনা হচ্ছিলো?" সোবহানাল্লাহ কুংফু অশ্রুগদগদ রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, "গানবাজনা হবে কীভাবে, গানের পাখিই যখন আর নেই আমাদের মাঝে?" শা ভা মোমেনের অট্টহাসি ভেসে এলো টয়লেট থেকে, "গোয়েন্দা সাহেব, ওকে জিজ্ঞাসা করুন, ভিভা ম্যাডামের গানের আসরে সে কী করতো!" কুংফু টয়লেটের দরজার সামনে তেড়ে গিয়ে বললেন, "খবরদার শা ভা, উল্টাপাল্টা কলঙ্ক লেপিস না! ভিভা ম্যাডামের গানের কদর তুই কী করবি রে, অসভ্য কোথাকার? তুই গানের বুঝিস কী?" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি কি নিহত ভিভা রহমানের গানের আসরে কখনো অংশগ্রহণ করেছেন জনাব কুংফু?" সোবহানাল্লাহ কুংফু জামার হাতায় অশ্রু মুছে বললেন, "হ্যাঁ! মাঝেমাঝে আমি তার গানের রেওয়াজে এসে হাজির হতাম বৈকি! অহো, অপূর্ব তার গানের গলা! মধুর সেই সুরলহরী! কিন্নরী তার কাছে তুচ্ছ!" শা ভা মোমেন টয়লেটের ভেতর থেকে কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বললেন, "থ্যাঙ্কিউ কুংফু, থ্যাঙ্কিউ! হচ্ছিলো না অনেকক্ষণ ধরে। আহ!" ঝাকানাকা বললেন, "এই গানের রেওয়াজে আপনি ছাড়া আর কেউ আসতো?" সোবহানাল্লাহ কুংফু থমথমে মুখে বললেন, "আসতে পারে। তবে আমি যখন আসতাম, তখন অন্য কেউ থাকতো না।" কিংকু চৌধারি বললেন, "আপনিও গান করেন নাকি?" সোবহানাল্লাহ কুংফু বললেন, "নাহ। আমি সমঝদার। সঙ্গীতরসিক। শুধু শুনি।" শা ভা মোমেন টয়লেটের ভেতর থেকে বললেন, "হাফমজুর ভাইয়ের সঙ্গে তোমার কী নিয়ে ঝগড়া ছিলো, সেটা বলো না কেন? ... ফ্লাশ করে কোনটা দিয়ে, য়্যাঁ? এখানে দেখি শয়ে শয়ে বোতাম। স্পেস শাটলের কনট্রোল প্যানেলেও তো এতো বোতাম থাকে না রে!" সোবহানাল্লাহ কুংফু বললেন, "একটা গোল লাল বোতাম আছে বাম দিকে, ঐটাতে চাপ দাও, ইডিয়েট! কিচ্ছু জানে না, জংলি কোথাকার!" ঝাকানাকা বললেন, "তা এই গানের আসর কোথায় বসতো?" সোবহানাল্লাহ কুংফু অশ্রুগদগদ রুদ্ধস্বরে বললেন, "এই ঘরেই। এখানেই কখনো মেঝেতে কখনো খাটের ওপর বাঘছাল পেতে তানপুরা হাতে নিয়ে রেওয়াজ করতেন আমাদের গানের পাখি! কতোদিন তন্ময় হয়ে শুয়ে শুয়ে শুনেছি সেই গান! আর আজ ...!" লাঠি বগলে চেপে দুই হাতে মুখ ঢাকলেন তিনি। ঝাকানাকা আড়চোখে কুংফুকে এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, "হুমমমম! আচ্ছা এই যে দেয়ালের এই ছবিটা একটু মন দিয়ে দেখুন তো?" সোবহানাল্লাহ কুংফুর হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলো। তিনি ফিসফিস করে বললেন, "এ কী! এ ছবি তো ... এ ছবি তো এমন ছিলো না আগে!" ঝাকানাকা বিড়বিড় করে বললেন, "আমিও তা-ই ভাবছিলাম।" সোবহানাল্লাহ কুংফু লাঠি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, "আমাকে ছেড়ে দিন আপনারা। আমি নির্দোষ। আমি এসব খুনজখমের কিছুই জানি না, শুধু জানি শা ভা মোমেন এই কাজে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাকে ফাঁসি দিন গোয়েন্দা সাহেব। আমি পাটের দড়ি আর কলা রেডি করছি, আপনারা শুধু লটকে দিন নচ্ছাড়টাকে।" টয়লেট থেকে ফ্লাশের প্রলয়ঙ্কর শব্দ ভেসে এলো। ঝাকানাকা বললেন, "আপনি আপনার বেআইনি লাঠিটা কিংকু সাহেবের জিম্মায় দিয়ে নিচে গিয়ে বসুন। চা খান, বিশ্রাম নিন। কলা-দড়ি আপাতত থাকুক। কিংকু সাহেব, আপনি শরিয়তুন্নেসা টাইফুনকে নিয়ে আসুন।" কিংকু চৌধারি কুংফুর ব্ল্যাকবেল্ট পাকড়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে তাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। শরিয়তুন্নেসা টাইফুন যখন হাজির হলেন, ঝাকানাকা মন দিয়ে হাফমজুরের মৃতদেহ পরীক্ষা করছেন। শরিয়তুন্নেসা টাইফুন গর্জে উঠলেন, "অহহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা! আপনার পুলিশ আমাকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বার করে এই অসভ্য ফ্যামিলির টয়লেটে কতগুলো গুণ্ডাবদমাশের সঙ্গে আটকে রেখেছে! বদি ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, কালই রবীন্দ্র সরোবরে আপনাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করছি দাঁড়ান!" ঝাকানাকা বললেন, "কিংকু সাহেব, টাইফুন ম্যাডামকে কেন আটক করা হয়েছে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "স্যার, উনি ফেসবুকে হাফমজুর আর ভিভার বিরুদ্ধে একটা হেইট ক্যাম্পেন চালিয়ে আসছেন অনেক বছর ধরে। "এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে" নামে একটা পেইজ খুলে। খুব পপুলার পেজ স্যার, লক্ষ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার। সবাই সেখানে প্ল্যানপ্রোগ্রাম করে, কীভাবে হাফমজুর আর ভিভাকে কোতল করা যায়। গত রাতেই স্যার উনি একটা পোস্ট দিয়েছেন, "আর বিলম্ব না না আর বিলম্ব নয়" শিরোনামে।" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন সগর্বে বললেন, "সুযোগ পেলে আমি গীতবিতান দিয়ে পিটিয়ে এই অসভ্য দুটোকে পিটিয়ে ভর্তা বানাতাম। কিন্তু আমার আগেই কে বা কাহারা স্কোর করে গেছে, আমি আর চান্সই পেলাম না!" ঝাকানাকা বললেন, "বটে? আপনি থাকেন কোথায়?" টাইফুন হাত মুঠো পাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "এই তো, পাশের বাসায়! এই বেডরুমের লাগোয়া ঘরটাই তো আমার বেডরুম! এদের জ্বালায় আমি গত দশটা বছর ঠিকমতো রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা করতে পারি না! আমাকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে ধারাগোল সঙ্গীত আশ্রমে গিয়ে তারপর গান গাইতে হয়, জানেন?" ঝাকানাকা বললেন, "ইন্টারেস্টিং! আপনি একটু বলুন তো, গতকাল রাত থেকে, ঠিক কী জানেন আপনি এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে?" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন জানালেন, টিভিতে টক শো দেখার বদভ্যাস তার নেই। ওখানে লোকজন এসে ঝগড়া করে কেবল। তিনি জলদি ঘুমিয়ে পড়েন, ভোরবেলা উঠে ভিভা রহমান ওঠার আগেই ঘন্টাখানেক রেওয়াজ করে নেন। আজ ভোরে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন। স্বপ্নে দেখেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা সবুজ লুঙ্গি পরে শান্তি নিকেতনের মাঠে ছুটতে ছুটতে বলছেন, "আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না! আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না!" তারপর তার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি এক গ্লাস চিরতার রস খেয়ে আবার উল্টো কাতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। তখন ধুপ ধাপ ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনতে পান তিনি। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে লোকজনের শোরগোলে তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন তিনি বিরক্ত হয়ে জানালা খুলে জানতে চান, ঘটনা কী। এক সাংবাদিক তাকে জানায়, হাফমজুর আর ভিভা খুন হয়েছে। তারপর তিনি তার ফেসবুক পেইজে টিএসসির সামনে আনন্দযাত্রার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দেন। তিরিশ হাজার তিনশো এগারোজন সেটাতে লাইক দিয়েছে। কিছু ভালোমন্দ বাজার করে রান্না করবেন ভেবে যখন বেরোতে যাবেন, তখন এই বর্বর পুলিশ কিংকু তাকে আটক করে এনে টয়লেটে আটকে রাখে। বদি ভাই রহমানও সেখানে ছিলেন। বদি ভাই রহমান একটু পর পর তার মোবাইল ধার চাইছিলেন। কিন্তু তিনি দেননি। আরো দুটো লোক টয়লেটে মারপিট করছিলো একটু পর পর। এমন খুশির দিনে তাকে কেন এই শাস্তি পেতে হচ্ছে, তিনি জানেন না। কিন্তু এর বিচার চান তিনি। ঝাকানাকা চিন্তিত মুখে বললেন, "আপনি কি সকালে কোনো গানের শব্দ পেয়েছিলেন?" টাইফুন বললেন, "ঘুম ভাঙার পর কোনো গানের শব্দ পাইনি।" ঝাকানাকা বললেন, "আপনি বলছিলেন, এদের জ্বালায় আপনি রেওয়াজ করতে পারেন না ... কিন্তু কেন?" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন চোখ পাকিয়ে বললেন, "এরা নিজেরাই তো সারাক্ষণ বেসুরো গলায় গানের রেওয়াজ করতে থাকে! স্বামী স্ত্রী দুইজনেই! আপনি সিটিয়েন বাংলায় এদের গান শোনেননি কখনো?" ঝাকানাকা তৃপ্ত গলায় বললেন, "নাহ, ঐ চ্যানেলটা ব্লক করে রেখেছি। দুজনই গান গাইতো?" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন বললেন, "হ্যাঁ! শুধু তা-ই নয়, ঐ রাক্ষুসীটা মাঝে মাঝে গানের আসর বসাতো! তখন আরো লোকজন এসে গান গাইতো!" ঝাকানাকা গলা খাঁকরে বললেন, "একাধিক লোক?" টাইফুন বললেন, "তা বলতে পারবো না। তবে গানগুলি ছিলো যুগলবন্দী! কী সব বিটকেলে জঘন্য গান, সুর নেই তাল নেই লয় নেই ... অহহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা!" কিংকু চৌধারি বললেন, "কী ধরনের গান?" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন ভুরু কুঁচকে বললেন, "জানি না। ইংরেজিতে ভক্তিমূলক গান, মনে হয়।" ঝাকানাকা বললেন, "ইংরেজিতে ভক্তিমূলক গান?" টাইফুন বললেন, "হ্যাঁ। ও গড আই অ্যাম কামিং, বা এইরকম একটা লাইন মনে আছে শুধু, প্রায়ই শুনতাম। কিন্তু কোনো সুরের বালাই ছিলো না। চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে রেওয়াজ করতো, সে গান শুনলে কাক হার্টফেল করবে!" কিংকু চৌধারি বললেন, "কিন্তু ... কিন্তু এটা তো ...!" ঝাকানাকা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "ঠিকাছে জনাব কিংকু, ঠিকাছে! আপনি টাইফুন ম্যাডামকে ওনার বাসায় পৌঁছে দিন।" শরিয়তুন্নেসা টাইফুন মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, "ইয়েসসসসসসস!" তারপর নাচতে নাচতে কিংকু চৌধারির সাথে বেরিয়ে গেলেন। শা ভা মোমেন টয়লেট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, চোখেমুখে পরিতৃপ্ত ভাব। "হাফমজুর ভাইয়ের টয়লেট এমন আলিশান, আগে জানতাম না! একবার ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছা করে না। শাদ্দাদের বেহেস্ত একেবারে, আহা!" ঝাকানাকা বললেন, "আপনারা বরং বাড়ি চলে যান। কেস ক্লোজড।" শা ভা মোমেন বিস্মিত হয়ে বললেন, "য়্যাঁ? ধরে ফেলেছেন কে খুন করেছে?" ঝাকানাকা বললেন, "হুমম! তবে সেসবের বিস্তারিত কিংকু সাহেবের কাছ থেকে যোগাড় করে নেবেন।" ২. কিংকু চৌধারি গাড়িতে বসে বিস্মিত মুখে বললেন, "সে কি স্যার, এদের মধ্যে কেউ তাহলে খুন করেনি?" ঝাকানাকা আসনে হেলান দিয়ে বললেন, "না।" কিংকু বললেন, "তাহলে কে?" ঝাকানাকা চুরুটে কষে টান দিয়ে বললেন, "ঘটনার মূলে আছে ঐ মিউজিক সিস্টেম।" কিংকু চৌধারি বললেন, "মিউজিক সিস্টেম? কীভাবে!" ঝাকানাকা বললেন, "গতকাল অনেক রাতে একেবারে পাঁড় মাতাল হয়ে মদের আড্ডা থেকে বাড়ি ফেরে হাফমজুর। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সে বা ভিভা, কারোই খেয়াল ছিলো না, সিডি প্লেয়ারে ভোর ছ'টার সময় অ্যালার্ম দেয়া ছিলো! ঠিক ছ'টা বাজতেই গান বেজে ওঠে তাতে।" কিংকু বলেন, "তারপর?" ঝাকানাকা বলেন, "হাফমজুর ভিভা রহমানের গান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্ত ছিলো। সে যদিও অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছে, ভিভাকে নিজের টিভি চ্যানেলে গানের সুযোগ করে দিয়েছে, তার মিউজিক অ্যালবামের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, বাড়িতে গানের রেওয়াজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি তেমন। কাকের পিছনে পয়সা খরচ করলেই সে কোকিল হয় না। তাই কিছুদিন ধরে সে ভিভা রহমানকে এইসব গানবাজনা, গানের আসর বন্ধ করার হুমকি দিয়ে আসছিলো। ভিভা পাত্তা না দেয়ায় সে হুমকি দেয়, "তুমি এসব বন্ধ না করলে কিন্তু আমিও শুরু করে দেবো!" এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে একটা কোল্ড ওয়ার চলছিলো, বুঝলেন?" কিংকু অস্ফূটে বললেন, "ওহ, সে কারণেই হাফমজুর ইদানীং নিজের টিভিতে নিজেই গান গাইতো?" ঝাকানাকা বললেন, "হ্যাঁ, ঠিক তাই! কিন্তু ভিভা রহমান পাত্তা দেয়নি। সে নিজের গান শোনে সারাদিন, হাফমজুরের গান শুনলে তার সমস্যা হবে কেন?" কিংকু চৌধারি বিড়বিড় করতে লাগলেন। ঝাকানাকা বললেন, "তাছাড়া ভিভা রহমান তার বিভিন্ন গুণগ্রাহীদের সাথে মাঝেমধ্যে ... গানের চর্চা করতেন। এ নিয়েও দুইজনের মধ্যে মনান্তর হয়েছিলো বোধহয়।" কিংকু চৌধারি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, "আমিও তো সেটাই বলছি স্যার! ঐ যে ইংরেজি ভক্তিমূলক গান ...!" ঝাকানাকা বললেন, "ঠিকাছে জনাব কিংকু, ঠিকাছে! হ্যাঁ, ঐ গানটা একটু ... ভক্তিমূলকই বটে। কিন্তু আজকের ঘটনা বলছি, শুনুন। মদের নেশায় কাবু হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো হাফমজুর, অ্যালার্মের কল্যাণে তার ঘুম ভেঙে যায় ভিভা রহমানের রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক অ্যালবামের চতুর্থ ট্র্যাক শুনে! ওঠো ওঠো রে বিফল প্রভাত বয়ে যায় যে। মেলো আঁখি জাগো জাগো থেকো না রে অচেতন! ... এই গানটি হাফমজুরের মনের মধ্যে এক বিচিত্র অনুভূতি তৈরি করে, বুঝতে পারছেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "জ্বি স্যার! গানটা খুবই সন্দেহজনক। এভাবে উঠতে বলা, অচেতন হয়ে থাকার খোঁটা দেয়া, কাঁচা ঘুম ভেঙে এসব সহ্য করা খুবই কঠিন স্যার!" ঝাকানাকা বললেন, "ঠিক! ভোরবেলা এই গান শুনে আরামের ঘুম নষ্ট হলে মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। হাফমজুরের মদের ঘোরও ঠিকমতো কাটেনি, সে তখন মেজাজ সামলাতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে ...।" কিংকু চৌধারি বলেন, "আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না!" ঝাকানাকা বললেন, "ব্রাভো! এই চিৎকারের শব্দ হানুফা, হাফিজ আর টাইফুন ম্যাডাম, তিনজনই শুনতে পান। কিন্তু যে যার মতো করে স্বপ্নে নিজেদের পছন্দসই ক্যারেক্টারের মুখে সেটা শুনতে পান। জানেন তো, ভোরবেলার স্বপ্নে আশেপাশের শব্দগুলোও এসে ঢুকে পড়ে?" কিংকু চৌধারি বলেন, "জানি স্যার! এ জন্যেই তো আমি রোজ সকালে রেডিও ঝাঞ্জাইলের গুনগুনগুন উইথ মুনমুনমুন প্রোগ্রামের আরজে মুনমুনমুনকে স্বপ্নে দেখি!" ঝাকানাকা গলা খাঁকরে বললেন, "যাই হোক। হাফমজুর তখন ঘুমন্ত ভিভার গলা টিপে ধরে। ভিভার ঘুম ভেঙে যায়। দুইজনে ধস্তাধস্তি করতে থাকে। সে ধস্তাধস্তির শব্দই শুনতে পায় হানুফা, হাফিজ আর টাইফুন।" কিংকু চৌধারি বললেন, "দুইজনই তো পালোয়ান স্যার! কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান!" ঝাকানাকা বললেন, "হুঁ। সম্ভবত ভিভা রহমানই হাফমজুরকে পাল্টা কাবু করে ফেলে। তখন আত্মরক্ষার জন্য হাফমজুর তানপুরা নিয়ে ভিভাকে আক্রমণ করে।" কিংকু চৌধারি বলেন, "তানপুরা?" ঝাকানাকা বললেন, "হ্যাঁ। তবে তানপুরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে একেবারে। আমি কাঠের টুকরো আর তার পরীক্ষা করে দেখলাম। ওটাই অস্ত্র।" কিংকু চৌধারি বলেন, "তারপর?" ঝাকানাকা বলেন, "তারপর হাফমজুর ভিভা রহমানকে পিটিয়ে রক্তারক্তি খুন করে তার গানের সব সিডি টুকরো টুকরো করে ভেঙে সারা ঘরে ছড়িয়ে রাখে।" কিংকু বলেন, "ওহ! ঐ যে প্লাস্টিকের টুকরোগুলো, ওগুলো সিডির টুকরো নাকি? আমি তো ভাবলাম সাংবাদিকরা এসে ওগুলো ভেঙে দিয়েছে!" ঝাকানাকা বললেন, "না, সবই হাফমজুরের কাজ। সব ভাংচুর শেষে হাফমজুরের হার্ট অ্যাটাক হয়। সে একটা পাঁড় মদখোর, সারা গায়ে চর্বি, হার্টের অবস্থাও সঙিন ছিলো। এতো উত্তেজনা খাটাখাটনি করে সে অভ্যস্ত নয়, তাই সে ঢলে পড়ে ভিভার পাশেই।" কিংকু চৌধারি বললেন, "ওহ! তাহলে তো কেস ক্লোজড স্যার!" ঝাকানাকা চিন্তিত মুখে বললেন, "অলমোস্ট ক্লোজড জনাব কিংকু, অলমোস্ট ক্লোজড!" কিংকু বললেন, "কেন স্যার?" ঝাকানাকা বললেন, "একবার চিন্তা করে দেখেছেন, এই গল্পের ক্যাটেগোরিতে "হড়ড়" লেখা কেন?" কিংকু গল্পের শুরুতে ক্যাটেগোরি দেখে নিয়ে বললেন, "কেন স্যার?" ঝাকানাকা বললেন, "দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটা পোর্ট্রেট ঝুলছিলো, দেখেছেন?" কিংকু বললেন, "যে ছবিটাকে সবাই অদ্ভুত বলছিলো স্যার, সেটা?" ঝাকানাকা বললেন, "হ্যাঁ। ঐ ছবিটার হিসাব মিলছে না।" কিংকু বললেন, "কেন স্যার?" ঝাকানাকা বললেন, "আমি রবীন্দ্রনাথের ওরকম দাঁত বের করা হাসিমুখের ছবি কখনো দেখিনি। আপনি দেখেছেন?" কিংকু ফ্যাকাশে মুখে বললেন, "না স্যার। রবি ঠাকুরের যে দাঁত থাকতে পারে, এটাই ভাবিনি কখনো।" ঝাকানাকা কিছু বললেন না, গুম হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন। [সমাপ্ত] ঝাকানাকার ফেসবুক পেইজের যাবতীয় অলঙ্করণ করেছেন কালাতো ভাই সুজন চৌধুরী।
false
mk
জি-৭ থেকে জি-৮ এবং বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে। শুধু দ্যাখা নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পথ নির্দেশিকা এবং সঠিক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যাত্রাপথ মসৃণ না হলেও, স্বপ্নপূরণের পালায় চড়াই-উতরাই ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে উন্নতির অগ্রযাত্রায়। তাকে পাড়ি দিতে হবে বহু পথ। সেই পথে যতই থাক কাঁটা বিছানো, তা উপড়ে ফেলার সক্ষমতাও ক্রমশ ধারণ করছে দেশটি। বাঙালীর আশা-আকাক্সক্ষার চৌহদ্দি স্বদেশ ছাড়িয়ে এখন বিশ্বসভায় পৌঁছে গেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক সূচকে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে সত্যিকারার্থেই উত্থান ঘটেছে দেশটির। তাই দেখা যায়, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতিশীল নেতৃত্বের কারণে বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে একজন আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের ইমেজ সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর সামনে এখন ২০২১ সালের চ্যালেঞ্জ। এই সময়ের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত করার যে লক্ষ্য স্থির করেছেন, তা পূরণ করতে হবে। এজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বিশ্বের মাঝে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রটিও করতে হচ্ছে সম্প্রসারিত। এটা সত্য যে, জনগণের সমর্থন ছাড়া পৃথিবীর কোন নেতারই শক্তি নেই কোন কর্মসূচী সফলভাবে বাস্তবায়ন করার। শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান বলা যায়। দেশের ১৬ কোটি মানুষের বড় অংশও শ্রমজীবী, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, কৃষিজীবীসহ পেশাজীবী এবং অন্যান্য স্তরের জনগণের সমর্থন পাচ্ছেন ব্যাপকার্থে। জনগণ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার এখন পাচ্ছে নিয়মিতভাবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো জনগণের দুয়ারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। শেখ হাসিনা জাপান টাইমসে গত ২৫ মে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধে বলেছেন যে, ‘আমি জনগণের ক্ষমতার শক্তিতে বিশ্বাস করি।’ এই বিশ্বাসই তাঁকে দেশের ছাড়িয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর জনগণের শক্তিতে বলিয়ান হতে পেরেছেন বলেই শত বাধা বিঘœতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির রথ টেনে নিতে পারছেন। তাই দেখা যায় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উর্ধমুখী। বাড়ছে মাথাপিছু আয়। বেড়েছে গড় আয়ু। কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। রফতানি আয় বাড়ছে। বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ একটি উপযোগী সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর অকুণ্ঠ সহযোগিতা বাংলাদেশকে যে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে লক্ষ্য পূরণে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র জাপান। বাংলাদেশের উন্নয়নে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রীও। শিনজো আবে বলেছেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নত করার জন্য শেখ হাসিনার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সবকিছুই করবেন। এই আশ্বাস অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে।কিন্তু বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত হবার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে, তা নয়। তার স্বপ্ন আরও দূরে, যেখানে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ শক্তির পাশে দাঁড়াতে পারবে। উন্নত বিশ্বের সাতটি দেশের জোট জি-৭ এর পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। বিষয়টি অভাবনীয় মনে হলেও বাস্তবতা বলে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হবে। আর এখন বাংলাদেশ আজকের জি-৭ এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জি-৮-এ পরিণত হবে। জাপান প্রবাসী বাংলাদেশীরাও দেখছেন এমন স্বপ্ন। নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রী নিতে মনবুশো বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়নরত ডাঃ শাহীন তার স্বপ্নের কথা জানালেন এভাবে, বাংলাদেশ যেভাবে সমৃদ্ধিতর হয়ে উঠছে, অগ্রগতির সোপানে নিজেকে সম্প্রসারিত করছে, তাতে ২০৪১-এর অনেক আগেই ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে। দেশবাসীর মধ্যে সেই স্বপ্ন জাগরিত করেছেন শেখ হাসিনা। এমনটাই তার ভাষ্য। শেখ হাসিনা নিজেও তাই ভাবেন। গত ২৫ মে জাপান টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধ ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রূপকল্পে’ তিনি তেমন আভাসই দিয়েছেন। লিখেছেনÑ ‘বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান কিভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নিজেদের পুনর্গঠন করেছে এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থনৈতিক আরেকটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে আমাদের আকাক্সক্ষা ও দৃঢ় সংকল্প এতটুকু কম নয়। শেখ হাসিনা এই বিশ্বাস এবং আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে উল্লেখ করেছেন, ‘একটি উন্নততর বিশ্ব আরও উন্নত একটি গ্রহ এবং শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য জনগণের জীবনকে রূপান্তর করতে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা এ অঞ্চলের বাকিদের এবং বিশ্বের সঙ্গে হাত মেলাতে চাই।’ অনুরূপ বক্তব্যও উঠে এসেছে জাপান সোসাইটি বাংলাদেশ আয়োজিত শেখ হাসিনার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কণ্ঠেও। তারাও বলেছেন, আমরা চাই বাংলাদেশ জি-৭ এ যোগ দিয়ে সংস্থাটিকে জি-৮ এ পরিণত করুক। জাপানের প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে প্রশংসিত করে এক্ষেত্রে তার দেশের সহযোগিতার কথা গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন। জি-৭ এর আউটরিচ (সম্প্রসারিত) বৈঠকে শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ সেই লক্ষ্য পূরণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার একটি ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।এমনটাই মনে করেন শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ডাকসুর একদা জিএস ও ভিপি এবং গাজীপুরের বর্তমান জেলা পরিষদের প্রশাসক আখতারুজ্জামান। সম্মেলন শেষে দেশে ফেরার পথে বিমানে আলাপকালে তিনি স্পষ্ট করলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের কারিগর শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে জি-৭ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে উন্নত দেশের নেতারা প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে নানাভাবে। আউটরিচ বৈঠকে বাংলাদেশের কাছ থেকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে এগিয়ে যাওয়ার রূপরেখা অবহিত হয়েছেন। তারা আভাসও দিয়েছেন। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথে তারা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবেন। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিত পাওয়া বাংলাদেশ শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের ইমেজ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথ কণ্টকমুক্ত থাকলে বাংলাদেশকে নিয়ে জি-৭ পরিণত হতে পারে জি-৮-এ।টোকিও থেকে তিনশ’ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্বত ও জনবসতিপূর্ণ এলাকা ইসিশিমাতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের শেষ দিনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার কাছ থেকে শুনেছেন বাংলাদেশের সাফল্য গাথা। সম্মেলনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে এবং এজন্যই বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। বিশ্ব নেতাদেরও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং শেখ হাসিনার উন্নয়ন নীতিমালা। বাংলাদেশের দ্রুত ও অভাবনীয় উন্নয়নে বিশ্বনেতারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গলা ফাটিয়ে না হলেও বলা যায়, এটা বাংলাদেশ বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সাফল্য ও অর্জনের স্বীকৃতি অবশ্যই। আউটরিচ বৈঠকে যে সাতটি দেশ যোগ দিয়েছেন, তারা সবাই কোন না কোন আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক জোটের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। আর শেখ হাসিনা বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন, তাঁর নিজের অর্জনগুলোকে তুলে ধরার জন্যই। তাঁকে রোল মডেল হিসেবে সামনে এনে শীর্ষ দেশগুলোর নেতারা চেয়েছেন, এখান থেকেই শিক্ষা নেবে আরও অনেক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ। শেখ হাসিনার উপস্থাপনায় বিশ্ব নেতারা আরও সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত হয়েছেন বাংলাদেশের অগ্রগতির রূপরেখা। এই সম্মেলনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে নারীর অধিক অংশগ্রহণ, নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য পরিষেবা বাড়ানোর ওপর যেমন জোর দিয়েছেন, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চ্যালেঞ্জ উত্তরণে প্রযুক্তি হস্তান্তর, সম্পদের সংযোজন এবং দরিদ্র দেশগুলোর সামর্থ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে উক্ত দেশগুলোকে আরও উদার হতে বলেছেন। সম্মেলনের ঘোষণায় শরণার্থী সমস্যা, বাণিজ্য, অবকাঠামো, নারীর ক্ষমতায়ন, সাইবার অপরাধ জলবায়ুর পরিবর্তনের পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত ও জোটবদ্ধ অভিযানের কথা বলা হলেও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।জি-৭ সম্মেলন প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি করেছে। জাপানে ২৮ বছর ধরে বসবাসরত বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জাপানের সভাপতি রফিক ফরাজী আলাপকালে বলছিলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্জন ও সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের জন্য অবশ্যই গর্ব ও আনন্দের। সব বাংলাদেশীর দায়িত্ব এ অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জন। এ পথে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতাও। গাড়ি ব্যবসা করেন জাপানে কুমিল্লার চান্দিনার হারং গ্রামের সবুজ। সম্মেলন তাকে আশাবাদী করলেও শঙ্কা রয়েছে মনে। জানালেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টিতে জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি করে দেশকে সন্ত্রাস সংঘাতময় জনপদ হিসেবে তুলে ধরতে নানাভাবে তৎপর। এসব মোকাবেলা করে অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে সর্বস্তরের নাগরিকের ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরী। না হলে সবই বৃথা হয়ে যাবে। নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি কোর্স করছেন ঢাকার আরাফাত। তার মতে এবারের সম্মেলনের আউট রিচ বৈঠকে শেখ হাসিনার উপস্থিতির এক ভিন্ন দিক ছিল। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে বিশ্ব নেতাদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়েছে। জাপান আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুন মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্লোবাল ইমেজ এবং এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তের স্বীকৃতি পেল এই সম্মেলনে। বৈঠকের দুটি অধিবেশনে জননেত্রী অগ্রগতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যা বলেছেন, তা সবার কাছে ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের পথচলা যে অন্যদের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে, সম্মেলন সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে অবশ্য এটাও তুলে ধরেছেন যে, উন্নত দেশগুলো যদি কারিগরি সহায়তা, অর্থায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, তাহলে বিশ্ব আজকে যেসব সমস্যায় পড়েছে, তা আর হবে না। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্প এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেনও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির গুরুত্ব অত্যধিক। জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতেমার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, বিশ্বের পশ্চাৎপদ অংশের এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করছে সব ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। তাঁর মতে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং এর নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা যে বিশ্ব পরিম-লে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন তার সর্বশেষ উদাহরণ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জোট-৭ এর দেশগুলোর সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ। মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ শাজাহান, কুড়ি বছর ধরে জাপানে বসবাস করছেন, তার বিশ্বাস আঞ্চলিক সহযোগিতা ও মৈত্রীর ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশকে একদিন উন্নত দেশে পরিণত করবে। বাংলাদেশকে নিয়ে জি-৭ একদিন জি-৮-এ উন্নীত হবে। সেই ভরসায় প্রবাসে ও দেশে কাজ করতে চান তিনি। সব মিলিয়ে ইসিশিমার সন্মেলন বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন। এই অর্জনকে সুদূরপ্রসারী করার জন্য একযোগে কাজ করতে হবে জনগণকেও। সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৪৪
false
fe
লাশ হয়ে পড়ে আছে বিজয় বালিকা লাশ হয়ে পড়ে আছে বিজয় বালিকাফকির ইলিয়াস====================================এই দেশে অনেক কিছুই হতে পারতো। হয়নি। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এমন অশান্তি এই জাতি চায়নি। তারপরও আজ বাংলাদেশ জ্বলছে। চারদিকে হায়েনার ফণা। হ্যাঁ, দায় নিয়েই চলেছে বাঙালি জাতি। কালের আবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেক কথা। অনেক স্মৃতি। তারপর বেইমানি করেছে রাজনীতিকরা। কথা দিয়েও, রাখেনি তারা। বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় গিয়ে অনেক ডকুমেন্টস নষ্ট করেছে। তারা তা করবে এটা অজানা ছিল না। কিন্তু যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাদের পশ্চাৎপদতা ছিল চোখে পড়ার মতো। চৌধুরী মইনুদ্দীন এখন লন্ডনের বাসিন্দা। আশরাফুজ্জামান খান নিউইয়র্কের বাসিন্দা। এই দুজনই বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম সহযোগী। এদের নাম আছে ঘাতক-দালালদের তালিকায়। এরা পালিয়ে এসেছিল। এদের বিচারের রায় হয়েছে। আর রায়ের পর এরা বলেছেÑ তাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।বাংলাদেশের রাজাকাররা তাদের ক্ষমতা পরীক্ষা অতীতে করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। তা নতুন কিছু নয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পাল্টে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে তাদের। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজনীতিকদের তারা কাজে লাগিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনে। আবার ছুড়ে দিয়েছে। ব্যবহার করে ছুড়ে দেয়াই মওদুদীপন্থীদের হীনকর্ম। যারা ব্যবহৃত হয়েছেন তারা কেউই লজ্জিত হননি। আর সেরা রাজাকার, আল-বদর কমান্ডাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটাই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে মহান বিজয় দিবসের প্রকৃত বাস্তবতা। বর্তমান সরকার প্রজন্মের কাছে ওয়াদা করেছিল এদের বিচার করবে। সেই ধারাবাহিকতায় এদের বিচারকাজ চলছে। এদের টুঁটি চেপে অনেক আগেই ধরা যেতো। কিন্তু রাজনীতিকরা তা ধরেননি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ হাজারের মতো। অথচ জনসংখ্যা দেশে সাড়ে পনেরো কোটির ওপরে। এদের তো রা করার কোনো উপায় থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও দেশের মহান বিজয়ের তিন দশক পার হওয়ার আগেই তারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। যারা সরাসরি একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভাগবাটোয়ারা করে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার জন্যও প্রতিযোগিতার ফল এমনটিই হয়। ভাবতে অবাক লাগে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ডিসকাশন গ্রুপে রাজাকারপন্থী কিছু কিছু উত্তরসূরি প্রশ্ন তোলে, ‘একাত্তরে আদৌ ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন কি না।’ ধৃষ্টতা আর কাকে বলে! তারা বলে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা চাননি, পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন। এমন নানা উদ্ভট তথ্যও হাজির করে মাঝে মাঝে। এসবের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের রাজাকারী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা। প্রজন্মের ব্রেনওয়াশ করা। এরা কোনো ইতিহাস, কোনো ডকুমেন্টারি মানতে চায় না। বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভে রাখা তথ্য-তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করতে চায় না। না বুঝতে চাইলে তাদের বুঝাবে কে? কিন্তু কথা হচ্ছে আজকে যারা সত্যের অন্বেষণের রাজনীতি উপহার দিতে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের জন্য কাজ করছেন, তাদের অভিপ্রায় কী এ ব্যাপারে? খুনিদের বিচার না করে কি সে লেভেল বাংলাদেশে তৈরি হবে?এই দাবি এদেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই করে আসছে। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এদেশের মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন। তার সেই ডাকের পথ ধরেই আজো চলছে এই আলোকিত প্রজন্ম। আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকায় এখনো নাৎসিবাদের গন্ধ পাওয়া গেলে সেখানে কামান দাগাবার চেষ্টা করে সরকার পক্ষ। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এ প্রশ্নে আপোস করলে রাষ্ট্র বিপন্ন হতে পারে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। আর পারি না বলেই বিষয়টি জিইয়ে রেখে শুধুই রাষ্ট্রের ক্ষতি করা হবে। একটা বিষয় আমরা লক্ষ করছি। আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে তখন বিশ্বের কোনো কোনো সংস্থা ‘মানবাধিকার’-এর কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন হলো একাত্তরে যখন বাংলাদেশে গণহত্যা হয়, তখন তাদের এই দাবি কোথায় ছিল? আমরা দেখেছি, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকোর ঢাকায় অবস্থান করছেন। এই সময়েই যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার নাভি পিল্লাই। তার এই চিঠি পাঠানোর মধ্যেই জামাতে ইসলামী নেতার ফাঁসি বুধবার সকাল পর্যন্ত স্থগিত রাখতে আদালতের আদেশ হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতিসংঘ যে কোনো মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে, সেটা যে পরিস্থিতিতে হোক না কেন, এমনকি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে হলেও।’ এর মধ্যেই কাদের মোল্লার জন্য শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠানোর তথ্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়েছে। একাত্তরে খুন-ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত কাদের মোল্লাকে মঙ্গলবার ফাঁসিতে ঝোলানো হবে বলে তার দল জামাতে ইসলামীর আশঙ্কা প্রকাশের মধ্যে সোমবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন দুই বিশেষজ্ঞ এই মৃত্যুদ- কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার পাননি অভিযোগ তুলে গাব্রিয়েলা নাউল ও ক্রিস্টফ হেইন্সের বিবৃতি দেয়ার এক দিনের মাথায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের ‘শেষ মুহূর্তের আহ্বান’ এলো, যাতে তিনি কাদের মোল্লাকে একজন রাজনীতিক হিসেবে উল্লেখ করে তাকে এখনি ফঁাঁসিতে না ঝোলানোর অনুরোধ করেছেন। কারা একাত্তরে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য পাকিদের শলাপরামর্শ দিয়েছিল, তা কিছুই লুকানো নয়। এসব বিষয়ে সে সময়ের দলিলপত্র দেশে-বিদেশে এখনো সংরক্ষিত আছে। কথা হচ্ছে, নানা রাজনৈতিক ছলচাতুরী সুবিধাভোগের ফন্দিফিকিরের নামে রাজনীতিকরা বেহুঁশ থাকায় ঘাতক দালালদের বিচার করা যায়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এদের বিচার কোনো দিনই করা যাবে না। কিংবা কেউ করতে পারবে না। ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলতেই বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন, শঙ্কার কথা তোলা হয়েছে শুরু থেকেই। এর নেপথ্য কারণ কী? যারা যুদ্ধ চলাকালে সুস্থ মস্তিষ্কে গণহত্যা করে কিংবা ম“ জোগায়, তারাই যুদ্ধাপরাধী। এসব যুদ্ধাপরাধীদের অবস্থান একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল তীব্রভাবে। তাই এই ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটিকেই বিচার চেয়ে বাদী হতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যুগে যুগে যেমনটি বিচার চাওয়া হয়েছে। এবং রাষ্ট্র সেসব বিচারের ব্যবস্থাও করেছে। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে সত্যের পক্ষে মানুষ যে কোনো সময়, যে কোনো দেশে দাঁড়াতে পারে।একটি কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলতে চাই। আর তা হচ্ছে, এ দেশে যদি কোনোভাবে রাজাকারদের পক্ষপাত করা হয়, তবে কারো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই শুভ হবে না। কারণ রাজাকাররা এমন এক অশুভ শক্তি, যারা সময় সুযোগ পেলেই ছোবল দেয়। অতীতে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে। দেশের আপামর জনগণ জানেন এরা কতো জঘন্য মানসিকতা সম্পন্ন। তাই এদের বিচার আজ রাষ্ট্রীয় দাবি। বর্তমান সরকার এদের বিচার না করলে কালের আবর্তে এই দেশ আবারো ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে যেতে পারে। রাষ্ট্রের বুকে সৃষ্ট ক্ষত আরো বিশাল আকার ধারণ করতে পারে। জাতিকে এদের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার বিহিত উদ্যোগ নেবেন বলেই জাতির প্রত্যাশা। বাংলাদেশ আজ চরম সংকটে। কে কোন দিকে চাল দিচ্ছে তা বুঝা ও বলা মুশকিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্জন পূর্ণতা না পেলে সে বিষয়ে আগাম লম্পঝম্প করার কোনো অর্থ নেই।স্বদেশ এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাদের সড়কের পাশে পড়ে আছে বিজয় বালিকার লাশ। যা আমরা প্রতিদিন দেখছি। আর কতো কতো প্রাণ ঝরবে? এদেশের মানুষ কি এই হায়েনাদের প্রতিরোধ করতে পারবে না?------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩
false
rg
আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গাধা ও হাতির লড়াই! মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটন (৭৯৫ মিলিয়ন+১.৩ বিলিয়ন) এই যে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করলো, অথচ আজ নির্বাচনের দিন মার্কিন ভোটারদের অন্তত শতকরা ৪৫ ভাগের এটা নিয়ে কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। মাত্র ৫৫ ভাগ মার্কিন ভোটারদের ভোটে ট্রাম্প বা হিলারি কেউ একজন হোয়াইট হাউজে যাবেন আগামী ২০ জানুয়ারি। সারাবিশ্বে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র বলে যারা খুব খবরদারি মারান, তাদের নিজেদের জনগণের অন্তত ৪৫ ভাগ তাদেরকে থোরাই কেয়ার করেন। মানে ওদের নিজেদের দেশেই কোনো গণতন্ত্র নাই। রিপাবলিকান দলের মার্কা হাতি আর ডেমোক্র্যাট দলের মার্কা গাধা। আজ হাতি ও গাধার লড়াই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মার্কিন দেশের ৪৫ ভাগ হলো ভোদাই। এদের কোনো রাজনৈতিক সচেতনতা নেই। এরা খায়, কাজ করে, সেক্স করে, বেড়ায় আর ঘুমায়। যার সরল অর্থ হলো, মার্কিন দেশে সত্যিকার অর্থেই কোনো গণতন্ত্র নাই। এফবিআই ওদের প্রেসিডেন্ট কে হবে এটা ঠিক করে। গোটা বিশ্বের উচিত খোদ মার্কিনীদের এমন নাজুক গণতন্ত্র এবং জটিল এক ভোটের ক্যাচাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ভোটের ক্যাচাল জটিল কেন? একজন প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ পপুলার ভোট পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট না পেলে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এখানেই এফবিআই'র ক্যারিশমা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, ওদের যে অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পায়, সেই অঙ্গরাজ্যের সকল (শতভাগ) ইলেকটোরাল ভোট সেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নামে যোগ হয়। এটাই সবচেয়ে বড় ডাকাতি। নির্বাচনের দিন এমন এক প্রকাশ্য ভোট ডাকাতি দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্র যাত্রা শুরু করে। যদি ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের আলাদা আলাদা ইলেকটোরাল ভোট আলাদাভাবে যোগ করা হতো, তাহলে একটা ন্যূনতম গণতন্ত্রের কথা হয়তো আমরা স্বীকার করতাম! কিন্তু এই যে একটা ক্যাচাল ওরা ভোটের দিনেই প্রকাশ্যে করে, তার সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আর যা হোক অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। ওরা বিশ্বাস করে ক্ষমতা। আর তা ঠিক করে এফবিআই। এফবিআই যাকে সমর্থন দেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসলে তিনি হবেন। মাঝখানে ওরা গোটা বিশ্বের চোখের সামনে একটা পাগলামি নির্বাচনের নাটক করে। এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হোক আর পরাজিত হোক বা যা কিছু হোক না কেন, ট্রাম্প একজন খুব ভালো এন্টারটেইনার, এটা আমি খুব এনজয় করছি। .............................৮ নভেম্বর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৮
false
ij
পাণিণি_ প্রাচীন ভারতের এক ঋদ্ধ বৈয়াকরণ একালের শিল্পীর আঁকা পাণিণি-র কল্পিত চিত্র। পাণিণি ছিলেন প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত ভাষার একজন প্রথিতযশা grammarian বা বৈয়াকরণ। পাণিণি সংস্কৃত ভাষার সমন্বিত ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন। সংস্কৃত ছিল তৎকালীন সময়ে ভারতীয় আর্যদের ধর্ম ও সাহিত্যে ধ্রুপদী ভাষা; পাণিণিকে একাধারে সংস্কৃত ভাষার জনক ও প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া হয়। অনেকেই আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাবিজ্ঞানের জনক ফার্দিনান্দ সাসুরের ওপর পাণিণির প্রভাব লক্ষ করেছেন; আরেক কীর্তিমান ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাঁর গবেষণায় পাণিণির ঋন সরাসরি স্বীকার করেছেন। সংস্কৃত ভাষার বর্ণমালা আমরা যাকে সংস্কৃত ভাষা বলি; সংস্কৃত ভাষায় এর নাম সংস্কৃতা। কোনও প্রাচীন ব্যাকরণে অবশ্য সংস্কৃত (সংস্কৃতা ) নামটি পাওয়া যায়না। শুদ্ধ ভাষার বিশেষণ রুপে সংস্কৃতা শব্দটি প্রথম উল্লেখ পাই রামায়ণে। আর্যরা ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে প্রবেশ করে। এরপর আর্য ভাষার দুটি রুপ পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। ১. প্রাচীন আর্য বা বৈদিক ভাষা; ২. অর্বাচীন আর্য বা সংস্কৃত ভাষা। প্রাচীন বৈয়াকরণ পাণিণি এই দুই ভাষার পার্থক্যকে ছন্দস ও ভাষা নামে অবহিত করেছেন। আরেক পন্ডিত, পতঞ্জলি বলেছেন,‘বৈদিক ও লৌকিক।’ এই বৈদিক ভাষার ব্যাকারণের কোনও প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া যায় না, তাই অনেকে পাণিণিরচিত ‘অষ্ঠাধায়ী নামক ব্যাকারণ গ্রন্থকেই বেদাঙ্গ বা বেদের অঙ্গ রুপে গ্রাহ্য করেন। অধ্যাপক ধীরন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ পাণিনীয় ব্যাকারণ মানবমনীষার এক অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন।’ (দ্র: ভূমিকা। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস।) এ জাতীয় গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে পাণিণির প্রজ্ঞার ছাপ ও স্বীকৃতি James Wyatt Cook সম্পাদিত ENCYCLOPEDIA OF ANCIENT LITERATURE লেখা আছে: Th e defi nitive grammarian of classical Sanskrit, Pāniņi composed what is conceivably the most complete grammatical analysis that has ever been made of any language. Before Pāniņi’s description of Sanskrit, that language had existed principally in the mouths of its speakers and, like every language, had been in a continual state of fl ux.The earliest document to survive in Sanskrit’s predecessor language and near relative, the Vedic tongue, is the Rig- Veda . As the Vedic language developed into Sanskrit, and as the hymns comprising the Rig- Veda were compiled and arranged into a liturgy, pressures increased among the Brahmins—the priestly class—to stablilize Sanskrit in a fi xed liturgical form. Pāniņi’s grammar made such a usually desperate hope a reality. Th is is not to say that popularly spoken Sanscrit did not continue to change. It did, and it evolved into the various Indo- Aryan languages of modern northern India. Pāniņi’s grammar, however, established a standard of liturgical speech and writing that the Brahmins could and did enforce for many centuries.(পৃষ্ঠা, ৫৩৩) পাণিণির সম্মানে ভারত সরকারের প্রবর্তিত ডাকটিকিট। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকেই বৈদিক ভাষার তিনটি পৃথক উপভাষা বা স্তরের উল্লেখ পাওয়া যায়-উদীচ্য (উত্তর-পশ্চিম), প্রাচ্য (পূর্ব) ও মধ্যদেশিয় (মধ্যভূমি)। পাণিণির আমলে অঞ্চলভেদে কথ্য সংস্কৃতির রুপভেদ থাকলেও উদীচ্য বা উত্তর-পশ্চিম ছাঁদটিই ছিল শিষ্ট ভাষা। বিদ্বৎসমাজে ব্যবহৃত উক্ত শিষ্ট ভাষাকে ভিত্তি করে পাণিণি তাঁর ‘অষ্ঠাধায়ী’ নামক ব্যাকারণ গ্রন্থে প্রায় ৪০০০ সূত্রের মাধ্যমে আর্য ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য (অর্থাৎ প্রাচ্য, উদিচ্য ও মধ্যদেশিয়) লেখ্য সাধুরুপ নির্ধারণ করলেন। তিনি আর্য ভাষা যে সংস্কার সাধন করলেন, কালক্রমে তাই শিষ্ট (স্টানডার্ড) ভাষারুপে সমাদৃত হল এবং এই পরিমার্যিত ও পরিশোধিত শিষ্ট আর্য ভাষাই সংস্কৃত নামে প্রচলিত। এ কালের শিল্পীর আঁকা পাণিণির ছবি। মাতৃভাষার ওপর গভীর শ্রদ্ধা ছিল এই পন্ডিতের। জীবনের সহজ সুখে ভেসে না গিয়ে সংযমী জীবন যাপন করে রচেছেন এমন এক গ্রন্থ যা তাঁকে অমর করে রেখেছে। পন্ডিতবর্গের অনুমান পাণিণির সময়কাল ৭ম-৪র্থ খ্রিস্টপূর্ব। তক্ষশিলার শালাতুর জনপদে এই বিশিষ্ট বৈয়াকরণ-এর জন্ম হয়। তাঁর মায়ের নাম ছিল দাক্ষী। বাবার নাম জানা যায়নি। একটি প্রাচীন শ্লোকে কবিদের প্রশংসায় দাক্ষীপুত্রের নামও উল্লেখিত। পাটলিপুত্রের প্রখ্যাত পন্ডিত বর্ষ ছিলেন পাণিণির শিক্ষাগুরু। মানচিত্র। ষোড়শ মহাজনপদ। গান্ধার। উদীচ্য (উত্তর-পশ্চিম) প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের প্রধান দুটি শহর পুরুষপুর ও তক্ষশিলা। এখন যেটা পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী পেশওয়ার। পুরুষপুর। পুরুষদের নগর। একদা মৌর্যদের সময়ে গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল। প্রতিষ্ঠাতা অযোধ্যার পুস্কর। তক্ষশিলা। তক্ষশিলার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবে; ইসলামাবাদের ৩২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। শিক্ষাসংস্কৃতিকে প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগে অতুলনীয় নগর ছিল তক্ষশিলা। তক্ষশিলাকে যেমন মহিমা দিয়েছেন বৈয়াকরণ পাণিণি তেমনি অতুল প্রজ্ঞার অধিকারী চাণক্য বা কৌটিল্য। তক্ষশিলার একটি স্থাপত্য। এখানেই এককালে বেঁচে ছিলেন পাণিণি। ‘সংস্কৃত’ শব্দের অর্থ সম্পূর্ন কিংবা নিখুঁত; এ কারণে ভাষাটিকে প্রাচীন ভারতে স্বর্গীয় ভাষাও ভাবা হত। যে কারণেএকে দেবভাষা বলা হত। পাণিণি পবিত্র দেবভাষা ও যোগাযোগের সাধারণ মাধ্যম হিসেবে আর্য ভাষার পার্থক্য তুলে ধরেছেন ‘অষ্ঠাধায়ী’ গ্রন্থে । পাণিণিরচিত ‘অষ্ঠাধায়ী’-র আটটি অধ্যায়; প্রতি অধ্যায়ের চারটি করে ভাগ। এসব অধ্যায়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্র ও সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের ১৭০০টি মূল ধারণা সম্বন্ধে লিখেছেন। যেমন বিশেষ্য, বিশেষন, পদ, ক্রিয়া, কারক, বিভক্তি ইত্যাদি। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণে শ্রেণিবিভাগ করে দেখিয়েছেন। বাক্যের গঠন, যৌগবিশেষ্য, এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে মনেই হয় না ‘অষ্ঠাধায়ী’ গ্রন্থটি ২৫০০ বছর আগে লেখা। অষ্ঠাধায়ী গ্রন্থের প্রচ্ছদ ব্যাকরণের সূত্র ব্যাখ্যা করার সময় অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক গণিতশাস্ত্রের সূত্রা অনুসরণ করেছেন ; পাণিণি ৪০০০ সূত্রের মাধ্যমে সমগ্র সংস্কৃতভাষাকে পুননির্মান করেছেন। ২৫০০ বছর ধরে যার তেমন পরিবর্তন হয়নি । এ প্রসঙ্গে জনৈক ইউরোপীয় লেখক লিখেছেন: An indirect consequence of Panini's efforts to increase the linguistic facility of Sanskrit soon became apparent in the character of scientific and mathematical literature. This may be brought out by comparing the grammar of Sanskrit with the geometry of Euclid - a particularly apposite comparison since,whereas mathematics grew out of philosophy in ancient Greece, it was ... partly an outcome of linguistic developments in India. সংস্কৃত ভাষার নিদর্শন পাণিণি কেবল বিদগ্ধ বৈয়াকরণই ছিলেন না, কবিও ছিলেন। রাজশেখর বসুসহ অনেক ভারতীয় পন্ডিত বৈয়াকরণ ও কবি পাণিণির অভিন্নতা প্রতিপাদন করেছেন। পাণিণিরচিত একটি প্রেমসিক্ত শ্লোক ও তার বাংলা তর্জমা দিয়ে শেষ করছি। ঐন্দ্রং ধনুঃ পান্ডুপয়েধরেণ/ শরদ্ দধানার্দ্রনখক্ষতাভম্। প্রসাদয়ন্তী সকলঙ্কমিন্দুং / তাপং রবেরভ্যধিকং চকার। শরতের পান্ডুমেঘে ইন্দ্রধনু আঁকা- নায়িকার স্তনতটে যেন নখলেখা; প্রসাদ কলঙ্কী চাঁদে শরৎ-প্রিয়ার জাগালো অধিক তাপ বিরহী -হিয়ার। তথ্যসূত্র: ধীরন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়; সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস। James Wyatt Cook সম্পাদিত ENCYCLOPEDIA OF ANCIENT LITERATURE সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:৫২
false
mk
শিবিরের বোমা ফ্যাক্টরী!!! সারাদেশে যৌথবাহিনীর চলমান অভিযানে রাজধানীর বনানী ও লালবাগ থানা এলাকার দুটি বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে। বনানীর কারখানাটি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের। আর লালবাগেরটি বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের। বনানীর কারখানা থেকে উদ্ধার হয়েছে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, কয়েক শ’ বোমা তৈরির বিস্ফোরক, গানপাউডারসহ নানা সরঞ্জাম এবং লালবাগের কারখানাটি থেকে উদ্ধার হয়েছে কয়েকটি তাজা বোমাসহ বোমা তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বনানীর বোমা তৈরির কারখানা থেকে গ্রেফতার হয়েছে বনানী থানা ছাত্রশিবিরের সভাপতিসহ দলটির ৫ নেতাকর্মী। গ্রেফতারকৃতরা শিবিরের প্রশিক্ষিত পেশাদার বোমা প্রস্তুতকারক। তারা বোমা তৈরির পাশাপাশি মজুদ, সরবরাহ ও বোমা হামলায় পারদর্শী। তৈরিকৃত বোমাগুলো বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী টানা অবরোধে ঢাকায় নাশকতা চালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বনানীর কারখানাটি থেকে উদ্ধার হয়েছে বোমাবাজদের চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ’ নেতা ও অর্থদাতার তালিকা। তালিকাভুক্তরা ২ হাজার থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক হারে চাঁদা দিয়ে থাকে।আর লালবাগে ছাত্রদলের বোমার তৈরির কারখানায় বোমা তৈরিকালে বিস্ফোরণে আহত হয়েছে এক শিশুসহ চারজন। ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পীর ডান হাত উড়ে গেছে। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাড়ির মালিক আবুল কাশেমকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।মঙ্গলবার রাত চারটার দিকে যৌথবাহিনী গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর বনানী মডেল থানাধীন মহাখালী টিবি গেট এলাকার চ ব্লকের ১৩৩/১ নম্বর আমিনুল ইসলাম ভিলা নামের পাঁচতলা বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বাড়িটির লিফটের দ্বিতীয় তলায় (তৃতীয় তলা) অবস্থিত ছাত্র শিবিরের একটি মেস থেকে উদ্ধার হয় ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা তৈরির জন্য মজুদ রাখা দুই লিটার পেট্রোল, ১০ কেজি পাথরের কুচি, এক কেজি গানপাউডার, ১২টি নতুন স্কচটেপ, ৩ কেজি প্যারেক, ৩ বান্ডেল তুলা, ৪৮টি বোমা তৈরির কৌটা, জর্দা, ১২টি ম্যাগাজিন, জিহাদী বই, ২৭টি খাকি খাম ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এবং অর্থদাতাদের নাম সংবলিত ছোট-বড় চারটি রেজিস্টার।পুলিশ জানায়, রেজিস্টারে কে কত টাকা মাসিক বা সাপ্তাহিক বা দৈনিক চাঁদা দেন তাদের নামসহ প্রদান করার চাঁদার পরিমাণ লেখা রয়েছে। যার সংখ্যা অন্তত কয়েক শ’। এর মধ্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর নেতা ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিটের নেতা এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দও রয়েছেন।মেস থেকে গ্রেফতার করা হয় ছাত্র শিবিরের বনানী থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (২৩)। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পিতা হারুনুর রশীদ। বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানা এলাকায়। শিবির কর্মী জয়নাল আবেদিন (২০) বেসরকারী প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবির তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। আরিফুজ্জামান আরিফ (১৮) রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আর্কিটেকচার বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। আতিয়ার রহমান (২২) মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজের ইংরেজী বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তার বাড়ি গাইবান্ধায়। আর খালিদ সাইফুল্লাহ (২০) সদ্য এইচএসসি পাস করে তিতুমীর কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তার বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাসিক ১৫ হাজার টাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে ভাড়া নেয় গ্রেফতারকৃতরা। জানুয়ারি থেকে তারা বাসায় বসবাস শুরু করে। ভাড়া নিয়েই তারা মেসটিতে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। মহাখালীর আমতলী, টিবি গেট, বনানী মোড়, মহাখালী ওভার ব্রিজের নিচে প্রায়ই জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীর ঝটিকা মিছিল করে। মিছিলকারীরা প্রায়ই যানবাহনে বোমা হামলা ও পেট্রোবোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিত। পুরো প্রক্রিয়াটি বনানীর এই শিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। চলমান টানা অবরোধে ঢাকায় নাশকতা চালাতে বোমাগুলো তৈরি করে মজুদ করা হয়েছিল।এ ব্যাপারে বনানী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভূঁইয়া মাহবুব হাসান জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। গ্রেফতারকৃতদের অর্থ ও বিস্ফোরক সরবরাহকারীদের তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। আর বাড়ি ভাড়া আইন অমান্য করে ভাড়া দেয়ায় বাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।এদিকে বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালবাগ থানাধীন ঢাকেশ্বরী এলাকার ৩১/২ নম্বর পাঁচতলা বাড়িতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পরেই চিৎকারে গোটা বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়। বাড়িসহ আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বাড়ির মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকেন। বাড়ির বাসিন্দারা প্রাণভয়ে দৌড়ে নিচে নামতে গেলে হুড়োহুড়িতে শিশুসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। এ সময় আশপাশের মানুষ দ্রুত ওই বাড়িতে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে হাজির হয়। পরে স্থানীয়রা ও পুলিশ মিলে বাড়িটির দ্বিতীয় তলা থেকে আহত অবস্থায় হ্যাপি (১৪), রিপন (৬), বাপ্পী (২০) ও রিপনের মা ঝুমুর বেগমকে (২২) উদ্ধার করে। আহতদের দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে রিপনের মা ঝুমুর বেগম সামান্য আহত হন। অন্য তিনজনের মধ্যে বাপ্পীর ডানহাতের কব্জির কিছু অংশ উড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বোমার বিস্ফোরণের আলামত উদ্ধার করেছে। জব্দকৃত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বাড়িটির ওই তলায় বোমা তৈরি করে মজুদ করে রাখা ছিল। বোমা বিস্ফোরণের ফলে তৈরিকৃত বোমাগুলোও বিস্ফোরিত হয়। ফলে বিস্ফোরণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশানার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাড়িতে বসে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে করে কয়েকজন আহত হয়। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।আহতদের কাছ থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, মাত্র দুই মাস আগে বাড়িটি ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পী পরিবারসহ বসবাসের কথা বলে ভাড়া নেন। ভাড়া নেয়ার পর থেকেই ফ্ল্যাটটিতে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বোমা তৈরি করে ওই ফ্ল্যাটে মজুদ করা হচ্ছিল। বুধবারও বোমা তৈরি করছিল আহত ছাত্রদল নেতা বাপ্পী। বোমার তৈরির সময় একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ফলে সেখানে থাকা তৈরিকৃত সব বোমা বিস্ফোরিত হয়ে যায়। আর তাতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে।ডিএমপির লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম মুরাদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, আহত বাপ্পী ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক। তার পিতার নাম আব্দুল মান্নান। বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। তবে বাপ্পী জন্মসূত্রে রাজধানী ঢাকার কাঁটাবনে বড় হয়েছেন। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।এ ব্যাপারে লালবাগ থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান জনকণ্ঠকে জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক আবুল কাশেমকে থানায় রাখা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেফতার বা আটক দেখানো হয়নি। মামলা দায়েরের পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় সমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে পরদিন থেকেই দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবরোধে সারাদেশে ভাড়াটে বোমাবাজদের দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীতে মৎস্য ভবনে পুলিশভ্যানে বোমা হামলা করে ১৪ পুলিশকে আহত করে অবরোধকারীরা। এদের মধ্যে কনস্টেবল শামীমকে বিদেশ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমাজের সব পেশাজীবী শ্রেণী মানুষই নাশকতার শিকার হয়েছেন। শত শত আহত ও দগ্ধদের অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে হাজারখানেক যানবাহনে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে।চলমান অভিযানে রবিবার রাতে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলাকারীদের অন্যতম নড়াইল জেলার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা প্রশিক্ষিত বোমাবাজ, বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহকারী ডজনখানেক মামলার আসামি ইমরুল কায়েস পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আর সোমবার রাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পুলিশভ্যানে বোমা হামলাকারী খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির মৃত্যু হয়। দুটি ঘটনাস্থল থেকেই বোমা, পিস্তল, বুলেটসহ পেট্রোলবোমা উদ্ধার হয়।
false
rg
সংশয়ের রাজনীতি ও এলোমেলো কথামালা___ ২৫ অক্টোবর ২০১৩ সালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি নের্তৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যে সমাবেশ করলো, সেই সমাবেশ দেশের জনগণকে কি কি বার্তা দিল? তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র মোটামুটি এরকম-১. সমাবেশ স্থলে সামনের দিকে ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের অবস্থান। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন, ব্যানার এবং বেলুন। আর মাথায় ছিল তাদের ব্রান্ডিং কাগজের টুপি। তাদের ব্যানার ফেস্টু আর বেলুনের দাবীগুলো ছিল সুস্পষ্ট। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যাদের সাজা দিয়েছে এবং যারা এখনো বিচারাধীন, তাদের মুক্তি দাবী করেছে তারা।২. বিএনপি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল শেষ পর্যন্ত জায়গা ঠেলাঠেলিতে জামায়াত শিবিরকে ছাড় দিয়েছে। ৩. সমাবেশ থেকে মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী একবারও বলেননি যে, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের দাবীগুলো তাদের নিজস্ব। যার সংগে বিএনপি'র কোনো সম্পর্ক নেই। মানে দাড়ায়, দাবীগুলো'র সঙ্গে বিএনপিও নিরব সমর্থক।৪. মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী গতকাল প্রেসক্লাবে দাবী করেছিলেন, ২৫ শে অক্টোবর থেকে বর্তমান সরকার অবৈধ। আজ সমাবেশে বললেন, আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে বর্তমান সরকার অবৈধ। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী'র কথা অনুযায়ী যদি সরকার অবৈধ হয়, তাহলে তারাও সংসদের বিরোধী দল হিসেবে অবৈধ। কিন্তু বিশ্বের কোথাও সংসদের মেয়াদ শেষ হবার আগে সাংবিধানিকভাবেই সরকার অবৈধ হবার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সরকারের চলতি নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪। অর্থ্যাৎ ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত বিরোধী দল মানুক আর না মানুক সরকার সাংবিধানিকভাবেই বৈধ।৫. মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের প্রশাসন, পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী, এবং বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক ও পেশাজীবীদের কাছে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যার অর্থ হল, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আতংকের কোনো কারণ নেই। ক্ষমা করে তাদের পক্ষে টানার একটি প্রক্রিয়ার অংশ এটা। পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছেন, আগামীতে এই সরকারের কোনো নির্দেশ যেনো প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অনুসরণ না করেন, সেজন্য তাদের আহবান জানিয়েছেন।৬. মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখা এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে এক চুলও নড়েন নি। বরং আজ সমাবেশে আবার বললেন, সংসদেও আমরা বলেছি, সংলাপ হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার কিভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে। আর সেই সরকারে উপদেষ্টা কারা হবেন তা নিয়ে। ৭. বিরোধীদল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহন করবে না।এবার আসা যাক আওয়ামী লীগ নের্তৃত্বাধীন বর্তমান ১৪ দলীয় জোট সরকারের নির্বাচন কালীন সরকারের রূপরেখা কেমন ছিল? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতি'র উদ্দেশ্য ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি ধারণা দিয়েছেন। সেটি কি ছিল?১. নির্বাচনকালীন সরকার হবে সর্বদলীয় সরকার। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে সেই সরকারে আসার জন্য আহবান করেছেন।২. যদি বিএনপি সেই সরকারে যোগ দেয়, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিতে।৩. প্রধান বিরোধীদলকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেবার জন্য সংলাপে বসার আহবান জানিয়েছেন।৪. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী'র ভাষণে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের সরকারপ্রধান কে হবেন সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। সেই সরকারের মন্ত্রীসভার আকার কেমন হবে, সে বিষয়েও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। ৫. সর্বদলীয় সরকারে যদি বিএনপি যোগ দেয়, তাদের সেই সরকারে কি কি মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে, বা কয়টি মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা ছিল না।৬. সর্বদলীয় সরকারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে কয়টি মন্ত্রণালয়ে ভাগ পাবে সে বিষয়েও কোনো স্পষ্টতা ছিল না।৭. সর্বদলীয় সরকার নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে সহায়তা করবে বা নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে শক্তিশালী করবে, বা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবে কিনা, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা ছিল না।এবার আসা যাক, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখা দিয়েছেন, সেটি কেমন? ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের ২০ জন উপদেষ্টা থেকে ১০ জন উপদেষ্টা নেবার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ৫ জন এবং আওয়ামীলীগ ৫ জন করে উপদেষ্টা দেবেন। সরকারপ্রধান হবেন গ্রহনযোগ্য কোনো ব্যক্তি। ইতোমধ্যে সেই ২০ উপদেষ্টা নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উপদেষ্টা দুই সরকার মিলে আসলে ১৮ জন। তাদের মধ্যে ৪ জন মারা গেছেন। ৪ জন শারীরিকভাবে অসুস্থ। ২ জন নতুন সরকারে যোগ দেবার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়েছেন। একজন ইতোমধ্যে বিতর্কের মধ্যে পড়েছেন। আর দুইজনের বক্তব্য পাওয়া যায় নি। অর্থ্যাৎ মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীর রূপরেখা অনুযায়ী, কোনোভাবেই ৫ জন + ৫ জন = ১০ জন উপদেষ্টা পাওয়া সম্ভব নয়।যদি মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী'র রূপরেখা আওয়ামী লীগ মেনে নেয়, তখন দেশের অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো আবার নতুন ইস্যু নিয়ে হাজির হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের গঠন এবং আকার নিয়েই বিতর্ক আরো দীর্ঘ হবে। এবার আসি, আমরা দেশের সাধারণ মানুষ কি চাইছি? বাংলাদেশের সর্বস্তরের সকল শ্রেণীপেশার সাধারণ মানুষ কি কি মনে করছে? সাধারণ মানুষের চাওয়া গুলো হতে পারে এরকম-১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী একটেবিলে সংলাপের সূচনা করুক। একটি দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রী ২৩ বছর কথা বলেন না, এটাই দেশের সবচেয়ে বড় সংকটের প্রতীক।২. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন না করেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী কেন ফোন করছেন না? ফোন করে দুইজন প্রতিদিনই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবেন, এটাই আমরা দেখতে চাই।৩. জাতীয় যে কোনো প্রয়োজনে প্রধান দুই নেত্রী একসঙ্গে বসে সংকটের সমাধান খুঁজবেন, এটাই আমাদের চাওয়া। শুধু পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনকালীন সংকটের সময় কথা বলার বিষয় নয়, সারা বছরই তারা কথা বলবেন, পরম্পর খোঁজখবর নিবেন, দেখা করবেন, একসঙ্গে বেড়াতে যাবেন, একসঙ্গে কফি খাবেন, একসঙ্গে আড্ডা দেবেন, একসঙ্গে একই অনুষ্ঠানে যাবেন, সারা বছরই যাবেন, এটাই আমরা চাই।৪. বাংলাদেশের বয়স ৪২ বছর হয়ে গেছে। এখন আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবে অন্তত একটা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কমিটি থাকা প্রয়োজন। যেখানে দুইনেত্রী একসঙ্গে বসে সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী থেকে শুরু করে সবার অংশগ্রহে একটি জাতীয় স্বার্থরক্ষা কমিটি গঠন করা দরকার। এই কমিটি যে কোনো রাজনৈতিক সরকারকেও গঠনমূলক পরামর্শ প্রদান করবে। সরকারের যে কোনো ভুল কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। জাতীয় যে কোনো বিপর্যয়ে সর্বোচ্চ সহনশীলতা প্রদর্শন করে যুক্তিসঙ্গত সমাধান বের করবে।৫. আমরা একটি স্থায়ী নির্বাচন কালীন সরকারের কাঠামো চাই। যাতে পাঁচ বছর পরে আবার আপনারা বেওয়াজ করতে না পারেন। প্রয়োজনে সেই কাঠামো ঠিক করতে সংবিধান পুনরায় সংশোধন করেন। কিন্তু কোনো অযৌক্তিক কারণে মাত্র এবারের নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন করাটা হবে নির্বুদ্ধিতার কাজ।৬. সকল রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য নিজ নিজ দলের বক্তব্য পেশ করুক। সবার বক্তব্য থেকে গ্রহনযোগ্য বিষয়গুলো মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনকে আমরা শক্তিশালী করি।৭. রাজপথ, হরতাল, মিছিল, মিাটিং, সমাবেশ এগুলো একটি স্বাধীন দেশে আপনারা আর কত করবেন? দেশের যদি আপনারা সত্যিকার উন্নয়ন করতে চান, আপনারা যদি সত্যিই জনগণের সেবা করতে চান, তাহলে তো আপনাদের মিছিল মিটিঙ সমাবেশ করার সময় পাওয়ার কথা না। আপনারা তো করছেন নিজেদের স্বার্থের রাজনীতি। নিজেদের সুবিধা আর ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা ধরে রাখার রাজনীতি। প্রকৃত জনগণের রাজনীতি আপনারা করছেন না। আপনাদের রাজনীতির কার্যকলাপ থেকে আপনাদের দেশপ্রেমই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ৮. দুর্নীতি বন্ধের জন্য আপনারা এক টেবিলে একযোগে একটা ঘোষণা দিন। হরতাল বন্ধের জন্য আপনারা এক টেবিলে একযোগে একটি ঘোষণা দিন। দলীয়করণ বন্ধের জন্য আপনারা এক টেবিলে একযোগে একটা ঘোষণা দিন। স্বজনপ্রীতি বন্ধের জন্য আপনারা এক টেবিলে একযোগে একটা ঘোষণা দিন। কালোবাজারী বন্ধের জন্য আপনারা এক টেবিলে একযোগে একটা ঘোষণা দিন। তাহলেই বুঝবো, আপনাদের দেশপ্রেম কতোটা আছে? আপনাদের এখন জনগণের কাছে সত্যিই দেশপ্রেমের পরীক্ষাটাই দিতে হবে সবার আগে।৯. ইতিহাস বিক্রি করে আপনারা আর কতোকাল খাবেন? সেই ইতিহাসেও আপনারা নিজেদের মত করে অদলবদল করেন। নিজেদের মত লেখেন। কিন্তু আসল ইতিহাস নিজেই লিখে রাখে কালের গায়ে, যা কেউ পাল্টাতে পারে না। তা নিজেই একটা ইতিহাস। আর আপনাদের পাল্টানোর ইতিহাসও আরেকটি কালো ইতিহাস।১০. যদি আমরা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি, তাহলে, নির্বাচনের যেখানে তিনমাসও নেই, আপনাদের কে কি আগামীতে করবেন, সেই রূপরেখাগুলো কোথায়? সেগুলো বরং এসময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় হবার কথা। সেই বিষয়গুলো কি আপনারা এখনো রচনা করতে পারেন নি। নাকি সোনার হাঁস এসে সেগুলৌ রাতারাতি পয়দা করে দিয়ে যাবে??১১. আমরা যদি সত্যিই বাংলাদেশকে ভালোবাসি, নিরহ মানুষের ঘাড়ে বন্দুব রেখে ক্ষমতা দেখানোর রাজনীতি করে আর লাভ হবে না। মানুষ এখন অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। সো, সাধু সাবধান।
false
rn
আনন্দ ধারা সারারাত ঘুম হয়নি।একটু আগে ফযরের আযান শেষ হলো।ভাবলাম শুয়ে থেকে লাভ নেই।রাস্তা থেকে হেঁটে আসি।অনেকদিন ভোরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি না।আমি রাস্তায় বের হলাম।সকালের পরিবেশটা একেবারেই অন্যরকম!রাস্তায় বেরিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল।সারা রাতের ক্লান্তি ভুলে গেলাম।কিছু মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছে।তাদের দেখতে ভালো লাগে।হাঁটতে হাঁটতে আমি বেলী রোড চলে এলাম।দিনের বেলা এখানে কতো মানুষের আনাগোনা।আমি যখন রাস্তায় হাঁটি সব কিছুর দিকে খুব মন দিয়ে তাকাই।এখনো কতো কিছু দেখে অবাক হতে হয়!''আনন্দধারা বহিছে ভুবনে''...গানটা গাইতে গাইতে হাঁটছি হটাৎ চোখে পড়লো রাস্তার বাম পাশের ডাষ্টবিন।ডাষ্টবিনের সামনে ছোট্র একটা বাচ্চা বসে আছে,আর একটা মহিলা কাগজ টোকাচ্ছে।আমি সামনে এগিয়ে গেলাম।বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে-আহ্ কি সুন্দর!!!আমার মনে হলো অনেক ময়লার মাঝে যেনো একটা গোলাপ পড়ে আছে।মহিলাটা আমাকে দেখে কাগজ টোকাতে টোকাতে বললো এই বাচ্চাটা কার?এখানে পইরা আছে!আমি তো অবাক!এতো সুন্দর একটা বাচ্চাকে কে ফেলে রেখে গেছে!আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম।আনন্দে আমার মনটা ভরে গেলো।বাচ্চাটা আমার গলা ধরে রেখেছে।পাতলা একটা গেঞ্জি পরা।মহিলাটাকে আমি একশো টাকা দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আশে পাশে ঘুরে বেড়ালাম।কিন্তু কাউকেই খুঁজে পেলাম না।আমি বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে বাসায় চলে এলাম।এখনও বাসার সবাই গভীর ঘুমে।আমি কাউকে জাগালাম না।বাচ্চাটাকে গোছল করালাম,রুটি খেতে দিলাম।বাচ্চাটা খুব আগ্রহ নিয়ে একটা রুটি খেয়ে ফেললো।বাচ্চাটা খুব সুন্দর।গায়ের রঙ ফরসা।চোখ দুটা কি সুন্দর!মা ঘুম থেকে ঊঠে দেখে আমি একটা বাচ্চার সাথে খেলছি।আমি মাঝে মাঝে আশে পাশের বাসা থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আসি।ওদের সাথে খেলি। দুপুর ২ টায় মাকে সব বললাম।মা খুব হই চই করলো।কিন্তু আমার মা ওনেক ভাল,আমি যা বলি তাই শুনে।কারন আমার মাথা গরম।খুব গরম।বাচ্চাটার নাম রেখেছি ফাহিম।ফাহিমের আজ তিন বছর।ছয় মাস বয়সে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম।ফাহিম আমাকে ছাড়া কিছুই বুজে না।আমি যখন কোন কাজে বাইরে থাকি, ফাহিমের জন্য অস্তির হয়ে থাকি।ফাহিম যেনো কি করছে?কেমন আছে?আমাদের পাশের বাসায় এক দম্পতি থাকেন তাদের কোনো বাচ্চা নেই।ফাহিম তাদের কাছে থাকে।তারা ফাহিম কে খুব আদর করেন।আমি যতক্ষন বাসায় থাকি ফাহিম আমার সাথেই থাকে।রাত ১২টা ১টা পর্যন্ত ফাহিম আমার সাথেই থাকে।আমরা দুজন একসাথে কম্পিউটার এ গেমস্ খেলি,ক্ষুধা পেলে নুডুলস রান্না করে খাই।ফাহিম সব ধরনের খাবার খায়।আট মাস বয়সে কঁচু ভরতা দিয়ে ভাত খেয়েছে আমার মা'র সাথে।আমার মা ফাহিমকে অনেক আদর করে।শুধু আমার মা না,সবাই ই ফাহিমকে আদর করে।এখন ফাহিমের কোনো কিছুর অভাব নেই।কত খেলনা,কত জামা।কত আদর,ভালোবাসা।সবাই ফাহিমের জন্য দোয়া করবেন।ও আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি,ফাহিমের ছবি আমার Facebook প্রফাইল এ আছে।ইচ্ছা করলে যে কেউ দেখতে পারেন।
false
ij
আল-খানসা_ সপ্তম শতকের এক আরব কবি আল-খানসার কাল্পনিক ছবি। আজ আমরা আরব দেশগুলিতে নারীর স্থান নিয়ে যাই বলি না কেন-সেই সপ্তম শতকেই কিন্তু এক প্রতিভাবান নারী কাব্য লিখে সমগ্র আরব উপদ্বীপের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তিনি আল-খানসা। আল-খানসার কবিতায় মরুভূমির সমস্ত উপাদান রয়েছে। যেমন: বৃষ্টি, তরবারী, উট, ধূলা, পাহাড়-যে পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলে আগুন। আল-খানসা তাঁর জীবদ্দশায় ইসলাম ধর্মের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন। শুধু তাই নয় - ইসলাম গ্রহন করেছিলেন কবি। আমৃত্যু মদিনায় ছিলেন। যেখানে ইসলামের নবী বাস করতেন। আল-খানসার পুরো নাম তুমাদির বিন্ত আমর ইব আল হারিথ ইবন আল শারিদ। সময়কাল : ৫৭৫-৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। মক্কা না মদিনা- আল-খানসা কোথায় জন্মেছেন-তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অবশ্য বির্তক আছে। শোকগাথা রচনা করার জন্য আল-খানসা আরবি সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন। আমরা জানি, কেউ মারা গেলে লাশ ঘিরে উচ্চস্বরে বিলাপ করার প্রথা রয়েছে আরবদেশে। কখনও কখনও সে শোকার্ত ঘটনা নিয়ে বিলাপকাব্য রচনা করা হয়। বিলাপকাব্য রচনার ক্ষেত্রে আল-খানসা ছিলেন অদ্বিতীয়। মধ্যযুগের আরবে গোত্রপরিচয় ছিল প্রধান। আল-খানসা ছিলেন সুলাইম গোত্রের। সেই সুলাইম গোত্রের কোন যোদ্ধা নিহত হলে তার উদ্দেশে আল-খানসা শোকগাথা রচনা করতেন। আল খানসার দুইজন ভাই ছিল। তাদের নাম: শাকর ও মুকুইযা। এরা যুদ্ধে মারা গেলে আল-খানসা শোকগাথা রচনা করেন। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সাসানিয় সম্রাটের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সমর অভিযান পরিচালিত হয় । আল-কাদিসিয়ার যুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হয়। আল-কাদিসিয়ার যুদ্ধে আল-খানসার চার ছেলে মারা গিয়েছিল। আরবি বিলাপসংগীতে বারংবার আক্ষেপ করা হয়-সেই সঙ্গে মৃতব্যাক্তির বীরত্বের প্রশংসা করা হয়। মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহনের কথাও বলা হয়। আল-খানসার বিলাপকাব্যেও এইসব বৈশিষ্টই বিদ্যমান। আরবিতে কবিতা সঙ্কলনকে বলে: ‘দিউয়ান’। আমাদের সৌভাগ্য এই-আল-খানসার দিউয়ান কালের যাত্রায় টিকে গিয়েছে। আজ আমরা আল-খানসার লেখা দুটি কবিতা পাঠ করব। শাকর-এর জন্য শোকগাথা শাকরের জন্য চিৎকার করে কাঁদো দেখ, উপত্যকায় একটি পাখিও শোকার্ত। যখন যোদ্ধারা হালকা অস্ত্রে হয় সজ্জিত যখন তরবারীর রঙ স্বচ্চ নুনের মতন যখন ধনুকের টঙ্কার করে আর্তনাদ যখন বাঁকানো বর্শাগুলো সব ভিজে সাহসী, দূর্বল নয়- বরং অরণ্যে শিকারী সিংহের ন্যায় সাহসী যে যুদ্ধ করেছে তার বন্ধুদের জন্য আত্মীয়বর্গের জন্য-তারাও সিংহের ন্যায় সাহসী। ঝড়ঝঞ্ছা থেকে সে তার গোত্রকে বাঁচিয়েছে বাঁচিয়েছে মরুভূমির একাকী পথিককে বাতাসের গর্জন করে উঠলে তার মানুষেরা সুখি যখন জমাট মেঘের নিচে উড়বে বাতাসের ধূলা। ঘুম নেই আমার দুচোখে ঘুম নেই সারারাত আমি জেগে ছিলাম যেন আমার দুচোখ থেকে বেরুচ্ছে থকথকে পুঁজ! আমার চোখ ছিল নক্ষত্রপুঞ্জে আমি যদিও ওদের মেষপালক নই ছেঁড়া কাপড়ে শরীর ঢেকে নিই আমি দুঃসংবাদ শুনেছি দূত বলল: ‘শাকর এখন পাথর ও জঙ্গলের মাঝখানের মাটির উপর শায়িত।’ যাও! আল্লাহ্ তোমার সহায় হোন, পুরুষের মতন প্রতিশোধ নাও। তোমার হৃদয় মুক্ত শক্ত তোমার হৃদয়ের শিকড়। মেষপালকের মতো তুমি রাত্রিকে উজ্জ্বলতা দান কর শক্ত, দৃঢ়-মুক্ত মানবের সন্তান। আমি আমার গোত্রের বীরের জন্য বিলাপ করি, মৃত্যু তোমাকে ও অন্যদের ছিনিয়ে নিয়েছে। যতক্ষণ পাখিটি কাঁদবে-আমি তোমার জন্য শোক করব যেভাবে মধ্যরাত্রির পথিককে আলো দেয় নক্ষত্র। শক্রদের সঙ্গে স্থাপন করব না শান্তি তাদের পালিত পশুরা সব বিবর্ণ হয়ে যাক তারা তোমার থেকে তাদের লজ্জ্বা ধুয়ে নেবে বিশুদ্ধ হবে তোমার পতিত রক্তঘাম আর যুদ্ধ তো খালিপিঠে কুঁজোর পিঠে চড়া! হে যুদ্ধের প্রতিপালক। তুমি বর্শাধারীর চুল ও নখ উপড়ে নাও! সহস্র চোখ দেখছে তোমাকে যারা ভয়ে অন্ধ। তারা বিস্মিত তোমার উদর নাভীর উপরে ছিন্নভিন্ন তোমার হৃদয়ের রক্তের ফেনা তোমার হৃদয়ের রক্তের ফেনা তোমার হৃদয়ের রক্তের ফেনা সূত্র: Willis Barnstone এবং Tony Barnstone সম্পাদিত Literatures of Asia, Africa, and Latin America. (From Antiquity to the Present) সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:০৯
false
fe
মানুষের উত্থানপর্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মানুষের উত্থান পর্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ফকির ইলিয়াস ========================================= প্রত্যাশা আর প্রত্যয় নিয়ে শেষ হলো এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। কলম্বোতে সার্ক দেশভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানরা সমবেত হয়েছিলেন পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। এবারের সার্ক সম্মেলন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন গোটা বিশ্বে চলছে চরম অস্খিরতা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দুই দেশের রক্ষীবাহিনীর গোলাগুলি, পাকিস্তান-ভারতে সহিংস বোমা হামলা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাসের তীব্র দাপট, চীনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিককে সামনে রেখে জঙ্গিবাদীদের হুমকি, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশী শ্রমিক খেদাও ও দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি ব্যাপক সমস্যাবলি। সার্ক তার এই দীর্ঘ পথচলা জীবনে ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কতটা মৌলিক কাজে এসেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কারণ যোগাত্মক কর্মকাণ্ডের পসরা যদি বলিষ্ঠ হতো তবে এসব দেশের চিত্র এখন অন্য রকমই হওয়ার কথা। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহযোগিতা অর্থনীতির ভিতকেই বেশি মজবুত করে। কিন্তু সার্ক অঞ্চলে আমরা তা দেখছি না। কথামালার রাজনীতির মধ্য দিয়ে এই দেশগুলোতে যে সমস্যার প্রকটতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে তাহলো­ দারিদ্র্যের তীব্রতা, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তার অভাবে প্রজন্মের অমানিশা যাপন। তার ওপর রয়েছে পারস্পারিক বিশ্বাসের অভাব। বিশেষ করে পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের চরম উথান এবং আফগান সীমান্তে এদের মহড়া এই অঞ্চলে জিইয়ে রেখেছে এক ধরনের তীব্র শঙ্কা। বুশ প্রশাসনের মদদপুষ্ট হামিদ কারজাই মুখে যতই শান্তির কথা বলুক না কেন, ভেতরে তারা লেফাফা দুরস্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বর্তমান তদারকি সরকারপ্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ খাদ্য সঙ্কট এবং নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার এই বক্তব্য আমরা শুনছি একদিকে, আর অন্যদিকে টাটা ফিরিয়ে নিচ্ছে তার বিনিয়োগ বাংলাদেশ থেকে। এই যে এক ধরনের আত্মঘাতী বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত তাই মূলত সার্ক দেশভুক্ত মানুষদের সমস্যাসঙ্কুল করে রাখছে বছরের পর বছর। তার ওপর রাজনৈতিক টানাপড়েন তো রয়েছেই। সম্প্রতি বিএনপির কারাবন্দি নেতা সাকা. চৌধুরীর একটি বক্তব্য শুনে আমার খুব হাসি পেয়েছে। তিনি মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে বলেছেন, আমরা শুধু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই ভারত বিরোধিতা করি। ‘ভারত বাংলাদেশ দখল করে নেবে’ তা স্রেফ বুলি মাত্র। সাংবাদিকদের সাকা. আরও বলেছেন, আসলে আমাদের এসব মতলবী বাণী যে ভুয়া তা ভারত সরকারও ভাল করে জানে। সাকা. চৌধুরী অকপটে একটি সত্য কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত যে শুধু হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য ভারত বিরোধিতা করে তা সবাই জানে এবং বুঝে। তারপরও গ্রামে-গ্রামাঞ্চলে এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করার প্রয়াস চালানো হয় ভারত বিরোধিতার নামে। বাংলাদেশে প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। গ্যাটকো মামলার অন্যতম আসামি সাইফুর রহমান দেশে ফিরে এসেছেন। তার আগাম জামিনও হয়ে গেছে ছয় মাসের। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেড়ে গেছে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার জামিনের মেয়াদও। মান্নান ভূঁইয়া, শামসুল ইসলামরা এখন মুক্ত। জামায়াতের নিজামীর জামিনের মেয়াদ কখন বেড়ে কত দীর্ঘ হবে তা অনুমান করা কঠিন। এর মাঝে নতুন সংযোজন হিসেবে ‘ট্রুথ কমিশন’ দায়িত্ব নিয়েছে। এই কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিরীক্ষণ করে আমার যা মনে হয়েছে তার সারাংশ হচ্ছে­ মূলত কিছু ব্যক্তিকে আগামী পাঁচ বছর নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখাই এই কমিশনের প্রধান কাজ। কারণ একটি দেশে কারা দুর্নীতিবাজ, কারা জনগণের অর্থ লুটপাট করল তা জনগণ দেখবে কিংবা জানতে পারবে না তা মেনে নেয়া কঠিন। কারণ ট্রুথ কমিশনের নিয়মাবলি মেনে যারা ‘মাফ’ চাইবে তারাই তো রেয়াত পাওয়ার কথা। তাহলে তো সব দুর্নীতিবাজই এই সুবিধা নেবে ক্রমেই। ‘দুনীতি দমন কমিশন’ এদের বিরুদ্ধে নতুন কোন ব্যবস্খা নিতে পারবে না। দেশের সামগ্রিক পরিস্খিতি নিয়ে কিছু চমৎকার কথা বলেছেন সাবেক ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নরে আলম সিদ্দিকী। নিউইয়র্কে এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, হয়তো আমরা দেখব এক সময় সেরা দুর্নীতিবাজ বলে কথিত তারেক রহমানও জামিনে বেরিয়ে আসবে। যদি তাই হয় তবে ওয়ান-ইলেভেনের কী প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্নটি এখন গোটা দেশবাসীর। কেন জানি মনে হচ্ছে যত দিন যাচ্ছে ততই ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছে ওয়ান-ইলেভেনের চেতনা। এক শ্রেণীর নব্য দুর্বৃত্ত দখল করছে পুরনো সেই চেয়ারগুলো। অন্যদিকে জনগণের হতাশা শুধুই বাড়ছে। কোন জনমতকে তোয়াক্কা না করার গ্লানি বারবারই কুঁকড়ে দিচ্ছে এই প্রজন্মকে। অথচ এই স্বাধীন বাংলাদেশে গণমানুষের শাসনই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা ছিল। দুই. এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই টিভির পর্দায় ভেসে আসছে বাংলাদেশের চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল। সিলেটে কারাবন্দি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক, বরিশালে শওকত হোসেন হিরণ এবং রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। কামরান বর্তমান মেয়র হিসেবে কারাবন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সরকার পক্ষের। তারপরও তিনি বিপুল ভোটে পাস করেছেন। বাকি তিন মেয়র বর্তমান সরকারের ঘোষিত ‘ফ্রি এন্ড ফেয়ার’ ইলেকশনে জিতেছেন অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে। ওয়ান-ইলেভেনের পর এই নির্বাচন ব্যাপক গুরুত্ববহন করছে দেশ-বিদেশে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আবারও সম্পন্ন হয়েছে জনগণের আরেকটি উত্থান পর্ব। জনগণ যে চাপানো কোন রায় মেনে নেয় না তা প্রমাণিত হয়েছে এই ভোটের মাধ্যমে। জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কাকে নেতা হিসেবে চায় এবং কেন চায়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তারা রাষ্ট্রের জনগণের মতামতকে সম্মান করেন, ভবিষ্যতেও করবেন। জনগণও চান একটি বলয় থেকে বেরিয়ে আসুক এদেশের রাজনীতি। কারণ এক ধরনের সামন্তবাদী রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বের আসন। সার্ক দেশগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই আমরা লক্ষ্য করি নেপথ্যে এক ধরনের স্বৈরাচারী মানসিকতা। এক ধরনের আধিপত্যবাদ। কম বেশি প্রায় প্রতিটি দেশেই মানবাধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে এই অঞ্চলের জনশক্তি। শুধু মুখে বললেই চলবে না, মানুষের শক্তি ও সাহসকে শাসককুলকে সম্মান জানাতে শিখতে হবে। কুয়েত-সৌদি আরবের যেসব রাজা-বাদশারা সেসব দেশে বিশ্ব শ্রম অধিকার আইন মানছে না তাদের তা মানতে বাধ্য করাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভু ইউরোপ আমেরিকার মাধ্যমে লবিং করে আরবদের 'প্রভু' মানসিকতা ভেঙে খানখান করে দিতে হবে। কথা বলতে হবে সাহস নিয়ে। কুয়েতে বাংলাদেশী শ্রমিকরা যে নির্মমভাবে নির্যাতন হয়েছেন তা চরম মানবতা লংঘনের শামিল। নিউইয়র্ক, ৫ আগস্ট ২০০৮ --------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ৮ আগষ্ট ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০০৮ সকাল ৭:৫৬
false