poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | তুমি অপরুপ, তুমি সৃষ্টির যথেষ্ট পূজা পেয়েছো জীবনে?
তুমি শুভ্র, বন্দনীয়, নারীর ভিতরে নারী, আপাতত, একমাত্র তুমি
বাথরুম থেকে এলে সিক্ত পায়ে, চরণকমলযুগ চুম্বনে মোছার যোগ্য ছিল-
তিন মাইল দুরে আমি ওষ্ঠ খুলে আছি, পূজার ফুলের মতো ওষ্ঠাধর
আমি পুরোহিত, দেখো, আমার চামর, বাহু স্বতোৎসার শ্লোক
হৃদয় অহিন্দু, মুখ সোমেটিক, প্রেমে ভিন্ন কোপটিক খৃষ্টান
আশৈশব থেকে আমি পুরোহিত হয়ে উঠে তোমার রূপের কাছে ঋণী
তোমার রূপের কাছে অগ্নি, হেম, শস্য হবি-পদাঘাতে পূজার আসন
ছড়িয়ে লুকাও তুমি বারবার, তখন তন্ত্রের ক্ষোভে অসহিষ্ণু আমি
সবলে তোমার বুকে বসি প্রেত সাধনায়, জীবন জাগাতে চেয়ে জীবনের ক্ষয়
ওষ্ঠের আর্দ্রতা থেকে রক্ত ঝরে, নারীর বদলে আমি স্ত্রীলোকের কাছে
মাথা খুঁড়ি, পুরোহিত থেকে আমি পুরুষের মতো চোখে ক্রুরতা ছড়িয়ে
আঙুলে আকাশ ছুঁই, তোমার নিঃশ্বাস থেকে নক্ষত্রের জন্ম হলে
আমি তাকে কশ্যপের পাশে রেখে আসি।
এ রকম পূজা হয়, দেখো ত্রিশিরা ছায়ায় কাঁপে ইহকাল
এমন ছায়ার মধ্যে রূপ তুমি রূপের কঠিন ঋণ বিশাল মেখলা
আমি ঋণী আমি ক্রীতদাস নই, আরাধনা মন্ত্রে আমি
তোমাকে সম্পূর্ণ করে যাবো।।
আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভূরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করোছো অসীম।
বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনও ভাবি অপার্থিব কিনা।
সারাদিন পৃথিবীকে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে সি’র জানি তুমি দেবে ক্ষমা।
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কার মুখর
তোমার সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখে জয়ের স্বাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্পূটে
অসি’র অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য, দুপুরের অস্থির কুহক
অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু’চক্ষুর সীমা
পথ চলতে থম্কে গেলো অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক।
ভিজে চুল খুলেছে সে সুকুমার, উদাস আঙুলে
স্তনের বৃন্তের কাছে উদ্বেলিত গ্রীষ্মের বাতাস
কি যেন দেখলো মিলে এক সঙ্গে নিল দীর্ঘশ্বাস।
একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে
সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো
সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুণে গুণে দেখলো সস্নেহে
এ মাসেই চাকবি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো
অলিন্দের আলো।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, নির্লিপ্তের মতো চেয়ে বললো মনে মনে
কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শেষবার ফিরে দেখলো তাকে
রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে
এ যেন নদীর মতো, নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার
রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-
শুকনো পাতার ভাঙা নিশ্বাসের মতো শব্দ
তলতা বাঁশের ছায়া, শালের বল্লরী,
সরু পথ
কালভার্টে, টিলার জঙ্গলে একা বসে থাকা কী-করম নিঝুম বিষন্ন
বড় হিংস্র দুঃখময়।
অসংখ্য আত্মার মতো লুকোনো পাখী ও প্রাণী, অপার্থিব নির্জনতা
ফুলের সুবর্ণরেখা গন্ধ, সামনে ঢেউ উৎরাই-
অসহিষ্ণু জুতোর ভিতরে বালি, শিরদাঁড়া ব্যথা পেতে দ্ধিধা করে
কেননা কুকের মধ্যে চাপা হাওয়া, করতলে মুখ।
গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-
তবু যেতে হয়
বারবার ফিরে যেতে হয়।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা
এ-কবিতা মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে
ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের
থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে একমুহূর্ত ভাবলে
কে তোমার কথা মনে করছে এত রাত্রে–তখন আমার
এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কম ড্যাস রেফ্
ও রয়ের ফুট্কি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার
আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও
বিছানায় আমার নিশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলি
এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু
তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে
তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি
আমার ভয়ংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না–আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মাতো ভদ্র হিম,
শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে–এরা তোমাকে চুম্বন করলে
তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে
এক বিছানায়–তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের
কাছে মরা প্রজাপতির মতো এরা লুটোবে। এদের আত্মা মিশে
থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো
বহুদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো
হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে। নীরা, আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো। আমি অন্য কথা
বলার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে মনে
ঘরভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে
নিজস্ব চোখে তাকাবো।
তুমি জানতে পারবে না–তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে
আমার একটি অতি-ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | নীরার চোখের জল অনেক চোখের অনেক
নীচে
টল্মল্
নীরার মুখের হাসি মুখের আড়াল থেকে
বুক, বাহু, আঙুলে
ছড়ায়
শাড়ির আঁচলে হাসি, ভিজে চুলে, হেলানো সন্ধ্যায় নীরা
আমাকে বাড়িয়ে দেয়, হাস্যময় হাত
আমার হাতের মধ্যে চৌরাস্তায় খেলা করে নীরার কৌতুক
তার ছদ্মবেশ থেকে ভেসে আসে সামুদ্রিক ঘ্রাণ
সে আমার দিকে চায়, নীরার গোধূলি মাখা ঠোঁট থেকে
ঝরে পড়ে লীলা লোধ্র
আমি তাকে প্রচ্ছন্ন আদর করি, গুপ্ত চোখে বলি :
নীরা, তুমি শান্ত হও
অমন মোহিনী হাস্যে আমার বিভ্রম হয় না, আমি সব জানি
পৃথিবী তোলপাড় করা প্লাবনের শব্দ শুনে টের পাই
তোমার মুখের পাশে উষ্ণ হাওয়া
নীরা, তুমি শান্ত হও!
নীরার সহাস্য বুকে আঁচলের পাখিগুলি
খেলা করে
কোমর ও শ্রোণী থেকে স্রোত উঠে ঘুরে যায় এক পলক
সংসারের সারাৎসার ঝলমলিয়ে সে তার দাঁতের আলো
সায়াহ্নের দিকে তুলে ধরে
নাগকেশরের মতো ওষ্ঠাধরে আঙুল ঠেকিয়ে বলে,
চুপ!
আমি জানি
নীরার চোখের জল চোখের অনেক নিচে টল্মল্।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই
সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন
আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে
আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে
আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | পৌষের পূর্ণিমা রাত ডেকে বললো, যা-
সে কোথায় যাবে?
নিঝুম মাঠের মধ্যে সে এখন রাজা
একা-একা দুন্দুভি বাজাবে?
ছিল বটে রৌদ্রালোকে তারও রাজ্যপাট
সোনালি কৈশোরে
আজ উল্লুকের পাল হয়েছে স্বরাট
চৌরাস্তার মোড়ে
দাঁতে দাঁত ঘষাঘষি, চোখের টঙ্কার
এরকম ভাষা
সে শেখেনি, তাই এই রূপকথায় তার
জন্ম কীর্তিনাশা!
গায়ে সে মেখেছে ধুলো, গূঢ় ছদ্মবেশে
বোবা ভ্রাম্যমাণ
অদৃশ্য সহস্র চোখ তবু নির্মিশেষে
ছিলা রাখে টান।
পৌষের পূর্ণিমা রাত ডেকে বললো, যা-
সে কোথায় যাবে?
যেতে সে চায়নি? কেউ খুলেছে দরোজা
পুনরায় মনুষ্য স্বভাবে? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | নদীর সঙ্গে খেলা শুরু করবার মুহূর্তে
আমার অন্ধকার পছন্দ হয়নি
আমি নক্ষত্রলোককে সংস্কৃত থেকে আনুবাদ করা ভাষায়
ডাক দিয়ে বললাম, আলো দেখাও!
চাঁদের অভিমান হয়েছিল, কিন্তু নীহারিকাপুঞ্জ
নিচু হয়ে এলো
কেনো দৈব-নির্দেশ ছাড়াই বাতাস উড়িয়ে নিলো
নদীটির ওড়না
আমার শরীরে অসহ্য উত্তাপ, আমি
সূর্যলোকোর আগন’ক
শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া খুলে
ঝাঁপ দিলাম
নগ্ন
জলস্রোতে
দু‘পাশে উদগ্রীব অরণ্য, ধোপার কাপড় কাচার
শব্দের মতন হরিণের ডাক
আমাদের ভিজে-ভিজে খেলা শুরু হয়
নদীর ছোট্ট কোমল স্তন ও
পারস্য চুরিকার মতন উরুদ্বয়ে
আমি দিই গরম আদর
তারপর মৃত্যু ও জীবন, জবিন ও মৃত্যু
তারপর জেগে ওঠে নাদ ব্রহ্ম
অন্তরীক্ষে ধ্বনিত হয় ওঁং শান্তি
চুন ভেজানো জলের মতন পাতলা আলোয়
পুনর্জন্মের সময় আমি শুনতে পাই
আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তদিদের জন্য অতীত-পুরুষরা
রেখে যাচ্ছে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস ভরা শুভাশিস।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমায় অনুসরণ করে আঠাশ বছর পেরিয়ে আসা শব্দ
যেন তাকায় অতিকুসীদ, যেন হরণ দাবি করে
যেন আমার বুকের মধ্যে তুঁত পোকার মতো নড়ে
অনুসরণ অনুসরণ শব্দ শব্দ ওঁ শব্দ
অতিক্ষিদেয় খেয়েছিলাম সাতশো বিবেক, শব্দ বললো, ‘আমি আছি’
শব্দ আমায় ট্রাম ভাড়া দেয়, বায়োস্কোপে টিকিট কাটে
খুনের রক্তে চোখ ভেসে যায়, দৈবে ঘুরি ঘোর ললাটে
অন্ধকারে মুখ দেখি না মুখের ভয়ে, শব্দ বললো, ‘আমি আছি!’ ওঁ শব্দ
আঠাশ বছর পবিত্রতার তুক শেখালো, বিনা সুদে আগাম লগ্নী
ওঁ স্বর্ণ ওঁ প্রেম ওঁ বেশ্যা ওঁ মধু ওঁ ভুঃ ওঁ দুঃখ
ওঁ ছায়া ওঁ কাম ওঁ মায়া ওঁ স্বর্গ ওঁ পাপ ওঁ অগ্নি
আঠাশ বছর শিল্প ভেবে হাতে রইলো সবুজ খড়ি
এখন এলাম ঋণের ভয়ে ইস্টিশনে তড়িঘড়ি
কেউ দেখেনি শরীর আমার শরীরীভূত, জ্বলে উঠলো তবু হঠাৎ
নাদ অগ্নি। ওঁ অগ্নি
আঠাশ বছর অনুসরণ যেন হরণ দাবী করে
যেন আমার বুকের মধ্যে তুঁত পোকার মতো নড়ে
অনুসরণ অনুসরণ শব্দ শব্দ মৃত্যুশব্দ। ওঁ শব্দ। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | যে-কোনো রাস্তায় যে-কোনো লোককে ডেকে বলো,
তুমি আমার বাল্যকালের খেলার সঙ্গী,
মনে পড়ে না?
কেন তোমার ব্যস্ত ভঙ্গি?
কেন আমায় এড়িয়ে যাবার চঞ্চলতা!
আমার অনেক কথা ছিল, তোমার জামার বোতাম ঘিরে
অনেক কথা
এই মুখ, এই ভূরুর পাশে চোরা চাহনি,
চিনতে পারেনি?
যে-কোনো রাস্তায় যে-কোনো লোককে ডেকে বলো,
আমি তোমার বল্যকালের খেলার সঙ্গী
মনে পড়ে না?
আমরা ছিলাম গাছের ছায়া, ঝড়ের হাওয়ায় ঝড়ের হাওয়া
আমরা ছিলাম দুপুরে রুক্ষ
ছুটি শেষের সমান দুঃখ-
এই দ্যাখো সেই গ্রীবার ক্ষত, এই যে দ্যাখো চেনা আঙ্গুল
এখনো ভুল?
মনে হয় না তোমার সেই নিরুদ্দেশ সখার মতো?
কেন তোমার পাংশু চিবুক, কেন তোমার প্রতিরোধের
কঠিন ভঙ্গি
চিনতি পারোনি?
যে-কোনো রাস্তায় যে-কোনো লোককে ডেকে বলো,
শত্রু নই তো, আমরা সেই ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী
মনে পড়ে না?
আমরা ছিলাম নদীর বাঁকে ঘূর্ণিপাকে সন্ধেবেলা
নিষিদ্ধ দেশ, ভাঙা মন্দির, দু’চোখে ধোঁয়া
দেবী মানবীর প্রথম দ্বিধা, প্রথম ছোঁয়া, আমৃত্যু পণ
গোপন গ্রনে’ এক শিহরণ, কৈশোরময় তুমুল খেলা…
লুকোচুরির খেলার শেষে কারুকে খুঁজে পাইনি
দ্যাখো সে মুখ, চোরা চাহনি
একই আয়না
চিনতে পারো না? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।
হলুদ-তেল মাখা একটি সকাল,
ঝর্নার জলে বৃষ্টিপাতের মতন শব্দ
ঝুল বারান্দার সামনের বাগানে কেউ হাসছে
শীতের রোদ্দুরের মতন।কিছু ভাঙছে, কিছু খসে যাচ্ছে
বইয়ের পাতায় কার আঙুল, এখুনি যাবে অন্য পাতায়।
দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের সুর
ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না
আয়না
ভেঙে
বিচ্ছুরণ
একদিন
বিস্ফোরণ হয়
বুক ভেঙে কান্না এলে কান্নাগুলি ছুটে যায় ধূসর অন্তিমে স্বর্গের অলিন্দে-
স্বর্গ থেকে
তারপর ঢলে পড়ে
মহিম হালদার স্ট্রীটে
প্রাচীন গহ্বরে
মধ্যরাতে।
জানলা ভেঙে বৃষ্টি এলে বুকে যে-রকম পাপ হয়
যে-রকম স্মৃতিহীন মহিম হালদার কিংবা আমি ও মোহিনী
পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রী-শরীর চরিত্র নদীর……
দীপকের মাথাব্যথা হাঁসের পালক ছুঁয়ে হাসাহাসি করে
যে-রকম শান্তিনিকেতন কোনো ত্রিভুবনে নেই
দীপক ও তারাপদ দুই কম্বুকন্ঠ জেগে রয়…….
যে রকম তারাপদ গান গায় গোটা উপন্যাসে সুর দেয়া
কবিতার লাইন ছুঁড়ে পাগলা-ঘন্টি বাজিয়ে ঘুরেছে-
নিকষ বৃত্তের থেকে চোখগুলি ঘোরে ও ঘুমোয়,
শিয়রে পায়ের কাছে বই-বই-বই
তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে।
আরো নিজে পাপোশের নিচে এক আহিরীটোলায়
বৃষ্টি পড়ে,
রোদ আসে,
বিড়ালীর সঙ্গে খেলে
বেজম্মা বালিকা-
ছাদে পায়চারি করে গিরগিটি,
শেয়াল ঢুকেছে নীল আলো-জ্বালা গরে
রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়-
থুতু ও পেচ্ছাব সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে-
এ-রকম ছবি দেখে বাতাস অসহ্য হয় বুকের ভিতরে খুব
কশা অভিমানে
শব্দ অপমান করে- ভয় আমাক নিয়ে যায় পুনরায় দক্ষিণ নগরে
মহিম হালদার স্ট্রীটে ঘুরে ফিরে ঘুরে আমি মহিম, মহিম
বলে ডাকাডাকি করি, কেই নেই, মহিম, মহিম, এসো তুমি আর
আমি ও মোহিনী
ফের খেলা শুরু করি, মহিম! মোহিনী।
কোনো সাড়া নেই। ক্রমশ গম্ভীর হয় বাড়িগুলি, আলো
হাড় হিম হয়ে আসে স্মৃতিনষ্ট শীতে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | রাত্তির সাড়ে বারোটায় বৃষ্টি, দুপুরে অত্যন্ত শুক্নো এবং ঝক্্ঝকে
ছিল পথ, মেঘ থেকে কাদা ঝরেছে, খুবই দুঃখিত মূর্তি একা
হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, কালো ভিজে চুপচাপ দ্বিধায়
ট্রাম বাস বন্ধ, রিক্সা ট্যাক্সি-পকেটে নেই, পৃথিবী তল্লাসী হয়ে গেছে পরশুদিন
পুলিশের হাতে শাস্তি এখন, অথবা নির্জনতাই প্রধান অস্ত্র এই বুধবার রাত্তিরে।
অনেক মোটরকারের শব্দ হয় না, ঘুমন্ত হেডলাইট, শুধু পাপপূণ্য
অত্যন্ত সশব্দে জেগে আছে, কতই তো প্রতিষ্ঠান উঠে যায়, ওরা শুধু
ঘাড়হীন অমর-গোঁয়ার।
মশারী ব্যবসায়ীদের মুন্ডুপাত হচ্ছে নর্দমায়, কলকন্ঠে, ঘুমহীন ঘুম
শিকে নিয়েছে ট্রাক ড্রাইভার। দু’পাশের আলো-জ্বলা অথবা
অন্ধকার ঘরগুলোয়
জন্মনিয়ন্ত্রণ জনপ্রিয় হয়নি। অসার্থক যৌন ত্রিয়ার পর
বারান্দায় বিড়ি খাচ্ছে বুড়ো লোটা, ঘন ঘন আগুনের চিহ্ন দেখে
বোঝা যায় কী তীব্র ওর দুঃখ! মৃত্যুর খুব কাছাকাছি-
হয়তো লোকটা
গত দশ বছর ধরে মরে গেছে, আমি বেঁচে আছি আঠাশ বছর।
সাত মাইল পদশব্দ শুনে কেউ পাগলামীর সীমা ছুঁয়ে যায় না
এ রাস্তা অনন্তে যায়নি, ডাদিকে বেঁকে কামিনী পুকুরে
দুই ব্রীজের নিচে জল, পাৎলুন গোটানো হলো, এই ঠান্ডা স্পর্শ
একাকী মানুষকে বড় অনুতাপ এনে দেয়-
লইট পোস্টে ওঠে বাল্ব চুরি করছে একজন, এই চোট্ট, তোর পকেটে
দেশলই আছে?
বহুক্ষণ সিগারেট খাইনি তাই একা লাগছে, দেশলাইটা নিয়ে নিলাম
ফেরত পাবি না
বল্ব চুরি করেই বাপু খুশি থাক না, দু’রকম আলো বা আগুন
এক জীবনে হয় না!….ভাগ শালা…..
ও-পাশে নীরেনবাবুর বাড়ি, থাক। এ-সময় যাওয়া চলে না- ডাকাতের
ছদ্মবেশ ছাড়া
চায়ের ফরমাস করলে নিশ্চয়ই চা খওয়াতেন, তিনদিন পরে
অন্য প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা
একটু দূরে রিটায়ার্ড জজসাহেবের সুরম্য হর্ম্যের
দেয়াল চকচকে শাদা, কী আশ্চর্য, আজো শাদা! টুকরো কাটকয়লায়
লিখে যাবো নাকি, আমি এসেছিলাম, যমদূত, ঘমন্ত দেখে ফিরে গেলম
কাল ফের আসবো, ইতিমধ্যে মায়াপাশ ছিন্ন করে রাখবেন নিশ্চই!
কুত্তারা পথ ছাড়! আমি চোর বা জোচ্ছোর নই, অথবা ভূত প্রেত
সমান্য মানুষ একা ফিরে যাচ্ছি নিজের বড়িতে
পথ ভুল হয়নি, ঠান্ডা চাবিটা পকেটে, বন্ধ দরজার সামনে থেমে
তিনবার নিজের নাম ধরে হাকবো, এবং তৎক্ষাণাৎ সুইচ টিপে
এলোমেলো অন্ধকার সরিয়ে
আয়নায় নিজের মুখ চিনে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ঢুকবো ঘরে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,
রাত জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম-
ভালবাসো?
তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..ধরো ক্লান্ত তুমি,
অফিস থেকে সবে ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত,
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে
ঘর্মাক্ত আমি তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম
শতব্যস্ত হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,
মাথার উপর তপ্ত রোদ,
বাহন পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময়
হঠাত দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার
দিকে তাকিয়ে
কাঁধে হাত দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..ধরো শেভ করছ তুমি,
গাল কেটে রক্ত পড়ছে,
এমন সময় তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..ধরো খুব অসুস্থ তুমি,
জ্বরে কপাল পুড়েযায়,
মুখে নেই রুচি,
নেই কথা বলার অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?
নাকি তোমার গরম শ্বাস আমার শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাসো?
ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও….
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে, বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…….ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ
তুমি,
দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,
হঠাত বাধা দিয়ে বললাম-ভালবাসো?
কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসিধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,
আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই পৃথিবীতে,
বাস করছি দুজনে চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাসো?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-
ভালবাসো?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই
আমাকে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,
না থাকলেও দূর
থেকে ধ্বনি তুলো,
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি..দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,
বুঝব তুমি আছ, তুমি আছ
ভালোবাসি,ভালোবাসি……..!আরও পড়ুন… কেউ কথা রাখেনি |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই
সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন
আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে
আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে
আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | বিমানের মধ্যে টাই খুলে ফেলে, সিট্ বেল্ট বরিয়ে
উঠে দাঁড়ালুম
চিৎকার করে বললুম কে কোথায় আছো?
পেঁজা তুলোর মতন তুলতুলে মুখ দু’জন হাওয়া-সখী ছুটে এলো-
তখন মাথার ওপর ও নিচে ভূমধ্য আকাশ এবং রূপালি সাগর
মাঝখানে নীল মেঘ ও ফড়িং
পিছনে সন্ধেবেলার ইওরোপ জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে
সামনে প্রাচ্যদেশ জুড়ে অন্ধকার
আমি কর্কশভাবে বললুম, কোথায় থাকে এতক্ষণ, আমি
আধঘন্টা আগে পানীয় চেঁয়েছি,
তা-ছাড়া আমার খিদে পেয়েছে-
বালিকা-সাজা দুই যুবতী অপ্রতিভ ভাবে হাসলো
সেই আগুন ও অন্ধকারের মাঝখানে নারী-হাস্য খুব অবান্তর লাগে
তাদের শরীরের রেখা-বিভঙ্গের দিকে চোখ পড়ে না
ভূমধ্যসাগরের অন্তরীক্ষে নিজেকে বন্ধনমুক্ত ও সরল সত্যবাদী
মনে হয় অকস্মাৎ-
পিছনে জ্বলন্ত ইউরোপ, সামনে ভস্মসাৎ কালো প্রাচ্যদেশ
এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি নিঃসঙ্গ ভারতীয়, আমি সম্রাটের পুত্র
সমস্ত পৃথিবীর উদ্দেশ্যে এখন আমি তীব্য কন্ঠে বলতে চাই,
আমার খিদে পেয়েছে, আমার খিদে পেয়েছে
আমি আর সহ্য করতে পারছি না-
আমি কামড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খাবার জন্য উদ্যত হয়েছি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | শোকমূলক | ছিলে কৈশোর যৌবনের সঙ্গী, কত সকাল,
কত মধ্যরাত,
সমস্ত হল্লার মধ্যে ছিল সুতো বাঁধা,
সংবাদপত্রের খুচরো গদ্য
আর প্রইভেট টিউশানির টাকার অর্ঘ্য
দিয়েছি তোমাকে, দিয়েছি ঘাম,
ঘোরঘুরি, ব্লক, বিজ্ঞাপন, নবীন কবির
কম্পিত বুক, ছেঁড়া পাঞ্জাবি
ও পাজামা পরে কলেজপালানো দুপুর,
মনে আছে মোহনবাগান
লেনের টিনের চালের ছাপাখানায়
প্রুফ নিয়ে বসে থাকা ঘন্টার পর
ঘন্টা, প্রেসের মালিক কলতেন,
খোকা ভাই, অত চার্মিনার খেও না,
গা দিয়ে মড়া পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন
আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির
দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো,
এর কী দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের
লুকোচুরি, খোলা হাস্য
জমে উঠেছিল এক নদীর কিনারে,
ছিটকে উঠেছিল জল, আকাশ
ছেয়েছিল লাল রঙের ধুলোয়, টলমল
করে উঠেছিল দশ দিগন্ত, তারপর
আমরা ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত
গাইতে-গাইতে বাতাস সাঁতরে চলে
গেলাম নিরুদ্দেশে |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | বালি ঝুমকো, হলুদ নাভি, শূন্য হাস্য
রূপালি ফল, নীল মিছিল, চিড়িক চক্ষু…
চিড়িক না সুখ? চিড়িক শব্দে ঢ্যাঁড়া বসালুম
রূপালি ফল, না রূপালি উরুত? দ্রিদিম জ্যোৎস্না
লিখে ভয় হয়
দ্রিদিম না স্মৃতি? জ্যোৎস্না না জল? অথবা সাগর?
দ্রিতিম সাগর? ঠিক ঠিক ঠিক! নিরুপদ্রব। শূন্য হাস্য
কুনকি কাফেলা, হাতেম তামস, শালু পালু লুস
তামস? আবার ভুলের শব্দ, ভয়ের শব্দ, (কাটতে কলম
থর খর করে)
তামসের চেয়ে প্রগাঢ় আমার গরি মার কাছে শ্যন্য হাস্য
অথের এত বিভ্রমে বহু অশ্রুবিন্দু, কুলকুল জল…
কুলুকুলু বড় মধুর শব্দ, মধুর তোমার শব্দে শব্দ
মন্দিরে বাজে দ্রিদিম ঘন্টা, জ্যোৎস্না উধাও, তামস উধাও।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর
ফুসফুস-ভরা হাসি
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা
এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা
আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ
নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ
জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে
বালিকার প্রতি বারবার ভুল
পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক
অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর
বুক চিরে দেখা
আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত
একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী —
এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে
আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর
তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও
অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার
তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | মাঠ থেকে উঠে ওরা এখন গোলায় শুয়ে আছে
সোনালী ফসল, কত রোদ ও বৃষ্টির স্বপ্ন যেন
স্নেহ লেগে আছে
লাউমাচায়, গরু ও গরুর ভর্তা সবান্ধব পুকুরের পাশে
মুখে বিশ্রামের ছবি, যদিও কোমরে গ্যাঁটে ব্যাথা ।শীত এলে মনে হয়, এবার দুপুর থেকে রাত
মধুময় হয়ে যাবে, যে রকম চেয়েছেন পিতৃপিতামহ
তাদের মৃত্যুর আগে ভেবেছেন আর দুটো বছর যদি…
শীত এলে মনে হয়, এই মাত্র পার হল সেই দু’বছর
এবার সমস্ত কিছু……
শীত চলে যায়, বছর বছর শীত চলে যায়,
সে দুটি বছর আর কখনো আসেনা । |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | হাওড়া ব্রীজের রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল
দ্বারভাঙা জেলা থেকে আসা টাট্কা রমনী
ব্রীজের অনেক নিচে জল, সেখানে কোনো ছায়া পড়ে না
কিন্তু বিশাল এক ভগবতী কুয়াশা কলকাতার উপদ্রুত অঞ্চল থেকে
গড়িয়ে এসে
সভ্যতার ভূমধ্য অরিন্দে এসে দাঁড়ালো
সমস্ত আকাশ থেকে খসে পড়লো ইতিহাসের পাপমোচানবারী বিষণ্ণতা
ক্রমে সব দৃশ্য, পথ ও মানুষ মুছে যায়, কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু রইলো সেই
লাল ফুল-ছাপ শাড়ি জড়ানো মূর্তি
রেখা ও আয়তনের শুভবিবাহমূলক একটি উদাসীন ছবি-
আকস্মাৎ ঘুরে গাঁড়ালো সে, সেই প্রধানা মচকা মাগি, গোঠের মল ঝামড়ে
মোষ তাড়ানোর ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
মুঠো পিছলোনো স্তনের সূর্যমুখী লঙ্কার মতো বোঁটায় ধাক্কা মারলো কুয়াশা
পাছার বিপুল দেলানিতে কেঁপে উঠলো নাদব্রহ্ম
অ্যাক্রোপলিসের থামের মতো উরুতের মাঝখানে
ভাটফুলে গন্ধ মাখা যোনির কাছে থেমে রইলো কাতর হওয়া
ডৌল হাত তুলে সে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
তখন সর্বনাশের কাছে সৃষ্টি হাঁটু গেড়ে বসে আছে
তখন বিষণ্নতার কাছে অবিশ্বাস তার আত্মার মুক্তিমূল্য পেয়ে গেছে…
সব ধ্বংসের পর
শুধু দ্বারভাঙা জেলার সেই রমণীই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো
কেননা ঐ মুহূর্তে সে মোষ তাড়ানোর স্বপ্নে দেখছিল।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
নীল ডুরে শাড়ী, স্বপ্নে পিঠের ওপরে চুল খোলা
বাতাসে অসংখ্য প্রজাপতি কিংবা সবই অভ্রফুল?
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
চোখ দুটি বিখ্যাত সুদূর, পায়ের আঙুলে লাল আভা।
ডান হতে, তর্জনিতে সামান্য কালির দাগ
একটু আগেই লিখছিলে
বাতাসে সুগন্ধ, কোথা যেন শুরু হলো সন্ধ্যারতি
অন্যদেশ থেকে আসে রাত্রি, আজ কিছু দেরি হবে
হাঁটুর ওপরে থু
শিল্পের শিরায় আসে উত্তেজনা, শিল্পের দু’চোখে
পোড়ে বাজি
মোহময় মিথ্যেগুলি চঞ্চল দৃষ্টির মতো, জোনাকির মতো উড়ে যায়
কোনোদিন দুঃখ ছিল, সেই কথা মনেও পড়ে না
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
সময় থামে না জানি, একদিন তুমি আমি সময়ে জড়াবো
সময় থামে না, একদিন মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে
দিগন্ত পেরিয়ে-
নতুন মানুষ এসে গড়ে দেবে নতুন সমাজ
নতুন বাতাস এসে মুছে দেবে পুরোনো নি:শ্বাস,
তবু আজ
হাঁটুর ওপরে থুতনি,তুমি বসে আছো
এই বসে থাকা, এই পেঠের ওপরে খোলা চুল,
আঙুলে কালির দাগ
এই দৃশ্য চিরকাল, এর সঙ্গে অমরতা সখ্য করে নেবে
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো.... |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ঠোঁট দেখলেই বুঝতে পারি, তুমি এদেশে বেড়াতে এসেছো
ঐ গ্রীবা, ঐ ভুরুর শোভা এদেশী নয়-
কপালে ঐ চূর্ণ অলক, নিমেষ-হারা দৃষ্টি পলক
ঐ মুখ ঐ বুকের রেখা এদেশী নয়!
বৃষ্টি থামা বিকেলবেলায় পথ ভরেছে শুকনো কাদায়
আমরা সবাই কাতর, বুকে পাথর
তোমার পা মাটি ছু’লো না
তোমার হাসি পাখি-তুলনা
তুমি বললে, আমার বৃষ্টি নামুক!
আমরা সবাই রূপ চেয়েছি
ধর্ম অর্থ কাম চেয়েছি
তোমার হাতে শুধু দু’মুঠো বালি।
রুক্ষ দিনের মতন আমরা রুক্ষতাময় তৃপ্তিহারা
আগুন থেকে জ্বলে আগুন, চক্ষু থেকে অগ্নিধারা
তুমি হাওয়ায় শূন্য ফসল দেখতে পেয়ে
বাজালে করতালি।
এই পৃথিবী বিদেশ তোমার
কতদিনের জন্য এলে?
বেড়াতে আসা, তাই তো মুখ অমন সুখ-ছোয়া!
যতি তোমায় বন্দী করি, মুঠোর মধ্যে ভ্রমর ধরি |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না।
জীবন রইলো পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি
তার কিছু দূরে নদী-
জল নিতে এসে কোনো সলাজ কুমারী
দেখে এক গলা-মোচড়ানো মারা হাঁস।
চোখের বিস্ময় থেকে আঙুলের প্রতিটি ডগায় তার দুঃখ
সে সসয় অকস্মাৎ ডঙ্কা বাজিয়ে জাগে জ্যোৎস্নার উৎসব
কেন, তার কোনো মানে নেই
যেমন বৃষ্টির দিনে অরণ্য শখরে ওঠে
সুপুরুষ আকাশের সপ্তরং ভুরু
আর তার খুব কাছে মধুলোভী আচমকা নিশ্বাসে পায়
বাঘের দুর্গন্ধ!
একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল
আর এক নৈঃশব্দ্যকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া
আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া
পাশ ছাড়ে না
এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–
নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ!
ওরা আমার বিষম চেনা!’
ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ–
লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা
ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল
নীরা জানে না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | যেমন উপত্যকা থেকে ফিরে এসেছি বহুবার, পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা হয়নি
যেমন হাত অঞ্জলিবদ্ধ করেছি বহুবার, কখনো পার্থনা জানাইনি
যেমন নারীর কাছে মৃত্যুকে সমর্পণ করেছিলাম
মৃত্যুর কাছে নারীকে
যেমন বৃক্ষের কাছে জল্লাদের মতন গিয়েছি কুঠার হাতে
উপকথার কাঠুরেকে করেছি উপহাস
যেমন মানুষের কাছে আমিও মানুষ সেজে থাকতে চেয়েছিলাম
কৃতজ্ঞতার বদলে ফিরিয়ে নিয়েছি মুখ
যেমন স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে শৈশব দেখেও চিনতে পারিনি
লোকের মধ্যে শিশুকো আদর করেছি, লৌকিকতাবশত
ডাকবাংলার বন্ধ দরজার সামনে চাবির বদলে হাতুড়ি চেয়েছিলাম
যেমন ঝামরে-পড়া অন্ধকারের মধ্যে থেকে সর্বাঙ্গে ভুসো কালি মেখে
এসেছিলাম আলোর কাছে
যেমন কুকুরের দাঁতে বার-বার ছুঁয়েছি স্তন ও ওষ্ঠসমূহ
যেমন জ্যোৎস্না মধ্য গন্ধরাজ ফুলগাছের পাশে দেখেছিলাম
এক বোবা কালা প্রেত
যেমন বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে গলা মুচড়ে মেরেছিলাম ধবল হাঁস
কানানা লুকোবার জন্য নতীতে স্নান করতে গিয়েছি
যেমন অন্ধ মেয়েটির কন্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছিল
আমার পূর্বজন্মের চেনা
অত্যন্ত মমতায় আমি তাকে উপহার দিয়েছিলাম রূপো বাঁধানো আয়না
যেমন ফিরে আসবো বলেও ফিরে যাইনি বেশ্যার কাছে
সমুদ্রের কাছেও আর যাইনি
ফিরে যাইনি ধলভূমগড়ের লালধুলোর রাস্তায়
দন্ডকারণ্যে নির্বাসিতা ধাইমা’র কাছেও যাওয়া হয়নি
যেমন ঠিকানা হারিয়ে বহু চিঠির উত্তর লেখা হয় না
তবু জেগে থাকে অভিমান
যেমন মায়ের কাছেও গোপন করেছি শরীরের অনেক অসুখ
যেমন মনে মনে গ্রহণ করা অনেক শপথ কেউ শুনতে পায়নি
বলেই মেনে চলিনি
যেমন কাঁটা বেঁধার পর রক্ত দর্শনে সূর্যাস্তের আবহমান
দৃশ্য থেকে ফিরে আসে চোখ;
তেমনই এই চৌতিরিশ বছরে এক ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে
আমার চকিতে দিগভ্রম হয়
বৃক্ষসারি ছুটে যায় আমার আপাত গতির বিপরীত দিকে
পুকুরে স্নানের দৃশ্য মুহূর্তের সত্য থেকে পরমুহূর্তের অলৌকিক
আমার বুক টনটন করে ওঠে অথচ নির্দিষ্ট শোক নেই
সান্তনার কথা মনে আসে না
আয়ুর সীমানা কেউ জানে না, তাই মনে হয় অনেক কিছু হারিয়েছি
কিন্তু মুহূর্তের সত্যেরই মতন, সেই মুহূর্তে শুধু মনে পড়ে
কৈশোরে হারিয়েছিলাম অতি প্রিয় একটা চন্দনকাঠের বোতাম
এখনও নাকে আসে তার মৃদু সুগন্ধ
শুধু সেই বোতামটা হারানোর দুঃখে
আমার ঠোঁটে কাতর ক্ষীণ হাসি লেগে থাকে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | মায়ামমতার মতো এখন শীতের রোদ
মাঠে শুয়ে আছে
আর কেউ নেই
ওরা সব ফিরে গেছে ঘরে
দু’একটা নিবারকণা খুঁটে খায় শালিকের ঝাঁক
ওপরে টহল দেয় গাংচিল, যেন প্রকৃতির কোতোয়াল।
গোরুর গাড়িটি বড় তৃপ্ত, টাপুটুপু ভরে এছ ধানে
অন্যমনা ডাহুকীর মতো শ্লথ গতি
অদূরে শহর আর ক্রোশ দুই পথ
সেখানে সবাই খুব প্রতীক্ষায় আছে
দালাল, পাইকার, ফড়ে, মিল, পার্র্টি, নেকড়ে ও পুলিস
হলূদ শস্যের স্তূপে পা ডুবিয়ে
ওরা মল্লযুদ্ধে মেতে যাবে
শোনা যাবে ঐক্যতান, ছিঁড়ে খাবো চুষে খাবো
ঐ লোকটিকে আমি তোদের আগে ছিঁড়ে খাবো।
সিমেন্টের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছে সেই লোকটা
বিড়ির বদলে সিগারেট
আজ সে শৌখিন বড়, চুলে তেল, হোটেলের ভাত খেয়ে
কিনেছিল এক খিলি পান
খেটেছে রোদ্দুরে জলে দীর্ঘদিন, পিতৃস্নেহ
দিয়েছিল মাঠে
গোরুর গাড়ির দিকে চোখ যায়, বড় শান্ত এই
চেয়ে থাকা
সোনালী ঘাসের বীজ আজ যেন নারীর চেয়েও গরবিনী
সহস্র চোখের সামনে গায়ে নিচ্ছে
রোদের আদর
এখনই যে লুট হবে কিছুই জানে না
পালক পিতাটি সেই সঙ্গে-সঙ্গে যাবে
যারা অগ্নিমান্দ্যে ভোগে তারা ঐ লোকটির
রক্ত মাংস খাবে।
আচর্য শঙ্কর, আমি করজোড়ে অনুরোধ করি
আকস্মাৎ এই দৃশ্যে আপনি এসে যেন না বলেন
এ তো সবই মায়া! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্গ ঈ-কারের মত তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছো!
এমনকি অদৃশ্য তুমি বহু চোখে
কত লোকে নামই শোনেনি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো-
তারা চেনে প্রেমিকা বা সহোদরা
জননী বা জায়া
দুধের দোকানে মেয়ে, কিংবা যারা নাচে গায়
রান্না ঘরে ঘামে
শিশু কোলে চৌরাস্তায় বাড়ায় কঙ্কাল হাত
ফ্রক কিংবা শাড়ী পরে দুঃখের ইস্কুলে যায়
মিস্তিরির পাশে থেকে সিমেন্ট মেশায় কান্না
কৌটো হাতে পরমার্থ চাঁদা তোলে
কৃষকের পান্তা ভাত পৌছে দেয় সূর্য ক্রুদ্ধ হলে
শিয়রের কছে রেখে উপন্যাস দুপুরে ঘুমোয়
এরা সব ঠিকঠাক আছে
এদের সবাই চেনে শয়নে, শরীরে
দুঃখ বা সুখের দিনে অচির সঙ্গিনী!
কিন’ নারী? সে কোথায়?
চল্লিশ শতাব্দী ধরে অবক্ষয়ী কবি দল
যাকে নিয়ে এমন মেতেছে?
সে কোথায়? সে কোথায়?
দীর্ঘ ঈ-কারের মত চুল মেলে
সে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে?
এই ভিড়ে কেমন গোপন থাকো তুমি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো… |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | গোলাপে রয়েছে আঁচ, পতঙ্গের ডানা পুড়ে যায়
হাওয়া ঘোরে দূরে-দূরে
ফুলকে সমীহ করে
সূর্যাস্তও থমকে থাকে!
দেখো-দেখো
আমার বাগানে এক অগ্নিময়
ফুল ফুটে আছে
তার সৌরভেও কত তাপ!
আর সব কুসুমের জীবন-চরিত তুচ্ছ করে
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে চতুর্দিক
বৈদুর্ষমণির মতো চোখ মেলে সে রয়েছে প্রতীক্ষায়
কার? কার? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সাতশো একান্নতম আনন্দটি পেয়েছি সেদিন
যখন বিকেলবেলা মেঘ এসে
ঝুঁকে পড়েছিল
গোলাপ বাগানে
এবং তোমার পায়ে ফুটে গেল লক্ষ্মীছাড়া কাঁটা!
তখন বাতাসে ছিল বিহ্্লতা, তখন আকাশে
ছিল কৃষ্ণক্লান্তি আলো,
ছিল না রঙের কোলাহল
ছিল না নিষেধ-
অতটুকা ওষ্ঠ থিকে অতখানি হাসির ফোয়ারা
মন্দিরের ভাস্কর্যকে ম্লান করে নতুন দৃুশ্যটি।
এর পরই বৃষ্টি আসে সাতশো বাহান্ন সঙ্গে নিয়ে
করমচা রঙের হাত, চিবুকের রেখা
চোখে চোখ
গোলাপ সৌরভ মেশা প্রতিটি নি:শ্বাস, যত্ন করে
জমিয়ে রাখার মতো-
সম্প্রতি ওল্টানো পদতলে
এত মায়া, বায়ু ধায় ন’শো ঊনপঞ্চাশের দিকে
নগ্ন প্রকৃতির
এত কাছাকাছি আর কখনো আসি নি মনে হয়
জীবন্ত কাঁটার কাছে হেরে যায় গোপন ঈশ্বর
রূপের সহস্র ছবি, বা আনন্দ একটি শরীরে? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | যে আমায় চোখ রাঙিয়ে এইমাত্র চলে গেল গট্গটিয়ে
সে আমায় দেয়ে গেল একটুকরো সুখ
শরীরে নতুন করে রক্ত চলাচল টের পাই
ইন্দ্রিয় সুতীক্ষ্ম হয়ে ওঠে
মৃদু হেসে মনে মনে
আমি তার নাম কেটে দিই।
সে আর কোথাও নেই,
হিম অন্ধকার এক গভীর বরফঘরে
নির্বাসিত, আহা সে জানে না!
সে তার জুতোর শব্দে মুগ্ধ ছিল
প্যান্টের পকেটে হাত
স্মৃতিহার বিভ্রান্ত মানুষ।
দাবা খেলুড়ের মতো আমি তাকে
এক ঘরে থেকে তুলে
অন্য ঘরে বসিয়ে চুপ করে চেয়ে থাবি
উপভোগ করি তার ছটফটানি!
জালের ফুটোর মধ্যে নাক দিয়ে
যেমন বিষণ্ন থাকে জেব্রা
শুকনো নদীর পাশে যে-রকম দুঃখী ঘাটোয়াল
আমার হঠাৎ খুব মায়া হয়
আমি তার রমণীকে নরম সান্ত্বনাবাক্য বলি
দু‘হাত ছড়িয়ে ফের
তছনছ করে দিই খেলা।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | -ভালো আছো?
-দেখো মেঘ, বৃষ্টি আসবে?
-ভালো আছো?
-দেখো ঈশান কোণের কালো, শুনতে পাচ্ছো ঝড়?
-ভালো আছো?
-এই মাত্র চমকে উঠলো ধবধবে বিদ্যুৎ।
-ভালো আছো?
-তুমি প্রকৃতিকে দেখো
-তুমি প্রকৃতিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছো
-আমি তো অণূর অনু, সামান্যের চেয়েও সামান্য
-তুমিই তো জ্বালো অগ্নি, তোলো ঝড়,রক্তে এত উম্মাদনা
-দেখো সত্যিকার বৃষ্টি, দেখো সত্যিকার ঝড়
-তোমাকে দেখাই আজও শেষ হয়নি, তুমি ভালো আছো? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার?
এই দিক-শূন্য ওড়াউড়ি, এ যেন শিল্পের রূপ-
আচমকা আলোর রশ্মি পপি ফুল ছুঁয়ে গেলে
যে-রকম মিহি মায়াজাল
বাতাসে তুলো বীজ, তুমি কার?
পাহাড়ী জঙ্গল
থেকে
উড়ে এলে
খোলা-জানালা পাঁচকোনা ঘরে
আমারও শব্দের রেশ উড়ে যায়
নামহীন নদীটির ধারে
স্বপ্নের ভিতর ফোটে স্নেহের মতন জ্যোৎস্না
বৃদ্ধ কৃষকের চায়া
আলপথে দাঁড়িয়ে ধানের গন্ধ নেয়
ঘুমে আঠা হয়ে আসে দূরে কোনো অচেনা নারীর চোখ…
এ যেন শিল্পের রূপ
এই দিক-শূন্য ওড়াউড়ি
বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সিঁড়ির মুখে কারা অমন শান্তভাবে কথা বললো?
বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে, তবু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে সিঁড়িতে
রেলিং-এ দুই হাত ও থুত্নি, তোমায় দেখে বলবে না কেউ থির বিজুরি
তোমার রঙ একটু ময়লা, পদ্মপাতার থেকে যেন একটু চুরি,
দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।
নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পূজোয়–দুটোই খুব রঙের মধ্যে
রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন–
ও দুটো দিন তুমি আলাদা, ও দুটো দিন তুমি যেন অন্য নীরা
বাকি তিনশো তেষট্টি বার তোমায় ঘিরে থাকে অন্য প্রহরীরা।
তুমি আমার মুখ দেখোনি একলা ঘরে, আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, আমরা কেউ বুকের কাছে কখনো
কথা বলিনি পরস্পর, চোখের গন্ধে করিনি চোখ প্রদক্ষিণ–
আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, নীরা তোমায় দেখা আমার মাত্র দু’দিন।
নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।
আমি তোমায় লোভ করিনি, আমি তোমায় টান মারিনি সুতোয়
আমি তোমার মন্দিরের মতো শরীরে ঢুকিনি ছল ছুতোয়
রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি;
দোল ও সরস্বতী পূজোয় তোমার সঙ্গে দেখা আমার–সিঁড়ির কাছে
আজকে এমন দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরনো বালক ভৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? তোমার বুকে হোঁচট পথে
চাঁদের আলোয় মোট বয়েছি, বেতের মতো গান সয়েছি
দু’হাত নিচে, পা শূন্যে- আমার সেই উদোম নৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ,
চাঁদের আলোয়?
মহারাজ, আমি তোমার চোখের জলে মাছ ধরেছি
মাছ না মাছি কাঁকরগাছি একলা শুয়েও বেঁচে তা আছি
ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
অমন তোমার ভালোবাসা, আমার বুকে পাখির বাসা
মহারাজ, তোমার গালে আমি গোলাপ গাছ পুঁতেছি-
প্রাণঠনাঠন ঝাড়লন্ঠন, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
মহারাজ, মা-বাপ তুমি, যত ইচ্ছে বকো মারো
মুঠো ভরা হাওয়ার হাওয়া, তো কেবল তুমিই পারো।
আমি তোমায় চিম্টি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি
চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায়
তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি
বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু
হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা
মহারাজ, মনে পড়ে না? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | এই যে বাইরে হু হু ঝড়, এর চেয়ে বেশী
বুকের মধ্যে আছে
কৈশোর জুড়ে বৃষ্টি বিশাল, আকাশে থাকুক যত মেঘ,
যত ক্ষণিকা
মেঘ উড়ে যায়
আকাশ ওড়ে না
আকাশের দিকে
উড়েছে নতুন সিঁড়ি
আমার দু বাহু একলা মাঠের জারুলের ডালপালা
কাচ ফেলা নদী যেন ভালোবাসা
ভালোবাসার মতো ভালোবাসা
দু‘দিকের পার ভেঙে
নরীরা সবাই ফুলের মতন, বাতাসে ওড়ায়
যখন তখন
রঙিন পাপড়ি
বাতাস তা জানে, নারীকে উড়াল দেয়ে নিয়ে যায়
তাই আমি আর প্রকৃতি দেখি না,
প্রকৃতি আমার চোখ নিয়ে চলে গেছে! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো
এবার কবিতা লিখে আমি চাই পন্টিয়াক গাড়ি
এবার কবিতা লিখে আমি ঠিক রাষ্ট্রপতি না হলেও
ত্রিপাদ ভূমির জন্য রাখব পা উঁচিয়ে -
মেশপালকের গানে এ পৃথিবী বহুদিন ঋণী!
কবিতা লিখেছি আমি চাই স্কচ, সাদা ঘড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক
মুর্গীর দু ঠ্যাং শুধু, আর মাংস নয় -
কবিতা লিখেছি তাই আমার সহস্র ক্রীতদাসী চাই -
অথবা একটি নারী অগোপন, যাকে আমি প্রকাশ্য রাস্তায় জানু ধরে
দয়া চাইতে পারি।
লেভেল-ক্রসিং এ আমি দাঁড়ালেই তোপধ্বনি শুনতে চাই
এবার কবিতা লিখে আমি আর দাবী ছাড়ব না
নেড়ি কুত্তা হয়ে আমি পায়ের ধুলোর থেকে গড়াগড়ি দিয়ে আসি
হাড় থেকে রক্ত নিংড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছি, ভিক্ষা চেয়ে মানুষের
চোখ থেকে মনুষ্যত্ব খুলে -
কপালের জ্বর, থুতু, শ্লেষ্মা থেকে উঠে এসে
মাতাল চন্ডাল হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফের ছাই থেকে উঠে এসে
আমার একলা ঘরে অসহায়তার মতো হা হা স্বর থেকে উঠে এসে
কবিতা লেখার সব প্রতিশোধ নিতে দাঁড়িয়েছি । |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত?
ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?
ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?
ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!
ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা
সেতু নেই আকাশে পারাপার
ভালাবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া
ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদ।
শরীর ফুরোয় ঘামে ভেসে যায় বুক
অপর বহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম
ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি
ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে
আমি এর সর্বনাশ করে যাবো-
আমি একে ফুসয়িয়ে নিয়ে যাবো হলদিয়া বন্দরে
নারকোল নাডুর সঙ্গে সেঁকো বিষ মিশিয়ে খাওয়াবো-
কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে।
কলকাতা চাঁদের আলো জাল করে, চুম্বনে শিয়ালকাঁটা
অথবা কাঁকর
আজ মেশাতে শিখেছে,
চোখের জলের মতো চায়ে তুমি চিনি দিতে ভুলে যাও এত
উপপতি
তোমার দিনে দুপুরে, ঊরুতে সম্মতি!
দিল্লির সুপ্রিমকোর্টে, সুন্দরী, তোমাকে আমি এমন সহজে
যেতে দিতে পারি? তার বদলে হৃদয়ে সুগন্ধ মেখে সন্ধেবেলা
প্রখর গরজে
তোমার দু’বাহু চেপে ট্যাক্সিতে বাতাস খেতে নিয়ে যাবো-
হোটেলে টুইস্ট নাচবে, হিল্লোলে আঁচল খুলে বুকে রাখবে দু’দুটো
ক্যামেরা
যদু….মধু এবং শ্যামেরা তুড়ি দেবে;
শরীরে অমন বজনা, আয়নার ভিতরে অতি মহার্ঘ আলোর মতো
তুমি, তোমার চরণে
বিশুদ্ধ কবিতাময় স্তাবকতা দক্ষিণ শহর থেকে এনে দিতে পারি
সোনার থালায় স’লপদ্ম চাও দুই হাতে?
তুমি খুন হবে মধ্যরাতে।
কলকাতা আমার হাত ছাড়িয়ে কোতায় যাবে, তুমি
বিছুতে ক্যানিং স্ট্রীটে লুকোতে পারবে না-
চীনে-পাড়া-ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটলে, আমিকও বাঘের মতো
ছুটে যাবো তোমার পিছনে
ডিঙিয়ে ট্রাফিক বাতি, বড়বাজার, রোগীর পথ্যের মতো
চৌরঙ্গি পেরিয়ে
আমার অনুসরণ, বয়ুভুক নিরালম্ব আত্মার মতন ভঙ্গি
কতর ভালোবাসার, প্রতিশোধে-
কোথায় পালাবে তুমি? গঙ্গা থেকে সব ক’টা জাহাজের মুখগুলো ফিরিয়ে
অন্ধকার ময়দানে প্রচন্ড সার্চলাইট ফেলে
টুঁটি চেপে ধরবো তোমার- তোমার শরীর ভরা পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে বরুদ ছড়িয়ে
আমার গোপন যাত্রা, একদিন শ্রেণীযুগে জ্বালবো দেশলাই-
উড়ে যাবে হর্ম্যসারি, ছেটকাবে ইঁটকাঠ, ধ্বংস হবে
সব লাস্য, অলংকার, চিৎপুরের অমর ভুবন
আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলে যদি, তোমার সহমরণ তবে কি বাঁচবে? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন
সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন!
একবার হাত ছুঁয়েছি সাত কি এগারো মাস পরে ঐ হাত
কিছু কৃশ, ঠাণ্ডা বা গরম নয়, অতীতের চেয়ে অলৌকিক
হাসির শব্দের মতো রক্তস্রোত, অত্যন্ত আপন ঐ হাত
সিগারেট না-থাকলে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিতুম
মুখ বা চুলের নয়, ঐ হাত ছুঁয়ে আমি সব বুঝি, আমি
দুনিয়ার সব ডাক্তারের চেয়ে বড়, আমি হাত ছুঁয়ে দূরে
ভ্রমর পেয়েছি শব্দে, প্রতিধ্বনি ফুলের শূন্যতা–
ফুলের? না ফসলের? বারান্দার নিচে ট্রেন সিটি মারে,
যেন ইয়ার্কির
টিকিট হয়েছে কেনা, আবার বিদেশে যাবো সমুদ্রে বা নদী…
আবার বিদেশে,
ট্রেনের জানালায় বসে ঐ হাত রুমাল ওড়াবে।
রাস্তায় এলুম আর শীত নেই, নিশ্বাস শরীরহীন, দ্রুত
ট্যাক্সি ছুটে যায় স্বর্গে, হো-হো অট্টহাস ভাসে ম্যাজিক-নিশীথে
মাথায় একছিটে নেই বাষ্প, চোখে চমৎকার আধো-জাগা ঘুম,
ঘুম! মনে পড়ে ঘুম, তুমি, ঘুম তুমি, ঘুম, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন ঘুম
ঘুমোবার আগে তুমি স্নান করো? নীরা তুমি, স্বপ্নে যেন এরকম ছিল…
কিংবা গান? বাথরুমে আয়না খুব সাঙ্ঘাতিক স্মৃতির মতন,
মনে পড়ে বস স্টপে? স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্নে–স্বপ্নে, বাস-স্টপে
কোনোদিন দেখা হয়নি, ও সব কবিতা! আজ যে রকম ঘোর
দুঃখ পাওয়া গেল, অথচ কোথায় দুঃখ, দুঃখের প্রভূত দুঃখ, আহা
মানুষকে ভূতের মতো দুঃখে ধরে, চৌরাস্তায় কোনো দুঃখ নেই, নীরা
বুকের সিন্দুক খুলে আমাকে কিছুটা দুঃখ বুকের সিন্দুক খুলে, যদি হাত ছুঁয়ে
পাওয়া যেত, হাত ছুঁয়ে, ধূসর খাতায় তবে আরেকটি কবিতা
কিংবা দুঃখ-না-থাকার-দুঃখ…। ভালোবাসা তার চেয়ে বড় নয়! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | কারাগারের ভিতরে পড়েছিল জোছনা
বাইরে হাওয়া, বিষম হাওয়া
সেই হাওয়ায় নশ্বরতার গন্ধ
তবু ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত চিঠি লিখেছিল তার বৌদিকে,
“আমি অমর, আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারও নাই।”মধ্যরাত্রির আর বেশি দেরি নেই
প্রহরের ঘণ্টা বাজে, সান্ত্রীও ক্লান্ত হয়
শিয়রের কাছে এসে মৃত্যুও বিমর্ষ বোধ করে।
কনডেমড সেলে বসে প্রদ্যুত ভট্টাচার্য লিখছেন,
“মা, তোমার প্রদ্যুত কি কখনো মরতে পারে ?
আজ চারিদিকে চেয়ে দেখ,
লক্ষ প্রদ্যুত তোমার দিকে চেয়ে হাসছে,
আমি বেঁচেই রইলাম মা, অক্ষয়”কেউ জানত না সে কোথায়,
বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ছেলেটি আর ফেরেনি
জানা গেল দেশকে ভালোবাসার জন্য সে পেয়েছে মৃত্যুদন্ড
শেষ মুহূর্তের আগে ভবানী ভট্টাচার্য
পোস্ট কার্ডে অতি দ্রুত লিখেছিল তার ছোট ভাইকে,
“অমাবস্যার শ্মশানে ভীরু ভয় পায়,
সাধক সেখানে সিদ্ধি লাভ করে,
আজ আমি বেশি কথা লিখব না
শুধু ভাববো মৃত্যু কত সুন্দর।”লোহার শিকের ওপর হাত,
তিনি তাকিয়ে আছেন অন্ধকারের দিকে
দৃষ্টি ভেদ করে যায় দেয়াল, অন্ধকারও বাঙময় হয়
সূর্য সেন পাঠালেন তার শেষ বাণী,
“আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম ?
শুধু একটি মাত্র জিনিস,
আমার স্বপ্ন একটি সোনালি স্বপ্ন,
এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম এই স্বপ্ন দেখেছিলাম ।”সেই সব স্বপ্ন এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায়
শোনা যায় নিঃশ্বাসের শব্দ
আর সব মরে স্বপ্ন মরে না
অমরত্বের অন্য নাম হয়
কানু, সন্তোষ, অসীম রা…
জেলখানার নির্মম অন্ধকারে বসে
এখনও সেরকম স্বপ্ন দেখছে |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | -চলে যাবে? সময় হয়েছে বুঝি?
-সময় হয়নি, তাই চলে যাওয়া ভালো
-এসো না এখনো এই গুহার ভিতরে খুঁজি
পড়ে আছে কিনা কোনো চুপচাপ আলো
-অথবা দু‘জনে চলো বাইরে যাই?
-আমার এ নির্বাসন-দণ্ড আজ শেষ হবে?
ওসব হেঁয়ালি আমি বুঝি না, তোমাকেসবার
মধ্যে চাই
-বহূদিন জনারণ্যে কাটিয়েছি, উৎসবে-পরবে
পিঁপড়ের মতো আমি খুঁটেখুঁটে জমিয়েছি সুখ
উপভোগ
একদিন স্বচ্ছ এক হ্রদে দেখি আকস্মাৎ কার দীর্ঘছায়া
খুব কাছে
এদিকে ওদিকে চাই, কেউ নেই,
তবে কি আমারই মনোরোগ?
বস্তুর সৃষ্টির মধ্যে কাল-ঋণী ছায়া পড়ে আছে।
অন্ধকারে ছায়া নেই, তাই আমি গুহার আাঁধারে
-আমাকে ডেকেছো কেন এই অবেলায়?
-ভেবেছি হয়তো ভুল, নরীর সুষমা বুঝি পারে
ভেঙে দিতে আলস্যের শীত, যদি স্পর্শের খেলায়
মুহূর্তে বিমূর্তে হয়, যদি চোখ….
-তবে তাই হোক, তবে তাই হোক
ভুল ভাঙা শুরু হতে দেরি করা ঠিক নয়
বিশেষত অন্ধকারে
-অন্ধকারে ফুল হলে ফুটে ওঠে নিষিদ্ধ লঘু লোভ
শৈশবের সব দুঃখ যে রকম ফিরে পেতেচাই
বার-বার
তুমিও দুঃখেরই মতো বড় প্রিয়, এই ওষ্ঠ বুক
-ওসব জানি না, দুঃখ বিংবা ছায়াটায়া এখণ থাকুক
ভুল ভাঙবার নামে আরও কিছু
ভুলকরা
এমন মধুর খেলা আর নেই
-তা হলে এবার বুঝলে,
গুহাটিকে মায়া বলে
উড়িয়ে দেওয়াটা হলো
এ জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ
ভুল! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাগলটি
পৃথিবীর সমস্ত পাগলের রাজা হয়ে
সে উলঙ্গ, কেননা উম্মাদ উলঙ্গ হতে পারে, তাতে
প্রকৃতির তালভঙ্গ হয় না কখনো
পাশেই গম্ভীর ট্রেন, ব্যস্ত মানুষের হুড়োহুড়ি
সকলেই কোথাও না কোথাও পৌছুতে চায়
তার মধ্যে এই মূর্তিমান ব্যতিক্রম, ইদানীং
অযাত্রী, উদাসীন-
মাঝারি বয়েস, লম্বা, জটপাকানো মাথা
তার নাম নেই, কে জানে আমিত্ব আছে কিনা
অথচ শরীর আছে
সুতোহীন দেহখানি দেহ সচেতন করে দেয়
পেটা বুক, খাঁজ-কাটা কোমর, আজানুলম্বিত বাহু
এবং দীর্ঘ পুরুষাঙ্গ
চুলের জঙ্গলে ঘেরা
পুরুষশ্রেষ্টের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিড়ে, যেন সদর্পে
সন্ন্যাসী হলেও কোনো মানে থাকতো, কেউ হয়তো প্রণাম জানাতো
কিন্তু এই শারীরিক প্রদর্শনী এত অপ্রাসঙ্গিক
টিকিটবাবুও তাকে বধা দেয় না
রেলরক্ষীরা মুখ ফিরিয়ে থাকে
ফিলমের পোস্টারের নারী-পুরুষদের সরে যাবার উপায় নেই
অপর নারী-পুরুষরা তাকে দেখেও দেখে না
তারা পাশ দিয়ে যেতে-যেতে একটু নিমেষহারা হয়েই
আবার দূরে চলে যায়
শুধু মায়ের হাত ধরা শিশুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে
একটি আপেল গড়ি েযায় লাইনের দিকে-
ঠিক সেই সময় বস্তাবন্দী চিঠির স’পের পাশ দিয়ে
এসে দাঁড়ায় দুটি হিজড়ে
নারীর বেশে ওরা নারী নয়, এবং সবাই জানে
ওদের বিস্ময়বোধ থাকে না
তবু হঠাৎ ওরা থমকে দাঁড়ায়; পরস্পরের দিকে
তাকায় অদ্ভুত বিহ্বল চোখে
যেন ওদের পা মাটিতে গেঁথে গেল
সার্চ লাইটের মতন চোখ ফেরালো পাগলটির শরীরে
সেই অপ্রয়োজনীয় সুঠাম সুন্দর শরীর,
নির্বিকার পুরুষাঙ্গ
যেন ওদের শপাং-শপাং করে চাবুক মারে
সূর্য থেকে গল-গল করে ঝরে পড়ে কালি
এই আছে ও নেই’-র যুক্তিহীন বৈষম্যে প্রকৃতি
দুর্দান্ত নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে
সেই দুই হিজড়ে অসম্ভব তীব্র চিৎকার করে ওঠে-
ধর্মীয় সঙ্গীতের মতন
ওরা কাঁদে,
দু’হাতে মুখ ঢাকে
বসে পড়ে মাটিতে
এবং টুকরো-টুকরো হয়ে মিশে যায়
নশ্বর ধুলোয়
অল্প দূরে, সিগারেট হাতে আমি এই দৃশ্য দেখি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | ঝড়ের ঝাপটায় উল্টে গেল একটি ঘুঘু পাখি
সে ঝড়কে ডেকেছিল
ঝড়ের ভালোবাসায় জেলেদের গ্রামটিতে আছড়ে পড়লো সমুদ্র
সমুদ্র ঝড়কে ডাকে
পাকের পাথরের মূর্তি অন্ধকারে দু‘হাত তোলে
শুকনো পাতারা জড়ো হয় তার পায়ের কাছে
কানা কাড়ির মতন পথের শিশুরা এদিক-ওদিক দৌড়ে যায়
মাটি কাঁপে, মাটি কাঁপে
মাটি ফিসফিস করে কথা বলে, ঘুমন্ত ভিখারিণীটি শোনে
ফুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অভিভূত কীট
কেউ বাজায় না, তবু বেজে ওঠে বাঁশি
রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝনঝন করে ছিটকে পড়ে মোজাইক মেঝেতে
তিনি ঝড়ের গান গেয়েছিলেন! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | শিউলি ফুলের রাশি শিশিরের আঘাতও সয় না
অন্তর আমার কৈশোরে তারা এ-রকমই ছিল
এখন শিউলি ফুলের খবরও রাখি না অবশ্য
জানি না, তারা স্বভাব বদলেছে কিনা।
আমার কৈশোরে শিউলির বোঁটার রং ছিল শুধু
শিউলির বোঁটারই মতন
কোনো কিছুর সঙ্গেই তার তুলনা চলতো না
আমার কৈশোরে পথের ওপর ঝরে পড়ে থাকা
শিশির মাখা শিউলির ওপর পা ফেললে
পাপ হতে
আমার পাপ কাটাবার জন্য প্রণাম করতাম।
আমার কৈশোরে শিউলির সম্মানে সরে যেত বৃষ্টিময় মেঘ
তখন রেদ্দুর ছিল তাপহীন উজ্জ্বল
দু’হাত ভরা শিউলির ঘ্রাণ নিতে নিতে মনে হতো
আমার কোনো গোপন দু:খ নেই, আমার হৃদয়ে
কোনো দাগ নেই
পৃথিবীর সব আকাশ থেকে বেজে উঠেছে উৎসবের বজনা।
শাদা শিউলির রাশি বড় স্তব্ধ, প্রয়োজনহীন, দেখলেই
বলতে ইচ্ছে করতো,
আমি কারুকে কখনো দু:খ দেবো না-
অন্তত এ-রকমই ছিলো আমার কৈশোরে
এখন অবশ্য শিউলি ফুলের খবরও রাখি না।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | অন্ধকারে তোমার হাত
ছুঁয়ে
যা পেয়েছি, সেইটুকুই তো পাওয়া
যেন হঠাৎ নদীর প্রান্তে
এসে
এক আঁজলা জল মাথায় ছুঁইয়ে যাওয়া। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | পথে পড়ে আছে এত কৃষ্ণচুড়া ফুল
দু’পায়ে মাড়িয়ে যাই, এলোমেলো হাওয়া
বড় প্রীতি-স্পর্শ দেয়, যেন নারী, সামনে বকুল
যার ঘ্রাণে মনে পড়ে করতল, চোখের মাধুরী
তারপরই হাসি পায়, মনে হয় আমি নয়, এই ভোরে
এত সুন্দরের কেন্দ্র চিরে
গল্পের বর্ণনা হয়ে হেঁটে যায় যে মানুষ
সে কি আমি?
ক্ষ্যাপাটের মত আমি মুখ মচকে হাসি।
ক্যাবিনের পর্দা উড়লে দেখা যায় উরুর কিঞ্চিৎ
একটি বাহুর ডৌল, টেবিলে রয়েছে ঝুঁকে মুখ
ও পাশে কে? ইতিহাস চূর্ণ করা নারীর সম্মুখে
রুক্ষচুল পুরুষটি এমন নির্বাক কেন? শুধু সিগারেট
নেড়েচেড়ে, এর নাম অভিমান? পাঁচটি চম্পক
এত কাছে, তবু ও নেয় না কেন, কেন ওর ওষ্ঠে
দেয় না গরম আদর?
শুধু চোখে চোখ- এটি অলৌকিক সেতু, একি
অসম্ভব চিন্ময়তা
চায়ের দোকানে ঐ পুরুষ নারূ-মূত্যি ব্যাথা দেয়
বুকের বড় ব্যাথা দেয়
ওরা এই পৃথিবীর কেউ নয় ইদানীং বেড়াতে এসেছে।
মধ্যরাত্রি ভেঙে-ভেঙে কে কোথায় চলে যায়, যেন উপবনে বসন্ত উঃসব হলো শেষ
বিদায় শব্দটি যাকে বিহ্বল করেছে
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে সে এখন দ্রুত উঠে আসে
চাঁদের শরীর ছুঁতে
অথবা স্বর্গের পথ এই দিকে হঠাৎ ভেবেছে
দরজা খুলো না তুমি, দূর থেকে রুক্ষ বাক্য বলে দাও
ও এখন দুঃখে- নোংরা, দু’হাতে তীব্রতা
এবং কপালে তৃষ্ণা, পর্দাহীন জানলার দিকে
দুই চোখ
মাতালের অসি’রতা মাধুর্যকে ওষ্ঠে নিতে চায়-
অথচ জানে না
গোলূলির কাছে তার নির্বাসন হয়ে গেছে কবে!
দরজা খুলো না তুমি, দুর থেকে রুক্ষ বাক্য বলে দাও
ও তোমার জানু আঁকড়ে আহত পশুর মতো ছটফটাবে
অতৃপ্তির সহোদর, সশরীর নিষিদ্ধ আগুন
ক্ষমা করো, আমি নই, ক্ষমা করো, দুঃস্বপ্ন, বিষাদ…… |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | সেই লেখাটা লিখতে হবে, যে লেখাটা লেখা হয়নি
এর মধ্যে চলছে কত রকম লেখালেখি
এর মধ্যে চলছে হাজার-হাজার কাটাকুটি
এর মধ্যে ব্যস্ততা, এর মধ্যে হুড়োহুড়ি
এর মধ্যে শুধু কথা রাখা আর কথা রাখা
শুধু অন্যের কাছে, শুধু ভদ্রতার কাছে, শুধু দীনতার কাছে
কত জায়গায় ফিরে আসবো বলে আর ফেরা হয়নি
অর্ধ-সমাপ্ত গানের ওপর এলিয়ে পড়েছিল ঘুম
মেলায় গে উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম
শোধ দেওয়া হয়নি সে ঋণ
এর মধ্যে চলেছে প্রতিদিন জেগে ওঠা ও জাগরণ থেকে ছুটি
এর মধ্যে চলেছে আড়চোখে মানুষের মুখ দেখাদেখি
এর মধ্যে চলছে স্রোতের বিপরীত দিক ভেবে স্রোতেই ভেসে যাওয়া
শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা
ব্যস্ততম মুহূর্তের মধ্যেও একটা ঝড়ে-ওড়া শুকনো পাতা
শুধু অপেক্ষা
সেই লেখাটা লিখতে হবে, যে লেখাটা লেখা হয়নি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না
মৃত্যু হয় না-
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।
আমার কেউ নাম রখেনি, তিনটে
চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধীমে,
আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার
হাত পুড়ে যায়
অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমায়ায়
অন্ধকারে মিশে থেকেছি
কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোনো ভয় হয় না
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ছেঁড়া পৃষ্ঠা উড়ে যায়, না-লেখা পৃষ্ঠাও কিছু ওড়ে
হিমাদ্রি-শিখর থেকে ঝুঁকে-জড়া জলাপ্রপাতের সবই আছে
শুধু যেন শব্দরাশি নেই
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ভোর আনে শালিকেরা, কোকিল ঘুমন্ত, আর
জেগে আছে দেবদারু বন
নীলিমার হিম থেকে খসে যায় রূপের কিরীট
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
বেলা গেল, শোনোনি কি ছেলেমানুষীরা কোনো
ভুল করা ডাক?
এপারে মৃত্যুর হাতছাছি আর অন্য পারে
অমরত্ব কঠিন নীরব
‘মনে পড়ে?’ এই ডাক কতকাল, কত শতাব্দীর
জলে ধুয়ে যায় স্মৃতি, কার জল কোন জল
কবেকার উষ্ণ প্রস্রবণ
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
খুঁজে পাবো?
অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | ঊনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উন্তিরিশে এসে
গর্ভবতী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ
কাঁপালো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতারে কুটিল সন্দেহ
সমস্ত শরীরে মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে
যন্ত্রনার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক।
দিবাসার্ধ পায়ে হেঁটে লিরি আমি জীবিকার দাসত্ব-ভিখারী
ক্লান্ত লাগে সারারাত, ক্লান্তি যেন অন্ধকার নারী।
একদা অসহ্য হলে বাহুর বন্ধনে পড়ে ধরা
যন্ত্রনায় জর্জরিতা দুঃখিনী সে আলোর স্বরূপে
মাংসের শরীর তার শুভক্ষণে সব ক্লান্তিহরা
মন্ডুকের মতো আমি মগ্ন হই সে কন্দর্প-কূপে।
তার সব ব্যর্থ হলো, দীর্ঘশ্বাসে ভরালো পৃথিবী
যদিও নিয়মনিষ্ঠা, স্বামী নামে স্বল্প চেনা লোকটির ছবি
শিয়রেতে ত্রুটিহীন, তবু তার দুই শঙ্খ স্তনে
পূজার বন্দনা বাজে আ-দিগন্ত রাত্রির নির্জনে।
সে তার শরীর থেকে ঝরিয়েছে কান্নার সাগর
আমার নির্মম হাতে সঁপেছে বুকের উপকূল,
তারপর শান্ত হলে সুখে-দুঃখে কামনার ঝড়
গর্ভের প্রাণের বৃন্তে ফুটে উঠলো সর্বনাশ-ফুল।
বাঁচাতে পারবে না তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বীরসিংহ শিশু
হবিষ্যান্নপুষ্ট দেহ ভবিষ্যের ভারে হলো মরণসম্ভবা
আফিম, ঘুমের দ্রব্য, বেছে নেবে আগুন, অথবা
দোষ নেই দায়ে পড়ে যদি-বা ভজনা করে যীশু।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জনলায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
ক্রুদ্ধ জলের প্রবল তোলপাড়ের উপড়ে গেছে রেললাইন
চৌচির হয়েছে ব্রীজ, মৃত পশুর পেটের কাছে ছন্নছাড়া বালক
তরঙ্গে ভেসে যায় বৃদ্ধের চশমা, বৃক্ষের শিখরে মানুষের
আপৎকালীন বন্ধুত্ব
এইসব টুকরো দৃশ্য- এক ধরনের সত্য, আংশিক, কিন্তু বড় তীব্র
বিপর্যয়ের সময় এই সব আংশিক সত্যই প্রধান হয়ে ওঠে
ইন্দিরা, লক্ষ্মীমেয়ে, তোমার এ-কথা ভোলা উচিত নয়
মেঘের প্রাসাদে বসে তোমার করুণ কন্ঠস্বরেও
কোনো সার্বজনীন দু:খ ধ্বনিত হবে না
তোমার শুকনো ঠোঁট, কতদিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি,
চোখের নিচে গভীর কালো ক্লান্তি, ব্যর্থ প্রেমিকার মতো চিবুকের রেখা
কিন্তু তুমি নিজেই বেছে নিয়েছো এই পথ
তোমার আর ফেরার পথ নেই
প্রিয়দর্শিনী, তুমি এখন বিমানের জনলায় বসে
উড়ে এসো না জলপাইগুড়ি, আসামের আকাশে
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
আমি তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি-
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত-যেন মেঘলা আকাশ উল্টো
হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়িও কান্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | মনে আছে সেই রাত্রি? সেই চাকভাঙা
মধুর মতন জ্যোৎস্না
উড়ো উড়ো পেঁজা মেঘ অলীক গর্ভের প্রজাপতি
দুগ্ধবর্ণ বাতাসের কখনো স্পর্শ ও ছবি খেলা
মিনারের মতোন পাঁচটি প্রচীন সুউচ্চ গাছ,
সেই
মানবিক চষা মাঠ, তিনটি দিগন্ত দূর, আরও দূর
পুকুরের ঢালু পাড়ে তুমি শুয়ে ছিলে
মনে আছে সেই রাত্রি, সঠিক পথেই ঠিক
ভুল করে যাওয়া?
বুকে কেউ চোখ ঘষে, ঊরুদ্বয়ে, ভেঙে যায় ঘুম
হঠাৎ প্রবাসী গল্প, ফিসফাস, শব্দ এসে
শব্দকে লুকোয়
অশ্রুর লবণ থেকে উঠে আসে স্মৃতিকথা, পিঠে
কাঁকর ও তৃণাঙ্কুর, অথচ এমন রাত্রি, এমন
জ্যোৎস্না মৃদু ঢেউ
কখনো দেখোনি কেউ, সমস্ত শরীরে আলো যেন
খুব জলের গভীরে
সাবলীল ভেসে যাওয়া, কত দেশ কত
নদী এমনকি
মনুষজন্ম পার হয়ে এসে
যেমন ফুলের বুকে ঘ্রাণ কিংবা ঘ্রান ছেঁচে
জন্ম নেয় ফুল
মনে পড়ে সেই রাত্রি? সঠিক পথেই ঠিক
ভুল করে যাওয়া? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | এ-পাশে দেয়াল, এত মাকড়সার জাল!
অন্যদিকে নদী, নাকি ঈর্ষা?
আসলে ব্যস্ততাময় অপরাহ্নে ছায়া ফেলে যায়
বাল্যপ্রেম
মানুষের ভিড়ে কোনো মানুষ থাকে না
অসম্ভব নির্জনতা চৌরাস্তায় বিহ্বল কৈশোর
এলোমেলো পদক্ষেপ, এতদিন পরে তুমি এলে?
তোমার মুখের পাশে কাঁটা ঝোঁপ, একটু সরে এসো! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | বহু অর্চনা করেছি তোমায়, এখন ইচ্ছে
টেনে চোখ মারি
হে বীণাবাদিনী, তুমিও তো নারী, ক্ষমা করো এই
বাক-ব্যবহার
তুমি ছাড়া আর এমন কে আছে, যার কাছে আমি
দাস্য মেনেছি-
এবার আমাকে প্রশ্রয় দাও, একবার আমি
ছিনা টান করি।
একবার এই পাংশুবেলায় তুমি হয়ে ওঠো
শরীরী প্রতিমা
অনেক দেখেছি দুনিয়া বাহার, এবার ফুঁদিয়ে
নেভাই গরিমা
হলুদকে বলা রক্তিম হতে-ভাষাভ্রান্তির
এই উপহাস
মানুষকে বড় বিমূঢ় করেছে, এবার অস্ত্র
দুঃখ-দহন।
জানি না কোথায় পড়েছিল বীজ, পৃথিবীতে এত
ভুল অরণ্য
দুঃখ সুখের খেলায় দেখেছি বারবার আসে
প্রগাঢ় তামস
তোমার রূপের মায়াবী বিভায় একবার জ্বালো
ক্ষণ-বিদ্যুৎ
চোখ যেন আর চিনতে ভোলে না, তুমি জানো আমি
কত অসহায়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | সে এত সুন্দর, তাই তার পাশে বসি
রূপের বিভায় আমি সেরে নিই লঘু আচমন
রূপের ভিতর থেকে উঠে আসে বুকভরা ঘুম
আমি তার চোখ থেকে তুলে নিই
মিহিন ফুলের পাপড়ি।
গন্ধ শুঁকি, পুনরায় ঘুম থেকে জাগি
উজ্জল দাঁতের আলো রক্তিম ওষ্ঠকে বহু দূরে নিয়ে যায়
রূপের সুদূরতম দেশে চলে যাবে এই ভয়ে
আমি দ্রুত সিঁড়ি গিয়ে নেমে…
সে এত সুন্দর তাই তার পাশে এশে বসি।
রূপ যেন অভিমান, আমি কোনো সান্তনা জানি না
যতখানি নিতে পারি, দিই না কিছুই
জানলার পাশ দিয়ে উঁকি মারে কার ছায়া?
ওকি প্রতিদ্বন্দ্ব?
ওকি নশ্বরতা?
শিখেছি অনেক অনেক কষ্টে তার চোখে ধূলো দেওয়া
এই শিল্পরীতি
চিরকাল না হলেও, বারবার ফেরানো যাবেই জেনে
রূপ থেকে সুধা পান করি
ঠিক উম্মাদের মত চোখ থেকে ঝড়ে পড়ে হাসি।
প্রকৃতির অলঙ্কার সে রেখেছে অনন্ত সীমানা জুড়ে জুড়ে
তাই প্রকৃতির কাছে অন্ধ হলে যাবো
সুমেরু পর্বতে আমি মাথা রাখি
সমুদ্রের ঢেউ লাগে হাতের আঙুলে
উরুর ভিতরে অগ্নি…এত মোহময়
অণ্যের গন্ধমাখা ….
নিঃশ্বাসে পলাশ ঝড়, বারবার
যুদ্ধের সুমিষ্ট স্বপ্ন, চোখ ঘুরে ঘুরে
যায়, আসে
যুদ্ধের অমর শিল্প….
সে এত সুন্দর তাই তার পাশে বাস! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে আমার চতুর্থভাগ আত্মা ছুটে যায়
প্রতিটি আত্মার সঙ্গে আমার নিজেস্ব ট্রেন অসময় নিয়ে
খেলা করে।
আলোর দোকানে আমি হাজার হাজার বাতি সজিয়ে রেখেছি
নষ্ট-আলো সঞ্জীবনী শিক্ষা করে আমার চঞ্চল
অহমিকা।
জাদুঘরে অসংখ্য ঘড়িতে আমি অসংখ্য সময় লিখে রাখি
নারীর ঊরুর কাছে আমার পিঁপড়ে দূত ঘোরেফেরে
আমারই ইঙ্গিতে তারা চুম্বনের আগে
কেঁপে ওঠে।
এইরূপ কর্মব্যস্ত জীবনের ভিতরে-বাইরেডুবে থেকে
বিকেলের অমসৃণ বাতাসে হঠাৎ আমি দেখি
আমার আত্মার একাটা কুচো টুকরো
আজও কোনো কাজ পায়নি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমি তোমাদের কোন্ অনন্ত ছায়ায়
শুয়ে আছি, শুয়ে রবো, আমি তোমাদের
থেকে বহু দুরে তবু ছায়ার ভিতরে
শুয়ে আছি, জেগে আছি, শিয়রে ও পায়ে
ছায়া পড়ে, ছায়া কাঁপে, চোখের ছায়ায়
মাছ খেলা করে, ভাসে, আমি তোমাদের
মাছের মতন চোখ ছায়ার সাঁতারে
তুলে আনি, তোমাদের গোলাপজামের
মতো চোষ ভালোবাসি, মুখে দিই, দাঁতে
‘তোমাদের’ ভালোবাসাময় চোখগুলি
ভেঙে যায়, মিশে যায়, হেমন্ত বেলায়
শিরীষ ফুলের মতো তোমাদের চোখ
আমাকে পালন করে গোধুলি ছায়ায়।
‘তোমাদের’ শব্দটিতে অনেক কুয়াশা
যেমন শব্দের কাছে নীরবতা ঋণী
যেমন নীরব ফুল সব বন্দনার
চেয়ে শ্রেষ্ঠ, ভ্রষ্ট ফুল যেমন বুকের
কাছে হাত জোড় করে, ছায়ায় শয়ান
ফুল ও বুকের চেয়ে কোমল পাছার
সঙ্গীতের মতো ভঙ্গি যেমন অনেক
দূর মনে হয়, আমি মনের কুয়াশা
‘তোমাদের’ মুখে রাখি, তোমাদের চোখ
কাজলের মতো লাগে, চোখে চোখে ছুঁয়ে
আমি দেখি, শুয়ে থাকি, যেন বিপুলের
ভিতরে নিঃস্বতা কাঁপে, চঞ্চলতা যেন
ছায়ায় গোপন, মুখ মুখশ্রী লুকোয়-
মুখের ভিতরে চোষ ভাঙে মিশে যায়।। |
মুহম্মদ নূরুল হুদা | স্বদেশমূলক | চলো ভাই চলো বোন চলো শাহবাগ
মহানগরীর মুখ চলো শাহবাগ
মহাজনতার মুখ চলো শাহবাগ
প্রজন্মের জয়ী মুখ চলো শাহবাগপিজি আর জাদুঘর পাশে শাহবাগ
নজরুল জয়নুল পাশে শাহবাগ
জনকের বজ্রধ্বনি পাশে শাহবাগ
সার্বভৌম হে তর্জনী পাশে শাহবাগশাহবাগ নেই শুধু শাহবাগ মোড়ে
শাহবাগ নেই শুধু ঢাকার শহরে
শাহবাগ নেই শুধু নগর-বাংলায়
যেখানে বাঙালি যায়, শাহবাগ যায়অলিগলি তেপান্তর আজ শাহবাগ
পাখপাখালির ডানা আজ শাহবাগ
মেঠোপথ বালুচর আজ শাহবাগ
বাঙালির পথচিহ্ন আজ শাহবাগরবীন্দ্রনাথের বাংলা আজ শাহবাগ
নজরুলের জয় বাংলা আজ শাহবাগ
মুজিবের জয় বাংলা আজ শাহবাগ
জনতার জয় বাংলা আজ শাহবাগচলো ভাই চলো বোন চলো শাহবাগ
এ বাংলার জলস্থল চলো শাহবাগ
এ বাংলার নভোতল চলো শাহবাগ
এ বাংলার প্রতি ইঞ্চি চলো শাহবাগখুনির বিচার আছে আছে শাহবাগ
জনতার রায় আছে আছে শাহবাগ
ফাঁসির মঞ্চ আছে আছে শাহবাগ
রাজা নেই রাণী নেই আছে শাহবাগচলো ভাই চলো বোন চলো শাহবাগ
হাতে হাত কাঁধে কাঁধ চলো শাহবাগ
শ্লোগানে ও গানে গানে চলো শাহবাগ
গণতন্ত্র জপমন্ত্র চলো শাহবাগআরেকবার বাহান্ন চলো শাহবাগ
আরেকবার একাত্তর চলো শাহবাগ
আরেকবার পুণ্যবাংলা চলো শাহবাগ
আরেকবার সাম্যবাদ চলো শাহবাগসকালে সূর্য জ্বলে চলো শাহবাগ
দুপুরে শৌর্য জ্বলে চলো শাহবাগ
বিকেলে জনতা জ্বলে চলো শাহবাগদিনে আলো রাতে আলো আলো শাহবাগ১০-১৪.০২.২০১৩ |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না? |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | তোমার জন্মদিনে কী আর দেব এই কথাটুকু ছাড়া
আবার আমাদের দেখা হবে কখনো
দেখা হবে তুলসীতলায় দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয়
দেখা হবে সুপুরি বনের কিনারে
আমরা ঘুরে বেড়াবো শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে
গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে
কিন্তু আমাদের ঘিরে থাকবে অদৃশ্য কত সুতনুকা হাওয়া
ওই তুলসী কিংবা সাঁকোর কিংবা সুপুরির
হাত তুলে নিয়ে বলব, এই তো, এইরকমই, শুধু
দু-একটা ব্যথা বাকি রয়ে গেল আজও
যাবার সময় হলে চোখের চাওয়ায় ভিজিয়ে নেবো চোখ
বুকের ওপর ছুঁয়ে যাবো আঙুলের একটি পালক
যেন আমাদের সামনে কোথাও কোনো অপঘাত নেই আর
মৃত্যু নেই দিগন্ত অবধি
তোমার জন্মদিনে কী আর দেবো শুধু এই কথাটুকু ছাড়া যে
কাল থেকে রোজই আমার জন্মদিন। |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | ‘সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!
বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা
আর তাছাড়া ভাইআর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খোল-নলিচাযাবে খোল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’
-কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশয়মিত্র বাবুমশয় বিষয়-আশয় বাড়িয়ে যান তাই
মাঝেমধ্যে ভাবেন তাদের নুন আনতে পান্তাই
নিত্য ফুরোয় যাদেরনিত্য ফুরোয় যাদের সাধ-আহ্লাদের শেষ তলানিটুকু
চিরটা কাল রাখবে তাদের পায়ের তলার কুকুর
সেটা হয় না বাবাসেটা হয় না বাবা’ বলেই থাবা বাড়ান যতেক বাবু
কার ভাগে কী কম প’ড়ে যায় ভাবতে থাকেন ভাবুক
অমনি্ দু’চোখ বেয়েঅমনি্ দু’চোখ বেয়ে অলপ্পেয়ে ঝরে জলের ধারা
বলেন বাবু ‘হা, বিপ্লবের সব মাটি সাহারা’
কুমীর কাঁদতে থাকেকুমীর কাঁদতে থাকে ‘আয় আমাকে নামা নামা ব’লে
কিন্তু বাপু আর যাব না চরাতে-জঙ্গলে
আমরা ঢের বুঝেছিআমরা ঢের বুঝেছি খেঁদীপেচী নামের এসব আদর
সামনে গেলেই ভরবে মুখে, প্রাণ ভ’রে তাই সাধো
তুমি সে-বন্ধু নাতুমি সে-বন্ধু না, যে ধুপধুনা জ্বলে হাজার চোখে
দেখতে পাবে তাকে, সে কি যেমন তেমন লোকে
তাই সব অমাত্যতাই। সব অমাত্য পাত্রমিত্র এই বিলাপে খুশী
শুঁড়িখানাই কেবল সত্য, আর তো সবই ভূষি
ছি ছি হায় বেচারা’ছি ছি হায় বেচারা? শুনুন যাঁরা মস্ত পরিত্রাতা
এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা
হেঁটে দেখতে শিখুনহেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়
আরেকটা কলকাতায় সাহেব আরেকটা কলকাতায়
সাহেব বাবুমশয়। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাত্ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে
তোমারই ঐ টুকরো-করা-শরীর
দু:সময়ে তখন তুমি জানো
হলকা নয়, জীবন বোনে জরি।
তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা-
মদ খেয়ে তো মাতাল হত সবাই
কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল ! |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | আমার বিশ্বাস আছে আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।
আগুন কখনো তাই সততায় ডাকে না আমাকে।
যত দূরে যাই দেখি তোমার মুখর মুদ্রাগুলি
ঘরের শিয়রে, পথে, জাদুঘরে, জলের প্রবাহে।
তোমার হৃদয় কোনো অর্থবতা জেনেছে কি আজ?
নিঃস্বতায় মুছে গেছে হৃদয়ের কালাকাল সীমা?
জাগো, জেগে ওঠো, জাগো, অন্ধকার জাগরণে জাগো—
আমাদের পৃথিবীতে কখনো ফেরে না হিরোশিমা।
তোমার বিশ্বাস নেই তোমাকে বিশ্বাস করি আমি?
এই ঘূর্ণিচরাচরে আমার সমস্ত রাত্রি ঘিরে
মুনিয়ার ডানা সব ঝরে গেছে আণবী ছটায়—
তোমাকেই খুঁজি তবু শরীরেরও ভিতরে শরীরে। |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা ।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা ।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে । |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | আমার কথা কি বলতে চাও না? নিশ্চিত তুমি বহিরাগত |
উঁচু স্বর তুলে কথা বলে যারা জেনে নাও তারা বহিরাগত |
গাঁয়ে কোণে কোণে গাঁয়ের মানুষ খেতে বা খামারে বহিরাগত |
মরা মানুষের মুখাচ্ছাদন সরিয়ো না, ও তো বহিরাগত |
মাঠে মাঠে ধরে যেটুকু ফসল সেসবও এখন বহিরাগত |
চালার উপরে ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বহুদূর থেকে বহিরাগত |
বর্ষাফলকে বিষ মেখে নিয়ে কালো মুখোশের আড়ালে যত
বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাহত | |
শঙ্খ ঘোষ | রূপক | ঈশানে নৈঋতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে
মাটির উপর মুখ রেখে
সে এখন শুয়ে আছে শেষ রাতের খোলা প্রান্তরে
আর কেউ নেই
শুধু তার পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা
হাতের ডানায় লেগে আছে ঘাসের সবুজ, বুকে ভেজা মাটি এইটুকু ছাতা
যেন কোনো কোমলতা ছিল না কোথাও কোনোখানে
তারপর
আকাশ আর পৃথিবীর ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসে ভোর
এসে দেখে :
যেখানে সে পা দুখানি রেখেছে, সেখানে
কাল বিকেলের শেষ ঝড়ে
পড়ে আছে কুরে খাওয়া সনাতন মহা নিমগাছ | |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | বুঝি তোমার চাউনি বুঝি
থাকবে না আর গলিঘুঁজি
থাকবে না আর ছাউনি আমার কোথাও
ও প্রমোটার ও প্রমোটার
তোমার হাতে সব ক্ষমতার
দিচ্ছি চাবি, ওঠাও আমায় ওঠাও |
তুমিই চিরনমস্য, তাই
তোমার পায়ে রত্ন জোটাই
তোমার পায়েই বিলিয়ে দিই শরীর—
যাঁর যা খুশি বলুন তিনি
করবে তুমি কল্লোলিনী
ভরসা কেবল কলসি এবং দড়ির |
আমার বলে রইলো শুধু
বুকের ভেতর মস্ত ধু ধু
দিয়েছি সব যেটুকু ছিল দেবার
ঘর ছেড়ে আজ বাইরে আসি
আমরা কজন অন্তেবাসী
শবসাধনার রাত কাটাব এবার | |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | হাতের কাছে ছিল হাতেমতাই
চূড়োয় বসিয়েছি তাকে
দুহাত জোড় করে বলেছি ‘প্রভু
দিয়েছি খত দেখো নাকে।
এবার যদি চাও গলাও দেব
দেখি না বরাতে যা থাকে -
আমার বাঁচামরা তোমারই হাতে
স্মরণে রেখো বান্দাকে!’
ডুমুরপাতা আজও কোমরে ঝোলে
লজ্জা বাকি আছে কিছু
এটাই লজ্জার। এখনও মজ্জার
ভিতরে এত আগুপিছু!
এবার সব খুলে চরণমূলে
ঝাঁপাব ডাঁই করা পাঁকে
এবং মিলে যাব যেমন সহজেই
চৈত্র মেশে বৈশাখে। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?
স্পষ্ট নৌকো, ছৈ ছিল না, ভাঙা বৈঠা গ্রাম হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলপুলন্ত নির্জনতা
আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি বা জন্মজীবন |
কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখে ঢেউ ছিল না!
আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন ক’রে দিয়ে ছিলাম
ছলছলানো মুখোশমালা, সে কথা তুই ভালই জানিস—
তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
সবার হাতে ঘুরতে-ঘরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন? |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে | |
শঙ্খ ঘোষ | ভক্তিমূলক | ১.
নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।
ছিলো, নেই- মাত্র এই; ইটের পাঁজায়
আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়
আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।২.
নষ্ট হয়ে যাবার পথে গিয়েছিলুম, প্রভু আমার!
তুমি আমার
নষ্ট হবার সমস্ত ঋণ
কোটর ভরে রেখেছিলে।কিন্তু আমার অমোঘ মুঠি ধরে বুকের মোরগঝুঁটি
সন্ধ্যাবেলা শুধু আমার
মুখের রঙে
ঝরে পড়ার ঝরে পড়ার
ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু!৩.
সকল প্রতাপ হলো প্রায় অবসিত
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই-
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই-
ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু। |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | তুমি বললে মানবতা
আমি বললে পাপ
বন্ধ করে দিয়েছে দেশ
সমস্ত তার ঝাঁপ
তুমি বললে হিটলারিও
জনপ্রেমে ভরা
আমি বললে গজদন্ত
তুমি বললে ছড়া ।তুমি বললে বাঁচার দাবি
আমি বললে ছুতো
হামলে কেন এল সবাই
দিব্বি খেত শুত ।
হোক না জীবন শুকনো খরা
বন্ধ্যা বা নিষ্ফলা ।
আমি বললে সেপাই দিয়ে
উপড়ে নেবে গলা ।তুমি বললে দণ্ডকে নয়
আপন ভূমিই চাই
আমি বললে ভণ্ড, কেবল
লোক খ্যাপাবার চাঁই ।
চোখের সামনে ধুঁকলে মানুষ
উড়িয়ে দেবে টিয়া
তুমি বললে বিপ্লব, আর
আমি প্রতিক্রিয়া । |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে
তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট
তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস
সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাত্ পেয়েছে তার মানে
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান
মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে । |
শঙ্খ ঘোষ | মানবতাবাদী | One more unfortunate
Weary of breath
Rashly importunate
Gone to her death. – Thomas Hoodনিভন্ত এই চুল্লীতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী
দু’এক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দি’।হায় তোকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়
হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়নিভন্ত এই চুল্লী তবে
একটু আগুন দে –
হাড়ের শিরায় শিখার মাতন
মরার আনন্দে।
দু’পারে দুই রুই কাৎলার
মারণী ফন্দী
বাঁচার আশায় হাত-হাতিয়ার
মৃত্যুতে মন দি’।বর্গী না টর্গী না, যমকে কে সামলায়!
ধার-চকচকে থাবা দেখছ না হামলায়?
যাস্ নে ও-হামলায়, যাস্ নে।।কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না-
মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না-
চলল মেয়ে রণে চলল।
বাজে না ডম্বরু, অস্ত্র ঝন্ ঝন্ করে না, জানল না কেউ তা
চলল মেয়ে রণে চলল।
পেশীর দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে
চলল মেয়ে রণে চলল।নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
মৃত্যুরই গান গা-
মায়ের চোখে বাপের চোখে
দু-তিনটে গঙ্গা।
দূর্বাতে তার রক্ত লেগে
সহস্র সঙ্গী
জাগে ধক্ ধক্, যজ্ঞে ঢালে
সহস্র মণ ঘি।যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাত সব বাস্তুহীন |
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শেয়ালদা
ভরদুপুর
উলকি-দেয়াল
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
কানাগলি
স্লোগান
মনুমেন্ট
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শরশয্যা
ল্যাম্প পোস্ট
লাল গঙ্গা
সমস্ত এক সঙ্গে ঘিরে ধরে মজ্জার অন্ধকার
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজে জলতরঙ্গ
চূড়োয় শূণ্য তুলে ধরে হাওড়া ব্রিজ
পায়ের নিচে গড়িয়ে যায় আবহমান |
যা কিছু আমার চার পাশে ঝর্না
উড়ন্ত চুল
উদোম পথ
ঝোড়ো মশাল
যা কিছু আমার চার পাশে স্বচ্ছ
ভোরের শব্ দ
স্নাত শরীর
শ্মশান শিব
যা কিছু আমার চার পাশে মৃত্যু
একেক দিন
হাজার দিন
জন্ম দিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন | |
শঙ্খ ঘোষ | প্রেমমূলক | সবকিছু মুছে নেওয়া এই রাত্রি তোমার সমান।
সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি পড়ে। কখনো-কখনো
কাছে দূরে জ্বলে ওঠে ফসফরাস। কিছুরই কোথাও
ক্ষান্তি নেই। প্রবাহ চলেছে শুধু তোমারই মতন
একা একা, তোমারই মতন এত বিকারবিহীন।
যখনই তোমার কথা ভাবি তবু, সমস্ত আঘাত
পালকের মতো এসে বুকের ওপরে হাত রাখে
যদিও জানি যে তুমি কোনোদিনই চাওনি আমাকে। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে ।
যখন যা চাই তখুনি তা চাই ।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে, আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে-
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবন ছাই!
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে ।। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মরলেখো আয়ু লেখো আয়ুভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগেস্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | আগুন লেগেছে শূন্যে, আমোদে মেতেছে তটভূমি ।
হাড়পোড়া শব্দগন্ধ জড়িয়েছে গভীর আশ্লেষে
ঘুমন্ত মনেরও বোধ । মনে হয় একদিন তুমি
জলাধার হয়ে তবু দাঁড়াবে আমারই সামনে এসে ।
কতজনে জানতে চায় বেঁচে আছি আজও কি তেমনই —
অথবা কীভাবে আজও তোমাকেই ভেবেছি প্রবাহ !
তোমার সঞ্চয় তবে মিথ্যে থেকে মিথ্যে হয়ে এল ?
আমারও প্রতীক্ষা তবে শেষ থেকে হয়ে এল শেষ ?আগুন ছড়ায় আরও, কোথাও কিছুই নেই বাকি
পুড়ে যায় চক্ষুতারা, পুড়ে যায় দূরে বনস্থলী —
তবুও কীভাবে আজও তোমাকেই ভবিতব্য ভাবি !
যে-কথা কারোরই কাছে বলা যায় না — কীভাবে তা বলি ! |
শঙ্খ ঘোষ | প্রেমমূলক | ভাঙা নৌকো পড়ে আছে খালের কিনারভরা
এখন সন্ধ্যার শত নাম;
তুমি আমি মুখোমুখি নই আর।
অবসাদ দিয়েছিলে মনে পড়ে, শুধু মনে পড়ে না কখন
অপরের হাত ধরে চলে গেছ নদীর জোয়ারে।চারিদিকে সব জল ঠিক আছে নীরবতাময়।
মাঝে-মাঝে যেন কোনো হঠাৎ শুশুক
ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় ব্যবহৃত সময়ের টান—
আমি যার নাম জানি সে কি জানে আমার হৃদয়?খাল থেকে ছোটো খাল
আরো ছোটো ছোটো সব খালের ভিতরে
কিছু আর মুখোমুখি নয়
আড়ালে অদৃশ্য জালে ঢাকা আছে বীজাণুর কাল—
এখন নদীর দিকে ভালোবাসা প্রতিহত হয়। |
শঙ্খ ঘোষ | চিন্তামূলক | হয়তো এসেছিল | কিন্তু আমি দেখিনি |
এখন কি সে অনেক দূরে চ’লে গেছে?
যাব | যাব | যাব |
সব তো ঠিক করাই আছে | এখন কেবল বিদায় নেওয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম!
কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকো বাঁধা আছে দুটি,
দুরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে— |
বিষ্ণু দে | প্রেমমূলক | হৃদয় তোমাকে পেয়েছি, স্রোতস্বিনী!
তুমি থেকে থেকে উত্তাল হয়ে ছোটো,
কখনো জোয়ারে আকণ্ঠ বেয়ে ওঠো
তোমার সে-রূপ বেহুলার মতো চিনি।
তোমার উৎসে স্মৃতি করে যাওয়া আসা
মনে-মনে চলি চঞ্চল অভিযানে,
সাহচর্যেই চলি, নয় অভিমানে,
আমার কথায় তোমারই তো পাওয়া ভাষা।
রক্তের স্রোতে জানি তুমি খরতোয়া,
ঊর্মিল জলে পেতেছি আসনপিঁড়ি,
থৈথৈ করে আমার ঘাটের সিঁড়ি,
কখনো-বা পলিচড়া-ই তোমার দোয়া।
তোমারই তো গান মহাজনী মাল্লার,
কখনো পান্সী-মাঝি গায় ভাটিয়ালি,
কখনো মৌন ব্যস্তের পাল্লায়,
কখনো-বা শুধু তক্তাই ভাসে খালি।
কত ডিঙি ভাঙো, যাও কত বন্দর,
কত কী যে আনো, দেখো কত বিকিকিনি,
তোমার চলায় ভাসাও, স্রোতস্বিনী, |
বিষ্ণু দে | প্রেমমূলক | সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনে
কৃতার্থ দোহার |
পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে ;
স্মৃতি আছে তার |
রৌদ্র-জলে সেই-স্মৃতি মরে না, আয়ু যে
দুরন্ত লোহার |
শুধু লেগে আছে মনে ব্যথার স্নায়ুতে
মর্চের বাহার || |
বিষ্ণু দে | সনেট | তোমায় লেগেছে ভালো – সে-কথা তো জানো ?
তোমার ও কটা চোখ – যদিচ বাঙালি,
বুধবার থেকে কেন মনে পড়ে খালি !
লোকে যাকে প্রেম বলে – সে কি তুমি মানো ?
জেনে-শুনে চোখ দিয়ে আমাকে কি টানো ?
না কি তুমি অজানিতে ভরে যাও ডালি ?
না কি আমি সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি
পড়েছি প্যারিসে গিয়ে, তাই চোখে আনো
কৌতুহল নামে বস্তু ? অলকা, বলো তো।
আমাকে বলতে কিছু ভয় পেয়ো নাকো;
একাধিক ওষ্ঠাধর ঠেকেছে এ-কানে;
তা ছাড়া প্রেমের ফুলও বিবেচনা-মতো
তুলি আমি। তবু কেন চুপ ক’রে থাকো?
ক্ষমা কোরো, হেসেছি কি সে-দিনের গানে? |
বিষ্ণু দে | চিন্তামূলক | তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাঁটায়
এ-দেশে ও-দেশে নিত্য ঊর্মিল কল্লোলে
পাড় গড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়
মরিয়া বন্যায় যুদ্ধে কখনো-বা ফল্গু বা পল্বলে
কখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদে
বিলাও বেগের আভা
আমি দূরে কখনো-বা কাছে পালে-পালে কখনো-বা হালে
তোমার স্রোতের সহযাত্রী চলি, ভোলো তুমি পাছে
তাই চলি সর্বদাই
যদি তুমি ম্লান অবসাদে
ক্লান্ত হও স্রোতস্বিনী অকর্মণ্য দূরের নির্ঝরে
জিয়াই তোমাকে পল্লবিত ছায়া বিছাই হদৃয়ে
তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের কাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে-ঘাটে বাগানে-বাগানে। |
বিষ্ণু দে | মানবতাবাদী | অনেক দিনের অনেক যত্নে কমিয়েছি সন্ত্রাস।
এদিকে আমার ছুটি শেষ হ’ল প্রায়,
আজ তিনটেতে গাছ থেকে নেমে বসেছিলো জানলায়।
এত ভীরু এত বিনীত কেন যে! এরাই তো ছিল খাস
সমুদ্র-জয়ী সীতা-সন্ধানী সেতুবন্ধের সঙ্গী;
দীন সজ্জন সাহসী উত্সাহিত
মজুরেরই মত ভঙ্গী।
এরা কেন ভয়ে ডালে-ডালে ঘোরে আজ?
এরা কোনও কালে করেনি তো লাফঝাঁপ
রামরাজত্বে সরকারি রামদাস!
যদিচ এদেরই কোমল অঙ্গে পাঁচ-আঙুলের ছাপ।
অনেক যত্নে নামিয়েছি আজ গাছ থেকে জানলায়
ভাবছি এখন কি ক’রে বাঁচাব এদের এ-বিশ্বাস!
হোটেল ছাড়ার সময় হয়েছে প্রায়।। |
বিষ্ণু দে | চিন্তামূলক | তুমিই মালিনী, তুমিই তো ফুল জানি ।
ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে, মালিনী,
বাতাসে গন্ধ, উৎস কি ফুলদানি,
নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?
দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নি
কালের বাগানে থামে নি কো আসা যাওয়া
ত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,
একটি প্রহর ফুলহার দাও খুলে,কালের মালিনী ! তোমাকেই ফুল জানি,
তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী,
তোমাকেই রাখী বেঁধে দিই করমূলে
অতীত থাকুক আগামীর সন্ধানী –
তাই দেখে ঐ কাল হাসে দুলে দুলে |
বিষ্ণু দে | চিন্তামূলক | আঁটসাঁট বেঁধে আচল জড়ালো কোমরে,
মুগ্ধ চোখের এক নিমেষের দেরিতে
লঘু লাবণ্যে লাফ দিয়ে হল পার |
কালো পাহাড়ের গায় চমকাল রেখা,
শাড়ির শাদায় কস্তাপাড়ের সিঁদুরে
কষ্টিতে ঋজু কোমল শরীরে তরল স্রোতের ছন্দ |
এই লাবণ্যে এই নিশ্চিত ছন্দে
আমরা সবাই কেনইবা পার হব না
সামনের এই পাহাড়ের খাড়া খন্দ ? |
বিষ্ণু দে | মানবতাবাদী | জন সমুদ্রে নেমেছে জোয়ার,
হৃদয় আমার চড়া |
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি—
কোথায় ঘোড়সওয়ার?
দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী! বর্শা তোলো |
কোন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?
নয়নে ঘনায় বারে বারে ওঠাপড়া?
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি?হৃদয় আমার চড়া?
অঙ্গে রাখিনা কারোই অঙ্গিকার?
চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া |
এখানে কখনো বাসর হয় না গড়া?
মৃগতৃষ্ণিকা দূর দিগন্তে ডাকি?
আত্মাহুতি কি চিরকাল থাকে বাকি?
জনসমুদ্রে উন্মথি’ কোলাহল
ললাটে তিলক টানো |
সাগরের শিরে উদ্বেল নোনা জল,
হৃদয়ে আধির চড়া |
চোরাবালি ডাকি দূর দিগন্তে,
কোথায় পুরুষকার?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর!
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?* * * *হালকা হাওয়ায় বল্লম উঁচু ধরো |
সাত সমুদ্র চৌদ্দ নদীর পার—
হালকা হাওয়ায় হৃদয় দু-হাতে ভরো,
হঠকারিতায় ভেঙে দাও ভীরু দ্বার |
পাহাড় এখানে হালকা হওয়ায় বোনে
হিম শিলাপাত ঝঞ্ঝার আশা মনে |
আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
কাঁপে তনু বায়ু কামনায় থরথর |
কামনার টানে সংহত গ্লেসিয়ার |
হালকা হাওয়ায় হৃদয় আমার ধরো,
হে দূর দেশের বিশ্ববিজয়ী দীপ্ত ঘোরসাওয়ার!
সূর্য তোমার ললাটে তিলক হানে
বিশ্বাস কেন বহিতেও ভয় মানে!
তরঙ্গ তব বৈতরণী পার |
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে |
চেয়ে দেখ ঐ পিতৃলোকের দ্বার!
জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার—
মেরুচূড়া জনহীন—
হালকা হওয়ায় কেটে গেছে কবে
লোক নিন্দার দিন |
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর,
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর |
কোথায় পুরুষকার?
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গিকার? |
বিষ্ণু দে | মানবতাবাদী | নানামুনি দেয় নানাবিধ মত মন্বন্তর আসে!
তবুও শহরে ওসারে বহরে জড়কবন্ধ ভিড়!
বহু সাপ্লাই উঠে গেল শুনি, তবু আজো লাগে চিড়
পদাতিক পথে, ট্রামে কারে ট্রাকে করে বিড়বিড়
দরকারী বিনাদরকরী কেউ সরকারী চোরাকারবারী ফ’ড়ে
আমীর ওমরা মজুতদারের পাশে
আমরা সবাই-তুমি আর আমি মৃত্যুর প্রতিভাসে
মিশে যাই,-জানি মিথ্যা নেহাত্; দুর্বার জীবনের
অবাধ প্রগতি মন্দাকিনী কি বালুচরে মরে ঘাসে!
কখনো ঝরনা সহস্রধারা, কখনো ফল্গু মীড়
কখনো প্রাণের প্রবল বন্যা, দুর্বার জীবনের
লাখো লাখো হাতে তরঙ্গাঘাতে দ্বন্দ্বের উচ্ছাসে
ভেঙে দেয় পাড়, ওড়ায় প্রাসাদ বসায় নতুন নীড়;
অর্কেস্ট্রার মিলিত জোয়াড়ে মাসতুত ভাই ডুবেছে খোঁয়াড়ে,
হস্তিনাপুরে রাজার মস্তি, মন্ত্রিরা দেখে ভিড়-
অগণন চাষী পলিমাটি চষে, কামার কাস্তে হাতুড়িতে কষে,
রেলপথে পথে আকাশে নদীতে বজ্রের গান পাতা।
কোথায় দিল্লী কোথা ক’লাকাতা মহেঞ্জোদারো ইতিহাসে গাঁথা-
মৃত্যুর পাশে জীবনের ভিড় বদ্ধমুষ্টি সঙ্ঘনিবিড়
মৃত্যুবিহীন আমাদের এই ভারতের ইতিহাসে। |
বিষ্ণু দে | সনেট | আকাশে তোমার মুক্তি; ? যে কৈলাশ বেঁধেছ ভাস্কর
তোমার উর্মিল নৃত্যে, নীলিমা সে নৃত্যের সঙ্গিনী ;
সেখানে নেইকো সোনা কৌটিল্যের নেই বিকিকিনি,
সেখানে শূণ্যের চোখে সম্পূর্ণতা স্বাধীন, ভাস্বর |
সে-দক্ষযজ্ঞের নাটে স্থিতি কাঁপে সংহারে-সংহারে,
রাজসূয় অসূয়ার যুগ গত কুমার সম্ভবে ;
নটরাজ সর্বহারা নীলকণ্ঠ গালবাদ্যরবে
পায়ে-পায়ে পৃথ্বী জাগে সতী তোলে সর্বংসহারে |
সন্ন্যাসী, তোমার মুক্তি বাঁধা জড় পাথরে আকাশে,
রৌদ্রেজলে ছায়াতপে বর্ষে-বর্ষে উন্মুক্ত সাক্ষর
কঠিন কষ্টিতে লেখা নীলাকাশে, কালের ঈশ্বর !
আমরা ভাস্কর, নই মূর্তি, মুক্তি আনি কর্মে চাষে,
যন্ত্রের ঘর্ঘরে, নিত্য আন্দোলনে, মুষ্ঠিভিক্ষা আসে
নীলকণ্ঠ আমাদের মুক্তি নিত্য | আমরা নশ্বর || |
বিষ্ণু দে | প্রেমমূলক | আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
ক্ষনিকের মরালকায়
ইন্দ্রিয়ের হর্ষে, জান গড়ে তুলি আমার ভুবন?
এসো তুমি সে ভুবনে, কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।
ক্ষণেক সেখানে থাকো,
তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি
ঘুরি যে সময় নেই- শুধু তুমি থাকো ক্ষণকাল,
ক্ষণিকের আনন্দাঅলোয়
অন্ধকার আকাশসভায়
নগ্নতায় দীপ্ত তনু জ্বালিয়ে যাও
নৃত্যময় দীপ্ত দেয়ালিতে।
আর রাত্রি, রবে কি উর্বশী,
আকাশের নক্ষত্রাঅভায়, রজনীর শব্দহীনতায়
রাহুগ্রস্ত হয়ে রবে বহুবন্ধে পৃথিবীর নারী
পরশ-কম্পিত দেহ সলজ্জ উত্সুক?
আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
আমরণ আসঙ্গলোলুপ,
আমি জানি আকাশ-পৃথিবী
আমি জানি ইন্দ্রধনু প্রেম আমাদের। |
বিষ্ণু দে | স্বদেশমূলক | আমরা বাংলার লোক,
বাংলাই আমাদের, এদের ওদের সবার জীবন |
আমাদের রক্তে ছন্দ এই নদি মাঠ ঘাট
এই আমজাম বন,
এই স্বচ্ছ রৌদ্রজলে অন্তরঙ্গ ঘরোয়া ভাষার
হাস্যস্নাত অশ্রুদীপ্ত পেশল বিস্তার|
চোখে কানে ঘ্রাণে প্রাণে দেহমনে কথায় স্নায়ুতে
গঙ্গার পদ্মার হাসি একাকার, সমগ্র সত্তার
অজেয় আয়ুতে নিত্য মৃত্যুত্তীর্ণ দুঃখে হর্ষে
ছন্দে বর্ণে বেঁধে দেবে কোমল কঠিন স্পর্শে |
যতই বর্বর হও শক্তিলোভে কূটবুদ্ধি
আজ শতাধিক রাবিন্দ্রিক পুণ্য বর্ষে
তুমি পাবে কোথায় নিস্তার ? |