poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | জীবন ও জীবনের মর্ম মুখোমুখি দাঁড়ালে
আমি ভুল বুঝতে পারি
আমার ক্ষামা চাইতে ইচ্ছে হয়।
বুদ্ধের বুকের হাঁস হানা ঝাপটায়, আমি মাংসলোভী
বিশাল বৃক্ষের ছায়া জলে ভাসে-আমি তমস্বান হয়ে ছুটে গেছি
আমি ভুল বুঝতে পারি-
বিস্মৃতিকে কতবার মনে ভেবেছি বিষন্নতা
ট্রেন লাইনের পশে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে বনবাসী হরিণ
কয়লা খনির ভিতরের অপরাহ্নের মতন উদসীনতা
আমাকে নদীর পাশেও স্রোতহীন রেখেছে
চঞ্চল হাওয়ায় উড়ে গেছে কৃতঘ্নতার হাসি
আমি ভুল বুঝতে পারি
আমার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হয়!
জীবন ও জীবনের মর্ম মুখোমুখি দাঁড়ালে, সেই মুহূর্তের
বিশাল জ্যোৎস্না যাবতীয় পার্থিব ম্যাজিকের
তাঁবুর মতন ঝড়ে উল্টে যায়
মেঘ জলস্তম্ভ হতে গিয়েও ফেটে ইলশেগুঁড়ি হয়ে ছড়ায়
সমগ্র কৈশোর কালের নদীর পার থেকে ছিটকে পড়ে যায়
শুনটানার মানুষ
বারো বছরের জন্মদিনে আমার কপালে মায়েমায়ের আঙ্গুল ছোঁয়া
লাল টিপ
মুছে গিয়েছিল কন্নায়, মুছে যায়নি।
এখন আমার ভরতবর্ষের মতন ললাটে সেই কাশ্মীর, অর্থাৎ দ্বিধা
আমি ভুল বুঝতে পারি
আমার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হয়।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমি ও নিখিলেশ, অর্থাৎ নিখিলেশ ও আমি, অর্থাৎ আমরা চারজন
একসঙ্গে সন্ধেবেলা কার্জন
পার্কের মধ্য দিয়ে,- চতুর্দিকে রাজকুমারীর মত আলো-
হেঁটে যাই, ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ঘড়ি ভয় দেখালো
উল্টো দিকে কাঁটা ঘুরে, আমাদের ঘাড় হেট
করা মূর্তি, আমরা চারজন হেটে যাই, মুখে সিগারেট
বদল হয়, আমরা কথা বলি না, রেড রোডের দু’পাশের
রঙিন ফুলবাগান থেকে নানা রঙের হাওয়া আসে, তাসের
ম্যাজিকের মতো গাড়িগুলো আসে ও যায়, আমরা এক ভাঙা কারখানায়
শিকল কিনতে গিয়েছিলাম, ফিরে যাচ্ছি, আমি বাকি তিনজনকে
চেয়ে দেখলুম, ওরাও আমাকে আড়চোখে…..
ছোট-বড়ো আলোয় বড়ো ছোট ছায়া সমান দুরত্বে
আমাদের, চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মাঠে ইঁদুর বা কেঁচোর গর্তে
পা মচকে আমি পিছিয়ে পড়ি, ওরা দেখে না, এগিয়ে যায়
কখনো ওরা আলোয়, কখনো গাছের নিচে ছায়ায়
ওরা পিছনে ফেরে না, থামে না, ওরা যায়-
আমি নাস্তিকের গলায় নিজের ছায়াকে ডাকি, একশো মেয়ের চিৎকার
মেমোরিয়ালের পাশ থেকে হাসি-সমেত তিনবার
জেগে উঠে আড়াল করে, এবার আমি নিজের নাম
চেচাঁই খুব জোরে, কেউ সাড়া দেবার আগেই একটা নিলাম-
ওয়ালা ‘কানাকড়ি’, ‘কানাকড়ি’ হাতুড়ি ঠোকে, একটা ঢিল
তুলে ছুঁড়তে যেতেই কে যেন বললো, ‘সুনীল,
এখানে কী করছিস? আমি হাঁটু ও কপালের
রক্ত ঘাসে মুছে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার সুবজ ও লালের
শিহরণ দেখি, দু’হাত উপরে তুলে বিচারক সপ্তর্ষিমন্ডল
আড়াল করতে ইচ্ছে হয়, ‘ওঠ্ বাড়ি চল্, কিংবা বল্
কোথায় লুকিয়েছিস নীরাকে? গলার স্বর শুনে মানুষকে
চেনা যায় না, একটি অন্ধ মেয়ে আমাকে বলেছিল, দু’চোখ উস্কে
আমি লোকটাকে তদন্ত করি; পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন
পায়ে চলা পথ ধরে কারা আসে। যেন গহন বন
পেরিয়ে শিকারী এলো, জীবনের তীব্রতম প্রশ্ন মুখে তুলে
দাঁড়িয়ে রইলো, যেন ছুঁয়ে দিল বেদান্তের মন্দিরচূড়ার মতো আঙুলে
নীলিমার মতো নিঃস্বতা,- যেন কত চেনা, অথচ মুখ চিনি না, চোখ
চিনি না, ছায়া নেই, লোকটার এমন নির্মম, এক-জীবনের শোক
বুকে এলো, ‘কোথায় লুকিয়েছিস?’ ‘জানি না’ এ-কথা
কপালে রক্তের মতো, তবু বোঝে না রক্তের ভাষা, তৃষ্ণা ও ব্যর্থতা
বার বার প্রশ্ন করে, জানি না কোথঅয় লুকিয়েছি নীরাকে, অথবা নীরা কোথায়
লুকিয়ে রেখেছে আমা! কোথায় হারালো নিখিলেশ, বিদ্যমানতায়
পরস্পর ছায়া ও মূর্তি, ‘…. আবার একা হাঁটতে লাগলুম, বহুক্ষণ
কেউ এলো না সঙ্গে, না প্রশ্ন, না ছায়া, না নিখিলেশ, না ভালোবাসা
শুধু নির্বাসন।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | লাল ও সবুজ আলোর মধ্যে অন্তকাল
আমি ডাইনে তাকাই পিছনে ফিরে অন্ধকার গলিতে
অনন্তকাল পিছনে নয়, ডাকদিকে নয়, সবুজ ও লাল-
সুখের মতো ভূবিস্তৃত, ঊরুদ্বয়ে শোকের মতো, দৃষ্টি থেকে ঘুমের মতো
পেরিয়ে যাই, কুসুম এবং ফলের কাছে বীজের মতো
দীক্ষা নিতে,
মৃত্যু থেকে সঙ্গোপনে শুন্য ঘরে, দ্রাক্ষাবনের
ছঅই বাতাস, জ্ঞানী মাথার খুলী, নদীর ভাঙ্গা পাড়ের শুকনো পাতা-
পেরিয়ে যাই মাঝরাতের পাঠশালার হাজার চোখ, ধূসর খাতা,
পেরিয়ে যাই ভূমিকম্প, সূচের সরুগর্ত দিয়ে অনন্তকাল
রেশমী প্যান্ট, কোমরবন্ধ, হাতে চুরুট; তবু আমায় বলো, ‘রাখাল’।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমার যমজ ভাই দুঃখ, আজ বহুদিন পলাতক
তার খোঁজে ইতিউতি যাবো- ইদানিং সময় পাই না
মাঝে-মাঝে কেউ বলে, তোমার ভাইকে কাল দেখলুম হে
চুপচাপ জারুল গাছে নিচে বৃষ্টিতে ভিজছিল
একটু আনমনা হই, উপন্যাস লেখা থেকে চোখ তুলে
শাদা দেয়ালের দিকে…..
গুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে- নিজেকে ঠেকিয়ে বলি
সে অনেক বদলে গেছে,
সে আর আমার মতো নেই
আমার যমজ ভাই দুঃখ, আজ বহুদিন পলাতক!
আমার বন্ধুর নাম চিরঋতু, সে অনেক আগেকার কথা
তখন বাতাস ছিল হিরন্ময়
তখন আকাশ ছিল অতি ব্যক্তিগত
তখন মাংসের লোভে যাইনি আমরা কেউ উঁচু প্রতিষ্ঠানে
তরল আগুন খেয়ে মাঝরাতে দেখিয়েছি হাজার ম্যাজিক
তখন বাতাস ছিল…. তখন আকাশ ছিল….. সে অনেক
আগেকার কথা!
এখন অন্যের বাড়ি অকস্মাৎ ঢুকে পড়লে সব কথা
থেমে যায়
বিষয় বদলাতে গিয়ে গ্রীষ্মকালে কেউ শীতে কাঁপে
এমনকি নীরারাও……
আমার কঠিন মুখ, আচমকা কর্কশ বাক্য….. নিজেই চমকে উঠি
যেন এক রণেক্ষেত্র, পিঠ ফেরালেই আছে শত-শত তীর
আমার বন্ধুর নাম চিরঋতু….চিরঋতু? ঠিক নাম
মনে রেখেছি তো? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | পাঁচজনে বলে পাঁচ কথা, আমি নিজেকে এখনো চিনি না
চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে
দশ দিকে চেয়ে আলোর আকাশে আয়নায় মুখ দেখা
আমিও ছিলাম, আমিও ছিলম, এই সুখে নিশ্বাস
জনি না কোথায় ভূল হয়ে যায়, ছায়া পড়ে ঘোর বনে
ঝড়ে বৃষ্টিতে পায়ে পায়ে হেঁটে যাকে মনে করি বন্ধু
সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, চোখে অচেনা মতন ভ্রূকুটি
নেশায় রক্ত উম্মাদ হয়, তছনছ করি নারীকে
অস্তিত্বের সীমানা ছাড়িয়ে জেগে ওঠে সঙহার
আঁধার সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে চোখ জ্বালা করে ওঠে।
চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে
বারবার সব ভুল হয়ে যায় এত বিপরীত স্রোত
বুকের মধ্যে পুবল নিদাঘ, পশ্চিমে হেলে মাথা
আমিও ছিলাম, আমিও ছিলাম, কান্নার মতো শোনায়! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | সকালবেলা এয়ারপোর্টে গেয়েছিলাম একজন বৃদ্ধ আন্তর্জাতিক
ফরাসীর সঙ্গে দেখা করার জন্য, যিনি নিজের শৈশবকে ঘৃণা
করেন।
তিনি তখনো আসেননি, আমি একা বসে রইলাম ভি আই পি
লাউঞ্জে। ঠান্ড ঘর, দুটি টাটকা ডালিয়া, বর্তমান রাষ্ট্রপতির
বিসদৃশ রকমের বড় ছবি। সিগারেট ধরিয়ে আমি বই খুলি।
যে- কোনো বিমানের শব্দে আমার উৎকর্ণ হয়ে ওঠার দরকার
নেই। বিশেষ অতিথির ঘর চিনতে ভুল হয় না। সিকিউরিটির
লোক একবার এসে আমাকে দেখে যায়। আমি অ্যাশট্রের
বদলে ছাই ফেলি সোফার গদিতে-কারণ, এতে বিছু যায়
আসে না।
সময়ের মুহূর্ত, পল, অনুপল স্তব্ধ হয়ে থকে-এক বন্ধ
বিরাট নির্জন ঘর, আমি একা, আমার পা ছড়ানো -আকাশ
থেকে মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় স্মৃতি, তার মধ্যে একটা
সূর্যমুখী ক্রমশ প্রকাণ্ড থেকে আরও বিশাল, লক্ষ লক্ষ
সমান্তরাল আলো, যুদ্ধ-প্রতিরোধের মিছিলের মতন,
যেন অজস্র মায়াময় চোখ দংশন করে নির্জনতা, ঘুমের
মধ্যে পাশ ফেরার মতন-
একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার জন্য নয়, আমার
জন্য নয়-|| |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | অপূর্ব নির্মাণ থেকে উঠে আসে
ভোরের কোকিল
কোকিল, তুমি কি পারো মুছে দিতে
সব কলরব?
হেলেঞ্চা লতায় কাঁপে
শিশিরের বিদায়ী শরীর
শিশির, না আমার শৈশব?
ভুলে যাওয়া ভালো, কিন্তু
কাঁটার মুকুট পরা মৃত্যু তো
সে নয়!
বৈশাখী আকাশ দেখে গাঢ় হয়
টিয়াঠুঁটি আম
সবই তো উচ্ছিষ্ট করে রেখে গেলে
পেয়েছো কি
যা ছিল পাওয়ার?
মধ্যজীবনের কাছে প্রশ্ন তোলে
স্থির মধ্যযাম।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | যেই দরজা খুলে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম
শরীর ভরে ঘূর্ণি খেললো লম্বা একটি হলদে রঙের আনন্দ
না খুলতেও পারতে তুমি, বলতে পারতে এখন বড় অসময়
সেই না-বলার দয়ায় হলো স্বর্ণ দিন, পুষ্পবৃষ্টি
ঝরে পড়লো বাসনায়।
এখন তুমি অসম্ভব দূরে থাকো, দূরত্বকে সুদূর করো
নীরা, তোমার মনে পড়ে না স্বর্গনদীর পারের দৃশ্য?
যুথীর মালা গলায় পরে বাতাস ওড়ে একলা একলা দুপুরবেলা
পথের যত হা-ঘরে আর ঘেয়ো কুকুর তারাই এখন আমার সঙ্গী।
বুকের ওপর রাখবো এই তৃষিত মুখ, উষ্ণ শ্বাস হৃদয় ছোঁবে
এই সাধারণ সাধটুকু কি শৌখিনতা? ক্ষুধার্তের ভাতরুটি নয়?
না পেলে সে অখাদ্য কুখাদ্য খাবে, খেয়ার ঘাটে কপাল কুটবে
মনে পড়ে না মধ্যরাতে দৈত্যসাজে দরজা ভেঙে কে এসেছিল?
ভুলে যাওয়ার ভেতর থেকে যেন একটি অতসী রং হল্কা এলো
যেই দরজা খুললে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | তোমাদের অসম্পূর্ণতা দেখে, স্মৃতির কুয়াশা দেখে আমার মন কেমন করে
সারা আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পরম কারুণিক নিষাদ
তার চোখ মেটে সিঁদুরের মতো লাল, আমি জানি তার দুঃখ
হে কুমারীর বিশ্বাসহন্তা, হে শহরতলীর ট্রেনের প্রতারক
তোমাদের টুকিটাকি সার্থকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরোনো মাছের আঁশ
হে উত্তরের জানালার ঝিল্লি, হে মধ্য সাগরের অবিযাত্রী মেঘদল
হে যুদ্ধের ভাষ্যকার, হে বিবাগী, হে মধ্যরয়সের স্বপ্ন, হে জন্ম
এত অসময় নিয়ে, এমন তৃষ্ণার্ত হাসি, এমন করুণা নিয়ে
কেন আমাকে জড়িয়ে রইলে,
কেন আমাকে…………..... |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?
গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি
হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো পাগ্লা ঘন্টি বাজিয়ে আকাশ জুড়ে
খেলা শুরু করলে
কলকাতার সব লোক মৃদু হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ বেড়াতে গিয়েছে।
আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ।
হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায়
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো, বিরক্ত মুখোস
সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট, শুরু হবে লণ্ডভণ্ড
টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি, আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও, আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!
অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে, মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ বলে ওঠে, বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | আমি সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো
আমি ফিরে এসেছি
আমার কপালে রক্ত;
বাষ্প-জমা গলায় বাস-ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে
ফিরে এলাম-
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ
আমার নিশ্বাস-।
রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করলো
আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী-
পিছনের দরজায় বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা
আমি তার হত্যার জন্য দায়ী-
আমি পুলিশের বোকামি দেখে প্রকাশ্যে হাসাহাসি করবো
আমি নেহেরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি
কম্যুনিষ্টদের শ্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;
আমি ভয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে জেগে উঠবো মমতায়
আমি মেয়েটির কাছে গিয়ে নিঃশব্দে মুখ চুম্বন করবো
সশরীরে বিছানায় শুয়ে দু’জনে কাঁদবো নানা ধরনে
পরদিন ঠিকঠাক বেঁচে উঠতে হবে, এই জেনে।
আমার গলা পরিস্কার, আমি স্পষ্ট করে কথা বলবো
সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে শুদ্ধভাবে
আমি
আজ উচ্চারণ করবো সেই পরম মন্ত্র
আমাকে চাঁচাতে না দিলে এ পৃথিবীও আর বাঁচবে না। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | ঋজু শাল অশ্বত্থের শিকড়ে শিকড়ে যত ক্ষুধা
সব তুমি সয়েছ, বসুধা।
স্তব্ধ নীল আকাশের দৃশ্য অন্তহীন পটভূমি
চক্ষুর সীমানা-প্রান্তে বেঁধে দিয়ে তুমি
এঁকে দিলে মাঠ বন বৃষ্টি-মগ্ন নদী-তার দুরাভাস তীর
আমাকে নিঃশেষে দিলে তোমার একান্ত মৃদু মাটির শরীর।
আমার জন্মের ভোর সূযর্য-শরে আহত মাটিতে
প্রত্যহকে ধরে থাকা অবাধ্য মুঠিতে।
নিবির ঘুমের মৌন জীবনের অস্পষ্ট আভাসে
নিস্পন্দ অন্ধকারে মিশে যায়,-বর্ণ ভেসে আসে,
লাগে স্পর্শ-উষ্ণ হাওয়া, দেখি চক্ষু ভ’রে
সূর্যমুখীর মতো মেলে আছো সেই এক অপরূপ ভোরে।
আমারও আকাঙক্ষা ছিল সূর্যের দোসর হবো তিমির শিকারে
সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে।
অথচ সময়াহত আপাত-বস’র দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত মনে
বর্তমান ভীত-চক্ষু মাটিতে ঢেকেছি সঙ্গোপনে।
দাঁড়াও ক্ষণিক তুমি স্তব্ধ করে কালচিহ্ন ভবিষ্যত অপার
হৃৎস্পন্দে দাও আলো-উৎসের ঝংকার।
নির্মম মুহূর্ত ছুঁয়ে বাঁচার বঞ্চনা স’য়ে স’য়ে
আমাকে স্বাক্ষর দাও নবীন যৌবন, সমারোহে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | ধলভূমগড়ে আবার ফিরে গেলাম, যেন এক সৃষ্টিছাড়া
লোভে। ওরা আর কেউ নেই। তরুণ শালবৃক্ষটি, যাঁর
মূলে হিসি করেছিলাম, তিনি এখন পরিবার-প্রধান
হয়েছেন। তাঁর চামড়ায় আর তকতকে সবুজ আঁচ দেখা
যায় না। কাঁটা গাছের ঝাড়ে ঐ থোকা শাদা
ফুলগুলোর নাম কী, জানা হলো না এবারও, ফুলমণি নামে
যে মেয়েটি আমার ওষ্ঠ কামড়ে রক্তদর্শন করেছিল, সে
ডুবে মরেছে দূরের সুবর্ণরেখারয়। সেই নদীর শিয়রে এই
শেষ বিকেলে সূর্যের ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে এখন। পাঁচটি
বিশাল বর্শা বিধে আছে আকাশের উরুতে, যেন এই
মুহূর্তে এক দুর্ধর্ষ খেলা সাঙ্গ হলো। মহুয়ার দোকানটির
কোমরে ঐ সিমেন্টের বেদি না-থাকা ছিল ভালো।
ঐখানে এক উম্মাদিনী নর্তকী দেখিয়েছিল তার তেজী
স্তনের কাঁপন, তার নিতম্বের গোঠে ঝামড়ে উঠেছিল
অন্ধকার। শালিকের মতন সে চলে যাবার পরও শব্দটা
রেখে গেছে। মাতালের অট্টহাসি থামিয়ে দেয় ট্রেনের হুইস্্ল।
জঙ্গলের মধ্যে তিনশো পা স্তব্ধভাবে হেঁটে এক
শুকনো খাঁড়ির পাশে আমরা তিন বন্ধু হাঁটু গেড়ে বসি।
পুরোনো সৈনিকদের ফিরে আসার কথা ছিল, সর্বাঙ্গ
ক্ষতবিক্ষত, তবু আমরা এসেছি। চিনতে পারো? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | সিংহাসন থেকে একটু নিচে নেমে, পাথরের
সিঁড়ির উপর বসে থাকি
একা, চিবুক নির্ভরশীল
চোখ লোকচক্ষু থেকে দূরে।
‘সম্রাটের চেয়ে কিছু কম সম্রাটত্ব’ থেকে ছুটি নিয়ে আজ
হলুদ দিনাবসানে পরিকীর্ণ শব্দটির মোহে
মাটির মানুষ হতে সাধ হয়। এক-একদিন একরকম হয়।
আমার চোখের নীচে কালো দাগ
ব্যান্ডেজের মধ্যে একটা পোকা ঢুকলে যে-রকম জাদুদন্ডসম কোনো
মহিলার মতো
নিয়তি বদল করে, আলো-ছায়া-আলো ঘোরে নিভৃত সানুদেশে
দপ করে জ্বলে ওঠে হৃদয়ের পুরনো বারুদ
তেমনিই দিনাবসান
তেমনিই মোহের থেকে মুক্ত নিচু চাঁদ-
সিংহাসন থেকে নেমে, হাত ভরা পশমের মতো
রোমশ স্তব্ধতা।
পাথরের মতো মসৃণ বেদির নিচে রুক্ষ মাটি, একটু দূরে পায়ে চলা পথ।
সম্রাটের শেষ বৃত্য চিরতরে যেখানে শয়ান
তার চেয়ে দূরে, সীমার যেখানে শেষ
সেখানে উদ্ভিদ, জল মেতে আছে পাংশু ঈর্ষায়
যেখানে বিশীর্ণ হাত কাদার ভেতর খোঁজ বলির ফসল
তার চেয়ে দূরে
যেখানে শামুক তার খাদ্য পায়, নিজেও সে খাদ্য হয়
ভেসে যায় সাপের খোলস, সেখানেও
আমার অতৃপ্তি বড় দীর্ঘশ্বাস বিষদৃষ্টি নিয়ে জেগে রয়-
মুকুট খোলার পর আমি আরও বহুদূরে নেমে যেতে চাই।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | পরিত্রাণ, তুমি শ্বেত, একটুও ধূসর নও, জোনাকির পিছনে বিদ্যুৎ,
যেমন তোমার চিরকাল
জোনাকির চিরকাল; স্বর্গ থেকে পতনের পর
তোমার অসুখ হলে ভয় পাই, বহু রাত্রি জাগরণ- প্রাচীন মাটিতে
তুমি শেষ উত্তরাধিকার। একাদশী পার হলে-তোমার নিশ্চিত পথ্য হবে।
আমার সঙ্গম নয় কুয়াশায় সমুদ্র ও নদী;
ঐ শব্দ চতুষ্পদ, দ্বিধঅ, কিছুটা উপরে, সার্থকতা যদি উদাসীন;
বিপুল তীর্থের পূণ্য-নয়? সর্বগ্রাস
যেমন জীবন আর জবিনী লেখক।
প্লেনের ভিতরে কান্না এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়িয়ে আনি
একই বুজের মধ্যে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ,
হাতঘড়ি ও কলম, পকেট বই, রুমাল-
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে,- বিদায় নিলাম,- সন্ধেবেলার রক্তবর্ণ বাতাস ও শেষ
শীতের মধ্যে, একা সিঁড়ি দিয়ে নামবার
সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গী ও দুঃখ, হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।
হাল্কা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমি নিখিলেশ হয়ে বহুদূর
হেঁটে গেলাম, নতুন গোধূলি ও রাত্রি, বাড়ি ও দরজা এমনটি অন্তঃপুর
ঘুঁমোবার আগে চুরুট, ঘুমের গভীরতা ও জাগরণ-
ছ’লক্ষ অ্যালার্ম ঘড়ি কলকাতার হিম আস্তরণ
ভাঙার আগেই আমি, অর্থাৎ নিখিলেশ, টেলিফোনে নিখিলেশ
অর্থাৎ সুনীলকে
ডেকে বলি, তুই কি রোড কন্ডেন্স্ড্ মিল্কে
চা খেতিস? বদ গন্ধ, তা হোক! আমি অর্থাৎ পুরোনো সুনীল,
নিখিলেশ এখন,
তোর অর্থাৎ পুরোনো নিখিল অর্থাৎ নতুন সুনীলের সিংহাসন
এবং হৃঃপিন্ড ও শোণিত
পেতে চাই, তোর পুরোনো ভবিষ্যৎ কিংবা আমার নতুন অতীত
তোর নতুন অতীতের মধ্যে, আমার পুরোনো ভবিষ্যতে
(কিংবা তোর ভবিষ্যতে আমার অতীত কোনো পঞ্চম অতীত ভবিষ্যতে)
কিংবা তোর নিঃসঙ্গতা, আমার না-বেঁচে-থাকা হৈ-হৈ জগতে
দু’রকম স্মৃতি ও বিস্মরণ, যেন স্বপ্ন কিংবা স্পপ্ন বদলের
বীয়ার ও রামের নেশা, বন্ধুহীন, বন্ধু ও দলের
আড়ালে প্রেম ও প্রেমহীনতা, দুঃখ ও দুঃখের মতো অবিশ্বাস
জীবনের তীব্র চুপ, যে-রকম মৃতের নিঃশ্বাস,-
লোভ ও শান্তির মুখোমুখি এসে আমার পূজা ও নারীহত্যা
তোর দিকে, রক্ত ও সৃষ্টির মধ্যে আমি অগত্যা
প্রেমিকার দিকে যাবো, স্তনের ওপরে মুখ, মুখ নয়, ধ্যান ও অসি’রতা
এক জীবনে, ঊরুর সামনে ঊরু, ঊরু নয়, যোনির সামনে লিঙ্গ, অশরীরী,
ঘৃণা ও মমতা
অসম্ভব তান্ডব কিংবা চেয়ে দেখা মুহূর্তের রৌদ্রে কোনো কুরূপা অস্পরী
শীত করলে অন্ধকারে শোবে। দুপুরে হঠাৎ রাস্তায় আমি তোকে
সুনীল সুনীল বলে ডেকে উঠবো, পুরোনো আমার নামে, দেখতে চাই চোখে
একশো আট পল্লব কাঁপে কি না, কতটা বাতাস লাগে গালে ও হৃদয়ে
ক’হাজার আলপিন, কত রূপান্তর জন্মে, শোকে পরাজয়ে,
সুখ, সুখ নয় পাপ, পাপ নয়, দোলে, দোলে না, ভাঙে, ভাঙে না, মৃত্যু, স্রোতে
আমি, ও আমার মতো, আমার মতো ও আমি, আমি নয়,
এক জীবন দৌড়াতে দৌড়াতে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | বেয়ারা পাঠিয়ে কারা টাকা তোলে ব্যঙ্ক থেকে?
আমি তো নিজের সইটা এখনো চিনি না
বিষম টাকার অভাব!নেই। শুধু হৃৎপিন্ড হাওয়া টেনে নেয়ে
হাসি কুলকুচো করি। মাথায় মুকুট নেই বলে
কেউ ধার দিতেও চায় না।
কিছু টাকা জমা আছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। সামান্য।
কাঁটা ছাড়ানো মাছের মতন
গদ্য লিখলে ক্যাশ আসে। পারি না। কবিতায় দশ টাকা
তাই বা মন্দ কি, কত দীর্ঘ দিন বন্ধুদেরটেবিলে বসিনি।
কতই তো দিলে বিধি- চোখ, নাক, হাত, ডিগ্রি, জিভ, ঘোরাঘুরি
কয়েকখানা বড় সাইজ উপন্যাস শেষ করার সামর্থ দিলে না?
শিল্পের জননী নাকি দুঃখ? সর্বনাশ, আমার তো কোনো দুঃখ নেই।
খুব গোপনে জানাচ্ছি
(একমাত্র টাকা কিংবা দুঃখ না-থাকার-দুঃখ যদি গণ্য হয়!)
কে কোথায় পায়নি প্রেম, এর সঙ্গী ভোগ করছে ওর সন্ধেবেলা
এসব চমৎকার লাগে।
কে যেন আমায় কথা দিয়েছিল! কথা সাঁতরে গেছে অন্ধকারে-
ভয়ঙ্কর জানলা খুলে রাত দুটোয় এক ঝলক আলো এসে পড়ে
মাঝে মাঝে চোখে মুখে। অমনি চেঁচিয়ে উঠি উল্লাসে মুখ তুলেঃ
বিশ্বাসঘাতিনী ভাগ্যে হয়েছিলে নারী, তাই বেঁচে থাকা এত রোমাঞ্চের
নেশাফেশা কিছু নেই, দুঃখ নেই, গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চাই
তাও কত শক্ত দেখেছি, চারবেলা অদ্ভুত চাকরি, ঘুমহীন চোখে
কবিতার আরাধনা
কেন এই আরাধনা? ওভারটাইম দশা টাকা?
ছোট ছোট ঝাল লঙ্কা কিংবা ঠিক টিনের চিরুনির মতো রেদে
পঞ্চাশটা কাবুলিকে স্বপ্ন দেখে আজ দুপুরে চমকে গেছি ট্রামে।
কোর্বন স্ট্রীটের মোড়ে বুড়ো দরবেশ চাইলো অমরত্ব খুবই আন্তরিক
কপালে কুষ্ঠের কাদা। তিনটে নয়া পয়সা দিয়ে মানুষের মতো অভিমান
সংকেতবিহীন কন্ঠে জানালুমঃ
যদি রাস্তা চিনতে পারো, যাও হে অনন্তধামে সন্ধের আগেই
ঈশ্বরের পাশে একটি তোমার জন্যেই খালি আসন রয়েছে আমি জানি
পরমহূর্তেই আমি পামের পাগলীর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে-
তিনটে পয়সা দাও ভাই আজ আমাকে
গাড়ি ভাড়া নেই বহুদূরে যেতে হবে।
মায়ের তোরঙ্গ থেকে সিঁদুরের গুড়ো ঝেড়ে আজও
সম্রাট পঞ্চম জর্জ কাটামুন্ডে সহাস্যবয়াস
যাও মাছের বাজারে ইয়োর ম্যাজিস্টি , পুঁইশাক, সিগারেট, কুমড়োয়
দেখি কতো তোমার মুরোদ! সব ম্যাজিক ভুলে গেছি-
একত্রিশ হারিখে দেখছি অ্যালয়ের কুশব্দ ইয়ার্কি
এখানে ওখানে নদী- কালো জল, প্রত্যহ স্নান সেরে বহু পবিত্র গন্ডার
চৌরঙ্গীর চতুর্দিকে হুটোপুটি করে- হাসে, মেয়েদের খোলা তলপেটে
সুড়সুড়ি দেয় কিংবা ঠোঁট চাটে, নুন ঝাল মিশিয়ে
প্রথম শীতের এই মনোরম সন্ধ্যাগুলি কাঁটা চামচে দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
সুস্বাদে চিবিয়ে খায়। সমস্ত রাস্তাই আজ ভিড়ে ভর্তি ভিড়ে
ভর্তি, অসম্ভব, আমি হঠাৎ কোথায় আজ হারালুম আমার নিজস্ব
গোপন প্রস্থান পথ- এ দুর্দিনে ফটকার বাজারে! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে-
সগন্ধের সঙ্গে পাবো, দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায়
আহা, কি শীতল স্পর্শ হৃদয়-ললাটে, আহা, চন্দন চন্দন
দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন
আমি বসে থাকবো দীর্ঘ নিরালায়
প্রথম যৌবনে আমি অনেক ঘুরেছি অন্ধ, শিমূলে জরুলে
লক্ষ লক্ষ মহাদ্রুম, শিরা-উপশিরা নিয়ে জীবনের কত বিজ্ঞাপন
তবুও জীবন জ্বলে, সমস্ত অরণ্য-দেশ জ্বলে ওঠে অশোক আাগুনে
আমি চলে যাই দূরে, হরিণের ক্রস্ত পায়ে, বনে বনান্তরে,অন্বেষণ।
ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে ….এতকাল ডাকো নি আমায়
কাঙালের মতো আমি এত একা, তোমায় কি মায়া হয়নি
শোনো নি আমার দীর্ঘশ্বাস?
হৃদয় উন্মুক্ত ছিল, তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!
আমার দুঃখের দিনে বৃষ্টি এলো, তাই আমি আগুন জ্বেলেছি,
সে কি ভুল!
শুনিনি তোমার ডাক, তাই মেঘমন্দ্র স্বরে গর্জন করেছি, সে কি ভুল?
আমার অনেক ভুল, অরন্যের একাকীত্ব অসি’রতা ভ্রাম্যমান ভুল!
এক মুহুর্তেই
সর্ব অঙ্গে শিহরণ, ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই
অলৌকিক ক্ষণ
তুমি কি অমূল-তরু, স্নিগ্ধজ্যোতি, চন্দন, চন্দন,
দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে চন্দন, চন্দন
আমার কুঠার দূরে ফেলে দেব, চলো যাই গভীর গভীরতম বনে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায় .. |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
বুঝি পাহাড়ের পায়ে পড়েছিল নীরব গোধূলি
নারী-কলহাস্য শুনে ভয় পেল ফেরার পাখিরা
পাথরের নিচে জল ঘুমে মগ্ন কয়েকশো বছর
মোষের পিঠের মতো, রাত্রির মেঘের মতো কালো
পাথর গড়িয়ে যায়, লম্বা গাছ শব্দ করে শোয়
একজন ক্ষ্যাপা লোক ঝর্নাটিতে জুতোসুদ্ধু নামে
কেউ কোনো দুঃখ পায় না, চতুর্দিকে এমনই স্বাধীন!
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
এই যে সবুজ দেশ, এরও মধ্যে রয়েছে খয়েরি
রূপের পাতলা আভা, তার নিচে গহন গভীর
অ্যালুমিনিয়াম-রঙা রোদ্দুরের বিপুল তান্ডব
বনের ভিতরে এত হাসিমুখ ক্ষুধার্ত মানুষ
যে-জন্য এখানে আসা, তার কোনো নাম গন্ধ নেই
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
এখানে ছিল না পথ, আজ থেকে যাত্রা শুরু হলো
একটি সঠিক টিয়া নামটি জানিয়ে উড়ে যায়
বিবর্ণ পাতায় ছোঁয়া ভালোবাসা-রিস্মৃতির খেদ
পা-ছড়িয়ে বসে আছে ছাগল-চরানো বোবা ছেলে
উদাসী ছায়ার মধ্যে ভাঙা কাচ, নরম দেশলাই
এইমাত্র ছুটে এল যে-বাতাস তাতে যেন চিরুনির দাঁত
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না… |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | শিল্পী ফিরে চলেছেন, এ কেমন চলে যাওয়া তার?
এমন নদীর ধার ঘেঁষে চলা,
যেখানে অজস্র কাঁটাঝোপ
এবং অদূরে রুক্ষ বালিয়াড়ি,
ওদিকে তো আর পথ নেই
এর নাম ফিরে যাওয়া? এ তো নয় শখের ভ্রশণ
রমণীর আলিঙ্গন ছেড়ে কেন সহসা লাফিয়ে ওঠা-
কপালে কোমল হাত, টেবিলে অনেক সিক্ত টিঠি
কত অসমাপ্ত কাজ, কত হাতছানি
তবু যেন মনে পড়ে মভুল ভাঙাবার বেলা এই মাত্র
পার হয়ে গেল!
বুকে এত ব্যাকুলতা, ওষ্ঠে এত মায়া
তবু ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে
এর নাম ফিরে যাওয়া? এতো নয় শখের ভ্রমণ
ওদিক তো আর পথ নেই
অচেনা অঞ্চলে কেউ ফেরে? যাওয়া যায়। ফেরে?
এর চেয়ে জলে নামা সহজ ছিল না?
সকলেই বলে দেবে, শিল্পী, আপনি ভুল করেছেন
অতৃপ্ত, দুঃখিত এক বৃহত্তম ভুল।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল
আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি
এই আক্ষরিক সত্যের কছে যুক্তি মূর্ছা যায়।
শিহরিত নির্জনতার মধ্যে বুক টন্টন করে ওঠে
হাল্কা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন
সবুজকে ধূসর হতে ডাকে
আ-দিগন্ত প্রান্তের ও টুকরো ছড়ানো টিরার উপর দিয়ে
ভেসে যায় অনৈতিহাসিক হাওয়া
অরণ্য আনে না কোনো কস্তুরীর ঘ্রাণ
কিছু নিচে ছুটন্ত মহিলার গোলাপি রুমাল উড়ে গিয়ে পড়ে
ফণমনসার ঝোপে
নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় খরগোশ আর রোদ্দুর।
এই যে মুহূর্তে, এই যে দাঁড়িয়ে থাকা–এর কোনো অর্থ নেই
ঝর্নার জলে ভেসে যায় সম্রাটের শিরস্ত্রাণ
কমলার কোয়া থেকে খসে পড়া বীজ ঢকে পড়ে পাতাল গর্ভে
পোল্কা ডট্ দুটি প্রজাপতি তাদের আপন আপন কাজে ব্যস্ত
বাব্লা গাছের শুক্নো কাঁটাও দাবী করেছে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব।
সব দৃশ্যই এমন নিরপেক্ষ
আমি জয়ী নই, আমি পরাজিত নই, আমি এমনই একজন মানুষ
পাহাড় চূড়ায় পৃথিবীকে পদতলে রেখে, আমার নাভিমূল
থেকে উঠে আসে বিষণ্ন, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস
এই নির্জনতাই আমার ক্ষমাপ্রার্থী অশ্রুমোচনের মুহূর্ত।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | ঝর্ণার ডুব দিয়ে দেখি নিচে একটা তলোয়ার
একটুও মর্চে পড়েনি, অতসী ফুলের মতো আভা
আমার হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ ভেঙে গেলে তার ঘুম
তুলে নিয়ে উঠে আসি, চুপ করে বসে থাকি কিচুক্ষন
কাছাকাছি আর কেউ নেই
যেন ঝর্ণাটাই আমার হাতের মুঠোয়, রৌদ্রে দেখছি
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
মাঝে মাজে এক-একটা ঝিলিকে চোখ ঝলসে যায়
মনে হয় না বহু ব্যবহৃত, ঠিক কুমারীর মতন
কোথাও ঘোড়ার ক্ষুর বা রক্তের দাগ নেই,
শান্ত বনস’লী
মাঝে-মাঝে অনৈতিহাসিক হাওয়া
একটি মৌটুসী খুব ডাকাডাকি করছে তার সঙ্গিনীকে
জলের চঞ্চল শব্দ তাকে সঙ্গতি দেয়
আমার চোখের সামনে হু-হু করে পিছিয়ে যেতে
থাকে সময়
কয়েকটি শতাব্দী গাছের শুকনো পাতার মতন উড়তে থাকে
সেই রকম একটা শুকনো পাতা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে
নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকি
মনে পড়ে, অথচ ঠিক মনে পড়ে না
শুকনো পাতাগুলি আমি নৌকোর মতন ভাসিয়ে দিই
ঝর্ণার জলে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | কেমন সহজ আমি ফোটালাম একলক্ষ ফুল
হঠাৎ দিলাম জ্বেলে কয়েকটা সুর্য চাঁদ তারা
আবার খেয়াল হলে এক ফুঁয়ে নেভালাম সেই জ্যোৎস্না
(মনে পড়ে কোন্ জ্যোৎস্না?) নেভালাম সেই রোদ (তাও মনে পড়ে?)
নিন্দুকে নানান কথা আমাকে দেখিয়ে বলবে, বিশ্বাস করো না।
হয়তো বলবে শিশু কংবা নির্বোধ অথবা
ম্যাজিকওয়ালা- ছেঁড়া তাঁবু ফাটা বজনা, নানান সেলাই
করা কালো কোর্তা গায়ে লোকটা কি মরণ খেলা
খেলাচ্ছে আহা রে ঐ মেয়েটার চোখে,
দর্শক ভুলছে না, হাসছে; আহা, শুধু অবঝ মেয়েটা
মায়ার ওষুখে ভুগছে; বিশ্বাস করো না।
দেখরে নিন্দুক দেখ, বামহাতে কনিষ্ঠ আঙউলে
ত্রিজগৎ ধরে আছি কেমন সহজে,
আমাকে অবাক চোখে দেখছে চেয়ে অন্ধকার, সমুদ্র, পাহাড়
শুধু কি তোরাই ভুললি বিস্ময়ের ভাষা!
আমার বাড়িতে আসবি, দেখবি সে কি আজব বাড়ি?
মাথার উপরে ছাদ-চেয়ে দেখ, চারদিকে, দেয়াল রাখিনি,
তোরাই দেয়াল ঘেরা, বুকে স্বপ্ন, শ্লেষ্মা নিয়ে চিরকাল থাকবি
সাবধানে আঙুলে বয়স গুণে-শখ করে সে দেয়ালে নানা ছবি এঁকে
আমার বাড়িতে দেখ অনুগত ভৃত্যের মতন
নানান জাতের হাওয়া ঘুরছে ফিরছে, ঝুল ঝাড়ছে ছাতের কার্নিসে।
নানান রঙের টান দিয়ে দেখছে, ব্যস্ত দিন রাত।
আমি বসে ছবি আঁকছি দেয়ালবিহীন ঘরে মেয়েটির চোখে
বাইরের ছবির চেয়ে চোখের মণিতে ছবি কেমন সহজ!
তোরাই নির্বোধ শিশু, ফিরে যা নিন্দুক-
আমাকে ম্যাজিকওয়ালা বললে তুমি বিশ্বাস করো না।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)
আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়িরে ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেকেরে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়অর;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্ড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে এক জীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?
রূপের মধ্যে মানুষ আছে, এই জেনে কি নারীর কাছে
রঙের ধাঁধা খুঁজতে খুঁজতে টনটনায় চক্ষু-স্নায়ু
কপালে দুই ভুরুর সন্ধি, তার ভিতরে ইচ্ছে বন্দী
আমার আয়ু, আমার ফুল ছেঁড়ার নেশা
নদীর জল সাগরে যায়, সাগর জল আকাশে মেশে
আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার
মুঠোয় ফেরা! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | স্বদেশমূলক | যমুনা, আমার হাত ধরো, স্বর্গে যাবো।
এসো, মুখে রাখো মুখ, চোখে চোখ, শরীরে শরীর
নবীনা পাতার মতো শুদ্ধরূপ, এসো
স্বর্গ খুব দুরে নয়, উত্তর সমুদ্র থেকে যে রকম বসন্ত প্রবাসে
উড়ে আসে কলস্বর, বাহু থেকে শীতের উত্তাপ
যে রকম অপর বুকের কাছে ঋণী হয়; যমুনা, আমার হাত ধরো,
স্বর্গে যাবো।
আমার প্রবাস আজ শেষ হলো, এরকম মধুর বিচ্ছেদ
মানুষ জানেনি আর। যমুনা আমার সঙ্গী-সহস্র রুমাল
স্বর্গের উদ্দেশ্যে ওড়ে; যমুনা তোমায় আমি নক্ষত্রের অতি প্রতিবেশী
করে রাখি, আসলে কি স্বাতী নক্ষত্রের সেই প্রবাদ মাখানো অশ্রূ তুমি নও?
তুমি নও ফেলে আসা লেবুর পাতার ঘ্রাণে জ্যোৎস্নাময় রাত?
তুমি নও ক্ষীণ ধূপ? তুমি কেউ নও
তুমিই বিস্মৃতি, তুমি শব্দময়ী, বর্ণ-নারী, স্তন ও জঙ্ঘায় নারী তুমি,
ভ্রমণে শয়নে তুমি সকল গ্রনে’র যুক্ত প্রণয় পিপাসা
চোখের বিশ্বাসে নারী, স্বেদে চুলে, নোখের ধুলোয়
প্রত্যেক অণুতে নারী, নারীর ভিতরে নারী, শূণ্যতায় সহাস্য সুন্দরী,
তুমিই গায়ত্রী ভাঙা মণীষার উপহাস, তুমি যৌবনের
প্রত্যেক কবির নীরা, দুনিয়ার সব দাপাদাপি ক্রুদ্ধ লোভ
ভুল ও ঘুমের মধ্যে তোমার মাধুরী ছুঁয়ে নদীর তরঙ্গ
পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী।
তুমি এ রকম? তুমি কেউ নও
তুমি শুধু আমার যমুনা।
হাত ধরো, স্বরবৃত্ত পদক্ষেপে নাচ হোক, লজ্জিত জীবন
অন্তরীক্ষে বর্ণনাকে দৃশ্য করে, এসো হাত ধরো।
পৃথিবীতে বড় বেশী দুঃখ আমি পেয়ে গেছি, অবিশ্বাসে
আমি খুনী, আমি পাতাল শহরে জালিয়াৎ, আমি অরণ্যেব
পলাতক, মাংসের দোকানে ঋণী, উৎসব ভাঙার ছদ্মবেশী গুপ্তচর।
তবুও দ্বিধায় আমি ভুলি নি স্বর্গের পথ, যে রকম প্রাক্তন স্বদেশ।
তুমি তো জানো না কিছু, না প্রেম, না নিচু স্বর্গ, না জানাই ভালো
তুমিই কিশোরী নদী, বিস্মৃতির স্রোত, বিকালের পুরস্কার……
আয় খুকী, স্বর্গের বাগানে আজ ছুটোছুটি করি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | ব্রিজের অনেক নিচে জল, আজ সেইখানে ঝুঁকেছে মানুষ
কখনো মানুষ হয়ে উঠি আমি,
কখনো মানুষ নই,
তবুও সন্ধ্যায়
ব্রিজের খিলান ধরে ঝুঁকে থেকে মনে হয় অবিকল মানুষেরই মতো
মানুষের জল দেখা, জলের মানুষ দেখা
পরস্পর মুখ;
মানুষ দেখেছে জল বহুদিন মানুষ দেখেছে অশ্রজল
মানুষ দেখেছে মুখ অশ্রুভেজা ব্রিজের অনেক নিচে
হিম কালো জলে
কালো জল বহু উর্ধ্বে দেখেছে কান্নায় সিক্ত গোপন কঠিন মুখ
মানুষের মতো।
আ-সমুদ্র দয়াপ্রার্থী আবার বৃষ্টির কাছে অতি পলাতক
কখনো নিথর জলে স্পষ্ট মুখ, কখনো তরঙ্গে ভাঙা হীন মানবীয়।
জলের কিনারে এলে জলের ভিতরে যাওয়া, জলের ভিতরে
মানুষ যখনই যায় একা, তার অলঙ্খ্য শরীর
মাতৃগর্ভবাসসম আগোপন;
অথবা না-হোক এক,
বন্ধু ও সঙ্গিনী
অদূরেই জলযুদ্ধে; একবার ডুব দিয়ে মীনচোখে দেখা
নারীর ঊরুর জোড়, খোলা স্তন কী-রকম আশ্চার্য সরল
জলেরই মতন সেও সজল, নীলের কলো,-সংখ্যতীত জিভে
জল তার সর্ব অঙ্গ লেহন করেছে, ঠিক যে-রকম
মানুষের হাত
জলের ভিতরে গিয়ে নিজের শরীরটাকে চিনে নেয়,
জলের ভিতরে
সহাস্যে পেচ্ছাপ করে লজ্জাহীন বাতাসের মতো জল, পরাগ ছাড়ায়।
কখনো মানুষ সেজে বীয়ার-বাস্কেট নিয়ে বসেছি নারীর
কাছাকাছি সন্ধুতটে সন্ধেবেলা, জ্যোৎস্না ভাঙে লাবণ্য হাওয়ায়
আকাশে অসংখ্য ছিদ্র, ঢেউয়ের চুড়ায় জ্বলে ফস্ফরাস্
দেখেছিল মুখ
অথবা ঢেউয়ের দল মানুষের মুর্খ চেয়ে সার বেঁধে আসে-
এমন উচ্ছল জল, মানুষের মুখ দেখা যেন তার আশৈশব সাধ।
মানুষের ছদ্মবেশে আছি, তাই চোখে আসে অশ্রু
মুখ ঢাকি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!বড় দেরি হয়ে গেল, আকাশে পোশাক হতে বেশি বাকি নেই
শতাব্দীর বাঁশবনে সাংঘাতিক ফুটেছে মুকুল
শোনোনি কি ঘোর দ্রিমি দ্রিমি?
জলের ভিতর থেকে সমুত্থিত জল কথা বলে
মরুভূমি মেরুভূমি পরস্পর ইশারায় ডাকে
শোনো, বুকের অলিন্দে গিয়ে শোনো
হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও।
কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা
চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে
কাছাকাছি আনো
নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে
পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে
জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ
দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো
ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা
আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়।প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের
শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো
গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে
উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও
হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার
বাড়ির সামনে, নীরা থুক্ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে
বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে
এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের
উৎস। আমি
ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন
আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার
আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় :
নীরা, তোমায় একটি রঙিন
সাবান উপহার
দিয়েছি শেষবার;
আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে।
বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে
আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে
ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন
অমর না হয়…অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে
চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে
ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার
মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা
নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট
শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়!এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন
বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন
আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি
জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের
সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর
পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ
সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি
দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার
নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে
১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে
উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে,
সোনার রজ্জুতে
বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা
পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে
এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য,
সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার
প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে?
কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু
ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি :
ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ
তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ
অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত
পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্যসিঁড়ির মুখে কারা অমন শান্তভাবে কথা বললো?
বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে, তবু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে সিঁড়িতে
রেলিং-এ দুই হাত ও থুত্নি, তোমায় দেখে বলবে না কেউ থির বিজুরি
তোমার রঙ একটু ময়লা, পদ্মপাতার থেকে যেন একটু চুরি,
দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পূজোয়–দুটোই খুব রঙের মধ্যে
রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন–
ও দুটো দিন তুমি আলাদা, ও দুটো দিন তুমি যেন অন্য নীরা
বাকি তিনশো তেষট্টি বার তোমায় ঘিরে থাকে অন্য প্রহরীরা।
তুমি আমার মুখ দেখোনি একলা ঘরে, আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, আমরা কেউ বুকের কাছে কখনো
কথা বলিনি পরস্পর, চোখের গন্ধে করিনি চোখ প্রদক্ষিণ–
আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, নীরা তোমায় দেখা আমার মাত্র দু’দিন।নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।
আমি তোমায় লোভ করিনি, আমি তোমায় টান মারিনি সুতোয়
আমি তোমার মন্দিরের মতো শরীরে ঢুকিনি ছল ছুতোয়
রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি;
দোল ও সরস্বতী পূজোয় তোমার সঙ্গে দেখা আমার–সিঁড়ির কাছে
আজকে এমন দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী।চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
খুঁজে পাবো?অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | এমনও তো হয় কোনোদিন
পৃথিবী বন্ধবহীন
তুমি যাও রেলব্রীজে এক-
ধূসর সন্ধ্যায় নামে ছায়া
নদীটিও স্থিরকায়া
বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।
ইস্টিশানে অতি ক্ষীণ আলো
তাও কে বেসেছে ভালো
এত প্রিয় এখন দ্যুলোক
হে মানুষ, বিস্মৃত নিমেষে
তুমিও বলেছো হেসে
বেঁচে থাকা স্বপ্নভাঙা শোক!
মনে পড়ে সেই মিথ্যে নেশা?
দাপটে উল্লাসে মেশা
অহঙ্কারী হাতে তরবারী
লোভী দুই চক্ষু চেয়েছিল
সোনার রূপোর ধুলো
প্রভুত্বের বেদী কিংবা নারী!
আজ সবকিছু ফেলে এলে
সূর্য রক্তে ডুবে গেলে
রেলব্রীজে একা কার হাসি?
হাহাকার মেশা উচ্চারণে
কে বলে আপন মনে
আমি পরিত্রাণ ভালোবাসি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | খড়ের চালায় লাউ ডড়া, ওতে কার প্রিয় সাধ লেগে আছে
জলের অনেক নিচে তুলসীমঞ্চ, সেইখানে ছোঁয়া ছিল অনেক প্রণাম
রান্নাঘরটিতে ছিল কিছু ক্ষুধা, কিছু স্নেহ, কিচু দুর্দিনের খুদকুঁড়ো
উঠোনে কয়েকটি পায়ে দাপাদাপি, দু‘খুঁটিতে টান করা ছেঁড়া ডুবে শাড়ি
পাশেই গেয়ালঘর, ঠিক ঠাকুমার মতো সহ্যশীলা নীরব গাভীটি
তাকে ছায়া দিত এক প্রাচীন জামরুল বৃক্ষ, যায় ফল খেয়ে যেত পোকা
পাটের ছবির মতো চুরি করা মাছ কুখে বিড়ালের পালানো দুপুর
সবই যেন দেখা যায়, অথচ কিছুই নেই, চতুর্দিকে জলের কল্লোল
এখন রাত্রির মতো দিন আর রাতগুলি আরও বেশি অতিকায় রাত
জননী মাটির কাছে মানুষের বুক ছিল, মাটিকে ভাসিয়ে গেছে মাটির দেবতা। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তোমার পূর্বের মহিলাকে
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রি রাজপথ
ঝকমক করে কঠিন সড়ক, আলোয় সাজানো, প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে
প্রতীক্ষা আছে আঁধারে লুকানো তবু জানি চিরদিন
এ-পথ্ থাকবে এমনি সাজানো, কেউ আসবে না, জনহীন, প্রেমহীন
শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তোমার পূর্বের মহিলাকে!
রূপ দেখে ভুলি কী রূপের বান, তোমার রূপের তুলনা
কে দেবে? এমন মূঢ় নেই কেউ, চক্ষু ফেরায়, চক্ষু ফেরাও
চোখে চোখে যদি বিদ্যুৎ জ্বলে কে বাঁচাবে তবে? এ হেন সাহস
নেই যে বলবো; যাও ফিরে যাও
প্রেমহীন আমি যাও ফিরে যাও
বটের ভীষণ শিকড়ের মতো শরীরের রস
নিতে লোভ হয়, শরীরে অমন সুষমা খুলো না
চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও!
টেবিলের পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালে তোমার
বুক দেখা যায়, বুকের মধ্যে বাসনার মতো
রৌদ্যের আভা, বুক জুড়ে শুধু ফুলসম্ভার,-
কপালের নিচে আমার দু’চোখে রক্তের ক্ষত
রক্ত ছেটানো ফুল নিয়ে তুমি কোন্ দেবতার
পূজায় বসবে? চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও, শত্রু তোমার
সামনে দাঁড়িয়ে, ভূরু জল্লাদ, চক্ষু ফেরাও!
তোমার ও রূপ মূর্ছিত করে আমার বাসনা, তবু প্রেমহীন
মায়ায় তোমায় কাননের মতো সাজাবার সাধ, তবু প্রেমহীন
চোখে ও শরীরে এঁকে দিতে চাই নদী মেঘ বন, তবু প্রেমহীন
এক জীবনের ভালোবাসা আমি হারিয়ে ফেলেছি খুব অবেলায়
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রির রাজপথ।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | পায়ে তোমার কাঁটা ফুটেছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা?
তুমি তাহলে পিছনে থাকো
বন্ধু ছিলে উদাসীনতা, তোমারও সাধ গৃহী হতে?
ডাইনে যাও
পোশাক, তুমি ছিন্ন হবে? শান্ত, তোমার তৃষ্ণা পাবে?
জিরোও এই গাছের নিচে
হলুদ বই, শাদা, বোতাম, কৃতজ্ঞতা, চাবির দু:খ, বিদায় দাও
আমার আর সময় নেই, আমি এখন
পেরিয়ে মজা দিঘির কোণ প্রণাম করে অরণ্যের সিংহাসনর, সামনে ঘুরে
দিগন্তের চেয়েও একটু দূরে যাবো।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে। কিংবা কী নেবে
লোহা শুঁয়ো পোকা?
অথবা সওদাগরের, নৌকো, যার গলুইয়ের
দু‘পাশে দু‘খানি
রঙিন চক্ষু, অথবা তীর্থ যাত্রীদলের, সার্থবাহের
সঙ্গী হবো কি?
চৌকো পাহাড়, গোল অরণ্যে মায়ার আঙুলে
হাতছানি দেয়
লাল সমুদ্র, নীল মরুভূমি, অচেনা দেশের
হলুদ আকাশ
সূর্য ও চাঁদ দিক বদলায় এন গহন
আমায় ডেকেছে
কিছু ছাড়বো না, আমি ঠিক জানি গোটা দুনিয়াটা
আমার মথুরা
জলের লেখায় আমি লিখে যাবো এই গ্রন’টির
তন্নতন্ন
মানস ভ্রমণ। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | যে পান্থনিবাসে যাই দ্বার বন্ধ, বলে, ‘ঐ যে রুগ্ন ফুলগুলি
বাগানে রয়েছে শুধু, এখন বসবেন?’ কেউ মুমূর্ষু অঙ্গুলি
আপন উরসে রেখে হেসে ওঠে, পাতা ঝরানোর হাসি, 'এই অবেলায়
কেন এসেছেন আপনি, কী আছে এখন? গত বসন্তমেলায়
সব ফুরিয়েছে, আর আলো নেই, দেখুন না তার ছিঁড়ে গেছে, সব ঘরে
ধুলো, তালা খুলবে না এ জন্মে; পরিচারিকার হাতে কুষ্ঠ!' ভগ্ন কণ্ঠস্বরে
নেবানো চুল্লীর জন্য কারো খেদ, কেউ আসবাববিহীন
বুকের শীতের মধ্যে শুয়ে আছে, মৃত্যু বহুদূর জেনে, চৈত্র রুক্ষ দিন
চিবুক ত্রিভাঁজ করে, প্রতিটি সরাইখানা উচ্ছিষ্ট পাঁজর ও রক্তে ক্লিন্ন হয়ে আছে
বাগানে কুসুমগুলি মৃত, গন্ধহীন, ওরা বাতাসে প্রেতের মতো নাচে।
আমার আগের যাত্রী রূপচোর, তাতার দস্যুর মতো বেপরোয়া, কব্জি শক্তিধর
অমোঘ মৃত্যুর চেয়ে কিছু ছোটো, জীবনের প্রশাখার মতো ভয়ঙ্কর
সেই গুপ্তচর পান্থ আগে এসে ছেঁচে নিল শেষ রূপ রস-
ক্ষণিক সরাইগুলি, হায়! এখন গ্রীবায় ছিন্ন ইতিহাস, ওষ্ঠে, চোখে, মসীলিপ্ত পুঁথির বয়স।
আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, জুতোয় পেরেক ছিল, পথে বড় কষ্ট, তবু ছুটে
এসেও পারি না ধরতে, ততক্ষণে লুট শেষ, দাঁড়িয়ে রয়েছে সব ম্লান ওষ্ঠপুটে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | সুখের তৃতীয় সিঁড়ি ডানপাশে
তার ওপাশে মাধুর্যের ঘোরানো বারান্দা
স্পষ্ট দেখা যায়, এই তো কতটুকুই বা দূরত্ব
যাও, চলে যাও সোজা!
সামনের চাতালটি বড় মনোরম, যেন খুব চেনা
পিতৃপরিচয় নেই, তবু বংশ-মহিমায় গরীয়ান
একটা বাড় গাছ, অনেক পুরোনো
তার নিচে শৈশবের, যৌবনেরর মানত-পুতুল
এত ছায়াময় এই জায়গাটা, যেন ভুলে যাওয়া স্নেহ
ভুল নয়, ছায়া তো রয়েছে।
সদর দরজাটি একেবারে হাট করে রাখা
বড় বেশি খোলা যেন হিংসের মতন নগ্ন
কিংবা জঙ্গলের ফাঁসকল
আসলে তা নয়, পূর্বপুরুষের তহীর্ঘ পরিহাস
লেহার বলটুতে এত সুন্দর সাপানো এত দৃঢ়
আর বন্ধই হয় না!
ভিতরের তেজি আলো প্রথমে যে-সিঁড়িটা দেখায়
সেটা মিথ্যে নয়, দ্বিতীয়টি অন্য শরীকের
বাকি সব দিক, বলা-ই বাহুল্য, মেঘময়।
মনে করো, মল্লিক বাড়ির মতো মৃত কোনো পথিক স’াপত্য
ভাঙা শ্বেত পাথরেরা হাসে, কাঠের ভিতরে নড়ে ঘুণ
কত রক, পরিত্যক্ত দরদালান, চামচিকের থুতু
আর কিছু ছাতা-পড়া জলচৌকি, ঐখানে
লেগে আছে যৌনতার তাপ
ঐখানে লেগে আছে বড় চেনা নশ্বরতা।
তবু সবকিছু দূরে ছোঁয়া যায় না, এমন অসি’র মনোহরণ
মধ্যরাতে ডাকে, তোমাকে, তোমাকে!
দুপুরেও আসা যায়, যদি ভাঙে মোহ
অথবা ঘুমোয় ঈর্ষা পাগলের শুদ্ধতার মতো
তখন কী শান্ত, একা, হৃদয় উতলা
হে আতুর, হে দুঃখী, তুমি এক-ছুটে চলে যাও
ঐ মাধুর্যের বারান্দায়
আর কেউ না-দেখুক, অন্তত একবার এ জীবনে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | স্বদেশমূলক | যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘোরে
লুঠেরা, ফেরারী!
শহরে বন্দরে এত অগ্নি বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্ফোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?
আমি কি দেখিনি কোনো মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি?
মোষের ঘাড়ের মত পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মত বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ স্বর?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
জুলাই ১৯৭১ : গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | শাদা বাড়িটার সামনে আলো-ছায়া-আলো, একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে
এখন দুপুর রাত অলীক রাত্রির মতো, অররণা রয়েছে খুব ঘুমে-
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে ঘুম স্পষ্টত খুব নীল;
যে স্তনে লগৈনি দাঁত তার খুব মৃদু ওঠপড়া
তলপেটে একটুও নেই ফাটা.দাগ, এ শরীর আজও ঋণী নয়
এই সেই অরুণা ও রুনি নাম্মী পরা ও অপরা
সুখ ও আসুখ নিয়ে ওষ্ঠাধর, এখন রয়েছে খুব ঘমে
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে-ঘুম স্পষ্টত খুব নীল।
সন্ন্যাসীর সাহসের মতো আন্ত অন্ধকার, কে তুমি কঙ্কাল-
প্রহরীর মতো, কেন বাধা তিদে চাও? কী তোমার ভাষা?
ছাড়ো পথ, আমি ঐ শাদা বাড়িটার মধ্যে যাবো।
করমচা ফুলেরঘ্রণ আলপিনের মতো এসে গয়ে লাগে
থামের আড়োলে থেকে ছুটে এলো হাওয়া, বহু ঘুমের নিশ্বাস
ভরা হাওয়া
আমি অরুণার ঘুমে এক ঘুম ঘুমোতে চাই আজ মধ্য রাতে
অরুণার শাড়ি ও শায়ার ঘুম, বুকে ঘুম, কুমারী জন্মের
পবিত্র নরম ঘুম, আমি ব্রাহ্মণের মতো তার প্রার্থী।
নিরস্ত্র কঙ্কাল, তুমি কার দূত? তোমার হৃদয় নেই, তুমি
প্রতীক্ষার ভঙ্গি নিয়ে কেন প্রতিরোধ করে আছো?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বারে তুমি কেন জেগে?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বরে তুমি কেন জেগে?
তুমি ভ্রমে বদ্ধ, তুমি ওপাশের লাল রঙা প্রাসাদের কাছে যাও
ঐখানে পাশা খেলা হয়, হু-রে-রে চিৎকরে ওঠে হৃদয়ে শকুনির
ঝটাপটি, তুমি যাও
ছাড়ো পথ, আমি এই নিদ্রিত বাড়ির মধ্যে যাবো।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আচমকা স্রোতের পাশে হেলে পড়া কম বৃক্ষটি
এরও কোনো মানে আছে।
নির্জন মাঠের পোড়োবাড়ি- হা হা করে ভাঙা পাল্লা
এরও কোনো মানে আছে?
ঠিক স্বপ্ন নয়- মাঝে মাঝে চৈতন্যের প্রদোষে সন্ধ্যায়
শিরশিরে অনুভূতি
কি যেন ছিল বা আছে অথবা যা দেখা যায় না
দুরস্ত পশুর মতো ছুটে আসে বিমূঢ়তা
জানলার পর্দাটা দোলে, থেমে যায়, দুলে ওঠে
এরও কোনো মানে আছে।
চুম্বনসংলগ্ন কোনো রমনীর চোখে দেখিনি কি
অন্যমনস্কতা?
চেনা বানানের ভূল বারবার। অকস্মাৎ স্মৃতির অতল
থেকে উঠে আসে গানের দু’একটা লাইন
বারান্দায় পাখিটি বসেই উড়ে যায়
হেমকান্তি সন্ধ্যার আড়ালে
এর কোনো মানে নেই? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশি, আমায় ভুল বুঝবে?
শরীর ছেনে আশ মেটে না, চক্ষু ছুঁয়ে আশ মেটে না
তোমার বুকে ওষ্ঠ রেখেও বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়
যেন আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
দিঘির পাড়ে বকের সাথে দেখা হলো না!
সখী, আমার পায়ের তলায় সর্ষে, আমি
বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী
আমায় কেউ দ্বার খোলে না, আমার দিকে চোখ তোলে না
হাতের তালু জ্বালা ধরায়, শপথগুলি ভুল করেছি
ভুল করেছি
মুহুর্মুহু স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্নে আমার ফিরে যাওয়ার
কথা ছিল, স্বপ্নে আমার স্নান হলো না।
সখী, আমার চক্ষুদুটি বর্ণকানা, দিনের আলোয়
জ্যোৎস্না ধাঁধা
ভালোবাসায় রক্ত দেখি, রক্ত নেশায় ভ্রমর দেখি
সুখের মধ্যে নদীর চড়া, শুকনো বালি হা হা তৃষ্ণা
হা হা তৃষ্ণা
কীর্তি ভেবে ঝড়ের মুষ্টি ধরতে গেলাম, যেন আমার
ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
স্বরূপ দেখা শেষ হলো না। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | শিল্প তো সার্বজনীন, তা কারুর একলার নয়
এ কথা ভাবলেই বড় ভয় লাগে, এই সত্য ঘোর শত্রু
ভয় লাগে, বড় ভয় লাগে।
নীরা নাম্মী মেয়েটি কি শুধু নারী? মন বিঁধে থাকে
নীরার সারল্য কিংবা লঘু খুশী,
আঙুলের হঠাৎ লাবণ্য কিংবা
ভোর ভোর মুখ
আমি দেখি, দেখে দেখে দৃষ্টিভ্রম হয়
এত চেনা, এত কাছে, তবু কেন এতটা সুদূর
নীরার সূপের গায়ে লেগে আছে যেন শিল্পচ্ছটা
ভয় হয়, চাপা দুঃখ হিম হয়ে আসে।
নীরা, তুমি বালিকার খেলা ছেড়ে শিল্পের জড়তে
যেতে চাও!
প্রতীক অরণ্যে তুমি মায়া বনদেবী?
তোমার হাসিতে যেন ইতালির এক শতাব্দীর মৃদু ছায়া
তোমার চোখের জলে ঝলকে ওঠে শিল্পের কিরণ
এ শিল্প মধুর কিন্তু ব্যক্তিগত নয়
শিল্প সহবাসে আমি তোমাকে স্বৈরিণী হতে
ছেড়ে দিব কোন্ প্রাণে বলো?
না, না, নীরা, ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি
তোমাকে আমার কিংবা আমাকে তোমার কোনো
নির্বাসন নেই
ফিরে এসো, এই বাহুঘেরে ফিরে এসো! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো লিবো এই ভাবনা
আরও প্রিয় লাগে
ভোর থেকে টুকটাক কাজ সারি, যেন ঘর ফাঁকা করে
সময়ে সুগন্ধ নিয়ে তৈরি হতে হবে
দরজায় পাহারা দেবে নিস্তব্ধতা, আকাশকে দিতে হবে
নারীর ঊরুর মসৃণতা, তারপর লেখা
হীরক-দ্যুতির মতো টোবল আচ্ছন্ন করে বসে থাকে
কালো রং কবিতার খাতা
আমি শিস দিই, সিগারেট ঠোঁটে, দেশলাই খুঁজি
মনে ফুরফুরে হাওয়া, এবার কবিতা একটি নতুন কবিতা…
তবু আমি কিছুই লিখি না
কলম গড়িয়ে যায়, ঝুপ করে শুয়ে পড়ি, প্রিয় চোখে
দেখি শাদা দেয়ালকে, কবিতার সুখস্বপ্ন
গাঢ় হয়ে আসে, মনে-মনে বলি, লিখবো
লিখবো এত ব্যস্ততা কিসের
কেউ লেখা চাইলে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, কাল দেবো, কাল দেবো
কাল ছোটে পরশু কিংবা তরশু কিংবা পরবর্তী সোমবারের দিকে
কেউ-কেউ বাঁকা সুরে বলে ওঠে, আজকাল গল্প উপন্যাস
এত লিখছেন
কবিতা লেখার জন্য সময়ই পান না।
বুঝি? না?
উত্তর না দিয়ে আমি জনান্তিকে মুখ মুচকে হাসি
ফাঁকা ঘরে, জানলার ওপার দূর
নীলাকাশ থেকে আসে
প্রিয়তম হাওয়া
না-লেখা কবিতাগুলি আমার সর্বঙ্গ
জড়িয়ে আদর করে, চলে যায়, ঘুরে ফিরে আসে
না-হয়ে ওঠার চেয়ে, আধো ফোটা, ওরা খুনসুটি
খুব ভালোবাসে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ফিরে যাবো, শীত শেষে অবিশ্বাসী মরালের মতো
অন্ধকার শুভ্ৰ হলে, ফিরে যাবো, হে সখি নিরালা,
উরসে চন্দন গন্ধ, বিন্দু বিন্দু রক্ত ইতস্তত
তোমার শিশির-স্বাদ মুখ আর দৃষ্টিপাত মালা—
ফেলে আমি চলে যাবো, নির্বাসনে, হে সখি নিরালা।যৌবন আশ্রিত বুঝি দীর্ঘ ঋজুরাত্রির শরীরে ;
দিনের আলোয় তুমি, ভীরু প্ৰাণ পতঙ্গের মতো ।
আমাকে ডেকেছো তাই স্রোতস্বিনী তমসার তীরে
অসহিষ্ণু বাসনায় নিজেকে ঢেকেছো অবিরত !
দিনের আলোয় তুমি মৃত্যুমুখী পতঙ্গের মতো।করুণ শয্যায় লগ্ন ঘন নীল তোমার বসন–
সমুদ্র, আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল,
তুলে নাও নতমুখে, লজ্জা ঢাকো, বিচ্ছেদের ক্ষণ
বিষাদের নীল শিখা চক্ষে জ্বলো, তারো সঙ্গে মিল
সমুদ্র আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল।ফিরে যাবো সব ফেলে দুঃখে, সুখে, হে সখি নিরালা,
শরীরে স্পর্শের স্বাস মুছে নেবে দিবসের চোখ
জনারণ্য উপহার দেবে শুধু অতৃপ্তির জ্বালা
আবার উষসী এলে ফিরে পাবো বিচ্ছেদের শোক ।
চতুর্দিকে রবে শুধু দিবসের শত তীক্ষ্ণ চোখ । |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | মানুষের মতো চোখ, বিস্ফোরণ, সমাধির মতো শূন্যে প্রচ্ছন্ন কপাল
পদচুম্বনের মতো ভালোবাসা ভিতরে রয়েছে
ভালোবাসা তিনশো মাইল দূরে গিয়ে আলিঙ্গন করে
দূর থেকে ভালোবাসা দেখে যেতে লোভ হয়, শরীর লুকোতে চায়
জ্যোৎস্নালোকে, তবুও জ্যোৎস্নায়
স্পষ্ঠ ছাড়া পড়ে এত স্পর্শকাতরতা।
গোলাপের মতো এক ধানক্ষেত, পুরুষ নামের সব নদী
বড় চেনা লাগে, দুঃখে কোনো পাপ নেই- যত ডুবে যাই ততই ঈশ্বর
মেঘমাশ্লিষ্টসানু পা ছড়ান, সুর্যাস্তের মতো তাঁর দুঃখ এত বড়
অথবা দুঃখের মধ্যে লোভ, কিংবা লোভের ভিতরে মুক্তি, মুক্তির ভিতরে
একজন্ম নিমগ্নতা-
এ যেন গভীর রাত্রে বাড়ি ফেরা, কোথাও বাতাস নেই তবুও গাছের
এক একটা পালক খসে; দোকান ঘুমোয়- তবু ভিতরে আলোয়
আধোজাগা স্ত্রীলোকের হাসাহাসি- ওসব দোকানে দিনমানে
স্ত্রীলোক বিক্রীত হয় না- আমি খুব ভালোভাবে জানি।
অথবা দুপুরে লরী সুরকি ঢালে-সুরকির ভিতরে কোন স্বপ্ন নেই?
অমন নরম ওরা, কিশোরীর হাতে ডোবা লাল- যেন রোদ্দুরে হাওয়ায়
বিশাল প্রসাদ এক দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐ সুরকি জমা স’পে পা ডুবিয়ে-
ঘড়ি চলে কুকুরের মতো শব্দে, অথবা কুকুর ডাকে ঘড়ির মতন
তড়িঘড়ি, আমার নিশ্বাস আরও দ্রুত-যেন বেড়াতে এনেছে-
এর ফাঁকে আমায় কিছু আন্তরিক ছোট ছোট কথা বলে যাবে
টুরিস্ট গাইডের হাসি যতখানি আন্তরিক হয়
চারদিকে দেয়াল বা দেবদারুশ্রেণীর মতো প্রতিদিন দিন
প্রতিটি বিদেশ যেন চুম্বকের ধাতু দিয়ে গড়া
কোথাও আঁধারে আসে তিনটে ছায়া, সেই ছায়াবহ ভয়,
প্রতি মানুষের পবিত্রতা
তবু কোনো কোনো দিন ডাকে, বহু ব্যক্তিগত বিস্ফোরণ, ইচ্ছে হয় বলি
চুল খোলো, বোতামের শব্দ শুনি, না-খোলা শায়ার মধ্যে হাত
অথবা চোখের জল চোখ থেকে ছেনে নিতে যাই
শীতে অবেলায় আমি, বাতাসে রেণুর মতো কান্না ভাসে, আমার ও
প্রতি মানুষের
মাঝে মাঝে বড় অসহায় লাগে, তখন কোথায় মুখ লুকাবো জানি না। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | শোকমূলক | একটা চিল ডেকে উঠলো দুপুর বেলা
বেজে উঠলো, বিদায়,
চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি, বিদায়
বিদায়, বিদায়!
ট্রামলাইনে রৌদ্র জ্বলে, গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলাম আমি
হঠাৎ যেন এই পৃথিবী ডেকে দেখালো আমায়
কাঁটা-বেধাঁনো নগ্ন একটি বুক;
রূপ গেল সব রূপান্তরে আকাশ হল স্মৃতি
ঘুমের মধ্যে ঘুমন্ত এক চোখের রশ্মি দেখে
অন্ধকারে মুখ লুকালো একটি অন্ধকার।
হঠাৎ যেন বাতাস মেঘ রৌদ্র বৃষ্টি এবং
গলির মোড়ের ঐ বাড়িটা, একটি-দুটি পাখি
চলতি ট্রামের অচেনা চোখ, প্রসেশনের নত মুখের শোভা
সমস্বরে ডেকে বললো, তোমায় চিরকালের
বিদায় দিলাম, চিরকালের বিদায় দিলাম, বিদায়;
চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি, বিদায়, বিদায় বিদায়।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | দু’জন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী
কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে
কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছ কেন?
সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না;
সিপাহী দু’জনেরই জিভ কাটা।
অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ
তাদের মুখে কঠোর বিষণ্নতা
তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা।
মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পাড় দিয়ে
ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে-
ফসল কাটা মাঠে এখন
সদ্যকৃত বধ্যভূমি।
সেখানে আরও চারজন সিপাহী রাইফেল হাতে প্রস’ত
তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ
কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে
কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে
কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে
কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে
কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি
যুবক এনেছে তার যুবতীকে
বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরর কাঁধ
সবাই এসেছে একজন কবির
হত্যাদৃশ্য
প্রত্যক্ষ করতে।
খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে,
তিনি দেখতে লাগলেন
তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো-
কনিষ্ঠায় একটি তিল, অনামিকা অলঙ্কারহীন
মধ্যমায় ঈষৎ টনটনে ব্যথা, তর্জনী সঙ্কেতময়
বৃদ্ধাঙ্গুলি বীভৎস, বিকৃত-
কবি সামান্য হাসলেন,
একজন সিপাহীকে বললেন, আঙুলে
রক্ত জমে যাচ্ছে হে,
হাতের শিকল খুলে দাও!
সহস্র জনতার চিৎকারে সিপাহীর কান
সেই মুহূর্তে বধির হয়ে গেল।
জনতার মধ্য থেখে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন একজন কসাইকে,
পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, ততই মুর্গী কমে যাচ্ছে।
একজন আদার ব্যাপারী জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে বললেন,
কাঁচা লঙ্কাতেও আজকাল তেমন ঝাল নেই!
একজন সংশয়বাদী উচ্চারণ করলোন আপন মনে,
বাপের জন্মেও এক সঙ্গে এত বেজম্মা দেখিনি, শালা!
পরাজিত এম এল এ বললেন একজন ব্যায়ামবীরকে,
কুঁচকিতে বড় আমবাত হচ্ছে হে আজকাল!
বাদামওয়ালাকে
একজন পকেটমারের হাত আকস্মাৎ অবশ হয়ে যায়
একজন ঘাটোয়াল বন্যার চিন্তায় আকুল হয়ে পড়ে
একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী তাঁর ছাত্রীদের জানালেন
প্লেটো বলেছিলেন…
একজন ছাত্র একটি লম্বা লোককে বললো,
মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা!
এক নারী অপর নারীকে বললো,
এখানে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিলে পারতো…
একজন চাষী একজন জনমজুরকে পরামর্শ দেয়,
বৌটার মুখে ফোলিডল ঢেলে দিতে পারো না?
একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে,
রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না।
তবু একজন সম্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, এ তো ভুল লোককে
এনেছে। ভুল মানুষ, ভুল মানুষ।
রক্ত গোধূলির পশ্চিমে জ্যোৎস্না, দক্ষিণে মেঘ
বাঁশবনে ডেকে উঠলো বিপন্ন শেয়াল
নারীর অভিমানের মতন পাতলা ছায়া ভাসে
পুকুরের জলে
ঝমঝুমির মতন একটা বকুল গাছের কয়েকশো পাখির ডাক
কবি তাঁর হাতের আঙুল থেকে চোখ তুলে তাকালেন,
জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে
রেখা ও অক্ষর থেকে রক্তমাংসের সমাহার
তাঁকে নিয়ে গেল অরণ্যের দিকে
ছেলেবেলার বাতাবি লেবু গাছের সঙ্গে মিশে গেল
হেমন্ত দিনের শেষ আলো
তিনি দেখলেন সেতুর নিচে ঘনায়মান অন্ধকারে
একগুচ্ছ জোনাকি
দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল, তিনি বুঝতে পারলেন
সমুদ্র থেকে আসছে বৃষ্টিময় মেঘ
তিনি বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে আবার
দেখতে পেলেন অরণ্য
অরণের প্রতিটি বৃক্ষির স্বাধীনতা-
গাব গাছ বেয়ে মন্থরভাবে নেমে এলো একটি তক্ষক
ঠিক ঘড়ির মতন সে সত বার ডাকলো :
গঙ্গে সঙ্গে ছয় রিপুর মতন ছ’জন
বোবা কালা সিপাহী
উঁচিয়ে ধরলো রাইফেল-
যেন মাঝখানে রয়েছে একজন ছেলেধরা
এমন ভাবে জনতা ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
কবির স্বতঃপ্রবৃত্ত ঠোঁট নড়ে উঠলো
তিনি অস্ফুট হৃষ্টতায় বললেন :
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
মানুষের মুক্তি আসুক!
আমার শিকল খুলে দাও!
কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!
প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | কেউ জানে না, গোপন- গোপনে জল উঠছে
জল বাড়ছে তিস্তায়, জল বাড়ছে তোর্সা
রাইডাক কালজানি নদীতে
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে, শুকনো নদীগুলো
এখন উন্মাদিনী
নেমে আসছে পাহাড়ী ঢল, ভেসে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত,
ভেঙে পড়ছে চা-বাগান
ডুবছে গ্রাম, চুয়াপাড়া, হাসিমারা, বাকসাদুয়ার
জল বাড়ছে মহানন্দায়, জল বাড়ছে পুনর্ববা
নাগর এবং কালিন্দীতে
ক্রুদ্ধ বিদ্রোহী জল ফুঁসে ফুঁসে উঠছে
ঝাপটা মারছে হাতে হাত মিলিয়ে
ভেঙে পড়ছে ভালুকা, রতুয়া, বলরামপুর, ইংলিশবাজার
ঘুমন্ত গ্রামগুলির ওপর দিয়ে হুড়হুড় করে
এগিয়ে আসছে জলস্রোত
জল বাড়ছে অজয়, মুন্ডেশ্বরী, কেলেঘাই নদীতে
জল বাড়ছে গঙ্গায়, পদ্মায়, যমুনায়, দামোদরে
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে
রোগা জল, কালো জল, দুঃখী জল, ভীতু জল
বুকের পাঁজরার মতো, তানপুরায় টঙ্কারের মতো
উড়ন্ত রুমালের মতো
জলের চঞ্চল খেলা
শত-শত ভ্রমরীর সহসা দিগন্তে উড়ে যাওয়া
অন্তরীক্ষ জুড়ে একটা ঘোর শব্দ- যা সংগীত নয়
ফারাক্কা ডি-ভি-সি’র বাঁধে প্রবল ধাক্কা দিচ্ছে জল
যেন লক্ষ-লক্ষ বাহু-
এবার সব ভেঙে পড়বে
জল উপচে এসে বর্ধমান, আসানসোল, দুর্গাপুরে
শোনা যাচ্ছে সমিমিলিত গর্জন
ওরা আর পিছিয়ে যাবে না
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে
সমস্ত ঘুম ভেঙে দেবে এবার
জল গড়িয়ে এসেছে কলকাতার ময়দানে
চতুর্দিকে থেকে শহরকে ঘিরে দৌড়ে আসছে ওরা
লাল, নীল, সবুজ বিভিন্ন রঙের
পতাকা ওড়ানো অফিসে দুমদাম করে
ধাক্কা দিচ্ছে জল
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে
এইমাত্র তারা ঢুকে এলো অফিস পাড়ায়
বিনয় বাদল দীনেশের মতো দুর্দান্ত সাহসী জল
লাফিয়ে উঠে পড়লো রাইটার্স বিল্ডিংস এর বারান্দায়….. |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | একলা ঘরে শুয়ে রইলে কারুর মুখ মনে পড়ে না
মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না
চিঠি লিখবো কোথায়, কোন মুন্ডহীন নারীর কাছে?
প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে না চোখের আলো মনে পড়ে না
ব্লেকের মতো জানলা খুলে মুখ দেখবো ঈশ্বরের?
বৃষ্টি ছিল রৌদ্র ছায়ায়, বাতাস ছিল বিখ্যাত
করমচার সবুজ ঝোপে পূর্বকালের গন্ধ ছিল
কত পাখির ডাক থামেনি, কত চাঁদের ঢেউ থামেনি
আলিঙ্গনের মতো শব্দ চোখ ছাড়েনি বুক ছাড়েনি
একলা ছিলুম বিকেলবেলা, বিকেল তবু একা ছিল না
একটা মুখ মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না।
এত মানুষ ঘুমোয় তবু আমার ঘুমে স্বপ্ন নেই
স্বপ্ন না হয় স্মৃতি না হয় লোভ কিংবা প্রতিহিংসা
যেমন ফুল প্রতিশোধের স্পৃহায় আনে বুকের গন্ধ
রমণী তার বুক দেখায়, ভালোবাসায় বুক ভর না
শরীর নাকি শরীর চায়, আমার কিছু মনে পড়ে না
মনে পড়ে না মনে পড়ে না- মেঘলা মতো বিস্মরণ
যেমন পথ মুখ লূকিয়ে ভিখারিণীর কোলে ঘুমোয়।
বৃক্ষ তোমার মুখ দেখাও, দেখি আকাশ তোমার মুখ
এসো আমার গতজন্ম তোমায় চেনা যায় কিনা
কোথাও নেই মুখচ্ছবি এ কী অসম্ভব দৈন্য-
আমার জানলা বন্ধ ছিল উঠেও ছিটকিনি খুলিনি
জানলা ভেঙে ঢোকার বুদ্ধি ঈশ্বরেরও মনে এলো না?
আমায় কেউ মনে রাখেনি, না ঈশ্বর না প্রতিমা……. |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া
আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া
পাশ ছাড়ে না
এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–
নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ!
ওরা আমার বিষম চেনা!’
ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ–
লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা
ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল
নীরা জানে না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রকৃতিমূলক | হলুদ শাড়ি আর পরো না, এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি
ঘরে তোমার হল্দে পর্দা! মিনতি করি খুলে রাখো
এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি।
এপাড়া জুড়ে সানাই বাজে, ওপাড়া জুড়ে শামিয়ানা
ব্যস্ত মানুষ, সুখী মানুষ, শঙ্খ আর উদ্ধ্বনি লাল চেলি
সবই থাকুক, বন্ধ রাখো গায়ে-হলুদ
এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি
আয় কাক আয় কাকের পাল আয়রে আয়-
গোয়াল ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটা ডাকে পুরোনো সুরে
ও খোকা, তুই কাক ডাকিসনে, ও ডাকা যে অলুক্ষণে
এ-বছর আর নবান্ন নেই, বান এসেছে
এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি।
দুপুরবেলা হলদে হাওয়া উদাস হয়ে ঘুরে বেড়য়ে
কোথায় কেউ কথা বললে রক্ত আলোয় তুফান ওঠে
পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকে হিম নিশীথের নীল জ্যোৎস্না
গাছের পাতা হলুদ হয় তবুও ভয়ে
মায়ের মুখ শিশুর মতো, জলে যেমন মেঘের ছায়া, থমথমে ভয়
ও মা, তুমি ভয় পেও না
শিশুর অন্নপ্রাশন হবে অনাদিকালের গোধুলি বেলয়।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
গোপনে
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল।
শব্দ ভেঙে গেল যেন শৃঙ্খলের মতো শব্দ হয়
পাহাড়ের চূড়া থেকে খসে পড়া রূপালি পাতার মতো
সন্ধ্যায় সূর্যকে দীপ্ত দেখে
লক্ষ বৎসরের পর এক মুহূর্তের জন্য দুর্লভ স্বরাজ
বুকের ভিতর যেন তোমার মুখের মতো প্রতিবিম্ব শিল্পে ঝলসে ওঠে
মনে হয়
সমস্ত শিল্পের সার তোমার ও মুখের বর্ণনা
সমস্ত শিল্পের সার তোমারও মুখের বর্ণনা
কালহীন, বর্ণহীন
প্রতিশব্দহীন
আমি সূর্যকরোজ্জল হ্রদের কিনার তবু ভালেরির মতো
পাইনি প্রার্থিত শব্দ, উদ্ভাসিত প্রতিবিম্ব, যদিও আমাকে
প্রেম তার প্রতিমূর্তি গোপনে দেখাবে বলেছিল।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | শুয়ে আছে বিছানায়, সামনে উম্মুক্ত নীল খাতা
উপুড় শরীর সেই রমণীর, খাটের বাইরে পা দু’খানি
পিঠে তার ভিজে চুল,
এবং সমুদ্রে দু’টি ঢেউ
ছায়াময় ঘরে যেন কিসের সুদন্ধ,
– জানায়
রৌদ্র যেন জলকণা, দূরে নীল নক্ষত্রের দেশ।
কী লেখে সে, কবিতা? না কবিতা রচনা করে তাকে?
সে বড় অসি’র, তার চোখে বড় বেশী অশ্রু আছে
পাশ ফেরা মুখখানি-
এখন স্তব্ধতা মূর্তিমতী-
শাড়ির অমনোযোগে কোমরের নগ্ন বারান্দায়
একটি পাহাড়ী দৃশ্য,
সবুজ সতেজ উপত্যকা
কেন বা নদী ও নয়? অথবা সে অপার্থিবা বুঝি।
কী লেখে সে, কবিতা? না কবিতা রচনা করে তাঁকে?
নগরে হঠাৎ বৃষ্টি, বৃষ্টিতে দুপুর ভেসে যায়
সে দেখেনি, সে শোনেনি কোনো শব্দ
যেন এক দ্বীপ
যেখানে হলুদ বর্ণ রক্তিমকে নিমন্ত্রণে ডাকে
অথবা সে জলকণ্যা
দু’বাহুতে হীরকের আঁশ
ক্রমশ উজ্জল হয় আঙুলে কলম চিক্রার্পিত
কী লেখে যে, কবিতা? না কবিতা রচনা করে তাকে? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি
যে আমায় ভুলে যায়, আমি তার ভুল
গোপন সিন্দুকে খুব যত্নে তুলে রাখি
পুকুরের মরা ঝাঁঝি হাতে নিয়ে বলি,
মনে আছে, জলের সংসার মনে আছে?
যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি!
যে আমায় বলেছিল, একলা থেকো না
আমি তার একাকিত্ব অরণ্যে খুঁজেছি
যে আমায় বলেছিল, অত্যাগসহন
আমি তার ত্রাগ নিয়ে বানিয়েছি শ্লোক
যে আমার বলেছিল, পশুকে মেরো না
আমার পশুত্ব তাকে দিয়েছে পাহারা!
দিন গেছে, দিন যায় যমজ চিন্তায়
যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সামনে দিগন্ত কিংবা অনন্ত থাকার কথা ছিল
অথচ কিছুটা গিয়ে
দেখি কানা গলি
ঘরের ভিতরে কিচু গোপন এবং প্রিয়
স্মৃতিচিহ্ন থেকে যাওয়া
উচিত ছিল না?
নেই, এই দুৎখ আমি কার কাছে বলি!
সমস্ত নারীর মধ্যে একজনই নারীকে খুঁজেছি
এ-রকমই কথা ছিল
স্নিগ্ধ ঊষাকালে
প্রবল স্রোতের মতো প্রতিদিন ছুটে চলে যায়
জন্ম থেকে বারবার খসে পড়ে আলো
রাত্রির জানলার পাশে আবার কখনো হয়তো
ফিরে আসে
ফুটে ওঠে ছোট্ট কুন্দ কলি।
তবু ঘোর ভেঙে যায় কোনো- কোনো দিন
চেয়ে দেখি, সত্য নয়
শুধুই তুলনা!
নেই, এই দুঃখ আমি কার কাছে বলি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়
ছাদের ঘরে
কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক
হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!
কবিতাকে আমি ভুলে থাকি যদি
অমনি সে রেগে হঠাৎ আমায়
ডবল ডেকার বাসের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়
আমার অসুখে শিয়রের কাছে জেগে বসে থাকে
আমার অসুখ কেড়ে নেওয়া তার প্রিয় খুনসুটি
আমি তাকে যদি
আয়নার মতো
ভেঙ্গে দিতে যাই
সে দেখায় তার নগ্ন শরীর
সে শরীর ছুঁয়ে শান্তি হয় না, বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | আমার নাকি বয়েস বাড়ছে? হাসতে হাসতে এই কথাটা
স্নানের আগে বথরুমে যে কবার বললুম!
এমন ঘোর একলা জায়গায় দুপাক নাচলেও
ক্ষতি নেই তো-
ব্যায়াম করে রোগা হবো, সরু ঘেরের প্যান্ট পরবো ?
হাসতে হাসতে দম পেটে যায়, বিকেলবেলায়
নীরার কাছে
বলি, আমার বয়েস বাড়ছে, শুনছো তো? ছাপা হয়েছে!
সত্যি সত্যি বুকের লোম, জুলপি, দাড়ি কাঁচায় পাকা-
এই যে চেয়ে দ্যাখো
দেখে সবাই বলবে না কি ছেলেটা কই, ও তো লোকটা!
এ সব খুব শক্ত ম্যাজিক, ছেলে কীভাবে লোক হয়ে যায়
লোকেরা ফের বুড়ো হবেই এবং মরবে,
আমিও মরবো
আরও খনিকটা ভালোবেসে, আরও কয়েকটা পদ্য লিলে
আমিও ঠিক মরে যাবো-
কী, তাই না?
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলুম, এ জায়গাটা এত অচেনা
আমার ছিল বিশাল রাজ্য, তার বইরেও এত অসীম
শরীরময় গান-বাজনা, পলক ফেলতেও মায়া জাগে
এই ভ্রমণটা বেশ লাগলো, কম কিছু তো দেখা হলো না
অন্ধকারও মধুর লাগে, নীরা, তোমার হাতটা দাও তো
সুগন্ধ নিই।
নীরা, শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | ছিলাম বাসনা-লঘু, ছন্দ এসে আমাকে সুসি’র হতে বলে
প্রিয় বয়স্যের মতো তার দন্তপঙ্ক্তি
আমি তাকে দূর হয়ে যেতে বলি নতুন বন্ধুর খোঁজে
আমি ছন্দহীন হতে হতে ক্রমশ ধর্মদ্রোহী আগোপন
পাষন্ড হয়ে যাই।
তবু সে দরজার কাছে মুখ চুন, আমি তাকে পালঙ্কের নিচ থেকে
জুতো মুখে করে আনতে হুকুম করেছি!
দ্বিধা নেই, সে এনেছে, সমালোচকের কানে মেরেছে চপ্পল।
সে আমার হাত ধরে স্ফটিকবর্ণের এক নারীর সান্নিধ্যে
টেনে আনে, মাত্রাহীন আঙুল তুলে নারীকে দেখিয়ে বলে,
সকল ছন্দের মধ্যে এই যে গায়ত্রী, তুমি নাও,
গায়ত্রীর মতো নারী শুয়ে আছে, বিশাল জঘন মেলে,
পর্ব ভেঙে ইশারায় আমাকে উপুড় হতে বলে
আমি তার শরীর বিস্তৃত করি, দুই বক্ষোদেশ ছিঁড়ে ক্রমশ পয়ারে
নিয়ে আসি, ঊরুদ্বয়ে কিছু কথ্য অশ্লীলতা মিশিয়ে চকিতে
খুলে ফেলি আরবের অলঙ্কার, যদিও নিশ্চিত
কাঙাল কুকুর হয়ে মাঝে মাঝে আমি বড় মিলন প্রত্যাশী।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি য়েলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?
তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি
তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেঁসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | ভেবেছিলাম নিচু করবো না মাথা, তবুও ভেতরের এক কুত্তার বাচ্চা
মাঝে মাঝে মসৃণ পায়ের কাছে ঘষতে চায় মুখ, জানি তো অসীমে
ভাসিয়েছি আমার আত্মার শাদা পায়রা দূত, বলেছি মৃত্যুর চেয়েও সাচ্চা
মানুষের মতো বেঁচে থঅকা- তবু তার দু’একটা পালক খসে
জ্যোস্নায় মনখারাপ হিমে।
মাঝে মাঝে গদি মোড়া চেয়ারে বসলেও ব্যথা করে পশ্চাৎদেশে, আমি জানি
আচম্বিতে পেয়ালা পিরীচ ভেঙে উঠে দাঁড়ানো উচিত ছিল আমার
জানলার বাইরে থেকে নিয়তি চোখ মারে, শীর্ণ হাতে দেয় হাতছানি
আমি মনকে চোখ ঠেরে অন্যমনস্ক হই, ইস্ত্রি ঠিক রাখি জামার।
এ-সব ইয়ার্কি আর কদ্দিন হে? শুধু বেঁচে থাকতেই হালুয়া
টাইট করে দিচ্ছে
অথচ কথা ছিল, সব মানুষের জন্য এই পৃথিবী সুসহ দেখে যাবো,
ঠিক যে-রকম
প্রত্যেক মৌমাছির আছে নিজস্ব খুপরি, কিন্তু যার যখন ইচ্ছে
উড়ে যাবার স্বাধীনতা : ফুলের ভেতরে মধু সে জেনেছে, তবু
সঙ্গসভ্যতার জন্য তার শ্রম।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
প্রবল ঢেউ-এর মাথায় ফেনার মধ্যে
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
সমুদ্রের অভিশাপ।
মেল ট্রেনের গায়ে আমি খড়ি দিয়ে এঁকেছিলাম
নারীর মুখ
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
এমনকি, সেই নারীরও চোখের তারা আঁকা ছিল না
এক স্টেশন পার হবার আগেই বৃষ্টি, প্রবল বৃষ্টি
হয়তো বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছিল আমার খড়ির শিল্প
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
মেল ট্রেনের অভিশাপ।
প্রতিদিন পথ চলা কি পথের বুকে পদাঘাত?
নারীর বুকে দাঁত বসানো কি শারীরিক আক্রমণ?
শীতের সকালে খেঁজুর-রস খেতে ভালো-লাগা
কি শোষক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া?
প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?
এ-সব বিষয়ে আমি মনস্থির করতে পারিনি
কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পাই
সমুদ্র ও মেল ট্রেনের অভিশাপ। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি
উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা
এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা
দর্পণের ঘরে বস
চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে
সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল
থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে
আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো
তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব
আমি তার ওষ্ঠ ও উরুতে মুখ গুঁজে
জানাই সেই খবর
কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | যে লেখে, সে আমি নয়
কেন যে আমায় দোষী করো!
আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুব্ধ হয়ে ছিঁড়েছি শৃঙ্খল?
নদীর কিনারে তার ছেলেবেলা কেটেছিল
সে দেখেছে সংসারের গোপন ফাটল
মাংসল জলের মধ্যে তার আয়না খুঁজেছে, ভেঙেছে।
আমি তো ইস্কুলে গেছি, বই পড়ে প্রকাশ্য রাস্তায়
একটা চাবুক পেয়ে হয়ে গেছি শূন্যতায়
ঘোড়সওয়ার।
যে লেখে সে আমি নয়
যে লেখে সে আমি নয়
সে এখন নীরার সংশ্রবে আছে পাহাড়-শিখরে
চৌকো বাব্যের সঙ্গে হাওয়াকেও
হারিয়ে গেয় দুরন্তপনায়
কাঙাল হতেও তার লজ্জা নেই
এবং ধ্বসের জন্য তার এত উম্মত্ততা
দূতাবাস কর্মীকেও খুন করতে ভয় পায় না
সে কখনো আমার মতন বসে থাকে
টেবিলে মুখ গুঁজে? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | বহুদিন লোভ নেই, শব্দে শিহরণ স্বপ্নে শিহরণ, ঘুম
শরীরে দুপুর এলো, যেন বহুদিন লোভ নেই
বহুদিন লোভ নেই, শ্মশানের পাশে গিয়ে বিকেলে বসিনি;
এবার তোমার কাছে চলে যাবো, ‘তুমি’ বহু গ্রন’ থেকে চুরি
এ-রকম যেতে হয়, বিকেলে মন খারাপ হলে তোমার ছায়ায়
না গেলে মানায় না, কিংবা চিঠি, বহু পুরোনো ভুলের
শোক থেকে ছায়ার ভিতরে জ্যোৎস্না, অথাবা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে ফেলা
শরীরের নিবেদন,-বৃষ্টি থেকে উঠে
তোমার বিজন ভালো, অশ্রু ভালো, বুক ভালো, এমনকি সর্বস্বতা খুলে
ভাটফুল দেখা ভালো, চোখ বুজে চোখ রাখা ভালো।
এ-রকম রাখা গেছে বহুবার, ‘তুমি’ নও, তাদের সবারই নাম ছিল
তাঁবুর ভিতরে সুশ্রী মুখখানি বরফের জীবনে ডুবেছে
তাঁবু মিথ্যে, সুশ্রী মিথ্যে, বরফ, জীবন, ডোবা কম মিথ্যে নয়
যেমন কবিতা মিথ্যে,
রক্তমাখা হাতে বেণী খুলে দিলে স্ত্রীলোকের যেমন আনন্দ
যেমন পৃথিবী থেকে সব গাছ খুন করেছিল পাগলা কবি
এ-রকম দিন গেছে, প্রতিদিন নাম জেনে ভুলে যাওয়া মুখ
লোভহীন উদাসীন, বিশাল চিৎকারে বহু মিথ্যে অসীমতা।
এ-রকম দিন গেছে, দিনের ভিতরে শুকনো চড়া জড়ে আছে!
বহুদিন লোভ নেই, শ্মশানের পাশে গিয়ে বিকেলে বসিনি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | কতটুকু দূরত্ব? সহস্র আলোকবর্ষ চকিতে পার হয়ে
আমি তোমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসি
তোমার নগ্ন কোমরের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলার আগে
অলঙ্কৃত পাড় দিতে ঢাকা অদৃশ্য পায়ের পাতা দুটি
বুকের কাছে এনে
চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে চাই
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বুক কাঁপে
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বাইরের জীবন মিথ্যে হয়ে যায়
বহুকাল পর অশ্রু বিস্মৃত শব্দটি
অসম্ভব মায়াময় মনে হয়
ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে
আমার দুঃখ মিশিয়ে আদর করি
সামাজিক কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে
স্ফুরিত হয় একটি মুহূর্ত
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে তোমার পায়ের কাছে…
বাইরে বড় চ্যাঁচামেচি, আবহাওয়া যখন তখন নিম্নচাপ
ধ্বংস ও সৃষ্টির বীজ ও ফসলে ধারাবাহিক কৌতুক
অজস্র মানুষের মাথা নিজস্ব নিয়মে ঘামে
সেই তো শ্রেষ্ঠ সময় যখন এ-সবকিছুই তুচ্ছ
যখন মানুষ ফিরে আসে তার ব্যক্তিগত স্বর্গের
অতৃপ্ত সিঁড়িতে
যখন শরীরের মধ্যে বন্দী ভ্রমরের মনে পড়ে যায়
এলাচ গন্ধের মতো বাল্যস্মৃতি
তোমার অলোকসামান্য মুখের দিকে আমার স্থির দৃষ্টি
তোমার রেজী অভিমানের কাছে প্রতিহত হয়
দ্যুলোক-সীমানা
প্রতীক্ষা করি ত্রিকাল দুলিয়ে দেওয়া গ্রীবাভঙ্গির
আমার বুক কাঁপে,
কথা বলি না
বুকে বুক রেখে যদি স্পর্শ করা যায় ব্যথাসরিৎসাগর
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে
চোখ শুকনো, তবু পদচুম্বনের আগে
অশ্রুপাতের জন্য মন কেমন করে! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | কেউ শরীরবাদী বলে আমায় ভর্ৎসনা করলে, তখনই ইচ্ছে হয়
অভিমানে অশরীরী হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাই।
আবার কেউ ‘অশরীরী’ শব্দটি উচ্চারন করলে আমি কান্নার মতন
ভয় পেয়ে তীব্র কন্ঠে বলি, শরীর, তুমি কোথায়? লুকিও না
এসো, তোমাকে একটু ছুঁই!
এই রকমই জীবন ও মানুষের হাঁটা চলার ভাষা-
সুতরাং ‘ভাষা’ শব্দটি কারুর মুখে শুনলে মনে হয় পৃথিবীর
যাবতীয় ক্ষত্রিয় গদ্যের
বিনাশ করে যেতে হবে।
কোথাও ‘ব্রাহ্মণ’ শুনলে মনে পড়ে ভাঙা মৃৎ-শকটের জন্য কান্না
এ-সবই তো আকাশের চিচে, তোমার মনে পড়ে না?
দেখো,আবার ‘তুমি’ বলছি, অর্থাৎ শরীর
এখন আমি শরীরবাদী না অশরীরী?
অশরীরী, অশলীরী, তাই তো শরীর ছুঁতে ইচ্ছে হয়,
এসো শরীর, তোমায় আদর করি
এসো শরীর, তোমায় ছাপার অক্ষরের মতো স্পষ্টভাবে চুম্বন করি
তোমায় সমাজ-সংস্কারের মতন আদর্শভাবে আলিঙ্গন করি
এসো, ভয় নেই, লজ্জা করো না, কেউ দেখবে না-দেখতে জানে না
সত্যবতী, তোমার দ্বীপের চারপাশ আমি ঢেকে দেবো কুয়াশায়
তোমার মীনচিহ্নিত দেহে ছড়িয়ে দেবো যোজনব্যাপী গন্ধ-
কবিও তো সন্ন্যাসীই, সন্ন্যাসীরই মতন সে হঠাৎ কখনো
যোগভ্রষ্ট হয়ে কামমোহিত হয়-
সেই বিস্মৃত মুহূর্তের লিপ্সা বড় তীব্র, তাকে অপমান করো না
যে যখন জ্যোৎস্নাকে ভোগ করতে চায়, তখন উম্মত্তের মতন
লন্ডভন্ড করে রাত্রি, সে যখন পৃথিবীকে দেখে, তখন
দশ আঙুলের মতন ভয়াবহ চোখে এই শৌখিন ধরিত্রীর সঙ্গে
সঙ্গম করে-যার ডাকনাম ভালোবাসা,-আঃ কেন আবার
একথা, আমি অশরীরী এখন, আমি এখন গীর্জার অন্দরের মতন
পবিত্র বিশেষণ, সমস্ত প্রতীক অগ্রাহ্য করা শ্রেষ্ঠ প্রতীক, এখন
‘সমাজ’ শব্দটি শুনলে পাট ভেজানো জলের গন্ধ মনে পড়ে, কেউ
ক্ষিদে পেয়েছে’ বললে মনে হয়, আহা লোকটি বড় নিষ্ঠাবান
অর্থাৎ ধ্যান, এখন আমার ধ্যান, আর বিস্মরণ নয়, ধ্যান-
কিন্তু যাই বলো, চারপাশে অপ্সরীর নৃত্য না থাকলে চোখ বুঝে
ধ্যানও জমে না!
আবার? আস্তে, না, শরীর নয়, আমি এখন আকাশের নিচে
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্ত অন্তরীক্ষ জুড়ে তালগাছের মতন
দীর্ঘ কোনো কন্ঠস্বর আমায় বলেছে, দাঁড়াও!
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, আমি এ-রকমও জানি,
চোখে জল এলে বুঝতে পারি, এও তো শরীর, পায়ের ধুলোও শরীরবাদী
আহা. শরীরের ধোষ নেই, সে অশীরীর সামনে হাত জোড়
করে দাঁড়িয়ে আছে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | আমি তোমার অধর থেকে ওষ্ঠ তুলে তাকিয়ে দেখি মুখের দিকে
তুমি তোমার কোনো কথাই রাখেনি
কথা ছিল কি এমন করে কান্না, এমন
চোখের দুই পাশ মুচড়ে তাকানোর?
কথা ছিল কি বিকেলবেলা ঘড়ির নিচে মায়ার খেলা
আদর পেয়ে মার্জারীর মতো শরীর বাঁকানো?
হাওয়ায় এখন নদীর মতো শব্দ ওঠে
তিনটি কথা বলতে এসে তোমার ঠোঁটে
চোখের মধ্যে দেখতে পেলাম মনোহরণ;
এখন আমার দুঃখ হয় না, রাগ হয় না, ঈর্ষা হয় না
এখন তোমার শরীর থেকে ফুলের গয়না
হাওয়ায় দাও ছড়িয়ে, কেউ এসে তোমায় রক্ষা করুক-
তুমি ভেঙেছো দুঃখ দিনে কঠিন পণ
নদীর শব্দ ছাড়িয়ে এখন বেজে উঠলো মেঘের মতো দুই ডমরু।
সখী, এবার স্পষ্ঠ কথা বলার দিন এসেছে
দু’পাঁচ বছর বাঁচাবো কিনা কেউ জানি না-
আমার কথা শীতের দেশের পাখির মতো ঝরে পড়ে
চিঠি পেয়িছি হিয়েরোগ্লিফিক্স্ অক্ষরের স্বরান্তরে
বরফ ফেটে অকস্মাৎ বেরিয়ে আসে জলস্তম্ভ
আমি যখন তোমার বুকে মুখ ডুবিয়ে গন্ধ শুঁকি
বৃক্ষ তখন আত্মা পায়, বায়ুুতে এসে নিরালম্ব………
ফূলের মধ্যে সূর্যমুখী
ফুটবে আজ দেরিতে খুব, সবুজ ঘরে জ্বলে এখন কমলা আলো
রক্ত আমার অবিশ্বাসী, সন্ধেবেলা দুটো নেশাই লাগলো ভালো
ক্লান্ত মাথা সরিয়ে এনে চোখ রেখিছি তোমার গালে
শরীর খুলে অন্য শরীর, কেন এমন লোভ দেখাল?
কিছুই বলা হলো না, তুমি কথা রাখোনি, দুঃখে অভিমানে
শ্বাসকষ্ট হলো আমার, চোখেও জল এসেছিল।
চোখে সে কথা জানে
আমি
দ্বিধার মধ্যে ডুবে গেলাম! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে
দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি
পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট
যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি
কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতই ইচ্ছে করে অবহেলায়
ধর্মতলায় দিন দুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি।
ইচ্ছে করে দুপুর রোদে ব্লাক আউটের হুকুম দেবার
ইচ্ছে করে বিবৃতি দিই ভাঁওতা মেলে জনসেবার
ইচ্ছে করে ভাঁওতাবাজ নেতার মুখে চুনকালি দিই।
ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মঠে
ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায়
বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাঁচের চুড়ি দেখলে ভাঙি...
ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমার কিছু ভাল্লাগে না।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন, কাটিয়েছি
কোনোদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা
সমীপেষু করা যায়।
ভেবেছি অরণ্যে যাব-সমগ্র সমাজ থেকে প্রতিভূ বৃক্ষকে খুঁজে নিতে
সেখানে সমস্তক্ষণ ছায়া
সেখানে ছায়ার জন্য কৃতজ্ঞতা নেই
সেখানে রক্তিম আলো নির্জনতা ভেদ করে খুঁজে নেয় পথ
মুহূর্তে আড়াল থেকে ছুঠে আসে কপিশ হিংস্রতা
গাঢ় অন্ধকার হলে আমি অসতর্ক অসহায়
জানু পেতে বসে বলবো
বহুদিন ছায়ায় কেটেছে এ জীবন-
হে ছায়া, আমারই হাতে তোমার ধ্বংসের মন্ত্র
বুকের ভিতরে ছিল শ্বাস- তার পরিক্রমা ঘূর্ণি দুনিয়ায়
ভূতলে অশুভ শব্দ, আঁচের মতন লাগে পাতার বীজন-
তবু শেষবার
পুরোনো কালের মতো বন্ধু বলে ডাকো
বল্কল বসন দাও, দাও রসসিক্ত ফল, দ্ধিধাহীন হয়ে একটু শুয়ে থাকি
শেষ প্রহরের আগে
এই হত্যাকারী হাতে শেষবার প্রণাম জানাই।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | আমাকে দিও না শাস্তি, শিয়রের কাছে কেন এত নীল জল
কোথাও বোঝার ভুল ছিল, তাই ঝড় এলো সন্ধের আকাশে
আমাকে দিও না শাস্তি, কেন ফেলে চলে গেলে অসমাপ্ত বই
চতুর্দিকে এত শব্দ, শব্দ গিরিবর্তে ঝোলে অদ্ভূত শূন্যতা
আকাশের গায়ে গায়ে কালো তাঁবু, জগতের সব দীন দুঃখী শুয়ে আছে
একজন শুধু বাইরে, তুমি তার একাকিত্ব তুলে নাও মরাল গ্রীবার মতো হাতে
আমাকে দিও না শাস্তি, নীরা, দাও বাল্য-প্রেমিকার স্নেহ, সারাটা জীবন
আমি
অবাধ্য শিশুর মতো প্রশ্রয় ভিখারী! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,
ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার
কাছে মাপে ছোট লাগলো। প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু
একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়
একটা নদী পেয়েছিস?
খুব জিতেছিস তো মাইরি!
তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।
তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।
নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।
যেমন, বলো তো, আজ
সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?
সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,
সে জানতো! সবাই জানে।
শৈশবে আর ফেরা যায় না।এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কষ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।
আমি ঈশ্বর মানি না, তিনি আমার মাথার কাছে ঝুঁকে দাঁড়াবেন না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | চিত্ত উতলা দশদিকে মেলা সহস্র চোখ
আমাকে এবার ফিরিয়ে নেবার জন্য এসেছে?
আর দুটো দিন করুণ রঙিন
পথ ঘুরে দেখা
হবে না আমার? পুরোনো জামার ছিঁড়েছে বোতাম?
তমসার তীরে নগ্ন শরীরে
দাঁড়ালাম আমি
পাশে নেই আর মায়া-সংসার আকাশে অশনি
নদীটি এখন বড় নির্জন
জলে শীত ছোঁওয়া
কে জানে কোথায় ন্যায়-অন্যায় সহসা লুকালো
এক অঞ্জলি জল তুলে বলি,
হে আঁধারবতী,
বহু ঘুরে-ঘুরে স্বপ্নে সুদূরে দেখা হয়েছিল
দুঃখ ক্ষুধায় এই বসুধায়
হয়েছি হন্যে
কখনো দাওনি সুধার চাহনি ফিরিয়েছো মুখ!
মনে আছে সব? শেষ উঃসব
আজ শুরু হবে
মেশাবো এ জলে মন্ত্রের ছলে অতি প্রতিশোধ
শরীর জানে না কে কার অচেনা
তাই ছুঁয়ে দেখা
এ অবগাহন শরীর-বাহন চির ভালোবাসা! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | এক এক সময় মনে হয়, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই
এক এক সময় মনে হয়
পৃথিবীটাকে দেখে যাবো শেষ পর্যন্ত!
এক এক সময় মানুষের ওপর রেগে উঠি
অথচ ভালোবাসা তো কারুকে দিতে হবে
জন্তু-জানোয়ার গাছপালাদের আমি ওসব
দিতে পারি না
এক এক সময় ইচ্ছে হয়
সব কিছু ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড করে ফেলি
আবার কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে
ইচ্ছে হয় কিছু এককটা তৈরি করে গেলে মন্দ হয় না।
হঠাৎ কখনো দেখতে পাই সহস্র চোখ মেলে
তাকিয়ে আছে সুন্দর
কেউ যেন ডেকে বলছে, এসো এসো,
কতক্ষণ ধরে বসে আমি তোমার জন্য
মনে পড়ে বন্ধুদের মুখ, যারা শত্রুদের, যারাও হয়তো কখনো
আবার বন্ধু হবে
নদীর বিনারে গিয়ে মনে পড়ে নদীর চেয়েও উত্তাল সুগভীর নারীকে
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।
ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাসা
বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা
বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | কিছু উপমার ফুল নিতে হবে নিরুপমা দেবী
যদিও নামের মধ্যে বেখেছেন আসল উপমা
ক্ষণিক প্রশ্রয়-তুষ্টি চায় আজ সামান্য এ কবি,
রবীন্দ্রনাথেরও আপনি চপলতা করেছেন ক্ষমা।
যদিও প্রত্যহ আসে অগণিত সুঠাম যুবক
নানা উপহার আনে সময় সাগর থেকে তুলে
আমি তো আনি নি কিছু চম্পা কিংবা কুর্চি কুরুবক
সাজাতে চেয়েছি শুধু স্পর্শহীন উপমার ফুলে।
আকাশে অনেক সজ্জা, তবু স্থির আকাশের নীল
সামান্য এ সত্যটুকু, শোনাতে চেয়েছি আপনাকে
শব্দ আর অলঙ্কারে খুঁজে খুঁজে জীবনের মিল
দেখিছি সমস্ত সাধ অন্য এক বুকে সুপ্ত থাকে।
আশা করি এতক্ষণে এঁকেছি আমার পটভূমি।
যদি অনুমতি হয় আজ থেকে শুরু হোক, তুমি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সকাল নয়, তবু আমার
প্রথম দেখার ছটফটানি
দুপুর নয়, তবু আমার
দুপুরবেলার প্রিয় তামাশা
ছিল না নদী, তবুও নদী
পেরিয়ে আসি তোমার কাছে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা!
শিরীষ গাছে রোদ লেগেছে
শিরীষ কোথায়, মরুভূমি!
বিকেল নয়, তবু আমার
বিকেলবেলর ক্ষুৎপিপাসা
চিঠির খামে গন্ধ বকুল
তৃষ্ণা ছোটে বিদেশ পানে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | স্বদেশমূলক | যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভুমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… । |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | শেষ কবে নারীহত্যা করেছি আমার ব্যক্তিগত স্বর্গে? বাথরুমে- ছ’মাস আগে, সেই থেকে চোখে ভালো দেখতে পাই না। সাতদিন পর্যন্ত আয়নায় হাসির প্রমাণ লেগেছিল- এছাড়া চোষের জল জমিয়ে রেখেছিলাম বেসিনে। সেই ঠান্ডা চোখের জলে রোজ মুখ ধুতাম ও কুলকুচোঁ করেছি জানালা দিয়ে। প্রতিবেশী এসে বিরাট আপত্তি জানালোঃ এতদিন পেচ্ছাপ করা সহ্য করেছি, তা বলে কি কুলকুচো করাও। তার ছোটো বাড়ির রঙ শাদা ছিল।
পুলিস এসে বলেছিলো, এই নিয়ে সাতটা খুনের জন্য তুমি মোট তেরোটা ছুরি ভেঙেছো। ইস্পাতের এ-রকম অনটনের দিনে তোমার অমন বিলাসিতা। এরপর থেকে তোমার ঐ খামখেয়ালরি জন্য যত খুশী সিল্কের রুমাল বা ধুত্রোফল ব্যবহার করবে। কিন’ ইস্পাতের অপচয়ের মতো বে-আইনী। দু’বছর অন্তত ঘানি ঘোরাতে।- আমার ঘড়ি ছিল না বলে ক’টা বাজে দেখবার জন্য আমি মণিবন্ধটা কানের কাছে। রক্ত চলাচলের স্পষ্ট শব্দ ও সময়।
টেলিফোন মিস্ত্রী অভিযোগ জানালো, আমার ঘরে রেডিও নেই কেন। সরমা অনুযোগ করেছিল, আমার ঘরে কোনও ছবি নেই। আমি ওকে টেবিলের সম্পূর্ণ খালি সতেরোটা ড্রয়ার দেখিয়েছিলাম। ও দূরের জ্বলন্ত জিরাফ একেবারে লক্ষ্য করেনি। সেই পাপেই ওর মৃত্যু হলো। দাঁতের ডাক্তার আমার পায়ে ঘা কর দিয়েছিলো বলে আমি কখনও আর সে শুয়োরের বাচ্চা জীবানু সমন্বয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাইনি। তার বদলে আমি এখন পেচ্ছাপ ও কান্নার সম্পর্ক নিয়ে বই লিখছি। এখন রাত্রি কি দিন চেনা যায় না। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | একটুখানি ভুল পথ, অনায়াসে ফিরে যাওয়া যেত
আকাশে বিদ্যুৎদীপ্ত, বুক কাঁপানো হাতছানি
এই কামরাঙা গাছ, নীল-রঙা ফুল, সবই ভুল
হে কিশোর, তবু তা-ই হলো এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি…...
কিছুটা জয়ের নেশা, কিছুটা ভয়ের জন্য দ্রুত ছদ্মবেশ
মৃত চিঠি পড়ে থাকে কালভার্টে নর্দমার জলে
স্বপ্নে কত এক ছিলে, স্বপ্ন ভেঙে মূর্খের মিছিলে
হে কিশোর, সেই অসময় নিয়ে খেলা হলো প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি……...
নদীর নরীরা সব ফিরে গেছে, পড়ে আছে নদী
অথবা নারীরা আছে, নদী খুন হয়ে গেছে কবে
যা-কিচু চোখের সামনে, বাদবাকি আঁধার বিস্মৃতি
প্রত্যক্ষের সিংহদ্বার, হে যৌবন হলো এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি…...
যে-দুঃখ বোঝে না কেউ তার অশ্রু মরকতমণি
শেষ বিকেলের মৃদু-আলো-মাখা-ঘাসে পড়ে আছে
নির্বাসন ছিল বড় মধুময়, মন গড়া দ্বীপে
প্রেম নয়, হে যৌবন, প্রতিচ্ছবি হলে এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি…... |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | মানবতাবাদী | বাঁচতে হবে বাঁচার মতন, বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক
আমি কিছুই ছাড়বো না, এই রোদ ও বৃষ্টি
আমাকে দাও ক্ষুধার অন্ন
শুধু যা নয় নিছক অন্ন
আমার চাই সব লাবণ্য
নইলে গোটা দুনিয়া খাবো!
আমাকে কেউ গ্রামে গঞ্জে ভিখারী করে
পালিয়ে যাবে?
আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো কলে
কামারশালায়?
আমি কিছুই ছাড়বো না আর, এখন আমার
অন্য খেলা
পদ্মপাতায় ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে
গোটা জীবন
মানুষ সেজে আসা হলো,
মানুষ হয়েই ফিরে যাবো
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন,বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক!
ফ্রয়েড ও মার্ক্স নামে দুই দাড়িওয়ালা
বলে গেল, মানুষেরও রয়েছে সীমানা
এঁচোড়ে পাকার মত এর পর অনেকেই চড়িয়েছে গলা
নৃমুন্ড শিকারী দেয় মনোলোকে হানা।
সকলেই সব জানে, এত জ্ঞানপাপী
বলেছে মুক্তর রং শাদা নয় খাকি
তবু যারা সিংহাসন নেয় তারা কথার খেলাপি
আবং আমার ভাই, মা-বোন নিখাকী।
ছিঁড়েছে সম্রাজ্য ঢের, নতুন বসতি
পুরোনো হবার আগে দু‘বার উল্টায়
দিকে দিকে গণভোটে রটে যায় বেশ্যারাও সতী
রং পলেস্তারা পড়ে দেয়ালের চলটায়।
এরকম চলে আসে, তবু নিরালায়
ছোট এক কবি বলে যাবে সিধে কথা
সূর্যাস্তের অগ্নিপ্রভা লেগে আছে আকাশের গায়
জীবনই জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | সেই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া
পড়ে আছে মিহিন কাচের মতো জ্যোৎস্না
শুকনো পাতার শব্দ এমন নিঃসঙ্গ
সেইসব পাতা ভেঙে
ভেঙে ভেঙে ভেঙে ভেঙে চলে যেতে
যেতে যেতে যেতে যেতে
বাতাসের স্পর্শ যেন কার যেন কার যেন কার যেন কার?
মনেও পড়ে না ঠিক যেন কার অঙ্গুলি
এই মুখে, রুক্ষ মুখে, আমার চিবুকে, এই কর্কম চিবুকে
ঠোঁটে, ঠোঁটের ওপরে, এবং ঠোঁটের নিচে
চোখের দু’পাশে যে কালো দাগ সেখানেও
যেন কার, যেন কার কোমল অঙ্গুলি?
কপালে হিঙ্গুল টিপ, নীলরঙা হাসি
পেছনে তাকাই আর দেখা যায় না
জ্যোৎস্না নেই, বোবা কালা অন্ধকার
শুকনো পাতার শব্দ…
সেই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া, ফিরে যেতে যেতে যেতে! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | কোন্ দিকে? কোন্ দিকে? আমি চিৎকার করলাম
অমনি ভিড়ের ভিতরে
একটা মোহর এসে ছিট্কে পড়লো। তৎক্ষণাৎ নৈঋত বাদ দিয়ে
সাতদিকে সাতটা রাস্তা খুলে গেল জ্যোৎস্নায়
বড় চিত্তহারী সেই পথগুলি এবং জ্যোৎস্নায়
ভিড়ের প্রতিটি টুকরো শত শত হুইস্ল বাজিলে ছুটে গেল
ব্যক্তিগত পথে পথে। কোন্ দিকে? কোন্ দিকে?
আমি তীব্র ধাবমান
কয়েকটি কলার চেপে হেঁকে উঠি, কী-করে জানলেন এইটা ঠিক
পথ? নাকি যে-কোন রাস্তায়?
তাদের উত্তরঃ পথ ও রাস্তার মধ্যে বহু ভেদ আছে, ইডিয়ট!
পথ কিংবা রাস্তা আমি কোন্টায় নামবো বহু ভেবে শেষটায়
পথেই নামলুম। কেননা ‘পথিক’ এই সুদূর শব্দটি
বড়ই রোমাঞ্চকর। তার বদলে ‘রাস্তার লোকটা’?
পরমুহূর্তেই হায়, কয়েকশত প্রেমিক ও
কবিদের স’তি, উপমার
ভয়ংকর নেকড়েগুলি ছিঁড়ে চুষে খেয়ে ফেললো
আমার শরীর রক্ত দু’চোখের মণি।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | প্রতীকের মুরুভূমি পায় না কখনো মরূদ্যান
যেমন নরীর নেই আঙুলের ব্যথা কবিতায়
আমার সমুদ্র নেই বিছানা, শিয়রের কাছে
শান্ত মেঘ
কবিতায় আছে।
বিংশ শতাব্দরি ঠিক মাঝামাঝি ভেঙেছিল ঘুম
গ্রাম্য সোঁদা গন্ধ-মাখা ক্ষ্যাপাটে কৈশোর
কেটেছে বাসনা-ক্ষুব্ধ মুখ চোরা দিন, প্রতিদিন
অথচ অক্ষরে, শব্দে, ছন্দ-মিলে তীব্র প্রতিশোধ
না-পাওয়া নারীর রূপে অবগাহনের উম্মত্ততা
প্রতীক জীবন, নেই মরূদ্যান, জ্যোৎস্নার সমুদ্র, নেই
শিয়রের কাছে শান্ত মেঘ-
কবিতায় আছে। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | ফুটে উঠলো একটি দুটি টগর
কন্ঠে মুক্তো- মালা
মরি মরি
তোমরা আজ সকালবেলার প্রসণ্নতা
এক মুহূর্তে শিশির ভেজা আলো
নর্মছলে তোমরা অন্সীরী।
‘কী সুন্দর ঐ টগর ফুল দুটো-
খোঁপায় গুঁজবো আমি!’
প্রাক-যুবতী বারান্দার প্রান্তে এসে আঁখি তুললো-
সদ্য ভোর, বিরল হওয়া, ঠান্ডা রোদ
সাংকেতিক পাখির ডাক, উপত্যকায় নির্জনতা
আমি বেতের ইজিচেয়ারে অলস।
ফুলের থেকে চোখ ফিরিয়ে নারীর দিকে
চোখই জানে চোখের মায়া দৃষ্টি জানে সৃষ্টির পূর্ণতা
একটি চাবি যেমন বহু বন্দী মুক্তি,
চাবির মতন
একপলকের চেয়ে দেখা
কললো আমায়ঃ
নারী যতই রূপসী হোক, এই মুহূর্তে মুকুটহীনা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে, বারান্দা থেকে নেমে
টগর গছের পাশে দাঁড়িয়ে
আমি হাত বড়িয়েছি
হাত থেমে রইলো শূন্যে
পৃথিবী কাঁপে না, তবু কখনো কখনো মানুষের
ভূমিকম্পন হয়
এত বাতাস, তবু দীর্ঘশ্বাস নিতে ইচ্ছা হয় না
ভূবনময় এই মোহিনী আলোর মধ্যে দুলে ওঠে বিষণ্নতা
হাত থেমে রইলো শূন্যে
টগর গাছের পাশে হলুদ সাপ
চোখে চোখ, হিম সম্ভাষণ
কী তথ্য এনেছো তুমি, প্রহরী?
হলুদ সাপ সকালের মূর্তিমতী স্তব্ধতাকে ভেঙে
সেই ভাঙা গলায়
বলে উঠলো;
ঘূর্ণী জলের পাশে একদিন দেখে নিও
মুকের ছায়ায় রোদ্র-ভ্রমরীর খেলা! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে
পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে
জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ
দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো
ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা
আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়।
প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের
শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো
গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে
উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও
হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার
বাড়ির সামনে, নীরা থুক্ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে
বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে
এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের
উৎস। আমি
ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন
আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।
কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার
আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় :
নীরা, তোমায় একটি রঙিন
সাবান উপহার
দিয়েছি শেষবার;
আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে।
বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে
আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে
ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন
অমর না হয়…
অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে
চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে
ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার
মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা
নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট
শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়!
এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন
বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন
আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি
জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের
সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর
পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ
সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি
দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার
নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে
১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে
উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে,
সোনার রজ্জুতে
বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা
পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে
এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য,
সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার
প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে?
কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু
ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি :
ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ
তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ
অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত
পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে
তবু ভালো, শোনার মতন কেউ নেই
সকলেই ঘোর অমাবস্যা দেখতে গিয়েছে সমুদ্রে
মনীশেরও পোশাকের মধ্যে আছে অতিশয় শশব্যন্ত অ-মনীশ
তার বন্ধু অ-সিদ্ধার্থ, অ-লাবণ্য এরাও গিয়েছে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে-
অ-ভালোবাসায় মগ্ন ওরা সব,
সকলেই এক হয়ে আছে
ও ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখে বাকিটুকু চুনকাম হয়
ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে সর্বস্ব নতুন
অ-ব্যবহৃত ক্রেন অ-মানুষ হয়ে উঁকি মারে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরন ভেঙে?-
মনীশ, মনীশ এসো, টেলিফোন, দূর থেকে কেউ…
অ-মনীশ ছুটে এলো,
কার জন্য? আমার নয়!
অ-লেখা চিঠিও ফিরে যায়, যে-রকম অ-দেখা স্বপ্নের বর্ণচ্ছট
ও আমার নয়, এই অ-সময় কেউ ডকবে না
বস’ত ঘুমই হয়নি কয়েক রাত, অতি দ্রুত চলছে মেরামত
কালই একটা কিছু হবে। সকালেই তৈরি থাকো,
তৈরি হও, কাল
আগামী কালের জন্য অপেক্ষায় আছে এই
জীবনের অ-বিপুল অ-পূর্ণতা
অ-মনীশ গেছে তার অ-বন্ধু ও অ-বান্ধবী
সকলের কাছে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে?
ও আমার নয় এই অ-সময়ে কেউ ডাকবে না।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
বাড়িতে আসবেন!’রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়।বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত
হলুদ আলোর রাস্তা চলে গেছে অতিকায় সুবর্ণ শহরে
কেউ আসে কেউ যায়, কারো আঙুল থেকে ঝরে পড়ে মধু
কেউ দাঁতে পিচ কাটে, সুবর্ণষ্ঠীবীর স্মৃতি লোভ ক’রে
কেউ বা ছুঁয়েছে খুব লঘু যত্নে, সুখী বারবনিতার
তম্বুরাযুগল হেন পাছা
কারো চুলে রত্নচ্ছটা, কারো কণ্ঠে কাঁচা-গন্ধ বাঘনখ দোলে
আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত।
কোথায় সুবর্ণ সেই নগরীটি? কোন্ রাস্তা হলুদ আলোয় আলোকিত?
কে দাঁড়িয়েছিলাম সেই পথপ্রান্তে? আমি নয়, কোনোদিন দেখিনি সে পথ
আঙুল কী করে ঝরে মধু? কেন কেউ কন্ঠে রাখে কাঁচা বাঘনখ?
কিচুই জানি না আমি, এমনকি সুবর্ণষ্ঠীবীর ঠিক বানানেও রয়েছে সন্দেহ
তবু কেন কবিতা লেখার আগে এই দৃশ্য, অবিকল, সম্পূর্ণ অটুট
স্বপ্ন, কিংবা তার চেয়ে বেশী সত্য হয়ে ওঠে, আমার চৈতন্য বেঁধে সুঁচ
প্রায় কোনো কাটাকাটি না-করেই অফিস- টেবিলে বসে আমি
ঐ দৃশ্য লিখে যাই।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | ভক্তিমূলক | তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে
হাত ছুঁয়ে বলে বন্ধু
তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে
মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়
হাসি বিনিময় করে চলে যায়
উত্তরে দক্ষিণে
তুমি যেই এসে দাঁড়ালে-
কেউ চিনলো না কেউ দেখলে না
সবাই সবার অচেনা! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | শব্দ মোহ বন্ধনে কবে প্রথম ধরা পড়েছিলুম আজ মনে নেই
কোনো এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জলস্রোতের পাশে
অকস্মাৎ দেখা যেন ঠিক আর এক স্রোত
সমস্ত ধ্বনির পাশাপাশি অন্য এক ধ্বনি
জীবন যাপনের পাশাপাশি এক অদেখা জীবন যাপন…
এক একদিন মনে হয়, প্রত্যেক পথেরই বুকের মধ্যে রয়েছে
দিক-হারাবার ব্যাকুলতা
চেনা বাড়ির রাস্তা দুঃখে কাতরায় নিরুদ্দেশের জন্য
প্রত্যেক স্বপ্নের ভিতরে আর একটি স্বপ্ন, তার ভিতরে, তারভিতরে, তার ভিতরে…নৌকোর গলুইতে পা ঝুলিয়ে বসার মতন প্রিয়
বালাকাল ছেড়ে একদিন এসেছি কৈশোরে
বাবার হাত শক্ত করে চেয়ে ধরে নিজের চোখের চেয়েও
অনেক বড় চোখ মেলে
পা দিয়েছিলাম এই শহরের বাঁধানো রাস্তায়
ছোট ছোট স্টিমারের মতো ট্রাম, মুখ-না-চেনা এত মানুষ
আর এত সাইনবোর্ড, এত হরফ, দেয়ালের এত পোশাক, ভোরের
কুয়াশার মধ্যেও যেন সব কিছুর জ্যোতি ঠিকরে আসে
আমার চোখে
ঘোড়াগাড়ির জানলা দিয়ে দেখা মুহুর্মুহু ব্যাকুল উন্মোচন
কেউ জানে না আমি এসেছি, তবু চতুর্দিকে এত সমারোহ
মায়ের গা ঘেঁষে বসা উষ্ণ আসনটি থেকে যেন আমি ছিটকে
পড়ে যাবো বাইরে, বাবা হাত বাড়িয়ে দিলেন
বাঁক ঘোরবার মুখেই হঠাৎ কে চেঁচিয়ে উঠলো, গুলাবি রেউড়ি, গুলাবি রেউড়ি
কেউ বললো, পাথরে নাম লেখাবেন, কেউ বললো, জয় হোক
তার সঙ্গে মিশে গেল হ্রেষা ও লৌহ শব্দ
সদ্য কাটা রক্তাক্ত মাংসের মতন টাটকা স্মৃতির সেই বয়েস…তারপর
একদিন আমি নিজেই ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বাবার হাত
বাবা আমাকে ধরতে এসেছেন,
আমি আড়ালে লুকিয়েছি
বাবা আমাকে রাস্তা চেনাতে গেলে
আমি ইচ্ছে করে গেছি ভুল রাস্তায়
তাঁর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে আমার ভয় ভাঙা
তাঁর বাৎসল্যকে ঠকিয়েছে আমার সব অজানা অঙ্কুর
তিনি বারবার আমায় কঠিন শাস্তি দিলে আমি তাঁকে
শাস্তি দিয়েছি কঠিনতর
আমি অনেক দূরে সরে গেছি…প্রথম প্রথম এই শহর আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল তার
শিহরন জাগানো গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
ছেলেভোলানো দৃশ্যের মতন আমি দেখেছিলাম রঙিন ময়দান
গঙ্গার ধারের বিখ্যাত সূর্যাস্তে দারুণ জমকালো সব
সারবন্দী জাহাজ
ইডেন বাগানে প্যাগোডার চূড়ায় ক্যালেণ্ডারে ছবির মতন রোদ
পরেশনাথ মন্দিরের দিঘিতে নিরামিষ মাছেদের খেলা
বাসের জানলায় কাঠের হাত, দোকানের কাচে সাজানো
কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের বই
প্রভাত ফেরীর সরল গান, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে বাঁদরদের সঙ্গে পিকনিক
দুমাসে একবার মামাবাড়িতে বেড়াতে যাবার উৎসব…
ক্রমশ আমি নিজেই খুঁজে বার করি গোপন সব
ছোট ছোট নরক
কলাবাগান, গোয়াবাগান, পঞ্চাননতলা, রাজাবাজার
চিৎপুরের সুড়ঙ্গ, চীনে পাড়ার গোলোকধাম, সোনাগাছি, ওয়াটগঞ্জ, মেটেবুরুজ
একটু বেশি রাতে দেখা অজস্র ফুটপাথের সংসার
হাওড়া ব্রীজের ওপর দাঁড়ানো বলিষ্ঠ উলঙ্গ পাগলের
প্রাণখোলা বুককাঁপানো হাসি
চীনাবাদাম-ভাঙা গড়ের মাঠের গল্পের শেষে হঠাৎ কোনো
হিজড়ের অনুনয় করা কর্কশ কণ্ঠস্বর
আমায় তাড়া করে ফেরে বহুদিন
দশকর্ম ভাণ্ডারের পাশেগাড়িবারান্দার নীচে তিনটে কুকুর ছানার সঙ্গে
লাফালাফি করে একটি শিশু
কুকুরগুলোর চেয়ে শিশুটিই আগে দৌড়ে যায় ঝড়ের মতন লরির তলায়
সে তো যাবেই, যাবার জন্যই সে এসেছিল, আশ্চর্য কিছু না
কিন্তু পরের বছর তার মা অবিকল সেই শিশুটিকেই আবার
স্তন্য দেয় সেখানে
এইসব দেখে, শুনে, দৌড়িয়ে, জিরিয়ে।
আমার কণ্ঠস্বর ভাঙে, হাফ প্যান্টের নীচে বেরিয়ে থাকে
এক জোড়া বিসদৃশ ঠ্যাঙ
গান্ধী হত্যার বিকট টেলিগ্রাম যখন কাঁপিয়ে দেয় পাড়া
তখন আমি বাটখারা নিয়ে পাশের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে
ছিপি খেলছিলাম…ভেবেছিলাম আসবো, দেখবো, বেড়াবো, ফিরে যাবো, আবার আসবো
ভেবেছিলাম দূরত্বের অপরিচয় ঘুচবে না কখনো
ভেবেছিলাম এই বিশাল মহান, গম্ভীর সুদূর শহর
গা ছমছমে অচেনা হয়েই থাকবে
জেলেরা যেমন সমুদ্রকে, শেরপারা যেমন পাহাড়কে, তেমন ভারে
এই শহরকে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে চাইনি
এক সময় দুপুর ছিল দিকহীন চিলের ছায়ার সঙ্গে ছুটে যাওয়া
শৈশব মেশানো আলপথ, পুকুরের ধারে ঝুঁকে থাকা খেজুর গাছ
এক সময় ভোর ছিল শিউলির গন্ধ মাখা, চোখে স্থলপদ্মের স্নেহ
এক সময় বিকেল ছিল গাব গাছে লাল পিপড়ের কামড়
অথবা মন্দিরের দূরাগত টুংটাং
অথবা পাটক্ষেতে কচি অসভ্যতা
এক সময় সকাল ছিল নদীর ধারে স্কুল-নৌকোর প্রতীক্ষায়
বসে থাকা
অথবা জারুল বাগানে হঠাৎ ভয় দেখানো গোসাপের হাঁ
এক সময় সন্ধ্যা ছিল বাঁশ ঝাড়ে শাকচুন্নীদের
নাকিসুর শুনে আপ্রাণ দৌড়
অথবা বঞ্চিত রাজপুত্রদের কাহিনী
জামরুল গাছের নীচে
চিকন বৃষ্টিতে ভেজা
এক সময় রাত্রি ছিল প্রগাঢ় অকৃত্রিম নিস্তব্ধতা
মৃত্যুর কাছাকাছি ঘুম, অথবা প্রশান্ত মহাসমুদ্রে
আস্তে আস্তে ড়ুবে যাওয়া এক জাহাজ
গন্ধলেবুর বাগানে শিশিরপাতেরও কোনো শব্দ নেই
কোনো শব্দ নেই দিঘির জলে একা একা চাঁদের
অবিশ্রান্ত লুটোপুটির
চরাচর জুড়ে এক শান্ত ছবি, গ্রাম বাংলায়
মেয়েলি আমেজ মাখা সুখ
তার মধ্যে একদিন সব নৈঃশব্দ খান খান করে ভেঙে
সমস্ত সুখের নিলাম করা সুরে
জেগে উঠতো নিশির ডাক :
সস্তা না মূল? সস্তা না মূল…কৈশোর ভেঙেছে তার একমাত্র গোপন কার্নিস
কৈশোরই ভেঙেছে
ভেঙে গেছে যত ঢেউ ছিল দূর আকাশগঙ্গায়
শত টুকরো হয়ে গেছে সোনালী পীরিচ
সে ভেঙেছে, সে নিজে ভেঙেছে
পাথরকুচির আঠা দুই চোখে লেগেছিল তার
রক্ত ঝরে পড়েছিল হাতে
তবুও সমস্ত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে এসে
পা সেঁকে নিয়েছে গাঢ় আগুনের আঁচে
কৈশোর ভেঙেছে সব ফেরার নিয়ম
যেরকম জলস্তম্ভ ভাঙে
কৈশোর ভেঙেছে তার নীল মখমলে ঢাকা অতিপ্রিয় পুতুলের দেশ
সে ভেঙেছে অনুপম তাঁত
চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন প্রতিষ্ঠান, চুন, সুরকি, ধুলো
মৃত পাখিদের কলকণ্ঠস্বর উড়ে গেছে হাওয়ার ঝাপটে
যেখানে বরফ ছিল সেখানেই জলছে মশাল
যেখানে কুহক ছিল সেখানে কান্নার শুকনো দাগ
এখনো স্নেহের পাশে লেগে আছে ক্ষীণ অভিমান
আয়নায় যাকে দেখা, তাকেই সে ভেঙেছিল বেশি
কৈশোর ভেঙেছে সব, কৈশোরই ভেঙেছে
যখন সবাই তাকে সমস্বরে বলে উঠেছিল, মা নিষাদ
সেইক্ষণে সে ভেঙেছে, তার নিজ হাতে গড়া ঈশ্বরের মুখ
আমরা যারা এই শহরে হুড়মুড় করে বেড়ে উঠেছি
আমরা যারা ইট চাপা হলুদ ঘাসের মতন একদিন ইট ঠেলে
মাথা তুলেছি আকাশের দিকে
আমরা যারা চৌকোকে করেছি গোল আর গোলকে করেছি জলের মতন
সমতল
আমরা যারা রোদ্দুর মিশিয়েছি জ্যোৎস্নায় আর
নদীর কাছে বসে থেকেছি গাঢ় তমসায়
আমরা যারা চালের বদলে খেয়েছি কাঁকর, চিনির বদলে কাচ
আর তেলের বদলে শিয়ালকাঁটা
আমরা যারা রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা
মৃতদেহগুলিকে দেখেছি
আস্তে আস্তে উঠে বসতে
আমরা যারা লাঠি, টিয়ার গ্যাস ও গুলির মাঝখান দিয়ে
ছুটে গেছি এঁকেবেঁকে
আমরা যারা হৃদয়ে ও জঠরে জ্বালিয়েছি আগুন
সেই আমরাই এক একদিন ইতিহাস বিস্মৃত সন্ধ্যায়
আচমকা হুল্লোড়ে বলে উঠেছি, আঃ,
বেঁচে থাকা কি সুন্দর!
আমরা ধুসরকে বলেছি রক্তিম হতে, হেমন্তের আকাশে
এনেছি বিদ্যুৎ
আমরা ঠনঠননের রাস্তায় হাঁটুসমান জল ভেঙে ভেঙে
পৌঁছে গেছি স্বর্গের দরজায়
আমরা নাচের তাণ্ডব তুলে ভাঙিয়ে ডেকে তুলেছি মধ্যরাত্রিকে
আমরা নিঃসঙ্গ কুষ্ঠরোগীকে, পথভ্রান্ত জন্মান্ধকে, হাড়কাটার
বাতিল বেশ্যাকে বলেছি, বেঁচে থাকো
বেঁচে থাকো
হে ধর্মঘটী, হে অনশনী, হে চণ্ডাল, হে কবরখানার ফুলচোর
বেঁচে থাকো
হে সন্তানহীনা ধাইমা, তুমিও বেঁচে থাকো, হে ব্যর্থ কবি, তুমিও
বাঁচো, বাঁচো, হে আতুর, হে বিরহী, হে আগুনে পোড়া সর্বস্বান্ত, বাঁচো
বাঁচো জেলখানায় তোমরা সবাই বাঁচো হাসপাতালে তোমরা
বাঁচো, বাঁচো, বেঁচে থাকো, উড়তে থাক নিশান, জ্বলুক বাতিস্তম্ভ
হাড় পাঁজরায় লেপটে থাক শেষ মুহূর্ত ভূমিকম্প
অথবা বজ্রপাতের মতন আমরা তুলেছি বেঁচে থাকার তুমুল হুঙ্কার
ধ্বংসের নেশায়, ধ্বংসকে ভালোবেসে আমরা চেয়েছি জন্মজয়ের প্রবল।
উখান।যারা অপমান দিয়ে চকিতে মিলিয়ে গেছে পথের বাঁকে, তারা।
হয়তো ভুলে গেছে, আমি ভুলিনি
স্মৃতির মধ্যে ঢুকেছিল বীজ, একদিন তা মহীরুহ হয়েছে
সমস্ত গভীরতার চেয়ে গভীর পাতালতম প্রদেশে তার শিকড়
সমস্ত উচ্চতার চেয়ে উঁচুতে অভ্রংলিহ তার শিখর
তার হিরণ্য ডালপালায় বসেছে এক পাখি যার হীরে কুচি চোখ
বহুদিনের অতীত ভেদ করে সে বলেছে, প্রতীক্ষায় আছি
আমার সারা শরীরে ঝাঁকুনি লাগে, কার জন্য প্রতীক্ষা?
কিসের জন্য প্রতীক্ষা?
আমি বিহ্বল হয়ে আকাশের দিকে তাকাই, আকাশকে মনে হয়
বারুদখানা
আমি বৃষ্টির মধ্যে সরু হয়ে হেঁটে যাই, বৃষ্টিকে মনে হয়
তেজস্ক্রিয়
আমি জানলার গরাদের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার প্রাণ-প্রতিমাকে
প্রশ্ন করি, জানো, কার জন্য প্রতীক্ষা?
কিসের প্রতীক্ষা?
এ তো প্রতিশোধ নয়, প্রতিশোধের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক মনোরাজ্য
যার কামারশালায় বিচ্ছুরিত শব্দের ফুলকি সর্বক্ষণ
ঘিরে রাখে আমার
একলা সময়
আসলে আমার একাকিত্ব নেই, আমার নির্জনতা নেই, মুক্তি নেই
এক একদিন এই শহর স্তব্ধ হয়ে যায়
এক একদিন এই চোখে দেখা জগতে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়
সমস্ত জনপ্রাণী
সেই মাতৃগর্ভের মতন নিবাত নিষ্কম্প অস্তিত্বের মধ্যেও
জেগে থাকে আদিম শব্দ
সমস্ত জাগরণের পাশে সেই এক মহা জাগরণ
সমস্ত ধ্বনির চেয়ে সেই এক আলাদা ধ্বনি
তখন সমস্ত অন্ধকারের পাশে এসে দাঁড়ায়।
এক অন্য অন্ধকার
স্পষ্ট চেনা যায় এক একবার, আবার চেনা যায় না
গভীর অতলের মধ্যে ড়ুবে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকড়ে ধরি
ভাসমান তৃণ
এই নিমজ্জন ও ভেসে ওঠা, বারবার, যেন শরীরের মধ্যেই
শরীরকে খোঁজাখুঁজি
যেমন নারীর ভিতরে নারীকে, তার ভিতরে এক অন্য নারী, যেমন
স্তন ও কোমরের খাঁজে অন্য এক
রূপের চোখ ফাটানো বিভা,
তার ভিতরে অন্য এক, তার
ভিতরে, তার ভিতরে,
যেমন স্বপ্নের মধ্যে
স্বপ্ন…এমনকি যেখানে সুন্দর অতি প্রথাসিদ্ধ, অরণ্যে বা পাহাড় চূড়ায়
যেখানে মেঘ ও রৌদ্রের খেলায় মেতে থাকে মেঘ ও রৌদ্রের প্রভুরা
সেখানে সমস্ত আলোর পাশে উড়তে থাকে আরও একটি আলোর পর্দা
সমস্ত বৃক্ষের মাথা ছাড়িয়ে উঠে আসে আর একটি বৃক্ষ, তার
হিরণ্য ডালপালা নিয়ে
সেখানে বসে থাকে একটি পাখি, যার হীরে কুচি চোখ
অচেনাতম কণ্ঠস্বরে সে বলে ওঠে, মনে আছে? প্রতীক্ষায় আছি!
তখনই শৃঙ্খলের মতন ঝনঝনিয়ে ওঠে নাদব্রহ্ম, তখনই
ছ’ নম্বরের দিকে ব্যাকুলভাবে চায় পাঁচটি ইন্দ্রিয়
কার প্রতীক্ষা? কিসের জন্য প্রতীক্ষা? উত্তর পাই না
যদিও জানি, এই নীলিমার পরপারে নেই আর অন্য নীলিমা
মৃত্যুর ওপারে জীবন!ছায়ার ভিতর থেকে বের হয়ে আসে ছায়া, সমান দূরত্ব রেখে
যমজের মতো ছুটে যায়
অথবা হ্রদের পাশে খুব শান্তভাবে বসে থাকা, যেন দু’রকম জলের কিনারে
দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়,দেখা হলো, দেখা হলো
রোদ্দুরের মধ্যে ওড়ে কার্পাস তুলোর বীজ,
এত মায়া, এত বেশি মায়া
সব কিছু এক জীবনের নর্ম সহচর, দেখা হলো, আরক্ত সন্ধ্যায়
দেখা হলো
দেখা হলো নারী ও নৈরাজ্য, কয়েক ফোঁটা ছন্নছাড়া কান্না বিন্দু
পড়ে রইলো ঘাসে
এদিকে ওদিকে জাগে আকস্মিক হাতছানি, যে-কোনো নদীর বাঁকে
চোখের ইশারা
দেখা হলো, পাথরের বুকে ঘুম, নদীর দর্পণে লুপ্ত সভ্যতার সঙ্গে
দেখা হলো
জননী-চুম্বক ছেড়ে আরও দূরে দেখা হলো নিভৃত শিল্পের বড়
মর্মভেদী টান
দেখা হলো, দেখা হলো, দেখা… |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | জুলপি দুটো দেখতে দেখতে শাদা হয়ে গেল!
আমাকে তরুণ কবি বলে কেউ ভুলেও ভববে না
পরবর্তী অগণন তরুণেরা এসেছে সুন্দর ক্রুদ্ধ মুখে
তাদের পৃথিবী তারা নিজস্ব নিয়মে নিয় নিক!
আমি আর কফি হাউস থেকে হেঁটে হেঁটে হেঁটে
নিরুদ্দিষ্ট কখনো হবে না
আমি আর ধোঁয়া দিয়ে করবো না ক্ষিদের আচমন্!
আমি আর পকেটে কবিতা নিয়ে ভেরবেলা
বন্ধবান্ধবের বাড় যাবো না কখনো
হসন্তকে এক মাত্রা ধরা হবে কিনা এর তর্কে আর
ফাটাবো না চায়ের টেবিল
আর কি কখনো আমি সুনীলকে মিল দেব
কণ্ডেন্সড্ মিল্কে?
এখন ক্রমশ আমি চলে যাবো তুমি’-র জগৎ ছেড়ে
আপনি’-র জগতে
কিছু প্রতিরোধ করে, হার মেনে, লিখে দেব
দুটি প্রতিরোধ করে, হার মেনে, লিখে দেব
দুটি একটি বইয়ের ভূমিকা
আকস্মাৎ উৎসব-বাড়িতে পূর্ব প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হলে
তার হৃষ্টপুষ্ট স্বামীটির সঙ্গে হবে
রাজনীতি নিয়ে আলোচনা
দিন যাবে, এরকমভাবে দিন যাবে!
অথচ একলা দিনে, কেউ নেই, শুয়ে আমি আমি আর
বুকের ওপরে প্রিয় বই
ঠিক যেন কৈশোরে পেরিয়ে আসা রক্তমাখা মরূদ্যান
খেলা করে মাথার ভিতরে
জঙ্গলের সিংহ এক ভাঙা প্রাসাদের কোণে
ল্যাজ আছড়িয়ে তোলে গম্ভীর গর্জন
নদীর প্রাঙ্গণে ওই স্নিগ্ধ ছায়ামূর্তিখানি কার?
ধড়ফড় করে উঠে বসি
কবিতার খাতা খুলে চুপে চাপে লিখে রাখি
গতকালপরশুর কিছু পাগলামি! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | স্বদেশমূলক | যাবে কি এবার বসন্তেই
আসছে শ্রাবনে
এসেছে শ্রাবণ, শোনো মেঘের গর্জন
আর দু’টো মাস
আশ্বিনের শাদা মেঘে ভরুক প্রবাস
আশ্বিনেও লেগেছিল লোভ
শীত মদালসা
ফেরার অনৈক্য ছিল গ্রীষ্মে
কেটেছে বছর
এমনকি শেষ দিনে এলো ঘূর্ণিঝড়!
যাবে কি শতাব্দী সাঙ্গ হলে?
না, না, তার আগে অস্থিরতা রোগে কম্পমান
আর দেরি নেই
প্রাক্তন স্বদেশে ফেরা এই মুহূর্তেই! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-
শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি
মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-
আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা
ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে
অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর
তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,
স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে
মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে
ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী
তুমি কথা দিয়েছিলে…..
এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু
কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা
ঊরুর শীৎকার
মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য
নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার
পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি
উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | একটাই তো কবিতা
লিখতে হবে, লিখে যাচ্ছি সারা জীবন ধরে
আকাশে একটা রক্তের দাগ, সে আমার কবিতা নয়
আমার রাগী মুহূর্ত কবিতা থেকে বহুদূরে সরে যায়
একটাই তো কবিতা লিখতে হবে
অথচ শব্দ তাকে দেখায় না সহস্রার পদ্ম
যজ্ঞ চলেছে সাড়স্বরে, কিন্তু যাজ্ঞসেনী অজ্ঞাতবাসে
একটাই কো কবিতা
কখন টলমলে শিশিরের শালুক বনে ঝড় উঠবে তার ঠিক নেই
দরজার পাশে মাঝে মাঝে কে যেন এসে দাঁড়ায় মুখ দেখায় না
ভালোবাসার পাশে শুয়ে থাকে হিংস্র একটা নেকড়ে
নদীর ভেতর থেকে উঠে আসে গরম নিশ্বাস
আকটাই তো কবিতা লিখতে হবে
আগোছাল কাগজপত্রের মধ্য থেকে উকি মারে ব্যর্থতা
অপমান জমতে জমতে পাহাড় হয়, তার ওপর উড়িয়ে দেবার কথা স্বর্গের পতাকা
শজারুর মতন কাঁটা ফুলিয়ে চলঅ-ফেরা করতে হয় মানুলের মধ্যে
রাত্রে সিগারেট ধরিয়ে মনে হয়, এ-এক ভুলমানুষের জীবন
বূল মানুষেরা কবিতা লেখে না, তারা অনেক দূরে, অনেক দূরে
যেন বজ্রকীট উল্টো হয়ে পড়ে আছে, এত অসহায়
নতুন ইতিহাসের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে সম্রাটদের কাঙালপনা
একটাই তো কবিতা, লিখে যাচ্ছি
লিখে যাবো, সারা জীবন ধরে
আবার দেখা হবে, আবার দেখা হবে, আবার দেখা হবে! |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস
দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক; আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে –
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।
দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।
এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।
বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
বাড়িতে আসবেন!’
রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়।
বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | চিন্তামূলক | সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখে না
সে খোঁজে ভ্রমর বিংবা
দিগন্তের মেঘের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
কতকাল দেখে না আকাশ
কতকাল নদী বা ঝরনায় আর
দেখে না নিজের মুখ
আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
রমনীর কাছে গিয়ে
বারবার হয়েছে কাঙাল
যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ
বহু বছরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়
অসম্ভব অভিমান খুন করে পরমা নারীকে
অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে
ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | মায়া যেন সশরীর, চুপে-চুপে
মশারির প্রান্তে এসে জ্বালছে দেশলাই
ভেতরে ঘুমন্ত আমি-
বাতাস ও নিস্তব্ধতা এখন দর্শক
রাত্রি এত স্নিগ্ধ, এত পরিপূর্ণ,
যেন নদী নয়, স্বপ্ন নয়।
স্বয়ং মায়ার হাত আমাকে আদর করে ঘুম পাড়ালো!
আবার কৌতুকে মেতে মশারিতে
জ্বালাবে আগুন
সমস্ত জানলা বন্ধ, দরোজায় চাবি
আহা কী মধুর খেলা,
সশস্ত্র সুন্দর!
আমাকে জাগাও তুমি,
আমাকে দেখতে দিও শুধু ।। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | প্রেমমূলক | এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ? |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় | রূপক | জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও
আরও কাছে যাও
ও কেন হিংসার মতো শুয়ে আছে যাখন পৃথিবী খুব
শৈশবের মতো প্রিয় হলো
জল কনা- মেশা হওয়া এখন এ আশ্বিনের প্রথম সোপানে
বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়
আরও কাছে যাও
জাগরণে হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।
মধু-বিহ্বলেরা কাল রাত্রিকে খেলার মাঠ করেছিল
ঘাসের শিশিরে তার খণ্ডচিহ্ন
ট্রেনের শব্দের মতো দিন এলে সব মুছে যায়
নিথর আলো মধ্যে
চমশা-পরা গয়লানী হাই তোলে দুধের গুমটিতে
নিথর আলোর মধ্যে
কাক শালিকের চক্ষু শান
রোদ্দুরের বেলা বাড়ে, এত স্বচ্ছ
নিজেকে দেখে না
আর খেলা নেই
ও কেন স্বপ্নের মধ্যে রয়ে যায়
শরীরে বৃষ্টির মতো মোহ
আরও কাছে যাও
জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।। |