label
stringclasses
6 values
text
stringlengths
1.57k
117k
is_valid
bool
1 class
hm
কাবার্ডের ভেতরে কঙ্কালগুলো (এক) বয়স তো কম হলো না। ৭০-৮০ তো হবেই। কত পাপ করেছি এ জীবনে। প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেরিয়ে পাপ করে এসেছি এমন ঘটনাও কম নয়। তাই ঠিক করেছি কাবার্ডের কিছু বাছাই করা কঙ্কালকে আলোবাতাস দেখাবো। এলোমেলো, হাতে যেটা ঠ্যাকে সেটা। প্রথম কঙ্কাল ছয়জন যাচ্ছি কক্সবাজার। ট্রেনে চিটাগং, সেখানে পতেঙ্গায় কিছুক্ষণ, তারপরে বিকালে কক্সবাজার পৌঁছাবো। সেদিন চিটাগঙে হাফবেলা হরতাল, বেশ নিরিবিলি হবে, আমরা রাতের ট্রেনে চেপে বসেছি। শীতের রাত, আমরা চারজন বামপাশে, আর দু'জন ডানে। হঠাৎ আমার চোখ গেলো সেই ডানপন্থী এক ভদ্রলোকের দিকে। তিনি ট্রেনের মনোরম ঝাঁকুনির তালে তালে ঢুলছেন, দুলছেন আর হঠাৎ চমকে চমকে জেগে এদিক ওদিক তাকিয়ে চেয়ারের পেছনে একটা খাপ আছে, সেখান থেকে পরম মমতায় একটা কমলা বার বার বার করে শুঁকছেন, নেড়েচেড়ে দেখছেন, তারপর আবার রেখে দিচ্ছেন। তারপর আবারও দোল দোল ঢুলুনি। কমলা হচ্ছে খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে ফেলার জিনিস, আতরের মতো শোঁকার কিছু না, আমার উদ্ধত তরুণ চিত্ত আমাকে তেমনই জানালো। আমি আমার বন্ধু রাশেদকে বললাম, কমলাটা বার করে খেয়ে ফেল। রাশেদ আবার সম্পূরক কুবুদ্ধি দিলো, কমলার বর্তমান বাজার দর যাচাই করে একটা সিগারেট সেটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেখে দেওয়ার। উত্তম প্রস্তাব। রাশেদ সিগারেট রেখে কমলা এনে সীটে বসেই খাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু কমলার আগ্রাসী ঘ্রাণ সম্পর্কে সাবধান করে দিলাম। দুটি কোয়া কনসালটেন্সি ফি দিয়ে সে চলে গেলো দূরে। পিছু পিছু আমার বন্ধু মুস্তাকিম আর সাদিক। যথারীতি সেই ভদ্রলোক চমকে জেগে উঠলেন, তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত ঢোকালেন চেয়ারের ঝোলায়। তারপর রীতিমতো আঁতকে উঠে বার করলেন সিগারেটটা। তারপর সেটা হাতে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন, "আমার অরেঞ্জ? অরেঞ্জ কোথায় গেলো যে?" আমার মুখে তখন সদ্যভুক্ত কমলার সুঘ্রাণ। ভদ্রলোক নাকমুখ কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আমাকেই পাকড়াও করলেন। আমার তখন বয়স কম, কাঁধ পর্যন্ত গজগজে চুল, মুখে অযত্নসম্ভূত দাড়িদুড়ি রেখে চে গেভারার একটা অপভ্রংশ হবার অপচেষ্টায় রত, কিন্তু তিনিও মুশকো রীতিমতো, আমার বিপ্লবী মুখচ্ছবিকে দুটাকা দামও দিলেন না। বললেন, "ব্রাদার, এইখানে যে অরেঞ্জ ছিলো, কোথায় গেলো?" রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো আমি যেন জেগে উঠলাম বিশ বছর পর। বললাম, "জ্বি, আমাকে কিছু বলছেন?" এবার ভদ্রলোক চটে উঠলেন, কারণ বাতাসে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে কমলার গন্ধ। উৎস আমার মুখ। তিনি ফাক ইউ ভঙ্গিমায় সিগারেট উঁচিয়ে গর্জে উঠলেন, "এইখানে একটা অরেঞ্জ ছিলো। কে যেন নিয়ে গেছে, আর তার বদলে একটা সিগারেট রেখে গেছে! কে সে?" আমি খুবই দৃঢ়তার সাথে বললাম, "আচ্ছা!" এরই মধ্যে রাশেদ-মুস্তাকিম-সাদিক ফিরে এসেছে। গা দিয়ে ভকভক করে কমলার গন্ধ বেরোচ্ছে। অসভ্যের মতো কমলা খেয়েছে শালারা। ভদ্রলোক তড়পে উঠে ওদের ধরলেন। সেই একই জিজ্ঞাসা। রাশেদ একটা সিগারেট ধরিয়ে সিগারেটটা উল্টেপাল্টে দেখলো, তারপর বললো, "রহস্যজনক।" এবার ভদ্রলোক পুরো ফেটে পড়লেন। তিনি ফিরে গেলেন চিটাগঙের প্রসিদ্ধ ভাষায়, যা আমি বুঝি না। তবে অরেঞ্জ আর *ুদানি শব্দ দুটি বুঝলাম, চেনা চেনা লাগলো বলে। মিনিট পাঁচেক অনর্গল ভারতীপূজার পর তিনি আবার আমাদের দিকে ফিরলেন। চোখে আগুন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কমলাটার রং কী ছিলো?" ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, "জ্বি?" আমি আবারও জানতে চাইলাম, কমলাটার রং কী ছিলো। নিখোঁজ কমলা সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলে যে তার একটা হদিশ বার করা যায়, সেটাও জানালাম। ভদ্রলোক আবারও শুরু করলেন চিটাগঙের ভাষায় আপনমনে কথা বলা। বিড়বিড়বিড়। এক পর্যায়ে সামনের সীটে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, "ভাই, আপনার কমলা গ্যাছে গ্যাছে আর পাইবেন না। আর সিগারেট যেইটা পাওয়া গ্যাছে ঐটা আপনি না খাইলে আমারে দিয়া দ্যান।" আবার গালি। বিড়বিড়বিড়। কাঁহাতক আর গালাগাল করা যায়? ক্লান্ত হয়ে আবার ঢুলতে লাগলেন বেচারা। হাতে ধরা না ধরানো সিগারেট। একটু পর পর চমকে চমকে ওঠেন, আর রোষকষায়িতলোচনে আমাদের আগাপাশতলা মাপেন। আমরা নিজেদের মধ্যে কমলার গন্ধ দূর করার জন্য যার যা আছে জ্বালিয়ে নিয়ে বসলাম। আমি ধূমপান করি না, তামাকের গন্ধ অসহ্য লাগে, কিন্তু কমলার গন্ধ ঢাকা পড়বে এই আশায় বসে রইলাম ধোঁয়াখোরদের পাশে। ঘন্টাখানেক পর রাশেদ প্রস্তাব করলো, একটা কমলা কোন স্টেশন থেকে কিনে আবার ঐ ঝোলায় রেখে দেয়া হোক। কিন্তু আমরা ভেটো দিলাম। ভাই, আবারও যদি কোনদিন দেখা হয়, আপনাকে আমি দুইটা কমলা কিনে খাওয়াবো। সালাম। পুনশ্চঃ বহু আগে অন্যত্র প্রকাশিত। সচলরা চাইলে আপনাদেরও কিছু কঙ্কাল মন্তব্যের খাতায় যোগ করতে পারেন।
false
hm
সেজারিয়ার জন্যে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে সেনেগাল আর গিনি বিসাউ থেকে আরো পশ্চিমে, আটলান্টিককে নিচে ফেলে আকাশ দেখার জন্যে জেগে উঠেছে যে কয়েকটা আগ্নেয় পাথরের দ্বীপ, সেই রুক্ষ মরুস্পৃষ্ট দ্বীপদেশ কাবো ভের্দেতে কয়েকটা পতাকা নতমুখে ভাবছিলো সেজারিয়ার কথা। কারণ সেজারিয়া আর নেই। বুড়িটা মারা গেলো শেষ পর্যন্ত। সত্তর বছর বয়স, আর কতো? অনেক তো গান হলো, অনেক সরাইখানায় টিমটিমে আলোর নিচে বিষণ্ণ সমুদ্রগন্ধী সন্ধ্যায় সঙ্গ দেয়া হলো অনেক কাভাকিনিয়োর টঙ্কার আর গন্তব্যের খরায় ভোগা মদ্যপদের, খালি পায়ে মঞ্চের ওপর ঘুরে ফিরে গাওয়া হলো পুরনো-নতুন মোরনায় বিচ্ছেদবিষাদের গান, শেষ কয়েকটা মাস সেজারিয়া এভোরা নিজেকে সঁপে দিলো দুরন্ত শ্বাসকষ্ট আর হাঁপিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডের কাছে। কাবো ভের্দে এক দুর্ভাগা দেশ। মানুষের বাস ছিলো না সেখানে। পূর্বে চোখের আড়ালে থেকেও সাহারা হাত বাড়িয়ে বসে আছে আটলান্টিকের ওপার থেকে, ঊষর মরু এক একটা দ্বীপকে গ্রাস করে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে পর্বতের কাছে এসে শীতল হওয়া মেঘের কাছে। ঐ একটু সবুজ, ঐ একটু জলের ওপর এসে দখল নিয়েছে বোম্বেটে পর্তুগীজরা। মানুষ ছিলো না ওখানে, কিন্তু আফ্রিকার উপকূল থেকে দাস অপহরণের ব্যবসা জমে ওঠার পর এই মরুময় দ্বীপগুলো হয়ে উঠলো দাসবাণিজ্যের আখড়া। যতদিন দাসব্যবসার রমরমা ছিলো, কাবো ভের্দের দিনও ছিলো সোনালি। কালো মানুষ কেনাবেচার দিন ফুরিয়ে আসার পরও শ'খানেক বছর বাণিজ্যপথে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে রাজারাজড়ার চোখে ধর্তব্য হিসেবে টিকে ছিলো কাবো ভের্দে। সেই দিনও যখন ফুরোলো, পর্তুগীজ দেখলো, এ তো কয়েকটা মরা দ্বীপ শুধু। চাষবাস নেই, খনিজ নেই, আছে শুধু দ্বীপবোঝাই দাস আর শ্বেতাঙ্গের সঙ্কর মানুষ। এদের জন্যে খরচাপাতি করার গরজ হয়নি পর্তুগালের। তবুও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখতে এক পর্যায়ে পর্তুগালের বাইরের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে লোকজনকে ভুলিয়েভালিয়ে রাখতে চেয়েছে তারা। কিন্তু সারা পৃথিবীই তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হচ্ছে চাবুক হাতে বুকের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর। কাবো ভের্দে তার ব্যতিক্রম নয়। শাসকের নিষ্ঠুর উদাসীনতার জবাব এক সময় বারুদ পোড়ার গন্ধে পাওয়া যায়। পর্তুগালের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই স্বাধীন হয় গিনি-বিসাউ আর কাবো ভের্দে। ততদিনে বাইরের দুনিয়ায় সচ্ছলতার টানে আর রাজনৈতিক ডামাডোলের ঠেলায় দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ পাড়ি জমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে, আর্জেন্টিনায়, ভূমধ্যসাগরীয় ইয়োরোপে, সুদূর উত্তর মেরুবৃত্তের দেশে, এমনকি তাদের মতোই আরেক গরীব দ্বীপ সওঁ তোমে আর প্রিন্সিপেতে। এখনও কাবো ভের্দের অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বীপটির অধিবাসী জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ঘর ছাড়ার পর আর ঘরে ফেরা যায় না পুরোপুরি। কিন্তু ঘর ছাড়াও যায় না। সে বিষণ্ণ প্রেতের মতো সওয়ার হয়ে থাকে ঘাড়ে, রাতের বেলা টোকা দেয় জানালায়, মেঘ থেকে গলে পড়ে, চিঠির খাম খুলে বেরিয়ে আসে। কাবো ভের্দের মানুষ, যাদের ঘর এক কালে ছিলো আরো পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বের উপকূল, বা সাহেলের আরো গভীর বুকে, যাদের পূর্বরমণীদের গর্ভে শ্বেতাঙ্গ দাসব্যবসায়ীরা তাদের জাতির ভিত গেড়েছিলো, তারা এই ঘরছাড়ার বিষাদকে বাঁচিয়ে রেখেছে গানে। কাবো ভের্দের নিজস্ব ঢঙের সঙ্গীত মোরনা। পর্তুগীজ বা কাবো ভের্দে ক্রিওলে তারা তাদের ছোট্ট দ্বীপদেশের সরাইখানাগুলোয় গায় মোরনা গান, ঘুরে ফিরে গেয়ে বলে স্মৃতিকাতরতার কথা, স্মরণ করে ফেলে আসা কোনো কিছুকে যার কাছে আর কখনও ফেরা হবে না। এই বিষাদকে আরো দীর্ঘজীবী করে প্রবাসী কাবো ভের্দেবাসী, যারা অন্য দেশে পুরুষান্তরে বাস করে, অন্য দেশের হয়ে লড়ে, অন্য দেশী হয়ে বাঁচে, কিন্তু নিজেদের খুঁজতে চায় মোরনায় ডুবে। সব কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা থিতিয়ে পড়ে সওদাদে, হারিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া একটা কিছুর প্রতি অলঙ্ঘ্য দূরত্বে থেকে ভালোবাসার কথা জানাতে। সেজারিয়া মোরনা ঘরানাকে সারা দুনিয়ার কাছে পরিচিত করেছেন। অল্প বয়সেই নিজের শহর মিন্দেলোর সরাইখানা আর রেস্তোরাঁর আবছায়া সন্ধ্যায় গান গাইতে নামতে হয়েছিলো সেজারিয়াকে, বছর পঁচিশেক সেভাবে এ দ্বীপ সে দ্বীপ, এ দেশ সে দেশ গেয়ে বেড়ানোর পর প্রথম অ্যালবাম রেকর্ড করার চুক্তিতে কলম ধরেন তিনি। তারপর একের পর এক অনেক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে, খ্যাতিও বেড়েছে, সারা দুনিয়া ঘুরে গান গেয়েছেন, পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে যখন তাঁকে জোর করে টেনে নামালো অসুখ, বিষণ্ণ সেজারিয়া ফিরে গেলেন যে শহরে জন্মেছেন, সেই মিন্দেলোতেই। সওঁ ভিসেন্তের এই মেঘের নিচে পাহাড় আর সমুদ্রে আচ্ছন্ন শহরের একটা ক্লিনিকেই গেলো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মারা গেলেন কাবো ভের্দের গানের পাখি। সেজারিয়ার গান প্রথম শুনি প্রতিবেশী পর্তুগীজ উগোর কাছে। প্রতিবেশী হিসেবে খারাপ হলেও উগো সঙ্গীতরসিক ছিলো, ব্রাজিল আর পর্তুগালের বেশ কিছু চমৎকার গান তার কাছে পেয়েছিলাম। সেজারিয়ার বিষাদে ভরা খসখসে গলায় গাওয়া সওদাদ গানটি গ্রীষ্মের শেষ হতে না চাওয়া দিনের শেষে শুনে আশ্চর্য একাকীত্বে গ্রস্ত হয়েছিলাম। নিজের দ্বীপ সওঁ নিকোলাউয়ের জন্যে বিলাপ করে গেছে কোনো এক গীতিকার, নিজেকেই প্রশ্ন করছে, কে দেখাবে তাকে দূরের সওঁ তোমে দ্বীপের পথ, আর বলছে, ভালো লাগে না। সওদাদের কোনো সরাসরি অনুবাদ নেই। সওদাদ দেখি আলীসাহেবের বয়ানে আবদুর রহমানের পানশিরের গল্পে, জানালার পাশে বসে যে তুষারের হাত ধরে ফিরে যায় তার বাড়ি। আরো টের পাই, আবদুর রহমান আলীসাহেবেরই নিঃসঙ্গ ঘরকাতরতার ব্যক্তিরূপ মাত্র, পানশিরের জন্যে আবদুর রহমানের সওদাদ অক্ষরের প্রলেপে ঢেকে রাখা দেশের জন্যে আলীসাহেবেরই দহনরেখা। আমাদের বাসায় কাজ করতো যে ছোট্ট মেয়েটা, সে যখন ঘুমের ঘোরে মাকে ডেকে ফেলতো, জেগে উঠে কাঁদতো আর বলতো, বুকটা পোড়ে, হয়তো ওটাই সওদাদ। সেজারিয়া এভোরা আমার জন্যে কয়েকটা গান রেখে গেছে। তার জন্যে একটা কবিতা আমি লিখতেই পারি। অলীক বাসযাত্রা সারা বাস জুড়ে অচেনা মুখের সারি বাস ছুটে চলে দূর সন্ধ্যার কাছে সন্ধ্যার পথ ফুরোবে না এই ভেবে কাঁধে মাথা রেখে বিকেল ঘুমিয়ে আছে। যেসব আসনে যাত্রী জোটেনি কোনো ঘন শূন্যতা সেখানে পা তুলে বসে জানালায় দেখি লাজুক রোদের বুকে শিমুলের তুলো এসে নতমুখ ঘষে। সন্ধ্যার পথ ক্রমশ দীর্ঘতর বিকেলের মাথা ঢেকেছে আমার বুক কোলে ফেলে রাখা সম্বল ব্যাকপ্যাকে ঢেকে রাখা কোনো তরুণীর হাসিমুখ। বাস খুঁজে ফেরে সন্ধ্যার ঘরবাড়ি সন্ধ্যা পালায় রাতের অন্ধকারে ফিরছে না কেউ ঘরে চড়ে এই বাসে যে ছাড়ে ঘর, সে ঘরে কি ফিরতে পারে?
false
hm
ফুটোস্কোপিক গল্প ০০৯ ফুটোস্কোপিক গল্প হচ্ছে ফুটোস্কোপ দিয়ে দেখা গল্প। সামান্যই দেখা যায়। : ... তারপর কী হোলো? : তারপর নায়িকা দৌড়াতে লাগলো। : নায়িকা দৌড়াতে লাগলো কেন? : ভিলেন যে ছুটছে পেছন পেছন? :ভিলেন পেছন পেছন ছুটছে কেন? :ভিলেন নায়িকাকে বিয়ে করতে চায়। : ভিলেন নায়িকাকে বিয়ে করতে চায় কেন? : নায়িকা দেখতে বেশ সুন্দর তো, তাই। :নায়িকা দেখতে কেমন সুন্দর? : মমমম, কেমন সুন্দর? পাশের বাড়ির কচি আন্টির মতো সুন্দর। পাতলি কমরিয়া, তিরছি নজরিয়া। ইয়াম ইয়াম। : তাহলে নায়িকা ছুটছে কেন? : সে তো ভিলেনকে বিয়ে করতে চায় না। : সে ভিলেনকে বিয়ে করতে চায় না কেন? : ভিলেনের গোঁফ আছে, তাই। : ভিলেনের গোঁফ আছে কেন? : মাথায় টাক যে? মাথায় চুল নেই বলে গোঁফ রেখেছে। : মাথায় টাক কেন? : ভিলেন যখন ছেলেবেলায় গোসল করতো, তখন ভিলেনের আম্মু ভিলেনের মাথায় শ্যাম্পু দিতে গেলে ভিলেন চেঁচাতো। মাথায় ঠিকমতো শ্যাম্পু করতে দিতো না। তাই টাক। : চেঁচাতো কেন? : ভিলেন যে! কোন ভালো কাজ তার পছন্দ নয়। : তাহলে ভিলেন নায়িকার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে কেন? : ভুঁড়ি আছে যে? : ভুঁড়ি আছে কেন? : ভিলেনদের ভুঁড়ি থাকতে হয়। : ভুঁড়ি থাকতে হয় কেন? : খাওয়াদাওয়া করে তো অনেক, তাই। : খাওয়াদাওয়া করে কেন? : না হলে নায়কের মার সহ্য করবে কিভাবে? : নায়ক ভিলেনকে মারবে কেন? : বা রে, নায়কের নায়িকার পেছনে ভিলেন দৌড়ালে নায়ক তাকে পেটাবে না? : নায়ক তাহলে ভিলেনকে মারে না কেন? : নায়ক তো বাড়িতে, ঘুমুচ্ছে। : নায়ক ঘুমায় কেন? : বা রে, নায়কের খাটনি আছে না? নায়িকার সাথে নাচতে হয়, ভিলেনের সাথে মারপিট করতে হয়, নায়িকার বাবার সাথে ঝগড়া করতে হয়। অনেক কাজ বেচারার। এতসব শেষ করে যদি একটু ঘুমাতে না পারে, তাহলে কিভাবে হবে? : নায়িকার বাবার সাথে ঝগড়া করতে হয় কেন? : নায়িকার বাবা চায় না নায়ক নায়িকার সাথে নাচুক। : চায় না কেন? : হিংসুটে একটা লোক তো, তাই। : হিংসুটে কেন? : নায়িকার বাবারা একটু হিংসুটেই হয়। : তারপর কী হলো? : নায়িকা ছুটতে লাগলো। ভিলেনও ছুটতে লাগলো পেছন পেছন। : তারপর কী হলো? : তারপর নায়িকা একটা পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে পৌঁছালো। আর তার পেছনে ভিলেন। সামনে বিরাট খাদ। : তারপর? : ভিলেন বললো, মুহাহাহাহাহা! বলো সুন্দরী, কোন কমিউনিটি সেন্টারে তোমার বৌভাত হবে? : নায়িকা কী বললো তখন? : নায়িকা বললো, বাঁচাও, বাঁচাও! : তারপর কী হলো? : ভিলেন বললো, কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না নায়িকা! এখানে শুধু তুমি আর আমি! আর একটু পর আসবেন কাজী সাহেব আর আমার দুই সাক্ষী লালু আর ভুলু। : কাজী সাহেব কে? : কাজী সাহেব বিয়ে দেন। : লালু আর ভুলু কে? : ওরা দু'জন ভিলেনের সাগরেদ। : ওরা আসবে কেন? : ওরা সাক্ষী দিতে আসবে। : সাক্ষী কী? : মমমম। বিয়ে তো একা একা করা যায় না। লোকজনকে দেখিয়ে করতে হয়। যাদেরকে দেখিয়ে বিয়ে করতে হয়, তারাই সাক্ষী? : তারপর কী হলো? : নায়িকা পা হড়কে পড়ে গেলো। : তারপর? : ভিলেন লাফিয়ে গিয়ে নায়িকার হাত ধরে ফেললো। : নায়িকা পড়ে গেলো নিচে? : উঁহু। ভিলেন তো তার হাত ধরে আছে। আর নায়িকা ঝুলছে ভিলেনের হাত থেকে। নিচে খাদ। অনেক নিচে। : পড়ে গেলে মরে যাবে? : একদম। : তারপর কী হলো? : তারপর? নায়িকা আবার বললো, বাঁচাও বাঁচাও। : ভিলেন কী বললো? : ভিলেন বললো, মুহাহাহাহাহা! : তারপর? : তারপর নায়িকা বললো, ছেড়ে দে শয়তান! ... [সমাপ্ত]
false
rn
আজ হিমির বিয়ে "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।" গুল্লুর সাথে হিমির পরিচয় হয়। তারপর প্রেম এবং তারপর ভালোবাসা । এক আকাশ গভীর ভালোবাসা । তারা আয়োজন করে একে অপরকে ভালোবাসেনি । চলতে চলতে মিশতে মিশতে একে অপরকে গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলে । একসময় তারা দুইজনই বুঝতে পারে-একজন আরেকজনের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আছে । মোহ নয় ভালোবাসা । গোপন ভালোবাসা । কেউ জানে না এবং কেউ টেরও পায়নি । আসলে এতদিন কাউকে জানানোর প্রয়োজন পড়েনি । হেসে-খেলে দিন পাড় হয়ে গেছে । কিন্তু কথায় বলে মানুষের সব দিন সমান যায় না । শরতের ঝলমলে আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে । আজ হিমির বিয়ে । হিমি অনেক সুন্দর করে সেজেছে। হিমিকে দেবী স্বরসতীর মতন লাগছে । এক আকাশ দুঃখে কষ্টে হিমির কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখ দেখে তা বুঝার উপায় নেই । গুল্লুর সাথে হিমির শেষ কথা হয় তিন দিন আগে । আসলে কোনো কথা হয়নি । ফোন দিয়ে হিমি খুব কাঁদছিল গুল্লুও কাঁদছিল । এভাবে ফোন একা একাই কেটে যায় এক ঘন্টা পর । হিমির সাথে যে ছেলের বিয়ে হচ্ছে- সে ছেলে আমেরিকা থাকে । দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, রুচিবান এবং দারুন পয়সাওয়ালা । হয়তো বিয়ের সাতদিন পরে গুল্লুকে একেবারে ভুলে যাবে । আনন্দে ঘর সংসার করবে । গুল্লুর অবস্থা ভয়াবহ । তাকে দেখলে মনে হয় সে একজন মানিসক রোগী । হিমির কোনো দোষ নেই । হিমি অনেক পথ দেখিয়েছিল- কিন্তু গুল্লু সে পথে যায়নি । গুল্লুর যুক্তি হচ্ছে- তার পায়ের নীচের মাটি এখন শক্ত হয়নি । সময়ের প্রয়োজন আছে । আর হিমির পরিবারের কাছে সময়ের অভাব । গুল্লু পাগলের মতন রাস্তায় হাঁটছে । যে কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে ।হিমির সাথে আনন্দময় সময় গুলোর কথা খুব বেশী মনে পড়ছে গুল্লুর । গুল্লুর ইচ্ছা করছে- এখনই ছুটে হিমির কাছে যেতে । হিমির হাত ধরে বলবে, চলো আমার সাথে । তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না । তুমি আমার পাশে নেই ভাবলেই বুকের মধ্যে ভীষন কষ্ট হয় । হিন্দুদের মহাদেবের বাহন ছিল ষাঁড়, কার্তিকের ময়ূর, লক্ষ্মীর পেঁচা, গনেশের ইঁদুর আর সরস্বতী'র হাঁস- গুল্লুর এই রকম একটা বাহন থাকলে ভালো হতো। সে দূরে কোথাও চলে যেতে পারতো । যেখানে হিমির কথা একটুও মনে পড়বে না । অনেক পুরুষ নারীর রুপ দেখে মুগ্ধ হয়। তারা বোকা । আজ, হিমিকে ছাড়া গুল্লু শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়েছে । হিমি গুল্লুর হৃদয় জয় করেছে- আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে,সেবা দিয়ে । হিমির এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যে তার সামনে দাঁড়িয়ে গুল্লু মিথ্যা কথা বলতে পারতো না । স্টুডিও থেকে গুল্লুকে ফোন করে বলা হলো- একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তুলতে যেতে । গুল্লু কঠিন গলায় মানা করে দিল। যদি গুল্লু সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যেত- তাহলে বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেত । সেই বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল হিমির । হিমির বিয়ে হয়ে গেল । হিমি তার স্বামীর সাথে চলে গেল আমেরিকা । গুল্লু আগের মতই রয়ে গেল । সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। ক্ষুধা পেলে রাস্তার পাশের দোকান চা সগারেট খাওয়া । বাস্তব জীবনে এই রকমই হয় । যদি সিনেমা হতো- তাহলে এই রকম হতো- বিয়ের আসর থেকে গুল্লু গিয়ে হিমিকে নিয়ে আসতো । গুল্লু হিমিকে বিয়ে করতো- তাপর চলে যেতো নীলগিরি পাহাড়ে । দু'বছর পর তিনটা বাচ্চা হতো । প্রথম বার দু'টা জমজ মেয়ে বাচ্চা হতো। বাচ্চার নাম রাখতো টাপুর টুপুর । আর ছেলে টার নাম রাখতো গেদু । "তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন। দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন, ও মোর ভালোবাসার ধন॥"
false
rg
!! মুক্তিযুদ্ধের তিন ট্রাংক দলিলপত্রের হদিস এখনো কেউ জানে না!! স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কবি বেলাল মোহাম্মদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার বলেছেন যে, মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল ফাইলপত্র, নানা ধরনের ডকুমেন্টস, দৈনন্দিন কার্যালীর তালিকা, নানা ধরনের কথিকা, নথিপত্র, এবং সংবাদের মূল স্ক্রিপ্ট নিজে উপস্থিত থেকে তিনটি ট্রাংকে জব্দ করেছিলেন। সাজ্জাদ নামের একজন সহকর্মী তাঁর সঙ্গে তখন ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওই তিন ট্রাঙ্ক ভর্তি ওইসব দলিলপত্র এস. এস. সান্দ্রা স্টিমারযোগে হুগলী নদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছেছিল। সেখান থেকে ট্রাংক তিনটি পরে শাহবাগ বেতার কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে সেই তিন ট্রাংক দলিলপত্রের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছিলেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ বছর পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ বেতার শাহবাগের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের স্টোর রুমে ওই ট্রাঙ্কগুলোর প্রথম সন্ধান মিলেছিল। পরবর্তী সময়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই সব মূল্যবান দলিলপত্র জাতীয় জাদুঘরে জমা দেওয়ার কথা ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী বলেন, ১৯৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ট্রাঙ্ক তিনটি সনাক্ত হওয়ার পর সেখান থেকে একটি ট্রাঙ্কের কাগজপত্র তখন খোলা হয়েছিল। পরে আবার সেসব দলিলপত্র ট্রাংকে ভরে সিলগালা করা হয়। তখন এই ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তৎকালীন ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের পরিচালক জনাব হাসান জামালকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আর সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, দলিলপত্র ভর্তি ট্রাঙ্ক তিনটি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হবে। শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী অভিযোগ করেন যে, এই ট্রাঙ্কগুলো তিনি দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেণ করেছিলেন। অথচ তদন্ত কমিটিতে তখন তাকে রাখা হয়নি। আর ওই দলিলপত্রের খবর মিডিয়ায় জানানোর কারণে তখন তাকে শাহবাগ থেকে জাতীয় বেতার ভবন আগারগাওঁয়ে বদলি করা হয়েছিল। যে কারণে তিনি পরে আর ওই দলিলপত্রের পরিণতি সত্যি সত্যি কি হয়েছিল তা জানতে পারেননি। কবি বেলাল মোহাম্মদ দাবী করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের এসব ডকুমেন্ট অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই নষ্ট করা হয়েছে। তবে এসব ডকুমেন্ট নিয়ে পরে অনেকে বই বের করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ঘোষক শহীদুল ইসলাম 'শব্দ সৈনিক' নামে যে সংকলনটি প্রকাশ করেছিলেন, এতে তার প্রথম কথিকা, যা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পাঠ করা হয়েছিল। সেটিসহ ট্রাঙ্কে ভর্তি অনেক লেখাও প্রকাশিত হয়েছিলো। বেলাল মোহাম্মদ দাবী করেন, ট্রাঙ্কে ভর্তি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র হারিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না। বিশ বছর পর উদ্ধার হয়ে এসব দলিলপত্র আবার হারিয়ে যাওয়া আরো দুঃখজনক। [সূত্র: চল্লিশ বছরেও স্বাধীন বাংলা বেতারের তিন ট্রাঙ্ক দলিলপত্রের রহস্যের জট খোলেনি, দৈনিক যুগান্তর, ১১ জানুয়ারি ২০১২, হোমপেজ গ্যালারি চ্যাটরুম জানুয়ারি ১১, ২০১২, বুধবার : পৌষ ২৮, ১৪১৮ এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯১, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিক সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের রিপোর্ট]১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দুইটি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতে অসুস্থ শরীর নিয়ে গাইবান্ধায় যাত্রা শুরু করেছিলেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনায় পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই তিনি পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তখন তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই অকাল মৃত্যুতে গোটা দেশ তখন শোকে মুহ্যমান হয়ে উঠেছিল। সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যু কি নেহাত দুর্ঘটনা? নাকি ওই তিন ট্রাংক দলিলপত্রের অনুসন্ধান জনিত রিপোর্টের কারণে একটি পরিকল্পিত খুন? বাংলাদেশ এখনো সেই রহস্য জানে না। মুক্তিযুদ্ধের মহা মূল্যবান তিন ট্রাংক দলিলপত্রের হদিসও বাংলাদেশ জানে না। ইতিহাসের মহান অর্জনের সেই সব মূল্যবান দলিলপত্রের হদিস নিয়ে আমরা এক দুর্ভেদ্য রহস্যের মধ্যে বসবাস করছি। সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ! সত্যি সেলুকাস!!!
false
mk
বিএনপিতে তারেক বিরোধীদের বর্তমান-ভবিষৎ তারেক রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হলেও দলের প্রথম সারির অনেক নেতাই তার নেতৃত্ব মানতে নারাজ। তারেক রহমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা চান তারেক রহমান তাদের নেতৃত্বে রাজনীতি করুক। দলের সিনিয়ার একাধিক নেতাসহ অনেকে চান না তারেক রহমান দেশে এসে রাজনীতিতে সংক্রিয় হন। সক্রিয় হলে তাদের অবস্থান হয়তো থাকবে না। তারা চান তারেক রহমান বিদেশেই থাকুক। এর সুযোগ হিসেবে তারা পেয়েছেন তারেকের মাথার ওপর ঝুলে থাকা মামলাগুলো। এদিকে তারেক রহমানও দলের একাধিক নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে শঙ্কিত। তারেক রহমানের শঙ্কা দলের মধ্যে এখনো মাইনাস ফর্মুলা কাজ করছে। এমনটি আঁচ করতে পেরে তিনি বেশ কয়েকজন নেতার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এর ফলে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, দলের মধ্যে তারেক রহমানকে নিয়ে একাধিক নেতা চরম উত্কণ্ঠতায় কাটাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলে তাতে যোগ দেওয়ার জন্যও তারা তৈরি হয়ে আছেন। বিভিন্ন সময়ে লন্ডন সফরে আসা বিএনপির কয়েক শীর্ষ নেতাও এ তালিকায় আছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া যারা আছেন তাদের একটি তালিকা তারেক রহমানের হাতে রয়েছে। লন্ডনে আসা নেতাদের সতর্কও করেছেন তারেক রহমান। এতেও তার ওপর অনেক নেতা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। দলের অনেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করে রাখায় তার ওপর ক্ষিপ্ত। কারণ হিসেবে তারা বলেন, তারেক রহমানের ইশারায় তিনি এখনো ভারপ্রাপ্ত রয়েছেন। এজন্যই ক্ষোভ বিরাজ করছে। এছাড়া ও বিভিন্ন কমিটিতে পদ পাওয়াকে কেন্দ্র্র করে দলের মধ্যে কোন্দল রয়েছে। তাছাড়া তারেক রহমান সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পর দলের যেসব জ্যেষ্ঠ নেতা তাকে মেনে নিতে পারেননি, তারা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে স্বস্তিতে নেই তারেক রহমান। সরকার পরিচালনার আধুনিক নিয়ম কী হবে তা তিনি বলে না দিলেও তার পুরো বক্তব্যে সে আভাস পাওয়া গেছে। ফলে এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা সন্তুষ্ট নন বলে জানা গেছে। কারণ তার বর্ণিত কৌশলে দেশের উন্নয়নের কথা থাকলেও কোথাও সিনিয়র নেতাদের স্বার্থ রক্ষার ইঙ্গিত নেই। তারেক রহমানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তরুণদের অংশগ্রহণেরই ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি আগের মতোই তরুণদের নিজের অনুকূলে রাখতে চান। ফলে এ নিয়েও ক্ষুব্ধ বিএনপির প্রবীণ নেতারা। তারা হিসাব বুঝে গনেশ উল্টে দিতে পারেন বলে মনে করছেন তারেক রহমানের লন্ডনের পরামর্শকরা। অন্যদিকে তারেক রহমান দীর্ঘ সময় লন্ডনে অবস্থান করায় যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে একরকম দলীয় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ মুহূর্তে এদের নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকা ছাড়া তার অন্য কোনো উপায়ও নেই।এ সুযোগ গ্রহণ করে যুক্তরাজ্য বিএনপির অনেক নেতা আগামী নির্বাচনে সিলেটের বিভিন্ন আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন। ইতোমধ্যে তারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছেন। এতে করে যারা এখন সিলেটের ওইসব এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বরাবরই থাকে। কিন্তু নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই একে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন তারেক রহমান। তিনি আপাতত দেশে ফিরতে না পারলেও দল গোছানোর কাজটি লন্ডনে বসেই শুরু করেছেন। তিনি দল ও দেশবাসীর সমর্থন আদায় করতে সম্প্রতি এক ইফতার পার্টিতে দেশের উন্নয়নে কী কী করণীয়, এর বর্ণনা করতে গিয়ে মূলত নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। এটি তার রাজনীতিতে পুনরায় প্রবেশের প্রাথমিক কৌশলের বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তার উন্নয়ন কৌশলের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে গতানুগতিক নিয়ম থেকে সরে গিয়ে সরকার পরিচালনা করার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। তারেক রহমানের এসব ভাবনা সিনিয়র নেতারা মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। নেতারা মনে করছেন, তারেক রহমান তাদের উপেক্ষা করছে। ভবিষতে আরো করবে। তাদের আর দলে গুরুত্ব থাকবে না। তবে একটি সূত্র জানায়, প্রয়োজনে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যের বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যবহার করলেও জাতীয় নির্বাচনে কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবছেন না। এ কথা জানাজানি হওয়ার পর যুক্তরাজ্য বিএনপিতে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। আগামী নির্বাচনে যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বৃহত্তর সিলেটের বেশির ভাগ আসনে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক নেতা জানান , তারেক রহমান দলের শীর্ষ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সে দলের কোন কাজ করতে পারছে না। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে অনেক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তারেক রহমান এই সময়ে দেশে আসলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকর মোশারর জানান, তারেক রহমান শুধু দলের নয়, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার দিকে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। সবার প্রতিক্ষা সে দেশে এসে নতুন ভাবে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি শুরু করবেন না। তিনি বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। এখনো তার বিরুদ্ধে দলে ও দলের বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কোন ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। এখনো যারা ষড়যন্ত্র করবে তাদের কর্মকাণ্ড অনুযায়ী তাদের দলে রাখার সিদ্ধান্ত হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জানান, সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতার অদৃশ্য সর্ম্পক আছে। তারা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চেয়েছিল। এখন তারেক জিয়াকে মাইনাস করতে চায়। ১/১১ ষড়যন্ত্রকারীরা অনেক দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের পাশে ছিলেন। এখন খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত ও দক্ষিণ হস্ত সেজে বসে আছেন।- See more at: Click This Link
false
ij
জিযিবেল জিযিবেল (Jezebel) ... ফিনিসিয় রাজকুমারী। সময়কাল? খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক। হিব্রু বাইবেলে জিযিবেল এর কথা ঘৃনাভরে উল্লেখ রয়েছে। তার কারণ, জিযিবেল ছিলেন ইজরাইলের রাজা আহাব এর স্ত্রী। তা সত্ত্বেও ইসরাইলি ধর্ম মেনে নিতে পারেন নি জিযিবেল - আমৃত্যু ছিলেন ফিনিসিয় ধর্মের প্রতি অনুরক্ত । তাঁর ধর্মবোধ এতই প্রবল ছিল যে তাঁকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ... ফিনিসিয় মানচিত্র। জিযিবেল ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৯ শতকের ফিনিসিয় একজন রাজকুমারী। ফিনিসিয় সভ্যতা ছিল মূলত নাগরিক সভ্যতা, যে কারণে, অনুমিত হয়, যথেস্ট পরিশীলিত ছিলেন জিযিবেল। যদিও পৌত্তলিক ছিলেন। একেশ্বরবাদকে মনেপ্রাণে ঘৃনা করতেন! দেবতা বাল। ফিনিসিয়দের আরাধ্য দেবতার নাম ছিল Baal. ‘জিযিবেল’ নামের অর্থ : ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ এই প্রিন্স হলেন বাল। বাল যখন পাতালে প্রবেশ করেন পৃথিবী তখন উষর হয়ে ওঠে। তখন ফিনিসিয় প্রার্থনাকারীগন সববেত কন্ঠে আহাজারী করে, ‘জিযিবেল’ ... ‘জিযিবেল’ ... ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ হিব্রুভাষীদের রানী হলেও বাল-এর ওপর প্রবল বিশ্বাস ছিল জিযিবেল এর। কথিত আছে, বাল এর উপসনালয়ে শিশুবলি হত। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়-কেবল ধর্মবিশ্বাসের জন্য নিষ্ঠুর প্রথা মেনে নিয়েছিলেন জিযিবেল। এবং তা কিতাবধারী হিব্রুভাষীদের সমাজে প্রচলনের চেষ্টা করেছেন! হিব্রু বাইবেলে জিযিবেল অশুভ শক্তির প্রতীক। জিযিবেল এর বাবার নাম এথবার। তাঁকে বলা হত সিদোনিওদের রাজা। কারণ, ফিনিসিয় নগরী টায়ার ও সিদোন ছিল ফিনিসিয় সাম্রাজ্যে অংশ ছিল। সিদোন থেকেই ওই নাম। সিদোন এর মানচিত্র। প্রাচীন ফিনিসিয় রাজ্যই বর্তমানকালের লেবানন । প্রাচীন ইসরাইল-এর মানচিত্র। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে রাজ্যটি দুটি খন্ডে বিভক্ত ছিল। উত্তরের রাজ্যের নাম ইসরাইল; দক্ষিণের নাম জুদাহ। উত্তরের ইসরাইলের রাজার নাম ছিল আহাব। তাঁর সময়কাল ৮৭৪ থেকে ৮৫৩ খ্রিস্টপূর্ব। রাজনৈতিক কারণেই এথবার এর সঙ্গে ইসরাইলের রাজা আহাব এর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে রাজা আহাব এর সঙ্গে রাজা এথবার এর কন্যা জিযিবেল এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ফলে, হিব্রু সাম্রাজ্যে ফিনিসিয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত ধর্মের ক্ষেত্রে। ইসরাইলী নগরগুলিতে ফিনিসিয় উপাসনালয় গড়ে উঠতে থাকে। জিযিবেল -এর সিল। জিযিবেল স্বামীর সঙ্গে ইসরাইল রাজ্য শাসন করেছেন। বিয়ের পর দুটো কারণে দুর্যোগ ঘনিয়ে ওঠে। (এক) তখন একবার বলেছি যে হিব্রুদের রানী হলেও বাল-এর ওপর প্রবল বিশ্বাস ছিল। পক্ষন্তরে হিব্রুভাষীরা উপসনা করত সর্বশক্তিমান ইয়াওয়ের। (দুই) রাজ্য পরিচালনার বিষয়ে জিযিবেল এর ধারণার সঙ্গে ইসরাইলীদের ধারণা পার্থক্য ছিল। জিযিবেল ফিনিসিয়ার একচ্ছত্র অধিপতির কন্যা। বিশ্বাস করতেন, ‘জোর যার মুলুক তার।’ যা ইচ্ছে করার অধিকার রয়েছে রাজার। উদাহরণসরূপ বলা যায়। রাজা আহাব এর প্রাসাদটি ছিল জিযরিল নামে একটি জায়গায়। প্রাসাদের পাশেই একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ ছিল: মালিক নাবোথ। আঙুর বাগানটি আহাব কিনতে চাইলেন। নাবোথ বিক্রি করতে রাজী নন। জিযিবেল নাবোথ কে হত্যা করে দ্রাক্ষাকুঞ্জের মালিকানা স্বামীকে দেন। জিযিবেল এর এই রকম রুক্ষ আগ্রাসী ছবিই ইউরোপের খ্রিস্টান জগতে আঁকা হয়েছে বেশি আমি যে সময়ে কথা বলছি সেই সময়ে ইসরাইলে ঐশি পথপ্রর্দকের নাম ছিল এলিজা। ইনিই ইসলামী বিশ্বের হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম নামে পরিচিত। পয়গম্বর এলিজার জেহু নামে একজন অনুচর ছিল। সে পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। যা হোক। পয়গম্বর এলিজার নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী ইয়াওয়ে আন্দোলন দানা বাঁধে। ওদিকে রানী জিযিবেল এর অনুগতের সংখ্যাও কম ছিল না। ফলত দুটি স¤প্রদায়ের মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত । স্বভাবতই জিযিবেল বাল এর পক্ষ নেয়। রাজা আহাব মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চাইলেন। পয়গম্বর এলিজা পক্ষ নেন ইয়াওয়ের। মুখোমুখি রাজা আহাব, জিযিবেল ও পয়গম্বর এলিজা পয়গম্বর এলিজার নির্দেশে জেহু আহাব পরিবারের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান ঘটায়। তাদের সপরিবারে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় জিযিবেল দেবতা বাল এর ধর্মীয় পোশাক পরে ছিলেন বলে কথিত আছে । জেহু প্রাসাদের খোজাদের রানীকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে হত্যা করতে নির্দেশ দেয় যাতে রাস্তার কুকুরেরা উৎসব করতে পারে! শিল্পী গুস্তাফ ডোর এর আঁকা জিযিবেল এর মৃত্যু জিযিবেল এর মৃত্যু। আরেকটি ভার্সান। জিযিবেল এর বিরুদ্ধে পয়গম্বর এলিজার বিজয় আব্রাহামিক ধর্মের বিশাল বিজয় বলে চিহ্নিত করা যায়। নয়তো এক ফিনিসিয় রাজকুমারীর প্রভাবে ইব্রাহিমের ধর্মটি হয়তো বিলুপ্ত না হলেও বিকৃত হয়ে যেত!মাঝে-মাঝে মনে হয় এমনই কাম্য-কেননা ফিনিসিয় দেবতা বাল এর উপসনালয়ে শিশুবলির কথা মনে হলে শিউরে উঠি! ওল্ড টেস্টামেন্টের "টেন কমান্ডমেন্টস" অনেক মানবিক ... জিযিবেল এর ওপর আল মুজাহিদ এর এই লেখাটি পড়তে পারেন ... সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৬
false
mk
এটাই গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিক উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন আর তার কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন। নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পর তিনি এ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে নানাভাবে। ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়াও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত এবং রক্তগত সুসম্পর্ক। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি অতীতে এ দেশ সফর করে বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু তিনি করবেন না। বাংলাদেশের জনগণের পাশে ভারতের সুদৃঢ় সহাবস্থান অব্যাহত থাকবে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি সেই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ইতোপূর্বেকার সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তাবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমাভারতীও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো উদ্যোগে ভারত সিদ্ধান্ত নেবে না বলে জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরিত হওয়ার ব্যাপারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আলোচনায় স্থান পেতে পারে প্রতিবেশী দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায়।বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের দেশের জনগণের পক্ষে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, দুঃসাহসিক পদক্ষেপ এবং উদার সহযোগিতা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এতে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের সুপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী বন্ধুদের পুরস্কৃত করে এ কৃতজ্ঞতা স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত ও রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে এসেছিল। মিত্রবাহিনীর ত্যাগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করেছিল। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবার বাংলাদেশের বীরত্ব, গৌরব এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন। শুধু তাই নয়_ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দক্ষতা ও অবদানের কথা স্মরণ করেছেন তিনি। তার মতে, বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে সুরক্ষা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ স্বীকৃতি ও ইতিবাচক মনোভাব বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে প্রণোদনা। বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধুর ওপর মানুষের প্রদত্তে সম্মান বেড়েছে এবং বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার রোধ হয়েছে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অর্ধশত বছর ধরে রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছেন। প্রায় ২৫ বছর কারাবন্দি জীবনযাপন করেছেন তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে, স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি জনগণকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং স্বাধীনতা লাভের জন্য উজ্জীবিত করেছেন। তার ঐতিহাসিক ভাষণেরও বিশ্বস্বীকৃতি জুটেছে বিগত আড়াই হাজার বছরের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর সঙ্গে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ গ্রন্থবদ্ধ হওয়ায়। বিশ্বনেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল কাস্ট্রো ও ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদি স্বীকার করলেন বঙ্গবন্ধুর অবদান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, সাহস ও গুণাবলির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশরক্ষামূলক উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন তিনি দেশের জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা গঠনে তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কোনোরূপ হুমকি এবং প্রাণনাশের অপচেষ্টায় ভীত নন তিনি। তার হারানোর কিছু নেই। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে জনগণের সঙ্গে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন।দেশ থেকে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র ও স্বৈরাচারী, রাজনীতি দূর করতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন সংসদ, সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরলসভাবে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নে তৎপর হয়েছেন। দেশকে কৃষিতে স্বনির্ভর, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অগ্রসর করে চলেছেন। মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। কৃষক, সাধারণ জনগণ ও শ্রমজীবী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সহিংস রাজনীতি, জঙ্গিবাদমৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গঠনে তার সরকার ভূমিকা পালন করে চলেছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সহিংস ও নাশকতামূলক রাজনীতির বিপরীতে সাংবিধানিক, সংসদীয় ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বব্যাপী তার নেতৃত্বের স্বীকৃতি জুটেছে। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর ও বিশ্বশান্তির মডেল প্রশংসিত ও গৃহীত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তার মনোভাবের প্রশংসা পেয়েছেন। স্বাধীনতার মূল নীতি ফিরিয়ে আনতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হয়েছে। ক্ষমতায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বন্ধ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অগ্রসর হয়েছে। জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসী ও সহিংস রাজনীতির উৎসাহীরা এ দেশে আর জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ পাবে না। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী শক্তি প্রশ্রয় পাবে না বলে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাব, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান তাকে এক ও অদ্বিতীয় নেতৃত্বে বিকশিত করেছে। সংবিধানের পথ থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না বলে ঘোষণা দেয়ার পরও সহিংস রাজনীতির নেত্রী এবং জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকরা রাজনীতিকে হুমকির মুখে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার অধীনে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে বলে তিনি সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। অসাংবিধানিক পন্থায় তিনি আর ক্ষমতা হস্তান্তর হতে দেবেন না। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি জাদুকরী বলে চিহ্নিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টে যারা সহিংস রাজনীতি করেছেন তারা পরাজিত হয়েছেন। তিনি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ধারায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপিজামায়াতহেফাজত জোটের যাবতীয় হুমকি ও উস্কানি মোকাবেলা করে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। সে জন্য তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। দেশকে অনিশ্চয়তা ও অসাংবিধানিক ধারা থেকে তিনি সুরক্ষা করেছেন। যার স্বীকৃতি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লন্ডনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এক ও অদ্বিতীয়।তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আগামী নির্বাচনও তার অধীনে এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার হুমকিও বাকসন্ত্রাস তিনি উপেক্ষা করেছেন। এছাড়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে উলি্লখিত হয়েছে খালেদা জিয়ার শাসনামলের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আর অযোগ্যতা। শেখ হাসিনা সরকার অর্থনীতিকে উন্নত করেছেন, দারিদ্র্য হ্রাস করেছেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছেন, দেশকে সাংবিধানিক ধারায় সুনিশ্চিত করেছেন এবং রাজনীতিকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় ধাবিত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার, রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণের বিচার এবং জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও বিচার অগ্রসরমান। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি অপেক্ষা আওয়ামী লীগের সরকার বিদেশি সরকারগুলোকে অধিক উৎসাহী করেছে। তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা বেড়েছে। বিএনপিজামায়াতের সহিংস রাজনীতি ধিকৃত হয়েছে। আর মহাজোটের জনসমর্থন বেড়েছে। বিএনপিজামায়াত এখন সংসদের বিরোধী দল নয়। নির্বাচন না করে বিএনপি আত্মঘাতী রাজনীতির পথে ধাবিত হয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জামায়াতের কার্যকারিতা নেই। ২০ দলীয় জোট করেও বিএনপি এগোতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছে ইকোনমিস্ট। এ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকার এখন চাপমুক্ত। সবকিছুই সরকারের অনুকূলে। কারণ সহিংস রাজনীতি জনগণ সমর্থন করে না, বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে, জামায়াত দুর্বল ও অকার্যকর রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাচিত বিরোধী দল সরকারের সহযোগী। এ অবস্থায় দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও অগ্রগতি প্রত্যাশিত। জনগণের পক্ষে সরকার এগিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে এবং আস্থার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। জনগণকে আশাবাদী করে তুলতে পেরেছেন। এ জন্য তার স্বীকৃতি ও প্রশংসা জুটেছে।
false
hm
কুবুদ্ধিগুলি দেয় কারা? মুহম্মদ বিন তুঘলক নির্বোধ ছিলেন না। ভারতবর্ষে নির্বোধ সুলতানের পক্ষে ছাব্বিশ বছর দিল্লির সুলতানাত শাসন করা সম্ভব কোনো কালেই ছিলো না। তর্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বহুভাষী এই শিল্পী সুলতান যুদ্ধের ময়দানেও কুশলী ছিলেন। সাম্রাজ্য চালাতে আর বাড়াতে গেলে যে নৃশংসতার প্রয়োজন হয়, তা-ও তাঁর ছিলো। কিন্তু মুহম্মদ বিন তুঘলকের গুণের কথা বাঙালির মুখে মুখে ফেরে না, ফেরে তাঁর প্রশাসনিক খামখেয়ালের গল্পই, বাগধারায় যাকে আমরা বলি তুঘলকি কাণ্ড। উঠলো বাই তো কটক যাই, এমন বায়ুতাড়িত সিদ্ধান্ত না নিলেও, দিল্লি থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের যে উটকো হুকুম সুলতান করে বসেছিলেন, তার পেছনে খুব ঠাণ্ডা মাথার বিবেচনা কাজ করেছে বলে আমাদের মনে হয় না। মুহম্মদ বিন তুঘলক যখন তখতে বসেছেন, তখন সুলতানাতের পশ্চিম সীমান্তে আর আগের মতো উৎপাত নেই, আফগান-মঙ্গোলরা নিজেদের অন্য হাঙ্গামায় ব্যস্ত, আর সুলতান তাঁর সীমানার ঘাঁটিগুলোকে নিয়ন্ত্রণও করতেন লৌহমুষ্ঠিতে। পশ্চিম সীমান্ত তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকায় তুঘলক সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেন দক্ষিণ দিকে, যেখানে প্রতাপশালী সব হিন্দু রাজ্য সগৌরবে দিল্লির আধিপত্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে যাচ্ছে। মুহম্মদ বিন তুঘলক চিন্তা করেন, যদি তিনি রাজধানীকে আরো দক্ষিণে, ভারতবর্ষের আরো কেন্দ্রে নিয়ে যান, তাহলে সেখানে বসে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে তিনি আরো জুত করে কাবু করতে পারবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি গোটা রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন। দৌলতাবাদ দুর্গ সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গগুলোর একটি ছিলো, কিন্তু দেবগিরি দিল্লির মতো মহানগর ছিলো না। সুলতানের নিজের বিলাসের সুযোগ সেই শহরে নিশ্চিত হলেও, তাঁর পাত্র-অমাত্যবর্গের জন্যে দৌলতাবাদে রম্যহর্ম্যের সুবন্দোবস্ত ছিলো না। আর দিল্লির সাধারণ মানুষ ও সৈন্যদের জন্যে জীবনধারণের যে নিত্যব্যবহার্য রসদ, তা যোগাতেও দৌলতাবাদ ব্যর্থ ছিলো। মুলতান থেকে দৌলতাবাদে বদলি হতে অস্বীকৃতি জানানোয় ক্রুদ্ধ সুলতান কিশলু খাঁ নামে এক সেনাপতিকে সুদূর মুলতানে গিয়ে দমন করেছিলেন। দৌলতাবাদ নিয়ে এই অসন্তোষ কিশলু খাঁর একার মনেই ছিলো, এমনও নয়। ফলে সুবিধা করতে না পেরে দুই বছরের মাথায় আবার মুহম্মদ বিন তুঘলক পাইকলস্কর ও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরে আসেন। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদের এই আপডাউন যাত্রায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। দিল্লিতে রাজধানী পুনর্প্রতিষ্ঠার পরও সেটিতে প্রাণের স্পর্শ ফিরে আসতে সময় লাগে। ইবনে বতুতা লিখেছিলেন, দিল্লিতে পা রেখে আমার মনে হয়েছিলো আমি এক ঊষর মরুতে এসে পড়েছি। তুলিশিল্পী মুহম্মদ বিন তুঘলক চমৎকার নকশা করা নানা মুদ্রাও বাজারে ছেড়েছিলেন। দাক্ষিণাত্য থেকে সোনাদানা লুট করে এনে তিনি ঠিক করেন, স্বর্ণমুদ্রায় তিনি এবার সোনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন। মুদ্রার নকশা সুলতান নাকি নিজেই বাতলে দিতেন। তাঁর মুদ্রানকশার ক্ষুধা মেটাতে তিনি নানারকম সিকি আধুলিও বাজারে ছাড়েন। বাজার থেকে সোনা আর রূপা তুলে রাজকোষে জমা করতে তিনি তামা আর কাঁসার মুদ্রা নকশা করে লোক ভোলানোর ধান্দাও করেছিলেন। মানুষ তাঁর সেই ফিকিরে পা দেয়নি। মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজকোষে সেই ব্যর্থ প্রকল্পের উপজাত হিসেবে পড়েছিলো স্তুপের পর স্তুপ তামার মুদ্রা, তাদের অপূর্ব সব শৈল্পিক কারুকাজ সত্ত্বেও। মুহম্মদ বিন তুঘলকের গল্প আমাদের যা শেখায়, তা হচ্ছে, শাসক কত বড় তর্কশাস্ত্র পণ্ডিত, কত বড় ভাষাবিদ, কতবড় তুলিশিল্পী, তা সাধারণ মানুষ মনে রাখে না। এমনকি শাসক কত বড় সুনিপুণ যোদ্ধা, বা পররাজ্যজয়ে কত কুশলী, সেটাও লোকে দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে মনে রাখে না। মানুষ মনে রাখে শাসকের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে হয়রানির কথা। মুহম্মদ বিন তুঘলক একজন যোদ্ধা হিসেবে দুর্ধর্ষ ছিলেন, যুদ্ধশাসনে আর সমরপরিকল্পনাতেও সুদক্ষ ছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা তিনি ভাবেননি। নিজের নকশাস্পৃহা চরিতার্থ করার কাজে সাধারণ মানুষের সাড়া তিনি পাবেন না, এই সত্যও তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। সাধারণ মানুষের মনোভাব অনুধাবনে তাঁর এই ব্যর্থতা, এই নির্লিপ্তি সাতশো বছর পরও তাঁকে শাস্তি দিয়ে চলছে মানুষের মুখে মুখে তুঘলকি কারবার শব্দযুগলে। আমার কৌতূহল, এই উদ্ভট সিদ্ধান্ত কি সুলতানের স্বকপোলকল্পিত? তিনি নিজে একদিন সকালে উঠে ডিমভাজা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে আচমকা সিদ্ধান্ত নিলেন, কাইলকাই যামুগা দৌলতাবাদ? নাকি তাঁর কোনো নায়েব, কোনো ওয়াজির, কোনো উচ্চাকাঙ্খী আমলা তাঁকে এই প্ররোচনা দিয়েছিলো? সুলতান-সম্রাটরা সবসময়ই কিছু রত্ন পরিবেষ্টিত থাকেন, যারা তাঁকে নানা সংবাদ, পরামর্শ আর দার্শনিক কচকচি শোনায়। সাধারণ মানুষের সংসর্গরহিত এই প্রবলপ্রতাপ শাসকেরা নিজের ইন্দ্রিয়ের বর্ধিতাংশ হিসেবেই ব্যবহার করেন তাঁর পারিষদবৃন্দকে। ইতিহাসের কলমের আড়ালে কি সেই এক বা একাধিক পরামর্শদাতার নাম চাপা পড়ে গেলো, আর সেই পরামর্শে পটে যাওয়া সুলতানকে ইতিহাসের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হলো এতো তর্কশাস্ত্র, এতো হেকিমি এলেম, এতো ক্যালিগ্রাফিতে পারদর্শিতার সুনাম, আর নিজেকে পরিচিত করতে হলো শতাব্দীশ্রেষ্ঠ ভাঁড় হিসেবে? সুলতান কি দিল্লির প্রাসাদে বসে সেই কালান্তক গ্রীষ্মের দিনটিতে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তিনি যার কুবুদ্ধিতে পটতে যাচ্ছেন, সেই লোক সেই কুবুদ্ধির দায় বহন করবে না, ইতিহাস সুলতানের স্কন্ধেই যাবতীয় দায়ভার ন্যস্ত করবে বিশ্বস্ত হাতে? কিংবা ধরুন কৌরবদের কথা। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়ার আগে গান্ধারের রাজা সুবলকে এক জ্যোতিষী বলেছিলো, দুর্যোগ এড়াতে চাইলে আগে তোমার মেয়েটাকে একটা ছাগলের সাথে বিয়ে দাও, যাতে ধৃতরাষ্ট্র তার দ্বিতীয় স্বামী হয়। জ্যোতিষীর পরামর্শে কান দিয়ে রাজা সুবল গান্ধারীকে একটি ছাগলের সাথে বিয়ে দেন। ত্রিভুজগোষ্ঠীর আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই, বিয়ে হওয়ার অব্যবহিত পরই সদ্যপরিণীত জামাতাকে রাজামশাই কোৎল করেন। গান্ধারীর সাথে সেই ছাগলটি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো কি না, জানি না, তাই ত্রিভুজগোষ্ঠীর আনন্দিত হওয়ার ন্যূনতম কারণটিও ঢ্যাঁড়া কেটে বাদ দিতে হয়। ধৃতরাষ্ট্র পরে এই তথ্য জেনে গেলে সক্রোধে রাজা সুবলকে গুষ্টিশুদ্ধু বন্দী করেন। নিজের শ্বশুরকে হত্যা করলে বদনাম হবে, তাই একেবারে জানে না মেরে গান্ধারের রাজ পরিবারকে প্রতিদিন মাথা পিছু এক গ্রাস করে খাবার দেয়া হতো। প্রবল প্রতিহিংসাপরায়ণ গান্ধাররাজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠিক করেন, তিনি শোধ নেবেন। পরিবারের সকলের খাবার একত্র করে তিনি তা খেতে দেন নিজের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শকুনিকে। তার আগে এক আঘাতে শকুনির একটি পা মটকে দিয়ে বলেন, এই খোঁড়া পা তোকে প্রতিশোধের কথা মনে করিয়ে দেবে। বাপ-মাকে খুন করার শোধ নিতে কুরুরাজ্য ধ্বংস করাই তোর জীবনের লক্ষ্য। এবার পেট ভরে খা। সুবল রাজার পরিবার না খেয়ে অন্ধকূপে পড়ে পড়ে মরে গেলেও শকুনি কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যায়। টিংটিঙে খোঁড়া শকুনির মাথা ছিলো খুব পরিষ্কার, তাই পরবর্তীতে সে ধৃতরাষ্ট্রের বড় ছেলে দুর্যোধনের উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করে। পিতা সুবলের ঊর্বাস্থি দিয়ে শকুনি তৈরি করে সেই পাশার ছক্কা, যা তার আদেশ মান্য করতো। সেই পাশার ছক্কা সম্বল করেই যুধিষ্ঠিরকে দুর্যোধনের সাথে পাশা খেলতে বসিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য থেকে শুরু করে বৌ, সবই হস্তগত করে শকুনি। এ অজানা নয়, যে এমনটা ঘটলে একটা বিরাট যুদ্ধ লাগবেই। সেটাই ছিলো শকুনির উদ্দেশ্য, কুরু-পাণ্ডবে কিলাকিলি লাগিয়ে কুরুরাজ্য পয়মাল করা। সহদেব শকুনিকে কুরুক্ষেত্রে হত্যা করলেও পুরাণ শকুনি মামাকে ক্ষমা করেনি। কুবুদ্ধি দেয়ার কাজে সুদক্ষ লোককে আজও শকুনি মামা ডাকে লোকে। যেখানেই প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তি আছে, সেখানে রাজনৈতিক মহাকর্ষের টানে শকুনি মামারাও দলে দলে এসে জুটে যায়। সেই উপদেষ্টা শকুনিরা যে কুবুদ্ধি দেন, তা শাসকবর্গের হ্রস্বমেয়াদী স্বার্থে কাজে লাগে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাদের ঊরুভঙ্গই ঘটায়। পৌরাণিক শকুনিরা সহজে পক্ষত্যাগ করতেন না, সাথে থেকেই আলগোছে পিঠে ছুরি মারা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে যেতেন, বর্তমানের শকুনির মামারা হেসে খেলে দলও পাল্টে ফেলেন। কে যে কখন কার সাথে থেকে কী বুদ্ধি দিচ্ছে, সেই কীর্তির দাগ খুব মন দিয়ে অনুসরণ না করলে শাসক গোষ্ঠী পিঠে ছুরি খাওয়ার জন্যে পিঠ পেতে দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। আর ইদানীং সেই ছুরি খাওয়ার জন্য তারা আর নিজেরা পিঠ পাতেন না, ছুরি গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের পিঠে। তারাই ভোগে, তারাই মরে, তারাই শাসকের অবিমৃষ্যকারিতার খেসারত দেয়, যেমন দিয়েছে সেই মুহম্মদ বিন তুঘলকের আমলেও। ইতিহাসের ছাত্র-গবেষকদের জন্যে ইতিহাসের শকুনিসন্ধান এক আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হতে পারে বলে আমি মনে করি। বড় বড় রাজা-সম্রাট-সুলতান-নওয়াব-প্রধানমন্ত্রীদের ছোটোখাটো আইনস্টাইন ভেবে নেয়ার কোনো কারণ নেই, বরং তাদের সু- ও কুবুদ্ধি দিতে বহুসংখ্যক শকুনি মামা যে যুগে যুগে তাঁদের চোখ-কানের নাগালেই বহাল থাকতেন, এমন হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। ইতিহাসের শকুনি মামাদের শনাক্ত করা এবং ইতিহাসের পাঠকের কাছে তুলে ধরার কাজটি ইতিহাসবেত্তাদেরই করতে হবে। তাই আমরা জানতে চাই, কে সেই লোক, যে আজ থেকে দুই দশক আগে বাংলাদেশকে তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বিশ্বের তথ্য মহাসড়কে উঠতে বাধা দিয়েছিলো? এই অপসিদ্ধান্তের দায় তৎকালীন বিএনপি সরকারকে যেমন নিতে হবে, তেমনি এই শকুনি মামাটিকেও খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানতে চাই, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে দলরাজনৈতিক ফায়দা লোটার কুবুদ্ধি মহাজোট সরকারকে কে দিলো? এই কুবুদ্ধির কুফল আওয়ামী লীগ একা ভোগ করবে না, ঢাকাবাসীসহ সারা দেশের মানুষই করবে। তাই এর রাজনৈতিক দায় আওয়ামী লীগকে যেমন নিতে হবে, পাশাপাশি আমাদের চিনে রাখতে হবে সেই বুদ্ধির জনক শকুনি মামাকেও। ইতিহাসের স্বার্থেই।
false
rg
আড্ডার কথা আড্ডায়। রেজা ঘটক একবাক্যে সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা দিতে পারতাম। আরো দিতে পারতাম কুয়াশামোড়া নাগরিক গোধূলীর ভাঁপা পিঠার নিমন্ত্রণ। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কিংম্বা টিএসসির বদ্বীপ সড়কের কোনায় দাঁড়িয়ে ভাঁপা পিঠা খেতে খেতে আড্ডায় যারা আনন্দ পায় না, তাদের কি অন্য কোন উষ্ণতায় শুভেচ্ছা জানিয়ে লাভ হবে? এমনিতে মানুষকে গায়ে পড়ে ভালো বুদ্ধি দিতে গেলে অনেকে গোস্যা করে। ভাব দেখায় সব জান্তা সমশের। নেহাত নিম্নর্বুদ্ধির কাজকেও মনে করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এই দলের লোকদের এড়িয়ে চলা একটি ফরজ কাজ। এই দলের লোকদের জন্য আমি কখনো শুভেচ্ছা দেই না। শুভেচ্ছা নেইও না। এদের সাথে কুতর্কে সময় নষ্ট করাও আহম্মকি। আমি খুব সচেতনভাবে এই গোষ্ঠীকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। যা বলছিলাম, আইডিয়া নিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটি। আসুন, এবার একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক, আড্ডায় আড্ডায়। এই ফাঁকে বলে রাখি, ইতোমধ্যে যারা মনে মনে আমাকেও আহম্মক ভাবতে শুরু করেছেন, তাদের জন্য আমার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। ভিন্ন মত ভিন্ন চিন্তা থাকবে। চিন্তার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলন ঘটুক এটা আমারও চাওয়া। অথবা আজাইরা প‌্যাচাল পারছি, এমন ভাবলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার কথা বলছি, আপনার কথা আপনি বলবেন। যাদের বয়স এখন ১৫ থেকে ৪৫-এর মধ্যে, তাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মাঝখানের এই ৩০ বছর সময়ই আপনার জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময়। এই সময়কালে আপনি যা করবেন, বিপ্লবী বীরের মতো করবেন, নায়কের মতো করবেন, যোদ্ধার মতো করবেন। পুরোপুরি নিজেকে উজার করে দিয়ে করবেন, ভালো লাগা দিয়ে করবেন, ভালোবাসা দিয়ে করবেন। নিজে আনন্দ নিবেন। অন্যকেও আনন্দ দিবেন। দেখবেন, জীবনটা খুব এনজয়ফুল। তখন বোরিং কোনো গবেষণার কাজকেও আপনার মনে হতে পারে মহা আনন্দের কাজ। আমরা যদি ১৫ থেকে ৪৫ বছরের বয়সক্রমকে তিনভাগে ভাগ করি, আমাদের কার কি কাজ, কিভাবে করলে সুবিধা, কে কোনটা করবে ইত্যাদি, তাহলে কি আপনারা শ্রেণী সচেতন ওয়ালারা আমাকে বর্ণ-বৈষম্যের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন? যদি আপনাদের জোড়ালো উচ্চারণ হ্যা-কে জয়যুক্ত করে, তাহলে তো মনে হয় আমার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানো অনেক উত্তম কাজ। আর যদি তাই না হয়, তাহলে, ১৫ থেকে ২৫ যাদের বয়স, তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে আমার ডানদিকে বসো। তোমাদের একটা নাম দেই, তাহলে হিসাবে আরো সুবিধা হবে। তোমাদের নাম হতে পারে প্রজাপতি ভোঁ ভোঁ গ্রুপ। অথবা চঞ্চল হৈ চৈ গ্রুপ। কিংম্বা আমার দেওয়া নামটা পছন্দ না হলে, নিজেরাও একটা সুন্দর নাম দিয়ে নিতে পারো। তোমরা হয়তো নিজেদের রয়েল গ্রুপও ভাবতে পারো। কারণ, এই বিষয়টায় সবচেয়ে তোমরাই বেশি লাভবান হবে। এটা কিন্তু চুপিচুপি বললাম। বড়োরা বুড়োরা যেনো না শোনে। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর, তারা মনে করো, তোমরা হলে তালপাতার সেপাই গ্রুপ। অথবা হতে পারে, মাছি মারা হরিপদ কেরানি গ্রুপ। কিংম্বা হবু ফাস্ট লেডি বা সদ্য ফাস্ট লেডি অথবা আরলি মেরিজ জনিত জটাকলে আটকা পড়ে ফাস্ট লেডি শাসিত বসিভূত শোষিত হুকুম তালিমে নিষ্ঠাবান কামনেওয়ালা গ্রুপ। অথবা কামিনী যামিনী গ্রুপ। জীবনে মৃত্যু ছাড়া যাদের আর জামিন নেই। বাকি জীবন এরা মুক্ত থেকেও প‌্যারোল পায় না। কিংম্বা এদের নাম হতে পারে, কামড়া-কামড়ি গ্রুপ। তোমরা এবার কামড়া কামড়ি ছেড়ে একদম চুপ চাপ হয়ে বসো। নইলে কারো কথা কেউ শুনতে পাবে না। আর তোমাদের যুদ্ধটা বাসায় গিয়ে দরজা আটকে কইরো। আমরা চোখ বন্ধ রাখবো। অতো দূরে কেনো? তোমরা ঠিক আমার এই বাম পাশটায় হাতের নাগালের মধ্যে বসো। যাতে মারামারি-টা কন্ট্রোল করা যায়। কি বল্লে? তোমরা বেশি বেশি কামড়া কামড়ি করবে? কইরো, এখন একটু চুপ থাকো। দেখো না ওই যে মুরব্বিরা দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু মনে করবেন না, ভাইয়েরা। ওরা এই রকম। ঘরে বাইরে সারাক্ষণ কামড়া কামড়ি করে। আপনাদের যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ তারা আমার ঠিক সামনা সামনি বসেন। আপনারা তো মুরব্বি। আপনাদের আজ যে জন্য ডেকেছি, তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। দয়া করে আপনাদের পরিচয়টা একটু যদি এক এক করে সবাই বলেন, আপনাদের পরিচয় পেলে আমরা বড়োই কৃতার্থ হই। এই যে ভায়া, হ্যা, আপনি শুরু করেন। নেড়ে মাথা থেকে ক্যাপ নামিয়ে উনি পাল্টা আমার কাছে জানতে চাইলেন- আমাকে বলছেন? - জি, আপনাকে। আপনি দেখতে অনেকটা আমাদের প্রিয় আহসান ভাইয়ের মতো। আপনি কি আমাদের আহসান কবিরকে চেনেন? আপনিও কি এখনো ব্যাচেলর মাল? - ত..ত.তোমার মাথা। আ.. আমাকে নিয়ে কি আপনি ম-ম-ম মসকরা করছেন? - না, মসকরা কেন করবো? আপনি তো আমাদের সম্মানিত গেস্ট। আপনার কাছে আমরা আপনার পরিচয় জানতে চাইছি। এই সভায় নয়া কেউ আসলে এটাই রেওয়াজ, বুঝলেন? _ আত..ছা। ব-ব-ব বলছি। তার আগে একটু পাস করা যাবে? মা মানে, মাইসাস, ভিষণ চাপ। ফ-ফ-ফ ফেটে যাবার মতো অবস্থা। আপনারা যারা দেরিতে আসছেন, বুঝতেই পারছেন, মুরব্বি-র একটু হালকা হওয়া এই মুহুর্তে কতোটা জরুরি। আমরা কি মুরব্বির জন্য অপেক্ষা করেবো? আমাদের এই ছোট্ট হলরুমটা প্রথম প্রথম কিন্তু এমন কানায় কানায় ভরতো না। দেওয়ালের ওই যে ছবিটা দেখছেন, উনিই আমাদের এই আড্ডার গুরু। আমাদের প্রিয় সঞ্জীব দা, সঞ্জীব চৌধুরী। আড্ডাবাজ প্রাণখোলা মানুষটা আমাদের জন্য এখন শুধুই স্বৃতি। কিংবদন্তি একদিন বড়ো হবে। ধীরে ধীরে আমাদের এই আড্ডার কথা কিংবদন্তিও একদিন জানবে। কথায় কথায় সঞ্জীব দা আইডিয়া দিতেন। বলতেন, এ্যান আইডিয়া ক্যান চ্যাইঞ্চ ইয়োর লাইফ। শুধু আড্ডা মারবে না। আড্ডায় আইডিয়ার কথা বলবে। আইডিয়া একদিন সমাজ বদলে দেবে। আমরা সঞ্জীব দা'র কথা মাথায় রেখে এই আড্ডার নাম দিয়েছি- `আড্ডায় আড্ডায় আইডিয়া'। তার আগে আমরা এখন ফ্লোর দেবো আমাদের প্রিয় আহসান ভাইকে। আহসান কবির। সঞ্জীব দা'র খাঁটি শিষ্য। কেমন আছেন সবাই? সঞ্জীব দা'র কথা যখন হচ্ছিল, তো সঞ্জীব দা'র একটা মজার হিস্ট্রি দিয়ে শুরু করি। সঞ্জীব দা গেছেন ছফা ভাইয়ের বাসায়। ছফা ভাই মানে আহমাদ ছফা। গিয়ে দ্যাখেন, ছফা ভাই সারা ঘরে পায়চারি করছেন। কিছুটা চিন্তিত। সঞ্জীব দা জানতে চাইলেন, ছফা ভাই, আপনি কি কোন সমস্যায় পড়েছেন? ছফা ভাই হাঁটছেন আর কথা বলছেন। সঞ্জীব, তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করবে? আমাকে একজন ফটোগ্রাফার দিতে পারো? সঞ্জীব দা, জানতে চাইলেন, ফটোগ্রাফার দিয়ে কি করবেন, ছফা ভাই? - ছবি তোলাবো। ছফা ভাইয়ের জবাব। সঞ্জীব দা জানতে চাইলেন, কার ছবি? - কার আবার আমার। আমার ছবি তোলাবো। - কখন তুলেত চান? হঠাৎ ছবি তুলবেন কেন? কি হয়েছে? ছবি কাকে দেবেন? ছফা ভাই? - একটু আগে তসলিমা এসেছিল। ওকে আমার একটা ছবি দিতে হবে। - কখন দিতে হবে? - কাল সকালে। - বাইরে টাইরে যাচ্ছেন নাকি? - না। - তাহলে ছবি দিয়ে কি করবেন? আর এতো তাড়াহুড়ো বা কিসের? - তুমি বুঝতে পারছো না, সঞ্জীব। - না বোঝার কি আছে? তসলিমাকে আপনার একটা ছবি দিতে হবে কাল সকালে। কাউকে বলে দেব। ছবি তুলে দেবে। এজন্য আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো, ছফা ভাই? আপনি বসেন তো, ছবি তোলা যাবে। আমি আপনার সাথে একটা সিরিয়াস বিষয়ে পরামর্শ করতে এসেছি। আপনি একটু বসেন, ছফা ভাই। - আগে তুমি আমার ছবি তোলার ব্যবস্থা করো। তারপর তোমার কথা শুনবো। - ছফা ভাই, বিষয়টা সিরিয়াস। - আমার বিষয়টাও সিরিয়াস। তুমি বুঝতে পারছো না, সঞ্জীব। - বলেন, আপনার সিরিয়াস বিষয়টাই আগে শুনি। - তসলিমা নাকি এখন ঢাকা মেডিকেলে বসে! একটু আগে ও এসেছিল। আমার অবস্থা দেখে তসলিমা বললো, আপনি সকালে চলে আসেন। আমি চেক-আপ করে দিচ্ছি। - তো যাবেন। চেক করাবেন। অসুবিধা কোথায়? - সেজন্যই তো বললাম, তুমিও বুঝলে না আমার কথা। - না বোঝার কি আছে? - না আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাবো না। - এটা কিন্তু ঠিক না, ছফা ভাই। আপনি অসুস্থ। মেডিকেলে যাবেন। চেক-আপ করাবেন। এটা না মানার কি আছে? - অসুস্থ কিসের তা না শুনেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে? গাধা কোথাকার। - আমি কিন্তু আপনার কথা এবার কিছুই বুঝলাম না। - তুমি ফটোগ্রাফার দিতে পারবে কিনা বলো? নইলে বিদায় হও।আমার কিছুই ভালো লাগছে না। - ছফা ভাই, সত্যি করে বলেন তো, অসুস্থতার সাথে ছবি তোলার ব্যাপারটা কিসের? - আমার পাছায় একটা ফোঁড়া উঠেছে। সেজন্য আমি কয়েক দিন বসতে পারছি না। তসলিমাকে বললাম, কোনো অসুধ খেলে সারবে কিনা? ও বলল, সকালে আসেন, চেক করে দেখি। -তারপর? - তুমি বলো সঞ্জীব, তসলিমাকে আমি কি পাছা দেখাতে পারি? তুমি একজন ফটোগ্রাফার ডাকো, ও ছবি তুলুক। তসলিমাকে পাছা দেখানোর চেয়ে ছবি পাঠাব ভেবেছি। তুমি ফটোগ্রাফার না নিয়ে আসবে না বলে দিচ্ছি। তারপর সঞ্জীব দা ফটোগ্রাফার খুঁজতে বের হয়ে গেলেন। --------------------------চলবে।। রেজা ঘটক - সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৩ রাত ৮:১০
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০২৬ ১. মরাল গ্রীবা যাকে বলে, তা-ই। আস্তে করে ঘাড়ে হাত রেখে ছুঁয়ে দেখলাম। বাদামী গায়ের রং, মসৃণ শরীরের বাঁক, এক কথায় অপূর্ব। কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে বসালাম, আলতো করে আঙুল রাখলাম নাইলনের ওপর। আহ, কতদিন পর পাচ্ছি এই স্পর্শ! দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম, ঝাড়া চার মাস পর। কথাগুলি আমার স্প্যানিশ-ইংরেজি পারস্পরিক ভাষা শিক্ষা প্রকল্পের পার্টনার পাওলা সম্পর্কে শতভাগ খাটে, তবে তাকে কোলে নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না তার নররূপী দানব বয়ফ্রেন্ডের কারণে। কোলে যাকে তুলে নিলাম সে আমার নতুন গীটার। চরম আর্থিক দুরবস্থার দিনে দুম করে কিনে ফেলা আমার নতুন ক্রোড়চারিণী। গীটারের দোকানে যে মিষ্টি বয়স্কা মহিলা বসেন, তিনি প্রথম দিন বেশ যত্ন করে দেখালেন তার গীটারের স্টক। সারা দোকান ভর্তি পিয়ানো, বাঘা বাঘা সব জিনিস, এক একটার নকশা তাকিয়ে দেখার মতো, দামও গগনচুম্বি। গীটারের দাম জেনে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিনের মতো চলে আসলাম, মনে মনে হিসেব কষছি, আগামী কত মাস কী কী তুচ্ছ বিলাসিতা বাদ দিতে হবে। হপ্তা যেদিন ফুরোবে, সেদিন বিকেলে গিয়ে হানা দিলাম আবার। গীটারের ব্যাগ স্টকে নেই, বাসে করে যাবো শুনে মহিলা রীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে গীটার প্যাক করে আমার হাতে তুলে দিলেন, সাথে পাঁচ ইউরো ডিসকাউন্ট। শহীদ কাদরী যেমন নিজের বাবা সৈয়দ খালিদ আহমেদ কাদরীর নামের সাথে দামেশকের ঝনঝনানিময় তলোয়ারের তুলনা করে নিজের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি ডিঙি নৌকার মতো পলকা, তেমনি পলকা আমি, তারচেয়েও পলকা আমার এই কাগজের কফিনে মোড়া গীটার বগলে করে বেরিয়ে আসি। এক একটা সময় যখন খুব শূন্য লাগে সবকিছু, খুব অর্থহীন মনে হয় আর সব কিছুই, তখন একটা কিছু ধরে বসে থাকতে ইচ্ছা করে, হোক কারো হাত, হোক একটা গীটারের কেঠো ঘাড়। একটা কিছু বাজুক তবু আমার হাতে। আমার জীবনের প্রথম উপার্জন দিয়ে কেনা আমার গীটারটা এখন ঢাকায় পড়ে আছে আমার ঘরে। এগারো বছর আগে কেনা সেই গীটারটার কথা মনে পড়ছে এই পোস্ট লিখতে গিয়ে। আমার অনেক আমি-ঘন্টা ধীরে ধীরে বিষন্নতার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে ঐ গীটারটা ধরে থেকে। এই পোস্ট উৎসর্গ করছি আমার রংচটা গীটারকেই। ২. ক্লাস নাইনে আমি যে শিক্ষকের কাছে বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে তাঁর বাড়িতে গিয়ে আলাদা করে গণিত শেখা শুরু করেছিলাম, তিনি সে বছরই বিয়ে করেছিলেন। ক্লাসে যে তিনি কোন অযত্ন নিয়ে গণিত শেখাতেন, এমনটা বলা ঠিক হবে না, তবে বাড়িতে আমাদের চাপের ওপর রেখে অঙ্ক করাতেন। তাঁর স্ত্রী, যতদূর স্মরণ করতে পারি, যথেষ্ঠ রূপবতী এবং আকর্ষণীয়া ছিলেন। একদিন পড়তে গিয়ে আমরা দেখি, স্যার বারান্দার গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে উদাস হয়ে আকাশ দেখছেন। এক বন্ধু ফিসফিস করে জানালো, বিরহ। ভাবি নাকি বাপের বাড়ি গেছেন দু'দিন আগে। বিরহকাতরতায় আরো অনেককেই ভুগতে দেখেছি। একটা সময় আমিও ভুগেছিলাম, যখন আরো কচি আর কাঁচা ছিলাম। কিন্তু তিনদিন আগে ফট করে ইন্টারনেটছিন্ন হয়ে পড়ার পর নিজের শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা লক্ষ করে বুঝলাম, আমি গভীরভাবে এই তথ্যবিনিময়ব্যবস্থার প্রেমে নিমজ্জিত। ইন্টারনেটের সাথে আমি আসলে বিবাহিত। পবিত্রগ্রন্থ হাতে কেউ এসে শুধু "টিল ডেথ ইউ ডু পার্ট" আর "ইউ মে কিস দ্য নেট" বলা বাকি। সমস্যা হচ্ছিলো কিছুদিন ধরেই, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক গায়েব। টোটকা প্রয়োগ করলে আবার ফেরত আসে। পাশের ফ্ল্যাটের ডাঁসা জার্মান এক ছুকরি এক দুপুরে এসে হাজির, আমার নেট কাজ করে কি না জানতে। তার সাথে আলাপ করে জানলাম, আমার সমস্যার চেয়ে তার সমস্যা আরো গুরুতর, সে গত কয়েকদিন যাবৎ নেটহারা হয়ে ঘুরছে। সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবার ঘরে ফিরে এসে পিসি ছেড়ে দেখি আমারও একই হাল। স্যামুয়েলকে পাকড়াও করলাম, সে জানালো, তার মাঝে মাঝে সমস্যা হয়, তবে এখন সে পরিজালিত অবস্থায় আছে, আমার কোন জরুরি মেইল করার দরকার হলে তার পিসি ব্যবহার করতে পারি। স্যামুয়েলকে কিভাবে বোঝাই যে নিজের বউ বাপের বাড়ি গেলে পরের বউকে ব্যবহারের সংস্কৃতিটা ভালো নয়? কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, এস নের্ফট (মেজাজ খারাপ লাগছে)। স্যামুয়েল বুদ্ধি দিলো হখশুলরেশেনৎসেন্ট্রুমে অভিযোগ করতে। পরদিন ভোরে বেরিয়ে আমার শ্রীলঙ্কান প্রতিবেশিনী সরসীর সাথে দেখা। তাকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করলাম নেটের কথা, সে মুখ কালো করে জানালো, ইতিমধ্যে দুইবার অভিযোগ করা হয়েছে, কিন্তু হাউসটিউটররা কোন সমাধান দিতে পারেনি। ক্লাসের পর গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণনাকেন্দ্রে। সেখানে হোঁৎকা এক হার্ডি আর শুঁটকো এক লরেল বসা। আমার সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলার পর হার্ডি জানালো, আমার আগেও অনেকে এসে এই অভিযোগ করে গেছে। অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমি বললাম, দ্যাখো আমি খুব কষ্টে আছি। কবে নাগাদ আবার ঘরে বসে নেট ব্যবহার করতে পারবো? লরেল জানালো, আসলে কোন সময়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া সম্ভব নয়। আমি যেন মেওয়া চাষে মনোযোগ দিই। এর মধ্যে আবার এক ফ্যাকড়া, সিস্টেমটেখনিকের সিম্যুলেশন করা হয়নি। উপস্থাপনার খসড়া ডক্টর প্রিসের পছন্দ হয়নি। মেইলে সে এক নিষ্করুণ ঝাড়ি। গ্রুপের পক্ষ থেকে আমি যোগাযোগ করি সাধারণত, প্রিস সরাসরি জানতে চেয়েছেন, "আপনার বাকি দুই সঙ্গী আসলে কী করে?" বুধবার ক্লাসের পর কাফেটেরিয়াতে বসে বসে বাকি দুইজনের সাথে বসে সিম্যুলেশন শেষ করা গেলো। পরদিন আমাদের উপস্থাপনার কথা ছিলো, আগেভাগে পিছিয়ে দেবার অনুরোধ করায় চামড়া কিছুটা বাঁচলো, তবে ক্লাসে প্রিস কড়া গলায় জানিয়ে দিলেন, এমনটা আর বরদাশত করা হবে না। বাকি দুই গ্রুপের উপস্থাপনা শেষ হবার পর তাকে কিছুটা ভজিয়ে নরম করা গেলো। ইন্টারনেটের অভাবে নিশ্চয়ই আমার চেহারা স্কুলে আমার গণিতশিক্ষকের মতোই হয়েছিলো। ওলাফ আর ক্রিস্তফ জানতে চাইলো, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। আমি বললাম, হ রে ভাই, ইন্টারনেট নাই বাসায়, রাতে ঘুম আসে না! ওলাফ বিবাহিত মানুষ, সপ্তাহান্তে ড্যুসেলডর্ফে বউয়ের কাছে চলে যায় ছুটতে ছুটতে, সে বোধহয় আমার মর্মযাতনা বুঝলো কিছুটা। বর্বর ক্রিস্তফ খালি এক প্লেট ফ্রেঞ্চফ্রাই এনে সাধলো, "খেতে চাইলে জলদি হাত চালাও।"
false
fe
পরিচয়ের রাষ্ট্রীয়করণ, রাজনীতির দেউলিয়াপনা পরিচয়ের রাষ্ট্রীয়করণ, রাজনীতির দেউলিয়াপনাফকির ইলিয়াস ===================================== কয়েক বছর আগে মিশিগান সীমান্তপথ দিয়ে আমরা কয়েকজন কানাডা গিয়েছিলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল নায়াগ্রা জলপ্রপাতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসা। যুক্তরাষ্ট্রের চেকপোস্ট পেরিয়ে কানাডার চেকপোস্ট যাওয়ার পর শুধুমাত্র গাড়ির নম্বর প্লেট এবং চালকের লাইসেন্স দেখার পর আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেনি কর্মকর্তারা। সন্দেহ হলে গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্কটি খুলে দেখতো তারা। কখনো কিছুই দেখতো না।এ ব্যবস্থায় এখন আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কানাডা এবং ম্যাক্সিকো দুই প্রতিবেশী দেশে যেতে আগে মার্কিনিদের কোনো ভিসা, আইডি কিছুই লাগতো না। সে ব্যবস্থা এখন আর নেই। গ্রিনকার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্টেট আইডি-এর যে কোনো একটির ফটো আইডি এখন সঙ্গে বহন করার বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ভিসার প্রয়োজন নেই যদিও, তবু নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার অধ্যাদেশের ফলে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টির যেমন কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তেমনি আইডি বানাবার জন্য নির্দিষ্ট অংকের ফিও পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।ইউরোপ আমেরিকাতে তো বটেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করার প্রথা চালু আছে দীর্ঘদিন থেকে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পাশাপাশি নন ড্রাইভিং আইডি ব্যবস্থা করে থাকে সেসব দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে এভাবে দীক্ষিত করা হয়, বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট যেমন জরুরি, দেশের বিভিন্ন সামাজিক, প্রশাসনিক, নিরাপত্তার প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয়পত্রটিও তেমনি জরুরি।বাংলাদেশে ভোটার আইডি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই নানা বিতর্ক চলছে। ইতিমধ্যে জেনেছি ভোটার আইডির কাজটি সম্পন্ন করে এনেছে নির্বাচন কমিশন। সে আইডিটি কেমন হবে, জাতীয় প্রয়োজনে তা কতোটা কাজে লাগবে,- এর কোনো স্বচ্ছ ধারণা এখনো পায়নি দেশের মানুষ। এবং তা দেওয়াও হচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে।জাতীয় পরিচয়পত্রের কথা বলা হলেই এর সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলো আসে প্রথমে। এটা থেকে রাষ্ট্রের বাসিন্দারা কতোটা সুবিধা পাবে , তাও বুঝাবার বিষয়টি সামনে চলে আসে। উন্নত বিশ্বের ‘সোশ্যাল সিক্যুরিটি’ বা ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ নামক একটি প্রথা চালু আছে। এর আওতায় সরকার প্রতিটি নাগরিককে একটি সোশ্যাল সিক্যুরিটি কার্ড দিয়ে থাকে একটি নম্বরসহ জন্মের পরপরই। যারা মাইগ্রেশন নিয়ে বাইরে থেকে আসেন, তাদেরও প্রথম কাজটি হয় এই কার্ডটির জন্য আবেদন করে তা সংগ্রহ করা।সোস্যাল সিক্যুরিটি নম্বরটির প্রথমেই প্রয়োজন পড়ে কোনো চাকরির জন্য দরখাস্ত করার বেলায়। চাকরিজীবী যে বেতন পান তা থেকে রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স বা পার্সোনাল ইনকাম ট্যাক্স কেটে নেওয়া হয় এই নম্বরের মাধ্যমে-এরই অনুকূলে। প্রতিটি ব্যক্তি নির্দিষ্ট বয়স হলে বিভিন্ন অংকের আর্থিক সুবিধা পান এই সিক্যুরিটি এডমিনিস্ট্রেশনের আওতায়। অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক অবসরপ্রাপ্ত হলে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় ভাতা পাবেন, তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় এই সোশ্যাল সিক্যুরিটি বিধানটি।চৌদ্দ কোটি মানুষের বাংলাদেশে হঠাৎ করে এমন নিরাপত্তা বিধান চালু করা কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। কিš' জাতীয় পরিচয়পত্র বানানো এবং তা বিতরণ করা মোটেই কঠিন নয়। বিশ্বে এখন চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়জয়কার। মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও আধিপত্য বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে অবাক হয়ে দেখার মতো। কোনো দিনমজুর যে একসের চাল কিনতে হিমশিম খায়, তার হাতেও মোবাইল ফোন। এই ফোনের খরচ আসে কোত্থেকে ? এই প্রশ্ন করা মোটেও অনৈতিক নয় বলে মনে করি। মানুষের আয়ের সঙ্গে বিলাস, খরচের সঙ্গতি রাখা প্রয়োজন। তা না হলে মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেউলিয়া হতে বাধ্য।বাংলাদেশে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনীয়তা খুবই জরুরি। এবং তা হওয়া উচিত ছবি সংবলিত। ডিজিটাল পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক প্রক্রিয়ায়। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি জন্ম নিবন্ধন এবং জন্মসনদ প্রদানে সরকার বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। একটি জন্মসনদ বা বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়াটা একটি শিশুর নাগরিক অধিকার। এ ব্যবস্থাটি একটি সভ্য, সুসংগঠিত এবং পরিশুদ্ধ প্রজন্ম, জাতি গঠনে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়। একজন মানুষ বড়ো হয়ে জানতে পারে তার জন্মতথ্য।ঠিক সেভাবে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র একটি সুশৃঙ্খলিত সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আমার মনে হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রথা চালুর মাধ্যমে অপরাধকর্ম কমিয়ে আনা এবং অপরাধীকে শনাক্ত করার কাজটিও সহজভাবে করতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ক্রমশ এর বাধ্যবাধকতা বাড়িয়ে দিতে পারলে মানুষ তা একদিন বহন করায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য হবে।কম্পিউটার পদ্ধতিতে আধুনিক একটি রাষ্ট্রীয় আইডি বানানো সরকারের খুব বেশি অর্থ খরচ হওয়ারও কথা নয়। নাগরিকগণ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে তা নিতে পারেন কিংবা পারবেন।আসছে ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল ক্রমশই কমে আসছে বলা যায়। আমরা দেখছি বেশ কিছু নতুন গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করছে এই সরকার। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার শুনানির মাধ্যমে দ্রুত জামিন পেয়েছেন আদালতে। ওয়ান-ইলেভেনের পর এমন নজির আমরা এই প্রথম দেখলাম। মেয়র খোকা তার সম্পদের সঠিক হিসাব দেননি। এই তার অপরাধ ছিল। এরকম অপরাধী আরো অনেকের ভাগ্যে ঘটেছে ভিন্ন ব্যবস্থা। জামাতের আলী আহসান মুজাহিদসহ আরো বেশ কিছু সিনিয়র রাজনীতিক এখনো রয়ে গেছেন বাইরে। তাদের ভবিষ্যৎ এখন ঝুলন্ত বলা যায়। কী হবে কেউ জানে না।র্ব্তমান সরকার তাদের কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে জনগণ যা প্রত্যাশা করছেন, তা হচ্ছে রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করে যেতে হবে। এই দেশে রাজনীতিকে যারা দেউলিয়া করেছেন, তাদের কারো মেরুদণ্ডই আজ সোজা নয়। এর দায় সিংহভাগ রাজনীতিকদের। তাই তা কাটিয়ে উঠতে একটি সৃষ্টিশীল মানব সমাজ দরকার। প্রয়োজন, নতুন ভাবনার সংযোজন। জাতীয় পরিচয়পত্র প্রথা চালু, সংবাদ মাধ্যমে সৃজনশীল স্বাধীনতা দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, আইডি ফিল্ডে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ও চাকরির ভিত মজবুত করার মধ্য দিয়ে সরকার তাদের শেষ দিনগুলো স্মরণীয় করে যেতে পারেন। সবই নির্ভর করছে তাদের সদিচ্ছার ওপর।৯ জুলাই ২০০৮----------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ। ১২ জুলাই ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত
false
rg
ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরষ্কার ২০১৩ জিতলেন আমেরিকান ছোট-গল্পকার লিডিয়া ডেভিস।। ২০১৩ সালের ম্যান বুকার পুরষ্কার জিতলেন আমেরিকান ছোট-গল্পকার লিডিয়া ডেভিস। লিডিয়া ডেভিস (জন্ম: ১৫ জুলাই ১৯৪৭) আমেরিকার একজন লেখক যিনি আধুনিক ছোট-গল্পকার হিসেবেই সবার কাছে বেশি পরিচিত। এছাড়া লিডিয়া উপন্যাস লেখেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন, এমন কি বিদেশী ভাষায় অনুবাদও করেন। বিশেষ করে ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে তার অনুবাদ সুপরিচিত। ফরাসি সাহিত্যের ক্ল্যাসিক অনুবাদ করে লিডিয়া চমক সৃষ্টি করেছেন। মারসেল প্রস্ত (১৮৭১-১৯২২)-এর সাতখণ্ডের বিখ্যাত ক্ল্যাসিক 'এ লা রিসার্সে দু টেমস পার্দু' বিখ্যাত উপন্যাস (ইন সার্স অব লস টাইম) ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। যার প্রথম খণ্ডের নাম 'সন'স ওয়ে'। গুস্তাভ ফ্লাউবার্টের বিখ্যাত উপন্যাস 'ম্যাডাম বোভারি' অনুবাদ করেন লিডিয়া। এ দুটি অনুবাদের জন্যে লিডিয়া সাহিত্য অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। লিডিয়া'র ছোটগল্প সত্যি সত্যিই আকারেও ছোট। লিডিয়ার কোনো কোনো গল্পের আকার এক প‌্যারা বা একটি মাত্র বাক্যে। অনেকটা হাইকু কবিতার মতো। দশ জনের শর্ট লিস্ট থেকে এ বছর লিডিয়া ডেভিসকে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরষ্কারের জন্য বাছাই করে লন্ডনের বুকার কমিটি। ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই আমেরিকার ম্যাসাচুয়েটস অঙ্গরাজ্যের নর্থহামটন শহরে লিডিয়া জন্মগ্রন করেন। তার বাবা রবার্ট গোরহাম ডেভিস একজন ইংরেজি সাহিত্যের প্রফেসর এবং সমালোচক। লিডিয়া'র মা হোপ হালে ডেভিস একজন ছোট-গল্পকার, স্মৃতিচারণমূলক রচয়িতা এবং শিক্ষিকা। ১৯৭৪ সালে লিডিয়া বিয়ে করেন পল অস্টারকে। লিডিয়া-অস্টার দম্পত্তি'র এক ছেলে ড্যানিয়েল। অস্টারের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটার পর লিডিয়া বিয়ে করেন আর্টিস্ট অ্যালান কোটকে। তাদের এক ছেলে থিও কোট। লিডিয়া বর্তমানে নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি'র ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের প্রফেসর। এছাড়া লিডিয়া নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিলিয়ান ভার্নোন ডিসটিংগুয়েসড রাইটার ইন রেসিডেন্স হিসেবে ২০১২ থেকে কর্মরত। লিডিয়া ডেভিসের এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ছোট গল্পের সংকলন ছয়টি। যার মধ্যে 'The Thirteenth Woman and Other Stories' (1976) ও 'Break It Down' (1986) পেন/হেমিংওয়ে পুরষ্কারের ফাইনাল লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। তার সর্বশেষ গল্প সংকলন 'Varieties of Disturbance' ২০০৭ সালের আমেরিকার জাতীয় বই পুরষ্কারের ফাইনাল লিস্টে স্থান করে নিয়েছে। ২০০৯ সালে Farrar, Straus and Giroux থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০০৮ পর্যন্ত লেখা লিডিয়ার সকল ছোট গল্প এক সঙ্গে। লিডিয়ার অসংখ্য পুরষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার হল ২০০৩ সালে তিনি পান ম্যাক-আর্থার ফেলোশিপ, ২০০৫ সালে নির্বাচিত হন আমেরিকার অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের সম্মানিত ফেলো এবং ২০০৪ সালে নটেরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিমটিংগুয়েসড স্পিকার। আর এ বছর তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করলেন। এক নজরে লিডিয়া ডেভিসের বই:Selected works:১. The Thirteenth Woman and Other Stories ২. Sketches for a Life of Wassilly৩. Story and Other Stories৪. Break It Down৫. The End of the Story৬. Almost No Memory৭. Samuel Johnson Is Indignant৮. Varieties of Disturbance৯. Proust, Blanchot, and a Woman in Red১০. The Collected Stories of Lydia Davis১১. The CowsAnthologies:১. Charles Wright, David Lehman, ed. (2008). "Men". The Best American Poetry 2008২. Robert Hass, David Lehman, ed. (2001). "A Mown Lawn". The Best American Poetry 2001৩. E. Annie Proulx, Katrina Kenison, ed. (1997). "St. Martin". The Best American Short Stories 1997৪. Biill Henderson, ed. (1989). The Pushcart prize: best of the small pressesTranslations:১. Maurice Blanchot (1981). P. Adams Sitney, ed. The Gaze of Orpheus, and Other Literary Essays২. Marcel Proust (2004). Lydia Davis, Christopher Prendergast, ed. Swann's Way৩. Vivant Denon (2009). Peter Brooks, ed. No Tomorrow৪. Gustave Flaubert (2010). Lydia Davis, ed. Madame BovaryAwards:১. 1986 PEN/Hemingway Award Finalist, for Break It Down২. 1988 Whiting Foundation Writers' Award for Fiction৩. "St. Martin," a short story that first appeared in Grand Street, was included in The Best American Short Stories 1997.৪. 1997 Guggenheim Fellowship৫. 1998 Lannan Literary Award for Fiction৬. 1999 Chevalier de l'Ordre des Arts et des Lettres for fiction and translation.৭. "Betrayal," a short-short story that first appeared in Hambone, was included in The Best American Poetry 1999৮. "A Mown Lawn," a short-short- story that first appeared in McSweeney's, was included in The Best American Poetry 2001৯. 2003 MacArthur Fellows Program১০. 2007 National Book Award Fiction Finalist,for Varieties of Disturbance: Stories১১. "Men," a short-short story that first appeared in 32 Poems, was included in The Best American Poetry 2009১২. 2013 American Academy of Arts and Letters’ Award of Merit Medal[17]১৩. 2013 Philolexian Award for Distinguished Literary Achievement১৪. 2013 Man Booker International Prize[13]
false
fe
অরক্ষিত মানুষের পাশে দাঁড়ান আমার কেন জানি মনে হচ্ছে , পুরো দেশটাই অরক্ষিত। পিলখানায় নারকীয় হত্যাকান্ডের পর পুরো দেশই উদ্বিগ্ন।কেউ জানে না কি হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে। 'অপারেশন রেবেল হান্ট' চলছে। দেশবাসী চান কোন নিরপরাধ যেন হান্টিং এর শিকার না হন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বহিরাগত একটা শক্তির প্রচ্ছন্ন ছায়ায় ঘটেছে ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। এরা কারা ? এই অস্ত্র এলো কোত্থেকে ? কারা চালালো এই অস্ত্র ? বিরোধী দলের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। এমনটিই হওয়ার কথা। জাতীয় সংসদ জাতির আশা-আকাংখার প্রাণবিন্দু। আর সাংসদরা তাদের যোগ্য প্রতিনিধি। জাতীয় প্রতিনিধিরা জাতির বিবেকের পক্ষে কথা বলবেন সেটাই নিয়ম। যুক্তিতর্ক হবে, সিদ্ধান্ত হবে। জাতি দেখবে মাননীয় এমপিরা জাতীয় ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন। প্রজন্ম জানবে তাদের গন্তব্যের কথা। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কথা। এবারের একুশে পালিত হয়েছে একটি ভিন্ন আবহে। এই একুশের চেতনা সামনে রেখে দেশের আপামর মানুষ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা বলেছে, ঘাতক রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ চাই। জাতি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তখন আমরা কিছু আস্ফালনও লক্ষ্য করছি। জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির মদদদাতা কিছু তথাকথিত জ্ঞানপাপী বলছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেই দেখুক না।’ বেশ বড় ধরনের ধমক তাদের কথাবার্তায়। এরা এই শক্তি পাচ্ছেন কোথা থেকে? তারা কি এখনও জাতির বিরুদ্ধে অবস্খান নিতে চান? যেমন করে একাত্তর সালে নিয়েছিলেন? স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে আইনানুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই পারে। এতে বাধা দেয়ার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। যারা এই বিচারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে চান তাদের চিনে রাখা দরকার। এরা গত সাঁইত্রিশ বছর বিভিন্ন তমদ্দুনের থলেতে লুকিয়ে ছিলেন। নিজে ধার্মিক নন, অথচ ধর্মের নামে যারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান তাদের ধ্বজা ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে। হীন স্বার্থ হাসিল করেছেন বিভিন্ন সরকারের কাছ থেকেও। এই প্রজন্ম আজ ঠিকই বলছে, জাতি বিপুল ভোটের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমাতসীনদের সেই রায় দিয়েছে। ম্যান্ডেট দিয়েছে যুদ্ধাপরাধী খুনিদের বিচার করার। ভেবে অবাক হতে হয়, এসব বর্ণচোরা তস্কররা এখনও লুকিয়ে আছে এই সমাজে। যারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দিতে চায়। যারা জাতির জনককে অবজ্ঞা করার ধৃষ্টতা দেখায়। এদেরই একজন সম্প্রতি চাকরিচ্যুত তথ্য সচিব আ. ত. ম ফজলুল করিম। যিনি কবি আবু করিম নামেই পরিচিত। তিনি এক সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন জাসদের মুখপাত্র দৈনিক গণকণ্ঠের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এরপর নিজেকে ঢেকে রেখেছেন। তার মন নতজানু হয়েছে ক্রমশ মৌলবাদী ডানপন্থিদের আরাধনায়। তারই বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি তার কবিতায়। কটাক্ষ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। তার অবুঝ শিশু রাসেলকেও। বাংলা কবিতার মাঠের একজন শব্দ শ্রমিক হিসেবে স্পষ্ট বলে দিতে পারি আবু করিম যে কবিতাটি লিখেছেন, তা পাঠে আমার মনে হয়েছে এটা আদৌ কোন কবিতা নয়। একটি পরিশুদ্ধ কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প যা থাকা দরকার এর এক শতাংশও নেই এই কবিতাটিতে। নিছক কটাক্ষ এবং ব্যঙ্গাত্মক শব্দের পরিমণ্ডলেই বেড়ে উঠেছে তার এই কথিত কবিতাটি। আবু করিমকে সবিনয়ে প্রশ্ন করি, বঙ্গবু শেখ মুজিব যদি এই জাতির মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব না দিতেন তবে আপনি কি এই স্বাধীন দেশের ‘সচিব’ পদটি পেতেন? অতএব জাতির স্খপতি, জাতির জনকের প্রতি অবজ্ঞা তো নিমকহারামীরই শামিল। একজন ‘কবি’ দাবিদার হয়ে আপনি এই কাজটি করতে পারলেন? এই আপনার কাব্য রুচি? দুই. একটি দেশের উন্নয়নে প্রতিটি মানুষের ভমিকা অপরিসীম। সে জন রাজনীতিকই হোন, আর আমজনতাই হোন। সরকারি দলের ভমিকা যেমন গুরুত্বপর্ণ তেমনি গুরুত্বপর্ণ বিরোধীদলের ভূমিকাও। সম্প্রতি সেই কথাটি আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন ভারতীয় লোকসভার স্পীকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নবীন এমপিদের একটি ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, বিরোধীদলকে সব সময় সৃজনশীল বিরোধিতার ভমিকায় থাকতে হয়। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার মানসিকতা ও প্রথা বাদ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশের স্বার্থই সবচেয়ে প্রধান। এই প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ করা প্রয়োজন। চারদলীয় জোট ২০০৬ সালে যখন ক্ষমতা ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হলো তখন তারা তাদের চারপাশে তৈরি করেছিল এক ধরনের ‘আলীবাবার’ দরজা। যেমনটি তারা চেয়েছিল তেমনটি চিচিং ফাঁক বললেই যেন তা তাদের অনুকলে প্রসন্ন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মন:পুত না হওয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে। দোহাই দেয় তারা সংবিধান, গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় জনমানসের। আসলে সবই ছিল হীন মানসিকতার জালে বোনা। ফলে বিএনপি নামক দলটি ব্যাপকভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের থানা, জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোও দখলদারদের কবলে পড়ে মহা রাক্ষসে পরিণত হয়। সম্প্রতি বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যে মতবিনিময় করেছে সেসব চিত্র দেখে খুব স্পষ্টই জানা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কেমন বৈরী আচরণ করেছিলেন। কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, এই হচ্ছে বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী’ চেতনার স্বরূপ। যাদের একটি পক্ষ এখনও বাংলাদেশে ডানপন্থি মৌলবাদী চক্রকে নেপথ্য মদদ দিয়ে যাচ্ছে। যারা এখনও একাত্তরের পরাজিত রাজাকার চক্রের সঙ্গে গাটছাড়া বিনষ্ট করার জন্য প্রস্তুত নয়। বর্তমান সরকারের ভাল কাজগুলোকে সাপোর্ট না দিতে পারলেও গঠনমূলক সমালোচনা করার দায়িত্বটি নিতে পারে প্রধান বিরোধীদল। কারণ তারা জনগণের ম্যান্ডেট প্রত্যাশা করলে জনগণের স্বার্থের পক্ষে তাদের দাঁড়াতেই হবে। সে ক্ষেত্রে ট্রানজিট, টিফা ইত্যাদিকে উপলক্ষ না করে বরং দেশের বাণিজ্য, উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির সেক্টরগুলোকে গতিশীল করার পক্ষেই বিরোধীদলের অবস্খান থাকা দরকার। এই লেখাটির শেষ পর্যায়ে এসে টিভি চ্যানেলে একটি বীভৎস সংবাদ দেখলাম। একই রাতে ঢাকার বিভিন্ন স্খানে ছিনতাই হয়েছে। পঁয়ত্রিশ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। ছিনতাইকারীরা কুপিয়েছে নিরীহ মানুষদের। টিভি রিপোর্টে দেখানো হচ্ছে, টহলরত পুলিশবাহিনী ঝিমুচ্ছে ভ্যানে বসে। দেশের আইনশৃখলা পরিস্খিতি ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। সে কথা দুই স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীই বলছেন বারবার। তারপরও দেশে চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পথচারীরাও যদি নিরাপদ না থাকতে পারেন তাহলে তো পুরো দেশই অরক্ষিত। এর শেষ কোথায় ? (সংযোজিত ) নিউইয়র্ক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ --------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০০৯ ভোর ৫:৫৫
false
hm
পিচ্চিতোষ গল্প ০৮: রামকাঙার গল্প ছোট্ট মানু রাতে ঘুমোবার সময় খুব ছটফট করে। তাকে রোজ রোজ গল্প শোনাতে হয়। মানু ছোট্ট হলেও বোকা নয়, পুরনো গল্প তাকে শোনালে সে ভারি রাগ করে। সব গল্পই তার মনে থাকে, কোন পুরনো গল্প একটু শুরু করলেই সে ক্ষেপে ওঠে। মানুর মা যেমন সেদিন বলছিলেন, "এক দেশে ছিলো একটা রাজা ...।" মানু চুপ করে শোনে। অনেক গল্পই রাজার গল্প, অনেক গল্পই রাজা দিয়ে শুরু হয়। মানুর মা বলেন, "রাজার ছিলো দুইটা রাণী। একটা সুয়োরাণী আরেকটা দুয়োরাণী ...।" মানু চুপ করে থাকে। রাজাদের একটার বেশি রাণী থাকাই দস্তুর। এর আগের গল্পের রাজাটার সাতটা রাণী ছিলো, এই রাজাটার দুইটা। এই রাজাটাকে আরো পাঁচটা বিয়ে করতে হবে। মানুর মা বলেন, "একদিন রাজার দেশে এলো একটা রাক্ষস, তার হাতে একটা বাঁশি। সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে যে শোনে সে-ই ঘুমিয়ে পড়ে ...।" অমনি মানু ক্ষেপে ওঠে। "না না না এই গল্পটা আমি শুনবো না আর। এটা আমি আগেও শুনেছি। ঐ রাক্কোসটা সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, তারপর তারপর ঐ যে রাখাল ছেলেটা গিয়ে রাজাকে বলে রাজাবাবু আমি এই রাক্কোসকে জব্দ করবো ... না না না, নতুন গল্প বলতে হবে নতুন গল্প ...।" মানুর মা হেসে ফেলেন। বলেন, "ওহহো, এটা আগে শুনে ফেলেছে মানুসোনা? আচ্ছা কাঁদে না, কাঁদে না, হাত পা ছোঁড়ে না, বিছানায় ওলটপালট খায় না, বলছি নতুন গল্প, বলছি। এক দেশে ছিলো একটা গোলাপী বাঘ ...।" সব গল্প মানুর ভালোও লাগে না। তার জেদে মাঝে মাঝে রাজকন্যাকে আবার জাদুর ওষুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হয়, দুষ্টু মন্ত্রীকে কানে ধরে ওঠবোস করাতে হয় একশোবার, টগবগপুরের রাজার ঘোড়াটা দিয়ে দিতে হয় ধুধুনগরের গরীব ঘুড়িওয়ালার ছেলেকে। তারপরেই মানু সন্তুষ্ট হয়ে ঘুমোতে যায়। মানুর মা একেবারে হাঁপিয়ে ওঠেন এত গল্প বলতে বলতে। মানুর বাবা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের গল্পের বই কিনে আনেন, কিন্তু তাতেও সব পুরনো গল্প। লাইব্রেরি থেকে আনানো বইগুলির গল্প মানুর জন্যে নয়, সেগুলি শুনে তার ভালো লাগে না। মানু ছোট্ট মানুষ, তার জন্যে কেউ গল্প লেখে না। একদিন মানুর ছোট মামা বেড়াতে এলেন অনেক দূরের দেশ থেকে। মানুর ছোট মামা টিঙটিঙে প্যাঁকাটির মতো দেখতে, কিন্তু মুখে মস্ত গোঁফ, আর অনেক কথা বলেন। মানুর মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, বললেন, ছোটন, যতদিন এখানে আছিস, মানুকে রোজ রাতে একটা করে গল্প বলবি। আর দিনের বেলা তিনটা করে গল্প লিখে দিবি আমাকে, তুই চলে গেলে ওকে শোনাবো। মানুর ছোট মামা গম্ভীর মুখে গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "তথাস্তু!" সেদিন রাতে মানু খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প শুনতে এলো তার মামার কাছে। ছোট মামা বললেন, "মানুকুমার, তুমি কি রামকাঙাদের গল্প শুনতে চাও?" মানু বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনতে চাই চাই!" ছোট মামা বললেন, "মানুকুমার, তুমি আবার রামকাঙাদের গল্প শুনে ভয় পাবে না তো?" মানু বললো, "না না না, ভয় পাবো না।" ছোট মামা বললেন, "ঠিক আছে মানুকুমার! তুমি সাহসী বালক, তোমাকে এই গল্প শোনানো যায়। তবে তুমি আবার তোমার মা-কে এই গল্প বোলো না, তোমার মা খুব ভীতু!" মানু হাসে, "আচ্ছা বলবো না।" ছোট মামা বলেন, "তুমি তো জানো মানুকুমার, আমি অনেক দূরের একটা দেশে থাকি। সেই দেশের নাম জামরুলনগর। সেখানে পথের পাশে, মাঠেঘাটেহাটে, নদীর দুই ধারে শুধু জামরুল গাছ! তাই সে দেশের নাম জামরুলনগর।" মানু অবাক হয়ে শোনে। বলে, "জামরুল ছাড়া ঐ দেশে আর কোন গাছ নেই?" ছোট মামা বলেন, "জামরুল ছাড়া ঐ দেশে আর কোন গাছ নেই। একটা কামরাঙা গাছ ছিলো, সে বুড়ো হয়ে মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আহা, সে বড় ভালো গাছ ছিলো। সবাই তাকে ভালোবাসতো।" মানুর মনটা খারাপ হয়ে যায় জামরুলনগরের কামরাঙা গাছটার জন্য। ছোট মামা বলেন, "জামরুলনগরের লোকজন সেই জামরুল খেয়ে বাঁচে। দিন নেই রাত নেই তারা শুধু জামরুল খায়। তাদের পকেটে হাত দিলেই তুমি চার পাঁচটা জামরুল পেয়ে যাবে। তাদের স্কুলব্যাগেও এক ছটাক করে জামরুল থাকে টিফিনের জন্য।" মানু অবাক হয়ে যায়। বলে, "ওরা আইসক্রীম খায় না?" ছোটমামা বলেন, "ওরা জামরুলের আইসক্রীম খায়।" মানু অবাক হয়ে ভাবে লোকগুলির কথা। ছোটমামা বললেন, "একদিন জামরুলনগরের লোকজন দেখলো, একটা জামরুল গাছের নিচে কী যেন একটা শুয়ে আছে।" মানু বললো, "কী শুয়ে আছে?" ছোটমামা বললেন, "সেটা দূর থেকে প্রথমে বোঝা গেলো না। কিন্তু সে এক মস্ত জন্তু! তার মস্তবড় ল্যাজ!" মানু গুটিসুটি হয়ে শোয়। বলে, "তারপর?" ছোটমামা বলেন, "তার দুটো ডানাও আছে!" মানু বলে, "উড়তে পারে?" ছোটমামা বলেন, "সবাই ভাবলো তা-ই। এত বড়ো জন্তু যদি ওড়ে, তাহলে কী ভীষণ কান্ড!" মানু বলে, "কেন, ভীষণ কান্ড কেন?" ছোটমামা বললেন, "উড়তে উড়তে যদি বাথরুম করে?" মানু ভাবে, তাই তো! ছোটমামা বলেন, "কেউ সে জন্তুর কাছে যেতে সাহস পাচ্ছিলো না। সবাই ভাবলো, যদি কামড়ে দেয়!" মানু বললো, "তারপর?" ছোটমামা বললেন, "জামরুলনগরের রাজা আমাকে এসে বললেন, জনাব, এই পরিস্থিতিতে আপনাকেই একটা কিছু করতে হবে।" মানু বললো, "রাজা কি তোমার বন্ধু?" ছোটমামা বললেন, "না, রাজাকে চিনি ছোটবেলা থেকে। খুব ভালো ছেলে। তারপরে কী হলো শোন। ... আমি গিয়ে দেখি, ওটা একটা রামকাঙা!" মানু বললো, "রামকাঙা কী?" ছোটমামা বললেন, "রামকাঙা জানো না? রামকাঙা এক অদ্ভুত জন্তু। তার ডানা আছে পাখির মতো, কিন্তু উড়তে পারে না। তার মস্ত লেজ আর ঠ্যাং আছে কাঙারুর মতো, কিন্তু লাফাতে পারে না।" মানু বললো, "সে তাহলে কিভাবে চলে?" ছোটমামা বললেন, "সে কেবল ডিগবাজি খায়।" মানু বললো, "সে ওখানে কী করছিলো?" ছোটমামা বললেন, "আমিও তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, রামকাঙা! তুমি এখানে কী করো? সে বলে, আমি কামরাঙা খাবো।" মানু বললো, "কিন্তু জামরুলনগরে তো কামরাঙা নাই, কামরাঙা গাছ তো মরে গেছে!" ছোটমামা বললেন, "হ্যাঁ, সেটাই তাকে তখন বললাম।" মানু বলো, "তারপর?" ছোটমামা বললেন, "দুঃখে রামকাঙা কেঁদে ফেললো। বললো, আমি তাহলে এখন কী খেয়ে বাঁচবো?" মানু বললো, "রামকাঙারা জামরুল খায় না?" ছোটমামা বললেন, "না, জামরুল খেলে রামকাঙাদের পেটে অসুখ করে।" মানু বললো, "তারপর?" ছোটমামা বললন, "আমি রামকাঙাকে বললাম, কেঁদো না রামকাঙা। কামরাঙা নেই তো কী হয়েছে, তুমি জলপাই খাও। রামকাঙা তখন খুশি হয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে সদর রাস্তা ধরে পাশের রাজ্য জলপাইনগরে চলে গেলো। সেখানে শুধু জলপাই গাছ।" মানু বললো, "তারপর?" ছোটমামা বললেন, "তারপর আর কী! রাজা এসে আমাকে বললেন, জনাব, আপনি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। আপনাকে আমি রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব দিতে চাই!" মানু বললো, "তারপর?" ছোটমামা বললেন, "আমি বললাম, রাজা, আমি রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব চাই না, একমাস ছুটি দাও বরং। তারপর ছুটি নিয়ে তোমাদের বাসায় এসেছি।" মানু বললো, "রামকাঙাটা কেমন আছে?" ছোটমামা বললেন, "রামকাঙাটা ভালো আছে। সে শুধু ডিগবাজি আর জলপাই খায়।"
false
fe
মানবসেবার পরিকাঠামো _ দেবেশ রায় দেবেশ রায় আমার একজন খুব প্রিয় সাহিত্যিক। এই ব্লগে অনেকেই আছেন ,তাঁর লেখার অনুরাগী। তাদের কথা বিবেচনা করেই লেখাটি এখানে যুক্ত করে দিলাম। পড়ার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে। ----------------------------------------------------------------------------- মানবসেবার পরিকাঠামো দেবেশ রায় ---------------------------------------------------------- দুনিয়ায় এখন একটা নতুন তত্ত্ব নিয়ে কথা উঠেছে। কোনো তত্ত্বই তত্ত্ব হয় না, যদি কঠিন তথ্যের ওপর তৈরি না হয়। নতুন তত্ত্বটি সেই কঠিন তথ্য জোগাড় করছে, এখন। মাইক্রোসফট ইত্যাদির মালিক বিল গেটস দানধ্যানে আমেরিকার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলছেন। এর আগে রেকর্ড ছিল জন ডি রকফেলারের। ২০০৫ সালের ডলারের দাম অনুযায়ী ৬ বিলিয়ন ডলার। এই সব টাকার অঙ্ক বুঝতে আমাদের অনেকেরই খুব অসুবিধে হয়, যেমন অসুবিধে হয় গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব বুঝতে- এ সবই আমাদের ধারণার ক্ষমতার এতোই বাইরে। মিলিয়ন তাও মনে থাকে- দশ লাখ বা এক নিযুত। আর, আমেরিকায় বিলিয়ন হচ্ছে, ‘এ থাউজ্যান্ড মিলিয়ন’, এক হাজার নিযুত বা একশ কোটি। বিল গেটস ইতিমধ্যেই ৩১০০ কোটি ডলার দান করে ফেলেছেন। তাঁর সারা জীবন তো পড়েই আছে। তাঁর ইচ্ছে জীবনাবসানের আগে তাঁর মোট সম্পদের বেশিটাই তিনি তাঁর ‘বিল এ্যান্ড মিলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন’-এ দান করে যাবেন। ‘ফর্বস’ ম্যাগাজিনের শেষ হিসাব অনুযায়ী সেই সম্পদের মূল্য দাঁড়াবে- প্রায় ৪৭০০ কোটি ডলার (২০০৬-এর ফেব্রুয়ারির হিসাব)। এই সব সংখ্যা অনেক সময় তুলনায় কিছুটা ধারণা করা যায়। ভারতের মতো বড় ও জনবহুল দেশের বার্ষিক বাজেট হয়, গত চার-পাঁচ বছরে, ৪০০০ কোটি ডলারের মতো। তার চাইতে বেশি টাকা একজন লোক, মাত্র একজন লোক, দান করে দিচ্ছেন আমেরিকায়। বিল গেটস ১৯৯৮ থেকে দানধ্যানে নেমেছেন। তাঁর দেখাদেখি যাঁরা সুপাররিচ বা মহাধনী, তাঁরা সকলেই দানধ্যান শুরু করেছেন। কার্নেগির দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান বার্তান গ্রেগরিয়ান বলেছেন, ‘জনসেবাকে বিল গেটস নিত্যকর্ম করে দিয়েছেন। তুমি যে জনসেবায় দান করবে, সেটা একটা সাধারণ প্রত্যাশা।’ এই তথ্য থেকেই নতুন একটি তত্ত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তার নাম বাংলায় বলতে পারি, ‘মানবসেবকধনতন্ত্র’ (দি ইকনমিস্ট ২৫ ফেব্র“য়ারি, ২০০৬ সংখ্যা)। ইতিহাসের নানা ঘটনা থেকে এই দাতব্যপুঁজির বিষয়টি আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। সেই প্রত্যেকটি চেষ্টাই ভুল হবে। আমাদের দেশে সেই পাঠান-মুঘল আমল থেকেই তো জলের জন্য দীঘি কাটানো, পুজোর জন্য মন্দির বানানো, নামাজের জন্য মসজিদ তৈরি করানো হয়ে আসছে। খুব ভিতরের সব মফস্বলে জমিদাররা যাতায়াতের রাস্তা বানিয়ে বা খাল কেটে দিতেন। এই কলকাতার গঙ্গার ধারে ঘাট তৈরি করিয়ে দিয়েছেন বাঙালি-অবাঙালি বাবুরা- পুরুষদের ও মেয়েদের আলাদা ঘাট। আগেকার দিনে ‘সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি’ ছিল হিন্দুদের স্বর্গের টিকিট। সেই কারণে মরণাপন্নকে নিয়ে যাওয়া হতো গঙ্গার ঘাটে। গঙ্গাযাত্রীদের জন্য শেড বানিয়ে দিয়েছেন বাবুরা- মাদার তেরেসা যেমন বানিয়েছেন কালীঘাটে মরণাপন্নদের প্রতীক্ষালয়। নিজের টাকা বেশি হলে দানধ্যানে দেয়ার নির্দেশ সব ধর্মেই আছে। নইলে আর তিরুপতির মন্দিরে নিজেকে গোপন রেখে লাখ লাখ টাকা থলিতে ফেলে কেন ভক্তজন? নতুন এই দাতব্যপুঁজি ঐ সব পুরোনো-নতুন ব্যাপার থেকে একেবারে আলাদা। এই নতুন ধারণায় দানধ্যান বিষয়টিকেই পুঁজি হিসেবে খাটানো হচ্ছে। যেমন, আমাদের জলতেষ্টা পায়- এই বিষয়টিকেই পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে ঠাণ্ডা পানীয়ের বাজার ও খদ্দের তৈরি হয়। যেমন, এই বাদাম-চানাচুর-ঝালমুড়ি-ফুচকা খাওয়ার মতো খেলার ছলে জিভ-চালানোর অভ্যেসকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে চুটকি খাবারের বিশাল শিল্প। যেমন, বেশ প্রাণ খুলে সেক্স করার ইচ্ছেকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে কনডোমের বাজার, যেন কনডোম একটি অতিরিক্ত লিঙ্গ। তেমনি একটু দানধ্যানের মানবিক ইচ্ছেকে পুঁজি করে তৈরি হতে চলেছে দাতব্যপুঁজির নতুন বিনিয়োগ। ভারতের ‘সান গ্রুপ বিনিয়োগ সংস্থা’ শিল্পপতি খেমকাদের পুরোনো বংশগত ব্যবসা। এখন তার কর্তা হয়েছেন, উদয় খেমকা। তিনি বলেছেন, ‘যদি জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে বলতে হয়, এই দাতব্যপুঁজির বিনিয়োগ ১৮৭০ সালে পড়ে আছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই দাতব্যতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পরিচায়ক হয়ে উঠবে।’ উদয় আরো বলেছেন, ‘আমি দাতব্যতার পরিকাঠামো উন্নত করতে টাকা খাটাব।’ এই প্রত্যেকটি শব্দ খুব জরুরি। দাতব্যতা। পরিকাঠামো। উন্নয়ন। বিনিয়োগ। একটু ঘুরিয়েও বলা যায় বা বলতে হয়। যেমন বাড়িঘর তৈরিতে যারা টাকা খাটান তাদের বলা হয়- ‘ডেভেলাপার’, বা ‘প্রোমোটার’, বা ‘রিয়্যালটার’। এগুলো শুধু শব্দ নয়, আলাদা-আলাদা অর্থের জন্য আলাদা-আলাদা শব্দ। সেই সব অর্থের মধ্যে একটা অর্থ লাল কালিতে দাগানো- কাজটা করতে যে টাকাটা লাগবে, সেটা ওরা খাটাচ্ছেন না-ঐ যারা ডেভেলাপার বা প্রোমোটার। টাকাটা আপনি খাটাচ্ছেন- আপনার একটি ফ্ল্যাটের জন্য। ধরা যাক ১৫ বা ২০ লাখই খাটাচ্ছেন। খাটাচ্ছেন পুরো কাজটির জন্যই- যেমন লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার কিনে, শেয়ার-হোল্ডার, কোম্পানির পুরো কাজেরই পুঁজি জোগায়। সেই কারণেই, কোম্পানির পুরো কাজে লাভ হলে শেয়ারহোল্ডার লাভের অংশ বা ডিভিডেন্ট পায়। বা শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ও শেয়ার বেচে দিয়েও শেয়ারহোল্ডার লাভ করতে পারে। ‘ডেভেলপার’ বা ‘প্রমোটার’ বা ‘রিয়্যালটার’কে টাকা আপনি জোগালেও আপনি কোনোভাবেই অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডার হতে পারেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি করে পুঁজি জোগাড় করার পদ্ধতি থেকেই আধুনিক ধনতন্ত্রের জন্ম ও বাড়বাড়ন্ত। যে নামেই ডাকা হোক, হাই ক্যাপিটালিজম, পোস্টমডার্ন ক্যাপিটালিজম, গ্লোবালাইজিং ক্যাপিটালিজম, গ্লোক্যালাইজিং ক্যাপিটালিজম- একুশ শতকের ধনতন্ত্র আর শেয়ার বেচে পুঁজি জোটাতে চায় না। চায় না এই একটি মাত্র কারণে যে, শেয়ার মানেই তো অংশ, শেয়ারহোল্ডার মানে অংশীদার, বা লাভের ভাগীদার- একুশ শতকের ধনতন্ত্র অংশীদারও চায় না, ভাগীদারও চায় না। একুশ শতকের ধনতন্ত্র,এখন দাতব্যতা বা মানবতা বা সেবা উৎপাদন করতে নেমেছে। সেই উৎপাদনের পরিকাঠামো এখন তৈরি হচ্ছে। এই মানবতার পরিকাঠামো গড়ার বিনিয়োগই এখন ধনতন্ত্রের প্রধানতম কর্মসূচি। ইন্দোনেশিয়ার সেলিম গোষ্ঠী যে রাজার হাটে শহর ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানাচ্ছে, সে তো মানবতার পরিকাঠামো। সেই পরিকাঠামো তৈরি করে দিতে পারলে, মানুষজনকে আধুনিকতম নগর জীবনযাপনে এনে ফেলতে পারলে, আরো কতো নতুন চাহিদাই না তৈরি হবে। হাওড়ার পশ্চিমে মোটরবাইক কারখানা খোলা হচ্ছে দুটি কারণে। একটা কারণ ঐ দাতব্য পুঁজির মধ্যেই পড়ে। এককালে যেমন নাইট স্কুল বসিয়ে নিরক্ষরতা দূর করা হতো, এখন তেমনি বাইক তৈরির কারখানা গড়ে আমাদের উন্নয়নসূচক ধারণাই বদলে ফেলা হবে। উন্নয়ন বলতে লোক-ধারণা এতে প্রশ্রয় পাবে- উৎপাদন> নিয়োগ> বিক্রি উৎপাদন> নিয়োগ> লাভ। মোটরবাইকের কারখানায় কোনো দেশ আর বাইরের পুঁজি খাটায় না। আর তার বাজারও এখন গুটিয়ে আসছে- লোকজন এখন ছোটখাটো গাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকেছে। ১৯৯৯-এ হার্ভার্ড বিজনেস রিভিয়ু-এ মাইকেল পোর্টার ও মার্ক ক্র্যামার একটি প্রবন্ধ লেখেন- ‘মানবসেবার নতুন কর্মসূচি : মূল্যমান তৈরি করা’। এই শেষাংশটুকু হয়তো কারো কারো কাছে ইংরেজিতেই সহজবোধ্য, ‘ক্রিয়েটিং ভ্যালু’। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সুন্দর ও সরল একটা বাংলা হয় ‘পণ্য’। যার পণ, বা দর, বা ভ্যালু আছে, সেটা পণ্য। তা হলে ১৯৯৯-এর ঐ তাত্ত্বিক ও দিকদিশারী প্রবন্ধটির বাংলা হতে পারে- ‘মানবসেবার নতুন লক্ষ্য এখন পণ্য হতে পারা।’ ‘মানবসেবার এই বাজার’কে ‘লাভজনক’ করতে হলে তিনটি কাজ করা দরকার বলে এরা মনে করছেন। ১. যেমন লিমিটেড কোম্পানিগুলোর লাভক্ষতি সাব্যস্ত হয় শেয়ার মার্কেটে, তেমনি সামাজিক পুঁজি বিনিয়োগীদের তৈরি চাহিদা পূরণের জন্য ‘মানবসেবা’র কোন দিকটাতে টাকা খাটানো যাবে তার স্পষ্ট সঙ্কেত। ২. ‘মানবসেবা’তে টাকা খাটাতে হলে একটা পরিকাঠামো দরকার- যেমন এখন আছে শেয়ার মার্কেট, বিনিয়োগী ব্যাংক, গবেষণা কেন্দ্র, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। ৩. ‘মানবসেবা’ যারা করতে চান, তাদের পুঁজি খাটুয়ে হতে হবে। এর সঙ্গে আরো অনেক কথা আছে। সব দেশেই, বিশেষ করে আমেরিকায়, মানবসেবার কাজে টাকা দিলে ট্যাক্স ও শুল্ক থেকে অনেক রেহাই পাওয়া যায়। তা হলে তো এই সব সংগঠনের কাজকর্মের ওপর কংগ্রেসের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে। ম্যানজমেন্ট গুরুদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন মানবসেবার জন্য যেসব ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে তাদের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ খাটে না। এমনকি রেডক্রসও এক খাতে বরাদ্দ টাকা কাউকে না জানিয়ে আর এক খাতে খরচা করে। এনজিও মারফৎ যে টাকা খরচা হয় তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। এমন ফাটকা বাজারে কী করে পুঁজি খাটানো যাবে? দেবেশ রায় : কথাসাহিত্যিক। ------------------------------------------------------ দৈনিক ভোরের কাগজ ,ঢাকা । ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ মংগলবার সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৭:৫৬
false
hm
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা একটু বড় ... লেখাটা ২০০৪ সালের অক্টোবরে লেখা। বছরদুয়েক আগে একাধিকবার অনলাইনে প্রকাশিত। এই লেখাটা একাধিক কারণে আমার প্রিয়। প্রথমত, লেখাটা প্রায় এক আসনে লেখা, মাঝখানে শুধু ঘুমিয়েছিলাম একটু। দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত এটাই আমার ম্যাগনাম ওপাস (আয়তনের দিক থেকে)। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটা, এমন একটা সময় এ লেখায় ধরে রাখা আছে, যা আমি আর কখনো পাবো না। পাঠকদের আরো জানাই, এ লেখায় কোন কল্পনাশ্রিত ঘটনা নেই। যা কিছু বলা হয়েছে, তা ঘটেছে, চরিত্ররাও সবাই এখনো জীবিত, চঞ্চল বাদে সবাই সহমত হবেন এই লেখার সাথে। আয়তনের কারণেই এর আগে লেখাটা পুরো পড়েছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা কম। তবে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া আমাকে আনন্দিত করেছে বরাবর। যিনি লেখাটা পুরো পড়বেন, তিনি ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবেন আমার কাছে। আর খুব দুঃখিতচিত্তে অনুভব করি, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে কীভাবে অনর্গল লেখার শক্তি আমাকে পরিত্যাগ করেছে। শিরোনাম দেখে পাঠকসমাজের (পাঠিকারাও আছেন এই দলে) মনে হতে পারে, হিমালয় বা আনদেজ চষে বেড়িয়ে এসে কলম হাতে নিয়েছি। আদপে ব্যাপারটা সেরকম নয়, ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলে, বান্দরবানের রুমা থেকে রাঙামাটির পুকুরপাড়া পর্যন্ত বিসতৃত গরীবের এই অভিযান। ভেবেছিলাম উত্তম পুরুষে লিখবো না, তেমনটা লেখা এই নরাধমকে মানায়ও না। কিন্তু এবারের যাত্রায় অনেকেই পৃথক ফল হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, কাজেই সেসব ফলের একটা সালাদ পাঠকের সামনে হাজির না করে বরং পেছন ফিরে আমার চোখেই গোটা অভিযানটাকে আগাপাশতলা একবার চেখে দেখি। স্মৃতির সাগর মন্থন করতে থাকলে এক সময় অমৃত কিছু মিলবেই, আর গরল যা উঠে আসবে, তা নিজের গলায় রেখে নীলকন্ঠ সাজতে আমার কিচ্ছু আপত্তি নেই। এক: নির্গলদ বিসমিল্লাহ কেওকারাডং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (মাত্র ৩,১৭২ ফিট উঁচু), আর সেখানেই নানা রূদ্ধশ্বাস কাহিনীর বুনটে সূর্যোৎসবের অভিযান দিয়েই EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর যাত্রা শুরু। বলা যেতে পারে, বান্দরবানের গহীন পাহাড়ি এলাকাই এই ক্লাবের আঁতুড়ঘর। ক্লাবের অভিযাত্রীদের অনেকেই পরে আবারো ফিরে গেছেন কেওকারাডঙে, বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন পথে। জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে কবিতার বিখ্যাত-বিতর্কিত একটি পঙক্তি পড়েছিলাম: মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে --- যদি বলি এক্সপ্লোরার ক্লাবের সদস্যদের কাছে নোনা মেয়েমানুষটি হচ্ছে বান্দরবানের পাহাড়গুচ্ছ, খুব একটা অতিশয়োক্তি হবে না। এই পাহাড়ের সারিগুলোর সৌন্দর্যের সাথে লুকিয়ে আছে এক আকর্ষক শক্তি, যা একজন ট্রেকারকে একাধিক অভিযানের জন্যে হাতছানি দেয়। এই ফেব্রুয়ারিতে সেই হাতছানিকে উপেক্ষা করার শক্তি ECB সদস্যদের একদমই ফুরিয়ে এসেছিলো। পাহাড় কতখানিই বা আছে এই বাংলাদেশে? উত্তরে গারো পাহাড়ের কয়েকটি শিরা, উত্তর পূবে খাসিয়া আর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের খাটো দেয়াল, আর নিচে দক্ষিণ পূবে মগের মুল্লুকে আরাকানের কিছু দলছুট পাহাড়। বাংলাদেশের ভেতরে এক হাজার মিটারের ওপরে কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই স্বল্প উচ্চতার --- স্বল্প বলছি এ কারণে, একবার উত্তর পশ্চিমে চোখ মেলে তাকালেই নগরাজ হিমালয়কে চোখে পড়ে --- মাঝেই পাহাড়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রস্তরনন্দিনী সব ঝর্ণা, পাথুরে ছড়ার খাত, ঘন নিবিড় জঙ্গল, হঠাৎ গভীর খাদ, বাঁশের ঝোপে ছাওয়া উপত্যকা আর জুম্ম চাষের ঢালু ক্ষেত। এর ফাঁকে ফাঁকেই হয়তো চোখে পড়ে আচমকা জেগে ওঠা দ্বীপের মতো একেকটা পাড়া, অর্থাৎ পাহাড়ীদের গ্রাম। তেমনই একটা গ্রাম, পুকুরপাড়া অভিযাত্রীদের এবারের যাত্রার গন্তব্য। পুকুরপাড়া রাঙামাটি জেলায় পড়লেও, সেখানে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা থেকে যাওয়াটাই সঙ্গত। ম্যাপে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেই বুঝবেন, কেন এ কথা বলছি। রাঙামাটির দক্ষিণ তৃতীয়াংশে অবস্থিত এই পাড়া একটা বিশাল পাহাড়ী দীঘিকে ঘিরে, বহুল আলোচিত বগালেকের চেয়ে আয়তনে কয়েকগুণ বড় এই দীঘির কাছেই রয়েছে রাইনক্ষ্যং নদীর একটি প্রপাত, এঁকেবেঁকে যে নদীটি যাত্রায় ক্ষান্তি দিয়েছে কাপ্তাই হ্রদের বুকে মুখ গুঁজে। আর এই রাইনক্ষ্যং-জলপ্রপাতই হয়ে উঠেছে ECB সদস্যদের পিপাসু চোখের লক্ষ্যবস্তু। ECB সম্পর্কে যারা একটু আধটু জানেন, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, এই ক্লাবের সদস্যেরা, যাদের বয়স আট থেকে আটাশির মধ্যে, যাবতীয় সরকারি ছুটির চরম সদব্যবহার --- অথবা বদব্যবহার --- করে থাকেন, বিশেষ করে দুই ঈদের প্রশস্ত ছুটিগুলো তাঁরা কাটিয়ে দেন কোন এক পথে কাঁধে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে কোন সুদূর গন্তব্যের দিকে জোর পায়ে হাঁটায়। তাই ফেব্রুয়ারির দুই তারিখে, কোরবানি ঈদের লঘু ছুটিতেই যাত্রা শুরু করার গুরু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো (কোরবানি ঈদের ছুটি যেমন খানিকটা প্রশস্ত, তেমনই আরেকটা সুবিধে হচ্ছে, এ সময়ে আকাশে শুক্লপক্ষের কড়া চাঁদ থাকে, রাতে পথ চলতে সুবিধে হয়)। বিকেলের মধ্যে কোরবানির দায়দায়িত্ব সেরে, নিহত পশুর ঝোল দিয়ে মেখে ভরপেট সেদ্ধ ধানের-দানা দিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে, ধীরেসুস্থে একেকজন হাজির হবেন কমলাপুরে বাস স্টেশনে, তেমনই অলিখিত চুক্তি হলো সবার মধ্যে। এবারের দল তুলনামূলকভাবে ছোট, কারণ কোরবানি ঈদে যাঁরা ঢাকার বাইরে বেরিয়ে পড়বেন, অথবা ঢাকায় ঈদোত্তর মেহমানদারিতে লিপ্ত হয়ে পড়বেন, তাঁরা গা মুচড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। ব্যতিক্রম শামীম খান মিলন, ক্লাবের দুর্দান্ত প্রতিশ্রুতিশীল সদস্য, যিনি আগে কখনো বান্দরবান যাননি। সুদূর সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তিনি প্রথমে পৌঁছুবেন সাতক্ষীরা, সেখান থেকে ঢাকার বাসে চড়ে পৌঁছুবেন ঢাকায়, তারপর আবার বাসে চড়ে বসবেন, বান্দরবানের পাহাড়গুলোকে এক হাত দেখে নেয়ার জন্যে, কম হ্যাপা নয়। আর আছে চঞ্চল, যে তার নামের যথার্থ সম্মান করতে শিখেছে, এই প্রথম পাহাড়ে চড়তে বেরিয়ে উৎসাহের চোটে একদিন আগেই কঙ্বাজার গিয়ে বসে আছে ব্যাটা, তিন তারিখ সকালে মূল দলের সাথে যোগ দেবে সে। এবার দলনেতা উচ্ছল, ইনিও নামের সাথে ঘাড়ত্যাড়ামো করেননি। ক্লাবের পথপ্রদর্শক বরুণ বকশী আর শাহেদ কামাল তো সাথে আছেনই, আর পাহাড়ের পথ প্রদর্শক মংক্ষিয়া মারমা আমাদের সাথে যোগ দেবেন বান্দরবান থেকে। ঘাগু দুই হাঁটাবাজ সালেহীন আর সৈকত মোটেও পিছপা নয়, যেমনটা নন পুতুল আপা, যেমনটা নই --- ইয়ে, আমি। দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়, আর পুকুরপাড়া তো কোন ছার। দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ, এমনই চিন্তা পুষে রাখা বুকটাকে ঠুকে নিয়ে ঈদের আগের দিন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি। আমার হাবাগোবা গোছের হ্যাভারস্যাক আগেও অনেক ধকল সয়েছে --- সাঙ্গু নদীতে গতবছর তার আরেকটু হলেই সলিল সমাধি ঘটতো, ওয়াহিদ ভাই সময় মতো কান ধরে টেনে না তুললে --- তাই এবার বেচারাকে একটু নিষকৃতি দেয়ার বাসনায় কেবল একটি প্যান্ট, একটি গেঞ্জি আর কী একটি যেন ঢোকাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাতে ঢোকে একখানা ট্রাইপড, একটা ক্যামেরা, একটা বাইনোকুলার, গামছা, টয়লেট পেপার, শুকনো খাবার, ইত্যাদি ইত্যাদি। কোরবানির মাংস ওজন করার যন্ত্রটায় চাপিয়ে দেখা গেলো, বারো কেজির চেয়ে একটু বেশি ওজন হয়েছে ব্যাগটার। এর আগে কেওকারাডং যাত্রায় আমার বোঁচকার ওজন হয়েছিলো সতেরো কেজি, এবার তারচেয়ে ঝাড়া পাঁচ কেজি কম। ঈদসংক্রান্ত সামাজিকতা সেরে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে কমলাপুরে পৌঁছে সেখানে প্রায় সবাইকে পেয়ে গেলাম। আরো কয়েকটা ছোট ছোট গ্রুপ চলেছে বান্দরবানে, তাঁরাও রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে বাস স্টেশনে উপস্থিত। আমাদের তোড়জোড় দেখে এক সহযাত্রী জানতে চাইলেন, আমরা কেওকারাডঙে যাচ্ছি কি না। পুকুরপাড়ার নাম শুনে ভদ্রলোক নাক সিঁটকালেন, অর্থাৎ, তিনি পুকুরপাড়ার নাম ইহজীবনে শোনেননি, এটা আবার কোথায় ---? তাঁরা সবাই চলছেন কেওকারাডঙে, গম্ভীরমুখে জানালেন। বাস জার্নির বর্ণণা কী আর দেবো? প্রায় ফাঁকা রাস্তায় উল্কা বেগে ছুটছে বাস, হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারের একটা সামান্য অংশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্ষণিকের জন্য, তারপর আবার ডুবে যাচ্ছে আঁধারে। ঈদক্লান্ত ঢাকা শহরকে পেছনে ফেলে বান্দরবান পৌঁছতে আমাদের চারপাশে ভোর ঘনিয়ে আসে। কিন্তু বান্দরবানে পৌঁছে সংকটের চেহারাটা চোখে পড়ে সবার। চঞ্চল বান্দরবানেই রাত কাটিয়ে ভোরে মূল দলের সাথে যোগাযোগ করবে, এমনই কথা ছিলো। কিন্তু বাস স্টেশনের আশেপাশে তার চেহারাখানা দেখা যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষার ফাঁকে হাতমুখ ধুয়ে ফেললেন সকলে, আর পুতুল আপা র্যাকস্যাকটাকে ঠিকমতো বাঁধাছাদা করতে বসলেন। তখন দেখলাম, একগাদা আচারের বোতল নিয়ে এসেছেন তিনি। সবার সাথেই কিছু না কিছু নগণ্য শুকনো খাবার আছে, যেমন আমার ব্যাগের ভেতরে পাঁউরুটি, বরুণদার কাছে চিঁড়া, সে জায়গায় পুতুল আপা জগদ্দল কাঁচের বয়ামে করে আচার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? হুড়োহুড়ি করে সেই বোঝা ভাগাভাগি করে নিলাম কয়েকজন। বরুণদা আর শাহেদ ভাই মংক্ষিয়া দাদার খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। খানিক বাদে তাঁরা ফিরলেন একেবারে চাঁদের গাড়ি চড়ে, এ গাড়িই রিজার্ভ করে ক্ষক্ষ্যংঝিরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। সেখানে নৌকোতে চড়ে রুমা পর্যন্ত বাকি পথ পাড়ি দিতে হবে, আর রুমা থেকেই শুরু হবে আমাদের পর্বতযাত্রা। আরেকটা দুঃসংবাদ জানা গেলো, গতকাল একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী রিগ্রিক্ষ্যং হিল রিসোর্টের ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে, বিপুল অঙ্কের মুক্তিপণ চেয়েছে তারা। চাঁদের গাড়ি থামিয়ে নাস্তার জন্যে বাজারের একটা খাবার দোকানে ঢুকলাম সবাই। ভোরবেলা বাসস্টলে এসে রিপোর্ট করার কথা চঞ্চলের, সে কোথায় কোন হোটেলে আছে কিছুই আমাদের জানা নেই, তাই উল্টে তাকে খোঁজার ব্যাপারটাও যথেষ্ঠ জটিল হয়ে পড়েছে। খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে চিন্তিত মুখে ভাবছি, এখন কী করা যায়, কিন্তু আমাদের খাওয়ার ফাঁকেই হঠাৎ চঞ্চলের আবিভর্াব ঘটলো, সবাই স্বস্তিতে হাঁপ ছাড়লাম। যাক, ব্যাটাকে আর খুঁজে বার করতে হয়নি, সে-ই আমাদের খুঁজে বার করেছে, শুধু তা-ই না, এভাবে আমরা হারিয়ে যাওয়ায় তার মৃদু তিরস্কারও আমাদের সহ্য করতে হলো। কী আর করা, কোনমতে মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে আমরা হুড়োহুড়ি করে চাঁদের গাড়িতে উঠে বসলাম। তারপর ভোঁওওও ---! জনৈক অভিযাত্রী রুমা পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে উৎসুক ছিলেন, তিনি সুট করে ভিড়ে পড়লেন আমাদের গাড়িতে। কোন পরিকল্পনা করে আসেননি তিনি, ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন, সবিনয়ে আমাদের সাথে বেড়ানোর অনুমতি চাইলেন। যখন তাঁকে আমাদের বেড়ানোর ধরনটা বোঝানো হলো, অর্থাৎ আমরা পাহাড়ি পথে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার হাঁটবো, পাহাড়ীদের গ্রামে রাত কাটাবো, ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত হাঁটবো, দিনে মোটে দুবেলা খাবো, ঝোপেঝাড়ে টয়লেট সারবো, সর্বোপরি যে পথ দিয়ে এগোবো সেটা যথেষ্ঠ দুর্গম ও বিপজ্জনক, আমাদের দলে যোগ দেবার উৎসাহ তাঁর পুরোটাই উবে গেলো। পাছে আমরা তাঁকে জোরজার করে ধরে নিয়ে যাই, সেই ভয়ে তিনি তদ্দন্ডেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। গাড়ির ভেতরে আলাপ জমে উঠলো। চঞ্চলের সাথে আমার খুবই শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক, তাই একে অপরকে গলা কেটে খুন করার পরিবর্তে কথার ছুরি চালিয়ে মাথা কাটার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কলম এখন আমার হাতে বলে বলছি না, সত্যি কথা হচ্ছে --- চঞ্চল কাজে যেমন, কথায় তেমন চঞ্চল নয়। আর হাঁটার সময় সবার পেছনে পড়ে থাকলেও, হেঁ হেঁ হেঁ, মুখটা আমার ভালোই চলে। কিন্তু এক চঞ্চলকে পঁচিয়ে কাঁহাতক আর ভালো লাগে? কাজেই আস্তে আস্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোচনা ঘুরে গেলো। ক্লাবের দু'বছরের সব অভিযানের ওপর আর্টিকেল আর সাথে মনকাড়া সব ছবির সংগ্রহকে একটা বইয়ের রূপ দেয়ার ইচ্ছে অনেকেরই। সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ চললো, তবে এই আলাপ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে শেষ হবার আগেই ক্ষক্ষ্যংঝিরি ঘাটে পৌঁছলাম আমরা। ঘাটে উপস্থিত পুলিশ সদস্য এবং অন্যান্যরা জানালেন, নৌকো দিয়ে সাঙ্গু নদী ধরে রুমা পৌঁছোনো খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কারণ কে বা কাহারা যেন কিছুদিন আগে কয়েকজন পর্যটককে নৌকো থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। কাজেই ভালো হবে, যদি আমরা গাড়িতে চড়েই আরো খানিকটা এগিয়ে নদী পেরিয়ে ডাঙার ওপর দিয়ে রুমাবাজারে পৌঁছোনোর চেষ্টা করি। এতক্ষণ চাঁদের গাড়িতে বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরিয়ে, পেট্রলের মনমাতানো সৌরভে অস্থির হয়ে, সর্পিল পথের কিনারা ধরে এগোতে এগোতে নিচে ঢালু খাদের রূপ দেখে দেখে একেবারে হেদিয়ে পড়েছিলাম, নদীর বাতাসে একটু চাঙা হয়ে হেঁড়ে গলায় একটা গান ধরার উদ্যোগও আঁটছিলাম, কিন্তু আবার সেই চন্দ্রযানে চড়তে হবে শুনে আঁতকে উঠলাম। কিন্তু কীই বা আর করার আছে? চাঁদের গাড়ি আবার হেলেদুলে আরো ওপরে চড়তে শুরু করলো। এবারের পথের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। তবে দূরে পাহাড়ের ঢালে ক্ষুদে ক্ষুদে সব কুটির, আনারসের বাগান, আরো দূরে পাহাড়ের ওপর গাছপালার সারি দেখতে দেখতে সময়টা অতটা খারাপ কাটলো না। মোটামুটি চানাচুরভর্তা হয়ে সেই পথ পার হয়ে সাঙ্গু নদীর ঢালে একসময় হাজির হলাম সবাই। উঁকিঝুঁকি মেরে ঠিক বোঝা গেলো না, এরপর ঘটনাটা কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ড্রাইভার লোকটা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ দিলো না আমাকে, মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী ঢালু একটা চরম বিশ্রী পথে সে সাঁ করে গাড়িটা গড়িয়ে দিলো মার্বেলের মতো। মিনিটখানেক পর দেখলাম, গাড়িটাও উল্টায়নি, আমরাও অক্ষত আছি, কেবল নেমে এসেছি সাঙ্গুর পাশে, তিরতির করে কয়েক গজ দূরে বয়ে চলছে এই ছেমরি নদী। এরপর ড্রাইভার আর হেলপারের কথোপকথন শুনে বোঝা গেলো, নদী পেরিয়ে একটা ঢাল ধরে উঠে গিয়ে কাঁচা পথ ধরে রুমা বাজারে পৌঁছুনোর চেষ্টা চালানো হবে। সাঙ্গুর গভীরতা এখানে কম, কাজেই সমস্যা হবে না। এ পর্যায়ে শাহেদ ভাই গম্ভীর মুখে নেমে গিয়ে বললেন, এটা নাকি মিশন ইম্পসিবল থ্রি ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীর অন্য পারের ঢালটা আরো বেশি খাড়া। অবশ্য বাকি সবাই গাড়ির ভেতরে মহানন্দে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলাম --- গাড়ি এবার চলতে শুরু করলো নদীর বুকে, তির্যকভাবে নদী পার হয়ে যাবো আমরা। দু'ধারেই একটু দূরে উঁচু খাড়া পাহাড়, গাঢ় সবুজে ঢাকা, সামনে পেছনে দু'দিকেই বাঁক ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে গেছে সাঙ্গু। গাড়ি যখন অপর প্রান্তের ঢালটার মুখোমুখি পৌঁছলো, তখন বোঝা গেলো, শাহেদ ভাই খুব একটা অতিরঞ্জন করেননি। খুবই খাড়া একটা ঢাল, তাও আবার এখানে সেখানে গর্ত, এবং ঝুরঝুরে বালুভর্তি। এই ঢাল বেয়ে উঠতে গেলে গাড়িটা উল্টে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের ড্রাইভার অবশ্য প্রবল আত্মবিশ্বাসী, সে জানালো, এর চেয়েও খাড়া ঢাল বেয়ে সে গাড়ি চালিয়ে উঠেছে, এগুলো তার কাছে ডালভাত। কিন্তু তার ডালভাত আমাদের সবার রুচলো না, হ্যাভারস্যাক গাড়ির ভেতরে রেখে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম, কেবল বরুণদা অটল বসে রইলেন, মনে হচ্ছে ডালভাতের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ খুব একটা কম নয়। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করে এই দৃশ্য পাকড়ানোর জন্যে তৈরি হয়ে রইলাম আমি আর সালেহীন। প্রথমবার প্রবল গর্জন করে এগিয়ে গেলো চাঁদের গাড়ি, ঢালের কিছুদূর উঠেই আবার হড়হড় করে গড়িয়ে ফিরে এলো পানিতে। আমাদের কয়েকজন এই ফাঁকে ঢাল বেয়ে ওপাশে উঠে গেছে, দাঁড়িয়ে দেখছে, কী হয় শেষ পর্যন্ত। কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয় ড্রাইভার, আবারও গড়গড়িয়ে রওনা দিলো সে। কিন্তু ফলাফল আগের মতোই। তবে এবার বরুণদা নেমে এলেন গাড়ি থেকে। তৃতীয় দফায় ব্যর্থতার পর মনে হলো, আসলেই মিশন ইম্পসিবল, একে এখানেই মুলতবি রেখে পায়ে হেঁটে বাকিটুকু পথ, অর্থাৎ রুমাবাজার পর্যন্ত পাড়ি দিতে হবে। কাজেই যে যার মতো ব্যাগ গুছিয়ে বেঁধে, জুতোর ফিতে ঠিক করে নিয়ে, দুয়েকঢোঁক পানি খেয়ে --- শুরু হলো হাঁটা! নদীর ঐ ধার থেকে হেঁটে রুমাবাজার পর্যন্ত পৌঁছুতে আমাদের সময় লাগলো প্রায় ঘন্টাখানেক। মাঝে এক জায়গায় বসে জুতো খুলে ভেতরে ঢুকে পড়া বালির দানা পরিষ্কার করতে হয়েছে। এর মাঝে একের পর এক ছোট ছোট পাহাড় টপকানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে কৌতূহলী স্থানীয় বাসিন্দারা মাঝে মাঝে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছেন, আমরা কোত্থেকে এসেছি। ঢাকা থেকে এসেছি জেনে সবাই ধরে নিয়েছেন যে আমরা কেওকারাডং যাবো, এই এক বছরে নাকি একের পর এক দল কেওকারাডঙের দিকে গিয়েছে। বাজারে পৌঁছে সবাই সুড়সুড় করে ঢুকলাম একটা খাবার দোকানে। শাহেদ ভাইয়ের ব্যাগের ভেতরে কী একটা যেন ভেঙে গিয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি ভারি বিব্রত, বাজারের একটা পাটাতনের ওপর ব্যাগ খুলে আবার সব গোছাচ্ছেন। তিনি এসে পড়ার পর খাবারদাবারের সুরত নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করলাম আমরা। ডিম কিংবা মুরগি খেতে হবে, মাছের অবস্থা তেমন সুবিধের নয়, আর পানি খাওয়ায় একটা রীতিমতো ঝক্কির ব্যাপার। তবে পুতুল আপার হ্যালোজেন ট্যাবলেটের ওপর ভরসা করে পুরোদমে পেটপূজায় বসে পড়লাম আমরা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে জিরোচ্ছি, এমন সময় লারামের সাথে দেখা, আমাদের গতবারের কেওকারাডং যাত্রার গাইড, সে এসে জানালো, আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে যেতে হবে। কুছ পরোয়া নেহি, বরুণদা আর শাহেদ ভাই দলের সবার নামধাম আর ক্লাবের অফিসের ঠিকানা দিয়ে এসে সবাইকে উঠে পড়ার জন্যে ইঙ্গিত দিলেন। দারুণ একটা রসিকতাও সাথে আমদানি করে ফিরলেন তাঁরা, নাম-ঠিকানা লেখার সময় এক পর্যায়ে ক্যাম্পের সেনাসদস্য নাকি প্রশ্ন করেছেন, এই হিমু যার নাম, সে ছেলে না মেয়ে --- হা হা হো হো হি হি, আমি ছাড়া সবাই দাঁত বার করে কিছুক্ষণ হেসে নিলো, কী বিদঘুটে রসবোধ এঁদের! যাকগে, এককাপ চা শেষ করে সবাই এবার এগোলাম, বাজার থেকে চাল-ডাল ইত্যাদি কেনার জন্যে। কয়েকদিন হলো খিচুড়ি রান্না শেখার জন্যে ঘ্যানর ঘ্যানর করছিলাম আমার মায়ের কাছে, তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে একদিন তিনি আমাকে একটা একঘন্টার সঠিকনিয়মেখিচুড়িরন্ধন কোর্স করিয়েছেন, সেই এক ঘন্টার বিদ্যার অহঙ্কারে আগেভাগেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম, এবার সবাইকে এমন খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবো, যেমনটা কেউ আগে কখনো খায়নি। তাই চাল-ডাল কেনার ব্যাপারে আমার পরামর্শই নেয়া হলো। জুতোর দোকান থেকে একজোড়া করে অ্যাঙ্কলেট কিনে নিয়েছি কয়েকজন, এই দীর্ঘ পথ হাঁটায় কাজে দেবে। কেনাকাটা শেষ করে আবার শুরু হলো হাঁটা, এবার হাঁটার শেষ হবে একেবারে বগামুখপাড়া, সাইকত পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে। মোটামুটি সমতল পথ শেষ হবে ঐ গ্রামে পৌঁছে। ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে, মাটিতে আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে আমাদের ছায়া। রুমা থেকে দক্ষিণপূবে যেতে প্রথমেই পড়ে লাইরুনপিপাড়া, লাইরুনপি পাহাড়ের ঢালে শায়িত গ্রাম। লাইরুনপি পাহাড় বেয়ে তার ওপাশের সমতল মাটিতে সহজেই নেমে পড়া যায়, আর ফেরার পথে ঘটে তার উল্টোটা। ফেরার সময় সঙ্গত কারণেই ক্লান্ত থাকে সবাই, আর পাহাড়ের গোড়ায় এসে সেটাকে বিশাল খাড়া একটা দেয়ালের মতো মনে হয়, সেটা বেয়ে যত সহজে নামা গিয়েছিলো, তত সহজে ওঠা যায় না। লাইরুনপিপাড়া ডিঙিয়ে ওপাশের মাটিতে নেমে ধীরেসুস্থে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। এবার অভিযানে বেশির ভাগের পায়েই জাঙ্গলবুট, কারণ বরুণদা এর আগে একাকী যে অসমাপ্ত অভিযান চালিয়েছিলেন, তাতে নাকি এই বুট অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। ট্রেক স্যান্ডেলগুলো পরে হাঁটতে আরাম ঠিকই, কিন্তু সেটা স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে। আর এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথে হাঁটতে গেলে স্যান্ডেল পরা কিছুটা বিপদজনক, পা মচকে যেতে পারে। তাছাড়া বরুণদা এ পথে আগে একবার হেঁটে গেছেন, কাজেই তাঁর উপদেশ ফেলবার নয়। তবে জাঙ্গলবুট কেনার পর অবশ্যই সেটার রোড টেস্ট করা জরুরি, কমসে কম দুহপ্তা সেটা পায়ে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সেটার স্বাদ পা-কে ভালো করে চাখিয়ে না নিলে ভাগ্যে কঠিন ভোগান্তি আছে, এটা বলে দিচ্ছি। লাইরুনপিপাড়ার ঠিক নিচেই একটা ছোট ছড়া আছে, তাতে পা ভিজিয়ে ওপারে পৌঁছেই টের পেলাম, কপালে দুঃখ লেখা ছিলো। পানির সাথে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব পাথরের কণা আর বালি ঢুকে গেছে মোজার নিচে, হাঁটতে গেলেই একেবারে মর্মে গিয়ে বিঁধছে। যেকোন অভিযানেই পিছিয়ে পড়তে আমার জুড়ি নেই। আর এই পিছিয়ে পড়ার জন্যে নানারকম অজুহাতও আমার জিভের ডগায় সবসময় তৈরি থাকে। ব্যাকপ্যাকের ওজন অনেক বেশি, তাই পিছিয়ে পড়েছি --- কিংবা ছবি তোলার জন্যে থেমেছিলাম, তাই পিছিয়ে পড়েছি, ইত্যাদি হাবিজাবি। অন্যেরা অবশ্য এসব গাঁজাখুরি অজুহাত এক কানে নিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দেন, তারা জানেন আমি তিরিশ মিনিট পর পর থেমে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই। কিন্তু, একটু থেমে, চারপাশের এই অপূর্ব সব খাটো খাটো পাহাড়ের সারিতে একটু চোখ বুলিয়ে না নিলে তো এখানে আসার আসল উদ্দেশ্যই মাঠে মারা পড়ছে। কেবল গটগটিয়ে হেঁটেই চলবো, একটু চোখ মেলে চেয়ে দেখবো না, তা কি হয়? কিন্তু এই প্রবল প্রকৃতিপ্রেমের মাশুলও আমাকেই দিতে হয়, একেবারে ঘন্টাখানেকের পথ পিছিয়ে পড়তে হয় অন্যদের চেয়ে। কারণ, আমাদের দলের অন্যদের প্রকৃতিপ্রেম আমার চেয়ে খুব একটা কম নয়, বরং খানিকটা বেশিই। তাই চলার ফাঁকেই তারা নিসর্গের প্রতি দৃষ্টিনৈবেদ্য দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে যান। তাই কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো, এদিকে ওদিকে কয়েকটা ছবি তুলে যখন ক্যামেরাটা আবার ব্যাগে ভরেছি, তখন আমার আশেপাশে আর কেউ নেই। জোর পায়ে হেঁটে কিছুদূরে গিয়ে শাহেদ ভাই আর বরুণদাকে পাওয়া গেলো, তাঁদেরকে কিছুটা ধীরে হাঁটার অনুরোধ করে আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম। পেছনে কেউ না থাকলে কেমন যেন লাগে, ঠিক না? মংক্ষিয়া দাদা আবার এক ফাঁকে কিছু জঙলি বড়ই পেড়ে এনেছেন, হাঁটতে হাঁটতে সেগুলো কুটকুট করে চিবোনো গেলো। রুমাবাজার থেকে বগামুখপাড়ার পথে যারা একবার শীতের মৌসুমে হেঁটে গেছেন, তারা জানেন, বড় বড় বোল্ডারের ফাঁকে ক্ষীণ পানির ধারা ছাড়া এই পথে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। শুধু ঐ বড় বড় পাথরের ওপর দিয়েই একটু সাবধানে চলতে হয়, কোনভাবে পা মচকে বসলে কপালে দুঃখ আছে। বর্ষা মৌসুমে এই গোটা পথ তলিয়ে যায় তীব্র পানির ঢলের নিচে। এক বছর আগে কেওকারাডঙে যাওয়ার পথে যে ছড়ায় হাঁটু পানি পার হয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে ওপরের পাহাড়ি অঞ্চলে এক দিনের বৃষ্টির কারণে সে ছড়া পার হতে হয়েছে কোমর পানি ভেঙে। বেশ খানিকটা পথ নিরূপদ্রব পার হওয়ার পর একটা ছড়ার পাশে দলের অগ্রগামী অংশটার সাথে সাক্ষাৎ হলো, মুখে একটু পানি ছিটিয়ে নেবার জন্যে বসেছেন তারা। সেখানে কাঁধের ব্যাগ খুলে উপদ্রুত কাঁধটাকে একটু রেহাই দিলাম, আর গোটা তিনেক দলগত চিত্রগ্রহণও চললো সাথে সাথে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ বসে থাকার জো নেই, আবারও চটজলদি পা চালিয়ে যেতে হলো আমাদের। চলতে চলতে এবার শাহেদ ভাই আর পুতুল আপাকে সঙ্গে পাওয়া গেলো। খানিকটা পথ গিয়ে দেখা গেলো, দু'জন বাঙালি ফিরছেন এ পথ দিয়ে। তাদের পায়ে সাধারণ চপ্পল, সাধারণ শার্টলুঙ্গি। আলাপ করে জানা গেলো, রংপুর থেকে বগা লেকে এসেছিলেন তারা, উদ্দেশ্য নিখাদ ভ্রমণ। কোনরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই গুটগুট করে হেঁটে চলে গেছেন তারা বগালেকপাড়ায়। বাঙালির এই পর্যটনপিপাসু চেহারা আমাদের আশাবাদী করে তুললো, যাক, অতটা ঘরকুনো আমরা তবে নই! আমাদের আয়োজন, বিশেষ করে গাঁটরিবোঁচকা দেখে যে তারা অত্যন্ত চমৎকৃত হয়েছেন, বোঝা গেলো, সবিনয়ে আমাদের একটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলেন একজন। তাদের ক্যামেরায় নিজেদের চেহারা অক্ষয় করে রেখে আবারও আমরা জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম সামনের দিকে। বালিপাথরের একটা খাটো পাহাড় সারির সমান্তরালে এগিয়ে একটা মোটামুটি বড় ছড়া পেরিয়ে গেলেই বগামুখপাড়ার বিসতৃত পথটার দেখা মেলে। পথ নয়, আসলে ওটা ছড়ার পাথুরে খাত। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সেই ছড়া বরাবর এগিয়ে গেলেই বগামুখপাড়া চোখে পড়ে। ইতিমধ্যে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে, যার ফলে সমস্ত পথ ছায়াচ্ছন্ন। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু কয়েক জায়গায় জলের কলধ্বনি, আর আমাদের এগিয়ে চলার শব্দ। চলার গতির হেরফেরে এখন আমার সঙ্গে পুতুল আপা আর মংক্ষিয়া দাদা। সৈকত আমাদের সাথেই চলছিলো কিছুদূর পথ, কী ভেবে জোর পায়ে এগিয়ে গেছে সে। দুয়েক জায়গায় একটু থেমে চলতে চলতে একসময় বগামুখপাড়ার কাছে কয়েকটা ছড়ার মোহনায় এসে দলের বাকিদের পাওয়া গেলো, এক একটা বোল্ডারের ওপর বসে এক একজন, সবার চেহারায় একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব। আমরা একটা বোল্ডারের ওপর বসতে না বসতেই বাকিরা উঠে পড়ার তোড়জোড় শুরু করলো। ওদিকে বাঁশের মাচায় ব্যাটারি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন পাহাড়ি, তাদের সৌজন্যে জানা গেলো, আজ বগামুখপাড়ায় জোর হুল্লোড় আর উৎসব হবে রাতে। এই খবর জানিয়ে দিয়ে হুমহাম করতে করতে নক্ষত্রবেগে এগিয়ে গেলো তারা। কানের কাছে একটা বিদঘুটে গুনগুন শুনে চমকে উঠলাম, নাকের সামনে দুয়েকটা সংসর্গবৎসল মশাকে ঘুরঘুর করতে দেখা গেলো। অমনি হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম, মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া বাঁধানোর কোন খায়েশ নেই আমার। পুতুল আপা আরেকটু জিরোতে চাইছিলেন, তাঁকেও ঠেলেঠুলে তুলে দেয়া হলো। ডিসেম্বর মাসে এই একই পথে ট্রেক করতে এসে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে আরেক অভিযাত্রী দলের এক সদস্য, কাজেই সাবধানের মার নেই। মিনিট পনেরো হাঁটতেই এবার বগামুখপাড়ায় পৌঁছে গেলাম সকলে। বগামুখপাড়ার গোড়ায় একগাদা দোকান, সেখানে চায়ের বন্দোবস্ত রয়েছে। দোকানের সামনে কাঠের মাচায় বসে, ব্যাগের হাত থেকে কাঁধদুটোকে, আর জুতোর হাত থেকে পাদুটোকে একটু রেহাই দিয়ে ক্যামেরা খুলে বসলাম। ফটোগ্রাফিতে আমার বিকট উৎসাহ, যদিও এলেম কম --- তাই ক্যামেরা বার করে স্থানীয়দের সান্ধ্য কার্যকলাপের কিছু ছবি তুললাম। উনুনে আগুন জ্বলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি শিশু, বয়স্করা বসে গল্পগুজব করছে ---। আর আমরা এক একজন আলাপ করছি, পেটপূজায় নৈবেদ্য কী দেয়া যায়? বাস্তবিক, বেশ কষেই লেগেছে খিদেটা, বিচিত্র সব গুরগুর শব্দে পেট সে কথা জানান দিচ্ছে। ওদিকে মংক্ষিয়াদা আজ রাতের জন্যে আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই বার করে ফেলেছেন, একটা মারমা কুটির। গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে সেই কুটিরে গিয়ে চড়লাম সকলে। বরুণদা যদিও ভোরের দিকে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, একেবারে এনংপাড়ায় গিয়ে রাতের আড্ডা গাড়বেন, কিন্তু ইঞ্জিনে তেল কম থাকায় আর সেটা হয়ে উঠলো না আর কি। বান্দরবানের এদিকটায় পাহাড়িদের কুটির যদি দেখে না থাকেন, তাহলে এক দফা হালকা লেকচার দিই। কুটিরগুলো তৈরি করা হয় বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। এখানে সব কুটিরই দোতলা। একতলাটা পুরোটাই ফাঁকা, তাতে কোন বেড়া নেই। সেই ফাঁকায় চড়ে বেড়ায় মুরগি, কুকুর আর শূকর । মাটি থেকে ফুট তিন-চার ওপরে ঘরের মেঝে, বাঁশের ফালি দিয়ে বোনা মজবুত মাদুর খুঁটির সাথে শক্ত করে এঁটে তৈরি করা। একটা কাঠের বীমে কয়েক জায়গায় দায়ের কোপ মেরে তৈরি করা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এই মাদুরের পাটাতনে। শুধু ঘরের মেঝেই নয়, দেয়ালও এই বাঁশের মাদুর দিয়ে তৈরি। হালকা, কিন্তু খুব মজবুত। পাটাতনে উঠে জুতো খুলে রেখে ঘরে ঢুকলাম সকলে। পলকে ঘরের কোণায় বিশাল এক হ্যাভারস্যাকের পাহাড় তৈরি হয়ে গেলো। যে যার পানির বোতল বার করে কয়েক ঢোঁক খেয়ে, হাতমুখ ধুয়ে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসতেই পেট কাদম্বিনীর মতো মরিয়া প্রমাণ করিলো যে সে মরে নাই, এখনো আছে। কাজেই পেটের জ্বালাকে প্রতিরোধ করার জন্যে সামান্য ডালভাতের আয়োজন করতে উঠলেন মংক্ষিয়াদা। ওদিকে পুতুল আপা তাঁর সেই মহার্ঘ আচারের বোতল, আপেল, মেয়োনেজ, ইত্যাদি বার করে অল্প সময়ের মধ্যে এমন এক অসামান্য ফ্রুট সালাদ তৈরি করলেন, যার স্বাদ জিভে লেগে নেই বলে এখন প্রবল আফসোস হয়। আর শাহেদ ভাই ম্যাজিশিয়ানের মতো ব্যাগ থেকে বার করলেন ভুনা গরুর মাংসের ছোট্ট একটা বাটি, ভাবির কল্যাণে, কোরবানির সৌজন্যে। ডাল, ভাত, মাংস আর সেই সালাদামৃত (যিনি সালাদ তিনিই অমৃত, তৎপুরুষ সমাস) দিয়ে চেটেপুটে খাওয়া শেষ করে মনে হলো, এমন ভোজ অনেকদিন হয়নি। খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমপরীরা যদি উড়ে এসে জুড়ে বসে, নিশ্চিন্তমনে চিৎ হয়ে দুদন্ড ঘুমোনোর পরামর্শ দেয়, উচিত হয় কি ফেরানো তাহারে? তাই পায়ে খানিকটা মলম মালিশ করে যখন ঘুমকম্বল নিয়ে টানাটানি করছি, তখন বাকিরা এমন জুলজুল করে আমাকে তাকিয়ে দেখতে শুরু করলো, যেন আমি খুনের মামলার আসামি। আজ রাতে জোর উৎসব হবে, দূরদূরান্ত থেকে ব্যাটারি কাঁধে নিয়ে যখন জড়ো হয়েছে শতাধিক লোকজন, আর আমি পাষন্ড কি না পড়ে পড়ে ঘুমোবো? ধিক, শতধিক! --- কিন্তু ভাই, ঘুমপরীদের সাথে তাংফাং করা অনুচিত, এ আমি কিভাবে বোঝাই? অবশ্য আমার সুযুক্তি কেউ কানে নিতে চাইলো না, বিশেষ করে চঞ্চল তো খুবই নিন্দামুখর হয়ে উঠলো --- ভালো কথা ইদানীং কি আর কেউ কানে নিতে চায়, বলুন --- দূর থেকে যখন ব্যাটারিচালিত মাইকে ভেসে এলো হারমোনিয়ামে সেই চিরাচরিত মুরং সুর আর গান, সক্কলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে বার হলো, যেন হাশরের ময়দানে রোলকল হচ্ছে। কীই বা করার রইলো আমার, স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া? দুই: ভোর হোলো দোর খোলো সেই সন্ধ্যে থেকে ঘুমুচ্ছি। যদিও হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, কানে ভেসে এসেছে উৎসবের সঙ্গীত, আবার অন্যেরা যখন পর্যটনে খ্যামা দিয়ে ঘুমোবার জন্যে ফিরে এসেছে, তখন তাদের লাথিঝাঁটাও কিঞ্চিৎ সহ্য করতে হয়েছে। বিশেষ করে এই চঞ্চলটা আমার ওপর চটা, কেন কে জানে, বিনা কারণেই আমাকে গজভুক্ত কপিত্থবৎ এক কোণ থেকে আরেক কোণে গড়িয়ে যাওয়ার মূহুর্মূহু হুকুমে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলো, একবার বলে ডানে চাপো, তো আরেকবার বলে নিচে নামো। তার অভিযোগ, আমি নাকি গোটা ঘর দখল করে শুয়ে ছিলাম। বোঝো কান্ড, দশজনের ঘর একজন কিভাবে দখল করে শোয়, তা বোঝা অন্তত আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না। এ নিয়ে চঞ্চলের সাথে তর্ক করাও বৃথা, ভারি সহিংস আচরণ করছিলো সে, বোধহয় পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ব্যাটার পোষায়নি, অথবা গুরুতর ধাতানি খেয়ে ফিরে এসেছে, কিন্তু ওর হাবভাব দেখে প্রাণের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাইনি --- যাই হোক, কিন্তু সূর্যের দেখা পাবার পর ঘুমোনোর কোন অধিকার এঙ্প্লোরারস' ক্লাবের সদস্যদের নেই, কাজেই উঠে পড়তে হলো। তখনও মাইকে ভেসে আসছে মুরংদের সেই গান। গানের কথা সময়ের সাথে পাল্টায়, কিন্তু সুরের ব্যাপারে এঁরা ভদ্রলোক, এই একই সুরে নানা গান বেজে চলছে। গ্যালো বছর যখন সূর্যোৎসবে এসেছিলাম, তখন বগালেকপাড়ায় মুরংদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও এই একই সুর শুনেছি, একেবারে মাথায় গেঁথে আছে সেটা। আমার পরিচিত এক কিশোরী বহু পরিশ্রম স্বীকার করে রবি ঠাকুরের আহা আজি এ বসন্তে গানখানা সুরে ও তালে গলায় তুলতে পেরেছিলো, আর সেই একখানা গান শিখেই সাধনায় খ্যামা দিয়েছিলো সে, পরবর্তীতে যে কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত, হোক সেটা বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কিংবা এসো হে বৈশাখ এসো এসো, সেই আজি এ বসন্তের সুর-তালের ছাঁচে ফেলে বেশ টেনে গাইতো বেচারি। মনে হচ্ছে এটাও একই কেস। এঁদের যে একজন প্রতিভাবান সুরকারের বিশেষ অভাব, বোঝা গেলো। আর এঁদের দোষ দেবো কেন, গোটা বাংলাদেশেই তো সুরের আকাল চলছে, অসুরই এখন এ দেশে নন্দিত! সাধারণত বরুণদা-ই আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কিন্তু আজ দিনটাই অন্যরকম। আমি প্রকৃতি ভালোবাসি, প্রকৃতিও আমাকে ভালোবাসে, হাতছানি দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ডাকে, তাই ভোরবেলার সেই মধুঘুম ভাঙলো প্রকৃতির প্রবল ডাকে। বড় স্কেলের কেলেঙ্কারি হয়ে যাবার আগেই ব্যাগ থেকে দরকারি কাগজপত্র, মানে টয়লেট পেপার নিয়ে অন্যের চপ্পল পায়ে গলিয়ে কার্ল লুইসের মতো ছুটলাম এক নিভৃত কোণে। আর কি মুশকিল, তেমন ঘন ঝোপঝাড় এখানে নেই, কাজেই কোন পাহাড়ি যদি প্রাতভ্রমণে বের হন, আমাকে ভারি নাজুক পরিস্থিতিতে দেখে ফেলতে পারেন। ওদিকে ভোরবেলা কনকনে ঠান্ডার কামড়, তার ওপর আছে মশার দংশনে ম্যালেরিয়ার ভয়, চারদিকে সতর্ক চোখ রাখতে হচ্ছে যাতে করে কোন শূকরবাহিনী এসে আমাকে গুঁতিয়ে দিতে না পারে (বান্দরবানের এদিকে প্রতিটি গ্রামেই শূকর পালন করা হয়। শূকরগুলো নিজের খেয়ালে চরে বেড়ায়। মানুষের বর্জ্য এদের বিশেষ পছন্দনীয়, তাই কাউকে "বড় বাইরে"-এর কাজে ব্যস্ত দেখলে এরা দল বেঁধে এসে ভোজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের কবলে পড়লে কপালে অশেষ ভোগান্তি আছে। টয়লেটে গেলে সবসময় হাতে লাঠি জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র রাখতে হবে। বিশ্বাস না হয় তো একবার খালিহাতে সরজমিন গিয়ে পরখ করে আসতে পারেন), আর এদিকে খোলা আকাশের নিচে কেবল কয়েকটি ক্ষীণকায় কলাগাছকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে সমাজের হাতে ধরা পড়ে কলঙ্কিত হবার কূলনাশা শঙ্কা, আর পেটের সেই চিনচিনে ব্যথাটা তো আছেই রে বাপ --- সব মিলিয়ে প্রকৃতির সেই ব্যাকুল ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আমার নাভিশ্বাস উঠে যাবার অবস্থা। যাই হোক, কোনমতে কাজ সেরে ভারি পুলকিতচিত্তে বেরিয়ে এসে দেখলাম, দলের অন্যদের মধ্যেও সাজো সাজো রব, বুঝলাম, প্রকৃতি কেবল একা আমাকেই ডাকছে না। চপ্পলের মালিক দলনেতা উচ্ছল ভাই অত্যন্ত গোমড়ামুখে পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে --- দেখে তেমন একটা উচ্ছল মনে হচ্ছিলো না তাঁকে --- তাঁর শারীরিক হাবভাব দেখে বুঝলাম, প্রকৃতিতোষণের সাধ থাকা সত্ত্বেও এক জোড়া জুৎসই স্যান্ডেলের অভাবে এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাধ্য তাঁর নেই, কারণ খালিপায়ে এখানে হাঁটাহাঁটি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় । তার ওপর তাঁর সাধের চপ্পল আমার পায়ে দেখে উচ্ছল অগি্নগর্ভ শমীবৃক্ষের মতো নিশ্চল হয়ে পড়লেন, নির্বাক হয়ে রক্তচক্ষু মেলে আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন একবার, আমার সুখী মুখ দেখে মনে মনে হয়তো পঞ্চাশ-ষাটটা গাল দিলেন, কিন্তু মুখে কিছু না বলে দলনেতাসুলভ ক্ষমাশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চুপচাপ আমার সারেন্ডার করা সেই চপ্পল পায়ে গলিয়ে গটগটিয়ে কোন এক নিভৃত ঝোপের সন্ধানে এগিয়ে গেলেন। আমি ভেবে দেখলাম, পরবর্তীতে এই পাড়ার অধিবাসীরা যে মর্মান্তিক চটবেন আমাদের ওপর, তাতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ একটা গোটা পাহাড়কে বৃত্তাকারে কলুষিত করে রেখে যাচ্ছি আমরা, যার কেন্দ্র আমাদের এই রাত্রিকালীন আশ্রয়কুটির। শহুরে বাবুদের পরিচ্ছন্নতাবোধকে যে এরা পরবর্তীতে কী পরিমাণ অবজ্ঞার চোখে দেখবে, তা-ই ভাবতে ভাবতে হেলেদুলে এগিয়ে গিয়ে পাটাতনে চড়ে হেঁড়ে গলায় একটা মানানসই গান ধরলাম, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, এ এ এ, রইবো না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে ---। কিন্তু বেরসিক চঞ্চলটা মাঝপথেই কোত্থেকে উদয় হয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, আমাকে নাকি জলদি করতে হবে, আমার জন্যে নাকি দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমিই নাকি সব নষ্টের গোড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্ষুণ্ন মনে ব্যাগ গুছিয়ে জুতো পরে অন্যদের পেছন পেছন এগিয়ে নেমে এলাম দোকানগুলোর সামনে, মনে মনে চঞ্চলকে বকলাম কিছুক্ষণ, ব্যাটা ফিলিস্টাইন, বর্বর অসভ্য, সঙ্গীতের মর্ম তুমি কী বোঝো? সেই দোকানের মাচায় ব্যাগ রেখে নিচের ছড়ায় গিয়ে কুল কুল করে বয়ে যাওয়া হিম জলে হাতমুখচশমা ধুয়ে দাঁত মেজে খেতে বসলাম সকলে। খাবার রাতের উদ্বৃত্ত সেই ডাল আর ভাত, সেটা দিয়েই যতটা সম্ভব না লাগা খিদের আগাম নিবৃত্তি করলাম। আজ যেতে হবে বহুদূর, পথে কোথাও খাবারদাবার পাওয়া যাবে কি না, কে জানে? পুকুরপাড়া আর বগামুখপাড়ার মাঝে তিনটে পাড়া পড়ে --- লেনতংসে পাড়া, মেনথুই পাড়া, আর এনংপাড়া। কিন্তু শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যে সেসব পাড়ায় থামার অবকাশ নেই আমাদের। এক যদি পথে কলাটলা পাওয়া যায়, নয়তো পেটে কিল মেরে এগিয়ে যেতে হবে। সবাই যখন চা খাওয়ার তোড়জোড় করছে, তখন ট্রাইপড বার করে একটা দলগত ছবি নেয়ার ধান্ধা করলাম। ক্যামেরাটা বসিয়ে যুৎসই ফ্রেম খুঁজছি, এমন সময় আবারো কোত্থেকে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো ঐ ব্যাটা চঞ্চল। আমাকে একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই ক্যামেরার স্পিড আর ফিল্ড সেট করলো সে। আমি একটা কিছু বলতে চাইছিলাম, ধমক খেয়ে আমাকে থেমে পড়তে হলো, আমি আবার ক্যামেরার কী বুঝি? তারপর ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেলো, ক্যামেরা আপত্তি জানাচ্ছে। এর কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা চঞ্চল সাহেব দিতে পারলেন না, বরং আমার ক্যামেরাটাকেই দুষবার একটা পাঁয়তাড়া কষতে লাগলেন। চটেমটে ব্যাটাকে হাঁকিয়ে দিয়ে সবাইকে জড়ো করে ক্যামেরাকে নিজ মর্জিতে চলতে দিয়ে একটা ছবি তোলা হলো, অবশ্যই আমি নতুন করে সব সেট করবার পর। আমাদের দশজনের একটা ঝকঝকে ছবি অক্ষয় হয়ে রইলো সেলুলয়েডে। তারপর ট্রাইপডটাকে আবারো গুটিয়ে ব্যাগে পুরে হাঁটা শুরু করলাম বাকিদের পেছন পেছন। বরুণদা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, একটানা প্রায় ঘন্টা তিনেক খাড়াই বেয়ে উঠতে হবে আজ। সবাই একটা করে লাঠি সবাই জুটিয়ে নিয়েছি, কারণ ষষ্ঠি বিনে এই পথে চলতে গেলে খবরই আছে, কেবল শাহেদ ভাই লাঠি বইতে রাজি নন। তবে লাঠির মাহাত্ম্য বাকি সবাই কমবেশি জানি। সালেহীন তো প্রত্যেক অভিযান শেষে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একখানা লাঠি ঘরে বয়ে নিয়ে যায়, গাদা খানেক লাঠি সে ইতিমধ্যে জমিয়ে ফেলেছে, এক পল্টন দাঙ্গা পুলিশকে সন্তুষ্ট করা যাবে তা দিয়ে। বগামুখপাড়ার পর ডানদিকে বেঁকলে বগালেকপাড়ার সেই বিদঘুটে পথ পাওয়া যায়, যে পথে পড়ে সেই ভয়ালদর্শন পতনছড়ি। কিন্তু আমাদের পথ বাম দিকে, একটা পাহাড়ের ঝুরঝুরে সরু পথ বেয়ে উঠে। সেই পথে পা ফেলেই টের পেলাম, আজ ভাগ্যে লাল কালিতে অনেক কিছু লেখা আছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে খানিকটা উঠে খানিকটা শক্ত মাটি পাওয়া গেলো। এই পথে একবার পা পিছলে পড়লে হয়তো কেউ প্রাণে মারা পড়বে না, কিন্তু পা মচকে যাবার একটা বিরাট সম্ভাবনা আছে। আর এখানে একবার পা মচকালে খবরই আছে! তখন লাঠিতে ভর দিয়ে বড়জোর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে, চলা যাবে না। আর চলতে না পারলে এই নির্জন ঘন অরণ্যশাসিত পাহাড়ে রাত কাটাতে হবে, একেবারে খোলা আকাশের নিচে। পথের দু'ধারে ঘন ঝোপ এখন, বিশাল সব গাছের জন্যে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছুতে পারছে না। সঙ্গত কারণেই মাটি কিছুটা ভিজে, পথের পাশে পড়ে থাকা মড়া গুঁড়ির ওপর ছত্রাকের আস্তরণ পুরু হয়ে জমেছে। লাঠি ঠুকে ঠুকে খানিকটা এগিয়ে গেলাম সবাই। আধঘন্টার মতো হাঁটার পরই কাহিল লাগছে। মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করলাম, হাঁটার চর্চা থামিয়ে দেবার জন্যে। পাহাড়ি পথে হেঁটেছি সেই এক বছর আগে, চর্চার অভাবে পায়ের পেশী খানিক পর পরই আপত্তি জানাচ্ছে। কিন্তু সকালের এই মিষ্টি নরম রোদ, নির্মল বাতাস আর চারপাশের সবুজই চাঙা করে রেখেছে আমাকে, আমাদের সবাইকে। ঢাকার বাতাসে যারা শ্বাস নিয়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই টাটকা হাওয়া যে কী মিষ্টি লাগে, তা বলার মতো নয়। ওদিকে চঞ্চল ভোরবেলা হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে আসল কাজে ঢিলেমি করেছে, এখন হাতের কাছে যুৎসই ঝোপ পেয়ে আর সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় সে, তাই এক দিস্তা দলিলদস্তাবেজ বার করে এক গহীন ঝাড়ে হানা দিয়েছে ব্যাটা। আমি, সালেহীন, মিলন ভাই আর উচ্ছল ভাই একটা গুঁড়ির ওপরে বসে কিছুক্ষণ সুখ দুঃখের আলাপ --- অ্যাতোক্ষণ হাঁটার পর খানিকটা বসলাম, এতেই সুখ, কিন্তু মিনিটখানেক বাদেই আবার উঠে পড়তে হবে, এটাই যা দুঃখ --- সেরে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। যথারীতি অন্যেরা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো, আর আমি রূপকথার ছোট্ট গোল রুটির মতো গুটিগুটি চলতে লাগলাম। পুকুরপাড়াটা অ্যাতো দূরে কেন রে বাবা? বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা সম্মানজনক উচ্চতায় উঠে আমরা কয়েকজন থামলাম। এরই মাঝে ক্যামেরা বার করে অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎবর্তী কয়েকজনের ছবি তুলেছি, ছবি তুলেছি দূরের পাহাড়সারির, মংক্ষিয়াদার। ইতিমধ্যে বরুণদা, পুতুল আপা আর শাহেদ ভাইও এগিয়ে এসেছেন। একটু থেমে পড়তেই আলাপ জমে উঠলো আমাদের। বিষয়: বাংলাদেশে পর্যটনের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা। বাংলাদেশের বাইরে অনেক দেশেই এমন সব পাহাড় চলে এসেছে দক্ষ পর্যটন ব্যবস্থাপনার তত্ত্বাবধানে। সেখানে নিয়ন্ত্রিত ট্রেক প্রোগ্রামের সুবন্দোবস্ত রয়েছে, আয়েশী পর্যটকের জন্যে রয়েছে ঝুলযানের ব্যবস্থা --- আরো অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের এমনি পোড়া কপাল, যে কোন দূরদর্শী মানুষ কখনো এদেশে পর্যটনের দায়িত্ব পায়নি। আর পর্যটনানুকূল মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি আমাদের মানুষদের মাঝে। সবেধন নীলমণি কঙ্বাজারে হুড়োহুড়ি করে বেড়াতে যান সকলে, সেখানকার সৈকতটাকে আবর্জনার গাদায় পরিণত করেন, আর কর্তৃপক্ষ তাদের জন্যে গলাকাটা দামের হোটেল মঞ্জুর করে দিয়ে ভাবেন, বাহ, বেশ একখান কাজ করলাম। সোনার হাঁস কবে ডিম পাড়বে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি নয় বাংলাদেশের লোকজন, যে যত জলদি পারে হাঁসটাকে কেটেকুটে সাফ করতে চায়। কিন্তু একটানা বদনাম আর আপসোসই বা কতক্ষণ করা যায়? আবার পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, আরো ওপরে। এবার আমি আর পুতুল আপাই একটু পিছিয়ে পড়লাম। তিন আদিবাসী নেমে আসছিলেন, পুতুল আপা তাদের দেখে যেন হাতে চাঁদ পেলেন, আদিবাসীদের সাথে আলাপ করার খুব ঝোঁক তাঁর। বাংলা খুব একটা বোঝেন না তারা, তবুও মিনিট পাঁচেক তাঁদের সাথে গল্প চললো। সবশেষে তাদের সাথে পুতুল আপার একটা ছবি তুলে নিয়ে চকলেট বিতরণ করে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। ততক্ষণে অন্যেরা নিঃসন্দেহে খানিকটা এগিয়ে গেছে। খানিকটা সমতল পেয়ে জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। হুড়হুড়িয়ে বেশ খানিকটা গিয়ে আবার বাকিদের দেখা পাওয়া গেলো। একটা গোড়াপোড়া গাছের পাশে বাঁধানো টংঘরে বসে আছে সবাই। বরুণদা জানালেন, এই টংঘর হচ্ছে লেনতংসে পাড়ায় প্রবেশের পথের মুখে, ডানের পথটা ধরে এগিয়ে গেলেই পড়বে পাড়াটা --- লেনতংসে পাড়ার কারবারির ছেলের সাথে গত রাতের উৎসবে নাকি তাঁর দেখাও হয়েছে, পাড়ায় নেমন্তন্ন করে গেছে সে। পাটাতনে ব্যাগটা খুলে রেখে ক্যামেরা বার করে কিছুক্ষণ টহল দিলাম। প্রকৃতির ছবি তো অনেকই তোলা হলো, এবার নিজের কৃষ্ণপক্ষের চাঁদবদনটাকেও সেলুলয়েডে পোক্ত করার বাসনায় সৈকতকে দায়িত্ব দিলাম। ইতিমধ্যে টংঘরে আরেক পথিক পাহাড়ি এসে বসেছেন, তাঁর নাম ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, তিনি চলেছেন তিনমাথায়। তিনমাথা জায়গাটা হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারের স্থলসঙ্গম, বর্ধিষ্ণু একটা গ্রাম আছে সেখানে, সেই গ্রামে ধনঞ্জয়ের কন্যার শ্বশুরবাড়ি। মেয়েকে দেখতে চলেছেন তিনি। এদিকে আমাদের পুতুল আপা দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে হাঁটতে গিয়ে একটু কাবু হয়ে পড়েছেন, তাই মংক্ষিয়াদার মধ্যস্থতায় ঠিক হলো, ধনঞ্জয়দা আমাদের সাথে পথ চলবেন, আর পুতুল আপার হ্যাভারস্যাকটা থাকবে তাঁর কাঁধে। তিনি সম্মত হতে আমাদের দলের আকার দশ জন থেকে বেড়ে দাঁড়ালো এগারোজনে। ঘন ঘন বিশ্রাম নেয়ায় খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি আমরা, এবার তাই সবাই জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। অনেকক্ষণ পর বেশ খানিকটা সমতল পথ পাওয়া গেছে, তেমন একটা চড়াই উৎরাই নেই, কাজেই বেশ কিছুটা পথ পেরোনো গেলো। তবে পথ সমতল হলেও তার ল্যাঠা কম নয়, বড় বড় গাছের কারণে দিনের বেশির ভাগ সময়েই এদিকটায় মাটিতে রোদ পড়ে না, তাই পথের মাটি নরম, কাদাটে আর খানিকটা পিচ্ছিল। পথ চলতে চলতে হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ শুনে দেখি, একটা হেলিকপ্টার বেশ নিচু দিয়েই হেলেদুলে উড়ে যাচ্ছে, আয়েশী বাদুড়ের মতো, নিশ্চয়ই কাছে কোন আর্মি ক্যাম্পে সাপ্লাই পৌঁছে দেবে। চলতে চলতে আশেপাশের পাহাড়, বাতাসে দোদুল্যমান এক মানুষ লম্বা ঘাসের শীষ, ইত্যাদির ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ খেয়াল হলো, বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। তেড়েফুঁড়ে খানিকটা হেঁটে একটা পাহাড় টপকাতেই দেখি মংক্ষিয়াদা দাঁড়িয়ে, আমার অপেক্ষায়, চোখে ভারি অননুমোদী দৃষ্টি, এভাবে হাঁটতে হাঁটতে হেদিয়ে পড়াটাকে ভালো চোখে দেখছেন না তিনি। তাই তাঁর মন আর নিজের মান রক্ষার্থে এবার ক্যামেরাটাকে ব্যাগবন্দী করে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা দিলাম। ডানে চলে গেছে একটা পথ, ওদিক দিয়ে গেলে সায়কতপাড়া পড়বে। সায়কতপাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গ্রাম। কেওকারাডঙের একেবারে গোড়ায় যে দার্জিলিংপাড়া, সেটাও এই সায়কতপাড়ার চেয়ে খানিকটা নিচুতে। পাহাড়িরা পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গায় মজবুত বেড়া দিয়ে রাখেন, যাতে তাঁদের পোষা গয়ালগুলো চরতে চরতে অন্যের সীমানায় চলে না যায়। আর এই বেড়া টপকানোর জন্যে রয়েছে তাঁদের সেই অভিনব সিঁড়ি, যেগুলো বেয়ে তাঁরা নিজেদের ঘরের পাটাতনে ওঠেন, একটা সরু গুঁড়ির কয়েক জায়গায় দায়ের কোপ মেরে তৈরি করা। এমনই একটা এবার পড়লো পথে। সেটা ডিঙিয়ে খানিকটা যেতেই অপূর্ব এক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সকালের রোদ এসে পড়েছে সেই অপূর্ব সবুজ পাহাড়ের ঢালে, যেন সবুজ আগুন জ্বলছে গোটা পাহাড় জুড়ে, মাথার ওপরে নির্মেঘ নীল আকাশ, দূরে একটার পর আরেকটা পাহাড়ের ঢাল, আস্তে আস্তে পাতলা একটা কুয়াশার চাদরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে তারা, আর সামনে এই আঁকাবাঁকা চলার পথ। চারিদিকে সব নিঝুম, কোন পাখি ডাকছে না, কোন ঝর্ণার ফিসফাস নেই, শুধু নিজের চলার খসখস শব্দ। এই নির্জন নিস্তব্ধ সকালগুলো আমাদের জীবন থেকে এত দূরে কেন থাকে, আমরা কেন এভাবে সরে সরে থাকি এই পাহাড়ি রোদের সাম্রাজ্য থেকে? আমি পথ চলতে চলতে নিজের কানে কানেই ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকি, ঠোঁটে কয়েকটি পঙক্তি ছুটে আসে নিজ থেকেই, --- এজন্যেই কি আমি অনেক শতাব্দী ধ'রে স্বপ্নবস্তুর ভেতর দিয়ে ছুটে-ছুটে পাঁচশো দেয়াল-জ্যোৎস্না-রাত্রি- ঝরাপাতা নিমেষে পেরিয়ে বলেছি, 'রূপসী, তুমি, আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ।' বেশ একটা ইয়ে এসে গিয়েছিলো নিজের মধ্যে, বুঝলেন, হঠাৎ চোখ পড়লো সামনে, দূরে তড়বড়িয়ে হেঁটে চলছে দলের বাকি লোকজন, আর তাদের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে বারে বারে ভারি তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে দেখে নিচ্ছে --- কয় কিলোমিটার পেছনে পড়ে আছি, কিংবা আদৌ এগোচ্ছি কি না --- আর কেউ নয়, সেই জংলি চঞ্চল ব্যাটা! রাগে আমার মাথার রন্ধ্রগুলো জ্বলে উঠলো, ব্যাটা বেরসিক, জানো তো শুধু গয়ালের মতো চরে বেড়াতে, সৌন্দর্য উপলব্ধি যদি তোমার কাজই হতো --- বহুকষ্টে যোগবলে রাগ কমিয়ে আনি, নাহ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ আর গোয়েটে ইনস্টিটুটে অ্যাতোদিন যাতায়াত করেও বর্বর আর অসংস্কৃতই রয়ে গেছে ছোকরা! রাগের চোটে হাঁটার গতি একটু কমে গিয়েছিলো, মংক্ষিয়াদার তাড়া খেয়ে আবার হনহনিয়ে হাঁটতে থাকি। একটা মোড় ঘুরে খানিকটা এগিয়ে দেখি, পথের ওপর যে যেভাবে পারে একটু বসে পড়েছে সকলে, হিরো থেকে জিরো হয়ে জিরোচ্ছে। আমিও ধুপ করে বসে পড়লাম, হাতের লাঠিটাকে মাটিতে গেঁথে। ধনঞ্জয় ত্রিপুরা তাঁর পাথেয় যে ক'টি কলা এনেছিলেন, সেগুলো একে একে খোসা হারিয়ে আমাদের ভোগে নিয়োজিত হলো। এক প্যাকেট বিস্কুটও কার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাড়িতে বসে কলা বা বিস্কুট আমি ছুঁয়েও দেখি না, কিন্তু এখন, বাপ রে, পেটে টহল মারছে এক দুর্দমনীয় ক্ষুধা, এখন করলা ভাজি দিয়ে পান্তাভাত সাধলেও গপগপিয়ে খেয়ে ফেলতে রাজি আছি। এমনকি বিস্কুটের ভাগাভাগি নিয়ে চঞ্চলের সাথে একদফা ঠান্ডা কুস্তিও হয়ে গেলো। দু'জন দু'জনের দিকে বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে টোস্ট বিস্কুট খেতে লাগলাম কড়মড়িয়ে, যেন একে অন্যের খুলিটাই চিবিয়ে খাচ্ছি। পেটকে কিছুটা বুঝ দিয়ে পানির বোতল মাত্র খুলেছি, ও মা, তাকিয়ে দেখি পটাপট উঠে পড়ছে সবাই। আমি পানি খেয়ে বোতলের ছিপি আটকে গোঁফের পানি মুছতে মুছতেই তারা শ'খানেক গজ এগিয়ে গেলো। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে লাঠিটাকে প্রেয়সীর মতো জাপটে ধরে আবার এগোতে লাগলাম। এবার সবাই আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে, তাই পেছন থেকে হুড়ো দেবার লোক নেই। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ক্যামেরাটা বার করলাম। ঐ তো দূরে কী চমৎকার একটা পাতায় সাজানো নাম না জানা গাছ, আর ঠিক তার পাশেই একটা ন্যাড়া শুকনো গাছ। বিত্ত ও দারিদ্র্যের নিশ্চুপ সহাবস্থান --- ছবির শিরোনাম ভাবতে ভাবতে আমার শিরোভাগ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, নানা কায়দায় কয়েকটা ছবি তুলি, বেশ সময় নিয়ে। তারপর খানিকক্ষণ নেমে এসে দেখি, কাছেই পাহাড়ের ওপর একটা পাড়া --- মেনথুই পাড়া --- দেখা যাচ্ছে। এবার সুবিধাজনক কিছু জায়গা থেকে সেই গ্রামেরও কয়েকটা ছবি তুললাম। তবে ছবি তুলতে গিয়ে মিনিট পাঁচেক সময় অপচিত হয়েছে, ইতিমধ্যে আমার সহযাত্রী বন্ধুরা যে অস্তমিত হয়েছেন, তাতে আর সন্দেহ কী? তাই ক্যামেরাটা আবারও ব্যাগে বুঁজিয়ে রেখে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিচে নেমে এলাম। প্রায় চলি্লশ মিনিট ধরে নামতে হয়েছে, যে পাহাড়টায় এতক্ষণ ধরে চড়েছি আমরা, তারই অন্য পাশে খানিকটা পথ নেমেছি এবার। গ্রামটাকে পাশ কাটিয়ে আরো নিচে নেমে দেখি একটা গম্ভীর সরসর শব্দ হচ্ছে। একটা ছড়ায় পানি বয়ে যাচ্ছে পাথরের ওপর, সারাটা পাহাড় জুড়ে তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সেই ছড়ার পাশে হাত পা এলিয়ে বসে আমাদের লোকজন, আর কিছু দূরে কয়েকটি পাহাড়ি তরুণী, ঝিম মেরে এক জায়গায় বসে আছে তারা। পরিশ্রমের কারণেই বোধহয় আমাদের সম্পর্কে তাদের কোন কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছে না। বহু দূর থেকে আসছে বেচারীরা, সম্ভবত রুমাবাজার থেকে, কারণ তাদের সাথে নানারকম মনোহারি পণ্যের বোঝা, আর যাবেও খুব সম্ভবত বহুদূর। পাহাড়িরা আমার চেয়ে চারগুণ ওজন বহন করে প্রায় তিনগুণ বেগে চলতে পারে এ অঞ্চলের পথঘাট দিয়ে, আর চলতেও পারে একটানা অনেকক্ষণ। কিন্তু মাঝে মাঝে কয়েকটা জায়গায় একটু বসে লম্বা বিশ্রাম নেয় তারা, আধঘন্টা বা পৌনে এক ঘন্টার মতো। পাহাড়িদের পায়ের গড়নই সম্পূর্ণ অন্যরকম। একমণ আদা পিঠের ঝুড়িতে --- ঝুড়িগুলোর ফিতে ওদের কপালের সাথে বাঁধা থাকে --- বয়ে দূরদূরান্ত থেকে রুমাবাজারে নিয়ে যায় তারা বিক্রি করতে, কিন্তু এবড়োখেবড়ো পিচ্ছিল পথের ওপর এমন অনায়াসে খালি পা ফেলে চলে, যেন কোন পার্কের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে। একইভাবে গাদা গাদা লাকড়ি ঝুড়িতে করে কুড়িয়ে নিয়ে যায় তারা। আর মাত্র বারো কেজি ওজন নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছি আমি, ভাবতেই লজ্জা লাগে। ছড়াটার পাশে এসে ব্যাগ খুলে সবেমাত্র বসেছি, হাত পা একটু মেলে বসারও ফুরসত মিললো না, চঞ্চল এসে হুকুম ঝাড়লো, 'রুটি বের করো!' যেন আমি ভিক্তর উগোর সেই জ্যাঁ ভালজ্যাঁ, রুটি চুরি করে গা ঢাকা দিয়েছি। আমিও কম যাই না, নরম ঘাসের ওপর শরীর মেলে দিয়ে মধুর গলায় বললাম, 'ব্যাগে আছে, বের করে নাও!' চঞ্চল দাঁতে দাঁত ঘষলো, তারপর আমার রুকস্যাকটাকে রীতিমতো র্যানস্যাক করে সেই এক পাউন্ডার পাঁউরুটির প্যাকেটখানা এমনভাবে বার করে আনলো, যেন এয়ারপোর্টে সোনার বারের চালান আটক করেছে। আমিও চোরাচালানিদের মতোই হাবভাব নিয়ে বসে রইলাম, যেন ওটা আমার ব্যাগে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু যতোই বেরসিক বর্বর হোক না কেন, আর গুন্ডামি করে বেড়াক না কেন, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে চঞ্চল বেশ কাজের গুন্ডা। পুতুল আপার মেয়োনেজটাকে সুচারুভাবে রুটিতে মেখে মেখে সবার হাতেই ধরিয়ে দিলো সে একেক টুকরো। আমার পূর্বপুরুষদের অসীম পূণ্যফল, যে আমার ভাগেও একটা টুকরো জুটেছিলো। ওর মতো বদের এই বদান্যতায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম, অর্ধেক খিদে তখনই উবে গেলো। তবে সাহিত্যপ্রবণ মন আমার, সেই কবে শৈশবে বান্দরের রুটি ভাগ বা এই গোছের একটা গল্প পড়েছিলাম, সেটাই থেকে থেকে অন্তরাত্মায় ঘা দিলো কিছুক্ষণ। ভরপেট না হোক, ভরমন খাওয়া হলো সবার। আর আফটার লাঞ্চ রেস্ট আ হোয়াইল, তাই সবাই একটু গড়িয়ে নিলো ঘাসে। পেছনে পাথর আর খাটো ঝোপের আড়ালে ঝরঝর অবিশ্রান্ত বয়ে চলেছে হিমসলিল, সামনে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সবুজ পাহাড়, অনেক উঁচুতে পাহাড়ের পেছনে উঁকি দিচ্ছে আকাশের বিশুদ্ধ নীল উষ্ণীষ। দিনের পর দিন কংক্রীট আর পিচের মাঝে বন্দী আমরা জীবন কাটাচ্ছি, ছোট্ট একটা পরিসরে ছুটে বেড়াচ্ছি, তাই হঠাৎ এই বিশালতা যেন আমাদের সবাইকে একটু বিষণ্ন, একটু নীরব, আর একটু অলস করে দিলো, যেন মরচেপড়া প্রদীপের ভেতর থেকে সেই বিশাল দৈত্য বেরিয়ে এসেছে আমাদের সামনে, যা এতোদিন ধরে খুঁজছিলাম তা এতো কাছে পেয়ে সবার চেষ্টা, সবার চঞ্চলতা জড় হয়ে পড়েছে ---। বেশ লাগছিলো, বুঝলেন, গুন গুন করে গানও গাইছিলাম, রামধনু চোখে চোখে, কথাকলি মুখে মুখে, এখানে মনের কথা বোলো না, না আ আ আ, এখানে মনের কথা বোলো না ---। কিন্তু গানের আমেজ ছারখার করে দিয়ে একটা তিতিবিরক্ত কর্কশ কন্ঠ যা বলে উঠলো, তার সারমর্ম হচ্ছে, অনেক বিশ্রাম হয়েছে, এবার বডি তুলতে হবে। কি, পাঠক, অ্যাদ্দূর পড়ে এসে নিশ্চয়ই ধরতে পারছেন, এই রসভঙ্গকারী নচ্ছাড়টা কে? পদে পদে ব্যাটার নামে দরূদ পড়তে পারবো না, বুঝে নিন! বরুণদা এর আগে এই পথে এক দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চার করে গেছেন, অলস হাত তুলে আমাদের এগোনোর পথ দেখিয়ে দিলেন তিনি। আমাদের আগুয়ান বাহিনী, অর্থাৎ দলনেতা উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, সৈকত, সালেহীন আর চঞ্চল চটপট উঠে পড়ে পিঠে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে, কোমরে কষি বেঁধে বুক ফুলিয়ে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে গেলো। আমি তখনো ঘায়েল হয়ে পড়ে, একে একে সকলে উঠবার পর সেই ঘাসের কোমল সান্নিধ্য ছেড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়ালাম। নাহ, লেটকে পড়ে থাকলে তো চলবে না, কদম কদম বাঢ়ায়ে যা খুশিসে গীত গায়ে যা ---। গাঁটরিবোঁচকা কাঁধে তুলে আবার টলন্ত পায়ে চলন্ত হলাম। আমাদের পথ ভারি নিরীহ চেহারা নিয়ে একটা প্যাঁচ খেয়ে উঠে গেছে এক ঢিবির ওপরে। ঢিবির উচ্চতা চারতালা সমান, একেবারে কাছে না গেলে বোঝা যায় না, কী পরিমাণ কুটিল ষড়যন্ত্র এখানে রয়েছে! ঢিবিটা একেবারে মসৃণ, তার যে খাঁজগুলোতে পা রাখতে হবে, সেগুলোও মসৃণ, আবার ঝুরঝুরে মাটি ভর্তি, পা রাখতে না রাখতেই পিছলে যেতে শুরু করে। আর এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজের দূরত্বটাও যেন স্বাভাবিক আকারের মানুষের জন্যে তৈরি নয়, ব্রবডিংন্যাগের লোকজনের জন্যেই তৈরি বোধহয়। বহুকষ্টে দাঁতমুখ খিচিয়ে খামচাখামচি করে ঢিবি বেয়ে একটা আপাতসমতল জায়গায় উঠে দাঁড়ালাম। একটা পথ চলে গেছে ডানে, বোধহয় কোনও পাড়ার দিকে, আরেকটা পথ গোঁৎ খেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে। ধনঞ্জয়দার এগোনো দেখে বুঝলাম, এখন আমাদের নিচে নামতে হবে। ভালো করে রুকস্যাক এঁটে নিয়ে তিন পা এগিয়েই বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম যেন। আমার সামনে বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত। পাহাড়ের পর পাহাড় সামনে, পাহাড় ছাড়া অন্য কিছু দেখবার জো নেই। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে আছি তেমনই একটা পাহাড়ের চূড়োয়, আর আমার নিচে ঝপ করে প্রায় খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল। ঢালে বিশাল সব ঝোপ, উঁচু উঁচু গাছ, বাঁশের ঝাড়, সবই আছে যা কিছু থাকবার কথা, কিন্তু তবুও দেখতে পাচ্ছি, পায়ে চলার পথের ঠিক পাশেই ঝপ করে নেমে গেছে পাহাড়, বিশাল খাদ নিচে, বারোশো থেকে পনেরোশো ফুট নিচে ক্ষুদে কিছু গাছপালা আর পাথর দেখা যাচ্ছে। ঐ গাছগুলো আদপে ক্ষুদে নয়, অনেক ওপর থেকে তাকিয়ে আছি আমি। আমি চলার পথের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে একটা ঢোঁক গিললাম। পথটা পাহাড়ের ঢালের ওপর, অর্থাৎ, পথটাও একই রকম ঢালু, তাতে এবড়ো খেবড়ো সব নুড়ি, আর সাকুল্যে একটি মাত্র পা রাখার মতো চওড়া সেটি। পথের পাশে মুখ ব্যাদান করে আছে সেই দেড়হাজারফুটি খাদ। পপাত চ মমার চ। আমি একজন অ্যাক্রোফোবিয়াক --- উচ্চতাকে দারুণ ভয় পাই আমি, তিনতলার ছাদে উঠেও রেলিঙের ধারে কাছে ঘেঁষি না। আপনিই বলুন, এ পরিস্থিতিতে আমার যদি তখন হাঁটুতে হাঁটুতে লেগে টরেটক্কা আওয়াজ উঠতো, দোষ কিছু হতো? --- কিন্ত না, হাঁটু আমার কাঁপেনি। আমি কোনমতে নিজের মনটাকে অন্য একটা ব্যাপারে স্থির করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা গিয়ে বুকে কিছুটা বল ফিরে এলো। নাহ, বেশ এগোচ্ছি তো! কিন্তু একটা মোড় ঘুরে দেখি পথের ওপর আড়াআড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে একটা ইয়া মোটা নাম-না-জানা কাঠের গাছ, তার ওপারে সশঙ্কিত চিত্তে দলের অগ্রবর্তীরা দাঁড়িয়ে, আর এ পারে আমি, ধনঞ্জয়দা আর পুতুল আপা। মংক্ষিয়াদা আমাকে ঘোড়ার সওয়ারির মতো গাছের ওপর চেপে এক পা টপকে দিতে বললেন। এ ছাড়া ঐ গাছ টপকে যাবার কোন পথ নেই। বামে প্রাচীরের মতো পাহাড়, ডানে খাদ, পথের ওপর কোমর সমান উচ্চতায় ঝুঁকে পড়া গাছ। সময় নষ্ট না করে গাছটার ওপর চড়ে বসলাম। আর গাছটাও বজ্জাত কম নয়, ঘোড়ার মতোই নড়েচড়ে উঠলো সে, স্পষ্ট শব্দ শুনলাম, গোঁওওও! এখন যদি গাছটা পিছলে নিচে নেমে আসে, তার সওয়ারীও খানিকটা পিছলে পড়বে, প্রায় হাজার ফুট নিচে! ঢোঁক গিলে নিজের হৃৎপিন্ডটাকে আলজিভের ওপর থেকে সরিয়ে আবার নিচে ফেরত পাঠালাম, নিজের জায়গা ছেড়ে আঘাটায় উঠে এসে ধুকধুক করছিলো ব্যাটা। তারপর একটা পা বাড়িয়ে দিয়ে হেলে পড়তেই ডান পায়ের নিচে আবার শক্ত মাটি ফিরে পেলাম। পুতুল আপাও আমার মতোই বৃক্ষারূঢ় হয়েই এই পুলসিরাত পেরিয়ে এলেন। ধনঞ্জয়দাকে পেরোতে দেখলাম, অবলীলায় গাছটাকে ডিঙিয়ে এসে ধুপ করে পড়লেন তিনি। গাছটা আবারও একটা আপত্তির হ্রেষাধ্বনি তুললো, ভ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ --- একটু নিচের দিকে নড়ে উঠলো, তারপর আবার সব চুপ। আবার অতি সন্তর্পণে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম সবাই। ইতিমধ্যে দলের আগুয়ান বাহিনী খানিকটা এগিয়ে গেছে, মংক্ষিয়াদা পুতুল আপাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছেন, আর পেছনে আমি, ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, শাহেদ ভাই আর বরুণদা। এই বিশ্রী পাহাড়ি পথে নামতে গিয়ে বার দুই পা পিছলে গিয়েছিলো, কপালের জোরে নিচে গিয়ে পড়িনি। তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কোন জায়গা ঐ পথের ওপর নেই, সমস্ত পথটাই নেমেছে খাদের পাশ ধরে, যত নিচে নামছি, অন্ধকার ঝোপঝাড় এগিয়ে আসছে। হুঁশিয়ার হয়ে একটু ধীরে নামছিলাম, শাহেদ ভাই আমার মনে সাহস যোগানোর জন্যে বললেন, 'হিমু, আস্তে আস্তে হাঁটেন। ভয়ের কিছু নাই।' আমিও নিজেকে প্রবোধ দিলাম, 'জি্ব শাহেদ ভাই, রাস্তাটা একটু ইয়ে, কিন্তু ভয়ের তেমন কিছু নাই।' সহজ সরল ধনঞ্জয় ত্রিপুরা এই পথে হরদম আসাযাওয়া করেন, তিনি আমাদের এই মিথ্যাচারের পরম্পরা সহ্য করলেন না, বলে উঠলেন, 'না না, এতা খুব খালাপ লাস্তা --- গলু পলে গেলে মলে যায়।' আমরা একটা বায়বীয় আশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বোধকরি একটু জোরসে হাঁটা শুরু করেছিলাম, কিন্তু এমন নিদারুণ দুঃসংবাদ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। শাহেদ ভাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, 'কী? --- গরু?' ধনঞ্জয় হাসিমুখে ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়লেন। শাহেদ ভাই বহুকষ্টে আমাকে সাইজে এনেছিলেন, তাঁর সব প্রচেষ্টা ঐ গরুর সাথেই মাঠে মারা গেলো, তিনি ডুকরে উঠলেন, 'গরু পড়বে কেন? য়্যাঁ? গরু পড়বে কেন এখানে?' আমারও মনে তখন একই প্রশ্ন। গরু কি পড়ার আর জায়গা পেলো না? এমন সূচাগ্রমেদিনীতুল্য পথে বেড়াতে এসে পা পিছলে মরলো কেন সে? এ কি ফাজলামো নাকি? ধনঞ্জয় তখন ঠিক পায়ের নিচে খাদের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার অংশ দেখিয়ে জানালেন, কয়েকদিন আগে একটি গরু ওখানে পড়ে গিয়েছে, এবং পতনের যা অবশ্যম্ভাবী ফল, সেইটি লাভ করেছে। এসব জায়গায় পদস্খলনের শাস্তি বড় কড়া। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমত, গরুটা পড়ে গিয়ে মারা গেছে। দ্বিতীয়ত, এখনই কেন আমাকে এই দুঃসংবাদটা পেতে হলো, যখন হাঁটু দু'টোকে বহুকষ্টে বাগে ধরে রাখা গেছে? তৃতীয়ত, আমার সাথে কি গরুর কোন সূক্ষ্ম তুলনা ফাঁদার চেষ্টা করছেন ধনঞ্জয়? ওদিকে শাহেদ ভাই ক্ষেপে উঠলেন একদম, 'না না, এখানে গরু টরু পড়ে না! হিমু আপনি আস্তে আস্তে আগান তো ভাই!' ধনঞ্জয় স্মিত হেসে চুপ করে গেলেন, আমি আরো সাবধান হয়ে পা টিপে টিপে নামতে লাগলাম। পড়ে মরা গরুর দলে শামিল হতে চাই না আমি। একটা কিছু ঘটে গেলে এই ধনঞ্জয়দা পরে বলে বেড়াবেন, এখানে দু'টো গরু পড়ে মারা গেছে! এই পশ্চাদবর্তী দলের মধ্যে আমি যেহেতু এগিয়ে, তাই আমার বেগেই আস্তে আস্তে নামতে লাগলো সবাই। সেই গরুপতন পয়েন্ট পেরিয়ে আরো খানিকটা নেমে পথটা পাহাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলো। খাদের কিনারা থেকে সরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা, চলার গতি কিছুটা বাড়লো। কয়েকটা জায়গায় বিশাল সব বোল্ডার বেয়ে নামতে গিয়ে একটু সময় লাগলেও, কোন অঘটন ঘটলো না। তবে বরুণদা কিছুদিন আগেই এ পথে এসেছিলেন, তখন এখানে তাঁর গাইড জুয়াম মদের ঝোঁক সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছিলো। সে কারণে মাঝপথ থেকেই সেবার ফিরে যেতে হয়েছে বরুণদাকে, আর জুয়াম কিরে কেটে জানিয়েছে, এই পথে, যেখানে শুয়োরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চলাও নিরাপদ নয়, আর কখনো পা ফেলতে আসবে না সে। আরো খানিকটা নেমে নিচের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমাদের। দূরে কিছু খাটো পাহাড়ের ওপর বিকেলের সূর্য আলো ঢালছে। আর আমাদের নিচে পাথুরে খাতের ওপর ঝিরঝির করে বয়ে চলছে প্রশস্ত একটি ধারা, তার দু'পাশে বিশাল দেয়ালের মতো পাহাড়, দু'তিনতলা উঁচু সব বোল্ডার ছড়িয়ে আছে এদিক সেদিক, তার ফাঁকে ফাঁকে পানির রঙ ইস্পাতের মতো নীল, হু হু করে বয়ে চলেছে। সেদিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছে আমাদের আগুয়ান জনগণ। পাহাড়ের অলিগলি দিয়ে বাকিটা পথ পেরিয়ে এসে দেখি জলের ধারে পাথরে হাসি হাসি মুখে বসে সবাই। বরুণদা একটা বোল্ডারের ওপর নবাব আলিবর্দি খানের মতো ভঙ্গি করে বসলেন, একটা ছবি তুলে দিলাম, আর সেই বিশাল বোল্ডারে ক্লাবের নামখানা টুকে রাখা হলো। তবে এই করাঙ্ক স্থাপনের গৌরব আমাদের একার নয়, এখানে যে এর আগেও ইংরিজি বর্ণজ্ঞানসম্পন্ন রসিক ব্যক্তিবর্গের পদার্পণ ঘটেছে, তারও প্রমাণ মিললো। বাকিরা ছবির ধার ধারলেন না, তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেলেন পানির দিকে। দলনেতা উচ্ছল এরই মধ্যে গোসল সেরে ফেলেছেন, বাকিরাও পুলকিত বদনে জুতো খুলে তীব্র পানির ধারায় পা মেলে রেখেছেন। বোঝা নামিয়ে রেখে আমিও সেই জলে নেমে পড়লাম। সেই ভোরবেলা থেকে হাঁটছি সবাই, এর মধ্যে আর জুতো খোলা হয়নি। মুখে মাথায় খানিকটা পানি ছিটিয়ে বরফশীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম, পানির স্রোত এত তীব্র যে মাসাজের কাজ হয়ে যায়। পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আশপাশটা দেখে নিলাম। যে পাহাড়টা মাত্র টপকে নেমে এসেছি, তার দিকে তাকালে ঢোঁক গেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। খাড়া পাহাড়টা আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে আকাশকে মুছে দিয়েছে পুরোপুরি। চলার পথটা এই ছড়া ধরে খানিক এগিয়ে বাঁয়ের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। মংক্ষিয়াদা জানালেন, আর মাত্র একটা পাহাড় ডিঙিয়ে গেলেই পুকুরপাড়ায় পৌঁছে যাবো আমরা। ছড়ায় মিনিট দশেক বসে, পা দু'টোকে একটু সেবা দিয়ে আবার জুতো পরে নিলাম। বিকেলের আলো আস্তে আস্তে মরে আসছে, কিছুক্ষণ পরই ঝুপ করে আঁধার নেমে আসবে, তাই মংক্ষিয়াদা তাড়া দিলেন সবাইকে। খানিকটা পানি খেয়ে নিয়ে আবার যখন উঠলাম, ততক্ষণে সবাই এগিয়ে গেছে, শাহেদ ভাই একটু দূরে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। এগিয়ে যাবার আগে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলাম সেই খতরনাক পাহাড়টাকে। অন্ধকার, অটল। খানিকটা এগোতে না এগোতেই ঘটলো বিপত্তি, ব্যাগের সাথে বাঁধা গোল করে পাকানো স্লিপিংব্যাগটা গড়গড়িয়ে খুলে গেলো। সেটাকে আবার ঠিকমতো বুঁজিয়ে শক্ত করে বাঁধতে গিয়ে নষ্ট হলো কয়েকটা মিনিট। শাহেদ ভাই জঙ্গলের ভেতর থেকে হাঁক ছেড়ে জানতে চাইলেন, কোন সমস্যা হলো কি না। জবাব দিতে যাবো, শুনতে পেলাম, মাথার ওপরে ঝোপে একটা ভারি খসখস শব্দ হলো। কী জন্তু কে জানে, তা দেখবার জন্যে আর অপেক্ষা করলাম না, দিলাম ঝেড়ে দৌড়, এক ছুটে একেবারে জঙ্গল পেরিয়ে আবার সেই পাথুরে খাতের ওপর। দূরে শাহেদ ভাই, বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা বিড়ি টানতে টানতে অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। ছড়ার ওপরে যে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম আমরা, সেটা আগেরটার মতো ঘাতক চরিত্রের না হলেও বেশ খাড়া। ভেজা ভেজা, পিচ্ছিল মাটি, পাহাড়ের বেশির ভাগ অংশেই রোদ পড়ার সুযোগ নেই উঁচু উঁচু গাছের জন্যে। ক্ষণিকের জন্যে রোদেলা একটা অংশ পাওয়া গেলো পথে, তারপর আবার সেই স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার পথ। লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে চললাম আমরা। উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, সালেহীন, সৈকত আর চঞ্চল এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা, বাকিরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। আরো খানিকটা এগিয়ে শুরু হলো খাড়া পথ। তবে পা রাখার মতো যথেষ্ঠ জায়গা আছে এখানে। কিছুদূর গিয়ে দম নেয়ার জন্যে একটু থেমে নিলাম, একটানা অত খাড়া পথে চলা ভারি কষ্টসাধ্য কাজ। পুকুরপাড়ার এক বাসিন্দা ফিরছিলেন এই পথে, আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে তিনি এগিয়ে গেলেন তরতর করে। ওদিকে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা এগিয়ে গেছেন খানিকটা। সূর্যের আলো বিবর্জিত এই পাহাড়ের পিচ্ছিল আর ঢালু পথ বেয়ে বেয়ে এক জায়গায় এসে চোখে পড়লো জুম্ম চাষের প্রস্তুতির চিহ্ন। পাহাড়ের খাড়া ঢাল থেকে ঝোপঝাড় সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে, বিশাল এক গাছকে কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে, একটা সাঁকোর মত দুই পাহাড়ের ঢালের ওপর পড়ে আছে সেটা, তার অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে নিকষ অন্ধকার। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম উৎফুল্ল মনে, কী ভাগ্য আমার যে এই সাঁকোর ওপর দিয়ে যেতে হচ্ছে না! আরো খানিকটা এগিয়ে চোখে পড়লো একটা বদ্ধ ছড়া। জায়গাটা বাঁশ ঝাড়ের পাশে, পানি এখানে জমাট হয়ে আছে, কোন স্রোত নেই, ছোট ছোট বোল্ডার ছড়ানো, আর একটা গাছের গুঁড়িতে আমাদের অপেক্ষায় বসে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা। ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিলো, বরুণদার ব্যাগে চিঁড়াভাজার ওপর হামলা করলাম। বরুণদা মিটিমিটি হাসলেন, কারণ ক্লাবসভায় শুকনো খাবার হিসেবে চিঁড়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলাম আমি, আর সেই আমিই এখন হামলে পড়ে চিঁড়া খাচ্ছি সমানে। পুতুল আপাও ইতিমধ্যে চলে এসেছেন, কয়েকটা খেজুর দিয়ে আমাকে আপ্যায়ন করলেন তিনিও। কিন্তু বেশিক্ষণ বসা গেলো না, জায়গাটা নিকষ অন্ধকার। কানের কাছে ভনভন শব্দ শুনে মশার ভয়ে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গেলাম আমরা। এবার পথ চলে গিয়েছে উঁচু ঘাসের ঝোপ আর বাঁশের ঝাড়ের মধ্য দিয়ে। মাটি এখানে শক্ত, দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলাম সবাই। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, গাছপালার জন্যে আলো ঢোকার কোন রাস্তা নেই, আর রাস্তা থাকলেও ঢোকার মতো আলো এখন নেই আকাশে। পথ শেষ হলো খাটো দেয়ালের মতো এক পাহাড়ের সারির গোড়ায়, ডানে বা বামে যতদূর চোখ যায়, দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে এই পাহাড়, এটিই বান্দরবান আর রাঙামাটি জেলার সীমানা। পাহাড়ের গোড়ায় কয়েকটা টং ঘর ছাড়া আর কিছু নেই, কিন্তু টেনিস কোর্টের মতো সমতল জায়গাটা। খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এসেছি আমরা, পেছনে ফেলে আসা সূর্যটাকে দেখাচ্ছে বড় একতাল সিঁদুরের মতো, আর আমাদের সামনে প্রসন্নমুখে ভেসে আছে ঝকমকে চাঁদ। এ দুয়ের আলোতে দেখে নিয়ে পাথুরে পথে এগোতে শুরু করলাম। বরুণদা আর শাহেদ ভাই আবারও এগিয়ে গেছেন, আর খানিকটা এগোলেই বান্দরবান পেরিয়ে রাঙামাটিতে পা দেবেন তাঁরা। পাহাড় পেরোতেই পথ আবার ঢেকে গেলো ঘন ঝোপে। এবার আর টর্চ ছাড়া উপায় নেই, আর হিম পড়ে গেছে বেশ। ব্যাগ থেকে জ্যাকেট আর টর্চ বের করে এগিয়ে গেলাম। পুতুল আপা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন, তিনিও এর মধ্যে চলে এসেছেন। আবার যখন খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলাম, দূরে একজোড়া সিগারেটের আগুন চোখে পড়লো, বরুণদা আর শাহেদ ভাই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছেন। চাঁদ এর মধ্যে আকাশে তার মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসেছে। সেই হালকা আলোয় দূরে চোখে পড়ছে একটা ঝকঝকে হ্রদ, আর তাকে ঘিরে একটা গ্রাম। চারপাশে গম্ভীর অন্ধকার সব পাহাড়ের সারি, তার মাঝে গোটা জলাশয় যেন চাঁদের আলোয় জ্বলছে। এ দৃশ্যের জন্যে আরো দুটো পাহাড় টপকে যেতে রাজি আছি আমি। কিন্তু আজকের মতো পাহাড় বেয়ে ওঠার কাজ আপাতত শেষ, এই পাহাড় বেয়ে নেমে গেলেই গ্রামে পৌঁছে যাবো আমরা। আর পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে বোঝা গেলো, ঝামেলার এখন কিছুটা বাকি। খুবই ঝুরঝুরে মাটি, গোড়াতেই পা পিছলে গিয়ে প্রবল এক অভূতপূর্ব হোঁচট খেলাম, পুতুল আপা আঁতকে উঠে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে অভয় দিলাম সবাইকে, আছি, মরি নাই! লাঠিটা ছিলো বলে কয়েকশো ফিট নিচের অন্ধকারে পড়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম, কিন্তু লাঠি বেচারা নিজে মচকে গিয়ে অচল হয়ে পড়লো। কী আর করা, কোন মতে টর্চের আলোয় সেই বদখদ পথ পেরিয়ে খানিকটা সমতলে নেমে এলাম আমরা। বরুণদার কাছে রাতে মুরগি খাবো মুরগি খাবো বলে খানিকটা ঘ্যানর ঘ্যানর করে করার পর আশ্বাস পেলাম, রাতে মুরগি হবে। এক দফা ভালো খানা জুটবে, সেই উল্লাসে বাকিটা পথ যেন উড়ে পেরিয়ে এলাম। খানিকটা চড়াই খানিকটা উৎরাই ভেঙে গ্রামের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম, আধ ঘন্টা হাঁটার পর। এখানে ঝোপঝাড়গুলো সেচের অভাবে ঠিক বাড়তে পারছে না, এই অজুহাতে একটা ঝোপের সামনে ছোটোবাইরের জন্যে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, বাকিরা এগিয়ে গেলো। হাতের কাজ সেরে নিয়ে একবার ফেলে আসা পাহাড়টাকে চাঁদের আলোয় দেখে নিলাম। আমার আকাশের অনেকখানি আড়াল করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হলো চারদিকে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল, মাথার ওপর প্রাচীন চাঁদ, আকাশে নক্ষত্রের নিজস্ব নকশা, এগুলো যুগ যুগ ধরে যেন সঙ্গ দিয়ে আসছে আমাকে, যেন আমি এদেরই স্বজন। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। গ্রামে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়লো বিরাট সব গয়াল আর প্রকান্ড আকৃতির শূকর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে সব, আমাদের দেখে গাঁক গাঁক করে অভ্যর্থনা জানালো তারা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কারবারির কুটিরের দিকে এগিয়ে গেলাম, কাছে যেতেই পরিচিত কন্ঠের কলরব কানে এলো। ব্যাগ আর জুতো খুলে কোনমতে টলতে টলতে কুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সালেহীন বত্রিশ দাঁত বার করে বরণ করে নিলো আমাদের। তিন: পুকুরপাড়া পুকুরপাড়া গ্রামটা ত্রিপুরা অধু্যষিত, কিন্তু কারবারির ঘরটা আর দশটা পাহাড়ি কুটিরের মতোই, অন্তত আমার কাঁচা চোখে কোন পাকা পার্থক্য চোখে পড়লো না। কুটিরের প্রথমেই খানিকটা বারান্দা, সেখানে জুতোজোড়াকে সমর্পণ করে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকে প্রথমে যে ঘরটা পড়ে, সেখানে একটা তাঁত বসানো। সে ঘরেরই এককোণে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে আমাদের কলম্বুষ সদস্যদের ব্যাগগুলো। আমার ঘুমকম্বলটাকে খুলে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি জ্বলছে কয়েকটা, আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন কৌতূহলী গ্রামবাসীর পাশে আমাদের কয়েকজন বসে। গ্রামবাসীদের মাঝে চেনা মুখ দু'জনের, ধনঞ্জয় ত্রিপুরা, আর দেবাশিস, যাঁর সাথে সন্ধ্যের আগে পাহাড়ে মুলাকাৎ হয়েছিলো। গুজগুজ আলাপ চলছে গ্রামবাসীদের মধ্যে। আমি ঘরে ঢুকেই এক কোণে স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে বসলাম। উচ্ছল ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যথার মলমটা চেয়ে নিয়ে, টর্চে নতুন ব্যাটারি ভরে নিয়ে লেগে পড়লাম নিজের পদসেবায়। উপস্থিত শিশুরা দেখলাম আমার স্কন্ধোত্তর চুল আর মোচদাড়ি দেখে বিমল আমোদিত হলো, নিজেদের ভাষায় যে কিচিরমিচির তারা জুড়ে দিলো, তার সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে, 'দ্যাখ কী আজব চিড়িয়া এসে জুটেছে।' খানিকটা ধাতস্থ হবার পর আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি, মিলন ভাইও আমার পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন, ঘুমকম্বলের ওপর চিৎপাৎ হয়ে পড়ে আছেন তিনি। সালেহীন আর উচ্ছল ভাই তুলনামূলকভাবে চাঙা, আর চঞ্চল তো কথাই নেই, তাৎক্ষণিক কফির মগে রসিয়ে রসিয়ে চুমুক মারছে সে, আর খামাখাই আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই জালেম দুনিয়ার বে-ইনসাফির দুঃখ ভোলার জন্যে সালেহীনের বিস্কুটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বসলাম। পুতুল আপা আশ্রয় নিলেন অন্দরমহলে, কুটিরের ভেতরের দিকের ঘরে। মিলন ভাইয়ের সৌজন্যে মুরগির ইনস্ট্যান্ট সু্যপের কয়েকটা প্যাকেট গরম পানি সহযোগে বিতরিত হলো, সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর সেই নোনতা তরল চোঁচোঁ করে গিলে নিলাম সবাই। ওদিকে মংক্ষিয়াদা দেবাশিসের সাথে আলাপ করে জানালেন, আমাদের খবর শুনে বেশ বিস্মিত হয়েছে গ্রামের লোকেরা। আমরা কেন সেই গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে এখানে এসেছি, তা বুঝতে পারছে না তারা। সেনাবাহিনীর লোকও নাকি বিপজ্জনক বলে গত তিন বছর ধরে ঐ পথ মাড়ায় না। পুকুরপাড়ায় সেনাছাউনি রয়েছে, তাদের যাতায়াতের জন্যে রুমা থেকে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক একটা পথ তৈরি করা হয়েছে। সেই পথ কিঞ্চিৎ দীর্ঘতর, কিন্তু সে পথে গরু পড়ে মরে যায় না। আর নিতান্ত ঠ্যাকায় না পড়লে আমাদের টপকে আসা পথ পাহাড়িরাও ব্যবহার করে না। এমন একটা সংবাদের জন্যেই বোধহয় অপেক্ষা করছিলাম। জিতা রহো দেবাশিস! আমি গলা খাঁকরে ভ্যানর ভ্যানর শুরু করলাম, ঐ গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে রুমায় ফিরতে আমি চাই না, একটা বিকল্প পথের আলামত যখন পাওয়া গেছে, সেটাই বাজিয়ে দেখা যাক, নতুন পথের সন্ধানেই তো আমরা দিগ্বিদিক ছুটে চলেছি --- ইত্যাদি। আর সবচে' বড় কথা হচ্ছে, এই বিকল্প পথে গরু পড়ে গিয়ে মরে যায় না, আর কী চাই? দলনেতা কী বলেন? আমার প্রস্তাবের কড়া সমর্থন পাওয়া গেলো মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে। বেচারার দুই পায়ের পেশীতেই মারাত্মক টান ধরেছে, পথের মাঝখানে এক জায়গায় তো প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিলো তাঁর। যে কোন বিকল্প পথেই তিনি যেতে রাজি, কিন্তু ঐ গরুমারা পাহাড়ে আর নয়! মিলন ভাইয়ের সমর্থনে, ইংরেজিতে যাকে বলে ডোমিনো এফেক্ট, পড়লো সবার ওপর, নতুন পথের পক্ষে উলু দিয়ে উঠলো বাকিরা। এর পরে নতুন আলোচ্য বিষয় হলো, পরদিন ভোরে আমরা কী করবো? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে সবার টনক নড়লো, তাই তো, স্রেফ পুকুরপাড়াই তো দেখতে আসিনি আমরা, এসেছি পুকুরপাড়ায় রাইনক্ষ্যং নদীর প্রপাত দেখতে। প্রসঙ্গ উঠতেই মংক্ষিয়াদা ভারি আপ্লুত হয়ে সেই প্রপাতের সৌন্দর্যকীর্তন করলেন কিছুক্ষণ। খানিক আলাপসালাপের পর পরদিন কাকভোরে, অর্থাৎ কাকও যখন পাশ ফিরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোয়, সেই ব্রাহ্ম মূহুর্তেই প্রপাততীর্থযাত্রা ঠিক হলো। জানা গেলো, পুকুরপাড়া থেকে আধঘন্টা হাঁটাপথ পেরোলেই সেই প্রপাতের দেখা মিলবে। তবে, পাহাড়িদের আধঘন্টার ওপর ভরসা নেই আমার, মনে মনে সেটাকে সাড়ে তিন দিয়ে গুণ করে নিলাম। আমাদের বিতর্কের ফাঁকে মংক্ষিয়াদা ইতিমধ্যে মুরগি ম্যানেজ করে ফেলেছেন, পাশের রান্নাঘর থেকে একটা দারুণ ঘ্রাণ ঘরময় কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। জিভের জলোচ্ছ্বাসকে কোনমতে সামলে খানিকটা সময় ঝিমিয়ে কাটালাম। ওদিকে বরুণদা, উচ্ছল ভাই আর চঞ্চল রান্নার কাজে মংক্ষিয়াদাকে সহযোগিতা করার জন্যে বসে গেছেন। সারাটা পথ সঙ্গ দেয়ার জন্যে আর ব্যাগ বহন করার জন্যে ধনঞ্জয় ত্রিপুরাকে ধন্যবাদ আর উপহারসহ বিদায় জানিয়েছেন পুতুল আপা। রাতের খাবারের গুণবর্ণনা করে আর কাজ নেই, সবার চেয়ে সেরা আচার হচ্ছে ক্ষিদে। হুমহাম করে পাহাড়ি মুরগি ভুনা আর ডাল দিয়ে পাহাড়িদের লালরঙা ভাত খেয়ে নিলাম সবাই। খেতে বসে ভাবলাম, কয়েক ঘন্টা আগেও এক বিঘত সরু পথের ওপর প্রাণটা হাতে করে হেঁটেছি, হোঁচট খেয়ে খাদের মুখে ছিটকে পড়েছি, পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শিকড় ধরে ঝুলে ঝুলে এগিয়েছি --- এগুলো কি সত্যিই ঘটেছে, নাকি সব তন্দ্রার ঘোরে দেখা স্বপ্ন রে বাপ? খাওয়াদাওয়ার আগেই কারবারির সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এখন মশা নেই, কাজেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারবো আমরা। তবুও সাবধানের মার নেই, খাওয়াদাওয়ার পর বীর চঞ্চল তার অ্যারোসলের শিশি বের করে ঘরময় কিছুক্ষণ দাপাদাপি করলো। তারপর আলো নিবিয়ে নিদ্রাসায়রে ডুব দিলাম সবাই। অন্তত ডোবার চেষ্টা করলাম। ঘরের দরজা জানালা যদিও ভেজানো, বাঁশের মাদুরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে মাঘের হিম বাতাস তুলোটে জ্যাকেট, পুরু স্লিপিং ব্যাগের ঠুনকো বাধা ডিঙিয়ে একেবারে হাড়ে গিয়ে নক করছে। নকের শব্দও যেন দাঁতে শুনলাম, খটাখট খটাখট ---। হাঁটার ক্লান্তি যে সবাইকে গ্রাস করেছে, বুঝতে পারলাম একটি পূর্বাশঙ্কিত শব্দের অভাবে, সবার নাকই জাতির বিবেকের মতো নিশ্চুপ। দুয়েক ঘন্টার জন্যে বোধহয় ঘুমটা লেগে এসেছিলো, কিন্তু স্বপ্ন দেখার ফুরসত মিললো না। ফিসফাস খুটখাট শুনে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন সোয়া পাঁচটা বাজে। প্রথমটায় জেগে গিয়ে ভাবলাম, জাগিনি, ঘুমিয়েই আছি, ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছি যে আমি জেগে উঠেছি --- কিন্তু বারান্দায় ধুপধাপ শুরু হতেই বুঝলাম, না দেখা দুঃস্বপ্নই সত্যি হয়েছে। কী আর করা, কোনমতে উঠে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালাম, আজ চঞ্চলের চপ্পল জোড়া হাইজ্যাক করে এগিয়ে গেলাম খানিকটা দূরে। আকাশে চাঁদ বত্রিশ দাঁত বার করে হাসছে, তারাগুলোও খুব তাল দিচ্ছে তার সাথে, কিন্তু এ আকাশ শেষ রাতের আকাশ, একটু পরই চারদিক ফসর্া হয়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে আসল কাজ সেরে দাঁত মেজে নিলাম। তবে আজ আর পরিবেশ দূষণ নিয়ে অনুশোচনা হচ্ছে না, পুকুরপাড়ার শূকরবাহিনীই সব জঞ্জাল সাফ করে দেবে। ক্যামেরা বার করে, জঙ্গলদল জুতো পায়ে দিয়ে সবাই যখন তৈরি, তখন পৌনে ছ'টা বাজে। আকাশ ফর্সা প্রায়, গ্রামও আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। প্রধান চত্বরে বিরাট এক আগুন জ্বলছে, তাকে ঘিরে নানা বয়সের শিশু, এক বিঘৎ হাঁ করে আমাদের দেখছে সবাই। আমাদের চালচলন নিঃসন্দেহে ভীষণ উদ্ভট ঠেকছে এদের কাছে। তাদের হাসিমুখের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে সবাই এগিয়ে গেলাম পূর্বোদ্দিষ্ট নদীপ্রপাতের পথে। প্রপাতের দিকে যাবার পথ হ্রদের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। চারদিকে কুয়াশার আস্তর, ফসলের মাঠে একটা নিঃসঙ্গ ন্যাড়া গাছকে কেবল দেখা যাচ্ছে, বাকি সব আড়ালে। একটা পাথরের মই বেয়ে নিচে নেমে সেই মাঠের ভেতর আড়াআড়ি চললাম সবাই। মাঠের বেশির ভাগ অংশেই কাদা, তার ওপর বাঁশ ফেলে কিছুটা গম্য করা হয়েছে। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ হুঁশ হলো, বাকিরা এগিয়ে গেছে খানিকটা, আমি আর পুতুল আপা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। হ্রদের তীরে এসে আরো পিছিয়ে পড়লাম আমি, কারণ এই অপূর্ব দৃশ্যকে মনের ক্যামেরা আর হাতের ক্যামেরায় তুলবার জন্যে খানিকটা সময় চাই। সূর্য ঢাকা পড়েছে কুয়াশায়, হ্রদের ওপর ভিখিরির কম্বলের মতো ছড়িয়ে আছে কুয়াশা, এখানে ওখানে ছেঁড়া ফাটা দিয়ে চোখে পড়ছে কাকচক্ষু জল। হ্রদের তীরে কয়েকটি ধূসর গাছ রুখে দাঁড়িয়েছে, কিছুদূরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সব কুটির, তার মাঝের পথে জড়ো হওয়া শিশুদের মাঝে ইতিমধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, অর্থাৎ বাকিরা এগিয়ে গেছে সে পথে। পুতুল আপাও এর মধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। বাচ্চাদের দঙ্গলে খানিকটা সময় কাটিয়ে জ্যাকেট খুলে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে খানিকটা জোর পায়ে হাঁটা দিলাম। মাটির রঙ লাল, দু'পাশে ঘাসের ঝোপের উচ্চতা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ঘাসের ঝোপে থেকে থেকেই সরসর শব্দ হচ্ছে --- উঁহু, সাপ বা সজারু নয়, ক্ষুদে ক্ষুদে ধূসর পাখি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। পথ মাঝে মাঝে দু'তিন দিকে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাটিতে জুতোর ছাপ দেখে চিনে নেয়া যাচ্ছে সহজেই। তাছাড়া চঞ্চলের কাছে চক আছে, মাটিতে তীর এঁকে দিক দেখিয়ে গেছে সে। পথ আস্তে আস্তে সমতল ছেড়ে উঁচুনিচু হচ্ছে। পাশে ঘাসের ঝোপও ঘন হচ্ছে পাল্লা দিয়ে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে বহু দূর থেকে পুতুল আপার জবাব পেলাম। আধঘন্টা পার হয়ে গেছে পনেরো মিনিট আগে, পথ ফুরোচ্ছে না, ফুরোতে আরো আধ ঘন্টা লাগবে, তা-ও বুঝতে পারছি। হঠাৎ হঠাৎ ঘাস পাতলা হয়ে গিয়ে হ্রদটা চোখে পড়ছে, নতুন সূর্যের রোদ যেন অলঙ্কার হয়ে ফুটে আছে তার জলে। একটা বাঁকে পৌঁছে চোখে পড়লো রাইনক্ষ্যং নদীর আঁকাবাঁকা সরু সর্পিল শরীরটা, সূর্যের আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে বলে ছবি তুলতে পারলাম না। এ নদীর ছবি তুলতে হবে অন্য পারে দাঁড়িয়ে, নয়তো সূর্যাস্তের সময়। কিন্তু দু'পাশের ঘন সবুজকে চিরে বয়ে যাওয়া এ নদীর রূপ ভোলার নয়। এদিকে পথের পাশে ঘাসের ঝোপ ফুরিয়ে গিয়ে যখন কাঁটাঝোপ শুরু হলো, তখন মেজাজের সূর্যটাও ভাবের কুয়াশা কেটে আস্তে আস্তে চড়তে শুরু করলো। এদিকে পথ পুরোদস্তুর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। পাথুরে মাটির দু'পাশে ছোট বড় সব গাছ, শিশিরে রোদ পড়ে ঘাসের চাদরে হাজারটা ক্ষুদে সূর্য দেখা যাচ্ছে। একটা পাথরের তোরণ, আর তার সামনে কাত হয়ে পড়ে থাকা গাছের নিচ দিয়ে এগিয়ে যেতেই কথাবার্তা কানে এলো। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা তিনতলা টিলা ডিঙোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো। পাহাড় আর অরণ্যের জন্য এই ভোরে নদীর এই অংশ আঁধারে ছেয়ে আছে। সালেহীন আর চঞ্চল তীরে দাঁড়িয়ে, উচ্ছল ভাই আর মিলন ভাই ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় নিচ্ছেন, সৈকত হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে, বাকিদের চোখে পড়ছে না। তীরের কাছে পানির গভীরতা হাঁটু ছাড়িয়ে --- সৈকতের হাঁটু একটু উচুতে --- গজ ত্রিশেক দূরে গম্ভীর প্রতিধ্বনি তুলে ধাপে ধাপে বয়ে চলছে রাইনক্ষ্যং নদীর জল। মূল প্রপাত বাঁয়ে আরো প্রায় আধ কিলোমিটার, সেখানে পৌঁছুতে হলে ডাঙার ওপর দিয়ে এগোনোর কোন পথ নেই, যেতে হবে নদীর এই অতি পিচ্ছিল পাথুরে খাত ধরে। ডানে বামে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায়, সূর্য চোখে পড়ছে না, বিষন্ন অন্ধকারে বুকফাটা শব্দে পাতালের লেলে নদীর মতো ছুটে চলছে স্রোত। কে জানে, হয়তো এর খানিকটা পান করলে আমরাও আমাদের অতীতবিস্মৃত হবো --- চঞ্চল ব্যাটাকে একটু গিলিয়ে দিয়ে দেখবো নাকি? উচ্ছল ভাইয়ের কাছ থেকে জানা গেলো, বরুণদা, শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা নদীর উজান ধরে এগিয়ে গেছেন, সৈকত তাঁদের পিছু পিছু চলছে, আর কোমর পানি ভেঙে এগিয়ে কোন দুর্ঘটনায় পড়তে বাকিরা কেউ রাজি নয়। এই তথ্য জানিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। কথা সত্য, নদীর পিচ্ছিল খাতে পড়ে গিয়ে যদি কারো পায়ে আঘাত লাগে, কপালে কঠিন দুঃখ আছে, অন্যের কোলে চ্যাংদোলা হওয়া ছাড়া গতি নেই। চঞ্চল চরম বিষণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা এত বিচ্ছিরি আঁধারে, যে ভালো ছবি তোলাও মুশকিল। পুতুল আপা একবার পানিতে নেমে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, আবার দাঁড়িয়ে পড়ছেন। ওদিকে সৈকত হাঁচোড়পাঁচোড় করে এগিয়ে গেছে। আমি অবশ্য এই ঝুঁকি নিতে নারাজ, প্রপাতের একেবারে গোড়ায় না গেলেও আমার ক্ষতি নেই, এখান থেকে যতটুকু দেখার আমি দেখে নিয়েছি। কী আর করা, হতোদ্যম চঞ্চল আর আমার একটা ছবি তুলে দিতে বললাম সালেহীনকে। বেশ কিছুক্ষণ পর বাকি চারজন ফিরে এলেন, সবার মুখ হাসি হাসি, প্যান্ট গোটানো, ঊরু পর্যন্ত জলের দাগ। ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। বরুণদার ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে, ঢাকায় ফিরে সেগুলো দেখতে হবে আর কি। নদীপ্রপাতকে কাছ থেকে খুঁটিয়ে না দেখতে পারার বিষাদে ফেরার পথে সবাই খানিকটা গজগজ করলাম। আঙুর ফল তো টকই হয়। আবারও সেই উঁচুনিচু, কাঁটাঝোপে ভরা পথ পেরিয়ে ফিরে এলাম খানিকটা খোলা জায়গায়। সূর্য অনেকখানি তেজ নিয়ে জ্বলছে এখন, চারদিক আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দিনের আলোয় হ্রদ আর তার চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। মেঘশুন্য আকাশের নিচে মিষ্টি সবুজ ঘিরে আছে গ্রামটাকে। ফেরার পথে সেই ঝোপের পাখিগুলোকে চোখে পড়লো আবারও, মহাব্যস্ত তারা। গ্রামবাসীরাও বেরিয়ে এসেছে তাদের ঝুড়ি-কাস্তে হাতে। খানিকটা দূরে তাদের জুম্ম চাষের ক্ষেত। আমাদের ফিরতে দেখে কলস্বরে কিছু একটা বললেন তাঁরা, ভাষার প্রাচীর ডিঙিয়ে সে বক্তব্য আমাদের মর্মে পৌঁছুলো না। তবে আমাদের সহাস্য নমস্কার তাঁরা একই উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন। ফেরার পথে ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলাম। আমার ক্যামেরায় গেঁথে রইলো গ্রামবাসীদের ঘর, হ্রদ আর আকাশের মাঝে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম, পাহাড়ের ঢালে পিঠে বোঝাভর্তি ঝুড়ি নিয়ে ত্রিপুরা রমণী ---। ক্ষেতে সেচের জন্যে বাঁশের পাইপে চালিত পরিষ্কার মিষ্টি পানি পেটভরে খেয়ে হেলেদুলে আমরা যখন আবার কারবারির কুটিরে ফিরে এলাম, তখন বেলা পৌনে দশটা বাজে। গ্রাম ছেড়ে বেরোনোর আগে গত রাতের উদ্বৃত্ত ডালভাতমুরগি দিয়ে যতটা সম্ভব পেট বোঝাই করে খেয়ে নিলাম সবাই। জিনিসপত্র গোছগাছ করার সময় দেখি, উচ্ছল ভাই আমাদের গৃহকত্রর্ীর কাছ থেকে একটা শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো ফ্লাস্ক কিনে নিয়েছেন, সেটা তাঁর পিঠ থেকে ঝুলছে বাঁদরশিশুর মতো। সব কিছু বেঁধেছেঁদে, কারবারির পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই, সাড়ে দশটা বেজে গেছে ততক্ষণে। দিন এখন প্রাপ্তবয়স্ক। পাড়া ছেড়ে যাবার আগে সেনাছাউনিতে রিপোর্ট করে যেতে হবে। আস্কন্দিত গতিতে সেদিকে হাঁটা শুরু করলাম, ক্যাম্পের প্রবেশপথ আমাদের পথেই পড়বে। যথারীতি দলের ফ্রন্টে সেই পাঁচজন এগিয়ে --- উচ্ছল ভাই, মিলন ভাই, চঞ্চল, সৈকত আর সালেহীন। পুতুল আপা একটু পিছিয়ে পড়েছেন, দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে আমার আর পুতুল আপারই হাঁটা শ্লথ হয়ে গেছে, তবে আমি বরাবরই শ্লথ, কিন্তু পুতুল আপা দুর্দান্ত হাঁটারু। বেশিদূর যেতে হলো না, গ্রামবাসী আগেই খবর পৌঁছে দিয়েছিলো ক্যাম্পে, সান্ত্রীকে দুয়েক কথায় সব বুঝিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, সে শুধু আমাদের মাথা গুণে রাখলো। যাত্রার আগে ক্যাম্পের ক্যান্টিনে চা খাওয়ার একটা প্রস্তাব উঠেছিলো, কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে গটগটিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। সেনা ছাউনির চারপাশে সতর্ক প্রহরায় দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সৈনিকেরা গম্ভীর মুখে আমাদের খুঁটিয়ে দেখলো, কিছু বললো না। সেনা ছাউনির সৌজন্যে পথ এখন প্রশস্ত, কখনো চড়াই কখনো উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে নীল আকাশের নিচে। পুকুরপাড়ার কারবারি জানিয়েছেন, একটু জোর পায়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটলে বড়থলি নামের একটা ত্রিপুরা জনপদে পৌঁছুবো আমরা। সেখান থেকে আরো ঘন্টা দুয়েক হাঁটলে প্রাংশা নামের আরেকটা ত্রিপুরা গ্রামে পৌঁছে খাওয়াদাওয়া করা যেতে পারে। সেই প্রাংশা থেকে ঘন্টা তিনেক হাঁটলে রুমাবাজারে পৌঁছে যাবো আমরা। খুব একটা আশাপ্রদ সংবাদ নয় এটি, বিশেষ করে পাহাড়িদের ঘন্টাকে বাঙালি ঘন্টায় রূপান্তরিত করতে হলে যখন সাড়ে তিন দিয়ে গুণ করতে হয়। মংক্ষিয়াদা জানিয়েছেন, সন্ধ্যের মধ্যে প্রাংশায় পৌঁছুতে পারলেই আজকের দিনের জন্যে যথেষ্ঠ অগ্রগতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে। কাজেই আমাদের চলার লক্ষ্য হচ্ছে প্রাংশা, ভায়া বড়থলি। বড়থলিতে হাট আছে, সেনাছাউনি আছে, সেখানে কিঞ্চিৎ জলযোগ করা যেতে পারে। সেনাসদস্যদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যে পথ তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে, যার ফলে পাহাড়ের প্রান্ত ধরে গুটিগুটি পায়ে এগোনোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। রোদ খানিকটা চড়ে গেছে, বেশ জোর পায়ে হাঁটতে লাগলাম। বরুণদা, শাহেদ ভাই, পুতুল আপা আর মংক্ষিয়াদা আমার পেছনে। ঢালু পথে গতি আপনাআপনি বেড়ে যায়, কিন্তু পায়ের গোড়ালি আর তালুতে ফোস্কা পড়ে গেছে বলে নামার সময় একটু লাগছে। চোখ কান বুঁজে কয়েকটা ঢাল টপকে নেমে দেখি, পথের মোড়ে একটা টংঘর, তার পাশে খড়ের গাদা, সেখানে নবাবের মতো আধশোয়া হয়ে দলের অগ্রার্ধ, যেন তাকিয়ায় শুয়ে বাঈজীর নাচ দেখছে জমিদার, জমিতেই যখন আশ্রয় নেয়া তখন কিছুটা জমিদারি করে নেয়াই শ্রেয়। তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গিয়ে তাদের পাশে বসলাম ধপ করে। রোদ আজ বেশ চড়া, খানিকটা হেঁটেই পিপাসা পেয়ে গেছে। পানির বোতলটা বের করে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে সৈকতের সাথে কিছুক্ষণ গুলতানি মারলাম, কারণ বাকিরা এর মধ্যে আবার উঠে হাঁটা শুরু করেছে। দলের মধ্যে আমি, সৈকত আর সালেহীনই ছাত্র, আমার ছাত্রত্ব চুকিয়ে দেবার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে এক হপ্তা আগে, সালেহীনের পরীক্ষাও শেষ, আর সৈকতের পরীক্ষা মাসখানেক ধরে চলছে, ঈদ উপলক্ষে লম্বাচওড়া ছুটি পেয়েছে বলেই বেরিয়ে পড়েছে সে। সৈকত মৃত্তিকাবিজ্ঞানের ছাত্র, সমপ্রতি ঠেসে অণুজীববিদ্যা পড়তে হচ্ছে বেচারাকে। সদ্যলব্ধ জ্ঞানের আলোকে সে জানালো, এবার প্রচুর ধূলোবালি ছানাছানি করতে হচ্ছে আমাদের, ঢাকায় গিয়েই কষে কৃমির ঔষধ খেতে হবে। মাটিতে যেসব জীবাণু রয়েছে, বিশ মিনিট সাবান পানিতে হাত ধুলে নাকি তার পঞ্চাশ শতাংশ দূর হয়, কাজেই আমাদের কপালে কঠিন খারাবি আছে। জীবাণুশঙ্কিত মন নিয়ে আবার উঠে পড়লাম, দলের পেছনের অংশ বেশ জোর পায়ে এগিয়ে আসছেন। আজ আমরা চলছি একেবারে ঊষর প্রান্ত দিয়ে, যতদূর চোখ যায়, গাছপালা খুব একটা নেই, লালচে পাহাড়ের সারি চারদিকে, মাঝে মাঝে কয়েকটা বিবাগী গাছ চোখে পড়ছে। আকাশে এক চিলতে মেঘেরও দেখা নেই, চারদিকে ঝকঝকে রোদ, এমন নির্মেঘ আকাশ ঢাকায় চোখে পড়ে না। তবে আকাশের এই সৌন্দর্য উপভোগের মাশুল দিতে হচ্ছে রোদে ভাজাভাজা হয়ে। চলতে চলতে একসময় প্রশস্ত পথ ফুরিয়ে এলো, হঠাৎ এক গিরিসঙ্কটে ঢুকে পড়লো সেটা। পাথরের শঙ্খপাক সিঁড়ি বেয়ে একটা ছড়ার ওপর নেমে এলাম, বিচিত্র আকার ও আকৃতির সব পাথর ছড়িয়ে আছে সেখানে। পানির বোতল হালকা হয়ে এসেছে, সেটাকে ভর্তি করে নেয়ার পাশাপাশি মুখেও একটু পানি ছিটানো গেলো। ছড়ার পানি সবসময় বরফশীতল, অদ্ভুত এক সঞ্জীবনী শক্তি আছে এর। মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও এগিয়ে চললাম আমরা। নিস্ফলা মাঠের ভেতর দিয়ে চলছি, চারদিকে পাহাড়ের প্রহরা, মাঝখানে এক ধু ধু মাঠ, পথটা এগিয়ে গেছে দূরের পাহাড়ের দিকে। সেই পাহাড়ের গোড়ায় এসে আবার ক্যামেরা বার করলাম, এই রুক্ষ দেশে মাথা উঁচু করে একা দাঁড়িয়ে এক বিদ্রোহী বৃক্ষ, তার স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। দলের অন্যেরা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে, তাদের পিছু পিছু এগিয়ে টের পেলাম, নতুন জ্বালাতন শুরু হয়েছে। খুব একটা খাড়া নয় এখানকার পাহাড়, কিন্তু পথের মাটি ভয়াবহ ঝুরঝুরে, পা বসতে চায় না, হড়হড়িয়ে পিছলে যায়। এদিকে চঞ্চল আমার দেরি দেখে একটা দড়ি ছুঁড়ে দিয়েছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে সেই বামন পাহাড় টপকে ওপরে উঠে মনটা দমে গেলো। সমতলের পালা শেষ, চোখের সামনে যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, পথ চলে গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চড়াই বেয়ে। আরো খানিকটা এগিয়ে একটা টংঘর পাওয়া গেলো, সেখানে দলের দুয়েকজন বসে, বাকিরা খানিক বিশ্রাম নিয়ে আরো এগিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে মংক্ষিয়াদার দেখা মিললো, তিনি জানালেন, শাহেদ ভাই আর পুতুল আপার এসে পড়বেন এক্ষুণি। ওঁদের জন্যে চকলেট রেখে আমি আবারও হাঁটা ধরলাম, পথ এবার শক্ত মাটির ধাপ ধরে এগিয়ে গেছে। আধঘন্টা হাঁটার পর পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলাম। পথের ওপর কয়েকটা গয়াল চরে বেড়াচ্ছে, আমাকে সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ঢাল বেয়ে তেঁড়েফুঁড়ে চলে গেলো সে। কেওকারাডঙে যাবার পথে বিশাল আকৃতির সব গয়াল দেখেছিলাম, পুকুরপাড়ার গয়ালগুলো অতটা বড়সড় নয়। স্বভাবে হিংস্র না হলেও গয়ালগুলো মাঝে মাঝে খামোকাই তেড়ে আসে, তাদের নিবৃত্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। বাঁশের ঝাড় চারপাশে, মিষ্টি একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আরো খানিকটা এগিয়ে একটা ছড়ার দেখা পাওয়া গেলো, সেই ছড়ার পাশে একটা পাথরে বসে আছেন বরুণদা, উচ্ছল ভাইয়ের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে সামনে কোথাও। আমি ব্যাগ নামিয়ে বসতে না বসতেই মংক্ষিয়াদা, শাহেদ ভাই আর পুতুল আপা চলে এলেন। মুখে একটু পানি ছিটিয়ে, আর খানিকটা পানিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে ছড়ার নড়বড়ে বোল্ডারগুলোর ওপর দিয়ে আবার এগিয়ে গেলাম সবাই। এটাই পথ। মিনিট বিশেক সেই ছড়া ধরে হেঁটে একটা গুঁড়ির সাঁকো পেরিয়ে আবার শক্ত পাহাড়ে পা দিলাম আমরা। আমি আর পুতুল আপা একটু পিছিয়ে পড়েছি, বাকিরা এগিয়ে গেছে খানিকটা। আরো আধঘন্টার মতো হেঁটে একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক টংঘরের দেখা মিললো, দূর থেকে দেখি, আমাদের দলের বাকিরা গুটগুট করে এগিয়ে চলছে ওটার দিকে। পথ এখন বেশ খাড়া, দ্রুত এগোনো মুশকিল হয়ে পড়েছে। সেই টংঘরে পৌঁছে একটা বড়সড় বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসলাম সবাই। টংঘরের চারদিকে পাহাড়ের ঢাল, অনেক অনেক দূরে ঝাপসা মেঘের মতো আরো পাহাড়ের শীর্ষ দেখা যাচ্ছে। দূরে দিগন্তের কাছে খানিকটা মেঘ, এ ছাড়া গোটা আকাশে নীলের রাজত্ব। ক্যামেরা বার করে কিছুক্ষণ টহল দিলাম আশেপাশে। পাহাড়ি এলাকায় বেশ খানিকটা পরপর, সাধারণত কিছুটা দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার পর এমন টংঘরের দেখা পাওয়া যায়। বাঁশ দিয়ে তৈরি এ ঘরগুলোতে স্রেফ বসবার জন্যে একটা পাটাতন, আর ওপরে একটা ছাউনি আছে। ছাউনির নিচে একটা মাচায় শুকনো লাউয়ের খোলে পানিও পাওয়া যায়। পাহাড়িরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে এই টংঘরে এসে বিশ্রাম নেন। যদি সাথে কোন উদ্বৃত্ত রসদ থাকে, এই ঘরে রেখে যান পরবর্তী আশ্রয়সন্ধানী পথিকের জন্যে। পাহাড়ের অধিবাসীরা আমাদের বিচারে হয়তো দরিদ্র, কিন্তু মানসিকতায় আমাদের চেয়ে অনেক উদার। অন্যের জন্যে এই মমত্ববোধ না থাকলে এই রুক্ষ পরিবেশে মানুষ টিকতে পারবে না। টংঘরের চারপাশে বুনো টক ফল ধরে আছে। আমার শৈশব কেটেছে সিলেটে, সেখানে এই ফলের ছড়াছড়ি, টক তরকারি রান্নায় বেশ জনপ্রিয়, চুকর নামেই চিনি এটাকে। কাঁটাওয়ালা গাছে শ'য়ে শ'য়ে ফল ধরে আছে, মংক্ষিয়াদা অনেকগুলো ফল পেড়ে নিলেন, রাতে ডালের সাথে রান্না করবেন। আমরাও হাত বোঝাই করে পেড়ে আনলাম, যতক্ষণ বসে আছি, ততক্ষণ একটা কিছু মুখে দেয়া যাবে। ভিটামিন সি-এর উৎস ধারে কাছে আর কিছু নেই। টংঘরে মিনিট পনেরো বসে সবাই আবার উঠে পড়লাম। অন্যদের তুলনায় আমি আর পুতুল আপা পিছিয়ে পড়েছি। চলতে চলতে পথের দু'পাশে ভিড় করে থাকা সেই চুকর ঝোপ থেকে ফল পাড়তে পাড়তে চললাম। বালুময় এই পথ ধরে এগিয়ে পাহাড়টা ডিঙিয়ে যাবার পর দলের আর কারো দেখা পেলাম না। আমি আর পুতুল আপা ধীরেসুস্থে পাহাড় বেয়ে নামছি। চলতে চলতে পুতুল আপা প্রতিজ্ঞা করলেন, ঢাকায় ফিরেই এবার কোন জিমে ভর্তি হবেন তিনি, ঘরে বসে থেকে থেকে তাঁর পেশী অচল হয়ে পড়েছে। বাস্তবিক, ঠিক এক বছর আগে পর্যন্ত যখন এক্সপ্লোরারস' ক্লাবের সদস্যরা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকত অতিক্রম করেছেন, পুতুল আপা ছিলেন সবার আগে। আমি অবশ্য বরাবরই ফেল্টুশ, তাই আমার ততটা দুঃখ নেই। এরপর ঠিক কতক্ষণ হেঁটেছি, ঠিক মনে নেই আমার, তবে দলের আর কারো দেখা মেলেনি। তিন পাহাড়ির একটা দলের দেখা মিললো, তারা পথের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সামনে আদা ভর্তি ঝুড়ি। কিছুক্ষণ আলাপ করা গেলো, বাংলা বেশ বোঝে তারা। জানতে পারলাম, সামনেই বড়থুলি, দশ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে। খানিকটা উল্লসিত হয়ে উঠলাম, যাক, তাহলে আরো পঁয়ত্রিশ মিনিট হাঁটলে বড়থুলির দেখা মিলবে। পাহাড়িদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। সূর্য মাথার ওপর থেকে ঢলে পড়ছে ধীরে ধীরে, চারদিকে এখনও রোদ, কিন্তু আরো একটা পাহাড় ডিঙিয়ে যেতেই আবার গাছের ছায়াঢাকা পথ পাওয়া গেলো। পথ ধরে এগিয়ে একটা ছড়ার সামনে একটু বিশ্রাম নিতে বসলাম। ছড়ার ওপর একটা নড়বড়ে চেহারার সাঁকো, তার দুপাশে থকথক করছে কাদা। মিনিট দুয়েক বসতে না বসতেই দেখি সেই পাহাড়িরা এসে পড়ছে, ক্ষিপ্র পায়ে হাঁটছে সকলে। আমাদের স্বচ্ছন্দ গতিতে অতিক্রম করে গেলো তারা, সাঁকোটা পার হতে পাঁচ সেকেন্ড সময়ও লাগলো না তাদের। কানের কাছে একটা পরিচিত ভনভন শব্দ শুনতেই আঁতকে উঠলাম, সর্বনাশ, মশা আছে না কি এখানে? কাল বিলম্ব না করে আবার পথ চলতে শুরু করলাম আমরা। খানিকটা পথ এগিয়ে এক গ্রামবাসীর দেখা মিললো, নমস্কার জানিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আমাদের দলের কাউকে দেখেছেন কি না। তিনি জানালেন, আমাদের দলের কয়েকজনের সাথে তাঁর দেখা হয়েছে, সামনের গ্রামের দিকে গিয়েছেন তাঁরা, মিনিট পনেরো আগে। আরো টুকটাক আলাপ করে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। এর পরের পাহাড়ের মাথায় উঠে চোখে পড়লো, সামনে বিসতৃত উপত্যকায় বেশ বড় একটা গ্রাম, অনেকগুলো কুটির। গ্রামের সামনে ছড়ার প্রস্থ অনেক, গভীরতাও যে কম নয়, বুঝতে পারলাম বুক পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে দেখে। আমাদের লোকজন কি তবে এখানেই এসে উঠলো না কি? আরো খানিকটা হেঁটে যখন সমতলে নামলাম, তখন বুঝলাম, এই ছড়া ডিঙিয়ে গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কোন ঘুরপথে গ্রামে যেতে হয়। কতগুলো ক্ষুদে বাচ্চা ছড়ার কিনারায় এসে জড়ো হয়েছে, বিশালকায় কয়েকটা শুয়োর নদীতে নেমে চকচক করে পানি খাচ্ছে, গ্রামের কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে চোখে পড়ছে না। সেই ছেলেপিলের দলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন পুতুল আপা, সব কয়টা ভোঁ দৌড় দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে কুটিরগুলোর দিকে ছুটে গেলো। মিনিট খানেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবান এক পুরুষ উদ্যত লাঠি হাতে বেরিয়ে এলেন, আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না, পিঠে রুকস্যাক দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন তিনি, হাত তুলে বামের পাহাড়সারির দিকে নির্দেশ করলেন। সেদিকে উঁচু নিচু ভাঙা পাথর বোঝাই, কোন পথ আছে কি না বোঝার উপায় নেই। তবে খানিক এগোতেই কয়েকটা পাথরের ওপর চকে আঁকা তীর চিহ্ন আর ঊঈই লেখা দেখে বোঝা গেলো, এদিকেই এগোতে হবে। পুতুল আপা সেই পথে এগিয়ে গেলেন, আমি ঘাসের ওপর ব্যাগ বিছিয়ে খানিকটা ঝিমিয়ে নিলাম। কানে আসছে দূরে শিশুর দঙ্গলের টুকরো টুকরো কথা, আর শূকরগুলোর পানি খাওয়ার শব্দ। মিনিট দশেক জিরিয়ে নিয়ে উঠে এগিয়ে গেলাম আমি। তীর চিহ্ন ধরে ঝোপজঙ্গলে ভরা পথ পেরিয়ে হঠাৎ পাড়ার আরেক অংশের দেখা মিললো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুটির, মাঝখানে বিভিন্ন বয়সের ছেলেপুলে ফুটবল খেলছে। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালো সবাই। বেজায় তৃষ্ণা পেয়েছে আমার, বোতলের পানি ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই, পুতুল আপার অবস্থাও তথৈবচ। এ পাড়ার সবাই বেশ ভালো বাংলা বোঝে, নমস্কারাদি শেষে আমাদের একটা কুটিরের বারান্দায় বসতে দিয়ে সেই লাউয়ের খোলে ভর্তি জল নিয়ে এলো এক কিশোর। তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেলো, আমাদের অগ্রবর্তী দল সামনে আর্মি ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছে। আরো জানা গেলো, এ গ্রামে একটা চার্চ আছে, চার্চ সংলগ্ন স্কুলও আছে, শিশুরা সেখানে লেখাপড়া করে। গ্রামের সবচেয়ে কৃতী বালকটিই আমাদের জল সরবরাহ করেছে, কাপ্তাই থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, হঠাৎ ডাক শুনে থামতে হলো। এক বৃদ্ধা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছেন। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, পরে বুঝলাম, আমাদের সাথে করমর্দনের জন্যেই তাঁর আগমন। বৃদ্ধা খৃষ্টান, চার্চের পাশের কুটির থাকেন, আমাদের সাথে আলাপ করে চরম প্রীত হয়েছেন তিনি। তাঁর করমর্দনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে বিদায় নিলাম আমরা। সূর্য ঢলে পড়েছে এক পাশে, দূরে রোদের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে পাহাড় সারি। চার: যথার্থ যাত্রী কিন্তু শুধু তারাই যথার্থ যাত্রী, যারা চ'লে যায় কেবল যাবারই জন্য, হালকা মন, বেলুনের মতো, নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়, কেন, তা জানে না, শুধু 'চলো, চলো' বলে অবিরত। শার্ল বোদল্যের তাঁর এই কবিতাটি মাক্সিম দ্যু কাঁ-কে উৎসর্গ করেছিলেন। আর ক'টা দিন বাঁচলে ECB সদস্যদের উৎসর্গ করে দিয়ে যেতেন এই চরণ চারখানা। অ্যাকেবারে আমাদের দশা দেখেই যেন লিখে গিয়েছেন বেচারা। তাঁর এই যথার্থ যাত্রী তো আমরাই, এই এক্সপ্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের পুকুরপাড়া অভিযানের পোড়াকপালিয়ার দল! বোঝেননি তো? মন দিয়ে তাহলে বাকিটা পড়ুন। গ্রামের পাশেই এক পাহাড়ের ঢালে সেনাছাউনি। ক্যাম্পে ঢুকে দেখলাম, ECB সদস্যরা সেনাদের সাথে বেশ জমিয়ে ফেলেছেন, চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাঁদের। সৈনিকরা জঙলা ছোপধরা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে আছেন, বেশ হাসিখুশি আমুদে ভাব তাদের মধ্যে। বালতিতে করে গরম পানি নিয়ে আসা হয়েছে চা বানানোর জন্যে, আর মুড়ি দিয়ে টা-য়ের কাজ চালানো হচ্ছে। মারদাঙ্গা এমন চরণের অভাব বোদল্যের-এর নেই, কিন্তু ওপরওয়ালা আমাদের প্রত্যেককে মোটে দু'টি করে দিয়েছেন, আমার ভাগের দু'টো আবার গড়পড়তার চেয়ে অধিক লিকলিকে। এই দুই শ্রীচরণ ভরসা করে অ্যাদ্দূর এসে টের পেলাম, ডান ঊরুর মাংসপেশী আসলে ঠিক কোথায় আছে। এতদিন বইপত্রেই তার নাম শুনে এসেছি, কিন্তু আর্মি ক্যাম্পে বসে যখন জুড়িয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে মনটাও প্রায় জুড়িয়ে এসেছে, তখন মারাত্মক এক মোচড় মেরে নিজের অবস্থা ও অবস্থান জানিয়ে দিলো ব্যাটা। মালিশ ছাড়া করার কিছু নেই, তারই ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চালিয়ে গেলাম। সেনাদের মধ্যে যিনি আমাদের আপ্যায়নের ভার নিয়েছেন, তিনি বেশ বিস্মিত আমাদের কাজকারবার দেখে। গরুমারা পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছি শুনে চোখ কপালে তুললেন তিনি, কারণ ঐ পথে নাকি তাঁরাও কেউ যাতায়াত করতে সাহস পান না। কেন আমরা খোদার খামাখা এখানে এসেছি, জানতে চাইলেন তিনি, দেশ দেখতে এসেছি শুনে ঠা ঠা করে হেসে ফেললেন তিনি, তাঁর সহকর্মীরাও দেখলাম খুব আমোদিত হলেন এই উত্তর শুনে। দেড় বছর ধরে এখানে আছেন তাঁরা, এখন প্রহর গুণছেন আর সূরা ইয়াসিন জপছেন, কবে এখান থেকে বিদায় নেবেন। এখানে সবকিছুই ভালো, তবে মশা আর শীত বাদ দিয়ে। মশার সীজনে লাখে লাখে মশা ছেয়ে থাকে চারদিকে, আর এই শীতে সূর্য ডুবতে না ডুবতেই এমন বিশ্রী ঠান্ডা পড়ে যে রাতে একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করে সময় কাটাতে হয়। সামনে পথের কথা জিজ্ঞেস করতে আরো একবার হেসে ফেললেন তিনি। আমরা নাকি নিজের চোখেই দেখতে পাবো, পথ কেমন। প্রাংশা পর্যন্ত পথ মন্দ নয়, কিন্তু প্রাংশা পেরিয়ে রুমাবাজারে যাবার পথে ময়না পাহাড় বলে এক বস্তু রয়েছে, সেটা পার হতে গিয়ে নাকি সৈনিকরাও মাথা ঘুরে পড়ে যায়, দোয়াদরূদ জপতে জপতে সেই পথ চলে তারা। প্রাংশা পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বললেন, সামনের বিশাল পাহাড়টা পার হতেই আমাদের ঘন্টা তিনেক লাগবে। তারপর ছড়ার মধ্যে দিয়ে আরো বিরাট পথ পাড়ি দিতে হবে। তখন বাজে প্রায় পাঁচটা, রাত দশটার আগে কোনভাবেই প্রাংশায় পৌঁছোনো সম্ভব না। আঁধার ঘনিয়ে আসবে আধ ঘন্টার মধ্যে, বাকিটুকু পথ পাড়ি দিতে হবে সেই আঁধারেই। পেটে দানাপানি পড়ায় বেশ চাঙা লাগছিলো, তাই দমলাম না। প্রাংশা পর্যন্ত পথ যখন ভালো, গরুমারা পাহাড়ের মতো কিছু যখন নেই, তখন রাতের আঁধারে চলতেও আপত্তি নেই আমাদের। চাঁদ আছে, তাছাড়া মুশকিলাসান টর্চ তো আছেই, আমি কী ডরাই সখি ভিখিরি আঁধারে? আরো মিনিট পাঁচেক বসে একে একে উঠে পড়লাম সকলে। সেনারা হাসিমুখে বিদায় জানালেন আমাদের, তবে ঢাকায় ফিরে অন্য কোন দলকে এ পথে পাঠাবার কোন ফিকির যাতে না করি, সে পরামর্শও দিলেন। এদিকে পরিস্থিতি নাকি ভালো না, কখন কী ঘটে, কিচ্ছু বলা যায় না। পান্তভূতের জ্যান্ত ছানার মতো আহ্লাদে ধুপধুপিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বড়থলির পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম আমরা। পথ এখানে খাড়া, কিন্তু অনেক প্রশস্ত, আর ঝুরঝুরে কাঁকরে ভর্তি, পায়ের নিচে প্রতিটি মূহুর্তে নিঃশব্দে চূর্ণ হচ্ছে তারা। যথারীতি খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি আমি, আমারও খানিক পেছনে পুতুল আপা, আর তাঁর সাথে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা। বড়থলির পাহাড় গরুমারা পাহাড়ের মতোই বিশাল, ঘন গাছপালায় ঢাকা। সূর্য আর আকাশে নেই, গোধূলির আলোয় লালচে মাটির পথে হেঁটে চলছি আমরা। পাহাড়ের প্রথম ধাপটা টপকে নামার পথে একটা ছোট্ট ছড়া পড়লো, সেখানে দেখি, কয়েকজন গ্রামবাসী বিশ্রাম নিচ্ছেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই আছে দলে। তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেলো, সকাল ন'টায় রুমা থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তারা, আর এখন বাজে পাঁচটার ওপরে, এরই মধ্যে বড়থলিতে পৌঁছে গেছে সবাই। আমরা প্রাংশার দিকে যাচ্ছি শুনে তারা পথ বলে দিলেন, পাহাড় ডিঙিয়ে ছড়া ধরে এগোলেই প্রাংশায় যাবার সোজা রাস্তা। ঢাল বেয়ে খানিকটা নেমে এবার ঝুরঝুরে মাটির বদলে শক্ত ভেজা ভেজা পাথুরে পথে পা পড়লো আমার। ইতিমধ্যে শাহেদ ভাই টপ গীয়ারে পা চালিয়ে আমাকে পেরিয়ে গেছেন, পুতুল আপা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন বলে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদাও চোখের আড়ালে, গোটা পাহাড়ে আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে দলের আর কেউ নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে পথ। দু'পাশে এতো ঘন ঝোপঝাড় যে দু'মিনিট হাঁটার পর পেছনে ফিরে তাকালে আর কোন কিছু চোখে পড়ে না, না ফেলে আসা পথ, না দিগন্ত। যদিও এ আলোয় চলতে এখনও সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু শিগগীরই যে হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ধাপে ধাপে পথ উঠে গেছে ওপরে, আর আমি উঠছি তো উঠছিই। ক্যাম্প ছেড়ে আসার প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে, কয়েকবার হাঁক ছেড়ে সামনের দলের লোকজনকে ডাকলাম, সাড়া না পেয়ে পেছনের দলের লোকজনকেও ডেকে দেখলাম, অবস্থা তথৈবচ। একসময় ওপরে ওঠার পালা শেষ হলো, পথ খানিকটা সমতল ধরে এগিয়ে গেছে। এখানে পথ আবার কিছুটা সরু ও পিচ্ছিল, পথের ডান পাশে গভীর খাদ, তবে খাদের ঢালে বিশাল সব বাঁশের ঝাড়, খাদে কেউ চাইলেও পড়তে পারবে না। মাথার ওপর বাঁশ ঝাড় আর অন্যান্য গাছের ক্যানোপি, তবুও ফাঁক গলে নরম আলো এসে পড়ছে মাটিতে, বোঝা যাচ্ছে বেশ, চাঁদ উঠে গেছে। আরো মিনিট পনেরো হেঁটে এক অসাধারণ পথ পাওয়া গেলো, তার দুপাশেই পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে, যতদূর চোখ যায় ঘন বাঁশঝাড়, আর আকাশে ভাসছে চমৎকার চাঁদ। বাঁশের ডগা আর পাতা দুলছে বাতাসে, পথের ওপর কেঁপে কেঁপে উঠছে ছায়ারা। চারদিক অন্ধকার, হঠাৎ সরসর শব্দ উঠছে ঝোপে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে দূরে কোথাও। মুগ্ধ হয়ে হাঁটছিলাম, পাড়া কাঁপিয়ে একটা গজলেও টান দিয়েছিলাম, ম্যায় নজর সে পি রাহা হুঁ, ইয়ে সামা বদল না যায়ে --- কিন্তু বাস্তবে ফিরে এলাম গাছের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যেতেই। আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছি, ধাপে ধাপে পথ উঠে গেছে পাহাড়ের বহু ওপরে। বেশ জেঁকে ঠান্ডা পড়ে গেছে, আর পথ এখন নিরেট আঁধারে, জ্যাকেট আর টর্চ ছাড়া গতি নেই। পেছন ফিরে একটা বড় হাঁক ছাড়লাম, 'পুতুল আপা! বরূণদা! মংক্ষিয়াদা!' কোন সাড়া নেই। পাহাড়িদের ঢঙে কুউউউ দিলাম, কিন্তু কোন কিইইই ভেসে এলো না। কী আর করা, একটা ধাপের ওপর পা ছড়িয়ে বসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বার করে নিলাম যা কিছু লাগে। একটা চকলেটও পাওয়া গেলো এক পকেটে, পানির বোতলটাও বার করে নিলাম, এতক্ষণ হাঁটার পর বসে থেকে কিছুক্ষণ কুটকুট করে চিবানো যাবে। চকলেটে দুয়েকটা কামড় দেয়ার পর দেখলাম, সত্যিই কুটকুট করে শব্দ হচ্ছে, এবং বেশ জোরে, এবং শব্দটা আসছে আশপাশ থেকে। ঘাবড়ে গিয়ে টর্চের আলো ফেললাম, কিছু চোখে পড়লো না। আলো নিবিয়ে আবার চকলেটে দাঁত বসিয়েছি, তখন পাশের ঝোপে বিকট ধস্তাধস্তির শব্দ পেলাম, শব্দটা আমার কাছ থেকে শুরু হয়ে দূরে চলে গেলো --- আর তারপরই বহুদূরে শোনা গেলো মানুষের প্রলম্বিত কান্নার মতো একটা শব্দ। এতক্ষণ অন্য কোন চিন্তা মাথায় ঢোকেনি, এই জংলি জলসা শুরু হতেই শাহেদ ভাইয়ের সাবধানবাণী মনে পড়লো, এখানে নাকি প্রচুর শেয়াল আছে। অনেক বছর আগে এক টিলার গর্তের মুখে একবার ভুঁড়ো শেয়ালের ধমক খেয়েছিলাম, সিলেটে, সেই আতঙ্ক আমার এখনও কাটেনি, চকলেটটা কোনমতে মুখে ভরে পানির বোতল হাতে নিয়ে দিলাম এক ছুট। ধাপ কাটা আছে পথের ওপর, তাই বেশ দ্রুত পার হয়ে এলাম অংশটা, কিন্তু পাহাড় থেকে নামার পথ খুব একটা সুবিধের নয়। একহাতে লাঠি আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে অতি সন্তর্পণে সেই সরু, খোঁচা খোঁচা পাথরে ভরা পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে একটা হাঁক ছাড়লাম, 'চঞ্চল! শাহেদ ভাই!' আমার ডাকের প্রতিধ্বনি ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। বহুদূর থেকে যেন উত্তর এলো, 'হিমু! আসেন তাড়াতাড়ি!' শাহেদ ভাইয়ের স্বর। আমি এবার আরো বুলন্দ গলায় হাঁক ছাড়লাম, শৃগালাশঙ্কা কাটেনি আমার, 'দাঁড়ান একটু, আমি আসি!' জবাব এলো, 'জলদি আসেন!' এবার এগোতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির, পথ চলে গেছে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে, যত্রতত্র গাছের শিকড় বেরিয়ে আছে বলে রক্ষা। একবার তো পা পিছলে পড়ছিলাম গড়গড়িয়ে, লাঠিটার কল্যাণে টাল সামলে নিতে পেরেছি। মিনিট দশেক হাঁচড়ে পাঁচড়ে কখনো পাথর কখনো শিকড় আঁকড়ে শেষ পর্যন্ত নেমে এলাম পাহাড় থেকে, একটা ছড়ার পাশে। কুলকুল করে বয়ে চলছে পানি, স্বল্প পরিসরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে চঞ্চল, সালেহীন, সৈকত, মিলন ভাই আর শাহেদ ভাই। মিলন ভাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, বেচারার দুই পা গতকালই টান খেয়ে বসেছে, তার ওপর আবার এই ধকল। শাহেদ ভাই জানতে চাইলেন, বাকিরা কোথায়। পুতুল আপা, মংক্ষিয়াদা আর বরূণদা বেশ খানিকটা পিছিয়ে, জানালাম আমি, কারণ শেষবার ডেকে ওঁদের কোন সাড়া পাইনি। সিদ্ধান্ত হলো, পুতুল আপারা এসে না পৌঁছুনো পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকবো। শাহেদ ভাইয়েরা এখানে মিনিট বিশেক হলো বসে আছেন। সৈকত তার বকের মতো ঠ্যাং ফেলে এগিয়ে ছিলো সবার চেয়ে, সবার আগে সে-ই এসে পৌঁছেছে, কিন্তু অন্ধকার পড়ে যাবার পর আর বেশি এগোতে সাহস করেনি সে, বিশ মিনিট চুপচাপ বসে অপেক্ষা করার পর বাকিদের সাথে তার মুলাকাৎ হয়েছে। ব্যাগটা খুলে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসতে না বসতেই শীত করতে শুরু করলো। এতক্ষণ পথ চলেছি, শরীর গরম ছিলো, কিন্তু গায়ের ঘাম এখন শুকোতে শুরু করেছে, আর প্রবল ঠান্ডা শরীরে কামড় দেয়া শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাদের ক্যাম্পের চেহারাটা ভালো করে দেখে নিলাম। বাঁয়ে পাহাড়ের ফাঁকে চলে গেছে জলের ধারা, ডানে আবছা চাঁদের আলোয় যতদূর চোখে পড়ে, বড় বড় বোল্ডার পড়ে আছে ছড়ার ওপর। আমাদের পেছনে আর সামনে খাড়া দেয়ালের মতো বিশাল পাহাড় নরকের প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ, একটা গভীর করিডোরের মেঝেতে আমরা বসে, এবং একটু পর পর হাড় কাঁপানো বাতাস এসে ধাক্কা মারছে আমাদের। সবাই যৌথভাবে মিনিট দশেক উসখুস করার পর চঞ্চল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, তারপর ছোটখাটো ডালপালা কুড়োনো শুরু করলো, বুঝলাম, আগুন জ্বালাবে সে। বাস্তবিক, আগুন ছাড়া এই ঠান্ডায় টেকা দায়, তাছাড়া চঞ্চলটা মহা অগ্ন্যুৎস্পৃহ, ম্লেচ্ছ ভাষায় যাকে বলে পাইরোম্যানিয়াক, সুযোগ পেলেই আগুন জ্বালিয়ে বসে, আগেও দেখেছি। দেখতে না দেখতে একগাদা কাঠিকুটো জড়ো করে একটা ছোটখাটো আগুন ধরিয়ে বসলো সে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করলো, বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় মোটামুটি এমন --- পাঁচ মিনিটের মধ্যে পঞ্চাশ মণ লাকড়ি নিয়ে আসো, নাহলে ---! চঞ্চলের সাথে লাকড়ি নিয়ে তর্কাতর্কি করতে যাওয়া বিপজ্জনক, তাই চুপচাপ আমি আর সালেহীন শুকনো কাঠ খুঁজে জড়ো করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের আরো কয়েকটা জিভ লকলকিয়ে বেড়ে উঠলো, আমাদের চারপাশে মোলায়েম জ্যোৎস্নার বোনা ছায়ার নকশা তার উদ্বাহু নৃত্যের তোড়ে হারিয়ে ফুরিয়ে গেলো। আধ ঘন্টা চুপচাপ কেটে গেলো, মিলন ভাই পাহাড়ে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, সৈকতের অবস্থাও খুব একটা সুবিধের নয়, শাহেদ ভাই একটু পর পর উঠে গিয়ে টর্চ ফেলে দেখছেন, পুতুল আপারা এসে পৌঁছুলেন কি না, চঞ্চল বসে বসে আগুনের কুন্ডটাকে ছহিহ্ তরিকাতে খোঁচাচ্ছে, যাতে সেটা চাঙা থাকে, আমি আর সালেহীন কাঠ কুড়োচ্ছি রূপকথার ওয়াসিলিসার মতো। কী কুক্ষণে একবার চঞ্চলকে একটা টীপি তৈরি করতে বলেছিলাম, যাতে আগুনটা সময় নিয়ে জ্বলতে পারে, একটা জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ হাতে নিয়ে ততোধিক জ্বলন্ত চোখ করে আমাকে বিরাট একটা নিঃশব্দ ধমক দিলো সে, আমি আঁতকে উঠে আবার টোকাইবৃত্তিতে মন দিলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আশপাশে পড়ে থাকা প্রতিটি কাঠের টুকরোকে এই যজ্ঞে আহুতি দিলাম আমরা, আধপোড়া কাঠ আর ছাইয়ের একটা সম্মানজনক স্তুপ তৈরি হলো সেই ছড়ার পাশে। কিন্তু আগুনটাকে জিইয়ে রাখার জন্যে আরো কাঠ দরকার, আর আগুন নিভে গেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জমে যাবো আমরা। শাহেদ ভাই ততোক্ষণে টর্চ হাতে নিয়ে আবার ওপরে উঠে গেছেন, বরুণদা-পুতুল আপা-মংক্ষিয়াদার খোঁজ নিতে। আর এদিকে শুকনো কাঠ ফুরিয়ে যাওয়ায় ছড়ার পানিতে পড়ে থাকা মোটা মোটা ভেজা ছাতাপড়া ডাল তুলে এনেছি আমরা, শেষ কাঠের টুকরোগুলোকে গ্রাস করে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর রেখে সেঁকা হচ্ছে সেগুলোকে, ভেজা ভেজা ভাবটা একটু কমলেই আগুনে গুঁজে দেয়া হবে। চঞ্চল এতেও সন্তুষ্ট নয়, ফের পাহাড়ের ওপর চড়ে ঝোপঝাড় থেকে পাতাসহ একগাদা ডাল ভেঙে নিয়ে এসেছে। সেই শিশিরে ভেজা ডালপালাও সে আগুনে গুঁজে দিতে চায়। আগুন আর ধোঁয়া নিয়ে আমরা যখন কিছুটা বিব্রত, তখন ওপর থেকে মানুষের গলা ভেসে এলো। মিনিট খানেকের মধ্যে এক বিশাল দুঃসংবাদও ভেসে এলো --- পুতুল আপার পা ভেঙে গেছে! আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়লো। এই জঙ্গলের মধ্যে এখন কীভাবে চিকিৎসা করা যায়? ন্যূনতম চিকিৎসাটুকু পেতে হলেও আমাদের রুমা পৌঁছুতে হবে। সামনে পথ কেমন, মংক্ষিয়াদা জানেন না, কারণ তিনি আগে কখনো এ পথে আসেননি। সামনে আদৌ পথ আছে কি না, তা-ও বোঝার উপায় নেই, কারণ টর্চের আলো আর আগুনের তেজে যতদূর চোখ যায়, চড়ায় পানির মৃদু স্রোতের মাঝে জেগে থাকা অতিকায় সব বোল্ডার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। সুস্থ পা নিয়েই এ পথে চলা মুশকিল, আর ভাঙা পা নিয়ে পুতুল আপা কিভাবে এগোবেন এ পথে? পুতুল আপাকে ধরে ধরে বরুণদা আর শাহেদ ভাই যখন নামলেন, তখন আমরা জানলাম, ভাঙেনি, কিন্তু পুতুল আপার পা মারাত্নকভাবে মচকে গেছে। তা-ও মচকে গেছে একেবারে এই ছড়ার কাছে এসে, তীরে এসে তরী ডোবা আর কাকে বলে? পুতুল আপা স্যান্ডেল খুলে ছড়ার হিমশীতল পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলেন কিছুক্ষণ, ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপছেন বেচারি। কিন্তু বাকিটা পথ হেঁটে যেতে পারবেন, শুরুতেই বাকিদের আশ্বস্ত করলেন তিনি। দুটো ব্যথানাশক ট্যাবলেট আর ব্যথাবিমোচক মলম তাঁকে সরবরাহ করা হলো তৎক্ষণাৎ, তারপর আগুনের পাশে আধঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দেয়া হলো। পুতুল আপা অবশ্য বেশিক্ষণ বসতে চাইলেন না, বসে থাকলেই ব্যথাটা তাঁকে কাবু করে ফেলবে, জানালেন তিনি। কাজেই দশ মিনিটের মধ্যেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবারো পা বাড়ালাম আমরা, অজানা, অনিশ্চিত পথে। পুতুল আপার পা-ই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, তাঁর টর্চটিও আঘাত পেয়ে বিকল হয়ে গেছে। ফুরিয়ে গেছে সৈকত আর উচ্ছল ভাইয়ের টর্চের ব্যাটারী। আমাদের দশজনের দলে কর্মক্ষম টর্চ তখন চারটা বা পাঁচটা, তাই এক টর্চের আলোয় দু'জনকে পথ চলতে হচ্ছে। কিন্তু পথের যা দশা, তাতে প্রত্যেকের পায়ের সামনে টর্চের আলো না ফেললে কী ঘটে যায় তা বলা মুশকিল। পানির ওপর জেগে থাকা পাথরগুলোর ওপর পা ফেলে এগিয়ে যেতে হচ্ছে, পানিতে পা ভিজিয়ে চললে নির্ঘাত নিউমোনিয়া লাগবে, তাছাড়া পানিতে ডুবে থাকা পাথরগুলো সাংঘাতিক পিচ্ছিল হয়। ছড়ায় যুগ যুগ ধরে পানি বয়ে চলছে, তাতে ভিজে ভিজে পাথরগুলো শুধু পিচ্ছিলই হয়নি, তাদের তলা থেকে মাটি আর পাথর সরে যাওয়ায় তারা নড়বড়েও হয়ে পড়েছে। পাঠক বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কিন্তু এক একটা দু'টনী বোল্ডারও পায়ের চাপে নড়ে ওঠে ঢেঁকির মতো। সেই পিচ্ছিল, নড়বড়ে পাথরগুলোর ওপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। একজন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পেছনে আলো ফেলেন, সেই আলো অনুসরণ করে আরেকজন এগিয়ে আসেন, এমনি করেই চলছে গোটা দল। সবার পেছনে বরুণদা, শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা পুতুল আপাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন। সামনের ছ'জন কিছুদূর এগিয়ে আবার বসে পড়ছি হাতির পিঠের মতো উঁচু উঁচু বোল্ডারের ওপর, অপেক্ষা করছি কখন পেছনের চারজন আবার এগিয়ে এসে আবার মিলিত হবেন। আমাদের পথের ওপর কখনো আকাশের চাঁদ আলো ফেলছে, কখনো পথ ঢেকে যাচ্ছে দু'পাশের গাছপালার প্রসারিত বাহুর নিচে, কখনো বা মাথার ওপর বিপজ্জনকভাবে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা ঝুলন্ত পাথরের ব্যালকনি, চাঁদের আলোর সংসর্গ হারিয়ে গাঢ় আদিম অন্ধকার সেখানে সহাস্যে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মংক্ষিয়াদা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ছড়ার দু'পাশে আলো ফেলে দেখতে বলছেন, কোন পায়ে চলা পথ ছড়া থেকে উঠে গেছে কি না, কিন্তু ছড়ার দু'পাশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার শুধু ঘন বন, নিরেট পাথরের দেয়াল, অথবা ছড়ার আরো শীর্ণ, আরো অন্ধকার, আরো বিপজ্জনক কোন শাখা। শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে গোটা দল, প্রতিটি পা মেপে মেপে ফেলছে সবাই, বিপজ্জনক কোন পাথরে পা পড়লে উঁচু গলায় পেছনের অভিযাত্রীকে সতর্ক করে দিচ্ছে সামনের জন, বিপজ্জনক কোন স্থানে একজনের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে এগিয়ে আসছেন আরেকজন, তাঁর হাত আবার প্রসারিত হচ্ছে আরেকজনের দিকে --- আর দশ মিনিট পর পর থেমে অপেক্ষা করছে সবাই, ধীর গতিতে একটিমাত্র সচল পায়ে এগিয়ে আসা পুতুল আপা আর তাঁর সঙ্গী তিনজনের জন্যে। চারপাশে শুধু জলের নরম শব্দ আর তার প্রতিধ্বনি, বাতাসে বাঁশের পাতার সরসর শব্দ, আর নিজেদের নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ। এই অস্বস্তিকর কলতানকে মাঝে মাঝে লঘু করে তুলছে সদস্যদের সরস মন্তব্য। এই রাতটি শুধু যে অভিযাত্রীদের স্মরণসরণীতে চিরকালের পথিক হয়ে আছে, তা-ই নয়, ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বন্ধনের দার্ঢ্য আরেকমাত্রা বৃদ্ধি করেছে। এভাবে ঘন্টাখানেক চলার পর বিশাল এক বোল্ডারে বসলাম সবাই, পা দুটোকে যতটা সম্ভব শুকনো জায়গায় রেখে। কে যেন একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করলো, সবার মধ্যে উৎসবের আমেজ চলে এলো। এমন আগ্রহ করে কখনো কিছু খাইনি, অন্তত, বিস্কুট না। বিস্কুটের সাথে হেঁড়ে গলায় একটা গানও ধরলাম, আকাশে হেলান দিয়েয়েয়েয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ ---! কেউ কোন আপত্তি না করায় বুঝলাম, গানটা ততটা খারাপ লাগছে না এই পরিবেশে। নানা আসরে বেসুরো গলায় ভুলভাল গান গেয়ে জুতো ও সব্জি সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আমার আছে, কিন্তু পাঠকদের কানে কানে বলি, সে রাতে রাঙামাটির সেই গহীন গিরিখাতে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার মাঝে জেগে থাকা বোল্ডারে বসে গান গেয়ে পাঁচ সহযাত্রীর নীরব বাহ্বা আর মিলন ভাইয়ের এগিয়ে দেয়া একটা বিস্কুটই আমার সুদীর্ঘ শিল্পীজীবনের সেরা পুরস্কার। তবে এমনও হতে পারে যে, জোর গলায় প্রতিবাদ করা, বা জুতো ছুঁড়ে মারার উদ্যম কারো মধ্যেই অবশিষ্ট ছিলো না, সকলেই ভীষণ হেদিয়ে পড়েছিলো। আশপাশে তখন অনেক শেয়ালের রাত্রিকালীন হাঁকডাক ভেসে আসছিলো, সেগুলোর পাশাপাশি আমার সঙ্গীতকেও হয়তো তাঁরা খানিকটা সহ্য করে নিয়েছেন। আর মিলন ভাই হয়তো এই ভেবে বিস্কুটটা এগিয়ে দিয়েছেন যে, সেটা খেতে হলে আমাকে গান বন্ধ করে খেতে হবে। কে জানে? পুতুল আপাদের এগিয়ে আসার খবর পেয়ে আবারো পা চালিয়ে গেলাম আমরা। ছড়া একের পর এক মোড় নিচ্ছে, কিন্তু ছড়ার পাশে কোন পায়ে চলা পথের দেখা পাচ্ছি না আমরা। টর্চের ব্যাটারীও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে, চাঁদ মাথার ওপর থেকে হেলে পড়েছে খানিকটা, এখন প্রায় মধ্যরাত। সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হবে, যদি টর্চ বিকল হয়ে পড়ে। আরো আধঘন্টা হাঁটার পর সকলেই উল্লসিত চিৎকার করে উঠলো, পাওয়া গেছে, দুলহান মিল গ্যয়ি! টর্চের শীর্ণ রশ্মি আর চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে বেশ সুডৌল একটা পায়ে চলা পথ, ঢুকে পড়েছে ছড়ার বাঁদিকের জঙ্গলে। সেই পথে চঞ্চল খানিকটা ঢুকে এসে রিপোর্ট করলো, পথ সামনে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, কানাগলি নয়। পুতুল আপারা খানিকটা এগিয়ে আসার পর সেই পথে ধুপধাপ করে এগিয়ে চললাম সবাই। নড়বড়ে পাথরের ওপর দিয়ে পথ চলার পালা শেষ হলো, পায়ের নিচে টেরা ফির্মা (শক্ত মাটি। একটু ল্যাটিন কপচালাম, পাঠক ক্ষমা করবেন।)পাওয়া গেছে যখন, আর কিছুই পরোয়া করি না! কিন্তু সেই পথ যখন আবারও ঘুরে ফিরে সেই ছড়ার পাথরের ওপর ফিরে এলো, আমরা শিউরে উঠলাম। সর্বনাশ, গোলকধাঁধাঁয় ঘুরপাক খাচ্ছি নাকি সবাই? মিনিট দশেক সেই ছড়ায় চলার পর আমাদের আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে আবারও শুকনো পথের দেখা মিললো। সবাই সেই পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখি, পাহাড়ের ওপর ধাপে ধাপে উঠে গেছে সেই পথ। বিশ্বাস করুন, পাহাড়ে হাঁটার সুযোগ পেয়ে খুশিতে চোখে পানি চলে এলো। কেবলই মনে হতে লাগলো, আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম, সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ --- ইত্যাদি ইত্যাদি। পাহাড়ে আধঘন্টা চলার পর মোটামুটি খোলা একটা জায়গা পাওয়া গেলো, একটা গাছের অতিকায় শিকড়ের ওপর বসলাম সবাই, পেছনের দলের জন্যে অপেক্ষায় সবাই। খানিকটা ফুরসত পেয়ে এবার আবারও খোনা গলায় গুনগুন করে উঠলাম, আমার প্রাণের 'পরে চলে গ্যালো কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ---। কিন্তু এবার যেন আপত্তির একটা মৃদু গুঞ্জণ শোনা গেলো আশপাশ থেকে, আর মাঘ মাসের ভয়ঙ্কর হিম হাওয়াও হারেরেরে করে ছুটে এসে গায়ে ঝাপটা মেরে বুঝিয়ে দিলো, বসন্তের এখনো বহুত বাকি। ক্ষুণ্ণ মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সহস্র নক্ষত্রের দীপাবলী জ্বলছে সেখানে। এক বছর আগে, দার্জিলিং পাড়ায় এক সন্ধ্যেবেলা বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম চরিত্র, নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের কাছ থেকে নক্ষত্রপরিচয় সম্পর্কে কিছু সবক নিয়েছিলাম, এই অজস্র তারার ভিড় দেখে বুঝলাম, বেচারা নূর মোহাম্মদের পরিশ্রমটাই মাঠে মারা গিয়েছে। তারার কাটাকুটি দেখতে দেখতে ভারি অশালীন একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো, গুরুজনেরা যেহেতু একটু পিছিয়ে পড়েছেন, তাই উদাত্ত গলায় সেটি সহযাত্রীদের কাছে পেশ করলাম। হু হু ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া যদি এনে দেয়া যায়, তাতে ক্ষতি কী? অশালীন কৌতুকের গুণ হচ্ছে, একটা বলা শেষ হলেই আরেকটার কথা মনে পড়ে যায়। কাজেই দূরে মংক্ষিয়াদার গলার স্বর যখন শুনতে পেলাম, ততক্ষণে ডজনখানেক চুটকির প্রভাবে পরিবেশ উষ্ণ তো বটেই, রীতিমতো উত্তপ্ত! কিন্তু আবারও হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়লাম আমরা। সবার মাথায় তখন একই চিন্তা, কখন প্রাংশা গ্রামে পৌঁছুবো, কোন একটা কুটিরের মাদুরে শরীর লম্বা করে একটু শোবো। ক্ষিদের কথা সবাই ভুলে গেছি, খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেউ, এখন শুধু একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমকম্বলের নিচে শুয়ে দু'দণ্ড ঘুমোতে চায় সবাই। মিলন ভাই তো আরেকটু হলে গাছের শিকড়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়ছিলেন, আমার বদখাসলত কৌতুকের ঠ্যালায় উঠে পড়তে হয়েছে বেচারাকে। ছড়ার পাশের এই কলাগাছে ভরপুর পাহাড় থেকে যখন নিচে খানিকটা সমতলে নেমে এলাম আমরা, তখন দেখা গেলো নতুন বিপত্তি। তিন দিকে তিনটা পথ চলে গেছে, একই রকম চওড়া তিনটা পথ, আর সবক'টা পথই মিশে গেছে গাছপালার আড়ালে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখানে গ্রামগুলোতে রাতে কোন আগুন জ্বলে না, যে বাইনোকুলার বার করে দেখে নেবো। গ্রামের আশেপাশে পাহাড়ের চূড়োয় যেসব টংঘর আছে, সেগুলো রাতে চোখে পড়বে না। এই তিনটা পথের যে কোন একটা সঠিক, আর সঠিক পথে নূ্যনতম ক'মাইল পথ হাঁটলে গ্রামের দেখা মিলবে, তা-ও কেউ নিশ্চিতভাবে জানি না, কাজেই একবার যদি ভুল পথে এগিয়ে যাই, সারারাত হাঁটলেও প্রাংশা গ্রামের সন্ধান মিলবে না, আর হাঁটতে হাঁটতে কোন চুলোয় গিয়ে ঠেকবো কে জানে? এক মগের মুল্লুক থেকে অন্য মগের মুল্লুক, মানে বার্মায় পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। পুতুল আপার সাথে বরুণদা আর মংক্ষিয়াদা এসে পৌঁছেছেন, শাহেদ ভাই খানিকটা এগিয়ে এসেছিলেন আগেই, আমাদের হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে মংক্ষিয়াদা টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একটা পথের ওপর মিনিটখানেক আলো ফেলে কী যেন পরখ করে দেখলেন, তারপর বললেন, 'এটা জুম্মের রাস্তা।' এর উল্টোদিকের পথটা আরো সময় নিয়ে দেখলেন তিনি, তারপর জানালেন, এটা গ্রামের রাস্তা নয়। কাজেই নাকবরাবরের পথ ধরেই এগিয়ে চললাম আমরা। তিন পথের সঙ্গমস্থলে থকথক করছে কাদা, কয়েকটা বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে সেখানে, তার ওপর সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সবাই। আরো মিনিট দশেক হাঁটতেই এক অদ্ভুত প্রান্তরে এসে পৌঁছুলাম যেন। পেছনে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক পাহাড় যেন কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন বলছে সে, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম, আবার এদিকে পা বাড়াবি তো দেখিস ---! সামনে বাঁদিকে অনুচ্চ খাড়া দেয়ালের মতো পাহাড়ের সারি, ডান দিকেও তাই। আর এই দুই সারির মাঝে, যতদূর চোখ যায়, সমতলের বুক চিরে চলে গেছে একটা পায়ে চলা পথ, পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে চাঁদ, শুধু নক্ষত্রের রোদে চকচক করছে সেই সাদা রাস্তা। পথের গোড়াতেই একটা টংঘর চোখে পড়লো, তেপান্তরের মাঠে একা বধূর মতো বসে। হাতের লাঠিটা এতক্ষণ বিচ্ছিরি বদখদ পথে পদে পদে আমার প্রাণ রক্ষা করেছে, সমতলে এসে তাকে সযত্নে শুন্যে তুলে জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। মিলন ভাই একটু অসুস্থ বোধ করছেন, তাকে খানিকটা পানি খাইয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দিয়ে তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম। দূরে, আমার বাঁয়ে পাহাড়ের চূড়ায় আবছাভাবে চোখে পড়ছে একটা টংঘরের ছায়াবয়ব, বাঁয়ে গাঢ় অন্ধকার। ফেব্রুয়ারির সেই রাতে, সেই সমতল পথে ঠিক কতক্ষণ পা চালিয়েছি, এই অক্টোবরে এসে আমার ঠিক মনে পড়ছে না, মাইল তিনেকের মতো পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। পাহাড়ে পথ চলার সময় পূর্ণ মনোযোগ থাকে পথের ওপর, কিন্তু সমতলে পা পড়লে মনের রাশ যেন শিথিল হয়ে পড়ে। এ পথে চলতে চলতে মাথায় ভিড় জমিয়েছে হাজারো চিন্তা, প্রিয়জনের মুখ মনে পড়েছে কয়েকবার, হয়তো এই বিপজ্জনক পথে চলতে চলতে নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিব্রত ছিলাম বলেই আর কারো কথা ভাবার সুযোগ মেলেনি। রবিবুড়োর বীরপুরুষ কবিতাটার কথা ভাবছিলাম, চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে। গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে, সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে, অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো। --- অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না বলেই চলতে চলতে হঠাৎ যেন সালেহীনের সাথে প্রায় ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি, কাছেই ঠায় দাঁড়িয়ে সৈকত। কী ব্যাপার, এই দু'জন এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে কেন? উত্তরটাও পেয়ে গেলাম সাথে সাথেই, আমাদের তিনজনের সামনে, গজ বিশেক দূরে, পাশের মাঠ থেকে পথের ওপর উঠে এসেছে কয়েকটি বিশাল আকৃতির ছায়া, আর প্রতিটি ছায়ার ওপরদিকে একজোড়া করে সবজে চোখ মিটমিট করছে তারার আলোয়! কী ভাই, ঘাবড়ে গেলেন নাকি? 'ভয়ের কিছু নেই, ওগুলো তো গয়াল!' সালেহীনকে অভয় দিচ্ছিলাম বটে, কিন্তু নিজের গলাই শুকিয়ে গিয়েছিলো আশঙ্কায়। সালেহীনও আমার বক্তব্যে খুব একটা আশ্বস্ত হলো না। পরিস্থিতি বেশ মিলে যাচ্ছিলো রবিবুড়োর কবিতার সাথে, কিন্তু এই গরুগুলো হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো? এ কথা সত্য, যে গয়াল আসলে এক ধরনের গরু, কিন্তু বেশ বড়সড়, পোক্ত ও দুর্দান্ত স্বভাবের গরু। এরা কোন কারণে চটে গেলে দল বেঁধে গুঁতিয়ে দিতে আসে। আমরা তিনজন আমাদের হাতের পলকা লাঠি দিয়ে এদের ঠেকাতেও পারবো না, কিংবা এদের সাথে দৌড়েও কুলিয়ে উঠতে পারবো না। গ্রামের লোকজন বোধহয় এদের রাতের বেলা এমনিতেই ছেড়ে রাখে, বিনে পয়সার পাহারাদারি করার জন্যে। অপরিচিত লোক দেখলেই বোধহয় গয়ালগুলো ফুঁসে ওঠে, তাছাড়া এখন রাত বাজে প্রায় দেড়টা, এ সময়ে কোন ভদ্রলোক এ পথে চলাফেরা করে না, কাজেই গয়ালগুলোর মনে সন্দেহের উদয় হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিট তিনেক, গয়ালগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে নিয়ে হঠাৎ আবার মাঠে ফিরে গেলো। কেবল একটা ছোটখাটো গয়াল ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো পথের ওপর। যে-ই না একটা পা সামনে বাড়িয়েছি, অমনি স্পেনের রাস্তার সেই মদ্যপ ষাঁড়ের মতোই গোটা শরীরে একটা ঢেউ তুলে তেড়ে এলো সে। গয়াল তো আর রয়াল বেঙ্গল নয়, মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিলাম, চোখের ওপর টর্চ ফেলে। টর্চের আলো দেখেই পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো সে, থেমে দাঁড়ালো, কিন্তু ফিরে গেলো না। মাটিতে খুর ঠুকলো কয়েকবার, লেজ সাপটালো, কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কুটিল চোখে দেখতে লাগলো আমাদের। গ্রামের লোক বোধহয় একে দানাপানি কিছুটা বেশি খাওয়ায়, তাই পাহারাদারির কাজে নিমকহারামি করতে চাইছে না গরুটা। সৈকত পরামর্শ দিলো, 'হিমু ভাই, চলেন একটু ঘুরে যাই।' অতি উত্তম প্রস্তাব, পথের পাশে একটু ঘুরে যাবার মতলবে টর্চটা নিবিয়ে পা বাড়াতেই দেখি ব্যাটা আবার তেড়ে আসে! এবার মেজাজটাই গেলো খারাপ হয়ে, টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গিয়ে কড়া একটা ধমক দিলাম, 'কী ব্যাপার? কী চাও তুমি? এমন করছো কেন, বেয়াদব? --- দুষ্ট গরু কোথাকার!' এবার বোধহয় ব্যাটার বোধোদয় হলো, কান দুটো খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে পথ থেকে সরে দাঁড়ালো সে। আমরা গটগটিয়ে এগিয়ে গেলাম, একবার পেছন ফিরে দেখি, তখনও পথের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে ব্যাটা। পুতুল আপার সাথে মংক্ষিয়াদা আছেন, কাজেই গয়াল ওঁদের কোন অনিষ্ট করতে পারবে না, এই ভরসায় সামনে এগিয়ে গেলাম। আরো প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটার পর চোখে পড়লো গ্রামটা, পাহাড়ের ওপর কতগুলো কুটির। চারদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। সম্ভবত গ্রামে কোন কুকুর নেই, অথবা তারা পেটভরে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে, নইলে এতক্ষণে পাড়া মাথায় তুলে ফেলতো। প্রাংশা ত্রিপুরাদের গ্রাম। আমরা ত্রিপুরা ভাষা জানি না, আমাদের চেহারাসুরত হাবভাব সন্দেহজনক, তাছাড়া রাত বাজে প্রায় দু'টো, এমন পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীদের মুখোমুখি হলে কোন সন্তোষজনক তথ্যের আদানপ্রদান সম্ভব নয়। তাই গ্রামের প্রবেশপথের মুখে, মোটামুটি পরিস্কার দেখে একটা জায়গায় বসে পড়রাম সবাই। সবাই আগে এক জায়গায় জড়ো হই, তারপর মংক্ষিয়াদা আমাদের হয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। থেমে থেমে ঝটকা দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে আসছে হিম বাতাস, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে রুকস্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমার পাশে শায়িত মিলন ভাই সম্ভবত ঘুমিয়েই পড়েছেন, হঠাৎ দেখি চঞ্চল তেড়েফুঁড়ে উঠে পড়েছে। সে আর দেরি করতে রাজি নয়, বাকিটা পথ সে কোন একটা টংঘরেই শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। টংঘরের সন্ধানে আবারও পথে বেরিয়ে পড়েছে ব্যাটা, এমন সময় দেখা গেলো, দলের বাকি চারজন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। স্বল্পভাষী মংক্ষিয়াদাকে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার দরকার হলো না, আমাদের গ্রামের গোড়ায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি শুধু বললেন, 'ভালো করেছেন।' তাঁর পিছু পিছু আমরা এগিয়ে গেলাম। গ্রামের ঢোকার প্রবেশ পথ মজবুত বেড়া দিয়ে আটকানো, তবে সেই চিরাচরিত কাঠের গুঁড়ির সিঁড়ি বেড়ার গায়ে লাগানো আছে। সেটা বেয়ে বেড়া টপকে গ্রামে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মংক্ষিয়াদা নিচু গলায় ডাকলেন, 'বেঈ, এ বেঈ, বেঈ? --- এএ বেঈ, বেঈ!' খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে সাড়া মিললো তীক্ষ্ণ গলায়। মারমা বা ত্রিপুরা ভাষা আমরা বুঝি না ঠিকই, কিন্তু সব ভাষার সুরেই কিছু সাধারণ গুণ থাকে, তাই মংক্ষিয়াদার গলায় ক্ষমাপ্রার্থনার টান, আর ভেতর থেকে আশ্বাসের সুর আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না, চাপা একটা স্বস্তির শ্বাস সবার বুক থেকেই বেরিয়ে এলো। পাঁচ: এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো ---? আমিই বলে দিচ্ছি কেমন হতো --- এই আর্টিকেলটা পড়ার দুর্ভাগ্য আপনার হতো না। যে পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এসেছি, সে পথে যে সন্ধ্যের পর পাহাড়িরাও চলাফেরা করে না, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি আমরা, কারণ সন্ধ্যের পর থেকে স্থানীয় কোন মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়নি। পরে জানতে পেরেছি, এ পথে রাতে পাহাড়ি চিতা আর ভালুক ঘোরাফেরা করে। যা-ই হোক, বাকিটুকু শুনুন। প্রাংশাপাড়ায় এক কুটিরের ভেতর, বৈঠককক্ষে লাকড়ির আগুনের সামনে বসে আছি আমরা কয়েকজন। এখন রাত পৌনে তিনটা। আমাদের সবার জুতো বাইরে বারান্দায় রাখে, ঘরের এক কোণে বিশাল ব্যাগের স্তুপ, আর ভেতরে ও বাইরের ঘরে সারিসারি স্লিপিং ব্যাগ পাতা। কুটিরের কর্ত্রী এই নৈশ উপদ্রবে কিছু মনে করেছেন বলে মনে হলো না, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজের ঘরেই আমাদের শুয়ে পড়তে বললেন। ভেতরের ঘরে তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য ঘুমিয়ে ছিলো, আমাদের উৎপাতে তাদের ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু গৃহকর্ত্রী সংক্ষেপে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন তাদের, আবার ঘুমোতে চলে গেলো তারা। তাদের পায়ের কাছেই আরেক সারি বেঁধে স্লিপিং ব্যাগ পাতা হলো। ভেতরের ঘরের এক কোণায় একটা মাটির পাত্রে ধিকিধিকি জ্বলছে কাঠের আগুন, ঘরের ভেতর আগুন না জ্বললে জমে হিম হয়ে যাবেন তারা। সেই আগুনকে ঘিরেই ঘনীভূত হয়ে শুয়ে পড়েছে দলের কয়েকজন। ভাবছিলাম, ঢাকায় রাত আড়াইটার সময় একদল অপরিচিত মানুষ আমার বাড়িতে ঘুমোবার বায়না ধরলে আমি কী করতাম? আগুনের পাশে বসে, নিজের ক্ষতিগ্রস্থ পায়ের পেশীতে কিছুক্ষণ ব্যথাবিমোচক মালিশ করলাম, পায়ের গোড়ালি আর তালুতে বিশাল তিনটা ফোস্কা পড়েছে। শাহেদ ভাই আর বরুণদার কাছে খানিকটা চিঁড়া ছিলো, তারই এক মুঠো মুখে গুঁজে দিয়েছি। বরুণদা কয়েকজনকে প্রলোভন দেখালেন, আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকলে মুরগির ইনস্ট্যান্ট স্যুপ জুটবে কপালে। কিন্তু মুরগি নিয়ে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না, পটাপট স্লিপিং ব্যাগের ওপর লম্বা হয়ে পড়েছে সবাই, আমিও তাদেরই দলে। ক্লান্তি এসে ঘুমের টুঁটি চেপে ধরেছে, তাই রাতের বাকিটা কাটলো একটি অসহনীয় তন্দ্রার ঘোরে। ঘরে আগুন জ্বলছে, স্লিপিং ব্যাগ আর জ্যাকেটের ভেতরে আমি, তবুও কুটিরের নিচে বয়ে যাওয়া হিম হাওয়ায় শরীর অবশ হয়ে এসেছে। এই তন্দ্রার ঘোরটাও ভেঙে গেলো বরুণদার ডাকে। 'মংক্ষিয়াদা! শাহেদ ভাই! হিমু! উচ্ছল!' সবার নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়ে আমিও স্লিপিংব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। বরুণদা রাতে আর ঘুমাননি, জেগেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সবাই উঠে হাতমুখ ধুয়ে ফিরতে ফিরতেই মংক্ষিয়াদা সবাইকে থালা বার করার ডাক দিলেন, ভাত, ডাল আর লাউ রান্না করা হয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, চুপচাপ খাচ্ছে সকলে। একেজনের চোখমুখ বসে গেছে, একুশ ঘন্টা টানা হাঁটার পর তিন ঘন্টা শোবার অবসর পেয়েছে সবাই, কাজেই চেহারা খোলতাই হবার কোন সুযোগ নেই। তবুও খানিকটা বিশ্রাম আর খানিকটা খাবার কিছুটা নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছে আমাদের মাঝে, সময় নষ্ট না করে আবারও বেরিয়ে পড়লাম সকলে। আমাদের গৃহকত্রর্ীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাঁর পাওনাগন্ডা বুঝিয়ে দিয়ে গাঁয়ের বুক চিরে চলে যাওয়া পথটা ধরে এগিয়ে গেলাম আমরা। আজ সাথে এক গ্রামবাসীকে পাওয়া গেলো, যে রুমাবাজারে যাবে, আমাদের দলকে সঙ্গ দিতে রাজি হলো সে। কিছুদূর যেতে না যেতেই একটা ছড়ার মুখোমুখি হলাম আমরা। গ্রামবাসী অক্লেশে কাপড়ে কাছা মেরে এর জানুস্পর্শী কাদাপানি ঠেলে পার হয়ে যান, কিন্তু আমরা পড়লাম সমস্যায়, কোমর পর্যন্ত ভেজা প্যান্ট নিয়ে পথ চলা সম্ভব নয়, তবে সমাধান বের করতে খুব একটা দেরি হলো না, মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজির পর লম্বা দেখে দুটো বাঁশ ফেলে একটা তাৎক্ষণিক সাঁকো তৈরি হয়ে গেলো। সেই টালমাটাল সাঁকো একে একে পেরিয়ে জোর পায়ে দূরের পাহাড়সারির দিকে চলতে শুরু করলাম আমরা। সাতটা বেজে গেছে, আমাদের দুপুরের মধ্যে রুমাবাজারে পৌঁছুতে হবে। আজও পথ চলে গেছে ছড়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু গতরাতের মতো অত দীর্ঘ নয়, খানিকটা হাঁটতেই আবার পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম আমরা। ঝুরঝুরে কাঁকর আর বালিভর্তি পথে ধুপধাপ পা ফেলে ঘন্টাখানেক চলার এক অপূর্ব জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। পাহাড়ের মাঝে একটা গভীর খাদ, পাহাড়ের ঢাল ঘাস আর হলদে-সোনালী ঝোপে ছাওয়া, মাঝে মাঝে কয়েকটা প্রকান্ড শিরীষ গাছ খাদের মধ্য থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আকাশ আজও পরিষ্কার, নীল আর সবুজ যেন ফেটে পড়ছে চারদিকে। প্রাংশাবাসী সেই ভদ্রলোক আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন, একটা পাঁচ বছরের ক্ষুদে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে কোন অ্যাথলেটের যেমন হাঁটতে বেরোলে সমস্যা হয় --- এখানে পৌঁছে তিনি মংক্ষিয়াদাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এই গতিতে চললে রাত আটটার মধ্যেও রুমায় পৌঁছুনো যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত হলো, যাদের আগামীকাল অফিস করার খুব জরুরী তাড়া আছে, তারা দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যাবে, বান্দরবানে পৌঁছে শেষ বাস, যেটা রাত আটটায় ছাড়ে, সেটা ধরার চেষ্টা করবে তারা, আর পেছনের দলের জন্যে অপেক্ষা করবে। আর যাদের তেমন একটা তাড়া নেই, তারা পুতুল আপাকে দেখেশুনে রাখবে, ওঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। পুতুল আপার নিজেরও অফিসের তাড়া আছে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনি আহত পা নিয়ে একটু পিছিয়ে পড়েছেন। আগুয়ান দলে যোগ দিলেন বরুণদা, উচ্ছল ভাই, সৈকত আর মিলন ভাই, তাঁদের গাইড হয়ে চললেন সেই প্রাংশাবাসী। তাঁরা এগিয়ে যাবেন, আর কোন রাস্তা একাধিক দিকে ভাগ হয়ে গেলে সঠিক পথে চক দিয়ে টিক চিহ্ন দিয়ে যাবেন। এ সিদ্ধান্ত হতে না হতেই সাঁই সাঁই করে পা চালিয়ে এগিয়ে গেলেন পাঁচজন, আমরা কিছুটা ধীরে পথ চলতে লাগলাম। বড়থলি ক্যাম্পে সেনারা জানিয়েছিলেন, প্রাংশা থেকে রুমাবাজার পর্যন্ত রাস্তা অতি চমৎকার, কেবল নেমে যেতে হবে, শুধু মাঝখানে এক জায়গায় ময়না পাহাড় বলে একটি বস্তু রয়েছে, যেটি সৈনিকদের মাথাও ঘুরিয়ে দেয়। আমি আর সালেহীন চলতে চলতে একটু এগিয়ে গেলাম, বাকিরা একটু ধীরে পা চালিয়ে পুতুল আপার সঙ্গে রইলেন। কিন্তু পা মচকে গেলেও পুতুল আপা যথেষ্ঠ দ্রুত হাঁটছেন, তাই দলের গতি খুব একটা মন্থর হলো না। কিছুদূর এগিয়ে আমি আর সালেহীন অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকিদের জন্যে, তাঁদের দেখা গেলেই আবার উঠে পড়ছি, আবার মিনিট বিশেক হেঁটে একটু বসছি। চলতে চলতে কয়েক জায়গায় পথ দু'তিনভাগ হয়ে গেছে, কিন্তু অগ্রগামীদের চকচিহ্ন দেখে সঠিক পথে পা বাড়িয়েছি আমরা। পথ চলে গেছে পাহাড়ের নিরাপদ এলাকা দিয়ে, পথের পাশে কোন খাদ নেই। যত পথ চলছি, ডানে আর বামে আরো নতুন সব পাহাড় চোখে পড়ছে। পাহাড়ের পাশে কয়েক জায়গায় বাঁশের ঝাড় কেটে সাফ করা হচ্ছে, কোথাও ঝোপে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে পাহাড়ের ঢাল --- জুম্ম চাষের প্রস্ততি। মাথার ওপর এই অভিযানে প্রথম মেঘের দেখা পেলাম, তার আড়ালে কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে যেন পোশাক পাল্টে আসছেন সূয্যিমামা, প্রত্যেকবার তাঁর বেশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে, আর এদিকে গলদঘর্ম হচ্ছে তাঁর পথচলা ভাগ্নের দল। আজ পথে কোন ছায়া নেই, একেবারে ন্যাড়ামুন্ডি পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলছি আমরা। খানিকটা এগিয়ে পথের পাশে একটা মুদি দোকান পড়লো, রুমাবাজার থেকে যাত্রার পর এই প্রথম। আমি আর সালেহীন সেখানে গুটগুটিয়ে ঢুকে পড়লাম, চা খাবো বলে। অবশ্য চায়ের সাথে টা-ও মিললো, গ্লুকোজ বিস্কুট। আমরা বসতে না বসতেই চঞ্চল এসে হাজির, তিনজন মিলে চা আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সারলাম। দোকানিয়া বুড়োর সাথে আলাপ করে জানা গেলো, আমাদের দলের বাকিরা মিনিট পনেরো আগে দোকান থেকে বেরিয়েছেন। রুমাবাজার আর কতক্ষণের পথ, জানতে চাইলে বুড়ো হেসে জানালেন, কতো আর, ঘন্টা দেড়েক? একটু আশ্বস্ত হলাম, তাহলে চারঘন্টার মধ্যে রুমায় পৌঁছে যাবো! পেটপূজা করে বেরোচ্ছি, এমন সময় দলের বাকিরা এসে উপস্থিত। তাঁদের বিদায় জানিয়ে এবার আমি, সালেহীন আর চঞ্চল পা বাড়ালাম। চঞ্চল আবার কয়েকটা বড়ই কিনে নিয়েছে দোকান থেকে, সেগুলো দাঁতে কাটতে কাটতে এগিয়ে গেলাম। পাহাড় থেকে নামার আনন্দ অন্যরকম, তাতে শারীরিক কষ্ট কিছুটা কম, আর যে পথ ধরে নামবো, সেটার অনেকখানি ওপর থেকে চোখে পড়ে। ঘন্টাখানেক বৈচিত্র্যহীন পথে চলতে চলতে একসময় একটা পিচ্ছিল খাড়াই হাঁচড়ে পাঁচড়ে পার হয়ে আমার আর সালেহীনের চক্ষুস্থির হয়ে গেলো। সামনে একটা বাঁক ঘুরে পথ উঠে গেছে একটা পাহাড়ে। খুব একটা উঁচু সেটা নয়, কিন্তু এখান থেকেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, পথের ঠিক নিচেই গভীর, অনেক গভীর খাদ। খাদের দেয়ালে দুয়েকটা ঝোপঝাড় গজিয়েছে বটে, কিন্তু সেই পথে যদি কারো পা পিছলে যায়, সোজা গিয়ে সেই খাদে পড়তে হবে। এটাই তাহলে সেই ময়না পাহাড়! বিবরণক্লান্ত পাঠককে সেই ময়না পাহাড়ে ওঠার দুঃসহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে পীড়ন করার ইচ্ছে আমার ছিলো না, তবু বলি, বড়জোর সাততলার সমান উঁচু সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে ঝাড়া পনেরো মিনিট সময় লেগেছে আমার। পথটা পাক দিয়ে পাহাড়ের কিনারা ধরে উঠে গেছে, গোটা পথটা অসম্ভব খাড়া, প্রায় সত্তর ডিগ্রীর মতো হবে, আর অসম্ভব পিচ্ছিল, পা রাখতে না রাখতেই পায়ের নিচের মাটি আর বালি ঝুরঝুর করে খসে আসতে থাকে। হাতের কাছে একটা কিচ্ছু নেই আঁকড়ে ধরার, পথের ওপর গেঁথে থাকা পাথরে হাত রাখলে আলগা হয়ে আসে, গাছের শুকনো শিকড় আঁকড়ে ধরতে গেলে ভেঙে আসে। পথের ওপর স্থির হয়ে থেমে থাকার জো নেই, গোটা শরীর অতি ধীরে নিচে নেমে আসতে থাকা। একবার শুধু ভুল করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়েছি, দেখি বহু নিচে অন্ধকার মুখব্যাদান করে আছে। সালেহীন সাবধানে পা ফেলে উঠে গেছে ওপরে, আমার জন্যে মিনিট পাঁচেক বসে ছিলো সে। অর্ধেক পথ পেরোনোর পর শুনলাম, সে ডাকছে, 'হিমু ভাই, ঠিক আছেন তো?' পান্ডব যুধিষ্ঠির পর্যন্ত মিথ্যে কথা বলে তার রথের চাকা ধূলোয় লুটিয়েছিলো, আর আমি তো এই পান্ডববর্জিত দেশের এক সামান্য মানুষ, শুনতে পেলাম জোর গলায় বলছি, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছি, আসছি এখুনি!' ওদিকে দূর থেকে আমাকে পাহাড়ের গায়ে ঝোঝুল্যমান অবস্থায় দেখে চঞ্চল দ্রুত এগিয়ে এসেছে, যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়, আমি ওঠার মিনিট তিনেক পরই দেখি উঠে এসেছে সে। পাহাড়ের ওপর একটা ঝোপের পাশে বসে হাঁপাচ্ছিলাম সবাই, আর ঢোঁক গিলছিলাম পুতুল আপার কথা ভেবে। একটা অচল পা নিয়ে এই ঈশ্বরপরিত্যক্ত পথে কিভাবে উঠবেন তিনি? ব্যাগগুলো খুলে রেখে পথের ওপর আবার গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। সাথে দড়ি আছে, প্রয়োজন হলে দড়ি বেয়ে উঠে আসতে পারবেন পুতুল আপা। পাহাড়ের ওপর থেকে পথটা দেখা যায় না, তাই আমরা খানিকটা নিচে নেমে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিনিট পনেরো পর দলের বাকিদের কন্ঠস্বর কানে এলো। চঞ্চল হাত বাড়িয়ে ব্যাগগুলো তুলে নিয়েছে, আর পুতুল আপাকে নিয়ে ওপরে উঠছেন শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা। শাহেদ ভাই পেছনে পেছনে আসছেন, যাতে পুতুল আপা পিছলে পড়ে যেতে না পারেন, আর তাঁর হাত ধরে টেনে তুলছেন মংক্ষিয়াদা। সবাই ওপরে উঠে যাবার পর শাহেদ ভাইয়ের খেয়াল হলো, তাঁর বিশেষ ট্রেকিং প্যান্টের একটা পায়া খুলে পড়ে গেছে, তিনি আবার নিচে নেমে সেটা উদ্ধার করে ফিরলেন। ময়না পাহাড়ের ওপরে সবার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসার পর কয়েক ঢোঁক পানি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম আমরা। সেনাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ময়না পাহাড়ের পর আর কোন ফাঁড়া নেই, পথ কেবল নেমে গেছে পাহাড়ের শিরদাঁড়া ধরে। আমি, সালেহীন আর চঞ্চল কিছুক্ষণ একসাথে এগোলাম, আধঘন্টা চলার পর চঞ্চল আর সালেহীন জোর পা চালিয়ে নিচে নেমে গেলো, আমি ধীরেসুস্থে পথ চলতে লাগলাম। পায়ের নিচের ফোস্কা দুটো একেবারে জ্বালিয়ে মারছে, মাটিকে পায়ের গোড়ালি ঠুকে ঠুকে এগোতে হচ্ছে। সূর্য মাথার ওপর থেকে একটু ঢলে গেছে, আমার সামনে দূরে সাঙ্গু উপত্যকা, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারির বুক চিরে বয়ে যাওয়া রূপালি ফিতের মতো নদীটাকে। সাঙ্গুর কিনারায় গড়ে ওঠা বিরাট জনপদটাকেও পুরোটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দুপুর তিনটার দিকে, ময়না পাহাড় পেরিয়ে আসার পর ঘন্টা দুয়েক হেঁটে একসময় নিউ ইডেন পাড়ার ভেতর দিয়ে রুমাবাজারে এসে পৌঁছেছি। মাঝে একটা টংঘরে মিনিট পাঁচেক বসেছিলাম, কিন্তু মশার ভনভন শুনে চটপট উঠে পড়েছি। রুমাবাজার যতো এগিয়ে আসছে, পথের পাশে কলাগাছের সংখ্যা ততই বাড়ছে। কলাগাছের গোড়ার মাটি খুব ঝুরঝুরে হয়, তাই পথের শেষ অংশ খুব সাবধানে পার হতে হয়েছে। পথে দেখা হলো আমাদের সেই প্রাংশাবি সঙ্গীপথিকের সাথে, রুমায় বাজারসদাই করে ফিরছেন তিনি, আমাদের প্রথম দলের সঙ্গীরা রুমায় পৌঁছে গেছে, জানালেন। আর নিউ ইডেন পাড়ার গোড়ায় পাহাড় থেকে সমতলে নামার জন্যে একটা ধাপকাটা কুন্ডলীর মতো পথ আছে, সেটার কথাও আমি কখনো ভুলবো না। এক পা এদিক ওদিক হলে শ'খানেক ফিট নিচের ছড়ায় পড়ে মরার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিলো ওখানে। নিউ ইডেন পাড়ায় পৌঁছে একটা জায়গায় পথের পাশে বাঁশের অ্যাকুয়াডাক্ট পাওয়া গেলো। আমার বোতলটা সেই ঠান্ডা পানিতে ভরে নিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর সময় নিয়ে পুরো এক বোতল পানি খেলাম, ভয়ানক তৃষ্ণা পেয়ে গিয়েছিলো। ঠান্ডা মাথা আর ঠান্ডা পেট নিয়ে পাড়ার ভেতর দিয়ে কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি ঠেলে চললাম। পথের দু'পাশে কুটির, কুটিরের সামনে শিশুরা খেলা করছে, বারান্দায় তাঁতে চাদর বুনছেন মহিলারা। কুটিরের আশেপাশে অবাধে চরছে কয়েকটা কুকুর আর অগণিত শূকর। এক জায়গায় দেখলাম, পথের ওপর একটা বাচ্চা মেয়ে খুব যত্ন করে একটা শুকরকে খৈল খাওয়াচ্ছে, আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরো খানিকটা সামনে গিয়ে দেখি একটা বিশাল মাদী শূকর রাস্তায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুধ খাচ্ছে তার পাঁচটা বাচ্চা, ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে পাড়া মাথায় উঠে যাবার যোগাড়। সালেহীন আর চঞ্চলকে এখন কোথায় পাই? সাতপাঁচ ভেবে উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসা এক মহিলাকে বিনীতভাবে নমস্কার করে জানতে চাইলাম, আমার মতো পিঠে ব্যাগ নিয়ে কাউকে দেখেছেন কি না। তিনি প্রতিনমস্কার করে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। চলতে চলতে তাঁর সাথে বেশ আলাপ জমে উঠলো। ঢাকায় দুয়েকবার গিয়েছেন তিনি, ভালো লেগেছে তাঁর কাছে, জানালেন। আমাদের সম্পর্কে পাহাড়িদের বেশ কৌতূহল, বিশেষ করে নিউ ইডেন পাড়া দিয়ে কোন অভিযাত্রীকে চলতে দেখেননি তাঁরা, অন্য যারা আসে তারা লাইরুনপিপাড়া হয়ে কেওকারাডঙের দিকে চলে যায়। আমরা প্রাংশাপাড়া থেকে আসছি শুনে বেশ উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন তিনি, সেখানে তাঁর দিদি থাকেন, ত্রিপুরাদের অন্যতম সঙ্গীতশিল্পী তিনি। মিনিট পাঁচেক পথ চলার পর একটা দোকানে চঞ্চল আর সালেহীনকে পাওয়া গেলো, আয়েশ করে কোমল পানীয়ে কঠোর চুমুক দিচ্ছে তারা। আমার পথপ্রদর্শিকা দিদিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমার বরাদ্দ বিস্কুটটুকুর ওপর। সালেহীন জানালো আরেক দুঃসংবাদ, আগামীকাল নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ, তার পরদিন আবার হরতাল! আজ যে করেই হোক, ঢাকার বাস ধরতে হবে আমাদের। দোকানিয়া প্রৌঢ়া দিদির নাম ফুলের মালা চাকমা, তাঁর সাথে বেশ আলাপ জমে উঠলো। তিনি রাঙামাটির শুভলঙের বাসিন্দা ছিলেন, কাপ্তাই হ্রদের নিচে সব ডুবে যাবার পর এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছেন তিনি। ফুলের মালা দিদির সাথে আলাপের এক পর্যায়ে মঞ্চে প্রবেশ ঘটলো আরেক উপদ্রবের, এক পাঁড় মাতাল বম, দিনে দুপুরে মদ খেয়ে হল্লা করছে সে। আশেপাশের লোকেরা চেয়ে চেয়ে তার কান্ড কারখানা দেখছে শুধু। কয়েকবার খেদিয়ে দেবার পরও গায়ে পড়ে এসে উৎপাত শুরু করলো সে, স্থানীয়দের অনুরোধ করলাম, একে সরে যেতে বলার জন্যে, কিন্তু কেউ গা করলো না। অগত্যা আধঘন্টা তার হৈচৈ-চিৎকার-গালাগালি সহ্য করার পর তাকে পাকড়াও করে রাস্তায় বার করে নিয়ে এলাম, বাসায় চলে যেতে বললাম। তখন শুরু হলো আরেক জ্বালা, সে তার বাসায় আমাদের মদের দাওয়াত দিতে চায়। লোকটা একটু তফাতে হঠার পর স্থানীয় চ্যাপেলের পাস্তর এসে দেখা করে গেলেন আমাদের সাথে। এমন সময় দেখি শাহেদ ভাই এসে হাজির, আরো দশ মিনিট পর পুতুল আপা আর মংক্ষিয়াদাও পৌঁছে গেলেন। ফুলের মালা দিদি মিষ্টি হেসে করমর্দন করে বিদায় জানালেন আমাদের, আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম ঘাটের দিকে। চারটা বাজেনি এখনও, পাঁচটার মধ্যে ক্ষক্ষ্যংঝিরি পৌঁছুতে হবে, রুমা-বান্দরবান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে এরপর। এরই মধ্যে কোত্থেকে আবার এসে উদয় হয়েছে সেই মাতাল ব্যাটা, পুতুল আপাকে জ্বালাতন করার উদ্যোগ নিয়েছে সে। এবার আর কথা বাড়ালাম না, একটা মাপা ধাক্কা দিতেই সে টলতে টলতে রাস্তার পাশে ধপাস করে পড়লো, আশেপাশের লোকজন বিরাট এক হর্ষধ্বনি তুললো, বুঝলাম, এমনটা প্রায়ই হয়। ঘাটে গিয়ে বরুণদার প্রাক্তন গাইড জুয়ামের সাথে দেখা। নৌকো নিয়ে দর কষাকষি হলো খানিকটা, চাটগাঁ থেকে এসে বসত গেড়ে বসা চ্যাংড়া মাঝি কিছুতেই চলতি মাথাপিছু ভাড়ায় নৌকো ভাসাবে না, তার নৌকো এখন রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে হবে। শাহেদ ভাই আর মংক্ষিয়াদা যথাক্রমে নরম ও গরম সুরে কিছুক্ষণ দর কষাকষি করার পর নৌকো পানিতে ভাসলো। কিন্তু এই ছোকরা মাঝি একা লগি বাইলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, সব কাজের কাজি মংক্ষিয়াদা তাই আরেক প্রান্তে বসে লগি হাতে তুলে নিলেন। মাঝে মাঝে লগি নামিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি, আর এক ঢোঁক পানীয় খেয়ে নিচ্ছেন। নৌকো ছুটে চলেছে অগভীর সাঙ্গুর ওপর দিয়ে। বাংলায় এর নাম শঙ্খ, বর্মী ভাষায় রিগ্রিক্ষ্যং। নদীর দুপাশে ঘন অরণ্যে ঢাকা খাটো খাটো পাহাড়, আর বালিতে ঢাকা পাড়ে কমলার ক্ষেত, প্রতি বছর রুমা থেকে লাখ লাখ কেজি কমলার চালান যায়। সূর্য আকাশ থেকে হারিয়ে গেছে, সন্ধ্যের ছাতা একটু একটু করে খুলছে চারপাশে, সেই ফুরিয়ে আসা আলোয় হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে নদীর ওপর ঝুঁকে আসা গাছের ডালে অপূর্ব রঙিন সব পাখি। ক্ষক্ষ্যংঝিরিতে পৌঁছে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। সবাই হুড়মুড়িয়ে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলাম গাড়ি ভাড়া করার জন্যে। খানিক বাকবিতন্ডার পর একটা গাড়ি পাওয়া গেলো, সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৈরি, তার স্টিয়ারিং আবার বাম দিকে, চালক জানালেন, এটা রুশ রাষ্ট্রের গাড়ি। গাড়িতে আমাদের সঙ্গী হলেন রুক্ষ চেহারার দুই ব্যক্তি, তাঁদের হাতে ওয়্যারলেস, হাবভাব দেখে গুন্ডা বদমাশ মনে হলেও আসলে তারা পুলিশ। এ পথে তাঁরা কারো না কারো চাঁদের গাড়িতে লিফট নিয়ে থাকেন, এটাই নিয়ম। গাড়িচালক খালেক সাহেব অভিজ্ঞ ড্রাইভার, বিপজ্জনক রুমা-বান্দরবান সড়কে সোঁ সোঁ করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন তিনি, গাড়ির ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ শুনলে মনে হয়, এই বুঝি ইঞ্জিনটা খুলে পড়ে যাবে পথের ওপর, তাঁর চালনকৌশলের জোরে আটটার আগেই এসে বান্দরবানে নিরাপদে পৌঁছুলাম আমরা। তবে আরেকটি শিহরণজাগানিয়া ঘটনা মাঝপথে ঘটেছে, বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে শুধু বলছি, এ সড়কে বিকেল গড়িয়ে গেলে কখনোই যাতায়াত করবেন না, কখনোই না, বিপদ ঘটতে পারে। বান্দরবানে পৌঁছে বাস স্ট্যান্ডে গাড়ি থামিয়ে টিকেট করতে ছুটে গেলেন শাহেদ ভাই, আমাদের সেই অবিবৃতঘটনাজনিত উত্তেজনা তখনও কাটেনি, নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে চলেছি। পরদিন সড়ক অবরোধ, পর পর দুটো বাস ছাড়ছে বান্দরবান থেকে, আমাদের জন্যে আসনের বন্দোবস্ত হলো না, তবে ইঞ্জিনের ওপর বসে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। খাওয়াদাওয়ার জন্যে বাজারের দিকে গাড়ি ঘোরাতেই পথের ওপর দলের প্রথম চারজনকে দেখা গেলো, নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে এগিয়ে আসছেন তাঁরা। দুই টুকরো আবার জোড়া লেগে গেলো, চাঁদের গাড়িতে উচ্ছ্বসিত হাউকাউ শুরু হয়ে গেলো। বরুণদার সাথে জুয়ামের দেখা হয়েছে, তিনি সন্তুষ্টচিত্তে জানালেন, তাঁর গাইড জুয়াম মদ ছেড়ে দিয়েছে, বরুণদার সেই অসমাপ্ত অভিযানে দুর্ঘটনার পর থেকে। স্থানীয় খাবার দোকানে ঢুকে ঠেসে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম সবাই, পুকুরপাড়া ছেড়ে আসার পর পেট ভরে এক বেলাও খাবার জোটেনি। মিনিট বিশেক পর বেরিয়ে মংক্ষিয়াদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোলাম সবাই। চট্টগ্রাম পর্যন্ত একসাথে যাবো আমরা, চট্টগ্রামে নেমে এক ঘন্টা পর আরেক বাসে ঢাকায় পৌঁছুবো আমি, সালেহীন, চঞ্চল আর শাহেদ ভাই। এবারের অভিযানে আমরা বান্দরবানে প্রবেশ করেছি শেষ রাতের আঁধারে, সন্ধ্যে রাতে এই অপূর্ব পাহাড়গুলোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম ব্যস্তসমস্ত ঢাকার দিকে। অভিযানের ক্লান্তি কেটে যাবে একবেলা ভালো ঘুম দিলে, কিন্তু এর স্মৃতির দাগ মন থেকে মুছবে না। ছয়: শেষ কথা বোদল্যেরকে দিয়েই শেষ করি। অদ্ভুত যাত্রীর দল! তলহীন, সমুদ্রের মতো, বিলোল নয়ন ভ'রে নিয়ে এলে প্রোজ্জ্বল কাহিনী; স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দেখাও, সেখানে আছে কত নীলিমার, নক্ষত্রের মণিহার, মুকুট, কিঙ্কিণী। আমরাও যাবো দূরে, বিনা পালে, বায়ুব্যতিরেকে ---; আমরা, আজন্ম বন্দী, বক্ষে চাপা নির্বেদের ভার, অকস্মাৎ উন্মোচিত আত্মার বনাতে দাও এঁকে দিগন্তের চালচিত্রে পুলকিত স্মৃতির সম্ভার। বলো, বলো, কী দেখেছো, বলো! পরিশিষ্ট: দু'টো আলাদা বাসে একই সাথে ঢাকায় পৌঁছেছে পুকুরপাড়া অভিযাত্রীরা, সাত তারিখ ভোরবেলা। পুতুল আপার পায়ে সূক্ষ্ম একটা ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছিলো, সেটাকে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রয়োগে ঠিক করা হয়েছে, পুতুল আপা এখন আবার আগের মতো সাঁই সাঁই করে হাঁটতে পারেন, তিনিই এবারের সেরা অভিযাত্রী। মিলন ভাইয়ের পায়ের পেশীও কয়েকদিন বিশ্রামে ঠিক হয়ে গেছে, তিনিও গটগটিয়ে হেঁটে বেড়ান। আঠারো তারিখে ম্যালেরিয়ার আক্রমণে কাবু হয়ে পড়েছে এ গল্পের লেখক, কয়েকমাস ভোগার পর এখন সে খাড়া হয়েছে, কিন্তু এখনও ল্যাগব্যাগ করে হাঁটে, তার বদখদ চেহারাখানা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে, দূর থেকে অনেকটা চঞ্চলের মতো লাগে দেখতে। (সমাপ্ত)
false
rn
আসুন নোয়াখালী সম্পর্কে জানি নোয়াখালী জেলা স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৩৬০১ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষীপুর ও ভোলা জেলা অবস্থিত।এই জেলার প্রধান নদী বামনি এবং মেঘনা। প্রধান খাল নোয়াখালী খাল । নোয়াখালী সদর মাইজদি ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। শহরের মোট জনসংখ্যা ৭৬,৫৮৫; শহুরে লোকদের মধ্যে শিক্ষিতের হার প্রায় ৬০.৭০%। নোয়াখালী সদরের আদি নাম সুধারাম। চৌমুহনী নোয়াখালীর আরেকটি ব্যস্ত শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র ।চরপার্বতী গ্রামের চোধুরী হাট বাজারের বিখ্যাত হাই স্কুল 'চোধুরী হাট উচ্চ বিদ্যালয় " এই বাজারে অবস্থিত । এই ছাড়া এই গ্রামে আর ও অনেক গুলো হাই স্কুল আছে যেমন - কদমতলা হাই স্কুল , মেহেরুন্নিসা হাই স্কুল, চোধুরী হাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া।ইতিহাসবিদদের মতে একবার ত্রিপুরা-র পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়া-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে।নোয়াখালীর ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ১৮৩০ সালে নোয়াখালীর জনগণের জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলন।১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার গোপালপুরে গণহত্যা চালায়। নোয়াখালী জেলার মানুষের মাথা পিছু আয় ১৯,৯৩৮ টাকা নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলাধীন বজরা ইউনিয়নের অন্তর্গত দিল্লির শাহী মসজিদের অনুকরণে নির্মিত বজরা শাহী মসজিদ মোগল সাম্রাজ্যের স্মৃতি বহন করছে।মসজিদ তৈরির ১৭৭ বছর পর ১৯০৯ সালে একবার মেরামত করা হয়।চলেছেন।জনশ্রুতি রয়েছে যে, এ মসজিদে কিছু মানত করলে তাতে শুভ ফল পাওয়া যায়। তাই দেখা যায় যে, দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়ার আশায় অগণিত মহিলা ও পুরুষ প্রতিদিন এ মসজিদে টাকা পয়সা সিন্নি দান করেন। এছাড়া বহু দূর- দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। নোয়াখালী শহরের প্রাণ কেন্দ্রে মাইজদী জামে মসজিদ। মাইজদী বড় মসজিদ নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। প্রতিদিন শতশত ধর্মপ্রাণ মুসল্লী নিয়মিত এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। মসজিদের সাথে ‌‌‌‍‌‌‌‌ মানব কল্যান মজলিস নামে একটি জনহিতকর সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। যা আর্তমানবতার সেবায় মসজিদ ভিত্তিক একটি সংগঠনের রুপ নিয়েছে। নোয়াখালীর উপকূলে প্রতি বছর সাগর থেকে জেগে উঠছে বিপুল পরিমান ভূমি। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর আয়তন।বর্তমানে নোয়াখালীর উপজেলার সংখ্যা নয়টি।পঞ্চাশের দশকে মূল নোয়াখালী মেঘনা আর সাগরে বিলিন হয়ে গেলে বৃটিশদের পরিকলপনায় নতুন করে এ শহরের পত্তন হয়। নোয়াখালী শহর যখন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন মাইজদী মৌজায় ধান ক্ষেত আর খোলা প্রান্তরে পুরাতন শহরের ভাঙ্গা অফিস আদালত গুলো এখানে এনে স্থাপন করা হয়। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ষোলো একর জুড়ে কাটা হয় এক বিশাল দীঘি। লোক মুখে প্রচলিত হয় বড় দীঘি নামে। এ জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িযে ছিটিয়ে আছে। তাদের টাকা রেমিটেন্স বেশীর ভাগ জমি কেনার কাজে ব্যাবহার করা হয়। এসব কারনেই দিন দিন এখানের যায়গা জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে।। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা সঠিক কাজে ব্যাবহার করে এ জেলাকে আরো সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। একটি পর্যটন জেলা হিসাবে গড়ে উঠার সব রকম সুযোগ সুবিধাই এ জেলায় বিদ্যমান। নিঝুম দ্বীপ - এটি নোয়াখালী জেলার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার কৃতি সন্তানঃ বেগম খালেদা জিয়া, বীর শ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমেদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। দেশে-বিদেশে বৃহত্তর নোয়াখালীর মান মর্যাদাকে তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা আসুন আমরা হিংসা ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে সে প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করি এবং সফলকাম হওয়ার চেষ্টা করি।বাংলাদেশের বেশীরভাগ ভালো ব্যবসায়ী কিন্তু নোয়াখালীর। আংগো বাড়ি ভাই নোয়াখালীরয়েল ডিস্টিক কয় বেকগুনে;দেশ-বিদেশ আকাশ-পাতালনোয়াখাইল্যা আছে সবখানে। সবার উপর নোয়াখালী। শ্বাশড়ি বউকে: ‘এরে হইন্নির ঝি, ইয়ানে তোর তালুকদারী আছে নি।’অর্থাৎ- শাশুড়ি বউকে এখানে ভিখারিনীর কন্যা বলে অভিহিত করে। শিক্ষক ছাত্রকে: ‘কীয়ারে অড়া, হড়া লেয়া কি তোর টঙ্গো উটছেনি।’অথবা ‘কীরে অডা, হড়ালেয়া কি তোর গাছের আগাত উঠছেনি।’অথবা ‘কীরে অডা, হড়ালেয়া কি তোর কাঁড়ে উঠছেনি!’অর্থাৎ- কী ছেলে তোমার পড়ালেখার কি গাছের মাচায় উঠলো? এখানে দুর্বল ছাত্রটির পড়ালেখার সমাপ্তির বিষয়টি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছে। আল্লাহ আংগো ব্যাকের মনের আশা পুরন করুক, আমিন।
false
mk
কোরানের আয়াতের খন্ডিত উদ্ধৃতি দিয়ে ‘বিকৃত’ ব্যাখ্যা দিয়েছেন আল্লামা শফি হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা আহমেদ শফি কোরানের একটি আয়াতের খন্ডিত অংশ উদ্ধৃত করে নারীদের ঘরের ভেতর থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু পুরো আয়াতটি উদ্ধৃত না করায় এর আয়াতটির অর্থ এবং ব্যাখ্যার ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। সমালোচকরা এটিকে আল্লামা শফির অপব্যাখ্যা বলেও অভিহিত করছেন।প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তোলপাড় করা আল্লামা আহমেদ শফির ওয়াজের একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, তিনি সুরা আযহাবের ৩৩ নং আয়াত উদ্ধৃত করে নারীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, “এই মহিলারা, ঘরের চার দিউয়ারির মধ্যে তোমরা থাকো। ঘরের বাহিরে ঘুরাফেরা করিও না। কে বলছে, আল্লাহপাক বলছে। হুজুরের আগের জামানায় মহিলারা বেপর্দায় চলাফেরা করতো। ঘর থেকে বাইর হইয়ো না তোমরা। উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরাফেরা করিও না রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মাঠে। সাবধান, মার্কেটিং করতে যাবেন না। ছেলে আছে, স্বামী আছে এদেরকে বলবা মার্কেটিং করার জন্য, তোমরা কেন যাইবা? তোমরা শুধু স্বামীকে অর্ডার করবে, এই জিনিস আনো, ওই জিনিস আনো, এই জিনিস নিয়া আসো। অর্ডার করবেন ছেলেকে অর্ডার করবেন বইসা বইসা আপনি কেন কষ্ট করবেন? আপনি স্বামীর ঘরের মধ্যে থাইকা স্বামীর আসবাবপত্র এগুলা হেফাজত কইরবেন। ছেলে-মেয়ে, ছেলে সন্তানকে লালন পালন করবেন। এগুলা আপনার কাজ। আপনে বাহিরে কেন যাবেন?” ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরানের কোনো কোন আয়াত যখন "এবং" (ওয়া) দিয়ে শুরু হয় তখন সেই আয়াতটার আগের আয়াতটাও পড়ে নেওয়া দরকার - তাতে আয়াতের মুল বিষয়টা বুঝা যায় ভাল ভাবে। নইলে খন্ডিত বা ভূল ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হয়। ভিডিওচিত্রে মাওলানা শাফি যে আয়াতটা বলেছেন - তা ছিলো সুরা আযহাবের ৩৩ নং আয়াত - যা শুরু হয়েছে ‘ওয়াকারনা’ মানে "এবং থাকো" দিয়ে । এই ‘এবং’ এর কারনেই আগের আয়াতটা উল্লেখও জরুরী ছিলো। কিন্তু মাওলানা শফি সেটি উল্লেখ করেন নি।সূরা আযহাবের (৩৩.৩২) আয়াতে বলা হয়েছে, হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। মাওলানা শফি নবী পত্নীদের উদ্দেশ্য নাজিল হওয়া আয়াতের এই অংশটুকু উদ্ধৃত করেননি। তিনি আয়াতের পরের অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, (৩৩:৩৩) তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে।ধর্মীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, কোরানের আয়াতে স্পষ্ট করে বলঅ হয়েছে, "হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও"। কিন্তু আল্লামা শফী এই আয়াতের বরাত দিয়ে সকল নারীকে "চারদেওয়ালের ভিতরে" আটকানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।যা কোরানের নির্দেশনাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহারের শামিল। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিষ্ট আবু সাঈদ জিয়া উদ্দিন বলেন, শফী সাহেবের ওয়াজের ভিডিও টি শুনে অবাক হইনি । কারন ওল্ড স্কুল অব থটসের এই ধরনের চিন্তাই ছিলো। উনি মুলত প্রাচীনপন্থী চিন্তার মানুষ এবং নারীদের গৃহবন্দী করে সকল সমস্যার সমাধান খুঁজেন। কিন্তু যদি আমরা ওমর (রা এর শাসনামল দেখি দেখবো উনি মদিনার বাজার পরিদর্শক হিসাবে একজন নারীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন - প্রশ্ন আসে ওমর (রা কি কোরানের এই আয়াতটা জানতেন না!
false
ij
গল্প_ কুকুর Feminism is the radical notion that women are people. Cheris Kramarae and Paula Treichler ফোন অফ করে অনেক ক্ষণ স্তব্দ হয়ে বসে থাকলেন নাসরিন রিয়াজ। তখন শহরের উপকন্ঠে সন্ধ্যা নামছিল। অন্ধকার দ্রুত এ ঘরটায় ছড়িয়ে পড়ছিল। জানালার কাছে বাতাসের দাপাদাপি। অস্থির বাতাসের গন্ধটাও কেমন নোনা। কাছেই টঙ্গি খাল। উত্তরার সেক্টর ১০ এর এই জায়গাটা এখনও অনেক নিরিবিলি। সদ্য বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। লাল রঙের সিরামিক ইটের দোতলা বাড়িটির নাম শখ করে রেখেছেন ‘বহ্নিশিখা’ । একতলা একটা কোরিয়ান ফার্ম ভাড়া নিয়েছে । ওরা বাইং হাউজ করবে। একতলা এখনও ফাঁকা। সালমা ঘরে ঢুকল। টিউব লাইট জ্বালাল। ওর হাতে চায়ের মগ। মগটা টেবিলের ওপর রেখে চলে যায় সালমা । কথাবার্তা খুবই কম বলে মেয়েটা। সারাদিন এ সংসারে কেমন ছায়ার মতো ঘুরে। অন্যমনস্ক হয়ে চায়ের মগ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন নাসরিন রিয়াজ । মাঝ বয়েসী চশমা পরা ভরাট ফরসা মুখে গভীর দুশ্চিন্তার গাঢ় ছায়া জমেছে। এতকাল ধরে সোসাল ওয়ার্ক করছেন - এই প্রথম প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি বিরোধ বাঁধল। এটিই দুশ্চিন্তার কারণ। কিছুক্ষণ আগে পুলিসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে কথা হল। ভদ্রলোক নিজেই ফোন করেছিলেন। বললেন, ম্যাডাম, আমরা যখন বিষয়টি দেখছি, আপনি কেন খামাখা আমাদের না জানিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন? কেন? আমার কি মেয়েটিকে প্রটেক্ট করার অধিকার নেই? আছে। স্বীকার করছি। তবে একটা ক্রাইম যখন হয়েছে ...মানে বলছিলাম মামলাও যখন দায়ের করা হয়েছে। এসব এখন থানার এক্তিয়ার নয় কি? নাসরিন রিয়াজ-এর মাথায় রক্ত চেপে গিয়েছিল; কেননা তিনি জানেন, থানা-পুলিশ ইন্টারফিয়ার করলে ধর্ষিতা মেয়ের হেনস্থা আরও বেড়ে যায়। আসমা এখন থেকে আমার হেফাজতে থাকবে । বলে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। শরীর ভীষণ কাঁপছিল। সেই সঙ্গে মাথায় নানা ভীতিকর ভাবনা ভর করছিল। একা একা এই যুদ্ধটা করতে পারব তো? ইস্, এ সময় যদি কণার বাবা পাশে থাকত। একটা আর্ন্তজাতিক সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য নাসরিন রিয়াজ-এর স্বামী ড. রিয়াজ রহমান এখন ফিলিপাইনে আছেন । দু-এক দিনের মধ্যেই ফেরার কথা। ছেলেমেয়েরাও ওদের বাবার ফেরার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। নাসরিন রিয়াজ-এর এক ছেলে এক মেয়ে। বড় মেয়ে কণা- প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়ছে। ছোট ছেলে রোমেল- এ বছরই উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। দু’দিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে খাগড়াছড়ি বেড়াতে গেছে রোমেল । অন্যমনস্ক হয়ে চায়ে চুমুক দিলেন নাসরিন রিয়াজ। স্বাদটা তেতো ঠেকছে। এমন হওয়ার কথা নয়। সালমা বেশ ভালো চা বানায়। আজ কি হল ওর? আসলে আসমা এ বাড়িতে আসার পর থেকেই এ বাড়ির সবকিছু উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে ... নাসরিন রিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফোন বাজল। নম্বর দেখে অবাক হলেন। মিজানুর রহমান বাদল। ভদ্রলোক স্থানীয় সংসদ সদস্য। এখন অবশ্য বিরোধী দলের। মাঝে মধ্যে টিভির টক শো কিংবা মানববন্ধন অথবা সভাসমিতিতে দেখা হয় মিজানুর রহমান বাদল-এর সঙ্গে। মোটামুটি পরিচয় আছে। আসসালামালাকুম আপা। আছেন কেমন? এই আছি ভাই। আপনি কেমন আছেন? মৃদু উদ্বেগ বোধ করেন নাসরিন রিয়াজ। আমি ভালো আছি। ... আপা ? জ্বী। বলুন। হক সাহেব একটু আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। কে? কার কথা বলছেন আপনি? আরে হক সাহেব। সরকারি দলের মাননীয় সংসদ সদস্য জাহিদুল হক মামুন। ওহ্ । নাসরিন রিয়াজের ভ্রুঁ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। আপা? বলেন। মামুন ভাই বললেন ফুলবাড়িয়া বস্তির কোন মেয়ে কে নাকি আপনি তুলে এনেছেন ... নাসরিন রিয়াজের হৃৎকম্পনের গতি বেড়ে যায়। কোনওমতে বললেন, দেখুন ভাই, মেয়েটাকে রেপ করা হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় পড়ে ছিল। বুঝলাম। সে জন্য তো দেশে আইন-আদালত আছে আপা। নাকি? নাসরিন রিয়াজ ক্ষেপে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, আইন-আদালতই কি সব? মেয়েটার মানসিক অবস্থা একবার বিবেচনা করবেন না আপনারা ? ওর এখন রেস্ট দরকার। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে। ও আগে সুস্থ হোক, তারপর যা করার করব। না, না। আমি ওসব শুনব না। আমার ওপর প্রেসার আছে। মিজানুর রহমান বাদল বললেন। লোকটার গলার স্বর মুহূর্তেই কেমন বদলে গেছে। আমি লোক পাঠাচ্ছি। আপনি মেয়েটিকে ওদের কাছে বুঝিয়ে দিবেন। মিজানুর রহমান বাদল ফোন অফ করে দিলেন। নাসরিন রিয়াজ-এর মনে হল কে যেন গালে চড় মেরেছে। হাতের মোবাইল ফোনটাকে মনে হচ্ছে এক খন্ড বরফ। কপালের বাঁ পাশে দপদপ করছে। গলার কাছে ঘাম জমেছে। মায়ের চিৎকার শুনেই মনে হয় কণা দরজা খুলে উঁকি দিল। সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা চশমা পরা ফরসা মুখ। পড়াশোনা করছিল হয়তো। চোখেমুখে কেমন ঘোর-ঘোর ভাব। হাত নেড়ে মেয়েকে চলে যেতে বললেন নাসরিন রিয়াজ । কণা চলে যায়। কণা কখনও আসমার মতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে না ...কারণ, কণা নিরাপদ। কণাকে ঘিরে আছে নিরাপদ সামাজিক বেস্টনী ...আসমার সামাজিক অবস্থান ভিন্ন ... নাসরিন রিয়াজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আসমা পাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছে। ১৪/১৫ বছর বয়েসি ফুটফুটে রূপবতী একটা মেয়ে। এই রূপই হয়েছে মেয়েটির ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ ; আসমার মা নেই। ফুলবাড়িয়া বস্তিতে থাকত বাবার সঙ্গে। আসমার বাবা হাকিম আলী রিকশাওয়ালা। দু’দিনের জ্বরে হাকিম আলী মারা যাওয়ার পর আসমার মাথার ওপর যে যৎসামান্য আশ্রয় ছিল- সেটিও সরে যায়। প্রশাসনের নাকের ডগায়, রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় ফুলবাড়িয়া বস্তিতে দীর্ঘকাল ধরে চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। ওই বস্তির ছেলেবুড়ো অনেকেই মাদকব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওদেরই কেউ সম্ভবত আসমাকে ধর্ষন করে। গত মঙ্গলবার রাতে । কী কারণে খবরটা কোনও পত্রিকায় ছাপা হয়নি। ভোরের কাগজ-এর ফটো সাংবাদিক আজাহারউদ্দীন- সেই নাসরিন রিয়াজ কে ফোন করে সব জানাল । নাসরিন রিয়াজ নিজেই উদ্যেগী হয়ে ফুলবাড়িয়া বস্তি থেকে আসমাকে নিয়ে এসেছেন । এ ধরণের কাজ আগেও করতে হয়েছে। নাসরিন রিয়াজ একটা মহিলা কলেজে পড়ান; পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে নারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ‘বহ্নিশিখা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ফটো সাংবাদিক আজাহার উদ্দীন ও এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত; ঢাকার বাইরেও কয়েকটি জেলায় ‘বহ্নিশিখা’ সংক্রিয়। শাহিন আরা কে ফোন করেছিলেন নাসরিন রিয়াজ । শাহিন আরা ডাক্তার এবং ‘বহ্নিশিখা’ -র একজন সক্রিয় সদস্য। ওই আসমার প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট যা করার করেছে। কাল সকালেও একবার আসার কথা শাহিনের। সোফার ওপর সিদে হয়ে বসে ছিলেন নাসরিন রিয়াজ। ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছেন। এখন হেলান দিলেন। ঠিকই তখনই সেল ফোনটা বাজল। ডিসপ্লে তে অচেনা নাম্বার। বুকটা ধক করে উঠল। রিয়াজ নয় তো? হ্যালো? হ্যালো। আমি। তোমাদের খবর ভালো তো? স্বামীর কন্ঠস্বরে স্বস্তি পেলেন। উদ্বেগ চেপে রেখে বললেন, আমরা ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। এই মাত্র হোটেলে ফিরলাম। শোন, আমি বুধবার দুপুরের মধ্যেই ফিরছি। ড. রিয়াজ বললেন। খাওয়াদাওয়া সব ঠিকঠাক হচ্ছে তো? হ্যাঁ। ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। রোমেল এখনও চিটাগাঙ ফেরেনি না? না। শোন। তখন কণা বলছিল ... ওর ল্যাপটপের কথা তোমার মনে আছে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার মনে আছে, মনে আছে। কাল মনে হয় সময় পাব, কাল শপিং করব। ওকে। এবার বল আসমা কেমন আছে? আসমা এখন ভালো। মনে হচ্ছে প্রাইমারি ট্রমা কাটিয়ে উঠেছে। আর শোন। এখন আমার কাছে ওর কেসটা পরিস্কার। আমি এখন জানি কারা আসমাকে রেপ করেছে এবং কেন করেছে? কারা? কারা আবার? এ শহরেরই একদল ভাড়াটে সস্ত্রাসী - যারা আসমার মতো ‘অ-নিরাপদ’ গরীব সুন্দরী মেয়েদের ধনীদের প্রমোদকুঞ্জে তোলে। তার আগে ওদের রেপ করে বা অন্য কোনও উপায়ে ব্যবহারযোগ্য করে নেয়। যে প্রমোদকুঞ্জে মিজানুর রহমান বাদল আর জাহিদুল হক মামুন -রা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে বসে মদ পান করে, স্বাদ নেয় কিশোরীর কোমল মাংশের । মিজানুর রহমান বাদল আর জাহিদুল হক মামুন? করা এরা? নাসরিন রিয়াজ সব খুলে বললেন। স্পস্ট টের পেলেন শরীরের সমস্ত রক্ত চলাচল কেমন অশান্ত হয়ে উঠেছে। সাবধানে থেকো। ড. রিয়াজ বললেন। থাকব। ফোন অফ করে সালমা কে ডাকলেন নাসরিন রিয়াজ । সালমা এল। রান্নাঘরে ছিল মনে হয়। একবার নীচে যা তো। কালেপসআবল গেটটা বন্ধ করে দিয়ে আয়, যা । সালমা চলে যায়। ভীষণ উদ্বেগ বোধ করছেন। তখন মিজানুর রহমান বাদল-এর গলার স্বর কেমন নিমিষে বদলে গেল। বললেন, আমি লোক পাঠাচ্ছি। আপনি মেয়েটিকে ওদের কাছে বুঝিয়ে দিবেন। নাসরিন রিয়াজ শিউরে উঠলেন। আসমাকে কি ফিরিয়ে দিতে হবে? সম্ভবত। নইলে এরা ‘বিশিষ্ট সমাজকর্মী অধ্যাপিকা নাসরিন রিয়াজ নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য’ ...ইত্যাদি বলে ফাঁসিয়ে দেবে। মিডিয়া এদের দখলে-এরা চাইলে যা ইচ্ছে করতে পারে। নইলে আসমার ধর্ষনের খবরটা কোনও পত্রিকায় ছাপা হয়নি কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাসরিন রিয়াজ । কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ? পুরুষের হা হা লোভই যদি প্রশাসন যন্ত্রে পরিনত হয় তখন ... তখন সেই অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে কে জেতে? অনেক দিন আগে ফরাসি গণিতবিদ পাসকাল বলেছিলেন: “Justice and power must be brought together, so that whatever is just may be powerful, and whatever is powerful may be just.” এই কথাটা আজও বিশ্বের কোনও সমাজেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা হয়েছে তা হল- ক্ষমতার একপাক্ষিক বিস্তার; যে বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষতন্ত্র। সেই অশুভ বিস্তারে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে সালমা-আসমাসহ অসংখ্য মেয়ের জীবন । এই কারণেই কি Roseanne Barr বলেছেন:The thing women have yet to learn is nobody gives you power. You just take it. সালমা ফিরে আসে। ভাত খাবে কিনা জিগ্যেস করল। ঘড়ি দেখলেন নাসরিন রিয়াজ । ১১টার মতো বাজে। শরীর ভিজে আছে। গলার কাছে তৃষ্ণা। মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাথার খুলির সেই ব্যথা ফিরে আসছে। না রে, এখন আমি কিছু খাব না। সালমা চলে যায়। এই মেয়েটিও অল্প বয়েসেই পুরুষের খেয়াল খুশির বলি হয়েছিল। রংপুরের বদরগঞ্জের মেয়ে সালমা । বিয়ের এক বছর পরই স্বামী তাড়িয়ে দেয়। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পথে পথে ঘুরছিল ... তখনই রওশনের সঙ্গে দেখা। রওশনের শ্বশুরবাড়ি ওখানেই। রওশনই ঢাকায় নিয়ে এসেছিল সালমাকে । নাসরিন রিয়াজ এর ছাত্রী রওশন । ড. শাহিন আরা, ফটো সাংবাদিক আজাহার উদ্দীন -এর মতো রওশনও ‘বহ্নিশিখা’-র একজন সক্রিয় কর্মী ... সালমার শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ার সময়ই মারা যায়। এর পর দীর্ঘকাল সালমা ক্রনিক মেলানকলিতে ভুগেছে। দীর্ঘকাল বিষন্ন ও মৌন ছিল। স্বামী ডাক্তার বলেই চিকিৎসার সুবিধার্থে সালমাকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন নাসরিন রিয়াজ । সাধারনত নির্যাতিত মেয়েদের কোথাও থিতু করিয়ে দেয় ‘বহ্নিশিখা’-র সদস্যরা। সালমা কে কোথাও থিতু করানো গেল না। আজও । হঠাৎই নীচের রাস্তায় এক সঙ্গে অনেকগুলি কুকুরের ডাক শোনা গেল । চমকে উঠলেন নাসরিন রিয়াজ । উঠে দাঁড়ালেন। মাথা সামান্য টলে উঠল। সামলে নিয়ে দ্রুত পায়ে জানালায় পাশে এসে দাঁড়ালেন । জানালার কাছে জোলো হাওয়ার মাতামাতি। নীচের রাস্তায় কয়েকটা জিপ আর একটা মাইক্রোবাস থেমে আছে। নাসরিন রিয়াজ এর বুক ধক করে ওঠে। কারা ওরা? মিজানুর রহমান বাদল-এর লোক? আসমাকে নিতে এসেছে? কী করবেন বুঝতে পারছেন না। রাস্তায় আবছা অন্ধকার। ওধারের কলাঝোপ আর বাউন্ডারি দেওয়া মাঠের ওপর ক্ষীণ চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে। হঠাৎই দৃশ্যটা চোখে পড়তেই নাসরিন রিয়াজ-এর শরীর মুহূর্তেই জমে উঠল। জিপ আর মাইক্রোবাস থেকে পিলপিল করে নামছে এক পাল-পাল কুকুর। মুহূর্তেই আধো-অন্ধকার রাস্তাটি ভরে উঠল কুকুরে-কুকুরে । কুকুর কেন? আশ্চর্য! নীচের ওই গা শিরশিরে দৃশ্য দেখে চাপা চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল নাসরিন রিয়াজ এর কন্ঠস্বর থেকে। কণা দৌড়ে এসে মা’র পাশে দাঁড়াল। গা ছমছমে দৃশ্যটা দেখে ‘মা’ বলে আর্ত চিৎকার করে মাকে জড়িয়ে ধরল। টের পেল মা’র শরীর থরথর করে কাঁপছে। যেন বধ্যভূমিতে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে, এখুনি খুনিদের রাইফেলের গুলিতে হৃৎপিন্ডটি ছিঁড়ে যাবে। নাসরিন রিয়াজ মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক তক্ষুণি একটি কুকুর বিশাল হয়ে উঠে দোতলা বাড়িটির ঝুঁটি ধরে ঝাঁকি দিল যেন। বাড়িটি থরথর করে কেঁপে উঠল। ততক্ষনে সালমাও এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছে। জানালায় উঁিক দিয়ে নীচে কুকুরগুলি দেখল। মেয়েটি অল্প বয়েসেই জীবনের বিভৎস রূপটি দেখেছিল বলে কঁকিয়ে উঠল না বা চিৎকার করে উঠল না । কেবল আঁচলে মুখচাপা দিয়ে ভৌতিক আলোয় দেখল লেলিহান কুকুর ...কুকুর আর কুকুর ... অজস্র কুকুর ... অজস্র ক্ষুধার্ত কুকুর ...কিশোরীর কোমল মাংশের লোভে এসেছে ... অজস্র কুকুর ... অজস্র ক্ষুধার্ত কুকুর ... পাল -পাল কুকুর ... কুকুর আর কুকুর ... কোনও কোনও কুকুরের মুখে স্বামীর মুখের আদল দেখেও বিস্মিত হল না সালমা... পৃথিবীর সর্বশেষ দিনটি আসন্ন জেনে নাসরিন রিয়াজ মেয়েকে আঁকড়ে ধরে চোখ বুজে আছেন। বুঝি, এখুনি ‘বহ্নিশিখা’ নামের বাড়িটি ধ্বসে পড়বে অতিকায় কুকুরগুলির বিষদাঁত আর নখর-আঘাতে ... সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১২:৩১
false
rg
সে রাতে উৎসব ছিল, শহীদুল জহিরের সঙ্গে___ সে রাতে উৎসব ছিল... টোকন ঠাকুর হতে পারে ১৯৯২ সালের দিকে, গত শতাব্দিতে আমি খুলনায় ছিলাম। রাজশাহী থেকে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজীজুল হক ছোটগল্প ও গদ্যকাগজ ‘প্রাকৃত’ প্রথম সংখ্যা বের করলেন। আগ্রহী বন্ধুদের কাছে বেচার জন্য হাসান স্যার ১০ কপি ‘প্রাকৃত’ ডাকযোগে পাঠালেন আমার তখনকার ঝিনাইদহের ঠিকানায়। ‘প্রাকৃত’তে হয়তো দুজন লেখককে পেলাম, তারা আমার কাছে নতুন। একজন তরুণী, আনন্দময়ী মজুমদার। পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা অনুবাদ করেছেন খন্ডাংশ, সেই অনুবাদ ভালো লাগল। আরেকজন একটি গল্প লিখেছেন, তিনি শহীদুল জহির। গল্পের নামÑ ‘ডুমুর খেকো মানুষ’। গল্পটি পড়েই, তখন, সেই টকটকে বয়সেই টের পাই, আগে পড়িনি তিনি এমন ভঙ্গির লেখক। অসাধারণ। ঢাকাবাসী জীবন শুরু হলো নব্বুইয়ের দশকের প্রথমভাগেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র নামধারী হয়ে। খুব বই পড়ার অভ্যাস আমার অনেক দিনের। শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ এবং গল্পগ্রন্থÑ ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ পড়া শেষ। আরো নিবিড় করে তার গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে আমি পুরোনো ঢাকার দণি মৈশুন্ডি, পদ্মনিধি লেন, কলতাবাজার, ভুতের গলি, নারিন্দা কিংবা সুহাসিনী, সুরধ্বনি, নলকার গ্রাম এলাকার কুয়াশায়, সবুজে ঢুকে পড়লাম। আগেই তো আমি তুমুল জড়িয়ে গেছি বাংলা কবিতায়, ছোটগল্পে, উপন্যাসে, নানান রচনায়। এবং পুরো নব্বুয়ের দশকে ঢাকার প্রায় বড় বড় সব কবি-সাহিত্যিককেই ঘরে, বাইরে, হাড়িতে, নাড়িতে, পথে, বেপথে, আনন্দ বেদনায়, ঘৃণায়, ভালোবাসায় কাছে থেকে দেখি, ভেতর থেকে কবিকে কিংবা লেখককে দেখার সুযোগ পেতে থাকি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, শওকত ওসমান পর্যন্তÑ প্রায় সবার সঙ্গেই সাহিত্য নিয়ে চাষবাস করি। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদকে তো প্রায় প্রতিটা দিনই কাছে গিয়ে পেয়েছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্বাধীনতা উদ্যান (সোহরাওয়ার্দি পার্ক), মোল্লার দোকান চারুকলা, কিংবা নব্য প্রতিষ্ঠিত শাহবাগের আজিজ মার্কেটের ছফা ভাই ও হুমায়ুন আজাদ স্যার বা ফরহাদ ভাই (মযহার) কে পেয়েছি। সঙ্গ নিয়েছি। দিয়েছিও, দিনের পর দিন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রিয় হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরকে কেন বাস্তবে দেখা পাই নাÑ এই প্রশ্ন নিজের মধ্যেই জাগে মাঝেমধ্যে। কিন্তু, ‘কোথায় পাবো তারে?’ একদিন জানলাম, তিনি সচিব বা উপসচিব। ব্রাত্য রাইসু বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম দিকের সাময়িকী সম্পাদক। একদিন রাইসুই ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পড়তে দিল। শহীদুল জহিরকে কাছে থেকে দেখার পিপাসা আরো বাড়ল। একদিন এক মন্ত্রণালয়ের দিকে ইচ্ছা তাক করে আমি উপসচিব শহীদুল হককে ফোন করি। ফোন নম্বরটি আমাকে দিয়েছিলেন আরেক আমলা, আমার প্রিয়জনদের একজন গোলাম শফিক। নাট্যকার। সেটা হয়তো ১৯৯৯ সাল। যাই হোক, আমি সেই প্রায়সচিবকে ফোনে বললাম, ‘হ্যালো?’ ‘হ্যালো।’ অপরপ্রান্তের উত্তর। ‘এখানে কি শহীদুল জহিরকে পাওয়া যাবে?’ ‘না।’ ‘কেন, এই নম্বরেই নাকি তাকে পাওয়া যায়?’ ‘না। শহীদুল জহির বলে এখানে কেউ নেই।’ ‘আপনি কে?’ ‘আমি শহীদুল হক। আর কিছু বলবেন?’ ‘না। আমি শহীদুল জহিরকে খুঁজছি। তাকে প্রয়োজন।’ ‘ঐ নামে তো এখানে কেউ নেই।’ ‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’ ফোনালাপে কোনো মীমাংসা হয় না। তারপর আবার দিন যায়। শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না, প্রার্থিত একটা আড্ডাও হয় না। এরপর, হতে পারে ২০০০ বা ২০০১ সাল। এক ঈদের দিন রাত ১০টার পরই নি:সঙ্গতার খপ্পরে পড়ে গিয়ে আমার ছোটবেলার বন্ধু হুমায়ুনকে নিয়ে আমি যাই বেইলি রোডের এক সরকারি আবাসনে। নাট্যকার গোলাম শফিকের বাসায়। তার কাছেই বলি, ‘আচ্ছা, শহীদুল জহির এখানে কোন ভবনে থাকেন?’ শফিক ভাই বলে দেন, ‘রাস্তার অপজিটে যে ছয় তলা ভবনের কোয়ার্টারগুলো, তারই এক বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় উনি থাকেন। আমাদের সিনিয়র। ’৮১ ব্যাচের ক্যাডার।’ রাত প্রায় সাড়ে দশটা বা তারও পরে ছয়তলা কোয়ার্টারের নিচতলায় আমি যাই এবং খুব সঙ্গত কারণেই একজন দারোয়ানের সঙ্গে কথোপকথন করিÑ আমি : এই বিল্ডিংয়ে কি শহীদুল জহির থাকেন? দারোয়ান : কোন শহীদুল জহির? আমি : লেখক। লেখালেখি করেন। প্রায়সচিব। দারোয়ান অবিশ্বাস্য একটি শব্দ ছুড়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি তার শব্দে বিস্মিত হই এবং একমত পোষণ করি, দারোয়ান প্রশ্ন করেনÑ দারোয়ান : অকৃতদার শহীদুল জহির? আমি ‘হ্যা’ এবং আমি হা। দারোয়ান বললেন, ‘যান, ছয়তলায় যান। স্যার বাসায় আছেন।’ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথে, প্রত্যেক তলায় দুটো করে দরজা। ঈদের দিন হওয়ায় বেশিরভাগ দরজার সামনেই প্রচুর জুতা-স্যান্ডেল। বাসায় ঈদের মেহমান। বাচ্চা-কাচ্চা থেকে শুরু করে নানা বয়সীদের নতুন জুতা স্যান্ডেল। ছয়তলাতেই অবস্থাটা বেশি চোখে পড়ল। একদিকের ফ্যাটের দরজার সামনে, সেই ঈদের রাতের প্রায় পৌনে এগারোটায়, বাচ্চা-বড়-বুড়োদের একগাদা নতুন জুতা-স্যান্ডেল, অন্যদিকের দরজাটাও কিছুটা শ্রীহীন, জুতা-স্যান্ডেল কিচ্ছু নেই। পা মোছার পাপোষও নেই। দরজায় কড়া নাড়ি। একবার, দুইবার... তখন আমি হয়তো কড়া নাড়ি আবদুল করিমের দরজায়... ভেতর থেকে দরজা খুলে, লুঙ্গি পরাÑশার্ট গায়ে দেওয়া যিনি বের হলেন, তার মুখ আমি দেখেছি, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ এবং ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (যে বই দুটো কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু থেকে বের হয়েছিল); বই দুটোর ফ্যাপে আমি এই মুখ দেখেছি, একটা ফটোতে গোঁফ আছে, একটাতে গোঁফ নেই। আমার সামনের মানুষটিরও তখন গোঁফ নেই। আমার আর বুঝতে বাকি নেই। তবু ফর্মাল একটা প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি শহীদুল জহির?’ শহীদুল জহির মাথা নেড়ে ফের আমাকেও একটা প্রশ্ন করেন, তার প্রশ্নে আমি বিস্মিত হই, খুশি হই, লজ্জাও পাই একধরনের; তার প্রশ্ন, ‘আপনি কি টোকন ঠাকুর?’ আমি হুমায়ুনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলি, ‘আমার বাল্যবন্ধু, পুলিশে আছে।’ শহীদুল জহির ভেতরে প্রবেশের ইংগিত করেন এবং সেই রাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক এবিষয়Ñ সেবিষয় নিয়ে কথা বলি। বলি কি, আমি প্রশ্ন করি, শহীদুল জহির তার এক ভক্তের পিপাসাকে আরো দীর্ঘ করে দেন। বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?’ প্রিয় লেখক বললেন, ‘কাগজে ছবি ছাপা দেখেছি...’ টিভিতে ঈদের দিনের প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছিল। একটি চ্যানেলে দেখাচ্ছিল ঈদ উপলে ঢাকায় জাতীয় মেহেদী উৎসব প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়েরা মেহেদী মাখা হাতে সাজুগুজু করছে। উৎসবের প থেকে দায়িত্বশীল এক তরুণ কথা বলছে টিভি সাাৎকারেÑ ‘মেহেদী উৎসব এবছর ঢাকায় শুরু হলেও আগামী বছর থেকে এটি জেলায় জেলায়, থানায় থানায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে, মেয়েরা সাজবে, ছেলেরা সাজাবে...’ শহীদুল জহির বললেন, ‘এ কি আপনাদের বন্ধু?’ বললাম, ‘হ্যা।’ ‘সেটাই অনুমান হলো।’ ঐ রাতে, টিভির মধ্য থেকে মেহেদী উৎসব নিয়ে সংগ্রামী কথা বলছিল আমাদের বন্ধু আদিত্য কবির। তারপর শহীদুল জহির নিজে হাতে চা কিংবা কফি খাওয়ালেন। তার লেখা নিয়ে কথা বলছিলাম আমি, সে রাতের পূর্ণিমা নিয়ে, ডুমুর খেকো মানুষের গল্প নিয়ে, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নিয়ে। তিনি তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘পারাপার’ এর কথা বললেন, আমি বললাম, তখন পর্যন্ত আমার সেটা পড়া নেই। বললাম. ‘আজিজে আসেন না কেন? মোল্লায় আসেন না কেন? চারুকলায় আসেন না কেন? পিককে আসেন না কেন? সাকুরায় আসেন না কেন? টিএসসি, মধুর কেন্টিন, বেইলি রোড বা শিল্পকলায় আসেন না কেন? তার উত্তর ছিল, ‘পোষায় না, তাছাড়া সময়ও তো পাই না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকি... চাকরি করি...’ জানালাম, ‘আপনার কোনো কোনো গল্প আমি বহুবার পড়েছি।’ তার চোখে সকৌতুক হাসি, যেন, পড়তেই হবে। বললাম, ‘সিরাজগঞ্জে ছিলেন কখনো?’ ‘ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, কয়েকমাস।’ বললাম, ‘আপনার আরো কিছু গল্প-উপন্যাস পড়তে চাই। অনেকেই চায়।’ তিনি জানতে চাইলেন, আমার বন্ধুদের মধ্যে কার কার লেখা আমার ভালো লাগে? কার কার সঙ্গে আমার আমার বন্ধুত্ব... ইত্যাদি। শহীদুল জহিরকে বললাম, ‘এখন তো প্রায় রাত ১২টা, আজ উঠি? আরেকদিন আসব।’ উনি বললেন, ‘ফোন করে আসবেন।’ আমার প্রিয় লেখকের বাসা থেকে, সেই রাত প্রায় ১২টার দিকে, ঈদের রাতে, বেরিয়ে আমার সময়, বিদায় নেবার আগে, আমি আর হুমায়ুন আর শহীদুল জহির, আর রাশি রাশি নি:সঙ্গতা... আর চারদিকে ঈদের আনন্দ... আমি বললাম, ‘আপনাদের দারোয়ানকে যখন প্রশ্ন করলাম, ‘শহীদুল জহির কি এই বিল্ডিংয়ে থাকেন? দারোয়ান বলল, অকৃতদার শহীদুল জহির?...’ শহীদুল জহির হা হা করে হেসে ফ্যালেন। হাসি আমরাও। আর কখনো যাওয়া হয়নি। এরপর ‘ডলু নদীর হাওয়া’... কিংবা ‘মুখের দিকে দেখি’ বেরিয়েছে, তিনি দু দুটা শ্রেষ্ঠ লেখক ধরনের পুরষ্কারও পেয়েছেন... আমি আমার এই প্রিয় লেখকের এক একটি গল্প বহুবার যেমন পড়েছি, এখনো পড়ি। এর মধ্যেই সেদিন, মাত্র ৫৩ / ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন হঠাৎ। এ বয়েসে যাওয়া তার ঠিক হয়নি। আরো কিছু লেখা পেতে পারতাম তার কাছ থেকে, স্বার্থপরের মতো। দীর্ঘকালের এই পৃথিবীতে আমরা শহীদুল জহিরের কাছ থেকে গল্প চেয়েছি, উপন্যাস চেয়েছি, কারণ হয়তো এটা যে, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শহীদুল জহির মোটা দাগে দাগ হয়ে থাকবেন বাংলা কথাসাহিত্যের শ্রীমুগ্ধ গভীর সংসারে। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের বদলে আমরা তাকে কি দিয়েছি? আমরা পাঠক, পাঠক কি খুব বেশি স্বার্থপর, প্রায়শই? সেই একবার দেখা আমার শহীদুল জহির অমর রহে... ৩০ অক্টোবর ২০০৮ সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৮:২৭
false
ij
হাইকসস কারা_ প্রাচীন যুগে যুদ্ধের সময় ঘোড়ায় টানা যুদ্ধরথের (horse-drawn chariots) ভূমিকা ছিল ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল নিকট প্রাচ্যের সেমেটিক সভ্যতাগুলি। যেমন, মেসোপটেমিয়া। প্রাচীন মিশরে যুদ্ধরথ প্রচলন করেছিল সেমেটিক হাইকসসরা। পরে যুদ্ধের জয়পরাজয় নির্ধারনে যুদ্ধরথের নৈপুন্য হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। মিশরীয় ভাষায় Hyksos শব্দের অর্থ বিদেশি শাসক। হাইকসসরা আসলে ছিল সেমেটিক যাযাবর। দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে তারা মিশর জয় করে নিয়েছিল। তারপর মিশরে তারা পঞ্চদশ রাজবংশ স্থাপন করেছিল। হাইকসসদের অনেকেই বলে “মেষপালক রাজা”। এই ব্যাখ্যাটি একেবারেই ভুল। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, হাইকসসদের উত্থান হয়েছিল সম্ভবত প্রাচীন সিরিয়া কিংবা ফিলিস্তিনে। জীবনযাত্রার দিক থেকে তারা ছিল যাযাবর ঘোড়সওয়ার। হাইকসসরা যুদ্ধে যুদ্ধরথ ব্যবহার করত-যা মিশরবাসীর অজানা ছিল। আসলে তারাই মিশরে ঘোড়ার প্রচলন করেছিল। ফ্লাভিয়াস জোসেফাস ছিলেন ইহুদি ঐতিহাসিক। তাঁর লেখায় হাইকসসদের সম্বন্ধে বিস্তারিত পাওয়া যায়। হাইকসস আমলে হিব্র“বাসীরা ছিল মিশরে । হাইকসসরা সেমেটিক যাযাবর হওয়ায় হিব্র“রা সহজেই তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে উঠছিল। হাইকসসদের সঙ্গে হিব্র“ভাষীদের দহরম-মহরম মিশরবাসীর পছন্দ হয়নি। কাজেই, হাইকসসরা মিশর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মিশরবাসী হিব্র“ভাষীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, এবং হিব্র“ভাষীদের ওপর নানারকম অত্যাচার করতে থাকে। পরে মুসা নবী হিব্র“বাসীদের মিশর থেকে সিনাই উপদ্বীপে নিয়ে আসেন। মিশর শাসনকালীন হাইকসসরা মিশরীয় প্রথা গ্রহন করেছিল। এমন কী তারা মিশরীয় নামও গ্রহন করত। ক্রিট দ্বীপ ও ব্যাবিলনের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল হাইকসসরা। অবশ্য তাদের আমলের উল্লেখযোগ্য ভবনাদির তেমন নির্দশন পাওয়া যায়নি। মেমফিস তখন ছিল মিশরের রাজধানী। হাইকসসরা মেমফিস দখল করে কর আদায় করতে থাকে। নীল উপত্যকার উত্তর-পূর্বাংশে হাইকসসদের অধিপত্য ছিল। দক্ষিণে- মিশরীয় অভিজাতরাই শাসন পরিচালনা করত। অবশ্য তাদের হাইকসস রাজাকে কর দিতে হত। এই মিশরীয় অভিজাতদের নেতৃত্বেই পরে সমগ্র মিশরবাসী গভীর জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাইকসসবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষাবধি তারা সফলও হয়। প্রথম আহমস অষ্টাদশ রাজবংশ স্থাপন করেন। এঁর সময়কাল: ১৫৫০-১৫২৫খ্রিস্টপূর্ব। ইনিই হাইকসসদের মিশর থেকে বের করে দেন। তারপর হিব্র“ভাষীদের পীড়ন করতে থাকেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মুসা নবী হিব্র“বাসীদের মিশর থেকে সিনাই উপদ্বীপে নিয়ে আসেন। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে এই ঘটনাই “এক্সডাস” নামে পরিচিত। তথ্য উৎস- "Hyksos." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved. সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:১৫
false
rg
মাই ডটার শান্তা ডায়েড এ্যাট ১১পিএম অন ফ্রাইডে ।। রেজা ঘটক ২০১০ সালের ১৩ মার্চ শনিবার সকাল ১১ টা ৩৭ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে আমার সেলফোনে একটা এসএমএস আসে। সেলফোনটা মাথার কাছে থাকায় মেসেজ রিসিপ্ট রিং টোনেই আমার ঘুম ভাঙে। কাঁচা ঘুমের মধ্যে হাতড়িয়ে মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা ওপেন করি। মেসেজ প্রেরক শামীম ভাই। অনেক দিন শামীম ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। এতো সকালে শামীম ভাইয়ের ঘুম থেকে ওঠার কথা নয়। সাধারনত জরুরী না হলে শামীম ভাইও আমার মতোই নিশি জাগা পাখী। শামীম ভাই এতো সকালে কী মেসেজ দিলেন। হালকা একটা আতংক মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। চোখ খুলে আমি মেসেজটা পড়ি। মাই ডটার শান্তা ডায়েড এ্যাট ১১পিএম অন ফ্রাইড। মাত্র ৮টি শব্দের কী ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের মেসেজ। ভুল পড়লাম না তো। আমি মেসেজটা আবার পড়ি। না কোনো ভুল নেই। শোয়া থেকে উঠে বিছানার ওপরে বসি। মেসেজটা আবার পড়ি। না কোনো ভুল নেই। আবার মেসেজটা পড়ি। আমার সারা শরীরে একটা কম্পন খেলে যায়। এটা কী সত্যি কোনো মেসেজ! নাকী জাঙ্ক ই-মেইলের মতো জাঙ্ক এসএমএস। সেলফোনে কী জাঙ্ক মেসেজ আসে? আমি মেসেজটা আবার পড়ি। আমার ধাতস্থ হতে আরো কয়েক মিনিট লাগে। শামীম ভাইকে কলব্যাক করি। ওপাশ থেকে জবাব আসে- দ্য ফোন ইউ ডায়াল ইজ আনরিচএ্যাবল নাউ, প্লিজ ট্রাই ইউ লেটার। আমি আবার ফোন করি। আবারো জবাব আসে- দ্য ফোন ইউ ডায়াল ইজ আনরিচএ্যাবল নাউ, প্লিজ ট্রাই ইউ লেটার। আমি শামীম ভাইয়ের অপর নাম্বরটায় রিং করি। নাহ! এটাও বন্ধ। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। আমি সময় হিসেব করি। তাহলে কী শান্তার এখন জানাজা হচ্ছে? নাকী অলরেডি মাটি দেয়া হয়ে গেছে? আবার ফোন করি। আবারো একই জবাব। দুটো নাম্বারই বন্ধ। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকি। চুপচাপ... শান্তার মুখখানা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী মিষ্টি কচি কমলার মতো মুখখানা। চোখ দুটোতে না বলা কতো যে জিজ্ঞাসা! আমার মনে পড়ে গত রমজান মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চার তলার মহিলা কেবিনে শাদা বিছানায় শুয়ে থাকা শান্ত চুপচাপ হাজারো কষ্ট লেখা অবুঝ শান্তার নির্বাক সেই ছোট্ট মুখখানা। শান্তার চোখের দিকে আমি সরাসরি তাকাতে পারিনি সেদিন। আমার সাথে ছিল বন্ধু নাহিদ। আমি নাহিদের পায়ে আস্তে একটা চাপ দেই। নাহিদ আমার ইসারা বুঝতে পারে। প্রায় সমস্বরে নাহিদ আর আমি শামীম ভাইকে বলি- চলেন, বাইরে যাই। শান্তার আসল পরিস্থিতি কী তা ওর সামনে জানতে চাওয়াটা উচিত হবে না। ওর শান্ত নির্বাক চোখের ভাষায় ভয়ঙ্কর কিছু লেখা। যার অর্থ হয়তো আমরা কেউই জানি না। ঢাকা মেডিকেলের মেইন গেট থেকে রাস্তা ক্রস করে আমরা টোঙ দোকানের সামনে চায়ের অসিলায় বসি। শামীম ভাই একটানা আমাদের শুনিয়ে যায়। গতকাল রাত থেকে যে কী রকম ঝড় গেছে, আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। রাত দুইটা পর্যন্ত এমার্জেন্সির সামনে মাটিতে শুয়ে আছে মেয়েটা। আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছিল না। বড় ছেলেটা আমাকে শান্তনা দিচ্ছিল, জানেন। আব্বু তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে একবার ভাবো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। সঞ্জিব (চৌধুরী) মারা যাবার পর থেকে আমি নিজেও কয়েক দিন ধরে বেশ অসুস্থ। কিচ্ছু ভালো লাগে না। চোখ বন্ধ করলেই সঞ্জিবকে দেখি। তার মধ্যে শান্তার এই অবস্থা। বলেন, কার মাথা ঠিক থাকে? তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে বাইরে আসি। ছেলেটা আমার সঙ্গে আসে। রাস্তা ক্রস করে এইখানটায় আসি। কাকে বলবো, কীভাবে বলবো, কিচ্ছুই মাথায় আসে না। কয়েক জায়গায় ফোন করি। অতো রাতে আমাগো মতো পাগল ছাড়া আর কে জেগে থাকবে বলেন? যাদের দিয়ে কাজ হতে পারে তাদের কেউ অতো রাতে কী খামাখা জেগে থাকার কথা! কয়েক মিনিট অনেক কিছু ভাবলাম। ছেলেটা বলল- আব্বু তুমি ফোনের বদলে বরং ওনাদের রিকোয়েস্ট করো। ওনারা তোমার কথা শুনতে পারে। মনে মনে ভাবলাম, ছেলেটার কথাটা যেন সত্যি হয়। মানুষ তো মানুষেরই জন্য, তাই না। সোজা উপরে গিয়ে ডিউটি ডক্টর নার্স আয়া যাকে হাতের কাছে পেলাম, খুব করে বললাম, মেয়েটার কথা। জানেন, পৃথিবীতে যে মানুষ এখনো মানুষের কথার অর্থ বুঝতে পারে, ঠিকঠাক বলতে পারলে যে কাজ হয়, তা কাল প্রমান পেলাম হাতেনাতে। মাত্র পঁয়ত্রিস মিনিটের মধ্যে শান্তাকে এই কেবিন আনার ব্যবস্থা হল। ওনাদের তাৎক্ষণিক অমোন সুন্দর ব্যবহারে আমি বড়োই কৃতজ্ঞ। শেষের দিকে ওনারা জানতে চাইলেন- আপনি কী করেন? মুখে কিছুই বললাম না। আমার আইডি কার্ডটা তখনো বুকের কাছে এভাবে ঝুলছিল। হঠাৎ সেদিকে নজর পরায় ওটা ওল্টাতেই ওনারা বললেন- আপনার পরিচয়টা প্রথমে দিলে মেয়েটা আরো আগে এখানে আসতে পারতো। আমি এখনো ভেবে পাইনা, ওনারা আমার পরিচয়টা তারপরেও ক্লিয়ারলি কেন জানতে চাইলেন না। জানেন, সেই রাতের ড্রেসে একটানা এখনো আছি। আম্মা আসছিল সকালে। আম্মাকে নিয়ে ছেলেটা বাসায় গেছে। আম্মার শরীরটাও ভালো না। সারাটা সকাল গেছে এই টেস্ট, সেই টেস্ট। আর এখন লিভারের টেস্টটা আসার পর ডাক্তাররা বোর্ড মিটিং করে জানাবেন, শান্তার আসলে কী হয়েছে। কিন্তু, আমি ওর এক্সরে রিপোর্ট দেখে খুবই ভয় পেয়েছি। আল্লাহ না করুক, ওইটুকু মেয়ের অতো বড় একটা অসুখ। লিভারে একদম ঘা হয়ে গেছে। সব আসলে আমার দোষ। দুপুর থেকে আমি নিজেকে নিজে অনেক দোষারোপ করেছি। না আমার ঠিক মতো ওদের দিকে নজর দেয়া হয়নি। এটা আমার ব্যর্থতা। বাচুম না, সঞ্জিবের মতো যে কোনো সময় দেখবেন, আমিও নাই। শালার জীবনে কী করলাম বলেন? তিনটা ছেলেমেয়ে, তাদের দিকে ভালো করে নজর দিতে পারলাম না। কতো বড় ব্যর্থ বাবা আমি। আম্মাকে আচ্ছামতো গালাগাল করেছি। তুমি থাকতে ওরা এভাবে অসুখ বাধালো। তুমি আমাকে একটা বারও জানালে না, শান্তা খাবারটা পর্যন্ত ঠিক সময়ে খায় না। কোই, প্রতি শুক্রবার-ইতো তোমাদের দেখতে আসি। কিচ্ছু লাগবে কিনা, জানতে চাই। একবারও তো কখনো বলোনি যে শান্তা এভাবে অনিয়ম করছে। জানেন না, মেয়েটা আমার ভারী অভিমানী। আম্মা তবু আমাকে এখনো বকাঝকা করেন। বাট, ওরা কখনোই আমার কাছে কিচ্ছু চায় না। সবসময় আম্মার ধমক খেয়ে আমার মনে পরে। তারপর ওদের এটাওটা কিনে দেই। এই পর্যায়ে আমি জানতে চাই- শান্তার মা কী ওর এই খবর জানে? শামীম ভাই ফোড়ন কাটেন- ধুস, আমার মাথায় আসলে কিচ্ছু কাজ করছে না। আপনারা যখন কেবিনে গেলেন, শান্তার মা তখন ছিল তো। আপনাদের সাথে পরিচয় করালাম না। দেখেন কারবার! নাহিদ তখন শামীম ভাইকে স্বরণ করিয়ে দেয়- কেবিনে তো শান্তা ছাড়া আর কেউ ছিল না। শামীম ভাই আবার বলেন- ওর মা বাথরুমে ছিল। আপনাদের আসার কথা ছেলের মুখ থেকে শুনেছে। তাই হয়তো ইচ্ছে করেই বাথরুমে পালিয়ে ছিল। আমি তখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম- কত বছর পর ছেলেমেয়েদের দেখতে পেলো? শামীম ভাই জবাব দেন- না, না, বছর হবে কেনো? ওদের সাথে তার নিয়মিতই দেখা হয়। আমি কিচ্ছু জানতে চাই না। ওরা মুখ ফুটে বললে চুপচাপ শুধু শুনি। বড় হবার পর থেকে আমি ওদেরকে একদিন সব বলেছি। দেখো, তোমরা ইচ্ছে করলে তোমাদের মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারো। আমি চাই তোমরাও তোমাদের মাকে নিজেরাই দেখে আবিস্কার করো, কে ভুল করেছে? আমি, না তোমাদের মা? প্রথমে ওরা যেতে চাইতো না। আমিই জোর করে ওদের পাঠিয়ে দিতাম। মাকে দেখতে ইচ্ছে করলে যাও, দেখে আসো। ওরা তেমন আগ্রহ দেখাতো না। আপনারা জানেন না, ওরা কতো লক্ষী। শান্তা তো রীতিমতো এখন আমাকে শাসন করে। গত সপ্তাহেও আমাকে শাসিয়েছে- তুমি যদি আব্বু সিখারেট খাওয়া না ছাড়ো, আমরা তোমার সাথে কথা বলবো না। জানেন, এখন আমি শুক্রবার শুক্রবার যাত্রাবাড়িতে গেলে সিখারেট খাই না। আর ওদের সামনে তো আগে থেকেও খেতাম না। কিন্তু শান্তা ঠিকই ধরে ফেলতো, আব্বু, তুমি ছাইপাশ খেয়ে ঘরে ঢুকেছো কেনো? যাও, ব্রাশ করে আসো। মেয়েটা দিনদিন আমার আম্মার সব গুনই দখল করছে। আম্মার পরে এখন আমি ওকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। শামীম ভাই তারপর বলতে থাকেন- এখন আল্লাহ জানেন, ওর কী হলো! আপনারা শান্তার জন্য একটু দোয়া করবেন। আর রেজা সবাইকে বলে রাখবেন- ব্লাড লাগবে। ডাক্তার বলেছেন, অনেক ব্লাড লাগবে শান্তার। একেবারে নাকি সিভিয়ার পর্যায়ে। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। বাবা হয়ে আমি ওদের এইটুকু খোজখবর রাখি না। সারাদিন খালি অফিস আর অফিস। বাচুম না। আমিও আর বাচুম না। কার বাঁচতে ভালো লাগে কন? আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। গত বছর ও গোল্ডেন এ পাবার পর, কী যে খুশি হয়েছিলাম। নাহিদকে ইঙ্গিত করে শামীম ভাই বলেন- আপনি তো ছিলেন না, ওর রেজাল্টের মিষ্টি জাফর আর রেজা পেয়েছিল। আর বুঝি রিয়াজও ছিল। এরপর নাহিদ প্রশ্ন করে- ওকে কোথায় ভর্তি করেছেন? কোন কলেজে? শামীম ভাই জবাব দেন- মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে। জানেন না, ও খুব ভালো নাচে। নিজে একটা নাচের ইস্কুল খুলেছে। আর ওই নাচের ইস্কুল খোলার পর থেকেই ওর এই পরিণাম। সকালে বাসা থেকে কী খেয়ে বের হতো, কোনোদিন হয়তো কিছুই খেতো না। আম্মা আর কতোক্ষণ খেয়াল রাখতে পারে, বলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত কলেজ, ক্লাস, প্রাইভেট, নাচের ইস্কুল। কোনোদিন হয়তো সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই খেতো না। ধীরে ধীরে এভাবে ওর আলচার হয়ে যায়। আম্মাও টের পায় নাই। আর আমি তো শুক্রবার ছাড়া ওদের সাথে দেখাই হয় না। আগে কাঁঠালবাগান থাকতে সপ্তাহে দু-তিন দিন দেখা হতো। কল্যানপুরে যাবার পর আর শুক্রবার ছাড়া আমি সময় করতে পারি না। ছেলেটা আবার আগামী সপ্তাতে জাপান যাচ্ছে। ওদের নাটকের গ্রুপ যাচ্ছে জাপানে শো করতে। ওর জন্য অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে। আমি কয়দিক সামলামো কন? অফিসে কিচ্ছু বলবার জো নেই। শালার নতুন বিল্ডিংয়ে যাবার পর ভাবছিলাম এবার বুঝি বকেয়া বেতনগুলো দিয়ে দেবে। অবস্থার কোনো পরিবর্তন নাই। এখনো ছয় মাসের বেতন বাকী। কন, দুই দুইটা সংসার চালানো কী চাট্টিখানি কথা। আমাগো ঢাকায় কী আছে কন? শালার মাস শেষে বেতনের পুরোটা না পাইলে চলুম কেমনে? তাও আম্মা এখনো জীবিত, তাই ওদের নিয়া আমার একদম টেনশান নাই। আম্মা সব সামলান। সামনে ঈদ, ওদের জন্য কী কিনবো, আম্মার জন্য একটা শাড়ি কিনতে হবে, গিন্নির অনেক বায়না। তারমধ্যে শান্তুটার এই অবস্থা। কোনদিক সামলামো কন! গত রমজানের ঈদের ঠিক দুই দিন আগে শান্তা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল। গোটা ঈদের সময়টা শামীম ভাই হাসপাতালে শান্তাকে নিয়ে। তখন রোজই আমরা বন্ধুরা ঢাকা মেডিকেলে শান্তাকে দেখতে যেতাম। বিশেষ করে ওর যখনই রক্ত প্রয়োজন হতো, তখনই আমাদের যেতে হতো। বন্ধুদের মধ্যে আমিনুর রহমান মুকুল যেদিন রক্ত দিল, শামীম ভাইয়ের মুখে সেদিন কী যে হাসি। শামীম ভাই সেদিন বারবার বলছিলেন- আগামীকাল ওকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে। এখন বাকী সময়টা ঠিকঠাক রিকোভার করলে আল্লাহ মাফ করেন। কারো বাচ্চার যেনো এরকম ভয়াবহ অসুখ ধরা না পরে। শান্তার যখন পেটে ব্যথা উঠতো, এমনিতে ও ভীষণ শান্ত। কিন্তু আপনারা জানেন না, সেই রাতের ওর চিৎকার আর কান্না এখনো আমার কানে বাজে। কী কষ্টটা যে আমার মেয়েটার উপর থেকে গেছে। ডাক্তার, নার্স, আয়া সবাই এই কয়দিনে ওর ভক্ত হয়ে গেছে। যখনই যিনি শোনেন, ও খুব ভালো স্টুডেন্ট, নাচ শেখায়। তখন সবাই ওকে খুব আদর করেন। আমার লাকটাও অনেক ভালো। ঢাকা মেডিকেলে বিনা তদবিরে অতো অল্প সময়ে কেবিন পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। এখন ভালোয় ভালোয় ও ভালো হয়ে গেলে বাঁচি। মুকুল, শামীম ভাইকে শান্তনা দেয়- না, ও দেখবেন ঠিকই ভালো হয়ে উঠবে। ও এতো কিছু করে, কোনোদিন তো বললেন না শামীম ভাই। এখন থেকে শান্তার খোজ আপনি না দিলেও আমরা নিজেরা নেবো। ওকে গ্রুপে নিয়ে আসবেন। শান্তার কেবিন থেকে বের হয়ে আমরা ঢাকা মেডিকেলের সামনে এসে সেদিন অনেকক্ষণ আড্ডা দেই। শামীম ভাই আমাদের আসস্থ করেন, আর কোনো অসুবিধা না হলে আগামীকাল আমরা ওকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। আপনারা শান্তার জন্য দোয়া করবেন। তারপর শামীম ভাই ঢাকা মেডিকেলে থেকে যায়। আমরা আমিনুর রহমান মুকুল, অজয় দাশ, কাজী ফয়সাল, ইকতারুল ইসলাম আর আমি হেঁটে হেঁটে দোয়েল চত্বরে আসি। মুকুল আর আমি বাংলা একাডেমীর রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ পায়ে হেঁটে আড্ডা মারি। অজয় ফয়সাল আর ইকতার চলে যায়। ওই রাতেই শেষবার আমি শান্তাকে দেখেছিলাম। তারপর শামীম ভাইয়ের সাথে যতোবার দেখা হয়েছে, যতোবার আমরা ভোরের কাগজে গেছি, যতোবার ফোনে কথা হয়েছে, শান্তার প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আমাদের আলাপে এসেছে। সেই শান্তা এখন নেই। এটা ভাবতে পারছি না। মনে মনে ভাবলাম অন্য বন্ধুরা কী দুঃসংবাদটা পেয়েছে? ওদের মনের অবস্থা জানার চেষ্টা করি। আর নিজেকে নিজেই শান্তনা দেই। শান্তা মরতে পারে না। ও চিরদিন আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। তারপর আমি বন্ধু মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ নাহিদকে প্রথমে ফোন করি। নাহিদ ফোন ধরামাত্র আমি জানতে চাই- কোনো খবর জানো কীনা? নাহিদ পাল্টা প্রশ্ন করে- কীসের খবর। বলি, শামীম ভাইর কোনো খবর জানো? নাহিদ জবাব দেয়- না। ক্যানো, কী হইছে? জবাবে বলি- শামীম ভাইর মেয়ে শান্তা গতরাতে মারা গেছে। টের পেলাম ফোনের ওপাশে নাহিদের শ্বাস-প্রশ্বাসও আমার মতো ঘন হয়ে গেছে। নাহিদ পাল্টা প্রশ্ন করে- তুমি কখন জানলা? : এইতো একটু আগে। : কীভাবে? : শামীম ভাই এসএমএস করেছে। : শামীম ভাইর সাথে কথা হইছে তোমার? : না। শামীম ভাইর দুটো ফোনই বন্ধ। তুমি কী বের হবা? : হ্যা, ঘণ্টাখানেক লাগবে। : আচ্ছা। শোনো, আজ আবার আমাদের শিল্পকলা একাডেমীতে শো আছে। নোরার তিনকন্যা। চারটা থেকে শিল্পকলায় রিহার্সেল। তার আগে কিন্তু যাত্রাবাড়ি থেকে ফিরতে হবে। : তুমি কোই থাকবা? : আমি এখন শিল্পকলায় যাবো, তুমি ওখানে আসো। : ঠিক আছে। এরপর আমি আমিনুর রহমান মুকুলকে ফোন করি। ফোনের ওপাশে মুকুলের অবস্থাও একই। বলো কী!! শান্তা মেয়েটা মারা গেছে!!! আহারে... খুব খারাপ সংবাদ। শামীম ভাইকে কীভাবে শান্তনা দেবো বলো। এটা কী মানার মতো খবর। এরপর জাফর আহমদ রাশেদকে ফোন করি। জাফরের ফোন বন্ধ। তারপর টোকন ঠাকুরকে ফোন করি। বলি- ঠাকুর, খুব খারাপ একটা দুঃসংবাদ এখন আপনাকে দিতে হচ্ছে। ঠাকুরের পাল্টা প্রশ্ন- কী??? : শামীম ভাইর মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। : বলেন কী?!! কীভাবে??? : শামীম ভাই শুধু একটা এসএমএস পাঠিয়েছে। শামীম ভাইর ফোন বন্ধ পাচ্ছি। : আয় হায় রে, শামীম ভাইকে এসময় কীভাবে শান্তনা দেবো? শামীম ভাইর ওদিকে আপনারা যদি যান, আমাকে জানাইয়েন, আমিও যাবো। : নাহিদ রওনা হইছে। আমরা শিল্পকলায় একসাথ হবো। : আচ্ছা, আমিও আসবো। আমাকে একটু সময়টা জানাইয়েন। ঠিক আছে। এরপর আমি ফিরোজ এহতেশামকে ফোন করি। ফিরোজ ফোন রিসিপ করার পর শুনতে পেলাম- একটা মহিলা কণ্ঠসর থেকে কবিতা ভেসে আসছে। ফিরোজ বলল- আমি একটা প্রোগ্রামে, কী বলবেন দ্রুত বলেন। বললাম, ভোকা শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। ওপাশ থেকে জবাব আসে- কীভাবে, কী হইছিল, কখন, বলেন কী!!! আচ্ছা, আমি পরে কথা বলছি। প্রোগ্রাম থেকে বের হয়ে। ওকে। এরপর পুলক বিশ্বাসকে ফোন করি। পুলক ফোন রিসিপ করেই জানায়- আমি একটা মিটিংয়ে আছি। ব্যাপার কী বলো? বললাম, ভোরের কাগজের শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। জবাব আসল- বলো কী??? আচ্ছা, আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। মিটিংটা শেষ হোক। এরপর ফোন করি খোকন কায়সারকে। ফোন রিসিপ করে খোকন কায়সার জানতে চায়- হ ভাইজান কন, কী কইবেন? বললাম- ভোকা শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। ওপাশ থেকে জবাব আসে- কন কী?!! কী হইছিল??? তারপর!!! শামীম ভাই মানে আমাদের শামীম ভাই তো? বললাম- হ্যা, মেয়েটা তো দীর্ঘদিন ধরে আলচারে ভুগছিল। একেবারে সিভিয়ার পর্যায়ে ছিল। শামীম ভাইর সাথে আমারও বেশ কয়েকদিন দেখা হয় না। ওপাশ থেকে আবার জবাব আসে- আহারে, শামীম ভাইর এখন কী হবে!!! ইস, বেচারা এরকম একটা আঘাত পাইল। ওর বয়স কত? জবাব দিলাম- এইতো এবছর ইন্টার দেবার কথা ছিল। খোকন কায়সার ওপাশে আফসোস করতে থাকে। আমি ফোন কেটে দেই। এরপর ফোন করি রোকন রহমানকে। রোকন ফোন রিসিপ করে ঠিকই, কিন্তু পাশে অন্য কাকে যেনো নির্দেশ দিচ্ছে- যা কইতাছি, তাড়াতাড়ি আসবি। হ্যা, কও, টাকা আমি ঢাকা আসলেই পাইবা। জবাবে বললাম- শোনো, তোমাকে একটা দুঃসংবাদ জানানোর জন্য ফোন করেছি। টাকার জন্য নয়। হ, কও, কীসের সংবাদ। শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। ওপাশের জবাব- তাই নাকি, ক্যান কী হইছিল? ক্যামনে? জবাবে কইলাম- তুমি শামীম ভাইরে ফোন দিয়া জাইনা লইও, চান্দু। সক্কাল বেলায়ই মালের হিসাব করতাছোস, মাগী। এরপর ফোন করি রাজীব নূরকে। রাজীব দা ফোন ধরে জানতে চায়- হ্যা, বলেন কী বলবেন? রাজীব দা, আমাদের শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। রাজীব নূরের জবাব- বলেন কী!!! তারপর? বলি- না, এই খবরটা দেবার জন্য ফোন করছি। ঠিক আছে রেজা, আমি একটু বিজি আছি। ওকে বাই। ভিতরে ভিতরে আমি একটা জিনিস টের পাচ্ছি। শামীম ভাইকে আমাদের বন্ধুদের কে কতোটা মুখে ভালোবাসে আর কে কতোটা অন্তরে ভালোবাসে তার একটা নিখাদ চেহারা এই ফোনালাপের মধ্য দিয়ে আমার সামনে ধরা পরতে লাগল। এই সময় কাজী ফয়সাল উকি দেয়। ফয়সালকে বললাম- খুব খারাপ একটা দুঃসংবাদে ঘুম ভাঙল ফয়সাল। কী সংবাদ রেজা ভাই? বললাম- ভোরের কাগজের শামীম ভাইর বড় মেয়েটা, শান্তা গতরাতে মারা গেছে। দেখলাম ফয়সালের নাকমুখ মুহূর্তে শুকিয়ে খাক। ফয়সাল পাল্টা জানতে চাইল- ঢাকা মেডিকেলে যাকে দেখতে গেছিলাম, ও? বললাম- হ্যা। খেয়াল করলাম, ফয়সাল প্রায় মিনিটখানেক আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না। কারণ, শান্তাকে ফয়সাল ঢাকা মেডিকেলে সর্বশেষ দেখেছিল। আমি শুধু বললাম, তুমি চলে যাও, আমি একটু পরে যাবো। ফয়সাল শিল্পকলার উদ্দেশ্যে যাবার আগে আরো একবার আমাকে তাড়া লাগায়। রেজা ভাই একটু তাড়াতাড়ি আইসেন। মুকুল ভাই কী জানে? বললাম- হ্যা আমার কাছে শুনেছে। এরপর ফোন করি অশোক দাশগুপ্ত অপুকে। ফোন রিসিপ করে অপু বলে- হ্যা রেজা ভাই বলেন। ওইদিন কখন চলে গেলেন, টের পেলাম না। বললাম, খুব খারাপ একটা দুঃসংবাদ দেব। শামীম ভাইর বড় মেয়েটা গতরাতে মারা গেছে। অপু ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল- এইবার আর শামীম ভাইকে বাঁচানো যাবে না। ইস বেচারা... হ্যা শুনছিলাম তো, ও হাসপাতালে, শামীম ভাই তাই নিয়া খুব ব্যস্ত। কিন্তু এভাবে শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। না, শামীম ভাইকে আর বাঁচানো যাবে না। এরপর ফোন করি কবি মাহবুব কবীরকে। হ্যা রেজা বলেন? বললাম, শামীম ভাইর বড় মেয়েটা গতরাতে মারা গেছে। বলেন কী? আয় হায় রে.. শেষ পর্যন্ত বাঁচলো না মেয়েটা। সত্যি খুব খারাপ খবর এটা। শামীম ভাইকে যে কী দিয়ে শান্তনা দেব এখন! এরপর ফোন করি মঈনুল বিপ্লবকে। ফোন বেজে চলে। কেউ রিসিপ করে না। শুক্র আর শনিবার বিপ্লব এই সময় ঘুমিয়ে থাকার কথা। বিকালে বিপ্লব পাল্টা ফোন করে বলল- আমি টের পাই নাই। ঘুমাইতেছিলাম। তারপর বলো, কেনো ফোন করছিলা? বললাম- আমাদের শামীম ভাইর বড় মেয়েটা গতরাতে মারা গেছে। বিপ্লব পাল্টা জিজ্ঞাসা করল- মানে যে মেয়েটা হাসপাতালে ভর্তি ছিল, ওইটা? : হ্যা। : আহারে, বাঁচলো না শেষ পর্যন্ত!!! শামীম ভাই তো খুব চেষ্টা করছিল। ও কি আর ভালো হয় নাই। আয় হায় রে.. না, সত্যি খুব খারাপ লাগছে শুনে। এই রকম খবর মানাটা খুব কষ্টের। শামীম ভাইর খুউব কষ্ট হবে। খুউব। বুঝলা, আমার না, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, ইস, ওর কথা শামীম ভাই প্রায়ই বলতো। এখন কী হবে!!! এরপর ফোন করি রিয়াজ হককে। হ্যা রেজা বলো? বললাম- শামীম ভাইর মেয়েটা মারা গেছে। : কখন? তুমি জানলা কীভাবে? : শামীম ভাই এসএমএস করেছে। কিন্তু শামীম ভাইর দুটো ফোনই বন্ধ। তুমি চেষ্টা করো দেখো পাওয়া যায় কীনা। : শামীম ভাই এখন কোথায়? : কিছুই জানি না। আচ্ছা তুমি কী যাত্রাবাড়ির বাসা চেনো? : ধোলাইখাল সিনেমা হলের পাশে। বেটার তুমি যাবার সময় ভোরের কাগজ থেকে এ্যাড্রেস কালেক্ট করে নিও। ওরা বলতে পারবে। : নাহিদের ঘণ্টাখানেক লাগবে বলল। তুমি কী বের হতে পারবা? : আজ তো আবার আমাদের বোর্ড মিটিং পড়ছে। দেখি। তোমরা যাবার সময় একটু জানাইও। আর ভোরের কাগজ হয়ে আসো, ওরা এ্যাড্রেস দিতে পারবে। ওদিকে ফাঁকে ফাঁকে আমি শামীম ভাইর দুটো নাম্বারে আর জাফরকে ফোন করতে থাকি। শামীম ভাইকে একটা এসএমএস করে রাখি। যাতে ফোন খোলা মাত্র ওটা পায়। আরো অনেককেই জানানোর ইচ্ছে হচ্ছিল। আবার আমার শিল্পকলায় যাবার তাড়া। কোনটা রেখে কোনটা করি। শান্তার শান্ত চুপচাপ মুখটা বারবার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কিছুতেই আর ওকে ভুলতে পারছি না। ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ঠিক চারটায় শিল্পকলা একাডেমীর এক্সপারিমেন্টাল হলে আমাদের রিহার্সেল শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পর বিপ্লবের ফোনটা পাই। না, রিহার্সেলে মন বসছে না আমার। অথচ ঠিক সাতটায় নোরার তিনকন্যার শো। বাইরে এসে একটার পর একটা সিখারেট ফুঁকছি। শামীম ভাইকে ফোন করে যাচ্ছি। এই সময় কবি জাফর আহমদ রাশেদের ফোন। হ্যা রেজা, আপনি ফোন দিয়েছিলেন, আমার ফোনটা ওই সময় বন্ধ ছিল। জাফর বলতে থাকে- আয় হায় রে, শামীম ভাইর এখন কী হবে। ইস, মেয়েটা কতো ভালো ছিল। এরকম একটা দুঃসংবাদ, বলেন এটা কী মানার মতো। আপনারা এখন কোথায়? বললাম- শিল্পকলা একাডেমী। আজ পালাকারের শো আছে। আমি এখন রিহার্সেলে। ৭টায় শো। পারলে চলে আসেন। জাফরের জবাব- দেখি, আমি চেষ্টা করব। শামীম ভাইকে কী যে বলবো, বুঝতে পারছি না। খুউব খারাপ লাগছে খবরটা শুনে। রিহার্সেলে আবারো ঢুকে পরেছি। এইসময় দেখলাম শামীম ভাইকে যে এসএমএস করে রেখেছিলাম, ওটা ডেলিভারড ওকে মেসেজ আসল। তারমানে এখন শামীম ভাইর ফোন খোলা। আমি আবার হলের বাইরে এসে শামীম ভাইকে ফোন করলাম। ফোন রিসিপ করলেন ভাবী। জানতে চাইলেন- কে? বললাম- ভাবী, আমি রেজা। শামীম ভাই কি পাশে আছেন? ভাবী বললেন- ওর তো ফোন বন্ধ। আর এই ফোনটা বাসায় ফেলে গেছে। গতরাত থেকেই ওর অবস্থাও খুব খারাপ। কী বলব বুঝতে পারছি না। বললাম- ভাবী, এই সময়টা আপনাকে খুউব শক্ত হতে হবে। শামীম ভাইকে দেখে রাখার সকল দায়িত্ব এখন আপনার উপর। আপনি ভেঙে পড়লে তাকে কে সামলাবে। আরো জানতে চাইলাম- মারা গেছে কোথায় বসে? জবাবে ভাবী বললেন- ঢাকা মেডিকেলে। আমি আর কথা বাড়াতে পারছিলাম না। শুধু চোখের সামনে ভাসছিল শান্তার চুপচাপ শান্ত নির্বাক সীমাহীন দুর্লঙ্ঘনীয় কষ্ট মাখানো না বলতে পারা মায়াবি দুটো চোখ, যে চোখের ভাষা বোঝার সাধ্য আমাদের কারো নেই। সেই দুঃসাধ্য চোখের ভাষা পৃথিবীর কোনো ভাষায় অনুবাদ করার সামর্থও আমরা আর কোনো দিন পাবো না। শুধু নির্জন কোনো ক্ষণে বা গমগমে কোনো আড্ডায় যখনই শান্তার কথা আমাদের মনে পড়বে, তখন আমরা চিরায়ত সহ্যের সীমাকে কেবল এই বলে বুঝ দেব- শান্তা তুমি আমাদের অন্তর দখল করেছো ঠিক যেমনটি তোমার করার কথা ছিল। তুমি বেঁচে আছো আমাদের সকলের হৃদয়ে ঠিক শান্ত নদীটার মতোন। আমাদের শান্তা মা-মনি হয়ে।। ১৩ মার্চ ২০১০ রাত ৪.৩০ মিনিট গাবতলা, ঢাকা। সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৫২
false
mk
বাংলাদেশের শিশু কিশোর কিশোর-তরুণদের একটি অংশের বখে যাওয়া, অপরাধে জড়িয়ে পড়া, জঙ্গি হওয়া, মানুষ হত্যায় মেতে ওঠা ইত্যাদি ঘটনা দেখে আমরা হতবাক হচ্ছি, নানা পরামর্শ শুনছি এবং দিচ্ছি। কিন্তু এতে খুব একটা কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। কার সন্তান কোন বয়সে গিয়ে কী করে বসে তা যেমন কেউ আগে থেকে বলতে পারছে না, আবার বেশিরভাগ সন্তানই গড়পড়তা মানুষ হওয়ার চেয়ে আধুনিক চিন্তাশীল, সৃজনশীল মানুষ হয়ে ওঠার দৃষ্টিতে পড়ার মতো এমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তন দৃষ্টিতে পড়ার মতো, সামাজিক উপরি কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটছে দ্রুততার সঙ্গে, কিন্তু আধুনিক মানস গড়ে ওঠার সমস্যা যেন দিন দিন প্রকটই হয়ে উঠছে। অনেক অভিজাত পরিবারই ভাবতে পারছে না, তাদের বিত্ত ও বৈভবের শেষ ভোক্তা কে হবে। তাদের কারো কারো সন্তান তো অপ্রত্যাশিত পথেই চলে গেছে, তাদের মনের হাহাকার দূর করার উপায় যেন কিছুতেই নেই। বেশিরভাগ পরিবারই কোনো না কোনো সন্তানকে নিয়ে বেশ কষ্টে আছে, এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। এমনিতে দেশের বেড়ে ওঠা তরুণদের বেশিরভাগই লেখাপড়া ও দক্ষ জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠা, কাজকর্ম পাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে মোটেও প্রত্যাশার ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারছে না। আমাদের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক অংশের খুব সামান্যই দেশের জন্য ইতিবাচক মানবসম্পদে পরিণত হতে পারছেন, বেশিরভাগই অদক্ষ, অযোগ্য এমনকি নানা ধরনের বোঝা হয়ে জীবনযাপন করছেন। দেশটাকে আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে অনেকটাই যেন বাধা হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিকজীবন ব্যবস্থায় শিশু-কিশোর ও তরুণ নিয়ে খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে নানা অব্যক্ত অসম্পূর্ণতা, ব্যর্থতা, হতাশা এবং মর্মবেদনাকে যেন ঢেকে রাখছি। এ সমস্যার সমাধানে আমরা কেউ দেশ ছাড়ছি, অনেকেই নিয়তিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি, বাকি মানুষগুলো জানিই না আসলে আমাদের কী করা উচিত। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা সামগ্রিক এই বিষয়টিকে নিয়ে একটি আধুনিক যুগোপযোগী অবস্থান তৈরিতে ততটা সক্ষমতা রাখে না।বস্তুত আমাদের শিশু, কিশোর ও তরুণদের বেড়ে ওঠার পথে মানুষ হওয়া ও গড়ে ওঠার বিষয়গুলোর মধ্যে যেমন অসংখ্য বিরাট ঘাটতি ও অভাব রয়েছে, তেমনি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সচেতনতাবোধেরও প্রচ- অভাব রয়েছে। শিশু-কিশোর ও তরুণদের দেহ গঠনে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি গরিব, ধনী নির্বিশেষে সবাই বোঝেন এবং আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ পরিবারগুলো তা মিটিয়েও থাকে, দরিদ্র পরিবারগুলোর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় খাবার শিশু-কিশোরদের দিতে পারছে না এটি জানা কথা। কিন্তু শিশু থেকে তারুণ্য পর্যন্ত বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের মানস গঠনে যে ধরনের শিক্ষা, দীক্ষা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, মানববোধ ও চেতনাবোধ গড়ে তোলার উপাদান থাকতেই হয়, সে ক্ষেত্রে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব মহলেই রয়েছে অবিশ্বাস্য রকম ঘাটতি ও অভাব। এটি অনেকটাই নির্ভর করছে পারিবারিক বিশ্বাস, অবিশ্বাস, চেতনাবোধ, শিক্ষাদীক্ষার ধরন-ধারণের ওপর। একটি শিশুকে তার চারপাশ বোঝা, চেনা, জানা এবং শেখার শুরু থেকে শিক্ষালয় যাওয়া পর্যন্ত, কিশোরকালের গুরুত্বপূর্ণ জানা-শেখার ধাপগুলো এবং অবশেষে তারুণ্যে প্রবেশ ও সময়টি অতিক্রম করার পুরো সময়টিকে একজন তরুণ বা তরুণী কীভাবে অতিক্রম করছে, কী শিখছে, জানছে ইত্যাদি বিষয়ের কোনো একটিকেও অবহেলা করার সুযোগ নেই। বলা চলে শিশুর তিন-চার বছর বয়স থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার অর্থাৎ ২৩-২৪ বছর বয়সটি পর্যন্ত বড় ধরনের মানস গঠনের নানা স্তরভিত্তিক ধাপ রয়েছে, যার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে থাকে। বলতে দ্বিধা নেই, মানস গঠনের এমন টানেলের পরতে পরতে শিশু, কিশোর ও তরুণের বয়স বিবেবচনায় চাহিদা মোতাবেক জানা, শেখা ও বোঝার চমৎকার আয়োজন থাকতেই হয়।আধুনিক সভ্য সমাজে শিশু-কিশোর ও তরুণরা পরিবার ও রাষ্ট্রের সেসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলার ফলে তারা চমৎকার শিশুকাল অতিক্রম করে, ঝরে যাওয়া বা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা এই স্তরে তাদের খুব একটা থাকে না, কিশোর বয়সটাও তাদের থাকে বেড়ে ওঠার উপযোগী করে, ফলে কৈশোর বয়সের চঞ্চলতাও নেতিবাচক প্রবণতাকে প্রায় শতভাগই অতিক্রম করতে পারে। এখানে পরিবার ও রাষ্ট্রের গড়ে তোলা পথচলার ব্যবস্থাই এদের সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। কৈশোর-উত্তীর্ণ বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই শিক্ষা এবং কর্মব্যস্ততার জীবনে প্রবেশ এবং বেড়ে ওঠার মধ্যে যুক্ত হয়। ফলে খুব অল্পসংখ্যক তরুণই বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অসফল হয়। রাষ্ট্র তার প্রতিটি শিশুকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য পদে পদে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, সেভাবেই তারা শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্যকে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। ব্যতিক্রম ঘটার হার খুবই কম। তবে বেশিরভাগ শিশু, কিশোর এবং তরুণই আধুনিক স্বাস্থ্য ও মানসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে, রাষ্ট্র নিজে এই মানবসম্পদে ক্রমাগতভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাদের পেছনে অনুসরণ করে আসা শিশু-কিশোর ও তরুণরা একই কাতারে শামিল হচ্ছে মাত্র। এটাই আধুনিক উন্নত দুনিয়ার সার্থকতা।আমাদের অবস্থাটি মোটেও এমন নয়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো আধুনিক ধ্যান-ধারণা, বিধিব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন ও সংস্কৃতিকে ধারণ করার ক্ষেত্রে মস্ত বড় সংকটে আছে। এর বেশিরভাগ মানুষই রাষ্ট্রের ধারণাটিকে মানবজীবন মান উন্নয়নের অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক উপাদান হিসেবে বোঝে এমনটি বলা বেশ কঠিন। রাষ্ট্রের চরিত্র কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে উন্নত করতে হয়, সে ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা কী, সরকার ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা ও করণীয় কী এসব নিয়ে কতসংখ্যক মানুষ স্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন তাই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। এ ধরনের সমাজবাস্তবতায় বেশিরভাগ মানুষ প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, বোধ ও চেতনাবোধ দিয়েই পরিচালিত হয়। এমনকি ধর্ম, শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনাবোধকে মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল ও সৃজনশীলতা গঠনের লক্ষ্যে খুব একটা কাজে লাগাচ্ছে না। সবকিছুরই বহিরাঙ্গনকে দেখা হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে, ভেতরের জ্ঞানগত সত্তা ও চেতনাকে খুব একটা ধারণ করা হচ্ছে না। ফলে আমাদের ধর্ম, শিক্ষা ও রাজনৈতিক শিক্ষার কোনোটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধারণা উপেক্ষিত, ধারণা ব্যতীত ঘটছে, চলছে। ফলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের যেমন ব্যাপক ব্যর্থতা ও সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই রকম ঘাটতি ও সংকট বিরাজ করছে। আমরা কোনোটাকেই মর্মমূলে শিখিনি, তাই ধারণও করছি না, করতে পারার মতো সক্ষমতা অর্জন করিনি। আমরা এখনো শুনে শুনে ধর্ম বিশ্বাস করছি, বইপুস্তক পড়ে এর ভেতরে প্রবেশ করছি না, শিক্ষাকে পরীক্ষার সনদনির্ভর করে ফেলেছি গবেষণা ও পঠনপাঠনের সংস্কৃতিতে আত্মস্থ হচ্ছি না, রাজনীতির বিষয়টি তো সম্পূর্ণরূপে গলাবাজি, আর্থিক ও জনশক্তি সমাবেশের বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছি। কোনো গভীর শিক্ষাদীক্ষার সংস্কৃতিতে আমাদের ধর্মীয়, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক চর্চা ও বিশ্বাস গঠনের বিষয়গুলো নেই।আমাদের বেশিরভাগ পরিবারই নিজেদের বিশ্বাস এবং ধ্যান-ধারণা মতো শিশুদের বাহ্যিকভাবে গড়ে তুলছে। শিশুর মানস গঠনে প্রকৃতির তরুলতা, জীবজগৎ, প্রাণী, মানুষ, চারপাশ ইত্যাদির সহজ, সরল, কৌতূহল নিবারণ, নতুন নতুন উদ্দীপক প্রশ্ন করা ও জানার বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে এমন কিছু তথাকথিত শিক্ষকের হাতে শিশুদের তুলে দিচ্ছি যাদের এ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানভিত্তিক কোনো ধারণাই নেই। তারা কিছু অন্ধবিশ্বাসে নিজেরা যেমন শিশুদেরও তাদের নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে নানা বিষয়ের আশ্রয় নেয় যা শিশুদের জানা ও শেখার শুরুতেই নানা বিভ্রান্তি, ভয়-ভীতি, অন্ধ বিশ্বাস ইত্যাদি ভরপুর করে তোলে। আমরা যেসব শিক্ষকের হাতে আমাদের শিশুদের ধর্মপাঠ নিতে পাঠাই তারা আসলেই ধর্মের শিশুতোষ পাঠ সম্পর্কে কতটা জ্ঞাত তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। এদের বেশিরভাগেরই শিশুতোষ শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা নেই। কত বয়সের শিশুকে কী ধরনের পাঠ দিতে হয়, ধর্মের কোন কোন দিকগুলো দিলে শিশুদের মন-মানবিকতায় ভরে উঠবে, সৎ, সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক হবে তা এই স্তরের বেশিরভাগ ধর্মশিক্ষকেরই নেই। অধিকন্তু তারা শিশুদের মনে নানা বিষয় নিয়ে ভয়-ভীতি, ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করার মতো পাঠ দিচ্ছেন যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শিশুরা পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত হয়। কোন বয়সের শিশুকে কী শিখতে দিতে হয়, কতটা দেওয়া উচিত তা নিয়ে না আছে শিক্ষক, অভিভাবক এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও কোনো ধারণা নেই। আমাদের বড়দের এমন অজ্ঞতা, খামখেয়ালি, অন্ধ বিশ্বাসসহ নানা বিশ্বাস গঠনের শিকার হচ্ছে আমাদের বৃহত্তর শিশুরা। তারা যখন কেজি স্কুল, মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখতে যায় সেখানেও তারা বড়দের এমন অজ্ঞতা, মূর্খতা ও অন্ধত্বের শিকার হচ্ছে। এখানে শিশুদের মানবিক গুণাবলির বিকাশের জন্য শিক্ষার উপাদানের চাইতেও অন্য বিষয়গুলো তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বেশি। তাদের প্রথমেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতায় নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে শিশু সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব বাস্তবতাকে সেই বিভাজনের রাস্তায় হেঁটেই শেখে ও বিশ্বাস করে। এই শিশুরা আর কোনোদিন নিজেদের বিশ্বমানব সম্প্রদায় ও সভ্যতার একজন হিসেবে ভাবছে না। তাদের শিক্ষাজীবনের কোথাও সভ্যতাপূর্ববর্তী সময় থেকে বর্তমান বিশ্বসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস, মানুষের অর্জনগুলো, মানুষ হিসেবে তাদের মেধা-মননের বিকাশ ঘটানোর উপায়গুলো কী, কীভাবে তারাও বিজ্ঞানী, গবেষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, জ্ঞানের উদ্ভাবক, সৃষ্টির রহস্যের উন্মোচনে অবদান রাখতে পারবে সেই চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানোর ধারে-কাছেও আমাদের শিশু, কিশোর এবং তরুণদের নেওয়া হচ্ছে না। ফলে আমাদের বেশিরভাগ শিশু যখন কৈশোরে প্রবেশ করে তখন তাদের গোটা প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে কোনো কৌতূহলী ধারণাই তৈরি হয় না, তারা সবকিছুকেই ইতিহাসবিবর্জিত এবং অতীতবিবর্জিত এমনকি ভবিষ্যৎবিহীনভাবেই বিশ্বাস করতে শেখে। আমাদের কিশোরদের আমরা প্রশ্ন করতে, ভাবতে এবং জানতে উৎসাহী করি না। এরা যখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে তখন তাদের সম্মুখে জিপিএ-৫ পাওয়াই মূল লক্ষ্য থাকে, জ্ঞানার্জনে নিজেদের মেধা-মননকে সমৃদ্ধ করার ধারণাই থাকে অনুপস্থিত। ফলে এখনকার তথাকথিত মেধাবী শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণা রাখে না, সে ধরনের বইপুস্তক পাঠের অভ্যাস তাদের গড়ে ওঠে না। নিজেদের জানা, শেখা ও বোঝার পরিস্থিতিটাকে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও বিশ্ববাস্তবতার নানা অগ্রসর চিন্তা ও বিতর্কে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সমৃদ্ধ না করে এরা বাহ্যিক রমরমা, চাকচিক্য, ভোগবিলাস, কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদিতে অভ্যস্ত করে ফেলে। এতে অনেকেই আটকে থাকে, অনেকে নানা বিভ্রান্তিতে পা বাড়ায়, কোনো বিজ্ঞানসম্মত উত্তর তাদের জানা নেই, নানা অন্ধ বিশ্বাসে অন্যদের মতো নিজেরাও চলে বা ব্যতিক্রমী কিছু ঘটাতে চায়। ছোটকাল থেকে যে সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা বা দীক্ষা নিয়ে বড় হয়ে ওঠে সে এই পথে চরমভাবাপন্ন হতেও কোনো দ্বিধা করে না। সেখান থেকেই উঠতি তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিবাদের হাতে ধরা দেয়। কেননা তার কাছে কোনো কিছুরই কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বিশ্ববাস্তবতায় বোঝার মতো জ্ঞান নেই, সে রকম কোনো পাঠচক্র তাদের নেই, মানবজীবন সম্পর্কে তাদের আধুনিক কোনো ধারণাই নেই। এখনো আমাদের বেশ বড় সংখ্যক শিশু-কিশোর ও তরুণ দারিদ্র্যের কারণে শারীরিক ও মানসিক অপুষ্টিতে বেড়ে উঠছে, অন্য একটি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশ শারীরিকভাবে পুষ্ট হলেও মানসিক বৈকল্য অতিক্রম করার মতো শিক্ষা ও দীক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ তরুণই প্রকৃত মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারছে না। এর ফলে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে মেধা, মনন ও প্রগতিশীলতার বেড়ে ওঠা শিশু, কিশোর ও তরুণের প্রাপ্তি থেকে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের এমন অপচয়কে রোধ করা, সন্তানদের প্রকৃত সৃজনশীল আধুনিক মানুষরূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং গড়ে ওঠার পথ ও মতের অভিজ্ঞতাটিই বোধহয় আমাদের খুব একটা জানা নেই। দ্রুত সেই পথেই আমাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা ও গড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই আমার, আপনার আপন সন্তানদের নিয়ে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাই আমরা সফল হব। লেখক: অধ্যাপক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:০১
false
rn
যখন জীবনটা হতাশা-বিশৃঙ্খলার মাঝে দিয়ে যায়, তখন প্রতিটা পুরুষের জন্যেই একজন প্রেরনাদায়ী নারীর প্রয়োজন পড়ে রহস্যময়ী এক নারী হেলেন কেলার।মানুষ বিধাতার সৃষ্টির সেরা জীব। তাই যুগে যুগে কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাদের দেখে খুবই বিস্মিত হতে হয়। চোখ দিয়ে সুন্দর পৃথিবী দেখেনি, কান দিয়ে শোনেনি কোনো বাক্য, পারেনি মুখ দিয়ে কথা বলতে। এই জগত্ তাদের কাছে অদৃশ্য, মানুষের কথা তাদের কাছে নিঃশব্দ, বাক্যহীন, নীরব, নিস্তব্ধ। পৃথিবীতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। উনিশ শতকের দিকে এরকমের একজন নারী হচ্ছেন ‘হেলেন কেলার’, বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ১৮৮০ সালের ২৭ জুন উত্তর আমেরিকার টুস্কুমরিয়া নামের ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আথার কেলার এবং মা’র নাম ক্যাথরিন। হেলেন কেলারের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা-মা প্রাণের প্রিয় কন্যার জীবনের আশা-ভরসা ছেড়ে দিলেও ভেঙে পড়েননি। চিকিত্সা শুরু করেন। তত্কালীন সময়ে আমেরিকা পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ হলেও আজকের মতো চ্যালেঞ্জিং চিকিত্সা ব্যবস্থা ছিল না। বহু চিকিত্সার পর জীবন রক্ষা পায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। অন্ধকার, আলোহীন আর নিস্তব্ধে ছেয়ে যায় মায়ার জীবন ও জগত্। আট বছর বয়সে অ্যানা সেলভেন নামের এক গৃহশিক্ষিকা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। এখান থেকেই তাদের ৪৯ বছরের সম্পর্কের শুরু। এনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ছিলেন। এনি প্রথমে আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে এবং এরপর বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। তারপর ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেন। ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন। ১৯০০ সালে রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন যেখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। কলেজে পড়বার সময়েই সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন হেলেন কেলার। ডিগ্রি অর্জনের আগেই তার আত্মজীবনী দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালে হেলেন প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। যদিও তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন, কিন্তু তিনি দৃষ্টিসম্পন্ন বহু জ্ঞানী লোকের চেয়েও বেশি বই পড়েছেন। শুধু বই পড়েনইনি, বই লিখেছেনও। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১১-প্রধান বই হচ্ছে—দি স্টোরি অব মাই লাইফ, লেট আস হ্যাভ কেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন। তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী ছিলেন অথচ স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি সঙ্গীত উপভোগ করতে পারতেন। তার সঙ্গীত উপভোগ করার আশ্চর্য পদ্ধতি ছিল। তিনি বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই বলে দিতে পারতেন তাতে কি ধরনের সুর বাজছে। হাতের স্পর্শ দিয়ে তিনি শ্রবণের কাজ করতেন আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা দ্বারা। গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হাত দিয়ে অনায়াসে বলতে পারতেন কি সঙ্গীত গাইছে। তার এমন আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল যে, বহুদিনের পরিচিত মানুষের সঙ্গে করমর্দন করে বলে দিতে পারতেন তার পরিচয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে তিনি নৌকা চালাতে পারতেন। নদীতে সাঁতার কাটতে পারতেন, নৌকা বাইতে পারতেন, দাবা ও তাস খেলতে পারতেন। ঘরে বসে সেলাই করতে পারতেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন এবং শান্তি ও আশার বাণী শোনাতেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ১৯৫৯ সালে হেলেন কেলার জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৬৮ সালের ১ জুন হৃদয়ের আলোতে আলোকিত এই মহিয়সী প্রতিবন্ধী নারী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান। বিশ্বব্যাপী বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীর স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য এবং অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দি ওভারসিজ ব্লাইন্ড’ গঠন করা হয়েছে। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল’ করা হয়েছে।
false
rn
হিমির অসুখ জীবনকে যারা বুঝে,বিশ্লেষন করে বাঁচতে চায়-তারা বড়ো দুঃখি মানুষ।জীবন থেকে বড়ো কিছু প্রত্যাশা থাকা বড় খারাপ,মানুষের যত বড় প্রত্যাশা থাকে তত বর দুঃখ পায়।আমি বড়ো বেশী খেয়ালি,দায়িত্ব জ্ঞানহীন,জীবনটা কে গুছিয়ে নেবার কোনো চেষ্টা নেই,সংসারে এতটুকু কাজে লাগবার জন্য মাথা- ব্যাথা নেই।জোর করে কিছুই চাই না -যা জোটে তাই গ্রহন করি,কোনো প্রত্যাশা রাখি না।মাঝে মাঝে ভাবি এই জীবন থেকে আনন্দময় স্বেচ্ছা নির্বাসন নিতে বাধা কোথায়?আমার ভয়াবহ সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি কষ্ট পাই।আমার হাতে একটি বিদেশী পএিকা।পাতা উলটাতেই চোখে পড়লো- Record Breakers of Filmfare Awards over the years:Film,Number of Filfare Awards.Madhumati(1958)1942 A Love story(1998)Kaho na...Pyar hai(2000)Kuch kuch hota Hai(1998)Lagaan(2001)Omkara(2006)Guide(1966)Upkar(1967)Be-lman(1972)Dewaar(1975)Rang deBasanti(2006)Mother India(1997)Dilwale Dulhania Le Jayenge(1995)Devdas(2002)আমি বসে আছি ছোট চাচার অফিসে।চাচা অফিসে নেই।অফিসের কাজে বাইরে গেছে।কিছুক্ষনের মধ্যে এসে পড়বেন।আমি অপেক্ষা করছি।আর অপেক্ষা করছে হিমির একটি চিঠি।এই চিঠি আমি চুন্নু মামার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে পড়ব।হাতে থাকবে জলন্ত সিগারেট।গতকাল রাতে হিমির একটি চিঠি পেয়েছি।হিমি অসুস্থ।আমাকে দেখা করতে বলেছে।আমি তার সাথে দেখা করলেই তার অসুখ নাকি ভালো হয়ে যাবে।তার অসুখের নাম ভালোবাসা।আর এই অসুখের ঔষধের নামও নাকি ভালোবাসা।আসলে হিমির কোনও দু:খ নেই, অতীতে ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না, তবু হিমি দু:খ নিয়ে বিলাসিতা করে ; এটা হিমির দু:খরোগ।হিমি কে আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে -যিনি দুঃখ দেন তিনিই ভিতরের থেকে সার্থকতা দিবেন।তোমাকে দিয়ে ইশ্বর তার বিশেষ কাজ আদায় করে নেবেন একথা স্থির হয়ে আছে,সেই জন্য'ই তোমাকে এত দু;খ কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।তুমি এক মুর্হুতের জন্য নিজেকে শক্তিহীন কল্পনা করো না।সময় এখনো আছে,জ্যোর্তিময় সত্যে তোমার ললাট উদ্ভাসিত হবে।এক গভীর রাতে হিমি আমাকে ফোন করে চার লাইনের একটি কবিতা শুনিয়ে বলে বলতো এইটা কার লেখা।আমি বলতে পারিনি।আমি কেন বলতে পারলাম না এই দুঃখে মেয়েটা কেঁদে ফেললো।হিমির চোখে মনে হয় অনেক জল।খুব সামান্য ব্যাপারেই চোখ ভিজে উঠে।আর আমার বুকের মধ্যে যেন কেমন করে!"When night is almost done,and Sunrise grows so nearThat we Can touch the spacesIt's time to smooth the hair."আমার হিমি অসুস্থ।তাই মহান আকাশ মুখ ভার করে রেখেছে।আমি আজ বিকেলে হিমির সাথে দেখা করতে যাবো।অনেক গুলো নানান রঙের ফুল নিয়ে।হিমির পাশে বসবো,হাত ধরবো,মাথায় হাত রাখব আর বলবো- 'এই যে আমি তোমার হাত ধরলাম,আর কোনো ভয় নেই।এখন তোমার সব অসুখ ভালো হয়ে যাবে।আমার হাতে অনেক মায়া আছে'।হিমি এতো আদর আর ভালোবাসা নিয়ে কেউ কি আর কখনও হাত ধরেছে কারো?হিমি আমার মতো ভালোবাসতে আর কেউ পারবে না।আমি জানি এতোটুকু কথায় হিমি চোখে জল ভরে উঠবে।কান্না ভেজা গলায় হিমি বলতে চাইবে- আমি হিমি কে থামিয়ে দিব।হিমি তোমার কিছু বলতে হবে না,আমি তোমার মনের সব কথাই বুঝতে পারি।কিভাবে বুঝতে পারি আমি নিজেও জানি না।তাই দেখ না বারবার তোমার কাছেই ফিরে আসি। তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজেই যে ব্যাথা পাই, তা সহ্য করতে না পেরে, নিজেই আবার তোমায় কাছে টানি।তারপর হিমিকে আমার প্রিয় একটা কবিতা আবৃওি করে শুনাবো।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "কেউ কথা রাখেনি''।কোনো কারন ছাড়াই এই কবিতাটি আমার খুব ভালো লাগে।কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনিছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলশুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবেতারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী আর এলোনাপঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুরতোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবোসেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনোলাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরাভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছিভিতরে রাস-উৎসবঅবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরাকত রকম আমোদে হেসেছেআমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুইসেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসবআমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবেসেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছিদূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্মতবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধএখনো সে যে-কোনো নারী।কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!বৃষ্টি হচ্ছে।খুব বৃষ্টি হচ্ছে।মনের গতি এমন'ই বিচিএ যে কিছুতেই তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।আমি খুব অনুভূতি প্রবন এই মাঝ রাতে এখন তাই-ই মনে হচ্ছে।এক একটা গানের নতুন করে মর্ম বুঝতে পারছি।অনেক ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন মনে পড়ছে।রাতে খাওয়ার পর অনেকক্ষন ব্যালকনিতে বসে থাকি।এখন বর্ষাকাল,তবু এক সময় হঠাৎ আকাশ পরিস্কার হয়ে গিয়ে বেড়িয়ে পড়ে জ্যোস্না।মনটা খুশিতে ভরে যায়,মনে হয় যেন এই সবই এক অপূর্ব ইশ্বরের উপহার।মাঝে মাঝে হিমির জন্য মনটা হু হু করে।তবু আমি হিমির মানুষের কাছে যাই না।এক সময় সব কিছু ফেলে হিমির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু আমি যাই না।সে ইচ্ছাটা কে অনুভব করি,তারপর দমন করি।তারপর চোখের পানি ফেলি।পুনশ্চঃ "আমার বুকে কষ্ট আছে-আছে বিশাল আনন্দপ্রয়োজন মতো দু'টোই পাবে,কষ্ট-আনন্দ নিয়ে হয়তো-চলে যাচ্ছি দূরে।দূরে থাকবো,তবু যেনো আছিএক'ই আকাশের নীচে।"ও আচ্ছা,ভালো কথা বলতে ভুলে গেছি -হিমি কে দেখতে যাওয়া আর হয়নি।
false
rn
নিষ্ঠুরতম, সবলতম, হৃদয়হীন ব্যক্তিরাই সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী হয় ১। বই মানে তো শুধু বই নয়। বই মানে স্মৃতি। বই মানে অনুষঙ্গ। বই এক স্থায়ী ভালবাসা। বইয়ের মৃত্যু হবে না। কম্প্যুটার, ফেসবুক-টুইট-স্যোশাল মিডিয়া যতই হোক, বই থাকবে। বই তো শুধু আমরা পড়ি না। গন্ধ শুঁকি। উপহার দিই। বইয়ে নিজের নাম লিখি। নড়াচড়া করি। সাজিয়ে রাখি।২। মার্ক টোয়েন অলওয়েজ বস। আমার সবচেয়ে প্রিয় কিশোর-এডভেঞ্চার লেখক।৩। সারাদিন চলার পথে যদি আপনি কোন সমস্যার মুখোমুখি না হন তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি ভুল পথে চলছেন।.........স্বামী বিবেকানন্দ। ৪। তরকারীতে তেল কম দিতে বলুন। আমাদের এটা বদ অভ্যাস তরকারীতে তেল বেশি দেওয়া অথচ তরকারীর স্বাদ বৃদ্ধিতে তেলের কোনই ভুমিকা নেই। তরকারীর স্বাদ বৃদ্ধিতে ভুমিকা হল শুধুই মসল্লার। তেলের কোন প্রকার ভুমিকা নেই। তরকারিতে তেল বেশি দিলে গ্যষ্ট্রিক রোগীদের জন্য বেশি ক্ষতির কারন হয়।৫। কেউ কখনও ভালোবাসা নিয়ে বলেনি,দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে বিশ্রাম নাও। ক্লান্ত আমি, বিষন্ন আমি। কিন্তু হায়!আম, জাম, কাঠাল, নারিকেল গাছ,আরও কত রকমের যে গাছ ছিল!ক্ষনিকের জন্য বসতে তো চাইতো মন-কিন্তু একটি স্বজনের আতিথেয়তা যে পেলাম না!তিলোত্তমা নগরীর মাঝে এক টুকরো ‍‍‍‌‌স্বর্গ কিন্তু হায় যাদের জন্য গড়া এই সুবিশাল আয়োজন,তারাই যে আজ বড় বেশি উদাসীন। দ্বিপদী জীবের প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত কিন্তু চতুষ্পদী জন্তু শোভা পায় আলিশান ড্রইংরুমে। মানবতা থেকে শ্রেনী বৈষম্যই যে প্রকট!হায়রে মানবতা! যা উচু আর নিচুঁতে করে বিভক্ত। (কবিতার মতোন কিছু একটা লিখতে আমার সময় লাগে না। মুহূর্তের মধ্যে লিখে ফেলতে পারি।) ৬। তোমার মন হচ্ছে – বাগান, তোমার চিন্তা হচ্ছে – বীজ। এখন তুমি ফুলও জন্মাতে পারো আবার আগাছাও জন্মাতে পারো, এটা শেষ পর্যন্ত তোমার ওপরেই নির্ভর করে । ৭। প্রেম হচ্ছে এক ধরনের চুলকানি বিশেষ, যতো চুলকানো যায় ততো সুখ সুখ লাগে। কিন্তু চুলকাতে চুলকাতে যখন ফোসকা পড়ে যায় কিংবা ঘা হয় তখন ঠিক মতো মলম না লাগালে কিন্তু বুকের মধ্যে ভীষণ জ্বালা করে। প্রেমিক-প্রেমিকারা বাবা-মায়ের কথা মনে না করেই প্রেম শুরু করে। এখনকার অভিভাবকরা ৬০ অথবা ৭০ দশকের মতো নিষ্ঠুর মন মানসিকতা সম্পন্ন বয় কিন্তু সব বাবা-মা'রাই এই ব্যাপারে রক্ষণশীল। যদি তারা ঘরের বাইরে যথেষ্ট প্রগতিশীল দেখান। যে মানূষ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যাকে মোকাবেলা করে নিজের অনুকূলে আনতে পারে সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান এবং প্রকৃত প্রেমিক হতে পারে। '৮। বর্তমানে বিশ্বে সুন্দর মুখ না, সুন্দর বাচন ভঙ্গীর জয় সর্বত্র। “কথা” বিশ্বের সেরা আর্ট, শুধু কথা দিয়েই জয় করা যায় সব কিছু। অবাস্তব কথা বললে, মানুষ জেনে যায় যে এটা একটা গাধা, আর গাধার ওপর যত ঝামেলা আছে, সবাই তা চাপিয়ে দেয়। বেশী বুঝার ভান করে কথা বললে, মানুষ জেনে যায় এটা একটা শিয়াল এবং এর ব্যাপারে সবাই সাবধান হয়ে যায়।নিজেকে দুর্বল করে বা অন্যকে ছোট করে কথা বললে, মানুষ বুঝে যায় যে, লোকটা অতি দুর্বল শ্রেনীর একধরনের মানুষ রূপী প্রানী। সিরিয়াস নীতি কথা, সরাসরি প্রশংসা বা মায়া দেখিয়ে ঢং করে কথা বললে, মানুষ বুঝে যায় লোকটা ভদ্র লোকের মুখোশ পরা ৪২০। উত্তেজিত হয়ে কথা বললে, মানুষ জেনে যায় যে, লোকটি লোভী প্রকৃতির। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যে পাগলা কুকুরের মত আচরন করছে। সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৪
false
rn
'Bird By Bird' লিখেছেন অ্যান লেমট ১। সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’, তালেয়া রেহমানের ‘লেখালেখি’- হাতে গোনা এমন দু-তিনটি বই ছাড়া লেখালেখির কৌশল নিয়ে তেমন কোনো বই নেই বাংলাভাষায়। এদেশে লেখকরা ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়েই লেখা শেখেন। লিখতে লিখতে লেখক হয়ে ওঠার এ প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে ভাল। আগে আড্ডা-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির মধ্য দিয়েই নতুন লেখকরা লেখালেখির প্রাথমিক পাঠটুকু পেয়ে যেতেন সিনিয়রদের কাছ থেকে। লেখালেখি নিয়ে প্রচুর বই আছে ইংরেজি ভাষায়। তেমন এক বই ‘বার্ড বাই বার্ড’। বইটির বেশ পসার আছে বাজারে, লেখকরা উপকার পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। অবশ্যই সবাই ভাল লিখতে চাইবে, কিন্তু হয়তো সেটা তারা পারবে না। কিন্তু কেউ যদি ধৈর্য আর বিশ্বাস নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় তবে একদিন অবশ্যই ভাল লিখতে পারবে।“Bird By Bird” লিখেছেন অ্যান লেমট। ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয়া মার্কিন লেখক অ্যান লেমটকে বলা হয়ে থাকে ‘জনতার লেখক’। গল্প এবং প্রবন্ধ দুই-ই তিনি সমান ভাবে লিখেছেন। তিনি একই সাথে একজন রাজনৈতিক কর্মী, বক্তা এবং শিক্ষক। মূলত সান ফ্রান্সিসকোতেই তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার রচিত প্রবন্ধগুলো মূলত আত্মজৈবনিক। নিজের রচনা সম্পর্কে এই লেখকের বক্তব্য হলো – আমি তা-ই লিখি যা লিখতে আমার ভাল লাগে; যাতে সত্য কথন থাকে, থাকে মানুষের জীবন ঘনিষ্ট হৃদয়ের অনুভূতি, আধ্যাত্মিক রূপান্তর, পরিবার, গোপনীয়তা, পাগলামী আর সর্বোপরি হাস্যরস। অ্যান লেমট রচিত “বার্ড বাই বার্ড” প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। এটি এমন একটি বই যাকে লেখালেখি সংক্রন্ত বিষয়ে কোর্স বলা চলে। ২। জিম হকিন্স নামে এক রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোর বাস করে সমূদ্র তীরের এক শহরে। সে ও তার মা সেখানে একটি সরাইখানা পরিচালনা করে। একদিন সেই সরাই খানায় এসে উপস্থিত হয় এক বদরাগী মেজাজের ঝগড়াটে ক্যাপ্টেন। লোকটি হঠাৎ মারা গেলে তার একটি সিন্দুক থেকে একটি মানচিত্র পাওয়া যায় যা জিম এবং শহরের কিছু লোককে নিয়ে যায় এক দুঃসাহসিক অভিযানে। যেখানে তারা মোকাবেলা করে জলদস্যু ও বিশ্বাস ঘাতকদের।বলুন আমি কোন উপন্যাসের কথা বলছি এবং লেখক কে?৩। বহুদিন আগে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন প্রিয়নাথ শাস্ত্রী মশাই। নাম ছিল ‘পত্রাবলী’। সেখানে শাস্ত্রী মশাই মোট ১৪৬খানা চিঠি সংকলিত করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল রাজনারায়ণ বসুকে লেখা, বেচারাম চট্টোপাধ্যায়কে লেখা, কেশবচন্দ্র সেন, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, রবীন্দ্রনাথ, সৌদামিনী দেবী ও আরও কয়েকজনকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের চিঠি। দেবেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিও ছিল কয়েকটা। বইয়ের ভূমিকা তথা ‘বিজ্ঞাপন’-এ শাস্ত্রীমশাই জানিয়েছিলেন-“ইহাকে তাঁহার স্বরচিত জীবনচরিতেরই আর এক পৃষ্ঠা বলা যাইতে পারে।” এমন একটা বই আর ছাপা হল না। বিশ্বভারতী প্রকাশনাও কেন যে গা করলেন না, জানিনা!
false
mk
প্রসঙ্গ শফিক রেহমান শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে কম-বেশি প্রতিটি ঘটনা নিয়ে যেমন হয়ে থাকে, তেমনি এই গ্রেপ্তার নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে কথা উঠেছে। প্রসঙ্গত, শফিক রেহমান সাংবাদিক, টিভি উপস্থাপক ও ডেমোক্রেসি ওয়াচ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধারই কেবল নন, সব কিছু ছাপিয়ে তিনি বিএনপির থিংক ট্যাংক হিসেবে সুপরিচিত। জানা যায়, তিনি বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের পক্ষে, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে এবং নির্বাচন বয়কট করে দেশকে অসংবিধানিক পথে ঠেলে দেয়ার হীন উদ্দেশ্যে পেট্রলবোমা দিয়ে নিরীহ মানুষ ও জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা বিষয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পরামর্শদাতা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সাংবাদিকতা, টিভিতে কিছু উপস্থাপনা, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত কোনো কারণ কিংবা বিএনপির থিংক ট্রাংক হিসেবে পরামর্শক হওয়ার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে খুবই গুরুতর সুনির্দিষ্ট এক অভিযোগে।অভিযোগ দেশবাসী সবারই জানা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইটি উপদেষ্টা এবং ক্রমে আওয়ামী লীগ রাজনীতি-সংগঠনে সম্পৃক্ত হতে থাকা তরুণ ব্যক্তিত্ব সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ ও হত্যা করার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, জয়কে যে হত্যা করার প্রচেষ্টা বিএনপি মহল থেকে নেয়া হয়েছিল, তা বোধকরি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না এ জন্য যে, ইতোমধ্যে আমেরিকায় এই মামলার বিচারে অভিযুক্ত হয়ে বিএনপি নেতার ছেলে রিজভী আহমদ সিজারের ৪২ মাসের এবং ঘুষ লেনদেনের জন্য এক এফবিআই এজেন্টের ৩০ মাস কারাদণ্ড হয়েছে।সহজেই ধারণা করা যায়, আমেরিকার জেলে বিএনপি নেতার যে ছেলে আছেন, তিনি একা একা হত্যার পরিকল্পনা, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি সব করেননি। দেশ-বিদেশে পর্দার অন্তরালে নিঃসন্দেহে আরো অনেকেই ওই যড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। এ কারণে ২০১৫ সালে পল্টন থানায় পুলিশ একটি মামলাও প্রদান করেছিল। প্রসঙ্গত এটা ঠিক, গুরুতর অনেক ঘটনায় তদন্ত কাজে কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারেন না কিংবা নানা কারণে হতেও চান না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। তদন্ত হয়েছে এবং অভিযোগের ভিত্তি পেয়েই শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য মামলার তদন্ত মাঝ পথে আটকে যায়, অগ্রসর হয় না প্রভৃতি সব যুক্তি উপস্থাপন করে কেউ যদি বলেন, এই মামলার তদন্ত করে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে তদন্ত হবে অন্য কারো হলে হবে না প্রভৃতি তবে ওই যুক্তিকে কি বলা যাবে! আইনে একটার বিচার হয় না বলে অন্যটার হবে না, এই যুক্তি অচল ও নিন্দনীয়। বস্তুতপক্ষে তা দোষীর পক্ষে অবস্থান নেয়ারই নামান্তর। তাই অপরাধও বটে।ইতোমধ্যে জানা গেছে, শফিক রেহমানকে হত্যার পরিকল্পকদের অন্যতম হিসেবে গ্রেপ্তার করার পর রিমান্ডে নিলে তিনি পরিকল্পনা, বিশেষত পরিকল্পনার সঙ্গে কারা কারা যুক্ত, কোথায় কি হয়েছে প্রভৃতি সম্পর্কে নানা কথা বলছেন। মামলা চালু হলে এবং রায় বের হলেই কেবল বোঝা যাবে তিনি ওই পরিকল্পনার সঙ্গে আদৌ ছিলেন কি না? তাই এখনই বলার সময় আদৌ আসেনি যে, ভিন্ন মত দমন কিংবা বিএনপিকে দমনের জন্য এই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা এটা বলছেন তারা গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক পরিবেশের নামে কার্যত সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যার পরিকল্পনাকারী কুশীলবদের আড়াল করতে চাইছেন। ওই হত্যা মামলার অপরাধী শনাক্তকরণে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করতে তৎপর থাকছেন।বলাই বাহুল্য, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে কেউ গ্রেপ্তার হলেই যদি এমন মতপ্রকাশ করা হয় যে, ভিন্নমত দমনের জন্য তা করা হচ্ছে, তবে বিরোধী দল-মত পরিগণিত হবে অপরাধীদের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার ছাতা হিসেবে। দেশবাসী যেমন অপরাধীরা পার পাওয়ার ছাতা হিসেবে সরকারি দলকে দেখতে চায় না, তেমনি বিরোধী দলকেও নয়। প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, প্রকৃতির মতোই রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে অসামঞ্জস্যতা যেমন স্বাভাবিক বিষয় তেমনি ওই অসামঞ্জস্যতা ক্রমে ভারসাম্যতার দিকে যাওয়াটাও অনিবার্য বিষয়। বিরোধী দল যদি অপরাধীদের ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে, তবে এমন জনমত দানা বাধতে বাধ্য যে, সরকারি দলও অপরাধীদের ছাতা হতে পারবে না এবং দল নির্বিশেষে অপরাধীদের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।ভারসাম্য গড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়াই ক্রমে আইনকে স্বাভাবিক পথে চলা ও মানবাধিকার রক্ষার গ্যারান্টি দিবে এবং দেশকে ক্রমে সুশাসনের দিকে নিয়ে যাবে। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলতেই হয় যে, এদিক ওদিক ছাতা থাকায় ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়ে দেশ বিশেষত রাজনীতি আজ যে অবস্থায় নিপতিত হয়েছে, তাতে শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার একটা সম্ভাবনার বার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে। দেশি-বিদেশি কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে এই মামলার এস্পার-ওস্পার হোক, এটা তাই গণতন্ত্র ও সুশাসনকামী সব নাগরিকেরই কাম্য হওয়া প্রয়োজন। নিতান্ত অন্ধ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তি গোষ্ঠী মহল দল ছাড়া দেশবাসী এখন নিঃসন্দেহে চাইবে প্রবাসে জয় হত্যা পরিকল্পনা মামলার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হোক। মাস্টারমাইন্ড দোষীদের মুখোশ উন্মোচন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।দেশবাসী এটা চাইবে কেবল ছাতি নামক যে ভূত দুটি রয়েছে তা জাতির ঘাড় থেকে নামানো এবং দল নির্বিশেষে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হওয়ার জন্যই কেবল নয়, হত্যা-ক্যুয়ের রাজনীতি থেকে দেশকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার জন্যও। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাই কেবল নয়, দুই বড় রাজনৈতিক দলই হত্যা ও ক্যুর শিকার। হত্যা-খুন-ক্যু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আগুন নিয়ে খেলারই মতো। যিনি খেলবেন তিনিও আগুনে দগ্ধ হতে বাধ্য। স্বাধীন দেশে হত্যা-ক্যুর রাজনীতির প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি এবং এর ভেতর দিয়ে ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করার নায়ক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ওই রাজনীতির কোপানলেই বলি হয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লক্ষের সঙ্গে জিয়া হত্যা বিষয় যুক্ত হওয়ার কারণেই এরশাদ আমলে বিএনপি দলটি ৭ দল গঠন করে ১৫ দলের সঙ্গে স্বৈরাচার ও হত্যা-ক্যু বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।কিন্তু ওই আন্দোলনে বিজয়ের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় যাওয়া বিশেষত ক্ষমতায় এসে বিএনপি আবার জিয়াউর রহমানের ওই ভ্রান্ত পথই গ্রহণ করে। আবার শুরু হয় আগুন নিয়ে খেলা। এর কারণ মূলত পাকিস্তানি আমলের তিন ভূত। প্রথমত দলটির জন্ম ও বিকাশ পাকিস্তানি আমলের কনভেনশন লীগের মতো সামরিক ছাউনিতে হয়েছে বিধায় দলটি ক্ষমতা কুক্ষিগত ও চিরস্থায়ী করতে জনতার ওপর ভরসা নয়, সামরিক কর্তাদের ওপরেই ভরসা করে। দ্বিতীয়ত জামায়াতকে নেয় ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার সাথী হিসেবে। ঠিক পকিস্তানি আমলের ইয়াহিয়ার মতো। তৃতীয়ত দলটি পাকিস্তানপন্থী অবস্থান নিয়ে অন্ধ ভারত বিরোধীতার নীতি গ্রহণ করে। যে নীতির ধারাবাহিকতায়ই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে বিএনপি ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারের মতো ঘটনায় পর্যন্ত দেশকে জড়িয়ে ফেলে। ক্ষুদ্র এ কলামে এই তিন ভূতের উদাহরণ না টেনে বলা যায়, আশির দশকের শেষ দিকে স্বৈরাচারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এবং নব্বইয়ের দশকের সূচনায় ওই আন্দোলনের বিজয় দেশের সামনে হত্যা-ক্যু বিরোধী গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পথ উন্মোচনে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল, তা বিনষ্ট করে দেয় বিএনপি।এককথায় বলা যায়, উল্লিখিত তিন নীতি-কৌশল নিয়ে বিএনপি দলটি চলে যায় স্বস্থানে, যেন মাতৃকোলে। আমাদের এই মানচিত্রের ইতিহাস দেখিয়ে দেয়, এই তিন ভূত নীতিগতভাবে থাকবে যে রাজনৈতিক দল-শক্তির ঘাড়ে বহাল তবিয়তে, সেই রাজনীতি ও সংগঠন হত্যা-ক্যুর রাজনীতি থেকে নিজকে বের করে নিয়ে আসতে পারবে না। বিএনপি ঠিক সেই তিন ভূতের কারণেই বাধা পড়ে গেছে আক্টোপাসের জালে। হত্যা-খুন-ক্যুর ওই রাজনীতি থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারছে না। পারবেও না। আগুন নিয়ে খেলছে তো খেলছেই এবং ক্রমেই বেশি বেশি করে যাচ্ছে জড়িয়ে।পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান সময়ের ইতিহাস স্মরণ ও পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ওই তিন ভূত ঘাড়ে থাকবে আর হত্যা-খুন-ক্যু ওই রাজনীতির মাস্টারমাইন্ডদের মাথায় থাকবে না, এটা হতে পারে না। এই হত্যা-খুন-ক্যুর টার্গেট পাকিস্তানি আমল থেকে এখনো হয়ে আছে ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পূর্বাপর ঘটনাবলি দেখিয়ে দেয়, মানুষের চেতনা ও মনস্তত্ত্বের ঘাতপ্রতিঘাত ও উঠতি-পড়তি সত্ত্বেও অবিনাশী ও চলমান এই চেতনার ধারক-বাহক-রক্ষক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরাই ওই মাস্টারমাইন্ডদের টার্গেট। রক্ত ঝড়ে তাদেরই। হত্যা-খুন ওই অপশক্তি মাস্টারমাইন্ডদের কাছে ছেলের হাতের মোয়াবিশেষ। পাকিস্তানি আমলে সোহরাওয়ার্দীকে বিদেশে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। সত্যতা ছিল কি না তা তদন্ত হয়নি বরং পল্টন ময়দানে শোক সমাবেশে এ অভিযোগ তোলার জন্য শেখ মুজিবকে মামলায় পড়তে হয়েছিল।পরবর্তীতে ৬-দফার সময় আগরতলা মামলা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে, পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে, শেখ হাসিনার ওপর বারবার বিশেষত কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড মারা দিয়ে এটা মাস্টারমাইন্ডরা প্রমাণ করেছে, বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও সহযোগীরা হচ্ছেন ওদের প্রধান টার্গেট। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নাতি ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় হচ্ছেন ওদের টার্গেট। বিদ্যমান জাতীয়, উপমহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থা ও বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করা যত কঠিন, ঠিক ততটুকুই কিন্তু সহজ বিদেশে সজীব ওয়াজেদ জয়কে গুম ও হত্যার জন্য টার্গেট করা। করা হয়েছিলও তা-ই। জয়কে হত্যার এই টার্গেট ও স্থান নির্বাচন এবং পন্থা নির্ধারণের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয়, ওই মাস্টরমাইন্ডরা যতটা সুদূরপ্রসারী ও হিসেবি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের নেতৃত্ব ততটাই যেন উদাসীন ও নির্লিপ্ত। যদি আমেরিকানরা ঘটনা না ধরতে পারতো, তবে কি হতো কে জানে! বলাই বাহুল্য উদাসীন ও নির্লিপ্ত ভাব দূর করার সঙ্গে সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে তদন্ত করে বের করা দরকার শফিক রেহমান ওই মাস্টারমাইন্ডদের সাথী কি না কিংবা ন্যূনতমভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না? আর কারা কারা যুক্ত তথা পুরো নেটওয়ার্ক শনাক্ত করা আজ দেশপ্রেমিক কর্তব্য। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া ভিন্ন বিকল্প আর কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে কে কত বড় রাজনীতিক, কে কত বড় সাংবাদিক কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি তা দেখার প্রয়োজন আছে বলে জনগণ মনে করে না।প্রসঙ্গত বিগত সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি যখন প্রদান করা হয়, তখনই এমন কথা হয়েছিল যে, কোনো হত্যা যে-ই করুক না কেন বাংলার মাটিতে বিচার ও শাস্তি হবেই। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি চলার সময়েও একই অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়। জাতির ওপর লেপ্টে থাকা কলঙ্ক মোচনের পথে যখন আমরা বড় বড় পদক্ষেপ নিচ্ছি এবং জয় হত্যা পরিকল্পনার তদন্ত ও বিচার করতে যাচ্ছি, তখন কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে বা সুপরিকল্পিতভাবে অন্য যেসব হত্যা-খুন হচ্ছে, তারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া জরুরি। নিঃসন্দেহে উল্লিখিত দুইয়ের একটা যোগসূত্র আছে। প্রথমটা দ্বিতীয়টা করার দায় সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদবে, এটা হতে পারে না। হতে দেয়া যায় না। সার্বিক বিচারে জাতির ওপর চেপে বসা কলঙ্কের দাগ মোচনের জন্য বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া আর অন্যান্য সব অপকর্মের বিচার ও শাস্তি হওয়া একই সূত্রে গাঁথা।এটা সর্বৈব সত্য হলেও জাতীয় চেতনার সাক্ষাৎ শত্রু মাস্টারমাইন্ডদের ইতিহাসের ধারাবাহিক হত্যা-খুন-ক্যুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সমাজজীবনের অন্যান্য অনভিপ্রেত, ঘৃণিত ও হৃদয়বিদারক সব হত্যাকাণ্ড এক করে একই গুরুত্ব দিয়ে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তাই বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে জয় হত্যা পরিকল্পনার তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি প্রদান ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানের অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের ভেতর দিয়েই অন্যান্য হত্যা ও অপকর্মের তদন্ত, বিচার, শাস্তি তরান্বিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। তবে বলাই বাহুল্য, শফিক রেহমান তদন্ত ও বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হোক, প্রাথমিক প্রমাণ ও তিনি রিমান্ডে যা বলছেন, তা মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটাই দেশবাসী চাইবে। দেশবাসী যদি প্রমাণ পায় আমেরিকায় জেলে থাকা বিএনপি নেতার শাস্তি পাওয়া ছেলেই কেবল হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত ছিল আর কেউ তাতে জড়িত নন, তবে স্বস্তিই পাবে। কিন্তু শফিক রেহমান যদি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে সৃষ্ট মাস্টারমাইন্ডদের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসে, তবে যথা কর্তব্য কাজটি করতে জাতি যেন অপারগ না হয়, এটাই আজ জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক। সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৪৭
false
rn
ইতিহাসঃ পানাম নগর ঈসা খাঁ এর আমলের বাংলার রাজধানী পানাম নগর। পানাম নগর পৃথীবির ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি।ঢাকার অদূরে ২৭ কি.মি দক্ষিণ-পূর্বে নারায়নগঞ্জ এর খুব কাছে সোনারগাঁতে অবস্থিত এই নগর।মধ্যযুগীয় নগরটির যথার্থ অবস্থান নির্দেশ করা কঠিন। বিক্ষিপ্ত নিদর্শনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল।এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূইয়াঁদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে।১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা।১৪০০ শতাব্দীতে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে পৃথীবির নামি-দামি শিক্ষকরা পড়াতে আসতেন।শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দির (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। মূলত পানাম ছিলো হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর।বাংলার স্বাধীন রাজা ঈসা খাঁর পদচারণা ছিলো এই নগরীতে। সুলতানী আমল থেকে এখানে বিকশিত ছিলো বাংলার সংস্কৃতি। সংস্কারের নামে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে পানাম নগরীর প্রকৃত নকশা।১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়।পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য।ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ।পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ।নর্তকীর পায়ের ঘুঙুর, দরবার ঘরে ঘরে বসে না মানুষের মেলা। সারি সারি ডিঙ্গি ভেড়ে না এখানে। ডিঙ্গি বেয়ে আসে না আর সওদাগর কিংবা বণিকের দল। মেতে ওঠে না কেনাবেচার বর্ণিল উৎসব। ধনদৌলতে ভরে ওঠে না খাজাঞ্চিখানা।নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর। এছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরোন টাকশাল বাড়ি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীলচাষের নির্মম ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে পানামের নীলকুঠি। পানাম পুলের কাছে দুলালপুর সড়কের পাশেই এর অবস্থান।একবার পারস্যের খ্যাতিমান কবি হাফিজ-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। বৃদ্ধ কবি হাফিজ সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসতে না পেরে একটা গজল রচনা করে উপহার পাঠান সুলতানকে। এই গজলের সূত্র ধরেই ফারসি এক পর্যটক এসেছিলেন সোনারগাঁ-তে, আর মুগ্ধ হয়েছিলেন পানাম নগরীর সৌন্দর্য্য দেখে।সেই সময় এই নগরী ছিল বস্ত্র-বাণিজ্যের রাজধানী। তবে ইংরেজরা ধীরে ধীরে একসময় ঐতিহাসিক এ ব্যবসাকেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। তারা মসলিনের কারিগরদের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে পঙ্গু করে দেয় যাতে তারা মসলিন কাপড় আর না বুনতে পারে। এর ফলে ইউরোপে তৈরি কাপড়ের একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি হয় এখানে। একইসঙ্গে এদেশীয় চাষাবাদ বন্ধ করে নীলচাষের জন্য এখানে তারা স্থাপন করে নীল কুঠি।পানাম নগরের মূল প্রবেশ পথের ছোট্ট খালটির উপরে একটি সেতু ছিলো, যার কোনো অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট নেই।অযত্ন আর অবহেলায় পানাম নগরের বাড়িঘরগুলোতে শ্যাওলা ধরেছে, ভেতরের পরিবেশটা স্যাঁতস্যাঁতে, গোমট। বাড়িগুলোর দেয়ালে গজাচ্ছে গাছপালা, অনেক বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে গাছের শিকড়। অনেক ঘরের চৌকাঠ ও রেলিং খুলে পড়েছে। চুরি হচ্ছে কড়িকাঠ ও তক্তা। ফলে বিভিন্ন সময় বাড়িগুলোর ছাদ ধ্বসে পড়ছে, ভেঙ্গে পড়ছে সিঁড়ি ও দেয়াল। পরিত্যক্ত এসব বাড়িগুলোর অনেকগুলোতে মানুষ কিংবা পশু-পাখি মলমূত্র ত্যাগ করে থাকে।এমনকি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে দুটো বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। বাংলাদেশে পানাম নগরীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় "সুবর্ণগ্রাম" নামে একটি ডকু-ড্রামা। নাটকটি রচনা করেন ইলোরা লিলিত এবং পরিচালনা করেন ফারুকে আজম।২০১০ খ্রিস্টাব্দে নাসির উদ্দীন ইউসুফ-এর পরিচালনায় "গেরিলা" নামের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণ হয় পানাম নগরীতে। চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পানাম নগরীকে বেছে নেয়া হয়েছে।ঢাকা থেকে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ।গুলিস্থান থেকে 'মোগরাপারা ' এর যেকোনো বাসে করে চলে আসা যায় 'মোগরাপারা'।সেখান থেকে অটোরিকশা যোগে দশ-পনের মিনিটেয় চলে আসা যায় পানাম নগরীতে।নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ঐতিহাসিক পানাম নগরে অবৈধভাবে বসবাসকারী ৪৯ জন দখলদারকে উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। দফায় দফায় নোটিশ দিয়েও দখলদারদের উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি।
false
rn
ভেরি ক্লিয়ার মানে সেরাম পরিস্কার কেউ যদি আপনার জীবনের অতীত ভুলিয়ে দিতে পারে খুব সম্ভবত সেই আপনারর জীবনের ভবিষ্যত . . . ♥♥♥ রাস্তাতে এক ফকির কে দেখে এক মহিলা বলছে- এই তোমাকে কোথায় যেন দেখছি মনে হচ্ছে !!ফকিরঃ হ্যাঁ ম্যাডাম কালকেই না আপনে আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলেন !! আর আমার প্রোফাইল পিকচার এ তো কমেন্ট ও দিছেন শিশুকে সৃজনশীল করার জন্য আমাদের পাঠ্যক্রম সৃজনশীল করা উচিত। যারা শিশুদের নিয়ে ভাববেন তাদের সৃজনশীল হওয়া চাই আগে ।তাহলেই প্রকৃত পক্ষে আমরা একটি সুন্দর প্রজন্ম পাব।পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মায় এবং সারাজীবন পশুই থাকে । কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ম নিয়ে জন্মায়না তাকে মনুষ্যত্ম অর্জন করতে হয় । ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে অনেক প্রাণী আছে যারা জন্ম থেকেই আত্মনির্ভরশীল হয়, কিন্তু মানব শিশু তা পারেনা । মানুষ জন্ম হয় পরনির্ভরশীল হয়ে পরে সে আত্মনির্ভরতা অর্জন করে । সকল প্রাণী আহার করে, বিশ্রাম করে, ভোগ করে, যৌন তারনা অনুভব করে, ক্ষুধার তীব্রতা বুঝতে পারে, মানুষও এসব পারে । মানুষ আরো অনেক কিছু পারে যা অপর কোন সৃষ্টি পারেনা ।রকিং চেয়ার অনেক টা টেনশনের মতো ,টেনশন যেমন মাথা আউলায়ে দেয় কিন্তু কোনই সমাধান দিতে পারেনা , রকিং চেয়ার ও সেরকম , শুধু নাড়া চাড়া করবে , কিন্তু সামনে পিছে নিতে পারবেনা , অর্থাৎ টেনশন এ কোনও সমাধান নেই , সব সময় সব অবস্থায় ভাব্বেন '' Oh Plz Take It Easy '' তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন ।পবিত্র কোরআনে আছে, একটি ভালো কথা এমন একটি ভালো গাছের মতো, যার শেকড় রয়েছে মাটির গভীরে আর শাখা-প্রশাখার বিস্তার দিগন্তব্যাপী, যা সারা বছর ফল দিয়ে যায়।প্রতিটি ভালো কাজই মানুষের মন জয় করে করতে হয়। আর মানুষের মন জয় করার একটি অব্যর্থ অস্ত্র হলো সুন্দর কথা। একবার রাজার এক ভৃত্য পলায়ন করেছে। রাজা তাকে প্রাণদন্ডের আদেশ দিলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো জলল্লাদের কাছে। জল্লাদ খড়গ তুলতে উদ্যত। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেচারা কাতর স্বরে প্রার্থনা করলো, হে করুণাময় যারা আমাকে হত্যা করতে চাইছে তাদেরকে তুমি ক্ষমা কর। কারণ আমি তাদের ক্ষমা করেছি। বাদশা আমাকে প্রাণদন্ডের আদেশ দিয়েছেন এতে আমার কোনো দুঃখ নেই কারণ এই বাদশাহ আমাকে প্রতিপালন করেছে। তুমি এদের সবার পাপ ক্ষমা করো। বাদশাহ ভৃত্যের ফাসির মঞ্চেই ছিলেন। ভৃত্যের মৃত্যুকালীন প্রার্থনা শুনে তার চিত্ত বিগলিত হলো। তার সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন, ওকে মুক্ত করে দাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। পশ্চিমাদের অনেকেরই এটা সহ্য হচ্ছিলো না বরং গাত্রদাহ হচ্ছিলো। একবার এক পশ্চিমা সাহেব রবীন্দ্রনাথকে বলেই বসলেন, গীতাঞ্জলি বইটি দারুণ হয়েছে। আসলে কে তোমার হয়ে ওটা লিখে দিয়েছিলো? সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো কবিগুরুর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, তার আগে বলো দেখি, কে আসলে তোমাকে পড়ে দিয়েছিলো, গীতাঞ্জলির মতো কাব্য। রবীন্দ্রনাথের একটা গানে তাঁর রাষ্ট্রদর্শন প্রকাশ পেয়েছে। সে বিস্ময়কর বিপুল জনপ্রিয় গানটিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের শাসক ও শাসিতের সর্ম্পক কেমন হওয়া উচিত। কেমন হওয়া উচিত নাগরিকের কার্যবিধি ও প্রশাসকের ক্ষমতার প্রকৃত সরূপ। গানটিতে আমরা রবীন্দ্রনাথের কল্যাণরাষ্ট্রের ধারনা পেয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথের যে কটি গান প্রতিটি বাঙালির চেতনা ধারন করা উচিৎ - আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে -এই গানটি তেমনই একটি গান। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভানুসিংহ ঠাকুর" ছদ্মনামে কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। আধুনিক লেখক মণিশংকর মুখোপাধ্যায় তাঁর শংকর ছদ্মনামেই সর্বাধিক পরিচিত। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের বিখ্যাত চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি "জটায়ু" ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখা। শার্লক হোমস একজন গোয়েন্দা, আর প্রফেসর শঙ্কু একজন পাগলাটে টাইপের বিজ্ঞানী। মিসির আলি সম্পূর্ণ অন্য রকম। গোয়েন্দাও নয়, আর পাগলাটে টাইপের বিজ্ঞানীও নয়। মিসির আলি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার একজন যুক্তিবাদী মানুষ, যার জীবনের পথচলার সম্বল হলো লজিক। প্রফেসর শঙ্কুর জীবনের চালিকাশক্তি হলো বিজ্ঞান। মিসির আলির চালিকাশক্তি লজিক। তিনি লজিক দিয়ে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে চান। কিন্তু কোনো কোনো সময় থমকেও যান, যখন দেখেন এমন বিষয় বা পরিস্থিতির তিনি মুখোমুখি হচ্ছেন, যা তিনি লজিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।অন্যের কথা মতো নিজের জীবনকে না গড়ে, অন্যের ইচ্ছা মতো নিজেকে পরিচালিত বা ব্যবহৃত না হয়ে নিজের মধ্যের গুপ্ত সম্পদের আহোরণই আপনাকে প্রকৃত মানুষ হতে সহায়তা করবে।বিখ্যাত হওয়ার চেয়ে ভাল মানুষ হওয়া বেশি কঠিন।
false
hm
ঈস্টার দ্বীপ ০১ ঈস্টার দ্বীপের রহস্যভেদের গল্প বলার আগে ঈস্টারদ্বীপের রহস্যের গল্প বলাই বোধ করি ভালো। ঈস্টার দ্বীপ প্রশান্ত মহাসাগরে ছোট্ট একটি দ্বীপ, এ কথা আগেই বলেছি। চিলি থেকে প্রায় ২,৩০০ মাইল পশ্চিমে, আর পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ থেকে ১,৩০০ মাইল পূর্বে অবস্থিত এই দ্বীপটি বর্তমানে চিলির অন্তর্ভুক্ত, স্থানীয়রা একে ডাকে ইজলা দে লা পাস্কুয়া নামে। ঈস্টারের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু, যা একসময় রীতিমতো রহস্যামোদীদের খোরাক ছিলো, এবং যা থেকে এরিক ফন দানিকেন এবং থর হাইয়ারডালের মতো "গবেষক"রা জন্ম দিয়েছেন বিচিত্র সব তত্ত্বের, হচ্ছে এর সৈকত জুড়ে স্থাপিত বিশালকায় সব পাথরের মূর্তি। মূর্তিগুলির উচ্চতা ৫ মিটার থেকে ১২ মিটার, ওজন ১০ থেকে ২৭০ টন। সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ প্রায় নয়শো মূর্তি সারা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঈস্টারের আদিবাসীদের কোন ক্রেন ছিলো না, ছিলো না চাকা, যন্ত্র, ধাতব অস্ত্র, ভারবাহী পশু, এক মানুষের পেশীশক্তি ছাড়া অন্য কোন যান্ত্রিক শক্তি তারা কাজে লাগায়নি এই বিশাল মূর্তিগুলি খোদাই, পরিবহন এবং স্থাপনের কাজে। ওলন্দাজ নাবিক ইয়াকব রগেভেন ১৭২২ সালের ঈস্টার উৎসবের দিনে (৫ এপ্রিল) দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। তিনি যখন দ্বীপে পা দেন, গোটা দ্বীপ জুড়ে রোগাভোগা মানুষ আর সরু কিছু গাছ ছাড়া আর যা তিনি দেখেছিলেন, তা হচ্ছে এই মূর্তিগুলি। ঈস্টারবাসীদের নৌকাগুলির বিশদ বর্ণনা রগেভেন দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্যমতে সেগুলি ছিলো রীতিমতো পলকা এবং বিপদজনক, বড়জোর দু'জন লোক সেই ফুট দশেক লম্বা নৌকায় বসতে পারে, পাতলা কিছু লতা দিয়ে সে নৌকার তক্তা একটা আরেকটার সাথে জোড়া লাগানো। যে দ্বীপের লোকজন ভালো একটা নৌকা পর্যন্ত বানাতে পারে না, তারা কী করে এমন বিশাল সব মূর্তি দাঁড়া করালো, তা রগেভেন বুঝতে পারেননি। তিনি আন্দাজ করেছিলেন, এসব মূর্তি দাঁড় করাতে গেলে মজবুত কাঠ আর মোটা দড়ি লাগবে, যার কোনটাই ঈস্টার দ্বীপে সে সময় ছিলো না। শুধু তা-ই না, যে দ্বীপে লোকজনের ভালো নৌকা নেই, সে দ্বীপে বসতি কিভাবে গড়ে উঠলো? কী করে, কখন, কোত্থেকে, কারা এসে ঈস্টারে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলো? তারচেয়ে আরো সূক্ষ্ম চিন্তার উদয় হয় ঈস্টারের ভূপ্রাকৃতিক চারিত্র্য বিশ্লেষণ করলে। এর প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়েছিটিয়ে আছে গোটা দ্বীপ জুড়ে: খোদাইপাথরের খনি (কোয়্যারি) আছে পূর্ব প্রান্তে, যন্ত্র তৈরির পাথর দক্ষিণপশ্চিমে, মাছ ধরার জন্য সেরা সৈকত উত্তরপশ্চিমে, সেরা আবাদি জমি দক্ষিণে। এই সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন বেশ জটিল কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সেটা কী করে গড়ে উঠলো এই ন্যাড়া ন্যাংটো দ্বীপে? এইসব মূর্তি খোদাই, বহন, স্থাপনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিভিন্ন কাজে পারদর্শী বিপুল মানবসম্পদ, তারা এই রুক্ষ দ্বীপে কী খেয়ে বেঁচেছিলো, যদি এক মুরগি আর পোকামাকড় ছাড়া আর কোন জীবজন্তু দেখে না থাকেন রগেভেন? যদি জটিল কোন সামাজিক ব্যবস্থা এখানে গড়েই উঠে থাকে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিলো? রুক্ষ, ন্যাড়া, অনুর্বর ঈস্টার দ্বীপে ঘিরে এই "রহস্যের" মনমতো উত্তর যোগানোর জন্য পরবর্তী সময়ের ইয়োরোপিয়রা বিভিন্ন চমকপ্রদ তত্ত্ব হাজির করেছেন। "অসভ্য" পলিনেশিয়রা এমন চমৎতার মূর্তি খোদাই বা স্থাপন করতে পারে, এ কথা মেনে নিতে নারাজ ছিলো অনেকেই। নরওয়ের পরিব্রাজক থর হেয়ারডাল, যিনি স্বীকার করতে চাননি যে পলিনেশিয়রা এশিয়া থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ঈস্টারে বসতি স্থাপন করতে পারে, এক তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন যে দক্ষিণামেরিকার আদিবাসীরাই পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ঈস্টারে বসতি গড়ে তুলেছিলো, আর এ কাজ যেহেতু তারা করতে পেরেছিলো, নিশ্চয়ই অতীতের কোন সমৃদ্ধ জাতি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দক্ষিণামেরিকায় সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিলো! থর হেয়ারডালের বিখ্যাত কন-টিকি অভিযান, নল-খাগড়ার ভেলায় চড়ে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ির চেষ্টা এ তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ঈস্টারের একটি সাধারণ "মোয়াই", মাঝপথে ফেলে রাখা সুইস শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পার্থিব সভ্যতার অপার্থিব উৎস তত্ত্বের প্রবক্তা এরিক ফন দানিকেন সরাসরি দাবি করেছিলেন, ঈস্টারের মূর্তিগুলি ভিনগ্রহের কোন উন্নততর বুদ্ধির জীবের তৈরি, যারা এককালে ঈস্টারে আটকা পড়েছিলো, সময় কাটানোর জন্য এসব মূর্তি গড়েছিলো তাদের উন্নততর যন্ত্রপাতি দিয়ে, তারপর উদ্ধার পেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চম্পট দিয়েছিলো। পেছনে পড়েছিলো তাদের মূর্তিগুলি, আর ঈস্টারের রোগাভোগা লোকজন। ঈস্টারের রহস্য ভেদ হয়েছে বেশ ভালোমতোই, তার গল্প শুরুর আগে ঈস্টারের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলবো। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলি সাধারণত প্রবাল দ্বীপ, অথবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট। ঈস্টার দ্বীপ দ্বিতীয় কিসিমের, ত্রিকোণাকৃতির এই দ্বীপটির তিন কোণায় রয়েছে সাগর থেকে উঠে আসা তিনটি মৃত আগ্নেয়গিরি। উত্তর কোণে তেরেভাকা, দুই লক্ষ বছর আগে যার অগ্ন্যুৎপাতে ঈস্টারের ৯৫% ভূমি তৈরি হয়েছে, দক্ষিণ কোণে সবচেয়ে প্রাচীন আগ্নেয়গিরি পোইকে, আর দক্ষিণ পশ্চিমে রানো কাউ। পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় ঈস্টার অনেক সমতল, আয়তনেও ক্ষুদ্র, মোটে ৬৬ বর্গমাইল, অবস্থান ২৭ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশে। আগ্নেয় ভস্ম আর ক্রান্তীয় অবস্থানের কারণে ঈস্টারের মাটি নিঃসন্দেহে এককালে যথেষ্ঠ ঊর্বর ছিলো। তবে বসতি স্থাপনকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এমন চমৎকার পরিবেশ অতোটা সুবিধার না-ও হতে পারে। ঈস্টারের আদি বসতিদাররা এসেছে উত্তরপশ্চিম দিক থেকে, যারা মূলত বিষুবীয় অঞ্চলের লোক। তাদের, তাদের শস্য ও পশুপাখির চোখে ঈস্টার যথেষ্ঠ ঠান্ডা একটা জায়গা বলেই বিবেচিত হয়েছিলো, সন্দেহ নেই। এর অন্যতম প্রমাণ, অন্যান্য পলিনেশিয় দ্বীপের সাথে ব্যতিক্রমানুসারে ঈস্টারে নারিকেল গাছ ছিলো না, পরবর্তীতে ইয়োরোপিয়দের হানাদারির পরই কেবল ঈস্টারে নারিকেল গাছ রোপণ করা হয়েছিলো, এবং দেখা গেছে, ঈস্টারের আবহাওয়া নারিকেল গাছের জন্য অনুকূল নয়। ঈস্টারের চারপাশের সাগরও প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার মতো ঊষ্ণ নয়, যে কারণে পলিনেশিয় দ্বীপগুলির মতো ঈস্টারে প্রবাল, এবং প্রবালপ্রাচীর নির্ভর ঝিনুক বা মাছ নেই। ঈস্টারের চারপাশের সাগরে মোটে ১২৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে, যা কি না ফিজিতে হাজারের ওপরে। আরো একটা সূক্ষ্ম সমস্যা, যা চট করে চোখে পড়ে না, সেটা হচ্ছে, ঈস্টার আক্ষরিক অর্থেই "বায়ুগ্রস্ত" দ্বীপ, ওখানে হাওয়ার বেগ যথেষ্ঠ বেশি, যে কারণে ঠিকমতো পেকে ওঠার আগেই ঈস্টারে রুটিফল গাছের ফল ডাল ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে যায়! কোন সন্দেহ নেই, প্রাচীন বসতিদারদের জন্য এই জায়গা কমবেশি ঝামেলারই ছিলো। মোটের ওপর, এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ঈস্টারে খাবারদাবার অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় কম ছিলো। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে বলা যেতে পারে ঈস্টারে মিষ্টি পানির সরবরাহ। বছরে গড়ে ১২৫০ মিমি বৃষ্টিপাত হয় ঈস্টারে, খুব একটা কম নয়, কিন্তু পলিনেশিয়ার তুলনায় বেশ কম। যা বৃষ্টি হয়, তা ঈস্টারের আগ্নেয় মাটিতে চুঁইয়ে চলে যায় নিচে। ঈস্টারে ছোট্ট, অনিয়মিত একটা ঝর্ণা আছে কেবল, আর আছে কিছু কুয়ো। মিষ্টি পানির জন্যে যে ঈস্টারের আদিবাসীদের যথেষ্ঠ খাটতে হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হেয়ারডাল নিজের সংস্কারের ব্যাপারে গোঁ ধরে ছিলেন বলে ঈস্টারের আদিবাসীদের উৎস নিয়ে অনেক প্রমাণ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম কথাই হলো, ঈস্টারের মূর্তিগুলির আদল পলিনেশিয়, এবং এমন ধাঁচের মূর্তি আরো দ্বীপে পাওয়া গেছে, কেবল আকারে অনেক ছোট, এ-ই যা। ঈস্টারবাসীদের মাছ ধরার বঁড়শি, পাথরের যন্ত্রপাতি, হারপুন, প্রবালের তৈরি উকো, সবই মেলে পলিনেশিয়দের সাথে। শুধু তা-ই না, ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৪ সালে যখন ঈস্টারে কয়েকদিন ছিলেন, তখন তাঁর পাকড়াও করা এক তাহিতিবাসী দিব্যি কথা বলেছে ঈস্টারের লোকজনের সাথে। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, ঈস্টারের ভাষা পূর্ব পলিনেশিয় ঘরানার, যাকে বলা হয় আদি মাঙ্গারেভিয়। শুধু তা-ই না, আদি ঈস্টারবাসীদের খুলির গড়ন মেলে পলিনেশিয়দের সাথে, কঙ্কাল থেকে পাওয়া ডিএনএ থেকে পরিষ্কার দেখা গেছে, পলিনেশিয়দের সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ নয়টি বিশেষ বেস-পেয়ারের লুপ্তি আর তিনটি বিশেষ বেস-পেয়ারের প্রতিস্থাপন সেখানে আছে। এই বৈশিষ্ট্য দক্ষিণামেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে নেই, কাজেই হেয়ারডালের হাইপোথিসিস যে রগে রগে ভুল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া ঈস্টারের ফসল, অর্থাৎ কলা, টারো, মিষ্টি আলু, আখ আর কাগুজে মালবেরি, এগুলি সবই পলিনেশিয় মাল। ঈস্টারের একমাত্র গৃহপালিত প্রাণী হচ্ছে মুরগি, যা কি না পলিনেশিয়া তথা এশিয়া থেকে ছড়িয়েছে। পলিনেশিয় বিস্তারক বলা হয় মানুষের ইতিহাসে নৌযাত্রার সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে পূর্বদিকে কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের বসতি বিস্তৃত হয়েছে, পদ্ধতিটিকে সাধারণত প্রজাতিবিস্তারের ভাষায় বলা হয় আইল্যান্ড হপিং, আমি এর বাংলা করতে চাই দ্বীপতিড়িং। দ্বীপতিড়িং ব্যাপারটা সহজে বোঝা যায়, যদি এর পেছনে যথেষ্ঠ সময়কে বিবেচনা করা হয়। ঝড়ে উপড়ে পড়া নারিকেল গাছ, আর সেই গাছে আশ্রয় নেয়া ইঁদুর, পাখি ও পোকামাকড় যে শয়ে শয়ে কিলোমিটার দূরত্ব সাগরে ভাসতে ভাসতে অতিক্রম করে কোন দ্বীপে গিয়ে ঠেকে বংশবিস্তার করতে পারে, এ রীতিমতো পরীক্ষিত সত্য। মানুষও প্রাগৈতিহাসিককালে এমনই ঘটনার শিকার হয়ে মূল ভূখন্ড থেকে কোন দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, ঐতিহাসিকরা এমনই অনুমান করে থাকেন। তবে পলিনেশিয় বিস্তার এমন কোন অঘটনের শিকার হয়ে ঘটেনি, ঝড়ের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে সাগরে ভাসতে ভাসতে কোন দ্বীপে গিয়ে ঠেকেনি অতীতের পলিনেশিয়রা, বরং রীতিমতো পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে তারা প্রশান্ত মহাসাগরের প্রতিটি বাসযোগ্য দ্বীপে বসতি স্থাপন করেছে। ১২০০ খ্রিষ্টপূর্ব সাল পর্যন্ত এশিয়া থেকে পূর্বদিকে দ্বীপগুলিতে বিস্তার থিতু ছিলো নিউগিনির পূর্বে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত। এ সময়ে কৃষিজীবী এবং নাবিক একটি জাতি (ধারণা করা হয় নিউগিনির উত্তরপূর্বে বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী এঁরা) অতি দ্রুত পূর্ব দিকের প্রায় হাজারখানেক মাইল সমুদ্র অতিক্রম করে ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গায় বসতি স্থাপন করে। এদেরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে পলিনেশিয়দের পূর্বপুরুষ হিসেবে। এদের সনাক্ত করা হয় একটি নির্ভুল নিদর্শন দিয়ে, যাকে বলা হয় লাপিতা মৃৎকর্ম, একটি বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র তৈরির ধরন। পলিনেশিয়দের না ছিলো ধাতব যন্ত্রপাতি, না ছিলো কম্পাস বা চার্ট, কিন্তু নৌযাত্রায় তারা ছিলো অসামান্য কুশলী জাতি। পেছনে ফেলে আসা বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে পলিনেশিয়দের বিস্তারের যাত্রাকে মোটামুটি নিখুঁতভাবে পুনর্চিত্রায়ন করা হয়েছে। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ মোটামুটি আড়াই হাজার বছরে পলিনেশিয়রা হাওয়াই, নিউজিল্যান্ড ও ঈস্টার দ্বীপের মধ্যবর্তী ত্রিকোণাকৃতি মহাসাগরের সব দ্বীপে বসতি গড়ে তোলে। কেন ঝড়ের খেয়ালে পথ হারানো নিরুদ্দেশ যাত্রা নয়, কেন পরিকল্পিত অভিযাত্রা, তার সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে এর সবই ছিলো পশ্চিম থেকে পূবে, অর্থাৎ স্রোত ও বাতাসের বিপরীতে। শস্য আর গৃহপালিত পশুর উপস্থিতিও প্রমাণ করে, এ অভিযানগুলি ছিলো বসতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে, যেখানে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বসতিতে টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় মূল্যবান খাবারের যোগান। স্রোত আর বাতাসের গতি বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, ঈস্টারের বসতি স্থাপনের জন্যে মাঙ্গারেভা, পিটকেয়ার্ন আর হেন্ডারসন দ্বীপকে মাঝসোপান হিসেবে ব্যবহার করেছিলো আদি পলিনেশিয়রা। ঈস্টারের ভাষার সাথে মাঙ্গারেভার ভাষার মিল, ঈস্টারে ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্রের সাথে মাঙ্গারেভা আর পিটকেয়ার্নে ব্যবহৃত যন্ত্রের মিল, আর ঈস্টারে পাওয়া কঙ্কালের খুলির সাথে হেন্ডারসনে পাওয়া খুলির সাদৃশ্য দেখে এ অনুমান আরো জোরদার হয়। ১৯৯৯ সালে পুনর্নির্মিত পলিনেশিয় ধাঁচের ক্যানো হোকুক'আ ১৭ দিনে মাঙ্গারেভা থেকে ঈস্টারে এসে পৌঁছেছিলো। প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা ক্ষুদে ক্যানোতে চড়ে আন্দাজে পূর্বদিকে বেরিয়ে পড়ে কী করে একদল লোক মাত্র নয় মাইল চওড়া একটা দ্বীপ আবিষ্কার করে ফেললো? এটা কি একটু বেশি আন্দাজ হয়ে যাচ্ছে না? তেরোশো মাইল দূর থেকে রওনা দিয়ে মোটে নয় মাইল চওড়া একটা অজানা দ্বীপ আবিষ্কার? সম্ভব। স্থলবাসী সামুদ্রিক পাখি এ কাজটি সহজ করে দেয়। ঈস্টারে একসময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক পাখিগুলির আবাস ছিলো (পরবর্তীতে আবিষ্কৃত কঙ্কাল থেকে আবিষ্কৃত তথ্য), যারা খাবারের সন্ধানে নিজের বাসা ছেড়ে একশো মাইল দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দেয় কখনো কখনো। সেক্ষেত্রে সাগরের বুকে নয় মাইলের ছোট্ট একটা বিন্দু নয়, বরং দুশো মাইল ব্যাসের একটি বেশ ডবকা এলাকা খুঁজে পাবার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়হিসাব করে দেখলাম, মোটামুটি নয় ডিগ্রী এলাকা। ঈস্টার দ্বীপে চলতি গল্প, যার অনেকগুলিই নিবন্ধিত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, অনুসারে হোতু মাতু'আ (বড় বাবা) নামে এক সর্দার দু'টি ক্যানোতে চড়ে তাঁর দুই বউ, ছয় ছেলে, আর তাদের বালবাচ্চাসহ ঈস্টারে এসে হাজির হন। এই গল্পের সত্যাসত্য যাচাই করা মুশকিল, কারণ ঘটনার হাজার বছর পর কতটা আসল আর কতটা রং চড়ানো তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আবিষ্কৃত, অধিকৃত এবং বাসযোগ্য হবার পর কি আগের দ্বীপগুলির সাথে ঈস্টারের যোগাযোগ ছিলো কি না১। প্রত্নতাত্ত্বিক রজার গ্রীন ঈস্টারে ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্র, আর বসতি স্থাপনের কয়েকশো বছর পর মাঙ্গারেভার কিছু যন্ত্রের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়ে দাবি করছেন, যোগাযোগ ছিলো, যেমনটা ছিলো পলিনেশিয়ার বেশির ভাগ "মূলদ্বীপ" ও "বসতিদ্বীপের" মধ্যে। কিন্তু ঈস্টারে কুকুর, শূকর এবং কিছু পলিনেশিয়ায় চলতি কিছু শস্যের অনুপস্থিতি নির্দেশ করে উল্টোটাই। পরবর্তীতে যদি যোগাযোগই থাকবে, তাহলে পলিনেশিয়দের সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এ শস্য ও প্রাণীগুলি ঈস্টারে থাকার কথা, বরং পরের যাত্রাদেই এদের চলে আসার কথা, যদি হোতু মাতু'আ ইতিমধ্যে এদের নিয়ে না আসেন। আরেকটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি দ্বীপের পাথরেরই একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংযুক্তি আছে, সেটি সেই দ্বীপের পরিচয় বহন করে। মার্কেসাস, পিটকেয়ার্ন, মাঙ্গারেভা, হেন্ডারসন আর সোসাইটিজ দ্বীপপুঞ্জে এরকম অহরহ এক দ্বীপের জিনিস অন্য দ্বীপে পাওয়া গেছে, কিন্তু ঈস্টারের পাথর অন্য কোথাও, কিংবা অন্য কোন জায়গার পাথুরে যন্ত্র ঈস্টারে পাওয়া যায়নি। এ থেকে অনুমান করা ভুল হবে না, যে হোতু মাতু'আ-র পদার্পণের পর প্রায় হাজার খানেক বছর ঈস্টার দ্বীপ সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো, ইয়াকব রগেভেন তার কূলে জাহাজ ভেড়ানোর আগ পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হোতু মাতু'আ বা তিনি যিনিই হোন, ঈস্টারে এসেছিলেন কবে? এ ব্যাপারে বেশ বড় ধরনের বিতর্ক আছে। প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থে ৩০০-৪০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে ঈস্টার দ্বীপে বসতি স্থাপন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, যার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, গ্লটোক্রোনোলজি, বা ভাষার বৈভিন্ন্যের সূত্র ধরে ব্যবহৃত কালনির্ণয় পদ্ধতি, আহু তে পেউ (স্থাপিত মূর্তির মঞ্চগুলিকে আহু বলা হয়, সারা দ্বীপ জুড়ে বিভিন্ন আহু ছড়িয়ে আছে, প্রতিটি আহু ও মূর্তির আলাদা নামও আছে), পোইকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আর এককালের হ্রদের থিতিয়ে পড়া পলিতে পাওয়া তিনটি চারকোলের নমুনার রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে কালনির্ণয়, যাকে মানুষের হাতে বন ভস্মীকরণের নমুনা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এ সূত্রগুলিকে ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কারণ, গ্লটোক্রোনোলজি দিয়ে নির্ণীত সময়ের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে ঈস্টারের ভাষার ক্ষেত্রে, কারণ এক্ষেত্রে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছে তাহিতি ও মার্কেসাসের অধিবাসীরা, যাদের মাধ্যমে সহজেই উপাদানগুলির দূষণ ঘটা সম্ভব। চারকোলগুলি যে পদ্ধতিতে কালনির্ণয় করা হয়েছে, সে পদ্ধতিটি এখন পুরনো এবং কম নির্ভরযোগ্য হিসেবে পরিগণিত, আর এই অঙ্গারের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যায় না, দাবানলে বা বজ্রপাতেও অনেক সময় অঙ্গার পাওয়া যায়। পরিবর্তে পুরাপ্রাণীতাত্ত্বিক ডেভিড স্টেডম্যান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লাউদিও ক্রিস্তিনো ও প্যাট্রিশিয়া ভার্গাস প্রস্তাব করেছেন আনুমানিক ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তাঁদের অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে ঈস্টারের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান , আনাকেনা সৈকতে পাওয়া কাঠের চারকোল আর মানুষের খাওয়া কাছিমের হাড়। ঈস্টার দ্বীপে ক্যানো ভেড়ানোর মতো খুব বেশি সৈকত নেই, গোটা দ্বীপের চারপাশটাই খুব গভীর, অল্প দুয়েকটা জায়গা বাদে, আনাকেনা তার মধ্যে ক্যানো ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে ভালো সৈকত, ধারণা করা যেতে পারে প্রথম অভিযাত্রীরা এখানেই প্রথম নৌকো ভিড়িয়ে থিতু হয়েছিলো। যে পদ্ধতিতে কালনির্ণয় করা হয়েছে, তা একেবারেই নতুন ও নিখুঁত প্রযুক্তি, যাকে বলা হয় অ্যাক্সিলারেটর ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি বা এএমএস। এই কাল নির্ণয় পদ্ধতিতে এক দফা শুদ্ধিও চালানো হয়েছে, কাছিমের মতো সামুদ্রিক জীবের হাড়ের রেডিওকার্বন ডেটিঙের জন্য মেরিন রিজারভয়ার কারেকশন। কিন্তু এই নিদর্শনগুলিকে শুরুর দিককার বলে ধরে নেয়া হবে কেন? এগুলি কি বসতি স্থাপনের ছয়শো বছর পরের নিদর্শন হতে পারে না? পারে, কিন্তু কাছিমের হাড়ের সাথে একই বয়সী এমন কিছু সামুদ্রিক পাখির হাড় পাওয়া গেছে, যা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঈস্টার এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপে, এবং মানুষর পদার্পণই এর একমাত্র কারণ বলে ধরা হয়। এ কারণে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দকেই ঈস্টারের নির্জনতাভঙ্গের সময় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। ১ এ প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ আছে, সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গের আলোকে যদিও। তবে এ নিয়ে এক দফা কপচানোর সুযোগ ছাড়ছি না।
false
mk
কে এই পিয়াস করিম_ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকার শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমের বাবা ও নানা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। তাঁরা ছিলেন কুমিল্লা জেলা শান্তি কমিটির নেতা। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাবা এ্যাডভোকেট এমএ করিম ও নানা জহিরুল হক লিল মিয়ার বাড়িতে গ্রেনেড চার্জ করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের পর ড. পিয়াস করিমের বাবা এ্যাডভোকেট এমকে করিমকে দালালির অপরাধে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি অনেকদিন কুমিল্লা কারাগারে বন্দী ছিলেন।ড. পিয়াস করিম কুমিল্লা শহরের জজকোর্ট রোডের এ্যাডভোকেট এমএ করিমের ছেলে। তাঁর বাবা এ্যাডভোকেট এমএ করিম মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলা শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি হোমনার রামপুরে। পিয়াস করিমের বাবা এমএ করিম বিয়ে করেন আরেক মুসলিম লীগ নেতা জহিরুল হক লিল মিয়ার মেয়ে বাচ্চুকে।জহিরুল হক লিল মিয়া এর আগে আওয়ামী মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ছিলেন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় জহিরুল হক লিল মিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার জজকোর্টের উত্তর পাশে জহিরুল হক লিল মিয়ার বাড়ি এবং জজকোর্ট রোডের এমএ করিমের বাড়িতে গ্রেনেড চার্জ করেছিলেন। আর এ গ্রেনেড চার্জে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল কবির বীরপ্রতীক, বাহার উদ্দিন রেজা বীরপ্রতীক ও মুক্তিযোদ্ধা খোকন।বাহার উদ্দিন রেজা বীরপ্রতীকের কাছ থেকে জানা গেছে, মেলাঘর থেকে কমান্ডার হায়দারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা জহিরুল হক লিল মিয়া এবং এমএ করিমের বাসায় গ্রেনেড হামলা করা হয়। তাঁদের বাড়িতে পাকিস্তানী বাহিনীর যাতায়াত ছিল। তিনি জানিয়েছেন, কী পর্যায়ে গেলে একজন কমান্ডার তাদের বাড়িতে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা বুঝে নিতে হবে।মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলে দালাল আইনে গ্রেফতার হন ড. পিয়াস করিমের বাবা এ্যাডভোকেট এমএ করিম। তিনি অনেকদিন কুমিল্লা কারাগারে ছিলেন।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাবাকে বাঁচাতে পিয়াস করিম কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগে নাম লেখান। যদিও জেলা ছাত্রলীগে তাঁর কোন পদবি ছিল না। সে সময়ের জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট রুস্তম আলী তাঁর ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।পিয়াস করিম কুমিল্লা মডার্ন স্কুল, কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনার পর আমেরিকায় চলে যান।স্বাধীনবাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ্যাডভোকেট রুস্তম আলীর কাছ থেকে জানা গেছে, পিয়াস করিম তাঁর বাবাকে বাঁচাতে ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকেননি। তিনি জানান, পিয়াস করিম নকশালের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। উল্লেখ্য, ড. পিয়াস করিম এক টক শোতে শাহবাগের আন্দোলনকে অবৈধ আখ্যা দেন। এ খবর শাহবাগে ছড়িয়ে পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে রাজাকারের দালাল আখ্যা দিয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। ( তথ্যসূত্র: বাংলানিউজ) ব্লগীয় পেচাল: পিয়াস মিয়া কইলাম এমন একটা জ্ঞানীও না। পিএইচডি করছে Kasas State University থেকে যার Ranking নাই (US News এর অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষার শাখায় প্রথম ৮০টার Ranking আছে, বাকিগুলার কোন Ranking নাই)। আর ১৭ বছর আমেরিকার MidWest-এর চিপাচাপার এমন সব ছোটখাটো রিজিওনাল কলেজে পড়াইছে যেগুলাতে পিএইচডি তো দূরের কথা, মাস্টার্স প্রোগ্রামও নাই। জীবন পার করছে আন্ডারগ্র্যাডের পোলাপাইনগো Introductory ও Intermediate Macro-Micro Economics এর গৎবাঁধা বুলি পড়ায়া। তেমন কোন রিসার্চও করা লাগে না এসব টিচিং স্কুলে। কোন বড় চ্যালেন্জিং ও দায়িত্বশীল পদেও ছিলো না কোন দিন। আমেরিকার এই রদ্দিমালটা দেশে গিয়া ভাব লয় যে আম্রিকা থিকা বিরাট কামেল আদমি আইছে। এমন ভাব নে‌য় যেন উনি Harvard-এর প্রফেসর ছিলো আর World Bank ও IMF'এ নিয়মিত পলিসি লেভেলের ইস্যুতে কনসালটেন্সি কইরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে!
false
ij
প্রাচীন গ্রিসের গানের মানুষ অর্ফিউস অর্ফিউস। প্রাচীন গ্রিসের গানের মানুষ । আলোর দেবতা অ্যাপোলোর কাছ থেকে কিশোর বয়েসে একটি বীণা (Lyre) পেয়েছিলেন অর্ফিউস। সে বীণার ঝংকারে বনাঞ্চলের বুনো জীবজন্তু গাছপালা ও ঝর্ণাধারা হয়ে উঠত মূখর। ঝর্ণাধারার কাছেই সুন্দরী বনপরীরা নাচতে নাচতে থমকে দাঁড়াত বীণার তরঙ্গাঘাতে। তবে প্রকৃত কবির মতোই দুঃখী ছিল অর্ফিউস-এর জীবন। প্রেয়সী বনপরী সেই ইউরিডাইস কে পেয়েও ধরে রাখতে পারেননি। অত্যন্ত নৃসংশ ভাবে খুন হন প্রতিদ্বন্দী ধর্মস¤প্রদায়ের হাতে! ... তবে আমাদের কাছে অর্ফিউস প্রাচীন গ্রিসের একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান গানের মানুষ ... যে কারণে বাংলার অর্ফিউস নজরুল গভীর শ্রদ্ধায় তার ঋদ্ধ রচনাবলীতে স্মরণ করেছেন অর্ফিউস কে ...গ্রিক পুরাণে কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য, ইতিহাস এবং অন্যান্য বিদ্যার সংরক্ষয়িত্রী ও উৎসাহদাত্রী নয় জন দেবীর কথা বলা হয়েছে। এরা সবাই জিউস-কন্যা এবং এরা ‘মিউজ’ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে বয়সে বড়ো ও উল্লেখযোগ্য মিউজ হলেন ক্যালিওপি। ক্যালিওপি শব্দের মানে কিন্নরকন্ঠী কিংবা যার কন্ঠস্বর মধুক্ষরা । ক্যালিওলি হলেন মহাকাব্য ও বাগ্মীতার দেবী। ইউরোপীয় শিল্পীর আঁকা ক্যালিওপি। আমরা একে অন্য এক ভূমিকায় একবার দেখেছি। ... সুদর্শন তরুণ অ্যাডোনিসকে নিয়ে দেবী আফ্রোদিতি ও পাতালের রানী পার্সিফোনে-র বিরোধ বেঁধেছিল। জিউস আসলে বিচারের ভার দিয়েছিলেন মিউজ ক্যাললিওপিকে। ক্যাললিওপির সন্তান অর্ফিউস। ক্যাললিওপির অন্যায্য বিচারের ফলে অর্ফিউস এর মৃত্যু ঘটেছিল। কী ভাবে বলি। মিউজ ক্যাললিওপি এই রায় দিয়েছিল যে পার্সিফোনে ও আফ্রোদিতি বছরের অর্ধেক সময় করে অ্যাডোনিস এর সঙ্গে থাকবে। এই রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়।প্রাচীন গ্রিসে সংগীতজ্ঞ, কবি ও পুরাণকার অর্ফিউস এর মা ছিলেন এই ক্যালিওপি। বাবা?কেউ বলে অর্ফিউস এর বাবা দেবতা অ্যাপোলো। আবার কারও কারও মতে অর্ফিউস এর বাবা থ্রাসের রাজা ওয়েআগরাস। তবে অর্ফিউস বেড়ে উঠেছিল পিতৃভূমি থ্রাসে নয়, পিমপ্লেইয়া নামে এক নগরে ; জায়গাটা অলিম্পাস পাহাড়ের কাছে। অলিম্পাস পাহাড়ের অবস্থান গ্রিসের মূল ভূখন্ডের মাঝখানে। মানচিত্রে পিমপ্লেইয়া। পিমপ্লেইয়ায় বেড়ে ওঠায় অর্ফিউস এর বাবা হিসেবে দেবতা অ্যাপোলোই স্বীকার্য হন। কেননা পিমপ্লেইয়া জায়গাটা গ্রিক দেবতাদের ‘থান’ অলিম্পাস পাহাড়ের কাছে।অর্ফিউস তখন কিশোর। একদিন। নিমগ্ন ভঙ্গিতে অরণ্য পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সহসা সামনে এসে দাঁড়ালেন আলোর দেবতা অ্যাপোলো । দেবতা কিশোরের হাতে একটি বীণা তুলে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য।আমার জন্য?হ্যাঁ। তোমার জন্য। তুমি বাজাবে।আমি তো বীণা বাজাতে জানি না দেবতা। একবার বীণার তারে আঙুল ছুঁইয়ে দেখই না। বলে দেবতা অ্যাপোলো অদৃশ্য হলেন।বীণা (Lyre)কিশোর একটা ওক গাছের নীচে বসল। বসে কোলে বীণা তুলে নিল। তারপর বীণার তারে আঙুর বোলাল। অপূর্ব ঝংকার তুলল। বাতাস বইল। ওকতলার শুকনো পাতারা সরসর করে গড়িয়ে গেল। কিছু ওকপাতাও ঝরল যেন। কাছেই ছিল শাদা রঙের অ্যানিমোন ফুলের গাছ। ফুলেরা ঝুঁকল মনে হল। আর একটা ঘুঘু পাখি উড়ে এল খুব কাছে ! কেন?কিশোর অর্ফিউস অচিরেই টের পেল পিতৃদেব আলোর দেবতার আর্শীবাদ। পিমপ্লেইয়া এখন । এককালে এখানেই কোথাও কেটেছিল অর্ফিউস এর শৈশব -কৈশর ও যৌবন।অর্ফিউস তখন তরুণ। হঠাৎই একদিন শুনল যে স্বর্নমেষের চামড়া আনতে অভিযানে যাবে কয়েক জন বীর। তারা থেসালির পূর্ব তীর থেকে আর্গো জাহাজের পাল ওড়াবে। সেই আর্গো জাহাজের নেতৃত্বে দেবে বীর জেসন । অর্ফিউস ঠিক করল সেও অভিযানে যোগ দেবে । অর্ফিউস থেসালী পৌঁছল। লক্ষ করুন পিমপ্লেইয়ার অবস্থান অর্ফিউস বীণা বাজাল। জাহাজ ছাড়ল। আর্গো জাহাজটি তিনটি রুক্ষ দ্বীপের পাশ দিয়ে যাবে। সে দ্বীপ তিনটির নাম: সাইরেনাম। ওখানে বাস করে সাইরেনরা। সাইরেনরা অতি মধুর সুরে গান করে। সে সুরের ঐন্দ্রজালিক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে জাহাজ সাইরেনাম এর পাথুরে উপকূলে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যাক। আর্গো জাহাজটি ভেসে চলেছে সাইরেনাম এর পাশ দিয়ে। অর্ফিউস শুনল সাইরেনদের সুরেলা গান সেই গানের চেয়েও শ্রুতিমধুর বীণা বাজাল অর্ফিউসআর আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল আর্গো ...যাক। স্বর্ণমেষের অভিযান শেষে পিমপ্লেইয়া ফিরে এল অর্ফিউস । একদিন। অরণ্য পথ ধরে যাচ্ছিল অর্ফিউস । নির্জন কোথাও বসে সংগীতসাধনা করবে। যতই প্রতিভা থাকুক, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। অর্ফিউস পাতাময় বনসড়কে মগ্ন হয়ে হাঁটছিল। হঠাৎই চোখ গেল অপূর্ব সুন্দর এক মেয়ের দিকে। এদিকেই আসছে। থমকে দাঁড়াল। কে এ দীর্ঘলকান্তি মেয়ে? স্বপ্ন দেখছি না তো। জিগ্যেস না করে পারল না। তুমি কে গো মেয়ে?মেয়েটি আয়ত চোখে তাকাল। হাসল। কী ঝকঝকে দাঁত। মিষ্টি কন্ঠে বলল, আমার নাম ইউরিডাইস; আমি যে বনপরী হই।ওহ্ । বনপরী ! এই সেই ইউরিডাইস .... ওক গাছের উপদেবী (nymph) ... অর্ফিউস বলল, তোমাকে তো অনেকে দেবতা অ্যাপোলোকন্যা বলেও মনে করে ইউরিডাইস।হ্যাঁ। ইউরিডাইস মাথা ঝাঁকাল। অর্ফিউস হেসে বলল, সূর্যদেব অ্যাপোলো আমারও পিতা; বাবাই তো আমাকে এই বীণা দিয়েছেন। এই দেখ। বলে হাতের বীণাখানি দেখাল।ওহ্ ।তাহলে আমরা ভাইবোন হই- কি বল? অর্ফিউস বলল।না! না! থ্রাসের রাজা ওয়েআগরাস তোমার পিতা হন। ইউরিডাইস কাতর স্বরে বলে।তুমি কী ভাবে জানলে?আমি যে বনপরী হই। এসো এখন আমরা বনাঞ্চলে খেলা করি। পিমপ্লেইয়া সুন্দর দেশ। আমি স¤প্রতি এদেশে এসেছি। আমি এখন দৌড় দেব। আমায় তুমি ধরো তো দেখি। বলে ইউরিডাইস পাতাময় বনসড়কে দৌড়ে যায়। খিলখিল করে হাসে। অর্ফিউসও দৌড় দেয়।আর তারপর পাগলী বনপরীটির প্রেমে পড়ে যায় অর্ফিউস। ক্রমে সে প্রেম গভীর এক রূপ নেয়। একে অন্যকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। তারা মনের সুখে কখনও চারণভূমির ওপর কখনও অরণ্যসড়কে দৌড়ে বেড়ায়। ইউরিডাইস ও অর্ফিউস । এই অমলিন মিলনের অনেক ছবি এঁকেছেন ইউরোপীয় শিল্পীরা। একদিন অর্ফিউস তার মা মিউজ ক্যালিওপি কে সব খুলে বলল।মিউজ ক্যালিওপী বললেন, প্রণয় আর জীবন হল একে অন্যের নিঃশ্বাস। আমি তোদের বিয়ের সব ব্যবস্থা করছি। বিয়ে হল। ধূমধাম করেই হল। অনেক খানাপিনাও হল। পিমপ্লেইয়া নগর মূখরিত হল।বিয়ের পর আবার বনপথে সুখী যুগলের ছোটাছুটি শুরু হল। ইউরিডাইস ও অর্ফিউস কে নিয়ে আঁকা আরেকটি অসাধারণ ছবি।কিন্তু এত সুখ কি সয়?মৌমাছির দেবতা অ্যারিষ্টিউস। একদিন বনপথে যাচ্ছিল ইউরিডাইস। কামতাড়িত হয়ে দূরাত্মা অ্যারিষ্টিউস ইউরিডাইস এর পিছু নিল । ইউরিডাইস সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য ছুটছে। ঝোপের ভিতরে ছিল সবজে রঙের একটি বিষময় সাপ ... ওকে কাটল! সে কালে মৃতদের চলে যেতে হত পাতালপুরীতে। কাজেই মৃত্যুর পর ইউরিডাইস কেও পাতালে চলে যেতে হল। গ্রিক পুরাণে পাতালকে বলা হত: Hades. উচ্চারণ: হেইডিস; পাতালের অধিপতি দেবতাকেও বলা হত হেইডিস। অর্ফিউস শোকার্ত হয়ে উঠল এবং সে পাতালে গেল ইউরিডাইস কে ফিরিয়ে আনতে । পাতালপুরীর অধিপতি দেবতা হেইডিস-এর মুখ গম্ভীর। কি আর করে অর্ফিউস । বীণা বাজিয়ে গান গাইতে লাগল। বড় বিষন্ন, বড় সুন্দর সে গান। যাক। হেইডিস-এর পাষাণ হৃদয় গলল সুরের সুললিত তরঙ্গে। তিনি সম্মত হলেন যে ... শিগগির ইউরিডাইস পাতাল থেকে ফিরে যাবে ওপরের জীবিতদের জগতে। তবে একটা শর্ত আছে। কি শর্ত? ইউরিডাইস কে নিয়ে যাওয়ার সময় অর্ফিউস যেন পিছন দিকে না তাকায়।তাইই সই।হায়। অর্ফিউসরা যখন ওপরে পৌঁছল ...তখন...তখন ... কী ভেবে হতভাগ্য অর্ফিউস একবার পিছন ফিরে তাকাল। ইউরিডাইস পিছলে আবার পাতালে পড়ে গেল। অর্ফিউস দুঃখ গভীর কষ্টে জর্জরিত হল। তার জীবনধারা গেল বদলে। মেয়েদের এড়িয়ে চলল। মিনাদ দেরও এড়িয়ে চলল। তো কারার মিনাদ? দিওনিসাস ছিলেন অর্ফিউস এর সময়ে গ্রিসের সুরার দেবতা। তার অনেক নারী ভক্ত ছিল। এদেরই বলা হত মিনাদ। যা হোক। প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্ম থেকে বিরত থাকল অর্ফিউস । একা একা বনের ভিতরে গাছের তলায় বসে বীণা বাজিয়ে বিরহের গান গায়। পাখিরা এসে শোনে। গাছের পাতা কাতর হয়ে ওঠে। সহসা একদিন বিপদ এল ঘনিয়ে। অর্ফিউস গাছতলায় বসে গান গাইছিল। ইউরিডাইস এর জন্য মন ভীষণ খারাপ। কয়েক জন মিনাদ এসে দাঁড়াল। মিনাদরা ক্ষেপে ছিল;হয়তো সুরাসক্ত ছিল; উন্মাদিনীরা অর্ফিউসকে লক্ষ করে পাথর, গাছের ডাল ছুড়ে মারতে লাগল । অর্ফিউসের বীণার সুরে আচ্ছন্ন হয়ে পাথর-গাছের ডাল অর্ফিউস কে আঘাত করল না। মিনাদরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে অর্ফিউস কে আক্রমন করে টুকরো টুকরো করে ফেলে। মাথা নদীতে ভেসে গেল। তখনও গাইছিল। মাথাটি লেসবস দ্বীপে ভিড়ল। যা হোক। এখন গ্রিক পুরাণ থেকে অর্ফিউসের অন্তিম মুহূর্ত সম্বন্ধে পাঠ করা যাক-It is said that when Orpheus finally met his death, the birds wept on the hillside.The trees shed their leaves and the nearby streams were swollen with their own tears. Orpheus' spirit went down to the Underworld and he soon found Eurydice. Although it is a shadowy existence the two walk together for eternity without fear of another separation.কিন্তু, মিনাদরা কেন অর্ফিউস কে আক্রমন করল? এর মূল কারণ গোষ্ঠীগত রেষারেষি। ততদিনে গ্রিস জুড়ে অর্ফিউস কে ঘিরে গড়ে উঠেছিল Orphic religious cult। আর অর্ফিউসও একমাত্র সূর্যদেব (দেবতা অ্যাপোলো ) ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করতে রাজী হয়নি। সুরার দেবতা দিওনিসাস তো নয়ই। এর কি কারণ? সুরাপানে নির্মল সংগীতের আবেদন ম্লান হয়ে যায় বলে? যা হোক ততদিনে দিওনিসাস পন্থী মিনাদরা আরেকটি স¤প্রদায় গড়ে তুলেছিল। আসলে একটি স¤প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য পোষন করে উগ্র না হয়ে ওঠা বড়ই কঠিন। কাজেই একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে সহ্য করবেই-বা কেন?এই ছবিই যেন ইতিহাসের অনিবার্য দৃশ্য।অন্য একটি ভাষ্যে রয়েছে অর্ফিউস ছিলেন মিশরীয় পুরোহিত। ক্রিটদ্বীপে এসেছিলেন। ওখানে দিওনিসাসপন্থী পুরোহিতরা অর্ফিউস কে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। মনে থাকার কথা ... সুদর্শন তরুণ অ্যাডোনিসকে নিয়ে দেবী আফ্রোদিতি ও পাতালের রানী পার্সিফোনে-র বিরোধ বেঁধেছিল। জিউস আসলে বিচারের ভার দিয়েছিলেন মিউজ ক্যাললিওপিকে। ক্যাললিওপির সন্তান অর্ফিউস। ক্যাললিওপির অন্যায্য বিচারের ফলে অর্ফিউস এর মৃত্যু ঘটেছিল। কী ভাবে বলি। মিউজ ক্যাললিওপি এই রায় দিয়েছিল যে পার্সিফোনে ও আফ্রোদিতি বছরের অর্ধেক সময় করে অ্যাডোনিস এর সঙ্গে থাকবে। এই রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়।তাহলে পুরাণ অনুযায়ী আফ্রোদিতি ক্রোধই ছিল অর্ফিউস এর মৃত্যুর কারণ।তার মানে ক্যাললিওপির একটি সিদ্ধান্তই তার সন্তানের মৃত্যুর কারণ?গ্রিক মিথ এভাবেই বিস্ময়কর ...ছবি: ইন্টারনেট।তথ্যসূত্র: প্রতীচ্য পুরাণ: ফরহাদ খান। এবংইন্টারনেটে অর্ফিউস-সংক্রান্ত বিভিন্ন সাইট।
false
rg
যুদ্ধাপরাধী মামলায় সাঈদী'র রায়, মাননীয় আইনমন্ত্রী'র উক্তি ও প্রসিকিউশনের দুর্বলতা!!! গতকাল ১৭ সেপ্টেম্বর একাত্তরের ঘৃণীত মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী'র আপিলের রায় কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড হবার পর মাননীয় আইনমন্ত্রী মিডিয়ার কাছে যে মন্তব্য করেছেন, এটি কোনো ভাবেই সুস্থ মানুষ হিসেবে মেনে নেবার মত নয়। মামলায় সাঈদীর রায় হবার পর মাননীয় আইনমন্ত্রী মিডিয়াকে বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। যে রায় হয়েছে তা মাথা পেতে নিচ্ছি। তবে, ব্যক্তিগতভাবে আমি বলব, কিছুটা হতাশ ও মর্মাহত হয়েছি। এটা আমার আবেগ। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর এ ব্যাপারে কিছু করা যায় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, 'যেটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, আমি শুনেছি তিনি পিস কমিটির মেম্বার ছিলেন এবং এ বিষয়ে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। স্বেচ্ছায় যারা পিস কমিটির মেম্বার হয়েছিলেন তারাতো সচেতনভাবেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। আমি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না দেখে কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে প্রসিকিউশন টিমের যা অবস্থা, সেখানে পরিবর্তন আসা উচিৎ। ট্রাইব্যুনালে কিছু কিছু মামলা চলছে, কিছু রায় অপেক্ষমাণ আছে। প্রসিকিউশন টিমের যেন কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য আমি কোনো পরিবর্তন আনিনি। তবে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।'মাননীয় আইনমন্ত্রী আপনার কথা থেকেই এটা সুস্পষ্ট যে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে কিছু ঝামেলা আছে। তাহলে সেই ঝামেলাগুলো কি কি তা কি বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারবে? দীর্ঘ ৪২ বছর পর মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের জন্য যে স্পর্শকাতর মামলাগুলো এই ট্রাইব্যুনালে এখন বিচারধীন, আপনি রাষ্ট্রের আইনমন্ত্রী হিসেবে সেই প্রসিকিউশনের ঝামেলা না এড়িয়ে সুস্পষ্টভাবেই রাষ্ট্রের সঙ্গে বেঈমানী করেছেন। নতুন সরকার গঠেনর পর আপনি আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে সেই ঝামেলাগুলো জানার পরেও কেন সেগুলো ঠিক করেন নি? কেন একটি জোড়াতালির প্রসিকিউশন টিম দিয়ে এত বড় স্পর্শকাতর মামলাগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে? তাহলে আইনমন্ত্রী হিসেবে আপনি এই নয় মাস কি করলেন? যদি প্রসিকিউশনের কোনো দুর্বলতার কারণে সাঈদীর মত দুর্ধর্ষ অপরাধী প্রাপ্ত সাজা থেকে রেহাই পেয়ে যায়, সেই দায় আপনি আইনমন্ত্রী হিসেবে মোটেও এড়াতে পারেন না। রাষ্ট্রের আইনমন্ত্রী হিসেবে প্রসিকিউশনের সকল ব্যর্থতার দায় আপনার ঘাড়েই পড়ে। আপনি কেন দীর্ঘ নয় মাসেও এই দুর্বল প্রসিকিউশন টিমকে শক্তিশালী টিমে রূপ দিতে পারলেন না? আবার আপনি বলছেন যে,প্রসিকিউশন টিমের যেন কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য আপনি কোনো পরিবর্তন আনেননি! প্রসিকিউশন টিমের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব তো আপনার নয়? প্রসিকিউশন টিমের সুবিধা-অসুবিধা দেখা নাকি রাষ্ট্রের বা জাতির সুবিধা অসুবিধা দেখা, কোনটা আপনার গুরুদায়িত্ব ছিল মাননীয় আইনমন্ত্রী? আপনি জাতির সুবিধা অসুবিধার কথা ভুলে সচেতনভাবেই নিরব ছিলেন। আর প্রসিকিউশনের দুর্বলতার সুযোগে সাঈদীর মত আসামীর সাজা কমে গেল। এখন এই দায় কে নেবে? আপনার এই ব্যর্থতার দায় তো বাংলাদেশ নেবে না। বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ নেবে না। আপনি কেন প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতার কথা জেনেও সেখানে পরিবর্তন আনলেন না? খুব শীঘ্রই আরো কিছু মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় আসবে। সেই রায়গুলো কি আপনার কথিত প্রসিকিউশনের দুর্বলতার বা ঝামেলার ফলে এমন ভাবেই সাজা কমার একটা দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে? তাহলে আইনমন্ত্রী হিসেবে আপনি জাতির সঙ্গে স্রেফ বেইমানী করছেন। আপনি শপথ নিয়ে আইনমন্ত্রী হয়েছেন। রাষ্ট্রের কোনো অসুবিধা হলে সেটি দেখার দায়িত্ব তাহলে কার? আপনি আইনমন্ত্রী হিসেবে তাহলে কি দায়িত্ব পালন করছেন?প্রসিকিউশন টিম মেরামতে আপনার সচেতনভাবে ইচ্ছাকৃত ঢিলেমির ফলে সৃষ্ট অক্ষমতায় সাইদীর মতো আসামি মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে গেল। এই দায়ভার তো আপনাকে নিতেই হবে মাননীয় মন্ত্রী। সরকার আপনাকে যে দায়িত্বটি দিয়েছে, সেই রাষ্ট্র ও জাতির সুবিধা-অসুবিধা দেখার কাজটি আপনি ঠিকমতো করলেই এই ক্ষতি জাতিকে বহন করতে হতো না। এখানে আপনার ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত হবার মত নরম গলায় কোনো মন্তব্য আমরা মানতে পারছি না। আপনার ব্যর্থতার দায় থেকেই সাঈদীর সাজা কমেছে এটাই এখন আপনার বক্তব্যের সূত্রেই সুস্পষ্ট। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। আপিল বিভাগের রায় সবাইকে মেনে নিতে হবে।’ বেশ ভালো কথা। কিন্তু প্রসিকিউশনের দুর্বলতার সুযোগ যিনি করে দিলেন, তার কি হবে? কেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী প্রসিকিউশনের দুর্বলতার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। এমন কি সামনে যে মামলাগুলো খুব শীঘ্রই আসবে, সেখানেও তিনি সেই দুর্বল প্রসিকিউশন রাখার পক্ষে? আমরা দেখতে চাই, মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীর আগামী মামলা গুলো আদালতে ওঠার আগেই মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রসিকিউশনের দুর্বলতাগুলো ঠিক করে প্রসিকিউশনকে আরো শক্তিশালী করার যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। যদি তিনি সেখানেও ঢিলেমি করেন বা করার চেষ্টা করেন বা এড়িয়ে গিয়ে দুর্বল প্রসিকিউশন দিয়ে মামলাগুলো পরিচালনার সুযোগ করে দেন, তাহলে বাঙালি জাতি আপনাকে ক্ষমা করবে না মাননীয় আইনমন্ত্রী।আপনার ব্যর্থতার দায় গোটা বাংলাদেশ নেবে না। আপনার ব্যর্থতার দায় বাঙালি জাতি নেবে না। আমরা আশা করব, অন্য মামলাগুলো আদালতে ওঠার আগেই আপনি আপনার ব্যর্থতা বুঝতে সক্ষম হবেন। এবং প্রসিকিউশনকে আরো শক্তিশালী করার যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। নইলে আইনমন্ত্রী হিসেবে আপনার নামের পাশে একটি কলঙ্ক যোগ হবে। আর সেই কলঙ্কের দায়ভার গোটা বাঙালি জাতি বহন করতে পারে না। মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী মামলার সকল প্রসিকিশন যাতে আরো শক্তিশালীভাবেই কাজ করতে পারে সেই উদ্যোগ আপনাকেই যথাযথভাবে নিতে হবে। নইলে আপনি আর আইনমন্ত্রীর পদ দখল করে বাংলাদেশের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারেন না। বাঙালি জাতি সেই সর্বনাশের দায় নিতেও পারে না মাননীয় আইনমন্ত্রী।
false
ij
হজরত শাহ জালাল_ আর সেই তিন কাঠুরিয়া-কন্যা। ১৯৯২ সাল। এক বন্ধুকে নিয়ে সিলেট গেছি; বেড়াতে। তো দিনের বেলায় শহরে লাক্কাতুরা, শহরের বাইরে জাফলং ইত্যাদি ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিনবেলা হজরত শাহ জালালের দরগায় যাই। সিঁড়ির ওপর বসে থাকি। মাজারময় কেমন একটা পুরনো গন্ধ। আগরবাতির গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে। পুরনো গন্ধ কত কথা যে বলে। একদিন সন্ধ্যায় দরগা থেকে বেড়িয়ে হাঁটছি। ভাদ্র মাস। ঝিরঝির বৃষ্টি। হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে হল না। রাতে খেয়ে একবারই ফিরব। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল আবার জাফলং যাব। ফুটপাত ঘেঁষেই একটা শপিং কমপ্লেক্স; কিছু করার নেই। ঢুকলাম ভিতরে, তখনও জমে ওঠেনি। কেমন ফাঁকা। একটা দোকানে ঢুকলাম। এটা সেটা দেখছি। লাইটার, পেনসিল ব্যাটারি। দোকানের মালিক তরুন। বেশ স্মার্ট। ফরসা। কালো রঙের টিশার্ট পরেছিল। বয়স এই পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। কথায় কথায় পরিচয় হল। নাম বলল ইমরান। সিলেটের স্থানীয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনে চেখেমুখে সমীহ ভাব ফুটল। বিনয়ের সঙ্গে বলল, পড়াশোনা তেমন শেষ হয়নি। কয়েক বছর লন্ডন ছিল। ফিরে এসে এই দোকান দিয়েছে। দোকানে একটা পিচ্ছি ছিল। ইমরান ওকে চা আনতে বলল। আমাদের বসতে বলল। কয়েকটা টুল ছিল। আমরা টুলের ওপর বসলাম। ইমরান জিজ্ঞেস করল, সিলেটে আসছেন, শাজালালোর মাজারে গেছেন না? হ্যাঁ। বললাম। আমি আগে মাজারে যাইতাম না। এখন রেগুলার যাই। ইমরান বলল। মানে? আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। ইমরান বলল, বিয়ের পর অনেকদিন ছেলেমেয়ে হয়নি। বউয়ের মুখ কালো। তখন মানত দরগায় করছিলাম। গত বছর আমার বউয়ের একটা ছেলে হয়েছে। বলে লাজুক হাসল। ও। ইমরান বলল, আমি এখন রেগুলার মাজারে যাই। আমার বউও যায়। কান্দে। হজরত শাজালাল সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করি। কত কিছু যে জানলাম। আমাদের হাতে কাজ নাই। বললাম, বলেন শুনি, কী জানলেন। ইমরান বলল, এই যেমন ধরেন-অনেকে মনে করে যে ওনার জন্ম ইয়েমেনে। কথাটা ঠিক না। আমিও তেমনই জানতাম। অবাক হয়ে বললাম, তা হলে? ওনার জন্ম ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে কোনিয়ায়। কোনিয়া হইল তুরস্কে। ও। হজরত শাজালালের পুরা নাম শেখ উল মাশায়েক মখদুম শেখ শাহ জালাল মোজোরোধ বিন মুহাম্মাদ। তার বাবা ছিলেন মওলানা জালালউদ্দীন রুমী সমসাময়িক। রুমীর মাজারও তুরস্কের কোনিয়ায়। পূর্ব পুরুষ আসছিল ইয়েমেন থেকে। এ জন্য শাহ জালালকে মোজোরোধ-ই- ইয়েমেনী বলা হয়। আমি এবার বেশ অবাক হলাম। ইমরান দেখছি অনেক কিছু জানে। আসলে বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্ছা হয়নি। বিপদে পড়েছিল। হয়তো বউ ... মানুষ তো অসহায়। তখন শাহ জালালের দরগায় মানত করে। তারপর বাচ্চা হয়েছে। কৃতজ্ঞতাসরুপ এখন দরবেশকে নিয়ে গবেষনা করছে। ভাল। আমাদের কত কথা জানা হল। পিচ্ছি চা নিয়ে এল। আমরা চায়ে চুমুক দিলাম। ইমরান বলল, শাজালাল তাঁর মামার কাছে মানুষ। মক্কায়। মামার নাম সৈয়দ আহমেদ কবির। কোরান হেফজ করলেন।ইসলাম নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করলেন। Legend has it that one day his uncle gave him a handful of earth and ask him to go to Hindustan with the instruction that whichever place in Hindustan matches this earth completely in smell and color, he should settle down for preaching and establishing Islam. আমি তখন সিগারেট খেতাম। চা শেষ করে ধরালাম। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। তার ক্ষীন শব্দ পেলাম। অল্প শীত করছিল। আতরের ক্ষীন গন্ধ পেলাম যেন। শাহ জালালের দরগার সিঁড়ির ওপর বসে থাকার সময় যেমন পুরনো গন্ধ পাই-অনেকটা সে রকম। দরগায় আগরবাতির গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে। পুরনো গন্ধেরা কত কথা যে বলে। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ। ইমরান বলল। শাহ জালাল রওনা হলেন পুবে। পুবে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষে তখন সম্মানিত পির (পির বানান ঠিকই আছে। বিদেশি শব্দ -িকার) ছিলেন আজমিরের খাজা বাবা, দিল্লীর নিজামউদ্দীন আউলিয়া প্রমূখ। শাজালাল বাবা সব বুগর্জ পিরের সঙ্গে দেখা করলেন। ওইখান থেকেই ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়া সিলেটে আসলেন। মামা সৈয়দ আহমেদ কবিরের দেওয়া মাটির সঙ্গে মিল হইল সিলেটের মাটির। কাজেই এই মাটিতেই আস্তানা হইল বাবা শাজালালের। ইমরানের কথায় গর্বের সুর ফুটল। এরপর ইমরান যা বলল তাতে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে গেলাম। সেই বিস্ময়ের ঘোর এতদিন পরেও কাটেনি। সেই ঝিরঝির বৃষ্টির সন্ধ্যায় ইমরাম যা বলল- তা আমি এখানে গুছিয়ে লিখছি। একদিন। শাহ জালাল তাঁর আস্তানায় বসে আছেন। এমন সময় একজন লোক তাঁর কাছে এল। কে তুমি? শাজালাল জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা বলল,আমি একজন গরীর কাঠুরিয়া। তো? লোকটা এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুজুর। আমার ঘরে তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যা রয়েছে। আমি গরীর মানুষ-ওদের বিবাহ দিতে পারছি না। আপনি যদি দয়া করে আপনার তিনজন্য শিষ্যর সে তুমি কাঠুরিয়া। না? জ্বী।হুজুর। ঠিক আছে। তুমি কাল ফজর নামাজের পরে এসো। দেখা যাক কি করতে পারি? পরের দিন; ভোরবেলা। গরীব কাঠুরিয়া আস্তানায় এল। এসে তো সে অবাক। কারণ। হজরত শাজালালসহ তিনশো ষাটজন আউলিয়ার পরনে কাঠুরিয়ার পোষাক। হাতে কুঠার। কাঁধে থলে। কী ব্যাপার? হযরত শাজালাল বললেন, আমরা আজ কাঠ কাঠতে যাব। কাঠুরিয়া স্তম্ভিত। সে আর কি বলবে। সে দলটাকে অনুসরন করে। এখনকার সিলেটের লাক্কাতুরা তখন গহীন অরণ্য। কাঠ কাটতে দরবেশরা সবাই সেই বনেই গেল। সারা দিন কাঠ কাটা হল। দুপুরে আহার করলেন, গরীর কাঠরিয়ারা যা করে তাই। সন্ধ্যের আগে আগেই দরবেশরা কাঠ কাঁধে নিয়ে ফিরে এলেন আস্তানায়। হজরত শাহ জালাল বললেন, আজ আমরা কি করলাম? কাঠ কাঠলাম। আউলিয়ারা সমস্বরে বললেন। তা হলে আমরা কাঠুরিয়া? (অন্তত একদিনের জন্য হলেও) হ্যাঁ। তা হলে এবার বল এই গরীব কাঠুরিয়ার তিন মেয়ে কে কারা কারা বিবাহ করবে? হাত অনেকেই তুলেছিল। শাহ জালাল তিনজনকে বেছে নিলেন। বলে ইমরান আমাদের দিকে তাকাল। তার মুখে মিটমিট হাসি। বলল, কি বুঝলেন? কী আর বুঝব। আমি আমার বন্ধু রুকসারের দিকে তাকালাম। ও কেমন ঘোরে আছে বলে মনে হল। আমারও কেমন ঘোর লাগল। হজরত শাহ জালাল জাঁদরেল পির। গরীব কাঠুরিয়ার তিন মেয়েকে বিয়ের করার জন্য শিষ্যদের তিনি আদেশ করলেই পারতেন। কিন্তু, তিনি নিজে কাঠ কাঠতে গেলেন কেন? সারদিন লাক্কাতুরার জঙ্গলে অত কষ্ট করলেন কেন? রোদে পুড়লেন। ঘাম ঝরালেন। কেন? গরীর কাঠুরিয়ার তিনটে মেয়ের কথাও আমার মনে পড়ল। আজও আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে হওয়া- না হওয়াটা বিশাল এক প্রশ্ন। বিয়ে প্রতিদিনই হচ্ছে; তবে তার পিছনের ইতিহাস অত সরল না। সেই সাত/আটশ বছর আগে তিনটি মেয়ে। তার ওপর বাবা গরীব কাঠুরিয়া...পিরের বদান্যতায় আউলিয়া বর পেয়েছিল তারা। তারা কি সুখি হয়েছিল? যখনই সিলেট যাই- তিনবেলা হজরত শাহ জালাল দরগায় সিঁড়ির ওপর বসে থাকি। মাজারজুড়ে কেমন একটা পুরনো গন্ধ। আগরবাতির তীব্র গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে। পুরনো গন্ধরা কত কথা যে বলে। ইমরানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। ন'টার মতো বাজে। শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে রাস্তায় অন্ধকার। অন্ধকার আর ঝিরঝির বৃষ্টি। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম: হজরত শাহ জালাল নিশ্চয়ই সেই তিনটে গরীব মেয়ের অসহায় অবস্থার কথা উপলব্দি করেছিলেন। বিয়ে হচ্ছিল না ...সহসা অনেক দিন আগে পড়া ইসলামের নবীর একটি হাদিস মনে পড়ল।The Prophet said, “(It happens that) I start the prayer intending to prolong it, but on hearing the cries of a child, I shorten the prayer because I know that the cries of the child will incite its mother’s passions.” আল-বুখারি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি। শীত করছিল। আমার মুখ চোখে বৃস্টির বিন্দু। চশমার কাচে জলবিন্দু। ঝাপসা দেখছি। একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবলাম: নারীর নিভৃত কান্না মহাপুরুষরা কখনও এড়িয়ে যাননি। যাওয়ার কথাও নয়। আমি আজও ভাবি: হজরত শাহজালাল নিজে কাঠ কাটতে গেলেন কেন? সারদিন অত কষ্ট করলেন কেন? সূত্র: Click This Link সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৩৬
false
rg
আমার বুকে চিনচিন ব্যথা করছে ।। রেজা ঘটক আজ সকাল থেকে আমার বুকে চিনচিন ব্যথা করছে। ব্যথাটা মোটেও কমছে না। কমার কোন লক্ষণও বুঝতে পারছি না। এটা কি হার্টের কোন সমস্যা? নাকি অন্য কোন ভয় থেকে? ভয় হলে, কীসের ভয়ে? ভয়ে কী বুকে ব্যথা করে? বুক চিনচিন করে? হার্ট এ্যাটাক করে? আমি জানি না। ডাক্তাররা বলতে পারবেন। মেডিকেল সাইন্স বলতে পারবে। আমার বুক ব্যথা করছে। এটা শুধু আমি বলতে পারি। আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। এটা শুধু আমি বলতে পারি। আমার শরীরটা ভালো নেই। এটা শুধু আমি বলতে পারি। আমার মন ভালো নেই। এটা শুধু আমি বলতে পারি। আমার কি হবে এটা আমি বলতে পারি না। আমার কিভাবে চিকিৎসা হবে, এটা আমি বলতে পারি না। আমার কোথায় কীভাবে চিকিৎসা হবে, এটাও আমি বলতে পারি না। আমি আসলে অনেক কিছুই বলতে পারি না। কি কি আমি বলতে পারি না, তাও আমি আসলে এই মুহূর্তে বলতে পারি না। কেন বলতে পারি নি, সেই ব্যাখ্যাও আমি বলতে পারি না। আমি আসলে অনেক কিছুই বলতে পারি না। কারণ, আমার বলার মতো অনেক কিছু থাকলেও কিছুই বলতে পারি না। আমি কেন বলতে পারি না? কারণ, আমি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমি কোন উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তার নিকট আত্মীয় নই। আমি কোন বড় এনজিও কর্মকর্তার সুহৃদ নই। আমি কোন প্রফেসরের পকেটের বিড়াল নই। আমি কোন ঝানু পলিটিশিয়ানের উপদেষ্টা নই। আমি কোন জাদরেল বিচারপতির ভাগ্নে নই। আমি কোন মিডিয়ার সম্পাদকের কাছের মানুষ নই। আমি কোন গুপ্ত ঘাতক দলের আন্ডারগ্রাউন্ড লিডার নই। আমি কোন বিদেশী সাহায্য সংস্থার লোকাল প্রতিনিধি নই। আমি কোন বিদেশী ইনটেলিজেন্স এজেন্সির রিপ্রেজেন্টেটিভ নই। তাই আসলে কিছু বলার থাকলেও আমি কিছুই বলতে পারি না। কারণ, আমি খুব ভালো করে জানি, আমি আসলেও একজন একা মানুষ। একা মানুষ অনেক কিছুই বলতে পারে না। অনেক কিছুই বলার মতো শক্তি ও সামর্থ আমার নেই। কারণ, আমি জানি, আমি কবরের নিস্তব্ধতার মতো নিঃসঙ্গ একাকী একজন মানুষ। আমার বুক ব্যথা করলেও বলা যাবে না। আমার শ্বাসকষ্ট হলেও বলা যাবে না। আমার পেটে ক্ষুধার সর্বোচ্চ দখলদারিত্ব কায়েম হলেও আমার কিছু বলার নিয়ম নেই। কারণ, আমি একা ও বিরল প্রজাতির এক খামখেয়ালির মানুষ। আমার অনেক কিছুতেই বলতে মানা। তাই আমি বলতে পারি না। আজ সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল এক বন্ধু সুহৃদের মুঠোফোনের কলে। প্রশ্ন ছিল, আমি কিছু জানি কিনা? জানতে চাইলাম কী? জবাবে অন্যপ্রান্ত থেকে বলা হল- কেন, কিছুই শোনেন-নি? - না। - টেলিভিশণ লাইভ দেখাচ্ছে। - কী লাইভ দেখাচ্ছে? - পিলখানার ঘটনা। - কেনো, পিলখানায় আবার কী হলো? - আর্মি আর বিডিআর-এর মধ্যে কিছু একটা হয়েছে হয়তো! - টিভি'অলারা কী বলছে? - বুঝতে পারছি না কিছুই। - আচ্ছা, দেখি খোঁজ নিয়ে। - ঠিক আছে। ভালো থাইকেন। সাবধানে থাইকেন। - তুমিও সাবধানে থাইকো। এরপর থেকে আমার বুকের ব্যথা আরো বাড়তে লাগল। আমি দু-একটা বন্ধুরে ফোন করি। তারাও সমান উদ্বিগ্ন। কারণ, ঢাকা এখন থমথমে। কেউ জানে না কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আর এর পরবর্তী পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ। আমরা কোথায় যাচ্ছি। কাদের ইসারায় আমরা কি করছি? কেনইবা করছি! বিবিসিতে শুনলাম, একজন বিডিআর জোয়ান তাদের দাবীদাওয়া ও ক্ষোভের কথা বললেন। পৃথিবীর সকল সংবাদ মাধ্যমের আজ প্রধান নিউজ বিডিআর হেড-কোয়ার্টার। অনেক গুজবও শোনা যাচ্ছে। আনেক সত্যি ঘটনা আবার কোনদিনই আর শোনা যাবে না। আজ রাতে ঢাকায় কী হতে যাচ্ছে, আমরা জানি না। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ভয়াল সেই রাতের পর জলে গেছে দীর্ঘ ৩৮টি বছর। আজও কাকতালীয়ভাবে ২৫ তারিখ। আগেরটা ছিল ২৫শে মার্চ। আর আজকেরটা ২৫শে ফেব্রুয়ারি। জ্যোর্তিরবিদদের গননায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ যদি সংখ্যা বিচারে হয় ১, আজকের রাত মানে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি হবে ২। এই ১ আর ২ এর মাঝখানে মাত্র ৩৮ বছর গেছে। বাংলাদেশের বয়সও ৩৮। সংখ্যাতত্ত্বে ৩৮ মানেও কিন্তু ২। আমার বুকে ব্যথা করছে। কারণ, আমার বয়সও ৩৮ ক্রস করেছে। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কারণ, আজকের হিসাবে আমার রাশির সংখ্যাও ওই ২। সারাদিন যা যা দেখলাম, যা যা শুনলাম, আজকের রাতের পরে আর কী কী হতে পারে, সেই আশংকায় আমার বুকের ব্যথা আরো বাড়ছে। আমি খুব অসহায় ফিল করছি। আমি সত্যিই অসহায় আছি। সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১০:৩১
false
mk
সংঘাত বিপদ ডেকে আনবে___ রাজনৈতিক বিরোধের কারণে গত দুই দিনের প্রাণহানির ঘটনা অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানে সহায়তা করবে। এমন রক্তপাতের রাজনীতি কোনো দলের জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না। বরং সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও চলতে থাকলে বিবদমান দলগুলোর জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসবে। এ মত দেশের বিশিষ্টজনদের। তাঁরা মনে করেন, সংঘর্ষের পথ ছেড়ে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে দুই দলের আলোচনায় বসা উচিত। হরতাল কর্মসূচি আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি করবে বলেও মত প্রকাশ করেন তাঁরা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধী দলের এ প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত ছিল। এতে সংকট সমাধানে সরকার কতটা আন্তরিক সে পরীক্ষাও হয়ে যেত। কিন্তু বিরোধী দল হরতাল-আলটিমেটামের যে পথ নিয়েছে, তাতে সমাধান আসবে না। এতে বরং সংঘাত বাড়বে।' তিনি বলেন, 'সংঘাতের কারণে দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে সামরিক সরকার আসার আশঙ্কা বাড়ছে। এটি দুশ্চিন্তার বিষয়। জনগণ ও রাজনীতিবিদদের নিজেদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে মীমাংসায় আসা উচিত। সংঘাতের ভয়াবহ ফল দুই দলের রাজনীতিবিদদেরই সবার আগে ভোগ করতে হবে।'এবারের রাজনৈতিক সংঘাতে অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি হতাহতের আশঙ্কা প্রকাশ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'এর আগে সংঘাতের মাত্রা বেশি থাকত রাজধানী ঢাকায়। প্রাণহানির বেশির ভাগই ঘটত ঢাকায়। কিন্তু এবার বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সংকটের সমাধান না হলে বহু প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সংঘাতের রাজনীতির এ ট্রেন চলতে থাকলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এটি নিয়ে দুই দলের নেতারা ভাবছেন না। কারণ রাজনৈতিক সংঘর্ষে উচ্চ পর্যায়ের নেতারা প্রাণ হারান না। দলের নিম্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মৃত্যু নিয়ে নীতিনির্ধারকরা খুব একটা ভাবছেন না।' তিনি বলেন, 'প্রাণহানির যে রাজনীতি চলছে, তা রাজনীতিকদের জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনবে না। এমন সংঘাত ও প্রাণহানি চলতে থাকলে এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এবার আরো বেশি রক্তক্ষয় ও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের মেয়াদের শেষ ৯০ দিন শুরু হয়ে গেছে। আর সময় নেই। এখনই দুই দলকে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।'লেখক-বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা আগেই ফয়সালা হলে এখন যে রক্ত ঝরছে, হানাহানি হচ্ছে, তা হতো না। দুই পক্ষের কারো হাতেই এখন আর সময় নেই বলে এ সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন যত দ্রুত মীমাংসা করা যায় জনগণ ও নেতাদের জন্য ততই মঙ্গল। আশা করি, দলগুলো একটি সমাধানের দিকেই যাবে।'সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাজনীতিতে সংঘাত শুরু হওয়ার ফলে অহেতুক প্রাণহানি ঘটছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ককটেল হামলা হচ্ছে। জনগণের জানমাল নিরাপদ নয়। দেশে একটি চরম অরাজকতাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই দায়ী।' তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বানে বিরোধী দলের সাড়া দেওয়া উচিত ছিল। অবিশ্বাসের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফলে হয়তো বিরোধী দল সাড়া দেয়নি। কিন্তু অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা উচিত। না হলে জনগণ ও রাজনীতিক- উভয়ের জন্যই কঠিন সময় আসবে।'সংঘাতের রাজনীতি দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটাবে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতার উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেওয়া। হরতালের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত ছিল। কারণ সংলাপের আহ্বানের পর হরতালের সিদ্ধান্ত আলোচনার পরিবেশকে নষ্ট করবে। আলোচনার পথকে সংকীর্ণ করে এমন কর্মসূচি থেকে সরে আসা উচিত।' তিনি আরো বলেন, 'সংঘাতের ফলে যে প্রাণহানি ঘটছে, তার দায় বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। এমন সংঘাতের ফলে দেশে গণতন্ত্রের পরিপন্থী শক্তি বিকশিত হবে।'
false
hm
আটক তিন ব্লগারের মুক্তি চাই না মাননীয় সরকার বাহাদুর, সারাদেশ জুড়ে কয়েক মাস ধরে চলমান নাশকতার পরিকল্পনাকারী জামাত-শিবিরের ফেসবুক প্রোপাগাণ্ডা পেজ "বাঁশের কেল্লা" ও "ইসলামী ছাত্রী সংস্থা" বহাল তবিয়তে আছে। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা পুলিশ ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী কমিশন তাদের কিছুই করেনি, করতে পারেওনি। পরিষ্কার ভাষায় রেললাইন উপড়ে ফেলার বা পুলিশ হত্যার আহ্বান জানানো এই পেজগুলোর সফলতা আজকের খবরের কাগজের অনলাইন সংস্করণে দেখতে পাবেন। রেল বিচ্যুত হয়ে হতাহত যাত্রী নিয়ে ধানক্ষেতে পড়ে আছে তূর্ণা নিশীথা, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় আছেন রাজশাহীতে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার। এই পেজ যারা চালায়, আপনারা তাদের গুপ্তকেশটাও ছিঁড়তে পারেন নাই। আপনারা ধরেছেন তিনজন ব্লগারকে। তাদের অপরাধ, তারা একটি ধর্ম সম্পর্কে নিজেদের মত প্রকাশ করেছে। তাদের এই মত প্রকাশের জন্য কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হয়নি, কোনো মানুষও আহত বা নিহত হননি। তারা কোনো ধরনের নাশকতার ডাকও দেননি। আপনারা যদি এতই ধর্মবিশ্বাসী হবেন, তাহলে ধর্মের ঈশ্বরের হাতে পরকালে এদের বিচারের ভার কেন ন্যস্ত করেন না? জামাতশিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সারা দেশে যখন শান্তিপূর্ণ অনশন পালিত হয়, আপনারা সাড়া দেন না, আর যখন অশান্তির হুমকি আসে হেফাজতে ইসলামের পাণ্ডাদের কাছ থেকে, তখন আপনারা নিরীহ তিনজন লোককে তুলে নিয়ে পিটিয়ে তাদের ছবি ছাপিয়ে দেন মোল্লাদের আশ্বস্ত করার জন্য। ভোটের জন্য? মোল্লাদের ভোট আপনারা পাবেন না। তাদের জুতা জিহ্বা দিয়ে চেটে সাফ করলেও পাবেন না। বরং যারা জামাতশিবিরের রাজনীতির মোকাবেলা করার জন্য আপনাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, তাদের ভোট হারানো শুরু করবেন। তিনটা ভোট এর মধ্যেই হারিয়েছেন, হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে তিন মিলিয়ন ভোটের সংকল্পের গন্তব্য পাল্টে যাবে। যে তিনজন ব্লগারকে আটক করেছেন, তাদের মুক্তি চাই না। তাদের আপনারা আটকে রাখুন। কারণ আপনারা তাদের নামধামছবি সব প্রকাশ করে দিয়েছেন। মুক্ত বাংলাদেশে এখন তাদের পিছু নেবে আততায়ীরা, যারা আপনাদের কল্যাণেই এদের চিনে নিয়েছে এবং যাদের দমন করার ব্যাপারে আপনাদের কোনো সদিচ্ছা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এই তিন ব্লগারকে আটকে রাখুন। যে দেশে ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থার শাস্তি ঘাতকেরা বাড়ি এসে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, সে দেশে পুলিশের হাত থেকে "মুক্তি"র কোনো অর্থ নাই। এদের আটকে রাখুন, বাঁচিয়ে রাখুন। আর মোল্লাদের স্যান্ডেল আইসক্রিম জ্ঞান করে লেহন করে যান। সংযোজন ১: তিন ব্লগারকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত [সূত্র]। রোহিঙ্গা জঙ্গি সালাউলের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি [সূত্র], ঠিক যেমন রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি জামাতশিবিরের সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগে আটক ইসলামী ব্যাঙ্কের মিরপুর শাখা ব্যববস্থাপক শহীদুল হকের [সূত্র]। সংযোজন ২: সালাউলের রিমান্ড আবেদন অবশেষে মঞ্জুর করেছেন কক্সবাজার আদালত [সূত্র]।
false
rn
রাস্তায় পাওয়া ডায়েরী থেকে- ৩০ ১/ খ্যাতনামা আইরিশ সাহিত্যিক, সমালোচক ও নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শর মুখের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর দাড়ি। একবার একটি ইলেকট্রিক রেজর নির্মাতা কোম্পানির কর্তারা বাজারে আসা তাঁদের নতুন রেজরের প্রচারণায় শর এই দাড়িকে নিশানা করল। শকে তারা এই নতুন রেজর দিয়ে দাড়ি কামানোর অনুরোধ করল। বিনিময়ে দেওয়া হবে লোভনীয় অঙ্কের টাকা। শ তাদের হতাশ করে বললেন, তাঁর বাবা যে কারণে দাড়ি কামানো বাদ দিয়েছিলেন, তিনিও ঠিক একই কারণে এ জঞ্জাল ধরে রেখেছেন। কোম্পানির কর্তারা কারণটি জানতে আগ্রহী হলে বার্নার্ড শ বললেন, “আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। একদিন বাবা দাড়ি কামাচ্ছেন, আমি তাঁকে বললাম, ‘বাবা, তুমি দাড়ি কামাচ্ছ কেন!’ তিনি এক মিনিট আমার দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আরে তাই তো, আমি এ ফালতু কাজ করছি কেন?’ এই বলে তিনি সেই যে জানালা দিয়ে রেজর ছুড়ে ফেললেন, জীবনে আর কখনো তা ধরেননি।” ২/ বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ইংরেজ শাসনামলের প্রথম বাঙ্গালী মেজিস্ট্রেট। মেজিস্ট্রেসিতে যোগ দিতে গিয়ে তাকে পরীক্ষা(ইন্টারভিউ) দিতে হয়েছিল,পরীক্ষক ছিলেন একজন ইংরেজ। পরীক্ষক বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রশ্ন করেছিলেন "হোয়াট ইজ দ্যা ডিফারেন্স বিটউইন আফদ(আপদ) এন্ড বিফদ(বিপদ)?"বঙ্কিমচন্দ্র উত্তর দিলেন :ধরুন, নৌকায় চড়ে নদী পার হচ্ছি এমন সময় প্রচন্ড ঝড় উঠল, এটা হচ্ছে বিপদ। আর এই যে আমি একজন বাঙ্গালী হয়েও ইংরেজের কাছে বাংলার পরীক্ষা দিচ্ছি এটা হচ্ছে আপদ। ৩/ আইনস্টাইন এর মেয়ের বিয়ে। সবাই চার্চে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে উনি উনার মেয়েকে বললেন তুমি চার্চের দিকে যাও আমি ল্যাবে আমার কলমটা রেখে আসতাছি। মেয়ে অনেক বারন করা সত্বেও উনি গেলেন, ৩০ মিনিটের কথা বলে উনি যখন না এলেন তখন সবাই মিলে উনার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। ৭ দিন পর উনার মেয়ে যখন বাসায় এসে মাকে জিজ্ঞাস করলো বাবা কোথায় তখন তার মা বলল ওই যে গেল আর আসে নাই। তখন উনি আইনস্টাইন এর খোজে ল্যাবে গেল। ল্যাবে গিয়ে দেখল যে তার বাবা একটা কলম নিয়ে বোর্ড এর সামনে গিয়ে কি জানি চিন্তা করছিল। মেয়ে বাবা কে বলল বাবা কি কর। তখন উনি বলল যে মা তুমি চার্চে যাও আমি এই কাজ টা ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ করে আসছি। ৪/ আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের পরিত্যক্ত সদর দফতরে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ফান ম্যাগাজিন ‘ম্যাড’ এর ২৭টি সংখ্যা। ধৃত আল কায়েদার অন্য সদস্যরা বলেছিল বিন লাদেন বইপত্র পড়তেন খুব এবং ‘ম্যাড’ ছিল তার সবচেয়ে পছন্দের ম্যাগাজিন। ৫/ বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় একবার ভীষণ বেগ পাওয়ায় রাস্তার ধারেই প্রস্রাব করতে বসতে বাধ্য হলেন । পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে গেল । দারোগাবাবু ধমকে জিজ্ঞেস করলেন ' রাস্তা নোংরা করলেন কেন ?' বিভূতিভুষণের জবাব ' নইলে জামাকাপড় নোংরা হত যে !' এই জবাবে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না দারোগাবাবু । শুরু করলেন জেরা । বিভূতিভুষণের নাম ধাম জেলা দু'চার কথাতেই দারোগাবাবু ধরে ফেললেন ধৃত ব্যক্তিই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভুষণ । সাহিত্যপ্রেমী দারোগাবাবু সসম্ভ্রমে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে নমষ্কার করে উৎফুল্ল স্বরে বললেন ' কি পরম সৌভাগ্য আমাদের যে "পথের পাঁচালি"র স্রষ্টাকে এই থানায় আমরা পেলাম ! অনেক কিছু জানার আছে আপনার কাছে । কিন্তু তার আগে , আমাদের এখানে একটা সুন্দর বাথরুম আছে আপনি চাইলেই সেটা ব্যবহার করতে পারেন ।' 'না ভাই' বিভূতিভুষণ বললেন ,' এক্ষুণি জলবিয়োগ হল , এখন শুধু জলযোগই হতে পারে ।' উত্তর শুনে পুলকিত দারোগাবাবু মিষ্টি আনতে পাঠালেন !
false
fe
যেভাবে জেগে ওঠে মুষ্টিবদ্ধ হাত যেভাবে জেগে ওঠে মুষ্টিবদ্ধ হাতফকির ইলিয়াস=====================================আমি ১৯৭১ দেখেছি। দেখেছি, কীভাবে জেগে ওঠে মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত। দেখেছি, কীভাবে বাঁশের লাঠি দিয়ে পাক হানাদারদের তাড়াবার জন্য মানুষ ছুটে এসেছিলেন গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে। তারা ভাবেননি, গুলির নিচে তাদের প্রাণ যাবে। তারা ভাবেননি, লাঠি দিয়ে স্টেনগান মোকাবেলা সম্ভব নয়। তারা ছুটে এসেছিলেন। প্রাণে তাদের যে সাহস ছিল এটাই ছিল অন্যতম শক্তি।আমরা এই জাগরণ এর পরও বারবার দেখেছি। ১৯৫২, ’৬৯, ’৭০, ’৭১ পেরিয়ে বাংলাদেশে মানুষ জেগে উঠেছে স্বাধীনতার পরও। ১৯৭৫ সালে যখন জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে- এর পরও মানুষ দ্রোহী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সামরিক জান্তারা পাকিস্তানি কায়দায় মানুষকে ঘর থেকে বেরোতে দেয়নি। এর পরও মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। যারা মুজিব হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন- তাদের কেউ কেউ এখনো বাংলাদেশে বেঁচে আছেন।১৯৯০-এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই দেশ থেকে স্বৈরাচারী সামরিক শক্তিকে বিতাড়িত করেন গণমানুষ। এ দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেও তাদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। শাহবাগের আন্দোলন স্মরণকালের একটি বড় সফলতা। এর রেশ ধরেই প্রজন্ম পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছু। আমি বলতে দ্বিধা করব না- এই আন্দোলন দেখেই বাংলাদেশে খুব ভীত হয়ে পড়েছে একটি মহল। তাই এরা প্রজন্মের কিছু সদস্যকে বেছে নিয়েছে তাদের হাতিয়ার হিসেবে। সাম্প্রতিককালে দেশে আধুনিক লেবাসধারী যে কয়েক জঙ্গি-জিহাদি আবির্ভূত হয়েছে, এরা সেই পরাজিত শক্তিরই মদদপুষ্ট। শাহবাগের পথ ধরেই আবার জেগে উঠছে বাংলাদেশ। এবার জেগে উঠছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। হাতে হাত রেখে দৃপ্ত কণ্ঠে জঙ্গিবাদকে ‘না’ বলেছে তরুণরা। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার এক মাস পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। সংস্থাটির অধীন ৩৭টি পাবলিক ও ৮৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসবের মধ্যে আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী-শিক্ষক রয়েছেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-শিক্ষক আছেন। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২০৫টি ফাজিল-কামিল মাদ্রাসার লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীও মানববন্ধনে অংশ নেয়। এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও মানববন্ধনে যোগ দেয়। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেয়। এত মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে জঙ্গিবাদের প্রতি অনাস্থা, ঘৃণা এবং নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জঙ্গিদের জানিয়ে দিয়েছি, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই সবুজভূমি কখনোই উগ্রবাদের চারণভূমি হবে না।’এই উচ্চারণটিই আজ আপামর বাঙালি জাতির। এই দেশ জঙ্গিদের বর্বরতার ভূমি হতে পারে না। বড় অবাক করা বিষয় হলো- এই যে তরুণ, এরা কারা? কে তাদের মগজ ধোলাই করছে? কেন করছে? কিভাবে করছে? তারা মানুষ খুন করে ইসলামি হুকুমত কায়েম করতে চায়। এই অবস্থা বাংলাদশে খুব নতুন নয়। এই দেশে মৌলবাদী জঙ্গিদের মদদ দেয়া হয়েছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। শায়খ রহমান-বাংলা ভাই কার তৈরি- তা দেশবাসীর অজানা নয়। আজো এরই ধারাবাহিকতা চলছে। এই যে ঘর ছেড়ে এরা মানুষ হত্যা প্রকল্পে নেমেছে- তাদের ভবিষ্যৎ কি? কেন তারা এমন সুস্থ-সুন্দর জীবন বাদ দিয়ে আত্মঘাতী পথ বেছে নিচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে। একই কথাটি মনে রাখা দরকার-চোরাগুপ্তা মানুষ খুন করে রেনেসাঁ কায়েম বর্তমান বিশ্বে সম্ভব নয়। মানুষ এখন অনেক এগিয়েছে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। তারপরও বোকার মতো এরা এমন পথ বেছে নিচ্ছে কেন? খুবই যৌক্তিক কথা বলেছেন দেশের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর রাখুন। সন্তানদের প্রতি নজর রাখুন। নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কোনো ছেলেমেয়ে যেন বিপর্যস্ত না হয় কিংবা বিপথগামী না হয় এ বিষয়ে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাইকে নজর রাখতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সিলেবাসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস পড়াতে হবে। যদি কেউ সেটা না করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। হ্যাঁ, এই প্রজন্ম সত্য ইতিহাস থেকে সরে গেছে। আমরা দেখেছি, কারা এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ভ্রান্ত ইতিহাস পড়িয়েছে। কারা পাল্টে দিতে চেয়েছে আমাদের অনেক গৌরবগাথা। মানববন্ধন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, যারা সরাসরি এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যারা ঘটিয়েছে, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, যারা অর্থায়ন করে, তারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। এই অমানুষদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে, পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে। এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে এদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য, এদের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব কিছু নয়। শুধু প্রয়োজন আমাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। দেশজুড়ে এখন জঙ্গিদের পরিচয় নিয়ে ব্যস্ততা দেখা দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, রাজধানীর কল্যাণপুরে পুলিশের ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ অভিযানে নিহত এক জঙ্গি পূর্ব পাকিস্তানের বহুল আলোচিত গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নাতি। তার নাম আকিফুজ্জামান খান। তার বাবা সাইফুজ্জামান খান। আর দাদা আবদুল মোনায়েম খান। তাহলে কি বংশ পরম্পরায় একটি শ্রেণি এখনো বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না? এখনো তারা এই দেশটিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে নানা ভাবে?এরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত ‘জিহাদি’দের পরিবারকে অর্থ সাহায্যও দিয়ে যাচ্ছে। এসব টাকা আসছে কোথা থেকে? বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বিশেষ করে বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান ও দি টাইমস এ নিয়ে বেশকিছু রিপোর্ট করে। ২০০২ সালের ১৫ অক্টোবর দি টাইমস ম্যাগাজিনে এলেক্স পেরির এক এক্সক্লুসিভ নিবন্ধে বলা হয়, এমভি মক্কা নামক একটি জাহাজে চড়ে ১৫০ জন আফগান ফেরত সশস্ত্র যোদ্ধা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেই যোদ্ধারাই দেশের মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি তৈরিতে লিপ্ত হয়। এ জঙ্গিদের সহযোগিতায়ই তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার, বেছে বেছে আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল নেতাদের খুন করার মিশনে নেমে পড়ে। এ খুনের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শেখ হাসিনা সরকারের সফল অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া, বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, মমতাজ উদ্দিন, খুলনার মনজুরুল হক এডভোকেট, সাংবাদিক শামসুর রহমান প্রমুখ। তারপর থেকে সিনেমা হল, মাজার, উপাসনালয়ে বোমা হামলা করে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় এক জঘন্য কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী-সমর্থককে হত্যা করে এবং এ হামলায় প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী পঙ্গুত্ববরণ করে।২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলার সাড়ে ৪শ স্থানে পাঁচ শতাধিক বোমার বিম্ফোরণ ঘটায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। একযোগে কেঁপে ওঠে সারা দেশ। নিজেদের শক্তি জানান দিতে ওই বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। এতে দু’জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। সেই সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমেই জঙ্গি কার্যক্রমের প্রকাশ ঘটায় সংগঠনটি। বাংলাদেশের মানুষ এসব ঘটনা ভুলে যাননি। আগস্টকে এরা বেছে নিয়েছে খুনের মাস হিসেবে। ১৫, ১৭, ২১ আগস্টের এই দিনগুলো আঁধার হয়েই থাকছে দেশের ইতিহাসে। এই আঁধারের নির্মাতা কারা? তা ক্রমশ প্রকাশ হয়ে পড়ছে। যারা ডানপন্থীদের রক্ষাকবচ, তারাই এখন বলছেন, মৌলবাদ ঝেড়ে ফেলতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামীর ‘ওইভাবে’ আর প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অন্যতম পরামর্শক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ২০ দলীয় জোটের জন্য জামায়াতকে একটি ‘দায়’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকার ও জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ‘চিন্তাভাবনা’ করতে পারে। প্রফেসর এমাজউদ্দীন বলেছেন, ‘দেশের যে অবস্থা, তাতে জাতীয় ঐক্য করতে একটি রাজনৈতিক দলই বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়। … জনগণের যে বিরোধী দল সেই দলের নেত্রী খালেদা জিয়া তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২০ দলের মধ্যে এই দলটিকে আর ওইভাবে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।’ এই কথাটির বিশ্লেষণ অন্যভাবেও করা যায়। বিএনপি কি চাইছে আপাতত জামায়াতকে বাদ দিয়ে সরকারের সঙ্গে দফারফা শেষে কিংবা ক্ষমতায় গিয়ে আবার জামায়াতের সঙ্গেই গাঁটছাড়া বাঁধতে? না হলে হঠাৎ করে ডানপন্থী বুদ্ধিজীবী এমাজউদ্দীন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা বুলি পাল্টাচ্ছেন কেন? নেপথ্যে কি অন্য কোনো মতলব কাজ করছে?চমক দেয়ার মতো আরেকটি সংবাদ। বিভিন্ন সময়ে হামলা করতে গিয়ে কিংবা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গিদের কেউ নিহত হলে তার স্ত্রীকে কে বিয়ে করবে, সেটাও আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। গোয়েন্দাদের মতে, নিষিদ্ধ সংগঠনের এসব সদস্য কৌশলে নারীদের ঘরছাড়া করে। তাদের ভাষায় একে বলে ‘হিজরত’। এই কথিত হিজরত করা নারীদের জঙ্গি নেটওয়ার্কের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের অনেক খবর রাখে। আর এ কারণেই স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের নিজেদের জঙ্গি নেটওয়ার্কের বাইরে যেতে দেয়া হয় না। এটি নিশ্চিত করতেই কোনো নারী জঙ্গির স্বামী পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কিংবা নিহত হলে তার দায়িত্ব কে নেবে সেটা আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। একইভাবে ওই নারীর দ্বিতীয় স্বামী মারা গেলে আবার তৃতীয় জনের কাছে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও ওই জঙ্গি নারীর দ্বিতীয় স্বামী বিয়ের পরপরই নির্ধারণ করে রাখে মৃত্যুর পর কার সঙ্গে তার স্ত্রীর বিয়ে হবে।কী ভয়াবহ চিত্র! না- আমরা এখনো মধ্যযুগ পেরিয়ে আসতে পারিনি! এসবের বিরুদ্ধে আজ প্রজন্ম জেগে উঠছে। এটা খুবই আশার কথা। নিজ নিজ প্লাটফর্ম থেকে এই মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করতে হবে। শক্তি আমাদের একটিই। ১৯৭১। ঠিক যেভাবে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেভাবেই হাতে হাত রেখে এগোতে হবে। সঠিক ইতিহাস চর্চাই বলে দেবে, এই বাংলার মাটি কীভাবে এঁকে রেখেছে বিজয়ী মানুষের পদচিহ্ন।-------------------------------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৬ আগস্ট ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৪:২৪
false
fe
যুদ্ধকৌশল ও মানবতার বৃত্তরেখা যুদ্ধকৌশল ও মানবতার বৃত্তরেখাফকির ইলিয়াস=======================================একটি ঘটনা এখন বিশ্বমিডিয়ায় আলোচিত বিষয়। তা হলো, বন্দিদের কিভাবে নির্যাতন করেছে মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা। মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দি মার্কিন সেনাদের ওপর ওয়াটারবোর্ডিং পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানোর দায়ে এই আমেরিকাই জাপানি সেনাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বন্দিদের ওপর সিআইএর পাশবিক নির্যাতনের প্রতি সমর্থন দেয়ায় বুশ প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তারা মার্কিন ইতিহাসকে নতুনভাবে তুলে ধরল।এদিকে আমেরিকার সাবেক যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ডিক চেনি বলেছেন, ‘সুযোগ পেলে আমি আবার মিনিটের মধ্যে ওই একই কাজ করতে বলব।’ ডিক চেনি এসব পদ্ধতিকে নির্যাতন বলতে অস্বীকার করলেও ম্যাককেইন তার বিরোধী। বন্দি নির্যাতনকারী সিআইএ সদস্যদের হিরো বলে আখ্যায়িত করছেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। একই সঙ্গে তিনি সিআইএর বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য আদায় ও জিজ্ঞাসাবাদের কর্মসূচিকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করেছেন। ডিক চেনি এনবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি তাদের হিরো বলতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করব না এবং তারা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার কাজ করেছেন। তাদের সম্মানিত করা উচিত।’ডিক চেনি বলেছেন, ১১ সেপ্টেম্বর যে হামলা হয়েছে এবং যেসব মানুষ মারা গেছে তাদের সঙ্গে এ নির্যাতনের কোনো তুলনা চলে না। তিনি আরো বলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলায় মারা যাওয়া ৩,০০০ মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে আলকায়েদার সন্ত্রাসীরা যে আচরণ করেছে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত নির্যাতন।ডিক চেনি আরো বলেছেন, নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় বন্দি সন্দেহভাজন আলকায়েদা সদস্যদের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদ ও এর ধরন সম্পর্কে সবকিছুই জানতেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি আরো বলেছেন, সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে সিনেট কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ‘অত্যন্ত নিম্নমানের’ ও ‘খুবই ত্রুটিপূর্ণ’।মার্কিন সিনেট সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অতিসম্প্রতি। প্রতিবেদনটি মূলত ৬,২০০ পৃষ্ঠার, তবে সংক্ষেপে তার সারকথা টানা হয়েছে ৪৮০ পৃষ্ঠার মধ্যে। এই প্রতিবেদনে নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বন্দিদের ওপর সংস্থাটির চালানো যৌন নির্যাতনের ভয়াল চিত্র উঠে এসেছে। পাশাপাশি প্রতিবেদনটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি জানানো হয়নি এবং ঊর্ধ্বতন রাজনীতিবিদদের ওই তদন্ত সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল বলে সিনেট দাবি করেছে।আমরা অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখব, ২০১১ সালেই বন্দিদের ওপর ওয়াটারবোর্ডিংসহ বর্বর নির্যাতন কৌশলের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের অন্যতম রূপকার এই দুজন হলেন মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড। ডিক চেনি বলেছিলেন, ‘ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পেতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ওয়াটারবোর্ডিংয়ের (পানিতে চুবিয়ে নির্যাতন) মতো কৌশল।’ আর রামসফেল্ড ওয়াটারবোর্ডিং আবারো চালু করার পক্ষে।‘ফক্স নিউজ সানডে’ অনুষ্ঠানে ডিক চেনি বলেছিলেন, ‘শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে লাদেনের অবস্থান নিশ্চিত হতে আগের তথ্য তাদের সহায়তা করেছে। সন্দেহভাজন বন্দিদের নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের সুফল মিলেছে।’ বন্দিদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদের পন্থা আবারো চালু করা উচিত কিনা জানতে চাইলে চেনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে এর সমর্থন করি।’সিবিএস টেলিভিশনের ‘ফেইস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে রামসফেল্ড বলেছিলেন, সিআইএর সাবেক তিন পরিচালক তাকে জানিয়েছেন, বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াটারবোর্ডিং পন্থা অবলম্বনের ফলেই তারা আলকায়েদা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান। ওই তথ্য পরেও সুফল বয়ে এনেছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, সিআইএ যে ধরনের পথ অনুসরণ করেছিল, তা কাজে দিয়েছে। সন্দেহভাজন বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদে ওই ধরনের কৌশল রদ করা ভুল হবে’।সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে কিউবায় মার্কিন বন্দিশালা গুয়ানতানামো বে’তে বন্দিদের ওপর বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। পরে ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব নেয়ার পর বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধের নির্দেশ দেন। তখন ওবামা বলেছিলেন, বুশের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সময় বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদে যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল সেগুলো ভুল ছিল। কয়েক মাস আগে ডিক চেনি আরো একটি বক্তব্য দিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকায় পরবর্তী সন্ত্রাসী হামলা হবে পরমাণু বোমা দিয়ে এবং তা হবে ৯/১১ হামলার চেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী।২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা ডেক চেনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকায় বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হবে। তার মতে, সে হামলা হবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ।আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় ইতোমধ্যে দেখছি, ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের হামলাকে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করে একটা মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ঘটনা। শুধু তাই নয় অনেকেই এও মনে করেন যে, ওই ঘটনার সঙ্গে সেই সময়কার মার্কিন প্রশাসনের কেউ কেউ জড়িত ছিলেন। একই ধরনের কথা বলেছেন বহু মার্কিন বিশ্লেষকও। এর মধ্যে ২০১৪-এর এপ্রিলে ইরানের প্রেস টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন শিক্ষাবিদ ড. কেভিন ব্যারেট বলেছিলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা সংঘটিত করতে আমেরিকা, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, ৯/১১ কোনো দুর্ঘটনা ছিল না বরং ছিল সামরিক হামলা। রেডিও তেহরানের ওয়েবসাইটে এটা নিয়ে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য একটি ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে যুদ্ধকৌশল। গত কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত একটি সংবাদ আমাদের আরো ভাবিয়েছে।ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কাছ থেকে যুদ্ধকৌশল শেখার জন্য তেলআবিবে মার্কিন সেনা পাঠিয়েছে আমেরিকা। এ কথা জানিয়েছেন মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি। তিনি তার ভাষায় বলেছেন, কিভাবে কম ক্ষতির মাধ্যমে যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় তার কৌশল ইসরায়েলের কাছ থেকে শিখতে হবে। গাজায় ইসরায়েলের সা¤প্রতিক বর্বর আগ্রাসনে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির পর বিশ্বব্যাপী যখন তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা চলছে তখন মার্কিন সেনাপ্রধান এ কথা বললেন।জেনারেল ডেম্পসি জানান, তিন মাসে আগে আমেরিকা সিনিয়র সামরিক ও নন-কমিশন্ড অফিসারের সমন্বয়ে একটি টিম পাঠিয়েছে ইসরায়েলে। এ টিম সরজমিন দেখবে যে, যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কিভাবে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমায় এবং তারা সুড়ঙ্গ নিয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।মার্কিন সেনাপ্রধান দাবি করেন, এবার ৫০ দিনের যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরায়েল অসাধারণভাবে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এনেছে। অথচ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ৫০ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল ছিল খুবই আগ্রাসী। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হামলা চালিয়ে নিরীহ ও সাধারণ মানুষ হত্যায় একবিন্দু দ্বিধা করছে না ইসরায়েলি আগ্রাসী বাহিনী। যদিও তারা অভিযোগ করেছিল, হামলা থেকে বাঁচতে হামাস বাহিনী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব এলাকায় তারাও তাই হামলা করতে বাধ্য হচ্ছে। জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরগুলোও ইসরায়েলের বর্বর হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি। ৫০ দিনের ইসরায়েলি আগ্রাসনে বেশ কয়েকবার জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয় শিবিরগুলো বোমা হামলার শিকার হয়েছে। অভিযোগ ছিল সেই একই, জাতিসংঘের ভবনসহ হাসপাতাল, এম্বুলেন্স, স্কুল, এমনকি মসজিদেও ওঁৎ পাতছে হামাসের যোদ্ধারা। তাই ইসরায়েল বাধ্য হচ্ছে হামলা চালাতে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার অভিমত যত ভিন্নই হোক না কেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন নির্মম প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের ফলে ইসরায়েল ও হামাসের অত্যন্ত অমানবিক যুদ্ধকৌশল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে ওই সময়ে। যদিও বিশ্ব এখন তা ভুলে যেতে বসেছে। জাতিসংঘ পরিচালিত জাবালিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের হামলা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুন বলেছিলেন, কোনোকিছুই এই ভয়ঙ্কর অমানবিক হামলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারে না। জাতিসংঘের পরিচালিত জাবালিয়া উদ্বাস্তু শিবিরের স্কুলটির কক্ষগুলোতে এখন রক্তভেজা নেকড়ায় মোড়ানো ছিন্নভিন্ন দেহগুলো ছড়িয়ে ছিল। জাতিসংঘের ওই ভবনটিতে ৩ হাজারের বেশি সাধারণ নিরীহ বেসামরিক নিরাশ্রয় গাজাবাসী আশ্রয় নিয়েছিল। হামাস নিধনের নামে ইসরায়েলের প্রায় একতরফা ও ভয়ঙ্কর হামলায় এসব মানুষ ঘর ছেড়ে হাতে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে এই স্কুলটিতে ছুটে এসেছিল। ‘একটি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনার স্বাধীন ও পৃথক তদন্ত দাবি করেছিল সেই সময়ে। বন্দি নির্যাতন একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। সেই কাজটিই যুক্তরাষ্ট্র করেছে বলে এখন সংবাদ বেরুচ্ছে। কথা হচ্ছে, মানবতার বৃত্তরেখা কি এভাবেই সীমাবদ্ধ থাকবে পরাক্রমশালীদের হাতে! মুখে বলা হচ্ছে এক কথা। কাজ করা হচ্ছে অন্য রকম। হাতে ক্ষমতা থাকলেই এর অপব্যবহার করলে, তা মানবতাবাদের নিয়মনীতিকে লঙ্ঘন করে। বিশ্বকে তাকিয়ে আর কি দেখতে হবে, তা সময়ই জানে।-----------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ প্রকাশিত
false
rg
কিভাবে পালাকার নাট্যদল গঠিত হল_ কিছু সত্য কথন। পর্ব তিন। রেজা ঘটক হ্যারি আর আমি বনানী অনিকেত পাল বাবু'দার অফিসে পৌঁছালে বাবু'দা বললেন, তোরা একটু ঘুরে আয়। আমার একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ হলেই তোদের সাথে বসবো। আমরা বললাম, তাহলে আমরা একটু বারিধারা থেকে ঘুরে আসি। হ্যারি'র জাপানি অ্যাম্বাসিতে একটা জরুরী কাজ আছে। বাবু'দা বললেন, যেখানে যাবি যা, ৫ টার মধ্যে আসিস, নইলে আমি কিন্তু সাভার রওনা হব। বনানী থেকে আমরা পদব্রজে গুলশান-২ এ আসলাম। ওয়ার্ড এন্ড পেজেজ-এ কাজ করে আমাদের বন্ধু নাহিদ। আমাদের পকেটে তখনো ২৫ টাকা সম্বল। হ্যারি বলল, বন্ধু ক্ষুধা লাগছে? ক্ষুধা তো আমারও লাগছে মাইরি। কি করি? নাহিদকে ফোন করে বললাম, নিমা আপারে একটা ফাঁকি মেরে ওই বিখ্যাত চায়ের দোকানে একটু আসবা? তোমার নামে তো আমরা দুই পাউরুটি আর দুই চা খেয়েছি। এখন তুমি আসলে সিগারেটও খামু। জবাবে নাহিদ বললো, আল্লাদ কতো? তোমার সাথে আর কে কে? জবাব দিলাম, হ্যারি আর আমি। দশ মিনিট খাঁড়াও। সিগারেট দুইটা খাইতে পারো, এর বেশি হইলে আমি নাই, বুঝছো? হ্যারী বললো, নাহিদ আসবে কনফর্ম? তাইলে পাউরুটি আরেকটা মেরেদি। একবারে লাঞ্চও হয়ে গেল। হ্যারির দেখাদেখি আমিও পাউরুটি আরেকটা নিলাম। নাহিদ আসলো। বললো, কি কি খাইছো? আরেক বার চা খেলুম। সিখারেটও খেলুম। নাহিদ বললো, নিমা আপার মেজাজ খারাপ। তোমরা এখন ভাগো। আমার কাজ আছে। কাল এফডিসিতে সুটিং। সবকিছু হ-য-ব-র-ল অবস্থা। আমরা চা শেষ করার আগেই নাহিদ বিল মিটিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। আমরা আবার পদব্রজে বারিধারা জাপানি অ্যাম্বাসির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জাপানি অ্যাম্বাসিতে ঢুকে আবিষ্কার করলাম এক মহা সুযোগ। বিনা খরচে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যায় সেখানে। হ্যারি ওর কাজের খোঁজ খবর নিল। আমিও একটু জাপানি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ওরা একটা খাতা দেখিয়ে বললো, এখানে সকল জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব ঠিকানা আছে। ওখানে কম্পিউটারে বসে সবকিছু জেনে নিন। হ্যারি আর আমি বসলাম দু'জনে দুই কম্পিউটারে। চ্যাটিং অপশন ওপেন করলাম, আসলো একটা সিকিউরিটি চেকবক্স। তাতে বলা হল, আমি যা কিছু করব সব সিকিউরিটি চেক-আপ হয়ে ঢুকবে। হ্যারি আমাকে নিষেধ করলো। তারপরও আমি ইয়াহু চ্যাট ওপেন করলাম। দেখি বন্ধু পুলক অনলাইনে। পুলক জানতে চাইলো, আমরা কোই? বললাম, জাপানে। পুলক বিস্ময় নিয়ে বললো, আরে শুক্রাবাদ থাকলে কও, আমি আইতাছি? কইলাম, শুক্রাবাদ যেতে সন্ধ্যা হবে। আমার দেখাদেখি পরে হ্যারিও কম্পিউটার বদল করে কিছুক্ষণ ওর জাপানি বান্ধবী মাদোকা'র সাথে গপ্পো করলো। সাড়ে চারটা পর্যন্ত আমরা প্রায় তিন ঘণ্টা জাপানি অ্যাম্বাসিতে ফ্রি চ্যাটিং করলাম। আহা কি শান্তি!! আজ শুক্রাবাদে অপুকে টাকা দিতে হবে না। বা সাকরিনকেও টাকা দিতে হবে না। ইান্টারনেটের যাবতীয় কাজ ই-মেইল চেক, চ্যাটিং সব করা শেষে আমরা আবার পদব্রজে বাবু'দার অফিস বনানীতে আসলাম। বাবু'দা আমাদের ১৫০ টাকা দিয়ে বললো, মুকুলকে একটা ফোন করতে বলিস। আমরা বনানী থেকে বাসে উঠলাম। যাবো শুক্রাবাদ। ওই সময় মিল্টনের ফোন। মামু তুমি কোই? কইলাম, বাসে। ভাইগ্না কইলো, বাসের হেলপারি করতাছো নাকি? কইলাম-হ। এখন কোতায় তোমার বাস? কইলাম, মহাখালি। তাইলে, নামো। আমরা অফিসে আছি। আজকের কাগজ অফিস তখন মহাখালীতে। আমরা মহাখালী নেমে আজকের কাগজের অফিসে ঢু মারতেই শামীম রেজা আর রিয়াজ মিল্টন, আমার দুই ভাইগ্না বন্ধুর সাথে কোলাকুলি করলাম। শামীম জিগাইল, মামু কি খাবা? বিদেশী গেস্ট নিয়া আইছো? চল ভালো কিছু খাই? কইলাম, প্রস্তাব মন্দ না, চল, খাই। গরম গরম সিক কাবাব আর হালিম আর পরোটা। আহা দুনিয়ার ক্ষুধা মিটিয়ে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত আজকের কাগজের অফিসে চাম্পিস আড্ডা মেরে হ্যারি আর আমি শুক্রবাদ রওনা হলাম বাসে। সেখানে পুলক, রিয়াজ, নাছিম, নাহিদ, পবন, জাফর ভাই, শামীম ভাই ওরা আড্ডায় আছে ধানমন্ডি নদীর পারে।........................চলবে......................
false
hm
ফুটোস্কোপিক ০১৬ ফুটোস্কোপিক গল্প হচ্ছে ফুটোস্কোপ দিয়ে দেখা গল্প। সামান্যই দেখা যায়। "মিলুদা, কই, লেখা শেষ হোলো?" জীবনানন্দ হাসিমুখে ঘাড় নাড়েন। পাড়ার ছোকরাগুলি কয়েকদিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছে। দিন কয়েক আগে তিনি বাজারের মোড়ে ব্যাটাদের কথাচ্ছলে জানিয়েছিলেন তাঁর কবিতার কথা। "এই কবিতাটা, বুঝলে, অনেক লোকে মনে রাখবে।" মৃদুস্বরে বলেছিলেন জীবনানন্দ। "কবিতার নাম কী রাখলে মিলুদা?" "বলবো, আগে লিখে শেষ করি।" স্মিতহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। সেই ছোকরাগুলিই আজ বাড়ি পর্যন্ত উজিয়ে এসেছে কবিতার খোঁজে। তা কবিতাটা শুরু হয়েছে বেশ। খাতাখানা খুলে জীবনানন্দ মৃদু গলায় কবিতা আবৃত্তি করে চলেন। "তিরিশ বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, বঙ্গোপসাগর থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;" এক ছোকরা খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলো এটুকু শুনেই। জীবনানন্দের মুখ লাল হয়ে যায়। "হাসছিস কেন রে ইষ্টুপিট? য়্যাঁ?" ছোকরা বহুকষ্টে হাসি থামায়। "হবে না গো দাদা, হবে না।" জীবনানন্দ রুষ্ট কণ্ঠে বলেন, "হবে না মানে? কী হবে না? আর হবে কি হবে না তা বলার তুই কে?" ছোকরা হাসে। বলে, "আমি পাঠক। পাঠকের আত্মায় ঘা দেবেন না।" জীবনানন্দ বলেন, "ঘা দিলাম কোথায় আবার রে রাস্কেল?" ছোকরা হাসে। বলে, "মোটে তিরিশ বছর হাঁটলে চলবে? আরো বাড়ান। আজকালকার জমানা অন্যরকমের গো দাদা। এটা হচ্ছে থ্রিলিং থার্টিজ! লোকে এখন এভারেস্টে চড়তে চায়, দক্ষিণ মেরুতে কচুরির দোকান খুলতে চায়। চারদিকে মাচোম্যানগিরির জয়জয়কার। আর আপনি মোটে তিরিশ বছর ধরে হাঁটবেন?" জীবনানন্দ একটু কাঁচুমাচু মুখে ভাবেন, ঠিকই তো। "তো কী করতে বলিস? তিরিশ কেটে শতেক বসিয়ে দেবো? শতেক বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি ... ?" ছোকরা কঠোর মুখে মাথা নাড়ে। "উঁহু। আরো চড়ান।" জীবনানন্দ অসহায় মুখে বলেন, "আরে ছন্দ মিলতে হবে তো!" ছোকরা ফস করে একটা বিড়ি ধরায়, ডেঁপো বদমায়েশ আর কাকে বলে! "তিরিশ কেটে হাজার করুন।" জীবনানন্দ বিড়বিড় করে বলেন, "হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে ...।" ছোকরা মাথা নাড়ে। "এই তো! দেখুন না, কী ঝাঁঝ! হাজার বছর ধরে আপনি পথ হাঁটিতেছেন পৃথিবীর পথে! ট্রাম বাস রেলের পরোয়া করছেন না! এই যে গোঁয়ারগোবিন্দ পথিকাত্মা, এটাই পাঠকের মুখে কষে এক চড় বসিয়ে দেবে!" জীবনানন্দ ঘাবড়ে যান। কিন্তু তিরিশ কেটে গুটি গুটি হরফে হাজার লেখেন। আরেক ছোকরা মন দিয়ে শুনছিলো এ বিতণ্ডা, সে এবার গলা খাঁকরে বলে, "আর ঐ বঙ্গোপসাগরটাও পাল্টে দিন দাদা। দেশি জিনিস লোকে পছন্দ করে না। স্বদেশী আন্দোলনের মূল্যই দিতে শেখেনি কবিতার পাঠক! তারা বিলেতি সাবান মাখে, বিলেতি পমেটম ঘষে, বিলেতি কাপড়ের উড়ুনি পরে! ওটাকে ভূমধ্যসাগর করে দিন।" বিপ্লবী গোছের একজন ক্ষেপে ওঠে, "ক্যানো রে? ভূমধ্যসাগর করতে হবে ক্যানো? বঙ্গোপসাগর খারাপটা কী?" একটা জোর তর্ক বেঁধে যায়। জীবনানন্দ দুর্বল গলায় বলেন, "আহ, ঘরের ভেতর এতো গোল কোরো না তো! আচ্ছা যাও, দু'পক্ষের কথাই রইলো। মাঝামাঝি কোথাও দিই। সিংহল সাগর। সিংহল সাগর কেমন শোনায়?" প্রথমজন বলে, "পড়ুন দিখি!" জীবনানন্দ কেশে গলা সাফ করে নিয়ে পড়েন, "হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;" সবাই মাথা নাড়ে। একজন বলে, "হ্যাঁ, এখন বেশ ভালো শোনাচ্ছে। একটা বেশ ইয়ে আছে, নাকি বলিস?" সবাই স্বীকার করে, একটা বেশ ইয়ে আছে কবিতাটায়। জীবনানন্দ বলেন, "তারপর শুনবি আরো, নাকি তক্কো করবি শুধু?" সবাই শুনতে চায় আরো। জীবনানন্দ পড়ে যান, "আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো খুলনার নেত্যকালী সেন।" ঘরে যেন নৈঃশব্দ্যের বোমা এসে পড়ে! সকলে চুপ করে যায়। অবশেষে একজন উঠে দাঁড়ায়। তার মুখ থমথমে, চোয়াল শক্ত। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে, "আপনে নিজে বরিশালের পোলা, আর আপনে কোবিতা লেখসেন খুলনায় মাইয়া লইয়া? ছি ছি ছি!" জীবনানন্দ থতমত খেয়ে বলেন, "কিন্তু ... আমি ... আমি ...।" ছোকরা গর্জে ওঠে। "খবরদার! বেশি এতালবেতাল করবেন না! খুলনার মাইয়া লইয়া কোনো কোবিতা ল্যাখা চলবেনা! ওইসব খুলনা টুলনা বাদ দিয়া ঢকপদ কইরা কিছু লেহেন!" জীবনানন্দ ঢোঁক গিলে বলেন, "কিন্তু তোমাদের তো বুঝতে হবে ... এটা একটা কবিতা মাত্র!" তুমুল শোরগোল ওঠে। ছোকরার দল হট্টগোল করতে থাকে। কবিতায় খুলনা থাকা চলবে না। জীবনানন্দ কপালের ঘাম মুছে বললেন, "তাহলে কি যশোর করে দেবো?" একটি ছোকরা বলে, "পড়েন দেখি!" জীবনানন্দ পড়েন, "আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো যশোরের নেত্যকালী সেন।" সবাই তুমুল অসন্তোষে মাথা নাড়ে। একজন দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "যশোইরগারাও জোম্মের খারাপ! ওগো লইয়াও কোনো ল্যাহাল্যাহি করবেননা কোলোম!" জীবনানন্দ বলেন, "তাহলে? তাহলে কি সিলেট দেবো? সিলেটের নেত্যকালী সেন?" ছোকরার দল এবার জীবনানন্দকে প্রায় ধরে পেটায় আর কি! সিলেট পর্যন্ত যেতে হবে কেন? বরিশালের মেয়ে কী দোষ করলো? জীবনানন্দ ক্লান্ত হয়ে বলেন, "আরো দুত্তোরি! বরিশাল দিলে ছন্দ মেলে না তো!" ছোকরারা মানতে রাজি নয়। তারা বলে, আপনি কবি, ছন্দ মিলানোই আপনার কাজ। দরকার হলে নেত্যকালীকে পাল্টান। কমলা সেন, রমলা সেন লিখুন। জীবনানন্দ বিব্রত হয়ে বলেন, "আচ্ছা, নেত্যকালীকে বাঁকুড়া পাঠিয়ে দিই বরং? বাঁকুড়ার নেত্যকালী সেন?" এক ছোকরা বলে, "নেত্যকালী নামটাই তো সুবিধার নয় মিলুদা! ওসব আদ্যিকালের নাম চলবে না! নতুন কিছু রাখুন! আধুনিকা, তন্বী তরুণীর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে হবে তো! নেত্যকালী তো আমার দিদিমার নাম!" বাকিরাও হই হই করে ওঠে। নেত্যকালী চলবে না। অন্য কিছু রাখতে হবে। এবার জীবনানন্দ হাল ছেড়ে দেন। "বল তাহলে তোরাই বল। কী নাম রাখবো?" বিপ্লবী চেহারার ছেলেটি বলে, "প্রীতিলতা সেন!" একজন তাতে আপত্তি করে। "উঁহু। সিডিশন আইনে ফেলে কোঁৎকা লাগাতে পারে মিলুদাকে। প্রীতিলতা বাদ।" বিপ্লবী ছোকরাটি তেড়ে আসে, "ক্যানো রে কাপুরুষ!" আবার তুমুল হট্টগোল বাঁধে। জীবনানন্দ মীমাংসা করার চেষ্টা করেন, "আহা এসব হচ্ছে কী? থাম তোরা! আচ্ছা ... সুখলতা করে দিই। বাঁকুড়ার সুখলতা সেন।" সবাই জল্পনা করতে থাকে। সুখলতা? সুখলতা সেন? হুমমমমম। এক ছোকরা বলে, "বাঁকুড়া আমার মেজ পিসের বাড়ি। এমন হতচ্ছাড়া লোক আর দুটো দেখিনি! ছোটলোকের হদ্দ! পিসির জীবনটা ছারখার করে খেয়েছে। বাঁকুড়া টাকুড়া চলবে না। অন্য কোনো লোকেশন বাছুন দাদা!" নাম নিয়ে আরেক ছোকরা ঘ্যাঙায়। "সুখলতা আমার সেজ কাকীমার নাম। না না না, অন্য কিছু রাখুন দাদা। শেষে একটা কেলেঙ্কারি না বাঁধে!" জীবনানন্দ ক্ষেপে ওঠেন ভয়ানক। "তোরা এক একটা মহামূর্খ!" চিৎকার করে বলেন তিনি। "খুলনায় সমস্যা, যশোরে সমস্যা, সিলেটে সমস্যা, বাঁকুড়ায় সমস্যা! নেত্যকালীকে কোথায় পাঠাতে বলিস, নাটোরে?!" সবাই চুপ হয়ে যায়, একজন শুধু বলে, "নেত্যকালী তো নয়, সুখলতা!" আরেকজন বলে, "নাটোরের সুখলতা সেন! হুমমম, খারাপ শোনাচ্ছে না দাদা!" যার সেজ কাকীমার নাম সুখলতা, সে আবার ফুঁসে ওঠে, "না না না! সুখলতা রাখা চলবে না!" জীবনানন্দের চোখে জল চলে আসে। "তোরা এক একজন মনুষ্যপদবাচ্য নোস!" ধরা গলায় বলেন তিনি। "কোনো সুখ নাই আমার জীবনে! একটা কবিতা লিখবো বলে খাটছি অহর্নিশি, আরো তোরা, পদে পদে গিয়ানজাম করিস! বরিশ্যাইল্যা কোথাকার! থাকবো না আর এখানে। সুখ নাই যখন, বনে চলে যাবো, বনবাসী হব!' ছোকরাদের একজনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। "সুখ নাই, বনে যাবেন?" জীবনানন্দ বলেন, "হ! বনেই যামু গিয়া!" ছোকরা উজ্জ্বল মুখে বলে, "পাইসি রে দাদো! সুখ কাইডগা বন বসাইয়া দ্যান! বনলতা সেন! নাটোরের বনলতা সেন!" জীবনানন্দ একটু থতমত খেয়ে যান। "বনলতা সেন?" ছোকরারা সবাই সানন্দে সম্মতি জানায়। নাটোর নিয়ে কারো আপত্তি নাই, কারো বজ্জাত পিসের বাড়ি সেখানে নয়, আর বনলতা সেনও কারো কাকীমার নাম নয়। জীবনানন্দ গোমড়ামুখে টুকে রাখেন নামটা। তারপর বলেন, "এইবেলা বেরো সবাই বাড়ি থেকে! আর কোনোদিন যদি তোদের কবিতা পড়ে শোনাই, তাহলে আমার নাম জীবনানন্দই নয়!" ... বরিশালের ভাষায় সংলাপ অনুবাদ করে দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বরিশালিয়ান।
false
mk
আনন্দ বাজারে খালেদা জিয়া! নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কড়া সমালোচনা করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক 'আনন্দবাজার পত্রিকা'। এ নিয়ে সোমবার পত্রিকাটি তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় 'যুক্তি হরতাল, প্রণবের সঙ্গে কথায় না খালেদার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালে ঢাকার পরিস্থিতি বোঝাতে প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, রাস্তায় গাড়ির স্রোত। দোকানপাট খোলা। শেয়ারবাজার আর ব্যাংকে লেনদেন চলছে আর পাঁচটা দিনের মতোই। ঢাকার হরতালের এই চিত্র তুলে ধরে পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এই হরতালকেই ঢাল করে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার এই পদক্ষেপ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তো বটেই, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও দূরপ্রসারী বার্তা দিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে ভি ভি গিরির পর দ্বিতীয় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঢাকা সফর করছেন প্রণব মুখার্জি। প্রণবের সফরের সময় ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে পত্রিকাটি বলছে, ঢাকায় শাহবাগের আন্দোলন তুঙ্গে। জামায়াতের চোরাগোপ্তা হানায় নানা জায়গায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবু এর মধ্যে শহরের মোড়ে মোড়ে দুই দেশের পতাকা। ভারতের রাষ্ট্রপতির হাসিমুখের ছবি, নিচে লেখা 'স্বাগত'। মানুষ ভিড় করছেন প্রণবকে দেখার জন্য। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে প্রণব নিজেই বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশ। বর্ষীয়ান রাষ্ট্রপতি হেসে বলেছেন, 'এ দেশ তো আমার বিদেশ বলেই মনে হয় না। নিজের ভাষায় কথা বলি, ভীষণ চেনা মুখগুলো।' 'আনন্দবাজার' তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, 'আর ভারতীয় হাইকমিশনে দু'লাইনের মেইল পাঠিয়ে প্রণববাবুর সেই সফর বয়কট করেছেন খালেদা জিয়া। সেই খালেদা, যিনি এক রকম ঝুলোঝুলি করেই গত নভেম্বরে দিলি্ল সফরের আমন্ত্রণ আদায় করেছিলেন। দিলি্ল গিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। তার পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সলমন খুরশিদের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছিলেন, প্রণববাবুর সঙ্গে তার অনেক কথা রয়েছে। কিন্তু আজ প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে খালেদা জিয়া বুঝিয়ে দিলেন, সামনের ভোটে ভারতবিরোধিতার সুর চড়ানোই হবে তার রণকৌশল।' 'আনন্দবাজার' জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার এই পদক্ষেপ সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, 'খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসবেন না বলে জানিয়েছেন। ব্যস, এর বেশি কিছু বলা আমাদের শোভা পায় না।' প্রণব মুখার্জির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি ভবনের এক কর্মকর্তা 'আনন্দবাজার' পত্রিকাকে বলেছেন, 'সকালে রওনা হওয়ার আগেই তিনি (প্রণব) খবরটা পান। প্রণববাবুর মুখের হাসি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যায়। তবে কোনো মন্তব্য করেননি।'
false
rn
যদি কোটিপতি হতে চান, যে ৯ টি বই আপনাকে পড়তে হবে যদি কোটিপতি হতে চান তবে অবশ্যই যে ৯ টি বই আপনাকে পড়তে হবে। বিল গেটস তার তালিকা দিয়েছেনঃ ১। ট্যাপ ড্যাংসিং টু ওয়ার্ক : ওয়ারেন বাফেট অন প্র্যাকটিক্যালি এভরিথিং ১৯৬৬-২০১২। বইটা লিখেছেন ক্যারোল লুমিস (Tap Dancing to Work: Warren Buffett on Practically Everything, 1966-2012 . by Carol Loomis) বইটি সম্পর্কে গেটস বলেছেন, ‘ যিনি এই বইটা পড়বেন তিনি মূলত দুইটি অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাবেন। প্রথমত, বাফেট কিভাবে তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন সেটা জানা যাবে এবং সবগুলো ক্যারিয়ারে কোন কোন বিষয়গুলোকে বাফেট তার প্রধান পুঁজি হিসেবে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এই বইটি ব্যবসা ও বিপণনকে জানতে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে শেখাবে। ২। মেকিং দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড : ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড ডিম্যাটেরিয়ালাইজেশন। বইটা লিখেছেন ভ্যাকভ স্মিল (Making the Modern World: Materials and Dematerialization. by Vaclav Smil) বিল গেটসের প্রিয় লেখক ভ্যাকভ স্মিল। এই লেখকের সর্বশেষ বই এটি। বইটি সম্পর্কে গেটস তার মতামত দিয়েছেন এভাবে, ‘আমরা কোথায় আছি এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি এটা জানার জন্য এই বইটিই যথেষ্ট।’ ৩। দ্য সিক্সথ এক্সটিনেকশন : অ্যান আনন্যাচারাল হিস্টোরি। এটি লিখেছেন এলিজাবেথ কোলবার্ট। (The Sixth Extinction: An Unnatural History. by Elizabeth Kolbert) আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই যে আজকের দিনটা বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ। কিভাবে? গেটস বলেছেন, সেটা জানা যাবে এই বইটি পড়লে। ৪। স্ট্রেস টেস্ট : রিফ্লেকশন অন ফিন্যানসিয়াল ক্রাইসিস। টিম গিথনারের লেখা। (Stress Test: Reflections on Financial Crises. by Tim Geithner) এই বইতে এমন একজন মানুষের পোর্ট্রেট এঁকেছেন গিথনার যে-মানুষটা বৈশ্বিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং একই সঙ্গে তার সমালোচক, আশ-পাশের লোকজন, বন্ধু-স্বজন এমনকি পরিবারের লোকদের বিষয় উঠে এসেছে। ৫। দ্যা বেটার অ্যাঞ্জেলস অব আওয়ার নেচার : হোয়াই ভায়োলেন্স হ্যাজ ডিকলাইনড। বইটির লেখক স্টিভেন পিংকার (The Better Angels of Our Nature: Why Violence Has Declined. by Steven Pinker) বইটি সম্পর্কে এক লাইনে নিজের মতামত দিয়েছেন গেটস-‘এত গুরুত্বপূর্ণ বই আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি পড়িনি।’ ৬। দ্যা ম্যান হু ফেড দ্যা ওয়ার্ল্ড। এই বইটি লিখেছেন লিয়ন হেসার (The Man Who Fed the World. by Leon Hesser) বইটির লেখক লিওন সম্পর্কে গেটস বলেছেন, ‘এই মানুষটা আমার সব কাজের আদর্শ। কারণ তিনি যে বিভিন্ন ধরনের বীজ আবিষ্কার করেছেন তা এই পৃথিবীর অনেক মানুষকে অনাহার থেকে মুক্তি দেবে। ৭। বিজনেস অ্যাডভেঞ্চার্স : টুয়েলভ ক্ল্যাসিক টেলস ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ড অব ওয়াল স্ট্রিট । বইটি লিখেছেন জন ব্রুকস। (Business Adventures: Twelve Classic Tales from the World of Wall Street. by John Brooks) একজন সফল ব্যবসায়ী হতে হলে কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, এই বই আপনাকে জানাবে সেসবের আদ্যপান্ত। বইটি সম্পর্কে এমন কথাই বলেছেন গেটস। ৮। দি বুলি পুলপিট : থিওডর রুজভেল্ট, উইরিয়াম হওয়ার্ড টাফ অ্যান্ড গোল্ডেন এজ অব জার্নালিজম। এই বইটির লেখক ডরিস কেয়ার্নস গুডউইন। (The Bully Pulpit: Theodore Roosevelt, William Howard Taft and the Golden Age of Journalism. by Doris Kearns Goodwin) অন্য আর সবার মতো রুজভেল্টের ব্যাপারে তুমুল আগ্রহ আছে বিল গেটসের। গেটস বলেন, আমার খুব জানতে উচ্ছে করল, রুজভেল্ট কীভাবে সমাজটাকে পরিবর্তন করলেন? এ বিষয়ে আমি অনেক ধারণা পেলাম এই বইটা পড়ে। বইটা যে কারও অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। ৯। দ্য রোজি প্রজেক্ট : অ্যা নভেল। বইটি লিখেছেন গ্রায়েম সিমসন। (The Rosie Project: A Novel. by Graeme Simsion) বিল গেটস বইটি সম্পর্কে বলেন, গল্প-উপন্যাসে খুব একটা আগ্রহ নেই আমার। তবে মেলিন্ডা যখন বইটা পড়তে বলল তখন বাধ্য হয়ে হাতে নিলাম। তারপর অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটল। আমি প্রায় বৈঠকে বইটা পড়ে শেষ করলাম। বইটি সত্যিই খুব মজার। এটি পড়ার পর এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা লিখেছেন বিল গেটস। সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৫৯
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০৩৪ আমি যে বেশ বুড়ো হয়ে পড়েছি ভেতরে ভেতরে, তার প্রমাণ পাচ্ছি ক'দিন ধরে। রাতে আর পড়তে পারি না। বরং সকালের দিকে মাথাটা একটু টাটকা থাকে। সন্ধ্যের পর একদম হেদিয়ে পড়ি। তখন মন শুধু অন্য কিছু চায়, লেখাপড়া আর ভাল্লাগেনা। আরো নবীন বয়সে সারারাতই জেগে থাকতাম বলতে গেলে, আর এখন রাতে জেগে থাকলে আর চিন্তাভাবনা ঠিকতালে কাজ করে না। আজ প্রায় কাকভোরেই উঠতে হয়েছে পরীক্ষার ঠ্যালায়। আজকে পড়বো কালকো পড়বো, এমন করে করে মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ব্যাপারটা পরীক্ষার দিন সকালে এসেই ঠেকেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকের দিনগুলোতে দায়সারা পরীক্ষা দেয়ার সময় এই অভ্যাসটা এমন গেড়ে বসেছে যে কিছুতেই আর সংশোধন করতে পারছি না। ছ'টার সময় ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম, সময় তো আছেই, না হয় একটু মেইল চেক করি। তারপর ভাবলাম, মেইল দেখলাম আর সচলে একটা ঢুঁ মারবো না? এমন করে করে শেষে সাড়ে সাতটার দিকে ফাইল খুলে বসলাম চোখ বুলানোর জন্য। থার্মোডাইনামিক্স শেষ পড়েছি ঊনিশশো নিরানব্বুই সালে, শেষ পড়িয়েছি বোধহয় দুই হাজার তিনে। বেমালুম খেয়ে ফেলেছি এর মধ্যে অনেক কিছুই। প্রফেসর শ্মিডের পড়ানোর ধরনটা একটু অন্যরকম, আমরা যেমন পি-ভি প্লেন বা টি-এস প্লেনে এক একটা চক্রিকপ্রক্রিয়া শিখেছি, তিনি পড়ান ই-টি ডায়াগ্রাম ধরে। খুব একটা জটিল কিছু না, সেই পুরনো গ্যাসের গতিতত্ত্ব, কার্নো-স্টার্লিং-এরিকসন-ব্রেটন সাইকেল, মাইক্রোগ্যাসটারবাইন, বের্নুয়ির সমীকরণ ইত্যাদি। ইদানীং অঙ্ক করতে গেলে মাথায় হালকা চাপ লাগে, অনভ্যাসের কারণেই হয়তো। সব শেষ করে দেখি দশটা বেজে গেছে। তখন মনে পড়লো, আজকে না বাস ধর্মঘট? মোটামুটি বজ্রাহত হবার মতোই ঘটনা, কারণ আমার বাসা থেকে সবচেয়ে কাছের ট্রাম স্টপেজে হেঁটে যেতে লাগে পঁচিশ থেকে তিরিশ মিনিট। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, তাপমাত্রা অবশ্য চড়ে গেছে ওপরে। কী আর করা, হেঁটেই রওনা দিলাম মূল ক্যাম্পাসের দিকে। হু হু বাতাস, হাঁটতেও খারাপ লাগছিলো না তেমন। হল্যান্ডিশার প্লাৎসে যখন পৌঁছেছি, তখনই হাল্টেষ্টেলে (স্টপেজ) কাঁপিয়ে ঘোষণা এলো, আজ ট্রামও চলবে না। ক্যামন লাগে এসব শুনলে? আর হল্যান্ডিশার প্লাৎস থেকে ইংশুলে আরো আধঘন্টার চড়াই পথ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে গেলো। ঘড়িতে দেখি আটতিরিশ বাজে, এগারোটার সময় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মনে মনে কল্পনার করার চেষ্টা করলাম, আমি আসলে একটা গোলাপি মেঘের ওপর বসে আছি। হাতে ধরা সুরার গেলাস। কাছেই জনৈকা অপ্সরা কুমতলব নিয়ে ওঁত পেতে আছে। ইত্যাদি ...। হুম। কল্পনায় খুব একটা কাজে দিলো না, গ্যাটম্যাট করে হাঁটা দিলাম আবার। সারা শহরের চেহারা হয়েছে অদ্ভুত, অসময়ে লোকজন গিজগিজ করছে রাস্তার ওপর। সবার চেহারাই খিড়কি পথে প্রেম খাওয়া। একদা ছিলো না জুতা চরণ যুগলে। কোয়নিগসপ্লাৎসে আপনমনে একটা গালির গানে সুর দিতে দিতে যাচ্ছি, দেখি আমার ভাইভা গ্রুপের আরেক সদস্য স্লাভ বিরস মুখে খুব কষ্টে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। ডাক দিতেই স্লাভ থামলো। ইচ্ছামতো কিছু গালাগালি করে মনের ঝাল মিটিয়ে তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। স্লাভকে বললাম, তুমি পারলে আগে গিয়ে জানাও যে আজ এই অবস্থা, সামান্য দেরি হতে পারে। স্লাভ জানালো, গ্রুপের আরেক সদস্য দিমো ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে, সে জানাবে বলেছে। ইংশুলেতে হেঁটে যাওয়ার ব্যাপারটা এমনিতে খারাপ লাগার কথা নয়, কিন্তু ভাইভার আগে এইসব ফালতু খাটনি কারই বা ভালো লাগে? প্রফেসর শ্মিড ভয়াবহ ব্যস্ত মানুষ, সম্ভবত গতকাল ফিরেছেন ভারত থেকে। আমাদের পরীক্ষা নিয়ে অন্য কোথাও যাবেন। দেরি করলে আমাদের শুধু পরীক্ষাই পিছাবে না, গ্রেডও জুটবে খারাপ। সম্ভাব্য কী কী ঝাড়ি খেতে পারি তার একটা তালিকা করার পর দেখলাম, আসলেই কপালে দুঃখ আছে। এমনিতেই আরেক কোর্সে দেরি করে যাবার জন্যে একদফা ঝাড়ি খেয়েছি শ্মিডের কাছে, আজকে পরীক্ষায় দেরি করে গেলে কী হয় কে জানে। শেষ পর্যন্ত দশ মিনিট দেরি করে বসলাম তিনজন। যে জিনিস আমি নিজে প্রায় বছর চারেক পড়িয়েছি অন্যদের, সেটার এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্যাঁচ শ্মিড বার করতে লাগলেন যে টাষ্কি খেয়ে গেলাম। যে প্রশ্ন তিনি দিমো বা স্লাভকে করেন, সেটার উত্তর ঠোঁটের ডগায় চলে আসে, কিন্তু আমার বেলায় এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করেন যে সেকেন্ড পনেরো চিন্তা করতে হয়। পাশে বসে আছে প্রোটোকোলান্ট ম্যাথিয়াস, সে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে কী কী সব লিখে যাচ্ছে প্রোটোকোল পাতার ওপর। প্রফেসর শ্মিড কোন কাজেই সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নন, পরীক্ষা শেষে দুমদাম করে গ্রেড জানিয়ে দিলেন। ডিপ্লোমআরবাইট, অর্থাৎ থিসিস লেখার সময় আগ্রহ থাকলে যোগাযোগ করতে বললেন, কী বিষয় নিয়ে ইদানীং কাজ করছেন তারও একটা ধারণা দিলেন। তারপর বললেন, যান গিয়ে ফূর্তি করেন। পরীক্ষা শ্যাষ। আবারও ঘন্টা আধেক হেঁটে গিয়ে সুমন চৌধুরীর ওপর হামলা করলাম। চৌধুরী নানা ভ্যাজালে থাকেন, তাকে বগলদাবা করে গেলাম রেয়াল-এ। রেয়াল বেশ বড়সড় বিভাগ-বিপণী, তবে একটু দূরে বলে কম যাওয়া হয়। রেয়ালে ফোরেলের দাম অন্য যে কোন দোকানের চেয়ে কম বলে ফোরেলে খেতে চাইলে সেখানে যাই। বেশ কিছুদিন আগে একদিন ফোরেলের দাম নিয়ে চৌধুরীর সাথে আলাপ করার সময় কোত্থেকে এক নারীকণ্ঠ শোনা গেলো ঐশীবাণীর মতো, "আপনারা বাঙালি?!" দেখলাম জনৈকা সুশ্রী মহিলা বেশ অবাক হয়ে দেখছেন আমাদের। মনে মনে বললাম, কপাল ভালো ফোরেলে নিয়ে আলাপ চলছিলো, কোন গরম বিষয়ে নয়। আলাপ করে জানা গেলো, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের। না, মহিলাটা কোনক্রমেই একাকিনী নন, সাথের গোমড়ামুখো টেকো ভদ্রলোকটি তাঁর সঙ্গী, ধরা যাক এই দম্পতির নাম চক্রবর্তী। সেই থেকে কাসেলে উচ্চস্বরে বাংলায় বাজে কথা বলার পরপরই আমি নিজেকে একটা সতর্কবাণী দিয়ে থাকি, "আপনারা বাঙালি?!" রেয়ালে এতদিন চালের দাম কম ছিলো, সেখানেও দাম চড়চড়িয়ে বেড়ে যাওয়ায় আমরা যার পর নাই ক্ষুব্ধ। সস্তায় ভালো চাল আর কোথায় পাওয়া যায়, তার খোঁজ নেয়ার জন্যে এর আগে এক ছুটির দিনে এক চৈনিক দোকানে হানা দেয়া হয়েছিলো। সেখানে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য নানারকমের জিনিস আছে, যেমন কই মাছ আবিষ্কার করে চৌধুরী রীতিমতো উল্লসিত, কিন্তু চালের মূল্য সেখানে প্রীতিকর নয়। সন্দেহজনক চেহারার কিছু চাল দেখলাম, যাদের বাসমতী বা জেসমিন চাল বলে চালিয়ে দেয়ার একটা অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিফল মনোরথে শেষমেশ বর্ধিতমূল্যের চাল খাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আমরা এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে এই অনাচারের শোধ নিতেই হবে। কোন জার্মান তরুণীর ওপর এই ঝাল ঝাড়তে পারলে তো কথাই নেই।
false
mk
বিএনপি জামায়াতের অগ্রবর্তী ‘প্রক্সি-দল’ যে কোনো যুদ্ধে অগ্রবর্তী একটা দল থাকে। তারা যুদ্ধে পেছনের মূলদলের অগ্রযাত্রা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পথের মাইন পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে নদীপথে পারাপারে ব্যবস্থা করা, সম্ভাব্য ছোটখাট প্রতিরোধ নির্মূল করা ছাড়াও মূলদলের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।নামে ভিন্নতা থাকলেও তারা আসলে একই দলের কৌশলগত যোদ্ধা, একই আদর্শিক দলের সদস্য এবং একই কমান্ডের অধীনে তারা অখণ্ড। এমনটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেমন কিছুদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি এসে ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে। তাঁর আগমনের এক সপ্তাহ আগেই সে দেশ থেকে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্রবর্তী একটি দল ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে অবস্থান নিয়েছিল।সর্বক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্যণীয় যে, অগ্রবর্তী দলটি মূলত তার পেছনের এলিট বা মূলদলটির অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে কাজ করে থাকে। নামে ভিন্নতা বা অবস্থানের সময়ে ভিন্নতা থাকলেও, মূলত দুটোই একই আদর্শে বিশ্বাসী, একই দলের অঙ্গ। পরিচয়ের এই ভিন্নতা শুধুই কৌশলগত কারণে; আদর্শগত বা অন্য কোনো কারণে নয়।ভূমিকায় এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামীর অবস্থান এবং ভূমিকার ব্যাপারে আমার তত্ত্বীয় ভাবনাগুলো উপস্থাপন করা। অনেকে হয়তো ভাববেন যে, এ ধরনের এবং ভাবাবেগের লেখা, ১৬ কোটি মানুষের দেশে এর আগেও অনেকেই লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন।আমার দাবি, না, প্রসঙ্গ এক হলেও, ভাবনায় ও বক্তব্যে লেখাটি একেবারেই ভিন্ন এবং উত্থাপিত দাবির বা বক্তব্যের পক্ষে, সম্ভবত এটাই প্রথম লেখা। আলোচনা, পর্যালোচনা এবং যুক্তির সরলরেখার পথ ধরে এগিয়ে গেলে, নিঃসন্দেহে লেখাটিকে একটি বইয়ের আকার দেওয়া যায়। তবে সে দায়ভার অন্য কেউ নেবেন, এটাই আশাবাদ।১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনীর দোসর, সহায়কবাহিনী জামায়াত ইসলাম দ্বারা গঠিত বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীসমূহ, যেমন, আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তিবাহিনী ইত্যাদির কথা বর্তমান প্রজন্ম জেনেছে বিভিন্নভাবে এবং উপস্থাপনায়। স্বাধীনতার পরে দলটির সর্বোচ্চ নেতাসহ অন্যান্যরা হয় দেশত্যাগ করেছিল, অথবা আত্মগোপনে গিয়েছিল। বেশকিছু জামায়াতি অবশ্য মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহতও হয়েছিল।১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রণীত সংবিধানে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণসহ তাবৎ ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াত ইসলামকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতের দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্বই ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে অপরাধের জন্য ১৯৭৩ সালে গ্রেফতারকৃত হাজার হাজার মিলিশিয়া সদস্যকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল বিশেষ আদালতে।জামায়াতও বসে থাকেনি। হৃত রাজ্য ফিরে পেতে, তার প্রভু পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খুব সূক্ষ্মভাবে বাংলাদেশে বিছিয়ে দেয় ভয়ঙ্কর সব চক্রান্তের রাজনীতি। ছদ্মবেশে অগ্রবর্তী একটা দলের সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে অবিশ্বাস্য গোপনীয়তায় সে চক্রান্তের জাল ফেলতে শুরু করেন মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন অতি চিকন মাথার সৈনিক।মেজর জিয়া নামের এ বিষবৃক্ষের চারা রোপিত হয়েছিল মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। যুদ্ধের ডামাডোলে কেউই তাকে সন্দেহ করতে পারেনি। সে সময় সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারলেও যুদ্ধপরবর্তী অনেক গবেষণায় বিতর্কের ঝড় তুলেছেন এ পাকসৈনিক।অনেকে সন্দেহের যৌক্তিক তীর ছুঁড়েছেন তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দিকে। অগ্রবর্তী দলের এ সেনানায়ক তার সুচতুর কৌশলে সদ্যজন্মা এ দেশটির সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি দখলে নিয়ে নেন প্রায় বিনাবাধায়। তাকে এ কাজে সহায়তা করে খোন্দকার মুশতাক শ্রেণির বেশ কিছু পাকিসৈনিক, যারা এ অগ্রবর্তী দলেরই সদস্য।১৯৭৫ সালের আগষ্টে এ অগ্রবর্তী দল অত্যন্ত সুকৌশলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে সক্ষম হয়। অগ্রবর্তী দলের সাফল্যজনক অগ্রযাত্রা সেই থেকে চলতে থাকে এবং প্রায় বাধাহীন ভাবেই। তারপর শুরু হয় প্রতিশোধের রাজনীতি আর মুক্তিযোদ্ধা নিধন। তা শুরু হয় প্রথমে মূল সেনাবাহিনীতে,তারপর বেসামরিকদের উপর। গভীরভাবে চিন্তা করলে খুব স্পষ্টতই ফুটে ওঠে এ অগ্রবর্তী বাহিনীর শৈল্পিক সুবিন্যস্ত কাজকর্মগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জিয়া কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়েই জারি করা হল ইনডেমনিটি আইন। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিশেষ বিমানযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হল লোকচক্ষুর অন্তরালে।বিভিন্নভাবে পুরষ্কৃত করা হল হত্যাকারীদের। পর্যায়ক্রমে তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। সেনাছাউনি থেকে গঠন করা হল বিএনপি নামের এক অগ্রবর্তী রাজনৈতিক দল। সেনা হিসেবে ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিকভাবে পেছনের মূল দল বা শক্তিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া অনেক কঠিন কাজ। তাই সরাসরি রাজনৈতিক ময়দান তৈরির কর্মযজ্ঞ।শুরু থেকে ছদ্মবেশে গোপনে থাকলেও, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে অগ্রবর্তী দলটি বিএনপির মাধ্যমে তার স্বরূপে আত্নপ্রকাশ করল। পাশাপাশি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল সৌদি আরব, চীনের মতো পাকিসমর্থক দেশগুলো। বাকশালের অতিউৎসাহী সদস্য হয়েও মেজর জিয়া বাকশালের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে বাংলার মাটিতে সাদর সম্ভাষণ জানাল বিতাড়িত জামায়াত ইসলামীকে। পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল জামায়াত ইসলামের বাংলার মাটিতে। সে সঙ্গে সমাপ্ত হল চক্রান্তের প্রথম ধাপটির। আওয়ামী লীগ তখন নিপাতিত একটা দল, যার নেতৃত্ব নেই, কর্মীরা আত্নগোপনে অথবা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা একটি দল। তারপর থেকে শুরু হল মূলদল জামায়াতকে শাসকদল হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার যতসব যজ্ঞ ও আয়োজন।পাঠক, একের পর এক ঘটনাগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখুন- কীভাবে জামায়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ছদ্মবেশী বিএনপিকে অগ্রবর্তী দল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলেই কি তা নয়? তাহলে এটাই হোক বিচার্য যে, এ বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বিএনপি স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যা কিছু করেছে,তা সম্পূর্ণ জামায়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই করেছে, যা সাধারণত একটা অগ্রবর্তী দলই করে থাকে।এ অগ্রবর্তী দল হুট করে হাওয়া থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এতে ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, কৌশল, সুদক্ষ অভিনয় এবং সর্বোপরি,আন্তর্জাতিক স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অকৃপণ সহযোগিতা। এছাড়াও যেটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং উল্লেখযোগ্য তা হল বাংলার এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রায় ৪২ বছর ধরে বোকা বানানো।যাক, যা বলছিলাম, অগ্রবর্তী দলটি হুট করে হাওয়া থেকে যে উড়ে আসেনি তার এক প্রমাণ সৈনিক জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশের পরই রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম, আই উইল মেক পলিটিক্স ইমপসিবল ফর দ্য পলিটিসিয়ানস।’কিন্তু এত টাকার উৎস কী? যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশটিতে যেখানে দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ চলছিল, সেটিই মুজিব হত্যার পর জিয়ার হাত ধরে কাড়ি কাড়ি টাকায় ভর্তি হয়ে গেল? উত্তর খুব সোজা। আমেরিকা, সৌদি আরব, পাকিস্তান, লিবিয়া আর চীনের মতো দেশগুলোই সে টাকার উৎস। যুদ্ধকালীন সময়ে এ দেশগুলোই পাকিস্তানকে অর্থ ও যুদ্ধের রসদ দিয়ে সাহায্য করেছিল এবং মুজিব হত্যার পর এ দেশগুলোই জিয়ার এ অগ্রবর্তী প্রক্সি-দল বিএনপিকে সহযোগিতা করেছিল মূলত বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নয়; বরং জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে পাকিবাজ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে।প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে মুজিব হত্যার পর সরাসরি জামায়াতকে কেন ক্ষমতায় বসানো হল না। তার উত্তর হচ্ছে প্রথমত, মুজিবহত্যাকে একটা সাধারণ সামরিক অভ্যুত্থানের পরিণতি হিসেবে দেখানো, এবং দ্বিতীয়ত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের সম্পর্ক নেই, তা প্রমাণের জন্য সরাসরি জামাতকে ক্ষমতায় প্রতিস্থাপিত করা হয়নি।এরপরও আর একটা উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট যে, যুদ্ধপরবর্তী এত অল্প সময়ের মধ্যে জামায়াতে ইসলামকে ক্ষমতার মসনদে দেখলে বাংলার মানুষ মেনে নিত না এবং তখনই হয়তো দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে বসত। তাছাড়া এত তাড়াহুড়ারও তো দরকার ছিল না। জামায়াতের অগ্রবর্তী প্রক্সি-দলটি ক্ষমতায় থাকা মানেই যে জামায়াতের ক্ষমতায় থাকা এটা সবচেয়ে বোকা শত্রুটিও বুঝতে পেরেছিল। দেশপরিচালনায় জামায়াতের অদৃশ্য একটা হাত সবসময়ই যে ছিল, তা আজ আর কারও না বোঝার কারণ দেখি না।এবার দেখা যাক, ক্ষমতায় না থেকেও কীভাবে জামায়াত দেশ শাসন করেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কী কী পরিবর্তন হয়েছে? সেগুলো কার প্রয়োজন পূরণ করেছে? এ দুটি প্রশ্নের যৌক্তিক পর্যালোচনা করলেই আমার দাবির যথার্থ উপস্থাপনা হবে বলে আমি মনে করি এবং আত্মবিশ্বাসে বেশ নিশ্চিত। কিছু উদাহরণ দিলে বুঝতে হয়তো সুবিধা হবে।যেমন, ইনডেমনিটি আইন জারি করা, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথমে বিসমিল্লাহ এবং পরবর্তীতে ইসলাম সংযুক্তিকরণ, ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম এবং স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস খুব সুচতুর ও সূক্ষ্মভাবে মুছে ফেলা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান মিত্রদেশ ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করা, খুব ধীরে নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা প্রদানে প্রাধান্য না দিয়ে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য দেশে স্কুলের চেয়ে অধিক হারে মাদ্রাসা এবং মসজিদ স্থাপনা করা, ব্যাঙ্ক-হাসপাতাল-শিশুশিক্ষা-বীমা ইত্যাদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা গ্রহণ করা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জামায়াতের লোকদের বিপুল হারে নিয়োগ দেওয়া, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব গোপনে ছাত্র শিবিরের প্রসার বৃদ্ধি করা, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিদেশে বিভিন্ন মিশনে চাকরি দেওয়া, সে হত্যাকারীদের বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেওয়া, সে দল থেকে সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া, জামায়াতকে বিএনপি সরকারের অধীনে দুজন মন্ত্রীর পদ দেওয়া, বিভিন্ন রূপে ও নামে বাংলা ভাইদের জন্ম দেওয়া, ২১ আগষ্টের নারকীয় ঘটনা ঘটানো, মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে রাজাকারদের দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা ইত্যাদি।এ ধরনের আরও শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। তারপরও যেমন পঁচাত্তর-পরবর্তীতে বাংলাদেশে একটা নব্য ধনিকশ্রেণি তৈরি করা হয়েছে। তাদের অর্থের উৎস এবং ক্ষমতার বলয় সম্পর্কে পরিষ্কার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ ৪০ বছরের শেষের দিকে এক কথায় তারাই মূলত বিভিন্নভাবে দেশশাসন করেছে, দিকনির্দেশনা দিয়েছে। চাকরি, ব্যবসায়, রাজনীতিতে, সাহিত্যে,মিডিয়াতে প্রায় সবখানেই এসব নব্য দাড়িগজানো ধনিকশ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় নয় কি?তাছাড়াও খুব সুচিন্তিত ও সূক্ষ্মভাবে এ নব্যদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে সমবন্টন আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দৃশ্যও কিন্তু যথেষ্ট দৃশ্যমান। এ সবকিছুর গোড়ার কারণই মূলত এক ও অভিন্ন, জামায়াতের মওদুদীবাদের বৈপ্লবিক প্রসার ঘটানো এবং ইরানীয় আদলে জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতার শীর্ষে বসানো।আসুন একটু কল্পনা করা যাক। ধরুন পঁচাত্তর-পরবর্তীতে বিএনপি না হয়ে যদি জামায়াতে ইসলামী সরাসরি ক্ষমতা দখল করত এবং বিএনপি বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনগুলো এনেছে এবং যেভাবে শাসন করেছে, জামাত কি তার থেকে আলাদা কিছু করত? আমার পর্যবেক্ষণে উত্তর হচ্ছে ‘না’, অর্থাৎ বিএনপি যা কিছু করেছে তা একটা অগ্রবর্তী দল হিসেবে তার মূল দলকে নির্বিঘ্নে প্রতিষ্ঠা এবং সার্ভ করার জন্যই করেছে।যদি তাই হয়, তাহলে দাঁড়াল কী? বিএনপি কি আসলেই স্বপ্রতিষ্ঠিত, স্বতন্ত্র কোন দল? না কি জামায়াতেরই একটা অংশমাত্র? আমার পর্যবেক্ষণ এবং বিবেচনায় বিএনপি শুধুই জামায়াতের একটা অগ্রবর্তী জামায়াতীয় প্রক্সি-দল; অর্থাৎ বিএনপির ভূমিকায় অভিনয় করছে যে দলটি, জামায়াতে ইসলামীই তার মূল এবং একমাত্র পরিচয়।আমার ধারণায়, গত জোট সরকারের আমলটা ছিল বিএনপি নামধারী দলটির শেষ আমল এবং অগ্রবর্তী দল হিসেবে বিএনপির যতটুকু করার কথা বা পরিকল্পনায় ছিল, তার সবটুকুই এ জামায়াতের প্রক্সি-দল বিএনপি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই শেষ করেছে। একটু খেয়াল করে দেখুন, গত জোট সরকারের আমলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। অথচ মাত্র দুটি মন্ত্রীত্ব পেয়েও দেশটি সম্পূর্ণ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম। সে সময় দেশের যে কোনো সিদ্ধান্তই হয়েছে জামায়াতের ইচ্ছায় অথবা ইশারায়।তারেক জিয়া জামায়াতের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের দুই সন্তান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ তো দাঁড়াতেও পারেনি। কিন্তু ছাত্রদল উঠতে-বসতে শিবিরের হাতে মার খেয়েছে, অপমানিত হয়েছে, শিবিরের বি-টিম হিসেবে কাজ করেছে অবনত মস্তকে। তা হয়েছে খালেদা-তারেকেরই আদেশে এবং হুমকিতে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের আশ্রয় দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করানো তো আজ সবার জানা। দশট্রাক অস্ত্র। জামায়াত একটা সম্পূর্ণ মুসলিম দেশের শাসনভার নিতে যাচ্ছে অচিরেই, অথচ সে দেশে হিন্দুরা থাকবে কেন? জোট সরকারের আমলের মতো হিন্দুদের উপর এত বীভৎস অত্যাচার এর আগে কি কখনও হয়েছে?যদিও খুব সুক্ষ্মভাবে দেশ থেকে হিন্দুবিতাড়ন শুরু হয়েছে মূলত পঁচাত্তরের পর থেকেই। এ পর্যন্ত প্রায় তিন কোটির অধিক হিন্দু দেশত্যাগ করেছে। এ ধরনের উদাহরণ আরও হাজারটা দেওয়া যেতে পারে।আমার ধারণা আরও স্পষ্ট হয় যখন ভাবি, ইয়াজউদ্দিন আর আজিজকে দিয়ে যে করেই হোক নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মাটি কামড়ানো চেষ্টার কথা। আমি আজ নিশ্চিত, সেবার যদি জোট আবার ক্ষমতায় আসত, বিএনপি যদিও তখন জামায়াত গহ্বরে হারিয়া যাওয়া একটা দল প্রায়, তারপরও সম্পূর্ণ ঘোষণা দিয়ে বিএনপি বিলুপ্ত করে দিয়ে বিএনপির সবাই জামায়াতে যোগদান করে শুধু বাংলাদেশ জামায়াত হিসেবেই এক দলের শাসন চালাত।ইরানের খোমেনীর যে বিপ্লব হয়েছিল শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ঠিক সেভাবেই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিপ্লবের মাধ্যমে জামায়াত বাংলাদেশে ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল। আরেকটু ভিন্নভাবে দেখলে বলা যায়, স্বাধীনতাপরবর্তীতে মুজিবহত্যার আগমূহূর্ত পর্যন্ত দেশ যে আদর্শ বা নীতিমালায় চালিত হয়েছে, চল্লিশ বছর পরের হিসেবে দেখা যায় দেশ চালিত হয়েছে সে আদর্শ বা নীতিমালার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে। এতেও আমার দাবির পক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায়।তাছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের দীক্ষার আলোয় একদলীয় বাকশালের যে শাসনের শুরু তিনি করেছিলেন, চল্লিশ বছর পর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যেতে পারলে মূলত জামায়াত-বিএনপিসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বিলুপ্ত করে ইরান-স্টাইলে ইসলামের শাসন জারি করলে আমি অবাক হতাম না।অবাক হতাম না বাহাত্তর-স্টাইলে জামায়াতকে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, তেমনি চল্লিশ বছর পর জামায়াতও চাইলে ক্ষমতার দম্ভে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এবং এর নেতৃত্বকে দেশছাড়া করলে। তার কিছু আলামত কি আমরা এক-এগারোর সময় দেখিনি। মাইনাস ওয়ানের কথা আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তার কারণ, জামায়াতের ইসলামিক ধারায় এক শাসনতন্ত্র মূলত সমাজতন্ত্রের একদলীয় বাকশালরীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মের একটা রীতি এবং জামায়াত ক্ষমতায় আসলে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। নয় কি?মূল জামায়াতে ইসলাম না হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ননামে অর্থাৎ ‘বিএনপি’ নাম ধারণ করে পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলাম এরই মধ্যে অনেক বছর শাসন করেছে বাংলাদেশ। এর আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি, আধা-সরকারি এবং বেসরকারি যে কোনো জায়গাতেই একাধিক স্তরে বসে আছে জামায়াতের নিজস্ব লোকজন। কিন্তু এটা কী করে হয়?আমার ধারণা, তারা এসব প্রশাসনে যখন নিয়োগ পেয়েছিল, তাদের লেবাস ছিল বিএনপির। অর্থাৎ মূলত তো তারা শুরু থেকেই মূল জামায়াতেরই লোক। এখানেও আমার সে দাবিই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ বিএনপি হচ্ছে বাংলাদেশে জামায়াতেরই অগ্রবর্তী একটি প্রক্সি দল। মূলত তারা এক এবং অভিন্ন জামায়াতে ইসলামী; তাদের স্বত্ত্বাও এক।বাংলাদেশে বিএনপি না থাকলে জামায়াত থাকবে, জামায়াত না থাকলে বিএনপি থাকবে। অর্থাৎ যে রূপেই থাকুক না কেন, জামায়াত থাকবেই। কারণ, যে নামেই ডাকুন, ভালবাসার মানুষটি তো সে একই জন। পোষাকের ভিতরের দেহটির অভিন্নতাই এর মূল কারণ। পঁচাত্তর-পরবর্তী বিএনপি তার বহুবিধ কাজ এবং আচরণ দিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা জামায়াতে ইসলামীরই ক্লোন বা অভিন্নরূপী। আর শুধুমাত্র এর ধারাবাহিকতার কারণেই খালেদার বিএনপি সম্পূর্ণ নির্লজ্জ-চাটুকর বেশে উঠে পড়ে লেগেছে জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে।ব্যাপারটা উল্টোটাও হতে পারত। ধরুন, জামায়াতে ইসলামের যা ইচ্ছা তাই হোক। বিএনপি এসব গায়ে না মাখিয়ে নিজের মতো চললে এবং নিজস্ব রাজনীতির চর্চায় মনোনিবেশ করলে, আমার দাবি নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পেত না। অথচ এর উল্টোটাই আমরা বরং ঘটতে দেখেছি এক-এগারোর সময়, যখন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং বিএনপির সব নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল।জামায়াতের ভূমিকা তখন কী ছিল? জামায়াত কিন্তু তখন সামান্য ভদ্রতাসূচক কোনো প্রতিবাদ জানায়নি বা বিএনপির পক্ষে বক্তব্য দেয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন জানায়নি? জানায়নি কারণ, এটাই নিয়ম। অগ্রবর্তী দল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মূলদলের পদচারণা নির্বিঘ্ন করবে। আর সে কাজ করতে গিয়ে যদি তাদের জীবন বিপন্ন হয়, তাতে জামায়াতে ইসলামীর কিছুই যায়-আসে না বা তারা সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকবে স্বভাবতই।কিন্তু খালেদা এবং বিএনপি সেটা করতে পারছেন না শুধুমাত্র তাদের ‘অগ্রবর্তী প্রক্সি দলের’ পরিকল্পনামাফিক দায়িত্বপালনের কারণে। জামায়াতকে বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে নির্বিঘ্নে হত্যা করতেও এতটুকু বুক কাঁপছে না দলটির। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জামায়াতের আরেক ক্লোন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ জলন্ত উদাহরণ। ব্যাপারটা এমন কী কঠিন যে বোঝা যাচ্ছে না তারপরও?বিষয়টা এতই স্পষ্ট যে, এতগুলো কথা না বললেও হয়তো চলত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি এবং জামায়াত, দল দুটোর যে কোনো একটিও যদি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে অপরটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আপনা থেকেই। সে কারণে বলা যেতে পারে, বর্তমান বাংলাদেশে এ মৌলবাদী দল দুটোর (মূলত একটি) বাঁচা-মরার লড়াই। টিকে থাকার লড়াই। যা এ দলদুটোর সমসাময়িক রাজনৈতিক চর্চায়ই স্পষ্টত দৃশ্যমান। চর্চাটা যে খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল, তাও নয়। তবে এর বিভৎসতার ধারণা এ প্রজন্মের ছিল না, যারা একাত্তর দেখেনি।এ যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির হার হলে, পরিণতি সে জামায়াত-বিএনপির মতোই হবে। এ লড়াই দুপক্ষেরই বেঁচে থাকার লড়াই; টিকে থাকার লড়াই। এ যুদ্ধে একপক্ষকে হারতেই হবে। এ পর্যায়ে যুদ্ধের এটাই নিয়ম। আর এ সত্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সরকারসহ সকল স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিগুলোকে উপলব্ধিতে আনতে হবে এবং সেভাবে কর্মপন্থা সাজাতে হবে। তা না হলে, দ্বিতীয় সুযোগটি আর পাওয়া না-ও যেতে পারে।সব্বির খান : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। লিনক
false
rn
একজন মহান সাহিত্যিক 'ক্ষীরের পুতুল' হলো হুমায়ূন আহমেদের পড়া প্রথম সাহিত্য। যদিও তার বাবার বিশাল লাইব্রেরি ছিলো।হুমায়ূন আহমেদের জন্ম পীরবংশে। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।স্বাভাবিকভাবেই হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ে ছিল গুলতেকিন এবং তার সন্তানদের এর জন্য চরম দুঃখজনক এবং অপমানজনক। গুলতেকিন তার আত্মসম্মান নিয়ে নিজেকে বিশেষ করে গণমাধ্যম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। হুমায়ূন তার লেখনীর মাধ্যমে একটা জাতীয় রুচি তৈরি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন জাতীয়- সম্পদ। লেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিও তিনি অবলীলায় ছেড়ে দিয়েছেন, সৎ থাকতে চেয়েছেন নিজের কাছে সমাজের কাছে। স্যারের একটা স্বপ্ন ছিলো। তা হলো একটি ক্যান্‌সার হাসপাতাল তৈরি করা। আমি অপেক্ষায় আছি কবে সেটার কাজ শুরু হবে..কবে আমরা একটি ক্যান্‌সার হাসপাতাল দেখতে পারবো... স্যার নিজেও মনে হয় অপেক্ষায় আছেন।এক দিকে তিনি আমাদের সাহস দিয়েছেন অপর দিকে তিনি নিজেই হাহাকার বাড়িয়েছেন।যখন যে ভাবে ইচ্ছা হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, অভিভূত করেছেন...সবাই যেন তাঁর ইচ্ছার পুতুল! আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। বৃষ্টিস্নাত রজনীতে ঢাকা নগরীতে হিমু ছাড়াও একজন মানুষ ঘরে বেড়ায়। সে অন্যদের চেয়ে উচ্চতায় লম্বা। অন্ধকারেও তাঁর চোখে থাকে কালো চশমা। হাটে ধভধভে শাদা গ্লাভস। এরা মানুষের খুব কাছে আসে না দূরে দাঁড়িয়ে পাখির মত শব্দ করে। হিমু এদের নাম দিয়েছে পক্ষী মানব।এক বৃষ্টিস্নাত রাতে হিমু বের হয়েছে পক্ষীমানবের সন্ধানে, তাঁর সঙ্গে আছে একজন রাশিয়ান পরী। ( হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী ) এ্যাই ছেলে এ্যাই। আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম। আমার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ । গায়ে চকচকে হলুদ পাঞ্জাবি পর পর তিনটা পান খেয়েছি বলে ঠোঁট এবং দাঁত লাল হয়ে আছে। হাতে সিগারেট। আমাকে 'এ্যাই ছেলে' বলে ডাকার কোনোই কারণ নেই। যিনি ডাকছেন তিনই মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা । তাঁর সঙ্গে আমার একটা ব্যাপারে মিল আছে। তিনিও পান খাচ্ছেন। আমি বললাম, আমাকে কিছু বলছেন?তোমার নাম কি টুটুল?আমি জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এই মহিলাকে আমি আগে কখনো দেখি নি। অথচ তিনই এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন মনে হচ্ছে আমি যদি বলি 'হ্যাঁ আমার নাম টুটুল' তাহলে ছুটে এসে আমার হাঁট ধরবেন। কথা বলছ না কেন? তোমার নাম কি টুটুল? হাসলাম এই আশায় যেন তিনি ধরেত পারেন আমি টুটুল না। হাসিতে খুব সহজেই মানুষকে চেনা যায়। সব মানুষ একই ভঙ্গিতে কাঁদে, কিন্তু হাসার সময় একেক জন একেক রকম করে হাসে। আমার হাসি নিশ্চয়ই ঐ টুটুলের মতো না । ( ময়ূরাক্ষী ) ইয়াছিন সাহেব বারান্দায় অজু করতে এসে দেখেন শশা- মাচার নিচে লাল শাড়ি পরা বউ মত কে যেন ঘুরঘুর করছে। শশা-মাচা তো বেড়ানোর জায়গা না। কে ওখানে? শশা তুলছে নাকি? তাই তো, শশাই তো তুলছে। কোঁচড়ভর্তি শশা । সূর্য ডোবার পর ফলবতী গাছের ফল ছেঁড়া যায় না- এই সত্যটা কি লাল শাড়ি পরা মেয়েটা জানে না। ইয়াছিন সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। একবার ভাবলেন অজু বন্ধ রেখে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে আসেন ব্যাপারটা কী? কিন্তু এটা ঠিক না। গুরুতর কোন ঘটনা না ঘটলে নামাজ ছেড়ে যেমন ওঠা যায় না, তেমনি অজু ছেড়েও ওঠা যায় না। লাল শাড়ি পরা মেয়ের শশা তোলা কোন গুরুতর ঘটনা না। ( ওমেগা পয়েন্ট ) হিমু কখনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে না । ছোটখাটো ঝামেলায় সে পড়ে । সেই সব ঝামেলা তাকে স্পর্শও করেনা । সে অনেকটা হাসের মত । ঝাড়া দিল গা থেকে ঝামেলা পানির মত ঝরে পড়ল ।আমার খুব দেখার শখ বড় রকমের ঝামেলায় পড়লে সে কি করে । কাজেই হিমুর জন্য বড় ধরণের একটা সমস্যা আমি তৈরী করেছি । এবং খুব আগ্রহ নিয়ে তার কান্ড-কারখানা দেখছি ।( একজন হিমু কয়েকটি ঝি ঝি পোকা ) আপনিই মিসির আলি?হ্যাঁ।মেয়েটা এমন ভাবে তাকাল যেন সে নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও কররে পারছে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলা থেকে নিজেকে সামাল দিয়ে নরম গলায় বলল, আমি ভীষণ জরুরি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিটা এই মুহূর্তে আপনাকে না দিয়ে একটু পরে দেই? নিজেকে সামলে নেই? আমি মনে মনে আপনার চেহারা যেমন হবে ভেবেছিলাম, অবিকল সেই রকম হয়েছে। মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। সরল ধরনের মুখ। যে মুখ অল্পতেই বিস্মিত হয়। বারান্দায় চড়ুই বসলে অবাক হয়ে বলে, ও মাগো কী অদ্ভুত চড়ুই!( আমিই মিসির আলি ) আদর্শ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না আদর্শ মানুষ ডিসটিল্ড ওয়াটারের মত -স্বাদহীন। সমাজ পছন্দ করে অনাদর্শ মানুষকে। যারা ডিসটিল্ড ওয়াটার নয় - কোকা কোলা ও পেপসীর মত মিষ্টি কিন্তু ঝাঁঝালো।( নবনী ) কেরামত বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। সে জানে না তার বয়স পাঁচপঞ্চাশ পার হয়েছে। এখন তার মাথায় চুল সবই সাদা। বাঁ চোখে ভাল দেখতেও পায় না। গায়ে সেই আগের জোড়ও নেই। কাজ কর্ম তেমন করতে পারে না। তবু পুরানা অভ্যাসে সারাদিন ক্ষেতে পড়ে থাকে । সন্ধাবেলায় নিজের বাড়িতে এসে অনাগত স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের কথা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে ।( আয়োময়) "মারিয়ার গলা ধরে এসেছে।সে আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে।কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার ভেতর এক ধরণের বিভ্রম তৈরি হল।মনে হল আমার আর হাটার প্রয়োজন নেই।মহাপুরুষ না, সাধারণ মানুষ হয়ে মমতাময়ী এই তরুণীটির পাশে এসে বসি।যে নীলপদ্ম হাতে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম,সেই পদ্মগুলি তার হাতে তুলে দেই।তারপরেই মনে হল-এ আমি কি করতে যাচ্ছি!আমি হিমু- হিমালয়।"( হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম )
false
ij
লালন ও সোফিস্টগন। প্রাচীন গ্রিসে এভাবে হেঁটে হেঁটে জ্ঞানচর্চা করতেন জ্ঞান তৃষ্ণার্তরা। এই ছবিটা অবশ্য রাফায়েলের আঁকা প্লেটো ও অ্যারিসটোটল। ‘সুফি’ শব্দটা তো আমরা শুনেছি। প্রখ্যাত ইতালিয় অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন-এর নামও আমরা জানি। এবং আমরা অনেকেই ইয়েস্তেন গার্ডার-এর লেখা "সোফির জগৎ" বইটি পড়েছি। মজার কথা এই যে-‘সুফি’ এবং ‘সোফিয়া’ এবং 'সোফি'-এই তিনটি শব্দের মূলে কিন্তু একটি গ্রিক শব্দ । sophistēs: অর্থ দক্ষ কারিগর। পরে শব্দটির অর্থ বদলে যায়। যেমন হয়। Sophists। এর মানে আয়নার কারিগর বা man of wisdom. আজ আমরা অবশ্য সোফিস্ট বলতে এক দার্শনিদের বুঝি যারা একটি বিশেষ সময়ে এথেন্স নগরে বাস করতেন। সেই বিশেষ সময়টা ছিল এথেনিয় রাজনীতিবিদ পেরিক্লিসের আমল। ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্ব। সদ্য পারস্য সম্রাট জারেকসেস এথেন্স তছনছ করে গিয়েছেন। অবশ্য এথেন্সের নেতৃত্বে পারশিকদের ভরাডুবি হয়েছিল ঠিকই। তারপর পরপরই এথেন্স হয়ে উঠল গ্রিকবিশ্বে অন্যতম এক সেরা নগররাষ্ট্র। এথেন্সের কাছে রৌপ্য খনি আবিস্কৃত হল; ফলে রৌপ্য মূদ্রার প্রচলনে অর্থনীতির চাকা ঘুরল। আমাদের যেমন চট্টগ্রাম; সেরকম এথেন্সের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর ছিল পিরেউস। সে বন্দরটি হয়ে উঠল হাজারও পন্যের ভিড়ে জমজমাট। নিয়তি কে নির্ধরন করে দেয় কে জানে। ঠিক ওই রকম একটা তুমুল সময়ে এথেন্স তার শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদকে পেল। পেরিক্লিস। তিনি মোটেও শিল্পান্ধ ছিলেন না; বরং শিল্পসাহিত্য বুঝতেন; চর্চা করতেন সঙ্গীত। তাঁকে ঘিরে ছিল ফিদিয়াসের মতন ভাস্কর, আনেক্সোগোরাস মতন দার্শনিক এউরিপিদিসের মতন নাট্যকার। তাঁকে ভালো বেসেছিল এক নারী। আসপাসিয়া। মূর্খেরা বলে আসপাসিয়া ছিলেন রক্ষিতা। আসলের আসপাসিয়া ছিলে সুন্দর মনের অধিকারী এক নারী। প্রথম স্ত্রীকে ডির্ভোস দিয়ে আসপাসিয়াকে ঘরে তুললেন পেরিক্লিস। এথেন্সের লোকের মুখে মুখে কত গুঞ্জন। আমরাও এক সময় যেমন এরশাদকে নিয়ে ...যাক। আসপাসিয়াকে ঘিরে পেরিক্লিসের ঘরে আলো করতেন সোফিস্ট দার্শনিকগন। প্রোটাগোরাস। গর্জিয়াস। আনেক্সোগোরাস ... আসলে সোফিস্টরা এথেন্স নগরে এসেছিল গ্রিসের নানা প্রান্ত থেকে। গ্রিসবিশ্বটি ছিল এজিয়ান সমুদ্র ঘিরে এশিয়ায় ও ইউরোপে ছড়িয়ে। সোফিস্টরা নানা অঞ্চলের রীতিনীতি দেখেছিলেন। তারা কোনও একটিকে শ্রেয় মনে করতেন না। তারা মনে করতেন যে- দেশ সমস্যা অনুসারে ভিন্ন বিধান হতে পারে। সূক্ষ জ্ঞানের বিচার করে পাপ-পূন্যের নাই বালাই । কাজেই এথেন্সের লোকে যখন বলল-আমাদের রীতিনীতিটাই সহি। কী করে জানলে? সোফিস্ট দার্শনিকরা চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞাসা করত। তো সোফিস্টা ভারি ভয়ানক কথা বলত। আনেক্সোগোরাস বলেছিলেন, সূর্য? আরে ওটা তো একটা লাল রঙের গরম পাথর। আকার? এই ধরো, আমাদের পেলোপন্নেসিয়ার সমান। এমনই অভক্তি তাদের। Gorgias নামে একজন বিখ্যাত সফিস্ট ছিলেন। তিনি একবার একটি অতি ভয়ানক কথা বলেছিলেন- nothing really exists, that if anything did exist it could not be known, and that if knowledge were possible, it could not be communicated. কী সাঙ্ঘাতিক। এমন কথা শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! আরেকজন ছিলেন Protagoras। বলেছিলেন, Man is the measure of all things.এই কথাটা আমরা কমবেশি জানি। আপনারা যে ইংলিশ গ্রামারের Parts of Speech এর জানেন।Protagorasই প্রথম এটি আবিস্কার করেছিলেন। কার্ল মাকর্স এ জন্যই একবার বলেছিলেন, প্রাচীন গ্রিকরা চিরকালই আমাদের শিক্ষক হয়ে থাকবেন। ধর্ম নিয়ে Protagoras বলেছিলেন-Concerning the gods; I have no means of knowing either that they exist or that they do not exist nor what sort of form they have. মোট কথা; সোফিস্টরা সব ছিলেন ঘোর সংশয়ী। তখন বললাম না যে- আসলে সোফিস্টরা এথেন্স নগরে এসেছিল গ্রিসের নানা প্রান্ত থেকে; আর, গ্রিসবিশ্বটি ছিল এজিয়ান সমুদ্র ঘিরে এশিয়ায় ও ইউরোপে ছড়িয়ে। সোফিস্টরা নানা অঞ্চলের রীতিনীতি দেখেছিলেন। তারা কোনও একটিকে শ্রেয় মনে করতেন না। তবু, এথেন্সের লোকে তাদের কাছে যেত। তাদের নানা কথা জিজ্ঞেস করত। লোকে যখন তাদের জিজ্ঞেস করত, হে আয়নার কারিগর, আমাদিগকে পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে বলুন। সম্ভবত তখন তারা বলতেন- পাপ-পুন্যের কথা আমি কারে বা শুধাই। এই দেশে যা পাপ গন্য অন্য দেশে পুন্য তাই। সূত্র: "Sophists." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. এবং উইকিপিডিয়া সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৪৩
false
fe
জনমত উপেক্ষা করার যখন সুযোগ থাকে না জনমত উপেক্ষা করার যখন সুযোগ থাকে নাফকির ইলিয়াস======================================বাংলাদেশে আবারও হরতালের রাজনীতি শুরু হয়ে যাচ্ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি হরতাল ডেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য এ হরতালের মাধ্যমে সরকারকে সতর্কীকরণ করা। সরকারকে সতর্ক করার দরকার মাঝে মধ্যে পড়ে। উন্নত বিশ্বেও আমরা দেখি, বিরোধীপক্ষ সরকারপক্ষের সমালোচনায় পঞ্চমুখ হন, এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নির্বাচনে। কিন্তু দমন-পীড়ন কিংবা ভাঙচুর, বন্ধের মতো ঘটনা উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বের রেওয়াজ নয়।বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা যেমন ধরাকে সরা জ্ঞান করে তেমনি যারা বিরোধীদলে থাকে তারা জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া আর কোন গত্যন্তর খুঁজে পায় না। আবার এ জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে কোন সরকারকে যে বিদায় করা গেছে তেমন কোন সুস্পষ্ট উদাহরণও বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন সেটি ছিল গণঅভ্যুত্থান। সম্মিলিত মানুষের সংগঠিত আন্দোলন। প্রায় এক দশক সময় ধরে রাষ্ট্রের বুক থেকে জগদ্দল পাথর সরাতে কত প্রাণ ঝরেছে, সে কথা কোনদিনই ভুলে যাওয়ার নয়।তবে এটা ঠিক, গণমানুষেরা সরকারপক্ষকে মাঝে মধ্যেই সতর্ক করে। যেমনটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে করেছে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনীতিক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়েছে নিউইয়র্কে। আলাপকালে তাকে বন্ধুবৎসল, সজ্জন বলেই মনে হয়েছে আমার। কিন্তু একটি কথা মানতে হবে, ১৫ বছরেরও বেশি সময় তিনি চট্টগ্রামের নগরপিতা ছিলেন। ফলে তার পক্ষ-বিপক্ষ দুই-ই তৈরি হয়েছে। 'সব ওয়াদা পূরণ করা যায় না' এ সত্যটিও খুব ধ্রুব হয়ে প্রমাণিত হয়েছে প্রাজ্ঞ রাজনীতিক মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনে।কিন্তু তারপরও কথা হচ্ছে, এই মেয়রের চেয়ারটি ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা কেন তার তৈরি হয়নি? কেন ২০১০ সালেও তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হলো? আর দলই বা তাকে মনোনয়ন দিল কেন? আওয়ামী লীগে কী আর যোগ্য মেয়র প্রার্থী ছিলেন না? আওয়ামী লীগ কী জনমত যাচাই করেনি?তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রচুর। বিশেষ করে নিজ দলের চট্টগ্রামের এমপিরা এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে তারা মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে কাজ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের তথা মহাজোট প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেননি।যেভাবেই হোক, মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরাজয় নতুন কোন বিষয় নয়। কারণ তা হতেই পারত। বরং নতুন মেয়র বিজয়ী মঞ্জুরুল আলমের আগমনই নতুন আলোচ্য বিষয়। কারণ যিনি একজন কমিশনার ছিলেন এবং একসময় আওয়ামী লীগের সমর্থকও ছিলেন। তার এই আওয়ামী লীগ বিমুখতার কারণটি দলের হাইকমান্ডের ভেবে দেখা দরকার।মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসী পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি মানুষ চেক এন্ড ব্যালেন্সের রাজনীতির প্রতিও পক্ষপাত দেখিয়েছে। জনগণের এই যে সতর্ক সংকেত তা বর্তমান সরকারের গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কোন প্রভাব ফেলবে না বলেই মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের কিছু শীর্ষ নেতা। কিন্তু আমার মতে, বিষয়টি এমন সহজভাবে দেখার নয়। কারণ, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মানুষ সরকারকে তাদের ওয়াদা পূরণ, গণসমস্যা সমাধানের দিকেই নজর দেয়ার বার্তা পাঠিয়েছে। সরকার তা কীভাবে, কতটা গ্রহণ করবে-তাই দেখার বিষয়।দুই.দেশের গার্মেন্টস সেক্টর আবারও অশান্ত, অচল হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের নানা দাবি তোয়াক্কা না করে গার্মেন্টস মালিকরা মিল-কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে শ্রমজীবী মানুষ আরও ফুঁসে উঠছে। বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার। একটি মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেলে, আমরা অনেকেই অনেকভাবে সোচ্চার হই। বলি, কয়েকশ' লোক তাদের চাকরি হারাচ্ছে। ঠিক একই সমানুপাতে একটি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হলে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে। সব মিলিয়ে হাজার হাজার পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছে রুটি-রুজি থেকে।গোটা বিশ্বে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। মন্দা অর্থনীতির ধকল সইতে হচ্ছে সবাইকে। তাই শ্রমিকরা, যারা বেতন বাড়ানোর দাবিসহ অন্যান্য যে দাবি-দাওয়া জানাচ্ছে তা সহানুভূতি, বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করা উচিত ছিল। আলোচনার মাধ্যমে, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। তা না করে মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা অবস্থাকে আরও জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা কোন মতেই কাম্য হতে পারে না।বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের একটি উৎসও বটে। এর সামান্য তোয়াক্কা না করে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার হঠকারি সিদ্ধান্ত যারা নিলেন তারা কি সামনে-পেছন ঠিকমতো ভেবে দেখেছেন? দেশবাসী লক্ষ্য করছে বেশ কিছুদিন থেকেই গার্মেন্টস শিল্পের মাঠটি উত্তপ্ত। সরকার 'গার্মেন্টস পুলিশ' গঠনের কথাও বলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেসব বাস্তবায়নের অগ্রগতি সাধন না করে বরং কারখানা বন্ধের দিকেই এগুচ্ছে মিল মালিকরা। বলা দরকার, হয়তো ছাঁটাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে 'আন্দোলনকারী' কিছু শ্রমিককে বাদ দেয়া যাবে কিংবা যেতে পারে। কিন্তু নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিলে ক্রমে তাদের মাঝে থেকেই কেউ কেউ যে একই আন্দোলনের পথ অনুসরণ করবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি?এটা আমরা অতীতেও দেখেছি কোন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, কোন ক্ষমতাবানদের পক্ষে জনমত উপেক্ষা করার যখন কোন সুযোগ থাকে না তখন তারা দমন-পীড়ন করে। মানুষকে রুখে দেয়ার নানা অপচেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে মানুষকে, মানুষের শক্তিকে কি দমানো যায়? না যায় না। আর যায় না বলেই মানুষের জয় হয়। অপশক্তিরা পরাজিত হয়।বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার মেরুদ- ভেঙে দিতে নানা অপশক্তিই তৎপর। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ সরকারের মেয়াদকালীনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। তাদের মেয়াদকাল এখনও সাড়ে তিন বছর। তবে কি এ বিচারকার্য তারা পুরো সাড়ে তিন বছরই ঝুলিয়ে রাখবেন? মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক ভুলের মাশুল কিন্তু বড়ই কঠিন।নিউইয়র্ক, ২৩ জুন ২০১০ -----------------------------------------------------------------------দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ২৫ জুন ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - কেসনি ইবি
false
mk
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এটি ছিল জাতীয় জীবনের অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃসহ অত্যাচার, অনাচার এবং দুর্নীতির প্রেক্ষিতে দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বজন প্রশংসিত নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে মহাজোটকে দেশ পরিচালনার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করার মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে তথাকথিত বিদ্রোহের নামে বর্বরোচিত হত্যাকা- সংঘটিত হয়। উক্ত বর্বরোচিত ঘটনায় সর্বমোট ৭৪ জন প্রাণ হারায়। যার মধ্যে ৫৭ জন ছিল সেনা কর্মকর্তা। পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতামূলক নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। বিডিআর বিদ্রোহে নিহত শহীদ সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারকে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাসন সুবিধা প্রদানসহ শহীদ পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান ও বিনাখরচে ভর্তি ও পড়ালেখার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যেই শহীদ ৩৭টি পরিবারকে মিরপুর ডিওএইচএস-এ স্থায়ী প্লট, ৩২ জনকে চাকরি ও শহীদ পরিবারগুলোর ৮৪ জনকে বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগসহ ৪৪টি পরিবারকে অস্থায়ী আবাসন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিডিআর হত্যাকা-ে শহীদ সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের পুনর্বাসনে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ১. আর্থিক সহযোগিতা ক. প্রধানমন্ত্রীর অনুদান ১০ লক্ষ টাকা। খ. সেনাবাহিনীর কল্যাণ তহবিল থেকে অনুদান ৫ লক্ষ টাকা। গ. বিডিআর তহবিল থেকে অনুদান ৫০ হাজার টাকা। ঘ. বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস কর্তৃক প্রতি বছর ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা হিসেবে অদ্যাবধি সর্বমোট ৫ বছরে ২৪ লক্ষ টাকা প্রদান। ঙ. শহীদ অফিসার পরিবারবর্গকে ২ লক্ষ টাকার ট্রাস্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্লেসমেন্ট শেয়ার প্রদান। চ. তাছাড়া নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক শহীদ পরিবারবর্গকে পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প তহবিল, ডিএসওপি ফান্ড, কল্যাণ তহবিল থেকে অনুদান, মৃত্যু আনুতোষিক, ছুটির পরিবর্তে নগদ অর্থ, কম্যুটেশন এবং মাসিক পেনশন প্রদান করা হয়েছে। ২. অন্যান্য সহযোগিতা ক. শহীদ অফিসার পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে চাকরি প্রদান করা হয়েছে; তন্মধ্যে ৩ জন বিদেশে বাংলাদেশস্থ দূতাবাসে চাকরিরত আছেন। খ. শহীদ অফিসার পরিবারবর্গের ৮৪ জন সদস্যকে (স্ত্রী/সন্তান) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং বিনা বেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ. শহীদ অফিসার পরিবারের ৯ জন সন্তানকে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমান বছরে ১ জন শহীদ অফিসারের সন্তানকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ঘ. শহীদ অফিসার পরিবারবর্গের স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য ৩৭ জনকে মিরপুর ডিওএইচএস-এ প্লট দেওয়া হয়েছে। ১০ জনকে মিরপুর ডিওএইচএস-এ ২টি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট প্রদানের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। তাছাড়া ১১ জন অফিসার শহীদ হওয়ার পূর্বেই ডিওএইচএস এবং রাজউকে প্লট পেয়েছিলেন। ঙ. ৪৪ জন শহীদ অফিসার পরিবারের অস্থায়ী আবাসন নিশ্চিতকল্পে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সরকারি পারিবারিক বাসস্থান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চ. ১৫ জন শহীদ অফিসারের গৃহ নির্মাণ অগ্রীম ঋণের সুদ ও আসল মওকুফ এবং ২৫ জন শহীদ অফিসার যাদের ট্রাস্ট ব্যাংকে লোন ছিল তাদের ২০০৯ সালের লোনের ওপর সুদ মওকুফ করা হয়েছে। ছ. শহীদ অফিসার পরিবারবর্গকে দুধ কুপন কার্ড, সামরিক টেলিফোন সংযোগ এবং নিয়মানুযায়ী সিএমএইচএ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত সেনাসদস্যদের পরিবার পরিজন যাতে নির্বিঘেœ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে সেই লক্ষ্যে সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর) মিলে উপরোক্ত কল্যাণ ও পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:৫০
false
mk
বিএনপি জামাত নজরদারিতে সরকার গভীরভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের কার্যক্রম ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। আন্দোলনের নামে দেশে কোনো ধরনের নাশকতা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। বিএনপি-জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের কর্মী, যারা আন্দোলনে দায়িত্বে থাকেন তাদের গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য আছে জামায়াত-শিবিরের আত্মগোপনে থাকা কর্মীরা নাশকতার মাধ্যমে ফের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারেন। সে কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের রাজনৈতিক কার্যালয়গুলোও কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সূত্রমতে, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন তীব্র হলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের রাজনৈতিক কৌশল আরও জোরদার করা হবে। মামলার জালে আবদ্ধ করা হবে নেতা-কর্মীদের। পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে সেগুলোর দ্রুততম সময়ে চার্জশিট দেওয়া হবে। এ ছাড়া অপেক্ষমাণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে। বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে যেসব মামলা রয়েছে তার বিচার শুরু হবে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। ইতিমধ্যে জামায়াতের সম্ভাব্য নৈরাজ্য ও নাশকতা ঠেকাতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এবং অফিস-আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। মহাসড়ক ও রেলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন রাজপথে প্রতিহত করতে ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগসহ দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। বিশেষ করে রাজধানীতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবেন সরকারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। ১৪ দলের শরিক নেতাদের সঙ্গে নিয়েও সারা দেশে সভা-সমাবেশের প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগের। সম্প্রতি ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের বৈঠকে এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলীয় নেতাদের এমন ইঙ্গিত দেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপি-জামায়াত কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করলে তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আন্দোলনের নামে নাশকতা সৃষ্টি করলে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে মোহাম্মদ নাসিম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে ১৪ দল। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, বিএনপি-জামায়াত দেশে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন আশঙ্কায় সরকার সতর্ক রয়েছে। সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা নাশকতা সৃষ্টি করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ১৪ দলের শরিক নেতা, জাসদ সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। তিনি বলেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা না হলে ষড়যন্ত্র থামবে না।সরকারকে কঠোর হাতে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য দমন করতে হবে। - See more at: Click This Link
false
ij
বাবা আলাউদ্দীন আমি এর আগে দু’জন বাঙালি সঙ্গীত পরিচালককে নিয়ে যৎসামান্য লিখেছি। একজন সলিল চৌধুরী ও অন্যজন অনন্দশঙ্কর। আজ এমন একজনকে স্মরণ করছি যিনি এক কথায় বাংলাদেশের র্গব। প্রখ্যাত সরোদবাদক আলাউদ্দীন খান। আমরা ভালোবেসে বলব বাবা আলাউদ্দীন। তাঁর শিষ্যদের নাম শুনলে গা ছমছম করে। রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দোপাধ্যায়, বসন্তরাজ, পান্নালাল ঘোষ। বাবা আলাউদ্দীনের জন্ম ১৮৬২ সালে। বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মনবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে। বাবার নাম সবদর হোসনে খান। বড় ভাই ফকরি আফতাবউদ্দীন বেহালা বাজাতেন। ছেলেবেলায় বড় ভাইয়ের কাছেই গানের হাতেখড়ি। গানের এমনই নেশা যে দশ বছর বয়েসে বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিলেন যাত্রাদলে। বাংলার লোকসঙ্গীতের অপার ঐশ্বর্যর সঙ্গে পরিচিত হলেন। তারপর এক সময় কোলকাতা পৌঁছলেন কিশোল আলাউদ্দীন। গায়ক হিসেবে তখন গোপালকৃষ্ণ ভটচাযের ভারি নামডাক। ইনি নুলু গোপাল নামেও পরিচিত। কিশোল আলাউদ্দীন তাঁকেই গুরু হিসেবে পেল। ১২ তালিম নেওয়ার শপথ করল। বিধি বাম। সাত বছর পর প্লেগ রোগে মারা গেলেন নুলু গোপাল। সেই সময়টায় কোলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দর ভারি নামডাক।তাঁরই এক ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন অমৃতলাল দত্ত। কোলকাতা স্টার থিয়েটারের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন অমৃতলাল দত্ত। আলাউদ্দীন তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করে যন্ত্রসংগীতে তালিম নিতে লাগলেন। সেই সময়টায় কন্ঠের চেয়ে যন্ত্রই বেশি টানছিল। তখন কোলকাতা ইংরেজ রাজত্বের রাজধানী। ভারতবর্ষের নানাস্থান থেকে লোকে কোলকাতায় আসত। সেরকম মিস্টার লোবো এসেছিলেন গোয়া থেকে। ভায়োলিন বাজালেন। ইউরোপের ক্ল্যাসিকাল মিউজিক সম্বন্ধে মিস্টার লোবোর কাছ থেকেই জানলেন। ভায়োলিন শিখতে শুরু করলেন। শেখার জন্য কত কিছুই না করেছিলেন বাবা আলাউদ্দীন। আর আমরা ... মুক্তাগাছার জমিদার ছিলেন জগৎ কিশোর আচার্য। তাঁর কোলকাতায় বিশাল বাড়ি ছিল। নিয়মিত গানের আসর বসত সে বাড়িতে। একদিন আলাউদ্দীন কার সঙ্গে যেন গেলেন সে বাড়িতে। সে রাতে সরোদ বাজাচ্ছিলেন আহমেদ আলী খান। আলাউদ্দীন মুগ্ধ। আসর শেষে পায়ে পড়লেন আহমেদ আলী খানের। ভালো মানুষ ছিলেন আহমেদ আলী খান। পূর্ববঙ্গে তৃষ্ণার্ত তরুনকে পায়ে ঠেললেন না। পাঁচ বছর সরোদের কঠোর সাধনা করলেন আহমদ আলীর কাছে। তারপর শুরু হল অন্য এক জীবন। রামপুর শহরটি উত্তর প্রদেশে। ওয়াজির খান বিনকার ছিলেন রামপুরের নবাবেরর দরবারের সঙ্গীতশিল্পী। স্বয়ং তানসেনের বংশধর ছিলেন ওয়াজির খান বিনকার। তানসেন সেনিয়া ঘরানা সৃষ্টি করেছিলেন। gharānā is a system of social organization linking musicians or dancers by lineage and/or apprenticeship, and by adherence to a particular musical style. A gharana also indicates a comprehensive musicological ideology. This ideology sometimes changes substantially from one gharana to another. It directly affects the thinking, teaching, performance and appreciation of music. আলাউদ্দীন সেনিয়া ঘরানার অর্ন্তভূক্ত হলেন। সেনিয়া ঘরানা ছিল উত্তরভারতের সঙ্গীতের অন্যতম কেন্দ্র। ১৯১৮। ওয়াজির খান বিনকারের কাছে তালিম শেষ। জীবিকার সন্ধানে বেরুলেন আলাউদ্দীন। মধ্যপ্রদেশের মাইহার। মহারাজা ছিলেন ব্রিজনাথ সিং। তাঁরই দরবারে কাজ জুটল। যদিও মাইহার ঘরানার সৃষ্টি উনিশ শতকে-মাইহার ঘরানার নবরুপ দান করলেন বাবা আলাউদ্দীন। তাঁকেই মাইহার ঘরানার জনক বলা হয়। This was a period of rapid change for Hindustani instrumental music, thanks not least to Khan, who infused the beenbaj and dhrupad ang, previously known from the been, surbahar (bass sitar) and sur-sringar (bass sarod), into the playing of many classical instruments. গানের আসরে সরোদ বাজালেও আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন বাবা আলাউদ্দীন। ১৯৩৫/৩৬ সালে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নৃত্যদলের সঙ্গে ইউরোপ গেলেন। শোনা যায় সেই সময় যুগোশ্লাভিয়ায় বাবার সরোদ শুনে একটি মেয়ে কেঁদে ফেলেছিল। ১৯৫২। সঙ্গীত নাটক একাডেমীর পুরস্কার পেলেন। ১৯৫৫। মাইহারে গড়ে তুললেন মাইহার কলেজ অভ মিউজিক। ১৯৫৮। এবার পেলেন পদ্মভূষন পুরস্কার। তাঁর রহস্যময় এক দিক ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন বাবা আলাউদ্দীন। যদিও জীবনভর দেবী স্বরসতীর ভজনা করেছেন। মাইহার পাহাড়ি অঞ্চল। সেরকম একটি পাহাড়ে ছিল সারদা দেবীর মন্দির। সারদা দেবী ছিলেন আসলে দেবী স্বরসতীরই এক রুপ। বাবা নিয়মিত সারদা দেবীর মন্দিরে নিয়মিত যেতেন। ওই মন্দিরের জন্যই তিনি কখনও মাইহারের বাইরে গিয়ে বাস করেননি। এমন কী হাসপাতালেও না। মরলে তিনি দেবীর কাছেই মরবেন। দূরে কোথাও না। বিয়ে করেছিলেন মদনমঞ্জরী দেবীকে। ১৮৮৮ সালে। পুত্র সন্তান একটিই। প্রখ্যাত সরোদবাদক আলী আকবর খান। তিনি মেয়ে। শাহাজিয়া, জাহানারা ও অন্নপূর্ণা। জাহানারার বিয়ের পর ওর শ্বাশুড়ি নাকি তানপুরা পুড়িয়ে ফেলেছিল। শিল্পের চেয়ে জীবন বড়। কাজেই, মেয়েদের আর তালিম দেননি। অবশ্য অন্নপূর্ণার সঙ্গীতপ্রতিভা ছিল। পরে রবিশঙ্করের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অন্নপূর্ণা। সে বিয়ে অবশ্য টেকেনি। অর্জুন ভগবতী ভীম ভুবনেশ্বরী ...প্রভৃতি রাগ সৃস্টি করেছিলেন বাবা আলাউদ্দীন। ১৯৭১ সালে পেলেন পদ্মবিভূষন খেতাব। ভারি রাগী ছিলেন বাবা। একবার নাকি মাইহারের রাজাকে তবলা টিউন করার হাতুরি ছুঁড়ে মেরেছিলেন। কেন? রাজা নাকি পঙ্গু ভিখিরিদের তেমন সাহায্য করছেন না। আসলেই ভারি রাগী ছিলেন বাবা।Nikhil Banerjee said that the tough image was "deliberately projected in order not to allow any liberty to the disciple. He always had the tension that soft treatment on his part would only spoil them". ভীষন জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল বাবার। সময় পেলেই বই পড়তেন। ১৯৭২ সালে এই অসাধারণ সঙ্গীতপ্রাণ মানুষটি আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে পাড়ি জমান। বাবার ঘরের জানালাটি দিয়ে দেখা যেত সারদা দেবী মন্দির। যে মন্দিরের জন্য বাবা কখনও মাইহার ছেড়ে যাননি। বাবার মাজার ওই মাইহারেই। কখনও সময় পেলে যাব। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৩৫
false
fe
নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত করতে না পারলে নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত করতে না পারলে ফকির ইলিয়াস========================================পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জাতি এখনও নিথর। শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানরা সুবিচার প্রার্থনা করে মানববন করেছে। সড়কে নেমে এসেছে তাদের সহপাঠীরা। সবার দাবি, ঘাতকদের দৃষ্টান্তমলক শাস্তি চাই। ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা খবর প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় দেখছি আমরা। এ পর্যন্ত কয়েকজন ডিএডিসহ বিডিআর জওয়ানদের বেশ কয়েকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেপথ্য নায়কদের সóáর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেছে কিনা তা জাতি জানছে না এখনও। এদিকে ব্যাপক তদন্তের স্বার্থে জাতীয় তদন্ত কমিটি আরও এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে। দ্রুত খুনিদের বিচার হোক­ এই দাবি আপামর মানুষের। তবে সেই সঙ্গে এর মল পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করতে চায় দেশের মানুষ। তারা জানতে চায়, কারা, কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটাল? এটা দেশবাসীর জানা, বাংলাদেশে নেপথ্যের হুকুমদাতারা অতীতেও পার পেয়েছে। তারা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যার ফলে তারা বারবার ছোবল দেয়ার সাহস পাচ্ছে এবং পেয়েই যাচ্ছে। এদের শিকড় কেন উপড়ে ফেলা হয়নি? পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, জাতির জনককে যারা সপরিবারে হত্যা করেছিল তাদের বিচার তো হয়ই নি বরং তাদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়েছিল। ইনডেমনিটি আইন করে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল। কেন করা হয়েছিল, কারা করেছিল তা দেশবাসীর সবই মনে আছে। খুনি তো খুনিই। সে রাষ্ট্রীয় মদদ পাবে কেন?হ্যাঁ, খুনিদের ব্যবহার করা হয়েছিল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। খুনিরা ব্যবহৃত হয়েছিল ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ড ঠিক আগের মতোই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার কোন দুরভিসি ছিল কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতি আশা করছে, অন্তত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটি যেন নেপথ্যের রাঘব বোয়ালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সমর্থ হয় এই আশা করব। না, এর অর্থ এই নয় সরকারি তদন্ত কমিটি তা পারবে না। তারাও পারবে। তারপরও কথা থেকে যায়, সরকারি তদন্তটি প্রধান বিরোধীদল বিএনপির শেষ পর্যন্ত পছন্দ নাও হতে পারে। তারা এটাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রচার শুরু করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কর্তৃক তদন্ত রিপোর্টটি তাদের কাছেও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে কিংবা হতে পারে বলেই আমি মনে করি। দুই.২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে বেশ জটিল বক্তব্য দিয়েছেন বেগম জিয়া। তার ভাষ্য মতে বোঝা গিয়েছিল­ তার কাছে এ বিষয়ে প্রচুর তথ্য রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেনও যদি তার কাছে কোন তথ্য থাকে তবে তা তদন্ত কমিটিকে জানানোর জন্য। খালেদা জিয়া শেষে সভা করে বলেছেন, তার কাছে কোন তথ্য নেই। এর কারণ কি? তাহলে এত বেশি বেশি কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল?মনে রাখতে হবে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যা বলা হয় তা খুব ভেবে চিন্তেই বলা দরকার। কারা ২৫ ফেব্রুয়ারির খুনি তা জানতে দেশবাসী যখন উদগ্রীব তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের এমন বক্তব্য গোটা জাতিকেই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। বেগম জিয়া আরও একটি ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন চলতি সপ্তাহে। বিএনপির শীর্ষ সিনিয়র নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর পুত্র ইরাদ সিদ্দিকী বলেছেন, মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম জিয়া নাকি ইরাদের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেছেন। বেগম জিয়া সরাসরি অর্থ চাইবেন সে বিশ্বাস আমিও করি না। তবে দল চালাতে কিংবা নির্বাচন করতে অর্থের ছড়াছড়িকে খালেদা জিয়া ঢালাওভাবে উৎসাহিত করছেন তা প্রমাণিত হয়েছে এই ঘটনার মাধ্যমে, যা একটি জাতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এই ঘটনায় বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটি চৌধুরী তানভীর সিদ্দিকীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। কারণ চৌধুরী তানভীর তার পুত্রের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে উপস্খিত ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরমভাবে ভরাডুবির পর বিএনপিতে গৃহদাহ চলছে­ তা দেশবাসীর অজানা নয়। তাই বলে এখন অনৈতিকভাবে কালো টাকার দাপটকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে হবে তা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে জামায়াত নেতারা বারবার বক্তব্য পাল্টিয়েছেন। এর আগে থেকেই তারা বলে আসছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়টি নাকি মীমাংসিত ইস্যু। জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক লন্ডনে মিডিয়াকে বলেছিলেন, ‘ওয়েট এন্ড সি’। এসব রহস্যজনক বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। এফবিআই এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। দেশী-বিদেশী তদন্ত কাজ সমন্বয় করার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে প্রধান সমন্বয়কারী নিয়োগ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বিদেশী গোয়েন্দাদের কাছ থেকে ঘটনার নমুনা, ধরন এবং ঘটনাস্খলের দরকারি তথ্য পাওয়ার সাহায্য মিললেও, নেপথ্যের গডফাদারদের সóáর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া নাও যেতে পারে। তা খুঁজে বের করতে হবে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদেরই। বাংলাদেশের মানুষের শোক শেষ না হতেই আরেকটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দু’জন সেনাকর্মকর্তা, যা খুবই বেদনাদায়ক। জাতির এই যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নেয়া খুবই কঠিন। এর মাঝে যদি ষড়যন্ত্রকারী এবং নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত না করা যায়, তবে তারা বারবারই আক্রমণ করবে। দু’চারজন চুনোপুঁটিকে ফাঁসির কাঠগড়ায় তাৎক্ষণিক দাঁড় করালেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। উপমহাদেশের চারদিকে মৌলবাদ নামক দানবটি ধেয়ে আসছে। এরা ঈদে মিলাদুন্নবীর মাহফিলেও বোমা হামলা করছে। আর কি বাকি থাকল? এদের হাতে কোন শুভশক্তিই যে নিরাপদ নয় তা বলার আর দরকার পড়ে না। এর চির অবসান চাইলে, সবাইকে দাঁড়াতেই হবে সম্মিলিতভাবে। না হয় এরা সময় সুযোগ মতো কামড় দেবে যে কাউকেই। নিউইয়র্ক, ১১ মার্চ ২০০৯--------------------------------------------------------------------দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ১৩ মার্চ ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
false
mk
আন্দোলন নিয়ে দোটানায় বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে বিএনপি দোটানায়। দলের একাংশের নেতারা চাচ্ছেন এখনই কঠোর আন্দোলনে গিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে। আর আরেক অংশ বাস্তবতার আলোকে এখনই আন্দোলন সফল করা যাবে না মনে করে আগে দল গুছিয়ে আরও সময় নিয়ে তারপর সে পথে এগুতে চায়। এ রকম পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচী প্রণয়নের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ডও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সিনিয়র নেতাদের মতামত নিতে আজ রাতে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসছে।এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমান সরকার এবং আওয়ামী লীগ যে কঠোর অবস্থানে আছে তাতে এখনই কঠোর আন্দোলনে যাওয়া এত সহজ কাজ নয়। আগে দল গুছিয়ে তার পর স্বাভাবিক কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সংগঠনমুখী করে আস্তে আস্তে আন্দোলনের দিকে যেতে হবে। দলের অপর এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, বিএনপির সামনে কঠোর আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। আন্দোলনের মাধ্যমেই নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে নির্বাচনে যেতে হবে। আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অবশ্যই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে।জানা যায়, ঈদের আগেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের ক’জন সিনিয়র নেতাকে কি ধরনের আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া যায় তার একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট নেতারা এ ব্যাপারে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রস্তাব পেশ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। কারণ আন্দোলন নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীরাই দোটানায় থাকায় খালেদা জিয়ার কাছে কি ধরনের প্রস্তাব পেশ করা যায় তা নিয়ে তাঁরা নিজেরাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন।এদিকে যখন থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা বলতে থাকেন ঠিক তখন থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারাও রাজপথে এ আন্দোলন মোকাবেলার কথা বলতে থাকেন। এ নিয়ে ক’দিন ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ চললেও তা এখন কিছুটা কমেছে। তবে সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিএনপির ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ এখনও অব্যাহত আছে। শনিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছে তা সংশোধনের জন্য বিএনপিকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না।সূত্র মতে, আজ রাতে খালেদা জিয়া বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আন্দোলনের ব্যাপারে সবার মতামত নেবেন। এর পর তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরদিন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়টি তাদের অবহিত করবেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কঠোর কোন আন্দোলন কর্মসূচী এখনই নেয়া হচ্ছে না। তবে আগাম ঘোষণার কারণে মান রক্ষা করতে গতানুগতিক কিছু আন্দোলন কর্মসূচী নেয়া হবে। এর মধ্যে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচী থাকতে পারে। এ ছাড়া ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে জাঁকজমকভাবে অন্তত ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।খোঁজ নিয়ে জানা যায় দীর্ঘদিন ধরে কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে সর্বস্তরে এবং অধিকাংশ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেরই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিল শেষে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের পর থেকেই বিএনপিতে কোন্দলসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দেয়। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাবার পর সংস্কারপন্থী কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় কোন্দল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর এর ঢেউ যেয়ে লাগে সারাদেশের সকল স্তরে। এর পর ওই বছর ৬ এপ্রিল সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করার পর দলে আরেক দফা সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক সিনিয়র নেতাকে ডিঙ্গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব করার বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারেননি কেউ কেউ। এ জন্য কোন কোন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনা করতে থাকেন। এখন আবার এ সমস্যাটি বড় হচ্ছে।৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নির্বাচন বানচালের ঘোষণা দেন বিএনপি হাইকমান্ড। কিন্তু সারাদেশে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ঢাকার রাজপথে নামতে দেখা যায়নি বিএনপির কোন সিনিয়র নেতাকেই। বরং সব নেতারা গ্রেফতার এড়াতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এ কারণে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়লে বিএনপির আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। পক্ষান্তরে বিএনপির আন্দোলনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি সমমনা দলকে নিয়ে নির্বাচন করে ফেলে এবং সরকার গঠন করে সারাবিশ্বের সমর্থনও পেয়ে যায়। এর পর বিএনপির নেতারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে আসেন।কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সিনিয়র নেতাদের প্রতি ক্ষোভ থাকায় দলীয় কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ে। তবে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে দল গোছানোর উদ্যোগ নেয় বিএনপি হাইকমান্ড। তবে তা করতে গিয়েও হোঁচট খায় বিএনপি। এ কারণে দেশব্যাপী সকল সাংগঠনিক জেলা কমিটি গোছাতে গিয়েও মাঝপথে থামিয়ে দেন খালেদা জিয়া।বর্তমানে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অধিকাংশ জেলায়ই একাধিক কমিটি রয়েছে। আবার কোন কোন জেলায় কোন কমিটিই নেই। বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেরও একই অবস্থা। এ পরিস্থতিতে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করলে এর পরিণতি কি হবে এ বিষয়টিই দলীয় হাইকমান্ডকে ভাবিয়ে তুলছে। আর এক সময় ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের আন্দোলনের ব্যাপারে যে ক্ষিপ্র গতি ছিল তাও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। জামায়াত এখন আন্দোলনের চেয়ে কৌশল প্রয়োগ করে দলের সিনিয়র নেতাদের জীবন রক্ষা করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে। তাই বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের ব্যাপারে তাদের তেমন আগ্রহ নেই।এদিকে আন্দোলন শুরুর আগেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর বিভিন্ন স্তরে গ্রুপিং কোন্দালে চাঙ্গা হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা। কিন্তু ঢাকা মহানগর বিএনপিকে আন্দোলনে সক্রিয় করার জন্য ১৮ জুলাই নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হলেও এ কমিটির নেতারা এখন নতুন করে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের অসহযোগিতার কারণে সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল কিছুই করতে পারছেন না। অপরদিকে ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে দেশের বাইরে রেখে নতুন কমিটি করায় তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ কারণে তাঁরা এখন সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। ঢাকা মহানগর বিএনপির এই বড় অংশটিকে সক্রিয় না করে বিএনপি কিভাবে আন্দোলন সফল করবে এ নিয়ে দলের মধ্যে ভাবনার শেষ নেই।ঢাকা মহানগর বিএনপির মতো দলের অন্যান্য স্তরেও একই অবস্থা। এক সময় বিএনপি আন্দোলনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল। কিন্তু ছাত্রদল এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বের কারণে এ সংগঠনটি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কোন কর্মকা- নেই। এই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলে জের ধরে গত ২ বছরে কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্রদলের কোন কোন নেতা বর্তমান কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করারও দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ড নতুন কমিটি ঘোষণার আশ্বাস দিয়েও তা ঝুলিয়ে রাখায় নতুন কমিটিতে ভাল পদের আশায় থাকা নেতারা এখন হতাশ হয়ে পড়ছেন। আর বর্তমান কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতারা মনে করছেন তারা তো বাদই পড়ে যাচ্ছেন তাই আন্দোলনের ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি?বিএনপির আরেক অঙ্গ সংগঠন যুবদলেরও অনেক দিন ধরে নতুন কমিটি হয় হয় অবস্থা। এ কারণে সংগঠনের বর্তমান এবং ভবিষ্যত নেতারা এখনই আন্দোলনের দিকে যেতে চাচ্ছেন না। তারা আগে সংগঠনের পদ-পদবি পেয়ে পরে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে চায়। এ ছাড়া এ সংগঠনের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরবের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় এ দ্বন্দ্ব সারাদেশের সর্বস্তরে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় এ সংগঠনটি আন্দোলনের জন্য অপ্রস্তুত রয়েছে। বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। এসব সংগঠনের নেতারা এখন সাংগঠনিক কাজ বাদ দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে বিএনপি হাইকমান্ডকে ম্যানেজ করে পদ রক্ষা করে চলছেন। তাই বিএনপি এখনই আন্দোলনে গেলে তারা সবাই আগের মতো গা বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
false
ij
কার্ল গুস্তাফ য়ুং_ লোকোত্তর এক বিশ্বঅবচেতনার সাধক সুইস মনস্তাত্ত্বিক কার্ল গুস্তাফ য়ুং। য়ুং -এর মনের গড়ন ছিল মরমী। সে জন্যই আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সঙ্গে ভাববাদী প্রাচ্যের দার্শনিক নীতির যেমন সমন্বয় করেছেন য়ুং-তেমনি প্রাচীন গ্রিসের পিথাগোরাসের মরমী চিন্তাধারাও তাঁর জীবনদর্শনে লক্ষ্য করা গেছে। মরমী বলেই য়ুং জীবনভর স্বোচ্চার ছিলেন অতিমাত্রার বস্তুবাদী যুক্তিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অত্যধিক যুক্তিবাদের চর্চা যে ইউরোপের মানুষের মনকে ক্লান্ত করে ফেলবে য়ুং তা তাঁর জীবদ্দশায় বুঝেছিলেন। তাই হয়েছে কিন্তু। তবে মনের গড়নে মরমী ধাঁচের বলেই জীবদ্দশায় কোণঠাসা ছিলেন য়ুং। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে মনস্তত্ত্বের নামে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রচারের। অধিকন্তু, য়ুং-এর পদ্ধতিটি বিষয়ী বা সাবজেটিভ বলেই পদ্ধতিটির ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদিও বাস্তবিকভাবে কার্যকর, তথাপি মনোবিদ্যা আজও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো নৈব্যার্ক্তিক হয়ে উঠল না। সে যাই হোক না কেন-যে ক’জন চিন্তাবিদ মনোবিদ্যাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন- য়ুং তাদের মধ্যে অন্যতম। য়ুংবাদী মনোবিদ্যা চর্চার ফলে মানবচরিত্র উপলব্দির ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্লেষনধর্মী মনোবিদ্যার ক্ষেত্রে একজন মহৎ পথিকৃৎ য়ুং । প্রচুর লিখেছেন। ‘ম্যান অ্যান্ড হিজ সিম্বল’; ‘মেমোরিজ ড্রিমস রিফ্লেকশন’ ইত্যাদি তাঁর বহুল পঠিত গ্রন্থ। ১৯১২ সালে প্রকাশ করেন ‘সাইকোলজি অভ দ্য আনকনশাস’ নামে বিখ্যাত বইটি। কার্ল গুস্তাফ য়ুং-এর জন্ম ১৮৭৫ সালের ২৬ জুলাই। সুইজারল্যান্ডের কেসউইল-এ । বাবা ছিলেন ধর্ম যাজক। নিঃসঙ্গ বালকবয়েসে স্বপ্ন নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন য়ুং। যে অভ্যেসটি তাঁর বড় বয়েসের কাজকে প্রভাবিত করেছিল। জুরিখের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় পাস করেন ১৯০২ সালে। জীববিদ্যা প্রাণিবিদ্যা ফসিলবিদ্যা প্রতœতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন য়ুং। মানবচরিত্র সম্বন্ধে উৎসুক ছিলেন-কাজেই সে জ্ঞান পুঁজি করে মানসিক রোগীদের রোগ নিরাময়ে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। মানসিক রোগীদের মধ্যে শব্দের অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু করেন-কেন বিশেষ বিশেষ শব্দে বিশেষ বিশেষ রোগী তাড়িত হয়ে ওঠে। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করার সময়েই ফ্রয়েডের সঙ্গে পরিচিত হন য়ুং; কিছুদিন ফ্রয়েডের ছাত্রও ছিলেন। তবে মতের মিল হয়নি ফ্রয়েডের সঙ্গে। দু’জনের কেবল বচসা হত। একবার য়ুং এত জোরে চিৎকার করেছিলেন-ফ্রয়েড মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন! ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতিতে অবদমিত যৌনতার ভূমিকাকে অত্যন্ত সংর্কীন মনে করতেন য়ুং- যে কারণে পরে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষনের বিরোধী তত্ত্ব উপস্থাপন করেন য়ুং । তিনি মনে করতেন: মনের বিচিত্র গঠনের সঙ্গে লোকসমাজের প্রাচীন উপকথা ও মানুষের নিজেকে প্রকাশ (শিল্পচর্চা কিংবা নির্বাচনে দাঁড়ানো) করার তাগিদ ঘনিষ্ট ভাবে সংশ্লিস্ট । বিশ্বজুড়ে শিল্পীসাহিত্যিকদের মধ্যে য়ুং-এর তুমুল জনপ্রিয়তার এইই মূল কারণ। মনস্তত্ত্বকে তিনি ফ্রয়েডের চেয়েও শিল্পীসাহিত্যিকদের কাছে আগ্রহের বিষয় করে তুলেছেন। আজ আমরা যে এত ‘প্রতীক’ শব্দটি শুনি-কার জন্য? মানবচৈতন্যকে তিনভাগে ভাগ করেছেন য়ুং। ক) অহং বা ইগো। খ) দি পারসোনাল আনকনশাস এবং গ) দি কালেকটিভ আনকনশাস বা যৌথ অবচেতনা। ধর্মদর্শন ও উপকথা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনার ফলে তাঁর মনে হয়েছে: এক লোকোত্তর বিশ্বঅবচেতনা নিজেকে প্রতীকের মাধমে প্রকাশ করতে চায় -যে ইচ্ছেটি স্বপ্ন, মরমীবাদ ও ধর্মে প্রতিফলিত হয়। এই জায়গায় য়ুং প্রাচ্যের মরমীবোধকে সযতেœ লালন করেছেন। এই জায়গায় তিনি লালনের খুব কাছে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। লালনের অচিন পাখিটি প্রতীক- প্রতীক লোকোত্তর এক বিশ্বঅবচেতনার। য়ুং যাকে জীবনভর বোঝার চেষ্টা করেছেন। সে বোঝার পথে পাশ্চাত্যের মহৎ অর্জন যুক্তিবোধ বাধা হয়ে দাঁড়লে তিনি অবলীলায় সেই যুক্তিবোধকে বিসর্জন দিয়েছেন। য়ুং-এর যৌথঅবচেতনার ধারনাটি বিস্ময়কর। এই ধারনা ব্যতীত লোকসমাজের তাৎপর্য অনুধাবন সম্ভব নয়। আমরা যে বলি, ‘আবহমান বাংলা’-সেও এক ধরনের য়ুংবাদী যৌথঅবচেতনা। আর্কিটাইপের ধারনাটিও য়ুংবাদী মনোবিদ্যায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। য়ুং-এর যৌথঅবচেতনার ধারনাটি তাঁর আর্কিটাইপ ধারনার সঙ্গে সংশ্লিস্ট। যৌথঅবচেতনা নির্ধারন করে দেয় যে মানবীয় অভিজ্ঞতা বিশেষ সাংগঠনিক নীতি দ্বারা নির্ধারিত। এই বিশেষ সাংগঠনিক নীতিই হল আর্কিটাইপ। য়ুং-এর মতে অনেক ধরনের আর্কিটাইপ হতে পারে। জীবন ও আচরণকে প্রভাবিত করে এমন কতগুলি আর্কিটাইপ নির্ধারণ করেছেন য়ুং। যেমন, মাদার আর্কিটাইপ। মানুষের জীবনে মায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। য়ুং-এর মাদার আর্কিটাইপের ধারনাটি অবশ্য তার চেয়েও বেশি কিছু। মাদার আর্কিটাইপ আসলে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা। য়ুং বলেছেন, আমরা আমাদের জীবনের দুর্যোগের সময়ে মমতা ও পরিষেবা আশা করি এবং আমাদের এ আকাঙ্খাটির পিছনে রয়েছে বিবর্তন । আমাদের জীবনের দুর্যোগের সময়ে আমরা প্রবল রক্ষাকর্ত্রী একজন মাকে খুঁজি। আমাদের চাহিদাগুলি মেটানোর দায়িত্ব মায়ের ওপরই প্রথমে বর্তায়। কিন্তু, যখন (আর্কিটাইপ) মা তার ভূমিকাটি ঠিক মতো পালন করতে পারে না- তখনই মানুষ হয়ে ওঠে মনোরোগী। মনোরোগীর আচরণে সে বিকার ফুটে ওঠে । আর্কিটাইপ মা স্নেহময়ী ভূমিকা পালন না করলে মায়ের বিকল্প ধর্ম কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদে খোঁজে মানুষ! (কাজেই, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক উগ্রবাদীদের উগ্রবাদী হয়ে ওঠার একটা কারণ জানা গেল! সিরিয়াল কিলারদের সম্বন্ধেও আমার ধারনা ঐ একই কারণ বিদ্যমান।) মনোবিদ্যায় য়ুং-এর অন্য একটি বিশেষ অবদান হল-ব্যাক্তিত্বের ধরণ বা পার্সোনালিটি টাইপ। য়ুং মনে করতেন, মানবীয় মূল ব্যাক্তিত্বের ধরণ প্রধানত দুরকম। ক) ইনট্রোভার্ট বা অর্ন্তমুখি। ও খ) এক্সট্রোভার্ট বা বর্হিঃমুখি। সাধারনত ইন্ট্রোভার্টরা লাজুক ও এক্সট্রোভার্টরা মিশুক হয়ে থাকে। তবে য়ুং-এর ব্যাখ্যা আরও নিগূঢ় ও গভীর তাৎপর্যপূর্ন। য়ুং-এর মতে: অর্ন্তমূখির অহং বা ইগো শ্বাশত নির্জ্ঞানের দিকে যায়। অপরদিকে বর্হিমূখির সত্তা বাহ্যিক বাস্তবতা নিয়ে বেশি উৎসাহী ও বাইরের কাজকর্মের দিকে বেশি উৎসুক। ব্যাক্তিত্বের এই পার্থক্য মানবসত্তায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আসলে সত্ত্বাই হল প্রধান আর্কিটাইপ। যে নীতি দ্বারা আমরা আমাদের জীবনকে পরিচালনা করি। সত্তা অনবরত উন্নতির প্রক্রিয়ায় থাকে। আমাদের ব্যাক্তিত্বের সব দিক প্রকাশিত হলেই তবে সত্তাকে বোঝা যায়। কাজেই চরম অর্ন্তমূখিনতা ও চরম বহিঃমূর্খিনতা হচ্ছে সত্তার বিকাশের প্রাথমিক ধাপমাত্র। স্বাভাবিক বিকাশ হলেই তবে দুটো পরস্পরবিরোধী ধারার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা পায়। অবশ্য, য়ুং-এর মতে, মৃত্যু ব্যতীত সত্তার পূর্ন উদ্বোধন সম্ভব নয়! কথাটি ঠিক যুক্তিযুক্ত নয়। তখন বলছিলাম, লোকোত্তর এক বিশ্বঅবচেতনার সাধক য়ুং ... যাকে জীবনভর বোঝার চেষ্টা করেছেন। সে বোঝার পথে পাশ্চাত্যের যুক্তিবোধ বাধা হয়ে দাঁড়লে অবলীলায় সেই যুক্তিবোধকে বিসর্জন দিয়েছেন। সূত্র: ফিলিপ স্টোকস রচিত, 'ফিলসফি: ওয়ান হানড্রেড অ্যাসেনসিয়াল থিঙ্কারস।' সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩০
false
rg
দৈনিক সমকালের সাংবাদিকতা!! সংবাদের হেডলাইন: বিশ্বের দীর্ঘতম রেল সুড়ঙ্গের উদ্বোধনে 'নগ্ন' নাচ!নিউজের ভেতরের অংশটি এরকম-''বিশ্বের দীর্ঘতম রেল সুড়ঙ্গ। সুইত্জারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার বুক চিরে তৈরি হয়েছে সেই সুড়ঙ্গ। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গটি আল্পসের সেন্ট্রাল ক্যান্টন থেকে টিকিনো ক্যান্টন পর্যন্ত বিস্তৃত। যার ফলে অনেকটাই কমবে জুরিখ থেকে মিউনিখ পর্যন্ত রেলযাত্রার সময়। ১৯৯৯ থেকে কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ সময় পর বুধবার সেই সুড়ঙ্গের উদ্বোধন হয়। এদিকে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই দেখা দিয়েছে বিতর্ক।বলা হচ্ছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি এক এক জায়গায় শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আয়োজকদের উদ্দেশ্য ছিল, দীর্ঘ ১৭ বছর সময়ে যে মারাত্মক পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন ইঞ্জিনিয়ার থেকে শ্রমিকরা সেটাই তুলে ধরা। কিন্তু ৬০০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আদতে হাস্যকর ও অশ্লীল ছাড়া কিছু নয় বলে মত অনেকের। ''কিন্তু সমকাল পত্রিকা তাদের ফেসবুক পাতায় এই সংবাদটি অত্যন্ত কৌশলে ভাইরাল করার জন্য হেডলাইনের ডানপাশে ব্রাকেটে 'ভিডিও সহ' কথাটি যুক্ত করে দেয়। সমকালের অনলাইন ভার্সনে এই সংবাদটির সঙ্গে ভিডিওটি আছে। ভিডিওটি দেখে কোথাও নগ্নতার দোষ চাপানো যায় না। অথচ পত্রিকাটি সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার আশায় এটাকে ফেসবুকে ভাইরাল করার জন্য এবং ফেসবুকে নিজেদের পাঠকসংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভণ্ডামি করেছে, এটি কোন ধরনের সাংবাদিকতা?ওই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। ভিডিওটি দেখে এটাকে কিছুতেই সমকালের ভাষার মত নগ্ন মনে হয়নি। অথচ একটু বাড়তি প্রচার পাবার আশায় পত্রিকাটি যে নিজেই নগ্নতার আশ্রয় নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত তৈরি করলো, এই দায় কী সমকাল পত্রিকা এড়াতে পারে? এই কাজটি বাংলাদেশের প্রায় সকল দৈনিক করে থাকে। ফেসবুক পাতায় সংবাদের হেডলাইনের পাশে লিখে দেয় ভিডিওসহ। পাঠক আকর্ষন করার এই সস্তা কৌশলটি মোটেও গ্রহনযোগ্য নয়। একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিককে ফেসবুকে এমন কাঙালিপনা শোভা পায় না। এগুলো অনলাইন নিউজপোর্টাল করলেও দেশের প্রথম শ্রেণীর একটি দৈনিকের এমন নগ্নতা মানায় না। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে কত কিসিমের যে ভণ্ডামি চলছে, এটা আমরা যারা ডিজিটাল বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের চোখ এড়ায় না। আমি সমকাল পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে এ ধরনের নিউজ ভাইরাল করার সস্তা কৌশল এড়ানোর আহবান জানাই। পাশাপাশি নিজেদের নগ্নতা আড়াল করারও পরামর্শ দেই। ওই পত্রিকায় আমার অনেক বন্ধু আছেন। তাদেরও এটি দেখে লজ্বা পাবার কথা! একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিককে এত দেউলিয়াত্ব মানায় না। ...................................৩ জুন ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ ভোর ৬:২৩
false
mk
অস্থিরতায়ও রিজার্ভ রেকর্ড দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ আবারও নতুন রেকর্ডে বা উচ্চতায় অবস্থান নিয়েছে। রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে ২ হাজার ৩০৩ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণে উন্নীত হয়। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে দেশের সাত মাসেরও অধিক সময়ের আমদানি দায় মেটানো যাবে।বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেকে নেমে আসা এবং দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিনিয়োগ আটকে পড়ায় রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।এর আগে গত বছরের ৭ আগস্ট দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। তার আগে ১৬ জুন ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার এবং ১০ এপ্রিল ২ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। আর তারও ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার।সার্কভুক্ত দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়তে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুসারে ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের রিজার্ভ ছিল ৩৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এর পরই বাংলাদেশ। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুসারে ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন মূলত, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বানানি তেলের দাম অর্ধেকে নেমে আসায় ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। তার সঙ্গে চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি হয়েছে।রিজার্ভ বৃদ্ধির আরেক অন্যতম কারণ হচ্ছে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ আটকে পড়েছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে বেসরকারি খাত প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের যে ঋণ এনেছে, এতেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর থেকে চাপ কমেছে।বিদেশি মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছেই পর্যাপ্ত ডলার রয়েছে। কারও কারও সংরক্ষণসীমাও অতিক্রম করছে। তারা ডলার বিক্রিও করছে। কিন্তু ক্রেতা কম। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ম অনুসারে ডলার কিনতে হয়েছে ব্যাংকের কাছ থেকে। তবে ২০১৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর সময়ে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তখন উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রিও করে।কয়েক বছর আগে এ পরিস্থিতি ছিল না। তখন ডলারের জন্য হাহাকার ছিল। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি করতে ডলার জোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নানা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আসছিল। আইডিবির কাছ থেকে শেষমেশ একটা বড় সহায়তা মেলে। যে পরিমাণ অর্থ জ্বালানি কিনতে ব্যয় হবে আইডিবি তা পরিশোধ করবে। আর ছয় থেকে নয় মাস পর তা পরিশোধ করা হবে।আবার সমসাময়িক সময়ে সার্বিক বৈদেশিক বিনিময় পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকেও সরকার ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। যার পাঁচটি কিস্তির অর্থ ইতিমধ্যেই রিজার্ভে এসে জমা হয়েছে।কিন্তু এখন কেউ আর ডলার চায় না। যে সময়টা ডলারের জন্য হাহাকার ছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছিল হু হু করে। একই সঙ্গে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর একটা তোড়জোড় পড়ে য়ায়। যার চাপ গিয়ে পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের চাহিদাও বাড়ে। যার জোগান দিতেও বেশি আমদানি করতে হয় বিপিসিকে। এখন তার পরিমাণ না কমলেও বৃদ্ধির হার নেই।সব মিলে সার্বিক আমদানি ব্যয় কমেছে। ব্যয় কমেছে দুভাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য কমে যাওয়ায় আমদানি কমেছে, আবার পরিমাণেও কমেছে আমদানি। আবার দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যপণ্য আমদানি কমে গেছে।অবশ্য তার পরও আমদানি ব্যয়ের জন্য আগামী সপ্তাহে রেকর্ড পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) কাজী ছাইদুর রহমান রিজার্ভ বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানিতে একটা প্রবৃদ্ধি আছে। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমেছে। খাদ্যপণ্য আমদানিও নেই। এখন যা আমদানি হচ্ছে তা প্রকৃত চাহিদা। এতে রিজার্ভ বাড়ছে।
false
hm
চাহিদাপত্র ১. মকবুল স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে পর্যবেক্ষণ ডেস্ক থেকে উঠে পড়লো। তার মাথা টিপটিপ করে ব‌্যথা করছে, শরীরের কোষগুলো একটু পর পর যেন বিড়বিড় করে বলছে, এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। নভোতরী "টিম্বাকটু" একটা ছোটো স্কাউটশিপ, সর্বোচ্চ চারজন নভোনাবিকের জন্যে তৈরি করা। কিন্তু মকবুলের মিশন সঙ্গীবিহীন। শুধু সঙ্গীবিহীনই নয়, ফেলে আসা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগবিহীনও। আরও তিন বছর তাকে কাটাতে হবে টিম্বাকটুতে। প্রশিক্ষণের সময় নভোমনোবিদ মেয়েটা অবশ্য মকবুলকে পরামর্শ দিয়েছিলো নিজের সাথে কথা বলার। তা নইলে কীসব নাকি সমস্যা হতে পারে। মকবুল বিড়বিড় করে নভোমনোবিদ মার্থা তিশিয়ানোকে কিছু বাছা বাছা বাজে গালি দিলো। শালি কোনো কাজের পরামর্শ দিতে পারেনি। "টয়লেট সেরে পেছন মুছতে ভুলো না", "পানি বুঝেশুনে খরচ কোরো" গোছের ফালতু সব পরামর্শ দিয়ে গেছে প্রশিক্ষণের সময়টা। নিজের সাথে কথা বলতে হবে, এটা কী এমন বিশেষজ্ঞের দাওয়াই? অবশ্য কী-ই বা বলবে বেচারী? খুব বেশি তথ্য তার বা তার মুরুব্বিদের হাতে এসে জমা হয়নি। পুরোনো নভোযাত্রীদের সঙ্কটের সাথে মকবুলের মতো পেশার মানুষদের সঙ্কটের কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। তারা কী সমস্যায় পড়ে, কীভাবে সে সমস্যা কমিয়ে আনা যায় বা সমাধান করা যায়, সেগুলো নিয়ে আরো বিশদ তথ্য জমা হবে যখন মকবুল ও তার সহকর্মীরা একে একে ফিরে যাবে পৃথিবীতে (যদি আদৌ ফিরতে পারে), নভোকেন্দ্রের কোনো এক অবকাশ কুটিরে বসে মার্থা বা তার কোনো সহকর্মীর কাছে ঝাড়া তিন মাস ধরে একগাদা নোটস নিয়ে বসবে, তারপর। মকবুলের সহপ্রশিক্ষণার্থী লিওনিদ একদিন ক্যাফেটিরিয়ায় আলুর চপ খেতে খেতে বলছিলো, ওরা নির্জন কারাবাসে দণ্ডিত অপরাধীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ট্রেনিং কর্পাস তৈরি করেছে। লিওনিদ খুব স্বল্পবাক মানুষ ছিলো বলে কেউ চট করে তার কথা ফেলে দিতে পারতো না, আর কথাটাও মোটামুটি বিশ্বাস্য, তবুও সেদিন মকবুলের ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এক অর্থে তো নির্জন কারাবাসেই যেতে হচ্ছে তাদের সবাইকে। নিঃসীম মহাশূন্যে মানবজাতির সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া একটা বড় সময় কাটাতে হবে এক ছোট্টো ধাতব কুঠুরির ভেতরে। মহাকাশে টানা দশ বছরের ডিউটি! একা! কফির কাপটা জীবাণু মুক্ত করার হিটার থেকে সাবধানে বার করে কফি মেশিনের নিচে পেতে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো মকবুল, "রোসিও ... রোসিও ... রোসিও ... ।" যে নীলচে ধূসর গ্রহটাকে ঘিরে টিম্বাকটু তার কক্ষপথে পাক খাচ্ছে, সেটার পোশাকি নাম অনেক বড়, কিন্তু প্রকল্প শুরুর সময় একটা ডাকনাম দেয়া হয়। এটা নিশ্চয়ই কোনো স্প্যানিশ ভাষাভাষীর রাখা। স্প্যানিশে রোসিও অর্থ শিশির। পরিচিত, একঘেয়ে, কিন্তু মনকে চাঙা করে তোলা গন্ধ নিয়ে কাপের ভেতরে সঞ্চিত হতে লাগলো কালো কফি, সে অবকাশে মকবুল মনে মনে গ্রহটার নাম যে রেখেছে, তার সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য অনুমান করার চেষ্টা করতে লাগলো। নীলচে ছাইয়ের গোলকের মতো একটা গ্রহকে শিশির নাম দেয়ার মতো রোমান্টিক মন আছে তার, হয়তো সে লাঞ্চ ব্রেকে কবিতা লিখতো। হয়তো পাবলো নেরুদার ছবি আঁকা টিশার্ট পরে সে অফিসে ফাইলে মাউস পিষতো। নাম রাখার সুযোগ যারা পায় তারা মোটামুটি উচ্চপদস্থ, হয়তো মকবুল যখন রোসিওকে ঘিরে একাধিক কক্ষপথে টিম্বাকটুকে পাক খাওয়ানোর কাজে গলদঘর্ম তখন পৃথিবীতে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা দেয়ার সময় প্রজেক্টরে রোসিওর কিছু বিশদানুভাগ ছবি দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় আবেগমথিত কিছু বুকনি ঝেড়ে বেড়াচ্ছে সে এখনও। এবং এখনও হয়তো সে রোসিওর মতো আরো কয়েকটি গ্রহের নাম স্প্যানিশ ভাষায় রেখে বেড়াচ্ছে। জেলখানার এতো সুন্দর নাম রেখে কী লাভ? কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে আরও ভাবতে লাগলো মকবুল। নামটা যে রেখেছে, সে কি ছেলে, না মেয়ে? যদি মেয়ে হয়, তাহলে সে দেখতে কেমন? প্রকল্প পরিচালনা পর্ষদের সদস্য না হলে গ্রহের নাম প্রস্তাবের সুযোগ থাকার কথা নয়। প্রকল্প পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে গেলে অনেক অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, কাজেই মেয়ে নয়, সে হবে মহিলা। বয়স কমসেকম চল্লিশ ... । মকবুলের কল্পনার তেল অনেকখানি উবে গেলো। ধুর। চারদিকে শুধু বুড়ি। নভোমনোবিদ মার্থা তিশিয়ানো ছাড়া গত দশ বছরে কোনো যুবতীর সাথে যোগাযোগেরই সুযোগ হয়নি তার। এর আগে যে জেলখানা, মানে, যে গ্রহটায় তার নামতে হয়েছিলো, এমনকি সেখানেও কোনো যুবতী মেয়ে ছিলো না। কেবল কয়েকটা বুড়ি আর তাদের নাতনি পিচকা কতগুলি বাচ্চা মেয়ে, আর কিছু ভয়ানক ক্ষ্যাপা পুরুষ কয়েদী ছিলো করবীতে। করবী নামটা মকবুলের অবশ্য বেশ পছন্দ হয়েছিলো। কে জানে, বাঙালি কারো রাখাই হয়তো, করবী ফুলের নামে। গ্রহটা মঙ্গলের মতোই ম্যাড়ম্যাড়ে লাল, করবী ফুলের নামে তার নাম রাখার অর্থ, যে ঐ নাম রেখেছে, তার কল্পনাশক্তির দৌড় সাংঘাতিক। মকবুল কফির কাপে চুমুক দিয়ে কোনো তন্বী বাঙালিনীর কথা ভাবার চেষ্টা করলো, যে নভোকেন্দ্রের বহির্গ্রহ অভিবাসন কর্মসূচির নভোকারাগার প্রকল্পে কাজ করে, যার বয়স কোনোমতেই চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়, যে নিজের কালো চুল আঙুলে জড়াতে জড়াতে একটা মহা কুৎসিত লাল গ্রহের নাম করবী রাখার কথা ভাবে, এবং যার বুকের মাপ কমপক্ষে চৌত্রিশ, সি কাপ হলে ভালো হয়। মকবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে একটা জোরালো চুমুক দিলো। কল্পনার জগতে ঘুরে ফিরে চৌত্রিশ ইঞ্চি ব্যাপারটা চলে আসছে, বছর তিনেক হলো। মার্থা তিশিয়ানো অবশ্য এ ব্যাপারে তাদের অনেক সবক দিয়েছে। খামাখাই। মেয়েটা এমন কিছুই তাদের শেখাতে পারেনি, যা মকবুল বা তার সহকর্মীরা আগে থেকে জানে না বা নিজে থেকে ভেবে বার করতে পারবে না। খামাখাই নভোকেন্দ্রে বসে বসে বেতন খাচ্ছে শালি। এরচেয়ে মকবুলের সাথে তাকে এই মিশনে পাঠালেও ভালো হতো। নভোমিশন সম্পর্কে হাতেকলমে নানা তথ্য-তত্ত্ব নিয়ে ফিরে একটা বই লিখতে পারতো, মকবুলের সময়টাও ভালো কেটে যেতো। মকবুল কফির কাপটা খালি করে ভাবে, পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে সে মার্থাকে কোনো এক সন্ধ্যায় নিমন্ত্রণ করবে নিজের বাড়িতে। কাঁচকি মাছের ঝাল চচ্চড়ি, চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁইশাক, হালকা ভাজা ইলিশ মাছ আর ভাঁপ ওঠা লাল চালের ভাত খাওয়াবে, ভালো ভিনটেজের সাদা ওয়াইনসহ। তারপর ভোর পর্যন্ত খাবার ঘর, শোবার ঘর আর স্নানঘরে ... । পর্যবেক্ষণ ডেস্ক থেকে মৃদু কিন্তু মনোযোগাকর্ষী একটা শব্দ মকবুলকে আবার ফিরিয়ে আনলো নিমেষে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মকবুল কফির কাপটা কয়েক আউন্স পানিতে ধুয়ে ঢুকিয়ে দিলো অটোক্লেভে। সব জীবাণুর মৃত্যু হোক, নিঃসঙ্গতার জীবাণুসহ। মার্থা তিশিয়ানো, রোসো, আসছি আমি কাজকাম সেরে। টিম্বাকটুর কেন্দ্রীয় কম্পিউটার মৌখিক আদেশ শুনেই কাজ করতে পারে, কিন্তু মকবুল যন্ত্রের সাথে কথা বলা পছন্দ করেনি কখনোই, সে বরাবরই কম্পিউটারের "কান" বন্ধ করে রাখে। যদিও সে জানে, তার অনেক তথ্যই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লগড হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রটার ব্ল্যাকবক্সে, তারপরও বাড়তি কোনো কিছু যোগাতে সে নারাজ। মকবুল প্রায়ই একা একা কথা বলে, নিজের সাথে ঝগড়া করে, মোটামুটি সুর-লয় রেখে মাউথ অর্গান বাজায়, পর্নো দেখে স্বমেহন করে এবং বেশ উচ্চগ্রামে নভোকেন্দ্রের কয়েকজন পরিচালকের মায়ের সাথে যৌন সংসর্গের প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করে। এসব তথ্য শেষমেশ পড়বে মার্থা তিশিয়ানোর হাতে। কী দরকার? মার্থার হাতে যদি কিছু দিতেই হয়, মকবুলের কাছে ঐসব তথ্যের চেয়ে উপযুক্ত একটা কিছু আছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ ডেস্কের নীল বিকনটা জ্বলছে নিভছে। এর অর্থ, কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার "কান" খুলেছে। ইমার্জেন্সি। "কী ব্যাপার?" মকবুল খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করলো। একটা যান্ত্রিক পুরুষ কণ্ঠ একঘেয়ে সুরে বললো, "কোনো প্রত্যুত্তর আসেনি। সর্বমোট বারো ঘন্টা দুই মিনিট ধরে চেষ্টা করা হয়েছে।" "মানে কী?" মকবুল মানে ভালো করেই জানে, কিন্তু তারপরও প্রশ্নটা এসে গেলো তার মুখে। "অপর প্রান্তের যোগাযোগ মডিউল বিকল।" মকবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইলো, "আর কিছু?" "আরেকটি সম্ভাবনা আছে কমাণ্ডার।" মকবুলের মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করলো। আরেকটা সম্ভাবনা থাকলে সেটা বলে ফ্যাল না ছাগল কোথাকার। খালি নাটক। "কী সম্ভাবনা?" "অপর প্রান্তের যোগাযোগ মডিউল সচল, কিন্তু তারা যোগাযোগে সাড়া দিতে অনিচ্ছুক।" মকবুল চোখ বন্ধ করে সম্ভাবনাটা উল্টেপাল্টে দেখলো কয়েক সেকেণ্ড, তারপর জানতে চাইলো, "আর কী তথ্য আছে?" "আর কোনো তথ্য নেই, কমাণ্ডার।" "মৌখিক যোগাযোগ নিষ্ক্রিয় করা হোক।" মৃদু একটা গুঞ্জন করে বন্ধ হয়ে গেলো কম্পিউটারের স্পিকার। মকবুল হাতের তালুতে ঘাড় ডলতে ডলতে পায়চারি করতে লাগলো পর্যবেক্ষণ বে-র সীমিত জায়গাটুকুতে। টিম্বাকটু একটা অক্ষকে ঘিরে পাক খাচ্ছে বলে মৃদু এক কৃত্রিম অভিকর্ষ কাজ করে এর বাসোপযোগী অংশতে, তবে তা পৃথিবীর তুলনায় নিতান্তই ক্ষীণ। তাই মকবুলের হাঁটাচলার ভঙ্গি অনেকটা পাল্টে গেছে গত সাত বছরে। বিশেষ প্রেশার স্যুট পরে না থাকলে এই সাত বছরে তার হাড় আর পেশীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো। সেসব থেকে রক্ষা পেলেও নাচুনে লিমারের মতো ভঙ্গি অভ্যাস হয়ে যাবার হাত থেকে রেহাই মেলেনি তার। একজন পুলিশের পক্ষে এমন ভঙ্গি রপ্ত করা ঠিক শোভন নয়। বেলা শেষে মকবুলের পরিচয় এটাই, সে একজন ঠোলা। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পরই পুলিশ একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলো মকবুল, নভোপুলিশ হওয়ার প্রবল বাসনা নিয়ে। সারা পৃথিবী থেকে হাতে গোনা কয়েকশো মানুষ নভোপুলিশ হওয়ার সুযোগ পায়, মকবুল শেষ পর্যন্ত সেই দলে টিকে গেছে। নিজের মেধা নিয়ে তেমন আস্থা তার ছিলো না, কিন্তু নিজের উদ্যম সম্পর্কে মকবুল বরাবরই আস্থাবান। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে ধাপে ধাপে সে উঠে এসে যোগ দিতে পেরেছে নভোপুলিশ ব্যাটেলিয়নে। আকর্ষণীয় কিন্তু বিপদজনক একটা পেশা, যাতে মধ্যযৌবনেই বেশ বড়সড় অঙ্কের পেনশন নিয়ে অবসরে যাওয়া যায়, নিরিবিলি উপভোগ করা যায় বাকিটা জীবন। মকবুলের লক্ষ্যও সেটাই। পুলিশ একাডেমিতে লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ আর নভোকেন্দ্রের অধীনে আরো কয়েক বছর কঠোর মগজ ও শরীর ধোলাইয়ের পর মাত্র এগারো বছর কাজ করতে হবে তাকে। তারপর সে ঘিঞ্জি লোকগিজগিজ পৃথিবীর একটু নির্জন কোনো এক দেশে নিরিবিলি একটা বাড়ি কিনে মাছ ধরে আর বই পড়ে আর সাঁতার কেটে কাটিয়ে দেবে বাকিটা জীবন, যেখানে বাকি পৃথিবীর লোককে মৌলিক চাহিদার সংস্থান করতে গিয়ে বছরভর বেদম খাটতে হচ্ছে ষাট-সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত। ঐ পুরস্কার পাওয়ার জন্যে জীবনের শ্রেষ্ঠ দশটা বছর একা একা মহাকাশে চক্কর কেটে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেনি মকবুল। পৃথিবীর জীবন সে খুব ভালো করেই দেখেছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সবার ধারণা ছিলো, কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবনের মূল্য বাড়িয়ে তোলা যাবে মানবসমাজের কাছে, বিজ্ঞান সেই পথ করে দেবে, প্রযুক্তি সেই সুযোগ করে দেবে। কিন্তু তা ঘটেনি। টানা এগারো বছর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলার পর পৃথিবী আরও কঠিন, নির্মম, কর্কশ একটি গ্রহ হয়ে উঠেছে কেবল। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মানুষকে আরো মানবিক করে তুলতে পারেনি এখনও। তবে বিজ্ঞানকে দোষ দেয়াদের দলে মকবুল নেই। সম্পূর্ণ নতুন সব দরজা খুলে গেছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। মকবুল যেমন কয়েক লক্ষ আলোকবছর দূরের ছায়াপথে গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা পৃথিবীতে ফিরে যাবার আশাটুকু বুকে নিয়ে। না, কয়েক লক্ষ বছর পরের পৃথিবীতে নয়, মকবুল ফিরতে পারবে ঠিক তার ফেলে আসা পৃথিবীর বয়স দশ বছর গড়ানোর পরই। মহাশূন্যের অলঙ্ঘ্য দূরত্বের প্রাচীরটুকু মানুষ চুরমার করে দিতে পেরেছে। মকবুলের দুঃখ হয় এগারো বছরে নিহত আঠারো কোটি মানুষের জন্যে। লোকগুলো জানতে পারলো না, কী বিশাল নতুন জগতের দুয়ার অর্গল খুলে মেলে ধরেছে মানুষ। মকবুল নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা নষ্ট হতে দেয়নি। তুলনারহিত নিঃসঙ্গতার পরও সে জানে, সে কাজ করে যাচ্ছে আগামীর পৃথিবীর জন্যে। মকবুল ফিরে যাবার পর তার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে নভোকেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে, মানুষ আর কোন কোন বহির্গ্রহে পা রাখবে, গড়ে তুলবে নতুন বসত। কেবল পৃথিবী, চাঁদ, মঙ্গল আর কিছু ভবঘুরে গ্রহাণুর বুকে মানুষের বন্দিত্বের দিন ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। মানুষ এখন ধাওয়া করছে অসীমতটের তারার রশ্মিকে। বাসযোগ্য অনেক গ্রহের খোঁজই পাওয়া গেছে গত দেড়শো বছরে। স্থানকালের আপাত অলঙ্ঘ্য বাধাটুকু টপকাতে সময় লেগেছে আরো কয়েক দশক। তারপর প্রশ্নটা আর "যদি" দিয়ে শুরু করেনি কেউ, নভোকেন্দ্রের ভেতরে ফিসফাস হলেও বাইরে মানুষ রীতিমতো গর্জন করে প্রশ্ন শুরু করেছে "কবে" শব্দটি দিয়ে। কবে মুক্ত হবে মানুষ এই সৌরজগতের ছোট্ট গণ্ডি ছেড়ে? মুশকিল হচ্ছে, এর ঝটপট উত্তর মেলেনি নভোকেন্দ্রের বাইরের মানুষের কারণেই। বহির্গ্রহে মানুষের বসতির প্রশ্নে পৃথিবীজুড়ে যে রাজনীতি এর পর শুরু হয়েছে, তার জন্যে অনেকেই প্রস্তুত ছিলো না। বহির্গ্রহে কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে, নাকি নেই? সেই প্রাণের সাথে কি বুদ্ধিমত্তা জড়িত, নাকি নয়? বহির্গ্রহের প্রাণের সাথে পৃথিবীর প্রাণের সহাবস্থান কি সম্ভব? নভোকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে শক্ত হাতে। তাই তাদের কণ্ঠস্বর মৃদু হলেও বলিষ্ঠতার অভাব ছিলো না। পৃথিবীর বাইরে নানা লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কারণে নভোকেন্দ্রের কখনোই টাকার অভাবে অন্যকে তোয়াজ করে মিনমিনে গলায় কিছু বলতে হয়নি, তাই গোটা পৃথিবীকেই জোর গলায় উত্তরটা জানিয়ে দিয়েছে তারা, সবই সম্ভব যদি মানুষ চায়, আর সেই চাওয়া যদি নভোকেন্দ্রের ইচ্ছার অনুকূলে থাকে। পৃথিবী জুড়ে যখন জোর বিতর্ক চলছে, কেমন করে বুদ্ধিমান যন্ত্র পাঠিয়ে বহির্গ্রহ সম্পর্কে যতো তথ্য আছে যোগাড় করে আনতে হবে, নভোকেন্দ্রের প্রধান ইসমেত বির্নি তখন চুপচাপ রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে একটা প্রস্তাবের চিঠিতে সই করেছেন। নভোকেন্দ্রের বক্তব্য খুব সরল। বুদ্ধিমান যন্ত্রের পেছনে গবেষণা চলছে চলুক, কিন্তু ফলের অপেক্ষায় নভোকেন্দ্র বসে থাকবে না। বহির্গ্রহ কেমন, তা জানতে মানুষ পাঠাতে হবে। চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ এরপর বেঁধে গেলেও কেউ হয়তো বিস্মিত হতো না - বা আপত্তিও করতো না - এমনই বোমা ফাটিয়েছিলেন বির্নি। মানুষ খুব সহজেই দুই দলে ভাগ হতে জানে। বির্নির প্রস্তাবে ক্ষমতাবানেরা আপত্তিকর কিছু পাননি, সাধারণ মানুষ এই প্রশ্নে দুই দলে ভাগ হয়ে তুমুল কোন্দল শুরু করে দিলো। পথেঘাটে সক্রিয়তাবাদীদের উত্তাল মিছিলের ভিডিও মকবুল দাঙ্গা ব্যবস্থাপনা ক্লাসে দেখেছিলো। তার যেসব পূর্বসূরী সেই মিছিল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলো, তাদের জন্যে মায়াই লেগেছিলো তার। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত সব অক্ষাংশে শহরে শহরে মানুষের মুখে তখন একই স্লোগান, "আর কোনো সিবিলিয়া চাই না!" সিবিলিয়া ছিলো মঙ্গলে মানুষের প্রথম কলোনি। সিবিলিয়ার দুই হাজার তিনশো একাশি জনের সকলে গোটা পৃথিবীর চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। বহির্গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের রাজনীতিও কঠিন করে দিয়ে যায় সিবিলিয়া। মঙ্গল গ্রহে দ্বিতীয় কলোনি স্থাপন করতে নভোকেন্দ্রের সময় লেগেছে তারপর একান্ন বছর। কিন্তু বির্নি তার পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া বদনামের ঘানি টানার মতো মহিলা ছিলেন না। বির্নির প্রস্তাব তাই সাধারণ মানুষকে প্রথম দফায় প্রচণ্ড উত্তেজিত করে দিলেও রাজনীতিকরা লুফে নিলেন। বহির্গ্রহে কলোনি স্থাপন করতে চান না বির্নি। তিনি চান বহির্গ্রহে কয়েকটা জেলখানা খুলতে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাড়ে আটশো কোটি মানুষ নিয়ে ধুঁকতে থাকা পৃথিবীতে শৃঙ্খলা বাড়েনি, বরং কিছুটা কমেছে। তাই আইন তার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমশ কঠোর হয়েছে। বির্নির নভোকারাগার প্রকল্পের প্রস্তাব তাই রাষ্ট্রসঙ্ঘ সহজভাবেই নিলো, আর স্থানীয় রাজনীতিকদের বিভিন্ন সুতোতে মৃদু বা কড়া টান দেয়ায় পথেঘাটে রায়টও মিলিয়ে গেলো হপ্তা দুয়েক পর। কয়েকটা কয়েদীর জন্যে কারোই তেমন মাথা ব্যথা ছিলো না। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গলার জোর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকখানিই কমে গিয়েছিলো, তারা ক্ষীণ গলায় সভাসেমিনারে কিছু বক্তব্য দিলেও সেগুলো তেমন সাড়া ফেলেনি। ইসমেত বির্নি জনসমক্ষে খুব কম আসতেন, নভোকারাগার প্রকল্পে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সায় পাওয়ার পর তিনি নিজের অফিসের বারান্দায় বসে সাদামাটা একটা সাক্ষাৎকার দিলেন একটি রেডিও চ্যানেলকে। হ্যাঁ, বহির্গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সিবিলিয়াতে যেমনটি ঘটেছিলো, তেমনটি এক্ষেত্রে করা হবে না। ভলান্টিয়ার নেয়ার বদলে দাগী বদমায়েশদের ছোটো ছোটো দল পাঠানো হবে বিভিন্ন বহির্গ্রহে, যেখানে মানুষের বাসোপযোগী পরিবেশ রয়েছে। সঙ্গে কিছু রসদ থাকবে, যাতে তারা কিছু করে খেতে পায় সেখানে। নভোকেন্দ্রের পুলিশ শাখা থেকে দশ বছর পর পর তাদের খোঁজ নেয়া হবে। যদি দেখা যায় তারা ভালোভাবে টিকে যেতে পেরেছে, তাহলে সেই গ্রহে ক্রমান্বয়ে আরো লোক পাঠানো হবে। হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই সেই হতভাগা কয়েদীগুলোর নাগালের বাইরে, দূরে কোথাও নতুন একটা কলোনি খুলে তবেই পাঠানো হবে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে যেভাবে দাগী বিটকেলদের পাঠানো হতো, অনেকটা সেভাবেই। যদি খারাপ কিছু ঘটে, তাহলে সেটা অল্প কয়েকটা নচ্ছাড়ের ওপর দিয়ে যাবে। না, বির্নি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চান, সিবিলিয়া মানুষের ইতিহাসে কেবল একবারই ঘটেছে। আর ঘটবে না। আর মানুষ কি জানে, সিবিলিয়াতে বির্নির মাতামহও ছিলেন? হ্যাঁ, বির্নি একজন সিবিলিয়া শহীদ পরিবারের সদস্য। তিনি সমস্যাটি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। রাষ্ট্রসঙ্ঘ আর রাজনীতিকদের কাজ বির্নি একাই সহজ করে দিয়েছিলেন। সেইসাথে কিছু রাজনীতিকের কাজ খুব কঠিনও করে দিয়েছিলেন বলা যায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর করা কালো তালিকায় প্রথম দশজনের মাঝে তাই বির্নিও একজন। আর নভোকেন্দ্রের নভোপুলিশ ব্যাটেলিয়নের অফিসের বাইরে ফোয়ারাটা তাই ইসমেত বির্নির মূর্তির হাতে ধরা রোমান কলসি থেকেই নির্গত। এরপর চলছে বহির্গ্রহে একের পর এক জেলখানা খোলা। পুরো গ্রহটিই এক অর্থে জেলখানা। এমন হাজারখানেক গ্রহ ছড়িয়ে আছে কয়েকটি ছায়াপথের কয়েকশো তারার চারপাশে। কোনো গ্রহে অক্সিজেনের মাত্রা কম তো কোনো গ্রহে প্রচণ্ড শীত। কোনো গ্রহে অভিকর্ষের টান পৃথিবীর চেয়ে বেশি তো কোনো গ্রহে জ্বালানি সঙ্কট। কোথাও অক্সিজেন এতো বেশি যে লোকে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না আর আগুন লাগলে তা নেভানো মুশকিল হয়ে যায়। কোনো গ্রহে আবার সুপেয় পানির মূল্য পৃথিবীতে স্বর্ণের মূল্যের সমান। কোনো গ্রহে আবার অন্য ধরনের প্রাণ আছে। কোনো গ্রহে আছে বুদ্ধিমান প্রাণীও। আবার কোনো গ্রহে সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে মানুষের সহাবস্থান অত্যন্ত কঠিন। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তুল্য কোনো গ্রহের সন্ধান মেলেনি। যে গ্রহটি বর্ণে গন্ধে ছন্দে রীতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি, সেটি অম্লীয় জলে পূর্ণ। কোনো এক বিজ্ঞানী তার নাম রেখেছে প্যারানোইয়া। পাঁচ দশক পূর্তি হয়ে গেছে বির্নির নভোকারাগার প্রকল্পের। অনুষ্ঠানে মকবুল থাকতে পারেনি, সে তখন পাক খাচ্ছে বিগল নামের এক গ্রহকে ঘিরে। সে অনুষ্ঠানে অবশ্য বির্নিও উপস্থিত ছিলেন না, তৃতীয় দশক উদযাপন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণ দেয়ার কয়েক দিন পরই বির্নির মৃত্যু ঘটে হাসপাতালে, হৃদরোগে। তখন মকবুল উচ্চমাধ্যমিকের জন্যে তৈরি হচ্ছে কেবল। দশ বছরে মকবুলকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে ছয়টি বহির্গ্রহ এবং তাতে স্থাপিত কলোনিতে বন্দী মানুষগুলোকে নিয়ে। নভোকেন্দ্র সচেতনভাবেই কলোনি শব্দটি এড়িয়ে কারাগার শব্দটি ব্যবহার করে, কিন্তু কিছু মিডিয়া কৌশলে কলোনিই ডাকে সেগুলোকে। গত পাঁচ দশকে এসব গ্রহ সম্পর্কে খুব কম তথ্যই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এমনকি নভোপুলিশ সদস্যরাও একে অন্যের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে পায় না, যদি না কোনো বিশেষ কারণে তা ফাইলে উল্লেখ করা থাকে। মকবুল জানে না, গত পাঁচ দশকে এই হাজারখানেক কারাগার সম্পর্কে ঠিক কী ধরনের তথ্য নভোকেন্দ্রের নভোকারাগার প্রকল্পের হাতে জমা হয়েছে। কিংবা, ঠিক কতজন নভোপুলিশ সদস্য ফিরে এসে রিপোর্ট করতে পেরেছে। লিওনিদ একদিন ক্যাফেটেরিয়ায় চা খেতে খেতে বলছিলো, কয়জন ফিরে আসতে পারে বলে তুমি মনে করো? আর যারা আসে, তাদের মধ্যেই বা কয়জন উন্মাদ হিসেবে কোনো অ্যাসাইলামে গিয়ে না ঢুকে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়? লিওনিদের কথাটা শুনে সেদিন মকবুলের চায়ের তেষ্টা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কে জানে, হয়তো এ সবই গুজব। বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত নভোকমাণ্ডার প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে অনেক কিছু শিখিয়েছেন তাদের, কিন্তু মার্থা তিশিয়ানোর ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যাফেতে ঢোকার পর লিওনিদ কখনোই ইতিবাচক কিছু বলেনি। তার চোখে এই পেশাটাই মরণফাঁদের চকচকে দিক কেবল। মকবুল একদিন বিরক্ত হয়ে জানতে চেয়েছিলো, "তুমি তাহলে এলে কেন?" লিওনিদ আলুভাজা চিবাতে চিবাতে বলেছিলো, "যে কারণে মাছি মক্ষিফাঁদ গাছে রস খেতে ঢোকে। আমার কিছু হবে না, দিব্যি রস চুষে খেয়ে ফসকে বেরিয়ে যেতে পারবো, এমন একটা দুরাশা থেকে।" মকবুল লিওনিদের মতো নৈরাশ্যের রোগী না হলেও তার মনে কিছুটা ভয় শুরুতে ছিলোই। দাগী আসামীদের দঙ্গলে নেমে তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করে আবার গ্রহ ছেড়ে বেরিয়ে কক্ষপথে পাক খেতে থাকা টিম্বাকটুর সাথে ডকিং করার কাজটা প্রশিক্ষণ সিমুলেটরে হাতসওয়া হয়ে গেলেও, বাস্তবে ব্যাপারটা বিপদজনক। একটু এদিক সেদিক হলে সব শেষ। তবে আশার কথা হচ্ছে, সব সময় গ্রহে নামতে হয় না। বিশেষ পরিস্থিতিতেই কেবল নিচে নেমে সরজমিন তত্ত্বতালাশ করতে হয়। নইলে কক্ষপথ থেকেই রেডিও যোগাযোগে তথ্য আদানপ্রদান করা দস্তুর। এর আগের তিনটি গ্রহের মাত্র একটিতেই তাকে নামতে হয়েছে। বাকি দু'টোতে সে রেডিও দিয়েই কাজ চালিয়ে দিয়েছে। মকবুলের কাজ সাদাচোখে খুব কঠিন কিছু নয়। নভোকেন্দ্র একটা বিরাট প্রশ্নপত্র দেয় প্রতিটি গ্রহের জন্যে। সেই ফাইল তাকে পূরণ করে আনতে হবে, প্রতিটি ছকে তথ্য পুরে। মকবুল ঠিক তথ্য পূরণ করলো কি না, তা যাচাই করার ব্যবস্থাও রয়েছে নভোকেন্দ্রের হাতে, তাই কোনো অতিচালাকি চলবে না। সাধারণত রেডিও দিয়েই কাজ হয়ে যায়, দুয়েকটি ক্ষেত্রে মকবুলকে নিচে নামতে হতে পারে। যেমন, যদি গ্রহটিতে স্থাপিত বিশেষ রেডিও টিম্বাকটুর সাথে যোগাযোগে সাড়া না দেয়। করবীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিলো অবশ্য। করবীর আবহাওয়া কেন্দ্রের সার্ভারে ত্রুটির কারণে সেটার তথ্য ডাউনলোড করতে পারছিলো না টিম্বাকটু। অগত্যা মকবুলকে নিজেই নামতে হয়েছে অবতরণযানে করে। করবী শুধু দেখতেই লাল নয়, গ্রহ হিসেবে তার শ্রেণীও লালচে। অর্থাৎ, বিপদজনক কয়েদী সেখানে বাস করে। মকবুল সেরকম পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করার জন্যে তৈরি হতে শিখেছে অবশ্য। পুলিশ একাডেমি আর নভোপুলিশ ব্যাটেলিয়নে তার প্রশিক্ষণের একটা বড় অংশই কেটেছে বৈরী বহুজনের সাথে লড়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখার নানা পদ্ধতি শেখা আর প্রয়োগ করা নিয়ে। করবীতে কলোনি স্থাপিত হয়েছে চল্লিশ বছর আগে, তাতে পাঠানো হয়েছিলো একশো জন কয়েদীকে, যাদের মাঝে অন্তত পক্ষে কুড়িজনের বিরুদ্ধে আদালতে সহিংস আচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিলো। বাকি আশিজনও ঠিক ফুলেল চরিত্র নয়, কেউ ঠগবাজ, কেউ জোচ্চোর, কেউ জেলভাঙা পলাতক, কেউ সশস্ত্রবাহিনীর পয়সামারা অফিসার। মোট কথা, মারদাঙ্গা সব লোকজন। মকবুলকে তাই অবতরণ করতে হয়েছে বড় ঝুঁকি নিয়ে। মকবুল পর্যবেক্ষণ ডেস্কে বসার আগে সিদ্ধান্ত নিলো, সে আরেক কাপ কফি খাবে। জীবাণুনাশক চুল্লি থেকে কফির কাপ বার করে সে আবার কফিমেশিনের নিচে ধরে চোখ বন্ধ করে গুনগুন করতে লাগলো, করবী ... করবী ... করবী। করবীতে লোকজন বদ হলেও তারা মকবুলকে তেমন কিছু বলেনি। না বলার অনেক কারণ ছিলো অবশ্য। চল্লিশ বছরে মোটামুটি নির্বিঘ্নে নির্জন গ্রহে বাস করে প্রকৃতি আরোপিত শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসে অনেকেই, যতটুকু সহিংসতা অবশিষ্ট থাকে, সোয়া ছয়ফুট লম্বা মকবুলের শীতল হিংস্র মূর্তি তার মাত্রা বেশি চড়তে দেয় না। মকবুলের শারীরিক বলই শুধু নয়, তার হাতে যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকে, সেটির সাথে পাল্লা দেয়ার সাধ্য কয়েদীদের নেই। সাধারণত কোনো কলোনিতেই মারণাস্ত্র রসদের সাথে দেয়া হয় না, এমনকি বুদ্ধিমান প্রাণী যেসব গ্রহে আছে, সেখানেও নয়। মকবুল ক্লাসে বসে জেনেছে, বেশ কিছু গ্রহ থেকেই মাঝে মাঝে আগ্নেয়াস্ত্রের কথা বলা হয় চাহিদাপত্রে, এ যাবৎ নাকি একটি মাত্র ক্ষেত্রে সে আবদার পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু একই সাথে সেই কারাগারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে অবতরণচুক্তি রদ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এরপর আর কেউ সেখানে অবতরণ করবে না, যোগাযোগ যা করার, রেডিওর মাধ্যমে বাইরে থেকে করা হবে, রসদ যোগাতে হলে একমুখী পার্সেল সার্ভিসে পাঠানো হবে। ঐ গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা ছিলো মাংসাশী। করবীতে লোকজন ক্ষ্যাপা ছিলো অবশ্য অন্য কারণে। প্রতি দশ বছর পরপর নভোকেন্দ্রের পক্ষ থেকে চাহিদাপত্র চাওয়া হয় প্রতিটি কারাগারের কাছ থেকে। ওষুধ, যন্ত্রপাতি, তথ্য রেকর্ড, নতুন নারী বা পুরুষ কয়েদী, শস্য বা পশু, অনেক কিছুই চাইতে পারে কয়েদীরা। করবীতে কোনো কারণে তৃতীয় মিশনটি আর যোগাযোগ করেনি। মকবুল চতুর্থ মিশন হিসেবে যোগাযোগ করেছে তাদের সাথে। করবীর চাহিদাপত্র ছিলো ওষুধের, তৃতীয় মিশন রহস্যজনক কারণে (বেশি রহস্য নেই অবশ্য, সম্ভবত স্কাউটশিপটি ধ্বংস বা বিকল হয়ে গিয়েছিলো মাঝপথে) যোগাযোগ না করায় কুড়ি বছর সেই ওষুধ ছাড়াই কাটিয়েছে তারা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নভোকেন্দ্রের ওপর তারা একটু বেশি ক্ষেপে ছিলো, যতটুকু ক্ষেপে থাকা স্বাভাবিক তারচেয়ে। মকবুল অবশ্য ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় খুব বেশি চোটপাট নিতে আসেনি কেউ। এক মাতাল বুড়ো কয়েদী একটা রেঞ্চ নিয়ে তেড়ে এসেছিলো কেবল। আইন অনুযায়ী মকবুল তাকে হত্যা করার অধিকার রাখলেও বুড়োকে একটা আছাড় দেয়ার বাইরে আর কিছু করেনি মকবুল। তাকে আক্রমণ করা মতো শারীরিক শক্তিসম্পন্ন আর কেউ ছিলোই না করবীতে। করবীর নিজস্ব ব্যাকটিরিয়াবাহিত রোগে প্রচুর লোক মারা পড়েছে গত কুড়ি বছরে, অল্প কয়েকজন কোনোমতে টিকে ছিলো কেবল, তাদের বেশিরভাগই নারী। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তাদের কারো মাঝেই পুলিশের ওপর গুণ্ডাগার্দি করার মনোবল অবশিষ্ট ছিলো না। মকবুল অবশ্য যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথেই অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়ে এসেছে করবীতে। কয়েকটা বড় ব্যাটারি বেচারাদের অনেক খাটনি বাঁচিয়ে দিয়েছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতির কিছু কিছু বদলে দিয়েছে মকবুল, নতুন এক জাতের ভূট্টার বীজ দিয়ে এসেছে যাতে করবীর ভৌত পরিস্থিতিতে ফলন বেশি হয়, ফোটোনিকসের ওপর কিছু ম্যানুয়ালও। সেইসাথে নতুন পুরুষ কয়েদী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি। একশোজন কয়েদী নেমেছিলো করবীতে, চল্লিশ বছর আগে, তাদের সংখ্যা বাড়ার বদলে কমে আটাত্তরে নেমে এসেছে, যাদের একটা বড় অংশ নারী। মকবুলের পর যে মিশন আসবে করবীতে, তাদের কাছে করবীর এখন বালিকা শিশুদের প্রত্যাশা থাকবে কয়েকজন তরুণ কয়েদী পাওয়ার। করবী গ্রহ হিসেবে মোটেও বাসবান্ধব নয়। গ্রহটিতে পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, কলোনির স্থানটিতে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত, মাটি অনুর্বর, স্থানীয় ব্যাকটিরিয়ার উৎপাতও যথেষ্ট। তবে বহুকোষী প্রাণ সেখানে এখনও গড়ে ওঠেনি বলে রক্ষা। আবার বহুকোষী প্রাণ নেই বলে জ্বালানিও নেই, একমাত্র ভরসা সৌরকোষ থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ। ভূট্টা আর গমের খড় করবীতে চড়া দামে লেনদেন হয়। আবহাওয়া কেন্দ্রের সার্ভারের জটিলতা মকবুল ছাড়া আর কারো সারানোর এখতিয়ার নেই। এখতিয়ার থাকলেও লাভ হতো না, করবীতে যারা বেঁচে আছে তাদের মাঝে কম্পিউটার বোঝে এমন আর কেউ নেই। মকবুলের খারাপই লাগছিলো, যখন তার অবতরণ যান করবী ছেড়ে চলে আসে। কী বেদনার্ত চোখ নিয়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছিলো ভাঙাচোরা মানুষগুলো! পাঁচ বছর পর মানুষের দেখা পেয়ে মকবুলের ভেতরটা খুব ওলটপালট লাগছিলো। মার্থা তিশিয়ানো ক্লাসে তাদের বহুবার বুঝিয়েছে, কোনো কারাগারে নামতে হলে মানুষের সাথে বেশি যোগাযোগ করা যাবে না, খুব বেশি হৃদ্য আচরণও করা যাবে না, কাতর করে তোলার মতো কোনো স্মৃতিও সঙ্গে নিয়ে আসা যাবে না। ঐসব গ্রহে যা ঘটবে, তা ফেলে আসতে হবে ঐ গ্রহেই। মকবুল তার করবীর ফাইল সঠিকভাবে সাফল্যের সাথেই পূরণ করে এসেছে, অন্য দু'টি গ্রহে যেমন। রোসিও তার চতুর্থ গ্রহ। তারপর আর দু'টি গ্রহ কেবল বাকি। তারপরই সে ফিরে যাবে পৃথিবীতে, তিন মাস কোয়ার‍্যানটাইনে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কাটাবে, তিন মাস নভোমনোবিদদের কাছে হাবিজাবি ইতংবিতং পরীক্ষা দেবে, তারপর ছয় মাস নভোকেন্দ্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সেরে বেতন আর পেনশনের কার্ড তুলে চলে যাবে কোথাও, নিরিবিলিতে, কোনো পাহাড়ি হ্রদের ধারে একটা কুটির তুলে বাস করার জন্যে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই মার্থা তিশিয়ানোকে নিমন্ত্রণ করবে সে সান্ধ্যভোজে। মেয়েটা এই দশ বছরে নিশ্চয়ই খুব বেশি বুড়িয়ে যায়নি। ক্লাসে বসে নভোমনোবিদ্যার নামে হাবিজাবি বকবক করলে বেশি বুড়িয়ে যাওয়ার কথাও নয়। হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং ...। মকবুল কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকালো। সময়ের সাথে সবকিছুই ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কফি, মার্থা, হয়তো সে নিজেও? মকবুল জানে না, করবীতে কোনো তরুণী থাকলে তার আচরণ কেমন হতো। সে কি প্রশিক্ষণ ভুলে করবীতে কিছু সময় কাটাতো সেই তরুণীর সাথে? সেই করবিনীর গর্ভে শুক্র নিষেক করে বিনিময়ে কোনো অজানা অপার্থিব অণুজীব সঙ্গে নিয়ে ফিরতো টিম্বাকটুতে? তারপর অন্য কোনো গ্রহে গিয়ে সেই অণুজীব ছড়িয়ে দিতো অন্য কোনো তরুণীর গর্ভে? মাথা ঝাঁকিয়ে মেয়েমানুষের চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলো মকবুল। ব্যাপারটা সহজ হবে না, মার্থা ক্লাসে বহুবার বলেছে তাদের। কিন্তু কখনো, কখনোই যেন কোনো কারাগারের কয়েদীদের সাথে কোনো ধরনের ঘনিষ্টতা না ঘটে। যদি কোনো স্বয়ংক্রিয় লগে ধরা পড়ে ব্যাপারটা, পেনশন কাটা যাবে। রোগজীবাণু নিয়ে ফিরলে তো কোয়ার‍্যানটাইনের ফাঁদেই আটকা পড়তে হবে। মকবুল অবশ্য বুঝতে পারছে না, এইসব শাস্তির ভয় কতটা কাজে দেবে। রোসিওতে নেমে কী দেখবে, মকবুল জানে না এখনও। করবীর মতো পরিস্থিতি সেখানে নাও হতে পারে। হয়তো অসুখবিসুখে মরে সাফ হয়ে গেছে সবাই। কিংবা দারুণ সব লাস্যময়ী মেয়ে একজন বলিষ্ঠ যুবকের আশায় বুক বেঁধে (চৌত্রিশ ইঞ্চি, সি কাপ হলে ভালো হয়) রোসিওর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে। মকবুল কি পারবে ব্যাটেলিয়নের প্রশিক্ষণ ক্লাসে শেখানো ব্যাপারগুলো মাথায় রাখতে? দু'হপ্তা ধরে রোসিওর ফাইলই ঘেঁটে দেখছিলো মকবুল। রোসিওর ক্যাটেগোরি সবুজ। অর্থাৎ কোনো সহিংসতার অভিযোগে দোষী ব্যক্তিকে রোসিওতে পাঠানো হয়নি। রোসিও নভোকারাগার প্রকল্পের প্রথম দিকের গ্রহ, পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিলো তখন, ছাব্বিশ জন নারী আর চব্বিশ জন পুরুষ। সকলেই ছোটোখাটো অপরাধ করেছে, এবং মোটামুটি শিক্ষিত পেশাদার লোকজন। তাদের মাঝে চুরিপাগল পকেটমার থেকে শুরু করে মাতাল হয়ে দোকানে আগুন ধরানো ছাত্র আছে। প্রত্যেকের প্রোফাইলেই মোটামুটি চোখ বুলিয়েছে মকবুল, কেউই মারদাঙ্গা গোছের নয়। পেশাগত জীবনে ডাক্তার, উকিল, মিস্ত্রি, কৃষক, সব ধরনের মানুষের মিশেল ঘটানোর চেষ্টা করা হয় কয়েদীদের বাছাইয়ে, রোসিও মোটামুটি আদর্শ বাছাই। গত চারটি মিশনের মাঝে তিনটির রিপোর্ট রয়েছে, চতুর্থ মিশন কোনো কারণে রিপোর্ট পাঠায়নি, হয়তো এটাই সেই মিশন যেটা করবীতে ওষুধ নিয়ে যাওয়ার জন্যে নির্ধারিত ছিলো। মকবুল রোসিওতে পঞ্চম মিশনে এসেছে। প্রথম তিনটি মিশনের চাহিদাপত্র খুঁটিয়ে দেখেছে মকবুল। অস্বাভাবিক কিছুই নেই। যেসব ওষুধ চাওয়া হয়েছে সেগুলো বেশ মামুলি, আগ্নেয়াস্ত্রের অনুরোধ একবারও আসেনি, যেসব যন্ত্রপাতি আর সফটওয়্যার চাওয়া হয়েছে সেগুলো দেখে বোঝা যায়, বেশ সক্রিয় আর কর্মঠ একটা সমাজ চলছে রোসিওতে। কিছু অদ্ভুত চাহিদা সবসময়ই থাকে, রোসিওর ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়, যেমন নাইলনের পাতলা কাপড় চাওয়া হয়েছে প্রচুর পরিমাণে (দেয়া হয়নি)। নারী বা পুরুষ কয়েদীও চাওয়া হয়নি, অর্থাৎ রোসিওতে নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাত স্বাভাবিক রয়েছে। নতুন শস্য, নতুন পশু বা নতুন কোনো বই, ম্যানুয়াল চাওয়া হয়নি। সাধারণত শুরুতেই বেশ ভালো একটি লাইব্রেরি সঙ্গে দেয়া হয়, সেটা পড়ে শেষ করতেই কয়েকশো বছর লেগে যাওয়ার কথা। পৃথিবীর সাম্প্রতিক আবিষ্কার বা পণ্যগুলো সাধারণত প্রচুর যাচাইবাছাইয়ের পর নভোকারাগারগুলোতে পাঠানো হয়, এবং সেগুলো গ্রহগুলোর পায়ের মাপে বানানো জুতো বলে ব্যাপারটা তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। তহবিল ব্যবস্থাপকদের মর্জির ওপর ব্যাপারটা নির্ভর করে। রোসিওর তৃতীয় চাহিদাপত্রের একটি আইটেম কেবল মকবুলকে ভাবিয়ে তুলেছে। ইনসুলিন প্ল্যান্ট। অনেকেই ওষুধ হিসেবে ইনসুলিন চাইতে পারে, কিন্তু একটা প্ল্যান্ট কেন চাওয়া হচ্ছে? ইনসুলিন প্ল্যান্ট ছোটোখাটো কিছু নয়, স্কাউটশিপের গুদামের জন্যে বরাদ্দ আয়তন ও ওজনের অনেকখানিই সেটা নিয়ে নেবে, সে কারণে কিছু ইনসুলিন সঙ্গে দেয়া হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে দেখেছে মকবুল। কিন্তু একটা প্ল্যান্ট কেন চাইছে রোসিওর লোকজন? চাহিদা কি এতই তীব্র যে শুধু ওষুধ দিয়ে আর পোষাচ্ছে না তাদের, আস্ত ফ্যাক্টরিই খুলে বসতে হবে? এদিকে টিম্বাকটু থেকে পাঠানো যোগাযোগবার্তায় সাড়া আসছে না রোসিও থেকে। মকবুল অবশ্য টিম্বাকটুর শক্তিশালী ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখেছে গত দু'দিন ধরে। কলোনিটা একটা পাহাড়ি এলাকায়, বড়সড় একটা হ্রদের পাশে, সেখানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলেছে রাতের বেলা। বেশ বড় এলাকা নিয়ে ছোপ ছোপ চারকোণা সবুজ-হলুদ দেখে বোঝা যায়, শস্য চাষ চলছে। ডায়াবেটিসে ফৌত হয়ে গেলে এসব থাকার কথা নয়। হয়তো যোগাযোগ মডিউলের কোনো একটা সাবমডিউল বিগড়ে গেছে। কিংবা কে জানে, হয়তো ব্যাটারা ব্যাটারি খুলে গম পেষার যন্ত্রের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। মকবুল পর্যবেক্ষণ বে-র মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো, হঠাৎ অবসাদ এসে স্পর্শ করেছে তাকে। "মৌখিক যোগাযোগ সক্রিয় করা হোক।" মৃদু একটা শব্দ করে কম্পিউটারের স্পিকার সতেজ হয়ে উঠলো। "কমাণ্ডার।" "আবহাওয়ার তথ্য ডাউনলোড করা গেছে?" মকবুল শবাসনে শুয়ে চোখ বুঁজে জানতে চাইলো। "আবহাওয়ার তথ্য সফলভাবে ডাউনলোড করা হয়েছে কমাণ্ডার।" "তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত আর আপেক্ষিক আর্দ্রতার হলোগ্রাম দেখাও।" পর্যবেক্ষণ বে-র ভেতরে শূন্যে ফুটে উঠলো রোসিওর কারাগার প্রকল্প এলাকার ভেতরে স্থাপিত আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যের গ্রাফ। রোসিও পৃথিবীর চেয়ে আকারে কিছুটা ছোটো, কিন্তু স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল সেখানে আছে। সমস্যা আপাতদৃষ্টিতে একটাই, তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশ কম, পৃথিবীর তুলনায় প্রায় অর্ধেক। হুট করে পৃথিবীর সমুদ্র সমতলের একজন মানুষকে রোসিওতে এনে ছেড়ে দিলে তার নানা সমস্যা হবে, হাইপোক্সিয়ায় ভুগে টেঁসেও যেতে পারে। এ ধরনের গ্রহতে নামতে গেলে সঙ্গে অক্সিজেন রাখতে হয়। খুব বেশি সময় কোনো গ্রহতে কাটানোর দরকার পড়ে না নভোপুলিশদের, কপালের ফেরে পড়ে লম্বা সময় থাকতে হলেও সেই সময় স্বল্প অক্সিজেনের সাথে শরীরকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট হয় না কখনোই। বৈরী পরিবেশে অক্সিজেন সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা বেশ দুরূহ বলে স্বল্প-অক্সিজেনের গ্রহগুলো নিয়ে প্রশিক্ষণের সময় সকলেই চটে থাকে বলে এ ধরনের গ্রহের ব্যাপারে নভোকেন্দ্রের হুকুম একটু বেশিই কড়া। উপযুক্ত কারণ থাকার পরও যদি কেউ অবতরণ না করে ফাঁকি মারে, তার পেনশন কাটা যেতে পারে। কিন্তু রোসিওর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ পৃথিবীর চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তাই যে নক্ষত্রটিকে ঘিরে রোসিও ঘুরছে, সেটি থেকে তার অবস্থান মোটামুটি দূরে হলেও গ্রিন হাউস ক্রিয়ার কারণে রোসিওর তাপমাত্রা মোটামুটি উষ্ণ, অন্ততপক্ষে বিষুবীয় অঞ্চলে তরল পানি ধারণ করার মতো। গ্রহটি পৃথিবীর মতোই কিছুটা হেলে আছে তার তারার দিকে, ফলে পৃথিবীর মতোই ঋতুচক্র রয়েছে। নভোকারাগার প্রকল্প সাধারণত মোটামুটি দুর্গম জায়গায় করা হয়, যাতে সহজে সেখান থেকে বেরিয়ে কয়েদীরা গ্রহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। রোসিওর কারাগারটি বিষুবীয় অঞ্চলে একটি উঁচু পর্বতমালার মাঝে উপত্যকায়, যার চারপাশে দুর্গম পর্বতশ্রেণী। তাই এখানে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, সবই মোটামুটি একরকম থাকে বছরভর। আঠারো থেকে কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় একটা ভূমধ্যসাগরীয় বসন্তের আমেজ থাকার কথা। রোসিওর কয়েদীরা হয়তো খুব বড়সড় দাগী বদমাশ নয় বলেই এমন আরামের একটা নির্বাসন পেয়েছে। করবীর কারাগার একটা মরুভূমির মাঝে মরুদ্যানের মতো জায়গায়, শীত আর গ্রীষ্ম দুটোরই প্রকোপ সাংঘাতিক। রোসিওর কয়েদীরা নিশ্চয়ই বছরভর শস্য ফলাতে পারে। মকবুল গলা চড়িয়ে বললো, "রোসিওর কারাগার প্রকল্পের নকশা দেখাও, সঙ্গে এখনকার ছবি।" গ্লুপ করে একটা শব্দ করে পাল্টে গেলো হলোগ্রাম, রোসিওর কারাগার প্রকল্পের কাকদৃষ্টি নকশা ভেসে উঠলো। মূল নকশায় আছে ভেড়ার খামার, মুরগির খামার, ক্ষেত, ছোটো নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্র, পানি পরিশোধন কেন্দ্র, আবহাওয়া কেন্দ্র, যোগাযোগ কেন্দ্র, আবাসিক এলাকা, তৃণভূমি আর বনভূমি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। নকশার সাথে খুব বেশি মিল থাকার কথাও নয়, পঞ্চাশ বছরে বহু পরিবর্তন আসাই স্বাভাবিক। কম্পিউটারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ক্ষেত, তৃণভূমি আর বনভূমি ছাড়া আর কোনোকিছুই নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়নি। বেশ কিছু পুকুর দেখা যাচ্ছে কারাগার প্রকল্প এলাকায়, আর প্রচুর ঘরবাড়ি। এরা মনে হয় আরামদায়ক পরিবেশ পেয়ে খরগোশের মতো বংশবৃদ্ধি করে গেছে গত পাঁচ দশকে, ভাবলো মকবুল। পুকুর থাকার অর্থ হচ্ছে, যে হ্রদের পাশে বসতি তোলা হয়েছে, তার পানি সম্ভবত সুপেয় নয়। আলাদাভাবে মাছ চাষও করতে পারে, কিছুই বলা যায় না। ক্ষেত আর তৃণভূমির মাঝে ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো গাছের বাগান, তাকে বনভূমি ঠিক বলা চলে না। কয়েদীদের রসদের সাথে বিশেষভাবে সংরক্ষিত বীজ দেয়া হয়, তারা সেগুলো অবস্থা বুঝে যাতে কাজে লাগাতে পারে। রোসিওর অবস্থা দেখে মনে হয়, এরা বেশ ভালোই কাজে লাগিয়েছে সেগুলোকে। মকবুল আবহাওয়া কেন্দ্রটাকে দেখতে পেলো বসতি থেকে দূরে একটা জায়গায়। মূল নকশাতেও তেমনই রাখা আছে। এরা বোধহয় এই একটা জিনিসই মেনে চলতে পেরেছে। আবহাওয়া কেন্দ্রের পাশে একটা চতুষ্কোণাকৃতির দেয়ালঘেরা জমি দেখা যাচ্ছে, সেটা কী কাজে লাগে কে জানে? যোগাযোগকেন্দ্র আবাসিক এলাকার একেবারে মাঝে থাকার কথা, কিন্তু এরা যোগাযোগকেন্দ্র স্থাপন করেছে এক পাশে, একটু দূরে। মকবুল অনুভব করলো, তার শরীর ঘুম চায়। কাপের পর কাপ কফি খেয়েও আর জেগে থাকা সম্ভব নয়। সে পর্যবেক্ষণ বে-র মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, "মৌখিক যোগাযোগ নিষ্ক্রিয় করা হোক।" মৃদু গুঞ্জণ করে নীরব হয়ে গেলো কম্পিউটার। পর্যবেক্ষণ বে ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় মকবুলের মনে হলো, কী যেন একটা দেখা হয়নি তার, অথচ সেটা দেখা জরুরি ছিলো। ক্লাসে মার্থা একটা কথা তাদের বার বার বলতো, মিশনে তোমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু তোমাদের সুস্থ মন। অবসন্ন মকবুলের সুস্থ মন ক্লান্তির স্তুপ ঠেলে কী যেন বলতে চাইছে তাকে, মকবুল বুঝতে পারছে না। হয়তো টানা ঘুম দিয়ে ওঠার পর সে ধরতে পারবে। মকবুল ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলো নিজের বাঙ্কারের দিকে। ঘুম থেকে উঠে রোসিওতে নামবে সে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মকবুলের মনে হলো, রোসিওর চতুর্থ চাহিদাপত্রটি তার দেখা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সেটা দেখার উপায় নেই, নভোকেন্দ্রের তথ্যভাণ্ডারে সেটি কখনোই জমা পড়েনি। ২. অবতরণযানে বসে মকবুল মনে মনে পঞ্চাশ-ষাটটা করে গালি দিচ্ছিলো রোসিওবাসীদের। নামার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রেডিওতে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে গেছে সে। নভোপুলিশের স্কাউটশিপ থেকে সঙ্কেত পেলে যোগাযোগকেন্দ্র থেকে একটা জোর অ্যালার্ম বেজে ওঠার কথা। শুধু অ্যালার্মই নয়, যোগাযোগকেন্দ্রের লাল বিকনটাও জ্বলতে-নিভতে থাকে। একটা অ্যামবুলেন্সকে যেমন অগ্রাহ্য করা যায় না, নভোপুলিশের তরফ থেকে যোগাযোগ করলেও তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কে জানে, হয়তো এগুলো সবই বিকল হয়ে পড়ে আছে। কুড়ি বছর আগে শেষবারের মতো এসবের রক্ষণাবেক্ষণ করে গেছে কোনো এক কমাণ্ডার, তারপর হয়তো প্রাকৃতিক কারণেই কিছু একটা ত্রুটি ঘটেছে। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, মকবুলকে নিচে নামতে হচ্ছে। তার মেজাজটাও বিগড়ে আছে সেই কারণেই। তিনদিন চলার মতো বাড়তি অক্সিজেন সাথে নিয়েছে মকবুল, যদিও বড়জোর দশ বারো ঘন্টার বেশি কাজ তার উপস্থিতি দাবি করে না। চাহিদাপত্রের অভাবে কিছু সাধারণ রসদ সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে সে, সেগুলো কয়েদীদের পালের গোদার হাতে তুলে দেবে সে। আবহাওয়া কেন্দ্র, যোগাযোগ কেন্দ্র, শক্তি কেন্দ্র আর পানি পরিশোধন কেন্দ্রের যন্ত্রপাতির একটা রুটিন চেক করবে, আর লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে তাদের সমস্যা আর দাবির কথা নোট করে নিয়ে আসবে। এর বাইরে বাড়তি কাজ হতে পারে যদি কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে থাকে সেটা সারানো, আর মদখোর কেউ গায়ে পড়ে মারপিট করতে এলে তাকে ধরে প্যাঁদানো। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে তাকে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে হতে পারে, তবে ব্যাপারটা সচরাচর ঘটে না। পুলিশের সাথে পাঙ্গা নিতে গেলে কয়েদীদেরই সমস্যা বাড়বে পরে। তারপরও মকবুল প্রস্তুত আছে, বিশেষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে সে। নভোপুলিশকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেয়া হয়, রোসিওর কয়েদীদের ক্যাটেগোরি বিবেচনা করে মকবুল সাথে নিয়েছে চেতনানাশক বুলেটসহ আগ্নেয়াস্ত্র। প্রতিটি অস্ত্রই একান্ত মকবুলের ব্যবহারের জন্যে সেট করা, কোনো কারণে অস্ত্র তার হাত থেকে অন্য কারো হাতে গিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই, মকবুলের আঙুলের ছাপ না পেলে কাজ করবে না এসব অস্ত্র। পুরোনো দিনের আগ্নেয়াস্ত্রও দুয়েকটা আছে টিম্বাকটুতে, কিন্তু মকবুল নতুন "বুদ্ধিমান" অস্ত্র চালিয়ে বেশি অভ্যস্ত, সে এতেই স্বস্তিবোধ করে। ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রণ আর লক্ষ্যভেদ ব্যবস্থা থাকায় এসব অস্ত্র চালাতে নিজের ঝুঁকি কম। প্রতিটি বুলেটই হননক্ষম, কিন্তু মকবুল সাধারণত শত্রুর ঊরু বা কাঁধে গুলি করে। বুলেটের ভেতরে যে রাসায়নিক রয়েছে, তা রক্তের সাথে মিশে গেলে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক মানুষকে অচেতন করে ফেলে, খুনখারাপি ছাড়াই শত্রুকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার ব্যাপারে এসব বুলেট মোক্ষম। মকবুল রোসিওর অণুজীবের ওপর রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখেছে, এককোষী-বহুকোষী সব ধরনের প্রাণই সেখানে আছে, তবে নিম্নস্তরের, মানুষের জন্যে ক্ষতিকারক নয়। শেষ রিপোর্ট ছত্রাকের কথা বলা হয়েছিলো, কয়েক ধরনের ছত্রাক রোসিওতে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তবুও মকবুলকে প্রতিরোধী পোশাক পরে নামতে হবে, বলা যায় না, করবীর মতো এখানেও যদি ব্যাকটিরিয়ার উৎপাত দেখা দেয়? রোসিওর বায়ুমণ্ডলের বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে মকবুল পর্যবেক্ষণের জানালার ওপর থেকে ধাতব আবরণ সরিয়ে নিলো। রোসিওর যে অংশে সে নামতে যাচ্ছে, সেখানে এখন বেলা মোটামুটি দুপুর। নিচে পাহাড়ি ভূমি দেখা যাচ্ছে টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁকে। পৃথিবীর মতো রোসিওতে এতো পানি নেই, সাগরগুলো এখানে ছোটো আর বিভক্ত। আরেকটু নিচে নামার পর পাহাড়ের শরীর বেয়ে নেমে আসা নদী চোখে পড়লো তার। কারাগার প্রকল্প এলাকার বাইরেও বসতি স্থাপন করার মতো অনেক জায়গা আছে তাহলে রোসিওতে। ফিরে গিয়ে মকবুল রোসিওর চারপাশে কয়েকটা কক্ষপথে চক্কর মেরে ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করবে। যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে রোসিওতে বড় একটা কলোনি পাঠানোর সুপারিশ করবে সে। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণসহ এই সুপারিশ দাখিল করতে পারলে বোনাস পাবে মকবুল। করবীর ক্ষেত্রে যেমন বোনাসের সুযোগ মেলেনি এ যাত্রা, গ্রহটা নতুন কলোনির জন্যে একেবারেই উপযোগী নয়। কারাগার প্রকল্পকে ঘিরে দেয়ালের মতো যে বিশাল পর্বতশ্রেণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, তার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় মুগ্ধ হলো মকবুল। সাদা বরফে ঢাকা চূড়ার পেছনে নীল আকাশ, কোথাও বরফের আবরণ সরিয়ে কুচকুচে কালো পাথুরে শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে। পাহাড়ের ঢালে একসময় বরফরেখা হারিয়ে গেছে, শুরু হয়েছে অনাবৃত কালো-ধূসর-লাল পাথর, একসময় সে পাথুরে শরীর গিয়ে মিশেছে সবুজে। তৃণভূমি নিজস্ব নিয়মে উঠে এসেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। তবে পৃথিবীর মতো ঢালাও সবুজ নয়, ইতস্তত সবুজের ছোপ পাহাড়ের গায়ে। ঘাস গজানোর মতো মাটি বোধহয় এখনও তৈরি হয়নি এখানে। আরো দূরে, আরো নিচে ছোটো ছোটো খেত, সেখানে সবুজ, হলুদ, সোনালি, সব রঙের শস্যই আছে দেখা যাচ্ছে। উল্টোদিকে বেশ বড় বড় গাছের সারি চলে গেছে। নভোপুলিশের নিজস্ব মেরুন রঙের অবতরণযান যদি কারো চোখে নাও পড়ে থাকে, অবতরণের সময় যে জেট চালু হয়, তার গর্জনই রোসিওর কয়েদীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যে যথেষ্ট। মকবুল নিরাপদে আর নির্বিঘ্নে রোসিওর কারাগার প্রকল্পের এক প্রান্তে আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে কয়েকশো মিটার দূরে নামালো যানটাকে। জায়গাটা আসলেও অপূর্ব। দূরে চারিদিকে পাহাড়ের সারি চারদিকে, বেলা দশটার আগে বোধহয় কেউই এখানে সূর্য দেখতে পায় না। যে হ্রদের পাশে কারাগার প্রকল্প, তার রং ঝকঝকে নীল। আকাশে টুকরো টুকরো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ উড়ছে। কিলোমিটার খানিক দূরে দেখা যাচ্ছে ঘরবাড়ি। মকবুল তার হেলমেটের শক্তিশালী টেলিস্কোপ চোখের সামনে এনে দেখলো, বেশ কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে একটা চত্বরের মতো জায়গায়। যাক, লোকজন বেঁচে আছে তাহলে। অবতরণযানের হ্যাচ খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মকবুল, তার পরনে বায়ুরোধী পোশাক, কোনো কিছুই ঢুকতে পারবে না এর ভেতরে। পোশাকটা হালকা হলেও খুব ত্বরিত নড়াচড়ার জন্যে সুবিধাজনক নয়, যে কারণে প্রশিক্ষণের সময় এটা নিয়ে সবাই খুব চটে থাকতো। চটপটে কয়েকজন যদি হঠাৎ করে চারপাশ থেকে আক্রমণ করে, সামলাতে মকবুলকে খুব বেগ পেতে হবে। কোমরের হোলস্টারে ইলেকট্রনিক পিস্তলটা গুঁজে কয়েকবার শূন্যে লাফ দিলো মকবুল, তারপর হাত পা টানটান করে জড়তা কাটিয়ে নিলো। লোকগুলো হারামিপনা না করলে তাকে শারীরিক বলপ্রয়োগে যেতে হবে না। কিন্তু যদি যেতে হয়, তার জন্যে তৈরি থাকবে মকবুল। এখনই রসদ নামাবে না সে, আগে পরিস্থিতি এক নজর দেখে আসা দরকার। চলে যাওয়ার সময় নামিয়ে মালসামানা বুঝিয়ে দিলেই চলবে। ইনসুলিনের কয়েকটা বাক্স নিয়ে এসেছে সে, প্ল্যান্ট না পেয়ে যদি লোকগুলো ক্ষেপে যায়, ওষুধ দিয়ে তাদের কিছুটা শান্ত করা যাবে। মকবুল যদিও জানে ব্যাপারটা, কিন্তু শূন্যে লাফানোর সময় সে আক্ষরিক অর্থেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে, রোসিওর অভিকর্ষজ ত্বরণ পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম। ব্যাপারটা মকবুলের কাজের জন্যে আপাতত সুবিধাজনক। তবে দীর্ঘদিন কম অভিকর্ষজ ত্বরণে থাকলে হাড় আর পেশীর ওপর প্রভাব পড়ে। মকবুল তার তত্ত্বীয় ক্লাসের শিক্ষা স্মরণ করলো, রোসিওতে কয়েক হাজার বছর পর গাছগুলো হবে বড়সড় আর লোকগুলো হবে হালকা পাতলা। হেলমেটের টেলিস্কোপ আবার চোখে তুলে মকবুল দেখতে পেলো, বাইসাইকেল চালিয়ে একটা লোক আসছে এদিকে। কিছুটা কৌতুক অনুভব করলো সে, নভোকারাগার প্রকল্পে বাইসাইকেল দেয়া হয়েছে ভেবে। জিনিসটা অন্তত কোনো চাহিদাপত্রে ছিলো না। মকবুল জোরে পা চালিয়ে আবহাওয়া কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেলো, সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করে দেয়া দরকার। আবহাওয়াকেন্দ্রের পাশে ওপর থেকে যে চারকোণা দেয়ালঘেরা জমিটা দেখতে পেয়েছিলো মকবুল, সেটার পাশ ধরেই চলছে সে। দেয়াল নয়, বরং ফুট দুয়েক উঁচু চুনাপাথরের চাঙর পাশাপাশি রেখে একটা সীমানা তৈরি করা হয়েছে কেবল। ভেতরে উঁকি দিয়ে মকবুল বুঝতে পারলো, জায়গাটা ঠিক কোন কাজে ব্যবহার করা হয়। এটা একটা সমাধিক্ষেত্র। বাইসাইকেলটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে দেখে মকবুল স্থির করলো, গোরস্থানের ভেতরটা একটু ঢুকে দেখবে সে। বেশ কিছুটা দূরে গোরস্থানের প্রবেশ দ্বার দেখা যাচ্ছে, এক মানুষ সমান উঁচু পাথরের কলাম দিয়ে তৈরি, কিন্তু অতদূর হেঁটে গিয়ে ভেতরে ঢোকার দরকার কী, যখন ছোট্টো একটা লাফ দিলেই সীমানা টপকে ভেতরে ঢোকা যায়? গোরস্থানটা বেশ বড়সড় হলেও তার সবটুকু জায়গা সমাধি নিয়ে নয়। ভেতরে এক চতুর্থাংশের মতো জায়গায় সমাধিপ্রস্তর চোখে পড়লো মকবুলের, বাকি জায়গাটুকু ঘাসে ছাওয়া। সমাধির অংশটুকু গোছানো, পরিপাটি, বাকি অংশের ঘাস অযত্নে বেড়ে ওঠা। মকবুল এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা সমাধিপ্রস্তরে লেখা নাম খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। চুনাপাথর নয়, গ্রানাইটের পাতলা অমসৃণ স্ল্যাবে খোদাই করে লেখা বিভিন্ন নাম, বেশির ভাগই রোমান হরফে, তবে চীনা, সিরিলিক আর দেবনাগরীও রয়েছে। মকবুল হেলমেটের ভেতরের স্ক্রিনে ডেটাবেজ খুলে নামগুলো মিলিয়ে দেখতে লাগলো। ইংরেজি, ফরাসি, হিসপানিক, জার্মান, নানা ভাষায় নামের নিচে কিছু কথা লেখা। "এখানে শায়িতা আছে রোজমেরি ফ্র্যাঙ্কলিন, ছয় সন্তানের গর্বিতা মাতা। মৃত্যু: ২১ সন।" মকবুল বিড়বিড় করে বললো, "রোজমেরি ফ্র্যাঙ্কলিন।" হেলমেটের ভেতরের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক যুবতীর বিষণ্ন সুন্দর মুখ। রোজমেরি ফ্র্যাঙ্কলিন, পেশায় ঋণ ঝুঁকি বিশেষজ্ঞ, অপরাধ মদ্যপ অবস্থায় আরেক তরুণীকে বোতল দিয়ে প্রহার। মকবুল এর পরের সমাধির দিকে এগিয়ে গেলো। "জাঁ কুস্তো, একজন আদর্শ নাগরিক। মৃত্যু: ২৪ সন।" ডেটাবেজ জানালো, জাঁ কুস্তো একজন ফরাসি সাংবাদিক, পুলিশকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে দণ্ডিত। কয়েকটা নাম মিলিয়ে দেখে মকবুলের আগ্রহ মরে গেলো। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো সে, এখানে কারোই জন্মসাল উল্লেখ করা নেই। মৃত্যুসাল যেভাবে লেখা, তাতে বোঝা যায়, রোসিওবাসী এখানে ক্যালেণ্ডার শুরু করেছে এই গ্রহে নিজেদের পদার্পণের দিনকে প্রথম দিন ধরে নিয়ে। কয়েকটা কবর পার হওয়ার পর মকবুল দেখলো, এরপরের কবরগুলো ছোটো ছোটো। ছোটো কবরের সংখ্যাই বেশি। ছোটো কবরের সমাধিপ্রস্তরগুলো ক্রমশ মসৃণ, সেটাতে খোদাইয়ের শৈলীও বড়দের নামফলকের চেয়ে সুন্দর। একটা কবরের নাম দেখলো মকবুল, আমির হালেব, মৃত্যু: ৩৩ সন। কবরের আকার দেখে বোঝা যায়, অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়েছে বাচ্চাটার। শিশুদের সারি সারি কবরের পাশ দিয়ে চলতে চলতে মকবুলের মনটা একটু ভারি হয়ে এলো। কোনো কারণে এখানে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। তার মানে অনেক বুড়ো এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু বাচ্চাদের অনেকেই টিকতে পারছে না। কেন? কোনো অজানা রোগ? গোরস্থানের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেই বাইসাইকেল আরোহীর মুখোমুখি হলো মকবুল। প্রথমে যে ব্যাপারটা মকবুলের নজর কাড়লো, সেটা আরোহী নয়, বরং সাইকেলটাই। সাইকেলটা কেবল পুরোনোই নয়, দেখতেও নড়বড়ে আর এবড়োখেবড়ো। এই সাইকেল পৃথিবী থেকে আসেনি, এখানেই বানানো হয়েছে। সাইকেলের কাঠামোটা বেত দিয়ে তৈরি, টায়ারগুলো এবড়োখেবড়ো রাবারের, স্পোকগুলো ইস্পাতের। জিনিসটা দেখতে মোটেও সুন্দর নয়, কিন্তু কাজ যে চলে যায়, সেটা বোঝা যায় পরিষ্কার। এর মালিক অনেকদিন ধরে এটি ব্যবহারই যে করছে, শুধু তা-ই নয়, যত্নও নিচ্ছে, কারণ সাইকেলটা পরিষ্কার, স্পোকগুলো ঝকমক করছে। সাইকেলটার হ্যাণ্ডলবার এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার আরোহী। আরোহীর দিকে চোখ পড়ার পর মকবুল আরেকটু বিস্মিত হলো। লোকটা বয়সে যুবক, মকবুলের মতোই হবে বয়স, কিন্তু চেহারার মধ্যে একটা অপুষ্ট ভাব আছে। উচ্চতায় মকবুলে চেয়ে ঝাড়া এক ফুট খাটো লোকটার পরনের পোশাক শণের তৈরি, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা রোমান টিউনিকের মতো একটা পোশাক, হাতা ছাড়া। রুগ্ন কিন্তু পাকানো হাতের পেশী দেখে বোঝা যায়, শ্রমঘন কাজ করে অভ্যস্ত সে। কোমরে একটা চওড়া বেল্ট, সেই বেল্ট থেকে একটা খাটো তলোয়ার ঝুলছে, যেটা ঊরুর সাথেও ফিতা দিয়ে বাঁধা। তলোয়ারের বাঁটটা কাঠের তৈরি, তাতে সরু সুতো প্যাঁচানো। আর সবচেয়ে যেটা বেমানান, লোকটার হাত পা সরু সরু হলেও পেটটা মোটাসোটা। তার পায়ের জুতোজোড়া খড় আর রাবার দিয়ে তৈরি। "রোসিওতে স্বাগতম।" ঘড়ঘড়ে গলায় ইংরেজিতে বললো যুবক। "আমি হুলিও, পাহাড়গ্রামের শেরিফ।" মকবুল হেলমেটের স্পিকার অন করে হাত তুলে অভিবাদন জানালো। "কমাণ্ডার মকবুল, তৃতীয় কোম্পানি, দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়ন, নভোপুলিশ। অভিবাদন শেরিফ।" হুলিও খুব মনোযোগ দিয়ে মকবুলের পরিচ্ছদ দেখে নিয়ে (বিশেষ করে হোলস্টারে গোঁজা পিস্তলটা) বললো, "গোরস্থানে কী করছেন কমাণ্ডার?" মকবুল হুলিওর প্রশ্নে কাঠিন্যের সুর টের পেয়ে বিরক্ত হলো। "কিছু না শেরিফ, এমনিতেই ঢুকে দেখছিলাম।" হুলিও নিষ্পলক চোখ মকবুলের চোখে রেখে আবার প্রশ্ন করলো, "কী দেখলেন?" মকবুল লোকটাকে না চটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। "অনেক বাচ্চা মারা গেছে দেখলাম। আপনাদের এদিকে কি কোনো ধরনের বড় অসুখ, মহামারী এসব হয়েছে নাকি?" হুলিও কথাটার কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ মকবুলের দিকে তাকিয়ে থেকে সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সাইকেলে চড়লো, তারপর মকবুলের দিকে না তাকিয়ে বললো, "আসুন আপনাকে নগরপালের কাছে নিয়ে যাই।" মকবুল লম্বা পা ফেলে হুলিওর পাশে চলতে লাগলো, লোকটা শ্লথ গতিতে চালাচ্ছে বাইসাইকেল। কিন্তু চালানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, সাইকেল চালাতে সে বিশেষ দক্ষ। "পাহাড়গ্রাম কি এই কলোনির নাম?" মকবুল নীরবতা ভাঙলো মিনিট দুয়েক পথ চলার পর। "হ্যাঁ।" সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো হুলিওর কাছ থেকে। "আরো কলোনি আছে নাকি এটাই একমাত্র?" হুলিও বিরস গলায় বললো, "এটাই একমাত্র কলোনি কমাণ্ডার।" আবহাওয়া কেন্দ্রের সামনে এসে মকবুল সিদ্ধান্ত নিলো, যন্ত্রপাতি পরীক্ষার কাজটা এখনই সেরে নেয়া ভালো। যতো সময় যাবে সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কাজে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। "হুলিও, আপনি অপেক্ষা করবেন একটু? আমি আবহাওয়া কেন্দ্রের মেইনটেন্যান্সটা করে ফেলি।" হুলিও বিনা বাক্যব্যয়ে সাইকেল থামিয়ে নেমে দাঁড়ালো। মকবুল খেয়াল করলো, হুলিও রোগা হলেও তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা টানটান। শেরিফ হিসেবে লোকটা মনে হয় খারাপ নয়। কিন্তু এমন দুবলা শেরিফ কেন বাছাই করেছে এরা? আবহাওয়া কেন্দ্র খুব জটিল কিছু নয়, বাতাসের গতিবেগ, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা ইত্যাদি তথ্য পরিমাপ করে সঞ্চয় করে রাখা হয়, শক্তিশালী একটা যোগাযোগ মডিউলের মাধ্যমে মহাকাশ থেকেই সেসব তথ্য ডাউনলোড করা সম্ভব। একটা ছোটো বায়ু টারবাইন দিয়ে কেন্দ্রের ব্যাটারি চাঙা রাখা হয় সবসময়। মকবুল মিনিট বিশেক ধরে প্রতিটি মডিউল পরীক্ষা করে দেখলো। সবকিছুই ঠিক আছে। যাওয়ার সময় শুধু লুব্রিক্যান্ট পাল্টে দিয়ে গেলেই হবে। আবহাওয়া কেন্দ্রের সংকীর্ণ কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে মকবুল দেখলো, হুলিওর পাশে আরেক যুবক এসে দাঁড়িয়ে আছে। এরও শারীরিক গড়ন আর পোশাক হুবহু হুলিওর মতো, কিন্তু বয়স হুলিওর চেয়ে কম। শুধু তা-ই নয়, বেচারার সাইকেলও নেই। তবে সেই দারিদ্র্য সে পুষিয়ে নিয়েছে অন্যভাবে। এর হাতে ধরা একটা বড় বল্লম। বল্লমের ফলাটা অনেক চওড়া এবং ধারালো। মকবুল ঠিক করলো, নভোপুলিশের কমাণ্ডার হিসেবে পরিস্থিতি এখন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা প্রয়োজন তার। কর্কশ কণ্ঠে গর্জন করে উঠলো সে, "কে তুমি?" তরুণ থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললো, "দি-দিমিত্রি, আমার নাম দিমিত্রি!" মকবুলের হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বার করার পর চটাশ করে একটা শব্দ হয় স্প্রিং লাগানো ফ্ল্যাপের, সেই শব্দটা দিমিত্রি আর হুলিও, দুজনকেই চমকে দিলো। "সোজা পেছনে ফিরে যেদিক থেকে এসেছো সেদিকে হাঁটো। ডবল কদম। জলদি জলদি জলদি!" দিমিত্রি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হুলিওর দিকে একবার, আরেকবার মকবুলের দিতে তাকালো। "আ-আমি তো, আমি তো ...।" "পা চালা!" হুঙ্কার দিলো মকবুল। দিমিত্রি মুখ কালো করে দুই হাতে বল্লমটা ধরে পেছনে ফিরে আস্তে আস্তে ছুটতে লাগলো। মকবুল লক্ষ্য করলো, দিমিত্রির দৌড়ানোর ভঙ্গিতে অভ্যাস আর শৃঙ্খলার ছাপ আছে। এই ছোকরা প্যারেড আর পিটি করে অভ্যস্ত। হুলিও কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সাইকেল ধরে। মকবুল কর্কশ গলায় বললো, "এ কে?" হুলিও আগের মতোই বিরস কিন্তু অবিচলিত কণ্ঠে বললো, "দিমিত্রি নগরপালের দেহরক্ষী। আপনাকে সঙ্গ দিতে এসেছিলো।" মকবুল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হুলিওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "শেরিফ, আমি যতক্ষণ রোসিওতে আছি, সব ধরনের অস্ত্র খাপের ভেতরে থাকুক, তা-ই চাই। আপনি এর দায়িত্ব নিন, এই মুহূর্ত থেকে। ঠিক আছে?" হুলিও নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ মকবুলের পিস্তলের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালো। "ঠিক আছে।" মকবুল বললো, "চলুন তবে।" হুলিও সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলো বিনা বাক্যব্যয়ে। মকবুল পিস্তলটা আবার হোলস্টারে গুঁজলো। চলতে চলতে পথের দুই পাশে গাছপালা দেখতে পেলো সে। জলপাই, ডুমুর আর আপেল গাছ ছাড়াও কয়েকটা তরুণ ওক গাছ মাথা উঁচিয়ে আছে। মৃদু হাওয়ায় দুলছে গাছের পাতা। পৃথিবীর সাথে পার্থক্য একটাই, কোনো পাখির ডাক নেই। শুধু গাছের সরসর শব্দ, আর দূর থেকে ভেসে আসা মানুষের কণ্ঠ। দূরে চত্বরে বেশ কয়েকজন মানুষ এসে জমায়েত হয়েছে, দেখতে পেলো মকবুল। আড়চোখে হুলিওর দিকে তাকিয়ে হেলমেটের টেলিস্কোপটা চোখের সামনে এনে সে দেখলো, রঙিন কাপড় পরা এক বুড়ো কুঁজো হয়ে হাতের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দিমিত্রি তার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, বল্লমটা তার হাতে ধরা। বুড়োর পাশে আরো কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। মকবুল খুঁটিয়ে দেখলো, এদের প্রত্যেকেই রোগাভোগা চেহারার। এরা তো বেশ চাষবাস করে দেখা যাচ্ছে, তাহলে এমন ভুখা চেহারা কেন? বদহজমের রোগ নাকি? ইনসুলিনের কথাটা মনে পড়তেই মকবুল চমকে উঠলো। এরা কি সবাই ডায়াবেটিস রোগী নাকি? জোর কদমে পা চালিয়ে পাথুরে চত্বরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দলটার কাছে হাজির হলো মকবুল। হুলিও একটু পেছনে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালো চুপচাপ। "অভিবাদন, মান্যবর।" হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলো মকবুল। বুড়ো লোকটা বয়সের ভারে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালেও সে দৈর্ঘ্যে আশপাশের লোকগুলোর চেয়ে এককালে বেশিই ছিলো, বোঝা যায়। সবারই পরনে শণের টিউনিক, বুড়োরও পরনে তা-ই, কিন্তু টিউনিকের ওপর একটা রঙিন উলের শাল পরে আছে সে। শালটায় বেশ চমৎকার একটা নকশা। বুড়ো লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে দু'পা এগিয়ে এসে কম্পিত কিন্তু চড়া গলায় বললো, "আমি এভানগেলোস, এই পাহাড়গ্রামের নগরপাল। তোমাকে স্বাগতম হে পৃথিবীবাসী!" মকবুল স্পিকার অফ করে দিয়ে বিড়বিড় করে হেলমেটের অভ্যন্তর স্ক্রিনে নামের তালিকা খুলে পরীক্ষা করতে লাগলো। এভানগেলোস উচ্চারণ করার সাথে সাথে একটা ভুক্তি খুলে গেলো। এভানগেলোস সিমিতিস, পেশায় পেশাদার পকেটমার, অপরাধ একই। ব্যঙ্গের হাসি মুখে নিয়ে যে তরুণের ছবি সেই ভুক্তিতে আছে, তার সাথে এই বৃদ্ধ মেয়রের চেহারার সাদৃশ্য সামান্যই। স্পিকার অন করে মকবুল বললো, "মান্যবর নগরপাল, আমি আপনাদের জন্যে পৃথিবীর পক্ষ থেকে রসদ নিয়ে এসেছি। একই সাথে আমি শক্তিকেন্দ্র, পানি পরিশোধন কেন্দ্র আর যোগাযোগ কেন্দ্র পরীক্ষা করে দেখবো।" এভানগেলোস মকবুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেঁড়ে গলায় বলে উঠলো, "কী বললে?" দিমিত্রি এগিয়ে এসে এভানগেলোসের কানের কাছে চেঁচিয়ে বললো, "ও রসদ নিয়ে এসেছে! আর শক্তিকেন্দ্র পানিকেন্দ্র ভোঁভোঁকেন্দ্র পরীক্ষা করে দেখতে চায়!" এভানগেলোস ফোকলা হেসে বললো, "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! কী রসদ এনেছো দেখি?" মকবুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলা চড়িয়ে বললো, "দেখাবো। কিন্তু তার আগে বলুন, আমি দু'দিন ধরে যোগাযোগ কেন্দ্রে সঙ্কেত পাঠিয়ে কোনো উত্তর পেলাম না কেন?" এভানগেলোস পেছনে দাঁড়ানো এক যুবককে বললো, "য়্যাই ছোকরা, তুই বল দেখি। দারোগা সাহেব উত্তর পায়নি কেন? উত্তর দে হারামজাদা!" চশমা পরা এক রুগ্ন যুবক কয়েক পা এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালো। "কমাণ্ডার, আমি এমিল, যোগাযোগকেন্দ্রের দায়িত্বে আমি আছি।" মকবুল এমিলের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি কোনো সিগনাল পাইনি। কী সমস্যা?" এমিল অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, "ট্র্যান্সমিটারে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। আমরা কিন্তু গতকাল থেকেই অ্যালার্মের জ্বালায় নাজেহাল। সেই দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত একটু পর পর অ্যালার্ম বেজেই যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের করার কিছু ছিলো না।" মকবুল এভানগেলোসের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি যোগাযোগ কেন্দ্র পরীক্ষা করতে যাচ্ছি। আপনার সাথে তারপর কলোনি নিয়ে আলাপ করবো।" এভানগেলোস ফোকলা হেসে সোৎসাহে বললো, "আরে শুধু আমার সঙ্গে কেন? কাউন্সিলের সবার সঙ্গেই কথা বলবে। তারা সবাই আসবে ভোজে।" মকবুল থমকে দাঁড়ালো। "কীসের ভোজ?" এভানগেলোস হাত নেড়ে বললো, "পৃথিবী থেকে এসেছো তুমি, ভোজ হবে না? আজ রাতে মান্যিগন্যিদের সঙ্গে একটা ভোজ আছে। আগামীকাল ছুটি, আগামীকাল হবে বড় ভোজ। এই, এই যে হুলিও, অকম্মার ঢেঁকি, লটারি হয়েছে, য়্যাঁ?" হুলিও স্বল্পবাক মানুষ, বোঝা গেলো, সে বিরস নির্লিপ্ত মুখে বললো, "হ্যাঁ।" এভানগেলোস বললো, "কয়জনকে ডাকছিস তাহলে?" হুলিও নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো, "দুইশো।" এভানগেলোস খনখনে গলায় বকতে লাগলো, "দুইশো জনের পাত পড়বে? য়্যাঁ? বলিস কী? লেকের ধারে টেবিল পাতার ব্যবস্থা করতে বল মেলিন্দাকে। আর রাঁধুনি কে এবার? সেই রাক্ষুসী ফোকলা অপয়া বুড়িটা নাকি? টমাটো আর তেঁতুলের ব্যবস্থা হয়েছে? ..." মকবুল এমিলের বাহু ধরে টান দিয়ে বললো, "চলো।" এমিল কথা না বাড়িয়ে জোরে পা চালালো। "এখানে লোক ক'জন এখন?" মকবুল চাপা গলায় প্রশ্ন করলো। পেছনে এভানগেলোসের তীক্ষ্ণ কাউকাউ শোনা যাচ্ছে এখনও, দিমিত্রিকে মা বাবা তুলে বকা দিচ্ছে সে। "আটশো বারো জন।" এমিল প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো। "আটশো বারো? আটশো বারোজন?" মকবুল একটু চমকে উঠলো। পঞ্চাশজন মানুষ পঞ্চাশ বছর পর আটশো বারোজনের একটা সমাজ গড়ে তুলেছে? এর সাথে যোগ করতে হবে গোরস্থানের আরো সত্তর আশিজনকে। এরা তো মুষলধারে সঙ্গম করেছে দেখি, মনে মনে ভাবলো মকবুল। এমিলও হুলিওর মতোই মিতবাক, সে কোনো উত্তর দিলো না। যোগাযোগকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে মকবুল যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে লাগলো। টিম্বাকটু ছেড়ে আসার আগে একটা টেস্ট সিগন্যাল চালু করে এসেছে সে, দশ মিনিট পর পর সেটা একটা করে পালস পাঠায়। সঙ্কেত গ্রহণের যাবতীয় মডিউল ঠিক আছে, কিন্তু এমিলের কথাই ঠিক, ট্র্যান্সমিটারে কোনো একটা সমস্যা আছে। পকেট থেকে কার্ড বের করে ট্র্যান্সমিটারের বন্ধ কেবিনের দরজা খুলে মকবুল চমকে উঠলো। ট্র্যান্সমিটার মডিউলের জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে, কতগুলো আলোকতন্তুর কেবল ঝুলছে শুধু! অবিশ্বাসভরা চোখে পেছনে দাঁড়ানো এমিলের দিকে তাকিয়ে মকবুল প্রশ্ন করলো, "ট্র্যান্সমিটার কোথায় গেলো?" এমিলের মুখটা এমনিতেই রোগা, শূন্যস্থানটুকু দেখে সেটি আরো রক্তশূন্য হয়ে গেলো। "আমি জানি না কমাণ্ডার!" অসহায় মুখে বললো সে। "এই কেবিনের চাবি তো আমাদের কারো কাছে থাকে না!" মকবুল এমিলের কাঁধে হাত রেখে একটা শক্ত চাপ দিয়ে শীতল ফিসফিসে গলায় বললো, "এটা তাহলে খালি হলো কীভাবে?" এমিলের চোখে ভয়ের ছাপ দেখে খুশি হলো মকবুল। বোঝাই যাচ্ছে এর আগে মিশনে যে কমাণ্ডার এসেছিলো, সে খুলে নিয়ে গেছে ট্র্যান্সমিটার। চাবি ছাড়া এই কেবিনের দরজা খোলা সম্ভব নয়, আর দরজাতেও জোর জবরদস্তির কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু এমিল আর তার সঙ্গীসাথীদের ঘাবড়ে দেয়াটা মকবুলের জন্যে জরুরি। দড়াম করে ট্র্যান্সমিটার কেবিনের দরজা বন্ধ করে মকবুল এমিলের বাহু পাকড়ে ধরে বেরিয়ে এলো যোগাযোগ কেন্দ্র থেকে। বাড়তি মডিউল অবতরণযানে করে নিয়ে এসেছে সে, পরে সেগুলো সাথে করে এনে লাগিয়ে দিতে হবে। বেরিয়ে এসে আবার এভানগেলোসের মুখোমুখি পড়ে গেলো মকবুল, লাঠি ঠুকঠুকিয়ে এগিয়ে এসেছে বুড়ো। পকেট মেরে হাজতে এলেও পরে পলিটিক্সে ঢুকে ব্যাটা নিঃসন্দেহে উন্নতি করেছে, ভাবলো মকবুল। অবশ্য দুই কাজে আজকাল পার্থক্য সামান্যই। এভানগেলোস চেঁচিয়ে উঠলো, "কী রে হারামজাদা, পেলি কিছু? কী সমিস্যা, য়্যাঁ? কাল সারাটা রাত ভোঁভোঁ শব্দ শুনে এক ফোঁটা ঘুমুতে পাল্লাম না এই ঘোড়ার ডিমটার জন্য। কী গো দারোগা, তোমার যন্ত্রের কোনো গতি হলো?" মকবুল এভানগেলোসের পেছন পেছন গোমড়ামুখে আসতে থাকা দিমিত্রির দিকে একটা চোখ রেখে বললো, "এর আগে যে কমাণ্ডার এসেছিলেন, তিনি কি এখান থেকে কোনো যন্ত্র খুলে নিয়ে গিয়েছিলেন?" এভানগেলোস খনখনে গলায় বললো, "তার আমি কী জানি রে বাপু? তোমরা ষাট সত্তর বছর পরপর নিজেদের মর্জিমাফিক আসো যাও, কখন কী সঙ্গে করে আনো, কখন কী সঙ্গে করে নিয়ে যাও সেসব কি হেফজ করে বসে আছি নাকি আমি? কী রে নাতি, তুই বলতে পারিস কিছু? তুই না এখানকার চার্জে আছিস?" এমিল ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়লো, "না দাদু!" মকবুল এমিলের দিকে এবার মনোযোগ দিয়ে তাকালো। এভানগেলোসের নাতি কি না, তা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। অবশ্য, পঞ্চাশজন থেকে বেড়ে আটশো বারোজন হতে গেলে এই বসতিতে এভানগেলোসের আরো এক গণ্ডা নাতিপুতি থাকার কথা। এভানগেলোস বললো, "তুমি না আরো কী সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে?" মকবুল মাথা নাড়লো। "হ্যাঁ, শক্তিকেন্দ্র আর পানি পরিশোধন কেন্দ্র। ওগুলোর দায়িত্বে কারা আছে?" এমিল গলা খাঁকরে বললো, "ওগুলো আমরা চালাই না।" মকবুলের শরীরটা শক্ত হয়ে উঠলো। সবকিছুই কি নষ্ট নাকি এখানে? এরা তাহলে চলছে কীভাবে? "চালাও না মানে?" এমিল নার্ভাস অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করে বললো, "ইয়ে, মানে, আমাদের শক্তিকেন্দ্রের ফুয়েল রড অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আর ... আর পানি পরিশোধন কেন্দ্র ...।" "অনেক আগে ফুয়েল রড ফুরিয়ে গেছে মানে?" মকবুলের প্রশ্নটা শেষ দিকে এসে চাপা গর্জনে পরিণত হলো। এভানগেলোস লাঠি ঠুকে এগিয়ে এলো এক পা। "ফুরিয়ে গেছে মানে ফুরিয়ে গেছে রে বাপ! তোমাদের তো দেখাই পাই না আমরা। নতুন জিনিসপাতি যে নিয়ে আসতে বলবো, সেটার উপায়ও তো নাই!" মকবুল এভানগেলোসের দিকে ফিরে বললো, "একশো বছরের সাপ্লাই দেয়া হয়েছে কয়েক দফায়। ফুয়েল রড ফুরিয়ে যায় কীভাবে এতো জলদি?" একটা ভারি, খসখসে কণ্ঠস্বর বললো, "ফুরিয়ে যায়, যখন টানা ব্যবহার করা হয়। একশো বছর চলতো, যদি আমরা পৃথিবীর ফতোয়া মেনে বছরে চারমাস শক্তিকেন্দ্র চালাতাম।" মকবুল ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো। প্রৌঢ় এক লোক এসে দাঁড়িয়েছে এমিলের পাশে। এমিল, দিমিত্রি বা হুলিওর মতো রোগা নয় সে। তেমন লম্বা না হলেও লোকটা যথেষ্ট শক্তিশালী গড়নের, শক্তিশালী কামানো চোয়াল, শীতল চোখ। অন্যদের মতো শণের টিউনিক পরা তার, কিন্তু কোমরের বেল্টটা টকটকে লাল উলের। "আমি হোসেন।" হাত তুললো লোকটা। "পাহাড়গ্রামের প্রধান প্রকৌশলী।" "মকবুল।" অভিবাদন জানালো মকবুল। হোসেনের বয়সই বলে দিচ্ছে, রোসিওর প্রথম প্রজন্মের লোক সে। "টানা চালানোর কারণ কী?" হোসেন এভানগেলোসের দিকে তাকিয়ে কুর্নিশ করলো, "মাননীয় নগরপাল, কমাণ্ডারকে আমি সঙ্গ দিচ্ছি এখন।" এমিলের দিকে ফিরে একটা ঘোঁৎ শব্দ করলো সে, এমিল ত্রস্ত পায়ে পিছিয়ে অন্য দিকে জোর কদমে হাঁটা দিলো। মকবুলের দিকে ফিরে দুই হাত পেছনে বেঁধে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হোসেন বললো, "আসুন আমার সাথে।" মকবুল একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হোসেনের পাশে চলতে লাগলো। হোসেন চলতে চলতে বললো, "আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমার মা-বাবারা যখন রোসিওতে আসেন, তখন তারা সংখ্যায় অনেক কম ছিলেন?" মকবুল মাথা নাড়লো। "পঞ্চাশ জন।" হোসেন সন্তুষ্ট ঘোঁৎ শব্দ করলো। "হ্যাঁ। পঞ্চাশ জন। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পৃথিবী থেকে মাত্র চারজনকে সক্রিয় অবস্থায় পাঠানো হয়েছিলো। বাকিরা ছিলো প্রাণযতির মধ্যে।" মকবুল একটু হোঁচট খেলো মনে মনে। ডিসপ্যাচের ব্যাপারস্যাপার সে তেমন স্পষ্ট জানে না। হোসেন মকবুলের নীরবতার সঠিক অনুবাদ করে নিয়ে বললো, "পৃথিবী থেকে অনেক রসদ সাথে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখানে এসে সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। ঘাসের বীজ ছড়িয়ে তৃণভূমি বানাতে হয়েছে, গাছের বীজ পুঁতে বাগান বানাতে হয়েছে, একেবারে পাথুরে মাটি চষে ক্ষেত বানাতে হয়েছে, তারপরে শস্যের চাষ শুরু হয়েছে। তার ফল পেতে আরো মাসচারেক সময় লাগে। চারমাস ধরে পঞ্চাশজন মানুষের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা পৃথিবী করেনি। বোধহয় খরচ কমানোর জন্যেই তারা শুধু চারজন মানুষের ছয় মাসের রসদ সঙ্গে দিয়েছিলো। সেই ছয় মাস চারজনকে কাজ করতে হয়েছে। তারা সবকিছু গুছিয়ে আনার পর একে একে বাকিদের প্রাণযতি থেকে চাঙা করে। রোসিওতে আমাদের এই বসতি গড়ার জন্যে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়েছে, তা পঞ্চাশজন মানুষের জন্যে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে তারা অনেকেই নিজেদের পেশায় দক্ষ ছিলো বলে আমরা বর্বর গুহামানব হিসেবে বেড়ে উঠিনি। শিল্পায়ন করতে পেরেছি, তাই ...।" "শিল্পায়ন?" মকবুল নিজের বিস্ময় গোপন করার কোনো চেষ্টা করলো না। হোসেনও নিজের বিরক্তি গোপনের চেষ্টার ধারেকাছ দিয়েও গেলো না। "হ্যাঁ, শিল্পায়ন। ঐ যে দেখছেন চাঁদপাকুড় পর্বত," আঙুল উঁচিয়ে দূরের লালচে এক পর্বতের দিকে ইঙ্গিত করলো হোসেন, "আমরা ওখানে লোহার খনি পেয়েছি। আর ঐ যে পেছনের নাশপাতিয়া পাহাড়, ওখানে পেয়েছি কয়লা। পরিমাণে খুব বেশি নয়, কিন্তু এর সাথে একটু শক্তি যোগ করলেই পেয়ে যাবেন ইস্পাত।" হুলিওর সাইকেল আর দিমিত্রির বল্লমের ছবি মকবুলের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। "কিন্তু কয়লা পেলেন কীভাবে? রোসিওতে তো শুনেছি প্রাণ খুবই নিম্নস্তরের ...।" হোসেন কাঁধ ঝাঁকালো। "পৃথিবীতে কয়লা যেমন গাছ থেকে এসেছে, এখানে সেরকম নয়। এককোষী প্রাণীই একটু একটু করে কয়লার ডিপোজিট করেছে বহু বছর ধরে। সে কারণেই পরিমাণে বেশি পাইনি আমরা। কিন্তু আমাদের কাজ শুরু করার জন্যে সেটা যথেষ্ট।" মকবুল আচমকা খেয়াল করলো, সামনে পথের পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন তরুণী। তাদেরও পরনে শণের টিউনিক। এমিল বা হুলিওর মতো তাদেরও শরীরে কিছুটা অপুষ্টির ছাপ, চোখেমুখে ক্ষুধার্ত ভাব। মকবুল আরও কয়েক পা চলার পর অনুভব করলো, এদের ক্ষুধাটা ঠিক সুবিধার নয়। এভানগেলোস পেছন পেছন আসছে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে, শুনতে পেলো মকবুল। হোসেন আবারও একটা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিলো, কয়েকজন তরুণী একজন আরেকজনকে ঠেলতে ঠেলতে মকবুলের সামনে এসে হাজির হলো। "অভিবাদন নগরপাল। অভিবাদন যন্ত্রপাল।" কলস্বরে বলে উঠলো তরুণীর দল। মকবুল বুক ভরে বোতলের অক্সিজেন শ্বাসে টেনে নিলো। সাত বছর পর সে প্রথম কোনো রক্তমাংসের তরুণীকে দেখছে। মেয়েগুলো রোগাভোগা হলেও, তাদের নারীত্বের চিহ্নে তেমন দৈন্যের আভাস নেই। রোসিওতে প্রায় সব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে মানুষকেই পাঠানো হয়েছে, মেয়েগুলোর মাঝেও তাই আয়তাক্ষী দক্ষিণামেরিকান, তির্যকলোচনা মঙ্গোলয়েড, শ্যামাঙ্গী ভারতবর্ষীয়া, সুডৌলনাসা ককেশিয়া আর স্ফূরিতোষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গিনী রয়েছে। বাদামি চুল চূড়া করে খোঁপা বাঁধা এক তরুণী বললো, "ইশশ কতো লম্বা!" বাকিরা খিলখিল করে হেসে উঠলো এ কথা শুনে। মকবুল অনুভব করলো, তার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শ্যামাঙ্গিনী একটি মেয়ে তার টলটলে চোখ মকবুলের চোখে রেখে এগিয়ে এসে মকবুলের বাহু স্পর্শ করলো। "তোমার গায়ে অনেক জোর, তাই না?" স্পষ্ট গলায় বললো সে। এভানগেলোস হুড়মুড়িয়ে এসে দাঁড়ালো মাঝখানে। "য়্যাই বেলেহাজ ছুকরির দল, গেলি এখান থেকে, য়্যাঁ? এহ, নতুন একটা মুশকো মদ্দা দেখেই একেবারে খলবলিয়ে দৌড়ে এসেছে, যত্তসব গতরখাকির দল ... পালা, পালা এখান থেকে?" মেয়েগুলো একটু ঝুঁকে ব্যঙ্গভরে কুর্নিশ করলো এভানগেলোসকে, টিউনিকের নিচে তাদের অনাবদ্ধ স্তনের খাদ ভেসে উঠলো মকবুলের চোখের সামনে। আয়তাক্ষী একটি মেয়ে এভানগেলোসকে বললো, "আমার জিভে জল চলে এসেছে মান্যবর নগরপাল! অপরাধ ক্ষমা করুন, দোহাই আপনার!" স্বর্ণকেশী মেয়েটি মকবুলের বাহু জড়িয়ে ধরে বললো, "আমরাই বরং কমাণ্ডারকে আমাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাই। চলো কমাণ্ডার, আমাদের সঙ্গে চলো!" এভানগেলোস বেতের লাঠিটা আকাশের দিকে উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, "তোদের কি অসুখ বিসুখের ভয় নাই? জানিস পৃথিবীতে কত রকমের রোগ? তার ওপর এই ব্যাটা পুলিশ! আজ এখানে কাল ওখানে তোদের মতো বদমাশ ছুকরিদের আশকারা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তোদের মাঝে একটা বেলেল্লা যদি অসুখ বাঁধিয়ে বসিস, পরদিন থেকে গোটা পাহাড়গ্রামের ছোকরাদের মধ্যে অসুখ ছড়িয়ে পড়বে, আর তারপর অসুখ বাঁধাবে রাক্ষুসী বুড়িগুলো! ছেনালপনা করতে চাস তো আসিস রাতের বেলা আমার বাড়িতে!" মেয়েগুলো একযোগে ইইইই শব্দ করে মকবুলের আরো কাছে ঘেঁষে এলো। এভানগেলোস ধমকে তাদের হটিয়ে দিলো। মকবুলের দিকে মদির কটাক্ষ হেনে মেয়েদের দল চলে গেলো, যাওয়ার আগে তাদের সঙ্গে পাহাড়গ্রাম ঘুরে দেখার আরেকদফা আমন্ত্রণ জানিয়ে। এভানগেলোস গজগজ করতে লাগলো, "বাপরে বাপ, কী খাইখাই রে ছেমরিগুলির! এই সেদিনও হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতো এগুলো, আর আজ পারলে রাস্তাতেই ধরে পুলিশটাকে খাবলে খেয়ে ফ্যালে! য়্যাই দিমিত্রি, এরা কাদের মেয়ে রে?" দিমিত্রি গোমড়া মুখে বললো, "পাথুরিয়া এস্তেবান, করাতি সলোমন আর কামার তুফান সিঙের মেয়ে এরা।" এভানগেলোস মকবুলের পাজরে কনুই মেরে বললো, "দ্যাখো, দ্যাখো! এই গোটা শহরের সব মেয়ে কোনটা কার, সব এই হারামজাদার মুখস্থ। কাজের বেলায় ঢুঢু, আর খালি মেয়েদের ঠিকুজি হেফজ করে হতভাগাটা!" মকবুল কথা না বলে হোসেনের দিকে চাইলো। হোসেন এতক্ষণ কিছুই বলেনি, শুধু তার কপালে একটা সাংঘাতিক ভ্রুকুটি দেখা যাচ্ছে। গোটা হাঙ্গামা শেষ হওয়ার পর আবার মুখ খুললো সে। "পানি পরিশোধন কেন্দ্রও আমরা বন্ধ করে রেখেছি। এখানে নিয়মিত বৃষ্টি হয়, আর প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়। আমরা কয়েকটা পুকুরের তলা চুনাপাথরের সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছি। বৃষ্টির পানি এসে তাতে জমা হয়, আমরা সেটাই ব্যবহার করি। আর এই যে এই ঘোড়ামুখ লেক দেখছেন, এই লেকের পানি ভয়ানক ক্ষারীয়, আমরা কেবল ধোয়ামোছার কাজে লাগাই।" মকবুল কাঁধ ঝাঁকালো। "তাহলে কি নতুন ফুয়েল রড চাইছেন আপনাদের চাহিদাপত্রে?" হোসেন থমকে দাঁড়ালো। "চাহিদাপত্র?" মকবুল অস্বস্তি নিয়ে হোসেনের মুখোমুখি হলো। "হ্যাঁ। আপনাদের এবারের চাহিদাপত্রে চাইলে ফুয়েল রডের কথা উল্লেখ করে দিতে পারেন। এরপর যে নভোপুলিশ সদস্য আসবেন, তিনি ফুয়েল রড নিয়ে আসবেন সাথে করে, যদি নভোকারাগার প্রকল্প তা অনুমোদন করে।" শেষ অংশটুকু জোর দিয়ে বললো সে। হোসেনের মুখের রং লালচে হয়ে উঠলো। এভানগেলোস লাঠি ঠুকে বললো, "যন্ত্রপাতি আর পরীক্ষা না করলে চলো তোমাকে ওনার কাছে নিয়ে যাই।" হোসেনের মুখের রক্তিমাভার পেছনে রাগ নাকি লজ্জা কাজ করছে, সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মকবুল এভানগেলোসকে প্রশ্ন করলো, "কার কাছে?" এভানগেলোস দিমিত্রিকে পাশে নিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে গেলো, তার খনখনে উচ্চগ্রামে স্বর ভেসে এলো বাতাসে, "রোসিওর রাষ্ট্রপতির কাছে।" মকবুল হোসেনের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলো, লোকটা তার সচকিত বিস্ময় গভীর সন্তোষ নিয়ে উপভোগ করছে। ৩. পাহাড়গ্রাম পুরোটা ঘুরে দেখতে গিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। পর্বতের কল্যাণে এখানে সূর্য আকাশ থেকে হারিয়ে যায় মাঝবিকেলেই। রোসিওর তারার আকার সূর্যের চেয়ে বেশ কিছুটা ছোটো দেখা যায়, রোসিওবাসী একে ডাকে জোনাকি বলে। রোসিওর কয়েদীদের পরবর্তী প্রজন্ম জীবনটাকে কঠোর পরিশ্রম করে গুছিয়ে নিয়েছে, এই সত্যটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সবজি, গম আর সরিষার ক্ষেত উপত্যকার অনেকটা জুড়ে, তারপর তৃণভূমি আর নানারকম গাছপালা। পৃথিবী থেকে মৌমাছিও এসেছে শস্য আর বৃক্ষের পরাগায়নের জন্যে, আর শণ আসে ভাং গাছ থেকে। মধু আর ভাঙের কল্যাণে মাদকেরও কমতি নেই, পড়ন্ত বিকেলেই তার নমুনা দেখা গেলো কিছু। লোকজনের মধ্যে বেশ উল্লসিত ভাব, যদিও তাদের বেশিরভাগেরই চেহারা রোসিওর দ্বিতীয় প্রজন্মের মতো, শীর্ণকায় আর ক্ষুধিত। এভানগেলোস লাঠি উঁচিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবকিছু দেখালো। "ঐ যে ওটা হচ্ছে আমাদের কামারশালা। ওখানে যাবতীয় শক্ত জিনিসপাতি তৈরি হয়। আর ওটা হচ্ছে রাবারশালা। রাবার গাছের বাগান আছে আমাদের এখানে, উউউউই যে ওদিকে, ওখান থেকে আমরা রাবার আনি, আর ওদিকের পাহাড়ে গন্ধক পাওয়া যায়। রাবারে গন্ধক মেশালে অনেক মজবুত হয়, জানো তো? ঐ রাবার দিয়ে আমরা জুতা বানাই, বর্ষাতি বানাই। ওটা হচ্ছে করাতখানা, সব কাঠের কারবার ওখানে। ওর পাশে ওটা হচ্ছে পাথরশাল, পাথর কাটাকাটি খোদাখুদি সব ওখানে করা হয়।" মকবুল শুরুতে ভাবছিলো, নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্রের ফুয়েল রড ফুরিয়ে গেলে এরা বিদ্যুৎ পায় কোত্থেকে, কিন্তু একটা টিলার ওপর চড়তেই তার কাছে উত্তরটা চলে এসেছে। উপত্যকার ঢালে সারি সারি বায়ু টারবাইন বসিয়েছে এরা। হোসেন বেশ নির্লিপ্ত মুখেই জানিয়েছে, ম্যানুয়াল দেখে দেখে ভারি বৈদ্যুতিক যন্ত্র বানাতে পারে তারা। তবে ইলেকট্রনিক্সে তারা কাঁচা, ওরকম কিছু উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি এখনও তাদের হাতের নাগালে আসেনি। চলে আসবে বিশ বছরের মধ্যেই। মকবুল বৈদ্যুতিক কেবলের কথা জিজ্ঞাসা করেনি আর। লোহার আকরিক পাওয়া গেলে রোসিওতে অ্যালুমিনিয়ামের আকরিকও পাওয়া দুষ্কর কিছু নয়। আর রাবার তো এরা রীতিমতো ভালকানাইজ করছেই। এভানগেলোস আবাসিক এলাকার এক প্রান্তে এক চত্বরে নিয়ে এলো মকবুলকে। "এটা হচ্ছে সরাইখানা। আমরা গম থেকে কিছুমিছু বানাই, মধু থেকে কিছুমিছু, আর এই যে দেখছো শণ, শণ আসে ভাং গাছ থেকে, সেটা থেকেও মনে করো কিছুমিছু বানাই। সব কিছুমিছু মিলে, ছুটির দিনে লোকজন খুব শোরগোল করে। এদেরকে ঠাণ্ডা রাখে হুলিও আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। তোমাকে ছেঁকে ধরেছিলো যে বেলেল্লাগুলো, ওগুলো ছুটির দিনে পড়াশোনা ঘরের কাজকম্মো বাদ দিয়ে এসে ছেলেবুড়ো সবার সাথে ঢলাঢলি করে। আর আমি বুড়ো মানুষটা, যার একটু সেবাযত্ন দরকার, যদি একটু হাত ধরে কাছে টানি, যদি একটু রানে চিমটি কাটি, যদি বলি চল আমার সাথে আমার বাড়িতে চল, ইইইই করে আওয়াজ তোলে! উচ্ছন্নে যাবে সমাজটা, বুঝলে? উচ্ছন্নে যাবে।" মকবুল বিরস বদনে বললো, "আসলেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমাকে তো আবার ট্র্যান্সমিটার ঠিক করতে হবে, আবহাওয়া কেন্দ্রেও লুব্রিক্যান্ট ভরতে হবে। আপনাদের রাষ্ট্রপতি মহোদয় আর কাউন্সিল সদস্যদের সাথে কখন সাক্ষাৎ ঘটতে পারে?" এভানগেলোস ব্যস্ত হয়ে বললো, "আরো রোসো না বাপু, এতো তাড়াহুড়ো কেন? রাষ্ট্রপতির ওখানে ভোজ আরেকটু বাদেই। তুমি চাইলে সরাইখানার বাইরে বসে এক পাত্তর মেরে দিতে পারো কিন্তু। আর মুণ্ডুতে এই বয়ামটা লাগিয়ে কেন ঘুরছো দারোগা বাবা? আমাদের এখানে এমন কোনো ভূতপেত্নী নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ওটা খুলে বোসো, চাঁদিতে আমাদের এখানকার নিম্মল হাওয়া লাগাও একটু।" চত্বরের মাঝখানে একটা ভাস্কর্য আছে, এভানগেলোসের কথায় পাত্তা না দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো মকবুল। কয়েক পাত্র মদ খেয়ে রোসিওর কচি মেয়েগুলোর সাথে হুল্লোড় করতে পারলে মন্দ হতো না, কিন্তু পেনশন কাটা যেতে পারে। সব আলাপই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লগ হয়ে যাচ্ছে মকবুলের হেলমেটের ক্ষুদে ইভেন্ট লগারে, এগুলো তাকে জমা দিতে হবে রিপোর্টের সাথে। চত্বরের ওপাশ থেকে এক যুবতী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো এভানগেলোসের কাছে, মকবুলের শরীর আরেকবার উষ্ণ হয়ে উঠলো তাকে দেখে। মেয়েটা অন্যদের মতো রুগ্ন নয়, তার চেহারায় একটা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের দ্যুতি কমনীয় মুখশ্রীকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে। অন্যদের মতো এই মেয়েটিও হাঁটু পর্যন্ত টিউনিক পরে আছে, দৌড়ের তালে তালে দুলে উঠছে তার বুক, ভরাট তামাটে ঠোঁট দুটি একটু ফাঁক হয়ে আছে শ্বাসের তোড়ে। "অভিবাদন নগরপাল!" হাঁপাতে হাঁপাতে বললো মেয়েটা। "লেকের পাশে পার্কে দুশো মানুষের বসার আয়োজন করেছি, মান্যবর!" এভানগেলোস স্নেহের হাত রাখলো মেয়েটার কাঁধে, কিন্তু মেয়েটা সম্ভবত এভানগেলোসের স্নেহের সাথে পরিচিত, সে মুচড়ে সরে গেলো মেয়রের হাতের নাগাল থেকে। এভানগেলোস মনমরা গলায় বললো, "সাবাশ মেলিন্দা। খুব ভালো করেছো। ইয়ে, রান্নার আয়োজন নিয়ে আমরা রাতে কথা বলবো, কেমন? এসো আমার বাড়িতে।" মেলিন্দা মুখের হাসি বজায় রেখেই বললো, "না মান্যবর। যা বলার এখনই বলুন। রাতে ঘুমোতে হবে জলদি জলদি। আগামীকাল অনেক কাজ।" এভানগেলোস গজগজ করতে করতে বললো, "কই হে দারোগা, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মেলিন্দা, আমাদের পাহাড়গ্রামের উৎসবকর্ত্রী। সব বড় উৎসব সে আয়োজন করে। আর এ হচ্ছে মফিদুল, নভোদারোগা, বিরাট কমাণ্ডার।" মকবুল হেলমেটের এপাশেই হাসলো মেলিন্দার চোখের দিকে তাকিয়ে। "মকবুল। অভিবাদন।" মেলিন্দা আন্তরিকতার সাথে মকবুলের বাহু জড়িয়ে ধরলো। "স্বাগতম কমাণ্ডার। আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। আপনি কালকে ভোজে থাকছেন কিন্তু!" মেলিন্দার নৈকট্য আর আমন্ত্রণভরা আয়ত চোখ মকবুলের হাঁটুর কাছটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে শক্তিরহিত করে তুললো। কী ক্ষতি যদি সে এই মেয়েটার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটায়? সাত বছর! সাত বছর সে কোনো মেয়ের সাথে সময় কাটায় না। আরও তিনটা বছর সে কীভাবে কাটাবে টিম্বাকটুতে? মার্থা তিশিয়ানো এ কারণেই কি তাদের সঙ্কট ব্যবস্থাপনা ক্লাসে পইপই করে বোঝানোর চেষ্টা করতো, কখনও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যোগাযোগ রাখবে না? যা ঘটবে সব ভুলে যেতে হবে। আর নারীসান্নিধ্য, নৈব নৈব চ। অসুখের ভয়, কোয়ার‍্যানটাইনে আটকের ভয়, পেনশন কাটা যাওয়ার ভয়, জেলজরিমানার ভয়। মেলিন্দা অনেকখানি পথ ছুটে এসেছে, তার বুক এখনও দুলে উঠছে নিঃশ্বাসের তালে, মকবুল মনে মনে নিজের গালে প্রচণ্ড একটা চড় কষালো। মেলিন্দাকে বাহুলগ্ন করেই সে ঘুরে দাঁড়ালো, "আপনার আমন্ত্রণ ... মানে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলে আমি খুবই আনন্দিত হতাম। কিন্তু এই দুঃখ নিয়েই আমাকে ফিরে যেতে হবে মিস। ... কিন্তু আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন, এই ভাস্কর্যের মানে কী?" চত্বরের ঠিক মাঝে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি অদ্ভুত একটা ভাস্কর্য। একটা ভেড়ার গলায় ছুরি চালাচ্ছে এক মহিলা। ভাস্কর্যটা যে তৈরি করেছে, তার হাত যথেষ্ট পাকা। রোদবৃষ্টিতে ভাস্কর্য খানিকটা ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু আবেদনটা তাতে মলিন হয়নি। দিগন্তে পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিচ্ছে রোসিওর জোনাকি, পড়ন্ত আলোয় মেলিন্দার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মকবুল আরও একবার বিবেচনা করলো, পেনশন কাটা গেলে কী এমন ক্ষতি হতে পারে। মেলিন্দা অসহায় হেসে মকবুলকে বললো, "আমি ... আমি ঠিক জানি না কমাণ্ডার, এটা যখন তৈরি হয় তখন আমি অনেক ছোটো ছিলাম, সম্ভবত মান্যবর কলাপাল আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন।" "কলাপাল?" মকবুল প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো এভানগেলোসের কাছে, বুড়ো কাছেই লাঠির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে দেখছে মেলিন্দা আর মকবুলকে, ভ্রুতে ঘোর অসন্তোষ নিয়ে। "আমরাও তো ছবিটবি আঁকি রে দারোগা। মূর্তিটুর্তিও গড়ি। গানবাজনাও খারাপ করি না। শিল্পোসমোসকৃতির এসব ব্যাপারস্যাপার একজন দেখাশোনা করে, বুড়ো গনজালেস। সে-ই আমাদের চিফ আর্টিস্ট, কলাপাল। এ জিনিস তারই পয়দা।" হেলমেটের ক্ষুদে কিন্তু শক্তিশালী টর্চ জ্বালিয়ে মকবুল মূর্তিটা আরেকবার ভালোমতো দেখে নিলো। কেন যেন ভেড়া জবাইরত মহিলাটিকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। "আপনাদের ভেড়া আর মুরগির খামারটা কোথায় করেছেন?" মকবুল টর্চ নিভিয়ে মেলিন্দাকে প্রশ্ন করলো, মেয়েটার সঙ্গ তার ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। সেটা টের পেয়েই বোধহয় এভানগেলোস হুড়ো দিলো মেলিন্দাকে। "মেলিন্দা, বাছা, তোমার অনেক কাজ আগামীকাল। তুমি এসো বরং এখন। কাজটাজ করো। আর আমরা নিরিবিলি দুজনে কিছু আলাপ করবো, কেমন?" মেলিন্দা মকবুলের শরীরে মৃদু ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো, "কমাণ্ডার, আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। কাল ভোজে আপনি থাকছেন, আপত্তি করলে চলবে না কিন্তু! আসি।" মকবুল বায়ুরোধী পোশাকের নিচে নিজের উত্থান দমন করার চেষ্টা করতে করতে জোর পায়ে অন্যদিকে চলতে থাকা মেলিন্দার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা পেছন থেকেও দেখতে দারুণ! এভানগেলোস গলা খাঁকরে বললো, "চারটা বাজতে চললো। কই হে যন্ত্রপাল, চলো, দারোগাবাবুকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে যাই। পেটে তো কিছু পড়েনি দুপুরের পর থেকে। তোমার খিদে লাগেনি কমাণ্ডার?" মকবুল আবারও জিজ্ঞাসা করলো, "আপনাদের ভেড়ার খামার কি ওদিকে নাকি?" আঙুল তুলে একটা টিলার দিকে নির্দেশ করলো সে। এভানগেলোস মাথা নেড়ে বললো, "নাহ, ওদিকে নয়, অন্যদিকটায়। চলো, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আর কাউন্সিল সদস্যদের সাথে মোলাকাত সেরে আসি। আমাকে আবার একটু জলদি জলদি বাড়ি ফিরতে হবে। মেলিন্দা ছুঁড়িটাকে বাগ মানানো বড় শক্ত। মেয়েটা যেদিকেই যায় সবকিছু শক্ত করে তোলে ...।" মকবুল কথাটার সাথে একমত না হয়ে পারলো না। আবাসিক এলাকাটুকু ছোটো ছোটো টিলার ওপরে বানানো প্রশস্ত ঘর আর ফাঁকে ফাঁকে চত্বর নিয়ে তৈরি, কিন্তু রোসিওর রাষ্ট্রপতির বাসভবন এই এলাকা থেকে দূরে, একটা বড় পাহাড়ের ঢালে। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর করে বসানো পাথরের ধাপ চলে গেছে সেই বাড়ি বরাবর। বাড়িটা পাহাড়গ্রামের অন্যান্য বাড়ির মতোই কাঠের তৈরি, কিন্তু অনেক প্রশস্ত। মকবুল পেছনে লাঠির শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো, আরো কয়েকজন বয়স্ক মানুষ লাঠি ঠুকতে ঠুকতে উঠে আসছে পাহাড় বেয়ে। এরাই বোধহয় কাউন্সিলের সদস্য। জোনাকি পুরোপুরি দিগন্তরেখার ওপাশে হারিয়ে গেছে, আকাশে পৃথিবীর মতোই বিলীয়মান রক্তিম আভা। রাষ্ট্রপতির বাড়ির বারান্দায় একটা লণ্ঠন জ্বলে উঠেছে, দেখতে পেলো মকবুল। নিচে হ্রদের পাশে টিলার ওপর ঘরগুলোয় টিমটিমে আলো জ্বলা শুরু করেছে। সড়ক আর চত্বরে জ্বলে উঠেছে বৈদ্যুতিক বাতি। সবকিছু পৃথিবীর মতোই, অথচ পৃথিবী নয়। মকবুল নতুন করে নিঃসঙ্গ বোধ করলো আবার। এভানগেলোসের পিছু পিছু রাষ্ট্রপতির বাড়ির বারান্দায় উঠে এলো মকবুল। মাঝবয়েসী একজন মানুষ সেখানে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে, তার পরনে সাধারণ পোশাক, কিন্তু গায়ে এভানগেলোসের মতোই রঙিন নকশাকরা উলের চাদর। লণ্ঠনের আলোয় সে নকশাটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো মকবুল। একটা ভেড়ার মাথা। এভানগেলোস হাত তুলে অভিবাদন করলো। "শুভ সন্ধ্যা হেক্টর। রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ কামনা করছি।" হেক্টর কুর্নিশ করলো। "শুভ সন্ধ্যা মান্যবর নগরপাল। রাষ্ট্রপতি অতিথিদের জন্যে ভোজঘরে অপেক্ষা করছেন।" এভানগেলোস পেছনে তাকালো, পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে বৃদ্ধ কাউন্সিল সদস্যেরা। "আসুক ওরা আস্তে আস্তে, চলো হে দারোগা, রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ করিয়ে দিই তোমাকে।" হেক্টর মৃদু গলায় বললো, "কোনো অস্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করা নিষিদ্ধ। আপনার আগ্নেয়াস্ত্রটি আমার কাছে জমা দিয়ে যান, কমাণ্ডার।" মকবুল একটু ঝুঁকে বিনয়ের সাথে বললো, "আমি এই নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, আমি যে কাজে এসেছি, তাতে এই অস্ত্রটি আমার হাতছাড়া হওয়ার উপায় নেই। প্রয়োজনে আমি রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ ছাড়াই ফিরে যেতে প্রস্তুত আছি।" হেক্টর ফিরে চাইলো এভানগেলোসের দিকে, বুড়ো খনখনে গলায় বললো, "আরে এতো দেমাগ দেখাও কেন রে বাবা হেক্টর, এ তো পৃথিবীর পুলিশ রে। রাষ্ট্রপতিকে সে কি গুলি করে মারতে এসেছে নাকি? আর রাষ্ট্রপতিকে গুলি করলে ও আস্ত থাকবে? য়্যাঁ? তোমার প্রিটোরিয়ান প্রহরীরা কোথায়?" হেক্টর মকবুলের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। "আসুন কমাণ্ডার, ভেতরে আসুন।" মকবুল আবারও মৃদু ঝুঁকে ধন্যবাদ জানালো, "ধন্যবাদ, প্রিটর হেক্টর।" হেক্টরের মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো। মকবুলের সম্বোধন ভুল নয়, হেক্টর রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী দলের প্রধান, সেনাধ্যক্ষ তাকে বলাই চলে।" মকবুল আরও লক্ষ্য করলো, হেক্টরের কোমরে কোনো ধরনের অস্ত্র ঝোলানো নেই। মনে মনে আরও সতর্ক হয়ে উঠলো সে। এরা যখন ইস্পাত বানাতে পেরেছে, তখন আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করতে পারাও অসম্ভব কিছু নয়। এখন পর্যন্ত কারো কাছে সে জিনিস না থাকলেও, হেক্টরের কাছে থাকতে পারে। হাজার হোক, রাষ্ট্রপতির রক্ষীবাহিনীর প্রধান বলে কথা। ভোজঘরটা যথেষ্ট বড়, তাতে যে টেবিলটি পাতা আছে সেখানে হেসেখেলে পঞ্চাশ জন লোক ফেলেছড়িয়ে খেতে পারবে। টেবিলের দূরবর্তী প্রান্তে বসে আছে কেউ একজন। নিঃসন্দেহে তিনিই রাষ্ট্রপতি। ঘরের ভেতরে অনেকগুলো লন্ঠন জ্বলছে, কোনো অন্ধকার নেই। মকবুল দেয়ালের দিকে তাকালো, সেখানে কাঁচা হাতে আঁকা বেশ কিছু আবক্ষ প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে। মকবুল হেক্টরের পিছু পিছু এগিয়ে গেলো মাপা পায়ে। প্রশস্ত কাঠের চেয়ারের ওপর একটা গদি পাতা, তাতে জবুথবু হয়ে যে লোকটা বসে আছে, তার বয়স কমপক্ষে নব্বই হবে। লোকটার চোখে একটা মোটা ঝাপসা লেন্সের চশমা, মাথায় কয়েক গাছা পাকা চুল, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে। পরনে শণের টিউনিক, তার ওপরে উলের নকশা করা চাদর। নকশাটা খুবই বাহারি, রাষ্ট্রপতির জন্যে বিশেষভাবে করা নিশ্চয়ই। মকবুল রোসিওর রাষ্ট্রপতিকে কুর্নিশ করে নিজের পরিচয় দিলো। "আমি কমাণ্ডার মকবুল, তৃতীয় কোম্পানি, দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়ন, নভোপুলিশ।" রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণ চুপচাপ মকবুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় বললেন, "আমার নাম রাগনার। আমি তোমার কাছে একজন বন্দী, কিন্তু রোসিওর লোকজন আমাকে এই সমস্ত গ্রহের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছে। আমি চাই তুমি তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখাও।" মকবুল আবার কুর্নিশ করলো। কে যায় খামাকা ঝামেলা পাকাতে? এই লোক নিজেকে রোসিওর রাষ্ট্রপতি ভেবে খুশি থাকলে থাকুক না। স্পিকার অফ করে সে হেলমেটের ভেতরের স্ক্রিনে তথ্যভাণ্ডার খুঁজতে লাগলো আবার। রাগনার ওলাফসন, পেশায় আইনজীবী, অপরাধ ছিলো দ্বিগামিতা। রাষ্ট্রপতি রাগনার ইশারায় মকবুলকে পাশে চেয়ারে বসতে বললেন। মকবুল সাবধানে একটা চেয়ার টেনে বসলো। রাগনার নিচু গলাতেই বললেন, "আমরা এখন সামান্য কিছু খাবো, আর সবার স্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে পান করবো। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারো, তোমার হেলমেটটিও খুলে রাখতে পারো।" মকবুল একটু ইতস্তত করে হেলমেটটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলো। কেবল তার নাকে অক্সিজেনের প্লাগটুকু রয়ে গেলো। আরো কয়েকজন বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘরে, রাষ্ট্রপতি এক হাত তুলে তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। "স্বাগতম, মাননীয় কাউন্সিল সদস্যবৃন্দ। আমাদের অতিথির সাথে পরিচিত হোন।" মঙ্গোলয়েড চেহারার এক বৃদ্ধ এসে কম্পিত কণ্ঠে বললো, "জলদি জলদি খানা লাগাতে বলুন মাননীয় রাষ্ট্রপতি। সবার আগে এক পাত্র ভাঙের শরবত হলে সবচেয়ে ভালো হয়।" রাগনারকে কিছুই বলতে হলো না, শণের টিউনিক পরা এক তরুণ এসে প্রত্যেকের সামনে এক পাত্র করে পানীয় রেখে গেলো। মকবুল এক এক করে কাউন্সিলরদের খুঁটিয়ে দেখলো। সব মিলিয়ে সাতজন কাউন্সিলর, প্রত্যেকেরই বয়স আশির কোঠায় বলে মনে হচ্ছে। এরা নিঃসন্দেহে সবাই রোসিওর মূল কয়েদী দলের লোক। রাগনার বললেন, "আগামীকাল আমাদের এক বিরাট ভোজ হবে, তোমার সম্মানে। আশা করি তুমি তাতে অংশ নেবে।" মকবুল বিনয়ের সাথেই বললো, "মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমি দুঃখিত যে আমাকে আজই চলে যেতে হবে। আপনার এবং মাননীয় কাউন্সিলরদের সাথে আলাপের পর আরো দু'টি কাজ আমাকে সম্পন্ন করে আজই ফিরে যেতে হবে।" রাগনার কিছু বললেন না আর, পরিচারক এসে খাবার পরিবেশন করা শুরু করলো। রাগনার পানীয়ের পাত্র তুলে ধরে বললেন, "সকলের সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে পান করছি।" কাউন্সিলররা সোৎসাহে পাত্র তুলে কড়া চুমুক দিলো। মকবুল সাবধানে পাত্র তুলে ঠোঁটের কাছে ধরলো, সিদ্ধির শরবত খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। তবে পাত্রটা চীনামাটির তৈরি, বেশ বাহারি জিনিস। যদি রোসিওতে বানানো হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে এদের মধ্যে বেশ দক্ষ মৃৎশিল্পীও রয়েছে। খাবার যা পরিবেশন করা হয়েছে, তা দেখে বেশ বিস্মিত হলো মকবুল। রাষ্ট্রপতি আর কাউন্সিলররা সবাই বোধহয় নিরামিষাশী। পরিবেশন করা হয়েছে ধোঁয়া ওঠা গরম গমের রুটি, সরু লম্বা সাদা ভাত, অনেক রকমের সব্জির ভাজাভুজি, মসুরের ডাল, সীমের বিচি, বেগুন ভাজা, সব্জি আর ফলের সালাদ আর ফলের রস। মহাকাশযানে দীর্ঘদিন কৃত্রিম সংশ্লেষিত খাবার খেয়ে খেয়ে মকবুলের অরুচি চলে এসেছে, টাটকা খাবার সামনে পেয়ে সে সানন্দ আগ্রহ নিয়ে খেয়ে চললো। খাওয়া শেষে সকলের জন্যে ধূমায়িত চা নিয়ে আবার ঘরে ঢুকলো পরিচারক। রাগনার বললেন, "আলাপ শুরুর আগে তোমার জন্যে একটা উপহার আছে কমাণ্ডার। আমার নাতনি তোমার জন্যে একটা ছবি এঁকেছে। তুমি অনুমতি দিলে সে সেটা নিজের হাতে তোমাকে উপহার দিতে চায়।" মকবুল অপ্রতিভ কণ্ঠে বললো, "নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।" রাগনার একটা ছোটো ঘন্টা তুলে বাজালেন। ষোড়শী এক তরুণী সলজ্জ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। তার পরনে সাধারণ পোশাক। এই মেয়েটির চেহারাতেও সেই হাড়গিলে রুগ্নভাব, কিন্তু তার শরীর বেশ প্রস্ফূট। মেয়েটি মকবুলের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বললো, "কমাণ্ডার, আপনার জন্যে এই উপহার।" একটা কাঠের ট্রে-র ওপরে একটা ক্যানভাসের ওপর একটি তৈলচিত্র আঁকা। তাতে একটি অবতরণযানের ছবি, তার সামনে নভোপুলিশের উর্দি পরা এক লোক দাঁড়িয়ে। মকবুল চিত্রকর্ম তেমন বোঝে না, সে শুধু জানে কিছু শিল্পী ছবিতে স্বাভাবিক রং বসায়, আর কিছু শিল্পী ভুলভাল রং দেয়, রাষ্ট্রপতির চৌত্রিশ ইঞ্চিসম্পন্না ডবকা নাতনিটি মনে হচ্ছে দ্বিতীয় দলের। মেয়েটি যে ভঙ্গিতে ছবিটি নিবেদন করছে, তাতে বোঝা যায়, সে নিজেকেও উপহার দিতে বেশ ব্যগ্র। মকবুল বহুকষ্টে নিজের নাকের কয়েক ইঞ্চি সামনে প্রস্ফূটিত স্তনস্তবক থেকে চোখ সরিয়ে প্রশংসার অভিব্যক্তি ফোটানোর চেষ্টা করলো। সবুজ আকাশ, মেরুন অবতরণযান, গোলাপি ইউনিফর্ম, কালো নভোপুলিশ। পুলিশটি শুধু কালোই নয়, তার চেহারাও আফ্রিকানদের মতো। রাগনার বললেন, "এই ছবিটি এঁকে এডনা গত বছর পাহাড়গ্রামের সেরা শিল্পীর পুরস্কার জিতেছে।" মকবুল বহু কষ্টে এডনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, "চমৎকার এডনা। খুব সুন্দর। দারুণ ফুটে উঠেছে সবকিছু।" এডনা আমন্ত্রণভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মকবুলের দিকে। মকবুল মাথা চুলকে বললো, "ছবিটা কি আমি গোল করে পাকিয়ে সঙ্গে নিতে পারি?" রাগনার বললেন, "এডনা, তুমি ছবিটা কমাণ্ডারের জন্যে প্যাকেট করো গিয়ে, যাও।" এডনা হাসিমুখে ছবি তুলে নিয়ে চলে গেলো কোমর দুলিয়ে। মকবুল তাড়াহুড়ো করে পেয়ালায় চা ঢেলে নিলো কেটলি থেকে। রাগনার বললেন, "তোমার নাম বানান করো কীভাবে কমাণ্ডার?" মকবুল থতমত খেয়ে বললো, "কেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি?" রাগনার বললেন, "তোমার নামের সঠিক উচ্চারণ বুঝতে পারছি না, তাই। ইংরেজিতে কীভাবে লেখো?" মকবুল অপ্রস্তুত হয়ে বললো, "এম ও কিউ বি ইউ এল। মকবুল।" রাগনার আসনের পাশ থেকে একটা তুলোট কাগজ আর কালির দোয়াত বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। হেক্টর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই কাগজে একটা কিছু লিখলো খসখস করে। রাগনার পকেট থেকে একটা সিল বার করে কালিতে চুবিয়ে কাগজে সিল মেরে বললেন, "কাউকে দিয়ে এস্তেবানের কাছে পাঠিয়ে দাও। কাজে লেগে পড়ুক সে।" কাউন্সিলররা সকলেই চায়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চুমুক দিচ্ছে, মকবুল সাবধানে চায়ের কাপে একটা ছোটো চুমুক দিলো। চমৎকার সুগন্ধী চা, বোধহয় কোনো ফুলের পাঁপড়ি মেশানো। হেক্টর কাগজের টুকরোটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো, রাগনার নিজের আসনে হেলান দিয়ে বসে বললেন, "এবার বলো মকবুল।" মকবুল বললো, "আমি আসলে আপনাদের চাহিদাপত্র নিয়ে যেতে এসেছি। যোগাযোগ কেন্দ্র বিকল হয়ে পড়ে ছিলো, নইলে হয়তো আমাকে আসতেও হতো না। আমি সরাসরি একটা ক্যাপসুলে করে সব রসদ পাঠিয়ে দিতাম।" রাগনার কাউন্সিলরদের দিকে তাকালেন। কাউন্সিলররা সবাই নির্বিকার চুমুক দিচ্ছে চায়ের পেয়ালায়। এভানগেলোসের চুমুকের আওয়াজ সবচেয়ে উচ্চগ্রামে শোনা যাচ্ছে। রাগনার বললেন, "আমাদের কোনো চাহিদাপত্র নেই। আমরা যা চাই তা পেয়ে গিয়েছি।" মকবুল বিস্মিত হলো কথাটা শুনে। চাহিদাপত্র নেই মানে? "আপনারা একটা ইনসুলিন প্ল্যান্ট চেয়েছিলেন ...", মকবুল কেশে শুরু করলো। রাগনার একটা হাত তুললেন। মকবুল থেমে গেলো। রাগনার বললেন, "আমরা কুড়ি বছর আগে ইনসুলিন প্ল্যান্ট চেয়েছিলাম। কিন্তু আর পাইনি। এখন আর আমাদের ইনসুলিন প্ল্যান্টের প্রয়োজন নেই বলে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি।" মকবুল এবার নিজের ভেতরে একটা ক্রোধের ছোঁয়া অনুভব করলো। ঘটনা কী? সে কণ্ঠস্বরে রাগের আঁচ লাগতে না দিয়ে প্রশ্ন করলো, "তাহলে আপনি আমার কিছু কৌতূহল নিবৃত্ত করুন বরং।" রাগনার মাথা ঝাঁকালেন, "চেষ্টা করতে পারি।" মকবুল বললো, "কিছু জিনিস একেবারেই হিসেবে মেলাতে পারছি না আমি। আপনাদের সর্বশেষ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেখলাম, তাদের দেখে মনে হয় তারা কোনো অসুখে ভুগছে। সবাই পেটরোগা। কিন্তু আপনারা বা আপনাদের সন্তানদের প্রজন্মের সবাই মোটামুটি স্বাভাবিক। আপনাদের কমিউনিটিতে কি কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়েছে? আপনারা কি এ কথা গোপন করে যেতে চান পৃথিবীর কাছ থেকে?" রাগনার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, "না, কোনো রোগ আমাদের নাতি নাতনিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি। তাদের খাদ্যাভ্যাস আমাদের তুলনায় একটু ভিন্ন, এ কারণে হয়তো তোমার চোখে তাদের পেটরোগা মনে হচ্ছে। তবে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কর্মক্ষম।" মকবুল সোজা হয়ে বসে শক্ত গলায় বললো, "আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না মাননীয় রাষ্ট্রপতি। আপনাদের গোরস্থানে আমি ঢুকেছিলাম। আমি দেখেছি, সেখানে সারি সারি শিশুর কবর। কী হয়েছিলো ঐ শিশুদের?" কাউন্সিলররা সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রাগনার নিরুত্তেজ গলায় বললেন, "সারি সারি শিশুর কবর? আমাদের এখানে কয়েকটা বাচ্চা মারা গেছে জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে, কিন্তু সারি সারি কবর দেয়ার মতো এতো শিশুর মৃত্যু তো হয়নি। তুমি ভুল দেখেছো।" মকবুলের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে জানতো, একটা কিছু ঘাপলা আছে রোসিওতে। কিন্তু এ নিয়ে বুড়োকে পরে চেপে ধরবে সে। "ইনসুলিন প্ল্যান্ট আপনারা কেন চেয়েছিলেন?" রাগনার কাঁধ ঝাঁকালেন। একজন কাউন্সিলর খুনখুনে গলায় বলে উঠলো, "রোসিওতে সবাই কমবেশি ডায়াবেটিক রোগী হে দারোগা। আমরা তো বটেই, আজকালকার ছোঁড়াছুঁড়িগুলোও পটাপট ডায়াবেটিস বাঁধিয়ে বসছে। ওষুধ আর কতো মাঙিয়ে আনবো? আমরা নিজেরা একটা প্ল্যান্ট পেলে নিজেরাই বানিয়ে নিতে পাত্তাম, সেটাও বোঝো না?" মকবুল এবার তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, "আপনাদের যোগাযোগ কেন্দ্রে ট্র্যান্সমিটার মডিউলগুলো পাওয়া যায়নি। কেউ ওগুলো খুলে নিয়ে গেছে। কে খুলেছে, কেন খুলেছে?" রাগনার মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, "যোগাযোগ কেন্দ্র আমি আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর আগে নিজের হাতে অ্যাসেম্বল করেছিলাম ম্যানুয়াল দেখে দেখে। ট্র্যান্সমিটার মডিউল তো তালাবন্ধ থাকে। সেই তালার চাবি থাকে তোমাদের হাতে, পুলিশের হাতে। সেটা যদি কেউ খুলে থাকে, তোমাদের লোকই হয়তো খুলেছে।" মকবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীর কণ্ঠে বললো, "রোসিওর প্রতীক কি ভেড়া?" কাউন্সিলররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আবার। রাগনার সোজা হয়ে বসে একটা কঠিন হাসি মুখে নিয়ে মকবুলকে বললেন, "কেন তোমার এ কথা মনে হলো?" মকবুল বললো, "আপনাদের সকলের গায়ে চাদরের নকশায় ভেড়ার মাথা দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের খাবার টেবিলে কাপড়ের মাদুরের ওপরে ভেড়ার মাথা নকশা করা। আপনার পেছনে দেয়ালে একটা ভেড়ার শিংওয়ালা মাথা স্টাফ করা। আপনার নাতনির গলায় একটা হার ঝুলছে, সেখানে ভেড়ার মাথার লকেট। আর আপনার সিলটাও ভেড়ার মাথার। রোসিওতে আপনারা ভেড়ার মাথার অনেক দাম দেন, বুঝতে পারছি।" রাগনার কঠিন হাসিটা মুখে রেখেই বললেন, "এটা কি তোমাদের পুলিশে রিপোর্টে পাওনি?" মকবুল মাথা নাড়লো। "না। পুলিশের রিপোর্টে এসব কিছু নেই। এমনকি রাষ্ট্রপতির কথাও সেখানে বলা নেই। আমার ধারণা যদি ভুল না হয়, এই ভড়ংগুলো খুব বেশিদিন ধরে হয়নি। বড়জোর কুড়ি বছর ধরে চলছে। কারণ আমাদের শেষ রিপোর্ট কুড়ি বছর আগের।" রাগনারের মুখ থেকে হাসি মুছে গেলো। তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, "ভড়ং?" মকবুল চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলো, হেক্টর ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে এদিকে। মকবুল ঘাড় না ঘুরিয়েই বললো, "মাননীয় রাষ্ট্রপতি, আপনার প্রিটর যদি আমার ধারে কাছে আসে, আমি তাকে পিটিয়ে তক্তা বানাবো, এ কথাটা তাকে জানিয়ে দিন।" রাগনার কঠিন চোখে মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমরা, নভোকেন্দ্রের মাতবররা কি ভেবেছো, আমরা সারাটা জীবন, বাপ-ছেলে-নাতি সবাই তোমাদের কয়েদ থেকে যাবো?" মকবুল শক্ত, হিংস্র গলায় বললো, "হ্যাঁ! এটা একটা জেলখানা, আপনাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আপনারা হয়তো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বাস করতে পারছেন, কিন্তু এ কথাটা ভুলে যাবেন না! এটা একটা জেল, আপনারা সকলে কয়েদী! আপনারা ছেলে-নাতি পয়দা করতে পেরেছেন নভোকেন্দ্রের মাতবরদের দাক্ষিণ্যেই। পৃথিবীতে থাকলে বাচ্চা পয়দা করার সুযোগ পেতেন আপনারা?" রাগনার শক্ত, নিচু গলায় বললেন, "কয়েদীর সন্তানও কয়েদী হবে? বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকবে এমন?" মকবুল একই রকম হিংস্র কণ্ঠে বললো, "হ্যাঁ! দশ বছর পর পর এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে আমরা আসবো। ভুলে যাবেন না সেকথা! ইসমেত বির্নি ভেড়ার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, এমন মূর্তি যতো খুশি বানান, আসল কথাটা না ভুললেই আমরা খুশি। অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে কয়েদী পাঠিয়ে বসতি গড়ে তোলা হয়েছিলো, রোসিওতেও সেরকমই করা হবে!" রাগনারের মুখে আবার হাসিটা ধীরে ধীরে ফিরে এলো। তিনি আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে বললেন, "গনজালেসের বানানো মূর্তিটা তুমি দেখেছো তাহলে? কেমন বুঝলে কলাপাল গনজালেস? তোমার মূর্তি দেখে পৃথিবীর নভোপুলিশ তো মহাক্ষিপ্ত দেখছি!" কাউন্সিলরদের মাঝে এক বৃদ্ধ চায়ের পেয়ালা তুলে সুড়ুৎ করে চুমুক দিলো। রাগনার মকবুলের দিকে ফিরে বললেন, "তুমি কি জানো, পৃথিবীতে আমার অপরাধ কী ছিলো?" মকবুল বললো, "জানি। আপনার নাম শোনার সাথে সাথেই চেক করেছি। দ্বিগামিতা।" রাগনার বললেন, "হ্যাঁ। আমি আইসল্যাণ্ডের লোক। আমার দেশে ওর শাস্তি খুব একটা কড়া কিছু ছিলো না। কিন্তু তোমাদের ইসমেত বির্নির ঠেলে দেয়া আইনের প্যাঁচে পড়ে আমার নাম লটারিতে উঠে গেলো। আমাকে দুটোর মধ্যে থেকে একটা সুযোগ বেছে নিতে বলা হলো। হয় নভোকারাগারে বাকি জীবন কাটাবো, অথবা পৃথিবীতে আমরণ কারাবাস। আমাকে রংচঙে একটা পুস্তিকা ধরিয়ে দেয়া হলো, তাতে রোসিওর আজগুবি সব ছবি। বলা হলো, এখানে একটা স্বাধীন জীবন পাবো আমি। এই কি তোমাদের ন্যায়বিচার? আমি বছর তিনেকের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যেতাম। বির্নির কারণে আমাকে শুধু আমরণ কারাবাসেই আসতে হলো না, আমি আরও কী হারালাম, তা জানো?" মকবুল কোনো উত্তর দিলো না। রাগনার নিচু, হিংস্র গলায় ফুঁসে উঠলেন, "আমি মানুষ হিসেবে হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকার হারালাম! আমি ছিলাম একজন আইনজীবী, একজন সভ্য মানুষ, যে দুটি নারীকে ভালোবাসতো, কিন্তু তাদের কাছে সে কথা মুখ ফুটে বলার সাহস করেনি, চুরি করে দুজনের সাথেই জীবনটা ভাগ করে নিতে চেয়েছে! আমার কাপুরুষতার অধিকারটুকু তোমাদের আইন কেড়ে নিতে চেয়েছে, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার ইতিহাস, আমার সভ্যতা, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কারের উত্তরাধিকার কেড়ে নিয়েছে তোমাদের ইসমেত বির্নি! আমি, আমরা সবাই হয়ে গেছি পরীক্ষাগারের ইঁদুর! কতগুলো ঘাস লতাপাতার বীজ আর ভেড়া-মুরগি সম্বল করে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে মহাবিশ্বের আরেক প্রান্তে! আমাকে বলা হচ্ছে একটা প্রাণীর মতো বেঁচে থেকে প্রমাণ করতে, যে এখানে এই গ্রহে, এই ভাসমান পাথরের টুকরোয়া তোমরা আরো অনেক মানুষকে পাঠাতে পারবে! তারা আসবে স্বেচ্ছায়, মানুষের হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার প্রত্যেকটা সুতোকে টেনে সঙ্গে নিয়ে। আর আমি? আমি এসেছি সব মূল পেছনে ফেলে, কয়েকটা ম্যানুয়াল সম্বল করে! আমাকে নিজের হাতে এই মরা মাটিতে ঘাসের বীজ ছড়াতে হয়েছে ভেড়া চড়ানোর জন্যে, আমাকে আকাশের দিকে মুখ হাঁ করে বসে থাকতে হয়েছে সঠিক পিএইচের বৃষ্টির জলের অপেক্ষায়! আমি একটা ল্যাবরেটরির সাদা ইঁদুর? আমি? রাগনার ওলাফসন, যার অন্য সবার মতো পৃথিবীর মাটিতে একটা মানুষ হয়ে, মানুষের উত্তরাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার ছিলো? তোমরা আমাকে দ্বিগামিতার জন্যে শাস্তি দিয়েছো, এখানে এসে আমি বারোজন নারীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছি, তোমরা মানুষের যে উত্তরাধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছো, তা নতুন করে সৃষ্টি করতে। তোমরা দশ বছর পর পর তোমাদের কর্তৃত্ব জাহির করতে আসো তোমাদের ভিক্ষার থলি নিয়ে, এটাসেটা হাবিজাবি দিয়ে যেতে চাও, যেভাবে গবেষণাগারের ইঁদুরকে কয়েকদিন পর পর পনিরের টুকরো দেয়া হয় তার ইঁদুর দৌড়ের পুরস্কার হিসেবে! তোমরা দেখতে আসো, আমরা ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারি কি না, আমাদের এখানে ঠিকমতো বৃষ্টি হয় কি না, ফসল ফলে কি না, মৌমাছি ফুলের মধু খায় কি না। আমরা এখানে মানুষ নই, আমরা এখানে শুধু পৃথিবীর প্রাণচক্র কৃত্রিমভাবে রোপণ করার দাসমাত্র! আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে যখন এখানে তোমাদের চোখে সত্যিকার মানুষেরা বড় নভোযানে চড়ে হাজারে হাজারে, অযুতে অযুতে এসে নামবে! তাই তো? মানি না আমি তোমাদের এই মাতবরি! রোসিও তোমাদের মর্জিমতো চলবে না!" রাগনার হাঁপাতে লাগলেন, মকবুল পাথরের মতো স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তার একটি চোখ একই সাথে টেবিলের ওপর রাখা নিজের হেলমেটে হেক্টরের প্রতিবিম্বের দিকে। হেক্টর নড়লে সেও নড়ে উঠবে। মকবুল কামনা করলো, হেক্টর নড়ে উঠুক। তার ভেতরে দলা পাকিয়ে ওঠা রাগ কারো ওপর ঝাড়তে হবে। রাগনার বললেন, "তোমার কৌতূহল মিটেছে?" মকবুল ধীর গলায় বললো, "না। আপনাদের ভেড়ার খামার কোথায়?" কাউন্সিলরদের মধ্যে একজন কেশে উঠলো। রাগনার হাসিমুখে বললেন, "আমাদের কোনো ভেড়ার খামার নেই।" মকবুল তাকিয়ে রইলো রাগনারের দিকে। লোকটার হাসিতে ভেতরের হিংস্রতাটুকুই শুধু ফুটে উঠেছে। "মুরগির খামার?" রাগনার বললেন, "আমাদের কোনো মুরগির খামারও নেই। ঊনিশ বছর আগে, এক ছত্রাকের সংক্রমণে আমাদের সব ভেড়া আর মুরগি মারা গিয়েছে। আমরা ভেড়া আর মুরগির যাবতীয় সরঞ্জাম অ্যালকোহল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছি।" মকবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, "এ কারণেই আপনারা সবাই নিরামিষাশী?" রাগনার কাঁধ ঝাঁকালেন। "আমাদের এখানে প্রাণীজ আমিষের কোনো উৎস নেই আর।" মকবুল ঝুঁকে পড়ে বললো, "ঐ রোগেই কি আপনাদের শিশুগুলো মারা গিয়েছে?" রাগনার হাসলেন। "না। আমি তো বললাম, আমাদের শিশুদের কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি।" মকবুল হেলমেটটা তুলে নিয়ে ভেতরের স্ক্রিন স্পর্শ করে দুপুরে দেখা গোরস্থানের দৃশ্য আবার নতুন করে দেখলো। একটা শিশুর কবরের নামফলক থেকে জোরে জোরে নাম পড়লো সে, "আমির হালেব। এই শিশুটির সাথে অন্তত পক্ষে ষাটটি শিশুর কবর দেখেছি আমি ...।" কাউন্সিলররা হেসে উঠলো সবাই। মকবুল কঠিন চোখে তাকালো তাদের দিকে। রাগনার হাসিমুখে বললেন, "আমির হালেব আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলো। সে শিশু হতে যাবে কেন? পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু ঘটেছে।" মকবুল গোরস্থানে আমির হালেবের কবরের দৃশ্য আরেকবার দেখলো। পরিষ্কারভাবেই সেটি একটি শিশুর কবর। বাইরে একটা ঘন্টা বেজে উঠলো। হেক্টর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। মকবুল রাগনারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। সাধারণ টিউনিক পরা একজন লোক হাতে একটা বাক্স নিয়ে প্রবেশ করলো হেক্টরের পিছু পিছু। রাগনার হাত বাড়িয়ে ইশারা করলেন। "এসো এস্তেবান।" মকবুল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। এস্তেবানের বয়স হেক্টরের মতোই হবে, সাধারণ চেহারা তার। হাতে একটা বাক্স। রাগনার বললেন, "আমি বুঝতে পারছি, তোমার ভুল কোথায় হচ্ছে। এই যে এসে গেছে এস্তেবান। আমাদের পাথরশালের অধ্যক্ষ। যাবতীয় পাথরের কাজ ও দেখে। আর এটা হচ্ছে একটা চুনাপাথরের বাক্স, আস্ত পাথর কুঁদে বানানো। অসুয়ারি কাকে বলে জানো?" মকবুল মাথা নাড়লো। সে জানে না। রাগনার ইশারা করার পর হেক্টর বাক্সের ওপরের ঢাকনাটা নামিয়ে বাক্সটা দেখালো মকবুলকে। ছোটো, দুই ফুট বাই দুই ফুট বাই এক ফুট মাপের বাক্সটা, ভেতরটা খালি। বাক্সের বাইরের দিকটা চমৎকার পালিশ করা। রাগনার বললেন, "অসুয়ারি হচ্ছে অস্থ্যাগার। ওর ভেতরে হাড়গুলো থাকে কেবল। পুরোনো দিনের অর্থডক্স খ্রিষ্টান আর ইহুদিদের ওভাবে সমাহিত করা হতো, জানো না বোধহয়।" মকবুল কিছু বললো না। ব্যাখ্যাটা গ্রহণযোগ্য। ওরকম একটা বাক্সে হাড়গোড় ভরে কবর দিয়ে রাখলে কবরটা ছোটোই হবে, বাচ্চাদের কবরের মতোই দেখাবে বাইরে থেকে। রাগনার হাসলেন। বললেন, "তুমি খুব চটে আছো আমার ওপর। ভাবছিলে একটা উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে চেপে ধরবে আমাকে? কিন্তু চেপে ধরলেই বা কী? আর কী শাস্তি দেবে আমাকে? ধরে নিয়ে যাবে? অন্য কোনো ফালতু গ্রহে আবার জেলে ঢোকাবে?" মকবুল ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইলো রাগনারের দিকে। রাগনার ইশারা করলেন, এস্তেবান বাক্সটা রেখেই চলে গেলো। হেক্টর বাক্সটা নিয়ে পিছিয়ে সম্মানজনক দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। রাগনার খুব ঠাণ্ডা, কঠিন স্বরে বললেন, "তুমি হয়তো ভাবছো, তুমি চাইলে ওরকম কিছু করতে পারবে। পারবে কি পারবে না, সক্ষমতা বা ঔচিত্যের আলাপ আমি পরে করবো। কিন্তু তুমি ঠিক প্রশ্নগুলো করছো না। ঠিক প্রশ্নগুলো করলে আমাকে ঠিকই প্যাঁচে ফেলতে পারো কিন্তু।" মকবুল ধীরে হাত বাড়িয়ে কোমরে পিস্তলের বাঁটের স্পর্শ নিলো আঙুলে। রাগনার চোখ বুঁজে বললেন, "যেমন মনে করো, তুমি বুঝতে পারছো, আমরা শর্করাপ্রধান খাবার খাই, আর আমিষ কম খাই বলে আমাদের নাতিনাতনিগুলো ওরকম পেটরোগা। কিন্তু তুমি জানতে চাইছো না, কেন আমরা তারপরও পৃথিবীর কাছ থেকে নতুন করে আমিষের চালান চাইছি না। কেন আমরা আরও ভেড়া, গরু, মুরগি বা মাছ চাইছি না, এ প্রশ্ন কিন্তু তুমি করছো না?" মকবুল বললো, "কেন?" রাগনার একটা হাত তুললেন। "বলছি। তুমি আরও জানতে চাইছো না, কেন আমার নাতনী, যার বয়স মাত্র ষোলো, যে কুড়ি বছর আগে জন্মায়ওনি, কীভাবে গতবছর এক ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় নভোপুলিশ আর তার অবতরণযানের ছবি এঁকে প্রথম পুরস্কার পেলো।" মকবুল অনুভব করলো, তার শরীরে একটা ঠাণ্ডা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে। তার কয়েক মুহূর্ত পরই তার হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুত হয়ে উঠলো। রাগনার বললেন, "তুমি আরও জানতে চাইছো না, কেন তোমার আগমন উপলক্ষে পাহাড়গ্রামে ছুটি ঘোষণা করে একদিনের ভোজ উৎসব ডাকা হয়েছে।" মকবুলের শরীরের পেশী কঠিন হয়ে উঠলো। রাগনার তাকিয়ে রইলেন মকবুলের দিকে, "এগুলো জরুরি প্রশ্ন কিন্তু!" মকবুলের মাথায় একটা আবছা ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হওয়া শুরু করলো। রাগনার একটু সামনে ঝুঁকে ধীর গলায় বললেন, "তুমি জানতে চাইছো না, কেন আমরা বলছি, আমাদের কোনো চাহিদাপত্র নেই, আমরা যা চাই তা পেয়ে গিয়েছি?" মকবুল ঘড়ঘড়ে গলায় বললো, "কেন?" রাগনারের মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি খেলে গেলো। "কারণ, আমরা পৃথিবীর সাথে আর এই ইঁদুর আর ইঁদুরওয়ালার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী নই। আমাদের যা কিছু সম্বল আছে, তা নিয়েই আমরা সামনে চলবো যতদিন পারি। তোমরা একটা মরা গ্রহে আমাদের রোপণ করে দিয়ে গেছো, আমরা সে কথা ভুলে গিয়েছি। আমাদের সবকিছু আবার শূন্য থেকে শুরু হয়েছে। আমরা চাই না, তোমরা আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করো।" মকবুল ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, "বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর কী?" রাগনার বললেন, "আমার নাতনি তোমাদের অবতরণযানের ছবি আঁকতে জানে, কারণ সে অল্প বয়সে ওরকম একটা জিনিসকে নামতে দেখেছিলো। সেই অবতরণযান থেকে এক কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশও নেমেছিলো রোসিওতে। তবে, সে আর ফিরে যায়নি। এখানেই রয়ে গেছে।" মকবুলের হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এলো, ফ্ল্যাপের চটাশ শব্দে কেঁপে উঠলো ভোজঘর। "কোথায় সে?" চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞাসা করলো মকবুল। রাগনার বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। হেক্টর বুকে হাত বেঁধে যেমন দাঁড়িয়েছিলো, তেমনই দাঁড়িয়ে রইলো। "তাকে, বা তার অবশিষ্টাংশ তুমি দেখেছো হয়তো, তবে মনোযোগ দিয়ে দেখোনি।" রাগনার অলস কণ্ঠে বললেন, "সে আমাদের গোরস্থানেই আছে।" মকবুলের মাথার ভেতরে একটা ছবি ক্রমশ দানা পাকিয়ে স্পষ্ট হয়ে আসছে, সে কপালের ঘাম মুছলো হাতের দস্তানায়। "কী হয়েছিলো তার?" রাগনার বললেন, "বলছি। তার চাবি দিয়েই ট্র্যান্সমিটার কেবিনের দরজা খুলেছিলাম আমরা। তারপর ট্র্যান্সমিটার মডিউল খুলে আমরা সেগুলো ধ্বংস করেছি। তারপর কেবিনের দরজা আবার লাগিয়ে দিয়েছি। সে কারণেই তুমি এসে সেগুলো দেখতে পাওনি।" মকবুল পিস্তলের মাজলটা হেক্টরের বুকের দিকে তাক করে বললো, "কেন?" রাগনার মকবুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঊনিশ বছর হয়ে গেছে, আমরা প্রাণীজ আমিষ খেতে পাই না, কমাণ্ডার মকবুল। তোমরা দশ বছর পর পর তাগড়া মোষের মতো একেকজন পুলিশ পাঠাও। তাদের ওজন কমসেকম দুশো পাউণ্ড হয়। দুশো পাউণ্ডের শরীরে মাংস থাকে ধরো একশো পাউণ্ডের মতো? আমরা একটা ভোজের আয়োজন করি, যেখানে মাথাপিছু আধ পাউণ্ড করে মাংস বরাদ্দ করা হয়। ধরো, দুশো জনের মতো লোক সেই ভোজে একটা দিন পেট পুরে মাংস খেতে পায়?" মকবুলের শরীরটা অবশ হয়ে এলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেলিন্দার মুখ। স্ফূরিত ঠোঁট মেলে মেয়েটা বলছে, আপনাকে কালকের ভোজে অংশ নিতে হবে কিন্তু! ভোজে কীভাবে অংশ নেবে মকবুল? অতিথি হয়ে, না খাবার হয়ে? নিরামিষাশী নয়, এরা নরখাদক! রাগনার নিজের আসনে হেলান দিয়ে বসে তৃপ্ত গলায় বললেন, "খুব তো অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ দিলে ছোকরা। পাপুয়া নিউগিনিতে কী করে লোকে জানো? কেউ মারা গেলে তাকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলে। কেন খায়? কারণ তাদের প্রাণীজ আমিষের তেমন কোনো উৎস নেই। আমাদের মতোই। আমরাও তাই কেউ মারা গেলে তার মাংসের অপচয় আর করি না। খেয়ে ফেলি, হাড়গোড়গুলো একটা অস্থ্যাগারে পুরে কবর দিয়ে দিই। ... তোমার অস্থ্যাগারটা কেমন দেখলে? পছন্দ হয়েছে তো? হেক্টর, ঢাকনাটা দেখাও কমাণ্ডারকে। মকবুল, দেখো তোমার নামের বানান ঠিক আছে কি না।" মকবুল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, হেক্টর একটা চুনাপাথরের স্ল্যাব ধরে রেখেছে বুকের কাছে। তাতে চমৎকার খোদাইয়ে আলকাতরা পুরে লেখা, কমাণ্ডার মকবুল। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। মৃত্যু: ৫০ সন। মকবুল হাতের পিস্তলটা তাক করলো রাগনারের মাথার দিকে। "দুঃখিত, মহামান্য রাষ্ট্রপতি।" চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সে। "এখনই মরার ইচ্ছা আমার নেই।" রাগনার মকবুলের পিস্তলের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। "আমারও না।" মকবুল অনুভব করলো, ঘামের একটা ধারা তার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। রাগনার কৌতুকের সাথে বললেন, "তুমি আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছো কমাণ্ডার।" মকবুলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, তার চোখের আগুনে ভেসে উঠলো প্রশ্নটা। রাগনার বললেন, "এভানগেলোসের মতো একটা পকেটমারকে আমরা কেন নগরপাল বানিয়েছি?" মকবুলের মুখ থেকে আস্তে আস্তে রক্ত সরে যেতে লাগলো। কেন? এভানগেলোসের মতো লোক কেন নগরপাল? রাগনার বললেন, "কারণ নগরপাল নভোপুলিশের কমাণ্ডারদের অভ্যর্থনা জানায়, সাথে সাথে থাকে। আর গত ষাট বছর ধরে প্র্যাকটিসের কল্যাণে, খুব সফলভাবে সেই কমাণ্ডারদের হোলস্টারের ইলেকট্রনিক পিস্তল থেকে ব্যাটারিটা খুলে রেখে দেয়।" মকবুল সাঁই করে ঘুরে হেক্টরের মাথা বরাবর পিস্তল তাক করে ট্রিগারে চাপ দিলো। কিছুই ঘটলো না। মকবুলের পেছনে দরজা খুলে গেলো। খাটো টিউনিক পরা ছয়জন যুবক প্রবেশ করলো সেই পথে। তাদের প্রত্যেকের হাতে খোলা তলোয়ার ধরা। ৪. ঘোড়ামুখ হ্রদের পারে ঝলমল করছে রোদ। পাইন কাঠের আগুনে ঝলসানো হচ্ছে টুকরো টুকরো মাংস। বেলেল্লা ছুকরির দল হাসাহাসি করছে একটা বিশেষ টুকরো নিয়ে। মেলিন্দা চুপচাপ আগুন খুঁচিয়ে আঁচ বাড়াতে লাগলো। সবাইকে পরিবেশন করে তবেই নিজে পাতে খাবার নিয়ে বসবে সে। [সমাপ্ত] বিশেষ দ্রষ্টব্য: গল্পটা প্রথমে ইংরেজিতে ভাবা আর লেখা শুরু করেছিলাম, Sins of the Flesh শিরোনামে। বাংলায় এরকম কোনো পানপ্রবণ শিরোনাম ভেবে পেলাম না বলে ম্যাড়ম্যাড়ে একটা নাম দিয়ে চালাতে হলো। তবে ইচ্ছা আছে সুযোগ ও সময় হলে ইংরেজি অনুবাদ করার। কোনো অসঙ্গতি পেলে ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইলো পাঠকের প্রতি। ধন্যবাদ। (১৪২২৪)
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০৫৫ কাজের লোড ঘাড়ে চাপতে পেরেছে আমারই ফাঁকিবাজির কারণে। মাঝখানে কিছুদিন ঢিল দেবার কারণে একটু একটু করে কাজের স্তুপ জমছে মাথার ওপর, সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার অকাজে তনোমনোধনোনিবেশ করেছি। শেষমেশ ব্যাপারটা দাঁড়ালো খাটো কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমানোর মতো, মাথা ঢাকতে গেলে পা বেরিয়ে যায়, আর পা ঢাকতে গেলে মাথা। সমাধান হচ্ছে কুন্ডলী পাকিয়ে শোয়া, তাই অবদমিত কাজের চাপে আমিও কুন্ডলী পাকিয়ে ছিলাম কয়েক হপ্তা। তো যাই হোক, শেষপর্যন্ত রফা হলো, উল্ম যাবো। ধূসর গোধূলি নিখোঁজ, শোনা যায় কোন এক মাফিয়া ডনের কুড়ি ইউরো মেরে গা ঢাকা দিয়েছ সে, ডনবাবাজি এখন বার্ষিক সুদ ১০% আর সার্ভিস চার্জ ২ ইউরো, একুনে চব্বিশ ইউরোর হুলিয়া জারি করেছে গোধূলির নামে। শুক্কুরবার ভোরবেলা আমি আর চৌধুরী ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য উল্ম শহরটি জার্মানির দক্ষিণে, বাডেনভুয়র্টেমবুর্গ আর বায়ার্ন (বাভারিয়া) এর সীমান্ত অঞ্চলে, দানিয়ুব নদীর পাশে। উল্মে আছে দু'টি দানব, যথাক্রমে উল্মারমুয়নস্টার এবং সচল হাসিব। রেলযাত্রার বর্ণনা দিতে কখনোই ভালো লাগে না, কিন্তু ব্যাপক ভুগতে হয়েছে। হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান। বুলেট ট্রেন সার্ভিস ইসেএ (ICE) এর টিকেট কাটতে না পেরে গরীববান্ধব রেগিওনালবান-ই আমাদের সম্বল, তাই কাসেল থেকে প্রথমে ঘন্টা দুয়েক ঝুক্কুর ঝুক্কুরের পর ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে মুতে আর খেয়ে চড়া হলো হাইডেলবার্গগামী আরেক রেগিওনালবানে, সেখানে মৃদু বিয়ারপানের পর ষ্টুটগার্ট, ষ্টুটগার্ট থেকে উল্ম। পাক্কা সোয়া আটঘন্টার জার্নি, ঘেডিঘুডি ব্যথা। ভুক্তভোগীরাই জানে হাসিব ভাই কী চীজ। কিন্তু লোহার হৃদয়ের পাশাপাশি তাঁর একটি কোমল হৃদয়ও আছে, টের পেলাম তাঁর রান্না মুরগি খেয়ে। একটু টাটকা হয়ে আমার নতুন ক্যামেরা বার করলাম, যাত্রাপথে আর সেটাকে এস্তেমাল করা হয়নি ক্লান্তিজনিত নিভু নিভু মুডের কারণে। তারপর আমাদের ছোট সচলকাফেলা বেরিয়ে পড়লো উল্মের ভাইনাখটসমার্কট দেখতে। উল্মের ভাইনাখটসমার্কটে যীশু ও জোসেফ পরীর পুতুল উল্মের ভাইনাখটসমার্কট উল্মের বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল, উল্মারমুয়নস্টারের গোড়াতেই বসে। আয়তন এবং আয়োজনেও সেটি কাসেলের ভাইনাখটসমার্কটগুলির তুলনায় জমজমাট। একটি কুঁড়েতে আলোকিত যীশু, মেরি আর যোসেফের মূর্তি দাঁড় করানো। বেথেলহামের সেই খোঁয়াড়ের ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্যে সেখানে খড়ের গাদায় শুয়ে ঝিমাচ্ছে গাধা, চড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়া। আপসোস, ছাগু ছিলো না। রাতের উল্ম নিরিবিলি। কেপলারের সৌরঘড়ি আর উল্মারমুয়নস্টারের বিভিন্ন দিক দেখে আমরা আবার ডেরায় ফেরত গেলাম। রাতে হাসিব ভাইয়ের দক্ষিণজার্মানীখ্যাত বিরিয়ানি রান্না হবে, উল্মের অন্যান্য বিচ্ছুদের সাথেও আড্ডা হবে। পরদিন ভোরে উঠে খেয়েদেয়ে বেরোলাম সকালের শহর দেখতে। উল্ম শহরটি অপূর্ব। পাহাড় আর এর পাদদেশে বিস্তৃত, বাড়িঘর সবই রঙিন, মানুষজনও হাসিখুশি। উত্তর হেসেনের লোকজন সব গোমড়ামুখো, ভাল্লাগেনা। দানিয়ুবের পাশে উল্মের প্রাচীর, নদীর ওপারে বাভারিয়ার শহর নয়উল্ম (নতুন উল্ম)। এই দুই নগরীর মানুষজনের সংস্কৃতিও ভাগ করে দু'দিকে ঠেলে দিয়েছে দানিয়ুব। বনাবনি নেই খুব একটা। শহরে এক চক্কর মেরে আমরা ঢুকলাম ক্যাথেড্রালে। উল্মে সবচেয়ে দামী পাড়ায় সব বাড়ি পুরনো এবং খান্দানি। ছয় থেকে সাড়ে ছয়শো বছর বয়স এক একটার। এ বাড়িতে ছয় শতাব্দী ধরে বাস করে আসছে একটি জেলে বংশের কয়েক পরিবার। কেপলার ছিলেন উল্মে। ভবনের দেয়ালে লেখাঃ ইয়োহানেস কেপলার, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জন্ম ১৫৭১, মৃত্যু ১৬৩০। ১৬২৭ এ কেপলার রুডলফিনিয়ান সারণী প্রকাশ করেন। ছয় শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি উল্মারমুয়নস্টার এক কথায় প্রকান্ড। ভেতরটা বিশাল তো বটেই, বাইরে থেকেও একে দেখতে গেলে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। শঙ্খপাক টাওয়ারে সাতশো আটষট্টিটা ধাপ, তবে শুনতে পেলাম বরফের কারণে দ্বিতীয় স্তরটা বন্ধ, আমাদের আধাআধি উঠেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এ যাত্রা। কী আর করা, ঢুকলাম আগে নিচটা ঘুরে দেখতে। ক্যাথেড্রালের ভেতরে রঙিন কাঁচে আঁকা নানা ছবি ক্যাথেড্রালের ভেতরে আবছায়া ঘুলঘুলির আলোয় উল্মারমুনস্টার "প্রিয় ঈশ্বর, দয়া করে আমার নাতি আলেকজান্ডারকে সাহায্য করো। ধন্যবাদ।" ক্যাথেড্রালের ভেতরে একটি বোর্ডে শতশত প্রার্থনার চিরকুট লেখা। তার মাঝে একটি। তোরণের ওপরে মূর্তি ভেতরটা বিশাল। একটু স্পৃষ্ট হলাম প্রার্থনার বোর্ড দেখে। সেখানে চিরকুটে করে ঈশ্বরের কাছে নানা আবেদন নিবেদন রেখে গেছে লোকে। ঈশ্বরকে সব জায়গায় পাওয়া যায় না, গির্জা-মন্দির-মসজিদ-সিনাগগে গিয়ে খুঁজতে হয়, এ-ই এক গেরো। ভদ্রলোক যে কবে একটু খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেবেন, ভাবি। শিশু আর ছাত্রদের জন্যে টাওয়ারের ওপর চড়ার ফি কম। আমাদের ছাত্রপরিচয়পত্র দেখে প্রৌড়া টিকেটবিক্রয়ব্যবস্থাপিকা ছেড়ে দিলেন। সেইসাথে টাওয়ারে আদ্ধেক না উঠতে পারার জন্যে কনসেশন। টাওয়ারের সিঁড়ি খুবই সরু, খাড়া এবং কিছুটা বিপজ্জনক। কিছুক্ষণ পরপরই ওপর থেকে কেউ না কেউ নামে, তখন মোচড়ামুচড়ি করে জায়গা করতে হয়। সিঁড়ির দেয়ালে নানারকম মাণিক্যখচিত বাক্যসম্ভার খোদিত। বাংলাদেশে প্রণয়ভারাক্রান্ত যুবকেরা যেমন বাসের সীটের পেছন থেকে শুরু করে প্রাচীন প্রত্ননিদর্শনে "খোকন + সুমি" লিখতে সর্বদা তৎপর থাকেন, জার্মানীও তার ব্যতিক্রম নয় বোধজয়, এখানেও বাসের সীটের পেছনে "আমি অমুককে ছাড়া বাঁচবো না", "তমুকের সাথে সঙ্গম করি" হরহামেশাই দেখা যায়। উল্মারমুয়নস্টারের টাওয়ারে ওঠার সিঁড়িতেও পৃথিবীর তাবৎ হরফে নানা কথাবার্তা লেখা। জার্মান, ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ আর ইতালীয় বক্তব্যগুলি ১০০% থেকে ৫০% শনাক্ত করতে পারলাম, সিরিলিক আর গ্রীক হরফের মাথামুন্ডু বোঝার প্রশ্নই আসে না। তবে মুগ্ধ হলাম এক জায়গায় এসে, সেখানে কোন এক বেরসিক হাঁপিয়ে গিয়ে দেয়ালে লিখে রেখেছে, "ফাক ত্রেপেন।" কাঁচা বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়, "সিঁড়িকে চুদি।" ক্যাপশন না দিলে হয় না? ওপরে উঠে কুয়াশাঘেরা উল্ম দেখে ভাল্লাগলো। ছবি কিছু তুলেছিলাম, ভালো আসেনি। কেবল ভেতরে ট্রফি রুমের একটা ছবিই দিচ্ছি। ওখানে একটা কপিকল ঝুলছে, আগে নাকি নিচ থেকে আপেলভর্তি ঝুড়ি তোলা হতো ওটা দিয়ে। কপিকলের নিচেই একটা গোল পোর্ট, তার কাঁচে চোখ ঠেকিয়ে দেখি নিচে মেরামতের স্ক্যাফোল্ড ফিট করা। বলতে ভুলে গেছি, উল্মারমুয়নস্টারের সংস্কার কাজ চলছে। এক একটা পুরনো পাথরের টুকরো সরিয়ে সরিয়ে অবিকল সেইরকম আরেকটা টুকরো বসানো হচ্ছে, একই উপাদানে তৈরি, একই রকম নকশায়। পুরোটাই হাতে বানানো। নিচে একটা ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, পাঁচটা পাথরের ব্লক তৈরিতে দেখলাম সময় লেগেছে ২৭০ ঘন্টা। এরকম হাজার পাঁচেক ব্লক আছে সম্ভবত সব মিলিয়ে। ট্রফি রুমে ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম উল্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। পথে পড়লো একটা ফলক, আলবার্ট আইনষ্টাইন যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, সেখানে বাড়িটা আর নেই, ফলকটা রয়ে গেছে। দূর থেকে উল্মারমুয়নস্টারের একটা ছবি তুলে বাসে চড়ে বসলাম আমরা। উল্ম বিশ্ববিদ্যালয়টিও শহরের মতোই রঙিন, পাহাড়ের ওপর এবং জঙ্গলের মাঝখানে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে এক একটা ভবন, স্থাপত্যরীতি দেখে মুগ্ধ হবার মতো। আমার লেন্স সিগমা ২৮-৭০, ক্রপ ফ্যাক্টরের কল্যাণে তা ৩৫ মিমির হিসাবে ৪২-১১২তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই সেসব ছবি ঠিক জুতমতো তুলতে পারবো না বুঝে দেখায় মন দিলাম। দূর থেকে উল্মারমুয়নস্টার উল্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ লাল ফল, নীল আকাশ উল্ম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে শহরে নামলো বাস। শহরের পাহাড়ি অংশটি এক কথায় অপূর্ব। নিচে নেমে আর দেরি করলাম না আমরা। ঊর্ধ্বশ্বাসে হাসিব ভাইয়ের আস্তানায় ফিরে তাঁরই রান্না দারুণ পাঙ্গাশ মাছ গান্ডেপিন্ডে গিলে ছুট দিলাম স্টেশনের দিকে। গন্তব্য দুই ঘন্টা দূরের মুয়নশেন, যে শহরে আমাদের জন্যে সপরিবারে অপেক্ষা করছেন সচল তীরন্দাজ আর পুতুল। মুয়নশেন, জার্মানিতে আমার দেখা প্রথম শহর, স্মৃতির কারণে খুব প্রিয়। তবে তার গল্প থাকবে পরের পর্বে, সেখানে ২০০৮ এর পাশাপাশি ২০০৩ ও উঁকি দেবে মাঝে মাঝে।
false
rg
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে বিশ্বকাপের ফরমেটে পরিবর্তন জরুরী ।। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার সেমি-ফাইনাল ম্যাচের পর, এ পর্যন্ত এগারোটি বিশ্বকাপে ভারতের খেলা সবগুলো ম্যাচের উপর আমি আবারো একটু নজর বুলিয়ে একটা বিষয় আবিস্কার করলাম, সেটা হল, ভারত ম্যাচ গড়াপেটার কাজটি দীর্ঘদিন ধরেই করছে। ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে সবচেয়ে বড় ধরনের খবরটি প্রথম রটেছিল ২০০০ সালের ৭ এপ্রিল দিল্লী পুলিশ যখন ঘোষণা করল যে, ভারতীয় বেটিং সিন্ডিকেটের সদস্য মিস্টার সঞ্জয় চাওয়ার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন অধিনায়ক প্রয়াত হেনসি ক্রোনিয়ের কথপোকথন তাদের কাছে রেকর্ড হিসেবে আছে। দিল্লী পুলিশের এই ঘোষণায় সারা বিশ্ব তখন অবাক হয়েছিল। পরে হ্যানসি যখন ম্যাচ গড়াপেটার কথা স্বীকার করেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টেনসি থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। এই ঘটনা সবার জানা। কিন্তু আমি যে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে চাই, সেটা হল, ভারতে ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বেটিং করার মত শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে, এই কথাটি কিন্তু মিথ্যে নয়। এমন কি চলতি বিশ্বকাপ চলার সময় বাংলাদেশ বনাম ভারতের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের দিন ভারতীয় পুলিশ শান্তি স্বরূপ ভাটিয়া নামে পশ্চিম বিহারের এক দালালকে গ্রেফতার করে। ভাটিয়ার কাছ থেকে ১১০টি মোবাইল ফোন, ১০৯টি এয়ার ফোন, দুই সেট টপ বক্স, ৮১টা মোবাইল চার্জার, একটা ল্যাপটপ, একটা এলসিডি স্কিন, এবং কিছু পিস্তলের কার্তুজ উদ্ধার করে। ভাটিয়া মুম্বাই ভায়া হয়ে দুবাইয়ের একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে চলতি বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে বল টু বল ম্যাচ গড়াপেটার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ভাটিয়া মোট ১১০টি লাইনের মাধ্যমে এই কাজটি করছিলেন। প্রতিটি লাইন থেকে তিনি বুকিদের কাছ থেকে তিন হাজার ভারতীয় রুপি করে প্রতিটি ম্যাচ থেকে মোট ৬ লাখ রুপি করে অর্থ উপার্জন করছিলেন। ভারতীয় পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মিস্টার রবীন্দ্র যাদবের বক্তব্য অনুযায়ী এমন খবরটি পত্রিকায় পড়েছিলাম। তার মানে এবারের বিশ্বকাপেও ম্যাচ গড়াপেটার ব্যাপারটি শুরু থেকেই ছিল। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আইসিসি'র প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভারতের মিস্টার জাগমোহন ডালমিয়া। ওই সময় হ্যাসনি ক্রোনিয়ে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় জাদেজা, হার্সেল গিবস, নিকি বোয়ে, পিটার স্টাইডোমের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের খবরটি প্রথম চাউর হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সপ্তম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় ভারতের জাগমোহন ডালমিয়া আইসিসি'র প্রধান ছিলেন। কিন্তু ভারত সুপার সিক্স রাউন্ডে সবচেয়ে বাজে ফলাফল করে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায়। ওই সময় ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। তাহলে কি ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচগুলো আগেই বুকিদের কাছে সেবার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল? নইলে ভারতীয় দল অমন বাজে পারফর্ম কিভাবে করল? ২০০৩ সালে অষ্টম বিশ্বকাপের সময় ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। গোটা ভারতীয় দলকে টিম ইন্ডিয়া বানিয়ে রাতারাতি সৌরভ একটা বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সৌরভের নেতৃত্বে ভারত সেবার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে রানারআপ হয়েছিল। ফাইনালে ভারত সোচনীয় ভাবে হারার পেছনে কি ভারতীয় বুকিদের কোনো হাত ছিল? এটা আমার মাথায় একটি জোড়ালো প্রশ্ন হিসেবে তখনো এসেছিল, এখনো সেই প্রশ্নটি আছে। ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আইসিসি'র প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভারতের সারদ পাওয়ার। যিনি একজন রাজনীতিবিদ। ওই সময় ভারত মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্ব দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জয় করে। মিস্টার সারদ পাওয়ারের আইসিসিতে একক ক্ষমতা ছিল বলেই তখন পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হওয়া ফাইনাল ম্যাচ ২০০৯ সালে শ্রীলংকান টিমের উপর সন্ত্রাসী হামলার দোহাই দিয়ে সেই ম্যাচ মুম্বাইতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। আর ফাইনালে শ্রীলংকাকে হারিয়ে ভারত কাপ জিতেছিল। সে বছর বহুল আলোচিত ইংল্যান্ড বনাম ভারতের ৩৩৮ রানের টাই ম্যাচটি নিয়ে আজো রহস্য ছড়িয়ে আছে। অনেকের ধারণা ওই ম্যাচটি বুকিদের কাছে উভয় দলই বিক্রি করেছিল। ২০০৭ সালে ক্যারিবিয় বিশ্বকাপে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন রাহুল দ্রাবিঢ়। তখন আইসিসির প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ আফ্রিকার পার্সি শ্যোন। ভারত গ্রুপ পর্বেই তিনটি ম্যাচের দুইটিতে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। অথচ ভারতীয় দলে তখনো টেন্ডুলকার, গাঙ্গুলী, সেবাগ, যুবরাজ, কুম্বলে, জহির খান, ইরফান পাঠানদের মত তারকায় ঠাসা। যাদের নিয়ে দলটি বাংলাদেশের কাছে হেরেছিল। সেবার বিশ্বকাপ আয়োজনে আইসিসির ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়েছিল। কারণ ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতীয় দর্শকরা ভারতের হারের পর থেকে বর্জন করেছিল। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম ভারতের কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারদের দেওয়া অন্তত তিনটি বাজে সিদ্ধান্তই ভারতীয়দের পক্ষে যাবার পেছনে কি ভারতীয় বুকিদেরই জোড়ালো হাত ছিল? নইলে আইসিসি'র প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের আ.হ.ম. মোস্তফা কামাল প্রতিবাদ করায় আইসিসির চিফ এক্সিবিউটিভ ডেভিড রিচার্ডস এতো চটলেন কেন? এখানে স্মলন করা যেতে পারে আইসিসির নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সবচেয়ে ক্ষমতাধার আইসিসির চেয়ারম্যান, যিনি বর্তমানে ভারতের মিস্টার নারায়ানাস্বামী শ্রীনিবাসন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আইসিসির প্রধান পদে যখনই কোনো ভারতীয় থাকেন অলৌকিক কোনো ক্ষমতা বলে সে বছর ভারতীয় দলে খুব ভালো পারফর্ম করে। আর যে বছর থাকে না, সে বছর যাচ্ছে তাই পারফর্ম করে আগেভাগেই বিদায় হয়। আমার এই আলোচনায় অবশ্যই ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হবার বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। এমন কি ১৯৮৭ সালে ভারত সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হারা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কারণ বিশ্ব ক্রিকেটে বুকিদের এসব কারবারি শুরু হয়েছে গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন-হ্যানসি ক্রোনিয়েদের আমল থেকেই যদি আমলে নেই, তাহলে বিশ্ব ক্রিকেটের বাণিজ্যিক ব্যাপার স্যাপারেরও চলন তখন থেকেই শুরু। এরপর যখন ক্রিকেটে আইপিএল-এর প্রচলন শুরু হল তখন বুকিদের এই ম্যাচ ফিক্সিং ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠল। ভারতীয় বোলার শ্রীশান্তের কথা আমরা জানি, যিনি জেল পর্যন্ত খেটেছেন ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে। এতো গেল বুকিদের নিয়ে খেলোয়াড়দের যোগসাজসে ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের খেলোয়াড় ও বুকিদের ম্যাচ গড়াপেটার প‌্যাচাল। আর তার সঙ্গে আইসিসির কর্তা ব্যক্তির ক্ষমতার দাপটের নানান খতিয়ান। এর বাইরে আমরা ধারণা, ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে শুরু হওয়া ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ক্রিকেট-ই এখন পর্যন্ত ক্রিকেটের সব ধরনের ফরমেটের মধ্যে আসল ক্রিকেট। যদিও সেই টেস্ট ম্যাচ নিয়ে ম্যাচ গড়াপেটার খবরও পত্রিকায় আসে, যার সঙ্গে ভারতীয় বুকিদের সবচেয়ে বেশি হাত। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে শুরু একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বরং সেই তুলনায় ক্রিকেটর যদিও নতুন ফারমেট, কিন্তু টেস্টের চেয়ে বেশি দর্শক প্রিয়তা পেয়েছে। আর ১৯৭৫ সালের ৭ জুন ইংল্যান্ডের লর্ডসে শুরু হওয়া ওডিআই ফরমেটের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আরো দর্শকপ্রিয়তা পেলে বিশ্বকাপ ফুটবলের মত প্রতি চার বছর পরপর ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের যে রীতি, এটা মানুষের কাছে অনেক আগ্রহ তৈরি করেছে। কিন্তু আইপিএল বা ক্রিকেটের টি-২০ ফরমেটটি ক্রিকেটের সকল জৌলুসকে ধ্বংস করার জন্য সম্ভবত বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় কাঁটা। ক্রিকেটের এই ফরমেটটি বুকিদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। ক্রিকেটের এই ফরমেটি চালু করার পেছনেও ভারতীয়েদর সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল। যে কারণে ক্রিকেটে বুকি, ম্যাচ ফিক্সিং, ম্যাচ গড়াপেটা নানান বিষয়ে যত দুর্নাম রয়েছে, সবগুলোর সঙ্গেই ভারতীয় ক্রিকেটের নাম আসবে সবার আগে। গোটা ভারত জুড়েই এই বাণিজ্যটি প্রথম প্রসারলাভ করেছে। পরে যা সারা দুনিয়ায় ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়েছে। আর এতে ভারতীয়েদর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরে পাকিস্তানীরাও জড়িয়ে যায়। আর এর প্রধান চারণভূমি বা হেডকোয়ার্টার হয়ে ওঠে দুবাই। ক্রিকেট মাঠের খেলা হলেও এখন এটি ধীরে ধীরে মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। আর সেই হাওয়ায় বাতাস দিচ্ছে স্বয়ং আইসিসি টি-২০ এর মত ফরমেট চালু করে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রতিটি আসরেই আইসিসি নানান ধরনের ফরমেট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। কিন্তু যোগ্যতার বিচারে শ্রেষ্ঠ দলটি বাছাই করার আদৌ ইচ্ছে হয়তো ক্রিকেটের প্রধান সংস্থা আইসিসির নেই। এখন পর্যন্ত এগারোটি আসরের মধ্যে যত ধরনের পরীক্ষা হয়েছে, এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপের আসরটি সেরা মনে হয়েছে। যেখানে শুরুতেই রাউন্ড রবিন লিগে আটটি দলই প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে সেরা চারটি দল সেমি ফাইনালে খেলেছে। দুর্বল দলটি সেরা চারে যেতে পারেনি। আমার মতে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকটি দলকেই অন্য সকল দলের সঙ্গে তাদের যোগ্যতা বিচারের সুযোগ দেওয়া উচিত। নইলে কোনো একদিন খারাপ খেললেই একটি দল অনায়াসে বাদ পড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর বিশ্বকাপের জন্য মোট বারোটি দলকে সুযোগ দেওয়া উচিত। টেস্ট প্লেয়িং ১০টি দলকে সরাসরি সুযোগ না দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের মত সকল দলকেই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলায় অংশগ্রহনের নিয়ম চালু করা উচিত। তাহলে আয়ারল্যান্ড বা আফগানিস্তানের মত দেশ হয়তো বড় বড় অনেক রাঘব বোয়ালদের বাছাই পর্বেই নাস্তানুবুদ করে ছেড়ে দেবে। আর মূল বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে সেরা আটটি দল। বাছাই পর্ব থেকে সেরা আট দল রাউন্ড রবিন লিগ খেলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে সেরা চার দল সেমিফাইনালে উঠুক। বরং সেমিফাইনাল স্টেজেও রবিন লিগ হলে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করার সুযোগটা তৈরি হবে। নতুবা বর্তমান বিচারে চার বছর পরপর আমরা যে ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখব, তারমধ্যে যে বুকিদের কারবারি, মাফিয়াদের মুনাফাবাণিজ্য, ম্যাচ গড়াপেটা, এসব থেকেই যাবে। আগে শুধুমাত্র খেলোয়াড় আর বুকিদের মধ্যে এটা সীসিত থাকলেও এখন সেটা আম্পায়ারদের মধ্যেও বিস্তার ঘটেছে। ফলে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরমেটে বিশেষ করে বিশ্বকাপ আসরে বুকিদের ম্যাচ গড়াপেটার ঝুঁকি বরং আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। সুতরাং বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ফরমেট আর বাছাই পর্বে যতদিন না সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা গড়ে না উঠবে, ততদিন আইসিসি মোড়লদের বেহায়াপনা বন্ধ হবে না। বুকিদের কারবারিও বন্ধ হবে না। মাফিয়াদের মুনাফাবাণিজ্যও বন্ধ হবে না। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করার জন্য তাই বিশ্বকাপ ফরমেটের আমূল পরিবর্তন না করতে পারলে, ছোট দলগুলো সব সময়ই বৈষম্যের স্বীকার হবে। এবার যেমন বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে এই বৈষম্য আধিপাত্যের কাছেই হেরে বিশ্বকাপের আসর থেকে ফেরত এসেছে। আমি মনে করি, আইসিসির ম্যাচ ফরমেটের ভেতরেই এই বৈষম্য আষ্ঠেপিষ্ঠে লেপ্টে আছে। অতএব সাধু সাবধান। ..................................... ঢাকা ২৮ মার্চ ২০১৫ সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:৫১
false
rg
পিএসসি'র সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা!!! বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যগণ কী আইনসঙ্গতভাবে পাবলিক মিটিং বা গণসংযোগ করতে পারেন? পারলে কতটুকু করতে পারেন? এ বিষয়ে বন্ধুদের অভিমত কী?মহামান্য আদালতের বিচারপতিদের যেমন গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিধান, মহামান্য বিচারকের প্রদত্ত বিচার যাতে নিরপেক্ষ থাকে বা পক্ষপাতদুষ্ট না হয়, এটাই হয়তো তার কারণ। তেমনি সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান বা কমিশনের সদস্যগণেরও পাবলিক মিটিং বা গণসংযোগ মোটেও বিধিসম্মত হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যগণের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক! এমনিতে আমাদের সরকারি কর্ম কমিশনের সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানান কিসিমের অনিয়ম এখন বিধিসম্মত রূপ নিয়েছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে সরকার দলীয় কর্মীদের দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি, বিসিএস প্রশ্নপত্র বিক্রি, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বিশেষ বিশেষ গ্রুপের কাছে অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা হলে পছন্দমত সিট বরাদ্দ দেওয়া, বিসিএস প্রিলিমিনারি টেস্টে অর্থের বিনিময়ে পাস করিয়ে দেওয়া, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় নকল করার সুযোগ দেওয়া, পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে থেকে উত্তরপত্র তৈরি করা, পরীক্ষা কেন্দ্রে না গিয়ে পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহন, পরীক্ষার খাতা অদলবদল, পরীক্ষার খাতায় নম্বর অদলবদল, বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে জালিয়াতি, পরীক্ষায় অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর মেরিট লিস্টে স্থান পাওয়া, বিসিএস ভাইভাতে নানান মাত্রার অনিয়ম, বিসিএস ভাইভাতে সরকার দলীয় লিস্টেড পরীক্ষার্থীদের ভাইভা বোর্ডে তুলনামূলক সহজ প্রশ্ন করা এবং সাধারণ পরীক্ষার্থীদের জন্য জটিল প্রশ্ন করা, সরকার দলীয় লিস্টেড পরীক্ষার্থীদের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক সকল ভাইভা বোর্ডে গোপন ইনস্ট্রাকশন পাঠানো যাতে লিস্টেড পরীক্ষার্থীদের বেশি নম্বর দেওয়ার অনুরোধ, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বা দলীয় পরিচয় আবিস্কার নিয়ে ভাইভা বোর্ডের নানান মাত্রার প্রচেষ্টা এবং সেই পরিচয়ের ভিত্তিতে নম্বর প্রদান প্রক্রিয়া, ভাইভা বোর্ডের এক্সটার্নালদের কাছে সরকার দলীয় লিস্টেড পরীক্ষার্থীদের পরিচয় সম্পর্কে আগেভাগে পরিচিতি তুলে ধরা, ভাইভা বোর্ডের পরীক্ষার্থীর সঙ্গে রূঢ় ও অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করা, অমুসলিম পরীক্ষার্থীদের সম্পর্কে ভাইভাতে রূঢ় বা নিয়ম বহির্ভূত আচরণ করা, বোর্ড কর্তৃক বিশেষ বিশেষ পরীক্ষার্থীকে এক্সট্রা অরডিনারি নম্বর প্রদান করা, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ভাইভা হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে বিশেষ বিশেষ পরীক্ষার্থীকে কমিশনে গোপনে ডাকা বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করে অর্থের বিনিময়ে কমিশনের বিভিন্ন স্তরের সিন্ডিকেট বা গ্রুপের সক্রিয় কর্মকাণ্ড, পুরো বিসিএস পরীক্ষার জন্য এসব সিন্ডিকেটের অর্থের বিনিময়ে এককালীন চুক্তি বা বিভিন্ন পর্যায়ের চুক্তি, সরকার দলীয় পরীক্ষার্থীর জন্য বিশেষ বিবেচনা, ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট প্রদান, বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণের পর পরবর্তী কোনো সময়ে কমিশনে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট প্রদান, কোটা সিস্টেমে দুর্নীতি, কমিশনের স্টাফদের মানি-মেকিং বিসনেস, পিএসসি-সিন্ডিকেট, তদন্ত রিপোর্ট অপ্রকাশিত থাকা, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষার নম্বর কমিশনে থেকে গোপনে সরবরাহ করাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে সরকারি কর্ম কমিশনের বিরুদ্ধে। আমি নিজে ১৭তম, ১৮তম ও ২০তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনবার ভাইভা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া একজন প্রাক্তন বিসিএস পরীক্ষার্থী। যে কারণে সরকারি কর্ম কমিশনের যে কোনো ধরনের দুর্নীতি, কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আমার আছে। আমার পরিবারের চাপে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার দৌঁড়ে আমার জীবন থেকে যে মূল্যবান ছয়টি বছর পিএসসি কেড়ে নিয়েছে, কেবল সেই অযুহাতে পিএসসি'র যে কোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমার কলম সবসময় সজাগ থাকবে। সর্বশেষ ২০তম বিসিএস পরীক্ষায় যে অনিয়ম করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আমরা তখন রাস্তায় প্রতিবাদ করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০তম বিসিএস পরীক্ষার অনিয়ম একটি কালো ইতিহাস হয়ে আছে। এরপর আমার সরকারি চাকরির বয়স সীমা ফুরিয়ে গেলে (২০তম বিসিএসের পর) আমার বিসিএস মিশন দুর্ভাগ্য নিয়েই শেষ হয়েছিল। কিন্তু সরকারি কর্ম কমিশনের সেই অনিয়ম ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পর্যায়ে বংশবৃদ্ধি করেছে। যার বিরুদ্ধে আমার কলম সবসময় জেগে আছে।বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাথে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সরকারি কর্ম কমিশন ২৭টি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ২৮টি ক্যাডারে মোট ৪১ হাজার ৪১৩ জনকে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছে। বর্তমানে কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষা প্রক্রিয়াধীন। সরকারি কর্ম কমিশনের গড়ে একটি বিসিএস পরীক্ষা শেষ করে প্রার্থীদের চাকুরিতে নিয়োগ দিতে ২৪.৭৫ মাস সময় লাগে। বিসিএস, নন-বিসিএস, প্রোমোশনাল এক্সাম, আর বার্ষিক রিপোর্ট তৈরির বাইরে সরকারি কর্ম কমিশনের বাকি সকল কাজ মোটামুটি রুটিন মাফিক। সংবিধান অনুসারে পিএসসি'র চেয়ারম্যান বা সদস্যগণ সাংবিধানিক পদমর্যাদা ভোগ করেন। সাংবিধানিক পদমর্যাদা ভোগকারী কোনো ব্যক্তি নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্য কোনো পদ বা পদবি ভোগ করতে পারেন না। যে কারণেই পিএসসি'র চেয়ারম্যান বা সদস্যগণের পাবলিক মিটিং বা গণসংযোগকে সাধারণ দোষে দুষ্ট হিসেবে ধরা যায়। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা সরকারি কর্ম কমিশন বা সংক্ষেপে পিএসসি'র চেয়ারম্যান বা সদস্যগণের পাবলিক মিটিংয়ে যাতায়াত, গণসংযোগ, বা বিশেষ বিশেষ নাগরিক শ্রেণির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপনকে মোটেও স্বাভাবিক ভাবে দেখার সুযোগ নাই। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড প্রায় সবসময়ই বিতর্কিত, সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে ঘনঘন বিভিন্ন শ্রেণিগোষ্ঠীর মিটিংয়ে উপস্থিত থাকাটা মোটেও সংবিধান সম্মত নয় বলেই আমি মনে করি। বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব ড. মুহাম্মদ সাদিক একজন প্রাক্তন আমলা ও কবি। কেবল কবি পরিচয়ের সূত্র ধরে সাংবিধানিক পদমর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন পাবলিক মিটিংয়ে তাঁর যাতায়াত মোটেও সংবিধান সম্মত হতে পারে না। প্রজাতন্ত্রের একটি সাংবিধানিক পদমর্যাদা নিয়ে তাঁর এমন গণসংযোগ মোটেও পক্ষপাতদুষ্টের ঊর্ধ্বে নয়। এমন গণসংযোগের আড়ালে বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্থ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হওয়ার সুযোগ কিন্তু সেক্ষেত্রে অবারিত! বিষয়টি একদিকে যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি খুব সেনসেটিভ। সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যগণের এভাবে গণসংযোগ থাকাটা মোটেও নিরপেক্ষভাবে দেখার সুযোগও নাই। আশা করি, বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ সাদেক বিষয়টিকে তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মানিয়ে নেবেন। কারণ সাংবিধানিক পদমর্যদার যে কোনো ব্যক্তি প্রথমে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষার প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল। এরপর নিজের অবস্থান ও নিজেকে সৎ, নিরপেক্ষ এবং রোল মডেল হিসেবে প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত তো আছেই। ...................................২৭ আগস্ট ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ২:১৬
false
fe
তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ও ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎ তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ও ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎফকির ইলিয়াস ============================================দেশে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন মনে হচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও হেরে গেছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এই হেরে যাওয়া বড় শোচনীয়। চেষ্টা কম করা হয়নি। কিন্তু পারা যায়নি কোনোভাবেই। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছিলেন, গোপালগঞ্জের পর গাজীপুরই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতেই ধ্বস নেমেছে আওয়ামী লীগের। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, তার এক বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন গাজীপুর আওয়ামী লীগের আরেক গোপালগঞ্জ। যদি গাজীপুর নির্বাচনে এই অবস্থা হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে গোপালগঞ্জের অবস্থা কী হবে? মওদুদ আহমদ বলেছেন, সরকার বলছে তারা সাড়ে চার বছরে অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের জোয়ার ভোটের জোয়ারে ভেসে গেছে। আগামী পাঁচ মাসে এ সরকার আরো ভুল করবে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে গেছে। এই রুগ্ণ সরকার এ অবস্থা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। তারা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।' এই প্রশ্ন গোটা দেশবাসীর। আওয়ামী লীগ কী করলো গেল পাঁচবছর। কেন তারা নিজেদেরকে শোধরাতে পারলো না? জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শেষ মুহুর্তে এসে এডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এতে কোনো কাজ হয়নি। কাজ হওয়ার কথা নয়। কারণ মানুষ এরশাদের কাছে দায়বদ্ধ ছিল না যে, তার হুকুম তামিল করতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, প্রতিটি বড় দলেই এখন আভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। বড় তিনটি দলের নিজের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মাঝে রাজনীতি ও দল নিয়ে হতাশা বেড়েছে। মানুষ এখন আর কারো চাপিয়ে দেয়া মতবাদ মানছে না। মানতে চাইছে না। এর প্রধান কারণ রাজনীতিকরা মানুষের কাছে দেয়া ওয়াদা পূরণ তো করেনইনি, বরং লুটপাট করেছেন অবলীলায়। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি যা করেছিল, তা মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল। এর ফলেই আওয়ামী লীগের অনেক অযোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগ সেই সম্মান ধরে রাখতে পারেনি। বরং তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করেছে। একটি দেশের স্থিতীশীলতার জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা খুবই দরকারি ছিল। লুটপাটকে উৎপাটন করা জরুরি ছিল। আওয়ামী লীগ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার মাশুল এসেছে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। বর্তমান সরকারের এই যে পতনধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তারপরও সরকারের নেতারা বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিতরা জয়ী হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। আগামীতে সরকার পরিবর্তনের যে রায় দেবে তখন তারা ভালোভাবে চিন্তা করে দেবে।’ কথা হচ্ছে, মানুষ আর কী চিন্তা করবে? কতোটুকু চিন্তা করবে? ড. হাসান মাহমুদ আরো বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যাগুলো বেশি উঠে আসে। তাই এ নিবার্চনে মানুষ যাকে ভালো মনে করেন তাকে ভোট দেন। সে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোক বা বিএনপিরই হোক। জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বোমাবাজ, গ্রেনেড হামলাকারী ও হাওয়া ভবন দখল আর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হবে নাকি বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়ন দেশ হবে তা বিবেচনা করবে। আশা করি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের সুচিন্তিত রায় দেবে। মানুষ ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তান বানাবেন না।’ এদিকে, আওয়ামী লীগ ভুল করে থাকলে জনগণ তা শোধরানোর সুযোগ দেবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।তিনি বলেন, আমরা হতাশও নই, শঙ্কিতও নই। আমাদের ভুল আছে- ত্রুটি আছে, কেউ আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এ ভুলের কারণে যদি কেউ আমাদের ভুল বুঝে থাকে তাহলে অনুরোধ করবো যে এ ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দেন। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশ নির্বাচনের পরাজয়ে আওয়ামী লীগ হতাশ ও শঙ্কিত নয়। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখা হবে। আর দলের সাময়িক বিপর্যয় হলেও চূড়ান্ত লড়াইয়ে আমাদের বিজয় হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাস আছে, ভুল সংশোধন করে অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে নিয়ে ইনশাল্লাহ আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনবোই। যে কোন বিপর্যয়ের সময় ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে জানে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখবে, নাকি জঙ্গিবাদি শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাবে। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মুখে যত বড় কথাই বলুন না কেন, তাদের যে গৃহদাহ চলছে, তা তারা স্বীকার করতে রাজি হচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের সহযোগী কিছু সংগঠনের নেতা কর্মীরা যেভাবে লুটপাট করেছে- করছে এর বিরুদ্ধেও তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অতিসম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন দেশবাসীকে নতুন তথ্য দিয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো ও পুলিশ বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারি সেবা গ্রহণে কোনো না কোনো একটি সেবায় ঘুষ বা নিয়মবহিভূত অর্থ দেওয়া হয় ভারতে। এ অবস্থানে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি এক সংবাদ সম্মেলনে গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে বলে মনে করেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। জরিপে অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৯৩ শতাংশের ধারণা, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দুর্নীতিপ্রবণ খাত বা প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল ও পুলিশ। আর ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এর পরের খাতই হলো বিচারব্যবস্থা। এছাড়া ভূমি সেবা, রেজিস্ট্রেশন, পারমিট সেবা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিসেবা এবং কর ব্যবস্থাও দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারি খাতে দুর্নীতি খুবই গুরুতর সমস্যা। তবে ৯২ শতাংশ মানুষই মনে করেন, সাধারণ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারেন ও তারা কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখতে চান। এদিকে দুর্নীতির এই জরিপে উত্তরদাতারা নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, বিচার, কর এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৩২ শতাংশের অভিমত হল দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারৗ পদক্ষেপ অকার্যকর। দুর্নীতির ঘটনা জানানোর ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের ৩১.৪ শতাংশ জনপ্রতিনিধিদের ওপর আস্থাবান। দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর ১৮.৮ শতাংশের আস্থা রয়েছে। আর দুদকের কাছে জানতে চান ১১.৪ শতাংশ উত্তরদাতা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ গ্রহীতা খাতগুলো হলো: পুলিশ ৭২ শতাংশ, বিচার ব্যবস্থা ৬৩ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৪ শতাংশ। ঘুষ প্রদানের কারণ হিসেবে ৫৮ শতাংশ মনে করেন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র পথ। টিআইবি’র পরিচালিত জাতীয় খানা পরিপ ২০১০ এর তুলনায় ২০১২ তে সেবাখাতে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার হারও তুলনামূলকভাবে কমেছিল। যে বিষয়টি সাধারণ মানুষ খুব বেশি পীড়া দিচ্ছে, তা হলো জাতি একটি নির্দিষ্ট কালো-বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষ শান্তির পথ দেখছেন না। এর ফাঁকে দেশে পরাজিত মৌলবাদী শক্তি তাদের ফণা দেখাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারকে যেসব বিষয়গুলো বেশি বেকায়দায় ফেলেছে এর মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি, তত্ত্বাবধায়ক প্রথার দাবী, মতিঝিলের হেফাজত ইস্যু, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের অপতৎপরতা, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি,পদ্মাসেতু ইস্যু, জিএসপি সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি। সরকার তা কাটিয়ে ওঠার যথেষ্ট চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে না। সবমিলিয়ে দেশের মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। কিন্তু কীভাবে হবে সে পরিবর্তন? পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। রমজানের পরই দেশে আন্দোলন-হরতাল কর্মসূচি শুরু হতে পারে। তা রাষ্ট্র ও জনগণকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবেÑ না কি অন্য কোনো শক্তির হাতে দেশকে তুলে দেবে তা এমুহুর্তে বলা কঠিন। তবে যে কথাটি বলা দরকার, তা হলো কোনোভাবেই দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া উচিৎ নয়। আর এই দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই বেশি। সরকার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা অন্ততঃ আমি দেখছি না। কারণ এ দেশের অনেক বিশ্লেষক, সমাজ সচেতন মানুষেরা সরকারকে নানাভাবে সংকেত দিয়েছেন। তা শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের গোচরে যদি আসতো, তবে তারা সতর্ক হতে পারতেন। সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর বলেছিলেন- যাদেরকে মন্ত্রী করা হয়েছে তারা প্রত্যাশা পূর্ণ করতে না পারলে বাদ দেয়া হবে। কারণ এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, এই কেবিনেটে অনেক ব্যর্থ মন্ত্রী ছিলেন। তাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়নি কেন? এতো ব্যর্থতার খবর জানার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন কঠোর হতে পারলেন না? তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ক্ষমতাসীনদের পতন ত্বরান্বিত করে। যা বিএনপির বেলায় ২০০৯ এ হয়েছিল, সেটা এবার আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও হচ্ছে কি?-----------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥: শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৩
false
hm
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক মিডিয়া শিরোনাম শুনলে বিরাট প্রবন্ধের মুখচ্ছবি কল্পনায় আসতে পারে, কিন্তু শুরুতেই সে কল্পনায় কাঠি দিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রকৃতি বা তীব্রতা সম্পর্কে জানার সুযোগ আমার কম ছিলো। কারণ হিসেবে প্রথমে ছিলো যথাযথ আগ্রহের অভাব, আর মিডিয়ার দুর্লভত্ব। দেশে সিএনএন দেখার সুযোগ ছিলো, এর বাইরে কিছু নয়। ফলে খুব জরুরি কিছু ইভেন্ট ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় ছিলো না। ব্লগের কল্যাণে (হাফিংটনপোস্টের নামই করবো সবার শুরুতে) ওবামা বনাম ম্যাকেইন প্রচারাভিযানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়ার সুযোগ এসেছে। প্রার্থীদের মধ্যে কে কী নিয়ে লড়ছেন, প্রতিপক্ষের কোন রন্ধ্রটিতে আঙুল ঢোকাচ্ছেন, সে সম্পর্কে অর্ধস্বচ্ছ একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। তবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গাঢ় পেনিট্রেশনের কারণে এই প্রচারাভিযানে টেলিভিশন যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, সেটা পরিষ্কার। ফক্স, সিবিএস, কমেডি সেন্ট্রাল, এইচবিওসহ আরো কয়েকটি চ্যানেল প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা এই নির্বাচন ক্যাম্পেইনকে প্রভাবিত করে চলছে। রাজনৈতিক মেরুমুখিতা অনুযায়ী বিভিন্ন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক তাদের অনুষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিক প্রচারযন্ত্র খুলে ধরছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই আমার। তারেক রহমান বা ফালুর লুটপাটের টাকায় গড়া দু'টি টেলিভিশন চ্যানেলের আমি মুগ্ধ দর্শক ছিলাম (আহ, সেই সংবাদপাঠিকারা!), অনেক সন্ধ্যায় তারেকমুখী বা ফালুমুখী সংবাদ জুলজুলদৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছি (ওরেরে, সেই সংবাদপাঠিকারা!)। তবে মার্কিন টেলিভিশনের শক্তি এর মাত্রায়। স্যাটারডে নাইট লাইভ [এসএনএল] যেমন বহু বছর ধরে জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান, সারাহ প্যালিন উপরাষ্ট্রপতি পদে ম্যাকেইনের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই অভিনেত্রী টিনা ফে তার ইমপারসোনেশন শুরু করেছেন। দূর থেকে টিনার সাথে সারাহ প্যালিনের পার্থক্য করা একটু মুশকিলই। প্যালিনের কথায় মধ্য-পশ্চিমের টান টিনা ফে চমৎকার অনুকরণ করতে পারেন, সেইসাথে প্যালিনের শারীরভঙ্গিও তিনি রপ্ত করে ফেলেছেন। ফলে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা বা বিতর্কের পরপরই শনিবার রাতে এসএনএলে টিনা ফে এসে প্যালিনকে নির্মমভাবে পঁচান। একটি পর্বে তিনি কেটি কুরিকের সাথে সারাহ প্যালিনের সাক্ষাৎকারে ব্যবহৃত অসংলগ্ন সংলাপ প্রায় হুবহু ডেলিভার করে লোক হাসিয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে সারাহ প্যালিনের অজ্ঞতা থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত অসংবৃত বুলিগুলো (যেমন হকি-মম, জো সিক্সপ্যাক ...), সবই সেই ইমপারসোনেশনে মেশানো হয়। কেবল প্যালিনকেই পঁচানো হয় না, ওবামা, ম্যাকেইন, ক্লিনটন, হিলারি, বুশ (উইল ফ্যারেল বুশকে পঁচানোর জন্যে আসেন, এক কথায় অনবদ্য), সবাইকেই কমবেশি ধোলাই করা হয় এসএনএলে। তো সেই এসএনএলে এই ভাঁড়ামিরই একটি অংশ হিসেবে সম্প্রতি খোদ সারাহ প্যালিন (গত হপ্তায়) এবং জন ও সিন্ডি ম্যাকেইন (এ হপ্তায়) এসেছিলেন। মিডিয়ার প্রভাব কতটা সুদূরগ্রাসী হলে কোন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী একটি লোক-হাসানো অনুষ্ঠানে অন্যের লেখা বুলি আউড়ে অভিনয় করতে রাজি না হয়ে পারে না, সেটিই আমার বিস্ময়ের কারণ।
false
rn
অধরা দাঁড়াও হিমি,এক মিনিট একটু অপেক্ষা করো।জৈষ্ঠ মাসের আকাশ তো হঠাৎ সেখানে চোখ গেলো।মন খারাপ হওয়ার আগেই জানালা বন্ধ করে দেই।আমি তোমাকে লিখছি জানালার কাছে বসেই।এইখানে বসেই আমি সব সস্তা উপন্যাস গুলো পড়ি এবং লিখি।ঝিম মেরে বসে থাকি,চা খাই আর আকাশ দেখি।আবার কখনো কখনো সিগারেট ধরিয়ে গভীর রাতের নীরব জ্যোন্সা দেখি।তখন বুকটা শির শির করে উঠে। জীবন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চেহারা নিয়েছে।ভীষন একা লাগে।আমার সব সময় ভয় যে আমাকে ভালোবেসেছ,শুধু এই কারনে তুমি আরো বড় বিপদে না পড়।হয়তো সত্যি যদি পড় তখনও আমি কিছুই করতে পারবো না।সময় আমাদের সব ক'টা আঙু্ল ক্ষইয়ে দিয়েছে।আমরা কারো হাত জড়িয়ে ধরতে পারি না,শুধু ঠেকাই মাএ। তুমি সব সময় ভালো থাকবে,শুধু আমার জন্য।কেমন স্বার্থপরের মতো শোনাচ্ছে কথাটা তবু তোমার কাছেই তো আমি স্বার্থপর হতে পারি।তোমার সমস্ত ভালো মন্দের জন্য আমি নিজের কাছে দায়বদ্ধ অথচ এই মুহুর্তে যদি তুমি অসুস্থ হও তবু আমি তোমার পাশে দাড়াতে পারবো না।এ যে কি যন্তনা তা কি করে বুঝাই। হিমি তুমি জানো স্বপ্ন দেখার সময় অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে।এতো দিনে আমি একদিনও বুঝতে পারিনি যে আমি তোমারি একটা তৈরী করা স্বপ্নের বৃওের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছি।হিমি,আমি যেখানেই হাত পেতেছি,সেখান থেকেই সারা জীবনা আমার হাতটি শূন্য হয়েই ফিরে এসেছে।আর যেখানে আমি হাত পাতিনি সেখানেও প্রতিপক্ষটি আমি হাত পেতেছি ভেবে আমার হাতটিকে আরো বেশী করে শূন্য করে দিয়েছে। তুমি আমাকে একটা কথা বললে।হোক না তুচ্ছ একটা কথা।তুমি হয়তো নানা কাজের ভিড়ে কি বলেছিলে ভুলেই যাও,যাকে বললে সে কিন্তু চিরজীবনের জন্য সেই কথাটাকে আঁকড়ে ধরলো।সেই ধরে থাকাটা কিন্তু অনেক শক্তি দেয়। তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে অদ্ভুদ এক অনুভূতি হলো।প্রতিটি অক্ষর গুলো তোমার সাথে মিলিমিশে এমন জড়িয়ে আছে,কি জানি তাই তোমাকে এতো ভালো লাগে কিনা।লিখতে গিয়ে টের পেলাম প্রতিটি শব্দ লেখার সময় আমি তোমার স্পর্শ পাচ্ছি।আর একটা কথা চার পাশে এতো সাপের মুখ যে ছোবল আসতে কতক্ষন!সর্তক থাকাই ভালো।আমি যা করি,নিশ্চয়ই তোমার তাতে সমর্থন থাকবে।সিগারেটের বদলে বিড়ির অভ্যাস করাই ভালো ছিল।প্রথম কথা টাকার অপচয় কম হতো।আর সবচেয়ে উপকারী যেটা সেটা হলো-ক্যান্সার হতো না।শুনেছি সিগারেটের কাগজটার ধোয়াই সবচেয়ে ক্ষতিকর।।বিড়িতে সেই ধোয়াটা নেই।গ্রামের মানুষের ক'জনার ক্যান্সার হয়?আমি ভাবছি এখন থেকে বিড়ি খাবো।হঠাৎ মনে হলো-তোমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে যদি আমি বিড়ি খাই তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হবে তোমার!হা হা হা...!!! কতো বড়ো হৃদয় থাকলে তবেই এভাবে তোমাকে আপন করে নেওয়া যায়,সেটা তুমি বুঝবে না।দুই জন দুই মেরুতে বাস করেও পরস্পরকে ভালোবাসতে পারে সারা জীবন।বুঝলেন মেম?এখন বলো ভালোবাসা কি জিনিশ?মানুষ মানুষকে কেন ভালোবাসে?আমি জানি তুমি এই মুহুর্তে খুব'ই চমকে উঠলে।তোমার গা-টা হয়তো শির শির করে উঠলো হয়তো।হয়তো একটু অন্তর টা গুলিয়ে উঠলো। হিমি,আমার ইচ্ছা হয় তোমাকে বলি-তুমি শুধু একটি হিমি নও,তুমি অনেক গুলো হিমির গুচ্ছ।শুনো- "খুব ভালো করে ভেবে দেখ তুমি/এখনো রয়েছে ফিরিবার অবসর/শুধু নিমিষের ভুলের লাগিয়ে-/কাঁদিবে যে তুমি/সারাটি জনম ভর"। হিমি তোমার প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-"মানুষের কোনো কথাটাই সোজা নয়।আমরা ডিকশনারিতে যে কথার এক মানে বেঁধে দেই,মানব জীবনের মধ্যে মানেটা সাতখানা হয়ে যায়।সমুদ্রের কাছে এসে গঙ্গার মতো।আমি রোমান্সের পরমহংস।ভালোবাসার সত্যকে আমি এক'ই শক্তিতে জলে স্থলে উপলব্দি করি।আমার মন জাগে তোমার ভালোবাসার প্রবাহ বেগে,তার প্রেরনায় আমার যথার্থ স্বরুপকে জানি।তোমাতেই পাই আমার প্রকাশ রুপিনী বানীকে।"তোমার প্রেমিকের জবাব নেই।দারুন। তুমি মুখটা গম্বীর করলেই বুকের ভিতরটা তোল্পাড় করে।আমি খুব অনুভব করতে পারি,তুমি আমার পাশে থাকলে কোনো অশুভ শক্তি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।তুমি যেভাবে অকপটে স্বীকারোক্তি করতে পারো- আমার ইচ্ছা করে ঐ মুহুর্তে মাথা নুইয়ে তোমার হাতটা জড়িয়ে ধরি।তবে কেন এই জোরজবরদস্তি!আমি যা করবো নিজের দায়িত্বেই করবো। সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:০৮
false
rn
বাচঁতে হলে জানতে হবে -১৯ (আগের লেখা গুলোর লিংক দিলাম না।এখানে ১৯৬১থেকে১৯৮০সাল পর্যন্ত দেয়া হলো।বাকি গুলো পরে যথা সময়ে দেয়া হবে।এই তথ্য গুলো সংগ্রহ করতে আমার সাড়ে চার বছর সময় লেগেছে।অসংখ্য বই পড়তে হয়েছে।দিনের পর দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লাইব্রেরীতে থাকতে হয়েছে।কতদিন দুপুরে খাওয়া হয়নি।কিন্তু কেউ এই মূল্যবান তথ্য গুলো পড়তে চায় না।জানতে চায় না।খুব দুঃখ হয়!)১৯৬১সালমুসলিম পারিবারিক আইন পাস হয়।বি.আর.টি.সি প্রতিষ্ঠিত হয়।ঢাকায় ৫ লক্ষ মুসলমান,৪০হাজার হিন্দু এবং ৩০০০ জন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল।ঢাকায় ছায়ানট(সাংস্কৃতিক সংগঠন)প্রতিষ্ঠিত হয়।ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান।১৯৬২সালরেশম গবেষনা ও প্রশিক্ষন ইনষ্টিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।জাতীয় সংসদ ভবনের ভিওি স্থাপন করা হয়।১৯৬৩সালময়ূর কে ভারতের জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষনা করা হয়।ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৬৪সালঢাকায় ফামের্সী শিক্ষা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়।নেলসন ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারা দন্ড দেয়া হয়।ঢাকায় প্রথম কমপিউটার ব্যবহার করা হয়।(পরমানু শক্তি কেন্দ্রে)১৯৬৫সাল ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত 'বঙ্গ বাজার' এলাকাটি নানা ধরনের খুচরা পন্যের হকার ও ছোট দোকানদারদের ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়।(সেপ্টেম্বর)ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো' এর মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরকে বরন করা হয়।১৯৬৬সালআবুল ফজল আদমজী পুরস্কার পান।শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষনা করেন।(৫,ফ্রেরুয়ারী)এশিয়া কাপ ফুটবল শুরু হয়।টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।১৯৬৭সালদক্ষিন আফ্রিকার কেপ্টাউনে প্রথম হৎপিন্ড সংযোজন করা হয়।চাঁদের বুকে মানুষের পা বাড়ে।(২১ জুলাই)১৯৬৮সালসত্যেন সেন 'বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী' প্রতিষ্ঠিত করেন।১৯৬৯ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়।অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।প্রথম কৃএিম ভাবে এনজাইম তৈরী করা হয়।১৯৭০সালবাংলাদেশে ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।সাধারন নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃ্ত্বে আওয়ামীলীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।১৯৭১সাল২৫ শে মার্চ বৃহস্পতিবার ভয়ঙ্কর কালরাএি নামে খ্যাত।২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ যা নয় মাস ধরে চলে।শেখ মুজিবুর রহমানকে 'জাতির জনক' ঘোষনা করা হয়।ডিসেম্বর মাস থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাস শুরু হয়। বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উওোলন করা হয়।(২,মার্চ)বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।(১৬,ডিসেম্বর)সাহিত্যিক তারাশঙ্কর মারা যান।১৯৭২সালবাংলাদেশ কমনওয়েলথ এর সদস্য পদ লাভ করে।(১৮,এপ্রিল)বাংলাদেশ বিমান সংস্থা গঠিত হয়।বাংলাদেশে 'ডিস এন্টিনা' ব্যাবহার চালু হয়।(২৭,এপ্রিল)১৯৭৩সালঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে 'অপরাজেয় বাংলা' ভাস্কর্যটি তৈরীর কাজ শুরু হয়।বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।(৭,মার্চ)১৯৭৪সালবাংলাদেশে জাতীয় রোয়িং ফেডারেশন গঠিত হয়।মার্কিন মহাশূন্য মেরিনার-১০ সর্বপ্রথম কাছ থেকে বুধের ছবি তুলে পাঠায়।বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৭৫সালআমেরিকান শিল্পী Adam Darius ইঞ্জিনিয়ার্স ইসষ্টিটিউটে প্রথম মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন।সুয়েজ খাল জাহাজ চলাচলের জন্য আবার খোলা হয়।ইসলামিক ফাইন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা হয়।(ইংল্যান্ড)লেবানন এ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়।চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।(৩১,আগষ্ট)১৯৭৬সালকবি জসিমউদ্দিন একুশে পদক পান।বাংলাদেশে মহিলা পুলিশ চালু হয়।প্রথম গ্যাস পরিষদ ঘোষনা করা হয়।কাজী নজরুল ইসলাম মারা যান।চীনে ভূমিকম্পে প্রায় ৭ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল।১৯৭৭সালবাংলাদেশ কে গুটি বসন্ত মুক্ত দেশ হিসেবে সরকারী ভাবে ঘোষনা করা হয়।ঢাকা থিয়েটার সেলিম আল- দীন রচিত 'চর কাঁকড়া'র ডকুমেন্টারী নামে প্রথম পথ নাটক ঢাকায় প্রদর্শন করে।১৯৭৮সালবাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বইমেলা শুরু হয়।বিশ্বে প্রথম টেষ্ট টিউব বেবীর জন্ম হয়।পল্লী বিদুৎতায়ন বোর্ড (আর.ই.বি)প্রতিষ্ঠিত হয়।বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সূচনা হয়।(১৭,ডিসেম্বর)জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন।(১ সেপ্টেম্বর)১৯৭৯সালশিশু পার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করা হয়।মাদার তেরেসা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।১৯৮০সাল২৬ মার্চ কে স্বাধীনতা দিবস ঘোষনা করা হয়।বাংলাদেশে রঙিন টিভি চালু হয়।(১,ডিসেম্বর)কুর্মি টোলা (জিয়া)আন্তজার্তিক বিমান বন্দর চালু হয়।রেকর্ডের জায়গায় দখল করে নেয় ডিকস্ ।ব্যাপকভাবে প্লাষ্টিকের এবং ষ্টিল এর আসবাবপএ তৈরি শুরু হয়।সি.এন.এন মার্কিন যুক্তরাষ্টের বেসকারী টেলিভিশন সম্পচার শুরু করে।প্রথম এশীয় কাবাডি চাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা হয়।
false
rn
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ১। খবরের কাগজে পড়লাম, এক বিদেশি জাহাজ মধুমতি নদীতে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। সেই ডুবে যাওয়া জাহাজ দেখার জন্য আমি ছুটে চললাম- মধুমতি নদীতে। জাহাজ এর নাম স্টিব অস্টিন। আমি মধুমতি'র পাড়ে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি দেখলাম, জাহাজটি অর্ধেক ডুবে গেছে। আমি একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে জাহাজটির সামনে যেতেই- এক পুলিশ অফিসার বলল- না, জাহাজের কাছে যাওয়া যাবে না। নো, নেভার। আমার নৌকার মাঝি বলল- আপনাকে আগেই বলেছিলাম- ওই জাহাজের সামনে যাওয়া নিষেধ আছে। পুলিশটি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। আমি মাঝিকে সাহস দিয়ে চলে এলাম একদম জাহাজের সামনে। লাফ দিয়ে জাহাজে উঠে পড়লাম। পুলিশ অফিসারটি বলল, সাহস করে চলেই যখন এসেছেন, তাহলে দুপুরে আমার সাথে ভাত খান, খুব খুশি হবো। মেন্যু অতি সামান্য। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে করলা ভাজি, আর ডাল। হঠাত আমার মনে হলো- পুলিশ অফিসারটি চাচ্ছে- আমি যেন এই ডুবে যাওয়া জাহাজটির সাথে তলিয়ে যাই। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম- পুলিশ অফিসারটি আমার পূর্ব পরিচিত। সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে- ধ্রুন, আমার হাত ধরুন, নয়তো আপনি ডুবে যাবেন। সময় খুব কম। আমি এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে পুলিশ অফিসারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ঠিক তখন কে যেন আমার কানে ফিস ফিস করে বলল- ''প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা''। ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ঘামে ভেজা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর চারটা। সুরভি গভীর ঘুমে। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম, আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। ভোরের আকাশ দেখা- দারুন একটা ব্যাপার। ২। গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখি- আমি আমার সব প্রিয় মানুষ ছেড়ে জঙ্গলে চলে গেছি। একা একা থাকি। ক্ষুধা পেলে বন থেকে ফল-টল সংগ্রহ করে খাই। রাতে চিন্তাহীন ঘুম দেই। বনের পশুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে- তারা আমার কোনো ক্ষতি করবে না। ছেড়ে আসা কোনো প্রিয় মানুষের কথা ইচ্ছা করেই মনে আনি না। অনেক রাত পর্যন্ত নদীর ধারে টীলার উপর বসে থাকি। আকাশের তারা দেখি। ব্যাপক আনন্দ! হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে হাজির। মেয়েটাকে একটা বাঘ তাড়া করেছে- মেয়েটি আমার সামনে এসে, আমাকে বলল- বাঘ! বাঘ! আমাকে বাঁচাও । আমি বললাম কোনো ভয় নেই- আমি আছি। আমি মেয়েটির হাত ধরলাম, মেয়েটি ভয়ে কাঁপছিল। বাঘটি এসে আমাকে দেখে চলে গেল। এমন ভাব যেন- ওস্তাদ স্যরি...ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। তারপর সারারাত মেয়েটির সাথে অনেক গল্প করলাম। মেয়েটির অনুমতি নিয়ে মেয়েটিকে অনেক আদর করলাম।তারপর বনে আমাদের সংসার জীবন শুরু হলো। দুই বছরের মধ্যে তিনটা বাচ্চা হলো। প্রথম বছর দু'টা জমজ বাচ্চা পরের বছর একটা। খুব আন্দময় জীবন। জঙ্গলে জ্যাম নেই, লোডশেডিং এর চিন্তা নেই। চুরী, ছিনতাই এর ভয় নেই। দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বৌ এর শপিং এর ঝামেলা নেই। মোবাইল নেই। হরতাল নেই। কেউ কুপিয়ে মেরে ফেলবে এই ভয় নেই। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরি বৌ আগুনে পুড়ে দেয়- ফরমালিন মুক্ত মাছ, আহ! ফরমালিন মুক্ত ফল। বাচ্চা গুলোও খুব নাদুস-নুদুস হয়েছে। রাতের বেলা বৌ গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়- "ঐ পাথুরে শহর ছেড়ে সবুজ তেপান্তরে/ স্বপ্ন কিছু সাজিয়ে নিতে সুখের বন্যা ধারায়/ শেষ হবেনা কোন দিন যুগল পথচলা।"৩। এই শহরে আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। থ্রি কমরেডস- এর মতন বন্ধু আমার একজনও নেই। কোনো-কোনো সন্ধ্যায় ইচ্ছা করে- ঘরে না ফিরে, কোথাও বসে খুব আড্ডা দেই। পুরো শহরটাকে একটা সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ মনে করে- আমি শুধু এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় হাঁটতেই থাকি। নানান রকম চিন্তা-ভাবনা করতে করতে- রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে চা খাই। চিন্তা ভাবনা থেকে মুক্তির জন্য- চায়ের দোকানে থাকা লোকদের সাথে তর্কাতর্কীতে মেতে উঠে- সব চিন্তা ভাবনা ভুলে যাই। সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৫
false
rg
পালাকার-এর ভারত জয়!!! বাংলাদেশের পর এবার ভারত জয় করল পালাকার। সম্প্রতি কলকাতার দর্শকদের মুগ্ধ করেছে ঢাকার থিয়েটার গ্রুপ পালাকার। নান্দীরঙ্গ আয়োজিত পাঁচ দিন ব্যাপী পঞ্চম নাট্যোৎসবের তৃতীয় দিনে, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে, কালীঘাটের তপন থিয়েটার মঞ্চে পালাকার (বাংলাদেশ)-এর প্রযোজনা ছিল 'নারীগণ'। 'নারীগণ' নাটকটির রচয়িতা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা দিয়েছেন আতাউর রহমান। নাটকটির সহ-নির্দেশনা দিয়েছেন আমিনুর রহমান মুকুল। নান্দীরঙ্গ আয়োজিত পাঁচ দিন ব্যাপী বাংলার এপার-ওপার পঞ্চম নাট্যোৎসবে এবার বাংলাদেশ থেকে নান্দীরঙ্গের আমন্ত্রণে কলকাতা গিয়েছিল ঢাকার থিয়েটার গ্রুপ পালাকার। কালীঘাটের তপন থিয়েটার মঞ্চে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় হাউজফুল দর্শকের সামনে পালাকার প্রদর্শন করল প্রায় দুই ঘণ্টার নাটক 'নারীগণ'। 'নারীগণ' একটি ঐতিহাসিক নাটক। দুইশো ষাট বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ বেনিয়াদের ষড়যন্ত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধে ব্রিটিশ লর্ড রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যদের কাছে বাংলার নবাবের প্রধান সিপাহশালার মীরজাফর আলী খাঁ'র ষড়যন্ত্রে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। আর তখন ভারতবর্ষে ইংরেজদের দুইশো বছরের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই উপমহাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় দুইশো বছর ব্রিটিশদের গোলামিতে পরিণত হয়েছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর নবাব পরিবারের অন্দরমহলের নারীদের কী হয়েছিল, সেটাই 'নারীগণ' নাটকের মূল বিষয়বস্তু।৩ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর নবাব মহলের অন্তপুরে বন্দি নারীদের নানান উপলব্ধি, নবাব সিরাজের বন্দি নানী শরিফুন্নেছা, মা আমিনা, পত্নী লুৎফুন্নেসার জবানে নাটকটিতে উঠে আসে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা পরম্পরা। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ, নারীর মর্যাদা ও নারীদের ইচ্ছার স্বাধীনতাসহ অনেক বিষয়ে অবমাননার হাত থেকে বাঁচতে এই বন্দি নারীরা তখন আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে না। কারণ তাদের আত্মহননের পথও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অঙ্গুরির বিষ কেড়ে নেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় খঞ্জর। প্রহরীর রূঢ় হাত তাদের শরীর স্পর্শ করে। তাদের বন্দি করার মাধ্যমেই কেবল ঘটনার শেষ হয় না। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এবং বিদ্রোহের পথ রুদ্ধ করতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এসব নারীদের একসময় হত্যাও করা হয়। এসব ঘটনা পরম্পরা নিয়েই 'নারীগণ' নাটকটি।কালীঘাটের তপন থিয়েটার মঞ্চে সেদিন হাউজফুল দর্শকের সামনে ইতিহাসের সেই ঘটনা পরম্পরার এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে পালাকার। 'নারীগণ' নাটকটি কলকাতার দর্শকদের কাছে সেদিন হয়ে উঠেছিল ইতিহাস ফিরে দেখার এক দুর্লভ মুহূর্ত। উপস্থিত দর্শকরা ফিরে গিয়েছিলেন ইতিহাসের দুইশো ষাট বছর আগে সংগঠিত সেই ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায়। প্রায় দুই ঘণ্টার নাটকে এক ঘোর লাগা নস্টালজিয়ায় ইতিহাস ভ্রমণে মেতেছিলেন তপন থিয়েটার মঞ্চের উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী। নাটক শেষে কলকাতার থিয়েটারের অনেক প্রথিতযশা নাট্যব্যক্তিত্ব মঞ্চে উঠে পালাকার নাট্যদলকে তাঁদের সেই ইতিহাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শোনান। পাশাপাশি সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিময় নস্টালজিক অভিজ্ঞতা শোনানোর ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা পালাকারের 'নারীগণ' প্রযোজনার ব্যাপক প্রশংসা করেন। তপন থিয়েটার মঞ্চে পালাকার যেভাবে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে, সেই প্রশংসাবাণী না শুনিয়ে, সেদিনের নাটক শেষের ছোট্ট একটা ঘটনার উদাহরণ এখানে কেবল উল্লেখ করতে চাই। সাত আট বছরের একটি শিশু তার মায়ের সঙ্গে সেদিন মঞ্চে ছিল। নাটক ও নাটক শেষে কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিদের ওই প্রশংসা পর্ব শেষ হলে, তপন থিয়েটার হলের দর্শক সারিতে ওই শিশুকে নিয়ে তখনো বসেছিলেন এক মা। শিশুটির আবদার নবাব সিরাজকে না ছুঁয়ে কিছুতেই সে বাড়িতে যাবে না। পরে শিশুটির সেই আবদার মেটানো হয়েছিল নবাবকে শিশুটির সামনে হাজির করে। 'নারীগণ' নাটকে নবাব সিরাজের নানী শরিফুন্নেছার চরিত্রে অভিনয় করেন ফারহানা মিঠু। সিরাজের মা আমিনার চরিত্রে অভিনয় করেন দীপ্তা রক্ষিত লাভলী। সিরাজের পত্নী লুৎফার চরিত্রে অভিনয় করেন তানিয়া হোসাইন। সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমের চরিত্রে অভিনয় করেন ফাহমিদা মল্লিক শিশির। এছাড়া নাটকে নতর্কী চরিত্রে জয়িতা মহলানবীশ, ডালিম চরিত্রে মনিরা অবনী, পায়েলী চরিত্রে তিথী দাশ সাথী, নবাব সিরাজের চরিত্রে শামীম সুফী, কুতুব-১ চরিত্রে শাহরিয়ার খান রিন্টু, কুতুব-২ চরিত্রে সানসি ফারুক, কুতুব-৩ চরিত্রে শামীম সাগর, কুতুব-৪ চরিত্রে সেলিম হায়দার, আলীবর্দী খাঁ চরিত্রে ফাইজুর মিল্টন, মাঝি চরিত্রে হিমালয় নিমগ্ন অরিত্র, প্রহরী-১ চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল, প্রহরী-২ চরিত্রে ইমরান হোসেন, প্রহরী চরিত্রে মুরাদ, বাঁদি চরিত্রে নভেম্বর টুইসডে রোদ। 'নারীগণ' নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন অনিকেত পাল বাবু, আলোক পরিকল্পনা করেছেন ঠাণ্ডু রায়হান, সংগীত পরিকল্পনা করেছেন অজয় দাশ, পোষাক পরিকল্পনা করেছেন লুসী তৃপ্তি গোমেজ, পোস্টার করেছেন দিলারা বেগম জলি এবং নাটকটির প্রযোজনা অধিকর্তা ছিলেন আমিনুর রহমান মুকুল। নান্দীরঙ্গ নাট্য সংস্থা এবার কলকাতায় পালাকার পরিবারকে যেভাবে বরণ করেছেন, যে আন্তরিক আতিথিয়েতা দেখিয়েছেন, প্রতিটি মুহূর্ত যেভাবে পালাকারের সকল চাহিদা মিটিয়েছেন, বিশেষ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নাটকের সেট নির্মাণ, লাইট সেটআপ, মিউজিক সেটআপসহ সকল কাজে সহযোগিতা দিয়েছেন, তা সত্যি সত্যি দুই বাংলার থিয়েটারের জন্য এক নবযুগের সূচনা করেছে। বিশেষ করে নান্দীরঙ্গের অপুদা (সম্বুদ্ধ গাঙ্গুলী) যেভাবে সার্বক্ষণিক পালাকার পরিবারকে সঙ্গ দিয়েছেন, সেজন্য পালাকার পরিবার সত্যি সত্যিই কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ-ভারত এপার বাংলা-ওপার বাংলার যে যোগসূত্র নান্দীরঙ্গ ও পালাকার স্থাপন করেছে, এটা আগামীতে উভয় দেশের সংস্কৃতি বিনিময়ে ও থিয়েটার চর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। উভয় দেশের এই কালচারাল ফ্রেন্ডশিপ ভবিষ্যতে আরো মজবুত ও টেকসই হোক। নান্দীরঙ্গ নাট্য সংস্থাকে পালাকার পরিবারের পরাণের গহীন ভেতর থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। জয়তু নান্দীরঙ্গ। জয়তু পালাকার। .................................১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৮:৩৩
false
rn
গরুর মাংসের রেসিপি ১/ শাহী বিফ উপকরণ : গরুর মাংস ১ কেজি হাড় ছাড়া, পেঁয়াজ ২০০ গ্রাম, আদা বাটা ১ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, জিরা ১ টেবিল চামচ, গরম মসলা ১ টেবিল চামচ, ডিম ২টি, টকদই ১ কাপ, মাওয়া ২ টেবিল চামচ, তেল ৭৫ গ্রাম, ঘি ৭৫ গ্রাম, কাঁচামরিচ ৫০ গ্রাম, পেস্তাবাদাম পেস্ট ১ টেবিল চামচ, কাজু বাদাম পেস্ট ১ টেবিল চামচ, টমেটো ২টি, কিশমিশ ৩০ গ্রাম, লবণ স্বাদমতো। প্রস্তুত প্রণালি : গরুর মাংস ভালোভাবে ধুয়ে ছেঁকে নিতে হবে। তারপর ডিম, মাওয়া, ঘি ছাড়া বাকি সব উপকরণ একসঙ্গে মিলিয়ে চুলোয় চড়াতে হবে। রান্না করতে হবে কিছুক্ষণ। মাঝে মধ্যে নেড়ে দিতে হবে যেন লেগে না যায়। পানি শুকিয়ে তেল ওপরে উঠে এলে পানি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে। সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে রান্না করতে হবে। সিদ্ধ হয়ে গেলে মাংস একটি পাত্রে নামিয়ে রাখতে হবে। একটি পাত্রে ঘি দিয়ে তাতে পেঁয়াজ, রসুন, এলাচ, দারুচিনি বাদামি না হওয়া পর্যন্ত ভাজতে হবে। মসলা বাদামি হয়ে এলে তাতে নামিয়ে রাখা মাংসগুলো দিয়ে কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে। মাংস ভাজা ভাজা হলে তাতে মাংসের জমানো ঝোল দিয়ে মাখা মাখা করে রান্না করতে হবে। মাখা মাখা হয়ে এলে এতে কিশমিশ ও মাওয়া দিয়ে নামিয়ে ফেলতে হবে। ডিম ভেজে জুরিয়ান করে কেটে গরম গরম পরোটা অথবা পোলাও এর সঙ্গে পরিবেশন করুন নবাবি বিফ। ২। গরুর চাপ উপকরণ : গরুর মাংস ৫০০ গ্রাম (কুঁজের হলে ভালো হয়), আদা বাটা ১ চা চামচ, রসুন বাটা আধা চা চামচ, টক দই ২ টেবিল চামচ, শুকনা মরিচ বাটা ১ চা চামচ, জায়ফল কোয়ার্টার ভাগ, জিরা সিকি চা চামচ, জয়ত্রী ৩টি, গোলমরিচ সিকি চা চামচ, দারুচিনি ২ টুকরা, এলাচ ছোট ২টি ও বড় ১টি সব একসঙ্গে গুঁড়া করে নিতে হবে। পেঁয়াজ মোটা করে কাটা ২টি (বড়), পেঁয়াজ বেরেস্তা ২ টেবিল চামচ, খোসাসহ কাঁচা পেঁপে বাটা ১ টেবিল চামচ, সরিষার তেল আধা কাপ, সয়াবিন তেল সিকি কাপ, কর্নফাওয়ার ১ টেবিল চামচ, লবন পরিমাণমতো । প্রণালী : মাংসের সঙ্গে সবকিছু মাখিযে ২-৩ ঘন্টা রাখতে হবে । এবার তাওয়ায় তেল দিয়ে মাখানো মাংস অল্প আঁচে কষাতে হবে। কালচে রং এলে মাখা মাখা অবস্থায় নামিয়ে নিতে হবে। তারপর লুচি অথবা পরাটার সাথে খাবেন। ৩। গরুর মাংস ভুনা উপকরণঃ গরুর মাংস ১ কেজি, আদা বাটা ৪ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ, আস্ত রসুন ৬ কোয়া, জিরা বাটা ১ চা চামচ, দারুচিনি ৬ টুকরা, এলাচ ৬ টুকরা, পেঁয়াজ মোটা গোল করে কাটা ২ কাপ, পেঁয়াজ চিকন কুচি ১ কাপ, কাঁচা জিরা, শুকনা মরিচ ২টা, তেল ২ কাপ, হলুদ বাটা দেড় চা চামচ, শুকনা মরিচ বাটা ১ চা চামচ, লবণ ১ টেবিল চামচ, চিনি ১ চা চামচ। প্রণালীঃ প্রথমে চুলায় তেল দিয়ে চিকন কুচি করা পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে। এবার মোটা গোল পেঁয়াজ দিয়ে একটু বাদামি হলে মাংস, আদা বাটা, রসুন বাটা, জিরা বাটা, হলুদ বাটা, মরিচ বাটা দিয়ে খুব ভালো করে ভুনে গরম পানি ২ কাপ ঢেলে দিতে হবে। মাংস আধা সেদ্ধ হলে আস্ত রসুন দিতে হবে এবং ঢিমা আঁচে রাখতে হবে। এবার চুলায় কাঁচা জিরা, দারুচিনি, এলাচ, শুকনা মরিচ শুকনা তাওয়ার ওপর ভেজে গুঁড়া করে নিতে হবে। ভাজা পেঁয়াজ চিনির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। যখন মাংস ভুনে তেলের ওপর আসবে, তখন পেঁয়াজের সঙ্গে মেশানো মসলা মাংসের ওপর ছড়িয়ে ঢিমা আঁচে আধা ঘণ্টা রাখতে হবে। ৪। গরুর মাংস ভুনা উপকরণঃ গরুর মাংস ১ কেজি, আদা বাটা ৪ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ, আস্ত রসুন ৬ কোয়া, জিরা বাটা ১ চা চামচ, দারুচিনি ৬ টুকরা, এলাচ ৬ টুকরা, পেঁয়াজ মোটা গোল করে কাটা ২ কাপ, পেঁয়াজ চিকন কুচি ১ কাপ, কাঁচা জিরা, শুকনা মরিচ ২টা, তেল ২ কাপ, হলুদ বাটা দেড় চা চামচ, শুকনা মরিচ বাটা ১ চা চামচ, লবণ ১ টেবিল চামচ, চিনি ১ চা চামচ। প্রণালীঃ প্রথমে চুলায় তেল দিয়ে চিকন কুচি করা পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে। এবার মোটা গোল পেঁয়াজ দিয়ে একটু বাদামি হলে মাংস, আদা বাটা, রসুন বাটা, জিরা বাটা, হলুদ বাটা, মরিচ বাটা দিয়ে খুব ভালো করে ভুনে গরম পানি ২ কাপ ঢেলে দিতে হবে। মাংস আধা সেদ্ধ হলে আস্ত রসুন দিতে হবে এবং ঢিমা আঁচে রাখতে হবে। এবার চুলায় কাঁচা জিরা, দারুচিনি, এলাচ, শুকনা মরিচ শুকনা তাওয়ার ওপর ভেজে গুঁড়া করে নিতে হবে। ভাজা পেঁয়াজ চিনির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। যখন মাংস ভুনে তেলের ওপর আসবে, তখন পেঁয়াজের সঙ্গে মেশানো মসলা মাংসের ওপর ছড়িয়ে ঢিমা আঁচে আধা ঘণ্টা রাখতে হবে। ৫। নেহারি যা যা লাগবেঃ গরুরর পায়া- ১ কেজি, হাড়সহ মাংস- ১ কেজি, পিঁয়াজ কুচি- ১ কাপ, আদা ছেঁচা- ২ টেবিল চামচ, বড় এলাচ গুঁড়া- ২টি, ছোট এলাচ গুঁড়া- ৪টি, শাহী জিরা- ২ চা চামচ, গোল মরিচ গুঁড়া- ২ চা চামচ, লবঙ্গ- ৩টি, দারুচিনি- ৩ টুকরা, শুকনা মরিচ- ৩টি, কাঁচামরিচ- ৭/৮টি, সয়াবিন তেল- ২ টেবিল চামচ, লবণ- স্বাদমতো, ধনেপাতা কুচি- ২ টেবিল চামচ। যেভাবে করবেনঃ তেলে গরুর পায়া ও মাংসগুলো লাল করে ভেজে ওই তেলেই পিঁয়াজ ভেজে তুলে রাখুন, আদা, বড় এলাচ, ছোট এলাচ, শাহী জিরা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি দিয়ে ১ মিনিট ভেজে এতে ভাজা মাংস, পিঁয়াজ, শুকনা মরিচ দিয়ে ২ মিনিট ভেজে ৪-৫ লিটার পানি দিয়ে দিন। ফুটে উঠলে মৃদু আঁচে ঢেকে ৩-৪ ঘণ্টা সিদ্ধ করে মাঝে ২ ঘণ্টা পর লবণ-কাঁচামরিচ দিয়ে দিন। হাড় থেকে মাংস খুলে এলে নামাবেন। ঝোল কিছুটা ঘন হবে কিন্তু অনেক ঝোল থাকবে। নান, তন্দুরি রুটির সঙ্গে পরিবেশন করুন। চাইলে পরিবেশনের সময় ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, আদাকুচি দেয়া যায়। এই রান্নার রেসিপি গুলো সংগ্রহ করেছি। এখনই রান্না করুন ।পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজা করে খান। আর যদি ইচ্ছা হয় তাহলে আমাকে ডেকে নিতে ভুলবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন বিক্ষিপ্ত মন মেজাজ নিয়ে রান্না ভালো হয় না। কাজেই হাসু খুশি থাকুন। রান্না করার সময় গুন গুন করে দু'চার লাইন রবীন্দ্র সংগীত গাইবেন । সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৪:০৭
false
fe
মানবাধিকারের বর্ম, বিবেকের বীজতলা মানবাধিকারের বর্ম, বিবেকের বীজতলাফকির ইলিয়াস=======================================বিশ্বে একটি আলোচিত বিষয় মানবাধিকার। আর এর অন্যতম মাপকাঠি তাদের হাতে, যারা বিশ্বের সুপার পাওয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা নিয়ে প্রায়ই কথা বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিয়ে তাদের এই মাথাব্যথা। কিন্তু কেমন চলছে যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার? এ নিয়ে স¤প্রতি একটি প্রতিবেদন করেছে চীন। চীনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেও নিজেদের খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোনো অনুতাপ নেই। দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়েছে, ওয়াশিংটন অন্যান্য দেশেও মানবাধিকারের নির্লজ্জ লঙ্ঘন ঘটাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশটির মুখ কালি মাখানো। যে কারণে অনেকবারই লাল কার্ড দেখানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার, একের পর এক সহিংস অপরাধ যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে অনেক প্রাণহানি এবং জনরোষের ঘটনা ঘটছে।’ উদাহরণ হিসেবে সা¤প্রতিক মিসৌরির ফার্গুসন শহরে ড্যারেন উইলসন নামে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে মাইকেল ব্রাউন নামে ১৮ বছর বয়সী নিরস্ত্র এক কিশোরের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে চীন। চীনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) নির্বিচারে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পথ অবলম্বন করে। টুইন টাওয়ার হামলার পর জঙ্গি সন্দেহে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে কিছু ‘ঘৃণ্য পদ্ধতি’ ব্যবহার হয়।ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অবিরাম পানিতে চুবিয়ে নির্যাতন করা ছাড়াও যৌন নির্যাতনের হুমকি দিয়ে, পায়ুপথে পানি ঢুকিয়ে, চড় মেরে, ঠাণ্ডার মধ্যে রেখে হেনস্তা করে এমনকি দিনের পর দিন ঘুমাতে না দিয়ে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান বলেও দাবি করা হয়েছে চীনা প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রে নারী ও শিশু অধিকারও পুরোপুরি সুরক্ষিত নয় দাবি করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর পুরুষের নির্যাতনের শিকার হয় ২১ লাখ নারী। প্রতিদিন গড়ে তিনজন নারী তার পুরুষ সঙ্গীর হাতে খুন হন এবং নিপীড়নের শিকার হয়ে মারা যান চারজন নারী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক লাখ শিশু গৃহহীন। আরো ভয়াবহ সংবাদ আছে। স¤প্রতি ফেডারেল প্রশাসনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯ জুন ২০১৫-এর আগ পর্যন্ত দুই বছর ৫ মাস ১৯ দিনে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে ২৯ হাজার ৭৯৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। হতাহতের বড় একটি অংশ শিশু-কিশোর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, রেস্টুরেন্ট ও জনসমাগমে এসব অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছিল। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ জনেরও বেশি। সর্বশেষ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলাইনায় চার্লস্টনে শত বছরের পুরনো গির্জায়। এ ঘটনায় প্রার্থনারত অবস্থায় নিহত হন নয়জন।প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে গুলিতে ১১ হাজার ৪১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ৬ হাজার ৪২০ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর। ২০১৪ সালে বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়েছে ১২ হাজার ৫৬১ জন। অতর্কিত গুলিতে ২২ হাজার ৯৮৮ জন আহত হয়েছে ওই বছর। নিহতদের মধ্যে ৬২৯ জনের বয়স ১১ বছরের কম। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছিল ২৩৭২ জন। ওই নির্বিচারে গুলি বর্ষণের ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৮৪ জন। এছাড়া দুর্ঘটনাক্রমে বন্দুকের গুলিতে মারা গেছেন ১৫৯৮ জন। চলতি বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত নিহত হয়েছে পাঁচ হাজার ৮১৫ জন। এর মধ্যে ১১ বছরের কম বয়সী রয়েছে ৩১১ জন। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী রয়েছে ১১০৮ জন। নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন ১৩৮ জন। এছাড়া ৯০৫ জনের প্রাণ গেছে দুর্ঘটনাক্রমে বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসা বুলেটে।স¤প্রতি সানফ্রান্সিসকোতে যুক্তরাষ্ট্রের সিটি মেয়রদের এক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, ‘বন্দুকের গুলিতে নিহত মানুষের প্রাণ যাওয়ার পর আমরা শুধু চোখের জল ফেলি, শোক-বিবৃতি দিই। এরকম অমানবিক আচরণ রোধে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যে কাজটি করার আহ্বান আমি বারবার জানাচ্ছি তার প্রতি কেউ ভ্রƒক্ষেপ করছেন না।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, পৃথিবীর মানুষ শান্তি চাইছেন। কিন্তু এর প্রক্রিয়া কী? কিভাবে আসতে পারে এই কাক্সিক্ষত শান্তি?স¤প্রতি হোয়াইট হাউসের ইফতার পার্টিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আবারো সেই উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, পিস-চ্যারিটি- ফরগিভনেস আমাদের মানবিক শক্তিকে বলীয়ান করবে। ইফতারের আগে ওবামা বলেন, রমজান মাসে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় চেতনার প্রতি আস্থাবোধকে উজ্জীবিত করেন। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস যাই হোক, আমরা যে একই পরিবারের সদস্য ও সব মানুষ যে সমান, সেই চেতনার প্রতি অবিচল আস্থার প্রকাশ ঘটাচ্ছি। ইফতার আয়োজন বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘এই উদ্যোগ এও প্রমাণ করে যে, আমেরিকা ধর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। এখানে যার যা বিশ্বাস স্বাধীনভাবে তা পালন করতে পারে।’ স¤প্রতি চার্লেস্টন চার্চে বন্দুকধারীর হামলায় ৯ কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা এবং চলতি বছরে চ্যাপেল হিলে তিন মুসলিম তরুণ হত্যার কথা উল্লেখ করে ওবামা বলেন, ‘তারা কে, দেখতে কেমন, কাকে তারা ভালোবাসেন, কিভাবে তারা প্রার্থনা করেন- এ সবের ভিত্তিতে কাউকে আক্রমণ করা যাবে না। আমেরিকান হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই।’ যে প্রশ্নটি আসছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রে কি মানবাধিকার যথাযথভাবে মানা হচ্ছে?যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক কথাই এবারো বলা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস এন্ড লেবারের এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে বাংলাদেশ বিষয়ে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, অনলাইন (সামাজিক গণমাধ্যম) ও গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, শ্রম অধিকার ও দুর্বল কর্মপরিবেশ বাংলাদেশের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন, সরকারি খাতে বিস্তৃত দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারী আটক, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা এবং বিচারের পূর্বে দীর্ঘকাল আটক রাখাও বাংলাদেশের মানবাধিকারের জন্য এখনো গুরুতর সমস্যা। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দলীয় অন্তঃকোন্দলও বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা। কিছু বেসরকারি সংগঠনের কার্যক্রমে আইনি ও অনানুষ্ঠানিক বাধা এসেছে। নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বাল্যবিয়ে একটি বিদ্যমান সমস্যা। শিশুরা বাধ্য হচ্ছে কাজ করতে। বাংলাদেশ বিষয়ে ৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের সারাংশে বলা হয়, সামাজিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। যদিও অনেক রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের মতে এসব ঘটনা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য নয় বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে শুধু দায়মুক্তি পাচ্ছেন না বরং সাধারণ নাগরিকদের অধিকারের দাবি করা থেকেও নিবৃত্ত করছে। স¤প্রতি বছরগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে হত্যা, নিপীড়নের ঘটনা ঘটলেও সরকার খুব কমই তদন্তের পদক্ষেপ নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করেছে।এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলছে, তখন বিশ্ব শান্তি সূচক জানাচ্ছে, শান্তি সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দ্য গ্লোবাল পিস ইনডেক্স বা বিশ্ব শান্তি সূচকের তালিকায় বাংলাদেশ ৯৮ স্থানে উঠে এসেছে। সূচকের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২২টি নির্দেশিকার ওপর ভিত্তি করে ১৬২টি দেশের এই তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ব শান্তি সূচক। গত আট বছর ধরে তারা নিয়মিত এই শান্তিপ্রিয় দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। বরাবরের মতো এবারো তালিকার প্রথম কুড়িটির ১৪টি হচ্ছে ইউরোপীয় দেশ। এবার বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে আইসল্যান্ড। তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ডেনমার্ক ও অস্ট্রিয়া। এছাড়া নিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং সুইজারল্যান্ড রয়েছে পঞ্চম স্থানে। গত বছর থেকে জর্জিয়া, কোট ডি আইভরি ও লিবিয়ার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। বিশ্বের সবচেয়ে কম শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে তালিকার একেবারে তলানিতে অর্থাৎ ১৬২তম স্থানে রয়েছে সিরিয়া। গত বছর এই স্থানটিতে ছিল আফগানিস্তান। একধাপ এগিয়ে আফগানিস্তান উঠে এসেছে ১৬১টিতে। আর ১৬০-এ রয়েছে দক্ষিণ সুদান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দুবছরে আরো ১০টি দেশ নতুন করে রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। দেশগুলো হচ্ছে, জাম্বিয়া, হাইতি, আর্জেন্টিনা, চাঁদ, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, নেপাল, বুরুন্ডি, জর্জিয়া, লাইবেরিয়া ও কাতার।তিনটি মূল থিম- নিরাপত্তার স্তর, নিরাপদ সমাজ এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংঘাতের ব্যাপ্তি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের শান্তিপূর্ণ দেশের এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় স্থান পাওয়া ১৬২টি দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯৯ দশমিক ৬ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। দেশটির অবস্থান তালিকার ১৬তম স্থানে। শান্তি সূচকে ৭৬ স্থানে রয়েছে নেপাল। বাংলাদেশ রয়েছে ৯৮তম অবস্থানে। এটি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। তালিকায় শ্রীলঙ্কা ১০৬, ভারত ১৪৩ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১৫৪তম স্থানে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্র নেমে গেছে তালিকার ১০১তম স্থানে।যুক্তরাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা বলে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কি ‘ক্রসফায়ার’ নেই! খুব সা¤প্রতিক একটা ঘটনা উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়। গেল ৬ জুন ২০১৫ নিউইয়র্কের দানেমোরা কারাগার থেকে পালিয়ে যায় একাধিক খুনের দায়ে দণ্ডিত অপরাধী রিচার্ড ও ডেভিড। নিñিদ্র নিরাপত্তার ওই কারাগার থেকে কয়েদি পালানোর প্রথম ঘটনা ছিল এটি। ঘটনার পর ব্যাপক যৌথ তল্লাশি শুরু হয়। কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই অপরাধীর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ জুন ২০১৫ শুক্রবার নিউইয়র্কের উপশহর মেলোনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জেল পালানো রিচার্ড ম্যাটের মৃত্যু হয়। কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় অপরাধী ডেভিড সুয়েটকে ২৮ জুন ২০১৫ রোববার গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে এখানে কিছু তথ্য তুলে ধরা দরকার। ওয়াশিংটন পোস্টের বরাত দিয়ে এএফপি ও রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৩৮৫ জন নিহত হয়েছেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন দুজনেরও (২ দশমিক ৬ জন) বেশি লোক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।এছাড়া ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর ৪০০ জন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে আসছে। তবে মার্কিন সরকার দেশব্যাপী এর ১৭ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বাইরে কোনো পরিসংখ্যান অনুমোদন করে না। এফবিআইয়ের হিসেব মতে, গত এক দশকে প্রতিদিন গড়ে ১.১ জন করে মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। হতাহতের শিকার মানুষদের বয়স ১৬ থেকে ৮৩ বছর। পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনের হাতে বন্দুক বা অন্য কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ছিল। নিহতদের মধ্যে ৯২ জন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলেও খবরে বলা হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জনসংখ্যার বিচারে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গরা নিহত হয়েছে অন্য সংখ্যালঘু বা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি হারে। পত্রিকাটি এ বছর যে হত্যাকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করেছে, তার ভিত্তিতেই এ হিসাব। বিশ্বে শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে আমরা যারা বড় গলায় কথা বলছি, তাদের ভেবে দেখতে হবে গোড়ায় গলদ কোথায়? মানুষের জন্য শান্তিময় বিশ্ব নির্মাণের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে বিবেকের বীজতলা তৈরি করা। সৃজনশীলতার বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকার ভোগ করা যায় না। উগ্র মানসিকতা, বেলেল্লেপনা, সামাজিক অনাচার, অন্যের ধর্মীয়-ঐতিহ্যের প্রতি আঘাত করা বিবর্তনের পথ হতে পারে না। বিবেকহীন মানুষ ও জঙ্গলের প্রাণীর মাঝে তাহলে আর পার্থক্য কী? পেশিশক্তির জোরে পরের ধনে পোদ্দারি করাকে মানুষ চিহ্নায়ন করতে পারছে। পরখ করতে পারছে শান্তি ও অশান্তির পথরেখা। এই বোধোদয় আরো উজ্জ্বল হলেই মানুষ এগোতে পারবে সব সৃষ্টির দিকে।--------------------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৪ জুলাই ২০১৫ প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:২৯
false
fe
জানমালের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রের শক্তিশালী হাত জানমালের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রের শক্তিশালী হাতফকির ইলিয়াস=========================================এই দেশ রক্ষা করার দায়িত্ব কার? যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের দায় এড়াবার কোনো সুযোগ নেই। দেশের মানুষ বলছেন, আমাদের বাঁচান। আমরা সহিংসতা চাই না। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে দাবি উঠেছে। বোমার আগুন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নারীরাও। এটা কি একাত্তর সাল? পশ্চিমা হায়েনাদের কায়দায় মৌলবাদী অবরোধকারীরা হামলে পড়ছে এ দেশের মানুষের ওপর! পুড়ছে ট্রাক। পুড়ছে মানুষ। কয়লা হয়ে যাচ্ছে মানুষের দেহ। খালেদা জিয়া বলছেন তিনি অবরুদ্ধ। তিনি তার গৃহে যাওয়ার চেষ্টা করছেন? না এমনটি কেউ দেখেনি। বরং অফিসেই আছেন। সেখানে থেকেই নির্দেশ দিচ্ছেন। আর তা প্রচার করছেন তার মুখপাত্ররা। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের পতন। পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা অবরোধ চালিয়ে যাবেন। আপাতত এটাই তাদের কথা। এখন তো পুলিশ নেই। তিনি বাড়িতে ফিরছেন না কেন?অন্যদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা বেশ শক্ত কথা বলেছেন। তারা রীতিমতো রাজনীতিকদের মতো ভাষণ দিয়েছেন। এসব তারা না বললেও পারতেন। তারা রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ করার মালিক। কথা বলা তাদের কাজ নয়। আইন যা বলবে- সেটা তারা তামিল করবেন। দেশে সহিংসতা চলছে। পশ্চিমা ও এশিয়া উভয় অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশের ক‚টনীতিকরা আন্দোলনের নামে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানিয়েছেন, ক‚টনীতিকরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির প্রশংসা করেন এবং চলমান সহিংস ঘটনার নিন্দা জানান। একাধিক দেশের ক‚টনীতিকরা তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কখনই গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। তাদের প্রত্যাশা, খুব শিগগির সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘হরতালের নামে এখন যেটা হচ্ছে সেটা হচ্ছে সন্ত্রাস। এগুলো মোকাবেলায় সন্ত্রাস দমন আইন আছে। এখন এ আইন প্রয়োগ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘যে আইনে জনগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে, সে আইন করা হয়। হরতাল বন্ধের জন্য দাবি উঠলে এ বিষয়েও আইন করা হবে।’ আমার মনে হয় এই দাবিটি এখন সময়ের। অবরোধ, হরতাল বন্ধ করার জন্য আইন প্রণীত হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন মুখথুবড়ে পড়বে।আমাদের জানা আছে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুলের কর্তৃত্ব সবসময়ই গণমানুষের জন্য অশান্তি বয়ে আনে। আর তা যদি হয় ভোগবাদীদের দ্বারা তৈরি, তবে তো কথাই নেই। একটি রাষ্ট্রে, স্বার্থপর ভোগবাদীদের সম্মিলিত একটি চক্র সব সময়ই তৎপর থাকে। তারা মানুষের স্বার্থ শুধু হরণই করে না, উচ্চ পর্যায়ে নিজেদের একটি সিঁড়িও তৈরি করে রাখে। সেই সিঁড়ি ব্যবহার করে তারা শাসকদের কারো কারো আনুক‚ল্য পায়। ফলে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে এবং তা একটি রাষ্ট্রকে ক্রমশ দেউলিয়া করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি সেই পথ উন্মুক্ত করে গেছে। এর পথ ধরেই এই দেশে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা হয়ে উঠেছে রাজনীতির হাতিয়ার। বাংলাদেশে এখনো কৃষক-মজুরই প্রধান শক্তি। অবরোধের কারণে আজ তারা কাজ করতে পারছে না। ফসল-সবজি-আনাজ আসতে পারছে না শহরে। এটা কেমন রাজনীতি?বাংলাদেশে ২০১৫-এর প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনা করছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সরকার ও বিরোধী দলসহ সবাইকে জাতীয় সংসদে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন তার স্বাগত ভাষণে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রেখে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনা করছে। গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন সুদৃঢ়করণ এবং সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিক চর্চা ও অনুশীলন জাতির বিভিন্নমুখী সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম।’মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ দেশের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এ প্রেক্ষাপটে আমি সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে সবাইকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণের প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই।’ বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলনের নামে কতিপয় রাজনৈতিক দলের জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, খুন-জখমসহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মধ্যে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে সরকার আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে, বাঙালি জাতিকে আবারো ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’ হ্যাঁ- সেটাই আজ আসল কথা। রাষ্ট্র ক্ষমতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা, দেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা মরিয়া হয়ে উঠেছে তাদের রুখে দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।আমরা জেনেছি বাংলাদেশে ভাইবার ও ট্যাঙ্গোর পর এবার হোয়াটস অ্যাপসহ আরো তিনটি ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ও ভিওআইপি এপ্লিকেশন ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ বন্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েগুলোকে (আইআইজি) হোয়াটস অ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের এই তিনটি অ্যাপ বন্ধের নির্দেশনা পাঠিয়েছে। এটা কি সাময়িক? এটা কি দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য? এমন অনেক কথা আসছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, অনলাইন যোগাযোগ এই সময়ে কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতেই পারে। কিন্তু অবাধ তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করা, স্থায়ী সমাধান নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। খুব দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে চাই, এই বিজয় আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের। যে চেতনায় বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন, সেই চেতনার বিজয় নিশানই আজ উড়াচ্ছে রাষ্ট্র। অভিবাদন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি।বলে নিতে চাই, গেল এক বছর তো দেশে স্থিতিশীলতা ছিল। এখন তা হলে অস্থির করে তোলার নেপথ্যে মতলব কি? রাষ্ট্রক্ষমতা দখল? যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেশে জঙ্গিবাদ কায়েম করা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে রাজাকারদের হাতে দেশ তুলে দেয়া? ‘আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান’ এই স্লোগান কারা দিয়েছিল, তাদের চেহারা বাংলার মানুষ এখনো মনে রেখেছেন। আজ সেই দানবরাই তাদের প্রকৃত চেহারা আবারো দেখাচ্ছে। বাংলাদেশে জানমালের নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তা সরকারকে করতে হবে। পেট্রল বোমা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করতে হবে। মোবাইল কোর্ট করে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি শাস্তি দিতে হবে। অপরাধীর কোনো দল নেই। এটা মনে রেখেই সরকারকে এগোতে হবে। চার দশকেরও বেশি বয়সী বাংলাদেশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ ভুল কর্তৃত্বের হাতে। সুবিধাবাদী এসব কর্তা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন অশুভ শক্তির প্রতিভু। এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এই প্রজন্মকে। শুদ্ধতার অতন্দ্র মনীষা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে গ্রামীণ জনপদের মানুষকে সতর্ক, সাহসী করে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে আটষট্টি হাজার গ্রামই বাংলাদেশের মূল শক্তি বিন্দু। সেই কৃষক মজুর সমাজই শ্রেষ্ঠ শক্তি যারা এ দেশের ধান, পাঠ, সবজি, ফলমূলসহ সব আহার্যের জোগানদার। সেই গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষই শক্তি যারা রিকশার প্যাডেল চাপে কিংবা গার্মেন্টসের চড়কা ঘুরায়। গণমানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রচারণা বন্ধ হলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অনেক ধাপ। আর এ জন্য এ প্রজন্মকেই নিতে হবে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা। আর সরকারকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের সাংবিধানিক শাসন।--------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ প্রকাশিত
false
rn
ফোটোগ্রাফী- ২৪ ''পাহাড়ে ওঠার অর্থ হলো তুমি যাতে পৃথিবীটাকে দেখতে পারো। এর অর্থ এই নয় যে পৃথিবী তোমায় দেখবে। অর্থাৎ অযথা ক্যামেরা ক্লিক না করে বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে চেষ্টা করুন।''কোন এক বিচিত্র কারনে মানুষ ছবি দেখতে খুবই পছন্দ করে। যদি কখনও কাউকে বলা হয় যে ছবি ভাল হয়নি কেন, তখন স্বাভাবিক ভাবে যা উত্তর আসে তা হল, “আমারতো ভাই দামী ক্যামেরা না”, “যদি আমারে কেউ ঘোরাঘুরির জন্য টাকা দিতে, তাইলে হয়ত আর একটু সময় নিয়ে ভাল কিছু করতে পারতাম”, “আমার যদি আর একটু সময় থাকত” ইত্যাদি ইত্যাদি। সরল কথায় এই গুলা হল অজুহাত। আর হুমায়ুন আহম্মেদের ভাষায় বাঙ্গালীর তিন হাত, ডান হাত, বাম হাত এবং অজুহাত। মূল বিষয় হল আপনি যদি পারেন, এমনিই পারেন, না পারলে কোন ভাবেই পারেন না। সুতরাং, আপনার যা নেই তার জন্য কান্নাকাটি না করে, আপনার যা আছে তাকেই আয়ত্ব করুন।বাংলা ভাষায় লেখা ফটোগ্রাফীর বই খূবই কম। যারা ফটোগ্রাফার এবং যাদের এই বিষয়ে আগ্রহ আছে তাদের জন্য ফটোগ্রাফি নিয়ে কিছু পড়াশোনা করা অত্যাবশ্যকীয়। ইংরেজী ভাষার ফটোগ্রাফি বই 'Fundamentals of Modern Photography' – লেখক Tom Ang বইটি সকল ফটোগ্রাফারদের অন্তত একবার হলেও পড়ে নেয়া দরকার। বই পড়ার সাথে ফটোগ্রাফি বিষয়ব টিউটোরিয়াল ভিত্তিক ওয়েবসাইট আছে সেগুলো নিয়মিত ভিজিট করুন। ফটোগ্রাফিক টিউটোরিয়ালগুলো দেখতে ইউটিউবে আপনি আপনার প্রশ্নগুলো সার্চ করুন সেখানে আপনি ভিডিও দেখতে পারবেন যার ফলে আমরা কনফিউশানগুলো দূর হয়ে যাবে। ইন্টারনেটে অসংখ্য ওয়েবসাইট বিনামুল্যে ফটোগ্রাফির বিভিন্ন টিউটোরিয়াল, টিপস, রিসোর্স দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া Flickr, 500px, YourShot ইত্যাদি ওয়েবসাইটে প্রচুর ছবি দেখে শিখতে পারবেন।অনেকরকম ফটোগ্রাফার কাজ করে আমাদের আশপাশে। প্রত্যেকের কাজের ক্ষেত্র আলাদা। যেমন ফ্যাশন ফটোগ্রাফাররা ফ্যাশন শুট করে, ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফাররা জীবজন্তুর ছবি তুলে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফটোগ্রাফাররা মেশিনের ছবি তুলে, আবার ফরেনসিক ফটোগ্রাফারদের কাজ বিভিন্ন অ্যাসপেক্ট থেকে কোনো ক্রাইমের ছবি তোলা, যেমন কোনো খুন হলে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে লাশের ছবি তোলা, যাতে ছবি দেখে তদন্ত করতে সুবিধে হয়। সায়েন্টিফিক ফটোগ্রাফাররা আবার রিসার্চ ওয়ার্কের ছবি তুলে। এর বাইরেও রয়েছে ন্যাচার অর্থাত্ প্রকৃতির ছবি তোলা। ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফার, তাদের কাজ শুধু বিভিন্ন স্থানকে দর্শনীয় স্থানের মতো করে ছবি তোলা। খুব স্বাভাবিক ভাবে কোথাও ছবি তুলতে গেলে আপনি যদি একটু বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারবেন। অনেককে দেখেছি, ক্যামেরা হাতে নিয়ে কঠিন ভাব নিতে চেষ্টা করেন, এটা ঠিক নয়। মানুষ হয়ে জন্মেছেন, মানুষের মত ব্যবহার করুন। সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৩
false
fe
বজলুর রহমান স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য স্মৃতিপদক প্রবর্তন বজলুর রহমান স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য স্মৃতিপদক প্রবর্তন ============================================ প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, আপনারা আমাদের শুভেচ্ছা জানবেন। আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত বজলুর রহমানের স্মরণে স্মারক বক্তৃতা ও স্মৃতিপদক প্রবর্তনের বিষয়ে আমাদের প্রস্তাবনা আপনাদের অবগত করার জন্য সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। বজলুর রহমান ছাত্রজীবনে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে সাপ্তাহিক সম্পাদন করেছেন এবং বিজয়ের অব্যবহিত পরে আফেন্সা-এশীয় গণসংহতি পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বজলুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং তার বিকৃতি রোধে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিশিষ্ট সুহৃদয়। বজলুর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরী ও তার বুরা বজলুর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ অনুভব করেন। তারা এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিদের সঙ্গে আলোচনার পর এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওপর দায়িত্ব অর্পণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই আলোচনার স্খির হয়ে যে, এই কার্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও বজলুর রহমানের আমৃত্যু পেশা সাংবাদিকতা প্রাধান্য পাবে। এ দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে প্রদানের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রতি যে আস্খা ও বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে সেজন্য মতিয়া চৌধুরী এবং বজলুর রহমানের স্বদেশ ও প্রবাসের বুদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনারা অবগত রয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং এই গৌরবোজ্জ্বল বিস্তারিত ইতিহাসের সঙ্গে দেশবাসী, বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের পরিচয় সাধনে জাতীয় কর্তব্যে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি বহু বছর ধরে দেশের তথ্য মাধ্যমের সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস উদঘাটন করে ইতিহাস সংরক্ষণ ও তার প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করেছেন। আজও এই বেদনা ও গৌরবের ইতিহাসের বহু উপাদান অজানা রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে গবেষণাভিত্তিক রিপোর্টিংয়ের বিকল্প নেই এবং এ ধরনের মৌলিক কাজ ইতিহাসের সব বিকৃতি রোধ করে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। এই কর্তব্য সাধনের জন্য আমরা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বজলুর রহমানের মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে, স্মারক বক্তৃতা আয়োজনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণাভিত্তিক সেরা রিপোর্টিং/প্রতিবেদনের জন্য প্রিন্ট মিডিয়ার একজন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজন সাংবাদিককে বজলুর রহমান স্মৃতিপদকে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিশিষ্টজন সমন্বয়ে জুরি বোর্ড গঠন করবে। এই জুরি বোর্ড সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনাক্রমে বাছাই এবং মনোনয়নের নীতিমালা ও প্রক্রিয়া স্খির করবে। এক্ষেত্রে একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিস্তারিত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ আহ্বান করা হচ্ছে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মতিয়া চৌধুরী বজলুর রহমানের মৃত্যুর কারণে পাওয়া অর্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বজলুর রহমানের স্বদেশ ও প্রবাসের বু এবং মতিয়া চৌধুরীর নিজস্ব অনুদান। তিনি ইতোমধ্যে ঢাকা ক্লাবে বজলুর রহমানের স্খায়ী সদস্য পদ হস্তান্তরের ফলে পাওয়া ১৪ লাখ টাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেছেন। এ সব অর্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্খায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখবে এবং তা থেকে অর্জিত অর্থে প্রতিবছর অনুষ্ঠান আয়োজন এবং মনোনীত সেরা সাংবাদিককে পদক ও নগদ অর্থ প্রদান করা সম্ভব হবে। আমরা আশা করছি ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বজলুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ২০০৮ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণাভিত্তিক রিপোর্টিং/প্রতিবেদনের জন্য সেরা সাংবাদিককে স্মৃতিপদক প্রদানের মধ্য দিয়ে এ আয়োজনের সূচনা হবে। সাংবাদিক বন্ধুরা, আমরা মনে করি, স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও সারাদেশে এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বহু মূল্যবান উপাদান অনুদঘাটিত রয়ে গেছে। যথাযথ গবেষণা ও অনুসানী কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস গবেষণাভিত্তিক রিপোর্টিং সংক্রান্ত কর্মসূচি এই জাতীয় কর্তব্য সাধনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উৎসাহিত করবে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম নতুন মাত্রা লাভ করবে। ধন্যবাদ ট্রাস্টিবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। [৯ জুন, সোমবার, ২০০৮ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সাংবাদিকদের উদ্দেশে পঠিত] ----দৈনিক সংবাদ / ১১জুন ২০০৮বুধবার প্রকাশিত সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৩৩
false
hm
প্রবাসে দৈবের বশে ০৪৫ ১. বোতল আমার হইলো না আদায় বোতল আমি টানতে পারলাম নাআআআ ...। দশ তারিখ পরীক্ষা শেষে ভরপেট মদ খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু ডিপার্টমেন্টের কাজে কামলা দিতে গিয়ে সব বরবাদ হলো। ধন্য আশা কুহকিনী। কাজ আর কিছুই না, কয়েকটা প্রোজেক্টে কর্মরত ডক্টোরান্ডদের একটা সম্মেলন গোছের ব্যাপারস্যাপার হবে, সেখানে গ্রিলের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চেপেছে। প্রথম কাজ হচ্ছে, বিয়ারের বেঞ্চ আর টেবিলসহ পানীয় ডেলিভারি দিয়ে যাবে এক প্রতিষ্ঠান, তাদের কাছ থেকে সব বুঝে শুনে নিয়ে স্টোররুমে গুছিয়ে রাখা। সময়মতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষার ব্যাপারে জার্মানরা বিখ্যাত, আর আমি কুখ্যাত। যখন টিউশনি করতাম, প্রথম দিনই ছাত্রছাত্রীদের বিএসটি আর এইচএসটির তফাৎ বুঝিয়ে বলতাম। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টাইম হিমু স্ট্যান্ডার্ড টাইম থেকে কিছুটা পিছিয়ে। অর্থাৎ কখনো যদি বলি যে মঙ্গলবার দিন সাতটার সময় আসবো, তাহলে আটটার আগে কখনোই আমাকে আশা করা উচিত হবে না। ২১ তারিখ বিকেল ৫টায় কোন এক বালিকার সাথে সময় নির্ধারণ করে ২২ তারিখ সন্ধ্যে ৬টায় দেখা করার উদাহরণও আছে। কিন্তু জার্মানিতে এসে আমাকে দৌড়ের ওপর থাকতে হচ্ছে, এরা অ্যাপয়েন্টমেন্টে গড়বড় একেবারেই সহ্য করতে পারে না। আমিও সময়মতো জিনিসপত্র বুঝে নিতে গিয়ে টাশকি খেলাম বেঞ্চ আর টেবলের আকৃতি দেখে। এর্গোনমিক্সে জার্মানরা বেশ এগিয়ে, টিংটিঙে এক ছোকরা আর দানবের মতো তার বস জনাব কোয়লার একটা ঠেলাগাড়ির ওপর পটাপট ছয় কেস বিয়ার আর আবঝাব কোমল পানীয় চাপিয়ে দোতলার স্টোর রুমে রেখে দিলো। সেদিনের জন্যে একটা বিশেষ চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে, ডিপার্টমেন্টের সব ঘরের দরজা সেটা দিয়ে খোলা যায়। হারিয়ে গেলে সব ঘরের দরজার তালা বদলাতে হবে, সেটার খরচ বহনের দায় আমার ঘাড়ে চাপবে, তাই একটু পরপরই পকেটে চাবির রিং চাপড়ে দেখি। বিয়ারের বেঞ্চ আর টেবিল যে কেমন জঘন্য জিনিস, তা টের পেলাম বিকেলে সব সেট করার সময়। আমাকে সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই, ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা ফারষ্টুলে (রোলিং টেবল) নিয়ে সেটার ওপর চাপিয়ে এলিভেটরে করে নিচে নামালাম সব। বড়সড় জিনিস বহনের জন্যে বিশেষ একটা এলিভেটর আছে, কিন্তু সেটার চাবি আবার আমাকে দেয়া হয়নি। জার্মানরা নিজেদের আন্দাজে সবকিছু পোক্ত করে বানায়, যে টেবিল কোয়লার একাই শিস দিতে দিতে এনে ল্যাবের মেঝেতে জড়ো করে রেখেছে, সেটা ফারষ্টুলেতে চাপিয়ে নিচে ঘাসে ছাওয়া লন পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যেতে গিয়ে আমার নাভিশ্বাস উঠে গেলো। গ্যাস দিয়ে গ্রিল হবে, সেজন্যে বিশেষ একটা গ্রিল আর প্রোপেনের একটা ট্যাঙ্ক ল্যাবমাস্টার হের নয়মান আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন বিকেলেই। জিনিসটা বেশ কাজের। কয়লা দিয়ে গ্রিল করার দুটো ঝামেলা, এক হচ্ছে কয়লায় আগুন ধরানোটা একটা ছোটখাটো ভ্যাজাল, দুই হচ্ছে বাতাসে কয়লার গুঁড়ো চারদিকে ছিটকে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সে তুলনায় গ্যাস গ্রিল অনেক পরিচ্ছন্ন। গ্রিলের সাথে একটা প্রেশার রেগুলেটর লাগানো আছে, বিপদের আশঙ্কাও তেমন নেই। হের নয়মান আমাদের ল্যাবে প্রাকটিকুম করান, তাই সব কিছুই গুছানো ধাপ অনুযায়ী বোঝানোর অভ্যাস হয়ে গেছে তার। পরিষ্কার করে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। সেইসাথে নানা ফতোয়া। "আপনি গ্রিলমাস্টার, আপনি যেভাবে ভালো মনে করবেন সেভাবে করবেন। লোকের কথায় কান দেবেন না। দেখবেন সবাই নিচে এসে একেক রকম কায়দার কথা বলবে, মাথা ধরিয়ে ফেলবে। পাত্তা দেবেন না। নিজের কাছে যা ভালো মনে হয় করবেন। কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝবেন কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ? আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি! প্রথমত ...।" বাস্তবে তেমনটাই হলো। পরে যখন গ্রিল সেট করছি, এক ডক্টোরান্ড দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। পোস্টার লাগানো হয়নি, এদিকে তার প্রেজেন্টেশন শুরু হয়ে গেছে। আমি তাকে উদ্ধার করতে পারি কি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোস্টার সাঁটানো শুরু করলাম গ্রিল ফেলে। ডিপার্টমেন্টের হেড এসে আমাকে এক ফাঁকে বলে গেছেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আরো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে প্রেজেন্টেশন শেষ হতে, আমি যেন নেক কাজ করি দিলে মনে। পোস্টার লাগিয়ে এসে গ্রিলে আগুন দিয়ে দেখি লোকজন বিয়ারের কেস হাতে বেরিয়ে আসছে লনে। গ্রিল শুরু হবার পর দেখা গেলো, মিছিমিছিই টেবিল পাতা হয়েছে। প্রফেসরেরা একটা টেবিল দখল করে বিয়ারের বোতল নিয়ে নিবিষ্ট মনে গুজগুজ করছেন, ডক্টোরান্ডরা সবাই হাভাতের মতো গ্রিলের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। নিরামিষাশীরা সব্জির শাসলিক গ্রিল করা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। কয়েকজন ছোঁচার মতো এসে বারবার সসেজ উল্টেপাল্টে দেখছে, হলো কি না। আমি হের নয়মানের অমৃতবাক্য স্মরণ করে দেখলাম, কথা সত্যি। বড়দের কথায় এ জন্যেই কান দিতে হয়। তবে যারা মাতবরি করতে এসেছে, তাদের হতাশ না করে আমি খুশিমনে বিয়ারের বোতল খুলে একপাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারতে লাগলাম। যার যেমন খুশি করে খাক, আমার কী? এর আগের হপ্তায় কাসেলের কয়েকটা গ্রিলকেন্দ্রের একটা, বুগা হ্রদের পাশে একটা ছোটখাটো গ্রিল করেছিলাম আমরা, কয়লা দিয়ে, তাই তাৎক্ষণিক তুলনায় বলতে পারি, গ্যাসের গ্রিল আসলেই কয়লার চেয়ে ভালো হয়। নয়মানের ভাষ্যমতে ইলেকট্রিক গ্রিল সবচেয়ে ভালো, কিন্তু সেটা তো আর সব জায়গায় ব্যবহারের সুযোগ নেই। আসর ফুরিয়ে যাবার পর আশেপাশে যাকে পেলাম পাকড়াও করলাম জিনিসপত্র গোছানোর জন্য। আমাদের হেডও এসে হাত লাগালেন (এ ব্যাপারটা সম্ভবত আমাদের দেশে কখনোই হবে না), ব্যাটার গায়ে যে প্রায় আসুরিক শক্তি আছে, সেটাও দেখলাম। যেখানে আমরা দু'জন মিলে একটা টেবিল ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি কষ্টেসৃষ্টে, তিনি একাই সেরকম দুটো বগলে করে ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন। গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে বিয়ার খাওয়া হলেও বাসায় ফিরে আর মাল খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। গোসল করে দিলাম ঘুম। যদিও চাবি ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি সেক্রেটারিয়েটে, কিন্তু ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখলাম, ডিপার্টমেন্টের সব দরজা হাঁ করে খোলা, আর আমার ইমিডিয়েট বস এসে গোমড়া মুখে গান গাইছে, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে? ২. আর ইউ সাজেস্টিং দ্যাট কোকোনাটস মাইগ্রেট? মন্টি পাইথনের দু'টো সিনেমা খুঁজে পেলাম, দেখলাম পরীক্ষায় প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে। মন্টি পাইথন প্রায় চল্লিশ বছর আগের এক ব্রিটিশ কমেডি গ্রুপ, যাকে বলে স্কেচ শো, অর্থাৎ বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক মিনিটের কমেডি, সেই ধারার অন্যতম জনপ্রিয় শো ছিলো তাদের। পাঁচটা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাও হয়েছে মন্টি পাইথনের ভাঁড়ামোর ভাঁড়ার থেকে, লাইফ অব ব্রায়ান আর হোলি গ্রেইল দেখলাম, বাকি তিনটা এখনো দেখিনি। মন্টি পাইথন গ্রুপের ছয়জনের মধ্যে গ্রাহাম চ্যাপম্যান বাদে সবাই মোটামুটি নাম কামিয়েছেন শো-বিজনেসে, চ্যাপম্যান মারা গেছেন ১৯৮৯ সালে। জন ক্লিজ মোটামুটি প্রবাদপ্রতিম কমেডিয়ান, এককালে বিটিভিতেও দেখাতো তাঁর অন্যতম টিভি সিরিয়াল ফল্টি টাওয়ারস। সে সময় আমি নিতান্ত নাদান ছিলাম, পরবর্তীতেও ফল্টি টাওয়ারস দুয়েকটা পর্ব দেখে খুব একটা ভালো লাগেনি। এরিক আইডল, মাইকেল প্যালিন বা টেরি জোনস ক্লিজের তুলনায় সিনেমা লাইনে তেমন আর এগোতে পারেননি, তবে টেরি জিলিয়াম পরিচালনায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মন্টি পাইথনের টিভি স্কেচগুলোও যে সবকয়টাই খুব জুতের, এমনটা নয়। ইউটিউব থেকে দু'টো স্কেচ যোগ করছি। তবে সিনেমাগুলিতে কিছু জায়গায় হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার যোগাড়। লাইফ অব ব্রায়ান যেমন। যীশুর পাশের আস্তাবলে জন্মায় ব্রায়ান, তিন জ্ঞানী ব্যক্তি প্রথমে ভুল করে তার মায়ের কাছেই সোনা, ধূপ আর পবিত্র মলম গছিয়ে দিয়ে চলে যায়, পরে আবার নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এসে কেড়েকুড়ে নিয়ে গিয়ে যীশুর আলোকিত আস্তাবলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। সেই ব্রায়ানকেই আবার লোকে পরে পাকেচক্রে মেসিয়াহ হিসেবে মানতে শুরু করে। ব্রায়ান আবার জড়িয়ে পড়ে রোমানবিরোধী গোপন নিষিদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনে। শহরের দেয়ালে রাতের আঁধারে চিকা মারা শুরু করে, Romanus eunt domus! টহলরত ডেসিউরিয়ান এসে আচমকা তার কান পাকড়ে ধরে, "এটা কী লিখেছিস, অ্যাঁ? মানে কী এর?" কানমলা খেয়ে ব্রায়ান ডুকরে ওঠে, "রোমানরা বাড়ি যাও!" ডেসিউরিয়ান আরো ভালো করে কান ডলতে ডলতে বলে, "বটে? লেখাপড়া তো কিছুই করিসনি মন দিয়ে! রোমানের বহুবচন কী হবে?" ব্রায়ান কাতরে ওঠে, "রোমানি! রোমানি!" ডেসিউরিয়ান বলে, "তার নিচে ওটা কী লিখেছিস? এউন্ত! এউন্ত! শব্দান্ত কর দেখি, "ইর" ক্রিয়ার শব্দান্ত কর!" ব্রায়ান কাঁদতে কাঁদতে শব্দান্ত করে। "এউন্ত মানে কী দাঁড়ায় তাহলে? তারা যায়! এখন বল, রোমানেরা বাড়ি যাও, এটা কি সাধারণ ক্রিয়া নাকি আদেশ ক্রিয়া?" ব্রায়ান বলে, "আদেশ! আদেশ ক্রিয়া!" ডেসিউরিয়ান বলে, "বেশ, এবার তাহলে ঠিক করে বল!" ব্রায়ান বলে, "ইৎ! ইৎ!" ডেসিউরিয়ান বলে, "বটে? কয়টা রোমানকে বাড়ি যেতে বলছিস? একটাকে না সবক'টাকে? বচন কী হবে?" ব্রায়ান এবার ফুঁপিয়ে ওঠে, "ইতে! ইতে!" ডেসিউরিয়ান বলে, "শেষমেষ ওটা কী লিখেছিস? বাড়ি যাও! এখানে বাড়ি কোন কারক? অ্যাঁ? কোন কারক কোন বিভক্তি? Domus নয়, এখানে হবে Domum! ল্যাটিন তো কিচ্ছু শিখিসনি দেখছি! এবার যা, শহরের দেয়ালে পাঁচশোবার শুদ্ধ করে লেখ, Romane ite domum!" ওদিকে হোলি গ্রেইলে রাজা আর্থার একটা স্বল্প বাজেট অভিযান চালায় পবিত্রপাত্র উদ্ধার করার জন্যে। আর্থারের ঘোড়া নেই, তার ভ্যালেট যাবতীয় মালপত্র বহন করে, আর দুটো নারিকেলের আধখোসা একটা আরেকটার সাথে বাড়ি মেরে ঘোড়ার খুরের খটখট আওয়াজ তোলে। এক দুর্গের সামনে এসে আর্থার হাঁক ছাড়ে, "কে তোমার লর্ড? তাকে বলো, সে রাজা আর্থারের এই অভিযানে যোগ দিতে রাজি কি না!" ওপর থেকে দুর্গের রক্ষী বলে, "বটে? কেমন রাজা আপনি? আপনার তো কোন ঘোড়াই নেই, দুটো নারিকেলের খোল নিয়ে একটা আরেকটার সাথে বাড়ি দিচ্ছেন! আপনি নারিকেল পেলেন কোথায়?" আর্থার বলে, "নারিকেল কোথায় পেলাম মানে?" রক্ষী বলে, "নারিকেল তো এদিকটায় জন্মায় না। এটা তো ক্রান্তীয় এলাকার ফল। কোত্থেকে পেলেন?" আর্থার বলে, "আমাদের সোয়ালোরা শীতে দক্ষিণে উড়াল দেয়! কই, সেটা নিয়ে তো কোন প্রশ্ন ওঠে না!" রক্ষী এবার বলে, "আর ইউ সাজেস্টিং দ্যাট কোকোনাটস মাইগ্রেট?!" ৩. ব্যারন মুনশাউজেনের অভিযানগুলি ফ্যান্টাসি আমার বেশ প্রিয়। যদিও লর্ড অব দ্য রিংস, হ্যারি পটার কিংবা ক্রনিকলস অব নার্নিয়ার ধাঁচের ফ্যান্টাসি না, আমার ভালো লাগে বাস্তবের হাতে হাত ধরে চলা অলীক বাস্তবতা, যে ফ্যান্টাসির সাথে মানুষের একেবারে খটখটে জীবনের বাস্তবতাও মিশে থাকে নিবিড়ভাবে। এ কারণে "দন হুয়ান দি মার্কো" আর "হীরক রাজার দেশে" আমার বেশ প্রিয় সিনেমা। তেমনি আরেকটা সিনেমা দেখে খুব ভালো লাগলো, টেরি জিলিয়ামের পরিচালনায় অ্যাডভেঞ্চারস অব ব্যারন মুনশাউজেন। ব্যারন মুনশাউজেন এক বীরপুরুষ, তার সঙ্গীরাও একেকজন নানা বিষয়ে কৃতী। বের্টোল্ড যেমন গুলির চেয়েও আগে ছুটতে পারে, যে কারণে সে দরকার না পড়লে পা থেকে শেকল দিয়ে বাঁধা লোহার গোলা খোলে না। আলব্রেখট অন্যতম শক্তিশালী লোক, ভারি ভারি জিনিস সে অক্লেশে কাঁধে তুলে নেয়। পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করে অ্যাডোলফাস, আর গুস্তাফাস তার বড় বড় কান দিয়ে শুনতে পায় নিযুত যোজন দূরের শব্দ। এমনই এক ব্যারনের কাহিনী রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ করছে শহরের থিয়েটার দল। ওদিকে বাইরে চলছ তুর্কিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ। ছোট্ট স্যালি তার বাবার থিয়েটার দলের ছোট্ট কান্ডারী, সে শহরে ঘুরে ঘুরে যেখানেই পোস্টারে "সল্ট অ্যান্ড সন" লেখা দেখে, সেখানেই "সন" কেটে "ডটার" লিখে দিয়ে আসে। ব্যারন মুনশাউজেনের গল্পে স্যালির দারুণ আগ্রহ। একদিন রঙ্গমঞ্চে স্যালির বাবা ব্যারন সেজে যখন নানা কাহিনী শোনাচ্ছে শহরের লোকজনকে, তখনই হঠাৎ মঞ্চে আবির্ভাব সত্যিকারের ব্যারন মুনশাউজেনের! মঞ্চ তছনছ করে দিয়ে ক্রুদ্ধ ব্যারন গর্জাতে থাকে, "বন্ধ করো এই প্রহসন! গল্প শুনতে চাইলে আমার কাছ থেকে শোনো!" তারপর শুরু হয় ব্যারনের আশ্চর্য গল্পযাত্রা। সিনেমা মঞ্চ টপকে চলতে থাকে সিনেমার পথে। এরই ফাঁকে আবার তুর্কি বাহিনী শহর আক্রমণ করে, গোলাবৃষ্টি হতে থাকে, মৃত্যুদূত এসে বৃদ্ধ ব্যারনের আত্মার ওপর হামলা করে, ছোট্ট স্যালি ছুটে গিয়ে হটিয়ে দেয় তাকে। ব্যারন হঠাৎ হাল ছেড়ে দেন, শান্তিতে মরতে চান তিনি, এই যুক্তির যুগ তাঁর আর ভালো লাগে না। যেখানে সব কিছুর জন্যেই একটা করে নিয়ম থাকে, রুলস অব হাইড্রলিকস, রুলস অব সোশ্যাল ডাইন্যামিক্স, যেখানে আর তিন পা অলা সাইক্লপসদের জায়গা হয় না, সেই সময়ে কেন তিনি বেঁচে থাকবেন? কেউ শুনতে চায় না তাঁর গল্প, কেউ বিশ্বাসে করে না। ছোট্ট স্যালি গুটিসুটি মেরে বসে তাঁর পাশে, সে শুনতে চায় সব গল্প, সে সব বিশ্বাস করে। এরই মধ্যে আবার শুরু হয় গোলাবৃষ্টি। এবার স্যালি ছুটতে ছুটতে বের হয়, শহরের প্রাচীরের ওপর রাখা কামানের ওপর বসে সে ঢিল ছুঁড়ে মারে তুর্কি বাহিনীর ওপর। "দূর হও তোমরা, আমাকে গল্প শুনতে দাও!" আমাকে যদি গত শতাব্দীর সেরা কিছু সিনেমার দৃশ্য বাছাই করতে বলা হতো, এ দৃশ্যমালা আমি ওপরের দিকে রাখতাম। ছোট্ট একটি শিশু এক টুকরো পাথর নিয়ে আক্রমণ করছে একটি সেনাবাহিনীকে, তার ফ্যান্টাসির জগতকে সে আক্রান্ত হতে দেবে না, তার সবটুকু সাধ্যমতো সে রক্ষা করে চলছে বাস্তবতার বিপরীতের কল্পজগতকে, এর মতো অপূর্ব দৃশ্য আর খুব বেশি আছে কি? সিনেমা এর পর অনেকদূর গড়ায়। ব্যারনের ভূমিকায় জন নেভিল আর স্যালির ভূমিকায় সারা পলি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সিনেমাটা দীর্ঘ, কিন্তু অভিনয় আর দৃশ্যায়নের গুণে দর্শক এই দৈর্ঘ্যের কথা ভুলতে বাধ্য। সিনেমাটা দেখে একটাই কাঁটা খচখচ করছে মনের মধ্যে, একটা ফ্যান্টাসিনির্ভর বড়গল্প লেখার চেষ্টা করছি গত দেড়বছর ধরে, প্লটটা মনের মধ্যে সাজানো আছে সবটুকুই, শুধু লিখতে বসা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ মদ্যপান করে এক বসায় লিখে ফেলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয় না। এই গল্প নিয়ে গল্প লেখা হয়ে যায়, দিনপঞ্জিতে গল্পের চেহারা আঁকা হয়ে যায় শৈশবের গাছ-নদী-ফুল-পাখির মতো, কিন্তু গল্পটা নিজে রয়ে যায় নাগালের বাইরে।
false
hm
হায়, বিটিভি ... ইউটিউবের কাছে কৃতজ্ঞ হতে হবে অজস্র কারণে। গতকাল ফেসবুকে এক ফেসবুকবন্ধুর দেয়া লিঙ্ক দেখে চমকে উঠলাম। শাহনাজ রহমতুল্লাহর একটি গান, বহু বছর আগে রেকর্ড করা। সাদাকালো সেই গানটা দেখে কুড়ি বছর আগের সবকিছুর ভেতরে যেন ফিরে গেলাম। এই লেখাটা প্রায় দু'বছরের পুরনো। প্রাসঙ্গিক মনে হলো বলে পোস্ট করলাম আবার। সেইসাথে যোগ করছি প্রিয় শিল্পী শাহনাজের গানটি। মালেনা দেখেছেন অনেকেই৷ যুদ্ধে গিয়ে মালেনার স্বামী আর ফিরে আসে না, বাতাসে গুঞ্জরিত হয় তার মৃত্যুসংবাদ, সুতন্বী মালেনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে বিনিদ্র স্বপ্নময় রাত কাটায় এক কিশোর, আর তার চোখের সামনে গোটা নগরের পুরুষরা হামলে পড়ে একা, অরক্ষিত মালেনার ওপর, তাকে সমাজচ্যুত করা হয় অক্লেশে, সে সংসাররীতির বাইরে পা বাড়ায় মামলায় উকিলের প্রাপ্য দেহ দিয়ে শোধ করতে, এক পর্যায়ে দিনের খাবারটুকুও তাকে কিনতে হয় চোরাচালানির কাছে নিজেকে মেলে ধরে৷ সেই কিশোরের চোখের সামনে দিয়ে এক সময় মালেনা পরিণত হয় বেশ্যায়, শহরে যখন জার্মান সৈন্যরা পা রাখে, তাদের অফিসারদের কন্ঠলগ্নাদের মধ্যে মালেনাও ছিলো এক সুন্দরী৷ সেই কিশোরের কাছে তবু মালেনার রূপ নষ্ট হয় না, সে তবুও ভেবে যায় নিজের মতো করে, তার কল্পনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দেয় মালেনা৷ বিটিভির প্রসঙ্গ উঠলে আমারও মনে হয় মালেনার কথা৷ বিটিভি আমার শৈশবের প্রেম৷ সেই রাত ন'টায় নাইট রাইডার, ফল গাই, দ্য এ টীম, ম্যাক গাইভার, রাতের খবরের পর থর্ন বার্ডস, অল দ্য রিভারস রান, টুইন পীকস ... সন্ধ্যাবেলা টেলস অব দ্য গোল্ডেন মাংকি, শুক্রবার দুপুরে থান্ডারক্যাটস৷ আকৈশোর আমার ভালোবাসা ছিলো বিটিভি৷ তখন নাটক আরো সীমিত, আরো পরিমিত ছিলো, হুমায়ূন আহমেদের নাটক তখন ছিলো প্রতিশ্রুত আনন্দের সমার্থক৷ আখতার ফেরদৌস রানাও বিটিভির জন্য চমৎ‍কার কিছু নাটক লিখেছিলেন, কয়েকটার টুকরো টুকরো সংলাপ মনে আছে এখনও৷ বিটিভির এই আকর্ষণের পাশাপাশি কালো দিকটাও ছিলো৷ খবর মানে এরশাদ সাহেবের ঘোড়ার মতো চেহারা, আর তার চেলাচামুন্ডাদের ভগরভগর৷ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর শুধু নাম পাল্টালো, খালেদা জিয়াই বিটিভির প্রিয়দর্শিনী হয়ে দাঁড়ালেন৷ তখন খবর দেখতাম না, বিটিভি ছিলো ম্যাকগাইভারখানা৷ এগুলো বাদ দিলেও বিটিভিতে হঠাৎ হঠাৎ‍ চমৎ‍কার সব প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখানো হতো, বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাঁকে দেখানো হতো টুকরো টুকরো চলচ্চিত্র, আরো অনেক কিছু৷ আমার ইংরেজি শেখার একটা সহায়ক মাধ্যম ছিলো বিটিভির সিরিয়ালগুলো৷ বৃহস্পতিবার মুভি অব দ্য উইকে দেখেছি খুব ভালো বাছাই করা কিছু মুভি, নির্বাচক কে বা কারা ছিলেন জানি না, আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই৷ বিটিভিও মালেনার মতোই চোখের সামনে ক্ষমতাসীনের রক্ষিতায় পরিণত হয়েছে৷ বেশ্যার শরীরে যেমন কামুক আর মাতালেরা চিহ্ন রেখে যায়, বিটিভির শরীরেও এখন সেরকম ক্ষত৷ ইংরেজি সিরিয়ালগুলো বাংলায় কুৎ‍সিত ডাব করে দেখানো হয়, অনুষ্ঠানের মান আগের তুলনায় অনেক খারাপ হয়েছে, বেসরকারী টেলিভিশনগুলোর বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনের অনুকরণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয় চরম অদক্ষ ক্রু নিয়ে, যেখানে রিপোর্টার বা সংবাদ পরিবেশকেরা জড়িয়ে জড়িয়ে ভুল বাংলায় কথাবার্তা বলেন, আর প্রায় সারাটা সময় দেশে যে কী দারুণ উন্নয়নের মড়ক লেগেছে সেটা প্রমাণের গাজোয়ারী চেষ্টা৷ প্রথমে বিএনপি, পরে আওয়ামী লীগ, তারপর এখন জোট সরকারের রক্ষিতাগিরি করে চলছে প্রৌঢ়া বিটিভি৷ আমি নিজের প্রাককৈশোর আর কৈশোরকে স্মরণ করে মাঝে মাঝে বিটিভি ধরে দেখি, মনে হয় কোন নাৎ‍সির কোলে ছেনালিতে রত এক বেশ্যাকে চুরি করে দেখছি৷ আজকে যাদের নাগালে আর কোন টেলিভিশন নেই, তাদের ইংরেজি চর্চার উপায়টা পর্যন্ত রাখেনি সদাশয় কর্মকর্তাগণ৷ সব চলচ্চিত্র আর সিরিয়াল আড়ষ্ট বাংলায় ডাব করা, সেটার রসাস্বাদন করা কোন সুস্থ পাকস্থলীর মানুষের পক্ষে বোধহয় সম্ভব নয়৷ সোর্ড অব টিপু সুলতান আর আলিফ লায়লা গোছের নিম্নমানের ভারতীয় অনুষ্ঠানের বাংলা সংস্করণের ঔপনিবেশিকতা শুরু হয়েছিলো আমার কৈশোরেই, আজো তার নখদাঁত থেকে বিটিভি মুক্তি পায়নি৷ শিশুদের অনুষ্ঠানে দেখি দেশের সবচেয়ে দাগী মাস্তানগুলোকে নিয়ে আসা হয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, যারা গুছিয়ে নিজের শিশুকাল নিয়ে একটা সত্য কথাও বলতে পারেন না৷ বিটিভির উদ্দেশ্য কী? সুস্থ, শিক্ষামূলক বিনোদনের মাধ্যমে দেশের অপেক্ষাকৃত স্বল্পবিত্ত মানুষের রুচির কাঠামো নির্দেশনা? নাকি সরকারের ঢোল বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে জঘন্য বমনউদ্রেককারী সব "অনুষ্ঠান" দেখিয়ে লোকজনকে চ্যানেল পাল্টাতে উৎ‍সাহ দেয়া? যাঁরা ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিক, তাঁরা হয়তো বিটিভির এই পতনের পেছনে বেসরকারী টেলিভিশনের ভূমিকাও আবিষ্কার করে বসবেন৷ যাঁরা মালেনা দেখেছেন, শেষটাও হয়তো দেখেছেন৷ মালেনার পঙ্গু স্বামী ফিরে আসে, মালেনাকে খুঁজে বার করে, তার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বাজারে আসে, যে ঈর্ষাণ্বিতা মহিলারা মালেনাকে পিটিয়ে আঁচড়ে খামচে উলঙ্গ করে বার করে দিয়েছিলো শহর থেকে, তাদেরই একজন সুপ্রভাত জানায় এই দম্পতিকে৷ সব কিছু প্রায় আবার আগের মতোই যেন হয়ে আসতে চায়৷ বিটিভিকে কেউ উদ্ধার করবে এই অপমানের হাত থেকে? এই গ্লানি থেকে? আবারও কি কখনো বিটিভি দেখে চমকে উঠে নিজের শৈশবকে স্মরণ করতে পারবো? কেউ কি আছেন ত্রাণের জন্য?
false
hm
খালিদী, আপনার সাথে একমত নই সম্প্রতি বিডিনিউজ২৪ ডট কমের কর্ণধার তৌফিক ইমরোজ খালিদী রাজনীতিকদের প্রতি ব্লগ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন [১]। তার নিজেরই প্রতিষ্ঠানে প্রকাশিত সংবাদ থেকে উদ্ধৃত করে তার কিছু কথা আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখতে পারি। তৌফিক খালিদী বলেন, “যে কেউ একটি সংবাদ মাধ্যমের (টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র ইত্যাদি) মালিক হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। সেই সঙ্গে মোবাইল ফোনে যে কেউ সংবাদ সেবা দেবে, এটাও হতে পারে না। নিয়মের মধ্য দিয়ে এটা করতে হবে। এ জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন।” বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক বলেন, “সংবাদ মাধ্যম যদি এ রকম লাগামহীন হয়, তবে তার জন্য রাজনীতিবিদদেরই যে বেশি ভুগতে হয়, তা আপনারা (রাজনীতিক) অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে পারবেন।” মুক্ত মত প্রকাশের প্রসঙ্গ ধরে ব্লগিংয়ের বিষয়টি তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “আমি সবিনয়ে বলতে চাই, মত প্রকাশের নামে যা ইচ্ছা তাই প্রকাশের আমি বিরোধিতা করি। মত প্রকাশ করতে হবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। মূলত স্বাধীনভাবে প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি।” তার মতে, কোনো ব্যক্তির নামে কল্পকাহিনী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কথা ব্লগ কিংবা ফেইসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ অনুচিত। তৌফিক ইমরোজ খালিদীর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা বিডিনিউজ২৪ ডট কম পাঠকপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট, পেশাদারিত্বের সাথে প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশের কারণে এটি দেশে ও প্রবাসে মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সম্ভবত এই সাফল্যই খালিদীকে প্ররোচিত করেছে, "যে কেউ" একটি সংবাদ মাধ্যমের মালিক হতে পারবে না, এমন একটি কথা বলে ফেলতে। আমি বিনয়ের সাথে খালিদীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তিনিও এই "যে কেউ"-এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি আকাশ থেকে অবতরণ করেননি, মাটি ফুঁড়েও বের হননি। তার মতো "যে কেউ" যদি বিডিনিউজ২৪ ডট কমের মতো একটি গোছানো সংবাদ পরিবেশক সংস্থা চালাতে পারে, তাহলে অন্য ব্যক্তি কেন পারবে না? সারবস্তু না থাকলে মানুষ কোনো কিছুই গ্রহণ করে না, সারা বাংলাদেশে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা সংবাদ পরিবেশক ওয়েবসাইটগুলোর করুণ হাল দেখলেই তা বোঝা যায়। সংবাদ পরিবেশনে মানুষের সক্ষমতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কিন্তু অধিকার নিয়ে পারেন কি? তিনি নিজে কোন নিয়ামকের অধীনে সংবাদ বিক্রি শুরু করেছিলেন, সেটাও তিনি জানাননি, অন্যের জন্য নিয়ামক প্রণয়নে নেমে পড়েছেন। এই অচিন দেশের রাজকুমার সিনড্রোম থেকে বেরিয়ে আসতে পারা সুস্থতার লক্ষণ হিসেবে কেউ কেউ বিবেচনা করতে পারেন। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্লগে "যা ইচ্ছা তাই" প্রকাশের সমস্যা সম্পর্কে আমরা অনবগত নই। কিন্তু কোনটা "যা ইচ্ছা তাই" আর কোনটা "দায়িত্বশীল বক্তব্য", সেটা কে কীভাবে ঠিক করে দেবে? উত্তর হতে পারে, ব্লগের পাঠক। ব্লগ সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতো সিমপ্লেক্স বা একমুখী মাধ্যম নয়, বরং পাঠকের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি ক্রমশ চলমান মাধ্যম, যেখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বক্তব্যকে খণ্ডনের সামর্থ্য রাখেন। যাচ্ছেতাই আধেয়কে পাঠক তেমন গুরুত্ব দেন না, আর গুরুত্ব দিলেও তার যাচ্ছেতাই বক্তব্যকে ধুয়ে ছেড়ে দেন। সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পরিবেশিত তথ্যের সংশোধনী আসতে অনেক সময় লাগে, ব্লগে সেটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই যুক্তি-তর্ক-রেফারেন্সসহ চলে আসে। এক জায়গায় প্রকাশিত বক্তব্যের প্রতিবাদ অন্য জায়গায় উঠে আসে। ব্লগ সাধারণ মানুষের মাধ্যম, তাই এখানে প্রতিরোধ আর প্রতিবাদও করে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে চলমান থিসিস আর অ্যান্টিথিসিসের সমন্বয়ে যদি সাংবাদিকরা আস্থা রাখতে না পারে, এবং তার জন্যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আইন প্রণয়ন করে সাধারণ মানুষের চিন্তাস্রোতে বাঁধ দেয়ার জন্যে ডাকাডাকি করে, বুঝতে হবে, সাংবাদিকতা নয়, এখানে উদ্দেশ্য অন্য কিছু। "লাগামহীন" সংবাদ মাধ্যমের কারণে রাজনীতিকদের ভোগান্তির দিকে ইঙ্গিত করে এ্কে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনীতিকদের হাতছানি দিচ্ছেন একজন খবরবণিক, এটি বিস্মিত হওয়ার মতোই একটি ঘটনা। রাজনীতিকরা নিজের ভোগান্তি হ্রাসের জন্যে সংবাদ মাধ্যমে লাগাম পরাবেন, এটিই খালিদীর কাছে কাম্য? তাহলে কেবল রাজনীতিকের ভোগান্তি আলোচিত হচ্ছে কেন? কেন সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা আসছে না? প্রকাশিত সংবাদ বা চেপে যাওয়া সংবাদ তো সাধারণ মানুষের বিপুল ভোগান্তিও ঘটাতে পারে। বিডিনিউজের খবর পড়ে, সাধারণ মানুষ খালিদীর কাছে কোনো ধর্তব্য বিষয় বলে মনে হয় না। তিনি এদের শুধু মোবাইলে খবরের ভোক্তা হিসেবে দেখেই সন্তুষ্ট। কল্পকাহিনী বা ধমীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার ব্যাপারটিও বহুল আলোচনায় দীর্ণ একটি বিরক্তিকর প্রসঙ্গ। কারো নামে সংবাদ মাধ্যমে কল্পকাহিনী ছড়ানো অবশ্যই গর্হিত অপরাধ, কিন্তু ব্লগে বা সামাজিক যোগাযোগ সাইটে এর কনটেক্সটটিও বিচার্য। সাধারণ মানুষ বড় বড় লোকদের নিয়ে কৌতুক বানায়, সেগুলোর সত্যতা নয়, বরং তার পেছনে হাস্যরসই সাধারণ মানুষের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কৌতুক প্রচলনের কারণে সোভিয়েত ই্‌উনিয়নে স্তালিন আমলে মানুষজনকে গুলাগে যেতে হতো, খালিদীর কথা শুনে মনে হয় তিনি বাংলাদেশে একটি গুলাগের অভাব বোধ করছেন। বিনা রেফারেন্সে কারো নামে কল্পকাহিনী ছড়ালে সেটি লোকে তো বিশ্বাস করেই না, বরং তর্ক করে এর অসারতা প্রমাণ করে। আর ধর্মীয় অনুভূতি কথাটা এতো অসংজ্ঞায়িত, যে এটি নিয়ে আলাপ শুরু করাও মুশকিল। কার ধর্মীয় অনুভূতির পায়ের মাপে জুতো তৈরি করবো আমরা? প্রতিটি মানুষই প্রতিটি কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। ধমীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে আমরা নিরীহ কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে দেখেছি মোল্লাদের হাতে নিগৃহীত হতে, দাউদ হায়দার আর তসলিমা নাসরিনকে দেখেছি দেশত্যাগে বাধ্য হতে, হুমায়ূন আজাদকে আক্রান্ত হতে দেখেছি। ধর্মীয় অনুভূতিকে যত সহজে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মুক্ত মতকে আক্রমণ করা যায়, আর কোনো কিছুকে তত সহজে ব্যবহার করা যায় না। এই মধ্যযুগীয় অজুহাতটি একবিংশ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হতে দেখতে চান না অনেকেই। দুঃখের বিষয়, সেই দলে খালিদী নেই। আমি যদি আগামীকাল একটি ধর্ম প্রচার করি, যে ধর্মে "তৌফিক ইমরোজ খালিদী" নামটি শ্রবণ করলে পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাওয়ার হুমকি আছে, আমার বিশ্বাস, হাজার পাঁচেক অনুসারী আমি পাবো। আমাদের সেই ধমীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে খালিদী কি নিজের নাম উচ্চারণ থেকে বিরত থাকবেন? ডয়চে ভেলে আজ তার একটি সাক্ষাৎকার [৩] নিয়েছে, সেখানে তিনি বেশ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলছেন, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে লেখা জনসভায় বক্তৃতার সমতুল্য। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রীর নামে অশালীন কথাবার্তা বলা চলবে না। আমি এ ব্যাপারে তার সাথে একমত, আমরা আমাদের নেত্রীদের বিরুদ্ধে অশালীন কথাবার্তা শুনতে চাই না। শুধু নেত্রী কেন, আমরা কারো সম্পর্কেই অশালীন কথা শুনতে চাই না। আমরা শুনতে চাই না, আমাদের বিরোধী দলীয় নেত্রী বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম কী [৪]। এটি শালীনতার মাত্রা লঙ্ঘন করে। আমরা শুনতে চাই না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলছেন, উনি রাতে কী করেন [৫]। এটিও শালীনতার মাত্রা লঙ্ঘন করে। তৌফিক ইমরোজ খালিদী তরুণদের ক্রুদ্ধ কণ্ঠে হুমকি দিয়ে শালীনতার সিরাতুল মোস্তাকিমে আনার জন্যে আইন ও নিয়ন্ত্রণ (রেগুলেশন) চাইছেন, তার কি হিম্মত আছে, এই দুই নেত্রীকে অশালীন বক্তব্য দিতে বাধা দেয়ার জন্য কোনো আইন বা রেগুলেশন প্রণয়নের দাবি জানানোর? দুই নেত্রী দূরে থাক, সাংসদদের আচরণবিধি নির্দেশ করে সাবের হোসেন চৌধুরী কর্তৃক প্রস্তাবিত আইন [৬], যেটি আর পাশ হয়নি, আর আলোর মুখ দেখেনি, সেটি কার্যকর করতে কোনো আহ্বান, কোনো চাপাচাপি করার সাহস কি তার আছে? আমি এ প্রশ্নের উত্তর জানি না। আশা করবো বিডিনিউজ২৪ ডট কমের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কোনো বক্তৃতায় তিনি ব্লগে সাধারণ মানুষের মুখে কাপাই পরানোর বায়না না ধরে রাজনীতিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা প্রণয়নের জন্য রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানানোর সৎসাহস অর্জন করবেন। এই এক বছর ধরে পড়ার জন্যে যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমনসের সদস্যদের আচরণবিধির [৭] লিঙ্কটি তার করকমলে পেশ করছি। পাঁচ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে খালিদী হঠাৎ কেন ব্লগের বিরুদ্ধে ডুকরে উঠলেন, যখন তিনি নিজেই ডিসেম্বর ৬, ২০১১তে টুইট করেছেন [২], Web is a two-edged sword. Use or manipulate it to your advantage. But if you ABUSE it or TRY to STRANGLE it, you risk losing more. এই রোমাঞ্চাভিলাষে ভরা স্ববিরোধিতার পেছনের সম্ভাব্য কারণটি নিয়ে আলাপ করবো পরবর্তী পোস্টে। আপাতত একটি ছোট্ট আখ্যান (অ্যানেকডোট)। তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বক্তব্য তাঁরই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো [১]। ব্লগে এর প্রতিক্রিয়া আসার কারণেই কি না, আমি নিশ্চিত নই, সেই বক্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ খবরটি থেকে বিনা নোটিশে অপসারিত হয়। এই সুযোগটি কেবল ওয়েবেই রয়েছে, সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে নয়। খবরটির প্রথম সংস্করণ দেখতে পাবেন এখানে, পরিবর্তিত সংস্করণটি পাবেন এখানে। প্রথম সংস্করণে খবরে ছিলো, এটা এক ধরনের অপরাধ, আর এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সরকারকে অবশ্যই নতুন আইন করতে হবে। স¤প্রতি শীর্ষ পর্যায়ের এক রাজনীতিকও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তার সঙ্গে আমি একমত, আর এত দিন ধরে তা না করার দায় রাজনীতিক হিসেবে তারও স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয় সংস্করণে "আর এত দিন ধরে তা না করার দায় রাজনীতিক হিসেবে তারও স্বীকার করতে হবে।" বাক্যাংশটি গায়েব করে দেয়া হয়েছে। জানি না, কাল সকালে আবার এটিকে ঠিক করে আগের চেহারায় নিয়ে আসা হবে কি না। এভাবে অতীতেও তারা খবর বদল করেছেন কি না, কিংবা ভবিষ্যতেও করবেন কি না, তা-ও জানি না। এই যে পাঠকের অগোচরে খবর পাল্টে দেয়া হলো, এটি কি রীতিসিদ্ধ, জনাব খালিদী? আপনি কি প্রকাশিত ঐ অংশটি বলেননি? যদি বলে থাকেন, তাহলে কেন সরিয়ে নিলেন? আমরা কি ধরে নিতে পারি, আপনার কথিত "দায়িত্বশীলতা" থেকেই ঐ অংশটি এক্সপাঞ্জ করা হয়েছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে কেন পাঠককে এ ব্যাপারে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না? একটা ছোট্ট সংশোধনী তো দিতে পারতেন। আর যদি ঐ অংশটি প্রকাশের অযোগ্য বলে মনে করে থাকেন, তাহলে কেন একটি ছোটো নোট দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন না, বললেন না, ঐ কথাটি আপনার বলা উচিত হয়নি? খালিদী, আপনার দায়িত্বশীলতার দৌড়ের একটা ছোটো নমুনা আমরা দেখলাম। ব্লগারদের দায়িত্বশীল হতে বলছেন আপনি, আমিও আপনার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, আসুন দায়িত্বশীল হই। সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধের ভুল সার্কাসে ক্লাউন হয়ে না নাচি। প্লিজ। সংযোজন: আগের পোস্ট --- মিডিয়াহাউসের মিডিয়াহাউশ। এখানে এই সিরিজের সবকটি পোস্ট একত্রে পাবেন। তথ্যসূত্র: [১] দায়িত্বহীন মুক্তমত নয়, বিডিনিউজ২৪.কম [২] খালিদীর টুইটার অ্যাকাউন্ট [৩] ডয়চে ভেলেতে খালিদীর সাক্ষাৎকার [৪] প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম কী, প্রশ্ন খালেদার, বিডিনিউজ২৪ ডট কম [৫] খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী: ওনার সকাল হয় কয়টায়?, প্রথম আলো [৬] Bill placed seeking code of conduct for MPs, ডেইলি স্টার [৭] যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমনসে সদস্যদের আচরণবিধি
false
rn
ছেলেটি জেগে আছে ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটি ১/ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গুলো খুব সস্তা হয়ে গেছে। এ যুগের স্মার্ট ছেলেমেয়েরা সকালে make up আর বিকালে break up করে। গাছের চারার সাথে ছোট থাকতেই কাঠি বেধে দিলে গাছ বাঁকা হয়ে বড় হয় না। কিন্তু গাছ বড় হয়ে গেলে তাকে কিছুতেই সোজা করা যায় না। ঠিক তেমনি ছেলে- মেয়েদের ছোট থাকতেই ইসলামী মন-মানসিকতা, আচার-ব্যবহার,পোষাকে বড় করলেই সে একজন যোগ্য মানুষ হতে পারে। ২/ জীবনটাও একটা আয়না স্বরূপ। আপনি যেভাবে জীবনকে দেখবেন, সেও ঠিক সে ভাবেই আপনার কাছে ধরা দিবে। যারা সাহসিকতা, ভালোবাসা, উৎসাহ, জয় করার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, জীবন তাদের কাছে অনেক সহজ ও আনন্দ ময় হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু যারা, হতাশা, ভয়, মানসিক অবসাদ নিয়ে সামনে এগুতে চায়, তাদের চোখে সাফল্য যেন মরীচিকা । জীবন হয়ে উঠে ক্লান্তিকর, বিষণ্ণময়। বাস্তবতাকে আপনি যেভাবে দেখবেন, আপনার সামনে তা সেভাবেই ধরা দিবে। ৩/ মনে রাখবেন সকল সফল ব্যক্তিই এক সময় মায়ের কোলে কাঁদতে থাকা শিশু ছিলো। সব বড় অট্টালিকাই একসময় শুধু একটি নকশা ছিলো। আপনি আজ কোথায় আছেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভবিষ্যতে আপনি কোথায় পৌছাবেন সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৪/ গ্রিক দার্শনিক প্রবর নাকি দিনের বেলা বাতি জ্বালিয়ে কোনো কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এক পথচারী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মহোদয় আপনি দিনের বেলায় এমন করে কী খুঁজছেন? উত্তরে দার্শনিক বলেছিলেন মানুষ। দার্শনিক প্রবরের খুঁজে বেড়ানোর ধারা আর উত্তরের মধ্যে বেশ অভিনবত্ব আছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। কারণ মানুষ যেখানে চারপাশেই ভিড় করে আছে সেখানে তাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না। আবার দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে খোঁজা সে তো এক দেখার মতো ব্যাপার। কাজেই সব ব্যাপারটার মধ্যে যদি অন্য কোনো তাৎর্পয না থাকে তাহলে এটাকে পাগলামি বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রই বলবেন, না, ব্যাপারটা পাগলামি নয় এর মধ্যে তাৎর্পয তো আছেই, তদপুরি আছে একটি শাশ্বত তথ্য। অর্থাৎ এমনি দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে মানুষ খোঁজার ব্যাপারটি দার্শনিকের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়নি। প্রতি যুগেই এমনি মানুষ খোঁজার একটা প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করে থাকি। অতীতেও তা ছিল, আর এখনো আছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ তাহলে মানুষ নয় আর দিনের আলোও আলো নয়। চারদিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ছেয়ে আছে। এর সামনে দিনের আলো আর রাতের কালো সবই এক সমান। আর সেই অন্ধকারে মানুষের চেহারা নিয়ে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সবাই মানুষ নয়, ভিন্নতর কোনো জীব। দার্শনিক জ্ঞানের মশাল নিয়ে তাই মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ৫/ তুমি পানির মত হতে চেষ্টা কর, যে কিনা নিজের চলার পথ নিজেই তৈরী করে নেয় ।পাথরের মত হয়োনা, যে নিজে অন্যের পথরোধ করে | - হযরত আলী (রাঃ)
false
mk
উন্নয়ন মহাসড়কে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ সদ্য জন্মলাভ করা একটি শিশু। নয় মাসের এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তার জন্ম। পিতা সে শিশুটির নাম রাখলেন বাংলাদেশ। পিতার হাত ধরে আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ে উঠছিল শিশুটি। কিন্তু জন্মের মাত্র চার বছরের মাথায় পিতাকে ঘাতকের দল নৃশংসভাবে হত্যা করে এতিম করে দিয়েছিল শিশুটিকে। তার পরের গল্প অবহেলার, অযত্ন আর চরম নির্মমতার...। ’৭৫-এ নির্মমভাবে স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর স্বাধীনতা-বিরোধীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বাংলার বুকে। যে ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে প্রকম্পিত করে বাংলাদেশের জন্ম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথে সেই জয় বাংলাকে মুছে দিয়ে রেডিওতে পাকিস্তানের আদলে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” নামে কুিসত এক স্লোগানের আবর্তন করে ঘাতকের দল। খুনিরা বঙ্গবন্ধুর রক্তকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু তাঁর দুই কন্যা দেশের বাইরে থাকায় খুনিদের ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়। এরপর কেটে যায় অনেক বছর। দেশে চলতে থাকে চরম বিশৃঙ্খলা, লুটপাট আর দুর্নীতির মহোত্সব। সেই ছোট্ট শিশুর কাঁধে একের পর এক চেপে বসে অগণতান্ত্রিক সরকার ও স্বৈরশাসক। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে দেশে আসতে বাধা দেওয়া হয় বারংবার। অবশেষে সকল বাধা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে আসেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির। দেশ ফিরে পায় তার আপন আত্মীয়কে...।চারদলীয় জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয়-ভীতির কারণে দেশে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিলো তা কাটিয়ে উঠতে শেখ হাসিনাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে শেখ হাসিনা শুরু করেন এক নতুন অভিযাত্রা। দিন বদলের সনদ হাতে নিয়ে দেখিয়েছেন একের পর এক চমক। ২০০৮-২০১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে দেশ বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করে যা দেশের বিভিন্ন ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে যোগ করে নতুন মাত্রা। এছাড়াও গড়ে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, পাঁচ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে জলসীমা চুক্তির বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মাধ্যমে বই উত্সব চালু, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড, ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা, ১৬০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন,দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৪.৩ শতাংশ হ্রাস করে নিয়ে আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার এবং সাজা নিশ্চিত করে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এ মেয়াদে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সফলতা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের আইনের সম্মুখীন করে তাদের বিচার নিশ্চিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের কলঙ্ক মুছে দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশ গঠনে তাঁর নানামুখী পদক্ষেপ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হতে শুরু করে এ মেয়াদে। বাংলাদেশ পরিণত হয় উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন ব্রেক্রো এমপি প্রধানমন্ত্রীকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদানের জন্য গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদানের জন্য আইএনইএসসিও ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রীকে কালচারাল ডাইভারসিটি পদকে ভূষিত করে। ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন, ‘একটি বাড়ি ও একটি খামার প্রকল্প’ ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় সাউথ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক ‘মান্থন অ্যাওয়ার্ড’ এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) দরিদ্রতা, অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত করে শেখ হাসিনাকে। ২০১৪ সালে নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’ পুরস্কারে ভূষিত করে। খাদ্য উত্পাদন ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রধানমন্ত্রীকে এই সম্মাননা সার্টিফিকেট প্রদান করে।২০০৮-২০১৪ মেয়াদের শেষের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতালোভী এ জোট কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে শেষে আক্রমণ করে বসে দেশের সাধারণ মানুষের উপর। প্রতিদিন তারা চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে দেশের মানুষের প্রতি তাদের ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের দমন করে জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করেছেন।২০১৪’র ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতা গ্রহণের পরে গোটা বিশ্বে শেখ হাসিনা পরিচিতি পান বিশ্বনেত্রী হিসেবে। দেশের জনগণের স্বপ্ন পদ্মা সেতু যখন নানামুখী ষড়যন্ত্রে ডুবে যেতে শুরু করেছিল তখন বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার এক সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল পদ্মা সেতুর কাজ এবং এই লেখাটি যখন লিখছি তখন পদ্মা সেতুর ৩৫% কাজ ইতোমধ্যেই শেষ! পদ্মা সেতুর মতোই দেশের সকল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে চলছে সমান তালে কাজ। যানজট নিরসনে নেত্রী গ্রহণ করেছেন একের পর এক পদক্ষেপ, নির্মাণ করে চলেছেন ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, ফোর লেন হাইওয়ে থেকে শুরু করে এইট লেন হাইওয়ে, মেট্রো রেল, এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বের সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা! ইতোমধ্যেই দেশ পরিণত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। শের শাহের আমলের পরে এই দেশে কবে ১০ টাকায় উন্নতমানের চাল পাওয়া যেত সেটি ইতিহাস ঘেঁটে দেখার বিষয়। শেখ হাসিনার সরকার আজকে তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার ১০ টাকা কেজি চাল নিম্ন-আয়ের মানুষদের প্রদান করছে। দেশে করা হয়েছে অর্থনৈতিক জোন। এ তো গেল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের কথা। বিশ্ব দরবারে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছে। নোবেল পুরস্কার যে ছয়টি বিষয়ে দেয়া হয়, সেখানে পরিবেশ নেই। তবে জাতিসংঘের পরিবেশ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ আখ্যা পেয়ে থাকে পরিবেশের নোবেল হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছর পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ সেই পুরস্কার পেয়েছেন। গত মে-তে জাপানে অনুষ্ঠিত জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ছিলেন সকলের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে দেশের সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা শেখ হাসিনার কাছে দিন বদলের এই চমকের রহস্য শিখতে চেয়েছেন! শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ দেখতে একে একে বাংলাদেশ সফর করছেন বিশ্ব মোড়লরা। এইতো গত শুক্রবার চীনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। গত ৩০ বছরে এই প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেছেন। নিঃসন্দেহে দেশরত্ন, বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং গঠনমূলক মৈত্রী-প্রিয় দৃষ্টান্তমূলক কূটনীতিক সাফল্যের প্রমাণ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই ঐতিহাসিক সফর। এর দুইদিন পরেই আবার এলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। তিনি এসে রেসিপি চাইলেন! কিসের রেসিপি? দিন বদলের রেসিপি কিভাবে এত দ্রুত বাংলাদেশের চিত্র বদলে গিয়েছে, কিভাবে এত দ্রুত গড়ে উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, সেটিই তিনি জানতে চাইলেন!জঙ্গিবাদ রুখতে যেখানে অন্যান্য দেশ রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে সেখানে হলি আর্টিজনে জঙ্গি হামলার মাত্র তিন মাসের মাথায় সবকিছু স্বাভাবিক করে নিয়ে এসেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। জঙ্গিবাদের কবলে পড়ে বহু দেশ আজ ভয়াবহ দিন কাটাচ্ছে সেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির শীর্ষে। সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:৫৭
false
ij
রোমান দার্শনিক এপিকটেটাস ও আমাদের সময়ের ধর্মান্ধরা এপিকটেটাস (৫৫-১৩৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন রোমান দার্শনিক। প্রথম জীবনে দাস ছিলেন এপিকটেটাস। ছিলেন আজন্ম পঙ্গু। কিংবা (কারও কারও মতে) তাঁর রোমান প্রভূ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁর পা খোঁড়া করে দিয়েছিল। এপিকটেটাস তবু বিশ্বাস করতেন মানুষ সম্পূর্ন স্বাধীন থেকে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে পারে বাঁচতে। বলতেন: শিক্ষিতরাই মুক্ত। তাঁর এই কথা কিন্তু অতি গভীর। শিক্ষিত মানে ধনী নয়- স্বশিক্ষিত। এপিকটেটাস-এর সময়ে (খ্রিষ্টিয় প্রথম শতক) স্টোয়িক দর্শনের প্রাধান্য ছিল। সে দর্শনের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন এপিকটেটাস- বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর ও মানুষের অসীম ক্ষমতায় । স্টোয়িক শব্দটা এসেছে গ্রিক 'স্টোয়া' থেকে। স্টোয়া মানে: বারান্দা, টানা বারান্দা। আমরা সবাই প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সের সেই বাজার- মানে আগোরার কথা শুনেছি। সেই আগোরার এককোণে ছিল স্টোয়া-মানে টানা বারান্দা। একটি স্টোয়ার নাম ছিল, ‘স্টোয়া পয়েকিল’। ‘পয়েকিল’-এই গ্রিক শব্দের মানে, ‘বর্ণময়’। তার কারণ, সেই স্টোয়া পয়েকিলের দেওয়ালে ছিল নানান শিল্পকর্ম;মূল গ্রিক চিত্রকরদের আঁকা চিত্র। তো, সেই স্টোয়া পয়েকিলের বসে তত্ত্বালোচনা করতেন একজন দার্শনিক। জেনো। সময়টা? যিশুর জন্মের এই ধরুন ৩০০ বছর আগে। দার্শনিক জেনোই স্টোয়িক দর্শন বা স্টোয়ার দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। তো, স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা কি? স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা আমাদের আবেগ অনুভূতি ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্ত ছলনামাত্র। এসব সিলি বিষয় পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। যে এই আত্মজ্ঞান লাভ করেছে সে আর নিছক আবেগ অনুভূতির অধীন নয়। কোথায় যেন ভারতীয় দর্শন ভারতীয় দর্শন বলে মনে হয় না? আসলে সেরকম হওয়ারই কথা। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০। আলেকজান্দার পাঞ্জাবের ঝিলাম অবধি পৌঁছে গেছেন। ভারতবর্ষ ও পশ্চিমের মধ্যে ভাব বিনিময় অবশ্য তার আগেই শুরু হয়ে গেছে। গণিতশাস্ত্রে ০ বা শূন্যের অবদান ভারতবর্ষেরই। তবে, স্টোয়িক দর্শনে যে করুন সুর রয়েছে তার কী কারণ। একটা কারণ হতে পারে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তখন আলেকজান্দার মৃত। তাঁর সাম্রাজ্যটি তিনভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সেই তিনটি ভাগের মধ্যে চলছিল বিরোধ। রক্তপাত। গ্রিস, মানে এথেন্সের সেই পূর্বেকার গৌরব আর নেই। এথেন্স হতশ্রী আর ম্লান। সেই ম্লান এথেন্সের হতশ্রী আগোরায় স্টোয়া পয়েকিলে বসে জেনো অনেকটা অসহায়ভাবেই বললেন: বিষন্নতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ২ যা হোক। গ্রিকদের পরে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে দেখা গেল রোমানদের। জেনোপ্রবর্তিত স্টোয়িক দর্শন আদৃত হয়েছিল রোমানসভ্যতায়। বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার ক্ষেত্রে দর্শনটি ছিল উপযোগী। কেননা, শাসন-শোষন স্বাভাবিক। এবং শাসন-শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ৩ খ্রিস্টপূর্ব যুগে ফ্রিজিয়া জায়গাটা ছিল গ্রিসে। পরে ফ্রিজিয়া রোমানরা দখল করে নেয়। জায়গাটা এখনকার তুরস্কে। যিশুখ্রিস্টের ক্রশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার কিছুকাল পরে-অর্থাৎ ৫৫ খ্রিস্টাব্দে এপিকটেটাস এর জন্ম হয়েছিল সেই ফ্রিজিয়াতেই। তারপর তাকে বন্দি করে দাস হিসেবে রোমে নেওয়া হয়। প্রভূর নাম: ইপাফ্রোডিটাস। ভারী ক্রোধী লোক। ওই ইপাফ্রোডিটাসই একবার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁর পা খোঁড়া করে দিয়েছিল। পা ভাঙ্গার সময় এপিকটেটাস নাকি চিৎকার বা প্রতিবাদ করেননি । শুধু বলেছিলেন, এভাবে চাপ দিলে যে আমার পা ভেঙ্গে যাবে। পা শেষমেশ ভেঙ্গেই গেল। পা ভাঙার পর এপিকটেটাস নাকি বলেছিলেন, আমার পা ভেঙ্গে গেল। কথাটা শুনে ইপাফ্রোডিটাস বলল, পা ভাঙ্গল। এখন কেমন লাগছে? এপিকটেটাস বললেন, We are disturbed not by events, but by the views which we take of them. (এই হচ্ছে স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা) যাক। এমন লোককে কি বন্দি করে রাখা যায়? এপিকটেটাস মুক্তি পেলেন। তারপর ৯০ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি রোমেই আকাদেমি খুলে দর্শন শিক্ষা দেন। কী বলতেন এপিকটেটাস? এপিকটেটাস বলতেন, All philosophy lies in two words, sustain and abstain. (এই উক্তির সঙ্গে আগের উক্তির সম্পর্ক লক্ষ করুন) এপিকটেটাস আরও বলতেন, Be careful to leave your sons well instructed rather than rich, for the hopes of the instructed are better than the wealth of the ignorant. আর বলতেন, First learn the meaning of what you say, and then speak. তো, সেই সময় রোমান সম্রাট ছিলেন ডোমেশিয়ান। কী কারণে সম্রাট দার্শনিকদের ভয় করতেন। তিনি রোম থেকে থেকে দার্শনিকদের নির্বাসিত করেন। এপিকটেটাস এর প্রধানতম শিষ্যের নাম ছিল আরিয়ান। এপিকটেটাস আরিয়ানের সঙ্গে রোম থেকে গ্রিসের এপিরাসে চলে যান। (জায়গাটি পশ্চিম গ্রিসে, বর্তমান আলবেনিয়ার দক্ষিণে।) এপিরাসেই বসবাস করতে থাকেন এপিকটেটাস। ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু সেখানেই হয় তাঁর। ৪ এপিকটেটাস নিজে কিছু লেখেননি। তার মৌখিক শিক্ষার ওপর আরিয়ান দুটি গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। (ক) এনচেইরিডিওন (রেফারেন্স বুক) এবং (খ) ডিসকোর্স (বয়ান)। এপিকটেটাস নৈতিকতা নিয়ে উদ্বিগ ছিলেন। পূন্যের সংজ্ঞা নির্ধারন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণি হলেও আলোকময় ঈশ্বর মঙ্গলময়-অতএব, মানুষের তার আলো চাই। মানুষ ভাগ্যকে (আগে থেকে) জানতে পারে না বলেই নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মানুষের উচিত নির্লোভ থাকা। আর, ভালোমন্দ সবই মেনে নেওয়া। অন্যের দোষক্রটিও ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা উচিত। এপিকটেটাস একবার বলেছিলেন: তুমি যদি শোনো যে কেউ তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলছে। প্রতিবাদ করো না। বরং বলো:তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জান না। আমার আরও খারাপ দিক রয়েছে। যা তুমি জান না। এপিকটেটাস দার্শনিক জেনোর মতোই সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জাগতিক সুখশান্তিকে তুচ্ছ মনে করেছেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চর্চা করে জাগতিক সুখশান্তি অস্বীকার করেই একজন মানুষ স্বাধীন ও সুখি হতে পারে। ‘স্টোয়িক ব্লিস’-কথাটি আমরা শুনেছি। সংযমী হয়ে পরমানন্দের (ব্লিস) সন্ধান করাই স্টোয়িকদের মোক্ষ। স্টোয়িক দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বও রয়েছে। দার্শনিক জেনো বিশ্বাস করতেন: জগতের মূল অগ্নি। আর, লোগোস হল শক্তি, বিধান ও যুক্তির সমন্বয়ে তৈরি এক অপার্থিক শক্তি। স্টোয়িকরা এই লোগোস-এর উপাসনা করেন। লোগোস এক ধরনের ঐশ্বরিক নির্দেশ-যা প্রকৃতিতে লীন হয়ে আছে। প্রকৃতি হচ্ছে দৈবশক্তি দ্বারা নির্মিত এক পদ্ধতি। প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই মানুষের বাঁচা উচিত। প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অংশ; যে কারণেই প্রত্যেকেই এক অখন্ড পরিবারের অংশ। এই সর্বজনীন মানবতাবাদই স্টোয়িক দর্শনের উজ্জ্বলতম দিক। ৫ উপরোন্ত, এপিকটেটাস বলতেন, All religions must be tolerated... for every man (এবং নারী) must get to heaven in his own way. এই কথাটাই আজকালকার দিনের ধর্মান্ধরা মানতে চায় না। এপিকটেটাস-এর এই উক্তিটির জন্যই আজ আমি এপিকটেটাস সম্বন্ধে লিখলাম। ধর্মান্ধরা বলবে এপিকটেটাস ভুল। অথচ এপিকটেটাস বলেছেন: যখন তুমি দরজা বন্ধ কর। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। তাই না? কিন্তু, তখন কি তুমি একা? না, তখনও তুমি একা নও। কেননা, ঈশ্বর রয়েছেন। আর রয়েছে তোমার প্রতিভা।। যারা এত প্রগাঢ় উপলব্দি তাঁর ভুল হয় কী করে? তারপরও আমাদের সময়ের ধর্মান্ধরা বলবে: এপিকটেটাস খ্রিস্টান। (যেমন, রবীন্দ্রনাথ কেবলি হিন্দু)। এপিকটেটাস ভুল, কেননা, এপিকটেটাস খ্রিস্টান। কেননা, এপিকটেটাস বলতেন, All religions must be tolerated... for every man (এবং নারী) must get to heaven in his own way. এপিকটটাস-এর ডিসর্কোস (বয়ান) পড়তে চাইলে- Click This Link সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৫২
false
rg
একটি অসম বিয়ে এবং মিডিয়ার বিকৃত উল্লাস!!! বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই এক বিচিত্র দেশ। এখানে কোনটা ভালো আর কোন খারাপ উদাহরণ হতে পারে, তা নিয়েই বরং এখন গবেষণা করার মত হাজার হাজার উপাদানে ভরপুর। আমাদের মিডিয়াগুলো সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এখন আর কষ্ট করতে চায় না। রেডিমেট সংবাদ একটু এদিক সেদিক করেই সংবাদ প্রচার করতে ব্যস্ত তারা। অনুসন্ধানি রিপোর্ট বলতে গেলে উঠেই যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হল, কোনটি সংবাদ আর কোনটি সংবাদ নয়, সেই বিবেচনা বোধেই আমাদের মিডিয়াগুলো এক ধরনের দেউলিয়াত্বে ভুগছে। অথচ আমাদের সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের প্রাইভেট টেলিভিশনের চ্যানেল সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের এফএম রেডিওর সংখ্যা বেড়েছে। সংবাদও বেড়েছে। কিন্তু সেই সংবাদের মধ্যে দেউলিয়াত্বও ভয়ংকর আকারে বেড়েছে। এক কথায় অনেকটা সরল করে বলা যায়, আমাদের মিডিয়ার দেউলিয়াপনা দিন দিন বাড়ছে। গতকাল ছিল আমাদের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিবের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। শুক্রবার বিয়ে। বিয়ের খবর তো খুশির খবর জবাই জানেন। কিন্তু এই বিয়ের মাহাত্ব কি? এটি একটি অসম বিয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি অসম বিয়েকে গোটা রাষ্ট্র একযোগে হৈহৈ চৈ চৈ করে নেচে গেয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। অসম কিভাবে? এই বিয়ের বর রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিবের বয়স মাত্র ৬৭ বছর। আর কনে অ্যাডভোকেট হনুফা আক্তার রিক্তার বয়স ২৯ বছর। বুড়ো বর যুবতী কনে। তাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র ৩৮ বছর। কনের বয়স ৩৮ বছর হতে আরো অন্তত ৯ বছর লাগবে। তখন বরের বয়স হবে মাত্র ৭৬ বছর। বুঝেন ঠ্যালা। রাষ্ট্রীয়ভাবে কিভাবে এই অসম বিয়েকে স্বগত জানানো হচ্ছে?কারণ, বর ও কনে দুজনের বাড়ি কুমিল্লা। বরের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। আর কনের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। এই বিয়ে উপলক্ষ্যে কুমিল্লা থেকে চান্দিনা পর্যন্ত বরকে বরণ করতে অন্তত এক ডজন তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। বরের গাড়িসহ কয়েকটি ভিআইপি গাড়ি যাবে কনের বাড়ি গল্লাই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা মীরাখলা গ্রামে। ৭শ বর যাত্রীর মধ্যে ডেপুটি স্পীকার এড. ফজলে রাব্বিসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০জন মন্ত্রীও উপস্থিত থাকবেন। বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রায় একশ স্বেচ্ছাসেবক , পুলিশ, আনসারসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় শতাধিক সদস্য সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন। একেবারে রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। তো এই বিয়েতে মাননীয় রেলমন্ত্রী কত টাকা খরচ করছেন? সেটা জানতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আসল খরচের ব্যাপারটা হয়তো কোনোদিনও জানা যাবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বিভাগের সেই প্রচেষ্টাও থাকবে না। কারণ, এই বিয়েতে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশির্বাদ রয়েছে।রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি অসম বিয়ের এমন হুজুগে দৃষ্টান্তের ভেতরেই অনেক না বলা রহস্য লুকিয়ে আছে। মাননীয় রেলমন্ত্রী, বাংলাদেশের রেলওয়ের বর্তমান দশা যে চেহারায় আছে, তাতে সেই মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে রেলের সার্বিক উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে আপনি যে বিয়ে করতে যাচ্ছেন বুড়ো বয়সে, এটাকে এক কথায় বলা যায়, বুড়ো বয়সে আপনার মধ্যে ভিমড়তি বাসা বেধেছে। আপনি অসম বিয়েকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন। এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ আপনার বিয়ে উপলক্ষ্যে রঙ্গরস করার একটি মোক্ষম উপাদান পেয়েছে। মানে আপনি মন্ত্রীসভায় একটি হাসির খোরাক যোগান দিয়েছেন। রাষ্ট্রের যে দায়িত্বটি আপনার করার কথা ছিল, সেটিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে আপনি রঙ্গরস সরবরাহের পাত্র হয়েছেন। ভবিষ্যতে দুদক যদি আপনআর এই বিয়ের হিসেব নিয়ে টানাটানি করে, তখন আপনাকে নতুন বিড়ম্বনায় জড়াতে হবে। রঙ্গরসের আরেকটি বিষয় হল, আমাদের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু মন্ত্রীসভায় বলেছেন, আপনার বিয়ের কারণে আমাদের সংসার ভাঙার উপক্রম হয়েছে। কানাডা, আমেরিকা, বৃটেন থেকে অনেক পরিচিতজন নাকি তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, আপনি নাকি আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছেন? তাঁর স্ত্রীকে অনেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার স্বামী নাকি আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। এতো গেলো মন্ত্রীসভার রঙ্গরস। গতকাল আমাদের টেলিভিশন মিডিয়াগুলো আপনার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান লাইভ টেলিকাস্ট করলো। আপনার বিভিন্ন মুডের ছবি ফেসবুক, ট্যুইটার সহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিশাল বিনোদনের খোড়াক হয়েছে। আপনি তো রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। রেলওয়ের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব আপনার হাতে। আর আপনি কিনা সেই গুরু দায়িত্ব অবহেলা করে সবার হাসির খোরাক হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন!! আপনার বিয়েটি যেভাবে মহা রাজকীয় ভাবে আয়োজন হল, এবার যদি আপনি বাংলাদেশের রেলওয়ের চেহারা এমন রাজকীয় করতে না পারেন, তাহলে আপনাকে সবাই ছি ছি করবে, এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আপনার কি হয়েছে??অনেকে একথাও বলছেন, যারা আপনার বিয়ে নিয়ে বিরুদ্ধাচারণ করছেন, তারা জেলাস থেকে করছেন। আপনি রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী। আপনার সাথে দেশের সাধারণ একজন নাগরিকের জেলাস করার কিছু নেই। আপনি কাজ করে বরং দেশের মানুষের হৃদয় জয় করবেন। এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। সেখানে আপনি একটি অসম বিয়ে করে রাষ্ট্রে অসম বিয়েকে উৎসাহ দিতে মদদ দিচ্ছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমরা অপেক্ষায় থাকব, কখন আপনি রেলওয়ের অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে আসেন। আর যদি সেটি করতে আপনি ব্যর্থ হন, তাহলে লোকে আপনাকে স্রেফ সঙ হিসেবে পরবর্তী সময়ে হিসেব করবে। এটা মনে রাখবেন।আমাদের মিডিয়া দিন দিন আরো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। কোনটা খবর, কোন খবর লাইভ দেখানো উচিত, এই কাণ্ডজ্ঞান আমাদের মিডিয়ার কবে হবে? একজন মন্ত্রী বিয়ে করছেন, তা লাইভ দেখানোর কি আছে? এর মধ্যে খবরের কি আছে? যদি বিনোদনের বিষয় হিসেবে এটি প্রচার করা হয়, তাহলে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান লাইভ দেখানোর মধ্যে বিনোদনের কি আছে বুঝি না। গতকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন ছিল। একাত্তরে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী'র মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেছেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১। মিডিয়ার উচিত ছিল, সারাদিন মতিউর রহমান নিজামীর একাত্তরে সংগঠিত নানান কুকর্মের অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট তুলে ধরা। গোটা বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসী জানতে পারতো, কিভাবে এই খুনি নরপিচাশ একাত্তরে কি কি অপরাধ করেছিল? কেন তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ‌্য। কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেই অনুসন্ধানি রিপোর্টে না গিয়ে, তারা প্রচার করলো, নিজামী কি খায়? এখন কি খাবে? পড়ণে কি ছিল? মাথায় জিন্নাহ টুপি ছিল কিনা এসব। এসব তো খবরের বিষয় নয়। এসব তো আবর্জনা। আবর্জনা কেন মিডিয়ার সংবাদ হবে। একাত্তরে যেসব পরিবার নিজামীর কুকর্মের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তাদের কথা শুনানোর সুযোগ ছিল। সেই সব পরিবার বর্তমানে কেমন মানবেতর জীবনযাপন করছে, তা তুলে ধরা যেতো। অথচ মিডিয়া নিজামীর পোশাক, খাবার, টুপি, ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়েই মেতে রইল। আমাদের মিডিয়া কবে অনুসন্ধানি রিপোর্টের দিকে অগ্রসর হবে? দেশে মিডিয়ার যে হারে প্রসার হয়েছে, সেই তুলনায় কোয়ালিটি খবর কি প্রচার করতে পারছে তারা? প্রফেশনালিজম কবে গড়ে উঠবে? জার্নালিজম মানে সাদা চোখে দেখা বিষয় নয়, খবরের অন্তরালের খবর বের করাই জার্নালিজম। আমাদের মিডিয়ার দেউলিয়াপনায় বারবার মনে হচ্ছে, মিডিয়া দেশের জন্য এখন একটি হিরিকে পরিনত হয়েছে। অনেক মিডিয়ার চেয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, অনেক খবরই তাদের আগেই প্রচার করছে। মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে মিডিয়ার চেয়ে খবরটি আগেই প্রচার করার মত সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাহলে মিডিয়ার ভূমিকা কি হবে? আমাদের টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও-র আগে যদি ফেসবুক থেকে খবরটি আগেভাগে জানা যায়, তাহলে বাংলাদেশে এতো এতো মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা কি জন্য?বাংলাদেশে মিডিয়াও এক বড় সন্ত্রাস সৃষ্টির আকড়া। খবরের পেছনে না ঘুরে এরা টাকার পেছনে ছোটে। আজকাল বিভিন্ন সভা-সেমিনার, মানববন্ধন, আন্দোলনের প্রধান ব্যাপার থাকে, কখন টেলিভিশনের ক্যামেরা আসবে? টেলিভিশনের ক্যামেরা আসার পর, তখন সেসব সভা সেমিনার, মানববন্ধনে এক ধরনের গতিশীলতা দেখা যায়। যতক্ষণ ক্যামেরা না আসে ততক্ষণ সভা, সেমিনার, মানববন্ধন শুরু হয় না। আর ক্যামেরা আসার পর তাদের এক্টিভিটিজ শুরু হয়। এমনও দেখেছি, মানববন্ধনে মোট উপস্থিতির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা দশ-পনের জন। ক্যামেরার কল্যানে তা বড় করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেসব বক্তব্য খবরের অংশ না হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না, আমাদের মিডিয়াগুলোর কাছে, তাই অনেক গুরুত্ব সহকারে প্রচার পাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির নাম বাংলাদেশ। এখানে পায়ে পায়ে মানুষ। গায়ে গায়ে মানুষ। দেশে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি নামে কোনো নীতিই কার্যকর নেই। কার্যকর নেই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি। এখানে খাবার নেই কিন্তু অসংখ্য অভুক্ত মুখ আছে। রাজধানী ঢাকায় যানজটের কথা না হয় নাইবা বললাম। ফুটপথ দিয়ে মানুষের কারণে হাঁটা যায় না। আপনি যদি সামনে তাকিয়ে হাঁটেন, পেছন থেকে ধাক্কা লাগবে। যদি পেছনে দেখতে যান, সামনে থেকে আপনার সেঙ্গ আরেকজনের ধাক্কা লাগবে। সারা পৃথিবীর মানুষ যদি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জড়ো করা হয়, তাহলে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘনত্ব দাঁড়াবে, তারচেয়েও বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বর্তমানে বেশি। এবার অনুমান করুন আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, আর সরকারি কাগজপত্রে যেভাবে দেখানো হচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য আপনার গবেষক হবার প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরলেই এর প্রমাণ হাতেনাতে পাবেন। এরকম একটি অপরিপক্ক, অগোছালো, জগাখিচুরি মার্কা দেশে একজন মন্ত্রী ৬৭ বছর বয়সে বিয়ে করার খায়েস কোথা থেকে পান? নিশ্চয়ই মন্ত্রী হবার পর ব্যাচারার আয় উন্নতি ঘটেছে। আরো উন্নতির প্রত্যাশাও রয়েছে। যে কারণে ২৯ বছরের একটি কনে তুড়ি মেড়ে জুটিয়ে ফেলেছেন। আর এই অসম বিয়েতে খোদ রাষ্ট্রের সায় আছে। উচিত ছিল, মন্ত্রীসভায় জনাব মুজিবুল হককে কড়া একটা ধমক মারা। মিঞা, রেলওয়ের দশা কি আছে, তাই ঠিক করুন। আপনি বিয়ে করার চিন্তা কিভাবে করতে পারেন? আর করলেও চুপচাপ করেন। ঢাক ঢোল পিটানোর কি আছে? সেই ধমকটি না খেয়ে মন্ত্রী বাহাদুর যখন সবার আনন্দের খোরাক হলেন, তখন তিনি আরো উৎসাহ পেলেন, 'যে তালি পরে লাইনে আছি গো'। আমরা জানি, রেলের গাড়ি গুলো লাইনেই চলে। লাইনচ্যুত হলেই বরং বিপদ। এখন সেই দপ্তরের মন্ত্রী যদি ভাবেন, উনিও লাইনে আছেন, 'কুনো অসুবিদা নাইক্কা'। তাহলে বাংলাদেশের কপালে আরো অনেক দুর্দশা আছে। আমাদের কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'উদ্ভট উটের পৃষ্ঠে চলছে স্বদেশ...' । কথাটি স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় কবি'র কলম থেকে বের হলেও, কবি'র এই কথাটি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই দেশের সকল কর্মকাণ্ড, যজ্ঞ, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, মিডিয়া, খবর, বিয়ে, মন্ত্রী, সবার বেলায় সব সময় প্রযোজ্য বলেই আমার মনে হয়। অদ্ভুত উটের পিঠে বাংলাদেশ সওয়ার হয়েছে। একটি অসম বিয়েকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এভাবে এক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করার পরিণাম কোনদিন ভালো হবার কথা না। আমার এই কথাটি মন্ত্রী মহোদয়কে ব্যক্তিগতভাবে কোনো কষ্ট দেবার জন্য নয়। টোটাল বিষয়টি বোঝাতে, দেশের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য বোঝাতে, মিডিয়ার বর্তমান চালচিত্র বোঝাতে, খবরের খাসিলত বোঝাতে বলেছি মাত্র। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, আপনি বিয়ে করছেন, আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক, সেই বাসনা করি। কিন্তু যে খারাপ দৃষ্টান্ত আপনি স্থাপন করলেন খোদ রাষ্ট্রের ঘাড়ে বন্দুক রেখে, এই অসম বিয়েতে নতুন প্রজন্ম যদি উৎসাহিত হয়, ভেবে দেখুন, এই বাংলাদেশের, এই মরার দেশের, এই গায়ে গায়ে পায়ে পায়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপনের দেশে, সেটি কতোটা ভয়ংকর খারাপ ফল নিয়ে আসবে!!! আশা করি, মন্ত্রীর বিয়ের বিষয়টি সবাই বিনোদনের খোরাক হিসেবে নিয়ে সেই খারাপ দিকে উৎসাহিত হবে না। কিন্তু মিডিয়ার কাণ্ডজ্ঞান কবে হবে, সেই আশা করার মত কোনো ভরসা পাচ্ছি না। বাংলাদেশের মিডিয়া দিনদিন দেউলিয়া হচ্ছে। এই দেউলিয়াত্বের জন্য মিডিয়া নিজেরাই দায়ী। এটা তাদের স্বীকার করতেই হবে। রেলওয়ের নানান কুকর্মের খবর নিয়ে যেখাানে মিডিয়ার ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে রেলমন্ত্রীর বিয়ে তারা লাইভ দেখায়। মিডিয়ার কি রুচিবোধও তৈরি হবে না? কোন খবরটা কতোটা প্রচার করা যায়, এই বোধটা তৈরি না হলে আমাদের মিডিয়ার যতোই প্রসার ঘটুক, তা কেবল কোয়ানটিটি বাড়াবে বটে, কোয়ালিটি নয়।
false
hm
হামিদ মিরের জন্য ১. হামিদ মির একজন পাঞ্জাবি সাংবাদিক, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদকেন্দ্রিক জিও টেলিভিশনের তিনি কর্তাপদস্থ ব্যক্তি। প্রায়ই দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর লেখা ছাপা হয়। সেগুলো পাকিস্তান প্রসঙ্গে। তাঁর সেই লেখাগুলো পড়ে তাঁকে একজন স্বাভাবিক মানুষ ও অস্বাভাবিক পাকিস্তানী বলে মনে হয়েছে। প্রথম আলোতে আগে ডন এর সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মোহাম্মদ বাকির নাকভির লেখা ছাপা হতো, ২০০৯ এর ৭ নভেম্বর নাকভির মৃত্যুর পর তাঁর স্থানটি মির দখল করেছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রথম আলোতে মির একটি লেখা দিয়েছেন সম্প্রতি। সেখানে তিনি পাকিস্তানীদের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশীদের কাছে "দুঃখ প্রকাশ" করতে এবং এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক নতুনভাবে শুরু করতে। যেহেতু মিরের লেখা ইংরেজিতে আসে, এবং সেটার একটি বাংলা অনুবাদ করা হয় প্রথম আলোতে, তাই আমরা ধরে নিতে পারি, মির দুঃখ প্রকাশ বলতে হয়তো রিগ্রেট বা সমার্থক শব্দ ব্যবহার করেছেন। মিরের লেখায় আমরা তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ প্রকাশের কথা জেনেছি। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, পাকিস্তানের অনেকে তাঁর এই অবস্থানের কারণে ক্ষিপ্ত। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সরকারী পর্যায়ে "দুঃখ প্রকাশ" এর যেসব মৃদু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত ৩৯ বছরে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি দৈনিকে প্রকাশিত হাসান ফেরদৌসের একটি লেখায়। ২. মির সাহেবের জন্যে এবার একটি ঘটনা তুলে ধরবো। ক্ষমতা জবরদখলকারী পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফর করেছিলো ২০০২ এর জুলাই মাসে। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে একটি জোর দাবি ওঠার কথা ছিলো, ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা নিয়ে। ওঠেনি। ওঠেনি তার কারণ এই পাক জেনারেল বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগে বিনা কারণে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর মাঝরাতে পুলিশ আক্রমণ করে, মেয়েদের লাঠিপেটা করে এবং রমনা থানার হাজতে নিয়ে আটক করে। সারা বিশ্ববিদ্যালয় অপদার্থ উপাচার্য আনোয়ারউল্লার প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রীদের ওপর এই বর্বর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে, আনোয়ার হোসেনের মতো বর্ষীয়ান অধ্যাপক পর্যন্ত প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পুলিশের লাঠিপেটায় পা ভেঙে হাসপাতালে যান, বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং খুব সফলভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাক জেনারেল পারভেজ মুশাররফের আগমন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সম্পর্কে যে কোনো বক্তব্য আসার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। ঢাকার কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন এই মনোযোগ দিকভ্রান্ত করার রাজনীতিটি ধরতে সমর্থ হয়নি, এবং জোট সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সকলে তাদের নিয়মে খেলে গেছে। নিরিবিলি ঢাকায় নেমে পাক জেনারেল মুশাররফ স্মৃতিসৌধে যান, পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন, এবং একটি মৃদু আপসোসবাণী উচ্চারণ করেন, "We feel sorry for the tragedy which left deep scars on both our nations. But wounds do heal with time." তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এতেই খুশিতে গদোগদো হয়ে পাক জেনারেলের ঢাকা সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৩. মির সাহেবকে এবার একটা ছোট্ট গল্প বলবো। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় যখন বাংলাদেশের দক্ষিণভাগকে পিষে গেছে, সাহায্যের জন্যে গোটা উপকূলীয় অঞ্চল হাহাকার করছে, পাক জেনারেল ইয়াহিয়া যখন ঝড় আঘাত হানার চৌদ্দদিন পর নিতান্ত বাটে পড়ে সরজমিন পরিদর্শনে এসেছে স্বল্প সময়ের জন্যে, কাছাকাছি সময়ে তখন পূর্ব ইয়োরোপে রাজনৈতিক পরিবর্তনের তোড়জোড় চলছে। পূর্ব ইয়োরোপের দেশে তখন পা রেখেছেন পশ্চিম ইয়োরোপের এক নেতা। সীমান্ত বিষয়ক উত্তেজনা প্রশমন চুক্তি করতে তিনি এসেছেন এমন এক দেশে, যেখানে তাঁর দেশ পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম বর্বর কীর্তিগুলোর একটি ঘটিয়েছিলো কয়েক দশক আগে। চুক্তি যেদিন স্বাক্ষরিত হয়ে, ৭ ডিসেম্বর, সেই নেতা একটি স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে যান। মালাটি নামিয়ে রাখার পর উপস্থিত জনতাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করেন। ঐ নেতার নাম ভিলি ব্রান্ট, আর ঐ দেশটির নাম পোল্যান্ড, যে পোল্যান্ডকে নাৎসি জার্মানি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো। সেই স্মৃতিসৌধের নাম এয়রেনমাল ডের হেল্ডেন ডেস ঘেটোস [ওয়ারশ ঘেটোর বীরদের সম্মানে স্মৃতিসৌধ]। ভিলি ব্রান্ট পরাক্রান্ত পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন তখন। ঐ ঘটনাকে জার্মানরা বলে ক্নিফাল ফন ভারশাউ [ওয়ারশয়ে হাঁটু গেড়ে বসা], এবং এটি জার্মান রাজনীতির ইতিহাসে প্রবল আলোচিত একটি বিষয়। ব্রান্ট প্রকাশ্যে ক্ষমা চাননি, ধোঁয়াটে দুঃখপ্রকাশ করে অতীতের পাপ ঢাকতে চাননি, কোনো কথাই বলেননি, শুধু নিঃশব্দে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলেন স্মৃতিসৌধের সামনে। পশ্চিম জার্মানি-পোল্যান্ড শান্তিচুক্তির জন্যে ব্রান্ট পরের বছর, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, যখন আমরা বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীকে আঘাতের পর আঘাতে কাবু করে আনছি, শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। পোলিশরাও ব্রান্টের এই ভঙ্গিমার সম্মান দিয়েছিলো খানিকটা। সেই স্মৃতিসৌধ থেকে কয়েকশো মিটার দূরে তারা আরেকটি প্ল্যাকেট বসিয়েছিলো জার্মান নেতার এই হাঁটু গেড়ে বসাকে স্মরণীয় করে রাখতে। পশ্চিম জার্মানির বিরোধী দল সিডিইউ-সিএসইউ তীব্র সমালোচনা করেছিলো ব্রান্টের এই ভঙ্গিমার; একটি জরিপে দেখা গিয়েছিলো ৪৮% জার্মান মনে করেন, এই আচরণ বাড়াবাড়ি। পোলিশরা একজন বুন্ডেসকানৎলারের এই ভঙ্গিমাকে গুরুত্ব দিয়েছিলো, কারণ ব্রান্ট কোনো ভুঁইফোঁড় ক্ষমতা জবরদখলকারী ছিলেন না, ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত বার্লিনের নগরপাল ছিলেন, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত চ্যান্সেলর এবং ১৯৬৯ সাল থেকে চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর এই ভঙ্গির মূল্য ছিলো। ব্রান্টকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনি যে ওভাবে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিলেন, এ কি পূর্বপরিকল্পিত ছিলো? ব্রান্ট উত্তর দিয়েছিলেন, „Ich hatte plötzlich das Gefühl, stehen reicht nicht!“ [আমার হঠাৎ এই অনুভূতি হয়েছিলো যে দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ঠ নয়]। ৪. মির সাহেব, "দুঃখ প্রকাশ" যথেষ্ঠ নয়। গোটা পাকিস্তান মিলে "দুঃখ প্রকাশ" করলেও না। আপনাদের নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। কোনো ভুঁইফোঁড় ক্ষমতা জবরদখলকারীর মৃদু আপসোসবাণী গ্রহণযোগ্য নয়। পার্লামেন্টে এই ক্ষমাপ্রার্থনার প্রস্তাব পাশ করার পর আপনাদের উচ্চ পরিষদের প্রধান এবং তিন বাহিনীর প্রধানেরা ঢাকায় আসবেন, শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বা হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইবেন। ইংরেজিতে অ্যাপলজি কথাটার মানে দেখাচ্ছে, অ্যাডমিশন অব গিল্ট অ্যাকমপ্যানিড বাই এক্সপ্রেশন অব রিগ্রেট। আপনারা ঐ চারজন স্বীকার করবেন, ১৯৭১ সালে আপনারা যা করেছেন, তা অন্যায় ও অপরাধ ছিলো এবং তারপর যে দুঃখ প্রকাশ করার কথা বলছেন, তা করবেন। এরচেয়ে কম কোনো কিছু আমরা গ্রহণ করবো না। সালাম।
false
rn
শীতের রাতে মেয়েটি এসেছিল আমার কাছে (১৮+) আখাউড়া স্টেশনে বসে আছি। রাত একটা। তীব্র শীতের রাত। চারিদিকে দারুন কুয়াশা। মোটা একটা শাল গায়ে দিয়ে বসে আছি। শালে শীত মানছে না, ইচ্ছা করছে মোটা দুইটা শাল গায়ে প্যাচিয়ে শুয়ে থাকি। চারপাশে থোকা থোকা অন্ধকার আর ঝি ঝি পোকার ডাক। আমি যাব ঢাকা, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। সাড়ে বারোটায় ট্রেন আসার কথা ছিল। ইচ্ছা করলে বাসে যেতে পারতাম, কিন্তু বাস জার্নির চেয়ে ট্রেন জার্নি টাই আমার বেশী ভালো লাগে। তাছাড়া সিলেট আসলেই আমি ট্রেনে করে যাতায়াত করি। ট্রেন কেন দেরী করছে- ইষ্টিশন মাস্টারের কাছ থেকেও জানতে পারলাম না। এ পর্যন্ত সাত কাপ চা খেয়ে ফেলেছি। খুবই বিচ্ছিরি চা। সিলেটের কোনো এলাকাতেই আমি চা খেয়ে শান্তি পেলাম না। এর চেয়ে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের চা অনেক ভালো।সব কিছু মিলিয়ে আমার বিরক্ত লাগছে না, কারন আমার হাতে আছে- তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর উপন্যাস 'কবি'। উপন্যাসটির মূল বিষয় তৎকালীন হিন্দু সমাজের রুপ ও আচার, প্রেম, জীবনসংগ্রাম, মনের বিভিন্ন দিক ইত্যাদি। মুলত একটি মানুষকে ঘিরেই উপন্যাসটি আবর্তিত। সে মানুষটি হল নিতাই, নিতাইচরন। নিতাই খুব নিচ বংশের ছেলে, পুর্ব পুরুষের পাপে সে অতিষ্ট। চোর, ডাকাত, খুনিদের বংশে জন্মেও সে চায়, "জন্মের চেয়ে কর্মকে বড় করে দেখতে"। বিধাতা প্রদত্ত সুমিষ্ট কন্ঠ দিয়ে সে জগৎকে জয় করতে চায়, চায় বংশের পাপ লোচন করতে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই বাধ্য হয়ে মাকে ছেড়ে-বাবার ভিটে ছেড়ে মুটের কাজ করতে হয় রেল ষ্টেশনে।রেলস্টেশনে সে পায় অকৃত্রিম বন্ধু রাজন, রাজাকে সে সত্যিই রাজা ধনে নয় মনে। নিতাই সুযোগ পেয়ে গ্রামের আসরে কবি গান গায় আর বনে যায় কবিয়াল তাও সবার কা‍ছে নয় রাজা, ঠাকুরঝি (রাজার শ্যালীকা যাকে রাজা ও নিতাই দুজনেই ঠাকুরঝি বলে) আরও পরিচিত সবার কাছে তবে পারেনি বিপ্রদিপ আর নিতাই এর মামাদের কাছে। কন্ঠে যার মধু মনে যার ভাব তার কি আর মুটোর কাজে মানায়। তাই সে ব্রত নেয় যে করেই হোক তার কবিয়াল হওয়া চাই। কিন্তু এই স্বল্পশিক্ষিত আর নিচু বংশের লোকের দ্বারা কি বড় কবিয়াল হওয়া সম্ভব? উপন্যাসটিতে তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত পরিবেশে তা সম্ভব। অনেক কষ্টে, অনেক সাধনায় সাধারন নিতাইচরন হয়ে হয়ে উঠেন একজন নামকরা কবিয়াল।যাই হোক, মূল গল্পে ফিরে আসি। আমি বেঞ্চে বসে বই পড়ছিলাম- হঠাত দেখি আমার পাশে খুব রুপসী একটা মেয়ে বসে আছে। সুন্দর একটা অফ হোয়াইট শাড়ি পরা। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। কপালে একটা বড় টিপ। আর দুই হাত ভর্তি চুড়ি। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল। শীতের ঠান্ডা বাতাসে মেয়েটার মাথার চুল উড়ছে। কেন জানি না, মেয়েটাকে দেখেই খুব আপন আপন লাগছে। সাথে খুব মায়াও হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা মনের মধ্যে তীব্র আনন্দ হচ্ছে। আমি কোনো রকম দ্বিধা সংকোচ না করেই সহজ ভাবে বললাম, চা খাবেন ? মেয়েটি সাথে সাথে মাথা কাত করে বলল হুম, খাবো। আমি দৌড়ে গিয়ে চা নিয়ে আসলাম, বুদ্ধি করে কলা আর রুটি নিয়ে এলাম- যদি মেয়েটার ক্ষুধা পেয়ে থাকে। মেয়েটা আরাম করে বসে কলা রুটি খেল, তারপর অনেক সময় নিয়ে চা শেষ করলো। আর কি আশ্চর্য, ঠিক তখন ট্রেন চলে আসলো। আমি মেয়েটির হাত ধরে বললাম, চলো ঢাকা যাই। আমি ট্রেনের একটা কামরা নিয়েছি। পকেট থেকে বের করে টিকিট দেখালাম। মেয়েটি আমার হাত ধরে বলল চলো। নিজেকে মনে হচ্ছে জাপানের সমাট্র। মেয়েটি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, তোমার কি মন খারাপ? মেয়েটি বিষন্ন মুখে আমার দিকে একটু চাইল, কিছু বলল না। আমি মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলাম। মেয়েটি গুন গুন করে গান গাইছে- "আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।/ ভয় কোরো না, সুখে থাকো, বেশিক্ষণ থাকব নাকো--/ এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥" মেয়েটি হঠাত গান থামিয়ে বলল- তুমি কেমন পুরুষ গো, এতক্ষন ধরে আমি তোমার সাথে আছি- চুমু তো দূরের কথা হাত ধরতে পর্যন্ত চাইলে না! নাকি তোমার জিনিশ ঠিক নাই ? মেয়েটির কথায় আমি খুব লজ্জা পেলাম। খুব সাহস করে মেয়েটির হাত ধরলাম। মেয়েটি কিছু বলল না, কিছুটা সাহস বেড়ে গেল আমার। কপালে একটা চুমু খেলাম, তাও মেয়েটি কিছু বলল না। আরও সাহস বেড়ে গেল আমার। ঠোঁটে চুমু খেলাম। ঠোঁটে চুমু খেতেই মেয়েটি যেন একটু কেঁপে উঠলো। এবার মেয়েটি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। পিঠে খামচি বসিয়ে দিল। ট্রেন দ্রুত চলছে, আমিও খুব দ্রুত আদর করে চলেছি। যেন ট্রেনের সাথে আমি পাল্লা দিয়েছি। মেয়েটি চুপ করে শুধু আদর নিয়ে যাচ্ছে। আদর করার সময় মেয়েটির মুখটি কি যে মায়াময় দেখায়। ইচ্ছা করে একটা জীবন শুধু এই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার আদর শেষে মেয়েটি আমাকে আদর করে দিল। মেয়েটি আমাকে অদ্ভুত ভাবে আদর করল। ছোট করে একটা চুমু দেয়, তারপর একটা কামড়। কামড়টা মোটামুটি জোড়েই দিচ্ছে। কসম খেয়ে বলতে পারি, এত সুন্দর চুমু আর কামড় পৃথিবীর কোনো মেয়ে পারবে না। নো নেভার। আদর শেষে দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন শুয়ে থাকলাম। হঠাত দেখি, মেয়েটার চোখের কোনায় পানি জমেছে। আমি চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম- না কাঁদে না। বাইরে আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। আমরা দুইজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ভোর হওয়া দেখছি। আমি মেয়েটির বুকে মাথা রেখে গুন গুন করে মাথা গাইছি- "একি মায়া, লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।/ আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে॥/ কৃপণ হয়ে হে মহারাজ, রইবে কি আজ/ আপন ভুবন-মাঝে॥" গান গাইতে গাইতে কখন দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি- মেয়েটি আমার পাশে নেই। পড়ে আছে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা... চিঠিতে কি লেখা সেটা আপনাদের না জানলেও চলবে। তবে এতটুকু বলতে পারি- চিঠিটা পড়েছি আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়েছে। কেউ যদি চিঠিটা পড়তে চান, পড়তে পারেন। চিঠিটা খুব যত্ন করে রেখেছি।
false
fe
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুনিশ্চিত সুশাসন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুনিশ্চিত সুশাসন ফকির ইলিয়াস ---------------------------------------------------------------- রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, শ্লোগানটি বেশ পরিচিত। তা বলেন অনেকেই। প্রায় প্রতিটি দলের ম্যানিফেস্টোতে সে কথাটি আছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যাশায় কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়? না, হয় না। আর হয় না বলেই শাসক শ্রেণীর আশপাশে তোষামোদকারী ফড়িয়া শ্রেণী ভিড়তে পারে। স্বার্থবাদী একটি পক্ষ কলুষিত করতে পারে মানুষের স্বপ্নকে। বাংলাদেশে একটি বিতর্ক এখন বেশ তুঙ্গে। তা হচ্ছে, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম স্থানীয় সাংসদদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কে কি করবেন, সেই রুটিন নিয়েও চলছে মতবিরোধ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দুটি পদই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। সাংসদ এবং উপজেলা চেয়ারম্যান দু'জনই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তারপরও স্থানীয় সাংসদরা একটা বিশেষ দাপট দেখাবার প্রয়াসী হচ্ছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা সরাকরের সহযোগিতাও পাচ্ছেন বেশি। এই যে দ্বন্দ্ব, এর প্রধান কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলবাজির প্রভাব। যেহেতু উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারেন না, তাই তারা সে পরিচয়ও দিতে পারেন না। আর সেই সুযোগ কাজে লাগান দলীয় সাংসদরা। ফলে স্থানীয় সাংসদ এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের মাঝে যে ঐক্য গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা ওঠেনি কিংবা উঠছে না। দ্বন্দ্বটা সেভাবেই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। বিশ্বের উন্নত অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দু'স্তর বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি প্রথা চালু রয়েছে। ভারতে রয়েছে স্থানীয়-প্রাদেশিক প্রশাসন। আর রয়েছে কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) প্রশাসন। একই অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটর প্রথার পাশাপাশি রয়েছে স্টেট গভর্নমেন্ট এবং ফেডারেল গভর্নমেন্ট। প্রতিটি স্টেটেও রয়েছে স্টেট সিনেটর, স্টেট কংগ্রেসম্যান প্রথা। এই যে দু'স্তর বিশিষ্ট প্রতিনিধি হাউজ, সেখানে কিন্তু এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের কোন বৈরিতা নেই। কেন নেই? কারণ দু'টি পক্ষই রাষ্ট্র এবং সুশাসনের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগে বিশ্বাসী। সেখানে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ এবং ইচ্ছা কারোরই নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই রাজনৈতিক সম্প্রীতিই জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বিশেষ সহায়ক হয়েছে। খুলে দিয়েছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশস্ত পথ। প্রায় পনেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে গণমানুষের স্বপ্ন পূরণের কথাটি অনেক সংগঠনই বলে আসছে। এর বাস্তবায়নে কাজ করা প্রয়োজন। কারণ মজবুত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে গ্রামীণ জনপদ তথা গোটা রাষ্ট্রের মৌলিক অবকাঠামোর উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমার জানা মতে, স্থানীয় সরকার বিষয়ে দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর ধরে কাজ করছেন একজন সংগঠক, গবেষক। তার নাম আবু তালেব। তিনি যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী হলেও, বাংলাদেশের মানব সম্পদ ও স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। অতি সম্প্রতি তার প্রতিষ্ঠিত অর্গানাইজেশন 'সেন্টার ফর ডেমেক্রেটিক লোকাল গভার্নেন্স'-এর পক্ষে একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছেন নির্বাহী পরিচালক আবু তালেব। আর তা হচ্ছে- 'গণস্বপ্ন ২০২০ : উন্নত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ - ২০২০'। সংগঠনটি যে সব দাবিগুলোর বাস্তবায়ন চেয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে তার প্রধান কিছু দাবির সঙ্গে সহ মত পোষণ করে আলোচনায় যেতে চাই। ক. যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এর বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে গণমুখী নীতি প্রণয়ন করতে হবে। খ. ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ণ সুনিশ্চিত এবং সমানুপাত করতে হবে। তাদের জন্য সরকারি ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। গ. ইউনিয়নের সংখ্যা ৪৪৯৮টি থেকে কমিয়ে ৩০০০টিতে এনে সিস্টেম কস্ট হ্রাস করার উদ্যোগ নিতে হবে। সব স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনের মেয়াদ চার বছর করতে হবে। ঘ. কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের জাতীয় এবং বৈশ্বিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারগুলোর দায়িত্ব পালনে গঠনমূলক সহযোগিতা দিতে হবে। মোট সতেরো দফা দাবিনামার পক্ষে কাজ করছে সংগঠনটি যদিও সব ক'টি দাবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানা সম্ভব নয়। কোন সরকার তা মানবেও না। কতটা জনগণ সংশ্লিষ্ট হলে একটা দাবি জাতীয় সংসদে পাস হয়_ তার উদাহরণ বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। যে সব সাংসদ জাতীয় সংসদকে সব প্রত্যাশার কেন্দ্র বিন্দু বলে দাবি করেন, সেই সংসদেই কোরাম সঙ্কট দেখা দেয়। বাংলাদেশে তা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারকে গণমুখী করলে কিংবা করতে পারলেই গণতন্ত্রের চর্চা এবং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর প্রধান অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিছু কিছু শীর্ষ নেতাকে বলতেও শুনেছি, স্থানীয় পর্যায়ে সবল নেতৃত্ব বৃদ্ধি পেলে তাদের নিজেদের জন্যই নাকি 'ফ্রাংকেনস্টাইন' তৈরি হয়। তাই তারাই কেন্দ্রে অবস্থান করে সব কলকাঠি নাড়তে চান। এবং নেড়েও যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে আওয়ামী লীগের। অতি সম্প্রতি আমরা দেখলাম স্পীকার আবদুল হামিদ নিজের দলের, নিজের সরকারের, সংসদে উপস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তা নিয়ে বিরোধীদল সমালোচনার মওকাও পেয়েছে। এর জবাবে পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, স্পিকার মহান সংসদের প্রভু নন, সেবক। তাদের এই বচসা যদি লোক দেখানো না হয়, তাহলে তো আমরা ধরে নিতে পারি সরকারের ভেতরে একটা নীরব স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এটা কিসের লক্ষণ? মন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় সংসদে আসতে পারবেন না বা পারেননি, এমন অজুহাত থাকতেই পারে। কিন্তু এর সমন্বয় সাধিত হচ্ছে না কেন? প্রধান বিরোধীদল সংসদে আসছে না। ছাড় দিয়ে হলেও এই বিষয়টি সমাধান করা উচিত সরকার পক্ষের। কারণ জনগণের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানতে হবে সর্বাগ্রে। নিউইয়র্ক, ১৩ অক্টোবর ২০০৯। ----------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ ।ঢাকা । ১৬ অক্টোবর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- বের্ন্ট জোহানসন সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০০৯ ভোর ৬:০৩
false
ij
‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা_’_ লালনের একটি গান। বাংলার মাটিতে যতই বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হোক না কেন -বাউল গান বাংলার মাটিতে বেঁচে থাকবে চিরকাল। সেদিন লালনের একটি গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম কারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে গেল? তারা কি অবিশ্বাসী। কেননা, লালন তো নিজেই আল্লাহ্ সম্বন্ধে বলেছেন- কেউ বলে পরম ইষ্টি কারো না হৈল দৃষ্টি; যাদের দৃষ্টি হয়নি-তারাই কি ভাঙ্গতে গেল বাউলভাস্কর্য?এই রকম একটি ভাবনায় আমি ভীষন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। কেননা, আমি জানি, লালনের কোনও কোনও গানের পরতে পরতে রয়েছে ইসলামের ব্যাখ্যা। "পাবে সামান্যে কি তার দেখা"-সেরকমই একটি গান। গানের কথাগুলি এইরকম- পাবে সামান্যে কি তার দেখা বেদে নাই যার নার রুপরেখা। নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে সদাই ফেরে অচিন দেশে। দোসর তার নাইকো পাশে ফেরে সে একা একা। কেউ বলে পরম ইষ্টি কারো না হৈল দৃষ্টি; বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি, তাই নিয়ে লেখাজোখা। কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব? সে তুলনা কি আর দেব? লালন বলে গুরু ভেব যাবে রে মনের ধোঁকা। এবার, আমি যা বুঝেছি, ক্ষাণিক ব্যাখ্যা করার চেস্টা করি। পাবে সামান্যে কি তার দেখা বেদে নাই যার নার রুপরেখা। পাবে সামান্যে কি তার দেখা-এই লাইনটির দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব। কিন্তু আমি আজ সে দিকে যাব না। সহজ ভাবেই বলি, আল্লাকে পাওয়ার পথ সোজা নয়। বেদে নাই যার নার রুপরেখা। বেদ বা জগতের ধর্মগ্রন্থসমূহ আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের ইঙ্গিতমাত্র। ধর্মগ্রন্থে তো আল্লা বা ঈশ্বরের পূর্নাঙ্গ সাক্ষাৎ পাওয়া যাওয়ার কথা না। নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে সদাই ফেরে অচিন দেশে; দোসর তার নাইকো পাশে ফেরে সে একা একা। নিরাকার ব্রহ্ম মানে-নিরাকার আল্লা। আল্লার যে আকার-সাকার নাই সেকথা মুসলমানমাত্রই বিশ্বাস করে। কাজেই তার দোসর থাকারও কথা নয়। কাজেই- অচিন দেশে একা একা ঘুরে ফেরে । কিন্তু, অচিন দেশ কি? অচিন দেশ হল যেখানে আল্লার ঘর: The Unknown. যেখান থেকে আসে উড়ে আসে জীবনরুপ অচিন পাখি। উড়ে এসে আমাদের দেহ খাঁচায় বাস করে। যাকে কখনও লালন বুঝতে পারেন নি। কেঁদে বলেছেন- আগে যদি যেত জানা জংলা কভূ পোষ মানে না। তা হলে হায় প্রেম করতাম না লালন ফকির কেঁদে কয় পাখি কখন জানি উড়ে যায়। একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায় ... জীবনরুপ অচিন পাখি উড়ে আসে অচিন দেশ বা The Unknown থেকে। কেউ বলে পরম ইষ্টি কারো না হৈল দৃষ্টি; এ দুটি চরণ, আমার মতে, লালনের কবিত্ব শক্তির অপূর্ব উদাহরণ। ঈশ্বরকে কেউ বলে পরম ইষ্টি বা আত্মীয় বা নিকটজন। কারো না হৈল দৃষ্টি; কেউ আবার সারাজীবন ঈশ্বরকে খুঁজে পেল না। তাই লালন বলছেন- কেউ বলে পরম ইষ্টি কারো না হৈল দৃষ্টি; বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি, তাই নিয়ে লেখাজোখা। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন বলেই এতকিছু। এই যে বেঁচে আছি। বেঁচে থেকে এ গানের ব্যাখ্যা লিখছি। বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি- বরাতের এক মানে কপাল বা ভাগ্য। আসলে দুনিয়া সৃস্টি হতই। কাজেই, বিশ্বাসীদের কাছে এ জগৎ অর্থহীন ও আকস্মিক নয়। কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব? সে তুলনা কি আর দেব? সবচে গুরুত্বপূর্ন চরণ। সৃস্টির আগের মুহূর্তের কথা বলছেন লালন। মহাদেব মানে মহাদেবতা, মানে আল্লা। ধ্যান মানে- সৃষ্টির আগেকার আল্লার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা। যে মুহূর্তটিকে জানতে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। এ বছর আদিকণা কি রকম ছিল সে বিষয়ে ব্যয়বহুল পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে ইউরোপে। আল্লার পরিকল্পনা জানতেই। লালন যেটা গানে বলেছেন। সেই সৃস্টিমুহূর্তই তো সব কিছুর মূলে-এই জীবনজগৎ, আমাদের জন্মমৃত্যু। তাই সৃষ্টিমুহূর্তের কোনও তুলনা হয় না। সবশেষে লালন বলছেন- লালন বলে গুরু ভেব যাবে রে মনের ধোঁকা। লালন বলছেন, আল্লাহ্ই যে সবের মূলে সেটা বিশ্বাস করতে হবে। তা হলেই মনের সংশয় কাটবে। এই গানটা সেদিন শুনতে শুনতে ভাবছিলাম- কারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে যায়! তারা অবিশ্বাসীরা নয় তো? লালন আল্লার পরমভক্ত। ইসলামের নবীরও। কাজেই, যারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে যায়-তারা কিছুতেই বিশ্বাসী নয়! *ফরহাদ মজহার তাঁর “ভাবান্দোলন” বইতে এই গানটির বিশদ ও অসাধারণ ব্যাখ্যা করেছেন। অবশ্যই পড়ে দেখবেন। সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:০৯
false
hm
ইতিহাস রচনা "কিছু পেলে, খান?" ডঃ খান এতো চমকে উঠলেন যে তাঁর হাত থেকে পেন্সিলটা পড়ে গেলো। কার্লোস। লোকটা বেড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটে। কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পাননি তিনি। "কাজ চলছে, কার্লোস।" গম্ভীর মুখে বলেন খান। কার্লোসের মুখে একটা বিরাট হাসি, চুপিচুপি এর ওর পেছনে হাজির হয়ে লোকজনকে চমকে দিয়ে একটা ছেলেমানুষি আনন্দ পায় সে। অনেকবার বলার পরও নিজেকে শোধরায়নি কার্লোস। মানচিত্র কেন্দ্রের প্রধান প্রশাসক অব্দি গড়িয়েছে ব্যাপারটা, তিনি ডেকে বকেছেন তাকে, কার্লোস গা করে না। লোকজনকে ভড়কে দেয়াই তার একমাত্র বিনোদন হয়তো। "তুমি এত ঘাবড়ে গেলে, হা হা হা, এত ঘাবড়ে গেলে, মনে হচ্ছিলো তুমি চুরি করে নেংটু থ্রিডিগ্রাফ দেখছো। হি হি হি।" ডঃ খান গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকেন কার্লোসের দিকে, তার হাসি থামেই না। ঊরুতে চাপড় দিয়ে সে হেসেই চলে। "কার্লোস, তোমার হাতে কোনো কাজ নাই?" গম্ভীরতর গলায় প্রশ্ন করেন খান। হাজার হোক, কার্লোস তাঁর সহকারী। চোখের পানি মুছে কার্লোস বললো, "হো হো হো ... হ্যাঁ শেষ। ভাবলাম নিজেই এসে জানাই তোমাকে। হা হা হা, নেংটু থ্রিডিভিডি, হা হা হা ...।" ডঃ খান গম্ভীর মুখে নেটওয়ার্ক থেকে কার্লোসের শেষ করা ম্যাপগুলো বেছে বের করেন। ফোল্ডার খুলতে গিয়ে তিনি দেখেন, বাংলায় লেখা, "পাছাপাহাড়"। কার্লোসের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন, সে আবার নিঃশব্দে শরীর কাঁপিয়ে হাসছে তাঁর অভিব্যক্তির পরিবর্তন দেখে। "এটা তুমি পেলে কোত্থেকে?" রুষ্ট গলায় প্রশ্ন করেন ডঃ খান। কার্লোস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাসতে হাসতে। "হা হা হা ... তুমি যদি তোমার চেহারাটা দেখতে পেতে খান ... এক সেকেণ্ডের মধ্যে তোমার চেহারাটা জেনারেল ফ্রাংকোর মতো কোষ্ঠকাঠিন্যমার্কা হয়ে গেলো! হো হো হো! পাছাপাহাড় ... হা হা হা ... পাছা পাহাড় ... লা সিয়েরা দে লোস কুলোস ... হা হা হা হা হা!" ডঃ খান চুপচাপ ফাইলটা খোলেন। মন্স ক্লুনিস নামটা দিয়েছিলো তাঁর এই প্রজেক্টের আগের ডিরেক্টর, মারিয়া ভারগাস। কে জানে, মেক্সিকোর সবারই প্রত্যঙ্গভিত্তিক রসিকতা উপভোগ করে কি না। কার্লোস যে করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ইন্টারনেট থেকে মন্স ক্লুনিসের বাংলা খুঁজে বার করে ফোল্ডারের নাম পাল্টে রেখেছে তাঁকে খ্যাপানোর জন্যে। কার্লোস গম্ভীর মুখে একবার ক্রুশ আঁকে বুকে। "মারিয়া ... ঈশ্বর তাকে স্বর্গে রাখুক ... কী জোস একটা নাম দিয়েছিলো দেখেছো?" এই প্রজেক্টের ম্যাপ দিনে কয়েক হাজার বার খুলে দেখতে হয় ডঃ খানকে, সাদৃশ্যটা চোখ এড়িয়ে যাবার কোনো উপায়ই নেই। ওডিনিয়া গ্রহের অন্যতম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এই বিশাল পাহাড়, দেখতে হুবহু মানুষের নিতম্বের মতো। মারিয়া ভারগাসকে শুধু একটু খেটে একটা ল্যাটিন নাম বার করতে হয়েছে। কার্লোস ফিসফিস করে বললো, "আমার কাছে এটাকে দেখতে মারিয়ার পাছার মতোই মনে হয় মাঝে মাঝে।" ডঃ খান সন্দিগ্ধ চোখে কার্লোসের দিকে তাকান, সে গম্ভীর মুখে সম্মতির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কোনো উত্তর না পেয়ে সে গোমড়া মুখে বলে, "দেখো, মারিয়া মারা গেছে, তার মানে এ-ই না যে তার সুন্দর পাছা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।" ডঃ খান বলেন, "কার্লোস, তুমি রিপোর্ট লেখোনি কেন?" কার্লোস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, "নিজেই তো এলাম। পরে ডেস্কে গিয়ে লিখছি দাঁড়াও। আসল কথা দুইটা বলে যাই। তোমার পাছার পাহাড়ে ... হে হে হে, তোমার পাছার পাহাড় ... হা হা হা, মানে, বলতে চাইছি মন্স ক্লুনিসে একটা গিরিখাত আছে। হা হা হা হা ... আসলেই পাছার পাহাড় ... হো হো হো।" ডঃ খান হতাশ মুখে বলেন, "কার্লোস, তোমাকে আমি মানুষ করতে পারবো না। ভাগো। ডেস্কে যাও, রিপোর্টটা দাও, আমি দেখছি ম্যাপটা।" কার্লোস একটা টুল টেনে বসে পড়ে বলে, "যাচ্ছি যাচ্ছি ... তুমি তো পাত্তাই দিচ্ছো না ব্যাপারটা। এই ক্যানিয়নটা প্রাকৃতিক বলে আমার মনে হচ্ছে না। আমি টেরেইন ফিচারগুলো রেন্ডার করলাম গত কয়েক হপ্তা ধরে। একেবারে মসৃণ, জ্যামিতিক একটা ক্যানিয়ন দুই পাহাড়ের মাঝখানে। কিন্তু দুই প্রান্ত এবড়োখেবড়ো। এ কারণেই আমাদের প্লটার রোবটগুলো যখন সার্ভে করছিলো, শুরুতে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি কেউ।" ডঃ খান কয়েক সেকেন্ড কার্লোসের চেহারা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন, সে নতুন কোনো রসিকতা শুরু করছে না। কার্লোস এই প্রজেক্টের অন্যতম সেরা টেলিকার্টোগ্রাফার, তার বদমায়েশি যে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এতদিন ধরে সহ্য করে আসছে, সেটা এমনি এমনি নয়। তিনি প্রথম ম্যাপটা খুললেন। "দ্যাখো।" একটা পেন্সিল তুলে ম্যাপের একটা অংশ জুম করে দেখালো কার্লোস। "গত সভায় এতটুকু পর্যন্ত কাজ করা হয়েছিলো। লারিসাকে চেনো না, ঐ যে লাটভিয়ার মেয়েটা, ও কাজ করছিলো এটা নিয়ে। কিচ্ছা খতম বলে জমা দিয়ে দিয়েছিলো প্রোজেক্ট। আমি এর পর থেকে কী ভেবে আবার শুরু করেছিলাম। এরপর দেখলাম আমার সন্দেহই ঠিক। একটা পুরো রাস্তা চলে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝখানে। প্রাকৃতিকভাবে এরকম একটা রাস্তা তৈরি হবার সম্ভাবনা খুব কম। অন্তত সোলার সিস্টেমে কোথাও নেই, সেটা আমি প্রায় নিশ্চিত।" ডঃ খান পরের ম্যাপটা খুলে চমকে উঠলেন। অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত একটা পথ বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে। মসৃণ জ্যামিতিক রেখায় একটু বাঁকা হয়ে চলে গেছে সেটা পাহাড়ের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। তিনি রুদ্ধশ্বাসে বললেন, "তুমি নিশ্চিত, এটা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হতে পারে না?" কার্লোস নিজের ভুঁড়ির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বললো, "আমি সেটারই খোঁজ নিতে লাইব্রেরিতে পাঠিয়েছিলাম লারিসাকে। সে গতকাল পর্যন্ত পৃথিবী, চাঁদ বা মঙ্গলে এমন কোনো কিছু পায়নি।" ডঃ খানের মুখ থেকে রক্ত নেমে গেলো। "তুমি ... তুমি বুঝতে পারছো এর মানে কী?" কার্লোস বললো, "হ্যাঁ। আমরা এখন পর্যন্ত ওডিনিয়ায় যতগুলো প্রোবিং স্টেশন চালু করেছি, তার কোনোটা থেকেই কিন্তু প্রাণের অস্তিত্বের সপক্ষে কোনো কিছু আসেনি। এইটা প্রথম।" ডঃ খান বললেন, "এর দুটো অর্থ থাকতে পারে। হয় ওখানে এরকম একটা গিরিখাত তৈরি করার মতো কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কোনো কিছু আছে, অথবা ওরকম বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী আমাদের আগে ওডিনিয়ায় নেমেছিলো।" কার্লোস বুড়ো আঙুল দেখালো। ডঃ খান কার্লোসের পিঠ চাপড়ে দিলেন। "সাবাশ ব্যাটা! দারুণ জিনিস বার করেছো!" কার্লোস আবার গা দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো। "হে হে হে হে ... খান, দারুণ জিনিসের কথা তো এখনও বলিনি!" ডঃ খান নিশ্চিত হলেন, কার্লোসের কাজের কথা ফুরিয়েছে। সে একটা অশ্লীল রসিকতা গুছিয়ে এনেছে মনে মনে। কার্লোস বহুকষ্টে হাসিটা দমিয়ে রেখে বললো, "এই গিরিখাতের এলিভেশন কনট্যুর ম্যাপটা দেখো। একটা প্ল্যান ভিউ রেডি করে রেখেছি তোমার জন্য।" পেন্সিল দিয়ে ম্যাপটা খোলে সে। ডঃ খান আবারও নির্বাক হয়ে যান। গিরিখাতের ঠিক মাঝখানের অংশটা অন্য অংশের চেয়ে চওড়ায় কয়েকগুণ। সেখানে একটা বৃত্তাকার কালো অংশ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, কোনো একটা গুহা বা সুড়ঙ্গ চলে গেছে গ্রহটার মাটির নিচে। কার্লোস এবার ঘর ফাটিয়ে হাসতে থাকে। "মারিয়া! মারিয়া! ও দিও মিও! আমি মরে যাবো হাসতে হাসতে! এটা আসলেই মন্স ক্লুনিস! পাছার পাহাড়! হো হো হো হো হো! শুধু পাছার পাহাড়ই নয়, এটার একটা পোঁদও আছে! হা হা হা হা হা হা!" ডঃ খান আচমকা হেসে ফেলেন। কার্লোসের হাসিটা দপ করে নিভে যায় তাঁর মুখে হাসি দেখে। খান বলেন, "কার্লোস, ওডিনিয়ার ম্যাপিং প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে এই ডিপ্রেশনটার নাম নিশ্চয়ই আমি রাখতে পারি?" কার্লোস আবার হাসতে শুরু করে। "অবশ্যই খান! নিশ্চয়ই পারো! তুমি তো ল্যাটিন জানো ভালো! কী রাখতে চাও? আনুস ক্লুনাই? হা হা হা হা হা! ইট লুকস লাইক অ্যান অ্যাসহোল ... ঈশ্বরের কসম!" ডঃ খান কার্লোসের কাঁধে হাত রেখে বললেন, "না, কার্লোস, আমি এটার নাম ল্যাটিনে নয়, বাংলায় রাখতে চাই।" কার্লোস সাগ্রহে বলে, "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! কী রাখতে চাও?" খান বেশি ভাবেন না। ছেলেবেলায় বাবার মুখে প্রায়ই শোনা একটা প্রতিজ্ঞাবাক্য মনে পড়ে যায় তাঁর। ভাষা উন্মুক্ত হবেই। কার্লোস বলে, "কী ভাবছো?" ডঃ খান হাসিমুখে বলেন, "আমি এটার নাম রাখতে চাই মোস্তফা গহ্বর!"
false
fe
সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কীভাবে বলছেন! সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কীভাবে বলছেন!ফকির ইলিয়াস========================================একটি চরম শঙ্কা আর ভয়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটছে বাংলাদেশের। পুরো দেশজুড়ে হত্যাকাণ্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজশাহী নগরীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকেও মোটরসাইকেলে এসে খুন করে গেছে দুর্বৃত্তরা। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকের কাছে অবসরপ্রাপ্ত একজন কারারক্ষী রুস্তম আলীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়েছে নারকীয় কায়দায়। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিস্টেন্ট জুলহাজ কাজ করছিলেন ইউএসএআইডির সঙ্গে। সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন তিনি। আর তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় লোকনাট্য দলের একজন সদস্য ছিলেন। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। বার্নিকাট বলেছেন, ‘এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে আমি হতবাক। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে আমাদের যারা জুলহাজের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের কাছে সে ছিল সহকর্মীর চেয়েও বেশি কিছু; সে ছিল আমাদের প্রিয় বন্ধুর মতো।’কী এক বীভৎস রক্তবন্যা বইছে পুরো দেশজুড়ে। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর বেরিয়েছে, গেল দেড় সপ্তাহে ৪০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পুরো দেশব্যাপী। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাধু পরমানন্দ রায়ের (৭৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাধু পরমানন্দ গিমাডাঙ্গা হাটে বাজার করতে যান। হাট থেকে ফেরার সময় গিমাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল মান্নান শেখ মানুর ছেলে শরিফুল শেখ ফার্নিচারের দোকান থেকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দেয়। প্রথমে তার হাতে ও পেটের নিচের অংশে কোপ দেয় দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে তিনি রাস্তার ওপর পড়ে গেলে শরিফুল তার পিঠে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে দেয়। অস্ত্রটি পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা থেকে রাতে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুপুরে তিনি মারা যান।এ মাসের শুরুতেই রাজধানীর সূত্রাপুরে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিম উদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেনকেও মসজিদে ঢুকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় এক স্কুলশিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ভেড়ামারার ফকিরাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ভেড়ামারা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ নূর হোসেন খন্দকার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নিহতের নাম মজিবর রহমান (৬৮)। তিনি ফকিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। এতগুলো খুন প্রায় একই সঙ্গে ঘটেছে। দেশ একটি চরম বেদনাদায়ক মুহ‚র্ত পার করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা শিলা বলেছেন, বাজারে আলু পটল বিক্রি করলে অধ্যাপক রেজাউল খুন হতেন না; বুদ্ধিজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন- ‘বিচার হবে, বিচার হবে এটা শুধু মুখের কথা নয় এর প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব বাংলাদেশ কত উন্নত হয়েছে, আপনি সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে তার প্রমাণ করুন।’আমাদের মনে আছে, ২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর রাবি শিক্ষক ইউনুস হত্যার মধ্য দিয়ে রাবিতে শুরু হয় শিক্ষক হত্যাক্রম। যা এখনো চলছে। কারা এর নেপথ্যে তা এখনো সরকার বের করতে পারেনি।বাংলাদেশে এই যে টালমাটাল অবস্থা চলছে, তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন- ‘আমি মনে করি না, সারা দেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে। এটি বিছিন্নভাবে দু’একটা ঘটছে এবং আমাদের দেশে যারা আগে থেকে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত ছিল, তাদেরই একটি ভগ্নাংশ কিংবা তারা প্রয়াস পাচ্ছে।’ তিনি জানান- ‘সবকিছু দমন করা হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। সে জন্য আমি মনে করি আমাদের দেশ, আমরা অনেক নিরাপদ আছি। মিডিয়াকে তিনি আরো বলেন- ‘আমরা সব সময় বলি, এগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ছিল ছাত্রশিবির, তারপর জেএমবি, তারপর হরকাতুল জিহাদ, তারপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম। এসব জঙ্গি সংগঠন একের পর এক তৈরি হয়েছে। আত্মপ্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি।’ তার মতে, বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সারা দেশে ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বোধ করার কোনো কারণ নেই। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন’ বলতে কি বুঝাতে চাইছেন? এতগুলো খুন ‘বিচ্ছিন্ন’ হয় কি করে? আমরা জানি, দেশে একটি সরকার আছে। বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কেউ কি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না? না কি সরকারকে প্রকৃত সত্য জানতে দেয়া হচ্ছে না?হত্যার ঘটনাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। তিনি বলেন, যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করতে গিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেছে, পরবর্তীতে সরকার উৎখাতের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে তারাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাদের ইন্ধনেই এসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ও ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে তারা (জামায়াত-বিএনপি) এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোনো অপশক্তির ওপর দায় চাপিয়েই কি রক্ষা পাবে সরকারপক্ষ? দায় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? যে কথাগুলো না বললেই নয় তা হলো, অভিজিৎ-দীপন-সাগর-রুনী-নীলাদ্রী-অনন্তবিজয়, এমন অনেক হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পারেনি সরকার। প্রধানমন্ত্রী ‘দায় না নেয়া’র যে কথাটি বলেছেন তা মূলত ঘাতকদের আসকারা দিয়েছে। শান্তি যারা চান তারা কখনো সংঘাত চান না। এটাই মূল বিষয়। আর শান্তি চাইলে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর কোনো সুযোগও নেই। কিন্তু যারা খুন করছে তারা তো চরমপন্থা অবলম্বন করছে। এদের ধরতে সরকার কতটা আন্তরিক?ভিন্ন ধর্ম বা মতের কারণে যদি কাউকে হত্যা করা হয় তাহলে পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি বলেছেন, ‘এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বরং দৃঢ়ভাবে বলা যায় বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের জন্য বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উদাহরণ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এখানে নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মীয় সম্প্রীতির আবহে তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করেন। এটি এ দেশের ঐতিহ্য ও গর্ব। তবে, মাঝে মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের কারণে খুন, মারামারি এবং ভাঙচুরের সংবাদ সংবাদপত্রে দেখা যায়। এটা যে কেবল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে তা নয়; মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝেও এ রকম ঘটতে দেখা যায়। তিনি বলেছেন- ‘এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহ্য করতে না পারা অথবা ভিন্ন মতের কারণে যদি মানুষকে হত্যা করতে হয় তাহলে পৃথিবী মানুষের জন্য বাসযোগ্য থাকবে না। আমি বিশ্বাস করি এই উগ্র মতাদর্শকে আমি যেমন সমর্থন করি না আপনারাও নিশ্চয়ই করবেন না।’ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে বলে যারা বাণী আওড়াচ্ছেন, তাদের বোধোদয় দরকার। না দেশ ঠিকঠাক চলছে না। ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ হতে পারে না। একজন নাগরিক নির্বিঘ্নে কাজ করতে না পারলে স্থবির হয়ে পড়ে শ্রমমাঠ। বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে। মানুষ শঙ্কায় ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। অন্যের ওপর দোষ দিয়ে একটি সরকার দায় এড়াতে পারে না। যারা দোষী তারা যেই হোক না কেন আইনের আওতায় আনতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ঠিকই বলেছেন, ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, সভ্যতা মানুষের লোভকে লাগামহীন করে তুলেছে। সারা বিশ্বে মানবতা আজ বিপর্যস্ত ও বিপন্ন। আমাদের মাঝে ন্যায়বিচার, সুশাসন, কল্যাণ, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতাবোধের বড়ই অভাব।’ এই অভাব কাটিয়ে উঠতে প্রজন্মকে সুসংহত হতে হবে। আর ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে সরকারকে।----------------------------------------------------------------------------------------দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৬ সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:০০
false
mk
এর নাম রাজনীতি! হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি এখন মূলত মানুষ হত্যার কর্মসূচিতে রূপ নিয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক জোটের অবরোধ কর্মসূচি এখনো চলছে; চলছে সহিংসতা-নাশকতা-রক্তপাত। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকলেও অবরোধ এবং তা প্রতিহতের নামে পথে পথে চোরাগোপ্তা হামলা-পাল্টাহামলা, পেট্রলবোমা ছোড়াসহ সহিংসতা-নাশকতার বহুমুখী কায়দায় লাশ পড়ছে রাস্তায়। গাড়িতে চড়তে গিয়ে যাত্রীর, গাড়ি চালাতে গিয়ে চালকের প্রাণ মুহূর্তে নিভে যাচ্ছে পেট্রলবোমায়। ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণ নিয়ে আবার ঘরে ফেরা দায় হয়ে উঠেছে। সচেতন মানুষের মনে তাই প্রশ্ন জেগেছে, এভাবে অবলীলায় মানুষের প্রাণহরণের নামই কি রাজনীতি?গত ৫ জানুয়ারি রাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৫ দিনে সহিংসতা ও নাশকতায় প্রাণহানি ঘটেছে ২৮ ব্যক্তির। তাদের মধ্যে ১১ জন পরিবহন শ্রমিক, ছয়জন রাজনৈতিক কর্মী ও বাকিরা যাত্রীসহ সাধারণ মানুষ। চলমান অবরোধ জিইয়ে রাখতে প্রতিদিন আগুন লাগানো ও ভাঙচুর করা হচ্ছে গাড়িতে। কোটি টাকা দামের গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত ২২ মাসের ব্যবধানে সাত দফা অবরোধ, হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে সহিংসতায় দেশে ৩২৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া অবরোধকালীন নাশকতায় পঙ্গু হয়ে কাতরাচ্ছে ১৩ হাজার ৩২৩ ব্যক্তি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩১ হাজার ১৬৯টি গাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মধ্যে ভাঙচুর চালিয়ে ক্ষতি করা হয়েছে ২৯ হাজার ৫৯৮টি আর আগুনে পুড়িয়ে অঙ্গার করা হয়েছে ৮৪৫টি গাড়ি। আগুন লাগানোয় আংশিক ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ৭২৬টি গাড়ির। গত রবিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। দগ্ধ ১০ জনের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় রাজধানীর লালমাটিয়ার সিটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন শিশুসন্তানসহ ডাক্তার দম্পতি। সেখানে এখনো চিকিৎসা চলছে আড়াই বছরের শিশু সাফিন, তার মা ডা. শারমিন সিদ্দিকী ও বাবা ডা. সাইফুল ইসলামের। ছবি : লুৎফর রহমানবিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটেছে দুই হাজার ২৩৪ জনের।বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি ও যানবাহনের ক্ষতিসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন আজ বুধবার প্রকাশ করবে। এ জন্য রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি মিলনায়তনে দুপুরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাস্তায় নিরাপদে চলাচলের শতভাগ অধিকার রয়েছে সাধারণ মানুষের। আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে তাতে রাস্তা বন্ধ করে, গাড়ি পুড়িয়ে যাত্রী অধিকার হরণ করে রাজনীতি করা হচ্ছে। এটা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। অবরোধ যদি প্রাণ হরণের অস্ত্র বা কৌশল হয় তাহলে এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের জানুয়ারির পর থেকে সহিংসতা তেমনটা ছিল না। ২০১৩ সালে সহিংসতা ছিল ভয়ানক। এবার অবশ্য ২০১৩ সালের মতো সব জেলায় বিস্তৃত হতে পারছে না সহিংসতা। আমরা ২০১৩ সাল থেকে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষতি নিয়ে কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখেছি, রাজনৈতিক আন্দোলনে নিরীহ যাত্রীদেরই বলি দেওয়া হয়েছে।’ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক সহিংসতার ধরন বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, জনগণের প্রতি সহিংসতা ঘটছে বেশি। এটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক সহিংসতা। অপকৌশল ও অপতৎপরতার মাধ্যমে জনগণকে দুর্দশায় ফেলে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য থেকেই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এখানে সরকারও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করছে। রাজনীতি জনস্বার্থকেন্দ্রিক না হওয়ায় সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। গত ২২ মাসে অবরোধ-হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলাকালে সহিংসতায় যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের প্রাণহানি ঘটেছে বেশি। তার মধ্যে রাস্তায় বের হয়ে গাড়িতে ওঠার পর পেট্রলবোমায় ঝলসে গেছে ২৩৯ নিরীহ যাত্রীর শরীর। জীবিকার প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার পর গাড়িতে নাশকতাকারীদের ছোড়া বোমা বা আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছে ৮৪ জন পরিবহন শ্রমিককে।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারির মধ্যে ছয় দফায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। চলতি বছর ৫ জানুয়ারি রাত থেকেই শুরু হয়েছে টানা অবরোধ। গতকাল পর্যন্ত ১৫ দিন পার হয়েছে অবরোধের। অবরোধে দেশের সড়ক পরিবহন খাত প্রায় অচল রয়েছে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পর্যটকরাও আসার সাহস পাচ্ছে না।অবরোধ বা হরতালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিপর্যস্ত হয় শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত। ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় অর্থনীতি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর হিসাব মতে, হরতাল-অবরোধে অস্থির এ সময়ে দিনে ক্ষতি হচ্ছে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে ২০১৩ সালের অবরোধের চেয়ে এবারের অবরোধে মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করছে অপেক্ষাকৃত বেশি। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট হরতাল-অবরোধকেই প্রধান কর্মসূচি হিসেবে বেছে নিয়েছে বারবার। এর আগে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি দুই দিন বাদ দিয়ে ১০ দিন অবরোধ পালন করে এই জোট। তারও আগে ২০১৩ সালে বিএনপি জোট ২৬ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ ধাপে ২৪ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। ওই সময়ে সহিংসতায় প্রাণ যায় ১২৭ ব্যক্তির। ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর, ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর, ৭ থেকে ১৩ ডিসেম্বর, ১৭ থেকে ২০ ডিসেম্বর, ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দফা অবরোধ হয়েছিল। তার আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর থেকে শুরু হয়েছিল টানা সহিংসতার। ওই সময়ে ‘বাঁশের কেল্লা’ নামে ফেসবুকের একটি পেইজে প্রচারণা চালিয়ে রেলে নাশকতায় নেমেছিল জামায়াত-শিবির। ২০১৩ সাল থেকে চালানো সহিংসতায় রেলে ৪০০ হামলায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। মহাসড়ক কেটে দেওয়া, গাছ কেটে নেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সড়ক খাতে ক্ষতি করা হয়। অবরোধ ছাড়াও ওই বছর থেকে বিভিন্ন সময়ে হরতাল ডাকা হয়েছিল।চলতি অবরোধে ২৮ প্রাণহানি : গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূতি পালনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে বছরের শুরু থেকে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৫ জানুয়ারি রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করলে আবারও অচল হয়ে পড়ে গোটা দেশ। ওই রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় গাড়িতে আগুন দেওয়ার মতো নাশকতা। অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৫ দিনে নাশকতায় প্রাণহানি ঘটেছে যে ২৮ ব্যক্তির, এর মধ্যে ১১ জনই পরিবহন শ্রমিক। গত ১৪ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে যাত্রীবাহী বাসে নাশকতায় প্রথমে পাঁচ ও গতকাল মঙ্গলবার একজনসহ মোট ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে। রাজনীতির নামে এসব মানুষ মারা হয়েছে পেট্রলবোমা মেরে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে।বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, চলমান অবরোধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের ৫৬৪টি যানবাহনে আগুন লাগানোয় আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আগুন লাগিয়ে ৬৪টি গাড়ি সম্পূর্ণভাবে পোড়ানো হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে তিন হাজার ২২৪টি গাড়ি। এবারের অবরোধে পর পর চার দফা নাশকতা চালানো হয়েছে রেলে।অবরোধ চলাকালে সহিংসতায় আহত হয়েছে ৫৫ হাজার ২০৭ জন। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আহতদের এই পরিসংখ্যান পায় যাত্রী অধিকার রক্ষায় কর্মরত এই সংস্থা। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মারা গেছে ২২২ জন যাত্রী। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ ১৯৬ জন। একই সময়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ৭৩ পরিবহন শ্রমিককে। তাদের বেশির ভাগই গাড়িচালক। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে কাতরাতে কাতরাতে মরতে হয়েছে বেশির ভাগকে। জেলায় জেলায় দগ্ধদের অনেককে ঢাকায় আনার আগেই প্রাণ হারায়।আক্রোশ গাড়িতে : বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তৈরি করা প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২২ মাসের বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় ও সেতুতে সহিংসতা চালিয়ে ২৬ হাজার ৩৭৪টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এক হাজার ১৬২টি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে আংশিক ক্ষতিসাধন করা হয়। এ ছাড়া ৭৮১টি গাড়ি সম্পূর্ণ পোড়ানো হয়। ৩০টি নাশকতার ক্ষেত্রে গাড়িসহ চালক ও চালকের সহকারীকে পুড়ে মরতে হয়েছে আগুনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে রেলে নাশকতা চালানো হয় ২১ দফায়। তিন দফা নাশকতার চেষ্টা করা হয় নৌপথে। একই সময়ের মধ্যে এসব নাশকতায় পঙ্গু হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ১৩ হাজার ২২৩ জন মানুষ।এবার ‘নরম’ অবরোধ : তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৪ দিন অবরোধ ছিল। এর বাইরে হরতাল কর্মসূচিও ছিল। ওই সময় কমপক্ষে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতদের বেশির ভাগই ছিল পরিবহন শ্রমিক। ওই বছর ২৬ নভেম্বর শুরু হওয়া প্রথম দফা অবরোধের তৃতীয় দিন রাজধানীর শাহবাগে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা ছড়িয়ে পড়ে। ১২ বছরের শিশুকেও প্রাণ দিতে হয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে।২০১৩ সালের বিএনপি জোটের অবরোধে এক দিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটে ৯টি। প্রথম দফা অবরোধের দ্বিতীয় দিন ২৭ নভেম্বর, দ্বিতীয় দফা অবরোধের চতুর্থ দিন ৩ ডিসেম্বর ও পঞ্চম দিন ৪ ডিসেম্বর ৯টি করে প্রাণ ঝরে গেছে সহিংসতার শিকার হয়ে। নৃশংস ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায়। তবে ২০১৩ সালের মধ্য ডিসেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান ও ১৯ ডিসেম্বর থেকে সেনা টহলের পর থেকে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কমতে থাকে অবরোধে সহিংসতার মাত্রা। এবার নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, চট্টগ্রামের মিরসরাই, লক্ষ্মীপুরে প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৩ সালে সাতক্ষীরায় যেমন বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারেনি- এমন অবস্থা সেখানে নেই। গত ১২ জানুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে।
false
rg
ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী মান্না দে গুরুতর অসুস্থ! রেজা ঘটক টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ায় ৮ জুন ২০১৩, শনিবার ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী মান্না দেকে ব্যাঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা বর্তমানে সংকটাপণ্ন। ৯৪ বছর বয়সী মান্না দে প্রায় ২০দিন আগে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী সুলোচনা কুমারণ স্মরণে গান রেকর্ড করার সময় অসুস্থ বোধ করেন। তখন থেকেই তিনি কল্যাণনগরে নিজের বাড়িতে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। গতকাল অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ব্যাঙ্গালুরু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯১৯ সালের ১ মে মান্না দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। বাবা পূর্ণ চন্দ্র দে ও মা মহামায়া দে। মান্না দে তাঁর ছোট কাকা সঙ্গীচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে (কে.সি দে)-এর কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি নেন এবং তিনিই মান্না দেকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টিতে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ওস্তাদ দবির খানের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। কলকাতার ইন্দু বাবু'র পাঠশালায় তার শিক্ষা জীবন শুরু। তারপর স্কটিস চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে মাধ্যমিক শেষ করে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশান শেষ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ছোট কাকার সঙ্গে বোম্বে চলে যান এবং কৃষ্ণ চন্দ্র দে;র একজন এসিট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি শচিন দেব বর্মণের এসিট্যান্ট হিসেবেও কাজ করেন। পাশাপাশি ওস্তাদ আমান আলী খান ও ওস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছে হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে তালিম নেন। ১৯৪৩ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র দে ও সুরাইয়া'র সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মান্না দে প্রথম ছায়াছবি 'তামান্না'তে গান করেন। প্রথম গানেই হিট। ১৯৫০ সালে মান্না দে সচিন দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় 'মশাল' ছবিতে একক কণ্ঠ দেন। তারপর থেকে মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ ও লতা মুঙ্গেশকারের সঙ্গে মান্না দে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্লব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সবার হৃদয়ে জায়গা করে নেন। হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, মারাঠি, মালায়ালাম, কান্নাডা, অসামী প্রভৃতি চলচ্চিত্রে মান্না দে কণ্ঠ দেন। ১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর মান্না দে কেরালার সুলোচনা কুমারণকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই মেয়ে। সুরমা দে জন্ম গ্রহন করেন ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে আর সুমিতা জন্মগ্রহন করেন ২০ জুন ১৯৫৮ সালে। ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি সুলোচনা কুমারণ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে মান্না দে অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে লাক করেন পদ্মশ্রী পদক, ২০০৫ সালে পান পদ্ম ভূষণ পদক আর ২০০৭ সালে পান দাদাভাই ফালকে পদক। সারা জীবনে মান্না দে প্রায় ৩৫০০ও বেশি গান রেকর্ড করেছেন। বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও মারাঠি, গুজরাটিসহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কল্যাণে মান্না দে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। মান্না দে'র গাওয়া 'কফি হাউজের সেই আড্ডাটা'; 'আবার হবে তো দেখা'; 'এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি'; 'তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়'; 'যদি কাগেজে লেখো নাম'; 'সে আমার ছোট বোনসহ বহু গান বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছেও অসম্ভব জনপ্রিয়। সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ২:৫২
false
ij
Chris Rea_ যার গানে একটা সময় ভীষন আচ্ছন্ন ছিলাম। Chris Rea: আসলে কবি। বিশ্বাস হয় না? Save your tears, you've got years and years. এই কথাগুলি তারই। উপরোন্ত, Chris Rea কী লিখেছেন On the Beach নামে গানটায়। পড়ে দেখুন- Between the eyes of love I call your name Behind the guarded walls I used to go Upon a summer wind there's a certain melody Takes me back to the place that I know Down on the beach The secrets of the summer I will keep The sands of time will blow a mystery (কী এর মানে?) No-one but you and I Underneath that moonlit sky Take me back to the place that I know On the beach Forever in my dreams my heart will be Hanging on to this sweet memory A day of strange desire And a night that burned like fire Take me back to the place that I know On the beach ক্রিস রিয়া যে পুরোদস্তুর কবি; তা আর বলে দেওয়ার দরকার নাই। পুরো নাম ক্রিস্টোফার অ্যান্টন রিয়া। জন্ম ৪ মার্চ। ১৯৫১; ইংল্যান্ড। মিডলবারো জায়গাটা কোথায়? সেখানে। বলাবাহুল্য গান ভালো লাগত শৈশব থেকেই। ভালো লাগত লিখতে। গানগুলি নিজেই লেখেন। ক্রিসের গানে কেমন এক করুন সুর থাকে। I told you so many years ago They're all gonna end up, end up this way কিংবা- Save your tears, you've got years and years. পশ্চিমাবিশ্বের সামাজিক নৈতিক পরিবেশ নিয়ে ভারি উদ্বিগ্ন। লিখেছেন দু পর্বের The Road to Hell এর মতন গান। Stood still on a highway I saw a woman By the side of the road With a face that I knew like my own Reflected in my window Well she walked up to my quarterlight And she bent down real slow A fearful pressure paralysed me In my shadow She said "Son, what are you doing here? My fear for you has turned me in my grave" I said "Mama, I come to the valley of the rich Myself to sell" She said "Son, this is the road to Hell" On your journey 'cross the wilderness >From the desert to the well You have strayed upon the motorway to Hell মানুষের স্বপ্নকে পিষ্ট হতে দেখেছেন রিয়া খুব কাছ থেকে। The fat man took my money, The fat man took my money বলে আর্তনাদ করেছেন 90's Blues গানে। ব্যাক্তিমানুষের করুন আর্তনাদ ফুটে উঠেছে গানটিতে। Well I look out of my window I see the morning cold and grey I look out of my window I see the morning cold and grey I told you so many years ago They're all gonna end up, end up this way Well the fat man took my money And the daughter won't give it back The fat man took my money Sons and daughters won't give it back Put my family out on the street Put my marriage on the rack Well they steal your water And if you want some you got to pay The greenies point their fingers The people know better they don't listen what they say They live in fear and frustration Oh their crappy lives why should they give a toss anyway Nineties blues Nineties blues Nineties blues কিশোর বয়েসের সুখদুঃখ নিয়ে ভারি উদ্বিগ্ন ছিলেন। লিখেছেন if you Think It's Over এর মতন অনন্য এক গান। A dying flame, you're free again Who could love and do that to you All dressed in black, he won't be coming back Save your tears, you've got years and years The pains of seventeen's Unreal they're only dreams Save your crying for the day Fool if you think it's over 'Cos you said goodbye Fool if you think it's over I'll tell you why New born eyes always cry with pain At the first look at the morning sun You're a fool if you think it's over It's just begun [ Find more Lyrics at http://www.mp3lyrics.org/CR2 ] Miss teenage dream, such a tragic scene he knocked your crown and ran away First wound of pride and how you cried and cried But save your tears you've got years and years Fool if you think it's over 'Cos you said goodbye Fool if you think it's over I'll tell you why (Fool if you think it's over) (Fool if you think it's over) I'll buy your first good wine We'll have a real good time Save your crying for the day That may not come but anyone Who had to pay would laugh at you and say Fool if you think it's over 'Cos you said goodbye Fool if you think it's over I'll tell you why if you Think It's Over গানটির ভিডিও ডাউনলোড লিঙ্ক সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৪০
false
rg
ছোটগল্প_ পাগলা বাবা !! এক.বটতলার পাগলা বাবা'র সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল বা্জুয়া বাজারে। ওপাশে পশুর নদীর উথাল পাতাল থৈ থৈ পানি, এপাশে সোনাই খালের রাস্তার মোড়ে বিশাল বটগাছ। একটু অদূরেই লঞ্চ টার্মিনাল। ওই টার্মিনালে নামার আগেই আকাশ ভেঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে হাড় কাঁপুনে অলক্ষুণে হিমেল বাতাস। বৃষ্টি বাতাস আর পশুর নদীর উজান ঠেলে চালনা থেকে বাজুয়া আসতেই সকাল গাড়িয়ে মধ্যান্থ। ওই টুকু ছোট্ট ইঞ্জিনের লঞ্চে কি আর পরাণ রাখা যায়! বুকের মধ্যে ভারী উচাটন নিয়ে দুরু-দুরু ভীরু-ভীরু চোখে তবু বড় বড় ঢেউ ফুরে লঞ্চ যখন ঢেউয়ের ডগায় ওঠে তখন কেবল এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। আর লঞ্চ যখন পাল্টা ঢেউয়ের তলানীতে হাবুডুবু খায় তখন চারপাশে শুধুই পানি আর পানি। এই বুঝি দরিয়ার যোম মরণ কামড় দেয়। আমার সঙ্গে নিতীশ ভয়ে ছিদ্র হওয়া বেলুনের মত একেবারে চুপশে গিয়ে ভারী হায় হুতোশ করছে। ভাগ্যিস ঝড় ওঠার আগেই আমাদের লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছাল। মাটির নিশানা পেয়ে আমরা ঝড়ো বৃষ্টির মধ্যেই সোনাই খালের পার ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম। সোনাই খাল পারে সারি সারি দোকান। একটা ভাতের হোটেলে আমরা ঢুকে পরলাম। ভয় পেলে কি মানুষের খুব ক্ষুধা লাগে? দোকান মালিক ক্যাশ বাক্সের সামনে বসে আছেন। তার স্ত্রী আমাদের খাবার পরিবেশন করছেন। খাবারের মেনুতে তেমন বৈচিত্র্য নেই। ফাইসা মাছ ভাজি, ভাইসা মাছের ঝোল, মুরগি, আলু ভর্তা আর ডাল। ঘরের মধ্যেই টিউবওয়েল। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে আমরা খেতে বসলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা খাবার। আমাদের খাবারের জোস দেখে দোকানি আরেকটা নতুন আইটেম বানালেন। শুটকি মাছের ভর্তা। পাঁচ ফোড়নের ডাল দিয়ে সেই ভর্তা ভারী সুস্বাদু। আমরা খাবার শেষ করে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আয়েশ করে বসলাম। ততোক্ষণে নিতীশ আবার প্রাণে ফিরে আসল। দুষ্টু চোখের রহস্য মাখিয়ে বললো, এখন একটা পান খাব। এক্কেবারে মামা বাড়ির আবদার? আশে পাশে কোথায় পানের দোকান? দোকানি বললেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী পান খাই, বসেন পান বানিয়ে দিচ্ছি। পান তামুক খেতে খেতে বিল কত জানতে চাইলে দোকানি তার স্বামীর কাছে হিসেব দিতে দিতে দু'জনে মিলে হিসেব কষে জানালেন, আশি টাকা। সেই সুযোগে দোকানিকে আমরা মাসী ডেকে বসলাম। এবার মাসী আর মেসোকে আমরা আমাদের বাজুয়ায় আসার হেতু খুলে বললাম। কাকে কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নিলাম। সোনাই খালের সাঁকো পেরিয়ে ওপারেই বাজুয়া বাজার। সেখানে বাজুয়া'র চেয়ারম্যান বাবুকে আমরা পেয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান বাবু আমাদের নিয়ে গোটা বাজুয়া বাজার ঘুরে দেখালেন। শনিবার আর মঙ্গলবার বাজুয়া বাজারে হাটের দিন। সেই হাটের দিনের বাজুয়া বাজারের চিত্র একেবারে অন্যরকম। গোটা দক্ষিণবঙ্গের সকল মানুষ সেই হাটে তখন কেনাবেচা করতে আসেন। ইতোমধ্যে আমাদের ঘিরে চেয়ারম্যান বাবু'র নের্তৃত্বে অম্বরেশ বাবু'র দোকানে বিশাল একটা জটলা পাকিয়েছে। উৎসুক সবাই আমাদের দেখছেন আর আমরা কি জানতে চাইছি তার জবাব দিচ্ছেন। এক ফাঁকে আমরা সিগারেট খাবার নাম করে বাজারের জটলা থেকে বাইরে এসে বিশাল এক বটগাছ আবিস্কার করলাম। চুপচাপ সিগারেট খাচ্ছি আর রাতে আমরা কোথাও খাকব সেই চিন্তা করছি। ঠিক ওই সময় পেছন থেকে পাগলা বাবা হাঁক ছাড়লেন। ওরে তুই কিডারে? আমার বটতলায় খাড়ায়া বিড়ি ফুকিস? এতো বড় সাহস তোর? পেছন ফিরে দেখলাম, বিশাল দেহি এক লম্বা চুলের বাউল। খালি পা খালি গা। কপালে সিঁদুর। মুখে চাপ দাড়ি। বিশাল মোঁচ ফসকে সাদা দাঁতের কিঞ্চিত দৃষ্টিত হয় বুঝিবা। এক হাতে ভিজে কাপড়। অন্য হাতে পিতলের বদনা। বদনার উপরে সিঁদুরের কৌটা। পাগলা বাবা সান্ধ্য স্নান সেরে আস্তানায় ফিরছেন। ভারী সুঠাম দেহের গড়ন তাঁর। ভারী বর্জ কণ্ঠ। ভারী রহস্যময় চোখের চাহনী। দূর আকাশের অপার নীলিমার ভারী সৌন্দর্য সেই চোখেমুখে। সেই রহস্যময়ী চোখে চোখ পড়তেই পাগলা বাবা শান্ত হলেন। ঝড় থেমে গেলে যেমন প্রকৃতি একেবারে থমকে যায় তেমনি চমকে রইলেন পাগলা বাবা। যুদ্ধ ফেরত ছেলেকে দেখলে মা যেমন ভারী রহস্যময়ী ভঙ্গিতে খুব ভালো করে ছেলেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন, তেমনি খুটিয়ে খুটিয়ে ভালো করে পাগলা বাবা আমাদের পর্যবেক্ষণ করলেন। এবার একেবারে সুমিষ্ঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কহোন আইছিস? খাইছিস কিছু? দাঁড়া একটু মুছে দি। বাদলায় সব ভিজে গেছে। নিজের পোস্তা করা লাল ইটের আসনখানি ভারী মমতা দিয়ে তিনি মুছতে লাগলেন ভিজে গামছা দিয়ে। তারপর আমাদের সঙ্গে নিজেও বসলেন। যেনো আমরা হাজার বছর ধরে তাঁর পরিচিত কোনো রত্ন বান্ধব। যেনো হাজার বছর পরে আমাদের ফের দেখা হল এক ঘোর লাগা মহাসন্ধ্যায়। যেনো এক নিমিষে পৃথিবীর সকল না বলা কথা কেবল ইসারায় বলা হয়ে গেল একটুখানি চোখাচোখিতে। তখন সূর্য ডোবার ক্ষণ। তখন গোধূলী লগ্ন। পাগলা বাবা আমাদের বসিয়ে রেখে সান্ধ্য প্রার্থণায় মগ্ন হলেন।............................................... চলবে...................
false
rn
প্রাচীন আরবের ইতিহাস প্রাচীনকালে আরবে মেয়েদের জীবিত কবর দেবার এক নিষ্ঠুর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সন্তান প্রসবকালেই মায়ের সামনেই একটি গর্ত খনন করে রাখা হতো। মেয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তখনই তাকে গর্তে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হতো । আবার কোথাও যদি মা এতে রাজী না হতো বা তার পরিবারের কেউ এতে বাধ সাধতো তাহলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপ কিছুদিন তাকে লালন পালন করতো। তারপর একদিন মরুভূমি , পাহাড় বা জংগলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কোথাও তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিতো। আমরা মাঝেমধ্যে ভুল করি এই ভেবে যে আরব ভূখন্ডে সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল ইসলামের আবির্ভাসের সময় থেকে। ইসলামের জন্মভূমি আরব বহু প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমন্বয়কেন্দ্রে পরিণত ছিল, আমরা ভুলে যাই। বণিক কাফেলার আনাগোনায় আরব উপদ্বীপ মুখরিত থেকেছে সূদূর অতীতকাল থেকে।আশ-শানফারা(৫১০খৃঃ)। প্রাচীন আরবের বেদুঈন কবিদের অন্যতম। তিনি দক্ষিণ আরবের ইয়ামেন প্রদেশের বিখ্যাত আযদ গোত্রের বনু আওয়াস ইবনে হুজর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছাবেত ইবনে আউস আল আয়াদী। কিন্তু তাঁর কৃষ্ণ চর্ম, পুরু ঠোঁট, আর বেশী বাচালতার জন্য তিনি শানফারা নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। শানফারার সেরা কাব্যকীর্তি তাঁর ‘লামিয়াতুল আরব’। এটি আরবী কবিতাবলীর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ঐ সময় মক্কা, মদিনা তথা আরব এলাকার ধর্ম ছিল আদিম প্রকৃতির জড় উপাসনাকেন্দ্রিক। আরব অধিবাসীরা মনে করতো, মরুভূমির বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দেব-দেবী অধিষ্ঠিত। ইসলাম প্রচলনের আগে আরবের অধিকাংশ মানুষই নানাধর্মে বিশ্বাসী ছিল। কোনো কোনো মরু দেবতাকে তারা ‘জিন’ বলতো। মরু এলাকায় চন্দ্রের পূজা এবং উর্বর এলাকায় সূর্যের উপাসনা করা হতো। হিজায অঞ্চলের প্রধান দেবতা ‘উজ্জা’, ‘লাত’ ও ‘মনাহ’-কে আল্লাহর কন্যা বলে মনে করা হতো। কুরাইশদের প্রধান দেবতা ছিল ‘উজজা’। প্রাক ইসলাম যুগে আরব বণিকদের উর্টের কাফেলা মরুসীমানা অতিক্রম না করলেও, ইসলামের অভ্যুদয়ের পর সমুদ্রের হাতছানি তারা উপেক্ষা করেননি। বাণিজ্যের তরী ভাসিয়ে তারা পাড়ি দিয়েছেন সাগর-মহাসাগর। একইসঙ্গে তারা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে নিয়ে গেছেন ইসলামের শাশ্বত বাণী। প্রাচীন যুগের আরবী কবিদের মধ্যে যে সমস্ত মনিষী রাজ-অনুগ্রহ লাভ করার পর রাজ-রোষের শিকার হন কবি মুতালাম্মিস তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। তিনি আরবের বাহরায়েন প্রদেশের বিখ্যাত দ্বাবী‘আ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম জারির ইবনে আবদুল মাসীহ। কিন্তু মুতালাম্মিস তাঁর কাব্যিক নাম। নৃপতি আমর বিন হিন্দ তাঁকে সেরা কবির মর্যাদা দান করেছিলেন এবং তাঁর ভাগ্না ত্বারাফাকেও তাঁর সহকারী নিযুক্ত করেছিলেন।প্রাচীন আরব বলতে মেসোপটেমিয়ার পশ্চিম এবং দক্ষিণ অঞ্চলকে বুঝায়। আরবরা, বিশেষতঃ মক্কাবাসীরা মদ্যপান, জুয়া ও সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিল। যে সকল দাসী-রমনী নৃত্যগীত করত তাদেরকে কীয়ান বলা হত। তারা ছিল চরম নীতিহীন। তথাপি তারা সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত ছিল এবং বড় বড় দলপতিরা তাদের প্রতি প্রণয় নিবেদন করত। বহুবিবাহ অবাধে অনুশীলিত হত। ৯৬৬ খৃঃ থেকে ১৯১৬ খৃঃ পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে মক্কা শরীফ ও মদিনা উপ শরিফের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর আল হেজাজে আবার নিজদের ২য় রাষ্ট্র কায়েম হয়। পরে আব্দুল আজিজ আল সৌদি নামক এক ব্যক্তি জজিরাতুল হেজাজ এবং জজিরাতুল নজদকে এক করে ১৯৩২ খৃঃ আজকের এই সৌদি আরব রাষ্ট্র গঠন করেন।প্রাচীন কাল থেকে জজিরাতুল আরব জজিরাতুল আল হেজাজ, জজিরাতুল ইয়েমেন, জজিরাতুল নজফ নামক বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন নগরের মধ্যে হেজাজে জেদ্দা, মক্কা, মদিনা, ইয়েমেনে সানা, নজফে রিয়াদ প্রভৃতি ছিল। সে সময় যেমন মক্কাকে বাক্কা মদিনাকেও ইয়াতরিব নামে পরিচিত ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে মক্কাকে মক্কা আল মোক্কারম এবং ইয়াতরিবকে মদিনা-তুন -নবী বা মদিনা আল মনওয়ারা বলে পরিচিতি লাভ করে। মদিনা বলতে যে কোন শহরকে বুঝা তা আরবরা জানে কিন্তু আমরা যারা নন আরব তারা কিন্তু মদিনা বলতে মদিনা তুন নবীকে বুঝে থাকেন। এটি কিন্তু সঠিক নয়।মক্কা বাণিজ্যিক রাজপথে অধিষ্ঠিত হওয়ায় প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে সম্পদ ও সংস্কৃতি সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিল। অবস্থানের অপরিহার্যতার ফলে হিজাজের আরবরা বিশ্বের জাতি সমূহের পরিবাহক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
false
mk
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কুড়িল ফ্লাইওভার নতুন সংযোজন গত ৯ আগস্ট পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাত্র ৫ দিন আগে চালু হওয়া কুড়িল ফ্লাইওভার রাজধানীবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ঈদ উৎসবের সময় তো বটেই স্বাভাবিক সময়েও এয়ারপোর্ট রোডের কাওলা থেকে খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, কুড়িল, কাজীবাড়ী হয়ে বসুন্ধরা গেট পর্যন্ত এক অসহনীয় যানজট ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এখানকার বিশ্বরোড রেলক্রসিংটি পার হতে কমপক্ষে ২০ মিনিট, কোনো কোনো সময় ঘণ্টাখানেকও লেগে যেত। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগেও খিলক্ষেত থেকে বিশ্বরোড, এরপর রেলক্রসিং পার হয়ে বসুন্ধরা পর্যন্ত যেতে গড়ে ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে। ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িল ফ্লাইওভারটি উদ্বোধনের পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে ওই দিনের অফিস ফেরত যাত্রীরা রীতিমতো অবাকই হয়েছিলেন। ৪ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে যানজট সেই যে নিষ্ক্রান্ত হয়, তা বিদ্যমান থাকে ১৮ আগস্টেও। সড়ক ব্যবস্থাপনাতে কোনো গলদ দেখা না দিলে এই এলাকা থেকে যে যানজট বিদায় নিয়েছে তা অর্ধ মাসের অভিজ্ঞতায় বেশ আস্থার সঙ্গেই বলে দেওয়া যায়। পাবলিক বাসে চড়ে কিম্বা পাজেরোতে চড়ে সাই-সাই করে এ এলাকা পাড়ি দেওয়ার সময় নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষ এবং কাজের তাগিদে শহরমুখো মানুষের অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা যায়, ‘ঈদ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এর চেয়ে ভালো উপহার আর হয় না।’রাজধানীতে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর থেকেই মানুষ এ ধরনের মন্তব্য করছে। গত ৪ আগস্ট রোববার ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ফ্লাইওভারটি উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী সাধারণ নির্বাচনে সতর্কতার সঙ্গে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, উন্নয়ন কাজ সম্পূর্ণ করা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। প্রধানমন্ত্রী আগামী সংসদ নির্বাচনে জনগণ যাকে ভোট দেবে, তাকেই মেনে নেবেন উল্লেখ করে বলেন, তবে ভোট একটি পবিত্র আমানত। এটি যেন অপাঙতেয়, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের না দেওয়া হয়। তাহলে ভোটের খেয়ানত করা হবে।কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িতদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একাজে দুর্নীতি থাকলে মাত্র ৩৮ মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ হতো না। এতো দ্রুত কাজ শেষ হওয়ার কারণ এখানে দুর্নীতি ছিল না, দেশপ্রেম ছিল, ছিল দায়িত্ববোধ।ফ্লাইওভার উদ্বোধনকালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের দুর্নীতির কারণেই দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে গিয়েছিল, দেশ পিছিয়ে গিয়েছিল। দেশ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।জানা যায়, রাজধানীর বড় একটি অংশ, কুড়িল লেবেল ক্রসিং ও আশেপাশের এলাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে এই ফ্লাইওভার। এটি ব্যবহার করে উত্তরা ও বনানী থেকে সহজেই পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্প ও প্রগতি সরণি হয়ে রামপুরা হয়ে মালিবাগের দিকে যাওয়া যাবে। এসব এলাকা থেকে বিমানবন্দর, বনানী ও মিরপুরেও সহজে যাতায়াত করা যাবে। বিমানবন্দর সড়ক ঘেষে ফ্লাইওভারটি তৈরি হওয়ায় সন্নিহিত এলাকার সৌন্দর্যও অনেকাংশে বেড়েছে বলে মানুষের অভিমত। তবে ফ্লাইওভারকে ঘিরে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা, লেক ও সবুজায়ন প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে এ এলাকাটি হাতিরঝিল প্রকল্পের মতো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠবে বলে অনেকের মন্তব্য।কুড়িল ফ্লাইওভার জোয়ার সাহারা মৌজার কুড়িল ইন্টার সেকশন থেকে শুরু হয়ে পূর্বাচল সড়কে গিয়ে শেষ হয়েছে। ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ফ্লাইওভারে লুপ আছে ৪টি, পাইল ২৯৪টি, পিয়ার ৬৯টি, পিসি গার্ডার ১০১টি, র‌্যাম্প ১০টি, ফুটওভার ব্রিজ ২টি, অভ্যন্তরীণ রাস্তা আছে ১ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার। ফ্লাইওভারটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। এটির উচ্চতা ৪৭ দশমিক ৫৭ ফুট, প্রস্থ ৩০ দশমিক ১৮ ফুট। ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করেছে প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড। প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪৭ কোটি টাকায় রেল ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফ্লাইওভারের ৪টি লুপ দিয়ে বনানী, কুড়িল, খিলক্ষেত ও পূর্বাচল প্রান্ত দিয়ে ওঠানামা করা যাবে। এটি সম্পূর্ণ টোল ফ্রি। ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে তিন প্রান্তে তিনটি সংযোগ সড়ক। ফ্লাইওভারের পূর্ব দিকে ২০ হাজার ৮০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি লেক তৈরি করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। রাজউকের নিজস্ব অর্থায়নে ফ্লাইওভার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা রাজউককে এ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করেছেন। ২০১০ সালের ২ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন আর এটির নির্মাণ কাজ শেষে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট।
false
mk
পাকিস্তান বাংলাদেশের বৈরি কেন_ পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের বিরোধিতা তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনীতির মেরুকরণে মূল ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্র রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারত ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকে এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং এই বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পর্কে পাকিস্তান পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জনগণ এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তানের নগ্ন হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য করছে। সর্বশেষ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার প্রেক্ষিতে তাকে নিশান-ই-পাকিস্তান পদকে ভূষিত করে দুই দেশের সম্পর্ককে বিঘি্নত করার পদক্ষেপ নেয়া হলো! বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ পাকিস্তানের সরকারের গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এ কারণে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখাটিও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে!ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে সৃষ্ট 'পাকিস্তান' সমগ্র বিশ্বের জন্য জঙ্গিবাদ উৎপাদন ও রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে কুখ্যাত। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা পাকিস্তানে এত ব্যাপক বিস্তৃত লক্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে যে পাকিস্তান বলতেই এখন একটি মূর্তিমান আতঙ্ক বোঝায়। অথচ পাকিস্তানের কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সংখ্যালঘুদের দাবির চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গণ্য হতেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, এমনকি তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছিলেন। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, অসাম্প্রদায়িক জিন্না, মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য 'দ্বিজাতি তত্ত্বের' পক্ষে কথা বলা শুরু করেছিলেন। এভাবে তার সহ-ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি দেখানোর প্রয়োজনে জিন্নাহ্ 'সাম্প্রদায়িক' মতাদর্শের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেন। জিন্নাহ্ সম্পর্কে জসওয়ান্ত সিংয়ের একটি পরিচিত বই হচ্ছে বিগত এক হাজার বছরের কাহিনীর কোনো পর্যায়ে ভারতীয় মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন? প্রশ্নটি স্পষ্টতই আলঙ্কারিক। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা কখনই সংখ্যাগত দিক দিয়ে মেজরিটি ছিলেন না।এর পরে এই বইতে আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, তা হলো 'মুঘল শাসন আমলে কি মুসলমানরা নিজেদের সংখ্যালঘু বিবেচনা করতেন,একশ বছরেরও বেশিকাল ধরে নির্জীব থাকার পরে চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৮৫৭ সালে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের নিচে কবরস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত?... ব্রিটিশ যুগে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ১১ ভাগ ছিলেন মুসলমান, আর হিন্দু ছিলেন শতকরা ৮৪ ভাগ। নিজাম-উল মূলক কর্তৃক শাসিত হওয়ার কালে হায়দরাবাদের মুসলমানরা কি নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করতেন? উত্তর হচ্ছে, 'না'। এভাবে প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে তারপর জসওয়ান্ত সিং সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা দিয়েছেন। বলেছেন, ' তাহলে মাইনরিটি কোনো সংখ্যা তাত্তি্বক ফল নয়, এটি ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত একটি ব্যাপার (সংজ্ঞা)। রাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিমরা যতক্ষণ সম্পৃক্ত ছিলেন, ততক্ষণ তারা অর্থনৈতিক মুনাফা এবং আমলা, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর চাকরি এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষিত হওয়া সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন, এখানে জনমিতিক সংখ্যা অপ্রাসঙ্গিক ছিল। (পৃ.৪৮৯)কিন্তু ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের পর থেকে 'মাইনরিটির' ধারণা পরিবর্তিত হওয়া শুরু করে। সম্প্রতি 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' সম্পর্কে আফগান-পাকিস্তানবিষয়ক স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক নাদিম আলিজাইয়ের পর্যবেক্ষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আলিজাই বলছেন, 'কোথা থেকে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব হলো যে হিন্দু এবং মুসলিমরা দুটি আলাদা জাতি! যখন মুসলমানরা ভারত শাসন করছিল তখন কেন এটি আসে নাই? তার মতে এটি একটি ভিত্তিহীন তত্ত্ব! এটি তাদের জন্যই করা হয়েছে যারা 'পাকিস্তান'-এর জন্য একটি ভিত্তি খুঁজছিলেন।' তিনি বলছেন, 'কোনো দিক দিয়েই পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র নয়। এমনকি মুসলিম পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন।' শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয় তারপর থেকে 'ক্ষমতা' ও 'সংখ্যা' উভয় দিক দিয়ে গরিষ্ঠতার কারণে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের মনমানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা মনে করতে থাকে যে, পাকিস্তানের মধ্যে যারা সংখ্যাগত দিক দিয়ে 'মাইনরিটি' তাদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা হচ্ছে তাদের (মেজরিটির) খেয়াল-খুশির ব্যাপার। মাইনরিটির জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতাসহ ইহজাগতিক ও পারলৌকিক সবকিছু ধর্মীয় পরিচিতির বিচার-বিবেচনা করার কারণে শেষ পর্যন্ত 'পাকিস্তান', অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। 'পাকিস্তান'-এর এই পরিস্থিতি এখনো বজায় আছে। সেটি এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। তবে ব্যর্থ রাষ্ট্রই শুধু 'পাকিস্তান'-এর জন্য সর্বশেষ তকমা নয়! এই রাষ্ট্রটির জন্য আরো কিছু অপেক্ষা করছে?আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যম 'খামা ডট কম'-এ 'আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের গণতন্ত্র' সম্পর্কে হুমা নাসেরির একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। এখানে নাসেরি বলছেন পাকিস্তানের (এবং আফগানিস্তানের) সম্পূর্ণ এলাকা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার শাসন করে না। উভয় দেশের অনেক এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং (এগুলো) মিলিশিয়া বা অরাষ্ট্রীয় শক্তি শাসন করছে যা প্রকারান্তরে ভঙ্গুর গণতন্ত্রের জন্য পুনরায় হুমকির সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আসলে যা করা হচ্ছে তাতে 'অরাষ্ট্রীয়' শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে। যদিও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীগুলো ২০১৪ সালের ১৫ জুন থেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে 'অপারেশন জার্ব-ই-আজব' পরিচালনা করছে। এটি একটি বিতর্কিত অপারেশন এবং ফলাফল বলতে গেলে 'শূন্য'। পাকিস্তানকে না জানিয়ে সে দেশের জঙ্গি নির্মূলের নামে মার্কিন বাহিনীর হামলা করতে দেখা যাচ্ছে। কারণ মার্কিন সরকারের অভিমত হচ্ছে জঙ্গিদের ওপর হামলার খবর পাকিস্তানকে জানানো হলে সে খবর অতিদ্রুত জঙ্গিদের কাছে চলে যায়। অতএব শেষ পর্যন্ত তা সফল হয় না। তাই পাকিস্তানকে না জানিয়েই মার্কিন হামলা হচ্ছে পাকিস্তানে। সংবাদমাধ্যম খবর দিচ্ছে ওবামা সরকারের আমলে পাকিস্তানের ওপর এ পর্যন্ত প্রায় ৬৩১ বার মার্কিন ড্রোন হামলা করা হয়েছে। দৃশ্যত পাকিস্তান মানেই হচ্ছে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র! পাকিস্তানের ডেইলি টাইমসে ২ মে, ইয়াসীর লতিফ হামদানির একটি লেখার শিরোনাম হচ্ছে, এই লেখাটিতে পাকিস্তানি নাগরিক হামদানি তুরস্ককে আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের মতো ভুল না করার জন্য। তুরস্কের প্রতি এই আহ্বান জানানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে হামদানি বলছেন, পাকিস্তানের অনুসৃত নীতির ফলে 'সাংবিধানিকভাবেই বিভক্তিবাদকে বৈধতা দেয়া হয়েছে' আফগানিস্তানের একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য এবং একজন বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক আব্দুর রশিদ ওয়াজিরি বলছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উপমহাদেশে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বা (এসনকি) খ্রিস্টীয় মতবাদের প্রসার বা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কোনো লাভজনক কিছু করার ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টিকে একটি নাটকীয় ঘটনা বলছেন। ওয়াজিরি বলছেন, পাকিস্তানের সৃষ্টি এই দিক দিয়ে নাটকীয় যে, এটির না আছে কোনো ভৌগোলিক কাঠামো না আছে যথাযথ কোনো মতাদর্শগত ভিত্তি। এটি বলা হয়ে থাকে যে পাকিস্তান এবং ইসরাইল ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। তবে এই দুটি রাষ্ট্রই পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষা করছে। অন্যদিকে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষা করছে। এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, শুধু মতাদর্শগুলোর প্রকৃতি ছাড়া। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করতেন না। শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জিন্না/পাকিস্তান নতুন ভাবনা' শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চে দিলি্লতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে 'জিন্না তার কুশলী আইনজীবীর যাবতীয় কলা প্রয়োগ করে ব্যাকুল' স্বরে বলেছিলেন, 'সংখ্যালঘুরা সর্বদা সংখ্যাগুরুদের আতঙ্কে দিনযাপন করে। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা তার মতে সচরাচর নিপীড়ক ও অত্যাচারী হয়। সুতরাং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাবি করার অধিকার সর্বদাই আছে।' এরপর তিনি বললেন, 'আমাদের সম্মিলিতভাবে থাকতে হবে, মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে যে যে বিষয়েই মতভেদ থাকুক না কেন, আমরা যেন তার অধিকন্তু আর পারস্পরিক দ্বেষ সৃষ্টি না করি। যদি আমরা সহমত হতে না পারি, আমরা যেন ভিন্নমত পোষণ করার ব্যাপারে সহমত হতে পারি এবং যেন বন্ধু হিসেবে এখান থেকে যেতে পারি। আমার কথা বিশ্বাস করুন যে হিন্দু ও মুসলমানরা মিলিত হতে না পারলে ভারতবর্ষের অগ্রগতি হবে না। তাই একটা আপস নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে কোনোরকম যুক্তি-তর্ক, দর্শন অথবা বাদ-বিবাদ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রত্যক্ষ করার চেয়ে আর কিছু আমাকে সুখী করতে পারবে না।' (পৃ.৫৫) বলা বাহুল্য, দিলি্লর সেই সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে মি. বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তুলে ধরেছেন। বলছেন, 'ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী জিন্নার জনৈক পার্সি সুহৃদ পরদিবস যখন রেলস্টেশনে জিন্নাকে দিলি্লতে রওনা করে দিতে গেলেন তখন তার হাত ধরে সজলচক্ষে জিন্না বললেন, 'জামসেদ, এবার আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল।' প্রকাশ্যে জিন্নার চোখে জল আসার যে বিরলসংখ্যক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় এ তার অন্যতম।' (পৃ.৫৬) এর পরের ঘটনাপ্রবাহ জিন্নাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শের অর্থাৎ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক বা অনুসারী হিসেবে উপস্থাপিত করে। জিন্না কী হতে বা করতে চেয়েছিলেন, এর চেয়ে তার সৃষ্টি পাকিস্তান বিশ্বে কী হিসেবে পরিচিত তাই এখন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকবলিত বিশ্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সমসাময়িক বিশ্বের উপলব্ধি হচ্ছে, 'জিন্না-সৃষ্ট পাকিস্তান সমগ্র বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ উৎপাদন ও রপ্তানি কেন্দ্র।'সাম্প্রতিককালে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোয় বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরের বিপরীতে পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর। প্রাথমিক স্তরে ভর্তির অনুপাত বাংলাদেশে ১১২%, পাকিস্তানে এই অনুপাত ৯৪%। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের 'রোল মডেল', অন্যদিকে পাকিস্তান এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের যে দুটি রাষ্ট্রে পোলিও আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে 'পাকিস্তান' অন্যটি হচ্ছে 'আফগানিস্তান'। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পোলিও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানে আছে 'পাকিস্তানে'। আবার 'সামাজিক ন্যায় বিচার' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে আছে। অন্যান্য কারণও থাকতে পারে, তবে, মূলত এসব কারণেই বাংলাদশের প্রতি পাকিস্তান বৈরী মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু এসব হচ্ছে 'সরকারের বা শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতার বিষয়' এসব নিয়ে কথা বললে তো পাকিস্তানের নিজেদেরই দুর্বলতা প্রকাশ পায়! অতএব, ধর্মের দোহাই দিয়ে যে মিথ্যা অপপ্রচার পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময়েও করেছে, এখনো তাই প্রচার করে এবং তাদের বাঙালি দোসরদের দিয়ে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চাইছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকলে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ! ড. অরুণ কুমার গোস্বামী:চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৪৫
false
fe
সরকারের মেয়াদ ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সরকারের মেয়াদ ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাফকির ইলিয়াস-----------------------------------না- মধ্যবর্তী কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। বর্তমান সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদ পার করেই নির্বাচন দেবে। সেই হিসেবে ২০১৯ সালে নির্বাচন হবে। কথাটি নিউ ইয়র্কে আবারও জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এমন খবর যমুনার জলে ভেসে এসেছে নাকি যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হচ্ছে! প্রধানমন্ত্রীর এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফর কিছুটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তিনি ব্যস্ত আছেন নানা কারণে। তিনি এ সফরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হাই প্রোফাইলের সাথে মতবিনিময় করেছেন। এর সবগুলোই ইতিবাচক দিক। এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবারও বেশ কিছু দরকারি কথা বলেছেন।তিনি বলেছেন- উন্নয়নের রাজনীতির ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই বিএনপির। তারা অগণতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতায় এসেছিলো। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দপ্তরে ভয়েস অফ আমেরিকাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্থান করে দেওয়া হচ্ছে না এ অভিযোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন চ্যানেলগুলোতে অহরহ সরকারের সমালোচনা চলছে। মিটিং-মিছিল, সভা সমাবেশও হচ্ছে অতএব এ অভিযোগ ঠিক নয় যে বিরোধীদল কোনো রাজনৈতিক স্থান পাচ্ছে না। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক উন্নয়নে তার সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন।মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা হ্রাস, অবশিষ্ট দরিদ্রের জন্য তার সরকারের সহায়তা প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধিসহ মানবোন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসামূলক বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, এ অর্জনের ব্যাপারে তাকে বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন তবে সব চ্যালেঞ্জকেই মোকাবেলা করেছেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। এ সময় সন্ত্রাস ও উগ্রবাদী সহিংসতা দমনে তার সরকারের নেওয়া জিরো টলারেন্স নীতি বহাল থাকবে এবং এ ব্যাপারেও তিনি জনগণের সম্পৃক্ততায় আশাবাদী মনোভাব পোষণ করার কথা উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বেশ কিছু সুস্পষ্ট কথা বলেছেন এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়।ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কথা তো কারো কাছ থেকে আমরা কেড়ে নিচ্ছি না। যার যার ইচ্ছামতো কথা বলেই যাচ্ছে। তারা মিটিং করছে, র‌্যালি করছে, সবই তারা করছে।’ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় যারা এ যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিলো, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।তিনি বলেন, এখনো যারা হতদরিদ্র বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বা যারা একটু কষ্টে আছে, তাদের কষ্ট দূর করার জন্য আমরা কতগুলি পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন ইতোমধ্যে ১০ টাকায় একজন মানুষ যেন ৩০ কেজি করে চাল কিনতে পারে, তার ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। ৫০ লক্ষ মানুষ এ সুযোগটা পাবে।ভয়েস অব আমেরিকা তার কাছে জানতে চেয়েছিলো, এই যে বিপুল সাফল্য, বিশেষ করে মানবোন্নয়নের ক্ষেত্রে আপনার সরকারের তুলনাহীন সাফল্য, এর পেছনে কী রহস্য কাজ করেছে? এতদিন হয়নি, এখন কেন হচ্ছে?এর উত্তরে তিনি জবাব দেন- ‘কেন হচ্ছে! আমি একটি কথা আপনাদের মনে করাতে চাই, যে দল একটা দেশের জন্য, জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে, বিপ্লব করে এবং যুদ্ধ করে বিজয় এনে দেয়, সেই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখনই কিন্তু দেশের উন্নতি হয়। কাজেই আমরা যেটা করি, আমাদের একটা অন্তরের টান থেকে কাজ করি। এখানে আর কোনো ম্যাজিক না। ম্যাজিক একটাই, আমরা জনগণের কল্যাণে দেশের স্বাধীনতা এনেছি, জনগণের কল্যাণ করাটাই আমরা মনে করি আমাদের কর্তব্য।’প্রধানমন্ত্রী তার সম্মানে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় বলেছেন- দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ সরকারের প্রশাসনে এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালিরা উচ্চপদে আসীন হতে পেরেছেন।প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত সাড়ে সাত বছরে আমাদের সরকার দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, গ্রামীণ উন্নয়ন, পররাষ্ট্র নীতি ও কৌশলসহ প্রতিটি সেক্টরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাপক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করেছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ০৫ শতাংশে উন্নীত এবং দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ৫ কোটি মানুষ নিম্ন আয়ের স্তর থেকে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রশাসন এবং শিক্ষা-দীক্ষার সকল ক্ষেত্রে বাঙালিদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘এ বৈষম্য দূর করে অধিকার আদায়ে জাতির পিতা ২৩টি বছর সংগ্রাম করেন, আন্দোলন করেন।’বঙ্গবন্ধুকে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসলেও দিনকতক বাদেই তাকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে আসল ষড়যন্ত্রকারী জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান সেনা আইন ভঙ্গ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে এই খুনিদেরকে পুরস্কৃত করে। যে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল, মার্শাল ল’ অর্ডিনেন্স দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে এই জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের ভোটের অধিকার ছিলো না। মার্শাল ল’ অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ সংশোধন করে জিয়া তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে রাজনীতি ও দল করার সুযোগ দিয়েছে।শেখ হাসিনা যে কথাগুলো বলছেন- তা নতুন প্রজন্মের জানা ও বোঝা দরকার। কারণ একটি জাতি তার অতীত ইতিহাস না জানলে, সামনে এগোতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে উন্নয়নের কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একটি সৃজনশীল সরকারের দীর্ঘ মেয়াদ দরকার। জামায়াত-বিএনপির সরকার, বাংলাদেশে একটি চরম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। তাদের ‘হাওয়া ভবন’ নিয়ন্ত্রণ করতো সবকিছু। এ গুলো দেশবাসীর অজানা নয়। আর অজানা নয় বলেই মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি সরকারের প্রতীক্ষায় ছিলো।বিশ্বরাজনীতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইলেকশনে অংশ নেওয়া-না নেওয়াও একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিএনপি কি তাদের সেই অধিকার খাটাচ্ছে? তারা তো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তাদের জনপ্রিয়তা নিজেদের অজানা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিএনপি ২০১৪ সালে প্রায় তিনমাস এ দেশে জ্বালাও পোড়াও করেছিলো কেন?২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না এসে বিএনপির একটি মহাভুল করেছিলো। এ ভুলের মাশুল দিতেই দলটি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালাচ্ছে। তাদের মূল ব্যর্থতার জন্য মৌলবাদী-জঙ্গিদের সমর্থনই অন্যতম কারণ।একটা কথা মনে রাখা দরকার, বিদেশের কোনো শক্তি বাংলাদেশের সরকার বদলে দেবে না। দেওয়ার সময়ও এখন নয়। বিশ্ব এখন গ্লোবাল পলিটিক্যাল ডেভেলপমেন্টকে বিবেচনা করছে খুব সূক্ষ্মভাবে। তাই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এখন প্রায় অচল।সেই বিবেচনায়, সরকারকে তাদের মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দিতে হবে। গণতন্ত্র কিংবা ভোটাধিকারের নামে কোনো জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া যায় না। দেওয়া উচিতও নয়।শেখ হাসিনার সরকার, বিদেশে বাংলাদেশকে উচ্চাসন দিয়েছে। এ ধারা সমুন্নত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে- গণতন্ত্র মানেই কোনো কালো শক্তির হাতে দেশকে তুলে দেওয়া নয়। -------------------------------------------------------------------------দৈনিক খোলাকাগজ ॥ ঢাকা ॥ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ শুক্রবার সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:২০
false
rg
আমি তো ভাবী, দেখি শালা কী করে_ রেজা ঘটক আমাদের সবার প্রিয় আক্কেল মিঞা একটা ভীতুর ডিম। বিশেষ করে মেয়েমানুষকে খুব ভয় পায় আক্কেল মিঞা। তো এই নিয়ে গ্রামে নানা জনের মুখে নানান টাইপের ক্যাচাল। শেষ পর্যন্ত সবার ক্যাচালের একটা জবাব দিতে একদিন আক্কেল মিঞা বিয়া করলেন। কিন্তু বউয়ের ভয়ে কিচ্ছু বলার সাহস দেখান না। তো আক্কেল মিঞা বিয়েতে কিছু উপহারসামগ্রী পেয়েছেন। তাই নিয়ে তার শুরু হল নয়া চিন্তা। কখন চোর আসে, সেই ভয়। সেদিন ছিল অমাবশ্যার রাত। আক্কেল মিঞা সন্ধ্যা না হতেই কপাটে খিল দিয়ে নতুন বউয়ের আঁচলের নিচে ঢুকলেন। ঘণ্টাখানেক পর আক্কেল মিঞার বাড়িতে চোরের উৎপাত। আক্কেল মিঞার বেগম বলছেন- দেখোতা কিসের শব্দ বাইরে? আক্কেল মিঞা চুপ। বিবি সাহেবা আবার বললেন- মনে হয় চোর আইছে? আক্কেল মিঞার জবাব, আসুক; চুপ করে থাকো। চোর মাটির ঘরে শিং কাটছে। বউ বলছেন- মনে হয় শিং কাটছে? আক্কেল মিঞা ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে থাকো; দেখি শালা কী করে? চোর শিং পথে ঘরে ঢুকলো। বউ বলছেন, চোর ঘরে ঢুকছে। আক্কেল মিঞা আরো ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ থাকো; দেখি শালা কী করে? স্বামী-স্ত্রী ঘুমিয়ে নাকি সজাগ তা পরখ করার জন্যে চোর মশারী উচিয়ে নাকের কাছে হাত রেখে নানাভাবে টেস্ট করছেন। চোর বুঝলো, হু, ভালো করে ঘুমাও তোমরা। এইবার যা নেবার নিয়ে যাই। মশারী ছেড়ে চোর চুরীতে মনযোগী হলেন। বিবি সাহেবা কী একটু ভয় পেলেন! আক্কেল মিঞা ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ থাকো; দেখি শালা কী করে? চোর একে একে সব একটা পাটের বস্তায় ঢুকালেন। বিবি সাহেবা অন্ধকারে চোখ বড় বড় করেই কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন। আক্কেল মিঞা বউয়ের মুখ চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন, দেখি শালা কী করে? এবার চোর বীরের মত শব্দ করে দরজা খুলে বস্তা ঘাড়ে ফেলে বাইরে রওনা দিলেন। বউ চিৎকার করে বলতে চাইলেন, সব নিয়ে যাচ্ছে! আক্কেল মিঞা বউয়ের মুখ চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ, একদম চুপ। দেখি শালা কী করে? চোর যখন আক্কেল মিঞার উঠোন পেড়িয়ে বাগানে ঢুকে গেল, তখন বিবি সাহেবা এক ঝটকায় খাট থেকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, চোর, চোর... আক্কেল মিঞা আস্তে করে বললেন, দেখি শালা কী করে? .... ..... .... .... .... .... .... খুব সকাল। সারা গ্রামে রাষ্ট্র হল আক্কেল মিঞার ঘর শিং কেটে চুরি হয়েছে। গ্রামের মানুষ দল বেধে আক্কেল মিঞার বাড়িতে হাজির। অতি উৎসাহী কেউ কেউ জানতে চাইলেন, কী হয়েছিল? কীভাবে হল চুরী? আক্কেল মিঞা আমতা আমতা করে বিষদ বর্ণনা করলেন, আর শেষে বললেন, আমি তো ভাবী, দেখি শালা কী করে? বাড়ি ভরতি মানুষের মধ্যে আক্কেল মিঞার বউ দরাজ গলায় বললেন, তুমি বসে ভাবতে থাকো, এই আমি চললাম... সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৪২
false
hm
সৈকতে সঞ্চরণ আবারও প্রাচীন পোস্ট। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা কয়েকজন পায়ে হেঁটে পার হয়েছিলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত। তখন রেওয়াজ ছিলো কোথাও এক্সকারশনে গেলে ফিরে এসে ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের জন্যে মুখরোচক একটি আর্টিকেল লেখার। এই আর্টিকেল পড়ে সেই অভিযানে অংশগ্রহণ করতে না পারা সদস্যরা বেজায় ক্ষেপেছিলেন, পারলে আমাদের ধরে পেটান আর কি। পরে অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, সেই আনন্দময় যাত্রার পুনরাবৃত্তি আর করা হয়নি আমাদের। এ লেখা উৎসর্গ করলাম এক্সপ্লোরারস ক্লাবের সেইসব সদস্যদের উদ্দেশ্যে, যারা সেবার আমাদের সঙ্গী হতে পারেননি। ১. কেওকারাডং থেকে ফিরে এসে EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর সদস্যদের নানা বিচিত্র উপসর্গ দেখা দিলো। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খামোকাই শহরময় হেঁটে বেড়ান, কেউ উঁচু বিল্ডিং দেখলে সেটার পাইপ বেয়ে ওঠা যায় না সেটা নিয়ে গুরুতর চিন্তাভাবনা শুরু করে দেন --- সবমিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তাই এইসব বদ লক্ষণ ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্যে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে আরেকটা অভিযানের আয়োজন করার উদ্যোগ নিতেই হলো। এবার আর উল্লম্ব নয়, সমান্তরাল। ক্লাবের সাপ্তাহিক আড্ডায় এ ব্যাপারে কী করা যায়, তা নিয়ে একদফা তর্কবিতর্ক হয়ে যাবার পর হঠাৎ এক বিকেলে উপস্থিত হলেন ওয়াহেদ ভাই, একা একা ট্রেকিং করা যাঁর বদস্বভাব। তাঁর বিস্তারিত পরিচয় গোপন রেখে বলছি, তিনিই মিলন ভাই আর হিমুর মাথায় নতুন খেয়াল চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, ক্লাবের সদস্যরা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেকিং করতে যাবেন। ECB সদস্যদের বয়স আট থেকে আটাশির মধ্যে, স্কুলের ছাত্র থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, সবাই আছেন। হিসেব কষার পর পরিস্থিতি দাঁড়ালো এমন, ঈদের রাতে ঢাকা ছাড়লে সব মিলিয়ে দিন পাঁচেক ছুটি সবাই ম্যানেজ করতে পারবেন। এ নিয়েও বিস্তর তর্কবিতর্ক হলো পরবর্তী মিটিঙে। ঈদের রাতের পক্ষেই বেশির ভাগ সদস্য ভোট দিলেন, কারণ এক্ষেত্রে টিকেটের জন্যে তিন মাইল লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে চুলোচুলি করতে হবে না, আর সবাই অর্ধেকটা ঈদ ঢাকায় কাটিয়ে যেতে পারবেন। সভা শেষে জানা গেলো, চৌদ্দ জনের মতো যাবেন এই যাত্রায়। বাকিরা হয় ছুটি ম্যানেজ করতে পারছেন না (যেমন উচ্ছল), অথবা নতুন বিয়ে করেছেন, শ্বশুরবাড়ির অনুমতি যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব (যেমন শিবলি), অথবা কোন কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন (যেমন শান্ত)। কাজেই এঁদেরকে তালাক দিয়ে বাকিরা গাঁটরিবোঁচকা বাঁধা শুরু করলেন। ঈদের তারিখ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কুতকুত খেলায় সারা দেশের মানুষই সমস্যার মুখে পড়েছিলেন, তবে ইসিবি সদস্যরা এই ঝামেলার মুখোমুখি পড়েন নি। কুঁড়ের বাদশা হিমুর ঘাড়ে টিকেট বুক করার দায়িত্ব পড়েছিলো, সে গড়িমসি করতে করতে ঈদের চাঁদ-এর পাকা দেখা হয়ে গেলো। জানা গেলো, তেরো নয়, বারো তারিখেই ঈদ। বারো তারিখ রাতে কমলাপুরে বাস কাউন্টারে এক এক করে হ্যাভারস্যাক কাঁধে নিয়ে জড়ো হলেন সবাই। কেওকারাডং-এ অনেকেই একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে নাকানিচোবানি খেয়ে এসেছেন, কাজেই এখানে সবাই যতদূর সম্ভব কম বোঝা নেয়ার ব্যাপারে মন দিয়েছেন। তবুও দেখা গেলো, একেবারেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হ্যাভারস্যাকের ওজনটা নেহায়েত মন্দ হয়নি। এবার সবচে ভারি বোঝা শাহুলের ঘাড়ে, আর সবচে হালকা মিলন ভাই, একটা ডেনিমের জ্যাকেট সম্বল করে বেড়িয়ে পড়েছেন তিনি। আর শেষ পর্যন্ত অভিযাত্রীর সংখ্যা সতেরো, যোগ দিয়েছেন পারভীন আপা, চঞ্চল আর ফাইয়াজ। রাত সোয়া দশটায় শুরু করে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছে গেলো বাস। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, দ্রুত কিন্তু নিরাপদ গতিতে ছুটেছে বাস। শুরুতে কয়েকজন প্রেতসংক্রান্ত গল্পগুজব করে রাতের অন্ধকারটাকে একটা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ক্লাবের কিছু সদস্য যে কোন পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়তে সক্ষম, তাঁরা স্বল্প পরিসরেই চাদর মুড়ি দিয়ে জটিল ঘুম দিয়ে তাজা হয়ে গেছেন। আর যারা নিদ্রাবিলাসী, চার পাঁচটা বালিশ আর শ'খানেক বর্গফুট জায়গা ছাড়া ঘুমাতে পারেন না, তাঁরা ভুগেছেন। আর কয়েকজন অসীম সাহার কিশোর জানে না কবিতার সেই বিষণ্ন কিশোরের মতো অন্ধকারে জেগে জেগে রাত্রির ঘ্রাণ শুঁকে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর সারাটা পথ যাচ্ছেতাই রকমের বাজে আধুনিক বাংলা গান শুনতে শুনতে একেকজনের অবস্থা আরো কাহিল, গানের সুর আর কথার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন তাঁরা, এবং এসব গানের গীতিকার ও সুরকারকে হাতের কাছে পেলে কিঞ্চিৎ লাঠ্যৌষধি শাসনম-এর বন্দোবস্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে ভেবে দেখেছেন। এ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটু চোখ এবং পা বুলিয়ে আসা হবে। ক্লাবের অন্যতম হন্টক (যিনি কষা হাঁটতে পারেন) মহাকাশ মিলন ভাই তখন জানালেন, কঙ্বাজারে তিনি কিছু কাজ সেরে যেতে চান, অতএব তিনি অন্যান্যদের সাথে সন্ধ্যেবেলা টেকনাফে মিলিত হবেন --- আসল কথা হচ্ছে সেন্ট মার্টিন মিলন ভাইয়ের আগাপাস্তলা দেখা আছে, রোদে ঘুরঘুর না করে একটু গড়িয়ে নিতে চান তিনি। তবে তাঁর এ প্রস্তাবে গররাজি হবার কিছু নেই, কাজেই মিলন ভাইকে তিনটি চকোলেটসহ বিদায় জানানো হলো। বাস্তবিক, তিনটে থেকে একটা বেছে নিতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু মিলন ভাই কোনটা ফেলে কোনটা বাছবেন বুঝতে না পেরে সবক'টাই গাপ করেছেন। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের বাস ছাড়লো সাড়ে ছ'টার সময়। একঘন্টা সময় বাস স্টেশনেই পায়চারি করে কাটাতে হলো সবাইকে। তবে এর মধ্যে একটু এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে হালকা হয়ে এসেছেন অনেকেই। সাড়ে আটটা নাগাদ বাস থেকে টেকনাফের সী-ট্রাক ঘাটের কাছে সবাই নেমে পড়লেন। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের রাস্তা একটু খারাপ, কড়া রোদ সরাসরি চোখে পড়ায় অনেকেরই মাথা ধরে আছে, আর এই বাসের আধুনিক বাংলা এবং অত্যাধুনিক হিন্দি গানের অবস্থা আরো খারাপ। পাতলি কমর তিরছি নজর ছাড়া এরা আর কিছু বোঝে না। সী-ট্রাক টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। ঘাটে নেমে টিকিট কাটার পর সবাই আবার সিদ্ধান্ত নিলেন, হ্যাভারস্যাকগুলোকে মিছিমিছি সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। অতএব সেগুলোকে কয়েকজন গিয়ে হোটেল ভাড়া করে রুমবন্দী করে আসুক, আর বাকিরা ঘাটে বসে ঝিমাক। এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে কয়েকজন তৎক্ষণাৎ একটা স্কাউট দল তৈরি করে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে চড়ে বসলেন। ঘাট থেকে টেকনাফ শহরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার, এটুকু পথ এত বোঝা নিয়ে হাঁটতে কেউ রাজি নন। টেকনাফে হোটেল খোঁজাখুঁজির ঝামেলা থেকে রেহাই দিলো মাইক্রোবাসের ড্রাইভার। সে সুড়ুৎ করে বিনা উসকানিতে হঠাৎ একটা সুদৃশ্য হোটেলের সামনে হাজির করলো স্কাউট দলকে, বোঝা গেলো, বিশেষ বন্দোবস্তের অধীনেই তার এই বদান্যতা। হোটেলের নাম, ধরা যাক, হোটেল অমুক। মাঝবয়েসী হোটেল ম্যানেজার কঠোর চেহারা করে অভ্যর্থনা জানালেন অভিযাত্রীদের। ইকবাল আর শাহেদ ভাই দোতলায় উঠে রূমগুলো ঘুরে ফিরে দেখতে গেলেন, ফরিদ ভাই আর হিমু দর কষাকষির দায়িত্ব নিলেন। এ পর্যায়ে ম্যানেজারের সাথে কিছুটা মন কষাকষিও হলো, কারণ বেচারা কিছুতেই ভাড়া সম্পর্কে মুখ খুলবেন না, বিনা আলাপেই অভিযাত্রীদেরকে তিনি নিজের হোটেলে অতিথি করে রাখতে চান। শুধু তাই না, তিনি জানালেন, সী-ট্রাক সাড়ে দশটার আগে কিছুতেই ছাড়বে না, কাজেই দর কষাকষির জন্যে তাদের হাতে এখনো ঘন্টা দেড়েক সময় আছে। তবে যাই হোক, শাহেদ ভাইয়ের ত্বরিৎ হস্তক্ষেপে দশ মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন আকারের পাঁচখানা রূম রফা হলো ষোলোশো টাকায়। একটা রূমে সব লাগেজ রেখে খানিকটা ফ্রেশ হয়ে আবার ঘাটে ফিরে এলেন সবাই। এসে সবার আক্কেল গুড়ুম, সী-ট্রাক বোঝাই লোকজন, বসার কোন জায়গা নেই, মোটামুটি আড়াই ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সবাইকে। হিমু আবার কোত্থেকে একটা অর্ধেক লাইফজ্যাকেট যোগাড় করে গায়ে এঁটে বসে আছে, সী-ট্রাকের যাত্রীরা এ নিয়ে কিছুক্ষণ বিমলানন্দ ভোগ করলেন। অবশ্য সাবধানের মার নাই, কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় সী-ট্রাক ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো সেটাকে গদি বানিয়ে হিমু আর চঞ্চল খুবই আরামে ঝিমাচ্ছে, আর বাকিরা হোটেল ম্যানেজারকে কষে বকাবকি করছেন ভুল তথ্য দেয়ার জন্যে। সত্যি সত্যি যদি সাড়ে দশটায় সবাই আসতেন, কপালে বিস্তর ভোগান্তি ছিলো। নাফ নদীর সৌন্দর্য বর্ণনা আপাতত সিলেবাসের বাইরে। ক্লাবের সদস্যরা কড়া রোদে ভাজা ভাজা হয়ে চঞ্চলের বাইনোকুলার দিয়ে দু'তীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন। বাম পাশে মায়ানমার, ডান পাশে বাংলাদেশ। শাহপুরির দ্বীপ আর বদর মোকাম দেখতে দেখতে কাটলো বেশ কিছুটা সময়। নাফ নদীতে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে বার্মিজ ট্রলার দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন। একসময় নদী পেরিয়ে সাগরে পড়লো সী-ট্রাক, বাম পাশে মায়ানমারের সৈকত শেষ হয়ে গেলো হঠাৎ। সী-ট্রাকের পরিবেশ হয়তো আরো কিছুটা ভালো হতে পারতো, কিন্তু নষ্ট মাইকে ভয়ঙ্কর শব্দ, আর কিছুক্ষণ পর পর জাহাজের সারেঙের সতর্কবাণী শুনতে শুনতে কান বিষিয়ে যাওয়ার যোগাড়। যদিও ডেকে তিলধারণের জায়গাটুকু নেই, সাগর দেখার জন্যে রেলিঙের পাশে ভিড় জমিয়েছে সবাই, নিরাপত্তার খাতিরে রেলিঙের ওপরে না বসার সৎ পরামর্শটিকে ভারি সহিংস ভঙ্গিতে দিয়ে চলছেন সারেঙ ভদ্রলোক। মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকলে তার সাথে সারেঙের মতের খুবই অমিল হতো, সন্দেহ নেই, সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনও বোধহয় অতোটা বদমেজাজি হয় না। ওদিকে সাগরে কিছুক্ষণ পর পর ডাইভ দিচ্ছে ডলফিন, হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক, দু'তিনবার পানির ওপর জেগে থাকা তীক্ষ্ণ ফিন দেখে কয়েকজন সেগুলোকে হাঙরের আলামত হিসেবে শনাক্ত করলেন। চারপাশে অলস উড়ে বেড়াচ্ছে সাদাকালো শঙ্খচিল। মাছ ধরা সাম্পান আর ট্রলার দেখা যাচ্ছে অহরহ। পানির রঙ চারদিকে মিষ্টি নীলচে সবুজ, শুধু যেখানে সমুদ্রে চর জাগছে, সেখানে পানির রঙ ফ্যাকাসে সাদা। সারেঙের ঝাড়ি খেতে খেতে কাহিল হয়ে একসময় সেন্ট মার্টিনে নামলেন সবাই। হলদে গরম বালি পার হয়ে হুড়োহুড়ি করে বাজারে পৌঁছে খাবার দোকানের সামনে ভিড় জমালেন প্রতিটি অভিযাত্রী। বিশাল আকারের সব গলদা চিঙড়ি, যেগুলোর মধ্যে কোন গলদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বরং দেখলেই জিভে জলোচ্ছ্বাস হয়, ডালিতে সাজিয়ে বিভিন্ন দোকানে উদ্যোক্তারা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কেবল দৃষ্টি নয়, পর্যটকদের পকেটের প্রতিও তাদের আকর্ষণ প্রবল, নিউটনের সূত্রকে একটি মাঝারি আকারের কাঁচকলা দেখিয়ে তারা নাগালের বাইরে এমন সব দাম হেঁকে চলেছেন যে চটজলদি মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন সকলে। সে সব মূল্যের কথা শুনে অভিযাত্রীদের জিভের জল চোখে উঠে যাওয়ার শামিল। তবে দুই বিঘত লম্বা একজোড়া নীল গলদা চিংড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার প্রলোভন সামলাতে পারলেন না বরুণদা। চিংড়ি দুটো বয়সে মুরুব্বি, কারণ অনেক বছর না বাঁচলে এদিককার পানিতে গলদা চিংড়ি এতো বড় হতে পারে না। ঢাকা ছেড়ে আসার পর কারো পেটেই দানাপানি পড়ে নি, খিদেয় অন্তরাত্মা চোঁ চোঁ করছে, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই চিংড়ির আশা বঙ্গোপসাগরে জলাঞ্জলি দিয়ে সবাই একটি মাছিবহুল ছাউনির নিচে কড়কড়ে ভাত আর কড়া রূপচাঁদা ভাজা খেতে বসে গেলেন। ভাত আর রূপচাঁদার বয়স নিয়ে কয়েকজন সন্দেহ পোষণ করলেও খিদের মুখে আপত্তি করার জোরালো কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না, কারণ সব দোকানেই মাছগুলোকে জান বাজি রেখে ঘোলা তেলে কষে ভাজা হয়। কেউ কেউ ডাল দিয়ে খাবারে একটু কোমলতা আমদানি করার জন্যে ফরমায়েশ দিলেন। ডাল নামক বস্তুটি আসার পর দেখা গেলো, সেটাতে ডাল, মশলা আর তেল, সব কিছু আলাদা করে শনাক্ত করা যাচ্ছে। ডালের রাঁধুনি অত্যন্ত উদার মনের মানুষ, ডালের সাথে ডালের রেসিপিও সরবরাহ করেছেন তিনি, কোন উপাদান যাতে বোধের অতীত হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন তিনি। ভাত খেয়ে ডাবের দোকানের সামনে হুটোপুটি করে ডাব খেয়ে সবাই হাঁটা শুরু করলেন দ্বীপের অন্য প্রান্তের দিকে। দ্বীপটির মাঝে বেখাপ্পা শানবাঁধানো পথ, রীতিমতো বিশ্রী দেখতে। অধিবাসীরা উৎসুক চোখে অভিযাত্রীদের পরখ করতে করতে চলেছে। সেন্ট মার্টিনে মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক, এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক অপশক্তির কান্ডকারখানা সেখানে প্রকট, ছোট ছোট নমুনা হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে। দ্বীপের ওদিকটায় প্রবাল সৈকত, প্রাক্তন কথাসাহিত্যিক ও বর্তমান চলচ্চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের একচালা ছিমছাম কুঁড়েটি সেখানে হাঁটু ভেঙে দ হয়ে পড়ে আছে। সৈকতের সে অংশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আর হুটোপুটি করে, সেইসাথে স্থিরচিত্রে নিজেদের অক্ষয় করে রাখার স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে আবার সী-ট্রাকের দিকে এগিয়ে চললেন সবাই। পারভীন আপা পানির পোকা, সাগরে শুয়ে একখন্ড প্রবালের ওপর মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, তাঁকে প্রায় একরকম ধমকে সাগর থেকে তুলে আনা হলো। ফেরার পথে কয়েকজন হেঁটে ফিরলেন, কয়েকজন ফিরলেন ভ্যানরিকশায় চড়ে। আবার সী-ট্রাকে চড়তে হবে ভেবেই সবাই মুষড়ে পড়লেন। এবং গোদের ওপর বিষফোঁড়া, সেটাতে চড়ার দশ মিনিটের মধ্যে সী-ট্রাকের প্যাকেজ প্রোগ্রামের শিকার কয়েকজন মানুষ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে ঝগড়া শুরু করলেন। বিকেলের রোদে সবাই সেদ্ধ, পাশে আবার কয়েকজন কাচ্চু খেলোয়াড় খুবই উল্লাসের সাথে তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, আর সামনে এই বিতর্ক --- অতিষ্ট হয়ে খেলাধূলা শুরু করলেন ক্লাবের সদস্যরাও। মনে মনে কোন একটা জন্তুর নাম ভাববেন একজন, বাকিরা দশটা প্রশ্ন (যার উত্তর কেবল হ্যাঁ কিংবা না) করে সেটার পরিচয় উদ্ধার করবেন। এমনি করে গরু, মানুষ, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি দুরূহ সব জন্তুর নাম উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে সবাই যখন ইস্তফা দিতে যাচ্ছেন, তখন শোনা গেলো টেকনাফ আর বেশি দূরে নেই। টেকনাফ পৌঁছুতে হবে হেঁটে। সবাই হাত পা খানিকটা খেলিয়ে শুরু করলেন হাঁটা। সাত কিলো পিচের রাস্তা পার হতে দেড় ঘন্টার মতো লাগবে। শেষ বিকেলের খানিকটা আলো তখনও আছে, চঞ্চল তার ক্যামেরা বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সী-ট্রাকেও পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফি নিয়ে গলদঘর্ম ছিলো বেচারা। বাকিরা কেউ কেউ গল্পগুজব করতে করতে হাঁটছেন, কেউ ঢিল ছুঁড়ে জংলি বড়ই গাছ থেকে পেড়ে খাচ্ছেন। এমনি করে সন্ধ্যে নেমে এলো, হোটেলে পৌঁছে সবাই বাথরুমে ছুটলেন। সবাই বালি আর নোনা বাতাসে মাখামাখি। মিলন ভাই হাজির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কঙ্বাজারে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে নিয়েছেন তিনি, সেখানে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কিছু অফিশিয়াল কাজও শেষ করে এসেছেন। ভারি সুখী সুখী চেহারা তাঁর, আর সবার এদিকে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে অবস্থা ভূতের মতো। যাই হোক, হোটেল অমুক সংলগ্ন রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেন সবাই। সেখানে খাবারদাবারের মান নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো, তবে সেন্ট মার্টিনের চেয়ে ভালো। খাওয়াদাওয়া শেষে কেউ কেউ গেলেন নাফের সৈকতে হাঁটতে, কেউ ঘরে ফিরলেন আর কয়েকজন গেলেন পরদিনের জন্যে বিস্কুট আর জেলি কিনতে। মিলন ভাই নাফের পারে বসে কিছুক্ষণ তারা চেনালেন, কিন্তু একই তারা রোজ রোজ দেখে সবাই বিরক্ত, তাছাড়া এক রাতে পাঁচটার বেশি তারা মিলন ভাই কখনোই শনাক্ত করতে পারেননি, তাই সবাই আবার হেঁটে হেঁটে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। হোটেলে ফিরে সবাই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। ২. পরদিন সকালে মোটামুটি সবাই হাঁটার জন্যে প্রস্তুত। তবে অনেকে রাতে বাসের সেই বাংলা গানগুলো স্বপ্নে দেখে আঁতকে উঠেছেন, ড়িদয়ে যাতনা তবু করিনি আপোষ --- হবো হবো না আমি তোমার পাপোষ --- ইত্যাদি ইত্যাদি। পারভীন আপা শব্দ হলে ঘুমাতে পারেন না, তাঁর পাশের ঘরে কে নাকি ভোর চারটা পর্যন্ত হৈচৈ করেছে, কাজেই তিনি খুবই ক্লান্ত। সোয়া ছয়টার মধ্যে নাস্তা আর লবণাক্ত চা (হোটেল অমুকের চিনিও লবণের মতো নোনতা) খেয়ে সবাই পথে নেমে এলেন। চঞ্চলের সৌজন্যে সবার মুখে চকলেট। হোটেল থেকে টেকনাফ বীচ চার কিলো, সবাই জোর কদমে হাঁটা শুরু করলেন। ঈদের ছুটির ভোর, টেকনাফের পথঘাট নির্জন, দীঘল ইঁট বিছানো পথে এক্সপ্লোরারস ক্লাবের সদস্যরাই হেঁটে চলছেন সৈকতের দিকে। পথে খেত থেকে শসা কিনে খেতে খেতে এক ঘন্টার মধ্যে বীচে পৌঁছে গেলেন সবাই। এর মাঝে পুতুল আপা এক স্থানীয় বেয়াদব পিচ্চিকে কড়া শাসন করেছেন, কৌশলে আঞ্চলিক ভাষায় সবাইকে মশলামাখা গালিগালাজ করে যাচ্ছিলো অপোগন্ডটা, আর চঞ্চল বেশ কিছু ছবি তুলেছে। আকাশের মুখ গোমড়া, সূর্য লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, সাগরে পদধূলি বিসর্জন দিয়ে সৈকতে একগাদা সাম্পানের সামনে অফিসিয়াল চিত্রগ্রহণের পর সবাই শুরু করলেন হাঁটা। বামে সমুদ্র, ডানে পাহাড়সারি, সামনে আদিগন্ত সৈকত। সবকিছু মিলিয়ে ভারি মনোরম দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে বালিতে কাঁকড়ার নকশা আর ঝিনুক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। কাঁকড়ার এই নকশাগুলো নাকি জহুরীরা সংগ্রহ করে নিয়ে যান সোনার গয়না বানানোর জন্যে। আরো খানিকটা হেঁটে দেখা গেলো জেলি ফিশ, সিন্ধুকচ্ছপের খোলা, তন্দ্রাচ্ছন্ন সামুদ্রিক সাপ আর বালিতে চাঁদের গাড়ির ট্র্যাক। উল্টো দিক থেকে ফিরছে মালবোঝাই একটা জীপ, অভিযাত্রীদের ভালো করে দেখতে ড্রাইভার জানালা দিয়ে কোমর পর্যন্ত শরীর বের করে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর অভিযাত্রীদের সঙ্গ নিলো একটা কুকুর। বয়স হয়েছে কুকুটার, শরীরে বেশ কিছু জায়গায় লোম পড়ে গেছে, মাথায় বাসি ক্ষতচিহ্ন। কিন্তু মিলন ভাই বিস্কুট খাইয়ে সেটার সাথে দোস্তি করে ফেললেন, মহা উৎসাহে সবার আগে আগে ছুটতে লাগলো সে। চারুকলার সজীব তার স্কেচের খাতা সাথে নিয়ে এসেছে, কিছুক্ষণ পর পরই খাতা খুলে ধ্যানস্থ হয়ে যাচ্ছে সে। ঘন্টাখানেক হেঁটে সবাই বালির ওপর দাঁড় করানো কয়েকটা সাম্পানে চড়ে বসলেন। ডাব খাওয়ার বিরতি। ডাব আসতে আসতে আধঘন্টার মামলা, এর মধ্যে হালকা গল্পগুজব চলতে লাগলো। পারভীন আপার ঘুম হয়নি রাতে, তিনি খুবই নাজেহাল হয়ে পড়েছেন, একটা চাঁদের গাড়ি থামিয়ে তাঁকে তুলে দেয়া হলো মনখালির উদ্দেশ্যে। বাকিরা আবার শুরু করলেন হাঁটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলন ভাই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন, জোর হাঁটা শুরু করেছেন তিনি, মনখালিতে পৌঁছে পারভীন আপাকে খুঁজে বের করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে, সৈকতের ওপর একটু পর পর ছুটে চলেছে চাঁদের গাড়ি, মাইকে চারদিক কাঁপিয়ে স্থানীয় ভাষায় প্রার্থীদের প্রচার চলছে। একটু পর পর দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মহিলাদের, ঝিনুক কুড়িয়ে গুঁড়ো করছেন তারা। পোলট্রি ফিড হিসেবে ঝিনুকের গুঁড়ো খুবই উত্তম। পথে আরো কয়েক জায়গায় ছোট ছোট বিরতি নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে এক সময় দুপুরের খাবারের জন্যে সবাই জড়ো হলেন বড্যিল বাজারে। টেকনাফ থেকে প্রায় ষোল কিলো দূরে জায়গাটা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, আকাশ তখনও বিষণ্ন। এর মধ্যে চঞ্চল একটা কাঁকড়া শিকার করেছে, সেটাকে ভেজে খাওয়ার দুরভিসন্ধি তার। অভিযাত্রীরা বেশ কিছু বিচিত্র নকশাওয়ালা বিশাল সবুজ কাঁকড়া দেখেছেন পথে, তবে সেগুলোকে পাকড়াও করা হয়নি। বড্যিল বাজারে কেউ কেউ হালকা ঘুম দিলেন, সামিয়াকে দেখা গেলো বেশ কিছু শিশু-ফ্যান যোগাড় করে তাদের ন্যায়শিক্ষা বা ফ্যাশনশিক্ষা এই গোছের কিছু একটা লেকচার দিতে, আর এক দোকানে ঢুকে নাজমুল ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন হূলস্থূল খিচুড়ি রান্না করে ফেললেন। এই খিচুড়ি খেয়ে তৎক্ষণাৎ ক্লাবের বাবুর্চি পদে ওয়াহিদ ভাইয়ের পাশাপাশি নাজমুল ভাইকেও আসীন করা হলো। বড্যিল বাজার পর্যন্ত স্থানীয় জনতা অভিযাত্রীদের যেসব প্রশ্ন করেছেন, সেগুলো হচ্ছে, তারা এদেশের লোক না, মুসলমান না, কেন এত ভালো চাঁদের গাড়ির সার্ভিস থাকতে তারা কষ্ট করে পায়দল চলছেন, তাদের দেশের বাড়ি কোথায়, তারা হেঁটে হেঁটে কতদূর যাবেন ইত্যাদি। ক্লাবের সদস্যাদের শার্টপ্যান্ট পরে হাঁটতে দেখে স্থানীয় মৌলানা আল্লার গজব নেমে এসেছে বলে রায় দিয়ে ফেলেছেন। যদিও অনেকের ধারণা, এটা আসলে স্থানীয় বাকরীতিতে অকুন্ঠ প্রশংসা। ঢেঁকুর তুলতে তুলতেই আবার সৈকতে নেমে এলেন সবাই। মনখালিতে গিয়ে থামবে গোটা দলটা, আরো অনেক পথ বাকি, মাত্র দুই পঞ্চমাংশ পার হয়েছে। চলতে চলতে কিছুদূর গিয়ে জেলেদের মাছধরা দেখার জন্যে থামলেন সবাই। বিশাল এক জাল সমুদ্রে সাম্পানে করে ফেলে আসা হয়, জোয়ারের সময় সেই জাল ডাঙা থেকে বিশ-পঁচিশজন মিলে টেনে তুলতে হয়। ভারি চমৎকার একটি দৃশ্য, কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন সৈকতে দু'টি মৃত তিমির বাচ্চা পাওয়া গেলো, সবার মনই খারাপ হয়ে গেলো। স্থানীয় জেলেরা লগা মাছ বলে চেনে এদের, ডলফিন আর তিমি মাছ তারা সাধারণত ধরে না, এ দু'টি মাছ নাকি দুর্ঘটনাবশত তাদের জালে ফেঁসে গেছে। এবং আরো মুশকিল হচ্ছে, এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কী আর করা, মৃত তিমিশিশু দুটির পাশে বসে থমথমে মুখে ছবি তুলে, সে দু'টিকে পানিতে বিসর্জন দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন সবাই। শঙ্কর প্রজাতির একটা মাছ আর ক্ষুদে স্কুইড ছাড়া আর তেমন কোন বিশেষ মাছ জেলেদের ঝুড়িতে ওঠেনি। স্থানীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শহীদউল্লাহ সাহেব চাঁদের গাড়িতে করে নির্বাচনী কাজে যাচ্ছিলেন, তিনি নিজের উদ্যোগে শামলাপুরে অভিযাত্রীদের আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। তাঁর রেফারেন্স চিঠিসহ অভিযাত্রীরা আবার হাঁটা শুরু করলেন। কিছুদূর যেতে না যেতেই মোক্তার ভাই মোটর সাইকেলে চড়ে উপস্থিত, শামলাপুরে ট্রেকারদের সহযোগিতা করার দায়িত্ব শহীদউল্লাহ সাহেব এঁকেই দিয়েছেন। শামলাপুরের কাছে সৈকতে তিনি উপস্থিত থাকবেন, এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি দক্ষিণ দিকে চলে গেলেন আবার। কিছুদূর গিয়ে দেখা গেলো, সামনে গোটা সৈকত টকটকে লাল, যেন কেউ আবীর ছড়িয়ে রেখেছে। কাছে গিয়ে দেখা গেলো হাজারে হাজারে লাল কাঁকড়া গর্ড় ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। অভিযাত্রীদের উপস্থিতি টের পেলো তারা সহজেই, অনেকে বিস্তর ছুটোছুটি করেও তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারলেন না। শাহুল আর চঞ্চল অনেক ছবি তুলেছে এর মধ্যে। ফরিদ ভাই ঢাউস এক বয়াম জেলি নিয়ে ঘুরছিলেন, সন্ধ্যে নামার আগে আগে ক্যানভাস বিছিয়ে বসে সেটাকে বের করে বিস্কুটে মাখিয়ে খেয়ে নিলেন সবাই। জেলিটাই ফরিদ ভাইয়ের সবচে বড় বোঝা, সেটাকে খতম করায় তিনি আনন্দে একেবারে উলু দিয়ে উঠলেন। আবার হাঁটা শুরু করার পর দেখা গেলো, ভর কমে যাওয়ায় ফরিদ ভাইয়ের বেগ অসাধারণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন তিনি। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় কয়েকটা খাল পার হয়ে ঘন্টাখানেক সৈকতে হাঁটার পর মোক্তার ভাইয়ের দেখা মিললো আবার, তাঁর পিছু পিছু শামলাপুর বাজারে পৌঁছালেন সবাই। সৈকতের ভেজা বালিতে হাঁটা মোটামুটি কষ্টসাধ্য কাজ, আর শামলাপুর যেতে হলে ঝুরঝুরে নরম বালির ওপর দিয়ে এক কিলো হাঁটতে হয়। কাজেই হয়রান হয়ে অবশেষে সবাই শামলাপুর পৌঁছে কোনমতে একটা চায়ের দোকানে হ্যাভারস্যাক খুলে বসলেন। আর হ্যাঁ, মিলন ভাই সে দোকানে ভারি তৃপ্ত চকচকে মুখে চা খাচ্ছেন কয়েকজন মুরুবি্বর সাথে। শামলাপুরে মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে, কয়েকজন গেলেন ফোন করতে, বাকিরা স্থানীয় জনতার কৌতূহল নিবারণের ভার নিলেন। ঢাকায় উৎকন্ঠিত স্বজনদের সাথে যোগাযোগ সেরে ফিরে মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে যা জানা গেলো, সেটা হচ্ছে, মনখালিতে বন বিভাগের রেস্টহাউসে রাত্রিনিবাসের বন্দোবস্ত হয়েছে। মিলন ভাই বিকেলে পৌঁছেছেন মনখালিতে, টানা হেঁটেছেন তিনি, স্থানীয় ইমাম তাঁর মেজবান হয়েছেন। পারভীন আপা সেই সকালে মনখালি পৌঁছে জনৈক সাংবাদিকের মেহমান হয়েছেন, তিনি সারাদিন এই এলাকায় শ'দেড়েক শিশু-ফ্যান জুটিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, একটা প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত করে ফেলেছেন। স্থানীয় জনতা তাঁর বেশভূষা দেখে সিদ্ধান্তে এসেছে, তিনি খ্রিষ্টান, এবং তাঁরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়, কারণ পারভীন আপার শিশু-ফ্যানদের ভাড়া করা হয়েছিলো নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, তারা সেটিতে ইস্তফা দিয়ে পারভীন আপার পিছু পিছু ঘুরেছে সারা দিন। আর হ্যাঁ, মিলন ভাইয়ের দোস্তান সেই কুকুরটাও তাঁর সাথে সাথে মনখালি পর্যন্ত চলে এসেছে। শামলাপুরের অধিবাসীরা মেরিন ড্রাইভের ব্যাপারে পত্রিকায় জোর লেখালেখির কাতর অনুরোধ জানালেন। তাঁদের অর্থনৈতিক সক্রিয়তা এই পথের কল্যাণে বহুদূর বৃদ্ধি পেতে পারে। এই এলাকায় সামুদ্রিক পণ্যের উৎপাদন প্রচুর, কিন্তু পরিবহনের কাজটি যথেষ্ঠ জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে যথেষ্ঠ পরিমাণে অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাঁদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তাঁরা বিষণ্ন মতামত জানালেন। মনখালিতে পৌঁছানোর জন্যে একটা খাল পার হতে হলো একটা নাজুক চেহারার ডিঙি নৌকোতে চড়ে। পারাপারের আগে মাঝখালে নৌকোটাকে ডানে বামে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সেটার খোলে জমে থাকা পানি ফেলে দেয়া হলো, এই অভিনব দৃশ্য দেখে কয়েকজনের আত্মারাম খাঁচার দরজা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। এঙ্প্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্যদের নৌকাভাগ্য খুব একটা ভালো না, এর আগে সাঙ্গু নদীতে রুমাঘাটে তাঁদের কয়েকজন নৌকাডুবির শিকার হয়েছিলেন, তবে এবার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ছাড়াই তাঁরা পার হয়ে গেলেন, মোক্তার ভাইয়ের সৌজন্যে। শামলাপুরের মানুষেরা মেজবান হিসেবে অসাধারণ, তাঁরা খুব যত্নে অভিযাত্রীদের এগিয়ে দিলেন মনখালি রেস্টহাউস পর্যন্ত, প্রায় দু'কিলো পথ। রেস্টহাউসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই প্রায় সবার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো ক্লান্তি। চলি্লশ কিলো পথ বালির ওপর দিয়ে হেঁটে এসে অনেকেই কাবু। হাতমুখ ধুয়ে এসে ব্যান্ডএইড আর মালিশ নিয়ে বসলেন সবাই। যারা কিছুটা চাঙা, তাঁরা স্থানীয় বাজারে গরম পানির সন্ধানে বেরোলেন, কফি বানিয়ে খাবেন। রান্না হতে অনেক দেরি, সারাদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যে বসলেন সবাই। গল্পের পাশাপাশি মালিশও চলতে লাগলো। মিলন ভাই তার সারমেয় সফরসঙ্গিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কুকুরটা নাকি তাঁর সব কথা বোঝে এবং মেনে চলে। তবে খাল পার হওয়ার সময় সে নৌকার ওপর ভরসা করে নি, সাঁতরে পার হয়ে এসেছে। কুকুরটার নাম দেয়া দরকার, আর মিলন ভাইকে নামকরণের দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি লুব্ধক অগস্ত্যমুনি গোছের নাম রেখে দেবেন। কিন্তু জানা গেলো মিলন ভাই সেটার নাম লালি রেখে আকিকা দেয়ার খায়েশ পোষণ করছেন। তবে হিমু প্রতিবাদ জানালো, কুকুরটা বাদামী, লাল নয়, কাজেই নাম রাখা হলো বালি। কুকুরের বয়সে বালি অনেক সিনিয়র, অনেকে তাকে বালি আপা ডাকা শুরু করলো। একসময় আলুভর্তা, মুসুরির ডাল আর ভাত খাওয়ার আহ্বান এলো, সবাই হুড়মুড় করে ছুটে গেলেন। খাওয়াদাওয়ার পর স্থানীয় সাংবাদিক ইনানীর কাছে মোহাম্মদশফিরবিল এলাকায় কানারাজার গুহার রোমহর্ষক গল্প শোনালেন। সেই গুহায় নাকি ভয়ঙ্কর এক অজগর বাস করে, বার্মা মুলুকের এক সময়ের দসু্য কানা রাজার গুপ্তধন সে পাহারা দেয়। পাকিস্তান আমলে তিন সরকারী অফিসার সেই গুহায় ঢুকে স্বচক্ষে সেই সাপকে দেখে এসেছেন। তারপর থেকে সেই গুহায় আর কেউ ঢোকে না। সঙ্গত কারণেই ঠিক করা হলো, অভিযাত্রীদের কেউ সেখানে ঢুকবেন না। পাকিস্তান আমলের অজগর বয়সে সবারই মুরুবি্ব, তাকে না ঘাঁটানোই শ্রেয়। খাওয়াদাওয়া সেরে হাই তুলতে তুলতে সবাই যে যার স্লিপিংব্যাগের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলেন। ভোর পাঁচটার আগে ক্লাবের অন্যতম দুই নাসিকাবীর শাহেদ ভাই আর বরুণদা ছাড়া কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। ফরিদ ভাই এই দু'জনের মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলেন, কাজেই সারা রাত ভেড়া, তারা ইত্যাদির পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলো বেচারাকে। ৩. পরদিন সকালে হুলস্থূল কান্ড। কারোই ঘুম হয়নি ঠিকমতো, অনেকের সারা গায়ে ব্যথা, আর ফার্নিচার সরাতে গিয়ে নাজমুল ভাই ডান পায়ের নখে ভয়ঙ্কর ব্যথা পেয়েছেন। বখতিয়ার ভাই অস্ত্রোপচার করে তাঁকে মোটামুটি সাইজে আনলেন। যাবতীয় প্রভাতীকর্তব্য সেরে, উপল উপকূল রেস্টহাউস-এর দেনাপাওনা মিটিয়ে, অফিশিয়াল চিত্রগ্রহণের আড়ম্বর সেরে বেরোতে বেরোতে রোদ চড়ে গেলো। আকাশ আজ স্মিতমুখ। আজকের গন্তব্য ইনানী, বাংলাদেশের একমাত্র প্রস্তরসৈকত, এশিয়ার প্রশস্ততম সৈকত। মনখালি সৈকতে পৌঁছোনোর পথ এক কথায় অপূর্ব। বেশ কয়েকটা লেগুন, পাশে ঝাউবন, লেগুনে বিভিন্ন ধাঁচের মাছধরা নৌকো, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির গায়ে বর্মী হরফে আঁকিবুকি কাটা, নোঙর করা রয়েছে। এখানে বালি খুব ঝকঝকে, পানির রঙ অদ্ভূত নীল, আর আকাশও সুর মিলিয়েছে সমুদ্রের সাথে। অভিযাত্রীদের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো তাঁদের পায়ের সাথে। কিছুদূর এগিয়ে ডাব খাওয়ার জন্যে একটা সাম্পানে চড়ে বসলেন সবাই। যুগে যুগে বহু জমিয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ, গোটা বছরের ডাবের দেনা এই সুযোগে মিটিয়ে নিতে চান সবাই। ঢাকায় যেমন ফোস্কাপড়া পিগমি ডাব আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয়, তেমনটা নয়, খুবই সস্তায় প্রমাণ সাইজের ঝকঝকে ডাব মেলে এখানে। মিলন ভাই আজকে অনেকের টার্গেট। মিলন ভাই নাকি গতদিন মোটেও হাঁটেননি, অন্যেরা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র চাঁদের গাড়িতে চেপে বসেছেন, মিলন ভাই নাকি পাঁচটা মাত্র তারার নাম জানেন, এগুলোই কুমীরের ছানার মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখান, মিলন ভাই নাকি জ্বীন সাধনা করেন --- ইত্যাদি ইত্যাদি। মিলন ভাই অবশ্য বালির ওপর শুয়ে শুয়ে বালির সাথে খেলা করছিলেন, তিনি জ্বীনসাধকদের মতো মিটিমিটি হাসেন, কিছু বলেন না। ডাব খেয়ে পোক্ত হয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন সবাই। বেশ কয়েক কিলো এগিয়ে অভিযাত্রীদের যা চোখে পড়লো, সেটা একটা বিস্ময়, এবং তা পাঠকদের কাছ থেকে গোপন রাখা হলো। কেবল যাঁরা হেঁটে পৌঁছুতে পারবেন, তারাই সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের নাগাল পাবেন, বাকিদের জন্যে ঘেঁচু। কিছুক্ষণ সেখানে উদাস মনে কাটিয়ে আবার উঠলেন সবাই। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পারভীন আপার সহকর্মী সাংবাদিক মোরশেদ ভাইকে সস্ত্রীক পাওয়া গেলো। যদিও একই দলে যোগ দেয়ার কথা ছিলো, শেষ মূহুর্তে যোগাযোগের অভাবে এঁরা দুজন দলছুট হয়ে পড়েছিলেন। তবে হাল ছাড়েননি তাঁরা, যাচ্ছেন উল্টো, অর্থাৎ হেঁটে হেঁটে কঙ্বাজার থেকে টেকনাফ। পথলব্ধ উপদেশ-পরামর্শ বিনিময় করে দু'পক্ষ দু'দিকে হাঁটা দিলেন। আজ আর গতদিনের মতো তেজ নেই কারো, বার বার বসা হলো বিশ্রামের জন্যে। পুতুল আপা স্থানীয়দের কাছ থেকে বরই কিনে খাওয়ালেন সবাইকে। রাতে ভালো ঘুম না হলে এই কড়া রোদে গতি বাড়ানো মুশকিল। অনেকের পায়ে ফোসকা পড়েছে, সেগুলো ফেটে গিয়ে জ্বলছে ভীষণ। কারো কাফ মাসল, কারো ঊরুর পেশীতে টান লেগেছে। তবে নাজমুল ভাই ব্যান্ডেজ করা পা নিয়েও চমৎকার হাঁটছেন। বালি আর মিলন ভাই নির্বিকার। বালির চারটা পা বলে তার গতিও দ্বিগুণ, আর মিলন ভাই যদিও দ্বিপদ ---। রূপবতীতে কিছুক্ষণ প্রবাল আর সবুজ পাথরের ওপর কাটিয়ে আবার সবাই এগোলেন, কেউ একটু সামনে, কেউ একটু পেছনে। বালি এখানে খানিকটা ঘুমিয়েছে, স্থানীয় এক প্রৌঢ় তাকে পুষ্যি নিতে চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু সে ট্রেকারদের পিছু ছাড়বার পাত্রী নয়। সবাই হাঁটা শুরুর সাথে সাথে সে ঘুমটুম ফেলে দে দৌড়। কিছুদূরে একটা বালিয়াড়ি পেরোনোর পর পেছনের দলটার সাথে বীচ প্যাট্রল (বিডিআর)-এর দেখা হলো। তারা দূরের একটা উঁচু টিনশেড দেখিয়ে বললেন, ওটা ইনানী রেস্টহাউস। সজীব আর শাহুল সাগরের মাঝে জেগে থাকা সৈকতসংলগ্ন ছোট্ট একটা ঝিকিমিকি দ্বীপে পদবালি দিয়ে এসেছে এর মধ্যে। ওয়াহিদ ভাই আর হিমু দ্বিতীয় দফা ডাব খাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, তবে ডাব আসতে আসতে সবাই এগিয়ে গেলেন অনেকটা। কী আর করা, শুকনো গলা নিয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো। কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়লো বিচিত্র দৃশ্য। দূরে একটা কিছু পড়ে আছে সৈকতে, তার একটু সামনে আরো একটা কিছু, তার কিছু সামনে আরেকটা। অনেক দূরে একটা কিছুর সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে চঞ্চল আর ফাইয়াজ। সামিয়া খুবই দুঃখ করতে লাগলো, এইভাবে সমানে তিমির বাচ্চা মারা পড়ছে দেখে, তবে আরেকটু এগোতেই বোঝা গেলো, ওগুলো মানুষের বাচ্চা --- যথাক্রমে পারভীন আপা, ইকবাল, শাহেদ ভাই ---। সৈকতে যে যার মতো চিৎপাত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সেই দূরের টিনশেডটা আসলে বহুদূরে, সেটাকে শুরুতে যেমন ছোট দেখাচ্ছিলো, ঘন্টাখানেক হাঁটার পরও তেমন ছোটই দেখালো। তারপর একসময় যখন সেটা কাছে এলো, তখন জানা গেলো, সেটা আসলে বিডিআর-এর ফাঁড়ি। সবার মেজাজ খারাপ, গলা শুকনো, বিডিআর সদস্যদের শাপান্ত করে, আবার খানিকটা বসে হাঁটা শুরু করতে হলো। কিছুটা এগিয়ে জনৈক প্রৌঢ়ের সাথে দেখা। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, অভিযাত্রীদের খবর তিনি পেয়েছেন আগেই, আর ইনানী রেস্টহাউস আরো সামনে। ঐ যে টিনশেড দেখা যাচ্ছে, ওটা পার হলে রেস্টহাউস চোখে পড়বে। ট্রেকাররা ইতিমধ্যে টিনশেডগুলোর স্বভাব বুঝে গেছেন, এরা অনেকক্ষণ যাবৎ দেখা দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। কাজেই আবার গরম মেজাজ নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটা। হিমুর ঊরুর পেশীতে টান পড়েছে, দশ মিনিট পরপরই বসে পড়তে চাইছে সে, কাজেই মিলন ভাই তার অহমে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্যে তার ব্যাগটা কাঁধে তুলে জোর হাঁটা শুরু করলেন। এভাবে তার প্রেস্টিজ হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটলো সে, মিলন ভাইয়ের হাত থেকে জগদ্দল ব্যাকপ্যাকটা উদ্ধার করা সহজ কথা নয়। ঘণ্টাখানেক পর যখন ইনানী রেস্ট হাউস চোখে পড়লো, তখন সবাই থামলেন। একটা বড়সড় বিশ্রাম নেয়া হবে। মিলন ভাই, বরুণদা আর শাহেদ ভাই এগিয়ে গেছেন লাঞ্চের খোঁজ নিতে। এই ফাঁকে বিস্কুট দিয়ে ক্ষিদে মারছেন সবাই। বখতিয়ার ভাই সমসাময়িক বাংলা কবিতা এবং ইংরেজি সাহিত্যে এর প্রভাব নিয়ে একটি জটিল তাত্তি্বক আলোচনার সূত্রপাত করতে যাবেন, এমন সময় স্থানীয় জনতা ভিড় করলো সেখানে। বালি রোদে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো, খামোকাই তাকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো একদল বাচ্চাকাচ্চা। এতোদূর হেঁটে হেঁটে সামিয়ার মেজাজ খারাপ, সে উঠে এসে এমন কড়া ঝাড়ি লাগালো যে জনতার ভিড় খুব জলদি জলদি পাতলা হয়ে গেলো। এরই মধ্যে বরুণদা ফিরে এলেন বিস্কিট আর হালকা পানীয় নিয়ে। সামনে কোথাও ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সব দোকান বন্ধ, আর রেস্টহাউসের বাবুর্চি কোন রকমের সহযোগিতা করতে নারাজ। বরুণদা ইনানীতে অফিশিয়াল ক্যাপাসিটিতে এসে ভবিষ্যতে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়ার সংকল্প নিয়েছেন। বিস্কিট খেয়ে আবার উঠলেন সবাই। সূর্য টলে গেছে অনেকখানি। চাঁদের ত্রয়োদশী চলছে, সমুদ্র বেশ উত্তাল। সমুদ্র আর বাতাসের গর্জনে অবশ্য সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপূর্ব বীচ, আর সন্ধ্যেবেলা পশ্চিমে সূর্য আর পূবে চাঁদ অন্য রকম আলো এনে দিয়েছে সৈকতে। আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে, কয়েকটা খাল পার হয়ে একসময় অভিযাত্রীরা পৌঁছালেন সীকিং হ্যাচারিতে। এখানেই রাতে আশ্রয় নেয়া হবে। হ্যাচারিতে পৌঁছে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে রান্নার তোড়জোড় নেয়া হলো। খাসির বারবিকিউ করার আয়োজন চলছিলো, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে সেটা বাতিল করা হলো। চাল-ডাল-আলু-ডিম কিনে দেয়া হয়েছে হ্যাচারির বাবুর্চি সেলিম ভাইকে, খিচুড়ি হবে রাতে। কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে একদল গেলেন হ্যাচারির অপারেশন দেখতে, একদল জখম হাত পা নিয়ে পড়ে রইলেন। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে জলদি জলদি ঘুমুতে গেলেন সবাই। তিরিশ কিলো হাঁটা হয়েছে আজ। পরদিন আরো তিরিশ কিলো। কাজেই উঠতে হবে ভোরে। পুতুল আপা, শিলা আপা, পারভীন আপা আর সামিয়া রইলেন হ্যাচারির গেস্টরুমে, বাকিরা বাইরে ওয়াচহাউসে। ওয়াচহাউসটা একটা গোল দোতলা ঘর, ধূসর সাগর আর মাখনরঙা চাঁদ চোখে পড়ে সেটা থেকে। মোটামুটি ঠান্ডা পড়েছে, স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে আড্ডা মারতে মারতে সবাই ঘুমসাগরে তলিয়ে গেলেন। ৪. ভোরে অ্যালার্মের একটা ছোটখাটো অপেরা হয়ে গেলো। নানা সুরে, নানা তালে একেক জনের অ্যালার্ম সোচ্চার হয়ে উঠলো। রাত ফুরিয়েছে। চাঁদ আস্তে আস্তে হলদে হয়ে ঢলে পড়ছে সাগরে। অপূর্ব একটা দৃশ্য, একে একে রেশম পোকার মতো ঘুমের গুটি কেটে স্লিপিং ব্যাগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সবাই। আজকে সবাই কিঞ্চিৎ টাটকা। আজই কঙ্বাজারে পৌঁছে ঢাকার বাসে চড়ে বসতে হবে। পরদিন সবার অফিস, ইউনিভার্সিটি খোলা। সবকিছু সেরে চটজলদি বেরিয়ে পড়লেন সবাই। আজ সৈকতে নেমে মিলন ভাই আরো কয়েকটা কুকুরকে দলে জুটিয়ে নিলেন। বালির সাথে ভাব হয়ে গেলো একটার, তার নাম বাঘা। মিলন ভাই অবশ্য আরো তিন চারটাকে টোস্ট বিস্কুটের লোভ দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা মনে করে উল্টো দিকে চোঁ চাঁ দৌড়ে পালালো। মিলন ভাই, পারভীন আপা, হিমু আর শাহুল আজ একটু পিছিয়ে, বাকিরা পা চালিয়ে এগিয়ে গেছে। চলতে চলতে শুরু হলো গান। লাকি আখন্দ, আজম খান, সুমন চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক, জিনাত রেহানা, শামশাদ বেগম, জন ডেনভার, লস লোবোস --- কাউকে রেহাই দেয়া হলো না। টানা দেড়ঘণ্টা গাইতে গাইতে আর হাঁটতে হাঁটতে একসময় রেজু খালের ওপর ব্রিজের ধারে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসা হলো। রেজু খালের দু'ধারে দৃশ্যপটের সৌন্দর্যের জন্যে বিশেষণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সামনে খানিকটা পথ বীচ ছেড়ে মেরিন ড্রাইভের জন্যে নিধর্ারিত পথে হাঁটতে হবে। সামনের দলটা একটু এগিয়ে গেছে। চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে একে একে চোখে পড়লো সেনা প্রকৌশলীদের বুলডোজার, নিমর্ীয়মাণ ম্যারিন ড্রাইভ, স্নিগ্ধ সবুজ সুপারি গাছের সারি, গম্ভীর নীল আকাশ, বাদামি বাঁশের কঞ্চিতে ঘেরা পানের বরজ, পান্নাবরণ ধানের ক্ষেত, বেঁটে পাহাড়ের গায়ে নানা চেহারার হাসিমুখ ঝাউবন, দূরে হলদে সৈকত আর নীল সমুদ্র --- রঙের রায়ট একেবারে, সব মিলিয়ে সব দৃশ্যে স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব, যদিও স্বপ্ন নাকি লোকে সাদাকালো দেখে। প্যাঁচার দ্বীপ একটা গ্রামের নাম, সেটা পার হয়ে আবার সৈকতে নেমে পড়েছেন অভিযাত্রীরা। পথে স্থানীয় শিশুরা দল বেঁধে তাদের পিছু নিয়েছে, মিলন ভাই তাদের ডেকে জানালেন, বন্ধুরা, তোমরা পপি আপাকে চেনো? বাংলা সিনেমা দেখো নাই? এই যে আপামণিকে দেখছো, ইনি পপি আপার ছোট বোন। ছেলেমেয়ের দল নিজেদের মধ্যে আলাপ করে পটাপট পারভীন আপার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো, ছবি তুলবে তারা। পপি আপার পরিবারের একজনের সঙ্গ খোদার ইশারায় মিলে গেছে, এ সুযোগ মাঠে মারতে তারা নারাজ। অবশ্য পারভীন আপাও এই মিথ্যাচারে আপত্তি করলেন না, পপিআপারছোটবোনসুলভ গ্ল্যামার আমদানি করে ছবিতে পোজ দিয়ে দাঁড়ালেন। মিলন ভাইও শিশুপাচারকারীদের মতো হাবভাব নিয়ে, একহাতে একটা কাটারি, অন্য হাতে একটা পিচ্চির কব্জি ধরে কয়েকটা ছবি তুললেন। শাহুল আর হিমুর মাথা আশেপাশের দৃশ্য দেখে গরম, তারা সমানে আকাশসাগরঅরণ্যের ছবি তুলছে। সৈকতে নেমে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পামের বন চোখে পড়লো। এতক্ষণ সৈকতে কোন আবর্জনা চোখে পড়েনি, কিন্তু যতই হিমছড়ি কাছে চলে আসছে, তত বেশি করে অবিবেচক টু্যরিস্টদের উপস্থিতির পরিচয় পেলেন অভিযাত্রীরা। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে নানা রকম পলি প্যাক, চিপস, বিস্কিট, এমনকি ডিটারজেন্টের প্যাকেট। বিয়ারের খালি কৌটোর কথা না বললেও চলে। পামের বনের ভেতরে একটা খামার বাড়ি, টু্যরিস্টদের জন্যে তৈরি এবং সজ্জিত করা। সেখানে ডাব পাওয়া এবং খাওয়া গেলো। গলা ভিজিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা। কিছুদূর এগিয়ে দেখা গেলো, সামনের দলটা বালির ওপর মেসেজ লিখে গেছে। সেটা পড়ে জানা গেলো, পেছনের দলটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে পড়েছে, কাজেই তাঁরা জোরে পা চালালেন। পথে দু'এক জায়গায় তাঁরা প্লাস্টিক পেতে বসেছিলেন, কিন্তু তীব্র বাতাসে বালির কণা এত জোরে গায়ে বেঁধে যে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আর এ বালি উড়ে আসে মাটি ঘেঁষে, তাই দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা নেই, বসলেই ঝামেলা। আরো ঘণ্টাখানেক পা চালিয়ে কয়েকটা জীপ দেখা গেলো। সেজেগুজে সমুদ্রদর্শনে এসেছেন কয়েকজন ট্যুরিস্ট। তাদের অনেক সামনে হেঁটে চলেছে কয়েকজন, পিঠে হ্যাভারস্যাক। হুম, এক্সপ্লোরারস' ক্লাবের মেম্বার না হয়েই যায় না। মিলন ভাইকে দূর থেকে সনাক্ত করতে পেরে থেমে পড়লেন অগ্রবর্তীরা। সবাই একসাথে হওয়ার পর একটা লম্বা বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামনের দলের অভিযাত্রীরা পথে তরমুজ কিনেছেন পিছিয়ে পড়া চারজনের জন্যে, কাজেই পশ্চাদবর্তী দলের সদস্যরা হামলে পড়লেন সেগুলোর ওপর। কিছুক্ষণ সমুদ্রে হাত পা ছুঁড়ে একে একে সবাই এগিয়ে চললেন আবার। এবার মিলন ভাই এগিয়ে গেলেন সামনে, শিলা আপা পিছিয়ে পড়লেন। হিমছড়ি পার হয়ে কক্সবাজারের দিকে এগিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়লো অসংখ্য জীপের ট্র্যাক। এবং দুঃখজনকভাবে, অসংখ্য বর্জ্য। এভাবেই মনোরম এই বালুকাবেলাকে নষ্ট করতে করতে এগিয়ে চলছে ট্যুরিস্টভর্তি গাড়িগুলো। প্লাস্টিকের প্যাকেট সৈকতে ছুঁড়ে ফেলতে কারো কোন দ্বিধা নেই। হিমছড়ি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকতের রূপ খানিকটা একঘেয়ে, লোকালয়ের কারণে কিছুটা বিনষ্টরূপ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই বিশাল বীচের সবচেয়ে নোঙরা অংশটি হচ্ছে হিমছড়ি থেকে কক্সবাজার। তিন দিনের এই অভিযাত্রায় কোন শ্বেতাঙ্গ পর্যটক অভিযাত্রীদের চোখে পড়েনি, যদিও টু্যরিস্ট সীজন এখন তুঙ্গে। অর্থাৎ, সৈকতের মূল সুষমাময় অংশটিতে বহির্বিশ্বের পর্যটকদের চোখ পড়েনি। এই নিয়ে গল্পগুজব করে পথ চলতে চলতে বিকেলবেলা কঙ্বাজারে পৌঁছে গেলো পেছনের দলটাও। বরুণদা অনেক আগে পৌঁছেছেন, জরুরি কাজে তিনি চলে গেছেন চট্টগ্রাম। সবার আগে পৌঁছেছেন বখতিয়ার ভাই। এক এক করে সবাই সৈকত থেকে কক্সবাজার শহরে হোটেল সায়েমানে নজরুল ভাইয়ের রুমে গিয়ে হাজির হলেন। নজরুল ওরফে খোকন ভাই কঙ্বাজারে একটা কার্গো এয়ারলাইন্স-এর পরিচালক, মূলত ইউক্রেনিয়ান ক্রু নিয়েই চলছে তাঁর জেড এয়ারলাইন্স। পুতুল আর শিলা, দুই বোন চলে গেছেন বার্মিজ মার্কেটে, তাঁরা একবারে সন্ধ্যে আটটার সময় বাস কাউন্টারে হাজির হবেন। সবাই গোসল সারতে সারতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। গায়ে মৃদু ব্যথা সবারই, খোলা আকাশ ছেড়ে ছাদের নিচে মাথা গুঁজে দেয়ায় সবাই একটা ঘোরের মধ্যে, ভাবখানা এমন, এইটা আবার কী জিনিস? সন্ধ্যেবেলা খোকন ভাই সবাইকে নিয়ে হাজির হলেন তাঁর বন্ধু সাজ্জাদ ভাইয়ের ক্যাফে 'অ্যাঞ্জেল ড্রপ'-এ। সেখানে কফি খেতে খেতে বাসের সময় হয়ে এলো, হুড়োহুড়ি করে সবাই আবার ছুটলেন বাস কাউন্টারের দিকে। মিনিট পাঁচেক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো বাসটাকে, বাসের যাত্রীদের কাছে সেজন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে একে একে সবাই চড়ে বসলেন। একশো কিলো ট্রেকিং শেষে খানিকটা ক্লান্ত পা নিয়ে ঢাকায় ফিরে চললেন সবাই। ফেরার রাতে পূর্ণিমা। চারদিকে নরম আলো ছড়িয়ে চাঁদ উঠেছে। আজ সাগরে জোয়ার সবচে জোরালো হবে। সাগরের তীর ছেড়ে আবার ধূলিমলিন ঢাকা শহরে ফিরে চলছেন সবাই। এ ক'দিনে টাটকা নোনা বাতাসে অভ্যস্ত সবাই, ঢাকায় ফিরে আবার সেই ধূলা আর কালো ধোঁয়ায় কী হয় কে জানে! বিশেষ দ্রষ্টব্য: বালি অভিযাত্রীদের সাথে কক্সবাজার পর্যন্ত এসেছিলো। বখতিয়ার ভাই বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্যে রিকশা ঠিক করেছিলেন, সে রিকশার পাশে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিলো। রিকশাওয়ালা গতি বাড়িয়ে দেয়ার পর সে আর বেশিক্ষণ তাল মিলিয়ে ছুটতে পারেনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে, পিছিয়ে পড়েছিলো। পরে পর্যটন মোটেলের কাছে সে পারভীন আপাকে খুঁজে বের করেছিলো, কিন্তু পারভীন আপা কুকুর ভয় পান বলে তাকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। মন খারাপ করে সেখানেই কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছিলো সে। ফরিদ ভাই তাকে শেষ দেখেছেন আরেকদল অভিযাত্রীর সঙ্গ নিতে। ৫. পাঠকদের জন্যে দু'টি অনুরোধ। এই অপূর্ব রূপময়ী সৈকতের সানি্নধ্যে যখন যাবেন, দয়া করে এমন কিছু ফেলে আসবেন না, যা জৈবপচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) নয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বোতল, চকলেট বা ব্যান্ডেজের খোসা, পানীয়ের ক্যান --- কিছুই না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এক্সপ্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্যরা তাঁদের ব্যবহৃত প্রত্যেকটি অপচনশীল বর্জ্য নিজেদের সাথে ফিরিয়ে এনে ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। আপনার ফেলে যাওয়া আবর্জনা কিন্তু সৈকতে পড়ে থাকবে বহুদিন। পরবর্তী পর্যটকদের বিরক্তি উৎপাদন করা ছাড়া আর কোন ভূমিকা সেগুলো রাখবে না। নিজের রূপের মতোই নিজের দেশের সৌন্দর্যের প্রতি যত্নবান হোন। আর, কেউ যদি বালিকে খুঁজে পান, দয়া করে ভালো কয়েকটা বিস্কিট খাওয়াবেন।
false
ij
ধর্মপদ_ আজকের বিষয়_ জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষ প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছেন। ইসলাম ধর্মে হযরত আলী, সনাতন ধর্মে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, খ্রিস্টধর্মে সাধু পল, বৌদ্ধধর্মে নাগার্জুন ...আমরা সবাই এঁদেরই উত্তরসূরি; আমরা এঁদের প্রত্যেকের কাছেই শিখব। বুদ্ধ - প্রাচীন বাংলাদেশে বেশ ক'বারই এসেছিলেন। আজ যে জায়গাটাকে আমরা বলি-বগুড়া; আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে সেখানেই ছিল পুন্ড্রবর্ধন রাজ্য। পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী-পুন্ড্রনগর, যে নগরের পুবদিকে বয়ে যেত করতোয়া নদী। তৎকালীন সময়ে, অর্থাৎ, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পুন্ড্রনগরের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল অনেকগুলি বৌদ্ধমঠ বা বিহার । ভাসু বিহার ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলায় এলে বুদ্ধ ওখানেই উঠতেন। সেই প্রাচীন সময়ে বৌদ্ধরা বর্ষাকালের চারটি মাস দুর্যোগপূর্ন হওয়ায় কোনও বিহারে কাটিয়ে দিত। বুদ্ধ বেশ কবার বর্ষাকালের চার মাস ভাসুবিহারে অবস্থান করেছিলেন । কখনও বগুড়ায় গেলে আজও ভাসুবিহারটির ধবংসাবশেষ আপনার চোখে পড়বে। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে- বুদ্ধ ভাসুবিহারের ঠিক কোন্ কক্ষটি বাস করতেন। Dhammapada 6. The Wise Man The wise man tells you Where you have fallen And where you yet may fall - Invaluable secrets! Follow him, follow the way. Let him chasten and teach you and keep you from mischief. The world may hate him. But good men love him. Do not look for bad company Or live with men who do not care. Find friends who love the truth. Drink deeply. Live in serenity and joy. The wise man delights in the truth And follows the law of the awakened. The farmer channels water to his land. The fletcher whittles his arrows. And the carpenter turns his wood. So the wise man directs his mind. The wind cannot shake a mountain. Neither praise nor blame moves the wise man. He is clarity. Hearing the truth, He is like a lake, Pure and tranquil and deep. Want nothing. Where there is desire, Say nothing. Happiness or sorrow - Whatever befalls you, Walk on Untouched, unattached. Do not ask for family or power or wealth, Either for yourself or for another. Can a wise man wish to rise unjustly? Few cross over the river. Most are stranded on this side. On the riverbank they run up and down. But the wise man, following the way, Crosses over, beyond the reach of death. He leaves the dark way For the way of light. He leaves his home, seeking Happiness on the hard road. Free from desire, Free from possessions, Free from the dark places of the heart. Free from attachment and appetite, Following the seven lights of awakening, And rejoicing greatly in his freedom, In this world the wise man Becomes himself a light, Pure, shining, free. সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৫৫
false
ij
কে ছিলেন রাসপুতিন_ ‘রাসপুতিন’ শব্দটায় নেতিবাচক অনুষঙ্গ জড়িয়ে থাকলেও রাশান ভাষায় রাসপুতিন শব্দটি কিন্তু মোটেও অস্বাভাবিক নয়; তবে বিশ্বজুড়ে রাসপুতিনের পরিচয় নারী আসক্ত ক্ষমতালিপ্সু এক উন্মাদ সাধু হিসেবে। তাঁকে বলা হয়েছে Russia's greatest love machine ...তবে, বর্তমানকালের বিচারে তাকে ততটা অনৈতিক লম্পট মনে না-হলেও রাসপুটিন যে এক রহস্যময় বিতর্কিত পুরুষ ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ... ছেলেবেলায় শুনতাম বনি এম এর গান - There lived a certain man in Russia long ago He was big and strong, in his eyes a flaming glow Most people looked at him with terror and with fear But to Moscow chicks he was such a lovely dear এই শেষ লাইনটা ভুল। কেননা, রাসপুটিনের সময়ে রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্র মস্কোয় ছিল না-ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ, পরবর্তীকালে যা পরিচিত হয়ে ওঠে লেলিনগ্রাদ নামে। তবে এককালে রাশিয়ায় সত্যি সত্যি রাসপুটিন নামে একজন বাস করতেন। রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় উরাল পাহাড়ের কাছে তুরা নদী। সেই নদীর তীরে ছিল প্রোকরোভস্কয় নামে একটি গ্রাম। গ্রামে কয়েকটা রাস্তা-রাস্তার পাশে কাঠের একতলা কি দোতলা বাড়ি। গ্রামের মাঝখানে খ্রিস্টান রাশিয়ার প্রতীক হিসেবে সোনালি গমম্বুজঅলা সাদা রঙের গির্জা । সেই প্রোকরোভস্কয় গ্রামেই ২২ জানুয়ারি ১৮৬৯ সালে জন্ম গ্রহন করেন গ্রিগরি ইয়েফ্লিমোভিচ রাসপুতিন । রাসপুতিনের বাবা ঘোড়ার ব্যবসা করতেন। তো, একবার তার কয়েকটা ঘোড়া চুরি হল- বালক রাসপুতিন নাকি ঘোড়া চোরের নাম বলে দিয়েছিল। গ্রামে লোক বলাবলি করল ছেলে তো খ্রিস্টের আর্শীবাদ পেয়েছে। সেই শুরু ... মারিয়া নামে বোন আর দিমিত্রি নামে এক ভাই ছিল রাসপুতিনের। মারিয়ার মৃগীরোগ ছিল- পুকুরে ডুবে মারা যায় মেয়েটি । একদিন দিমিত্রির সঙ্গে পুকুর পাড়ে খেলছিল রাসপুটিন। দিমিত্রি হঠাৎ পকুরে পড়ে যায়। রাসপুতিন ভাইকে বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাবুডুবু খাচ্চিল। পথচারীরা তাদের বাঁচায়। পরে অবশ্য দিমিত্রি মারা যায় নিমোনিয়ায় । শোক ... শোক আর শোক ... জীবন কি অর্থহীন ঠেকছিল রাসপুতিনের কাছে? আঠারো বছর বয়েসে অতীন্দ্রি অনুভূতি হয় রাসপুতিনের । সেই সময়ে ভ্রমনে বেরয় সে। সাইবেরিয়ার মঠে মঠে ঘুরে বেড়ায়। সম্ভবত, শোক ও নিঃসঙ্গতা এড়াতে ধর্মের আশ্রয় খুঁজছিল সে। এই সময়ে খলেস্টি স¤প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয় হল তার। খলেস্টি স¤প্রদায়ের প্রবক্তা সাইবেরিয়ার একজন চাষি; এরা গির্জে মানে না, ধর্মীয় পুস্তকও মানে না ... যা হোক। ১ বছর ঘোরাঘুরির পর গ্রামে ফিরে আসে রাসপুতিন। বিয়ে করে। কনের নাম প্রাসকোভিয়া ফিয়োদরোনভা। তিনটি বাচ্চা হল এদের- দিমিত্রি, মারিয়া ও ভারভারা। সংসারে মন বসল না। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল । সাধারন লোকে বলে অলৌকিক কান্ড ঘটায় সে। নিরক্ষর রাশিয়ার চাষি সমাজ সেসব বিশ্বাসও করত। মানুষের কত সমস্যা-তারা রাসপুতিনের কাছে যেত। সব সমস্যার সমাধান হত কি না -প্রশ্ন সেটাই। যা হোক। শিষ্যও জুটেছিল রাসপুতিনের । তাদের সঙ্গে নিয়ে ১৯০৫ সালে তৎকালীন রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছলেন । সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিজাত ভক্তশিষ্য জুটেছিল- বেশির ভাগই দুনীর্তিগ্রস্থ আমলা-তারাই রাসপুতিনের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। অভিজাত মানুষের নানা সমস্যা-আসলে মানুষের নানা সমস্যা-তারা সেসব সমস্যা নিয়ে রাসপুতিনের কাছে যেত। এই সময়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিজাত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট মেলামেশা বাড়ছিল রাসপুতিনের। আসলে নারীরাই মুগ্ধ ছিল রাসপুটিনের প্রতি...এমন কী হতে পারে না? তখন রাশিয়ায় রোমানভ বংশের শাসন। রাশিয়ার সম্রাটকে বলা হয় জার। জার ২য় নিকোলাস রাশিয়ার সম্রাট -ইনিই রোমানভ বংশের সর্বশেষ ...একেই লেলিনের নেতৃত্বে উৎখাত করা হয়েছিল ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের সময়। জারের স্ত্রী জারিনা আলেকজান্দ্রা। এদের একমাত্র পুত্র আলেকসেই -রাশিয়ার সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরসূরী ... তো, সে সময় দূর্ঘটনাবশত আলেকসেই ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিল; তারপর থেকে তার অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে: হেমোফিলিয়া । চিকিৎসা চলছিল -লাভ হচ্ছিল না। রাসপুতিনের অলৌকিক মাহাত্ব্যের কথা জার আর জারিনার কানে পৌঁছেছিল। তারা বিশেষ পাত্তা দেননি। পরে চিকিৎসকরা আলেকসেইর জীবনের আশা ছেড়ে দিলে ১৯০৭ সালে রাসপুতিনকে জারের প্রাসাদের ডাকা হল। রাসপুতিন কী এক যাদুবলে আলেকসেই কে সারিয়ে তুললেন। অনেকে বলে জোঁক দিয়ে নাকি রাসপুতিন আলেকসেইর রক্ত শুষে নিয়েছিল । জোঁকের লালায় থাকে হিরুদিন; যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। আবার অনেকে বলে অ্যাসপিরিন দিয়ে নাকি আলেকসেই কে সারিয়ে তুলেছিল রাসপুতিন। অ্যাসপিরিন জিনিসটা ১৮৯৮ সাল থেকেই ইউরোপে পাওয়া যেত। যাই হোক - আলেকসেই সেরে ওঠার পর জার নিকোলাস রাসপুটিনকে রাশিয়া ও জার-পরিবারের বিশ্বস্ত বন্ধু ঘোষনা করলেন। তারপর থেকে জারিনা আলেকজান্দ্রার ওপর রাসপুটিনের প্রভাব বাড়তে থাকে। রাসপুটিনের কথা ঈশ্বরের কন্ঠস্বর বলে ভ্রম করতে লাগলে জারিনা আলেকজান্দ্রা ... নানা রকম কানাঘুঁষা শোনা গেল। এ নিয়ে বনি এম এর গীতিকার লিখেছেন- RA RA RASPUTIN Lover of the Russian queen There was a cat that really was gone RA RA RASPUTIN Russia's greatest love machine It was a shame how he carried on শেষ কথাটি কোনও ইউরোপীয় গীতিকার লিখেছেন -ভাবাই যায় না ... যাক। তারপর ১ম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হল। তার নিদারুন ধাক্কা লাগল রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী সমাজদেহে। সেই সঙ্গে ছিল অনৈতিক আমলাদের সীমাহীন লুটপাট। এসব কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। অথচ, সে সময় অনেক অভিজাত রাজপুরুষই জারিনা আলেকজান্দ্রার ওপর রাসপুতিনের প্রভাবকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুর্গতির মূল কারণ বলে অবহিত করল। ১৯১৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ -এর অভিজাতরা রাসপুটিনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই হত্যাকান্ডের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রিন্স ফেলিকস ইউসুপভ। তিনি রাসপুতিনকে তার প্রাসাদে নিমন্ত্রন করেন। বিষ মেশানো মদ আর কেক খেতে দেন রাসপুতিনকে। তাতেও নাকি রাসপুতিনের ওপর বিষের ক্রিয়া হয়নি। এই ঘটনা নিয়ে বনি এমের গীতিকার লিখেছেন- RA RA RASPUTIN Lover of the Russian queen They put some poison into his wine RA RA RASPUTIN Russia's greatest love machine He drank it all and he said "I feel fine" রাসপুতিনের ওপর বিষের ক্রিয়া হয়নি দেখে রাগের মাথায় ইউসুপভ গুলি করে বসেন রাসপুতিনকে। রাসপুতিন গড়িয়ে গড়িয়ে ইঁট বাঁধানো প্রাঙ্গনে নেমে গেলে ইউসুপভ ও অন্যেরা রাসপুতিনকে নেভা নদীতে ফেলে দেয় ... There lived a certain man in Russia long ago He was big and strong, in his eyes a flaming glow সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৩২
false
mk
বেগম জিয়ার চিত্তশূন্য একুশে আগস্ট শোকবাহ দিন। দেশের মতো বিদেশের বাংলাদেশীদের মনেও এর বিরূপ এবং দুঃখজনক প্রভাব আছে। আওয়ামী লীগ করেন না এমন অনেক ব্যক্তিকে আমি এ বিষয়ে শোকার্ত ও সোচ্চার দেখতে পাই। খুব ভালভাবে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখলে বোঝা কঠিন নয়। হামলাটির লক্ষ্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার এমন হীন ও জঘন্য হত্যাকাণ্ডে অফসল প্রতিপক্ষ কিন্তু একেবারে ব্যর্থ ছিল না। এই হামলায় অন্যান্য নিরীহ নেতাকর্মীর সঙ্গে উড়ে গিয়েছিল আইভী রহমানের পদযুগল। আইভী রহমানের স্বামী জিল্লুর রহমান পরবর্তীতে এ দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন। তিনিও আজ প্রয়াত। প্রশ্ন জেগেছে প্রবাসীদের মনে, দেশের শীর্ষ দুটি পদে আসীন মানুষদের জীবন ও পরিবার নিয়ে খেলার পরও খুনীদের বিচার আজও কেন ঝুলে আছে?এটা পঁচাত্তর নয়। এখন আর আগের মতো সত্য ধামাচাপা দেয়া সম্ভব নয়। একুশে আগস্ট জাতির জীবনে কলঙ্কময়-রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্য রাজপথে রক্তে ভাসিয়ে দেশকে আফগানিস্তান বা বধ্যভূমি বানানোর পেছনে কারা জড়িত, সবাই জানে। তবু কেন বিচার হলো না! তবে কি আমরা ধরে নেব, শত্রুর হাত দীর্ঘ ও শক্তিশালী? এমনকি ক্ষমতার চেয়েও বড়?এবার আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, কিছু মিডিয়া পুরো ঘটনার দায় একটি জঙ্গী সংগঠনের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। হুজি নামের এই সংগঠনটি নিশ্চয়ই দায়ী হতে পারে। বর্বর গ্রেনেড হামলা চালানোর জন্য ওই জাতীয় সাংগঠনিক ভিডি প্রশিক্ষিত কর্মী বা খুনীর প্রয়োজনও স্বীকৃত। কিন্তু এই দোষারোপ সম্পূর্ণ সঠিক বা উদ্দেশ্যহীন কিছু নয়, এতে তারেক জিয়া, বাবর, জজসহ দেশের কিছু সুশীল বাদ পড়ে যাচ্ছে। কে জড়িত, কে জড়িত না; তার বিচার ও শাস্তি আইনের হাতে। আমরা প্রবাসে থেকেও উদ্বিগ্ন আর ভয়ার্ত। এই কারণে বন্দুকের গুলি বা নলের বিচারে অন্তত আমাদের দেশে নেপথ্যে থাক। আসল খুনীরা বিচারের আওতায় আসে না। ছলেবলে-কৌশলে পার পেয়ে যায়। একুশে আগস্টের হোতারা পার পেয়ে গেলে বাংলাদেশের স্থিরতা ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে, তোপের মুখে পড়বে ইমেজ; সব চেয়ে ভয়ের বিষয় খুনের রাজনীতি আবারও উস্কে উঠবে। লন্ডন থেকে মাঝে মাঝে সে ইন্ধন নানা চেহারা ও বক্তব্যে ভেসে আসে। টের পাওয়া যায় চৌকোণা বাক্স পুড়ে অনর্গল বকে যাওয়া, রাতজাগা অতিথির কণ্ঠে। ফলে সাবধানতার বিকল্প নেই। সিডনি প্রবাসী তথা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা একুশে আগস্টের ঘটনার পেছনে জড়িত থাকা সকলের শাস্তি চায়। নির্বিঘ্ন-সুন্দর-চমৎকার স্বদেশের কামনায় এটা হওয়াই জরুরী। কেবল এতেই ঝরে যাওয়া প্রাণ ও রক্তধারা শুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।শূন্যতায় শোকসভা ও বেগম জিয়া?ধরে নিলাম, বিশাল কোন জনসভায় উপস্থিত থাকার কথা, কিন্তু শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকতে পারেননি। এবার কয়েকটি মিডিয়ার কথা ভেবে নিই, আর কিছু লেখক নামধারী সুশীল ও টকশো বক্তাওয়ালা। গলগল করে বিষবাষ্প বেরুচ্ছে। ভন ভন করে কথার মাছি উড়ছে। সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের গুজবের ডানা তখন আসমানে। ট্যাবলয়েডের জমিনে মুখরোচক গল্পে আওয়ামী লীগে ভাঙ্গনের বা অন্য কিছুর বিকৃত আনন্দ। এ কল্পনা নিছক অনুমাননির্ভর কিছু না। আমাদের নিয়তি অথবা দুর্ভাগ্য যেটাই বলি না কেন, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে চেনা-অচেনা, পাল্টে যাওয়া মুখের শত্রুরা এভাবেই তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করে আসছে।ঢাকঢোল পিটিয়ে জনগণের দোহাই দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান চাওয়া বিএনপির মহাসমাবেশে খালেদা জিয়া ছিলেন অনুপস্থিত। সভা চলাকালে কেউ প্রশ্ন করে না, প্রশ্নের বা উত্তরেরও সুযোগ থাকে না। তাঁরা নিজেরাই বলে দিয়েছেন, খালেদা জিয়া না আসার পেছনে কোন রহস্য নেই। শুধু তাই নয়, এদের শরিক বাংলাদেশের রাজনীতির কলঙ্কপুত্র শফিউল আলম প্রধান জনসভায় দাঁড়িয়েই এ সত্য অনুমোদন করে বলেছেন তারা এ সত্য মেনে নিয়েছেন। যেমন সত্যবাদী তেমনি তার অনুমোদনদাতা। আজ যাঁরা সাত খুন নয়, খুন খুনের নহরে ভাসা লাশের জন্য আহাজারি করেন, প্রকৃত দোষী চিহ্নিতকরণ বা নিশ্চিত শাস্তিদানের পরিবর্তে পানি ঘোলা করছেন তাঁরা জেনেও ভুলে থাকেন স্বাধীন দেশে সাত খুনের আসামি এই প্রধান। এখনও বিএনপির দোসর হয়ে প্রধান ভূমিকায় থাকার কসরৎ করে যাচ্ছেন। ইনিই খালেদা জিয়াকে মঞ্চে তিলকওয়ালী বলে সম্বোধন করেছিলেন। বারোস্তরের রাজনীতিতে তেরোতম পিশাচ দিচ্ছে সত্যের অনুমোদন, হাস্যকরই বটে!বিএনপি জানে, জামায়াতের সঙ্গে নিবিড়ঘন বন্ধুত্বের আকাশে এখন ভাঙনের কালো মেঘ। এও জানে, মজেনা মানেই আমেরিকা নয়, ড. ইউনূস মানে ব্যাপক দুনিয়া নয়। কদিন আগে দু-একটি মিডিয়া গায়িকা ন্যান্সির আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং বেঁচে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগকে দায়ী করতে চেয়েছিল; তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বেগম জিয়াকে সমর্থনই নাকি এই বিপর্যয়ের নেপথ্য কারণ। এখন তাঁরা কি বলবেন? অসুস্থ খালেদা জিয়ার অসুখ আওয়ামী অভিশাপ না চক্রান্ত?আমরা কারও বিপদে মন্দ বলি না, অসুস্থতা কামনা করি না। কেন জানি দেশ বিভাগের অব্যবহিত পূর্বের গল্পটি মনে পড়ে যাচ্ছে-শেষ ভাইসরয় নাকি দুঃখ করে বলেছিলেন, জিন্নাহ সাহেবের যক্ষ্মা বা ক্ষয়রোগ হয়েছে জানলে পাকভারতের বিভক্তিটা আরও কিছুদিন ঝুলিয়ে দেখতাম, কি হয়। শ্রুত যে, বেগম জিয়া নাকি গুরুতর এক অসুখে ভুগছেন জানলে জামায়াত ও দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা কি ভাববেন, কে জানে। উদ্যানে যতবড় জমায়েতই হোক না কেন, রোল কলে দেখা গেল : খালেদা জিয়া এ্যাবসেন্ট! প্লিজ, এভাবে কি আন্দোলন হয় আদৌ?
false