content
stringlengths
0
129k
পঞ্চাশজনের দুর্ধর্ষ এই দলটা নিষ্কর্মা পড়ে আছে সেই তখন থেকেই
একদল সশস্ত্র যোদ্ধাকে এরকমভাবে ফেলে রাখা আর মেরে ফেলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই
তিনি পেশাদার যোদ্ধা
সামরিক বাহিনী থেকে কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন
যুদ্ধের প্রয়োজনে যুদ্ধহীন দীর্ঘ প্রতীক্ষাতেও সমস্যা হয় না তাঁর
কিন্তু, তাঁর সাথের যোদ্ধারা প্রায় সবাই সামরিক পটভূমিকাবিহীন
কেউ ছাত্র, কেউ মাঠে কাজ করতো, কেউ ইটের ভাটায়, কেউ বা টুকটাক ব্যবসা করতো, কেউ ছিল বেকার
বাপের হোটেলে বসেই অন্ন ধ্বংস করতো
এই যুদ্ধ শুরু হবার আগে এরা কেউ আগ্নেয় অস্ত্র চোখেও দেখে নি
ওপারে শত্রুদের রেখে এপারে নিশ্চুপ বসে থাকায় স্নায়ুর উপর তীব্র চাপ পড়ছে সবারই
এই দলের প্রায় সবাই তাঁর কাছাকাছি বয়সের
কেউ কেউ তাঁর থেকে বয়সে বড়ও
কিন্তু কী কারণে যেন তাঁকে যমের মত ভয় পায় এরা
হয়তো তাঁর গম্ভীর আচরণের কারণে
কিংবা ভয়ংকর মেজাজের জন্যেও হতে পারে
একবার এক টগবগে রক্তগরম কিশোর যোদ্ধার সৌখিন চুল চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ছেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি
দেশের জন্য যুদ্ধ করার সময় ব্যক্তিগত বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, এই ছিল তাঁর যুক্তি
আরেকবার কয়েকটা ছেলে অবসরে রেডিওতে গান শুনছিল বলে, সেই রেডিও কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি
তিরস্কার করে বলেছিলেন, "গ্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, মেয়েদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, আর তোমরা গান শুনে ফুর্তি করছো? রেডিও শুধু খবর শোনার জন্য
খবর শুনবে, তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে কালকে কোথায় যুদ্ধ করতে যাবে, কীভাবে যুদ্ধ করবে?"
তবে, তাঁর যোদ্ধারা তাঁকে শুধু ভয় পায় বললে ভুল হবে
এদের প্রবল শ্রদ্ধা এবং অসীম আস্থা তিনি অর্জন করে নিয়েছেন নিজ যোগ্যতা বলে
আর সে কারণেই মুখ ফুটে কেউ কিছুই বলছে না তাঁকে
কিন্তু তাদের চোখের অস্থির ভাষাটা পড়তে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না তাঁর
এভাবে বেশিক্ষন আটকে রাখা যাবে না এইসব টগবগে তরুণদের
বিশেষ করে যখন এরা টের পেয়ে গিয়েছে যে, যুদ্ধজয় আর বেশি দূরের ঘটনা নয়
একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হতে যাচ্ছে তাদের হাত দিয়ে
এর থেকে রোমাঞ্চকর বিষয় আর কী হতে পারে?
চাপাই নবাবগঞ্জ দখল করার জন্য তিনটে দল ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে
একটা দল পজিশন নিয়েছে রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ সড়কে
রাজশাহী থেকে চাপাই নবাবগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই মুল উদ্দেশ্য
দ্বিতীয় দল দায়িত্ব পেয়েছে কাটঅফ পার্টি নিশ্চিত করার
আর তাঁর দলের উপর মূল দায়িত্ব
চাপাই নবাবগঞ্জ দখল করা
আক্রমণের মূল পরিকল্পনা করা হয়েছিল ভারতে বসে
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং ছিলেন সেই মিটিং এ
কথা ছিল যে, তাঁরা মহানন্দার এপাশে পজিশন নেবার পরেই এগারো তারিখে শত্রুপক্ষের উপর আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করবে ভারতীয় বাহিনী
তাদের বিভ্রান্ত এবং দুর্বল করাই মূল লক্ষ্য
এই হট্টগোলের মধ্যে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন শত্রুর উপরে
তারপর দখল নেবেন চাপাই নবাবগঞ্জের
সেই গোলাবর্ষণ আর হয় নি
ওয়ারলেসে হাজার চেষ্টা করেও ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি তিনি
মেজাজের পারদ সর্বোচ্চতে পৌঁছে গেছে সেই সময় থেকেই
দায়িত্বে অবহেলা আর কথা দিয়ে কথা না রাখাকে প্রবলভাবে ঘৃণা করেন তিনি
এই চুতিয়াদের উপর নির্ভর করাটাই বোকামি হয়েছে
এই দেশ আমাদের
যুদ্ধটাও আমাদের
যা করার আমাদেরই করতে হবে
মনে মনে প্রেম সিং এর মাকে নিয়ে প্রেম ভালবাসা বিষয়ক কুৎসিত একটা গালি দেন তিনি
আবছা অন্ধকারে কিশোরীর রুপোলি ফিতার মত নিথর হয়ে পড়ে থাকা মহানন্দার দিকে তাকান তিনি
কপালে চিন্তার ভাঁজ
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন নিজের অজান্তেই
নদীটা পাড়ি দিতে হবে
ওপারে একটা ব্যাংকারে লাইট মেশিনগান আছে
ওটাকে অকেজো করতে না পারলে নদী পার হওয়াটা অনেক বিপদজনক
কচুকাটা হয়ে যাবে তাঁর অপেশাদার বাহিনী
মহানন্দার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময়টা পিছিয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত
এরকমই এক নদী পেরিয়ে এসে মাত্র কয়েক মাস আগে যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি
আজ আরেক নদী পেরিয়ে সেই যুদ্ধের শেষ করতে যাচ্ছেন
মাঝখানে পেরিয়ে গিয়েছে কতখানি সময়, কতখানি ভৌগলিক দূরত্ব
জুলাই মাসে তিনি ছিলেন কারাকোরামে
আরো তিনজন বাঙালি অফিসারকে নিয়ে মিলিশিয়ার ছদ্মবেশ ধরে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতে আসেন তাঁরা
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন
প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল সারা এলাকা
কোথাও হাঁটু পরিমাণ পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা গলা পরিমাণ পানি
এগুলো ভেঙেই এগোচ্ছিলেন তাঁরা
ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে তাঁরা ভুল করে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি রেঞ্জারদের ক্যাম্পের পাশে
কোন হ্যায় বলে অস্ত্র হাতে তারা বের হয়ে এসেছিল খোঁজাখুঁজি করার জন্য
পানির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে শুধু নাক জাগিয়ে নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন তাঁরা
বৃষ্টিময় রাতে অন্ধকারে কাউকে না দেখতে পেয়ে ফিরে গিয়েছিল রেঞ্জাররা
গভীর রাতে তাঁরা পৌঁছেছিলেন মুনাওয়ার তাবী নদীর ধারে
এই নদী পার হলেও ওপারে ভারত
কিন্তু নদীতে পা দিয়ে চমকে গিয়েছিলেন তাঁরা
ভয়ংকর স্রোত আর বরফের মত শীতল পানি নদীর
বরিশালের ছেলে তিনি
নদী নালাতে জীবন কেটেছে তাঁর
সেই তিনিও সাহস পেলেন না এই যৌবন উন্মত্ত নদীতে সাঁতার দিতে
আরো দুই তিন মাইল উজানে হেঁটে গিয়েছিলেন তাঁরা যৌবনবতী নদীর সরু কোমরের আশায়
পেয়েছিলেন সেরকম
কিন্তু সেখান দিয়ে পার হতে গিয়েও জীবন প্রায় বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা
পুরো পথটাই তেমন কোনো কথা হয় নি তাঁদের
বিশেষ করে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন
তাঁকে গম্ভীর দেখে অন্যেরাও কথা বলে বিরক্ত করে নি তাঁকে
কিন্তু বিদায় নেবার সময় আচমকাই ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন প্রশ্ন করে বসেছিলেন তাঁকে
"আচ্ছা, পালাবার ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের মনেই এক-একটা না একটা কারণ কাজ করেছে
আপনার পালানোর পিছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল কী?"
আচমকা এই প্রশ্নে স্থির হয়ে যান তিনি
যখন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন যে, এর উত্তর তিনি পাচ্ছেন না, ঠিক সেই সময়ে কথা বলে উঠেন
মৃদু স্বরে বলেন, "প্রথম থেকেই পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবো, এরকম ইচ্ছে ছিল
তবে পালাবার পথ বা সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিলাম না
কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম যে, পাকিস্তানিরা কিছু বাঙালি মেয়েকে ধরে এনে লাহোরে বিক্রি করে দিয়েছে, সেদিন থেকে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম
একটু দম নেন তিনি
চোখ নামিয়ে নেন মাটির দিকে
তারপর প্রায় শোনা যায় না, এমন অনুচ্চ স্বরে বলেন, "খবরটা জানার পর আট-দশদিন পানি ছাড়া আর কিছু খেতে পারি নাই আমি
আমার নিজের একটা কিশোরী বোন আছে
ওর ছবি সবসময় আমার মানিব্যাগে থাকে
তার মুখটা শুধু ভেসে উঠেছে আমার চোখের সামনে
নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি
তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আউয়ালও এসে দাঁড়ায় পাশে
আউয়াল এই অপারেশনের সহকারী কমাণ্ডার