author
stringclasses
33 values
text
stringlengths
86
1.25M
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কনভয় সুকান্ত ভট্টাচার্য হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেল যুদ্ধফেরত এক কনভয়ঃ ক্ষেপে-ওঠা পঙ্গপালের মতো রাজপথ সচকিত ক’রে আগে আগে কামান উঁচিয়ে, পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার। ইতিহাসের ছাত্র আমি, জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ইতিহাসের দিকে। সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে। সামনে ধূম-উদ্‌গীরণরত কামান, পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা– কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম, মানুষ। আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা। অনেক যুগ, অনেক অরণ্য,পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছে; ঝল্‌সানো কঠোর মুখে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কলম সুকান্ত ভট্টাচার্য কলম, তুমি কত না যুগ কত না কাল ধ’রে অক্ষরে অক্ষরে গিয়েছ শুধু ক্লান্তিহীন কাহিনী শুরু ক’রে। কলম, তুমি কাহিনী লেখো, তোমার কাহিনী কি দুঃখে জ্বলে তলোয়ারের মতন ঝিকিমিকি? কলম, তুমি শুধু বারংবার, আনত ক’রে ক্লান্ত ঘাড় গিয়েছ লিখে স্বপ্ন আর পুরনো কত কথা, সাহিত্যের দাসত্বের ক্ষুদিত বশ্যতা। ভগ্ন নিব, রুগ্ন দেহ, জলের মতো কালি, কলম, তুমি নিরপরাদ তবুও গালাগালি খেয়েছ আর সয়েছ কত লেখকদের ঘৃণা, কলম, তুমি চেষ্টা কর, দাঁড়াতে পার কি না। হে কলম! তুমি ইতিহাস গিয়েছ লিখে লিখে লিখে শুধু ছড়িয়ে দিয়েছ চতুর্দিকে। তবু ইতিহাস মূল্য দেবে না, এতটুকু কোন দেবে না তোমায়, জেনো ইতিহাস বড়ই কৃপণ; কত লাঞ্ছনা, খাটুনি গিয়েছে লেখকের হাতে ঘুমহীন চোখে অবিশ্রান্ত অজস্র রাতে। তোমার গোপন অশ্রু তাইতো ফসল ফলায় বহু সাহিত্য বহু কাব্যের বুকের তলায়। তবু দেখ বোধ নেই লেখকের কৃতজ্ঞতা, কেন চলবে এ প্রভুর খেয়ালে, লিখবে কথা? হে কলম! হে লেখনী! আর কত দিন ঘর্ষণে ঘর্ষণে হবে ক্ষীণ? আর কত মৌন-মূক, শব্দহীন দ্বিধান্বিত বুকে কালির কলঙ্ক চিহ্ন রেখে দেবে মুখে? আর কত আর কাটবে দুঃসহ দিন দুর্বার লজ্জার? এই দাসত্ব ঘুচে যাক, এ কলঙ্ক মুছে যাক আজ, কাজ কর- কাজ। মজুর দেখ নি তুমি? হে কলম, দেখ নি বেকার? বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার? কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস, প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস! দিন নেই, রাত্রি নেই, শ্রান্তিহীন, নেই কোনো ছুটি, একটু অবাধ্য হলে তখুনি ভ্রূকুটি; এমনি করেই কাটে দুর্ভাগা তোমার বারো মাস, কয়েকটি পয়সায় কেনা, হে কলম, তুমি ক্রীতদাস। তাই যত লেখ, তত পরিশ্রম এসে হয় জড়োঃ -কলম! বিদ্রোহ আজ! দল বেঁধে ধর্মঘট করো। লেখক স্তম্ভিত হোক, কেরানীরা ছেড়ে দিক হাঁফ, মহাজনী বন্ধ হোক, বন্ধ হোক মজুরের পাপ; উদ্বেগ-আকুল হোক প্রিয়া যত দূর দূর দেশে, কলম! বিদ্রোহ আজ, ধর্মঘট, হোক অবশেষে; আর কালো কালি নয়, রক্তে আজ ইতিহাস লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে এঁটে, হে কলম,                            আনো দিকে দিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কাশ্মীর সুকান্ত ভট্টাচার্য সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি, হঠাৎ জেগে উঠেছে– সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ। দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে, ডেকেছে রৌদ্রকে, ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে, পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর। কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হল প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে। গলে গলে পড়ছে বরফ– ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দনঃ শ্যামল আর সমতল মাটির স্পর্শ লেগেছে ওর মুখে, দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুলঃ আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি। কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়ঃ সূর্য-করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত। তাই আজ কাল-বৈশাখীর পতাকা উড়ছে ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়; দুলে দুলে উঠছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ বিরাট ব্যাপ্ত হিমালয়ের বুক।। ২ দম-আটকানো কুয়াশা তো আর নেই নেই আর সেই বিশ্রী তুষার-বৃষ্টি, সূর্য ছুঁয়েছে ‘ভূস্বর্গ চঞ্চল’ সহসা জেগেই চমকে উঠেছে দৃষ্টি। দুহাতে তুষার-পর্দা সরিয়ে ফেলে হঠাৎ হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে রোদকে ডেকেছে নন্দনবন পৃথিবীর বৈশাখী ঝড় দিয়েছে বরফ গুঁড়িয়ে। সুন্দর মুখ কঠোর করেছে কাশ্মীর তীক্ষ্ণ চাহনি সূর্যের উত্তাপে, গলিত বরফে জীবনের স্পন্দন শ্যামল মাটির স্পর্শে ও আজ কাঁপে। সাগর-বাতাসে উড়ছে আজ ওর চুল শাল দেবদারু পাইনের বনে ক্ষোভ, ঝড়ের পক্ষে চূড়ান্ত সম্মতি– কাশ্মীর নয়, জমাট বাঁধা বরফ। কঠোর গ্রীষ্মে সূর্যোত্তাপে জাগা– কাশ্মীর আজ চঞ্চল-স্রোত লক্ষঃ দিগ্‌দিগন্তে ছুটে ছুটে চলে দুর্বার দুঃসহ ক্রোধে ফুলে ওঠে বক্ষ। ক্ষুব্ধ হাওয়ায় উদ্দাম উঁচু কাশ্মীর কালবোশেখীর পতাকা উড়ছে নভে, দুলে দুলে ওঠে ঘুমন্ত হিমালয় বহু যুগ পরে বুঝি জাগ্রত হবে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কৃষকের গান সুকান্ত ভট্টাচার্য এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে এইবার ফলাব ফসল– আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে আজ তার নির্জন বোধন। এ মাটির গর্ভে আজ আমি দেখেছি আসন্ন জন্মেরা ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ দুর্ভিরে অন্তিম কবর। আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি? (গোপন একান্ত এক পণ) এ মাটিতে জন্ম দেব আমি অগণিত পল্টন-ফসল। ঘনায় ভাঙন দুই চোখে ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে; আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি। দুয়ারে শত্রুর হানা মুঠিতে আমার দুঃসাহস। কর্ষিত মাটির পথে পথে নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
খবর সুকান্ত ভট্টাচার্য খবর আসে! দিগ্‌দিগন্ত থেকে বিদ্যুদ্‌বাহিনী খবর; যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ঝড় —এখানে সাংবাদিকতার নৈশ নৈঃশব্দ্য। রাত গভীর হয় যন্ত্রের ঝঙ্কৃত ছন্দে- প্রকাশের ব্যগ্রতায়; তোমাদের জীবনে যখন নিদ্রাভিভুত মধ্যরাত্রি চোখে স্বপ্ন আর ঘরে অন্ধকার। অতল অদৃশ্য কথার সমুদ্র থেকে নিঃশব্দ শব্দেরা উঠে আসে; অভস্ত হাতে খবর সাজাই- ভাষা থেকে ভাষান্তর করতে কখনো চমকে উঠি, দেখি যুগ থেকে যুগান্তর। কখনো হাত কেঁপে ওঠে খবর দিতে ; বাইশে শ্রাবণ, বাইশে জুনে। তোমাদের ঘুমের অন্ধকার পথ বেয়ে খবর-পরীরা এখানে আসে তোমাদের আগে, তাদের পেয়ে কখনো কণ্ঠে নামে ব্যথা, কখনো বা আসে গান ; সকালে দিনের আলোয় যখন তোমাদের কাছে তারা পৌঁছোয় তখন আমাদের চোখে তাদের ডানা ঝরে গেছে। তোমরা খবর পাও, শুধু খবর রাখো না কারো বিনিদ্র চোখ আর উৎকর্ণ কানের। ঐ কম্পোজিটর কি কখনো চমকে ওঠে নিখুঁত যান্ত্রিকতার কোনো ফাঁকে? পুরনো ভাঙা চশমায় ঝাপসা মনে হয় পৃথিবী ৯ই আগস্টে কি আসাম সীমান্ত আক্রমণে? জ্বলে ওঠে কি স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধে, মহাত্মাজীর মুক্তিতে, প্যারিসের অভ্যুত্থানে? দুঃসংবাদকে মনে হয় না কি কালো অক্ষরের পরিচ্ছদে শোকযাত্রা? যে খবর প্রাণের পক্ষপাতিত্বে অভিষিক্ত আত্মপ্রকাশ করে নাকি বড় হরফের সম্মানে? এ প্রশ্ন অব্যক্ত অনুচ্চারিত থাকে ভোরবেলাকার কাগজের পরিচ্ছন্ন ভাঁজে ভাঁজে। শুদু আমরা দৈনন্দিন ইতিহাস লিখি! তবু ইতিহাস মনে রাখবে না আমাদের- কে আর মনে রাখে নবান্নের দিনে কাটা দানের গুচ্ছকে? কিন্তু মনে রেখো তোমাদের আগেই আমরা খবর পাই মদ্যরাত্রির অন্ধকারে তোমাদের তন্দ্রার অগোচরেও। তাই তোমাদের আগেই খবর-পরীরা এসেছে আমাদের চেতনার পথ বেয়ে। আমার হৃদ্‌যন্ত্রে ঘা লেগে বেজে উঠেছে কয়েকটি কথা- পৃথিবী মুক্ত- জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী। তোমাদের ঘরে আজো অন্ধকার, চোখে স্বপ্ন। কিন্তু জানি একদিন সে সকাল আসবেই যেদিন এই খবর পাবে প্রত্যেকের চোখেমুখে সকালের আলোয়, ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়। আজ তোমরা এখনো ঘুমে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চট্টগ্রামঃ ১৯৪৩ সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুদার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম– চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম! বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন। চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম! এখনো নিস্তব্ধ তুমি তাই আজো পাশবিকতার দুঃসহ মহড়া চলে, তাই আজো শত্রুরা সাহসী। জানি আমি তোমার হৃদয়ে অজস্র ঔদার্য আছে; জানি আছে সুস্থ শালীনতা জানি তুমি আঘাতে আঘাতে এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম– হে চট্টগ্রাম! তাই আজো মনে পড়ে রক্তাক্ত তোমাকে সহস্র কাজের ফাঁকে মনে পড়ে শার্দূলের ঘুম অরণ্যের স্বপ্ন চোখে, দাঁতে নখে প্রতিজ্ঞা কঠোর। হে অভুক্ত ক্ষুদিত শ্বাপদ– তোমার উদ্যত থাবা, সংঘবদ্ধ প্রতিটি নখর এখনো হয় নি নিরাপদ। দিগন্তে দিগন্তে তাই ধ্বনিত গর্জন তুমি চাও শোণিতের স্বাদ– যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ। তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস। তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম! আমার হৃৎপিণ্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চারাগাছ সুকান্ত ভট্টাচার্য ভাঙা কুঁড়ে ঘরে থাকি; পাশে এক বিরাট প্রাসাদ প্রতিদিন চোখে পড়ে; সে প্রাসাদ কী দুঃসহ স্পর্ধায় প্রত্যহ আকাশকে বন্ধুত্ব জানায়; আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখি। চেয়ে চেয়ে দেখি আর মনে মনে ভাবি- এ অট্টালিকার প্রতি ইঁটের হৃদয়ে অনেক কাহিনী আছে অত্যন্ত গোপনে, ঘামের, রক্তের আর চেখের জলের। তবু এই প্রাসাদকে প্রতিদিন হাজারে হাজারে সেলাম জানায় লোকে, চেয়ে থাকে বিমূঢ় বিস্ময়ে। আমি তাই এ প্রাসাদে এতকাল ঐশ্বর্য দেখেছি, দেখেছি উদ্ধত এক বনিয়াদী কীর্তির মহিমা। হঠাৎ সেদিন চকিত বিস্ময়ে দেখি অত্যন্ত প্রাচীন সেই প্রাসাদের কার্নিশের দারে অশ্বত্থ গাছের চারা। অমনি পৃথিবী আমার চোখের আর মনের পর্দায় আসন্ন দিনের ছবি মেলে দিল একটি পলকে। ছোট ছোট চারাগাছ- রসহীন খাদ্যহীন কার্নিশের দারে বলিষ্ঠ শিশুর মতো বেড়ে ওঠে দুরন্ত উচ্ছ্বাসে। হঠাৎ চকিতে, এ শিশুর মদ্যে আমি দেখি এক বৃদ্ধ মহীরুহ শিকড়ে শিকড়ে আনে অবাধ্য ফাটল উদ্ধত প্রাচীন সেই বনিয়াদী প্রাসাদের দেহে। ছোট ছোট চারাগাছ- নিঃশব্দে হাওয়ায় দোলে, কান পেতে শোনেঃ প্রত্যেক ইঁটের নীচে ঢাকা বহু গোপন কাহিনী রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের। তাইতো অবাক আমি দেখি যত অশ্বত্থচারায় গোপনে বিদ্রোহ জমে, জমে দেহে শক্তির বারুদ ; প্রাসাদ-বিদীর্ণ-করা বন্যা আসে শিকড়ে শিকড়ে। মনে হয়, এই সব অশ্বত্থ-শিশুর রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের দারায় দারায় জন্ম, ওরা তাই বিদ্রোহের দূত।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিল সুকান্ত ভট্টাচার্য পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখলামঃ ফুটপাতে এক মরা চিল! চমকে উঠলাম ওর করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে। অনেক উঁচু থেকে যে এই পৃথিবীটাকে দেখেছে লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ; যার শ্যেন দৃষ্টিতে কেবল ছিল তীব্র লোভ আর ছোঁ মারার দস্যু প্রবৃত্তি– তাকে দেখলাম, ফুটপাতে মুখ গুঁজে প’ড়ে। গম্বুজশিখরে বাস করত এই চিল, নিজেকে জাহির করত সুতীক্ষ্ণ চীৎকারে; হালকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিত আকাশের নীলে- অনেককে ছাড়িয়েঃ এককঃ পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে। অনেকে আজ নিরাপদ; নিরাপদ ইঁদুর ছানারা আর খাদ্য-হাতে ত্রস্ত পথচারী, নিরাপদ–কারণ আজ সে মৃত। আজ আর কেউ নেই ছোঁ মারার, ওরই ফেলে-দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো ও পড়ে রইল ফুটপাতে, শুক্‌নো-শীতল, বিকৃত দেহে। হাতে যাদের ছিল প্রাণধারণের খাদ্য বুকের কাছে সযত্নে চেপে ধরা– তারা আজ এগিয়ে গেল নির্ভয়ে; নিষ্ঠুর বিদ্রূপের মতো পিছনে ফেলে আকাশচ্যুত এক উদ্ধত চিলকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ছাড়পত্র সুকান্ত ভট্টাচার্য যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে তার মুখে খবর পেলুমঃ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। সে ভাষা বোঝে না কেউ, কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার। আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা। পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ঠিকানা সুকান্ত ভট্টাচার্য ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু– ঠিকানার সন্ধান, আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান? ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু, পথে পথে বাস করি, কখনো গাছের তলাতে কখনো পর্ণকুটির গড়ি। আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি, হাজার জনতা যেখানে, সেখানে আমি প্রতিদিন ঘুরি। বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ, তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব মজবুত ইমারত। বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না              তোমাদের দেওয়া ক্ষতে, আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু              সূর্যোদয়ের পথে। ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া,    রুশ ও চীনের কাছে, আমার ঠিকানা বহুকাল ধ’রে    জেনো গচ্ছিত আছে। আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো    সমস্ত দেশ জুড়ে? তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ    ভুল পথে ঘুরে ঘুরে। আমার হদিশ জীবনের পথে              মন্বন্তর থেকে ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে    মুক্তির পথে বেঁকে। বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই              সূর্যোদয়ের ভোরে; পথ হারিও না আলোর আশায়    তুমি একা ভুল ক’রে। বন্ধু, আজকে জানি অস্থির              রক্ত, নদীর জল, নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল। বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো              ঠিকানা অবজ্ঞাত বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত? আর কতদিন দুচক্ষু কচ্‌লাবে, জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু              সে পথে আমাকে পাবে, জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই              ধর্মতলার পরে, দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।         বন্ধু, আজকে বিদায়!                      দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,               ঠিকানা রইল,        এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ডাক সুকান্ত ভট্টাচার্য মুখে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের। গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা– হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা, শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের। দুর্ভিক্ষকে তাড়াও, ওদেরও তাড়াও– সন্ধিপত্র মাড়াও, দু’পায়ে মাড়াও। তিন-পতাকার মিনতিঃ দেবে না সাড়াও? অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের! ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা, শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা, ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা দেখ, ভিড় দেখ স্বাদীনতালুব্ধের। ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা। গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা, নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা– জাগে বিক্ষোভে চারিপাশে ক্ষুব্ধের। হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল? সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তালঃ তুমি কোন্ দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দামঃ ‘গুণ্ডা’র দলে আজো লেখাও নি নাম?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দুরাশার মৃত্যু সুকান্ত ভট্টাচার্য দ্বারে মৃত্যু, বনে বনে লেগেছে জোয়ার, পিছনে কি পথ নেই আর? আমাদের এই পলায়ন জেনেছে মরণ, অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে, প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে। দাবানল! ব্যর্থ হল শুষ্ক অশ্রুজল, বেনামী কৌশল জেনেছে যে আরণ্যক প্রাণী তাই শেষে নির্মূল বনানী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দেশলাই কাঠি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ তবু জেনো মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ– বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস; আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি। মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল? ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন– আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়! কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে, কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি। এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের? মনে নেই? এই সেদিন– আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে; চমকে উঠেছিলে– আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ। আমাদের কী অসীম শক্তি তা তো অনুভব করেছ বারংবার; তবু কেন বোঝো না, আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে , গ্রামে–দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়– তা তো তোমরা জানোই! কিন্তু তোমরা তো জানো না: কবে আমরা জ্বলে উঠব– সবাই শেষবারের মতো!
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রস্তুত সুকান্ত ভট্টাচার্য কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্বরায়, নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়। ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ; তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক, কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ আগুন ছড়ায়। অবশেষে ভুল ভেঙেছে, জোয়ার মনের কোণে, তীব্র ভ্রূকুটি হেনেছি কুটিল ফুলের বনে; আভিশাপময় যে সব আত্মা আজো অধীর, তাদের সকাশে রেখেছি প্রাণের দৃঢ় শিবির; নিজেকে মুক্ত করেছি আত্মসমর্পণে। চাঁদের স্বপ্নে ধুয়ে গেছে মন যে-সব দিনে, তাদের আজকে শত্রু বলেই নিয়েছি চিনে, হীন র্স্পধারা ধূর্তের মতো শক্তিশেলে ছিনিয়ে আমায় নিতে পারে আজো সুযোগ পেলে তাই সতর্ক হয়েছি মনকে রাখি নি ঋণে। অসংখ্য দিন কেটেছে প্রাণের বৃথা রোদনে নরম সোফায় বিপ্লবী মন উদ্ধোধনে; আজকে কিন্তু জনতা-জোয়ারে দোলে প্লাবন, নিরন্ন মনে রক্তিম পথ অনুধাবন, করছে পৃথিবী পূর্ব-পন্থা সংশোধনে। অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই, মহামরণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই; পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন, ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রার্থী সুকান্ত ভট্টাচার্য হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়              আমরা থাকি, যেমন প্রতীক্ষা ক’রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ,              ধানকাটার রেমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।               হে সূর্য, তুমি তো জানো, আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!               সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে, এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে, কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই! সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর        এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী। ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই        এক-টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।        হে সুর্য! তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে        উত্তাপ আর আলো দিও,        আর উত্তাপ দিও, রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।        হে সূর্য তুমি আমাদের উত্তাপ দিও শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড,          তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে                            পরিণত হব! তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,           তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো                       রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ফসলের ডাক ১৩৫১ সুকান্ত ভট্টাচার্য কাস্তে দাও আমার এ হাতে সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে । শক্তির উন্মুক্ত হাওয়া আমার পেশীতে স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি চেতনার বিদ্যুৎ বিকাশ : দু পায়ে অস্থির আজ বলিষ্ঠ কদম ; কাস্তে দাও আমার এ হাতে । দু চোখে আমার আজ বিচ্ছুরিত মাঠের আগুন, নি-শব্দে বিস্তীর্ণ ক্ষেতে তরঙ্গিত প্রাণের জোয়ার মৌসুমি হাওয়ায় আসে জীবনের ডাক ; শহরের চুল্লী ঘিরে পতঙ্গের কানে । বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে, মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্পদ, কাস্তে দাও আমার এ হাতে । মনে আছে একদিন তোমাদের ঘরে নবান্ন উজাড় ক’রে পাঠিয়েছি সোনার বছরে, নির্ভাবনার হাসি ছড়িয়েছি মুখে তৃপ্তির প্রগাঢ় চিহ্ন এনেছি সম্মুখে, সেদিনের অলক্ষ্য সেবার বিনিময়ে আজ শুধু কাস্তে দাও আমার এ হাতে । আমার পুরনো কাস্তে পুড়েন গেছে ক্ষুধার আগুনে, তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্যপ্রখর —— যে কাস্তে ঝল্ সাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে… জানি আমি মৃত্যু আজ ঘুরে যায় তোমাদেরও দ্বারে, দুর্ভিক্ষ ফেলেছে ছায়া তোমাদের দৈনিক ভান্ডারে ; তোমাদের বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা আমার, শুধু আজ কাস্তে দাও আমার এ হাতে । পরাস্ত অনেক চাষী ; ক্ষিপ্রগতি নিঃশব্দ মরণ—— জলন্ত মৃত্যুর হাতে দেখা গেল বুভুক্ষের আত্মসমর্পণ, তাদের ফসল প’ড়ে দৃষ্টি জ্বলে সুদূরসন্ধানী তাদের ক্ষেতের হাওয়া চুপিচুপি করে কানাকানি—— আমাকেই কাস্তে নিতে হবে | নিয়ত আমার কানে গুঞ্জরিত ক্ষুধার যন্ত্রণা, উদ্বেলিত হাওয়া আনে মাঠের সে উচ্ছ্বসিত ডাক, সুস্পষ্ট আমার কাছে জীবনের সুতীব্র সংকেত ; তাই আজ একবার কাস্তে দাও আমার এ হাতে ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিবৃতি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে, জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে, দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল, প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল। আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ; বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দু’পাশে, প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে। মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীন নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন, পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে, দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে! দুয়ারে দুয়ারে ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল, নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল; রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে, বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে। পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে, বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে, নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন, ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন। সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে দেশপ্রেমে দৃপ্তপ্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে। তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত, এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত, ভারতবর্ষের ‘পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ– দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ, রক্তে আনো লাল, রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল। উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ, আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ। আজকে মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ, কারখানায় কারখানায় তোলে ঐক্যতান। অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে। আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন, এদেশে ভাণ্ডার ভ’রে দেবে জানি নতুন য়ূক্রেন। নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ, টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ। তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি বিক্ষুব্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী: বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক। ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা, ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বোধন সুকান্ত ভট্টাচার্য হে মহামানব, একবার এসো ফিরে শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে, এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার; লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার। এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি; কোথাও নেইকো পার মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল, এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল, ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো, হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো। ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে, হে নীড়-বিহারী সঙ্গী! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আমার– ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস তাদের করেছ মা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ। তোমার ক্ষেতের শস্য চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায় তাদেরি দু’পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়; লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিস্ফল– তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল। তুমি তো প্রহর গোনো, তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি, তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে– কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে। পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার! সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড় দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড় সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার: কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার- এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার? লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম। সুদ ও আসলে আজকে তাই যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই। কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র, লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে। লোভের মাথায় পদাঘাত হানো– আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো। দৈত্যরাজের যত অনুচর মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর; মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ- হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ। তোমার ফসল, তোমার মাটি তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি তোমার চেতনা চালিত হাতে। এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে? স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি? এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র? করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্রঃ শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার! তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়– হিসাব কি দিবি তার? প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,                           ভেঙেছিস ঘরবাড়ি, সে কথা কি আমি জীবনে মরণে                           কখনো ভুলতে পারি? আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের                           চিতা আমি তুলবই। শোন্‌ ‌রে মজুতদার, ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ                           করব তোকে এবার। তারপর বহুশত যুগ পরে ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার, মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার। তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার মানুষ ছিল কি? জবাব মেলে না তার। আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়, দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়; আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি। দুহাতে বাজাও প্রতিশোদের উন্মত্ত দামামা, প্রার্থনা করোঃ হে জীবন, যে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা- আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি, প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের                            তুষার-গলানো উত্তাপ। টুকরে টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী। শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে একত্রিত হোক আমাদের সংহতি। তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর; তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি মানুষ নও- গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও। ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মজুরদের ঝড় সুকান্ত ভট্টাচার্য (ল্যাংস্টন হিউজ) এখন এই তো সময়– কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালরা; সেই সব দালালরা- ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়, বেরিয়ে এসো! জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল, বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য পরাজয় আর মৃত্যুর দূত– বেরিয়ে এসো! বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে। গর্তের পোকারা! এই তো তোমাদের শুভক্ষণ, গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো। সময় হয়েছে, আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে সাদা যাদের পেট– বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক, এই তো তাদের সুযোগ। মানুষ ভালো করেই জানে অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই পুরনো কায়দা। সামান্য কয়েকজন লোভী অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে– আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে ক্ষয়ে-যাওয়ার দল। সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা। অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার। কিন্তু এখন সেই সময়, সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল ক’রো না– বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে, বিপদে পড়লে যারা ডাকে তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের। এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুদার চূড়ান্ত চিহ্ন। –অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয় নি যার অজ্ঞাত নামঃ “দর্মঘট ভাঙার দল” অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না। ঝড় আসছে–সেই ঝড়ঃ যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে। আর হুঁশিয়ার মজুরঃ সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মধ্যবিত্ত `৪২ সুকান্ত ভট্টাচার্য পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে, আজকে সকলে ভুগছে একযোগে, এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস। উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল, হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল, গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে, বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে। সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন, লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন। সহসা নেতারা রুদ্ধ–দেশ জুড়ে ‘দেশপ্রেমিক’ উদিত ভুঁই ফুঁড়ে। প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে; দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায় একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়। এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে আবার বোমারু রক্ত পান করে, ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে, শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে; তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে, দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মৃত্যুজয়ী গান সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায় অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে; নির্বায়ুমণ্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে। দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ, সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতেঃ অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ। বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পড়েঃ মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা; ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়। নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন; শোকচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতেঃ দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর– দৃষ্টিপথ অন্ধকার, সন্দিহান আগামী দিনেরা। গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, কণ্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর। সহসা জানালায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ– অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে; সে মিছিলে শোনা গেল জনতার মৃত্যুজয়ী গান।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্ত ভট্টাচার্য এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি, প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি, এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি; এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে, তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে। এখনো স্বগত ভাবাবেগে মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে। তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে; যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে। তবুও নিশ্চিত উপবাস, আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস- আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি, প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়, আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে, আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে। তাই আজ আমারো বিশ্বাস, “শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।” তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রানার সুকান্ত ভট্টাচার্য রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে, রানার চলেছে রানার! রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার– কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার। রানার! রানার! জানা-অজানার বোঝা আজ তার কাঁধে, বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে; রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়, আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়। তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন, আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ। অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্‌মিট্ ক’রে চায়! কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়! কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে– শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে; হাতে লণ্ঠন করে ঠন্‌ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো। এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে, পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’। ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে। অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে, ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে। রানার! রানার! এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে? ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো দোঁয়া, পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া, রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে, দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে। কত চিঠি লেখে লোকে– কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে। এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও, এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ, এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে, এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে। দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,– এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি- রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব’য়ে? কি হবে ক্ষুদার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে? রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে–আকাশ হয়েছে লাল আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল? রানার! গ্রামের রানার! সময় হয়েছে নতুন খবর আনার; শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ              ভীরুতা পিছনে ফেলে– পৌঁছে দাও এ নতুন খবর              অগ্রগতির ‘মেলে’, দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি–              নেই, দেরি নেই আর, ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে                      দুর্দম, হে রানার।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
লেনিন সুকান্ত ভট্টাচার্য লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ। আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে, মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,– বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ; –আসে শত্রুজয়ের সংবাদ। সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন, কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ। বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে, দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে। দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি আজো যায় শোনা, দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা। পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে, লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে। আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে; ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন, যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন। অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ; দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত, অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ– এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন। লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ। মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস। লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
শত্রু এক সুকান্ত ভট্টাচার্য এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন– মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর; তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর আমার সম্মুখে আজ এক শত্রুঃ এক লাল পথ, শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ। কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়, প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়। আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন স্মরণ করায় পণ; অবসাদ দিই বিসর্জন। বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা, সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা। অদূর দিগন্ত আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা– আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা। আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব প্রচুর সৃষ্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উৎসব।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সিঁড়ি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে           প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;           তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন। তোমরাও তা জানো, তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে           তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি। তবুও আমরা জানি,           চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে                           চাপা থাকবে না। আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।           আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সিগারেট সুকান্ত ভট্টাচার্য আমরা সিগারেট। তোমরা আমাদের বাঁচতে দাও না কেন? আমাদের কেন নিঃশেষ করো পুড়িয়ে? কেন এত স্বল্প-স্থায়ী আমাদের আয়ু? মানবতার কোন্ দোহাই তোমরা পাড়বে? আমাদের দাম বড় কম এই পৃথিবীতে। তাই কি তোমরা আমাদের শোষণ করো? বিলাসের সামগ্রী হিসাবে ফেলো পুড়িয়ে? তোমাদের শোষণের টানে আমরা ছাই হই: তোমরা নিবিড় হও আরামের উত্তাপে। তোমাদের আরামঃ আমাদের মৃত্যু। এমনি ক’রে চলবে আর কত কাল? আর কতকাল আমরা এমনি নিঃশব্দে ডাকব আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে? দিন আর রাত্রি – রাত্রি আর দিন; তোমরা আমাদের শোষণ করছ সর্বক্ষণ– আমাদের বিশ্রাম নেই, মজুরি নেই– নেই কোনো অল্প-মাত্রার ছুটি। তাই, আর নয়; আর আমরা বন্দী থাকব না কৌটোয় আর প্যাকেটে; আঙুলে আর পকেটে সোনা-বাঁধানো ‘কেসে’ আমাদের নিঃশ্বাস হবে না রুদ্ধ। আমরা বেরিয়ে পড়ব, সবাই একজোটে, একত্রে– তারপর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে জ্বলন্ত আমরা ছিট্‌কে পড়ব তোমাদের হাত থেকে বিছানায় অথবা কাপড়ে; নিঃশব্দে হঠাৎ জ্বলে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারব তোমাদের যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সেপ্টেম্বর `৪৬ সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতায় শান্তি নেই। রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাত্রে প্রতিটি সন্ধ্যায়। হৃৎস্পন্দনধ্বনি দ্রুত হয়ঃ মূর্ছিত শহর। এখন গ্রামের মতো সন্ধ্যা হলে জনহীন নগরের পথ; স্তম্ভিত আলোকস্তম্ভ আলো দেয় নিতান্ত সভয়ে। কোথায় দোকানপাট? কই সেই জনতার স্রোত? সন্ধ্যার আলোর বন্যা আজ আর তোলে নাকো জনতরণীর পাল শহরের পথে। ট্রাম নেই, বাস নেই– সাহসী পথিকহীন এ শহর আতঙ্ক ছড়ায়। সারি সারি বাড়ি সব মনে হয় কবরের মতো, মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে চুপ ক’রে সভয়ে নির্জনে। মাঝে মাঝে শব্দ হয়ঃ মিলিটারী লরীর গর্জন পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো সদম্ভ আক্রোশে। কলঙ্কিত কালো কালো রক্তের মতন অন্ধকার হানা দেয় অতন্দ্র শহরে; হয়তো অনেক রাত্রে পথচারী কুকুরের দল মানুষের দেখাদেখি স্বজাতিকে দেখে আস্ফালন, আক্রমণ করে। রুদ্ধশ্বাস এ শহর ছট্ফট করে সারা রাত– কখন সকাল হবে? জীয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে উজ্জ্বল রোদ্দুরে? সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল প্রহরে প্রহরে সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘণ্টায় ধৈর্যহীন শহরের প্রাণঃ এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর? বাদুড়ের মতো কালো অন্ধকার ভর ক’রে গুজবের ডানা উৎকর্ণ কানের কাছে সারা রাত ঘুরপাক খায়। স্তব্ধতা কাঁপিয়ে দিয়ে কখনো বা গৃহস্থের দ্বারে উদ্ধত, অটল আর সুগম্ভীর শব্দ ওঠে কঠিন বুটের। শহর মূর্ছিত হয়ে পড়ে। জুলাই! জুলাই! আবার আসুক ফিরে আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা; দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল– এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা। অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস এবারের মতো মুছে যাক ইতিহাসে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে মহাজীবন সুকান্ত ভট্টাচার্য হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয় এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো, পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো! প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা– কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অসহ্য দিন সুকান্ত ভট্টাচার্য অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত। মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত হৃদয়গত। ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে। এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত, মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমার মৃত্যুর পর সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন, বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে, উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন। পরিচয়ভারে ন্যুব্জ অনেকের শোকগ্রস্ত মন, বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের। কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ। আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর লাঞ্ছনার বেদনায়, ষ্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আলো-অন্ধকার সুকান্ত ভট্টাচার্য দৃষ্টিহীন সন্ধ্যাবেলা শীতল কোমল অন্ধকার স্পর্শ ক’রে গেল মোরে। স্বপনের গভীর চুম্বন, ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় ভ্রান্তি এনে দিল চিরন্তন। অহর্নিশি চিন্তা মোর বিক্ষুব্ধ হয়েছে; প্রতিবার স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি অন্ধকারে মৃত্যুর বিস্তার। মুহূর্ত-কম্পিত-আমি বন্ধ করি অলৌকিক গান, প্রচ্ছন্ন স্বপন মোর আরিক মিথ্যার পাষাণ, কঠিন প্রলুব্ধ চিন্তা নগরীতে নিষ্ফল আমার। তবু চাই রুদ্ধতায় আলোকের আদিম প্রকাশ, পৃথিবীর গন্ধ নেই এমন দিবস বারোমাস। আবার জাগ্রত মোর দুষ্ট চিন্তা নিগূঢ় ইঙ্গিতে; ভুঁইচাঁপা সুরভির মরণ অস্তিত্বময় নয়, তার সাথে কল্পনার কখনো হবে না পরিচয় ; তবু যেন আলো আর অন্ধকার মোর চারিভিতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আসন্ন আঁধারে সুকান্ত ভট্টাচার্য নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে – দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা? নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে প্রগল্‌ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়। -তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক? স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু প্রখর আলোর সীমা হতে বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে। কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক। গোপনে নির্জনে ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে পেয়েছিল অতীত বারতা? মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায় বার বার আর্তনাদ করে আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল, তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের। প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়, আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে এসে পড়েছিল একদিন- উদ্‌ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে যত দূরে দৃষ্টি যায় – চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা। উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার, -এই কি পৃথিবী? একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় – আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
উদ্যোগ সুকান্ত ভট্টাচার্য বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন, একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন। ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখ কাস্তে, গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে। আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত, প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত। আজকে মজুর হতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত, আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত। ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য, বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য! সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়, ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়। বন্ধু, তোমারা ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ঘুমভাঙার গান সুকান্ত ভট্টাচার্য মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল           মোছ উদ্‌গত অশ্রুজল যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল?           ভোল ক্ষত! তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল,           বোঝ নি ধূর্ত চতুর ছল, হাসে যে আকাশচারীর দল,           অনাহত। শোন অবনত বিন্ধ্যাচল,           তুমি নও ভীরু বিগত বল কাঁপে অবাধ্য হৃদয়দল           অবিরত। কঠিন, কঠোর বিন্ধ্যাচল,           অনেক ধৈর্যে আজো অটল ভাঙো বিঘ্নকেঃ করো শিকল           পদাহত। বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল,           দেখ সূর্যের দর্পানল; ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল           বাধা যত। সময় যে হল বিন্ধ্যাচল,           ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল           শত শত।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জাগবার দিন আজ সুকান্ত ভট্টাচার্য জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে; যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে – তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে, মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে।            আজকের দিন নয় কাব্যের – আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের; শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী, কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোনো আসর-ই। আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার – মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার, মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পস্ট।            তবুও তোমার চাই চেতনা, চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না, আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর হাতে করো বর্জন, আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন;            তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিত্তি কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;            পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;            সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,            দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আজকে শপথ করো সকলে বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে; তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,            একতাবদ্ধ হও এখনি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
তরঙ্গ ভঙ্গ সুকান্ত ভট্টাচার্য হে নাবিক, আজ কোন্ সমুদ্রে             এল মহাঝড়, তারি অদৃশ্য আঘাতে অবশ              মরু-প্রান্তর। এই ভুবনের পথে চলবার              শেষ-সম্বল ফুরিয়েছে, তাই আজ নিরুক্ত              প্রাণ চঞ্চল। আজ জীবনেতে নেই অবসাদ! কেবল ধ্বংস, কেবল বিবাদ- এই জীবনের একী মহা উৎকর্ষ! পথে যেতে যেতে পায়ে পায়ে সংঘর্ষ। (ছুটি আজ চাই ছুটি, চাই আমাদের সকালে বিকালে দুটি নুন-ভাত, নয় আধপোড়া কিছু রুটি!) -একী অবসাদ ক্লান্তি নেমেছে বুকে, তাইতো শক্তি হারিয়েছি আজ            দাঁড়াতে পারি না রুখে। বন্ধু, আমরা হারিয়েছি বুঝি প্রাণধারণের শক্তি, তাইতো নিঠুর মনে হয় এই অযথা রক্তারক্তি। এর চেয়ে ভাল মনে হয় আজ পুরনো দিন, আমাদের ভাল পুরনো, চাই না বৃথা নবীন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
তারুণ্য সুকান্ত ভট্টাচার্য হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’ উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে। জীবনের প্রতি পদপে তাই বুঝি ব্যাথাবিদ্ধ বিষণ্ণ বিদায়ে। রক্তময় দ্বিপ্রহরে অনাগত সন্ধ্যার আভাসে তোমার অক্ষয় বীজ অঙ্কুরিত যবে বিষ-মগ্ন রাত্রিবেলা কালের হিংস্রতা কণ্ঠরোধ করে অবিশ্বাসে। অগ্নিময় দিনরাত্রি মোর; আমি যে প্রভাতসূর্য স্পর্শহীন অন্ধকারে চৈতন্যের তীরে উন্মাদ, সন্ধান করি বিশ্বের বন্যায় সৃষ্টির প্রথম সুর। বজ্রের ঝংকারে প্রচণ্ড ধ্বংসের বার্তা আমি যেন পাই। মুক্তির পুলক-লুব্ধ বেগে একী মোর প্রথম স্পন্দন! আমার বক্ষের মাঝে প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারুণ্য, রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায় আমার প্রাণের কণ্ঠে দিয়ে গেল গান; বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর। উচ্ছ্বসিত প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস। আমি যেন মৃত্যুর প্রতীক। তাণ্ডবের সুর যেন নৃত্যময় প্রতি অঙ্গে মোর, সম্মুখীন সৃষ্টির আশ্বাসে। মধ্যাহ্নের ধ্যান মোর মুক্তি পেল তোমার ইঙ্গিতে। তারুণ্যের ব্যর্থ বেদনায় নিমজ্জিত দিনগুলি যাত্রা করে সম্মুখের টানে। নৈরাশ্য নিঃশ্বাসে ক্সত তোমার বিশ্বাস প্রতিদিন বৃদ্ধ হয় কালের কর্দমে। হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রী সঙ্গীত বিহীন, আকাশের স্বপ্ন মাঝে রাত্রির জিজ্ঞাসা ক্ষয় হয়ে যায়। নিভৃত ক্রন্দনে তাই পরিশ্রান্ত সংগ্রামের দিন। বহ্নিময় দিনরাত্রি চক্ষে মোর এনেছে অন্তিম। ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুদিত পৃথিবী আর সর্পিল সভ্যতা। ইতিহাস স্তুতিময় শোকের উচ্ছ্বাস! তবু আজ তারুণ্যের মুক্তি নেই, মুমূর্ষু মানব। প্রাণে মোর অজানা উত্তাপ অবিরাম মুগ্ধ করে পুষ্টিকর রক্তের সঙ্কেতে! পরিপূর্ণ সভ্যতা সঞ্চয়ে আজ যারা রক্তলোভী বর্ধিত প্রলয় অন্বেষণে, তাদের সংহার করো মৃতের মিনতি। অন্ধ তমিস্রার স্রোতে দূরগামী দিন আসন্ন রক্তের গন্ধে মূর্ছিত সভয়ে। চলেছে রাত্রির যাত্রী আলোকের পানে দূর হতে দূরে। বিফল তারুণ্য-স্রোতে জরাগ্রস্ত কিশলয় দিন। নিত্যকার আবর্তনে তারুণ্যের উদ্‌গত উদ্যম বার্ধক্যের বেলাভূমি ‘পরে অতর্কিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবু, হায়রে পৃথিবী, তারুণ্যের মর্মকথা কে বুঝাবে তোরে! কালের গহ্বরে খেলা করে চিরকাল বিস্ফোরণহীন। স্তিমিত বসন্তবেগ নিরুদ্দেশ যাত্রা করে জোয়ারের জলে। অন্ধকার, অন্ধকার, বিভ্রান্ত বিদায়; নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী। বিকৃত বিশ্বের বুকে প্রকম্পিত ছায়া মরণের, নক্ষত্রের আহ্বানে বিহ্বল তারুণ্যের হৃৎপিণ্ডে বিদীর্ণ বিলাস। ক্ষুব্ধ অন্তরের জ্বালা, তীব্র অভিশাপ; পর্বতের বক্ষমাঝে নির্ঝর-গুঞ্জনে উৎস হতে ধবমান দিক্-চক্রবালে। সম্মুখের পানপাত্রে কী দুর্বার মোহ, তবু হায় বিপ্রলব্ধ রিক্ত হোমশিখা! মত্ততায় দিক্ভ্রান্তি, প্রাণের মঞ্জরী দক্ষিণের গুঞ্জরণে নিষ্ঠুর প্রলাপে অস্বীকার করে পৃথিবীরে। অলক্ষিতে ভূমিলগ্ন আকাশ কুসুম ঝরে যায় অস্পষ্ট হাসিতে। তারুণ্যের নীলরক্ত সহস্র সূর্যের স্রোতে মৃত্যুর স্পর্ধায় ভেসে যায় দিগন্ত আঁধারে। প্রত্যুষের কালো পাখি গোধূলির রক্তিম ছায়ায় আকাশের বার্তা নিয়ে বিনিদ্র তারার বুকে ফিরে গেল নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়। দিনের পিপাসু দৃষ্টি, রাত্রি ঝরে বিবর্ণ পথের চারিদিকে। ভয়ঙ্কর দিনরাত্রি প্রলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বে লীন; তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান উর্বর-উচ্ছেদ। অশরীরী আমি আজ তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত উত্তপ্ত শয্যায়। ক্রমাগত শতাব্দীর বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে। বিদায় পৃথিবী আজ, তারুণ্যের তাপে নিবদ্ধ পথিক-দৃষ্টি উদ্বুদ্ধ আকাশে, সার্থক আমার নিত্য-লুপ্ত পরিক্রমা ধ্বনিময় অনন্ত প্রান্তরে। দূরগামী আমি আজ উদ্বেলিত পশ্চাতের পানে উদাস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি রেখে যাই সম্মুখের ডাকে। শাশ্বত ভাস্বর পথে আমার নিষিদ্ধ আয়োজন, হিমাচ্ছন্ন চক্ষে মোর জড়তার ঘন অন্ধকার। হে দেবতা আলো চাই, সূর্যের সঞ্চয় তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা! অন্ধকার অরণ্যের উদ্দাম উল্লাস লুপ্ত হোক আশঙ্কায় উদ্ধত মৃত্যুতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দুর্মর সুকান্ত ভট্টাচার্য হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে, সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে। হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ। “হয় দান নয় প্রাণ” এ শব্দে সারা দেশ দিশাহারা, একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা। সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন দান, দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দেয়ালিকা সুকান্ত ভট্টাচার্য এক দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা। আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা। দুই সকালে বিকালে মনের খেয়ালে ইঁদারায় দাঁড়িয়ে থাকলে অর্থটা তার কি দাঁড়ায়? তিন কখন বাজল ছ’টা প্রাসাদে প্রাসাদে ঝলসায় দেখি শেষ সূর্যের ছটা – স্তিমিত দিনের উদ্ধত ঘনঘটা। চার বেজে চলে রেডিও সর্বদা গোলমাল করতেই ‘রেডি’ ও। পাঁচ জাপানী গো জাপানী ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ ধরে গেল হাঁপানী? ছয় জার্মানী গো জার্মানী তুমি ছিলে অজেয় বীর এ কথা আজ আর মানি! সাত হে রাজকন্যে তোমার জন্যে এ জনারণ্যে নেইকো ঠাঁই- জানাই তাই। আট আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সল্‌তেঃ ‘চাইনে চাইনে আমি জ্বলতে।’
সুকান্ত ভট্টাচার্য
নিবৃত্তির পূর্বে সুকান্ত ভট্টাচার্য দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে, মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ; অবরুদ্ধ বে তার উন্মাদ তড়িৎ; নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ। ভয়ার্ত শোণিত-চক্ষে নামে কালোছায়া, রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ– দিক্প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রূর হাসি, রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ। দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনাঃ ধূ-ধূ করে চেরাপুঞ্জি-সহিষ্ণু হৃদয়। ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দনঃ নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পরাভব সুকান্ত ভট্টাচার্য হঠাৎ ফাল্গুনী হাওয়া ব্যাধিগ্রস্ত কলির সন্ধ্যায়ঃ নগরে নগররক্ষী পদাতিক পদধ্বনি শুনি; – দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন, – মহামারী,অন্তরে বিক্ষোভ – অবসন্ন বিলাসের সংকুচিত প্রাণ। ব্যক্তিত্বের গাত্রদাহ; রন্ধ্রহীন স্বধর্ম বিকাশ অতীতের ভগ্ননীড় এইবার সুপুষ্ট সন্ধ্যায়। বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পরে, – বৈশাখের ঝড়ে তারই অস্পষ্ট চেতনা। ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়…. নশ্বর পৌষের দিন চারিদিকে ধূর্তের সমতাঃ জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন। গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, – প্রকাশ্য ভিক্ষার ঝুলি কালক্রমে অত্যন্ত উদার; সংক্রামিত রক্ত-রোগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে। শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন, পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতে, দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর। বিজিগীষা? – সন্দিহান আগামী দিনেরাঃ দৃষ্টিপথ অন্ধকার, (লাল-সূর্য মুক্তির প্রতীক? -আজ তবে প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পরিবেশন সুকান্ত ভট্টাচার্য সান্ধ্য ভিড় জমে ওঠে রেস্তোরাঁর দুর্লভ আসরে, অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমার পরিচ্ছন্ন পথে – খুঁজে ফেরে অনন্তের বিলুপ্ত পর্যায়। গন্ধহীন আনন্দের অন্তিম নির্যাস এক কাপ চা-এ আর রঙিন সজ্জায়। সম্প্রতি নীরব হল; বিনিদ্র বাসরে ধূমপান চলেঃ তবে ভবতরী তাস। স্মৃতি-ভ্রষ্ট উঞ্ছজীবী চলে কোন মতে। জড়-ভরতের দল বসে আছে পার্কের বেঞ্চিতে, পবিত্র জাহ্নবী-তীরে প্রার্থী যত বেকার যুবক। কতক্ষণ? গঞ্জনার বড় তীব্র জ্বালা- বিবাগী প্রাণের তবু গৃহগত টান। ক্রমে গোঠে সন্ধ্যা নামেঃ অন্তরও নিরালা, এই বার ফিরে চলো, ভাগ্য সবই মিতে; দূরে বাজে একটানা রেডিয়োর গান। এখনো হয় নি শূন্য, ক্রমাগত বেড়ে চলে সখ। ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসে, আগমনী পশ্চিমা হাওয়ায়, সুপ্রাচীন গুরুভক্তি আজো আনে উন্মুক্ত লালসা। চুপ করে বসে থাকো অন্ধকার ঘরে এক কোণেঃ রাম আর রাবণের উভয়েরই হাতে তীক্ষ্ণ কশা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পূর্বাভাস সুকান্ত ভট্টাচার্য সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে। বুভুক্ষু প্রেতেরা হাসে শাণিত বিদ্রূপে, প্রাণ চায় শতাব্দীর বিলুপ্ত রক্তের– সুষুপ্ত যরো নিত্য কাঁদিছে ক্ষুদায় দূর্ত দাবাগ্নি আজ জ্বলে চুপে চুপে প্রমত্ত কস্তুরীমৃগ ক্ষুব্ধ চেতনায় বিপন্ন করুণ ডাকে তোলে আর্তনাদ। ব্যর্থ আজ শব্দভেদী বাণ– সহস্র তির্যকশৃঙ্গ করিছে বিবাদ – জীবন-মৃত্যুর সীমানায়।                      লাঞ্ছিত সম্মান। ফিরে চায় ভীরু-দৃষ্টি দিয়ে। দুর্বল তিতিক্ষা আজ দুর্বাশার তেজে স্বপ্ন মাঝে উঠেছে বিষিয়ে। দূর পূর্বাকাশে, বিহ্বল বিষাণ উঠে বেজে মরণের শিরায় শিরায়। মুমূর্ষ বিবর্ণ যত রক্তহীন প্রাণ– বিস্ফারিত হিংস্র-বেদনায়। অসংখ্য স্পন্দনে চলে মৃত্যু অভিযান লৌহের দুয়ারে পড়ে কুটিল আঘাত, উত্তপ্ত মাটিতে ঝরে বর্ণহীন শোণিত প্রপাত। সুপ্তোত্থিত পিরামিড দুঃসহ জ্বালায় পৈশাচিক ক্রূর হাসি হেসে বিস্তীর্ণ অরণ্য মাঝে কুঠার চালায়। কালো মৃত্যু ফিরে যায় এসে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রতিদ্বন্দ্বী সুকান্ত ভট্টাচার্য গন্ধ এনেছে তীব্র নেশায়, ফেনিল মদির, জোয়ার কি এল রক্ত নদীর? নইলে কখনো নিস্তার নেই বন্দীশালায়। সচারাচর কি সামনা সামনি ধূর্ত পালায়? কাজ নেই আর বল্লাল সেন-ই আমলে, মুক্তি পেয়েছি ধোঁয়াতে নিবিড় শ্যামলে, তোমাতে আমাতে চিরদিন চলে দ্বন্দ্ব। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তীব্র বাঁশির ছন্দ। মনেরে জাগায় সাবধান হুঁশিয়ার। খুঁজে নিতে হবে পুরাতন হাতিয়ার পাণ্ডুর পৃথিবীতে। আফিঙের ঘোর মেরু-বর্জিত শীতে বিষাক্ত আর শিথিল আবেষ্টনে তোমারে স্মরিছে মনে। সন্ধান করে নিত্য নিভৃত রাতে প্রতিদ্বন্দ্বী, -উচ্ছল মদিরাতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রথম বার্ষিকী সুকান্ত ভট্টাচার্য আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ। আজ বর্ষশেষে হে অতীত,                       কোন সম্ভাষণ            জানাব অলক্ষ্য পানে?            ব্যথাক্ষুব্ধ গানে                       ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ! দিনে দিনে, তিলে তিলে যে বেদনা                       উদাস মধুর            হয়েছে নিঃশব্দ প্রাণে            ভরেছে বিপুল টানে,                       তারে আজ দেব কোন সুর? তোমার ধূসর স্মৃতি, তোমার কাব্যের সুরভিতে লেগেছে সন্ধ্যার ছোঁওয়া, প্রাণ ভরে দিতে            হেমন্তের শিশিরের কণা            আমি পারিব না। প্রশান্ত সূর্যাস্ত পরে দিগন্তের যে রাগ-রক্তিমা,            লেগেছে প্রাণের ‘পরে,            সহসা স্মৃতির ঝড়ে                       মুছিয়া যাবে কী তার সীমা! তোমার সন্ধ্যার ছায়াখানি            কোন পথ হতে মোরে কোন পথে নিয়ে যাবে টানি’            অমর্ত্যরে আলোক সন্ধানী                       আমি নাহি জানি। একদা শ্রাবণ দিনে গভীর চরণে, নীরবে নিষ্ঠুর সরণিতে            পাদস্পর্শ দিতে                       ভিক্ষুক মরণে। পেয়েছে পথের মধ্যে দিয়েছ অক্ষয়                       তব দান,            হে বিরাট প্রাণ! তোমার চরণ স্পর্শে রোমাঞ্চিত পৃথিবীর ধূলি            উঠিছে আকুলি’, আজিও স্মৃতির গন্ধে ব্যথিত জনতা কহিছে নিঃশব্দ স্বরে একমাত্র কথা,            ‘তুমি হেথা নাই’। বিস্ময়ের অন্ধকারে মুহ্যমান জলস্থল তাই আদো তন্দ্রা, আধো জাগরণে দক্ষিণ হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে            ফেলিছে নিঃশ্বাস। ক্লে­দক্লি­ষ্ট পৃথিবীতে একী পরিহাস। তুমি চলে গেছ তবু আজিও বহিছে বারোমাস            উদ্দাম বাতাস, এখনো বসন্ত আসে            সকরুণ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে, এখনো শ্রাবণ ঝরোঝর            অবিশ্রান্ত মাতায় অন্তর। এখনো কদম্ব বনে বনে            লাগে দোলা মত্ত সমীরণে,            এখনো উদাসি’ শরতে কাশের ফোটে হাসি। জীবনে উচ্ছ্বাস, হাসি গান            এখনো হয় নি অবসান। এখনো ফুটিছে চাঁপা হেনা,            কিছুই তো তুমি দেখিলে না।            তোমার কবির দৃষ্টি দিয়ে            কোন কিছু দিলে না চিনিয়ে এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,            সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়; স্বার্থের প্রাচীরতলে মানুষের সমাধি রচনা,            অযথা বিভেদ সৃষ্টি, হীন প্ররোচনা            পরস্পর বিদ্বেষ সংঘাতে,                       মিথ্যা ছলনাতে –            আজিকার মানুষের জয়; প্রসন্ন জীবন মাঝে বিসর্পিল, বিভীষিকাময়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিভীষণের প্রতি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক লুপ্ত অধুনা এদেশে তোমার গুপ্তঘাতক, হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে, পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে। অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক, এখানে সবাই সংঘবদ্ধ, হে নবজাতক। ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ রক্ত-কুসুম ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, তাতে ভাঙে ভীত ঘুম। এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে, তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে , যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুমঃ তবু শত্রুর নিদনে লিপ্ত বাসনার দুম। মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ, তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত। ক্ষুদিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, “প্রবেশ নিষেধ, এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব ভুলেছে বিভেদ।” দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ, শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বুদ্বুদ মাত্র সুকান্ত ভট্টাচার্য মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই, তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে, মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে, – তারি তরে পাতা সিংহাসন, রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন। তবুও প্রচণ্ড-গতি জীবনের ধরা, নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা, জন্মের প্রথম কাল হতে, আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে। এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী, যেখানে কীর্তির নামাবলী, আমাদের স্থান নেই সেথা – আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মুহূর্ত (ক) সুকান্ত ভট্টাচার্য এমন মুহূর্ত এসেছিল একদিন আমার জীবনে যে মহূর্তে মনে হয়েছিল সার্থক ভুবনে বেঁচে থাকাঃ কালের আরণ্য পদপাত ঘটেছিল আমার গুহায়। জরাগ্রস্ত শীতের পাতারা উড়ে এসেছিল কোথা থেকে, সব কিছু মিশে একাকার কাল-বোশেখীর পদার্পণে সেদিন হাওয়ায় জমেছিল অদ্ভুত রোমাঞ্চ দিকে দিকে; আকাশের চোখে আশীর্বাদ, চুক্তি ছিল আমৃত্যু জীবনে। সে সব মুহূর্তগুলো আজো প্রাণের অষ্পষ্ট প্রশাখায় ফোটায় সবুজ ফুল, উড়ে আসে কাব্যের মৌমাছি। অসংখ্য মুহূর্তে গ’ড়ে তোলা স্বপ্ন-দুর্গ মুহূর্তে চুরমার। আজ কক্ষচ্যুত ভাবি আমি মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা; – যে মুহূর্ত অদৃশ্য প্লাবনে টেনে নিয়ে যায় কান্তরে। আজ আছি নক্ষত্রের দলে, কাল জানি মুহূর্তের টানে ভেসে যাব সূর্যের সভায়, ক্ষুব্ধ কালো ঝড়ের জাহাজে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মুহূর্ত (খ) সুকান্ত ভট্টাচার্য মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা যে মুহূর্ত তোমার আমার আর অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা, যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা আর তোমার আগ্রহ। এ মুহূর্তে সূর্যোদয়, এ মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা, আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে সুস্পষ্ট সংকেত। অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর বাড়াল ফসল, মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ। এমন মুহূর্ত এল আমার জীবনে, যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায় – অথচ আশ্চর্য কথা নতুন মুহূর্ত আর এক সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ। অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবন, যে সব মুহূর্ত মিলে আমার কাব্যের শূন্য হাতে ভরে দিত অক্ষয় সম্পদ। কিন্তু আজ উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার দুঃসহ চেষ্টায়। হয়তো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি কাব্যের অজস্র প্রেরণায় উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি। অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয়। গোপন মুহূর্ত আজ এক নিশ্ছিদ্র আকাশে অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে, নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া ধূলিসাৎ – তাই আজ দেখি, প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত মুহূর্তের রক্তিম কপোলে তুলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মৃত পৃথিবী সুকান্ত ভট্টাচার্য পৃথিবী কি আজ শেষে নিঃস্ব ক্ষুধাতুর কাঁদে সারা বিশ্ব, চারিদিকে ঝরে পড়া রক্ত, জীবন আজকে উত্যক্ত। আজকের দিন নয় কাব্যের পরিণাম আর সম্ভাব্যের ভয় নিয়ে দিন কাটে নিত্য, জীবনে গোপন-দুর্বৃত্ত। তাইতো জীবন আজ রিক্ত, অলস হৃদয় স্বেদসিক্ত; আজকে প্রাচীর গড়া ভিন্ন পৃথিবী ছড়াবে ক্ষতচিহ্ন। অগোচরে নামে হিম-শৈত্য, কোথায় পালাবে মরু দৈত্য? জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত, তবু তো হৃদয় উদ্দীপ্ত, বোধহয় আগামী কোনো বন্যায়, ভেসে যাবে অনশন, অন্যায়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সহসা সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী এপারে মর্মরধ্বনি শুনি, নিস্পন্দ শবের রাজ্য হতে ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি। গোদূলি আকাশ ব’লে দিল তোমার মরণ অতি কাছে, তোমার বিশাল পৃথিবীতে এখনো বসন্ত বেঁচে আছে। অদূরে নিবিড় ঝাউবনে যে কালো ঘিরেছে নীরবতা, চোখ তারই দীর্ঘায়িত পথে অস্পষ্ট ভাষায় কয় কথা। আমার দিনান্ত নামে ধীরে আমি তো সুদূর পরাহত, অশত্থশাখায় কালো পাখি দুশ্চিন্তা ছড়ায় অবিরত। সন্ধ্যাবেলা, আজ সন্ধ্যাবেলা নিষ্ঠুর তমিস্রা ঘনাল কী! মরণ পশ্চাতে বুঝি ছিল সহসা উদার চোখাচোখি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুতরাং সুকান্ত ভট্টাচার্য এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক, আজ চোখে দেখি শুধু নরক!            এত আঘাত কি সইবে,                      যদি না বাঁচি দৈবে?                                  চারি পাশে লেগে গেছে মড়ক! বহুদিনকার উপার্জন, আজ দিতে হবে বিসর্জন।             নিষ্ফল যদি পন্থা;                        সুতরাং ছেঁড়া কন্থা                                  মনে হয় শ্রেয় বর্জন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বতঃসিদ্ধ সুকান্ত ভট্টাচার্য মৃত্যুর মৃত্তিকা ‘পরে ভিত্তি প্রতিকূল – সেখানে নিয়ত রাত্রি ঘনায় বিপুল; সহসা চৈত্রের হাওয়া ছড়ায় বিদায়ঃ স্তিমিত সূর্যের চোখে অন্ধকার ছায়। বিরহ-বন্যার বেগে প্রভাতের মেঘ রাত্রির সীমায় এসে জানায় আবেগ, ধূসর প্রপঞ্চ-বিশ্ব উন্মুক্ত আকাশে অনেক বিপন্ন স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। তবু তো প্রাণের মর্মে প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা অজস্র ফুলের রাজ্যে বাঁধে লঘু বাসা; রাত্রির বিবর্ণ স্মৃতি প্রভাতের বুকে ছড়ায় মলিন হাসি নিরর্থ-কৌতুকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বপ্নপথ সুকান্ত ভট্টাচার্য আজ রাত্রে ভেঙে গেল ঘুম, চারিদিক নিস্তব্ধ নিঃঝুম, তন্দ্রাঘোরে দেখিলাম চেয়ে অবিরাম স্বপ্নপথ বেয়ে চলিয়াছে দুরাশার স্রোত, বুকে তার বহু ভগ্ন পোত। বিফল জীবন যাহাদের, তারাই টানিছে তার জের; অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে, জলে স্থলে আকাশে পর্বতে। একদিন পথে যেতে যেতে উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে যাহাদের, তারাই সংঘাতে মৃত্যুমুখী, ব্যর্থ রক্তপাতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্মারক সুকান্ত ভট্টাচার্য আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় তবুও পড়িবে মনে, চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে হৃদয়ের আঙ্গিনায় রজনীগন্ধা বনে, তবুও পড়িবে মনে। বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে বন্যার মহাবেগে, তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে মুক্তির ঢেউ লেগে, মুক্তির মহাবেগে। বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি বিনিদ্র কলরবে তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি পার হয়ে যেতে হবে, বিনিদ্র কলরবে। মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উৎসবহীন রাতে বিষণ্ণ অবসাদে বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে অস্থির হয়ে কাঁদে, বিষণ্ণ অবসাদে। নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তহীন মায়া ধূলিরে উড়ায় দূরে, আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া নিঃশ্বাস ফেলে সুরে; ধূলিরে উড়ায় দূরে। কাহার চকিত-চাহনি-অধীর পিছনের পানে চেয়ে কাঁদিয়া কাটায় রাতি, আলেয়ার বুকে জ্যোৎস্নার ছবি সহসা দেখিতে পেয়ে জ্বালে নাই তার বাতি, কাঁদিয়া কাটায় রাতি। বিরহিণী তারা আঁধারের বুকে সূর্যেরে কভু হায় দেখেনিকো কোনো ক্ষণে। আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় হয়তো পড়িবে মনে, রজনীগন্ধা বনে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হদিশ সুকান্ত ভট্টাচার্য আমি সৈনিক, হাঁটি যুগ থেকে যুগান্তরে প্রভাতী আলোয়, অনেক ক্লান্ত দিনের পরে,           অজ্ঞাত এক প্রাণের ঝড়ে। বহু শতাব্দী দরে লাঞ্ছিত, পাই নি ছাড়া বহু বিদ্রোহ দিয়েছে মনের প্রান্ত নাড়া           তবু হতবাক দিই নি সাড়া। আমি সৈনিক, দাসত্ব কাঁদে যুদ্ধে যেতে দেখেছি প্রাণের উচ্ছ্বাস দূরে ধানের ক্ষেতে           তবু কেন যেন উঠি নি মেতে। কত সান্ত্বনা খুঁজেছি আকাশে গভীর নীলে শুধু শূন্যতা এনেছে বিষাদ এই নিখিলে           মূঢ় আতঙ্ক জন-মিছিলে। ক্ষতবিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ ঠেকা           কোন সূর্যের পাই নি দেখা। অনেক রক্ত দিয়েছি বিমূঢ় বিনা কারণে বিরোধী স্বার্থ করেছি পুষ্ট অযথা রণে;           সঙ্গিবিহীন প্রাণধারণে। ভীরু সৈনিক করেছি দলিত কত বিক্ষোভ ইন্ধন চেয়ে যখনি জ্বলেছে কুবেরীর লোভ           দিয়েছি তখনি জন-খাণ্ডব! একদা যুদ্ধ শুরু হল সারা বিশ্ব জুড়ে, জগতের যত লুণ্ঠনকারী আর মজুরে,           চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে। উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই এল আহ্বান জন-পুঞ্জের শুনি রোশনাই           দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই। হাতছানি দিয়ে গেল শস্যের উন্নত শীষ,           জনযাত্রায় নতুন হদিশ – সহসা প্রণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে পৃথিবী সুকান্ত ভট্টাচার্য হে পৃথিবী, আজিকে বিদায় এ দুর্ভাগা চায়, যদি কভু শুধু ভুল ক’রে মনে রাখো মোরে, বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে দুর্ভাগার!             বিস্মৃত শৈশবে যে আঁদার ছিল চারিভিতে তারে কি নিভৃতে আবার আপন ক’রে পাব, ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব, স্মৃতির মর্মরে? প্রভাতপাখির কলস্বরে যে লগ্নে করেছি অভিযান, আজ তার তিক্ত অবসান। তবু তো পথের পাশে পাশে প্রতি ঘাসে ঘাসে। লেগেছে বিস্ময়! সেই মোর জয়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
উদ্যোগ সুকান্ত ভট্টাচার্য বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন, একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন। ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে, গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে। আজ দৃঢ় দাঁতে পুজিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত, প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত। আজকে মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত, আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত। ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য, বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য! সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়, ফেণী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষীপ্ত জনতা গর্জায়। বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
“নব জ্যামিতি”র ছড়া সুকান্ত ভট্টাচার্য Food Problem [একটি প্রাথমিক সম্পাদ্যের ছায়া অবলম্বনে] সিদ্ধান্ত: আজকে দেশে রব উঠেছে, দেশেতে নেই খাদ্য; ‘আছে’, সেটা প্রমাণ করাই অধুনা ‘সম্পাদ্য’। কল্পনা: মনে করো, আসছে জাপান অতি অবিলম্বে, সাধারণকে রুখতে হবে অতি দৃঢ় ‘লম্বে’। “খাদ্য নেই” এর প্রথম পাওয়া খুব ‘সরল রেখা’তে, দেশরক্ষার ‘লম্ব’ তোলাই আজকে হবে শেখাতে। অঙ্কন: আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে, প্রতিরোধের বিন্দুতে নাও ঐক্য-রেখা এঁকে! ‘হিন্দু-মুসলমানে’র কেন্দ্রে, দুদিকের দুই ‘চাপে’ যুক্ত করো উভয়কে এক প্রতিরোধের ধাপে। প্রতিরোধের বিন্দুতে দুই জাতি যদি মেলে, সাথে সাথেই খাদ্য পাওয়ার হদিশ তুমি পেলে। প্রমাণ: খাদ্য এবং প্রতিরোধ উভয়েরই চাই, হিন্দু এবং মুসলমান মিলন হবে তাই। উভয়ের চাই স্বাধীনতা, উভয় দাবীই সমান, দিকে দিকে ‘খাদ্যলাভ’ একতারই প্রমাণ। প্রতিরোধের সঠিক পথে অগ্রসর যারা, ঐক্যবদ্ধ পরস্পর খাদ্য পায় তারা॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অতি কিশোরের ছড়া সুকান্ত ভট্টাচার্য তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি, আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি, কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া, পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া। তোতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ। বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ, ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব । পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ, পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক। হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি, যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছুটোছুটি। পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া, ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তারা। তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক, বুঝি কেবল গোময় সেটা,- নয়কো মধুপর্ক। ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে খেয়ালমতো কাজ করে যাই, কস্ট পাই কি সাধে ? সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃস্ট চক্র! আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আজব লড়াই সুকান্ত ভট্টাচার্য ফেব্রুয়ারী মাসে ভাই, কলকাতা শহরে ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে! লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের, কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের; রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে, তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে, শুধু শুনি ‘ধর’ ‘ধর’ ‘মার’ ‘মার’ শব্দ যেন খাঁটি যুদ্ধ এ মিলিটারী জব্দ। বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে, ‘সব ঢাল জল’। ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো, ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো, ইট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি, এইবার যাবে কোথা বাছাধন বৈরী! ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা! এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা; ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও, গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও। জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের। বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে; ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান, “বিশ্ববিজয়ী” তাই রাখে জান, বাঁচে মান। খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন; সাবাস! সাবাস! ওরা খেয়েছে রাজার নুন। ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা, রক্ত-রাঙানো পথে দু’পাশে ছেলের মেলা; দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয়? ও-বাড়ি ও ও-পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয়। স্বচে দেখলাম বস্তির আলী জান, ‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ। এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট; এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে, ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে; পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা, দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
এক যে ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্য এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর, ইস্কুল তার ভাল লাগত না, সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনোকালেই, অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারা দেশের সবটুকু পাণ্ডিত্যকে। কেমন ক’রে?          সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।। বড়মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ, তাই বড় হয়ে সে বড় মানুষ না হয়ে             মানুষ হিসেব হল অনেক বড়। কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।। গানসাধার বাঁধা আইন সে মানে নি, অথচ স্বর্গের বাগান থেকে সে চুরি করে আনল             তোমার আমার গান। কবি সে, ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল না ছোট বয়সে, অথচ শিল্পী ব’লে সে-ই পেল শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্মান। কেমন ক’রে ? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।। মানুষ হল না বলে যে ছিল তার দিদির আক্ষেপের বিষয়, অনেক দিন, অনেক বিদ্রূপ যাকে করেছে আহত; সে-ই একদিন চমক লাগিয়ে করল দিগ্বিজয়। কেউ তাকে বলল, ‘বিশ্বকবি’, কেউ বা ‘কবিগুরু’ উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিক করল প্রণাম। তাই পৃথিবী আজো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছেঃ কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না, এ প্রশ্নের জবাব তোমাদের মতো আমিও খুঁজি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
খাদ্য সমস্যার সমাধান সুকান্ত ভট্টাচার্য বন্ধুঃ ঘরে আমার চাল বাড়ন্ত             তোমার কাছে তাই, এলাম ছুটে, আমায় কিছু             চাল ধার দাও ভাই।             মজুতদারঃ দাঁড়াও তবে, বাড়ির ভেতর             একটু ঘুরে আসি, চালের সঙ্গে ফাউও পাবে             ফুটবে মুখে হাসি।             মজুদতারঃ এই নাও ভাই, চালকুমড়ো             আমায় খাতির করো, চালও পেলে কুমড়ো পেলে             লাভটা হল বড় ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
গোপন খবর সুকান্ত ভট্টাচার্য শোন একটা গোপন খবর দিচ্ছি আমি তোমায়, কলকাতাটা যখন খাবি খাচ্ছিল রোজ বোমায়, সেই সময়ে একটা বোমা গড়ের মাঠের ধারে, মাটির ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ছিল এক্কেবারে, অনেক দিনের ঘটনা তাই ভুলে গেছ্‌ল লোকে, মাটির ভেতর ছিল তাইতো দেখে নি কেউ চোখে, অনেক বর্ষা কেটে গেল, গেল অনেক মাস, যুদ্ধ থামায় ফেলল লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস, হাঠাৎ সেদিন একলা রাতে গড়ের মাঠের ধারে, বেড়িয়ে ফেরার সময় হঠাৎ চমকে উঠিঃ আরে! বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ, তারই মাথায় দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ, গাছের ডালে ঝুলছে কেবল বোমা-ই সারি সারি, তাই না দেখে ভড়কে গিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। পরের দিনই সকাল বেলা গেলাম ময়দানে, হায়রে!- গাছটা চুরি গেছে কোথায় কে তা জানে। গাছটা ছিল। গড়ের মাঠে খুঁজতে আজো ঘুরি, প্রমাণ আছে অনেক, কেবল গাছটা গেছে চুরি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জ্ঞানী সুকান্ত ভট্টাচার্য বরেনবাবু মস্ত জ্ঞানী, মস্ত বড় পাঠক, পড়েন তিনি দিনরাত্তির গল্প এবং নাটক, কবিতা আর উপন্যাসের বেজায় তিনি ভক্ত, ডিটেক্‌টিভের কাহিনীতে গরম করেন রক্ত; জানেন তিনি দর্শন আর নানা রকম বিজ্ঞান জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি, তাইতো আছে দিক্-জ্ঞান; ইতিহাস আর ভূগোলেতে বেজায় তিনি দক্ষ,- এসব কথা ভাবলেই তাঁর ফুলতে থাকে বক্ষ। সব সময়েই পড়েন তিনি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, ছুটির দিনে পড়েন তিনি, পড়েন পূজোর বন্ধে। মাঝে মাঝে প্রকাশ করেন গূঢ় জ্ঞানের তত্ত্ব বিদ্যাখানা জাহির করেন বরেন্দ্রনাথ দত্তঃ হঠাৎ ঢুকে রান্না ঘরে বলেন, ওসব কী রে? ভাইঝি গীতা হেসে বলে, এসব কালো জিরে। বরেনবাবু রেগে বলেন, জিরে তো হয় সাদা, তিলও কালো, জিরেও কালো? পেয়েছিস কি গাধা? রান্না করার সময় কেবল পুড়িয়ে হাজার লঙ্কা, হনুমতী হয়েছিস তুই, হচ্ছে আমার শঙ্কা। হঠাৎ ছোট্ট খোকাটাকে কাঁদতে দেখে, দত্ত খোলেন বিরাট বইয়ের পাতা নামটি “মনস্তত্ত্ব”। খুঁজতে খুঁজতে বরেনবাবু হয়ে গেলেন সারা- বুঝলেন না, কেন খোকা মাথায় করছে পাড়া। হঠাৎ এসে ভাইঝি গীতা দুধের বাটি নিয়ে, খাইয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিটে দিল ঘুম পাড়িয়ে। বরেনবাবু ভাবেন, ‘খোকার কেমনতর ধারা আধ ঘণ্টার চেঁচামেচি পাঁচ মিনিটেই সারা?’ বরেনবাবুর কাছে আরো বিরাট একটি ধাঁধা, হলদে চালের রঙ কেন হয় ভাত হলে পর সাদা? পাথর বাটির গরম জিনিস ঠাণ্ডা হয় তা জানি, পাহাড় দেশে গরম কেন এমন ছটফটানি? পথ চলতে ভেবে এসব ভিজে ওঠেন ঘামে, মানিকতলা যেতে চাপেন ধর্মতলার ট্রামে। বরেনবাবু জানেন কিন্তু নানা রকম বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি তাইতো এমন দিক্-জ্ঞান।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পুরনো ধাঁধা সুকান্ত ভট্টাচার্য বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে? গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে? বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি, গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি? বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে, কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে? ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা, গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা। বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য, ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য? ‘হিং-টিং-ছট্’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়, বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পৃথিবীর দিকে তাকাও সুকান্ত ভট্টাচার্য দেখ, এই মোটা লোকটাকে দেখ         অভাব জানে না লোকটা, যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে         লোভে জ্বলে তার চোখটা। মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি         পাথরে তৈরি সব তার, কত সুন্দর, পুরোনো এগুলো!         অট্রালিকা এ লোকটার। উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে         চেয়ে দেখে না সে নীচুতে, কত জামির যে মালিক লোকটা         বুঝবে না তুমি কিছুতে। দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে         কলে আর কারখানাতে, মেশিনের কপিকলের শব্দ         শোনো, সবাইকে জানাতে। মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-         খেটে খেটে হল হন্যে ; ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে         মোটা প্রভুটির জন্যে। দেখ একজন মজুরকে দেখ         ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে, কেনা গোলামের মতই খাটুনি         তাই হাড়ভাঙা খাটছে। ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার         স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা, এর সঙ্গে কি তুলনা করবে         প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা? কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে         কাজ করে সারা বেলা এ, পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-         বাকিটা পোষায় সেলায়ে। তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,         থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল, বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে         এমনি করেই কাটে কাল। বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া         করে চোখে চোখে রাখে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে         দোকানে যাওয়ার ফাঁকে। খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা         ছুটে আসে পালে পাল, খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর         হয়তো একটু ডাল। কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে         খাদ্য কিনতে গিয়ে দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,         বসে গালে হাত দিয়ে। পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু (সুতরাং চুপ; কথা বলবে না কভু) সকলেরই প্রভু- ভালো আর খারাপের তাঁরই ইচ্ছায় এ; চুপ করো সব ফের। শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে, চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে। এদের কথায় ভরসা হয় না তবু? সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু। ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি, আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি। যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায় পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায়। মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত- কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে। সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে। রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান্ দেশ, যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ; রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়, লেনিন গড়েছে রাশিয়া! কী বিস্ময়! রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী, নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী, সোভিয়েট-‘তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো, প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো। মজুরের দেশ, কল-কারখানা, প্রাসাদ, নগর, গ্রাম, মজুরের খাওয়া মজুরের হাওয়া, শুধু মজুরের নাম। মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর গরমে সাগর-ধার, মজুরের কত স্বাধীনতা! আর অজস্র অধিকার। মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায় জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে, ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে। মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয় পাহারা দিন ও রাত, গরীবের দেশে সইবে না তারা বড়লোকদের হাত। শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন জীবন সেখানে, তাই সকলেই সুখে বাস করে আর সকলেই ভাই-ভাই; এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা বাঁচাতে মাতৃভূমি, তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে, আমার জন্যে তুমি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিয়ে বাড়ির মজা সুকান্ত ভট্টাচার্য বিয়ে বাড়িঃ বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানা রকম খাদ্য; হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ, আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ, বাসরঘরে সাজছে কনে, সকলে উৎফুল্ল, লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুললঃ “আসুন, আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য, যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য; মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি। খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।” বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক, আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক্-ধুক্, ‘হুলু’ দিতে তৈরী সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত, সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত। ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ; হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দঃ হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজলো জোরে, বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে। কোথায় বরের সাজসজ্জা? কোথায় ফুলের মালা? সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা। বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে। বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে, বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন? পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন! এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে? থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে? কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে, গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ব্ল্যাক-মার্কেট সুকান্ত ভট্টাচার্য হাত করে মহাজন, হাত করে জোতদার, ব্ল্যাক-মার্কেট করে ধনী রাম পোদ্দার, গরীব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালো বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান ছয় হাঁকালো। কেউ নেই ত্রিভুবনে, নেই কিছু অভাবও তবু ছাড়ল না তার লোক-মারা স্বভাবও। একা থাকে, তাই হরি চাকরটা রক্ষী ত্রিসীমানা মাড়ায় না তাই কাক-পক্ষী। বিশ্বে কাউকে রাম কাছে পেতে চান না, হরিই বাজার করে, সে-ই করে রান্না। এমনি ক’রেই বেশ কেটে যাচ্ছিল কাল, হঠাৎ হিসেবে রাম দেখলেন গোলমাল, বললেন চাকরকেঃ কিরে ব্যাটা, কি ব্যাপার? এত টাকা লাগে কেন বাজারেতে রোজকার? আলু তিন টাকা সের? পটল পনেরো আনা? ভেবেছিস বাজারের কিছু বুঝি নেই জানা? রোজ রোজ চুরি তোর? হতভাগা, বজ্জাত! হাসছিস? এক্ষুণি ভেঙে দেব সব দাঁত। খানিকটা চুপ করে বলল চাকর হরিঃ আপনারই দেখাদেখি ব্ল্যাক-মাকের্ট করি।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভাল খাবার সুকান্ত ভট্টাচার্য ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত; সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে। সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা, হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা। সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর, কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর। এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ঘুটে, টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে; খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত, খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত। দিনরাত চিৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই, আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই। সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো, খাওয়া ফেলে দিনরাত টাকা ব’লে চেঁচানো। ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে; চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে। নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতিঃ কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি? নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক-ফিক্; তারপর বললেনঃ বলা ভারি শক্ত সবচেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভেজাল সুকান্ত ভট্টাচার্য ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়! ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা, ‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা।’ ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা, ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা ভেজাল কথা- বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে, ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে। ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাটি কেবল আর সকলই মিথ্যে। কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মেয়েদের পদবী সুকান্ত ভট্টাচার্য মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী, অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি; ‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার। ‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে, দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে। সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’, তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা, ‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’ নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা; ‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘ দাস’ হলে ‘দাসা’ শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা; ‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’ মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- “সরা”। ‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’ বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রেশন কার্ড সুকান্ত ভট্টাচার্য রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা, হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা; তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে, রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে, সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা- দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা, হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায় ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়; কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার, আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার, তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে, ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে। রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব? ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব? আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে- যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে; পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে, নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সিপাহী বিদ্রোহ সুকান্ত ভট্টাচার্য হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ- “হো-হো, হো-হো, হো-হো” চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে- সিপাহী বিদ্রোহ! আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে, ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগেঃ একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত, বিদেশীদের রক্ত পেলে তবেই হবে তৃপ্ত! নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী- সবার হাতে অস্ত্র, নাচে বনের পশু-পক্ষী। কেবল ধনী, জমিদার, আর আগের রাজার ভক্ত যোগ দিল, তা নয়কো, দিল গরীবেরাও রক্ত! সবাই জীবন তুচ্ছ করে, মুসলমান ও হিন্দু, সবাই দিতে রাজি তাদের প্রতি রক্তবিন্দু; ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে, বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে। অত্যাচারী নয়কো তারা, অত্যাচারীর মুণ্ডু চেয়েছিল ফেলতে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ডু। নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খঃ সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ; তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে এগিয়েছিল, এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে! আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা উঠেছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা; জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য, তখন এঁদের স্মরণ করো, স্মরণ করো নিত্য- এঁদের নামে, এঁদের পণে শানিয়ে তোলো চিত্ত। নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী, এঁদের নামে, দৃপ্ত কিশোর, খুলবে তোমার চোখ কি?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দেবতাদের ভয় সুকান্ত ভট্টাচার্য [পাত্ৰ-পাত্রী : ইন্দ্ৰ, ব্ৰহ্মা, নারদ, অগ্নি, বরুণ ও পবন।] ইন্দ্ৰ : কি ব্যাপার? ব্ৰহ্মা : আমার এত কষ্টের ব্ৰহ্মাণ্ডটা বোধহয় ছারখার হয়ে গেল। হায়—হায়—হায়! নারদ : মানুষের হাত থেকে স্বর্গের আর নিস্তার নেই মহারাজ, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ইন্দ্র : আঃ বাজে বকবক না করে আসল ব্যাপারটা খুলে বলুন না, কি হয়েছে? ব্ৰহ্মা : আর কী হয়েছে। অ্যাটম বোমা!–বুঝলে? অ্যাটম বোমা। ইন্দ্র : কই, অ্যাটম বোমার সম্বন্ধে কাগজে তো কিছু লেখে নি? নারদ : ও আপনার পাঁচ বছরের পুরনো মফঃস্বল সংস্করণ কাগজ। ওতে কি ছাই কিছু আছে নাকি? ইন্দ্ৰ : অ্যাটম বোমাটা তবে কি জিনিস? ব্ৰহ্মা : মহাশক্তিশালী অস্ত্ৰ। পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারে। ইন্দ্র : আমার বজ্রের চেয়েও শক্তিশালী? নারদ : আপনার বজ্রে তো শুধু একটা তালগাছ মরে, এতে পৃথিবীটাই লোপাট হয়ে যাবে। ইন্দ্ৰ : তইতো, বড় চিন্তার কথা। এই রকম অস্ত্র আমরা তৈরী করতে পারি না? বিশ্বকৰ্মা কি বলে? নারদ : বিশ্বকৰ্মা বলছে তাঁর সেকেলে মালমশলা আর যন্ত্রপাতি দিয়ে ওসব করা যায় না। তা ছাড়া সে যা মাইনে পায় তাতে অতি খাটুনি পোষায়ও না। ইন্দ্র : তবে তো মুস্কিল! ওরা আমার পুষ্পকরথের নকল করে এরোপ্লেন করেছে, আর বজ্রের নকল করে অ্যাটম বোমাও করল। এবার যদি হানা দেয় তা হলেই সেরেছে। আচ্ছা অগ্নি, তুমি পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে দিতে পার না? অগ্নি : আগে হলে পারতুম। আজকাল দমকলের ঠেলায় দম আটকে মারা যাই যাই অবস্থা। ইন্দ্ৰ : বরুণ! তুমি ওদের জলে ড়ুবিয়ে মারতে পার না? বরুণ : পরাধীন দেশ হলে পারি। এই তো সেদিন চট্টগ্রামকে ড়ুবিয়ে দিলুম। কিন্তু স্বাধীন দেশে আর মাথাটি তোলবার জো নেই। কেবল ওরা বাঁধ দিচ্ছে। ইন্দ্ৰ : পবন? পবন : পরাধীন দেশের গরিবদের কুঁড়েগুলোই শুধু উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে লাভ কি? ইন্দ্ৰ : আমাদের তৈরী মানুষগুলোর এত আস্পর্ধা? দাও সব স্বর্গের মজুরদের পাঁচিল তোলার কাজে লাগিয়ে— নারদ : কিন্তু তারা যে ধর্মঘট করেছে। ইন্দ্র : ধর্মঘট কেন? কি তাদের দাবি? নারদ : আপনি যেভাবে থাকেন তারাও সেইভাবে থাকতে চায়। ইন্দ্ৰ : (ঠোঁট কামড়িয়ে) বটে? মহাদেব আর বিষ্ণু কি করছেন? ব্ৰহ্মা : মহাদেব গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছেন। আর বিষ্ণু অনন্ত শয়নে নাক ডাকাচ্ছেন। ইন্দ্ৰ : এঁদের দ্বারা কিছু হবে না। আচ্ছা, মানুষগুলোকে ডেকে বুঝিয়ে দিতে পার যে এতই যখন করছে তখন ওরা একটা আলাদা স্বৰ্গ বানিয়ে নিক না কেন? নারদ : তা তো করেছে। সোভিয়েট রাশিয়া নাকি ওদের কাছে স্বৰ্গ, খাওয়া-পরার কষ্ট নাকি কারুর সেখানে নেই। সবাই সেখানে নাকি সুখী। ইন্দ্র : কিন্তু সেখানে কেউ তো অমর নয়। ব্ৰহ্মা : নয়। কিন্তু মরা মানুষ বাঁচানোর কৌশলও সেখানে আবিষ্কার হয়েছে। অমর হতে আর বাকি কী? ইন্দ্ৰ : তা হলে উপায়? ব্ৰহ্মা : উপায় একটা আছে। ওদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটিটা যদি বজায় রাখা যায় তা হলেই ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করে মারা পড়বে, আমরাও নিশ্চিন্ত হব। ইন্দ্র : তা হলে নারদ, তুমিই একমাত্র ভরসা। তুমি চলে যাও সটান পৃথিবীতে। সেখানে লোকদের বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের বিষ ঢুকিয়ে দাও। তা হলেই তা হলেই আমাদের স্বৰ্গ মানুষের হাত থেকে বেঁচে যাবে। নারদ : তথাস্তু। আমার ঢেঁকিও তৈরী আছে! [নারদের প্রস্থান]
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রাখাল ছেলে সুকান্ত ভট্টাচার্য সূৰ্য যখন লাল টুকটুকে হয়ে দেখা দেয় ভোরবেলায়, রাখাল ছেলে তখন গরু নিয়ে যায় মাঠে। সাঁঝের বেলায় যখন সূৰ্য ড়ুবে যায় বনের পিছনে, তখন তাকে দেখা যায় ফেরার পথে। একই পথে তার নিত্য যাওয়া-আসা। বনের পথ দিয়ে সে যায় নদীর ধারের সবুজ মাঠে। গরুগুলো সেখানেই চ’রে বেড়ায়। আর সে বসে থাকে গাছের ছায়ায় বাঁশিটি হাতে নিয়ে, চুপ করে চেয়ে থাকে নদীর দিকে, আপন মনে ঢেউ গুনতে গুনতে কখন যেন বাঁশিটি তুলে নিয়ে তাতে ফুঁ দেয়। আর সেই সুর শুনে নদীর ঢেউ নাচতে থাকে, গাছের পাতা দুলতে থাকে। আর পাখিরা কিচির-মিচির করে তাদের আনন্দ জানায়! একদিন দোয়েল পাখি তাকে ডেকে বলে : ।। গান।। ও ভাই, রাখাল ছেলে! এমন সুরের সোনা বলে কোথায় পেলে। আমি যে রোজ সাঁঝা-সকালে, বসে থাকি গাছের ডালে, তোমার বাঁশির সুরেতে প্ৰাণ দিই ঢেলে।। তোমার বাঁশির সুর যেন গো নির্ঝরিণী তাই শোনে রোজ পিছন হতে বনহরিণী। চুপি চুপি আড়াল থেকে সে যায় গো তোমায় দেখে অবাক হয়ে দেখে তোমায় নয়ন মেলে।। রাখাল ছেলে অবাক হয়ে দেখে সত্যিই এক দুষ্ট হরিণী লতাগুলোর আড়াল থেকে মুখ বার করে অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। সে তাকে বললে : ওগো বনের হরিণী! তুমি রইলে কেন দূরে দূরে, বিভোর হয়ে বাঁশির সুরে, আমি তো কাছে এসে বসতে তোমায় নিষেধ করি নি। হরিণীর ভয় ভেঙে গেল, সে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এল রাখাল ছেলের কাছে। সে তার পাশটিতে এসে চোখে চোখ মিলিয়ে শুনতে লাগল তার বাঁশি। অবোধ বনের পশু মুগ্ধ হল বাঁশির তানে। তারপর প্ৰতিদিন সে এসে বাঁশি শুনত, যতক্ষণ না তার রেশটুকু মিলিয়ে যেত বনান্তরে। হরিণীর মা-র কিন্তু পছন্দ হল না তার মেয়ের এই বাঁশি-শোনা। তাই সে মেয়েকে বলল : ও আমার দুষ্ট মেয়ে রোজ সকালে নদীর ধারে যাস কেন ধেয়ে। ভুল ক’রে আর যাসিনেরে তুই শুনতে বাঁশি ওরা সব দুষ্ট মানুষ মন ভুলাবে মিষ্টি হাসি বুঝি বা ফাঁদ পেতেছে ওরা তোকে একলা পেয়ে।। তখন হরিণী তার মা-কে বুঝোয় : না গো মা, ভয় ক’রো না। সে তো মানুষ নয়। সে যে গো রাখাল ছেলে আমি তার কাছে গেলে বড্ড খুশি হয়। এমনি ক’রে সুরের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে হরিণী। রাখাল ছেলে হরিণীকে শোনায় বাঁশি, আর হরিণী রাখাল ছেলেকে শোনায় গান : তোমার বাঁশির সুরা যেন গো নদীর জলে ঢেউয়ের ধ্বনি, পাতায় পাতায় কাঁপন জাগায় মাতায় বনের দিনরাজনী। সকাল হলে যখন হেথায় আস বাঁশির সুরে সুরে আমায় গভীর ভালবাসো– মনের পাখায় উড়ে আমি স্বপনপুরে যাই তখনি।। কিন্তু হরিণীর নিত্য স্বপনপুরে যাওয়া আর হল না। একদিন এক শিকারী এল সেই বনে। দূর থেকে সে অবাক হয়ে দেখল একটি রাখাল ছেলে বিহ্বল হয়ে বঁশি বাজিয়ে চলেছে আর একটি বন্য হরিণী তার পাশে দাড়িয়ে তার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। কিন্তু শিকারীর মন ভিজল না। সেই স্বৰ্গীয় দৃশ্যে, সে এই সুযোগের অপব্যয় না করে বধ করল হরিণীকে। মৃত্যুপথযাত্রী হরিণী তখন রাখাল ছেলেকে বললে–বাঁশিতে মুগ্ধ হয়ে তোমাদের আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সেই তুমি, বোধহয় মানুষ বলেই, আমার মৃত্যুর কারণ হলে। তবু তোমায় মিনতি করছি : বাঁশি তোমার বাজাও বন্ধু আমার মরণকালে, মরণ আমার আসুক আজি বাঁশির তালে তালে। যতক্ষণ মোর রয়েছে প্ৰাণ শোনাও তোমার বাঁশরির তান বাঁশির তরে মরণ আমার ছিল মন্দ-ভালে। বনের হরিণ আমি যে গো কারুর সাড়া পেলে, নিমেষে উধাও হতাম সকল বাধা ঠেলে। সেই আমি বাঁশরির তানে কিছুই শুনিনি কানে তাই তো আমি জড়ালেম এই কঠিন মরণ-জালে।। বাঁশি শুনতে শুনতে ধীরে ধীরে হরিণীর মৃত্যু হল। সাখীকে হারিয়ে রাখাল ছেলে অসীম দুঃখ পেল। সে তখন কেঁদে বললে : বিদায় দাও গো বনের পাখি! বিদায় নদীর ধার, সাথীকে হারিয়ে আমার বাঁচা হল ভার। আর কখনো হেথায় আসি বাজাব না এমন বাঁশি আবার আমার বাঁশি শুনে মরণ হবে কার। বনের পাখি, নদীর ধার সবাই তাকে মিনতি করলে-তুমি যেও না। যেও না গো রাখাল ছেলে আমাদেরকে ছেড়ে, তুমি গেলে বনের হাসি মরণ নেবে কেড়ে, হরিণীর মরণের তরে কে কোথা আর বিলাপ করে ক্ষণিকের এই ব্যথা তোমার আপনি যাবে সরে। দূর থেকে শুধু রাখাল ছেলে বলে গেল : ডেকো না গো তোমরা আমায় চলে যাবার বেলা, রাখাল ছেলে খেলবে না আর মরণ-বাঁশির খেলা।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
লেজের কাহিনী সুকান্ত ভট্টাচার্য একটি মাছি একজন মানুষের কাছে উড়ে এসে বলল : তুমি সব জানোয়ারের মুরুব্বি, তুমি সব কিছুই করতে পার, কাজেই আমাকে একটি লেজ করে দাও। মানুষটি বললে : কি দরকার তোমার লেজের? মাছিটি বললে : আমি কি জন্যে লেজ চাইছি? যে জন্যে সব জানোয়ারের লেজ আছে–সুন্দর হবার জন্যে। মানুষটি তখন বলল : আমি তো কোন প্ৰাণীকেই জানি না যার শুধু সুন্দর হবার জন্যেই লেজ আছে। তোমার লেজ না হলেও চলবে। এই কথা শুনে মাছিটি ভীষণ ক্ষেপে গেল আর সে লোকটিকে জব্দ করতে আরম্ভ করে দিল। প্ৰথমে সে বসল তার আচারের বোতলের ওপরে, তারপর নাকে সুড়সুড়ি দিল, তারপর এ-কানে ও-কানে ভন্‌ভন্‌ করতে লাগল। শেষকালে লোকটি বাধ্য হয়ে তাকে বলল : বেশ, তুমি উড়ে উড়ে বনে, নদীতে, মাঠে যাও, যদি তুমি কোনো জন্তু, পাখি কিংবা সরীসৃপ দেখতে পাও যার কেবল সুন্দর হবার জন্যেই লেজ আছে, তার লেজটা তুমি নিতে পার। আমি তোমায় পুরো অনুমতি দিচ্ছি। এই কথা শুনে মাছিটি আহলাদে আটখানা হয়ে জানালা দিয়ে সোজা উড়ে চলে গেল। বাগান দিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পেল একটা গুটিপোকা পাতার ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে। সে তখন গুটিপোকার কাছে উড়ে এসে চেচিয়ে বলল : গুটিপোকা! তুমি তোমার লেজটা আমাকে দাও, ওটা তো কেবল তোমার সুন্দর হবার জন্যে। গুটিপোকা : বটে? বটে? আমার মোটে লেজই হয় নি, এটা তো আমার পেট। আমি ওটাকে টেনে ছোট করি, এইভাবে আমি চলি। আমি হচ্ছি, যাকে বলে, বুকে-হাঁটা প্ৰাণী। মাছি দেখল তার ভুল হয়েছে, তাই সে দূরে উড়ে গেল। তারপর সে নদীর কাছে এল। নদীর মধ্যে ছিল একটা মাছ আর একটা চিংড়ি। মাছি মাছটিকে বলল। তোমার লেজটা আমায় দাও, ওটা তো কেবল তোমার সুন্দর হবার জন্যে আছে। মাছ বলল : এটা কেবল সুন্দর হবার জন্যে আছে তা নয়, এটা আমার দাঁড়। তুমি দেখ, যদি আমি ডান-দিকে বেঁকতে চাই তাহলে লেজটা আমি বাঁ-দিকে বেঁকাই আর বাঁ-দিকে চাইলে ডান-দিকে বেঁকাই। আমি কিছুতেই আমার লেজটি তোমায় দিতে পারি না। মাছি তখন চিংড়িকে বলল : তোমার লেজটা তাহলে আমায় দাও, চিংড়ি। চিংড়ি জবাব দিল : তা আমি পারব না। দেখ না, আমার পা-গুলো চলার পক্ষে কি রকম সরু আর দুর্বল, কিন্তু আমার লেজটি চওড়া আর শক্ত। যখন আমি জলের মধ্যে এটা নাড়ি, তখন এ আমায় ঠেলে নিয়ে চলে। নাড়ি-চাড়ি, নাড়ি-চাড়ি-আর যেখানে খুশি সাঁতার কেটে বেড়াই। আমার লেজও দাঁড়ের মতো কাজ করে। মাছি আরো দূরে উড়ে গেল। ঝোপের মধ্যে মাছি একটা হরিণকে তার বাচ্চার সঙ্গে দেখতে পেল। হরিণটির ছোট্ট একটি লেজ ছিল-ক্ষুদে নরম, সাদা, লেজ। অমনি মাছি ভন ভন করতে আরম্ভ করল : তোমার ছোট্ট লেজটি দাও না হরিণ! হরিণ ভয় পেয়ে গেল। হরিণ বললে : কেন ভাই? কেন? যদি তোমায় আমি লেজটি দিই, তাহলে আমি যে আমার বাচ্চাদের হারাব। অবাক হয়ে মাছি বললে : তোমার লেজ তাদের কি কাজে লাগবে? হরিণ বললে : বাঃ, কী প্রশ্নই না তুমি করলে। ধর, যখন একটা নেকড়ে আমাদের তাড়া করে–তখন আমি বনের মধ্যে ছুটে গিয়ে লুকোই আর ছানারা আমার পিছু নেয়। কেবল তারাই আমায় গাছের মধ্যে দেখতে পায়, কেননা আমি আমার ছোট্ট সাদা লেজটা রুমালের মতো নাড়ি, যেন বলি : এই দিকে, বাছারা, এই দিকে। তারা তাদের সামনে সাদা মতো একটা কিছু নড়তে দেখে আমার পিছু নেয়। আর এইভাবেই আমরা নেকড়ের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচি, নিরুপায় হয়ে মাছি উড়ে গেল। সে উড়তে লাগল-যতক্ষণ না সে একটা বনের মধ্যে গাছের ডালে একটা কাঠঠোকরাকে দেখতে পেল। তাকে দেখে মাছি বলল : কাঠঠোকরা, তোমার লেজটা আমায় দাও। এটা তো তোমার শুধু সুন্দর হবার জন্যে! কাঠঠোকরা বললে : কী মাথা-মোটা তুমি! তাহলে কি করে আমি কাঠ ঠুকরে খাবার পাব? কি করে বাসা তৈরী করব বাচ্চাদের জন্যে? মাছি বলল : কিন্তু তুমি তো তা তোমার ঠোঁট দিয়েই করতে পার! কাঠঠোকরা জবাব দিল : ঠোঁট কেবল ঠোঁটই। কিন্তু লেজ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। তুমি দেখ, কিভাবে আমি ঠোকরাই। কাঠঠোকরা তার শক্ত লেজ দিয়ে গাছের ছাল আঁকড়ে ধরে গা দুলিয়ে এমন ঠোক্কর দিতে লাগল যে তার থেকে ছালের চোকলা উড়তে লাগল। মাছি এটা না মেনে পারল না যে, কাঠঠোকরা যখন ঠোকরায় তখন সে লেজের ওপর বসে। এটা ছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। এটা তার ঠেক্‌নার কাজ করে। মাছি আর কোথাও উড়ে গেল না। মাছি দেখতে পেল সব প্ৰাণীর লেজই কাজের জন্যে। বে-দরকারী লেজ কোথাও নেই–বনেও না, নদীতেও না। সে মনে মনে ভাবল–বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। “আমি লোকটাকে সোজা করবই। যতক্ষণ না সে আমায় লেজ করে দেয়। আমি তাকে কষ্ট দেব।” মানুষটি জানলায় বসে বাগান দেখছিল। মাছি তার নাকে এসে বসল। লোকটি নাক ঝাড়া দিল, কিন্তু ততক্ষণে সে তার কপালে গিয়ে ব’সে পড়েছে। লোকটি কপাল নাড়ল-মাছি তখন আবার তার নাকে? লোকটি কাতর প্রার্থনা জানাল : আমায় ছেড়ে দাও, মাছি। ভন ভন করে মাছি বলল : কিছুতেই তোমায় ছাড়ব না। কেন তুমি আমায় অকেজো লেজ আছে কি না দেখতে পাঠিয়ে বোকা বানিয়েছে। আমি সব প্ৰাণীকেই জিগ্‌গেস করেছি—তাদের সবার লেজই দরকারী। লোকটি দেখল মাছি ছাড়বার পাত্র নয়—এমনই বদ এটা। একটু ভেবে সে বলল; মাছি, মাছি। দেখ, মাঠে গরু রয়েছে। তাকে জিগগেস করো তার লেজের কী দরকার। মাছি জানলা দিয়ে উড়ে গিয়ে গরুর পিঠে বসে ভন ভন করে জিগগেস করল : গরু, গরু। তোমার লেজ কিসের জন্যে? তোমার লেজ কিসের জন্যে? গরু একটি কথাও বলল না-একটি কথাও না। তারপর হঠাৎ সে তার লেজ দিয়ে নিজের পিঠে সপাৎ করে মারল—আর মাছি ছিটকে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ে মাছির শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেলা-পা দুটো উচু হয়ে রইল। আকাশের দিকে। লোকটি জানলা থেকে বলল : এ-ই ঠিক করেছে মাছির। মানুষকে কষ্ট দিও না, প্ৰাণীদেরও কষ্ট দিও না। তুমি আমাদের কেবল জ্বালিয়ে মেরেছি। [ সোভিয়েট শিশুসাহিত্যিক ভি. বিয়াঙ্কির “টেইল্‌স্‌” গল্পের অনুবাদ। ]
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ষাঁড়-গাধা-ছাগলের কথা সুকান্ত ভট্টাচার্য একটি লোকের একটা ষাঁড়, একটা গাধা আর একটা ছাগল ছিল। লোকটি বেজায় অত্যাচার করত তাদের ওপর। ষাঁড়কে দিয়ে ঘানি টানোত, গাধা দিয়ে মাল বওয়াত আর ছাগলের সবটুকু দুধ দুয়ে নিয়ে বাচ্চাদের কেটে কেটে খেত, কিন্তু তাদের কিছুই প্ৰায় খেতে দিত না। কথায় কথায় বেদম প্ৰহার দিত। তিনজনেই সব সময় বাধা থাকত, কেবল রাত্তির বেলায় ছাগলছানাদের শেয়ালে নিয়ে যাবে ব’লে গোয়ালঘরের মাচায় ছাগলকে না বেঁধেই ছানাদের সঙ্গে রাখা হত। একদিন দিনের বেলায় কি ক’রে যেন ষাঁড়, গাধা, ছাগল তিনজনেই ছাড়া অবস্থায় ছিল। লোকটিও কি কাজে বাইরে গিয়ে ফিরতে দেরি ক’রে ফেলল। তিনজনের অনেক দিনের চাড়া দিয়ে উঠতেই গাধা সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ভাল ভাল জি খেতে আরম্ভ করল। ষাঁড়টা কিছুক্ষণের মধ্যেই সাফ করে ফেলল লোকটির চমৎকার তরকারির বাগানটা। ছাগলটা আর কী করে, কিছুই যখন খাবার নেই, তখন সে বারান্দায় মেলা একটা আস্ত কাপড় খেয়ে ফেলল মনের আনন্দে। লোকটি ফিরে এসে কাণ্ড দেখে তাজব ব’নে গেল। তারপর চেলাকাঠ দিয়ে এমন মার মারল তিনজনকে যে আশপাশের পাঁচটা গ্ৰাম জেনে গেল লোকটির বাড়ি কিছু হয়েছে। সেদিনকার মতো তিনজনেরই খাওয়া বন্ধ করে দিল লোকটি। রাত হতেই মাচা থেকে টুক ক’রে লাফিয়ে পড়ল ছাগল। তারপর গাধা আর ষাঁড়কে জিজ্ঞেস করল : গাধা ভাই, ষাঁড় ভাই, জেগে আছ। দুজনেই বলল : হ্যাঁ, ভাই! ছাগল বলল : কি করা যায়? ওরা বলল : কী আর করব, গলা যে বাঁধা। ছাগল বলল সে জন্যে ভাবনা নেই, আমি কি-না খাই? আমি এখুনি তোমাদের গলার দড়ি দুটো খেয়ে ফেলছি। আর খিদেও যা পেয়েছে। ছাগল দড়ি দুটো খেয়ে ফেলতেই তিনজনের পরামর্শ-সভা। শুরু হয়ে গেল। তারা পরামর্শ করে একটা ‘সমিতি’ তৈরী করল। ঠিক হল আবার যদি এই রকম হয়, তাহলে তিনজনেই একসঙ্গে লোকটিকে আক্রমণ করবে। ষাঁড় আর গাধা দুজনে একমত হয়ে ছাগলকে সমিতির সম্পাদক করল। কিন্তু গোল বাধল সভাপতি হওয়া নিয়ে। ষাঁড় আর গাধা দুজনেই সভাপতি হতে চায়। বেজায় ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। শেষকালে তারা কে বেশী যোগ্য ঠিক করবার জন্যে, সালিশী মানতে মোড়লের বাড়ি গেল। ছাগলকে রেখে গেল লোকটির ওপর নজর রাখতে। মোড়ল ছিল লোকটির বন্ধু। গাধাটা চেঁচামেচি করে ঘুম ভাঙাতেই বাইরে বেরিয়ে মোড়ল চিনল এই দুটি তার বন্ধুর ষাঁড় আর গাধা। সে সব কথা শুনে বলল : বেশ, তোমরা এখন আমার বাইরের ঘরে খাও আর বিশ্রাম কর, পরে তোমাদের বলছি কে যোগ্য বেশী। ব’লে সে তার গোয়ালঘর দেখিয়ে দিল। দুজনেরই খুব খিদে। তারা গোয়ালঘরে ঢুকতেই মোড়ল গোয়ালের শিকল তুলে দিয়ে বলল : মানুষের বিরুদ্ধে সমিতি গড়ার মজাটা কি, কাল সকালে তোমাদের মনিবের হাতে টের পাবে। এদিকে অনেক রাত হয়ে যেতেই ছাগল বুঝল ওরা বিপদে পড়েছে, তাই আসতে দেরি হচ্ছে। সে তার ছানাদের নিয়ে প্ৰাণের ভয়ে ধীরে ধীরে লোকটির বাড়ি ছেড়ে চলে গেল বনের দিকে। সকাল হতেই খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল চারিদিকে। লোকটি এক সময়ে খবর পেল ষাঁড় আর গাধা আছে তার মোড়ল-বন্ধুর বাড়ি। আমনি দড়ি আর লাঠি নিয়ে ছুটল সে মোড়লের কাছে, জানোয়ার আনতে। ‘মানুষকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই’ এই কথা ভাবতে ভাবতে খালি পেটে ষাঁড় আর গাধা পালাবার মতলব আঁটছিল। এমন সময় সেখানে লোকটি হাজির হল। তারপর লোকটির হাতে প্ৰচণ্ড মার খেতে খেতে ফিরে এসে গাধা আর ষাঁড় আবার মাল বইতে আর ঘানি টানতে শুরু করল আগের মতোই। কেবল ছাগলটাই আর কখনো ফিরে এল না। কারণ অনেক মহাপুরুষের মতো ছাগলটারও একটু দাড়ি ছিল। উপদেশ : নিজের কাজের মীমাংসা করতে অন্যের কাছে কখনো যেতে নেই।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হরতাল সুকান্ত ভট্টাচার্য রেলে ‘হরতাল’ ‘হরতাল’ একটা রব উঠেছে। সে খবর ইঞ্জিন, লাইন, ঘণ্টা, সিগন্যাল এদের কাছেও পৌঁছে গেছে। তাই এরা একটা সভা ডাকল। মস্ত সভা। পূর্ণিমার দিন রাত দুটোয় অস্পষ্ট মেঘে ঢাকা চাদের আলোর নীচে সবাই জড়ো হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বিশালবপু সভাপতি ইঞ্জিন মশাই এলেন। র্তার লেট হয়ে গেছে। লম্বা চেহারার সিগন্যাল সাহেব এলেন হাত দুটো লাটুপটু করতে করতে, তিনি কখনো নীল চোখে, কখনো লাল চোখে তাকান। বন্দুক উচোনো সিপাইদের মতো সারি বেঁধে এলেন লাইন-ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতলেরা। ঠকাঠক ঠকাঠক করতে করতে রোগা রোগ লাইন আর টেলিগেরাফের খুঁটির মিছিল করে সভা ভরিয়ে দিল। ফাজলামি করতে করতে ইস্‌টিশানের ঘণ্টা আর গার্ড সাহেবের লাল-সবুজ নিশানেরাও হাজির। সভা জমজমাট। সভাপতি শুরু করলেন : “ভাইসব, তোমরা শুনেছ মানুষ-মজুরের হরতাল করছে। কিন্তু মানুষ-মজুরেরা কি জানে যে তাদের চেয়েও বেশী কষ্ট করতে হয় আমাদের, এইসব ইঞ্জিন-লাইন-সিগন্যাল-ঘণ্টাদের? জানলে তারা আমাদের দাবিগুলিও কর্তাদের জানাতে ভুলত না। বন্ধুগণ, তোমরা জানো আমার এই বিরাট গতরটার জন্যে আমি একটু বেশী খাই, কিন্তু যুদ্ধের আগে যতটা কয়লা খেতে পেতুম এখন আর ততটা পাই না, অনেক কম পাই। অথচ অনেক বেশী মানুষ আর মাল আমাদের টানতে হচ্ছে যুদ্ধের পর থেকে। তাই বন্ধুগণ, আমরা এই ধর্মঘটে সাহায্য করব। আর কিছু না হোক, বছরের পর বছর একটানা খাটুনির হাত থেকে কয়েক দিনের জন্যে আমরা রেহাই পাব। সেইটাই আমাদের লাভ হবে। তাতে শরীর একটু ভাল হতে পারে। প্ৰস্তাব সমর্থন করে ইঞ্জিনের চাকার বলল : ধৰ্মঘট হলে আমরা এক-পাও নড়ছি না, দাঁতে দাঁত দিয়ে পড়ে থাকব সকলে। সিগন্যাল সাহেব বলল : মানুষ-মজুর আর আমাদের বড়বাবু ইঞ্জিন মশাইরা তবু কিছু খেতে পান। আমরা কিছুই পাই না, আমরা খাঁটি মজুর। হরতাল হলে আমি আর রাস্তার পুলিশের মতো হাত ওঠান-নামান মানবো না; চোখ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে পড়ে থাকব। লাইন ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতল বলল : আমরাও হরতাল করব। হরতালের সময় হাজার ঠেলাঠেলিতেও আমরা নড়ছি না। দেখি কি করে লাইন ক্লিয়ার হয়। লাইনেরা বলল : ঠিক ঠিক, আমরাও নট নড়ন-চড়ন, দাদা। ইস্‌টিশানের ঘণ্টা বলল : সে সময় আমায় খুঁজেই পাবে না কেউ। ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াব। লাল-সবুজ নিশান বন্ধুরাও আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। ট্রেন ছাড়বে কি করে? সভাপতি ইঞ্জিন মশাই বললেন : আমাকে বড়বাবু ইঞ্জিন মশাই বলে আর সম্মান করতে হবে না। আমি তোমাদের, বিশেষ করে আমার অধীনস্থ কর্মচারী চাকাদের কথা শুনে এতই উৎসাহিত হয়েছি যে আমি ঠিক করেছি। অনশন ধর্মঘট করব। এক টুকরো কয়লাও আমি খাব না, তাহলেই সব আচল হয়ে পড়বে। এদিকে কতকগুলো ইস্‌টিশানের ঘড়ি আর বাঁশি এসেছিল কর্তাদের দালাল হয়ে সভা ভাঙবার জন্যে। সভার কাজ ঠিক মতো হচ্ছে দেখে বাঁশিগুলো টিক টিক করে টিটুকিরী মেরে হট্টগোল করতে লাগল। আমনি সবাই হৈ হৈ করে তেড়ে মেড়ে মারতে গেল ঘড়ি আর বাঁশিদের। ঘড়িরা আর কী করে, প্ৰাণের ভয়ে তাড়াতাড়ি ছ’টা বাজিয়ে দিল। আমনি সূৰ্য উঠে পড়ল। দিন হতেই সকলে ছুটে চলে গেল যে যার জায়গায়। সভা আর সেদিন হল না।
জীবনানন্দ দাশ
নীলিমা জীবনানন্দ দাশ রৌদ্র-ঝিলমিল উষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে-বারে নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে। উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী, উগ্র চুল্লীবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি’, আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা, মরীচিকা-ঢাকা। অগণন যাত্রিকের প্রাণ খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান; চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল; হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী! জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী; স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা! চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা, জ্ব’লে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা! বসুধার অশ্রুপাংশু আতপ্ত সৈকত, ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ, লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার ডুবে যায় নীলিমায়—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে, শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে; ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
জীবনানন্দ দাশ
পিরামিড জীবনানন্দ দাশ বেলা ব’য়ে যায়, গোধূলির মেঘ-সীমানায় ধূম্রমৌন সাঁঝে নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে, শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে; পান্থ ম্লান চিতার কবলে একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ; কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ— কি এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন! অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের; কোন্ দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের দেউটি নিভায়ে গেছে—চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া, চ’লে গেছে প্রিয়তম—চ’লে গেছে প্রিয়া যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী কবে কোন বেলাশেষে হায় দূর অস্তশেখরের গায়। তোমারে যায়নি তা’রা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া; সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী, তোরণে আসেনি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী অশ্রু-ছলছল চোখে পাণ্ডুর বদনে; কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তা’রা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে জানো নাই তুমি; জানে না তো মিশরের মুক মরুভূমি তাদের সন্ধান। হে নির্বাক পিরামিড,—অতীতের স্তব্ধ প্রেতপ্রাণ, অবিচল স্মৃতির মন্দির, আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি ব’সে আছে স্থির; নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে মেঘরক্ত ময়ূখের পানে, জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে নূতন ভাস্কর; বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর নবোদিত অরুণের সনে— কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে! পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধিরফোয়ারা— কী এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া! থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন; শতাব্দীর বিরহীর মন নিটল নিথর সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত পীত সাগরের ’পর; বালুকার স্ফীত পারাবারে লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি’ মৌন ভিক্ষা মাগি। খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার মুখরিত প্রাণের সঞ্চার ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়— বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই ব’সে আছে পিরামিড হায়। কতো আগন্তুক কাল অতিথি সভ্যতা তোমার দুয়ারে এসে ক’য়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা, তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল, তুমি রহো নিরুত্তর—নির্বেদী—নিশ্চল মৌন—অন্যমনা; প্রিয়ার বক্ষের ’পরে বসি’ একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা— হে প্রেমিক—স্বতন্ত্র স্বরাট। কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট উঠিবে জাগিয়া, সস্মিত নয়ন তুলি’ কবে তব প্রিয়া আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডু চূর্ণ ব্যথিত কপোলে, মিশরঅলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্ব’লে, ব’সে আছে অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই; ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি–প্রেমের প্রহরা। মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা হেমন্তের বিদায়-কুহেলি— অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান দু-দিনের তরে শুধু; নবোৎফুল্লা মাধবীর গান মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে নিমেষে চকিতে; অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে।
জীবনানন্দ দাশ
সেদিন এ-ধরণীর জীবনানন্দ দাশ সেদিন এ-ধরণীর সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড় মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো। দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল, সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি, অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার। সেইদিন মোর অভিসার মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে ভেসেছিলো আতুর উদাসী; বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি সেদিন শুনিনি তাহা; ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে। আমার এ শিরা-উপশিরা চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন, শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন— মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার; ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়, আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি, কঙ্কালের রাশি, দাউ-দাউ চিতা, কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা, সর্বনাশ ব্যসন বাসনা, কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা, কতো তিথি—কতো যে অতিথি— কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি করেছিলো উতলা আমারে। আধো আলো—আধেক আঁধারে মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে, মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে; ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া; মাঝপথে থেমে গেল তা'রা সব; শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে, নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে অসীমের আঁচলের তলে স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে— দূর ছায়াপথে। পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি; ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে; সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা, সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা, মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে; মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ; জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া, এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া; তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী, মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি, উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি, মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী; মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে— কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা! নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে, সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
জীবনানন্দ দাশ
অবসরের গান জীবনানন্দ দাশ শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে; মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয়; বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময় চারিদিকে এখন সকাল— রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল; মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ— পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান। চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল; প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে, যেই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর, চারিদিকে ছায়া—রোদ—খুদ—কুঁড়ো—কার্তিকের ভিড়; চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হ’তেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার— শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে; আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস; মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য—জয়—সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিলো তুলে নেবো তার শীতলতা; ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব; মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে— শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব। হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয়; দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ– আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরাযে গিয়েছে খেতে—রোদ গেছে প’ড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে; তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়; হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালীর বিছানার ’পর; মদের ফোঁটার শেষ হ’য়ে গেছে এ-মাঠের মাটির ভিতর, তখন সবুজ ঘাস হ’য়ে গেছে শাদা সব, হ’যে গেছে আকাশ ধবল, চ'লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদেব দল। ২ পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে এসেছে বাহির হ’য়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের ’পরে; সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চ’লে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা; শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা। ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন; ফসল—ধানের ফলে যাহাদের মন ভ'রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন— আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়— যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটিব নিচে পৃথিবীর তলে; কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায়নি তাদের সময়, পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তা’রা করে নাই ভয়, প্রণয়ীর মতো তা’রা ছেঁড়েনি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেযেদের নামে; চাষীদের মতো তা’রা ক্লান্ত হ’যে কপালের ঘামে কাটায়নি—কাটায়নি কাল; অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে, যোদ্ধা—জয়ী—বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে—পাশাপাশি— জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তা’রা চ'লে গেছে—তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়— আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা—জানে তাহা নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে-সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে-ডেকে। মাটির নিচের থেকে তা’রা মৃতের মাথার স্বপ্নে ন'ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভূত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে— আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে। সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর—বন্দর—বস্তি—কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই খেতে; শরীরের অবসাদ–হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন জমি উপ্‌ড়ায়ে ফেলে চ’লে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে—পুরানো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে— দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে যায় চাঁদ; অবসর আছে তার—অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে, এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে। ৩ ফুরোনো খেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নেই, কোনো কৃষকের মতো দরকার নেই দূরে মাঠে গিয়ে আর; রোধ—অবরোধ—ক্লেশ—কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়, জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে— কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়; আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং; দামামা থামায়ে ফেল—পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক্ রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ। এখানে নাহিকো কাজ—উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকে ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়। সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন— জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হ’তে হবেনাকো, ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই—এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়; এইখানে কাজ এসে জমেনাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে; এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর, রাখিবে না চোখ আর নয়নের ’পর; ভালোবাসা আসিবে না— জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে
জীবনানন্দ দাশ
ক্যাম্পে জীবনানন্দ দাশ এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি; সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি— কাহারে সে ডাকে! কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার; বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিযাছে, আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন, এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ঘুম আর আসেনাকো বসন্তের রাতে। চারিপাশে বনের বিস্ময়, চৈত্রের বাতাস, জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন; ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; কোথাও অনেক বনে—যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার; তাহারা পেতেছে টের, আসিতেছে তার দিকে। আজ এই বিস্ময়ের রাতে তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে; তাহাদের হৃদয়ের বোন বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়— পিপাসার সান্ত্বনায়—আঘ্রাণে—আস্বাদে; কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন; মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই, সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু; কেবল পিপাসা আছে, রোমহর্ষ আছে। মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়; লালসা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হ’য়ে উঠিতেছে সব দিকে আজ এই বসন্তের রাতে; এইখানে আমার নকটার্ন। একে-একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে, সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে দাঁতের—নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই সুন্দরী গাছের নিচে—জ্যোৎস্নায়, মানুষ যেমন ক’রে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে হরিণেরা আসিতেছে। —তাদের পেতেছি আমি টের অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায, ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়। ঘুমাতে পারি না আর; শুয়ে-শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি; তারপর বন্দুকের শব্দ শুনি। চাঁদের আলোষ ঘাইহরিণী আবার ডাকে, এইখানে প’ড়ে থেকে একা-একা আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জ’মে ওঠে বন্দুকের শব্দ শুনে-শুনে হরিণীর ডাক শুনে-শুনে। কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া; সকালে—আলোয় তাকে দেখা যাবে— পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে। মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তাকে এই সব। আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো, …মাংস-খাওয়া হ’লো তবু শেষ? …কেন শেষ হবে? কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে তাদের মতন নই আমিও কি? কোনো এক বসন্তের রাতে জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়—দখিনা বাতাসে ওই ঘাইহরিণীর মতো? আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ— পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে? আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো যখন ধূলায রক্তে মিশে গেছে এই হবিণীব মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি জীবনের বিস্ময়ের রাতে কোনো এক বসন্তের রাতে? তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে। মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস ল’য়ে আমরাও প’ড়ে থাকি; বিয়োগের—বিয়োগের—মরণের মুখে এসে পড়ে সব ঐ মৃত মৃগদের মতো। প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন ল’য়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা-মৃত্যু পাই; পাই না কি? দোনলার শব্দ শুনি। ঘাইমৃগী ডেকে যায়, আমার হৃদয়ে ঘুম আসেনাকো এক-একা শুয়ে থেকে; বন্দুকের শব্দ তবু চুপে-চুপে ভুলে যেতে হয়। ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে; যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা ম’রে যায় হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন; ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয় কথা ভেবে—কথা ভেবে-ভেবে। এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে— কোথাও ফড়িঙে-কীটে—মানুষের বুকের ভিতরে, আমাদের সবের জীবনে। বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই।
জীবনানন্দ দাশ
নির্জন স্বাক্ষর জীবনানন্দ দাশ তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে; যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’— পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার! তোমার এ জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই; শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে; আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে, —আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে। রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে— আকাশ ছডায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে; জীবনের রং তবু ফলানো কি হয় এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময় পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল, চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল; রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে কোনো এক মানুষের তরে যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে। একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা; যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে। নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়— পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে ব’লে; আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে কোনো এক মানুষীর তরে যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে। আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত। যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে আমার শরীরে— যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে তুমি আছো জেগে— যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে আছো; জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়। হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়; কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত— তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার। যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি; তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু— বাহিরের আকাশের শীতে নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝ’রে— ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে। জানোনাকো তুমি তার স্বাদ— তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ, জীবন অগাধ। হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার। তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে। আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে; আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।
জীবনানন্দ দাশ
পাখিরা জীবনানন্দ দাশ ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে— বসন্তের রাতে বিছানায় শুয়ে আছি; —এখন সে কতো রাত! ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর। তারপর চ’লে যায় কোথায় আকাশে? তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে। শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে, চোখ আর চায় না ঘুমাতে; জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে, সাগরের জলের বাতাসে আমার হৃদয় সুস্থ হয়; সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে— সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়? সাগরের ওই পারে—আরো দূর পারে কোনো এক মেরুর পাহাড়ে এই সব পাখি ছিলো; ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে দলে-দলে সমুদ্রের ’পর নেমেছিলো তারা তারপর, মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে। বাদামী—সোনালি—শাদা—ফুট্‌ফুট্‌ ডানার ভিতরে রবারের বলের মতন ছোটো বুকে তাদের জীবন ছিলো— যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ-লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে তেমন অতল সত্য হ’য়ে। কোথাও জীবন আছে—জীবনের স্বাদ রহিয়াছে, কোথাও নদীর জল র’য়ে গেছে–সাগরের তিতা ফেনা নয়, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় এই জানিয়াছে; কোথাও রয়েছে প’ড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে তা’রা আসিয়াছে। তারপর চ’লে যায় কোন এক খেতে; তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে-যেতে সে কি কথা কয়? তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময়। অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ-মাটির ঘ্রাণ, ভালোবাসা আর ভালোবাসার সন্তান, আর সেই নীড়, এই স্বাদ—গভীর—গভীর। আজ এই বসন্তের রাতে ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে; ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর
জীবনানন্দ দাশ
বোধ জীবনানন্দ দাশ আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে; স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়; আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়। সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে। কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার। সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে, শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, শরীরে জলের গন্ধ মেখে, উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে চাষার মতন প্রাণ পেয়ে কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে? স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে। পথে চ’লে পারে—পারাপারে উপেক্ষা করিতে চাই তারে; মড়ার খুলির মতো ধ’রে আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে তবু সে মাথার চারিপাশে, তবু সে চোখের চারিপাশে, তবু সে বুকের চারিপাশে; আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে। আমি থামি— সেও থেমে যায়; সকল লোকের মাঝে ব’সে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা? জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মতো হ’য়ে— সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়, কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে; তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন আমার মনের মতো না কি? —তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী। হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল? বাল্‌টিতে টানিনি কি জল? কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে? মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে ঘুরিয়াছি; পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে গিয়েছে জড়ায়ে; –এই সব স্বাদ; —এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ বয়েছে জীবন, নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন এক দিন; এই সব সাধ জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ; চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে; ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে; আমারে সে ভালোবাসিয়াছে, আসিয়াছে কাছে, উপেক্ষা সে করেছে আমারে, ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে ভালোবেসে তারে; তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা; আমি তার উপেক্ষার ভাষা আমি তার ঘৃণার আক্রোশ অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা আমি তা’ ভুলিয়া গেছি; তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা। মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে। আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে: সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়! অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়? কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন! মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন! শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন! এই বোধ—শুধু এই স্বাদ পায় সে কি অগাধ—অগাধ! পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ চায় না সে? করেছে শপথ দেখিবে সে মানুষের মুখ? দেখিবে সে মানুষীর মুখ? দেখিবে সে শিশুদের মুখ? চোখে কালো শিরার অসুখ, কানে যেই বধিরতা আছে, যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে, যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে —সেই সব।
জীবনানন্দ দাশ
মাঠের গল্প জীবনানন্দ দাশ মেঠো চাঁদ মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি—খড়—নাডা—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল। মেঠো চাঁদ—কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা— চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত—নাই লেখা-জোখা। মেঠো চাঁদ বলে: ‘আকাশের তলে খেতে-খেতে লাঙলের ধার মুছে গেছে—ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে—চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিয়া গেছে—তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে এক-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে খড়-নাড়া—পোড়ো জমি—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’ ..... আমি তারে বলি: ‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি, শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো— বুড়ো হ’য়ে গেছ তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো! খেতে-খেতে লাঙলের ধার মুছে গেছে কতোবার—কতোবার ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিযা গেছে—তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি—খড়-নাড়া—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’ পেঁচা প্রথম ফসল গেছে ঘরে— হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল; অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে হিম হ’য়ে আসে বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা; বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; ধানখেতে—মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা; ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী— তবু পাই টের কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের কোনো সাধ। হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে, শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে, পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জাগে এক অঘ্রাণের রাতে সেই পাখি; আজ মনে পড়ে সেদিনও এমনি গেছে ঘরে প্রথম ফসল; মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর, কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুর; হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে, শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে, পাথার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে, মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জেগেছিলো অঘ্রাণের রাতে এই পাখি। নদীটির শ্বাসে সে-রাতেও হিম হ’য়ে আসে বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা, বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; ধানখেতে মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা, ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী, তবু আমি পেয়েছি যে টের কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের কোনো সাধ। পঁচিশ বছর পরে শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে— বলিলাম—‘একদিন এমন সময় আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়— পঁচিশ বছর পরে।’ এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে; তারপর, কতোবার চাঁদ আর তারা মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা জ্যোৎস্নায় ধানখেত খুঁজে এলো গেল; চোখ বুজে কতোবার ডানে আর বাঁয়ে পড়িল ঘুমায়ে কতো-কেউ; রহিলাম জেগে আমি একা; নক্ষত্র যে-বেগে ছুটিছে আকাশে তার চেয়ে আগে চ’লে আসে যদিও সময়, পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়! তারপর—একদিন আবার হলদে তৃণ ভ’রে আছে মাঠে, পাতায়, শুকনো ডাঁটে ভাসিছে কুয়াশা দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা শিশিরে গিয়েছে ভিজে—পথের উপর পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়্‌কড়্‌; শসাফুল—দু-একটা নষ্ট শাদা শসা, মাকড়ের ছেঁড়া জাল—শুক্‌নো মাকড়সা লতায়—পাতায়; ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়; দেখা যায় কয়েকটা তারা হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে, পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে! কার্তিক মাঠের চাঁদ জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ— পাহাড়ের মতো ওই মেঘ সঙ্গে ল’য়ে আসে মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে যখন তোমারে, —মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিলো যারে; ছেঁড়া-ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে তরাসে ছেলের মতো—আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক সময়— তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে—চাঁদ; পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়, একদিন হয়েছে যা—তারপর হাতছাড়া হ’য়ে হারায়ে ফুরায়ে গেছে—আজো তুমি তার স্বাদ ল’য়ে আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছো এসে! নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে, শস্যের খেত চ’ষে-চ’ষে গেছে চাষা চ’লে; তাদের মাটির গল্প—তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে অনেক তবুও থাকে বাকি— তুমি জানো—এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি!
জীবনানন্দ দাশ
মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ দাশ আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে; আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো, খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার: পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো! বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক; আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক; আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে, আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে; শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস; দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ, হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ, চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে; মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে, বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে, নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে, খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে; বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে; নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে; আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল; পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে; আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ, প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ; আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা; চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির: পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর; আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে। কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
জীবনানন্দ দাশ
শকুন জীবনানন্দ দাশ মাঠ থেকে মাঠে-মাঠে—সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে-আকাশে শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি; নিস্তব্ধ প্রান্তর শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে আরেক আকাশ যেন—সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর কঠিন মেঘের থেকে; যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ প’ড়ে গেছে—প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার খেত মাঠ প্রান্তরের পর এই সব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহূর্ত শুধু; আবার করিছে আরোহণ আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে—পাহাড়ের শিঙে-শিঙে সমুদ্রের পারে; একবার পৃথিবীর শোভা দেখে, বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দ্যাখে তাই; একবার স্নিগ্ধ মালাবারে উড়ে যায়—কোন্ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন্ মৃত্যুর ওপারে; যেন কোন্ বৈতরণী অথবা এ-জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন কেঁদে ওঠে...চেয়ে দ্যাখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেই সব হূন।
জীবনানন্দ দাশ
সহজ জীবনানন্দ দাশ আমার এ-গান কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে— আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে, তবুও হৃদয়ে গান আসে। ডাকিবার ভাষা তবুও ভুলি না আমি— তবু ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে; পৃথিবীর কানে নক্ষত্রের কানে তবু গাই গান; কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি— আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে— তবুও হৃদয়ে গান আসে। তুমি জল, তুমি ঢেউ–সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ—তোমার সহজ মন ভেসে যায় সাগরের জলের আবেগে; কোন্ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিলো লেগে কোন্ অন্ধকারে জানে না সে; কোন্ ঢেউ তারে অন্ধকারে খুঁজিছে কেবল জানে না সে; রাত্রির সিন্ধুর জল রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ তুমি এক; তোমারে কে ভালোবাসে; তোমারে কি কেউ বুকে ক’রে রাখে। জলের আবেগে তুমি চ’লে যাও— জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধুধু জল তোমারে যে ডাকে। তুমি শুধু একদিন, এক রজনীর; মানুষের—মানুষীর ভিড় তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে—কতো দূরে— কোন্ সমুদ্রের পারে, বনে—মাঠে—কিংবা যে-আকাশ জুড়ে উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে— কিংবা যে-আকাশে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ জেগে ওঠে—ডুবে যায়—তোমার প্রাণের সাধ তাহাদের তরে; যেখানে গাছের শাখা নড়ে শীত রাতে—মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন— যেইখানে বন আদিম রাত্রির ঘ্রাণ বুকে ল’য়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান— তুমি সেইখানে। নিঃসঙ্গ বুকের গানে নিশীথের বাতাসের মতো একদিন এসেছিলে, দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত।
জীবনানন্দ দাশ
স্বপ্নের হাতে জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীর বাধা— এই দেহের ব্যাঘাতে হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে আমি তাই আমারে তুলিয়া দিতে চাই। যেই সব ছায়া এসে পড়ে দিনের রাতের ঢেউয়ে— তাহাদের তরে জেগে আছে আমার জীবন; সব ছেড়ে আমাদের মন ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে বেদনা পেত না তবে কেউ আর— থাকিত না হৃদয়ের জরা— সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা। আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে, সারা দিন— সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে, পৃথিবীর যত ব্যথা— বিরোধ— বাস্তব হৃদয় ভুলিয়া যায় সব; চাহিয়াছে অন্তর যে-ভাষা, যেই ইচ্ছা— যেই ভালোবাসা খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে-পারে গিয়া— স্বপ্নে তাহা সত্য হ’য়ে উঠেছে ফলিয়া। মরমের যত তৃষ্ণা আছে— তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপনের কাছে তোমরা চলিয়া এসো— তোমরা চলিয়া এসো সব! ভুলে যাও পৃথিবীর ওই ব্যথা— ব্যাঘাত— বাস্তব! সকল সময় স্বপ্ন— শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় যাদের অন্তরে, পরস্পরে যারা হাত ধরে নিরালা ঢেউয়ের পাশে-পাশে— গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম— মৃত্যু— সব— পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব শোনে না তাহারা; সন্ধ্যার নদীর জল— পাথরে জলের ধারা আয়নার মতো জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত তাহাদের তরে। তাদের অন্তরে স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় সকল সময় … পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা— সে-সব ব্যর্থতা আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া; দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়— ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি, তবে ওই পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে লিখিতে ষেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে অন্তরের কথা; আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে-সব ব্যর্থতা। পৃথিবীর ওই অধীরতা থেমে যায়— আমাদের হৃদয়ের ব্যথা দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে স্বপ্নেরে— ধ্যানেরে কাছে ডেকে লয়; উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়, মানুষেরো আয়ু শেষ হয়। পৃথিবীর পুরানো সে-পথ মুছে ফেলে রেখা তার— কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়! সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব— নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়!
জীবনানন্দ দাশ
অন্ধকার জীবনানন্দ দাশ গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে— কোনোদিন আর জাগবো না জেনে কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর— হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও, হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে রয়েছে যে অগাধ ঘুম সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই, তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও— জানো না কি চাঁদ, নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, জানো না কি নিশীথ, আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে বুঝতে পেরেছি আবার; ভয় পেয়েছি, পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা; দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে; আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে; সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে। হায়, উৎসব! হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই। যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ, সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি, শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর; এই সব ভয়াবহ আরতি! গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন। অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর; তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে— কোনোদিন জাগবো না জেনে— কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।
জীবনানন্দ দাশ
আবহমান জীবনানন্দ দাশ পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম। সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে; যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে; যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় খেতের গোধূম চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম গাঢ় ক’রে দিয়ে যায়। —এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের। সমুদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ নদীর তরঙ্গে— ক্রমে— তুষারের স্তূপে তার ঢেউ একবার টের পাবে— দ্বিতীয় বারের সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে টের এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে নির্জন খেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা; এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে; অঘ্রাণের বিকেলের কমলা আলোকে নিড়ানো খেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে; একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে। পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে নষ্ট হ’য়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে; সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে। ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হ’য়ে আসে। মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হ’লো মানুষের বৃত্তি আদায়। যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায় আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন। অভিভূত হ’য়ে আছে— চেয়ে দ্যাখো— বেদনার নিজের নিয়ম। নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়; জলপাই-অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা; ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়; প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে। সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়। পৃথিবীর রাজপথে— রক্তপথে— অন্ধকার অববাহিকায় এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়। তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মূক অপেক্ষায়; তাহার মাথার ’পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়; এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হ’য়ে থেকে ক্রমে একদিন কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ? চেয়েছে মাটির দিকে— ভূগর্ভে তেলের দিকে সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা, মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার; দূরবীনে কিমাকার সিংহের সাড়া পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে। বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তা’রা। যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে, মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে; চিরদিন এই সব হৃদয় ও রুধিরের ধারা। মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে; অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া। মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে ব’সে— অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে আমরা যতটা দূর চ’লে যাই— চেয়ে দেখি আরো-কিছু আছে তারপরে। অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে ছায়া ফেলে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে, কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে, অথবা যে-সব থাম সমীচীন মিস্ত্রির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে, তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ। হয়তো অনেক এগিয়ে তা’রা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোল্‌তার নেই অবলেশ। তাই তা’রা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরো জীবনের লিপ্ত অভিধানে বৰ্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে। সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয়— এই জ্ঞানে লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে নিজের বীজের তরে জোর ক’রে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে। অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে। একটি আলোক নিয়ে ব’সে থাকা চিরদিন; নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে; সে-সবের দিন শেষ হ’য়ে গেছে এখন সৃষ্টির মনে— অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে। সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে। একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে— বালুচরে, সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে। আমরা জটিল ঢের হ’য়ে গেছি— বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে। যদি কেউ বলে এসে: ‘এই সেই নারী, একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ—’ তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ? আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর, যদিও অনেক মৃত্যুপরম্পরা ছিলো ইতিহাসে; বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অব্‌লঙ ছবি; নানারূপ ক্ষতি ক্ষয়ে নানা দিকে ম’রে গেছি— মনে পড়ে বটে এই সব ছবি দেখে; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থানু। এক দরজায় ঢুকে বহিষ্কৃত হ’য়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে অমেয় আলোয় হেঁটে তা’রা সব। (আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিলো; তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?) আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি কাচের গেলাসে জলে উজ্জ্বল শফরী; সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো; তারপর অন্য গ্রহ নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে। সৃষ্টির নাড়ীর ’পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায় অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ; তবু তা’রা করেনাকো পরস্পরের ঋণশোধ।
জীবনানন্দ দাশ
আমাকে তুমি জীবনানন্দ দাশ আমাকে তুমি দেখিয়েছিলে একদিন: মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল; দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়; জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার; জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে: পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়। তারপর দূরে অনেক দূরে খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায় এই দুপুরের বাতাস। এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন। বিকেলে নরম মুহূর্ত; নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া; একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো নদীর জলে সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে স্থির। মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ, আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ; বিকেলে অসম্ভব বিষণ্ণতা। ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু— বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা; শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়, রাত্রি; নক্ষত্র ও নক্ষত্রের অতীত নিস্তব্ধতা। মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।
জীবনানন্দ দাশ
তুমি জীবনানন্দ দাশ নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ; বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস; কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি। ‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে? ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে: মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’ বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
জীবনানন্দ দাশ
তোমাকে জীবনানন্দ দাশ একদিন মনে হ’তো জলের মতন তুমি। সকালবেলার রোদে তোমর মুখের থেকে বিভা— অথবা দুপুরবেলা— বিকেলের আসন্ন আলোয়— চেয়ে আছে— চ’লে যায়— জলের প্রতিভা। মনে হ’তো তীরের উপরে ব’সে থেকে। আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল কেউ-কেউ তুলে নিয়ে চ’লে গেলে— নিচে তোমার মুখের মতন অবিকল নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে; স্থানান্তরিত হ’য়ে দিবসের আলোর ভিতরে নিজের মুথের ঠাণ্ডা জলরেখা নিয়ে পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে; এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হ’য়ে গেছে জেনে এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় ব’লে রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়; অপরাহ্ণে আকাশের রং ফিকে হ’লে। তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল; তোমার বুকের ’পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস; তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত: নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
জীবনানন্দ দাশ
ধান কাটা হ’য়ে গেছে জীবনানন্দ দাশ ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড় পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত। এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়। ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন, হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ; শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।
জীবনানন্দ দাশ
পথ হাঁটা জীবনানন্দ দাশ কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে; তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে: সারা রাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো ক’রে জ্বলে। কেউ ভুল করেনাকো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে। এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব; তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব আর-কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা? চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়; চোখ বুজে একপাশে স’রে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণ পাতা উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।