label
stringclasses
6 values
text
stringlengths
1.57k
117k
is_valid
bool
1 class
ij
গল্প_ স্বপ্ন ও বাস্তব টিউশনি শেষে বাড়ি ফেরার পথে চৌরাস্তার কাছাকাছি পৌঁছে থমকে যায় জামিল। চারিদিকে প্রখর রোদ। হঠাৎ চোখে পড়ল- রিকশা জটলা ও বাসযাত্রীদের ভিড়ে মধ্যে চশমা পরা বেশ সৌম্য চেহারার একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন; ভদ্রলোকের পরনে সাদা শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট, গায়ের রং ফরসা, দাড়িতে মেহেদির প্রলেপ, বুকে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে মুখচোখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক । জামিল দ্রুত এগিয়ে যায়। আপনার কি খারাপ লাগছে? জিজ্ঞেস করে। ঘেমে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখ তুলে ভদ্রলোক জামিলের শ্যামলা মতন ঘেমে যাওয়া মুখের দিকে তাকালেন। তারপর ঈষৎ কর্কস কন্ঠে বললেন, হ্যাঁ। আমার সঙ্গে একটু এসো তো বাবা। কাছেই বাড়ি। চলুন। জামিল সঙ্গে যায়।পুরনো দেওয়াল, টিনের গেট। ভিতরে ছোট্ট এক ফালি বাগান; একতলা টিন সেডের বাড়ি। লাল সিমেন্টের মেঝে ...সব ... সব কেমন পরিচিত মনে হল। জামিল গত দু-মাস হল একটাই স্বপ্ন দেখছে। বড় আশ্চর্য সে স্বপ্ন ... যেন স্বপ্নে সে এই পুরনো দেওয়াল, টিনের গেট, ভিতরে ছোট্ট এক ফালি বাগান; একতলা টিন সেডের বাড়ি আর লাল সিমেন্টের মেঝে দেখেছে।কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ আর সবুজ ওড়না পরা আঠারো-উনিশ বছরের শ্যামলা একটি মেয়ে। জামিল ভীষণ চমকে ওঠে। ওর বুকটা ধক ধক করতে থাকে। অবিকল এই মেয়েটির মুখই সে মাস দুয়েক ধরে স্বপ্নে দেখছে। এক রাশ ঘন চুল। একটু কাৎ হওয়া দাঁড়ানোর ভঙ্গি। ‘তুমি বস বাবা’ বলে মাঝবয়েসি অসুস্থ ভদ্রলোক মেয়েটির সঙ্গে ভিতরে চলে গেলেন। জামিল একটা সোফায় বসে । মধ্যবিত্তের বসার ঘরটি পরম যত্নে সাজানো । শেষ বিকেলে কী রকম সুনসান করছে। ধীরে ধীরে সে সুনসান নির্জনতা তার মস্তিস্কের একান্ত ভাবনার ভিতর প্রবেশ করতে থাকে। এলোমেলো কত কী যে ভাবে সে । দু-মাস ধরে স্বপ্নে একটি মেয়ের মুখ দেখছে। আজ বাস্তবে মুখটা দেখল। আশ্চর্য! এমনও হয়? হতে পারে? সে শীত বোধ করতে থাকে, পরনের টি-শার্টটা ভিজে গেছে; শরীরময় মৃদু কাঁপুনি টের পায়।ঘরময় কী এক মিষ্টি সুগন্ধী ভাসছিল। মেয়েটির কত বয়েস? সতরো-আঠারোর বেশি বলে মনে হল না।ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে মেয়েটির কি সম্পর্ক? মেয়ে কি? এমন কি হতে পারে না যে ঐ শ্যামলা মেয়েটি আমার মতোই একা? এমন কি হতে পারে না আজ আমার জীবনে নতুন দিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে? ভদ্রলোক তো ওপর ভীষণ প্লিজড। মাঝে- মাঝে নিশ্চয়ই আমাকে এ বাড়িতে আসতে বলবেন। জামিল আপন ভাবনায় তলিয়ে যেতে থাকে। একটু পর মৃদু সুগন্ধী উড়িয়ে মেয়েটি আসে, জামিল উঠে দাঁড়ায়, মেয়েটির হাতে মোবাইল। ছোট্ট চারকোণা কালো রঙের চশমা পরে এসেছে। (স্বপ্নে চশমা ছিল না!) জামিল জিজ্ঞেস করল, উনি এখন কেমন আছেন? আব্বা? ভালো। প্রেশার এখন নর্মাল। মাঝেমাঝে এরকম হয়। আজ দুপুরে আব্বা অষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিলেন । পোস্ট অফিসে কাজ ছিল বলে বেরিয়েছে। বলে মেয়েটি ম্লান হাসল। চোখ দুটি ঝকমক করছে। যেনবা চোখের দৃষ্টিতে তেইশ বছর বয়েসি শ্যামলা মতন তরুণের প্রতি অসীম কৌতূহল ঝরে ঝরে পড়ে। ও। আমার কি এখন দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে? আমি বরং এখন চলে যাই। পরে ভদ্রলোকের খোঁজখবর নিতে আসা যাবে। আমাকে আসতেই হবে। স্বপ্নে তো সেরকমই ইঙ্গিত আছে। উত্তেজনা চেপে রেখে জামিল ভাবল । কবজি উলটে ঘড়ি দেখল একবার। তারপর বলল, আমি এখন যাই তাহলে । না, না। বসুন, প্লিজ। মেয়েটি বলল। আমার হাজব্যান্ডকে এইমাত্র ফোন করেছি। ও এখুনি আসছে। প্লিজ, ওর সঙ্গে দেখা করে যান। আজ আপনি আমাদের যা উপকার করলেন ...
false
hm
চতুর্থ স্তম্ভ গেরিলা, হেহ! হাফমিদুল হাসে মিটিমিটি। কাজটা মার্চ মাসে যতটা কঠিন ছিলো, এপ্রিলে এসে ততটাই সহজ হয়ে গেছে। কত সব ঘটনা ঘটে চলছে চারপাশে, মানুষের ছোট্ট স্মৃতি কতটুকু আর আগলে রাখতে পারে? যতই দিন যাচ্ছে, আসল কথা ভুলে যাচ্ছে লোকে। এখন প্রোপাগাণ্ডা মেশিনে স্টার্ট দিতে হবে, মনে মনে ভাবে হাফমিদুল হক। মেহেরযৌবন নিষিদ্ধ কেন কর্তৃপক্ষ জবাব চাই! ম্যাডাম আজ দুপুরে ফোন দিয়েছিলেন। খানদানি ঘরের মেয়ে, দেশের বাইরে লেখাপড়া করেছে, আদবকায়দা খুউব ভালো জানে। ভাড়াটে লেখকেরও সম্মান আছে, সেটা অন্তত বোঝে। কখনো ভুলে যায় না যে হাফমিদুল একজন শিক্ষক। কথা শুরু করে স্যার দিয়ে, মাঝেমধ্যে শেষ করে স্যার দিয়ে। হাফমিদুল বোঝে, এই মহিলা বহুদূর যাবে। বহুদূর যাবার মাইলেজ তার শরীরের নীল রক্তে আছে। "স্যার, আরো কিছু লেখা তৈরি করতে হবে।" একটু অনুযোগের সুরেই বলেন ম্যাডাম। হাফমিদুল একটু ব্যস্ততার ভান করে। "কিন্তু আমার যে একটা সেমিনারের জন্য পেপার ফাইনাল করতে হবে মিসেস হোসেন? রেফারেন্সের কাজটা পুরা বাকি। হাতের কাজটা শেষ করে ...?" "না স্যার।" ম্যাডাম নরম গলায় শক্ত কথাটা বলেন। "দুই-তিনদিনের মধ্যেই দিতে হবে পেপারে। আমি কথা বলেছি ওদের সাথে। ফারুক বললো জলদি পাঠাতে।" হাফমিদুল আরেকটু সুতো ছাড়ে। "কিন্তু ম্যাডাম, সেমিনারে গিয়ে তো আমি খালি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। পেপারটা তো শেষ করতে হবে, নাকি?" ম্যাডাম টোপের ধার ধারেন না, সোজা বলেন, "শিওর, ইট হ্যাজ এভরি রাইট টু বি এক্সপেনসিভ! আই উইল চেইঞ্জ সাম ডিজিটস অন দ্য চেক, ওকে?" হাফমিদুল হাল ছাড়ার ভান করেন, "মিসেস হোসেন, আপনি যে কেন এত ভরসা করেন আমার ওপর! আমাদের তো বয়স হয়ে গেছে, আপনি ইয়াং জেনারেশনের কাউকে দিয়ে ...।" ম্যাডামের শরীরের নীল রক্ত কোলেস্টেরলের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে দমকে দমকে ছুটে আসে হাতের পেশীতে, সংযোগটা কেটে দেয় একটা অধৈর্য আঙুল। হাফমিদুল একটা দীর্ঘশ্বাসকে ছোটো করে ছাড়ে কেবল। এই লাইনে মাঝেমধ্যে একটু আধটু অপমান সহ্য করতে হয়। মুখের উপর ফোনই তো কেটে দিয়েছে, জুতো তো আর মারেনি! তবে এর পরের দিন একটু টাইট দিতে হবে, নাহলে জুতো মারার দিন শুরু হয়ে যাবে। রমণ সুমহানকে নাকি যাচ্ছেতাই ভাষায় ধমক দিয়েছিলেন ম্যাডাম। মহিলাকে বুঝতে হবে, হাফমিদুল একজন সম্মানিত ব্যক্তি, খানসামা নয়। টাকার বিনিময়ে কাজ হচ্ছে এখানে, সম্মানের বিনিময়ে নয়। সম্মানের বিনিময়ে কাজ হলে চেকের অঙ্কে অন্তত একটা শূন্য বেশি বসাতে হবে। ল্যাপটপের ওপর চিন্তামগ্ন আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটাকে পুড়তে দেয় হাফমিদুল। গতবার তাড়াহুড়োয়ে একটা ভুল হয়ে গেছে। পুরোনো আরেকটা লেখার ল্যাজামুড়ো ছেঁটে খ্যাপের লেখাটা নামিয়েছিলেন তিনি, এবার সেটা করা যাবে না। তবে ভুলটা নিশ্চিন্দিপুরের অভদ্রগুলো ছাড়া আর কারো চোখে পড়েনি। শালারা কোত্থেকে খুঁজে খুঁজে ঠিকই বের করে ফেলেছে আসল লেখাটা! হাফমিদুলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, টাকের কাছটা রঙিন হয়ে ওঠে একটু। শোবার ঘরে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে শেফালি, সেখানে একটা চরিত্র ডুকরে ওঠে, পেয়ার কি মতলব তুম কেয়া সমঝোগে? তীব্র বেহালা বেজে ওঠে সংলাপের পর, আর অনুরণিত হতে থাকে কথার শেষ অংশটা, তুম কেয়া সমঝোগে, তুম কেয়া সমঝোগে, তুম কেয়া সমঝোগে ...? আসলেই তো। হাফমিদুল সিগারেটের গোড়ায় হালকা চুম্বন করে। পাবলিক প্রেমের মানে কী বুঝবে? পাবলিক শুধু বোঝে রক্তারক্তি। যেন ১৯৭১ সালে কেউ প্রেম করে নাই, হেহ! গলা চড়িয়ে ডাকে হাফমিদুল, "শেফালি, ভলিউমটা কমাইবা একটু? লেখালেখি করতেছি।" শেফালি বিরস কণ্ঠে বলে, "দরজা লাগাইয়া লেখালেখি করো। ভলিউম কমান যাইতো না।" হাফমিদুল বিরক্ত হয়। বউটা যদি একটু সহযোগিতা করতো কোনো কাজে! "তাইলে মশারি টাঙ্গাইয়া দিমু? শুইয়া শুইয়া দ্যাখো?" হাঁক ছেড়ে বলে হাফমিদুল। "সিরিয়াল শ্যাষ হৌক, তারপরে টাঙ্গাইবা। মশারির ভিতরে শুইয়া টিভি দ্যাখন যায়?" শেফালি খনখনে কণ্ঠে ধমকে ওঠে। হাফমিদুল সিগারেটের গোড়ায় একটা অস্থির চুমুক লাগায়। সে ঠিক জানে, লেখাটায় যখন সে ডুবে যাবে, চোথা খুলে কোটেশন লিখবে, ভালো ভালো কথা দিয়ে পিচ্ছিল পিচ্ছিল জায়গাগুলো বালুচাপা দেবে, তখনই শেফালি আবার হেঁকে উঠবে, "মশারিটা টাঙ্গাইয়া দিয়া যাও!" ধাড়ি মেয়েছেলে, একটা মশারি টাঙাতে পারে না! কিন্তু বসে থাকলে কাজ এগোবে না। সকালে আবার ক্লাস আছে একটা। হাফমিদুল ফেসবুকে ঢোকে একবার। আমার বন্ধু রাশেদ আর গেরিলা নিয়ে আবাল পাবলিক খুব লাফালাফি করছে। এই লাফঝাঁপকে মেহেরযৌবনের পক্ষে কাজে লাগাতে হবে। খ্যাপের লেখায় যুক্তি লাগে না যদিও, কিন্তু একটা যুক্তি সাজাতে পারলে মন্দ কী? হাফমিদুল মনের চোথায় খসখস করে নোট তোলে। আমার বন্ধু রাশেদ আর গেরিলা দেখতে হলে জনতার ঢল দেখেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের সুনির্মিত চলচ্চিত্র দর্শকের কোনো অভাব নেই। এই লাইনে শুরু করা যায়। তারপর একটা মিথ্যা কথা বলতে হবে, অভাব ছিলো না মেহেরযৌবনের দর্শকেরও। পেপার যারা পড়ে, তারা কোনো কিছু চেক করে না, কাজেই ছাপা হওয়ার পর এইটাই সত্য হয়ে যাবে। এরপর একটা ধাক্কা, একটা কান্নাচাপা অভিযোগ করতে হবে, কেন আমরা এমন? বাঙালির নরকে কি আসলেই প্রহরী নিয়োগ দিতে হয় না? এই লাইনটা খুব খাবে, মনে মনে হাসে হাফমিদুল। ইউনূস সাহেবের ঘটনার পর ফুলে আছে সবাই, কাজেই ইউনূস সাহেবকেও টানা যায় এর মধ্যে। লিখতে হবে, আমরা এত স্বশ্রীকাতর কেন? যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে কীভাবে গুণী জন্মাবে? আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলাম, ইউনূসকে অপমান করলাম, আর মেহেরযৌবনকে করলাম নিষিদ্ধ! সিগারেটের পুটকিটা চুষতে চুষতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হাফমিদুলের মুখ। নাহ, নিকোটিনে জাদু আছে! এইভাবেই এগিয়ে নিতে হবে। তারপর বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন থেকে ... নাহ, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন নিয়ে গতবার একটা সমস্যা হয়েছিলো। এবার আহমদ ছফা থেকে কিছু বলতে হবে। ছফার নামে একটা মাদকতা আছে। পাঠকদের মধ্যে যারা একটু ত্যাড়া, তারাও ছফার নাম পড়লে চুপ করে যাবে। এরপর বলতে হবে, মেহেরযৌবন সম্ভবত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভুল-বোঝা নিদর্শন। মেহেরযৌবনের সাথে আমাদের এক শ্রেণীর ইতর মানুষ যে আচরণ করেছে, তাকে বীরাঙ্গনাদের সাথে বাঙালির যুদ্ধ-পরবর্তী আচরণের কি কোনো পার্থক্য আছে? এক তরুণী নারীর লাঞ্ছনার ইতিহাসকে সেলুলয়েডে বন্দী করতে প্রবাসের ভোগ-বিলাস ছেড়ে ছুটে এসেছেন দেশের মাটিতে, দোর থেকে দোরে ফিরেছেন বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে, নিজের ব্যবসা আর শিক্ষকতার দুঃসহ চাপ সয়ে সয়ে তিলে তিলে তিলোত্তমা করে নির্মাণ করেছেন এই দশকের সবচেয়ে নন্দিত সিনেমাটি, আর আমরা কী করেছি? মেহেরযৌবনকে নিষিদ্ধ করেছি, ঠিক যেভাবে পাকিস্তানীদের হাতে ... ওহ না, পাকিস্তানী বলা যাবে না, হামিদ মিরের প্রজেক্টের কথা খেয়াল রাখতে হবে ... হানাদারদের হাতে ধর্ষিতা বীরাঙ্গনাদের আমরা নিষিদ্ধ করেছিলাম আমাদের সমাজে! মেহেরযৌবনকে আবার চালুর প্রস্তাবটা কখনো করা যাবে না। ম্যাডাম বাংলাদেশে মেহেরযৌবন চালানোর ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী না। পাবলিসিটি যতটুকু পাওয়া দরকার, পাওয়া গেছে। বিবিসিও কাভারেজ দিয়েছে কয়েকদিন আগে। এখন সিনেমাটা প্যারিসে ওপেন করার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে ... কলকাতা, দুবাই আর লণ্ডনেও পাঠানো হবে। টাকা নিয়ে তো কোনো চিন্তা নাই, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সাঁই সাঁই করে চলবে মেহেরযৌবন। জয়া বচ্চন আছে, ভিক্টর ব্যানার্জি আছে, তারা কি কেশ উৎপাটনের জন্য আছে এই সিনেমায়? তাদের নামের ভারেই ইনডিয়া আর বাকি দুনিয়ায় কাটবে যা কাটার, বাংলাদেশে না চললেও কোনো ক্ষতি নাই। লেখার বাকিটায় থাকবে শুধু অনুযোগ। আমরা খল, আমরা নৃশংস, আমরা অপরিণামদর্শী। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করতে চায় আমাদের তথাকথিত শিক্ষিতরাই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্তরে স্তরে ঘুণ না ধরলে একটা জাতিকে কখনো সিনেমা নিষিদ্ধ করার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঘুরতে হয় না ...! চিন্তার সুতোটা কেটে যায় শেফালির খনখনে গলার উচ্চগ্রাম হুকুমে, "মশারিটা টাঙ্গাইয়া দিয়া যাও!" ছাইদানিতে সিগারেটটা পিষে গুঁজতে গুঁজতে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি ঠিক করে হাফমিদুল। শেফালি পূর্বাভাসযোগ্যা, এটাই যা সান্ত্বনা। বাকিটা কিসমত। স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়ে গলিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে হাফমিদুল। শেফালি বিছানায় শুয়ে পড়েছে পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো মেহগনি কাঠের মস্ত পালঙ্ক। শ্বশুরের পয়সা আছে প্রচুর, রুচি ততটা নাই, মোগল আমলের নকশার ফার্নিচার পাঠিয়েছে ব্যাটা। খাটের চার কোণায় চারটা প্রকাণ্ড মশারির স্ট্যাণ্ড লাগানো ছিলো, মিস্ত্রি ডাকিয়ে খুলিয়েছে হাফমিদুল। ঐ স্ট্যাণ্ডওয়ালা পালঙ্কে শুলে মনে হতো সুপারিবাগানে শুয়ে আছে সে। তিনটা স্ট্যাণ্ড খাটের নিচে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, একটা শুধু কাজে লাগাতে হয়। খাটের তিন কোণে দেয়ালে প্লাস্টিকের হুক লাগানো আছে, সেখানে মশারি ফিতার ফাঁসটা চমৎকার ভাবে আটকানো যায়। চতুর্থ স্ট্যাণ্ডটা প্রতি রাতে খাটের নিচ থেকে বের করে ফিট করে তারপর মশারি টাঙাতে হয়, ঘরের ঐদিকটায় মশারি টাঙানোর মতো জুৎসই কোনো কিছু নেই। মশারির তিন কোণা লাগিয়ে গুঁজতে গুঁজতে হাফমিদুল শুনতে পায়, শেফালি ঘুমিয়ে পড়েছে। স্ট্যাণ্ডটা কি লাগাবে হাফমিদুল? নাকি তিন কোণা টাঙালেই চলবে? টানটান করে না টাঙালে মশা আবার মশারির গায়ে বসেই রক্ত খাবে না তো? শেফালি জেগে গেলে আবার তাকে ঠেলেঠুলে স্ট্যাণ্ড ফিট করতে পাঠাবে। বিরক্ত মুখে খাটের নিচ থেকে স্ট্যাণ্ডটা বের করে খাটের শরীরে ফিট করা ধাতব খাপে ঢোকাতে থাকে হাফমিদুল। বাকি তিনটা স্ট্যাণ্ড জাহান্নামে যাক, এই চার নাম্বার স্ট্যাণ্ডটা তাকে সমুন্নত রাখতেই হবে।
false
rg
।। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও অন্যান্য।। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩০ বছর পর ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জনবল মোট ৫১ জন যাদের মধ্যে ২৪ কর্মকর্তা এবং ২৭ জন কর্মচারী। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে দুইটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অনুমোদিত পদ ৬৯৩টি। যার মধ্যে কর্মকর্তা ৮২জন এবং কর্মচারী ৬১১ জন। আর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনুমোদিত পদ ৩২টি। যার মধ্যে কর্মকর্তা ১২ জন ও কর্মচারী ২০ জন।মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় মোট ২,৬৫,৪৩৫ টি আবেদনের প্রেক্ষিতে এপ্রিল ২০১২ পর্যন্ত ১,৬৭,৬৬৪ টি মুক্তিযোদ্ধা সাময়িক সনদপত্র ইস্যু করেছে। এর মধ্যে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন সেই চিত্র হল:(ক) সম্মানী ভাতা প্রাপ্ত (সমাজ কল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাঃ ১,৫০,০০০ জন।(খ) ভাতা প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা (কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে) সংখ্যাঃ ৫,৩৬৬ জন।(গ) ভাতা প্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা (কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে) পরিবারের সংখ্যাঃ ২,৫০২ জন।(ঘ) ভাতা প্রাপ্ত (কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে) বীর শ্রেষ্ঠ পরিবারের সংখ্যাঃ ০৭ জন।(ঙ) রেশন প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সংখ্যাঃ ৭,৮৩৮ জন।সম্মানী ভাতা হিসেবে প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ২০০০/- (দুই হাজার) টাকা হারে প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে ১,৫০,০০০ (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। এ খাতে বছরে ৩৬০ (তিনশো ষাট) কোটি টাকা সরকারের ব্যয় হচ্ছে।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬৭৬ জনকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুত্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৮০ জন। বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন। বীর উত্তম ৭০ জন। (সর্বশেষ বীর উত্তম খেতাব পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামাল উদ্দিন আহমদ ১ লা এপ্রিল ২০১০ তারিখে)। বীর বিক্রম ১৭৭ জন। আর বীর প্রতীক ৪২৬ জন। সর্বশেষ বীর প্রতীক খেতাব পান তারামন বিবি।বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার মাসিক ২০০ টাকা, বীর উত্তম ১৫০ টাকা, বীর বিক্রম ১২৫ টাকা এবং বীর প্রতীক ১০০ টাকা হারে সম্মানী ভাতা পাচ্ছিলেন। ২০১১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বিভিন্ন বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু বেসামরিক খেতাবপ্রাপ্ত ২১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আগের হারেই সম্মানী পাচ্ছিলেন। আজ ২২ জুলাই ২০১৩, সোমবার সরকার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ‘খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান নীতিমালা ২০১৩’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের জানান, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার মাসিক সম্মানী ভাতা হিসেবে ১২ হাজার টাকা, বীর উত্তম ১০ হাজার টাকা, বীর বিক্রম আট হাজার টাকা ও বীর প্রতীক ছয় হাজার টাকা করে পাবেন।এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের পরিবার (পরিবারের সদস্য সংখ্যার হিসেবে) চাল, আটা, চিনি, ভোজ্য তেল এবং ডাল সরকারি রেশন হিসেবে প্রতি মাসে পান। আর সরকারি/আধাসরকারি দপ্তর, স্বায়ত্ব শাসিত/আধা স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা/প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনের চাকুরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এবং সন্তান না পাওয়া গেলে পুত্র-কন্যার পুত্র-কন্যাদের জন্য ৩০% কোটা সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করেন। এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ভর্তির ক্ষেত্রে ৫% কোটা সুবিধা ভোগ করেন। আর এসব বিষয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মনিটরিং করে থাকে।আর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের সরকারি চাকুরিতে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৫৯ বছরে উন্নীত করা হয়েছে।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় সম্মানীভাতা বাবদ মোট ১০ ক্যাটাগরি রয়েছে। এই ১০ ক্যাটাগরির সুযোগ সুবিধার ধরনও ভিন্ন ভিন্ন।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ছিল এই ভূখণ্ডে। রাজাকার, আলবদর, আলসামস, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দোসরদের বাদ দিলে বাকি সবাই এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহন করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধের সনদের নামেই প্রথমে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বর্তমান হিসেব অনুযায়ী সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ১,৬৭,৬৬৪ (এক লাখ সাতষট্টি হাজার ছয়শো চৌষাট্টি) জন। এখনো মুক্তিযোদ্ধা অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি থেকে এই বাছাই করার বেআক্কেল দায়িত্বটা কেন সরকার নিল? অনেক জামায়াত রাজাকার পরিবারের সদস্যরাও এই সনদ পেয়েছে। এভাবে একটা জাতিকে হাজার ভাবে ভাগ করে কখনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভাগ যতো বেশি, যারা ভাগ করার দায়িত্বে আছেন, তাদের পকেট ততো ভারী হয়। এটাই বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছর ধরে চলে আসছে।শুধুমাত্র ভাগ করে রাখতে পারলেই চতুর রাজনীতিবিদদের আতলামী করার সুযোগটি থাকে বেশি। বাংলাদেশ আর কতো এই বৈষম্য বয়ে বেড়াবে? মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের সেই সাত কোটি মানুষ কি অপরাধ করেছিল যে সনদ প্রদানের নামে এই অনিয়ম ৪২ বছর ধরে চলতে থাকবে? রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করার জন্য এটা একটি অবলম্বন। মুখে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক বুলি ছাড়ি। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি স্থায়ী ব্যবসা খোলা হয়েছে স্বয়ং রাষ্ট্রীয় তাবেদারীতে। যা নিয়ে সুস্থ মাথায় চিন্তা করার একটি মানুষও কি দেশে নেই? যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে চান, তাহলে বাকী সাত কোটি মানুষ কেন বৈষম্যের শিকার? আর আমরা সবাই খুব চেতনার পতাকা উড়াই? চেতনা খালি মুখে হয় না। একজন সাংসদ চুরি-চামারির বাইরে মাসে কতো টাকা রাষ্ট্রীয় ভাতা পান? আর ৪২ বছর পরে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ২০০ টাকার সম্মানী বাড়িয়ে করলেন ১২ হাজার!! আহারে আমার দরদ!! আর কতো মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করবেন আপনারা? এবার থামুন। তারমধ্যে আবার আওয়ামী লীগ বিএনপি ভাগাভাগি তো আছেই। এভাবেই বাংলাদেশকে আমাদের নষ্ট রাজনীতি তীলে তীলে ভাগ করে দিচ্ছে।
false
hm
পাঠ্যক্রমে নতুন ঢঙে ইতিহাস পড়ানো হোক সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ি, ছোটোখাটো এক বিষণ্ণ চেহারার শিক্ষিকা এলেন আমাদের ক্লাসে। আমরা নতুন এই ম্যাডামকে খালি হাতে ক্লাসে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, একটু নিরাপদে বিটকেলপনা করা যাবে, এ-ই ভেবে। সেই ভুলজন্মা স্বস্তি মিনিট পাঁচেক স্থায়ী ছিলো। ম্যাডাম নিচু গলায় জানালেন, তাঁর নাম মিসেস ত্রিবেদী। তাঁর পূর্বপুরুষ তিনটি বেদ কণ্ঠস্থ করেছিলেন বলে তাঁদের এই পদবী। তারপর তিনি চেশায়ার বেড়ালের মতো হাসিমুখে আমাদের বললেন, আমার পূর্বপুরুষ যদি তিনটি বেদ মুখস্থ করতে পারেন, তোমরা সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের এক পাতা মুখস্থ করতে পারবে না কেন? রোজ এক পাতা করে মুখস্থ করে আসবে বাড়ি থেকে। ক্লাসে আমি পড়া ধরবো। যে পারবে না তাকে বেতের বাড়ি খেতে হবে। এরপর দপ্তরী দাঁত বের করে হাসতে হাসতে প্রকাণ্ড এক বেত নিয়ে আমাদের ক্লাসে ঢুকলো। সেই বেতের উচ্চতা মিসেস ত্রিবেদীর সমান, প্রস্থে আমাদের একেকজনের হাতের বুড়ো আঙুলের মতো। মিসেস ত্রিবেদী বেতটা নিয়ে বাতাসে সপাং করে একটা শব্দ করলেন, আমরা বহু কষ্টে প্যান্ট শুষ্ক রেখে ক্লাসটা কোনোমতে পার করলাম। এরপর বছরভর সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের এক এক পাতা করে আমাদের মুখস্থ করতে হয়েছে। আমি জীবনে একবারই ত্রিবেদী ম্যাডামের ধোলাই খেয়েছিলাম। তিনি দুঃখিত চিত্তে বলেছিলেন, তুমি তো অন্যদিন পারো, আজকে পারলে না কেন? আমি অন্যদিন পারি বলে সেদিন আমাকে ছাড় দেননি, লোকে যেভাবে অন্য লোকের গরুকে পিটিয়ে ক্ষেত থেকে তাড়ায়, সেভাবে পিটিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে গোসল করতে গিয়ে দেখি আমার বাহু আর কাঁধে বেতের চাকা চাকা দাগ হয়ে আছে। ক্লাস সেভেনে সমাজ বিজ্ঞানের একটা বিরাট অংশ ছিলো ইতিহাস। বখতিয়ার খিলজির পর হোসেনশাহী, তারপর মোগল আমল, তারপর ইংরেজ আমল নিয়ে পাতার পর পাতা সাল আর নামে কণ্টকিত তখনকার আমার চোখে নিরর্থক সব কথাবার্তা দিয়ে বইটা বোঝাই ছিলো। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পাতা মুখস্থ করার কয়েকদিন পর আবার ওয়ারেন হেস্টিংসের পাতা মুখস্থ করতে হতো, ততোদিনে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের কিছুই আমার আর মনে নেই। সেটাও সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের ঐ নীরস, বিশুষ্ক তথ্যে ঠাসা লেখার ধরনের জন্যেই হোক, কিংবা মিসেস ত্রিবেদীর গরুপেটা ধোলাইয়ের কারণেই হোক, এই ইতিহাসের ওপর আমার মনে একটা মর্মান্তিক বিরাগ জন্মায়। আমাদের স্কুলে অন্যান্য ম্যাডামরাও ক্লাস সেভেনের পর বছরখানেক সমাজ বিজ্ঞান পড়িয়েছিলেন, তাঁরা অনেক স্নেহ নিয়ে পড়ালেও আমরা সাধারণত ঐ একটা ঘণ্টা হট্টগোল করে কাটিয়ে দিতাম। ক্লাস সিক্সে বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম, এনোফিলিস মশা ভূমির সাথে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে বসে, আর কিউলেক্স মশা বসে ভূমির সাথে সমান্তরাল হয়ে। দুই যুগ আগে পড়া এই তথ্য এর পর একবারও পুনরাবৃত্ত হয়নি লেখাপড়ার কোনো কাজে, তারপরও, এখনও মনে আছে, কারণ অনেক বিস্ময় নিয়ে তখন ক্লাসে বসে ভাবছিলাম, যারা বই লেখে, তারা কীভাবে এই কোণটা মাপলো? মশাগুলো কি চুপচাপ বসে থেকে চাঁদা দিয়ে কোণ মাপা বরদাশত করেছিলো? মতিকণ্ঠের ভাষায় সংক্ষেপে বলতে গেলে, "কায়দাটা কী"? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য সমাধান অনেক পরে ত্রিকোণমিতি শেখার পর নিজে ভেবে বের করেছিলাম, কিন্তু এখন চিন্তা করলে মনে হয়, কোণ কীভাবে মাপা হয়েছিলো, সেটা বলা না থাকলেও বইটা একটা কাজের কাজ করতে পেরেছিলো, আমার মনে কৌতূহলটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো, যেটা ঐ বয়সের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে আবশ্যক। অথচ সমাজ বিজ্ঞান বইতে পড়ার পর আরো বহুবার পড়েছি, কিন্তু আমার এখন মনে নেই, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কবে গদিতে বসেছিলো, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কবে হয়, কিংবা কোন লর্ডের পর কোন লর্ড ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় পদে সমাসীন ছিলো। এর পেছনে মিসেস ত্রিবেদীর লাঠ্যৌষধি পাঠদানের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তারচেয়ে বহুগুণে আছে এই ব্যাপারগুলো কীভাবে আমাদের পড়তে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেই ক্লাস সেভেনেরও আগে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কিশোর ক্লাসিকের নানা গল্প, যেগুলোতে মূলত ইতিহাসের গল্পই বলা হয়েছে, সেগুলো কিন্তু মনে গেঁথে ছিলো বহুদিন। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কিংবা আ টেল অব টু সিটিজ সাগ্রহে পড়ে গেছি, কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামল নিয়ে পড়তে গিয়ে ভীষণ বিরক্ত লেগেছে। এমন কেন হয়েছিলো? এমনকি গরুও ঘাসের সেলুলোজ একা একা হজম করতে পারে না। তার জন্যে তাকে নিজের পেটে জীবাণু পালতে হয়। সেই জীবাণুরা সেলুলোজ ভেঙে গরুকে বাঁচায়, আমরাও দুধ আইসক্রিম ইত্যাদি খাওয়ার সুযোগ পাই। আমাদের পাঠ্যক্রমের ইতিহাস বইগুলো এমনভাবে লেখা, যেন গরুর বদলে মানুষকে ঘাস খেতে দেওয়া হচ্ছে। এখন কী অবস্থা, আমি জানি না, কিন্তু এখনকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়নি। আমাদের পাঠ্যবইগুলো যাঁরা লেখেন, তারা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কতোটা সদয়, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ওয়ারেন হেস্টিংসীয় ইতিহাসের প্রতি আমার বিরাগমোচন (রাগমোচনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না) ঘটতে অনেক দেরি লেগেছিলো। সেটাও ঘটেছে গল্প উপন্যাসের হাত ধরে। বিনয়-বাদল-দীনেশের কাহিনী পড়ে দারুণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, কিন্তু এঁদের গল্প আমাদের পাঠ্যবইতে আসেনি। আব্রাহাম ইরেইলির বইগুলো পড়ে ভারতবর্ষ বা মোগলদের ইতিহাস পড়ে যতোটা তৃপ্তি পাওয়া যায়, সমাজবিজ্ঞান বইতে তা পাইনি। কেন এমন হলো? ইতিহাস তো আসলে গল্পই। কিন্তু সে গল্প কাকে বলা হচ্ছে, সেটা গল্প বলার সময় মাথায় থাকতে হবে। এগারো বছরের বাচ্চাদের এতো শয়ে শয়ে নাম আর সাল গরুপেটা করে মুখস্থ করানোর নাম কেন শিক্ষাদান হবে? এটা তো নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। সমাজ বিজ্ঞানে লেখা ইতিহাস পড়ে খুব বেশি কৌতূহল জাগেনি মনে। মনে হয়েছিলো, ঐ লোকগুলো কেবল আমাদের নির্যাতন করার জন্যই প্রতি দশ বছর পর পর ১৪৫০, ১৬৮০, ১৭৭০, এরকম মুখস্থবান্ধব সালে ক্ষমতা না ছেড়ে মাঝামাঝি নানা বছরে গদি ছেড়েছে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার ছেলেকে ক্ষমতাই যখন দেবে, কেন তার নাম আমাদের কথা বিবেচনা করে সালাউদ্দিন হোসেন শাহ রাখেনি, সেটা নিয়েও একটু চাপা অনুযোগ ছিলো আমাদের মধ্যে। হেস্টিংস, ডালহৌসি, ক্যানিং, মিন্টো, রিপন, লিটন হাবিজাবি নামগুলোকে মনে হয়েছে এদের বাবামায়ের বিটকেলপনা। আর এতো নাম আর সাল মুখস্থ করে এসে নিজের দেশের নিকট ইতিহাস পড়তে গেলে আরো আটকে যেতে হতো, কারণ সেগুলোও অনেক একঘেয়েভাবে লেখা ছিলো। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করে, ১৯৭১ এর পর কীভাবে কী হলো, সেটা তারা জানতে চায়, কিন্তু ভালো বই নেই। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা এক জিনিস, আর কিশোরপাঠ্য ইতিহাস লিখতে পারা আরেক জিনিস। আমাদের এতো শয়ে শয়ে নাম মুখস্থ না করিয়ে যদি কৌতূহলের চাবিটা তুলে দেওয়া হতো, তাহলে ইতিহাস মুখস্থ করার বদলে আমরা ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হতে শিখতাম। হয়তো ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার কী কী ক্ষতি করে গেছে, নিজেরাই এ বই ও বই টুকে খোঁজ করার চেষ্টা করতাম, যদি শুধু আমাদের শিক্ষকেরা কৌতূহলী হতে শেখাতেন। এখনও তো বাচ্চাদের প্রকাণ্ড ভারি বোঝা নিয়ে স্কুলে-কোচিঙে-টিউটরের কাছে হানা দিয়ে অনেক কিছু গলাধকরণ করতে হয়, কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, কোনটা জরুরি? এই তথ্যগুলো মুখস্থ করানো, নাকি তথ্যগুলো নিয়ে তাদের চমৎকৃত হতে শেখানো? আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত খুব চতুর কোনো লোক, কিংবা একাধিক লোক, আলগোছে একটা পুরো জাতিকে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে নির্লিপ্ত, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বীতশ্রদ্ধ বানানোর পথ খুঁজে পেয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের ইংরেজি আর আরবি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা দেশের ইতিহাস কতোটুকু কীভাবে জানে, আমি জানি না। বাংলা মাধ্যমে আমি লেখাপড়া করে এসেছি, শুধু পাঠ্যবই দিয়ে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জাগানো আমার মতো বইপড়ুয়ার জন্যেও ছিলো না। এটা কি কেবল গ্রন্থরচয়িতাদের অবহেলায় হয়েছে, নাকি পরিকল্পিত ছকেই? ইতিহাস জানতে হয় নিজেকে চিনে নেওয়ার জন্যে। আজ থেকে শয়ে শয়ে বছর আগে কোন রাজার পর কোন নবাব গদি দখল করেছিলো, সেই সাল আর নাম মুখস্থ করার চেয়েও বেশি জরুরি, আমাদের সমাজটা কীভাবে সেই রাজা-নবাবদের হাতে পড়ে নিজের চেহারা পাল্টেছে। কেন আলীবর্দি খাঁয়ের চেয়ে সিরাজউদ্দৌলার শাসন খারাপ ছিলো, ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে পড়ে সেটা আরো খারাপ কীভাবে হলো? আমরা শৈশব-কৈশোরে, কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও, বর্তমানকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু বর্তমান যে একটা দীর্ঘ প্রবাহের ফল, সেটা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়। প্রবাহটাকে বুঝতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের গন্তব্য কোথায়, সেটাও ধরতে আমাদের বেগ পেতে হয়। এই ধরতে পারাটা কেবল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাজ নয়, এটা সামষ্টিকভাবে ধরতে শিখতে হবে, কারণ আমাদের গন্তব্যও কমবেশি সামষ্টিক। আজ আমরা বুড়িগঙ্গার দূষণ দেখে নাক কোঁচকাই, কিন্তু যে কিশোরটি বুড়িগঙ্গার অদূষিত চেহারা দেখেনি, তাকে কীভাবে এই দূষণের খারাপ দিকগুলো বোঝাবো আমরা? বোঝাতে গেলে আমাদের ইতিহাস শিক্ষায় ফিরে যেতে হবে। শিক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটিকে আমরা এমন তথ্যকণ্টকিত করে রেখেছি, যে ইতিহাস শেখানো মানে যে গল্প বলা, সেটাও আমরা বিস্মৃত হয়েছি। ইতিহাস মানে অসংখ্য রোমাঞ্চকর গল্পেরও সমষ্টি। আমাদের কিশোর-কিশোরীদের কথা চিন্তা করে নতুন ঢঙে ইতিহাস পড়ানো শুরু হোক। তথ্যের কাঁটায় তাদের ঝাঁঝরা না করে, কৌতূহলের চাবিটা তাদের হাতে ধরিয়ে দিন। ক্লাস শেষে ইতিহাসের গল্প নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের লেখা নাটক মঞ্চায়িত হোক, ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা বই ঘেঁটে নিজেদের পছন্দসই ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর প্রবন্ধ লিখতে শিখুক, ইতিহাসের পরিণতি কীভাবে ভিন্ন হতে পারতো, তা নিয়ে বিতর্ক হোক। মিসেস ত্রিবেদী বেঁচে আছেন কি না জানি না। যদি তিনি বেঁচে থাকেন, আর এই লেখা তাঁর কাছে কোনোভাবে পৌঁছায়, তাহলে তাঁকে বলতে চাই, আমি নিশ্চিত, তিনি তাঁর নাতি-নাতনিদের ছুটির দুপুরে অনেক আদর করে পুরাণ আর ইতিহাসের নানা গল্প শোনান, তাদের গায়ে মারের দাগও নেই। আপনার বেতের বাড়ি আমার কোনো উপকারে আসেনি ম্যাডাম। এখন রজার ক্রাউলির লেখা ইতিহাসের ওপর চমৎকার একটা বই "সিটি অব ফরচুনস" পড়ছি, আর চিন্তা করছি, আপনার মতো আরো কতো শিক্ষক-শিক্ষিকা কতো ছেলেমেয়েকে ইতিহাস থেকে বেতিয়ে বিমুখ করেছেন। আপনি যে বইয়ের পাতা মুখস্থ করাতেন, সে বইয়ের লেখকদের সঙ্গে নিয়ে আপনার মতো মানুষগুলো অবসর নিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে দূর হয়ে যাক। ভালো থাকবেন।
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০২৯ চোখেমুখে মাঝে মাঝে অন্ধকার দেখি। আজকে ভোরে বাথরুমে গিয়ে যেমন দেখলাম। ঘোর কেটে যাবার পর বুঝলাম, ঐ পুঞ্জীভূত আঁধার আর কিছু নয়, আমারই কেলোবদন, আয়নায়। আয়না ছাড়াও অন্ধকার দেখছি বাকিটা সময়। ব্যবস্থাকৌশল নামের এক কোর্স নিয়ে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছিলাম গত কয়েক হপ্তা ধরে। প্রফেসর দুর্ধর্ষ স্মার্ট লোক, দারুণ গুছিয়ে কথা বলেন, আর অল্প কথা বলে লোকজনকে ফ্যাসাদে ফেলে দেন। গত হপ্তায় এক মেইল পেয়ে রীতিমতো খাবি খাওয়ার দশা। গ্রুপের বাকি দুইজন পারলে গলাগলি করে কাঁদে। এদিকে ইন্টারনেটের সংযোগের ছিন্নমূল অবস্থা, প্রফেসর সাহেবকে মেইল লিখে সেন্ড করতে গিয়ে দেখি নেট গায়েব। ছোটো আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার পুলে। সেখানে বসে ওলাফকে ফোন করে জানালাম, আমাদের স্ট্র্যাটেজি এখন মারমুখো হওয়া উচিত। ওলাফেরও ঘরে নেট নাই, বউ থাকে ড্যুসেলডর্ফ, সে-ও মুখ গোমড়া করে থাকে আমার মতো, সব শুনে সে বললো, উঁহু, আমাদের একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হবে। এভাবে ... বলে সে শুরু করলো গড়গড়িয়ে। ওলাফের ড্রাফট শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, শালা বাংলায় লিখতে পারলে সচলে অতিথি লেখক হিসেবে পোস্ট দিতে বলতাম। ঝটপট টাইপ করে সেটা পাঠিয়ে দিলাম প্রিসের কাছে, যদিও ততক্ষণে ব্যাটা অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। আমাদের খসড়া করা সিস্টেম ঠিক সুবোধ আচরণ করছিলো না, ভুলটা কোথায় সেটাও বার করতে পারছিলাম না, তিনজন মিলে মাথা খাটিয়েও না। শেষমেশ গত হপ্তায় প্রবল সর্দি আর মাথাব্যথা নিয়েও আবার নতুন করে ডিজাইন করলাম সবকিছু। দু'টো গুরুতর ভুল করেছিলাম, নতুন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে গিয়ে সেগুলো চিহ্নিত করা গেলো অবশেষে। এবার সিস্টেম রান করে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শেষমেশ মিলেছে! পরদিন ক্লাসে গিয়ে শুনি ফতোয়া, প্রিস তাঁর এক সহকর্মীর কাছে আমাদের সিস্টেম দেখানোর হুকুম করেছেন। সেই ব্যাটাও হুবহু প্রিসের মতোই, ঠান্ডা, গুছিয়ে কথা বলে, আর একই রকম চালু। আমাদের ঈস্টার দ্বীপের সিস্টেম মনোযোগ দিয়ে দেখে আর শুনে নতুন এক গলদ বার করে বসলো ব্যাটা। কপাল আর কাকে বলে! তবে আজ একদম শেষ দেখে ছাড়া হয়েছে ব্যাপারটার, একটু পরই কাজ শুরু করবো প্রেজেন্টেশন নিয়ে। শুক্কুরবার ছিলো আমার আরেক সেমিনারের চরম-উপস্থাপনা, সেটার জন্যেও দৌড়ুতে হয়েছে প্রচুর। প্রফেসর শ্মিডের ডকটোরান্ড জন জিভার্স রীতিমতো মাটির মানুষ, সে মাঝখানে একদিন অন্য এক কোর্সের মাঝে এসে আমাকে জানিয়ে গেলো, এই শুক্রবার প্রেজেন্টেশনের তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে, আমি যেন প্রস্তুত থাকি। বিনামেঘে বজ্রপাত খেয়ে খেয়ে এখন মনে হচ্ছে নিয়তি আমাকে প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে পদ্ধতিতে মেরে চলছে অনবরত। বহুকষ্টে বললাম, ঠিক আছে, কোন ব্যাপারই না। বৃহস্পতিবার ধুঁকতে ধুঁকতে কোনমতে জিনিসপত্র নিয়ে গেলাম জনের কাছে। সে দারুণ খুঁতখুঁতে লোক, অনেকগুলি খুঁত বার করে শুধরে দিলো অনেক কিছু। ওদিকে বাংলাদেশের বায়ুশক্তি সম্ভাবনা নিয়ে একটা উপস্থাপনা করতে হবে আরেক কোর্সে। সেটার খসড়া গত হপ্তায় জমা দেয়ার কথা ছিলো, দেয়া হয়নি। কী যে গেরো! গতকাল বাড়িতে নেটের অভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনমতে করলাম কিছু, এদিকে আজ সকালে একটা পরীক্ষা আর তার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার পালা, সেগুলোও জমে আছে ... সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো ... মনে হচ্ছিলো ... খারাপ খারাপ কথা মনে হচ্ছিলো আর কী। যাই হোক, সকালে পরীক্ষা দিতে গেছি দশমিনিট দেরি করে। ভোরে উঠে অ্যাসাইনমেন্টের বাকি অংশ শেষ করতে করতে হঠাৎ দেখি সাতটা সাতান্ন বাজে। আবারও বজ্রপাত। কোনমতে প্যান্ট পরে চোঁচাঁ করে দৌড় মারলাম। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে দেখি ষ্টেফি রাস্তার ওপর, হেলতে দুলতে যাচ্ছে। ওকে বললাম, সময় থাকতে দৌড়াও! অন্য লোকের বাড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে শর্টকাট দিচ্ছি, কোত্থেকে এক মহিলা দুইটা বাঘের মতো কুকুর নিয়ে হাজির। কুকুর অপরিচিত ছুটন্ত মানুষ পছন্দ করে না, দুই দুইটা আদমসন্তানকে দৌড়াতে দেখে তারা পাড়া কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে তেড়ে এলো। কপাল ভালো মহিলার গায়ে জোর ছিলো, বেল্ট টেনে ধরে রেখে আমাদের জান বাঁচিয়ে দিলো শেষ পর্যন্ত। পরীক্ষা দিতে গিয়েও আরেক মুশকিল, ব্রেন্ট দারুণ রসিক লোক, সে একটু পর পর এক একটা রসিকতা করে আর সবাই হেসে কুটিপাটি। আমার কাছে এসে সে খাতা খুঁটিয়ে দেখে এক জায়গায় হাত রেখে সে বললো, এটা কী লিখেছো? আমি থতমত খেয়ে বললাম, আকুমুলিয়ের্ট! সে হুমহাম শব্দ করে বললো, অঙ্কটা নিয়ে সমস্যা নাকি, সাহায্য করবো? আমি সানন্দে বললাম, হ্যাঁ করেন! তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র ও তরঙ্গ কুইজে প্রফেসর মতিনের আগে বা পরে কোন শিক্ষক আমাকে পরীক্ষায় সাহায্য করেনি, আজকে ব্রেন্ট সেই তালিকায় নাম লেখালো। একটু পরে দেখলাম, সবারই ঐ একই জায়গায় সমস্যা, মারিয়েনকেও গিয়ে অঙ্ক কষে দিয়ে আসছে ব্রেন্ট। মারিয়েন অবশ্য হিন্ট পেয়েও খুশি না, সে দাঁত কেলিয়ে সেক্সি হাসি দিয়ে বললো, ভাস ডান? তারপর কী? ব্রেন্ট দাঁত খিঁচিয়ে বললো, ভাস ডান? আজকালকার ছেরিগুলি চায় কী? ভাস ডান! মারিয়েনের পাশে বসা আরেক ছেমরি, সে দাবি জানালো, যেহেতু এক্সপেরিমেন্ট গ্রুপে করা হয়েছে, পরীক্ষাও গ্রুপে দেয়ার সুযোগ দেয়া হোক! ব্রেন্ট বললো, জেগে ওঠো! দুই ছোকরা খুব আলোচনা করে পরীক্ষা দিচ্ছিলো, ব্রেন্ট গিয়ে হানা দিয়ে বললো, হাতের লেখা ভালো হলে চলবে না! হাতের লেখা খারাপ হতে হবে, যাতে তোমার পড়শী তোমারটা পড়তে না পারে! পরীক্ষা শেষ করে এসে প্রেজেন্টেশনের বাকি কাজ শেষ করলাম, ভাগ্য ভালো নেট সংযোগ ছিলো। যে কথা না বললেই নয়, তা হচ্ছে, এই উপস্থাপনায় দুই সচল সদস্য দ্রোহী আর তানভীর অপরিমেয় উপকার করেছেন কিছু জিনিস যুগিয়ে দিয়ে। প্রেজেন্টেশন বেশ ভালো হয়েছে, এর জন্যে তাঁরাই ধন্যবাদার্হ। পাশাপাশি সুখের খবর হচ্ছে, ঝড় নিয়ে তানভীর শুরু করতে যাচ্ছেন তাঁর জমজমাট সিরিজ "তানভীর-তুফান ভাই ভাই!" এর আংরেজি সংস্করণ আমি মোটামুটি আঁতিপাঁতি করেই পড়েছি, বাংলাটাও আশা করি দমকা ও ঝোড়ো ধরনের সুখপাঠ্য হবে। বিষ্যুদবারে ঈস্টার দ্বীপের ওপর বক্তৃতা শেষ হলে আপাতত বাঁচি। কয়েকটা উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে সবসময় প্রোবেফোরত্রাগ বা পরীক্ষামূলক বক্তৃতা সেরে নেবো কাউকে মুরগি বানিয়ে। সেদিন যেমন স্যামুয়েল বা ষ্টেফি কাউকেই হাতের কাছে না পেয়ে একটু হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলাম। আজ সুমন চৌধুরী আর ষ্টেফান ব্রাককে মুরগি বানানোর সুফল একদম হাতে নাতে পেয়েছি।
false
rn
ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) বিশ্বজনীন ও চিরন্তন ইসলাম সপ্তম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়ে মাত্র এক শ বছরের মধ্যে অর্ধ পৃথিবীতে আধ্যত্মিক, নৈতিক ও বস্তুগত উৎকর্ষের জোয়ার সৃষ্টি করছিল। চৌদ্দ ও ষোল শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়, তার পেছনে ছিল মুসলিম বিশ্বের মধ্যযুগীয় সাফল্যেরই প্রেরণা।ইসলামী পুনর্জাগরণ বা ইসলামী গণসচেতনতা কোনও মধ্যযুগীয় ঘটনা নয়। এটি পুরোপুরি সমকালীন বাস্তবতা। ইসলামের আগমনের পূর্বে খ্রিষ্টধর্মের সর্বত্র বিস্তার ঘটেছিল। খ্রিষ্টযুগের পূর্বে মিসর, ব্যাবিলন, এশিরীয়, চীন, ভারত, গ্রিস প্রভৃতি পৃথক পৃথক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল। সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বসভ্যতায় তাদের ফলপ্রসূ অবদান ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারা মানবজাতির জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই গ্রিক দর্শনের যেকোনো আলোচনায় সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল ছিল সর্বজন প্রশংসিত।ইবনে খালদুন কে কি সমাজ বিজ্ঞানের জনক বলা যায়?"এক জাতি, এক ভূমি"- এই চেতনা ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে একদা যে মুসলিম উম্মাহ্‌ পরিণত হয়েছিল বিশ্বের প্রভাবশালী সভ্যতায় সেই একই জাতি সিংহাসন হারানোর পর আজ হতবিহ্বল ও দিশেহারা।ইবনে খালেদুন বিশ্বাস করতেন যে ,ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে বিশ্বজনীন আইন সমাজের ভাগ্যকে পরিচালিত করে । তিনি সিদ্ধান্তে পৌছান যে দলীয় সংহতির (আসিবীয়াহ্-asibiyyah) প্রবল বোধই কোনো জাতিকে টিকে থাকতে সক্ষম করে তোলে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে অন্য জাতিকে ও বশীভূত করা যায় । তখন প্রভাবশালী দলটি অধীনের লোকদের সম্পদ আত্মীকরণ করে সংস্কৃতি আর জটিল নাগরিক জীবন গড়ে তুলে বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলে আবার এক নতুন চক্রের সুচনা ঘটে ।ইবনে খালদুন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম তিনি।মুকাদ্দিসা তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ।ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন আল মুকাদ্দসার দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন- জনগণের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ও নির্যাতন চালানো হলে তাদের সম্পদ উপার্জনের স্পৃহা নস্যাৎ হয়ে যায়। যখন স্পৃহা নষ্ট হয়ে যায় তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্রম ও সাধনা থেকে তারা হাত গুটিয়ে নেয়। আর জনপদ যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্রম বিমুখ হয়ে পড়ে তখন বাজারে মন্দা দেখা যায়। দেশের বাসিন্দা হয়ে ওঠে কর্ম বিমূখ এবং উজাড় হয়ে যায় নগর বন্দর আর জনপদ। ইবনে খালদুন লিখেছেন- ‘জুলুম ব্যাপক অর্থবহ, যারা কোন অধিকার ছাড়া সম্পদ আহরণ করে তারা জালিম। যারা অন্যের সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে তারা জালিম এবং যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে তারাও জালিম। মালিকানা হরণ কারীরাও সাধারণত জালিম। এসবের খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ে রাষ্ট্রের উপর সামাজিক বিকৃতির আকারে। সর্বস্তরে জনগণের সম্পদ লোপাট ও সর্বাবস্থায় জনগনকে শোষণ করার অনিবার্য পরিণতি থেকে উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তি সমষ্টি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিকৃতি। আজ ব্যক্তি চেতনা ক্লেদাক্ত সংকীর্ণ এবং সার্বজনীন আবেদন ও ঔদার্য থেকে অনেক দূরে। সামষ্টিক চেতনায় বিরাজ করছে তীব্র প্রতিযোগিতা পরস্পরের ঘাড়ে পা রেখে আকাশ ছোয়ার আকাঙ্খা সামাজিক বিপর্যয়ের সূচনা করছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রীয় চেতানায় রয়েছে প্রভূত্বের দাপট, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের দুর্নিবার, আকাঙ্খা; আর প্রভূত্বের আসন নিরাপদ করার জন্য লুটেরা মাস্তান দুষ্কৃতকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের অলিখিত কার্যক্রম। যে কারণে আজ ৯০ শতাংশ শোষিত বঞ্চিত লুণ্ঠিত মানুষ হতাশা ও বঞ্চনা নিয়ে নিরুপায় হয়ে নির্বিকার চিত্তে দুর্গতির শেষ সীমার দিকে এগিয়ে চলছে।আল্লামা ইবনে খালদুন (রহঃ) তাঁর মুকাদ্দামায় বলেন, “উক্ত চার ইমামের তাক্বলীদ গোটা বিশ্বে চালু হয়ে গেছে। অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বগণ (আলিমগণ) অন্যান্যদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন এবং সর্বসাধারণের মধ্যে মতবিরোধ ও মতানৈক্যের ধারা বন্ধ করে দিলেন। কারণ দ্বীনী ইল্মের পরিভাষাসমূহ অনেক শাখা-প্রশাখায় ব্যাপক রুপ ধারন করেছে। আর ইজতিহাদের স্তরে পৌঁছার মত প্রতিভার অনেক বিরল হয়ে যাচ্ছিল। তা ছাড়া অনুপযুক্ত-অযোগ্য লোক, যাদের মতামত বা ধর্মের ব্যাপারে, আস্থা রাখা যায়না। এমন ধরনের মুজতাহিদ নামধারীদের প্রাদুর্ভাবের আশংকায়, উক্ত বিদ্যান-অনুসারীরা, নিজেদের বেলায় অপারগতার (নতুন মতামত প্রতিষ্ঠার), অন্যদের নিরুৎসাহিত করনের এবং মুসলমানদের উক্ত চার ইমামের তাক্বলীদের দিকে ধাবিত করতে লাগলেন, নিজ নিজ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি। আর সতর্ক করতে থাকলেন যাতে কেউ কখনও একজনের আবার কখনও অন্যজনের তাক্বলীদ না করে। কেননা এটা একটা তামাশার বস্তুতে পর্যবসিত হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন মাযহাবের ধারাবাহিকতা অবশিষ্ট রইল না। প্রত্যেক মুকাল্লিদ ব্যক্তি নিজ নিজ মাযহাব সঠিক সূত্র-পরম্পরা ও পরিশুদ্ধি বজায় রেখে আমল করে আসছেন। যা কিনা বর্তমানে আমাদের সামনে‘ফিকাহ্’ নামে বিদ্যমান। তা ছাড়া এ যুগে যারা মুজতাহিদ হওযার দাবী করবে, তারা প্রত্যাখ্যাত। তাদের ‘তাক্বলীদ’ বা অনুসরণ নিষিদ্ধ। কেননা, তর্বমানে মুসলিম বিশ্ব উক্ত চার ইমামের তাক্বলীদেই সীমিত হয়ে গেছে।”
false
hm
নেভারেস্ট: পর্ব ২ What can be asserted without proof can be dismissed without proof. – Christopher Hitchens Extraordinary claims require extraordinary evidence. — Carl Sagan লাগসই উক্তি দু'টির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি সন্ন্যাসীদার কাছে নেভারেস্ট: পর্ব ১ আগের পর্বে আলোচনা করতে চেয়েছি পর্বতারোহণ নিয়ে মুসা ইব্রাহীম ও তার সঙ্গীদের একটি নির্দিষ্ট দাবি ও তদসংক্রান্ত বক্তব্যের অসঙ্গতি নিয়ে। এই অসঙ্গতিগুলো দূর না হলে, অন্নপূর্ণা-৪ পর্বতশৃঙ্গজয়ের যে দাবি তারা করেছেন, সেটি মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই। পাঠক যদি প্রথম পর্বটি পড়ে না থাকেন, পড়ে নেয়ার অনুরোধ রইলো। পাশাপাশি ধারাবাহিকতা বজায়ের জন্যে নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের অন্নপূর্ণা-৪ যাত্রার কিছু আলোকচিত্র নিয়ে তৈরি একটি ভিডিও এমবেড করছি। ভিডিওর দাবি অনুযায়ী ছবিগুলো তাদের নেপালী সদস্য সারিন প্রকাশ প্রধানের তোলা। Annapurna IV from Nanan Somossa on Vimeo. এই পর্ব শুরু করার আগে আমার পাঠকবর্গের কাছে আমাকে দুঃখপ্রকাশ করতে হচ্ছে, অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের জন্যে। তবে একটি মজার ব্যাপার লক্ষ করেছি। মুসা ইব্রাহীম প্রথম আলোর বুধবারের সাময়িকী "স্বপ্ন নিয়ে" পাতায় ধারাবাহিকভাবে নিজের এভারেস্ট জয়ের কাহিনী লিখছিলেন। নেভারেস্ট সিরিজের প্রথম পর্ব প্রকাশের পর তিনি এভারেস্ট থেকে নিজের অবরোহণের গল্পটি বেমালুম গিলে ফেলে পরবর্তী পর্বে ব্যক্তিগত আখ্যান বর্ণনা করে চলছেন। পাঠকের সুবিধার জন্যে আমি লিঙ্কসহ সারমর্ম দিচ্ছি। পর্ব ১, এভারেস্ট আরোহণ পর্ব ২, এভারেস্ট আরোহণ পর্ব ৩, এভারেস্ট আরোহণ ৬ জুলাই নেভারেস্ট প্রথম পর্ব প্রকাশের পর মুসার কলামে বিষয়গত পরিবর্তন আসে। পর্ব ৪, এ পর্ব থেকে মুসা এভারেস্ট থেকে নামতে ভুলে যান, এবং এক লাইনের মাথায় এভারেস্ট থেকে ঠাকুরগাঁয়ে নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পর্ব ৫, বিএমটিসির সাথে কলহ এবং এনএসিবি গঠনের পটভূমি পর্ব ৬, বিবাহের কিচ্ছা পর্ব ৭, লাংসিসা রি অভিযানের পটভূমি মুসা ইব্রাহীম কেন নিজের অবরোহণের গল্প লিখলেন না? কেন চেপে গেলেন একদম? যেখানে তিনি নিজেই লিখেছেন [১২], আর এ মুহূর্তে ভাবছি চূড়ায় ওঠাটাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব নয়। নিরাপদে নেমে আসাটাই পর্বতারোহণে সবচেয়ে বড় ক্লাইমেক্স। এই তথাকথিত "অবরোহণের" সময় তার প্রাণ সংশয় হয়, এবং অন্য দলের দু'জন পর্বতারোহী তার প্রাণরক্ষা করেন। এই দুই পর্বতারোহীর বক্তব্য থেকে এমন কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যা মুসার গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। সম্ভবত এ কারণেই মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট বেয়ে ওঠার গল্পটি রসিয়ে ফেনিয়ে তিন পর্বে লিখলেও, নেমে আসার ব্যাপারে বরাবর বাককুণ্ঠ রয়ে গেছেন, আর সবচেয়ে বড় ক্লাইম্যাক্সটিকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিশদ লিখছি পরে। আর জানিয়ে রাখি, সিরিজের মূল আকর্ষণীয় অংশটুকু [কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও ছবি] পরের পর্বে লেখার ইচ্ছা পোষণ করি। এই পর্বে মূলত প্রাথমিক সাক্ষ্য নিয়ে কথা বলতে চাই। আমার ক্ষেত্রে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের ঘটনাটির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে অন্নপূর্ণা-৪ নিয়ে তার ও তার পর্বতারোহণ সংগঠনের অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য। অন্নপূর্ণা-৪ শৃঙ্গজয় না করেই যদি শৃঙ্গজয়ের দাবি করা যায়, তাহলে সেই একই কাজ এভারেস্টের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্ত হয়নি, তা আমরা কীভাবে বলতে পারি? এখানেই চলে আসে সাক্ষ্য-প্রমাণের ব্যাপার। প্রথমেই প্রশ্ন আসে, এভারেস্ট জয় না করে কেউ জয়ের দাবি করতে পারেন কি না, এবং সেটি সর্বজনস্বীকৃত হতে পারে কি না। এডমাণ্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে এভারেস্টে চড়েছেন, তার প্রমাণ কী? তাদের সার্টিফিকেটও ছিলো না, বুদ্ধমূর্তির সাথে ছবিও ছিলো না। ছিলো কেবল কয়েকটি ছবি, আর নিচে কয়েকজন সহ-অভিযাত্রীর সাক্ষ্য। বাকি পৃথিবী সেগুলোকেই গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু সেই সত্যযুগের সমাপ্তি হয়েছে বহু আগেই। এভারেস্ট শৃঙ্গজয় আগের মতো এখনও একটি বেশ ব্যয়বহুল ব্যাপার, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যয় বহন করে কোনো স্পনসর। প্রচুর অর্থব্যয় যেখানে জড়িত, সেখানে হোক্সের [১][১৭] সম্ভাবনাও স্বাভাবিকভাবেই বেশি। প্রথমেই আসি মুসা ইব্রাহীমের গাইডদের ব্যাপারে। তিনি এভারেস্ট অভিযানের জন্যে বেছে নেন কৈলাস তামাং ও সোম বাহাদুর তামাং নামের দু'জন গাইডকে, যারা অন্নপূর্ণা-৪ অভিযানেও তার সঙ্গী ছিলেন। অন্নপূর্ণা-৪ এর অসঙ্গতি নিয়ে আমরা গত পর্বে জেনেছি অনেক কিছু, সেই সব কিছুর সাক্ষী ও সহচর এই দুই গাইড। আসুন, তারও আগে বিটিএমসির চুলু-ওয়েস্ট শীর্ষজয় নিয়ে মুসা ইব্রাহীমের নিজের কলমে কিছু লেখা [২] আমরা পড়ি। এ নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশণ থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা হলো। নূর মোহাম্মদও সার্টিফিকেট পেল। এমনকি যে আমি তাঁবুতে বসেছিলাম, সেই আমিও চুলু ওয়েস্ট জয়ের সার্টিফিকেট পেলাম। হায় চুলু ওয়েস্ট! দেশে ফিরলাম সবাই। এখানে তখন চুলু ওয়েস্ট জয়ের ডামাডোল বাজছে। বিএমটিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আল হককে ব্যাপারটা জানানোর পরও সেই ডামাডোল বন্ধ হয় নি। বরং শুক্রবার, ৮ জুন ২০০৭ তারিখে প্রেস কনফারেন্স করা হলো জাতীয় প্রেস ক্লাবে। এখানে অবশ্য বলা হলো সজল ও মুহিত চুলু ওয়েস্ট জয় করেছে, বাকি দু’জন করতে পারে নি। মুসা ইব্রাহীমের নিজের এ লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, ১. সোম বাহাদুর তামাং তাদের গাইড ছিলেন। ২. পর্বতশীর্ষ জয় না করেও সেই অভিযানের সকলে নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন থেকে সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। ৩. পর্বতারোহণ ক্লাবের প্রধানকে ব্যাপারটা জানানোর পরও মিডিয়াতে সত্য কথা বেরিয়ে আসেনি। এখানেই আমাদের সার্টিফিকেটভক্তি দুই দাগ কমে যাওয়ার কথা। প্রথমত, সোম বাহাদুর তামাং এমন একজন গাইড, যিনি সত্য সাক্ষ্য দেন না, এবং অসত্য সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে অনায়াসে একটি শৃঙ্গজয়ের সার্টিফিকেট কব্জা করা যায়। মুসার ড্রয়ারে চুলু ওয়েস্ট জয়ের যে সার্টিফিকেটটি পড়ে আছে, সেটা তাঁর কথামতো তিনি তাঁবুতে বসেই পেয়েছেন। আর মুসার এভারেস্ট জয়ের যে সার্টিফিকেটটির ওপর আমরা আস্থা এনেছি, সেটি তিব্বত মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের ইস্যু করা, এবং এটি ট্যুর অপারেটর সংগ্রহ করে থাকে। মুসার প্রাণ রক্ষাকারী দুই যুবকের একজন, ব্রেণ্ডান ও'ম্যাহোনি একটি সাক্ষাৎকারে আমাকে এমনটিই জানান। আমার প্রশ্ন ছিলো, সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্যে কী প্রমাণ দাখিল করতে হয়? ব্রেণ্ডান জানায়, সার্টিফিকেট তাদের ট্যুর অপারেটর সংগ্রহ করেছে, তাদের কোনো ধরনের প্রমাণ দাখিল করতে হয়নি। এ ধরনের সার্টিফিকেট বোধ করি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেও আমরা সংগ্রহ করি। বিআরটিএর গাড়ির ফিটনেসের সার্টিফিকেটকে এক্ষেত্রে তুল্য ধরা যেতে পারে। সার্টিফিকেট প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন [১৬]। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, নেপাল হয়ে এভারেস্ট আরোহণ করলে নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন সার্টিফিকেট ইস্যু করে, এবং তারা এখন প্রমাণ হিসেবে ভিডিও দেখতে চায়। পাঠক যুক্তি তুলে ধরতে পারেন, সোম বাহাদুর তামাং তো আর মুসার সাথে এভারেস্টে চড়েননি। তিনি ছিলেন বেইস ক্যাম্পে। মুসার সাথে গিয়েছিলেন কৈলাস তামাং। পত্রিকায় পড়তে পাই [৩], কৈলাশ তামাং প্রথম আলোর কাছে এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘আমাদের জন্ম হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট ওপরে। একেকজন তিন-চারবার করে এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছি। অথচ এভারেস্ট সামিটিয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, কৈলাস তামাং এভারেস্টে আরোহণ করেছেন মাত্র একবার, মে ১৫, ২০০৭ তারিখে, নর্থ-কোল নর্থইস্ট রিজ রুট ধরে [৪]। আর লাকপা নুরু শেরপা সম্পর্কে খোঁজ নেয়া একটু কঠিন হয়ে গেছে, কারণ লাকপা নুরু নামটা শেরপাদের মধ্যে খুব প্রচলিত। শেরপাদের প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই একজন করে লাকপা নুরু আছে। আমি খুঁজতে গিয়ে সাতজনকে পেয়েছি। সাধারণত শেরপাদের শুধু নাম বলা যথেষ্ঠ নয়, ব্র্যাকেটে লিখতে হয় তার গ্রাম বা গোত্র, যেমন তাতে, থামি, পারে, য়িলাজুং, চৌনরিখার্কা, ফুর্তে, ফোর্তসে, নামচেবাজার ... ইত্যাদি। তাই মুসার সঙ্গী লাকপা নুরু শেরপা এভারেস্টে এর আগে কয়বার উঠেছেন, বা আদৌ উঠেছেন কি না, তা তার ব্র্যাকেটের খবর না জানলে জানা সম্ভব নয়। মুসাকে নিয়ে লাকপা নুরু শেরপা কোনো বিবৃতিও দেননি, আর মুসার পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি যখন এভারেস্টে চড়েছিলেন তখন লাকপা নুরু শেরপা ধারেকাছে ছিলেন না। প্রথম আলোয় ২৫ মে, ২০১০ তারিখে প্রকাশিত ছবি দেখেও বোঝা যায়, মুসার পরিকল্পিত দলে শুরুতে লাকপা নুরু শেরপা ছিলেন না। আগাগোড়াই মুসার সঙ্গে ছিলেন কৈলাস তামাং। তবে এ কথা পরিষ্কার, নিজের কীর্তি সম্পর্কে কৈলাস তামাঙের দাবি অসত্য। পত্রিকার কাছে এসে যে গাইড নিজের সম্পর্কে অসত্য তথ্য দেন, তিনি এভারেস্ট আরোহণ নিয়ে কতটুকু সত্য সাক্ষ্য দেবেন, সেটা ভাবার বিষয়। আরো একটি প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে। সংবাদ সূত্র [৩] অনুযায়ী, এই তিন শেরপাকে মুসা বাংলাদেশে শুধু আমন্ত্রণই জানাননি, বেড়াতে নিয়ে গেছেন কক্সবাজার সৈকতে [১৩]। অথচ তার প্রাণ রক্ষা করেছেন যে ব্রেণ্ডান ও'ম্যাহোনি আর স্টিফেন গ্রিন, তাঁদের সম্পর্কে তিনি একেবারেই নিরব। একটি অক্ষরও তিনি তাঁদের নাম ধরে এখন পর্যন্ত কোথাও লেখেননি। হয় মুসা চরম অকৃতজ্ঞ, অথবা এই দু'টি নামের সাথে এমন কোনো তথ্য বা ঘটনা জড়িয়ে আছে, যা প্রকাশিত হোক, তা মুসা চাইছেন না। যদিও তিনি নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসে এই দুই তরুণকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের নামোচ্চারণ না করার ব্যাপারে তিনি সতর্ক থেকেছেন বরাবর। পত্রিকায় আমরা তাই পড়েছি একজন অস্ট্রেলিয়ানের [ও'ম্যাহোনি] কথা, কিন্তু নামটা জানতে পারিনি। বাংলাদেশে এই তিন শেরপা গাইডের জন্যে ভ্রমণের আয়োজন কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, নাকি কোনো ধরনের উৎকোচ, এ প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। মুসার ভাষ্যমতে, কৈলাস তামাং ওয়্যারলেস বার্তায় তার এভারেস্ট জয়ের খবর অ্যাডভ্যান্সড বেইসক্যাম্পে জানিয়ে দেন [৫]। সেখান থেকে শেরপা সর্দার ভোলা পড়েল তার প্রতিষ্ঠানের কাঠমাণ্ডু অফিসে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে এ সংবাদ জানিয়ে দেন [৬]। মুসার পর্বতজয়ের বার্তাটি নিশ্চিত করেছে হিমালয়ান গাইডস নামের এই প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত অভিযান আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই তাদের ওয়েবসাইটে শিখরজয়ীদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু হিমালয়ান গাইডস একটি অভূতপূর্ব ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে মুসার ক্ষেত্রে [৭]। ব্যাপারটি পরিষ্কার করে বোঝাতে পুরো পেইজের একটি স্ক্রিনশট তুলে দিলাম। পুরো পেইজের স্ক্রিনশটটি পাবেন এখানে। মনোযোগী পাঠক এখানে একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, ১৭ মে ও ২৫ মে এভারেস্ট শিখরজয়ীদের প্রত্যেকের নামের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা এসেছে। এ দুয়ের মাঝখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২৬ জনের H.G. International Everest Expedition 2010 [এই দলের উল্লেখ এভারেস্টের অন্য কোনো ওয়েবসাইটের ডিসপ্যাচ রেকর্ডে নেই, প্রয়োজনে নিজেই গুগলে খুঁজে দেখতে পারেন] দলের ২৫ জনকেই উপেক্ষার অন্ধকারে ঠেলে ফেলে দিয়ে এক ও একক মুসা ইব্রাহীমের কীর্তির জয়গান গাওয়া হয়েছে। Md. Musa Ibrahim has been successful to scale Mt. Everest Md. Musa Ibrahim, member of H.G. International Everest Expedition 2010, has been successful to scale 8,848 meter high Mt. Everest on 23rd May, 2010. Musa used the North Alpine route on the Tibetan side to conquer the top of the world. All 26 members of the expedition including 14 Sherpas got to the summit. Besides Musa, six British, three Montenegrins, an American and a Serbian are in the team. যদিও, অনিক খান লিখেছেন [৬], কিন্তু হিমালয়ান গাইডসের অফিসে ঢুকেই পাড়ওয়ালের টেবিলের ওপর দেখি স্তূপ করে রাখা আরোহীদের একগাদা ছবি এবং কাকতালীয়ভাবে সবার ওপরের ছবিটাই মুসা ইব্রাহীমের। অর্থাৎ, মুসার সঙ্গীসাথীদের নামধামও হিমালয়ান গাইডস কর্তৃপক্ষের নাগালেই ছিলো। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মুসা কি হিমালয়ান গাইডসের কোনো বিশেষ মক্কেল? এমন একজন ক্লায়েন্ট, যার নামটি অভিযাত্রী দলের একজন হিসেবে না এসে একটি পৃথক ভুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে যুক্ত হয়? এর পটভূমি সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায় সচল মুস্তাফিজের এই পোস্টে [৮] মুসার এভারেস্ট জয় নিয়ে সংশয় প্রকাশের প্রথম লগ্নে, যখন কোনো ওয়েবসাইটে কিংবা কোনো ডিসপ্যাচে মুসার নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই পোস্টের ৫৩ নং কমেন্টে আমরা দেখতে পাই, মুসা ইব্রাহীমের বন্ধু ও প্রথম আলোর সাংবাদিক সিমু নাসের এসে আমাদের জানাচ্ছেন, ৫৩ | সিমু নাসের (যাচাই করা হয়নি) | মঙ্গল, ২০১০-০৫-২৫ ১৭:০৯ মুসার এভারেস্ট জয় বিষয়ক ‌হিমালয়ান গাইডস নেপালের ওয়েবসাইট দেখতে ক্লিক করুন এই লিংকে http://www.himalayanguides.com/news_and_events.php মনে সন্দেহ আরো একটু ঘনীভূত হয়। মুসার নামে আলাদা একটি নোটিশ ইস্যু করানোর পেছনে কি মুসার এই বন্ধুদের কোনো তৎপরতা ছিলো? আমরা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখি, আমরা বুঝতে পারবো, মিডিয়ায় এ নিয়ে যে রিপোর্টিং হয়েছে, তা কতটুকু পেশাদার সাংবাদিকতা, আর কতটুকু বন্ধুকৃত্য। আমরা দেখেছি, এই সংবাদ ঢাকায় জানিয়েছেন মুসার বন্ধু অনিক খান, যিনি রহস্যময় কোনো কারণে সে সময় কাঠমাণ্ডুতেই অবস্থান করছিলেন। পুরো জাতিকে খবরটি আবেগের চোলাইসহ পান করিয়েছেন আনিসুল হক, যিনি মুসা ইব্রাহীমের নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি [তিনিই সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব সভাপতি, যিনি একজন পর্বতে-না-চড়া সাংবাদিক]। পুরোটা সময় এই ইভেন্টটি কাভার করেছেন মুসার বন্ধুরাই। এভারেস্ট জয় নিয়ে কোনো ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিবর্তে আমরা পেয়েছি মধ্যবিত্তের মনভোলানো নানা গালগল্প আর টুকে আনা বিবৃতি। গোটা ঘটনাটিই ছিলো একধরনের মিডিয়া হোয়াইটআউটের মধ্যে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, হিমালয়ান গাইডস কেন এ ধরনের অস্বাভাবিক নোটিশ ইস্যু করলো? মুসা ইব্রাহীমই বা কেন বিশেষ একজন মক্কেল হতে যাবেন? তাহলে চিন্তা করে দেখুন, মুসা ইব্রাহীম বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিডিয়াগ্রুপের একজন সাংবাদিক। তিনি এভারেস্টে চড়লেন বলেই তো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোতে দিনের পর দিন "হিমালয়ান গাইডস" নামটি উচ্চারিত হয়েছে। প্রথম আলোর উপসম্পাদক নেপাল পর্যন্ত ছুটে গিয়ে হিমালয়ান গাইডসের জ্যাঠা থামেলে অবস্থিত অফিসের কথা লিখেছেন। প্রায় ৪ লক্ষ সার্কুলেশন আর ২৪ লক্ষ রিডারশিপের [৯] এই পত্রিকার প্রথম পাতায় লিড নিউজে বিনা খরচে নিজেদের সুনাম প্রকাশের সুযোগ করে দেন যে মক্কেল, তিনি অবশ্যই বিশিষ্টজন। আর মুসা ইব্রাহীম তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। যে তরুণ-তরুণীর দল প্রথম আলোতে মুসার এই রোমাঞ্চকর যাত্রার খবর পড়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে এভারেস্টের দিকে যাত্রা করবেন [১০], তারা স্বাভাবিকভাবেই মুসার মাধ্যমে বা স্বপ্রণোদিত হয়ে হিমালয়ান গাইডসের শরণাপন্ন হবেন। মুসা এক বিরাট ক্লায়েন্টেলের অগ্রদূত। তিনি বিশিষ্টজন নন তো কী? প্রথম আলোতে আন্তর্জাতিক মক্কেলের জন্যে স্পট অ্যাডের রেট হচ্ছে কলাম-ইঞ্চি ৪৫০ ইউএস ডলার। মুসার খবরের পাশাপাশি হিমালয়ান গাইডস নামটা, কাঠমাণ্ডুতে তাদের ঠিকানাটা যদি সাত দিনে মেরে কেটে কুড়ি কলাম-ইঞ্চি জুড়েও থাকে, তাহলেও তো এই সুসম্পর্কের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৯,০০০ ইউ এস ডলার। মুসার খবর ওয়েবসাইটে আলাদা করে আসবে না তো কার খবর আসবে? আরো একটা জিনিস ভাবুন। মুসা ইব্রাহীম যদি এভারেস্ট জয় না করে থাকেন, তাহলে কি এই সুযোগটা আর ঈশ্বরী পড়েলের হাতে থাকে? দাঁওটা ফস্কে যায় না? মুসা এভারেস্টে চড়তে না পারলে সামনে চার-পাঁচ বছরে অন্তত বাংলাদেশের চার-পাঁচশো ক্লায়েন্টও ফস্কে যাবে। হিমালয়ান গাইডসের জন্যে কি সেটা বাঞ্ছনীয়? আমরা এখানে একটা খুবই জটিল পরিস্থিতি দেখতে পাই। মুসা জিতলে সবাই জিতছে। প্রথম আলো একটা ব্র্যাণ্ড ড্রাইভ দিতে পারছে [২০০৯ সালে মুসা যখন অন্নপূর্ণা-৪ অভিযানে ছিলেন, প্রথম আলো তখন গ্রীষ্মকালীন ব্র্যাণ্ড ড্রাইভ "বদলে যাও বদলে দাও" উপলক্ষে দেশের প্রবীণ বুদ্ধিজীবীদের হাতে ত্যানা ধরিয়ে দিয়ে সৈকতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো] , মুসা পাচ্ছেন দেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী হিসেবে নানা সম্মাননা, স্বীকৃতি এবং সুশীল হিসেবে সর্ববিষয়ে ওয়াজ-নছিহতের Carte Blanche [১৪], হিমালয়ান গাইডস মক্কেল হিসেবে পাচ্ছে বাংলাদেশের আগামী কয়েক বছরের সকল পর্বতারোহীকে, আর বাংলাদেশের নাকের-বদলে-নরুণে-তুষ্ট আমজনতা পাচ্ছে এভারেস্ট জয়ের তৃপ্তির বাতাসা। আর মুসা যদি হারেন, তাহলে প্রথম আলোকে হয়তো আবারও নতুন কোনো উছিলা নিয়ে পথে নামাতে হবে আনিসুজ্জামান-মনিরুজ্জামানদের, মুসা হয়তো পরের বছর বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টজয়ীর শিরোপা খুইয়ে বসবেন অন্য কোনো পর্বতারোহীর কাছে, আর হিমালয়ান গাইডসেরও ব্যবসা ফস্কে যাবে, পাবলিকের কথা বাদ দিলাম। সব দিক বিচার করে বললে বলা যায়, মুসা এভারেস্টে চড়েছেন, এমন একটি বিবৃতি দেয়া হিমালয়ান গাইডসের জন্যে লাভজনক। তাদের সাক্ষ্যকে তাই কুম গ্রানো সালিস বিবেচনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মুসা ইব্রাহীমের অসত্যভাষী গাইডের সাক্ষ্য, তার বাণিজ্যিক সম্পর্কে আবদ্ধ ট্যুর অপারেটরের সাক্ষ্য এবং সার্টিফিকেটের সহজলভ্যতা নিয়ে আমার এ সংশয়ের পর পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এভারেস্ট জয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ কী? আমার উত্তর, একাধিক স্পষ্ট ছবি, যেখানে এভারেস্টের আশেপাশের ভৌগোলিক ফিচারগুলো বোঝা যায়; একটি ভিডিও লগ; সম্ভব হলে অন্যান্য পর্বতারোহীদের ডিসপ্যাচে উল্লেখ। এই তিনটির একটিও মুসা এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে হাজির করেননি, কেবল একটি অস্পষ্ট ছবিকে এভারেস্টের শীর্ষে তোলা বলে প্রথম আলোতে প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি তিনি যত্রতত্র সম্বর্ধনা নিয়ে বেড়াচ্ছেন যেসব জায়গায়, সেখানেও ব্যানারে লোকজন তাঁর এভারেস্টের কোনো ছবি সংযোজন করতে পারেনি, অন্নপূর্ণা-৪ অভিযানে তোলা ছবি দিয়েই তারা মূর্খের মতো কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে মুসা কোনো সংশোধনী দিয়েছেন, কিংবা নিদেনপক্ষে সম্বর্ধনা আয়োজকদের নিজের একটি "এভারেস্টশীর্ষে তোলা ছবি" যুগিয়ে সহায়তা করছেন, এমন নমুনাও দেখা যায় না। নিচের ছবিতে দেখুন তার প্রমাণ, ব্যানারে যুক্ত ছবিটিতে মুসার অন্নপূর্ণা-৪ অভিযানের সহযাত্রী তৌহিদ হোসেনকে দেখা যাচ্ছে। সবশেষে বিবেচনা করতে হয় মুসা ইব্রাহীমের নিজের বক্তব্য। তিনি বেইস ক্যাম্পে ফিরে এসে ডয়েচে ভেলে আর বিবিসিকে পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন নিজের এভারেস্ট জয়ের কথা। এখানেও সেই একই হার আর জিতের হিসাব। মুসা ইব্রাহীমের বক্তব্য মতে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে তিনি এভারেস্টে গেছেন। এই অর্থের পরিমাণ একেক সময় একেক অঙ্কে জানা যাচ্ছে, আমার কাছে যে টিভি রিপোর্টটি আছে, সেখানে তিনি বলেছেন ছেচল্লিশ লক্ষ টাকার কথা [১৫]। মুসা ইব্রাহীমের ক্লাব সভাপতি আনিসুল হক জানাচ্ছেন [১১], টাকাটা আমরা তাঁকে জোগাড় করে দিতে পারিনি। মতি ভাই (মতিউর রহমান) কয়েকজনকে অনুরোধ করে লাখ ১২ টাকা জোগাড় করে দিতে পেরেছিলেন। অতএব, মুসা আর হকের বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিলে মুসা ৩৪ লক্ষ টাকা নিজের উদ্যোগে যোগাড় করেছেন। হকের ভাষায় [১১], কিন্তু মুসা তো তাঁর ফেসবুকে নিজের পরিচিতিতে লিখেই রেখেছেন, ‘ইফ আই টার্গেট সামথিং টু ডু, মাইন্ড ইট—আই উইল ডু ইট বাই অ্যানি মিনস।’ আমরা জানলাম, মুসা রওনা হয়ে গেছেন। ওর প্রবাসী বড় বোন মনির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ধার নিয়ে মুসা রওনা হয়ে গেছেন স্বপ্নপূরণের অনিশ্চিত পথে। ধরে নিচ্ছি এ বক্তব্যও সত্য, বোনের অ্যাকাউন্ট থেকেই ছেচল্লিশ বিয়োগ বারো রইলো চৌত্রিশ লক্ষ টাকা তুলে নিয়ে মুসা এভারেস্টে চড়তে চলে গেছেন। আমরা নিশ্চিত, এ সংক্রান্ত কাগজপত্রও মুসা প্রোডিউস করতে পারবেন। এতগুলো টাকা বাংলাদেশের বাইরে নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কেও শুনেছি কাগজপত্র নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, কাজেই এ সংক্রান্ত পেপারওয়ার্কস নিশ্চয়ই রয়েছে। পাঠক, ভাবুন একটু। মুসার জুতোয় নিজের পা ঢোকান। চৌত্রিশ লক্ষ টাকা ধার করে একটি অলাভজনক উদ্যোগ নিয়েছেন আপনি। লক্ষ একটি সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেটটি অর্জনও খুব একটা কঠিন কিছু নয়, যেহেতু এটি সংগ্রহ করবে আপনার ট্যুর অপারেটর হিমালয়ান গাইডস, যাদের স্বার্থ আমি একটু ওপরে ব্যাখ্যা করেছি। এই সার্টিফিকেটের জন্যে আপনাকে এভারেস্টের ওপরে উঠতে হবে। উঠতে না পারলে শক্তভাবে একটা মিথ্যা কথা বলতে হবে। আপনি একজন মধ্যবিত্ত যুবক, প্রথম আলো গোষ্ঠীর সাংবাদিক আর ফেসবুকে নিজের পরিচয় দেন এভাবে, ইফ ইউ টার্গেট সামথিং টু ডু, এভরিওয়ান ইজ রিমাইণ্ডেড—ইউ উইল ডু ইট বাই এনি মিনস। এনি মিনস? কী করবেন পাঠক, যদি এভারেস্টে উঠতে না পারেন? পেছনে পড়ে আছে আপনার দেড় বছরের সন্তান, উদ্বিগ্না স্ত্রী, মধ্যবয়স্ক উপসম্পাদক কাম ক্লাব সভাপতি আর চৌত্রিশ লক্ষ টাকার কথিত দেনা। সম্ভবত ইউ উইল ডু ইট বাই এনি মিনস। নেমে এসে "পারিনি" বলাটা আপনার জন্যে কোনো অপশন নয়। যেমন পারেনি মার্কেজের রেলাতো দে উন নাউফ্রাগোর লুইস আলেখান্দ্রো বেলাস্কো। কলম্বিয়াতে একজন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ছিলেন বলে সত্যটি পেয়েছে প্রকাশ, পাঠক পেয়েছে একটি নন-ফিকশন কাহিনি, আর বেলাস্কো পেয়েছে মুক্তি। The Story of a Shipwrecked Sailor বইটির প্রারম্ভিকায় মার্কেজ লিখেছিলেন, সবাই নিজের মূর্তি ডাইনামাইট দিয়ে ধ্বংস করতে পারে না, বেলাস্কো সেই বিরল ব্যতিক্রমদের একজন। মুসা বেলাস্কো নন, আর আমাদের দেশে সাংবাদিকদের মধ্যে হয়তো কেবল আনিসুল হক, সিমু নাসের আর অনিক খানেরাই আছেন, কোনো মার্কেজ নেই, তাই আমরা শেষ পর্যন্ত সংশয়ীদের গালি দিয়েই খুশি থাকি। ব্যস্ততার কারণে আগামী পর্ব লিখতে আমার একটু সময় লাগবে। পর্ব ৩ এ থাকবে কয়েকটি সাক্ষাৎকার [বিদেশী পর্বতারোহী, যাঁরা ২৩ মে এভারেস্ট সামিট বিডে ছিলেন], ম্যাপ আর ছবি, আলোচনা করা হবে এভারেস্ট অভিযানে মুসার বক্তব্যের কয়েকটি অসঙ্গতি নিয়ে। সিরিজটি সম্ভবত আগামী পর্বেই শেষ হবে, তবে পরিস্থিতিভেদে আরো একটি পর্ব লেখা হতে পারে। খুশি হবো যদি পাঠকেরা এই পোস্টে আলোচনা প্রাসঙ্গিক রাখেন। অপ্রাসঙ্গিক আলোচনাকে নিরুৎসাহিত করা হবে। ধন্যবাদ। তথ্যসূত্রঃ [১] এভারেস্ট হোক্স [২] "বিএমটিসি চুলু ওয়েস্ট জয় করেনি", মুসা ইব্রাহীম [৩] প্রথম আলোতে তিন শেরপা [৪] http://www.everestsummiteersassociation.org/component/content/article/13-nepal?start=13 [৫] পাহাড় ছোঁয়ার গল্প: পর্ব-৩, এভারেস্ট জয়ের সেই সকালটি, মুসা ইব্রাহীম [৬] "গোড়ায় বসে চূড়ার খবর", অনিক খান [৭] হিমালয়ান গাইডসের ওয়েবপেইজ [৮] মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয় এবং একজনের অভিজ্ঞতা [৯] বিজ্ঞাপনের হার, প্রথম আলো [১০] আমার স্বপ্ন: এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখি, সানজিদা কাঁকন  [১১] পাহাড়সমান প্রতিজ্ঞা হার মানল এভারেস্ট - আনিসুল হক [১২] "পর্ব-৪ পাহাড় ছোঁয়ার গল্প,পাহাড়ের ডাকে", মুসা ইব্রাহীম [১৩] ‘ইনি মনে হয় মুসা!’, আবদুল কুদ্দুস [১৪] "নেপাল ভ্রমণে স্বাগতম!", মোছাব্বের হোসেন [১৫] মুসার সাক্ষাৎকার, দেশ টিভি, ৩:০৪ [১৬] এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট প্রদান পদ্ধতি [১৭] Top women mountaineers clash over photo in race to scale highest summits
false
rg
ভুয়া ISBN নম্বর দিয়ে আর কতকাল চলবে বাংলাদেশ_ মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী দয়া করে কিছু একটা করুন!!! ISBN কি? International Standard Book Number। প্রকাশিত বইয়ের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ইউনিক নম্বর। প্রতিটি বই শুধুমাত্র এই একটি নম্বর দিয়ে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো বইয়ের ISBN নম্বর সঠিক নয়। কারণ তেরো ডিজিটের এই ISBN নম্বর ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে বাংলাদেশের কোনো বইয়ের পরিচয় জানা যায় না। তাহলে আমরা কেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করছি, এটা একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বটে!!! বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইপত্রে যে সকল ISBN নম্বর দেওয়া হয়, সবগুলোই বাতিল জিনিস ভুয়া নম্বর।। ইন্টারনেটে বাংলাদেশের কোনো বইয়ের ISBN নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে কিছুই দেখায় না। মানে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের এসব ISBN নম্বরের কোনো পরিচয় জানা যায় না। কারণ টা কি? প্রধান কারণ, সরকারিভাবে যে ISBN নম্বরটি একটি বইয়ের জন্য দেওয়া হয়, সেটি ভুল। যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি নেই। থাকলে আপনার বইয়ের ISBN নম্বরটি ইন্টারনেটে সার্চ দিলে আপনার বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানা যেত। আমাদের মহান প্রকাশকগণ বই প্রকাশের সময় যে ISBN নম্বরটি বইয়ে ব্যবহার করেন, এটার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ৪৩ বছর ধরে একটি দেশে ভুয়া ISBN নম্বর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যা নিয়ে সরকার বা আমাদের লেখক, প্রকাশক কারো কোনো আগ্রহ নেই। বিষয়টা সত্যিসত্যিই খুব পিড়াদায়ক। তাহলে আপনার বই প্রকাশ পেলেও আপনার বইয়ে যে ISBN নম্বর সেটি ভুয়া। ভুয়া ISBN নম্বর দিয়ে আপনি ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে এই বইয়ের কোনো পরিচয় জানতে পারবেন না। এজন্য এখন কী করতে হবে? সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ISBN নম্বর ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ যাবত প্রকাশিত সকল বইয়ের ISBN নম্বর সংশোধন করতে হবে। আর নতুন প্রকাশিত বইয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ISBN নম্বর ব্যবহার করতে হবে। নইলে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো বইয়ের পরিচিতি ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে জানার উপায় নাই। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সকল বই, টেক্সট, ছবি, অডিও, ভিডিও, প্রকাশনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য উপাত্তের কপিরাইট সংরক্ষণ, লাইসেন্সিং এবং পুনঃপ্রকাশের ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা বছর বছর আমরা যা কিছু প্রকাশ করি না কেন, আন্তর্জাতিকভাবে এটার কোনো স্বীকৃতি নেই। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আগারগাঁওয়ের শেরে বাংলা নগরে যে নামকাওয়াস্তে একটি অথর্ব আরকাইভস ও জাতীয় পাঠাগার আছে, সেখানে আলাদা একটি বিভাগ থেকে কপিরাইট ও ISBN নম্বর দেওয়ার প্রচলন আছে। সরকারিভাবে সেখান থেকে প্রকাশকদের/লেখকদের জন্য যে ISBN নম্বর দেওয়া হয়, সেটি ভুয়া। সেটি ঠিক করার কোনো উদ্যোগ বিগত ৪৩ বছরে নেওয়া হয় নাই। কেন নেওয়া হয় নাই, তা জানার উপায় নাই। হয় আমাদের সরকার এই বিষয়টি বোঝে না। অথবা এটি কার্যকর করার জন্য যে সব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। কয়েক বছর ধরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময় মেলায় আমাদের জাতীয় আরকাইভস ও জাতীয় পাঠাগারের একটি স্টল দেখা যায়। জাতীয় আরকাইভস ও জাতীয় পাঠাগার অধিদপ্তর থেকেই আমাদের সকল ISBN নম্বর প্রদান করা হয়। কিন্তু তারা যে ISBN নম্বরটি প্রদান করেন, সেটি ভুয়া। যার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। যদি থাকতো তাহলে সেই ISBN নম্বর দিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে সেই প্রকাশনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানতে পাওয়ার কথা। মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর, আমাদের ISBN নম্বর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত করার যথাযথ উদ্যোগ নিবেন বলেই আমরা আশা করি। নইলে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো কিছুরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলে ডিজিটাল উন্নয়নের নামে আমরা যা কিছু করব, সব আবর্জনা হবে। ৪৩ বছরে বাংলাদেশে যে বিষয়টি ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেটি এখন কিভাবে ঠিক হবে তা এখন দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে আমাদের প্রকাশক ও লেখকদের আরো সচেতন হবার এখনই সময়। নইলে প্রতি বছর আমরা যেসব বই প্রকাশ করছি, তার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না। কারণ, বইয়ে প্রকাশিত বা প্রদানকৃত ISBN নম্বরটি যে ভুয়া। ভুয়া ISBN নম্বর দিয়ে আর কতকাল চলবে বাংলাদেশ??? .............................. ৫ জানুয়ারি ২০১৫ ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৬
false
rn
রবীন্দ্রনাথের কোনো বিকল্প নাই- ৮১ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "প্রথম আলো" উপন্যাসের এক পাতায় রবীন্দ্রনাথ তার বৌদি নতুন বউঠান কাদম্বিরি'র শোক ভূলতে তাঁর স্ত্রী মৃনালিনী'র কাছে এলেন এবং তাদের প্রথম মিলনটির ঘটনা এভাবেই বর্নিত -" . . . . . দ্রুত বিছানার কাছে চলে এল রবি। এ ঘরে একটি মৃদু গ্যাসের বাতি সারারাত জ্বলে। স্বচ্ছ মশারি দিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটা পাশ বালিশ জড়িয়ে এক পাশে ফিরে ঘুমিয়ে আছে মৃণালিনী, গোলাপি ডুরে শাড়ি পরা, খানিকটা চুল এসে পড়েছে মুখের ওপর, তার ফাঁক দিয়ে ঝিকমিক করছে কানের হীরের দুল।মশারি তুলে ভেতরে ঢুকল রবি, অন্যদিন যাতে মৃনালিনীর ঘুম না ভাঙ্গে তাই সে সন্তর্পণে অনেকটা দুরত্ব রেখে শোয়, আজ সে পাশে আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল ওর মুখের চুল। সেই সামান্য স্পর্শেই চোখ মেলে তাকাল মৃনালিনী, চমকে উঠল না, উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল। রবি তার ঠোটে আঙুল বুলিয়ে দিল, তারপর তার নাক ও চোখের পাশে পাশে আঙুল দিয়ে যেন আঁকতে লাগল ছবি। মৃনালিনী তার আঙুলটা এক সময় চেপে ধরতেই রবি তাকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল। ছায়া থেকে শরীর অনেক বেশি আপন হতে পারে। শরীর অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়, এমনকি শোকও ভুলিয়ে দেয়।" বিদুষী মারাঠি রূপসী তরুণী আন্না তড়খড়।(আন্না পান্ডুরং তড়খড় জন্ম: ১৮৫৬—মৃত্যু: ১৮৯১) উঠতি কবির উত্তরকৈশোর ও প্রথম যৌবনের সন্ধিক্ষণে দেখা সুঠাম সুপুরুষ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনটির শেষ পর্যন্তই হূদয়ে পোষণ করে গেছেন আন্না।সম্ভবত আন্না-ট্যাগোরের প্রণয়-সম্পর্কের বিচিত্র এই বিরল ধারার কারণেই লাখ লাখ পৃষ্ঠার রবীন্দ্রচর্চার পরিসরেও আন্না পান্ডুরং তড়খড়ের কোনো জায়গা হয় না। ফলে কাদম্বরী, রানু আর ওকাম্পোকে নিয়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু কোলাহলের তলে অশ্রুতির পরম্পরায় আন্না-প্রসঙ্গটি আজ প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত। রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের আগস্টে মেজদা আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল আহমেদাবাদ ত্যাগ করে বোম্বাইতে তাঁর বন্ধু ডা. আত্মারাম পান্ডুরংয়ের পরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন—প্রধানত স্পোকেন ইংলিশে সড়গড় ও ইংরেজদের আদবকায়দায় ধাতস্থ হওয়ার উদ্দেশ্যে।গুজরাটের ‘প্রার্থনা সমাজ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আত্মারাম।আর তাঁর বিলাতফেরত কন্যা আন্না অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন নবীন রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজিয়ানায় প্রশিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:‘কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম যুগিয়ে—সেটা ভালো লাগল তাঁর কানে। ইচ্ছে করেছিলেন সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাঁথুনিতে; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে; বললেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।” ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ এই তরুণীর কথা স্মরণ করেছেন:‘তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হ’ল বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে।...সে-পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী। যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক।...তার স্তাবক-সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না—বিশেষ আরো এই জন্যে যে ঐ বয়সেই সে একবার বিলেত চক্র দিয়ে এসেছিল। সেসময়ে মেয়েদের বিলেত-যাওয়া আজকের মতন পাড়া-বেড়ানো গোছের ছিল না, মনে রেখো। ‘আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো ক’রেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে।—আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।‘একথা আমি মানব যে আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু হায় রে, সে-হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনোরকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। ‘একদিন সন্ধ্যাবেলা...সে আচম্্কা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত। চার দিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া!...কিন্তু আমি তখন কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছুই। মন কেমন করছে বাংলাদেশের জন্যে, আমাদের বাড়ির জন্যে, কলকাতার গঙ্গার জন্যে। হোমসিকেনস যাকে বলে। সে ব’লে বসল: “আহা, কী এত ভাবো আকাশপাতাল!”‘তার ধরনধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু যেন কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্নটি করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ারের খাটির উপরেই এসে বসল।‘কিন্তু কী করি—যা হোক হুঁ হাঁ ক’রে কাজ সেরে দিই। সে কথাবার্তায় বোধহয় জুৎ পাচ্ছিল না, হঠাৎ বলল :“আচ্ছা আমার হাত ধ’রে টানো তো—টাগ্্-অফ্্-ওয়ারে দেখি কে জেতে?” ‘আমি সত্যিই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তার এতরকম খেলা থাকতে টাগ্্-অফ্্-ওয়ারের কথাই মনে প’ড়ে গেল। এমন কি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হ’তে না হ’তে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হার মানা সত্ত্বেও আমার না হ’ল পুলক-রোমাঞ্চ না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হ’য়ে পড়েছিল। ‘শেষে একদিন বলল তেমনি আচম্্কা: “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” ‘ব’লে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করে নি।’ বউঠাকরুন কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের সুপুরি-কাটা হাতের গুণ ছাড়া অন্য-কিছুরই প্রশংসা করতেন না, ‘এমন-কি চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন।’ কিন্তু এই তরুণীর মুখেই তিনি প্রথম শুনেছিলেন তাঁর চেহারার প্রশংসা। আন্না তাঁকে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনো দিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে।’ ১১ নভেম্বর ১৮৭৯ তারিখে বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিট্লেডলের সঙ্গে আন্না-র বিবাহ হয়। ১৮৮০ সালে আন্না বরোদার রানির গৃহশিক্ষক রূপে নিযুক্ত হন। আন্না-র দুটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। আন্না-র মৃত্যু হয় ৫ জুলাই ১৮৯১ তারিখে এডিনবরা শহরে।বিবাহিত জীবনেও তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননি। সেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাক নাম ‘নলিনী’ স্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেন— তাঁর অপেক্ষাকৃত পরিণত মনেও সেই ‘আপন-মানুষের দূত’ গভীর স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছিলেন, এ তারই প্রমাণ। এ-প্রসঙ্গে এই তথ্যটিও উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’।এই পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘকাল পরেও রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। আন্না-র কনিষ্ঠা ভগিনী মানক-কে ২৯ জানুয়ারি ১৯১৪ তারিখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: It is nice of you to write to me as you have done. Youৎ voice belongs to that little world of familiar faces in a city of strangers where I took my shelter when I was seventeen and where you were just emerging from your nebulous stage of indistinctness....The other day when I accepted an invitation to come to Bombay I hoped to see you and talk to you of the old days spent under your father’s roof.
false
fe
আলোচিত অস্ত্র চালান ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বলয় আলোচিত অস্ত্র চালান ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বলয়ফকির ইলিয়াস==========================================বাংলাদেশে বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় হয়েছে। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ একটি রাজনৈতিক দল ও তাদেরই সরকারি ছত্রছায়ায় এমন একটি অস্ত্র পাচার মামলার রায় দেখার জন্য দেশের মানুষ ছিলেন উন্মুখ। দেখা যাক এই বিচারের রায়ে মাননীয় বিচারক সংক্ষিপ্তসারে কী বলেছেন। চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের একটি সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান চট্টগ্রাম স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবর রহমান। বিচারক বলেন, এটা একটি ট্রায়াল কোর্ট। সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাক্ষ্যপ্রমাণের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমার নেই। বিচারক বলেন এটি একটি বড় মামলা। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গোয়েন্দা সংস্থা এসএসআই ও ডিজিএফআই-এ কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা এই মামলায় আসামি হিসেবে আছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা গেছে তারা একে অপরকে জড়িয়ে কথা বলেছেন। তাতে বোঝা গেছে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া ও অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক ছিল। পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে এনএসআইয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে মিটিং করেছেন। পরেশ ও অনুপের সঙ্গে একই ফ্লাইটে দুবাই গেছেন এনএসআইয়ের ডিজি। বিচারক তার পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, রায়ের সারাংশে মতিউর রহমান নিজামীর বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে বিচারক বলেন, চট্টগ্রামে সিইউএফএল জেটিঘাট তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণে বিষয়টি উঠে এসেছে। বিসিআইসি ও সিইউএফএল জেটিঘাট নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা মতিউর রহমান নিজামী নিজেই স্বীকার করেছেন।সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বিষয়ে বিচারক বলেন, বাবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তার নির্দেশে ঘটনাস্থল থেকে ৫ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। অস্ত্র আটকের পর বাবর চট্টগ্রাম এসে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন, ‘এটা একটা সেনসেটিভ মামলা, তোমরা কেউ মুখ খুলবে না’। চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় রাজনৈতিক হয়রানির প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে বিচারক বলেন, লুৎফুজ্জামান বাবর ও মতিউর রহমান নিজামী বারবার অভিযোগ করেছিলেন তাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। কিন্তু সাক্ষীদের সাক্ষ্যে এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ মামলায় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি সাক্ষ্য দেননি। নিজামী ও বাবরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদাতা কেউ তাদের প্রতিপক্ষ দলের ছিলেন না। তাই নিজামী ও বাবরের যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমরা পেছন ফিরে তাকালে দেখবো এই ঘটনা ও মামলাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জঘন্য চেষ্টা করেছিল তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার। সেই রাতের ঘটনাটি ছিল এরকম। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে সিইউএফএল জেটিঘাটে ইঞ্জিন বোট থেকে ট্রাকে বোঝাইকালে অবৈধ অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়ে যায় পুলিশের দুই সার্জেন্টের হাতে। ঘটনার রাত ১০টার দিকে তৎকালীন বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির হাবিলদার গোপন সূত্রে টেলিফোন পেয়ে বিষয়টি জানান ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও কয়লা ডিপো ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীন ভূঁইয়াকে। টেলিফোন পাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ঘটনাস্থলের পাশের ঘাট থেকে নৌকাযোগে কয়লা ডিপো হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ঘাটে নামার পর তিনি টেলিফোন পান হাবিলদার গোলাম রসুলের কাছ থেকে।গোলাম রসুল তাকে জানান সিইউএফএল জেটি ঘাটে অস্ত্র নামছে বলে এক ব্যক্তি তাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন। দ্রুততম সময়ে ২ দফায় টেলিফোন পেয়ে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীনকে নিয়ে ছুটে যান সিইউএফএল জেটি ঘাটে। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন ঘাটে দুটি ইঞ্জিন বোট নোঙর করা আছে। এর একটি থেকে ক্রেনের সাহায্যে কাঠের বাক্স উঠানো হচ্ছে অপেক্ষমাণ ট্রাকে। সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীন সেখানে পরিচিত কিছু শ্রমিককে দেখতে পেয়ে জানতে চান- এ সব কী হচ্ছে। তখন উলফা নেতা পরিচয়ের আবুল হোসেন (মেজর লিয়াকত) জানান, তারা এসব মালের মালিক। এগুলো অস্ত্র। প্রশাসনের সবাই এ বিষয়ে জানে। তখন দুই সার্জেন্ট এসব অস্ত্রের বৈধ কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে চোরাচালানি হাফিজ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, কিসের কাগজ? বাধা দিলে আপনাদের ক্ষতি হবে। পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি বেড়ে যেতে থাকলে খালাস কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকেন। কারণ তাদের জানানো হয়েছিল এসব অস্ত্র খালাসে সরকারের তদারকি থাকবে। কিন্তু দুই পুলিশ সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও হেলাল উদ্দীন নাছোড় বান্দা থাকায় এক পর্যায়ে অস্ত্র খালাস কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে পুলিশ দল নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান হাবিলদার গোলাম রসুল। তারপর পৌঁছেন কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমানও। পরিস্থিতি হয়ে যায় জটিল। এ সময় চোরাচালানি হাফিজ ক্ষিপ্ত হয়ে বলতে থাকেন- তোদের বাপ ডিজিএফআইয়ের বড়কর্তার সঙ্গে কথা বল। তিনি লাইনে আছেন। এতে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ভয় পেয়ে যান। কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরই মধ্যে ঘটনার খবর পৌঁছে যায় সিএমপির ডিসি পোর্টসহ পুলিশের অনেক কর্মকর্তার কাছে। অবস্থা বেগতিক দেখে চোরাচালানি হাফিজ উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের মোটা অংকের টাকা দিতে তৎপর হলেও পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় পুলিশ এতে সায় দেয়নি। এরই মাঝে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলে চোরাচালানি হাফিজসহ জড়িত সবাই সটকে পড়ে। আর এতেই ধরা পড়ে যায় দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অবৈধ অস্ত্রের চালানটি।স্মরণ করা দরকার, এ ঘটনার পর ওই দুই সার্জেন্টকে অস্ত্র খোয়া যাওয়ায় সাসপেন্ড ও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিয়ে নিরপরাধ প্রমাণিত হন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা চাকরি ফিরে পান। ঘটনার সরকারি তৎপরতা এতোই নির্মম ছিল, দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের রাতে হেলাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিনদের সাহসিকতায় ধরা পড়ে দেশ-বিদেশে সাড়া জাগানো অস্ত্রের চোরাচালান। পরে আবার এই দুই সার্জেন্টকেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বানানো হয়েছিল ‘খলনায়ক’, আটক অস্ত্রের চালান থেকে একে-৪৭ রাইফেল চুরি করে অন্যের কাছে বিক্রির মিথ্যা অভিযোগে তাদের করা হয়েছিল চাকরিচ্যুত। অস্ত্র মামলায় প্রায় ২৭ মাস কারাগারে রাখা হয়েছিল তাদের। র‌্যাব কার্যালয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে দুজনের পা ভেঙে দেয়া হয়েছিল দুজনের ভূমিকা ও সাহসের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) এডভোকেট কামাল উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিনের কারণে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এ জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার ও প্রভাবশালী আসামিদের ইন্ধনে তাদের অস্ত্র মামলার আসামি করে, পায়ে ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালতে এনে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। হয়রানির কারণে বাধ্য হয়ে তারা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু সর্বশেষ ২০১২ সালে তারা নির্ভয়ে আদালতে সত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের সাহসী ভূমিকার কারণেই অস্ত্র মামলায় আসামিদের দোষ প্রমাণ করা রাষ্ট্রপক্ষের জন্য সহজ হয়েছে। আর অধিকতর তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তাও তদন্তে গতি পেয়েছিলেন।পিপি কামাল উদ্দিন আহাম্মদ আরো বলেন, ২০০৪ সালে আটক অস্ত্রের চালান থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল চুরির অভিযোগে দুই সার্জেন্টকে ২০০৫ সালে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। পরে তাদের নোয়াখালী থানার সুধারামপুর থানার একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই সময় র‌্যাব কার্যালয়ে তাদের মারধরও করা হয়। পরে সিআইডির তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২০০৪ সালে আটক অস্ত্রের চালানের মধ্যে একে-৪৭ অস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। অথচ তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তাদের অপরাধ ছিল, তারা অস্ত্র আটকের ঘটনায় সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।২০১২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমানের আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে সার্জেন্ট হেলাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, বদলি সূত্রে আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট আমাকে ডিএমপির দক্ষিণ বিভাগে ডেকে নেয়া হয়। পরে তুলে দেয়া হয় র‌্যাবের হাতে। র‌্যাবের উত্তরা কার্যালয়ে নেয়ার পর র‌্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল গুলজার ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় বেশ কিছু তথ্য জানতে চান। একপর্যায়ে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে আমার সামনে আনা হয়। পরে দুজনকে র‌্যাব পাহারায় চট্টগ্রামে র‌্যাব ৭-এর কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ২০ আগস্ট চট্টগ্রামে র‌্যাব কার্যালয়ে আনার পর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমদাদের কক্ষে নেয়া হয়। সেখানে অধিনায়ক জানতে চান সার্জেন্ট হেলালকে। আমি পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাপ্পড় মেরে মাটিতে ফেলে দেন এবং লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে বাম পা ভেঙে দেন।এসব ঘটনা ঘটেছিল সেই সময়ের প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতে। মামলার রায়ে মাননীয় বিচারক বলেছেন, চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটি ঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্র জব্দের পর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানালেও তিনি নীরব ছিলেন। বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক সাদিক হাসান রুমী সাক্ষ্য দেয়ার সময় জানিয়েছিলেন, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অস্ত্র আটকের ঘটনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ কথায় তখন নীরব ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী একটি তদন্ত কমিটি করবেন বলে রুমীকে জানান। এ ঘটনাও মামলায় এসেছে। এমনকি হাওয়া ভবনের জড়িত থাকার কথাও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।এছাড়া বিভিন্নজনের জবাববন্দির ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের। আর এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল ভারতের আসাম রাজ্যের বিছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে একটি কালোশক্তি সবসময়ই সহিংস অস্ত্রের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং করে যাচ্ছে। এরা কারা তা এই প্রজন্মের অজানা নয়। এরা নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও এর ধারাবাহিকতার বিরোধিতা করে যাচ্ছে। দেশে তাদের টাকাকড়ির শক্তিও কম নয়। তারপরও আমরা দেখছি এদেশের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলধারাকেই সমর্থন করে যাচ্ছেন। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই জেতার সম্ভাবনা ছিল বলে একটি মার্কিন সংস্থার জরিপের ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে মার্কিন নীতি-প্রচারক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল পুরো বাংলাদেশে জরিপটি চালায়। বহু স্তরভিত্তিতে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে জরিপটি চালানো হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নিলে আওয়ামী লীগ ৪২.৭% ভোট পেতো। আওয়ামী লীগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এই কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে পারলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা ভালো ফল করতে পারতো। বাংলাদেশের উন্নয়নের এখনো প্রধান শত্রু সেই পরাজিতরা, যারা একাত্তরে হেরে গিয়েছিল। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ডানপন্থী সুবিধাবাদীরা। এরা এখনো মনে করে ভারতই বাংলাদেশের প্রধান শত্রু, পাকিস্তান নয়। কারণে-অকারণে এরা ভারতের বিরুদ্ধে জিগির তোলে। অথচ তারা ভুলে যায়, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। তাই ভারতের কোন ‘হরিনাথ পোদ্দার’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কী বললো না বললো তাতে কি বাংলাদেশের মানুষের কিছু যায় আসে?--------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
false
mk
জামায়াতের চক্রান্তেই জঙ্গিবাদের বিস্তার, নিষিদ্ধ নয় কেন ধর্মের নামে রাজনৈতিক অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। এ দেশকে জঙ্গিবাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত জামায়াতে ইসলামী। তাই জঙ্গি নির্মূল করতে হলে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধর্মীয় রাজনীতির নামে অপতৎপরতা রোধ করতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলের লহরী হলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদের হুমকি : বাংলাদেশ ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে দেশের সুধীজনরা এ মতামত দিয়েছেন।সেমিনারে বক্তারা জঙ্গিবাদের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘আপসকামিতাও’ দায়ী। আল-কায়েদাপ্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সাম্প্রতিক অডিওবার্তায় বাংলাদেশের প্রতি হুমকিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবিষয়ক এ আলোচনায় বক্তারা আরো বলেছেন, দেশে ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করছে তারা ক্ষমতার স্বার্থে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়, এ দলটি স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সেমিনারে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অংশ নেন। প্রাণবন্ত মত প্রকাশের এ অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি অনেকে ভিডিও কনফারেন্স ও স্কাইপের মাধ্যমেও যোগ দেন।সেমিনারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, জঙ্গিবাদ এখন হুমকি নয়, এটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতা যদি আমরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি তা হলে অনেক মূল্য দিতে হবে। সরকারি দল ও যাঁরা প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। নেতাদের জনগণের কাছে যাওয়া উচিত। জনগণের কাছে যেতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, যার প্রমাণ প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচন। তিনি আরো বলেন, সরকারে থাকা ১৪ দলের নেতারা যদি মন্ত্রিত্ব আর সুবিধার রাজনীতি করেন, তা হলে আমরা জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি পাব না। জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করাই এখন দেশের প্রধান কাজ। যাঁরা বলছেন আরেকটি নির্বাচন করাই এখন সরকারের প্রধান কাজ তাঁদের বলব, জাতিকে ভুল পথে নিয়ে যাবেন না। আরো একটি সতর্কবাণী- জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করতে হবে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না।সেমিনারে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা এ কে মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের জনক জামায়াতে ইসলামী। তাদের অর্থের উৎস খুঁজতে হবে। স্বাধীনতার পর জামায়াত মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করে এখন ইউরোপ থেকে অনুদান নিচ্ছে তারা। যুক্তরাজ্যে টিভিতে প্রচারণা চালাচ্ছে জামায়াত।বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ধর্মের রাজনীতি ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আধুনিক বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বর্তমান সময়ে বিশ্ব যে দানবের মুখে দাঁড়িয়ে তা হচ্ছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাদ জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আর তাই বিশ্বে জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় গ্লোবাল টাস্কফোর্স গঠন এবং সরকারের প্রগতিশীল দল ও সংগঠনগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান সরকারের সাংগঠনিক দুর্বলতা দেশে জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জঙ্গিবাদের অবস্থান রয়েছে। জঙ্গিবাদের একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক যদি আমরা না বুঝি তবে জঙ্গিবাদ দমন অসম্ভব। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী থাকলে দেশে ‘জঙ্গিবাদের চাষ’ হবে। তাই এই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বারবার বলা হয় জামায়াত জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। যদি তারাই এটা করে থাকে তবে কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। জঙ্গি সংগঠন হিসেবে হিজবুত তাহরীর ও জেএমবিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে কেন সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারছে না?মানবাধিকার নেতা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, জঙ্গিবাদ একটি ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলা’। জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আপসকামী রাজনীতির কারণে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যাঁরা দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তাঁদের ওপর ওরা সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।সেমিনারে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আমীর-উল ইসলাম বলেন, জঙ্গিবাদকে কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে ভুল হবে। তাদের উত্থানকে দেখতে হবে সমগ্র বিশ্বের আলোকে। বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা নেই। জঙ্গিবাদ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রতিটি মসজিদের ইমাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ ধর্মীয় নেতাদের একত্রে কাজ করতে হবে।দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেছেন, বারবার জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতের নাম এলেও কেন তাদের নিষিদ্ধ করছে না সরকার? জামায়াত রাজনৈতিক তৎপরতার আড়ালে জঙ্গিবাদের বিস্তারে সক্রিয় আছে। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে গ্রামে জামায়াতের মহিলা কর্মীদের দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, রাজনৈতিক বিভাজন থাকলে জঙ্গিবাদ সমস্যার সুরাহা হবে না। জঙ্গিবাদ কোনো দলের সমস্যা নয়, এটি এখন দেশের জাতীয় সমস্যা। মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্ররা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এটি একটি ভুল ধারণা। কেননা দেশের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় পড়ে।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সরোয়ার আলী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ভাবাদর্শের সংগ্রাম। এ অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে এখন তৃণমূল মানুষের কাছে ইসলামের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।সেমিনারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, ইসলামী সংগঠনের নামে মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে। জিহাদের কথা বলে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে এখনই সবাইকে সচেতন হতে হবে।প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক এলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী। কাওমি মাদ্রাসা, সাধারণ মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা যেন তিন দেশের তিনটি শিক্ষা পদ্ধতি। এখানে মনিটরিং নেই।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের ছায়ায় রেখে দেওয়ার কারণেই জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গির উত্থান। তারা (বিএনপি-জামায়াত) অনেক হিসেবী হয়ে এগিয়েছে, নির্বাচনের ফল তা প্রমাণ করে। জামায়াতের আর্থিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে সরকারকে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার আমলা ও গোয়েন্দানির্ভর হলে কাজটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, এখন মনে হচ্ছে ধর্ম ও জঙ্গিবাদ সমান্তরাল হয়ে গেছে। অথচ পৃথিবীতে কোনো ধর্ম জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। তাহলে কিভাবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে ধর্ম আসে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।সেমিনারে সাবেক বিচারপতি আবদুর রশিদ বলেছেন, বাংলাদেশে ৪০টির মতো জঙ্গি সংগঠন ক্রিয়াশীল। জঙ্গিবাদের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২২ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, বর্তমানে প্রশাসনের যে দুরবস্থা তা থেকে জঙ্গি দমন তো দূরের কথা, সুশাসন নিশ্চিতও কঠিন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে দক্ষ করতে হবে, বিএনপি-জামায়াতের সময় প্রশাসনে যারা তাদের অনুগত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের সরিয়ে ফেলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীদের সরকারি চাকরিতে ঢোকা বন্ধ করতে হবে।সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। জঙ্গিবাদ একটি রোগ। আমাদের এ রোগের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। আর তা যদি না হয়, তবে বাংলাদেশ অগ্রসর হবে না।’শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদদীন মাসউদ বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে। আর জামায়াত যেহেতু সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াতের সব ধরনের প্রকাশ বন্ধ করতে হবে।সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, বাংলাদেশে জাওয়াহিরির অসংখ্য অনুসারী জঙ্গি নেতা রয়েছেন, যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকে মনিটরিং সেল গঠন করে মাদ্রাসাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।সেমিনারে আরো অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের বার্তা সম্পাদক গাজী নাসিরউদ্দীন, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নূরন্নবী প্রমুখ।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমির অনুষ্ঠাটি সঞ্চালনা করেন।- See more at: Click This Link
false
fe
আব্দুস সামাদ আজাদ _ একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের স্মৃতিকথা আব্দুস সামাদ আজাদ : একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের স্মৃতিকথা ফকির ইলিয়াস ====================================== ‘এই প্রজন্ম একদিন সত্য ইতিহাস জানতে পারবে। একদিন তারাই ঢেকে দেবে সব আঁধারের কালিমা। এই প্রজন্মই একদিন বাস্তবায়ন করবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের।’ কথাগুলো প্রায়ই বলতেন বর্ষীয়ান জননেতা আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ। সেই প্রত্যয় বুকে নিয়েই তিনি আজ পরপারে। তিনি চলে গেছেন চিরতরে। যে নিবাস থেকে কেউ কোনদিন আর ফিরে আসে না। মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের কথা। আমি তখন একজন কিশোর স্কুল ছাত্র। সিলেটের সারদা স্মৃতিভবনে এক সংবর্ধনা সভায় তার হাতে একগুচ্ছ ফুল তুলে দিয়েছিলাম। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের একজন রাজনীতিকের হাতে পুষ্পগুচ্ছ তুলে দেয়ার আনন্দ একজন কিশোরের কাছে তখন ছিল দিগ্বিজয়ের মতো। মনে হয়েছিল, একজন প্রথম সারির রাজনীতিক বোধ হয় অন্য কোন গ্রহের মানুষ। না, জননেতা সামাদ আজাদ অন্য কোন গ্রহের মানুষ ছিলেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। হাওর-বাওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি। গ্রামের মানুষের জীবন-প্রচলন আমার চাইতে কে ভালো বুঝবে।’ দেশে এবং প্রবাসে অনেকবারই এই কিংবদন্তী নেতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। কখনো জনসভায়, কখনো ঘরোয়া আড্ডায়, কখনো সাক্ষাৎকার গ্রহণে, কখনো মতবিনিময়ে। সামাদ আজাদের একটি কথা আমার বুকে খুব বাজতো। তিনি বলতেন ‘আমি তো বর্ধিত জীবন নিয়েই বেঁচে আছি। আমি তো আমার সহযোদ্ধা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের সহযাত্রী হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ৩ নভেম্বর ’৭৫ই ছিল আমার মৃত্যু দিবস। কিন্তু মহান করুনাময় আমাকে জালেমদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।’ সেই গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ২৭ এপ্রিল ২০০৫ তাঁর বর্ধিত জীবনেরই অবসান ঘটিয়ে চলে গিয়েছেন পরপারে। চলে গেছেন একজন রাজনৈতিক অভিভাবক। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এক চরম ক্রান্তি লগ্নে হাল ধরেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির জনক হত্যাকান্ড, জেল হত্যাকান্ড, সামরিক শাসনের দাঁতাল পেশীশক্তি যখন আওয়ামী লীগকে ভীষণ দুর্বল করে তুলেছিল তখন লীগের অনেক নেতাই হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সামাদ আজাদ। তাঁর অসম ধৈর্য, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার ফলেই ১৯৭৮-৭৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রাণ পেতে শুরু করেছিল পুরোমাত্রায়। সে সময়ে গ্রামে গ্রামান্তরে তিনি আপামর জনসাধারণকে যে সাহসটি তার বক্তব্যে দিয়ে বেড়াতেন তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে কেউ ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। মুজিব হত্যার বিচার বাংলাদেশে হবেই। তাঁর সে স্বপ্ন যে বাস্তবতার পরশ পেয়েছে তা বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করবেন। দুই. প্রবাদপ্রতিম এই জননেতাকে ঘিরে অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে। ১৯৮৯ এর ঘটনা। বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদ শাহীর শাসনের টালমাটাল সময়। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা বাংলাদেশে স্বৈরশাসন অবসানের লক্ষ্যে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাদ আজাদ তখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন। নিউইয়র্কের কার্ডিনাল স্পেলম্যান সেন্টারে তিনি প্রবাসীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সে সভায় তিনি স্পষ্ট বলে ছিলেন ছাত্রজনতার গণঅভ্যূথানেই এরশাদ সরকারের পতন হবে শীঘ্রই। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু এরশাদ তো বলেই যাচ্ছেন তাকে কোন শক্তিই সরাতে পারবে না। সামাদ আজাদ বলেছিলেন, কোন শক্তি তাকে সরাবে- তা সময় এলেই তিনি দেখতে পারবেন। ৯০এর গণঅভ্যূথানে এরশাদ সরকারের শোচনীয় পতন ঘটেছিল। আব্দুস সামাদ আজাদ সিদ্ধান্ত নিতেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে। একজন সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কিংবা ৯৬ পরবর্তী সময়ে তিনি যে আন্তর্জাতিক দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তা ছিল প্রণিধানযোগ্য। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড, ফন্সান্স, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশগুলোর সাথে যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল- তা বিদেশের এসব দেশে রাজনীতিকরাও স্বীকার করেছেন অকপটে। আজো স্মরণ করছেন শ্রদ্ধার সাথে। তিনি বলতেন, চলমান বিশ্ব হচ্ছে কুট-কৌশলের ক্ষেত্র। আর তাই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে সেই কুটনৈতিক বিচক্ষণতাকে সামনে রেখেই। মডার্ণ গ্লোবাল ভিলেজের সাথে সঙ্গতি রাখতে হবে। ১৯৯৪ সালের কথা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সে মতবিনিময় সভায় আমার উপস্খিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একটি প্রশ্ন করতেই ছাত্রলীগের কিছু তরুণকর্মী আমাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। কারণ প্রশ্নটি ছিল আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল ও সংস্কার বিষয়ে। মনে পড়ছে, সামাদ আজাদ সাথে সাথেই ঐসব তরুণ কর্মীদের কে হাত উঠিয়ে থামতে বলেছিলেন। তিনি জোর গলায় বলেছিলেন ‘ফকির ইলিয়াস-কে প্রশ্ন করতে দাও।’ সাথে সাথে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন- হ্যাঁ আপনি প্রশ্ন করুন। আমি সব কথা শুনতে চাই এবং জবাব দিতে চাই।’ সামাদ আজাদের মুক্ত মানসিকতা ছিল অত্যন্ত বিশাল। তিনি বলতেন পাহাড় সমান সমস্যা আসবেই। তা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন। আর রাজনীতিতে সৃজনশীল ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তিন. ২০০০ সালে নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া ওয়ার্ল্ড ম্যানরের বিলাসবহুল বলরুমে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে এক বর্ণাঢ্য নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালীরা। সেই সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যই হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমি আজীবন সত্যের পক্ষেই গণমানুষের স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করে গেছি।’ সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একান্ত আলাপচারিতায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একজন রাজনৈতিক হিসেবে আপনার এই অগ্রজ সময়ে একান্ত ভাবনাগুলো কি? সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে চাই। অবসরে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হতে চাই না। মহান সর্বশক্তিমান তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছেন। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন কালেই তিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। দেশ ও জনগণের দেয়া পবিত্র আমানতী দায়িত্ব পালনকালেই তিনি চলে গেছেন পরপারে। সামাদ আজাদ যখনই যুক্তরাষ্ট্রে কোন সফরে এসেছেন তখন ম্যারিয়ট, প্লাজা কিংবা গ্র্যান্ড হায়াট হোটেলের কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘ফকির ইলিয়াস তো বেশি বেশি প্রশ্ন করবে। তাই তার প্রশ্ন উত্তর দিয়েই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করবো।’ তাঁর উত্তরে যেমন যুক্তি থাকতো-তেমনি থাকতো ঐতিহাসিক উদাহরণ। প্রশ্ন করলে পাশ কাটিয়ে যেতেন না তিনি। জবাব দিতেন সরাসরি। যা একজন বরেণ্য রাজনীতিক দ্বারাই সব সময় সম্ভব হয়। সম্ভব হয় সেই রাজনীতিকের প্রাজ্ঞতার চেতনার আলোকে। তাঁর ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৫১ বছরই তিনি ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর এই সংগ্রামী জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অবসান হয়েছে। কিন্তু থেকে গেছে তাঁর কর্ম। তাঁর চেতনা। তাঁর আদর্শ। আজ যারা তরুণ রাজনীতিক- তারা সামাদ আজাদের ত্যাগী রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করলে উপকৃত হবেন, সন্দেহ নেই। তাঁর মহত্বই হতে পারে একজন অনুসারী রাজনীতিকের পাথেয়। শেষ সাক্ষাৎকালে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখনো আপনাকে মিছিলের অগ্রভাগে শক্ত হাতে সারিবদ্ধ দেখা যায়। এতো শক্তি পান কিভাবে? উচ্চ হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমার বাহুতে হাত দিয়ে দেখো- এই শক্তি বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মজলুম জনতার। হ্যাঁ, সেই অসীম শক্তির অধিকারী ছিলেন সামাদ আজাদ। বীর সেনানীর মতোই তিনি চলে গেছেন- বাংলার মানুষকে কাঁদিয়ে, বাঙালী জাতির হৃদয় শূন্য করে। তাঁর ঐতিহাসিক কর্মজীবন ব্যাপকভাবে আলোচিত হোক। তাঁর কর্মযজ্ঞ ধারণ করা হোক রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পের বড় বড় ক্যানভাসে। তিনি অমর হয়ে থাকবেন। যতোদিন থাকবে এই বাংলা, এই বাঙালি জাতি। # --------------------------------------------------------------------- দৈনিক উত্তরপূর্ব / সিলেট / ২৭ এপ্রিল ২০১০ সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:০০
false
ij
গল্প_ সাইকেল কড্ডার মোড়ে উঠে মোটর সাইকেলটা ডান দিকে বাঁক নিতেই ঘটনাটা ঘটল। চোখের নিমিষেই ঘটল। রড ভর্তি ট্রাকটাকে আসতে দেখেছিল ঠিকই -ওটা হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর পড়ার আগে লাল রঙের হেলমেটের নিচে ঘাড়ের কাছে যমুনার গরম বাতাসও টের পেয়েছিল সে ... বগুড়াগামী একটা বাস ধূলো উড়িয়ে পশ্চিমে চলে যাচ্ছিল। তার পিছন পিছন সেই বেপরোয়া খুনি ট্রাকটি ... তখন সবে দুপুর। হাইওয়ের ওপর -হাইওয়ের চারপাশে শেষ ফাল্গুনের রোদ ঝলমল করছিল; পেট্রলের গন্ধ, রাস্তার দুই পাশে ধূলিধূসরিত গাছপালা, মনোহারীর দোকান, কয়েকটা ভ্যানরিকশা, একটা নসিমন; স-মিল, ভাতের দোকান, কাঠের ঢাউশ স্পিকারে বিকট কন্ঠে মমতাজের গান ...আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো পাড়ার ককিলে ...এসব ঠিকই ছিল ... আর, ঘাতক ট্রাকটা চলে যাওয়ার সময় জনতা ক্রদ্ধ আক্রোশে হই হই করে উঠেছিল ঠিকই... তো, এসব শোনার কথা নয় শহীদুলের ...ওর চোখে তখন অথৈই অন্ধকার । দেলদুয়ার যাওয়ার দরকার ছিল শহীদুলের । বারোটার দিকে ভাত খেয়েই রওয়া দিয়েছিল । স্বপ্না, শহীদুলের বউ, আজ সকাল থেকেই বিনবিন করছিল। আমারে বাপের বাড়ি রাইখা আসেন ... আমারে বাপের বাড়ি রাইখা আসেন ... আমি মইরে যাব ... ইত্যাদি। দাওয়ার উপর পাটি পেতে পুঁইশাক ডলে দ্রুত ভাত খাচ্ছিল শহীদুল। তো, এসব ব্যাপারে অসীম ধৈর্য্য তার। গত পনেরো বছরে যথেষ্ট শিখেছে সে-বাচ্চা হওয়ার আগে এমনই বিনবিন বিনবিন করতে থাকে স্বপ্না; কাজেই চুপচাপ ভাত খেয়ে উঠে উঠানে নেমে টিপকলে হাতমুখ ধুয়ে, আবার দাওয়ায় উঠে এসে দড়িতে ঝোলানো গামছা দিয়ে মুখহাত মুছে-যেহেতেু কালো প্যান্ট আর হলুদ র্শাটটা পরাই ছিল- আবার দ্রুত পায়ে উঠানে নেমে মোটরসাইকেলের দিকে হাঁটতে থাকে। তারপর বেলকুচি থেকে কড্ডার মোড় পর্যন্ত রকেটের মতন উড়িয়ে নিয়ে এসেছে ইয়ামাহাটা। সারাটা পথ বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিল শহীদুলের : ছাব্বিশ লাখ টাকার কাজ ...লতিফ ভাই তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। লতিফ ভাই অপেক্ষা করছেন দেলদুয়ারে কার্তিকের দোকানে । যমুনা নদীর দুই পার্শ্বে লতিফ ভাইয়ের নানা ধরনের ধান্ধা আছে-বিস্তর এলেমদার মানুষ। যদিও যমুনা নদীর দুই পার্শ্বের গাঁ-গেরামের লোকজন লতিফ ভাইয়ের নামে নানা কথা বলে। আগে লোকটাকে এড়িয়েই চলত শহীদুল। তারপর আর সম্ভব হয়নি। ব্যবসা করতে নামলে নানা কিসিমের লোকের সঙ্গেও মিশতে হয় - এ লাইনে বেছে বেছে চলা মুশকিল; আর, কে কেমন - সে তো ক্ষতি না হওয়ার আগে টের পাওয়া যায় না ... শেষ ফাল্গুনের ঝলমলে রোদে সবজে রঙের ইয়ামাহাটা রকেটের মতন উড়ছিল । এই সময়টায় নিজেকে রাজাবাদশা মনে হয় তার; মনে মনে হাসে শহীদুল। কী আশ্চর্য! কম বয়েসে একটা সাইকেল চেয়ে পায়নি। আর এখন? একশ সি সি-র সবুজ রঙের একটা ইয়ামাহার মালিক সে। পনেরো-ষোল বছর বয়স হল মোটর সাইকেলটার- এখনও পঙ্খির মতন ছোটে ... বিয়ের সময় জিনিশটা পেয়েছিল শহীদুল-হ্যাঁ, যৌতুক হিসেবেই । শহীদুলের শ্বশুড় সাহেদ আলীর বাড়ি এনায়েতপুরে; পেশায় তাঁতি (স্থানীয় ভাষায় জোলা)-তা, তাঁতি হলে কী হবে -বেশ প্রভাবশালী আর অবস্থাসম্পন্ন লোক সাহেদ আলী; যমুনার চরে-মানে, চৌহালিতে বিস্তর জমাজমিও দখলে আছে তার। স্বপ্না তাঁরই কনিষ্ঠা কন্যা, নিজ চেস্টায় শহীদুলের উন্নতির কথা তার কানে পৌঁছেছিল। বিয়ের সময় শহীদুলের দিক থেকে অবশ্য তেমন দাবীদাওয়া তেমন ছিল না। তার কারণ আছে। কলেজ জীবনে বেতকান্দির বদরুল ভাইয়ের প্রভাবে কিছুদিন ছাত্রমৈত্রী করেছিল শহীদুল। তখনই চোখকান কতকটা কিছু খুলে গেছিল ... শাহজাদপুর কলেজে বছর খানেক পড়েছিল সে ...; তো, পরিবারের অবস্থা তখন একেবারেই প’ড়ো প’ড়ো হয়ে আসছিল-কাজেই অনেকটা বাধ্য হয়েই পড়ালেখা ছেড়ে টুকটাক এটা-ওটা করতে করতে অতি কষ্টে জমানো পয়সা গোপনে হাত বদল করে সিরাজগঞ্জ সদরে গণপূর্তের কিছু সাপলাইয়ের কাজটাজও পেয়ে যায় সে; ... খানিকটা বিতর্কিত লতিফ ভাইর সঙ্গে তখনই ঘনিষ্টতা শুরু ... তা ছাড়া, খালাতো ভাই হিরণকে নিয়ে নসিমনের ফ্যাক্টরি দিয়েছিল বেলকুচিতে-আসলে শহীদুলরাই নসিমন জিনিশটা এই অঞ্চলে চালু করেছে। তারপর সংসারের হাল কিছু ফিরলে শহীদুলের বিয়ের কথা উঠল। শহীদুলের শ্বশুড় সাহেদ আলী খুব হুঁশিয়ার লোক-সে শহীদুলের কদর ঠিকই বুঝেছিল। মোটল সাইকেলটা শহীদুল চায়নি-কিংবা তার বাপ আলতাফ আলীর চাইতে মনে ছিল না ঠিকই -দেখা গেল বিয়ের দুদিন আগে শহীদুলের শ্বশুড় ঠিকই পাঠিয়ে দিলেন জিনিশটা। সেই মুহূর্তের গর্ব মেশানো আনন্দ অনেক দিন মনে ছিল শহীদুলের ...সময়টা বিকাল ... ছোট (হবু) শ্যালক হাবিব ঝকঝকে সবুজ ইয়ামাহাটা ভটভট শব্দে উঠানের মুখে ঝিকা গাছের কাছে এসে থামাল । পলকেই দাওয়ায় বসে থাকা শহীদুল যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। সবুজ রঙের ১০০ সিসি ... মনে মনে হাসছিল শহীদুল। কী আশ্চর্য! কম বয়েসে একটা সাইকেল চেয়ে পায়নি। আর এখন? না, চাইতেই একশ সি সি-র সবুজ রঙের ইয়ামাহা এসে হাজির। আশ্চর্য! শহীদুলের বাবা আলতাফ আলী এক এক করে সাত সন্তানের জনক হলেও জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। বেলকুচির পৈত্রিক ভিটেই সম্বল- আর, ভিটে সংলগ্ন সামান্য জমিজমা। বর্গার ধান সেখান থেকেই আসত, শরিকী জলা থেকে আসত মাছ ...সংসার কোনও রকমে চলছিল; এই সময়ে শহীদুলের সাইকেলের আবদার- তখন শহীদুল ক্লাস নাইনে পড়ে । রাগের মাথায় চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে ছেলেকে তাড়া করেছিল । ছেলেও দৌড় ... দৌড় ... দৌড় ... একেবারে খুকনি। খুকনিতে হিরণদের বাড়ি। হিরণের একটা লাল রঙের চাইনিজ সাইকেল ছিল ... সাইকেলটা নিয়ে কই কই চলে যেত সে কিশোর বয়েসে- কড্ডার মোড়, বগুড়া রোড, এনায়েতপুর, খুকনি, কৌজুরি ...কখনও হিরণ থাকত সঙ্গে-কখনও সে একাই ...পাকা সড়কের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে বাতাসের বেগে সাইকেল চালাত সে ...কখনও গ্রামের পথ দিয়ে ... এসব কতদিনের কথা ... তখনও যমুনা ব্রিজটা হয়নি। আজ ওই ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লতিফ ভাই দেলদুয়ারে অপেক্ষা করছেন। সকালের দিকে ফোন করছিলেন-জলদি, আয়া পড়, কাম আছে ...শহীদুল আর দেরি করেনি। অথচ, আজই স্বপ্নাকে এনায়েতপুর রেখে আসার কথা ছিল । বাচ্চা হওয়ার আগে আগে স্বপ্নাকে ওর বাপের বাড়ি রেখে আসতে হয় ... আজও সকাল থেকেই বিনবিন করছিল ... আমারে বাপের বাড়ি রাইখা আস। আমারে বাপের বাড়ি রাইখা আস। আমি মরে যাব ... ইত্যাদি। বাচ্চা হওয়ার আগে এমনই বিনবিন বিনবিন করতে থাকে স্বপ্না; আবার বাচ্চা কোলে বাপের বাড়ি থেকে ফিরেও আসে হাসিমুখে আরও টলটলে হয়ে হয়ে। একবাবার এনায়েতপুর যাওয়া দরকার ছিল-অনেকদিন শ্বশুড়বাড়ি যাওয়া হয় না। শ্বশুড়ের শরীর ভালো না, হাঁপানির রুগি, বছর পাঁচেক হল ডায়াবেটিসও ধরেছে -তাঁতের ব্যবসাও ভালো না-গত বছরের বন্যায় সিরাজগঞ্জের বিশ হাজার তাঁত নষ্ট হয়ে গেছিল ...আজই স্বপ্নাকে নিয়ে এনায়েতপুর যেত শহীদুল ... তখনই লতিফ ভাইয়ের ফোন এল- ছাব্বিশ লাখ টাকার কাজ ...আমি দেলদুয়ারে কার্তিকের দোকানে বইসা চা খাইতাছি আর বিড়ি টানতাছি, অখনই তুমি পাঙ্খা লইয়া চইলা আস শহীদ ...শহীদুল আর দেরি করেনি ... ২/৪ লাখ টাকা এখনই দরকার তার -কায়েমপুরের সাত্তার ছত্রিশ হাজার টাকা পায়, সেই টাকার জন্য দিনরাত জ্বালাতন করছে ছেলেটা...বারবার ফোন করছে-সাত্তারের ছোটভাই সোলেমান নাকি মালয়েশিয়া যাবে ... তো, টাকাটা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না ...ইদানিং ব্যবসাপাতিও ভালো না - ছোট শ্যালক হাবীব গত বছর মার্ডার কেসে ফেঁসে গেছিল চৌহালির জমাজমি নিয়ে ...তখন নগদ টাকা নিয়ে শ্বশুড়কে সাহায্য করেছিল শহীদুল ... তা ছাড়া বারবার সদরে যাও, উকিলের সঙ্গে কথা বল, উকিলও ঘুরায় ...বারবার মামলার ডেট চেঞ্জ করে ...তা শ্বশুড়কে ভারি ভক্তি করে শহীদুল ... তিনিই তো স্বপ্নটা পূরণ করে দিলেন ...ছোটবেলা থেকে নিজের একটা সাইকেলের কত শখ ছিল ...পনেরো-ষোল বছর ধরে সে শুধু সাইকেলে নয়- রীতিমতো মোটর সাইকেলের মালিক ...তো, সেই মোটল সাইকেল করেই আজ কড্ডার মোড়ে উঠে ডান দিকে বাঁক নিতেই ঘটনাটা ঘটল ...তখন মধ্য দুপুর। সাজাহানের ভাতের দোকানের পাশে মুজিবের লনড্রির কাছে বড় বড় দুটো স্পিকারে মমতাজের গান বাজছিল। হাইওয়েতে রোদ, পেট্রলের গন্ধ ... লাল হেলমেটের নিচে ঘাড়ের কাছে যমুনার গরম বাতাসও টের পেয়েছিল সে ... বগুড়াগামী একটা বাস ধূলো উড়িয়ে পশ্চিমে চলে যাচ্ছিল ... সাদা একটা মাইক্রোবাস-তার হর্নের আওয়াজ ... শহীদুল সবটা শুনতে পারেনি। রডবোঝাই ট্রাকটা অকস্মাৎ ঘাড়ের ওপর উঠে এসেছিল ...সামলাতে সময় পায় নি। অথচ তার মোটর সাইকেল চালানোর দক্ষতার কথা শাহাজাদপুরের সবাই জানে-সেই ছেলেবেলা থেকেই সে সাইকেল চালানোয় দক্ষ। নিজের সাইকেল ছিল না- খুকনির হিরনের সাইকেলটায় চড়ে দ্রুত প্যাডেল মেরে মনের সাধ মিটিয়ে নিত শহীদুল ...তখন একবার কৈজুরির মোড়ের কাছে বড্ড বাঁচা বেঁচে গিয়েছিল ... কুরবানী ঈদের আগে গরুভর্তি ঢাকাগামী একটা ট্রাক প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে এসেছিল ... দ্রুত, নিপুন ভাবে সামলে নিয়েছিল শহীদুল ... এবার আর পারল না সে ...পনেরো বছর আগের এক বিকেলে শ্বশুড়ের দেওয়া মোটরসাইকেলটা দেখে মনে মনে হেসেছিল শহীদুল। কী আশ্চর্য! কম বয়েসে একটা সাইকেল চেয়ে পায়নি সে - সাইকেলের বায়না ধরাতে বাপজান পিঠের ওপর লাঠি ভেঙ্গেছিল; আর এখন? না, চাইতেই একটা একশ সি সি-র সবুজ রঙের ইয়ামাহা এসে হাজির ... আশ্চর্য! সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৫১
false
rn
ইংরেজ ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ধরে এ দেশ শাসন করে।ইংরেজরা বাংলায় আসার কারণে বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারায় এবং সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্য সংস্থার নাম ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।ইংরেজ শাসনের নীতি ছিল ‘ভাগ করো শাসন করো’।১৯১১ সালে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।ইংরেজরা ক্ষুদিরাম ও মাস্টারদা সূর্য সেনকে ফাঁসি দিয়েছিল। ব্রিটিশরা কলিকাতাকে ‘ক্যালকাটা’ নামে অভিহিত করত।ইংরেজরা শর্ত ভংগ করে কলকাতা আক্রমণ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয় ঘটলে বাংলায় ব্রিটিশ প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ।লর্ড ক্লাইভ ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি। বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম আর ভাগলপুরের বিশাল অঞ্চল দিলো, যার প্রায় পুরোটাই ছিলো পাহাড়ি বনাঞ্চল। কথা ছিলো সেখানে চাষবাস করলে সাঁওতালদের খাজনা দিতে হবে না। তাই সাঁওতালরা ক্রমশ বনভূমিতে জঙ্গল কেটে সাফ করে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করলো। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রতি ভঙ্গ করে খাজনা আদায় করা শুরু করলো। শুধু তাই না, তারা ধীরে ধীরে খাজনার পরিমাণও বাড়াতে শুরু করলো। ১৮৫৪-৫৫ সালে খাজনার পরিমাণও যেমন বেড়ে গেলো অনেক, তেমনি বেড়ে গেলো খাজনা আদায়ের জন্য সাঁওতাল কৃষকদের উপর অত্যাচারও। ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে বোঝায়।১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হস্তে ভারতের শাসনভার তুলে নেন।ব্রিটিশের ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে মুসলিম জনসংখ্যায় খুব কমই বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি ঘটেছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর। বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যরা তাদের সাহিত্যে যে মুসলিম বিরোধী বিষ উদগিরণ করেছেন সেটি বাংলার সমাজ ও আলোবাতাস থেকে উদ্ভুত হলে তার নমুনা মধ্য যুগের বা আদি যুগের সাহিত্যেও পাওয়া যেত। কিন্তু তা নেই। তাদের মগজে ঘৃনাপূর্ণ মিথ্যার বিষটি ঢুকিয়েছিল বস্তুত ইংরেজগণ। তারাই প্রথম আবিস্কার করে, ভারতের মুসলিম শাসন শুধু ধ্বংস, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও শোষণ ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বলেছে, মন্দির ভেঙ্গে তার উপর মসজিদ গড়েছে। তাদের লেখনিতে শিবাজীর চরিত্র অংকিত হয়েছে হিন্দু জাগরনের এক মহান ও আদর্শনীয় বীর রূপে, আর মোঘল বাদশা আওরঙ্গজীব চিত্রিত হয়েছেন কুৎসিত ভিলেন রূপে। বাংলায় হিন্দুদের বাস মুসলমানদের চেয়ে অধিক কাল ধরে। অথচ তাদের ব্যর্থতা হল, সমগ্র ইতিহাস ঘেঁটে একজন হিন্দুকেও বের করতে পারে যিনি স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলার মানুষের সামনে আদর্শ হিসাবে চিত্রিত হতে পারেন। তেমন চরিত্রের তালাশে বঙ্কিম ও মাইকেল মধুসূদন যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও ব্যর্থ হয়েছেন। সে এক বিশাল শূন্যতা। ব্রিটিশ আমলে কৃষকদের কাছে নীল চাষ ছিল আতঙ্ক। নীল চাষে ইংরেজদের শাসন, শোষন ও কৃষক নির্যাতনের কথা এখন ইতিহাস। সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৩ রাত ৯:৩০
false
ij
গল্প_ বাসনার কুকুর সূর্যদহ গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে অনেক দিনের পুরনো একটি মজা খাল। সে খালের ধারে গাব গাছের সারি, চালতা গাছের সারি এবং খালের পশ্চিম পাশে ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ভিতরে অন্ধকার এবং সে অন্ধকারে একটি পাতায় ভরা সবজে রঙের পরিত্যক্ত পুকুর। পুকুর পাড়ে ঘন ছায়ার আড়ালে সার সার প্রাচীন কবর । খাল পাড়ের এ দিকটায় গভীর নির্জনতা বিরাজ করে ও বাতাসে সারাক্ষন কচুরি পানার গন্ধ ভাসে । বাঁশঝাড়ের ছায়া বিছানো পথের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে যেতে দেখা যায় সূর্যদহ গ্রামেরই এক কিশোরীকে। নাম তার বাসনা। বাসনার পিছু পিছু যায় একটি লালচে বর্ণের নেড়ি কুকুর- নাম তার লাল ; হয়তো সূর্যদহ গাঁয়েরই কোথাও তার জন্ম। তবে কুকুরটির নাম কে লাল রেখেছে -বাসনা জানে না। বালিকা বয়েস থেকেই এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বেড়ায় বাসনা ; দরগা পাড়ায় সখী মিতালিদের বাড়ি, পুব পাড়ায় প্রতিমা মাসীর বাড়ি, রোজ একবার বেনী দুলিয়ে সবুজ শাড়ি পরে নাচতে নাচতে ওদিকটায় একবার যাওয়া চাই। লাল একদিন বালিকার সঙ্গী হল।বাসনা যে লাল রঙের রোঁয়া-ওঠা দিশি কুকুরটিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ করল, তাও না। তবে লাল কী কারণে ওর পিছু পিছু ঘুরতে থাকে। একটা সংযোগ স্থাপন করতে চায়। এই লক্ষ্যে বাসনার সঙ্গে পাড়া বেড়ায়। তবে পাড়া বেড়ানো ছাড়াও লাল বাসনাদের বাড়ির উঠানে ঘুরঘুর করে, ঘুমায় বাসনাদের বাড়ির দাওয়ায়। সূর্যদহ গ্রাম আর পুব পাড়ার মাঝখানে ছোট গরু-চরা ঘাসের মাঠ, তারই মাঝখান দিয়ে মেঠোপথ, বাঁ দিকে একটা তালগাছে ঘেরা পানা পুকুর, এদিকটায় কিছু ঝোপঝাড় । মাঠ পেরিয়ে মন্ডলবাড়ির সীমানা। পুব পাড়া যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই মন্ডল বাড়ির মেজো ছেলে ইলিয়াস মন্ডলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । যেতে যেতে বাসনা থমকে যায়। লালও থেমে অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরে-কেউ কেউ করে। ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি পরা বাবরী চুলের দীর্ঘকায় বলিষ্ট ফরসা যুবক ইলিয়াস মন্ডল, গলায় সোনার সরু চেইন, ফরিদ গঞ্জের উঠতি ধনবান ব্যাপারী সে, গোপালপুরে মমতা ‘স’ মিলের মালিক; ঠিকাদারীও করে। বাসনাকে দেখে ইলিয়াস ব্যাপারীর চোখ দুটি সরু হয়ে যায়। কথা বলার চেষ্টা করে সে। ইদিকে কোথায় যাস রে বাসনা? বাসনা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়ষ্ট বোধ করে। সে আড়ষ্টতা বোধহয় লালের সীমাবদ্ধ চেতনায় সঞ্চারিত হয়। সে ইলিয়াস ব্যাপারীর ওপর রাগ ঝাড়তেই বুঝি অদূরের রাজহাঁসটির দিকে তেড়ে যায়। বাসনার শাড়ির আঁচলের তলায় একটা বাটিতে কতবেল ভর্তা, ওখান থেকে টক টক গন্ধ ছড়ায়। চারি দিকে ধবধবে সাদা রোদের আলো...আষাঢ় মাস। লালের তাড়া খেয়ে আতঙ্কিত রাজহাঁসটি বেলগাছের ওদিকে চলে যায়। বেলগাছে কাকের মেলা বসেছে। কা কা ডাকের চিৎকারে কান পাতা দায়। বেলগাছের নিচে খুঁটিতে বাঁধা একটা কালো রঙের ছাগল। ওখানে একটি দশ-এগারো বছরের বালক দাঁড়িয়ে। বালকটির নাম ছায়েদ। সে খালি গায়ে থাকলেও কালো রঙের হাফপ্যান্ট পরে আছে। ছায়েদ মন্ডলবাড়ি মেজো বউ মায়মুনার মেজো ছেলে।বাসনা পা বাড়ায়।শোন।বাসনা থমকে যায়। আজ বিকালে সুতীর হাটে যামু। তোর জইন্যে কি আনব রে বাসনা?কিছু আনতে হবে না। (ইস্, কথাটা আমি বললাম কেন? কথাটা আমি বলতে চাইনি।)লাল ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বেলগাছের কাকেরা উড়াল দেয়। দূর থেকে সাইকেল ঘন্টি বাজিয়ে আশরাফ মাস্টারকে আসতে দেখা যায়। পুব পাড়ার দিকে পা বাড়ায় বাসনা ।শোন।বাসনা থামে না। একটু আগে রোদ মুছে গেছে। কখন আবার মেঘ জমে; এইসব আষাঢ়ের দিনে বিশ্বাস কি! হুট করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে। ক’দিন অবশ্য বৃষ্টি-টিস্টি হয়নি। বাসনা বৃষ্টির অপেক্ষা করে অছে। বৃষ্টি এলেই ভিজবে। সেই সঙ্গে লালও ভিজবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ওর ভালো লাগে। সম্ভবত লালেরও। বৃষ্টিতে ভিজলে ওকে কেউই বারণ করে না। ও মনের সাধ মিটিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে। এই দেশে এতই সুখ। তবে ঐ ইলিয়াস মন্ডলরাই যা সুখের দেশের কাঁটা। পুব পাড়ায় প্রতিমা মাসী বাসনার মা রওশন আরার সই-অনেক দিনের সম্পর্ক। প্রতিমা মাসী বিধবা। তবে অবস্থা একেবারে মন্দ না। প্রতিমা মাসীর স্বামী গৌড়াঙ্গ হালদার সুতীর হাটের জনতা ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন। একটাই ছেলে প্রতিমা মাসীর। অরুন ভাই রূপগঞ্জে ‘বাটা’-র দোকানের কর্মচারী।অরুন ভাইয়ের বউ ললিতা বউদিদিও অনেক ভালো। ভালো আর সুন্দরী। বাসনার মনের অনেক কথা জানে ।জোছনা মাসী ঘরের মেঝেয় বসে চাল বাছছিলেন। মাঝবয়েসি সুন্দরী মহিলা। গায়ের রং ফরসা । কাটা- কাটা চোখ নাকমুখ। পরনে সাদা শাড়ি। মাথার চুলে অবশ্য পাক ধরেছে। এ ঘরে জানালা দিয়ে অনেক রোদ ঢুকেছে। দরজায় শব্দ হতেই প্রতিমা মাসী মুখ তুলে হাসেন। বলেন, আয় রে তিলোত্তমা। মাঝে মাঝে প্রতিমা মাসী বাসনাকে তিলোত্তমা বলে ডাকেন। বাসনা ধপ করে মেঝের ওপর বসে। তারপর আঁচলের তল থেকে কতবেল ভর্তার বাটি বের করে মেঝের ওপরে রাখে। বলে, খাও গো মাসি।আমি এখন খাব না রে। ক্যান? উপাস দিচ্ছ?না রে। একটু আগে ভাত খাইছি।কি রানলা আজ?বাইলা মাছ। যাওয়ার সময় তর মায়ের জন্য নিয়া যাস। শুনলাম তোর দাদী আইছে রে বাসনা?হ।তোর মায়ে তোর দাদীর লগে কথা কয়?না। বাসনা মাথা নাড়ে।হিন্দু মাইয়াগো রাগ বেশি। হইব না? বিয়ার পর দাদী মায়রে খাইতে দেয় নাই। বাসনা ফস করে ওঠে ।তোর বাপের ওপর তোর দাদীর বড় রাগ হইছিল।ক্যান?তোর দাদীর ইচ্ছা ছিল তোর বাপের লগে তোর দাদীর খালাতো ভাই শমশের আলী পান্নার মেজ মেয়ের হাসনার বিয়া দিব। শমশের আলী পান্নার কাছে এক লাখ টাকা কর্জ নিসিল। উত্তরপাড়ায় জমি কিনব।দাদীর যেমন বুদ্ধি! বলে বাসনা মুখ বাঁকায়। হ । তোর মায়ে যাত্রা করত। ফরিদগঞ্জের মেয়ে। যৌবনকালে ফুটফুটে রূপসী ছিল দেখতে। এই জন্য তুই রূপসীহইছস। বলে বাসনার থুতনি নেড়ে দেন প্রতিমা। বাসনা লজ্জা পায়। ওর ইলিয়াস ব্যাপারীর ফরসা বসন্ত খাওয়া মুখটি মনে পড়ল। ও আজ ইলিয়াস ব্যাপারীর চোখে লোভ দেখেছে। কথাটা মাসীকে বলা যায় না। ললিতা বউদিদি থাকলে বলা যেত। তো ললিতা বউদিদি তো বাসায় নেই। বউদিদির বাচ্চা হবে। দু’মাস ধরে বাপের বাড়ি গেছে। তোর বাপে রাইতবিরাইতে সুতীর হাটে গেছিল যাত্রা দেখতে। প্রতিমা মাসী বলেন। ‘বিরহী সীতার পালা’। গিয়া তোর মায়েরে দেখল। মনে ধরল, বিয়ার প্রস্তাব দিল। তোর মা হিন্দুর মেয়ে। নাম বাসনা পাল। তারপরেও তোর বাপরে মনে ধরল। তারা দুইজনে যুক্তি কইরা পলাইল। তোর বাপ আর তোর দাদীর বাড়ি উঠে নাই। বিয়ার আগে তোর মায়ে মুসলমান হইল, তবে হিন্দুয়ানি যায় নাই। বিয়ার দশ বছর পর তুই হইলি। তখন তোর নাম রাখল বাসনা।শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায় বাসনা। কী কারণে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করে। কাল রাইতে খারাপ স্বপ্ন দেখছি। প্রতিমা মাসী বলেন। কি দেখলা মাসী? বাসনা বিষন্নতা টের পায়। দেখলাম, ... থাক সে কথায় কাম নাই। তুই আমার লগে আয়। বলে উঠে পড়েন প্রতিমা । তারপর ঠাকুরঘরের দিকে যেতে থাকেন। ঠাকুরের সামনে থেকে বেলাপাতা তুলে নেন। আঙুলে লিখলেন ‘শিব’। তারপর লাল রঙের সুতলিতে বাসনার বাহুতে বেঁধে দিলেন। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে আসে। আকাশে মেঘ জমে ওঠে। বাতাস অস্থির হয়ে ওঠে। আমি যাই গো মাসী। বৃষ্টি আসতেছে। বলে বাসনা উঠানে এসে দাঁড়াল। উঠানে কালো ছায়া জমে আছে। বাতাসে সজনে গাছের ডালপালা নড়ছিল সরসর করে। লাল কে কোথাও দেখল না। মাঝে মাঝে লাল এমন করে উধাও হয়ে যায়। তখন কই যে যায় কে জানে!বৃষ্টি শুরুর আগেই ইলিয়াস ব্যাপারী সুতীর হাটের নূরীবালার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। নূরীবালার ঘরটি দোতলায়। একতলায় জনতা ব্যাঙ্কের লোকাল শাখা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে কালো রং করা কালেপসআবল গেইট। তার সামনে পাটল রঙের উর্দি পরা দারোয়ান। জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ইলিয়াস ব্যাপারী অবশ্যি আমজনতার একজন নয়। এ অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুৎ দিনের বেলাতেও ঝামেলা করে। ঝড়বৃষ্টির সময় তো কথাই নেই। আজ দুপুরের পর থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ জমে উঠলে বিরক্ত হয়ে মোম জ্বালায় নূরীবালা। ড্রেসিংটেবিলের সামনে ঘিয়ে রঙের লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে বসেছিল মাঝবয়েসী বিগত যৌবনা নূরীবালা । তবে অতিথি অভ্যাগতদের আগমনে এখনও তেমন ভাঁটা পরেনি। ফরসা ছড়ানো কপালে লাল টিপ আঁকছিল। ঝকঝকে আয়নায় ভরাট মুখটি দেখে আপনমনে হাসল। ড্রেসিংটেবিলটিও খানদানী, মূল্যবান - সদ্য প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান শমশের আলী পান্নার শেষ উপহার। জীবদ্দশায় তিনি নিয়মিতই নূরীবালার ঘরে আসতেন, মদ্য পান করতেন, ম্যাসেজ করিয়ে নিতেন। বর্তমানে ইলিয়াস ব্যাপারী ও আসে। এসব ব্যাপারে জুনিয়ার -সিনিয়ার বলে কিছু নেই। এসব ব্যাপারে একমাত্র যোগ্যতা হল- তাকৎ। আর মাসওয়ারি কে কত ‘মাল’ কামায় তার ওপর।ঘরের দেওয়াল সাদা চুনকাম করা। এক বাংলা ক্যালেন্ডার বাদেও পুব পাশের দেওয়ালে ঝুলছে বিদ্রোহ কবির ঝাঁকড়া চুলের সেই বিখ্যাত ছবিটি। এ ছবি এ রকম ক্রাইম জোনে কেমন করে এল তা গবেষনার বিষয়। খুক খুক করে কেশে ইলিয়াস ব্যাপারী ঘরে ঢুকল। নূরীবালা মুখ টিপে হাসে। ছোকড়া কখনও শরীর ছোঁয় না, ছোকড়া যত টান কম বয়েসী বালিকাদের প্রতি, মন্ডলের পো শুধু পান করতে আসে। এদিকে কালো রঙের ঢাউশ পুরনো একটি ডবল সোফা। (স্থানীয় এক প্রভাবশালী সংসদসদস্যের উপহার। ঢাকার গুলশান ২-এর একটি পুরনো ফর্নিচারের দোকান থেকে কেনা। ট্রাকে করে তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছিলে। ) সোফায় ধপ করে বসে ইলিয়াস ব্যাপারী জিগ্যেস করে, আছে নাকি রাই?নূরীবালার উচুঁদরের সমঝদারদের মধ্যে নূরীবালার অপর নাম: ‘রাই।’নাই আবার। কন্ঠে গভীর অনুরাগ ঢেলে বলে নূরীবালা। তারপর উঠে ওপাশের কাঠের আলমারীর কাছে যায়। আলমারীটি উপহার দিয়েছিল গোপালপুরের ইঁট ভাঁটার মালিক নিবারন চন্দ্র রায়। বুকে আঁচল সরালে লাল ব্লাউজ ভারী স্তনের আভাস ফুটে ওঠে। ওদিকে চোখ যেতেই ইলিয়াস ব্যাপারী চোখ চকচক করে ওঠে। তবে নূরবালার জন্য নয়, বাসনার জন্য। বাসনার স্তন দুটি পিষ্ট করার ভয়ঙ্কর ইচ্ছে জাগে। আলমারীর পাল্লা খুলে পাঁইট বার করে নূরবালা। ভারতীয় লাল মদ। সীমান্তের এদিক-ওদিক ঘুষ দিয়ে জিনিসটা নূরীবালা নিজেই ইমপোর্ট করে। বোতলের অর্ধেকটা ড্রামে ফেলে পানি মেশায়, তারপর আবার বোতলে ভরে। উচুঁদরের সমঝদারদের চড়া দামে বেচে। এসব ছাড়াও আরও দু' নম্বরী ধান্ধা আছে মহিলার। ঝকঝকে গেলাসে ঢেলে দেয় মধুবর্ণের তরল। ইলিয়াস ব্যাপারী চুমুক দেয়। আহ্ ।কন্ঠনালী ও অন্ননালী দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নেমে যায় ঝাঁঝালোতরল। বলে, কাজ কামের ঠেলায় অনেক দিন তুমার এখানে আসা হয় না রাই ।তোমার দিন কেমন যায় গো?ব্যবসাপাতি খারাপ। বলে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে নূরবালা। নবীগঞ্জে নতুন মেয়ে এসেছে। সবাই এখন তার পানে ছুইটছে।কে? কার কথা বল?রেশমী না কি নাম-অ।ওখানে যাওয়া হয়েছে নাকি? নূরবালা মুখ টিপে হাসে। হ্যাঁ। নিবারনদা একবার নিয়ে গেছিলেন।তা কেমন লাগল শুনি?ভালো না। মাইয়াটা নাকি ফিলমের এক্সটা ছিল ।নূরীবালার মোবাইলটা বাজে। ফোনটা তুলে কার সঙ্গে হেসে কথা বলে। কথা শেষ করে ফোন অফ করে দেয়। তারপর ইলিয়াস ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে, এবার আমারে মাফ করতি হয়। পান্নাবাবুর বড় ছেলে আইসতেছেন ইয়ার দোস্তদের নিয়া। ইলিয়াস ব্যাপারী তাকৎ আছে বটে। তবে সে এখনও পান্নাবাবুর বড় ছেলের মত রুই-কাতলা হয়ে ওঠেনি। পান্নাবাবুর বড় ছেলে মানে আরমান বাবু... তেরো খুনের আসামী, লেটেস্ট মডেলের পাজেরো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খুন না করলে আজকাল জাতে ওঠা যায় না, থানার ওসি বেটাও সালাম দেয় না। ইলিয়াস ব্যাপারী ‘স’ মিলের ব্যবসার আড়ালে ভারত থেকে ফেনসিডিল চোরাচালান করে বটে-তবে এখনও পর্যন্ত সে খুনখারাপি করেনি বলে অনেকটা পিছিয়ে আছে। গাঁয়েগঞ্জে সম্মান পেতে হলে অতি সত্ত্বর একটা খুন-টুন করতে হবে। বাকি তরল দ্রুত গলায় ঢালে ইলিয়াস ব্যাপারী । তারপর ৫০০ টাকার একটা নোট ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ইলিয়াস ব্যাপারী যখন টলতে টলতে নীচে নেমে এল ততক্ষনে সন্ধ্যা উৎরে গেছে। আলোও এসে পড়েছে। তার পা দু’খানি টলছিল। গুনগুন করে গাইছিল: “আমার বুকের মইধ্যে খানে / মন যেখানে হৃদয় সেখানে।” ঠিক তখনই কাদেরের চায়ের দোকানের সামনে লালকে দেখে ইলিয়াস ব্যাপারী শরীর জুড়ে এক শিহরণস্রোত টের পায়। এক বিকেলে খালপাড়ের বাঁশঝাড়ের ভিতরে পরিত্যক্ত সেই পুকুরটির পাশে বাসনার ক্ষতবিক্ষত লাশ আবিস্কার করে সূর্যদহের গ্রামবাসী শোকে দুঃখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কে এমন কাজ করল!মেয়েটির লাশটা বৃষ্টিতে ভিজছিল।বাসনার মৃত্যুর পর লালকেও মুষড়ে পড়তে দেখা যায়। সারাক্ষন বাসনার কবরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। খালপাড়ের বাঁশঝাড়ের আশেপাশেও অবিরাম ঘোরঘুরি করতে দেখা যায়। মধ্যরাত অবধি বাসনাদের বাড়ির সামনে বিষন্ন সুরে কাঁদে।ক’দিন পর। তখন বিকেল: শেষ বেলার নম্র মনোরম আলো ছড়িয়ে ছিল সুতীর হাটের দোকানপাট, টিনের চালা, গাছপালা ও হাটের ধূসর জনমানুষের ওপরে। কাদেরের চায়ের দোকানে চা খেয়ে ইলিয়াস ব্যাপারী বেড়িয়ে এসে আড়মোড়া ভাঙল। মুখখানা ঝকঝক করছে তার। শেষ বেলার আলোয় চিকিয়ে ওঠে কন্ঠেরগলার সোনার চেইন, ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে বাংলা সিনেমার এক উঠতি নায়কের মতো মনে হয়। একটা বেনসন লাইটস ধরাল লোকটা। ঘটনাটা তখনই ঘটল। হঠাৎই ইলিয়াস ব্যাপারীর ওপর ক্ষিপ্রগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাল । বিপদের আশঙ্কায় হাটের লোকজন থমকে যায়। কেউ কেউ এগিয়ে আসতে চায় ...ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক হাট লোকের সামনে সৌখিন যুবকটিকে তীক্ষ্ম দাঁতে ও নখে আছড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলতে থাকে বাসনার কুকুর...কাছেই দোতলা একটি দালানের গ্রিলে ঘেরা বারান্দার আড়াল থেকে মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখে আতঙ্কে হিম হয়ে যায় নূরবালা ...
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০৫৪ ১. কী যে অসম্ভব উদ্বিগ্ন ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেলো ক'টা হপ্তা! আক্ষরিক অর্থেই নাওয়াখাওয়া ভুলে কাজে ডুবে ছিলাম, হাওয়াখাওয়া তো দূরের কথা। ক্যালেন্ডারে কাজের ডেডলাইন টুকতে টুকতে খেয়াল হলো, এক বিশাল ইয়েমারার সামনে আমি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। লিডল থেকে প্রচুর খাবারদাবার কিনে এনে ফ্রিজ বোঝাই করে বসলাম কাজে। তারপর ডুব। এরপর দাড়ি কামানো হয় না, গোসল করা হয় না। কাজ-খাওয়া-হাগা-ঘুম-কাজ। অ্যাকদম ইয়ে যাকে বলে। ২. ফ্ল্যাটমেট সৈয়দ মোটামুটি ভালো লোক বলেই মনে হয়েছে। প্যাঁচঘোঁচ নাই। সেদিন পিৎজা গরম করে খাচ্ছি, সে এসে উঁকি দিয়ে বললো, এগুলোর দাম কেমন? সৈয়দ রান্না করতে জানে না, তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রান্নার ওপর লেকচার দিয়ে কিছু একেবারেই সাদাসিধা খাবার তৈরি দেখিয়েছি, ওগুলোই সে ঘুরেফিরে রাঁধে, তাই ফ্রোজেন পিৎজার প্রতি একটা টান জন্মানো তার পক্ষে নেহায়েত অস্বাভাবিক নয়। আমি গম্ভীর মুখে তাকে সমস্যাটার কথা জানালাম। "এটাতে পর্ক আছে।" সৈয়দের মুখ পুরোপুরি রক্তশূন্য হয়ে গেলো। সে তুর্কি দোকান থেকেও মাংস কিনে খায় না, কাসেলের সব পাকিস্তানী নাকি জনৈক পাকিস্তানীর নেতৃত্বে ছাগল আর মুরগি জবাই করে ছুটির দিনে, সেখান থেকে সে ড্রেসড মুরগি কিনে আনে মাঝে মাঝে। আমি তাকে পিৎজার ওপর আরো কিছু জ্ঞান দিলাম। "তুমি খুব দেখেশুনে খেও। কারণ এরা অনেকসময় পিৎজায় ষ্পেক (শুকরের চর্বি) ছিটিয়ে দেয় স্বাদের জন্যে। প্যাকেটের লেখা মন দিয়ে পড়ে দেখবে, কী আছে কী নেই। সবচেয়ে ভালো হয় কোন তুর্কি পিৎজেরিয়াতে গিয়ে তোমার সমস্যা খুলে বলে হালাল কোনকিছু খাওয়া, সব্জি বা টুনা, এমন কিছু।" সৈয়দ বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলো। পরদিন সন্ধ্যায় সে ক্লাস থেকে ফিরে আরো এক দফা ধন্যবাদ জানালো, তাকে সাবধান করে দিয়েছি বলে। নাহলে সে হয়তো ভুল করে পিৎজা খেয়েই ফেলতো একদিন। ৩. কাজে ডুবে ছিলাম সারারাত, ভোরে মনে হলো, একটু হেঁটে আসি পাশের পাহাড় থেকে। জানালার পর্দা সরিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম, অবিশ্রান্ত তুষারপাত চলছে। সামনে রাস্তায় পার্ক করে রাখা গাড়ি কমসে কম নয়ইঞ্চি পুরু তুষারে ঢেকে গেছে। বাহিরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর এমন স্ট্রোবোস্কোপিক ভিউ পেলে মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না। ৪. অবশেষে, দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা, সংযম, মিতব্যয়, সঞ্চয় আর টিপস সংগ্রহের পর কিনলাম আমার ডিজিটাল ক্যামেরা। সবচেয়ে সস্তা, ক্যানন ইওএস ১০০০ডি। কেবল গেহয়জে কিনেছি, আগের ইএফ লেন্স ব্যবহার করছি এর সাথে। সিগমা ২৮-৭০, ৩.৫-৫.৬ সেটা। আমার পুরনো ম্যানুয়াল ১০০০এফএনটা যত্ন করে প্যাক করে রেখে দিলাম বাক্সের ভেতরে। সেটাও এমনি দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর সংযমের পর কেনা, জার্মানী থেকেই, ২০০৩ সালে। পুরনো জিনিসগুলোর ওপর যে কী অবর্ণণীয় মায়া পড়ে যায় মাঝে মাঝে! ২০০৫ এ একবার বান্দরবানে থানচি থেকে রুমা পর্যন্ত এক অদ্ভুত নৌযাত্রার সুযোগ হয়েছিলো সাঙ্গুনদী বেয়ে, সেখানে ক্যামেরাটার শাটার অয়েল লিক করে একটা কান্ড ঘটেছিলো, খুব মন খারাপ ছিলো অনেকদিন, কারণ ক্যামেরা ঠিক করার টাকা হাতে আসতে সময় লেগেছে। বহু ছবি ডেভেলপ করে রেখে দিয়েছি, প্রিন্ট করার পয়সা ছিলো না হাতে। এইসব ছোট ছোট না পারার, না ঘটার, না হবার স্মৃতিকে সেই ক্যামেরার সাথেই বাক্সে গুঁজে রাখি। ডিজিটাল ক্যামেরা এসেছে হাতে, এইবার ফাটিয়ে ফেলবো ছবি তুলে। আইতাছি খাড়া! ৫. গেলো হপ্তায় কাজের শ্বাসরুদ্ধকর চাপ মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম অতিষ্ঠ হয়ে, একটু বাতাসের খোঁজে। আমি আর হের চৌধুরীই কাফেলায়, বলাই মহাব্যস্ত, ধূসর গোধূলি কী এক মাফিয়াচক্রের কারবারে ফেঁসে (মনে হয় কাকে লাইড়তে গিয়ে কোন ডনের শালিকে লাইড়ে বসেছিলো ব্যাটা) বাডেনভুয়র্টেমবুর্গের এর এক শহরে আত্মগোপন করেছে। আমাদের গন্তব্য উল্ম, সেখান থেকে মুয়নশেন। দুই শহরে আমাদের জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন তিন সচল, হাসিব-তীরন্দাজ-পুতুল। সে গল্প থাকবে পরের পর্বে, যদি আয়ু থাকে ততদিন পর্যন্ত। আমার নতুন ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবি অন্যত্র আপলোড করেছি কিছু, সংশ্লিষ্ট পর্বে সচলদের জন্যেও তুলে দেবো। ৬. ছোট্ট ঘটনা, তবু না বললে খচখচ করবে মনের মধ্যে। মুয়নশেন থেকে রাতে ফেরার পর সৈয়দ একটা বস্তা হাতে হাজির। সেটাতে অচেনা এক ধরনের বাদাম বোঝাই। সে জানালো, তার বাবাকে সে জানিয়েছে আমার বিভিন্ন সময়ে করা উপকারের কথা, তাই তার বাবা আমার জন্যে আলাদা করে পাঠিয়েছে কোয়েট্টা থেকে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভাবলাম, মুখের ওপর না করে দিই। কিন্তু বয়স্ক একজন মানুষ তার ছেলেকে সাহায্য করে, এমন একটা লোকের জন্যে আলাদা করে বাদাম প্যাক করে পাঠাচ্ছে দূর দেশে, এই ছবিটা মাথায় আসার পর চুপ করে গেলাম।
false
ij
‘ভাটির পুরুষ’ শাকুর মজিদ নির্মিত তথ্যচিত্র শাহ আবদুল করিম। গত ১২ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেছেন। তাঁর সেই চলে যাওয়াটি অবশ্যি দৈহিক, যেহেতু বলা হয় আমাদের শরীরটি তৈরি মাটির-আর আত্মা নাকি অমর। আত্মা অমর না হলেও শাহ আবদুল করিম যে বাংলায় চিরকাল বেঁচে থাকবেন সে ব্যাপারে কারও কোনও সংশয় নেই । তার কারণ করিমের আন্তরিকতা। তার শিল্পে-যাকে আমরা বলি গান, সেই গানে কোনও রকম ফর্মালিটি নেই, কৃত্রিমতা নেই ...এইটেই করিমের অমরতা লাভের রহস্য বলে বোধ হয় ... শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে শাকুর মজিদ নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্রটি দেখে অনেক অজানা তথ্য জানা গেল। জানা গেল শাহ আবদুল করিমের মুখেই- গানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের কথা বলেছেন। আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় তথ্যচিত্রটি নির্মানকালে অনেক সুস্থ্য ছিলেন করিম-কাজেই যা বলার স্পস্ট করেই বলেছেন। তথ্যচিত্রে সঞ্জীব চৌধুরিকে দেখে, তাঁর গান শুনে অনেকেই হয়তো বিষন্ন হয়ে পরবেন। শাকুর মজিদ অভিনব টেকনিক অ্যাপ্লাই করেছেন। বট গাছের নিচে বসে সঞ্জীব চৌধুরি গাইছেন ‘গাড়ি চলে না চলেনা। শাহ আবদুল করিমও গাইছেন ‘গাড়ি চলে না চলেনা।’ যে কারণে একই গানের দুটি ভিন্ন প্রজন্মের সুরের পার্থক্যটি বোঝা যায়। তথ্যচিত্রটির একটি অন্যতম সংযোজন বলে আমার কাছে মনে হয়ে কলকাতার দোহার শিল্পীগোষ্ঠীর কালিকা প্রসাদের বক্তব্য। কলকাতায় করিমের সম্মান কেমন-সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কালিকা প্রসাদের বক্তব্যে এবং দোহার শিল্পীগোষ্ঠীর পারফরমেন্স দেখে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে। ‘ভাটির পুরুষ’- দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে তথ্যচিত্রটি দর্শককে সন্তুষ্ট করবে। অনেক টুকরো টুকরো গান ছাড়াও করিমের জীবনের নানাদিক ফুটে উঠেছে। শাহ আবদুল করিমকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পিছনে যে নারী- আফতাবুন্নেছা (সরলা) তাঁর কথাও অনিবার্যভাবেই উল্লেখযোগ্য পরিমানেই রয়েছে। করিমের শিষ্য আর শিষ্যাদের অনুভূতির কথাও আছে: রনেশ ঠাকুর, জামালউদ্দীন হাসান বান্না, রুহি ঠাকুর, সেরাজুন নেছা-এরা প্রত্যেকেই গান শুনিয়েছেন, কথা বলেছেন। অদ্ভূত এক দৃশ্য আছে-কালিনী নদীর ধারে ...সন্ধ্যার পর ... সবাই করিমের পাশে বসে গান গাইছে। অল্প অল্প আলো, অনেকটাই অন্ধকার ...নারীপুরুষ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। সেরাজুন নেছার মুখটা অল্প অল্প বোঝা যায় ... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীততত্ত্ব বিভাগের যশস্বী অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বাউলদর্শন ব্যাখ্যা করেছেন, করিম ও সুনামগঞ্জের গানের ধারা নিয়ে নিজস্ব মতামত রেখেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীই প্রথম ১৯৯০/৯১ সালের দিকে শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় নিয়ে এসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বুদ্ধিজীবিমহলের সঙ্গে করিমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে করিমের গান শুনে কবীর চৌধুরী থেকে তসলিমা নাসরীন বাকরুদ্ধ। তাদের একটাই কথা: ‘আমাদের আপনি ক্ষমা করুন। আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি।’ ওই একই সময়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় এনে করিমের একটি ইন্টারভিয়্যূ ও গান রেকর্ডিং করেছিলেন এবং কেন একুশে পদকটি ভাটি অঞ্চলের এই সুরসাধককে দেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন, পরে করিমকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। করিম প্রধানত বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কবি। তবে একুশ শতকের প্রারম্ভে করিম ও শহুরে জনগোষ্ঠীর সম্পর্কটি নতুন এক স্তরে উপনীত হয়। তরুণ প্রজন্মের প্রবাসী সংগীতশিল্পীরা যেসব গান শুনছিল তাতে তারা ঠিক পুরোপুরি তৃপ্তি পাচ্ছিল না মনে হয়। তারা বুঝতে পেরেছিল- একমাত্র মিডিয়া দখলে থাকায় অনেক সাবষ্ট্যার্ন্ডাড শিল্পীই বিশ্বজুড়ে তুমুল প্রচার পাচ্ছিল। তরুণ প্রজন্মকে বাংলার নিজস্ব সুরসম্পদের আশ্রয় নিতেই হল। হাবীব-লন্ডনপ্রবাসী একজন প্রতিভাব সংগীতশিল্পী শাহ আবদুল করিমের গান সংগ্রহ করে রিমিক্স করে। পরে অ্যালবামটি বাংলাদেশে রিলিজ করা হলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে দেওয়ানা বানাইছে ... গানের ভিতরে আন্তরিকতা ও সহজাত সুরের সমন্বয়ে শহরবাসী নবীন ও প্রবীন উভয় প্রজন্মই চমকে ওঠে। শহরের মোড়ে মোড়ে ক্যাসেট-সিডির দোকানে শোনা যায় ...কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল ... প্রবীন শহরবাসী ও নবীন প্রজন্ম চমকে ওঠে এই কারণে যে এই জায়গার (কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল ) সুরটি ঠিক গ্রামীণ নয়, যারা দীর্ঘদিন সংগীতসাধনা করছেন তারা জানেন, কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল-র সুরটি অতি উচ্চাঙ্গের- রাগ মন্দ বলে একটি রাগ আছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ...তারই ছায়া পাওয়া যায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কে এই আবদুল করিম। জানা গেল ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষকপরিবারে শাহ আবদুল করিমের জন্ম। শিক্ষাবঞ্চিত শৈশব কেটেছে রাখালজীবনে যে কারণে বালকটি লাভ করেছিল নির্মল মেষপালকের হৃদয় । আর বালকের কলবের ভিতরে ছিল মখলুকাতের আতশী আয়না। আর সে জন্যই বোধহয় পরবর্তীকালে রাখালের জীবনসঙ্গীনি আবতাবুনেচ্ছা হয়ে উঠেছিলেন ঠিক স্ত্রী নয়-মুর্শিদ (আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক)। জায়গাজমি নিয়ে লোকে খুনখারাপি করে-আর করিম পৈত্রিক সম্পদ বেচে নিজের লেখা বই ছাপিয়েছেন, আফতাবসংগীত, কালিনীর ঢেউ ...ইত্যাদি । সে বইয়ে চরণের গভীরে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে - কে হবে মেম্বার কে-বা গ্রাম সরকার আমরা কি তার খবর লইতাম ভাইরে ... এরপর থেকে করিম চর্চা অব্যাহত রয়েছে। থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় শাকুর মজিদ এর ‘ভাটির পুরুষ।’ শ্রম স্বীকারের জন্য শাকুর মজিদ কে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। অনেক যত্নে তথ্যচিত্রটি নির্মান করেছেন তিনি, বাংলার ভাটি অঞ্চলের এক সংগীতসাধককে দিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান। তথ্যচিত্রটার শুরুটাও অতি আবেগঘন- বাংলাদেশের একটি চমৎকার মানচিত্র, (লেখায় বা তথ্যচিত্রে এই রকম মানচিত্রময় ইনট্রো আমারও খুব পছন্দ) তারপর বাঁশীর সুর, প্লেনের জানালায় বাংলার চিরায়ত দৃশ্য, দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে ...ইউক্যালিপটাস গাছ, টিলা, টিলার ওপর চা বাগান, শহর সিলেট, হযরত শাহ জালাল-এর দরগার তোরণদ্বার ...এসব কারণেই অ-সিলেটিদের কাছেও সিলেট এত গভীর আবেগের নাম ... ভিসিডিটি বাজারজাত করেছে লেজার ভিশন। বাউল গানের গভীর আকর্ষনের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকবেন শাহ আবদুল করিম, বাংলার ভাটি অঞ্চলের মেষপালকের হৃদয়ের সঙ্গে সমকালীন বিশ্বের সাধুসমাজের জানাশোনা হবে, চিন-পরিচয় হবে -এসব কারণে না হলেও ভিসিডিটি নিজস্ব সংগ্রহে রাখা বাঙালির একান্ত দায় বলেই মনে করি। সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২২
false
fe
কবি মমিনুল মউজদীন কে নিয়ে একটি লেখা দৈনিক সংবাদ / সাহিত্য সাময়িকী বৃহস্পতিবার | নভেম্বর ২২, ২০০৭ -------------------------------------------- মমিনুল মউজদীন : কবি ও কোড়া-শিকারীর প্রস্খান দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু =========================== কবি মউজদীন এবং রাজনীতিবিদ মউজদীনের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোনো সত্তা যে বিরাজিত ছিল না এ বিষয়টির একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ স্মরণ করতে চাই­ সাল ১৯৯২। কবি মমিনুল মউজদীন পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে জগন্নাথপুর থেকে কবি মাশুক ইবনে আনিস একখানা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। প্রতিউত্তরে মউজদীন লিখেছিলেন­ একদিন দেখবেন সুনামগঞ্জ পৌরসভা কবিসভায় পরিণত হয়েছে। সেই সভা স্বচক্ষে দেখে যাবার জন্য আপনাকে অগ্রিম আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমন্ত্রণ তিনি আমাকেও জানিয়েছিলেন­ সুনামগঞ্জের বালিহাঁস দেখে যাবার জন্য; তাঁর নিজহাতে গড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম, গ্রামের সাধারণ মানুষ আর পূর্ণিমার আলো দেখে যাবার জন্য। হায়! একজন্মে মানুষ কতকিছু দেখতে পারে না। আমি ভাল করে মমিনুল মউজদীনকে দেখতে পারিনি। আমার প্রিয় মানুষের মৃত্যু হয় শীতকালে। দু’ধারী তলোয়ারের মত ধারাল ঠান্ডা হৃৎপিন্ডে বিঁধে যায়, অথচ নগরীর কোথাও সাদা রক্ত পড়ে থাকতে দেখি না। গত বছর এমনই এক শীতার্ত দিনে কবিবু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মৃত্যু সংবাদ পাই। উজ্জ্বল আসমানে দীর্ঘক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়েছিলাম- কিশওয়ার নেই অথচ মাথার উপরে সূর্যটি এখনো বেঁচে আছে? কবি মমিনুল মউজদীনের মৃত্যু সংবাদে (আদৌ কি মউজদীন মারা গেছেন? এ কী করে সম্ভব! আমি তো কণ্ঠস্বর শুনতে পাই- কবি, মেঘালয়ের তীর থেকে আমি মউজদীন বলছি... -দেশে চলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি! -হ্যাঁ, চলে এলাম। প্রিয় শহর আর হাওরের বাতাস ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারি না...) আমার ভ্রম-বিভ্রমের প্রাচীর ভেদ করে সয়ম্ভু হয় পৃথক উপলব্ধি- প্রত্যেকটি মৃত্যুর পরে আমাদের নিকটতম সূর্য একবার করে রং বদলায়। ... আর এ মৃত্যু যদি হয় কবি মমিনুল মউজদীনের? তবে কি গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণাবর্ত ক্ষণিকের জন্য থেমে যায়! শীতের শহর ঘুরে প্রতিটি শীতার্ত দরোজায় কড়া নেড়ে যাই দরজা খোলে না। একটি কুৎসিত হাত যদি খুলে দিত আবদ্ধ কপাট একজোড়া অ চোখ ও নিমীলিত বিপন্ন পাতায় সহানুভূতির নম্র কেশর উড়তো একজোড়া বোবা ঠোঁটও যদি কাঁপতো না-বলা কিছু শব্দের তাড়ায়! (দরোজা/এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়) গত বছর এমনই এক শীতকালে মউজদীন তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায় আমার হাতে তুলে দেন। খুব বিনম্র ভঙ্গিতে নিম্নস্বরে বলেন- বহু আগের লেখা, এখন কবিতায় সময় দিতে পারি না। আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাই। দরোজা কবিতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। স্পষ্টতই দৃশ্যমান হয় মউজদীন রচিত শীতের শহর আর শীতার্ত দরোজাগুলো। ঐ রাতে আব্দুল আহাদ চৌধুরীর রেস্তোরাঁয় বেশ ঠান্ডা ছিল। মউজদীনের পরনে ছিল কালো রঙা কোট। আমরা যেন ওভারকোটের নিচে শীতঋতু বদলে দিয়েছিলাম। আমাদের কফির পেয়ালা ক্রমশ ঘর্মাক্ত হচ্ছিল। মউজদীন সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এ উপলক্ষে অনেকেই এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আমি এবং সৈয়দ নাসির ব্যতীত উপস্খিত সকলেই সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। এদের অধিকাংশজনকেই আমি চিনি এবং এদের সম্পর্কে জানি। এরা সজ্জন এবং দুর্জন। কিন্তু এরা সবাই মমিনুল মউজদীনের ভক্ত। এদের সবার আলোচ্য বিষয়- সুনামগঞ্জের রাজনীতি এবং আগামী নির্বাচনে কে কোন দল থেকে টিকেট লাভ করবে? মউজদীন কথা বলেন- জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে; মউজদীন কথা বলেন পূর্ণিমারাত, টি এম কায়সার, তুহিন, ধ্রুব এষ, হাওরের বাতাস, টাঙ্গুয়ার জলে-ভাসা পক্ষীকুল নিয়ে। আমি বিব্রত বোধ করি। এ রকম পরিবেশে কোনোদিন আমি কারো কাছে কাব্য-কথা শুনিনি। মউজদীন মন্ত্রের মত বলেন। উপস্খিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনেন। তারা জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে শাহ করীমের গানের সাযুজ্য খোঁজেন, বঙ্গবু উনিশ শ’ কত সালে বাউল করীমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?... আমার বুঝতে বাকি রইল না- মউজদীনের সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। আর এ না হলে একজন কবি তিন তিন বার কি করে পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন! আমি উপলব্ধি করি তার কথা বলার কৌশল, তাঁর কথায় নীরবতা আছে, যা দু’টি শব্দ কিংবা দু’টি বাক্যের মধ্যবর্তী শূন্যতা। তাঁকে বলি- আহমেদ কায়সার এবং আপনি ব্যতিরেকে সুনামগঞ্জের কেউ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। আপনার কথায় স্পেইস আছে আবার কায়সারের কথায় স্পেইসের অভাব লক্ষ্য করেছি। তবে আপনাদের দু’জনের মিল একটি জায়গায়, তা হল- দু’জনের কথাতেই আমি হাওরের বাতাস অনুভব করি। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেই- একজন মানুষের ভাষা থেকেই বোঝা যায় সে কোন জলবায়ুতে বড় হয়েছে। ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ দ্য হাউস অব বিয়িং, মউজদীনের দু’চোখ চিকচিক করে। তার মুখমন্ডলে রক্তাভ আভা ফুটে ওঠে। কবি কায়সারের মুখে অনেক শুনেছি পূর্ণিমা রাতে পৌরসভার বাতি নিভিয়ে দেবার গল্প; ... তারপর প্রিয় মানুষেরা দল বেঁধে পূর্ণিমা-স্নান করত আর হাওরের ওপর পড়ে-থাকা গ্রামের ছায়ায় তখন শোনা যেত বাঁশি অথবা শঙ্খের আওয়াজ। মউজদীন বলেন- তুহিন, কায়সার এরা তো পূর্ণিমার সন্তান। সুনামগঞ্জের মানুষ যারা বার্মিংহামে থাকেন, চেয়ারম্যান মউজদীন এবং তাঁর পৌরসভা নিয়ে যতবারই তাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে বারংবার বিস্মিত হয়েছি এজন্যে যে, সরাসরি ভোটের রাজনীতি করেও লোকটার কোনো শত্রু নেই কেন? সবাই একবাক্যে তাঁকে ঐ জনপদের নেতা মেনে নেন। মরমি কবি হাছন রাজার যোগ্যতম উত্তরসূরী হিসেবেই চিহ্নিত করেন না­ কবি, গায়ক, সুনামগঞ্জের বু, বীর, সৎ, যোগ্য ইত্যাদি অভিধায় শনাক্ত করেন। অজাতশত্রু মমিনুল মউজদীনেরও শত্রু থাকে। এর নাম মৃত্যু। এ সংবাদ দেশ-বিদেশে বিদ্যুৎ বেগে ছড়াতে থাকে­ ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান কবি মমিনুল মউজদীন এবং তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও ড্রাইভার। কবি মউজদীন তাঁর পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনার শিকার হন। নিহত মউজদীনের প্রাইভেট কারটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া এসে পৌঁছলে সিলেট থেকে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্খলে মারা যান কবি মউজদীনের স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী, ছেলে কাহলিল জিব্রান চৌধুরী ও ড্রাইভার কবীর হোসেন। গুরুতর আহত অবস্খায় ঢাকা নেওয়ার পথে আশুগঞ্জ নূর মেডিকেল সেন্টারে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন মমিনুল মউজদীন। এ ঘটনায় সুনামগঞ্জ পৌর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।’ নদী আর সাত সমুদ্রের ওপারে, বার্মিংহামের শীত ক্রমশ গাঢ় হয় মৃত্যুর ঘনত্বে। জীবিত মানুষের ঠান্ডা লাগে। এখন মমিনুল মউজদীনের ঠান্ডা লাগে না। এখন তাঁর কবিতার রঙ আরও নীলবর্ণ ধারণ করছে। মনে হচ্ছে, মৃত্যুর পরেও মানুষটি প্রেমিক, মৃত্যুর পরেও মানুষটি শির উঁচু করে ব্রহ্মান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃত্যুর হিমেল সুর বেজে চলে অরণ্যে পাহাড়ে বসন্তের বানভাসা জলে ভাসে নীল শহরের জ্যোৎস্না-ঝরা ভবঘুরে রাত... জলমগ্ন কবরে ফেল দুই ফুটা ফুরাতের জল নগ্ন, উষä বাহু রেখ মৃত্যুহীম কপালে আমার। আমার সমুখ দিয়ে মাথার ওপর দিয়ে শাণিত ছুরির মতো আমাকে দ্বিখন্ডিত করে যাও এপারে ওপারে যাও, এদেশে ওদেশে আর জীবনের এপিঠে ওপিঠে। কখনো মৃত্যুর দুটি হিমচোখ ভেদ করে যাও নদী আর নাব্যতার আত্মগ্ন ব-দ্বীপের কাছে ফিরে যাই, শুনি কার পায়ের আওয়াজ... কবি মউজদীন এবং রাজনীতিবিদ মউজদীনের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোনো সত্তা যে বিরাজিত ছিল না এ বিষয়টির একটি প্রত্যক্ষ উদহারণ স্মরণ করতে চাই­ সাল ১৯৯২। কবি মমিনুল মউজদীন পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে জগন্নাথপুর থেকে কবি মাশুক ইবনে আনিস একখানা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। প্রতিউত্তরে মউজদীন লিখেছিলেন­ একদিন দেখবেন সুনামগঞ্জ পৌরসভা কবিসভায় পরিণত হয়েছে। সেই সভা স্বচক্ষে দেখে যাবার জন্য আপনাকে অগ্রিম আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমন্ত্রণ তিনি আমাকেও জানিয়েছিলেন­ সুনামগঞ্জের বালিহাঁস দেখে যাবার জন্য; তাঁর নিজহাতে গড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম, গ্রামের সাধারণ মানুষ আর পূর্ণিমার আলো দেখে যাবার জন্য। হায়! একজন্মে মানুষ কতকিছু দেখতে পারে না। আমি ভাল করে মমিনুল মউজদীনকে দেখতে পারিনি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় খুব অল্প দিনের। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের জন্য দায়ী আহমেদ কায়সার। রাজবদনের সঙ্গে আমার পুন:পরিচয়ের জন্য দায়ী স্বয়ং মমিনুল মউজদীন। আমি রাজবদনের সঙ্গে ঘন ঘন কথা বলি। বই উৎসর্গ করি। মমিনুল মউজদীনকে বই উৎসর্গ করি না। আমি জানতাম- কবি মউজদীনকে বই উৎসর্গ করতে হয় না; উৎসর্গ করতে হয় পূর্ণিমা। আমায় ক্ষমা করবেন মউজদীন- আমার কাছে যে পূর্ণিমা ছিল না! এখন প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে মমিনুল মউজদীনের নামাজে জানাজায় শরিক হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, অত:পর কুলখানি হবে, কে হবে নতুন পৌর চেয়ারম্যান, তা-ই নিয়ে ভাবিত হবেন কেউ কেউ। কিন্তু আমার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে- প্রিয় সন্তানের মৃত্যুতে প্রাচীনতম ভোর নেমেছে মাতৃপৃথিবীতে। এ ভোর ছায়া-রায়া। এ ভোরের বাতাস ছেঁড়া ছেঁড়া। নগরবাসী কিছুক্ষণের জন্যে তার লাশ উত্তর-শিরানা করে হাওরের পারে রেখে এসেছে। এ হাওর কি তবে দেহার হাওর, শনি বা টাঙ্গুয়ার হাওর? অভয়ারণ্য তছনছ করে পাখিরা সারিবদ্ধ হয়েছে পাখিদের রাজা মউজদীনের লাশের পাশে। তারা অপেক্ষা করছে সেই সব পঙ্গু কুড়াদের, যারা সুনামগঞ্জের ক্ষেতি জমিনে কাদাবিদ্ধ ছিল, যাদেরকে মউজদীন শুশ্রূষা করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারা এলেই জানাজা শুরু হবে।... আর তো জানি, পাখিরা সব মানুষের জন্যে নামাজে জানাজা পড়ে না, মমিনুল মউজদীনের জন্য পড়ে। সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:১১
false
hm
আরশ জওয়ান মোসলেম খান স্টেনগানটা কাঁধ থেকে নামিয়ে আনে, কিন্তু সামনে দাঁড়ানো কালোপানা লোকটার মুখের ওপর থেকে চোখ সরায় না। লোকটার কালোকিষ্টি চেহারা থেকে সমস্ত রক্ত নেমে যায় পলকের মধ্যে। "হুজুর ... হুজুর ...।" বাকি শব্দগুলি বের হয় না তার কাঁপতে থাকা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে, কিন্তু মোসলেম খানের বুঝতে বাকি থাকে না, লোকটা কী বলতে চাইছে। "তুম মুসলিম হো কেয়া?" মোসলেম খান আয়েশ করে স্টেনটাকে অন্যকাঁধে ঝোলায়। লোকটার চোখ সম্মোহিতের মতো স্টেনের নলটাকে অনুসরণ করে শুধু। "হ্যাঁ হুজুর। হাম মুসলিম হায়।" "নাম কেয়া? নাম বোলো।" "ইদরিস, হুজুর।" মোসলেম খান আপনমনে উচ্চারণ করে ইদরিস নামটাকে। বিভিন্নভাবে। ইদ্রিস। ইদরিস। ইদরিশ। ইদরিস কাঁপতেই থাকে। "কেয়া ভাই ইদরিস, অওর কুছ হায় কেয়া তেরে নামকে আগে পিছে?" "হুজুর?" "কেয়া তেরা নাম সিরফ ইদ্রিস হায়? অওর কুছ নাহি তেরে নামকে সাথ?" ইদরিস মনে মনে জিভ কাটে হয়তো, মোসলেম খান স্পষ্ট দেখতে পায়। ইদ্রিসের উচ্চতাটুকু সে মাপে মনে মনে। পাঁচ ফিট এক ইঞ্চি হবে। ওজন কেমন হবে এই শুয়ারের বাচ্চার? চল্লিশ সের? মুরগির মতো সিনা। কুকুরের মতো সিয়া গায়ের রং। এ-ই সম্বল করে বুজদিলরা আজাদী চায়। "মোহাম্মদ ইদরিস আলি হুজুর।" "ওয়াহ ওয়াহ। কেয়া খুবসুরৎ নাম হ্যায় ভাই! মোহাম্মদ ইদরিস আলি! কান রওশন হো গায়া মেরা। কাপড়া উতার।" "হুজুর?" মোসলেম এবার হাত চালায়। চটাশ করে শব্দ হয়। মোসলেম হাতটা নিজের পাৎলুনের পেছনে মুছে নেয় চট করে। বাংগালটার গাল ভর্তি ঘাম। "বাত সমঝ মে নাহি আয়া মাদারচওদ? ম্যায়নে কাহা কাপড়া উতার।" ইদরিস আলি কাঁপা হাতে নিজের গেঞ্জি খুলতে যায়। মোসলেম হেসে ফেলে। "বানিয়ান উতারকে কেয়া দেখলাওগে? তুমহারা হাড্ডি গিননেকা ওয়াক্ত নাহি হ্যায় মেরে পাস। কাপড়া উতারো বেহেনচোদ কাহিকা।" ইদরিস আলি লুঙ্গির গিঁটে হাত দেয় কাঁপা হাতে। তার ঠোঁটের কোণে রক্ত। মোসলেম খান স্টেনের গ্রিপ চেপে ধরে অলস চোখে চারপাশটা দেখে নেয় একবার। ধারেকাছে কোন দর্শকও নেই। মোসলেম বিরক্ত হয়। অন্তত শ'খানেক লোকের দেখা দরকার ছিলো এই দৃশ্য। ইদরিস আলি লুঙ্গি ফেলে দিয়ে দাঁড়ায়। মোসলেম খান আটদিন আগে এই এলাকায় অপারেশনে ছিলো। ইদরিস আলির মতোই রোগাপটকা একেকটা শুয়ারের বাচ্চা সেদিন হল থেকে পাকিস্তানী ফৌজের ওপর গুলি করার হিম্মৎ দেখিয়েছে। মোসলেমের ইউনিট ছাড়েনি তাদের। পরদিন যতগুলোকে পেয়েছে, পেছনে মাঠে নিয়ে কবর খুঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছে। এক দলের কবর অন্য দল খুঁড়েছে, লাশ তুলে এনে গোর দিয়েছে আরেকদল, নতুন খোঁড়া গোরের মধ্যে গুলি খেয়ে লাশ হয়ে পড়েছে আরেকদল, সেই গোরে মাটি চাপা দিয়েছে আরেকদল। পালে পালে বাঙালি। রোগা, কালো, বেঈমান। রাস্তার কুত্তাগুলি পর্যন্ত ওদের চেয়ে উঁচু দরের পাকিস্তানী। হাফনাঙ্গা ইদরিস কাঁপতে থাকে এপ্রিলের কটকটে রোদের নিচে দাঁড়িয়ে। মোসলেম খান ইদরিসের শিশ্ন দেখে মনোযোগ দিয়ে। নাম মোহাম্মদ ইদরিস আলি, বললেই ইয়াকিন যাবার পাত্র সে নয়। এই ইদরিস হিন্দুর দালাল, নাকি নিজেই হিন্দু, সেটা পরখ করে দেখতে হবে আগে। আরশ থেকে মোসলেম খানের ঈশ্বর নেমে ইদরিসের রুগ্ন কুঞ্চিত শিশ্নের ডগায় ভর করেন মোসলেমের স্টেনের দাপটে। তেসরা এপ্রিল, ঊনিশশো একাত্তর। . .
false
hm
দ্বাদশ ক্রুদ্ধজন ব্যাপারটা একটু কাকতালীয়, গত ২৪ ঘন্টায় তিনবার "টুয়েলভ অ্যাংরি মেন" চোখের সামনে এসে হাজির। একবার দুর্দান্তের লেখায়, একবার বঙ্কার মেসেজে, আরেকবার এক লুল ভিক্টিমার মুখে। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন নিয়ে আগে কথাও শুনেছি, লেখাও পড়েছি, কিন্তু দেখার কৌতূহল জাগেনি। এমন জোরালো কাকতাল ঘটায় দেখতে বসে পড়লাম। সিনেমা রিভিউ লেখার সমস্যা, যেটা নিয়ে প্রত্যেক সিনেমা রিভিউতে কথা বলি, হচ্ছে দুটো। এক, সিনেমা বুঝি কম, আর দুই, রসিয়ে লিখতে গেলে পণ্ডিকা [স্পয়লারের বাংলা করলাম] চলে আসে লেখায়। সিনেমামূর্খতা ঢেকে আর পণ্ডিকা এড়িয়ে লিখতে গেলে শেষমেশ জিনিসটা বেরসিক হয়। পরিচালক সিডনি লুমে মার্কিন সিনেমার দিকপালদের একজন, চিত্রনাট্যকারের খোঁজে গুগল মেরে পেলাম রেজিনাল্ড রোজকে। নেটে ঘাঁটলে সিনেমাটা নিয়ে আরো একগাদা তথ্য আর কথাবার্তা পাওয়া যাবে, আগ্রহীরা খুঁজে দেখতে পারেন। আমি দর্শকপ্রতিক্রিয়াটুকুই লিখি। পুরনো হলিউডি সিনেমাগুলোতে একটা কিছু ছিলো, যা এখনকার সিনেমায় নেই। সেটা কী, এক কথায় বলে বোঝানো সম্ভব না, হয়তো অনেকক্ষণ চিন্তা করেও যুৎসই শব্দ আসবে না মাথায়। কিন্তু পুরনো সিনেমা দেখতে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন শুরু হয়েছে সাদামাটা ভাবে, কিন্তু এই যে বিলুপ্ত মশলা, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই দর্শকের মনের জিভে আসর করা শুরু করে। মোটা দাগে কাহিনী এমন, এক তরুণ তার পিতাকে ছুরি মেরে খুনের দায়ে অভিযুক্ত। বারোজন জুররের কাঁধে দায়িত্ব পড়েছে, সমস্ত ফ্যাক্টস আর দুই পক্ষের যুক্তি শুনে রায় দেয়ার। পরিকল্পিত খুনের অভিযোগ, কাজেই শাস্তি গুরুতর, মৃত্যুদণ্ড। বারোজন জুরির রায় একই হতে হবে, দোষী বা নির্দোষ। করিডোর ধরে বিচারালয়ের ভেতরে এগোয় ক্যামেরা, নানা টুকিটাকি প্রাসঙ্গিক এবং ডিটেইলে ভরা দৃশ্য পেরিয়ে বিচারকক্ষে ঢুকে ক্যামেরা এই তথ্য জানায় দর্শককে। বারোজন জুরি উঠে চলে যান পাশের ঘরে, অভিযুক্ত তরুণের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে। সিনেমাটা ঐ বারোজন জুররকে নিয়ে। গোটা সিনেমাটা অভিনীত হয়েছে সেই পাশের ঘরে, দর্শককে যা ক্ষণিকের জন্যে হিচককের রোপ-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে রোপের মতো অতো দীর্ঘ শটের সিনেমা নয় এটি, বরং পরিচালক এই বারোজন জুররের গল্পটি ফুটিয়ে তুলতে ক্যামেরার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছেন ষোলো আনা। সংলাপবহুল সিনেমা বলে পরিচালক চেষ্টা করেছেন চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তি যতটুকু সম্ভব ফুটিয়ে তুলতে, তাই শটের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, লুমে শটগুলো সাজিয়েছেন দারুণ, দারুণ মুনশিয়ানায়। হিচককের মতো সাসপেন্স নেই, কিন্তু দর্শক এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরাতে পারেন না পর্দা থেকে। কেন? সংলাপ। এই জায়গায় এসে মনে হয়, পুরনো হলিউডি সিনেমার সাথে নতুন দিনের সিনেমাগুলোর পার্থক্য কোথায়। এখন ঘটনার এতো বেশি ঘনঘটা, যে সংলাপ অনেক নির্ভার হয়ে পড়েছে। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন এ প্রতিটি সংলাপ অভিনেতাদের কাছ থেকে যে নৈপুণ্য আর পারিপাট্য নিয়ে এসেছে, তা অসাধারণ। এক একটা বাক্য পরিমিত, কিন্তু আরোপিত মনে হবার জো নেই। খুব সাধারণ একটা কথা, ঐ মুহূর্তে ঐ রকম চরিত্রের মুখে ঐ রকম কথাই আমরা আশা করবো, কিন্তু এতো চমৎকার কৌশলে লেখা আর ডেলিভার করা যে অভিভূত হতে হয়। সিনেমার কাহিনী এবার সামান্য একটু বলি, যতটুকু ঊরু না দেখালেই নয়। ঘরে ঢোকার পর বারোজনের মধ্যে এগারো জন জুরর মত দেন, অভিযুক্ত তরুণ দোষী। একজন মাথা নাড়েন। তিনি বলেন, আমি জানি না। রায় ফেঁসে যায়, কারণ বারোজনকে একমত হতে হবে দোষী অথবা নির্দোষ বিচারে। বাকি এগারোজন চটে ওঠেন। জানেন না মানে কী? কী করতে চান আপনি? সেই লোক বলে, আসুন কথা বলি। হ্যাঁ, এরপর কথা শুরু হয় কেবল। এই কথা নিয়েই সিনেমা। একজন মানুষের প্রাণ বারোজন মানুষের হাতে, সে নিয়ে কথা। তর্ক। আলোচনা। খুনসুটি। ঝগড়া। অপমান। স্বগতোক্তি। একজন স্থপতি, একজন সেলসম্যান, একজন রংমিস্ত্রি, একজন শেয়ারদালাল, একজন ঘড়ি নির্মাতা, একজন বিজ্ঞাপন কপিরাইটার, একজন ফুটবল কোচ ... এরকম বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন রুচির বিভিন্ন শিক্ষার বিভিন্ন চরিত্রের বারোজন মানুষের মধ্যে একটি ঘরে এক অভূতপূর্ব টেনশন তৈরি হয়ে ত্রয়োদশ একটি মানুষের প্রাণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে। এ কথার মধ্যে দিয়ে লুমে যে কী অসাধারণ একটি সিনেমা যে নির্মাণ করেছেন, শেষ দৃশ্যের আগে এসে দর্শকের সে উপলব্ধির ফুরসতও থাকে না। মৃদু কণ্ঠের সংলাপ, ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চিৎকার, এক একটা বাক্য যেন আলাদা চরিত্রের চেহারা নিয়ে ঘুরপাক খায় সেই ঘরে, পর্দায়, দর্শকের মনে। মাত্র বারোজন মানুষ একটি ঘরে, কিন্তু তাদের সংলাপ ঘটনাকে কুমোরের চাকার মতো ক্ষণে ক্ষণে ভিন্ন চেহারা দেয়। যাঁরা রহস্যগল্প ভালোবাসেন, তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এটি একটি রোমাঞ্চকর রহস্যকাহিনীও বটে। কিন্তু এখানে রহস্য একটি নয়, একাধিক। খুনের মামলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উঠে আসে আরো কয়েকটি ইস্যু, যা আদালতে ওঠে না, যা মানুষের পৃথিবীতে অমীমাংসিত থেকে যায় বেশিরভাগ সময়। চরিত্রগুলোর চেহারার ভাঁজ খুলে বেরিয়ে আসে ভিন্ন চেহারা, সংলাপের সুর আর স্বর আস্তে আস্তে তাদের নতুন রূপ দেয়, নতুন ছকে দর্শক তাঁদের পুনর্কল্পনা করেন। সিনেমাটা দেখতে দেখতে ক্রিস্টির মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের কথা মনে পড়ছিলো, সিনেমা শেষ করে গুগল মেরে দেখি হায়, লুমে সেটারও পরিচালক! সিনেমাটার সমাপ্তি আমার দেখা গত আটবছরে দেখা সব সিনেমা অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে। মালেনা দেখে খুব আবেগতাড়িত হয়েছিলাম, মনে আছে, মনে হয়েছিলো মানুষ এরকমই। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন দেখে সজল চোখে অনুভব করলাম, মানুষ অনেকরকম। মানুষ কখনো সেই স্থপতির মতো রুখে দাঁড়াতে জানে, মানুষ সেই বিজ্ঞাপনের কপিরাইটারের মতো দ্বৈরথে ভুগতে জানে, মানুষ সেই বৃদ্ধ জুররের মতো চরিত্রবিচার করতে জানে, মানুষ সেই রেসিস্ট ইতালিয়ানের মতো নিজের ভেতরের অমানুষকে বের করে আনতে জানে, মানুষ সেই অভিবাসি শীর্ণকায় ঘড়ি নির্মাতার মতো নিজেকে অতিক্রম করে শক্তিশালী হয়ে উঠতে জানে, মানুষ ভুলটাকে গোঁয়ারের মতো আঁকড়ে ধরে চিৎকার করতে জানে, মানুষ ভুল স্বীকার করে বিপক্ষের যুক্তি মেনে নিতে জানে, কিন্তু সবকিছুর শেষে, সিনেমার শেষটুকুর শিক্ষা, মানুষ আসলে মানুষই। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন এর মতো একটা সিনেমার গল্প কি লিখতে পারবো কখনো? লিখবো। লিখতেই হবে। ... আহ, কত পরিতৃপ্তির স্বপ্ন দেখি!
false
hm
প্রায়নেভারেস্ট পোস্ট: আনিসুল হকের সাক্ষাৎকার ও বিশ্লেষণ দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদক কলামিস্ট আনিসুল হক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের সংবাদ এবং তদপরবর্তী ঘটনাবলি আমরা পত্রিকায় তার বয়ানে জেনেছি। স্বভাবতই মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় নিয়ে সংশয় সময়ের সাথে চক্রবৃদ্ধিহারে বহুগুণিত হওয়ায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানার কৌতূহল আমার জেগে উঠেছে। উদ্যোগ নিয়ে আমি তার মোবাইল নাম্বারটি সংগ্রহ করে তাকে ফো ... দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদক কলামিস্ট আনিসুল হক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের সংবাদ এবং তদপরবর্তী ঘটনাবলি আমরা পত্রিকায় তার বয়ানে জেনেছি। স্বভাবতই মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় নিয়ে সংশয় সময়ের সাথে চক্রবৃদ্ধিহারে বহুগুণিত হওয়ায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানার কৌতূহল আমার জেগে উঠেছে। উদ্যোগ নিয়ে আমি তার মোবাইল নাম্বারটি সংগ্রহ করে তাকে ফোন করি গত ১৯ সেপ্টেম্বর। আনিসুল হক ফোন ধরেন, সাক্ষাৎকারের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং একটি অসমাপ্ত সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে কৌতূহলোদ্দীপক বেশ কিছু ব্যাপার উঠে এসেছে, সেই সঙ্গে এভারেস্ট-জয়ের-দাবি বিষয়টি সম্পর্কে সাংবাদিকদের একাংশের প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়েছে। যিনি নর্থ আলপাইন ক্লাবের সভাপতি, তিনিই যাচ্ছেন পত্রিকার হয়ে মুসার স্টোরি কাভার করতে, তাহলে সাংবাদিকসুলভ দূরত্ব আর বজায় রইলো কোথায়? আনিসুল হক স্বীকার করেছেন, মুসার এভারেস্ট জয়ের সংবাদের পর তিনি এত কিছু চিন্তা করেননি, স্টোরি কাভার করতে চলে গেছেন কাঠমাণ্ডু। আমরা এই চর্চাকে কীভাবে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বলে ধরে নেবো? এটির সাথে কি প্রথম আলোর উপসম্পাদকের ব্যক্তিগত স্বার্থও জড়িত নয়? নিচের ভিডিওতে সাংবাদিকদের সাথে মুসাকে নেপাল তিব্বত সীমান্তে দেখা যাবে। সাংবাদিকসুলভ দূরত্বের ব্যাপারটিও ভিডিওতে স্পষ্ট হবে। সেখানে সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে মুসাকে কে কার আগে আলিঙ্গন করবেন, সেই প্রতিযোগিতা চলছে। একে সাংবাদিক সমাবেশ না বলে বন্ধুসভা বলাই ভালো, এবং এই বন্ধুসভা থেকে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আশা করা বাতুলতা মাত্র। আনিসুল হকের "কেন প্রমাণ করতে হবে আমাকে বলেন?" আর্তনাদের মধ্যেই এটি স্পষ্ট, এভারেস্ট জয়ের দাবি মানুষের সামনে উপস্থাপনে তাঁরা যত তৎপর, প্রমাণ উপস্থাপনে ঠিক ততটাই নিরুৎসুক। সংবাদপত্রে সাংবাদিকরা একটা কিছু লিখে দিয়ে বসে থাকবেন, সাধারণ মানুষ তার সপক্ষে প্রমাণ চাইলে শুনতে হবে ধমক, "কেন প্রমাণ করতে হবে?" তিনি বলেছেন, একটা দুটো ছবি তো নানা জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। এ কথা স্পষ্ট, প্রথম আলো বাদে এই নানা জায়গা বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন সামহোয়্যারইনব্লগের কথা, যেখানে মুসার কতিপয় বন্ধু বেনামে সেসব অস্পষ্ট ছবি আপলোড করেছে। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট স্টোরি কি সামহোয়্যারইনব্লগে লিখেছিলেন আনিসুল হক? না, লিখেছিলেন প্রথম আলোয়। তাহলে সেই দাবির সপক্ষে প্রমাণ কেন প্রথম আলোয় প্রকাশিত হবে না? কারণ একটিই, সেসব অস্পষ্ট ছবি, যেগুলো আরো নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, প্রকাশ করে মানুষের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে চায় না পত্রিকাটি। যেহেতু প্রশ্ন আর সংশয় এখন পর্যন্ত অনলাইনেই সীমাবদ্ধ, মুসার সাংবাদিক বন্ধুরা সামহোয়্যারইনব্লগে বেনামে সক্রিয়তার সুযোগটি নিয়ে নানা নিকে সেসব ছবি দেখিয়ে সে সংশয় দূর করার কাজে নেমেছেন। সত্যই যদি এভারেস্ট জয় করে থাকেন মুসা, সেই ছবি তো ঘরে ঘরে শোভা পাওয়ার কথা, কেন এত লুকোচুরি? পর্বতারোহণ নিয়ে ইতিপূর্বে বাংলাদেশের পর্বতারোহীদের নানা দাবি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিলো কি না, এই প্রসঙ্গটি আনিসুল হক পরিষ্কারভাবে এড়িয়ে গেছেন, তবে মুখ ফসকে এ নিয়ে আগে বিতর্ক হওয়ার কথা বলে ফেলেছেন। তিনি দায় চাপিয়েছেন ইতিপূর্বে যারা এসব খবর প্রকাশ করেছে, তাদের ঘাড়ে। কারা ইতিপূর্বে এসব খবর প্রকাশ করেছিলেন? প্রথম আলো, ডেইলি স্টার আর তার সাংবাদিকেরাই কি প্রকাশ করেননি? অথচ আনিসুল হকই ব্লগের সাথে সংবাদপত্রের পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোনো আইটেম তিন-চার হাত ঘুরে সম্পাদিত হয়ে তারপর প্রকাশিত হয়, প্রতিষ্ঠান তার পেছনে দায় নেয়, ব্লগে দায় নেয় শুধু পোস্ট লেখক। এই কথা সত্য, এবং আমরা তাঁর কথা অনুসারেই ধরে নিতে পারি, ইতিপূর্বে পর্বতারোহণের যেসব সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো তিন চার হাত ঘুরে সম্পাদিত হয়েই প্রকাশিত হয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠান সেসব সংবাদের দায় নেবে। কিন্তু সেসব প্রকাশিত খবরে অনুসন্ধানের লেশমাত্র নেই, পর্বতারোহীরা যখন যা বলেছেন, সেটিই প্রকাশিত হয়েছে। কোনো অনুসন্ধান, কিংবা প্রমাণ উপস্থাপনেরও প্রয়োজন বোধ করেননি সাংবাদিকেরা। এভাবে তাদেরই প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে নানা পর্বতজয়ের মিথ, যেগুলো একটু খতিয়ে দেখলেই হাজারো অসঙ্গতি বেরিয়ে আসে। "তিন চার হাত ঘুরে সম্পাদিত হওয়া" একটি সংবাদের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এটি কাঠমাণ্ডু থেকে লিখেছেন সাংবাদিক আনিসুল হক [১], মুসা ইব্রাহীমের কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলছেন: ... তারপর যন্ত্র সেরে গেলে আবার আমি অক্সিজেন টেনে নিলাম বুকের ভেতরে। আমি জীবন ফিরে পেলাম। আট হাজার ৬০০ ফুট পাড়ি দিয়েছি। আর মাত্র ২৪৮ ফুট। পুরকৌশলী বলেই সম্ভবত আনিসুল হক সবকিছু ফুটে মেপে অভ্যস্ত। এই ত্রুটিটি খুব একটা বড় কিছু নয়, মিটারকে তিনি ফুট বলেছেন কেবল, কিন্তু এই সামান্য ত্রুটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পাদনার মুখ দেখেনি, সরাসরি প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। এর অর্থ, হয় পত্রিকার তিন-চার হাত ঘুরে আনিসুল হকের লেখা সম্পাদিত হয় না, কিংবা সম্পাদিত হলেও যিনি বা যারা সম্পাদনা করছেন, তারা এভারেস্টের উচ্চতা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। এঁরাই এর আগে নির্বিকারে প্রকাশ করেছেন ফ্রে পিক জয়ের ভুল তথ্য, চুল্লু ওয়েস্টে তাঁবুতে বসে থাকার পরও সামিট জয়ের সংবাদ, লাংসিসা রি জয়ের মিথ্যা দাবি, অন্নপূর্ণা-৪ জয়ের রূপকথা এবং এখন এভারেস্ট জয়ের সংবাদ। তরুণ কনট্রিবিউটরদের কথা বাদই দিলাম, ডাকসাইটে কলামিস্টদের কথাই ধরুন। তিন-চার হাত ঘুরে সম্পাদনার পরও দেখি প্রথম আলোতে সিনেমা না দেখেই রিভিউ লিখে ফেলেন সুমন রহমান [৯], আয়ারল্যাণ্ডকে স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ায় পাঠিয়ে দেন আবুল মকসুদ [১০], মওদুদির বইকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বানিয়ে দেন হাসান ফেরদৌস [১১]। প্রথম আলোর এই তিন চার হাতের ওপর কতটুকু আস্থা রাখা যায়? আনিসুল হক বলছেন, মুসার সাথে কথা বলার পর, দেখা হবার পর তিনি নিঃসন্দেহ, যে মুসা এভারেস্ট জয় করেছে। অথচ উইকিপিডিয়ায় রক্ষিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সংবাদ আসার পরপরই আনিসুল হকের চলচ্চিত্র "থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার" এর ওয়েবসাইটের ওয়েবমাস্টার দেওয়ান কামরুল হাসান মুসার জীবনী উইকিপিডিয়ায় সংরক্ষণের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন [৮]। অর্থাৎ, এ তথ্য ভালোমতো যাচাই করার আগেই একটি মহল মুসার এই জয়ের দাবিকে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নেমে পড়েছে। আনিসুল হক আরো জানাচ্ছেন, তার কখনও এই সন্দেহ হয়নি যে মুসা এভারেস্টে না উঠে এভারেস্ট জয়ের দাবি করছে। তিনি আরও জানাচ্ছেন, মুসার সাথে যারা উঠেছে তারা কেউ বলেনি যে মুসা ওঠেনি। আনিসুল হক বলছেন, একই বাসে করে তারা এসেছে, তাদের সাথে রেস্তোরাঁয় দেখা হয়েছে, এমব্যাসিতে তারা মুসাকে ফুল উপহার দিয়েছে। যুক্তির ধারাটি দেখুন পাঠক, কেউ কিছু বলেনি, অতএব প্রমাণিত হয়ে গেলো মুসা এভারেস্টে উঠেছে। কেউ যদি বলতো মুসা ওঠেনি, তাহলেই কি প্রমাণিত হয়ে যেতো যে মুসা ওঠেনি? নাকি এ নিয়ে অনুসন্ধানের অবকাশ থাকে? এখানে ফাঁকিটা আবারও সেই সঠিক সূত্র উপস্থাপন না করায়। কারা মুসার সাথে একই বাসে ফিরেছে? ওপরে ভিডিওতেই দেখা যাচ্ছে মুসার বাস থেকে নামার দৃশ্য। যারা মুসার সাথে একই বাসে ফিরেছে, তাদের কয়জন খোঁজ রাখে, মুসা এভারেস্ট জয় করেছে কি করেনি? তাদের কারো সাক্ষাৎকার কি তখন নেয়া হয়েছে? এমন কেউ কি সেখানে থাকার কথা, যে বাস থেকে নেমেই সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা দেবে, মুসা এভারেস্ট জয় করেছে, কিংবা মুসা এভারেস্ট জয় করেনি? মুসার সাথে একই বাসে ফেরা আরোহীরা যে সবাই এভারেস্টে গেছে, তারই বা কী প্রমাণ রয়েছে? আর ঘটনাচক্রে রামডুডল হোটেলে যাদের সাথে মুসার সাক্ষাৎ হয়েছে, তারা সেই ব্রেণ্ডান ও'ম্যাহোনি আর স্টিফেন গ্রিন [৬], সেদিন আচমকা দেখা হয়ে না গেলে তারা দূতাবাসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতও হতো না, এবং একটি রহস্যজনক অধ্যায় অন্ধকারেই থেকে যেতো। আর যারা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, তারা পরে আমন্ত্রিত হলে মুসাকে ফুল উপহার দিতেই পারে। আমাদের দেশেও যদি কেউ দাওয়াত দেয়, আমরা মিষ্টি নিয়ে হাজির হই, কিন্তু তার মানে এই নয়, মেজবানের সমস্ত বক্তব্যের প্রতি আমরা সমর্থন প্রকাশ করি। সেই অনুষ্ঠানে যখন কোনো ভিডিও আর ছবি প্রদর্শন না করেই উপস্থিত সাংবাদিক, এমনকি খোদ রাষ্ট্রদূতও মুসাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন এভারেস্ট জয়ের জন্যে, মাঝপথে অজ্ঞান অবস্থায় মুসার প্রাণরক্ষাকারী দুই যুবক কোন দুঃখে কোনো মত দিতে যাবে? তাদের উপস্থিতিকেই মুসার দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার এ চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাক্ষাৎকারটি যারা শুনলেন, তারা বুঝতে পারবেন, আনিসুল হক টাকাপয়সার প্রশ্ন উঠতেই খুব দ্রুত একটি কারণ দেখিয়ে সাক্ষাৎকারটিকে মাঝপথে রেখে প্রস্থান করেছেন। তিনি পত্রিকায় স্বহস্তে লিখে দাবি করেছেন, মুসার এভারেস্ট অভিযানের জন্যে প্রয়োজন ছিলো প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা [২]। পর্বতারোহী এম এ মুহিত এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এভারেস্ট অভিযানে তাঁর ব্যয় হয়েছে ছত্রিশ হাজার ডলার, তিনি যদি সামিট জয় করতে পারতেন, তাহলে সামিট বোনাস দিতে হতো আরো দু'হাজার ডলার, সর্বমোট আটত্রিশ হাজার ডলার ব্যয় হতে পারতো [৫]। মুহিতের দেয়া তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় কমার্শিয়াল অফারগুলোতেও [৭]। মুহিতের বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর অভিযানের ব্যয় ২৬ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ। এর প্রায় দ্বিগুণ অর্থের কথা আনিসুল হক কেন লিখলেন কাগজে? তিনি নিজেই এই সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, এই খরচ অডিটেড নয়। যে খরচের কোনো হিসাব নেয়া হয়নি, সে খরচ কেন কাগজে লিখে গ্রহণযোগ্য বানিয়ে দেয়া হচ্ছে? মুসা বলছেন, তার ব্যয় হয়েছে ৪৬ লক্ষ টাকা [৩]। আনিসুল হক টাকার পরিমাণের এই পার্থক্য প্রসঙ্গে বলছেন, এমনটি হতেই পারে, এমনও ব্যবস্থা আছে, যেটিতে পর্বতারোহীকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হয়, সবচে ভালো থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অথচ তিনিই লিখেছেন [১], ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী ক্যাম্পে থাকলেন তাঁরা। ওখানে থাকতে হয় তাঁবুতে। সঙ্গের শেরপারা তাঁবু গাড়েন। রান্নাবান্না করার জন্যও লোক আছে ওই দলেই। খাওয়ার মধ্যে ভাত-ডাল-ডিম। হিমবাহর ওপর দিয়ে যাওয়া। শেষের দিকে পাথর। খাওয়ার অবস্থা খুব খারাপ। বরফ গলিয়ে পানি খাওয়া। চা, চিঁড়া, চকলেট। এর বাইরে কোনো খাওয়া নেই। মুসা কি তবে শেরপাদের ঘাড়ে চড়ে এভারেস্টে উঠেছিলেন? তিনি কি শেরপাদের ঘাড়ে চড়ে এভারেস্টে যাওয়ার জন্যে প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা বেশি খরচ করেছিলেন? এই কথা পরিষ্কার যে লোকে ভালো খাওয়ার জন্যে পর্বতারোহণ অভিযানে যায় না। খরচ বাঁচানো যায় যদি হাই অলটিচ্যুডে পর্বতারোহীরা কিচেন শেয়ার করেন। মুসাও কিচেন শেয়ার করেছিলেন আরো এগারোজনের সাথে। একই রুট ধরে গেলেন তিনি আর মুহিত, দু'জনের সাথেই দু'জন করে হাই অলটিচ্যুড শেরপা [সোম বাহাদুর তামাং [১৩] হাই অলটিচ্যুড শেরপা নন, তিনি বেইস ক্যাম্পেই বসে ছিলেন, এই অভিযানে তার ভূমিকা কী, তা একমাত্র মুসা ইব্রাহীমই বলতে পারবেন], একজনের খরচ হলো ৪৬ লক্ষ, আরেকজনের ২৬ লক্ষ। কীভাবে সম্ভব? মুসার ভাষ্যমতেই তার অভিযানের তিন চতুর্থাংশ টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন বোনের কাছ থেকে। এ তথ্য সত্য হলে, তার অবশ্যই গরজ থাকতো যতটুকু কম খরচে সম্ভব অভিযান পরিচালনার। মুহিত যদি ২৬ লক্ষ টাকা খরচ করে যেতে পারেন, মুসা কেন পারলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরটি সম্ভবত এমন, প্রকৃতপক্ষে ৪৬ লক্ষ টাকা মুসার এভারেস্ট অভিযানে খরচ হয়নি। কিন্তু আনিসুল হকের আর্টিকেল ও মুসার দাবির পর এই পরিমাণ অর্থই এখন সাধারণ মানুষ ও সম্ভাব্য স্পনসরদের চোখে স্ট্যাণ্ডার্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এভারেস্টবাণিজ্যের [১২] আভাসও মিলবে এই শুভঙ্করের ফাঁকি থেকেই। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, মুসা ইব্রাহীম একজন নারীকে এভারেস্ট অভিযানে পাঠানোর তোড়জোড় নিচ্ছেন, চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে মুসা দর্শকদের সামনে এই ঘোষণাও দিয়েছেন। সে উপলক্ষে স্পনসরদের কাছেও নিশ্চয়ই এই পরিমাণ অর্থই চাওয়া হবে। এই পরিমাণ টাকা যে খরচ হয় না, সেটা এম এ মুহিতের অভিযান থেকেই স্পষ্ট। বাকিটা কোথায় যাবে, কীভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা হবে, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। ৪৬ লক্ষ টাকা প্রায় ৬৫ হাজার ইউএস ডলারের সমপরিমাণ। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি মনে জাগে, এত টাকা মুসা কী করে বাংলাদেশ থেকে নেপালে স্থানান্তর করলেন? দেশ থেকে আইনানুগ পদ্ধতিতে দেশের বাইরে ডলার নেয়া যায় কেবল ছাত্র অ্যাকাউন্টে, রোগীর চিকিৎসার জন্যে, আর এল/সির বিপরীতে। মুসার পর্বতারোহণ অভিযান তিনটির কোনটির জন্যেই খাটে না। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের মানি লণ্ডারিং মনিটরিং সেলের কর্তাব্যক্তিদের উচিত এই ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখা। কারণ এর আগেও বিপুল অঙ্কের অর্থের কথা মুসা নানা অভিযানের জন্যে উল্লেখ করেছেন, এবং ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ থেকে আরো অনেকেই পর্বতারোহণে যাবেন। মুদ্রা স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি আইনী চ্যানেলে হওয়া বাঞ্ছনীয়, এবং অনিয়মের যথেষ্ঠ সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে বলেই মনিটিরিং জরুরি। আনিসুল হক টাকাপয়সার প্রসঙ্গ উঠতেই দ্রুত সাক্ষাৎকার ছেড়ে চলে গেলেন, নইলে আরো কিছু প্রশ্ন তাকে করার ছিলো। কিন্তু প্রশ্নকারীকে আনিসুল হক "আপনি একটি পক্ষ" বলে তিরস্কার করেন। যতদূর বুঝতে পারি, তিনি প্রশ্ন বা প্রমাণ জাতীয় বিষয় ভালোবাসেন না। তার নমুনা মেলে তাঁর লেখা একটি ছদ্মরম্য লেখায় [৪]: রবি ঢাকায় যে আমাদের এভারেস্ট জয়ের খবর এসএমএস করে পাঠিয়েছিল, তা কেউ বিশ্বাস করল না। কিন্তু একজন করলেন। তাঁর নাম মিতু। তিনি রবির স্ত্রী। রবি আমাদের জানালেন, ‘মিতু বিশ্বাস করছে আমরা এভারেস্ট জয় করছি। মিতু বিশ্বাস করছে।’ আমার চোখে জল। এই রকম স্ত্রীই তো দরকার, যে স্বামী যা বলবে তা-ই প্রশ্নহীন বিশ্বাস করবে। কেন আমাদের ঘরে ঘরে এই রকম স্ত্রী থাকে না? আশীফ এন্তাজ রবির এসএমএসের মতো সাংবাদিকরা একটি খবর প্রকাশ করবেন, আর পাঠকগোষ্ঠী রবির সরলস্বভাবা স্ত্রী মিতুর মতো বিনা প্রশ্নে সেই খবর গ্রহণ করে নেবে? দিন শেষে যা বুঝতে পারি, আনিসুল হক ও তাঁর সমমনা সাংবাদিকেরা একটি প্রশ্নবিমুখ পাঠকজগত কামনা করেন, যেখানে মাদ্রাসার তালেবেলেমদের মতো বিনা প্রশ্নে তাদের লেখাগুলো ফুট-মিটার বিবেচনা না করে গলাধকরণ করা হবে। প্রসঙ্গ বোঝার জন্যে নিচের দু'টি পোস্ট পাঠকের কাজে আসতে পারে। নেভারেস্ট: পর্ব ১ নেভারেস্ট: পর্ব ২ তথ্যসূত্র: [১] "মুসা যেভাবে উঠলেন এভারেস্টের চূড়ায়", ২৭-০৫-২০১০ [২] পাহাড়সমান প্রতিজ্ঞা হার মানল এভারেস্ট, ২৪-০৫-২০১০ [৩] মুসার সাক্ষাৎকার, দেশ টিভি, ৩:০৪ [৪] "আমরা এভারেস্টেরও উঁচুতে উঠেছিলাম...", ০৬-০৯-২০১০ [৫] প্রায়নেভারেস্ট পোস্ট: এম এ মুহিতের সাক্ষাৎকার [৬] Hands of Australian saved Musa's life [৭] তিব্বত অভিমুখ থেকে এভারেস্ট অভিযানের খরচ নিয়ে একটি কমার্শিয়াল অফারের তথ্য [৮] প্রায়নেভারেস্ট পোস্ট: উইকিপিডিয়ায় মুসা এবং একজন দেওয়ান কামরুল হাসান [৯] মাই নেইম ইজ খান - সুমন রহমানের চলচ্চিত্র রিভিউ (!!) [১০] টনি ব্লেয়ার, ডিম-জুতা এবং প্রথম আলো [১১] মওদুদির নিষিদ্ধ গ্রন্থ নিয়ে হাসান ফেরদৌসের কষ্টকথন [১২] প্রায়নেভারেস্ট পোস্ট: মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্টবাণিজ্য [১৩] প্রায়নেভারেস্ট পোস্ট: সোম বাহাদুর তামাং
false
rg
তামাক শিল্পকে বাঁচাতে সুস্পষ্ট ঘোষণা চাই।। এক সময় পাট ছিল বাংলাদেশের সোনালী আঁশ আর তামাক ছিল সোনালী ফসল। সেসব কথা এখন রূপকথা। বিগত ৪২ বছরে শুধুমাত্র তামাক ও বিড়ি শিল্পে শ্রমিক বেকার হয়েছে ২৭ লাখ। তামাক ও বিড়ি শিল্পের ২৭ লাখ বেকার শ্রমিক নিয়ে আমাদের দেশে কোনো সভা-সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, সিম্পুজিয়াম বা আলোচনা হয় না। বরং তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উপর বছর বছর উচ্চহারে কর বসিয়ে এই শিল্পের প্রতি মানুষকে বিমুখ করতে এনজিও সর্বস্ব একশ্রেণীর দেশী ও বিদেশী দালাল কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এই শিল্পকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আমার বক্তব্য খুব পরিষ্কার। আপনি আমি কোন বাপের ছাওয়াল? আমার মা বাবা দু'জনেই বিড়ি-সিগারেট খেতেন। আমার দাদুভাই দাদীমা সবাই হুক্কা খেতেন। বিজ্ঞানের কল্যানে আমরা ফিলটার সিগারেট ফুঁকছি। আপনি কোন বাপের ছাওয়াল, শুনি? আপনার বাপ-দাদা কি বিড়ি-সিগারেট-হুক্কা খেতেন না? আপনার মা-দাদী-নানীরা কি বিড়ি ফুঁকতো না? এখনো কি আপনার আশেপাশে ফিলটার সিগারেট খায় না? যারা তামাক খাবার লোক তারা সব জনমে খাবে। মেডিকেল সায়েন্স বলে যে এটা জেনেটিক। আমি সিগারেট খাই। আমার বউও খায়। তবে দুজ'নের ব্র্যান্ড একটু আলাদা। এ নিয়ে আমার কোনো বাহাদুরী নেই। কোনো আপত্তিও নেই। যে খাবার সে খাবে। সামনে না খেলে পেছনে পালিয়ে খাবে। আমরা এক মায়ের পেটে বারো ভাইবোন। আট ভাই চার বোন। তার মধ্যে বড় দুই ভাই ও একেবারে ছোট ভাই তাদের ছোটবেলায় মারা গেছে। আমরা নয় ভাই বোন এখনো জীবিত। আমাদের এই নয় জনের মধ্যে আমি, আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই চেইন স্মোকার। আমার একেবারে ছোট বোন স্যোসালি স্মোক করে। কারণ, ওর হাসব্যান্ডও চেইন স্মোকার। আমাদের পরিবারে এই তামাকসেবীদের বিষয়টা ওপেন সিকরেট। শুধু বড়দের সম্মান করে তাদের সামনে খাই না। আমরা ছোটরা সবাই একসাথে খাই। আমার কাজিনরা যারা আমার চেয়ে অনেক ছোট কিন্তু সিগারেট খায়, তারা আমার সাথেও সিগারেট খায়। পালিয়ে প্রথম খেতো। আমিই তাদের ভয় ভাঙতে সহযোগিতা করেছি। যারা ক্যান্সারে মারা যাবে তারা সিগারেট না খেলেও মারা যাবে। যাদের ক্যান্সার হবে তারা সিগারেট না খেলেও ক্যান্সার হবে। আমার নানা ৯৫ বছর বেঁচে ছিলেন। চেইন স্মোকার ছিলেন। সিগারেট টানতে টানতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। যাকে বলে স্বর্গীয় মৃত্যু। আমার নানীও সিগারেট খেতেন। তিনি টিবিতে মারা যান। সিগারেট না খেলেও মারা যেতেন। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান বা সংক্ষেপে ডব্লিউএইচও সারা বিশ্বে তামাক ও তামাকজাত পন্যের ব্যবহার বন্ধে সবচেয়ে বড় দানব। আমি নিজে ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশানের টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তামাক বিরোধী জনসচেতনতায় কাজ করেছি। কাজের ফাঁকে সিকরেটলি সিগারেট খেতাম। আমাদের প্রায় সকল ভলান্টিয়ার ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সবাই স্মোকার। তামাক বিরোধী কার্যক্রমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করলেও আমরা স্মোকার। অন্যকে সচেতন করতে তো দোষ নেই। জনগণ সচেতন হলে ভালো। তামাক সেবন করলেও ভালো। কারণ, ক্যান্সার যার হবে তার সঙ্গে তামাকের সরাসরি কোনো কারবারি নেই। পরোক্ষ কারবারি থাকতে পারে। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার রোধে গণ সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমার বানানো পাঁচ মিনিটের ভিডিও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশানের চোখে সেরা ক্যাম্পেইন ছিল তখন। কিন্তু আমি নিজে সিগারেট ছাড়তে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুষ্ঠানে আমার তিন বন্ধু'র সিগারেটকে না বলার প্রতিশুতি ছিল। কথা ছিল অনুষ্ঠানে তারা সিগারেটকে না বলার অঙ্গিকার করবেন। প্রথমজন প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার। অনুষ্ঠানের মাঝখানেই উধাও। কোনো কমিটমেন্ট করলেন না জাকির তালুকদার। দ্বিতীয় জন রম্যলেখক আহসান কবির। তিনি ওই অনুষ্ঠানের পর থেকে আর সিগারেট খাননি। তৃতীয়জন বিখ্যাত সাংবাদিক নজরুল কবীর। অনুষ্ঠানের আগে গোটা এক প‌্যাকেট সিগারেট শেষ করেছেন। সবাইকে অবাক করে অনুষ্ঠানে সিগারেট ছাড়ার প্রতিশুতি করেছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত নজরুলের বড় ভাই ইকবাল কবীর নজরুলকে খুশিতে কুঁড়ি হাজার টাকা নগদ বকশিশ দিয়েছেন। পরদিন বিকালে নজরুলের বাসায় নজরুলকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন আমার দুই বন্ধু বিখ্যাত লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও কবি আলফ্রেড খোকন। বন্ধুদের সেই স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানেই নজরুল আবার সিগারেট খেয়েছে জোর করে কেড়ে নিয়ে। আমার বন্ধু কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান চলাকালে আমাদের ক্যাম্পেইনে উৎসাহ দিতে গিয়ে গ্রিনরুমে বসে আমার সঙ্গে সিগারেট খেয়ে ক্যাম্পেইনের শতভাগ সুফল কামনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে তৎকালীন ভিসি প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ স্যার স্বিকার করেছেন যে তাঁর বন্ধুদের তুলনায় তাঁকে নাকি বেশি বয়স্ক লাগে। আর এজন্য নাকি সিগারেট দায়ী। তবু স্যার সেদিন ছাত্রছাত্রীদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষকদের তামাক ও তামাকজাত পণ্য বর্জণের আহবান জানিয়েছিলেন। প্রতি বছর বাংলাদেশে বাজেটের আগে আগে সিগারেটের দাম বাড়ে। এটা একটা প্রহসন। সেই প্রহসনে সরকার, সরকারের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, দালাল, এনজিও, এমন কি খোদ ট্যোবাকো কোম্পানির লোকজন জড়িত। তামাক ও তামাক পণ্য নিয়ে তারা প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অবৈধ ব্যবসা করেন। সরকারি ভাবে এই অবৈধ ব্যবসা যেনো লাইসেন্স পেয়ে গেছে এমনি তাদের স্বভাব ও হাবভাবে বোঝা যায়। সরকারের নাকের ডগায় এসব ঘটে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। বাজেটে সিগারেটের উপর কর বাড়ানো হয়। সিগারেটের দাম বাড়ে। কিন্তু সিগারেটের ক্রেতা কমেছে এ খবরটি কোনো ইতিহাসে পাওয়া যায় না। মাঝখানে এই অবৈধ ব্যবসায় সরকারি ইন্ধনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে তামাক ও বিড়ি শিল্প এখন পথে বসতে বসেছে। ইতোমধ্যে ২৭ লাখ বেকার শ্রমিক তিন কোটি বেকারের দেশে অবশ্যই বাড়তি বোঝা। আসুন, তামাক ও তামাকজাত শিল্পকে বাঁচাতে এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ বেকার শ্রমিকে বাঁচাতে আমরা কোনো উদ্যোগ গ্রহন করি। তামাক শিল্পকে বাঁচাতে পারলে এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব। আমি তামাকের ক্ষতিকর বিষয়টিকে অগ্রাহ্য না করেই বলতে চাই, এই শিল্পটিকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত। বাপ-দাদাদের চৌদ্দ গুষ্ঠী যে শিল্পকে মৃত্যুর হুঙ্কার তোয়াক্কা না করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাকে লালন করাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে।তামাক ও তামাকজাত শিল্পকে বাঁচাতে আসন্ন বাজেটে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা চাই। পাশাপাশি ২৭ লাখ বেকার শ্রমিককে কর্মসংস্থানের সুযোগ দানের ব্যবস্থা রাখার আহবান জানাই। আমরা মরলে ভাতে মরব, তামাকে নয়। তামাক, তামাকু, তামুক, তাম্রকূট, তাম্রকূট্টক, তাম্রকূটধূম নমঃ নমঃ।
false
rg
নীলফামারী'র টুপামারী'র আজকের আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র যৌথ মানববন্ধন ও সমাবেশ একটি শিক্ষণীয় কর্মসূচি!! কেউ হয়তো মফস্বল সংবাদ বলে উড়িয়ে দেবেন। কেউ হয়তো বলবেন এটা একটা সাজানো নাটক। কিন্তু নীলফামারীতে আজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র নেতাকর্মীরা একসঙ্গে একটি মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধনটি পরে সমাবেশে রূপ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের আজকের এই নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধ ও সমাবেশ থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। বিগত ১২ ডিসেম্বর একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার দিন রাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা নীলফামারী জেলা সদরের লক্ষীচাপ ও পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চালায়। ১৪ ডিসেম্বর নীলফামারী'র ওই অঞ্চলের আওয়ামী লীগের সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর সেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে বিকেল ৫টা দিকে রামগঞ্জ বাজারের কাছাকাছি সাংসদ আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে জামায়াত শিবির হামলা চালায়। হামলায় আসাদুজ্জামান নূর প্রাণে রক্ষা পেলেও তাঁকে মানব ঢালের মাধ্যমে বাঁচাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের চার নেতা-কর্মী ও একজন পথচারী নিহত হন। ওই দিন রাতেই ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে নীলফামারী সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাবুল আকতার বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।আজকের মানববন্ধন ও সমাবেশ ছিল সেই হামলার বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সহ সর্বস্তরের জনসাধারণের একটি সম্মিলিত প্রতিবাদ। এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী বিএনপির নেতা-কর্মীরাও জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা প্রতিহত করার পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকারও ঘোষণা দেন। টুপামারী বাজারে আজ সোমবার সকালে এ মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে টুপামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। মানববন্ধন শেষে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম শাহ'র সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা দেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদুল ইসলাম, ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সামসুদ্দোহা শাহ, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মছিরত আলী শাহ ফকির, সদর উপজেলা জিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার আলী ভুট্টু, ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মশিউর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক হেলাল উদ্দীন, সদর উপজেলা যুবলীগের অর্থ সম্পাদক আবুল কাশেম শাহ, আওয়ামী লীগের নেতা ছমির উদ্দিন সরকার ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন চৌধুরী।সাংসদ আসাদুজ্জামান নূরের ওপর হামলার জন্য জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের দায়ী করে সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা ওই হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি করেন। জাতীয় পর্যায়ে আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কি এভাবে কখনো ভাবতে পারি? একই অনুষ্ঠানে দেশের দুইটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মানববন্ধন ও সমাবেশ করবে? যেখানে জামায়াত শিবিরের সহিসংতা ও নাশকতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র জাতীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা? নীলফামারী'র টুপামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ওই কর্মসূচি আয়োজন করলেও সেখানে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা যেভাবে সপ্রণোদিত হয়ে যোগদান করেছেন, তা থেকে কি আমাদের বড় দুইটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কোনো শিক্ষাগ্রহন করতে পারে?নীলফামারী'র টুপামারী'র এই চিত্রটি যদি ঢাকায় বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে জামায়াত শিবির পালানোর পথ পাবে না। টুপামারী আজ আমাদের যে শিক্ষা দিলেন, আমাদের বড় দুইটি রাজনৈতিক দল সেখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন। শিখতে না পারলেও অন্তত তাদের অনুসরণ করতে পারেন। তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবির একদিন নিশ্চিন্থ হয়ে যাবে। যদি আপনারা সত্যি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে থাকেন, তাহলে টুপামারীকে অনুসরণ করে দুই দল একত্রে ঢাকা'র জাতীয় প‌্যারেড গ্রাউন্ডে একটি সম্মিলিত কর্মসূচি দিয়ে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ পথে ফিরিয়ে আনতে পারেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বলবো, আপনি টুপামারী স্থানীয় বিএনপি থেকে রাজনৈতিক পরামর্শ গ্রহন করুন। আর আওয়ামী লীগকে বলবো, আপনারাও টুপামারী স্থানীয় আওয়ামী লীগের অর্জনকে জাতীয় পর্যায়ে ছিড়েয় দিন। তাহলে বাংলাদেশ একটি শান্তির জনপদে ফিরে আসবে। দয়া করে আপনারা টুপামারী'র মত একটি সম্মিলিত সমাবেশ করে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ দিন। আমীন।
false
rn
নারীর জন্য বিশ্বের সেরা এবং__নিকৃষ্ট স্থান ১. নারীর জন্য সেরা দেশ আইসল্যান্ড: রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যসূচকের বিবেচনায় আইসল্যান্ড নারী-পুরুষ সাম্যে বিশ্বের সেরা জায়গা। সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান ইয়েমেন। আর সবচেয়ে বিপজ্জনক আফগানিস্তান। ২. নারী রাজনীতিকের জন্য সেরা রুয়ান্ডা: মধ্য আফ্রিকার রুয়ান্ডা বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে পার্লামেন্টে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৮০ আসনের পার্লামেন্টের ৪৫টিই নারীর দখলে। নারীদের রাজনীতি করার জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইয়েমেন, কাতার, ওমান ও মধ্য আমেরিকার বেলিজ। এসব দেশের পার্লামেন্টে কোনো নারী সদস্য নেই।৩. মায়ের জন্য সেরা স্থান নরওয়ে: মায়েদের জন্য বিশ্বের সেরা স্থান নরওয়ে। মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি এ দেশে সর্বনিম্ন। এ ঝুঁকি সাত হাজার ৬০০ জনে মাত্র একজন। শিশু জন্মের সময়ে প্রায় সবাই দক্ষ ধাত্রীর সেবা পান। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আফগানিস্তানে। যুদ্ধপীড়িত হলেও এ দেশে একজন নারীর শিশুজন্মের সময় মৃত্যুর যে ঝুঁকি, তা বোমা বা বুলেটের আঘাতের চেয়ে কমপক্ষে ২০০ গুণ বেশি।৪. লেখাপড়ার জন্য সেরা স্থান লেসেথো: দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ লেসেথোতে নারীদের সাক্ষরতার হার পুরুষদের চেয়ে বেশি। সে দেশের ৯৫ শতাংশ নারীই লিখতে ও পড়তে পারেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আফ্রিকার ইথিওপিয়ার। দেশটির মাত্র ১৮ শতাংশ নারী লিখতে ও পড়তে পারেন। পুরুষদের সাক্ষরতা ৪২ শতাংশ।৫. নারী সরকারপ্রধানের জন্য সেরা শ্রীলঙ্কা: শ্রীলঙ্কায় নারীরা দেশ শাসন করেছেন ২৩ বছর। অথচ স্পেন ও সুইডেনের মতো দেশেও নারীরা কখনো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেননি।৬. শিল্পকলায় নারীদের জন্য সেরা সুইডেন: সুইডেনের আর্ট কাউন্সিল শিল্পকলায় নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। সুইডেনের ফিল্ম ইনস্টিটিউট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চলচ্চিত্রের জন্য আর্থিক সহায়তা নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে দেওয়া হবে। এর বাইরে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোটা রয়েছে।৭. দীর্ঘায়ুর জন্য সেরা স্থান জাপান: জাপানের নারীরা সবচেয়ে দীর্ঘ জীবন (গড়ে ৮৭ বছর) আশা করতে পারেন। পুরুষদের চেয়েও তা গড়ে সাত বছর বেশি। নারীদের আয়ু সবচেয়ে কম লেসেথোতে (গড়ে ৪৮ বছর)। তবে দেশটিতে পুরুষদের গড় আয়ুও খুব বেশি নয়, নারীর চেয়ে মাত্র দুই বছর বেশি।৮. সন্তান প্রসবের জন্য সেরা গ্রিস: সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ গ্রিস। সেখানে প্রসবের সময় মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি ৩১ হাজার ৮০০ জনে মাত্র একজন। প্রসবে মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি নতুন দেশ দক্ষিণ সুদানে। সেখানে ধাত্রীর সংখ্যা ২০ জনেরও কম।৯. স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির ক্ষেত্রে এগিয়ে গুয়াম: মাইক্রোনেশীয় দ্বীপরাষ্ট্র গুয়ামে বিবাহবিচ্ছেদের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। আর গুয়েতেমালাতে সবচেয়ে কম।১০. ক্রীড়াবিদদের জন্য সেরা যুক্তরাষ্ট্র: ২০১১ সালে বিশ্বের সর্বাধিক আয় করা ১০ জন নারী ক্রীড়াবিদের মধ্যে পাঁচজনই যুক্তরাষ্ট্রের। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে সৌদি আরব। দেশটি কখনোই কোনো নারী খেলোয়াড়কে অলিম্পিকে পাঠায়নি। এ ছাড়া সরকারি স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।১১. অবসরের জন্য নারীদের সেরা স্থান ডেনমার্ক: ডেনমার্কের নারীরা অবসরের জন্য সবচেয়ে বেশি সময় পান। যে শ্রমের আর্থিক মূল্য নেই, এমন কাজে পুরুষদের চেয়ে প্রতিদিন মাত্র ৫৭ মিনিট বেশি সময় ব্যয় করেন ডেনমার্কের নারীরা। অন্যদিকে মেক্সিকো ঠিক এর উল্টো। ওই দেশের নারীদের অর্থমূল্য হয় না, এমন কাজে প্রতিদিন গড়ে পুরুষদের চেয়ে চার ঘণ্টা ২১ মিনিট বেশি সময় ব্যয় করতে হয়।১২. টাকা উপার্জনের জন্য সেরা স্থান লুক্সেমবার্গ: টাকা উপার্জনের জন্য লুক্সেমবার্গ (নরওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে) নারীদের জন্য আদর্শ স্থান। ওই দেশে নারী ও পুরুষের আয়ের হার প্রায় সমান। নারীদের পারিশ্রমিকের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সৌদি আরবে।১৩. নারীদের উচ্চশিক্ষায় সবার আগে কাতার: কাতারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন পুরুষের বিপরীতে ছয়জন নারী ভর্তি হন। তবে নারী শিক্ষায় এ বিনিয়োগ তাদের দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কতটা যুক্ত করছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
false
ij
গল্প _ তেপান্তরের মাঠের খোঁজে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচির মিছিলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে এই লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। ৮০ শতাংশ রপ্তানির সুযোগ রেখে দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) না করার দাবিতে এই ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কমিটি।লাঠিপেটায় প্রায় ৭০ জন আহত হয়েছে বলে কমিটি দাবি করেছে। এর মধ্যে কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল হকসহ ৩০-৩৫ জনের জখম গুরুতর। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরের বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন বলে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ...এরই প্রতিবাদে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন। মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম দীপুও উপস্থিত। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ওপর আঘাত তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। অধ্যাপক আরিফ আজ কালো প্যান্টের ওপর সাদা ফতুয়া পরেছেন । সকাল থেকেই গনগনে তাত ঝরছে ঢাকা শহরে, আড়ংয়ের ফতুয়াটি ঘামে ভিজে গেছে। মাঝারি উচ্চতার অধ্যাপকটির গায়ের রং শ্যামল, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা-সব মিলিয়ে মেধার দীপ্তি ছড়াচ্ছে। অধ্যাপক আরিফের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় মধ্যবয়েসী কর্মী। নাজমূন নাহার । তিনি মহিলা লালমাটিয়া গালর্স কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার অধ্যাপক আরিফের দিকে তাকিয়ে তিক্ত কন্ঠে বললেন, ধিক! এরা কী ভাবে দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয় অধ্যাপক আরিফ! এর পিছনে রয়েছে পেট্রোবাংলার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আপনি নিশ্চয়ই তার নাম জানেন। হ্যাঁ, আমি ড. সালমান রশীদ-এর কথা বলছি । অধ্যাপক আরিফ হাসলেন। বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন আপা। ড. রশীদের যে বাংলাদেশের প্রতি টান নেই তার কারণ আছে। অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার অধ্যাপক আরিফ-এর ঘেমে যাওয়া শ্যামল মুখের দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকালেন । অধ্যাপক আরিফ পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, আমাদের ছোটবেলায় নানা আমাদের গল্প শোনাতেন। সালমান কখনও শোনেনি। ভিনদেশি কমিকস পড়েছে। কি! কি বললেন! অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার গভীর বিস্ময় বোধ করেন। অধ্যাপক আরিফ হেসে বললেন, ড. সালমান রশীদ আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়। বলতে পারেন আমরা একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। আমি আজও তেপান্তরের মাঠ খুঁজছি ... সালমান এই কথার মানে কখনোই বোঝেনি। অধ্যাপক আরিফের কথায় অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার কেমন হতভম্ব হয়ে যান। আরিফুর রহমান দীপুও প্রেস ক্লাবের সামনে প্রখর রোধের ভিতরে দাঁড়িয়ে অনেক বছর পিছিয়ে যেতে থাকেন ... ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের এক দুপুরে ফুলতলি গ্রামে একা একা ঘুরছিল দীপু। ভাদ্র মাসের ঝকঝকে দিন । মেঘশূন্য নীলাভ আকাশে চিলপাখিদের ওড়াওড়ি। শীর্ণ সোহাগী নদীর পাড়ের মাঠে চিলপাখিদের চলন্ত ছায়া। এই সব নিঝঝুম ভাদ্রের দিনে ফুলতলীর পথ-ঘাট, গাছপালা সব কেমন টানটান হয়ে আছে। তালপুকুরের ওপাশটায় ঘন আমবন। আমবনে রোদের হাট বসেছে। আমবনের বাঁ পাশে তালপুকুর। তালপুকুরে ঝাঁপাচ্ছে ন্যাংটো ছেলের দল ...এইসব দেখতে দেখতে দীপুর ঘোর লাগে। এই দেশ কী নির্জন! শ্যামল! সুন্দর! এই দেশটি নিজের মতো করে থাকবে বলেই আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। তবে দীপুর বিশ্বাস যতদিন তারা বেঁচে ছিল-বড় সুখেই বেঁচে ছিল। বড় খালা আজ ধনে পাতা দিয়ে কই মাছ রেঁধেছিল। অপূর্ব সে স্বাদ, আর অপূর্ব এই শেষ বেলার রোদের স্পর্শ। হ্যাঁ, বাংলার সুখশান্তি জগতের অন্যকোনও দেশের মত নয়। দূরে রেললাইন। সেদিকে যেতে থাকে দীপু। আসলে তেপান্তরের মাঠ খুঁজছে দীপু । বাংলাদেশের কোথাও আছে তেপান্তরের মাঠ, গল্পগাথায় সে কথা লেখা রয়েছে। কিন্তু কোথায়? ওর মনের গহন ইচ্ছে একবার তেপান্তরের মাঠটি খুঁজে বার করে, তারপর সেই মাঠে ঠিক মাঝখানে গিয়ে একবার দাঁড়াবে। ... বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হল। নানাবাড়ির সামনে আমলকি গাছের তলায় সেজ খালার সাদা রঙের মাজদা গাড়ি থেমে; গাড়ির পাশে সালমান দাঁড়িয়ে। সেজ খালার ছেলে সালমান ওরই সমবয়েসি, স্কুল ফাইনাল দিয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে সালমান । দীপু থাকে মালিবাগে - সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল থেকে এবার এস এস সি দিল। কাজেই সালমান খানিক গম্ভীর হয়েই থাকে। হয়তো গাম্বীর্য বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। সালমানের বাবা আদনান কোরেশী বিরাট ব্যবসায়ী। দীপু দেখল নানা উঠানে দাঁড়িয়ে। সালমান কে জড়িয়ে ধরলেন। কি রে তুই একা এলি? তোর মা-রা এল না? কাল আসবে। আব্বা কালকে ফিলিপাইন ফিরবে থেকে। বলে ভিতরে চলে যায় সালমান । ড্রাইভার বক্সি ব্যাগ নিয়ে পিছন পিছন যায়। একটু আগে মাগরিবের আজান দিল। নানা মসজিদে চলে যান। নানাকে বিমর্ষ দেখাল। গত বছর এই দিনে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। দীপু জানে নানা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভক্ত। যে কারণে বিমর্ষতা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। দীপু পুকুর পাড়ে যায়। মায়ের দুদিন ধরে জ্বর। নানীর ঘরে ঢুকে খোঁজ খবর নেয়। টুনি মায়ের মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে। হারিকেনের আলোয় টুনির মুখখানা শুকনো দেখাল। বড় খালা মায়ের পায়ে সর্ষের তেল মাখছেন। মা বলে, বুবু ও বুবু। আমি মরে গেলে আমার দীপুটুনিরে দেইখ। তুই চুপ কর তো শেফালি। বড় খালা ধমক দেন। দীপু ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। উঠান ভরা জোছনা। নানা নামাজ সেরে এসে রোজকার মতো উঠানে বসবেন। নাতী নাতনীরা সব বড় একটা মাদুরে বসবে। সব মিলিয়ে দশ বারো জন। ছোট খালা একটা টুকরিতে তালের পিঠা কি মুড়ি ভাজা নিয়ে আসবে । ছোটখালার চলাফেরা কেমন সাবলীল। কে বলবে দু’দিন পর বিয়ে। মাদুরে বসে নানা গল্প বলেন। মজার কথা হল, নানা গল্প বলেন সাধু ভাষায়। নানা বলতে থাকেন-এক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন,-”আচ্ছা, যাক্।”তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজিল,রাজা চর-অনুচর দিলেন,রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন। রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নূতন পোশাক পরিয়া, নূতন তলোয়ার ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন। যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন ...সালমান এল না। ও ঘরে কমিকস পড়ছে। দীপু আর গল্প শুনতে বসল না। গল্পটা ও অনেকবারই শুনেছে। দীপু পুকুর ঘাটের দিকে যায়। মায়ের জ্বর হলে ওর মন খারাপ থাকে। পুকুরপাড়ে কলাঝোপ। তালের গুঁড়ি কেটে ঘাট বসিয়েছে। বসে। কচুরিপানার গন্ধ পায়। ওপাশের ঘরে আলো জ্বলছে। সালমান কমিকস পড়ছে। ও রূপকথার গল্প শোনে না, তেপান্তরের মাঠ খোঁজে না। সালমান অ-বাংলাদেশি গল্পে সুখ খুঁজে পায়। ছোট খালা এসে ধপ করে বসল। দীপু, বর আমার পছন্দ না। আমার বিয়ে হবে না। বল কি? দীপু আঁতকে ওঠে। হ। তা হলে ? তা হইলে আর কি। বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছোট খালু তৈহিদুর রহমান সুজন; উত্তর পাড়ার স্কুল মাস্টার। আদর্শবাদী পড়ালেখা জানা সজ্জন এক মানুষ। দীপুর মনের বদ্ধ জানালা খুলে দিয়েছিলেন। দীপু কে বলেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্রের কারণ খুঁজে বার করতে। দীপু বলেছিল, খালু, আমি তেপান্তরের মাঠ খুঁজি। ছোট খালু বললেন,ভালো কথা। তবে এ দেশের দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের কথাও ভেব। সালমানটা যেন কেমন? ছোট খালা বলে। কেমন? তালের পিঠা দিলাম খাইল না। ওহ্। বড় দেমাগ। বড়লোকের ছেলে তো। কী আর করা। দীপু কাঁধ ঝাকাল। হঠাৎই আঁচল থেকে কী বার করে ছোট খালা দীপুর শার্টের পকেটে গুঁজে দিল। কী! দীপু অবাক। যা, তুই অখনই সাইকেল নিয়া উত্তর পাড়ায় যা। কাজীবাড়ির মৌলভী মজিবর রহমান এর বেটা সুজনরে এই চিঠি দে গা,যা। আমার কেন মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে হবে না সেই কথা চিঠিতে সবিস্তারে লেখা আছে। দীপু মুচকি হাসে। ছোট খালার বিয়ে ধুমধাম করেই হয়েছিল। ছোট খালাদের মত সুখি দম্পতি কমই দেখেছে দীপু। ... বিয়ের চার বছর পর নানাজান মারা যান। দীপু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে। সন্ধ্যার আগে ফুলতলি পৌঁছে নানার কবরের সামনে হুহু করে কাঁদল। সালমান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গেছে । যোগাযোগ তেমন নেই। সালমানের মা সেজ খালার ক্যান্সার হয়েছিল। পরীক্ষার অজুহাতে সালমান মাকে দেখতে আসেনি । মেজ মেয়ের অসুখই নানার মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ বলে মনে করে দীপু। সেজ খালা কে নানা অসম্ভব ভালোবাসতেন। সেজ খালার মৃত্যুর পর সেজ খালু আবার বিয়ে করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাস-লাইব্রেরি ছাড়াও মধুর ক্যান্টিনেও সময় কাটে। একদিন ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুল এসে বলল, দীপু, কমরেড রতন সেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। ঝিকাতলায় মনেশ্বর রোডের এক মেসে আছেন। আজ আর ক্লাস ছিল না। সাইফুলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে দীপু উঠে পড়ে। লাইব্রেরির সামনে এসে দেখল শবনম দাঁড়িয়ে আছে। ও আজ শাড়ি পড়েছে-ঘিয়ে রঙের দামী সিল্ক। হঠাৎই মনে পড়ল দীপুর- আজ ১ মার্চ, শবনমের আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন শবনম। দীপু বলল। শবনম হাসল। অর্থনীতির দুর্দান্ত ছাত্রী মীর্জা আদিলা শবনম ঢাকার এক বনেদি পরিবারের মেয়ে। মায়ের দিক থেকে পাকিস্তানি রক্ত আছে শরীরে। পাকিস্তান আমলে বাওয়ানি জট মিলস ওদেরই কোন্ আত্মীয়র ছিল। ওকে নিতে কালো মার্সিডিজ আসে। শবনম জিগ্যেস করল। কোথাও যাচ্ছ কি? হু। আমি কি যাব? চল। দীপু বলল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ভাষা ইন্সিটিউটের সামনে চলে আসে। ওখানে রিকশার জটলা। ওঠ। দীপু বলে। শবনম উঠে বসল। দীপু রিকশায় উঠে বসতেই বেলি ফুলে সুগন্ধ পায়, আর শবনমের শরীরের কোমলতা ... সেখানকার মৃদু তাপ । সিগারেট ধরায় দীপু। শবনম বলল, ভাবছি এবার আমি আর অর্নাস ফাইনাল দেব না দীপু । কেন? দীপু অবাক হয়। ধোঁওয়া ছাড়ে। আমি অর্নাস ফাইনাল দিলে তুমি তো আর ফাস্ট ক্লাস পাবে না। বলে শবনম হাসে। হাঃ হাঃ হাঃ। দীপুও হাসে। এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ে। রাস্তায় ঝকঝকে রোদ। একটা আর্মির জিপ চলে যায় নীল ক্ষেতের মোড়ের দিকে। জহুরুল হক হলের সামনে ফুটপাতে আকাশি রঙের কাবুলী পোশাক পরা এক এক তরুণ দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করছে। ’৭৫ এর পর এসব পাকিস্তানি পোশাক বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য সচেতন ভাবে প্রচলন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা। নানার কথা মনে পড়ে যায় দীপুর। নানা আহমদ হোসেন মৃধা মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে জ্যোস্নালোকিত উঠানে বসে নাতীনাতনীদের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের গল্প শোনাতেন । বাংলাদেশের বৃদ্ধরা এখন নাতীনাতনীদের কি গল্প শোনায়? । তখনই রিকশাওয়ালার পিঠে চোখ গেল। পিঠে কালশিটে পড়েছে। আর কতকাল এরা সহ্য করবে? এ দেশে কেবলি ক্ষমতার পালাবদল। গত বছর ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন । আজ ১৯৮২ সালের ১ মার্চ; দীপু জানে না ... আর মাত্র ২৩ দিন পর, অর্থাৎ, ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যূত্থানের পর নিজেকে বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ঘোষনা করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ অবধি বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল স্বৈরাচারী পাথর চাপাবেন। রিকশা থামল মনেশ্বর রোডের এক ঘিঞ্জি গলির সামনে । এখানে মানুষ থাকে। হাঁটতে হাঁটতে শবনম নাকমুখ চেপে বলে। শাড়ি পরে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। এর চেয়েও অমানবিক পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ বাস করে। দীপু বলল। ওহ্ । আমার সঙ্গে তুমি একদিন আদমজী জুটমিলের শ্রমিক বস্তিতে যাবে শবনম? প্লিজ, না। গলির ভিতরে একটা জরাজীর্ণ টিনসেডের বাড়ি। তারই একটি ঘরে কমরেড রতন সেন পরে বসে ছিলেন। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি । পেপার পড়ছিলেন বর্ষীয়ান কমরেড। ঘরে একটি চৌকি। একটাই চেয়ার। শবনম চেয়ারে বসল। দীপু বসল চৌকির এক কোনে, কমরেড রতন সেনের পাশে ।শবনমকে দেখে যেন কিঞ্চিৎ অবাক হলেন চিরকুমার রাজনীতিবিদ। পরবর্তীকালে এঁকে খুলনায় অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল স্বার্থান্বেষী মহলের ইঙ্গিতে। দরজার কাছে ১৯৮২ সালের ১ মার্চের রোদ ঝলমল করছিল। সাইফুল আপনার ঠিকানা দিল। ওহ্ । আপনার নামই কি আরিফুল ইসলাম দীপু? জ্বী। আপনিই কি এই নিবন্ধটি লিখেছেন? বলে ‘উত্তরাধিকার’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা এগিয়ে দিলেন প্রবীণ কমরেড। পত্রিকাটি দীপুর লেখা ‘তেপান্তরের মাঠের সন্ধানে’ নামক নিবন্ধটি ছেপেছিল। পত্রিকাটির সহম্পাদক কবি হুমায়ুন রেজা দীপুর কলেজ জীবনের বন্ধু। হ্যাঁ। আপনি তা হলে তেপান্তরের মাঠ খুঁজছেন? হ্যাঁ। পেলেন? কররেড মিটমিট করে হাসছেন। না এখনও পাইনি, তবে পাবো বলে আশা আছে। তবে আমি বিশ্বাস করি তেপান্তরের মাঠের নীচে রয়েছে মূল্যবান সম্পদ। প্রবীণ কমরেড হাসলেন। জিগ্যেস করলেন, বাংলাদেশ তাহলে অতীব সম্পদশালী? অবশ্যই। তবে বাংলাদেশের আসল সম্পদ হল এর ভাবসম্পদ। দীপু বলল। কমরেড মাথা নাড়লেন। বললেন, তাহলে এর সম্পদ বাঁচাতে জান দেবেন তো? অবশ্যই। আমি আপনার কাছে শপথ করলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওরা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। কমরেড অনিল মুখার্জীর লেখা বই উপহার দিলেন কমরেড রতন সেন। শবনমের মুখ গম্ভীর। বলল, এসব রাজনীতি কি ছাড়া যায় না? ধুরও কি যে বল। দীপু হাসে। বলে, আজ আমার সত্যিকারের রাজনীতির হাতেখড়ি হল। কতদিনের ইচ্ছে দিল কমরেড রতন সেনকে দেখব। শবনম শাঁশায়। বলে, কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের ক্ষমতা নিতে যাচ্ছেন। জান? কে বলল? দীপু চমকে ওঠে। আজ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আব্বা বলল । শবনমের বাবা জাস্টিস মীর্জা রেজা আদিল উচ্চ আদালতের একজন জাঁদরেল বিচারপতি। এদের না-জানিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার পালা বদল হয় না। তুমি রাজনীতি ছাড়বে কি ছাড়বে না বল? শবনমের কন্ঠস্বর সিরিয়াস শোনায়। না। আমার পক্ষে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সম্ভব না। বলে সিগারেট ধরায় দীপু। হাত কাঁপছে। তা হলে আমি অনার্স পরীক্ষা দেব বলছি। আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! দীপুর কন্ঠস্বর চড়ে যায়। শবনম চুপ করে থাকে। তুমি অনার্স পরীক্ষা দেবে না দেবে তা তোমার ইচ্ছে। বলে গনগনে মুখে ধোঁওয়া ছাড়ল দীপু। শবনমের মুখও গনগনে হয়ে উঠেছে। গলির মুখে এসে পড়েছে ওরা। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। একাই। দীপু শূন্য বোধ করলেও সামলে নেয়। বাংলাদেশ শবনমেরও চেয়ে অনেকই বড়। বাসায় ফিরতে হবে। ও বাসস্টপের দিকে হাঁটতে থাকে। ...গতকাল ছোট খালারা এসেছেন। ছোট খালুর কিডনিতে সমস্যা। তার চিকিৎসা করাতে। সমস্ত দৌড়ঝাঁপ দীপুকেই করতে হবে। ছোট খালু অনেক বদলে গেছেন। আজকাল তাবলীগ করেন; দাড়ি রেখেছেন, পাগড়ীও পরেন। ছোট খালা আগের মতোই আছেন। তবে সন্তানের মা হতে পারেননি। তবে মুখের হাসি মুছে যায়নি। ...বিকেলের আগেই মালিবাগের বাড়িতে ফিরল। মায়ের জ্বর। টুনির বিয়ে কথাবার্তা চলছে। দীপুর বাবা সাদাসিদে মানুষ, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। দীপুকেই সব দেখতে হয়। কয়েকটা টিউশনীও করে। শবনম আর অনার্স শেষ করল না। ও বিদেশ চলে গেল। দীপু অনার্স আর মাস্টাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হল। যোগ দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা মারা গেল । বিয়ে করল দীপু। স্ত্রী নীলুফার -দু-বছরের জুনিয়র কলিগ। সময় কেমন করে কেটে যায় ... এখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে সেসব কথা মনে পড়ে যায় অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম দীপুর । প্রখর রোদে জ্বলে যাচ্ছে ঢাকা শহর। কপালের ঘাম মুছে অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার জিগ্যেস করলেন, পেট্রোবাংলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. সালমান রশীদ আপনার আত্মীয়? অধ্যাপক আরিফ মাথা নাড়েন। হাসেন। সালমান পড়াশোনা করেছে আমেরিকার মিনোসোটায়। সালমান সম্ভবত ভাদ্র মাসের ঝকঝকে দিন, মেঘশূন্য নীলাভ আকাশে চিলপাখিদের ওড়াওড়ি, শীর্ণ সোহাগী নদীর পাড়ের মাঠে চিলপাখিদের চলন্ত ছায়া, এই সব নিঝ্ঝুম ভাদ্রের দিনে ফুলতলীর পথ-ঘাট, গাছপালা সব কেমন টানটান হয়ে থাকা, তালপুকুর, আমবন ...এইসব শ্যামল নির্জন সুন্দর পাড়াগাঁ আর বড় খালার ধনে পাতা দিয়ে রাঁধা কই মাছ তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। নাজমূন নাহার জিগ্যেস করলেন, অধ্যাপক আরিফ? জ্বী। বলুন। দূরে হাইকোর্টের দিকে হেলমেট পরা পুলিশের একটা ব্যাটেলিয়ন ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। সেদিকে চোখ রেখে অধ্যাপক আরিফ বললেন। আপনি তেপান্তরের মাঠ খুঁজছেন অধ্যাপক আরিফ? হ্যাঁ। পেলেন? অধ্যাপক আরিফ হাসলেন। কমরেড রতন সেনের মুখটি মনে পড়ে গেল তাঁর। পকেট থেকে রূমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, না, এখনও পাইনি। তবে জানি যে তেপান্তরের মাঠ নিচে রয়েছে অমূল্য সব সম্পদ । নাজমূন নাহার হেসে বললেন, যে সম্পদ রক্ষার জন্য একটু পর আমরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির ইঙ্গিতে পুলিশের বেধড়ক লাঠির বাড়ি খেতে যাচ্ছি-কী বলেন? হ্যাঁ, তাই তো। অধ্যাপক আরিফও হাসলেন। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:২৬
false
rn
টিপু সুলতান টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনিএকজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। তিনি তাঁর শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) নামে পরিচিত ছিলেন। টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর; উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া।বাবা হায়দার, ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে টিপু নামে এক ফকিরের দোয়ায় এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং আনন্দচিত্তে ঐ ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন "টিপু"।কেউ কেউ তাকে ধর্মরক্ষক বীর যোদ্ধা মনে করেন কেউবা অত্যাচারী স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করেন। কেউ কেউ আবার টিপু সুলতানকে গাজী বা পীর বলেও মনে করেন।দক্ষিণ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসক ছিলেন টিপু সুলতান৷ পিতা হায়দার আলী মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন৷ শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামে কাবেরী নদীর একটি ব-দ্বীপে নির্মিত একটি দূর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন৷ ছোটবেলা থেকেই টিপু, বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবাই তাঁকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিলো তাঁর অনুপ্রেরণার মতো। তাঁর রাজ্যের পতাকায় কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিলো "বাঘই ঈশ্বর"। তিনি সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝেই বলতেন:“ ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো ” ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন। টিপুর এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান৷ পরে তার পরিবারের মানুষজনকে ভেলোরের দূর্গে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা৷টিপু সুলতানের ৪জন স্ত্রী, ১৬জন পুত্র এবং কমপক্ষে ৮জন কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাদের পরিচিতি অজানাই রয়ে যায়। টিপু সুলতান শুধু একজন শাসকই ছিলেন না, একাধারে তিনি ছিলেন উদ্ভাবক, বহু ভাষাবিদ এবং কবি।টিপু সুলতান বাঘ নিয়ে একটি মিউজিক্যাল খেলনা বানিয়েছিলেন, যা তখন পৃথিবী জোড়া খ্যাতি পায়। এই খেলনাকে "টিপুর বাঘ " (Tipus Tiger) বলা হত।বেশ কিছু ইতিহাসবিদরা মনে করেন টিপু সুলতান হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।টিপু সুলতান শাহি মসজিদ কলকাতার একটি বিখ্যাত মসজিদ। ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ এই মসজিদটি নির্মাণ করান। এটি কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ। সকল ধর্মের মানুষের জন্য এই মসজিদের দ্বার উন্মুক্ত। টিপু সুলতান ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর বর্তমান ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩৩ কি.মি দূরে "দিভানাহালি " নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। টিপু সুলতান একবার তার ফরাসি বন্ধুর সাথে সুন্দরবনে শিকারে যান, একটি বাঘের সামনে পড়েন এবং তার বন্দুক কাজ করছিল না। তখন তিনি একটি ছোট্ট ছোড়া দিয়েই বাঘের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং বাঘটিকে হত্যা করেন। টিপু সুলতান পরবর্তী জীবনে তার নামের প্রমান রেখেছেন তার কাজের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বাঘের মতো সাহসী, ক্ষিপ্র এবং তেজী। এছাড়া বাঘের প্রতি তার ছিল অনেক ভালোবাসা। ছোটবেলায় বাবা হায়দার আলীর কাছে বাঘের গল্প শোনার জন্য টিপু বায়না করতেন। এমনকি কিশোর বয়সে টিপু একটি বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পরে টিপু নতুন সিংহাসন তৈরী করেন, যদিও সিংহাসনে সিংহ নয় বরং বাঘের প্রতিকৃতি ছিল।টিপু সুলতান হিন্দু এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জোর করে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তর করেন।টিপু সুলতান ২৭টি ক্যাথলিক চার্চ ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। ১৭৯৯ সালের ৪ই মে ৪৮ বছর বয়সে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের হাতে নিহত হন। টিপু সুলতান ওমান, পারস্য, অটোমান এবং ফ্রান্সে নতুন দূতাবাস খোলেন এবং কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি অটোমানের সুলতান প্রথম আব্দুল হামিদ এর কাছে ব্রিটিশদের পরাজিত করতে সামরিক সাহায্য চান, কিন্তু অটোমান সম্রাজ্য তখন অস্ট্রো-অটোমান যুদ্ধে ব্যস্ত এবং নতুন করে রাশিয়ার সঙ্গেও তখন যুদ্ধাবস্থার সম্মুখিন হয়। তাই অটোমানরা টিপু সুলতানকে কোন সাহায্য দিতে পারেনি।১৭৮৬ সালে টিপু সুলতান ৭২ কামানের ২০ টি যুদ্ধ জাহাজ এবং ৬২ কামানের ২০টি রণতরী (frigates) দিয়ে তার নৌবাহীনিকে সুসজ্জিত করেন। ১৭৮৯ সালের ভেতরই টিপু সুলতানের প্রায় সকল জাহাজেই তামার পাটাতনে উন্নীত করা হয়। ১৭৯০ সালে তিনি কামালুদ্দিনকে তার "মীর বাহার" পদে নিযুক্ত করেন এবং জামালাবাদ এবং মাজিদাবাদে সুবিশাল ডকইয়ার্ড নির্মান করেন। টিপু সুলতানের পুরো জীবনটাই যুদ্ধ; যুদ্ধের মাঝে জন্ম, বেড়ে উঠা, যুদ্ধেই মৃত্যু। বাবা হায়দার আলীরও সারা জীবন কেটেছে যুদ্ধে। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন,দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন।কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়,গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়। তাই টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্মরণীয় বীর।
false
fe
যে কারণে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কল্যাণ চায় না যে কারণে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কল্যাণ চায় না ফকির ইলিয়াস ======================================= বর্তমান সময়ে তালেবান এবং আল-কায়েদার চারণভূমি বলে পরিচিত ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রটি চায় না বাংলাদেশে স্থিতিশীল অবস্থা চালু থাকুক। এর অন্যতম একটি কারণ আছে। আর কারণটি হচ্ছে তাদের এই মানসিকতা যে, ‘আমাদের শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে তোমরা কি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে?’ এই হীন মানসিকতা সিংহভাগ পাকিস্তানিদের মাঝে। কথাটির অনুরণন আমরা এখনো শুনতে পাই। সম্প্রতি একটি আড্ডায় পাকিস্তানি-আমেরিকান একজন শিক্ষকের কথা শুনে আমার স্পষ্টই মনে হয়, ওরা এখনো বাংলাদেশের সুখ দেখতে নারাজ। এই শিক্ষকের নাম শওকত আফসার। তিনি নিউইয়র্কে একটি কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রসঙ্গ আসলে শেখ মুজিবকে দোষারোপ সিংহভাগ পাকিস্তানিরাই করে। সঙ্গে তারা যোগ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নামও। মুজিব-ভুট্টো এই দুজনে ক্ষমতা ভোগ করার জন্যই ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রটিকে ভাগ করেছিলেন- এমন একটি উষ্মা প্রকাশ করেই পাকিস্তানিরা আলোচনা শুরু করে। সত্তরের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অবস্থাটি কেমন ছিল? কেমন ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের গতি-প্রকৃতি, রাজনীতির ভবিষ্যৎ? এই প্রশ্নটির উত্তর অনেকেই জানেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উত্তরসূরি জে. ইয়াহিয়া খান সামরিক যাঁতাকলই চালু রেখেছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো ইচ্ছেই এসব জান্তাদের ছিল না। ছিল না এ জন্য, কারণ ‘ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন’- হলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভোটের কাছে পাকিস্তানিরা হেরে যাবে, তা নতুন কোনো বিষয় ছিল না। তাই সামরিক নিষ্পেষণের মাধ্যমে বাঙালিকে দমিয়ে রাখা হোক- সেটিই ছিল পাকিস্তানিদের সহজ পথ। জাতিগতভাবে পাকিস্তানিদের স্বরূপ-চরিত্র কেমন, তা একটু লক্ষ্য করলেই যে কোনো বাঙালি সহজভাবে বুঝতে পারবেন। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যের সহানুভূতি নিতে চাইলেও পবিত্রতম ধর্ম পালনে নিজেরা সব সময়ই উদাসীন। সেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি ‘জিন্নাহ টুপি’ মাথায় রেখে রাজনীতি করতেন, তার ব্যক্তিগত জীবনাচার ছিল উদভ্রান্ত কোনো পাশ্চাত্য নাগরিকের মতোই। বিভিন্ন ইতিহাসবেত্তারা বারবারই এ প্রসঙ্গে বলেছেন। সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এখনো মনেপ্রাণে বাংলাদেশের কল্যাণ চায় না। তারা যে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, স্থিতিশীলতা থামিয়ে দিতে মাঠে আছে। এর মাধ্যমে তারা একাত্তরে পরাজয়ের সামাজিক শোধ যেমনভাবে নিতে চায়, তেমনি বিনষ্ট করতে চায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্প্রীতি। এর জন্য যা যা করা দরকার, তার সবকিছুই করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সিলেট প্রেসক্লাবে ‘মিডিয়া সেন্টার’ স্থাপনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের ঢাকাস্থ দূতাবাস কম্পিউটার দিতে চেয়েছিল। সিলেট প্রেসক্লাবে গিয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা উদ্বোধন করার কথা ছিল ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাস কর্মকর্তার। কিন্তু সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সদস্যরা এর প্রতিবাদ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাংবাদিকরা সোচ্চার হয়ে ঐক্য গড়ে তোলেন। ফলে পাকিস্তানি দূতাবাস সেই কম্পিউটার স্থাপনের কাজটি করতে পারেনি। এই খবরটি বিশ্বের সব বিবেকবান বাঙালি সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। পাকি দূতাবাস প্রেসক্লাবে এমন মিশন চালাতে চাইছে কেন? তারা নেপথ্যে কী ষড়যন্ত্র আঁটছে? সিলেট প্রেসক্লাবের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রেসক্লাবের কর্মকর্তারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। যারা এখনো পাকিস্তানি তমদ্দুন লালন করেন, তারা এক পক্ষে। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাংবাদিকরা এক পক্ষে। ইতিমধ্যে নতুন কমিটিও ঘোষিত হয়েছে। এই ঘটনা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি চরেরা এখনো বাংলাদেশে তৎপর। এরা তাদের পাকি প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য একাত্তরে যেমনটি করেছিল, সুযোগ পেলে এখনো তেমনটি করবে। সুযোগ পেলেই তারা অবমাননা করবে লাখ শহীদের রক্তের। দুই. ফিরে আসি সেই পাকিস্তানি শিক্ষক শওকত আফসারের সঙ্গে আড্ডা প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, ইসলামি মূল্যবোধ ধারণ করে অখণ্ড পাকিস্তান বহাল থাকলে আজ সে রাষ্ট্র ইউরোপের মতো সমৃদ্ধ হতে পারতো! আমি বললাম, তাহলে আপনারা একাত্তরে বাঙালিদের ওপর নেতৃত্বটা ছেড়ে দিলেই পারতেন! তিনি এর মৃদু প্রতিবাদ করলেন। বললেন, পাকিস্তানিরা অন্য যে কোনো জাতির চেয়ে কর্মঠ জাতি। তারাই পারতো অখণ্ড পাকিস্তানের নেতৃত্ব দিতে। আমি বললাম তাহলে তো আর গণতন্ত্র মানার পক্ষে আপনি সায় দিচ্ছেন না। তিনি বললেন, গণতন্ত্র তো ‘গরিব লোক’দের জন্য নয়। তাই আমাদের উচিত ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের নেতৃত্ব নির্ধারণ করা। আমি কিছুটা রাগতস্বরেই বললাম এটা তো গাদ্দারি ভাষা। উপস্থিত অন্যরা যোগ দিলেন আলোচনাটা থামিয়ে দিতে। আমিও কোনো গাদ্দার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বাড়াতে রাজি হলাম না। ওদের এমন মানসিকতা নতুন নয়, এরা সব সময়ই কর্তৃত্ব নিজের হাতে রেখে ‘হাম ভি মুসলিম, তুম ভি মুসলিম’ এমন বুলি অনেক আওড়িয়েছে। এখনো আওড়াতে চায়। কিন্তু আদতে তারা বাংলাদেশের কোনো কল্যাণই চায় না মনেপ্রাণে। ভুলে গেলে চলবে না পাকিস্তান ও তার অনুসারী ধর্মের ধ্বজাধারীরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর। পাকিস্তানে বর্তমানে যে তালেবানি আগ্রাসন চলছে, তারা তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চায়। এর জন্য তারা পাকিস্তানি তো বটেই এমনকি ভারতীয় মুসলিম জঙ্গি গ্রুপকে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গেলো কিছু দিন আগে পাকিস্তানি জঙ্গি গ্রুপের কিছু তরুণ বাংলাদেশে ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকার পাকিস্তানি দূতাবাস বাংলাদেশের ডানপন্থী মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য বজায় রেখেই চলেছে। এনজিওর নামেও তারা সাহায্যের প্রজেক্ট হাতে নিয়ে বিস্তৃত রেখেছে নানা কর্মকাণ্ড। যা সরকারের ঘনিষ্ঠভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। এটা বর্তমান বাংলাদেশের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের কথা যে, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এখনো মানসে পাকিস্তানি তমদ্দুন লালন করেন। এখনো তারা বলে বেড়ান ভারতই বাংলাদেশের প্রধান শত্রু। প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্র কেন শত্রু হবে? এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা না দিয়েই তারা ‘ভারত নিয়ে নিলো’ এমন জুজুর ভয় দেখাতে সব সময়ই তৎপর। অথচ এই ভারত মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিল, বিষয়টি এসব বুদ্ধির ঢেঁকিরা বেমালুম চেপে যান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাবার, কৃষ্টি, সভ্যতা, সামাজিকতার দিক দিয়েও ভারত রাষ্ট্র সত্তাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রসত্তার অনেক কাছাকাছি। বিষয়টি তারা তো চেপে যানই, বরং তাদের ক্ষোভ এতোই বেশি যে আর কিছুদিন পর তারা যদি বাঙালি নারীদের শাড়ি আর পুরুষের পাঞ্জাবি-পাজামা পরার ওপরও ফরমান জারি করেন তবুও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কটাক্ষ করেছেন সেই সব খিস্তিখেউড় মার্কা বুদ্ধিজীবীরা। কারণ সেটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন। এরা পয়লা বৈশাখ পালনকেও হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে ফতোয়া দিয়েছে। অথচ তাদের পেয়ারা তালেবানি রাষ্ট্র পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকারে এখনো কুণ্ঠাবোধ করে না। এসব বিষয়গুলো বর্তমান প্রজন্মকে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। একাত্তরে যারা বাঙালি নারীকে ‘গনিমতের মাল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল সেইসব হায়েনারা এখনো বাংলাদেশে তৎপর। একাত্তরের ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাক্কালে তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে কচ্ছপের মতো উঁকি দিচ্ছে। তারা নানাভাবে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পাঁয়তারা করছে। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, শোনা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে নাক গলিয়ে পাকিস্তান বিশ্বের বিভিন্ন মহলে ধরনা দিচ্ছে যাতে এই বিচার প্রক্রিয়া ঠেকানো যায়। এই বিষয়গুলো বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের নজরে রাখা উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মানেই, মহান মুক্তি সংগ্রামে গণহত্যার বিপক্ষে নৈতিক বিজয়। এই বিজয় বাঙালি জাতিকে অর্জন করতেই হবে। # -------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা/ ১১ জানুয়ারি ২০১০ সোমবার প্রকাশিত ছবি- গেইল ভ্যানএন্টর‌্যাপ সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৬:১৭
false
hm
অন্ধকারে সিগারেট যতবারই মনে পড়ে তাঁকে, এই অন্ধকারে সিগারেটের ছবিই ভেসে ওঠে মনে। বারান্দায় নিঃশব্দে বসে, কিংবা দাঁড়িয়ে, কিংবা পায়চারি করতে করতে একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে যাচ্ছেন আমার বাবা। দূরের শহর থেকে ঘরে ফিরছে তাঁর কোন সন্তান, রাতের ট্রেনে, যথারীতি ট্রেন লেট। আমার বাবা কোনদিন ঘুম ভেঙে উঠে কাউকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না, যত রাতই হোক, জেগে অপেক্ষা করেছেন। সেই অপেক্ষার সময়গুলিতে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে তাঁর সিগারেট আর মশা, আর ঘাপটি মেরে পর্যবেক্ষণে ছিলাম আমি। আমার ভাই বা বোন, যে-ই ফিরুন না কেন, সঙ্গে প্রচুর বই নিয়ে ফিরবেন। তাঁদের ব্যাগ থেকে সেই সব বই বার করে, নেড়েচেড়ে গন্ধ নিয়ে তারপরই আমি ঘুমাতে যাবো, তার আগে নয়। তাই বাইরে নিঝুম শহরের নিস্তব্ধতার বুকে বিলি কেটে যখন কোন রিকশার টুংটাং শোনা যেতো, আমার বাবার পেছন পেছন ছুটে গিয়ে আমিও দরজার পাশে দাঁড়াতাম। এখন মাঝে মাঝে বিষাদ আর আক্ষেপ নিয়ে ভাবি, সেই সময়ে উঠে কখনো তাঁকে সঙ্গ দেয়া হয়নি। ধমকের ভয়ে নয়, কোন তাগিদই অনুভব করিনি। আমি সারাজীবনে হাতে গোনা কয়েকবার ধমক খেয়েছি আমার বাবার কাছে, মার খাওয়া তো দূরের কথা। তাঁর গম্ভীর, নির্বাক পরিমিতিকেই ভীষণ সমঝে চলতাম, তিনি কোন কারণে রুষ্ট হয়ে শুধু নাম ধরে ডাক দিলে মুড়ির মতো মিইয়ে যেতাম, স্পষ্ট মনে আছে। কিছুদিন আগে আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। অনেকগুলি বছর পেরিয়ে গেছে, পিতৃবিয়োগের শোক স্তিমিত হয়ে এসেছে সময়ের ব্যস্তানুপাতে, কিন্তু পেছনে তাকালে আর ভাবলে কেবল অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু হয় না। অনুতপ্ত হয়ে তাই অনুভব করি, আমার বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, তিনি কী চেয়েছিলেন জীবনে। আমার চোখের সামনেই আমার পিতামাতা আমাদের ভাইবোনের জন্যে তাঁদের জীবনকে আক্ষরিক অর্থে বিসর্জন দিয়ে, নিংড়ে শেষ করে দিয়েছেন। আমি জানি না, আমার বাবা সেই বারান্দায় নিঃসঙ্গ রাতগুলিতে কী ভেবেছেন নিজেকে নিয়ে। হয়তো তিনি অবসরের জীবনটাকে অন্যভাবে পেতে চেয়েছিলেন, হয়তো গ্রামে পুকুরে ছিপ হাতে বসে একটা চায়ের ফ্লাস্ক আর দুই প্যাকেট সিগারেট নিয়ে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এক একটা দিন, হয়তো মেঠো রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে দূরে কোন বন্ধুর সাথে আড্ডা মারতে যেতে চেয়েছিলেন, হয়তো একদিন কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ঘুরে আসতে চেয়েছিলেন কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি থেকে, ফিরে এসে জমিয়ে গল্প করার জন্যে। জানি না। কী যে ছোট হয়ে যাই নিজের কাছে এই অজ্ঞানতার জন্যে! মনে হলো, সারাটা জীবন ধরে তাঁকে আমি, আমরা, ব্যবহার করে গেলাম। যেমন অনায়াসে শ্বাস নিই, তেমন অনায়াসেই তাঁকে পরিবেশের একটি নিত্যব্যবহার্য উপাদানের মতো চিনে নিতে শিখেছিলাম শুধু। অথচ সুযোগ ছিলো আমার অনেক। আমি শুধু বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে তাঁর পাশে বসতে পারতাম, হয়তো প্রশ্নও করতে হতো না, হয়তো তিনি নিজ থেকেই বলতেন তাঁর খুব ভেতরের স্বপ্নগুলোর কথা। গার্সিয়া মার্কেজের একটি খুব সত্যি বাক্য আছে, মানুষ তখনই বুড়ো হয়, যখন সে দেখতে তার পিতার মতো হতে শুরু করে। আমার চেহারার সাথে আমার বাবার তেমন সাদৃশ্য নেই, তবুও নিজের ভেতরে তাঁকে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাই, আর আতঙ্কিত হই বার্ধক্যের পদধ্বনির আশঙ্কায়। আর ইতর স্বার্থপরের মতো অনুভব করি, আমি তাঁর মতো হতে চাই না। তিনি যেমন বেঁচেছিলেন আমাদের জন্যে, তাঁর সন্তানদের জন্যে, তেমনটা আমি হতে চাই না। আমাদের জন্যে যে উৎকণ্ঠা তাঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একটু একটু করে খুঁটে খেয়েছে, তার সংক্রমণ আমার কাম্য নয়। আমি আমার জীবনটা স্বার্থপরের মতো নিজের জন্যে বাঁচতে চাই। যা কিছু আমার পিতার ইন্দ্রিয়ের বাইরে রয়ে গেছে আমার পেছনে খাটতে গিয়ে, তার সবই আমি চাই। তারপরও আমার ভেতরে তাঁর পাশ ফিরে শোয়া অনুভব করি। দূরে অতীতের অন্ধকারে আরেকটা সিগারেটের আলো জ্বলে ওঠে। রিকশার ঘন্টার পর শুনতে পাই তাঁর মন্দ্র স্বস্তিমাখা স্বর, "আসছো?" নিজেকে ইতর ছাড়া আর কিছু মনে হয় না তখন। আরো তীব্র শূলবিদ্ধি অনুভব করি, যখন দেখি যে মৃত্যুর পরও এই ব্যক্তিকে ব্যবহার করা বন্ধ করতে পারি না, নিজের কষ্টগুলোতে চোখ শুকনো রেখে রেখে অবশেষে উপলক্ষ্য হিসেবে তাঁকে টেনে আনি। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে হয়তো কাউকে বলি, মন ভালো নেই, অনেক বছর আগে এই দিনে আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন ...। নিজের ওপর এই ক্ষোভ আরো ঘনীভূত হয় এই ভেবে, আমার পিতা আমার কাছে অন্ধকারে সিগারেটের আগুনটুকুই হয়ে রয়ে গেলেন। তাঁর স্বপ্ন, তাঁর গভীরে লালিত সাধ, তাঁর উচ্চাশা, সবটুকুই সেই আগুনের পেছনে অবয়ব হয়ে আমার চোখে অন্ধকারে মিশে রইলো। হে পিতা, মুক্তি দিন আপনার ছায়া থেকে। আপনার মতো সন্তানবৎসল উৎকণ্ঠাময় জীবনের উদাহরণ থেকে আমাকে মুক্তি দিন। আপনার মতো আমি চাই না স্বার্থপর সন্তানের পিতা হয়ে অন্ধকারে একাকী বসে থাকতে। আমি বরং হই আমার মতন।
false
ij
গল্প_ সীমান্তে সেপ্টেম্বর, ২০০১ আমার নিজেকে এত ভারী লাগছে কেন? আধোঅন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল মঞ্জুর। একেকটা ধাপ মনে হচ্ছে একেকটা অনতিক্রম্য দূরত্ব। কিছুতেই পেরোনো যাবে না, তার আগেই দম ফুরিয়ে যাবে আর সেপ্টেম্বর মাসের এই যে গরম; দুদিন ধরে বৃষ্টিটিষ্টি নেই, সন্ধ্যার পর গুমোট আর গলিটায় রিকসার টুংটাং আর গাড়ির হর্ন; একটা ট্রেন চলে যাচ্ছিল-সেই শব্দ। মঞ্জুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য হাপাচ্ছে। কলিংবেলের ওপর আঙুলও ভারী ঠেকল। এবার অপেক্ষা। দরজা খুলে দিল পাখি। আদুরে গলায় বলল, ও, বাবা তুমি, আমি ভাবলাম মা। তোর মা ঘরে নেই? না। মা তো তিন তলায় গেছে। ও। মঞ্জুরের হাতে একটা আইসক্রীমের বাক্স ছিল, সেটা পাখির হাতে দিয়ে বলল, রেহানাকে বল, এককাপ চা দিতে। বলছি। আইসক্রীমের বাক্স নিয়ে পাখি চলে গেল। বসবার ঘরটায় ফ্যানটা ছাড়া আর টিভিটাও শব্দ কমিয়ে ছাড়া। এই মুহূর্তে পেপসোডেন্টের বিজ্ঞাপন হচ্ছে। বসার ঘরেই সোফার ওপরে হাত-পা ছাড়িয়ে বসল মঞ্জুর। পোশাক ছাড়ল না। ভারি ক্লান্ত লাগছিল আর সেই সঙ্গে উদ্বেগ। টিভির ওপর চোখ রাখল মঞ্জুর। চ্যানেল আই’র (সাতটার) খবর হচ্ছিল; কুষ্টিয়ায় কোন্ নদীর উপরে একটা কার্লভার্ট নির্মান উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনা ভাষন দিচ্ছেন। ভাষনে পরোক্ষভাবে বেগম খালেদা জিয়া কে সমালোচনা করছেন তিনি। বললেন, ৯৬ এ ক্ষমতা পেয়ে এই ২০০১ সাল পর্যন্ত নানা উন্নয়নমূলক এবারেও অর্থাৎ ২০০১ সালেও তিনি ও তার দল জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবেন ইনশাল্লা। কথাটা কি তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন? আওয়ামি লিগ কি এবার আসতে পারবে। যেভাবে দলটির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস করছে গডফাদাররা। ফেনিতে জয়নাল হাজারী; নারায়নগঞ্জে শামীম ওসমান এসব কি নেতৃী জানেন না? জানেন তো অবশ্যই।অবশ্য ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং তো তিনি করতেই পারেন। রফিকও আজ এনিয়ে আজ উদ্বেগ প্রকাশ করল। ও যতই মৃত্যুর মুখে থাকুক না কে ও সময় পেলেই রাজনীতি নিয়ে ভাবে। রাজনৈতিক আলোচনা ওর প্রিয়; হয়তো বাঙালি বলেই। মঞ্জুরের মত রফিকও উভয়সঙ্কটে পড়েছে। আওয়ামি লিগকে সমর্থন করা যাচ্ছে না আবার স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলানোর কারণে জাতীয়তাবাদী দলকে কিছুতেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। বারীন প্রায়ই বলে, ফ্যাসীবাদের জন্ম হবে বাংলাদেশে। সে জানে উগ্র জাতীয়তাবাদ + মৌলবাদ = ফ্যাসিবাদ। জঙ্গিবাদের উত্থান হবে এদের ছত্রছায়ায়। সে আওয়ামি লিগের ঘোর সমালোচক, ৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামি লিগের দূর্নীতি ও স্থানীয় গডফাদারদের সন্ত্রাস বিরুদ্ধে সে পত্রিকায় লিখেওছিল। তবে, মঞ্জুরের ক্ষীন আশা আওয়ামি লিগ ভুলক্রটি শুধরে আবার ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতাবিরোধী সঙ্গে আতাত করা জাতীয়তাবাদী শক্তি কিছুতেই নয়। কিন্তু, কোনও দল পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশে এমন নজীর নেই। মঞ্জুর উদ্বেগ বোধ করে। এবং এখন সেপ্টেম্বর মাস বলেই দেশে জোর নির্বাচনী প্রচারনার হাওয়া বইছে। রাস্তায় বেরুলে মিছিল, সভা সমিতি আর তোরণ। বাসায় বাসায় গিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের লিফলেট বিতরণ। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে মঞ্জুরের উদ্বেগ ততই বাড়ছিল। তা হলে স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতা বসতে যাচ্ছে? তার হৃৎ স্পন্দ বেড়ে যায়। এ নিয়ে ব্যাংকেও তুমুল হট্টগোল। সরকারী মোবাইল চালু না করার শর্তে নাছিম সাহেব নাকি পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন! তা হলে? তা হলে আওয়ামি লিগ আসে কী করে? রফিক থাকলে কিছু বলত। তবে মঞ্জুর চুপ করেই থাকে। সে বরাবরই নিরীহ ধরনের। উদ্বেগবোধ করে স্বাধীনতাবিরোধী সঙ্গে আতাত করা জাতীয়তাবাদী শক্তি না আবার ক্ষমতায় চলে আসে। তবে, মঞ্জুরের ক্ষীন আশা আওয়ামি লিগ ভুলক্রটি শুধরে নেবে। নিজেকে মনে মনে শান্তনা দেয় ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং তো সরকারের হাতে তারা কি স্বাধীনতাবিরোধী সঙ্গে আঁতাত করা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঠেকানো জন্য ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং করবে না? নিশ্চয়ই করবে। এটা হয়তো অন্যায় তবে আরেকটি অন্যায় ঠেকানোর জন্য আওয়ামি লিগ সেটা করতেই পারে। পারে না? রফিক থাকলে কী বলত? ওর তো বিশ্বাস ছিল আওয়ামি লিগই আবার ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতাবিরোধী সঙ্গে আতাত করা জাতীয়তাবাদী শক্তি কিছুতেই নয়। কিন্তু, কোনও দল পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশে এমন নজীর নেই। আর রফিক তো এখন কবরের শীতল অন্ধকারে। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা থেকেই টিভির সামনে বসে ছিল মঞ্জুর। ভোর পাঁচটার দিকে অবশ বোধ করতে শুরু করে মঞ্জুর । টিভিটার ওপর চোখ রেখে সামনে বেতের টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সোফার ওপরে গা এলিয়ে বসেছিল; ভিতরে ভিতরে উদ্বেগটা বাড়ছিল তখন থেকে, একটা সিগারেট ধরানো দরকার সে টের পেল সিগারেট ধরানোর শক্তিটুকুও নেই। আর শরীরটা ভারী ঠেকছিল। গলার কাছে কপালের কাছে ঘাম ফুটছিল মাথার ওপরে পাখা ঘুরছিল; বসার ঘরে ম্লান আলো জ্বলেছিল। আজ কী কারণে কারেন্ট যায়নি। হাতে রিমোট কন্ট্রোলার। ভীষন ভারী ঠেকল। ওটা টিপে যে টিভি বন্ধ করে দেবে সে শক্তিও নেই। মঞ্জুর পরম উদ্বেগ বোধ করে এদিকওদিক তাকাল। সে আওয়ামি লিগের ঘোর সমালোচক, ৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামি লিগের দূর্নীতি ও স্থানীয় গডফাদারদের সন্ত্রাস বিরুদ্ধে সে পত্রিকায় লিখেওছিল। তবে সে আওয়ামি লিগের ঠিক পতন কামনা করেনি। কারণ জাতীয়তাবাদী দল স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। মঞ্জুরের বিস্ময় এখানেই যে দেশের অর্ধেক লোক জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক আর তারা এখন জোটকে জিতিয়ে দিল! তারা একবারও প্রশ্ন তুলল না জাতীয়তাবাদী দলটি সঙ্গে কাদের নিল! দেশের অর্ধেক মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল ওরা কী করেছিল একাত্তরে। কে যেন তার ভিতরে বলে চলেছে: আবার যুদ্ধে যেতে হবে। সীমান্ত পেরুতে হবে। আবার হাতে তুলে নিতে হবে ষ্টেন। অবশ বোধ করে মঞ্জুর; ইদানিং রক্তচাপের সমস্যাটা বেড়েছে। টের পায় মাথার তালু ঘামছে। গলার কাছে তৃষ্ণা এক গ্লাস পানি খেলে ভালো হত। ফিরোজাকে ডাকল দুবার। গলার স্বর ঠিকঠাক ফুটল না। খানিক বাদে শক্তি সঞ্চয় করে রিমোটটা টিপে টিভি অফ করল করে উঠে দাঁড়াল সে । ওসব দেখে আর কী হবে। সবই যে শেষ হয়ে গেল। ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরের দিকে যেতে থাকে মঞ্জুর। দুটো পা-ই অবশ বোধ করে শক্তি নেই। মনে হচ্ছে পড়ে ...দরজার পাশে ফ্রিজ। ওটা খুলে পানির বোতল বার করে খাওয়া যায়। তক্ষুনি কে যেন তার ভিতরে বলে চলেছে: আবার যুদ্ধে যেতে হবে। সীমান্ত পেরুতে হবে। আবার হাতে তুলে নিতে হবে ষ্টেন। সে ভূতের মতন হেঁটে শোবার ঘরে এল। কে হাঁটছে? আমি কি? না আমি না। অন্য কেউ। শোবার ঘরে আলো নেভানো। আবছা অন্ধকারে ফিরোজার ঘুমন্ত শরীরটি বোঝা যায়। খালি গায়েই ছিল মঞ্জুর। অক্টোবরের প্রারম্ভে কী আর এমন শীত এখন বাংলাদেশে? বুকটা ভীষন কাঁপছে। অন্ধকার হাতড়ে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরে নিল মঞ্জুর। আবার যুদ্ধে যেতে হবে। সীমান্ত পেরুতে হবে। আবার হাতে তুলে নিতে হবে ষ্টেন। মানিব্যাগটা সন্তপর্নে ড্রয়ার খুলে পকেটে ভরল। কাল ব্যাংক খোলা। কিন্তু, সেসব কথা এখন আর ভাবল না মঞ্জুর...এখন যুদ্ধে যেতে হবে ...ঘরের বাতি না-জ্বালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফিরোজার দিকে ভালো করে তাকাল না মঞ্জুর। কিংবা পাশের ঘরে ঘুমন্ত পাখির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালও না। তার কারণ তার হৃদয় বড় কঠিন। তার হৃদয় কঠিন হওয়ার কারণ-একাত্তরে মঞ্জুরের বন্ধু বাদশার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানী সৈন্যরা। বাদশাদের বাড়ি ছিল নেত্রকোণার কলমাকান্দায়। ঢাকা ভার্সিটি ভরতি হয়েই বাদশার সঙ্গে পরিচয়, তারপর যা হয়- ঘনিষ্টতা। রফিক বাদশা আর মঞ্জুর এই তিনজন ছিল অভিন্ন প্রাণ। বাদশার সঙ্গে মঞ্জুর আর রফিক একবার গিয়েছিল কলমাকান্দায়। সোমেশ্বরী নদীটা ওদের বাড়ির খুব কাছেই। মঞ্জুরা পিরোজপুরের ; বাদশার ছোট বোন পাখির সঙ্গে বিয়ের কথা তুলেছিল বাদশার মা-ই, মঞ্জুররা দক্ষিণ বঙ্গের লোক বলে নাক সিটকায়নি বাদশার মা সায়রা খালা। বিয়েটা হতই যদি না দেশে একটা যুদ্ধ বেধে যেত। বাদশাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানী সৈন্যরা-তখন বারীন বাদশা আর মঞ্জুর মুক্তিবাহিনীতে ... ওরা বাদশার মাবাবাকে গুলি করে মেরেছিল আর পাখিকে ধরে নিয়ে যায় ... ... আর ... বাদশা ...বাদশা আত্মহত্যা করেছিল স্বাধীনতার পর ... সেমেশ্বরী নদীর পাড়ে ...আর এতদিন পর এখন আবার যুদ্ধে যেতে হবে বলে বাতি না-জ্বালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফিরোজার দিকে ভালো করে তাকাল না মঞ্জুর বা পাখির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালও না -তার কারণ তার হৃদয় বড় কঠিন। দোতলার বারান্ধায় এসে কোলাপস্যাবল গেটটা কৌশলে খুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় ফজরের আযান শুনতে পেল মঞ্জুর। সেই সঙ্গে টের পেল ভোরের ঠান্ডা বাতাস ওর শরীরে ...। অন্যদিন ছটার দিকে রমনা পার্কে যায় হাঁটাহাঁটি করতে যায়। বারীণের কিডনি ইনফেকশান হওয়ার পর তারও ... পঞ্চাশ বছরের শরীরে মধুমেহ রোগটি বাসা বেধেঁছে। হাঁটাহাঁটি এ রোগের অন্যতমন প্রতিকার বলেই ডাক্তারের পরামর্শে ... নিচের গলিতে তখনও অন্ধকার ফিকে হয়নি। মগবাজার থেকে মহাখালি পৌঁছতে ভোর হল । বাস ছাড়বে কি ছাড়বে না সে-নিয়ে সংশয় ছিল মঞ্জুরের। বাস না পেলে ট্রেনে যাব ট্রেন না পেলে হেঁটেই যাব। নেতৃকোণা কী এমন দূর? এখন যুদ্ধের সময়। তিরিশ বছর আগে সেই বছরটা মাইলের পর মাইল হেঁটেছিল মঞ্জুর মাইলের পর মাইল আর ওরা ওই ঘাতকদের ক্ষমতায় বসালো? বসাতে পারল? টার্মিনালে এখন অন্ধকার অনেকটা কেটেছে। একটা বাস ছাড়বে ছাড়বে করছিল। লোকজন একেবারেই কম। বাসটায় উঠে পড়ল। বসল পিছন দিকে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে। যেন ওকে ফলো করছে কেই। বাসটা ছাড়তেই ঘুমিয়ে পড়ল মঞ্জুর। ঘন্টাখানেকবাদে দারুন এক অপস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে জেগে উঠল সে। জানালার ওপাশে রোদ ঝলমল করছিল। মঞ্জুর হাসল। কেননা মঞ্জুর এখন জানে এই ঝলমলের রোদের বাংলাদেশে ফ্যাসীবাদের জন্ম হবে এখন । সে জানে উগ্র জাতীয়তাবাদ + মৌলবাদ = ফ্যাসিবাদ। জঙ্গিবাদের উত্থান হবে এদের ছত্রছায়ায়। আর বিশেষ বাহিনী গঠন করে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড ঘটাবে এরা। দুর্নীতির পাহাড় জমবে। জাতীয়তাবাদীদের উপলব্দি ক্ষমতা অগভীর। এদের দেশপ্রেম লোকদেখানো। নেত্রকোনা পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়াল। এখান থেকে কলমাকান্দাও যাওয়া যায়। সেকথাও মনে পড়ল তার। বাদশাদের বাড়িটা ছিল কলমাকান্দা সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে। সেই নদীর শোলমাছ রেধে খাওয়াত সায়রা খালা। এখনও সেই স্বাদ লেগে আছে স্মৃতির জিভে। কে ধ্বংস করে দিল সেই সব রোদে ভরা উঠানের দিন। মার্চ মাস। সতের কি আঠারো তারিখ। পাখিকে ছুঁয়েছিল মঞ্জুর। আহ, সোমেশ্বরী নদীটার কথা আজও মনে পড়ে। বাদশা ওই নদীতেই ডুবে আত্মহত্যা করেছিল স্বাধীনতার মাস দুয়েক পরে। কলমাকান্দার সোমেশ্বরী, বিরিশিরির সোমেশ্বরী নয়। বাদশা জীবনের ওপর সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। বাবা মায়ের মৃত্যু ভাইবোনের মৃত্যু বাদশা একাই কলমাকান্দার সব রাজাকার আর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানদের খুন করেছি ...বাদশার মৃত্যু পর মরতে চেয়েছিল মঞ্জুরও। পারেনি। বারীন ওকে আকড়ে ধরেছিল। তা ঝাড়া রামপুরায় জোহরা খালার বাড়িতে ৭৩এর ফিরোজাকে দেখল। ফিরোজা তখন ছিপছিপে ছিল, তন্বী ছিল। নজরুলগীতি গাইত। আর ...আর ...পাখির সঙ্গে ফিরোজার ভারি মিল ছিল। কথাটা কখনও বলা হয়নি ফিরোজাকে। বলা আর হবেও না। বাস থেকে নেমে মঞ্জুর হাঁটতে থাকে স্টেশনের দিকে। রোদের তেজ আছে। খিদেও পেয়েছে। সকালে নাশতা খাওয়া হয়নি। আজকাল খালিপেটে থাকলে হাতপা কাঁপে ওই মধুমেহর জন্য। আজ আর এসব সে গ্রাহ্য করল না বরং বিরিশিরির বাসের খোঁজ করতে থাকে। এখানেও চারপাশটা থমথম করছিল। কেবল তরুনযুবাদের একটা আনন্দমিছিল রাস্তা কাঁপিয়ে চলে যায়। তরুনযুবাদের অনেকেরই মুখে দাড়ি, কেউ কেউ টুপি পরা। মঞ্জুর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। ওর হাতটা নিশপিশ করে। তীব্র চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে। ৭২ সালে ষ্টেন গানটা এ জমা দেওয়া ঠিক হয়নি। ওটা লুকিয়ে রাখা উচিত ছিল। মেঘালয় থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় বাদশা বলল, অস্ত্র কখনও জমা দিতে নাই মঞ্জুর। কখন আবার কাজে লাগে। এই দুইটা এইখানে লুকায় রাখি, তুই কী বলিস? পরে দরকার হলে তুলে নিব। কথাটা শুনে অবাক হয়েছিল মঞ্জুর। বারীনও। বাদশা তখনও বেঁচে বাদশা তখনও অবিস্কার করেনি কলমাকান্দায় ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে। ক্যাম্পে অবশ্য নানা রকম গুঞ্জন শোনা যেত। তবে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস কী। গারো পাহারে একটা জলপাই গাছের নীচে রাতের অন্ধকারে বাদশা দুটো স্টেন লুকিয়ে রেখেছিল । এখন এত বছর পর সেখানেই চলেছে মঞ্জুর। ওই জলপাই গাছের নিচে তিরিশ বছর ধরে দুটো ষ্টেন পড়ে আছে। সেকথা ভাবতেই ওর চোখ দুটো খুনেদের মতন ধকধক করে জ্বলছে আর নিভবে। এবং এই নেতৃকোণা শহরের খুব কম লোকই টের পাচ্ছে তা। হাতপা এখন রীতিমতন কাঁপছে মঞ্জুরের। ষ্টেশনের কাছেই একটা ভাতের হোটেলে ঢুকে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেবে বলে ঠিক করল। না নিজেকে আর কষ্ট দেব না। সামনে অনেকটা পথ পেরুতে হবে। এখনই ক্ষুধাতৃষ্ণায় ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। গারো পাহাড়ে পৌঁছনোর মতন শক্তি চাই। বিল মিটিয়ে হোটেলের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল মঞ্জুর। তারপর বাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। বাস ভরতি লোক। মঞ্জুর কোনওমতে উঠে পড়ল। একটা শিশু কাঁদছিল চিৎকার করে। আর ছিল মুরগীর খাঁচা, বিড়ির গন্ধ আর আমড়া বিক্রেতার সেই সঙ্গে ভাবছিল ফিরোজা আমাকে খুঁজবে? পাখি কি কাঁদছে ...আধ ঘন্টা মতন কাটলে বসার সিট পেল মঞ্জুর। কংস নদীর পাড় থেকে বাতাস আসছিল। হু হু করে পেরিয়ে যাচ্ছিল ধানের ক্ষেত ...বাসটা ঝাঁকুনি খেল। মঞ্জুরের মাথা ঠুকে যায় জানালার ... কংস নদীটা পার হওয়ার সময় পাখির কথা মনে পড়ল । মেয়েটা এবার ইন্টারমিডিয়েট দেবে ... বাসটা যখন মঞ্জুরকে বিরিশিরি নামিয়ে দিল তখনও বিকেলের আলো মুছে যায়নি। সে বাস থেকে নেমে উত্তরমুখো হয়ে হাঁটতে থাকে। ওদিকেই গারো পাহাড়। ওদিকেই বাদশার লুকিয়ে রাখা ষ্টেন গান একটা জলপাই গাছের নিচে এখনও পড়ে রয়েছে। বিরিশিরি জায়গাটা এমনিতেই নির্জন। রাস্তার দুধারে ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ি গাছপালা আর মাঠ। সেসবের ওপর সোনালি রঙের প্রলেপ পড়েছিল। এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব ... আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব আর এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব ... এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব... এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব... এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব... এই সুন্দর মায়াবী দেশে এখন এক অন্ধকায় জন্তু খল খল করে হেসে উঠবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব ...সোমেশ্বরী নদীটায় বালি আর বালি; হেঁটেই পেরুলো নদীটা। আরও অনেক মানুষ হাঁটছিল; তাদের সঙ্গে হাঁটছিল মঞ্জুর। ওপারে দূর্গাপুর। দূর্গাপুর পৌঁছতে সন্ধ্যা হল। এখানেও ছাত্রদের একটা আনন্দমিছিল বেরিয়েছে। সে ক্রর হাসে। তার মনে পড়ল বাদশা তার জন্য অপেক্ষা করছে। গারো পাহাড়ে। অনেকদিন পর স্টেনটা তুলে ধরতে কেমন লাগবে? ওই মিছিলে ব্রাশ ফায়ার করার সময় আমার হৃদয় কি ভরে উঠবে? ৩০ বছর আগে সীমান্ত পেরিয়েছিল মঞ্জুর। তখন সীমান্ত পেরুনোর কারণ ছিল, তখন অনেকেই সীমান্ত পেরিয়েছিল; সে মনে করে এখন আবার সীমান্ত পেরুনোর সময় এসেছে। মঞ্জুর গোপালপুর যাবে বলে ঠিক করেছে ও গোপালপুর দূর্গাপুরের উত্তরে। তিরিশ বছর আগে গোপালপুর দিয়েই সে সীমান্ত পেরিয়েছিল। এত বছর পর সেদিকে যাবে বলেই ঠিক করল। ও রাতভর হাঁটবে বলে ঠিক করল। এখন ওর পঞ্চাশ বছরের মধুমেহতে আক্রান্ত শরীরটা বিশ বয়েসে এসে ঠেকেছে। সিগারটে টানতে টানতে ও হাঁটতে থাকে মঞ্জুর। দুপাশে দোকানপাটা সিনেমা হল ও একটা ব্যাংক। আলো জ্বলছিল। থমথম করছিল। আনন্দমিছিলটা ঘুরে আবার এদিকে আসছিল। সে খানিকটা সরে পড়ল। মঞ্জুর জানে এখন ফ্যাসীবাদের জন্ম হবে বাংলাদেশে। সে জানে উগ্র জাতীয়তাবাদ + মৌলবাদ = ফ্যাসিবাদ। জঙ্গিবাদের উত্থান হবে এদের ছত্রছায়ায়। আর বিশেষ বাহিনী গঠন করে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড ঘটাবে এরা। দুর্নীতির পাহাড় জমবে। জাতীয়তাবাদীদের উপলব্দি ক্ষমতা অগভীর। এদের দেশপ্রেম লোকদেখানো। ও হাঁটতে থাকে। একটা সময় পাকা রাস্তা শেষ হয়ে শুরু হয় গ্রাম্যপথ। আকাশে ক্ষীনকায় একটা চাঁদ ঝুলে আছে। তার ম্লান আলো এখানকার পথেঘাটে ছড়িয়েছ। বিমর্ষ স্কুলঘরের ওপর ...মঞ্জুর পিরোজপুরের ছেলে হলেও এবং গত তিরিশটা বছর সে ঢাকায় কাটালেও সে এ অঞ্চলটা ভালোই চেনে। এর কারণ আছে। স্বাধীনতার পর সে এসব অঞ্চল পাখির খোঁজে চষে বেড়িয়েছে, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে পাখিকে । পায়নি। মঞ্জুরের অবশ্য বিশ্বাস ছিল পাখি বেঁচে আছে -ওরকম ফুটফুটে মুখ ...কারা মেরে ফেলতে পারে? কারা? দূর্গাপুর শহরের মিছিলে চিৎকার ছিল নারায়ে তাকবীর ...ও ক্রোধে অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এবং তখন ফিরোজা কিংবা পাখির কথা মনে পড়েনা তার কেবল মনে পড়ে ...হাঁটতে হাঁটতে সে ঠিকই টের পায় তার বাঁয়ে এখন সোমেশ্বরী নদীটা । সোমেশ্বরী নদীর পাড়েই পাখিকে চুমু খেয়েছিল মঞ্জুর। বিরিসিরির সোমেশ্বরী না-কলমাকান্দার সোমেশ্বরীর পাড়ে। সময়টা ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ; রাত সাড়ে ৮টায়। বাদশাই সুযোগ করে দিয়েছিল। বাদশা জানত মঞ্জুরের সঙ্গেই পাখির বিয়েটা হতে যাচ্ছে। বাদশা ও বারীন নৌকা থেকে নেমে পড়েছিল। রাতটায় জোছনা ভরে ছিল আর নৌকাটা মৃদু মৃদু কাঁপছিল। পাখিই কী রকম সাহসী হয়ে উঠেছিল ... ওর এত ফুটফুটে মুখ। সতের বছরের দেহটি এমন বাক্সময়। এসব ফিরোজা জানে না। এসব কথা ফিরোজাকে বলেনি মঞ্জুর। কারা তাকে মেরে ফেলতে পারে? পাখিকে? মঞ্জুর হাঁটতে থাকে। দুপাশে নিঝুম গ্রাম। ঘুমন্ত জনপদ। নিঃসাড় লোকালয়। দুপাশে ঘুমন্ত গাছ ম্লান জোছনার আলো গ্রাম্যকুকুরের চিৎকার। রাতভর হেঁটে সে সীমান্তর কাছাকাছি পৌঁছে আরেকটা বিরুপ বিষন্ন ও ধূসর ভোরের মুখোমুখি হল। সে জানে ওপারে মেঘালয়; তার আগে গারো পাহাড়। সে ভেবেছিল পথে আরও অনেকে থাকবে তার মতন অথচ সে কাউকে দেখতে পেল না। সে কেবল ভোরের ম্লান আলোয় গারো পাহাড়ের অবয়ব দেখে। এখানে একটা হাজং-গ্রাম। দূর থেকে মনি সিং কে দেখে থমকালো মঞ্জুর। মনি সিং-এর দীর্ঘ শরীর টকটকে ফরসা; উঠানে দাঁড়িয়ে একদল হাজংএর সামনে দাঁড়িয়ে কী উত্তেজিত ভঙ্গিকে যেন বলছিলেন। মঞ্জুর জানে মনি সিং কী বলছেন হাজংদের। ওদের সবার হাতে, এমনকী মেয়েদের হাতেও ঝকঝকে দা, তীর-ধনুক আর বর্শা-বল্লম। সবার মুখ উত্তেজনায় চকচক করছিল। লুকিয়ে রাখা স্টেনের কথা মনে পড়ল মঞ্জুরের। সে আবার হাঁটতে শুরু করল। মাটি অল্প অল্প করে উঁচু হয়ে উঠেছে। চড়াই-পথ বলেই হয়তো। দৃশ্যপথও বদলে যাচ্ছে ক্রমেই মাটিটা লাল। রুখু। পথের দুপাশে ঘন গাছ, জঙ্গলমতন। বাঁশঝার। একটা বাঁশ বেয়ে উঠছিল একটা বাদামি-ধূসর রঙের ছোট একটা লজ্জাবতী বানর। বাঁশঝারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল একটা অল্পবয়েসী ছেলে- বানরটাকে দেখছিল । ছেলেটা কি গারো? গারোই হবে। কাছে এসে দেখল কালো চুল কালো চোখ / মাথা ও মুখটা গোলাকার/ কপাল চোখের দিকে কিছুটা বাড়ানো /ঘন ভ্রু/ ছোট চোখ/ গালে মনে হয়না দাড়িগোফ ওঠে / শরীর নির্লোম /চ্যাপ্টা নাকমুখ/ উঁচু চোয়াল/ নাকের ফুটা মোটা/ বুকটা চওড়া /হাত পা পেশি /স্থুল সবল শরীর/ বেঁটে /চমড়া মসৃন /পীতাভ রং ...এইসব দৃশ্য পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে মঞ্জুর। ক্রমেই একটি দিনের সূচনা হতে থাকে আর সেই সঙ্গে পাখিদের কোলাহল বাড়তে থাকে ও ভোরের রংহীন আকাশে কয়েকটি শকুন উড়ছে থাকে বলে মনে হয় মঞ্জুরের; পচা লাসের গন্ধও টের পায় সে। চারপাশটা কীরকম নিঝুম হয়ে আছে। সময়টা যেন তিরিশ বছর পিছিয়ে গেছে আর তখন তো ... এবং দূর থেকে দেখতে পায়-একটা কামরাঙ্গা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাদশা । ওকে দেখে ভীষন স্বস্তি পেল মঞ্জুর। বুকের ধুকধুকানি কমে। এতক্ষন গাঢ় একাকীত্ব ভর করেছিল। সেটা কেটে গেল। বাদশার পরনে খাকি সার্ট। মুখে দাড়ি গোঁফ। সিগারেট টানছিল। একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল, এত দেরি যে? বাস থামিয়ে চেক করছিল শালারা। মঞ্জুর থুতু ফেলে বলল। বাদশার মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠল। বলল, আয়। চল। পাহাড়ের আরেকটু ভিতরে একটা জলপাই গাছের নিচে চলে এল ওরা। বাদশা উবু হয়ে নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করে দিল। আরও খানিকক্ষন বাদে স্টেনদুটো বার করে ওদুটোর গায়ে লেগে থাকা মাটিটাটি ঝেড়ে একটা মঞ্জুরের হাতে দিয়ে বলল, চল। ওটা নিয়ে মঞ্জুর বলল, চল। এতদিন বাদে মঞ্জুরের হাতে স্টেনটা ভারী ঠেকল না। সূর্য ওঠার আগেই ওরা দুজন সীমান্তের কাছাকাছি চলে এল। অক্টোবার মাস বলেই আকাশে মেঘ জমল। অল্প অল্প বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করল। ওরা বৃষ্টি ভেঙ্গে হাঁটতে থাকে। ওপাশে মেঘালয়। ওপাশে কোথাও ( কিংবা আগরতলায়) মেজর জিয়া রয়েছেন; দেশ শক্রমুক্ত করার আগে মেজর জিয়ার কাছে দীক্ষা নেবে ওরা। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা একটা উঁচু পোষ্ট থেকে ওদের দেখছিল। ওদের দেখে রক্ষীরা সম্ভবত অবাক হয়ে গিয়েছিল। কারা এরা ? উলফা নয়তো? ওরা গুলি করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। ওরা দুজন কিংবা মঞ্জুর একাই যেরকম ভেবেছিল সেরকম করে এত বছর পরে আর সীমান্ত প্রহরীরা উপরের মহলের নির্দেশে ওদের স্বাগত জানাল না। এতদিনে গঙ্গাযমুনার পানি যেমন গড়িয়ে গেছে তেমনি অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। তা ছাড়া, সীমান্তে আজকাল একটা-না-একটা গোলযোগ লেগেই রয়েছে। এসব কারণেই ওপার থেকে সীমান্তরক্ষীরা দুজনকে দেখেই নির্বিচারে গুলি চালালোর সিদ্ধান্ত নিল। ঠা ঠা ঠা ঠা ... একজন অনেককাল আগেই মৃত হয়েছিল; সে-ও আজ মরল। সেই সঙ্গে আরেকজন যে মরতেই চেয়েছিল ... (উৎসর্গ: কাকাশালিখচড়াইগাঙচিল ...) সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:২২
false
fe
ইমেইল প্রতারনার রকমফের ইমেইল প্রতারনার রকমফের ফকির ইলিয়াস ============================================= যুক্তরাষ্ট্রে প্রতারনার অন্যতম একটি হচ্ছে ইমেইলে প্রতারনা। হ্যাকিং করে কারো ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব নম্বর, ক্রেডিট কার্ড, সোস্যাল সিক্যুরিটি নম্বর জালিয়াতি করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। তাছাড়াও ইমেইল এ্যাড্রেস পাচার করে বিভিন্ন লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ইমেইলের মাধ্যমে প্রতারণার বড় বড় ঘটনার পেছনে ছুটছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্খা। এগুলোর নামও দেয়া হয়েছে। আফ্রিকা কানেকশন, ডলার কানেকশান ইত্যাদি। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী এসব প্রতারণার কলকাঠি নাড়ে। এ রকম প্রতারণার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। একদিন একটি লোভনীয় প্রস্তাবসহ ইমেইল পান নিউইয়র্কের একজন বাংলাদেশী অভিবাসী। যে ইমেইল করেছে, সে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন প্রয়াত জেনারেলের মেয়ে হিসেবে। মেয়েটি জানায়, তার পিতা শ্বেতাঙ্গের নির্যাতনে নিহত একজন জেনারেল। তার পিতা ২৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেখে গেছেন। তারা এগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করতে চায়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে একজন অভিভাবক প্রয়োজন। ইমেইলে প্রস্তাব করা হয় যদি নিউইয়র্কের ঐ ব্যক্তিটি তার ব্যাংক একাউন্ট নম্বরসহ যাবতীয় তথ্য প্রদান করে, তবে ঐ ২৭ মিলিয়ন ডলার তার একাউন্টে জমা দেয়া হবে। এ বাবত তিনি কমিশন পাবেন পনেরো শতাংশ। লোভনীয় ঐ প্রস্তাবে রাজী হন ঐ বাংলাদেশী। তিনি কয়েক দফা ইমেইল বিনিময় করে পুরো নিশ্চিত হন। দেন তার ব্যাংক একাউন্টসহ পুরো তথ্য। দু-সপ্তাহ পরে দেখা যায় তার একাউন্টে নিজের জমানো এগারো হাজার ডলার হ্যাকিং হয়ে গেছে। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ব্যাং কে বিস্তারিত জানানোর পর বিষয়টি এখন ততন্তাধীন। এজন্য দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। কে জানে তিনি তার উপার্জিত ডলারগুলো ফেরৎ পাবেন কিনা। আরেকটি ঘটনা আরো মর্মস্পর্শী। একজন অভিবাসী বাঙালী প্রায় একই ধরনের ইমেইল পান। ঐ ইমেইলে বলা হয় ইমেইলকারী নাইজেরিয়ার একজন উচ্চপদস্খ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। তিনি বিশ মিলিয়ন ডলার পাচার করতে চান। এজন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্খ পার্টনার প্রয়োজন। নিউইয়র্কের ঐ বাঙালীকে এজন্য তিনি নাইজেরিয়া ভ্রমণের আহ্বান জানান। ফোনে তাদের কথাও হয় কয়েক দফা। নিউইয়র্কের ঐ ভদ্রলোক বিশ্বাসে এবং লোভে নাইজেরিয়া যান। বিমানবন্দর থেকে তাকে স্বাগত জানিয়ে হোটেলে নিয়ে তোলা হয়। ঐ রাতেই অস্ত্রধারীরা প্রথমে তার কাছ থেকে নগদ তিন হাজার ডলার ছিনিয়ে নেয়। তাকে হুমকি দেয়া হয় যদি তিনি তার সাথে থাকা প্রতিটি ক্রেডিট কার্ড পরদিন ব্যাংকে চার্জ না করেন তবে তাকে মেরে ফেলা হবে। তিনি শংকার রাত কাটিয়ে পরদিন তার সবগুলো ক্রেডিট কার্ড সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেন। তারা তা ইচ্ছেমতো চার্জ করে। তারপর তাকে অর্ধমৃত অবস্খায় বিমানবন্দরে ছেড়ে যায়। তিনি কোনমতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বাঁচিয়ে নিউইয়র্কে আসতে সক্ষম হন। তিনি যে একটি ফোন করতে পারবেন সে সুযোগও তার ছিল না। নিউইয়র্ক ফিরে তার ক্রেডিট কার্ড কোম্পানীগুলো থেকে তিনি জানতে পারেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলার চার্জ করা হয়েছে। তীব্র সংকটাপন্ন জীবন কাটাচ্ছেন ঐ প্রবাসী। গোয়েন্দা সংস্খাগুলো বিষয়টি ইনভেনটিগেশন করছে। কিন্তু যা হবার তাতো হয়ে গেছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী তিনি যে বেঁচে আসতে পেরেছেন তাই তার সৌভাগ্য। ইমেইলে এসব ডলার পাচার বিষয়ক প্রস্তাবগুলো বেশি আসছে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। নাইজেরিয়া, কঙ্গোঁ, ফিজি, বার্মুডা, এ্যাঙ্গোঁলা, সোমালিয়া, উগান্ডা, মোজাব্বিক, রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলোর স্বঘোষিত প্রিন্স, কর্ণেল, জেনারেল, মন্ত্রী, ট্রেজারার পরিচয়দানকারীরা এভাবেই লুফে নেয় তাদের শিকার। তারাই এতোই ধূর্ত যে বিভিন্ন ইমেইল এ্যাড্রেস দেখে তারা বাছাই করে নেয় অপেক্ষাকৃত সহজ সরল কে বা কারা হতে পারে। এবং সেভাবেই চালায় তাদের ডলার কানেকশন। দুই. ইন্টারনেটে চ্যাটিং করে পরে ইমেইলে সখ্যতা গড়ে তোলার রেওয়াজ এবং অবৈধ সম্পর্ক স্খাপন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ করে তা যদি হয় কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরীর সাথে। প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়, এক শ্রেণীর বিকার গ্রস্খ পুরুষেরা ইমেইল চালাচালি করে সম্পর্ক গড়ে তোলে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সাথে। অবশ্য এসব রোধে ইন্টারনেটে গোয়েন্দাদের রেড এলার্টও এখন বাড়ছে ক্রমশ:। সন্দেহ হলেই চ্যার্টিং পর্বটি মনিটরিং এবং রেকর্ডিং করছে নেট গোয়েন্দারা। সম্প্রতি নিউইয়র্কের একজন ধনকুবের ইমেইল সংযোগের ফল হিসেবে স্কুলগামী তিনজন কিশোরীকে বাগিয়ে নিয়ে উঠেছিল লং আইল্যান্ডের একটি হোটেলে। গোয়েন্দারা আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল সেখানে। হোটেলের রুমে ঢুকার সাথে সাথেই তিনি গ্রেফতার হন। শিশু কিশোর উৎপীড়ন আইনে তার পঁচিশ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। ইমেইল প্রতারণার আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে ইমেইলে মিতালী গড়ে তোলে সাহায্য চাওয়া। একাজটি বেশি হচ্ছে ইউরোপের তুলনামূলক গরীব দেশগুলো থেকে। পোল্যান্ড, রুমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং ভেঙ্গে যাওয়া রাশিয়ার বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র থেকে পাতা হয় এমন মিতালী ফাঁদ। চ্যাটিং করে এরা আমেরিকান যুবকদেরকে বেছে নেয়। মেয়ে সেজে কাছে আসার প্রলোভন দেখায়। এক সময় বলে, তুমি যদি আমাকে বিমান টিকিটের খরচ দাও তবে আমি তোমার কাছে চলে আসবো। আমেরিকান যুবক সরল বিশ্বাসে টিকেট ও অন্যান্য খরচ বাবৎ পাঠিয়ে দেয় হাজার / দেড় হাজার ডলার। তারপরই গায়েব হয়ে যায় সেই মিতা। আমেরিকান যুবকের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। অন্যদিকে ‘মিতা’ খুঁজে নতুন শিকার। এক সময় যুবক বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। ইমেইলে পণ্য বিপনন করে প্রতারনা প্রক্রিয়াটিও বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এটা কিনুন, ওটা কিনুন, পঞ্চাশ থেকে ষাট শতাংশ ডিসকাউন্ট এমন অভিনব বিজ্ঞাপন সম্বলিত ইমেইল পাওয়া যায় প্রতিদিনই। ‘আগে আসলে আগে পাবেন- ডিজনীল্যান্ড ট্যুর’ বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয় মাত্র পঞ্চাশ ডলার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে আপনি পেতে পারে চারজনের ফিন্স টিকেটসহ পাঁচদিনের ভ্রমন প্যাকেজ, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। লক্ষ লক্ষ লোক রেজিস্ট্রেশন করেন কিন্তু পান মাত্র দশ জন। এভাবেই শুভংকরের ফাঁকি’র মধ্যদিয়ে চলে যায় ‘দ্যা আমেরিকান লাইফ’। ওয়েবসাইট দেখে কিংবা ইমেইলে জেনে অর্ডার দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক ক্রেতা। দেখা যায়, ছবি দেখে একটি অর্ডার দেয়া হলো কিন্তু পার্সেলে যে দ্রব্যটি এলো তার গুনগত মান সম্পূর্ণই সস্তা। তারপর আবার যোগাযোগ, ফেরৎ পাঠানোর প্রক্রিয়া, নিজের একাউন্টে মূল্য ফেরৎ পাবার জন্য প্রতীক্ষা ইত্যাদি ঝামেলাগুলো পোহাতে হয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সর্বশেষ এবং শক্তিশালী ভরসাটি হচ্ছে ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষনকারী সংস্খা ‘দ্যা কনজুমার এফেয়ার্স’। কিছু কিনে ঠকলে তাদেরকে জানালেই একটা বিহীত ব্যবস্খা হবে। বিক্রেতা, ক্রেতাকে ঠকিয়েছেন এমনটি প্রমাণিত হলে সুদাসলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় ক্রেতাকে। আর এভাবেই ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষিত হয় একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে। ব্যবসার অন্যমত স্তম্ভ হচ্ছে বিশ্বাস। ক্রেতা বিক্রেতার সাথে বিশ্বাস স্খাপনই রক্ষা করে ব্যবসার স্বার্থ। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই সেরা ভাগ্যবান(!)। যদি বাংলাদেশে শক্তিশালী কনজ্যুমার এফেয়ার্স থাকতো তবে হয়তো তারা এমন মনোপলী ব্যবসা করতে পারতেন না। সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ৯:৫৬
false
hm
আমরণ হরতাল ১. 'স্বনির্ভরতা।' সুলেমান সাহেব হাসলেন। 'কথাটা হচ্ছে স্বনির্ভরতা।' বদরুল কিছু বললো না, সুলেমান সাহেবের বাড়িয়ে দেয়া হাতের লাইটারে চুপচাপ সিগারেটটা ধরিয়ে নিলো। সুলেমান সাহেবের হাসিটা তার পছন্দ হচ্ছে না। ভদ্রলোক নিজেও অস্বস্তি নিয়ে হেসে যাচ্ছেন, আর তাকেও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। 'চান্দিনা এখন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।' বেশ গর্বিত সুরে বললেন সুলেমান। বদরুল পায়ের ওপর পা তুলে বসলো, কষে সিগারেটের গোড়ায় টান দিচ্ছে সে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটটা উঁচিয়ে ধরলো, 'এখানে বানানো?' 'হ্যাঁ।' সুলেমান সাহেব আবার হাসলেন, অস্বস্তির হাসি। 'বাহ্।' মাথা নাড়লো বদরুল, তার কাঁচাপাকা চুলগুলো নড়ে উঠলো। 'আপনাদের এই ছোট্ট জায়গার মধ্যে আপনারা তামাক পর্যন্ত ফলান?' চান্দিনা কোন গ্রহ নয়, এমনকি কোন উপগ্রহও নয়। এটি এবড়োখেবড়ো, বায়ুমন্ডলহীন ছোট্ট একটি গ্রহকণা, যথেষ্ঠ জটিল কক্ষপথে ঘুরছে একটা মাঝারি মাপের তারাকে ঘিরে। চান্দিনার সূর্যটাকে পৃথিবীর লোকজন নাম দিয়েছে জোনাকিতারা। জোনাকিতারা এখন চান্দিনা থেকে দু'শো কোটি মাইল দূরে। চান্দিনায় আসার পথে মহাকাশযান থেকে একবার বদরুল উঁকি মেরে দেখেছিলো গ্রহকণাটিকে। চান্দিনার ব্যাস বড়জোড় কয়েকশো মাইল, জোনাকিতারার আলোয় সেটিকে ধূসর রঙের একটি পাথর ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি তার কাছে। মানুষ সৌরজগত থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক শতক আগেই, চান্দিনায় মানুষের একটি কলোনি বাস করছে প্রায় পৌনে দু'শো বছর ধরে। বদরুল আলম পেশায় একজন সমাজবিজ্ঞানী। গত দশ বছর ধরে সে সৌরজগতের বাইরে মানুষের এই কলোনিগুলোর ওপর গবেষণা চালিয়ে আসছে। চান্দিনা হবে তার রিসার্চের তালিকায় সপ্তম মানবসমাজ। বদরুলের এই গবেষণা যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি ব্যয়বহুল। অবশ্য ব্যয় নিয়ে বদরুল মাথা ঘামাচ্ছে না, পৃথিবী থেকে তার এই গবেষণার পেছনে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করা হচ্ছে। সুলেমান সাহেবের অস্বস্তিকর হাসিটা একচুল বিস্তৃত হলো শুধু, চেহারায় অন্য কোন পরিবর্তন হলো না। 'আমাদের জায়গাটা মোটেও ছোট্ট নয়, ডঃ আলম। অবশ্য প্রথম প্রথম বহিরাগতদের তাই মনে হতে পারে। হ্যাঁ, চান্দিনায় সমতল জমি খুব, খুবই কম। আপনাদের নিউইয়র্কের চারভাগের তিনভাগও হবে না। কিন্তু ডঃ আলম, চান্দিনার আয়তন কিন্তু কম নয়। আমরা চাইলেই চান্দিনার মাটি খুঁড়ে এর ভেতর সেঁধিয়ে যেতে পারি। আর পঞ্চাশ মাইল গড় ব্যাসার্ধ ধরে নিলে আমাদের হাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ ঘনমাইল আয়তন রয়েছে। পঞ্চাশ ফিট তফাত রেখে যদি চান্দিনার মাটির ভেতরে বিভিন্ন লেভেলে আমরা বসবাস করা শুরু করি, আমাদের বসবাসযোগ্য জায়গার মাপটা হবে সাড়ে পাঁচ কোটি বর্গমাইল। আপনাদের পৃথিবীর সমান। আর হ্যাঁ, ডঃ আলম, এই জায়গা আমরা কিন্তু এমনি এমনি ফেলে রাখবো না, পুরোপুরি উৎপাদনশীল করে তুলবো।' বদরুল মনে মনে একটু হোঁচট খেলো, সে এভাবে চিন্তা করে নি। শুকনো গলায় সে বললো, 'হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। চান্দিনা ছাড়া অন্য কোন গ্রহকণায় মানুষের বসতি নেই তো, তাই দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র ছাড়া চিন্তা করতে আমরা ঠিক অভ্যস্ত নই। .. .. যাকগে, আপনাদের কাউন্সিলের সহযোগিতা পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি।' সুলেমান সাহেব মাথা নাড়লেন, তার চেহারা থেকে অস্বস্তিটা কিছুতেই দূর হচ্ছে না। বদরুল মনে মনে ভাবলো, ব্যাটা আমার আসাটাকে ভালো চোখে দেখছে না। অবশ্য এ জিনিসটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়, এর আগেও দু'তিনটা কলোনিতে বদরুল এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। 'অবশ্য,' সুলেমান সাহেব আবার শুরু করলেন, 'চান্দিনার খুব অল্প জায়গায় এই ধরনের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের লোকসংখ্যা খুব একটা বেশি না, তাই প্রয়োজনও পড়েনি। তাছাড়া আমাদের যন্ত্রপাতির ধারণক্ষমতাও খুব বেশি না।' 'বুঝতে পারছি। কিন্তু সুলেমান সাহেব, আমি শিগগীরই কাজ শুরু করে দিতে চাই। আপনাদের কৃষি আর পশুপালনের সেক্টরটা দিয়ে শুরু করবো ভাবছি।' সুলেমান সাহেব কৌতুক করার চেষ্টা করলেন, 'মানুষ বাদ দিয়ে শুরুতেই পশু? পশু কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?' বদরুল হাসলো। 'না না, ব্যাপারটা ঠিক তা না। তবে মাটির নিচে এই কাজগুলো কিভাবে করা হচ্ছে, সেটা দেখার কৌতূহল সামলাতে পারছি না।' সুলেমান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। 'আমাদের এখানে গরু-ছাগলগুলো সম্ভবত আপনাদের পৃথিবীর প্রাণীগুলোর চেয়ে আকারে একটু ছোট। আর ধান, গমও খুব একটা বেশি নেই। তবে আমরা প্রচুর ঈস্ট ফলাই। আমাদের এখানে কিছু তুলার প্ল্যান্টেশন আছে, আর তামাক তো দেখতেই পাচ্ছেন। ফলের গাছও দেখতে পাবেন।' 'হুম।' শেষ ধোঁয়াটুকু ছেড়ে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলো বদরুল। 'তাহলে তো আপনাদের স্বনির্ভর বলতেই হচ্ছে। .. .. ভালো কথা, আপনারা তো সব রিসাইকেল করেন, নাকি?' সুলেমান সাহেব যে একটু চমকে উঠেছেন, সেটা বদরুলের চোখ এড়ালো না। চান্দিনার কাউন্সিলরের চোখ দু'টো সরু হয়ে এলো। তিনি ভারি গলায় বলতে শুরু করলেন, 'হ্যাঁ। আমাদের সবকিছুই রিসাইকেল করতে হয়। বাতাস, পানি, খাবার, খনিজ .. .. যা কিছু আমরা ব্যবহার করি, সবকিছু রিসাইকেল করে আবার কাঁচামালে পরিণত করা হয়। শুধু বেশ খানিকটা শক্তির প্রয়োজন হয়, আর জোনাকিতারার কল্যাণে সেটা আমাদের অঢেল আছে। অবশ্য পুরোপুরি রিসাইকেল করা কখনোই সম্ভব না, খানিকটা অপচয় সব সময়ই হচ্ছে, বুঝতেই পারছেন। প্রতিবছর আমরা সামান্য পানি আমদানী করি শুধু। আর ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে .. ..,' গলা খাঁকারি দিলেন তিনি, 'আমরা হয়তো খানিকটা তেল আর অক্সিজেনও আমদানী করা শুরু করবো।' বদরুল পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। 'তো সুলেমান সাহেব .. .. কখন থেকে জরিপ শুরু করবো?' সুলেমান সাহেবের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠতে শুরু করেছিলো, সেটা সামান্য মিইয়ে গেলো প্রশ্নটা শুনে। 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ডঃ আলম। কিছু রুটিন কাজ আছে, সেগুলো সেরে।' বদরুল মনে মনে ভাবলো, কিসের রুটিন কাজ? প্রথমে যখন যোগাযোগ করা হয়েছিলো, তখন তো সুলেমান প্রায় লাফাচ্ছিলো। মহাকাশের কোন এক চিপায় ছোট্ট একটা গ্রহকণা চান্দিনা, তাকে এতো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে কাউন্সিলর খুব গদগদ ভাব দেখাচ্ছিলো। আর এখন ব্যাটা উসখুস করছে খালি। 'যে কাজ নিয়ে আমি এখানে এসেছি, আপনাদের সমাজে আবার কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না তো?' বদরুল বাজিয়ে দেখার জন্যে প্রশ্ন করলো। সুলেমান সাহেব কোন রকম দ্বিধা না করেই বললেন, 'দেবে। চান্দিনার রীতিনীতি একটু অন্যরকম, বুঝতেই পারছেন। এখানে প্রতিটি চান্দিনাবাসীর নির্দিষ্ট একটি .. ..ইয়ে, কি বলে ... পরিচয় এবং মর্যাদা আছে। হুট করে বাইরের কেউ চলে এলে পরিস্থিতি কিছুটা নাজুক হয়ে পড়তে পারে।' বদরুল 'পরিচয়' এবং 'মর্যাদা' কথাটার মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ খুঁজে পেলো। 'আপনাদের এখানেও তাহলে সেই প্রাচীন গোত্র বা বংশ রীতি চালু আছে?' সুলেমান সাহেব ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন। 'খুব ভালো করেই আছে।' 'আপনার কি মনে হয় না ব্যাপারটা কিছুটা অযৌক্তিক?' সুলেমান সাহেব অবিচলিত গলায় বললেন, 'হয়তো, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় নয়। আমাদের সমাজে এটার দরকার রয়েছে। এখানে বিয়েশাদির ক্ষেত্রে এই গোত্রের প্রথা খুব কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এমনকি চান্দিনাবাসীদের চাকরি আর ব্যবসার ক্ষেত্রেও বংশের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। অনেক কাজ আছে, যেগুলো নির্দিষ্ট কিছু বংশের লোক পুরুষানুক্রমে করে আসছে। এখানে প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্যে একটি নির্দিষ্ট পরিচয় ও দায়িত্ব রয়েছে। তারা সেটা জানে, মেনে নেয় এবং সেটার সাথে মানিয়ে নেয়। এ কারণেই আমাদের এখানে কোন ধরনের দুর্নীতি নেই।' 'সবাই মানিয়ে নেয়?' বদরুল কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো। সুলেমান সাহেব খুব সম্ভবত 'না' বলার জন্যে মুখ খুলেছিলেন, মাঝপথেই কথাটা গিলে ফেললেন তিনি। তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো তিনি মহা অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। 'আপনার বোধহয় বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। তারপর আপনাকে আমি ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করছি।' বদরুল উঠে দাঁড়ালো, তারপর সুলেমান সাহেবের সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ২. কোথাও না কোথাও একটা ভ্যাজাল আছে, সুলেমান সাহেবের সাথে আলাপ শেষ করে বদরুল সিদ্ধান্তে পৌঁছুলো। খবরের কাগজ পড়ে তার এই ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো। ঘুমোতে যাওয়ার আগে কাগজটা নিয়ে বসেছিলো বদরুল। আট পাতার সিনথেটিক কাগজে ছাপানো একটা ট্যাবলয়েড, নাম আজকের চান্দিনা। প্রথম দু'পাতা জুড়ে নানারকম ব্যক্তিগত খবরাখবর, শুভ বিবাহ, জন্ম সংবাদ আর মৃত্যু সংবাদ, কোথায় কোথায় নতুন বাসযোগ্য জায়গা খোঁড়া হচ্ছে তার বিবরণ, জিনিসপত্রের দাম কেমন বাড়লো বা কমলো ইত্যাদি হরেক রকম বিজ্ঞপ্তি। বাকিটুকু নানারকম জ্ঞানগর্ভ রচনা। বদরুল উল্টেপাল্টে দেখলো, নানারকম শিক্ষামূলক প্রবন্ধ আর গল্প-কবিতাও রয়েছে। কিন্তু খবর বলতে যা বোঝায়, অন্তত বদরুল খবর বলতে যা বোঝে, তার কিছুই নেই। শেষ পাতায় এসে একটা হেডিং-এর ওপর বদরুলের চোখ আটকে গেলো। দাবি অপরিবর্তিত গতকালের মতো আজও তার কার্যকলাপে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রধান কাউন্সিলর তাঁর দ্বিতীয় দফা আলোচনার পর জানিয়েছেন যে, তার দাবি দাওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এবং কোন প্রকারেই সেসব দাবি পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। চান্দিনাবাসী তার ইশারায় ওঠবস করবে না বলে আজকের চান্দিনার সম্পাদকমন্ডলী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। খবরের এ অংশটুকু বদরুল পরপর তিনবার পড়লো। তার কার্যকলাপ, তার দাবি, তার ইশারা। কার? বদরুল মনের মধ্যে একটা খচখচানি নিয়ে সে রাতে ঘুমুতে গেলো। ৩. এর পরের ক'টা দিন বদরুল খবরের কাগজ পড়ার মতো সময়ই পেলো না, কিন্তু সেই খচখচানিটা হঠাৎ হঠাৎ তার মনে পড়ে যেতে লাগলো। ব্যাপারটা কী? সুলেমান সাহেব বদরুলের সাথে সাথেই আছেন, কিন্তু তিনি দিনকে দিন গুটিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনটা প্রশ্ন করলে হয়তো একটার জবাব দেন, তাও অস্পষ্ট গলায়। তৃতীয় দিন, (আরো নিখুঁতভাবে বলা যায়, পৃথিবীর বাহাত্তর ঘন্টা সময় পার হবার পর) সুলেমান সাহেব বদরুলকে নিয়ে চান্দিনার এক প্রান্তে চলে এলেন। 'এই অংশটায় শুধু রাসায়নিক শিল্পকারখানা আছে। আমার মনে হয় এটা আপনার কাছে খুব একটা ভালো লাগবে না .. ..।' সুলেমান কেমন একটা ফ্যাকাসে মুখ করে দ্রুত হাঁটছিলেন, এবার তিনি উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বদরুল কনুইয়ের কাছটায় তাঁর হাত ধরে ফেললো। 'এখানে কী তৈরি করা হয়?' সুলেমান সাহেব শক্ত মুখ করে মৃদু গলায় বললেন, 'সার। আরো কিছু কিছু জৈব প্রোডাক্ট।' বদরুল সুলেমান সাহেবের হাত ধরে রেখেই সামনে দেখার চেষ্টা করলো। সামনে চান্দিনার মলিন দিগন্ত, আর সুসজ্জিত পাথরের সারি। এর মাঝখানে অনেকগুলো বিল্ডিং। সুলেমান সাহেব সেই বিল্ডিংগুলোর দিকে পেছন ফিরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বদরুল ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আমি কিন্তু একটা কোয়ার্টার দেখতে পাচ্ছি। ঐ তো, ওখানে।' আঙুল দিয়ে বিল্ডিংগুলোর দিকে দেখালো সে। সুলেমান সাহেব সেদিকে তাকালেন না। বদরুল মনোযোগ দিয়ে আরো কিছুক্ষণ দেখলো, তারপর বললো, 'এ তো বিশাল কোয়ার্টার। আমি তো এতোবড়ো বাড়ি এখানে আগে দেখিনি। কারখানা এলাকায় এতো বড় বাড়ি কেন?' এর আগে সে দেখেছে, চান্দিনার সবকিছু তিনটা ভাগে ভাগ করা। কৃষি, শিল্প আর আবাস। কৃষি এলাকায় কোন বাড়িঘর তার চোখে পড়েনি। শিল্প এলাকায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন? সুলেমান সাহেবের কোন উত্তর না পেয়ে সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো, তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটা ধরেছেন। বদরুল প্রায় ছুটতে ছুটতে তাঁর সঙ্গ ধরলো। 'কী ব্যাপার, সুলেমান সাহেব, কোন সমস্যা?' হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো সে। সুলেমান সাহেব থামলেন না, বিড়বিড় করে বললেন, 'আমি .. .. আমি দুঃখিত। আমি জানি, এমন করাটা অভদ্রতা। কিন্তু .. .. আমার আসলে খুব সমস্যা যাচ্ছে ক'দিন ধরে .. ..।' 'তার দাবি দাওয়া নিয়ে?' বদরুল খোঁচা দিলো। সুলেমান সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। 'আপনি এ ব্যাপারে কী কী জানেন?' 'যা বললাম তার চেয়ে বেশি কিছু না। আপনাদের খবরের কাগজে এ ব্যাপারে এটুকুর চেয়ে বেশি কিছু লেখেনি।' সুলেমান বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। বদরুল কথাটা ধরতে পারলো না। 'কী বললেন? চৌধুরী? সেটা কী?' সুলেমান সাহেব ভারি একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। 'আমার মনে হয় আপনাকে সব খুলে বলাটাই উচিত ছিলো। ব্যাপারটা .. .. ব্যাপারটা খুবই বাজে, আর .. .. অস্বস্তিকর। আমরা ভেবেছিলাম, আপনি আসার আগেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আর আপনার কোন সমস্যাও হবে না .. .. কাজেই জিনিসটা আপনাকে না জানালেও কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু এখন প্রায় এক হপ্তা হয়ে গেলো, সমস্যাটার কোন কিনারা হচ্ছে না। এরপর যে কি হবে, আমি বুঝতে পারছি না। যদি কোন সমাধান না হয়, আপনার বোধহয় চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। আমরা চাই না, বহিরাগত কেউ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এখানে থাকুক।' বদরুল একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসলো। 'মৃত্যুর ঝুঁকি? আপনাদের এই নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট জায়গায়? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।' চান্দিনার কাউন্সিলরের মুখটা মলিন হয়েই রইলো। 'বুঝিয়ে বলছি। সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে মনে হচ্ছে।' মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি, তারপর বললেন, 'আপনাকে বলেছিলাম না, চান্দিনার সবকিছুই রিসাইকেল করতে হয়?' 'হ্যাঁ।' 'এর মধ্যে .. .. ইয়ে .. .. মানুষের বর্জ্যও রয়েছে।' সুলেমান সাহেবের মুখ কুঁচকে গেলো। 'আমিও ধরে নিয়েছিলাম, এরকম কিছু করা হয়।' বদরুল ব্যাপারটার মধ্যে কোন দোষ খুঁজে পেলো না। 'ওগুলো থেকে পানি তৈরী করা হয়। ডিস্টিলেশানের মাধ্যমে। যা বাকি থাকে, সেগুলো ঈস্টের সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য জৈব প্রোডাক্ট তৈরীতেও এসব .. .. জিনিস ব্যবহার করা হয়। এখানে যে সব কারখানা দেখছেন .. ..,' বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছনে দেখালেন সুলেমান সাহেব, 'এখানেই সেসব করা হয়।' 'তো?' প্রথম প্রথম চান্দিনায় এসে বদরুলের পানি খেতে কিছুটা সমস্যা হতো, কারণ পানিটা কোত্থেকে আসছে বুঝতে তার খুব একটা সমস্যা হয় নি। তবে এই অনুভূতিটা কাটিয়ে উঠতে তার সময় লাগেনি। পৃথিবীতেও এভাবেই খাওয়ার অযোগ্য জিনিস থেকে পানি ফিল্টার করা হয়। পদ্ধতিটা প্রাকৃতিক বলে মানুষের ততটা গায়ে লাগে না। সুলেমান সাহেব যে প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করছেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। 'নানা চৌধুরী এই কারখানার ইনচার্জ। এখানে যত কাজ আছে, সব তার তত্ত্বাবধানেই হয়। চান্দিনায় মানুষ যখন প্রথম উপনিবেশ গড়ে তুলেছে, তখন থেকেই নানা চৌধুরীদের বংশের লোকজন এই কারখানা চালিয়ে আসছে। নানা চৌধুরীর এক পূর্বপুরুষ, চান্দিনার প্রথম অভিযাত্রীদের একজন, রানা চৌধুরী, আর সে ছিলো .. .. সে ছিলো .. ..।' 'এই কারখানার প্রথম ইন চার্জ।' বদরুল সহযোগিতা করলো। 'হ্যাঁ। আপনি যে কোয়ার্টারটা দেখাচ্ছিলেন, সেটা হচ্ছে চৌধুরী ভিলা। চান্দিনার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি এটা। নানা চৌধুরীকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়, যা আমরা কখনো পাই না। কিন্তু .. ..,' সুলেমান সাহেব গাঢ় স্বরে বললেন, 'আমরা কখনোই তার সাথে কথা বলি না।' 'কী?' 'নানা চৌধুরী সামাজিকভাবে আমাদের সমকক্ষ হতে চায়।' তিক্ত গলায় বললেন সুলেমান সাহেব। 'সে চায়, তার ছেলেমেয়েরা যেন আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে পারে। সে চায়, আমাদের ঘরের বৌরা যেন তার পরিবারের মেয়েদের সাথে মেশে .. .. ছিহ্।' বদরুল সুলেমান সাহেবের কন্ঠে ঘেন্না ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলো না। ব্যাপারটা তার কাছে এখন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে। এমনকি খবরের কাগজে নানা চৌধুরীর নামটা পর্যন্ত ছাপা হয়নি! 'আমার ধারণা, তার পেশার কারণে আপনারা নানা চৌধুরীর বংশটিকে কিছুটা নিচু বলে ধরে নিচ্ছেন?' বদরুল ব্যাপারটা খোলাসা করতে চাইলো। 'অবশ্যই। যে লোক মানুষের ইয়ে .. ..।' সুলেমান সাহেব ভাষা হারিয়ে ফেললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের মিহি ঘাম মুছে তিনি বললেন, 'আপনি পৃথিবীর মানুষ, আপনি বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝবেন না। আপনার বোঝার কথাও না।' 'একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আপনাদের সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি।' বদরুল সহানুভূতি নিয়ে বললো। পৃথিবীতেও এমন ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। প্রাচীন ভারতে মৃতদেহের সৎকার করতো যারা, তাদেরকেও এমনিভাবে চন্ডাল নাম দিয়ে অস্পৃশ্য করে রাখা হতো। বহু প্রাচীন কালের এশিয়া মাইনরের শুকরপালকদের সামাজিক ইতিহাস জানে বদরুল, সেসব ইতিহাস এখন তার মনে পড়ে গেলো। বদরুল অবশ্য এটুকু জেনেই চুপ করে রইলো না। 'চান্দিনার লোকজন নিশ্চয়ই তার, মানে, নানা চৌধুরীর এসব দাবি মেনে নেবে না?' কখনো মেনে নেয়া হয় না, সে জানে। 'কখনোই না।' সুলেমান সাহেব খুব জোর দিয়ে বললেন। 'কক্ষণো না।' 'তাহলে?' 'নানা চৌধুরী আমাদের হুমকি দিয়েছে, তার দাবি মেনে নেয়া না হলে সে সব কাজকর্ম বন্ধ করে দেবে।' 'মানে, সে হরতাল করবে?' 'হ্যাঁ।' 'তাতে কি খুব একটা সমস্যা হবে আপনাদের?' 'আমাদের হাতে অনেক খাবার আর পানি মজুদ আছে।' আবার ঘাম মুছলেন সুলেমান। 'নূতন করে তৈরী করার তেমন একটা প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু আমাদের .. .. বর্জ্যগুলো জমতে শুরু করবে। আর একবার জমতে শুরু করলে বিশাল একটা সমস্যা দেখা দেবে।' 'কী রকম?' 'চান্দিনায় অসুখবিসুখ খুব একটা হয় না। একদম শুরু থেকেই কড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিলো। কিন্তু এ কারণেই সমস্যাটা হয়ে গেছে। চান্দিনার মানুষদের প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম। বর্জ্যগুলো জমতে শুরু করলে গোটা গ্রহকণায় রোগ জীবাণুর প্রকোপ দেখা দেবে। একবার যদি কোন মহামারী শুরু হয়, আমরা কয়েকদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।' 'নানা চৌধুরী এ কথা জানে?' 'অবশ্যই জানে।' 'তারপরও কি আপনার মনে হয় যে সে হরতাল চালিয়ে যাবে?' 'সে এখন উন্মাদ। সত্যি কথা বলতে কি, সে ইতিমধ্যে কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি যেদিন চান্দিনায় পৌঁছুলেন, তার আগের দিনই সে এই রিসাইকেল করা সে বন্ধ করে দিয়েছে।' সুলেমান সাহেব এমনভাবে নাক কুঁচকালেন, যেন তিনি আকাশে বাতাসে মানুষের পুরীষের গন্ধ পাচ্ছেন। তাই দেখে বদরুলও নিজের অজান্তে জোরে শ্বাস টানলো, তার কাছে কোন আপত্তিকর গন্ধ ধরা পড়লো না। 'এ জন্যেই আমি বলছি, আপনি বরং চলে যান।' সুলেমান সাহেব অনুনয়ের সুরে বললেন। 'আমি জানি, এমন অনুরোধ করাটা অপমানকর, কিন্তু সেটাই আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে।' বদরুল কথাটাকে পাত্তা দিলো না। 'বলেন কী? এখনই চলে যাবো? আমি একজন সমাজবিজ্ঞানী, আর এ সব ঘটনাই তো আমার গবেষণার খোরাক। আমি তো রীতিমতো উৎসাহ পাচ্ছি।' একটু থেমে যোগ করলো সে, 'আমি কি নানা চৌধুরীর সাথে কথা বলতে পারি?' 'কোন ভাবেই না।' সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললেন সুলেমান সাহেব। 'কিন্তু দেখুন, সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে ভালো করে বুঝতে হলে এ নিয়ে দু'পক্ষের সাথেই আলোচনা করতে হবে। এখানে এখন যা ঘটতে যাচ্ছে, তা একেবারেই বিরল একটি ঘটনা। এই বিশ্বের অন্য কোথাও মানুষের বিষ্ঠা নিয়ে এতো টানাটানি হয়নি .. ..', বদরুল উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, 'বুঝতেই পারছেন, আমি চান্দিনা ছাড়া অন্য কোথাও এমন পরিস্থিতি পাবো না। কাজেই বিজ্ঞান আর গবেষণার খাতিরে .. ..।' 'কথা বলবেন?' নাক সিঁটকে রইলেন সুলেমান সাহেব। 'ভিডিফোন হলে চলবে?' 'হ্যাঁ।' স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বদরুল। 'ঠিক আছে। আমি কাউন্সিলে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে দেখবো।' বিড় বিড় করে আরো কীসব যেন বললেন সুলেমান সাহেব, বদরুল বুঝতে পারলো না। খুব সম্ভবত তার রুচি নিয়েই কিছু বলছেন কাউন্সিলর। ৪. তাঁরা সবাই বদরুলকে ঘিরে বসে আছেন। তাদের শান্ত, সৌম্য ও অভিজাত চেহারাগুলো কী এক নিদারুণ অস্বস্তিতে বিকৃত হয়ে আছে। তাঁদের মাঝখানেই বসে আছেন সুলেমান সাহেব, বদরুলের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছেন না। প্রধান কাউন্সিলর অনেক বয়স্ক একজন মানুষ। মাথা ভর্তি রূপালী চুল, মুখের চামড়া কুঁচকে রয়েছে, ভদ্রলোক বেশ রোগা। 'আপনি যদি কোনভাবে তাকে প্রভাবিত করতে পারেন, ডঃ আলম, আপনার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে, আমরা খুশি হবো।' থেমে থেমে, নরম গলায় বললেন তিনি। 'কিন্তু, কোনক্রমেই, তাকে এমন কোন ধারণা দেবেন না, যাতে সে ধরে নেয়, আমরা তার কথায় রাজি হবো।' সমস্ত কাউন্সিল আর বদরুলের মাঝখানে একটা ভারি, অস্বচ্ছ পর্দা ধীরে ধীরে নেমে এলো। বদরুল তার ভেতর দিয়ে কারো চেহারাই দেখতে পাচ্ছিলো না। সে তার সামনের ছোটো রিসিভারটার দিকে ঘুরলো, তারপর সেটা অন করলো। রিসিভারে বদরুল একটা বিশাল মাথা দেখতে পেলো। শ্যামলা রঙ, চৌকো থুতনি, আর মোটা মোটা ঠোঁট নানা চৌধুরীর মধ্যবয়স্ক চেহারায় একটা শক্তির ছাপ এনে দিয়েছে। 'কে তুমি?' সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ভেসে এলো। বদরুল নরম গলায় বললো, 'আমার নাম বদরুল আলম। আমি পৃথিবী থেকে এসেছি।' 'অর্থাৎ, একজন বহিরাগত?' 'হ্যাঁ। আমি চান্দিনায় এসেছি বিশেষ কিছু কাজে। আপনি নানা চৌধুরী?' 'নানা জসিম চৌধুরী, আপনার সেবায় নিয়োজিত।' ব্যঙ্গের সুরে বললো নানা চৌধুরী। 'ঝামেলা একটাই, আপাতত কোন সেবা চলছে না। ভবিষ্যতেও চলবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।' বদরুল আরো নরম গলায় বললো, 'আপনি কি জানেন, চান্দিনা এখন কত বড় বিপদের মুখে রয়েছে? যে কোন মূহুর্তে মহামারী দেখা দিতে পারে। পরিস্থিতি এখন খুব বিপজ্জনক।' 'তাদের পরিস্থিতি বিপজ্জনক।' নিমেষে নানা চৌধুরীর মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। 'আমাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হোক, আমি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি।' 'আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি যথেষ্ঠ শিক্ষিত একজন মানুষ, চৌধুরী সাহেব।' 'তো?' 'আমি শুনেছি, আপনার আরামআয়েশের ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি নেই। আপনি চান্দিনার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়িটিতে বাস করছেন। চান্দিনার যে কোন মানুষের চেয়ে আপনি ভালো খাবার খাচ্ছেন, ভালো কাপড় পড়ছেন। আপনার ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে ভালো শিক্ষা পাচ্ছে।' 'মানলাম। শিক্ষা তারা পাচ্ছে, একেবারে হাড়ে হাড়ে পাচ্ছে।' নানা চৌধুরীর মুখ দেখে মনে হলো সে রাগে ফেটে পড়বে এখন। 'সেই শিক্ষা দেয়ার দায়িত্বে কারা আছে জানো? রোবটরা। যতো অনাথ মেয়ে শিশুদের পাঠানো হয় আমাদের কাছে, যাতে তারা বড় হয়ে আমাদের বাড়ির বৌ হতে পারে। সারা জীবন একা একা থাকে বলে তারা বেশিদিন বাঁচেও না। কেন?' আচমকা রূদ্ধ গলায় বলতে লাগলো নানা চৌধুরী। 'কেন আমাদের বছরের পর বছর একা একা থাকতে হয়? আমরা তো কোন দানব নই যে মানুষের সাথে আমরা মিশতে পারবো না! আমরা কি মানুষ নই? আমাদের কি আর সবার মতো একই রকম অনুভূতি আর অভিলাষ নেই? আমাদের কি আর সবার মতো শখ-আহ্লাদ নেই? আমরা কি যথেষ্ঠ গুরুত্ব আর সম্মানজনক একটা কাজ করি না?' বদরুলের পেছনে অনেকগুলো চাপা, অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেলো। নানা চৌধুরী সে আওয়াজ শুনে বললো, 'আচ্ছা, তাহলে কাউন্সিলের লোকজনও এখানে আছে।' তার কণ্ঠস্বরে প্রবল বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো। 'এই যে ভদ্রলোকেরা, আমার কথার জবাব দিন। আমাদের কাজটা কি যথেষ্ঠ গুরুত্ব আর সম্মানজনক নয়? আপনাদের গু থেকে আমরা আপনাদের জন্যেই খাবার তৈরী করি। দোষটা কার বেশি, যে নোংরা জিনিস তৈরী করে, তার, নাকি যে সেই নোংরা পরিশোধন করে, তার? হ্যাঁ?' কোন জবাব এলো না। 'শুনে রাখুন আপনারা!' ক্ষিপ্ত গলায় বললো নানা চৌধুরী। 'আমি কোনভাবেই হাল ছাড়বো না। মরে যাক, নোংরা কোন অসুখে ভুগে চান্দিনার সব ভন্ড ইতরগুলো মরে যাক! শালাদের গু নিয়ে অনেক ভুগেছি, আর না। দরকার হলে আমি আর আমার পরিবারের সবাই মরবো, কিন্তু আমার দাবি আমি তুলে নেবো না। এখন যেভাবে বেঁচে আছি, তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।' বদরুল একটু নাক গলালো, 'আপনি তো জন্মের পর থেকেই এ পেশায় নিয়োজিত, তাই না?' 'যদি তাই হয়ে থাকি?' 'এতদিনে আপনি নিশ্চয়ই এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন?' 'কক্ষণো না।' চটে গেলো নানা চৌধুরী। 'আমি এই জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছি। আমার বাবাও বাধ্য হয়েছিলেন, সম্ভবত আমার দাদাও তা-ই। এতদিন আমি বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছি। কিন্তু এখন আমি আমার ছেলেকে দেখছি। আমার একমাত্র ছেলে, অবোধ শিশু মাত্র, তার কোন খেলার সাথী নেই। আমার তবুও একটা ভাই ছিলো, আমরা মিলেমিশে বড় হয়েছিলাম, আমার ছেলেটার তা-ও নেই। আমি এখন আর মুখ বুঁজে সহ্য করবো না। চান্দিনার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। .. .. আর শোনো বাইরের লোক, তোমার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।' রিসিভারটা নীরব হয়ে গেলো। বদরুল উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো, কাউন্সিলের সদস্যদের সবার চেহারা ফ্যাকাসে। সবচেয়ে বেশি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে প্রধান কাউন্সিলরকে। তিনি আর সুলেমান সাহেব বদরুলকে এগিয়ে দিতে এলেন। 'লোকটা বদ্ধ পাগল।' রুদ্ধ গলায় বললেন প্রধান কাউন্সিলর। 'একে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়, আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না।' বদরুল এই প্রথম খেয়াল করলো, প্রধান কাউন্সিলরের হাতে একটা গ্লাস, তাতে লালচে একটা তরল। তাঁর ধবধবে সাদা স্যুটেও লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। ওয়াইন খেতে গিয়ে ছলকে পড়েছে বোধহয়। বদরুল আচমকা বলে ফেললো, 'আচ্ছা, নানা চৌধুরীর দাবিগুলো কি খুব অন্যায় কিছু? তাকে সমাজে মিশতে দিলে কী হবে?' কথাটা বলেই সে বুঝলো, ভুল হয়েছে। সুলেমান সাহেব এক মূহুর্তে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন, 'একজন .. .. বিষ্ঠার ইয়েকে আমাদের সমাজে .. ..।' নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, 'যাকগে, আপনি তো পৃথিবীর লোক।' হঠাৎ করে বদরুলের মনে পড়লো, বিংশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে বিধবা মহিলাদেরকে স্থানীয় মৌলবাদীরা নানাভাবে অত্যাচার করতো, তার মধ্যে একটি হচ্ছে একঘরে করে রাখা। যে প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে তা করা হতো, সেটাকে বলা হতো ফতোয়া জারি করা। পাঁচশো বছর পর নানা চৌধুরীকে একরকম ফতোয়া দিয়েই একঘরে করে রাখা হচ্ছে। বদরুলের মাথায় একটা সন্দেহ খেলে গেলো। 'আচছা, নানা চৌধুরী কি সরাসরি এই .. .. বিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে? মানে, আমি জানতে চাইছি যে, বিষ্ঠার সাথে তার শারীরিক সংস্পর্শ হয় কি না।' প্রধান কাউন্সিলর আর সুলেমান সাহেব, দু'জনেই শিউরে উঠে চোখ বুঁজলেন। বদরুল কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো, অতটা ঝামেলা বোধহয় চৌধুরী বেচারাকে করতে হয় না। 'নিশ্চয়ই সব কাজ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে করানো হয়?' 'নিশ্চয়ই।' 'তাহলে নানা চৌধুরীর কাজটা কী?' 'সে যন্ত্রপাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।' প্রধান কাউন্সিলর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন। 'কাজগুলো কতটা দ্রুত করা হবে, কিভাবে করা হবে, সেগুলো সে দেখে। দিনের একেক সময় একেক রকম পারফরম্যান্স দরকার হয়, সেগুলো সে দেখাশোনা করে। চাহিদা অনুযায়ী সে উৎপাদনের হার পরিবর্তন করে।' তিনি শুকনো, বিষণ্ণ গলায় বললেন, 'আমাদের যদি আরো বেশি জায়গা থাকতো, তাহলে এই গু ঘাঁটার যন্ত্রগুলো আরো বড়, আরো জটিল করে তৈরী করা যেতো, যাতে সরাসরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমাদের জায়গা নেই। তাই আর খামোকা অপচয় করা হয়নি।' 'কিন্তু তাই যদি হয়,' বদরুল জোর দিয়ে বললো, 'নানা চৌধুরী কেবল নানারকম সুইচ নিয়ে কাজ করে? নিজের হাতে তো তাকে ইয়ে করতে হচ্ছে না?' 'হ্যাঁ।' 'তাহলে চান্দিনার অন্যান্য মানুষের সাথে তার তফাৎটা কী?' সুলেমান সাহেব দৃঢ় গলায় বললেন, 'ডঃ আলম, আপনি একজন নামকরা সমাজবিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ হিসেবে এই ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারবেন না।' 'এই সমস্যার কারণে আপনারা আপনাদের লোকজনের মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছেন?' 'আমাদের আর কিছু করার নেই।' সুলেমান সাহেবের গলায় এমন যন্ত্রণার আভাস ছিলো, বদরুল বুঝলো, গোটা পরিস্থিতিটাই এঁদের জন্যে পীড়াদায়ক, কিন্তু এঁদের আসলেই আর কিছু করার নেই। বদরুল কিছুটা বিরক্ত হয়ে কাঁধ ঝাঁকালো, 'তাহলে হরতাল ভেঙে দিন। শায়েস্তা করুন নানা চৌধুরীকে।' 'কীভাবে?' প্রধান কাউন্সিলর হাতের গ্লাসটা থেকে সমস্ত ওয়াইন ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। 'কে যাবে তাকে শায়েস্তা করতে? তার কাছে কেউ যাবে না। আর যদি দূর থেকে বোমা ফেলে তাকে খতম করে দেয়া হয়, তাতেই বা আমাদের লাভটা কী?' বদরুল মনে মনে ভাবলো, এরা দেখি শায়েস্তা বলতে খুনজখম ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সে ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করলো, 'নানা চৌধুরীর যন্ত্রপাতিগুলো কীভাবে চালাতে হয় আপনি জানেন?' প্রধান কাউন্সিলর একটা ছোট কাউচে বসে পড়েছিলেন, নিমেষে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। 'আমি?' হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন তিনি। 'না না না।' বদরুল আর্তনাদ করে উঠলো। 'আমি আপনি বলতে আপনাকে বোঝাইনি। ওটা আসলে বলার জন্যে বলা। চান্দিনার কোন মানুষ কি জানে কিভাবে ঐসব যন্ত্র চালাতে হয়?' প্রধান কাউন্সিলর কিছুটা শান্ত হলেন। 'কারখানার হ্যান্ডবুকে লেখা আছে, সম্ভবত। কিন্তু এই আপনাকে বলে রাখছি, এসব নিয়ে আমি কক্ষণো মাথা ঘামাইনি। কখনোই না।' 'তাহলে ঐ হ্যান্ডবুক পড়ে, যন্ত্রপাতিগুলো কিভাবে কাজ করে, সেটা শিখে নেয়া যায় না? তাহলে তো নানা চৌধুরী কাজ না করলেও কোন সমস্যা নেই, তার বদলে অন্য কেউ করতে পারে।' সুলেমান সাহেব আঁতকে উঠলেন। 'কে করবে ঐ কাজ? আমি অন্তত করবো না। কখনোই না।' বদরুল মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীতে এমন ট্যাবু কী কী থাকতে পারে? নরমাংস ভোজন? ঈশ্বরকে গালাগালি করা? সে বিরক্ত গলায় বললো, 'কিন্তু নানা চৌধুরী যদি এখন মারা যেতো, আপনারা কী করতেন? নিশ্চয়ই এই পদে অন্য কাউকে চাকরি দিতেন?' 'তাহলে তার ছেলে আপনাআপনি সেই পদে বহাল হয়ে যেতো। ছেলে না থাকলে অন্যান্য যেসব আত্মীয় আছে, তাদের কেউ। এমনি করেই জিনিসটা বংশানুক্রমে হয়ে আসছে।' 'যদি তার কোন প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয় না থাকতো?' 'সেরকম কখনো ঘটেনি। সেরকম কখনো ঘটবেও না।' ছেলেমানুষের মতো বললেন সুলেমান সাহেব। 'আর সেরকম কিছু হবার সম্ভাবনা থাকলে,' ভেবে চিন্তে যোগ করলেন প্রধান কাউন্সিলর, 'আমরা কোন শিশুকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম, বড় হয়ে এই কাজ করার জন্যে।' 'আচ্ছা।' বদরুল মহা বিরক্ত হলো। 'সেই শিশুটাকে আপনারা বাছাই করতেন কিভাবে?' 'যেসব শিশুর মা নেই, তাদের মধ্য থেকে। যেভাবে আমরা চৌধুরীদের জন্যে কনে বাছাই করি, সেভাবে।' চটপট জবাব দিলেন প্রধান কাউন্সিলর। 'তাহলে এখনই একগাদা শিশু বাছাই করে ফেলুন। ভবিষ্যতে যাতে নানা চৌধুরীর বিকল্প নিয়ে কোন টানাটানি না পড়ে।' বদরুল চটে গিয়ে বললো। 'অসম্ভব।' প্রধান কাউন্সিলর দৃঢ় গলায় বললেন, 'আমরা কখনোই কনে ছাড়া অন্য কোন ভূমিকায় কোন শিশুকে পাঠাই না। যদি পাঠাতাম, তাহলে ঐ পাগলটার দাবি মেনে নিতে আর কী অসুবিধে ছিলো? আর একটা শিশু ছোটবেলা থেকে ঐ ধরনের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, জেনেশুনে কিভাবে আমরা একাধিক শিশুকে পাঠাবো? আর পাঠালেই বা কী লাভ? ঐ শিশুকে পেলেপুষে নিজের বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে লোকটা রাজি হবে কেন? আর, তার বিকল্প হতে গেলে কম করে হলেও পনেরো বছর সময় লাগবে, আমাদের হাতে আর তিন দিন সময়ও আছে কি না আমি জানি না। এখন আমাদের প্রয়োজন কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে, যে রাজি হবে .. ..,' একটু ইতস্তত করে প্রধান কাউন্সিলর প্রথমবারের মতো নানা চৌধুরীর নাম উচ্চারণ করলেন, '.. .. এই চৌধুরীত্ব মেনে নিতে। চান্দিনায় সেরকম কোন লোক আছে বলে আমার মনে হয় না। আর কাউকে জোর করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা তো আর অমানুষ নই।' কোন লাভ নেই, বদরুল হতাশ হয়ে ভাবলো। কোন লাভ নেই, যদি না .. ..। বদরুলের মাথায় "যদি না"-এর পর আর কিছু এলো না। ৫. সেই রাতে বদরুলের চোখে আর ঘুম এলো না। নানা চৌধুরী এমন কোন মহার্ঘ্য জিনিস চায়নি। মনুষ্যত্বের মূল উপকরণই চেয়েছে শুধু। সঙ্গ, সমাজ। আর তার এই চাহিদাটুকু মেনে নেয়া না হলে তিরিশ হাজার চান্দিনাবাসীকে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে হবে। একদিকে তিরিশ হাজার চান্দিনাবাসীর কল্যাণ, অন্যদিকে একটি মাত্র পরিবারের দাবি। চৌধুরীদের প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে, তা সত্যি। কিন্তু সেই অবিচারকে সমর্থন করার শাস্তি নিশ্চয়ই মৃত্যু নয়। মৃত্যু তো এই তিরিশ হাজার মানুষের প্রাপ্য নয়। আর এই যে অবিচার, তার মাপকাঠিই বা কোথাকার? পৃথিবীর? নাকি, চান্দিনার? আর বদরুল আলমের কী ঠ্যাকা পড়েছে বিচার-অবিচার বিচার করার? সে কোথাকার কে? আর নানা চৌধুরী? এই তিরিশ হাজার লোক মারা গেলেও তার কিছু আসে যায় না। এই তিরিশ হাজার লোকের মধ্যে সেইসব নারী আর পুরুষরা রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে একটি বিশেষ সামাজিক রীতি শেখানো হয়ে আসছে। এখন এই রীতি তারা চাইলেও পরিবর্তন করতে পারবে না। এই তিরিশ হাজার লোকের মধ্যে সেইসব শিশুরাও আছে, যারা গোটা ব্যাপারটার কিছুই বোঝে না। এক পাশে তিরিশ হাজার, অন্য পাশে একটি বংশ। বদরুল ভোরের দিকে এসে সিদ্ধান্ত নিলো। মরীয়া একটি সিদ্ধান্ত। সকাল হতে না হতে সে সুলেমান সাহেবকে ফোন করলো। 'সুলেমান সাহেব, আপনি যদি একজন বিকল্পকে খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে নানা চৌধুরী বুঝবে যে আর গোঁয়ার্তুমি করে লাভ নেই, তার মতলব কাজে আসবে না। সে তখন আবার সুড়সুড় করে নিজের কাজে ফিরে যাবে .. ..।' সুলেমান সাহেব খুব অধৈর্য হয়ে বললেন, 'ডঃ আলম, এ নিয়ে তো গত রাতেই কথা হলো। আপনি তো ভালো করেই জানেন, বিকল্প কেউ নেই।' 'চান্দিনাবাসীদের মধ্যে কোন বিকল্প নেই, আমি ভালো করেই জানি।' বদরুল শান্ত গলায় বললো। 'কিন্তু আমি তো আর চান্দিনাবাসী নই। আমার এ নিয়ে কোন সংস্কার নেই। আমিই বিকল্প নানা চৌধুরী হবো।' ৬. বদরুল যতোটা না উত্তেজিতো হলো, তাঁরা উত্তেজিত হলেন তার চেয়ে অনেক বেশি। বদরুলকে অন্তত দশবার জিজ্ঞেস করা হলো, সে তার প্রস্তাবে ব্যাপারে সিরিয়াস কি না। ভোরে উঠে বদরুলের দাড়ি কামানো হয়নি, তার একটু গা গুলাচ্ছিলো। 'হ্যাঁ রে ভাই, আমি সিরিয়াস।' চটে গিয়ে বললো সে। 'আর ভবিষ্যতে নানা চৌধুরী যদি এরকম ঘাউরামি করে, আপনারা যখন খুশি বিকল্প গুবিশারদ আমদানি করে নিতে পারেন। এই দুনিয়ার আর কোথাও মানুষের বিষ্ঠা নিয়ে এমন সংস্কার নেই, ভালো পয়সা দিলে গন্ডায় গন্ডায় নানা চৌধুরী খুঁজে পাবেন।' যে চিন্তাটা বদরুলকে বিরক্ত করছিলো সেটা আর কিছু না, চান্দিনার কাউন্সিলকে সহযোগিতা করতে গিয়ে সে একজন নির্যাতিত মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অবশ্য, বদরুল নিজেকে মনে মনে প্রবোধ দিলো, একঘরে করে রাখার ব্যাপারটা বাদ দিলে নানা চৌধুরীকে একরকম রাজাবাদশাই বলা যায়। নইলে ব্যাটা যথেষ্ঠ ভালো হালেই ছিলো। বদরুলকে হ্যান্ডবুকগুলো এনে দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে সে ছয় ঘন্টা কাটিয়ে দিলো। যেহেতু প্রশ্নের জবাব দেয়ার কেউ নেই, কাজেই প্রশ্ন করেও কোন লাভ নেই। বদরুল একবার বইগুলো পড়া শেষ করে ফের গোড়া থেকে শুরু করলো। এই প্রথম সে হাড়ে হাড়ে টের পেলো, নানা চৌধুরীকে যথেষ্ঠ জটিল একটা কাজ করতে হয়। বদরুল বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো, 'যতক্ষণ আটাশ নাম্বার সহনিয়ন্ত্রকের সিগন্যাল লাল থাকবে, ততক্ষণ পনেরো নাম্বার অ্যামিটারের রিডিং জিরো থাকবে। .. .. এখন কথা হচ্ছে, সহনিয়ন্ত্রকটা কী জিনিস?' 'ওখানে নিশ্চয়ই মেশিনের ওপর লেখা থাকবে .. ..।' আমতা আমতা করে বললেন সুলেমান সাহেব। চান্দিনাবাসী অন্যান্য কাউন্সিলরেরা বোকার মতো একে অন্যের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর যে যার নখের ডগায় মনোনিবেশ করলেন। ৭. বদরুলকে কারখানার সামনে ছেড়ে দেয়া হলো। চান্দিনার নির্মাণ করপোরেশনের দেয়া একটা ম্যাপ দেখে এগোতে হবে বদরুলকে। হোঁচট খেতে খেতে ম্যাপ হাতে বদরুল এগোতে লাগলো। নানা গলি ঘুপচি ঘুরে, মাটির তলায় বিভিন্ন লেভেল পার হয়ে অবশেষে সে চৌধুরীদের কন্ট্রোলরুমে উপস্থিত হলো। কন্ট্রোল রুমের অবস্থা দেখে বদরুল আরেকটা হোঁচট খেলো, তবে মনে মনে। এতোগুলো যন্ত্রপাতি থাকবে, সেটা সে বিভিন্ন ক্রমিক সংখ্যার নমুনা দেখেই বুঝে গিয়েছিলো, কিন্তু সেসব যন্ত্র যে দেখতে এতো বিটকেল হবে, সে বুঝতে পারেনি। হ্যান্ডবুক দেখে দেখে বদরুল আটাশ নাম্বার সহনিয়ন্ত্রক খুঁজে বের করলো। অর্ধবৃত্তাকার একটা ধাতব চাকতি, মাটির মধ্যে গেড়ে বসানো, তার ওপর বিভিন্ন রঙের নির্দেশক বাতি। বদরুল নিজেকে খানিকটা আÍবিশ্বাস যোগানোর চেষ্টা করলো। কোথাও না কোথাও গাদা গাদা বিষ্ঠা জমে যাচ্ছে, তার সাথে কিছু কলকব্জাও নড়ছে। এখন তাকে শুধু বাঁধাধরা কিছু কাজ করে যেতে হবে, যাতে ময়লাগুলো আর না জমে। বদরুল শক্ত হাতে একটা লিভার ধরে টান দিলো, হ্যান্ডবুকে প্রথমে তাই করতে বলা হয়েছে। সেকেন্ডের মধ্যে মৃদু একটা গুঞ্জন শুরু হলো। আস্তে আস্তে সেই গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে মেঝে কাঁপানো গর্জনে পরিণত হলো। বদরুল প্রত্যেক ধাপে বই দেখে দেখে কাজ করতে লাগলো। গোটা কন্ট্রোল রুম বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ডায়াল আর ইনডিকেটরের আলোয় উজ্জ¡ল হয়ে উঠলো। ফ্যাক্টরির কোন এক জায়গায় জমে থাকে ময়লার স্তুপ নির্দিষ্ট প্যাসেজ ধরে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো। ৮. আচমকা একটা তীক্ষ্ম শব্দে বদরুল চমকে উঠলো, অত্যন্ত পীড়াদায়ক মনোযোগ থেকে সরে আসতে বাধ্য হতে হলো তাকে। না, কোন রকম গন্ডগোল হয়নি, তার হাতের যোগাযোগ মডিউলটি থেকে এই বদখদ শব্দটা বের হচ্ছে। বদরুল তাড়াহুড়ো করে সেটার রিসিভার অন করলো। মনিটরে নানা চৌধুরীর বিশাল মাথাটা ভেসে উঠলো। তার চোখে বিস্মিত দৃষ্টি। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি থেকে অবিশ্বাস আর বিষণ্ণতা মুছে গেলো। 'ও, এই তাহলে আসল ব্যাপার।' মৃদু, শান্ত গলায় বললো সে। 'আমি পৃথিবী থেকে এসেছি, চৌধুরী সাহেব, আমি চান্দিনার কেউ নই। এই কাজ করতে আমার কোন অসুবিধে নেই।' বদরুল ক্লান্ত গলায় বললো। 'ঠিক। তুমি চান্দিনার কেউ নও। কেন তুমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে গেলে?' 'চৌধুরী সাহেব, আমি আপনার পক্ষে। কিন্তু আমাকে এ কাজ করতেই হচ্ছে।' 'তুমি আমার পক্ষে? কেন? আর আমার পক্ষে হলে এ কাজ করছো কেন? তোমার পৃথিবীতে কি মানুষকে আমার মতোই অত্যাচার করা হয়?' 'এখন আর করা হয় না। আপনার সব যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এই চান্দিনার তিরিশ হাজার মানুষের কথাও তো চিন্তা করে দেখা উচিত।' 'চান্দিনার মানুষ আমার দাবি মেনে নিতো।' নানা জসিম চৌধুরী খুব শান্ত গলায় বললো। 'তুমি এসে আমার একমাত্র সুযোগটা নষ্ট করে দিলে।' 'তারা আপনার দাবি মেনে নিতো না।' বদরুল জোর গলায় বললো। 'আর এক অর্থে আপনিই জিতেছেন। তারা জানে আপনার অসন্তোষের কথা। এর আগে তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে, চৌধুরী বংশের কেউ কোন কারণে অসন্তুষ্ট হতে পারে।' 'এখন তারা জানলেই বা কী? তারা যেটা করবে, বাইরে থেকে তোমার মতো কাউকে ধরে নিয়ে আসবে।' বদরুল সজোরে মাথা ঝাঁকালো। এই ব্যাপারটা নিয়ে সে গত কয়েকটি তিক্ত ঘন্টা মাথা ঘামিয়েছে। 'তারা আপনার কথা জানার পর এখন আপনাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। তাদের অনেকেই ভেবে দেখবে, যে অবিচার আপনার সাথে করা হচ্ছে, তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি না। বাইরে থেকে যদি কাউকে ভাড়া করে আনা হয়, তারা ফিরে গিয়ে সমস্ত বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবে আপনার ওপর এই অত্যাচারের কাহিনী। সমস্ত মানুষ তখন আপনার কথা জানবে, আপনার পক্ষ নেবে।' 'তারপর?' নানা চৌধুরী আশ্চর্য শীতল গলায় প্রশ্ন করলো। 'পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। আপনার ছেলে বড় হতে হতে চান্দিনার পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যাবে। এমনটা আর থাকবে না।' 'আমার ছেলে বড় হতে হতে।' নানা চৌধুরী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো। 'তুমি যে ভালো পরিস্থিতির কথা বলছো, আমার ছেলে ছোট থাকতে থাকতেই সেটা আমি সৃষ্টি করতে পারতাম। যাকগে, আমি হেরে গেছি। যাও তুমি এখান থেকে। আমি কাজে ফিরে যাচ্ছি।' তার বিশাল মাথাটা খানিকটা ঝুঁকে পড়লো। বদরুল প্রচন্ড স্বস্তি আর নিষ্কৃতি বোধ করলো। 'চৌধুরী সাহেব, আপনি এখনই চলে আসুন। আপনার কাজ ফিরিয়ে নিন .. .. আর আপনার সাথে করমর্দন করতে পারলে আমি সম্মানিত বোধ করবো।' মনিটরে নানা চৌধুরীর ঝুঁকে পড়া মাথাটা পলকে সোজা হয়ে গেলো। তার বিষণ্ণ চোখে এক ধরনের অহংকার ফুটে উঠলো। 'আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছো তুমি, করমর্দনও করতে চাইছো। শোনো পৃথিবীর মানুষ, নিজের কাজে ফিরে যাও, আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। তোমার সাথে হাত মেলানোর ইচ্ছে আমার নেই।' ৯. বদরুল যে পথে এসেছিলো, সে পথেই ফিরে যেতে শুরু করলো, অবশ্যই ম্যাপ দেখে দেখে। বড় আরাম লাগছে তার। শেষ পর্যন্ত সব ঝামেলা শেষ হলো। সারারাত ঘুম হয়নি, প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে তার নিজেকে। কারখানার এলাকা থেকে বের হবার শেষ করিডোরে এসে বদরুল থমকে দাঁড়ালো। তার সামনে বিশাল একটা কর্ডন, বের হবার কোন উপায় নেই। বের অন্য কোন বিকল্প পথও নেই, সেটা বদরুল জানে। আচমকা গমগমে একটা আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠলো। 'ডঃ আলম, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি কাউন্সিলর সুলেমান।' বদরুল ওপর দিকে তাকালো। আওয়াজটা নিঃসন্দেহে ওপর থেকে আসছে, কিন্তু মাইক বা এরকম কিছু তার চোখে পড়লো না। বদরুল জবাব দিলো, 'কী ব্যাপার সুলেমান সাহেব, কোন সমস্যা? আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?' 'আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি।' জবাব এলো। বদরুল নিজের অজান্তেই চেঁচাচ্ছিলো। 'কী ব্যাপার, কোন সমস্যা? এখানে একটা কর্ডন দেখতে পাচ্ছি। নানা চৌধুরী কাজে ফেরেনি?' 'সে কাজে গেছে।' সুলেমান সাহেব থেমে থেমে বললেন। 'দুর্যোগের অবসান ঘটেছে। আপনাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। বদরুল মহা বিরক্ত হয়ে বললো, 'আমি তো যেতেই চাচ্ছি। এখানে কর্ডন দিয়েছেন কেন? সরানোর ব্যবস্থা করুন।' সুলেমান সাহেব থেমে থেমে বললেন, 'ডঃ আলম, আপনাকে এক্ষুণি চান্দিনা ত্যাগ করতে হবে। 'চান্দিনা ত্যাগ করতে হবে?' বদরুল হতভম্ব হয়ে গেলো। 'হ্যাঁ। আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে একটি মহাকাশযান এই মূহুর্তে তৈরী রয়েছে।' 'মহাকাশযান?' বদরুল কিছুই বুঝতে পারছে না। 'আরে ভাই, আমার তো এখনও ড্যাটা সংগ্রহ করা হয়নি।' 'এ ব্যাপারে আপনাকে আমি সহযোগিতা করতে পারছি না। আপনাকে এক্ষুণি মহাকাশযানে চলে যেতে হবে। সেখানে আপনার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রোবটদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হবে। আমাদের অনুরোধ .. .. আমাদের অনুরোধ .. ..।' একটা ব্যাপার বদরুলের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। 'কী অনুরোধ?' 'আমাদের অনুরোধ, আপনি পথে কোন চান্দিনাবাসীর সাথে দেখা করবেন না, কিংবা কথা বলবেন না। এবং,' সুলেমান সাহেব জোর দিয়ে বললেন, 'ভবিষ্যতে কখনও চান্দিনায় ফিরে আসার চেষ্টা করে আমাদের বিব্রত করবেন না। আপনার যদি ড্যাটা সংগ্রহের নিতান্ত জরুরী প্রয়োজন হয়ে থাকে, আপনার কোন সহকর্মীকে দয়া করে পাঠাবেন। আমরা তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।' বদরুল অবসন্ন গলায় বললো, 'বুঝতে পেরেছি।' বদরুল বুঝতে পেরেছে। এখন সে-ও আরেকজন নানা চৌধুরী। বিষ্ঠা ঘাঁটার যন্ত্রগুলো এখন সে-ও ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এখন তাকেও একঘরে করা হয়েছে। এখন সে প্রাচীন ভারতের একজন চন্ডাল, প্রাচীন এশিয়া মাইনরের একজন শুকরপালক, বিংশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের একজন বিধবা মহিলা। তার ওপর কঠিন ফতোয়া জারি করা হয়েছে। বদরুল নির্বিকার গলায় বললো, 'বিদায়।' সুলেমান সাহেব বললেন, 'আপনাকে মহাকাশযানে পাঠানোর আগে একটা কথা জানাচ্ছি, ডঃ আলম। এই ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করায় চান্দিনার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আপনাকে আমি অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।' 'আপনাকেও ধন্যবাদ।' বদরুল তার কণ্ঠস্বরের তিক্ততা লুকোনোর চেষ্টা করলো না। (২৮ই জানুয়ারি, ২০০১) [এ গল্পটি আজিমভের 'স্ট্রাইকব্রেকার' গল্পের ছায়াবলম্বনে লেখা। দ্য অরিজিনাল সায়েন্স ফিকশন স্টোরিজ ম্যাগাজিনের জানুয়ারি, ১৯৫৭ সংখ্যায় সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।]
false
rg
হোসে মুজিকা দ্য লাস্ট হিরো অব পলিটিক্স !!! ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোসে আলবার্তো পেপে মুজিকা কর্ডানো। উরুগুয়ের মানুষ তাদের প্রিয় এই নেতাকে ভালোবেসে ডাকেন 'এল পেপে'। হোসে মুজিকাকে মিডিয়া ব্যাঙ্গ করে প্রচার করেছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে। তবে গোটা বিশ্বের মিডিয়া তাঁকে গরীব প্রেসিডেন্ট বললেও নিজেকে কিন্তু মোটেও গরিব ভাবেন না মুজিকা। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে গরীব হচ্ছে তারাই যারা খুবই বেশি বেশি চায়। কারণ যাদের চাওয়া অনেক বেশি, তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না।’ হোসে মুজিকা ছিলেন উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট। ১ মার্চ ২০১৫ সালে তাঁর প্রেসিডেন্টিয়াল মেয়াদ শেষ হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কে এই হোসে মুজিকা?ল্যাতিন আমেরিকার একটি দেশ উরুগুয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে অবস্থিত এই দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। ১৯৩৫ সালের ২০ মে উরুগুয়ের মোন্তেভিদিও'র এক গ্রামে এই মহানায়কের জন্ম। বাবার নাম দেমেত্রিও মুজিকা। মায়ের নাম লুসি কর্ডানো। মুজিকার বাবা ছিলেন উরুগুয়ের স্প‌্যানিশ শাসিত বাস্কি আদিবাসিদের বংশধর। পেশায় একজন কৃষক। আর মা লুসি ছিলেন এক ইতালীয় ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের মেয়ে। ১৯৪০ সালে বাবা দেমেত্রিও মুজিকা যখন মারা যায়, তখন লুসির পরিবারে একটি কানাকড়িও ছিল না। তাই পাঁচ বছরের মুজিকাকে নিয়ে লুসি বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ইতালীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লিগুরিয়া থেকে লুসির পরিবার উরুগুয়ের কারমেলোতে আসে। সেখানে লুসির বাবা পাঁচ একর জমি কিনে ভিনেগার চাষ শুরু করেন। কারমেলো হল উরুগুয়ের পশ্চিমাঞ্চলের স্প‌্যানিশ কলোনিয়াল গ্রামের একটি। যেখানে প্রচুর পরিমাণে ভিনেগার উৎপন্ন হয়। ভিনেগার দিয়ে তৈরি করা হয় ওয়াইন। বালক মুজিকা লুসির সঙ্গে নানাবাড়িতে বড় হতে থাকেন। মুজিকা'র শৈশব ও কৈশোর:ছোটবেলায় হোসে মুজিকা মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় এক বেকারির দোকানে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি হোটেল বয় হিসেবেও কাজ করতেন। এছাড়া নানাবাড়ির পিছনে বয়ে যাওয়া খাঁড়ি থেকে অ্যারাম লিলি ফুল তুলে বিক্রি করতেন। যা দিয়ে মা ও ছেলের সংসারের খরচ চলত। ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মুজিকা সাইকেল চালানোতে খুব পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবের সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে অনেক পুরস্কার জেতেন। এভাবেই দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হতে থাকেন মুজিকা। খুব ছোটবেলা থেকেই মুজিকা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি ন্যাশনাল পার্টির নেতা এনরিকে এরোর খুব ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি বাম চরমপন্থী নেতা হিসেবে উরুগুয়ের ত্রাস হয়ে ওঠেন। মুজিকার মত তরুণ গেরিলা সদস্যরা তখন দলবেঁধে বিভিন্ন ধনিক শ্রেণীর আস্তানায় হানা দিতেন। লুটপাট ডাকাতি করে যে টাকা পয়সা পেতেন, তা তারা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এক সময় এই গেরিলারা আর্জেন্টিনার বিপ্লবী নেতা আর্নেস্টো চে গুয়েভারার সংস্পর্শে আসে। তখন তাদের চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মে আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে উরুগুয়েতে চরম মুদ্রাস্ফীতির কারণে রুগ্ন অর্থনীতি মহাসঙ্কটে পড়ে যায়। তখন চে-র ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন মুজিকা ও তার সঙ্গীরা।গেরিলা জীবন:নতুন কিছু করার তাড়না থেকেই মুজিকা ও তার সঙ্গীরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করেন। রাউল সেনডিকের নেতৃত্বে এসব গেরিলা মিলে গঠন করেন টুপামারোস ন্যাশন্যাল লিবারেশান মুভমেন্ট বা সংক্ষেপে এনএলএম-টি। পেরুর কিংবদন্তী বিপ্লবী চরিত্র দ্বিতীয় টুপাক আমারুর নামানুকরণে এই গেরিলা বাহিনী তাঁদের দলের নাম রাখেন। আর এসব গেরিলাদের তখন বলা হতো ‘টুপামারো’। টুপামারো গেরিলাদের প্রধান নীতি ছিল অত্যাচারীর নিধন ও দরিদ্রের পালন। যে কারণে রাতারাতি টুপামারো গেরিলারা উরুগুয়ের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১০০ জনেরও কম মানুষ নিয়ে তাঁরা সেসময় উরুগুয়ের অত্যাচারী শাসকদের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। টুপামারো গেরিলারা ব্যাংক লুট করে বিত্তশালীদের অবৈধ অর্থ দরিদ্রদের উন্নয়নে ব্যয় করতেন। ধনী ব্যবসায়ীদের খুন করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেন। দামি ক্যাসিনো দখল করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের টাকা পাঠাতেন। যে কারণে ১৯৬৯ সালে টাইমস ম্যাগাজিন তাদেরকে ‘রবিন হুড গেরিলা’ নামে আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত স্থায়ী উরুগুয়ের শহরভিত্তিক তাদের এই গেরিলা বিদ্রোহ কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।কারাবন্দী জীবন:১৯৬৮ সালের জুন মাসে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ পাসেকো আরেকো অব্যাহত শ্রমিক ধর্মঘট প্রতিরোধে দেশে জরুরী আইন জারী করেন। সংবিধান ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘোষণা করেন। তখন সেনাবাহিনী এসব চরমপন্থী গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অব্যাহত সেনা অভিযানের ফলে টুপামারো গেরিলাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পাশাপাশি সমাজের মঙ্গল করার বদলে কেবল মানুষ অপহরণ ও খুনের কারণে টুপামারো গেরিলারা জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। একারণে গতি হারায় তাদের বিপ্লব। ভাঙন শুরু হয় তাদের মধ্যে। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে এক পানশালায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার হন এল পেপে। পেটে মোট ৬টি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন মুজিকা। গ্রেপ্তারের পর মন্টেভিডিও শহরের পান্টা ক্যারেটাস কারাগারে তার ঠাঁই হয়। সেখান থেকে দু’বার পালিয়ে গিয়েও ১৯৭২ সালে ফের ধরা পড়েন মুজিকা। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে এক মিলিটারি ক্যুয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী উরুগুয়ের ক্ষমতা দখল করে। যার পরিণতি হিসেবে জেলেবন্দী টুপামারো গেরিলাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ বিভীষিকা। নয়জন বিশেষ টুপামারোসকে বিশেষভাবে সনাক্ত করে ছুঁড়ে ফেলা হয় সলিটারি সেলে। যাদের মধ্যে ছিলেন রাউল সেনডিক, ফারনান্দেজ হুইদোব্রো, হোসে মুজিকা, হেনরি এংলার, মাউরিসিও রোসেনকফ প্রমুখ। অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে এই সময়ে কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এ সময়ে মিলিটারি জান্তা প্রচুর সংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল।বন্দি জীবনের অবসান ও নতুন রাজনৈতিক জীবনের শুরু:১৯৮০ সালে উরুগুয়ের জনসাধারণ মিলিটারি ডেকটেটর থেকে গণতন্ত্রে ফেরার জন্য গণভোটে অংশ নেয়। গণভোট গনতন্ত্রে পক্ষে গেলে সেনাপ্রধান গ্রেগরিও কনরাডো আলভারেজ ১৯৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিজেকে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময়ে আলভারেজ উরুগুয়ের কমিউনিস্ট ও টুপামারোসদের ব্যাপকহারে নিধন করেন। এক সময় আলভারেজের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধ্বস নামে। এমন কি সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকহারে হ্রাস পায়। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে কলরাডো পার্টির জুলিও মারিয়া সাংগুয়েনেট্টি জয়ী হন। উরুগুয়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী দেশের প্রেসিডেন্ট শপথ নেন ১লা মার্চ। তার আগে ১২ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক গ্রেগরিও কনরাডো আলভারেজ পদত্যাগ করেন। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তখন শপথ নেন সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল আদ্দিয়েগো। দীর্ঘ ১৪ বছর কঠোর বন্দি জীবনের পর ১৯৮৫ সালে মুক্তি পান হোসে মুজিকা। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর টুপামারোস গেরিলারা মিলে বামপন্থী রাজনৈতিক দল ব্রোড ফ্রন্ট করেন। ১৯৭৩ সালে এই দলটি গঠিত হলেও উরুগুয়েতে স্বৈরশাসনের অবসানে ব্রোড ফ্রন্ট দলটি আবার কার্যক্রম শুরু করে। এই দল থেকে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন হোসে মুজিকা। জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে মুজিকার পুরোনো দিনের রবিন হুড গেরিলা ভাবমূর্তিও ভূমিকা রাখে। ৮০ ও ৯০-এর দশকে উরুগুয়ে শাসন করে কলরাডো পার্টি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয়ের কাছাকাছি এসেও হার মানে ব্রোড ফ্রন্ট। তবে ৯৯ জন সাংসদের পার্লামেন্টে তখন দু’জন প্রাক্তন টুপামারো নেতা নির্বাচিত হন। এদেরই একজন ছিলেন হোসে মুজিকা। ১৯৯৯ সালে মুজিকা সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের নির্বাচনে উরুগুয়ের প্রভাবশালী কলোরাডো ও ন্যাশনাল পার্টির জোটকে হারিয়ে বামপন্থী জোট ব্রড ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন তাবারে ভাসকুয়েজ। হোসে মুজিকা ২০০৫-২০০৮ সাল পর্যন্ত তাবারে ভাসকুয়েজের কেবিনেটে পশুসম্পদ, কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রোড ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে হোসে মুজিকা উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১ মার্চ ২০১০ সালে তিনি উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ও দায়িত্বভার গ্রহন করেন। প্রেম-ভালোবাসা এবং বিয়ে:দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে হোসে মুজিকারও প্রেম এসেছিল। বিপ্লবী সতীর্থ লুসিয়া টোপোল্যানস্কির সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া হয় হোসে মুজিকার। দীর্ঘ বিশ বছর প্রেমের পর ২০০৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। মন্টেভিডিও'র এক শহরতলীতে তারা এক কৃষি ফার্মের ভেতর একেবারে অরডিনারি টিনের ঘরে বসবাস করেন। স্ত্রী লুসিয়া টোপোল্যানস্কিও একজন টুপামারো গেরিলা ও কৃষক। তাঁরা দু'জনে মিলে শবজি ও ফুলের চাষ করেন। নিঃসন্তান এই দম্পতির তিন পায়া একটি খোঁড়া কুকুর আছে। যার নাম ম্যানুয়েলা। এই দম্পতির সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা মাত্র এক হাজার আটশো ডলারের একটি গাড়ি পুরাতন ভোক্সওয়াগন বিটল মডেলের গাড়ি। মুজিকা নিজেই এটি চালান। প্রেসিডেন্ট এল পেপে:২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত গোসে মুজিকা এল পেপে উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেছেন। উরুগুয়ের বিশাল জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে তাঁর ঠোঁটকাটা কথা, আদর্শবাদী ভাবমূর্তি এবং সহজ-সরল জীবন-যাপন। তার অনুসারীদের মতে, এল পেপে মুখে যা বলেন, কাজেও তা করে দেখান। সাধারণ পোষাকে চলতি ভাষায় অবিশ্রান্ত গালাগালিতে ভরপুর তাঁর বক্তৃতা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়। জীবনেও তিনি গলাবন্ধ টাই পড়েননি। মুজিকার সমালোচকরা বলেন, আসলে তিনি এক পাগলাটে, বাতিকগ্রস্ত বুড়ো যিনি বন্দুক ও বিপ্লব দুটিকেই সরিয়ে রেখেছেন। নিন্দুকদের কথায় অবশ্য আদৌ আমলে নেন না প্রেসিডেন্ট। বরং স্পষ্টভাষী হিসেবে বরাবরই বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতায় এসে তিনি দেশে গাঁজার চাষ ও বিপণনকে বৈধতা দিয়েছেন। এছাড়া গর্ভপাত এবং সমকামী বিবাহকে তিনি আইনগতভাবে অনুমোদন করেছেন। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে সদস্যদের মুজিকা বলেন, ‘বিপুল অর্থব্যয়ে আয়োজিত বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করুন। এখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না।’ অনাড়ম্বর জীবনযাপন:শৈশব থেকেই চরম দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হোসে মুজিকা দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও বদলাননি তাঁর জীবনযাপনের ধরন। ১৯৯৪ সালে উরুগুয়ের পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হবার পর থেকে নিজের ভোক্সওয়াগন বিটলে চেপেই পার্লামেন্টে যাতায়াত করতেন। ২০০৫ সালে বিয়ের পর ফুলের বাগান ঘেরা শহরতলির তিন কামরার টিনের চালওয়ালা ভাঙাচোরা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল-মুরগি আর ভেড়াদের নিয়েই তাঁর সুখে সংসার। প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই সমবয়সী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কোন সশস্ত্র দেহরক্ষী নেই সেখানে। চোখ ধাঁধানো লিম্যুজিন বা সালোঁ নয়, ঘোরাফেরার জন্য তার নিত্যসঙ্গী ২৫ বছরের পুরনো ভোক্সওয়াগান বিটল। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার ডলার। যার ৯০ ভাগই তিনি দান করে দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। যা ব্যয় করা হতো গরীবদের সহায়তা এবং ছোট বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দেশের সামাজিক সেবামূলক সংস্থায়। নিজের বেতনের মধ্য থেকে তিনি নিজের জন্য রাখতেন মাত্র ৭৭৫ ডলার। এই অনাড়ম্বর জীবন যাপনের জন্য সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে। উরুগুয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলেও মুজিকার বসবাসের খামার বাড়িটি দেখলে যে কেউ ভূতেরবাড়ি বলে ভুল করতে পারে। বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকার বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন নিতান্তই এক সাধারণ জীবন। এখনো কর্দমাক্ত পথ পেরিয়েই নিজের খামার বাড়িতে পৌঁছাতে হয় তাঁকে। মজার ব্যাপার হল, এই অর্ধ-পরিত্যক্ত খামার বাড়ির মালিক কিন্তু তিনি নন, বাড়িটির মালিক তাঁর স্ত্রী লুসিয়া টোপোল্যানস্কি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও মুজিকা খামারে স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত কৃষিকাজ করতেন। খামারে চাষ করছেন বিভিন্ন রকমের ফুল। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এই প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিল মাত্র দু'জন পুলিশ আর ম্যানুয়েলা নামের একটি কুকুর। নিজেকে সব সময় ঋণমুক্ত রেখেছেন মুজিকা। বামপন্থি টুপামারোস এই গেরিলা নেতার নামে কোনো ঋণ নেই। এমনকি তাঁর কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। সবসময় নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মুজিকা। মাথায় ভরা এলোমেলো ধূসর চুল, ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফ, দশাসই চেহারা দেখে মুজিকার বয়সটা অনুমান করা মুশকিল। দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবন যাপনের ধারা বদলাতে রাজি হননি তিনি। যে কারণে বিলাসবহুল আড়ম্বর ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি-গাড়ি-খামার নিয়েই দিব্যি ভালোই আছেন মুজিকা। দেশবাসী যাঁকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’। প্রতিবছর উরুগুয়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুজিকা তাঁর সম্পদের পরিমাণ দেখান এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। যা কিনা তাঁর ১৯৮৭ মডেলের ভোক্সওয়াগন বিটল গাড়িটির দাম। ২০১২ সালের সম্পদের বিবরণীতে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পদ যুক্ত করেন পেপে। এই সম্পদের মধ্যে ছিল জমি, ট্রাক্টর ও বাড়ির দাম। এতে তাঁর মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছিল দুই লাখ ১৫ হাজার ডলার। যা তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্টের ঘোষিত সম্পদের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ।গাড়িটিও বিক্রি করতে চান পেপে:মুজিকার অন্যতম সম্পদ ভোক্সওয়াগন বিটল কার। এখন বোধহয় ওটাও আর থাকবে না পেপের কাছে। ওই কারের জন্য ১০ লাখ ডলারের অফার পেয়েছেন তিনি। আর খুশিতে তিনি ওটা বেঁচেও দিতে চান! বাসকোয়েডা ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেপে বলেছেন, কারটি বিক্রি করলে ১০ লাখ ডলার পাবেন। এক আরব শেখ তাকে এ অফার দিয়েছেন। তিনি অফারটি গ্রহণ করবেন কিনা ভাবছেন। আর যদি সত্যিই তিনি কারটি বিক্রি করতে পারেন, তাহলে প্রাপ্ত টাকা তিনি গরীবদের সাহায্যে বিলিয়ে দেবেন। মুজিকা বলেন, 'গাড়ির সঙ্গে আমার এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই যে তা বিক্রি করা যাবে না। বরং হাসি মুখেই গাড়িটি বিক্রি করতে চাই। আর সেই টাকা বিলিয়ে দিতে চাই আশ্রয়হীনদের জন্য, যেন তারা মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পান'। অবশ্য মজা করে মুজিকা বলেন, গাড়িটি অবশ্য আমার প্রিয় কুকুর ম্যানুয়েলার জন্য রেখে দিতে চেয়েছিলাম হা হা হা...। এল পেপের অবসর জীবন:একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও যে নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করা সম্ভব সেটি দেখিয়েছেন এ বছর ২০ মে ৮০ বছরে পর্দাপন করা উরুগুয়ের সদ্য সাবেক হওয়া প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। গত ১ মার্চ তিনি নব নির্বাচিত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাসকুয়েজের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা জীবন চরম দারিদ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা এই মানুষটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরেও কখনো বিলাসিতা করেননি। গোটা পৃথিবীর সকল দেশের শাসকগণ যদি হোসে মুজিকার পথ অনুসরণ করতো, তাহলে হয়তো কোনো দেশেই প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেবার জন্য আলাদা কোনো বাহিনীর প্রয়োজন হতো না। অবসর জীবনও দারুভাবে উপভোগ করছেন এল পেপে। বিভিন্ন দেশের বড় বড় সাংবাদিকদের তিনি নিজের বাড়িতে ও কৃষিখামারে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সঙ্গীত শিল্পী এমির কুস্তরিকা মুজিকার জীবন নিয়ে তৈরি করেছেন একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। এমির তার ফিল্মের নাম দিয়েছেন 'দ্য লাস্ট হিরো অব পলিটিক্স'। বিবিসি'র রিও ডিও'র সাংবাদিক উইরে ডেভিসকে এক সাক্ষাৎকারে মুজিকা বলেন, ১৪ বছরের বন্দি জীবনে ওরা আমাকে সলিটারি সেলে আটকে রেখেছিল। যেখান থেকে আমি জীবনের এক কঠিন শিক্ষা পেয়েছি। এখন দিনের বেলায় এই যে কাঠের সোফায় বসতে পারছি, এটাইতো এক জীবনে অনেক কিছু। সলিটারি সেল আমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সাহস যুগিয়েছে। এমন কি সাত-আট বছর আমি কোনো বই পর্যন্ত পড়তে পারিনি। মুজিকা বলেন, "This world is crazy, crazy! People are amazed by normal things and that obsession worries me!" প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেন উরুগুয়েতে গাঁজার অবাধ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মুজিকা বলেন, "Marijuana is another plague, another addiction. Some say its good but no, that's rubbish. Not marijuana, tobacco or alcohol - the only good addiction is love! But 150,000 people smoke [marijuana] here and I couldn't leave them at the mercy of drugs traffickers. It's easier to control something if it's legal and that's why we've done this." অবসরে কি করবেন? জবাবে মুজিকা বলেন, "I have no intention of being an old pensioner, sitting in a corner writing my memoirs - no way! I'm tired of course, but I'm not ready to stop. My journey's ending and every day I'm a little closer to the grave." আহা বাংলাদেশের শাসকগণ যদি হোসে মুজিকার মত এমন নির্লোভ ও সাধারণ হতো, তাহলে হয়তো আমাদের এত হাজার হাজার সমস্যা থাকতো না। আমাদের শাসকদের অন্তত এল পেপে'র জীবন পাঠ করা উচিত। পৃথিবীতে এতো লোভ যে একদিন কোনো কাজে লাগবে না, সেই শিক্ষা এদের হয়তো কোনোদিনই হবে না। হোসে মুজিকাকে জন্য গোটা পৃথিবীর মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে। এই পৃথিবীর জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন টুপামারো এই গেরিলা নেতা এল পেপে। .................................২৯ মে ২০১৫ঢাকা
false
rg
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে লাগাতার মিথ্যাচার!!! সঙ্গে আছে চ্যানেল আই!!! আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন খেলায় মেতেছে। ১৯৭১ সালে যে বিবিসি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশান) মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুঃসাহসী খবর প্রচার করেছিল, সেই বিবিসি এখন দালালের ভূমিকায় নেমেছে। একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই বিবিসি প্রকাশ্যে এই চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তাই আমেরিকান মিডিয়া'র খবরেও তখন পাকিস্তানী জয়গান শোনা যেত। তখন বিবিসি অনেকটা নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করে বাংলাদেশের কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছিল। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশেষ করে নাই ইলেভেনের পর থেকে বৃটেন হয়ে গেছে আমেরিকার প্রকাশ্য দালাল। সেই দালালি ব্রিটিশ সরকারের মিডিয়া বিবিসিকেও গ্রাস করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের মনগড়া মিথ্যা খবর প্রচার করছে। বিবিসি সংলাপের নামে বাংলাদেশে বিবিসি কি করছে? বাংলাদেশকে স্বীকার করে না বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় এমন সব ব্যক্তিদের নিয়ে নানা ধরনের বিরূপ প্রচারণা চালাচ্ছে বিবিসি। অনেক সময় সেই প্রোগ্রামে সরকারের মন্ত্রী বা সরকারি দলের বড় বড় নেতাকেও উপস্থিত করে তাদের নাজেহাল করার চেষ্টার মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে বিবিসি। মূলত জামায়াতে ইসলামী'র টাকায় আর বিএনপি'র প্রণোদনায় বিবিসি এই অনুষ্ঠান করছে। সেখানে দর্শক সারীতে যারা উপস্থিত থাকছে, তাদের প্রশ্নের ধরন দেখেই বোঝা যায়, এই বিবিসি সংলাপের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আসলে কি? বিবিসি সুস্পষ্টভাবেই বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রপাগাণ্ডা চালাতে এ ধরনের অনুষ্ঠান করছে। সেখানে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে সরকারের সমালোচনা করা এবং বাংলাদেশের ভাবমুর্তি বহির্বিশ্বে খাটো করাই বিবিসি সংলাপের একমাত্র উদ্দেশ্য।বাংলাদেশের কিছু প্রাইভেট চ্যানেল টাকার লোভে সেই অনুষ্ঠান আবার লাইভ ব্রডকাস্ট করছে। এছাড়া জনসাধারণের বাড়তি নজর কাড়ার জন্য সেই অনুষ্ঠান আবার পুনঃপ্রচার করা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতারা বিবিসি'র এই পক্ষপাতিত্ব বুঝতে পেরেও সেটি আমলে নিচ্ছেন না বরং টেলিভিশনে চেহারা দেখানো প্রতিযোগিতায় ডাক পেলেই হাজির হচ্ছেন। বিবিসি সংলাপের নামে আসলে বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি তাদের টাকায় কেনা বিবিসিকে সুকৌশলে ব্যবহার করছে। সেই প্রচারে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক খবরগুলো বহির্বিশ্বে প্রচার হচ্ছে, সেটিকে পুঁজি করেই পাকিস্তান পন্থী এই জোট তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করছে।যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বিবিসি প্রচার করেছে, বাংলাদেশের সরকার ইসলামী নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। সেখানে একাত্তরে কাদের মোল্লা'র ভূমিকাকে বরং অনেকটাই অনুল্লেখ করা হয়েছে। বিবিসি'র সঙ্গে সুর মিলিয়ে রয়টার্সও একই সুরে কথা বলেছে। আর ইসলাম পন্থী আল জাজিরাতো আরেক ডিগ্রি এগিয়ে প্রচার করেছে যে, বাংলাদেশে বিরোধী দলের ইসলামী নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে আল জাজিরা একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী মাঈনউদ্দীনের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। সেখানে মাঈনউদ্দীন অনেক মিথ্যাচার করেছেন। একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই আমেরিকা ও বৃটেনে পালিয়ে আছে। তারা আমেরিকা ও বৃটেনের সরকারি সহযোগীতা নিয়েই পালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বঙ্গবন্ধু'র অনেক খুনি আমেরিকা, বৃটেন ও তাদের মিত্র দেশে পালিয়ে আছেন। তাদেরকে আইনের আওতায় যাতে বাংলাদেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না যায়, সেই দরকষাকষি করছেন তাদের দূতাবাসগুলো। অনেকে সেই বিচারের সঙ্গে নানান শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের যারা সেসব দেশে এখনো পালিয়ে আছেন, তাদেরও অনুরূপ প্রতিরক্ষা দেবার জন্য এইসব দেশ ও তাদের মিত্ররা এখন তৈরি। পাশাপাশি সেসব দেশের মিডিয়াগুলো ইসলাম পন্থী ও পাকিস্তানের মিত্রদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশ্যে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আল-জাজিরা, ডন, এবং তাদের মিত্র মিডিয়া গুলো দল বেধে খুব আটসাট বেঁধেই প্রকাশ্যে এই মিখ্যাচার এবং নেতিবাচক সংবাদ প্রচারে একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই নেমেছে। সেই উদ্দেশ্যটি ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে, সেটি হল বাংলাদেশকে তারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে দেখতে চায় না। এটাকে তারা এখনো দ্বিতীয় পাকিস্তান হিসেবে দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো অনেকটা জোটবদ্ধ হয়েই এই অপপ্রচার চালাতে ভূমিকা পালন করছে। আর সেই ভূমিকা'র পেছনে একদিকে আছে জামায়াত- শিবির-বিএনপি, আরেকদিকে আছে পাকিস্তানের আইএসআই। পাশাপাশি কিছু দেশীয় মিডিয়া বুঝে বা না বুঝে অথবা মুনাফার লোভে সেই ফাঁদে পা দিয়ে তাদের সেই অপপ্রচারে সমান তালেই ভূমিকা পালন করছে।চ্যানেল আই একদিকে বলছে হৃদয়ে বাংলাদেশ, আরেকদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে সেই চ্যানেলটি সরাসরি ভূমিকা পালন করছে মুনাফার লোভে। দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে এভাবে নিলর্জ্বের মত ভূমিকা রাখার জন্য চ্যানেল আইকে একদিন বাংলাদেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এদের এক পা বাংলাদেশের বুকের মধ্যে আরেক পা বিদেশী বুর্জোয়া শ্রেণীর কার্পেটের নিচে। ফলে মুনাফার বাইরে তাদেরকে নানান চেহারায় নানা ভাবে দেখা যাচ্ছে। চ্যানেল আই মুক্তিযুদ্ধের বিরত্ব গাঁথা প্রচার করে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করার চেষ্টা করার পাশাপাশি এই অপকর্মটিও খুব চতুরতার সাথেই করে যাচ্ছে। ফলে বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন বা চ্যানেল আই-কে সাদা চোখে আলাদা করা যাচ্ছে না। কিন্তু খুব গভীরভাবে এদের কার্যকলাপ নিয়ে বিশ্লেষণ করলেই একটি অদ্ভুত মিল পাওয়া যাবে। সেই মিলটি হল মুনাফা লোটার জায়গাটি। দেশপ্রেম এদের কাছে একটি টুলস। এই টুলসটি ব্যবহার করে ব্যবসা করতে সুবিধা অনেক বেশি। এতে সরকার বা বাংলাদেশের সরধারণ মানুষের কাছে এদের ভেতরের আসল চেহারাটি সব সময় অনাবিস্কৃতই থেকে যায়।কর্পোরেট মুনাফার নামে এরা দলবেঁধে দেশের অর্জন নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। পাশাপাশি খুব সাবধানে এবং কৌশলে অপপ্রচারটি করছে যাতে কেউ এদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম না হয়। চ্যানেল আই বিবিসি সংলাপ প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতিবাচক খবর বহির্বিশ্বে প্রচারে সরাসরি ভূমিকা পালন করে একটি অপরাধ করে যাচ্ছে। এই অপরাধটি মিডিয়ার স্বাধীনতা'র নামে বেশ সুকৌশলেই করা হচ্ছে। এর আড়ালের হিসেবটি বড় জটিল আর নেতিবাচক। যদি চ্যানেল আই সত্যিকার ভাবেই হৃদয়ে বাংলাদেশ নামের শ্লোগান ধারণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, তাহলে চ্যানেল আই বিবিসি সংলাপের নামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারেও ভূমিকা পালন করছে। চ্যানেল আইয়ের এই দুমুখী চরিত্রটি খুবই বিপদজনক। এটি রাষ্ট্রের জন্য তো বটেই বাংলাদেশের ভাবমুর্তির জন্য বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা আশা করি, কোনো ধরনের মুখোশের আশ্রয় না নিয়ে চ্যানেল আই হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারিত নেতিবাচক বিবিসি সংলাপ প্রচার বন্ধ করবে, নইলে তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো মিডিয়া নয়, সেটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে। আমরা বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, আল-জাজিরার দেশীয় এজেন্ট চ্যানেল আইয়ে আর বিবিসি সংলাপের নামে মিথ্যাচার প্রচার দেখতে চাই না।
false
rn
টেলিস্কোপ অ্যাস্ট্রোনমি(Astronomy) বা জ্যোতির্বিদ্যার কাজ হল মহাকাশের কোন বস্তুর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।পারতপক্ষে জ্যোতির্বিদ্যার কাজ শুধুমাত্র মহাকাশের কোন বস্তুর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাই না বরং জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমেই আমরা মহাবিশ্বের গঠন ও সৃষ্টিতত্ত(Cosmology) সম্পর্কে জানতে পারি।আর এই অ্যাস্ট্রোনমি(Astronomy) বা জ্যোতির্বিদ্যার সবচে বড় হাতিয়ার হল টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ। গ্যালাক্সি হচ্ছে মহাকাশের সবচেয়ে দীর্ঘতম পর্যবেক্ষণ বস্তু। গ্যালাক্সি সম্পর্কে যত গভীর আর স্পষ্ট তথ্য জানা যাবে ততই মহাকাশ সৃষ্টি এবং মহাকাশ বিবর্তন সম্পর্কে ভালোভাবে জানা সম্ভব হবে। যারা বিজ্ঞানী নন, তাদেরও তো আছে আকাশ দেখার সাধ। আর তাই তাদের জন্যেও আছে কিছু যন্ত্রপাতি। শখ করে জ্যোতির্বিদ হতে চাইলে প্রথমেই চাই একটা টেলিস্কোপ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি হয়েছে হাবল এবং আলমার মত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ ।সাধারন টেলিস্কোপের প্রধান সমস্যা হলো এতে মহাকাশের যে চিত্র দেখা যায় তা কিছুটা ঝাপসা। কারন টেলিস্কোপ আর মহাকাশের মাঝে থাকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল। ঠিক এ কারনেই ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে ভূ-পৃষ্ট থেকে ৬০০কিলোমিটার উপরে বায়ুমন্ডলে মহাশূন্যে স্থাপন করা হয় ২.৪ মিটার দীর্ঘ হাবল টেলিস্কোপ। প্রথমদিকে এই টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রাপ্ত ছবিও ঝাপসা দেখাত। ফলে তিন বছর পর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মেরামতের পর এই টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে কয়েক বিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের গ্যালাক্সিও স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল টেলিস্কোপের। গ্যালিলিও টেলিস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন গ্রহের পরিভ্রমণ পথ পরীক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। বর্তমানে আধুনিক অনেক টেলিস্কোপ তৈরি হচ্ছে।গ্যালিলিওর মৃত্যুর পর আইজ্যাক নিউটন টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ শুরু করেন। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিসরণ ও প্রতিফলন- এ দুই ধরনের টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিসরণ টেলিস্কোপের উদ্ভাবক গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং প্রতিফলন টেলিস্কোপের আবিষ্কারক আইজ্যাক নিউটন।বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত অপটিক্যাল দুরবিন, এটি গ্রেগরিয়ান বাইনোকুলার দুরবিন। এলিয়েন বা ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের খুঁজে বের করার লক্ষে মেক্সিকোতে ২৫০ ফুট দীর্ঘ একটি টেলিস্কোপ বসানোর পরিকল্পনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা।পৃথিবী থেকে ৬০ বা ৭০ আলোকবর্ষ দূরেও কোন গ্রহেও এলিয়েনদের খোঁজ করতে সক্ষম হবে এ টেলিস্কোপ। এক খবরে এ তথ্য জানিয়েছে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া।এলিয়েন প্রসঙ্গে পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং সতর্ক করে বলেছেন, এলিয়েনদের ঘাঁটানো বা বিরক্ত করা ঠিক হবে না। এতে তারা পৃথিবীতে আক্রমণ করে বসতে পারে। গবেষকেরা আশা করছেন, কলোসাস নামের টেলিস্কোপ তৈরি করা সম্ভব হলে এলিয়েনদের বিরক্ত না করেই দূর থেকে তাদের ওপর নজরদারি করা যাবে।হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে প্রায় ছয়শ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে আর অন্যদিকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে প্রায় দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করবে! পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিন্দুটি দ্বিতীয় ল্যাগরেঞ্জ বিন্দু (যা সংক্ষেপে L2 point) হিসেবে পরিচিত। গবেষকরা দেখেছেন, পৃথিবী থেকে মহাকাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা হচ্ছে এই বিন্দুটি।টেলিস্কোপ অনেক দামের হয়ে থাকে ।মূলত আপনি ১০,০০০ হতে কয়েক লক্ষ টাকা দামের ঢাকা হতে কিনতে পারেন। অথবা কিছু টেলিস্কোপ আছে যেগুলোর দিয়ে পৃথিবীর ভেতরেই বিভিন্ন জিনিস দেখা যায়। ঊঁচু পর্বতের তলায় দাড়িয়ে এক টানে চূড়াটাকে কাছে টেনে আনা যায় এমন টেলিস্কোপও আছে। এই টেলিস্কোপগুলো পাওয়‍া যাবে ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটে। চাঁদ-তারা দেখা যায় এমন টেলিস্কোপগুলোর দাম ৩৫,০০০টাকা থেকে শুরু করে ৪,০০,০০০টাকা পর্যন্ত। আর সাধারণ দূরত্বে দেখতে চাইলে ১৮,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা দামের টেলিস্কোপই যথেষ্ট। সৌখিন জোতির্বিদদের জন্য বাজারে আছে নানান রকম টেলিস্কোপ। কোনটা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদ। কোনটা দিয়ে আবার একলাফে চলে যাওয়া যায় আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্রে।ইকারাসের নাম কে না শুনেছে, ঐইই যে, মোমবাতির মোম দিয়ে তৈরি পাখা নিয়ে সূর্যের কাছে উড়ে যাওয়া, আর তারপর সূর্যের তাপে পাখা গলে গিয়ে ভূপাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ…। …মৃত্যু তো অনিবার্য, কিন্তু মুক্তির যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়ে গিয়েছিল ইকারাসের সেই রূপকথা— আমরা আশাবাদি, জেম্‌স ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে সেই মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারবে আগামীর সম্ভাবনাময় বিশ্বে।দেশীয় প্রযুক্তিতে স্বল্প খরচে টেলিস্কোপ তৈরি করেছেন ফজলে রাবি্ব। পড়ছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের দ্বিতীয় সেমিস্টারে।২০২১ সাল নাগাদ চিলিতে বৃহৎ টেলিস্কোপের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। ইউরোপিয়ান এক্সট্রিমলিলার্জ টেলিস্কোপ নামে এই টেলিস্কোপটির মূল আয়না হবে ১৩৭ ফিট, ক্ষমতা হবে টিএমটির চেয়ে ৩০ ভাগ বেশি। তবে মহাকাশে স্থাপিত জেমস-ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সঙ্গে সমন্বয়ের ফলে টিএমটি এরচেয়ে অনেক বেশি কার্যকরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছেন মহাকাশবিদরা।
false
rn
অস্ত্র অস্ত্র অস্ত্র পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সালে। বিশ্বের ১ম দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা আবিস্কার ও উন্নয়নের জন্য উদ্যোগী হয়।১৯৪০-এর দশকে নতুন ধরণের পরমাণু বোমা হিসেবে হাইড্রোজেন বোমা আবিস্কারের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমা আবিস্কারের প্রেক্ষাপটে আন্দ্রে শাখারভ হাইড্রোজেন বোমা'র জনক হিসেবে ইতিহাসে চিত্রিত হয়ে আছেন তাঁর স্ব-মহিমায়। পারমাণবিক অস্ত্রকে ধরা হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের এক বোমা হিসেবে। যুদ্ধের ইতিহাসে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত করা হয়েছিল।আমাদের দেশে বর্তমানে ৯ ও ৭ পয়েন্ট ৬২ মিলিমিটার ক্যালিবারের পিস্তল ব্যবহার করছেন এসআই থেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা।বর্তমানে অন্যান্য উন্নত দেশে মহানগর এলাকায় সাব মেশিনগান ব্যবহৃত হয়। স্নাইপার রাইফেল, সিঙ্গেল গ্যাস লাঞ্চার, মাল্টিপল গ্যাস লাঞ্চার, গ্যাস গ্রেনেড, মাল্টিপল গ্যাস গ্রেনেড, ট্রেসার গান ব্যবহারের কথাও বলা হয়। রিভলবার এবং পিস্তল । খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে এই দুটো আবার আলাদা আলাদা করে কি বোঝায় । যেসব আগ্নেয়াস্ত্র এক হাতে ধরে গুলি ছোঁড়া যায়, এক কথায় তাদেরই পিস্তল বা রিভলবার বলা যাবে। আদি পিস্তল গুলোতে একবারে মাত্র একটাই গুলি ছোঁড়া যেত । সেই দিয়েই মানুষ পরমানন্দে খুনাখুনি চালাতে চালাতে অনুভব করলো বার বার বারুদ ভরো, গুলি ভরো, তারপর মারো; এই প্রক্রিয়াটা অনেক সময়সাপেক্ষ। আরো তাড়াতাড়ি মারতে পারলে সুবিধা । সেই প্রচেষ্টার ফলেই এলো রিভলবার । একবারে ৬ টা গুলি ভরে নিয়ে খুনোখুনি করায় সুবিধা হলো আরো বেশি ।সাল ১৮৩০। স্যামুয়েল কোল্ট নামের বছর ১৬ বছরের এক ছেলে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়ল । ভাগ্যসন্ধানের জন্য চড়ে বসলো ভারতবর্ষগামী এক বানিজ্য জাহাজে । জাহাজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে খেলাচ্ছলে বানিয়ে ফেলল এক নতুন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র - যেটা বারবার লোড না করেই গুলি ছোঁড়া যায় পরপর ।কোল্ট এরপর স্থাপন করেন রিভলবার এর কারখানা ।১৮৫০ এর দিকে প্রথম কোল্ট এর কারখানা অভূতপূর্ব সাফল্য পেতে শুরু করে।কারিগরী দিক থেকে ভীষনরকম সরল এই যন্ত্রটি প্রথমে আমেরিকা এবং পরে সাড়া পৃথিবীর মানুষের জীবনধারাই পাল্টে দেয় । শুনতে নিষ্ঠুর হলেও ভীষণ বাস্তব এই সত্য যে , মুঠোভর্তি মাত্র এই অস্ত্র যত সহজে মুহুর্তের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে একটা প্রানীকে, এত সহজ খুন করার যন্ত্র ছিলনা আগে মানুষের হাতে । বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকার অন্তত ৩০ টি স্পটে গোপন কারখানা গড়ে তাতে তৈরি হচ্ছে দেশী বন্দুক।দিনের বেলায় মুলত অস্ত্র তৈরির কাজ চলে। পাহাড়ের অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে গড়ে তোলা প্রায় প্রতিটি কারখানার পরিবেশ অনেকটা ওর্য়াকশপ ও কামারের দোকানের মত। বিগত সময় এখান থেকে এম-১৬, একে-৪৭ ও রকেট লাঞ্চারের মত আধুনিক মারণাস্ত্র উদ্ধার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেনেড এক প্রকারের নিক্ষেপণযোগ্য বোমা।অধিকাংশ গ্রেনেডই বিসফোরণের পরে চারিদিকে ছররা বা ধাতুর টুকরো বা শার্পনেল অতি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার বছর আগে চাইনিজদের আবিস্কৃত গান পাউডার বদলে দেয় সমরাস্ত্রের ধরন। তখনকার দিনে গ্রেনেড বোমায় ব্যবহৃত হত গান পাউডার। অধিকাংশ বোমাই সাধারণ জ্বালানীর তুলনায় কম শক্তি সঞ্চিত করে। ব্যতিক্রম হিসেবে রয়েছে পারমাণবিক বোমা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে গ্রেনেডের মাধ্যমে সৃষ্ট বোমা হামলায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ও তাঁর কানের পর্দা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উক্ত হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ১৯ জন মৃত্যুবরণ করেন ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।আইনস্টাইনে সেই সূএর টির E=mc^2 উপরেই আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসে শক্তিশালি বোমা পারমানবিক বোমা। এই পোস্টে মূলত অস্ত্র কি এবং কেন এ সম্পর্কে ধারনা দিতে চেস্টা করা হয়েছে। তবে মারনাস্ত্র তৈরি ও এ সম্পর্কিত গবেষনাকে বরাবরই ঘৃনা করি। এগুলো একটি সভ্যতাকে ধংস করে দেয়ার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।একটু লক্ষ করলে দেখবেন এই বোমা গুলো তৈরী জন্য আমেরিকা যে পরিমান অর্থ আর মেধা ব্যয় করেছে তা যদি মানবতার কল্যানে ব্যয় করা হয় আজ পৃথিবী অন্যরকম হত।
false
mk
বঙ্গবন্ধু এবং ৭ মার্চ যেকোনো বিচারেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই, বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে যত রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বক্তৃতা ছিল। আনুমানিক ১৯ মিনিটের একটি বক্তৃতায় একটি দেশের পূর্ব ইতিহাস, জনগণের প্রত্যাশা ও তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের প্রতারণা, তাদের ত্যাগ, আগামী দিনের জন্য দিকনিদের্শনা ইত্যাদি বিষয় আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তৃতায় আজ পর্যন্ত স্থান পায়নি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি রাজপথ থেকে উঠে এসেছিলেন। দেশভাগের আগে তিনি কলকাতায় একজন ছাত্রনেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম, দেশবন্ধু সি আর দাশ প্রমুখের নেতৃত্বে রাজপথে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন। তিনি যেহেতু আজীবন গণমানুষের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সেহেতু তিনি সেদিন এক নিঃশ্বাসে বলতে পেরেছিলেন দেশ ভাগোত্তর বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস।পাকিস্তানের গণপরিষদের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এটি ধারণা করা হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তথা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চাননি এককভাবে বাঙালির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর হোক। নির্বাচনের পরই ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করতে ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান মার্চের ১ তারিখে অকস্মাত্ পাকিস্তানের গণপরিষদের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন স্থগিত করেন। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু সে সময় হোটেল পূর্বাণীতে দলীয় নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। তিনি সেই বৈঠক থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে গণপরিষদের বৈঠক স্থগিতে তাঁর ক্ষোভের কথা জানান। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাল্টে যায় শুধু ঢাকার নয়, সারা বাংলাদেশের চিত্র। আসলে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিতের আদেশই বাংলাদেশকে অখণ্ড পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কেমন ছিল সেই উত্তাল দিন, তা আজকের প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না। আওয়ামী লীগের ডাকে ঘোষণা করা হলো ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হবে। ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানানো হয়। ১ তারিখ ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৩ তারিখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সেই সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। উত্তোলন করা হয় সেই বাংলাদেশের সেই পতাকা, যা আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে উত্তোলন করা হয়েছিল। এ সময় দেশে সামরিক সরকার প্রতি রাতে কারফিউ জারি করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু জনতার রোষে সেই কারফিউ অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রতিদিন পালিত হয় হরতাল আর বিক্ষোভ মিছিল। সব মিছিল গিয়ে শেষ হয় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে।৭ মার্চ সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জানিয়ে দেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে মারাত্মকভাবে ভুল করেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে প্রায়শ একই ভুল এখনো করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সারা পাকিস্তানে ঔত্সুক্য তো ছিলই, বহির্বিশ্বের মানুষও নজর রাখছিল পূর্ব বাংলার দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সারা দুনিয়া থেকে সাংবাদিকরা ঢাকায় ভিড় করেছিলেন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি রিপোর্ট করার জন্য। ৭ তারিখ সকালে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করেছিলেন। কেউ হয়তো রমনা রেসকোর্সে তাঁর কী বলা উচিত সে সম্পর্কেও তাঁর সঙ্গে দু-চার কথা বলেও থাকতে পারেন। ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসভায় গিয়েছিলেন কলকাতার দিনগুলো থেকে তাঁর পরিচিত হাজি গোলাম মুর্শিদের গাড়িতে। গত বছর হাজি গোলাম মুর্শিদের সঙ্গে বিটিভিতে আমার কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা যখন এলিফ্যান্ট রোডে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আজ কী বলবেন মুজিব ভাই?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু কোনো কিছু তেমন একটা চিন্তা না করেই বলেন, ‘জানি না। আল্লাহ আমাকে দিয়ে যা বলাবেন তাই বলব।’ হাজি গোলাম মুর্শিদ এখনো জীবিত আছেন।৭ মার্চের সেই ১৯ মিনিটের ভাষণ প্রমাণ করেছে বঙ্গবন্ধুকে কেন রাজনীতির কবি বলা হয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে তিনি একপর্যায়ে বলেন, ‘২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২তে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই।’ এই তিনটি লাইনে তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কিভাবে বাঙালিদের শোষণ ও শাসন করেছে তার কথা বলেছেন। অথচ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে শুধু অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছিল। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পায়নি। বাঙালিরা পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল এই বিবেচনায় যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হলে তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পারবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি দেশের অধিকার চাই।’ এ দেশের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরে ১৮ বার জেলে গিয়েছেন, সাড়ে ১১ বছর জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ক্ষমতা দিয়ে আঁচ করতে পেরেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ আসন্ন। তিনি জনগণকে সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এ-ও বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ একবার শুরু হলে হয় তিনি বন্দি হবেন, নয়তো বা মৃত্যুবরণ করবেন। তিনি তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে কী কী করণীয় সেই নির্দেশনাও দিয়ে গিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে।অনেকে বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করে সেনানিবাস আক্রমণ করলে বাংলাদেশ সেদিনই স্বাধীন হয়ে যেত। এটি একটি বালখিল্যসুলভ মন্তব্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল কখনো একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে না। তা করলে সেটি মুক্তিযুদ্ধ হয় না, হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকায় একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়েছে। বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছে। সমসাময়িক ইতিহাসে সুদান ও পূর্ব তিমুর এমন আন্দোলন করে সফল হয়েছে জাতিসংঘ ও বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যস্থতায়। একাত্তরে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পক্ষে তো ছিলই না, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর প্রায় সব আরব রাষ্ট্র (ইরাক ছাড়া) পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা হতো নিছক বোকামি। কিন্তু একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই তাঁর ভাষণের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন আসন্ন লড়াইটার উদ্দেশ্য কী হবে। অন্যদিকে মার্চের ১ তারিখে ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরপরই বাংলাদেশের শাসনভার সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এমনকি ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল কিন্তু সেদিন সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি।১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী নেতা ড. মার্টিন লুথার কিং সে দেশে বর্ণবাদ বিলুপ্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তৃতা ‘I have a dream’ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কিং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। কারণ তাঁকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশের সার্বিক মুক্তি দেখার আগেই তাঁকেও ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। তাঁর সেই অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব এখন তাঁর কন্যার হাতে। পিতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে কন্যা সফল হবেন—আজকের দিনে সেটাই একমাত্র প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৪৪
false
rn
পাঁচশ বছর আগের কথা পাঁচশ বছর আগের কথা। তখন আরব বণিকদের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। এশিয়ার আরব, পারস্য, ভারত, চীন ছিলো সমৃদ্ধশালী দেশ। আর ইউরোপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ছিলো উন্নত দেশ। আফ্রিকার মিশরও কিন্তু এক সময় অনেক উন্নত ছিলো।পর্তুগিজ নাবি ভাস্কো দা গামা।তিনি ছিলেন, পনেরো শতকের বিশ্বসেরা পর্যটক। তিনিই প্রথম এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যপথ আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের যুগের সফলতম নাবিক ভাস্কো দা গামা ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর ভারতের কোচিতে মৃত্যুবরণ করেন। তার নেতৃত্বেই প্রথম ইউরোপীয় জাহাজ ভারতে আসে।ভাস্কো ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান।হজব্রত পালনের উদ্দেশে মক্কাগামী কালিকটের মুসলমানরা তার বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, ৪০০ হজযাত্রীসহ জাহাজটিকে গামা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তাদের সবাইকে পুড়িয়ে মারেন। সভ্য পৃথিবীর শুরুটা হয়েছিলো ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশ থেকে। এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের সমৃদ্ধির জন্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ নিয়ে আসতো। কখনো এই সম্পদ আনতো ব্যবসার মাধ্যমে আবার কখনো আনতো দেশ দখল করে। এই সম্পদ সংগ্রহের জন্যই সেই দেশগুলোর দরকার নতুন নতুন দেশ খুঁজে বের করা। গামা ১৭০ জন নাবিক ও চারটি জাহাজ নিয়ে ৮ জুলাই ১৪৯৭ সালে পর্তুগালের লিসবন বন্দর থেকে যাত্রা করেন। উত্তমাশা অন্তরীণ অতিক্রম করে মোজাম্বিক, মোম্বাসা, মালিন্দি হয়ে ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান। আরব বণিকদের বিরোধিতার কারণে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হন। ভারতের সঙ্গে ইউরোপের জলপথ আবিষ্কারে পর্তুগালের রাজা মানুয়েল ছিলেন বিশেষ উদ্যোগী। তিনি প্রথমে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভাস্কো দা গামার পিতাকে। পরে তিনি এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন ভাস্কো দা গামার উপর। ভাস্কো দা গামার অভিযাত্রার সাফল্য সম্পর্কে তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। প্রাচ্যদেশে ভারত তখন ছিল এক সমৃদ্ধ উপমহাদেশ। এখানে আসার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা চলেছিল বহু বছর ধরে। এর প্রায় দুশ বছর আগে থেকে স্পেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের অভিযাত্রী নাবিকরা সমুদ্রপথে ভারতে আসার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক পর্তুগিজ পর্যটকও এ পথে অভিযান চালিয়েছিলেন। তারা কেবল উপকূলীয় নৌ-চালনা জানতেন। এদের মধ্যে লোপো গনজালভেজ বিষুব রেখা অতিক্রম করেছিলেন। দিয়োগো চাও আবিষ্কার করেছিলেন জায়ারে।এক সময় ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতবর্ষ আবিষ্কারের নেশায় নিনা, পিন্টা, সান্তামারিয়া নামের তিনটি জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে ভেসেছিলেন। দুই মাস লোনা জলে ভেসে যখন সবুজের সন্ধান লাভ আর বিস্তীর্ণ তটরেখা দেখলেন, তিনি উল্লসিত হয়ে বললেন, আমি ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেছি। আসলে সেটি ভারতবর্ষ নয়, ১৪৯২ এর ১২ অক্টোবর তিনি আমেরিকার বাহামা দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করেছিলেন। সেটা ছিল তার আমেরিকা আবিষ্কার। বাঙলার সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য, পুথি, কবিতা, গান এমনকি বালক রবীন্দ্রনাথের আমসত্ত্ব দুধ ভাতে আকৃষ্ট হয়ে কোনো বণিক বা পর্যটক বঙ্গে আসেনি। বাঙলা ভাষাতেও আকৃষ্ট হয়ে নয়, ওরা এসেছে বাংলাদেশের বিখ্যাত মসলার গন্ধে। গোলমরিচ আর লবণ ছিটিয়ে সেদিন পর্যন্ত ওরা কেটে-ছিঁড়ে মাংস খেত। বঙ্গের তেজপত্র, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ রন্ধনে যুক্ত হয়ে গোশেতর স্বাদই দিল পাল্টে। আর যুগ যুগ ধরে আরব বণিকরাই পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভারতীয় মসলার জোগান দিয়ে রসনার উদ্রেক ও মাংসাশী জাতিগুলোকে ভারতমুখী করেছিল। ভারত ভূমের সন্ধান পেয়ে পর্তুগিজরা আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে আরব ও মুসলিম বিতাড়ণে তত্পর হয়।বিশ্বখ্যাত নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসও ভারতে আসার জলপথ খুঁজতে অভিযাত্রায় বের হয়েছিলেন। ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট তিনি কাঠের তৈরি তিনটি জাহাজ ও ৯০ জন নাবিকসমেত সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন। ভারতের জলপথ আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এক নতুন মহাদেশ। তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি ভারতে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আসলে তিনি যে মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন সে মহাদেশের নাম আমেরিকা। ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোল ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে পরিভ্রমণে বেরিয়ে যে দ্বীপমালাটির নাম রেখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিজ তার অধুনা নামটি হলো ইন্দোনেশিয়া তথা ইন্ডিয়েন এশিয়া, যেখানে ভাস্কো দা গামার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীতে হাজির হতে থাকল অন্যান্য পর্তুগিজ নাবিক। ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সেখানে চলল ইউরোপীয় নানা জাতের শ্বেতাঙ্গদের দখলদারিত্বের লড়াই যাতে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলো ক্ষুদ্রতর হল্যান্ড। প্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষ থেকে জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত গোটা ভূভাগই ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ইন্ডিজ তথা ভারতবর্ষ হিসেবে। ভাস্কো দা গামার জন্ম পর্তুগালের সাইনিসে, ১৪৬৯ সালে। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা এবং নৌচালনবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৫০২ সালে ভাস্কো দা গামা ১৫টি জাহাজ এবং যুদ্ধ সরঞ্জামসহ দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে আসেন। প্রথমবার পর্তুগিজদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করার অজুহাতে তিনি বহু নিরীহ ভারতীয়কে হত্যা করেন। ভাস্কো দা গামা ও তার সঙ্গীরা ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। তাদের মনে হল, স্থানীয় লোকজন খ্রিস্টানদের সঙ্গে শত্রুতা করতে পারে। এই ভয়ে তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়। ১৪৯৮ সালের ২০ মে। ভাস্কো দা গামা তার জাহাজের বহর নোঙর করলেন কালিকট বন্দরে। আরব সাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত বন্দর ছিল এটি। সেখানে তিনি আর একটা পেদ্রো স্থাপন করলেন। তিনি যে ভারতে পৌঁছে গেছেন সেটা ছিল তার স্বাক্ষর। এভাবে আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে ইউরোপ থেকে প্রাচ্যে ভাস্কো দা গামার প্রথম অভিযাত্রা শেষ হল।সে সময়ে কালিকট দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। সেখানকার হিন্দুরাজা ছিলেন সামুথিরি (জামোরিন)। তিনি তখন ছিলেন তার দ্বিতীয় রাজধানী পোন্নানিতে। ইউরোপীয় নৌবহরের আগমনের খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ফিরে এলেন রাজধানীতে। ঐতিহ্য অনুযায়ী ভাস্কো দা গামাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হল। প্রায় ৩০০০ সশস্ত্র লোক সামিল হল অভ্যর্থনা শোভাযাত্রায়। ভাস্কো দা গামা ১৫০২ সালে ১৫টি জাহাজ ও যুদ্ধসরঞ্জাম নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতে আসেন। এ যাত্রায় তিনি একটি দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন। এর নাম রাখা হয় আমিরান্তে দ্বীপপুঞ্জ। সে সময়ে ভারতে কালিকট ও কোচিনের রাজার মধ্যে বিবাদ চলছিল। এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে ভাস্কো দা গামা ভারতে প্রথম পর্তুগিজ বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করেন। কোচিন ও কানানোর নামে দুটি জায়গায় বাণিজ্যকুঠি নির্মিত হয়। কোচিন শহরে পর্তুগিজরা দুর্গ নির্মাণ করে এবং নিকটবর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করে। ভারতের বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও ভারতে যাতায়াত শুরু করে।
false
mk
রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ সমস্যাটি প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের। কিন্তু সেটি এখন বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর তিনটি ক্যাম্পের ওপর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণের জের ধরে নতুন করে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচনায় এসেছে। আক্রমণে মিয়ানমারের ৯ জন সীমান্ত বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ধারণা ওই আক্রমণ চালিয়েছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সোলিডারিটি অরগানাইজেশন)। ফলে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশনের জের ধরে গত সপ্তাহে কয়েকশত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বিজিবি বেশ কিছু দলকে পুশব্যাক করতে সক্ষম হলেও উদ্বাস্তুদের স্রোত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নতুন ঘটনা নয়। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (আগের নাম বার্মা) স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবার কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় এসে বসতি গেড়েছে ও সবার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি। তবে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে মিয়ানমারের মূলস্রোতের সমাজ, রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বহু আগ থেকেই একটা বড় দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে আছে। ১৯৪৭-৪৮ সালে রোহিঙ্গাদের কিছু স্থানীয় নেতা রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলকে পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যদিও সেটি তখন তেমন গুরুত্ব পায়নি। সুতরাং ১৯৪৮ সাল থেকেই মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী বার্মিজ এবং তাদের শাসকদের কাছে রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবে সন্দেহের পাত্রে পরিণত হয়। বার্মিজ শাসকদের বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে বিদ্রোহী সংস্থা, যা এক সময়ে এসে সশস্ত্র সংগঠনে রূপ নেয়। কিন্তু সশস্ত্র তত্পরতা বেশি দূর এগোতে পারে না। কারণ, নিকট প্রতিবেশী কোনো দেশের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কার্যকর সশস্ত্র তত্পরতা চালানো সম্ভব হয় না। সংগত কারণেই চীন ও ভারতের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ কখনোই ছিল না। আর পাকিস্তান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সহযোগিতা প্রদানের বিষয় নিয়ে বেশি জড়িত থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রতি কখনো গুরুত্ব দেয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার দৃঢ় নীতির কারণেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনের আর কোনো ভরসা থাকে না। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে উগ্র ইসলামিস্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ জামায়াতের মতো ওয়াহাবিবাদীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো নতুন আশায় আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ফলে ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সরকার সব রোহিঙ্গাকে বিতাড়ন করার উদ্দেশে অভিযান চালায় এবং প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। সমস্যা সমাধানের বদলে আরও জটিল করে তোলা হয়। এ সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়ানোর ফলে সমস্যা আরও বহুমুখী জটিল রূপ ধারণ করে। সাধারণ রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য মহামানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলেও সশস্ত্র সংগঠনগুলোর জন্য নতুন সুযোগ আসে। আর এভাবেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য মহাযন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অন্যের বোঝা আমাদের মাথায় পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেশের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে তা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়াউল হক প্যান ইসলামিজমের নীতি বিস্তারের পরিকল্পনায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মতো আরএসওকেও করাচিতে অফিস খোলার সুযোগসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়, যার ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে তখন দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।জামায়াতসহ উগ্র ইসলামিস্টদের পোয়াবারো হয়। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পায়। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে আরও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়। মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলে তাদের সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু হিতেবিপরীত হয়েছে। এটা এখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, উভয়ের জন্য বড় ধরনের জটিল নিরাপত্তা সংকটের সৃষ্টি করেছে। ২০১২ সালে একশ্রেণির উগ্র ইসলামিস্টের প্রোপাগান্ডা ও প্ররোচনায় কক্সবাজারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে আক্রমণ হয় এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলে তার পেছনেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে মিয়ানমার সরকারের ভ্রান্তনীতি থেকেই এ সংকটের উত্পত্তি। একটা জনগোষ্ঠীকে বিনাশ-বিতাড়ন করার প্রচেষ্টা কখনোই কোনো সমাধান দেবে না। তবে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক একটা প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই, তার সঙ্গে বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক এবং জামায়াত-বিএনপি সরকার বিষয়টিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণে আমাদের জন্য এটা এখন একটা বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করেছে। একদিকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের ভিতরে এবং বহির্বিশ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বহু রকম স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার স্বার্থে এই সংকটকে জিইয়ে রাখতে চায়, পরিপূর্ণ সমাধান চায় না। ফলে দেখা গেল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই আরএএসও কর্তৃক মিয়ানমারের নিরাপত্তা ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ এবং তার অজুহাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নতুন করে কম্বিং অপারেশন, নতুন উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা। ১৯৭৮ ও ৯১ সালে দুই দফায় প্রায় ছয়-সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়। তাছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণের ভয়ে এবং ভালো সুযোগের সন্ধানে চোরাই পথে প্রতিনিয়তই বিক্ষিপ্তভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাঝখানে একবার প্রায় দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত দেওয়া হয়। এখনো প্রায় পাঁচ লাখের মতো অবৈধ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় এক রকম স্থায়ী বসতি গেড়ে বসে গেছে। বৈধ শরণার্থী হিসেবে আছে মাত্র ২৮ হাজার। কক্সবাজারের স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা রকম অপকর্ম যেমন মানব পাচার, অবৈধ ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় রোহিঙ্গারাও তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। শোনা যায় বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত। এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে কক্সবাজারের সংসদীয় আসনগুলোর জয়-পরাজয়ের বড় ফ্যাক্টর হবে রোহিঙ্গা ভোটাররা। রোহিঙ্গাদের তখন আর ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। যার সুযোগ নেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো এবং তাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। স্থায়ী ও অনিরাময়যোগ্য বিষফোঁড়া গায়ে নিয়ে বাংলাদেশকে চলতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সত্য হলো— মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছা ব্যতিরেকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বিদেশি কোনো সশস্ত্র সংগঠন বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া হবে না, এই নীতির সুযোগ নিয়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতায় এলে সেটা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো। সহজ সমাধানের একটা পথ বের হতো। বাংলাদেশের বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার এই নীতির বাস্তব প্রতিফলন ভারতের সঙ্গে দেখিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাই মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশকে আস্থায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা একটা ইতিবাচক পথের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু তা না হলে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করলে সব রকম সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় শতভাগ বন্ধ করা কখনো সম্ভব হবে না। এর সুযোগ নেবে দেশি-বিদেশি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং বহুরূপী স্বার্থান্বেষী মহল। এটাই বাস্তব ও কঠিন সত্য কথা। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।নোবেল জয়ী অং সান সু চির দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর একটা আশা মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তিনি সবাইকে হতাশ করেছেন। তবে বাংলাদেশকে বসে থাকলে চলবে না। বিষফোঁড়া নিয়ে বসে থাকার যন্ত্রণা বড় কঠিন যন্ত্রণা। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদীয়, সব ওষুধ ও চিকিৎসার সন্ধান করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করতে হবে। বন্ধুসম তৃতীয় পক্ষকে কাজে লাগাতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে অথবা সুযোগ নিয়ে আমাদের নিরাপত্তার জন্য কেউ যাতে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা নীতির আওতায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৫৯
false
ij
গল্প_ বোধোদয় আজ সকাল থেকেই লন্ডন শহরের ওপরের হালকা নীল আকাশ থেকে রোদ ঝরছে । সেই নীল আকাশের বুকে ভাসছে শুভ্র মেঘের গুচ্ছ। আজ সকাল থেকেই উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছিল পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস, হোয়াইটচ্যাপেল, ব্রিক লেইন । ব্রিক লেইনের রাস্তার দু’পাশে লাল ইটের নির্বিকার দালানকোঠা, পুরাতন ফুটপাতে লোকজনের চলাচল, থেমে থাকা গাড়ির লাইন-; তবে লন্ডনের বাংলাটাউন নামে খ্যাত এই জায়গায় এই মুহূর্তে তেমন ভিড় নেই । মোবাইল ফোনটা কানে ঠেকিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল তানিম। ওর ডান পাশে রাস্তার উলটোদিকে সিটি স্পাইস, সেবা তন্দুরী, আলাদিন সুইট সেন্টার আর আলাদিন রেস্টুরেন্ট। তুর্কি মালিকানাধীন ক্লিফটন রেস্টুরেন্টটা আরেকটু সামনে। ওই রেস্টুরেন্টেই মাস তিনেক হল কাজ করছে তানিম । রেস্টুরেন্টের মালিক তুর্কি-নাম আগা আহমেত। ফরসা পঞ্চাশের মতন বয়স লোকটার , ভীষণ সময় সচেতন; তিরিশ বছর আগে লন্ডনে এসে রীতিমতো ব্রিটিশ হয়ে গেছে তুর্কিটি। দ্রুত হাঁটছে তানিম। সময় মত পৌঁছতে না পারলে বকবক করবেন আগা আহমেত । ইউরোপজুড়ে রিসেসন চলছে। এই সময়ে চাকরি হারালে সর্বনাশ। অনেক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীর চাকরি নেই। কী যে কষ্ট করে পড়ছে তারা। টেলিফোনের অপরপ্রান্তে মা বলছিল, কষ্ট হলে চাকরিটা ছেড়ে দে তানিম। তানিম আঁতকে ওঠে। বলে, না না। জব ছাড়া যাবে না। লন্ডনে জিনিসপত্রের যা দাম। ঢাকাতেই ভালো ছিলাম মা। এখানে এক মা বলল, আমি আরও টাকা পাঠাবো? তোর মবিন খালু ডেমরার জমিটা কিনতে চাইছে।তানিম বলল, না না। ডেমরার জমিটা বিক্রি করো না। তোমাকে টাকা ভাবতে হবে না। আমার যা ইনকাম হচ্ছে তাতে চলে যাবে।ভালো করে খাওয়াদাওয়া করিস বাবা।তানিম হাসল। বলল, আরে আমি খাওয়ার জায়গায় চাকরি করি মা। জানই তো আমার রেস্টুরেন্টের মালিক টার্কিশ; এরা খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে অনেক উদার। ভালো করে পড়িস বাবা। তোর বাবার শখ ছিল বিলেতে ব্যারিষ্টারি পড়বে, হল না। এখন যদি বেহেস্ত থেকে তোকে দেখে শান্তি পায়। আচ্ছা মা। আমি ভালো করেই পড়ব।রোজ মায়ে ছেলের এমন সব কথা হয় । অনেক কষ্টে পয়সা বাঁচিয়ে রোজ একবার ঢাকায় ফোন করে তানিম। রোজ একবার মায়ের সঙ্গে কথা বলা চাই। ফোন অফ করে আশেপাশে একবার তাকায় তানিম। দূর থেকে মিসেস মেহনাজ শামসী কে আসতে দেখল তানিম । মাঝ বয়েসী দীর্ঘাঙ্গী মহিলাটি পাকিস্থানি। মিসেস মেহনাজ শামসীর পরনে সালোয়ার কামিজ। ব্রাডি স্ট্রিটে তানিমের প্রতিবেশি মহিলা। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এই মহিলার ভারি বদনাম আছে। বাঙালিদের ভয়ানক অপছন্দ করেন মিসেস মেহনাজ শামসী । লন্ডন পৌঁছে প্রথম প্রথম তানিম এই বাঙালি বিদ্বেষের ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। পরে বাঙালিদের মুখে শুনে বুঝতে পেরেছে। একাত্তরের যুদ্ধের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সর্ম্পক ঠিক আগের মত নেই-তানিম এসব জানে। তানিম অবশ্য মিসেস শামসীকে ঘৃনাও করে না বা শ্রদ্ধাও করে না। আসলে ও এসব নিয়ে তেমন ভাবেও না। ওর আগ্রহের বিষয় অন্য । মিউজিক। ঢাকায় থাকতে একটা ব্যান্ডে ড্রামস বাজাত তানিম। রেগুলার কনসার্ট করত। লন্ডন আসার আগে সে চ্যাপ্টার শেষ করেই এসেছে। মিউজিক আর না-এখন থেকে মন দিয়ে পড়বে। নওরীন অপেক্ষ করছে। পড়াশোনা শেষ করে একটা জব নিয়ে নওরীনকে বিয়ে করবে । তানিমের ভাগ্যে মনে হয় মিউজিকই আছে । লন্ডন এসে ক’জন মিউজিশিয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। জয়, সুজানা, আরাফাত ও শামস। এরা সবাই ছোট বেলা থেকেই লন্ডনেই বেড়ে উঠেছে । তবে বাংলা গান করে; “শতাব্দী” নামে একটা ব্যান্ড আছে এদের। সুজানা ব্যান্ডের ভোকাল। মেয়েটির গলা চমৎকার। মূলত ফোক ধাঁচের গান করে শতাব্দী। ওরা ড্রামার খুঁজছিল। তানিমকে অফার করলে সে ড্রামস বাজাতে রাজী হয়। সেই থেকে একসঙ্গে কনসার্ট করছে। বাঙালি কমিউনিটিতে শতাব্দী জনপ্রিয় ব্যান্ড। তানিম ও ব্যান্ডের অন্য সদস্যরাও জনপ্রিয়। বিশেষ করে সুজানা। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে তানিমের ভ্রুঁ কুচঁকে যায়। ও থমকে যায়। মিসেস মেহনাজ শামসীর ঠিক পিছনে তিন চার জন তরুণ। ব্ল্যাক। আফ্রিকা না ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঠিক বোঝা গেল না। লন্ডনের অনেক ব্যাপার এখনও বুঝে উঠতে পারেনি তানিম। লন্ডনে ব্ল্যাকরা সাধারনত মাইল এন্ড, স্টেফনি, প্যাডিংটন আর সেন্ট গিলস এ থাকে। ছেলেগুলোর হাঁটার ধরন এবং মুভমেন্ট ভালো লাগল না তানিমের। ও লক্ষ করে, সামান্য পৃথুলা মেহনাজ শামসী একটা ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছেন; ব্ল্যাক তিনজন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় এবং একজন মিসেস মেহনাজ শামসীকে অতিক্রম করে যায়। অন্যজন ঠিক পাশে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকায়। তানিম যা বোঝার বুঝে যায়। তানিমের মূল আগ্রহ মিউজিক হলেও ও জানে পৃথিবীর যে কোনও স্থানে নারীর ওপর অ্যাটাক হলে জানবাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। চোখের পলকে দ্রুত দৌড়ে শূন্যে লাফিয়ে পড়ে তারপর তিজনজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তানিম। অতর্কিত আক্রমনে ছেলেগুলো প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়ে। শিকার ফসকে যাচ্ছে বলে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়। এরপর গুলির ভয়ঙ্কর শব্দে ভীষণ ভাবে কেঁপে ওঠে ব্রিক লেইন। ঢলে পড়ল তানিম । এখুনি পুলিশ আসবে। ছেলেগুলো এদিক ওদিক পালিয়ে যায়।ফুটপাতের কিনারায় ব্রিক লেইনের লাল দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফ্যাকাশে ভয়ার্ত মুখটা ঢেকে থরথর করে কাঁপতে থাকেন মিসেস মেহনাজ শামসী ।ছিনতাইকারীর আক্রমনের সময় একজন বাংলাদেশি ছাত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন পাকিস্তানি মহিলাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে; সেই বাংলাদেশি ছাত্রটি এই মুহূর্তে হোয়াইটচ্যাপেল এর রয়েল লন্ডন হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে - এ ঘটনাটি পূর্ব লন্ডনের দক্ষিণ এশিয় কমিউনিটিতে দারুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাস যে বৈরী তা সকলেই জানে। কাজেই এ ধরনের ঘটনা তো ঘটার কথা না ...বাংলাদেশি ছাত্রটি কেন তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিল এ ব্যাপারে মিসেস মেহনাজ শামসীও নিশ্চিন্ত নন; তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ব্রাডি স্ট্রিটে নিজের ঘরে জায়নামাজ পেতে মেঝেতে ওপর বসে আছেন তিনি। ভারি বিষন্ন বোধ করছেন। ব্রিকলেইন পুলিশ স্টেশনে মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে দেড় ঘন্টা দীর্ঘ জবানবন্দি দিতে হয়েছে। তখন খুব ক্লান্ত লাগছিল। ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এসেছিল। পুলিশের ধারণা বাঙালি ছেলেটি রুখে না দাঁড়ালে আজ তিনি খুন হতে পারতেন। বাংলাদেশি ছেলেটাকে রক্তাক্ত অবস্থায় হোয়াইটচ্যাপেল রয়েল লন্ডন হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে। ব্রিকলেইন পুলিশ স্টেশন থেকে হোয়াইটচ্যাপেল যাননি। ঘরে ফিরে এসেছেন। মনে এজন্য এক ধরণের অস্বস্তি জমে উঠছিল। বাঙালিদের অপছন্দ করেন; অথচ এক বাঙালি ছেলে প্রাণ বাঁচাল। বাংলাদেশি ছেলেটা কাছেই থাকে। মাঝেমাঝে দেখেছেন। এড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশিদের পছন্দ করেন না মিসেস মেহনাজ শামসী । কাজেই এড়িয়ে যেতে হয়। আজ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ঘরে ফেরার পথে রাস্তায় ব্ল্যাক দেখলেই ভয় হচ্ছিল। ইকোনমিক রিসেসন চলছে, চাকরি-বাকরি নেই, সরকারি বেকার ভাতায় চলে না। লন্ডন শহরে বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেট বরোয় ক্যারবিয়দের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়দের জীবনযাত্রার মান উন্নত বলেই প্রতিহিংসাবশত মাঝেমধ্যেই ইর্ষাকাতর ক্যারবিয়রা লুঠতরাজের শিকার হয় দক্ষিণ এশিয়রা।মিসেস মেহনাজ শামসী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হ্যাঁ, দক্ষিণ এশিয় হিসেবে তিনিও স্বচ্ছল জীবন যাপন করেন বৈ কী। ১৯৭২ সালে মিসেস মেহনাজ শামসী পাকিস্তানের লাহোর থেকে স্বামীর সঙ্গে বিলেত পাড়ি জমান । তখন শুরুটা আজকের মতো স্বচ্ছল ছিল না। যদিও লাহোরের এক বনেদি পাঞ্জাবি পরিবারে জন্ম মিসেস মেহনাজ শামসীর। ইস্ট পাকিস্তানে পাট শিল্পে কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছিলেন মিসেস মেহনাজ শামসীর বাবা ইন্তেখাব জামান। ইষ্ট পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলে কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রেখে মারা যান ইন্তেখাব জামান। জীবন হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। সদ্য বিয়ে হয়েছে মিসেস শামসীর। স্বচ্ছল জীবনের আশায় স্বামী মুস্তাক রেহমান এর হাত ধরে লন্ডন আসতেই হল। জীবন তখন ছিল কঠিন সংগ্রামে ভরা অনিশ্চিত । স্বামী মুস্তাক রেহমান যথেস্ট স্ট্র্যাগল করেছেন। স্বামীর পাশাপাশি তিনি নিজেও স্ট্র্যাগল করেছেন। গত বছর মুস্তাক রেহমান মারা গেছেন। স্ট্রোকে। মেহনাজ শামসীর একটিই ছেলে-জুনায়েদ অস্ট্রেলিয়া থাকে; দুটি মেয়ের একজন থাকে লিভারপুল ও অন্যজন ডাবলিন । ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। হ্যাঁ। মেহনাজ শামসীর জীবন এখন নিঃসঙ্গ হলেও উন্নত। দরিদ্র ইর্ষাকাতর ক্যারবিয়রা তাকে লক্ষবস্তুতে পরিনত করতেই পারে । আজ যদি বাংলাদেশি ছেলেটা আমাকে না-বাঁচাত? শিউরে উঠলেন মিসেস মেহনাজ শামসী। জায়নামাজে বসে নিজের সঙ্গে অনেক ক্ষণ যুদ্ধ করলেন মিসেস মেহনাজ শামসী। তারপর উঠে দাঁড়ালেন । জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে চেয়ারে বসলেন । তারপর টেবিলের ওপর থেকে কলম আর লেখার প্যাডটি টেনে খসখস করে লিখতে থাকেন: প্রিয় তানিম, শুভেচ্ছা নিও। আমার বিশ্বাস আল্লাহ্তালার অসীম রহমতে তুমি অচিরেই সুস্থ্য হয়ে উঠবে। আসলে ভুল আমারই হয়েছিল। আজ আমার ভুল তুমি ভেঙ্গে দিয়েছ। আমার ... আমার খুব খারাপ লাগছে এই ভেবে যে আমি বাঙালিদের ঘৃনা করতাম। কারণ, আমি মনে করতাম বাঙালিরা পাকিস্তানের চেয়ে ইন্ডিয়াকে পছন্দ করে বেশি, ইন্ডিয়ার কথা শুনেই বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছে। এখন আমি জানি সেভেনটি ওয়ানের যুদ্ধ নিছক গৃহযুদ্ধ (অধিকাংশ পাকিস্তানি যেরকম বিশ্বাস করে ...) ছিল না- ছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ। আজ আমার চোখ খুলে গিয়েছে। বাঙালিদের দাবীই সত্য ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানা দিক দিয়ে ইষ্ট পাকিস্তানের বাঙালিদের বঞ্চিত করেছিল। যাক, একাত্তরের যুদ্ধে আমার কয়েকজন নিকট আত্মীয় মারা গেছেন-তারা পাকিস্তানি আর্মিতে ছিল। ষাটের দশকে আমার বাবা ইস্ট পাকিস্তানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ... ইস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হলে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হয়ে বলে আমি বাঙালিদের ওপর ক্ষেপে ছিলাম। তা ছাড়া পাকিস্তানে সরকারিভাবেই ১৯৭১ সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেওয়া হয়। এ কারণে আজও অনেক পাকিস্তানি বাঙালিদের স্বাধিকার সংগ্রাম সম্বন্ধে মিথ্যে ধারণা আঁকড়ে ধরে আছে। যাক। আজ আমি বিশ্বাস করি বাঙালিরা জগতের শ্রেষ্ঠ এক জাতি ; যাদের দৃঢ় অবস্থান ন্যায়বিচার ও মূল্যবোধের পক্ষে। মায়ের প্রতি বাঙালিদের শ্রদ্ধা, গভীর মমতা ও আত্মত্যাগের তুলনা হয় না। বাঙালি চরিত্র সম্বন্ধে এতোদিন আমি ভুল বুঝে ছিলাম; সম্ভব হলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কখনও বাংলাদেশে যাইনি তবে আমি জানি যে তোমাদের ফসলের মাঠ কী রকম সুবিশাল মনোমুগ্ধকর আর সোনালি। জগতের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ নদীকে তোমরা করতলগত করে রেখেছ এবং তোমাদের বদ্বীপের সূর্যালোক অদ্ভুত সুন্দর ও উজ্জ্বল। কৃষ্ণকায় বাদামি রঙের মানুষেরা ন্যায়বিচার ও মূল্যবোধের পক্ষে। শুনেছি বাঙালিরা কোন্ এক কবির গান গায়, সম্ভবত টেগোর; তিনিও সত্য সুন্দর ও মহৎ। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বকোণে আমার জন্ম না হওয়ার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে ... মিসেস মেহনাজ শামসী। লেখা শেষ করে কাগজটি ভাঁজ করে একটা বাদামি রঙের ইনভেলাপে ভরে রাখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার থেকে ব্যাংয়ের চেকবই বার করলেন। চেকবই আর ইনভেলাপটা ব্যাগে রেখে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলেন । প্রথমে ব্যাংকে যাবেন তিনি। তারপর হোয়াইটচ্যাপেল এর রয়েল লন্ডন হাসপাতালে। হোয়াইটচ্যাপেল রয়েল লন্ডন হাসপাতালটি পূর্ব লন্ডনের একটি বিখ্যাত হাসপাতাল। তারই উল্টোদিকের ফুটপাতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা বয়েসি লোকজন দাঁড়িয়ে। প্রতেক্যের মুখ বেদনার চিহ্ন; প্রতেক্যের হাতে ফুল। এখনও সন্ধ্যা নামেনি। সন্ধ্যার পর সবার হাতে মোমবাতি জ্বলে উঠবে যদি না ততক্ষণে প্রত্যাশিত সংবাদ না আসে। গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালিদের কারও কারও হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা: “ ফিরে এসো তানিম ”, “জীবন তোমাকে ডাকছে’,“ তুমি আবার ফিরে এসো গানের মঞ্চে।” পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটিতে মিউজিশিয়ান হিসেবে পরিচিত তানিম । সে মূলত ড্রাম বাজালেও কী বোর্ড বাজিয়ে চমৎকার গান গাইতে পারে। গেল সপ্তাহে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার পার্টির ক্যান্ডিডেট রৌশনআরা আলীর একটা সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান হয়ে গেল। সে অনুষ্ঠানে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের “আমি ফুল/ বন্ধু ফুলের ভোমরা ” - এই জমজমাট গানটি গেয়ে উপস্থিত দর্শকশ্রোতার মন জয় করেছে। ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সুজানা। অল্প অল্প কাঁপছে মেয়েটি। এইমাত্র তানিমের মা রওশন আন্টির সঙ্গে ফোন কথা হল। আন্টি ভীষন ভেঙ্গে পড়েছেন। ভেঙ্গে পড়েছে সুজানাও। আজ সন্ধ্যায় বেথনাল গ্রিন-এ কনসার্ট ছিল। কনসার্ট না-হয় বাদ দেওয়া গেল। তানিম ওর ভালো বন্ধু -কী যে অস্থির লাগছে। এই মুহূর্তে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তানিম ; রওশন আন্টির একটাই ছেলে। রওশন আন্টি বিধবা। এখন কী যে হবে। সুজানার অবিরল চোখের জলে রাস্তার ওপাশের রয়েল লন্ডন হাসপাতালের গম্ভীর দালানটি ঝাপসা দেখায়। বাংলাদেশিদের মৌন সমাবেশের আশেপাশে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ন জাতিগোষ্ঠী। লেবার পার্টির থেকে এবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রৌশনআরা আলীর এম পি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। পুলিশের নিরাপত্তা সেকারণেই। পথচলতি কয়েকজন কৌতূহলী শ্বেতাঙ্গ এগিয়ে আসে তারপর ঘটনার বিস্তারিত শুনে সমবেদনা প্রকাশ করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশি স্টুডেন্টটি মিউজিশিয়ান শুনে তাদের কেউ কেউ মৌন সমাবেশে যোগ দেয়।। মায়ের বয়েসি এক পাকিস্তানি মহিলাকে কৃষ্ণকায় দৃস্কৃতিকারীরা আক্রমন করেছিল। বাংলাদেশি ছেলেটি যে মহৎ হৃদয়ের অধিকারী সে ব্যাপারে সন্দেহ কী। তামিমকে যারা যারা চেনে কিংবা যারা যারা তানিমক চেনে না-তাদের প্রত্যেকের মুখই বিমর্ষ দেখায় । সমবেদনা জানাতে এমন কী ক্লিফটন রেস্টুরেন্টটা মালিক আগা আহমেত ও এসেছেন। ঐ টার্কিশ ভদ্রলোক বাংলাদেশিদের তিনি আশ্বস্ত করতে এসেছেন। এই রিসেসনের সময় তানিমের জব যাবেই না, বরং প্রয়োজনে টাকাপয়সা লাগলে তাকে যেন জানানো হয়। হঠাৎই ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে আসা একজন মহিলার ওপর চোখ আটকে যায় সুজানার। মাঝ বয়েসী দীর্ঘাঙ্গী মহিলার পরনে সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ। কাঁধ ও মাথা কালো ওড়নায় ঢাকা । দেখেই বোঝা যায় পাকিস্তানি। কেমন যেন চেনা চেনা লাগল মহিলাকে। সুজানার ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। ইনিই কি সেই পাকিস্তানি মহিলা- যাকে বাঁচাতে আজ সকালে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছে তানিম? হতে পারে। মহিলার হাতে ফুলের তোড়া। সুজানার কাছে এসে দাঁড়ালেন মহিলা । খানিকক্ষণ ইতস্থত করে বললেন, আমার নাম মিসেস মেহনাজ শামসী।জ্বী, বলুন। সুজানার কন্ঠস্বর ভারী শোনালো। কেমন আছে ছেলেটি?আপনি কি তানিমের কথা বলছেন?হ্যাঁ। মহিলা মাথ ঝাঁকাল। এখনও সেন্স ফেরেনি। শ্বাস টেনে সুজানা বলল। ওহ্। কোমায়? হ্যাঁ। সুজানা তীক্ষ্মচোখে মহিলাকে দেখছে । কালো ওরনার ফাকে লালচে চুল, অভিজাত ফরসা মুখে রুক্ষ সৌন্দর্য। সে মুখে চাপা উদ্বেগ। সুজানা টের পেল মিসেস মেহনাজ শামসী কি যেন বলতে ।ও ... ও আজ আমার জান বাঁচাল ... মিসেস মেহনাজ শামসীর কন্ঠস্ব জড়িয়ে যায়। সুজানা মাথা নাড়ে। ওর চোখের জলের ধারা তখনও শুকায়নি। এটা রাখ। বলে সুজানাকে ফুলের তোড়টি দিলেন মিসেস মেহনাজ শামসী । ‘ওহ!’ অস্ফুট শব্দ করে সুজানা ফুলের তোড়াটি নিল। মেহনাজ শামসী বললেন, তুমি কি তানিম কে ব্যাক্তিগত ভাবে চেন?সুজানা বলল, হ্যাঁ আন্টি। আমরা বন্ধু। আমাদের ব্যান্ড আছে। ওহ্, ইয়ে ...মানে ... তুমি কি তানিমের মায়ের টেলিফোন নাম্বারটা আমাকে যোগার করে দিতে পার?হ্যাঁ। আন্টি। রওশন আন্টির নাম্বার আমার কাছে আছে। রওশন?সুজানা বলল, রওশন আরা আন্টি তানিমের মা। ওহ্ ,। রওশন আরা। মিসেস মেহনাজ শামসী মনে মনে বললেন, কী আশ্চর্য! আমার মায়ের নামও তো রৌশনারা! বাঙালি কার যেন নাম রৌশনআরা আলী -এবার যার লেবার পার্টি থেকে এম পি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অনেক অনেক দিন পর এই মুহূর্তে নির্ভার লাগছে এই পাকিস্তানি মহিলার ; তার হৃদয়ের ওপর ভুলের বিরাট পাথরটি নেমে যাচ্ছে বলে ...ততক্ষণে সুজানা জ্যাকেটের পকেট থেকে নকিয়াটা বার করেছে। বলল, এই যে বলছি, আপনি সেভ করে নিন। টেলিফোন নম্বর সেভ করার পর ব্যাগ থেকে একটি বাদামি ইনভেলাপ বার করে সুজানাকে দিয়ে মিসেস মেহনাজ শামসী বললেন, এটা তোমার কাছে রাখ।কি? সুজানা অবাক। একটা চেক। ট্রিটমেন্টের অনেক খরচ আছে। তানিমকে দিও। ওহ্ । সুজানার ভিতরটা কেঁপে ওঠে। মুহূর্তেই ও অনেক কিছু বুঝে নেয়। ও জেনে যায় তানিমের জ্ঞান ফিরবে। তানিম আবার গান গাইবে। আর একটা চিঠি আছে। তানিম যেন পড়ে।
false
mk
নিখোঁজ জঙ্গিরা দেশেই আছে নিখোঁজ হয়েই ভয়ঙ্কর জঙ্গি তত্পরতায় জড়িয়ে পড়ছে ওরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এরই মধ্যে নিখোঁজ অনেকের নাম, ছবি প্রকাশ করেছে। আরও অনেকের নাম প্রকাশের অপেক্ষায়। সমপ্রতি দশ নিখোঁজ তরুণের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, এরাও ঘর থেকে পালিয়েছে। এই দশ জনই জঙ্গি তত্পরতায় লিপ্ত বলে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে খবর রয়েছে। নিখোঁজ জঙ্গিদের অনেকেই দেশে অবস্থান করছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে। অনেক ঘর পালানো তরুণ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, তুরস্ক, সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে অংশ নেয় । তাদের অনেকেই পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে বলে দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। প্রথম পাসপোর্টের ছবিতে দাড়ি থাকলেও দ্বিতীয় পাসপোর্টের ছবিতে দাড়ি থাকে না। নাম ঠিক রেখে অন্যান্য তথ্য ভুল দেয়। এসব পাসপোর্ট নিয়ে অনেক জঙ্গি দেশে ফেরে। এই পাসপোর্ট পাওয়ার বিষয়ে দূতাবাসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত। ইতোমধ্যে এই ধরনের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসা এক জঙ্গি নেতার সন্ধানে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে রয়েছে।পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর অনেক নিখোঁজ তরুণ বিদেশে না গিয়ে ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া অঞ্চলে গিয়ে জঙ্গি তত্পরতায় যুক্ত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের অনেক হামলার সঙ্গে তারা জড়িত। এক অঞ্চলের জঙ্গি অন্য অঞ্চলে গিয়ে হামলা চালায়। যাতে কেউ তাদের চিনতে না পারে। বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে সংশ্লিষ্ট সকল থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।এদিকে গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একটি বিষয় ভাবিয়ে তুলছে। দেখা গেছে, হামলার আগে জঙ্গিরা টার্গেট এলাকার আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করে। তাই জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।ইতোমধ্যে বাড়িওয়ালাদের জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। জননিরাপত্তা ও নাগরিকদের আইনগত সেবা প্রদানের জন্য বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়াদের ছবিসহ তথ্য পুলিশের কাছে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যদি কেউ তথ্য না দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভাড়াটিয়াদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে বাড়িওয়ালা এবং আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।সংশ্লিষ্টরা বলছে, অনেক নিখোঁজ তরুণ বিদেশে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে অবস্থান করছেন। নতুন হামলার ছক কষছেন বলেও গোয়েন্দারা ধারণা করছেন। সর্বশেষ ফাঁস হওয়া মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের এক হাজার ৭৫০ বিদেশি জঙ্গির তথ্যসংবলিত গোপন নথিতে দেখা যায় সাত বাংলাদেশি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিহত হয়েছে। এরাও গোপনে দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় আইএস-এ যোগ দিয়েছিল।এদিকে তিন জঙ্গি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জানিয়েছে, আর্টিজানের মতো হামলা বাংলাদেশে আরও হবে। এ খবরের পর পুলিশ এদের খুঁজছে।জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা ঝিনাইদহের দারুস সালাম জামে মসজিদের ইমাম রোকনুজ্জামান রোকনকে নিজের এলাকাবাসী ‘ভালো ছেলে’ হিসেবেই জানত। তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার খবরে এলাকাবাসী হতবাক হয়েছেন। রোকন ঝিনাইদহে অবস্থানকালে একটি মেসে ৮ জঙ্গিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এর মধ্যে গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গি নিব্রাস ইসলামও রয়েছে।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের নাইড়া গ্রামের মৃত আইনুদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি ঝিনাইদহ শহরের সোনালী পাড়ার দারুস সালাম মসজিদে তিনি ইমামতি করতেন। সেই সূত্র ধরেই তিনি ওই এলাকার মেসে জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। ঝিনাইদহ শহরের সোনালী পাড়ার সাবেক সেনা সার্জেন্ট কাউসার আলীর স্ত্রী বিলকিস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাড়ির পাশের দারুস সালাম মসজিদের ইমাম ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকনুজ্জামান প্রায় চার মাস আগে তার বাড়িতে ভাড়াটিয়া নিয়ে আসেন। ইমাম তখন বলেছিলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকবেন। প্রথমে দুইজন ওঠে। পরে আরও ছয়জন আসেন। এরপর তাদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়া হয়।এদিকে জঙ্গি প্রচারণা, উস্কানিমূলক কনটেন্ট বা এ ধরনের অ্যাপসহ ফোন সেট আমদানি ঠেকাতে নজরদারি বাড়াচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।তিনি বলেন, জঙ্গি প্রচারণা, উস্কানিমূলক কনটেন্ট বা এ ধরনের অ্যাপসহ মোবাইল হ্যান্ডসেটের দেশে প্রবেশ ঠেকাতে আমদানি অনুমতিতে যাচাই প্রক্রিয়া আরো কঠোর করা হবে। সরকারের অগোচরে জঙ্গি প্রচারণার কনটেন্টসহ হ্যান্ডসেট বাজারে পাওয়া গেলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও ওই কর্মকর্তা জানান। সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:৪৪
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০৩৩ নানা কারণে মন মেজাজ খারাপ থাকার কথা হলেও ততটা খারাপ নেই। প্রথমত, কমলার খোসা ছাড়িয়ে মুখে একটা কোয়া দিয়ে দেখি সেটার স্বাদ অবিকল কাঁঠালের মতো! হাসতে হাসতে বিষম খাচ্ছিলাম আরেকটু হলেই। জার্মানীতে এসে অবধি নপুংসক কমলা খাচ্ছি, আজকের কমলায় দেখলাম শয়ে শয়ে বিচি। কাঁঠাল আমার প্রিয় ফল নয়, কাঁঠাল বা কাঁঠালপাতার অনুরাগীদেরও আমি সন্দেহের চোখে দেখি, তবু কমলায় কাঁঠালের স্বাদ পেয়ে একে কোন আসমানী মোজেজা বলেই মনে হচ্ছে। মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এলাম একটা। পরীক্ষক দু'জনেই বড় অমায়িক, নিচু গলায় খুব স্নেহের সাথে কথা বলেন, শেষ প্রশ্নটা বাদে বাকি সবগুলোর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলাম। গতকাল থেকে এই পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিতে বসেছি, প্রায় হাজারখানেক পৃষ্ঠা বসে বসে পড়তে হয়েছে (এর মধ্যে নয়শোর ওপর হয়তো শুধু চোখ বুলিয়ে গিয়েছি) কাল থেকে। এই কোর্স পরিচালিত হচ্ছে একটি বিশেষ প্রোগ্রামের আওতায়, সেটার ওয়েবসাইট থেকে যাবতীয় নোটস নামিয়ে নিয়ে পড়ার কথা সবার। ডাউনলোড করতে গিয়ে ঘেমে গেলাম কাল সারাটা দিন আর রাত। শেষ কয়েক কিলোবাইট আর ডাউনলোড হয় না, আটকে বসে থাকে। শেষে আজ সকালে সুমন চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে সেখানে বসে বাকি ফাইলগুলি নামিয়ে এনে পড়তে হলো। এই যে পদে পদে অন্যায় ভালোবাসা গ্রহণ করতে হচ্ছে খিড়কি দরজা দিয়ে, এ-ই কি আমার প্রাপ্য? মনে মনে ভাগ্যের মা-কে ভালোবেসে আজকে দুপুরবেলা বড় কষ্টে প্রস্তুতি নেয়া শেষ করেছি। প্রফেসর রোরিগ আর লাঙ্গের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় শুনলাম আমার প্রেজেন্টেশেন ২,৩ পেয়েছি, শুনে মনটা একটু খারাপই হলো। তবে মৌখিক পরীক্ষা ভালো হওয়ার আনন্দে আর তেমন গা করলাম না। উপস্থাপন আর মৌখিক পরীক্ষায় আধাআধি নাম্বার, কাজেই হয়তো টেনেটুনে ১,৭ এ উঠে যাবো। জার্মানীতে গ্রেড দেয়ার পদ্ধতি আমাদের ঠিক উল্টো। তার আগে আরো একটা উল্টো জিনিসের ফিরিস্তি দিয়ে রাখি। ইয়োরোপে কমা আর দশমিকের ব্যবহার উল্টো, অর্থাৎ আমরা পাঁচ হাজার আটশো দুই দশমিক পাঁচ তিনকে লিখি ৫,৮০২.৫৩, আর এখানে লেখা হয় ৫.৮০২,৫৩। এখানে সবচেয়ে ভালো গ্রেড হচ্ছে ১,০, তারপর ১,৩, তারপর ১,৭, তারপর ২.০, তারপর ২,৩ ... এভাবে। সাধারণত ৯৫% এর বেশি পেলে ১,০ দেয়া হয়, তবে এর বিন্যাসও একেক প্রফেসরের কাছে একেক রকম, যেমন গেলো পরীক্ষায় প্রফেসর হায়ারের কাছে ১,০ মানে ১০০%। কিছু কিছু পরীক্ষায় অনেক সময় পাশ-ফেল নিয়েই এক সঙ্কট থাকে (৬০% এর কম পেলে ফেল), সেক্ষেত্রে সেই পরীক্ষায় পূর্ববর্তী ফলাফলের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে গ্রেড নির্ধারণ করা হয়। কোন কোর্সে গণহারে বেশিরভাগ ছাত্র ফেল করলে ছাত্ররা গিয়ে পরীক্ষানিয়ন্ত্রণ দপ্তরে নালিশ ঠুকে দেয়, তখন প্রশ্নকর্তাকে সেই পরীক্ষা নিজে বসে দিতে হয়। কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুনেছি আইন আছে, কোন প্রফেসর নিজে যদি ৪০ মিনিটের মধ্যে নিজের করা প্রশ্ন সবক'টার সঠিক উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে পরীক্ষা বাতিল হয়, আবার নতুন করে প্রশ্ন করতে হয়। সোমবার থেকে একটা সিম্যুলেশন প্রোগ্রামের ওপর কোর্স চলছে, সেটা পরপর দু'দিন বাং মেরেছি। আজকে সেই কোর্সের এক পরিচালকের ঘরে গিয়েছি এক কাজে, সে আমাকে দেখে লাফিয়ে উঠলো, ব্যাপার কী, আমি থাকি কই, কোর্সে নাম লিখিয়ে করছি না কেন? তাকে আমার দুঃখের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা করলাম, আশ্বাস দিলাম যে আগামীকাল থেকেই সহিসালামতে শুরু করে দেবো। সে আমাকে কয়েকটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাঁকিয়ে দিলো। তার সহকর্মিনীরা অবশ্য অনেক দয়ালু ও মিষ্টি, তারা বাকি কাজ শেষ করে দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের উষ্ণ শুভাশিস জানিয়ে বিদায় দিলো। পরীক্ষানিয়ন্ত্রণ দপ্তরে একটা ঝামেলা পাকিয়ে এসেছি, সেটার জন্যে একটা দরখাস্ত দিতে হবে কাল। প্রফেসর শ্মিডের কাছেও দুইটা বড় বড় মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে, সেজন্যে গিয়ে নাম লেখাতে হবে। কিচ্ছু করা হয়নি, একের পর এক কাজ জমছে কেবল। বহুদিন পরে আবার থার্মোডাইনামিক্স পড়তে হচ্ছে, অনেক কিছু ভুলে গিয়েছিলাম, একেবারে রগে রগে গিয়ে ঘা খেতে হচ্ছে আবার। কাসেলে ঠান্ডা এখন একটা মশকরার পর্যায়ে রূপ নিয়েছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে দুপুরে তাপমাত্রা একে নামবে, তার প্রস্তুতি নিয়ে ঘর ছাড়লে একটু পরেই ঘেমেচুরে শেষ হয়ে যাবার যোগাড়। আবার অবিশ্বাসী হয়ে শুধু সোয়েটার পরে বেরোলে দাঁতে দাঁত বাড়ি খায়। মার্চ মাস থেকে শুরু হচ্ছে কলিজা কাঁপানো একেকটা পরীক্ষা, বিশেষ করে বিয়োমাসে, অর্থাৎ জৈববস্তু। হাজার খানেক চার্ট আর গ্রাফ জমে আছে ফাইলে। সেদিন দুই সহপাঠীকে পাকড়াও করে বললাম, তোমরা একটা বুদ্ধি দাও, কিভাবে এই গু-টাকে ম্যানেজ করা যায়? (জার্মান শাইসে মানে গু, তবে এর ব্যবহারকে মোটামুটি অভদ্র হিসেবে ধরা হয়, অনেকটা আমাদের কথ্য গুপ্তকেশের মতো। সেদিন আমাদের এক সহপাঠী প্রেজেন্টেশনের সময় মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে বিড়বিড় করে শাইসে বলে ফেলায় প্রফেসর প্রিস ঘ্যাঁচ করে তার নাম্বার কেটে দিয়েছেন) একজন গম্ভীর হয়ে বললো, আমি এই গুয়ের ওপর থিসিস করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আমাদের সবার কপালে দুঃখ আছে। এ আর কিছু নয়, শুধু গু!
false
mk
চ্যালেঞ্জের মুখে খালেদা জিয়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে উত্তপ্ত জোট-মহাজোটের বর্তমান রাজনীতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট বেশ ভালোভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে। মহাজোট নির্বাচনি এ প্রক্রিয়ায় বেশ সফলভাবে যাত্রা শুরু করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বেশ বেকায়দায় রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে সরকারি দলের নানামুখী নির্বাচনি চাপ ও আকর্ষণীয় প্রস্তাবে ১৮ দলীয় জোটের শরিক অনেক প্রভাবশালী নেতাই বেশ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন যে কোনো নেতা ১৮ দল ছেড়ে সরকারের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারেন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও প্রচ- চাপে রয়েছেন স্বয়ং জোট নেতা খালেদা জিয়া। কারণ জরিপে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল নেতাদের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখনো নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অনড় রয়েছেন। ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও জোটের অন্য শরিকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে জোটবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সম্প্রতি মহাজোট থেকে বেরিয়ে জাতীয়পার্টি চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জোট গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এদিকে সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া বিএনএফ শহীদ জিয়ার আদর্শের কথা বলে তৃণমূলের নেতাদের তাদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতাদের ধরে রাখতে ও অন্যদিকে জোট রক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘরে-বাইরে নানামুখী চাপে রয়েছেন তিনি। সরকার যাতে দল ও জোট থেকে কোনো নেতাকে বাগিয়ে নিতে না পারে সে চেষ্টাও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। একদিকে দল ও জোট নেতাদের ধরে রাখা অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের দাবি বেগবান করার আন্দোলন চূড়ান্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে খালেদা জিয়া সতর্কতার সাথে পা ফেলছেন। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজনরা মনে করেন, সরকারের কৌশলের কাছে ন্যূনতম ভুল করলে বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত রাজনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকারের নতুন মন্ত্রীদের শপথ নেওয়ার পরদিন গত ১৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোটের অবস্থান তুলে ধরতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেও খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে অনঢ় অবস্থানের কথা জানান। রাষ্ট্রপতির কাছে খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে চলমানরাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপে বসতে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই চিঠির কোনো উত্তর পায়নি বিএনপি। এর জবাবে রাষ্ট্রপতি বেগম জিয়াকে এ বিষয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বস্ত করেন।ক্ষমতাসীনরা বিএনপি এবং জোটের কিছু নেতা ও দলকে বাগিয়ে নিতে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টা এবং আগামী নির্বাচনে চাহিদামাফিক আসনে প্রার্থী করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, খালেদা জিয়া বিভিন্ন সূত্রে এমন খবর জানার পর বঙ্গভবন থেকে ফিরেই ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে খালেদা জিয়া জোট নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, এখন সরকারের নানা মহল থেকে আপনাদের কাছে নানা অফার আসবে। আপনারা সে অফার গ্রহণ করবেন কি না সেটা একদমই আপনাদের বিষয়। তবে এই অল্প সময়ের জন্য সরকারের সুযোগ গ্রহণ করে জাতীয় বেইমান না হওয়াই ভালো।জোট নেতাদের খালেদা জিয়া আশ্বস্ত করেছেন, ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় গেলে শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। জবাবে জোট নেতারা খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেছেন, তারা কেউই তাকে ছেড়ে যাবেন না। তবে বৈঠকে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমেদ (অব.), বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এবং লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান খালেদা জিয়ার কাছে স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন অফার দিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।সূত্র মতে, গত ১৯ নভেম্বর দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুর রহমান চৌধুরী এবং সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঘণ্টাব্যাপী চলা এই বৈঠকে এলডিপির এই প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়াকে জানান, সরকার তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়ার জন্য অফার করেছে। এলডিপি যদি বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়, তাহলে একজন মন্ত্রী, একজন উপদেষ্টা পাবেন। আর আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে ১২টি আসনে তাদের প্রার্থী থাকবে। এই অবস্থায়, তার দল ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে থাকতে চায়; সে ক্ষেত্রে তারা বিএনপির কাছে ১৫টি আসনের নিশ্চয়তা চায়। এ ছাড়া যেসব স্থানে বিএনপির সঙ্গে এলডিপির বিরোধ আছে, তা সমাধানে খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলডিপির নেতারা। এ বিষয়ে শাহাদত হোসেন সেলিম জানান, নানা চাপেও আমরা বিএনপির সঙ্গে আছি। সে ক্ষেত্রে ১৫টি আসন দাবি করা অযৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। খালেদা জিয়ার আশ্বাসে এই তালিকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট সামাল দিতে নিজেদের মধ্যে সব ধরনের মতভেদ দূর করে দলের কথিত সংস্কারপন্থিদের আরও কাছে টানার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত ১৯ নভেম্বর রাতে রাজধানীর গুলশানে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বাসায় সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বৈঠকে অন্যদের মধ্যে যোগ দেন জহিরউদ্দিন স্বপন, জিয়াউল হক জিয়া, রেজাউল বারী ডিনা, শহিদুজ্জামান, নজির হোসেন, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, শামিম কায়সার লিংকন। জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক সংকটের ফলে দলের মধ্যে সম্ভাব্য যে কোনো ধরনের ভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি এই দুঃসময়ে দলকে আরও শক্তিশালী করতে সংস্কারপন্থিদের দলে আরও সক্রিয় করতে চায় বিএনপি। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইতোমধ্যেই দলের শীর্ষ নেতাদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন। নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন এবং সংস্কারপন্থিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।জহির উদ্দিন স্বপন জানান, দলের দুঃসময়ে আমরা মহাসচিবের মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার আগ্রহ জানিয়েছি। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।বিএনপি নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে সংস্কার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ মুছে দিয়েছেন, বিএনপিরও সে রকম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য স্বদেশ খবরকে বলেন, সংকটময় সময়ে যারা দলে ভাঙন তৈরি করেছিল সেই সংস্কারপন্থিদের দলের মধ্যে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বরং এটি দলের অন্য নেতাকর্মীদের কাছে একটি ভুল বার্তা পৌঁছাবে এবং এটা দলের জন্য সুখকর কোনো কিছু নাও হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে যারা এতদিন ধরে আন্দোলন করে জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা হয়তো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এসব নেতাদের অনেক আগেই ক্ষমা করেছিলেন। তারপরও তাদের নিজের এলাকা এবং দলের কেন্দ্রীয় অফিসে আসতে দেখা যায়নি। বরং তারা দলের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে।চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ‘হস্তক্ষেপ’ চেয়েও আশান্বিত হতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া না পাওয়ায় লাগাতার কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন বিরোধী জোটের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা। তবে পরিস্থিতি আরও দুএকদিন পর্যবেক্ষণ করে করণীয় নির্ধারণ করতে চায় তারা। দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বিরোধী জোট। টানা হরতাল ও অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনে বেশ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঙ্কার দিলেও পরবর্তীতে দল ও জোটের আশু ভাঙন ঠেকাতে নমনীয়তা প্রদর্শন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমতাবস্থায়, অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা-কর্মীরা।
false
ij
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বাঙালি ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ দ্বারা উজ্জীবিত। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম তাঁর মধ্যে উদার মানবিক ভাবমূর্তির সৃষ্টি করেছিল। আবদুল মমিন চৌধুরীরর মতে,“বহুমুখী সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে পরিস্ফুট রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক সর্বজনীন কৌতূহল বরাবরই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে হয়। কট্টর ব্রাহ্ম পারিবারিক পটভূমিও তাঁকে আপন লক্ষ্য খুঁজে পেতে সহায়তা যুগিয়েছে।” (বাংলাপিডিয়া) নীহাররঞ্জনের জন্ম ১৯০৩। তৎকালীন পূর্ববাংলার ময়মনসিংহ। বাবা ছিলেন স্থানীয় ন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক। পড়াশোনার শুরু ওই স্কুলেই। ১৯২৪ সালে সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক। তারপর ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় ইতিহাসে এম এ পাশ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিবিধ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন গ্রন্থাগারিকের পদে কাজ করেন। তারপর চারুকলা বিভাগের রাণী বাগেশ্বরী প্রফেসর নিযুক্ত হন। তিনি প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগেরও অধ্যাপক ছিলেন। ভারতবর্ষ ও বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিসিটিং প্রফেসর ছিলেন। রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব আর্টস অ্যান্ড লের্টাস (জুরিখ) এবং কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন। তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরুস্কার ও পদ্মভূষন পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৩। এই সময়টায় তিনি বার্মায় ছিলেন। ওখানকার মন্দির স্থাপত্যের ওপর গবেষনা করেন। এ সময়েই কারুশিল্পের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মায়। ওই সময়কার তাঁর উল্লেখযোগ্য তিনটি গ্রন্থ হল: Sanskrit Bhuddism in Burma (১৯৩৬); An Introduction to the Study of Theravada Bhddhism in Burma (১৯৪৬), Art in Burma (১৯৫৪) “বাঙালির ইতিহাস” (আদি পর্ব) নীহাররঞ্জনের অক্ষয় কীর্তি। ঐতিহাসিক যদুনাদ সরকার বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের“বাঙালীর ইতিহাস” একখানি অমূল্য গ্রন্থ। বহু বৎসর ধরিয়া ইহা আমাদের অবশ্য-পঠিতব্য প্রামাণিক গ্রন্থ বলিয়া গন্য হইবে, এবং ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকের পথনির্দেশ করিবে। এই একুশ শতকেও ঐতিহাসিক যদুনাদ সরকারের মন্তব্যটি অব্যর্থ হয়ে রয়েছে। কৈশর থেকেই নীহাররঞ্জন ছিলেন সমাজসচেতন। ময়মনসিংহে স্কুলের পড়ার সময়ই অনুশীলন ও যুগান্তরের মতো প্রসিদ্ধ বিপ্লবী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন নীহাররঞ্জন । ১৯২৬ সাল অব্দি অনুশীলন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখেন। কলেজ জীবনে ইংরেজ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন । এই সময়েই গ্রাম পর্যায়ে কংগ্রেসের কাজে জড়িয়ে পড়েন। তিরিশের দশকের গোড়ায় কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ভারত ছাড় আন্দোলনেও যোগ দেন। ১৯৪২ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে বন্দি করে। কারাগারেই লিখতে শুরু করেন ‘বাঙালীর ইতিহাস’ । নীহাররঞ্জনের মৃত্যু ১৯৮১ সালে । ইচ্ছে ছিল বাঙালির ইতিহাস ২য় খন্ড লিখবেন। তা আর হয়ে ওঠেনি। তথ্যসূত্র: আবদুল মমিন চৌধুরী (বাংলাপিডিয়া) সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৫৩
false
rg
বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৫ ফাইনালের জন্য বাংলাদেশের মাত্র তিন ম্যাচের অপেক্ষা !!! ক). টাইগার্সদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট মিশন: স্মৃতির পাতা থেকে ......................................................১৯৯৭ সালের ১২ ও ১৩ এপ্রিলের কথা মনে আছে? মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাই পর্ব আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালটি হয়েছিল দুই দিন ধরে। ২২টি দল নিয়ে ২৪ মার্চ ১৯৯৭ শুরু হওয়া সেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাই পর্বে ফাইনালে খেলেছিল কেনিয়া আর বাংলাদেশ। ১২ এপ্রিল ১৯৯৭ তারিখে টসে জিতে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খান ফিল্ডিং নিয়েছিলেন। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে কেনিয়া তুলেছিল ২৪১ রান। কেনিয়ার স্টিভ টিকালো ১৫২ বলে করেছিলেন ১৪৭ রান। আর কেনিয়ার অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে ৬৩ বলে করেছিলেন ৪৩ রান। বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিক ৬ ওভার বল করে ৪০ রানে পেয়েছিলেন ৩টি উইকেট, সাইফুল ইসলাম ৯ ওভার বল করে পেয়েছিলেন ২টি উইকেট এবং খালেদ মাহমুদ সূজন ৭ ওভার বল করে ৩১ রানে পেয়েছিলেন ২টি উইকেট। তারপর সেই বিখ্যাত বৃষ্টি। সারাদিনে আর খেলা মাঠে গড়ায়নি। পরদিন ১৩ এপ্রিল ১৯৯৭ তারিখে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের জন্য ২৫ ওভারে ১৬৬ রানের জয়ের লক্ষ্য ধার্য করা হয়। বাংলাদেশ দল ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম বলেই বিপত্তি। বাংলাদেশ ইনিংসের প্রথম বলেই কেনিয়ার এমএ সুজি'র করা প্রথম বলে নাঈমুর রহমান দুর্জয় শূন্য রানে বোল্ড। অধিনায়ক আকরাম খান সেদিন বাংলাদেশ দলের ওপেনিংয়ে একটা বড় ধরনের রদবদল করেছিলেন। দুর্জয় আর আতাহার আলী খানের বদলে ওপেনিং করিয়েছিলেন দুর্জয় আর মোহাম্মদ রফিককে দিয়ে। অবশ্য আগের দিন ফিল্ডিংয়ের সময়ে আতাহার আলী চোট পেয়েছিলেন। ব্যাট করতে না পারার মত অবস্থায় ছিলেন তিনি। দুর্জয় প্রথম বলে আউট হবার পর মিনহাজুল আবেদীন নান্নু উইেকেটে যোগ দেন রফিকের সাথে। দু'জনে ৫০ রান তোলার পর রফিক আবার আরেক সুজি'র শিকাড় হন। কেনিয়া দলে দখন দুই সুজি আর দুই টিকালো ভাইদের রাজত্ব। ১৫ বলে ২৬ রান করে রফিক আউট হবার পর উইকেটে আসেন বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এই জুটি ১৩ রান তুলতেই ৬৩ রানের মাথায় বাংলাদেশের নান্নু আউট। ৩৩ বলে নান্নু করেছিলেন ২৬ রান। এরপর উইকেটে আসেন বাংলাদেশের অধিনায়ক আকরাম খান। বুলবুল-আকরাম মিলে ৫৩ রানের একটি পার্টনারশিপ দাঁড় করান। দলীয় ১১৩ রানের মাথায় ৩৭ বলে ৩৭ রান করা বুলবুলকে বোল্ড করেন করিম। উইকেটে আসেন অভিজ্ঞ এনামুল হক। কিন্তু দলে আর মাত্র দুই রান যোগ হবার পরেই আবার কেনিয়ার সেই আঘাত। এবার ঘাতকের নাম মরিস ওদুম্বে। ক্যাপ্টেন টু ক্যাপ্টেন। ২৭ বলে আকরাম করেছিলেন ২২ রান। বাংলাদেশের রান ৫ উইকেটে ১১৮। উইকেটে আসার কথা তখন উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলটের। কিন্তু অধিনায়ক আকরাম খান আরেকটা বাজি ধরলেন। উইকেটে পাঠালেন বোলার সাইফুল ইসলামকে। মাত্র ৫ রান যোগ হবার পর বাংলাদেশের রান যখন ১২৩ তখন আবার ঘাতকের ভূমিকায় সেই করিম। ৬ উইকেট বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ১২৩ রান। এবার ৭ বলে ৫ রান করা এনামুল আউট। ক্রিজে আসলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। সাইফুলকে সঙ্গে নিয়ে বিধস্ত অবস্থা সামাল দেবার চেষ্টা চালান পাইলট। কিন্তু দলীয় ১৩৯ রানের মাথায় আবার সেই করিমের আঘাত। ১৩ বলে ১৪ রান করে ওদুম্বের কাছে ক্যাচ দেন সাইফুল। ১৩৯ রানে বাংলাদেশের ৭ উইকেটের পতন। এবার ক্রিজে আসেন বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য ফাইটার খালেদ মাহমুদ সূজন। ৫ বলে ৫ রান করে ওদুম্বের বলে ওটিয়েনোর কাছে ধরা পড়েন সূজন। বাংলাদেশের রান তখন ৮ উইকেটে ১৫১। জিততে দরকার আরো ১৫ রান। হাতে আছে দুই উইকেট। আতাহার আলী যেহেতু ব্যাট করার মত অবস্থায় নাই, তাই একটি উইকেট পরলেই ম্যাচ জিতে যায় কেনিয়া। ২৪.৫ ওভারে বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ তখন ১৬৫ রান। স্ট্রাইকিংয়ে পাইলট। অপর প্রান্তে হাসিবুল হোসেন শান্ত। গোটা বাংলাদেশ কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠের সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে তাকিয়ে। শেষ বলে পাইলট এক রান নিলেই বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়লাভ করে বাংলাদেশ। পাইলট ৭ বলে করেছিলেন ১৫ রান আর শান্ত ৫ বলে করেছিলেন ৪ রান। এরা দুজন অপরাজিত ছিলেন। আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন কেনিয়ার স্টিভ টিকালো। আর কাপ নিয়ে পরদিন ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের সকালে দেশে ফিরেছিল আকরাম বাহিনী। গোটা বাংলাদেশ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেই সাফল্যে তখন এক হয়ে গিয়েছিল। শেরে বাংলা নগরের মানিক মিঞা অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলকে বীরের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তারপর গোটা রাজধানী জুড়ে চলেছে বিজয় মিছিল। ট্রাকের উপর জাতীয় দলের ক্রিকেটারগণ। আমরা তখন সেই মিছিলের পেছনে পেছনে। সে বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আইসিসি টুর্নামেন্টের রানার-আপ কেনিয়া ও তৃতীয় স্থান দখলকারী স্কটল্যান্ডও বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। এর আগে বাংলাদেশ উল্লাসে মেতেছিল ৯ এপ্রিল ১৯৯৭ তারিখে। সেদিন আইসিসি কাপের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। সেমি-ফাইনালের সেই খেলাটিও ছিল দীর্ঘতম। আর বৃষ্টিবিঘ্নিত। ৮ এপ্রিল টস জিতে স্কটল্যান্ড বাংলাদেশকে ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাংলাদেশ নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে করেছিল ২৪৩ রান। সেদিনও অধিনায়ক আকরাম খান ওয়ানডাউনে নান্নুর বদলে মাঠে পাঠিয়েছিলেন পাইলটকে। পাইলট ১৩৬ বলে করেছিলেন সর্বোচ্চ ৭০ রান। বুলবুল করেছিলেন ১০৪ বলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৭ রান। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৯ রানে অপরাজিত ছিলেন নান্নু। জয়ের জন্য স্কটল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫০ ওভারে ২৪৪ রান। তারপর সেই ঐতিহাসিক বৃষ্টি। দ্বিতীয় ইংনিসে ব্যাট করতে স্কটল্যান্ড কিলাতক্লাব মাঠে নেমেছিল পরদিন ৯ এপ্রিল। ৪৪.৫ ওভারে ১৭১ রানে স্কটল্যান্ড অলআইট হয়েছিল। বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ৭২ রানের। ৫.৫ ওভারে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। এছাড়া এনামুল হক ১০ ওভারে ৩১ রানে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট আর ৯ ওভারে ৩০ রান দিয়ে ১উইকেট নিয়েছিলেন দুর্জয়। আর স্কটল্যান্ডের দুইজন হয়েছিলেন রানআউট। লোকিকে রানআউট করেছিলেন শান্ত আর ব্লায়ানকে রানআউট করেছিলেন সাইফুল। স্কটল্যান্ডকে সেদিন ৭২ রানে হারিয়ে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা টিএসসিতে উল্লাসে মেতেছিলাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই অর্জনে। তারপর মাঝখানে প্রায় আঠারো বছর চলে গেছে। এর মধ্যে কেনিয়া একটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালও খেলেছে। এখন সেই কেনিয়া বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই থেকে বাদ। সেখানে যোগ দিয়েছে নতুন আসা আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড আর সংযুক্ত আরব-আমিরাত। খ). বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনাল থেকে টিম টাইগার্স মাত্র তিন ম্যাচ দূরে!!!....................................................................এবারের ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। পুল-এ তে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, ইংল্যান্ড, আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ড। ১৮ ফেব্রুয়ারিবাংলাদেশ প্রথম খেলায় আফগানিস্তানকে ১০৫ রানে হারিয়ে পূর্ণ ২ পয়েন্ট লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বৃষ্টির কারণে একটি বলও মাঠে গড়ায়নি। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে ১ পয়েন্ট ভাগ পায়। তৃতীয় খেলায় ২৬ ফেব্রুয়ারি শ্রীলংকার কাছে বাংলাদেশ হারে ৯২ রানে। চতুর্থ খেলায় ৫ মার্চ স্কটল্যান্ডের করা ৩১৮ রান টপকে বাংলাদেশ করে ৩২২ রান। বাংলাদেশ ৬ উইকেটের জয় পায়। ৯ মার্চ ছিল বাংলাদেশের পঞ্চম খেলা। প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। টস জিতে ইংল্যান্ড বাংলাদেশকে ব্যাট করতে পাঠায়। শুরুতেই আবার বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়। দলীয় ৩ রানের মাথায় বাংলাদেশের ওপেনার কায়েস আউট। ৫ রান পরে দলীয় ৮ রানের মাথায় অপর ওপেনার তামিম আউট। তারপর সৌম্য আর মোহাম্মদুল্লাহ রিয়াদ মিলে প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেন। দলীয় ৯৪ রানের মাথায় ৫২ বলৈ ৪০ রান করে সৌম্য আউট হন। রিয়াদ সৌম্য জুটি গড়েন ৮৬ রানের একটা কার্যকর পার্টনারশিপ। তারপর আবার বাংলাদেশ দলের ছন্দপতন। ৫ রান পরে দলীয় ৯৯ রানের মাথায় শাকিব আউট। ২ উইকেট ৯২ থেকে মুহূর্তে ৪ উইকেটে ৯৯-এ পরিনত হয় বাংলাদেশ। এবার আবার বাংলাদেশের ত্রাণের ভূমিকায় নামেন বাংলাদেশের লিটল মাস্টার মুশফিকুর রহিম আর তার ভায়রাভাই মোহাম্মদউল্লাহ রিয়াদ। এই জুটি বাংলাদেশকে উপহার দেন ১৪১ রানের পার্টনারশিপ। দলীয় ২৪০ রানের মাথায়। বাংলাদেশের পক্ষে এই প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপের আসরে সেঞ্চুর তোলেন। মোহাম্মদউল্লাহ রিয়াদ ১৩৮ বলে করেন ১০৩ রান। তারপর আবার সেই ছন্দপতন। দলীয় ২৬১ রানের মাথায় মুশফিকুর রহিম ফিরে যান ৭৭ বলে ৮৯ রান করে। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে তুলে নেয় ২৭৫ রান। ইংলান্ডের জন্য যা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টিকে থাকার বাঁচা-মরার লড়াই। জিততে হলে ইংল্যান্ডকে করতে হবে ৫০ ওভারে ২৭৬ রান। ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার মোমেন আলী আর ইয়ান বেল বেশ সতর্কতার সঙ্গে শুরু করেন। দলীয় ৪৩ রানের মাথায় মোমেন আলী রানআউট। তারপর উইকেটে এসে হেলস বেলকে নিয়ে সেই বিপর্যয় সামাল দেন। দলীয় ৯৭ রানের মাথায় হেলসকে শিকাড় করেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তাজা। ২৭তম ওভারের প্রথম বলে ইয়ান বেলকে এবং চতুর্থ বলে ইংলিশ দলনায়ক মর্গনকে আউট করে বাংলাদেশ দলের আস্থা ফিরিয়ে আনেন রুবেল হোসেন। তারপর মুহূর্তে ইংল্যান্ড যেন খেই হারিয়ে ফেলে। ৯৭ রানে ২ উইকেট থেকে ১৬৩ রানে ৬ উইকেটে পরিনত হয় ইংল্যান্ড। তারপর আবার ব্রিটিশদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বাটলার এবং ওকস। সপ্তম উইকেট জুটিতে এই দুই ইংলিশ ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এবং বাংলাদেশ শিবিরে তখন আবার পরাজয়ের হাতছানি। ৪৬ তম ওভারের ৫ম বলে দলীয় ২৩৮ রানের মাথায় ৭৫ বলে দলীয় সর্বোচ্চ ৬৫ রান করে বাটলার তাসকিনের শিকাড় হন। আবার বাংলাদেশ শিবিরে উক্তেজনা। ম্যাচে ফেরার চেষ্টা। পরের ৪৬ তম ওভারের শেষ বল জর্ডান রানআউট। ২৩৮ রানে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ তখন ৮ উইকেটে ২৩৮ রান। শেষ ২৪ বলে ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৩৮ রান। ক্রিজে আছেন মারকুটে ওকস। পরের দুই ওভারে ইংল্যান্ড সংগ্র করে মূল্যবান ২২ রান। শেষ ১২ বলে ইংল্যান্ডের ১৬ রান। ততক্ষণে মাশরাফি ও শাকিবের ১০ ওভারের কোটা শেষ। এছাড়া আরাফাত সানি ৮ ওভার, রুবেল ৯ ওভার, তাসকিন ৯ ওভার ও সাব্বির ২ ওভার করেছেন। বাংলাদেশের বিচক্ষণ অধিনায়ক মাশরাফি এবার দলীয় ৪৯তম ওভারে বল তুলে দিলেন রুবেলের হাতে। ৪৯তম ওভারের প্রথম বলে ব্রডকে সরাসরি বোল্ড করে দেন রুবেল। ক্রিজে আসেন শেষ ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যান্ডারসন। অপরপ্রাপ্তে দাপটের সঙ্গে খেলতে থাকা ওকস অপরাজিত ৪২ রানে। যা করার এই ওভারেই করতে হবে। নইলে ওকসের হাত থেকে আর ম্যাচ বাঁচানো যাবে না। রুবেলের দ্বিতীয় বল অ্যান্ডারসন ব্যাটে লাগাতে পারেননি। একটি ডট বল। ৪৯তম ওভারের তৃতীয় বলে রুবেল করেন সেই অবিশ্বাস্য দুর্দান্ত বলটি। এবার অ্যান্ডারসন সরাসরি বোল্ড। আঠারো বছর পরে আবার উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। কারণ, এবার এই প্রথম বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল। গোটা বিশ্ব আবারো প্রত্যক্ষ করল বাঘের গর্জন। বিশ্বের এক নাম্বার টেস্ট ক্রিকেটের দল ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ থেকে গ্রুপ পর্বে বিদায় বাংলাদেশের কাছে হেরে। এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদউল্লাহ রিয়াদ ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেও এই ম্যাচের আসল নায়ক রুবেল। ৯.৩ ওভারে ৫৩ রানে রুবেল নেন ইংল্যান্ডের মূল্যবান ৪টি উইকেট। আর ব্যাটিংয়ে মুশফিকুর রহিমের ঝড়ো ৭৭ বলে ৮৯ রান এবং প্রাথমিক বিপর্যয়ে পড়া বাংলাদেশ দলকে সৌম্য সরকারের ৮৩ বলের ৪০ রানের ধৈর্যশীল ইনিংসটি বাংলাদেশের এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এছাড়া ভালো খেলতে থাকা ইংলিশ ব্যাটসম্যান হলস ও রুটকে ফিরিয়ে দিয়ে এই ম্যাচের অপর নায়ক অধিনায়ক মাশরাফি। ব্যাটিংয়ে শাকিব আল হাসান খারাপ করলেও ১০ ওভার বল করে ৪১ রান দিয়ে কোনো উইকেট পায়নি এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। কিন্তু রুবেলের করা ২৭তম ওভারের চতুর্থ বলে ইংলিশ অধিনায়ক মর্গনের যে ক্যাচটি শাকিব তালুবন্দি করেন, সেটিও এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আগামী ১৩ মার্চ শুক্রবার বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের শেষ খেলায় নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে। নিউজিল্যান্ড ইতোমধ্যে ৫ খেলায় জিতে ১০ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের শীর্ষে অবস্থান করছে। ৪টি জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা। ৩ জয় ও একটি ভাগাভাগি থেকে সমান সংখ্যক ৭ পয়েন্ট নিয়ে রান রেটে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান গ্রুপের তিন নাম্বারে আর বাংলাদেশ চার নাম্বারে। ১৪ মার্চ অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ খেলবে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে। যদি বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হারায় আর অস্ট্রেলিয়া স্কটল্যান্ডের কাছে হারে, তাহলে ৯ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ চলে যাবে গ্রুপের দ্বিতীয় অবস্থানে। শ্রীলংকা চলে যাবে তিন নাম্বারে আর অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে চার নাম্বারে। আর যদি নিউজিল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ হারে এবং স্কটল্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়া জেতে, তাহলে ৯ পয়েন্ট নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে গ্রুপের দ্বিতীয় অবস্থানে, শ্রীলংকা চলে যাবে তিন নাম্বারে আর বাংলাদেশ চার নাম্বারেই থেকে যাবে। গ্রুপ পর্বে পুল-বি তে ৫ খেলায় ৫ জয়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত। ৫ খেলায় ৩টি করে জয় নিয়ে সমান সংখ্যক ৬ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ড। ৫ খেলায় ২ জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পুল-বি তে ভারতের গ্রুপ পর্বের শেষ খেলা জিম্বাবুয়ের সাথে। এই ম্যাচে ভারত হারলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, জিতলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। ১৫ মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে। যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। ফলে ৬ খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের পয়েন্ট দাঁড়াবে ৩টি জয় নিয়ে ৬। অন্যদিকে একটু পরেই দক্ষিণ আফ্রিকা মাঠে নামবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে। এই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো অনায়াস জয় তুলে নেবে। সেক্ষেত্রে তাদের দলীয় পয়েন্ট হবে ৪ জয়ে ৮। ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপে তৃতীয় ও চতুর্থ থাকা পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের খেলা ১৫ মার্চ। এই খেলায় যদি আয়ারল্যান্ড জেতে, তাহলে আয়ারল্যান্ড পৌঁছে যাবে গ্রুপের তিন নাম্বার অবস্থানে। সেক্ষেত্রে চতুর্থ অবস্থানের জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে রান রেটে পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডজের সঙ্গে। আর যদি আয়ারল্যান্ড পাকিস্তানের কাছে হারে, তাহলে চতুর্থ অবস্থানের জন্য রান রেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আয়ারল্যান্ড। মানে পুল-বি তে চতুর্থ দলটি আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে কেউ-ই হতে পারে।গ). টাইগার্সদের মিশন বিশ্বকাপ ক্রিকেট ট্রফি!!!............................................................কোয়ার্টার ফাইনালে পুল-এ চ্যাম্পিয়ন খেলবে পুল-বি এর চতুর্থ দলটির সাথে। পুল-বি চ্যাম্পিয়ন খেলবে পুল-এ এর চতুর্থ দলটির সঙ্গে। পুল-এ রানারআপ খেলবে পুল-বি এর তৃতীয় স্থানের সাথে। আর পুল-বি রানারআপ খেলবে পুল-এ এর তৃতীয় স্থানের সাথে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ যদি নিউজিল্যান্ডের সাথে জিতে যায়, তাহলে বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল প্রতিপক্ষ হবে আয়ারল্যান্ড বা পাকিস্তান। এই দুই দলের বিজয়ী দলটির সাথে। আর যদি বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বে চতুর্থ অবস্থানেই থাকে তাহলে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রতিপক্ষ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত। আমার ব্যক্তিগত সাইকোলজি বলছে, কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ কে হবে, সে হিসাব পরে দেখা যাবে। ১৩ মার্চ বাংলাদেশের এখন একমাত্র লক্ষ্য নিউজিল্যান্ডকে হারানো। সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ৭ ম্যাচে বাংলাদেশ সাতটি-ই জিতেছে। যাকে নিউজিল্যান্ড খুব স্বাভাবিকভাবেই ভয় পাবে টাইগার্সদের। তাছাড়া তিনশো'র উপরে রান করে স্কটল্যান্ডকে চিস করা এবং ইংল্যান্ডের সাথে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে টাইগার বাহিনীর ঐতিহাসিক বিজয়কে গুরুত্ব দিয়েই আমার মন বলছে, ১৩ মার্চ নিউজিল্যান্ডকে আমরা ওদের ঘরের মাটিতে হারিয়ে আবারো লাল-সবুজের পতাকা ওড়াবো। আগামী ১৩ মার্চ, শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাতটায় শুরু হবে আমাদের সেই নিউজিল্যান্ড মিশন। আর আমার হিসাব যদি শতভাগ সত্য হয়, তাহলে কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ড বা ভাগ্যর কোঠায় ঝুলতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে-ই হোক না কেন, কোনো ব্যাপার না। তাদের আমরা তীব্র মনবলের জোরেই হারিয়ে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করব। আপাতত সেমি-ফাইনালের স্বপ্ন তাই টাইগাররা বেশ জোরেসোরেই করতে পারে। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত হলেও আমরা ছেড়ে কথা বলব না। আর আমরা সবাই তো জানি, ভারতের শিবিরে একবার টাইগার গর্জন শুরু হলে ওরা কিভাবে লেজ গুটিয়ে যাবে। সে দৃশ্যও যেন চোখের সামনে ভাসছে। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে যে, আমরা একটি ম্যাচ করে জেতার জন্য মাঠে নামব। যেদিন যে ম্যাচ, সেদিন শুধু সেই ম্যাচটিতে দলীয় সকল নৈপুণ্য শতভাগ উজাড় করে দেবার জন্য আমরা মাঠে নামব। আর কিছু না। বিশ্বের যে কোনো দলকে এখন হারানোর মত সামর্থ রাখে টাইগার বাহিনী। এটাই আমাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান যেন হয়। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ক্রিকেট হল চরম অনিশ্চয়তার খেলা। কিন্তু টাইগার বাহিনী এখন এমন চাঙ্গা অবস্থায় আছে যে, বিশ্বের যে কোনো দলকে আমরা চোখ বন্ধ করে হারানোর ক্ষমতা রাখি। বিশ্বের এক নাম্বার টেল খেলুড়ে দল ইংল্যান্ড বাংলাদেশের কাছে হেরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বাঘের গর্জন। সেই গর্জন এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অবশিষ্ট মাত্র তিনটি দলকে টের পেতে হবে। গ্রুপের শেষ খেলায় নিউজিল্যান্ড, কোয়ার্টার ফাইনালে আয়ারল্যান্ড/পাকিস্তান/ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ভারত যে-ই আসুক বাঘের হুংকার তাকে মোকাবেলা করতেই হবে। উপায় নেই ক্রিকেট মোড়লেরা। এবার বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়লদের বধ করার অভিযানে নেমেছে মাশরাফি বাহিনী। অতএব, আইসিসি'র মোড়লগণ ভাইয়েরা সাবধান। জয়তু টিম টাইগার্স। জয়তু বাংলাদেশ। ..................................ঢাকা১২ মার্চ ২০১৫
false
mk
জঙ্গিরা আপনার আশেপাশেই রয়েছে__ সাবধান গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গি নিবরাসের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিহত আবির রহমানও মাস খানেক ঝিনাইদহের সোনালীপাড়ার ওই জঙ্গি আস্তানায় ছিলেন।আবিরের ছবি দেখে গতকাল শুক্রবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সোনালীপাড়ার বাসিন্দারা। সাঈদ নাম ধারণ করে ওই জঙ্গি আস্তানায় মাস খানেক ছিলেন গুলশান হামলায় চিহ্নিত পাঁচ জঙ্গির একজন নিবরাস। আর নিবরাসের খালাতো ভাই পরিচয়ে ছিলেন আবির রহমান।পরিবারের দাবি অনুযায়ী, আবির (২২) চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন। তবে তাঁর নিখোঁজ থাকার বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে রাজধানীর ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয় ৬ জুলাই। এর পরদিন ফেসবুক ও গণমাধ্যমে ছবি দেখে স্বজনেরা জানতে পারেন, শোলাকিয়ায় নিহত হয়েছেন আবির।ঝিনাইদহ শহরে সোনালীপাড়ার ওই জঙ্গি আস্তানার লাগোয়া মসজিদের মাঠে স্থানীয় তরুণদের সঙ্গে ফুটবল খেলায় অংশ নিতেন সাঈদ নামধারী নিবরাস। ওই মাঠে খেলতেন এমন কয়েকজন স্থানীয় তরুণকে গতকাল আবিরের ছবি দেখালে তাঁরা তাঁকে শনাক্ত করেন ‘সাঈদ ভাইয়ের খালাতো ভাই’ হিসেবে। জঙ্গিদের ভাড়া করা ওই বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন যে নারী, তিনিও আবিরের ছবি দেখে শনাক্ত করেছেন।এর আগের দিন বৃহস্পতিবার বাড়ির মালিকের স্ত্রী, গৃহকর্মী ও ফুটবল খেলার সাথিরা ছবি দেখে নিবরাসকে শনাক্ত করেন। গতকাল শুক্রবার আবার সেখানে আবিরের ছবি দেখানো হয়। স্থানীয় দুজন তরুণ (তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে নাম প্রকাশ করা হলো না) প্রথম আলোকে বলেন, এই ছবি সাঈদ ওরফে নিবরাসের খালাতো ভাইয়ের। তিনি সবার সঙ্গে মিশতেন না, ফুটবলও খেলতেন না। মাঠের পাশে বসে সময় কাটাতেন। মাঝেমধ্যে মাঠের পাশে ছোট জায়গায় বাচ্চাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন।ওই দুই স্থানীয় তরুণ বলেন, ‘ওই ভাইয়ের নাম কী জিজ্ঞাসা করলে সে জবাব দেওয়ার আগেই সাঈদ ভাই বলতেন, এটা আমার খালাতো ভাই।’ তাঁরা বলেন, আবিরের চলাফেরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিল। কেমন যেন হেলেদুলে হাঁটতেন।আবিরদের মেসে তিন বেলা রান্না করে দিয়ে আসতেন স্থানীয় এক নারী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাঈদ ভাই (নিবরাস) আর ছবির এই ভাই (আবির) একই রুমে থাকতেন। তাঁরা বেশির ভাগ সময় ঘরেই কাটাতেন।’ তিনি বলেন, সাঈদ ওরফে নিবরাস মাঝে মাঝে মোটরসাইকেলে চেপে বাইরে যেতেন, তবে আবিরকে বাইরে যেতে তিনি দেখেননি। আবির কবে মেস ছেড়ে গেছেন, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।সোনালীপাড়ার ওই বাড়ির মালিক সাবেক সেনাসদস্য কওছার আলী। কলেজপড়ুয়া দুই ছেলেসহ তাঁকে এবং পাশের মসজিদের ইমাম মো. রোকনুজ্জামান ও সহকারী ইমাম সাব্বির হোসেনকে ৬ জুলাই ভোরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে নিয়ে গেছে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এঁদের আটক করার কথা স্বীকার করেনি কোনো বাহিনী। স্থানীয় পুলিশ বলছে, তারা এ ব্যাপারে কিছু জানে না।গত শুক্রবার বাড়ির মালিকের স্ত্রী বিলকিস নাহার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, মাস চারেক আগে পাশের মসজিদের ইমামের মাধ্যমে প্রথমে দুজন ও পরে আরও ছয়জন ওই বাড়িতে ভাড়ায় ওঠেন। তাঁদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে জানিয়েছিলেন ইমাম রোকনুজ্জামান, যিনি নিজেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।এর মধ্যে দুজনের পরিচয় মিললেও বাকি ছয়জন কারা ছিলেন, সেটা এখনো জানা যায়নি। বিলকিস নাহার শুক্রবার বলেছিলেন, ওই বাড়ি বা মেসে যে আটজন থাকতেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জন রোজার শুরুতে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যান। বাকি দুজন গেছেন ২৮ জুন (গুলশান হামলার দুদিন আগে)।আবিরের ব্যাপারে জানতে গতকাল আবার ওই বাড়িতে গেলে বিলকিস নাহার ঘরের দরজা খোলেননি। ঘরের জানালাও বন্ধ ছিল। ঘরের ভেতর থেকে একজন নারী বলেন, তাঁদের ওপর নানাভাবে চাপ এসেছে। তাঁরা আর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। কারা চাপ দিচ্ছে, সেটা বলতে চাননি তাঁরা।গুলশান হামলায় নিহত ও চিহ্নিত পাঁচ জঙ্গির মতো শোলাকিয়ায় হামলায় নিহত আবির এবং আহত হয়ে ধরা পড়া শফিউর চার থেকে ছয় মাস আগে বাড়ি ছাড়েন। পরিবারের দাবি অনুযায়ী, এরপর থেকে তাঁরা নিরুদ্দেশ ছিলেন, বাড়ির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না।এঁদের মধ্যে আবির গত মার্চ থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে থানায় জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানায় ঢাকার ভাটারা থানার পুলিশ। আর নিবরাস নিখোঁজ ছিলেন পাঁচ মাস। এর মধ্যে মাস খানেক ঝিনাইদহের ওই আস্তানায় থাকার তথ্য মিললেও বাকি সময় তাঁরা কোথায় ছিলেন, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। আবিরের বাসা ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়তেন। এর আগে তিনি ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়ালে (বিআইটি)। আবিরদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়। সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:৪৭
false
rn
একটি পিশাচ এর আত্মকাহিনী উইকিপিডিয়া'তে লেখা আছে- ''পিশাচ একধরনের রূপকথার দানব যে মানুষের মৃতদেহ ভক্ষণ করে।এই প্রাণী কবরের মধ্যে বাস করে বলে মনে করা হয়।'' আমি একজন পিশাচ। কিন্তু কেউ দেখে বুঝতে পারে না। সবাই মনে করে- আমি একজন আধুনিক সহজ সরল মানুষ। মানব সমাজে বাস করার এই এক মজা। তারা উপরের চাকচিক্য দেখেই- বাহবা দেয়। যাই হোক, আমি আগে পিশাচ ছিলাম না। খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতাম। সেই জীবনে কোনো আনন্দ ছিল না। রোমাঞ্চ ছিল না। পিশাচ হওয়ার পর হঠাত জীবন হয়ে গেল দারুন আনন্দময়। এক আকাশ সমান সাহস বেড়ে গেল। আগে রাত্রেবেলা বাথরুমে যেতেও ভয় পেতাম। আর এখন মধ্যরাতে কবরস্থানে বসে থাকলেও ভয় লাগে না। এখন আমি নিয়মিত জলজ্যান্ত মানুষের রক্ত খাই। যেদিন রক্ত ব্যবস্থা করতে পারি না- সেদিন হাসপাতাল থেকে দুই ব্যাগ রক্ত কিনে নিয়ে আসি। মাসে একবার রক্ত দিয়ে গোছল করি। মানুষের রক্ত অনেক গরম থাকে- তাই ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিতে হয়। আমার ক্ষুধা লাগলে- ভাত মাছ যেমন খাই, মানুষের কলিজাও খাই। একটা জীবন্ত মানুষকে খুন তার রক্ত এবং কলিজা খুবলে খুবলে খেতে কি যে ভালো লাগে! তবে মেয়েদের কলিজা খেয়ে আরাম বেশী পাই। একেবারে মোমের মতন নরম- মুখে দিলেই গলে গলে আয়।ধারালো ছুড়ি দিয়ে যখন বুকটা দু'ভাগ করি- কলিজাটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকি- থরথর করে কলিজাটা কাঁপে। আসলে কলিজা তো জমাট বাধা রক্ত'ই। প্রথম যে মেয়েটার কলিজা খাই, সেই গল্পটা শুনুন- মেয়েটার নাম মায়া। বয়স উনিশ। ইডেন কলেজে পড়তো। দেখতে সহজ সরল সুন্দর। মায়া সব সময় চোখে কাজল দিত। একদিন মেয়েটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে- আমার ঘরে নিয়ে আসি। চায়ের সাথে চেতনানাশক ট্যাবলেট মিশিয়ে খাইয়ে দেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই তন্দ্রাভাব এসে যায়। তখন হাত পা ভালো করে খাটের সাথে বেঁধে ফেলি। চিৎকার যেন না করতে পারে তার জন্য মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে দেই। আধা ঘন্টা পর মায়ার তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ধারালো ছুড়ি দিয়ে একটু একটু করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারি। মেয়েটা ব্যাথায় যত চিৎকার দেয়- আমি তত আনন্দ পাই। বেশ কিছু ছবি আমি তুলে রেখেছি- সময় পেলে একদিন আপনাদের দেখাব। যশোরের নিমতলা শশ্মানের অনেক নাম শুনেছি। আমি পিশাচ হলেও সব কিছুতেই আমার কৌতূহল বেশী। একদিন মধ্যরাত্রে নিমতলা শশ্মানে গিয়ে হাজির হই। আমার ভাগ্য ভালো, গিয়েই একটি দশ বছরের বাচ্চার লাশ পাই। টাকার অভাবে লাকড়ি কিনতে না পেরে- ছোট বাচ্চার লাশটি ফেলে চলে যায়। আহ সে রাতে কত আরাম করে খেয়েছিলাম। সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। যদিও আমি ছোট বাচ্চা কম খাই। আমি পিশাচ তবু কেন জানি মায়া লাগে। দয়া করে আমাকে রাক্ষস ভাববেন না। আমি শুধু রক্ত আর কলিজা খাই।ইদানিং বাসি রক্ত এবং কলিজা একেবারেই খেতে ইচ্ছা করে না। নিজের হাতে শিকার ধরে কেটে-কুটে খাওয়ার মজাই আলাদা। আমার আর একটা বাজে অভ্যাস আছে। মৃত মেয়েদের সাথে সেক্স করা। জীবিত মেয়েদের সাথে সেক্স করার চেয়ে মৃত মেয়েদের সাথে সেক্স করে আনন্দ বেশী। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে কত মৃত মেয়ের সাথে সেক্স করলাম। তবে আমার ভালো লাগে কোনো মেয়েকে কবর দেওয়ার এক ঘন্টা পর কবর থেকে তুলে সেক্স করতে। জীবিত থেকে মৃত নারীর মুখ অনেক বেশী মায়াময়। সেক্স করা শেষ হলে কলিজা খাই। একেবারে চেটে-পুটে খাই। তারপর যেভাবে কবর থেকে তুলি, সেভাবে আবার কবর দিয়ে দেই। আমার একটি সবুজ রঙের ডায়েরী আছে। সেই ডায়েরীতে আমার সমস্ত পিশাচ এর কাহিনী লিখে রেখেছি। সেই ডায়েরী মানুষ পড়বে আর বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিবে। হা হা হা... আমি পিশাচ কিন্তু কেউ জানে না। একটা বড় কোম্পানীতে চাকরী করি। ভালো টাকা বেতন পাই। আমার পিশাচ এর সমস্ত কর্ম কান্ড শুরু হয় গভীর রাতে। আমি এতটাই চালাক চতুর যে আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে ধরতে পারেনি। কখনও পারবেও না। আমার চিন্তা- পরিকল্পনা খুবই নিখুত। আপনারা মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এবং টিভিতে দেখেন- অমুক জায়গায় এক যুবতীত লাশ উদ্ধার, অমুক জায়গায় গলা কাঁটা লাশ উদ্ধার- সবই আমার কর্ম। মাঝে মাঝে শুধু গলা কেটে ছেড়ে দেই- কলিজা খেতে ইচ্ছা করে না। যারা পিশাচ হতে চান- তাদের কে একটা বুদ্ধি দিয়ে দেই- সবার প্রথমে কোনো মৃত নারীর ঠোটে চুমু খাবেন অনেকক্ষন ধরে। তারপর মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়ুন শিকারের সন্ধানে। কখন বুঝবেন আপনি পিশাচ হয়েছেন? পিশাচ হওয়ার পর মাটিতে আপনার ছায়া পড়বে না।
false
rn
কিছু প্রিয় খাবারের রেসিপি # কাঁচা আমের টিকিয়া: উপকরণ: কাঁচা আম কুচানো ২ কাপ,সেদ্ধ আলু ১টি, পেঁয়াজ কুচি ২ টেবিল চামচ, জিরার গুঁড়া ১ চা-চামচ, ধনেগুঁড়া আধা চা-চামচ, জয়ফল জয়ত্রীর গুঁড়া আধা চা-চামচ, ডিম (ফেটানো) ২ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, গোলমরিচের গুঁড়া আধা চা-চামচ, কর্নফ্লাওয়ার ১ টেবিল চামচ। প্রণালি: কুচানো কাঁচা আমের সঙ্গে মাখানো সেদ্ধ আলু এবং বাকি সব উপকরণ একসঙ্গে মেখে আমের টিকিয়া বানিয়ে ভেজে নিন। # চালের নাড়ু: উপকরণ: চাল ১ কাপ, গুড় কোরানো দেড় কাপ, নারকেল কোরানো ১ কাপ ও তিল আধা কাপ।প্রণালি: চাল ১ চিমটি লবণ ও পানি দিয়ে মাখিয়ে খোলাতে আধা ভাজা করে গুঁড়া করে নিতে হবে। তিল ভেজে নিতে হবে। গুড় ২ টেবিল-চামচ পানি দিয়ে চুলায় দিতে হবে। গলে এলে চালের গুঁড়া, নারকেল ও তিল একসঙ্গে দিয়ে দিতে হবে। ভালোভাবে মিশে গেলে নামিয়ে পিঁড়িতে ঢেলে দিতে হবে এবং ঢেকে রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি গরম গরম নাড়ু বানাতে হবে। যদি ঠান্ডা হয়ে যায়, তবে আবার একটু গরম করে নিতে হবে। # চিংড়ি ফ্রাই: উপকরণ : চিংড়ি ৫০০ গ্রাম (খোসা ছাড়ানো), কর্নফ্লাওয়ার ২ টেবিল চামচ, চালের গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, ডিম ১টি, দুধ আধাকাপ, আদা ও রসুন বাটা ১ চা-চামচ, গোল মরিচ ও মরিচের গুঁড়া ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদমত, তেল পরিমাণমত।প্রণালী : প্রথমে চিংড়ি ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রাখতে হবে। এবার একটি বাটিতে চালের গুঁড়া, কর্নফ্লাওয়ার, আদা ও রসুন বাটা, ডিম, দুধ, লবণ, গোলমরিচ ও মরিচের গুঁড়া দিয়ে ঘন মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। কড়াইতে তেল গরম হলে চিংড়ি মাছগুলো মিশ্রণে ডুবিয়ে একে একে তেলে ছাড়ুন। বাদামি বা সোনালি রং করে ভেজে তুলুন। তৈরি হয়ে গেলে চিংড়ি মচমচে ফ্রাই। # রুই ভুনা: উপকরণ- রুই মাছ ৫০০ গ্রাম, পেঁয়াজ কুচি, তেল ৩ টেবিল চামচ করে; মরিচ গুঁড়ো ১ চা-চামচ, হলুদ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো আধা চা-চামচ করে; ধনে গুঁড়ো কোয়ার্টার চা-চামচ, কাঁচামরিচ ৪-৫টি, ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ, লবণ পরিমাণমতো।প্রণালী: মাছ কেটে টুকরো করে পানি ঝরান। ওভেনপ্রæফ পাত্রে তেল, পেঁয়াজ কুচি, হলুদ, মরিচ, ধনে, জিরার গুঁড়ো ২ টেবিল চামচ পানি দিয়ে ভালোভাবে মিশান। পাত্রের ঢাকনা খুলে ওভেনের ভেতর রাখুন। মাইক্রো পাওয়ার হাই পয়েন্টে সেট করুন। ওভেনে ২ মিনিট মসলা ভুনে নিন। ২ মিনিট পর পাত্র নামিয়ে ভুনা মসলার সঙ্গে মাছের টুকরো, কাঁচামরিচ ফালি, লবণ ও ৪ টেবিল চামচ পানি ভালো করে মিশান। পাত্রের ঢাকনা বন্ধ করে ওভেনে ৬ মিনিট রান্না করুন। এবার ডিশ বের করে নিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিন। আরো ৪ মিনিট ওভেনে হাই পাওয়ারে পাত্রের ঢাকনা বন্ধ করে রান্না করুন। এবার পাত্র নামিয়ে ধনেপাতা কুচি ও সামান্য ভাজা জিরার গুঁড়ো ছিটিয়ে পাত্র ওভেনের বাইরে ২ মিনিট ঢেকে রাখুন।# চিকেন রোস্ট: উপকরণ: মুরগী ২টা (১টা ৪পিছ করে), পেয়াজ ১০০ গ্রা্‌ম, আদা বাটা ১০ গ্রা্‌ম, রসুন বাটা ৭ গ্রা্‌ম, বাদাম বাটা ৫ গ্রা্‌ম, পেস্তা দানা বাটা ২ গ্রাম, গুড়া মরিচ ১ চা চামচ, টক দই ১/২ কাপ, দারচিনি, লং, এলাচ কালো গোলমরিচ ৪টি করে, লবণ পরিমাণ মতো, তেল ১ কাপ, ঘি ১০ গ্রাম, আলু বোখারা এবং কিসমিস।প্রণালী: প্রথমে একটা মুরগী ৪ পিছ করে কেটে নিয়ে পানিতে ভালো ভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। পরে মুরগীতে লবণ মিশিয়ে গরম তেলে হালকা ভেজে নিতে হবে। মুরগী ভাজার পর ওই তেলে প্রথমে পেয়াজ কুচা ভাজতে হবে। পেয়াজের রং বাদামী রং হওয়ার পর আদা, রসুন, বাদাম, পেস্তাদানা বাটা এবং টক দই দিয়ে অল্পতাপে ভাজতে হবে। যখন মসলার কাঁচা গন্ধ চলে যাবে তখন মসলায় মুরগী ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণ তাপ দেওয়ার পর ডিম আগুনে ঢাকনা দিয়ে দমে দিতে হবে। যখন মুরগী নরম হয়ে আসবে তখন আলু বোখারা ও কিসমিস দিয়ে নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এসব মজার মজার খাবার তৈরি কোন অসাধ্য কিছু নয়। যদি কেউ এইসব খাবার তৈরি করে- তাহলে আমাকে দাওয়াত দিতে ভুলবেন না।
false
ij
শুভ জন্মদিন_ শাহ আবদুল করিম ভাটি অঞ্চলের সুরসাধক শাহ আবদুল করিম বাওরের আদিগন্ত জল ও জলের গন্ধের সঙ্গে আজন্ম পরিচিত। সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের জেলেরা যেমন বাওরের আদিগন্ত জলে জাল ফেলে মাছ ধরে, করিমও তেমনি তাঁর মনের অভ্যন্তরীন আকাশে অদৃশ্য জাল ফেলে কথা ও সুর ধরেন। মাছ ধরা শেষ হলে জেলেরা, গ্রামের জনমানুষের পুষ্টি ও স্বাদ যোগাবে বলে, সে মাছ নিয়ে হাটে যায় বেচতে । করিমও ঠিক তেমনি গান রচনা করে রসিক বাঙালির আত্মার খোরাক যোগান । বাঙালি বড় তৃষ্ণার্ত। করিমের গানে তাদের তৃষ্ণা মেটে আবার মেটেও না। সে কারণেই কি তারা করিমকে ভক্তিভরে কখনও ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’, কখনও ‘বাউলসম্রাট’ বলে ডাকে? যখন ক’জন লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি মিউজিশিয়ান শাহ আবদুল করিমের গান তাদের পার্সোনাল স্টুডিওতে যত্ন নিয়ে রেকর্ড করেন- আমি দূর থেকে শিহরণ বোধ করি। ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’-করিমের এই দীর্ঘশ্বাসময় গানটি লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি মিউজিশিয়ানরা কী যত্ন নিয়ে রেকর্ড করেছেন-তা সামান্য মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। করিমের এই প্রবল বিলাপময় গানটির শুরু অ্যাকুয়েস্টিক গিটারে অল্টারনেটিভ রিদম দিয়ে। বিট শুরু হয়েছে অনেক পরে-কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি/ কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাধি গো বন্ধু-এই দুটি লাইন গাওয়ার পর। কথাগুলি শেষ হলে বিটের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকুয়েস্টিক গিটারে রিদম ও অ্যাকুয়েস্টিক গিটারেই মেজর স্কেলে ছোট মেলোডিক পিস বাজল কিছুক্ষণ। এরপরে পিয়ানো, বাঁশী ও গিটারের ত্রিমূখি আলাপ শোনা গেল। অল্প পরে বেহালার একটু একটু ছড়ের টান। এবার এই কথাগুলি- পাড়াপড়শী বাদি আমার বাদি কালননদী/মরম জ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু। কথা শেষ হলে আকস্মিক তবলা বোল - সঙ্গে পুরুষ কন্ঠের ক্যাসিকাল স্বরবিস্তার। সা রে গা পা /সা ধা পা। স্বরগুলোয় ডিজিটাল ভোকোডারের ( ভোকোডার=যা কন্ঠস্বরকে স্কেলে রেখেও শ্র“তিমধুরভাবে ডিসটরটেড করে) সার্থক প্রয়োগ। তাই বলছিলাম লন্ডনপ্রবাসী মিউজিশিয়ানরা অসম্ভব যত্ন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গানটি রেকর্ড করেছেন । প্রবাসজীবনে তাদের এই নিষ্ঠা করিমের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধারই নিদর্শন । তো, বাঙালি সমাজে করিমের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ এই গানটির কথা আর সুরেই স্পস্ট। কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি। কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাদি গো বন্ধু। পাড়াপড়শী বাদি আমার বাদি কালননদী মরমজ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু কারে কী বলিব আমি- নিজে অপরাধী কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদীরে বন্ধু পাগল আবদুল করিম বলে হল একী ব্যাধি তুমি বিনে এভূবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু। প্রেমভালোবাসা নিয়ে কে কতটা বিপর্যস্ত তা নিয়ে বাঙালির কৌতূহল অপরিসীম। বিপর্যস্ত হৃদয়ের কথা তাঁর গানে ব্যক্ত করেছেন করিম-‘কারে কী বলিব আমি- নিজে অপরাধী/ কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদীরে বন্ধু।’ কোনওরকম রাখঢাক না করেই এ ধরনের সরল স্বীকারোক্তি কারণেই অনেক অনেক আগেই বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই হয়ে গেছে করিমের । বাঙালি ভনিতা কি রাখঢাক পছন্দ করে না, আন্তরিক কথায় তার আসক্তি সহজাত। করিমও রাখঢাক করেন না। যা বলার তিনি সরাসরিই বলেন-রঙের দুনিয়া তোরে চাই না চাই না/দিবানিশি ভাবি যারে তারে যদি পাই না। রঙের দুনিয়া তোরে চাই না চাই না। উপরোন্ত, আমাদের সমাজে বিরহ চর্চার রেওয়াজ আছে। বাওর পাড়ের করিম তো জাত বিরহী। কাজেই, বিরহকাতর বাঙালির হৃদয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ করিমের বসবাস। যে কারণে করিমকে তারা ভক্তিভরে ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’, ‘বাউলসম্রাট’ ইত্যাদি নামে ডাকে। আমি বাঙালি সমাজে করিমের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম। কেবলমাত্র বয়স্কজন না- স¤প্রতি নতুন প্রজন্মের কাছেও করিম দারুন পপুলার হয়ে উঠেছেন। কী এর কারণ? আমরা মতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বুদ্ধিমান ও সজৃনশীল। তারা ভালো মন্দের পার্থক্যটা বেশ বুঝতে পারে। তারা বোঝে কারা যুদ্ধাপরাধী আর কারা দিনরাত খেটে ‘মুক্তির গান’ তৈরি করে। তারা বোঝে- গানের পথ আর শাস্ত্রের পথ কোনওদিনই একসঙ্গে মিশে যাবে না। এসব কারণে তারা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত গানের পথই বেছে নিল এবং আজ থেকে বছর কয়েক আগে যখন একজন বিলেতফেরত মিউজিশিয়ান (হাবিব) নতুন প্রজন্মের হাতে ফোকফিউশন গানের অ্যালবাম (কৃষ্ণ) তুলে দিয়ে বলল-দেখ, সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলায় উজানধল গ্রামে একজন বিস্ময়কর গানের মানুষ বাস করেন-যিনি মুসলমানের ঘরে জন্মেও ভীষন কৃষ্ণভক্ত। নতুন প্রজন্ম সেকুল্যার বলেই সেই বিস্ময়কর গানের মানুষের প্রতি ভীষন কৌতূহলী হয়ে উঠল। তারা শুনল সেই গানের মানুষের বিস্ময়কর গান- গান গাইয়া আমার মনরে বুঝাই মন করে পাগলপারা আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া গান ছাড়া। নতুন প্রজন্মও গান ছাড়া কিছু চায় না। যে কারণে তাদের পকেটে এমপিথ্রি প্লেয়ার, কানে হেডফোন, গান রাখার জন্য তাদের মোবাইলে কমপক্ষে ১ জি বি স্লট চাই। ওদিকে বাওর পাড়ের করিমও গান ছাড়া আর কিছু চান না। সুতরাং, গান পাগল নতুন প্রজন্ম আরেক গান পাগলের প্রতি ঝুঁকল। আর সময়টা এমন- বাংলাদেশে যখন একটা রোম্যান্টিক (সেক্যুলার) বিপ্লব চলছে, নতুন প্রজন্ম যখন রোম্যান্টিক হয়ে উঠছে -তারা তো রোম্যান্টিক করিমের গান শুনবেই। হ্যাঁ, করিম আপাদমস্তক রোম্যান্টিক। গানে বন্ধুরে ডাকি/ গানে প্রেমের ছবি আঁকি পাব বলে আশায় থাকি/ না পেলে যাব মারা। এবং, এই বন্ধুকে ঈশ্বরও মনে করতে হবে। কেননা, করিম মূলত বাউল। বাংলার বাউলরা গানে গানেই ঈশ্বরসাধনা করেন। রবীন্দ্রবাউলও তাইই করেছেন জীবনভর। ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে/ তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।’ লালনেরও একটা গান আছে, বড় মারাত্মক সে গান, ‘বীণার নামাজ তারে তারে/ আমার নামাজ কন্ঠে গাই।’ সেরকম, নতুন প্রজন্ম সৃজনশীল ও বুদ্ধিমান বলেই সজ্ঞানে অসার শাস্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত গানের পথটি বেছে নিল বলেই করিমকে তারা চিনতে পারল। করিমকে চিনেছিলেন মওলানা ভাসানীও । ১৯৫৭ সাল। ৬-১০ ফেব্র“য়ারি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে চলছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সে সম্মেলনে মঞ্চে উঠে জনসমুদ্রের সামনে করিম গাইলেন- জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বল ওগো সাঁই। এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই। করিমের গান শুনে মুগ্ধ মওলানা বলেছিলেন, ‘সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গনমানুষের শিল্পী হবে।’ আজ আমরা জানি সেই জ্ঞানীবৃদ্ধের ভবিষ্যৎবানী সফল হয়েছে। করিমের একটি দেশের গান এরকম- আমি বাংলা মায়ের ছেলে জীবন আমার ধন্য যে হায়, জন্ম বাংলা মায়ের কোলে। শেষ চরণটির সুরে দ্বিজেন -অতুলপ্রসাদ উঁকি দেন। আমি শিহরণ টের পাই। মাত্র তিনটি চরণ। আর তাতেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সমস্ত কৈফিয়ৎ দেওয়া হয়ে গেছে। এরকম আন্তরিক সুরের ছোট ছোট বাক্যে মনের অনুভূতির সুরাশ্রয়ী প্রকাশ- এইই করিমের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন বৃহত্তর বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের খেটে খাওয়া মানুষের বিশ্রামের চা স্টলের স্টিরিও, টিভি থেকে ইয়ং জেনারেশনের সেলফোনে, এমপিথ্রি প্লেয়ারে। করিমের অনুভূতির মূলে প্রেম। সেই চিরকালীন অনুভবের এত সহজসরল সুরময় ছন্দময় প্রকাশে বাঙালি সমাজের হাইক্লাসের সফিকটিকেটেড নাক উঁচু মানুষ অবধি বিমুগ্ধ! ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতেই হয়-করিম যখন বলেন- না আসিলে কালো ভ্রমর, কে হবে যৌবনের দোসর? সে বিনে মোর শুন্য বাসর-আমি জিয়ন্তে মরা। আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা। দোসর, বাসর, মরা, ভ্রমরা। করিমের গানের কথাতেও ছন্দের সমাহার-যা বাংলা গানের নিজস্ব বৈশিস্ট্য । আর, লক্ষ করুন, করিম নিজেকে ফুল (নারীবাচক) কল্পনা করেছেন। প্রেমিকাকে (পুরুষবাচক) ভ্রমর। কিছু ভাববিপর্যয় হয়ে গেল না কি? না। করিম সচেতনভাবেই ভাববিপর্যয় ঘটিয়েছেন। কেননা, বাংলা গানের আবহমান স্রোতধারার পাশেই করিম দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাখ্যা করি। বাংলা গানের শুরুটা হয়েছিল দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব এবং পঞ্চদশ শতকে শ্রীচৈতন্যদেব-এর হাতে। শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, ‘আমার অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।’ এই কথার সরল মানে- পুরুষদেহে নারীর অনুভূতি, প্রকারন্তরে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা। আর, করিম আবহমান বাংলার ভাবের ধারায় লিপ্ত থেকে নিজেকে (নারীবাচক) ফুল কল্পনা করেছেন। প্রেমিকাকে (পুরুষবাচক) ভ্রমর। এক্ষণে বলি, করিমের প্রেমিকার নাম ছিল সরলা (আফতাবুন্নেছা)। বাউলের সাধনমার্গে স্থিত থেকে সরলা ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করতেন করিম? নিশ্চয়ই। কখনও তাঁর ঘোর লাগত। একবার সেই ঘোরে গেয়েই উঠলেন- মায়া লাগায়ছে, পিরিতি শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছ করিমের এই তুমুল জনপ্রিয় এই গানটিকে কি কেবলি লাভ সং? বিলক্ষণ নয়। বাংলা এখানেই স্বতন্ত্র বিশ্বের অন্যান্য ‘সংস্কৃতি’ থেকে। ফারসী ‘দেওয়ানা’ শব্দটি লক্ষ করুন। কে মায়া লাগাল? নারী? সরলা? যে করিমের প্রেমিকাও বটে। কেননা, তিনি নারীর ধর্ম পালন করেন-ছলেবলে পিরিতি শেখান- সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো! কাজেই নারীপ্রেমিকার রুপ ধরে ঐশ্বররিক শক্তির বশে কবি পুরুষকে দেওয়ানা করেন, পাগল করেন, জাদু করেন, মায়া লাগান। কে সে? ঈশ্বর? নাকি ঈশ্বরী? এই প্রশ্নে বাউল তো ছিন্নভিন্ন হবেই। এবং, এই প্রশ্নের ফলে যে গানের জন্ম হল সেই গানটিই কেন করিমের সবচে লোকপ্রিয় গান-এই ভেবে ভেবে এ শঝের গবেষকও দীর্ঘদিন দিশেহারা- দিশেহারা লন্ডন প্রবাসী করিমভক্ত মিউজিশিয়ানরাও। যে কারণে তারা প্রবাসজীবনের শত বিপত্তি সত্ত্বেও গান যত্ন নিয়ে বাউল সম্রাটের গান নিজস্ব স্টুডিওতে রেকর্ড করেন। উপরোন্ত- ‘মায়া লাগাইছে’ গানটি লোকসঙ্গীত হলেও গানটির শরীরে রাগ ‘মন্দ’-এর আবেশ মিশে আছে। ঘটনা এইখানেই। উত্তর ভারতীয় উচ্চকোটির রাগসঙ্গীত করিমের গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- তাও করিমের সবচে বিখ্যাত গানে! ঈশ্বর বিরহ যেখানে প্রবল- বসে ভাবি নিরালায়/ আগে তো জানি না বন্ধুর পিরিতের জ্বালা। হায় গো নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে। নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে? বাংলা গানে এই ধরনের উপমার প্রয়োগ একেবারেই অভাবনীয়। রবীন্দ্রনাথ কি কখনও ভেবেছিলেন যে একদিন বাংলা গানে ইটের ভাঁটার উপমা দেবেন ভাটি অঞ্চলের একজন কবি ও সুরসাধক? কিন্তু, বিসদৃশ উপমাটি মানিয়ে যায়নি কি? গেছে? কেন? যেহেতু গানটিতে স্বয়ং ঈশ্বর ভর করেছেন; যেহেতু ঈশ্বর নিজে ধরা না দিলেও নিজেকে প্রকাশ করতে সদা তৎপর। ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী। বাউলের সাধনমার্গে স্থিত থেকে সরলা ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করতেন করিম। গানটি ঐশ্বরিক। অন্যকারণে। করিম সবাইকে বিরাট এক ফাঁকি দিয়েছেন। সবাই ভেবে বসে আছে গানটি নিছক বিরহের গান। আসল ঘটনা অন্যরকম। গানটি ইনটেন্স ম্যাটাফিজিকাল সং। কেবলমাত্র ঐশ্বরিক শিল্পেই এ ধরনের ফাঁকির ঘটনা ঘটে। অবশ্য, এই কথাগুলোন ইউরোপীয় নন্দনতাত্ত্বিকদের জন্য নয়। তাদের কিছু বিষয় ঠিক বোঝানো যাবে না কোনওকালেই। আর, করিমের গানের সুরও কখনোই কৃত্রিম নয় তো নয়ই বরং আন্তরিক লোকজ সুর। চলে গাড়ি হাওয়ারই ভারে, আজব কল গাড়ির ভিতরে। নিচ দিকেতে চাকা ঘুরে, সামনে বাতি জ্বলে না। আমি তোমার কলের গাড়ি, তুমি হও ড্রাইভার। আর করিমের সৃজনশীলতার দিক? সেও আছে। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা’ -এই বহুলপ্রচারিত গানটির তালটি বাওরের আদিগন্ত জলে নৌকাবাইচের ছন্দকে ধারন করেছে। তরুণ বয়েসে যে করিম গ্রামের বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নাও দৌড়ায়তেন-গানে সে কথাও রয়েছে। গানটি করিমের আত্মজীবনী ও জীবনদর্শনের সংমিশ্রণ বলেই মনে হয়। বাউলের জীবনদর্শন। করিম বলেছেন, ‘কে হবে মেম্বার কেবা গ্রামসরকার/আমরা কি তার খবর লইতাম ভাইরে?’ সত্যিই তো, প্রকৃত শিল্পী কেন মোড়লদের ভিড়ে যাবেন। সন্ধ্যার পর সব ধান্দাবাজ লোকেরা কমিশনারের অফিসে বসে থাকে না? তারা চা খায়, বিড়ি টানে। করিমের ভিতরে শিল্পীসত্তা রয়েছে বলেই গানের বই প্রকাশ করার জন্য জমি অবধি বেচেছেন। তাতে সরলার সায় ছিল মহাকালের কর্তা নিজে ধরা না দিলেও নিজেকে প্রকাশ করতে সদা তৎপর বলেই এবং চতুদর্শ শতকের কবি চন্ডীদাসের প্রেমিকা শ্রীরামীর সঙ্গে দেবী সরলার তুলনা করে বিস্মিত হয়ে যাই। ১৯৮১ সালে গানের বই (কালনীর ঢেউ) প্রকাশ করার জন্য করিম সর্বশেষ সম্বল নয় বিঘা জমি অবধি বেচেছেন যখন বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা নানান ফন্দি ফিকির করে জমিজিরেত বাড়ায়। সে কথা করিমই বলেছেন, ‘মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল/ এখন সবাই পাগল কেমনে বড়লোক হইতাম।’ করিমের আংশকা- করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না ছিল বাসনা সুখি হইতাম। দিন হতে দিন আসে যে কঠিন করিম দীনহীন কোন্ পথে যাইতাম? ২ ঠিক গানের জন্য নয়। আমি করিমের প্রতি অন্য কারণে উৎসুক । করিমের বিশ্বাস ও জীবনদর্শনের ভিতরে আমি অন্যতর প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়েছি-যা এক কথায় বিস্ময়কর। করিমের জীবনবোধ আবহমান বাংলার ভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। খুলে বলি। বাংলা মাতৃতান্ত্রিক এবং তাঁর দর্শন বা ভাবটিতে নারীপ্রাধান্য বিদ্যমান- বাংলার সাধকপুরুষদের সাধনায় কথাটিই প্রতীয়মান হয়। এমনকী সপ্তম শতকের বাঙালি তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কবিতায় সে ইঙ্গিতটি স্পস্ট। দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব লিখলেন ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য। সে কাব্যেই প্রথম রাধা-কল্পনা করলেন কবি জয়দেব। জয়দেবের কাব্যপ্রেরনার মূলে ছিলেন তাঁর দক্ষিণভারতীয় স্ত্রী পদ্মাবতী। বাংলায় দূর্গা (নারী বা মা) পূজার উদ্বোধন হল চতুদর্শ শতকে -কী আশ্চর্য! ঠিক সেই শতকেই পশ্চিমবঙ্গের নান্নুর গ্রামের এক সাব-অলর্টান নারী রামী -শাস্ত্রভক্ত পুরোহিত চন্ডীদাসকে আপন নারীশক্তি বলে (নারী ও শাস্ত্র পরস্পরবিরোধী বলে) চন্ডীদাসকে টান দিয়ে মন্দির থেকে বের করে প্রেমময় সেক্যুলার কবিতে রুপান্তরিত করলেন! তখন বলছিলাম, ... নারীপ্রেমিকার রুপ ধরে ঐশ্বররিক শক্তির বশে কবি পুরুষকে দেওয়ানা করেন, পাগল করেন, জাদু করেন, মায়া লাগান। অনেককের মনে হতে পারে আমি হয়তো সাধারনীকরণ করছি। আমি মনে করি আমি বাংলার নারীবন্দনার ধারাবাহিক সূত্রটি আবিস্কার করার চেষ্টা করছি। ইসলাম যে বঙ্গদেশে এত ব্যাপক পপুলারিটি পেয়ে গেল- তার কারণ কি? বঙ্গদেশে ইসলামের ব্যাপক পপুলারিটি লাভের অন্যতম কারণ নারীর প্রতি পীরদরবেশ, ওলি আউলিয়াদের শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি। Click This Link বায়োজিদ বোস্তামির অচলা মাতৃভক্তির কথা কে না জানে। সে প্রসঙ্গে কবিশেখর কালিদাস রায়ের আবেগমথিত উচ্চারণ-বায়েজিদ বোস্তামি/শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী। (মাতৃভক্তি) বাংলায় বাউল মার্গের উদ্ভব বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মত ও সুফিবাদের সম্মিলনে। বৌদ্ধ ধর্ম সমস্তরকম লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরোধী। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বুদ্ধের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠোর। উপরোন্ত বুদ্ধ মনে করতেন, নারীও বোধিলাভে সক্ষম। এসব কারণেই মাতৃতান্ত্রিক বাংলার সঙ্গে বাউলসাধনার যোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং শাহ আবদুল করিম সে ধারা থেকে কোনওমতেই বিচ্ছিন্ন নন। যেহেতু আমি পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে নারীর ইতিহাসের প্রতি গভীর উৎসুক, যে ইতিহাস তুষার যুগের অন্তে নগরসমূহ গড়ে ওঠার প্রাক্কালে নারীকে ক্ষমতাচ্যূত করারই ইতিহাস- সে সমস্ত পূর্বাপর কথা মাথায় রেখেই আমি করিমের একটি মন্তব্যে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যাই। করিম বলেছেন, ‘আমি সরলাকে (করিমের স্ত্রী) আমার মুর্শিদ (পথপ্রদর্শক) জ্ঞান করি।’ (ভারত ও ভারততত্ব। এটি মূলত প্রবন্ধ সংকল। সুধীর চক্রবর্তীর প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘ভাটি অঞ্চলের গণগীতিকার শাহ্ আবদুল করিম।’ পৃষ্ঠা, ৪৩৩) নারী মুর্শিদ কিংবা পথপ্রদর্শক হতে পারেন- এই হচ্ছে করিমের বিশ্বাস। একুশ শতকে পৌঁছে অনেকেরই মনে হতে পারে- এ এক যথার্থ অনুভূতির সঙ্গত প্রকাশ। সঙ্গত-এই কারণে যে- সেই তুষার যুগ থেকেই মানবসমাজে নারীর ক্ষমতায়ন অক্ষুন্ন থাকলে সভ্যতার নিষ্ঠুর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলি অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস পেত এবং পুরুষতন্ত্রের অনভিপ্রেত উত্থান ঘটনা না, পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে অজস্র নারীর প্রাণ বলি হত না। করিমের বিশ্বাসটি যথার্থ এই কারণেই যে- নারীর ওপর স্বয়ং ঈশ্বরও নির্ভরশীল তার সৃষ্টিকে বহমান রাখার জন্যই! নারীর প্রসবযন্ত্রণা কি ঈশ্বর সহ্য করেন? করেন না। তা হলে নারীই কি ঈশ্বর? এই প্রশ্নটি সিদ্ধ। হিব্র“ভাষী প্রাচীন পুরুষেরা মনে করতে যে- ঈশ্বর পুরুষ। কেননা, সকল গ্রন্থরচয়িতারাই পুরুষ। হোয়াট আ প্যারাড´! এসব বিভ্রান্তি এড়িয়ে করিম প্রকৃত সত্যটি উপলব্দি করেছেন। প্রকৃত সত্য উপলব্দি অবশ্যি অনেক আধুনিক প্রগতিশীল পুরুষই করেন তবে সুশীল সমাজে খাটো হয়ে যাবার ভয়ে সত্যটি প্রকাশ করতে তারা অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করেন। এখানেই করিম অনন্য। তাঁর অমূলক সঙ্কোচ নেই, অহংবোধ নেই-তিনি সৃষ্টির মানে জেনেছেন। শুধুমাত্র এই কারণেই, অন্তত আমার কাছে, পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ একদিকে- করিম অন্যদিকে। আজ সবাই তাঁর গানে আচ্ছন্ন। একদিন সবাই করিমের গানকে ছাড়িয়ে করিমের জীবনবোধের সত্যটা উপলব্দি করবে: করিম তাঁর সৃস্ট সঙ্গীতের চেয়েও উর্ধে। যে কারণে, হাজার বছর ধরে যাঁদের জীবনসাধনার ফলে বাংলা জগতের অন্যন্য স্থানের চেয়ে স্বর্গের অন্তত দু’ধাপ হলেও কাছে -শাহ আবদুল করিম তাদেরই একজন। ৩ ১৩২২ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার জন্মেছিলেন করিম। সে হিসেবে ইংরেজি ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি ১৫। আজ ফেব্রুয়ারি ১৫। এই বিরাট ও অনন্য পুরুষটির ৯৪তম জন্মদিন। আজও তিনি বেঁচে আছেন সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজান ধল নামে একটি গ্রামের বাওরের আদিগন্ত পানির পাড়ে। কারা কারা এখনও উজান ধল গ্রামের ওই পবিত্র তীর্থে যান নি? সত্ত্বর রওনা দিন- উজানধলে ভিড় বাড়ার আগেই। আজ যেমন ইচ্ছে থাকলেও মধ্য ডিসেম্বরে কক্সবাজারে হোটেলের রুম আপনারা খালি পান না- আর দশ কি পনেরো বছরের মধ্যেই বিশ্বের তাবৎ শান্তিবাদী কবি আর জিজ্ঞাসুদের ভিড়ে ওই উজানধল গ্রামের হোটেলের রুম খালি পাবেন না বলে রাখলাম । আর দশ-পনেরো বছরের মধ্যেই উজানধল গ্রামে করিমের শ্বেতপাথরের একটি আকাশছোঁওয়া ভাস্কর্য স্থাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের তাবৎ শান্তিকল্যাণবাদী মানুষের উদ্যোগে। কেননা, ততদিনে আর্ন্তজাতিক মহলে এই কথা রটে যাবে যে- অল্প বয়েসে করিম ছিলেন রাখালবালক। বাড়ির কাছের বাওরের আদিগন্ত পানির পাড়ের ঘাসের মাঠে করিম গোরু চড়াতেন ছেলেবেলায়। সবকিছু মিলে যাচ্ছে যে! মানবসভ্যতার সবচে শুদ্ধ আত্মার অধিকারীরাই যে মেষপালক! তাইই বলছিলাম-কারা কারা এখনও উজান ধল গ্রামের ওই পবিত্র তীর্থে যান নি? ভিড় বাড়ার আগেই সত্ত্বর রওনা দিন। সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩৬
false
hm
ধন্যবাদ, হন্ডুরাস ও করাচী ১. ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে হণ্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপা থেকে কিছু দূরে কোমায়াগুয়া শহরের কারাগারে আগুন [১] লাগে। পেনিতেনসিয়ারিয়া নাসিওনাল দে কোমায়াগুয়ার সাড়ে আটশো কয়েদীর মাঝে একজন রাজ্যপালকে ফোন করে চিৎকার করে বলে, এই কারাগার সে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেবে। কেউ কেউ পরে অনুমান করেছে, তার বান্ধবী তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো তার আগের দিন, ১৪ তারিখ, ভালোবাসা দিবসে। কম্বলে লাগানো আগুন মুহূর্তের মাঝে ছড়িয়ে যায় ব্যারাকে। শুরু হয় চিৎকার, হুড়োহুড়ি, একটু বাতাসের জন্য হাহাকার করা মানুষের আতঙ্কিত ধাক্কাধাক্কি। কারারক্ষীরা দরজা বন্ধ করে আকাশে ফাঁকা গুলি করতে থাকে। অগ্নিসেনারা এসে দাঁড়িয়ে থাকে বদ্ধ দরজার সামনে। ভেতরে তখন মানুষ পুড়ছে, কারাগারের দরজা বন্ধ। আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা একজন জানায়, প্রাণ বাঁচাতে বাইরে বেরিয়ে এসে সে দেখতে পায়, কারাকক্ষের গরাদে আটকে জ্যান্ত পুড়ে মরছে মানুষ। আরেকজন বলে, কারারক্ষীরা তাদের শত অনুনয়েও সাড়া দেয়নি, পুড়ে মরতে দিয়েছে, তবু কারাকক্ষের দরজা খোলেনি। ছয়টা ব্যারাক পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায় সে আগুনে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে স্নানাগারে ঢুকেছিলো, পানি দিয়ে আগুনের বিরুদ্ধে যুঝতে, লাভ হয়নি। তাদের পোড়া শরীর পাওয়া গেছে সেখানে। কেউ কেউ দেয়াল টপকে ছাদের ধাতব আবরণ সরিয়ে পালাতে চেয়েছে। কেউ পেরেছে, কেউ পারেনি। যারা পারেনি, তাদের পোড়া শরীরগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে লেপ্টেছিলো, কমলার খোসার মতো করে ছাড়িয়ে তাদের ব্যাগে পুরে ফরেনসিক অনুসন্ধানের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হণ্ডুরাসের ঐ কারাগারে কোনো শারীরিক বা মানসিক চিকিৎসার সুবিধা ছিলো না। পাঁচশো জনের জন্যে তৈরি কারাগারটিতে সাড়ে আটশোর মতো কয়েদি ছিলো, প্রত্যেকের খাওয়ার জন্য দিনে ১ ডলারেরও কম খরচ বরাদ্দ ছিলো। ১৫ ফেব্রুয়ারির আগুনে পুড়ে মারা যায় ৩৫৮ জন কয়েদী। ২. ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে পাকিস্তানের করাচী শহরের বলদিয়া টাউনে আলি এন্টারপ্রাইজ, একটি পোশাক কারখানা, আগুনে [২] ভস্ম হয়। চারতলা কারখানার জানালায় ধাতব গরাদ লাগানো ছিলো, আগুন থেকে পালানোর জন্য কোনো নিষ্ক্রমণপথও ছিলো না। লাফিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয় অনেকে, ভেতরে হুড়োহুড়িতে আহত ও নিহত হয় অনেকে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির দরজা ছিলো তালা লাগানো। দারোয়ানদের কাছে চিৎকার করে চাবি চেয়েছিলেন ভেতরে আটকা পড়া কর্মীরা, তারা সাড়া দেয়নি। অতি দাহ্য সব বস্তু দিয়ে বোঝাই ছিলো কারখানার ভেতরটা। দ্রুত বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে ভেতরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ, তারপর তাদের মৃতদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। কর্মীদের ধারণা, জেনারেটরের ত্রুটি থেকেই আগুন ছড়িয়েছিলো। বিবিসি সেদিনের খবরে ২৮৯ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। ৩. আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় আগুনে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত ১১০ জন মানুষের মৃত্যু (বাস্তবে আরো অনেক বেশি হতে পারে) নিয়ে মিডিয়ায় নানা সংবাদ ও মত প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যবৃন্দ। খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি [৩], সভায় সংগঠনটির সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এই ঘটনায় মারা যাওয়া ৫৩ জন শ্রমিকের পরিচয় আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। তাই তাঁদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এই দায় আমাদের। আমরা এসব শ্রমিকের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারিনি। এ জন্য জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’ আরো জানতে পারি [৪], গণমাধ্যম নিয়ে সমালোচনার এক পর্যায়ে সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এক পর্যায়ে আলোচনার মূল বিষয়ে আসতে বক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। ... “হন্ডুরাসের জেলে একসঙ্গে ৩৬১ জন ও পাকিস্তানের করাচির একটি ফ্যাক্টরিতে ১৬০ জন মারা গেছে। সেই তুলনায় আমরা অনেক প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। এগুলো মিডিয়াকে বুঝতে হবে,” বলেন তিনি। আমরা জানতে পারি, এই সংগঠনের সদস্যরা তাদের কারখানার শ্রমিকদের জীবিত থেকে লাশ হয়ে যাওয়ার জন্যে নয়, বরং লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা জানতে পারি, পোশাক শিল্প মালিকেরা মনের গোপন কোণে নিজের কারখানাটিকে হণ্ডুরাসের কারাগারের সমকক্ষ ভেবে তুলনা করেন, ৩৫৮ সংখ্যাটি ১১০ এর চেয়ে অনেক বেশি, এই ভেবে তৃপ্ত থাকেন। আমরা আরো বুঝতে পারি, আমাদের পোশাক শিল্প কারখানার একজন শ্রমিকের জীবন হণ্ডুরাসের একটি ঘিঞ্জি কারাগারের কয়েদীর জীবনের মতোই। অন্তত দৈনিক আয় আর অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচার সম্ভাবনার কথা ভাবলে, দু'জনের মাঝে পার্থক্য কোথায়? আমি তাই হৃদয় নিঙড়ানো শুভাশিস জানাতে চাই হণ্ডুরাস ও করাচীর প্রতি। তারা দেখিয়েছে, আমাদের চেয়েও বড় শুয়োরের বাচ্চা আছে পৃথিবীতে। নাহলে শতাধিক পোড়া গরিবের লাশ নিয়ে আমরা কোথায় যেতাম, কার কাছে মুখ দেখাতাম? তথ্যসূত্র: [১] Honduras prison fire victims 'burned up against the bars, stuck to them': দ্য গার্ডিয়ান, ১৬-০২-২০১২ [২] Death toll from Karachi factory fire soars: বিবিসি, ১২-০৯-২০১২ [৩] বিজিএমইএ ক্ষমা চেয়েছে, গণমাধ্যমকেও দুষেছে: প্রথম আলো, ৩০-১১-২০১২ [৪] পোশাক শিল্প মালিকরা দুষছেন গণমাধ্যমকে: বিডিনিউজ২৪ডটকম, ৩০-১১-২০১২
false
ij
জীবনানন্দের একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের ‘কবিতা’ নামক কবিতাটি আমায় ভীষণ টানে। প্রায়শ পাঠ করি । জীবনানন্দের একটি শীর্ষস্থানীয় রচনা বলে মনে হয় কবিতাটি; যেখানে জীবনানন্দীয় সব ঝোঁক ও বৈশিষ্ট্য উপস্থিত। যদিও বহু পাঠেও কবিতার মানে বুঝে উঠতে পারিনি। সে চেষ্টা করিও না। কারণ, কবিতার যতটুকু বোঝা যায় না ঠিক ততটুকুই নাকি কবিতা। মাঝে মাঝে ভাবি যে, কবিতাটি অনুবাদ করলে কেমন হয়। সে রকম করা গেলে পরিচিত কবিতাকে একটু অন্যভাবে দেখার সুযোগ হয়। কবিতা পাঠে আমি যে নিবিড় উত্তেজনা লাভ করি সেটি অন্যের মনেও পৌঁছে দেওয়া যায়-তাও বা কম কী; কিংবা জীবনানন্দের দর্শনকে নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। নতুন প্রজন্ম- যাদের জীবনযাপনে জীবনানন্দের কবিতার বইয়ের ততটা একসেস নেই হয়তো । এসব ভেবেই অনুবাদের উদ্যেগ। তবে, কবিতা অনুবাদ অসম্ভব একটি বিষয়। জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে কথাটি যেন আরও সত্য। কাজেই জীবনানন্দের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে একই সঙ্গে ইংরেজি কবিতার স্বাদ দেওয়া এককথায় অসম্ভব। মূল কবিতা আমার উপলব্ধির বাইরে থেকে গেলে-ইংরেজি রুপান্তরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কাজেই আমরা কেবল কবিতাটি আক্ষরিক অনুবাদ করেছি নতুন প্রজন্মকে জীবনানন্দের রহস্য ও চিন্তাধারা সম্বন্ধে ধারণা দেব বলে। অসিফ হক এর সাহায্য ছাড়া অনুবাদ সম্ভব হত না, চূড়ান্ত এডিট ওই করেছে, আমার ভূমিকা সামান্য । আসিফ পিএইচডি ক্যানডিডেট, কম্পিউটার সায়েন্স, কর্নেল ইউনিভারসিটি, নিউ ইর্য়ক। কবিতা আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছি ভেসে; তা না হলে সকলি হারায়ে যেত ক্ষমাহীন রক্তে -নিরুদ্দেশে। হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর; তারপর হয়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্দ সমুদ্রের। ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই, নেই কোনও নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে। বানরী ছাগল নিয়ে যে ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে- আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে- খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে। চামচিকা বার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ূসন্তরণে; প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে; জীর্নতম সমাধির ভাঙা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝি -দম্পতির ক্ষুধা করে আবিস্কার। একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জোছনার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায় যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার। হে আকাশ, হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি মেরুনিশীথের স্তব্দ সমুদ্রের মতো; তারপর হয়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার। ইংরেজি অনুবাদ Poetry Inside our bones, there is a smokeless joy - feeling it -we are Floating in the rotten timestream; Otherwise, everything must have vanished in merciless blood, vanished and lost. Oh sky, once you were the river of the dawn; Then you became the soundless ocean of a remote polar night. Hence, the dawnbirds do not falter, No loss in the life of the insects drawn towards light. The beggar who roams with monkeys and goats on the deceived streets- In the darkness of the tranquil water on his palm- Gets the meaning of his quest. The bats take flight towards another world, in a windswim; At the beginning of a heap of provincial grass - the immortality of the pasture awakes. Beside the thickly dense weed, the worn out graveyard’s broken brick Discovers the green golden-eyed cricket couple’s hunger. A bat beckons for a distant self-achieved moonlight’s flair Those who desire the spread out horizon. Oh sky, oh sky, Once you seemed like the soundless ocean of a polar night; Then became as brilliant as the river at dawn. উৎসর্গ: হারুন আল নাসিফ সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:৩৩
false
rn
রাস্তায় পাওয়া ডায়েরী থেকে-৩ (রুবেল শাহ্,আপনিতো আমাকে চমকে দিয়েছেন!এই লেখাটা আপনাকে উৎসর্গ করা হলো।ভালো থাকবেন,আপনার জন্য এক আকাশ শুভ কামনা।)গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকালে সব সময়ই নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়।শুধু আমার না অনেকের'ই হয়তো এমন মনে হয়।মনে হয় আমার এখনো অনেক কিছু বাকি আছে।কিন্তু সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে।অনেক কথা জানানো হয়নি।শুধু আমি এই ব্যালকনিতে বসে অন্ধকারে নিজের সাথে কথা বলেছি।নানান ভাবে নিজেকে বুঝ দিয়েছি।এক একটা মুর্হূতে 'হিমি'(দুঃখিত,নামটা 'হিমি' ব্যাবহার করলাম।কেন জানি এই নামটার উপর খুব মায়া পড়ে গেছে!)কে আমি বুঝতে পারি না।তখন আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়।'হিমি'র নিরবতা আমাকে ভেতরে ভেতরে চুরমার করে দেয়।'হিমি' ইচ্ছা করলেই আমার পৃথিবী আনন্দে ভরে দিতে পারে।আমি বুজি না ওর সমস্যা টা কোথায়!বিশেষ করে আজকের এই বৃষ্টি'র রাতে বারবার মনে হচ্ছে-'হিমি পাশে থাকলে ভাল হতো,খুব ভালো হতো।জীবনটাই বদলে যেত।দু'জনে ব্যালকনিতে বসে চা খেতাম গল্প করতাম!সারাটা রাত হয়তো গল্প করেই কাটিয়ে দিতাম!কি আনন্দ নিয়েই না সময় পার করে দিতাম আর এখন সময়'ই যেতে চায় না।ঝুম ঝুম বৃষ্টি'র শব্দটা বিরক্ত লাগে।সকালে রাস্তায় পানি জমে থাকবে।দূর কিছুই ভালো লাগছে না।জানালা দিলাম খুলে-ভিজে যাক,সব ভিজে যাক।'হিমি' ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কিছু নেই?তাহলে কেন বারবার সব কিছুতেই'হিমি' কে এনে দাঁড় করাই।সত্যি কথা বলতে কি হিমি কে ছাড়া সব কিছুই বড় বিষময় মনে হয়।একটুও ভালো লাগে না।আমি কি করবো?রাতটাই এমন!আবার ঝুম বৃষ্টি!মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সব বর্ষা আমার মনে ভর করেছে।ইচ্ছা করে মেঘের মতো ভেসে ভেসে তোমার কাছে যাই,তোমাকে আদর করি,তোমার কাছ থেকে আদর নেই।তোমার কোলে মাথা রেখে কাঁদি,খুব কাঁদি।এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে আমি একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।বাইরে হয়তো ঝুম বৃষ্টি পড়ছেই।সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো আজ আমার কোন কাজ নেই,আরো কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিলাম।নিজেকে চঁড়ুই পাখির মতো মনে হলো।গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আমি ব্যালকনিতে যাই।"চেনা শোনার কোন বাইরে/যেখানে পথ নাই নাইরে/সেখানে অকারনে যাই ছুটে/যা না চাইবার তাই আমি চাই গো/যা না পাইবার তা কোথা পাই গো"।বুকের ভেতর উওরের শীতল বাতাস।'হিমি' তুমি?তোমার কথা ভাবলেই বুকের যেন কেমন করে!মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তুমিহীন তোমার কথা ভেবে ভেবে জীবনকে আনন্দময় করে তুলি।মনে হয় আমার কোন ব্যার্থতা নেই।তোমার কথা ভাবতে ভাবতে সারা পৃথিবী দৌঁড়ে এলেও আমি ক্লান্ত হবো না।তুমি এমনই আমার কাছে।'হিমি আসো আমরা শপথ করি-কেউ কাউকে ছেঁড়ে থাকবো না।দাও তোমার হাতটা দাও।তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই বুঝি না।আমার সব টুকু ভালোবাসা বারবার তোমার দিকেই ছুটে যায়।তুমি ছাড়া আমার কোন মুক্তি নেই। নেই। নেই।
false
fe
নির্যাতিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তিবর্ম নির্যাতিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তিবর্মফকির ইলিয়াস=============================================মায়ানমারে কি হচ্ছে? কেন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে? এটা কেমন অমানবিকতা? কেউ কিছু বলছেন না কেন? জাতিসংঘ দায়সাড়া গোছের একটি বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব খালাস করতে চাইছে? জাতিপুঞ্জের সংবিধান কি বলছে? আমাদের মনে আছে, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে বন্দি শিবির ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তা নিয়ে কি কোনো তল্লাশি করেছিল বিশ্বসম্প্রদায়? না- করেনি। খবর বেরিয়েছিল, মায়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নির্যাতন করে দেশ থেকে জোরপূর্বক সাগরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করছে দেশটির ক্ষমতাসীনরা। তারপরও বিশ্বের মানবতাবাদী নেতারা পালন করছেন এক ধরনের নীরবতা। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, বর্তমান মায়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপক‚ল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপক‚লে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস।২০১২ সালেও একবার এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর হামলে পড়েছিল খুনিরা। কিছুদিন পরে তা কিছুটা স্তিমিত হলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ চলছেই নীরবে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক কথা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় গোত্র দাবি করেন। অথচ সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাতির দেশ মায়ানমারে গণহত্যা চলছে। তারা ভুলে গেছে মহামতি বুদ্ধের অমর বাণী- প্রাণী হত্যা মহাপাপ। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সীমান্ত খুলে দেয়ার এবং অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবিক বিবেচনায় সীমান্ত খুলে দেয়ার কথা বললেও বাংলাদেশ মনে করে, মানবতার দায় বাংলাদেশের একার নয়। কথাটা বাংলাদেশের সরকার ঠিকই বলছে। কারণ মায়ানমারে কোনো যুদ্ধ চলছে না। একটি গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। বিশ্বের প্রভাবশালীরা কেন মায়ানমারের শাসকচক্রকে ডেকে তা জিজ্ঞাসা করছেন না? বিশ্ব সম্প্রদায়েরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দায় রয়েছে। তাদের উচিত, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানে এগিয়ে আসা। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গা কমিশনেরও কার্যকর তৎপরতা প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের নৃশংস নির্যাতন চলছে। গত ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানে এ পর্যন্ত ৩৫০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র ও বিশ্ব গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, এই সংখ্যা অনেক বেশি। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের চার শতাধিক বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিম-সমর্থিত ‘রোহিঙ্গা ভিশন’ নামে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা ভিডিওচিত্রে আগুনে পোড়া কিছু মৃতদেহ এবং এসব মৃতদেহ ঘিরে তাদের স্বজনদের শোকের মাতম দেখা গেছে। দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে- ‘মাত্র এক বছর আগে, ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর দীর্ঘ সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী, নোবেলজয়ী অং সান সু চি মায়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান হন। এতে আশার সঞ্চার হয়েছিল, তিনি রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ ভোগান্তির অবসান ঘটাবেন। সেপ্টেম্বরে ওবামা প্রশাসন মায়ানমারের ওপর থেকে অবশিষ্ট অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেয়। তখন মায়ানমারের অন্যান্য অর্জনের পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়, নতুন সরকার ‘তার নাগরিকদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর ওপর’ জোর দিচ্ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এমন কথা বলাটা ছিল অপরিপক্ব। সু চি নিজেই রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ নাগরিক হওয়ার হাস্যকর দাবিকে জোরালো করেছেন। তাদের ‘বাঙালি’ বলেই এটা করেছেন এক সময় ‘বিবেকের দূত’ উপাধি পাওয়া সু চি। একই সঙ্গে হামলার জবাবে সরকারের দমন-পীড়নমূলক অবস্থানকে ‘আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে’ বলে দাবি করেছেন তিনি। এদিকে নির্যাতনের শিকার মানুষের কাছে ওই এলাকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বেশিরভাগ পথও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, অপুষ্টির শিকার হাজার হাজার শিশু ক্ষুধা ও চিকিৎসা সেবার স্বল্পতার ঝুঁকিতে রয়েছে। সরকারকে অবশ্যই অভাবীদের কাছে অবিলম্বে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর অনুমোদন দিতে হবে। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলমান সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে।’ কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে না। বরং হত্যা অব্যাহত রয়েছে।মায়ানমারের রোহিঙ্গা বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে এই এলাকায় বেশ কিছু মৌলবাদী-জঙ্গি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যে জঙ্গি গ্রুপ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে নিঃশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার মদদ দিচ্ছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, মায়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যার তীব্র প্রতিবাদ আমরা জানাচ্ছি, জানাব। কিন্তু সিরিয়া, ইয়ামেন, ইরাক, তুরস্ক, মরক্কো, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে প্রায় প্রতিদিন মুসলমানদের হাতে শত শত মুসলমান যে নিহত হচ্ছেন- এর তীব্র প্রতিবাদ কেন করা হচ্ছে না? কোনো কোনো মৌলবাদী নেতা বলছেন, সেগুলো ওসব দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। অথচ ১৯৭৮ সালে এরকম এক হামলার পর প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরা এখনো বাংলাদেশেই আছে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিহারিরা বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল- এদের প্রজন্মের সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি বলে বলা হচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে অর্থ পাওনা দাবি করেছে সম্প্রতি। কিন্তু তারা তাদের ওই বিহারিদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা একবারও বলেনি গেল ৪৫ বছরে।ফিরে আসি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে। আগেই জানানো হয়েছে মায়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সম্পর্কিত একটি কমিশন গঠন করবে দেশটির সরকার। যার প্রধান হবেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। এই কমিশন মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা ও তাদের ঘিরে দেশটিতে যে সংকট রয়েছে তার সমাধান খোঁজার জন্য কাজ করবে। তবে, নতুন এই কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মায়ানমারের মধ্যে চলমান সংকট নিয়েও কাজ করবে কিনা সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। জাতিসংঘের ভাষায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটি। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাস, যারা পৃথিবীর কোনো দেশের নাগরিক নয়। দেশটি রোহিঙ্গাদের তার নাগরিক মনে করে না। বরং মায়ানমার মনে করে তাদের আদি আবাস বাংলাদেশ। এমনকি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারেও দেশটির সরকারের আপত্তি রয়েছে। এসব বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দেশটির গনতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সাং সুচি বহুদিন যাবৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করেননি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই নেত্রী রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে কথা বলবেন সেটাই বিশ্ব প্রত্যাশা করেছিল। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি চাইলে এই সমস্যার জোর সমাধান দরকার। সু চি কি তাহলে তার অবস্থানের পরিবর্তন করেছেন? কেন করেছেন? তিনি তো ‘শান্তির’ জন্যই নোবেল পেয়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন-নেপাল-শ্রীলঙ্কার যৌথ আলোচনা দরকার। মায়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা দরকার, বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য। কারণ রক্তাক্ত সহিংসতা আরো রক্তপাতের জন্ম দেয়। যা প্রতিবেশী দেশের শান্তি খুব সহজেই বিপন্ন করে তুলতে পারে।-------------------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:২৭
false
ij
চেন লিন-এর কবিতা আমরা বলি চিনের প্রাচীর বা গ্রেট ওয়াল। চিনেরা বলে দীর্ঘ দেওয়াল। চিনের প্রাচীর নিয়ে ওদের কত গর্ব, গর্ব পৃথিবীর মানুষের। তার কারণ আছে। চিনের প্রাচীরই পৃথিবীর একমাত্র মানবনির্মিত কাঠামো যা কিনা চাঁদ থেকে দেখা যায়! কিন্তু, চিনের প্রাচীরটি গড়তে যে সব শ্রমিকরা অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রাণ দিয়েছে তাদের কথা কি আমরা কখনও ভাবি? বোধ হয় না। সেদিন একজন তাজমহল ঘুরে এসে বলল সুন্দর। কই রক্তপাতের কথা তো একবারও বলল না! যা হোক। চিনের প্রাচীরের শ্রমিকদের দুঃখকষ্টের কথা নিয়ে একটি কবিতা পেলাম মাইক্রোসফট এনর্কাটায়। কবির নাম চেন লিন।হান রাজবংশের শেষ আমলে চেন লি বেঁচে ছিলেন । মৃত্যু ২১৭ খ্রিস্টাব্দ । কবিতায় তিনি চৈনিক সম্রাট শি হুয়াঙ তি সময়কালে দীর্ঘ প্রাচীরের শ্রমিকদের দুঃসহ জীবনের কথা লিখেছেন। কবিতার নাম: “দীর্ঘ দেওয়ালের গুহার কাছে আমি আমার ঘোড়াকে পানি খাওয়াই।” অভিজাত বংশে জন্ম হলেও সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ অনুভব করার শক্তি চেন লিনের হৃদয়ে ছিল। কবি বলেই হয়তো ...। দীর্ঘ দেওয়ালের গুহার কাছে আমি আমার ঘোড়াকে পানি খাওয়াই, ঠান্ডা পানি ঘোড়াটির হাড়গোর কাঁপিয়ে দেয়; দীর্ঘ প্রাচীরের কাছে গিয়ে আমি প্রহরীকে বলি: “আমরা তাইয়ূয়ানের লোক- তোমরা কি আমাদের এখানে চিরকাল আটকে রাখবে?” “ সম্রাটের কাজ ঠিকঠাক চালাতে হবে-কথা কম বল আর হাতুড়ি চালিয়ে যাও।” এই দীর্ঘ দেওয়ালে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে আমার যুদ্ধক্ষেত্রেই মরে যাওয়া উচিত ছিল! তিন হাজার লি দীর্ঘ আঁকাবাকা এই অভিশপ্ত দীর্ঘ প্রাচীর! এখানে সীমান্তের কাছে, পুরুষেরা পরিশ্রমে নুয়ে আছে। অথচ বাড়িতে তাদের বউরা ... বিধবারা ... আমি আমার বউয়ের কাছে চিঠি লিখেছি: “আমার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে বরং আবার বিয়ে করো- নতুন শ্বাশুড়ির যতœ নিও মাঝে মাঝে আমার কথাও ভেবো।” বউ লিখল-“ কি সব যা তা লিখেছ? তুমি যখন কষ্টে রয়েছে তখন আমি কী করে অন্য লোকে ঘরে যাই?” (সে) তোমার যদি ছেলে হয় তো কখনোই এখানে এনো না! মেয়ে হলে- ওকে ভালো করে খাইয়ো-পড়িও। তুমি কখনোই দেখতে পাবে না কী ভাবে এখানে মৃতদের হাড়গোড়ের পাহাড় জমে উঠছে! (নারী) আমি চুল বেঁধে তোমার কাছেই যাব; আমার বুকের ভিতরে যে কী রকম করছে। আমি জানি সীমান্তের দুঃসহ যন্ত্রনার কথা। আমি ...আমি যে আর সইতে পারছি না ... সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৩
false
rn
শেষের অনেক দেরী "তোমাকে শুধু তোমাকেই চাই,পাবো?পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।ইচ্ছে হলে দেখতে দিও,দেখো।হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও,রেখো।"সাইকোলজিষ্টরা বলেন,খারাপ প্রকতির মানুষের হাতে পড়লে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।তারা যা বলে তাতেই রাজি হতে হয়।এবং চেষ্ট করতে হবে কথা বার্তা বলার।তাদের কেউ যদি বলে,আমরা এখন তোমাকে গুলি করে মারবো তখন ভয়ে অস্থির হওয়া চলবে না।ভয় খুব সংক্রামক।তোমার ভয় দেখে সেও ভয় পাবে।হিমির অবস্থা এখন এই রকম।আমি অধম যেনেও হিমি আমাকে কম দেয়নি।হিমির মন অনেক গভীর এবং স্পশকাতরতা খুব প্রখর।যে কোনো কথা ছাড়াই আমাকে খুব বুঝতে পারে।হিমির মন আকাশের দেবীর মত। অনেকদিন লিখি না।আজ হিমিকে নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছা করছে।এখন আষাঢ় মাস চলছে।বৃষ্টি নেই।রোদের কি মারাত্নক তাপ কিন্তু আকাশ মেঘে ভরা।অনেকে বলে আমি খুব বেশী রোমান্টি্ক।আশ্চর্য রোমান্টিক কথাটা কে এরা আজকাল দিব্যি গালি হিসেবেই ব্যাবহার করে।ওদের যুক্তি গুলো এতো খেলো এবং খবুরে কাগুজে যে রীতিমতো হাসি পায় আমার।আমি নাকি রোমান্টিক প্রতিক্রিয়াশীল,হা হা হা Shakespeare এর সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে একটু বদলিয়ে বলতে পারি শুধু- In sooth I know not why I am so silent?আকাশে বষ্টির আয়োজন,মেঘের মোহড়া।মনে মনে গান গাই রবীন্দ্রনাথের।ভালো লাগছে সব কিছু।আর এ ভালো লাগার নেহাত অপ্রয়োজনীয় খবর টুকু লিখতে পেরে ভালো লাগছে।কিন্তু এ ভালো লাগা বেশী ক্ষন থাকে না,ঝরে যায়-মুছে যায় রাইনার মারিয়া বিলকের বর্নিত পাতার মতো।তাই একটা বিষাদ ছেয়ে আসে পরক্ষনে।তবুও হিমি আমার পাশে আছে এটাই বড় কথা।আকাশে মেঘ সরে গেছে,রোদ ফুটে উঠেছে।কবিতা লেখার মতো সকাল এখন।কিন্তু এখন কবিতার জন্ম সম্ভব না।এই মুর্হুতে হিমির মুখ মনে পড়লো।তাই ইচ্ছা হলো খানিক গল্প করি।টেলিফোনে যোগাযোগ সম্ভব নয় বলেই লিখতে হলো।হিমির কথা ভাবলেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়।চোখ বন্ধ করলেই হিমিকে দেখতে পাই- বিশাল একটা সবুজ পাহাড়ে নীল শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে।হিমির হাসি ভরা মুখটা ঝক মক করছে রোদের আলো পড়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।তখন মনে হয় হিমি আমার পাশের ঘরেই আছে।ডাকলেই সাড়া দিবে।আর তখন স্বংয় রবীন্দ্রনাথ আমার জন্য গান করেন।রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আমার চোখ ভিজে উঠে ।আর মনে পড়ে হিমির মুখ,হিমির চোখ,হিমির ঠোট,হিমির চুল।হয়তো কক্সবাজারে এখন বষ্টি হচ্ছে।অর্কিড ফুলের সবুজ পাতা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি ঝরছে বা দুর থেকে নীলগিরি পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে না মেঘের কারনে।খুব দেখতে ইচ্ছা করছে এসব দৃশ্য।মন কেমন করে হিমির কথা ভেবে ভেব।শুয়ে শুয়ে ভাবি কবিতার লাইন,আলসেমি করি-স্বপ্ন দেখি।আমি ঠিক করেছি হিমিকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া যাবো।সেখানে বালি নামে খুব সুন্দর একটা দ্বীপ আছে সমুদ্রের কাছে।মনোরম পরিবেশ।আমার প্রিয় কবি টি এস এলিয়েট একটা প্রবন্ধে লিখেছেন- কোনো কবিতা পড়ার সাথে সাথে তার যেটুকু সরাসরি বুঝে ফেলি তার মধ্যে এর প্রকৃত কবিতা নেই।সেটুকুই এর কবিতা যা স্পষ্ট কথা গুলোর আড়ালে -আবডালে বাতাসের ভিতর ঝুলে থাকা কুয়াশার মতো রহস্যময় ভাবে জড়িয়ে থাকে,যার কিছুটা বুঝা যায় কিছুটা বুঝা যায় না।কিছুটা চেনা কিছুটা বোধের বাইরে।হিমি কে আমার এই রকম'ই মনে হয়।হিমি তোমাকে ধরে রাখবার জন্য আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব আর ভালোবাসাটার কথা বার বার তোমাকে স্মরন করিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনোও পথ,আর এই পরিপ্রেক্ষিতে খুঁজে পেতাম না।আমি ঠিক মনে করতে পারছি না আমরা কে কাকে আবিষ্কার করেছিলাম!তুমি আমার সব গ্রহনতা কে উন্মোচিত করেছ।আমাদের পরস্পরকে অতিক্রম করার কাজটি যে এখনও চলছে সেটা কি তুমি টের পাও?আমি পাই।মনে হয় প্রতিনিয়ত'ই তো আমরা রাস্তা-ঘাটে,হাঁটে-বাজারে কত মানুষকে অতিক্রম করে যাই,কিন্তু সেটা একবারেই জন্য'ই।কিন্তু যারা আপনজন এবং সেই আপনজনদের সাথে যদি সময় ও পরিস্থির কারনে বিচ্ছেদও ঘটে তাহলেও তাদের অতিক্রম করার কিংবা ক্রস করার কাজটি আর শেষ হয় না,এই জন্য যে ভালোবাসা কিংবা সম্পর্কের উওাপ শত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেও ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসে নিবিড় সৃস্তির ভেতরে।মাঝে মাঝে তোমার কাছ থেকে দীর্ঘ নিশ্চুপতা পেয়ে,আমি মনে মনে ভেবে নিই-তুমি আমার মতো তেমন ভাবে ইমোশনালি ইমব্যালান্সড হও না।আবেগে ভারসাম্যহীন হওয়ার বিষয়টা নারী পুরুষের মধ্যে এক রকমের হয় না বোধ হয়।এনিম্যাল প্লানেট চ্যানেলটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।পাহাড় বনভূমি সমুদ্রের তলদেশ,বরফ ঢাকা মাইলকে মাইল সাদা প্রান্তর।ঝরনা,নিবিড় বন,বৃষ্টি।প্রকৃতি কী যে সুন্দর এই চ্যানেলটা দেখলে তা বোঝা যায়।(চলবে...)
false
ij
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক_ যাঁর চিন্তায় বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব ছিল অনিবার্য। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর নাম আমরা সবাই কমবেশি জানি; কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কতটুকু জানি? আমরা কি জানি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল? সেদিন আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর লেখা (আমাদের মুক্তিযুদ্ধ: অনিবার্য ছিলো, আকস্মিক নয় ) পড়তে পড়তে আমার অনিবার্যভাবেই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর কথা মনে পড়ে গেল। কেননা, কামালের সে অনবদ্য লেখায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর প্রসঙ্গ উল্লেখিত ছিল। আমি সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর জন্ম ১৯১৪ সালে। ঢাকার নবাবগঞ্জ জেলার পারাগ্রাম-এ। পারাগ্রাম এখন অবশ্য উপজেলা। বাবা আবদুল আলী-চাকরি করতের ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ বিভাগে। আমরা জানি, পুলিশ বিভাগের চাকরি বদলীর চাকরি। সুতরাং ছেলেবেলায় নানা জায়গায় ঘুরেছেন আবদুর রাজ্জাক। ছেলেবেলার পড়াশোনা: যেমন রংপুরে, তেমনি হুগলীতে ঢাকার সরকারি মুসলিম হাইস্কুল। রাজ্জাক ম্যাট্রিক পাস করেছেন ঐ স্কুল থেকেই। আই. এ- পাস করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ১৯৩১ সাল। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগ নামে একটি পৃথক বিভাগ ছিল, সে বিভাগেই ভর্তি হলে। এম. এ পাস করলেন ১৯৩৬ সালে । ঐ বছরই রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দিলেন রাজ্জাক। পরে অবশ্য রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগ ভেঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নামে দুটি পৃথক বিভাগ হল। রাজ্জাক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিয়েছিলেন। কখনও আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগেও কাজ করেছেন। আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগটি গঠিত হয়েছিল ইতিহাস বিভাগ ভেঙ্গে। ১৯৫০ সাল। লন্ডন গেলেন রাজ্জাক।। ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অভ ইকনমিক্সে। অবশ্য কোনও ডিগ্রি না নিয়েই দেশে ফিরে এলেন। আসলে ডিগ্রির প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না রাজ্জাকের। তাঁর জীবনও ছিল অত্যন্ত সাধাসিধে। সংসারে জড়াননি, ছিলেন চিরকুমার। খুব বই পড়তেন। শুনেছি জ্ঞানতৃষ্ণার্তরা তাঁর কাছে এলে তিনি নাকি ভীষন উজ্জ্বীবিত বোধ করতেন। তবে রাজ্জাকের লেখার অভ্যেসও তেমন ছিল না। কেন? বলতে পারি না। কয়েকটি প্রবন্ধ ও লিখিত ভাষন ব্যতীত তাঁর কোনও প্রকাশিত লেখাই নেই! রাজ্জাকের আগ্রহ এবং পান্ডিত্য ছিল প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস কী ছিল? এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান লিখেছেন, The "pernicious" influence of his political ideas on the dissenting politicians of the 1960s once led the Ayub regime to dismiss him from his teaching position at Dhaka University on the allegation that he was not mindful of his duties as a teacher, but which the government failed to establish in the court. His "treasonable" acts during the War of Liberation earned him in absentia a fourteen-year rigorous imprisonment.(বাংলাপিডিয়া) এবার আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর লেখার প্রসঙ্গে আসি। (আমাদের মুক্তিযুদ্ধ: অনিবার্য ছিলো, আকস্মিক নয় ); আবদুর রাজ্জাক মনে করতেন যে, দেশ বিভাগের পরবাঙালির একাংশ (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ) বৃহত্তর ভারতীয় জাতিসত্ত্বায় মিশে যেতে সম্মত হলেও অপরঅংশটি (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্থান) পাকিস্থানের অংশ হতে সম্মত হল বটে-তবে পূর্ববাংলার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য (সাংস্কৃতিক) অক্ষুন্ন রেখেই। কামাল লিখেছেন, (অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতে) যে বৈশিষ্ট্য জন্ম দিল ভাষা আন্দোলনের-যার চূড়ান্ত পরিণতিই জাতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর লেখাটির লিঙ্ক- Click This Link অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন তারা প্রত্যেকেই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কে বলেছেন: “শিক্ষকের শিক্ষক।” এই একটি মাত্র উক্তিতে আমরা বুঝতে পারি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর মননশীলতার গভীরতা পরিমান। যা তা লোক তাঁর পাশে ভিড় করেননি। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতন প্রাজ্ঞ নেতা, তেমনি আহমেদ ছফার মতন প্রাজ্ঞ লেখক। আহমেদ ছফা তো বটেই- সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল প্রমূখ -রাজ্জাক ঘরানার সার্থক উত্তরসূরী। তখন বলছিলাম যে, আসলে ডিগ্রির প্রতি আবদুর রাজ্জাকের বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। তারপরও ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় আবদুর রাজ্জাককে পি এইচ ডি প্রদান করেন। তাঁর জ্ঞানসাধনার কথা তাহলে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল? ১৯৭৫ সালে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন রাজ্জাক। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকার আবদুর রাজ্জাককে জাতীয় অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত করে। আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যু ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়-অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানের আলোয় আলোকময় হয়েছেন অল্পসংখ্যক মানুষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা, তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, তারা। অথচ, আবদুর রাজ্জাক বই লিখেননি বলে বৃহত্তর বাঙালি জাতি জানলই না কী তিনি ভাবতেন। আমার মনে হল, আবদুর রাজ্জাক এক মৌন পাহাড়, যে পাহাড়ের সোনার খনির সন্ধান অল্প সংখ্যক অভিযাত্রীই জানে। পরে আবার মনে হল, পাহাড়েরও তো ছায়া থাকে, যা অতি গভীর। গভীর ও বিস্তারিত। তথ্য ও ছবি: বাংলাপিডিয়া। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৬
false
rn
শেষ কথা-২১ গত ছয় মাস ধরে বিছানায় আরাম করে ঘুমাতে পারছি না। প্রতিদিন রাত্রে বিছানায় যাওয়ার পর কি যেন কুট কুট করে কামড়ায়। একদিন ঘুম থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দেখি ছোট ছোট অনেক গুলো পোকা। একটা পোকা মেরে দেখি পেট ভরতি রক্ত।এমন পোকা আমি আগে কখনো দেখিনি।সকাল বেলা মাকে বললাম- মা বলল পোকা গুলোর নাম ছার পোকা। এরা রক্ত খায়। দিনেরবেলা আর পোকাদের কথা মনে থাকে না। রাতে বিছানায় যাওয়ার পোকার কামড় খেয়ে- ছার পোকার কথা মনে পড়ে। সামান্য ছোট ছোট পোকা গুলোর জন্য ছয় মাস ধরে ঘুমাতে পারছি না। এই পোকা মারার জন্য সব রকমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে- কোনো কাজ হয়নি, ( ডিডিটি পাউডার ছাড়া ) । একদিন বিরক্ত হয়ে বালিশ তোষক সব সরিয়ে দেখি- একশো দুইশো না, পাঁচ শো-সাত শো ছারপোকা। এই ভারি জাজিম তোষক ছয় তলার ছাদে নিয়ে গিয়ে রোদে দেওয়া সম্ভব নয়। এই ছোট পোকা গুলো আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আরে...রক্ত খাবি খা, কামড়ার কি দরকার। কামড়ানোর পর লাল হয়ে ফুলে থাকে সারাদিন। আমার খালাতো বলেন বলেন- টাকা পয়সা বেশি হলে ঘরে ছারপোকার উপদ্রপ হয়। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে শত শত ছারপোকা মেরে ওদের প্রতিহত করতে পারছি না। রাতে পোকা গুলো আমার শরীরের উপরে হাঁটা হাটি করে- আমি স্পষ্ট টের পাই। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে হাসপাতাল থেকে এক ব্যাগ রক্ত কিনে এনে বাটিতে করে ওদের খেতে দেই। একদিন খবরের কাগজে দেখি- "বাসের সিটে ছারপোকার উৎপাত ঠেকাতে আগুন দেওয়া হয়েছে।" সেদিন রাগে দুঃখে মধ্যেরাত্রে সুনীলের একটি কবিতা মনে পড়ল- আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ/এই কী মানুষজন্ম?/আমি আক্রোশে হেসে উঠি না,/ আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,/ মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে;/খাঁটি অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে/আজকাল আমার নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। /এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।" আমি আর বেশী দিন বাচবো না। এই ছারপোকা আমাকে অতিষ্ট করে দিয়েছে। ঈশ্বরের কি দরকার ছিল- ছারপোকা বানানোর? মানুষের চোখে রয়েছে যখন একক লেন্স তথন পোকামাকড়ের চোখ অথ্যাৎ যৌগ চোখে রয়েছে অনেক ছোট চাক্ষুষ ইউনিট।একদিন এক পাজি ছারপোকা কানের ভেতরে ঢুকে গেল। হঠাত দেখি মোবাইল চার্জ হয়, কারন অনুসন্ধান করে দেখি- মোবাইলের ভেতরে তিন টা ছার পোকা। ছারপোকা শুধু আমার বাসায় না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা হলে হাজার হাজার ছারপোকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রতিটা ব্র্যাকে হাজার হাজার ছারপোকা।উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রয়েছে ১৭টি। এমন কি অনেক সরকারী হাসপাতা এবং অফিসেও হাজার হাজার ছারপোকা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছি- এখন সব জাগায় ছারপোকা। দামী এসি বাসে আজকাল অনেক ছারপোকা পাওয়া যায়।কিছু মানুষও ছারপোকার মতন নিষ্ঠুর। আসুন, ছার পোকা সমন্ধে কিছু যেনে নিই- ছারপোকা সিমিসিডে গোত্রের একটি ছোট্ট পরজীবী পতঙ্গবিশেষ।ইংরেজিতে বলে: Bed bug ।এটি রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে।মূলতঃ এ পোকাটি বিছানা, মশারী, বালিশের এক প্রান্তে বাসা বাঁধলেও ট্রেন কিংবা বাসের আসনেও এদের দেখা মেলে।পুরোপুরি নিশাচর না হলেও ছারপোকা সাধারণত রাতেই অধিক সক্রিয় থাকে এবং মানুষের অগোচরে রক্ত চোষে নেয়। মশার ন্যায ছোট্ট কামড় বসিয়ে এরা স্থান ত্যাগ করে। সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৩ রাত ৯:৪৩
false
rg
বইমেলার ডায়েরি (৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) !!! ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, রবিবার। আজ বইমেলা ধন্য। শিল্পী ধ্রুব এষ আজ বইমেলায় এসেছিলেন। অবশ্য আমি বইমেলায় পৌঁছানোর আগেই ধ্রুবদা মেলা থেকে চলে গেছেন। খবরটি আমাকে দিয়েছিলেন ঢালী ভাই। উদ্যানে ঢুকে মাধবদার সঙ্গে কথা বলছি। তখন ঢালী ভাই (লেখক ও কবি হুমায়ুন কবির ঢালী) জানালেন, ধ্রুবদা মেলায় আছে। একাডেমি প্রাঙ্গনে আছে। আমি দ্রুত ছুটি। বাংলা একাডেমির সামনে পাই দুই কমরেডকে। শিল্পী শেইখ শাহেদ আর রম্য লেখক ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবিবকে। আহসান হাবিবকে আমি ডাকি শাহীন ভাই। রাস্তার আইল্যান্ডে বসে অনেকক্ষণ আমরা আড্ডা দিলাম। চা-সিগারেট খেলাম। শাহীন ভাই জানালেন, ধ্রুবদা বের হয়ে গেছেন। এবার বাংলা একাডেমি উন্মাদ পত্রিকাকে কোনো স্টল বরাদ্দ দেয়নি। এজন্য শাহেদ ভাই, শাহীন ভাইয়ের মত একনিষ্ঠ উন্মাদভক্ত আমারও খুব মন খারাপ। শাহীন ভাইকে বললাম, চলেন, মিছিল করি। শাহীন ভাই বললেন, তার চেয়ে চা খাই, কোরিয়ান সিগারেট খাই, আড্ডা মারি, সেই অনেক ভালো। কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে আমি নন্দন স্টলে গিয়ে বই সাজাতে সাজাতেই আসল নন্দন সম্পাদক বন্ধু কবি আলফ্রেড খোকন। খোকন বলল, বই আনতে পারি নাই। তুই পারলে একবার সময় করে অফিসে আয়। খোকন মেলা থেকে বের হয়ে গেল। দেখি বর্ধমান হাউজের সিঁড়িতে বসে আছে শিল্পী সব্যসাচী হাজরা, কবি তনুজা, সব্য-তনুজার কন্যা পৌষ। ওদের ঘিরে বিশাল জটলা। জটলায় ঢুকে জানলাম, সব্য'র বইটার মোড়ক উন্মোচন করতেই ধ্রুবদা আজ বইমেলায় এসেছিলেন। থাকতে না পেরে খুব খারাপ লাগল। লিটল ম্যাগ স্টল থেকে সব্য'র বইটা হাতে নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। নিঃসন্দেহে এবারের বইমেলার সেরা প্রোডাকশন এটি। শিশুদের চিত্রবর্ণ পরিচয় করাতে সব্যসাচী হাজরা এক ব্যতিক্রমী বই প্রকাশ করেছেন। বইয়ের নাম চিত্রলিপি। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি অক্ষরকে এক-একটা ছবি আকারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সব্য। যাতে শিশুরা চেনাজানা পাখি, প্রাণী, প্রজাপতি এসব দেখে দেখে অক্ষর চিনতে পারে। বইটির প্রকাশক সব্যসাচী হাজরা নিজেই। বইটি যারা দেখেননি, তারা লিটল ম্যাগ চত্বরে ভিন্নচোখ স্টলে ঢু মারতে পারেন। আপনার যদি ছোট্ট শিশু থাকে, যার এখন অক্ষর শেখার বয়স, বইটি তার জন্য খুুবই প্রয়োজনীয়। এই সময়ের, এবারের বইমেলার সেরা উপহার এটি। বইটির প্রচ্ছদ, অংকন, শিল্পভাবনা সবকিছুই সব্য করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা ভাষার বর্ণ পরিচয়ে সব্যসাচী হাজরা এক নতুন উদ্যোগ গ্রহন করল। সব্যকে প্রাণ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আশা করি, বাংলা একাডেমি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠশালা ও বাংলাদেশের ও বাইরের সকল স্তরে যারা বাংলা বর্ণ পরিচয় শিখতে চায়, তাদের জন্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য বইটি দারুণ উপকারে আসবে। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে দুইশো টাকা। দেখা হল, আড্ডা হল মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট বেলায়েত হোসেন মামুনের সঙ্গে। কবি জুয়েল মোস্তাফিজ, কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি মাহবুব কবির, কবি মামুন খান, কবি মাসুদ হোসেন, কবি তানিম কবির, লেখক স্বকৃত নোমান, লেখক ঋষি এস্তেবান, কবি সাফি সমুদ্র, শিল্পী চারু পিন্টু, কবি শামিমুল হক শামীম, শামীম ভাইয়ের দুই ছেলে সহ অনেকের সঙ্গে। আজ ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে মেলায় এসেছে কবি মাহবুব কবিরের কাব্যগ্রন্থ 'আয়নার দিকে'। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। মাহবুব ভাই জানালেন, এডিট করতে গিয়ে কিছু কবিতা ফেলে দিয়েছেন। তাই বইটি হয়েছে ৪০ পৃষ্ঠার। কিন্তু বইটি হাতে নিলেই যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। বইমেলায় পরিচয় হল কবি কবির য়াহমদ ও অনুপ্রাণন পত্রিকার সম্পাদক প্রকৌশলী ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর জুলেল, মামুন, পিন্টুদের সঙ্গে আড্ডা মারতেই মেলার ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল। আজও কোনো বেচাবাট্টা হয়নি। সো, স্টল বন্ধ করে মেলা থেকে বের হলাম দলবেধে। জুয়েল, মামুনদের সঙ্গে ছবিরহাটে এসে পেলাম চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি টোকন ঠাকুর ও ফটোগ্রাফার সূর্যকে। সেখানে দেখা হল বন্ধু লেখক ও সাংবাদিক তরুণ সরকারের সঙ্গে। কবি কামরুজ্জামান কামু'র সঙ্গে। পরে ঠাকুর আর আমি ধ্রুবদার বাসায় গেলাম। জি-বাংলায় আজ ছিল মিরাক্কল-৮ এর ফাইনাল রাউন্ড। ধ্রুবদা আর শিল্পী মামুন হোসাইন বসে বসে মিরাক্কল দেখছিলেন। পরে আমরাও তা দেখার জন্য বসে গেলাম। পরে সেখান থেকে সোজা বাসায়। ................................ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৩৭
false
hm
শক্তি নিয়ে প্রাথমিক প্যাঁচাল নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে আগে এক পোস্টে গলা খাঁকারি দেবার পর আগ্রহী সচলরা আমাকে অশেষ উপকৃত করেছেন তাঁদের জিজ্ঞাস্য নানা বিষয় সম্পর্কে মূল্যবান মন্তব্য রেখে। কিছুটা তারই আলোকে নতুন প্যাঁচাল শুরু করছি। নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পর্কে কথা শুরুর আগেই যে প্রশ্নটি জাগতে পারে, সেটি হচ্ছে নবায়নের প্রশ্ন এখানে কেন আসছে? নবায়নের অযোগ্য শক্তি আবার কী? পদার্থবিদ্যার একেবারে গোড়ার দিকের কথা, শক্তির অনশ্বরতার তত্ত্ব টেনে এনে এ নিয়ে তর্ক শুরু করা যায়। শক্তি আত্মার মতোই চীজ, আগুন ইহাকে পোড়াইতে পারে না, জল ইহাকে ভিজাইতে পারে না, রোদ ইহাকে শুকাইতে পারে না ... ইত্যাদি ইত্যাদি। শক্তির শুধু রূপান্তর ঘটে, এক চেহারা থেকে সে অন্য চেহারা ধারণ করে এফডিসির নায়িকার মেকআপের আগে ও পরের ঘটনার মতো। নবায়নযোগ্য শক্তির আগে তাই প্রচলিত শক্তি ব্যবস্থাগুলি নিয়ে খানিক কথা বলা প্রয়োজন। তারও আগে বলা প্রয়োজন, মানুষের সমাজব্যবস্থায় শক্তির ভূমিকা নিয়ে। মানুষ তার ইতিহাসের একটা বিরাট সময় পার করেছে আগুন থেকে পাওয়া তাপশক্তি আর পেশীশক্তির ওপর নির্ভর করে। প্রথমে পেশী ছিলো একান্ত তার নিজের, পরবর্তীতে তার সাথে যোগ হয়েছে বশ করা পশুর পেশী। ভারবাহী পশু না থাকলে মানুষের সামাজিক বিকাশের গতি অন্যরকম হতো। ফ্রান্সিসকো পিজারো পারতেন না আতাহুয়ালপাকে পরাজিত করে পেরু জবরদখল করতে, মঙ্গোলরা পারতো না তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। পশুর পেশীশক্তির ওপর যখন কোন একটি গোষ্ঠীর মানুষ নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে, তখনই সে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার তুলনামূলকভাবে দুর্বল প্রতিবেশীদের জন্যে, যাদের নিয়ন্ত্রণে সে পরিমাণ শক্তি ছিলো না। শক্তি সেই প্রাচীন সমাজে যে কাজে লাগতো, এখনও সেই একই কাজে লাগছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা আগে দাহ্য কোন বস্তু পুড়িয়ে রান্না করতেন, শীতের মোকাবেলা করতেন, অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করতেন কিংবা শত্রুর বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতেন, আজও আমরা তা-ই করি। ভারবাহী পশুর কাজ করছে বৈদ্যুতিক ও তাপীয় এঞ্জিন। আর এই গোটা রূপান্তরটি আমরা ঘটিয়েছি বিভিন্ন জ্বালানিকে আরো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে। আমাদের প্রচলিত জ্বালানিগুলো, অর্থাৎ তেল, কয়লা, গ্যাস বা কাঠ ... এগুলোতে আসলে কী আছে? দহনের ফলে এগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ তাপশক্তি অবমুক্ত হয় (আরো অবমুক্ত হয় কার্বন, বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড হিসেবে)। কেন আমরা অন্য জিনিস ফেলে তেল, কয়লা, গ্যাস বা কাঠ পোড়াই? কারণ এগুলো প্রকৃতিতে বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায় (ফলে এদের দাম কম), এবং অন্যান্য বিকল্প দাহ্যবস্তুর তুলনায় এদের শক্তি ঘনত্ব (অর্থাৎ ওজন বা আয়তন পিছু ধৃত শক্তি) অনেক বেশি। জ্বালানিদহন তাপ (মেগাজুল/কেজি)কিলোওয়াটঘন্টা/কেজি পেট্রল৪৭১৩.০৫ কয়লা১৫-২৭৪.১৭-৭.৫ প্রাকৃতিক গ্যাস৫৪১৫ কাঠ১৫৪.১৭ তাপীয় শক্তির পরিমাপ সাদা চোখ আন্দাজ করা একটু মুশকিল, তাই এভাবে বলা যেতে পারে, আমরা যদি এক কেজি পেট্রলকে পুড়িয়ে পাওয়া তাপকে সম্পূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারতাম, তাহলে তা দিয়ে একটা একশো ওয়াটের বাতিকে ১৩০ ঘন্টা জ্বালানো সম্ভব। এক কেজি কয়লা দিয়ে তা করা যেতে পারে প্রায় ৪২ থেকে ৭১ ঘন্টা (নির্ভর করছে কয়লার কিসিমের ওপর), প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে প্রায় ১৫০ ঘন্টা, আর এক কেজি কাঠ দিয়ে মোটামুটি ৪২ ঘন্টা। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা কখনোই তাপীয় শক্তিকে পুরোপুরি অন্যকোন শক্তিতে রূপান্তর করতে পারবো না। রূপান্তর প্রক্রিয়াটাই এমন যে সেখানে নানা কিসিমের লোকসান হতে বাধ্য। তারপরও আমরা দেখতে পাই, এক কেজি জ্বালানির মধ্যে কী বিপুল শক্তি রয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপারটা যদি বুঝতে সমস্যা হয়, তাহলে এভাবে চিন্তা করে দেখুন, এক কেজি তেল থেকে পাওয়া শক্তি একটা পুলিশের ঘোড়াকে দিয়ে (পুলিশের ঘোড়া বলার কারণ হচ্ছে, ঢাকায় আমরা সাধারণত যেসব ঘোড়াকে গাড়ি টানতে দেখি, সেগুলি নিতান্তই দুবলা, ঘোড়া নামের কলঙ্ক) ১৭ ঘন্টা কাজ করানোর শক্তির সমান। এক কেজি কয়লা থেকে তা ৫.৫ থেকে ১০ ঘন্টার ঘোড়ার কাজের সমান, এক কেজি প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্যে তা ২০ ঘন্টা, এক কেজি কাঠের জন্যে ৫.৫ ঘন্টা। তাপশক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তির রূপান্তরটুকুই মানুষ আয়ত্ব করতে পেরেছে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় এঞ্জিনের কল্যাণে (ওয়াটকে সম্মান দেখানোর জন্যেই আমরা কাজ করার ক্ষমতার একককে ওয়াট বলে থাকি, প্রতি সেকেন্ডে এক জুল কাজ করার, অর্থাৎ বলা যেতে পারে, এক সেকেন্ডে এক কেজি ওজনের কোন বস্তুকে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার ওপরে তোলার ক্ষমতাকে এক ওয়াট বলা হয়)। তার আগ পর্যন্ত মানুষের যান্ত্রিক শক্তির রূপান্তরের পেছনে পর্দার আড়ালে ছিলো পেশীশক্তি, আর হ্যাঁ, নবায়নযোগ্য শক্তি। আমরা যেন ভুলে না যাই পাল তুলে চলা নৌকা, আর দন কিহোতের তীব্র আক্রমণের মুখেও অটল বায়ুকলগুলির কথা। প্রাচীন পারস্য ও মধ্যযুগের পশ্চিম ইয়োরোপে বায়ুশক্তির সাহায্যে শস্য গুঁড়ো করা হতো। সেইসাথে চীনে সুদীর্ঘকাল ধরে পানির স্রোতের শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়েছে। পশু বা মানুষের পেশীশক্তিও নবায়নযোগ্য শক্তি। সেই শক্তি আসে কার্বোহাইড্রেট পুড়িয়ে পাওয়া শক্তি থেকে, যে রাসায়নিক প্রক্রিয়াটি শরীরে সতত চলমান। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার রসদ আসে একটি চক্র থেকে। শক্তির উৎস, অর্থাৎ জ্বালানি শর্করা এখানে রূপান্তরিত হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইডে, কিন্তু সেই কার্বন ডাই অক্সাইড আবার উদ্ভিদের কল্যাণে সূর্যের আলো ও পানি যোগে ফিরে আসছে প্রাণীর কাছে। উদ্ভিদ আর প্রাণী এই চক্র অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। সে কারণেই এ শক্তি "নবায়নযোগ্য"। কিন্তু এই নবায়নযোগ্য শক্তির সমস্যা একটাই। এর ঘনত্ব বড় কম। অর্থাৎ, এক কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তি পেতে গেলে হয় বিপুল আয়তনের, নয় বিরাট ওজন নিয়ে লেনদেন করতে হবে। ঘোড়া ফেলে মানুষের কথাই ধরুন। এক কিলোওয়াটঘন্টা শক্তি ব্যয় করতে গেলে একজন মানুষকে ১০০ কেজি ওজন ৩৬৭৩ মিটার উচ্চতায় তুলতে হবে। মানুষের গড় শক্তিভোগ হচ্ছে সারাদিনে দুই হাজার কিলোক্যালরি, বা আট হাজার তিনশো ষাট কিলোজুলের মতো। যদি সারাদিন ধরে এই শক্তির পুরোটা মানুষ কাজ করে খরচ করে, তাহলে এই শক্তিকে এক দিন, অর্থাৎ ছিয়াশি হাজার চারশো সেকেন্ড দিয়ে ভাগ করলে মানুষের ক্ষমতা বেরিয়ে আসে, সাতানব্বই ওয়াটের কাছাকাছি (তবে স্বাভাবিকভাবেই জাতিভেদে এর কমবেশি হবে)। ধরে নেয়া যায়, আটজন গড় মানুষকে পাওয়া গেলে এক কিলোওয়াট ক্ষমতা পাওয়া যাবে। এক কিলোওয়াটঘন্টা শক্তির জন্যে এই আটজনকে এক ঘন্টা করে খাটতে হবে। এই আটজনের ওজন যদি পাঁচশো কেজি হয়, তাহলে কেজি পিছু দুই ওয়াট করে ক্ষমতা পাওয়া যাবে। মোটর গাড়ির জন্যে কেজি পিছু দুই থেকে তিনশো ওয়াট ক্ষমতা পাওয়া যাবে, বড় ইলেকট্রিক মোটরের জন্যে পাওয়া যাবে কেজি পিছু দেড়শো ওয়াটের মতো, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে কেজি পিছু আঠারোশো ওয়াট। যদিও প্রথম দিকের বাষ্পীয় এঞ্জিনগুলোর দক্ষতা ছিলো ২% এর মতো, তারপরও এ এক সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা। দক্ষতা বা এফিশিয়েন্সি জিনিসটা মাপা হয় কী দিনু আর কী পেনু, সেই অনুপাত হিসাব করে। ১০০ একক তাপশক্তি যুগিয়ে যদি ২ একক যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যায়, তাহলে আজ আমাদের কাছে মনে হতে পারে, এতো ফাল পাড়ার কী আছে? আছে এ কারণে, এমন সব কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করানো সম্ভব, যা পেশীশক্তি হয় করতে পারবে না, নয়তো পারলেও অনেক জায়গা লাগবে। অল্প একটু জায়গায় বসানো যন্ত্র থেকে অনেকখানি কাজ, এটাই মানুষের দরকার ছিলো অনেক বছর ধরে। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাপশক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তির রূপান্তর ঘটিয়ে আসছে। তাপশক্তি পাওয়া যাচ্ছে তেল-গ্যাস-কয়লা-কাঠ-পরমাণু থেকে, সেই তাপ দিয়ে হয় বাষ্প তৈরি করে সেই বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো হচ্ছে, অথবা সেই তাপ গ্যাসটারবাইনে প্রয়োগ করা হচ্ছে, অথবা অন্তর্দহন এঞ্জিনের শ্যাফট ঘোরানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই রূপান্তরে দক্ষতা যন্ত্রের কিসিমের ওপর নির্ভর করে, মোটামুটি ২০% থেকে ৪০% এর মধ্যে। অর্থাৎ, ১০০ একক তাপ যুগিয়ে বড়জোর ৪০ একক যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যাচ্ছে, বাকিটা অর্থমন্ত্রী সাইফুরের ভাষায়, লুসকান। রূপান্তরকিন্তু যান্ত্রিক শক্তি পরিবহনের উপযোগী নয়। পরিবহন বা সঞ্চালন করা যায় কাঁচা জ্বালানি, নয়তো বিদ্যুৎ। তাই যান্ত্রিক শক্তিকে আরেক দফা রূপান্তর ঘটাই আমরা তড়িৎশক্তিতে। এই আরেক দফা রূপান্তরেও আরেক দফা "লুসকান" ঘটে। শেষমেষ ১০০ একক তাপ যুগিয়ে হাতে হয়তো ৩০ একক তড়িৎশক্তি পাওয়া যায়। সেখান থেকেই আমাদের শহরগুলোত আলো আর অন্ধকারের আমলনামা লেখা শুরু করতে হয়। (আরও একটু এগোবে। কিছু খাই এখন।)
false
rn
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহ মধ্যপ্রাচ্য হলো এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল।সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে শুস্ক ও গরম জলবায়ু বিদ্যমান ।মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ পারস্য উপসাগর তীরে অবস্থিত এবং প্রচুর অশোধিত পেট্রোলিয়াম জ্বালানী তেল সম্পদে ভরপুর ।কুয়েত রাজ্য একটি ছোট তেল সমৃদ্ধ, দক্ষিণে সৌদি আরব ও উত্তরে ইরাক বেষ্টিত রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।কুয়েতের জনগণের প্রায় ৮৫% ভাব মৌখিক আদান-প্রদানের জন্য উপসাগরীয় আরবি ভাষা ব্যবহার করেন।২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইরাক যুদ্ধ। অবশেষে ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে। লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, তিউনিশিয়া সহ সকল দেশের এই গণবিক্ষোভের পেছনে রয়েছে ওবামা ও মার্কিন প্রশাসনের জোর সমর্থন। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি দীর্ঘ ৪২ বছর ক্ষমতায় আছেন। তার কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও তিনিই লিবিয়াকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক অগ্রসর মান করতে পেরেছিলেন।লিবিয়ার অস্ত্র সংগ্রহের প্রধান উৎস রাশিয়া। দুবাই আরব আমিরাতের সাতটি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশ।১৮৩৩ সাল থেকে দুবাই শাসন করে আসছে আল মাকতুম পারিবার।দুবাইয়ের প্রধান রাজস্ব আয় হচ্ছে পর্যটন ,রিয়েল এস্টেট এবং অর্থনৈতিক সেবা। সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। এই মরুভূমি আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত। মিশর, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, চাদ, সুদান, নাইজার, মালি প্রভৃতি দেশ পর্যন্ত সাহারা মরূভুমি বিস্তৃত।বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২০ সেমি-র বেশী হবে না। দিনে প্রচন্ড গরম ও রাতে ঠান্ডা। কখনো কখনো পাহাড়ের চূড়ায় বরফও জমে থাকতে দেখা যায়। ১০,০০০ বছর আগে সাহারার আবহাওয়া অনেক ভালো ছিলো, হ্রদ ও ছোট নদী ছিলো। এই এলাকায় হাতি জিরাফ ও অন্যান্য প্রাণী বাস করত। কাতার পারস্য উপসাগরের একটি দেশ। ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল-থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। হামাদ বিন খালিফা আল সানি ১৯৯৫ সাল থেকে দেশটির বর্তমান আমীর। ওমানের পশ্চিমে ইয়েমেন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, পূর্বে আরব সাগর, উত্তরে ওমান উপসাগর।পারস্য উপসাগরে ওমানের কয়েক কিলোমিটার তটরেখা আছে। মাসকাত ওমানের রাজধানী এবং বৃহত্তম নগর।ওমান আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব চতুর্থাংশে অবস্থিত। ওমানের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকা মরুভূমি, ১৫% পর্বত এবং মাত্র ৩% উপকূলীয় সমভূমি। বেশির ভাগ লোকালয় সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত।পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গুহা মাজলিস আল জিন এখানে অবস্থিত।ওমানে বহু বিদেশীর বাস। এখানকার ৩০ লক্ষ লোকের মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ লোক ওমানি নাগরিক নন, মূলত ভারত, পাকিস্তান ও ইরান থেকে আগত বিদেশী কর্মী।ইরান বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলির একটি; এখানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেয়া।ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহৎ সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের যার সূচনা হিসেবে বলা যায় ইরানী প্লেট-এ অবস্থিতআজারবাইজানের Mannaean সভ্যতা। সৌদি আরবের পর ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দেশটির মোট আয়তন ১,৬৪৮,০০০ বর্গকিলোমিটার। লেবানন এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র।লেবানন ধর্ম ও গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত একটি রাষ্ট্র। এখানে খ্রিস্টান, সুন্নী মুসলমান ও শিয়া মুসলমানেরা একত্রে বাস করেন।আরবি ভাষা লেবাননের সরকারী ভাষা। দেশটির ৯০%-এরও বেশি লোক আরবি ভাষাতে কথা বলে। ( ইউকিপিডিয়া থেকে )
false
ij
গল্প_ সীমান্তে মৃত্যুর গান আগষ্ট মাসের গোড়ায় ফরিদা দেখে তাদের কাকনহাটি গ্রামের ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজনে ভরে যাচ্ছে। শহরে মিলিটারি। শহরে নাকি থাকা যাচ্ছে না। শহরের লোকজন গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে ছুটে এসেছে। বাড়িময় চরকির মত ঘুরছে ফরিদা। আম্মা আম্মা বিছানায়, কোমড়ে ব্যাথা। তিন ভাবীর একজন পোয়াতি; বড় জন বাপের বাড়ি, ছোটজন কলমাকান্দার, আর এতই ছোট যে বাড়িভরতি বিদেশি লোকজন দেখে ভীষন ঘাবড়ে গেছে। তার ওপর ফরিদার বড় বোন রেহানার ননদের ছোট মেয়েটার পক্স। তার জন্য নিমপাতা যোগার কর। জামাল, জামাল কই, জামাল ...যা, মোনাফ কবিরাজরে খবর দে। বাড়িভরতি মেহমানদের সামলাতে বাড়িময় চরকির মত ঘুরছে ফরিদা।এক দুপুরে গৌরীপুরের মাইলাকান্দা থেকে ফরিদার বড় ভাবীর বাপের বাড়ির লোকজনও এলো। সঙ্গে বড় ভাই ও ভাবী। রীনা ভাবি ফরিদার এই বড় ভাবীর খালাতো বোন। রীনা ভাবীর স্বামী শতকত ভাই ঈশ্বরগঞ্জ কলেজের বাংলার শিক্ষক। গত বছর আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি রীনা ভাবীদের ঈশ্বরগঞ্জে বাড়িতেই প্রথম আরজ ভাইকে দেখেছিল ফরিদা। কিন্তু, এইসব ভাবার সময় এখন কই? শরীফাবুর সাত মাসের বাচ্চার কী জ্বর। শরীফাবু, ফরিদার বড় বোনের জা, তের বছর পর বাচ্চা হয়েছে। সেই শরিফার স্বামী আলী আহমেদ দিঘলিয়ায় সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাস খানেক ধরে নাকি শরীফাবুর স্বামীর কুনো খোঁজখবর নাই। মাস ছয়েক ধরে নাকি স্বামীস্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য চলছে । দিনরাত শরীফাবুর কান্নাকাটি, তার ওপর বাচ্চার জ্বর। ফরিদা কী করে। চরকির মত বাড়িময় ঘুরতে থাকে। ইব্রাহীম শেখের বড় বেয়াই আবদুল লতিফ পোদ্দারের বাড়ি গৌরীপুরের মাইলাকান্দায়। আজীবন সুরিয়া নামে একটি নদীর উত্তরে ক্ষেতিজমিতে কৃষি করেছেন লতিফ পোদ্দার। বর্তমানে সেই কৃষিজমিতে পাকবাহিনীর শিবির, জবাইকৃত গরুর রক্ত, হাড়, ভুঁড়ি। সুরিয়া নদীর পানির রং পালটায় গেছে। দেশে এমন গজব নাজিল হইছে। বিপদ বুঝে পরিবারপরিজন সমেত কাকনহাটির বেয়াইবাড়ি এসেছেন লতিফ পোদ্দার । তারপর থেকেই ইব্রাহীম শেখের কালো মুখটা চাপা আনন্দে ভরে যাচ্ছিল। বড়ছেলের বিয়ের সময় সামান্য বাদানুবাদের কারণে বিয়ের পর শেখবাড়ি তেমন এই আসেন নাই লতিফ পোদ্দার। বড় বেয়াইকে আপ্যায়ন করার জন্য শিশুর মতন হয়ে ওঠেন ইব্রাহীম শেখ । বাড়িময় চরকির মতন ঘুরছে ইব্রাহীম শেখ । তার সঙ্গে সঙ্গে পানের বাটা, জায়নামাজ ও অজুর পানির বদনা নিয়ে ফরিদাও। ফরিদার মেজবোন শাহানার শ্বশুড়বাড়ি ঢাকার কলাবাগান। তারাও এসেছে, দুপক্ষর সম্পর্ক আগে শীতল ছিল, শাহানার বাবা নাকি বেশি খরচ করেন, হিসাবী নন। শাহানার শ্বশুড়ের আদিবাড়ি মুর্শিদাবাদ বলেই হয়তো এইরকম বলার কারণ। এখন ওসব অভিযোগ ধুয়ে মুছে গেছে। তার কারণ এই হতে পারে যে, আসলে ইব্রাহিম শেখ দারুন হিসেবী লোক হলেও ঘরভরতি আত্মীয়স্বজন দেখে এখন কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মসজিদের পুকুরে জাল ফেলার জন্য ওড়াপাড়ার ফালুমাঝিকে নির্দেশ এরই মধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে । কদিন ধরে ভোরবেলা থেকেই পুকুরঘাটে ভিড়, যেন উৎসব, যেন শহরে মিলিটারি আসে নাই, যেন তারা গতমাসে পুবপাড়ার কুতুবের চুরানব্বই বছর বয়েসি নানীরে তারা গুলি কইরা মারে নাই। যেন শেখবাড়িতে মিলিটারি আসবে না, শেখ বাড়িতে এখন বেয়াই খাওনের ধুম, মিলিটারি তফাৎ থাকো।সকাল থেকে শাহানার শ্বশুড় সৈয়দ আহমেদ নাজীর পুকুরঘাটে আরাম কেদারায় আরাম করে বসে ঘন ঘন পাইপ টানছেন। নিজেকে তিনি মুর্শিদাবাদের ভুতপূর্ব নবাবদের একজন বলে দাবী করেন। অবসর জীবনে যাওয়ার পর এই নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনার কথাও ভাবেন। এখন এই রৌদ্রময় সকালে পাইপ টানতে টানতে মাঝে মাঝে বেয়াইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন আড়চোখে। বেয়াইটি খালি গা, লুঙ্গি পরা,সামান্য উত্তেজিত। যেন মসজিদের পুকুরের সব মাছ আজই তুলে ফেলবেন বলে পন করেছেন। সৈয়দ আহমেদ নাজীর এখন বুঝতে পারেন বেঁচে থাকার স্বাথে‘বাঙাল’দের এইরকম দলবদ্ধ হুলুস্থুলেরও দরকার আছে। দুপুরে সবাই সবে খেয়ে উঠে দাওয়ার ওপর বসে গল্পগুজব করে। সৈয়দ আহমেদ নাজীর কী মনে করে পান খাওয়া ধরেছেন। যদিও পরস্পরের কাছে পরস্পরের ভাষা বোধগম্য নয়; তবু, স্বল্পভাষী লতিফ পোদ্দার তাঁকে সাদা পাতার ফজিলত বুঝিয়ে দেন। কিন্তু কিছুতেই সৈয়দ আহমেদ নাজীর পানের সঙ্গে সাদাপাতা খেতে রাজি হচ্ছেন না, পান যে খাচ্ছেন এই তো যথেষ্ট। উঠানের রোদের ভিতরে তখন মুরগীর ছানার কক কক করছিল। এই শান্তি। তখন মনে হয় এই ভাটির দেশে বিদেশি সৈন্যরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে না। তাদের সাহায্যকারীরা নিরীহ লোকজনদের জবাই করছে না। তখন..তখন লতিফ পোদ্দারের ছোট ছেলে সোলেমান গান ধরে। প্রায় দু-বছর হতে চলল সুমানগঞ্জের প্রখ্যাত সুরসাধক রহমত আলীর শিষ্যত্ব বরণ করেছে সোলেমান । প্রায়ই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সুমানগঞ্জে। সোলেমানের গান গাওয়ার প্রতিভা এখন সবার আমোদের কারণ হয়ে উঠেছে। গতকালও চাঁদের আলোয় আলোকিত পুকুরঘাটে বসে অনেকরাত্র অবধি গান করেছিল সে । বাররি চুলের শ্যামলা স্বাস্থল অবিবাহিত এই বয়াতি এরইমধ্যে শেখ বাড়ির মেয়েমহলে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ তাকে গান ধরার জন্য অনুরোধ করলে সে সাধারনত দেওয়ানজীর এই গানটাই প্রথমে ধরে: কানাই তুমি খেল খেলাও কেমনে রঙ্গে রঙ্গিলা কানাই, কানাই তুমি খেল খেলাও কেমনে? শ্রোতাদের মধ্যে সৈয়দ নাজীর আহমেদের মেঝ বোনের বড় ছেলে রাসেল ছিল। রাসেল নিজেও মিউজিশিয়ান বলেই হয়তো-বা খুব মন দিয়ে সোলেমানকে লক্ষ করে। ও এভাবে সামনাসামনি এর আগে কখনও গ্রামীন পরিবেশে ফোন গান শোনেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাসেল। ওর বাবার পোস্টিং যদি হবিগঞ্জে; ওর মাও সেখানেই থাকে। রাসেল অবশ্য ছেলেবেলা থেকেই মামার বাড়ি থেকে ঢাকার স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। চমৎকার গিটার বাজায়।কিন্তু, এখন ও লক্ষ করে বাংলা ফোকগানের মেলোডির ব্যবহার অসাধারন। ও বিশ্বাস করে গানের প্রাণই হচ্ছে মেলোডি। রাসেল সোলেমানের গান শুনতে শুনতে চমৎকৃত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সোলেমান যখন এই গানটি গাইতে শুরু করল: বাউলা কে বানাইল রে হাছন রাজারে বাউলা ...তখন রাসেল গিটারের জন্য হাত নিসপিস করে। হায়, শহরে সৈন্যদের আক্রমন কতকিছু কেড়ে নেয়। রাসেল কলাবাগানে ওর ঘরটির কথা মনে করে ম্লান হয়ে যায়। গান শুনতে শুনতে কেউ কেউ উঠান ভরা রোদের দিকে তাকিয়েছিল। পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুকুর ঘাটে বাসনকোসন নিয়ে বসেছিল সরলা । আর একটু পরেই তেঁতুলগাছে ডেকে উঠবে একটা চিল আর একদল নীলাভ ফরিং উড়ে আসবে এই সব গাঢ় নির্জন দুপুরের রোদে। যারা উঠান ও পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়েছিল তাদেরই কেউ জামালকে দৌড়ে উঠানে এসে দাঁড়াতে দেখল প্রথম। জামালের পাশে তার জানের দোস্ত মিরু হাজং। জামাল প্রচন্ড হাঁপাচ্ছিল। জামাল চিৎকার করে বলল, বাড়িতে আর থাকন যাবো না। বাড়িতে আর থাকন যাবো না। কেন কী হইছে! ইব্রাহীম শেখ গর্জে ওঠেন। জামাল চিৎকার করে বলল, বাজারে মিলিটারি আইসে, বাজারে মিলিটারি আইসে, বাজারে আগুন দিসে, বাজারে আগুন দিসে, বাজারে আগুন দিসে। বাড়িতে আর থাকন যাবো না। বাড়িতে আর থাকন যাবো না। মোনাফ কবিরাজরে গুলি কইরা মারছে। মোনাফ কবিরাজরে গুলি কইরা মারছে। নিমিষে বাড়ির অতিথিদের আতঙ্কের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। আর্মিরা মি: মোনাফ কবিরাজকে গুলি করে মেরেছে। এ বাড়িতে না মানুষটা সেদিন এলো । সবাইকে যেচে সবুজ রঙের নিমপাতার বড়ি খেতে সাধল? তারপর একাই ৫ প্লেট ভাত খেলো? ইজন্ট হি আ ফানি ম্যান? আর্মিরা মি: মোনাফ কবিরাজকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারল? উৎসবরত মুখগুলিতে ভয়ের ছায়া ঘনীভূত হয়, হতে থাকে। আমরা কি অনেক দূর থেকে আসি নি? তা হলে কোথায় যাব? তা হলে কোথায় যাব? আমরা কি অনেক দূর থেকে আসি নি? তা হলে আমরা এখন কোথায় যাব? এই প্রশ্নের এক আবছা উত্তর ছিল। উত্তরের এক অচেনা পথে। পুড়ে মরার চেয়ে কিংবা গুলি খেয়ে মরার চেয়ে অজানা পথে চলাই ভালো। তাতে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মালপত্র তুলে নিতে সবাই ছুটল। মালপত্র বেশির ভাগই পড়ে রইল। শেখ বাড়িতে শিশুর সংখ্যা ২৫/৩০ এর মতো হবে। যে যেমন পারল কোলে-কাঁধে শিশু তুলে নিল। সৈয়দ আহমেদ নাজীর যখন আগ বাড়িয়ে রেহানার ননদের ছোট মেয়েটার পক্সশরীরটা কোলে তুলে নিলেন তখন বোঝা গেল বর্তমান দূর্যোগ এতদিনকার অনেক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। ফরিদার মেঝভাবি মোমেনা ভরা পোয়াতি; নয় মাস চলছে একুশ বছরের মেয়েটির। ফ্যাকাশে বউটিকে অতি দ্রুত একটা বাঁশের মাচায় তোলা হলো । বাঁশের মাচাটি পুরুষেরা বহন করবে। বহনকারীদের মধ্যে রাসেলও ছিল। সে, রাসেল, ভাবছিল: ঢাকা ছাড়ার পর থেকে আমার এত ষ্ট্রেঞ্জ একসপিরিয়েন্স হচ্ছে কেন? তা হলে কি আমরা আমাদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? মিলিটারির নামে ফরিদার মায়ের কোমড়ের ব্যথা কোথায় পালাল। ফরিদা অবাক হয়ে লক্ষ করে মা গটগট করে হাঁটতে পারছে। একহাতে মুড়ির টিন অন্য হাতে সবুজ রঙের কাঁথা। চুলার আগুন নিভিয়ে সরলা ও জোছনা উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। ইব্রাহিম শেখের হাঁপানির ব্যামো। খালপাড়ে গাব গাছের নীচে বসে পড়ে ইব্রাহিম শেখ বলে, আমি যামু না। তোমরা যাও। আমি আর পারি না। আমি বুড়া মানুষ আমারে তারা মারবে না। ইব্রাহীম শেখের বড় ছেলে আমানুল্লা বলল, তারা কাউরে ছাড়ে না। শোনেন নাই গতমাসে পুবপাড়ার কুতুবের নানীরে তারা গুলি কইরা মারছে? ইব্রাহিম শেখ জানে কুতুবের নানীর বয়স ছিল চুরানব্বই। ইব্রাহিম শেখ উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে মিরু হাজং। এই সপ্তাখানেক আগেও জামালের প্রানের দোস্ত এই মিরু হাজং গালাগাল করেছিল ইব্রাহিম শেখ। এখন সেসব ধুয়েমুছে গেছে। অগাষ্ট মাসের ২য় সপ্তাহে শেখ বাড়ির লোকেরা/অতিথিরা উত্তরের অচেনা পথে নামল। দলটা বেশ বড়। ছেলেবুড়ো মিলিয়ে সত্তর/আশিজনের কম হবে না। পথ দেখিয়ে নিচ্ছিল মিরু হাজং। ও ছাড়া এ এলাকা আর কে এত ভালো করে চেনে? হ্যাঁ, মিরুর ওপর ভরসা করা যায়। সে গারো পাহাড়ের পথ চেনে।শরীফাবুর পাশে পাশে ফরিদা হাঁটতে থাকে । পরিচিত বাড়িঘর পড়ে থাকল পিছনে। আর তখনও ভরা দুপুর বলেই শেখবাড়ির টিনের চালে রোদ পড়ে ঝকঝক করছিল। গোয়ালঘরের সামনে থেকে দুধির গম্ভীর ডাকও শোনা গেল একবার। খালপাড়ের গাবগাছের গাবপাতারা ডুমুর পাতারা কাঁপছিল ঝিরঝির মিঠা বাতাসে।রাসেল এর আগে তেমন গ্রামে আসেনি। সে এখন চেয়ে চেয়ে দেখল পথটা আর বাঁশঝারের ছায়ায় ঢাকা থাকল না, ক্রমেই কেমন অপরিচিত আর অন্যরকম হয়ে উঠেছে। চারপাশের সবই যেন কালো ধোঁওয়ায় ঢাকা। বাতাসে পোড়া পোড়া গন্ধ। কীসের? আর দিনে দুপুরে এত শিয়াল ডাকে কেন? মুখ তুললে দেখা যায় একটা পোড়াটে আকাশ, রংশূন্য, সে আকাশে অনেক শকুন। দিগন্তের কাছে কালো ধোঁওয়ার পাক। এখন খাঁ খাঁ দুপুর। পথের পাশে পোড়া পোড়া ভাঙ্গাচোরা বাড়িঘর। বাতাসে মাংশ পোড়া, পাতা পোড়ার গন্ধ; ডালপালা পোড়ার গন্ধ। ঝোপে ঝারে শেয়ালকুকুরের লাশ নিয়ে খেয়োখেয়ি। আর সেই খেয়োখেয়ি থামলে অটুট নির্জনতা। একটা লাল রঙের পুকুর। লাল রঙের সিঁড়ি। একটি মসজিদের ভাঙ্গা গম্বুজ। কামান দেগে ভেঙ্গেছে। পোড়া বাজার।পোড়া দোকানপাঠ। দুর্গন্ধ ও শুনশান নীরবতা। রাস্তায় ট্রাকের চাকার দাগ; খালি কেরসিনের টিন, শুকনো রক্তের দাগ, শুকনো পাতার ওপর শুকনো রক্তের দাগ, মৃত কুকুরের শরীর; কালো রঙের পোড়া কুকুরের শরীর। গুলিবিদ্ধ কুকুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাস্তার পাশে বুলেটবিদ্ধ গাছ ও গাছের গুঁড়ি। রাস্তার পাশে খাল। খালে কচুরিপানা। একটা সাদা রঙের হাত কচুরিপানার ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে। রাস্তায় বুলেটবিদ্ধ একটা লাশ। সেই লাশ নিয়ে জীবিত কুকুরদের মধ্যে লড়াই। গোলাপি রঙের ছোট্ট খুলিটা বলের মতো গড়িয়ে যায় রাস্তার ওপর। লাশটা শিশুর! রাস্তার দুধারে পোড়া বাঁশঝাড়, গাছ। পোড়া কলাগাছের ফাঁকে ছাই ভরতি পুকুর। পুকুর পাড়ে মানুষের পোড়া শরীর, খড়ের পোড়া স্তুপ, বিধস্ত উঠান, পোড়া বাড়ি, পোড়া ঘর পোড়া বাড়িঘর পোড়া গরু পোড়া হাঁসমুরগীছাগলমানুষশিশু ...সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। দ্রুত পা ফেলে হাঁটে। সামনে একটা পথ। তারপর পথটা বেঁকে যেতেই একটা মাঠ পড়ল, ছায়াশূন্য মাঠ, রাখালশূন্য গরুশূন্য মাঠ; ছায়াশূন্য গরুশূন্য তেপান্তরের মাঠ...এমন ধূ ধূ। সেই তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে একটা পদ্মপুকুর। পুকুরে চোখ বাঁধা লাশ। রাখালের? ভেসে ফুলে উঠেছে। পুকুরপাড়ে কয়েকটা শকুন বসে। দলটা থমকে যায়। মিরু হাজং তাড়া দিলে আবার হাঁটতে থাকে উদ্বাস্তুরা। সোলেমান বয়াতির পাশে পাশে হাঁটছিল অবসন্ন রাসেল। একবার মুখ তুলে দেখল সোলেমান বয়াতি ঝুঁকে-ঝুঁকে হাঁটছিল। ভঙ্গিটা বড় মর্মান্তিক। রাসেল ঠিকই টের পেয়েছিল শেখবাড়ি ছাড়ার পরপরই বিষম মনমরা হয়ে রয়েছে এই সঙ্গীত শিল্পী। গায়ের কালো পাঞ্জাবিটা অজস্র ভাঁজ। শ্যামলা মুখটা শুকনো। গানের এই দেশটা এই সুরের দেশটা বহিরাগত লুটেরা দস্যুরা ছারখার করে দিচ্ছে Ñ স্পর্শকাতর শিল্পী বলে ব্যথা বেশি বাজতেই পারে বুকে। শেখবাড়ি আসার পরপরই সোলেমান বয়াতির সঙ্গে খানিকটা খাতির হয়ে গেছে রাসেলের। বয়াতিরা সহজে ধরা দেয় না। তবুও। তবুও সোলেমান বয়াতি কাল রাতে রাসেলকে কিছু গোপন কথা বলল। তার মধ্যে যেমন ছিল লালনের গোপন তরিকার কথা ও মারেফত-এর গুপ্ত সাধনার কথা তেমনি ছিল, সুনামগঞ্জের ধিরাই অঞ্চলের উজান ধল গ্রামের তাঁর এক উস্তাদ বাউল শাহ আবদুল করিমের কথা। আল্লা নাকি নিজ হাতে শাহ আবদুল করিমকে সঙ্গীতপ্রতিভা দিয়েছেন। তাঁর গানের মধ্যে আল্লাপ্রেম আর মানবপ্রেম একাকার হয়ে গেছে। আবদুল করিমের গানে প্রেমই প্রধান। এখন যুদ্ধের সময় কে বাঁচে কে মরে বলা যায় না। শাহ আবদুল করিম বেঁচে থাকলে বাংলার মানুষ তাঁকে ঘিরে উন্মাদ হয়ে যাবে। তাঁর গান অন্যরকম। সহজসরল ভাবে হৃদয়ের কথা বলে। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ও সাংস্কৃতিক হইছিল, সেখানে গান গাইছিল শাহ্ আবদুল করিম। গান গেয়ে নাইমা আসার পরে মাওলানা ভাসানী শাহ আবদুল করিমরে বললেন, শাহ আবদুল করিম, সাধনায় একাগ্র থাকলে একদিন তুমি গনমানুষের শিল্পী হবে। রাসেল ঠিক করল সে যুদ্ধের পরে শাহ আবদুল করিমকে খুঁজবে। আমি আমেরিকান ব্যান্ড ঞযব ইুৎফং এর খোঁজ রাখি: আমি বাউল শাহ আবদুল করিমের খোঁজ করব না কেন? তারপর সোলেমান বয়াতি হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ পথের শুকনো পাতার উপর পড়ে যায়। সবাই পথচলা থামিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। দলটার সঙ্গে ঢাকার এক ডাক্তার ছিলেন। নাজমুন্নাহার। ডাক্তার নাজমুন্নাহার ঝুঁকে পড়ে সোলেমান বয়াতির পালস পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন। তারপর সবাই সোলেমান বয়াতির লাস ফেলে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকে। মিরু হাজংএর পিছু-পিছু উত্তরের সীমান্তের দিকে হাঁটতে থাকে উদ্বাস্তুরা। যাত্রাপথে সোমেশ্বরী নদীটা হাতের বাঁয়েই থাকল। ওটার কাছাকাছি যাওয়া হলেও ঠিক পাড় হতে হলো না। পথে আরও যে কত পোড়া গ্রাম পড়ল। যাত্রাপথে উদ্বাস্তুরা জিপের শব্দ পায়। ট্রাকের শব্দ পায়। দলটা তখন কলাঝোপের আড়ালের লুকায় কিংবা অগভীর খালের পানিতে নেমে যায়। জিপের শব্দ, ট্রাকের শব্দ দূরে সরে গেলে আবার হাঁটতে থাকে কাদামাখা ভুতের মতন আতংকিত-ক্লান্ত দলটা । প্রচন্ড যন্ত্রনায় ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সবার শরীর ভেঙ্গে আসতে চায় ও শরণার্থীরা দূরে আবছা একটি পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পায়। মেঘালয়? ফরিদার বড় ভাবী মনোয়ারার পায়ে ব্যথা। কোলে দুই বছরের ইয়াসিনকে নিয়ে সেই ব্যথা নিয়েই হাঁটছিল মনোয়ারা। ফরিদা হাঁটতে হাঁটতে বড় ভাবীর পাশে যায়। কী মনে করে ফিসফিস করে আরেকবার রীনা ভাবীদের কথা জিজ্ঞেস করল ফরিদা। মনোয়ারা বলল, তাদের খবর জানি না ..., আমরা বাজারে গুলির শব্দ শুনে যেমন তেমন পলায়া আসছি। ফরিরদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এখন আরজ ভাই সঙ্গে থাকলে একসঙ্গে মরে যাওয়া যেত। সেই দিনটায় শতকত ভাই কত বাজার করল শওকত ভাই। রীনা ভাবি আর ফরিদা মিলে রান্না করতে বসল। খিচুরি, বেগুন ভাজি, পটল ভাজা, পাবদা মাছ, ভাজা ও রান্না, হাঁসের মাংস, গুড়ের ক্ষীর। রীনা ভাবী নারী বলেই সবই বুঝতে পারে। ফরিদার অবস্থা দমসম দেখে রীনা ভাবী হাসছিল মিটমিট করে । একবার তো ধাক্কাও মারল। দৃশ্য দেখে শওকত ভাই অবাক। কী কর তোমরা? আমরা কী করি তা বুঝলে তো? মেয়েরা কত কী যে করে। তো আরজ ভাই লোকটা আসল না বারান্দায়। খাওয়ার পর বাইরের ঘরে বসে থাকল আরজ ভাই। তখন কানে কারে রীনা ভাবী যা বলল তা মুখে আনা যায় না। কথাটা বলে আবার একবার তো ধাক্কাও মারল রীনা ভাবী। এইবার ভালোই ব্যথা পেল ফরিদা। তখন সত্তর সাল, আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। আমবাগানে ও ঘাসের মাছে মিষ্টি রোদ ছড়িয়েছিল। নির্জন দুপুর। দূরে রেললাইনের পাশের তারে বসে ঘুঘুপাখি ডাকতেছিল খালের পানিতে আকাশের ছায়া। আকাশে বাতাসে শীত আসবে সেই কথা বলে। খাওয়া দাওয়ার পর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিল ফরিদা। না, লোকটা আসে নাই। বসার ঘরে বই খুলে মুখ গুঁজে লোকটা। না, আরজ ভাই আসে নাই। আসে নাই বলেই লোকটাকে বিয়ে করার জেদ ধরে ফরিদা। তারপর বিকালের দিকে একফাঁকে টেনে নিয়ে রীনা ভাবী বলেই বসল, তুমি কোনও চিন্তা কইর না ফরি, দরকার পড়লে আমি খালুজানরে সব বুঝায়ে বলব। ফরিদা সেই আশায় ছিল এতদিন। কিন্তু ...কিন্তু ...রীনা ভাবীরা এখন কোথায়? রাতটা কাটল মিরু হাজংদের গ্রামে। দুটো ঘটনা ঘটল এখানে। এক. এত ক্লান্তি ও বিপদেও সজারুর মাংস খেয়ে আহলাদিত হয়ে উঠল উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ । দুই. রেহানার ননদের ছোট মেয়েটার পক্সশরীরটা ঝেঁড়ে দিল এক শনচুলো থুড়থুড়ি বুড়ি। পরদিন সকালে দেখা গেল রেহনুমা হাঁটতে পারছে । পরদিন ভোরে আবার সেই প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যের দিকে যাত্রা শুরু। তার আগে মিরু হাজংদের গ্রামে ফরিদার মেঝভাবি মোমেনাকে রেখে যেতেই হলো। প্রসব বেদনা উঠেছে পোয়াতির। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। সেই শনচুলো থুড়থুড়ি বুড়িটি অবশ্য নির্বিকার। বুড়ি ওত পেতে আছে। ঘুপচি একটি ঘরের প্রায়ান্ধকারে একটি থকথকে পিছল লাল শিশুর জন্মপথের খুব কাছেই আছে ওত পেতে বুড়ি। এই অতি বয়স্ক অরণ্যবুড়িটি এখনও না-জম্মানো শিশুটির নাড়ি কাটবে বলে শুয়োরের সুতীক্ষ্ম হাড় নিয়ে ওত পেতে আছে ওত পেতে আছে ওই থকথকে পিছল লাল শিশুটিকে এই এই ভয়ার্ত কালো ধোঁওয়ার পোড়া গন্ধের বিশাক্ত কটূ জগতে স্বাগত জানাবে। হাজংদের গ্রামে ফরিদার মা আর বড় ভাবী থাকল । সঙ্গে কয়েকটি গোমরামুখো বিষন্ন শিশু । ইব্রাহীম শেখের বড় বেয়াই গৌরীপুরের মাইলাকান্দার সেই আবদুল লতিফ পোদ্দারও রয়ে গেলেন। এমন পেট ছেড়েছে তার। আজীবন সুরিয়া নামে একটি নদীর উত্তর দিকের জমিতে কৃষি করেছেন লতিফ পোদ্দার। এখন সেই কৃষিজমি পাকবাহিনীর দখলে। আর আশেপাশের গ্রামগুলিও তাদের নির্বিচার গুলিবর্ষনের লক্ষ্যবস্তু। সে কারণেই এখন সুরিয়া নদীতে লাশের স্রোত নদীর স্রোতের মতন। বিপদ বুঝে কাকনহাটির বেয়াইবাড়ি এসেছেন। সেখান থেকে এই হাজংগ্রামে। আজীবন গারো-হাজংদের এড়িয়ে গেছেন লতিফ পোদ্দার। গালাগাল করেছেন। জমিতে খাটিয়েছেন। এখন তাদের হাতেই ভাত খেতেই হচ্ছে। কী আর করা। মেয়েদের সঙ্গে এক তরুন কারও থাকা উচিত। বয়স্করা বিষন্ন রাসেলকে নির্বাচন করলেন। এর আগে কখনও হাজংগ্রামে আসেনি রাসেল। প্রাক্-সন্ধ্যার বিষন্ন আলোয় একটি থকথকে কাদার উঠান আর উঠান ঘিরে কয়েকটি দূর্বল ঘর আর লালমুখো গোল আর থকথকে কাদার উঠানে রোওয়া-ওঠা শূকরছানার সঙ্গে হাজংশিশুদেরখেলা সে খুব মন দিয়ে লক্ষ করে। পরবর্তীকালে এই হাজং গ্রামেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল রাসেলের। ভোরের অশুভ আলোয় হাঁটতে হাঁটতে উদ্বাস্তুরা দেখল চারদিকে বাঁশের বন আর তারই তলাকার লাল রঙের মাটি অল্প অল্প করে উঁচু হয়ে উঠেছে । চড়াই-পথ আরম্ভ হয়েছে। দৃশ্যপথও বদলে যাচ্ছে ক্রমেই। পায়ের নিচের মাটিটা এখন আরও লাল। লাল আর রুখু, কোথাও নুড়িপাথর ছড়ানো। পথের দুপাশে বাঁশঝার আর কীসব ঘন গাছ, ছায়াছায়া। জঙ্গলমতন। গাছে গাছে পাতলা কুয়াশা ঝুলে ছিল। আস্তে আস্তে ডালপালা ফুঁড়ে আকাশের আলোও ফুটে উঠছিল। আর সেই আলোয় পাতলা কুয়াশার ফাঁকে দেখা গেল একটা বাদামি-ধূসর রঙের ছোট একটা লজ্জাবতী বানর। একটা বাঁশ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে । বাঁশঝারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল একটা অল্পবয়েসী ছেলে ওই লজ্জাবতী বানরটাকে দেখছিল । কাছে এসে ফরিদা দেখল ছেলেটার কালো চুল কালো চোখ / মাথা ও মুখটা গোলাকার/ কপাল চোখের দিকে কিছুটা বাড়ানো /ঘন ভুরু/ ছোট চোখ/ গালে মনে হয়না দাড়িগোফ ওঠে / শরীর নির্লোম /চ্যাপ্টা নাকমুখ/ উঁচু চোয়াল/ নাকের ফুটা মোটা/ বুকটা চওড়া /হাত পা পেশি /স্থুল সবল শরীর/ বেঁটে /চমড়া মসৃন / পীতাভ রং ...ছেলেটা কি গারো? সৈয়দ আহমেদ নাজীর ভাবলেন। গারোই হবে। গারো বালক বাঁশঝার লজ্জ্বাবতী বানর ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে উদ্বাস্তুরা। সন্ধ্যার মুখে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। সেই বৃষ্টি মাথায় উদ্বাস্তুরা সীমান্তের কাছাকাছি সেই প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যে ঢুকল। সবার পায়ের নিচে ভেজা মাটি। সেই ভেজা মাটিতে শুকনো আর ভেজা বাঁশপাতা, তার বুনো গন্ধ। সবার শরীরে ঘাম ও তরল উদ্বেগ। একথালা সাদা ভাতের জন্য ক্ষুধা ও হাহাকার। তা সত্ত্বেও যে যার মতো ভেজা মাটির ওপর অন্ধকার অরণ্যটি এই মুহূর্তে শ্বাপদপ্রজাতির চাপা চিৎকারে ভরে যাচ্ছিল। ষ্পস্টতই সে চিৎকার আশ্রয়প্রার্থীদের কানে আতঙ্কজনক মনে হতে থাকে। কারও কারও চোখে ঘুম। ভেজা মাটির ওপর কেউ-বা শুয়েও পড়ল। ঘুমের মধ্যে কেউ-বা সামনে একটা ধূসর বেঁকে-যাওয়া পথ দেখতে পায়। বাঁকটা পেরোতেই একটা ছায়াশূন্য রাখালশূন্য গরুশূন্য তেপান্তরের মাঠ...এমন ধূ ধূ। সেই তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে একটা হৃৎপিন্ডাকৃতির পদ্মপুকুর। পুকুরের পানি সবজে রঙের আর পদ্মফুলে ফুলে ভ্রমর। সবুজ পানিতে লাশ। চোখ বাঁধা। ভেসে ফুলে উঠেছে। মধ্যরাত্রে কী এক শব্দ শোনা গেল। পাতায় পাতায় বাতাসের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার অরণ্যে। অনেকটা তীব্র ঝড়ের মতো, যেন গাছগুলি উপড়ে ফেলবে। সেই সঙ্গে বোঁ বোঁ শব্দ শোনা গেল। এর কিছুক্ষন পর খুব নীচু দিয়ে একটা কী উড়ে গেল। প্লেন? সৈয়দ আহমেদ নাজীর অবাক হলেন। প্লেন কেন? এই অনিবার্য প্রশ্নটিই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ততক্ষনে পপলারের ধাক্কায় গাছের পাতায় পাতায় তীব্র ধাক্কায় বাতাস দুলে যায়। শরণার্থীদৈর সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও তারা একে অন্যের কাছাকাছি চলে আসে আতংকে । মায়েরা শিশুদের কোলের কাছে চেপে ধরে ও অন্ধকারে তারা একে অন্যের দিকে তাকায় । খুব কাছের মুখগুলিও খুব পরিস্কার না। খানিকবাদে মাটি দুলে উঠল। বোম্বিং? সৈয়দ আহমেদ নাজীর অবাক হলেন। ভূমিকম্প? না। প্রচন্ড শব্দ ওঠে। একের পর এক। একের পর এক। কেঁপে ওঠে অরণ্যের মাটি, তার মধ্যরাত। তার গাছ, গাছের পাতা, মাটি... মাটির ওপর দিয়ে একটা যান্ত্রিক গুড়গুড় শব্দ এগিয়ে আসছিল। কী যেন একটা এগিয়ে আসছিল। তাতে গুড়গুড় শব্দ ওঠে। শিশুর কান্নার শব্দ ওঠে। ইব্রাহীম শেখ তখন চাপা স্বরে বলল, এই, এখন বাচ্চার মুখ বন্ধ রাখো কইলাম। এইটুকুন বাচ্চার মুখ বন্ধ করি কী করে কন? শিরিনবু ফুঁসে ওঠে। মরবা কইলাম। মরুম। মর। আহ, আপনি চুপ করেন তো বেয়াই। শিশু বলে কথা। সৈয়দ আহমেদ নাজীর মৃদু ধমক দিয়ে উঠলেন। সৈয়দ আহমেদ নাজীর ক্রমেই উপলব্দি করলেন প্রায় লাখ খানেক শরণার্থী এ অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সম্মিলিত হত্যার এমন সুযোগ ওরা ছাড়বে কেন ইষ্ট পাকিস্তানে যখন রক্তের হোলি উৎসব চলেছে। না। সে রাতে কেউই চিৎকার করেনি। সবাই চিৎকার করতে ভুলে গেছিল। সবাই অন্ধকার হয়ে ছিল। অন্ধকারে গাছ হয়ে ছিল। গাছের তলাকার মাটি হয়ে ছিল। গাছের তলাকার ভিজে মাটি হয়ে ছিল। আর, অরণ্যের অন্ধকারে জড়িয়ে ছিল একটা দীর্ঘরাত। সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৫৭
false
rg
অপরাজনীতি বিরোধী দুঃসাহসী উপন্যাস ঋষি এস্তেবানের 'বাস্টার্ড' সুদীর্ঘ ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনের পর বাংলাদেশকে আবার ২৪ বছর পাকিস্তানী দুঃশাসনে নিস্পেশিত হতে হয়। তারপর দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র চার বছরের মাথায় খুনি ঘাতকচক্র পাকিস্তান ও মার্কিনীদের যোগসাজসে সপরিবারে খুন করে বঙ্গবন্ধুকে। পরবর্তী তিন মাসের মাথায় জেলখানায় হত্যা করে বঙ্গবন্ধু'র চার প্রধান সহযোগীকে। তারপর রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় সেই পাকিস্তানী দালাল ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট পতিত পাকদোসরদের দখলে। ঔপন্যাসিক ঋষি এস্তেবান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাঙালি জাতির সেই কলংকময় অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন এক ভিন্ন আঙ্গিকের উপন্যাস 'বাস্টার্ড'। সম্পূর্ণ নড়াইলের আঞ্চলিক ভাষায় নাতীদীর্ঘ এই উপন্যাসে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কিভাবে সামরিক শাসনের জাতাকলে স্বাধীন বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানী ভাবধারায় নতুন করে যাত্রা শুরু করল, তার এক দুঃসাহসী, নির্ভিক ও নির্ভেজাল উচ্চারণ ঋষি এস্তেবানের 'বাস্টার্ড'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। পচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সামরিক শাসনের আড়ালে সেই মার্কিন মদদপুষ্ট ও পাকিস্তানী ভাবধারার দোসররাই বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। প্রথমে তারা কারাবন্দি পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও জামায়াত নেতাদের বিনা শর্তে মুক্তি দেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা জামায়াতের অনেক পলাতক নেতাদের আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী'র আসনে বসান এক কুখ্যাত জামায়াত নেতাকে। তারপর সংবিধান পরিবর্তন করে জারী করেন কুখ্যাত কালো আইন 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ'। এই আইনের বলে বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচারের পথ রহিত করা হয়। পাশাপাশি সংবিধান থেকে বাংলাদেশের প্রধান চারটি নীতি পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে সেখানে সংযোজন করা হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। পতিত জামায়াত ও পাকিস্তানপন্থীদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মার্কিন মদদে দেশের সকল জাতীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সেখানে বিকেন্দ্রীকরণের নামে শুরু হয় এক অভিনব রাষ্ট্রধ্বংসের খেলা। ঔপন্যাসিক ঋষি এস্তেবান দুঃসাহসী বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে 'বাস্টার্ড' উপন্যাসে সেসব তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নির্ভেজাল বয়ানে।বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই প্রথম সামরিক শাসন পরবর্তী সময়ে কিভাবে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল আর অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী অপশক্তির হাতে কাদের ইসারায় কিভাবে চলে যায়, সেসব সত্য ঘটনার এক নির্ভিক উচ্চারণ 'বাস্টার্ড' উপন্যাসের পৃস্ঠায় পৃষ্ঠায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যখন ধর্মভিত্তিক দুর্বল কাঠামোর মোড়কে সর্বত্র বিস্তার লাভ করে, তখন কিভাবে একে একে দেশের সকল শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, প্রতিবেশী-বন্ধু সম্পর্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, অপরাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে গোটা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে যায়, কিভাবে সকল বন্ধন তীলে তীলে খসে ভেঙে চুড়ে একাকার হয়ে যায়, তার সচিত্র আখ্যান উঠে আসে ঋষি এস্তেবানের 'বাস্টার্ড' উপন্যাসে।ঘটনা যখন ইতিহাসের পতিত কুশিলব ও কুচক্রীদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এভাবে পেছনে যাত্রা শুরু করে, তখন দেশের আইন শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সর্বত্র কিভাবে দুর্নীতির বিষবাষ্প রোপিত হল, পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ডালপালা ছড়িয়ে ক্ষমতা শক্তিশালী করার সকল রঙ্গ সাঙ্গ করল, সেসব বস্তুনিষ্ট অথচ সত্যকথন উঠে এসেছে 'বাস্টার্ড' উপন্যাসে এক ব্যতিক্রমি ঢঙে। পচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে কিভাবে রাতারাতি চোর, বদমাস, লম্পট, ছিনতাইকারী, লুটপাটকারী, দখলবাজ, ভূমিদস্যু, বনদস্যু, ধর্ম-ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, চরদখলকারী, খাসজমি দখলকারী, আর স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত দোসরদের হাতে রাষ্ট্রীয় মদদে চলে গেল, তার এক সুদীর্ঘ রূপায়ন ঋষি এস্তেবানের উপন্যাস 'বাস্টার্ড'।ঔপন্যাসিক ঋষি এস্তেবান 'বাস্টার্ড' উপন্যাস লিখতে নড়াইলের আঞ্চলিক ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। উপন্যাসের চরিত্রগুলো নড়াইলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ঘটনার পরম্পরা নড়াইলকে ছাড়িয়ে গোটা বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি মানুষের অন্তরের ক্ষোভ, দুঃখ, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-বেদনা, ক্লেদ-অভিমান, বিষয়-আশয়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তখন গোটা বাংলাদেশের হৃদয়ের ক্ষতটি সুস্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে 'বাস্টার্ড' উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। গোটা বাংলাদেশের প্রতিটি রক্তক্ষরণের দাগ ও অভিঘাতের বেদনা জড়িয়ে পড়ে সেই ঘোর লাগা তরতাজা ঘটনায়।প্রচলিত উপন্যাসের বাইরে 'বাস্টার্ড' এক ভিন্নধর্মী সত্য প্রকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঔপন্যাসিক ঋষি এস্তেবান উপন্যাসের নানা ঘটনার মাধ্যমে পাঠকের অন্তরে সেই দাহটি জাগিয়ে দিতে চান, যা দিয়ে বাংলাদেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সঠিক পথে নতুন করে যাত্রা শুরু করবে। অপরাজনীতি ও দুষ্টু রাজনীতির দুর্বত্তায়নের কবল থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গঠনে যে দীপ্ত শপথ ও দৃঢ়তার প্রয়োজন, সেই চূড়ান্ত শপথ নেবার জন্য যে ত্যাগ ও দেশপ্রেম মননে থাকা জরুরী, সেই অগ্নিগর্ব দীপ্ত শপথ নেবার জন্য পাঠককে উপন্যাস 'বাস্টার্ড' উৎসাহ যোগাবে বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। উপন্যাস 'বাস্টার্ড' প্রকাশ করেছে করাতকল। অমর একুশে বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বরের দ্রষ্টব্য, চালচিত্র ও লিটিলম্যাগ কর্ণারে পাওয়া যাবে ঋষি এস্তেবানের অপরাজনীতি বিরোধী উপন্যাস 'বাস্টার্ড'। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী চারু পিন্টু।
false
ij
বোথিয়াস_ সান্ত্বনার সহজ পাঠ রোমের এক অভিজাত পরিবারে রোমান দার্শনিক বোথিয়াস (খ্রিস্টাব্দ ৪৮০-৫২৪) এর জন্ম। তাঁর পুরো নাম আনিসিউস ম্যানলিউস সেভেরিনাস বোথিয়াস। সেই সময়টায় পুব দিক থেকে বর্বর হুনরা বারংবার হুঙ্কার দিচ্ছিল, টলিয়ে দিচ্ছিল রোমান সাম্রাজ্যের ভিত । তখনকার দিনের কনসাল এর ক্ষমতা অনেকটা এখনকার দিনের ম্যাজিস্ট্রেটের মতো। বোথিয়াসের বাবা ছিলেন একজন রোমান কনসাল। অসট্রোগথরা ছিল (পূর্ব ) জার্মানিক ট্রাইব। হুনদের তাড়া খেয়ে তারা রোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করে রোমান সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়। বোথিয়াস কে অসট্রোগথদের কনসাল নিযুক্ত করা হয়েছিল। রোমান সম্রাট সে সময় থিওডোরিক। তো, সম্রাট বোথিয়াসকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন! কেন? কনসাল বোথিয়াস নাকি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে অর্থাৎ বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন! বোথিয়াস নাকি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। অতএব তাকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করাই যায়, অতএব তাকে হত্যা করাই যায়! আসলে, অনুমান করি, বোথিয়াস প্রশাসক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অসট্রোগথ-প্রজারা তাঁকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। সম্রাটের কানে সেসব কথা গিয়েছিল। হয়তো প্রশাসক হিসেবে বোথিয়াসের গৃহিত নীতিমালা ছিল বহুসংখ্যক মানুষের জন্য কল্যাণকর! হয়তো ...মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার আগে বোথিয়াস রোমে গৃহবন্দি ছিলেন। ভীষণ মানসিক অস্থিরতা। মন শান্ত করার লিখবেন ভাবলেন। লিখলেন। পরে ইংরেজিতে সে বইয়ের নাম দেওয়া হল: “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” এর বাংলা করলে দাঁড়ায়: দর্শনের সান্ত্বনা বা দর্শনের প্রবোধ। রেনেসাঁ পর্যন্ত সমগ্র খ্রিস্টানবিশ্বের এরকম প্রভাবশালী গ্রন্থ খুব কমই ছিল। বোথিয়াস একনিষ্ট খ্রিস্টান হলেও অন্ধবিশ্বাসের বদলে মানবীয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেছেন। “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বইটির রচনারীতি, মানে, ভাষা প্রয়োগ অশ্র“তপূর্ব। একই রচনায় গদ্যে ও পদ্যের মিশ্রন! বইটি আসলে দু-পক্ষের সংলাপ। একজন বোথিয়াস নিজে, অপর পক্ষ হলেন স্বয়ং দর্শন এবং দর্শনকে নারী কল্পনা করেছেন বোথিয়াস! এমনই সৃজনশীল মানুষ ছিলেন বোথিয়াস। তখন একবার আমি বলেছি, বোথিয়াস প্রশাসক হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সৃজনশীল বলেই বোথিয়াস মানবিক আর মানবিক বলেই বোথিয়াসের গৃহিত নীতিমালা ছিল বহুসংখ্যক মানুষের জন্য মঙ্গলময়! এবং আরও বিস্ময়কর এই যে ... “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বইতে বোথিয়াস তাঁর বক্তব্য রেখেছেন গদ্যে, পক্ষান্তরে, দর্শন (নারী) তাঁর বক্তব্য রেখেছেন পদ্যে!সেই খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের এই সৃজনশীলতা! বোথিয়াস-এঁরাই তৈরি করেছেন বিস্ময়কর ইউরোপীয় মনচেতনা-যে মনচেতনা নিয়ে আমাদের বিস্ময় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সন্দেহ কি- আমাদের ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে আমরা ওদের সমকক্ষ হতে চাই ,ক্ষুধা ও দারিদ্রকে দূর করতে চাই, বিশ্বকে নিতে চাই হাতের মুঠোয়, কক্ষপথে পাঠাতে চাই স্যাটেলাইট, অথচ, ইউরোপীয় মনচেতনার ভিতটি যে ঠিক কোথায়- সে বিষয়ে অনুসন্ধানের তাগিদ আমরা একেবারেই বোধ করি না। এই এক প্যরাডক্স! এই এক প্যরাডক্স যে - ধ্রুপদি দর্শনগ্রন্থাবলীর সঙ্গে পরিচিত না-হয়েই আমরা কেবলি ভুরি ভুরি বৈজ্ঞানিক পয়দা করতে চাই! যেন-দার্শনিক মতবাদসমূহ বিজ্ঞানের পথকে কখনোই সুগম করে তোলেনি ...যেন বৈজ্ঞানিক নিউটনের নাম জানলেই যথেষ্ট ...দার্শনিক ডেভিড হিউম বাস্তবতা (রিয়েলিটি) সম্বন্ধে কি বিশ্বাস করতেন, তার আগে রেনে দেকার্ত চিন্তন (থিংকিং) সম্বন্ধে কী বললেন সেসব সম্বন্ধে জানার কোনওই দরকার নেই ... বাংলাদেশের বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তর থেকে পাঠসূচিতে দর্শনের ইতিহাস অর্ন্তভূক্ত করার দাবী করছি। দেশের মানুষকে অন্ধ করে রাখার শাসকশ্রেণির কোনও অধিকার নেই!যাক। তো, বোথিয়াস তাঁর বইতে কি লিখেছেন? যা লিখেছেন তেমনটা লেখাই তাঁর পক্ষে ছিল স্বাভাবিক। তখন আমি বলেছি যে বোথিয়াস ছিলেন একজন খ্রিস্টান দার্শনিক- যে কারণে অকপটে লিখেছেন, ‘জগতে নানাবিধ অন্যায় ও অসাম্য পরিলক্ষিত হলেও জগতে এক মহান স্বর্গীয় শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। সেই মহান স্বর্গীয় শক্তির তুলনায় ‘এভরিথিং এলস ইজ সেকেন্ডারি।’ মানে সেই মহান স্বর্গীয় শক্তির তুলনায় যা কিছু রয়েছে তা সবই তুচ্ছ।’এ ছাড়াও জগতে অশুভের উপস্থিতি, নিয়তিবাদ, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও বিচারের প্রকৃতি (দি নেচার অভ জাস্টিস) এবং পুন্য বিষয়ক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বোথিয়াস । বোথিয়াস মন ও মনন প্লেটো দ্বারা প্রভাবিত। তার কারণ আছে। ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড মনে করেন: পাশ্চাত্য দর্শন আসলে প্লেটোর রচনার ধারাবাহিক ফুটনোটস বা পাদটীকা! কাজেই বোথিয়াস এই প্লেটোনিকসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,“ঐশ্বরিক উপাদান মঙ্গলময়।” অন্যকথায় ঈশ্বর ও শুভবোধ অভিন্ন। সিদ্ধান্তটি সরল ও নিরীহ মনে হলেও পরবর্তীকালে দর্শনজগতে এই সিদ্ধান্তের অপরিসীম প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বোথিয়াস আরও বললেন, যারা ঐশি ক্ষমতা অর্জন করেছেন তারাই ঈশ্বর। পরবর্তীকালে এ কথার মানে দাঁড়াল: মানুষ হিসেবে যে ভালো সেইই ঈশ্বর! কুষ্ঠিয়ার ছেঁউরিয়ায় বাউলদের মাঝে এমন ধারণা বিদ্যমান। আবদেল মাননান কর্তৃক লালনসমগ্রর প্রথম সঙ্কলনের ভূমিকা দেখুন। লালনকে স্বয়ং ঈশ্বর সাব্যস্ত করেছেন ঐ বিদগ্ধ লালন গবেষক। লালন অবশ্য বিশ্বাস করতেন মহাকালের কর্তা বা সাঁই মানুষের ভিতর বাড়িতে বাস করেন। একটা গান হয়ে যাক ...যেখানে সাঁই বারামখানা শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে দেখতে যেন ভুজঙ্গনা ...ভুজঙ্গ মানে সাপ। হঠাৎ সাপ দেখলে লোকে যেন চমকে ওঠে। তেমনি লোকে চমকে ওঠে যখন শোনে যে মহাকালের কর্তা বা সাঁই তার ভিতর বাড়িতে বাস করেন। বোথিয়াস লিখেছেন: দে হু অবটেইন ডিভিনিটি বিকাম গডস। অর্থাৎ স্বর্গীয় গুণ অর্জন করে ঈশ্বর হওয়া যায়। বোথিয়াস আরও বললেন: অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা সুখি তারাই ঈশ্বর। রবীন্দ্রনাথের মূল বক্তব্যও কি তাই নয়? একটা গান হয়ে যাক ...জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো॥আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়, ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো॥বাংলার মাঝির একটি ভাটিয়ালি গানে আছে:দুঃখসুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জলসুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল?তাইতো বলি ওরে ও মন এ যে কঠিন ঠাঁইকোন্ খানে পাঠায়া দিলা মওলা মালিক সাঁই রে ...(এমন অন্তরঙ্গ নিবিড় কথা কি বোথিয়াসের কনসোলেশন এ আছে? থাকা সম্ভব? তাহলে?) অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা হাসতে পারে তারাই ঈশ্বর। বাল্যকালে ইসলামের নবীর বাণী শুনেছি:“আল্লাহ মানুষের বিষন্ন মুখ অপছন্দ করেন।” বোথিয়াস রচিত বইটির নাম আবারও মনে করি: “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বা দর্শনের সান্ত্বনা। অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা সুখি তারাই ঈশ্বর। এই হল দর্শনের সান্ত্বনা বা দর্শনের প্রবোধ। জন্ম লয়ে মানুষেরে বাতাসের মতন ঘিরে ধরে দুঃখেরা। আমাদের হাসতে হবে। আমাদের হাসতে হবে। বিশিষ্ট ভারতীয় যোগী রজনীশও ঐএকই কথা বলতেন। উপরোন্ত তিনি তাঁর অনুরাগীদের বলতেন নাচতে । কেন নাচতে বলতেন? কেননা মওলানা রুমি বলেছেন: Whosoever knoweth the power of the dance, dwelleth in God.আহ্!এবং এ ভাবেই জগতের মহাত্মাগন অভিন্ন।বোথিয়াস মনে করতেন প্রকৃতগতভাবে ঈশ্বর অবশ্যি একজনই। তবে গুনানুসারে বহু হতে পারে। এটি কিন্তু বহুঈশ্বরবাদ নয়!প্রশ্নতো উঠবেই-ঈশ্বর যদি থাকেনই তাহলে সৃষ্টিজগতে এত অশুভ কেন?এর উত্তরে অ্যারিষ্টটলের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে বোথিয়াস বললেন, দি ডিভাইন প্রোভাইডেন্স অ্যাজ রাদার লাইক আ স্পেটাটর অভ দ্য ইউনিভার্স রাদার দ্যান অ্যান ইন্টারভেইনিং এজেন্ট ...মানে স্বর্গীয় সত্ত্বা হলেন এমন একজন দর্শক যিনি সৃষ্টিকার্যে হস্তক্ষেপ করেন না। কাজেই বোথিয়াসের দর্শনে ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন! স্পেনের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদের ঈশ্বরের সরূপও এরূপ নির্বিকার।বোথিয়াসের দর্শনে ভারতীয় দর্শনের উপাদান ছিল। কারমা। যারা অন্যের ক্ষতি করে তারা দুর্ভোগ পোহাবে বেশি যদি তারা কৃতকর্মের জন্য এ জগতেই শাস্তি না পায়। এ বিষয়ে বোথিয়াসের যুক্তি অকপট, মরমী নয়। তাঁর মতে, যারা ইহজগতে শাস্তি এড়িয়ে যায়, তারা খারাপ হতেই থাকে এবং সুখের থেকে দূরে থাকে। বোথিয়াস আরও দাবী করলেন, পূন্যবান ব্যাক্তি শক্তিশালী, ভালোটা সবাই চায় কেবল পুন্যবানেরাই তা অর্জন করে। কে জানে নিজের লেখা কতটুকু সান্ত্বনা দিতে পেরেছিল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান দার্শনিকটিকে। সম্রাটের আশেপাশে ছিলেন বলেই বোথিয়াসকে অকালে মৃত্যু স্পর্শ করেছিল। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্ষমতার আশেপাশে ঘুরঘুর করে মৃত্যুর অদৃশ্য হাত আর যত্রতত্র নেমে আসে তার নির্মম খড়গ। সৃজনশীল মানুষেরা সাধারনত নির্জনতা প্রিয় হয়। বোথিয়াস দূরের কোনও নির্জন পাহাড়ে চলে গেলেই পারতেন। তথ্যসূত্র:১ ফিলিপ স্ট্রোকেস সম্পাদিত “হানড্রেড অ্যাসেনসিয়াল থিঙ্কারস”২ অ্যান্থনি কেনি রচিত ‘ব্রিফ হিস্টি অভ ওয়েষ্টার্ন ফিলসফি’
false
rg
পুরস্কার লাগবে_ পুরস্কার_ হরেব রকম পুরস্কার আছে; চাইলেই দেওয়া হয়।। রেজা ঘটক বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কার কিভাবে দেওয়া হয়? পুরস্কার যে প্রতিষ্ঠান প্রদান করে, তারা একটি ঘোষণা দেয়। অমুক তারিখের মধ্যে অমুক অমুক শাখায় বই জমা দেওয়া যাবে। বই জমা দেবে লেখক নিজে অথবা প্রকাশক। ওই ঘোষণা শোনার পর পুরস্কারের আশায় আগ্রহী লেখক/প্রকাশকরা তমুক তমুক শাখায় বই জমা দেয়। যে প্রতিষ্ঠান পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল, তারা তাদের পছন্দ সকই একটি গোপন নির্বাচক প‌্যানেল গঠন করেন। কিন্তু বাছাইয়ের কাজটি করেন সেই প্রতিষ্ঠান নিজেই। বাছাই কিভাবে করে? যাদের পুরস্কার দেবার ইচ্ছা তাদের বইগুলো প্রথমেই তালিকায় ঢোকানো হয়। আর কিছু পরিচিত আর কিছু অপরিচিতদের কিছু বইও রাখা হয়। তারপর নির্বাচক প‌্যানেলকে সেই শর্ট লিস্ট ধরিয়ে অনুরোধ করা হয়, এবার আপনারা একটা রায় দিন। বই পড়ার কাজটি কেউ করেন না। নির্বাচক প‌্যানেলের কারো জীবনে ওই তালিকার বই পড়ার সময় নাই। এমন কি যে প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেবে বই পড়ার তাদেরও সময় নাই। তারা মুখ চেনা কয়েকজনের একটি তালিকা তৈরি করেন। কয়েক দিন পর সেই তালিকা নির্বাচক প‌্যানেলকে দেখানো হয়। তারা জিজ্ঞেস করেন, এর মধ্যে এবার কাকে কাকে দিতে চাও? পরুস্কার যারা দেবেন তারা তখন আরো একটি শর্ট লিস্ট উপস্থাপন করেন। বিতর্ক এড়াতে একটি কৌশল নেওয়া হয়। সেই কৌশলে দু'চার জন নতুন ঢুকে পড়ে। তারপর ঘোষণা হয় এ বছর অমুক পেলেন তমুক পুরস্কার। প্রশ্ন হল বই না পড়েই কেন পুরস্কার দেওয়া হয়? জবাব খুব সোজা। সময় নাই। যারা পুরস্কারের জন্য বই জমা দেয় নাই, তারা তো অটোমেটিক বাদ। তাহলে কিভাবে বোঝা যাবে তমুকের লেখা অমুক বইটি খুব ভালো। বাকি বইতো পড়া-ই হল না। তাছাড়া পুরস্কার যে বইটি পাচ্ছে, সেই বইও পর্যন্ত নির্বাচক প‌্যানেল বা পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কেউ পড়ল না। কামের কাম কি হল? পুরস্কার ঘোষণার পর, কিছু লোক স্বউদ্দ্যোগে পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটি পড়ার আগ্রহ দেখায়। কেউ কেউ বইটির উপর রিভিউ লেখে। অথবা পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কয়েকটি সিলেকট করা বই কাউকে কাউকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে রিভিউ করায়। এবার পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সেই রিভিউগুলোর ফটোকপি নির্বাচক প‌্যানেলের বাসায় নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেয়। অন্তঃত পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আগে কোনো ফাঁকে যদি নির্বাচক প‌্যানলের মান্যবর গন্যবররা সেই রিভিউতে চোখ বুলিয়ে পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক সম্পর্কে এবং তার বইটি সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে পারে। তারপর মহা ধুমধাম করে পুরস্কার প্রদান করা হয়। গোটা ব্যবস্থাপনায় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক প্রায় সময়ই থাকেন কলুর বলদ। কারণ, বই জমার কাজটি ব্যবসার খাতিরে সাধারণত প্রকাশকের উদ্দ্যোগেই হয়ে থাকে। তবে লেখকের পারমিশান ছাড়া বই জমা করা সম্ভব হয় না। পুরস্কারের চন্য বই জমা হবার পর লেখক উটপাখির মতো সুখবরটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আর প্রকাশক পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন দরবার করতে থাকেন। এবার লেনদেন দরবার যাদের ভালো হল বলে বিবেচ্য পায়, তারাই শেষ হাসিটি হাসে। কি চমৎকার সাহিত্য পুরস্কার, আহা!!!এক বছরে সারা দেশে সৃজনশীল যতো বই ছাপা হয় তার কয়টার নাম জানে ওই পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান? শতকরা ১ ভাগও না। কয়জন ভালো লেখকের নাম জানে? শতকরা ১ ভাগও না। কয়টি বই বাছাই করল? শতকরা ভাগে হিসাব করা যায় না। কারণ এটা ইসারা হিসাবে করা হয়। এই হিসাব কারা শিখায়? আমাদের সাজ্জাত শরিফ গংরা। যাকে যে বছর টার্গেট করে, তার ভাগ্যে সে বছর পুরস্কার জোটে। একটা উদাহরণ দেই। শহীদুল জহির আমার একজন পছন্দের লেখক। প্রথম আলো বর্ষ সেরা বই পুরস্কার পান শহীদুল জহির। কোন বইটায়? শহীদুল জহির সারা জীবনে যা লিখেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল যে বইটি, সেটি প্রথম আলো'র বিবেচনায় বর্ষ সেরা বই পুরস্কার পেল। বর্ষ সেরা বই কথাটি কি ঠিক? মোটেও না। কারণ, সারা দেশের সকল বই বাছাই করা হয়নি। নির্বাচিত কয়েকটি বই থেকে কয়েকটি রিভিউ করা হয়। সেই রিভিউ করা বইয়ের তালিকা থেকে দুই জনকে প্রথম আলো সৃজনশীল আর মননশীল শাখায় পুরস্কার দেয়। সৃজনশীল আর মননশীলের পার্থক্য কি? এটা পৃথিবীর একমাত্র সাজ্জাদ শরিফ ভালো জবাব জানেন। তাও আমরা মেনে নিলাম, যে এটা তাদের বানানো নীতিমালা। কিন্তু নির্বাচিত কয়েকটি বই থেকে বর্ষ সেরা বলাটা কি সঠিক? মোটেও না। প্রথম আলো দেশে এভাবে সাহিত্য পুরস্কারের নামে সাহিত্য সন্ত্রাস ছড়িয়ে সাহিত্য চর্চার কাজটিকে নষ্ট করার পায়তারায় ব্যস্ত। স্বয়ং বাংলা একাডেমী পুরস্কার এমন অনেক লেখককে দেওয়া হয়েছে যারা এখনো ভুল বাক্য লিখে অভ্যস্থ। সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য জানে না। কিন্তু বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়ে গেছেন। বাংলা একাডেমী'র গায়ে লেখা 'জাতির মননের প্রতীক'। কিন্তু সারা বছর তাদের কাম হল আকাম অলস সময় কাটানো। সাহিত্য নিয়ে গবেষণা তো করেই না। গল্পের বই ছাপে না। কিন্তু আপনি যদি কোনো একটা আপজাপ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে নিয়ে বাংলা একাডেমীর কোনো কর্মকর্তাকে ভালো করে তেল মারতে পারেন, তাহলে আপনার প্রবন্ধের বইখানা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ পাবে। তেল ঠিক মতো না মারতে পারলে কিন্তু খবর আর হল না। সেই অথর্ব একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে জাতির মননের প্রতীক হয়? যে দেশে জাতীয় সংসদে একজন সাংসদ অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে সাহস পান, সে দেশে তো অমন অথর্ব বাংলা একাডেমী-ই হাজার বছর টিকে থাকবে। বাংলা একাডেমী সারা বছর কয়টি ভালো বই প্রকাশ করে? একটিও না। কালে ভদ্রে দুই একটা। তাও হাজার বছর অপেক্ষার পর। সো, সেই দেশে সাহিত্য পুরস্কারের মত একটি মামলি ব্যাপার নিয়ে এতো হৈ চৈ-এর কিছু নেই। তার চেয়ে পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকের বইটি চুপচাপ পড়ার পর সেটি নিয়ে আলোচনা করলে বা লিখলে সেটি বরং কাজের কাজ হয়। পুরস্কারের ব্যাপারটির ধাপ্পাবাজির সঙ্গে প্রকাশকরা জড়িত। কেউ যদি এটাকে চ্যালেঞ্জ করেন, আমি হাতে নাতে প্রমাণ দিতে পারব। নইলে অনেক পুরষ্কারের খবর আমি আগেই জানতে পারি ক্যামনে? আমি তো কোনো এ্যাসট্রোলোজার নই। ভবিষ্যৎ গণনাও জানি না। তবে পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকের একটা লাভ হয় বটে। সবাই তার বইটি সম্পর্কে জানতে পারে। নকুন অনেকে তখন বইটি পড়তে আগ্রহ দেখায়। বাংলাদেশের পুরস্কার প্রাপ্ত সকল জীবিত ও মৃত লেখককুলকে একসঙ্গে সহস্র বছরের পুরাতন চলমান ও ভবিষ্যৎ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। আপনারা কেউ আবার ব্যাপারটা নিজের গায়ে মাইখেন না। আমি সিস্টেম নিয়ে কথা বলেছি। সেই বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে কইতে পারেন। আওয়াজ দিয়েন। আর সাধু সাবসান। কি ভাইজানরা কি মাইন্ড খাইলেন???
false
fe
None মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের খোঁজে কায়েস আহমেদপ্রশান্ত মৃধা-----------------------------------------------------------তিন শব্দের সরল একটি বাক্যে গল্পের শুরু। যেন, ‘এক দেশে ছিল এক রাজা’ কথকতায় কোনও-এক গ্রামের উপাখ্যান বা বৃত্তান্ত শোনানো হবে, ‘গ্রামের নাম মালপদিয়া।’ এরপরে আরও একটি তিন শব্দের বাক্য মালপদিয়াকে আঞ্চলিক উচ্চারণে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ‘লোকে বলে মালোইদ্দা।’ তারপর মাত্র দু’টি বাক্যে গ্রামটির প্রাকৃতিক-ভৌগোলিকতার ছবি। এই নিয়ে প্রথম অনুচ্ছেদ। কিন্তু গল্পের ওপর একটা শিরোনাম থাকে, থাকতেই হয়, তাই পাঠককে ‘গ্রামের নাম মালপদিয়া।’ পড়ে-নেয়ার আগেই, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’- এই শিরোনাম জেনে নিতে বাধ্য করে : হ্যাঁ, মালপদিয়া আছে, সেখানে রমণী মুখুজ্জেও আছেন, তবে এ কোনও গ্রামের আখ্যান নয়, বৃত্তান্ত তো নয়ই বরং এই গল্প লেখা হচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে নিয়ে, রমণী মুখুজ্জে সেখানের এক স্মারক মাত্র। গল্পের লেখক গল্প আর গ্রামের ভেতরে ঢুকছেন পরিব্রাজকের ইচ্ছায়, ‘জৈনসার গ্রাম থেকে পথ প্রদর্শক হয়ে আসা যুবকটি বিরক্ত হয় মনে মনে।’২.অকালপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদের (২৫ মার্চ, ১৯৪৮- ১৪ জুন, ১৯৯২) শেষ গল্পগ্রন্থ লাশকাটা ঘর-এর সবচেয়ে বড় আর দীর্ঘ শিরোনামের গল্প ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’তে ছিল পরবর্তী উত্তরণের আভাস। কায়েস আহমেদের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তার মিতায়তন রচনাবলিতে অন্তর্ভুক্ত ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’ (এটি সম্ভবত লেখকের শেষ গল্প-প্রচেষ্টা) গল্পটিকে একটু তীব্র-চোখে নজরে পড়লে, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃকঃ ’-এর সঙ্গে ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’-এর ভাষার আপাত সাদৃশ্য পাঠকের কোনোভাবে নজর এড়ায় না। যদিও ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃকঃ’-র বীজ কায়েস আহমেদের মাথায় ঢুকেছিল ১৯৭৯-এ মালপদিয়ায় প্রায় এক অবলম্বনহীন ভ্রমণের ভেতর দিয়ে; ওই সময়ে বাংলাদেশ আগাপাস্তলায় সেনাছাউনির রঙে ছয়লাপ, গল্পটি লিখেছেনও ওই রঙের দোর্দণ্ড প্রতাপের ভেতরেই (১৯৭৮-৮৬); আর, ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’ (দৈনিক সংবাদ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১) প্রকাশিত হয়েছে সামরিক উর্দির রঙ নাগরিক জনরোষে মুছে গেলে। ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে’-র গল্পভাষার সঙ্গে লাশকাটা ঘর-এর আর-কোনও গল্পের গল্পভাষার প্রায় মিল নেই বলে হয়তো উত্তরণের অঙ্গীকারের প্রক্রিয়াটি আবিষ্কৃত হয় সহজেই। এই আবিষ্কারের সূত্র ধরেই গল্পপাঠে সজ্ঞান (!) পাঠককে তাকাতে হয় তাঁর পরবর্তী গল্পের দিকে, এক ভাষা-সাজুয্যের সেতু খুঁজে নেয়ার জন্যেই যেন, আপাতভাবে। ভাষা সাযুজ্য খুঁজে দেখার সঙ্গে এই গল্প পাঠের ভেতর দিয়ে কায়েস আহমেদ পাঠককে বানিয়ে দেন ভেদ-বুদ্ধির রাজনীতির অসাড় পুতুল। গল্প তখন আর শুধুই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটে খোঁজার গল্প থাকে না। কায়েস আহমেদ গল্পের শব্দের পর শব্দে গাঁথতে থাকেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, নিজভূমে পরবাসী পঙ্কিল জীবন যাপনে দায়গ্রস্ত মানুষের ছবি। যে পাঠকের শুধুই ভ্রমণ আর সংবাদের ভাষ্যে তথ্য তুলে নেয়ার কথা, সেই ভ্রমণের সেই সংবাদ পাঠ আর পাঠককে নেয়া হয় না; বরং তাকে গ্রহণ করতে হয় মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার সলজ্জ চোখ, যুগপৎ কায়েস আহমেদের সঙ্গে চলতে থাকে অদৃশ্য হাত ধরে চলা পথ।৩.মালপদিয়া পৌঁছানোর পরেই কায়েস আহমেদ সংকটে পড়ে যান, ‘এই গণ্ডগ্রামে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনার তো প্রশ্নই ওঠে না, এতো বছর পর এই গ্রামেরই মানুষ তাঁর বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বা কে চিনবে?’ এই সংশয়ের জিজ্ঞাসা সঙ্গে নিয়ে জনে জনে না খুঁজে তিনি খুঁজে নিতে চান গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন মানুষটিকে। জানলেন রমণী মুখুজ্জে তার নাম, ‘ওই যে গাছপালা, ওইখানে গেলেই একতলা পাকা দালান, ওইটাই রমণী মুখুইজ্জার বাড়ি।’ বাড়িতে ঘাটশিলার স্টেশন মাস্টার অশীতিপর রমণী মুখুজ্জেকে পেলেন, আর তাঁর ছেলে এক সময় ঢাকা লায়ন সিনেমার বুকিং ক্লার্ক বিমলকেও পেয়ে যান। কথোপকথনে কায়েস আহমেদ জানলেন রমণী মুখুজ্জে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন, ‘হরিহর বাড়ুইজ্জা এই গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট, তার ছেলে সুধাংশু বাড়ুইজ্জা বড় সরকারী চাকরি করতো [ঃ] সুধাংশু বাড়ুইজ্জার বিয়াতে কলিকাতায় নেমন্তন্ন খাইচি, ভালো খাওন দাওন হইছিলো, গ্রামের মানুষ যে ক’জন কলিকাতায় আছিলো, তাগো খুঁইজা খুঁইজা নেমন্তন্ন করছিলো হরিহর বাড়ুইজ্জা, বেশ বড়ো ঘরে বিয়া হইছিলো।’ কিন্তু কায়েস আহমেদ যখন তার উদ্দেশে কথা বলেন, আচ্ছা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন না? হরিহর বাড়ুইজ্জের ছেলে সুধাংশু বাবুর ছোট, খুব বড় লেখক। তখন রমণী মুখুজ্জে মাথা নাড়েন, ‘না চিনি না।’ তবু একটু জানতে পেরেই কায়েস আহমেদ খুশি। তিনি বিমল বাবুকে তার বাবার কাছে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের কথা জিজ্ঞেস করতে বলেন। কিন্তু উত্তর আসে সেই একই, এ গ্রামে ঢোকার পরে যে প্রশ্নের মুখে তিনি আরও অন্তত বারদুয়েক পড়েছেন, ‘ক্যান্, জায়গা জমির কোনও ব্যাপার?’ বিমল বাবু তার বাবাকে ব্যাপার বুঝিয়ে বলার পরে, রমণী মুখুজ্জে প্রথম কায়েস আহমেদের উদ্দেশে কথা বলেন, ‘ভিটা তো আর নিজের না, হরিহর বাড়ুইজ্জার বাবার মামা ব্রজনাথ চক্তোত্তির, হরিহর বাড়ুইজ্জা ওই বাড়িতে মানুষ; কিন্তু সেই ভিটার কিছুই অহন আর নাই, অন্যেরা আছে, কেউ চিনবোও না।ঃ আমার তো সেই অবস্থা নাই, নাইলে আমিই নিয়া যাইতাম, আমি ছাড়া আর চিনবো একমাত্র মোহান্ত মণ্ডল, আপনারা তার লগে দেখা করেন।’মোহান্ত মণ্ডলও সরাসরি একই প্রশ্ন ঠুকে দেন, ‘বিষয়টি কি কন তো? হরিহর বাড়ুইজ্জা, ব্রজনাথ চক্কোত্তি হগলেরই নাম জাইন্যা এত দূর থেইকা ভিটার খোঁজে আইছেন, আসল বিষয়টা কি, জায়গা জমিনের ব্যাপার?’ তাকে বুঝিয়ে বলার পরে, সেই ভিটাতে কারা থাকে জানতে চাইলে মোহান্ত মণ্ডলের গলায় অসন্তোষ ধ্বনিত হয়, ‘কারা আর থাকবো? যারা থাকনের তারাই আছে।’ মোহান্ত মণ্ডল কায়েস আহমেদকে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটে চিনিয়ে দেবার জন্য একটি বারো-তের বছরের ছেলেকে সঙ্গে দেয়। ‘বালকের সঙ্গে আমরা বাঁদিকের উঁচু পাট ক্ষেতে উঠে যাই, ছোট্ট এক টুকরো উঁচু ডাঙ্গা জমি, (হয়তো মোহান্ত মণ্ডলেরই) তার সরু আল ধরে এগিয়ে সেই ডাঙার শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছাই।’ তখন কায়েস আহমেদ দেখতে পান, ‘নীচের আগাছা ভরা ঢালুর পরেই একটি ডোবার মতো পুকুর, সেই পুকুরের ওপারে ভেঙে যাওয়া ছোট্ট পুরানো ঘাট, মাটির ভেতর থেকে ভাঙাচোরা নোনা ধরা ইট বেরিয়ে আছে, তার ওপরই টিনের চালের খান দুই হতশ্রী বেড়ার ঘর দাঁড়িয়ে আছে, তার উঠোনে শাঁখা-সিঁদুরহীন মহিলাকুল, শিশু এবং বালক-বালিকা দেখা যায়।’‘এই হলো ব্রজনাথ চক্রবর্তী ভিটে।’ কিন্তু এখানো গল্পের শেষ নয়। শেষে যেতে কায়েস আহমেদকে লিখতে হয় আরও দুটো পৃষ্ঠা। ‘এই হলো ব্রজনাথ চক্রবর্তীর ভিটে।’ লিখতেই তার ভ্রমণ শেষ হয় ঠিকই, পাঠককে আর তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হয় না, পাঠকও হাঁটেন না। গল্পকথক সগত সংলাপে নিজের উপলব্ধির গল্প শোনান ওই দু’ পৃষ্ঠায়। সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, তার বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছে, আছেন ব্রজনাথ চক্রবর্তীও; এই এতক্ষণের ভ্রমণে কায়েস আহমেদ যাদের এখানে সঙ্গে পেয়ে যান- রমণী মুখোপাধ্যায়, বিমল মুখোপাধ্যায় ও মোহান্ত মণ্ডলই যেন হয়ে ওঠেন এতক্ষণের মূল প্রাপ্তি, ‘কিন্তু কি পেতে চেয়েছিলাম? দরিদ্র বারুইদের বাড়ি বাড়ি পুজো করে সংসার চালানো অকৃতদার দরিদ্র ব্রাহ্মণ ব্রজনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি এতো দিনে আমাদের কি রূপ দেখাবে? কিন্তু সেই বাড়ি দেখতে এসে যা পেলাম- রমণী মুখুজ্জে, বিমল, তার পরিবার, মোহান্ত মণ্ডল- এমন অপ্রত্যাশিতভাবে এত পাওয়া কে ভেবেছিল আগে?৪.শেষ হওয়ার পরও এই গল্প পাঠকের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া প্রশ্নবোধক। কায়েস আহমেদ যখন রমণী মুখুজ্জের বাড়ির পৈঠায় পৌঁছেছিলেন, তখন তার পুত্রবধূ জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনারা কি হিন্দু না মোসলমান?’ কেন এই প্রশ্ন? এর জবাব জানতে, জেনে নিতে কায়েস আহমেদকে দ্বিধায় পড়তে হয়নি, কিন্তু পাঠক স্পৃষ্ট হন বিমল মুখুজ্জের সঙ্গে কায়েস আহমেদের সংলাপে। বিমল মুখজ্জে যখন নিঃসঙ্কোচে জানান, ‘কি আর কমু, দ্যাশ গ্রামের অবস্থা ভালো না, আত্মীয় স্বজন সব ওই পারে, যে কোনো দিন চইলা যাইতে পারি, পারি না খালি বাবার জন্য, এমন বৃদ্ধ, দুর্বল, অক্ষম মানুষ নিয়ে এতো দূরের পথ কেমনে যাই, বাবা দেহ রাখলেই যামু গিয়া। কেমনে থাকি কন, নিজের জায়গা জমি তা-ও রক্ষা করা দুষ্কর, জীবনের ওপর দিয়াও হামলা গেছে, ঘরে ওইলো ডাকাতি, এমুন কইরা ভয়ে ভয়ে মানুষ বাঁচে কেমনে!’ অথচ দেশ ছেড়ে যেতে নারাজ মোহান্ত মণ্ডল। কায়েস আহমেদ তাকে, ‘এদিকের অবস্থা কেমন?’ জানতে চাইলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘অবস্থা আর কি!’ হাসলেন। ‘আছি, বাড়িতে দুইবার কইরা ডাকাইত পড়লো, আছি।’ ‘আছি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি। বড় বিচিত্র সেই হাসি। যেন কাউকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন, দেখি আমার কি করতে পারিস!বিমল মুখুজ্জে আর মোহান্ত মণ্ডলের সংলাপে ফারাক বিস্তর, ফারাক তাদের শ্রেণিতে, বর্ণেও- অন্তত পদবি তো তাই বলে। বিমল মুখুজ্জের বাবা ছিলেন ঘাটশিলার স্টেশন মাস্টার, কলকাতা শহরে কাটিয়েছেন, বিমল নিজে চাকরি করেছেন ঢাকায়, এক ভাই পশ্চিমবঙ্গের বাটানগরে সংস্কৃতের শিক্ষক। আর মোহান্ত মণ্ডল মৃত্তিকা-নির্ভর ঘোর কৃষক। এই নিজস্ব জমি ছেড়ে তিনি যাবেন কোথায়?তবে এই শ্রেণিগত পার্থক্যই কিন্তু শেষ কথা নয়। উভয়ের সম্প্রদায়গত মিল আছে বলেই কায়েস আহমেদ লিখেছেন: ‘যার জন্যে বিমলকে পিতার মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হয় এবং ব্রজনাথ চক্রবর্তীর ভিটেতে এখন কারা থাকে জানতে চাইলে মোহান্ত মণ্ডলের গলায় অসন্তোষ ধ্বনিত হয়, ‘কারা আর থাকব? যারা থাকনের তারাই আছে।’অথচ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘অধিকাংশ বারুইজীবী ও ২/৩ ঘর কায়স্থ ছিল। বারুইগণ চাষী শ্রেণীর লোক, পানের ব্যাবসা তাদের ছিল না। ক্ষেতের ফলস, বাড়ির শাক সবজি ও কলা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি বিক্রি করিয়া সংসার চালাইতো। ঃআমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান দু’ জাতীয় লোকেরই বাস, কিন্তু হিন্দুর সংখ্যা অনেক বেশী। মুসলমানগণ এক ভিন্ন পাড়ায় বাস করিয়া আছে। দু’ জাতির মধ্যে তখন এতো সদ্ভাব দেখিয়াছি যে, তাহার শতাংশ এখন থাকিলেও বর্তমান কালের বীভৎস কাণ্ড ঘটিতে পারিত না।’ ঘটে-যাওয়া সেই ‘বিভৎস্য কাণ্ডের’ সশরীর সাক্ষী হয়েছিলেন তার পুত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬-এর হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শান্তি স্থাপনে জন্যে বের হয়েছেন তিনি। তখন সংসারে তাঁর দারিদ্র্য চরমে, পরিবারের জনেরা বিপন্ন। রাতে চোর এসে রান্নাঘরের সব কিছু নিয়ে গেছে। তবু এই ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট দূরে ঠেলে রোগজর্জর শরীর নিয়ে তিনি ছুটে যান উপদ্রুত এলাকায়।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডাইরিতে লিখেছেন: ‘দাঙ্গার সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে এরকম জানাই ছিলো, তবু মনে হলো- কি আপশোষ! কি আপশোষ!ঃ কালীঘাট অঞ্চলে শিখদের সঙ্গে মুসলিমদের ভীষণ সংঘর্ষ হয়েছে শুনলাম। ফাঁড়ির ওদিকে নাকি গোল বেঁধেছে। মসজিদের সামনে ভিড় দেখে এলাম।ঃ মিটমাটের চেষ্টা ব্যর্থ হবে, কাল বিকালের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি।ঃ ধীরে শান্ত আত্মপ্রতিষ্ঠা ভাব না বজায় রাখতে পারলে নিশ্চয় মার খেতাম। ‘শালা কম্যুনিস্ট! ‘মুসলমানের দালাল।’ রব উঠেছিলো চারদিকে।ঃ ফাঁড়ির মোড়টা জনহীন। দূরে চারু মার্কেটের দিকে রাস্তায় হাঙ্গামা হচ্ছে। পাশে একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। কেপি লেনে বহু লোক উত্তেজিন, হিংস্র। ছাদ থেকে এক ব্যাটা চিৎকার করল- ‘ওই সেই ব্যাটা ঔপন্যাসিক যায়।’ ধীর পদে চলতে লাগলাম।৫.আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে খুঁজতে আসা কায়েস আহমেদ তো হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বীভৎস কাণ্ড’-এর উত্তর খুঁজতে হয় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সচেতন প্রয়াসে, চোখকে কাগেজের একবারে কাছে নামিয়ে যেন চোখ ঝাপসা দেখতে দেখতে লিখতে পারে এমন নম্র ইচ্ছায় শব্দের উত্তাপ তিনি ছড়িয়ে যান :১। ‘আপনারা কি হিন্দু না মুসলমান?’ বড়ো বিব্রত কর প্রশ্ন। আমাদের সঙ্গী গাইডটি সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘না আমরা হিন্দ না মুসলমান।’ মহিলা রান্নঘরের দরজায় খুঁটি ধরলেন। তারপর আমদের দিকে আবার তাকালেন, সেই বিষাদময় মুখের দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর আবার মুচড়ে উঠলো, আহা, কেনো পরিচয় দিতে গেলো। মনে মনে বলি, পরিচয় পেয়ে ওই যে তিনি হঠাৎ রান্নাঘরের দরজার খুঁটি ধরলেন, ওই যে চোখের তার কেঁপে উঠলো, ওই যে দৃষ্টি ছায়া পড়লো- ওসব দেখে আহত হয়ো না, লজ্জিত হও। এ তোমার এ আমার পাপ!২। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর আজ পর্যন্ত- এতো বছর পরও বিভক্ত ভারতবর্ষে প্রবল দুই ধর্ম সম্পদায় হিন্দু-মুসলমান- যারা তাঁদের স্ব স্ব জন্মভূমিতে ‘সংখ্যালঘু’ এই নামে অভিহিত হয়ে আসছে- অর্থাৎ সংখ্যাগুরু দ্বারা রাষ্ট্রীয়ভাবে শাসিত হয়ে আসছে, কি হিন্দু কি মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এক ধরনের মানস সংকট সৃষ্টি হয়ে আছে, মনোজগতের সেই পরবসী চেতনাই তার শিকড় আলগা করে দিয়েছে স্বদেশের ভূমিতে।কিন্তু পাশাপাশি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একজন নিঃস্ব ব্যক্তি এ ধরনের মানসসংকটে ভোগেন না- তার কারণও সেই একই রাজনীতি।৩। এই যে মানুষজন দূরে দূরে, এই যে দূরে দূরে ছায়া-ঘন-বাড়ি-ঘর না- কোনও অশান্তি নেই, কেমন শান্ত, স্থির, মন্থর, সরল- এই আকাশ আর গাছপালার মতোই স্বাভাবিক। অথচ এর গভীরে যে জটিল কুৎসিত কূটিল বাস্তবতা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে! মানুষের শ্রমে ঘামে, ক্ষুধায়-দারিদ্র্যে, ভালোবাসায়, আতঙ্কে, অশ্রুতে, দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে। তাকে তো এর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। কী সীমাহীন অসঙ্গতিময় এই বাস্তবতা!৬.এক ভিটে খোঁর গল্প শোনাতে শুরু করেছিলেন কায়েস আহমেদ নিজস্ব ভ্রমণের হাত ধরে, সেই হাত দিয়েছিলেন পাঠকের হাতে। গল্প, গল্পে পেয়ে-যাওয়া মানুষেরা মানে গল্পের চরিত্রেরা আর তাকে সে পথে যেতে দিল কই? প্রত্যেকে সশরীরে জীবন্ত হয়ে মূর্তিমানের মতো আপনাকে খুলে দেখিয়ে দিল- কায়েস আহমেদও দূঢ় কলেমে লিখে গেলেন সেই কাহিনি। আজও এই গল্প লিখিত হচ্ছে সন্দেহে, সংশয়ে আর কূচালের রাজনীতিতে। বাংলাভাষী পাঠকমাত্রই ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ পড়ে নিজেকে দেখে নেবেন নিজের মতো করে নিজস্ব বোধ বিশ্বাস উপলব্ধিতে। এই উপলব্ধির রাসায়ন পান করে আলোর সন্ধানে বেরিয়ে তখন রক্তাক্ত হৃদয়ে তখন শুধুই অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা, কায়েস আহমেদের চাবুকের তোড়ে রক্তাক্ত হয়। [দৈনিক ইত্তেফাক / ২ এপ্রিল ২০১০ ]
false
fe
চলে গেলেন পথিকৃৎ প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা দৈনিক ভোরের কাগজ রিপোর্ট ডিসেম্বর ২৭, ২০০৭, বৃহস্পতিবার : ------------------------------------------------------------------------ প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ চিত্তরঞ্জন সাহা আর নেই ================================ ইমরুল ইউসুফ : বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এবং এদেশে বইমেলার পথিকৃৎ, মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তরঞ্জন সাহা আর নেই। গতকাল বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী বিজলীপ্রভা সাহাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় তার মরদেহ ৩৮ বাংলাবাজার চত্বরে আনা হবে এবং পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। আজ তার প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলাবাজার, নর্থব্র"ক হল রোড ও প্যারিদাস রোডের সকল বইয়ের দোকান দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। প্রকাশনা শিল্পের অনন্য কারিগর চিত্তরঞ্জন সাহার জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার লতিবপুর গ্রামে। তার পিতার নাম কৈলাশ চন্দ্র সাহা। মাতার নাম তীর্থবাসী সাহা। পিতামাতার ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৫১ সালে বিএ পাস করার পর পৈতৃক বণিক ব্যবসা পরিত্যাগ করে নোয়াখালীতেই বইয়ের ব্যবসা শুর" করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি তার স্ত্রীর মালিকানায় ছাপাঘর নামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। ১৯৫৭ সালে বই বাঁধাইয়ের জন্য তিনি বাঁধাইঘর নামে নিজ মালিকানায় পুস্তক বাঁধাইয়ের কাজ শুর" করেন। তার এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশির ভাগই প্রকাশিত হতো মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নোট বই। ১৯৬৭ সালে তিনি গঠন করেন পুথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তধারা নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। মুক্তধারা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক বই প্রকাশ শুর" করেন। মুক্তধারা প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑ ছড়া, রূপকথা, বিজ্ঞান, কাব্য, নাটক, উপন্যাস, রম্যরচনা, জীবনী, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, সমালোচনা প্রভৃতি। ৩৫ বছর আগে ১৯৭২ সালে মুক্তধারাকে নিয়ে বাংলা একাডেমীতে চাদর বিছিয়ে এদেশে প্রথম তিনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। যে বইমেলা আজ সময়ের পরিক্রমায় বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে পরিচিত। শুধু বাংলা একাডেমী নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলায় মুক্তধারার আয়োজনে বইমেলার আয়োজন করতেন তিনি। একুশে পদকসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সম্মাননাপ্রাপ্ত চিত্তরঞ্জন সাহা অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সহসভাপতি ছিলেন তিনি। প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে মর্যাদা দান ও বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য ১৯৮১ সালে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার ‘কাগজ উপদেষ্টা বোর্ডে’র সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ও আজীবন সদস্য। বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদের আজীবন সদস্য। বইয়ের ওপর বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তিনি অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। তার স্বাস্থ্য সব সময় ভালো ছিল। ১৯৭৭ সালে তার একবার স্ট্রোক হয়। এরপর থেকে তিনি কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেন। সুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি দৈনিক ১৮ ঘণ্টা তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে সময় দিতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পুরান ঢাকার ২২, প্যারীদাস রোডের বাড়িতে বসবাস করে গেছেন। মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, বাংলা একাডেমীর জীবনসদস্য চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যুতে বাংলা একাডেমী গভীর শোক প্রকাশ করেছে। একাডেমীর মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তার শোকবার্তায় বলেন, প্রকাশনা জগতে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। কবি-সাহিত্যিক-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার ছিল গভীর যোগাযোগ। তার একান্ত নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে এ দেশের সৃজনশীল সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী পুস্তক প্রকাশনায় নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। বইকে পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুর"র প্রাক্কালে তার অবদানের কথা বাংলা একাডেমী কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছে। তিনি আরো বলেন, চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যুতে জাতি একজন গুণী মানুষকে হারালো। দেশের প্রকাশনা জগতে যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বাংলা একাডেমী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করছে ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মোঃ আবু তাহের এক বিবৃতিতে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক, ঐতিহ্যবাহী মুক্তধারা ও পুঁথিঘর লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যুতে প্রকাশনা জগত শোকাভিভূত উল্লেখ করে বলেন, তিনি একুশে পদকসহ অসংখ্য পদক এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। সমিতির পক্ষ থেকে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনকে গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জানানো হয়। প্রকাশনা জগতের সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যুতে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি, শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবীন আহসানসহ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা গভীর শোক প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ১০:০১
false
rn
আদিম মানুষ কুড়ি লাখ বছর বা তার চেয়েও বেশি আগে আদিম মানুষ গুহায় বাস করতো৷ শিকার করার পরে কী ভাবে মানুষ সেই খাবার খেতেন ? সেই সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা সব্জি, ফলমুল, বাদাম, নানা রকম শেকড়বাকর এবং মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতেন৷ আদি পৃথিবী ছিল ভীষন উত্তপ্ত।এটি ছিল এক প্রচন্ড উত্তপ্ত গোলক পিন্ড।প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ছিল কৃষিকাজের একেবারে প্রাথমিক যুগ৷ ১ লক্ষ বছর আগে থেমে যাওয়া জনৈক আদিম মানবের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের প্রথম জনপদ না হলেও শৈলাশ্রয় বা যাকে বলে রক-শেলটার ।বর্তমান বাংলাদেশকে এখন আমরা যেমন দেখি- পাঁচ কি দশ হাজার বছর আগে সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা ঠিক এ রকম ছিল না। থাকা সম্ভবও ছিল না। তার কারণ, বাংলার অর্ধেক ভূখন্ডই তো হিমালয় থেকে উত্থিত হওয়া নদীগুলির পলি পড়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে। আদিম মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য আলোর বিন্দু দেখে বিস্মিত হয়ে রচনা করেছে তাদের মনগড়া কল্পকাহিনী। কিছু আলোর বিন্দুকে ঘুরতে দেখে তাদের নাম দিয়ছে প্লানেট বা ভ্রমনকারী।প্রথম রকেট ব্যবহার হয় চীন দেশে। ১২৩২ খৃস্টাব্দে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দুকের বারুদ পুরে বানানো রকেট ব্যবহার করে চীনারা।আদিম যুগের মানুষেরা এক গুহা থেকে আরেক গুহায় যাওয়ার সময় কখনোই যানবাহন ব্যবহার করত না। তারা হেঁটে হেঁটে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে যেত। আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের পাড় ছিল ঢাকার শ্যামলীর আদাবরের কাছে!বুনো যুগের বৈশিষ্ট্য হল আগুনের আবিস্কার, তীর ধনুক দিয়ে শিকার করা ও মৃৎশিল্পের ব্যবহার। বর্বর পর্যায়ে আদিম মানুষ পশুপালন করতে শেখে, কৃষিকাজও শুরু হয় এই পর্যায়েই। সেই সঙ্গে ধাতু শিল্পর ব্যবহারও জানে আদিম মানুষ । সভ্যতায় বর্ণমালা ও লেখনিই হয়ে ওঠে সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য।পৃথিবীর আদিমতম সম্পর্কটির নাম ভালোবাসা।মানুষের মন থেকেই ধর্মের জন্ম, ঈশ্বর নামক অদৃশ্য অলীক ব্যক্তিটির গর্ভপাত। তারপরও মানুষ তার অ-মানুষ স্তর থেকে মানুষের অবস্থায় বিবর্তিত হওয়ার কালে কেন বা কি করে ধার্মিক হয়ে উঠলো এবং আজ পর্যন্তই বা কেন ধর্মবিশ্বাসকে আগলে রেখেছে।তীর ধনুক আদিমযুগের মানুষের জীবন রক্ষার একমাত্র অবলম্বন বললে বোধ হয় ভুল হবে না। ধারনা করা হয় যে, পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় পূর্বে তীরধনুকের প্রচলন ঘটেছিল। আদিমযুগের মানুষ বিভিন্ন গুহা, পাহাড়-পর্বত ও বনজঙ্গলে থাকতো। তাই বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হতো। এই বাঁচার তাগিদেই মানুষ আবিস্কার করলো তীর ধনুক।মিশরের প্রাচীন অস্ত্রের তালিকায় ছিল এই তীর ধনুক। গ্রীক পুরানে যে সব দেব-দেবীদে যেমন বন্যপ্রাণী ও মিকারের দেবী আর্টেমিসদের কথা আছে, তাদের অনেকেই তীরধনুক ব্যবহার করেন। ভারতবর্ষে দুই মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারতে তীর ধনুকের ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো।আদিম যুগে মানুষ শীত থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় জানত না। কারণ উদোম শরীরে সারাদিন বনে বনে সংগ্রহে ঘুরে বেড়াত। প্রচণ্ড শীতে ঠাণ্ডা পাথরের গুহাভ্যন্তরে জড়ো হয়ে কোনোরকমে কষ্টের রাতগুলো কাটাত! বস্ত্র তৈরি তো দূরের কথা কোনো কিছু চাপা দিয়ে দীর্ঘ শীতের রাত কাটানোর মতো উপকরণও তাদের হাতের কাছে ছিল না। এমনই অসহায়ভাবে বছরের পর বছর কাটানোর পর তারা পা দিল নতুন প্রস্তর যুগে। এবার তারা পাথর কেটে কেটে সুতীক্ষ্ন অস্ত্র তৈরি করতে শিখল। সদ্য তৈরি পাথরের অস্ত্র নিয়ে এবার বন্য পশুর পেছনে ছুটে বেড়াতে লাগল। আয়ত্ত করল পশুশিকার পদ্ধতি। মৃত পশুকে তারা এবার দুভাবে ব্যবহার করতে শিখল। তাদের কাঁচা মাংসে উদরপূর্তি আর লোমশ চামড়ায় নিবারণ করত ঠাণ্ডা। প্রথমদিকে চামড়াকে কোনো রকমে গায়ে জড়িয়ে শীত মোকাবিলার চেষ্টা করত। তারপর পশুর চামড়াকে পোশাকের মতো করে নিল। এটি গায়ে জড়িয়ে শিকারের পেছনে অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করতে তখন আর তেমন অসুবিধা হতো না। আরও সহজ উপায়ে তারা নলখাগড়া, শন এবং গাছের তন্তু দিয়ে পোশাক তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করল। পৃথিবীতে কত ভাষা আছে? তিন হাজার না তার চেয়ে বেশি? পৃথিবীর এই হাজার হাজার ভাষা আর তাদের অসংখ্য উপভাষাগুলোর উদ্ভব কি একটি আদিম ভাষা থেকে? ওইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা কোনগুলো, তাদের বয়স কত, কোন আদিম ভাষা কখন কোন অঞ্চলে কোন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল? এসব প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর আমরা দিতে পারব না, কারণ অনেক অনুসন্ধান করেও সব কথা জানা যায়নি। কত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কে জানে? আর তার সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের কত চিন্তা, কত ভাবনা, কত অভিজ্ঞতা? সভ্যতার যেমন উত্থান আছে পতন আছে, ভাষারও হয়তো তেমনি। কিন্তু অনেক সভ্যতা, অনেক জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথচ তাদের ভাষা ধ্বংস হয়ে যায়নি, আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার স্মৃতিকে বহন করে টিকে আছে কোনো কোনো ভাষা, তবে একটি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে একটি জাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সম্রাজ্য হল মৌর্ষ সম্রজ্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্ষ এ সম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের প্রথম সম্রাট। বাংলাদেশে কখন মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে তার সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে আর্যদের বাংলাদেশে আসার আগে অজয় নদের সভ্যতার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।বাংলার আদিম অধিবাসীরা ছিলেন প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। বাংলার আদিম অধিবাসী ছিল অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী।প্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু মহাভারত মানুষের মুখে মুখে আসেনি। মহাভারতের ঘটনাটা আনুমানিক সারে তিন হাজার বছরের আগেরকার__ কৃষ্ণের সময়কার। মহাভারত ও রামায়নে তার উল্লেখ আছে, তা বাল্মীকি রামায়নের নয়, তৎকালীন প্রচলিত রামায়নের গল্প সমন্ধে যা মানুষের মুখে মুখে চলতো।বাল্মীকির রামায়নে রাম দেবী দুর্গার পুজা করেছেন এক'শ আটটা নীলকমল দিয়ে। ৩০ হাজার বছরেরও আগে থেকে কুকুর মানুষের সবচেয়ে সহচর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।ভেড়া গরু বা ছাগলের মতো প্রাণীদের চেয়ে অনেক অনেক আগে থেকে কুকুর ছিল গৃহপালিত প্রাণী।প্রাচীনকালেও আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের রক্ষা ও সঙ্গী হিসেবে কুকুরকেই পছন্দ করতেন। কুকুরই ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।
false
rn
রাস্তায় পাওয়া ডায়েরী থেকে- ২৯ আমি মনে করি রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলো জ্ঞানের ভান্ডার। একটা চায়ের দোকানে নানান রকম মানুষ আসে- তারা চা খেতে খেতে নানান রকম গল্প করে, সেই গল্প থেকে অনেক কিছু জানা যায়। আমি নিয়মিত রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলোতে যাই। চা খাই আর আশে পাশের লোকজনদের কথা গুলো খুব মন দিয়ে শুনি। কত রকম বিষয় নিয়ে যে আলোচনা হয়- তা চায়ের দোকানে না গেলে বুঝা সম্ভব নয়। ইদানিং হরতাল আর অবরোধের কারনে রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলো পুলিশ খুলতে দেয় না। যাই হোক, গ্রামের চায়ের দোকান গুলো আরো বেশী আনন্দের। তবে এখনকার গ্রামের চায়ের দোকান গুলোতে সারাদিন সিডিতে বাংলা সিনেমা চলতে থাকে। বেশীর ভাগ সিনেমা গুলোর ডায়লোগ'ই খুবই নোংরা এবং নাচ গান গুলো খুবই অশালীন। এক সময় আমার খুব ইচ্ছা ছিল- বড় করে একটা চায়ের দোকান দিবো। সারাদিন দুনিয়ার মানুষজন এসে আমার দোকানে চা খাবে-গল্প করবে। আর আমি খুব মন দিয়ে তাদের গল্প শুনব। এই ইচ্ছাটা আমার এখনও আছে। সেদিন সন্ধ্যায় বড় ভাইয়ের মেয়ে রোজাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছি। রোজা আমার গলা জড়িয়ে ধরে নানান গল্প করছে। রাস্তায় বের হলেই রোজা অনেক খুশি। রাস্তারা সব কিছুই তার ভালো লাগে। যদি রাস্তা দিয়ে একটা ভিক্ষুকও হেঁটে যায়- সে এক আকাশ বিস্ময় ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে থাকয়াবে। মাঝে মাঝে আমি চায়ে খেতে গেলে রোজাকে কোলে করে নিয়ে যাই। চায়ের দোকানের মালিক জোর করে রোজার হাতে বিস্কুট- রুটি কলা দিয়ে দেয়। রোজা এক কামড় মুখে দিয়ে ফেলে দেয়। এদিকে রোজার মা বাইরের সব ধরনের খাবার রোজার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। তো সেদিন, চা শেষ করে ফুটপাত ধরে বাসায় ফিরছি। হঠাত রাস্তার মাঝখানে পর-পর তিনটা ককটেল ফাটল। মুহূর্তের মধ্যে দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তা খালি হয়ে গেল। আমি কোনো রকমে রোজাকে ঝাপটে ধরে গলির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। রোজা প্রচন্ড ভয় পেয়ে হাট দিয়ে দুই কান ঢেকে রাখে। আল্লাহকে ধন্যবাদ সেদিন একটা ককটেল আমাদের গায়ে এসে পড়েনি। খিলগা ওভার ব্রীজের কাছে একটা চায়ের দোকান আছে। আমার খুব প্রিয় একটা চায়ের দোকান। চা-টা দারুন বানায়। এক কাপ চা খেলেই- মনটা আনন্দে ভরে উঠে। সেদিন দুপুরবেলা আরাম করে চা খাচ্ছি- এমন সময় পাঁচ সাতজন পুলিশ এসে উপস্থিত। একজন পুলিশ চায়ের দোকানদারকে খুব বাজে কয়েকটা গালি দিল। আমি মাত্র চায়ে প্রথম চুমুক দিবো, এমন সময় একটা পুলিশ ধমক দিয়ে বলল- চায়ের কাপ রাখেন। আমি বললাম কেন? পুলিশ বলল- রাখতে বলেছি রাখেন, চেক করবো। আমি বললাম- চা-টা শেষ করে নিই, ঠান্ডা হয়ে যাবে তো! পুলিশ চোখ মুখ খিচিয়ে বলল- আপনার কাজ আগে না আমাদের কাজ আগে? একটা পুলিশ আমার হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিল। কিছু গরম চা ছিটকে এসে আমার হাতে পড়ল। পুলিশ আমাকে চেক করে পিস্তল, ছুরি বা ককটেল কিছুই পেল না। এর মধ্যে একজন পুলিশ আমার ম্যানিব্যাগ তন্ন তন্ন করে কি যেন খুজছে। যেন আমি ম্যানিব্যাগে গ্রেনেড লুকিয়ে রেখেছি। হঠাত করে একজন পুলিশ তুই করে বলতে শুরু করলো- তুই কই থাকস? কি করস? অপরিচিত মানুষ তুই করে বললে খুব রাগ হয় আমার। ইচ্ছা করলো একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। এই হরতাল, অবরোধ, গাড়ি বাসে আগুন দেওয়া, গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করা, পিটিয়ে-কুপিয়ে- আগুন দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা- এইসব কবে বন্ধ হবে। দিনের পর দিন- আর ভাল্লাগে না। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই খারাপ কাজ গুলো যারা করে মনে মনে তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করি প্রতিদিন। দেশের মানুষকে কষ্ট দিয়ে রাজনীতিবিদরা কেমন রাজনীতি করেন? আজিব!! আমি কোনো দল করি না। হাসিনা খালেদা কেউই ভালো না। আমার ক্ষমতা থাকলে এই দুইজনকে জোর করে অবসর করাতাম। কারন তাদের রাজনীতির মধ্যে দেশের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় ক্ষমতার প্রতি লোভ। খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে টিভিতে খবর দেখাও ছেড়ে দিতে হবে। সব গুলো চ্যানেলই ভন্ড-বদমাইশ। নিরপেক্ষ খবর কেউ প্রচার করে না। ( টক শো গুলো তো- মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়।) মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই দেশটা ছেড়ে ইউরোপের কোনো দেশে চলে যাই। বাকিটা জীবন সুখে শান্তিতে বাস করি। সমস্যা হচ্ছে- এইদেশটাকে আমি অনেক ভালোবাসি। খুব বেশী ভালোবাসি। বেশ কয়েক বছর আগে- একবার তাড়াহুড়া করে পাসপোর্ট ভিসা রে্ডী করলাম মালোশিয়া চলে যাব। প্লেনে ওঠার দুই দিন আগে- ভাবলাম, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। না। নো নেভার। একজন ধনী ব্যক্তি তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে গেল। তারা কয়েকদিন গ্রামে থাকলো, গ্রামের গরীব মানুষদের সাথে পরিচিত হল। ফেরার পথে ছোট ছেলেটার বাবা তাকে বলল, “দেখেছো গ্রামের মানুষ কত গরীব?? কি শিখলে তুমি তাদের দেখে?” ছেলেটা বলল, “আমাদের একটা কুকুর আছে, ওদের আছে পাঁচটা; আমাদের সুইমিং পুল আছে, ওদের আছে নদী; আমাদের আছে ডিম লাইট রাতে ঘুমানোর জন্য, ওদের আছে তাঁরা; আমাদের সুরক্ষার জন্য আছে দেয়াল, ওদের আছে বন্ধু;আমরা খাবার কিনে খাই; ওরা নিজেরা উৎপন্ন করে; আমরা টাকা দিয়ে মানুষের সাহায্য পাই, ওরা পায় বিনামুল্যে।বাবা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমরা কতটা গরীব সেটা আমকে দেখানর জন্য।”শুধু টাকা থাকলেই মানুষ ধনী হয় না, প্রকৃত ধনী সেই যে জীবনটাকে সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পারে।
false
hm
চণ্ডীশিরা: প্রথম পর্ব রবির কথা ১. ইউনি বন্ধ। রাতে একটু দেরিতে ঘুমাই। এক বাক্স ডিভিডি নিয়ে এসেছি হাফিজের কাছ থেকে, রাত জেগে সিনেমা দেখি। কালকে দেখলাম লেট দ্য রাইট ওয়ান ইন। গায়ের লোম বসার চান্সই পাচ্ছিলো না। ইচ্ছা ছিলো বেলা একটার দিকে ঘুম থেকে উঠে একেবারে দুপুরের খাবার খাবো, গোসল না করেই। বিলু ছাগলটা সেই ইচ্ছার গোড়ায় পানি ঢেলে দিলো সকাল আটটার দিকে। তিন ঘন্টা ঘুমানোর পর কোনো পাষণ্ড এসে একটা মানুষকে জাগিয়ে তুললে সেই ব্যাটা পাষণ্ডকে গুলি করে মারা উচিত। মোবাইল হাতে নিয়ে মনে মনে একটা ঝাড়ি তৈরি করছিলাম। বিলু, ইউ ইডিয়েট, জন্ডিসরোগী বলদ, কী চাস তুই এই সাত সকালে? কোনো কথা শুনতে চাই না শালা, তোর বাপ মরলেও আমার কিছু করার নাই। গো অ্যান্ড রট ইন হেল। বিলু ফোনের ওপাশ থেকে ইমার্জেন্সি ইমার্জেন্সি গলায় বললো, "রবি, জলদি বাসায় আয়। আমি একলা ম্যানেজ করতে পারছি না, তোকে দরকার। কুইক।" জন্ডিসরোগী বলদ পর্যন্ত যেতে পারলাম, বিলু ওপাশ থেকে ফিনাইলের গন্ধ ছড়িয়ে দিলো আমার ঘরে, "দোস্ত, বাবা মনে হয় মারা গেছে। তুই আয়। নাফিসা আর জয়াকেও ডাক।" ফোন কেটে গেলো, থতমত খেয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। খাইসে, সত্যি সত্যিই বিলুর বাবা মারা গেছেন? যদি তাই হয়ে থাকে, ও "মনে হয়" বলছে কেন? মারা গেছেন নাকি মারা যান নাই? নাকি মারা যাওয়ার পথে? বিশ্ববিদ্যালয় যখন বন্ধ থাকে, সকাল আটটা বাজে কাজের ছেলেটাও ঘুমায়। তাকে সাড়ে আটটার দিকে বহু কষ্টে ঠেলেঠুলে তুলতে হয়। বাবা অফিসে গিয়ে নাস্তা করে বহুদিন ধরে, মা-ও আমার তাড়া না থাকলে দেরিতে ওঠে। আমার গোটা দুনিয়া এখন ঘুমাতে চাইছে, শুধু বিলুর বাবাটা বোকার মতো মরে গিয়ে সব কিছু পয়মাল করে দিলেন। বহুকষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে টলতে টলতে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত গেলাম। ওখানেই তোষক পেতে ঘুমায় একরাম। গিয়ে দেখি সে হাসিহাসি মুখে ফোঁসফোঁস করে ঘুমাচ্ছে। রাত একটা পর্যন্ত জেগে টিভিতে টক শো দ্যাখে হতভাগা। "একরাম! পাছা তোলো মহারাজ! এককাপ চা দিও আমাকে! কুইক কুইক!" একটা ছোটোখাটো হুঙ্কার দিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেলাম। কষ্ট করে হলেও হাগতে হবে। নাহলে আজকে সারাদিনে আর পেট সাফা করার সুযোগ না-ও মিলতে পারে। বিলুর বাড়িতে নিশ্চয়ই প্রচুর কাজ। কেউ মারা গেলে কী করতে হয়, পরিষ্কার ধারণা নেই আমার। লাশের গোসল দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়, জানাজা পড়তে হয়, তারপর লাশ নিয়ে গোরস্থানে রওনা দিতে হয়। কাফনের কাপড়, খাটিয়া এইসব ম্যানেজ করতে হয়। আগরবাতিও কিনতে হবে। আর কিছু কি বাদ পড়ে গ্যালো? বিলুর বদমেজাজী হোঁৎকা মামাটা কি গাইড করতে পারবে না? না পারলে এই ব্যাপারে এক্সপার্ট কাউকে তলব করতে হবে। কিন্তু বিলু কেন বললো, ওর "মনে হয়" ওর বাবা মারা গেছে? বিলুরা থাকে মোহাম্মদপুর, আর শেষবিদায় স্টোরগুলি সব কাঁটাবনে। মোহাম্মদপুর থেকে কাঁটাবনে গিয়ে সদাই করে ফিরতে ফিরতেই তো বিলুর বাবার লাশ পঁচে গন্ধ ছুটবে। ফিনাইল ... ফিনাইলও কিনতে হবে। কিন্তু লাশটা এখন কোথায়? নাফিসা আর জয়াকেই বা ডাকলো কেন বিলু? ওরা গিয়ে কী করবে? কোনো খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার আছে নাকি? নাম্বার টু করতে গেলে বুদ্ধি খুলে যায় সবারই। নিউটন আপেল গাছের নিচে বসে মহাকর্ষ আবিষ্কার করে ফেলেছে বলে সকলেই কত কথা বলে, কিন্তু নিউটন বাবাজি আপেল গাছের নিচে কী করতে বসেছিলেন, সে ব্যাপারে সব কুতুবই নীরব। নিউটনের আমলে বাড়িঘরের ভেতরে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা যে অতিশয় জঘন্য ছিলো সে তো জানা কথা। খোলা আকাশের নিচে দখিনা বাতাসে দুদণ্ড ইয়ে করতে গিয়েই যে নিউটন টের পেলেন, কিছু জিনিস সবসময়ই নিচের দিকে নামে, সেটা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। কেন রে ভাই? নিউটন বলে কি মানুষ নয়? "একরাম! চা হলো?" আরেকটা হাঁক দিয়ে একরামের কাজেকর্মে একটু গতি আনার চেষ্টা করি। মা শোবার ঘর থেকে পাল্টা হাঁক ছাড়ে বিরক্ত হয়ে, "কী হলো? সাত সকালে চিল্লাচ্ছিস কেন গরুর মতো?" "পরিস্থিতি ভালো না মা!" ফ্লাশ করে বেসিনের ট্যাপ খুলি। "বিলুর বাবা মনে হয় মারা গেছেন!" মা একটু চুপ করে যায়। আমি হাত ধুয়ে ব্রাশে পেস্ট মাখাই। মা উঠে এসে বলেন, "মনে হয় মানে কী? মারা গেছেন নাকি হাসপাতালে আছেন?" আমি দাঁত মাজতে মাজতেই হাসি। "জানি না মা। বিলু যা বললো, সেটাই রিপিট করলাম। হাসপাতালেই আছেন মনে হয়। আজকাল হাসপাতালে কেউ গেলে আর জীবিত ফেরে না।" মা বললেন, "আমি ফোন করছি দাঁড়া।" আমি ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ দাঁত মেজে যাই। আমি নিশ্চিত, ফোনটা বিলুই ধরবে, ধরে একই কথা বলবে। "হ্যাঁ আন্টি, বাবা মনে হয় মারা গেছেন। হ্যাঁ আন্টি, আমি মনে হয় রবিকে আসতে বলেছিলাম। হ্যাঁ আন্টি, সূর্য মনে হয় পূর্ব দিকেই ওঠে। হ্যাঁ আন্টি, আমি মনে হয় একটা আপাদমস্তক বোকাচ্চো--।" জিভ কেটে কুলকুচি করি। মা এসে দরজায় ধাক্কা দিলো, "য়্যাই, বিলু তোকে জলদি যেতে বলছে। ওর বাবা মনে হয় মারা গেছেন!" মুখ ধুতে ধুতে বললাম, "জানি মা। আমাকে মনে হয় যেতে হবে। আর একরামকে মনে হয় চা বানাতে বলেছিলাম। " মা গজগজ করতে থাকে, কী নিয়ে কে জানে! ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দেখি একরাম চোখ ডলতে ডলতে মাত্র রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। ব্যাটা টক শো দেখে দেখে বিরাট বুদ্ধিজীবী হয়ে গেছে। সেদিন রাতে টিভি বন্ধ করে চোখ রাঙিয়ে তাকে শুতে যেতে বললাম, ব্যাটা মুখ কালো করে বলে, দাদা, দ্যাশে মনে হয় আবার একখান সাংবিধানিক সংকট লাগতে আছে! ... রোসো বেআক্কেল, সাংবিধানিক সংকট তোমার ইয়ে দিয়ে ... "কী রে একরাম, চা দিবি কি না বল!" "আইতে আছে!" একরাম হেঁড়ে গলায় বলে। এহ, চা তো না, মালগাড়ির ইনজিন, আইতে আছে! ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পরতে পরতে নাফিসাকে ফোন দিলাম। নাফিসার এখন টার্মের শেষ দিক, হাবিজাবি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। সেও বোধহয় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমার পিলে কাঁপিয়ে ফোন ধরলেন নাফিসার মা। "হেলু, হেলু, হেলু, হেলু ...!" "আন্টি, আসসালামু আলাইকুম!" যতটুকু সম্ভব তাজিমের সাথে বললাম। "আমি রবি, নাফিসার বন্ধু। নাফিসা কি আছে?" আন্টি এইবার বরফের মতো গলায় বললেন, "কুন রবি?" একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। কীভাবে বোঝাই কোন রবি? নাফিসার কয়টা বন্ধু আছে রবি নামে? "ইয়ে, আন্টি, আমি ওর বন্ধু রবি। ইকোনমিক্সে পড়ি ...।" আন্টি এইবার খোদ অ্যান্টার্কটিকার কিনারা থেকে বরফ আমদানি করেন, যেমন ঠাণ্ডা তেমন চোখা, "তুমরা এই ইয়ারদুস্তরা মিল্লা নাফিসার পড়াশুনা সব গুল্লায় ফালাইতেছ! তুমাদের জন্যি নাফিসা কেলাশ টেষ্টে দশে দুই পায়! তুমরা আমার মাইয়াটারে আর কত জ্বালাইবা? ঢাকা শহরে কি জ্বালানির জন্যি আর কুন মাইয়া চিন না তুমরা?" এ কী হুজ্জতে পড়লাম! নাফিসার মোবাইল আন্টির হাতে ক্যান গেলো, ক্যান ক্যান ক্যান? তাহলে কি নাফিসাও টয়লেটে, বিলুর বাসায় যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে? আর ক্লাস টেস্টে ও দশে দুই পায় এইটা কি আমার দোষ? মিনমিন করে বলি, "সরি আন্টি, এখন থেকে নাফিসাকে বেশি বেশি করে পড়তে বলবো, ফোনটা একটু দিবেন?" আন্টি অ্যান্টার্কটিকার প্রান্ত থেকে ক্রমশ মেরুর দিকে এগোতে থাকেন, যেখানে বরফ আরো বেশি ঠাণ্ডা, শক্ত, আর জোরালো ঝোড়ো হাওয়াবাতাসও চালায়। "তুমার মা কুথায়?" এইবার ফোন রেখে দিই। নাফিসার মা যদি আমার মাকে চিবি দিয়ে ধরেন, ক্যান নাফিসা ক্লাস টেস্টে দশে দুই পেলো? মা কী বলবে? থাক বাবা, নাফিসা জাহান্নামে যাক। জ্বালানির জন্যি ঢাকা শহরে এখন বাকি থাকে জয়া। জয়া ফোন ধরার পর তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে বলে মনে হয়, যে কখনও মায়ের কিংবা বাপের কব্জায় ফোন রেখে যায় না। জয়ার বাপটা আবার বিরাট মাসলম্যান, সকালবেলা খালি গায়ে ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়ামট্যায়াম করে, পানিতে ভিজিয়ে আদাকুচি দিয়ে বুট খায়, কোনো কারণে জয়া ক্লাস টেস্টে দশে দুই পেলে তো সেই লোক বাড়িতে এসে পিটিয়ে লম্বা করে দিয়ে যাবে। "কী রে, তুই এত সকালে কী চাস?" জয়া হাই তুলতে তুলতে বলে। "বিলুর বাবা মনে হয় মারা গেছেন।" আমি বেশি ভূমিকা করি না। "বিলুদের বাসায় যেতে হবে।" জয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, "মনে হয় মারা গেছেন? তুই শিওর না? হাসপাতালে নাকি?" আমি বললাম, "বিলু যা বললো, আমি সেটাই জানালাম। ওর কাছে মনে হচ্ছে ওর বাবা মারা গেছে, কিন্তু বিস্তারিত কিছুই জানি না। তুই আর নাফিসা চলে যা বিলুর বাসায়, আমি আসছি।" জয়া জিভ দিয়ে ছিক শব্দ করে বললো, "এহ, একটু সমস্যা আছে। নাফিসাকে ফোন করা বারণ। ওর মা ওর ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে। নেটের লাইনও কেটে দিয়েছে মনে হয়। ও এখন পুরাই বন্দী মুরগি। ভুলেও ফোন করিস না।" একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো না চাইতেই। "টু লেইট। তোকে ফোন করার আগেই আমার উপর দিয়ে এক রাউণ্ড গেছে। নাফিসা নাকি ক্লাস টেস্টে দশে দুই পেয়েছে। আমি যদি আগে জানতাম ঐটা আমার দোষ, তাহলে ...।" "আচ্ছা তুই যা। আমিও যাচ্ছি। বাই।" জয়া খট করে ফোন কেটে দেয়। মনে হয় ওর মুশকো বাপ এসে তদন্ত করছে, ঘটনা কী। ডাইনিং রুমে এসে দেখি একরাম চায়ের কাপ পিরিচ দিয়ে ঢেকে টেবিলের পাশে মেঝেতে বসে পেপার পড়ছে। আমাকে দেখে সে বললো, "দাদা, চা! দ্যাশের অবস্থা খুব খারাব গো দাদা, আইজকা মৌলভিবাজারে দুইখান গলাকাডা লাশ পাওয়া গেছে!" চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো, সেটা হচ্ছে, এই দুইটার একটা আবার বিলুর বাবার লাশ না তো? বিলুকে আমরা সবাই কমবেশি খুব ভালোবাসি, ও আমার স্কুলের বন্ধু, কিন্তু ওর বাবাকে কখনও দেখিনি। ভদ্রলোক সিলেটের দিকে কোনো এক গ্রামে একা একা থাকেন। বিলুর মা আর বিলু থাকে বিলুদের নানাবাড়িতে। আন্টি খুবই মিষ্টি একজন মানুষ, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাষণ্ডটাও হয়তো আন্টিকে আর বিলুকে ফেলে রেখে একা জঙ্গলে পড়ে থাকতে চাইবে না, কিন্তু বিলুর বাবা এই কাজটা বহু বছর ধরে করে আসছেন। চার পাঁচ বছর পর পর তিনি একবার করে শ্বশুরবাড়িতে হাজিরা দেন, দু'তিনদিন থেকে আবার ফিরে যান নিজের গ্রামের বাড়িতে। বিলু একবারই তার বাবাকে দেখতে গিয়েছিলো, ফিরে এসে চোখ বড়বড় করে বলেছিলো, খুব ভয়ঙ্কর জায়গা রে, বাপরে বাপ, বাবা কী করে থাকে ওখানে! বিলুর বাবার একটা ছবি আছে ওদের ঘরে, সেটাতে একজন লম্বা, রোগা, চশমাপরা হাসিখুশি মানুষকে আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবা কী করে, বিলু মিনমিন করে বলে, উনি ডাক্তার, কিন্তু আমার কাছে এসে একদিন বিলু নিচু গলায় বলেছিলো, আই থিঙ্ক হি ইজ আ উইচ ডক্টর! চায়ের কাপটা শেষ করে হাঁক ছেড়ে বলি, "মা গেলাম!" মা শোবার ঘর থেকে বলেন, "দুপুরে খেয়ে নিস কিছু। ওদের বাড়িতে কিন্তু রান্নাবান্নার হাঙ্গামা হবে না। অবস্থা বেশি খারাপ দেখলে ফোন করে দিস, আমি দরকার হলে কিছু রেঁধে পাঠিয়ে দেবো নাহয়।" আমি মানিব্যাগ বার করে ভেতরের গ্লোবাল ইকোনমিক ক্রাইসিসের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে ভাবলাম, মা বিলুর মাকে মোটেও চেনেন না। আমি ঠিক জানি, গিয়ে দেখবো, আন্টি শান্ত মুখে এক কাপ চা আর পিরিচভর্তি ফ্রুট কেক নিয়ে এসে বলছেন, "কেমন আছো রবি? মা ভালো আছেন? বাবা?" ২. "জ্বি আন্টি, মা ভালো আছেন। বাবাও ভালো।" আমি শুকনো মুখে একটা কেক তুলে কামড় দিলাম। ভেবেছিলাম গোটা বাড়ি ভর্তি লোকজন গিজগিজ করবে, কিন্তু আমি আর অচেনা এক ভদ্রলোক ছাড়া কাউকেই দেখলাম না। ভদ্রলোক বেশ অস্থির হয়ে আছেন, ঘন ঘন এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বসছেন, গলা খাঁকরাচ্ছেন, বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন, আর মাঝেমধ্যে চমকে উঠে চায়ের কাপে ফড়াৎ করে চুমুক দিয়ে বলছেন, আহ! আন্টিকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আন্টিকে মাঝেমধ্যে বিষণ্ণ মুখে দেখেছি বটে, কিন্তু আজ দেখে মনে হলো, উনি একা একা বেশ কিছুক্ষণ কেঁদেছেন, চোখের নিচে কালো ছাপ পড়ে গেছে। কোথায় কোন পাহাড়ের জঙ্গলে বছরের পর বছর হাপিস হয়ে থাকেন বিলুর বাবা, কিন্তু আন্টি ঠিকই হয়তো খুব ভালোবাসেন তাঁকে। বিলু টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো, তার চেহারা নির্বিকার। আমাকে দেখে বললো, "কী রে, নাফিসা আর জয়া কই?" আমি সংক্ষেপে শুধু বললাম, "আসবে। কী অবস্থা তোর?" বিলু ধপ করে সোফায় বসে পড়ে হাতে মুখ ঘষে বললো, "অবস্থা ভালো না। অ্যাপারেন্টলি, বাবা আর বেঁচে নেই।" আন্টি পাশের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, "অ্যাপারেন্টলি নয় বিলু, তোমার বাবা আর বেঁচে নেই।" আমি ফিসফিস করে বললাম, "কী হয়েছে?" বিলু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে বললো, "মমম ... উইয়ার্ড স্টাফ। মন দিয়ে শোন। আজ ভোরবেলা আমাদের বাসায় ... একটা পার্সেল আর একটা চিঠি এসেছে। পার্সেলটাতে কী আছে আমি এখনও জানি না, চিঠিটাতে কী আছে সেটাও মা আমাকে সব খুলে বলছে না। কিন্তু চিঠিটা বাবার লেখা। চিঠির বক্তব্য আমি পুরোটা জানি না, কিন্তু মা বলছে, একমাত্র যদি বাবা মারা যায়, তবেই এ চিঠিটা ডেলিভার করা হয়ে থাকবে।" আমি ঘাবড়ে গিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম, "কে পাঠিয়েছে চিঠি ... আর পার্সেল?" বিলু আড়চোখে অচেনা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো, "এটা হচ্ছে মোস্ট উইয়ার্ড পার্ট। চিঠি আর পার্সেল মায়ের ঘরের টেবিলের ওপর রেখে গেছে কেউ।" আমি এত চমকে উঠলাম যে আমার হাত থেকে চা ছলকে পড়লো ডাইনিং টেবিলের ওপর। "মানে?!" বিলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, "আমি জানি না দোস্ত ... ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, মায়ের ঘরে বাইরের কারো পক্ষে দরজা বা জানালা না ভেঙে ঢোকা সম্ভব না।" আন্টি পাশের ঘর থেকে বললেন, "বিলু, রবিকে আমার ঘরটা দেখিয়ে নিয়ে এসো।" বিলু চোখের ইশারায় আমাকে আন্টির ঘরের দিকে যেতে বললো। আমি কড়া এক চুমুকে চায়ের কাপের বাকিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম, অচেনা ভদ্রলোক রক্তচক্ষু মেলে আমার দিকে তাকিয়ে নিজের কাপে একটা নিঃশব্দ চুমুক দিলেন, বাবা রে বাবা, পুরাই সাইলেন্সার লাগানো চিতাবাঘ! আন্টির শোবার ঘরে ঢোকার পর কেন যেন প্রবল অস্বস্তিতে শরীরটা কুঁকড়ে গেলো। কয়েক সেকেণ্ড পর ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। একটা খুব মৃদু চামড়াপোড়া গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরে। গন্ধটা পুরোপুরি পোড়া চামড়ারও নয়, কিন্তু চট করে মাথা ধরিয়ে দেয়। বিলু আমার নাকের দিকেই তাকিয়ে ছিলো, আমার প্রতিক্রিয়া দেখে ফিসফিস করে বললো, "কোনো বিদঘুটে গন্ধ পাচ্ছিস?" আমি মাথা ঝাঁকালাম। "হ!" বিলুর মুখটা একটু পাংশু হয়ে গেলো, ও এবার ঘরের এক কোণার দিকে আঙুল তুলে বললো, "ওখানে দ্যাখ।" আমি একটু এগিয়ে গিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম আবার। ঘরের মেঝেটা মোজাইক করা, কিন্তু গাঢ় কালো রঙে সেখানে কেউ একটা ঢ্যাঁড়া কেটে রেখে গেছে। একটা মোটা কালো দাগের ওপর কোণাকুণি কাটা একটা সরু কালো দাগ। এবং নিশ্চিতভাবেই গন্ধটা আসছে এই ঢ্যাঁড়া থেকেই, কাছে যেতেই একটু তীব্র হয়ে উঠেছে সেটা। "কী এটা?" ফিসফিস করে জানতে চাইলাম। বিলু মাথা চুলকে বললো, "আমি ঠিক শিওর না ... সম্ভবত অ্যাটেনড্যান্স শিট সাইন করে যাওয়ার মতো একটা কিছু।" "মানে?" বুঝলাম না আগামাথা কিছুই। "কীসের অ্যাটেনড্যান্স শিট?" বিলু চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, "কেউ একজন ... বা কিছু একটা ... মায়ের ঘরে এই পার্সেল আর চিঠিটা রেখে গেছে। যাওয়ার আগে একটা সিগনেচার রেখে গেছে, যে সে এসেছিলো, কিংবা যে কাজ করতে এসেছিলো, সেটা করে গেছে।" আমি কিছুই ধরতে পারলাম না, বোকার মতো কিছুক্ষণ ক্রসচিহ্নটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, "তোদের বাড়িতে ভোরবেলা কাউকে না জাগিয়ে ঘরে ঢুকে এরকম একটা বিশ্রী দাগ কেটে যাওয়া কি সম্ভব? তোর মামার না লাইসেন্স করা বন্দুক আছে?" বিলুর দাঁত আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো। বাইরের ঘরে শুনতে পেলাম, আন্টি বলছেন, "বাদল, আমি বিলুকে নিয়ে হবিগঞ্জ যাবো রে, তোর গাড়িটা দিতে পারবি আজকের জন্যে?" অচেনা ভদ্রলোকের গলা শুনতে পেলাম, একেবারে তীক্ষ্ণ স্বর, "বুবু, গাড়ি আর ড্রাইভার নিচে তৈরি আছে। তেলটা শুধু নিয়ে নিতে হবে পথে কোথাও থেকে।" বিলু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "নাফিসা আর জয়া আসবে কখন? একটু পরই তো রওনা দিতে হবে।" আমি বললাম, "কখন যাচ্ছিস তোরা?" বিলু আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ""তোরা" না, বল "আমরা"। আমরা সবাই যাচ্ছি।" আমি থতমত খেয়ে বললাম, "আমরা মানে?" বিলু এক নিঃশ্বাসে বললো, "আমরা মানে মা আমি তুই নাফিসা জয়া। হবিগঞ্জে বাবার ঐ ক্যাসলটাতে যাবো। ওখানে আমি আর মা একা একা গিয়ে সব ম্যানেজ করতে পারবো না, তোদের হেল্প লাগবে না?" আমি আকাশ থেকে পড়লাম, "তাহলে আগে বলবি না বেকুব? জামাকাপড় নিতে হবে না? আগে বললে ব্যাগ গুছিয়ে আসতাম ...।" বিলু কেমন যেন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "সমস্যা নেই। ওখানে গেলে এসবের কোনো অভাব হবে না।" বিলুর কথার অর্থ আমি ধরতে না পারলেও ওকে আর ঘাঁটালাম না, আমার নিজের মেজাজটাই চড়ে আছে। হবিগঞ্জ যেতে হবে জানলে ল্যাপটপটা সাথে করে আনতাম অন্তত। ঐ জঙ্গলে অবশ্য ইলেকট্রিসিটি আছে কি না কে জানে? বিলু বললো, "নাফিসাকে জানিয়েছিস? জয়াকে?" আমি বললাম, "জয়া আসবে বললো। আর নাফিসার ফোন নাফিসার মা ধরেছে। এমন ঝাড়ি দিলো, কী বলবো। নাফিসা ক্যান ক্লাস টেস্টে দশে দুই পেলো, সেই কৈফিয়ত চেয়ে বসলেন ...।" বিলু চোখমুখ কুঁচকে বললো, "স্ট্রেইঞ্জ!" আমি বললাম, "স্ট্রেইঞ্জার দ্যান ফিকশন দোস্ত। কখনও শুনেছিস এমন ঝাড়ি?" বিলু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "ইন ফ্যাক্ট, সেইম ঝাড়িই উনি আমাকে দিয়েছেন, যখন সকালে তোকে ফোন করার আগে নাফিসাকে কল দিয়েছিলাম। আজব না?" আমি বিলুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। শালা বলদ বলে কী? ও নিজে ঝাড়ি খেয়েও আমাকে ঝাড়ির মুখে পাঠালো? বিলু বললো, "আমার ধারণা আন্টি ক্লাস সিক্স থেকেই নাফিসার সব বন্ধুকে এই একই ঝাড়ি দিয়ে আসছেন। ওনার কোনো ক্রিয়েটিভ স্কিল নাই। তবে ঝাড়িটায় কাজে দেয়, তোকে স্বীকার করতেই হবে। কাজে দেয় বলেই উনি নতুন কিছু আর ভেবে বার করার ঝামেলায় যান নাই। এনিওয়ে ... একটা জিনিস দ্যাখ ...।" বিলুর পাছায় কষে একটা লাথি মারার ইচ্ছা কোনোমতে দমন করছি, বিলু ওর গেঞ্জির নিচ থেকে আমার দেখা সবচে আজব জিনিসটা বের করলো। একটা মেডেলের মতো দেখতে জিনিস কালো সুতার মতো গিঁট দেয়া একটা কিছুর সাথে বাঁধা। মেডেলটা পুরোপুরি গোল না, ভচকানো। "এটা কী?" আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম। বিলু আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, "এটা হচ্ছে আরেকটা উইয়ার্ড স্টাফ। আজ সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে তুলেই এটা জোর করে পরিয়ে দিয়েছে। খোলা মানা।" আমি বললাম, "এটা কি ... সর্ট অব ... তাবিজ? কিংবা কী যেন বলে, কবচ?" বিলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুধু বললো, "সম্ভবত। কিন্তু একটা জিনিস টেস্ট করা দরকার।" আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিলু মেডেলটা নিজের গলা থেকে খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো, "কোনো গন্ধ পাচ্ছিস?" আমি শুধু টের পেলাম, খুব ধারালো একটা অনুভূতি আমার নাকের ভেতর দিয়ে একেবারে মাথার ভেতর পর্যন্ত বয়ে গেলো। বিশ্রী চামড়াপোড়া গন্ধটা বিলকুল গায়েব। শুধু বিশ্রী গন্ধটাই গায়েব না, একটা মৃদু বুনো ফুলের গন্ধ যেন পাক খাচ্ছে আমার চারপাশে। বিলুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও একমনে চেয়ে আছে আন্টির ঘরের এককোণে রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে। বিলুর মুখটা ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে দেখে আমি এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে আয়নার দিকে তাকালাম, সেখানে দেখার মতো কিছু নেই। পেছন ফিরে বিলুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাগজের মতো সাদা হয়ে উঠেছে ওর মুখ। ঘড়ঘড়ে গলায় বিলু শুধু বললো, "তাবিজটা দে! জলদি!" [দ্বিতীয় পর্ব পরে কোন এক সময় আসবে]
false
mk
হত্যার ষড়যন্ত্রে শফিক রেহমান গ্রেপ্তার সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তাকে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।আজ শনিবার রাতে জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ কথা জানান।শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে সজীব ওয়াজেদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘কত হরহামেশা আপনি এমন কোন লোককে পাবেন যে আপনাকে হত্যার চেষ্টা করছে? আমার ক্ষেত্রে, আপাতদৃষ্টিতে আমার জানার বাইরেও এটা প্রায়শই হচ্ছে। আমি অপরাধী বা কোন খারাপ মানুষও নই যে এমনটা হবে। এটা শুধু এ জন্য ঘটছে যে আমার মা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছেন এবং আমি সময়ে সময়ে তাঁকে সাহায্য করি। এটা এ জন্যও যে আমাদের বিরোধী দল যারা বিশেষত সহিংস অপরাধমূলক কাজে নিমজ্জিত এবং দেশের শীর্ষ মৌলবাদী দল যারা সরাসরি আইএসআইএসের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে জোটভুক্ত।’‘অন্য প্রসঙ্গে আসি। যুক্তরাষ্ট্রে আমাকে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে সিনিয়র সাংবাদিক ও বিএনপি নেতা শফিক রেহমানকে আজ আমাদের সরকার গ্রেপ্তার করেছে। একজন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতার ছেলে, একজন সাবেক এফবিআই এজেন্ট এবং এই দুজনের অন্য একজন আমেরিকান বন্ধু; এরা সবাই এই ষড়যন্ত্রের কারণে সাজা ভোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের প্রেস রিলিজ থেকে আপনি এই মামলার বিষয়ে সরাসরি পড়তে পারবেন। ‘‘খ্যাতিমান’’ অংশটির বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই কিন্তু সেখানে উল্লেখ করা ‘‘বাংলাদেশের নাগরিক’’ হচ্ছি আমি।’‘সাংবাদিক’ শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে প্রমাণাদি সরাসরি এ মামলা থেকে এসেছে। লক্ষ্য করুন, আমি সাংবাদিক শব্দটি উদ্ধৃত করেছি কারণ, যখন আপনি অপহরণ ও হত্যার চেষ্টায় যুক্ত হবেন তখন আমার বিশ্বাস আপনি আপনার পেশার ধরন পরিবর্তন করে সাংবাদিক থেকে অপরাধী হয়ে গিয়েছেন। বিএনপি এসব কাজের জন্য একটি মধ্যবর্তী পেশার কার্যধারা পরিচালনা করে।’প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিক শফিক রেহমানকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে পুলিশ তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। বিচারক আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।এর আগে গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সজীব ওয়াজেদ জয়। dainikamadershomoy সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৫৫
false
rg
পাকিস্তান এখনো ঠিক অসভ্য বর্বর ইতর শ্রেণীতেই রয়ে গেছে!!! একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে আলদা আলাদা দুটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। পাকিস্তানে এই প্রস্তাব পাশ থেকে একটি বিষয় এখন সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এখন চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের এই প্রস্তাবকেও এভিডেন্স হিসেবে সাক্ষ্য প্রমাণে হাজির করা যাবে। অর্থ্যাৎ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে এদেশীয় দোসর হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস নিরীহ বাঙালি জনসাধারণের উপর যে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল, সেই অপরাধের ঘটনাগুলো যে একশোভাগ সত্য ছিল, সেটি এখন পাকিস্তান প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে আসলে স্বীকার-ই করে নিল। যদিও পাকিস্তানের বাংলাদেশের বিষয়ে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং সর্বোচ্চ নিন্দনীয় একটি বিষয়। তবুও পাকিস্তান কার্যত যে এখনো জামায়াতে ইসলামী'র অকৃত্রিম বন্ধু এবং জামায়াত ও পাকিস্তান যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এখনো বিশ্বাস করে না, তা পাকিস্তান জামায়াতের সাংসদ জনাব শের আকবর খান, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব চৌধুরী নিসার আলী খান, তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা জনাব ইমরান খান, আওয়ামী মুসলিম লিগ, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কায়েদে আজম) ও জমিয়তে উলামা ইসলাম আবারো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন।পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালি মাত্র ২৪ বছর একসঙ্গে থেকেই বুঝতে পেরেছিল, তাদের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্মীয় গোড়ামি, অসভ্য পর্যায়ের। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে সারা বিশ্বে এখন প্রমাণিত যে, পাকিস্তান একটি অসভ্য জাতি। আর বাঙালি সেই অসভ্য জাতি থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বের বুকে আপন গৌরব ও ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। আজ যদি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে অবিসংবাদিত মানবতার প্রতীক মহাত্মা নেলসন ম্যান্ডেলা'র মৃত্যু নিয়ে শোক প্রস্তাব গৃহীত হত, তাহলে বোঝা যেত পাকিস্তান সভ্য হতে শুরু করেছে। কিন্তু তারা যে অসভ্য এবং এখনো ১৯৭১ সালের পরাজয়ের গ্লানী ভুলতে পারেনি, সেই হতাশা, পরাজয়, আর আক্রোশ থেকে তারা একজন মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী'র একটি স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত ব্যক্তির নামে শোক প্রস্তাব পাশ করে এটাই প্রমাণ করলো যে, তারা ৪২ বছরেও সভ্য হতে পারেনি। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তারা কি ধরনের অসভ্যতা করবে সেটি তাদের ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশকে নিন্দা করার মত যোগ্যতা, সভ্যতা এবং সততা তাদের নেই। এজন্য তাদের প্রতি প্রস্তাবকে বাংলাদেশের সচেতন সাধারণ নাগরিকরা নিন্দা করেছে, প্রতিবাদ করেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমাহীন ঔদ্বত্য হিসেবে সম্পূর্ণরূপে ইগনোর করেছে। এখন আর একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান প্রত্রিয়ায় অকারণে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। কারণ, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবেই মূলত সেই দায় স্বীকার করে নিয়েছে।এখন বাংলাদেশ খুব ন্যায্য ভাবেই আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের কাছে পাওনা সকল দেনা চাইতে পারবে। বাংলাদেশে আটকে পরা তিন লাখ পাকিস্তানীকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবার যুক্তি আরো জোরালোভাবে তুলতে পারবে। আর যদি পাকিস্তান বাংলাদেশের সেই ন্যায্য দাবীকে অগ্রাহ্য করে, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিতেও পারবে।জনাব ইমরান খান পাকিস্তানের একজন বিশ্বকাপ জেতা ক্রিকেটার। ক্রিকেট থেকে অবসরে যাবার পর রাজনীতি ধরেছেন। রাজনীতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন নাক্কারজনক বক্তব্য দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের যেসব মানুষ এতোদিন পাকিস্তান ক্রিকেটের ভক্ত ছিল, তারাও ইমরান খানের কথায় কষ্ট পেয়েছেন। জনাব ইমরান খান ক্রিকেটের এককালের সম্রাট হলেও রাজনৈতিক ভাবে ভারী মুর্খ, তা তিনি এবার প্রমাণ করলেন।আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরে একটি জিনিস আরো সুস্পষ্ট হল, বাংলাদেশের কোন মানুষগুলো আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর, সেই সুস্পষ্ট অবস্থানটি এবার পরিস্কার হল। পাকিস্তানের তারিক আলী'রা যখন ব্যক্তিগত ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে এরকম ধৃষ্টতা যে পাকিস্তানের অসভ্যতা বর্বরতার প্রমাণ এখনো বহন করে সেটিই আবার প্রমাণিত হল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংরাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের কাছে পরাজিত হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী আছে, এখন আমরা পাকিস্তানকে মোটেও প্রতিপক্ষই মনে করি না। কারণ, তারা তো আমাদের অপ্রশিক্ষিত সাধারণ জনগণের কাছেই হেরেছে। তাদের সঙ্গে আবার কিসের প্রতিযোগিতা? পাকিস্তানকে আমরা আর কোনো প্রতিযোগীই মনে করি না। অন্তত যুদ্ধে তো নয়ই। কারণ, তারা ১৯৭১ সালে হেরেছে। এখন তো এমনিতেই হেরে বসে আছে। কারণ ৪২ বছরে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি সেটি হয়তো পাকিস্তান জানেই না। কারণ অসভ্য বর্বর ইতরদের সেটিজানার কথাও নয়।
false
ij
আনোয়ার স্যারের ক্লাসে ডক্টর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। অসম্ভব উজ্জ্বল এক মেধা। সমকালীন ইতিহাসে সুপন্ডিত। আমাদের সৌভাগ্য এই-আমরা তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। ১৯৯১/৯২ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে কাটছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি। আনোয়ার স্যার ‘এশিয়া ও আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদ’ পড়াতেন। স্যারের পড়াবার ভঙ্গিটি দারুন। অত্যন্ত শুদ্ধ ভঙ্গিতে কথা বলেন। ঠিক কুড়ি মিনিট পড়াতেন। তারপর অন্যান্য প্রসঙ্গ; এই যেমন-হার্বাল মেডিসিন কি সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্তিতি। স্যার, রাজনীতিতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। কৌতুহলী ছিলেন-চিনের সমাজ-সংস্কৃতি নিয়েও। স্যারের মুখেই প্রথম শুনেছি-চিনের সিগারেটও নাকি হারবাল! খেলে, উপকার হয়! বেশ ক’বার চিনে গিয়েছেন। সেসব কথাও বলতেন। কাজেই, ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন ডক্টর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। একবার। আমার মনে আছে। স্যার, আলজেরিয়ায় ফরাসী উপনিবেশিক আমলের ইতিহাস পড়াচ্ছেন। ফরাসীরা কী নিদারুন শোষন করেছিল আলজেরিয়ায়-সেইসব মর্মান্তিক ইতিবৃত্ত। আমি বরাবরই অন্যমনস্ক ধাতের। আনোয়ার স্যারের লেকচার যদিও অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিল -আমি ঠিকঠাক শুনছিলাম না; আমি খাতায় গাছপালা-সূর্য ও পাখপাখালির ছবি আঁকছিলাম। হিজিবিজি দাগ কাটছিলাম। মাঝে মাঝে কানে আসছিল -আলজেরিয়দের প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা, ফরাসীদের অবাধ লুঠপাটের কথা ... এ ভাবেই সেদিন ক্লাসটা শেষ হল। আমার এক সহপাঠী; রঞ্জু - সেদিনের ক্লাস কী কারণে যেন করতে পারেনি। ক্লাসের পরে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল-দে, স্যারের লেকচার দে। বলে আমার খাতা টেনে নিল। দেখল নিউজপ্রিন্টের পৃষ্ঠাভর্তি নীল রঙের বলপয়েন্ট দিয়ে গাছপালা-সূর্য ও পাখপাখালির ছবি আঁকা। হিজিবিজি দাগ কাটা। ও আমার মনের গতিক জানলেও -খানিকটা বিমূঢ়। আমি বললাল, আনোয়ার স্যারের লেকচার নিবি? ও মাথা নাড়ল। আমি রঞ্জুর খাতা টেনে নিলাম। তারপর ওর খাতায় দু-লাইনের ছড়া লিখে দিলাম; আলজেরিয় বৃদ্ধের হাড়ে, প্যারির জৌলুষ বাড়ে। ছড়া পড়ে রঞ্জু তো রীতিমতো হতভম্ব। সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৪৩
false
rg
বাজেট বিশ্লেষণ-পর্ব ২ ।। রেজা ঘটক ৬ জুন ২০১৩ তারিখে জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের জন্য ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন সেখানে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতকে। ২০১৭ সালের মধ্যে ১৯,৭০১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে এই উচ্চাভিলাষ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী দাবী করছেন, যদি এই লক্ষ্য পূরণ হয় তাহলে তখন বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্যে তিনি আগামী অর্থ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে বরাদ্দ দিয়েছেন ১১ হাজার ৩৫১ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রথমেই বলতে হয় শুধুমাত্র দলীয় লোকদের বাছাই করে পাওয়ার প্লান্টের কাজ দিলেই তা দিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে না। দলীয় লোকদের চুরি চামারির একটা মোক্ষম উপায় হবে মাত্র। পাওয়ার প্লান্টের নামে দেশে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে সব দলীয় বিবেচনায়। দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য নয়। বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক যে পাওয়ার প্লান্টের নীল নকশা করা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায়, সেটি আমাদের সুন্দরবনকে ধ্বংস করে সেখানে বিরাম মরুভূমি করবে। রামপাল পাওয়ার প্লান্ট যদি সরকার বন্ধ না করে তা নিয়ে দেশে দুর্বার আন্দোলন হবে। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো মূল্যে সুন্দরবনকে কারো আখের গোছানোর শয়তানী থেকে রক্ষা করবে। তাই রামপাল কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টের বিষয়টি যদি বাজেটে পুনঃবিবেচিত না হয় তা নিয়ে বাংলাদেশকে অনেক কঠিন শিক্ষা মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ নিয়ে বিদেশী চোরাকারবারী সিন্ডকেটের সঙ্গে সরকারের বা যে কোনো দলের যে ধরনের বিনিময় চুক্তি হোক না কেন সেখানে দেশীয় স্বার্থ লঙ্ঘনের একটি ভূমিকা আমরা সবসময় লক্ষ্য করেছি। দেশীয় স্বার্থ লঙ্ঘন করে বিদেশী স্বার্থে কেবল ক্ষমতায় যাবার সিড়ি হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালীনী খাতকে অগ্রাধিকার দিলে তার জন্য বাংলাদেশকে সামনে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বাজেটে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার স্বপ্নকে। বা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ডিজিটালের নামে সরকারি সেক্টরগুলো যে লেজেগোবরে অবস্থা তাতে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না যে, আগামীতে এই দুরাবস্থা আরো বাড়বে। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো জাতীয় ডিজিটাল নীতি ঠিক হয় নাই। চুরি চামারির জন্যে ডিজিটালের নামে এখন পর্যন্ত যা করা হয়েছে সব ভুয়া। একটা সরকারি অফিসের ওয়েব পেইজ ভিজিট করে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ডিজিটালের নামে যারা তোড়জোর করেন তারা নিজেরাই জানেন না কিভাবে কি করতে হয়। কিন্তু সরকার কোনো বিশেষজ্ঞ টিম না করেই যাকে যেভাবে পারছে এই খাতে টাকা দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে আওয়ামী লীগ মহাজোট সরকার চুরির একটি নতুন খাত তৈরি করেছে। সরকারি অফিসের কোনো পাতায় নিয়মিত কোনো আপডেট নাই। এমনকি মন্ত্রণালয়গুলোর ওয়েব পাতায় অনেক মন্ত্রীর নাম পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ভিডিও কনফারেন্স করা আর ডিজিটাল বাংলাদেশ মোটেও এক জিনিস নয় রে ভাই। ডিজিটাল মানে ডেইলি আপডেট ব্যাপার স্যাপার সেখানে থাকার কথা। ছাগল দিয়ে যেমন লাঙল চাষ করা যায় না, তেমনি একটি অদক্ষ মাথাভারী প্রশাসন দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করা যায় না। ডিজিটাল মানে চলতি সংসদে সাংসদের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র তা জাতীয় সংসদের ওয়েব পাতায় এতজন নাগরিকের দেখতে পাওয়ার কথা। ডিজিটাল মানে মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে পাতা ভরে রাখা নয়। ওই ওয়েব পাতায় ঢু মারলে আবার ৪০৪ এরর আসে। আহারে আমার ডিজিটাল বাংলাদেশ!! ডিজিটাল মানে একটি অদক্ষ বিটিআরসি নয়। যে কারণ দর্শিয়ে সরকার ইউটিউব বন্ধ করেছিল, আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত, যারা ব্যক্তিগতভাবে আধুনিক ডিজিটাল ব্যাপার স্যাপার নাড়াচাড়া করেন, তারা সবাই সেই ভিডিও ফুটেজ দেখতে পেরেছে। ভিডিও ভুটেজ দেখার জন্য শুধুমাত্র বিটিআরসি;র কথিত ইউটিউব বন্ধ রাখলেই ল্যাঠা চুকে গেল, কে বলেছে? অদক্ষ প্রশাসন দিয়ে ডিজিটিল হবে না বাট চুরির ব্যাপার স্যাপার হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন বাংলাদেশে ডিজিটালের নামে কতোজন কতো কামাই করেছে। ব্যাপারটা স্রেফ সরকারের সমর্থনে চুরি করার একটি ওপেন সিক্রেট খাত। আর কিছু না। তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হল কৃষি খাত। ভালো কথা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বছরের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করবেন। আগের বছরে কৃষিতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি ছিল যা সংশোধিত বাজেটে ১২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। যে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষক। সেই দেশের বাজেটে কৃষি কিভাবে তিন নাম্বারে যায়? আর কৃষিতে যতো বাজেটই ধরা হোক, তা কেন ভর্তুকির তকমা পাবে? বাজেটে কৃষিতে যা কিছু বরাদ্দ হয়, তাকে আমি একজন কৃষকের ছেলে হিসেবে অর্থনীতির ভাষায় ভর্তুকি বলতে পারি না। এটা জাতীয় লজ্বার কথা। ভর্তকি হতে পারে ডিজিটাল খাতে। ভর্তকি হতে পারে প্রতিরক্ষা খাতে অস্ত্র কেনার খাতে। কৃষিতে কেন ভর্তুকি লাগবে? কৃষক তো আমার দেশের প্রাণ। কৃষক তো আমাদের উদর পূরণের খাদ্য উৎপাদন করে। তাই খেয়ে আমরা আকডুম বাগডুম করি। কৃষকের জিনিস খেয়ে আমরা সহজেই কৃষকের কথা ভুলে যাই। একমাত্র জাতীয় বেঈমানরাই কৃষককে ভুলতে পারে। কৃষিখাতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ২৭৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা মাত্র। বাংলাদেশের বাজেটে কৃষি খাতে মিনিমাম শতকরা ৩৩ ভাগ বরাদ্দ হওয়া উচিত। শিল্প শিল্প করে আমরা এদেশে কিছু ভুরিমোটা চোর বাটপার তৈরি করেছি। আর কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির কষ্টের চেয়ে মধ্যবর্তী দালাল বা ফরিয়ারাই কৃষি উৎপাদন থেকে মুনাফা ঘরে তোলে। আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ঘোড়ারোগ কৃষককে অবহেলা করা। কৃষকের ধন চুরি করা। কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনিকে অমর্যাদা করা। বাংলাদেশ কৃষকের দেশ। যে ভাত খেয়ে আমরা এসিরুমে বসে চুরি করার কুমতলব করি, সেই ভাতের চাল যিনি উৎপাদন করেন, তার টিনের চালও নাই। তার নাড়ার চাল দিয়ে বৃষ্টি পরে। এটাই বাস্তবতা। শুধুমাত্র কৃষককে অবহেলা করার জন্যে বাংলাদেশে আইন দরকার। কৃষকের কোনো মজুরি চুরি করার জন্য সরাসরি ফাঁসির আইন দরকার। যিনি চাল উৎপাদন করেন তিনি না খেয়ে থাকেন, আর দেশে যিনি আরামসে চাল বিক্রির দালালি করেন, তিনি এসি রুমে ঘুমান। আহারে দেশ আমার। বাংলাদেশ যতোদিন বাঁচবে কৃষকের হাত ধরেই বাঁচবে। বাংলাদেশে কৃষক যেদিন আর থাকবে না, সেদিন এই সোনার বাংলাও থাকবে না। অতএব সাধু সা্বধান।।
false
rn
ইংরেজি সাহিত্যে যে ১০০ টি বই আপনাকে পড়তেই হবে (এক) অনুবাদ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অনুবাদ সাহিত্য নিঃসন্দেহে একটি শিল্পকর্ম। অনুবাদের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের গতিধারা ও রূপবৈচিত্র্যের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। এক কথায় অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশি সাহিত্যের একটি সামগ্রিক রূপ প্রতিফলিত হয় নিজস্ব সাহিত্যে। ইংরেজি সাহিত্য বলতে বোঝায় ইংরেজি ভাষায় রচিত সাহিত্য। কেবলমাত্র ইংল্যান্ডের লেখকদের সাহিত্যকেই এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা নয়। উদাহরণস্বরূপ, রবার্ট বার্নস ছিলেন একজন স্কটিশ, জেমস জয়েস ছিলেন আইরিশ, জোসেফ কনরাড পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ডিলান টমাস ছিলেন ওয়েলশ, এডগার অ্যালান পো ছিলেন আমেরিকান, ভি. এস. নাইপল ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ভ্লাদিমির নবোকভ ছিলেন রাশিয়ান। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়ে থাকেন।১। 'গ্রেট এক্সপেক্টেশন' লেখক- চার্লস ডিকেন্স। পিপ নামে এক ইংরেজ ছোকরার গল্প। তার বড়ো হওয়ার গল্প। সে অপরাধীদের সাহায্য করছে, নিজের ভালবাসার মানুষটাকে খুঁজছে, আবার এক বুড়ি বিধবাকে পুড়ে মরতেও দেখছে। তার নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো আশাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। উপন্যাসের শেষে দেখা যাবে, সে তার পুরনো প্রেমিকাকে খুঁজে পাচ্ছে। ২। 'দ্য আলকেমিস্ট' লেখক- পাওলো কোয়ালহো। অসাধারন একটা বই । জীবনটাকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারার মত বই।সান্তিয়াগো নামে এক তরুন স্ব্প্নচারীর নিজেকে পাওয়ার গল্প বলা হয়েছে এখানে। ৩। 'অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' ও 'থ্রি কমরেডস' লেখক- এরিখ মারিয়া রেমার্ক। প্রথমবার পড়ে চোখের পানি আর আটকিয়ে রাখতে পারিনি।পল বোমান নামক সতের বছরের এক কিশোর,রঙিন স্ব্প্ন দেখার যখন সময় তখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ।লেখক বুঝিয়েছেন যে, হাজার বছরের সভ্যতাও মানুষের পশুত্বকে মুছে দিতে পারেনি।পল বোমার চরিত্রটার মাধ্যমে লেখক নিজের জ়ীবনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাই ফুটিয়ে তুলেছেন। যুদ্ধোত্তর জামার্নীর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে পা ফেলে চলেছে তিনজন প্রাক্তন সৈনিক।সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে জেগে রয়েছে শুধু অটুট বন্ধুক্ত আর প্রেম।তাদেরই এক জনের অপ্রত্যাশিত অকুন্ঠ আত্নত্যাগের কাহিনী এই থ্রি কমরেডস। ৪। 'দ্য গডফাদার' লেখক- মারিও পুজো। এই উপন্যাস সম্পর্কে জানেননা এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন।আর যারা মোটামুট বইপত্র পড়েন, তাদের প্রায় সবাই উপন্যাসটি পড়েছেন।ভিটো কর্লিয়ানি আর তার পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কাহিনি গড়ে উঠেছে।গডফাদারের সেই বিখ্যাত উক্তি-“প্রতিটা মানুষের জীবনেই এক সুনির্দিষ্ট নিয়তি থাকে”-এর মর্মার্থ মাইকেল কর্লিয়ানি চরিত্রটার মাধ্যমেই বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে।পারিবারিক ব্যবসা থেকে দূরে সরে থাকতে চাইলেও নিয়তিই শেষ পর্যন্ত তাকেই গডফাদার বানালো। ৫। 'ট্রেজার আইল্যান্ড' লেখক- রবার্ট লুইস স্টিভেনসন। জিম হকিন্স নামে এক রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোর বাস করে সমূদ্র তীরের এক শহরে।সে ও তার মা সেখানে একটি সরাইখানা পরিচালনা করে।একদিন সেই সরাই খানায় এসে উপস্থিত হয় এক বদরাগী মেজাজের ঝগড়াটে ক্যাপ্টেন।লোকটি হঠাৎ মারা গেলে তার একটি সিন্দুক থেকে একটি মানচিত্র পাওয়া যায় যা জিম এবং শহরের কিছু লোককে নিয়ে যায় এক দুঃসাহসিক অভিযানে।যেখানে তারা মোকাবেলা করে জলদস্যু ও বিশ্বাস ঘাতকদের। ৬। 'লা মিজারেবল' লেখক- ভিক্টর হুগো। জা ভালজা নামক এক হতভাগার জীবনের ঘটনা-দূর্ঘটনার কাহিনী। জা ভালজা চরিত্রটি ভিক্টর হুগোর এক অমর সৃষ্টি। এক টুকরো রুটির জন্য তাকে খাটতে হয়েছে ২০ বছরের জেল। বারবার জেল আর পালানোর মধ্যে কেটেছিল তার জীবন। ৭। 'আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী' উপন্যাসের ট্রাজেডী অনেক পড়েছি,তবে বাস্তব ট্রাজেডী যে গল্প-উপন্যাসের চেয়েও অনেক বেশি কষ্টের তা আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী না পড়লে বোঝা যায় না।মাঝে মাঝে এই বইয়ের দুই-এক পাতা উল্টালেও মন বিষন্ন হয়ে ওঠে। ৮। 'কিস দা গার্লস' লেখক- জেমস প্যাঁটারসন। অনুবাদ করেছেন, অনীশ দাস। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মত একটি বই। এই গল্পে সিরিয়াল কিলার দুই জন। এক জন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে সুন্দরী,বুদ্ধিমতী মেয়েদের অপহরণ করছে ক্রমাগত ভাবে। সে মেয়েদের কাছে নিজেকে বিশ্বপ্রেমিক ক্যাসানোভা দাবী করে। সে মেয়েদেরকে বন্দী করে রাখে তার গোপন আস্থানাই সেখানেই তাদের উপর চলে বিভিন্ন অত্যাচার ও বিভিন্ন খামখেয়ালী পরীক্ষা নিরীক্ষা। অপরজন লস-এঞ্জেলসে বর্ণনাতীত নৃশংস খুন করে সৃষ্টি করছে আতংক। দুই জনই খুবই প্রতিভাবান এবং কৌশলী খুনি তাদের পতিটি খুন হল পারফেক্ট ক্রাইম। ৯। 'থ্রী মাস্কেটিয়ার্স' লেখক- আলেকজেন্ডার দ্যুমা। ইতিহাস আশ্রিত অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লেখক হিসেবে তিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন। সব মিলিয়ে তার প্রকাশিত লেখা ১ লাখ পাতার। তার লেখা উপন্যাসগুলো প্রায় ১০০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। যা তাকে ফরাসি লেখকদের মধ্যে বহির্বিশ্বে সবচাইতে বেশি পরিচিত লেখক করে তুলেছে। তার লেখা উপন্যাস অবলম্বনে প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। উপন্যাসটির নায়ক দ্য আরতাঁনা, অ্যাথোস,পার্থোস এবং আরামিস। এই উপন্যাসটির ধারাবাহিকতায় আরো দুইটি গ্রন্থ রচনা করেছেন আলেক্সান্ডার দ্যুমা। এর মধ্যে একটি "ম্যান ইন দ্যা আয়রন মাস্ক" চরিত্রের কারণে বিখ্যাত দ্য ভিকম্‌তে ডি ব্রাগেলোঁ, বাংলায় যার অর্থ "দশ বছর পর"। ১০। 'শী' লেখক- হেনরী রাইডার হ্যাগার্ড। সাদামাটা জীবনের মারপ্যাঁচে পড়ে যারা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চান, দুর্গম শহর, রাজপথ বা মিসরের পিরামিডের ভেতরের অপার রহস্যে সামিল হতে চান, তাদের জন্য হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড হচ্ছেন আশ্চর্য এক জাদুকাঠির নাম। ইচ্ছা হলে, এই লেখকের এই বই গুলো পড়ে দেখতে পারেন- ক্লিওপেট্রা, কিং সলোমন মাইনস, আল্যান কোয়াটারমেইন এবং আল্যান এন্ড দ্য হোলি ফ্লাওয়ার।
false
rg
কেউ চুরি করে ভোট কেউবা সরকারি পাসপোর্ট!!! সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মানবপাচারের ঘটনা শোনার পর আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল? পাসপোর্ট অধিদপ্তর যে বাংলাদেশের একটি প্রধান দুর্নীতির আকড়া, এটা মনে হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে শুনলো? পাসপোর্ট পেতে হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগে। দেশের বাইরে যেতে হলে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগে। এই দুটো কাজেই যে কত লাখ দুর্নীতি হয়, তা কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না? অবশ্যই জানে, আর জানে বলেই এই প্রাকটিস বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই হয়ে আসছে। এখনো হচ্ছে। এটা বন্ধ করার কোনো সদিচ্ছা কোনো সরকারেরই ছিল না। বর্তমান সরকারেরও নেই। নইলে এর আগে হাজার হাজার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সহ কতজন যে কতবার ধরা পড়লো, তারা কারা? তাদের পাসপোর্ট করে দিতে কি ভীনগ্রহ থেকে লোক এসেছিল? রোহিঙ্গাদের অনেকেও এই মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করে নানান পথে বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে বাইরে গেছে, এখনো যাচ্ছে। এসব মনে হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না? এসব ঘটনা দু-এক দিন আলোচনায় থেকে আবার নাগরিক ব্যস্ততায় চাপা পড়ে যায়। মিডিয়ার কাছে নতুন খবর আসলে এসব খবরও চাপা পড়ে যায়। মানুষ এসব দুদিন পরেই ভুলে যায়। আর সেই সুযোগে এসব অপরাধ একটি মেগা ধারাবাহিক নাটকের মত চলতেই থাকে। পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশের যৌথ প্রযোজনায় এই মেগা সিরিয়াল বাংলাদেশে মোটেও নতুন কোনো ঘটনা নয়।বাংলাদেশের দুর্নীতি পরায়ন এই দুষ্টু চক্র খুব ভালো করেই জানে, ধরা পরা কোনো ঘটনা দু-একদিন আলোচনায় থাকার পর আবার ঢাকা পড়ে যায়। ওই দু-একদিন কোনো মতে 'সাময়িক বরখাস্ত' টাইপের সাজা মাথায় নিয়ে পার করতে পারলেই, আবার সব ঘটনাই ঘটানো যাবে। এই প্রক্রিয়াটি তো আর চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না। তো এক মুন্সীর জায়গায় তখন আরেক মুন্সী আসবে। নতুন উদ্দামে নতুন রেটে আবার এসব অপকর্ম শুরু হবে। কিভাবে সেটা বোঝার জন্য আমাদের ফুট পথ থেকে পুলিশের হকার উচ্ছেদ বা পার্ক ও রাস্তার পাশের টং দোকান উচ্ছেদে পুলিশি অভিযানগুলো একটু খেয়াল করলেই ব্যাপারটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। হকার বা টং দোকানগুলো দিনের মধ্যে পুলিশ নানান অযুহাতে নানাভাবে উচ্ছেদ করে। কিন্তু দিনশেষে বা পরদিন সেগুলো আবার যথাস্থানে ঠিক আগের মতই বসে। মাঝখানে ওদের সাথে পুলিশের আরেকটা নতুন রেটে সাময়িক মৌখিক চুক্তি হয়। পুলিশ ছাড়াও এসব হকার ও টং দোকানদের ক্ষমতাসীন দলের চ্যালাচামুন্ডাদের কয়েক দফায় চাঁদা দিতে হয়। ব্যাস, মামলা খালাস। কিন্তু হকার বা টং দোকান স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার কোনো সরকারি উদ্যোগ কখনোই কার্যকর হয় না। একই ঘটনা এই পাসপোর্ট অফিসের বেলায়ও প্রযোজ্য। আগে তো আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের বাইরে দালালদের হাজার হাজার চেম্বার ছিল। পাসপোর্ট অফিসে কি কি হয়, কোথায় কি কিভাবে করতে হয়, তা আমার চেয়ে ওখানের বারান্দায় যে ছোট্ট ছেলেটি আইকা/গাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে অনেক ভালো জানে। এখন দালালদের সেই চেম্বারের আদলটায় একটু পরিবর্তন ঘটেছে। ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন দালালদের কাজ কর্মেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এসব পুলিশ জানে না বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব খবর রাখে না, এটা একদম অকল্পনীয় ব্যাপার। বরং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তর বা অধিদপ্তরের একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব অপকর্ম রাজার হালেই হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভিসা ছাড়া যেসব দেশে যাবার সুযোগ এখনো বেশি, এসব কাজে সেসব রুটই বেশি ব্যবহৃত হয়। আর সরকারি পাসপোর্টে যেসব দেশে বিনা ভিসায় যাওয়া যায়, সেসব দেশে সরকারি অনাপত্তি সনদ আর সরকারি আদেশ জাল করেই একজনকে সরকারি পাসপোর্ট দিয়ে সহজেই পাচার করার কাজটি করা যাচ্ছে। এই গোটা জালিয়াতি চক্রের সাথে পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত। এদের সহায়তা ছাড়া কোনোভাবেই সরকারি আদেশ নিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে বাইরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এতো গেল পাসপোর্ট অফিস আর পুলিশের ব্যাপার। আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে কি সবাই ধোয়া তুলসি পাতা? পাসপোর্ট অফিসের এই চক্রের সাথে বিমানবন্দরেও তাদের একটি বিশেষ চক্র এই কাজে সরাসরি জড়িত। যারা বিমানবন্দরে এদের ইমিগ্রেশান ছহিছালামতে করে পার করে দেবার কাজটি করে দেয়। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চক্রের সবাইকেই চেনে। খুব ভালো করেই চেনে। এমন কি এর সঙ্গে দেশের বড় বড় হোমরা ছোমড়া রাঘব বোয়ালরাও জড়িত। সাগরপথে মানবপাচারের ঘটনা নিয়ে এখন সারা বিশ্বের মিডিয়ায় বাংলাদেশের নাম প্রতিদিন উচ্চারিত হচ্ছে। সাগর পথে মানবপাচারের সেই কাজের হোতা কারা? বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এমন কি জনপ্রতিনিধিরা এসব অপকর্মে যে জড়িত, তা আমাদের পুলিশ খুব ভালো করেই জানে। সোজা কথায় এই চক্রের কাজকর্ম বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা হয় না বলেই তা বন্ধ হয় না। সরকার এদের লাই দেন বলেই এসব অপকর্ম এখনো চলছে। সরকারি অনুমোদন নিয়েই চলছে। পাসপোর্ট অফিসে হয়রানি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর পর থেকে এখন একজন নাগরিক নিজেই বিনা বাধায় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে যত ধরনের অনিয়ম, অপকর্ম হয়, তা তো আর বন্ধ হয়নি। দালালদের এখন একটু ঘুর পথে সেই কাজগুলো করতে হয়। কারণ, পাসপোর্ট অফিসে তো সেই একই রক্ত মাংসের মানুষগুলোই বসে আছে। দৈনিক প্রথম আলো'র খবর বলছে, ''দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় সরকারি কর্মকর্তারা ২০১২ সাল থেকে তুরস্কে ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন। সেখান থেকে তাৎক্ষণিক ভিসা নিয়ে যাওয়া যায় ইউরোপের অন্যান্য দেশে। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি। আর এ কাজে সহায়তা দিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারাই। অনেক দিন ধরে এভাবে মানব পাচার হলেও এবারই প্রথম তা ধরা পড়ল। তুরস্ক সরকারের দেওয়া এক চিঠির সূত্র ধরে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে ঠিক কতজন এই পথে সরকারি কর্মকর্তা সেজে চলে গেছেন, তা জানা যায়নি। এর জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চারজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে তুরস্ক বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহারকারী এ রকম তিনজনের একটি তালিকা পাঠিয়েছে। এঁরা হচ্ছেন তফিকুল ইসলাম (৫১২৫৮৪৫), মামুনুর রশিদ (৬১২৬০৪২) ও আমিন উদ্দিন (১১২৬৬৩৯)। চিঠিতে জানানো হয়েছে, তুরস্কের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করে এমন আরও ব্যক্তির নাম পাঠানো হবে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তুরস্কের পাঠানো এ অভিযোগের পর বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায়। কোন কোন কর্মকর্তা এসব পাসপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন, কারা সিল মেরেছেন, কার নির্দেশে তা তৈরি হয়েছে—এসব যাচাই-বাছাই করা হয়। তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে চিহ্নিত করে অধিদপ্তর। তাঁরা হলেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, সহকারী পরিচালক এস এম শাহজাহান, উচ্চমান সহকারী মো. শাহজাহান মিয়া এবং মো. সাইফুল ইসলাম। এই চারজনকেই মিথ্যা তথ্য ও জাল অনাপত্তি সনদ দেখিয়ে সরকারি কর্মকর্তা নন এমন নাগরিকদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে সহকারী পরিচালক এস এম শাহজাহান এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রদানে সহায়তার জন্য সৌদি আরবে আছেন। বরখাস্তের আদেশ দেওয়া চিঠিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলেছে, প্রাপ্যতাবিহীন ব্যক্তিদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। যাঁরা সরকারি কর্মকর্তা সেজে ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ নিয়ে তুরস্কে গিয়েছেন, তাঁদের পাসপোর্ট আবেদনপত্র যাচাই করে দেখা গেছে যে আবেদন গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই পাসপোর্টের আবেদনপত্র গ্রহণ ও ইস্যু প্রক্রিয়ায় জড়িত থেকে কর্মকর্তারা কর্তব্যে অবহেলা ও গুরুতর অসদাচরণ করেছেন।তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা সেজে বিদেশে যাওয়া শতাধিক ব্যক্তির নাম বের হয়ে আসতে পারে। আর এগুলো তো হঠাৎ করে হচ্ছে না, অনেক দিন ধরেই চলছে। তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, যাঁরা এভাবে বিদেশে গেছেন, তাঁরা জঙ্গি বা অন্য যেকোনো দলের বা গোষ্ঠীর লোক হতে পারেন। আবার সাধারণ কেউও হতে পারেন।''এবার পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন, বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস কত বড় ভয়ংকর অপরাধে জড়িত। এদের সহায়তা নিয়ে বিশাল কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা অনায়াসেই বাইরে যেতে পারে। বাইরে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারি পাসপোর্ট থাকায় তারা আবার আরামসে দেশে ফেরত আসতে পারে। আর জঙ্গিরা যে এই রুটটি ব্যবহার করছে না, এটা তো কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবকিছু জেনেশুনেও না জানার ভান করছে?আমি তো মনে করি, বাংলাদেশের পুলিশ দেশের কে কে ভালো মানুষ, কে কে কি কি অপরাধ করে, কে কে কি কি চোরাচালানে জড়িত, কে কে মানবপাচারে জড়িত, কে কে পাসপোর্ট জালিয়াতিতে জড়িত, কে কে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত, কে কে নারী ও শিশু পাচারে জড়িত, কে কে চাঁদাবাজিতে জড়িত, কে কে অবৈধ সম্পত্তি বানানে জড়িত, কে কে সরকারি সম্পত্তি দখলে জড়িত, কে কে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের সঙ্গে জড়িত, এদের সবাইকেই খুব ভালো করেই চেনে। আর সরকার বাহাদুরের সদিচ্ছা থাকলেই কেবল এসব প্রতিটি চক্রের সকল রাঘব বোয়ালদেরই পুলিশ হাতে নাতে মাত্র এক সপ্তাহের নোটিশেই ধরতে সক্ষম। কিন্তু যারাই সরকারে থাকে, তাদের সঙ্গেই এসব কুচক্রের রাতারাতি সখ্যতা তৈরি হয়। কারণ সেই সখ্যতায় টাকার লেনদেন আছে। তাই সরকার বাহাদুর ইচ্ছে করেই এসব লালন-পালন করে। তাতে কিছু লোকের দুচার পয়সা আয়-রোজগার হয়। এরা দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মোটা অংকের চাঁদাটাদা দেয়। বাংলাদেশের মত গরীব একটি দেশে এসব ঘটনা ঘটবে, এটাই তো বরং স্বাভাবিক। এসব ঘটতে না দিলে তো দেশ নরওয়ে-সুইডেনের মত অতি ভালোতে পরিনত হবে। তা তো আমাদের সরকারের সদিচ্ছায় নেই। দেশের মানুষের গড় আয় ১৩১৪ মার্কিন ডলার। চোরাই পথে মানবপাচার যত বেশি হবে, ততই দেশে রেমিটেন্স ঢুকে মাথাপিছু গড় আয় আরো দ্রুত বাড়বে। দেশ শনৈ শনৈ করতে করতে গরীব থেকে মধ্যম আয়ের দেশে, মধ্যম আয় থেকে ধনিক দেশে পরিনত হবে। আহা আর কি চাই???বরং সরকার বাহাদুর যেটা মন থেকে যেটা চায়, সেটা হল, এসব অপরাধী চক্রের কাজকাম নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হোক। তুরস্কের মত দু'চারটা দেশ দু'চারটা চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে সরকারকে অবগত করলে, তার জন্য সাময়িক বরখাস্ত নিয়ম তো আছেই। এটা নিয়ে এতো উতলা হলে তো চলে না রে ভাই। দেশে এরচেয়ে কত বড় বড় কাজ আছে, যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এগুলো তো কোনো আলোচনার বিষয়ই না। এগুলো সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আরো সুস্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সাময়িক বরখাস্ত নিয়মে সরকার এসব খুব ভালোভাবেই ট্যাকেল দেবার মত সামর্থ্য রাখে বটে। একটা জিনিস সবাইকে মনে রাখতে হবে, কোনো সরকারই কিন্তু কখনোই বলে নাই যে, দেশ থেকে এসব অপরাধ চক্রকে শিকড় সহ উৎপাটন করবে। বরং জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও বিভিন্ন দাতা দেশের সুপারিশে এসব দিনদিন বছর বছর কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমাদের সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে। সেই হিসাবে এখানে বরং সরকার বাহাদুরের তো কোনো দোষই নাই। কারণ আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘এটা ভয়ংকর ঘটনা। এমন প্রথম শুনলাম। অনাপত্তি সনদও জাল, আবার জিও জাল। এ ঘটনায় যাদেরই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে।’ আহা সাধু সাধু। বরং আসুন আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুলি, বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস, বিমানবন্দর, পুলিশ এদের মত ভালো প্রতিষ্ঠান বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। আগামীতে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে আরো ভালো কাজ করে যাবে। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন, বাংলাদেশের এসব প্রতিষ্ঠান নোবেল শান্তি পুরাস্কারেও ভূষিত হবে। তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকলে আমরা মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেই সেই পুরস্কার আনার জন্য যাইতে দেখব। ততক্ষণ সবাই নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমান। প্রথম আলোর এ সংক্রান্ত রিপোর্টের নিচে অনেকেই অনেক মন্তব্য করছেন। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে জনাব আবু হানিফের মন্তব্য। তিনি লিখেছেন, 'কেউ চুরি করে ভোট-কেউ পাসপোর্ট!!' এই লাইনটা দিয়ে কেউ এখন ইচ্ছে করলে গান বানাতে পারেন। ............................২১ মে ২০১৫ঢাকা সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:২১
false
fe
রাজনীতির কৌশল, নিঃস্বার্থ রাষ্ট্রসেবা রাজনীতির কৌশল, নিঃস্বার্থ রাষ্ট্রসেবাফকির ইলিয়াস=====================================না, বিএনপি জামাতকে ত্যাগ করছে না। করবেও না। খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে সমাবেশ করেছেন, তাতে জামাতের হাজার হাজার লোক ছিল। নেতা না থাকলে কী হবে! এটা বিএনপির একটা কৌশল। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ভারতকে জড়িয়ে কথা বলে সেই পুরোনো ‘ইন্ডিয়া বিরোধী’ মানসিকতাই প্রকাশ করেছেন। আর লবিং করছেন ভারতের কৃপা পাবার জন্য।কিন্তু তারপরও একটা বিশ্বাস নিয়েই এই প্রজন্ম চলছে। তা হচ্ছে, ঘুরে দাঁড়াবেই বাংলাদেশ। আমরা এর প্রমাণ দেখছি। গোটা দেশজুড়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে যে জনসমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ, তা ছিল লাখো মানুষের ঢল। ‘সাম্প্রদায়িক হামলা, রুখে দাঁড়াও বাংলা’ সেøাগানে তিন দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রোববার ৩টায় গোপালপুর গ্রামে পৌঁছান গণজাগরণ মঞ্চের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। গোপালপুর ইসকন মন্দির প্রাঙ্গণে সমাবেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রোধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আলাদা আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়।গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ’৪৭ সাল থেকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সব ঘটনায় জামাত জড়িত। তবুও এ দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা জামাত-শিবিরকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সারা দেশে যেসব মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দাঁড়িয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে রয়েছেন, তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ালেই এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও তাদের ম“দাতা জামাত-শিবির এ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।ইমরান এইচ সরকার কর্ণাই গ্রামের হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উদ্দেশে বলেন, এই দেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামাত-শিবিরের কোনো ঠাঁই নেই। ঐক্যবদ্ধ থেকে বুকে মুক্তিযুদ্ধের সাহস নিয়ে তাদের প্রতিহত করতে হবে। একটি কথা খুবই স্পষ্ট, কোনো ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনই বিফলে যায় না। আরো একটি সংবাদের দিকে আমরা চোখ বুলাতে পারি। আমরা ইতোমধ্যেই খবরে জেনেছি, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করবে না পাকিস্তান। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ খান সম্প্রতি বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে আবদুল মোমেনকে এ কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।মানবতাবিরোধী অপরাধে জামাত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার আফ্রাসিয়াব মেহদি হাশমিকে তলব করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ওই নিন্দা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে বিক্ষুব্ধ জনগণ পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করারও দাবি ওঠে।পাকিস্তান, বাংলাদেশে ৭১ সালে যে গণহত্যা করেছিলÑ এর জন্য তারা এখনো ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। বরং তারা এখনো বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ আইনি শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আর এদের বাহবা দিচ্ছে বাংলাদেশেরই কিছু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল।এদিকে হঠাৎ করেই কিছুটা পাল্টে গেছে জামাতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক। গেলো সোমবারের গণসমাবেশে দেখা গেছে জামাতে ইসলামীর শীর্ষ নেতার নির্ধারিত আসনে স্থান পেয়েছেন কাজী জাফর আহমদ। এ অবস্থায় সমাবেশে আসা ১৮ দলের শরিক নেতা ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জামাত থাকবে কি-না তা নিয়ে চলছে কানাঘুষা। জোটের বিগত সব কর্মসূচিতে দেখা গেছে- মঞ্চে খালেদা জিয়ার পরের আসনটি এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অব. অলি আহমেদের জন্য নির্ধারিত থাকতো। এরপরের আসনটি থাকতো জামাতে ইসলামীর শীর্ষ নেতার জন্য। তবে আজকে এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েছে। কারণ জামাত সমাবেশে যোগ দেবে নাÑ এ কারণে গণসমাবেশে জামাত নেতার নির্ধারিত আসনে জায়গা পেয়েছেন জাতীয় পার্টি একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ।১৮ দলের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা মিডিয়াকে বলেছেন, ‘আজকের সমাবেশে ১৮ দলের অন্যতম শরিক জামাতে ইসলামীর জন্য মঞ্চে কোনো আসন রাখা হয়নি। তাদের স্থানে যুক্ত হয়েছে কাজী জাফর আহমদ।’ জোট থেকে জামাতকে বাদ দেয়া হবে কিনাÑ জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখনো কিছু জানি না। তবে আমি অবাক হয়েছি জামাতের আসনে জাতীয় পার্টিকে দেখে।’ এটা বিএনপির কোনো নতুন চাল কিনাÑ তাও বুঝা যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। তবে জামাতের সঙ্গ ত্যাগ করলে বিএনপিই লাভবান হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।দেশে আবারো বইতে শুরু করেছে ভোটের হাওয়া। এই ভোট উপজেলা নির্বাচনের। একটি তফসিল ঘোষিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের ১০২টির তফসিল ঘোষণার একদিন পর গেলো সোমবার শেরেবাংলা নগরে নিজের কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চলতি ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়ে এ সপ্তাহেই দ্বিতীয় তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গেলো রোববার প্রথম দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।১০২টি উপজেলার পর দেশের ৪৮৭ উপজেলার বাকিগুলোতে ধাপে ধাপে ভোট করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। খবর বয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ অন্যান্য মেয়াদ শেষ হওয়া সিটিতেও নির্বাচন সম্পন্ন করবে ইসি। যে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশ তার কার্যনির্বাহী ক্ষমতা নিয়েই এগোচ্ছে। এখানে মৌলবাদীরা কী বললো তাতে গণমানুষের কিছুই যাচ্ছে-আসছে না।এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হু মু এরশাদ আবারো কিছুটা সক্রিয় হয়েছেন নিজ দলে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য ৯৬ জন মহিলা প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিয়েছেন তিনি। এর মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন ৬ জন। এটা সবাই জনেন, এরশাদ এখন ঐ আগের কায়দায়ই পতিত নেতা। তার সকল কাজকে কী ‘রাজনৈতিক উদ্ধার’ বলা যাবে? না যাবে না। তারপরও তিনি আছেন! থাকবেন! বাংলাদেশের রাজনীতিতে।বাংলাদেশের এই মুহূর্তে প্রধান সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরা সফর করেছেন। সাতক্ষীরার নাশকতা দমনে সরকারের কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা সাতক্ষীরাকে রক্তাক্ত করেছে, যারা মানুষ খুন করেছে, তারা কেউ রেহাই পাবে না। প্রত্যেককে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। সাতক্ষীরা আর রক্তাক্ত থাকবে না। তিনি সাতক্ষীরাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা (সাতক্ষীরাবাসী) নিজেরা শক্তি নিয়ে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। আমরা আপনাদের পাশে আছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আপনাদের পাশে আছে’।যতোদিন সাতক্ষীরায় শান্তি ফিরে না আসবে, ততোদিন সেখানে যৌথবাহিনী থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে জামাত-শিবিরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ কথা জানান তিনি। গোটা দেশে সন্ত্রাস দমনে সরকারকে আরো শক্ত হতে হবে। মনে রাখা দরকার, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি, জামাতও অংশ নেবে। কারণ সেটা দলীয় নির্বাচন নয়। তাই দেশের প্রত্যন্ত এলাকা আবারো চরম অশান্ত করে তোলা হতে পারে। দেশে যতোক্ষণ শান্তি ফিরে না আসে ততোক্ষণ উন্নয়নের চরকা শক্তিশালী হবে না। আর সে প্রয়োজনেই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের। নবনির্বাচিত মন্ত্রীরা এখন নিজ নিজ এলাকায় সংবর্ধনা নিয়ে ব্যস্ত। মনে রাখতে হবে মুখে অনেক আপ্তবাক্য বলে যে মন্ত্রীরা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা যে তাদের কিছু পূর্বসূরির মতো চুপসে না যান। তারা যেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকেন।কারণ আওয়ামী লীগ যে সুযোগ পেয়েছে তা কাজে লাগাতে ক্ষমতাসীনদের চাক্ষুস হতে হবে। যদি তাদের ভরাডুবি হয়, তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি কালের গহ্বরে তলিয়ে যেতে পারে।বিএনপি রাজনীতিতে নতুন কৌশল খুঁজছে। এই কৌশল মোকাবেলা করতে হলে আওয়ামী লীগকে মানুষের সেবার মাধ্যমেই জবাব দিতে হবে। এই সরকার দুই বছর থাকুক আর পাঁচ বছর থাকুক, আওয়ামী লীগের হারানো অর্জন, পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই কঠিন কাজটি করতে, দল ও সরকারকে হতে হবে আরো অনেক হিসেবি।--------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥: শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৪
false
rg
আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ন্যূনতম ৪২ ভূত মোকাবেলা করতে হবে।। রেজা ঘটক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসংখ্য শ্রমঘণ্টা রাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন দেখিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের শিক্ষাজীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকারের অমানিশা। নির্মম বলি হতে হয়েছিল ডাক্তার মিলন, নূর হোসেন সহ অসংখ্য স্বপ্নপুরুষের। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী হবে আমাদের তখন সেরকম স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আমরা নব্বই পরবর্তীকালে বিএনপি'র দুই টার্ম (১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬) এবং আওয়ামী লীগের দুই টার্ম (১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০১৩) শাসনামলে সেই দুঃস্বপ্ন হারে হারে টের পেয়েছি। স্বৈরাচার পরবর্তী বিগত তেঁইশ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসন বলতে যা বুঝায় তা আমরা স্বপ্নেও দেখিনি। বরং দুর্নীতি, ঘুষ, হত্যা, খুন, গুম, দখল, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, হামলা, মামলা, জ্বালাও পোড়াও, ধর্মীয় উসকানী, সংখ্যালঘু নির্যাতন, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, নমিনেশান কেনাবেচার হাট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস, বৈষম্যমূলক বিভিন্ন চুক্তি, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের লেজুরবৃত্তি, দলীয় কোন্দল, ছাত্র রাজনীতির অপব্যবহার, হরতাল, ধর্মঘট সহ অসংখ্য নেগেটিভ প্রপঞ্চের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। দূর ভবিষ্যতে সেই সংকা থেকে শীঘ্রই মুক্তি মিলবে বলেও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সেই বিবেচনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় আওয়ামী লীগ নের্তৃত্বাধীন জোট সরকারকে অন্তঃত ৪২ টি ভূত মোকাবেলা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে। আলোচিত সেই ৪২ ভূত গুলো এমন হতে পারঃ- ১. পদ্মা সেতু দুর্নীতি প্রসঙ্গ আগামী নির্বাচনে অন্যতম ইস্যু হবে। আওয়ামী লীগকে পদ্মা সেতু নিয়ে জনগণের সামনে খোলামেলা একটা জায়গায় না আসতে পারলে এটি নির্বাচনের ভোটে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। ২. সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেংকারী আগামী নির্বাচনে একটি প্রধান ইস্যু হবে। ৩. ডেসটিনি মাল্টি কো-অপারেটিভ কেলেংকারী নির্বাচনে একটি প্রধান ইস্যু হবে। ৪. রেলওয়ে কেলেংকারী আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। ৫. বিশ্বজিত হত্যা আগামী নির্বাচনে অ্ন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৬. চার সিটি কর্পোরেশানে হার একটি ইস্যু হবে। ৭. ঢাকা সিটি কর্পোরেশান বিভক্তি একটি ইস্যু হবে। ৮. নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের উর্ধ্ব গতি ইস্যু হবে। ৯. বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ১০. বিডিআর বিদ্রোহ অন্যতম ইস্যু হবে। ১১. সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুণি হত্যা অন্যতম ইস্যু হবে। ১২. গণ-জাগরণ মঞ্চ এবং হেফাজতে ইসলাম অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ১৩. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ১৪. ভারতের সঙ্গে তিস্তা পানি চুক্তি অন্যতম ইস্যু হবে। ১৫. রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অন্যতম ইস্যু হবে। ১৬. রামু বৌদ্ধ মন্দির জ্বালোনা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন অন্যতম ইস্যু হবে। ১৭. মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ১৮. আইসিটি বিচারকের স্কাইফ কথোপকথন ফাঁস অন্যতম ইস্যু হবে। ১৯. রানা প্লাজা ধ্বস ও তাজরীন ফ্যাসনে আগুন অন্যতম ইস্যু হবে। ২০. ছাত্রলীগের দৌরাত্ম অন্যতম ইস্যু হবে। ২১. গ্রামীন ব্যাংক ও প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস নিয়ে বাড়াবাড়ি অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ২২. ধর্ম নিয়ে রাজনীতি অন্যতম ইস্যু হবে। ২৩. টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী ও দখলবাজী ইস্যু হবে। ২৪. খুন ও গুম ইস্যু হবে। ২৫. অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ ইস্যু হবে। ২৬. দলীয়করণ অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ২৭. সরকারি অর্থের অপচয় ইস্যু হবে। ২৮. সামাজিক খাতের নিরাপত্তার চেয়ে দলীয় নিরাপত্তা অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ২৯. ভারত তোষণ নীতি অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩০. বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, উন্নয়ন সহযোগী অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩১. দলীয় কোন্দল অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩২. নির্বাচন কমিশন অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩৩. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩৪. পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা অন্যতম ইস্যু হবে। ৩৫. সংবিধান সংশোধন অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৩৬. মামলা-হামলা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা অন্যতম ইস্যু হবে। ৩৭. নমিনেশান বিক্রি অন্যতম ইস্যু হবে। ৩৮. কলেজ ছাত্র লিমন ইস্যু অন্যতম ইস্যু হবে। ৩৯. মিডিয়ার নেগেটিভ ও পজেটিভ প্রচার অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৪০. টিফকা চুক্তি অন্যতম ইস্যু হবে। ৪১. তেল-গ্যাস-জ্বালানী-বিদ্যুতের দাম অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। ৪২. অদক্ষ মন্ত্রীসভা এবং তাদের ব্যর্থতা অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে তা প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নানান ভেলকি দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতায় আসবে। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আওযামী লীগ ও তাদের জোটকে উপরে উল্লেখিত ৪২টি ইস্যুর মোকাবেলা করেই সেই নির্বাচনী পরীক্ষায় নামতে হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যতোই শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হবে ততোই ভণ্ড রাজনীতিবিদদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। একুশ শতকে কেউ আর যেনো তেনো ভাবে একটা বুঝ দিয়ে যুবসমাজের ভোটকে অপব্যবহার করতে পারবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ৪২ টি ইস্যু মোকাবেলা করেই আওয়ামী লীগকে ভোট যুদ্ধে প্রতিপক্ষের সঙ্গে টিকে থাকতে হবে। আর যদি এসব বিষয়কে থোরাই কেয়ার না করে তাহলে আওয়ামী লীগের সামনে ভয়াবহ দুঃসময় অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের মানুষ দূর অতীতের ঘটনা দ্রুত ভুলে যায়। নিকট অতীতকে বেশি মনে রাখে। তাই নিকট অতীতে সংঘটিত রাজনৈতিক ভুল বা ব্যর্থতাগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে আওয়ামী লীগ কঠিন ভাবে ভুল পথে পা দেবে। আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এই মূল্যায়নের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু এটা নিয়ে কেউ দয়া করে ভুল ব্যাখ্যার অপপ্রয়াস করবেন না। পরবর্তী লেখায় বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের একটি মূল্যায়ন করার চেষ্টা করব। সবাই ভালো থাকবেন। সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:৪৫
false
fe
১৯৭৪ আর ২০১৬ এক নয়, প্রিয় জনক ১৯৭৪ আর ২০১৬ এক নয়, প্রিয় জনকফকির ইলিয়াস=========================================একটি কথা বার বার আমাকে ভাবায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশের গণউন্নয়নের ধারাটি কিছুটা হলেও দেখে যেতে পারতেন! তিনি যদি এই মাটিতে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারতেন! না তিনি পারেননি। আমি তাঁর শাসনামল দেখেছি। দেখেছি ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে কীভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। কারা তা করেছিল? কেন খাদ্যভর্তি জাহাজ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল?বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক কথা আছে। শেখ মুজিবের শাসনকে কলঙ্কিত করতেই এমনটি করা হয়েছিল। বিষয়গুলো ক্রমশ বেরিয়ে এসেছে। সেই ছবি তোলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন একজন, তার নাম রাজো বালা। তিনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন। প্রকৃত দৃশ্য বর্ণনা করতে চান না। এখনো ভয় পান। তার মতে, ‘এসব বললে ক্ষতি হতে পারে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, বলে আর লাভ কি। পরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর রাজো বালা বর্ণনা করেন সেই দৃশ্য। ছলছল চোখে আনমনা হয়ে কথা বলেন তিনি। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৭৪-এ যখন বাসন্তী-দুর্গাতিদের ছবি তোলা হয়, তখন ছিল বর্ষাকাল। চারদিকে পানি আর পানি। এমনি প্রেক্ষাপটে তিনজন লোক আসেন বাসন্তীদের বাড়িতে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান। তার নাম আনছার। অপর দুজনকে রাজো বালা চিনতে পারেনি। বাসন্তী-দুর্গাতিদের একটি কলাগাছের ভেলায় করে বাড়ি থেকে বের করা হয়। আর অন্য একটি ভেলায় রেখে তাদের ছবি নেয়া হয়। এ সময় পাশের একটি পাটক্ষেতে ছিলেন রাজো বালা। ছবি তোলার আগে আগন্তুকরা বাসন্তীদের মুখে কাঁচা পাটের ডগা দিয়ে বলে- এগুলো খেতে থাকো। এর বেশি আর কিছু জানাতে পারেননি রাজো বালা। বাসন্তীর কাকা বুদুরাম দাসের কাছে সেই ছবি তোলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কাঁচুমাচু করেন। এক পর্যায়ে অশ্রæসিক্ত নয়নে বর্ণনা করেন সেই ছবি তোলার নেপথ্য কাহিনী। শেষ পর্যায়ে তিনি ওই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং প্রতিকার চান।’তিনি বলেন- ‘সঠিকভাবে দিন-তারিখ মনে নেই। একদিন বাসন্তী ও তার কাকাতো বোন দুর্গাতিসহ পরিবারের আরো কয়েকজন মিলে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের ওপর বসেছিলেন। তখন দুপুর গড়িয়েছে। এমন সময় ইউপি চেয়ারম্যান আনসার আলী ব্যাপারী (এক সময়ের মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা) কয়েকজন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ একজন সাংবাদিককে (আফতাব আহমেদ, আলোকচিত্রী, দৈনিক ইত্তেফাক) নিয়ে আসেন মাঝি পাড়ায়। তারা বাসন্তী ও দুর্গাতির ছবি তুলতে চান। এ সময় তারা বাঁধের ওপর মাঝিদের রোদে শুকোতে দেয়া জাল তুলে এনে তা বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ির ওপর পরিয়ে ছবি (১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় এই ছবি দু’টি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। সূত্র : ‘চিলমারীর এক যুগ’ মোনাজাত উদ্দিন) তোলেন। বুদুরাম এভাবে ছবি তুলতে আপত্তি জানিয়ে নিষেধ করেছিলেন। তবুও তারা শোনেননি। এ প্রসঙ্গে বুদুরাম দাশ তার ভাষায় জানায়, ‘চেয়ারম্যান সাব, ছেঁড়া হউক আর ফারা হউক একনাতো শাড়ি আছে উয়ার উপরত ফির জাল খান ক্যা পরান, ইয়ার মানে কি? (চেয়ারম্যান সাহেব, ছেঁড়া হোক একটা শাড়ি তো আছে, তার ওপর জাল কেন পরান; এর কারণ কি?) তখন সাইবদের মইদ্যে একজন কয় ইয়ার পরোত আরো কত কিছু হইবে। (তখন একজন সাহেব জানায়, এরপর আরো অনেক কিছু হবে…)’।এভাবেই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বাসন্তীর ছবি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওই ছবিটি প্রকাশের আগে থেকেই দেশের তৎকালীন অবস্থা নিয়ে জনগণ বিচলিত ছিলেন। দুর্ভিক্ষ-সৃষ্ট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বঙ্গবন্ধু সরকার তখন প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। এ রকম একটা সময়ে বাসন্তীর ছবিটি ছাপা হয় এবং ছবিটি জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষের ভাবনা ছিল, এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন হলো। অথচ স্বাধীন দেশে একটি যুবতী মেয়ের পরার মতো কাপড় নেই। এমনটা কেন হবে। পরবর্তীতে জানা যায় ছবিটি সাজানো ছিল এবং এ থেকে মানুষ আসল সত্য জানতে পারে। একটা সরকারের বিরোধী পক্ষ থাকবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ওই আলোকচিত্রী যে কাজটি করেছিলেন তা সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। এটা অন্যায়।’কে ছিলেন এই আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ? ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে- ১৯৯৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া ফটো সাংবাদিকদের কোনো একটি অনুষ্ঠানে চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের বিশেষ করে বাসন্তীর মর্মস্পর্শী ছবিটি তোলার কারণে আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সেই ঘোষণার পর ইত্তেফাকে বিবৃতি দিয়ে আফতাব আহমেদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন খালেদা জিয়ার প্রতি। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে একুশে পদক পেয়েছিলেন তিনি। আর সেই পুরস্কারটি দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ২০০৬ সালে আরেকটি ঘটনায় আফতাব আহমেদের রাজনৈতিক চরিত্রটি আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সেই বছর ইসলামী ছাত্র শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ পদক প্রদান করা হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর হাত থেকে পদকটি গ্রহণ করেছিলেন হাস্যোজ্জ্বল আফতাব আহমেদ। এই আফতাব আহমেদ পরে আততায়ীর হাতে খুন হয়েছিলেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে।একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, মুজিবের দেশপ্রেম ও অগ্রসরমানতাকে একটি মহল শুরু থেকেই মানতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি কৃষকের হাতকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সম্পর্কের কথা কারো অজানা নয়। নির্বাচনী ডামাডোলের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ১৯৭৩-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মমতার টানে ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বরে। ব্রহ্মপুত্রের তীরে সবুজ শ্যামল অঙ্গনে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ সফর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই সফর আজো কৃষিবিদদের মায়াবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। কৃষিবিদ সমাজ ঐতিহাসিক এ দিনটির অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকেন।১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সামাজিক জীবনে একটি খড়গ নেমে আসে। বিশেষ করে সামরিক জান্তারা তাদের গদি রক্ষার জন্য নানা রকম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। নড়বড়ে হয়ে ওঠে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা। বহু কষ্টে সেই বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে জাতির জনকেরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। পরিসংখ্যান বলছে, বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বিবিএসের হিসেবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি টন। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে বর্তমানে ৫০ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যই কেবল নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। কিছুদিন আগেও যেখানে বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলু আমদানি করতে হতো, সেখানে গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের আলু রপ্তানি হয়েছে।সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বর্তমান জনগণবান্ধব সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ (এযাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) এবং আগামী অর্থবছরে যা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো। এটা বিশ্বের যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেসব সাফল্য অর্জন করেছে তা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই করতে পারেনি।গত বছর জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এসবই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের বিজয় হিসেবে। এই বিজয়কে ঠেকিয়ে দিতে অনেক প্রেতাত্মাই এখনো মাঠে। তারা কী করছে- আমরা সবই দেখছি। বলে নেয়া দরকার ১৯৭৪ আর ২০১৬ এক নয়। মানুষ এখন আর জাল দিয়ে ছবি তুলতে দেবে না। জাতির জনক ছিলেন মহান চিত্তের মানুষ। তার এই মহানুভবতাকে দুর্বলতা ভেবেই একটি মহল তাকে ঘায়েল করতে প্রয়াসী ছিল। তারাই তৈরি করেছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত।বাংলাদেশ, জাতির জনকের স্বপ্নের পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে- যাবে। মানুষ এখন অনেক সত্য জানতে পারছে, বুঝতে পারছে। আর এই অনুধাবন জাগ্রত হবে বাঙালি সমাজে- সেটাই চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ॥ ঢাকা ॥ ১৩ আগস্ট ২০১৬ শনিবার সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৩৮
false
mk
হেফাজতের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে _ অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা আর আধিপত্য বিস্তারে বিভক্ত কওমী মাদ্রাসা কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে ১৮ দলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও খেলাফত মজলিশ এবং ১৮ দলীয় জোটের বাইরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যে চলছে চরম দ্বন্দ্ব। এসব দলের নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধমূলক তথ্য প্রকাশ করছেন। তবে হেফাজতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত দলগুলো নিজেদের স্বার্থে হেফাজতের ১৩ দফা বাদ দিয়ে, যাতে হেফাজতের বাইরে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন। সূত্রমতে, হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর কাছে ১৮ দলীয় জোটের বাইরের বিভিন্ন দলের নেতারা ইতোমধ্যে জোটভুক্ত বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। ওদিকে টাকা পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে হেফাজত নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। জামায়াত-বিএনপির কাছ থেকে পাওয়া অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ক্ষুব্ধ বিভিন্ন দলের নেতারা। দলের দু’গ্র“পের দ্বন্দ্বের কারণে আল্লামা শফী নিজেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর শুরু করেছেন।সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতা ও খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, ইসলামী ঐক্যজোটের শীর্ষপর্যায়ের নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুফতি তৈয়ব, মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী, মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোটের মনোনয়ন তদবিরের অভিযোগ উঠেছে। গত রমজান মাসে রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে ইসলামী ঐক্যজোট ইফতার পার্টির আয়োজন করে। সেখানে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়াসহ জোট নেতাদের উদ্দেশ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর নেতা মাওলানা মুফতি তৈয়ব বলেছিলেন, ইসলামী ঐক্যজোট মানে হেফাজতে ইসলাম। আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারাই। জানা যায়, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষনেতারা এখনও হেফাজতের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন। সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী, মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ইসলামী ঐক্যজোটের উপদেষ্টা। এছাড়া ১৮ দলীয় জোটের বিভিন্ন শরিক দলের নেতা মুফতি ওয়াক্কাস জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরের সভাপতি, মুহিব্বুল্লাহ বাবনুগরী হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা, জুনায়েদ আল হাবিব হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা, মুফতি ফয়জুল্লাহ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্মমহাসচিব, মুফতি তৈয়ব হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা, মাওলানা আবদুর রব ইউসূফী হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা ও মুফতি ইজহারুল ইসলামসহ অধিকাংশ নেতা হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।অর্থ লোপাট, টাকার ভাগাভাগি, আধিপত্য বিস্তার আর ১৮ দলের নির্বাচনের পাঁয়তারা নিয়ে চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে রাজধানীতে হেফাজতের সবচেয়ে বড় আস্তানা হিসেবে পরিচিত লালবাগ মাদ্রাসা, কামরাঙ্গীরচর ও বারিধারা মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণকারী নেতারা জড়িয়ে পড়েছেন বিরোধে। লালবাগ মাদ্রাসার হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অন্য নেতারা অভিযোগ তুলেছেন, লালবাগিরা আহমদ শফীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে হেফাজতের সকল কর্মসূচিকে জামায়াত-শিবিরের সহযোগিতায় হিংসাত্মক ও জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে পরিণত করছে। লালবাগ মাদ্রাসার হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন চট্টগ্রামের হেফাজত নেতারাও। এদিকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী হেফাজতের প্রভাবশালী দুই যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাঈনুদ্দীন রুহীর বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে নেতাকর্মীরা। দুজনের বিরুদ্ধে ১৮ দলের কাছ থেকে টাকা এনে আত্মসাৎ করা ও নির্বাচন বাণিজ্য করার অভিযোগ এনে আমিরের কাছে বহিষ্কারের পাশাপাশি কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন নেতাকর্মীরা।ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকজন হেফাজত নেতা ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা সূত্রে বিরোধের এই চিত্রই পাওয়া গেছে। তবে এসব নিয়ে আমির আহমদ শফী প্রকাশ্যে এখনও কিছু না বললেও সম্প্রতি তিনি দুুটি সভায় দলের মধ্যে বিরোধের বিষয়ে বলেছেন, হেফাজতের ক্ষমতা টের পেয়ে দেশি-বিদেশি নাস্তিক্যবাদীরা নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য তিনি আহ্বানও জানিয়েছেন। জানা গেছে, রাজধানীতে হেফাজতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে মূলত লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও বারিধারা মাদ্রাসাকেন্দ্রিক নেতারা। তবে লালবাগ মাদ্রাসার নেতাদের আবার প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দল। যার প্রত্যেকটি ১৮ দলের অন্তর্ভুক্ত। তাই ১৮ দলের সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অভিযোগ এখানকার নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল সব সময়েই। তবে সেই বিরোধ এবার চরম আকার ধারণ করেছে। বিষয়টি সামাল দিতে হেফাজতের আমির সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন। যদিও এসব ঘটনা লালবাগ নেতাদের কেউ স্বীকার করছে না। তবে ক্ষোভের কথা বলছেন, অন্য মাদ্রাসার নেতারা। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে, আগে লালবাগ থেকে হেফাজতের ব্যানারে ঢাকার নেতারা আমিরের বক্তব্যসহ সকল কর্মসূচি প্রচার করলেও এখন চট্টগ্রামের নেতারা তা মানছেন না। একাধিক ব্যক্তি নিজেদের প্রচার সম্পাদক পরিচয় দিয়ে হেফাজতের বিবৃতি দিচ্ছেন। একই বিষয়ে দেয়া হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বিবৃতি। বিষয়টি জানতে পেরে আমির আহমদ শফী চট্টগ্রাম থেকে নিজেই বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করা শুরু করেছেন। বলা হয়েছে, তার স্বাক্ষর ছাড়া বিবৃতি দেয়া যাবে না। আবার ঢাকার নেতারা বিভিন্নভাবে বলে বেড়াচ্ছেন, তাদের বাদ দিয়ে কিছু করতে গেলে তারা মানবেন না। ঢাকায় সংগঠন করতে দেবেন না বলেও হুমকি দিয়েছেন ঢাকার অনেক নেতা। চট্টগ্রামের কয়েক নেতা আমিরের কাছে দাবি তুলেছেন, হেফাজতের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ঢাকার নেতারাই দায়ী। তাদের মতে, ঢাকার নেতাদের অতি উৎসাহ আর স্বার্থের কারণেই হেফাজতের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। যুগ্ম মহাসচিব পদের এক নেতা বলেন, আমরা আমির সাহেবকে বলেছি সঙ্কটের জন্য যারাই দায়ী তাদের তদন্ত করে চিহ্নিত করতে হবে। সকল কর্মসূচিতে ঢাকার নেতাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে তাদের রাখা যাবে না। ওই নেতারা অভিযোগ করেন, ঢাকার কিছু নেতারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই সেদিন অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে নিরীহ হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলার সুযোগ পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনী। আর রাতে সাধারণ কর্মীদের রেখে নেতারা সেখান থেকে সরে পড়েছিলেন। অবরোধে জামায়াত-শিবিরের নাশকতার কথা উল্লেখ করে আগেই কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল চট্টগ্রামের ছয়টি বড় মাদ্রাসা। এর একটির অধ্যক্ষ সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন বৈঠক করতে। তার অভিযোগ, কিছু নেতার ‘মঞ্চ কাঁপানো-অযৌক্তিক’ বক্তব্যের জন্যই হেফাজতের আজকে এ দশা হয়েছে। হেফাজত আজ বিতর্কের মুখে পড়েছে।এদিকে হেফাজতের বিরোধের কারণে একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চলেছেন। তাদের অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসছে নানা গোপন তথ্য। হেফাজতে ইমানের বাংলাদেশের ব্যানারে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ঢাকার দুটি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, হেফাজতে ইসলামের ৫ মের অবরোধের পিছনে জামায়াতের গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী শাপলা চত্বরে অবস্থান করে পরদিন ৬ মে ভোরে ব্যাংক লুট করাসহ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ছিল। অবস্থান সফল না হওয়ায় এখন এ জন্য প্রাপ্ত বিপুল অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে ঢাকা মহানগর হেফাজত এবং কেন্দ্রীয় হেফাজতের মধ্যে জামায়াত ঘেঁষা নেতাদের মধ্যে চলছে চরম দ্বন্দ্ব। অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা সঠিক না হওয়া, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও বারিধারা মাদ্রাসার নেতারা পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করাসহ বিবৃতি দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গেল রমজান মাসে হোটেল পূর্বাণীতে ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ) আয়োজিত মুফতি আমিনী স্মরণে আলোচনা ও ইফতার পার্টিতে বারিধারাকেন্দ্রিক নেতাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। এর পর থেকে বিবৃতিও দেয়া হচ্ছে পৃথক পৃথকভাবে। হেফাজতে ইমান বাংলাদেশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলের বার্তা প্রেরক আব্দুল মোস্তফা একই সঙ্গে বলেছেন, লালবাগ মাদ্রাসার হেফাজত নেতাদের বাদ দিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। গত ২ সেপ্টেম্বর কিল্লার মোড়ে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান ওরফে আনোয়ার রাজাকার কর্তৃক জামায়াত থেকে প্রাপ্ত অর্থে কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত ইসলামী দলসমূহের বৈঠকের আড়ালে হেফাজত নেতারা বৈঠকে লালবাগ মাদ্রাসার নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। লালবাগ মাদ্রাসার হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অন্য নেতারা অভিযোগ করেছেন, তারা আহমদ শফীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে হেফাজতের শান্তিপূর্ণ অরাজনৈতিক কর্মসূচিকে জামায়াত-শিবিরের সহযোগিতায় হিংসাত্মক ও জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে পরিণত করেছিল। তারা সরকারের পতন ঘটিয়ে ৬ মে দেশের শাসনভার তাদের হাতে নিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। আর এ জন্য ৫ মে দিবাগত রাতে বিএনপির অফিসে মন্ত্রীসভা গঠনের লক্ষ্যে রাতভর খাওয়া দাওয়ার ধুম ছিল বলেও জানিয়েছে হেফাজতে ইমান বাংলাদেশ। লালবাগ মাদ্রাসাকে ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসেবে আখ্যায়িত করে অবিলম্বে এই মাদ্রাসায় রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বিশিষ্ট আলেম ও নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইসলামী ঐক্য মঞ্চ।’ সংগঠনের নেতারা বলেছেন, এখানে হেফাজতসহ কারও রাজনৈতিক অফিস থাকতে পারবে না। এই মাদ্রাসা থেকেই গত ৫ মে সরকার উৎখাতের চক্রান্ত হয়েছিল। ইসলামী শিক্ষাদানের নামে এই মাদ্রাসায় চলে রাজনৈতিক কার্যকলাপ। চলে পবিত্র ইসলামকে অপবিত্র করার ষড়যন্ত্র। ইসলামী ঐক্যমঞ্চের সভাপতি মাওলানা মাসউদুর রহমান বিক্রমপুরী বলেছেন, লালবাগ থেকে বার বার ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এতে দেশের সব আলেম সমাজ লালবাগ ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের আন্দোলনকেও নিজেদের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে এই লালবাগ থেকেই। হাফেজ্জি হুজুর যে ইসলামী গণজাগরণ গড়ে তুলেছিলেন, তা লালবাগ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল। ইসলামী ঐক্যেজোটের কবরও রচিত হয়েছিল লালবাগের কারণে। তিনি লালবাগের জন্মদাতা মওদুদী জামায়াত-শিবির চক্রের ষড়যন্ত্র থেকে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। জামায়াত-শিবিরকে ইহুদির ‘দালাল’ উল্লেখ করে মাসউদ আরও বলেন, জামায়াত-শিবির চক্র ও এর দোসরদের আলেম সমাজকে চিনে রাখতে হবে। ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী মওদুদী জামায়াত প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এদেশের হকপন্থী আলেমগণের বিরোধিতা করে আসছে। তারা এখনও বিরোধিতা করছে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।এদিকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী হেফাজতের প্রভাবশালী দুই যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাঈনুদ্দীন রুহীর বিরুদ্ধেও ক্ষোভে ফুঁসছে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। দুজনের বিরুদ্ধে ১৮ দলের কাছ থেকে টাকা এনে আত্মসাত করা ও নির্বাচন বাণিজ্য করার অভিযোগ এনে আমিরের কাছে বহিষ্কারের পাশাপাশি কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন নেতাকর্মীরা। অনেকে একে হেফাজতের নেতৃত্বে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা ও সাধারণ কওমি মাদ্রাসার সাধারণ ধর্মীয় নেতাদের বিরোধ বলে অভিহিত করেছেন। আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আর সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে ১৮ দলের কাছে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার অভিযোগ এ দুই নেতার বিরুদ্ধে। দুজনই খেলাফতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে মুফতি ফয়জুল্লাহ খেলাফতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব এবং মাওলানা রুহী খেলাফতে ইসলামীর যুগ্ম মহসচিব, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সহকারি মহাসচিব। সাংবাদিকদের কাছেও ফোন করে নেতাকর্মীরা ফয়জুল্লাহ ও রুহীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরছেন। হেফাজতের কেন্দ্রীয়, ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরের একাধিক নেতাও এই দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তবে ঐক্যের কথা বিবেচনায় এনে তারা নিজেদের নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চাচ্ছেন না। তাদের মতে, ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পরে শাপলা চত্বরে রাতে অবস্থানের বিষয়ে সংগঠনের আমির শফীকে ভুল বুঝিয়েছেন ফয়জুল্লাহ ও রুহী। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা আমিরকে না জানিয়ে বিএনপির কাছ থেকে ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে রাতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত আদায় করে নেন তারা। অথচ এ সিদ্ধান্তে সংগঠনের বেশিরভাগ নেতারই মত ছিল না। পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সংগঠনের প্রায় সব নেতাই সন্ধ্যার মধ্যে সমাবেশ শেষ করে দেয়ার মতামত জানিয়েছিলেন। তার পরও সবার মতামতকে উপেক্ষা করে আমিরকে ভুল বুঝিয়ে রাতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত আদায় করে নেন এ দুজনই। এমনকি এ সময় আমিরের কাছে নিজেদের আশির্বাদপুষ্ট লালবাগকেন্দ্রিক এক-দুজন নেতা ছাড়া অন্য কাউকে এ দুনেতা ঘেঁষতে দেননি বলেও অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের নেতারা। তারা অভিযোগ করেছেন, ওই দুই নেতা টাকা লোপাট ছাড়াও ১৮ দলের শরিক দলে থাকায় তারা হেফাজতের নামে ফায়দা হাসিল করতে যাচ্ছেন। আমিরের কাছ থেকে নিজেদের মতো করে সব ধরনের সিদ্ধান্ত আদায়েও তারা দুজনই তৎপর। দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতাই। এ বিষয়ে হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ওয়াক্কাস সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত ছিল ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান না করার পক্ষে। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই সমাবেশ শেষ করে দেয়ার মত আমি দিয়েছিলাম। সন্ধ্যার একটু আগে আমিও সমাবেশ থেকে চলে গেছি। সেদিন অবস্থান না করলে হেফাজতের পরিস্থিতি এমন হতো না। তিনি আরও বলেন, এখানে অনেক ঘটনা আছে। বহু লোক নিয়ে কাজ করতে গেলে অনেক সমস্যা হয়। তবে সেদিন কারা মোনাফেকের ভূমিকা পালন করেছে, সেটা উন্মোচিত হয়ে যাবে। হেফাজতের এ নায়েবে আমির প্রকাশ্যে ফয়জুল্লাহ ও রুহীর বিরুদ্ধে কিছু না বললেও তার একাধিক অনুসারী প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেন, ফয়জুল্লাহ ও রুহী এখন নমিনেশন বাণিজ্য শুরু করেছেন। হেফাজতের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে নিজের আসন পোক্ত করার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছেন। ঢাকা মহানগর হেফাজতকেও এই দুজন নিজেদের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্যই ঢাকা মহানগর হেফাজতের বেশিরভাগ সভা নিজেদের মতো করে লালবাগেই আয়োজন করেন। ঢাকা মহানগর হেফাজতের যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী এ বিষয়ে বলেন, মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা রুহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এসব নিয়ে অচিরেই বৈঠকে বসা হচ্ছে। মুফতি ফয়জুল্লাহ’র রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কয়েকটি বক্তব্য আছে। এগুলো সাংগঠনিক বক্তব্য না, সাংগঠনিক বিরোধী। তবে অভিযুক্তদের একজন মুফতি ফয়জুল্লাহ এক কথায় বলছেন, ‘এগুলো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
false
hm
কোন যন্ত্রটি সবচেয়ে শক্তিশালী? বুলডোজারের কথা ভুলে যান। জানালা দিয়ে ফেলে দিন এক্সক্যাভেটরকে। সাগরের নিচ দিয়ে টানেল খোঁড়ার ড্রিলটাকেও পুঁতে ফেলুন ডাস্টবিনে। আসুন তিনটি যন্ত্র নিয়ে ভাবি। তারপর রক-সিজর্স-পেপার অ্যালগরিদমে এগিয়ে দেখি, এদের মধ্যে আসলে কে সবচেয়ে তাকতধারী। যন্ত্র নং ১: ষড়যন্ত্র যন্ত্র নং ২: রাষ্ট্রযন্ত্র যন্ত্র নং ৩: পরিমল জয়ধরের যন্ত্র রক সিজর্স পেপার খেলেছেন যারা, তারা জানেন, আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে দুবলা বলে মনে হয় যাকে, সে সবসময় দুবলা নয়। কাঁচি কাগজকে কাটে, কাগজ পাথরকে ঢাকে, পাথর আবার কাঁচিকে বাড়ি মেরে ভর্তা করে ফেলে। তাই এই তিন যন্ত্রের শক্তি পরীক্ষার জন্যে আমাদের একটাকে অন্যের মুখোমুখি করাতে হবে। পরিমল জয়ধরের যন্ত্রকে খুবই নগণ্য বলে মনে হতে পারে। ক্লাস টেনে পড়া এক নাবালিকার ওপর সে এই যন্ত্র প্রয়োগ করেছে। আমরা একে ধর্ষণ বললেও মেয়েটির স্কুলের অধ্যক্ষা বেগম হোসনে আরা জানিয়েছিলেন, এটি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সাধিত যৌনসঙ্গম। যদিও আইন নাকি বলে, আঠারো বছরের কম বয়সী কোনো নাবালিকার যৌনাঙ্গে শিশ্ন স্পর্শ করামাত্র সেটি ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। নাবালক নাবালিকাদের যৌন সঙ্গমে সম্মতির কোনো আইনগত অধিকারই নেই। হোসনে আরা খোদ প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন, এখন তার কথা বড় না আইন বড়, কে জানে? এখন চলুন রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিমলযন্ত্রের মুখোমুখি করাই। আমরা দেখতে পাই, অনেক পানি ঘোলার পর পরিমলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পরিমল তাদের কাছে কবুল করেছে, স্কার্ট আর টপস পড়ার "অপরাধেই" সে তার নাবালিকা ছাত্রীর ওপর চড়াও হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র পরিমলযন্ত্রের সামনে থাকার সাহস পাচ্ছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র আকারে বিরাট হলেও অরক্ষিত, স্কার্ট আর টপসও তার ঠিক জায়গামতো নেই। ওদিকে পরিমল গোপালগঞ্জের সন্তান, কখন সে তার যন্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন অরক্ষিত রন্ধ্রের ওপর হামলা চালায়, কোনো ঠিক আছে? তাই পরিমলযন্ত্রের প্রাথমিক রক্ষাবর্ম অধ্যক্ষা হোসনে আরাকে যে স্কুল কমিটি খারিজ করেছে, সেই স্কুল কমিটিকেই রাষ্ট্রযন্ত্র খারিজ করে দিয়েছে। সম্ভবত কমিটিও স্কার্ট আর টপস পড়ে কাজে নেমেছিলো। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নামান পরিমলযন্ত্রকে। হুঁ। রাষ্ট্রযন্ত্রই জানাচ্ছে, পরিমলযন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশে আপাতত বিএনপি-জামায়াতেরই ষড়যন্ত্রের মৌসুম চলমান। তারাই নিশ্চয়ই পরিমলের নুনুটি পয়মাল করার জন্যে ক্ষেপে উঠেছে। না না না, এভাবে চলতে দেয়া যায় না। কাজেই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে পরিমলযন্ত্রকে রক্ষার দায়িত্বও রাষ্ট্রযন্ত্রই হাতে নিয়েছে। রাষ্ট্রের একটা হাস্যকর চতুর্থ স্তম্ভ আছে, যেটা মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না আর, বাকি তিন স্তম্ভের ওপর ভরসা করে ঝুলছে শিথিল বিশেষাঙ্গের মতো, তার নাম মিডিয়া, মিডিয়ার রাঘববোয়ালরাও এখন পরিমলযন্ত্র রক্ষায় হাতে আর কলমে তেল মেখে নিয়েছেন। পরিমল আর পরিমলবান্ধব হোসনে আরার বিরুদ্ধে বেশ আন্দোলন চলছে, সেটাকে একদিকে পুলিশ আর অন্যদিকে সাংবাদিক পাঠিয়ে কাবু করার কাজ চলছে। শেষমেশ কোনো যন্ত্রই পরিমলযন্ত্রের বিরুদ্ধে টিকতে পারছে না। পরিমল জয়ধর ছাত্রলীগ করতো, গোপালগঞ্জের সন্তান, গোপালগঞ্জের আলোহাওয়ায় তার যন্ত্রটি বেড়ে উঠেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ বলুন আর রাষ্ট্রযন্ত্র বলুন, সবাই সেটার গোড়া ধরে উঁচিয়ে রেখেছে। পরিমলের বিচি কমসেকম তিন ইঞ্চি পুরু টাইটেনিয়াম প্লেটে আবৃত, কার সাধ্য সেখানে চিবি দেয়? ওখানে মিসাইল মারলে পরিমল বড়জোর হেসে বলবে, কাতুকুতু লাগে। হোসনে আরার বান্ধবী হোন আর না হোন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই অতীতবিস্মৃত হননি। মায়া চৌধুরীর ছেলে দীপু চৌধুরীও তাঁর গত শাসনামলে এক নিরীহ মোবাইল ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়িয়েছিলো বলে খবরের কাগজে পড়েছিলাম আমরা। পরের স্টিন্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসতে পারেননি। ক্ষমতায় এসে জোট সরকারের পাণ্ডারা শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড মেরে যখন দুই ডজন মানুষ মেরে ফেললো, দীপু চৌধুরী তখন ঐ তল্লাটে ছিলো কি? সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাপটে শেখ হাসিনাকে যখন দেশ ছাড়তে হলো, তখন কি দীপু চৌধুরী কোনো কাজে এসেছিলো তাঁর? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতায় আসতে না পারেন, পরিমল জয়ধরগোষ্ঠী আপনার উপকারে এগিয়ে আসবে কি? দীপু চৌধুরীর মতো তারাও লাপাত্তা হয়ে যাবে না? আপনি তো পরিমলের একার ভোটে ক্ষমতায় আসেননি, আসবেনও না। কনকোফিলিপ্স চুক্তি আপনার পুনর্বার ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করবে কি? মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টালকে তো আপনার অতীত সরকারের সচিব তৌফিক এলাহী চৌধুরী ছাড় দিয়েছিলো, পেরেছিলেন তার পরের স্টিন্টে ক্ষমতায় আসতে? আসবেন তো মানুষের ভোটেই। পরিমলের মতো একটা ছুঁচোকে বাঁচাতে গিয়ে কতগুলো মানুষের মন নষ্ট হচ্ছে, একটু কি তাকিয়ে দেখবেন? পাবলিক যন্ত্র নয়। সে কারণেই পাবলিকের সামনে ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র, এমনকি মহা কাবিল পরিমলযন্ত্রও খুব নগণ্য হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তখন ক্ষমতা থেকে যদি সরে দাঁড়াতে হয়, তখন ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না, রাষ্ট্রযন্ত্রও না। পরিমলযন্ত্রটিকে আর ক্ষমতাবান না করে, শাস্তি দিন। একটি আক্রান্তা কিশোরী আর তার বন্ধু-অভিভাবককে ভরসা দিন, যে আপনি তাদের ছায়া দিতে জানেন। আর না পারলে, ইতিহাস যে বারবার পুনরাবৃত্ত হয়, সেটা নিজে ভুগে আর মানুষকে ভুগিয়ে পুনর্বার প্রমাণ করে ছাড়ুন। ক্ষমতায় গিয়ে পরিমলের ওপর তো আর বিএনপি-জামায়াত হামলা করবে না, তাই না? দীপু চৌধুরীর ওপর যেমন করেনি। পুনশ্চ: পরিমল যদি কোনো শাস্তি না পায়, তাহলে তার যন্ত্রটির আদলে একটি সৌধ নির্মাণ করা হোক ঢাকা শহরের কোথাও। পরিমল, হাসান সাঈদ সুমন, এদের প্রচুর নীরব ভক্ত আছে দেশে। তাদের তো মাঝেমধ্যে কোথাও ফুলটুল দিতে ইচ্ছা করে। হোক না সিকো, তারাও তো ভোটার।
false
hm
সমর্থক রুস্তম স্টেডিয়ামে বাঘ সেজে বাংলাদেশের খেলা দেখতে যায়। কাজটা সহজ নয়। রুস্তমকে নিজের জামা খুলে সারা গায়ে প্রথমে হলুদ রং মেখে নিতে হয়। এর ওপর আঁকতে হয় কালো ডোরা। একটা কাপড়ের ডোরাকাটা লেজও সে বানিয়ে নিয়েছে, যেটা হাফপ্যান্টের সাথে সে গিঁট দিয়ে রাখে। রং মেখে বাঘ সাজার পর সে এর ওপর আবার জামা পরে স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দেয়। কখনো বাসে, কখনো অটোরিকশায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে পায়ে হেঁটে। বসন্তে আয়োজিত ম্যাচগুলোতে তার তেমন সমস্যা হয় না। তখন বাতাস থাকে শান্ত, ঈষদুষ্ণ। রুস্তম লেজটা পকেটে গুটিয়ে রেখে নাচতে নাচতে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ে, আর ঢুকে পড়ে নাচতে থাকে। স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ মানেই হরেক কোণে ওঁত পেতে বসে থাকা ক্যামেরা। তারা রুস্তমকে আজকাল খুঁজে খুঁজে বার করে দুই ওভারের ফাঁকে। ফিল্ডাররা যখন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বদলে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্যে ফিল্ডিং সজ্জা পাল্টানোর জন্যে অলস পায়ে ছুটতে থাকে, কোনো এক ক্যামেরা রুস্তমকে পাকড়াও করে কোটি কোটি মানুষের কাছে দেখায়। রুস্তম স্টেডিয়ামে ঢুকলে অন্য কোনো অচেনা দর্শক ঠিকই একটা ঢোল বাজাতে বাজাতে এসে তার পাশে এসে নাচতে থাকে, কিংবা পতাকা তুলে নাড়তে থাকে কেউ। রুস্তম বুক ফুলিয়ে লেজ দুলিয়ে বিকট লাফঝাঁপ দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে তাদের তালে তালে। বাঘ সাজলে কখনো একা হতে হয় না রুস্তমকে। ধারাভাষ্যকারেরা মাঝে মাঝে রসিকতা করে রুস্তমকে নিয়ে। বিদঘুটে টানে ইংরেজিতে চিবিয়ে চিবিয়ে হর্ষ ভোগলে জিজ্ঞাসা করে আতাহার আলী খানকে, এই লোকটা খেলার পরে গা থেকে রং তোলে কীভাবে? আতাহার আলী খান বিরস গলায় বলেন, পানি দিয়ে। দিবারাত্রির ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামে অনেক আবছায়া নেমে আসে, অনেকের মুখের অন্ধকার যোগ হয়ে তাতে, সেই আবডালে ক্যামেরা সবসময় রুস্তমকে খুঁজে বের করতে পারে না। কিন্তু ক্যামেরার নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রায়ই তার গালে দু'টি বাড়তি উলম্ব ডোরা যোগ হয়। আসর ভেঙে যাওয়ার পর রুস্তম ভাঙা বুক নিয়ে গুটি গুটি পায়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে বাস খোঁজে, অটোরিকশা খোঁজে, চুপচাপ লেজ গুটিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে যায়। কোনো ক্যামেরা তাকে তখন আর অনুসরণ করে না। রুস্তমকে পাশ কাটিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরের অনুজ্জ্বল শহরে আরো অনেকে নানা সুরে নানা স্বরে নানা কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরে। সেই ভিড়ে ভাঙা বাঘ হয়ে রুস্তমের শুধু মনে হয়, রঙের দাগটা যেন খুব বেশি চড়চড় করছে, কাপড়ের লেজটা যেন অনেক বেশি বেখাপ্পা। বাড়ি ফিরে রুস্তম চুপচাপ বালতি থেকে মগে পানি তুলে বাঘস্নান করে। চুপচাপ ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে নেয় ঠাণ্ডা তরকারি দিয়ে। তারপরে সে ভ্রুণের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়। স্বপ্নে সে একটা হলুদ-কালো ডোরাকাটা ঘুড়ি হয়ে ক্রিকেটের মাঠে ঘুরপাক খায়, দেখে নিচের সবুজ থেকে তামিম, সাকিব, মুশফিক, জিয়ার হাতে ধরা ব্যাট থেকে শিমুলের পেঁজা তুলোর মতো তার দিকে আলগোছে উড়ে আসছে সাদা বলের স্রোত, তারপর আবার ফিরে যাচ্ছে মাটিতে, সীমানার বাইরে। ছক্কা! রুস্তম ঘুমের ঘোরেই হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায়। পরদিন সে আবার ফিরে যায় নিজের কাজে। কিন্তু মাঝে মাঝে বিশেষ এক খেলায় স্টেডিয়ামে গিয়ে রুস্তম দেখে, সে একা বাঘ নয়। স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বারের সারিতে তার মতো আরো অনেক বাঘ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তারা কেউ রুস্তমের মতো হতে পারেনি। তারা এখনও ফুলপ্যান্ট পরে থাকে, সানগ্লাস পরে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের কোনো লেজ নেই। রুস্তম মনে মনে হাসে। বাঘ হওয়া এতো সোজা নাকি? হেহ। মুখ থেকে পেট পর্যন্ত রং করলেই যদি বাঘ হওয়া যেতো ... হাহাহা। স্টেডিয়ামের ভেতরে যাওয়ার পর সেসব পার্থক্যও ঘুচে যায়। আন্তর্জাতিক মানের ক্যামেরাগুলো তাদের স্বচ্ছ আর নিরপেক্ষ লেন্স বাগিয়ে স্টেডিয়ামের সব বাঘকে ধরতে গিয়ে ট্রাইপডের বিয়ারিং ক্ষয় করে ফেলে। ডানে বাঘ, বামে বাঘ। কেউ লাফাচ্ছে, কেউ নাচছে, কেউ বসে বসে মোবাইলে কথা বলছে। অনেক বাঘের ভিড়ে তারা রুস্তমকে খোঁজে। রুস্তম হচ্ছে সেই বাঘ যে কখনো খেলা কামাই করে না। যেখানেই বাংলাদেশ, সেখানেই রুস্তম। রুস্তম এক কোণে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠাভরে চেঁচায় আর নাচে। সে জানে, রুস্তম-বাঘ না নাচলে রান উঠবে না বাংলাদেশের, না চেঁচালে উইকেটও পড়বে না বিশেষ খেলার অন্য দলটার। বৃষ্টি নামুক, বাজ পড়ুক, শিল পড়ুক বা শিশির পড়ুক, তাকে নাচতেই হবে। রুস্তম নাচতে নাচতেই দেখে, স্টেডিয়ামে সবাই বাঘ সেজে আসে না। কেউ কেউ আসে শূকর সেজে। তাদের গালে সবুজ জমিনে সাদা চাঁদ-তারা আঁকা। অন্য দলটা মাশরাফির বলে চার হাঁকালে তারা আনন্দে ঝলমল করে ওঠে, অন্য দলটা স্পিনের মোচড়ে মুশফিককে আউট করে দিলে তারা শীৎকার করতে থাকে, অন্য দলের খেলোয়াড়রা যখন পানীয় বিরতির সময় ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তাদের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ওঠে। রুস্তম তখন ঢোলে জোরে বাড়ি দিতে বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। নিজের হুঙ্কারে সে এই শূকরদের ঘোঁৎঘোঁৎ চাপা দিতে চায়। শূকরেরা আড়চোখে তাকে দেখে চুপচাপ বসে যায় আবার। বাংলাদেশ খেলার মাঠে হেরে যায় তবুও। রুস্তম ক্যামেরার গ্রহণবলয়ে দাঁড়িয়ে বুক উজাড় করে কাঁদে, তার গালে আবারও বাড়তি ডোরা যোগ হয়। শূকরের দল উৎফুল্ল মুখে মোবাইলে কথা বলতে বলতে স্টেডিয়াম ছাড়ে। রুস্তম ভাঙা মন নিয়ে বেরিয়ে আসে স্টেডিয়াম ছেড়ে আবার। রাতে বাড়ি ফিরে সে নিদ্রার ঘোরে স্বপ্নে দেখে, বিশাল এক বাঘা ঘুড়ি হয়ে সে ভাসছে স্টেডিয়ামের আকাশে, তার চারপাশে বেলুন হয়ে ঘুরছে কতোগুলো হাসিমুখ দেঁতো চাঁদ-তারা শূকর। রুস্তম ছুটে ছুটে তাদের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে, আর নিচ থেকে একের পর এক সাদা বল এসে শূকরবেলুনগুলোর মুখ চূর্ণ করে দিচ্ছে। রুস্তম ঘুমের ঘোরে হো হো করে হাসে আর পাক খায়। শূকর জিতে গেলেও শূকরই রয়ে যায়। আর বাঘ হেরে গেলেও থেকে যায় বাঘ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রুস্তম আবার কাজে বেরিয়ে যায়। শহরের মানুষ আর শূকর অবাক হয়ে দেখে, একটি গর্বিত বাঘ লেজ দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাথ ধরে, আর তার মাথার ওপর শনশন করে ছুটে যাচ্ছে একটা হলুদ-কালো ডোরাকাটা ঘুড়ি।
false
hm
কবিতা লেখা আমার ধারণা, আমার "ড্রাইভিং সেন্স" খুব একটা মানসম্পন্ন নয়। আমি এখনো পর্যন্ত গাড়ি চালানোর চেষ্টা করিনি। শেখার সুযোগ এসেছে বহুবার, তারপরও না। মোটর সাইকেল এবং মোটরহীন সাইকেল, দু'টো নিয়েই আমি বেশ কেলেঙ্কারিয়াস দুর্ঘটনায় পড়েছি একাধিকবার। এখন যেমন বাইসাইকেল চালানোর বেশ চমৎকার সুযোগ আছে, তারপরও সাইকেল চালাই না। এই একই কারণে আমি কবিতা লিখি না। আমি কবিতা লিখতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। কবিতার ক্ষেত্রে "হয়ে ওঠা"র একটা ব্যাপার থাকে, সেটা আবার সব সময় হয়ে ওঠে না। খারাপ একটা কবিতা লিখলে, বা বলা যায়, একটা কবিতা লিখে ফেলার পর সেটা খুব একটা পদের কিছু হয়নি, তা টের পাওয়ার অনুভূতিটা অনেকটা ঝোড়ো বাতাসে লুঙ্গি উড়ে যাবার মতো। পাঠক, আপনার কি কোনদিন ঝোড়ো বাতাসে লুঙ্গি উড়ে গেছে? যদি না যায় তাহলে একটা বাজে কবিতা লিখে দেখুন। তারপরও আমি কিছুদিন কবিতা লিখেছি। এখনও মাঝে মাঝে হাওয়া অনুকূল থাকলে দু'একটা লেখার চেষ্টা করি। কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁদের মোটা দাগে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। একদল কবি, সে কারণে কবিতা লেখেন। দ্বিতীয় দলের লোকেরা (যেমন আমি) ঠিক নিজেকে সামলাতে পারেন না। কবিতার চাপ নাম্বার টু-এর মতো অনেকখানি, খুব ঝামেলায় ফ্যালে, একে নিষ্কাশিত না করলে নানা কেলেঙ্কারি হয়। পেট খারাপের সাথে তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে, এ হচ্ছে হৃদয় খারাপ হওয়া। আমি এই পোস্টে মূলত যা করতে চাইছি তা হচ্ছে বিটিভির পুনর্প্রচারের মতো। পুরনো কিছু কবিতা আবারও সম্প্রচার করা হচ্ছে। নতুন কবিতা লিখতে গেলে নতুন করে হৃদয় খারাপ হওয়া প্রয়োজন, সেটাও কুলিয়ে উঠতে পারছি না আপাতত। পুরনো কবিতা মাঝে মাঝে লোকজনকে শোনানোর দরকার হয়ে পড়ে, দীর্ঘদিন ফোনালাপের অনভ্যাস আর ব্লগের বদভ্যাসের কারণে পুনর্পোস্টের পথকেই বেছে নিচ্ছি। আমার কবিতাগুলি ২০০৩ থেকে ২০০৬ এর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে "বোকাদের পদ্য" শিরোনাম ও ক্রমিকে লেখা, সচলায়তনের ভেটেরান ব্লগাররা বহু আগেই এসব কবিতা পড়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। নতুন সচলদের বন্দুকের মুখে জিম্মি করে কবিতা পড়ানোর এই সুবর্ণ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না। তুফানে বেঁধেছি লুঙ্গি, বাতাসে কী ভয়? ১. কাকের উড্ডাল ধরে এগোলেও অযুতেক ক্রোশ দূরে আছি তবু ভাবি, এখনো শরীরজলে ডুবে সঞ্চিত নিশ্বাস ফেলি মুখ রেখে স্তনের বিষুবে একবার, বারবার .. .. ঘ্রাণ নিই নিপাট সন্তোষে৷ আমার আক্ষেপ ছোঁয়া দিয়ে যায় অযুতেক ক্রোশে৷ ২. প্রত্যেক ক্রিসমাসে স্কুলে নাটক হতো তুমি অবধারিতভাবে রাজকন্যার গুলগুল্লা রোল পেয়ে যেতে নীরব সন্তুষ্টিতে তোমার গালে বেগুনি আঁচ লাগতো, আমি দেখতাম আমার ভুরুর আড়াল থেকে। আমাকে সবাই বলতো নিয়ান্ডার্টাল হিমু নাটকের স্যার মৃদু হেসে বলতেন, কোয়াসিমোদো ... আমি তখনও জানতাম না ... নোতরদামের কুঁজো তো পড়বো স্কুল ছেড়ে যাবার পর, নইলে তখনই আঁচড়ে খামচে উঠে পড়তাম স্কুলের পাশের পুরানো চার্চটা বেয়ে। স্কুলের নাটক একেক বছর একেকটা, কিন্তু সবই লিখতেন নাটকের স্যার সেখানে রাজকন্যা আর কুৎসিত ক্রীতদাস থাকবেই কারণ তুমি পড়তে সে স্কুলে আর আমিও পড়তাম আমরা নাটক ভালোবাসতাম, দু'জনেই ...। আমি সেই ছোট্ট তোমাকে নতজানু হয়ে কুর্ণিশ করেছি, যখন আমি সেই ছোট্ট আমি ছিলাম হাঁটু গেড়ে বসে কতবার রাজকন্যার জুতোর ফিতে বেঁধেছি আমি ক্রীতদাস আমার হাতে বর্ষাতি আর টুপি সঁপে দিয়ে কত ভিনদেশি রাজপুত্র তোমার পদ্মকোরকের মতো নরম হাত নিজের মুঠোয় নিয়েছে এক এক বছর আমি সেই টুপিবর্ষাতির ভুলে যাওয়া ন্যাপথলিনের গন্ধ নতুন করে ফিরে পেয়ে চমকে দাঁড়িয়ে থেকেছি কত নাটক করলাম আমরা দু'জন কত মারপিট, অস্ত্রের হ্রেষাধ্বনি মঞ্চে গড়াগড়ি দিলো কত সুপুরুষ স্কুলপড়ুয়া আর তুমি জড়িয়ে ধরলে আরো সুপুরুষ কতো স্কুলপড়ুয়াকে আমি ক্রীতদাস ছেঁড়া পাজামার হাঁটু ময়লা করে চিনে নিলাম তোমার প্রতি বছরের নাটকের জুতোর ফিতাবিন্যাস রাজপুত্রদের বর্ষাতির বল্লরী আর, নিথর দাঁড়িয়ে থেকে, মঞ্চে, তোমাকে। সামনে ক্রিসমাস আসছে, রাজকন্যা আমি, নিয়ান্ডার্টাল হিমু, নাটকের স্যারের কোয়াসিমোদো এবার সটান মাথা উঁচিয়ে বলবো আমার ভাঙা গলায়, স্যার আমি আর নাটক করবো না। ৩. উত্তরের অন্ধকার, সকলেই ঝড় বলে তাকে শনাক্ত করেছে, আর কালবৈশাখী নাম ধরে ডাকে বিভ্রান্ত মানুষগুলো জানেনি তো এ আন্ধারী ঝড় এ সন্ধ্যায় আমাদের ব্যক্তিগত একান্ত ঈশ্বর৷ ছাদের পানির ট্যাঙ্কে থরথর লোহার সোপান বজ্রের ধমকে যত অট্টালিকা ভয়ে কম্পমান আমিই উদ্বাহু নাচি, অট্টহাস্যে বলি আয় আয় নিজেকে করেছি বলি, তুই ছাড়া আমাকে কে খায়? হাতের মুদ্রায় তোর বায়বীয় প্রতিমাকে গড়ি নৈবেদ্য চেটে যা এসে একচক্ষু ঈশ্বরসুন্দরী বজ্র হাওয়া জল তোর যা যা আছে সঙ্গে নিয়ে এসে আলিঙ্গন হয়ে যাক নিঃশর্ত উদ্দাম ভালোবেসে৷ তোকেই হেনেছি প্রেম, বায়ুস্রোত, হে নির্মাণখাকি পুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যা আমায়, মধুবৈশাখী! ৪. স্বপ্ন, নাকি জেগেই ছিলাম নাকি ও দুটোর কোনটাই নয় আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি হ্যাঁ, তোমার কবোষ্ণ বুকেই হাত রেখে বলতে পারি খুল যা সিম সিম বলে হা রে রে রে আমার দিকে তেড়ে এলো একের পর এক ছেঁড়া কাঁথায় মোড়া লাখটাকাগন্ধী কাগজের বান্ডিল বান্ডিলের কাগজ কে যে কার বুঝে উঠতে না উঠতেই আবার দশদিক কাঁপিয়ে চিৎকার ওঠে খুল যা সিম সিম আমি দেখি আমার অস্থিপঞ্জর আলিবাবার গুহার দরজার মতো হুটহাট খুলে যায় দল বেঁধে ঈভের কাঠামোর মতো নেচে বেড়ায় তারা চারপাশে আর আমি হাড়হারা হয়ে তৈমুর লঙের মতো ছটফটিয়ে ছুটে ফিরি কাগজের বান্ডিলের পিছু পিছু স্বপ্ন? নাকি জেগেই ছিলাম? নাকি ও দু'টোর কোনটাই নয়? নাকি দু'টোই সত্যি ছিলো? এই দ্বিধা আর দ্বৈরথে পড়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত তোমার বুকে হাত রাখাই সত্যি আর সত্যি হয়ে থাকে। ৫. মৃত্যু, অভিমানী বালিকা প্রেয়সী অমন নরম হাতে কচি হাঁটু শক্ত বেঁধে বসে, খোলা চুলে মুখ ঢাকো, কান্না তবু ঠেলে আসে ঠিকই তোমার আদুর পিঠ তারই ভারে কেঁপে ওঠে, কোমল সরসী --- যতো যাই --- যতো চাই, ভালোবেসে কাঁধ ছুঁয়ে বলি আর মাত্র ক'টা দিন কেটে গেলে তোমার সাথেই হাত ধরে ছুটোছুটি, বাগানোর ফুল চুরি খেলা ... অফুরন্ত সঙ্গ দেবো এত অল্পে অভিমানীকেই। বালিকা শোনেনা কথা, বাহুমূলে মুখ গুঁজে রাখে তাকে ফাঁকি দিয়ে কেন জীবনের সঙ্গে উঠি বসি? ৬. আষাঢ় আসুক, তার চলে আসা রোধের অতীত কদম্বে আপত্তি নেই, কিন্তু ভারি জল জমে যায় কাদারা থিতিয়ে গেলে হাঁটা পথে আরশিতে দেখি আমারই আষাঢ়ে মুখে আকাশের মেঘের সঙ্গীত। কোকিল নিথর আজ, ব্যাঙেদের মুশায়রা ক্ষীণ আকাশ গম্ভীর তবু সবুজ সবুজতর লাগে বারান্দার মুখোমুখি ছাদে দুটি সতেজ বালিকা আষাঢ়কে ঋদ্ধ করে তারাই --- বর্ষণে ব্রীড়াহীন। মেঘদূত! --- ভেসে যায়, তার দৌত্যে আস্থা কারো নেই --- আমার চুম্বন তুমি দিও এই মেয়ে দুটিকেই। ৭. আবারও হয়তো কোন ভেজা দিনে ছোঁয়াছুঁয়ি হবে, যতখানি শুন্যস্থান আমাদের মধ্যে টেনে আনি পার হবো কিছু তার, তুমি --- নয়তো আমি, ঠিক জানি --- তেমনই শেখায় বৃষ্টি, শ্রাবণের বৃষ্টিগ্রস্ত দিন আর --- তেমন কঠিন নয় এ প্রকৃতিক্লাস, শিক্ষণেও নেই কোন ভুল দেখি রোজ মেঘমগ্ন জল ছোঁয় ঘাসের মাস্তুল। ৮. ভেজার ইচ্ছে আমার খানিক ছিলো খুকিই তাকে উসকে অনেক দিলো আলতো হেসে আমার পাশে এসে জলের ধারা নিজের গায়ে নিলো। আকাশ তখন ভার করেছে মুখ-ই খুকি তবু তাকে দেখেই সুখী বাজের আলোর তাল মিলিয়ে হেসে বৃষ্টি মাথায় বেড়ায় ছুটে খুকি। তেপান্তরের সেই গহীনে ঠায় ভিজেই কাটে আমার বিকেল হায় বাতাস কাঁপে মেঘের ধমক শুনে খুকির হাসির দমক বেড়ে যায়। মেঘদেবতার মুড ভালো নেই বুঝি শিলের পাহাড় ছিলো কি তাঁর পুঁজি? ভীষণ বেগে পড়তে থাকে তারা। সেই তুফানে খুকিকে কই খুঁজি? হাত বাড়িয়ে ধরতে তাকে গেলে চমকে উঠে দেয় সে আমায় ঠেলে আমরা দু'জন ছুটতে থাকি দূরে পিপুল গাছ এক যেথায় বাহু মেলে। গাছের নিচে ক্ষুণ্ন মনে বসে খুকির চোখে অশ্রু পড়ে খসে বেশ তো ছিলো জলের সাথে খেলা বিগড়ে গেলো সবই ঝড়ের দোষে। থামলো শেষে ঝড়ের মাতামাতি .. .. হাওয়ার সাথে গাছের হাতাহাতি .. .. তেপান্তরে শিলের ঝিকিমিকি .. .. খুকি আমার সে উদ্ভাসের সাথী। আমি কিন্তু নিপাট সরল মনে শুধিয়েছিলেম, "শিল কুড়াতে যাবে?" খুকি ভাবলো কী তা কে বা জানে মুখ ফেরালো ভীষণ অসদ্ভাবে। .. .. শিলগুলো সব জল হয়েছে গলে খুকিও গেছে নিজের পথে চলে আমিই শুধু একলা ভেজা মনে অশ্রু শিশির মেশাই মেঘের জলে।
false
rg
সজল খালেদ, বাংলাদেশের মিডিয়া এবং এভারেস্টনামা।। ২০১০ সালের ২৩ মে এভারেস্ট চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে লাল সবুজের পতাকা ওড়ালেন মুসা ইব্রহিম। বাংলাদেশের সকল মিডিয়া তখন ডেইলি আপডেট করেছিল। মুসা'র সর্বশেষ পরিস্থিতি। সারা দেশে তখন মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে মিডিয়া নাচানাচি করেছিল। আবার এমএ মুহিত ২০১১ সালের ২১শে মে যখন দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট জয় করল তখন মিডিয়া অনেকটা দায়সারা গোছের নিউজ করেছিল। ভাবটা এমন এমএ মুহিতটা আবার কে? মিডিয়াকে তখন ভারী অসহায় মনে হচ্ছিল। কেউ কেউ অবশ্য মুসা আর মুহিতকে নিয়ে আড়ালে আবডালে আলোচনা করেছিল। সেখানেও মুসাকে এগিয়ে রাখা হয়েছিল আলোচনায়। এরপর ২০১২ সালের ১৯শে মে বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন নিশাত মজুমদার। মিডিয়া যেনো একটু বিরক্ত! নিশাত মজুমদার কে? তার তো প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করার কথা নয়। তখন এমএম মুহিত মিডিয়াকে আরেকটা চপেটাঘাত মারলেন কষে। দেখো বাংলাদেশ, এমএ মুহিত বাংলাদেশের একমাত্র ছেলে যিনি দু'বার এভারেস্ট জয় করেছেন। তারপরেও মিডিয়ায় তেমন হাঁকডাক নেই। মিডিয়ার অপেক্ষা যেনো শেষ হয় না আর...অবশেষে মিডিয়ার খোরাক যোগাতে এভারেস্ট চূড়ায় নাম লেখালেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী হিসেবে তিনি এভারেস্ট জয় করলেন ২০১২ সালের ২৬ মে। অর্থ্যাৎ নিশাত আর মুহিতের এভারেস্ট জয়ের ঠিক এক সপ্তাহ পর। তাতে কি, তাতে কি? ওয়াসফিয়া নাজরীনকে নিয়ে আবার গোটা মিডিয়া জগত নাচানাচি শুরু করল। সেই নাচানাচিতে নিশাত আর মুহিতরা হারিয়ে যাবার মত দশা। মিডিয়ার থেকে সরকার বাহাদুর বা পিছিয়ে থাকবে কেন? সোজা গণভবনে ডেকে চার বাংলাদেশীকে মুসা, মুহিত, নিশাত, নাজরীনকে বিপুল ফুলেল সংবর্ধণা দেওয়া হল। বাংলাদেশ দেখলো চার এভারেস্ট বিজয়ীকে একসঙ্গে। কিন্তু মিডিয়ার ভারী দুঃখ! আহা মুসা আর নাজরীন ছাড়া তাদের কাছে মুহিত আর নিশাত যেনো অপাংতেয় কোনো ভীন দেশী। মিডিয়া মুসা আর নাজরীনের কীর্তিতে খুশি। মুহিত আর নিশাতের কীর্তিতে অভিমানী। হায়রে বাংলাদেশের মিডিয়া!!সর্বশেষ পঞ্চম বাংলাদেশী হিসেবে সজল খালেদ এভারেস্ট জয় করেছেন ২০ মে ২০১৩ সালে। ২১শে মে ২০১৩ সালে সজল খালেদ এভারেস্টের অন্তঃত ২৮ হাজার ২১৫ ফুট উচ্চতায় এসে মুত্যুর কোলে ঢলে পরেন। আমাদের হাজার হাজার মিডিয়া সেই খবরটি পায় সজল খালেদ মারা যাবার পর। এমন কি সজল খালেদের এভারেস্ট জয়ের খবরটি পর্যন্ত বাংলাদেশ জানতো না যদি না তাঁর মৃত্যু হতো অথবা সজল ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের না জানাতেন। অর্থ্যাৎ সজল খালেদের প্রতি মিডিয়া যেনো আরো নাখোশ। অথচ পাঁচজন এভারেস্ট জয়ী বাংলাদেশীর মধ্যে একমাত্র সজল খালেদই স্বয়ং মিডিয়ার মানুষ ছিলেন। আর বাংলাদেশের হাজার হাজার সংবাদপত্র, কুঁড়ির উপরে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল, কয়েক শো অনলাইন সংবাদপত্র, হাজার হাজার স্যোসাল মিডিয়া কিন্তু কোথাও সজল খালেদের এভারেস্ট জয়ের খবরটি আমরা আগে পাইনি। বাংলাদেশে মিডিয়ার আরেকটি পরিচয় হল বেশ্যার মত। যাকে তাদের পছন্দ তাকে তারা বিখ্যাত বানায়। যাকে তাদের অপছন্দ তাকে তারা ভিলেন বানায়। বাংলাদেশে মিডিয়ার এই চরিরত্রহীনতা অনেক পুরানো। হাজার হাজার মিডিয়ার ভিড়ে এখন আসল খবরটি সবার আগে পেতে হয় স্যোসাল মিডিয়া থেকে। আহারে বাংলাদেশের মিডিয়া। আমার প্রশ্ন, একজন মুসা ইব্রাহিমের জন্য আনিসুল হকরা কাঠমুন্ডুতে বসে থাকেন। একজন ওয়াসফিয়ার জন্য আনিসুল হকরা পারলে হিমালয়ের বেস ক্যাম্পে ছুটে যান। একজন এমএ মুহিতের জন্য প্রথম আলো'র কলম ভাঙার অবস্থা। একজন নিশাত মজুমদারের জন্য মিডিয়ার অশ্রুসজল আবেগ। আর একজন সজল খালেদে যিনি কিনা নিজেই মিডিয়ার মানুষ, তাঁর জন্যে কেউ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ছুটে যায় না। এই হল বাংলাদেশের মিডিয়ার চরিত্র। সজল খালেদের এভারেস্ট জয়ের খবর খোদ সরকারি সংবাদ মাধ্যম ঠিক সময়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সবার চেয়ে উন্নয়নের অগ্রগতিতে এগিয়ে থাকলেও সরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলো খবরের বেলায় সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকতেই যেনো বদ্ধপরিকব। আহারে বাংলাদেশের মিডিয়া। ভারী কষ্ট লাগে তাদের এই চরিত্র দেখে। বেশ্যার তবু একটি সুনির্দিষ্ট চরিত্র আছে কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়ার সত্যি সত্যিই কোনো চরিত্র নেই। একেবারেই চরিত্রহীন। ডাহা মিথ্যাকে তারা সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায়। আবার জীবন্ত সত্যকে তারা অবলীলায় অবহেলা করতে কেতাবপণ্ডিৎ। মানে হল, মিডিয়ার পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়ে আপনি মহাকাণ্ড করে ফেললেও মিডিয়ার কিছু যায় আসে না। আর আপনি যদি মিডিয়ার পছন্দের তালিকায় থাকেন, আপনি সকালে বায়ুত্যাগ করেছেন কিনা, করলে কয়বার করেছেন, দিনে কয়বার করেন, ঘুমের মধ্যে বায়ুত্যাগের অভ্যাস আছে কিনা, তার সঠিক তথ্য উদ্ধারে মিডিয়া আপনার বাসায় স্পেশাল প্রতিনিধি পাঠাবেন। আপনি হাঁচি দিলে শব্দ হয় কিনা, হাঁচি কতদূর থেকে শোনা যায়, হাঁচির ধরণ কেমন, ডাক্তার দেখানো জরুরী কিনা এসব বিষয়ে মিডিয়া আপনার উঠোনে বসে থাকবে। তারা খবরের জন্য আপনাকে একটা মোয়া বানিয়েছে। এবার আপনার কাজ শুধু খবরের ডিম পারা। ধিক মিডিয়ার এসব বেহায়াপনাকে। ধিক মিডীয়ার অসততাকে। ধিক মিডিয়ার নির্লজ্বতাকে।সজল খালেদের কাছ থেকে মিডিয়া এখন শত চেষ্টা করেও তাঁর এভারেস্ট জয়ের অনুভূতি জানতে পারবে না। রানা প্লাজার মৃত্যুকূপ থেকে অসুস্থ মানুষ বের হবার পর যেসব মিডিয়া তাদের অনুভূতি জানতে চায়, এরা তো সেই মিডিয়া, যাদের নিজস্ব কোনো অনুভূতি নেই। এখন বাংলাদেশের সকল মিডিয়া একাট্টা হয়ে পারলে সজল খালেদের অনুভূতি জানুক। মৃত্যুর আগে আগে সজল খালেদের কেমন অনুভূতি ছিল, এমুন বেহায়া প্রশ্নও হয়তো কারো নোটবুকে জমা আছে!বাংলাদেশের মিডিয়ার উচিত সজল খালেদের এভারেস্ট জয়ের খবরটি সঠিক সময়ে না দিতে পারার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। আর আবহাওয়া অনুকূলে আসলে যখন হিমালয় থেকে পর্বতারোহীদের মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়, তখন অন্তঃত বাংলাদেশ থেকে যাতে সজল খালেদকে খুঁজতে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে বিষয়ে এখনই সকল কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা। এই বিষয়ে সরকার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী না হলে সজল খালেদের লাশ কোনো দিন আমরা পাব না। হিমালয়ের নেশা যার ধমনিতে তাঁর কবর শেষ পর্যন্ত হিমালয়ের অজানা নিশানায় চিরকালই কি হীমশীলত হয়ে পড়ে থাকবে? বাংলাদেশের মিডিয়ার অন্তঃত এই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হবার অনুরোধ রইল।
false
ij
গম্ভীরা_ যে গানের কথায় ও সুরে ফুটে ওঠে গ্রামীন সমাজের সঙ্কট বাংলার লোকসংগীত যে কত সমৃদ্ধ সে কথা আর নতুন করে কী কব। ভাওয়াইয়া, জারি-সারি-মুর্শিদি ...একেক অঞ্চলের ভাবের প্রকাশ একেক ধরনের-সবই শ্রুতিমধুর; দার্শনিক। এবং, মনোমুগ্ধকর। রাজশাহী ও (চাঁপাই)নবাবগঞ্জে তেমনি গম্ভীরা গান অত্র অঞ্চলের জনমানসের ভাবের প্রকাশক। অত্যন্ত আকর্ষনীয় সে গান-যে গানের কথা ও সুরে ফুটে ওঠে গ্রামীন সমাজের অনিবার্য সঙ্কট। সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম পূজ্য দেবতা শিব। শিবের এক নাম, ‘গম্ভীর’। কাজেই এককালে শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়; ‘গম্ভীরা’। শিব> গম্ভীর> গম্ভীরা। পরে, যেমন হয়-গম্ভীরা গানের ধরন যায় বদলে। গানের সুরে সুরে দেবদেবীকে সম্বোধন করে বলা হতে থাকে গ্রামীণ দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ। কখনও কখনও সারা বছরের প্রধান প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হত। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্য তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত। এসবই বিভাগ-পূর্ব সময়ের কথা। এই কথা বলার কারণ আছে। গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্থানের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গম্ভীরা টিকে রইল। তারপর থেকে গম্ভীরা গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। ফলত, গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়ে ওঠে অনিবার্য। যেমন -আগে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হত। বর্তমানে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের পরিবর্তে ‘নানা-নাতি’র ভূমিকায় দুজন অভিনয় করে। কাজেই, গানটা সর্ম্পূনতঃ মর্ত্তের মানুষের হয়ে গেল। দেবতারা সব তফাতে গেলেন। যাগ গে। নানার মুখে পাকা দাঁড়ি, মাথায় মাথাল,পরনে লুঙ্গি; হাতে লাঠি। আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা ইত্যাদি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের ছবি। ‘নানা-নাতি’র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। এভাবেই দেশবিভাগের পর থেকেই রাজশাহী নবাবগঞ্জ ও নওগাঁ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গম্ভীরা। বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে গম্ভীরাই সবচে বেশি জনমানুষসংশ্লিষ্ট গান। কেননা, গানে গ্রামীণজীবনের সমস্যা তুলে ধরা হয় ও সমাধানও বলে দেওয়া হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সংলাপ ও গানের মাধ্যমে কোনও একটা বিষয় তুলে ধরা হয়। গানের একটি ধুয়া থাকে; সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলি ধুয়ার সুরে গীত হয়। গম্ভীরা গানে প্রধানত গ্রামীণসমাজের নানা দোষ-ক্রটি উঠে আসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিবউদ্দীন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম প্রমূখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। এঁরা গম্ভীরাকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তথ্যউৎস: বাংলাপিডিয়া। সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৪৫
false
hm
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা একটু বড় ... লেখাটা ২০০৪ সালের অক্টোবরে লেখা। বছরদুয়েক আগে একাধিকবার অনলাইনে প্রকাশিত। এই লেখাটা একাধিক কারণে আমার প্রিয়। প্রথমত, লেখাটা প্রায় এক আসনে লেখা, মাঝখানে শুধু ঘুমিয়েছিলাম একটু। দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত এটাই আমার ম্যাগনাম ওপাস (আয়তনের দিক থেকে)। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটা, এমন একটা সময় এ লেখায় ধরে রাখা আছে, যা আমি আর কখনো পাবো না। পাঠকদের আরো জানাই, এ লেখায় কোন কল্পনাশ্রিত ঘটনা নেই। যা কিছু বলা হয়েছে, তা ঘটেছে, চরিত্ররাও সবাই এখনো জীবিত, চঞ্চল বাদে সবাই সহমত হবেন এই লেখার সাথে। আয়তনের কারণেই এর আগে লেখাটা পুরো পড়েছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা কম। তবে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া আমাকে আনন্দিত করেছে বরাবর। যিনি লেখাটা পুরো পড়বেন, তিনি ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবেন আমার কাছে। আর খুব দুঃখিতচিত্তে অনুভব করি, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে কীভাবে অনর্গল লেখার শক্তি আমাকে পরিত্যাগ করেছে। শিরোনাম দেখে পাঠকসমাজের (পাঠিকারাও আছেন এই দলে) মনে হতে পারে, হিমালয় বা আনদেজ চষে বেড়িয়ে এসে কলম হাতে নিয়েছি। আদপে ব্যাপারটা সেরকম নয়, ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলে, বান্দরবানের রুমা থেকে রাঙামাটির পুকুরপাড়া পর্যন্ত বিসতৃত গরীবের এই অভিযান। ভেবেছিলাম উত্তম পুরুষে লিখবো না, তেমনটা লেখা এই নরাধমকে মানায়ও না। কিন্তু এবারের যাত্রায় অনেকেই পৃথক ফল হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, কাজেই সেসব ফলের একটা সালাদ পাঠকের সামনে হাজির না করে বরং পেছন ফিরে আমার চোখেই গোটা অভিযানটাকে আগাপাশতলা একবার চেখে দেখি। স্মৃতির সাগর মন্থন করতে থাকলে এক সময় অমৃত কিছু মিলবেই, আর গরল যা উঠে আসবে, তা নিজের গলায় রেখে নীলকন্ঠ সাজতে আমার কিচ্ছু আপত্তি নেই। এক: নির্গলদ বিসমিল্লাহ কেওকারাডং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (মাত্র ৩,১৭২ ফিট উঁচু), আর সেখানেই নানা রূদ্ধশ্বাস কাহিনীর বুনটে সূর্যোৎসবের অভিযান দিয়েই EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর যাত্রা শুরু। বলা যেতে পারে, বান্দরবানের গহীন পাহাড়ি এলাকাই এই ক্লাবের আঁতুড়ঘর। ক্লাবের অভিযাত্রীদের অনেকেই পরে আবারো ফিরে গেছেন কেওকারাডঙে, বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন পথে। জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে কবিতার বিখ্যাত-বিতর্কিত একটি পঙক্তি পড়েছিলাম: মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে --- যদি বলি এক্সপ্লোরার ক্লাবের সদস্যদের কাছে নোনা মেয়েমানুষটি হচ্ছে বান্দরবানের পাহাড়গুচ্ছ, খুব একটা অতিশয়োক্তি হবে না। এই পাহাড়ের সারিগুলোর সৌন্দর্যের সাথে লুকিয়ে আছে এক আকর্ষক শক্তি, যা একজন ট্রেকারকে একাধিক অভিযানের জন্যে হাতছানি দেয়। এই ফেব্রুয়ারিতে সেই হাতছানিকে উপেক্ষা করার শক্তি ECB সদস্যদের একদমই ফুরিয়ে এসেছিলো। পাহাড় কতখানিই বা আছে এই বাংলাদেশে? উত্তরে গারো পাহাড়ের কয়েকটি শিরা, উত্তর পূবে খাসিয়া আর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের খাটো দেয়াল, আর নিচে দক্ষিণ পূবে মগের মুল্লুকে আরাকানের কিছু দলছুট পাহাড়। বাংলাদেশের ভেতরে এক হাজার মিটারের ওপরে কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই স্বল্প উচ্চতার --- স্বল্প বলছি এ কারণে, একবার উত্তর পশ্চিমে চোখ মেলে তাকালেই নগরাজ হিমালয়কে চোখে পড়ে --- মাঝেই পাহাড়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রস্তরনন্দিনী সব ঝর্ণা, পাথুরে ছড়ার খাত, ঘন নিবিড় জঙ্গল, হঠাৎ গভীর খাদ, বাঁশের ঝোপে ছাওয়া উপত্যকা আর জুম্ম চাষের ঢালু ক্ষেত। এর ফাঁকে ফাঁকেই হয়তো চোখে পড়ে আচমকা জেগে ওঠা দ্বীপের মতো একেকটা পাড়া, অর্থাৎ পাহাড়ীদের গ্রাম। তেমনই একটা গ্রাম, পুকুরপাড়া অভিযাত্রীদের এবারের যাত্রার গন্তব্য। পুকুরপাড়া রাঙামাটি জেলায় পড়লেও, সেখানে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা থেকে যাওয়াটাই সঙ্গত। ম্যাপে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেই বুঝবেন, কেন এ কথা বলছি। রাঙামাটির দক্ষিণ তৃতীয়াংশে অবস্থিত এই পাড়া একটা বিশাল পাহাড়ী দীঘিকে ঘিরে, বহুল আলোচিত বগালেকের চেয়ে আয়তনে কয়েকগুণ বড় এই দীঘির কাছেই রয়েছে রাইনক্ষ্যং নদীর একটি প্রপাত, এঁকেবেঁকে যে নদীটি যাত্রায় ক্ষান্তি দিয়েছে কাপ্তাই হ্রদের বুকে মুখ গুঁজে। আর এই রাইনক্ষ্যং-জলপ্রপাতই হয়ে উঠেছে ECB সদস্যদের পিপাসু চোখের লক্ষ্যবস্তু। ECB সম্পর্কে যারা একটু আধটু জানেন, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, এই ক্লাবের সদস্যেরা, যাদের বয়স আট থেকে আটাশির মধ্যে, যাবতীয় সরকারি ছুটির চরম সদব্যবহার --- অথবা বদব্যবহার --- করে থাকেন, বিশেষ করে দুই ঈদের প্রশস্ত ছুটিগুলো তাঁরা কাটিয়ে দেন কোন এক পথে কাঁধে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে কোন সুদূর গন্তব্যের দিকে জোর পায়ে হাঁটায়। তাই ফেব্রুয়ারির দুই তারিখে, কোরবানি ঈদের লঘু ছুটিতেই যাত্রা শুরু করার গুরু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো (কোরবানি ঈদের ছুটি যেমন খানিকটা প্রশস্ত, তেমনই আরেকটা সুবিধে হচ্ছে, এ সময়ে আকাশে শুক্লপক্ষের কড়া চাঁদ থাকে, রাতে পথ চলতে সুবিধে হয়)। বিকেলের মধ্যে কোরবানির দায়দায়িত্ব সেরে, নিহত পশুর ঝোল দিয়ে মেখে ভরপেট সেদ্ধ ধানের-দানা দিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে, ধীরেসুস্থে একেকজন হাজির হবেন কমলাপুরে বাস স্টেশনে, তেমনই অলিখিত চুক্তি হলো সবার মধ্যে। এবারের দল তুলনামূলকভাবে ছোট, কারণ কোরবানি ঈদে যাঁরা ঢাকার বাইরে বেরিয়ে পড়বেন, অথবা ঢাকায় ঈদোত্তর মেহমানদারিতে লিপ্ত হয়ে পড়বেন, তাঁরা গা মুচড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। ব্যতিক্রম শামীম খান মিলন, ক্লাবের দুর্দান্ত প্রতিশ্রুতিশীল সদস্য, যিনি আগে কখনো বান্দরবান যাননি। সুদূর সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তিনি প্রথমে পৌঁছুবেন সাতক্ষীরা, সেখান থেকে ঢাকার বাসে চড়ে পৌঁছুবেন ঢাকায়, তারপর আবার বাসে চড়ে বসবেন, বান্দরবানের পাহাড়গুলোকে এক হাত দেখে নেয়ার জন্যে, কম হ্যাপা নয়। আর আছে চঞ্চল, যে তার নামের যথার্থ সম্মান করতে শিখেছে, এই প্রথম পাহাড়ে চড়তে বেরিয়ে উৎসাহের চোটে একদিন আগেই কঙ্বাজার গিয়ে বসে আছে ব্যাটা, তিন তারিখ সকালে মূল দলের সাথে যোগ দেবে সে। এবার দলনেতা উচ্ছল, ইনিও নামের সাথে ঘাড়ত্যাড়ামো করেননি। ক্লাবের পথপ্রদর্শক বরুণ বকশী আর শাহেদ কামাল তো সাথে আছেনই, আর পাহাড়ের পথ প্রদর্শক মংক্ষিয়া মারমা আমাদের সাথে যোগ দেবেন বান্দরবান থেকে। ঘাগু দুই হাঁটাবাজ সালেহীন আর সৈকত মোটেও পিছপা নয়, যেমনটা নন পুতুল আপা, যেমনটা নই --- ইয়ে, আমি। দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়, আর পুকুরপাড়া তো কোন ছার। দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ, এমনই চিন্তা পুষে রাখা বুকটাকে ঠুকে নিয়ে ঈদের আগের দিন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি। আমার হাবাগোবা গোছের হ্যাভারস্যাক আগেও অনেক ধকল সয়েছে --- সাঙ্গু নদীতে গতবছর তার আরেকটু হলেই সলিল সমাধি ঘটতো, ওয়াহিদ ভাই সময় মতো কান ধরে টেনে না তুললে --- তাই এবার বেচারাকে একটু নিষকৃতি দেয়ার বাসনায় কেবল একটি প্যান্ট, একটি গেঞ্জি আর কী একটি যেন ঢোকাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাতে ঢোকে একখানা ট্রাইপড, একটা ক্যামেরা, একটা বাইনোকুলার, গামছা, টয়লেট পেপার, শুকনো খাবার, ইত্যাদি ইত্যাদি। কোরবানির মাংস ওজন করার যন্ত্রটায় চাপিয়ে দেখা গেলো, বারো কেজির চেয়ে একটু বেশি ওজন হয়েছে ব্যাগটার। এর আগে কেওকারাডং যাত্রায় আমার বোঁচকার ওজন হয়েছিলো সতেরো কেজি, এবার তারচেয়ে ঝাড়া পাঁচ কেজি কম। ঈদসংক্রান্ত সামাজিকতা সেরে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে কমলাপুরে পৌঁছে সেখানে প্রায় সবাইকে পেয়ে গেলাম। আরো কয়েকটা ছোট ছোট গ্রুপ চলেছে বান্দরবানে, তাঁরাও রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে বাস স্টেশনে উপস্থিত। আমাদের তোড়জোড় দেখে এক সহযাত্রী জানতে চাইলেন, আমরা কেওকারাডঙে যাচ্ছি কি না। পুকুরপাড়ার নাম শুনে ভদ্রলোক নাক সিঁটকালেন, অর্থাৎ, তিনি পুকুরপাড়ার নাম ইহজীবনে শোনেননি, এটা আবার কোথায় ---? তাঁরা সবাই চলছেন কেওকারাডঙে, গম্ভীরমুখে জানালেন। বাস জার্নির বর্ণণা কী আর দেবো? প্রায় ফাঁকা রাস্তায় উল্কা বেগে ছুটছে বাস, হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারের একটা সামান্য অংশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্ষণিকের জন্য, তারপর আবার ডুবে যাচ্ছে আঁধারে। ঈদক্লান্ত ঢাকা শহরকে পেছনে ফেলে বান্দরবান পৌঁছতে আমাদের চারপাশে ভোর ঘনিয়ে আসে। কিন্তু বান্দরবানে পৌঁছে সংকটের চেহারাটা চোখে পড়ে সবার। চঞ্চল বান্দরবানেই রাত কাটিয়ে ভোরে মূল দলের সাথে যোগাযোগ করবে, এমনই কথা ছিলো। কিন্তু বাস স্টেশনের আশেপাশে তার চেহারাখানা দেখা যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষার ফাঁকে হাতমুখ ধুয়ে ফেললেন সকলে, আর পুতুল আপা র্যাকস্যাকটাকে ঠিকমতো বাঁধাছাদা করতে বসলেন। তখন দেখলাম, একগাদা আচারের বোতল নিয়ে এসেছেন তিনি। সবার সাথেই কিছু না কিছু নগণ্য শুকনো খাবার আছে, যেমন আমার ব্যাগের ভেতরে পাঁউরুটি, বরুণদার কাছে চিঁড়া, সে জায়গায় পুতুল আপা জগদ্দল কাঁচের বয়ামে করে আচার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? হুড়োহুড়ি করে সেই বোঝা ভাগাভাগি করে নিলাম কয়েকজন। বরুণদা আর শাহেদ ভাই মংক্ষিয়া দাদার খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। খানিক বাদে তাঁরা ফিরলেন একেবারে চাঁদের গাড়ি চড়ে, এ গাড়িই রিজার্ভ করে ক্ষক্ষ্যংঝিরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। সেখানে নৌকোতে চড়ে রুমা পর্যন্ত বাকি পথ পাড়ি দিতে হবে, আর রুমা থেকেই শুরু হবে আমাদের পর্বতযাত্রা। আরেকটা দুঃসংবাদ জানা গেলো, গতকাল একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী রিগ্রিক্ষ্যং হিল রিসোর্টের ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে, বিপুল অঙ্কের মুক্তিপণ চেয়েছে তারা। চাঁদের গাড়ি থামিয়ে নাস্তার জন্যে বাজারের একটা খাবার দোকানে ঢুকলাম সবাই। ভোরবেলা বাসস্টলে এসে রিপোর্ট করার কথা চঞ্চলের, সে কোথায় কোন হোটেলে আছে কিছুই আমাদের জানা নেই, তাই উল্টে তাকে খোঁজার ব্যাপারটাও যথেষ্ঠ জটিল হয়ে পড়েছে। খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে চিন্তিত মুখে ভাবছি, এখন কী করা যায়, কিন্তু আমাদের খাওয়ার ফাঁকেই হঠাৎ চঞ্চলের আবিভর্াব ঘটলো, সবাই স্বস্তিতে হাঁপ ছাড়লাম। যাক, ব্যাটাকে আর খুঁজে বার করতে হয়নি, সে-ই আমাদের খুঁজে বার করেছে, শুধু তা-ই না, এভাবে আমরা হারিয়ে যাওয়ায় তার মৃদু তিরস্কারও আমাদের সহ্য করতে হলো। কী আর করা, কোনমতে মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে আমরা হুড়োহুড়ি করে চাঁদের গাড়িতে উঠে বসলাম। তারপর ভোঁওওও ---! জনৈক অভিযাত্রী রুমা পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে উৎসুক ছিলেন, তিনি সুট করে ভিড়ে পড়লেন আমাদের গাড়িতে। কোন পরিকল্পনা করে আসেননি তিনি, ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন, সবিনয়ে আমাদের সাথে বেড়ানোর অনুমতি চাইলেন। যখন তাঁকে আমাদের বেড়ানোর ধরনটা বোঝানো হলো, অর্থাৎ আমরা পাহাড়ি পথে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার হাঁটবো, পাহাড়ীদের গ্রামে রাত কাটাবো, ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত হাঁটবো, দিনে মোটে দুবেলা খাবো, ঝোপেঝাড়ে টয়লেট সারবো, সর্বোপরি যে পথ দিয়ে এগোবো সেটা যথেষ্ঠ দুর্গম ও বিপজ্জনক, আমাদের দলে যোগ দেবার উৎসাহ তাঁর পুরোটাই উবে গেলো। পাছে আমরা তাঁকে জোরজার করে ধরে নিয়ে যাই, সেই ভয়ে তিনি তদ্দন্ডেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। গাড়ির ভেতরে আলাপ জমে উঠলো। চঞ্চলের সাথে আমার খুবই শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক, তাই একে অপরকে গলা কেটে খুন করার পরিবর্তে কথার ছুরি চালিয়ে মাথা কাটার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কলম এখন আমার হাতে বলে বলছি না, সত্যি কথা হচ্ছে --- চঞ্চল কাজে যেমন, কথায় তেমন চঞ্চল নয়। আর হাঁটার সময় সবার পেছনে পড়ে থাকলেও, হেঁ হেঁ হেঁ, মুখটা আমার ভালোই চলে। কিন্তু এক চঞ্চলকে পঁচিয়ে কাঁহাতক আর ভালো লাগে? কাজেই আস্তে আস্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোচনা ঘুরে গেলো। ক্লাবের দু'বছরের সব অভিযানের ওপর আর্টিকেল আর সাথে মনকাড়া সব ছবির সংগ্রহকে একটা বইয়ের রূপ দেয়ার ইচ্ছে অনেকেরই। সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ চললো, তবে এই আলাপ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে শেষ হবার আগেই ক্ষক্ষ্যংঝিরি ঘাটে পৌঁছলাম আমরা। ঘাটে উপস্থিত পুলিশ সদস্য এবং অন্যান্যরা জানালেন, নৌকো দিয়ে সাঙ্গু নদী ধরে রুমা পৌঁছোনো খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কারণ কে বা কাহারা যেন কিছুদিন আগে কয়েকজন পর্যটককে নৌকো থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। কাজেই ভালো হবে, যদি আমরা গাড়িতে চড়েই আরো খানিকটা এগিয়ে নদী পেরিয়ে ডাঙার ওপর দিয়ে রুমাবাজারে পৌঁছোনোর চেষ্টা করি। এতক্ষণ চাঁদের গাড়িতে বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরিয়ে, পেট্রলের মনমাতানো সৌরভে অস্থির হয়ে, সর্পিল পথের কিনারা ধরে এগোতে এগোতে নিচে ঢালু খাদের রূপ দেখে দেখে একেবারে হেদিয়ে পড়েছিলাম, নদীর বাতাসে একটু চাঙা হয়ে হেঁড়ে গলায় একটা গান ধরার উদ্যোগও আঁটছিলাম, কিন্তু আবার সেই চন্দ্রযানে চড়তে হবে শুনে আঁতকে উঠলাম। কিন্তু কীই বা আর করার আছে? চাঁদের গাড়ি আবার হেলেদুলে আরো ওপরে চড়তে শুরু করলো। এবারের পথের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। তবে দূরে পাহাড়ের ঢালে ক্ষুদে ক্ষুদে সব কুটির, আনারসের বাগান, আরো দূরে পাহাড়ের ওপর গাছপালার সারি দেখতে দেখতে সময়টা অতটা খারাপ কাটলো না। মোটামুটি চানাচুরভর্তা হয়ে সেই পথ পার হয়ে সাঙ্গু নদীর ঢালে একসময় হাজির হলাম সবাই। উঁকিঝুঁকি মেরে ঠিক বোঝা গেলো না, এরপর ঘটনাটা কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ড্রাইভার লোকটা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ দিলো না আমাকে, মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী ঢালু একটা চরম বিশ্রী পথে সে সাঁ করে গাড়িটা গড়িয়ে দিলো মার্বেলের মতো। মিনিটখানেক পর দেখলাম, গাড়িটাও উল্টায়নি, আমরাও অক্ষত আছি, কেবল নেমে এসেছি সাঙ্গুর পাশে, তিরতির করে কয়েক গজ দূরে বয়ে চলছে এই ছেমরি নদী। এরপর ড্রাইভার আর হেলপারের কথোপকথন শুনে বোঝা গেলো, নদী পেরিয়ে একটা ঢাল ধরে উঠে গিয়ে কাঁচা পথ ধরে রুমা বাজারে পৌঁছুনোর চেষ্টা চালানো হবে। সাঙ্গুর গভীরতা এখানে কম, কাজেই সমস্যা হবে না। এ পর্যায়ে শাহেদ ভাই গম্ভীর মুখে নেমে গিয়ে বললেন, এটা নাকি মিশন ইম্পসিবল থ্রি ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীর অন্য পারের ঢালটা আরো বেশি খাড়া। অবশ্য বাকি সবাই গাড়ির ভেতরে মহানন্দে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলাম --- গাড়ি এবার চলতে শুরু করলো নদীর বুকে, তির্যকভাবে নদী পার হয়ে যাবো আমরা। দু'ধারেই একটু দূরে উঁচু খাড়া পাহাড়, গাঢ় সবুজে ঢাকা, সামনে পেছনে দু'দিকেই বাঁক ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে গেছে সাঙ্গু। গাড়ি যখন অপর প্রান্তের ঢালটার মুখোমুখি পৌঁছলো, তখন বোঝা গেলো, শাহেদ ভাই খুব একটা অতিরঞ্জন করেননি। খুবই খাড়া একটা ঢাল, তাও আবার এখানে সেখানে গর্ত, এবং ঝুরঝুরে বালুভর্তি। এই ঢাল বেয়ে উঠতে গেলে গাড়িটা উল্টে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের ড্রাইভার অবশ্য প্রবল আত্মবিশ্বাসী, সে জানালো, এর চেয়েও খাড়া ঢাল বেয়ে সে গাড়ি চালিয়ে উঠেছে, এগুলো তার কাছে ডালভাত। কিন্তু তার ডালভাত আমাদের সবার রুচলো না, হ্যাভারস্যাক গাড়ির ভেতরে রেখে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম, কেবল বরুণদা অটল বসে রইলেন, মনে হচ্ছে ডালভাতের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ খুব একটা কম নয়। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করে এই দৃশ্য পাকড়ানোর জন্যে তৈরি হয়ে রইলাম আমি আর সালেহীন। প্রথমবার প্রবল গর্জন করে এগিয়ে গেলো চাঁদের গাড়ি, ঢালের কিছুদূর উঠেই আবার হড়হড় করে গড়িয়ে ফিরে এলো পানিতে। আমাদের কয়েকজন এই ফাঁকে ঢাল বেয়ে ওপাশে উঠে গেছে, দাঁড়িয়ে দেখছে, কী হয় শেষ পর্যন্ত। কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয় ড্রাইভার, আবারও গড়গড়িয়ে রওনা দিলো সে। কিন্তু ফলাফল আগের মতোই। তবে এবার বরুণদা নেমে এলেন গাড়ি থেকে। তৃতীয় দফায় ব্যর্থতার পর মনে হলো, আসলেই মিশন ইম্পসিবল, একে এখানেই মুলতবি রেখে পায়ে হেঁটে বাকিটুকু পথ, অর্থাৎ রুমাবাজার পর্যন্ত পাড়ি দিতে হবে। কাজেই যে যার মতো ব্যাগ গুছিয়ে বেঁধে, জুতোর ফিতে ঠিক করে নিয়ে, দুয়েকঢোঁক পানি খেয়ে --- শুরু হলো হাঁটা! নদীর ঐ ধার থেকে হেঁটে রুমাবাজার পর্যন্ত পৌঁছুতে আমাদের সময় লাগলো প্রায় ঘন্টাখানেক। মাঝে এক জায়গায় বসে জুতো খুলে ভেতরে ঢুকে পড়া বালির দানা পরিষ্কার করতে হয়েছে। এর মাঝে একের পর এক ছোট ছোট পাহাড় টপকানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে কৌতূহলী স্থানীয় বাসিন্দারা মাঝে মাঝে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছেন, আমরা কোত্থেকে এসেছি। ঢাকা থেকে এসেছি জেনে সবাই ধরে নিয়েছেন যে আমরা কেওকারাডং যাবো, এই এক বছরে নাকি একের পর এক দল কেওকারাডঙের দিকে গিয়েছে। বাজারে পৌঁছে সবাই সুড়সুড় করে ঢুকলাম একটা খাবার দোকানে। শাহেদ ভাইয়ের ব্যাগের ভেতরে কী একটা যেন ভেঙে গিয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি ভারি বিব্রত, বাজারের একটা পাটাতনের ওপর ব্যাগ খুলে আবার সব গোছাচ্ছেন। তিনি এসে পড়ার পর খাবারদাবারের সুরত নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করলাম আমরা। ডিম কিংবা মুরগি খেতে হবে, মাছের অবস্থা তেমন সুবিধের নয়, আর পানি খাওয়ায় একটা রীতিমতো ঝক্কির ব্যাপার। তবে পুতুল আপার হ্যালোজেন ট্যাবলেটের ওপর ভরসা করে পুরোদমে পেটপূজায় বসে পড়লাম আমরা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে জিরোচ্ছি, এমন সময় লারামের সাথে দেখা, আমাদের গতবারের কেওকারাডং যাত্রার গাইড, সে এসে জানালো, আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে যেতে হবে। কুছ পরোয়া নেহি, বরুণদা আর শাহেদ ভাই দলের সবার নামধাম আর ক্লাবের অফিসের ঠিকানা দিয়ে এসে সবাইকে উঠে পড়ার জন্যে ইঙ্গিত দিলেন। দারুণ একটা রসিকতাও সাথে আমদানি করে ফিরলেন তাঁরা, নাম-ঠিকানা লেখার সময় এক পর্যায়ে ক্যাম্পের সেনাসদস্য নাকি প্রশ্ন করেছেন, এই হিমু যার নাম, সে ছেলে না মেয়ে --- হা হা হো হো হি হি, আমি ছাড়া সবাই দাঁত বার করে কিছুক্ষণ হেসে নিলো, কী বিদঘুটে রসবোধ এঁদের! যাকগে, এককাপ চা শেষ করে সবাই এবার এগোলাম, বাজার থেকে চাল-ডাল ইত্যাদি কেনার জন্যে। কয়েকদিন হলো খিচুড়ি রান্না শেখার জন্যে ঘ্যানর ঘ্যানর করছিলাম আমার মায়ের কাছে, তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে একদিন তিনি আমাকে একটা একঘন্টার সঠিকনিয়মেখিচুড়িরন্ধন কোর্স করিয়েছেন, সেই এক ঘন্টার বিদ্যার অহঙ্কারে আগেভাগেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম, এবার সবাইকে এমন খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবো, যেমনটা কেউ আগে কখনো খায়নি। তাই চাল-ডাল কেনার ব্যাপারে আমার পরামর্শই নেয়া হলো। জুতোর দোকান থেকে একজোড়া করে অ্যাঙ্কলেট কিনে নিয়েছি কয়েকজন, এই দীর্ঘ পথ হাঁটায় কাজে দেবে। কেনাকাটা শেষ করে আবার শুরু হলো হাঁটা, এবার হাঁটার শেষ হবে একেবারে বগামুখপাড়া, সাইকত পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে। মোটামুটি সমতল পথ শেষ হবে ঐ গ্রামে পৌঁছে। ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে, মাটিতে আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে আমাদের ছায়া। রুমা থেকে দক্ষিণপূবে যেতে প্রথমেই পড়ে লাইরুনপিপাড়া, লাইরুনপি পাহাড়ের ঢালে শায়িত গ্রাম। লাইরুনপি পাহাড় বেয়ে তার ওপাশের সমতল মাটিতে সহজেই নেমে পড়া যায়, আর ফেরার পথে ঘটে তার উল্টোটা। ফেরার সময় সঙ্গত কারণেই ক্লান্ত থাকে সবাই, আর পাহাড়ের গোড়ায় এসে সেটাকে বিশাল খাড়া একটা দেয়ালের মতো মনে হয়, সেটা বেয়ে যত সহজে নামা গিয়েছিলো, তত সহজে ওঠা যায় না। লাইরুনপিপাড়া ডিঙিয়ে ওপাশের মাটিতে নেমে ধীরেসুস্থে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। এবার অভিযানে বেশির ভাগের পায়েই জাঙ্গলবুট, কারণ বরুণদা এর আগে একাকী যে অসমাপ্ত অভিযান চালিয়েছিলেন, তাতে নাকি এই বুট অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। ট্রেক স্যান্ডেলগুলো পরে হাঁটতে আরাম ঠিকই, কিন্তু সেটা স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে। আর এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথে হাঁটতে গেলে স্যান্ডেল পরা কিছুটা বিপদজনক, পা মচকে যেতে পারে। তাছাড়া বরুণদা এ পথে আগে একবার হেঁটে গেছেন, কাজেই তাঁর উপদেশ ফেলবার নয়। তবে জাঙ্গলবুট কেনার পর অবশ্যই সেটার রোড টেস্ট করা জরুরি, কমসে কম দুহপ্তা সেটা পায়ে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সেটার স্বাদ পা-কে ভালো করে চাখিয়ে না নিলে ভাগ্যে কঠিন ভোগান্তি আছে, এটা বলে দিচ্ছি। লাইরুনপিপাড়ার ঠিক নিচেই একটা ছোট ছড়া আছে, তাতে পা ভিজিয়ে ওপারে পৌঁছেই টের পেলাম, কপালে দুঃখ লেখা ছিলো। পানির সাথে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব পাথরের কণা আর বালি ঢুকে গেছে মোজার নিচে, হাঁটতে গেলেই একেবারে মর্মে গিয়ে বিঁধছে। যেকোন অভিযানেই পিছিয়ে পড়তে আমার জুড়ি নেই। আর এই পিছিয়ে পড়ার জন্যে নানারকম অজুহাতও আমার জিভের ডগায় সবসময় তৈরি থাকে। ব্যাকপ্যাকের ওজন অনেক বেশি, তাই পিছিয়ে পড়েছি --- কিংবা ছবি তোলার জন্যে থেমেছিলাম, তাই পিছিয়ে পড়েছি, ইত্যাদি হাবিজাবি। অন্যেরা অবশ্য এসব গাঁজাখুরি অজুহাত এক কানে নিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দেন, তারা জানেন আমি তিরিশ মিনিট পর পর থেমে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই। কিন্তু, একটু থেমে, চারপাশের এই অপূর্ব সব খাটো খাটো পাহাড়ের সারিতে একটু চোখ বুলিয়ে না নিলে তো এখানে আসার আসল উদ্দেশ্যই মাঠে মারা পড়ছে। কেবল গটগটিয়ে হেঁটেই চলবো, একটু চোখ মেলে চেয়ে দেখবো না, তা কি হয়? কিন্তু এই প্রবল প্রকৃতিপ্রেমের মাশুলও আমাকেই দিতে হয়, একেবারে ঘন্টাখানেকের পথ পিছিয়ে পড়তে হয় অন্যদের চেয়ে। কারণ, আমাদের দলের অন্যদের প্রকৃতিপ্রেম আমার চেয়ে খুব একটা কম নয়, বরং খানিকটা বেশিই। তাই চলার ফাঁকেই তারা নিসর্গের প্রতি দৃষ্টিনৈবেদ্য দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে যান। তাই কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো, এদিকে ওদিকে কয়েকটা ছবি তুলে যখন ক্যামেরাটা আবার ব্যাগে ভরেছি, তখন আমার আশেপাশে আর কেউ নেই। জোর পায়ে হেঁটে কিছুদূরে গিয়ে শাহেদ ভাই আর বরুণদাকে পাওয়া গেলো, তাঁদেরকে কিছুটা ধীরে হাঁটার অনুরোধ করে আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম। পেছনে কেউ না থাকলে কেমন যেন লাগে, ঠিক না? মংক্ষিয়া দাদা আবার এক ফাঁকে কিছু জঙলি বড়ই পেড়ে এনেছেন, হাঁটতে হাঁটতে সেগুলো কুটকুট করে চিবোনো গেলো। রুমাবাজার থেকে বগামুখপাড়ার পথে যারা একবার শীতের মৌসুমে হেঁটে গেছেন, তারা জানেন, বড় বড় বোল্ডারের ফাঁকে ক্ষীণ পানির ধারা ছাড়া এই পথে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। শুধু ঐ বড় বড় পাথরের ওপর দিয়েই একটু সাবধানে চলতে হয়, কোনভাবে পা মচকে বসলে কপালে দুঃখ আছে। বর্ষা মৌসুমে এই গোটা পথ তলিয়ে যায় তীব্র পানির ঢলের নিচে। এক বছর আগে কেওকারাডঙে যাওয়ার পথে যে ছড়ায় হাঁটু পানি পার হয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে ওপরের পাহাড়ি অঞ্চলে এক দিনের বৃষ্টির কারণে সে ছড়া পার হতে হয়েছে কোমর পানি ভেঙে। বেশ খানিকটা পথ নিরূপদ্রব পার হওয়ার পর একটা ছড়ার পাশে দলের অগ্রগামী অংশটার সাথে সাক্ষাৎ হলো, মুখে একটু পানি ছিটিয়ে নেবার জন্যে বসেছেন তারা। সেখানে কাঁধের ব্যাগ খুলে উপদ্রুত কাঁধটাকে একটু রেহাই দিলাম, আর গোটা তিনেক দলগত চিত্রগ্রহণও চললো সাথে সাথে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ বসে থাকার জো নেই, আবারও চটজলদি পা চালিয়ে যেতে হলো আমাদের। চলতে চলতে এবার শাহেদ ভাই আর পুতুল আপাকে সঙ্গে পাওয়া গেলো। খানিকটা পথ গিয়ে দেখা গেলো, দু'জন বাঙালি ফিরছেন এ পথ দিয়ে। তাদের পায়ে সাধারণ চপ্পল, সাধারণ শার্টলুঙ্গি। আলাপ করে জানা গেলো, রংপুর থেকে বগা লেকে এসেছিলেন তারা, উদ্দেশ্য নিখাদ ভ্রমণ। কোনরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই গুটগুট করে হেঁটে চলে গেছেন তারা বগালেকপাড়ায়। বাঙালির এই পর্যটনপিপাসু চেহারা আমাদের আশাবাদী করে তুললো, যাক, অতটা ঘরকুনো আমরা তবে নই! আমাদের আয়োজন, বিশেষ করে গাঁটরিবোঁচকা দেখে যে তারা অত্যন্ত চমৎকৃত হয়েছেন, বোঝা গেলো, সবিনয়ে আমাদের একটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলেন একজন। তাদের ক্যামেরায় নিজেদের চেহারা অক্ষয় করে রেখে আবারও আমরা জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম সামনের দিকে। বালিপাথরের একটা খাটো পাহাড় সারির সমান্তরালে এগিয়ে একটা মোটামুটি বড় ছড়া পেরিয়ে গেলেই বগামুখপাড়ার বিসতৃত পথটার দেখা মেলে। পথ নয়, আসলে ওটা ছড়ার পাথুরে খাত। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সেই ছড়া বরাবর এগিয়ে গেলেই বগামুখপাড়া চোখে পড়ে। ইতিমধ্যে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে, যার ফলে সমস্ত পথ ছায়াচ্ছন্ন। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু কয়েক জায়গায় জলের কলধ্বনি, আর আমাদের এগিয়ে চলার শব্দ। চলার গতির হেরফেরে এখন আমার সঙ্গে পুতুল আপা আর মংক্ষিয়া দাদা। সৈকত আমাদের সাথেই চলছিলো কিছুদূর পথ, কী ভেবে জোর পায়ে এগিয়ে গেছে সে। দুয়েক জায়গায় একটু থেমে চলতে চলতে একসময় বগামুখপাড়ার কাছে কয়েকটা ছড়ার মোহনায় এসে দলের বাকিদের পাওয়া গেলো, এক একটা বোল্ডারের ওপর বসে এক একজন, সবার চেহারায় একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব। আমরা একটা বোল্ডারের ওপর বসতে না বসতেই বাকিরা উঠে পড়ার তোড়জোড় শুরু করলো। ওদিকে বাঁশের মাচায় ব্যাটারি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন পাহাড়ি, তাদের সৌজন্যে জানা গেলো, আজ বগামুখপাড়ায় জোর হুল্লোড় আর উৎসব হবে রাতে। এই খবর জানিয়ে দিয়ে হুমহাম করতে করতে নক্ষত্রবেগে এগিয়ে গেলো তারা। কানের কাছে একটা বিদঘুটে গুনগুন শুনে চমকে উঠলাম, নাকের সামনে দুয়েকটা সংসর্গবৎসল মশাকে ঘুরঘুর করতে দেখা গেলো। অমনি হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম, মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া বাঁধানোর কোন খায়েশ নেই আমার। পুতুল আপা আরেকটু জিরোতে চাইছিলেন, তাঁকেও ঠেলেঠুলে তুলে দেয়া হলো। ডিসেম্বর মাসে এই একই পথে ট্রেক করতে এসে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে আরেক অভিযাত্রী দলের এক সদস্য, কাজেই সাবধানের মার নেই। মিনিট পনেরো হাঁটতেই এবার বগামুখপাড়ায় পৌঁছে গেলাম সকলে। বগামুখপাড়ার গোড়ায় একগাদা দোকান, সেখানে চায়ের বন্দোবস্ত রয়েছে। দোকানের সামনে কাঠের মাচায় বসে, ব্যাগের হাত থেকে কাঁধদুটোকে, আর জুতোর হাত থেকে পাদুটোকে একটু রেহাই দিয়ে ক্যামেরা খুলে বসলাম। ফটোগ্রাফিতে আমার বিকট উৎসাহ, যদিও এলেম কম --- তাই ক্যামেরা বার করে স্থানীয়দের সান্ধ্য কার্যকলাপের কিছু ছবি তুললাম। উনুনে আগুন জ্বলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি শিশু, বয়স্করা বসে গল্পগুজব করছে ---। আর আমরা এক একজন আলাপ করছি, পেটপূজায় নৈবেদ্য কী দেয়া যায়? বাস্তবিক, বেশ কষেই লেগেছে খিদেটা, বিচিত্র সব গুরগুর শব্দে পেট সে কথা জানান দিচ্ছে। ওদিকে মংক্ষিয়াদা আজ রাতের জন্যে আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই বার করে ফেলেছেন, একটা মারমা কুটির। গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে সেই কুটিরে গিয়ে চড়লাম সকলে। বরুণদা যদিও ভোরের দিকে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, একেবারে এনংপাড়ায় গিয়ে রাতের আড্ডা গাড়বেন, কিন্তু ইঞ্জিনে তেল কম থাকায় আর সেটা হয়ে উঠলো না আর কি। বান্দরবানের এদিকটায় পাহাড়িদের কুটির যদি দেখে না থাকেন, তাহলে এক দফা হালকা লেকচার দিই। কুটিরগুলো তৈরি করা হয় বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। এখানে সব কুটিরই দোতলা। একতলাটা পুরোটাই ফাঁকা, তাতে কোন বেড়া নেই। সেই ফাঁকায় চড়ে বেড়ায় মুরগি, কুকুর আর শূকর । মাটি থেকে ফুট তিন-চার ওপরে ঘরের মেঝে, বাঁশের ফালি দিয়ে বোনা মজবুত মাদুর খুঁটির সাথে শক্ত করে এঁটে তৈরি করা। একটা কাঠের বীমে কয়েক জায়গায় দায়ের কোপ মেরে তৈরি করা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এই মাদুরের পাটাতনে। শুধু ঘরের মেঝেই নয়, দেয়ালও এই বাঁশের মাদুর দিয়ে তৈরি। হালকা, কিন্তু খুব মজবুত। পাটাতনে উঠে জুতো খুলে রেখে ঘরে ঢুকলাম সকলে। পলকে ঘরের কোণায় বিশাল এক হ্যাভারস্যাকের পাহাড় তৈরি হয়ে গেলো। যে যার পানির বোতল বার করে কয়েক ঢোঁক খেয়ে, হাতমুখ ধুয়ে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসতেই পেট কাদম্বিনীর মতো মরিয়া প্রমাণ করিলো যে সে মরে নাই, এখনো আছে। কাজেই পেটের জ্বালাকে প্রতিরোধ করার জন্যে সামান্য ডালভাতের আয়োজন করতে উঠলেন মংক্ষিয়াদা। ওদিকে পুতুল আপা তাঁর সেই মহার্ঘ আচারের বোতল, আপেল, মেয়োনেজ, ইত্যাদি বার করে অল্প সময়ের মধ্যে এমন এক অসামান্য ফ্রুট সালাদ তৈরি করলেন, যার স্বাদ জিভে লেগে নেই বলে এখন প্রবল আফসোস হয়। আর শাহেদ ভাই ম্যাজিশিয়ানের মতো ব্যাগ থেকে বার করলেন ভুনা গরুর মাংসের ছোট্ট একটা বাটি, ভাবির কল্যাণে, কোরবানির সৌজন্যে। ডাল, ভাত, মাংস আর সেই সালাদামৃত (যিনি সালাদ তিনিই অমৃত, তৎপুরুষ সমাস) দিয়ে চেটেপুটে খাওয়া শেষ করে মনে হলো, এমন ভোজ অনেকদিন হয়নি। খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমপরীরা যদি উড়ে এসে জুড়ে বসে, নিশ্চিন্তমনে চিৎ হয়ে দুদন্ড ঘুমোনোর পরামর্শ দেয়, উচিত হয় কি ফেরানো তাহারে? তাই পায়ে খানিকটা মলম মালিশ করে যখন ঘুমকম্বল নিয়ে টানাটানি করছি, তখন বাকিরা এমন জুলজুল করে আমাকে তাকিয়ে দেখতে শুরু করলো, যেন আমি খুনের মামলার আসামি। আজ রাতে জোর উৎসব হবে, দূরদূরান্ত থেকে ব্যাটারি কাঁধে নিয়ে যখন জড়ো হয়েছে শতাধিক লোকজন, আর আমি পাষন্ড কি না পড়ে পড়ে ঘুমোবো? ধিক, শতধিক! --- কিন্তু ভাই, ঘুমপরীদের সাথে তাংফাং করা অনুচিত, এ আমি কিভাবে বোঝাই? অবশ্য আমার সুযুক্তি কেউ কানে নিতে চাইলো না, বিশেষ করে চঞ্চল তো খুবই নিন্দামুখর হয়ে উঠলো --- ভালো কথা ইদানীং কি আর কেউ কানে নিতে চায়, বলুন --- দূর থেকে যখন ব্যাটারিচালিত মাইকে ভেসে এলো হারমোনিয়ামে সেই চিরাচরিত মুরং সুর আর গান, সক্কলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে বার হলো, যেন হাশরের ময়দানে রোলকল হচ্ছে। কীই বা করার রইলো আমার, স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া? দুই: ভোর হোলো দোর খোলো সেই সন্ধ্যে থেকে ঘুমুচ্ছি। যদিও হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, কানে ভেসে এসেছে উৎসবের সঙ্গীত, আবার অন্যেরা যখন পর্যটনে খ্যামা দিয়ে ঘুমোবার জন্যে ফিরে এসেছে, তখন তাদের লাথিঝাঁটাও কিঞ্চিৎ সহ্য করতে হয়েছে। বিশেষ করে এই চঞ্চলটা আমার ওপর চটা, কেন কে জানে, বিনা কারণেই আমাকে গজভুক্ত কপিত্থবৎ এক কোণ থেকে আরেক কোণে গড়িয়ে যাওয়ার মূহুর্মূহু হুকুমে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলো, একবার বলে ডানে চাপো, তো আরেকবার বলে নিচে নামো। তার অভিযোগ, আমি নাকি গোটা ঘর দখল করে শুয়ে ছিলাম। বোঝো কান্ড, দশজনের ঘর একজন কিভাবে দখল করে শোয়, তা বোঝা অন্তত আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না। এ নিয়ে চঞ্চলের সাথে তর্ক করাও বৃথা, ভারি সহিংস আচরণ করছিলো সে, বোধহয় পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ব্যাটার পোষায়নি, অথবা গুরুতর ধাতানি খেয়ে ফিরে এসেছে, কিন্তু ওর হাবভাব দেখে প্রাণের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাইনি --- যাই হোক, কিন্তু সূর্যের দেখা পাবার পর ঘুমোনোর কোন অধিকার এঙ্প্লোরারস' ক্লাবের সদস্যদের নেই, কাজেই উঠে পড়তে হলো। তখনও মাইকে ভেসে আসছে মুরংদের সেই গান। গানের কথা সময়ের সাথে পাল্টায়, কিন্তু সুরের ব্যাপারে এঁরা ভদ্রলোক, এই একই সুরে নানা গান বেজে চলছে। গ্যালো বছর যখন সূর্যোৎসবে এসেছিলাম, তখন বগালেকপাড়ায় মুরংদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও এই একই সুর শুনেছি, একেবারে মাথায় গেঁথে আছে সেটা। আমার পরিচিত এক কিশোরী বহু পরিশ্রম স্বীকার করে রবি ঠাকুরের আহা আজি এ বসন্তে গানখানা সুরে ও তালে গলায় তুলতে পেরেছিলো, আর সেই একখানা গান শিখেই সাধনায় খ্যামা দিয়েছিলো সে, পরবর্তীতে যে কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত, হোক সেটা বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কিংবা এসো হে বৈশাখ এসো এসো, সেই আজি এ বসন্তের সুর-তালের ছাঁচে ফেলে বেশ টেনে গাইতো বেচারি। মনে হচ্ছে এটাও একই কেস। এঁদের যে একজন প্রতিভাবান সুরকারের বিশেষ অভাব, বোঝা গেলো। আর এঁদের দোষ দেবো কেন, গোটা বাংলাদেশেই তো সুরের আকাল চলছে, অসুরই এখন এ দেশে নন্দিত! সাধারণত বরুণদা-ই আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কিন্তু আজ দিনটাই অন্যরকম। আমি প্রকৃতি ভালোবাসি, প্রকৃতিও আমাকে ভালোবাসে, হাতছানি দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ডাকে, তাই ভোরবেলার সেই মধুঘুম ভাঙলো প্রকৃতির প্রবল ডাকে। বড় স্কেলের কেলেঙ্কারি হয়ে যাবার আগেই ব্যাগ থেকে দরকারি কাগজপত্র, মানে টয়লেট পেপার নিয়ে অন্যের চপ্পল পায়ে গলিয়ে কার্ল লুইসের মতো ছুটলাম এক নিভৃত কোণে। আর কি মুশকিল, তেমন ঘন ঝোপঝাড় এখানে নেই, কাজেই কোন পাহাড়ি যদি প্রাতভ্রমণে বের হন, আমাকে ভারি নাজুক পরিস্থিতিতে দেখে ফেলতে পারেন। ওদিকে ভোরবেলা কনকনে ঠান্ডার কামড়, তার ওপর আছে মশার দংশনে ম্যালেরিয়ার ভয়, চারদিকে সতর্ক চোখ রাখতে হচ্ছে যাতে করে কোন শূকরবাহিনী এসে আমাকে গুঁতিয়ে দিতে না পারে (বান্দরবানের এদিকে প্রতিটি গ্রামেই শূকর পালন করা হয়। শূকরগুলো নিজের খেয়ালে চরে বেড়ায়। মানুষের বর্জ্য এদের বিশেষ পছন্দনীয়, তাই কাউকে "বড় বাইরে"-এর কাজে ব্যস্ত দেখলে এরা দল বেঁধে এসে ভোজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের কবলে পড়লে কপালে অশেষ ভোগান্তি আছে। টয়লেটে গেলে সবসময় হাতে লাঠি জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র রাখতে হবে। বিশ্বাস না হয় তো একবার খালিহাতে সরজমিন গিয়ে পরখ করে আসতে পারেন), আর এদিকে খোলা আকাশের নিচে কেবল কয়েকটি ক্ষীণকায় কলাগাছকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে সমাজের হাতে ধরা পড়ে কলঙ্কিত হবার কূলনাশা শঙ্কা, আর পেটের সেই চিনচিনে ব্যথাটা তো আছেই রে বাপ --- সব মিলিয়ে প্রকৃতির সেই ব্যাকুল ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আমার নাভিশ্বাস উঠে যাবার অবস্থা। যাই হোক, কোনমতে কাজ সেরে ভারি পুলকিতচিত্তে বেরিয়ে এসে দেখলাম, দলের অন্যদের মধ্যেও সাজো সাজো রব, বুঝলাম, প্রকৃতি কেবল একা আমাকেই ডাকছে না। চপ্পলের মালিক দলনেতা উচ্ছল ভাই অত্যন্ত গোমড়ামুখে পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে --- দেখে তেমন একটা উচ্ছল মনে হচ্ছিলো না তাঁকে --- তাঁর শারীরিক হাবভাব দেখে বুঝলাম, প্রকৃতিতোষণের সাধ থাকা সত্ত্বেও এক জোড়া জুৎসই স্যান্ডেলের অভাবে এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাধ্য তাঁর নেই, কারণ খালিপায়ে এখানে হাঁটাহাঁটি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় । তার ওপর তাঁর সাধের চপ্পল আমার পায়ে দেখে উচ্ছল অগি্নগর্ভ শমীবৃক্ষের মতো নিশ্চল হয়ে পড়লেন, নির্বাক হয়ে রক্তচক্ষু মেলে আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন একবার, আমার সুখী মুখ দেখে মনে মনে হয়তো পঞ্চাশ-ষাটটা গাল দিলেন, কিন্তু মুখে কিছু না বলে দলনেতাসুলভ ক্ষমাশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চুপচাপ আমার সারেন্ডার করা সেই চপ্পল পায়ে গলিয়ে গটগটিয়ে কোন এক নিভৃত ঝোপের সন্ধানে এগিয়ে গেলেন। আমি ভেবে দেখলাম, পরবর্তীতে এই পাড়ার অধিবাসীরা যে মর্মান্তিক চটবেন আমাদের ওপর, তাতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ একটা গোটা পাহাড়কে বৃত্তাকারে কলুষিত করে রেখে যাচ্ছি আমরা, যার কেন্দ্র আমাদের এই রাত্রিকালীন আশ্রয়কুটির। শহুরে বাবুদের পরিচ্ছন্নতাবোধকে যে এরা পরবর্তীতে কী পরিমাণ অবজ্ঞার চোখে দেখবে, তা-ই ভাবতে ভাবতে হেলেদুলে এগিয়ে গিয়ে পাটাতনে চড়ে হেঁড়ে গলায় একটা মানানসই গান ধরলাম, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, এ এ এ, রইবো না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে ---। কিন্তু বেরসিক চঞ্চলটা মাঝপথেই কোত্থেকে উদয় হয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, আমাকে নাকি জলদি করতে হবে, আমার জন্যে নাকি দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমিই নাকি সব নষ্টের গোড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্ষুণ্ন মনে ব্যাগ গুছিয়ে জুতো পরে অন্যদের পেছন পেছন এগিয়ে নেমে এলাম দোকানগুলোর সামনে, মনে মনে চঞ্চলকে বকলাম কিছুক্ষণ, ব্যাটা ফিলিস্টাইন, বর্বর অসভ্য, সঙ্গীতের মর্ম তুমি কী বোঝো? সেই দোকানের মাচায় ব্যাগ রেখে নিচের ছড়ায় গিয়ে কুল কুল করে বয়ে যাওয়া হিম জলে হাতমুখচশমা ধুয়ে দাঁত মেজে খেতে বসলাম সকলে। খাবার রাতের উদ্বৃত্ত সেই ডাল আর ভাত, সেটা দিয়েই যতটা সম্ভব না লাগা খিদের আগাম নিবৃত্তি করলাম। আজ যেতে হবে বহুদূর, পথে কোথাও খাবারদাবার পাওয়া যাবে কি না, কে জানে? পুকুরপাড়া আর বগামুখপাড়ার মাঝে তিনটে পাড়া পড়ে --- লেনতংসে পাড়া, মেনথুই পাড়া, আর এনংপাড়া। কিন্তু শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যে সেসব পাড়ায় থামার অবকাশ নেই আমাদের। এক যদি পথে কলাটলা পাওয়া যায়, নয়তো পেটে কিল মেরে এগিয়ে যেতে হবে। সবাই যখন চা খাওয়ার তোড়জোড় করছে, তখন ট্রাইপড বার করে একটা দলগত ছবি নেয়ার ধান্ধা করলাম। ক্যামেরাটা বসিয়ে যুৎসই ফ্রেম খুঁজছি, এমন সময় আবারো কোত্থেকে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো ঐ ব্যাটা চঞ্চল। আমাকে একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই ক্যামেরার স্পিড আর ফিল্ড সেট করলো সে। আমি একটা কিছু বলতে চাইছিলাম, ধমক খেয়ে আমাকে থেমে পড়তে হলো, আমি আবার ক্যামেরার কী বুঝি? তারপর ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেলো, ক্যামেরা আপত্তি জানাচ্ছে। এর কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা চঞ্চল সাহেব দিতে পারলেন না, বরং আমার ক্যামেরাটাকেই দুষবার একটা পাঁয়তাড়া কষতে লাগলেন। চটেমটে ব্যাটাকে হাঁকিয়ে দিয়ে সবাইকে জড়ো করে ক্যামেরাকে নিজ মর্জিতে চলতে দিয়ে একটা ছবি তোলা হলো, অবশ্যই আমি নতুন করে সব সেট করবার পর। আমাদের দশজনের একটা ঝকঝকে ছবি অক্ষয় হয়ে রইলো সেলুলয়েডে। তারপর ট্রাইপডটাকে আবারো গুটিয়ে ব্যাগে পুরে হাঁটা শুরু করলাম বাকিদের পেছন পেছন। বরুণদা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, একটানা প্রায় ঘন্টা তিনেক খাড়াই বেয়ে উঠতে হবে আজ। সবাই একটা করে লাঠি সবাই জুটিয়ে নিয়েছি, কারণ ষষ্ঠি বিনে এই পথে চলতে গেলে খবরই আছে, কেবল শাহেদ ভাই লাঠি বইতে রাজি নন। তবে লাঠির মাহাত্ম্য বাকি সবাই কমবেশি জানি। সালেহীন তো প্রত্যেক অভিযান শেষে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একখানা লাঠি ঘরে বয়ে নিয়ে যায়, গাদা খানেক লাঠি সে ইতিমধ্যে জমিয়ে ফেলেছে, এক পল্টন দাঙ্গা পুলিশকে সন্তুষ্ট করা যাবে তা দিয়ে। বগামুখপাড়ার পর ডানদিকে বেঁকলে বগালেকপাড়ার সেই বিদঘুটে পথ পাওয়া যায়, যে পথে পড়ে সেই ভয়ালদর্শন পতনছড়ি। কিন্তু আমাদের পথ বাম দিকে, একটা পাহাড়ের ঝুরঝুরে সরু পথ বেয়ে উঠে। সেই পথে পা ফেলেই টের পেলাম, আজ ভাগ্যে লাল কালিতে অনেক কিছু লেখা আছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে খানিকটা উঠে খানিকটা শক্ত মাটি পাওয়া গেলো। এই পথে একবার পা পিছলে পড়লে হয়তো কেউ প্রাণে মারা পড়বে না, কিন্তু পা মচকে যাবার একটা বিরাট সম্ভাবনা আছে। আর এখানে একবার পা মচকালে খবরই আছে! তখন লাঠিতে ভর দিয়ে বড়জোর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে, চলা যাবে না। আর চলতে না পারলে এই নির্জন ঘন অরণ্যশাসিত পাহাড়ে রাত কাটাতে হবে, একেবারে খোলা আকাশের নিচে। পথের দু'ধারে ঘন ঝোপ এখন, বিশাল সব গাছের জন্যে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছুতে পারছে না। সঙ্গত কারণেই মাটি কিছুটা ভিজে, পথের পাশে পড়ে থাকা মড়া গুঁড়ির ওপর ছত্রাকের আস্তরণ পুরু হয়ে জমেছে। লাঠি ঠুকে ঠুকে খানিকটা এগিয়ে গেলাম সবাই। আধঘন্টার মতো হাঁটার পরই কাহিল লাগছে। মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করলাম, হাঁটার চর্চা থামিয়ে দেবার জন্যে। পাহাড়ি পথে হেঁটেছি সেই এক বছর আগে, চর্চার অভাবে পায়ের পেশী খানিক পর পরই আপত্তি জানাচ্ছে। কিন্তু সকালের এই মিষ্টি নরম রোদ, নির্মল বাতাস আর চারপাশের সবুজই চাঙা করে রেখেছে আমাকে, আমাদের সবাইকে। ঢাকার বাতাসে যারা শ্বাস নিয়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই টাটকা হাওয়া যে কী মিষ্টি লাগে, তা বলার মতো নয়। ওদিকে চঞ্চল ভোরবেলা হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে আসল কাজে ঢিলেমি করেছে, এখন হাতের কাছে যুৎসই ঝোপ পেয়ে আর সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় সে, তাই এক দিস্তা দলিলদস্তাবেজ বার করে এক গহীন ঝাড়ে হানা দিয়েছে ব্যাটা। আমি, সালেহীন, মিলন ভাই আর উচ্ছল ভাই একটা গুঁড়ির ওপরে বসে কিছুক্ষণ সুখ দুঃখের আলাপ --- অ্যাতোক্ষণ হাঁটার পর খানিকটা বসলাম, এতেই সুখ, কিন্তু মিনিটখানেক বাদেই আবার উঠে পড়তে হবে, এটাই যা দুঃখ --- সেরে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। যথারীতি অন্যেরা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো, আর আমি রূপকথার ছোট্ট গোল রুটির মতো গুটিগুটি চলতে লাগলাম। পুকুরপাড়াটা অ্যাতো দূরে কেন রে বাবা? বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা সম্মানজনক উচ্চতায় উঠে আমরা কয়েকজন থামলাম। এরই মাঝে ক্যামেরা বার করে অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎবর্তী কয়েকজনের ছবি তুলেছি, ছবি তুলেছি দূরের পাহাড়সারির, মংক্ষিয়াদার। ইতিমধ্যে বরুণদা, পুতুল আপা আর শাহেদ ভাইও এগিয়ে এসেছেন। একটু থেমে পড়তেই আলাপ জমে উঠলো আমাদের। বিষয়: বাংলাদেশে পর্যটনের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা। বাংলাদেশের বাইরে অনেক দেশেই এমন সব পাহাড় চলে এসেছে দক্ষ পর্যটন ব্যবস্থাপনার তত্ত্বাবধানে। সেখানে নিয়ন্ত্রিত ট্রেক প্রোগ্রামের সুবন্দোবস্ত রয়েছে, আয়েশী পর্যটকের জন্যে রয়েছে ঝুলযানের ব্যবস্থা --- আরো অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের এমনি পোড়া কপাল, যে কোন দূরদর্শী মানুষ কখনো এদেশে পর্যটনের দায়িত্ব পায়নি। আর পর্যটনানুকূল মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি আমাদের মানুষদের মাঝে। সবেধন নীলমণি কঙ্বাজারে হুড়োহুড়ি করে বেড়াতে যান সকলে, সেখানকার সৈকতটাকে আবর্জনার গাদায় পরিণত করেন, আর কর্তৃপক্ষ তাদের জন্যে গলাকাটা দামের হোটেল মঞ্জুর করে দিয়ে ভাবেন, বাহ, বেশ একখান কাজ করলাম। সোনার হাঁস কবে ডিম পাড়বে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি নয় বাংলাদেশের লোকজন, যে যত জলদি পারে হাঁসটাকে কেটেকুটে সাফ করতে চায়। কিন্তু একটানা বদনাম আর আপসোসই বা কতক্ষণ করা যায়? আবার পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, আরো ওপরে। এবার আমি আর পুতুল আপাই একটু পিছিয়ে পড়লাম। তিন আদিবাসী নেমে আসছিলেন, পুতুল আপা তাদের দেখে যেন হাতে চাঁদ পেলেন, আদিবাসীদের সাথে আলাপ করার খুব ঝোঁক তাঁর। বাংলা খুব একটা বোঝেন না তারা, তবুও মিনিট পাঁচেক তাঁদের সাথে গল্প চললো। সবশেষে তাদের সাথে পুতুল আপার একটা ছবি তুলে নিয়ে চকলেট বিতরণ করে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। ততক্ষণে অন্যেরা নিঃসন্দেহে খানিকটা এগিয়ে গেছে। খানিকটা সমতল পেয়ে জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। হুড়হুড়িয়ে বেশ খানিকটা গিয়ে আবার বাকিদের দেখা পাওয়া গেলো। একটা গোড়াপোড়া গাছের পাশে বাঁধানো টংঘরে বসে আছে সবাই। বরুণদা জানালেন, এই টংঘর হচ্ছে লেনতংসে পাড়ায় প্রবেশের পথের মুখে, ডানের পথটা ধরে এগিয়ে গেলেই পড়বে পাড়াটা --- লেনতংসে পাড়ার কারবারির ছেলের সাথে গত রাতের উৎসবে নাকি তাঁর দেখাও হয়েছে, পাড়ায় নেমন্তন্ন করে গেছে সে। পাটাতনে ব্যাগটা খুলে রেখে ক্যামেরা বার করে কিছুক্ষণ টহল দিলাম। প্রকৃতির ছবি তো অনেকই তোলা হলো, এবার নিজের কৃষ্ণপক্ষের চাঁদবদনটাকেও সেলুলয়েডে পোক্ত করার বাসনায় সৈকতকে দায়িত্ব দিলাম। ইতিমধ্যে টংঘরে আরেক পথিক পাহাড়ি এসে বসেছেন, তাঁর নাম ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, তিনি চলেছেন তিনমাথায়। তিনমাথা জায়গাটা হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারের স্থলসঙ্গম, বর্ধিষ্ণু একটা গ্রাম আছে সেখানে, সেই গ্রামে ধনঞ্জয়ের কন্যার শ্বশুরবাড়ি। মেয়েকে দেখতে চলেছেন তিনি। এদিকে আমাদের পুতুল আপা দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে হাঁটতে গিয়ে একটু কাবু হয়ে পড়েছেন, তাই মংক্ষিয়াদার মধ্যস্থতায় ঠিক হলো, ধনঞ্জয়দা আমাদের সাথে পথ চলবেন, আর পুতুল আপার হ্যাভারস্যাকটা থাকবে তাঁর কাঁধে। তিনি সম্মত হতে আমাদের দলের আকার দশ জন থেকে বেড়ে দাঁড়ালো এগারোজনে। ঘন ঘন বিশ্রাম নেয়ায় খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি আমরা, এবার তাই সবাই জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। অনেকক্ষণ পর বেশ খানিকটা সমতল পথ পাওয়া গেছে, তেমন একটা চড়াই উৎরাই নেই, কাজেই বেশ কিছুটা পথ পেরোনো গেলো। তবে পথ সমতল হলেও তার ল্যাঠা কম নয়, বড় বড় গাছের কারণে দিনের বেশির ভাগ সময়েই এদিকটায় মাটিতে রোদ পড়ে না, তাই পথের মাটি নরম, কাদাটে আর খানিকটা পিচ্ছিল। পথ চলতে চলতে হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ শুনে দেখি, একটা হেলিকপ্টার বেশ নিচু দিয়েই হেলেদুলে উড়ে যাচ্ছে, আয়েশী বাদুড়ের মতো, নিশ্চয়ই কাছে কোন আর্মি ক্যাম্পে সাপ্লাই পৌঁছে দেবে। চলতে চলতে আশেপাশের পাহাড়, বাতাসে দোদুল্যমান এক মানুষ লম্বা ঘাসের শীষ, ইত্যাদির ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ খেয়াল হলো, বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। তেড়েফুঁড়ে খানিকটা হেঁটে একটা পাহাড় টপকাতেই দেখি মংক্ষিয়াদা দাঁড়িয়ে, আমার অপেক্ষায়, চোখে ভারি অননুমোদী দৃষ্টি, এভাবে হাঁটতে হাঁটতে হেদিয়ে পড়াটাকে ভালো চোখে দেখছেন না তিনি। তাই তাঁর মন আর নিজের মান রক্ষার্থে এবার ক্যামেরাটাকে ব্যাগবন্দী করে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা দিলাম। ডানে চলে গেছে একটা পথ, ওদিক দিয়ে গেলে সায়কতপাড়া পড়বে। সায়কতপাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গ্রাম। কেওকারাডঙের একেবারে গোড়ায় যে দার্জিলিংপাড়া, সেটাও এই সায়কতপাড়ার চেয়ে খানিকটা নিচুতে। পাহাড়িরা পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গায় মজবুত বেড়া দিয়ে রাখেন, যাতে তাঁদের পোষা গয়ালগুলো চরতে চরতে অন্যের সীমানায় চলে না যায়। আর এই বেড়া টপকানোর জন্যে রয়েছে তাঁদের সেই অভিনব সিঁড়ি, যেগুলো বেয়ে তাঁরা নিজেদের ঘরের পাটাতনে ওঠেন, একটা সরু গুঁড়ির কয়েক জায়গায় দায়ের কোপ মেরে তৈরি করা। এমনই একটা এবার পড়লো পথে। সেটা ডিঙিয়ে খানিকটা যেতেই অপূর্ব এক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সকালের রোদ এসে পড়েছে সেই অপূর্ব সবুজ পাহাড়ের ঢালে, যেন সবুজ আগুন জ্বলছে গোটা পাহাড় জুড়ে, মাথার ওপরে নির্মেঘ নীল আকাশ, দূরে একটার পর আরেকটা পাহাড়ের ঢাল, আস্তে আস্তে পাতলা একটা কুয়াশার চাদরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে তারা, আর সামনে এই আঁকাবাঁকা চলার পথ। চারিদিকে সব নিঝুম, কোন পাখি ডাকছে না, কোন ঝর্ণার ফিসফাস নেই, শুধু নিজের চলার খসখস শব্দ। এই নির্জন নিস্তব্ধ সকালগুলো আমাদের জীবন থেকে এত দূরে কেন থাকে, আমরা কেন এভাবে সরে সরে থাকি এই পাহাড়ি রোদের সাম্রাজ্য থেকে? আমি পথ চলতে চলতে নিজের কানে কানেই ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকি, ঠোঁটে কয়েকটি পঙক্তি ছুটে আসে নিজ থেকেই, --- এজন্যেই কি আমি অনেক শতাব্দী ধ'রে স্বপ্নবস্তুর ভেতর দিয়ে ছুটে-ছুটে পাঁচশো দেয়াল-জ্যোৎস্না-রাত্রি- ঝরাপাতা নিমেষে পেরিয়ে বলেছি, 'রূপসী, তুমি, আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ।' বেশ একটা ইয়ে এসে গিয়েছিলো নিজের মধ্যে, বুঝলেন, হঠাৎ চোখ পড়লো সামনে, দূরে তড়বড়িয়ে হেঁটে চলছে দলের বাকি লোকজন, আর তাদের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে ভারি তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে দেখে নিচ্ছে --- কয় কিলোমিটার পেছনে পড়ে আছি, কিংবা আদৌ এগোচ্ছি কি না --- আর কেউ নয়, সেই জংলি চঞ্চল ব্যাটা! রাগে আমার মাথার রন্ধ্রগুলো জ্বলে উঠলো, ব্যাটা বেরসিক, জানো তো শুধু গয়ালের মতো চরে বেড়াতে, সৌন্দর্য উপলব্ধি যদি তোমার কাজই হতো --- বহুকষ্টে যোগবলে রাগ কমিয়ে আনি, নাহ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ আর গোয়েটে ইনস্টিটুটে অ্যাতোদিন যাতায়াত করেও বর্বর আর অসংস্কৃতই রয়ে গেছে ছোকরা! রাগের চোটে হাঁটার গতি একটু কমে গিয়েছিলো, মংক্ষিয়াদার তাড়া খেয়ে আবার হনহনিয়ে হাঁটতে থাকি। একটা মোড় ঘুরে খানিকটা এগিয়ে দেখি, পথের ওপর যে যেভাবে পারে একটু বসে পড়েছে সকলে, হিরো থেকে জিরো হয়ে জিরোচ্ছে। আমিও ধুপ করে বসে পড়লাম, হাতের লাঠিটাকে মাটিতে গেঁথে। ধনঞ্জয় ত্রিপুরা তাঁর পাথেয় যে ক'টি কলা এনেছিলেন, সেগুলো একে একে খোসা হারিয়ে আমাদের ভোগে নিয়োজিত হলো। এক প্যাকেট বিস্কুটও কার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাড়িতে বসে কলা বা বিস্কুট আমি ছুঁয়েও দেখি না, কিন্তু এখন, বাপ রে, পেটে টহল মারছে এক দুর্দমনীয় ক্ষুধা, এখন করলা ভাজি দিয়ে পান্তাভাত সাধলেও গপগপিয়ে খেয়ে ফেলতে রাজি আছি। এমনকি বিস্কুটের ভাগাভাগি নিয়ে চঞ্চলের সাথে একদফা ঠান্ডা কুস্তিও হয়ে গেলো। দু'জন দু'জনের দিকে বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে টোস্ট বিস্কুট খেতে লাগলাম কড়মড়িয়ে, যেন একে অন্যের খুলিটাই চিবিয়ে খাচ্ছি। পেটকে কিছুটা বুঝ দিয়ে পানির বোতল মাত্র খুলেছি, ও মা, তাকিয়ে দেখি পটাপট উঠে পড়ছে সবাই। আমি পানি খেয়ে বোতলের ছিপি আটকে গোঁফের পানি মুছতে মুছতেই তারা শ'খানেক গজ এগিয়ে গেলো। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে লাঠিটাকে প্রেয়সীর মতো জাপটে ধরে আবার এগোতে লাগলাম। এবার সবাই আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে, তাই পেছন থেকে হুড়ো দেবার লোক নেই। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ক্যামেরাটা বার করলাম। ঐ তো দূরে কী চমৎকার একটা পাতায় সাজানো নাম না জানা গাছ, আর ঠিক তার পাশেই একটা ন্যাড়া শুকনো গাছ। বিত্ত ও দারিদ্র্যের নিশ্চুপ সহাবস্থান --- ছবির শিরোনাম ভাবতে ভাবতে আমার শিরোভাগ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, নানা কায়দায় কয়েকটা ছবি তুলি, বেশ সময় নিয়ে। তারপর খানিকক্ষণ নেমে এসে দেখি, কাছেই পাহাড়ের ওপর একটা পাড়া --- মেনথুই পাড়া --- দেখা যাচ্ছে। এবার সুবিধাজনক কিছু জায়গা থেকে সেই গ্রামেরও কয়েকটা ছবি তুললাম। তবে ছবি তুলতে গিয়ে মিনিট পাঁচেক সময় অপচিত হয়েছে, ইতিমধ্যে আমার সহযাত্রী বন্ধুরা যে অস্তমিত হয়েছেন, তাতে আর সন্দেহ কী? তাই ক্যামেরাটা আবারও ব্যাগে বুঁজিয়ে রেখে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিচে নেমে এলাম। প্রায় চলি্লশ মিনিট ধরে নামতে হয়েছে, যে পাহাড়টায় এতক্ষণ ধরে চড়েছি আমরা, তারই অন্য পাশে খানিকটা পথ নেমেছি এবার। গ্রামটাকে পাশ কাটিয়ে আরো নিচে নেমে দেখি একটা গম্ভীর সরসর শব্দ হচ্ছে। একটা ছড়ায় পানি বয়ে যাচ্ছে পাথরের ওপর, সারাটা পাহাড় জুড়ে তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সেই ছড়ার পাশে হাত পা এলিয়ে বসে আমাদের লোকজন, আর কিছু দূরে কয়েকটি পাহাড়ি তরুণী, ঝিম মেরে এক জায়গায় বসে আছে তারা। পরিশ্রমের কারণেই বোধহয় আমাদের সম্পর্কে তাদের কোন কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছে না। বহু দূর থেকে আসছে বেচারীরা, সম্ভবত রুমাবাজার থেকে, কারণ তাদের সাথে নানারকম মনোহারি পণ্যের বোঝা, আর যাবেও খুব সম্ভবত বহুদূর। পাহাড়িরা আমার চেয়ে চারগুণ ওজন বহন করে প্রায় তিনগুণ বেগে চলতে পারে এ অঞ্চলের পথঘাট দিয়ে, আর চলতেও পারে একটানা অনেকক্ষণ। কিন্তু মাঝে মাঝে কয়েকটা জায়গায় একটু বসে লম্বা বিশ্রাম নেয় তারা, আধঘন্টা বা পৌনে এক ঘন্টার মতো। পাহাড়িদের পায়ের গড়নই সম্পূর্ণ অন্যরকম। একমণ আদা পিঠের ঝুড়িতে --- ঝুড়িগুলোর ফিতে ওদের কপালের সাথে বাঁধা থাকে --- বয়ে দূরদূরান্ত থেকে রুমাবাজারে নিয়ে যায় তারা বিক্রি করতে, কিন্তু এবড়োখেবড়ো পিচ্ছিল পথের ওপর এমন অনায়াসে খালি পা ফেলে চলে, যেন কোন পার্কের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে। একইভাবে গাদা গাদা লাকড়ি ঝুড়িতে করে কুড়িয়ে নিয়ে যায় তারা। আর মাত্র বারো কেজি ওজন নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছি আমি, ভাবতেই লজ্জা লাগে। ছড়াটার পাশে এসে ব্যাগ খুলে সবেমাত্র বসেছি, হাত পা একটু মেলে বসারও ফুরসত মিললো না, চঞ্চল এসে হুকুম ঝাড়লো, 'রুটি বের করো!' যেন আমি ভিক্তর উগোর সেই জ্যাঁ ভালজ্যাঁ, রুটি চুরি করে গা ঢাকা দিয়েছি। আমিও কম যাই না, নরম ঘাসের ওপর শরীর মেলে দিয়ে মধুর গলায় বললাম, 'ব্যাগে আছে, বের করে নাও!' চঞ্চল দাঁতে দাঁত ঘষলো, তারপর আমার রুকস্যাকটাকে রীতিমতো র্যানস্যাক করে সেই এক পাউন্ডার পাঁউরুটির প্যাকেটখানা এমনভাবে বার করে আনলো, যেন এয়ারপোর্টে সোনার বারের চালান আটক করেছে। আমিও চোরাচালানিদের মতোই হাবভাব নিয়ে বসে রইলাম, যেন ওটা আমার ব্যাগে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু যতোই বেরসিক বর্বর হোক না কেন, আর গুন্ডামি করে বেড়াক না কেন, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে চঞ্চল বেশ কাজের গুন্ডা। পুতুল আপার মেয়োনেজটাকে সুচারুভাবে রুটিতে মেখে মেখে সবার হাতেই ধরিয়ে দিলো সে একেক টুকরো। আমার পূর্বপুরুষদের অসীম পূণ্যফল, যে আমার ভাগেও একটা টুকরো জুটেছিলো। ওর মতো বদের এই বদান্যতায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম, অর্ধেক খিদে তখনই উবে গেলো। তবে সাহিত্যপ্রবণ মন আমার, সেই কবে শৈশবে বান্দরের রুটি ভাগ বা এই গোছের একটা গল্প পড়েছিলাম, সেটাই থেকে থেকে অন্তরাত্মায় ঘা দিলো কিছুক্ষণ। ভরপেট না হোক, ভরমন খাওয়া হলো সবার। আর আফটার লাঞ্চ রেস্ট আ হোয়াইল, তাই সবাই একটু গড়িয়ে নিলো ঘাসে। পেছনে পাথর আর খাটো ঝোপের আড়ালে ঝরঝর অবিশ্রান্ত বয়ে চলেছে হিমসলিল, সামনে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সবুজ পাহাড়, অনেক উঁচুতে পাহাড়ের পেছনে উঁকি দিচ্ছে আকাশের বিশুদ্ধ নীল উষ্ণীষ। দিনের পর দিন কংক্রীট আর পিচের মাঝে বন্দী আমরা জীবন কাটাচ্ছি, ছোট্ট একটা পরিসরে ছুটে বেড়াচ্ছি, তাই হঠাৎ এই বিশালতা যেন আমাদের সবাইকে একটু বিষণ্ন, একটু নীরব, আর একটু অলস করে দিলো, যেন মরচেপড়া প্রদীপের ভেতর থেকে সেই বিশাল দৈত্য বেরিয়ে এসেছে আমাদের সামনে, যা এতোদিন ধরে খুঁজছিলাম তা এতো কাছে পেয়ে সবার চেষ্টা, সবার চঞ্চলতা জড় হয়ে পড়েছে ---। বেশ লাগছিলো, বুঝলেন, গুন গুন করে গানও গাইছিলাম, রামধনু চোখে চোখে, কথাকলি মুখে মুখে, এখানে মনের কথা বোলো না, না আ আ আ, এখানে মনের কথা বোলো না ---। কিন্তু গানের আমেজ ছারখার করে দিয়ে একটা তিতিবিরক্ত কর্কশ কন্ঠ যা বলে উঠলো, তার সারমর্ম হচ্ছে, অনেক বিশ্রাম হয়েছে, এবার বডি তুলতে হবে। কি, পাঠক, অ্যাদ্দূর পড়ে এসে নিশ্চয়ই ধরতে পারছেন, এই রসভঙ্গকারী নচ্ছাড়টা কে? পদে পদে ব্যাটার নামে দরূদ পড়তে পারবো না, বুঝে নিন! বরুণদা এর আগে এই পথে এক দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চার করে গেছেন, অলস হাত তুলে আমাদের এগোনোর পথ দেখিয়ে দিলেন তিনি। আমাদের আগুয়ান বাহিনী, অর্থাৎ দলনেতা উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, সৈকত, সালেহীন আর চঞ্চল চটপট উঠে পড়ে পিঠে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে, কোমরে কষি বেঁধে বুক ফুলিয়ে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে গেলো। আমি তখনো ঘায়েল হয়ে পড়ে, একে একে সকলে উঠবার পর সেই ঘাসের কোমল সান্নিধ্য ছেড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়ালাম। নাহ, লেটকে পড়ে থাকলে তো চলবে না, কদম কদম বাঢ়ায়ে যা খুশিসে গীত গায়ে যা ---। গাঁটরিবোঁচকা কাঁধে তুলে আবার টলন্ত পায়ে চলন্ত হলাম। আমাদের পথ ভারি নিরীহ চেহারা নিয়ে একটা প্যাঁচ খেয়ে উঠে গেছে এক ঢিবির ওপরে। ঢিবির উচ্চতা চারতালা সমান, একেবারে কাছে না গেলে বোঝা যায় না, কী পরিমাণ কুটিল ষড়যন্ত্র এখানে রয়েছে! ঢিবিটা একেবারে মসৃণ, তার যে খাঁজগুলোতে পা রাখতে হবে, সেগুলোও মসৃণ, আবার ঝুরঝুরে মাটি ভর্তি, পা রাখতে না রাখতেই পিছলে যেতে শুরু করে। আর এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজের দূরত্বটাও যেন স্বাভাবিক আকারের মানুষের জন্যে তৈরি নয়, ব্রবডিংন্যাগের লোকজনের জন্যেই তৈরি বোধহয়। বহুকষ্টে দাঁতমুখ খিচিয়ে খামচাখামচি করে ঢিবি বেয়ে একটা আপাতসমতল জায়গায় উঠে দাঁড়ালাম। একটা পথ চলে গেছে ডানে, বোধহয় কোনও পাড়ার দিকে, আরেকটা পথ গোঁৎ খেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে। ধনঞ্জয়দার এগোনো দেখে বুঝলাম, এখন আমাদের নিচে নামতে হবে। ভালো করে রুকস্যাক এঁটে নিয়ে তিন পা এগিয়েই বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম যেন। আমার সামনে বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত। পাহাড়ের পর পাহাড় সামনে, পাহাড় ছাড়া অন্য কিছু দেখবার জো নেই। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে আছি তেমনই একটা পাহাড়ের চূড়োয়, আর আমার নিচে ঝপ করে প্রায় খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল। ঢালে বিশাল সব ঝোপ, উঁচু উঁচু গাছ, বাঁশের ঝাড়, সবই আছে যা কিছু থাকবার কথা, কিন্তু তবুও দেখতে পাচ্ছি, পায়ে চলার পথের ঠিক পাশেই ঝপ করে নেমে গেছে পাহাড়, বিশাল খাদ নিচে, বারোশো থেকে পনেরোশো ফুট নিচে ক্ষুদে কিছু গাছপালা আর পাথর দেখা যাচ্ছে। ঐ গাছগুলো আদপে ক্ষুদে নয়, অনেক ওপর থেকে তাকিয়ে আছি আমি। আমি চলার পথের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে একটা ঢোঁক গিললাম। পথটা পাহাড়ের ঢালের ওপর, অর্থাৎ, পথটাও একই রকম ঢালু, তাতে এবড়ো খেবড়ো সব নুড়ি, আর সাকুল্যে একটি মাত্র পা রাখার মতো চওড়া সেটি। পথের পাশে মুখ ব্যাদান করে আছে সেই দেড়হাজারফুটি খাদ। পপাত চ মমার চ। আমি একজন অ্যাক্রোফোবিয়াক --- উচ্চতাকে দারুণ ভয় পাই আমি, তিনতলার ছাদে উঠেও রেলিঙের ধারে কাছে ঘেঁষি না। আপনিই বলুন, এ পরিস্থিতিতে আমার যদি তখন হাঁটুতে হাঁটুতে লেগে টরেটক্কা আওয়াজ উঠতো, দোষ কিছু হতো? --- কিন্ত না, হাঁটু আমার কাঁপেনি। আমি কোনমতে নিজের মনটাকে অন্য একটা ব্যাপারে স্থির করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা গিয়ে বুকে কিছুটা বল ফিরে এলো। নাহ, বেশ এগোচ্ছি তো! কিন্তু একটা মোড় ঘুরে দেখি পথের ওপর আড়াআড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে একটা ইয়া মোটা নাম-না-জানা কাঠের গাছ, তার ওপারে সশঙ্কিত চিত্তে দলের অগ্রবর্তীরা দাঁড়িয়ে, আর এ পারে আমি, ধনঞ্জয়দা আর পুতুল আপা। মংক্ষিয়াদা আমাকে ঘোড়ার সওয়ারির মতো গাছের ওপর চেপে এক পা টপকে দিতে বললেন। এ ছাড়া ঐ গাছ টপকে যাবার কোন পথ নেই। বামে প্রাচীরের মতো পাহাড়, ডানে খাদ, পথের ওপর কোমর সমান উচ্চতায় ঝুঁকে পড়া গাছ। সময় নষ্ট না করে গাছটার ওপর চড়ে বসলাম। আর গাছটাও বজ্জাত কম নয়, ঘোড়ার মতোই নড়েচড়ে উঠলো সে, স্পষ্ট শব্দ শুনলাম, গোঁওওও! এখন যদি গাছটা পিছলে নিচে নেমে আসে, তার সওয়ারীও খানিকটা পিছলে পড়বে, প্রায় হাজার ফুট নিচে! ঢোঁক গিলে নিজের হৃৎপিন্ডটাকে আলজিভের ওপর থেকে সরিয়ে আবার নিচে ফেরত পাঠালাম, নিজের জায়গা ছেড়ে আঘাটায় উঠে এসে ধুকধুক করছিলো ব্যাটা। তারপর একটা পা বাড়িয়ে দিয়ে হেলে পড়তেই ডান পায়ের নিচে আবার শক্ত মাটি ফিরে পেলাম। পুতুল আপাও আমার মতোই বৃক্ষারূঢ় হয়েই এই পুলসিরাত পেরিয়ে এলেন। ধনঞ্জয়দাকে পেরোতে দেখলাম, অবলীলায় গাছটাকে ডিঙিয়ে এসে ধুপ করে পড়লেন তিনি। গাছটা আবারও একটা আপত্তির হ্রেষাধ্বনি তুললো, ভ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ --- একটু নিচের দিকে নড়ে উঠলো, তারপর আবার সব চুপ। আবার অতি সন্তর্পণে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম সবাই। ইতিমধ্যে দলের আগুয়ান বাহিনী খানিকটা এগিয়ে গেছে, মংক্ষিয়াদা পুতুল আপাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছেন, আর পেছনে আমি, ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, শাহেদ ভাই আর বরুণদা। এই বিশ্রী পাহাড়ি পথে নামতে গিয়ে বার দুই পা পিছলে গিয়েছিলো, কপালের জোরে নিচে গিয়ে পড়িনি। তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কোন জায়গা ঐ পথের ওপর নেই, সমস্ত পথটাই নেমেছে খাদের পাশ ধরে, যত নিচে নামছি, অন্ধকার ঝোপঝাড় এগিয়ে আসছে। হুঁশিয়ার হয়ে একটু ধীরে নামছিলাম, শাহেদ ভাই আমার মনে সাহস যোগানোর জন্যে বললেন, 'হিমু, আস্তে আস্তে হাঁটেন। ভয়ের কিছু নাই।' আমিও নিজেকে প্রবোধ দিলাম, 'জি্ব শাহেদ ভাই, রাস্তাটা একটু ইয়ে, কিন্তু ভয়ের তেমন কিছু নাই।' সহজ সরল ধনঞ্জয় ত্রিপুরা এই পথে হরদম আসাযাওয়া করেন, তিনি আমাদের এই মিথ্যাচারের পরম্পরা সহ্য করলেন না, বলে উঠলেন, 'না না, এতা খুব খালাপ লাস্তা --- গলু পলে গেলে মলে যায়।' আমরা একটা বায়বীয় আশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বোধকরি একটু জোরসে হাঁটা শুরু করেছিলাম, কিন্তু এমন নিদারুণ দুঃসংবাদ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। শাহেদ ভাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, 'কী? --- গরু?' ধনঞ্জয় হাসিমুখে ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়লেন। শাহেদ ভাই বহুকষ্টে আমাকে সাইজে এনেছিলেন, তাঁর সব প্রচেষ্টা ঐ গরুর সাথেই মাঠে মারা গেলো, তিনি ডুকরে উঠলেন, 'গরু পড়বে কেন? য়্যাঁ? গরু পড়বে কেন এখানে?' আমারও মনে তখন একই প্রশ্ন। গরু কি পড়ার আর জায়গা পেলো না? এমন সূচাগ্রমেদিনীতুল্য পথে বেড়াতে এসে পা পিছলে মরলো কেন সে? এ কি ফাজলামো নাকি? ধনঞ্জয় তখন ঠিক পায়ের নিচে খাদের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার অংশ দেখিয়ে জানালেন, কয়েকদিন আগে একটি গরু ওখানে পড়ে গিয়েছে, এবং পতনের যা অবশ্যম্ভাবী ফল, সেইটি লাভ করেছে। এসব জায়গায় পদস্খলনের শাস্তি বড় কড়া। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমত, গরুটা পড়ে গিয়ে মারা গেছে। দ্বিতীয়ত, এখনই কেন আমাকে এই দুঃসংবাদটা পেতে হলো, যখন হাঁটু দু'টোকে বহুকষ্টে বাগে ধরে রাখা গেছে? তৃতীয়ত, আমার সাথে কি গরুর কোন সূক্ষ্ম তুলনা ফাঁদার চেষ্টা করছেন ধনঞ্জয়? ওদিকে শাহেদ ভাই ক্ষেপে উঠলেন একদম, 'না না, এখানে গরু টরু পড়ে না! হিমু আপনি আস্তে আস্তে আগান তো ভাই!' ধনঞ্জয় স্মিত হেসে চুপ করে গেলেন, আমি আরো সাবধান হয়ে পা টিপে টিপে নামতে লাগলাম। পড়ে মরা গরুর দলে শামিল হতে চাই না আমি। একটা কিছু ঘটে গেলে এই ধনঞ্জয়দা পরে বলে বেড়াবেন, এখানে দু'টো গরু পড়ে মারা গেছে! এই পশ্চাদবর্তী দলের মধ্যে আমি যেহেতু এগিয়ে, তাই আমার বেগেই আস্তে আস্তে নামতে লাগলো সবাই। সেই গরুপতন পয়েন্ট পেরিয়ে আরো খানিকটা নেমে পথটা পাহাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলো। খাদের কিনারা থেকে সরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা, চলার গতি কিছুটা বাড়লো। কয়েকটা জায়গায় বিশাল সব বোল্ডার বেয়ে নামতে গিয়ে একটু সময় লাগলেও, কোন অঘটন ঘটলো না। তবে বরুণদা কিছুদিন আগেই এ পথে এসেছিলেন, তখন এখানে তাঁর গাইড জুয়াম মদের ঝোঁক সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছিলো। সে কারণে মাঝপথ থেকেই সেবার ফিরে যেতে হয়েছে বরুণদাকে, আর জুয়াম কিরে কেটে জানিয়েছে, এই পথে, যেখানে শুয়োরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চলাও নিরাপদ নয়, আর কখনো পা ফেলতে আসবে না সে। আরো খানিকটা নেমে নিচের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমাদের। দূরে কিছু খাটো পাহাড়ের ওপর বিকেলের সূর্য আলো ঢালছে। আর আমাদের নিচে পাথুরে খাতের ওপর ঝিরঝির করে বয়ে চলছে প্রশস্ত একটি ধারা, তার দু'পাশে বিশাল দেয়ালের মতো পাহাড়, দু'তিনতলা উঁচু সব বোল্ডার ছড়িয়ে আছে এদিক সেদিক, তার ফাঁকে ফাঁকে পানির রঙ ইস্পাতের মতো নীল, হু হু করে বয়ে চলেছে। সেদিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছে আমাদের আগুয়ান জনগণ। পাহাড়ের অলিগলি দিয়ে বাকিটা পথ পেরিয়ে এসে দেখি জলের ধারে পাথরে হাসি হাসি মুখে বসে সবাই। বরুণদা একটা বোল্ডারের ওপর নবাব আলিবর্দি খানের মতো ভঙ্গি করে বসলেন, একটা ছবি তুলে দিলাম, আর সেই বিশাল বোল্ডারে ক্লাবের নামখানা টুকে রাখা হলো। তবে এই করাঙ্ক স্থাপনের গৌরব আমাদের একার নয়, এখানে যে এর আগেও ইংরিজি বর্ণজ্ঞানসম্পন্ন রসিক ব্যক্তিবর্গের পদার্পণ ঘটেছে, তারও প্রমাণ মিললো। বাকিরা ছবির ধার ধারলেন না, তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেলেন পানির দিকে। দলনেতা উচ্ছল এরই মধ্যে গোসল সেরে ফেলেছেন, বাকিরাও পুলকিত বদনে জুতো খুলে তীব্র পানির ধারায় পা মেলে রেখেছেন। বোঝা নামিয়ে রেখে আমিও সেই জলে নেমে পড়লাম। সেই ভোরবেলা থেকে হাঁটছি সবাই, এর মধ্যে আর জুতো খোলা হয়নি। মুখে মাথায় খানিকটা পানি ছিটিয়ে বরফশীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম, পানির স্রোত এত তীব্র যে মাসাজের কাজ হয়ে যায়। পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আশপাশটা দেখে নিলাম। যে পাহাড়টা মাত্র টপকে নেমে এসেছি, তার দিকে তাকালে ঢোঁক গেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। খাড়া পাহাড়টা আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে আকাশকে মুছে দিয়েছে পুরোপুরি। চলার পথটা এই ছড়া ধরে খানিক এগিয়ে বাঁয়ের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। মংক্ষিয়াদা জানালেন, আর মাত্র একটা পাহাড় ডিঙিয়ে গেলেই পুকুরপাড়ায় পৌঁছে যাবো আমরা। ছড়ায় মিনিট দশেক বসে, পা দু'টোকে একটু সেবা দিয়ে আবার জুতো পরে নিলাম। বিকেলের আলো আস্তে আস্তে মরে আসছে, কিছুক্ষণ পরই ঝুপ করে আঁধার নেমে আসবে, তাই মংক্ষিয়াদা তাড়া দিলেন সবাইকে। খানিকটা পানি খেয়ে নিয়ে আবার যখন উঠলাম, ততক্ষণে সবাই এগিয়ে গেছে, শাহেদ ভাই একটু দূরে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। এগিয়ে যাবার আগে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলাম সেই খতরনাক পাহাড়টাকে। অন্ধকার, অটল। খানিকটা এগোতে না এগোতেই ঘটলো বিপত্তি, ব্যাগের সাথে বাঁধা গোল করে পাকানো স্লিপিংব্যাগটা গড়গড়িয়ে খুলে গেলো। সেটাকে আবার ঠিকমতো বুঁজিয়ে শক্ত করে বাঁধতে গিয়ে নষ্ট হলো কয়েকটা মিনিট। শাহেদ ভাই জঙ্গলের ভেতর থেকে হাঁক ছেড়ে জানতে চাইলেন, কোন সমস্যা হলো কি না। জবাব দিতে যাবো, শুনতে পেলাম, মাথার ওপরে ঝোপে একটা ভারি খসখস শব্দ হলো। কী জন্তু কে জানে, তা দেখবার জন্যে আর অপেক্ষা করলাম না, দিলাম ঝেড়ে দৌড়, এক ছুটে একেবারে জঙ্গল পেরিয়ে আবার সেই পাথুরে খাতের ওপর। দূরে শাহেদ ভাই, বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা বিড়ি টানতে টানতে অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। ছড়ার ওপরে যে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম আমরা, সেটা আগেরটার মতো ঘাতক চরিত্রের না হলেও বেশ খাড়া। ভেজা ভেজা, পিচ্ছিল মাটি, পাহাড়ের বেশির ভাগ অংশেই রোদ পড়ার সুযোগ নেই উঁচু উঁচু গাছের জন্যে। ক্ষণিকের জন্যে রোদেলা একটা অংশ পাওয়া গেলো পথে, তারপর আবার সেই স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার পথ। লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে চললাম আমরা। উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, সালেহীন, সৈকত আর চঞ্চল এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা, বাকিরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। আরো খানিকটা এগিয়ে শুরু হলো খাড়া পথ। তবে পা রাখার মতো যথেষ্ঠ জায়গা আছে এখানে। কিছুদূর গিয়ে দম নেয়ার জন্যে একটু থেমে নিলাম, একটানা অত খাড়া পথে চলা ভারি কষ্টসাধ্য কাজ। পুকুরপাড়ার এক বাসিন্দা ফিরছিলেন এই পথে, আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে তিনি এগিয়ে গেলেন তরতর করে। ওদিকে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা এগিয়ে গেছেন খানিকটা। সূর্যের আলো বিবর্জিত এই পাহাড়ের পিচ্ছিল আর ঢালু পথ বেয়ে বেয়ে এক জায়গায় এসে চোখে পড়লো জুম্ম চাষের প্রস্তুতির চিহ্ন। পাহাড়ের খাড়া ঢাল থেকে ঝোপঝাড় সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে, বিশাল এক গাছকে কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে, একটা সাঁকোর মত দুই পাহাড়ের ঢালের ওপর পড়ে আছে সেটা, তার অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে নিকষ অন্ধকার। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম উৎফুল্ল মনে, কী ভাগ্য আমার যে এই সাঁকোর ওপর দিয়ে যেতে হচ্ছে না! আরো খানিকটা এগিয়ে চোখে পড়লো একটা বদ্ধ ছড়া। জায়গাটা বাঁশ ঝাড়ের পাশে, পানি এখানে জমাট হয়ে আছে, কোন স্রোত নেই, ছোট ছোট বোল্ডার ছড়ানো, আর একটা গাছের গুঁড়িতে আমাদের অপেক্ষায় বসে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা। ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিলো, বরুণদার ব্যাগে চিঁড়াভাজার ওপর হামলা করলাম। বরুণদা মিটিমিটি হাসলেন, কারণ ক্লাবসভায় শুকনো খাবার হিসেবে চিঁড়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলাম আমি, আর সেই আমিই এখন হামলে পড়ে চিঁড়া খাচ্ছি সমানে। পুতুল আপাও ইতিমধ্যে চলে এসেছেন, কয়েকটা খেজুর দিয়ে আমাকে আপ্যায়ন করলেন তিনিও। কিন্তু বেশিক্ষণ বসা গেলো না, জায়গাটা নিকষ অন্ধকার। কানের কাছে ভনভন শব্দ শুনে মশার ভয়ে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গেলাম আমরা। এবার পথ চলে গিয়েছে উঁচু ঘাসের ঝোপ আর বাঁশের ঝাড়ের মধ্য দিয়ে। মাটি এখানে শক্ত, দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলাম সবাই। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, গাছপালার জন্যে আলো ঢোকার কোন রাস্তা নেই, আর রাস্তা থাকলেও ঢোকার মতো আলো এখন নেই আকাশে। পথ শেষ হলো খাটো দেয়ালের মতো এক পাহাড়ের সারির গোড়ায়, ডানে বা বামে যতদূর চোখ যায়, দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে এই পাহাড়, এটিই বান্দরবান আর রাঙামাটি জেলার সীমানা। পাহাড়ের গোড়ায় কয়েকটা টং ঘর ছাড়া আর কিছু নেই, কিন্তু টেনিস কোর্টের মতো সমতল জায়গাটা। খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এসেছি আমরা, পেছনে ফেলে আসা সূর্যটাকে দেখাচ্ছে বড় একতাল সিঁদুরের মতো, আর আমাদের সামনে প্রসন্নমুখে ভেসে আছে ঝকমকে চাঁদ। এ দুয়ের আলোতে দেখে নিয়ে পাথুরে পথে এগোতে শুরু করলাম। বরুণদা আর শাহেদ ভাই আবারও এগিয়ে গেছেন, আর খানিকটা এগোলেই বান্দরবান পেরিয়ে রাঙামাটিতে পা দেবেন তাঁরা। পাহাড় পেরোতেই পথ আবার ঢেকে গেলো ঘন ঝোপে। এবার আর টর্চ ছাড়া উপায় নেই, আর হিম পড়ে গেছে বেশ। ব্যাগ থেকে জ্যাকেট আর টর্চ বের করে এগিয়ে গেলাম। পুতুল আপা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন, তিনিও এর মধ্যে চলে এসেছেন। আবার যখন খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলাম, দূরে একজোড়া সিগারেটের আগুন চোখে পড়লো, বরুণদা আর শাহেদ ভাই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছেন। চাঁদ এর মধ্যে আকাশে তার মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসেছে। সেই হালকা আলোয় দূরে চোখে পড়ছে একটা ঝকঝকে হ্রদ, আর তাকে ঘিরে একটা গ্রাম। চারপাশে গম্ভীর অন্ধকার সব পাহাড়ের সারি, তার মাঝে গোটা জলাশয় যেন চাঁদের আলোয় জ্বলছে। এ দৃশ্যের জন্যে আরো দুটো পাহাড় টপকে যেতে রাজি আছি আমি। কিন্তু আজকের মতো পাহাড় বেয়ে ওঠার কাজ আপাতত শেষ, এই পাহাড় বেয়ে নেমে গেলেই গ্রামে পৌঁছে যাবো আমরা। আর পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে বোঝা গেলো, ঝামেলার এখন কিছুটা বাকি। খুবই ঝুরঝুরে মাটি, গোড়াতেই পা পিছলে গিয়ে প্রবল এক অভূতপূর্ব হোঁচট খেলাম, পুতুল আপা আঁতকে উঠে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে অভয় দিলাম সবাইকে, আছি, মরি নাই! লাঠিটা ছিলো বলে কয়েকশো ফিট নিচের অন্ধকারে পড়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম, কিন্তু লাঠি বেচারা নিজে মচকে গিয়ে অচল হয়ে পড়লো। কী আর করা, কোন মতে টর্চের আলোয় সেই বদখদ পথ পেরিয়ে খানিকটা সমতলে নেমে এলাম আমরা। বরুণদার কাছে রাতে মুরগি খাবো মুরগি খাবো বলে খানিকটা ঘ্যানর ঘ্যানর করে করার পর আশ্বাস পেলাম, রাতে মুরগি হবে। এক দফা ভালো খানা জুটবে, সেই উল্লাসে বাকিটা পথ যেন উড়ে পেরিয়ে এলাম। খানিকটা চড়াই খানিকটা উৎরাই ভেঙে গ্রামের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম, আধ ঘন্টা হাঁটার পর। এখানে ঝোপঝাড়গুলো সেচের অভাবে ঠিক বাড়তে পারছে না, এই অজুহাতে একটা ঝোপের সামনে ছোটোবাইরের জন্যে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, বাকিরা এগিয়ে গেলো। হাতের কাজ সেরে নিয়ে একবার ফেলে আসা পাহাড়টাকে চাঁদের আলোয় দেখে নিলাম। আমার আকাশের অনেকখানি আড়াল করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হলো চারদিকে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল, মাথার ওপর প্রাচীন চাঁদ, আকাশে নক্ষত্রের নিজস্ব নকশা, এগুলো যুগ যুগ ধরে যেন সঙ্গ দিয়ে আসছে আমাকে, যেন আমি এদেরই স্বজন। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। গ্রামে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়লো বিরাট সব গয়াল আর প্রকান্ড আকৃতির শূকর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে সব, আমাদের দেখে গাঁক গাঁক করে অভ্যর্থনা জানালো তারা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কারবারির কুটিরের দিকে এগিয়ে গেলাম, কাছে যেতেই পরিচিত কন্ঠের কলরব কানে এলো। ব্যাগ আর জুতো খুলে কোনমতে টলতে টলতে কুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সালেহীন বত্রিশ দাঁত বার করে বরণ করে নিলো আমাদের। তিন: পুকুরপাড়া পুকুরপাড়া গ্রামটা ত্রিপুরা অধু্যষিত, কিন্তু কারবারির ঘরটা আর দশটা পাহাড়ি কুটিরের মতোই, অন্তত আমার কাঁচা চোখে কোন পাকা পার্থক্য চোখে পড়লো না। কুটিরের প্রথমেই খানিকটা বারান্দা, সেখানে জুতোজোড়াকে সমর্পণ করে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকে প্রথমে যে ঘরটা পড়ে, সেখানে একটা তাঁত বসানো। সে ঘরেরই এককোণে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে আমাদের কলম্বুষ সদস্যদের ব্যাগগুলো। আমার ঘুমকম্বলটাকে খুলে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি জ্বলছে কয়েকটা, আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন কৌতূহলী গ্রামবাসীর পাশে আমাদের কয়েকজন বসে। গ্রামবাসীদের মাঝে চেনা মুখ দু'জনের, ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, আর দেবাশিস, যাঁর সাথে সন্ধ্যের আগে পাহাড়ে মুলাকাৎ হয়েছিলো। গুজগুজ আলাপ চলছে গ্রামবাসীদের মধ্যে। আমি ঘরে ঢুকেই এক কোণে স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে বসলাম। উচ্ছল ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যথার মলমটা চেয়ে নিয়ে, টর্চে নতুন ব্যাটারি ভরে নিয়ে লেগে পড়লাম নিজের পদসেবায়। উপস্থিত শিশুরা দেখলাম আমার স্কন্ধোত্তর চুল আর মোচদাড়ি দেখে বিমল আমোদিত হলো, নিজেদের ভাষায় যে কিচিরমিচির তারা জুড়ে দিলো, তার সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে, 'দ্যাখ কী আজব চিড়িয়া এসে জুটেছে।' খানিকটা ধাতস্থ হবার পর আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি, মিলন ভাইও আমার পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন, ঘুমকম্বলের ওপর চিৎপাৎ হয়ে পড়ে আছেন তিনি। সালেহীন আর উচ্ছল ভাই তুলনামূলকভাবে চাঙা, আর চঞ্চল তো কথাই নেই, তাৎক্ষণিক কফির মগে রসিয়ে রসিয়ে চুমুক মারছে সে, আর খামাখাই আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই জালেম দুনিয়ার বে-ইনসাফির দুঃখ ভোলার জন্যে সালেহীনের বিস্কুটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বসলাম। পুতুল আপা আশ্রয় নিলেন অন্দরমহলে, কুটিরের ভেতরের দিকের ঘরে। মিলন ভাইয়ের সৌজন্যে মুরগির ইনস্ট্যান্ট সু্যপের কয়েকটা প্যাকেট গরম পানি সহযোগে বিতরিত হলো, সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর সেই নোনতা তরল চোঁচোঁ করে গিলে নিলাম সবাই। ওদিকে মংক্ষিয়াদা দেবাশিসের সাথে আলাপ করে জানালেন, আমাদের খবর শুনে বেশ বিস্মিত হয়েছে গ্রামের লোকেরা। আমরা কেন সেই গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে এখানে এসেছি, তা বুঝতে পারছে না তারা। সেনাবাহিনীর লোকও নাকি বিপজ্জনক বলে গত তিন বছর ধরে ঐ পথ মাড়ায় না। পুকুরপাড়ায় সেনাছাউনি রয়েছে, তাদের যাতায়াতের জন্যে রুমা থেকে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক একটা পথ তৈরি করা হয়েছে। সেই পথ কিঞ্চিৎ দীর্ঘতর, কিন্তু সে পথে গরু পড়ে মরে যায় না। আর নিতান্ত ঠ্যাকায় না পড়লে আমাদের টপকে আসা পথ পাহাড়িরাও ব্যবহার করে না। এমন একটা সংবাদের জন্যেই বোধহয় অপেক্ষা করছিলাম। জিতা রহো দেবাশিস! আমি গলা খাঁকরে ভ্যানর ভ্যানর শুরু করলাম, ঐ গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে রুমায় ফিরতে আমি চাই না, একটা বিকল্প পথের আলামত যখন পাওয়া গেছে, সেটাই বাজিয়ে দেখা যাক, নতুন পথের সন্ধানেই তো আমরা দিগ্বিদিক ছুটে চলেছি --- ইত্যাদি। আর সবচে' বড় কথা হচ্ছে, এই বিকল্প পথে গরু পড়ে গিয়ে মরে যায় না, আর কী চাই? দলনেতা কী বলেন? আমার প্রস্তাবের কড়া সমর্থন পাওয়া গেলো মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে। বেচারার দুই পায়ের পেশীতেই মারাত্মক টান ধরেছে, পথের মাঝখানে এক জায়গায় তো প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিলো তাঁর। যে কোন বিকল্প পথেই তিনি যেতে রাজি, কিন্তু ঐ গরুমারা পাহাড়ে আর নয়! মিলন ভাইয়ের সমর্থনে, ইংরেজিতে যাকে বলে ডোমিনো এফেক্ট, পড়লো সবার ওপর, নতুন পথের পক্ষে উলু দিয়ে উঠলো বাকিরা। এর পরে নতুন আলোচ্য বিষয় হলো, পরদিন ভোরে আমরা কী করবো? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে সবার টনক নড়লো, তাই তো, স্রেফ পুকুরপাড়াই তো দেখতে আসিনি আমরা, এসেছি পুকুরপাড়ায় রাইনক্ষ্যং নদীর প্রপাত দেখতে। প্রসঙ্গ উঠতেই মংক্ষিয়াদা ভারি আপ্লুত হয়ে সেই প্রপাতের সৌন্দর্যকীর্তন করলেন কিছুক্ষণ। খানিক আলাপসালাপের পর পরদিন কাকভোরে, অর্থাৎ কাকও যখন পাশ ফিরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোয়, সেই ব্রাহ্ম মূহুর্তেই প্রপাততীর্থযাত্রা ঠিক হলো। জানা গেলো, পুকুরপাড়া থেকে আধঘন্টা হাঁটাপথ পেরোলেই সেই প্রপাতের দেখা মিলবে। তবে, পাহাড়িদের আধঘন্টার ওপর ভরসা নেই আমার, মনে মনে সেটাকে সাড়ে তিন দিয়ে গুণ করে নিলাম। আমাদের বিতর্কের ফাঁকে মংক্ষিয়াদা ইতিমধ্যে মুরগি ম্যানেজ করে ফেলেছেন, পাশের রান্নাঘর থেকে একটা দারুণ ঘ্রাণ ঘরময় কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। জিভের জলোচ্ছ্বাসকে কোনমতে সামলে খানিকটা সময় ঝিমিয়ে কাটালাম। ওদিকে বরুণদা, উচ্ছল ভাই আর চঞ্চল রান্নার কাজে মংক্ষিয়াদাকে সহযোগিতা করার জন্যে বসে গেছেন। সারাটা পথ সঙ্গ দেয়ার জন্যে আর ব্যাগ বহন করার জন্যে ধনঞ্জয় ত্রিপুরাকে ধন্যবাদ আর উপহারসহ বিদায় জানিয়েছেন পুতুল আপা। রাতের খাবারের গুণবর্ণনা করে আর কাজ নেই, সবার চেয়ে সেরা আচার হচ্ছে ক্ষিদে। হুমহাম করে পাহাড়ি মুরগি ভুনা আর ডাল দিয়ে পাহাড়িদের লালরঙা ভাত খেয়ে নিলাম সবাই। খেতে বসে ভাবলাম, কয়েক ঘন্টা আগেও এক বিঘত সরু পথের ওপর প্রাণটা হাতে করে হেঁটেছি, হোঁচট খেয়ে খাদের মুখে ছিটকে পড়েছি, পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শিকড় ধরে ঝুলে ঝুলে এগিয়েছি --- এগুলো কি সত্যিই ঘটেছে, নাকি সব তন্দ্রার ঘোরে দেখা স্বপ্ন রে বাপ? খাওয়াদাওয়ার আগেই কারবারির সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এখন মশা নেই, কাজেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারবো আমরা। তবুও সাবধানের মার নেই, খাওয়াদাওয়ার পর বীর চঞ্চল তার অ্যারোসলের শিশি বের করে ঘরময় কিছুক্ষণ দাপাদাপি করলো। তারপর আলো নিবিয়ে নিদ্রাসায়রে ডুব দিলাম সবাই। অন্তত ডোবার চেষ্টা করলাম। ঘরের দরজা জানালা যদিও ভেজানো, বাঁশের মাদুরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে মাঘের হিম বাতাস তুলোটে জ্যাকেট, পুরু স্লিপিং ব্যাগের ঠুনকো বাধা ডিঙিয়ে একেবারে হাড়ে গিয়ে নক করছে। নকের শব্দও যেন দাঁতে শুনলাম, খটাখট খটাখট ---। হাঁটার ক্লান্তি যে সবাইকে গ্রাস করেছে, বুঝতে পারলাম একটি পূর্বাশঙ্কিত শব্দের অভাবে, সবার নাকই জাতির বিবেকের মতো নিশ্চুপ। দুয়েক ঘন্টার জন্যে বোধহয় ঘুমটা লেগে এসেছিলো, কিন্তু স্বপ্ন দেখার ফুরসত মিললো না। ফিসফাস খুটখাট শুনে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন সোয়া পাঁচটা বাজে। প্রথমটায় জেগে গিয়ে ভাবলাম, জাগিনি, ঘুমিয়েই আছি, ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছি যে আমি জেগে উঠেছি --- কিন্তু বারান্দায় ধুপধাপ শুরু হতেই বুঝলাম, না দেখা দুঃস্বপ্নই সত্যি হয়েছে। কী আর করা, কোনমতে উঠে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালাম, আজ চঞ্চলের চপ্পল জোড়া হাইজ্যাক করে এগিয়ে গেলাম খানিকটা দূরে। আকাশে চাঁদ বত্রিশ দাঁত বার করে হাসছে, তারাগুলোও খুব তাল দিচ্ছে তার সাথে, কিন্তু এ আকাশ শেষ রাতের আকাশ, একটু পরই চারদিক ফসর্া হয়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে আসল কাজ সেরে দাঁত মেজে নিলাম। তবে আজ আর পরিবেশ দূষণ নিয়ে অনুশোচনা হচ্ছে না, পুকুরপাড়ার শূকরবাহিনীই সব জঞ্জাল সাফ করে দেবে। ক্যামেরা বার করে, জঙ্গলদল জুতো পায়ে দিয়ে সবাই যখন তৈরি, তখন পৌনে ছ'টা বাজে। আকাশ ফর্সা প্রায়, গ্রামও আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। প্রধান চত্বরে বিরাট এক আগুন জ্বলছে, তাকে ঘিরে নানা বয়সের শিশু, এক বিঘৎ হাঁ করে আমাদের দেখছে সবাই। আমাদের চালচলন নিঃসন্দেহে ভীষণ উদ্ভট ঠেকছে এদের কাছে। তাদের হাসিমুখের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে সবাই এগিয়ে গেলাম পূর্বোদ্দিষ্ট নদীপ্রপাতের পথে। প্রপাতের দিকে যাবার পথ হ্রদের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। চারদিকে কুয়াশার আস্তর, ফসলের মাঠে একটা নিঃসঙ্গ ন্যাড়া গাছকে কেবল দেখা যাচ্ছে, বাকি সব আড়ালে। একটা পাথরের মই বেয়ে নিচে নেমে সেই মাঠের ভেতর আড়াআড়ি চললাম সবাই। মাঠের বেশির ভাগ অংশেই কাদা, তার ওপর বাঁশ ফেলে কিছুটা গম্য করা হয়েছে। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ হুঁশ হলো, বাকিরা এগিয়ে গেছে খানিকটা, আমি আর পুতুল আপা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। হ্রদের তীরে এসে আরো পিছিয়ে পড়লাম আমি, কারণ এই অপূর্ব দৃশ্যকে মনের ক্যামেরা আর হাতের ক্যামেরায় তুলবার জন্যে খানিকটা সময় চাই। সূর্য ঢাকা পড়েছে কুয়াশায়, হ্রদের ওপর ভিখিরির কম্বলের মতো ছড়িয়ে আছে কুয়াশা, এখানে ওখানে ছেঁড়া ফাটা দিয়ে চোখে পড়ছে কাকচক্ষু জল। হ্রদের তীরে কয়েকটি ধূসর গাছ রুখে দাঁড়িয়েছে, কিছুদূরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সব কুটির, তার মাঝের পথে জড়ো হওয়া শিশুদের মাঝে ইতিমধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, অর্থাৎ বাকিরা এগিয়ে গেছে সে পথে। পুতুল আপাও এর মধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। বাচ্চাদের দঙ্গলে খানিকটা সময় কাটিয়ে জ্যাকেট খুলে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে খানিকটা জোর পায়ে হাঁটা দিলাম। মাটির রঙ লাল, দু'পাশে ঘাসের ঝোপের উচ্চতা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ঘাসের ঝোপে থেকে থেকেই সরসর শব্দ হচ্ছে --- উঁহু, সাপ বা সজারু নয়, ক্ষুদে ক্ষুদে ধূসর পাখি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। পথ মাঝে মাঝে দু'তিন দিকে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাটিতে জুতোর ছাপ দেখে চিনে নেয়া যাচ্ছে সহজেই। তাছাড়া চঞ্চলের কাছে চক আছে, মাটিতে তীর এঁকে দিক দেখিয়ে গেছে সে। পথ আস্তে আস্তে সমতল ছেড়ে উঁচুনিচু হচ্ছে। পাশে ঘাসের ঝোপও ঘন হচ্ছে পাল্লা দিয়ে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে বহু দূর থেকে পুতুল আপার জবাব পেলাম। আধঘন্টা পার হয়ে গেছে পনেরো মিনিট আগে, পথ ফুরোচ্ছে না, ফুরোতে আরো আধ ঘন্টা লাগবে, তা-ও বুঝতে পারছি। হঠাৎ হঠাৎ ঘাস পাতলা হয়ে গিয়ে হ্রদটা চোখে পড়ছে, নতুন সূর্যের রোদ যেন অলঙ্কার হয়ে ফুটে আছে তার জলে। একটা বাঁকে পৌঁছে চোখে পড়লো রাইনক্ষ্যং নদীর আঁকাবাঁকা সরু সর্পিল শরীরটা, সূর্যের আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে বলে ছবি তুলতে পারলাম না। এ নদীর ছবি তুলতে হবে অন্য পারে দাঁড়িয়ে, নয়তো সূর্যাস্তের সময়। কিন্তু দু'পাশের ঘন সবুজকে চিরে বয়ে যাওয়া এ নদীর রূপ ভোলার নয়। এদিকে পথের পাশে ঘাসের ঝোপ ফুরিয়ে গিয়ে যখন কাঁটাঝোপ শুরু হলো, তখন মেজাজের সূর্যটাও ভাবের কুয়াশা কেটে আস্তে আস্তে চড়তে শুরু করলো। এদিকে পথ পুরোদস্তুর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। পাথুরে মাটির দু'পাশে ছোট বড় সব গাছ, শিশিরে রোদ পড়ে ঘাসের চাদরে হাজারটা ক্ষুদে সূর্য দেখা যাচ্ছে। একটা পাথরের তোরণ, আর তার সামনে কাত হয়ে পড়ে থাকা গাছের নিচ দিয়ে এগিয়ে যেতেই কথাবার্তা কানে এলো। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা তিনতলা টিলা ডিঙোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো। পাহাড় আর অরণ্যের জন্য এই ভোরে নদীর এই অংশ আঁধারে ছেয়ে আছে। সালেহীন আর চঞ্চল তীরে দাঁড়িয়ে, উচ্ছল ভাই আর মিলন ভাই ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় নিচ্ছেন, সৈকত হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে, বাকিদের চোখে পড়ছে না। তীরের কাছে পানির গভীরতা হাঁটু ছাড়িয়ে --- সৈকতের হাঁটু একটু উচুতে --- গজ ত্রিশেক দূরে গম্ভীর প্রতিধ্বনি তুলে ধাপে ধাপে বয়ে চলছে রাইনক্ষ্যং নদীর জল। মূল প্রপাত বাঁয়ে আরো প্রায় আধ কিলোমিটার, সেখানে পৌঁছুতে হলে ডাঙার ওপর দিয়ে এগোনোর কোন পথ নেই, যেতে হবে নদীর এই অতি পিচ্ছিল পাথুরে খাত ধরে। ডানে বামে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায়, সূর্য চোখে পড়ছে না, বিষন্ন অন্ধকারে বুকফাটা শব্দে পাতালের লেলে নদীর মতো ছুটে চলছে স্রোত। কে জানে, হয়তো এর খানিকটা পান করলে আমরাও আমাদের অতীতবিস্মৃত হবো --- চঞ্চল ব্যাটাকে একটু গিলিয়ে দিয়ে দেখবো নাকি? উচ্ছল ভাইয়ের কাছ থেকে জানা গেলো, বরুণদা, শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা নদীর উজান ধরে এগিয়ে গেছেন, সৈকত তাঁদের পিছু পিছু চলছে, আর কোমর পানি ভেঙে এগিয়ে কোন দুর্ঘটনায় পড়তে বাকিরা কেউ রাজি নয়। এই তথ্য জানিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। কথা সত্য, নদীর পিচ্ছিল খাতে পড়ে গিয়ে যদি কারো পায়ে আঘাত লাগে, কপালে কঠিন দুঃখ আছে, অন্যের কোলে চ্যাংদোলা হওয়া ছাড়া গতি নেই। চঞ্চল চরম বিষণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা এত বিচ্ছিরি আঁধারে, যে ভালো ছবি তোলাও মুশকিল। পুতুল আপা একবার পানিতে নেমে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, আবার দাঁড়িয়ে পড়ছেন। ওদিকে সৈকত হাঁচোড়পাঁচোড় করে এগিয়ে গেছে। আমি অবশ্য এই ঝুঁকি নিতে নারাজ, প্রপাতের একেবারে গোড়ায় না গেলেও আমার ক্ষতি নেই, এখান থেকে যতটুকু দেখার আমি দেখে নিয়েছি। কী আর করা, হতোদ্যম চঞ্চল আর আমার একটা ছবি তুলে দিতে বললাম সালেহীনকে। বেশ কিছুক্ষণ পর বাকি চারজন ফিরে এলেন, সবার মুখ হাসি হাসি, প্যান্ট গোটানো, ঊরু পর্যন্ত জলের দাগ। ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। বরুণদার ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে, ঢাকায় ফিরে সেগুলো দেখতে হবে আর কি। নদীপ্রপাতকে কাছ থেকে খুঁটিয়ে না দেখতে পারার বিষাদে ফেরার পথে সবাই খানিকটা গজগজ করলাম। আঙুর ফল তো টকই হয়। আবারও সেই উঁচুনিচু, কাঁটাঝোপে ভরা পথ পেরিয়ে ফিরে এলাম খানিকটা খোলা জায়গায়। সূর্য অনেকখানি তেজ নিয়ে জ্বলছে এখন, চারদিক আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দিনের আলোয় হ্রদ আর তার চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। মেঘশুন্য আকাশের নিচে মিষ্টি সবুজ ঘিরে আছে গ্রামটাকে। ফেরার পথে সেই ঝোপের পাখিগুলোকে চোখে পড়লো আবারও, মহাব্যস্ত তারা। গ্রামবাসীরাও বেরিয়ে এসেছে তাদের ঝুড়ি-কাস্তে হাতে। খানিকটা দূরে তাদের জুম্ম চাষের ক্ষেত। আমাদের ফিরতে দেখে কলস্বরে কিছু একটা বললেন তাঁরা, ভাষার প্রাচীর ডিঙিয়ে সে বক্তব্য আমাদের মর্মে পৌঁছুলো না। তবে আমাদের সহাস্য নমস্কার তাঁরা একই উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন। ফেরার পথে ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলাম। আমার ক্যামেরায় গেঁথে রইলো গ্রামবাসীদের ঘর, হ্রদ আর আকাশের মাঝে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম, পাহাড়ের ঢালে পিঠে বোঝাভর্তি ঝুড়ি নিয়ে ত্রিপুরা রমণী ---। ক্ষেতে সেচের জন্যে বাঁশের পাইপে চালিত পরিষ্কার মিষ্টি পানি পেটভরে খেয়ে হেলেদুলে আমরা যখন আবার কারবারির কুটিরে ফিরে এলাম, তখন বেলা পৌনে দশটা বাজে। গ্রাম ছেড়ে বেরোনোর আগে গত রাতের উদ্বৃত্ত ডালভাতমুরগি দিয়ে যতটা সম্ভব পেট বোঝাই করে খেয়ে নিলাম সবাই। জিনিসপত্র গোছগাছ করার সময় দেখি, উচ্ছল ভাই আমাদের গৃহকত্রর্ীর কাছ থেকে একটা শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো ফ্লাস্ক কিনে নিয়েছেন, সেটা তাঁর পিঠ থেকে ঝুলছে বাঁদরশিশুর মতো। সব কিছু বেঁধেছেঁদে, কারবারির পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই, সাড়ে দশটা বেজে গেছে ততক্ষণে। দিন এখন প্রাপ্তবয়স্ক। পাড়া ছেড়ে যাবার আগে সেনাছাউনিতে রিপোর্ট করে যেতে হবে। আস্কন্দিত গতিতে সেদিকে হাঁটা শুরু করলাম, ক্যাম্পের প্রবেশপথ আমাদের পথেই পড়বে। যথারীতি দলের ফ্রন্টে সেই পাঁচজন এগিয়ে --- উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, চঞ্চল, সৈকত আর সালেহীন। পুতুল আপা একটু পিছিয়ে পড়েছেন, দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে আমার আর পুতুল আপারই হাঁটা শ্লথ হয়ে গেছে, তবে আমি বরাবরই শ্লথ, কিন্তু পুতুল আপা দুর্দান্ত হাঁটারু। বেশিদূর যেতে হলো না, গ্রামবাসী আগেই খবর পৌঁছে দিয়েছিলো ক্যাম্পে, সান্ত্রীকে দুয়েক কথায় সব বুঝিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, সে শুধু আমাদের মাথা গুণে রাখলো। যাত্রার আগে ক্যাম্পের ক্যান্টিনে চা খাওয়ার একটা প্রস্তাব উঠেছিলো, কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে গটগটিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। সেনা ছাউনির চারপাশে সতর্ক প্রহরায় দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সৈনিকেরা গম্ভীর মুখে আমাদের খুঁটিয়ে দেখলো, কিছু বললো না। সেনা ছাউনির সৌজন্যে পথ এখন প্রশস্ত, কখনো চড়াই কখনো উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে নীল আকাশের নিচে। পুকুরপাড়ার কারবারি জানিয়েছেন, একটু জোর পায়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটলে বড়থলি নামের একটা ত্রিপুরা জনপদে পৌঁছুবো আমরা। সেখান থেকে আরো ঘন্টা দুয়েক হাঁটলে প্রাংশা নামের আরেকটা ত্রিপুরা গ্রামে পৌঁছে খাওয়াদাওয়া করা যেতে পারে। সেই প্রাংশা থেকে ঘন্টা তিনেক হাঁটলে রুমাবাজারে পৌঁছে যাবো আমরা। খুব একটা আশাপ্রদ সংবাদ নয় এটি, বিশেষ করে পাহাড়িদের ঘন্টাকে বাঙালি ঘন্টায় রূপান্তরিত করতে হলে যখন সাড়ে তিন দিয়ে গুণ করতে হয়। মংক্ষিয়াদা জানিয়েছেন, সন্ধ্যের মধ্যে প্রাংশায় পৌঁছুতে পারলেই আজকের দিনের জন্যে যথেষ্ঠ অগ্রগতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে। কাজেই আমাদের চলার লক্ষ্য হচ্ছে প্রাংশা, ভায়া বড়থলি। বড়থলিতে হাট আছে, সেনাছাউনি আছে, সেখানে কিঞ্চিৎ জলযোগ করা যেতে পারে। সেনাসদস্যদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যে পথ তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে, যার ফলে পাহাড়ের প্রান্ত ধরে গুটিগুটি পায়ে এগোনোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। রোদ খানিকটা চড়ে গেছে, বেশ জোর পায়ে হাঁটতে লাগলাম। বরুণদা, শাহেদ ভাই, পুতুল আপা আর মংক্ষিয়াদা আমার পেছনে। ঢালু পথে গতি আপনাআপনি বেড়ে যায়, কিন্তু পায়ের গোড়ালি আর তালুতে ফোস্কা পড়ে গেছে বলে নামার সময় একটু লাগছে। চোখ কান বুঁজে কয়েকটা ঢাল টপকে নেমে দেখি, পথের মোড়ে একটা টংঘর, তার পাশে খড়ের গাদা, সেখানে নবাবের মতো আধশোয়া হয়ে দলের অগ্রার্ধ, যেন তাকিয়ায় শুয়ে বাঈজীর নাচ দেখছে জমিদার, জমিতেই যখন আশ্রয় নেয়া তখন কিছুটা জমিদারি করে নেয়াই শ্রেয়। তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গিয়ে তাদের পাশে বসলাম ধপ করে। রোদ আজ বেশ চড়া, খানিকটা হেঁটেই পিপাসা পেয়ে গেছে। পানির বোতলটা বের করে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে সৈকতের সাথে কিছুক্ষণ গুলতানি মারলাম, কারণ বাকিরা এর মধ্যে আবার উঠে হাঁটা শুরু করেছে। দলের মধ্যে আমি, সৈকত আর সালেহীনই ছাত্র, আমার ছাত্রত্ব চুকিয়ে দেবার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে এক হপ্তা আগে, সালেহীনের পরীক্ষাও শেষ, আর সৈকতের পরীক্ষা মাসখানেক ধরে চলছে, ঈদ উপলক্ষে লম্বাচওড়া ছুটি পেয়েছে বলেই বেরিয়ে পড়েছে সে। সৈকত মৃত্তিকাবিজ্ঞানের ছাত্র, সমপ্রতি ঠেসে অণুজীববিদ্যা পড়তে হচ্ছে বেচারাকে। সদ্যলব্ধ জ্ঞানের আলোকে সে জানালো, এবার প্রচুর ধূলোবালি ছানাছানি করতে হচ্ছে আমাদের, ঢাকায় গিয়েই কষে কৃমির ঔষধ খেতে হবে। মাটিতে যেসব জীবাণু রয়েছে, বিশ মিনিট সাবান পানিতে হাত ধুলে নাকি তার পঞ্চাশ শতাংশ দূর হয়, কাজেই আমাদের কপালে কঠিন খারাবি আছে। জীবাণুশঙ্কিত মন নিয়ে আবার উঠে পড়লাম, দলের পেছনের অংশ বেশ জোর পায়ে এগিয়ে আসছেন। আজ আমরা চলছি একেবারে ঊষর প্রান্ত দিয়ে, যতদূর চোখ যায়, গাছপালা খুব একটা নেই, লালচে পাহাড়ের সারি চারদিকে, মাঝে মাঝে কয়েকটা বিবাগী গাছ চোখে পড়ছে। আকাশে এক চিলতে মেঘেরও দেখা নেই, চারদিকে ঝকঝকে রোদ, এমন নির্মেঘ আকাশ ঢাকায় চোখে পড়ে না। তবে আকাশের এই সৌন্দর্য উপভোগের মাশুল দিতে হচ্ছে রোদে ভাজাভাজা হয়ে। চলতে চলতে একসময় প্রশস্ত পথ ফুরিয়ে এলো, হঠাৎ এক গিরিসঙ্কটে ঢুকে পড়লো সেটা। পাথরের শঙ্খপাক সিঁড়ি বেয়ে একটা ছড়ার ওপর নেমে এলাম, বিচিত্র আকার ও আকৃতির সব পাথর ছড়িয়ে আছে সেখানে। পানির বোতল হালকা হয়ে এসেছে, সেটাকে ভর্তি করে নেয়ার পাশাপাশি মুখেও একটু পানি ছিটানো গেলো। ছড়ার পানি সবসময় বরফশীতল, অদ্ভুত এক সঞ্জীবনী শক্তি আছে এর। মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও এগিয়ে চললাম আমরা। নিস্ফলা মাঠের ভেতর দিয়ে চলছি, চারদিকে পাহাড়ের প্রহরা, মাঝখানে এক ধু ধু মাঠ, পথটা এগিয়ে গেছে দূরের পাহাড়ের দিকে। সেই পাহাড়ের গোড়ায় এসে আবার ক্যামেরা বার করলাম, এই রুক্ষ দেশে মাথা উঁচু করে একা দাঁড়িয়ে এক বিদ্রোহী বৃক্ষ, তার স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। দলের অন্যেরা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে, তাদের পিছু পিছু এগিয়ে টের পেলাম, নতুন জ্বালাতন শুরু হয়েছে। খুব একটা খাড়া নয় এখানকার পাহাড়, কিন্তু পথের মাটি ভয়াবহ ঝুরঝুরে, পা বসতে চায় না, হড়হড়িয়ে পিছলে যায়। এদিকে চঞ্চল আমার দেরি দেখে একটা দড়ি ছুঁড়ে দিয়েছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে সেই বামন পাহাড় টপকে ওপরে উঠে মনটা দমে গেলো। সমতলের পালা শেষ, চোখের সামনে যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, পথ চলে গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চড়াই বেয়ে। আরো খানিকটা এগিয়ে একটা টংঘর পাওয়া গেলো, সেখানে দলের দুয়েকজন বসে, বাকিরা খানিক বিশ্রাম নিয়ে আরো এগিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে মংক্ষিয়াদার দেখা মিললো, তিনি জানালেন, শাহেদ ভাই আর পুতুল আপার এসে পড়বেন এক্ষুণি। ওঁদের জন্যে চকলেট রেখে আমি আবারও হাঁটা ধরলাম, পথ এবার শক্ত মাটির ধাপ ধরে এগিয়ে গেছে। আধঘন্টা হাঁটার পর পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলাম। পথের ওপর কয়েকটা গয়াল চরে বেড়াচ্ছে, আমাকে সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ঢাল বেয়ে তেঁড়েফুঁড়ে চলে গেলো সে। কেওকারাডঙে যাবার পথে বিশাল আকৃতির সব গয়াল দেখেছিলাম, পুকুরপাড়ার গয়ালগুলো অতটা বড়সড় নয়। স্বভাবে হিংস্র না হলেও গয়ালগুলো মাঝে মাঝে খামোকাই তেড়ে আসে, তাদের নিবৃত্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। বাঁশের ঝাড় চারপাশে, মিষ্টি একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আরো খানিকটা এগিয়ে একটা ছড়ার দেখা পাওয়া গেলো, সেই ছড়ার পাশে একটা পাথরে বসে আছেন বরুণদা, উচ্ছল ভাইয়ের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে সামনে কোথাও। আমি ব্যাগ নামিয়ে বসতে না বসতেই মংক্ষিয়াদা, শাহেদ ভাই আর পুতুল আপা চলে এলেন। মুখে একটু পানি ছিটিয়ে, আর খানিকটা পানিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে ছড়ার নড়বড়ে বোল্ডারগুলোর ওপর দিয়ে আবার এগিয়ে গেলাম সবাই। এটাই পথ। মিনিট বিশেক সেই ছড়া ধরে হেঁটে একটা গুঁড়ির সাঁকো পেরিয়ে আবার শক্ত পাহাড়ে পা দিলাম আমরা। আমি আর পুতুল আপা একটু পিছিয়ে পড়েছি, বাকিরা এগিয়ে গেছে খানিকটা। আরো আধঘন্টার মতো হেঁটে একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক টংঘরের দেখা মিললো, দূর থেকে দেখি, আমাদের দলের বাকিরা গুটগুট করে এগিয়ে চলছে ওটার দিকে। পথ এখন বেশ খাড়া, দ্রুত এগোনো মুশকিল হয়ে পড়েছে। সেই টংঘরে পৌঁছে একটা বড়সড় বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসলাম সবাই। টংঘরের চারদিকে পাহাড়ের ঢাল, অনেক অনেক দূরে ঝাপসা মেঘের মতো আরো পাহাড়ের শীর্ষ দেখা যাচ্ছে। দূরে দিগন্তের কাছে খানিকটা মেঘ, এ ছাড়া গোটা আকাশে নীলের রাজত্ব। ক্যামেরা বার করে কিছুক্ষণ টহল দিলাম আশেপাশে। পাহাড়ি এলাকায় বেশ খানিকটা পরপর, সাধারণত কিছুটা দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার পর এমন টংঘরের দেখা পাওয়া যায়। বাঁশ দিয়ে তৈরি এ ঘরগুলোতে স্রেফ বসবার জন্যে একটা পাটাতন, আর ওপরে একটা ছাউনি আছে। ছাউনির নিচে একটা মাচায় শুকনো লাউয়ের খোলে পানিও পাওয়া যায়। পাহাড়িরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে এই টংঘরে এসে বিশ্রাম নেন। যদি সাথে কোন উদ্বৃত্ত রসদ থাকে, এই ঘরে রেখে যান পরবর্তী আশ্রয়সন্ধানী পথিকের জন্যে। পাহাড়ের অধিবাসীরা আমাদের বিচারে হয়তো দরিদ্র, কিন্তু মানসিকতায় আমাদের চেয়ে অনেক উদার। অন্যের জন্যে এই মমত্ববোধ না থাকলে এই রুক্ষ পরিবেশে মানুষ টিকতে পারবে না। টংঘরের চারপাশে বুনো টক ফল ধরে আছে। আমার শৈশব কেটেছে সিলেটে, সেখানে এই ফলের ছড়াছড়ি, টক তরকারি রান্নায় বেশ জনপ্রিয়, চুকর নামেই চিনি এটাকে। কাঁটাওয়ালা গাছে শ'য়ে শ'য়ে ফল ধরে আছে, মংক্ষিয়াদা অনেকগুলো ফল পেড়ে নিলেন, রাতে ডালের সাথে রান্না করবেন। আমরাও হাত বোঝাই করে পেড়ে আনলাম, যতক্ষণ বসে আছি, ততক্ষণ একটা কিছু মুখে দেয়া যাবে। ভিটামিন সি-এর উৎস ধারে কাছে আর কিছু নেই। টংঘরে মিনিট পনেরো বসে সবাই আবার উঠে পড়লাম। অন্যদের তুলনায় আমি আর পুতুল আপা পিছিয়ে পড়েছি। চলতে চলতে পথের দু'পাশে ভিড় করে থাকা সেই চুকর ঝোপ থেকে ফল পাড়তে পাড়তে চললাম। বালুময় এই পথ ধরে এগিয়ে পাহাড়টা ডিঙিয়ে যাবার পর দলের আর কারো দেখা পেলাম না। আমি আর পুতুল আপা ধীরেসুস্থে পাহাড় বেয়ে নামছি। চলতে চলতে পুতুল আপা প্রতিজ্ঞা করলেন, ঢাকায় ফিরেই এবার কোন জিমে ভর্তি হবেন তিনি, ঘরে বসে থেকে থেকে তাঁর পেশী অচল হয়ে পড়েছে। বাস্তবিক, ঠিক এক বছর আগে পর্যন্ত যখন এক্সপ্লোরারস' ক্লাবের সদস্যরা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকত অতিক্রম করেছেন, পুতুল আপা ছিলেন সবার আগে। আমি অবশ্য বরাবরই ফেল্টুশ, তাই আমার ততটা দুঃখ নেই। এরপর ঠিক কতক্ষণ হেঁটেছি, ঠিক মনে নেই আমার, তবে দলের আর কারো দেখা মেলেনি। তিন পাহাড়ির একটা দলের দেখা মিললো, তারা পথের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সামনে আদা ভর্তি ঝুড়ি। কিছুক্ষণ আলাপ করা গেলো, বাংলা বেশ বোঝে তারা। জানতে পারলাম, সামনেই বড়থুলি, দশ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে। খানিকটা উল্লসিত হয়ে উঠলাম, যাক, তাহলে আরো পঁয়ত্রিশ মিনিট হাঁটলে বড়থুলির দেখা মিলবে। পাহাড়িদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। সূর্য মাথার ওপর থেকে ঢলে পড়ছে ধীরে ধীরে, চারদিকে এখনও রোদ, কিন্তু আরো একটা পাহাড় ডিঙিয়ে যেতেই আবার গাছের ছায়াঢাকা পথ পাওয়া গেলো। পথ ধরে এগিয়ে একটা ছড়ার সামনে একটু বিশ্রাম নিতে বসলাম। ছড়ার ওপর একটা নড়বড়ে চেহারার সাঁকো, তার দুপাশে থকথক করছে কাদা। মিনিট দুয়েক বসতে না বসতেই দেখি সেই পাহাড়িরা এসে পড়ছে, ক্ষিপ্র পায়ে হাঁটছে সকলে। আমাদের স্বচ্ছন্দ গতিতে অতিক্রম করে গেলো তারা, সাঁকোটা পার হতে পাঁচ সেকেন্ড সময়ও লাগলো না তাদের। কানের কাছে একটা পরিচিত ভনভন শব্দ শুনতেই আঁতকে উঠলাম, সর্বনাশ, মশা আছে না কি এখানে? কাল বিলম্ব না করে আবার পথ চলতে শুরু করলাম আমরা। খানিকটা পথ এগিয়ে এক গ্রামবাসীর দেখা মিললো, নমস্কার জানিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আমাদের দলের কাউকে দেখেছেন কি না। তিনি জানালেন, আমাদের দলের কয়েকজনের সাথে তাঁর দেখা হয়েছে, সামনের গ্রামের দিকে গিয়েছেন তাঁরা, মিনিট পনেরো আগে। আরো টুকটাক আলাপ করে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। এর পরের পাহাড়ের মাথায় উঠে চোখে পড়লো, সামনে বিসতৃত উপত্যকায় বেশ বড় একটা গ্রাম, অনেকগুলো কুটির। গ্রামের সামনে ছড়ার প্রস্থ অনেক, গভীরতাও যে কম নয়, বুঝতে পারলাম বুক পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে দেখে। আমাদের লোকজন কি তবে এখানেই এসে উঠলো না কি? আরো খানিকটা হেঁটে যখন সমতলে নামলাম, তখন বুঝলাম, এই ছড়া ডিঙিয়ে গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কোন ঘুরপথে গ্রামে যেতে হয়। কতগুলো ক্ষুদে বাচ্চা ছড়ার কিনারায় এসে জড়ো হয়েছে, বিশালকায় কয়েকটা শুয়োর নদীতে নেমে চকচক করে পানি খাচ্ছে, গ্রামের কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে চোখে পড়ছে না। সেই ছেলেপিলের দলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন পুতুল আপা, সব কয়টা ভোঁ দৌড় দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে কুটিরগুলোর দিকে ছুটে গেলো। মিনিট খানেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবান এক পুরুষ উদ্যত লাঠি হাতে বেরিয়ে এলেন, আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না, পিঠে রুকস্যাক দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন তিনি, হাত তুলে বামের পাহাড়সারির দিকে নির্দেশ করলেন। সেদিকে উঁচু নিচু ভাঙা পাথর বোঝাই, কোন পথ আছে কি না বোঝার উপায় নেই। তবে খানিক এগোতেই কয়েকটা পাথরের ওপর চকে আঁকা তীর চিহ্ন আর ঊঈই লেখা দেখে বোঝা গেলো, এদিকেই এগোতে হবে। পুতুল আপা সেই পথে এগিয়ে গেলেন, আমি ঘাসের ওপর ব্যাগ বিছিয়ে খানিকটা ঝিমিয়ে নিলাম। কানে আসছে দূরে শিশুর দঙ্গলের টুকরো টুকরো কথা, আর শূকরগুলোর পানি খাওয়ার শব্দ। মিনিট দশেক জিরিয়ে নিয়ে উঠে এগিয়ে গেলাম আমি। তীর চিহ্ন ধরে ঝোপজঙ্গলে ভরা পথ পেরিয়ে হঠাৎ পাড়ার আরেক অংশের দেখা মিললো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুটির, মাঝখানে বিভিন্ন বয়সের ছেলেপুলে ফুটবল খেলছে। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালো সবাই। বেজায় তৃষ্ণা পেয়েছে আমার, বোতলের পানি ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই, পুতুল আপার অবস্থাও তথৈবচ। এ পাড়ার সবাই বেশ ভালো বাংলা বোঝে, নমস্কারাদি শেষে আমাদের একটা কুটিরের বারান্দায় বসতে দিয়ে সেই লাউয়ের খোলে ভর্তি জল নিয়ে এলো এক কিশোর। তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেলো, আমাদের অগ্রবর্তী দল সামনে আর্মি ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছে। আরো জানা গেলো, এ গ্রামে একটা চার্চ আছে, চার্চ সংলগ্ন স্কুলও আছে, শিশুরা সেখানে লেখাপড়া করে। গ্রামের সবচেয়ে কৃতী বালকটিই আমাদের জল সরবরাহ করেছে, কাপ্তাই থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, হঠাৎ ডাক শুনে থামতে হলো। এক বৃদ্ধা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছেন। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, পরে বুঝলাম, আমাদের সাথে করমর্দনের জন্যেই তাঁর আগমন। বৃদ্ধা খৃষ্টান, চার্চের পাশের কুটির থাকেন, আমাদের সাথে আলাপ করে চরম প্রীত হয়েছেন তিনি। তাঁর করমর্দনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে বিদায় নিলাম আমরা। সূর্য ঢলে পড়েছে এক পাশে, দূরে রোদের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে পাহাড় সারি। চার: যথার্থ যাত্রী কিন্তু শুধু তারাই যথার্থ যাত্রী, যারা চ'লে যায় কেবল যাবারই জন্য, হালকা মন, বেলুনের মতো, নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়, কেন, তা জানে না, শুধু 'চলো, চলো' বলে অবিরত। শার্ল বোদল্যের তাঁর এই কবিতাটি মাক্সিম দ্যু কাঁ-কে উৎসর্গ করেছিলেন। আর ক'টা দিন বাঁচলে ECB সদস্যদের উৎসর্গ করে দিয়ে যেতেন এই চরণ চারখানা। অ্যাকেবারে আমাদের দশা দেখেই যেন লিখে গিয়েছেন বেচারা। তাঁর এই যথার্থ যাত্রী তো আমরাই, এই এক্সপ্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের পুকুরপাড়া অভিযানের পোড়াকপালিয়ার দল! বোঝেননি তো? মন দিয়ে তাহলে বাকিটা পড়ুন। গ্রামের পাশেই এক পাহাড়ের ঢালে সেনাছাউনি। ক্যাম্পে ঢুকে দেখলাম, ECB সদস্যরা সেনাদের সাথে বেশ জমিয়ে ফেলেছেন, চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাঁদের। সৈনিকরা জঙলা ছোপধরা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে আছেন, বেশ হাসিখুশি আমুদে ভাব তাদের মধ্যে। বালতিতে করে গরম পানি নিয়ে আসা হয়েছে চা বানানোর জন্যে, আর মুড়ি দিয়ে টা-য়ের কাজ চালানো হচ্ছে। মারদাঙ্গা এমন চরণের অভাব বোদল্যের-এর নেই, কিন্তু ওপরওয়ালা আমাদের প্রত্যেককে মোটে দু'টি করে দিয়েছেন, আমার ভাগের দু'টো আবার গড়পড়তার চেয়ে অধিক লিকলিকে। এই দুই শ্রীচরণ ভরসা করে অ্যাদ্দূর এসে টের পেলাম, ডান ঊরুর মাংসপেশী আসলে ঠিক কোথায় আছে। এতদিন বইপত্রেই তার নাম শুনে এসেছি, কিন্তু আর্মি ক্যাম্পে বসে যখন জুড়িয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে মনটাও প্রায় জুড়িয়ে এসেছে, তখন মারাত্মক এক মোচড় মেরে নিজের অবস্থা ও অবস্থান জানিয়ে দিলো ব্যাটা। মালিশ ছাড়া করার কিছু নেই, তারই ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চালিয়ে গেলাম। সেনাদের মধ্যে যিনি আমাদের আপ্যায়নের ভার নিয়েছেন, তিনি বেশ বিস্মিত আমাদের কাজকারবার দেখে। গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছি শুনে চোখ কপালে তুললেন তিনি, কারণ ঐ পথে নাকি তাঁরাও কেউ যাতায়াত করতে সাহস পান না। কেন আমরা খোদার খামাখা এখানে এসেছি, জানতে চাইলেন তিনি, দেশ দেখতে এসেছি শুনে ঠা ঠা করে হেসে ফেললেন তিনি, তাঁর সহকর্মীরাও দেখলাম খুব আমোদিত হলেন এই উত্তর শুনে। দেড় বছর ধরে এখানে আছেন তাঁরা, এখন প্রহর গুণছেন আর সূরা ইয়াসিন জপছেন, কবে এখান থেকে বিদায় নেবেন। এখানে সবকিছুই ভালো, তবে মশা আর শীত বাদ দিয়ে। মশার সীজনে লাখে লাখে মশা ছেয়ে থাকে চারদিকে, আর এই শীতে সূর্য ডুবতে না ডুবতেই এমন বিশ্রী ঠান্ডা পড়ে যে রাতে একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করে সময় কাটাতে হয়। সামনে পথের কথা জিজ্ঞেস করতে আরো একবার হেসে ফেললেন তিনি। আমরা নাকি নিজের চোখেই দেখতে পাবো, পথ কেমন। প্রাংশা পর্যন্ত পথ মন্দ নয়, কিন্তু প্রাংশা পেরিয়ে রুমাবাজারে যাবার পথে ময়না পাহাড় বলে এক বস্তু রয়েছে, সেটা পার হতে গিয়ে নাকি সৈনিকরাও মাথা ঘুরে পড়ে যায়, দোয়াদরূদ জপতে জপতে সেই পথ চলে তারা। প্রাংশা পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বললেন, সামনের বিশাল পাহাড়টা পার হতেই আমাদের ঘন্টা তিনেক লাগবে। তারপর ছড়ার মধ্যে দিয়ে আরো বিরাট পথ পাড়ি দিতে হবে। তখন বাজে প্রায় পাঁচটা, রাত দশটার আগে কোনভাবেই প্রাংশায় পৌঁছোনো সম্ভব না। আঁধার ঘনিয়ে আসবে আধ ঘন্টার মধ্যে, বাকিটুকু পথ পাড়ি দিতে হবে সেই আঁধারেই। পেটে দানাপানি পড়ায় বেশ চাঙা লাগছিলো, তাই দমলাম না। প্রাংশা পর্যন্ত পথ যখন ভালো, গরুমারা পাহাড়ের মতো কিছু যখন নেই, তখন রাতের আঁধারে চলতেও আপত্তি নেই আমাদের। চাঁদ আছে, তাছাড়া মুশকিলাসান টর্চ তো আছেই, আমি কী ডরাই সখি ভিখিরি আঁধারে? আরো মিনিট পাঁচেক বসে একে একে উঠে পড়লাম সকলে। সেনারা হাসিমুখে বিদায় জানালেন আমাদের, তবে ঢাকায় ফিরে অন্য কোন দলকে এ পথে পাঠাবার কোন ফিকির যাতে না করি, সে পরামর্শও দিলেন। এদিকে পরিস্থিতি নাকি ভালো না, কখন কী ঘটে, কিচ্ছু বলা যায় না। পান্তভূতের জ্যান্ত ছানার মতো আহ্লাদে ধুপধুপিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বড়থলির পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম আমরা। পথ এখানে খাড়া, কিন্তু অনেক প্রশস্ত, আর ঝুরঝুরে কাঁকরে ভর্তি, পায়ের নিচে প্রতিটি মূহুর্তে নিঃশব্দে চূর্ণ হচ্ছে তারা। যথারীতি খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি আমি, আমারও খানিক পেছনে পুতুল আপা, আর তাঁর সাথে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা। বড়থলির পাহাড় গরুমারা পাহাড়ের মতোই বিশাল, ঘন গাছপালায় ঢাকা। সূর্য আর আকাশে নেই, গোধূলির আলোয় লালচে মাটির পথে হেঁটে চলছি আমরা। পাহাড়ের প্রথম ধাপটা টপকে নামার পথে একটা ছোট্ট ছড়া পড়লো, সেখানে দেখি, কয়েকজন গ্রামবাসী বিশ্রাম নিচ্ছেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই আছে দলে। তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেলো, সকাল ন'টায় রুমা থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তারা, আর এখন বাজে পাঁচটার ওপরে, এরই মধ্যে বড়থলিতে পৌঁছে গেছে সবাই। আমরা প্রাংশার দিকে যাচ্ছি শুনে তারা পথ বলে দিলেন, পাহাড় ডিঙিয়ে ছড়া ধরে এগোলেই প্রাংশায় যাবার সোজা রাস্তা। ঢাল বেয়ে খানিকটা নেমে এবার ঝুরঝুরে মাটির বদলে শক্ত ভেজা ভেজা পাথুরে পথে পা পড়লো আমার। ইতিমধ্যে শাহেদ ভাই টপ গীয়ারে পা চালিয়ে আমাকে পেরিয়ে গেছেন, পুতুল আপা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন বলে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদাও চোখের আড়ালে, গোটা পাহাড়ে আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে দলের আর কেউ নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে পথ। দু'পাশে এতো ঘন ঝোপঝাড় যে দু'মিনিট হাঁটার পর পেছনে ফিরে তাকালে আর কোন কিছু চোখে পড়ে না, না ফেলে আসা পথ, না দিগন্ত। যদিও এ আলোয় চলতে এখনও সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু শিগগীরই যে হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ধাপে ধাপে পথ উঠে গেছে ওপরে, আর আমি উঠছি তো উঠছিই। ক্যাম্প ছেড়ে আসার প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে, কয়েকবার হাঁক ছেড়ে সামনের দলের লোকজনকে ডাকলাম, সাড়া না পেয়ে পেছনের দলের লোকজনকেও ডেকে দেখলাম, অবস্থা তথৈবচ। একসময় ওপরে ওঠার পালা শেষ হলো, পথ খানিকটা সমতল ধরে এগিয়ে গেছে। এখানে পথ আবার কিছুটা সরু ও পিচ্ছিল, পথের ডান পাশে গভীর খাদ, তবে খাদের ঢালে বিশাল সব বাঁশের ঝাড়, খাদে কেউ চাইলেও পড়তে পারবে না। মাথার ওপর বাঁশ ঝাড় আর অন্যান্য গাছের ক্যানোপি, তবুও ফাঁক গলে নরম আলো এসে পড়ছে মাটিতে, বোঝা যাচ্ছে বেশ, চাঁদ উঠে গেছে। আরো মিনিট পনেরো হেঁটে এক অসাধারণ পথ পাওয়া গেলো, তার দুপাশেই পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে, যতদূর চোখ যায় ঘন বাঁশঝাড়, আর আকাশে ভাসছে চমৎকার চাঁদ। বাঁশের ডগা আর পাতা দুলছে বাতাসে, পথের ওপর কেঁপে কেঁপে উঠছে ছায়ারা। চারদিক অন্ধকার, হঠাৎ সরসর শব্দ উঠছে ঝোপে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে দূরে কোথাও। মুগ্ধ হয়ে হাঁটছিলাম, পাড়া কাঁপিয়ে একটা গজলেও টান দিয়েছিলাম, ম্যায় নজর সে পি রাহা হুঁ, ইয়ে সামা বদল না যায়ে --- কিন্তু বাস্তবে ফিরে এলাম গাছের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যেতেই। আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছি, ধাপে ধাপে পথ উঠে গেছে পাহাড়ের বহু ওপরে। বেশ জেঁকে ঠান্ডা পড়ে গেছে, আর পথ এখন নিরেট আঁধারে, জ্যাকেট আর টর্চ ছাড়া গতি নেই। পেছন ফিরে একটা বড় হাঁক ছাড়লাম, 'পুতুল আপা! বরূণদা! মংক্ষিয়াদা!' কোন সাড়া নেই। পাহাড়িদের ঢঙে কুউউউ দিলাম, কিন্তু কোন কিইইই ভেসে এলো না। কী আর করা, একটা ধাপের ওপর পা ছড়িয়ে বসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বার করে নিলাম যা কিছু লাগে। একটা চকলেটও পাওয়া গেলো এক পকেটে, পানির বোতলটাও বার করে নিলাম, এতক্ষণ হাঁটার পর বসে থেকে কিছুক্ষণ কুটকুট করে চিবানো যাবে। চকলেটে দুয়েকটা কামড় দেয়ার পর দেখলাম, সত্যিই কুটকুট করে শব্দ হচ্ছে, এবং বেশ জোরে, এবং শব্দটা আসছে আশপাশ থেকে। ঘাবড়ে গিয়ে টর্চের আলো ফেললাম, কিছু চোখে পড়লো না। আলো নিবিয়ে আবার চকলেটে দাঁত বসিয়েছি, তখন পাশের ঝোপে বিকট ধস্তাধস্তির শব্দ পেলাম, শব্দটা আমার কাছ থেকে শুরু হয়ে দূরে চলে গেলো --- আর তারপরই বহুদূরে শোনা গেলো মানুষের প্রলম্বিত কান্নার মতো একটা শব্দ। এতক্ষণ অন্য কোন চিন্তা মাথায় ঢোকেনি, এই জংলি জলসা শুরু হতেই শাহেদ ভাইয়ের সাবধানবাণী মনে পড়লো, এখানে নাকি প্রচুর শেয়াল আছে। অনেক বছর আগে এক টিলার গর্তের মুখে একবার ভুঁড়ো শেয়ালের ধমক খেয়েছিলাম, সিলেটে, সেই আতঙ্ক আমার এখনও কাটেনি, চকলেটটা কোনমতে মুখে ভরে পানির বোতল হাতে নিয়ে দিলাম এক ছুট। ধাপ কাটা আছে পথের ওপর, তাই বেশ দ্রুত পার হয়ে এলাম অংশটা, কিন্তু পাহাড় থেকে নামার পথ খুব একটা সুবিধের নয়। একহাতে লাঠি আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে অতি সন্তর্পণে সেই সরু, খোঁচা খোঁচা পাথরে ভরা পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে একটা হাঁক ছাড়লাম, 'চঞ্চল! শাহেদ ভাই!' আমার ডাকের প্রতিধ্বনি ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। বহুদূর থেকে যেন উত্তর এলো, 'হিমু! আসেন তাড়াতাড়ি!' শাহেদ ভাইয়ের স্বর। আমি এবার আরো বুলন্দ গলায় হাঁক ছাড়লাম, শৃগালাশঙ্কা কাটেনি আমার, 'দাঁড়ান একটু, আমি আসি!' জবাব এলো, 'জলদি আসেন!' এবার এগোতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির, পথ চলে গেছে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে, যত্রতত্র গাছের শিকড় বেরিয়ে আছে বলে রক্ষা। একবার তো পা পিছলে পড়ছিলাম গড়গড়িয়ে, লাঠিটার কল্যাণে টাল সামলে নিতে পেরেছি। মিনিট দশেক হাঁচড়ে পাঁচড়ে কখনো পাথর কখনো শিকড় আঁকড়ে শেষ পর্যন্ত নেমে এলাম পাহাড় থেকে, একটা ছড়ার পাশে। কুলকুল করে বয়ে চলছে পানি, স্বল্প পরিসরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে চঞ্চল, সালেহীন, সৈকত, মিলন ভাই আর শাহেদ ভাই। মিলন ভাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, বেচারার দুই পা গতকালই টান খেয়ে বসেছে, তার ওপর আবার এই ধকল। শাহেদ ভাই জানতে চাইলেন, বাকিরা কোথায়। পুতুল আপা, মংক্ষিয়াদা আর বরূণদা বেশ খানিকটা পিছিয়ে, জানালাম আমি, কারণ শেষবার ডেকে ওঁদের কোন সাড়া পাইনি। সিদ্ধান্ত হলো, পুতুল আপারা এসে না পৌঁছুনো পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকবো। শাহেদ ভাইয়েরা এখানে মিনিট বিশেক হলো বসে আছেন। সৈকত তার বকের মতো ঠ্যাং ফেলে এগিয়ে ছিলো সবার চেয়ে, সবার আগে সে-ই এসে পৌঁছেছে, কিন্তু অন্ধকার পড়ে যাবার পর আর বেশি এগোতে সাহস করেনি সে, বিশ মিনিট চুপচাপ বসে অপেক্ষা করার পর বাকিদের সাথে তার মুলাকাৎ হয়েছে। ব্যাগটা খুলে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসতে না বসতেই শীত করতে শুরু করলো। এতক্ষণ পথ চলেছি, শরীর গরম ছিলো, কিন্তু গায়ের ঘাম এখন শুকোতে শুরু করেছে, আর প্রবল ঠান্ডা শরীরে কামড় দেয়া শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাদের ক্যাম্পের চেহারাটা ভালো করে দেখে নিলাম। বাঁয়ে পাহাড়ের ফাঁকে চলে গেছে জলের ধারা, ডানে আবছা চাঁদের আলোয় যতদূর চোখে পড়ে, বড় বড় বোল্ডার পড়ে আছে ছড়ার ওপর। আমাদের পেছনে আর সামনে খাড়া দেয়ালের মতো বিশাল পাহাড় নরকের প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ, একটা গভীর করিডোরের মেঝেতে আমরা বসে, এবং একটু পর পর হাড় কাঁপানো বাতাস এসে ধাক্কা মারছে আমাদের। সবাই যৌথভাবে মিনিট দশেক উসখুস করার পর চঞ্চল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, তারপর ছোটখাটো ডালপালা কুড়োনো শুরু করলো, বুঝলাম, আগুন জ্বালাবে সে। বাস্তবিক, আগুন ছাড়া এই ঠান্ডায় টেকা দায়, তাছাড়া চঞ্চলটা মহা অগ্ন্যুৎস্পৃহ, ম্লেচ্ছ ভাষায় যাকে বলে পাইরোম্যানিয়াক, সুযোগ পেলেই আগুন জ্বালিয়ে বসে, আগেও দেখেছি। দেখতে না দেখতে একগাদা কাঠিকুটো জড়ো করে একটা ছোটখাটো আগুন ধরিয়ে বসলো সে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করলো, বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় মোটামুটি এমন --- পাঁচ মিনিটের মধ্যে পঞ্চাশ মণ লাকড়ি নিয়ে আসো, নাহলে ---! চঞ্চলের সাথে লাকড়ি নিয়ে তর্কাতর্কি করতে যাওয়া বিপজ্জনক, তাই চুপচাপ আমি আর সালেহীন শুকনো কাঠ খুঁজে জড়ো করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের আরো কয়েকটা জিভ লকলকিয়ে বেড়ে উঠলো, আমাদের চারপাশে মোলায়েম জ্যোৎস্নার বোনা ছায়ার নকশা তার উদ্বাহু নৃত্যের তোড়ে হারিয়ে ফুরিয়ে গেলো। আধ ঘন্টা চুপচাপ কেটে গেলো, মিলন ভাই পাহাড়ে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, সৈকতের অবস্থাও খুব একটা সুবিধের নয়, শাহেদ ভাই একটু পর পর উঠে গিয়ে টর্চ ফেলে দেখছেন, পুতুল আপারা এসে পৌঁছুলেন কি না, চঞ্চল বসে বসে আগুনের কুন্ডটাকে ছহিহ্ তরিকাতে খোঁচাচ্ছে, যাতে সেটা চাঙা থাকে, আমি আর সালেহীন কাঠ কুড়োচ্ছি রূপকথার ওয়াসিলিসার মতো। কী কুক্ষণে একবার চঞ্চলকে একটা টীপি তৈরি করতে বলেছিলাম, যাতে আগুনটা সময় নিয়ে জ্বলতে পারে, একটা জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ হাতে নিয়ে ততোধিক জ্বলন্ত চোখ করে আমাকে বিরাট একটা নিঃশব্দ ধমক দিলো সে, আমি আঁতকে উঠে আবার টোকাইবৃত্তিতে মন দিলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আশপাশে পড়ে থাকা প্রতিটি কাঠের টুকরোকে এই যজ্ঞে আহুতি দিলাম আমরা, আধপোড়া কাঠ আর ছাইয়ের একটা সম্মানজনক স্তুপ তৈরি হলো সেই ছড়ার পাশে। কিন্তু আগুনটাকে জিইয়ে রাখার জন্যে আরো কাঠ দরকার, আর আগুন নিভে গেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জমে যাবো আমরা। শাহেদ ভাই ততোক্ষণে টর্চ হাতে নিয়ে আবার ওপরে উঠে গেছেন, বরুণদা-পুতুল আপা-মংক্ষিয়াদার খোঁজ নিতে। আর এদিকে শুকনো কাঠ ফুরিয়ে যাওয়ায় ছড়ার পানিতে পড়ে থাকা মোটা মোটা ভেজা ছাতাপড়া ডাল তুলে এনেছি আমরা, শেষ কাঠের টুকরোগুলোকে গ্রাস করে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর রেখে সেঁকা হচ্ছে সেগুলোকে, ভেজা ভেজা ভাবটা একটু কমলেই আগুনে গুঁজে দেয়া হবে। চঞ্চল এতেও সন্তুষ্ট নয়, ফের পাহাড়ের ওপর চড়ে ঝোপঝাড় থেকে পাতাসহ একগাদা ডাল ভেঙে নিয়ে এসেছে। সেই শিশিরে ভেজা ডালপালাও সে আগুনে গুঁজে দিতে চায়। আগুন আর ধোঁয়া নিয়ে আমরা যখন কিছুটা বিব্রত, তখন ওপর থেকে মানুষের গলা ভেসে এলো। মিনিট খানেকের মধ্যে এক বিশাল দুঃসংবাদও ভেসে এলো --- পুতুল আপার পা ভেঙে গেছে! আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়লো। এই জঙ্গলের মধ্যে এখন কীভাবে চিকিৎসা করা যায়? ন্যূনতম চিকিৎসাটুকু পেতে হলেও আমাদের রুমা পৌঁছুতে হবে। সামনে পথ কেমন, মংক্ষিয়াদা জানেন না, কারণ তিনি আগে কখনো এ পথে আসেননি। সামনে আদৌ পথ আছে কি না, তা-ও বোঝার উপায় নেই, কারণ টর্চের আলো আর আগুনের তেজে যতদূর চোখ যায়, চড়ায় পানির মৃদু স্রোতের মাঝে জেগে থাকা অতিকায় সব বোল্ডার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। সুস্থ পা নিয়েই এ পথে চলা মুশকিল, আর ভাঙা পা নিয়ে পুতুল আপা কিভাবে এগোবেন এ পথে? পুতুল আপাকে ধরে ধরে বরুণদা আর শাহেদ ভাই যখন নামলেন, তখন আমরা জানলাম, ভাঙেনি, কিন্তু পুতুল আপার পা মারাত্নকভাবে মচকে গেছে। তা-ও মচকে গেছে একেবারে এই ছড়ার কাছে এসে, তীরে এসে তরী ডোবা আর কাকে বলে? পুতুল আপা স্যান্ডেল খুলে ছড়ার হিমশীতল পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলেন কিছুক্ষণ, ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপছেন বেচারি। কিন্তু বাকিটা পথ হেঁটে যেতে পারবেন, শুরুতেই বাকিদের আশ্বস্ত করলেন তিনি। দুটো ব্যথানাশক ট্যাবলেট আর ব্যথাবিমোচক মলম তাঁকে সরবরাহ করা হলো তৎক্ষণাৎ, তারপর আগুনের পাশে আধঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দেয়া হলো। পুতুল আপা অবশ্য বেশিক্ষণ বসতে চাইলেন না, বসে থাকলেই ব্যথাটা তাঁকে কাবু করে ফেলবে, জানালেন তিনি। কাজেই দশ মিনিটের মধ্যেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবারো পা বাড়ালাম আমরা, অজানা, অনিশ্চিত পথে। পুতুল আপার পা-ই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, তাঁর টর্চটিও আঘাত পেয়ে বিকল হয়ে গেছে। ফুরিয়ে গেছে সৈকত আর উচ্ছল ভাইয়ের টর্চের ব্যাটারী। আমাদের দশজনের দলে কর্মক্ষম টর্চ তখন চারটা বা পাঁচটা, তাই এক টর্চের আলোয় দু'জনকে পথ চলতে হচ্ছে। কিন্তু পথের যা দশা, তাতে প্রত্যেকের পায়ের সামনে টর্চের আলো না ফেললে কী ঘটে যায় তা বলা মুশকিল। পানির ওপর জেগে থাকা পাথরগুলোর ওপর পা ফেলে এগিয়ে যেতে হচ্ছে, পানিতে পা ভিজিয়ে চললে নির্ঘাত নিউমোনিয়া লাগবে, তাছাড়া পানিতে ডুবে থাকা পাথরগুলো সাংঘাতিক পিচ্ছিল হয়। ছড়ায় যুগ যুগ ধরে পানি বয়ে চলছে, তাতে ভিজে ভিজে পাথরগুলো শুধু পিচ্ছিলই হয়নি, তাদের তলা থেকে মাটি আর পাথর সরে যাওয়ায় তারা নড়বড়েও হয়ে পড়েছে। পাঠক বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কিন্তু এক একটা দু'টনী বোল্ডারও পায়ের চাপে নড়ে ওঠে ঢেঁকির মতো। সেই পিচ্ছিল, নড়বড়ে পাথরগুলোর ওপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। একজন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পেছনে আলো ফেলেন, সেই আলো অনুসরণ করে আরেকজন এগিয়ে আসেন, এমনি করেই চলছে গোটা দল। সবার পেছনে বরুণদা, শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা পুতুল আপাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন। সামনের ছ'জন কিছুদূর এগিয়ে আবার বসে পড়ছি হাতির পিঠের মতো উঁচু উঁচু বোল্ডারের ওপর, অপেক্ষা করছি কখন পেছনের চারজন আবার এগিয়ে এসে আবার মিলিত হবেন। আমাদের পথের ওপর কখনো আকাশের চাঁদ আলো ফেলছে, কখনো পথ ঢেকে যাচ্ছে দু'পাশের গাছপালার প্রসারিত বাহুর নিচে, কখনো বা মাথার ওপর বিপজ্জনকভাবে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা ঝুলন্ত পাথরের ব্যালকনি, চাঁদের আলোর সংসর্গ হারিয়ে গাঢ় আদিম অন্ধকার সেখানে সহাস্যে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মংক্ষিয়াদা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ছড়ার দু'পাশে আলো ফেলে দেখতে বলছেন, কোন পায়ে চলা পথ ছড়া থেকে উঠে গেছে কি না, কিন্তু ছড়ার দু'পাশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার শুধু ঘন বন, নিরেট পাথরের দেয়াল, অথবা ছড়ার আরো শীর্ণ, আরো অন্ধকার, আরো বিপজ্জনক কোন শাখা। শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে গোটা দল, প্রতিটি পা মেপে মেপে ফেলছে সবাই, বিপজ্জনক কোন পাথরে পা পড়লে উঁচু গলায় পেছনের অভিযাত্রীকে সতর্ক করে দিচ্ছে সামনের জন, বিপজ্জনক কোন স্থানে একজনের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে এগিয়ে আসছেন আরেকজন, তাঁর হাত আবার প্রসারিত হচ্ছে আরেকজনের দিকে --- আর দশ মিনিট পর পর থেমে অপেক্ষা করছে সবাই, ধীর গতিতে একটিমাত্র সচল পায়ে এগিয়ে আসা পুতুল আপা আর তাঁর সঙ্গী তিনজনের জন্যে। চারপাশে শুধু জলের নরম শব্দ আর তার প্রতিধ্বনি, বাতাসে বাঁশের পাতার সরসর শব্দ, আর নিজেদের নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ। এই অস্বস্তিকর কলতানকে মাঝে মাঝে লঘু করে তুলছে সদস্যদের সরস মন্তব্য। এই রাতটি শুধু যে অভিযাত্রীদের স্মরণসরণীতে চিরকালের পথিক হয়ে আছে, তা-ই নয়, ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বন্ধনের দার্ঢ্য আরেকমাত্রা বৃদ্ধি করেছে। এভাবে ঘন্টাখানেক চলার পর বিশাল এক বোল্ডারে বসলাম সবাই, পা দুটোকে যতটা সম্ভব শুকনো জায়গায় রেখে। কে যেন একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করলো, সবার মধ্যে উৎসবের আমেজ চলে এলো। এমন আগ্রহ করে কখনো কিছু খাইনি, অন্তত, বিস্কুট না। বিস্কুটের সাথে হেঁড়ে গলায় একটা গানও ধরলাম, আকাশে হেলান দিয়েয়েয়েয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ ---! কেউ কোন আপত্তি না করায় বুঝলাম, গানটা ততটা খারাপ লাগছে না এই পরিবেশে। নানা আসরে বেসুরো গলায় ভুলভাল গান গেয়ে জুতো ও সব্জি সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আমার আছে, কিন্তু পাঠকদের কানে কানে বলি, সে রাতে রাঙামাটির সেই গহীন গিরিখাতে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার মাঝে জেগে থাকা বোল্ডারে বসে গান গেয়ে পাঁচ সহযাত্রীর নীরব বাহ্বা আর মিলন ভাইয়ের এগিয়ে দেয়া একটা বিস্কুটই আমার সুদীর্ঘ শিল্পীজীবনের সেরা পুরস্কার। তবে এমনও হতে পারে যে, জোর গলায় প্রতিবাদ করা, বা জুতো ছুঁড়ে মারার উদ্যম কারো মধ্যেই অবশিষ্ট ছিলো না, সকলেই ভীষণ হেদিয়ে পড়েছিলো। আশপাশে তখন অনেক শেয়ালের রাত্রিকালীন হাঁকডাক ভেসে আসছিলো, সেগুলোর পাশাপাশি আমার সঙ্গীতকেও হয়তো তাঁরা খানিকটা সহ্য করে নিয়েছেন। আর মিলন ভাই হয়তো এই ভেবে বিস্কুটটা এগিয়ে দিয়েছেন যে, সেটা খেতে হলে আমাকে গান বন্ধ করে খেতে হবে। কে জানে? পুতুল আপাদের এগিয়ে আসার খবর পেয়ে আবারো পা চালিয়ে গেলাম আমরা। ছড়া একের পর এক মোড় নিচ্ছে, কিন্তু ছড়ার পাশে কোন পায়ে চলা পথের দেখা পাচ্ছি না আমরা। টর্চের ব্যাটারীও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে, চাঁদ মাথার ওপর থেকে হেলে পড়েছে খানিকটা, এখন প্রায় মধ্যরাত। সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হবে, যদি টর্চ বিকল হয়ে পড়ে। আরো আধঘন্টা হাঁটার পর সকলেই উল্লসিত চিৎকার করে উঠলো, পাওয়া গেছে, দুলহান মিল গ্যয়ি! টর্চের শীর্ণ রশ্মি আর চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে বেশ সুডৌল একটা পায়ে চলা পথ, ঢুকে পড়েছে ছড়ার বাঁদিকের জঙ্গলে। সেই পথে চঞ্চল খানিকটা ঢুকে এসে রিপোর্ট করলো, পথ সামনে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, কানাগলি নয়। পুতুল আপারা খানিকটা এগিয়ে আসার পর সেই পথে ধুপধাপ করে এগিয়ে চললাম সবাই। নড়বড়ে পাথরের ওপর দিয়ে পথ চলার পালা শেষ হলো, পায়ের নিচে টেরা ফির্মা (শক্ত মাটি। একটু ল্যাটিন কপচালাম, পাঠক ক্ষমা করবেন।)পাওয়া গেছে যখন, আর কিছুই পরোয়া করি না! কিন্তু সেই পথ যখন আবারও ঘুরে ফিরে সেই ছড়ার পাথরের ওপর ফিরে এলো, আমরা শিউরে উঠলাম। সর্বনাশ, গোলকধাঁধাঁয় ঘুরপাক খাচ্ছি নাকি সবাই? মিনিট দশেক সেই ছড়ায় চলার পর আমাদের আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে আবারও শুকনো পথের দেখা মিললো। সবাই সেই পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখি, পাহাড়ের ওপর ধাপে ধাপে উঠে গেছে সেই পথ। বিশ্বাস করুন, পাহাড়ে হাঁটার সুযোগ পেয়ে খুশিতে চোখে পানি চলে এলো। কেবলই মনে হতে লাগলো, আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম, সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ --- ইত্যাদি ইত্যাদি। পাহাড়ে আধঘন্টা চলার পর মোটামুটি খোলা একটা জায়গা পাওয়া গেলো, একটা গাছের অতিকায় শিকড়ের ওপর বসলাম সবাই, পেছনের দলের জন্যে অপেক্ষায় সবাই। খানিকটা ফুরসত পেয়ে এবার আবারও খোনা গলায় গুনগুন করে উঠলাম, আমার প্রাণের 'পরে চলে গ্যালো কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ---। কিন্তু এবার যেন আপত্তির একটা মৃদু গুঞ্জণ শোনা গেলো আশপাশ থেকে, আর মাঘ মাসের ভয়ঙ্কর হিম হাওয়াও হারেরেরে করে ছুটে এসে গায়ে ঝাপটা মেরে বুঝিয়ে দিলো, বসন্তের এখনো বহুত বাকি। ক্ষুণ্ণ মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সহস্র নক্ষত্রের দীপাবলী জ্বলছে সেখানে। এক বছর আগে, দার্জিলিং পাড়ায় এক সন্ধ্যেবেলা বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম চরিত্র, নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের কাছ থেকে নক্ষত্রপরিচয় সম্পর্কে কিছু সবক নিয়েছিলাম, এই অজস্র তারার ভিড় দেখে বুঝলাম, বেচারা নূর মোহাম্মদের পরিশ্রমটাই মাঠে মারা গিয়েছে। তারার কাটাকুটি দেখতে দেখতে ভারি অশালীন একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো, গুরুজনেরা যেহেতু একটু পিছিয়ে পড়েছেন, তাই উদাত্ত গলায় সেটি সহযাত্রীদের কাছে পেশ করলাম। হু হু ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া যদি এনে দেয়া যায়, তাতে ক্ষতি কী? অশালীন কৌতুকের গুণ হচ্ছে, একটা বলা শেষ হলেই আরেকটার কথা মনে পড়ে যায়। কাজেই দূরে মংক্ষিয়াদার গলার স্বর যখন শুনতে পেলাম, ততক্ষণে ডজনখানেক চুটকির প্রভাবে পরিবেশ উষ্ণ তো বটেই, রীতিমতো উত্তপ্ত! কিন্তু আবারও হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়লাম আমরা। সবার মাথায় তখন একই চিন্তা, কখন প্রাংশা গ্রামে পৌঁছুবো, কোন একটা কুটিরের মাদুরে শরীর লম্বা করে একটু শোবো। ক্ষিদের কথা সবাই ভুলে গেছি, খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেউ, এখন শুধু একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমকম্বলের নিচে শুয়ে দু'দণ্ড ঘুমোতে চায় সবাই। মিলন ভাই তো আরেকটু হলে গাছের শিকড়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়ছিলেন, আমার বদখাসলত কৌতুকের ঠ্যালায় উঠে পড়তে হয়েছে বেচারাকে। ছড়ার পাশের এই কলাগাছে ভরপুর পাহাড় থেকে যখন নিচে খানিকটা সমতলে নেমে এলাম আমরা, তখন দেখা গেলো নতুন বিপত্তি। তিন দিকে তিনটা পথ চলে গেছে, একই রকম চওড়া তিনটা পথ, আর সবক'টা পথই মিশে গেছে গাছপালার আড়ালে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখানে গ্রামগুলোতে রাতে কোন আগুন জ্বলে না, যে বাইনোকুলার বার করে দেখে নেবো। গ্রামের আশেপাশে পাহাড়ের চূড়োয় যেসব টংঘর আছে, সেগুলো রাতে চোখে পড়বে না। এই তিনটা পথের যে কোন একটা সঠিক, আর সঠিক পথে নূ্যনতম ক'মাইল পথ হাঁটলে গ্রামের দেখা মিলবে, তা-ও কেউ নিশ্চিতভাবে জানি না, কাজেই একবার যদি ভুল পথে এগিয়ে যাই, সারারাত হাঁটলেও প্রাংশা গ্রামের সন্ধান মিলবে না, আর হাঁটতে হাঁটতে কোন চুলোয় গিয়ে ঠেকবো কে জানে? এক মগের মুল্লুক থেকে অন্য মগের মুল্লুক, মানে বার্মায় পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। পুতুল আপার সাথে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা এসে পৌঁছেছেন, শাহেদ ভাই খানিকটা এগিয়ে এসেছিলেন আগেই, আমাদের হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে মংক্ষিয়াদা টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একটা পথের ওপর মিনিটখানেক আলো ফেলে কী যেন পরখ করে দেখলেন, তারপর বললেন, 'এটা জুম্মের রাস্তা।' এর উল্টোদিকের পথটা আরো সময় নিয়ে দেখলেন তিনি, তারপর জানালেন, এটা গ্রামের রাস্তা নয়। কাজেই নাকবরাবরের পথ ধরেই এগিয়ে চললাম আমরা। তিন পথের সঙ্গমস্থলে থকথক করছে কাদা, কয়েকটা বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে সেখানে, তার ওপর সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সবাই। আরো মিনিট দশেক হাঁটতেই এক অদ্ভুত প্রান্তরে এসে পৌঁছুলাম যেন। পেছনে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক পাহাড় যেন কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন বলছে সে, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম, আবার এদিকে পা বাড়াবি তো দেখিস ---! সামনে বাঁদিকে অনুচ্চ খাড়া দেয়ালের মতো পাহাড়ের সারি, ডান দিকেও তাই। আর এই দুই সারির মাঝে, যতদূর চোখ যায়, সমতলের বুক চিরে চলে গেছে একটা পায়ে চলা পথ, পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে চাঁদ, শুধু নক্ষত্রের রোদে চকচক করছে সেই সাদা রাস্তা। পথের গোড়াতেই একটা টংঘর চোখে পড়লো, তেপান্তরের মাঠে একা বধূর মতো বসে। হাতের লাঠিটা এতক্ষণ বিচ্ছিরি বদখদ পথে পদে পদে আমার প্রাণ রক্ষা করেছে, সমতলে এসে তাকে সযত্নে শুন্যে তুলে জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। মিলন ভাই একটু অসুস্থ বোধ করছেন, তাকে খানিকটা পানি খাইয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দিয়ে তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম। দূরে, আমার বাঁয়ে পাহাড়ের চূড়ায় আবছাভাবে চোখে পড়ছে একটা টংঘরের ছায়াবয়ব, বাঁয়ে গাঢ় অন্ধকার। ফেব্রুয়ারির সেই রাতে, সেই সমতল পথে ঠিক কতক্ষণ পা চালিয়েছি, এই অক্টোবরে এসে আমার ঠিক মনে পড়ছে না, মাইল তিনেকের মতো পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। পাহাড়ে পথ চলার সময় পূর্ণ মনোযোগ থাকে পথের ওপর, কিন্তু সমতলে পা পড়লে মনের রাশ যেন শিথিল হয়ে পড়ে। এ পথে চলতে চলতে মাথায় ভিড় জমিয়েছে হাজারো চিন্তা, প্রিয়জনের মুখ মনে পড়েছে কয়েকবার, হয়তো এই বিপজ্জনক পথে চলতে চলতে নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিব্রত ছিলাম বলেই আর কারো কথা ভাবার সুযোগ মেলেনি। রবিবুড়োর বীরপুরুষ কবিতাটার কথা ভাবছিলাম, চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে। গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে, সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে, অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো। --- অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না বলেই চলতে চলতে হঠাৎ যেন সালেহীনের সাথে প্রায় ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি, কাছেই ঠায় দাঁড়িয়ে সৈকত। কী ব্যাপার, এই দু'জন এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে কেন? উত্তরটাও পেয়ে গেলাম সাথে সাথেই, আমাদের তিনজনের সামনে, গজ বিশেক দূরে, পাশের মাঠ থেকে পথের ওপর উঠে এসেছে কয়েকটি বিশাল আকৃতির ছায়া, আর প্রতিটি ছায়ার ওপরদিকে একজোড়া করে সবজে চোখ মিটমিট করছে তারার আলোয়! কী ভাই, ঘাবড়ে গেলেন নাকি? 'ভয়ের কিছু নেই, ওগুলো তো গয়াল!' সালেহীনকে অভয় দিচ্ছিলাম বটে, কিন্তু নিজের গলাই শুকিয়ে গিয়েছিলো আশঙ্কায়। সালেহীনও আমার বক্তব্যে খুব একটা আশ্বস্ত হলো না। পরিস্থিতি বেশ মিলে যাচ্ছিলো রবিবুড়োর কবিতার সাথে, কিন্তু এই গরুগুলো হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো? এ কথা সত্য, যে গয়াল আসলে এক ধরনের গরু, কিন্তু বেশ বড়সড়, পোক্ত ও দুর্দান্ত স্বভাবের গরু। এরা কোন কারণে চটে গেলে দল বেঁধে গুঁতিয়ে দিতে আসে। আমরা তিনজন আমাদের হাতের পলকা লাঠি দিয়ে এদের ঠেকাতেও পারবো না, কিংবা এদের সাথে দৌড়েও কুলিয়ে উঠতে পারবো না। গ্রামের লোকজন বোধহয় এদের রাতের বেলা এমনিতেই ছেড়ে রাখে, বিনে পয়সার পাহারাদারি করার জন্যে। অপরিচিত লোক দেখলেই বোধহয় গয়ালগুলো ফুঁসে ওঠে, তাছাড়া এখন রাত বাজে প্রায় দেড়টা, এ সময়ে কোন ভদ্রলোক এ পথে চলাফেরা করে না, কাজেই গয়ালগুলোর মনে সন্দেহের উদয় হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিট তিনেক, গয়ালগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে নিয়ে হঠাৎ আবার মাঠে ফিরে গেলো। কেবল একটা ছোটখাটো গয়াল ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো পথের ওপর। যে-ই না একটা পা সামনে বাড়িয়েছি, অমনি স্পেনের রাস্তার সেই মদ্যপ ষাঁড়ের মতোই গোটা শরীরে একটা ঢেউ তুলে তেড়ে এলো সে। গয়াল তো আর রয়াল বেঙ্গল নয়, মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিলাম, চোখের ওপর টর্চ ফেলে। টর্চের আলো দেখেই পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো সে, থেমে দাঁড়ালো, কিন্তু ফিরে গেলো না। মাটিতে খুর ঠুকলো কয়েকবার, লেজ সাপটালো, কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কুটিল চোখে দেখতে লাগলো আমাদের। গ্রামের লোক বোধহয় একে দানাপানি কিছুটা বেশি খাওয়ায়, তাই পাহারাদারির কাজে নিমকহারামি করতে চাইছে না গরুটা। সৈকত পরামর্শ দিলো, 'হিমু ভাই, চলেন একটু ঘুরে যাই।' অতি উত্তম প্রস্তাব, পথের পাশে একটু ঘুরে যাবার মতলবে টর্চটা নিবিয়ে পা বাড়াতেই দেখি ব্যাটা আবার তেড়ে আসে! এবার মেজাজটাই গেলো খারাপ হয়ে, টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গিয়ে কড়া একটা ধমক দিলাম, 'কী ব্যাপার? কী চাও তুমি? এমন করছো কেন, বেয়াদব? --- দুষ্ট গরু কোথাকার!' এবার বোধহয় ব্যাটার বোধোদয় হলো, কান দুটো খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে পথ থেকে সরে দাঁড়ালো সে। আমরা গটগটিয়ে এগিয়ে গেলাম, একবার পেছন ফিরে দেখি, তখনও পথের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে ব্যাটা। পুতুল আপার সাথে মংক্ষিয়াদা আছেন, কাজেই গয়াল ওঁদের কোন অনিষ্ট করতে পারবে না, এই ভরসায় সামনে এগিয়ে গেলাম। আরো প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটার পর চোখে পড়লো গ্রামটা, পাহাড়ের ওপর কতগুলো কুটির। চারদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। সম্ভবত গ্রামে কোন কুকুর নেই, অথবা তারা পেটভরে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে, নইলে এতক্ষণে পাড়া মাথায় তুলে ফেলতো। প্রাংশা ত্রিপুরাদের গ্রাম। আমরা ত্রিপুরা ভাষা জানি না, আমাদের চেহারাসুরত হাবভাব সন্দেহজনক, তাছাড়া রাত বাজে প্রায় দু'টো, এমন পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীদের মুখোমুখি হলে কোন সন্তোষজনক তথ্যের আদানপ্রদান সম্ভব নয়। তাই গ্রামের প্রবেশপথের মুখে, মোটামুটি পরিস্কার দেখে একটা জায়গায় বসে পড়রাম সবাই। সবাই আগে এক জায়গায় জড়ো হই, তারপর মংক্ষিয়াদা আমাদের হয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। থেমে থেমে ঝটকা দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে আসছে হিম বাতাস, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে রুকস্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমার পাশে শায়িত মিলন ভাই সম্ভবত ঘুমিয়েই পড়েছেন, হঠাৎ দেখি চঞ্চল তেড়েফুঁড়ে উঠে পড়েছে। সে আর দেরি করতে রাজি নয়, বাকিটা পথ সে কোন একটা টংঘরেই শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। টংঘরের সন্ধানে আবারও পথে বেরিয়ে পড়েছে ব্যাটা, এমন সময় দেখা গেলো, দলের বাকি চারজন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। স্বল্পভাষী মংক্ষিয়াদাকে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার দরকার হলো না, আমাদের গ্রামের গোড়ায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি শুধু বললেন, 'ভালো করেছেন।' তাঁর পিছু পিছু আমরা এগিয়ে গেলাম। গ্রামের ঢোকার প্রবেশ পথ মজবুত বেড়া দিয়ে আটকানো, তবে সেই চিরাচরিত কাঠের গুঁড়ির সিঁড়ি বেড়ার গায়ে লাগানো আছে। সেটা বেয়ে বেড়া টপকে গ্রামে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মংক্ষিয়াদা নিচু গলায় ডাকলেন, 'বেঈ, এ বেঈ, বেঈ? --- এএ বেঈ, বেঈ!' খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে সাড়া মিললো তীক্ষ্ণ গলায়। মারমা বা ত্রিপুরা ভাষা আমরা বুঝি না ঠিকই, কিন্তু সব ভাষার সুরেই কিছু সাধারণ গুণ থাকে, তাই মংক্ষিয়াদার গলায় ক্ষমাপ্রার্থনার টান, আর ভেতর থেকে আশ্বাসের সুর আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না, চাপা একটা স্বস্তির শ্বাস সবার বুক থেকেই বেরিয়ে এলো। পাঁচ: এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো ---? আমিই বলে দিচ্ছি কেমন হতো --- এই আর্টিকেলটা পড়ার দুর্ভাগ্য আপনার হতো না। যে পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এসেছি, সে পথে যে সন্ধ্যের পর পাহাড়িরাও চলাফেরা করে না, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি আমরা, কারণ সন্ধ্যের পর থেকে স্থানীয় কোন মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়নি। পরে জানতে পেরেছি, এ পথে রাতে পাহাড়ি চিতা আর ভালুক ঘোরাফেরা করে। যা-ই হোক, বাকিটুকু শুনুন। প্রাংশাপাড়ায় এক কুটিরের ভেতর, বৈঠককক্ষে লাকড়ির আগুনের সামনে বসে আছি আমরা কয়েকজন। এখন রাত পৌনে তিনটা। আমাদের সবার জুতো বাইরে বারান্দায় রাখে, ঘরের এক কোণে বিশাল ব্যাগের স্তুপ, আর ভেতরে ও বাইরের ঘরে সারিসারি স্লিপিং ব্যাগ পাতা। কুটিরের কর্ত্রী এই নৈশ উপদ্রবে কিছু মনে করেছেন বলে মনে হলো না, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজের ঘরেই আমাদের শুয়ে পড়তে বললেন। ভেতরের ঘরে তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য ঘুমিয়ে ছিলো, আমাদের উৎপাতে তাদের ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু গৃহকর্ত্রী সংক্ষেপে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন তাদের, আবার ঘুমোতে চলে গেলো তারা। তাদের পায়ের কাছেই আরেক সারি বেঁধে স্লিপিং ব্যাগ পাতা হলো। ভেতরের ঘরের এক কোণায় একটা মাটির পাত্রে ধিকিধিকি জ্বলছে কাঠের আগুন, ঘরের ভেতর আগুন না জ্বললে জমে হিম হয়ে যাবেন তারা। সেই আগুনকে ঘিরেই ঘনীভূত হয়ে শুয়ে পড়েছে দলের কয়েকজন। ভাবছিলাম, ঢাকায় রাত আড়াইটার সময় একদল অপরিচিত মানুষ আমার বাড়িতে ঘুমোবার বায়না ধরলে আমি কী করতাম? আগুনের পাশে বসে, নিজের ক্ষতিগ্রস্থ পায়ের পেশীতে কিছুক্ষণ ব্যথাবিমোচক মালিশ করলাম, পায়ের গোড়ালি আর তালুতে বিশাল তিনটা ফোস্কা পড়েছে। শাহেদ ভাই আর বরুণদার কাছে খানিকটা চিঁড়া ছিলো, তারই এক মুঠো মুখে গুঁজে দিয়েছি। বরুণদা কয়েকজনকে প্রলোভন দেখালেন, আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকলে মুরগির ইনস্ট্যান্ট স্যুপ জুটবে কপালে। কিন্তু মুরগি নিয়ে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না, পটাপট স্লিপিং ব্যাগের ওপর লম্বা হয়ে পড়েছে সবাই, আমিও তাদেরই দলে। ক্লান্তি এসে ঘুমের টুঁটি চেপে ধরেছে, তাই রাতের বাকিটা কাটলো একটি অসহনীয় তন্দ্রার ঘোরে। ঘরে আগুন জ্বলছে, স্লিপিং ব্যাগ আর জ্যাকেটের ভেতরে আমি, তবুও কুটিরের নিচে বয়ে যাওয়া হিম হাওয়ায় শরীর অবশ হয়ে এসেছে। এই তন্দ্রার ঘোরটাও ভেঙে গেলো বরুণদার ডাকে। 'মংক্ষিয়াদা! শাহেদ ভাই! হিমু! উচ্ছল!' সবার নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়ে আমিও স্লিপিংব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। বরুণদা রাতে আর ঘুমাননি, জেগেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সবাই উঠে হাতমুখ ধুয়ে ফিরতে ফিরতেই মংক্ষিয়াদা সবাইকে থালা বার করার ডাক দিলেন, ভাত, ডাল আর লাউ রান্না করা হয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, চুপচাপ খাচ্ছে সকলে। একেজনের চোখমুখ বসে গেছে, একুশ ঘন্টা টানা হাঁটার পর তিন ঘন্টা শোবার অবসর পেয়েছে সবাই, কাজেই চেহারা খোলতাই হবার কোন সুযোগ নেই। তবুও খানিকটা বিশ্রাম আর খানিকটা খাবার কিছুটা নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছে আমাদের মাঝে, সময় নষ্ট না করে আবারও বেরিয়ে পড়লাম সকলে। আমাদের গৃহকত্রর্ীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাঁর পাওনাগন্ডা বুঝিয়ে দিয়ে গাঁয়ের বুক চিরে চলে যাওয়া পথটা ধরে এগিয়ে গেলাম আমরা। আজ সাথে এক গ্রামবাসীকে পাওয়া গেলো, যে রুমাবাজারে যাবে, আমাদের দলকে সঙ্গ দিতে রাজি হলো সে। কিছুদূর যেতে না যেতেই একটা ছড়ার মুখোমুখি হলাম আমরা। গ্রামবাসী অক্লেশে কাপড়ে কাছা মেরে এর জানুস্পর্শী কাদাপানি ঠেলে পার হয়ে যান, কিন্তু আমরা পড়লাম সমস্যায়, কোমর পর্যন্ত ভেজা প্যান্ট নিয়ে পথ চলা সম্ভব নয়, তবে সমাধান বের করতে খুব একটা দেরি হলো না, মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজির পর লম্বা দেখে দুটো বাঁশ ফেলে একটা তাৎক্ষণিক সাঁকো তৈরি হয়ে গেলো। সেই টালমাটাল সাঁকো একে একে পেরিয়ে জোর পায়ে দূরের পাহাড়সারির দিকে চলতে শুরু করলাম আমরা। সাতটা বেজে গেছে, আমাদের দুপুরের মধ্যে রুমাবাজারে পৌঁছুতে হবে। আজও পথ চলে গেছে ছড়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু গতরাতের মতো অত দীর্ঘ নয়, খানিকটা হাঁটতেই আবার পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম আমরা। ঝুরঝুরে কাঁকর আর বালিভর্তি পথে ধুপধাপ পা ফেলে ঘন্টাখানেক চলার এক অপূর্ব জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। পাহাড়ের মাঝে একটা গভীর খাদ, পাহাড়ের ঢাল ঘাস আর হলদে-সোনালী ঝোপে ছাওয়া, মাঝে মাঝে কয়েকটা প্রকান্ড শিরীষ গাছ খাদের মধ্য থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আকাশ আজও পরিষ্কার, নীল আর সবুজ যেন ফেটে পড়ছে চারদিকে। প্রাংশাবাসী সেই ভদ্রলোক আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন, একটা পাঁচ বছরের ক্ষুদে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে কোন অ্যাথলেটের যেমন হাঁটতে বেরোলে সমস্যা হয় --- এখানে পৌঁছে তিনি মংক্ষিয়াদাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এই গতিতে চললে রাত আটটার মধ্যেও রুমায় পৌঁছুনো যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত হলো, যাদের আগামীকাল অফিস করার খুব জরুরী তাড়া আছে, তারা দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যাবে, বান্দরবানে পৌঁছে শেষ বাস, যেটা রাত আটটায় ছাড়ে, সেটা ধরার চেষ্টা করবে তারা, আর পেছনের দলের জন্যে অপেক্ষা করবে। আর যাদের তেমন একটা তাড়া নেই, তারা পুতুল আপাকে দেখেশুনে রাখবে, ওঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। পুতুল আপার নিজেরও অফিসের তাড়া আছে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনি আহত পা নিয়ে একটু পিছিয়ে পড়েছেন। আগুয়ান দলে যোগ দিলেন বরুণদা, উচ্ছল ভাই, সৈকত আর মিলন ভাই, তাঁদের গাইড হয়ে চললেন সেই প্রাংশাবাসী। তাঁরা এগিয়ে যাবেন, আর কোন রাস্তা একাধিক দিকে ভাগ হয়ে গেলে সঠিক পথে চক দিয়ে টিক চিহ্ন দিয়ে যাবেন। এ সিদ্ধান্ত হতে না হতেই সাঁই সাঁই করে পা চালিয়ে এগিয়ে গেলেন পাঁচজন, আমরা কিছুটা ধীরে পথ চলতে লাগলাম। বড়থলি ক্যাম্পে সেনারা জানিয়েছিলেন, প্রাংশা থেকে রুমাবাজার পর্যন্ত রাস্তা অতি চমৎকার, কেবল নেমে যেতে হবে, শুধু মাঝখানে এক জায়গায় ময়না পাহাড় বলে একটি বস্তু রয়েছে, যেটি সৈনিকদের মাথাও ঘুরিয়ে দেয়। আমি আর সালেহীন চলতে চলতে একটু এগিয়ে গেলাম, বাকিরা একটু ধীরে পা চালিয়ে পুতুল আপার সঙ্গে রইলেন। কিন্তু পা মচকে গেলেও পুতুল আপা যথেষ্ঠ দ্রুত হাঁটছেন, তাই দলের গতি খুব একটা মন্থর হলো না। কিছুদূর এগিয়ে আমি আর সালেহীন অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকিদের জন্যে, তাঁদের দেখা গেলেই আবার উঠে পড়ছি, আবার মিনিট বিশেক হেঁটে একটু বসছি। চলতে চলতে কয়েক জায়গায় পথ দু'তিনভাগ হয়ে গেছে, কিন্তু অগ্রগামীদের চকচিহ্ন দেখে সঠিক পথে পা বাড়িয়েছি আমরা। পথ চলে গেছে পাহাড়ের নিরাপদ এলাকা দিয়ে, পথের পাশে কোন খাদ নেই। যত পথ চলছি, ডানে আর বামে আরো নতুন সব পাহাড় চোখে পড়ছে। পাহাড়ের পাশে কয়েক জায়গায় বাঁশের ঝাড় কেটে সাফ করা হচ্ছে, কোথাও ঝোপে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে পাহাড়ের ঢাল --- জুম্ম চাষের প্রস্ততি। মাথার ওপর এই অভিযানে প্রথম মেঘের দেখা পেলাম, তার আড়ালে কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে যেন পোশাক পাল্টে আসছেন সূয্যিমামা, প্রত্যেকবার তাঁর বেশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে, আর এদিকে গলদঘর্ম হচ্ছে তাঁর পথচলা ভাগ্নের দল। আজ পথে কোন ছায়া নেই, একেবারে ন্যাড়ামুন্ডি পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলছি আমরা। খানিকটা এগিয়ে পথের পাশে একটা মুদি দোকান পড়লো, রুমাবাজার থেকে যাত্রার পর এই প্রথম। আমি আর সালেহীন সেখানে গুটগুটিয়ে ঢুকে পড়লাম, চা খাবো বলে। অবশ্য চায়ের সাথে টা-ও মিললো, গ্লুকোজ বিস্কুট। আমরা বসতে না বসতেই চঞ্চল এসে হাজির, তিনজন মিলে চা আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সারলাম। দোকানিয়া বুড়োর সাথে আলাপ করে জানা গেলো, আমাদের দলের বাকিরা মিনিট পনেরো আগে দোকান থেকে বেরিয়েছেন। রুমাবাজার আর কতক্ষণের পথ, জানতে চাইলে বুড়ো হেসে জানালেন, কতো আর, ঘন্টা দেড়েক? একটু আশ্বস্ত হলাম, তাহলে চারঘন্টার মধ্যে রুমায় পৌঁছে যাবো! পেটপূজা করে বেরোচ্ছি, এমন সময় দলের বাকিরা এসে উপস্থিত। তাঁদের বিদায় জানিয়ে এবার আমি, সালেহীন আর চঞ্চল পা বাড়ালাম। চঞ্চল আবার কয়েকটা বড়ই কিনে নিয়েছে দোকান থেকে, সেগুলো দাঁতে কাটতে কাটতে এগিয়ে গেলাম। পাহাড় থেকে নামার আনন্দ অন্যরকম, তাতে শারীরিক কষ্ট কিছুটা কম, আর যে পথ ধরে নামবো, সেটার অনেকখানি ওপর থেকে চোখে পড়ে। ঘন্টাখানেক বৈচিত্র্যহীন পথে চলতে চলতে একসময় একটা পিচ্ছিল খাড়াই হাঁচড়ে পাঁচড়ে পার হয়ে আমার আর সালেহীনের চক্ষুস্থির হয়ে গেলো। সামনে একটা বাঁক ঘুরে পথ উঠে গেছে একটা পাহাড়ে। খুব একটা উঁচু সেটা নয়, কিন্তু এখান থেকেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, পথের ঠিক নিচেই গভীর, অনেক গভীর খাদ। খাদের দেয়ালে দুয়েকটা ঝোপঝাড় গজিয়েছে বটে, কিন্তু সেই পথে যদি কারো পা পিছলে যায়, সোজা গিয়ে সেই খাদে পড়তে হবে। এটাই তাহলে সেই ময়না পাহাড়! বিবরণক্লান্ত পাঠককে সেই ময়না পাহাড়ে ওঠার দুঃসহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে পীড়ন করার ইচ্ছে আমার ছিলো না, তবু বলি, বড়জোর সাততলার সমান উঁচু সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে ঝাড়া পনেরো মিনিট সময় লেগেছে আমার। পথটা পাক দিয়ে পাহাড়ের কিনারা ধরে উঠে গেছে, গোটা পথটা অসম্ভব খাড়া, প্রায় সত্তর ডিগ্রীর মতো হবে, আর অসম্ভব পিচ্ছিল, পা রাখতে না রাখতেই পায়ের নিচের মাটি আর বালি ঝুরঝুর করে খসে আসতে থাকে। হাতের কাছে একটা কিচ্ছু নেই আঁকড়ে ধরার, পথের ওপর গেঁথে থাকা পাথরে হাত রাখলে আলগা হয়ে আসে, গাছের শুকনো শিকড় আঁকড়ে ধরতে গেলে ভেঙে আসে। পথের ওপর স্থির হয়ে থেমে থাকার জো নেই, গোটা শরীর অতি ধীরে নিচে নেমে আসতে থাকা। একবার শুধু ভুল করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়েছি, দেখি বহু নিচে অন্ধকার মুখব্যাদান করে আছে। সালেহীন সাবধানে পা ফেলে উঠে গেছে ওপরে, আমার জন্যে মিনিট পাঁচেক বসে ছিলো সে। অর্ধেক পথ পেরোনোর পর শুনলাম, সে ডাকছে, 'হিমু ভাই, ঠিক আছেন তো?' পান্ডব যুধিষ্ঠির পর্যন্ত মিথ্যে কথা বলে তার রথের চাকা ধূলোয় লুটিয়েছিলো, আর আমি তো এই পান্ডববর্জিত দেশের এক সামান্য মানুষ, শুনতে পেলাম জোর গলায় বলছি, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছি, আসছি এখুনি!' ওদিকে দূর থেকে আমাকে পাহাড়ের গায়ে ঝোঝুল্যমান অবস্থায় দেখে চঞ্চল দ্রুত এগিয়ে এসেছে, যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়, আমি ওঠার মিনিট তিনেক পরই দেখি উঠে এসেছে সে। পাহাড়ের ওপর একটা ঝোপের পাশে বসে হাঁপাচ্ছিলাম সবাই, আর ঢোঁক গিলছিলাম পুতুল আপার কথা ভেবে। একটা অচল পা নিয়ে এই ঈশ্বরপরিত্যক্ত পথে কিভাবে উঠবেন তিনি? ব্যাগগুলো খুলে রেখে পথের ওপর আবার গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। সাথে দড়ি আছে, প্রয়োজন হলে দড়ি বেয়ে উঠে আসতে পারবেন পুতুল আপা। পাহাড়ের ওপর থেকে পথটা দেখা যায় না, তাই আমরা খানিকটা নিচে নেমে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিনিট পনেরো পর দলের বাকিদের কন্ঠস্বর কানে এলো। চঞ্চল হাত বাড়িয়ে ব্যাগগুলো তুলে নিয়েছে, আর পুতুল আপাকে নিয়ে ওপরে উঠছেন শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা। শাহেদ ভাই পেছনে পেছনে আসছেন, যাতে পুতুল আপা পিছলে পড়ে যেতে না পারেন, আর তাঁর হাত ধরে টেনে তুলছেন মংক্ষিয়াদা। সবাই ওপরে উঠে যাবার পর শাহেদ ভাইয়ের খেয়াল হলো, তাঁর বিশেষ ট্রেকিং প্যান্টের একটা পায়া খুলে পড়ে গেছে, তিনি আবার নিচে নেমে সেটা উদ্ধার করে ফিরলেন। ময়না পাহাড়ের ওপরে সবার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসার পর কয়েক ঢোঁক পানি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম আমরা। সেনাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ময়না পাহাড়ের পর আর কোন ফাঁড়া নেই, পথ কেবল নেমে গেছে পাহাড়ের শিরদাঁড়া ধরে। আমি, সালেহীন আর চঞ্চল কিছুক্ষণ একসাথে এগোলাম, আধঘন্টা চলার পর চঞ্চল আর সালেহীন জোর পা চালিয়ে নিচে নেমে গেলো, আমি ধীরেসুস্থে পথ চলতে লাগলাম। পায়ের নিচের ফোস্কা দুটো একেবারে জ্বালিয়ে মারছে, মাটিকে পায়ের গোড়ালি ঠুকে ঠুকে এগোতে হচ্ছে। সূর্য মাথার ওপর থেকে একটু ঢলে গেছে, আমার সামনে দূরে সাঙ্গু উপত্যকা, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারির বুক চিরে বয়ে যাওয়া রূপালি ফিতের মতো নদীটাকে। সাঙ্গুর কিনারায় গড়ে ওঠা বিরাট জনপদটাকেও পুরোটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দুপুর তিনটার দিকে, ময়না পাহাড় পেরিয়ে আসার পর ঘন্টা দুয়েক হেঁটে একসময় নিউ ইডেন পাড়ার ভেতর দিয়ে রুমাবাজারে এসে পৌঁছেছি। মাঝে একটা টংঘরে মিনিট পাঁচেক বসেছিলাম, কিন্তু মশার ভনভন শুনে চটপট উঠে পড়েছি। রুমাবাজার যতো এগিয়ে আসছে, পথের পাশে কলাগাছের সংখ্যা ততই বাড়ছে। কলাগাছের গোড়ার মাটি খুব ঝুরঝুরে হয়, তাই পথের শেষ অংশ খুব সাবধানে পার হতে হয়েছে। পথে দেখা হলো আমাদের সেই প্রাংশাবি সঙ্গীপথিকের সাথে, রুমায় বাজারসদাই করে ফিরছেন তিনি, আমাদের প্রথম দলের সঙ্গীরা রুমায় পৌঁছে গেছে, জানালেন। আর নিউ ইডেন পাড়ার গোড়ায় পাহাড় থেকে সমতলে নামার জন্যে একটা ধাপকাটা কুন্ডলীর মতো পথ আছে, সেটার কথাও আমি কখনো ভুলবো না। এক পা এদিক ওদিক হলে শ'খানেক ফিট নিচের ছড়ায় পড়ে মরার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিলো ওখানে। নিউ ইডেন পাড়ায় পৌঁছে একটা জায়গায় পথের পাশে বাঁশের অ্যাকুয়াডাক্ট পাওয়া গেলো। আমার বোতলটা সেই ঠান্ডা পানিতে ভরে নিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর সময় নিয়ে পুরো এক বোতল পানি খেলাম, ভয়ানক তৃষ্ণা পেয়ে গিয়েছিলো। ঠান্ডা মাথা আর ঠান্ডা পেট নিয়ে পাড়ার ভেতর দিয়ে কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি ঠেলে চললাম। পথের দু'পাশে কুটির, কুটিরের সামনে শিশুরা খেলা করছে, বারান্দায় তাঁতে চাদর বুনছেন মহিলারা। কুটিরের আশেপাশে অবাধে চরছে কয়েকটা কুকুর আর অগণিত শূকর। এক জায়গায় দেখলাম, পথের ওপর একটা বাচ্চা মেয়ে খুব যত্ন করে একটা শুকরকে খৈল খাওয়াচ্ছে, আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরো খানিকটা সামনে গিয়ে দেখি একটা বিশাল মাদী শূকর রাস্তায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুধ খাচ্ছে তার পাঁচটা বাচ্চা, ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে পাড়া মাথায় উঠে যাবার যোগাড়। সালেহীন আর চঞ্চলকে এখন কোথায় পাই? সাতপাঁচ ভেবে উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসা এক মহিলাকে বিনীতভাবে নমস্কার করে জানতে চাইলাম, আমার মতো পিঠে ব্যাগ নিয়ে কাউকে দেখেছেন কি না। তিনি প্রতিনমস্কার করে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। চলতে চলতে তাঁর সাথে বেশ আলাপ জমে উঠলো। ঢাকায় দুয়েকবার গিয়েছেন তিনি, ভালো লেগেছে তাঁর কাছে, জানালেন। আমাদের সম্পর্কে পাহাড়িদের বেশ কৌতূহল, বিশেষ করে নিউ ইডেন পাড়া দিয়ে কোন অভিযাত্রীকে চলতে দেখেননি তাঁরা, অন্য যারা আসে তারা লাইরুনপিপাড়া হয়ে কেওকারাডঙের দিকে চলে যায়। আমরা প্রাংশাপাড়া থেকে আসছি শুনে বেশ উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন তিনি, সেখানে তাঁর দিদি থাকেন, ত্রিপুরাদের অন্যতম সঙ্গীতশিল্পী তিনি। মিনিট পাঁচেক পথ চলার পর একটা দোকানে চঞ্চল আর সালেহীনকে পাওয়া গেলো, আয়েশ করে কোমল পানীয়ে কঠোর চুমুক দিচ্ছে তারা। আমার পথপ্রদর্শিকা দিদিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমার বরাদ্দ বিস্কুটটুকুর ওপর। সালেহীন জানালো আরেক দুঃসংবাদ, আগামীকাল নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ, তার পরদিন আবার হরতাল! আজ যে করেই হোক, ঢাকার বাস ধরতে হবে আমাদের। দোকানিয়া প্রৌঢ়া দিদির নাম ফুলের মালা চাকমা, তাঁর সাথে বেশ আলাপ জমে উঠলো। তিনি রাঙামাটির শুভলঙের বাসিন্দা ছিলেন, কাপ্তাই হ্রদের নিচে সব ডুবে যাবার পর এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছেন তিনি। ফুলের মালা দিদির সাথে আলাপের এক পর্যায়ে মঞ্চে প্রবেশ ঘটলো আরেক উপদ্রবের, এক পাঁড় মাতাল বম, দিনে দুপুরে মদ খেয়ে হল্লা করছে সে। আশেপাশের লোকেরা চেয়ে চেয়ে তার কান্ড কারখানা দেখছে শুধু। কয়েকবার খেদিয়ে দেবার পরও গায়ে পড়ে এসে উৎপাত শুরু করলো সে, স্থানীয়দের অনুরোধ করলাম, একে সরে যেতে বলার জন্যে, কিন্তু কেউ গা করলো না। অগত্যা আধঘন্টা তার হৈচৈ-চিৎকার-গালাগালি সহ্য করার পর তাকে পাকড়াও করে রাস্তায় বার করে নিয়ে এলাম, বাসায় চলে যেতে বললাম। তখন শুরু হলো আরেক জ্বালা, সে তার বাসায় আমাদের মদের দাওয়াত দিতে চায়। লোকটা একটু তফাতে হঠার পর স্থানীয় চ্যাপেলের পাস্তর এসে দেখা করে গেলেন আমাদের সাথে। এমন সময় দেখি শাহেদ ভাই এসে হাজির, আরো দশ মিনিট পর পুতুল আপা আর মংক্ষিয়াদাও পৌঁছে গেলেন। ফুলের মালা দিদি মিষ্টি হেসে করমর্দন করে বিদায় জানালেন আমাদের, আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম ঘাটের দিকে। চারটা বাজেনি এখনও, পাঁচটার মধ্যে ক্ষক্ষ্যংঝিরি পৌঁছুতে হবে, রুমা-বান্দরবান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে এরপর। এরই মধ্যে কোত্থেকে আবার এসে উদয় হয়েছে সেই মাতাল ব্যাটা, পুতুল আপাকে জ্বালাতন করার উদ্যোগ নিয়েছে সে। এবার আর কথা বাড়ালাম না, একটা মাপা ধাক্কা দিতেই সে টলতে টলতে রাস্তার পাশে ধপাস করে পড়লো, আশেপাশের লোকজন বিরাট এক হর্ষধ্বনি তুললো, বুঝলাম, এমনটা প্রায়ই হয়। ঘাটে গিয়ে বরুণদার প্রাক্তন গাইড জুয়ামের সাথে দেখা। নৌকো নিয়ে দর কষাকষি হলো খানিকটা, চাটগাঁ থেকে এসে বসত গেড়ে বসা চ্যাংড়া মাঝি কিছুতেই চলতি মাথাপিছু ভাড়ায় নৌকো ভাসাবে না, তার নৌকো এখন রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে হবে। শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা যথাক্রমে নরম ও গরম সুরে কিছুক্ষণ দর কষাকষি করার পর নৌকো পানিতে ভাসলো। কিন্তু এই ছোকরা মাঝি একা লগি বাইলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, সব কাজের কাজি মংক্ষিয়াদা তাই আরেক প্রান্তে বসে লগি হাতে তুলে নিলেন। মাঝে মাঝে লগি নামিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি, আর এক ঢোঁক পানীয় খেয়ে নিচ্ছেন। নৌকো ছুটে চলেছে অগভীর সাঙ্গুর ওপর দিয়ে। বাংলায় এর নাম শঙ্খ, বর্মী ভাষায় রিগ্রিক্ষ্যং। নদীর দুপাশে ঘন অরণ্যে ঢাকা খাটো খাটো পাহাড়, আর বালিতে ঢাকা পাড়ে কমলার ক্ষেত, প্রতি বছর রুমা থেকে লাখ লাখ কেজি কমলার চালান যায়। সূর্য আকাশ থেকে হারিয়ে গেছে, সন্ধ্যের ছাতা একটু একটু করে খুলছে চারপাশে, সেই ফুরিয়ে আসা আলোয় হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে নদীর ওপর ঝুঁকে আসা গাছের ডালে অপূর্ব রঙিন সব পাখি। ক্ষক্ষ্যংঝিরিতে পৌঁছে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। সবাই হুড়মুড়িয়ে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলাম গাড়ি ভাড়া করার জন্যে। খানিক বাকবিতন্ডার পর একটা গাড়ি পাওয়া গেলো, সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৈরি, তার স্টিয়ারিং আবার বাম দিকে, চালক জানালেন, এটা রুশ রাষ্ট্রের গাড়ি। গাড়িতে আমাদের সঙ্গী হলেন রুক্ষ চেহারার দুই ব্যক্তি, তাঁদের হাতে ওয়্যারলেস, হাবভাব দেখে গুন্ডা বদমাশ মনে হলেও আসলে তারা পুলিশ। এ পথে তাঁরা কারো না কারো চাঁদের গাড়িতে লিফট নিয়ে থাকেন, এটাই নিয়ম। গাড়িচালক খালেক সাহেব অভিজ্ঞ ড্রাইভার, বিপজ্জনক রুমা-বান্দরবান সড়কে সোঁ সোঁ করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন তিনি, গাড়ির ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ শুনলে মনে হয়, এই বুঝি ইঞ্জিনটা খুলে পড়ে যাবে পথের ওপর, তাঁর চালনকৌশলের জোরে আটটার আগেই এসে বান্দরবানে নিরাপদে পৌঁছুলাম আমরা। তবে আরেকটি শিহরণজাগানিয়া ঘটনা মাঝপথে ঘটেছে, বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে শুধু বলছি, এ সড়কে বিকেল গড়িয়ে গেলে কখনোই যাতায়াত করবেন না, কখনোই না, বিপদ ঘটতে পারে। বান্দরবানে পৌঁছে বাস স্ট্যান্ডে গাড়ি থামিয়ে টিকেট করতে ছুটে গেলেন শাহেদ ভাই, আমাদের সেই অবিবৃতঘটনাজনিত উত্তেজনা তখনও কাটেনি, নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে চলেছি। পরদিন সড়ক অবরোধ, পর পর দুটো বাস ছাড়ছে বান্দরবান থেকে, আমাদের জন্যে আসনের বন্দোবস্ত হলো না, তবে ইঞ্জিনের ওপর বসে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। খাওয়াদাওয়ার জন্যে বাজারের দিকে গাড়ি ঘোরাতেই পথের ওপর দলের প্রথম চারজনকে দেখা গেলো, নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে এগিয়ে আসছেন তাঁরা। দুই টুকরো আবার জোড়া লেগে গেলো, চাঁদের গাড়িতে উচ্ছ্বসিত হাউকাউ শুরু হয়ে গেলো। বরুণদার সাথে জুয়ামের দেখা হয়েছে, তিনি সন্তুষ্টচিত্তে জানালেন, তাঁর গাইড জুয়াম মদ ছেড়ে দিয়েছে, বরুণদার সেই অসমাপ্ত অভিযানে দুর্ঘটনার পর থেকে। স্থানীয় খাবার দোকানে ঢুকে ঠেসে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম সবাই, পুকুরপাড়া ছেড়ে আসার পর পেট ভরে এক বেলাও খাবার জোটেনি। মিনিট বিশেক পর বেরিয়ে মংক্ষিয়াদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোলাম সবাই। চট্টগ্রাম পর্যন্ত একসাথে যাবো আমরা, চট্টগ্রামে নেমে এক ঘন্টা পর আরেক বাসে ঢাকায় পৌঁছুবো আমি, সালেহীন, চঞ্চল আর শাহেদ ভাই। এবারের অভিযানে আমরা বান্দরবানে প্রবেশ করেছি শেষ রাতের আঁধারে, সন্ধ্যে রাতে এই অপূর্ব পাহাড়গুলোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম ব্যস্তসমস্ত ঢাকার দিকে। অভিযানের ক্লান্তি কেটে যাবে একবেলা ভালো ঘুম দিলে, কিন্তু এর স্মৃতির দাগ মন থেকে মুছবে না। ছয়: শেষ কথা বোদল্যেরকে দিয়েই শেষ করি। অদ্ভুত যাত্রীর দল! তলহীন, সমুদ্রের মতো, বিলোল নয়ন ভ'রে নিয়ে এলে প্রোজ্জ্বল কাহিনী; স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দেখাও, সেখানে আছে কত নীলিমার, নক্ষত্রের মণিহার, মুকুট, কিঙ্কিণী। আমরাও যাবো দূরে, বিনা পালে, বায়ুব্যতিরেকে ---; আমরা, আজন্ম বন্দী, বক্ষে চাপা নির্বেদের ভার, অকস্মাৎ উন্মোচিত আত্মার বনাতে দাও এঁকে দিগন্তের চালচিত্রে পুলকিত স্মৃতির সম্ভার। বলো, বলো, কী দেখেছো, বলো! পরিশিষ্ট: দু'টো আলাদা বাসে একই সাথে ঢাকায় পৌঁছেছে পুকুরপাড়া অভিযাত্রীরা, সাত তারিখ ভোরবেলা। পুতুল আপার পায়ে সূক্ষ্ম একটা ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছিলো, সেটাকে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রয়োগে ঠিক করা হয়েছে, পুতুল আপা এখন আবার আগের মতো সাঁই সাঁই করে হাঁটতে পারেন, তিনিই এবারের সেরা অভিযাত্রী। মিলন ভাইয়ের পায়ের পেশীও কয়েকদিন বিশ্রামে ঠিক হয়ে গেছে, তিনিও গটগটিয়ে হেঁটে বেড়ান। আঠারো তারিখে ম্যালেরিয়ার আক্রমণে কাবু হয়ে পড়েছে এ গল্পের লেখক, কয়েকমাস ভোগার পর এখন সে খাড়া হয়েছে, কিন্তু এখনও ল্যাগব্যাগ করে হাঁটে, তার বদখদ চেহারাখানা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে, দূর থেকে অনেকটা চঞ্চলের মতো লাগে দেখতে। (সমাপ্ত)
false
mk
জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ স্বস্তিকর স্থানীয় সময় শনিবার ২৮ সেপ্টেম্বর বিকালে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতি থাকলে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হলে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মুক্ত থাকলে- আমরা স্বস্তি পাই। কারণ সে পরিবেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে ভারতে কিংবা আশপাশের দেশে নাশকতা চালানোর সুযোগ পায় না।” বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়েছে এবং বাংলাদেশের আপামর মানুষ এখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বলে মত দেন মনমোহন সিং। কেবল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন বিশ্বের অনেক শীর্ষ নেতারা একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আবহমান বাংলা সবসময়ই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। এ সেদিন পর্যন্ত অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের আগেও এদেশে জঙ্গিবাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসন-কালোত্তর টানা ২১ বছর সামরিক শাসকদের মদদে দেশের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার ক্ষমতায় এলে পটভূমি পাল্টে যায়। মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গিরা তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হলে জঙ্গিরা গা-ঢাকা দেয়। আত্মগোপনে থাকা এসব জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠন মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আবারও মাথা তোলার চেষ্টা করছে। আর সংগঠনগুলোর সবই একই নেটওয়ার্কে অর্থাৎ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি)-এর কার্যক্রম অনুসরণ করে নাশকতার বিস্তৃত কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছে। ১৯৯২ সালে আফগান-ফেরত মুজাহিদদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের অনুসৃত পথে এখন শতাধিক জঙ্গি সংগঠন রয়েছে দেশে। নেতৃত্বে আছে আফগান-ফেরত মুজাহিদদের কেউ না কেউ। বরগুনা থেকে ১২ আগস্ট গ্রেফতারকৃত ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সদস্যরা সংগঠিত হচ্ছিল হুজির সাবেক নেতা ও ফাঁসিতে মৃত্যুবরণকারী শায়খ আবদুর রহমানের আদর্শে। মূলত হুজির পূর্বসূরিদের ‘সশস্ত্র বিপ্লব’-এর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ‘অসম্পন্ন’ কাজ সম্পন্ন করতে নেমেছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায়, জঙ্গিদের কার্যক্রম প্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য সরকারের শেষ সময়ে নাশকতার সৃষ্টি করে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করছে তারা। তারা হেফাজতের সঙ্গে মিশেও সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিল; ব্যর্থ হয়ে নিজেরা নাশকতার ছক তৈরি করছে দেশজুড়ে। উল্লেখ্য, আফগান-ফেরত কয়েক হাজার মুজাহিদ আলাদা আলাদা সংগঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর কার্যক্রমে জড়িত রয়েছে। হুজি, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ ও আনসারুল্লাহ’র নীতি ও আদর্শ একই। শেখ হাসিন নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসীন হয়ে গত সাড়ে চার বছরে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর দিকে অগ্রসর হয়েছে। এ সময় সরকার ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং বামপন্থী সর্বহারাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। কিন্তু ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হলে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির দেশে অরাজকতা ও নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। অন্যদিকে চলতি বছর (২০১৩) হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত কিছু জঙ্গি সংগঠন। এদের সকলের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। ফলে এ সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও, তাদের কারণে খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০১২ সাল পর্যন্ত বর্তমান সরকারকে ১৮ টির মতো সন্ত্রাসী কর্মকা- মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়েছে ৪৬ জন। ৩৫ টির মতো ইসলামী দলের নাশকতা ব্যর্থ করেছে পুলিশ-র‌্যাবের যৌথবাহিনী। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৬১৬ জঙ্গিকে যারা হুজি, ইসলামী ছাত্র শিবির, জেএমবি, হিযবুত তাহেরি ও হিযবুত তাওহিদের সদস্য। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলামী নেতাদের মুক্ত করার জন্য দেশব্যাপী যে নাশকতার সৃষ্টি করা হয় সে পরিস্থিতিতে আরও বেশ কিছু শিবিরকর্মীকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এক হিসেবে, ২০১২ সাল পর্যন্ত ৭৭ টি নাশকতার ঘটনায় ১২৪৪ জন ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মূলত ইসলামী জঙ্গি গ্রেফতারে সাফল্য রয়েছে অনেক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর পুলিশ ছাত্র শিবিরের ১০৭ ক্যাডারকে গ্রেফতার করে। এর আগে ৬ নভেম্বর একই অভিযোগে সারাদেশ থেকে ২০৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছর যেমন, তেমনি ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর র‌্যাব বরগুনা থেকে হিযবুত তাহেরির ৮ ক্যাডারকে গ্রেফতার করে। সে বছরের ১২ আগস্ট ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা করার জন্য মিটিংয়ে বসলে ঢাকার পান্থপথের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে হিযবুত তাওহিদের ৩৫ ক্যাডারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করার চেষ্টা করলে কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে র‌্যাব ও পুলিশ গ্রেফতার করেছে একাধিক জনকে। এদের মধ্যে কেবল হিযবুত তাওহিদ নয়, জেএমবি’র নেতারাও রয়েছে। ২০১২ সালের ৫ মার্চ র‌্যাব খুলনা ও সাভার জোনের দুই প্রধান জেএমবি নেতাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এর আগে ঢাকার উত্তরা থেকে ৯ জানুয়ারি জেএমবি নেতা বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ এমদাদুল হক উজ্জ্বলকে গ্রেফতার করে পুলিশ প্রশাসন। জেএমবি’র অর্থ লেনদেনের প্রধান তাহা মোহাম্মদ ফাহিমকে সঙ্গীসহ গ্রেফতার করা হয় একই মাসের ৮ তারিখে। চৌদ্দজন নেতাসহ ৩৪ জন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সর্বহারাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে যেমন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- নির্মূল করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের নাশকতা ও জঙ্গিপনার জবাব দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিশ্বব্যাপী সকলের কাছে একথা পরিষ্কার যে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে জামায়াত-শিবির দেশের মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ঘাপটি মেরে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই জামায়াত-শিবির সক্রিয় হয় দেশ-বিদেশে। গত বছর (২০১২ সালে) বিচারের রায় দেওয়া আরম্ভ হলে তারা আরও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। তখন ৫ নভেম্বর থেকে টানা ৯ দিন নাশকতায় লিপ্ত হয় তারা। অপরাধীদের মুক্তি দাবি করে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ পরিস্থিতিতে ১৪ নভেম্বর ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা হবে। যত বাধা ও হামলা আসবে তত দ্রুত নিষ্পন্ন হতে থাকবে মামলা এবং একে একে রায় ঘোষিত হবে। সে বছরই ২৫ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানানো হয়। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় আসীন হলে এসব অপরাধীদের যে মুক্তি দেওয়া হতে পারে সে সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়। কারণ অপরাধীদের ফাঁসির রায় ঘোষিত হলেও তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকেন্দ্রিক আন্দোলনের সুযোগে জঙ্গিদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হলে বিএনপি দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধের ডাক দেয়। গত বছর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের আন্দোলনের নামে সহিংসতায় মারা যায় ২ জন, ৪০ জন পুলিশসহ আহত হয় ২৯০ জন। ৭০ টির মতো বোমা হামলা চালায় বিরোধী সমর্থকরা। পুলিশের ৫ টিসহ গাড়ি পোড়ানো হয় ৫০ টি। ভাঙচুর করা হয় আরও ১৫০টি। সরকার বিএনপির দাবিকে অযৌক্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বারবারই বলে আসছে। কারণ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ ৬ হাজার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে সক্ষম বলে তারা মনে করেন। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে জঙ্গি দমনের বিষয়ে অভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সন্ত্রাস নির্মূলে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ‘বন্দি-বিনিময় চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। উপরন্তু সীমান্তে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারী ব্যতীত কাউকে গুলি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ও চলতি বছর উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ঢাকা থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছে।এর আগে মার্কিন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের প্রশংসা করা হয়েছে। ‘এ দেশের মাটিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানো কঠিন’- এ শিরোনামে সন্ত্রাস দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের মাটিতে কাজ চালানো সন্ত্রাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক সন্ত্রাস নিয়ে ৩০ মে ওয়াশিংটনে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়। ২০১২ সালের পরিস্থিতি নিয়ে ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেরোরিজম ২০১২’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯’ পাস করে। সে আইনকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দেয় বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ধরন দ্রুত পাল্টানোর ফলে। এজন্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদ- অনুসরণ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরপর গত বছর (২০১২) এক দফা আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু তারপরও আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনুরোধ আসে। এসব বিষয় যুক্ত করতেই সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১১ জুন জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল ২০১৩ পাস হয়েছে। এ বিলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ইন্টারনেটভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ধারাসমূহের অন্তর্ভুক্তি। কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- করলে সাক্ষ্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে। অন্যদিকে, এ বিলে জঙ্গি দমনে গুরুত্বপূর্ণ ধারা যুক্ত হয়েছে। আল কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদে অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া দুটি প্রস্তাবও আইনে পরিণত করা হয়েছে। আইন, বিচার ও নিবিড় নজরদারির জন্য বাংলাদেশে জঙ্গিরা সুবিধা করতে পারছে না। র‌্যাবের মিডিয়া উইং থেকে জানা গেছে, বোমা হামলা ও অন্যান্য ধর্মীয় উগ্রপনার কারণে মামলার বিচারে ২০১২-১৩ সালে ৫৮ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ জনের যাবজ্জীবন এবং ১০ জনের ফাঁসির দ-াদেশ হয়েছে। মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুততা জঙ্গিবাদ নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ২০১২ সালের ১৩ মার্চ দ্রুত বিচার আদালত-৪ জেএমবি নেতা মামুনর রশীদকে মৃত্যুদ- দেয় ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপারের অফিসে বোমা হামলার অভিযোগে। সে ঘটনায় ১৬ জন আহত হয়েছিল। এছাড়া ২১ আগস্ট (২০০৪) গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ঢাকা কোর্ট বেগম জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। মূলত বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়মিত জঙ্গিদের কার্যক্রম নজরদারি করা হচ্ছে। তারা যাতে সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। একইসঙ্গে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে এদেশের। নাশকতা ও সহিংসতা গণতন্ত্রকামী মানুষকে আকৃষ্ট করে না। বরং যারা নাশকতা ও সহিংসতা করবে বা এর পৃষ্ঠপোষকতা দেবে, তাদের প্রতি ক্রমাগত ঘৃণাই প্রকাশ করবে জনগণ। আর জঙ্গিমুক্ত স্বস্তিকর বাংলাদেশই জনগণের প্রত্যাশিত সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৮:১১
false
rg
টি২০ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ বনাম ভারত ম্যাচের স্কোরবোর্ড নিয়ে ভুল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে অনলাইন নিউজপেপার!! গত ২৩ মার্চ ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যেকার টি২০ বিশ্বকাপ ম্যাচের স্কোরবোর্ড নিয়ে আজ কিছু অনলাইন পত্রিকায় ১ রান নিয়ে একটি চরম মিথ্যা সংবাদ ভাইরাল হয়েছে। খুব খেয়াল না করলে সেই ব্যাখ্যায় আপনিও ধরা খেতে পারেন। ক্রিকেটে স্কোরবোর্ডের হিসাবটা হলো ব্যাটসম্যানরা যত রান নিবে, তার সঙ্গে এক্সট্রা রান যোগ হয়ে হবে দলীয় স্কোর। সেই হিসাবে প্রথমে ব্যাট করে ভারতের ব্যাটসম্যানরা নিয়েছিলেন ১৪৩ রান। আর অতিরিক্ত ৩ রান মিলে ভারতের টোটাল স্কোর হলো ১৪৬। এবার চলুন ভারতের ব্যাটসম্যানদের রানের হিসাবটা দেখা যাক। রোহিত শর্মা ১৬ বলে ১৮ রান, শেখর ধাওয়ান ২২ বলে ২৩ রান, বিরাট কোহলি ২৪ বলে ২৪ রান, সুরেশ রায়ানা ২৩ বলে ৩০ রান, হার্ডিক পান্ডিয়া ৭ বলে ১৫ রান, এমএস ধোনি ১২ বলে ১৩ রান, যুবরাজ সিং ৬ বলে ৩ রান, রবীন্দ্র জাদেজা ৮ বলে ১২ রান, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ২ বলে ৫ রান এবং অতিরিক্ত ৩ রান। তাহলে ভারতের স্কোর দাঁড়ায় (১৮+২৩+২৪+৩০+১৫+১৩+৩+১২+৫)+৩ = ১৪৬ রান। অতিরিক্ত ৩ রান এসেছে লেগবাই থেকে ২ রান এবং ওয়াইড থেকে ১ রান। একইভাবে বাংলাদেশের স্কোরটা খেয়াল করুন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সবাই মিলে করেছে ১৪০ রান এবং অতিরিক্ত হিসাবে এসেছে ৫ রান। তাই বাংলাদেশের মোট স্কোর ১৪৫ রান। এবার বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রানের হিসাবটা একটু দেখা যাক। তামিম ইকবাল ৩২ বলে ৩৫ রান, মোহাম্মদ মিথুন ৩ বলে ১ রান, সাব্বির রহমান ১৫ বলে ২৬ রান, শাকিব আল-হাসান ১৫ বলে ২২ রান, মাশরাফি মোর্তাজা ৫ বলে ৬ রান, মাহমুদুল্লাহ ২২ বলে ১৮ রান, সৌম্য সরকার ২১ বলে ২১ রান, মুশফিকুর রহিম ৬ বলে ১১ রান, শুভাগত হোম ১ বলে শূন্য রান। মুস্তাফিজুর রহমান ০ বলে ০ রান। অতিরিক্ত রান ৫। তাহলে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় (৩৫+১+২৬+২২+৬+১৮+২১+১১+০)+৫= ১৪৫। অতিরিক্ত ৫ রানের মধ্যে ৪টি ছিল লেগবাই এবং ১টি ছিল ওয়াইড। যে কারণে ফলাফলে ভারত ১ রানে বিজয়ী। আজকে অনলাইন পত্রিকায় যে বিষয়টি ছড়ানো হয়েছে সেখানে দেখানো হচ্ছে বোলার কত রান দিল আর তার সাথে এক্সট্রা রান যোগ করে কত হলো, সেই হিসাবের একটি ভুল ব্যাখ্যা। চলুন তাহলে আগে বাংলাদেশের বোলাররা কত রান দিয়েছিল একটু দেখা যাক। সেদিন বাংলাদেশের মোট ছয়জন বোলার সেদিন বল করেন। মাশরাফি মুর্তাজা ৪ ওভার বল করে ২২ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। শুভাগত হোম ৩ ওভার বল করে ২৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ১টি উইকেট। আল-আমিন হোসেন ৪ ওভার বল করে ৩৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ২টি উইকেট। মুস্তাফিজুর রহমান ৪ ওভার বল করে ৩৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ২টি উইকেট। শাকিব আল-হাসান ৪ ওভার বল করে ২৩ রান দিয়ে নিয়েছেন ১টি উইকেট। মাহমুদুল্লাহ ১ ওভার বল করে ৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ১ উইকেট। বাংলাদেশের বোলাররা সেদিন ১টি ওয়াইড ও ২টি লেগবাই দিয়েছেন। মানে অতিরিক্ত রান ৩। তাহলে বোলারের রান দেবার হিসাবে ভারতের রান হবার কথা (২২+২৪+৩৭+৩৪+২৩+৪)+৩ = ১৪৭ !!! কিন্তু ভারতের রান আসলে ১৪৬। কারণ, মাশরাফি যে বলটি প্রথম ওভারে ওয়াইড দিয়েছিল, ওয়াইড থেকে সেই রানটি এক্সট্রাতে একবার যোগ হয়েছে। আবার সেই রানটি কিন্তু মাশরাফি'র ব্যক্তিগত রান দেবার সঙ্গে এমনিতেই যোগ আছে। সেই ১ রান তো দলীয় স্কোরের সাথে দুইবার যোগ হবে না। এক্সট্রা হিসাবে ভারতের স্কোরের সাথে একবারই যোগ হবে। তাই বোলার কত রান দিল, সেখান থেকে ওয়াইড বা নো বলের রানটি এক্সট্রাতে যখন যোগ হচ্ছে, সেই রান আবার বোলারের রানের সাথেও যোগ হচ্ছে। ফলে বোলারের রানের সাথে এক্সট্রা রান যোগ করলেই হিসাবটা গুলিয়ে যাবে। এখানে যেটি মনে রাখতে হবে একজন বোলারের বল থেকে যখন লেগবাই রান আসে, সেই রানটি বোলারের সঙ্গে যোগ হয় না। কিন্তু ওয়াইড বা নো বল থেকে যে এক্সট্রা রান আসে সেটি কিন্তু বোলারের ফিগারে যোগ হয়। এখন কেউ যদি বোলারের দেওয়া রানের সেই এক্সট্রা রান দুইবার যোগ দেখায়, তাহলেই ভুলটা হবে। এবার চলুন ভারতীয় বোলাররা কত রান দিল সেটা দেখা যাক। সেদিন বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের মোট ছয়জন বোলার বল করেন। আইসিসি'র স্কোরবোর্ড অনুযায়ী, আশিস নেহারা ৪ ওভার বল করে ২৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ১টি উইকেট। জাসপ্রিট বুমরা ৪ ওভার বল করে ৩২ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ৪ ওভার বল করে ২০ রান দিয়ে নিয়েছেন ২টি উইকেট। রবীন্দ্র জাদেজা ৪ ওভার বল করে ২২ রান দিয়ে নিয়েছেন ২টি উইকেট। হার্ডিক পান্ডিয়া ৩ ওভার বল করে ২৯ রানে নিয়েছেন ২টি উইকেট। আর সুরেশ রায়ানা ১ ওভার বল করে ৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ১টি উইকেট। সেদিন ভারতের বোলাররা মোট ১টি ওয়াইড ও ৪টি লেগবাই রান দিয়েছেন। মানে অতিরিক্ত রান মোট ৫টি। তাহলে ভুল ব্যাখ্যায় বাংলাদেশের রান হবার কথা (২৯+৩২+২০+২২+২৯+৯)+৫= ১৪৬ !! কারণ এখানে সুরেশ রায়ানার দেওয়া ওয়াইড রানটি কিন্তু স্কোরবোর্ডে একবার এক্সট্রা রান হিসাবে কাউন্ট হয়েছে। আবার সুরেশ রায়ানার ১ ওভারে দেওয়া ৯ রানের মধ্যেও সেই ওয়াইড রানটি আছে। যেটি দুইবার যোগ করা যাবে না। কিন্তু আজ অনলাইন পত্রিকায় যে গুজবটি ছড়ানো হয়েছে, সেখানে এই এক্সট্রা রানটি দুইবার যোগ করে বলঅ হচ্ছে বাংলাদেশের স্কোর ১৪৬। সেই হিসাবে তো মাশরাফি'র ওয়াইড বলটা নিয়ে ভারতের স্কোর হবার কথা ১৪৭, তাই নয় কী? তাহলে বোলারের হিসাব কেন আসছে!!!মনে রাখতে হবে যে, লেগবাই এক্সট্রা রানটি বোলারের রানের ফিগারে যোগ হয় না। কিন্তু ওয়াইড বা নো বলে থেকে প্রতিপক্ষ যত রান নিক না কেন, তা বোলারের ফিগারে যোগ হবে। এখন ভুল করে বোলারের দেওয়া রান আর এক্সট্রা রান যোগ করলে কিন্তু টোটাল স্কোরটা কিন্তু ভুল হয়ে যাবে। যারা এখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না, দয়া করে আজকে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের ভেতরকার ম্যাচটি একটু খেয়াল করুন। শুভংকরের ফাঁকিটা বুঝতে পারেবন। সোজা কথায় ভারত বিদ্বেষী একটা হৈচৈ ফেলে দেবার জন্যই এই সহজ ভুলটি দেখিয়ে একটি মহল মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। একটা ম্যাচে কোনো দলের ব্যাটসম্যানরা সবাই মিলে কত রান নিলেন আর এক্সট্রা রান কত হলো, তার টোটাল হলো দলীয় স্কোর। এখন এক্সট্রা রানের মধ্যে ওয়াইড, লেগবাই, বাই, নো, বা পেনাল্টি রান থাকতে পারে। বোলার কত রান দিল তার সঙ্গে সরাসরি এক্সট্রা রান হিসাব করতে গেলেই হিসাবটা গুলিয়ে যাবে। অতএব ক্রিকেট না বুঝে মন্তব্য করতে গেলেই ঝামেলাটা হবে। আমি নিজেও হিসাবটা ভালো মত খেয়াল না করে এই বিষয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, পরে সেটা মুছে দিয়েছি। কারণ এক্সট্রা রানের হিসাবটা বোলারের সাথে কীভাবে যোগ হবে, সেটা নিয়ে আমার কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। অতএব ভারত বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে কারো মনে আর কোনো সন্দেহ থাকাটা উচিত নয়। বাংলাদেশ ১ রানে হেরেছে। স্কোরবোর্ডে কোনো সমস্যা নাই। .......................................৩০ মার্চ ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:০১
false
hm
গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও জাঙ্গিয়া রহস্য এক. আবদুল গোলাম হক নাক কুঁচকে বললেন, "শেষ পর্যন্ত আমাকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম যেতে হবে? য়্যাঁ? তা-ও অন্য লোকের ট্রেনে?" সেক্রেটারি মিস জুলিয়া বললেন (ভাই, বিলিয়নেয়ারের বাড়ির বেড়ালটাকেও আপনি আপনি করে বলতে হয়, আর মিস জুলিয়া তো কুখ্যাত ক্রোড়পতি আবদুল গোলাম হকের বিশেষ প্রিয়পাত্রী আর সেক্রেটারি, তাঁকে আপনি না বলে শেষে লেখালেখির পাট খোয়াই আর কি), "কিন্তু স্যার, আপনার নিরাপত্তার জন্যেই তো ...।" ...[justify] এক. আবদুল গোলাম হক নাক কুঁচকে বললেন, "শেষ পর্যন্ত আমাকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম যেতে হবে? য়্যাঁ? তা-ও পরের ট্রেনে?" সেক্রেটারি মিস জুলিয়া বললেন (ভাই, বিলিয়নেয়ারের বাড়ির বেড়ালটাকেও আপনি আপনি করে বলতে হয়, আর মিস জুলিয়া তো কুখ্যাত ক্রোড়পতি আবদুল গোলাম হকের বিশেষ প্রিয়পাত্রী আর সেক্রেটারি, তাঁকে আপনি না বলে শেষে লেখালেখির পাট খোয়াই আর কি), "কিন্তু স্যার, আপনার নিরাপত্তার জন্যেই তো ...।" আবদুল গোলাম হক গজগজ করতে লাগলেন, "তাই বলে পরের ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাবো ...।" মিস জুলিয়া বললেন, "স্যার, বাংলাদেশে তো সব ট্রেনই পরের ট্রেন। সব ট্রেনই বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্পত্তি। খালি কয়েকটা খেলনা ট্রেন আছে স্যার শিশুপার্ক আর ফ্যান্টাসি কিংডমে ...।" আবদুল গোলাম হক খাপ্পা হয়ে গেলেন। বললেন, "দ্যাখো মিস জুলিয়া, পদে পদে জ্ঞান দিতে এসো না! পয়সা খরচ করলে সব পাওয়া যায়। দাঁড়াও না, ফাঁড়াটা খালি কাটুক আগে, আমি ঢাকা-টু-চিটাগাং ট্রেন সার্ভিসের ব্যবসা শুরু করবো। একটা ট্রেন কিনতে কয় টাকা লাগে?" মিস জুলিয়া তাঁর ল্যাপটপে খুটখুট করে নোট করতে করতে বললেন, "দেখি স্যার ইন্টারনেটে সার্চ করে। ... কিন্তু স্যার, রেলওয়ে কি তাদের লাইনে আপনার ট্রেন চলতে দেবে?" আবদুল গোলাম হক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, "দিবে না মানে? একশোবার দিবে! দিতেই হবে! না দিলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেল চলাচল আমি বন্ধ করে দিবো!" মিস জুলিয়া বললেন, "জ্বি স্যার, তা তো অবশ্যই!" আবদুল গোলাম হক বললেন, "এক্ষুণি খোঁজ নাও, ট্রেন কিনতে কত টাকা লাগে।" মিস জুলিয়া আমতা আমতা করে বললেন, "স্যার, গুগলে তো ট্রেনের দাম পাওয়া যাচ্ছে না, সচলায়তনে জিজ্ঞেস করবো?" আবদুল গোলাম হক বললেন, "যাকে খুশি জিজ্ঞেস করো, আমার দাম জানা হলেই হয়!" মিস জুলিয়া আবার খুট খুট করে টাইপ করতে লাগলেন। আবদুল গোলাম হক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "প্লেনে গেলে কী সমস্যা ছিলো?" মিস জুলিয়া বললেন, "প্লেনে স্যার একটু বিপদ নাকি ছিলো, উনি বললেন।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "কী বিপদ?" মিস জুলিয়া বললেন, "তা তো স্যার আমাকে খুলে বলেননি। আমি জিজ্ঞেস করে ধমক খেলাম খামাকা।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "থাক তাহলে। ঐ ব্যাটাকে খামাকা ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বলেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই একটা কিছু বিপদ ছিলো!" মিস জুলিয়া বললেন, "জ্বি স্যার।" আবদুল গোলাম হক একটু পর আবারও ক্ষেপে গেলেন। "কিন্তু তাই বলে ট্রেনে? বাসে গেলেও তো হতো।" মিস জুলিয়া বললেন, "বাসে নাকি স্যার সবচেয়ে বেশি বিপদ। তাছাড়া আপনাকে তো লোকে চেনে জানে ...।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "আরে, ট্রেনে কোন বিপদ নাই নাকি? টয়লেটের অবস্থা কী খারাপ জানো?" মিস জুলিয়া বললেন, "স্যার শহিদুলকে বলবো, টয়লেটে আপনার জন্য পটি ফিট করে দেবে নাহয় ...?" আবদুল গোলাম হক গোঁ গোঁ করে বললেন, "আচ্ছা, আবারও গেলে দেখা যাবে। আর টয়লেটে যাওয়াও তো এক কষ্ট। একটু আগে যখন বেরোলাম, করিডোরের বাতি গেলো নিভে। অন্ধকারে ধাক্কা খেলাম এক লোকের সাথে ... ওফ ... কী এক জ্বালা! এ কারণেই আমার এই দেশে থাকতে ইচ্ছা করে না। নিরিবিলিতে একটু টয়লেটে যাওয়ার উপায়ও নাই, মানুষ গিজগিজ করে!" মিস জুলিয়া বললেন, "ঠিকাছে স্যার, এরপর দরকার হলে আমি আর শহিদুল আপনার সাথে যাবো টর্চ নিয়ে।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "ঠিকাছে ঠিকাছে! এইবার দ্যাখো ট্রেনের দাম কতো!" মিস জুলিয়া বললেন, "স্যার, সচলায়তনেও পেলাম না।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "কেন, ওরা জানে না? মিস জুলিয়া বললেন, "না স্যার, জানে তো না-ই, উল্টা মশকরা করছে। বলছে, আপনাকে উত্তম জাঝা আর বিপ্লব।" আবদুল গোলাম হক গজগজ করে উঠলেন, "যত্তোসব বখাটের আড্ডা ... আমি পরশুদিনই আবার দুবাই ফিরে যাবো!" দুই. গোয়েন্দা ঝাকানাকা আনমনে ঘড়ি দেখছিলেন একটু পর পর। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার দুঁদে কর্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি, ওরফে কিংকু চৌধারি তাই কৌতূহলভরে প্রশ্ন করলেন, "ব্যাপার কী স্যার? একটু পর পর ঘড়ি দেখছেন কেন?" ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, "ঘড়ি তো একটু পর পরই দেখতে হয়, চলছে কি না! ঘড়ি মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় যদি?" কিংকু চৌধারি থতমত খেয়ে বললেন, "তা ঠিক। কিন্তু সে তো আপনি না দেখলেও বন্ধ হবে।" ঝাকানাকা বললেন, "আরে কী আপদ! তাই তো চোখে চোখে রাখছি! বন্ধ হয়ে গেলেই এটা খুলে ফেলবো।" কিংকু চৌধারি বললেন, "তারপর?" ঝাকানাকা বললেন, "তারপর ব্যাটারি পাল্টে ফেলবো। এই দেখুন, নতুন ব্যাটারি নিয়ে এসেছি সাথে।" পকেট থেকে সেলোফেনের প্যাকেটে ভরা ব্যাটারি দেখালেন তিনি। কিংকু চৌধারি বললেন, "তাহলে এখনই পাল্টে ফেলুন না, বার বার তাহলে আর ঘড়ি পাহারা দিতে হয় না।" ঝাকানাকা বললেন, "কেন, এখনো তো ঘড়ি চলছে, থামেনি তো!" কিংকু চৌধারি বললেন, "তা ঠিক, কিন্তু ...।" ঝাকানাকা বললেন, "কিন্তু আর কিছুই না, আপনাদের আলসেমি! একটা লোক কাজ করে খাচ্ছে, এ ব্যাপারটা আপনারা পুলিশেরা সহ্য করতে পারছেন না। একটা ঘড়িকে দেখেশুনে রাখছি, এই তত্ত্বাবধান আপনার পছন্দ হচ্ছে না। কারণ আপনি পুলিশ। কোন কিছুই দেখেশুনে রাখা আপনাদের পছন্দ না। একটা কিছু হলে পরে তারপর আপনারা নড়েনচড়েন। আমার ঘড়িটা খোয়া গেলেই মনে হয় আপনি খুশি হন?" কিংকু চৌধারি হেঁ হেঁ করে হাসলেন একটু। বললেন, "যা-ই বলুন স্যার, গেলো গল্পে আপনার আন্দাজ মেলেনি একদম! বিষ্ণুমূর্তি স্যার, পাওয়া গেলো টুকরাটাকরা অবস্থায় ...।" ঝাকানাকা বললেন, "বাজে কথা বলবেন না জনাব চৌধারি। ভুল লোককে প্যাঁদানোর কারণেই মূর্তিটার এই হাল। ঠিক লোকগুলিকে প্যাঁদালে মূর্তি সোজা জাদুঘরে ফেরত আসতো অক্ষত অবস্থায়।" কিংকু চৌধারি কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় টিকেটচেকার এসে বললো, "আপনাদের টিকেট প্লিজ।" কিংকু চৌধারি পকেট থেকে টিকেট বার করে চেকারের হাতে দিলেন। চেকার আনমনে সেটার একটা পাতা ছিঁড়ে আরেকটা পাতায় খসখস করে টিকমার্ক দিয়ে টিকেট ফিরিয়ে দিলো। চেকার চলে যাবার পর ঝাকানাকা বললেন, "সময় হয়েছে প্রায়, তৈরি হোন।" কিংকু চৌধারি চমকে গিয়ে বললেন, "কেন কেন?" ঝাকানাকা বললেন, "দেখুন, বদরু খাঁকে আমি প্রায় ছোটবেলা থেকে চিনি। সে-ও সবসময় ধরা খায় তার আলসে স্বভাবের জন্য। অবশ্য আপনারা ওরচেয়েও অলস, তাই আমি আপনাদের তাড়া না দিলে সে ধরা পড়ে না।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কিন্তু সময় হয়েছে বুঝলেন কিভাবে?" ঝাকানাকা বললেন, "এই চেকারকে আপনি চেনেন?" কিংকু চৌধারি বললেন, "না, আমি কিভাবে চিনবো?" ঝাকানাকা বললেন, "আমি চিনি। এর নাম ইদ্রিস আলি। আজকে সকাল থেকে ওকে আমার লোক ফলো করছে। রাতে ট্রেনে ওঠার আগ পর্যন্ত সে নজরবন্দি ছিলো। আমার লোক জানিয়েছে, এই লোক খাঁটি ইদ্রিস আলি।" কিংকু চৌধারি থতমত খেয়ে বললেন, "তো?" ঝাকানাকা বললেন, "কিছুক্ষণের মধ্যেই ইদ্রিস আলি আক্রান্ত হবে বদরু খাঁ-র হাতে। চেকারের ছদ্মবেশ নিয়ে বদরু খাঁ ঢুকে পড়বে হক সাহেবের কামরায়।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কিন্তু হক সাহেবের কামরার আশেপাশে তো সাদাপোশাকের পুলিশ আছে পাহারায়! ওনার নিজস্ব সিকিউরিটির লোক শহিদুলকেও তো দেখলাম ট্রেনে!" ঝাকানাকা বললেন, "আমি কিছুক্ষণ আগে টয়লেটে গিয়েছিলাম, আপনার মনে পড়ে?" কিংকু চৌধারি বললেন, "হুঁ, মনে পড়ে। বলেছিলেন, নাম্বার ওয়ান।" ঝাকানাকা বললেন, "হ্যাঁ। তখন গিয়ে দেখি, টয়লেটের মধ্যে কে বা কাহারা শহিদুলকে পেঁদিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে গেছে। বাধ্য হয়ে আমি জানালা দিয়ে নাম্বার ওয়ান করে এসেছি।" কিংকু চৌধারি ধড়ফড় করে আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন, "বলেন কী? য়্যাঁ? সর্বনাশ ...!" ঝাকানাকা বললেন, "ব্যস্ত হবেন না। মাঝে মাঝে ট্রেনের জানালা দিয়ে নাম্বার ওয়ান করার অভ্যেস থাকা দরকার। আমি তো গেলবছর কাম্পুচিয়ায় প্লেনের জানালা দিয়ে নাম্বার টু পর্যন্ত করেছি ... আর এ তো সামান্য ট্রেন ...।" কিংকু চৌধারি বললেন, "তাই বলে ... শহিদুলকে কে পেটালো?" ঝাকানাকা বললেন, "হয়তো বদরু খাঁ! হয়তো অজ্ঞান পার্টির লোক! হয়তো পিকলু পটল!" কিংকু চৌধারি চমকে গিয়ে বললেন, "পিকলু পটল! তার কথা আপনি জানলেন কী করে?" ঝাকানাকা মুহাহাহাহাহাহা করে হেসে উঠলেন। বললেন, "পিকলু পটলের কথা আমি জানবো না-ই বা কেন? যেভাবে আপনারা তার ছবি, জীবনী, চিঠিপত্র সব ছাপিয়ে দিচ্ছেন আপনাদের ভাড়াটে পত্রিকা আমোদী রসময়-এ! তার কথা ছেলেবুড়ো সকলেই জানে। পিকলু পটলের পোস্টার বিক্রি হচ্ছে দেখলাম আমার মহল্লায়। তাকে নিয়ে ইস্তফা মনোয়ার সুজুকি নাটক পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। তাকে নিয়ে ফালতু কবির প্রোডাকশনস এর সিনেমা তৈরি হচ্ছে, হাতে মারি! ... কোথায় থাকেন আপনি?" কিংকু চৌধারি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, "নাটকটা দেখেছেন?" ঝাকানাকা বললেন, "সময় পাইনি। মিস মিলি দেখেছে বললো, ওর কাছ থেকে পরে সময় করে শুনে নেবেন। কিংবা ইউটিউবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন আছে কি না ...।" কিংকু চৌধারি লজ্জা পেয়ে বললেন, "না, মানে, মিস মিলি তো কিছু বললো না নাটকটা দেখে ...। আর ইউটিউব দেখতে বলছেন? ইন্টারনেটে লগ ইন করা-ই এক দায়, আর ইউটিউব তো কোন ছার ...!" ঝাকানাকা বললেন, "তবে আপনি যে পিকলু পটলের সন্ধান পেয়েই এ ট্রেনে আজ আমার সাথে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চড়েছেন, তা আমি কিভাবে জানলাম, সেটা আপনাকে বলা যাবে না। সেটা আমার গোপন রহস্য, পারলে আপনি সমাধান করুন গিয়ে।" কিংকু চৌধারি মলিন মুখে বললেন, "আর বলবেন না স্যার, হাড্ডিচর্বি এক হয়ে যাচ্ছে এই পিকলু শালার পেছনে ছুটতে গিয়ে! জেল থেকে পালিয়ে শালা আমার জীবনটা বরবাদ করে ছাড়ছে! সেদিন বিশ্বব্যাঙ্কের কান্ট্রি ডিরেক্টরের পকেট মেরেছে স্যার! আমাদের তো চাকরি টেকানো নিয়েই মুশকিল! বড় বড় স্যারেরা ফোন করে ধমকায় রোজ!" ঝাকানাকা হাসলেন। বললেন, "আপনার চাকরি অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিলো। অবশ্য আপনারটা গেলে পুলিশের আরো আরো কর্তারও যাওয়া উচিত। যাকগে, চলুন, আগে আমার শিকার পাকড়াও করি।" কিংকু চৌধারি বললেন, "আগে মানে? স্যার, আপনি কি পিকলু পটলকে ট্রেস করে ফেলেছেন?" ঝাকানাকা চোখ টিপে বললেন, "ঐটা চার নাম্বার চ্যাপ্টারে গিয়ে জানতে পারবেন। এখন আপনার বন্দুকে গুলি ভরে নিন। বদরু খাঁ কিন্তু ভয়াবহ চিজ!" কিংকু চৌধারি মাথা নেড়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল বার করতে গিয়ে থমকে গেলেন, তারপর আর্তনাদ করে বললেন, "স্যার, আমার পিস্তল! আমার পিস্তল হারিয়ে গেছে স্যার!" ঝাকানাকা গোঁফ চোমড়াতে চোমড়াতে বললেন, "হারিয়ে গেছে না পিকপকেট হয়েছে?" কিংকু চৌধারির কালোপানা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেলো। তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, "বটে? কিংকু দারোগার পকেটে হাত! তবেরে শয়তান ...!" ঝাকানাকা চোখ বুঁজে মুহাহাহাহাহাহা করে হাসলেন। বললেন, "তাবৎ এশিয়ার সবচেয়ে ধুরন্ধর পকেটমার পিকলু পটল এই ট্রেনে আপনার সঙ্গী, তা জেনেও আপনি আপনার পিস্তল কী করে পকেটে গুঁজে ঘুরে বেড়ান আমি বুঝি না। আমার মতো শোল্ডার হোলস্টারে রাখতে পারতেন না?" কিংকু চৌধারি ফ্যাকাসে মুখে বললেন, "চিন্তার কিছু নাই স্যার, আমার ব্যাগে আরেকটা পিস্তল আছে।" ঝাকানাকা বললেন, "ঠিকাছে, ওটা বার করে গুলিটুলি ভরে নিন। বদরু খাঁ কিন্তু বাগে পেলে একদম ফুঁড়ে দেবে আপনাকে!" কিংকু চৌধারি কেবিনের তাকের ওপর রাখা ব্যাগ নামিয়ে পিস্তল খুঁজতে লাগলেন। ঝাকানাকা শোল্ডার হোলস্টার থেকে নিজের বিখ্যাত ষোলঘরা রিভলভার "ষোড়শী" বার করে পরীক্ষা করতে লাগলেন। বদরু খাঁর সাথে প্রায়ই তাঁকে গুলিবিনিময় করতে হয়। বদরু খাঁর বারো ছররার দোয়াজদাহাম পিস্তলের সাথে মোকাবেলা করার জন্য জিঞ্জিরা থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে তৈরি করা রিভলভার এই ষোড়শী, চোরডাকাতরা এর চেহারা দেখলেই অনেক সময় ঘাবড়ে গিয়ে বন্দুকপিস্তল ফেলে দেয়। কিংকু চৌধারি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হলেন। "যাক, স্যার, এই পিস্তলটা খোয়া যায়নি। এটাতে সবসময় গুলি ভরাই থাকে ...।" বলতে বলতে তিনি ঝাকানাকার রাগরক্তিম চেহারা দেখে থেমে গেলেন। "কী ব্যাপার স্যার?" ঝাকানাকা তাঁর ষোড়শীকে বাড়িয়ে ধরলেন কিংকু চৌধারির দিকে। কিংকু চৌধারি সেটা হাতে নিয়ে দেখলেন উল্টেপাল্টে। "সে কি স্যার, গুলি ভরেননি কেন এখনো?" ঝাকানাকা বললেন, "দুপুরে আমি নিজের হাতে গুনে গুনে ষোলটা গুলি ভরেছিলাম এটাতে।" কিংকু চৌধারি বললেন, "এখন খালি কেন?" ঝাকানাকা বললেন, "পিকলু পটলের কাজ। রিভলভারটা রেখে গেছে, তবে গুলিগুলো ঝেড়ে দিয়েছে!" তিন. বদরু খাঁ ইদ্রিস আলির হাত পিছমোড়া করে বাঁধতে বাঁধতে বললো, "ইদ্রিস আলি! ... বেশি চোট লাগেনি তো?" ইদ্রিস আলির চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। বদরু খাঁ গিঁট টেনে পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে বললো, "এই যে প্যাঁচটা কষিয়ে তোমাকে বাঁধলাম, এই গিঁট্টুর নাম জাহাজবন্ধন গিঁট্টু। মোগল আমলে এই গিঁট মেরে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ ডকের সাথে বাঁধা হতো। এমনও হয়েছে, যে ঝড়ে দড়ি ছিঁড়ে গেছে, কিন্তু গিঁট অটুট রয়েছে! কিছুদিন আগে একটা ফারসী পুঁথি পাওয়া গিয়েছিলো সাতকানিয়ায়। পুঁথিটা আমিই চুরি করেছিলাম যাদুঘর থেকে। পথে যেতে যেতে বোরড হয়ে যেতে পারি ভেবে যাদুঘরের এক ফারসী-দুরস্ত কর্মকর্তাকেও কিডন্যাপ করেছিলাম সে কারণে। তিনি আমাকে সেদিন সারারাত মাইক্রোবাসে বসে বসে দুলে দুলে পুঁথি পড়ে আর অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন। ... আহ, ইতিহাস! বড় ইন্টারেস্টিং জিনিস। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা পাস করতে পারলে আমি হয়তো ইতিহাসের ছাত্রই হতাম! তো, ঐ পুঁথিতে এই গিঁট্টুর সব রহস্য এঁকে দেয়া ছিলো। ভোরবেলা যখন আমি চিলমারি হয়ে বর্ডার টপকাচ্ছি, তখন ভাবলাম, যাদুঘরের ভদ্রলোকের ওপরই এই গিঁট একটু পরীক্ষা করে যাই না কেন? দিলাম বেচারাকে গিঁট মেরে। আজ থেকে এক বছর আগের ঘটনা। এখনো বেচারা ঐ মাইক্রোবাসেই বাঁধা আছে। কোন শালার ব্যাটা খুলতে পারেনি ঐ দড়ি। ড্রাইভার বাধ্য হয়েছে গাড়িটা সস্তায় ঐ যাদুঘরওয়ালার বউয়ের কাছে বেচে দিতে। বেচারা এখন গ্যারেজে বাস করে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবনটা। ... কী করে ছুটবে, বলো? গিঁট খোলার তরিকা জানি দুনিয়াতে কেবল আমি, আর পুঁথিটা যে গুজরাটির কাছে বিক্রি করেছি, সে।" ইদ্রিস আলি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে, বলে, "স্যার গো, রহম করেন!" বদরু খাঁ এক ভুরু উত্তোলন করে বলে, "স্যার? তুমি আমায় স্যার ডাকলে শেষ পর্যন্ত? যখন তোমাকে ভদ্রভাবে গিয়ে বলেছিলাম, ইদ্রিস আলি, চুপচাপ বোসো, তোমাকে কেবল একটু বেঁধে এখানেই, সীটের কোণায় বসিয়ে থুয়ে যাবো। তখন তো তুমি খুব শালার ব্যাটা বলে গালি দিয়েছিলে আমাকে। তোমার এত বড় সাহস, চড় তুলে আমাকে মারতেও এসেছিলে! তুমি জানো, আমার গায়ে মশা পর্যন্ত ভয়ে বসে না? আর বসলেও যে আমি কিছু করতে ভয় পেতাম, কারণ আমার নিজের গায়ে হাতো তোলার সাহস আমার নিজের পর্যন্ত নেই! এক পল্টন গুর্খা পেয়াদা কুকরি নিয়ে আমাকে সেবার মারতে এসেছিলো বার্মিংহ্যামে, দশটি বছর আগে, আজও নেপালে তাদের গ্রামে সন্ধ্যেবেলা তাদের কান্নার আওয়াজে লোকে টিভি দেখতে পারে না, এমনি পেঁদিয়েছিলাম সবক'টাকে! আর তুমি, ইদ্রিস আলি, একজন দুর্নীতিবাজ, ভুঁড়ো, টেকো টিকিটচেকার, যে কি না গত দশ বছরে একটা বার ডন বৈঠকও ভাঁজোনি, এসেছিলো আমাকে মারতে! ... প্রথমে ভেবেছিলাম, তোমাকে পিটিয়ে ছাতু করে টয়লেটে গুঁজে দেবো। কিন্তু টয়লেটটা সেই কখন থেকে কে যেন ভেতরে ঢুকে জাম করে রেখেছে, বাধ্য হয়ে আমাকে ট্রেনের জানালা দিয়ে নাম্বার টু সারতে হয়েছে, শালা! আর তোমাকে এখানে ফেলে যেতে হচ্ছে এই কেবিনে!" ইদ্রিস আলি কাঁদতে কাঁদতে বললো, "কেন মিছিমিছি গরীবের জান কালি করছেন স্যার? আমি আপনার কী ক্ষতি করলাম? খালি তো টিকেট দেখতে চেয়েছিলাম! ... এই অপরাধে আমাকে এরকম করে মারলেন? এখন আবার জাহাজমারা গিঁট দিয়ে বাঁধলেন? এ-ই কি আপনার ইনসাফ, স্যার?" বদরু খাঁ মুহাহাহাহাহাহাহাহাহা করে হাসে। বলে, "শুধুই কি টিকেট দেখতে চেয়েছিলে? টিকেট দেখাতে পারিনি বলে ঘুষ চাওনি? যখন বললাম, আমি ঘুষ দেই না, তখন বলোনি, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে ঘুষ না দেয়ার অপরাধে? য়্যাঁ? তারপর যখন মিষ্টি করে বললাম এসো বেঁধে তোমার খাটনি ক্ষণিকের জন্যে লাঘব করে দিচ্ছি, তখন পাঞ্জা বাগিয়ে এলে আমাকে থাপড়াতে? এখন বাকিটা জীবন কাটাও এই ট্রেনে, এই কেবিনে। বাংলাদেশ রেলওয়ে তো আর তোমার বউয়ের কাছে এই বগিটা বেচে দেবে না, তোমার কপাল যাদুঘরঅলার চেয়ে খারাপ। কী আর করা, কর্মফল!" ইদ্রিস আলি কাঁদতে কাঁদতে বলে, "স্যার, আপনার বিচার আল্লায় করবে! এমন জুলুম আল্লা সহ্য করবে না! আল্লার আরশ কেঁপে উঠবে আজ আমার মাতমে। ভ্যাঁ ....!" বদরু খাঁ হাসে মুহাহাহাহাহাহা করে। বলে, "তোমার মাতম আল্লার আরশ তো দূরের কথা, এই কেবিন পেরিয়েই বেরোতে দেবো না!" ইদ্রিস আলি বলে, "না না স্যার, দোহাই আপনার, জানে মারবেন না!" বদরু খাঁ বলে, "জানে মারবো কি মারবো না, নির্ভর করছে তোমার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর।" ইদ্রিস আলি বলে, "মানে?" বদরু খাঁ বলে, "মানে হচ্ছে, তোমার একটা মোজা খুলে সেটা আমি তোমার মুখে গুঁজে দেবো! যদি তোমার মোজা পরিষ্কার হয়, তুমি বেঁচে থাকবে, আর যদি আমার মোজার মতো ময়লা হয়, তুমি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মরে যাবে।" ইদ্রিস আলি কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ টলে পড়ে যায় সীটের ওপর। বদরু খাঁ মুহুহুহুহুহু হেসে উঠে এক জোড়া গ্লাভস পরে নেয়, তারপর ইদ্রিস আলির একটা মোজা খুলে নিয়ে তার মুখটা কষে বাঁধে। তারপর ইদ্রিস আলির রেলওয়ের মনোগ্রাম আঁকা কোটটা নিজের শরীরের ওপর চাপায়। "উঁহুহুহু। টাইট হচ্ছে।" বদরু খাঁ একটু হতাশ হয়, তারপর ব্যাগ থেকে আয়না বার করে নিজেকে দেখে। বলে, "নাহ, মানাচ্ছে না। আমাকে শালার শুধু কয়েদিদের ডোরাকাটা পায়জামাতেই যে কেন মানায় বুঝি না! নাহ ... শিগগীরই বুবি রসুলকে কিডন্যাপ করে আমার জন্য কিছু নতুন ফ্যাশনের জামাকাপড় ডিজাইন করাতে হবে!" কেবিনের বাতি নিভিয়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বদরু খাঁ বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে যায় আবদুল গোলাম হকের কেবিনের দিকে। কেবিনের দরজার সামনে কিছুক্ষণ কান পেতে এদিক ওদিক শোনে বদরু খাঁ। চারদিকে শুধু ট্রেনের ঝুকঝুক শব্দ। দরজায় টোকা দেয় সে। "এক্সখিউজ মি, টিকিট প্লিজ!" মিস জুলিয়া কেবিনের দরজা খুলে দেন, "কে? ওহ, চেকার সাহেব?" ভেতর থেকে আবদুল গোলাম হক বলেন, "শহিদুল গাধাটা কোথায় গেলো? বদরু খাঁ কেবিনের ভেতর ঢুকে বিনীত একটা হাসি দেয়, "টিকেট প্লিজ!" মিস জুলিয়া তাঁর হাতব্যাগ থেকে গোলাপি খাম বার করেন একটা, সেটা থেকে বার করেন টিকিট। "এই যে নিন।" বদরু খাঁ মুগ্ধ হয়ে দ্যাখে মিস জুলিয়ার কান্ডকারখানা। তারপর বলে, "বাহ, কী চমৎকার টিকেট! এটা রইলো আমার কাছে। পরে কাজে লাগবে।" মিস জুলিয়া থতমত খেয়ে বলেন, "মানে?" বদরু খাঁ মধুর হাসি হেসে বলে, "মানে খুব সহজ।" এই বলে সে পকেট থেকে বার করে তার দেখতে-ভয়ানক-শুঁকতে-ভয়ানক-শুনলে-পরে-আরো-ভয়ানক দোয়াজদাহাম পিস্তল। মিস জুলিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান সীটের ওপরে। আবদুল গোলাম হক সটান দাঁড়িয়ে যান সীট ছেড়ে, "হচ্ছেটা কী? বলি, হচ্ছেটা কী?" বদরু খাঁ জিভ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে। তারপর সে ফেরে উত্তেজিত আবদুল গোলাম হকের দিকে। "ডাকাতি হচ্ছে, আবার কী? বসুন চুপটি করে। নইলে কিন্তু এই পিস্তল পুরোটা খালি করবো আপনার টাকের ওপর!" আবদুল গোলাম হক মুখ চুন করে বসে পড়েন। বদরু খাঁ মিস জুলিয়ার পাশে বসে পড়ে। "বড়ই সুন্দরী আপনার সেক্রেটারি, কী যেন নাম ... ওহ, হ্যাঁ, মিস জুলিয়া! একেবারে সুচিত্রা সেন! আপনার কপালটা চওড়া হলেও ভালো স্যার! সবারই একটা করে সুন্দরী সেক্রেটারি থাকে। আপনার আছে, মিস জুলিয়া। বদের হাড় গোয়েন্দা ঝাকানাকা বদমাশটারও একজন আছে, মিস মিলি। আমি কত খুঁজলাম একজন সেক্রেটারি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম, বিশ্ববিখ্যাত দস্যুসম্রাট বদরু খাঁ একজন সুন্দরী, তন্বী, চালাকচতুর, চটপটে, পায়খানার পাইপ বেয়ে উঁচু বিল্ডিং আরোহণে পারদর্শী সেক্রেটারি প্রয়োজন। ... আমার শালা কপালটাই খারাপ!" আবদুল গোলাম হক বললেন, "পাও নাই?" বদরু খাঁ বললো, "নাহ! একজন চাক্কা সাবান ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় রানার আপ যোগাযোগ করেছিলো, কিন্তু সে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানে না। এক সুন্দরী কম্পিউটার সায়েন্স পড়ুয়া মেয়ে অ্যাপ্লাই করলো, সে পায়খানার পাইপ তো দূরের কথা, সিঁড়ি বেয়েই উঠতে নারাজ। ... পায়খানার পাইপ বেয়ে যে মহিলা উঠতে পারেন, তিনি ইন্টারনেট ব্যবহারেও বেশ চটপটে ছিলেন, কিন্তু দেখতে স্যার অনেকটা আপনার মতোই, কালো, ভুঁড়ো, টেকো। সেক্রেটারি কি আর অমন হলে চলে, আপনিই বলুন?" মিস জুলিয়া নড়েচড়ে উঠে বসেন। বদরু খাঁ মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, "আপনি কি পায়খানার পাইপ বেয়ে উঁচু বিল্ডিঙে উঠতে পারেন?" মিস জুলিয়া আবারও টলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। বদরু খাঁ মাথা নাড়ে। "নাহ, উনি বড় সুশীলা। ফিটের ব্যারাম আছে। ওনাকে দিয়ে হবে না। কাজের সময় ওনার নাকে চামড়ার জুতা ধরার সময় কই আমার? আবদুল গোলাম হক বললেন, "কী চাও তুমি? রাতদুপুরে ট্রেনের কামরায় ঢুকে আমার সেক্রেটারির দিকে কুনজর দিচ্ছো? জানো, তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারি?" বদরু খাঁ কেবিন কাঁপিয়ে হাসে ঠা ঠা করে, পাক্কা দুই মিনিট। তারপর বহুকষ্টে হাসি সামলে বলে, "সাদা পোশাকের পুলিশের কথা বলছেন তো স্যার? সর্বমোট ছয়জন ছিলো। ইন ফ্যাক্ট, এখনও আছে, মরেনি। তবে ওনাদের অবস্থাও এই সফেদ মিস জুলিয়ার মতোই। ওনারাও ফিটের ব্যারামের শিকার। কারণটাও এই আমিই। মৃদু প্যাঁদাতে হয়েছে সকলকেই। এদের মধ্যে দু'জন আবার কমান্ডো ট্রেনিং পাওয়া, তাদের একটু বেছে প্যাঁদাতে হয়েছে। তবে ভয় নেই, বেঁচে উঠবে সকলেই। কাল সকাল সকাল চিটাগাং মেডিকেলে নিয়ে ভাঙা হাড়গুলি জোড়া দিতে পারলে চাকরিও টিকে যাবে।" আবদুল গোলাম হকের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, "কী চাও তুমি, শয়তান?" মিস জুলিয়া আবারও উঠে বসেন। বদরু খাঁ উঠে দাঁড়ায়, বলে, আমি আসলে আমাদের তিনজনের জন্যেই কিছু উপহার এনেছি। ... নিন ম্যাডাম, ব্যাগটা খুলুন।" হাতের ব্যাগটা মিস জুলিয়ার দিকে এগিয়ে দেয় সে। মিস জুলিয়া ভয়ে ভয়ে ব্যাগটা খোলেন। সেটার ভেতর থেকে বার হয় একটা কালো স্কার্ফ, আর দুইটা লুঙ্গি। "এসব কী?" আবদুল গোলাম হক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। বদরু খাঁ হাসে ঠা ঠা করে। বলে, "স্কার্ফটা হচ্ছে আপনার এই লাস্যময়ী সেক্রেটারি মিস জুলিয়ার জন্য। লুঙ্গিদু'টো আপনার আর আমার জন্যে।" মিস জুলিয়া ফুঁসে উঠে বলেন, "এর মানে কী?" বদরু খাঁ চোখ টিপে বলে, "মানে খুব সোজা। এখন আমি আর জনাব হক দু'জনেই এই লুঙ্গিদু'টি ব্যবহার করে কাপড় পাল্টাবো। আর আপনি যেহেতু এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন না, তাই আপনি এই স্কার্ফটা দিয়ে নিজের চোখ বেঁধে বসে থাকবেন ন্যায়মূর্তির মহিলাটার মতো!" আবদুল গোলাম হক উত্তেজনায় তোৎলা হয় পড়েন, বলেন, "ক্কী ... ক্কী বলছো তুমি? কী-কী-কীসের কাপড় পাল্টাবো?" বদরু খাঁ এবার ঘর কাঁপিয়ে হাসে। বলে, "এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার হক! আপনার জাঙ্গিয়াতে যেসব অমূল্য হীরের টুকরো সেলাই করা আছে, সেই জাঙ্গিয়াটাই আপনি খুলে আমাকে দেবেন। আর আমি সেই জাঙ্গিয়াটা নিজে পরে আমারটা আপনাকে দিয়ে দেবো! মুহাহাহাহাহাহাহাহা! চার. কিংকু চৌধারি একটু অভিমান করেন, বলেন, "চার নাম্বার চ্যাপ্টারে তো এসে পড়েছি, এখন একটু বুঝিয়ে বলুন না!" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "আপনার সাদা পোশাকের লোকজনের হাল দেখলেন?" কিংকু চৌধারি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বলেন, "হ্যাঁ! নির্মমভাবে পেঁদিয়েছে ব্যাটাদের। সবক'টাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।" ঝাকানাকা বলেন, "আপনার পুলিশ সব অজ্ঞান। হক সাহেবের দেহরক্ষী শহিদুলও অজ্ঞান। টিকেট চেকার ইদ্রিস আলি অজ্ঞান। বাকি রইলাম আমি, আপনি, মিস জুলিয়া, হক সাহেব আর বদরু গরুচোরাটা! এখন নাটকে আমরাই পাত্রপাত্রী।" কিংকু চৌধারি বললেন, "পিকলু পটল? পিকলু পটলের কী হবে?" ঝাকানাকা বললেন, "পিকলু পটলকে নিয়ে চিন্তা নেই। ওর একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে।" কিংকু চৌধারি উত্তেজনায় সোজা হয়ে দাঁড়ান। "য়্যাঁ? বলছেন কী স্যার?" ঝাকানাকা বললেন, "পিকলু পটল ছদ্মবেশে খুব ওস্তাদ, জানেন নিশ্চয়ই?" কিংকু চৌধারি বলেন, "তা তো বটেই! কিন্তু হঠাৎ একথা বলছেন কেন স্যার?" ঝাকানাকা হাসেন। কিংকু চৌধারি বলেন, "আপনি কি বলতে চান, আমাদের মধ্যে কেউ একজন আসলে পিকলু পটল, ছদ্মবেশ নিয়ে আছে?" ঝাকানাকা উদাস গলায় বলেন, "হোলেও হোতে পারে! যা-ই হোক, মাথা ঘামানোর দরকার নেই এ নিয়ে। আসুন এখন বদরু খাঁকে সাইজ করা যাক।" ওদিকে কেবিনের ভেতরে চলছে এক করুণ দৃশ্য। মিস জুলিয়া নিজে থেকেই স্কার্ফ দিয়ে নিজের চোখ বেঁধে বসে আছেন। আর আবদুল গোলাম হক দাঁত দিয়ে লুঙ্গি কামড়ে ধরে আছেন, যাকে বলে দাঁতে দাঁত চেপে। বদরু খা হাসিমুখে বলে, "অণুবীক্ষণ লুঙ্গি, বাজারের সেরা লুঙ্গি! সাড়ে আটশো টাকা দিয়ে কেনা স্যার। দেখুন কি মসৃণ কলাপাতারঙা জিনিস। হেভি আরাম পাবেন স্যার পরে।" আবদুল গোলাম হক নিজের জাঙ্গিয়া খুলতে খুলতে বলেন, "গমমমমমমমমমফফফফফফফফফ ...!" বদরু খাঁ বলে, "আহাহা, আগে আন্ডি খুলুন, লুঙ্গির গিঁট বাঁধুন সহি কায়দায়, তারপর নাহয় আমার সুনাম গাইবেন দুয়েক কলি!" আবদুল গোলাম হক এবার লুঙ্গির গিঁট দিতে দিতে বলেন, "তুমি কিভাবে জানলে আমার এই হীরে চালানের কথা?" বদরু খাঁ লাজুক হাসে। বলে, "ফোর্বস এর ড়্যাঙ্কিঙে আমি এশিয়ার সবচেয়ে ভয়ানক দস্যু ছিলাম গত তিন বছর ধরে। তার আগে ছিলাম টানা চারবছর দ্বিতীয় স্থানে। আপনার এসব মামুলি হীরে চালানের কারবার জানা আমার সাগরেদদের কাজ। ... তবে আপনার বোধহয় মনে আছে, কিছুদিন আগে আপনার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিলো ঠমক টিভির পক্ষ থেকে? ঢ্যাঙামতো এক মেয়ে সাংবাদিক গিয়েছিলো ইন্টারভিউ নিতে, যার পেছনে চিমটি কাটতে গিয়ে আপনি আঙুলে ব্যথা পেয়েছিলেন?" আবদুল গোলাম হক চমকে ওঠেন। মিস জুলিয়া বলেন, "মুনিয়া সরফরাজ!" বদরু খাঁ মুগ্ধ হাসি দ্যায় মিস জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে। বলে, "ঠিক! মুনিয়া সরফরাজ সেজেই গিয়েছিলাম বটে! হাঁ স্যার, সিনসিয়ারলি ইয়োরস!" আবদুল গোলাম হক চমকে ওঠেন আরো! "সেদিনই আপনার স্ত্রীকে হিপনোটাইজ করে সব খবর বার করে নিয়েছি। উনি যে আপনার একটা জাঙ্গিয়াতে কয়েকদিন ধরে বেশ কিছু অমূল্য হীরের টুকরো সেলাই করছেন বসে বসে, সে খবর তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আর আপনি কবে চিটাগং যাচ্ছেন সে খবর তো টেলিফোনে একটু আড়ি পাতলেই জানা যায়!" মিস জুলিয়া বলেন, "স্যার, আপনাদের কি জামা পাল্টানো শেষ?" বদরু খাঁ বলে, "তিষ্ঠ, কাজ অতি অল্প অবশিষ্ট!" আবদুল গোলাম হক এবার নিচু হয়ে পা গলিয়ে নিজের আন্ডি বার করে বদরু খাঁর হাতে দিতে গিয়ে থমকে যান। অস্ফূটে বলেন, "এ কী!" বদরু খাঁ হেসে ওঠে ঠা ঠা করে। "গোলাপি? গোলাপি আন্ডি পরেন নাকি আপনি? তা-ও সবুজ ফুল আঁকা? ছি ছি স্যার, আপনার এ-ই রুচি! ... উঁহুহু মিস জুলিয়া, বাঁধন আলগা করে দেখবেন না এই জিনিস, আপনি আবারও ফিট খেতে পারেন! আমার নিজেরই তো গা গুলাচ্ছে দেখে! ... দুঃখ করবেন না স্যার! জাঙ্গিয়ার মতো জাঙ্গিয়া একটা দিচ্ছি আপনাকে। পুরুষের জাঙ্গিয়া হবে মিশকালো! আমারটা অবশ্য কেনার সময় ধূসর ছিলো, তবে এখন বেশ কালচে মেরে গেছে! আমার কপাল খারাপ, নেহায়েত কোটি কোটি টাকার হীরে সেলাই করা আছে এতে, তা না হলে আপনার জাঙ্গিয়া আমি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিতাম!" এমন সময় হাট করে খুলে যায় দরজা, পিস্তল উঁচিয়ে ঘরে ঢোকেন গোয়েন্দা ঝাকানাকা, আর বেত উঁচিয়ে ঢোকেন কিংকু চৌধারি। "খেল খতম, বদরু খাঁ!" ঝাকানাকা গর্জে ওঠেন। "পিস্তল মাটিতে না ফেললে গুনে গুনে তোর পোঁদে ছ'টা গুলি করবো! বদরু খাঁ পিস্তল মাটিতে ফেলে দেয় খটাস করে। কিংকু চৌধারি সযত্নে মিস জুলিয়ার চোখের বাঁধন খুলে দ্যান। "আপনার কোন সমস্যা হয়নি তো মিস?" মিস জুলিয়া টলে পড়ে যান। ঝাকানাকা বলেন, "চৌধারি, যে কোন ভদ্রমহিলাই পুলিশ দেখে ভয় পাবেন। সেন্টু খাবেন না।" বদরু খাঁ হাসে। বলে, "পুলিশ না, তোকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে মিস জুলিয়া!" কিংকু চৌধারি বলেন, "আমার মনে হয় এই গোলাপি জাঙ্গিয়া দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে মিস জুলিয়া!" ঝাকানাকা বলেন, "থাকুন উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে ময়লা একটা মোজা নাকের সামনে ধরলেই হবে।" আবদুল গোলাম হক ফুঁপিয়ে ওঠেন, "আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে!" কিংকু চৌধারি বলেন, "কী সর্বনাশ হলো আবার? জাঙ্গিয়া তো উদ্ধার হলো শেষমেশ!" আবদুল গোলাম হক বলেন, "ওটা আমার জাঙ্গিয়া নয়!" বদরু খাঁ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। "বটে?" জাঙ্গিয়া উঁচিয়ে বলে সে। "নিজের হাতে নিজের গা থেকে খুললেন, এখন পষ্টাপষ্টি অস্বীকার যাচ্ছেন? আপনারা, এই বিলিয়নেয়াররা পারেনও বটে! চোখের চামড়া নেই এক বর্গমিলিমিটারও!" আবদুল গোলাম হক অসহায়রে মতো বলেন, "হ্যাঁ, আমি এটা পরেছিলাম, এটা নিজেই খুলেছি একটু আগে, কিন্তু এটা আমার আন্ডি নয়! আমি সবসময় ফ্রান্সের গোঁগোঁ ব্র্যান্ডের জাঙ্গিয়া পরি। এটা গোঁগোঁ নয়! গোঁগোঁর জাঙ্গিয়াতে গোঁগোঁর লোগো থাকে।" বদরু খাঁর হাসি এবার একটু শুকিয়ে আসে, সে জাঙ্গিয়াটা নেড়েচেড়ে টিপেটুপে দ্যাখে, তারপর আর্তনাদ করে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় এক কোণে। "সাবান! সাবান!" তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সে। "হীরা নাই এইটাতে! কোন কিছুই সেলাই করা নাই! শুধু শুধু এই হোঁৎকাটার আন্ডি ঘাঁটলাম এতক্ষণ! ডেটল! ডেটল!" ঝাকানাকা হাসেন। "হক সাহেব, আপনার জাঙ্গিয়াটা তাহলে কোথায়?" আবদুল গোলাম হক সীটে ধপ করে বসে পড়ে লুঙ্গি দিয়ে নিজের চোখ মোছেন। "জানি না!" ডুকরে ওঠেন তিনি। "সন্ধ্যাবেলা তো নিজের হাতে পরলাম!" ঝাকানাকা বলেন, "আমি বলছি আপনার জাঙ্গিয়ার কী হয়েছে! আপনার জাঙ্গিয়া পিকপকেট হয়েছে!" আবদুল গোলাম হক সটান দাঁড়িয়ে যান। দাঁড়িয়ে যান বিস্মিত কিংকু চৌধারিও। থমকে যায় বদরু খাঁ। "পিকলু পটল, এশিয়া তথা গোটা দুনিয়ার অন্যতম সেরা পকেটমার, বেশ কিছুদিন আগে জেল ভেঙে পালিয়েছে, এ তো বোধহয় জানেন!" ঝাকানাকা বলে যান। "জেল ভেঙে বেরিয়েই সে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মোবাইল, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নরের কলম, বিমানবাহিনীপ্রধানের বিয়ের আংটি আর বিশ্বব্যাঙ্কের কান্ট্রি ডিরেক্টরের মানিব্যাগ হাতিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সকলকে এক দফা কাঁচকলা দেখিয়েছে। আর ছদ্মবেশেও সে যথেষ্ঠ ঘাগু।" আবদুল গোলাম হক বললেন, "আমি সন্ধ্যাবেলা আমার হীরেসেলাই করা জাঙ্গিয়াটা পরলাম! আর আপনি বলছেন ওটা পিকপকেট হয়েছে?" ঝাকানাকা বললেন, "হ্যাঁ! পিকলু পটল, দুনিয়ার সকল পকেটমারের গুরু! আজ যখন আপনি ট্রেনে টয়লেটে যান, তখন মনে পড়ে, করিডোরের বাতি নিভে গিয়েছিলো? অন্ধকারে ধাক্কা খেয়েছিলেন এক লোকের সঙ্গে?" আবদুল গোলাম হক অস্ফুটে বলেন, "হ্যাঁ, কিন্তু ...!" ঝাকানাকা বলেন, "ওটাই ছিলো পিকলু পটল! ঐ সামান্য ধাক্কার সময়েই সে আপনার হীরেবসানো জাঙ্গিয়া খুলে নিয়ে এই গোলাপি সবুজ ফুল আঁকা বিশ্রী বাজেরুচির আন্ডিটা পরিয়ে দিয়েছিলো! জ্বি স্যার ... পিকলুর পক্ষেই কেবল এটা সম্ভব!" বদরু খাঁ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে। ঝাকানাকা বলেন, "কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া অত সোজা নয়। কারণ ঠমক টিভির সাক্ষাৎকারের দিন আমিও ছিলাম ওখানে! বদরু খাঁ, মনে আছে, নাস্তা পরিবেশন করতে এসেছিলো ঢ্যাঙামতো একটা মেয়ে, যার পেছনে চিমটি কাটতে গিয়ে তুমি আঙুলে ব্যথা পেয়েছিলে?" বদরু খাঁ অস্ফূটে বলে, "নূরী ...!" ঝাকানাকা সগর্বে বলেন, "সিনসিয়ারলি ইয়োরস! নূরীর ছদ্মবেশেই গিয়েছিলাম ক্লু এর নুড়ি কুড়াতে! ঠমক টিভির সাংবাদিক সেজে আসা বদরু খাঁ আর রেডিও ব্রডগেজের আরজে গফুর সেজে আসা পিকলু পটল, দু'টোকেই শনাক্ত করেছি সেদিন। আর তাই আজ পিকলুকে এক নজর দেখেই চিনতে অসুবিধে হয়নি!" কিংকু চৌধারি এবার মিস জুলিয়াকে হাত পিছমোড়া করে পাকড়াও করেন। "বুঝেছি স্যার!" গর্জে ওঠেন তিনি। "পিকলু মিস জুলিয়ার ছদ্মবেশ নিয়েছে! আমার চোখকে ব্যাটা ফাঁকি দিতে পারবে না!" ঝাকানাকা বিরক্ত হয়ে বলেন, "খামাকা বেচারিকে ব্যথা দেবেন না চৌধারি। উনি পিকলু পটল নন! পিকলু আজ ট্রেনে উঠেছে হক সাহেবের বডিগার্ড শহিদুলের ছদ্মবেশে!" কিংকু চৌধারি থতমত খেয়ে মিস জুলিয়াকে ছেড়ে দেন। আবদুল গোলাম হক আর্তনাদ করে ওঠেন, "এই জন্যই তো বলি, শহিদুল হারামজাদাটাকে আজ চোখে পড়েনি কেন! আমার সামনেই আসেনি আজ!" ঝাকানাকা বলেন, "এসেছিলো, তবে অন্ধকারে! না এলে আপনার জাঙ্গিয়া চুরি হবে কখন?" হক সাহেব লুঙ্গি দিয়ে অশ্রু মোছেন আবারো। কিংকু চৌধারি বলেন, "কিন্তু স্যার, আপনি এতকিছু জানলেন কিভাবে?" ঝাকানাকা বললেন, "আমার কাজই তো পর্যবেক্ষণ, জনাব চৌধারি! আজ শহিদুল ওরফে পিকলুকে সন্দেহ হবার পর থেকেই ওকে চোখে চোখে রেখেছি। ও যখন করিডোরের বাতিটা খুলছে, তখন আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে। তারপর হক সাহেব বেরোলেন, আমি আমার নাইটভিশন চশমা লাগিয়ে সব কান্ডকারখানা দেখলাম সিনেমার মতো। পিকলু পটলের হাতের কাজ অসাধারণ! এক লহমায় কেমন করে হক সাহেবের প্যান্টের ভেতর থেকে জাঙ্গিয়া একটা খুলে এনে আরেকটা পরিয়ে দিলো, তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না! অসাধারণ!" আবদুল গোলাম হক বললেন, "এখন কথা হচ্ছে, আমার কোটি টাকা দামের জাঙ্গিয়াটা এখন কোথায়?" ঝাকানাকা বললেন, "বলছি দাঁড়ান! তারপর হক সাহেব টয়লেটে গেলেন, পিকলু পটল রওনা দিলো পাশের বগির টয়লেটের দিকে। আমি আর দেরি করলাম না, সোজা গিয়ে শুরু করলাম প্যাঁদানো। আচ্ছামতো পিটিয়ে অজ্ঞান করে হাতপা বেঁধে ওকে রেখে এসেছি ঐ টয়লেটে। আর জাঙ্গিয়াটা আসলে পকেটে রাখার সাহস পাইনি, তাই ওটা আমাকেই পরে থাকতে হয়েছে। তবে জাঙ্গিয়াটা গোঁগোঁ কোম্পানির হলেও আমার ঢোলা হয়েছে অনেক, জুত লাগছে না কিছুতেই।" বদরু খাঁ সটান উঠে দাঁড়ায় এবার। ঝাকানাকা হাসেন। "উহুঁ বদরু, কোন বেচাল দেখলেই তোর ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবো একদম!" আবদুল গোলাম হক কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, "ভাগ্যিস আপনাকে জানিয়ে চট্টগ্রাম রওনা হয়েছিলাম, নাহলে আজ যে কী ক্ষতি হতো! হীরেগুলি তো যেতই, প্রাণটাও যেতো এই ডাকুটার হাতে!" ঝাকানাকা বলেন, "কোন চিন্তা নেই! এই ব্যাটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে তারপর আপনার জাঙ্গিয়া আপনাকে ফেরত দেবো হীরেসহ। বাহ, বদরু দেখি লুঙ্গি এনেছে একটা আমার জন্য! অনুবীক্ষণ লুঙ্গি নাকি, য়্যাঁ?" বদরু খাঁ দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "রোসো! বদরু খাঁকে পুলিশে দেয়া এতো সহজ হলে বদরু পুলিশের কব্জাতেই থাকতো সারাজীবন!" ঝাকানাকা কিছু বলতে যাবেন, চোখের পলকে বদরু কেবিনের চেইন ধরে টান দেয়। ট্রেন ব্রেক কষে হঠাৎ, সবাই টাল হারিয়ে পড়ে যায় এদিক ওদিক, বদরু খাঁ চোখের পলকে ট্রেনের জানালা খুলে বাইরে লাফিয়ে পড়ে। ঝাকানাকা টাল সামলে জানালার দিকে ছুটে যান, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ঝাকানাকা বিড়বিড় করে বলেন, "দাঁড়া, আসছে গল্পে যদি তোকে ইসকুরু টাইট না দিই, আমার নাম ঝাকানাকাই নয়!" কিংকু চৌধারি মিস জুলিয়ার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দ্যান, "মিস, উঠুন! আর ভয় নেই!" আবদুল গোলাম হক খ্যাঁক করে ওঠেন, "খবরদার, আমার সেক্রেটারির গায়ে হাত দেবেন না!" (সমাপ্ত) . . . গোয়েন্দা ঝাকানাকা! | Promote Your Page Too
false
fe
দাম্ভিকতার কাছে নৈতিকতার পরাজয় দাম্ভিকতার কাছে নৈতিকতার পরাজয়ফকির ইলিয়াস==============================ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছেন। হেরে গেছে আমেরিকা! না, ঠিক এমনটি বলা যাবে না। কারণ এ দেশের মানুষ ভোট দিয়েই ট্রাম্পকে ক্ষমতায় এনেছেন। এবারের নির্বাচনে পপুলার ভোট খুব কমই ব্যবধান ছিল হিলারি-ট্রাম্পের মাঝে। কেন এমন হয়েছে? এর বিশ্লেষণ অনেকভাবে করা যায়। মিডিয়া জরিপে হিলারি এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পারলেন না কেন? পারেননি, কারণ তার রাজনীতি মার্কিনিদের পরিচিত। তারা আর পরিচিত মুখ দেখতে চায়নি। হ্যাঁ, হিলারির স্থলে যদি বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক মনোনয়ন পেতেন তাহলে অবস্থা অন্য রকম হতো। না, ডেমোক্র্যাটরা সেই সুযোগ দেননি। এবার যে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় আসবে তা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু একটাই চান্স ছিল, রিপালিকান প্রার্থী একজন নারী নিপীড়ক, লম্পট, অরাজনীতিক, বেফাঁস কথক। তার পরও এ দেশের মানুষ তাকে মেনে নিলেন! কেন মেনে নিলেন?এর অন্যতম কারণ হলো, ‘আই উইল মেক এ চেঞ্জ’ বলে বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাকে আট বছর সুযোগ দিয়েছিল মার্কিনিরা। তিনি খুব বেশি কিছুই পারেননি। বরং আমেরিকানদের হেলথ কেয়ারের বারোটা বাজিয়েছেন। হেলথ ইন্স্যুরেন্স বাড়িয়েছেন। সুবিধা কমিয়েছেন। এ জন্য ক্রমশ ক্ষেপতে শুরু করেছিলেন মার্কিনিরা। ওবামা দরদ দেখিয়েছেন এমন কিছু শক্তির প্রতি যাদের মূলত মোটিভ কী তা বিশ্ববাসীর অজানা। তিনি ‘শরণার্থীদের’ সুবিধা দেয়ার নামে আমেরিকার দরজা খুলে দিতে চেয়েছেন। সিরিয়া থেকে শরণার্থী যারা আসবে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কী তা কি জানে আমেরিকানরা? না জানে না। তাহলে এরা খুনি না দস্যু তা জানবে কে? ট্রাম্প এই ভীতি ঠিকমতোই আমেরিকানদের মনে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তারা বলেছে, আমেরিকা আমাদের। এখানে বহিরাগতদের পোদ্দারি আমরা মেনে নেব না।ট্রাম্প প্রথম ১০০ দিনে যা করবেন তার একটা হিসাব তিনি ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং। এগুলোর মাঝে আছে- যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০ লাখের বেশি অপরাধী ও অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া শুরু করা। যেসব দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে তাদের ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা বাতিল করা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সব ধরনের নির্বাহী আদেশ রদ করা। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের লবিংয়ের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা। কংগ্রেস সদস্যদের দায়িত্বে থাকার মেয়াদ কমিয়ে আনা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতিসংঘের নেয়া প্রকল্পগুলোতে অর্থ দেয়া বন্ধ করা। ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোগত সংস্কারে কাজে লাগানো। চীনকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ দেশ ঘোষণা করা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ এবং নির্মাণ খরচ মেক্সিকো সরকারের কাছ থেকে আদায়ের কথা নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত বলে এসেছেন ট্রাম্প। জয়ের পর এ বিষয়ে নিজের সমর্থকদের পুনরায় আশ^স্ত করেছেন তিনি। তবে কবে নাগাদ বা কিভাবে কাজ শুরু হবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি। কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড’ চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প নতুন করে আলোচনা শুরু করতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ছয়টি ধনী দেশের সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ ট্রাম্পের জয়ের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প ওই চুক্তি ভেস্তে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। যদিও ১২ বছরের পরিকল্পনার পর ইরানের সঙ্গে ছয়টি দেশের একযোগে করা এ চুক্তি থেকে কত দ্রুত ট্রাম্প সরে আসতে পারবেন তা এখনো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং সিনেট রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত বলে ট্রাম্প কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন বলেই আপাতত ধরে নেয়া যায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্প একটা বড় পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন এবং একটি গোষ্ঠী তাকে পাঠিয়েছে। এরা কারা? তাদের স্বার্থ কী? তাও আমরা জেনে যাব আগামী এক বছরের মাঝেই।যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো হিলারি যে খুব যোগ্য প্রার্থী ছিলেন, তা কিন্তু নয়। তিনি ফার্স্ট লেডি ছিলেন। তিনি নিউইয়র্কের সিনেটর ছিলেন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তার মুখ আমেরিকানরা অনেক দেখেছে, আর দেখতে তারা রাজি ছিল না। অন্যদিকে ট্রাম্পের নৈতিকতা কী জঘন্য, তা আর কি বলতে হবে! আমরা দেখেছি- আফ্রিকান-আমেরিকান, স্প্যানিশ ভাষী ল্যাটিনো, নারী, শ্বেতাঙ্গদের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার আশায় ছিলেন হিলারি। এর আগে ২০১২ সালে ওবামা আফ্রো-আমেরিকান ভোটারদের এ অংশ থেকে পেয়েছিলেন ৯৩ শতাংশ ভোট। আর হিলারি এবার পেয়েছেন মাত্র ৮৮ শতাংশ ভোট। একই অবস্থা দেখা গেছে ল্যাটিনো ভোটের ক্ষেত্রেও। ২০১২ সালে ওবামা ল্যাটিনো ভোটের ৭১ শতাংশ পেয়েছিলেন। আর এবার হিলারির ক্ষেত্রে তা নেমে এসেছে ৬৫ শতাংশে। ওবামা ২০১২ সালে নারীদের মধ্য থেকে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আর হিলারির জুটেছে ৫৪ শতাংশ। তরুণদের ভোট হিলারি পেয়েছেন মাত্র ৫৫ শতাংশ। ২০১২ সালে ওবামা পেয়েছিলেন ৬০ শতাংশ ভোট।বন্দুক নিয়ন্ত্রণ, সমকামীদের অধিকার, ইরান ও কিউবার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এমন বেশ কিছু নীতির প্রবল বিরোধী রিপাবলিকানরা। ফলে ব্যালটে সেই বিরোধিতারই স্বাক্ষর রেখে ট্রাম্পের হাতে তুলে দিয়েছেন তারা আমেরিকার ক্ষমতাভার। তিনি আগামী চার বছরের প্রেসিডেন্ট এটাই সত্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকার কথা স্বীকার করে নিলেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, আমরা সবাই এখন তার সাফল্যই কামনা করছি। ট্রাম্পের কাছে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে কাজ করে যাবেন বলেও জানিয়েছেন ওবামা।হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে এক বিবৃতিতে ওবামা বলেছেন, ‘দেশকে একতাবদ্ধ করা এবং নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই এখন ট্রাম্পের সাফল্য কামনায় অবিচল রয়েছি।’ নির্বাচনে হিলারির পরাজয়ে মুষড়েপড়া ডেমোক্র্যাটদেরও হতাশা দূরে সরিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়ে ওবামা তার বক্তব্যে ইতিবাচক সুরে কথা বলেন। শান্তিপূর্ণভাবে ট্রাম্পের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন জানিয়ে ওবামা বলেন, ‘এটি আমাদের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। আগামী কয়েক মাসে আমরা বিশ্বকে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দেখাব।’ইলেকশনের পর দিন ৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। মিছিলকারীরা বলেছে, ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার ভোরে বার্কলে ও ওকল্যান্ড শহরে কয়েকশ মানুষ রাস্তায় নেমে ট্রাম্প ‘আমার প্রেসিডেন্ট নয়’ বলে স্লোগান দেয়। পিটসবার্গ, সিয়াটল, পোর্টল্যান্ড ও ওরেতেও বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। পেনসিলভেনিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন থেকে ওয়াশিংটন স্টেট সব জায়গায় শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। ওরেগনে বিক্ষোভকারীরা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেল চলাচলেও বাধা তৈরি করে। নিউইয়র্কে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল যখন ট্রাম্প টাওয়ারের দিকে যাচ্ছিল তখন আমি ফিফথ অ্যাভিন্যুর ওপর দাঁড়িয়েই মিছিলটি দেখছিলাম।অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, ‘ভাগ হয়ে যাওয়া’ আমেরিকাকে এক করার সময় এখন। যারা অতীতে আমাকে সমর্থন দেননি, তারা সংখ্যায় কম হলেও আমি তাদের কাছে সাহায্য ও দিকনির্দেশনার জন্য যাব। যার মধ্য দিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘আমেরিকাকে আমি সব সময় শীর্ষে রাখব।’ তিনি বলেছেন, ‘হিলারি অনেক দিন ধরে পরিশ্রম করেছেন। দেশের জন্য তার অবদান আমাদের ঋণী করেছে।’আমরা যারা ট্রাম্পকে ভোট দেইনি, এখন তিনিও আমাদের প্রেসিডেন্ট। এটাই আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সত্য আমাদের মানতেই হবে। ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিতে আরো কিছু কাজ হয়েছে। তা হলো- এখানে গোত্রগত, ধর্মগত বিশ্বাসী কিছু মানুষের লম্পঝম্প। তারা হিলারির পক্ষে এমনভাবে খেটেছেন, যেন হিলারি অন্যান্য দেশের রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করবেন। আবারো বলি, ধনকুবের হলে রাজনীতিক না হলেও চলে। তা প্রমাণ করেছেন ট্রাম্প। নীতি সেখানেই মার খেয়েছে। এই ধারা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও অনুসরণ করা হবে, যা বিশ্ব রাজনীতির জন্য শুভ নয়। অবশ্য মার্কিনি জাঁদরেল রাজনীতিকরা ট্রাম্পকে গাইড দিয়ে এগিয়ে নেবেন, সেই ভরসা রেখেই এগোচ্ছেন এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ।--------------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৪
false
ij
ইতিহাসের পাঠ_ প্রাচীন বাংলা (২য় পর্ব) কারা আদিঅস্ত্রাল? প্রথম পর্বের ব্যাখ্যাবিশ্লেষন। স্বীকার করছি, প্রাগৈতিহাসিক বাংলায় আদিম মানুষ এসেছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে-এরকম একটি একপেষে মন্তব্য করা আমার ঠিক হয়নি। সৌভাগ্য এই সীমাবদ্ধ মন্তব্য শুধরে নেওয়া যায় ব্লগ-এ। কিন্তু, আমার ওমন মনে হল কেন যে প্রাগৈতিহাসিক বাংলায় আদিম মানুষ এসেছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে? খুলে বলছি। প্রাগৈতিহাসিক বাংলা সম্বন্ধে আমার অনুসন্ধানের শুরু প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের একটা মন্তব্য পড়ে। নীহাররঞ্জন রায় সেই বিখ্যাত বইটায় লিখেছেন, “নিুবর্ণের বাঙালির এবং বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ভেতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নরতত্ত্ববিদেরা তাহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অষ্ট্রেলীয় বা proto-Austroloid (বাঙালির ইতিহাস । পৃষ্ঠা,৩১ ) এই আদি-অষ্ট্রেলীয় শব্দটায় আমি সচেতন হয়ে উঠি। এই আদি-অষ্ট্রেলীয় শব্দটির অন্য একটি প্রতিশব্দ আগেই জানা ছিল- আদিঅস্ত্রাল। (দ্র. কাবেদুল ইসলাম। প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী। উত্তরণ। ২০০৪; পৃষ্ঠা, ১৬৭) তো কারা এই আদি-অষ্ট্রেলিয়? ভাবতে থাকি। আদিঅস্ত্রালরা প্রাগৈতিহাসিক অস্ট্রেলিয়ার কোনও আদিম আদিবাসী কি? উইকিপিডিয়ায়Prehistory of Australia সার্চ করে এই কথাগুলি পাওয়া গেল: The minimum widely-accepted timeframe for the arrival of humans in Australia is placed at least 40,000 years ago.অস্ট্রেলিয়া তো দ্বীপ। তো প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ওখানে গেল কি করে? অত বছর আগে? প্লেনে নিশ্চয়ই যায়নি? নৌযোগে? তাই হবে। arrival শব্দটা খেয়াল করুন। তো প্রাচীন অস্ট্রেলিয়ায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষ কোত্থেকে গেল? আমি ক্রমেই কৌতূহলী হয়ে উঠতে থাকি। উইকিপিডিয়ায় Human evolution সার্চ করে পেলাম: .... .... According to the Out of Africa Model, developed by Chris Stringer and Peter Andrews, modern H. sapiens evolved in Africa 200,000 years ago. Homo sapiens began migrating from Africa between 70,000 – 50,000 years ago and would eventually replace existing hominid species in Europe and Asia. আমি তাই ইতিহাসের পাঠ: প্রাচীন বাংলা (প্রথম পর্ব) লিখেছি- আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে একদল মানুষ পূর্বআফ্রিকা থেকে নৌপথে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল ... ভেবেছিলাম, অষ্ট্রেলিয়া দ্বীপ যেহেতু। তাদের পক্ষে উড়োজাহাজে আসা তো সম্ভব ছিল না। সূর্যর লেখা পড়ে এখন জানলাম, আধুনিক ঐতিহাসিকগন আদিম মানুষের পূর্বআফ্রিকা থেকে নৌপথে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছেন। তো?The minimum widely-accepted timeframe for the arrival of humans in Australia is placed at least 40,000 years ago.অস্ট্রেলিয়া তো দ্বীপ। তো প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ওখানে গেল কি করে? অত বছর আগে? তবুও প্রশ্নটা রয়ে যায়। যা হোক। আর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে বাংলার সঙ্গে অস্ট্রেলিয় আদিবাসীদের সম্পর্ক ঘনিষ্ট। তিনি লিখেছেন, নিুবর্ণের বাঙালির এবং বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ভেতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নরতত্ত্ববিদেরা তাহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অষ্ট্রেলীয় ... ভ্রান্তির উৎস এখানেই। আসলে, আদিম মানুষ উপমহাদেশজুড়ে আগে থেকেই ছিল। কেননা, Homo sapiens began migrating from Africa between 70,000 – 50,000 years ago and would eventually replace existing hominid species in Europe and Asia. তা হলে? তা হলে তো আপাতত আউট অভ আফ্রিকা থিউরিটা মেনে নিতেই হয়। উপরোন্ত, The Out of Africa Model has gained support by recent research using mitochondrial DNA (mtDNA). After analysing genealogy trees constructed using 133 types of mtDNA, they concluded that all were descended from a woman from Africa, dubbed Mitochondrial Eve.(উইকিপিডিয়া) আর ওই ‘বোঙ্গা’ দেবতার ব্যাপারটা? কাবেদুল ইসলাম লিখেছেন: “বঙ্গ নামটির উৎপত্তির সঠিক কোনো ইতিহাস জানা যায় না। সম্ভবত, ‘অস্ট্রিক ভাষার দেবতাবোধ ক বোঙ্গা শব্দ থেকে ...বঙ্গ শব্দটির উদ্ভবের কথা অনুমান করা যেতে পারে।” ( প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী। উত্তরণ। ২০০৪; পৃষ্ঠা, ১৭) আদিঅস্ত্রালদের ভাষাই তো অস্ট্রিক। কাজেই আমি কাবেদুল ইসলামের কথার ওপর ভিত্তি করে প্রথম পর্বে লিখেছি- ...একটা দল আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল- যাদের আমরা বলি প্রাচীন বাংলা। তারা কথা বলত অট্রিক ভাষায়। তারা দেখতে ছিল কালো, বেঁটে। চুল কোঁকড়া। ওই ভাষী কালো বেটে মানুষগুলি প্রাচীন বাংলার উপকূলে নামল। ...ওদের দেবতার নাম ছিল বোঙ্গা। অনেকের অনুমান এই বোঙ্গা শব্দ থেকেই বঙ্গ শব্দটির উদ্ভব। আমি লিখেছি-...ওই অস্ট্রিকভাষী কালো বেটে মানুষগুলি প্রাচীন বাংলার উপকূলে নামল। ...ওরা বাংলায় এসে কি করল? কি আর । বসবাস করতে লাগল। অনুমান করি, তখন প্রাচীন বাংলা ছিল জল ও জঙ্গলে পরিপূর্ন। তারা অরণ্যেই বসবাস করতে লাগল। ফলমূল কুড়িয়ে খেত, পশু-পাখি শিকার করত। আর উপাসনা করত। অশোক দেব যথার্থই লিখেছেন ... মানুষ যখন ফনমূল কুড়য়িে খাচ্ছে তার আগইে তাহলে তারা এত র্দীঘ জলপথ পাড়ি দবোর মত নৌ বদ্যিা আয়ত্ত্ব করে ফলে,ে আর্শ্চয। তাই তো? আমাও প্রশ্ন এই ... তবে যে তখনও চাষবাদ শুরু করে তার বাড়তি থেকে নগর গড়ে ওঠেনি-তাও ঠিক। নগর গড়ে উঠেছিল আরও পরে। যিশুর জন্মের মাত্র ৬ ৭শ বছর আগে। পুন্ড্রনগর। সে উপাখ্যান পরে লিখব। আর আহমাদ মুজতবা কামাল রেফারেন্স-এর কথা বলেছেন । কথাটা তখন মনে হয়নি বলে খারাপ লাগছে। আসলে রেফারেন্স দিলেও লাভ নেই। বিষয়টি ইতিহাস। আমাদের ৩৬ বছরের ইতিহাসই দেখুন না- কত তার পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যাবয়ান। আর আমি তো লিখছি প্রাগৈতিহাসিক বাংলা! আসলে কিছুই প্রমান করা যাবে না আরও ধোঁওয়া সৃষ্টি করা ছাড়া। তবু ভাবনার একটি কাবিক্য কাঠামো নির্মান করতে ভালো লাগে। ... তাদেরই একটা দল আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল- যাদের আমরা বলি প্রাচীন বাংলা। তারা কথা বলত অট্রিক ভাষায়। তারা দেখতে ছিল কালো, বেঁটে। চুল কোঁকড়া। ওই ভাষী কালো বেটে মানুষগুলি প্রাচীন বাংলার উপকূলে নামল। আর লিখতে ভালো লাগে- প্রাচীন বাংলার অরণ্যে ভিজছে আদিঅস্ত্রাল নিষাদ শিশু ... পাতার ফাঁকে দেখছে ওকে- শান্তশিষ্ট অবোধ পশু ... একেই কি quasi-history বলে? সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২২
false
rg
পালাকারের 'কালবেলা' নাটকে আবারো মুগ্ধ হাউজফুল দর্শক!!! গত শুক্রবার (২০ মে ২০১৬) শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে পালাকার মঞ্চায়ন করল বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর নাটক 'কালবেলা'। ১৯৬২ সালে ড্রামা সার্কেল 'কালবেলা' নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন করেছিল। ড্রামা সার্কেল এবং নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের অংশ হিসাবে দীর্ঘদিন পরে 'কালবেলা' নাটকটি নতুন করে মঞ্চে এনেছে পালাকার। শুক্রবার এটি ছিল পালাকারের প্রযোজনায় 'কালবেলা'র দশম শো। নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর 'কালবেলা' একটি অ্যাবসার্ড বা অধিবাস্তববাদি নাটক। প্রচলিত জীবনের অর্থহীনতা বা একঘেয়েমিকে পুঁজি করে জাদুবাস্তবতার কৌশল নিয়ে সেই অনর্থক জীবনের অন্তরালের অর্থময় জীবনকে উপলব্ধি করার দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়াকে নানান বর্ণিল বাক্য, সংলাপ, কাহিনী, দৃশ্য ও বিচিত্র ভাবের সংশ্রব আসলে অ্যাবসার্ড নাটক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপ তথা গোটা বিশ্ব জুড়ে অ্যাবসার্ড নাটক তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। ঊনিশ শতকের দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে মানুষ আসলে জীবনের জন্য কী কী শিখল? সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চিন্তাশীল কবি, লেখক, নাট্যকারগণ একসময় দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার উন্মোচনে অ্যাবসার্ড বা অধিবাস্তবাদের দিকে ঝুকে পড়েন। জাদুবাস্তবতা দিয়ে তখন জীবনের অর্থহীন অনর্থক জীবনকে কিছুটা অর্থময় করার প্রয়াস থেকেই অ্যাবসার্ড লেখনির উপলব্ধি। নাট্যকার সাঈদ আহমদও নাট্যভাবনায় সেই আলোড়নে অালোড়িত হয়েছিলেন।মানুষের জীবনে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরম্পরা সংঘটিত নানান কিসিমের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ, রক্তপাত, অশ্রু, অশান্তিকে জীবনের শেষলগ্নে গিয়ে মনে হতে পারে এসব নিছক অর্থহীন ছিল। অথচ জীবনে ফেলে আসা সেসব অর্থহীন সময়কে আর নতুন করে ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই। মানুষ তখন পিছনের কলংকময় জীবনকে অর্থহীন মনে করে এক অশান্তির ঘোরে প্রলুব্ধ হয়। তখন মানুষ নিজেকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, রাষ্ট্রকে নিয়ে, মানুষের পরম্পরা সম্পর্কের টানাপোড়ন নিয়ে বড়োই আফসোস করে। আহা জীবন যদি হাসি, ঠাট্টা, প্রেম, বন্ধুত্ব, আনন্দ আর মুখরতায় ভরিয়ে দেওয়া যেত! কত না ভালো হতো! মানুষের সেই অন্তর্জগতের উপলব্ধি নিজের বিবেকের দংশনের কাছেই নিজেকে তখন এক বোধহীন অসার অতৃপ্তি বাসনার ঘেরাটপে অটোমেটিক বন্দি করে। কিন্তু তখন আর বিলাপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। তখন এই নিরন্তর আত্ম জিঘাংসার পরিসমাপ্তিকে কিছুটা অর্থপূর্ণ করার এক ঘোরলাগা নেশায় পায় মানুষকে। মানুষ তখন নিজেই নিজের জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরম আত্মউপলব্ধি করার চেষ্টা করে। মানুষের এই সহজাত স্বরূপ উপলব্ধি করার প্রত্যয়কেই তখন দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ত্রিয়ায় জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে অ্যাবসার্ডিটির প্রতি প্রলুব্ধ করে। মানুষ তখন সত্য, প্রেম, সুন্দর, সহজ, সরল এক পরম জীবনের অনুসন্ধান চালায়। নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর 'কালবেলা' নাটকের কাহিনী, বিন্যাস, ঘটনা, পাত্রপাত্রী, স্থান, কাল, দৃশ্য, বাক্য, সংলাপ, আর জীবনের নানান বৈচিত্র্যের ভেতরে মানুষের সেই হারানো অনর্থক জীবনকে হাসি, ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, কৌতুক আর ভাবরসে এক অর্থময় জীবনকে দেখানোর প্রয়াস সুস্পষ্ট। জীবনের পরম সত্যকে আবিস্কারের এক নান্দনিক সৃষ্টি সাঈদ আহমদ-এর নাটক 'কালবেলা'। 'কালবেলা' নাটকের গল্প বা কাহিনী মূলত চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত এক দ্বীপকে ঘিরে। এই দ্বীপ আসলে গোটা বিশ্বজগতেরই রূপক বা প্রতীক স্বরূপ। সেখানে নানান শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে একদল নৃগোষ্ঠী মানুষেরও বসবাস। দ্বীপবাসীর প্রচলিত জীবনের দৈনন্দিন জীবনাচার, রীতি-নীতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বন অনেকটা কুসংস্কারপূর্ণ। নানান কিসিমের নিছক ও অলীক জিনিসের প্রতি দ্বীপবাসীর প্রগাঢ় বিশ্বাস। সেই প্রচল বিশ্বাসে ঘাই মারা বা ফাটল ধরানো কার সাধ্য? উপেং পুরোহীত গোটা দ্বীপবাসীকে নানান কিসিমের অলীক জাদুমন্ত্রে একটা প্রাচীন অলীক বিশ্বাসের প্রতি সবাইকে হেমিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মত বশ মানিয়ে রাখেন। পুরোহীতের দেখানো সেই রহস্যময় কারসাজি, ছলনা, মূর্ছনাকে দ্বীপবাসী অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। আর উপেং পুরোহীতের সেই ছলনার ভিকটিম হয় এক যৈবতী উর্বশি নারী নিবেদিকা। নিবেদিকাকে দিয়ে উপেং পুরোহিত দ্বীপবাসীর অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দেবার মিথ্যা ছলনা করান। অনেকটা স্বৈরাচারী কায়দায় উপেং পুরোহীতের সকল ভুংভাং, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র, তন্ত্র, তর্জন, গর্জন, শাসনকে দ্বীপবাসী অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। গোটা দ্বীপবাসী যেন উপেং পুরোহীতের নির্দেশিত এক অমোঘ দৈবক্রিয়ার কাছে বন্দি। যৈবতী উর্বশি নিবেদিকা নারীর মাধ্যমে দ্বীপবাসী একসময় জানতে পারে, সাতটা বাজলেই এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড় সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে নশ্বর এই পৃথিবীকে সাতটা বাজলেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। দ্বীপবাসীর অনর্থক এই জীবন তখন এক চরম ধ্বংসের মুখোমুখি। সাতটা বাজলেই যেহেতু নশ্বর এই জীবনের ধ্বংস অনিবার্য, তাই দ্বীপবাসী নিজেদের জীবনের অপূর্ণ সাধ, আহ্বলাদ, ইচ্ছা, আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ চাপমুক্তভাবে নতুন করে উপলব্দি করার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের পরম্পরা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, যুদ্ধ, সংঘর্ষকে পাশকাটিয়ে জীবনের শেষলগ্নে শৈশবের ফেলে আসা জীবনের নানান আনন্দ, খেলা, ঘটনা ও স্মৃতিকে পুঁজি করে নিজেদর মধ্যে নতুন এক বন্ধুত্বকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে শেষ সময়টুকু কাটানোর ইচ্ছায় মত্ত হয়। অর্থহীন জীবনের ব্যর্থতা ও গ্লানিকে আর দ্বন্দ্বময় না রেখে তারা তখণ বরং দ্বন্দ্বহীন এক আমৃত্যু অর্থময় জীবনের অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে যায়। স্মৃতি হাতড়ে তারা শৈশবের আনন্দময় নানান খেলায় মেতে ওঠে। মোড়লের নেতৃত্বে তার দুই বন্ধু আহম্মদ আর মুনীর ছেলেবেলার সেই প্রিয় ডাঙ্গুলী খেলায় নিজেদের তখন ব্যস্ত রাখে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই খেলা বুড়ো বয়সে খেলতে গিয়েও তারা আবার স্মৃতির চোরাগলি ধরে পুরানা কলহে নিমজ্জিত হয়। ঘটনাচক্রে তখন জেল থেকে পালানো দাগী কয়েদির সঙ্গে দেখা হয় সহজ, সরল জীবন কাটানো শিসদার বংশীধারীর। নির্জন পথে মুখোমুখি তখন একসময়ের দুর্ধর্ষ গুণ্ডা জেল থেকে পালানো দাগী কয়েদি আর ঠিক এর বিপরীতধর্মী সহজ, সরল, স্বাভাবিক সুন্দর, আনন্দময় জীবন কাটানো শিসদার বংশীধারী। কথায় কথায় পরিচয়ের একপর্বে শিসদার বংশীধারী দাগী কয়েদির কাছে গান শোনার বায়না ধরেন। দাগী কয়েদি তখন সহজ স্বীকারোক্তি করেন যে তিনি তো গান গাইতে জানেন না। কিন্তু পরক্ষণেই তার উপলব্ধিতে আসে এক অমোঘ সত্য। জীবনে এই যে এত দ্বীধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, যুদ্ধ, অনাচার, অবিচার, এর কী অর্থ আছে আর! সাতটা বাজলেই তো এই জীবন শেষ। তবু জীবনের পরম লগ্নে যখন এমন একজন সহজ, সরল বন্ধুকে পথে পেলেন, যে করেই হোক তাকে গান শোনানোর ব্যবস্থা করার তাগিদ অনুভব করেন দাগী কয়েদি। তাতে যদি জীবনে সংঘটিত যত পাপ কিছুটা যদি রোহিত হয়, এমন এক প্রবঞ্চনায় আত্মজিজ্ঞাসার কাছে সমর্পিত হয় দাগী কয়েদি। এই সময় তার কানে ভেসে আসে এক অপূর্ব মনোলোভা নারী কণ্ঠের গান। সেদিকে খুঁজতে গিয়ে দাগী কয়েদি পায় যৈবতী উর্বশি নিবেদিকাকে। নিবেদিকাকে দিয়ে বন্ধুকে গান শোনানোর ইচ্ছেটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দাগী কয়েদি উপেং পুরোহীতের কড়া ধমকের মুখোমুখি হয়। খবরদার, ওকে ওভাবে নিবেদন করবি না। এমন চেষ্টা চালালে তুই ধ্বংস হয়ে যাবি এমন অভিশাপ দেয় পুরোহীত। অগত্যা কে গান শোনাতে পারে এমন কারো খোঁজে দ্বীপময় ঘুরতে যায় দাগী কয়েদি। ওদিকে মোড়লের নেতৃত্বে সবাই ডাঙ্গুলী খেলায় মত্ত। কিন্তু নিবেদিকার রহস্যময় আচরণ আর পাগলামিতে দ্বীপবাসী আরো ভীত হয়ে পড়ে। উপেং পুরোহীতের নিবেদিকাকে দিয়ে দেখানো ভুংভাং, অলীক জাদুমন্ত্রকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসে নবাগত শিসদার বংশীধারী। সামান্য এক বাঁশির ফুৎকার দিয়ে গোটা দ্বীপবাসীর সামনেই শিসদার বংশীধারী প্রবল শক্তিধর উপেং পুরোহীতকে অপমান করে বেকুপ করে দেয়। মাত্র এক বাঁশির ফুতে উপেং পুরোহীতের এতদিনের আত্মগড়িমা, ছলনা, কারসাজি নিমিষেই কর্পূরের মত উড়ে যায়। গোটা দ্বীপবাসী তখন শিসদার বংশীধারীর নামে জয়ধ্বনী দেয়। আর উপেং পুরোহীতকে ভর্ৎসনা করে। সেই সব ঘটনার জালে মোড়লের নেতৃত্বে এতক্ষণ যারা ডাঙ্গুলী খেলছিলেন, তারা তাদের ছোট্ট কাঠের কাঠি হারিয়ে ফেলে। মোড়ল সবাইকে হারানো কাঠি খোঁজার অনুরোধ করেন। শিসদার বংশীধারীও কাঠি খোঁজার কাজে খুব সহজেই যোগ দেয়। অগত্য উপেং পুরোহীতও দ্বীপরাষ্ট্রে বসবাসের আশায় সবার সঙ্গে কাঠি খোঁজায় যোগ দেয়। কোনো এক দ্বীপবাসী যখন সেই কাঠি খুঁজে পায়, নিবেদিকার মাধ্যমে সেই কাঠি হাতে পেয়ে মোড়ল মাটিতে একটি বিন্দু নির্দেশ করে ঘোষণা করেন, এখানেই এই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। অন্যদের তখন মোড়লের ঘোষিত কথায় সন্দেহ হয়। এক এক করে তারা একজন অপরের কাছ থেকে কাঠি কেড়ে নিয়ে নিজেদের পছন্দমত জায়গায় কাঠি পুতে সেই বিন্দুকে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু দাবি করতে থাকে। আবারো তাদের মধ্যে চিরায়ত কলহ, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে। ঘটনা পরম্পরায় দাগী কয়েদি খুঁজে পায় এক পাহাড়ি ঢুলিকে। ঢুলিকে সঙ্গে নিয়ে সে আসে বন্ধু শিসদার বংশীধারীকে গান শোনাতে। ঢুলির বাজানো তুমুল বাদ্য আর গানের মাঝে শিসদার বংশীধারী জীবনের এক পরম সত্যকে উচ্চারণ করেন। সহজ, সরল দ্বন্দ্বহীন জীবনই অর্থময়, বাকি সব মিথ্যা, অলীক। মানুষের মাঝে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, যুদ্ধ পরম জীবনের কাছে অর্থহীন। গোটা দ্বীপবাসী তখন উপেং পুরোহীতের দেখানো অলীক আজগুবিকে প্রত্যাখ্যান করে শিসদার বংশীধারীর উচ্চারিত নতুন সহজ, সরল পরম আনন্দময় জীবনের দিকে বিনাবাক্য ব্যয়ে ঝুঁকে যায়। এখানেই 'কালবেলা' নাটকটি জীবনের পরম সুন্দরের উপলব্ধির কথা দর্শক শ্রোতাদের নাটকীয় রহস্যময়তা ও জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে মর্মবাণী শোনায়। অ্যাবসার্ড নাটকে যে চরম জাদুবাস্তবতা, বিচিত্র ঘটনা পরম্পরা, দৃশ্য, বাক্য, বর্ণ ও সংলাপে এক ঘোরলাগা রহস্য সৃষ্টি করে, তা যেন শেষপর্যন্ত জীবনের পরম সত্যকে অনুসন্ধান করার দিকে গোটা মানবজাতিকেই প্রলুব্ধ করে। সাঈদ আহমদ 'কালবেলা' নাটকে যে দ্বীপবাসীর গল্প শোনান, তা যেন গোটা বিশ্বজগতেরই প্রতিনিধিত্ব করে মানুষকে অনর্থক জীবনের পেছনে না ছুটে অর্থময় জীবন গড়ার প্রতি অবগাহনের আহবান জানায়। পালাকারের 'কালবেলা' নাটকের দশম শো দেখার পর আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, নাটকটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী এই জগতসংসারের অন্তসারের আড়ালের কথাকেই ফুটিয়ে তোলে। শিসদার বংশীধারী চরিত্রে নূরী শাহ যদিও আমাকে কিছুটা হতাশ করেছেন। তার স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতা ও চৌকশ নাটকে কিছুটা যেন অনুপস্থিত ছিল। যা গোটা নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা ঘাটতি মনে হয়েছে। উপেং পুরোহীতের চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল চমৎকার অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে তার ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রপড়া ও নতুন স্টাইলে হাঁটার ব্যাপারটি চরিত্র হিসাবে কিছুটা ঘোর লাগায়। ঝোলা থেকে ছলনা ছোড়ার কৌশলটি দারুন। তবুও কোথায় যেন কিছুটা ছন্দপতন ছিল, সেটা কী সংলাপ না মুভমেন্ট না অন্যদের চৌকশ অভিনয়ের ঘাটতি থেকে উত্থিত কিনা বোঝা মুশকিল!নিবেদিকা চরিত্রে ফারহানা মিঠু দারুন অভিনয় করেছেন। কিন্তু মুকুলের মত তারও কোথায় যেন একটা ঘাটতি অনুভব করেছি। মোড়ল চরিত্রে শাহরিয়ার খান রিন্টু ও তার দুই বন্ধু'র চরিত্রে কাজী ফয়সল ও নিপুন আহমেদের অভিনয়েও সেই জৌলুসটা ধরা পড়েনি! বরং স্বল্প সময়ের উপস্থিতি হলেও ঢুলি চরিত্রে অজয় দাশ বাজি মাত করেছেন। দাগী চরিত্রে সেলিম হায়দারের মধ্যে গতি জড়তার অভাব ছিল। পার্ষদ ও দ্বীপবাসীদের ভেতর থেকে সেই জড়তা ও ছন্দহীনতার আগমন কিনা সেটা বলা মুশকিল!'কালবেলা'র মঞ্চ পরিকল্পনা যতটা না আমাকে মুগ্ধ করেছে, আলোকসজ্জা ঠিক যেন ততটা হতাশ করেছে। মঞ্চের আকার বা কাঠামোকে আমার কখনো মনে হয়েছে এটা বুঝিবা স্রেফ একটা মাকড়শার জাল! যেখানে সমাজের হাজারো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, হাসি, ঠাট্টা, প্রেম, বন্ধুত্ব যেভাবে জালের মত পরম্পরা জড়িত, এই মাকড়শার বাসা বুঝিবা সেই রূপক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আবার কখনো মনে হয়েছে এটা বুঝি পৃথিবীর ভূগোলের সেই গোলক। কল্পিত দ্বীপের আড়ালে যা গোটা বিশ্বকেই উন্মোচন করেছে। তবে নাটকের কাহিনী ও জনগোষ্ঠীর জীবনাচারের সঙ্গে মিলিয়ে যদি সেখানে কোনো কাঠের নৌকার উপস্থিতি থাকতো, বা কিছু মাছ ধরা জালের দৃশ্যমানতা থাকতো তাহলে হয়তো তা আরো জীবনঘনিষ্ঠ হতে পারতো! কিংবা দু'একটা বাবুই পাখির বাসা যদি কোথাও ঝুলে থাকতো! কারণ দ্বীপবাসী হয়তো সমুদ্রে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে।অ্যাবসার্ড নাটকে আলো নিজেই একটি শক্তিশালী ক্যারেক্টার। আলোর নাচন যতটা রহস্যময় হবে, নাটকের পাত্রপাত্রী, ঘটনা পরম্পরা, দৃশ্যের পর দৃশ্য ততই দর্শক-শ্রোতাদের মনোজগতে ধাধার ঘোর লাগাবে। আলো'র সেই খেলাটার কিছুটা ঘাটতি আমি অনুভব করেছি। অথবা হতে পারে নাটকের নির্দেশক আলো'র চেয়ে বাস্তবের চরিত্রগুলোকে আরো বেশি জাদুবাস্তবতার ঘেরাটপে আটকাতে চেয়েছেন। তবে আলোক পরিকল্পনায় আরো একটু মনোযোগী হবার দাবি রইল। 'কালবেলা' নাটকের মিউজিক ডিজাইন চমৎকার। কিন্তু পারফর্মারদের পরিবেশনায় কোথায় যেন সুস্পষ্ট কিছু ঘাটতি অনুভব করেছি। পাশাপাশি নৃত্য পরিবেশনে তাল, লয়, ছন্দ, গতি আরো যতটা চৌকশ হওয়া উচিত, তত ভালো। এই জায়গায় হয়তো প্রশিক্ষণের ও নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই!তবে এই কথাগুলো কেবল চূড়ান্ত পারফেকশনের কথা বিবেচনা করেই বলা। এমনিতে পালাকারের পরিবেশনা সবসময় দর্শক শ্রোতাদের উপেং পুরোহীতের মত জাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করে। 'কালবেলা'ও হাউজফুল দর্শকের চিত্ত আকর্ষন করেছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 'কালবেলা' নাটকে মোড়লের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরিয়ার খান রিন্টু, মোড়লের দুই বন্ধু আহম্মদ চরিত্রে কাজী ফয়সল ও মুনীর চরিত্রে নিপুন আহমেদ। ঢুলী চরিত্রে অজয় দাশ, দাগী চরিত্রে সেলিম হায়দার, শিসদার বংশীধারী চরিত্রে দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ, উনেন চরিত্রে লিয়াকত লিকু। আর নিবেদিকা চরিত্রে ফারহানা মিঠু ও উপেং চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল অভিনয় করেছেন। 'কালবেলা' নাটকটির রচয়িতা বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমদ। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আমিনুর রহমান মুকুল। নির্দেশনা উপদেষ্টা ছিলেন নাট্যজন আতাউর রহমান ও মঞ্চ উপদেষ্টা ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন অনিকেত পাল বাবু, আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান, আবহ সংগীত পরিকল্পনায় অজয় দাশ, কস্টিউম ডিজাইন করেছেন লুসি তৃপ্তি গোমেজ। মঞ্চ থিয়েটারে পালাকার সবসময় ভিন্নধর্মী নাটক নিয়ে দর্শকের হৃদয় জয় করে। পালাকারের 'কালবেলা' অ্যাবসার্ড নাটকটিও হাউজফুল দর্শককে আলোড়িত করেছে বলেই আমার বিশ্বাস। 'শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়'-এর মত পালাকারের 'কালবেলা' নাটকটি ভবিষ্যতে আরো চৌকশ পরিবেশনায় সবাইকে জীবনের পরম সত্যকে অনুধাবনের নিরন্তর সঙ্গী করবে এই কামনা করি। জয়তু পালাকার। জয়তু মঞ্চ নাটক।.......................২৩ মে ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩
false
hm
টয় পাইলট ১. তুহিন অনেকক্ষণ ধরে চোখ কুঁচকে আকাশ দেখে, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা লোকটাকে বলে, "বাবা, প্লেনটা তো আর দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেলো?" তুহিনের বাবা আড়চোখে ছেলেকে পরখ করে নিয়ে বলেন, "এই তো বাবা, প্লেনটা এখন অনেএএএএক ওপর দিয়ে উড়ছে। তাই তুমি দেখতে পাচ্ছো না।" তুহিন গোমড়া মুখে আবার আকাশের দিকে তাকায়। বাবার সঙ্গে হাতিরঝিলে টয় প্লেন চালাতে আসাই ভুল হয়েছে তার, মনে মনে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সে। বাবা সবসময় রিমোট কন্ট্রোলটা দখল করে বসে থাকে। আধঘণ্টা টয় প্লেন চালালে তার মাঝে পঁচিশ মিনিটই বাবা নিজে চালায়, তুহিনের ভাগ্যে হয়তো পাঁচ মিনিট জোটে। এরপর মায়ের সাথে আসতে হবে, মনে মনে সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে সে। তুহিনের বাবা উদ্বেগ গোপন করে রিমোট কন্ট্রোল নাড়াচাড়া করতে থাকেন। প্লেনটা সম্ভবত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এ কথা তুহিনকে বললে সে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড না ঘটিয়ে ছাড়বে না। ছেলেটা এক বছর ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর বায়না করার পর অবশেষে গত বছর সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মল থেকে তুহিনের জন্যে টয় প্লেন কিনে এনেছেন তিনি। এরপর দেশে শুরু হলো মারপিট খুনাখুনি। বার পাঁচেক টয় প্লেন চালাতে এসেছে তুহিন। বাচ্চা ছেলে, প্লেন চালাতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবে, এ কারণে বেশির ভাগ সময় তিনি নিজেই টয় প্লেনের পাইলটের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছেন। আজ তুহিনের স্কুল ছুটি, সে গতকাল রাতেই ঘোষণা দিয়েছে আজ দুপুরভর সে হাতিরঝিলে টয় প্লেন চালাবে। এখন যদি এটা খোয়া যায়, ছেলেটা আবার মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করবে। তুহিন আরো কিছুক্ষণ উসখুস করে বলে, "বাবা, প্লেনটাকে নিচে নামিয়ে আনো।" তুহিনের বাবা ঢোঁক গিলে আবার চেষ্টা করতে থাকেন, রিমোট কন্ট্রোলের সব কয়টা বাটনই তার কাছে অচেনা মনে হতে থাকে। টয় প্লেন চালানো এতো কঠিন কেন? এই প্রথম বিমানচালকদের ওপর একটা ক্ষীণ শ্রদ্ধা জন্মায় তার। কাজটা বেশ কঠিন, উপলব্ধি করেন তিনি। দেশী পাইলটদের বরাবরই তাচ্ছিল্য করে এসেছেন তিনি। কোনো পাইলট কখনো আশেপাশে ভাব নিতে এলে সবসময় দুটো কড়া কড়া বাঁকা কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। একবার এক পাইলট এক বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে খুব গম্ভীর মুখে বাকতাল্লা মারছিলো, কীভাবে ব্যাংকক থেকে ফেরার পথে হঠাৎ মুখোমুখি আরেকটা বিমান এসে পড়ে, কীভাবে তাৎক্ষণিক তৎপরতায় তিনি বিমানের মান আর জান রক্ষা করেন, কিন্তু কীভাবে কিসমতের ফেরে ধানক্ষেতে অবতরণে বাধ্য হন। বোরহানির গ্লাসে সুড়ুৎ করে এক চুমুক দিয়ে তিনি তারপর সেই পাইলটকে চিবি দিয়ে ধরেন। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তিনি বিতর্ক করে আসছেন, আর ঐ পাইলট তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না। ফলে দাওয়াতে উপস্থিত সবাই মেনে নিলো যে এই পাইলট কোনো কাজেরই না, এই দেশে ভালো পাইলট পাওয়া যায় না, পাইলটের মতো পাইলট পাওয়া যায় কেবল সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এয়ারলাইন্সে। তিনি তরুণ বয়সে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন, তখন দেখেছিলেন, মোস্তফা এয়ারলাইন্সের পাইলটগুলো কী নিপুণ, কী দুর্ধর্ষ। বিমান চালু করার আগে তারা ভারি গলায় কী সুন্দর করে একটা ছোট্ট বক্তৃতা দেয়, বিমান অবতরণের পর সবাই কেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে পাইলটকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়, স্বল্প-কিন্তু-ভদ্রবসনা বিমানবালারা কেমন একটু পর পর আকুল হয়ে পাইলটের কেবিনে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয়। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এয়ারলাইন্স অতুলনীয়। পাইলটটা মুখ চুন করে বোরহানি না খেয়েই দাওয়াত থেকে কেটে পড়েছিলো। অচেনা লোকজন উদ্ভাসিত মুখে এসে তার দস্ত মর্দন করে বলেছিলো, আবদুন সাহেব, আপনার ফেসবুক ফলো করি। যা দিলেন ভাই, হেঁহেঁহেঁ ...। তুহিনের চিৎকার শুনে সম্বিত ফিরে পান তিনি। "বাবা, প্লেনটা নিচে নামিয়ে আনো! এবার আমি চালাবো, আমি আমি আমি!" রিমোট কন্ট্রোলের বোতামগুলো টিপতে টিপতে ছেলেকে সস্নেহ বকুনি দেন তিনি। "আহ তুহিন, কতোবার বলেছি, শুধু আমি আমি করবে না। বাবাকে এখন একটু কনসেনট্রেট করতে দাও। প্লেন চালানো কঠিন কাজ বাবা।" তুহিন কাঁদো কাঁদো মুখে বাবার মুখে দিকে তাকায়। তার মনে হয়, বাবা তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। টয় প্লেন চালানো খুব কঠিন কাজ হলে বাবা কীভাবে চালায়? তুহিনের বাবা আবারো আড়চোখে ছেলেকে দেখে নিয়ে তাড়াতাড়ি রিমোট কন্ট্রোলে থাপ্পড় মারতে থাকেন। মেশিনে থাপ্পড় দিলে অনেক সময় কাজ হয়। তুহিনের চোখমুখ লালচে হয়ে গেছে, সে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে, আগের মতো তাকে কোলে করে শান্ত করা যায় না, এখন হাত পা ছুঁড়তে থাকলে দুই-তিনজন লোক লাগবে তাকে শান্ত করতে। "কাম ডাউন বাবা। এই যে নামিয়ে আনছি, সবুর করো।" প্রাণপণে রিমোট কন্ট্রোলে চাপ দিতে থাকেন তিনি। তুহিন চিৎকার করার আগেই হুট করে একটা উটকো লোক এসে উদয় হয় কোত্থেকে যেন। "স্যার, আসসালামু আলাইকুম! আপনি এখানে?" তুহিনের বাবা স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলেন। সেলিব্রিটি হওয়ার এই একটা সুবিধা, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে স্যার বলে ডাক দেওয়ার লোক পাওয়া যায়। রিমোট কন্ট্রোলটা তুহিনের হাতে সস্নেহে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, "নাও, তুমিই নামিয়ে আনো।" তারপর হাসিমুখে উটকো লোকটার সালামের জবাব দিয়ে তিনি বলেন, "এই তো, ছেলেটাকে নিয়ে একটু টয় প্লেন চালাতে এলাম।" লোকটা তুহিনের বাবার সঙ্গে কথা বলতে থাকে, তুহিন রিমোট কন্ট্রোল হাতে অসহায়ের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের টয় প্লেনটাকে খুঁজতে থাকে। বাবা ওটাকে কোথায় পাঠিয়ে দিলো? ২. কেন্টাকির নিরালা পাহাড়ি এলাকায় ক্রিচ এয়ার ফোর্স বেইসে কমিউনিকেশন রুমের দরজা খুলে ভূতের মতো নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলো কর্নেল কোলম্যান। কানে হেডফোন গুঁজে বসে থাকা যোগাযোগ অফিসার সার্জেন্ট মেহিউ অস্পষ্ট গুনগুন শব্দ করছিলো, কোলম্যানের হুঙ্কার শুনে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো সে। "বেইস ফ্যালকনহেডকে ধরো। তারা কোথায়?" সার্জেন্ট মেহিউ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, "তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে বেইস ফ্যালকনহেড অনলাইনে আসবে, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান অসন্তুষ্ট গলায় ঘোঁৎ করে ওঠে। ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটা ড্রোন বিধ্বস্ত হয়েছে কান্দাহারের কাছে, ওপরমহলে এ নিয়ে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। কর্নেল কোলম্যান ডিরেক্টর অব অপারেশনসের দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রিচ বেইস থেকে দূরযোগাযোগের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সফলভাবে অনেকগুলো ড্রোন অপারেশন চালানো হয়েছে আফগানিস্তানে, নিজেদের পক্ষে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া। এই প্রথম তার সাদা পাতায় লালদাগ পড়লো। যোগাযোগ স্ক্রিনে ধূসর ছোপছোপ ইউনিফর্ম পরা এক সেনা কর্মকর্তার চেহারা ভেসে উঠলো। মাথা কামানো, রোদে পোড়া চেহারা, অভিব্যক্তিহীন নির্বিকার চেহারা। "মেজর হ্যামন্ড রিপোর্ট করছি বেইস ফ্যালকনহেড থেকে।" কর্নেল কোলম্যান ভুরু কুঁচকে ক্যামেরার দিকে তাকালো। "নেস্ট থেকে অপস ডিরেক্টর কোলম্যান বলছি। কী ঘটেছে মেজর?" মেজর হ্যামন্ড ভাবলেশহীন মুখে বললো, "বেইস থেকে পঞ্চান্ন মাইল রেডিয়াসে ডেরা সাক্কো গ্রামে সম্ভাব্য ইনসারজেন্সির রিপোর্ট পেয়ে আজ সকাল দশটা কুড়ি মিনিটে আমরা রেকি করতে একটা নিরস্ত্র ফ্যালকন ক্লাস ড্রোন পাঠাই, স্যার। বেইস থেকে উড়াল দেওয়ার তিরিশ সেকেণ্ড পর সেটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেইসের কাছে একটা পাহাড়ে আছড়ে পড়ে। সার্জেন্ট গিলমোরের নেতৃত্বে একটা দল সেটাকে উদ্ধার করে আবার বেইসে ফিরিয়ে এনেছে, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান বলে, "নেস্টের ড্রোন অপারেটর মাজিনি বলছে সমস্যাটা ওখানকার, এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ ঠিক ছিলো। এ ব্যাপারে তোমার কী মত, মেজর?" মেজর হ্যামন্ড একঘেয়ে সুরে বলে, "সঠিক, কর্নেল। সার্জেন্ট গিলমোর দুর্ঘটনার স্পট থেকে আরেকটি বিধ্বস্ত ও নিরস্ত্র ড্রোন উদ্ধার করে এনেছে। এটি আমাদের বহরের ড্রোন নয়। ক্ষতির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, বহিরাগত ড্রোনটি আমাদের ড্রোনের স্টারবোর্ড প্রান্তে এসে তার সম্মুখভাগ দিয়ে ধাক্কা মেরেছে। এর ফলে দুটি ড্রোনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আকাশে ভেসে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান সটান খাড়া হয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলে, "মানে? আরেকটা ড্রোন কোত্থেকে এলো?" মেজর হ্যামন্ড বললো, "এই বহিরাগত ড্রোনে আমরা কোনো ইনসিগনিয়া পাইনি, স্যার। এতে কোনো ধরনের অস্ত্র সংযোজনের ব্যবস্থাও নেই। এতে কোনো ধরনের রাডার কিংবা ক্যামেরাও নেই, নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা দুর্বল একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে কেবল। আমার অভিমত, এটা খালি চোখে না দেখে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।" কর্নেল কোলম্যান চোখ লাল করে বললো, "তার মানে তুমি বলতে চাও কোনো শত্রু আমাদের বেইসের কাছে বসে একটা ফালতু ড্রোন চালিয়ে আমাদের একটা মিলিয়ন ডলার দামের ড্রোনকে ঠুক্কি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে?" মেজর হ্যামন্ড বললো, "সঠিক স্যার।" কর্নেল কোলম্যান হুঙ্কার দিয়ে বললো, "বেইসের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মেজর?" মেজর হ্যামন্ড বললো, "আমরা ইতিমধ্যে বেইস ফ্ল্যামিঙ্গোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি স্যার। মেজর হ্যারিসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি আরো তিরিশ মিনিট পর এসে পৌঁছাবে। সন্ধ্যা থেকে আমরা আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করা শুরু করবো স্যার।" কর্নেল কোলম্যান রাগে গরগর করতে করতে বললেন, "শত্রুপক্ষের ড্রোনটা ভালোমতো পরীক্ষা করা হয়েছে মেজর? এটা কাদের বানানো বলে তোমার ধারণা? চীন? ভারত? রাশিয়া?" মেজর হ্যামন্ড বললো, "নিশ্চিতভাবেই চীন স্যার। এর ইলেকট্রনিক অংশগুলোতে পরিষ্কার চীনা হরফ ছাপানো আছে। ক্যাপ্টেন ও'ব্রায়েন ইতিমধ্যে নেস্টের অ্যানালিস্টদের কাছে সব ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে, স্যার।" রাগে কর্নেল কোলম্যানের মাথায় ছোটো ছোটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। চীনাদের এতো বড় সাহস, তারা আল কায়দার হাতে এখন ড্রোন তুলে দিচ্ছে? মেজর হ্যামন্ড বললো, "বহিরাগত ড্রোনের একটি ডানায় কালো কালিতে রোমান হরফে একটি বার্তা লেখা আছে, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান বললেন, "ড্রোনের ডানায় বার্তা? কী বার্তা?" মেজর হ্যামন্ড বললো, "EAST OR WEST, MOSTOFA IS THE BEST, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "আগামীকাল ইস্টার্ন সময় সকাল আটটার মধ্যে লিখিত রিপোর্ট চাই মেজর হ্যামন্ড। আর কিছু জানাতে চাও এখন?" মেজর হ্যামন্ড নির্লিপ্ত মুখে বললো, "আর কিছু জানাবার নেই, স্যার।" কর্নেল কোলম্যান বললো, "ওভার অ্যান্ড আউট।" স্ক্রিন থেকে মেজর হ্যামন্ডের চেহারাটা মুছে গেলো। কমিউনিকেশন রুমে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো কর্নেল কোলম্যান। কে এই মোস্তফা? তার এতো বড় সাহস, মার্কিন ড্রোনঘাঁটির বগলে বসে সে আকাশ থেকে মার্কিন ড্রোন গুতা মেরে ফেলে দেয়? এ কি তবে নতুন ওসামা? কর্নেল কোলম্যান কমিউনিকেশন রুম ছেড়ে বেরিয়ে নিজের অফিসের দিকে যেতে যেতে টের পায়, পরিস্থিতি আবারো জটিল হচ্ছে। মার্কিন জাতির স্বাধীনতা লুটেপুটে খেতে এবার মাঠে নেমেছে আকাশসন্ত্রাসী মোস্তফা। ওয়াশিংটন অবশ্য ব্যাপারটাকে লুফে নেবে, এমন সুযোগ বার বার আসে না। দেশ ও জাতির জন্যে একটা জবরদস্তু জুজুর বন্দোবস্ত আপনা থেকেই হয়ে গেলে মন্দ কী? ওদিকে বেচারা হ্যামন্ড আর হ্যারিসরা কবে বাড়ি ফিরতে পারবে, কে জানে? ৩. তুহিন সজল চোখে রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টেপে, ঝকঝকে নীল আকাশে তার টয় প্লেনের নিশানা দেখা যায় না। দুয়েকটা চিল কেবল উড়ছে হাতিরঝিলের আকাশে। তুহিন হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুঝে রাগে গনগনে মুখে বাবার দিকে তাকায়। বাবা তখনও একটা অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। তুহিন বাবার কথা কিছুই বোঝে না। "... দ্যাখেন, গত বছর আমি অনেক হুজ্জতের মধ্যে পড়েছি। আমি জানতাম এমন সমস্যা হবে। তারপরও কিন্তু আমি গেছিলাম। যাই নাই? এই বছর যদি যাই, আরো বড় হুজ্জত হবে। সেই হুজ্জত কে সামলাবে? আমি না আপনি? যদি আমারেই সামলাতে হয়, তার খরচ তো আমাকে পেতে হবে, নাকি?" লোকটা বিগলিত মুখে বলে, "স্যার এই ফেসবুকে কে কী বলে এগুলিকে পাত্তা দিয়েন না। সোজা ব্লক করে দিবেন স্যার।" তুহিনের বাবা অসহিষ্ণু হয়ে নিচু গলায় বলেন, "কয়জনরে ব্লক করবো? এরা ফেসবুকের সব চিপাচাপায় বসে আছে। পান থেকে চুন খসলেই গালি খাইতে হয়। না ভাই, বাজারে মুরগির দাম বাড়ছে, সক্রেটিসের মুরগির দামও এখন বাড়তি। গত বছর যা দিছেন, এইবার তার দ্বিগুণ দিতে হবে। নাহইলে আমি নাই।" লোকটা তারপরও হাসিমুখে চাপাচাপি করে, বলে, "স্যার এমন করা কি ঠিক? আমাদের বেকায়দায় পেয়ে হাদিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন?" তুহিনের বাবা এবার একটু ক্ষেপেই ওঠেন, আড়চোখে একবার তুহিনকে দেখে নিয়ে গলার স্বর নিচে নামিয়ে ধমকে বলেন, "আপনাদের আবার কী বেকায়দা? আপনাদের গায়ে তো ফুলের টোকাও পড়ে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়ে গ্রামেগঞ্জে আপনাদের ব্যাঙ্কের নতুন শাখার ফিতা কাটে। বেকায়দায় তো পড়বো আমি বেচারা আবদুন। সবাই মিলে ফেসবুকে আমারে গালি দিয়ে পচায়ে গন্ধ ছুটাবে। গতবার বহু কষ্টে একে ওকে মুরুব্বি ধরে, সাক্ষী মেনে, সক্রেটিসের মুরগি তত্ত্ব দিয়ে ইজ্জত বাঁচাইলাম। এক মুরগি কয়বার কাটবো? এইবার আপনারা হাদিয়া ডাবল করে না দিলে এতো খাটনির মধ্যে আমি নাই!" তুহিন শুনতে পায়, অচেনা লোকটা হাসতে হাসতে বলছে, "স্যার, খাটনি কোথায়? মঞ্চে উঠে কয়েকটা নাম পড়বেন, বাস এই তো?" তুহিনের বাবা আঁতকে উঠে ফিসফিস করে গর্জে ওঠেন, "মঞ্চে উঠবো মানে? মঞ্চে ওঠার কোনো কারবার আপনাদের সঙ্গে আমার নাই। আমি জাগরণমঞ্চের লোক। আপনাদের মঞ্চে আমি কোনোদিন উঠবো না। বড়জোর মঞ্চের পিছন থেকে পর্দার আড়ালে বসে একটু কণ্ঠমধু দিতে পারি। যদি আগেরবারের ডাবল হাদিয়া দিতে রাজি থাকেন। নাহলে আমি নাই। রাজা রিচার্ডের তাঁবুতে সালাদিন প্রথমবার সস্তায় গিয়ে কোনোমতে পোষাতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয়বার যদি সালাদিনরে রিচার্ডের তাঁবুতে ঢুকাইতে চান, হাদিয়া ডাবল করতেই হবে। সস্তার কারবারে সালাদিন আর নাই।" অচেনা লোকটা কী যেন চিন্তা করে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, "আচ্ছা স্যার, আমি ব্যাঙ্কের আমীর সাহেবকে বলে দেখি। এখন তাহলে আসি। আল্লাহ হাফেজ।" তুহিনের বাবা বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে তুহিনের কাছে এগিয়ে আসেন আবার। তুহিন বহু কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলে, "প্লেন কই?" তুহিনের বাবা চোখ পাকিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলেন, "এ কী? তুমি প্লেন নিচে নামাওনি কেন? প্লেন কোথায়?" তুহিন চেঁচিয়ে বলে, "তুমি প্লেন উপরে উঠিয়েছো! এখন আমি আর নামাতে পারি না! আমাকে প্লেন এনে দাও!" তুহিনের বাবা তুহিনের হাত থেকে রিমোট কন্ট্রোল কেড়ে নিয়ে কিছুক্ষণ বোতাম টিপে হতাশ গলায় বলেন, "যাহ! হারিয়ে গেলো! সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মল থেকে তোমাকে একটা প্লেন কিনে এনে দিলাম, এভাবে দিনে দুপুরে হারিয়ে ফেললে?" তুহিন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি খায়। তুহিনের বাবা বহু কষ্টে তুহিনকে জাপটে ধরে তুলে গাড়ির দিকে নিয়ে যান। তুহিন হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমাকে আমার প্লেন এনে দাও! আমাকে আমার প্লেন এনে দাও!" তুহিনের বাবা গাড়িতে তুহিনকে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে সাবধানে বাড়ির দিকের পথে গাড়ি ঘোরান। তুহিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে মোবাইল ফোন বের করে মাকে ফোন দিয়ে নালিশ করে, "আম্মু! বাবা আমার প্লেন হারিয়ে ফেলেছে! আমার প্লেন আকাশে উড়ছিলো, তারপর বাবা সেটাকে কই নিয়ে গেলো, এখন আর প্লেন নিচে নামছে না!" তুহিন ফোন ধরে কাঁদতে থাকে। তুহিনের বাবা গলা চড়িয়ে বলেন, "ওর হাতে দশ মিনিটের জন্য রিমোট কন্ট্রোলটা দিলাম, বাস, প্লেন গায়েব। এই হারে খেলনা হারালে চলবে?" তুহিন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমাকে প্লেন এনে দাও।" তুহিনের বাবা তুহিনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, "আচ্ছা, আরেকটা এনে দেবো। এই তো আগামী মাসেই একটা অনুষ্ঠান আছে। ওটা হলে বাবার হাতে টাকা আসবে, তখন বাবা সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবে তোমাকে। এবার মোস্তফা মল থেকে আরো বড় একটা প্লেন কিনে আনবো আমরা, কেমন?" তুহিন চোখ ডলতে ডলতে বললো, "তাহলে ঐটা আমি একা চালাবো। তুমি চালাতে পারবে না।" তুহিনের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "আচ্ছা, ঠিকাছে। কিন্তু তুমি তো একা চালাতে গেলে প্লেন হারিয়ে ফেলো।" তুহিন আবার চিৎকার করে বললো, "আমি প্লেন হারাইনি! তুমি প্লেন হারিয়েছো, তুমি তুমি তুমি!" ৪. তুহিনের বাবা বাড়ি ফিরে ফিরে তুহিনের মায়ের ধমক খেলেন অনেকক্ষণ ধরে। "এর আগে একটা স্পিডবোট কিনে আনলে তুহিনের জন্যে, সেটাও হারিয়ে গেলো। এবার প্লেন কিনে আনলে, সেটাও হারিয়ে গেলো। সমস্যা কী? এভাবে সব খোয়া যায় কেন?" তুহিনের মা ধমক শেষ করলেন এই জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে। তুহিনের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "কী করবো তুহিনের মা? এই দেশটার আকাশেই সমস্যা। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা পার্কের আকাশে যখন প্লেন ওড়ালাম, তখন কোনো সমস্যাই হয়নি। আসলে আমাদের গোটা দেশেই অসুখ। এর মূল অনেক গভীরে। এখন গালাগালি না করে চলো সুস্থভাবে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি।"
false
fe
পরিশুদ্ধ রাজনীতির আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরিশুদ্ধ রাজনীতির আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়েফকির ইলিয়াস--------------------------------------------অবশেষে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক সচিব খান মুহাম্মদ নূরুল হুদা। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। বলা হচ্ছে, কবিতা খানমের নাম আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করেছিল। মাহবুব তালুকদারের নাম এসেছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কে এম নূরুল হককে ওএসডি করে রেখেছিল জামায়াত-বিএনপি জোটের সরকার। পরে তিনি ২০০৬ সালে অবসরে যেতে বাধ্য হন। কী অপরাধ ছিল তার? কেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাডার সদস্যকে ওএসডি করেছিল রাজাকারলালিত একটি জোট সরকার? এ সব বিষয় আলোচনায় আসতেই পারে। রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশে সিইসি পদে নুরুল হুদার নামের সঙ্গে ছিল সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের নামও। সার্চ কমিটির সুপারিশে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আরো যে চারটি নাম ছিল, তারা হলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক জারিনা রহমান খান ও অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নেতৃত্বাধীন এ কমিটিতে সদস্য করা হয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য শিরীণ আখতারকে। তারাই দশ সদস্যের শর্টলিস্ট তুলে দেন রাষ্ট্রপতির হাতে। একটি বিষয় স্পষ্ট, এ নির্বাচন কমিশনই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। ফলে, এ কমিশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে, জাতির কাছে। এ কমিশন সম্পর্কে বিএনপি ইতোমধ্যে নেতিবাচক কথাবার্তা বলা শুরু করেছে। তারা প্রথমেই বলছে, তাদের করা ওএসডি সচিবকে কেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হলো!এটা বলার অপেক্ষা রাখে না- বিএনপি এখন যে কাদার গর্তে পতিত হয়েছে তাতে তারা ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত আর কোনো সত্যই মানবে না। কাউকেই বিশ্বাস করবে না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে হতাশা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করে দলটি। এমনকি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে জনতার মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও দাবি করছে বিএনপি। তাদের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে একজনকেও নতুন ইসিতে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে দলটি। অথচ মাহবুব তালুকদার তাদের ঘরানার মানুষ বলেই চাউর রয়েছে।বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান মিডিয়াকে বলেছেন, আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত লোকদেরই ইসিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কমিশন আমরা গ্রহণ করবো না। একইসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনতার মঞ্চের বিতর্কিত আমলা ছিলেন। কাজেই তার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করা যায় না। বিএনপি তাদের নিজের তৈরি ভাঙা সাঁকোর উপর দিয়েই হাঁটছে। তারা এমন করে হেঁটে কতদূর যাবে তা-ই এখন দেখার বিষয়। অন্যদিকে দেশে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই একটি গোষ্ঠী সরকারি শক্তির ছত্রছায়ায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এরা এতই বেপরোয়া যে, তারা যত্রতত্র অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিতে আহত হন দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল। পর দিন দুপুরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শাহজাদপুর সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসানাত। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পুলিশ পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর বাড়ির সামনে পাহারায় ছিল। তার বাড়ির সামনে দুপুরে বিক্ষুব্ধরা মিছিল নিয়ে আসলে পুলিশের উপস্থিতিতে এবং পুলিশকে ডিঙ্গিয়ে তিনি নিজের শর্টগান দিয়ে বেশ ক’রাউন্ড গুলি ছোড়েন। যার একটি গুলিতে সাংবাদিক শিমুল গুলিবিদ্ধ হন।’ শিমুলের জানাজার পূর্বে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় এমন বক্তব্য দেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। আবদুল হাকিম শিমুল হত্যা মামলায় গ্রেফতার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মিরুকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি তাকে রিমান্ড আবেদনের বিষয়ে শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও)।আসলে কী হচ্ছে বাংলাদেশে? ক্ষমতাসীনদের কিছু পোষ্য কেন এতো সহিংস হয়ে উঠছে? কেন তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে? শিমুল হত্যাকাণ্ডে যেই জড়িত থাকুক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে যত বড় শক্তিশালী কিংবা প্রভাবশালী জড়িত থাকুক না কেন; অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সরকার সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে রাজনীতির নামে এখন আজব আজব কর্ম করছেন কিছু রাজনীতিক।শিক্ষার্থীদের হাতে হাত রেখে বানানো হয়েছে ‘পদ্মা সেতু’। শোয়া আরেক ছাত্রের পিঠে চড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারী। ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ছবিতে দেখা যায়, দুই দল শিক্ষার্থী হাতে হাত রেখে ‘সেতু’ তৈরি করেছে এবং আরেক ছাত্র তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়েছে। ওই অবস্থায় তার পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন। মানবসেতুতে হেঁটে সমালোচনার মুখে পড়া আওয়ামী লীগ নেতাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না, সে আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোক। নূর হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেছেন- ‘চাঁদপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন ছাত্রদের দিয়ে যে কাজটি করেছেন সেটি ঘৃণ্য। এ ধরনের ঘৃণ্য, জঘন্য কাজ যারা করে, তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।’বাংলাদেশে এ সময়ে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যানের সংখ্যা কত? তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে আওয়ামী লীগ কী করছে কিংবা কী করতে পারছে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দরকার। দরকার মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও শক্তির পথরেখা জরিপের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন এবং সামাজিক জীবন দুটোই আজ এতটা বিপন্ন যে, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে ভাবলে লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছানো যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর, ক্ষমতাসীন সরকার পক্ষের জবাবদিহিতা করার মতো প্লাটফর্ম অতীতে থাকতো তবে হয়তো দেশ এতোটা লুটেরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি পতিত হতো না। একাত্তরের পরাজিত রাজাকারশক্তি, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নানাভাবে আনুক‚ল্য পেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কথা আজ অনেকেই ভুলে যেতে বসেছেন। সংবিধান বলছে, ভূমি-মানুষ-সার্বভৌমত্ব-সমাজ রক্ষা এবং এর উন্নতি সাধন করাই একটি সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এর প্রয়োজনে তাদের যতটা দরকার জবাবদিহি করতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত দেশে যে সব দল টিকে থাকবে এবং যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের সবারই এ চিন্তাটি মাথা রাখতে হবে। এ সুযোগ উন্মুক্ত হলে পাল্টে যেতে বাধ্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আজাদের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’। হ্যাঁ, নিজ সত্তা নিয়ে অন্যদের সময়ে বেঁচে থাকা বড় দুঃখজনক এবং কঠিন কাজ। ১৯৭১ থেকে ২০১৭। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এর কম সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি- সেটা বলছি না। কিন্তু এ দেশটি আরো শান্তিময় হয়ে উঠতে পারতো। আরো নিরাপদ থাকতে পারতো এ দেশের মানুষ।একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল বিবর্তন সবসময়ই কাম্য হয়। কারণ নান্দনিক পরিবর্তন, ভাঙচুরের মাধ্যমেই এগিয়ে যায় মানবসমাজ। গেলো এক যুগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ফিল্ডে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বলা যায়। এর পাশাপাশি অবশ্য নানা শঙ্কা-সংকটও বেড়ে উঠেছে নানাভাবে। মনে পড়ছে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয় শওকত ওসমান একটি সেমিনারে বলেছিলেন, সংস্কৃতির আবিষ্কার এবং আগ্রাসন দুটিই আছে। প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা গ্রহণ করবে।আজকের প্রজন্মকে পরিশুদ্ধ রাজনীতির আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। দাঁড় করাতে হবে রাজনীতিকদেরও। মানুষ এ কাজটি করতে পারে সহজেই। নিজ স্বার্থের জন্য কোনো নেতা কিছু একটা বললেই তা মানতে হবে কেন? মানুষ যতক্ষণ বিবেকবান না হয়- ততক্ষণ একটি জাতি সামনে এগোতে পারে না। =====================================================দৈনিক খোলাকাগজ ॥ ঢাকা ॥ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সোমবার সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:৫২
false
hm
কবিতা বিষয়ে ঘুম নিয়ে একটা সমস্যায় ভুগছি, তাই খুব বোরিং কিছু লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়বো ভাবছি। কী নিয়ে লেখা যায়, ভাবতে ভাবতে এই লেখার গল্প শুরু করলাম। ব্লগে আমি যে নিরর্থক হাবিজাবি লিখে যাই, সেই লেখালেখির শুরুটা হয়েছিলো কবিতা দিয়ে! সেসময়ে আমি বিস্তর কাব্যস্রাবে আশপাশ ভিজিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর সব নতুন কবিদের মতো। পাঠের অযোগ্য সেসব কবিতার বেশিরভাগই পরে আমি নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলেছি, অন্য কারো কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগলে ওরচেয়ে বাজে যতগুলো কবিতা লিখেছি সব একসাথে নষ্ট করে ফেলতাম। আমার লেখালেখির সমস্ত পর্বই কম্পিউটারে কম্পোজ করা, কাগজের ওপর কলম দিয়ে দুয়েকটা গদগদ চিঠি ছাড়া আর কিছু লিখিনি। কিন্তু প্রিন্ট আউট নিতাম, ফলে কবিতাগুলি নষ্ট করার পর্বটা একটু ঝামেলারই ছিলো। ভোরবেলা আমার মা জেগে উঠে এসে বলতেন, পোড়া গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়? নমস্য কবিদের কিছু কবিতা পড়ে আমি একদিন হতাশ হয়ে উপলব্ধি করলাম, কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা পড়া উত্তম। তাতে কাগজ পোড়াতে হয় কম, কম্পিউটারে ফাইল মুছতে হয় কম। আমার কবিজীবনের সাক্ষীর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, তারাও বিস্মরণপ্রবণ, তাই তাদের খুন করে লাশ গুম করার ঝামেলায় আমাকে যেতে হয়নি। একদিন এক সুন্দর সকালে কবিতা লেখার দায় স্কন্ধচ্যুত করে আমি কোথায় যেন বেরিয়ে গেলাম। আজও তাই আমি কবিতা লিখতে সংকোচ আর গ্লানি অনুভব করি, মনে হয় যেন অপরের পায়জামা পরে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই অসফল কবিজীবনে আমি কিছু কবিতা পড়েছি। পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কবিতা ব্যাপারটা ঐ তরল পদার্থের মতোই, পাত্রভেদে এর অনেক কিছু পাল্টায়। আমার পড়ে ভালো লাগেনি, কিন্তু সেটি নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাসের লালায় জগৎ ভাসিয়ে দিয়েছেন, এমন কবিতার সংখ্যা কম নয়। আবার আমার ভালো লেগেছে কিন্তু অনেকেই সেটিকে তুচ্ছজ্ঞান করে সরিয়ে রেখেছেন, এমন কবিতাও অনেক। কাজেই প্রতিটি ভালো লাগা কবিতাই আসলে কবি, পাঠক আর পাঠকালীন পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একটা চুক্তির মতো। কবিরা অত্যন্ত উদ্যমী। তাঁরা সহজে থামেন না। নিজের উদ্যোগে সব কবিতা না পড়ে কাব্যরুচির সঙ্গে মেলে, এমন একজন সমঝদারের সাথে যোগাযোগ করা ভালো। পরবর্তীতে আমি আবিষ্কার করি, আমার পরিচিতমহলে কিছু ব্যক্তি কবিতা লেখেন, কিন্তু তারা আমার মতো অনধ্যবসায়ী নন। বেশির ভাগই মনে করেন, তারা স্রেফ অনুগ্রহ করেই বড় বড় কবিদের ভাত মারছেন না। তারা সচরাচর গায়ে পড়ে কবিতা শোনাতেন, এমন নন, কিন্তু কবিতা প্রসঙ্গ উঠলেই ভুরু কুঁচকে তাকাতেন, যার অনেক অর্থের একটি ছিলো, তুই জানস কী? এমনই একজনকে একদিন তেল দিয়ে তার একটি কবিতা বেছে দিতে বললাম, তিনি আমাকে চক্ষু দিয়ে আগাপাস্তলা পরিমাপ করে কী যেন ভেবে বার করে দিলেন একটি আস্ত খাতা। ঘরের এক কোণে সেই খাতার প্রথম কবিতা পড়েই আমার পেট-মাথা উভয়েই চক্কর দিয়ে উঠলো। বহু কষ্টে আরো দু'য়েক পাতা উল্টে বিদায় নিলাম, প্রতিজ্ঞা করলাম, কবিতা পড়ি আর না পড়ি, কবিদের ধারেকাছে আর নাই। সেই থেকে আজ অব্দি, সুন্দরী বালিকাদের ব্যতিক্রম ছাড়া, কেউ আমাকে কবিতা পড়াতে বা শোনাতে এলেই আমি ফসকে যাই। লিখিত কবিতার অনেক গুণ, চাইলে পড়ো, না চাইলো পড়ো না, কিন্তু যে কবিতার পরিণতি শ্রুত হওয়া, তার অনেক হ্যাপা, কান তো বুঁজে থাকা যায় না। ইতোমধ্যে যে সত্যটি আবিষ্কার করেছিলাম, কবিতার গুণ শুধু কবিতাতেই থাকে না, গদ্যেও থাকতে পারে। শীর্ষেন্দুর আশ্চর্য ভ্রমণ আমার খুব প্রিয় এক উপন্যাস, সেখানে একটি পংক্তি ছিলো অনেকটা এমন, "... এক গভীর আনন্দ স্টীমারের মতো আলো ফেলে যায় অন্ধকার বুকে।" এই কথাটা আমার কাব্যান্ধ বুকেও যেন এচ করে বসে যায়। আমি টের পেলাম, সরল ভাষায় লেখা এই মিহি উপন্যাসে কবিতার পায়ের ছাপ আছে, তার ফেলে রেখে যাওয়া গন্ধ আছে, যিনি লিখছেন আর যে পড়ছে, আর যে পারিপার্শ্বিক, এই তিনের মধ্যে সেই অলিখিত চুক্তিটুকু যেন সই হয়ে যাচ্ছে মহাকালকে সাক্ষী রেখে। এখনও মনে আছে, আশ্চর্য ভ্রমণ পড়ছিলাম এক মেঘলা দিনে, শোবার ঘর থেকে উঠে গিয়ে ড্রয়িংরুমে, মাঝে পান করেছিলাম এক পেয়ালা গরম চা, আমার ভাই অফিস থেকে ফিরেছিলেন বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে হয়ে। পরে আমি যখন দুয়েকজন কবিকে, যাদের লেখা ছাপার হরফে পড়তে মেলে, চোখের সামনে দেখি, তাদের কথাবার্তা শুনি, এবং কৌতূহলী হয়ে তাদের কবিতা পড়ি, তখন কবিতার প্রতি আমার যা ক্ষীণ আকর্ষণ, তাকে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করার জন্যই ঠিক করি, কবিদের সংসর্গ এড়িয়ে চলতে হবে, তা না হলে জীবনে কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব হবে না। আমি এখনও এই নীতি অনুসরণে আগ্রহী। কবিদের সাথে কবি বা কবিতা বিষয়ে আলাপে আমি প্রথম সুযোগেই মৌন মেরে যাবার পক্ষপাতী। কবিদের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ যোগাযোগ সম্ভব তাদের কবিতা পাঠেই, কবিতা নিয়ে তাদের বুকনিতে নয়। এই কথাটা সাহস করে কোন কবির সামনে বলার ঝুঁকি যে আমি নিইনি, তা বলা বাহুল্যমাত্র। যখনই আমি কবিদের লাইনের ওপারে পাঠিয়ে দিলাম, তখনই দেখলাম, কবিতা ব্যাপারটাকে যত জটিল বলে মনে করা হয়, বা বলা হয়, তার লেশমাত্র আর থাকে না। কোথাও কবিতাটা লেখা থাকতে হবে, কবি থাকবেন দূরে, নাগালের বাইরে, হাতপাচোখকান পোঁছোয় না এমন জায়গায়, আর পাঠক কবিতাখানি নিজের মনে পড়বেন। প্রতিটি কবিতার সার্থকতাই হয়তো পাঠককে স্পর্শ করার মধ্যে, সেটি সবচেয়ে ভালোভাবে সম্ভব যদি কবি এদের দু'জনের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। কবিতা লিখে ফেলার পর কবি গোটা ব্যাপারটায় সেই দ্য ত্রো, বাহুল্যমাত্র, কাবাবে হাড্ডি, চাঁদে কলঙ্ক। তারপরও নির্লজ্জের মতো মাঝে মাঝে কবিতা লিখে ফেলেছি। সন্তর্পণে প্রিন্ট আউট নিয়ে নিজে বার তিনেক পড়েছি আবার, গভীর রাতে ফোন করে জাগিয়ে তুলেছি কাউকে, কবিতা পড়ে শুনিয়েছি। পৃথিবীটা এতো সুন্দর, কারণ প্রতিটি মানুষই আলাদা, যাদের ফোন নাম্বার জানতাম তারা আমার মতো হিসাবকিতাব করেনি কবিতা নিয়ে, চুপচাপ শুনে গেছে, এমনকি এই যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষার জন্যে প্রশংসা পর্যন্ত করেছে। কবিতা লেখার পড়ার শোনানোর ভালোলাগানোর গভীর আনন্দ নিয়ে ভোরবেলা ঘুমাতে গেছি, বা আদৌ ঘুমাইনি, চলে গেছি ক্লাসে। কবিতা লিখে পোস্ট করে পাঠিয়েছি, মেইল করেছি, নির্জন নিরিবিলিতে স্মৃতি থেকে শুনিয়েছি অনেককে। ব্লগে কবিতা লিখে চুপ করে সরে গেছি, বহুদিন পর সলজ্জ ক্লিকে খুলে দেখেছি, কেউ পড়লেন কি না। নিজে মূল্য দিয়ে জানি, প্রতিটি কবিতাই কিভাবে আমাকে কাতর আর নিঃস্ব করে তোলে পাঠকের জন্য। এর মূল্য স্তুতিতে মেলে না, কোন দাবিও খাটে না এক্ষেত্রে। ঐ যে পাঠক আর তার পারিপার্শ্বিকের সাথে চুক্তি, তা চোখে না দেখলে, কানে না শুনলে শান্তি মেলে না। উপন্যাস বা গল্পের সমালোচনা লোকে মুখ নিচু করে মেনে নিতে পারে হয়তো, কবিতার সমালোচনা আত্মায় আঘাত করে, এ তো আর গীতায় বর্ণিত আমজনতার আত্মা নয় যে নৈনং ছিন্দন্তি নিন্দাণি! কবিতাকে সম্মানজনক দূরত্বে রেখেই চলতে চাই। একে লিখে যেন নষ্ট করতে না হয়, একে পড়ে যেন বিরক্ত হতে না হয়, এর রচয়িতার মুখোমুখি হয়ে যেন একে নিয়ে আলাপ করতে না হয়। ওতে শুধু বিষের গ্রন্থির গুরুত্ব বাড়ে, ভালোবাসা লাঘব হয়। তারপরও বলি, মানুষের জীবনে গ্লানিময় অতীত থাকেই। আমারও দুয়েকটি অতি নাখাস্তা কবিতা ছাপার অক্ষরে পাঠকের চক্ষুস্পর্শ করেছে। কপাল ভালো তখন ব্লগ ছিলো না, থাকলে আমি নিশ্চয়ই প্রচুর বাজে কবিতা লিখে পাঠকের কালোফর্দে নাম তুলতাম, কিংবা কবিতা লেখার ব্যর্থতা ঢাকতাম কবিতা নিয়ে কলতলার কলহের বুলন্দিতে।
false
rg
বইমেলার ডায়েরি (৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) !!! আজ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, সোমবার। অমর একুশে বইমেলার নবম দিন। বইমেলায় ঢুকতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা হল কবি আয়শা ঝর্না, কবি ফারুক ও মোজাম্মেলের সঙ্গে। আজ ঐতিহ্য থেকে মেলায় এসেছে বিশ্বের নারী কবিদের কবিতার অনুবাদ নিয়ে আয়শা ঝর্নার কাব্যনুবাদ 'নারীস্বর'। ৩৪ টি দেশের নারী কবিদের কবিতা আছে বইটিতে। আছে এশিয়া, আমেরিকা, মিডল ইস্ট ও সাউথ আফ্রিকার কবিদের কবিতা। ঝর্না জানালেন, বিভিন্ন দেশের নারী কবিদের চিন্তার জগতে উঁকি মারতে গিয়েই এই অনুবাদে আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশ্বের আরো যেসব নারী কবিদের কবিতা ঝর্নার ভালো লাগে, সেগুলোর অনুবাদ আগামীতে আসবে। আশা করি ঝর্নার কাব্যনুবাদ বন্ধুদের ভালো লাগবে। লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গনে গিয়ে নন্দনের স্টলে বই সাজিয়ে ঝর্নাদের সঙ্গে চা খেতে যাই একাডেমির ক্যাফেতে। তার আগে ঝর্না আমার গল্পের বই 'পঞ্চভূতেষু' কিনে নিলেন। বাংলা একাডেমির ক্যাফেতে চা কেবল ওদের তালিকায় আছে বটে, বাস্তবে নেই সেই চায়ের কোনো অস্তিত্ব টের পেলাম না। সেখানে বিক্রি হচ্ছে নানান কিসিমের খাবার। এমন কি পাটিসাফটা পিঠাও আছে। তবে কফি পাওয়া গেল। ঝর্নার সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় পাঠসূত্র আমলের শুরুর দিকে, ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালে পাঠসূত্র থেকে বের হয়েছিল ঝর্নার কবিতার বই 'চারকোল'। বর্তমানের পেট্রোলপোড়া রাজনীতিতে আমার মত ঝর্নার মধ্যেও পথেঘাটে, রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। তাই আলো থাকতেই ঝর্না উত্তরায় বাসার উদ্দেশ্য চলে গেলেন। লিটল ম্যাগ চত্বরে শুরু হল আমাদের রোজকার আড্ডা। ভিন্নচোখের প্রকাশক ও এন্টিম্যাটার লেখক আলী আফজাল খান, বাস্টার্ড-এর লেখক মহান ঋষি এস্তেবান, শিল্পী চারু পিন্টু আর আমাকে চা খাওয়াতে বাইরে নিয়ে আসলেন। আমরা চা খেতে খেতে পুলিশ ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম। পুলিশ ভাইয়েরা জানালেন, তারাও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারাক্ষণ এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। লিটল ম্যাগ চত্বরে ফিরে আবার পিন্টু আর আমি গেলাম উদ্যানে ঘুরতে। অনেক ছোটবড় বইয়ের স্টলে ঢু মারলাম। দেখা হল কবি শহিদুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম অনুপ্রাণন প্রকাশন-এ। সেখানে ক্যামেরা নিয়ে ওৎ পেতেছেন কুহক মাহমুদ। পিন্টু আর আমি কুহক ভাইয়ের ক্যমেরার শিকার হলাম। উদ্যানে বইমেলার প্রধান অংশে ঘুরতে ঘুরতে আবিস্কার করলাম বাংলা একাডেমির আরেকটি অবদান। নামাজি বইপ্রেমীদের জন্য উদ্যানের পূর্বপাশে পুরুষ ও মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য পাশাপাশি আলাদা আলাদা দুইটি জায়গা বরাদ্দ করেছে এবার বাংলা একাডেমি। সেদিন বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের পঞ্চম তলায়ও দেখলাম এমন ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলা একাডেমির অবদান সত্যি মনে রাখার মত বটে।বইমেলায় বইয়ের ক্রেতা তেমন চোখে পড়ল না। টেলিটকের সিম কেনার লাইন আর প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টারদের সংখ্যার তুলনায় মেলায় বইপ্রেমীদের সংখ্যা কি কম না বেশি, সেটা বরং সাধারণ দর্শকদের জন্য একটা মজার ধাধা হতে পারে। আচ্ছা বলুন তো, হরতাল অবরোধ পেট্রোলপোড়ার দেশে এবার অমর একুশে বইমেলায় টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার আর টেলিটকের সিম কেনার দর্শকদের চেয়ে বইয়ের ক্রেতা বেশি না কম? অথচ বাংলা একাডেমি এবার ৬০ বছর পূর্তি পূরণ করেছে। ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মেলার প্রথম চারদিন ছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। যেখানে ২৯টি দেশের কবি সাহিত্যিকরা এসেছিলেন। কেমন ছিল বাংলা একাডেমির সেই আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন? কেউ যদি আমাকে এমন প্রশ্ন করেন, আমি ভাই আমাদের আদালতের মহামান্য বিচারকদের মত সেই প্রশ্নে ভারি বিব্রতবোধ করব। কারণ, বাংলা একাডেমি বিদেশি কবি লেখকদের সঙ্গে বাংলাদেশী তরুণ প্রজন্মের কবি-লেখকদের কোনো আড্ডার ব্যবস্থা করেনি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই গৎবাধা সেমিনারের আয়োজন ছিল। সেখানে দেশের বড় বড় মন্ত্রী বাহাদুরেরা গেস্ট ছিলেন। মিডিয়ার কিছু রিপোর্টার ছিলেন। আর ছিলেন বাংলাদেশের কিছু নামিদামি কবি লেখক। এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের কোনো কবি বা লেখকের কাছে বিগত নয়দিনে একটা নতুন গল্পও শুনলাম না। তাহলে এমন নামকাওয়াস্তে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন করে বাংলা একাডেমি আসলে গোটা বাংলাদেশকে কি উপহার দিল? তরুণ প্রজন্মের লেখকরা বা এই সাহিত্য সম্মেলন থেকে কি পেল?আমাদের বাংলা একাডেমি কি আদৌ কোনো পরিকল্পনা সুন্দর করে করতে জানে? ৬০ বছরে একটা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান হবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। চারদিন ব্যাপী একটা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করল বাংলা একাডেমি, আর দেশের তরুণ প্রজন্মের যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত তারা কেউ একদম কিছু জানল না, কিচ্ছু শিখল না সেখান থেকে, কিচ্ছু পেল না সেখান থেকে, এমন অকর্মন্য বাংলা একাডেমি পুষে আমাদের আসলে কি লাভ হচ্ছে!!বাংলা সাহিত্যের কোন কোন লেখকের ইংরেজি বা অন্য ভাষার অনুবাদ বিদেশি লেখকদের সামনে তুলে ধরল এবার বাংলা একাডেমি, আমরা কিন্তু কিচ্ছু জানি না। শুধু বিদেশ থেকে কিছু কবি সাহিত্যিককে বিমানভাড়া দিয়ে এনে পাঁচতারা হোটেলে রেখে চারদিন প্রাগৈতিহাসিক মার্কা সেমিনার করে রাষ্ট্রের কি কি দায় মেটাল বাংলা একাডেমি? আমাদের বুজুর্গ মুরব্বি লেখকরা বা কেন তরুণ প্রজন্মকে এই সাহিত্য সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দিলেন না বা নিরব ভূমিকা পালন করল? তাদের কি কোনো গোপন ইন্টারেস্ট আছে? নইলে দেশের তরুণ প্রজন্ম কিভাবে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে? প্রশ্নের পিঠে আরো প্রশ্ন উঠবে। সোজা কথায় স্বয়ং ভগবান রাগ দেখান। সো সাধু সাবধান।লিটল ম্যাগ চত্বরে ফিরে আড্ডা হল শিল্পী ভব, কবি শহিদুল্লাহ সিরাজী, কবি নীলসাধু, কবি কবির য়াহমদ, কবি সরসিজ আলীম, শিল্পী চারু পিন্টু, কবি আলোড়ন খিসা, কথাসাহিত্যিক মণিকা চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে। শিল্পী ভব বইমেলায় ঘুরে ঘুরে লালনের পোস্টার বিক্রি করছেন। শিল্পী চারু পিন্টু'র করা লালনের পোট্রেট এটা। দাম ৫০ টাকা। লালনভক্তরা পোস্টারটি ভব'র থেকে বা নন্দন স্টল থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।আজ মেলায় এসেছে কথাসাহিত্যিক মণিকা চক্রবর্তীর নভেলেট 'যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্রঝিনুক'। বইটি প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। বন্ধুদের সংগ্রহ করার অনুরোধ রইল। মেলা থেকে বের হতেই ফোন করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি টোকন ঠাকুর। কালী মন্দিরের গেটে আমরা মিলিত হলাম। ঠাকুর পরিচয় করিয়ে দিলেন কবি জয়ন্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে। উদ্যানে বইমেলার প্রধান গেট ততক্ষণে বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার মানে আজ আর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না, কেবল বের হতে পারবে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে ঠাকুর আর আমি চলে গেলাম যথারীতি ধ্রুবদার বাসায়। ধ্রুবদা জানালেন, আগামী সপ্তাহ নাগাদ বইমেলার চাপ কিছুটা কমবে। আমরা কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে বাসায় চলে আসলাম। ..................................৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ঢাকা
false
rn
কেমন ছেলে বিয়ে করবেন সহজ সরল সত্য কথা- প্রতিটা ছেলেই বদ। বিরাট বদ। এই লক্ষ লক্ষ বদ থেকে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে- যে ছেলে কম বদ। যে ছেলেকে দেখে আপনার মনে হবে- এই ছেলেটা ভালো, দেখতে সুন্দর, ফরসা, কি সুন্দর হাসি- খুব সহজ সরল, রুচিশীল শিক্ষিত কিন্তু বিশ্বাস করুন- এই ছেলেও বদমাশ। বর্তমান সমাজে একেবারে নিখুঁত ভালো ছেলে একজনও নেই। এমন ছেলেকে বিয়ে করবেন- যে ছেলে আপনাকে বিশ্বাস করবে, ভালোবাসবে এবং সম্মান করবে। মেয়েদের সবচেয়ে বড় বকামি সে নিজের ডিসিশন নিতে পারেনা। যে ছেলে কারো নিন্দা করে না, দরিদ্রকে সাহায্য করে, পরিচিত-অপরিচিত সব মুরব্বীদের সম্মান করে এবং সবচেয়ে বড় কথা কুৎসিত ভাবে রাস্তা ঘাটে চলার সময় কোনো মেয়েদের দিয়ে কাতায় না। সুন্দর বাজার সদাই করতে পারে, পরিশ্রমী, ভালো চাকরি করে, গানবাজনা ভালোবাসে, কৃপণ নয়। ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেয় না- এমন ছেলেকেই বিয়ে করা উচিত। বিয়ে, সারা জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। বিয়ে তো জীবনে একবারই করবেন। কিন্তু সেই বিয়ে করে যদি জীবন বোরিং হয়ে যায়, তাহলে বিয়ে করে লাভটা কী? ঢাকা শহরের বড় বড় অফিসে আমি দেখেছি- কোনো মেয়ে ইন্টারভিউ দিতে এলে- সে একা আসে না। তার মা অথবা বাবা নিয়ে আসে। তাহলেই বুঝুন একটা মেয়ে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে!! যে মেয়ে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছে- কিন্তু একা একটা অফিসে ইন্টারভিউ দিতে সাহস পায় না। তার মানে এই সমাজে ভয়ঙ্কর কিছু জীব আছে। এই জীব গুলো সব যুগেই সব জাগায়ই আছে। থাকবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই জীব গুলো কারো না কারো ছেলে, কারো ভাই, কারো মামা ইত্যাদি। এদের মধ্যে থেকেই তো আপনাকে কাউকে না কাউকে বেছে নিতে হবে বিয়ের জন্য। যে ছেলেটার সাথে কথা বলে, বা তার সাথে কিছুদিন মিশে আপনার মনে হচ্ছে- এই ছেলেটা খুব। আশে পাশের অনেকেই তাকে খুব ভালো বলেছে- কিন্তু বিশ্বাস করুন- এই ছেলেটিও ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। রাত জেগে পর্ণ ভিডিও দেখে। রাস্তায় চলাফেরা করার সময় মেয়েদের বুকের দিকে কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বেকার কোনো ছেলেকে বিয়ে করবেন না। ভুল করার আগে সিদ্ধান্ত নিতে আপনি সচেতন হন কাজেই আপনি যাকেই বিয়ে করেন না কেন, ধরেই নিবেন সে বিরাট বদ। এই বদকে নিয়েই সারা জীবন সংসার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা এই বদকে কিন্তু আপনি পারেন এক প্রেম ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করতে। দিনের পর দিন আপনার স্বচ্ছ ভালোবাসা সে স্বচ্ছ ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। নারীরা সাবধান থাকুন। বিয়ের সময় আবেগকে প্রাধান্য দিবেন না। যাঁদের কোনো বন্ধু নেই; যেসব পুরুষ লোকজনের মধ্যে প্রেমিকাকে একা ছেড়ে যান; রেস্তোরাঁ বা ক্যাফেতে ওয়েটারদের সঙ্গে যাঁরা খারাপ আচরণ করেন- এদের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকবেন।কথায় বলে পুরুষ যেন মেয়েদের না কাঁদায় স্বয়ং ঈশ্বর রাখেন তাদের চোখের জলের হিসাব। ঈশ্বরের কি খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই! জন্মের সময়ই তো মানূষ কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে আসে। মেয়েরা হাসেও বেশী, কাদেও বেশী। তাদের হাসির হিসাব রাখবে কে? সবচেয়ে ভালো হয় বিয়ে না করা। একা থাকাই সবচেয়ে উত্তম। মাদার তেরেসা বিয়ে করেননি, লতা মঙ্গেশকর বিয়ে করেননি, দু'দিন আগে তামিল নাড়ুর আম্মা (জয়ললিতা) বিয়ে করেননি। এমন অজস্র উদাহরন দেয়া যবে। (লেখাটা অগোছালো হওয়ার কারণ হলো- অফিসে কাজের ফাঁকে (লুকিয়ে লুকিয়ে) লিখেছি বলে।) সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২৯
false
rg
'মানঝি_ দ্য মাউন্টেন ম্যান' কেতন মেহতার নতুন মাত্রার ছবি! সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় হিন্দি ফিল্মে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন বলিউড নির্মাতা কেতন মেহতা। বিহারের গেহলৌর গ্রামের দশরথ মানঝি'র জীবনের সত্য কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত 'মানঝি' ছবিটি ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন চমক। ছবিটি 'দ্য মাউন্টেন ম্যান' নামে ইতিমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। বিহারের গেহলৌর গ্রামের দরিদ্র দশরথ মানঝি এক অদ্ভুত ব্যক্তি ছিলেন। যিনি একাই একটা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছিলেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার অমন চরম নিদর্শন কেবল ভারতীয় সাহিত্যেই এর আগে দেখা যায়। ছবিতে দশরথ মানঝির চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ খ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। আর দশরথ মানঝির স্ত্রী'র চরিত্রে অত্যন্ত সাহসী অভিনয় করেছেন ‘অহল্যা’ খ্যাত অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে। পরিচালক কেতন মেহতা এই 'মানঝি' ছবিতে এমন কিছু সাহসী শট নিয়েছেন, যা ভারতীয় সিনেমায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট 'মানঝি' মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে দেড় মিলিয়ন ডলার আয় করে। 'মানঝি' ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেন কেতন মেহতা, আনজুম রাজাবলী ও মহেন্দ্র ঝাকার। সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন রাজীব জৈন। ছবিটি প্রডিউস করেছেন নিনা লাথ গুপ্তা ও দীপা শাহী। ছবিটির গল্পটি এরকম- বিহারের গেহলৌর গ্রামের দরিদ্র দশরথ মানঝি নিজের স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন। স্ত্রীর নাম ফাগুনিয়া দেবী। গ্রামের পাশেই উঁচু পাহাড়। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ের জন্মের ঠিক কয়েক দিন আগে পাহাড় ডিঙিয়ে জল আনতে গিয়ে ফাগুনিয়া দেবী পাহাড় থেকে পড়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। স্বামী দশরথ মানঝি তার বন্ধু'র সহযোগিতায় ঘুর পথে ফাগুনিয়াকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে পেটের বাচ্চাকে বাঁচাতে সক্ষম হন কিন্তু ফাগুনিয়া দেবীকে আর বাঁচাতে পারেননি। স্ত্রীকে হারানোর পর দশরথ মানঝি মনে করেন ওই পাহাড় না থাকলে তার স্ত্রী ওভাবে পড়ে মারা যেত না। তাছাড়া ওই পাহাড়ের কারণেই ঘুর পথে শহরের হাসপাতালে যেতে অনেক সময় লাগে। তাই দশরথ মানঝি সিদ্ধান্ত নেয় একা একাই ওই পাহাড় কেটে ধ্বসিয়ে দেবেন। বিহারের গয়ার আত্তারি আর ওয়াজিরগঞ্জ ব্লকের মাঝে খাড়া দাঁড়িয়ে এক দৈত্যাকার পাথুরে পাহাড়, যার সামনেই গেহলৌর গ্রাম। ফাগুনিয়া দেবীর মৃত্যুই বদলে দিল এ গ্রামের ভূগোল। এ ঘটনা ৫৪ বছর আগের। এরপরেই শুরু হয় এ গল্পের হতদরিদ্র শ্রমিক দশরথের হাতে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর গ্রামের আর কাউকে যাতে অসুস্থ হয়ে পথেই না মরতে হয় তার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খাড়া পাহাড়টি, ওই পাহাড়টি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন দশরথ মানঝি। শেষ পর্যন্ত কারো সহায়তা না পেয়ে একাই পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজে নেমে পড়েন তিনি। সঙ্গী শুধু শাবল আর হাতুড়ি। একা হাতে দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনিকে নিত্যসঙ্গী করে পাথর ভাঙলেন দশরথ। তার নাম হয়ে গেল ‘পাহাড়-মানব’।বৃদ্ধ বাবার নিষেধ সত্ত্বেও দশরথ মানঝি ছেলেমেয়ে সংসার ফেলে একটানা ২২ বছর ধরে ওই পাহাড় কাটতে থাকেন। গ্রামের সবাই এক সময় দশরথ মানঝিকে পাগল ডাকতেন। ২৫ ফুট উঁচু ৩০ ফুট চওড়া ও ৩৬০ ফুট লম্বা পাহাড় কাটার পর শহরের হাসপাতালে যাবার জন্য একটা সোজা পথ তৈরি হয়। ১৯৬৩ সালে দশরথ মানঝি ওই পাহাড় কাটা শুরু করেন। আর ত্রিশ বছর পরে সেখানে চলাচলের মত রাস্তা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে দশরথ মানঝিকে গ্রামের সবাই পাগলা বাবা ডাকা শুরু করেন। দশরথ মানঝি একাই এমন একটি অসাধ্য কাজ করায় ভারত সরকার দশরথ মানঝিকে পরবর্তী সময়ে পুরস্কৃত করে। দশরথের গ্রাম থেকে নিকটবর্তী শহর ওয়াজিরগঞ্জের দূরত্ব ছিল ৬৫ কি.মি.। দশরথের সৌজন্যে সেই দূরত্ব কমে দাঁড়ায় ১৫ কি.মিটারে। ২০০৭ সালে দশরথ মানঝি মারা যাবার পর ২০১১ সালে ভারত সরকার ওই পাহাড় কাটা পথে গেহলৌরের সড়ক নির্মাণ করে। দশরথ যে পাথুরে পাহাড়টি কাটেন তার নাম ‘গেহলৌর পাহাড়’। এই মহতী সাহসী কর্মবীরের সম্মানে বিহার সরকার ‘গেহলৌর থেকে আমেথি’ পর্যন্ত যে রাস্তা নির্মাণ করেছেন তার নাম এখন ‘দশরথ মানঝি সড়ক’। ২০০৬ সালে মানঝিকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়া হয়। ২০০৭ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান দশরথ। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।ছবিতে দশরথ মানঝির চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অসাধারণ অভিনয় করেন। দশরথ মানঝির স্ত্রীর চরিত্রে রাধিকা আপ্তে অত্যন্ত সাহসী কিছু শট দিয়েছেন। যা ভারতীয় সিনেমায় এ যুগে বিরল। এছাড়া ল্যান্ডলর্ড মুখিয়া'র চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিগমাংশু ঢুলিয়া। মুখিয়ার ছেলে রুয়াবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পংকজ ত্রিপাঠী। সাংবাদিক অলোক ঝায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন গৌরব দ্বিবেদী। দশরথের বাবা মাগরুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আশরাফুল হক। লাউকি চরিত্রে উর্মিলা মহান্ত, শুকলাজি চরিত্রে জগৎ রাওয়াত, ঝুমরু চরিত্রে প্রশান্ত নারায়ণ, গোপালের বাবার চরিত্রে ভরদরাজ স্বামী অভিনয় করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী'র চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রডিউসার দীপা শাহী। 'মানঝি' ছবিতে গান লিখেছেন দীপক রামোলা, কেতন মেহতা ও কুমার। গানের কম্পোজ করেছেন সন্দেশ সান্দিলিয়া ও হিটসেন সোনিক। আর সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন ভাবীন শাস্ত্রী, পাওয়ানী পাণ্ডে ও দিব্য কুমার। কেতন মেহতা 'মানঝি' ছবিতে কাহিনী, গল্পের চিত্রায়ন, বস্তুনিষ্ঠতা, লোকেশান নির্বাচন, সেট, কস্টিউম, বিহারের গেহলৌর পাহাড়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, আচার, রিচুয়াল আর সমকালীন নকশাল আন্দোলনের যে সংমিশ্রণ করেছেন, তা সত্যি সত্যিই দর্শকদের মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ। দশরথ মানঝি চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অসাধারণ অভিনয় ছবিটিকে এক অনন্য উচ্চতায় ঠাই দিয়েছে। পরিচালকের কিছু সাহসী শট নায়িকা রাধিকা আপ্তে যে অমায়িক অভিনয় করেছেন, এটা সত্যি মুগ্ধ করার মত। বিশেষ করে কাদার মধ্যে নওয়াজ সিদ্দিকী ও রাধিকা আপ্তে'র যে শর্টটি এবং কূপের মধ্যে তাদের সঙ্গমের যে দৃশ্যায়ন, এটি সত্যিই অপূর্ব। বেশ কিছু এক্সপারিমেন্টাল শটেও পরিচালক মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। জয়তু কেতন মেহতা। জয়তু নওয়াজ সিদ্দিকী ও রাধিকা আপ্তে। জয়তু সিনেমা। ...............................২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:৩০
false
fe
দেশটি ভেঙে যাচ্ছে! _ মি শা হো সে ন একটি লেখা । পড়লাম । শেয়ার করলাম এখানে দেশটি ভেঙে যাচ্ছে! মি শা হো সে ন ------------------------------------------------------------------- সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী যেভাবে উচ্ছেদ হয়েছে, তা দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হতে পারে। কিছুদিন আগে সংসদ ভবনের চারপাশে একটি মানববন্ধন রচনা করা হয়। ধ্বনিত হয় ‘ইসলামকে রাজনীতির বাইরে রাখুন’ স্লোগান। এই ঘটনা দ্বারা প্রত্যয়ী হয়ে আমি পাকিস্তান সফর করি একই ধরনের অনুভূতির সন্ধানে। এ বছর জামরুদে আÍঘাতী বোমা হামলায় যখন ৮৫ জন নিহত হয়, তার কয়েক দিন পর আমি করাচি যাই। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলজুড়ে ওই হামলার খবর। ইসলাম অথবা ধর্মের নামে সহিংসতার খবর দিয়ে আবারও শিরোনাম লেখা হচ্ছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রের এক জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ১০০ দিনে পাকিস্তানে ৩৩২টি সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও পাকিস্তানে কেউই কিছু করছে না। রাজনীতিকরা বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, সাংবাদিকরা লিখছেন, কিন্তু কেউই রাস্তায় প্রতিবাদে নামছেন না। এর পরিবর্তে ১৬ কোটি লোক ঘরের ভেতরে আবদ্ধ রয়েছে এবং দেশের এই অবনতিশীল পরিস্থিতি অবলোকন করছে চা পানের ফাঁকে ফাঁকে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সেই দিনগুলো কোথায়, যার ওপর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? দু’দিন পর কয়েকটি ব্রিটিশ দৈনিকে একটি ১৭ বছরের মেয়ে সম্পর্কিত খবর ছাপা হয়। স্বামীর পরিবর্তে আরেকজনের সঙ্গে দেখা যাওয়ায় তাকে চাবুক মারা হয়েছে। এ সংক্রান্ত অনাকাক্সিক্ষত ভিডিওটি আমি দেখতে বাধ্য হই। প্রতিটি আঘাত আমার বিবেককে বিদ্ধ করে। তার এ অগ্নিপরীক্ষা তার স্বজনদের মতো আমাকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা শিরোনাম করেছে- ‘পাকিস্তানে ভয়ার্ত চিৎকার’। তবে আবারও লক্ষ্য করলাম, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের ভাষা সোচ্চার ও সংহত নয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওই উš§ত্ততা থেকে করাচি এখনও লাখ লাখ মাইল দূরে বলেই মনে হয়। এখানে এখনও আশা আছে। করাচি একটি কসমোপলিটন নগরী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। আমার অভিজ্ঞতা হল, পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের তুলনায় এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, আছে আন্দোলনও। তবে এখানে, দেশের উদারপন্থার এই কেন্দ্রে, প্রতিবাদকারীরা একটি বার্ষিক শিল্পকলা উৎসব ভণ্ডুল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। কেন? কারণ এটা নাকি তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে ‘লংঘন’ করেছে! যখন একটি উগ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী করাচিবাসীর বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তখন কি একইভাবে তাদের অধিকার লংঘিত হয় না? আবারও কথার তুবড়ি ছোটানো ছাড়া আর কিছুই নয়! আমি ভেবে পাই না, কেন গোটা নগরী বর্বরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। আমাদের মধ্যে যারা সমতাবাদে বিশ্বাসী, যদি কেবল তাদের কিছু দৃঢ় প্রত্যয় থাকত যা অন্যদের নেই, তাহলে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটতে শুরু করত। তাই এক অর্থে বলা যায়, পাকিস্তানে যদি বিপ্লব সংঘটিত হয়, তার সূচনা হবে করাচি থেকেই। নগরীটির এক ধরনের রূঢ়, তেজি অনুভূতি আছেÑ পরিচ্ছন্ন, সবুজ রাজধানী ইসলামাবাদে যার অভাব দেখা যায়। করাচির একটি সাহসী ও নির্ভীক পরিচয় রয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে এর নাগরিকদের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, এখানে নারীরা আপাদমস্তক ঢেকে রাখে না। তাদের আছে সজীব অভিব্যক্তি, কণ্ঠ ও নির্দেশনা। তারা স্বাধীন, অগ্রসর চিন্তাধারার অধিকারীÑ সাহসের সঙ্গে বলব? আবেদনময়ী। সোয়াতসহ পাকিস্তানের অন্যান্য দমিত অঞ্চলে যে আশার স্পন্দন শোনা যায় না, এখানে তরুণ ও উদ্যমীদের সমাবেশগুলোতে তা ধ্বনিত হয়। এখানে পাকিস্তানের একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের দেখা মেলে। যা প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক। আমি প্রায়ই ভাবতাম, বাংলাদেশ নানাভাবে বিভক্ত। কিন্তু এখন আমি উপলব্ধি করি, আমাদের আসল মূল্যবোধগুলো অভিন্ন : আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই খাবার খাই, একই পোশাক পরি, দেখতে একইরকম এবং একই ভৌগোলিক এলাকায় বসবাস করি। আমরা একটি জাতি; মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ- সবার একটি অভিন্ন লক্ষ্য আছে- গণতন্ত্র। এই একটি আশা কখনও ‘ধর্মীয়’ উপসর্গে ভুগবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের মানুষের নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার মতো কিছুই নেই। ১৯৭১ সালের বিভক্তির পর থেকে বিশাল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ (অন্তত দুজন রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যাকাণ্ড, চারবার জরুরি অবস্থা, পাঁচটি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং ১৯ বার প্রধানমন্ত্রী বদলের সম্মুখীন) জাতি হিসেবে আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছি। এর বিপরীতে পাকিস্তান একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হওয়ার কিনারায়। অবশ্য আমি পশ্চিমা কূটনীতিকদের এ উদ্ধৃতিটি ব্যবহারে ঘৃণা করি। দেশটি (আমি এটাকে একটি জাতি বলতে চাই না) ভেঙে পড়ছে। ধর্মকে গণতন্ত্রের সঙ্গে মেশানোর ধারণা স্পষ্টভাবেই কোন টেকসই বিকল্প নয়। জনগণকে এখন বা চিরদিনের জন্য শান্তি ধরে রাখতে হবে। মিশা হোসেন : বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক ---------------------------------------------------------------- দৈনিক যুগান্তর।২৯ এপ্রিল ২০০৯ প্রকাশিত ছবি - ক্রিস গ্রুমবকো সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৬:৫৩
false
mk
গোলাম আযমের জানাজা ও খালেদার আশাহত সফর কুখ্যাত রাজাকার ও নারী ধর্ষণকারী সাঈদীর সাজার পরিমাণ সুপ্রীমকোর্ট থেকে কমে যাওয়া, গোলাম আযমের জানাজা দেশের জাতীয় মসজিদে পুলিশ প্রহরায় হওয়ার পরে, গোটা জাতির সঙ্গে নিজেও কিছুটা হতাশ ছিলাম। এই হতাশার সময়ে নিজামীর মামলার রায়ের দিন আসে। কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও একটি বিশেষ স্থানে ভর করে নিশ্চিত ছিলাম নিজামীর ফাঁসি হবে। এই বিশেষ স্থানটি মাননীয় বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম। কারণ, বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমকে যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন তিনি আপাদমস্তক সৎ ও দক্ষ একজন বিচারক। আমাদের দেশে সততার সংজ্ঞা ভুল দেয়া হয়। অনেক শিক্ষিত মানুষকে বলতে শুনেছি, জামায়াতের অমুক ব্যক্তি খুব সৎ। বিএনপির অমুক লোকটি খুব সৎ। এই ধরনের কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের করুণা করা ও ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কারণ, একটা লোক জামায়াত করে, সে কীভাবে সৎ হবে, সে নিজের দেশ মানে না, দেশের সংবিধান মানে না, দেশের জন্য যাঁরা আত্মদান করেছে তাঁদের সম্মান করে না, সে নারী ধর্ষককে সমর্থন করে, হত্যাকে সমর্থন করে, সে কীভাবে সৎ হবে? এর থেকে বড় দুর্বৃত্ত একটি দেশে আর কারা হতে পারে? তেমনি যে বিএনপি করে তার শুরুটা মিথ্যে দিয়ে। দিনের মতো সত্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই সত্যকে যে মানে না, সেখানে মিথ্যেকে হাজির করে। যে মিথ্যে বলে, মিথ্যে বিশ্বাস করে, সে কীভাবে সৎ হবে? সততা বিচার করতে গেলে দেখতে হয়, একটি মানুষের দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটুকু। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের এই দায়বদ্ধতা শতভাগ। তাই হতাশার কুয়াশা আকাশে জমা হলেও সূর্য হিসেবে আশা ছিল ইনায়েতুর রহিম ও তাঁর নেতৃত্বের বিচারপতিগণ। এর আগে জাতি সে উদাহরণ পেয়েছে, কারণ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তাঁর প্রমাণ রেখেছেন, একজন বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা সাঈদীকে বেকসুর খালাস দেন, প্রধান বিচারপতি ও বাকি দু’জন বিচারপতি আমৃত্যু জেল দিলেও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তাঁর ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। সাঈদীর ফাঁসির রায় বহাল রাখার ভিতর দিয়ে শতভাগ সততা, দেশ ও মানুষের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করেছেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। সাবেক বিচারপতি নাঈমুদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন ও সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী তাঁদের অনেক বক্তৃতায় বলে গেছেন, কোর্টের রায় নিয়ে সমালোচনা করা যায়। তাছাড়া ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় দেখি রায় নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। সুপ্রীমকোর্টের দেয়া সাঈদীর রায় কোন মতে সমালোচার উর্ধে নয়। এখানে বিচারপতিরাও সমালোচনার উর্ধে নন। বরং এই রায়ের ভিতর দিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য একটি দিকও বেরিয়ে এসেছে, যা হলো বাংলাদেশে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা কনভেনশন অন্তত থাকা দরকার যে, স্বাধীনতার বিরোধিতার সঙ্গে যে ব্যক্তির বা তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাকে বাংলাদেশে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে না। কারণ, তার কাছ থেকে দেশ কখনও সঠিক বিচার পাবে না। যেমন সাঈদী যে হত্যা ও ধর্ষণ করেছিল ও করিয়েছিল এগুলো সাধারণ হত্যা ও ধর্ষণ হিসেবে দেখার কোন সুযোগ নেই। সে এই দেশ সৃষ্টিকে ঠেকানোর জন্যে, দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষ যাতে যোগ না দেয় এই জন্য হত্যা ও ধর্ষণ করে মানুষকে ভীত করে তুলতে চেয়েছিল। তাই সাঈদীর হত্যাকা- সাধারণ হত্যাকা-ের থেকে অনেক জঘন্য ও পরিকল্পিত। এ কারণে এখানে তার মৃত্যুদ-ের বাইরে কোন সাজা হতে পারে না। এখানে দেখা যাচ্ছে, একজন বিচারপতি তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। আমাদের সমাজ গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উচিত ওই বিচারকের নিজের ও পরিবারের ঠিকুজি খোঁজ করা। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার ঘাটতির উপাদান তার নিজের ও পরিবারের ভিতর পাওয়া যাবে। এই রক্তে প্রবাহিত ঘাটতি ছাড়া কোনমতেই সাঈদীকে কোন সৎ বাঙালী বিচারক বেকসুর খালাস দিতে পারে না। ঠিক তেমনি ওই সুপ্রীমকোর্টের আরেক বিচারপতি এখনও বিচারপতি থাকতে পারে কিনা এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। কারণ, একজন বিচারপতি যখন এজলাসে বসে স্বীকার করেন, আমি একাত্তরে শান্তি কমিটির মেম্বর ছিলাম, তারপরে ওই বিচারপতি আর বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টে কেন কোন কোর্টে বিচারপতি থাকতে পারেন কিনা এটা দেশের জাতীয় সংসদকে বিবেচনা করা উচিত। একাত্তরের শান্তি কমিটি বাংলাদেশের গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড গোলাম আযমের সৃষ্টি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে শক্তি সংগঠিত করার জন্য টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযম এই শান্তি কমিটি গঠন করে। আর সেই শান্তি কমিটির মেম্বর বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হবেন এবং তিনি এজলাসে বসে শান্তি কমিটির পক্ষে সাফাই গাইবেন, এরপরেও দেশের সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি থাকবেন এটা কীভাবে হয়? দেশের জাতীয় সংসদ যদি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেয় তাহলে এই জাতীয় সংসদও কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি, দেশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের কর্তব্যে অবহেলা করবে। যাহোক, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দেশ ও জাতির প্রতি এই নির্মোহ দায়বদ্ধতা সাঈদীর রায় ঘিরে সৃষ্ট হতাশার মাঝেও একটি আশা দিয়ে গিয়েছিল। এই আশা ছিল, বিচারপতি যদি সততার সঙ্গে দেশের প্রতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হন তাহলে নিজামীর ফাঁসি হবে। এক্ষেত্রে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের ওপর শতভাগ আস্থা রাখা রায়। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, দেশের প্রতি ও মানুষের প্রতি সৎ দায়বদ্ধতাই ছিল ভরসা। সেটা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে বিচারকগণ জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। তবে অন্যদিকে কলঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। দেশের জাতীয় মসজিদে পুলিশ প্রহরায় কুখ্যাত গোলাম আযমের জানাজা হওয়া শুধু জাতির জন্য কলঙ্ক বা অপমান নয়, জাতির সমস্ত অহঙ্কার, সমস্ত বীরত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া। ‘বাঁধনের এক পাটি জুতো’ না থাকলে কুখ্যাত গোলাম আযমের এই জানাজা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের এই প্রজন্মকে ঘৃণার সামগ্রী হিসেবে উপস্থিত করত। এখন শুধু ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এইটুকু সান্ত¡না যে একটি ছেলে অন্তত তখনও বেঁচে ছিল। আর একটি জাতিতে একজন বেঁচে থাকাও যে কত বড় তার প্রমাণ বাঁধন। সেদিন বাঁধনকে দেখে মনে হলো, জানি না বাঁধন কতটা রবীন্দ্রনাথকে পড়েছে তবে মনে হলো আমাদের এই সময়ের বাঙালীর ভিতর বাঁধনের মতো রবীন্দ্রনাথকে কেউ আত্মস্থ করতে পারেনি। আমরা বার বার গাই, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো- কিন্তু সেই চলার সাহস আমরা কেউ বুকে ধরতে পারিনি। বাঁধন পেরেছে। এখন বার বার প্রশ্ন আসছে, বাঁধনকে কেন এই জাতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য দায়ভার নিতে হলো? অনেকে এর যোগসূত্র খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রীর ইউনাইটেড আরব এ্যামিরাটস সফর নিয়ে। কারণ, গোলাম আযমের জানাজা ছিল প্রধানমন্ত্রীর ইউনাইটেড আরব আমিরাত সফরের দিনে। যারা ইউনাইটেড আরব আমিরাত সম্পর্কে জানেন, তারা সকলে জানেন, ওই দেশটি মূলত পাকিস্তানী জঙ্গীদের একটি ঘাঁটি। এমনকি ভারতের জঙ্গী দাউদ ইব্রাহিম থেকে শুরু করে সারাবিশ্বের জঙ্গীদের একটি নিরাপদ স্থান। বিশেষ করে, পাকিস্তানী আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগসূত্র আছে এমন জঙ্গীদের জন্য এটা অভয়ারণ্য। এ কারণে বাংলাদেশের পাকিস্তানী আইএসআই নিয়ন্ত্রিত জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে এ দেশটির ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। তাদেরই পরামর্শে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশের ভিসা বন্ধ, শ্রমিক নেয়া বন্ধসহ অনেক কিছু করছে। জামায়াত ও বিএনপির জঙ্গী, তারেক রহমান অনেক কিছুর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ। যাহোক বাংলাদেশ সরকার চেয়েছিল, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। আর এই সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থেই হয়তো ছাড় দেয়া হয়েছিল গোলাম আযমের জানাজার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীকে। সরকারে থাকলে কখনও কখনও এমন ভুল সব সরকারই করে। যেমন ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অক্ষমতা দেখে বঙ্গবন্ধু আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। সেবার জাতিসংঘ অধিবেশন থেকে ওয়াশিংটন যাবার জন্য বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন এক সাংবাদিক নির্বাচন করেছিলেন, যিনি পাকিস্তান ও আমেরিকার খুব ঘনিষ্ঠ। ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের পর ভারতীয় পার্লামেন্টে মিস গান্ধী ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে বিবৃতি দেন সেখানে ওই সাংবাদিকের নাম ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে। আর ওয়াশিংটন সফর যে কতটুকু সফল হয়েছিল তার প্রমাণ তো ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার ভূমিকা। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্যদিকে বর্তমান সরকার প্রধানের ইউনাইডেট আরব আমিরাত (ইউএই) সফর শেষ হওয়ার আগেই মির্জা ফখরুলের নাচুনিই বলে দিয়েছে সরকার গোলাম আযমের জানাজায় ছাড় দিলেও বিএনপি-জামায়াত সরকারকে ছাড় দেয়নি। তারা তাদের বন্ধু ইউএইয়ের সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ রেখেছিল, তাদের মূলদেশ পাকিস্তানও তাদের পক্ষে ছিল। যে কারণে সফর শেষ হওয়ার আগেই রাজাকার পুত্র মির্জা নাচতে শুরু করে দিলেন সফর ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ তারা সফল হয়েছেন। বাস্তবেও এটা সত্য, সরকারপ্রধানের এই সফর শতভাগ ব্যর্থ না হলেও একটি আশাহত সফর। যেজন্য এ সফর ছিল সেই জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে কোন লাভ হয়নি। তিনটি চুক্তি হয়েছে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলে প্রত্যেকটা সরকার তাদের নানান হিসাব-নিকাশ থেকে কাজ করে। তাদের কাছে নতুন তথ্য উপাত্ত আসে সেগুলো বিশ্লেষণ করে তারা সিদ্ধান্ত নেয়। হয়ত তেমনি হিসাব করেই ইউএই সফরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না তা মনে হয় এখন আর বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বরং এই ভুলের সঙ্গে ইতিহাসের অন্য ভুল মিলিয়ে দেখে ভবিষ্যত চিন্তা করা উচিত। যেমন ১৯৭৪-এর বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর ওয়াশিংটন সফর ভুল ছিল। কিন্তু একই ধরনের ভুলে সব সময়ই একই ধরনের উপাদান থাকে। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৪-এর আমেরিকা সফরে আমেরিকা ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককেই নির্বাচন করা হয়েছিল। কারণ, ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। এখনও প্রধানমন্ত্রীর পাশে পাকিস্তান ও জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক। এই ছোট ছোট মিলগুলোই অনেক বড় কিছু বুঝতে সহজ করে দেয়। সেগুলো মিলিয়ে দেখলে ভাল করবেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ চীন, জাপান, জাতিসংঘ অধিবেশনে গিয়ে একাধিক সফলতার পরে কেন এই ইউএইতে আশাহত হওয়া? অন্তত সহজ বিষয়টি, কারণ শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ইউএইয়ের বন্ধুত্ব কখনও এভাবে হবে না। ইউএই বাস্তবে বকলমে একটি পাকিস্তান। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হয় না। তবে হ্যাঁ, আরব বিশ্ব শেখ হাসিনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হবে। তার জন্য কোন পাকিস্তানী বা জামায়াতকে ছাড় দেয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পশ্চিমা বিশ্ব ও এশীয় শক্তিদের এখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দরকার। এর কোন বিকল্প নেই। অন্যদিকে আরব বিশ্ব আমেরিকার হাতের একটি খেলনা। আমেরিকার ইচ্ছে ছাড়া সৌদি মরুভূমিতে একটি বালু কণাও নড়ে না। তাই গণতান্ত্রিক বিশ্বে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের নেতৃত্ব যত দৃঢ় হবে, আরব বিশ্ব ততই বাধ্য হবে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। এখানে পাকিস্তানীদের ছাড় দেয়ার কোন দরকার নেই।আর গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দৃঢ় করবে এই যুদ্ধাপরাধীর বিচার। এই নিজামীদের ফাঁসি কার্যকর করা। এ নিয়ে আর বেশিদিন অপেক্ষা করা উচিত নয়। বিচার শেষ ও রায় কার্যকর করে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। এরা যতদিন থাকবে ততদিন জেএমবি, হুজি ইত্যাদি এমনকি আইএস এসব পথে তারা দেশকে নেয়ার চেষ্টা করবে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর, জঙ্গী দমনের জন্যে অবিলম্বে পুলিশের ভিতর বা আলাদা করে হলেও একটি জঙ্গী দমন বাহিনী বা ইউনিট সৃষ্টি করে দ্রুত জঙ্গী দমনের কাজগুলো করা দরকার। পাশাপাশি মনে রাখা দরকার, বিএনপি জঙ্গীর বাইরে কিছু নয়। খালেদা জিয়া জঙ্গী আশ্রয়দাতা। তাই তাদের জঙ্গী কার্যক্রমও দমন করতে হবে এ সরকারকে। এগুলো সাফল্যের সঙ্গে করলে অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, তাতে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এই সত্য পথ থাকতে গোলাম আযমের জানাজার কালিমা জাতির কপালে দিতে সহায়তা করার কোন দরকার ছিল না সরকারের। সহায়তা বলছি এ কারণে, এই জানাজার জন্য সরকার একা দায়ী নয়। জাতি হিসেবে আমরাও কিন্তু রাজাকারদের সঙ্গে আপোস করেছি। তা না হলে ওইদিন যদি ১০ হাজার মানুষ সকাল থেকে কুখ্যাত ওই নারীধর্ষক, খুনীর জানাজা ঠেকাতে জাতীয় মসজিদের সামনে জড়ো হতো, কার সাধ্য ছিল ওখানে ওই পাকিস্তানী রাজাকারের জানাজা করে। গোলাম আযমের জানাজার সপক্ষে কি মিডিয়ায় ওকলাতি হয়নি? তাই সরকারের কাঁধে সব দোষ না চাপিয়ে নিজেদের দায়ও নিজেদের নিতে হবে। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ-তরুণীরা কাদের ইন্ধনে তিন ভাগে ভাগ হয়ে আছে? এই বিভক্তি রাজাকার ও নব্যরাজাকারদের সহায়তা করছে। যত দ্রুত সম্ভব গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক তরুণদের এক হওয়া দরকার। ওখানে উগ্রতা কমাতে হবে, হঠকারিতা কমাতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মনে রাখা উচিত তারা যুদ্ধে নেমেছে। কারও কারও মাথায় দেখছি হঠকারী বামবুদ্ধি অর্থাৎ সরকার মানেই সে খারাপ। এ সব ভুল থেকে বেরিয়ে এসে এক হতে হবে। মনে রাখা দরকার, তরুণ প্রজন্মের ঐক্য কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত করেছিল। এই ঐক্যই সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করবে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আল-বদর প্রধান নিজামীর ফাঁসির রায় হওয়ার দিনটি একটি শুভদিন। কারণ, এ দিনে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল। তাদের উদ্দেশে বলতে পারলো, দেখ আমরা তোমাদের হত্যাকারীর বিচার করে ফাঁসির রায় দিয়েছি। এখন বুদ্ধিজীবীদের রক্তের শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমগ্র তরুণ সমাজের ঐক্য সূচনা হোক এই কামনা করি এ শুভদিনে।
false
hm
আকাশকুসুম সেদিন স্বপ্নে খুব মনোযোগ দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর নামে হত্যা মামলার তদন্ত দেখছিলাম। চাপাবাজি নয় একটুও, একেবারে বর্ণে বর্ণে সত্যি। মহাত্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ খুব শক্ত, তিনি কাকে বা কাদের যেন রীতিমতো ছুরি মেরে খুন করেছেন। ছুরিটাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে এনে সবাইকে দেখানো হচ্ছে। বাপুজি তাঁর সামান্য বস্ত্র পরে এক কোণায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছেন। কে যেন খুব হাঁকডাক দিচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেলো সময়মতো। বেশিরভাগ স্বপ্নই মানুষ ভুলে যায় ঘুম ভাঙার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, এটা বেশ গেঁথে গেছে মাথার ভেতরে। তবে কিছু আকাশকুসুম জেগে জেগেই দেখি। কিছুদিন আগে জার্মান রেলসংস্থা ডয়েচে বান এর ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবার রেল যোগাযোগের হালত যাচাই করার জন্যে। জার্মান রেলযোগাযোগ বেশ কার্যকরী জিনিস, কিছু জিনিস বাদ দিলে বেশ উপযোগীই বলা চলে, যদিও অনেকেই রেলে চলাচলের বদলে মিটফার (পেইড লিফট বলা চলে) পছন্দ করেন, কিছুটা আর্থিক কারণে, কিছুটা চলার স্বস্তির জন্যে। আমার আকাশকুসুম ফুটে উঠেছিলো এমন, যে একদিন বাংলাদেশেও রেলযোগাযোগ এমনি পল্লবিত হয়ে উঠবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, বা ঢাকা থেকে কুমিল্লা, কিংবা কিশোরগঞ্জ থেকে লাকসামযাত্রাও সহজ হয়ে উঠবে রেলের কল্যাণে। আর, নতুন লাইন বসুক না বসুক, টিকেট কাটার ব্যবস্থাটা সহজ হয়ে উঠবে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আমরা মুখে প্রচুর ফেনা তুললেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত করতে পারিনি। ব্যাংকিং তার মধ্যে একটা। নিরাপত্তার খাতিরে অনলাইন লেনদেন দেশে বিকশিত হতে পারেনি। এটিএম বুথ-ব্যবস্থা যদিও তৃতীয় প্রজন্মের দেশী ব্যাংক আর বিদেশী ব্যাংকগুলির কল্যাণে সম্প্রসারিত হয়েছে, নিরাপত্তার কথা ভাবলে সেগুলি থেকেও সাবধান হতে হয়। হের চৌধুরী একবার জানালেন, তাঁর এক পরিচিত ভদ্রলোককে রাত পৌনে বারোটার দিকে ছিনতাইকারী ধরে পাকড়াও করে একটা এটিএম বুথে নিয়ে গেছে। সেখানে দিনে সর্বোচ্চ কুড়ি হাজার টাকা তোলা যায়। এগারোটা পঞ্চান্নতে একবার, আর বারোটা পাঁচে আরেকবার সেই ভদ্রলোককে মোট চল্লিশ হাজার টাকা তুলে সশস্ত্র ছিনতাইকারীর হাতে তুলে দিতে হয়েছিলো। একই ঘটনা ঘটতে পারে অনলাইন ব্যাঙ্কিঙের ক্ষেত্রেও। তবুও বলি, অনলাইন ব্যাংকিঙের সুবিধাগুলো দেশে জরুরি ভিত্তিতে চালু করা উচিত। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যতবার ফি জমা দিতে যেতাম, এই কথাটা মাথায় ঘুরতো। পুরো একটা দিন জলাঞ্জলি দিতে হতো ফি দিতে গিয়ে, হাজার তিনেক ছাত্রছাত্রীর জন্যে তিন বা চারজন অসহায় ব্যাংককর্মী সেখানে মুখে ফেনা তুলে কাজ করতেন, তাদের সামনে ছোট ঘরে ঘিঞ্জি লাইন ধরে আমরাও মুখে ফেনা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এই একই সফেন দৃশ্য প্রতিদিন প্রত্যেকটা সরকারি ব্যাঙ্কে দেখা যায়, দেখা যায় কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কেও। অথচ খুব সহজেই এই ঝামেলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতো বলে বিশ্বাস করি। যে কোন ধরনের বিল যদি অনলাইনে মেটানোর সুযোগ দেয়া হতো গ্রাহকদের, তাহলে যে বিপুল পরিমাণ সময় বাঁচতো মানুষের, তা অন্য কাজে লাগতো। কোন বিল দিতে যাওয়া মানেই বিশ-তিরিশ টাকা রিকশাভাড়া খরচ, দেড় থেকে তিন ঘন্টা সময় পন্ড। একে মোট গ্রাহক সংখ্যা দিয়ে গুণ করা হলে ক্ষতির মোট পরিমাণ বেরিয়ে আসে। এ কথা সত্য যে টেলিযোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু তা মানুষের জীবনকে যতটুকু সহজ করে তুলতে পারতো, সেই সম্ভাবনার (পোটেনশিয়াল) কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে? ঢাকা থেকে রেলে চট্টগ্রাম যেতে হলে আমার বন্ধু দস্তগীরকে মিরপুর থেকে কমলাপুর যেতে হচ্ছে টিকেট কেনার জন্যে। রেলের টিকেটের সাথে যোগ করতে হবে এই সময় আর যাতায়াতের খরচ। যদি রেলের টিকেট কেনার ব্যবস্থা অনলাইন হতো, তাহলে বাড়তি খরচটা দস্তু হারামজাদার বহন করতে হতো না। সে অনলাইনে টিকেট বুক করতো, উত্তরে একটা বড়সড় বারকোড পাঠানো হতো তাকে, সেটা প্রিন্ট করে নিয়ে সে যাত্রার সময় স্টেশনে হাজির হতো, বারকোড রিডার দিয়ে চেক করে টিটি তাকে স্টেশনে ঢুকতে দিতো। দস্তু যদি বাসে করে মিরপুর থেকে কমলাপুর যাওয়া-আসা করে, তাহলে তার খরচ হবে পঁচিশ টাকা আর তিনঘন্টা। দস্তু যদি ট্যাক্সি করে যায়, তাহলে তার খরচ হবে আড়াইশো টাকা আর দুইঘন্টা। ওদিকে একটা প্রিন্ট আউটের জন্যে দস্তুর খরচ পড়তো একটাকা আর এক মিনিটের মতো। আমাদের রেলের টিকেট ব্যবস্থা একটা অব্যক্ত মোটাসোটা অপরচুনিটি কস্টের বোঝা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে, অযথাই, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করে।
false
mk
জঙ্গিরা কেন মাথা চাড়া দিচ্ছে_ গোলাম মোস্তফা রচিত বিশ্বনবী (সা) গ্রন্থ থেকে দুটি বড় উদ্ধৃতির প্রাসঙ্গিক অংশ উল্লেখপূর্বক আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। মক্কা বিজয়ের আগে মুতা অভিযানের প্রাক্কালে অভিযাত্রীদের সকলকে হযরত মুহাম্মদ (সা) উপদেশ দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘সাবধান! কোন সাধু-সন্ন্যাসীকে, বালক-বালিকাকে বা স্ত্রীলোকদের বধ করিও না।’ (গোলাম মোস্তফা, বিশ্বনবী, পৃ. ৩০৮)। মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানের এক পর্যায়ে নজরান প্রদেশের একদল খ্রিস্টান মদিনায় উপস্থিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সেখানে বসবাসের আগ্রহ প্রকাশ করেন। মহানবী (সা) তাদেরকে বসবাসের অনুমতি দেন এবং ঘোষণা করেন- ‘নজরানের পাদ্রী, পুরোহিত ও সাধারণ নাগরিকদের প্রতি আল্লাহর নামে তাঁহার রসুল মুহম্মদ (সা) এই প্রতিজ্ঞা করিতেছে যে, সর্বপ্রকার সম্ভবপর চেষ্টা দ্বারা আমরা তাহাদিগকে নিরাপদ রাখিব, তাহাদের দেশ, তাহাদের জীবন ও ধনসম্পদ অক্ষুণœ থাকিবে, তাহাদের ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হইবে না, কোন ধর্মযাজক বা পুরোহিতকে পদচ্যুত করা হইবে না, কোন সন্ন্যাসীর সাধনায় ব্যাঘাত জন্মানো হইবে না’ (প্রাগুক্ত পৃ. ৩৩৩)।গত ৫ জুন রবিবার চট্টগ্রামে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ একজন গৃহিণীকে, তাঁর সাত বছরের সন্তানের সামনে। একই দিনে নাটোরের বনপাড়ায় একজন নিরীহ খ্রিস্টান দোকানদারকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, নাম মাহমুদা আক্তার মিতু এবং দ্বিতীয়জনের নাম সুনীল গোমেজ। লেখার শুরুতে বিশ্বনবী (সা) গ্রন্থ থেকে দুটি উদ্ধৃতির অংশ উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আলোচ্য দুটি হত্যাকা-ের জন্য সঙ্গতকারণেই যাদেরকে প্রবলভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে তারা পবিত্র ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে একের পর এক এই ধরনের গুপ্তহত্যা, টার্গেটেড কিলিং চালাচ্ছে। এটা যে ইসলাম ধর্মের কত বড় অবমাননা এবং নবী (সা)-এর নির্দেশের লঙ্ঘন, উপরের দুটি উদ্ধৃতিই তার প্রমাণ বহন করে। এ যাবত যারা ব্যক্তিগতভাবে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও জীবন বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে চারটি শ্রেণীগত চিত্র পাওয়া যায়। প্রথমত. ইসলাম ধর্মের আলেম ও পীর, ফকির, যারা উগ্রবাদিতা, ওয়াহাবিতন্ত্র ও ফেতনা ফ্যাসাদের বিরোধী এবং নিজেরা চিন্তা চেতনায় উদার, সহিষ্ণু ও শান্তিপ্রিয়। এই শ্রেণীতে পড়ে জঙ্গীদের হাতে নিহত হয়েছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, প্রখ্যাত ইসলামিক আলেম মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী, পীর খিজির হায়াত খান, যাত্রাবাড়ীর কথিত পীর লুৎফর রহমান এবং চট্টগ্রামের কথিত ন্যাংটা ফকির। দ্বিতীয়ত. হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের সাধারণ মানুষ, ধর্মযাজক ও গুরু যার সাম্প্রতিক শিকার নাটোরের বনপাড়ার সুনীল গোমেজ এবং ৭ জুনে হত্যার শিকার হওয়া ঝিনাইদহের হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল। তৃতীয়ত. বাঙালী সংস্কৃতির লালন-পালনকারী এবং তার বিস্তৃতির জন্য কাজ করেন এমন সব মানুষ এবং যারা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। এ শ্রেণীর সর্বশেষ শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। হুমকির মুখে রয়েছেন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক। চতুর্থত. মুক্তচিন্তার কিছু ব্লগার, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় এরা নাকি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেন। তবে অদম্য সাহসী, আইকন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতারের স্ত্রীকে হত্যা করে জঙ্গীরা বোধহয় আরেকটি নতুন ফ্রন্ট ওপেন করলেন। নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন পুলিশের প্রতি। উল্লেখিত চার-পাঁচ শ্রেণীর বাইরে গত বছর দুই অচেনা, অজানা নিরীহ বিদেশীকে হত্যা করা হয়। একজন ইতালির সিজার তাভেলা, অন্যজন জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও। এই দুই জনের হত্যার সঙ্গে জঙ্গী কানেকশন থাকলেও থাকতে পারে, তবে এর পেছনে মূলত নেপথ্যের ভূমিকায় গডফাদারের কাজ করেছে দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক চক্রান্ত, যারা শেখ হাসিনার সরকারকে দ্রুত ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চায় অথবা নিদেনপক্ষে চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। সে সময়ে এই বিষয়ের ওপর কয়েকটি দৈনিকে একাধিকবার লিখেছি বিধায় আজকে আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি না। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের সিআইয়ের নিজস্ব লোক রিতা কর্টেজ নামক এক ইহুদী দ্বারা পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটা সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক আইএসের নিজস্ব অথবা সকলের কাছে পরিচিত কোন সূত্রের উল্লেখ না করে প্রতিটি গুপ্ত হত্যার পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার করছে বাংলাদেশে এসব হত্যাকা- নাকি চালাচ্ছে সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক আইএস সদস্যরা। এর থেকে মিথ্যাচার এবং নিম্নমানের ষড়যন্ত্র আর হতে পারে না। আল কায়েদার বর্তমান প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি একটা বই লিখেছেন, যার নাম ‘দ্য নাইটস (শহরমযঃং) আন্ডার প্রোফেট ব্যানারস’। ওই বইয়ে আল কায়েদার মতে কারা তাদের শত্রু এবং শত্রুদের পরাজিত করার যুদ্ধ কৌশলের বর্ণনা রয়েছে। এই বইয়ের বর্ণনা অনুসারে এবং ২০১৪ সালে আইএস সৃষ্টি হওয়ার শুরু থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্যান্য দেশে যত আক্রমণ চালিয়েছে সে সব টার্গেটে বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রমাণ হয় যে, কেবল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন ধর্মের যাজক ও গুরু হওয়ার জন্য বা ভিন্ন মতাদর্শের জন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর একটি আক্রমণ ও হত্যাকা- আইএস চালায়নি। সিরিয়ায় প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার শতকরা দশভাগ খ্রিস্টান। সিরিয়ায় তো আইএসের সীমাহীন দৌরাত্ম্য ও ক্ষমতা রয়েছে। তারপরও কেবল খ্রিস্টান হওয়ার জন্য স্বতন্ত্রভাবে কারও ওপর একটি আক্রমণও আইএস চালায়নি, যা বাংলাদেশের জঙ্গীরা করছে। সুতরাং আইএস নয়, বাংলাদেশের জঙ্গীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথমত. ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তারা প্রমাণ করতে চায় এ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যাতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান অন্যরকম উষ্ণ সম্পর্কের চিড় ধরে, যা এখন জামায়াত-বিএনপির অন্যতম একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ হওয়ার অজুহাতে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সরকার নরম হলে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- রহিত হবে এবং জামায়াত অস্তিত্বের সঙ্কট কাটিয়ে আবার শ্বাস নেয়ার সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত. সরাসরি জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথকে সুগম করা। অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা ভীত হয়ে দেশ ছেড়ে গেলে বাংলাদেশ একটা মনোলিথিক রাষ্ট্র হবে এবং আবার ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণার পথ সুগম হবে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা অবাধে যে রকম বড় বড় জঙ্গী তৎপরতা চালাতে পেরেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই স্কেল ও মাত্রায় একটি ঘটনাও তারা ঘটাতে পারেনি। সেটি করতে পারলে এতদিনে বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া বা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যেত। কোন কোন আন্তর্জাতিক চক্র এটাই চায় তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য এখানে। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। শুরু হয় অভাবনীয় গুপ্তহত্যা, টার্গেটেড কিলিং। টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়া হয় এমন সব মানুষ ও স্থানকে যা সকলের কল্পনার বাইরে। অলি-গলি, গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে বেছে নেয়া হয়, যাকে নিরাপত্তার ভাষায় বলা হয় সফ্্ট টার্গেট। এ সমস্ত গুপ্তহত্যা বন্ধে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। অনেক সময় আমাদের কাছেও মনে হয়েছে তাহলে পুলিশ কি দিশেহারা হয়ে গেল। প্রশ্ন ওঠে জঙ্গীদের কৌশলের কাছে পুলিশের গোয়েন্দারা কি হেরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের এক অদম্য সাহসী অফিসার বাবুল আকতার হয়ে ওঠেন জঙ্গীদের আতঙ্ক। নিজের কর্তব্য পালনে সততা ও দায়িত্বকে ব্রত মেনে জঙ্গী দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখান পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতার। তারই নির্মম, বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়েছে জঙ্গীরা বাবুল আকতারের স্ত্রীকে হত্যার মাধ্যমে। সরাসরি হুমকির কথা জানা থাকা সত্ত্বেও বাবুল আকতারের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ অফিসারের পরিবারকে চট্টগ্রাম পুলিশ নিরাপত্তা প্রদানে কেন ব্যর্থ হলো, এই কথাটি আজ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের কারসাজির কথা আবার সামনে এসেছে। তবে একজন নিরস্ত্র, নিরীহ নারীকে একলা রাস্তায় পেয়ে হত্যা করা চরম কাপুরুষোচিত কাজ। সমস্ত মানবতা, সভ্যতা ও ধর্মের বাণীকে তারা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি ঔদ্ধত্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই এহেন জঙ্গীদের প্রতি মানবতার দায় দেখাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। রাষ্ট্রকে অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর হতে হবে। রাষ্ট্রের পুলিশ জঙ্গীদের এই ঔদ্ধত্য বর্বর চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দেবে- এটাই মানুষ দেখতে চায়। সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৪৬
false