১৯৪১ সাল নীল সমুদ্রের ইশারা- অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ, আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা; নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল মত্ততাময় পদক্ষেপঃ এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর জীবনের ওপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয় তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে ডাক এল- সভ্যতার ডাক নিষ্ঠুর ক্ষুদার্ত পরোয়ানা আমাকে চিহ্নিত ক'রে গেল। আমার একক পৃথিবী ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে। মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা গভীরতা রচনা করে, আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা ইতস্ততঃ ধাবমান। নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল পূর্ণতায় মূর্তি চায়; আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ, আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা তাই পরাহত হল। কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক! দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস। যে সব মুহূর্ত-পরমাণু গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা, সে সব মুহূর্ত আজ প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায় অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে।। ১লা মে-র কবিতা লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়? কতদিন তুষ্ট থাকবে আর অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে? মনের কথা ব্যক্ত করবে ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে? ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন? ঝুলে পড়া তোমার জিভ, শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল? মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে? কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ? তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো, অস্বীকার করো বশ্যতাকে। চলো, শুকনো হাড়ের বদলে সন্ধান করি তাজা রক্তের, তৈরী হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য। শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।। অতি কিশোরের ছড়া তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি, আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি, কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া, পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া। তোতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ। বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ, ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব । পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ, পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক। হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি, যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছুটোছুটি। পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া, ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তারা। তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক, বুঝি কেবল গোময় সেটা,- নয়কো মধুপর্ক। ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে খেয়ালমতো কাজ করে যাই, কস্ট পাই কি সাধে ? সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃস্ট চক্র! আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) অদ্বৈধ নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল? দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য; ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য এখনো বিপদ অগ্রাহ্য? পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য।রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ, একলা গহন পথে চলতে জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ।জীবন ললিত নয় আজকে ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা, বিফল স্রোতের পিছুটানকে শরণ করেছে ভীরু সত্তা।তবু আজ রক্তের নিদ্রা, তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য; সহসা চমক লাগে চিত্তে দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ!নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈদ নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর, বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর।দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন নতুন, নতুনতর বিশ্ব, তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) অনন্যোপায় অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার, নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার, অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান, চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান। যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়। উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়। বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ, নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ। আজকে ভাঙার স্বপ্ন- অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার, বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর। তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল, রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল। নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে, উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) অনুভব ১৯৪০ অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন। অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন; অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো- দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে দেখেছি লিখিত- 'রক্ত খরচ' তাতে। এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!               ১৯৪৬ বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে, এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ; স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব? নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট; রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট। প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত, দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত; তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি, তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি। তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।। অবৈধ আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল উত্তর মহাসাগরের কূলে আমার স্বপ্নের ফুলে তারা কথা কয়েছিল অস্পষ্ট পুরনো ভাষায়         অস্ফুট স্বপ্নের ফুল অসহ্য সূর্যের তাপে অনিবার্য ঝরেছিল         মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্‌ভ হতাশায়।হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া সেদিন আর নেই- নেই আর সূর্য-বিকিরণ আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ! শুনি নি স্বপ্নের ডাকঃ থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে। সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে এল নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা। সেইদিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত ।আজ মনে হয় হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে, কী ক'রে সম্ভব হল আমার রক্তকে ভালবাসা! সূর্যের কুয়াশা এখনো কাটে নি ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা। মুহূর্তের সোনা এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়, এরই মদ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর, অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা- হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা।। অভিবাদন হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা দিকে দিকে উদ্‌যাপন করছে লগ্ন, পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন।আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন, মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা, ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা।স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য, বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ! হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান? দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান।বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি; তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।। অলক্ষ্যে আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর; ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর, এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির; নিভেছে প্রদূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ; স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর- অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ; উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা, অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর।গলিত স্মৃতির বাস্প সেদিনের পল্লব শাখায় বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়; বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত। আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে।। অসহ্য দিন অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত। মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত হৃদয়গত। ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে। এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত, মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।। আগামী জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে, বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা। আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা: তারপর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে, ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে। সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়: শাখায় শাখায় বাধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়; অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে। আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে; জয়ধ্বনি কিশলয়ে: সম্বর্ধনা জনাবে সকলে। ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি, বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তার তো সম্মতি। সেদিন ছায়ায় এসো: হানো যদি কঠিন কুঠারে, তবু তোমায় আমি হাতছানি দেবো বারে বারে; ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।। আগ্নেয়গিরি কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ আমি এক আগ্নেয় পাহাড়। শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা। এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার আমি পাথরঃ আমি তা সহ্য করেছি।মুখে আমার মৃদু হাসি, বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা। সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছিঃ মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর, আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী, বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতস-বাজি– তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা।দেখ, দেখঃ ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ; দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা। তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক, কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত, কিছুতেই বিশ্বাস ক’রো না– আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর। তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার, অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা।তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো, বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন: ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত। উৎসব কর, উৎসব কর– ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়, ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর। আর, আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।। আজব লড়াই ফেব্রুয়ারী মাসে ভাই, কলকাতা শহরে ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে! লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের, কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের; রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে, তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে, শুধু শুনি ‘ধর’ ‘ধর’ ‘মার’ ‘মার’ শব্দ যেন খাঁটি যুদ্ধ এ মিলিটারী জব্দ। বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে, ‘সব ঢাল জল’। ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো, ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো, ইট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি, এইবার যাবে কোথা বাছাধন বৈরী! ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা! এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা; ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও, গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও। জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের। বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে; ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান, “বিশ্ববিজয়ী” তাই রাখে জান, বাঁচে মান। খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন; সাবাস! সাবাস! ওরা খেয়েছে রাজার নুন।ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা, রক্ত-রাঙানো পথে দু’পাশে ছেলের মেলা; দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয়? ও-বাড়ি ও ও-পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয়। স্বচে দেখলাম বস্তির আলী জান, ‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ।এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট; এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে, ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে; পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা, দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা । আজিকার দিন কেটে যায় আজিকার দিন কেটে যায়,— অনলস মধ্যাহ্ন বেলায় যাহার অক্ষয় মূর্তি পেয়েছিনু খুঁজে তারি পানে চেয়ে আছি চক্ষু বুজে৷ আমি সেই ধনুর্ধর যার শরাসনে অস্ত্র নাই, দীপ্তি মনে মনে, দিগন্তের স্তিমিত আলোকে পূজা চলে অনিত্যের বহ্নিময় স্রোতে৷ চলমান নির্বিরোধ ডাক, আজিকে অন্তর হতে চিরমুক্তি পাক৷ কঠিন প্রস্তরমূর্তি ভেঙে যাবে যবে সেই দিন আমাদের অস্ত্র তার কোষমুক্ত হবে৷ সুতরাং রুদ্ধতায় আজিকার দিন হোক মুক্তিহীন৷ প্রথম বাঁশির স্ফূর্তি গুপ্ত উৎস হতে জীবন‍–সিন্ধুর বুকে আন্তরিক পোতে আজিও পায় নি পথ তাই আমার রুদ্রের পূজা নগণ্য প্রথাই তবুও আগত দিন ব্যগ্র হয়ে বারংবার চায় আজিকার দিন কেটে যায়॥এই কবিতাটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এটি ১৯৪০-এর আগের রচনা। আঠারো বছর বয়স আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি, আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।আঠারো বছর বয়সের নেই ভয় পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়- আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা, এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো, এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে, বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়- এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।। আমরা এসেছি কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল, মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল। দুঃখ-যুগের দারায় দারায় যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায় তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল। তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল-কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল, তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল। আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা, হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল-আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল। উধাও আলোর নিচে সমারোহ , মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ! ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল! সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল- একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল, দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল। সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার, থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়, ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল। আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।। আমার মৃত্যুর পর আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন, বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে, উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন। পরিচয়ভারে ন্যুব্জ অনেকের শোকগ্রস্ত মন, বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের। কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ।আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর লাঞ্ছনার বেদনায়, ষ্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) আলো-অন্ধকার দৃষ্টিহীন সন্ধ্যাবেলা শীতল কোমল অন্ধকার স্পর্শ ক’রে গেল মোরে। স্বপনের গভীর চুম্বন, ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় ভ্রান্তি এনে দিল চিরন্তন। অহর্নিশি চিন্তা মোর বিক্ষুব্ধ হয়েছে; প্রতিবার স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি অন্ধকারে মৃত্যুর বিস্তার। মুহূর্ত-কম্পিত-আমি বন্ধ করি অলৌকিক গান, প্রচ্ছন্ন স্বপন মোর আরিক মিথ্যার পাষাণ, কঠিন প্রলুব্ধ চিন্তা নগরীতে নিষ্ফল আমার। তবু চাই রুদ্ধতায় আলোকের আদিম প্রকাশ, পৃথিবীর গন্ধ নেই এমন দিবস বারোমাস। আবার জাগ্রত মোর দুষ্ট চিন্তা নিগূঢ় ইঙ্গিতে; ভুঁইচাঁপা সুরভির মরণ অস্তিত্বময় নয়, তার সাথে কল্পনার কখনো হবে না পরিচয় ; তবু যেন আলো আর অন্ধকার মোর চারিভিতে।।  (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) আসন্ন আঁধারে নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে – দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা? নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে প্রগল্‌ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়। -তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক? স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু প্রখর আলোর সীমা হতে বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে। কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক। গোপনে নির্জনে ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে পেয়েছিল অতীত বারতা? মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায় বার বার আর্তনাদ করে আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল, তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের।প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়, আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে এসে পড়েছিল একদিন- উদ্‌ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে যত দূরে দৃষ্টি যায় – চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা। উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার, -এই কি পৃথিবী? একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় – আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) ইউরোপের উদ্দেশে ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন, এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন; হয়তো ওখানে শুরু মন্থর দক্ষিণ হাওয়া; এখানে বোশেখী ঝড়ের ঝাপ্টা পশ্চাৎ দাওয়া; এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে কত রঙ, কত বিচিত্র নিশি দেখা দেয় এসে। ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলেমেয়ে এই বসন্তে কত উৎসব কত গান গেয়ে। এখানে তো ফুল শুকনো, ধূসর রঙের ধুলোয় খাঁ-খাঁ করে সারা দেশটা, শান্তি গিয়েছে চুলোয়। কঠিন রোদের ভয়ে ছেলেমেয়ে বন্ধ ঘরে, সব চুপচাপ; জাগবে হয়তো বোশেখী ঝড়ে। অনেক খাটুনি, অনেক লড়াই করার শেষে চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমাদের দেশে; এদেশে যুদ্ধ মহামারী, ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে- অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখে- তোমাদের দেশে মে-মাস; এখানে ঝোড়ো বৈশাখ।। উদ্বীক্ষণ নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড় ভগ্ননীড়,- ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়। সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল, কী উচ্ছল, তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল। কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে; দাঁতে ও নখে- জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে। তবু সমুদ্র সীমানা রাখে, দুর্বিপাকে দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে। আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময় যে বিস্ময় ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়? দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার, ঘোড়সোয়ার চিনে নেবে দৃঢ় লোহার, যে পথে নিত্য সূর্যোদয় আনে প্রলয়, সেই সীমান্তে বাতাস বয়; তাই প্রতীক্ষা- ঘনায় দিন স্বপ্নহীন।। উদ্যোগ বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন, একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন। ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখ কাস্তে, গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে। আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত, প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত। আজকে মজুর হতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত, আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত। ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য, বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য! সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়, ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়। বন্ধু, তোমারা ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) এই নবান্নে এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান- পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান। তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায়ঃ হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দায়; গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন, পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন; নিজের হাতের জমি ধান-বোনা, বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা, কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসেনি শুভক্ষণ- তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন।এবার নতুন জোরালো বাতাসে জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে, পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বাচন- এই হেমন্তে ফসলেরা বলেঃ কোথায় আপন জন? তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে, অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে, প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করছে উচ্চারণ এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ? এক যে ছিল এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর, ইস্কুল তার ভাল লাগত না, সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনোকালেই, অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারা দেশের সবটুকু পাণ্ডিত্যকে। কেমন ক’রে?          সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।বড়মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ, তাই বড় হয়ে সে বড় মানুষ না হয়ে             মানুষ হিসেব হল অনেক বড়। কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।গানসাধার বাঁধা আইন সে মানে নি, অথচ স্বর্গের বাগান থেকে সে চুরি করে আনল             তোমার আমার গান। কবি সে, ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল না ছোট বয়সে, অথচ শিল্পী ব’লে সে-ই পেল শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্মান। কেমন ক’রে ? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।মানুষ হল না বলে যে ছিল তার দিদির আক্ষেপের বিষয়, অনেক দিন, অনেক বিদ্রূপ যাকে করেছে আহত; সে-ই একদিন চমক লাগিয়ে করল দিগ্বিজয়। কেউ তাকে বলল, ‘বিশ্বকবি’, কেউ বা ‘কবিগুরু’ উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিক করল প্রণাম। তাই পৃথিবী আজো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছেঃ কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না, এ প্রশ্নের জবাব তোমাদের মতো আমিও খুঁজি।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) একটি মোরগের কাহিনী একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে, ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায় আরো দু'তিনটি মুরগীর সঙ্গে। আশ্রয় যদিও মিলল, উপযুক্ত আহার মিলল না। সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে গলা ফাটাল সেই মোরগ ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত- তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।তারপর শুরু হল তাঁর আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা; আর্শ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!তারপর এক সময় আঁস্তাকুড়েও এল অংশীদার- ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু'তিনটে মানুষ; কাজেই দুর্বলতার মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার! অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে বার বার চেষ্টা ক'রল প্রাসাদে ঢুকতে, প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড। ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে- 'প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার'!তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল, একেবারে সোজা চলে এল ধব্‌ধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ; অবশ্য খাবার খেতে নয় খাবার হিসেবে একুশে নভেম্বরঃ ১৯৪৬ আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর- আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল মুত্যুকাঁপানো ঝড়। আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর। আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।। পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল; বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে- বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে। শোন্ রে বিদেশী, শোন্ আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ। আমরা সবাই অসভ্য, বুনো- বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো একপা পিছিয়ে দু'পা এগোনোর আমরা করেছি পণ, ঠ'কে শিখলাম- তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। আহ্বান আসে অনেক দূরের, হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের, আজ প্রয়োজন একটি সুরের একটি কঠোর স্বরঃ 'দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর।' ডাক ওঠে, ডাক ওঠে- আবার কঠোর বহু হরতালে আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে। এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে।।আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম তবু বাঁচবার শপথ নিলুম কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়! ল'ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়।।আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী, দাঁতে দাঁত চেপে হাতে হাত চেপে উদ্যত সারি সারি , কিছু না হলেও আবার আমরা রক্ত দিতে তো পারি? পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি। এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) ঐতিহাসিক আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎঃ কেন মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল? আজ বাহান্ন সালের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে? জানি! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত, তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি? দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি! লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস কর নি কোনোদিন, একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর, তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ। কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকেঃ -কেন এমন হল?একদা দুর্ভিক্ষ এল ক্ষুদার মাহীন তাড়নায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস। চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন? এ সব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন। কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য, তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন।মূর্খ তোমরা লাইন দিলেঃ কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু, রক্তয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা। ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার। লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা, সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি সর্ব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে। এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান, প্রার্থী অনেক; কিন্তু পরিমিত মুক্তি। হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে- এ কথা ঘোষণা ক'রে দাও তোমাদের দেশময় প্রতিবেশীর কাছে। তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা আর প্রতীক্ষা নিয়ে হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ। আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো, মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি। আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র, নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।। কনভয় হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেল যুদ্ধফেরত এক কনভয়ঃ ক্ষেপে-ওঠা পঙ্গপালের মতো রাজপথ সচকিত ক'রে আগে আগে কামান উঁচিয়ে, পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার।ইতিহাসের ছাত্র আমি. জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ইতিহাসের দিকে। সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে। সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান, পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা- কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম, মানুষ। আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা। অনেক যুগ, অনেক অরণ্য,পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছে; ঝল্‌সানো কঠোর মুখে।। কবিতার খসড়া আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায় ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়, জানে না কেউ। উদ্যমহীন মূঢ় কারায় পুরনো বুলির মাছি তাড়ায় যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায় স্মৃতির ফেউ।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) কবে অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চুতুর্দিক, আজো বেঁচে আছি মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক। দুলে ওঠে দিন; শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া, হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া। জ^লে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ, নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত। মূঢ় ইতিহাস; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি। সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি? জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা। তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়, ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয়। সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার, এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার? কলম কলম, তুমি কত না যুগ কত না কাল ধ'রে অক্ষরে অক্ষরে গিয়েছ শুধু ক্লান্তিহীন কাহিনী শুরু ক'রে। কলম, তুমি কাহিনী লেখো, তোমার কাহিনী কি দুঃখে জ্বলে তলোয়ারের মতন ঝিকিমিকি?কলম, তুমি শুধু বারংবার, আনত ক'রে ক্লান্ত ঘাড় গিয়েছ লিখে স্বপ্ন আর পুরনো কত কথা, সাহিত্যের দাসত্বের ক্ষুদিত বশ্যতা। ভগ্ন নিব, রুগ্ন দেহ, জলের মতো কালি, কলম, তুমি নিরপরাদ তবুও গালাগালি খেয়েছ আর সয়েছ কত লেখকদের ঘৃণা, কলম, তুমি চেষ্টা কর, দাঁড়াতে পার কি না।হে কলম! তুমি ইতিহাস গিয়েছ লিখে লিখে লিখে শুধু ছড়িয়ে দিয়েছ চতুর্দিকে। তবু ইতিহাস মূল্য দেবে না, এতটুকু কোন দেবে না তোমায়, জেনো ইতিহাস বড়ই কৃপণ; কত লাঞ্ছনা, খাটুনি গিয়েছে লেখকের হাতে ঘুমহীন চোখে অবিশ্রান্ত অজস্র রাতে। তোমার গোপন অশ্রু তাইতো ফসল ফলায় বহু সাহিত্য বহু কাব্যের বুকের তলায়। তবু দেখ বোধ নেই লেখকের কৃতজ্ঞতা, কেন চলবে এ প্রভুর খেয়ালে, লিখবে কথা?হে কলম! হে লেখনী! আর কত দিন ঘর্ষণে ঘর্ষণে হবে ক্ষীণ? আর কত মৌন-মূক, শব্দহীন দ্বিধান্বিত বুকে কালির কলঙ্ক চিহ্ন রেখে দেবে মুখে? আর কত আর কাটবে দুঃসহ দিন দুর্বার লজ্জার? এই দাসত্ব ঘুচে যাক, এ কলঙ্ক মুছে যাক আজ, কাজ কর- কাজ।মজুর দেখ নি তুমি? হে কলম, দেখ নি বেকার? বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার? কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস, প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস! দিন নেই, রাত্রি নেই, শ্রান্তিহীন, নেই কোনো ছুটি, একটু অবাধ্য হলে তখুনি ভ্রূকুটি; এমনি করেই কাটে দুর্ভাগা তোমার বারো মাস, কয়েকটি পয়সায় কেনা, হে কলম, তুমি ক্রীতদাস। তাই যত লেখ, তত পরিশ্রম এসে হয় জড়োঃ -কলম! বিদ্রোহ আজ! দল বেঁধে ধর্মঘট করো। লেখক স্তম্ভিত হোক, কেরানীরা ছেড়ে দিক হাঁফ, মহাজনী বন্ধ হোক, বন্ধ হোক মজুরের পাপ; উদ্বেগ-আকুল হোক প্রিয়া যত দূর দূর দেশে, কলম! বিদ্রোহ আজ, ধর্মঘট, হোক অবশেষে; আর কালো কালি নয়, রক্তে আজ ইতিহাস লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে এঁটে, হে কলম, আনো দিকে দিকে।। কাশ্মীর সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি, হঠাৎ জেগে উঠেছে- সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ। দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে, ডেকেছে রৌদ্রকে, ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে, পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হল প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে। গলে গলে পড়ছে বরফ- ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দনঃ শ্যামল আর সমতল মাটির স্পর্শ লেগেছে ওর মুখে, দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুলঃ আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি। কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়ঃ সূর্য-করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত।তাই আজ কাল-বৈশাখীর পতাকা উড়ছে ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়; দুলে দুলে উঠছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ বিরাট ব্যাপ্ত হিমালয়ের বুক।।২ দম-আটকানো কুয়াশা তো আর নেই নেই আর সেই বিশ্রী তুষার-বৃষ্টি, সূর্য ছুঁয়েছে 'ভূস্বর্গ চঞ্চল' সহসা জেগেই চমকে উঠেছে দৃষ্টি।দুহাতে তুষার-পর্দা সরিয়ে ফেলে হঠাৎ হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে রোদকে ডেকেছে নন্দনবন পৃথিবীর বৈশাখী ঝড় দিয়েছে বরফ গুঁড়িয়ে।সুন্দর মুখ কঠোর করেছে কাশ্মীর তীক্ষ্ণ চাহনি সূর্যের উত্তাপে, গলিত বরফে জীবনের স্পন্দন শ্যামল মাটির স্পর্শে ও আজ কাঁপে।সাগর-বাতাসে উড়ছে আজ ওর চুল শাল দেবদারু পাইনের বনে ক্ষোভ, ঝড়ের পক্ষে চূড়ান্ত সম্মতি- কাশ্মীর নয়, জমাট বাঁধা বরফ।কঠোর গ্রীষ্মে সূর্যোত্তাপে জাগা- কাশ্মীর আজ চঞ্চল-স্রোত লক্ষঃ দিগ্‌দিগন্তে ছুটে ছুটে চলে দুর্বার দুঃসহ ক্রোধে ফুলে ওঠে বক্ষ।ক্ষুব্ধ হাওয়ায় উদ্দাম উঁচু কাশ্মীর কালবোশেখীর পতাকা উড়ছে নভে, দুলে দুলে ওঠে ঘুমন্ত হিমালয় বহু যুগ পরে বুঝি জাগ্রত হবে।কাব্যগ্রন্থঃ -ছাড়পত্র কৃষকের গান এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে এইবার ফলাব ফসল- আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে আজ তার নির্জন বোধন। এ মাটির গর্ভে আজ আমি দেখেছি আসন্ন জন্মেরা ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ দুর্ভিরে অন্তিম কবর। আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি? (গোপন একান্ত এক পণ) এ মাটিতে জন্ম দেব আমি অগণিত পল্টন-ফসল। ঘনায় ভাঙন দুই চোখে ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে; আমার প্রতিজ্ঞা গ'ড়ে তোলে ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি। দুয়ারে শত্রুর হানা মুঠিতে আমার দুঃসাহস। কর্ষিত মাটির পথে পথে নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।। খবর খবর আসে! দিগ্‌দিগন্ত থেকে বিদ্যুদ্‌বাহিনী খবর; যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ঝড় ---এখানে সাংবাদিকতার নৈশ নৈঃশব্দ্য। রাত গভীর হয় যন্ত্রের ঝঙ্কৃত ছন্দে- প্রকাশের ব্যগ্রতায়; তোমাদের জীবনে যখন নিদ্রাভিভুত মধ্যরাত্রি চোখে স্বপ্ন আর ঘরে অন্ধকার। অতল অদৃশ্য কথার সমুদ্র থেকে নিঃশব্দ শব্দেরা উঠে আসে; অভস্ত হাতে খবর সাজাই- ভাষা থেকে ভাষান্তর করতে কখনো চমকে উঠি, দেখি যুগ থেকে যুগান্তর। কখনো হাত কেঁপে ওঠে খবর দিতে ; বাইশে শ্রাবণ, বাইশে জুনে।তোমাদের ঘুমের অন্ধকার পথ বেয়ে খবর-পরীরা এখানে আসে তোমাদের আগে, তাদের পেয়ে কখনো কণ্ঠে নামে ব্যথা, কখনো বা আসে গান ; সকালে দিনের আলোয় যখন তোমাদের কাছে তারা পৌঁছোয় তখন আমাদের চোখে তাদের ডানা ঝরে গেছে। তোমরা খবর পাও, শুধু খবর রাখো না কারো বিনিদ্র চোখ আর উৎকর্ণ কানের। ঐ কম্পোজিটর কি কখনো চমকে ওঠে নিখুঁত যান্ত্রিকতার কোনো ফাঁকে?পুরনো ভাঙা চশমায় ঝাপসা মনে হয় পৃথিবী ৯ই আগস্টে কি আসাম সীমান্ত আক্রমণে? জ্বলে ওঠে কি স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধে, মহাত্মাজীর মুক্তিতে, প্যারিসের অভ্যুত্থানে? দুঃসংবাদকে মনে হয় না কি কালো অক্ষরের পরিচ্ছদে শোকযাত্রা? যে খবর প্রাণের পক্ষপাতিত্বে অভিষিক্ত আত্মপ্রকাশ করে নাকি বড় হরফের সম্মানে? এ প্রশ্ন অব্যক্ত অনুচ্চারিত থাকে ভোরবেলাকার কাগজের পরিচ্ছন্ন ভাঁজে ভাঁজে।শুদু আমরা দৈনন্দিন ইতিহাস লিখি!তবু ইতিহাস মনে রাখবে না আমাদের- কে আর মনে রাখে নবান্নের দিনে কাটা দানের গুচ্ছকে? কিন্তু মনে রেখো তোমাদের আগেই আমরা খবর পাই মদ্যরাত্রির অন্ধকারে তোমাদের তন্দ্রার অগোচরেও। তাই তোমাদের আগেই খবর-পরীরা এসেছে আমাদের চেতনার পথ বেয়ে।আমার হৃদ্‌যন্ত্রে ঘা লেগে বেজে উঠেছে কয়েকটি কথা- পৃথিবী মুক্ত- জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী। তোমাদের ঘরে আজো অন্ধকার, চোখে স্বপ্ন। কিন্তু জানি একদিন সে সকাল আসবেই যেদিন এই খবর পাবে প্রত্যেকের চোখেমুখে সকালের আলোয়, ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়।আজ তোমরা এখনো ঘুমে।। খাদ্য সমস্যার সমাধান বন্ধুঃ ঘরে আমার চাল বাড়ন্ত             তোমার কাছে তাই, এলাম ছুটে, আমায় কিছু             চাল ধার দাও ভাই।            মজুতদারঃ দাঁড়াও তবে, বাড়ির ভেতর             একটু ঘুরে আসি, চালের সঙ্গে ফাউও পাবে             ফুটবে মুখে হাসি।            মজুদতারঃ এই নাও ভাই, চালকুমড়ো             আমায় খাতির করো, চালও পেলে কুমড়ো পেলে             লাভটা হল বড় ।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) গান যেমন ক'রে তপন টানে জল তেমনি ক'রে তোমায় অবিরল টানছি দিনে দিনে তুমি লও গো আমায় চিনে শুধু ঘোচাও তোমার ছল।। আমি জানি তোমায় বলা বৃথা তুমি আমার আমি তোমার মিতা, রুদ্ধ দুয়ার খুলে তুমি আসবে নাকো ভুলে থামবে নাকো আমার চলাচল।। গীতিগুচ্ছ-১ ওগো কবি তুমি আপন ভোলা, আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা! মালাখানি নিয়ে মোর একী বাঁধলে অলখ ডোর! নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কী সুর                                       তোলা! জেনেছ তো তুমি অজানা প্রাণের                         নীরব কথা। তোমার বাণীতে আমার মনের                    এ ব্যাকুলতা- পেয়েছ কী তুমি সাঁঝের বেলাতে যখন ছিলাম কাজের খেলাতে তখন কি তুমি এসেছিলে- ছিল দুয়ার খোলা।। গীতিগুচ্ছ-২ এই নিবিড় বাদল দিনে কে নেবে আমায় চিনে,               জানিনে তা। এই নব ঘন ঘোরে কে ডেকে নেবে মোরে কে নেবে হৃদয় কিনে,               উদাসচেতা। পবন যে গহন ঘুম আনে, তার বাণী দেবে কি কানে, যে আমার চিরদিন              অভিপ্রেতা! শ্যামল রঙ বনে বনে, উদাস সুর মনে মনে, অদেখা বাঁধন বিনে ফিরে কি আসবে হেথা? গীতিগুচ্ছ-৩ গানের সাগর পাড়ি দিলাম সুরের তরঙ্গে, প্রাণ ছুটেছে নিরুদ্দেশে ভাবের তুরঙ্গে। আমার আকাশ মীড়ের মূর্ছনাতে উধাও দিনে রাতে; তান তুলেছে অন্তবিহীন রসের মৃদঙ্গে! আমি কবি সপ্তসুরের ডোরে, মগ্ন হলাম অতল ঘুম-ঘোরে; জয় করেছি জীবনে শঙ্কারে, মোর বীণা ঝংকারে গানের পথের পথিক আমি সুরেরই সঙ্গে।। গোপন খবর শোন একটা গোপন খবর দিচ্ছি আমি তোমায়, কলকাতাটা যখন খাবি খাচ্ছিল রোজ বোমায়, সেই সময়ে একটা বোমা গড়ের মাঠের ধারে, মাটির ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ছিল এক্কেবারে, অনেক দিনের ঘটনা তাই ভুলে গেছ্‌ল লোকে, মাটির ভেতর ছিল তাইতো দেখে নি কেউ চোখে, অনেক বর্ষা কেটে গেল, গেল অনেক মাস, যুদ্ধ থামায় ফেলল লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস, হাঠাৎ সেদিন একলা রাতে গড়ের মাঠের ধারে, বেড়িয়ে ফেরার সময় হঠাৎ চমকে উঠিঃ আরে! বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ, তারই মাথায় দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ, গাছের ডালে ঝুলছে কেবল বোমা-ই সারি সারি, তাই না দেখে ভড়কে গিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। পরের দিনই সকাল বেলা গেলাম ময়দানে, হায়রে!- গাছটা চুরি গেছে কোথায় কে তা জানে। গাছটা ছিল। গড়ের মাঠে খুঁজতে আজো ঘুরি, প্রমাণ আছে অনেক, কেবল গাছটা গেছে চুরি।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) ঘুমভাঙার গান মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল           মোছ উদ্‌গত অশ্রুজল যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল?           ভোল ক্ষত! তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল,           বোঝ নি ধূর্ত চতুর ছল, হাসে যে আকাশচারীর দল,           অনাহত। শোন অবনত বিন্ধ্যাচল,           তুমি নও ভীরু বিগত বল কাঁপে অবাধ্য হৃদয়দল           অবিরত। কঠিন, কঠোর বিন্ধ্যাচল,           অনেক ধৈর্যে আজো অটল ভাঙো বিঘ্নকেঃ করো শিকল           পদাহত। বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল,           দেখ সূর্যের দর্পানল; ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল           বাধা যত। সময় যে হল বিন্ধ্যাচল,           ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল           শত শত।।  (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) চট্টগ্রামঃ ১৯৪৩ ক্ষুদার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম- চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম! বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন। চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম! এখনো নিস্তব্ধ তুমি তাই আজো পাশবিকতার দুঃসহ মহড়া চলে, তাই আজো শত্রুরা সাহসী। জানি আমি তোমার হৃদয়ে অজস্র ঔদার্য আছে; জানি আছে সুস্থ শালীনতা জানি তুমি আঘাতে আঘাতে এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম- হে চট্টগ্রাম! তাই আজো মনে পড়ে রক্তাক্ত তোমাকে সহস্র কাজের ফাঁকে মনে পড়ে শার্দূলের ঘুম অরণ্যের স্বপ্ন চোখে, দাঁতে নখে প্রতিজ্ঞা কঠোর। হে অভুক্ত ক্ষুদিত শ্বাপদ- তোমার উদ্যত থাবা, সংঘবদ্ধ প্রতিটি নখর এখনো হয় নি নিরাপদ। দিগন্তে দিগন্তে তাই ধ্বনিত গর্জন তুমি চাও শোণিতের স্বাদ- যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ। তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস। তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম! আমার হৃৎপিণ্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।। চরমপত্র তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা; অনেক দুঃখে মথিত এ শেষ বিদ্যে শেখা৷ অগণ্য চাষী-মজুর জেগেছে শহরে গ্রামে সবাই দিচ্ছি চরমপত্র একটি খামে : পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই, ক্ষুব্ধ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত ‘স্বাধীনতা চাই’৷ বহু উপহার দিয়েছ,—শাস্তি, ফাঁসি ও গুলি, অরাজক, মারী, মন্বন্তরে মাথার খুলি৷ তোমার যোগ্য প্রতিনিধি দেশে গড়েছে শ্মশান, নেড়েছে পর্ণকুটির, কেড়েছে ইজ্জত, মান! এতদিন বহু আঘাত হেনেছ, পেয়ে গেছ পার, ভুলি নি আমরা, শুরু হোক শেষ হিসাবটা তার, ধর্মতলাকে ভুলি নি আমরা, চট্টগ্রাম সর্বদা মনে অঙ্কুশ হানে নেই বিশ্রাম৷ বোম্বাই থেকে শহীদ জীবন আনে সংহতি, ছড়ায় রক্ত প্লাবন, এদেশে বিদ্যুৎগতি৷ আমাদের এই দলাদলি দেখে ভেবেছ তোমার আয়ু সুদীর্ঘ, যুগ বেপরোয়া গুলি ও বোমার, সে স্বপ্ন ভোলো চরমপত্র সমুখে গড়ায়, তোমাদের চোখ-রাঙানিকে আজ বলো কে ডরায়? বহু তো অগ্নি বর্ষণ করো সদলবলে, আমরা জ্বালছি আগুন নেভাও অশ্রুজলে৷ স্পর্ধা, তাইতো ভেঙে দিলে শেষ-রক্তের বাঁধ রোখো বন্যাকে, চরমপত্রে ঘোষণা : জেহাদ॥ চারাগাছ ভাঙা কুঁড়ে ঘরে থাকি: পাশে এক বিরাট প্রাসাদ প্রতিদিন চোখে পড়ে; সে প্রাসাদ কি দুঃসহ স্পর্ধায় প্রত্যহ আকাশকে বন্ধুত্ব জানায়, আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখি। চেয়ে চেয়ে দেখি আর মনে মনে ভাবি- এ অট্টালিকার প্রতি ইটের হৃদয়ে অনেক কাহিনী আছে অত্যন্ত গোপনে, ঘামের, রক্তের আর চোখের জলের। তবু এই প্রাসাদকে প্রতিদিন হাজারে হাজারে সেলাম জানায় লোকে, চেয়ে থাকে বিমূঢ় বিস্ময়ে। আমি তাই এ প্রাসাদে এতকাল ঐশ্বর্য দেখেছি, দেখেছি উদ্ধত এক বনিয়াদী কীর্তির মহিমা।হঠাৎ সেদিন চকিত বিস্ময়ে দেখি অত্যন্ত প্রাচীন সেই প্রাসাদের কার্নিশের ধারে অশ্বত্থ গাছের চারা।অমনি পৃথিবী আমার চোখের আর মনের পর্দায় আসন্ন দিনের ছবি মেলে দিল একটি পলকে।ছোট ছোট চারাগাছ- রসহীন খাদ্যহীন কার্নিশের ধারে বলিষ্ঠ শিশুর মতো বেড়ে ওঠে দুরন্ত উচ্ছাসে। হঠাৎ চকিতে, এ শিশুর মধ্যে আমি দেখি এক বৃদ্ধ মহীরুহ শিকড়ে শিকড়ে আনে অবাধ্য ফাটল উদ্ধত প্রাচীন সেই বনিয়াদী প্রাসাদের দেহে।ছোট ছোট চারাগাছ- নিঃশব্দে হাওয়ায় দোলে, কান পেতে শোনে: প্রত্যেক ইটের নীচে ঢাকা বহু গোপন কাহিনী রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের।তাই তো অবাক আমি, দেখি যত অশ্বত্থচারায় গোপনে বিদ্রোহ জমে, জমে দেহে শক্তির বারুদ; প্রাসাদ-বিদীর্ণ-করা বন্য আসে শিকড়ে শিকড়ে।মনে হয়, এই সব অশ্বত্থ-শিশুর রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের ধারায় ধারায় জন্ম, ওরা তাই বিদ্রোহের দূত।। চিরদিনের এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা, সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা।জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া, পচা জল আর মশায় অহংকারী নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া।এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে, গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে।রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ; বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত।দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে।রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে, কেমন ক'রে সে আকালেতে গতবারে, চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে।এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে, সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে।হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে, ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে, সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) চিল পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখলামঃ ফুটপাতে এক মরা চিল!চমকে উঠলাম ওর করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে। অনেক উঁচু থেকে যে এই পৃথিবীটাকে দেখেছে লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ; যার শ্যেন দৃষ্টিতে কেবল ছিল তীব্র লোভ আর ছোঁ মারার দস্যু প্রবৃত্তি- তাকে দেখলাম, ফুটপাতে মুখ গুঁজে প'ড়ে। গম্বুজশিখরে বাস করত এই চিল, নিজেকে জাহির করত সুতীক্ষ্ণ চীৎকারে; হালকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিত আকাশের নীলে- অনেককে ছাড়িয়েঃ এককঃ পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে।অনেকে আজ নিরাপদ; নিরাপদ ইঁদুর ছানারা আর খাদ্য-হাতে ত্রস্ত পথচারী, নিরাপদ- কারণ আজ সে মৃত। আজ আর কেউ নেই ছোঁ মারার, ওরই ফেলে-দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো ও পড়ে রইল ফুটপাতে, শুক্‌নো, শীতল, বিকৃত দেহে।হাতে যাদের ছিল প্রাণধারণের খাদ্য বুকের কাছে সযত্নে চেপে ধরা তারা আজ এগিয়ে গেল নির্ভয়ে; নিষ্ঠুর বিদ্রূপের মতো পিছনে ফেলে আকাশচ্যুত এক উদ্ধত চিলকে।।কাব্যগ্রন্থঃ- ছাড়পত্র চৈত্রদিনের গান চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া আমায় ডেকে বলে, “বনানী আজ সজীব হ’ল নতুন ফুলে ফলে৷ এখনও কি ঘুম-বিভোর? পাতায় পাতায় জানায় দোল বসন্তেরই হাওয়া৷ তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে, কে সে আলোর জোয়ার আনে? নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া; তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷ ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷ তোমার সোনার রথে চ’ড়ে মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷ রক্তস্রোতে তোমার দিন, চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷ তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল, তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”‘চৈত্রদিনের গান’ কবিতাটি বিজনকুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের ‘শিখা’ পত্রিকার জন্য রচিত৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪০৷ ছাড়পত্র যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে তার মুখে খবর পেলুম: সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। সে ভাষা বোঝে না কেউ, কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার। আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের- পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে। চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।। ছুরি বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন, আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য, শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি, দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি। হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত, দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত। বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদয়-বৃন্তে সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে। শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য। ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ, তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ, শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণঃ এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য। বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপ, এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য। বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী, এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী; আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে বজ্রের কানাকানি। সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে শান্তি পালাল আজ। দিন ও রাত্রি হল অস্থির কাজ, আর শুধু কাজ! জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর ওঠে তার গর্জন- প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!হাজার হাজার শহীদ ও বীর স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন। ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্‌ঝন্; প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার, অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার দ্বার ভাঙা আজ পণ; এতদিন ধ'রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্‌ঝন্। ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর; ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায় কে আছে আজকে ওদের ফিরায় কে ভাবে ওদের পর? ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়! নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে ওদের ফিরাব কবে? কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে কোটি মানুষের দুর্বার চাপে শৃঙ্খল গত হবে? কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে কোটি জনতার জোয়ারের জলে ভেসে যাবে কারাগার। কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার? মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি; ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে, বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে গোপনে করেছে ঋণী। মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি! হে খাতক নির্বোধ, রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ! শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো, শোনো স্বদেশের ভাই, রক্তের বিনিময় হয় হোক আমরা ওদের চাই।। জনযুদ্ধের গান - ৯ জনগণ হও আজ উদ্বুদ্ধ শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ, জাপানী ফ্যাসিস্টদের ঘোর দুর্দিন মিলছে ভারত আর বীর মহাচীন। সাম্যবাদীরা আজ মহা ক্রুদ্ধ শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ। জনগণ শক্তির ক্ষয় নেই, ভয় নেই আমাদের ভয় নেই। নিস্ক্রিয়তায় তবে কেন মন মগ্ন কেড়ে নাও হাতিয়ার, শুভলগ্ন। করো জাপানের আজ গতি রুদ্ধ; শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ।। জনরব পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে, ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে, আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো, পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো। স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান- পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান; আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে রুদ্ধ ঘরে ব'সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে, হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল, মুক্তির অবাদ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল; স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে, আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে, নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা, তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা।জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা. দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা; এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ বলে ক'রে থাকি ঘৃণা, আলোর খবর এরা কি ক'রে যে পায় তা জানি না। এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে, অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলেঃ হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ, চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ। অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পঞ্চজন্যধ্বনি, দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটছে তখনি, মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ? জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ? - ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস। পখিদের মাতামাতি; বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব, যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব।। জবাব আশংকা নয় আসন্ন রাত্রিকে মুক্তি-মগ্ন প্রতিজ্ঞায় চারিদিকে হানবে এবার অজস্র মৃত্যুকে; জঙ্গী-জনতা ক্রমাগত সম্মুখে৷শত্রুদল গোপনে আজ, হানো আঘাত এসেছে দিন; পতেঙ্গার রক্তপাত আনে নি ক্রোধ, স্বার্থবোধ দুর্দিনে? উষ্ণমন শাণিত হোক সঙ্গীনে৷ক্ষিপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক তুচ্ছ প্রাণ কাস্তে ধরো, মুঠিতে এক গুচ্ছ ধান৷ মর্ম আজ বর্ম সাজ আচ্ছাদন করুক : চাই এদেশে বীর উৎপাদন৷শ্রমিক দৃঢ় কারখানায়, কৃষক দৃঢ় মাঠে, তাই প্রতীক্ষা, ঘনায় দিন স্বপ্নহীন হাটে৷ তীব্রতর আগুন চোখে, চরণপাত নিবিড় পতেঙ্গার জবাব দেবে এদেশের জনশিবির॥ জাগবার দিন আজ জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে; যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে – তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে, মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে।            আজকের দিন নয় কাব্যের – আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের; শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী, কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোনো আসর-ই। আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার – মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার, মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পস্ট।            তবুও তোমার চাই চেতনা, চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না, আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর হাতে করো বর্জন, আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন;            তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিত্তি কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;            পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;            সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,            দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আজকে শপথ করো সকলে বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে; তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,            একতাবদ্ধ হও এখনি।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) জ্ঞানী বরেনবাবু মস্ত জ্ঞানী, মস্ত বড় পাঠক, পড়েন তিনি দিনরাত্তির গল্প এবং নাটক, কবিতা আর উপন্যাসের বেজায় তিনি ভক্ত, ডিটেক্‌টিভের কাহিনীতে গরম করেন রক্ত; জানেন তিনি দর্শন আর নানা রকম বিজ্ঞান জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি, তাইতো আছে দিক্-জ্ঞান; ইতিহাস আর ভূগোলেতে বেজায় তিনি দক্ষ,- এসব কথা ভাবলেই তাঁর ফুলতে থাকে বক্ষ। সব সময়েই পড়েন তিনি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, ছুটির দিনে পড়েন তিনি, পড়েন পূজোর বন্ধে। মাঝে মাঝে প্রকাশ করেন গূঢ় জ্ঞানের তত্ত্ব বিদ্যাখানা জাহির করেন বরেন্দ্রনাথ দত্তঃ হঠাৎ ঢুকে রান্না ঘরে বলেন, ওসব কী রে? ভাইঝি গীতা হেসে বলে, এসব কালো জিরে। বরেনবাবু রেগে বলেন, জিরে তো হয় সাদা, তিলও কালো, জিরেও কালো? পেয়েছিস কি গাধা? রান্না করার সময় কেবল পুড়িয়ে হাজার লঙ্কা, হনুমতী হয়েছিস তুই, হচ্ছে আমার শঙ্কা। হঠাৎ ছোট্ট খোকাটাকে কাঁদতে দেখে, দত্ত খোলেন বিরাট বইয়ের পাতা নামটি “মনস্তত্ত্ব”। খুঁজতে খুঁজতে বরেনবাবু হয়ে গেলেন সারা- বুঝলেন না, কেন খোকা মাথায় করছে পাড়া। হঠাৎ এসে ভাইঝি গীতা দুধের বাটি নিয়ে, খাইয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিটে দিল ঘুম পাড়িয়ে। বরেনবাবু ভাবেন, ‘খোকার কেমনতর ধারা আধ ঘণ্টার চেঁচামেচি পাঁচ মিনিটেই সারা?’ বরেনবাবুর কাছে আরো বিরাট একটি ধাঁধা, হলদে চালের রঙ কেন হয় ভাত হলে পর সাদা? পাথর বাটির গরম জিনিস ঠাণ্ডা হয় তা জানি, পাহাড় দেশে গরম কেন এমন ছটফটানি? পথ চলতে ভেবে এসব ভিজে ওঠেন ঘামে, মানিকতলা যেতে চাপেন ধর্মতলার ট্রামে। বরেনবাবু জানেন কিন্তু নানা রকম বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি তাইতো এমন দিক্-জ্ঞান।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) ঠিকানা ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু ঠিকানার সন্ধান, আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান? ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু, পথে পথে বাস করি, কখনো গাছের তলাতে কখনো পর্ণকুটির গড়ি। আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি, হাজার জনতা যেখানে, সেখানে আমি প্রতিদিন ঘুরি। বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ, তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব মজবুত ইমারত।বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না তোমাদের দেওয়া ক্ষতে, আমার ঠিকানা খোঁজ ক'রো শুধু সূর্যোদয়ের পথে। ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুশ ও চীনের কাছে, আমার ঠিকানা বহুকাল ধ'রে জেনো গচ্ছিত আছে। আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো সমস্ত দেশ জুড়ে? তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ ভুল পথে ঘুরে ঘুরে। আমার হদিশ জীবনের পথে মন্বন্তর থেকে ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে মুক্তির পথে বেঁকে। বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই সূর্যোদয়ের ভোরে; পথ হারিও না আলোর আশায় তুমি একা ভুল ক'রে। বন্ধু, আজকে জানি অস্থির রক্ত, নদীর জল, নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল। বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো ঠিকানা অবজ্ঞাত বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত? আর কতদিন দুচক্ষু কচ্‌লাবে, জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু সে পথে আমাকে পাবে, জালালাবাদের পথ ধ'রে ভাই ধর্মতলার পরে, দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে। বন্ধু, আজকে বিদায়! দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো, ঠিকানা রইল, এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক'রো।। ডাক খে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের। গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা- হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা, শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের। দুর্ভিক্ষকে তাড়াও, ওদেরও তাড়াও- সন্ধিপত্র মাড়াও, দু'পায়ে মাড়াও। তিন-পতাকার মিনতিঃ দেবে না সাড়াও? অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের!ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা, শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা, ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা দেখ, ভিড় দেখ স্বাদীনতালুব্ধের।ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা। গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা, নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা- জাগে বিক্ষোভে চারিপাশে ক্ষুব্ধের।হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল? সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তালঃ তুমি কোন্ দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দামঃ 'গুণ্ডা'র দলে আজো লেখাও নি নাম? তরঙ্গ ভঙ্গ হে নাবিক, আজ কোন্ সমুদ্রে             এল মহাঝড়, তারি অদৃশ্য আঘাতে অবশ              মরু-প্রান্তর। এই ভুবনের পথে চলবার              শেষ-সম্বল ফুরিয়েছে, তাই আজ নিরুক্ত              প্রাণ চঞ্চল।আজ জীবনেতে নেই অবসাদ! কেবল ধ্বংস, কেবল বিবাদ- এই জীবনের একী মহা উৎকর্ষ! পথে যেতে যেতে পায়ে পায়ে সংঘর্ষ। (ছুটি আজ চাই ছুটি, চাই আমাদের সকালে বিকালে দুটি নুন-ভাত, নয় আধপোড়া কিছু রুটি!) -একী অবসাদ ক্লান্তি নেমেছে বুকে, তাইতো শক্তি হারিয়েছি আজ            দাঁড়াতে পারি না রুখে। বন্ধু, আমরা হারিয়েছি বুঝি প্রাণধারণের শক্তি, তাইতো নিঠুর মনে হয় এই অযথা রক্তারক্তি।এর চেয়ে ভাল মনে হয় আজ পুরনো দিন, আমাদের ভাল পুরনো, চাই না বৃথা নবীন।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) তারুণ্য হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’ উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে। জীবনের প্রতি পদপে তাই বুঝি ব্যাথাবিদ্ধ বিষণ্ণ বিদায়ে। রক্তময় দ্বিপ্রহরে অনাগত সন্ধ্যার আভাসে তোমার অক্ষয় বীজ অঙ্কুরিত যবে বিষ-মগ্ন রাত্রিবেলা কালের হিংস্রতা কণ্ঠরোধ করে অবিশ্বাসে। অগ্নিময় দিনরাত্রি মোর; আমি যে প্রভাতসূর্য স্পর্শহীন অন্ধকারে চৈতন্যের তীরে উন্মাদ, সন্ধান করি বিশ্বের বন্যায় সৃষ্টির প্রথম সুর। বজ্রের ঝংকারে প্রচণ্ড ধ্বংসের বার্তা আমি যেন পাই। মুক্তির পুলক-লুব্ধ বেগে একী মোর প্রথম স্পন্দন! আমার বক্ষের মাঝে প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারুণ্য, রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায় আমার প্রাণের কণ্ঠে দিয়ে গেল গান; বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর। উচ্ছ্বসিত প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস। আমি যেন মৃত্যুর প্রতীক। তাণ্ডবের সুর যেন নৃত্যময় প্রতি অঙ্গে মোর, সম্মুখীন সৃষ্টির আশ্বাসে। মধ্যাহ্নের ধ্যান মোর মুক্তি পেল তোমার ইঙ্গিতে। তারুণ্যের ব্যর্থ বেদনায় নিমজ্জিত দিনগুলি যাত্রা করে সম্মুখের টানে। নৈরাশ্য নিঃশ্বাসে ক্সত তোমার বিশ্বাস প্রতিদিন বৃদ্ধ হয় কালের কর্দমে। হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রী সঙ্গীত বিহীন, আকাশের স্বপ্ন মাঝে রাত্রির জিজ্ঞাসা ক্ষয় হয়ে যায়। নিভৃত ক্রন্দনে তাই পরিশ্রান্ত সংগ্রামের দিন। বহ্নিময় দিনরাত্রি চক্ষে মোর এনেছে অন্তিম। ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুদিত পৃথিবী আর সর্পিল সভ্যতা। ইতিহাস স্তুতিময় শোকের উচ্ছ্বাস! তবু আজ তারুণ্যের মুক্তি নেই, মুমূর্ষু মানব। প্রাণে মোর অজানা উত্তাপ অবিরাম মুগ্ধ করে পুষ্টিকর রক্তের সঙ্কেতে! পরিপূর্ণ সভ্যতা সঞ্চয়ে আজ যারা রক্তলোভী বর্ধিত প্রলয় অন্বেষণে, তাদের সংহার করো মৃতের মিনতি। অন্ধ তমিস্রার স্রোতে দূরগামী দিন আসন্ন রক্তের গন্ধে মূর্ছিত সভয়ে। চলেছে রাত্রির যাত্রী আলোকের পানে দূর হতে দূরে। বিফল তারুণ্য-স্রোতে জরাগ্রস্ত কিশলয় দিন। নিত্যকার আবর্তনে তারুণ্যের উদ্‌গত উদ্যম বার্ধক্যের বেলাভূমি ‘পরে অতর্কিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবু, হায়রে পৃথিবী, তারুণ্যের মর্মকথা কে বুঝাবে তোরে! কালের গহ্বরে খেলা করে চিরকাল বিস্ফোরণহীন। স্তিমিত বসন্তবেগ নিরুদ্দেশ যাত্রা করে জোয়ারের জলে। অন্ধকার, অন্ধকার, বিভ্রান্ত বিদায়; নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী। বিকৃত বিশ্বের বুকে প্রকম্পিত ছায়া মরণের, নক্ষত্রের আহ্বানে বিহ্বল তারুণ্যের হৃৎপিণ্ডে বিদীর্ণ বিলাস। ক্ষুব্ধ অন্তরের জ্বালা, তীব্র অভিশাপ; পর্বতের বক্ষমাঝে নির্ঝর-গুঞ্জনে উৎস হতে ধবমান দিক্-চক্রবালে। সম্মুখের পানপাত্রে কী দুর্বার মোহ, তবু হায় বিপ্রলব্ধ রিক্ত হোমশিখা! মত্ততায় দিক্ভ্রান্তি, প্রাণের মঞ্জরী দক্ষিণের গুঞ্জরণে নিষ্ঠুর প্রলাপে অস্বীকার করে পৃথিবীরে। অলক্ষিতে ভূমিলগ্ন আকাশ কুসুম ঝরে যায় অস্পষ্ট হাসিতে। তারুণ্যের নীলরক্ত সহস্র সূর্যের স্রোতে মৃত্যুর স্পর্ধায় ভেসে যায় দিগন্ত আঁধারে। প্রত্যুষের কালো পাখি গোধূলির রক্তিম ছায়ায় আকাশের বার্তা নিয়ে বিনিদ্র তারার বুকে ফিরে গেল নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়। দিনের পিপাসু দৃষ্টি, রাত্রি ঝরে বিবর্ণ পথের চারিদিকে। ভয়ঙ্কর দিনরাত্রি প্রলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বে লীন; তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান উর্বর-উচ্ছেদ। অশরীরী আমি আজ তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত উত্তপ্ত শয্যায়। ক্রমাগত শতাব্দীর বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে। বিদায় পৃথিবী আজ, তারুণ্যের তাপে নিবদ্ধ পথিক-দৃষ্টি উদ্বুদ্ধ আকাশে, সার্থক আমার নিত্য-লুপ্ত পরিক্রমা ধ্বনিময় অনন্ত প্রান্তরে। দূরগামী আমি আজ উদ্বেলিত পশ্চাতের পানে উদাস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি রেখে যাই সম্মুখের ডাকে। শাশ্বত ভাস্বর পথে আমার নিষিদ্ধ আয়োজন, হিমাচ্ছন্ন চক্ষে মোর জড়তার ঘন অন্ধকার। হে দেবতা আলো চাই, সূর্যের সঞ্চয় তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা! অন্ধকার অরণ্যের উদ্দাম উল্লাস লুপ্ত হোক আশঙ্কায় উদ্ধত মৃত্যুতে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) দিকপ্রান্তে ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে; অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে, অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে, দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে।বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে পশেছে আঁদার রাত্রে- প্রত্যেক স্নায়ুতে;- গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে আরক্তিম আদিম প্রদোষে।।দিনের নীলাভ শেষ আলো জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে। অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানেক্ষেতে সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল; দিক্প্রান্তে সূর্য চমকাল।। দিনবদলের পালা আর এক যুদ্ধ শেষ, পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ। উদ্দাম ঢাকের শব্দে সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে, নামে এক ক্লান্তির জড়তা। রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে নাড়া দেয় পৃথিবীকে, সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? তুষারখচিত মাঠে, ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়, ভাঙা কামানের মুখে ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসাঃ কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর?দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন! বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন, হাতে হিসেবের খাতা উন্মুখর এই পৃথিবীঃ আজ তার শোধ করো ঋণ। অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার, আজ হোক তোমার বিচার। তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ, তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান; জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল, পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল, স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম, প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম, বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম, দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম। তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ সে কেবল আমাদের বিরাট মায়। এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক, গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক; এ সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী, আমরা প্রহর শুধু গনি।পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালাঃ ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা; জানো না এখানে যুদ্ধ-শুরু দিনবদলের পালা।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) দুরাশার মৃত্যু দ্বারে মৃত্যু, বনে বনে লেগেছে জোয়ার, পিছনে কি পথ নেই আর? আমাদের এই পলায়ন জেনেছে মরণ, অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে, প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে।দাবানল! ব্যর্থ হল শুষ্ক অশ্রুজল, বেনামী কৌশল জেনেছে যে আরণ্যক প্রাণী তাই শেষে নির্মূল বনানী।। দুর্মর হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে, সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।“হয় দান নয় প্রাণ” এ শব্দে সারা দেশ দিশাহারা, একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা।সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন দান, দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) দেওয়ালী তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা, আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব, রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব। এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি, মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী, সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতঃ এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা; তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে। যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে, তবুও নতুন ক'রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ, মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক, এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে? আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে, আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই- শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই।।(ভূপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য-কে উদ্দেশ্য করে লেখা) দেবদারু গাছে রোদের ঝলক দেবদারু গাছে রোদের ঝলক, হেমন্তে ঝরে পাতা, সারাদিন ধ’রে মুরগীরা ডাকে, এই নিয়ে দিন গাঁথা৷ রক্তের ঝড় বাইরে বইছে, ছোটে হিংসার ঢেউ, খবরে কাগজ জানায় সেকথা, চোখে দেখি নাকো কেউ॥১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রচিত এই কবিতাটি খুলনার ‘সপ্তর্ষি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ শয্যাশায়ী সুকান্ত ‘রেড-এড কিওর হোম’ হাসপাতালের রাইটিং প্যাডে এটি লিখে পাঠান৷ কবিতাটি মনীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত৷ দেয়ালিকা এক দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা। আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।দুই সকালে বিকালে মনের খেয়ালে ইঁদারায় দাঁড়িয়ে থাকলে অর্থটা তার কি দাঁড়ায়?তিন কখন বাজল ছ’টা প্রাসাদে প্রাসাদে ঝলসায় দেখি শেষ সূর্যের ছটা – স্তিমিত দিনের উদ্ধত ঘনঘটা।চার বেজে চলে রেডিও সর্বদা গোলমাল করতেই ‘রেডি’ ও।পাঁচ জাপানী গো জাপানী ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ ধরে গেল হাঁপানী?ছয় জার্মানী গো জার্মানী তুমি ছিলে অজেয় বীর এ কথা আজ আর মানি!সাত হে রাজকন্যে তোমার জন্যে এ জনারণ্যে নেইকো ঠাঁই- জানাই তাই।আট আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সল্‌তেঃ ‘চাইনে চাইনে আমি জ্বলতে।’   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) দেশলাই কাঠি আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ তবু জেনো মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ- বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস; আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল? ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন- আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়! কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে, কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের? মনে নেই? এই সেদিন- আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে; চমকে উঠেছিলে- আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।আমাদের কী অসীম শক্তি তা তো অনুভব করেছ বারংবার; তবু কেন বোঝো না, আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে , গ্রামে- দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায় তা তো তোমরা জানোই! কিন্তু তোমরা তো জানো না: কবে আমরা জ্বলে উঠব- সবাই শেষবারের মতো!কাব্যগ্রন্থঃ- ছাড়পত্র নব জ্যামিতির ছড়া Food-Problem (একটি প্রাথমিক সম্পাদ্যের ছায়া অবলম্বনে)সিদ্ধান্ত : আজকে দেশে রব উঠেছে, দেশেতে নেই খাদ্য; ‘আছে’, সেটা প্রমাণ করাই অধুনা ‘সম্পাদ্য’৷ *কল্পনা : মনে করো, আসছে জাপান অতি অবিলম্বে, সাধারণকে রাখতে হবে লৌহদৃঢ় ‘লম্বে’৷ “খাদ্য নেই” এর প্রথম পাওয়া খুব ‘সরল রেখা’তে’, দেশরক্ষার ‘লম্ব’ তোলাই আজকে হবে শেখাতে৷ *অঙ্কন : আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে, প্রতিরোধের বিন্দুতে নাও ঐক্য-রেখা এঁকে! ‘হিন্দু’-‘মুসলমানে’র কেন্দ্রে, দুদিকের দুই ‘চাপে’, যুক্ত করো উভয়কে এক প্রতিরোধের ধাপে৷ প্রতিরোধের বিন্দুতে দুই জাতি যদি মেলে, সাথে সাথেই খাদ্য পাওয়ার হদিশ তুমি পেলে৷ *প্রমাণ : খাদ্য এবং প্রতিরোধ উভয়েরই চাই, হিন্দু এবং মুসলমানে মিলন হবে তাই৷ উভয়ের চাই স্বাধীনতা, উভয় দাবী সমান, দিকে দিকে ‘খাদ্যলাভ’ একতারই প্রমাণ৷ প্রতিরোধের সঠিক পথে অগ্রসর যারা, ঐক্যবদ্ধ পরস্পর খাদ্য পায় তারা॥‘নব জ্যামিতির ছড়া’ সাপ্তাহিক জনযুদ্ধের কিশোর বিভাগে প্রকাশের জন্যে রচিত হয়েছিল৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪৩৷ নিবৃত্তির পূর্বে দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে, মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ; অবরুদ্ধ বে তার উন্মাদ তড়িৎ; নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ।ভয়ার্ত শোণিত-চক্ষে নামে কালোছায়া, রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ দিক্প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রূর হাসি, রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ।দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনাঃ ধূ-ধূ করে চেরাপুঞ্জি- সহিষ্ণু হৃদয়। ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দনঃ নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয়।। নিভৃত বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়, সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো, শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব। নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে, অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ? জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী, আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।। পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ, আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের। হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক, পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা, আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা। পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ; দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ (বিগত দিনের) ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত, যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের। বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরদার, ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা; তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার। রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী           অকস্মাৎ করে কানাকানি ; 'দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা           এ ঝড়ো যুগের মাঝে'নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন, বিষ্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ রায়ু ; আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু। ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন , পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু, দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায়। রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক। পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক'রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায় রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক। এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর; জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে।যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক। আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ।। পটভূমি অজাতশত্রু, কতদিন কাল কাটলো : চিরজীবন কি আবাদ-ই ফসল ফলবে? ওগো ত্রিশঙ্কু, নামাবলী আজ সম্বল টংকারে মূঢ় স্তব্ধ বুকের রক্ত৷কখনো সন্ধ্যা জীবনকে চায় বাঁধতে, সাদা রাতগুলো স্বপ্নের ছায়া মনে হয়, মাটির বুকেতে পরিচিত পদশব্দ, কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি থেকেই অব্যয়৷ভীরু একদিন চেয়েছিল দূর অতীতে রক্তের গড়া মানুষকে ভালবাসতে; তাই বলে আজ পেশাদারী কোন মৃত্যু! বিপদকে ভয়? সাম্যের পুনরুক্তি৷সখের শপথ গলিতে কালের গর্ভে— প্রপঞ্চময় এই দুনিয়ার মুষ্ঠি, তবু দিন চাই, উপসংহারে নিঃস্ব নইলে চটুল কালের চপল দৃষ্টি৷পঙ্গু জীবন; পিচ্ছিল ভীত আত্মা,— রাত্রির বুকে উদ্যত লাল চক্ষু; শেষ নিঃশ্বাস পড়ুক মৌন মন্ত্রে, যদি ধরিত্রী একটুও হয় রক্তিম॥‘পটভুমি’ কবিতাটির রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪২-৪৩৷ পত্র কাশী গিয়ে হু হু ক’রে কাটলো কয়েক মাস তো, কেমন আছে মেজাজ ও মন, কেমন আছে স্বাস্থ্য? বেজায় রকম ঠাণ্ডা সবাই করছে তো বরদাস্ত? খাচ্ছে সবাই সস্তা জিনিস, খাচ্ছে পাঁঠা আস্ত?সেলাই কলের কথাটুকু মেজদার দু’কান স্পর্শ ক’রে গেছে বলেই আমার অনুমান৷ ব্যবস্থাটা হবেই, করি অভয় বর দান; আশা করি, শুনে হবে উল্লসিত প্রাণ৷ এতটা কাল ঠাকুর ও ঝি লোভ সামলে আসতো, এবার বুঝি লোভের দায়ে হয় তারা বরখাস্ত৷চারুটাও হয়ে গেছে বেজায় বেয়াড়া, মাথার ওপরে ঝোলে যা খুশির খাঁড়া৷ নতেদা’র বেড়ে গেছে অঙ্গুলি হাড়া, ঘেলুর পরীক্ষাও হয়ে গেছে সারা; এবার খরচ ক’রে কিছু রেল-ভাড়া মাতিয়ে তুলতে বলি রামধন পাড়া৷এবার বোধহয় ছাড়তে হল কাশী, ছাড়তে হল শৈলর মা, ইন্দু ও ন’মাসি৷ দুঃখ কিসের, কেউ কি সেথায় থাকে বারোমাসই? কাশী থাকতে চাইবে তারা যারা স্বর্গবাসী, আমি কিন্তু কলকাতাতেই থাকতে ভালবাসি৷ আমার যুক্তি শুনতে গিয়ে পাচ্ছে কি খুব হাসি? লেখা বন্ধ হোক তা হলে, এবার আমি আসি॥১৯৪৫ সালে সুকান্ত মেজবৌদি রেণু দেবীর সঙ্গে কাশী বেড়াতে যান৷ সুকান্ত ফিরে এসে শ্যামবাজারের বাড়ি থেকে এই চিঠিটি তাঁকে লিখেছিলেন৷ চিঠিটি রাখাল ভট্টাচার্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন৷ পরাভব হঠাৎ ফাল্গুনী হাওয়া ব্যাধিগ্রস্ত কলির সন্ধ্যায়ঃ নগরে নগররক্ষী পদাতিক পদধ্বনি শুনি; – দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন, – মহামারী,অন্তরে বিক্ষোভ – অবসন্ন বিলাসের সংকুচিত প্রাণ। ব্যক্তিত্বের গাত্রদাহ; রন্ধ্রহীন স্বধর্ম বিকাশ অতীতের ভগ্ননীড় এইবার সুপুষ্ট সন্ধ্যায়। বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পরে, – বৈশাখের ঝড়ে তারই অস্পষ্ট চেতনা। ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়…. নশ্বর পৌষের দিন চারিদিকে ধূর্তের সমতাঃ জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন। গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, – প্রকাশ্য ভিক্ষার ঝুলি কালক্রমে অত্যন্ত উদার; সংক্রামিত রক্ত-রোগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে। শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন, পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতে, দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর। বিজিগীষা? – সন্দিহান আগামী দিনেরাঃ দৃষ্টিপথ অন্ধকার, (লাল-সূর্য মুক্তির প্রতীক? -আজ তবে প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।)   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) পরিখা স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে প্লাবন, উষ্ণ নিবিড় ধুলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল। ক্লান্ত বুকের হৃৎস্পন্দন ক্রমেই ধীর হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল। ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ?শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত; কত শিখণ্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে? দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো। মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে; গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে।পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ। চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি, সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি। অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে। মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে।সঙ্গীবিহনি দুর্জয় এই পরিভ্রমণ রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ, এইবারে করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ। দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন।পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড় পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে। চলো, আরো দূরে? ক্ষুদিত মরণ নিরন্তর, পুরনো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে, অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা খনন, থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ।মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির- পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ। বারুদের দুম কালো ছায়া আনে, - তিক্ত রুধির ; পৃথিবী এখনো নির্জন নয়- জ্বলন্ত ধূপ। নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) পরিচয় ও পাড়ার শ্যাম রায় কাছে পেলে কামড়ায় এমনি সে পালোয়ান, একদিন দুপুরে ডেকে বলে গুপুরে ‘এক্ষুনি আলো আন্’৷ কী বিপদ তা হ’লে মার খাব আমরা? দিলে পরে উত্তর রেগে বলে ‘দুত্তর, যত সব দামড়া’৷ কেঁদে বলি, শ্রীপদে বাঁচাও এ বিপদে— অক্ষম আমাদের৷ হেসে বলে শাম-দা নিয়ে আয় রামদা ধুবড়ির রামাদের॥‘পরিচয়’ ছড়াটির রচনাকাল ১৯৩৯-৪০ সাল বলে মনে হয়৷ পরিবেশন সান্ধ্য ভিড় জমে ওঠে রেস্তোরাঁর দুর্লভ আসরে, অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমার পরিচ্ছন্ন পথে – খুঁজে ফেরে অনন্তের বিলুপ্ত পর্যায়। গন্ধহীন আনন্দের অন্তিম নির্যাস এক কাপ চা-এ আর রঙিন সজ্জায়। সম্প্রতি নীরব হল; বিনিদ্র বাসরে ধূমপান চলেঃ তবে ভবতরী তাস। স্মৃতি-ভ্রষ্ট উঞ্ছজীবী চলে কোন মতে।জড়-ভরতের দল বসে আছে পার্কের বেঞ্চিতে, পবিত্র জাহ্নবী-তীরে প্রার্থী যত বেকার যুবক। কতক্ষণ? গঞ্জনার বড় তীব্র জ্বালা- বিবাগী প্রাণের তবু গৃহগত টান।ক্রমে গোঠে সন্ধ্যা নামেঃ অন্তরও নিরালা, এই বার ফিরে চলো, ভাগ্য সবই মিতে; দূরে বাজে একটানা রেডিয়োর গান। এখনো হয় নি শূন্য, ক্রমাগত বেড়ে চলে সখ।ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসে, আগমনী পশ্চিমা হাওয়ায়, সুপ্রাচীন গুরুভক্তি আজো আনে উন্মুক্ত লালসা। চুপ করে বসে থাকো অন্ধকার ঘরে এক কোণেঃ রাম আর রাবণের উভয়েরই হাতে তীক্ষ্ণ কশা।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) পরিশিষ্ট অনেক উল্কার স্রোত বয়েছিল হঠাৎ প্রত্যুষে. বিনিদ্র তারার বে পল্লবিত মেঘ ছুঁয়েছিল রশ্মিটুকু প্রথম আবেগে। অকস্মাৎ কম্পমান অশরীরী দিন, রক্তের বাসরঘরে বিবর্ণ মৃত্যুর বীজ ছড়াল আসন্ন রাজপথে। তবু স্বপ্ন নয়ঃ গোদূলীর প্রত্যহ ছায়ায় গোপন স্বার সৃষ্টি কচ্যুত গ্রহ-উপবনেঃ দিগন্তের নিশ্চল আভাস। ভস্মীভূত শ্মশানক্রন্দনে, রক্তিম আকাশচিহ্ন সবেগে প্রস্থান করে যূথ ব্যঞ্জনায়।নিষিদ্ধ কল্পনাগুলি বন্ধ্যা তবু অলক্ষ্যে প্রসব করে অব্যক্ত যন্ত্রণা, প্রথম যৌবন তার রক্তময় রিক্ত জয়টীকা স্তম্ভিত জীবন হতে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন ক'রে দিল। তারপরঃ প্রান্তিক যাত্রায় অতৃপ্ত রাত্রির স্বাদ, বাসর শয্যায় অসম্বৃত দীর্ঘশ্বাস বিস্মরণী সুরাপানে নিত্য নিমজ্জিত স্বগত জাহ্নবীজলে। তৃষ্ণার্ত কঙ্কাল অতীত অমৃত পানে দৃষ্টি হানে কত! সর্বগ্রাসী প্রলুব্ধ চিতার অপবাদে সভয়ে সন্ধান করে ইতিবৃত্ত দগ্ধপ্রায় মনে। প্রেতাত্মার প্রতিবিম্ব বার্ধক্যের প্রকম্পনে লীন, অনুর্বর জীবনের সূর্যোদয়ঃ ভস্মশেষ চিতা। কুজ্ঝটিকা মূর্ছা গেল আলোক-সম্পাতে, বাসনা-উদ্গ্রীব চিন্তা উন্মুখ ধ্বংসের আর্তনাদে।সরীসৃপ বন্যা যেন জড়তার স্থির প্রতিবাদ, মানবিক অভিযানে নিশ্চিন্ত উষ্ণীষ! প্রচ্ছন্ন অগ্ন্যুৎপাতে সংজ্ঞাহীন মেরুদণ্ড-দিন নিতান্ত ভঙ্গুর, তাই উদ্যত সৃষ্টির ত্রাসে কাঁপেঃ পণভারে জর্জরিত পাথেয় সংগ্রাম, চকিত হরিণদৃষ্টি অভুক্ত মনের পুষ্টিকরঃ অনাসক্ত চৈতন্যের অস্থায়ী প্রয়াণ। অথবা দৈবাৎ কোন নৈর্ব্যক্তিক আশার নিঃশ্বাস নগণ্য অঙ্গারতলে খুঁজেছে অন্তিম। রুদ্ধশ্বাস বসন্তের আদিম প্রকাশ, বিপ্রলব্ধ জনতার কুটিল বিষাক্ত প্রতিবাদে প্রত্যহ লাঞ্ছিত স্বপ্ন, স্পর্ধিত আঘাত! সুষুপ্ত প্রকোষ্ঠতলে তন্দ্রাহীন দ্বৈতাচারী নর নিজেরে বিনষ্ট করে উৎসারিত ধূমে, অদ্ভুত ব্যাধির হিমছায়া দীর্ণ করে নির্যাতিত শুদ্ধ কল্পনাকে ; সদ্যমৃত-পৃথিবীর মানুষের মতো প্রত্যেক মানবমনে একই উত্তাপ অবসাদে। তবুও শার্দূল-মন অন্ধকারে সন্ধ্যার মিছিলে প্রথম বিস্ময়দৃষ্টি মেলে ধরে বিষাক্ত বিশ্বাসে।বহ্নিমান তপ্তশিখা উন্মেষিত প্রথম স্পর্ধায়- বিষকন্যা পৃথিবীর চক্রান্তে বিহ্বল উপস্থিত প্রহরী সভ্যতা। ধূসর অগ্নির পিণ্ডঃ উত্তাপবিহীন স্তিমিত মত্ততাগুলি স্তব্ধ নীহারিকা, মৃত্তিকার দাত্রী অবশেষে।। পুরনো ধাঁধা বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে? গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে? বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি, গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি? বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে, কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে? ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা, গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা। বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য, ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য? ‘হিং-টিং-ছট্’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়, বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) পূর্বাভাস সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে। বুভুক্ষু প্রেতেরা হাসে শাণিত বিদ্রূপে, প্রাণ চায় শতাব্দীর বিলুপ্ত রক্তের– সুষুপ্ত যরো নিত্য কাঁদিছে ক্ষুদায় দূর্ত দাবাগ্নি আজ জ্বলে চুপে চুপে প্রমত্ত কস্তুরীমৃগ ক্ষুব্ধ চেতনায় বিপন্ন করুণ ডাকে তোলে আর্তনাদ। ব্যর্থ আজ শব্দভেদী বাণ– সহস্র তির্যকশৃঙ্গ করিছে বিবাদ – জীবন-মৃত্যুর সীমানায়।                      লাঞ্ছিত সম্মান। ফিরে চায় ভীরু-দৃষ্টি দিয়ে। দুর্বল তিতিক্ষা আজ দুর্বাশার তেজে স্বপ্ন মাঝে উঠেছে বিষিয়ে। দূর পূর্বাকাশে, বিহ্বল বিষাণ উঠে বেজে মরণের শিরায় শিরায়। মুমূর্ষ বিবর্ণ যত রক্তহীন প্রাণ– বিস্ফারিত হিংস্র-বেদনায়। অসংখ্য স্পন্দনে চলে মৃত্যু অভিযান লৌহের দুয়ারে পড়ে কুটিল আঘাত, উত্তপ্ত মাটিতে ঝরে বর্ণহীন শোণিত প্রপাত। সুপ্তোত্থিত পিরামিড দুঃসহ জ্বালায় পৈশাচিক ক্রূর হাসি হেসে বিস্তীর্ণ অরণ্য মাঝে কুঠার চালায়। কালো মৃত্যু ফিরে যায় এসে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) পৃথিবীর দিকে তাকাও দেখ, এই মোটা লোকটাকে দেখ         অভাব জানে না লোকটা, যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে         লোভে জ্বলে তার চোখটা। মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি         পাথরে তৈরি সব তার, কত সুন্দর, পুরোনো এগুলো!         অট্রালিকা এ লোকটার। উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে         চেয়ে দেখে না সে নীচুতে, কত জামির যে মালিক লোকটা         বুঝবে না তুমি কিছুতে। দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে         কলে আর কারখানাতে, মেশিনের কপিকলের শব্দ         শোনো, সবাইকে জানাতে। মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-         খেটে খেটে হল হন্যে ; ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে         মোটা প্রভুটির জন্যে। দেখ একজন মজুরকে দেখ         ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে, কেনা গোলামের মতই খাটুনি         তাই হাড়ভাঙা খাটছে। ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার         স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা, এর সঙ্গে কি তুলনা করবে         প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা? কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে         কাজ করে সারা বেলা এ, পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-         বাকিটা পোষায় সেলায়ে। তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,         থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল, বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে         এমনি করেই কাটে কাল। বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া         করে চোখে চোখে রাখে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে         দোকানে যাওয়ার ফাঁকে। খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা         ছুটে আসে পালে পাল, খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর         হয়তো একটু ডাল। কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে         খাদ্য কিনতে গিয়ে দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,         বসে গালে হাত দিয়ে। পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু (সুতরাং চুপ; কথা বলবে না কভু) সকলেরই প্রভু- ভালো আর খারাপের তাঁরই ইচ্ছায় এ; চুপ করো সব ফের। শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে, চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে। এদের কথায় ভরসা হয় না তবু? সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু। ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি, আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি। যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায় পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায়। মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত- কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে। সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে। রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান্ দেশ, যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ; রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়, লেনিন গড়েছে রাশিয়া! কী বিস্ময়! রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী, নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী, সোভিয়েট-‘তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো, প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো। মজুরের দেশ, কল-কারখানা, প্রাসাদ, নগর, গ্রাম, মজুরের খাওয়া মজুরের হাওয়া, শুধু মজুরের নাম। মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর গরমে সাগর-ধার, মজুরের কত স্বাধীনতা! আর অজস্র অধিকার। মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায় জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে, ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে। মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয় পাহারা দিন ও রাত, গরীবের দেশে সইবে না তারা বড়লোকদের হাত। শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন জীবন সেখানে, তাই সকলেই সুখে বাস করে আর সকলেই ভাই-ভাই; এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা বাঁচাতে মাতৃভূমি, তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে, আমার জন্যে তুমি।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) প্রতিদ্বন্দ্বী গন্ধ এনেছে তীব্র নেশায়, ফেনিল মদির, জোয়ার কি এল রক্ত নদীর? নইলে কখনো নিস্তার নেই বন্দীশালায়। সচারাচর কি সামনা সামনি ধূর্ত পালায়? কাজ নেই আর বল্লাল সেন-ই আমলে, মুক্তি পেয়েছি ধোঁয়াতে নিবিড় শ্যামলে, তোমাতে আমাতে চিরদিন চলে দ্বন্দ্ব। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তীব্র বাঁশির ছন্দ। মনেরে জাগায় সাবধান হুঁশিয়ার। খুঁজে নিতে হবে পুরাতন হাতিয়ার পাণ্ডুর পৃথিবীতে। আফিঙের ঘোর মেরু-বর্জিত শীতে বিষাক্ত আর শিথিল আবেষ্টনে তোমারে স্মরিছে মনে। সন্ধান করে নিত্য নিভৃত রাতে প্রতিদ্বন্দ্বী, -উচ্ছল মদিরাতে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) প্রথম বার্ষিকী আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ। আজ বর্ষশেষে হে অতীত,                       কোন সম্ভাষণ            জানাব অলক্ষ্য পানে?            ব্যথাক্ষুব্ধ গানে                       ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ!দিনে দিনে, তিলে তিলে যে বেদনা                       উদাস মধুর            হয়েছে নিঃশব্দ প্রাণে            ভরেছে বিপুল টানে,                       তারে আজ দেব কোন সুর?তোমার ধূসর স্মৃতি, তোমার কাব্যের সুরভিতে লেগেছে সন্ধ্যার ছোঁওয়া, প্রাণ ভরে দিতে            হেমন্তের শিশিরের কণা            আমি পারিব না।প্রশান্ত সূর্যাস্ত পরে দিগন্তের যে রাগ-রক্তিমা,            লেগেছে প্রাণের ‘পরে,            সহসা স্মৃতির ঝড়ে                       মুছিয়া যাবে কী তার সীমা! তোমার সন্ধ্যার ছায়াখানি            কোন পথ হতে মোরে কোন পথে নিয়ে যাবে টানি’            অমর্ত্যরে আলোক সন্ধানী                       আমি নাহি জানি। একদা শ্রাবণ দিনে গভীর চরণে, নীরবে নিষ্ঠুর সরণিতে            পাদস্পর্শ দিতে                       ভিক্ষুক মরণে। পেয়েছে পথের মধ্যে দিয়েছ অক্ষয়                       তব দান,            হে বিরাট প্রাণ! তোমার চরণ স্পর্শে রোমাঞ্চিত পৃথিবীর ধূলি            উঠিছে আকুলি’, আজিও স্মৃতির গন্ধে ব্যথিত জনতা কহিছে নিঃশব্দ স্বরে একমাত্র কথা,            ‘তুমি হেথা নাই’। বিস্ময়ের অন্ধকারে মুহ্যমান জলস্থল তাই আদো তন্দ্রা, আধো জাগরণে দক্ষিণ হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে            ফেলিছে নিঃশ্বাস। ক্লে­দক্লি­ষ্ট পৃথিবীতে একী পরিহাস। তুমি চলে গেছ তবু আজিও বহিছে বারোমাস            উদ্দাম বাতাস, এখনো বসন্ত আসে            সকরুণ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে, এখনো শ্রাবণ ঝরোঝর            অবিশ্রান্ত মাতায় অন্তর। এখনো কদম্ব বনে বনে            লাগে দোলা মত্ত সমীরণে,            এখনো উদাসি’ শরতে কাশের ফোটে হাসি। জীবনে উচ্ছ্বাস, হাসি গান            এখনো হয় নি অবসান। এখনো ফুটিছে চাঁপা হেনা,            কিছুই তো তুমি দেখিলে না।            তোমার কবির দৃষ্টি দিয়ে            কোন কিছু দিলে না চিনিয়ে এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,            সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়; স্বার্থের প্রাচীরতলে মানুষের সমাধি রচনা,            অযথা বিভেদ সৃষ্টি, হীন প্ররোচনা            পরস্পর বিদ্বেষ সংঘাতে,                       মিথ্যা ছলনাতে –            আজিকার মানুষের জয়; প্রসন্ন জীবন মাঝে বিসর্পিল, বিভীষিকাময়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) প্রস্তুত কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্বরায়, নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়। ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ; তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক, কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ্ব আগুন ছড়ায়।অবশেষে ভুল ভেঙেছে, জোয়ার মনের কোণে, তীব্র ভ্রূকুটি হেনেছি কুটিল ফুলের বনে; আভিশাপময় যে সব আত্মা আজো অধীর, তাদের সকাশে রেখেছি প্রাণের দৃঢ় শিবির; নিজেকে মুক্ত করেছি আত্মসমর্পণে।চাঁদের স্বপ্নে ধুয়ে গেছে মন যে-সব দিনে, তাদের আজকে শত্রু বলেই নিয়েছি চিনে, হীন র্স্পধারা ধূর্তের মতো শক্তিশেলে ছিনিয়ে আমায় নিতে পারে আজো সুযোগ পেলে তাই সতর্ক হয়েছি মনকে রাখি নি ঋণে।অসংখ্য দিন কেটেছে প্রাণের বৃথা রোদনে নরম সোফায় বিপ্লবী মন উদ্ধোধনে; আজকে কিন্তু জনতা-জোয়ারে দোলে প্লাবন, নিরন্ন মনে রক্তিম পথ অনুধাবন, করছে পৃথিবী পূর্ব-পন্থা সংশোধনে।অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই, মহামরণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই; পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন, ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।। প্রার্থী হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি, যেমন প্রতীক্ষা ক'রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ, ধানকাটার রেমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।হে সূর্য, তুমি তো জানো, আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব! সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে, এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে, কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই!সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী। ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই এক-টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।হে সুর্য! তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে উত্তাপ আর আলো দিও, আর উত্তাপ দিও, রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।হে সূর্য তুমি আমাদের উত্তাপ দিও শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড, তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হব! তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা, তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।। প্রিয়তমাসু সীমান্তে আজ আমি প্রহরী। অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি- স্বদেশের সীমানায়।ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী, স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে; - ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক, হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল, রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ, আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি। আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ, স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ, চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে? কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক? যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি, চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া, প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল, গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক, রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই।তোমাকে ভেবেছি কতদিন, কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কত গোলা ফাটার মুহূর্তে। কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে তোমার আর তোমাদের ভাবনায়। তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে, ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব। আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে। জানি না আজো, আছ কি নেই, দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে জানি না তাও।তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায় ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে। জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে; জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে, মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার। তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে সে তোমার হৃদয়। যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে; পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় আর সামনে নয়, এবার পেছন ফেরার পালা।পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে। প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক'রে পেলাম কী? উত্তর তার- তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়, ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব, ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র; আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।। ফসলের ডাকঃ ১৩৫১ কাস্তে দাও আমার এ হাতে সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে। শক্তির উন্মুক্ত হাওয়া আমার পেশীতে স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি চেতনার বিদ্যুৎ বিকাশঃ দু'পায়ে অস্থির আজ বলিষ্ঠ কদম; কাস্তে দাও আমার এ হাতে। দু'চোখে আমার আজ বিচ্ছুরিত মাঠের আগুন, নিঃশব্দে বিস্তীর্ণ ক্ষেতে তরঙ্গিত প্রাণের জোয়ার মৌসুমী হাওয়ায় আসে জীবনের ডাক; শহরের চুল্লী ঘিরে পতঙ্গের কানে।বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে, মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্পদ; কাস্তে দাও আমার এ হাতে। মনে আছে একদিন তোমাদের ঘরে নবান্ন উজাড় ক'রে পাঠিয়েছি সোনার বছরে, নির্ভাবনার হাসি ছড়িয়েছি মুখে তৃপ্তির প্রগাঢ় চিহ্ন এনেছি সম্মুখে, সেদিনের অলক্ষ্য সেবার বিনিময়ে আজ শুধু কাস্তে দাও আমার এ হাতে।আমার পুরনো কাস্তে পুড়ে গেছে ক্ষুদার আগুনে, তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্যপ্রখর- যে কাস্তে ঝল্‌সাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে। জানি আমি মৃত্যু আজ ঘুরে যায় তোমাদেরও দ্বারে, দুর্ভিক্ষ ফেলেছে ছায়া তোমাদের দৈনিক ভাণ্ডারে; তোমাদের বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা আমার, শুখু আজ কাস্তে দাও আমার এ হাতে। পরাস্ত অনেক চাষী; ক্ষিপ্রগতি নিঃশব্দ মরণ- জ্বলন্ত মৃত্যুর হাতে দেখা গেল বুভুক্ষুর আত্মসমর্পণ, তাদের ফসল পড়ে, দৃষ্টি জ্বলে সুদূরসন্ধানী তাদের ক্ষেতের হাওয়া চুপিচুপি করে কানাকানি- আমাকেই কাস্তে নিতে হবে। নিয়ত আমার কানে গুঞ্জরিত ক্ষুদার যন্ত্রণা, উদ্বেলিত হাওয়া আনে মাঠের সে উচ্ছ্বসিত ডাক, সুস্পষ্ট আমার কাছে জীবনের সুতীব্র সংকেতঃ তাই আজ একবার কাস্তে দাও আমার এ হাতে।। বিক্ষোভ দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম, হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম। জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে, কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে? যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী, আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি। ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি, আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি, অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা, তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা? বিদ্রোহী মন! আজকে ক'রো না মানা, দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা, দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে, জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে। কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল, ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল, ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে। ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ, আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) বিদ্রোহের গান বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি? এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি, আমরা সবাই যে যার প্রহরী উঠুক ডাক।উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে ভীরুরা থাক।মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি, চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি রুখবে কে আর এ অগ্রগতি, সাধ্য কার?রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন? এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন? চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য ধারি না ধার।খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি, গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি, ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি, মৃত্যুপণ।দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে, বসে থাকবার বেলা নেই মোটে, রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে পূর্বকোণ।ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি, বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি, কোথায় প্রাণ!দেখব, ওপারে আজো আছে কারা, খসাব আঘাতে আকাশের তারা, সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া, ছড়াব দান। জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান।। বিবৃতি আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে, জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে, দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল, প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ; বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দু'পাশে, প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীন নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন, পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে, দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে! দুয়ারে দুয়ারে ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল, নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল; রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে, বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে। পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে, বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে, নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন, ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন। সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে দেশপ্রেমে দৃপ্তপ্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে।তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত, এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত, ভারতবর্ষের 'পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ- দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ, রক্তে আনো লাল, রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল। উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ, আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।আজকে মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ, কারখানায় কারখানায় তোলে ঐক্যতান। অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে। আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন, এদেশে ভাণ্ডার ভ'রে দেবে জানি নতুন য়ূক্রেন।নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ, টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ। তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি বিক্ষুব্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী: বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক। ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা, ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।।কাব্যগ্রন্থঃ- ছাড়পত্র বিভীষণের প্রতি বিভীষণের প্রতিআমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক ! লুপ্ত অধুনা এদেশে তোমার গুপ্তঘাতক, হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে, পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে । অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক, এখানে সবাই সংঘবদ্ধ, যে নবজাতক ।ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ রক্ত-কুসুম ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, ভাঙে ভীত ঘুম । এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে, তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে, যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুম : তবু শত্রুর নিধনে লিপ্ত বাসনার ধূম ।মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ, তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত । ক্ষুধিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, "প্রবেশ নিষেধ, এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব, ভুলেছে বিভেদ ।" দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ, শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ ॥ বিয়ে বাড়ির মজা বিয়ে বাড়িঃ বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানা রকম খাদ্য; হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ, আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ, বাসরঘরে সাজছে কনে, সকলে উৎফুল্ল, লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুললঃ “আসুন, আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য, যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য; মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি। খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।” বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক, আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক্-ধুক্, ‘হুলু’ দিতে তৈরী সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত, সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত। ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ; হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দঃ হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজলো জোরে, বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে। কোথায় বরের সাজসজ্জা? কোথায় ফুলের মালা? সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা। বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে। বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে, বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন? পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন! এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে? থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে? কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে, গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) বুদ্বুদ মাত্র মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই, তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে, মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে, – তারি তরে পাতা সিংহাসন, রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন। তবুও প্রচণ্ড-গতি জীবনের ধরা, নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা, জন্মের প্রথম কাল হতে, আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে। এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী, যেখানে কীর্তির নামাবলী, আমাদের স্থান নেই সেথা – আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) বৈশম্পায়ন আকাশের খাপছাড়া ক্রন্দন নাই আর আষাঢ়ের খেলনা। নিত্য যে পাণ্ডুর জড়তা সথীহারা পথিকের সঞ্চয়।রক্তের বুকভরা নিঃশ্বাস, আঁধারের বুকফাটা চীৎকার- এই নিয়ে মেতে আছি আমরা কাজ নেই হিসাবের খাতাতে।মিলাল দিনের কোনো ছায়াতে পিপাসায় আর কূল পাই না; হারানো স্মৃতির মৃদু গন্ধে প্রাণ কভু হয় নাকো চঞ্চল।মাঝে মাঝে অনাহূত আহ্বান আনে কই আলেয়ার বিত্ত? শহরের জমকালো খবরে হাজিরা খাতাটা থাকে শূন্য।আনমনে জানা পথ চলতে পাই নাকো মাদকের গন্ধ! রাত্রিদিনের দাবা চালেতে আমাদের মন কেন উষ্ণ?শ্মশানঘাটেতে ব' কখনো দেখি নাই মরীচিকা সহসা, তাই বুঝি চিরকাল আঁধারে আমরাই দেখি শুধু স্বপ্ন!বার বার কায়াহীন ছায়ারে ধরেছিনু বাহুপাশে জড়িয়ে, তাই আজ গৈরিক মাটিতে রঙিন বসন করি শুদ্ধ।। বোধন হে মহামানব, একবার এসো ফিরে শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে, এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার; লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার। এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;কোথাও নেইকো পার মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল, এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল, ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো, হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে, হে নীড়-বিহারী সঙ্গী! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আমার- ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস তাদের করেছ মা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ। তোমার ক্ষেতের শস্য চুরি ক'রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায় তাদেরি দু'পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়; লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিস্ফল- তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল। তুমি তো প্রহর গোনো, তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি, তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে- কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার! সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড় দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড় সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার: কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার- এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার?লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম। সুদ ও আসলে আজকে তাই যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র, লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে। লোভের মাথায় পদাঘাত হানো- আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো। দৈত্যরাজের যত অনুচর মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর; মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ- হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ। তোমার ফসল, তোমার মাটি তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি তোমার চেতনা চালিত হাতে। এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে? স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি? এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র? করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্রঃ শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার! তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়- হিসাব কি দিবি তার?প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা, ভেঙেছিস ঘরবাড়ি, সে কথা কি আমি জীবনে মরণে কখনো ভুলতে পারি? আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।শোন্ রে মজুতদার, ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ করব তোকে এবার।তারপর বহুশত যুগ পরে ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার, মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার। তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার মানুষ ছিল কি? জবাব মেলে না তার।আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়, দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়; আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি। দুহাতে বাজাও প্রতিশোদের উন্মত্ত দামামা, প্রার্থনা করোঃ হে জীবন, যে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা- আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি, প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের তুষার-গলানো উত্তাপ। টুকরে টুকরো ক'রে ছেঁড়ো তোমার অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী। শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর; তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি মানুষ নও- গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও। ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।। ব্যর্থতা আজকে হঠাৎ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হ’তে সাধ জাগে, মনে হয় তবু যদি পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ, চাষার ছেলের হাতে এসে যেত হঠাৎ আজ৷ তা হলে না হয় আকাশবিহার হ’ত সফল, টুকরো মেঘেরা যেতে-যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল; জনারণ্যে কি রাজকন্যার নেইকো ঠাঁই? কাস্তেখানাকে বাগিয়ে আজকে ভাবছি তাই৷অসি নাই থাক, হাতে তো আমার কাস্তে আছে, চাষার ছেলের অসিকে কি ভালবাসাতে আছে? তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন, যেখানে ঝলসে উঠবে কাস্তে দৃপ্ত-কিরণ৷ হে রাজকন্যা, দৈত্যপুরীতে বন্দী থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমায় নিয়েছ ডেকে৷ হেমন্তে পাকা ফসল সামনে, তবু দিলে ডাক; তোমাকে মুক্ত করব, আজকে ধান কাটা থাক৷রাজপুত্রের মতন যদিও নেই কৃপাণ, তবু মনে আশা, তাই কাস্তেতে দিচ্ছি শান, হে রাজকুমারী, আমাদের ঘরে আসতে তোমার মন চাইবে তো? হবে কষ্টের সমুদ্র পার? দৈত্যশালায় পাথরের ঘর, পালঙ্ক-খাট, আমাদের শুধু পর্ণ-কুটির, ফাঁকা ক্ষেত-মাঠ; সোনার শিকল নেই, আমাদের মুক্ত আকাশ, রাজার ঝিয়ারী! এখানে নিদ্রাহীন বারো মাস৷এখানে দিন ও রাত্রি পরিশ্রমেই কাটে সূর্য এখানে দ্রুত ওঠে, নামে দেরিতে পাটে৷ হে রাজকন্যা, চলো যাই, আজ এলাম পাশে, পক্ষীরাজের অভাবে পা দেব কোমল ঘাসে৷ হে রাজকন্যা সাড়া দাও, কেন মৌন পাষাণ? আমার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে তুমি তুলবে না ধান? হে রাজকন্যা, ঘুম ভাঙলো না? সোনার কাঠি কোথা থেকে পাব, আমরা নিঃস্ব, ক্ষেতেই খাটি৷ সোনার কাঠির সোনা নেই, আছে ধানের সোনা, তাতে কি হবে না? তবে তো বৃথাই অনুশোচনা॥ব্যর্থতা’ কবিতাটি আষাঢ় ১৩৫৩-র কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ কবিতাটি ‘মীমাংসা’ কবিতার প্রথম খসড়া বলে মনে হয়৷ ব্ল্যাক-মার্কেট হাত করে মহাজন, হাত করে জোতদার, ব্ল্যাক-মার্কেট করে ধনী রাম পোদ্দার, গরীব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালো বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান ছয় হাঁকালো। কেউ নেই ত্রিভুবনে, নেই কিছু অভাবও তবু ছাড়ল না তার লোক-মারা স্বভাবও। একা থাকে, তাই হরি চাকরটা রক্ষী ত্রিসীমানা মাড়ায় না তাই কাক-পক্ষী। বিশ্বে কাউকে রাম কাছে পেতে চান না, হরিই বাজার করে, সে-ই করে রান্না। এমনি ক’রেই বেশ কেটে যাচ্ছিল কাল, হঠাৎ হিসেবে রাম দেখলেন গোলমাল, বললেন চাকরকেঃ কিরে ব্যাটা, কি ব্যাপার? এত টাকা লাগে কেন বাজারেতে রোজকার? আলু তিন টাকা সের? পটল পনেরো আনা? ভেবেছিস বাজারের কিছু বুঝি নেই জানা? রোজ রোজ চুরি তোর? হতভাগা, বজ্জাত! হাসছিস? এক্ষুণি ভেঙে দেব সব দাঁত। খানিকটা চুপ করে বলল চাকর হরিঃ আপনারই দেখাদেখি ব্ল্যাক-মাকের্ট করি।  (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) ভবিষ্যতে স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ থাকবে না বন্ধন, আমারা সবাই স্বরাজ-যজ্ঞে হব রে ইন্ধন! বুকের রক্ত দিব ঢালি স্বাধীনতারে, রক্ত পণে মুক্তি দের ভারত-মাতারে৷ মূর্খ যারা অজ্ঞ যারা যে জন বঞ্চিত তাদের তরে মুক্তি-সুধা করব সঞ্চিত৷ চাষী মজুর দীন দরিদ্র সবাই মোদের ভাই, একস্বরে বলব মোরা স্বাধীনতা চাই॥ থাকবে নাকো মতভেদ আর মিথ্যা সম্প্রদায় ছিন্ন হবে ভেদের গ্রন্থি কঠিন প্রতিজ্ঞায়৷ আমরা সবাই ভারতবাসী শ্রেষ্ঠ পৃথিবীর আমরা হব মুক্তিদাতা আমরা হব বীর॥‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত। ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস (শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে)অকস্মাৎ মধ্যদিনে গান বন্ধ ক’রে দিল পাখি, ছিন্নভিন্ন সন্ধ্যাবেলা প্রাত্যহিক মিলনের রাখী; ঘরে ঘরে অনেকেই নিঃসঙ্গ একাকী৷ক্লাব উঠে গিয়েছে সফরে, শূন্য ঘর, শূন্য মাঠ, ফুল ফোটা মালঞ্চ প’ড়ে ত্যক্ত এ ক্লাবের কক্ষে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে৷ সূর্য অস্ত গিয়েছে কখন, কারো আজ দেখা নেই— কোথাও বন্ধুর দল ছড়ায় না হাসি, নিষ্প্রভ ভোজের স্বপ্ন; একটি কথাও শব্দ তোলে না বাতাসে— ক্লাব-ঘরে ধুলো জমে, বিনা গল্পে সন্ধ্যা হয়; চাঁদ ওঠে উন্মুক্ত আকাশে৷খেলোয়াড় খেলে নাকো, গায়কেরা গায় নাকো গান— বক্তারা বলে না কথা সাঁতারুর বন্ধ আজ স্নান৷ সর্বস্ব নিয়েছে গোরা তারা মারে ঊরুতে চাপড়, যে পথে এ ক্লাব গেছে কে জানে সে পথের খবর?সন্ধ্যার আভাস আসে, জ্বলে না আলোক ক্লাব কক্ষের কোলে, হাতে হাতে নেই সিগারেট— তর্কাতর্কি হয় নাকো বিভক্ত দু’দলে; অযথা সন্ধ্যায় কোনো অচেনার পদশব্দে মালীটি হাঁকে না৷মনে পড়ে লেকের সে পথ? মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়ার চাবুক৷ অনেক উজ্জ্বল দৃশ্য এই লেকে করেছিল উৎসাহিত বুক৷ কেরানী, বেকার, ছাত্র, অধ্যাপক, শিল্পী ও ডাক্তার সকলের কাছে ছিল অবারিত দ্বার, কাজের গহ্বর থেকে পাখিদের মতো এরা নীড় সন্ধানে, সন্ধ্যায় ডেকে এনেছিল এইখানে ভিড়৷ রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সিনেমার কথা, এদের রসনা থেকে প্রত্যহ স্খলিত হ’তে অলক্ষ্যে অযথা; মাঝে মাঝে অনর্থক উচ্ছ্বসিত হাসি, বাতাসে ছড়াত নিত্য শব্দ রাশি রাশি৷তারপর অকস্মাৎ ভেঙে গেল রুদ্ধশ্বাস মন্ত্রমুগ্ধ সভা, সহসা চৈতন্যোদয়; প্রত্যেকের বুকে ফোটে ক্ষুব্ধ রক্তজবা; সমস্ত গানের শেষে যেন ভেঙে গেল এক গানের আসর, যেমন রাত্রির শেষে নিঃশ্বেষে কাঙাল হয় বিবাহ-বাসর৷‘জীবন-রক্ষক’ এই সমাজের দারুণ অভাবে, এদের ‘জীবন-রক্ষা’ হয়তো কঠিন হবে, হয়তো অনেক প্রাণ যাবে॥‘ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস (শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)’—এই শিরোনামায় কবিতাটি লেখা হয়েছিল৷ দক্ষিণ কলকাতার লেক অঞ্চলের ‘ইণ্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য৷ লেকে যুদ্ধকালীন মিলিটারী ক্যাম্প হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে সুকান্ত এই কবিতাটি লিখেছিলেন৷ ভাল খাবার ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত; সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে। সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা, হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা। সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর, কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর। এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ঘুটে, টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে; খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত, খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত। দিনরাত চিৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই, আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই। সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো, খাওয়া ফেলে দিনরাত টাকা ব’লে চেঁচানো। ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে; চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে। নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতিঃ কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি? নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক-ফিক্; তারপর বললেনঃ বলা ভারি শক্ত সবচেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) ভেজাল ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়! ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা, ‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা।’ ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা, ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা ভেজাল কথা- বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে, ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে। ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাটি কেবল আর সকলই মিথ্যে। কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) মজুরদের ঝড় এখন এই তো সময়- কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালরা; সেই সব দালালরা- ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়, বেরিয়ে এসো! জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল, বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য পরাজয় আর মৃত্যুর দূত- বেরিয়ে এসো! বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে। গর্তের পোকারা! এই তো তোমাদের শুভক্ষণ, গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো। সময় হয়েছে, আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে সাদা যাদের পেট- বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক, এই তো তাদের সুযোগ। মানুষ ভালো করেই জানে অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই পুরনো কায়দা।সামান্য কয়েকজন লোভী অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে- আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে ক্ষয়ে-যাওয়ার দল। সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা।অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার। কিন্তু এখন সেই সময়, সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল ক'রো না- বিশ্বাস ক'রো না সেই সব সাপেদের জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে, বিপদে পড়লে যারা ডাকে তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের। এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুদার চূড়ান্ত চিহ্ন।- অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয় নি যার অজ্ঞাত নামঃ "দর্মঘট ভাঙার দল" অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না। ঝড় আসছে- সেই ঝড়ঃ যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে। আর হুঁশিয়ার মজুরঃ সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি।। মণিপুর এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধ'রে এসে আমি জানি পরিপাটি, জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা। যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে, যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উত্থানে! যে চাষী কেটেছে ধন, এ মাটিতে নিয়েছে কবর, এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর। অদৃশ্য তাদের স্বপ্নের সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি, মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক'রে ভুলি? আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে উদয়স্ত খাটি, ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি। এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস, তৈমুর, সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর। কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়, উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড়। তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান, এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান। আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে, আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে। এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক, এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক। এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ'রে রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক'রে। আজকে যখন এই দিক্প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়, কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর, তখন চীৎকার ক' রক্ত ব' ওঠে 'ধিক্ ধিক্, এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক! দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক'রে উন্মোচিত হোক একবার বিশ্বরূপ- উদ্দাম, হে অধিনায়ক!’ এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকণ্ঠায় অস্থির দুপুর- কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন? দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে- এখনো শত্রু ক্ষমা? শত্রু কি করেছে ক্ষমা         বিধ্বস্ত বাংলাকে? আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা, কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা। তুমি কি ক্ষুদিত বন্ধু? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো? তা হোক , তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো। বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়, আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়, এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ, ক্ষুদার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ, তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ? এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি, এদেশে বিপ্লবী আছে, জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী। দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ। তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে। ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি, মৃত্যুকে নিহত ক'রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি, পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে, ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার দান, রঙ লাগে মেঘে। এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা, মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা, আগন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়, ওরা আজ পলিমাটি অবিরাম রক্তের বন্যায়; ওদের দুচোখে আজ বিকশিত আমার কামনা, অভিনন্দন গাছে, পথের দুপাশে অভ্যর্থনা। ওদের পতাকা ওড়ে প্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে, মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে।। মধ্যবিত্ত -৪২ পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে, আজকে সকলে ভুগছে একযোগে, এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস। উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল, হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল, গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে, বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে। সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন, লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন। সহসা নেতারা রুদ্ধ- দেশ জুড়ে 'দেশপ্রেমিক' উদিত ভুঁই ফুঁড়ে। প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে; দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায় একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়। এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে আবার বোমারু রক্ত পান করে, ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে, শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে; তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে, দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।। মহাত্মাজীর প্রতি চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, হাঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবনে শুভক্ষণ এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি। রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী। এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার। এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস- তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস; নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান; বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান। তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি, মনে হয় শুদু তোমারই মধ্যে-আমরা যে বেঁচে আছি- তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু উত্তরণের শেষে, তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে। দিক্‌দিগন্তে প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক, তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ।। মার্শাল তিতোর প্রতি মার্শাল তিতোর প্রতিকমরেড, তুমি পাঠালে ঘোষণা দেশান্তরে, কুটিরে কুটিরে প্রতিধ্বনি,— তুলেছে মুক্তি দারুণ তুফান প্রাণের ঝড়ে তুমি শক্তির অটুট খনি৷ কমরেড, আজ কিষাণ শ্রমিক তোমার পাশে তুমি যে মুক্তি রটনা করো, তারাই সৈন্য : হাজারে হাজারে এগিয়ে আসে তোমার দু’পাশে সকলে জড়ো৷ হে বন্ধু, আজ তুমি বিদ্যুৎ অন্ধকারে সে আলোয় দ্রুত পথকে চেনা : সহসা জনতা দৃপ্ত গেরিলা—অত্যাচারে, দৃঢ় শত্রুর মেটায় দেনা৷ তোমার মন্ত্র কোণে কোণে ফেরে সংগোপনে পথচারীদের ক্ষিপ্রগতি; মেতেছে জনতা মুক্তির দ্বার উদঘাটনে : —ভীরু প্রস্তাবে অসম্মতি৷ ফসলের ক্ষেতে শত্রু রক্ত-সেচন করে, মৃত্যুর ঢেউ কারখানাতে— তবুও আকাশ ভরে আচমকে আর্তস্বরে : শত্রু নিহত স্তব্ধ রাতে৷ প্রবল পাহাড়ে গোপন যুদ্ধ সঞ্চারিত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুখর গানে, বিপ্লবী পথে মিলেছে এবার বন্ধু তিতো : মুক্তির ফৌজ আঘাত হানে৷ শত্রু শিবিরে লাগানো আগুনে বাঁধন পোড়ে —অগ্নি ইশারা জনান্তিকে! ধ্বংসস্তূপে আজ মুক্তির পতাকা ওড়ে ভাঙার বন্যা চতুর্দিকে৷ নামে বসন্ত, পাইন বনের শাখায় শাখায় গাঢ়-সংগীত তুষারপাতে, অযুত জীবন ঘনিষ্ঠ দেহে সামনে তাকায় : মারণ-অস্ত্র সবল হাতে৷ লক্ষ জনতা রক্তে শপথ রচনা করে— ‘আমরা নই তো মৃত্যুভীত, তৈরি আমরা; যুগোশ্লাভের প্রতিটি ঘরে তুমি আছ জানি বন্ধু তিতো৷’ তোমার সেনানী পথে প্রান্তরে দোসর খোঁজে : ‘কোথায় কে আছ মুক্তিকামী?’ ক্ষিপ্ত করেছে তোমার সে ডাক আমাকেও যে তাইতো তোমার পেছনে আমি॥‘মার্শাল তিতোর প্রতি’ কবিতাটির রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪৪৷ মীমাংসা আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তের-নদী পার হতে সাধ জাগে মনে, হায় তবু যদি পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ- তাহলে না হয় আকাশ বিহার হত সফল, টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল।আর আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার হতাম; যেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার। মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি; হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী। (রাজকন্যার লোভ নেই, -লোভ অলঙ্কারে, দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক'রে চায় তাহারে।)আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজার তনয় এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়- তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন, যেখানে ঝল্‌সে উঠবে আমার অসির কিরণ। ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, (নয় দু'ধারী) তাও হ'ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি। তাই ভাবি আজ, তবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন নেব কয়েকটা বেছে জানা জানা বুলি সৌখিন।। মুক্ত বীরদের প্রতি তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর! অবাক অভ্যুদয়। যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময়। তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া- আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা। আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি! একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী। আমরা যে বারে বারে তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে, মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে, তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উত্থানে, উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে, পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো। এই সেই কলকাতা। একদিন যার ভয়ে দুরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা। মনে পড়ে চব্বিশে? সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে; হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাইঃ রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই। সফল! সফল! সেদিনের কলকাতা- হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা। জানি বিকৃত আজকের কলকাতা বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা!গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে- ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান; সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্‌খান্। তোমারা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো।তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার- তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর। পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়বে বহুদুর-বহুদূর তোমরা এসেছ, জেনো এইবার নির্ভয় কলকাতা- অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা। তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসেঃ পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে, মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শাখায় শাখায় লাগেঃ হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে অস্থির হাওয়া অরণ্যপর্বতে, গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে।আজ তোমাদের মুক্তিসভায় তোমদের সম্মুখে, শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখেঃ যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান, আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান। অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে। তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে, তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে।তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়, উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়। তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার, পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার। আবার জ্বালাব বাতি, হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) মুহূর্ত (ক) এমন মুহূর্ত এসেছিল একদিন আমার জীবনে যে মহূর্তে মনে হয়েছিল সার্থক ভুবনে বেঁচে থাকাঃ কালের আরণ্য পদপাত ঘটেছিল আমার গুহায়। জরাগ্রস্ত শীতের পাতারা উড়ে এসেছিল কোথা থেকে, সব কিছু মিশে একাকার কাল-বোশেখীর পদার্পণে সেদিন হাওয়ায় জমেছিল অদ্ভুত রোমাঞ্চ দিকে দিকে; আকাশের চোখে আশীর্বাদ, চুক্তি ছিল আমৃত্যু জীবনে। সে সব মুহূর্তগুলো আজো প্রাণের অষ্পষ্ট প্রশাখায় ফোটায় সবুজ ফুল, উড়ে আসে কাব্যের মৌমাছি। অসংখ্য মুহূর্তে গ’ড়ে তোলা স্বপ্ন-দুর্গ মুহূর্তে চুরমার। আজ কক্ষচ্যুত ভাবি আমি মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা; – যে মুহূর্ত অদৃশ্য প্লাবনে টেনে নিয়ে যায় কান্তরে। আজ আছি নক্ষত্রের দলে, কাল জানি মুহূর্তের টানে ভেসে যাব সূর্যের সভায়, ক্ষুব্ধ কালো ঝড়ের জাহাজে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) মুহূর্ত (খ) মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা যে মুহূর্ত তোমার আমার আর অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা, যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা আর তোমার আগ্রহ। এ মুহূর্তে সূর্যোদয়, এ মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা, আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে সুস্পষ্ট সংকেত। অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর বাড়াল ফসল, মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ।এমন মুহূর্ত এল আমার জীবনে, যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায় – অথচ আশ্চর্য কথা নতুন মুহূর্ত আর এক সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ। অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবন, যে সব মুহূর্ত মিলে আমার কাব্যের শূন্য হাতে ভরে দিত অক্ষয় সম্পদ। কিন্তু আজ উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার দুঃসহ চেষ্টায়। হয়তো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি কাব্যের অজস্র প্রেরণায় উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি। অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয়। গোপন মুহূর্ত আজ এক নিশ্ছিদ্র আকাশে অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে, নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া ধূলিসাৎ – তাই আজ দেখি, প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত মুহূর্তের রক্তিম কপোলে তুলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) মৃত পৃথিবী পৃথিবী কি আজ শেষে নিঃস্ব ক্ষুধাতুর কাঁদে সারা বিশ্ব, চারিদিকে ঝরে পড়া রক্ত, জীবন আজকে উত্যক্ত। আজকের দিন নয় কাব্যের পরিণাম আর সম্ভাব্যের ভয় নিয়ে দিন কাটে নিত্য, জীবনে গোপন-দুর্বৃত্ত। তাইতো জীবন আজ রিক্ত, অলস হৃদয় স্বেদসিক্ত; আজকে প্রাচীর গড়া ভিন্ন পৃথিবী ছড়াবে ক্ষতচিহ্ন। অগোচরে নামে হিম-শৈত্য, কোথায় পালাবে মরু দৈত্য? জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত, তবু তো হৃদয় উদ্দীপ্ত, বোধহয় আগামী কোনো বন্যায়, ভেসে যাবে অনশন, অন্যায়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যুজয়ী গান নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায় অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে; নির্বায়ুমণ্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে। দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ, সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতেঃ অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ।বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ'রে পড়েঃ মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা; ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়। নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন; শোকচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতেঃ দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর- দৃষ্টিপথ অন্ধকার, সন্দিহান আগামী দিনেরা। গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, কণ্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।সহসা জানালায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ- অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে; সে মিছিলে শোনা গেল জনতার মৃত্যুজয়ী গান।। মেজদাকে : মুক্তির অভিনন্দন তোমাকে দেখেছি আমি অবিচল, দৃপ্ত দুঃসময়ে ললাটে পড়ে নি রেখা ক্রূরতম সংকটেরও ভয়ে; তোমাকে দেখেছি আমি বিপদেও পরিহাস রত দেখেছি তোমার মধ্যে কোনো এক শক্তি সুসংহত৷ দুঃখ শোকে, বারবার অদৃষ্টের নিষ্ঠুর আঘাতে অনাহত, আত্মমগ্ন সমুদ্যত জয়ধ্বজা হাতে৷ শিল্প ও সাহিত্যরসে পরিপুষ্ট তোমার হৃদয় জীবনকে জানো তাই মান নাকো কোনো পরাজয়; দাক্ষিণ্যে সমৃদ্ধ মন যেন ব্যস্ত ভাগীরথী জল পথের দু’ধারে তার ছড়ায় যে দানের ফসল, পরোয়া রাখে না প্রতিদানের তা এমনি উদার, বহুবার মুখোমুখি হয়েছে সে বিশ্বাসহন্তার৷ তবুও অক্ষুণ্ণ মন, যতো হোক নিন্দা ও অখ্যাতি সহিষ্ণু হৃদয় জানে সর্বদা মানুষের জ্ঞাতি, তাইতো তোমার মুখে শুনে বাণপ্রস্থের ইঙ্গিত মনেতে বিস্ময় মানি, শেষে হবে বিরক্তির জিত? পৃথিবীকে চেয়ে দেখ, প্রশ্ন ও সংশয়ে থরো থরো, তোমার মুক্তির সঙ্গে বিশ্বের মুক্তিকে যোগ করো॥১৯৪৪ সালে সুকান্তর মেজদা রাখাল ভট্টাচার্য গ্রেপ্তার হন৷ তাঁর মুক্তি উপলক্ষে সুকান্ত এই কবিতাটি লেখেন৷ মেয়েদের পদবী মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী, অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি; 'আ'কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার চেষ্টা হাসির ৷ তাই ভূমিকা ছড়ার ৷ 'গুপ্ত' 'গুপ্তা' হয় মেয়েদের নামে, দেখেছি অনেক চিঠি, পোস্টকার্ড, খামে ৷ সে নিয়মে যদি আজ 'ঘোষ' হয় 'ঘোষা' তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা, 'পালিত' 'পালিতা' হলে 'পাল' হবে 'পালা' নির্ঘাত বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা; 'মল্লিক' 'মল্লিকা' হলে 'দাস হলে 'দাসা' শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা; 'কর' যদি 'করা' হয়, 'ধর' হয় 'ধরা' মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- "সরা" ৷ 'নাগ' যদি 'নাগা' হয় 'সেন'  হয় 'সেনা' বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা ৷৷ রবীন্দ্রনাথের প্রতি এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি, প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি, এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি; এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে, তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে। এখনো স্বগত ভাবাবেগে, মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে। তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সম্রাজ্য গড়ে তোলে, গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে; যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।তবুও নিশ্চিত উপবাস আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস- আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়, আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে, আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।তাই আজ আমারো বিশ্বাস, 'শান্তির লালিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।' তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি, প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি, এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি; এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে, তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে। এখনো স্বগত ভাবাবেগে, মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে। তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে; যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে। তবুও নিশ্চিত উপবাস আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস- আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি, প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমার বসন্ত খাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়, আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে, আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে। তাই আজ আমারো বিশ্বাস, "শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।" তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।। রানার রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে, রানার চলেছে রানার! রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার- কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।রানার! রানার! জানা-অজানার বোঝা আজ তার কাঁধে, বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে; রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়, আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়। তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স'রে যায় বন, আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ। অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্‌মিট্ ক'রে চায়! কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়! কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে- শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে; হাতে লণ্ঠন করে ঠন্‌ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো।এমনি ক'রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে, পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে 'মেলে'। ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে। অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে, ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।রানার! রানার! এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে? ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া, পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া, রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে, দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে। কত চিঠি লেখে লোকে- কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে। এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও, এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ, এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে, এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে। দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি, - এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি- রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব'য়ে? কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে? রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?রানার! গ্রামের রানার! সময় হয়েছে নতুন খবর আনার; শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ ভীরুতা পিছনে ফেলে- পৌঁছে দাও এ নতুন খবর অগ্রগতির 'মেলে', দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি- নেই, দেরি নেই আর, ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে দুর্দম, হে রানার।। রেশন কার্ড রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা, হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা; তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে, রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে, সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা- দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা, হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায় ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়; কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার, আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার, তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে, ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে। রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব? ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব? আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে- যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে; পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে, নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) রোম ভেঙ্গেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন, ছত্রপতি হয়েছে উধাও; শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর। 'সাথী আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও' - রোমের প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশ অস্থির। উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকম্পিত যুগ যুগ অন্ধকার রোম। হাজার বছর ধ'রে দাসত্ব বেঁদেছে বাসা রোমের দেউলে, দিয়েছে অনেক রক্ত রোমের শ্রমিক- তাদের শক্তির হাওয়া মুক্তির দুয়ার দিল খুলে, আজকে রক্তাক্ত পথ; উদ্ভাসিত দিক। শিল্পী আর মজুরের বহু পরিশ্রম একদিন গড়েছিল রোম, তারা আজ একে একে ভেঙে দেয় রোমের সে সৌন্দর্যসম্ভার, ভগ্নস্তূপে ভবিষ্যৎ মুক্তির প্রচার। রেমের বিপ্লবী হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত মুক্তির সশস্ত্র ফৌজ আসে অগণিত, দুচোখে সংহার স্বপ্ন, বুকে তীব্র ঘৃণা শত্রুকে বিধ্বস্ত করা যেতে পারে কিনা রাইফেলের মুখে এই সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা। যদিও উদ্বেগ মনে, তবু দীপ্ত আশা; পথে পথে জনতার রক্তাক্ত উত্থান, বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে ডেকে ওঠে বান।ভেঙে পড়ে দস্যুতার, পশুতার প্রথম প্রাসাদ বিক্ষুব্ধ অগ্ন্যুৎপাতে উচ্চারিত শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ। যে উদ্ধত একদিন দেশে দেশে দিয়েছে শৃঙ্খল আবিসিনিয়ার চোখে আজ তার সে দম্ভ নিষ্ফল।এদিকে ত্বরিত সূর্য রোমের আকাশে যদিও কুয়াশাঢাকা আকাশের নীল, তবুও বিপ্লবী জানে, সোভিয়েট পাশে।। রৌদ্রের গান এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ, যে সোনার মদ পান ক'রে ধন ক্ষেত দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার, সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো, অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা, প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে, কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা ! রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব, মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত? কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়, এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি- দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া, আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।। লেনিন লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ। আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে, মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন, বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ; - আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন, কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ। বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে, দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে। দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি আজো যায় শোনা, দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা। পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে, লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে। আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে; ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন, যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন। অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ; দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত, অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ- এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন। লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ। মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস। লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।। শত্রু এক এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন- মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর; তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর আমার সম্মুখে আজ এক শত্রুঃ এক লাল পথ, শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ। কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়, প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়। আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন স্মরণ করায় পণ; অবসাদ দিই বিসর্জন। বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা, সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা। অদূর দিগন্ত আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা- আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা। আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব প্রচুর প্রচুর সৃস্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উৎসব।। সব্যসাচী অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে জ্বলে রাত্রিদিন। কেয়াফুল ফুল চাই ---- চাই কেয়াফুল!----   সহসা পথের ‘পরে   আমার এ ভাঙ্গা ঘরে   কন্ঠ কার ধ্বনিল আকুল।      তখনো শ্রাবণ-সন্ধ্যা   নিঃশেষে হয়নি বন্ধ্যা-----   থেকে থেকে ঝরিতেছে জল;   পবন উঠিছে জেগে,   বিজলী ঝলিছে বেগে------   মেঘে মেঘে বাজিছে মাদল।      জনহীন ক্ষুব্ধ পথ   জাগিছে দুঃস্বপ্নবৎ----   বুকে চাপি’ আর্ত্ত অন্ধকার;   কোনমতে কাজ সারি’   যে যার ফিরিছে বাড়ী,   ঘরে ঘরে বন্ধ যত দ্বার।      শূন্য ঘরে   হিয়া গুমরিয়া মরে   স্মরি’ যত জীবনের ভুল;   অকস্মাৎ তারি মাঝে   ধ্বনি কার কানে বাজে-----   চাই ফুল----চাই কেয়াফুল!      পাগল!   আজি এ রাতে   এ দুর্য্যোগ-অভিঘাতে----   বৃষ্টিপাতে বিলুপ্ত মেদিনী;   তার মাঝে কে আছে,   কেতকী-সৌরভ যাচে!   কোথায় বা হবে বিকিকিনি?   পবন উঠিছে মাতি!   কিছুক্ষণ কান পাতি’   মনে হ’ল গিয়াছে বালাই;   সহসা আমারি দ্বারে   ডাক এল একেবারে----   চাই ফুল --- কেয়াফুল চাই!      ভাবিলাম মনে মনে-----   হয়ত বা এ জীবনে   কোনোদিন কিনেছিনু ফুল;   সেই কথা মনে ক’রে   আজো বা আশায় ঘোরে;   কিম্বা কারে করিয়াছে ভুল!      তাড়াতাড়ি আলো তুলি’   বাহিরিনু দ্বার খুলি,   সবিস্ময়ে দেখিলাম চেয়ে----   মাথায় বৃহৎ ডালা,   দাঁড়ায়ে পসারী-বালা-----   শ্রাবণ ঝরিছে অঙ্গ বেয়ে;      কহিলাম, এ কি কান্ড!   তোমার পসরাভান্ড   আজ রাতে কে কিনিবে আর ?   এ প্রলয়ে কারো কাছে   কিছু কি প্রত্যাশা আছে-----   কেন মিছে বহিছ এ ভার!      আর্দ্র দেহে আর্দ্র বাসে   সে কহিল মৃদু হাসে,-----   শিরে বায়ু সুগন্ধ ছড়ায়----   যে ফুল বেসাতি করি,   বাদল যে শিরে ধরি,-----   কপালে লিখিল বিধি তাই!      বহিয়া দুখের ঋণ   যে কষ্টে কাটাই দিন-----   এ দুর্দ্দিন কিবা তার কাছে?   ওগো তুমি নেবে কিছু?   নয়ন হইল নীচু----   সেথাও বা মেঘ নামিয়াছে!      খোলা দরজার পাশে   বায়ু গরজিয়া আসে,   ফুলবাসে ভরি দেহ-মন;   ঝর-ঝর  ঝরে জল,   আঁখি করে ছল-ছল   ঘনাইয়া প্রাণের শ্রাবণ!      বাদলের বিহ্বলতা----   বুঝি হায়!   লাগিল তা’   নয়নে বচনে সর্ব্ব দেহে;   সহসা চাহিয়া আড়   রমণী ফিরাল ঘাড়-----   উর্দ্ধে যেন কি দেখিবে চেয়ে!      না কহিয়া কোন বাণী   পসরা লইনু টানি’-----   মূল্য তার হাতে দিনু যবে,   উজার করিতে ডালা   কাঁদিয়া ফেলিল  বালা------   ওমা এ কি ---- এত কেন হবে?      কহিনু ---যা’ কিনিলাম,   এ নহে তাহারি দাম-----   প্রতিদিন দিতে হবে মোরে;   এক পণ দুই পণ----   যেদিন যেমন মন,   তাহারি আগাম দিনু তোরে;      কতক বুঝে’  না-বুঝে’   হৃদয়ের ভাষা খুঁজে’   বহুকষ্টে জানাইয়া তাই,   পুষ্পগন্ধে মোরে ঘিরে’   অন্ধকারে ধীরে-ধীরে   পসারিনী লইল বিদায়।      ফিরিনু একলা ঘরে-----   বাদল তখনো ঝরে,   পুষ্পগন্ধে পূর্ণ গৃহতল;   শয্যা লইলাম পাতি’   নিবায়ে দিলাম বাতি----   আবার আসিল বেগে জল!      রুদ্ধ জানালার ফাঁকে   বাতাস কাহারে ডাকে,   বিজলী চমকি’ কারে চায়!   কোন্ অন্ধ অনুরাগে   ত্রিযামা যামিনী জাগে   শ্রাবণ ব্যাকুল-ব্যর্থতায়!      সঙ্গীহীন শূন্য ঘরে   হিয়া গুমরিয়া মরে----   স্মরিয়া এ জীবনের ভুল;   সেই সাথে থেকে- থেকে   মনে হয় --- গেল ডেকে’   কাননের যত কেয়াফুল! অন্ধ বধূ পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী! আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি — ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়? তাইত বলি, বদোরের পাশে, রাত্তিরে কাল — মধুমদির বাসে আকাশ-পাতাল — কতই মনে হয় । জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই — আমের গায়ে বরণ দেখা যায় ? —অনেক দেরি? কেমন করে’ হবে ! কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে, দখিন হাওয়া —বন্ধ কবে ভাই ; দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে — শেওলা-পিছল — এমনি শঙ্কা লাগে, পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই! মন্দ নেহাৎ হয়না কিন্তু তায় — অন্ধ চোখের দ্বন্ধ চুকে’ যায়! দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্ , অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন? বাঁচবি তোরা —দাদা তো তার আগে? এই আষাড়েই আবার বিয়ে হবে, বাড়ি আসার পথ খুঁজে’ না পাবে — দেখবি তখন —প্রবাস কেমন লাগে ? —কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল ? হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল ! কত লোকেই যায় তো পরবাসে — কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে ? চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ ! পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর, তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর — ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ ! —ঐ যে হথায় ঘরের কাঁটা আছে — ফিরে’ আসতে হবে তো তার কাছে ! এই খানেতে একটু ধরিস ভাই, পিছল-ভারি — ফসকে যদি যাই — এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে ! আসুন ফিরে’ — অনেক দিনের আশা, থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা — তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে! জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’ — সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে। ‘চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হ’ল সারা। আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা — জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ ! কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার — ছাই! কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই, কতক তবু কমত যে তার শোক! ‌‌‍‍‍‌’চোখ’ গেল– তার ভরসা তবু আছে — চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে ! টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি — সেই তো ফিরে’ যাব আবার বাড়ি, একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ — তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে দুটো যেন প্রাণের কথা বলে — দরদ-ভরা দুখের আলাপন পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত ! এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে — বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়, জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে — সকল বালাই বহি আপন মাথায় ! — দেখিস তখন, কানার জন্য আর কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর। তারপরে – এই শেওলা-দীঘির ধার — সঙ্গে আসতে বলবনা’ক আর, শেষের পথে কিসের বল’ ভয় — এইখানে এই বেতের বনের ধারে, ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে — সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়। শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে — মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে’! অপরাজিতা পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে, তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম? বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম। ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি ; রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি! কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে— ফুল কহে—মোর কিছু নাই কিছু নাই, ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক, বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ। মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে, পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত ; তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে— কর্ম শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,   শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই।   ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন---   কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন।      চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের - বিন্দু তাহে লজ্জা নাই,   কর্ম মোদের রক্ষা করে অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই।   সাধ্য যেমন - শক্তি যেমন - তেমনি অটল চেষ্টাতে--   দুঃখে-সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে।      কর্মে ক্ষুধার অন্ন যোগায়, কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই;   দুর্ভাবনায় শান্তি আনে --- নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই।      তুচ্ছ পরচর্চাগ্লানি--- মন্দ ভালো--- কোন্ টা কে---   নিন্দা হতে মুক্তি দিয়া হাল্কা রেখে মনটাকে।      পৃথ্বি-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই;   পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি-হাওয়া ভগ্নী-ভাই।   তৃপ্তি তাঁরি শস্যে-জলে ক্ষুত্ পিপাসা দুঃসহ।   মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁরেই প্রত্যহ।      ক্ষুদ্র নহি - তুচ্ছ নহি - ব্যর্থ মোরা নই কভু।   অর্থ মোদের দাস্য করে - অর্থ মোদের নয় প্রভু।   স্বর্ণ বল, রৌপ্য বল, বিত্তে করি জন্মদান,   চিত্ত তবু রিক্ত মোদের নিত্য রহে শক্তিমান।      কীর্তি মোদের মৃত্তিকাতে প্রত্যহ রয় মুদ্রিত,   শুণ্য' পরে নিত্য হের স্তোত্র মোদের উদ্গীত।   সিন্ধুবারি পণ্য বহি' ধন্য করে তৃপ্তিতে,   বহ্নি' মোদের রুদ্র প্রতাপ ব্যক্ত করে দীপ্তিতে।      বিশ্ব জুড়ি' সৃষ্টি মোদের, হস্ত মোদের বিশ্বময়,   কাণ্ড মোদের, সর্বঘটে - কোন্ খানে তা দৃষ্য নয়?   বিশ্বনাথের যজ্ঞশালে কর্মযোগের অন্ত নাই,   কর্ম সে যে ধর্ম মোদের, -- কর্ম চাহি -- কর্ম চাই। কলঙ্ক কলঙ্ক যতীন্দ্রমোহন বাগচীবাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর------   কলঙ্কী মন, চেয়ে দেখ্ আজি সঙ্গী মিলেছে তোর।   দিবা অবসান, রবি হ’ল রাঙা,   পশ্চিমাকাশে নট্ কনা -ভাঙা;   সঙ্গহীনের যাহা কিছু কাজ সাঙ্গ করেছি মোর,   কুঞ্জদুয়ারে ব’সে আছি একা কুসুমগন্ধে ভোর!      আধফুটন্ত বাতাবিকুসুমে কানন ভরিয়া আছে,----   কি গোপন কথা গুঞ্জরি’ অলি ফিরিছে ফুলের কাছে!   ফুটনোন্মুখ ফুলদলগুলি   পুলক-পরশে উঠে দুলিদুলি   গন্ধভিখারী সন্ধ্যার বায় ফুলপরিমল যাচে-----   সঙ্কোচে নত পুষ্পবালিকা---অতিথি ফিরে বা পাছে!      বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যার বায় আসি’ কহে বার বার,   সন্ধ্যা হয় যে অন্ধ কুসুম-----খোলো অন্তর-দ্বার!   মুকুলগন্ধ অন্ধ ব্যথায়   কুঁড়ির বন্ধ টুটিবারে চায়,   লুটাইতে চায় সন্ধ্যার পায় রুদ্ধ আবেগভার,   বিকাইতে চায় চরণের পরে কৌমার সুকুমার।      মন্থরপদে সন্ধ্যা নামিছে কাজলতিমিরে আঁকা,   দুয়ারে অতিথি, অন্তরে ব্যথা--- সম্ভব সে কি থাকা?   গন্ধে পাগল অন্তর যার,   আবরণ মাঝে থাকে সে কি আর,   খুলি’ দিল দ্বার, পরান তাহার পরাগে-শিশিরে মাখা;   কুঞ্জ ঘিরিয়া আঁধারে ছাইল স্বপ্নপাখীর পাখা।      বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর----   হা রে কলঙ্কী হৃদয় আমার, সঙ্গী মিলেছে তোর।   দূরদিগন্তে দিবা হল সারা;   অন্তর ভরি ফুটে’ উঠে তারা,   নব-ফুটন্ত নেবুর গন্ধে আসিল তন্দ্রাঘোর-----   কলঙ্কী প্রেম, মুগ্ধ হৃদয়-----একই "পরিণাম তোর। কাজলা দিদি বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই- মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;- দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো? খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন, ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো? আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে? কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে! দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে, আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল। ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে, উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,- দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই- এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই? লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই? দাসীপুত্র পরের দুয়ারে দাসী বটে আজি, তবু সে মোদেরই মা,---   ভুলিবারে চাই সতত সে কথা ; ভুলিবারে পারি না।   কাঙালের ঘরে যাহা কিছু জোটে, সে যে ধূলিমাখা খুদ,   উপবাস ক্ষীণ শীর্ণ বক্ষে শুকায়ে গিয়াছে দুধ,---   তবু তাই খেয়ে বাঁচে এই প্রাণ, তাই দিয়ে এই দেহ,   ধূলামাটি মাখা তাহারই অঙ্কে বাঁধি দুদিনের গেহ,   হাঁটিতে শিখেছি যার হাঁটু ধরে, যে বুকে মেলিয়া পা,   হক ভিখারিনী---তবু সে জননী, কেমনে ভুলিব তা?      মাতা বিনতার দুখের দুলাল, মানুষ নয় সে, পাখি!   মায়ের দুঃখ-ভরা দাসীত্ব ঘুচাইয়াছিল না কি?   যতই এ-হিয়া উঠে গুমরিয়া বিপদ-বেদনা-বিষে,   মানুষের ঘরে জন্ম লভিয়া সে-কথা ভুলিব কিসে?   কোথা প্রাণপণ প্রবল নিষ্ঠা, চিত্ত অকুতোভয়,   কই সে বেদনা, শক্তিসাধনা, পণ মৃত্যুঞ্জয়?      প্রচণ্ড তেজ চাই সে গরুড়---আমাদেরই মাঝে চাই,   অমৃতের লাগি সেই প্রাণপণ--- ভুলিবনা ভুলি নাই।      এস তপস্বী, উগ্রশক্তি, এস হে কর্মবীর,   কর দৃঢ় পণ মায়ের চক্ষে মুছাতে অশ্রুনীর;   পায়ে-পায়ে যত বিভেদের বাধা ভুলায়ে পরস্পরে   ভায়ে ভায়ে আজি মিলাইতে হবে জননীর ভাঙা ঘরে;   এস হে হিন্দু, এস খ্রীষ্টীয়, পারসী, মুসলমান   যে মায়ের বুকে জন্ম তোমার, রাখ আজি তার মান।   যে জননী আজ ভিখারিনী হয়ে ভুলেছে আপন বাণী,   অর্জিয়া তারি ধর্মরাজ্য কর তাঁরে রাজরাণী। দ্বিপ্রহরে বইয়ের পাতায় মন বসেনা, খোলা পাতা খোলাই পড়ে’ থাকে, চোখের পাতায় ঘুম আসেনা—- দেহের ক্লান্তি বুঝাই বলো কা’কে ? কাজের মাঝে হাত লাগাব, কোথাও কোন’ উত্সাহ নাই তার, চেয়ে আছি চেয়েই আছি, চাওয়ার তবু নাইক কিছু আর !বেলা বাড়ে, রোদ চড়ে’ যায়, প্রখর রবি দহে আকাশ তল, ঝাঁঝাঁ করে ভিতর-বাহির, চোখের পথে শুকায় চোখের জল ; মোহাচ্ছন্ন মৌন জগৎ, কোথাও যেন জীবনচেষ্টা নাহি, ক্লিষ্ট আকাশ নির্ণিমেষে দিনের দাহ দেখছে শুধু চাহি’ !ঘরে ঘরে আগল আঁটা, আমার ঘরেই মুক্ত শুধু দ্বার, সেই যে খুলে’ চলে’ গেছে তেম্ নি আছে, কে দেয় উঠে’ আর ! পথের ধারে নিমের গাছে একটি কেবল তিক্ত মধুর শ্বাস ক্ষণে ক্ষণে জানায় শুধু গোপন বুকের উদাসী উচ্ছ্বাস !হাহা করে তপ্ত হাওয়া শষ্যহারা বসন্ত-শেষ মাঠে, চোতের ফসল বিকিয়ে গেছে কবে কোথায় অজানা কোন্ হাটে ! উদার মলয় নিঃস্ব আজি, সাম্ নে শুধু ধূসর বালুচর পঞ্চতপা দিক্-বিধবার বসন খানি লুট্ ছে নিরন্তর !কোন্ পথে সে গেছে চলি’ মরু-বেলায় চিহ্নটি নাই তার, লুপ্ত সকল শ্যামলিমা লয়ে তাহার মুগ্ধ উপাচার ; জাগ্ ছে শুধু প্রখর দাহ তৃষ্ণাভরা বিশুষ্ক জিহ্বায় দিনান্ত সে আস্ বে কখন ? দম্ কা বাতাস ধমক্ দিয়ে যায় ! নাগকেশর চিত্ততলে যে নাগবালা ছড়িয়ে ছিঁগে কেশের কেশর কাঁদছে অফুরন্ত অশ্রুধারা সহস্রবার নাসার বশের বাঁধছে ; মানিক-হারা পাগল-পারা যে বেদনা বাজছে তাহার বক্ষে পলে-পলে পলক বেয়ে অলক ছেয়ে ঝরছে যাহা চক্ষে ; দুঃখে ভাঙা বক্ষে যাহা নশ্চিসিয়া সকাল-সাঁঝে টুটছে মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে।মন-মাতালে যে নাগবালা রতন-জ্বালা কক্ষে বসে হাসছে দীপ্তি যাহার নেত্রপথে শুভ্র-শুচি দৃষ্টি হয়ে আসছে ; মুক্তামানিক সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে উল্লাসে যে চঞ্চল, উদ্বেলিত সিন্ধুসম দুলছে যাহার উচ্ছ্বসিত অঞ্চল ; বিশ্বভূবন পূর্ণ করে যে আনন্দ শঙ্খস্বরে উঠছে মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে। প্রিয়া প্রিয়ার আবাস খুঁজি, সারাদিন ফিরি সযতনে নাম-ধাম-গোত্র-গৃহ - বাঁধিবারে সহস্র বন্ধনে। না খুঁজিয়া পাই দেখা, খুঁজিয়া সন্ধান নাই যার কি করি তাহারে লয়ে,  এ যে বড় বি চিত্র ব্যাপার। শ্রন্ত দেহে ক্লান্ত মনে, অর্ধ্বরাত্রে করিনু শয়ন নিদ্রা, না সে জাগরণ! দেখিলাম অদ্ভুত স্বপন। সেই হাসি, সেই অশ্রু সেই মুর্ত্তি পার্শ্বে মোর আসি কহিল কৌতুক কণ্ঠে স্মিত হাস্যে সাদর সম্ভাষি। এ কি কৌতুহল বন্ধু, কেন এই মিথ্যা খোঁজাখুঁজি ভাল যদি বেসে থাক, সেই মোর ঠিকানা ঠিকুজি। কি বন্ধন চাহ আর, বাকি কি রয়েছে বল দিতে? নাম? প্রিয়া; গোত্র? প্রেম-গৃহ? তব অন্তর গলিতে। ভালবাসার জয় ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে- গোলাগুলির গোলাতে নয়, গভীর ভালবেসে। খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার, কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার? শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে- ও তার স্বভাব সর্বনেশে। ভালবাসায় ভুবন করে জয়, সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়- সে যে সৃজন পরিচয়। শত আঘাত-ব্যথা-অপমানে লয় সে কোলে এসে, মৃত্যুরে সে বন্ধু বলে ধরে শেষে। মাধবিকা দখিন হাওয়া---রঙিন হাওয়া, নূতন রঙের ভাণ্ডারী,   জীবন-রসের রসিক বঁধু, যৌবনেরি কাণ্ডারী!   সিন্ধু থেকে সদ্দ বুঝি আসছ আজি স্নান করি'---   গাং-চিলেদের পক্ষধ্বনির শন্ শনানির গান্ ধরি';   মৌমাছিদের মনভুলানি গুনগুনানির সুর ধরে'---   চললে কোথায় মুগ্ধ পথিক, পথটি বেয়ে উত্তরে?      অনেক দিনের পরে দেখা, বছর-পারের সঙ্গী গো,   হোক্ না হাজার ছাড়াছাড়ি, রেখেছ সেই ভঙ্গি তো!   ---তেমনি সরস ঠাণ্ডা পরশ, তেমনি গলার হাঁকটি , সেই   দেখতে পেলেই চিনতে পারি, কোনোখানেই ফাঁকটি নেই!   ---কোথায় ছিলে বন্ধু আমার, কোন্ মলয়ের বন ঘিরে,'   নারিকেলের কুঞ্জে-বেড়া কোন্ সাগরের কোন্ তীরে!   লকলকে সেই বেতসবীথির বলো তো ভাই কোন্ গলি,   এলা-লতার কেয়াপাতার খবর তো সব মঙ্গলই?      ---ভালো কথা, দেখলে পথে সবাই তোমায় বন্দে তো,---   বন্ধু বলে' চিনতে কারো হয়নি তো ভাই সন্দেহ?   নরনারী তোমার মোহে তেমনি তো সব ভুল করে---   তেমনিতর পরস্পরের মনের বনে ফুল ধরে!   আসতে যেতে দীঘির পথে তেমনি নারীর ছল করা;   পথিকবধুর চোখের কোণে তেমনি তো সেই জলভরা?      রঙ্গনে সেই রং তো আছে, অশোকে তাই ফুটছে তো,   শাখায় তারি দুলতে দোলায় তরুণীদল জুটছে তো?   তোমায় দেখে' তেমনি দেখে উঠছে তো সব বিহঙ্গ,   সবুজ ঘাসের শীষটি বেয়ে রয় তো চেয়ে পতঙ্গ?      তেমনি---সবই তেমনি আছে! --- হ'লাম শুনে' খুব খুশী,   প্রাণটা ওঠে চনচনিয়ে, মনটা ওঠে উসখুসি', ---   নূতন রসে রসল হৃদয়, রক্ত চলে চঞ্চলি', ---   বন্ধু তোমায় অর্ঘ্য দিলাম উচ্ছলিত অঞ্জলি।   গ্রহণ করো, গ্রহণ করো---বন্ধু আমার দণ্ডেকের---   জানিনাক আবার কবে দেখা তোমার সঙ্গে ফের।। যৌবন-চাঞ্চল্য অতীতের ছবি পর্ব ১ছিল এ ভারতে এমন দিন মানুষের মন ছিল স্বাধীন ; সহজ উদার সরল প্রাণে বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে। আকাশে তখন তারকা চলে, নদী যায় ভেসে, সাগর টলে, বাতাস ছুটিছে আপন কাজে, পৃথিবী সাজিছে নানান সাজে ; ফুলে ফলে ছয় ঋতুর খেলা, কত রূপ কত রঙের মেলা; মুখরিত বন পাখির গানে, অটঁল পাহাড় মগন ধ্যানে; নীলকাশে ঘন মেঘের ঘটাঁ, তাহে ইন্দ্রধনু বিজলী ছঁটা, তাহে বারিধারা পড়িছে ঝরি- দেখিত মানুষ নয়ন ভরি। কোথায় চলেছে কিসের টানে কোথা হতে আসে, কেহ না জানে। ভাবিত মানব দিবস-যামী, ইহারি মাঝারে জাগিয়া আমি, কিছু নাহি বুঝি কিছু নাহি জানি, দেখি দেখি আর অবাক মানি। কেন চলি ফিরি কিসের লাগি কখন ঘুমাই কখন জাগি, কত কান্না হাসি দুখে ও সুখে ক্ষুধা তৃষ্ণা কত বাজিছে বুকে। জন্ম লভি জীব জীবন ধরে, কোথায় মিলায় মরণ পরে? ভবিতে ভাবিতে আকুল প্রাণে ডুবিত মানব গভীর ধ্যানে। অকূল রহস্য তিমির তলে, জ্ঞানজ্যোতিময় প্রদীপ জ্বলে, সমাহিত চিতে যতন করি অচঞ্চল শিখা সে আলো ধরি দিব্য জ্ঞানময় নয়ন লভি, হেরিল নতুন জগত ছবি। অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে ভাসিয়া চলেছে অকুল পথে প্রতি ধুলিকণা নিখিল টানে এক হতে ধায় একেরি পানে, চলেছে একেরি শাসন মানি, লোকে লোকান্তরে একেরি বাণী এক সে অমৃতে হয়েছে হারা নিখিল জীবন-মরণ ধারা। সে অমৃতজ্যোতি আকাশ ঘেরি, অন্তরে বাহিরে অমৃত হেরি। যাঁহা হতে জীব জনম লভে, যাহা হতে ধরে জীবন সবে, যাহার মাঝারে মরণ পরে ফিরি পুন সবে প্রবেশ করে, তাহার জানিবে যতন ধরি। তিনি ব্রহ্ম তারে প্রনাম করি। আনন্দেতে জীব জনম লভে আনন্দে জীবিত রয়েছে সবে; আনন্দে বিরাম লভিয়া প্রাণ আনন্দের মাঝে করে প্রয়াণ। শুন বিশ্বলোক শুনহ বাণী অমৃতের পুত্র সকল প্রাণী, দিব্যধামিবাসী শুনহ সবে- জেনেছি তাহারে, যিনি এ ভবে মহান পুরুষ নিখিল গতি, তমসার পরে পরম জ্যোতি : তেজোময় রূপে হেরিয়া তাঁরে স্তব্ধ হয় মন, বচন হারে। বামে ও দখিনে উপরে নীচে, ভিতরে বাহিরে সমুখে পিছে, কিবা জলেস্থলে আকাশ পরে আধারে আলোকে চেতনে জড়ে: আমার মাঝারে আমারে ঘেরি এক ব্রহ্মময় প্রকাশ হেরি। সে আলোকে চাহি আপন পানে আপনারে মন স্বরূপ জানে। আমি আমি করি দিবস- যামী, না জানি কেমন কোথা সে আমি অজর অমর অরূপ রূপ নহি আমি এই জড়ের স্তুপ দেহ নহে মোর চির-নিবাস দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ। বিশ্ব আত্মা মাঝে হয়ে মগন আপন স্বরূপ হেরিলে মন না থাকে সন্দেহ না থাকে ভয় শোক তাপ মোহে নিমেষে লয়, জীবনে মরণে না রহে ছেদ, ইহা পরলোকে না রহে ভেদ। ব্রহ্মানন্দময় পরম ধাম, হেথা আসি সবে লভে বিরাম; পরম সম্পদ পরম গতি, লভ তাঁরে জীব যতনে অতি।পর্ব ২কালচক্রে হায় এমন দেশে ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে। দশদিকে হতে আঁধার আসি ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি। কোথা সে প্রাচীন জ্ঞানের জ্যোতি, সত্য অন্বেষণে গভীর মতি ; কোথা ব্রহ্মজ্ঞান সাধন ধন, কোথা ঋষিগণ ধ্যানে মগন; কোথা ব্রহ্মচারী তাপস যত, কোথা সে ব্রাহ্মণ সাধনা রত? একে একে সবে মিলাল কোথা, আর নাহি শুনি প্রাচীন কথা। মহামূল্য নিধি ঠেলিয়া পায় হেলায় মানুষ হারাল তায়। আপন স্বরূপ ভুলিয়া মন ক্ষুদ্রের সাধনে হল মগন। ক্ষুদ্র চিন্তা মাঝে নিয়ত মজি, ক্ষুদ্র স্বার্থ-সুখ জীবনে ভাজি; ক্ষুদ্র তৃপ্তি লয়ে মূঢ়ের মত ক্ষুদ্রের সেবায় হইল রত। রচি নব নব বিধি-বিধান নিগড়ে বাঁধিল মানব প্রাণ; সহস্র নিয়ম নিষেধ শত ; তাহে বদ্ধ নর জড়ের মত ; লিখি দাসখত ললাটে তার রুদ্ধ করি দিল মনের দ্বার। জ্বলন্ত যাঁহার প্রকাশ ভাবে- হায়রে তাঁহারে ভুলিল সবে; কল্পনার পিছে ধাইল মন, কল্পিত দেবতা হল সৃজন, কল্পিত রূপের মূরতি গড়ি, মিথ্যা পূজাচার রচন করি, ব্যাখ্যা করি তার মহিমা শত, মিথ্যা শাস্ত্রবাণী রচিল কত। তাহে তৃপ্ত হয়ে অবোধ নরে রহে উদাসীন মোহের ভরে। না জাগে জিজ্ঞাসা অলস মনে, দেখিয়া না দেখে পরম ধনে। ব্রাহ্মণেরে লোকে দেবতা মানি নির্বিচারে শুনে তাহারি বাণী। পিতৃপুরুষের প্রসাদ বরে বসি উচ্চাসনে গরব ভরে পূজা-উপচার নিয়ত লভি ভুলিল ব্রাহ্মণ নিজ পদবী। কিসে নিত্যকালে এ ভারতভাবে আপন শাসন অঁটুট রবে- এই চিন্তা সদা করি বিচার হল স্বার্থপর হৃদয় তার। ভেদবুদ্ধিময় মানব মন নব নব ভেদ করে সৃজন। জাতিরে ভাঙিয়া শতধা করে, তাহার উপরে সমাজ গড়ে; নানা বর্ণ নানা শ্রেণীবিচার , নানা কুটবিধি হল প্রচার। ভেদ বুদ্ধি কত জীবন মাঝে অশনে বসেন সকল কাজে, ধর্ম অধিকারে বিচার ভেদ মানুষে মানুষে করে প্রভেদ। ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে, জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে। মিথ্যা অহংকারে মোহের বশে জাতির একতা বাঁধন খসে: হয়ে আত্মঘাতী ভারতভবে আপন কল্যণ ভুলিল সবে।পর্ব ৩এখনও গভীর তমসা রাতি, ভারত ভবনে নিভিছে বাতি - মানুষ না দেখি ভারতভূমে, সবাই মগন গভীর ঘুমে। কত জাতি আজ হেলার ভরে হেথায় আসিয়া বসতি করে। ভারতের বুকে নিশান গাথি বসেছে সবলে আসন পাতি। নিজ ধনমান নিজ বিভব বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব, ভারতের মুখে না ফুটে বাণী, মৌন রহে দেশ শরম মানি। - হেনকালে শুন ভেদি আঁধার সুগম্ভীর বানী উঠিল কার- “ভাব সেই এক ভাবহ তারে, জলে স্থলে শুন্যে হেরিছ যারে নিয়ত যাহার স্বরূপ ধ্যানে দিব্য জ্ঞান জাগে মানব প্রাণে। ছাড় তুচ্ছ পূজা জড় সাধন, মিথ্যা দেবসেবা ছাড়া এখন, বেদান্তের বাণী স্মরণ কর, ব্রহ্মজ্ঞান-শিখা হৃদয়ে ধর সত্য মিথ্যা দেখে করি বিচার খুলি দাও যত মনের দ্বার । মানুষের মত স্বাধীন প্রাণ নির্ভয়ে তাকাও জগত পানে- দিকে দিকে দেখ ঘুচিছে রাতি, দিকে দিকে জাগে কত না জাতি; দিকে দিকে লোক সাধনারত জ্ঞানের ভান্ডার খুলেছে কত। নাহি কি তোমার জ্ঞানের খনি ? বেদান্ত রতন মুকুটমণি? অসারে মজে কি ভুলেছ তুমি- ধর্মে গরীয়ান ভারতভুমি?” -শুনি মৃতদেশ পরান পায়, বিস্ময়ে মানুষ ফিরিয়া চায়। দেখে দিব্যরূপ পুরুষ বরে কান্তি তেজোময় নয়ন হরে, গবল শরীর সুঠাম অতি, ললাট প্রসর, নয়নে জ্যোতি, গম্ভীর স্বভাব,বচন ধীর, সত্যের সংগ্রামে অজেয় বীর; অতুল প্রখর প্রতিভা ধরে নানা শাস্ত্র ভাষা বিচার করে। রামমোহনের১ জীবন স্মরি, কৃতজ্ঞতা ভরে প্রনাম করি। দেশের দুর্গতি সকলখানে হেরিয়া বাজিল রাজার প্রাণে । কত অসহায় অবোধ নারী সতীত্বের নামে সকল ছাড়ি, কেহ স্ব-ইচছায়, কেহবা ভয়ে, শাসনে তাড়নে পিষিত হয়ে, পতির চিতায় পুড়িয়া মরে- শুনি কাদে প্রাণ তাদের তরে । নারীদুঃখ নাশ করিল পণ, ঘুচিল নারীর সহমরণ । নিষ্কাম করম- যোগীর মত দেশের কল্যাণ সাধনে রত, নানা শাস্ত্রবাণী করে চয়ন, দেশ দেশান্তের ঋষিবচন; পশ্চিমের নব জ্ঞানের বাণী দেশের সমুখে ধরিল আনি। কিরূপেতে পুন এ ভারতভবে ব্রহ্মজ্ঞান কথা প্রচার হবে , নিয়ত যতন তাহারি তরে, কত শ্রম কত প্রয়াস করে ; তর্ক আলোচনা কত বিচার কত গ্রন্থ রচি’ করে প্রচার; -ক্রমে বিনাশিতে জড় ধরম ‘ব্রহ্ম সমাজে’র হল জনম । শুনে দেশবাসি নুতন কথা, মূরতিবিহীন পুজার প্রথা উপাসনা -গৃহ দেখে নতুন- যেথায় স্বদেশী বিদেশী জন শুদ্র দ্বিজ আদি মিলিয়া সবে নির্বিচারে সদা আসন লাভে। মহাপুরুষের বিপুল শ্রমে দেশে যুগান্তর আসিল ক্রমে। স্বদেশের তার আকুল প্রাণ প্রবাসেতে রাজা করে প্রয়ান; সেথায় সুদুর বিলাতে হায় অকালেতে রাজা ত্যজিল কায়। অসমাপ্ত কাজ রহিল পড়ে, ফিরে যায় লোকে নিরাশা ভরে; একে একে সব যেতেছে চলে- ভাসে রামচন্দ্র২ নয়নজলে। রাজার জীবন নিয়ত স্মরি’ উপাসনা গৃহে রহে সে পড়ি, নিয়ম ধরিয়া পূজার কালে নিষ্ঠাভাবে সেথা প্রদীপ জ্বালে। একা বসি ভাবে রাজার কাজ এমন দুর্দিনে কে লবে আজ।পর্ব ৪ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে একা বসি তার রজনী কাটে। অদূরে অন্তিম শয়নোপরি দিদিমা তাহার আছেন পড়ি, সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে, তাহারি মাঝারে নদীর তীরে হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে। একাকী যুবক বসিয়া কুলে সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে। প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি, তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব বিলাস বাসনা অসার সব, অজানা কি যেন সহসা স্মরি পলকে পরান উঠিল ভরি। আর কি সে মন বিরাম মানে? গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে। কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা শুধায় সবারে না পায় দিশা। -সহসা একদা তাহার ঘরে ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ; কি যেন বচন লিখিত তায় অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়। বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে যুবা সে বাণীর মরম লভে- “যাহা কিছু এই জগততলে অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-” শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়। শুনি মহাবাণী চমক লাগে, আরো জানিব রে বাসনা জাগে ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন গভীর সাধনে হল মগন: যত ডোবে আরো ডুবিতে চায় ডুবি নব নব রতন পায়া। হেনকালে হল অশনিপাত যুবকের পিতা দ্বারকানাথ, অতুল সম্পদ ধন বিভব ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ অকালে সহসা ত্যজিল দেহ। আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে, “যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে- কর অস্বীকার ঋণের দায় নহিলে তোমার সকলি যায়।” নাহি টলে তায় যুবার মন, পিতৃঋণ শোধ করিল পণ, হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ। উত্তমর্ণজনে অবাক মানি কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী, “বিষয় বিভব থাকুক তব, মোরা তাহা হতে কিছু না লব। সাধুতা তোমার তুলনাহীন; সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।” বরষের পর বরষ যায়, যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়। সংসারে বাসনা -বিগত মন, ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন, ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান , ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান; বচনেতে যেন অমৃত ঝরে- নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে। ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়, কত শত লোকে শুনিতে ধায়। “ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে, প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে। হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে, সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে। জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে , যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে । জানিবার পথ নাহিক আর, নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর । বহু তর্ক বহু বিচার বলে বহু জপ তপ সাধন ফলে বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে নাহি পায় সেই বচনাতীতে।” ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে , মহর্ষির৩ বানী চেতনা আনে। দলে দলে লোক সেথায় ছোটে ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে। মত্ত অনুরাগে কেশব৪ ধায়, প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়; আকুল আগ্রহে পরান খুলি ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি। হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে “ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে । লভি নব প্রানে সমাজ কায় নব নব ভাবে বিকাশ পায় ; ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন, ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে তাহে নিমগন পুলক ভরে ।পর্ব ৫সমাজে সুদিন এল আবার, ক্রমে প্রসারিল জীবন তার। কেশব আপন প্রতিভা বলে যতনে গঠিল যুবকদলে। নগরে নগরে হল প্রচার- "ধর্ম রাজ্যে নাহি জাতিবিচার; নাহি ভেদ হেথা নারী ও নরে, ভক্তি আছে যার সে যায় ত'রে। জাতিবর্ণ- ভেদ কুরীতি যত ভাঙি দাও চিরদিনের মত। দেশ দেশান্তরে ধাঊক মন, সর্বধর্মবাণী কর চয়ন; ধর্মে ধর্মে নাহি বিরোধ রবে, মহা সমম্বয় গঠিত হবে।" পশিল সে বাণী দেশের প্রাণে, মুগ্ধ নরনারী অবাক মানে । নগরে নগরে তুফান উঠে, ঘরে ঘরে কত বাঁধন টুটে; ব্রহ্ম নামে সবে ছুটিয়া চলে, প্রাণ হতে প্রাণে আগুন জ্বলে। আসিল গোঁসাই৫ ব্যাকুল হয়ে প্রেমে ভরপূর ভকতি লয়ে। আসিল প্রতাপ৬ স্বভাব ধীর, গম্ভীর বচন জ্ঞানে গভীর। স্বল্পভাষী সাধু অঘোরনাথ৭ যোগমগ্ন মন দিবসরাত। গৌরগোবিন্দের৮ সাধক প্রাণ হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর অতুল জ্ঞান। কান্তিচন্দ্র৯ সদা সেবায় রত সেবাধর্ম তাঁর জীবন-ব্রত। ত্রৈলোক্যনাথের১০ সরস গান নব নব ভাবে মাতায় প্রাণ। আরো কত সাধু ধরমমতি বঙ্গচন্দ্র১১ আদি প্রচার-ব্রতী একসাথে মিলি প্রেমের ভরে প্রেমপরিবার গঠন করে। কাল কিবা খাবে কেহ না জানে, আকুল উৎসাহ সবার প্রাণে । নূতন মন্দির নব সমাজ নব ভাবে কত নূতন কাজ। দিনে দিনে নব প্রেরণা পায়, উৎসাহের স্রোত বাড়িয়া যায়। সমাজ-চালনা বিধি-বিচার কেশবের হাতে সকল ভার; কেশবপ্রেরণা সবার মূলে তাঁর নামে সবে আপনা ভুলে। ধন্য ব্রহ্মানন্দ যাঁহার বাণী শিরে ধরে লোকে প্রমাণ মানি। যাঁহার সাধনা আজিও হেরি রয়েছে সমাজ জীবন ঘেরি ; যাঁহার মূরতি স্মরণ করি, যাঁহার জীবন হৃদয়ে ধরি, শত শত লোক প্রেরণা পায়- আজি ভক্তিভরে প্রণমি তাঁয়। আবার বহিল নূতন ধারা, সমাজের প্রাণে বাজিল সাড়া; ভাসি বহুজনে সে নব স্রোতে বাহির হাইল নূতন পথে। মিলি অনুরাগে যতন ভরে এই "সাধারণ" সমাজ গড়ে। ওদিকে কেশব নূতন বলে বাঁধিল আবার আপন দলে। নব ভাবে "নববিধান" গড়ি, নূতন সংহিতা রচনা করি, ভগ্নদেহ লয়ে অবশপ্রায়, খাটিতে খাটিতে ত্যজিল কায়।পর্ব ৬ধরি নব পথ নূতন ধারা নবীন প্রেরণে আসিল যারা, আজি তাঁহাদের চরণ ধরি ভক্তিভরে সবে স্মরণ করি। শাস্ত্রী শবনাথ সকল ফেলি বিষয় বাসনা চরণে ঠেলি বহু নির্যাতন বহিয়া শিরে, অনুরাগে ভাসি নয়ন নীরে, সর্বত্যাগী হয়ে ব্যাকুল প্রাণে ছুটে আসে ওই কিসের টানে, দেখ ওই চলে পাগলমত ভক্তশ্রেষ্ট বীর বিনয়নত, বিজয় গোঁসাই সরল প্রাণ- হেরি আজি তাঁই প্রেম বয়ান। সাধু রামতনু১২ জ্ঞানে প্রবীণ, শিশুর মতন চির নবীন। শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন, কর্মনিষ্ঠাময় সাধু জীবন । নগেন্দ্রনাথের১৩ যুকতি বানে কূট তর্ক যত নিমেষে হানে । আনন্দমোহন১৪ মুরতি যার। উমেশচন্দ্রের১৫ জীবণ মন , নীরব সাধনে সদা মগন। দুর্গামোহনের১৬ জীবনগত সমাজের সেবা দানের ব্রত। দ্বারকানাথের১৭ স্মরন হয় ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয় । পূর্ব বঙ্গে হোথা সাধক কত নবধর্ম বানী প্রচারে কত। সংসারে নিলিপ্ত ভাবুক প্রাণ স্বার্থক প্রচারে কালীনারা'ণ১৮ কত নাম কব কত যে জ্ঞানী কত ভক্ত সাধু যোগী ও ধ্যানী; কত মধুময় প্রেমিক মন আড়ম্বহীন সেবকজন ; আসিল হেথায় আকাশ ভরে সবার যতনে সমাজ গড়ে। এই যে মন্দির হেরিছ যার ইটকাঠ ময় স্থুল আকার ; ইহারি মাঝারে কত যেস্মৃতি, কত আকিঞ্চন সমাজ প্রীতি, ব্যাকুল ভাবনা দিবস রাত বিনিদ্র সাধনে জীবন পাত । বহু কর্মময় এই সমাজ সে সব কাহিনী না কব আজ, আজিকে কেবল স্মরণে আনি ব্রাহ্মসমাজের মহান বাণী । যে বাণী শুনুনু রাজার মুখে, মহর্ষি যাহারে ধরিল বুকে, কেশব যে বাণী প্রচার কারে- স্মরি আজ তাহা ভকতি ভরে। রক্তাক্ষরে লিখা যে বাণী রটে এই সমাজের জীবনপটে- “স্বাধীন মানবহৃদয়তলে বিবেকের শিখা নিয়ত জ্বলে। গুরুর আদেশ সাধুর বাণী ইহার উপরে কারে না মানি?” স্বাধীন মানে এই সমাজ মুক্ত ধর্মলাভে ইহার কাজ। হেথায় সকল বিরোধ গুচি রবে নানা মত নানান্ রুচি কাহারো রচিত বিধি বিধান রুধিবে না হেথা কাহারো প্রাণ। প্রতি জীবনের বিবেক ভাতি সবার জীবনে জ্বলিবে বাতি। নর নারী হেথা মিলিয়া সবে সম অধিকারে আসন লাভে। প্রেমেতে বিশাল জ্ঞানে গভীর চরিত্রে সংযত করমে বীর ; ঈশ্বরে ভক্তি মানবে প্রীতি, হেথা মানুষের জীবন নীতি। ফুরাল কি সব হেথায় আসি ? আসিবে না প্রেম জড়তা নাশি? জাগিবে না প্রাণ ব্যাকুল হয়ে, নব নব বাণী জীবনে লয়ে ? জ্বলিবে না নব সাধন শিখা ? নব ইতিহাস হবে না লিখা ? চিররুদ্ধ রবে পুজার দ্বার ? আসিবে না নব পুজারী আর ? কোথাও আশার আলো কি নাহি ? শুধাই সবার বদন চাহি। অন্ধ মেয়ে গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা, রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা! সবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!অন্ধ মেয়ে দেখছে না তা - নাইবা যদি দেখে- শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে! শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরয কোলাকুলি মিষ্ট ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি! দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে, তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।। অবাক কাণ্ড শুন্‌ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে, সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে? শুন্‌ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে? চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে?চল্‌তে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভূয়েঁর পরে ঠেকে? কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে? শোয় নাকি সে মুণ্ডটাকে শিয়র পানে দিয়ে? হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল্‌ না দেখি গিয়ে! অবুঝ চুপ করে থাক্, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভাল না, এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা। দেখ্ ত দেখি আজও আমার মনের তেজটি নেভেনি- এইবার শোন বলছি এখন- কি বলছিলাম ভেবেনি! বলছিলাম কি, আমি একটা বই লিখেছি কবিতার, উচু রকম পদ্যে লেখা আগাগোড়াই সবি তার । তাইতে আছে 'দশমুখে চায়, হ জম করে দশোদর, শ্মশানঘাটে শষপানি খায় শশব্যস্ত শশধর।' এই কথাটার অর্থ যে কি ,ভাবছে না কেউ মোটেও- বুঝছে না কেউ লাভ হবে কি, অর্থ যদি জোটেও। এরই মধ্যে হাই তুলিস যে? পুতে ফেলব এখনি, ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু, ফাঁদ ত বাবা দেখনি! কি বললি তুই? সাতান্নবার শুনেছিস্ ঐ কথাটা? এমন মিথ্যা কইতে পারিস্ লক্ষ্মীছাড়া বখাটা! আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধ্যি নেই কো পেরোবার হিসেব দেব বলেছি এই চোদ্দবার কি তেরোবার। সাতান্ন তুই গুনতে পারিস? মিথ্যেবাদী! গুনে যা- ও শ্যামাদাস! পালাস্ কেন? রাগ করিনি, শুনে যা। অসম্ভব নয় এক যে ছিল সাহেব, তাহার গুণের মধ্যে নাকের বাহার। তার যে গাধা বাহন, সেটা যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা। ডাইনে বল্‌লে যায় সে বামে তিন পা যেতে দুবার থামে । চল্‌তে চল্‌তে থেকে থেকে খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে। ব্যাপার দেখে এম্নিতরো সাহেব বললে 'সবুর করো- মাম্‌দোবাজি আমার কাছে? এ রোগেরও ওষুধ আছে।' এই না বলে ভীষন ক্ষেপে গাধার পিঠে বস্‌ল চেপে মুলোর ঝুটি ঝুলিয়ে নাকে আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে? মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে - যতই ছোটে 'ধরব' ব'লে ততই মুলো এগিয়ে চলে ! খাবার লোভে উদাস প্রাণে কেবল ছোটে মুলোর টানে - ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে ফেরেন গাধা নাকের চালে। আকাশের গায়ে আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে, দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে; তাই দেখে খুঁৎ-ধরা বুড়ো কয় চটে, দেখছ কি, এই রং পাকা নয় মোটে।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) আজব খেলা সোনার মেঘে আল্‌তা ঢেলে সিঁদুর মেখে গায় সকাল সাঁঝে সূর্যি মামা নিত্যি আসে যায়। নিত্যি খেলে রঙের খেলা আকাশ ভ'রে ভ'রে আপন ছবি আপনি মুছে আঁকে নূতন ক'রে। ভোরের ছবি মিলিয়ে দিল দিনের আল জ্বেলে সাঁঝের আঁকা রঙিন ছবি রাতের কালি ঢেলে। আবার আঁকে আবার মোছে দিনের পরে দিন আপন সাথে আপন খেলা চলে বিরামহীন। ফুরায় নাকি সোনার খেলা? রঙের নাহি পার? কেউ কি জানে কাহার সাথে এমন খেলা তার? সেই খেলা, যে ধরার বুকে আলোর গানে গানে উঠ্‌ছে জেগে- সেই কথা কি সুর্যিমামা জানে? আড়ি কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে— বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে।শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি, সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী!আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে? কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়।তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখনি? ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি।তার চেয়ে বেশি আড়ি পারি আমি কহিতে— তোমাদের কারো কারো কেতাবের সহিতে। আদুরে পুতুল যাদুরে আমার আদুরে গোপাল, নাকটি নাদুস থোপ্‌না গাল, ঝিকিমিকি চোখ মিট্‌মিটি চায়, ঠোঁট দুটি তায় টাট্‌কা লাল । মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক্‌ দাঁত মেলে আর চুল খুলে- টিনের পুতুল চীনের পুতুল কেউ কি এমন তুলতুলে ? গোব্‌দা গড়ন এমনি ধরন আব্‌দারে কেউ ঠোঁট ফুলোয় ? মখমলি রং মিষ্টি নরম- দেখ্‌ছ কেমন হাত বুলোয় ! বল্‌বি কি বল্‌ হাব্‌লা পাগল আবোল তাবোল কান ঘেঁষে, ফোক্‌লা গদাই যা বলবি তাই ছাপিয়ে পাঠাই "সন্দেশে" । আনন্দ যে আনন্দ ফুলের বাসে, যে আনন্দ পাখির গানে, যে আনন্দ অরুণ আলোয়, যে আনন্দ শিশুর প্রাণে, যে আনন্দ বাতাস বহে, যে আনন্দ সাগরজলে, যে আনন্দ ধুলির কণায়, যে আনন্দ তৃণের দলে, যে আনন্দ আকাশ ভরা, যে আনন্দ তারায় তারায়, যে আনন্দ সকল সুখে, যে আনন্দ রক্তধারায় সে আনন্দ মধুর হয়ে তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি, সে আনন্দ আলোর মত থাকুক তব জীবন ভরি। আবোল তাবোল আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা    স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়, আয়রে পাগল আবোল তাবোল    মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়। আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে    নাইকো মানে নাইকো সুর, আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়    মন ভেসে যায় কোন সুদূর।...আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন    জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্, আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া    নিয়মহারা হিসাবহীন। আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল    মাতবি মাতাল রঙ্গেতে— আয়রে তবে ভুলের ভবে    অসম্ভবের ছন্দেতে॥ আবোল তাবোল - ২ মেঘ মুলুকে ঝাপ‌্সা রাতে, রামধনুকের আব্ছায়াতে, তাল বেতালে খেয়াল সুরে, তান ধরেছি কন্ঠ পুরে। হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা, নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা। হেথায় রঙিন্ আকাশতলে স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে, সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে, আকাশ কুসুম আপনি ফোটে, রাঙিয়ে আকাশ, রাঙিয়ে মন চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ। আজকে দাদা যাবার আগে বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে- নাই বা তাহার অর্থ হোক্ নাইবা বুঝুক বেবাক্ লোক। আপনাকে আজ আপন হতে ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।ছুট‌লে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে? আজকে আমার মনের মাঝে ধাঁই ধপাধপ তব্‌লা বাজে- রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ কথায় কাটে কথার প্যাঁচ্ । আলোয় ঢাকা অন্ধকার, ঘন্টা বাজে গন্ধে তার। গোপন প্রাণে স্বপন দূত, মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভুত! হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা, শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা! মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ- দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ! আদিম কালের চাঁদিম হিম তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর। আবোল তাবোল - ৩ এক যে ছিল রাজা- (থুড়ি, রাজা নয় সে ডাইনি বুড়ি) ! তার যে ছিল ময়ূর- (না না, ময়ূর কিসের ? ছাগল ছানা) । উঠানে তার থাক্‌ত পোঁতা- -(বাড়িই নেই, তার উঠান কোথা) ? শুনেছি তার পিশতুতো ভাই- -(ভাই নয়ত, মামা-গোঁসাই ) । বল্‌ত সে তার শিষ্যটিরে- -(জন্ম-বোবা বলবে কিরে) । যা হোক, তারা তিনটি প্রানী- -(পাঁচটি তারা, সবাই জানি !) থও না বাপু খ্যাঁচাখেচি -(আচ্ছা বল, চুপ করেছি) ।। তারপরে যেই সন্ধ্যাবেলা, যেম্নি না তার ওষুধ গেলা, অম্‌নি তেড়ে জটায় ধরা- -(কোথায় জটা ? টাক যে ভরা !) হোক্‌ না টেকো তোর তাতে কি ? গোমরামুখো মুখ্যু ঢেঁকি ! ধরব ঠেসে টুটির পরে পিট্‌ব তোমার মুণ্ডু ধরে । এখন বাপু পালাও কোথা ? গল্প বলা সহজ কথা ? আয়রে আলো আয় পুব গগনে রাত পোহাল, ভোরের কোণে লাজুক আলো          নয়ন মেলে চায়। আকাশতলে ঝলক জ্বলে, মেঘের শিশু খেলার ছলে          আলোক মাখে গায়।। সোনার আলো, রঙিন্‌ আলো, স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো-          আয়রে আলো আয়। আয়রে নেমে আঁধার পরে, পাষাণ কালো ধৌত ক'রে          আলোর ঝরণায়।। ঘুম ভাঙান পাখির তানে জাগ্‌রে আলো আকুল গানে          আকূল নীলিমায়। আলসভরা আঁখির কোণে, দুঃখ ভয়ে আঁধার মনে,          আয়রে আলো আয়।। আলোছায়া হোক্‌না কেন যতই কালো          এমন ছায়া নাইরে নাই- লাগ্‌লে পরে রোদের আলো          পালায় না যে আপ্‌নি ভাই!..শুষ্কমুখে আঁধার ধোঁয়া          কঠিন হেন কোথায় বল্‌, লাগ্‌লে যাতে হাসির ছোঁয়া          আপ্‌নি গলে হয় না জল।। আশ্চর্য নিরীহ কলম, নিরীহ কালি, নিরীহ কাগজে লিখিল গালি-- "বাঁদর বেকুব আজব হাঁদা বকাট্‌ ফাজিল অকাট্‌ গাধা।" আবার লিখিল কলম ধরি বচন মিষ্টি, যতন করি-- "শান্ত মানিক শিষ্ট সাধু বাছারে, ধনরে লক্ষ্মী যাদু।" মনের কথাটি ছিলো যে মনে, রটিয়া উঠিল খাতার কোণে, আঁচরে আঁকিতে আখর ক'টি কেহ খুশি, কেহ উঠিল চটি! রকম রকম কালির টানে কারো কারো অশ্রু আনে, মারে না, ধরে না, হাঁকে না বুলি লোকে হাসে কাঁদে কি দেখি ভুলি? শাদায় কালোয় কি খেলা জানে? ভাবিয়া ভাবিয়া না পাই মানে। আহ্লাদী হাসছি মোরা হাসছি দেখ,হাসছি মোরা আহ্লাদী, তিন জনেতে জটলা ক'রে ফোক্‌লা হাসির পাল্লা দি। হাসতে হাসতে আসছে দাদা ,আসছি আমি,আসছে ভাই, হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে , ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হেসে ফ্যাক ক'রে । পাচ্ছে হাসি চাপতে গিয়ে, পাচেছ হাসি চোখ বুজে, পাচ্ছে হাসি চিমটি কেটে নাকের ভিতর নোখ গুজে। হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড় নৌকা ফানুস পিপড়ে মানুষ রেলের গাড়ী তেলের ভাঁড়। পড়তে গিয়ে ফেলছি হেসে 'ক খ গ' আর শ্লেট দেখে- উঠ্‌ছে হাসি ভস্‌ভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে। একুশে আইন শিবঠাকুরের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশে! কেউ যদি যায় পিছলে প'ড়ে, প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে, কাজির কাছে হয় বিচার-       একুশ টাকা দন্ড তার।। সেথায় সন্ধে ছটার আগে হাঁচতে হলে টিকিট লাগে হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে দম‌্দমাদম্ লাগায় পিঠে, কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে-       একুশ দফা হাচিয়ে মারে।। কারুর যদি দাতটি নড়ে, চার্‌টি টাকা মাশুল ধরে , কারুর যদি গোঁফ গজায়, একশো আনা ট্যাক্সো চায়- খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,       সেলাম ঠোকায় একুশ বার।। চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়, রাজার কাছে খবর ছোটে, পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে, দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়-       একুশ হাতা জল গেলায়।। যে সব লোকে পদ্য লেখে, তাদের ধরে খাঁচায় রেখে, কানের কাছে নানান্ সুরে নামতা শোনায় একশো উড়ে, সামনে রেখে মুদীর খাতা-       হিসেব কষায় একুশ পাতা।। হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে, অম্‌‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে, গোবর গুলে বেলের কষে, একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে-       একুশ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে।। ও বাবা পড়তে বসে মুখের কাছে কাগজখানি থুয়ে রমেশ ভায়া ঘুমোয় পড়ে আরাম ক'রে শুয়ে । শুনছ নাকি ঘড়র ঘড়র নাক ডাকার ধূম ? সখ যে বড় বেজায় দেখি- দিনের বেলায় ঘুম !বাতাস পোরা এই যে থলি দেখ্‌‌ছ আমার হাতে, দুড়ম করে পিট্‌‌লে পরে শব্দ হবে তাতে । রমেশ ভায়া আঁৎ‌কে উঠে পড়্‌‌বে কুপোকাৎ‌ লাগাও তবে- ধূমধারাক্কা ! ক্যাবাৎ‌ ! ক্যাবাৎ‌ !ও বাবারে ! এ কেরে ভাই ! মারবে নাকি চাঁটি ? আমি ভাবছি রমেশ বুঝি ! সব করেছে মাটি ! আবার দেখ চোখ পাকিয়ে আস্‌‌ছে আমায় তেড়ে- আর কেন ভাই ? দৌড়ে পালাই, প্রাণের আশা ছেড়ে ! ও বাবা! পড়তে বসে মুখের পরে কাগজ খানি থুয়ে রমেশ ভায়া ঘুমোয় পড়ে আরাম ক’রে শুয়ে। শুনছ নাকি ঘড়র্ ঘড়র্ নাক ডাকার ধুম? সখ যে বড় বেজায় দেখি- দিনের বেলায় ঘুম!বাতাস পোরা এই যে থলি দেখ্‌ছ আমার হাতে, দুড়ম করে পিট্‌লে পরে শব্দ হবে তাতে। রমেশ ভায়া আঁতকে উঠে পড়বে কুপোকাৎ লাগাও তবে -ধুম ধাড়াক্কা! ক্যাবাৎ! ক্যাবাৎ!ও বাবারে! এ কেরে ভাই! মারবে নাকি চাটি? আমি ভাবছি রমেশ বুঝি! সব করেছে মাটি! আবার দেখ চোখ পাকিয়ে আস্‌ছে আমায় তেড়ে, আর কেন ভাই? দৌড়ে পালাই, প্রানের আশা ছেড়ে! কত বড় ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা, ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা। ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে- দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে। চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি- "ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?" কলিকাতা কোথা রে গিরিধি আরামপুরী, দেহ মন চিৎপাত, খেয়ে শুয়ে হু হু করে কেটে যায় দিনরাত; হৈ চৈ হাঙ্গামা হুড়োতাড়া হেথা নাই; মাস বার তারিখের কোন কিছু ল্যাঠা নেই; খিদে পেলে তেড়ে খাও, ঘুম পেলে ঘুমিও- মোট কথা, কি আরাম, বুঝলে না তুমিও ! ভুলেই গেছিনু কোথা এই ধরা মাঝেতে আছে যে শহর এক কলকাতা নামেতে- হেন কালে চেয়ে দেখি চিঠি এক সমুখে, চায়েতে অমুক দিন ভোজ দেয় অমুকে । 'কোথায়? কোথায়?' বলে মন ওঠে লাফিয়ে তাড়াতাড়ি চিঠিখানা তেড়ে ধরি চাপিয়ে, ঠিকানাটা চেয়ে দেখি নীচু পানে ওধারে লেখা আছে 'কলিকাতা' - সে আবার কোথারে ! স্মৃতি কয় 'কলিকাতা ' রোস দেখি; তাই ত , কোথায় শুনেছি যেন , মনে ঠিক নাই ত, বেগতিক শুধালেম সাধুরাম ধোপারে ; সে কহিল, হলে হবে উশ্রীর ওপারে। ওপারের জেলেবুড়ো মাথা নেড়ে কয় সে , 'হেন নাম শুনি নাই আমার এ বয়সে ।' তারপরে পুছিলাম সরকারী মজুরে তামাম মুলুক সে ত বাৎলায় 'হুজুরে' বেঙাবাদ বরাকর , ইদিকে পচম্বা , উদিকে পরেশনাথ ,পাড়ি দাও লম্বা ; সব তার সড়গড় নেই কোন ভুল তায় - 'কুলিকাতা কাঁহা' বলি সেও মাথা চুলকায় ! অবশেষে নিরুপায় মাথা যায় ঘুলিয়ে ' 'টাইম টেবিল' খুলি দেখি চোখ বুলয়ে । সেথায় পাটনা পুরী গয়া গোমো মাল্‌দ বজবজ দমদম হাওড়া ও শ্যালদ - ইত্যাদি কত নাম চেয়ে দেখি সামনেই তার মাঝে কোন খানে কলিকাতা নাম নেই !! -সব ফাঁকি বুজ্‌রুকী রসিকতা -চেষ্টা ! উদ্দেশে 'শালা ' বলি গাল দিনু শেষটা।- সহসা স্মৃতিতে যেন লাগিল কি ফুৎকার উদিল কুমড়া হেন চাঁদপানা মুখ কার! আশে পাশে ঢিপি ঢুপি পাহাড়ে পুঞ্জ, মুখ চাঁচা ময়দান, মাঝে কিবা কুঞ্জ ! সে শোভা স্মরণে ঝরে নয়নের ঝরনা ; গৃহিনীরে কহি 'প্রিয়ে !মারা যাই ধর না । তার পরে দেখি ঘরে অতি ঘোর অনাচার - রাখে না কো কেউ কোন তারিখের সমাচার ! তখনি আনিয়া পাঁজি দেখা গেল গণিয়া, চায়ের সময় এল একেবারে ঘনিয়া ! হায়রে সময় নেই, মন কাদে হতাশে- কোথায় চায়ের মেলা! মুখশশী কোথা সে ! স্বপন শূকায়ে যায় আধারিয়া নয়নে , কবিতায় গলি তাই গাহি শোক শয়নে। কহ ভাই কহ রে কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে, বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) কাঁদুনে ছিচ্‌কাঁদুনে মিচকে যারা সস্তা কেঁদে নাম কেনে, ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যান্‌ঘ্যানে আর প্যানপ্যানে— কুঁকিয়ে কাঁদে খিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধম্‌কালে, কিম্বা হঠাৎ লাগলে ব্যাথা, কিম্বা ভয়ে চম্‌কালে; অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই; মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই— তারেই বলি মিথ্যে কাঁদন, আসল কান্না শুনবে কে? অবাক্ হবে থম্‌কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে! নন্দঘোষের পাশের বাড়ী বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার। কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে, কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন–কাদুনে রাক্ষুসে! নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা, হঠাৎ শুনি অর্থবিহীন আকাশ–ফাটান জোর গলা। হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান, বাপ মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান। বাসরে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই? কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই! ঝুমঝুমি দাও পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার, বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার। কান্নাভরে উল্‌টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে, গিলতে চাহে দালানবাড়ী হাঁ'খানি তার হাঁক্ দিয়ে, ভূত–ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে— কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ্ সাহেবের বাচ্চারে। কাজের লোক প্রথম। বাঃ - আমার নাম 'বাঃ', বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা! লেখাপড়ার ধার ধারিনে , বছর ভরে ছুটি, হেসে খেলে আরাম ক'রে দুশো মজা লুটি। কারে কবে কেয়ার করি , কিসের করি ডর? কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর। গাধার মতন খাটিস্ তোরা মুখটা করে চুন- আহাম্মুকি কান্ড দেখে হেসেই আমি খুন।                    সকলে। আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা, হাস্‌ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা।                    দ্বিতীয়। 'যদি' বলে ডাকে আমায় নামটি আমার যদি - আশায় আশায় বসে থাকি হেলনা দিয়ে গদি। সব কাজেতে থাকতে যদি খেলার মত মজা, লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা - স্যান্ডো সমান ষন্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে, প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে - উঠে পড়ে গেলে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে। করতে পারি সবি - যদি সহজ উপায় মেলে।                    সকলে। হাতের কাছে সুযোগ, তবু যদির আশায় বসে নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে                    তৃতীয়। আমার নাম 'বটে' আমি সদাই আছি চটে- কট্‌মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে। চশমা পরে বিচার ক'রে চিরে দেখাই চুল- উঠ্‌তে বস্‌তে কচ্ছে সবাই হাজার গন্ডা ভুল। আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার? ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার। হাসছ? বটে ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক, একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ।                    সকলে। দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল? আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে - নিজেই গায়েই ফেল।                    চতুর্থ। আমার নাম 'কিন্তু' আমায় 'কিন্তু' বলে ডাকে, সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে। দমটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি, ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি। লম্ফ ঝম্ফবহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি- ফোস করে যাই তেড়ে - আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি। পাঁচটা জিনিস গড়তে গেলে দশটা ভেঙে চুর - বল্ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদুর!                    সকলে। উচিত তোমায় বেধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি, বেগারখাটা পশুকাজের মূল্য কানাকড়ি।                    পঞ্চম। আমার নাম 'তবু' তোমার কেউ কি আময়ি চেনো? দেখতে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো। এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে, যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে। এম্নি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি, একুশ বারে না হয় যদি বাইশ বারে কষি। হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে, হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ'মে।                    সকলে। নিস্কম্মারা গেল কোথা,পালাল কোন দেশে? কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে। হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়, সময়টা যে কাজে লাগায়,চালাক বলে তায়। কাঠ বুড়ো হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে–যেন কে বৃদ্ধ রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ । মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সঙ্গীত ভাব দেখে মনে হয় না–জানি কি পণ্ডিত ! বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ— 'আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত ।' টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম, রেগে বলে, 'কেবা বোঝে এ সবের মর্ম ? আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ, বোঝেনাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব । কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব, একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত ?'আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য ; কোন্ ফুটো খেতে ভালো, কোন্‌টা বা মন্দ, কোন্ কোন্ ফাটলের কি রকম গন্ধ । কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক শব্দ । বলে, 'জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ ; কাঠকুঠো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট, এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট । কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন কাঠ শান্ত, কোন্ কাঠ টিম্‌টিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত । কোন্ কাঠে জ্ঞান নেই মিথ্যা কি সত্য, আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত ।' কাতুকুতু বুড়ো আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার! সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি— কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি। কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌ সড়কের মোড়ে, একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে। বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী, শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি। না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে, তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে। কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে, গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে। কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি— বেচ্‌ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি। ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা, কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্‌পনা সব আঁকা। অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি, ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।” এই না বলে কুটুত্‍‌ ক’রে চিম্‌টি কাটে ঘাড়ে, খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে। তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি, যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি। কানা-খোঁড়া সংবাদ পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,           নাম ধাম নাহি জানা, একজন তার খোড়া অতিশয়,           অপর ভূপতি কানা। মন ছিল খোলা, অতি আলো ভোলা           ধরমেতে ছিল মতি, পর ধনে সদা ছিল দোঁহাকার           বিরাগ বিকট অতি। প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি           মেজাজ রাজারি মত, শুনেছি কেবল, বুদ্ধিটা নাকি           নাহি ছিল সরু তত, ভাই ভাই মত ছিল দুই রাজা,           না ছিল ঝগড়াঝাঁটি, হেনকালে আসি তিন হাত জমি           সকল করিল মাটি। তিন হাত জমি হেন ছিল, তাহা           কেহ নাহি জানে কার, কহে খোঁড়া রায় "এক চক্ষু যার           এ জমি হইবে তার"।' শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়           "আরে অভাগার পুত্র, এ জমি তোমারি- দেখ না এখনি           খুলিয়া কাগজ পত্র"। নক্সা রেখেছে এক বছর           বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি, কীট কুটমতি কাটিয়া কাটিয়া           করিয়াছে তারে মাটি ; কাজেই তর্ক না মিটিল হায়           বিরোধ বাধিল ভারি, হইল য্দ্দু হদ্দ মতন           চৌদ্দ বছর ধরি। মরিল সৈন্য, ভাঙিল অস্ত্র,           রক্ত চলিল বহি, তিন হাত জমি তেমনি রহিল,           কারও হার জিত নাহি তবে খোঁড়া রাজা কহে, হায় হায়,           তর্ক নাহিক মিটে, ঘোরতর রণে অতি অকারণে           মরণ সবার ঘটে" বলিতে বলিতে চঁটাৎ করিয়া           হঠাৎ মাথায় তার অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল           অতীব চমৎকার। কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,           শুন মোর কানা ভাই, তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া           কখনও সুযশ নাই। তার চেয়ে জমি দান করে ফেল           আপদ শান্তি হবে।" কানা রাজা কহে, খাসা কথা ভাই,           কারে দিই কহ তবে।" কহেন খঞ্জ, " আমার রাজ্যে           আছে তিন মহাবীর- একটি পেটুক, অপর অলস,           তৃতীয় কুস্তিগীর। তোমার মুলুক কে আছে এমন           এদের হারাতে পারে?- সবার সমুখে তিন হাত জমি           বকশিস দিব তারে। কানা রাজা কহে ভীমের দোসর           আছে ত মল্ল মম, ফালাহারে পটু, পঁচাশি পেটুক           অলস কুমড়া সম। দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি           আসুক তোমার লোক; যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি-           খোড়া বলে, তাই হোক। পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে           আলিশান সভা হবে, তামাসা দেখিতে চারিদিক হতে           ছুটিয়া আসিল সবে। ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথঘাট,           লোকে হল লোকাকার, মহা কোলাহল দাড়াবার ঠাই           কোনোখানে নাহি আর। তারপর ক্রমে রাজার হুকুমে           গোলমাল গেল থেমে, দুইদিক হতে দুই পালোয়ান           আসরে আসিল নেমে। লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল           গজ-কচ্ছপ হেন, রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোহায়-           বজ্র পড়িল যেন! গুঁতাইল কত ভোঁতাইল নাসা           উপাড়িল গোফ দাড়ি, যতেক দন্ত করিল অন্ত           ভীষণ চাপটি মারি তারপরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া           ছুঁড়িল এমনি জোরে, গোলার মতন গেল গো উড়িয়া           দুই বীর বেগভরে। কিহল তাদের কেহ নাহি জানে           নানা কথা কয় লোকে, আজও কেহ তার পায়নি খবর,           কেহই দেখেনি চোখে। যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে           এল পেটুকের পালা, যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,           অথবা ঢাকাই জালা। ওজনেতে তারা কেহ নহে কম,           ভোজনেতে ততোধিক, বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষন-           ভারি সাতমন ঠিক। অবাক দেখিছে সভার সকলে           আজব কান্ড ভারি- ধামা ধামা লুচি নিমেষে ফুরায়           দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি! দাড়ি পাল্লায় মাপিয়া সকলে           দেখে আহারের পরে , দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে           সাড়ে তিন মন করে। কানা রাজা বলে একি হল জ্বালা,           আক্কেল নাই কারো , কেহ কি বোঝেনা সোজা কথা এই,           হয় জেতো নয় হারো।" তার পর এল কুঁড়ে দুই জন           ঝাকার উপর চড়ে, সভামাঝে দোহে শুয়ে চিৎপাত           চুপ চাপ রহে পড়ে। হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,           কথা নাই কারো মুখে, দিন দুই তিন রহিল পড়িয়া,           নাসা গীত গাহি সুখে। জঠরে যখন জ্বলিল আগুন,           পরান কণ্ঠাগত, তখন কেবল মেলিয়া আনন           থাকিল মড়ার মত। দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ           নিকটে আসিয়া ছুটি মুখের নিকটে ধরিল তাদের           চাটিম কদলি দুটি। খঞ্জের লোকে কহিল কষ্টে,           "ছাড়িয়া দে নারে ভাই" কানার ভৃত্য রহিল হা করে           মুখে তার কথা নাই । তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া           তায় কেরোসিন ঢালি, কুড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে           দেশলাই দিল জ্বালি। খোঁড়ার প্রজাটি বাপরে বলিয়া           লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি কম্পিত পদে চম্পট দিল           একেবারে সভা ছাড়ি। দুয়ো বলি সবে দেয় করতালি           পিছু পিছু ডাকে "ফেউ"? কানার অলস বলে কি আপদ           ঘুমুতে দিবিনা কেঊ? শুনে সবে বলে "ধন্য ধন্য           কুঁড়ে-কুল চুড়ামণি!" ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল           আগুন হইতে টানি। কানার লোকের গুণপনা দেখে           কানা রাজা খুসী ভারি, জমিতে দিলেই আরও দিল কত,           টাকাকড়ি ঘরবাড়ি। কানে খাটো বংশীধর কানে খাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি, গুনগুন গান গায় আর নাড়ে দাড়ি।। চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর, সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর।। বংশীধর বলে, 'আহা, না জানি কি পাখি সুদুরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি।। দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি, কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি।।' এদিকে বেড়াল ভাবে, 'এযে বড় দায়, প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায়।। গলা ছেড়ে এত চেঁচামেচি এত করি হায় তবু যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায়।। আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি, যা থাকে কপালে, দেই এক থাবা মারি।।' বংশীধর ভাবে, 'একি! বেসুরা যে করে, গলা গেছে ভেঙে তাই 'ফ্যাঁস্‌' সুর ধরে।।' হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি, একেবারে সব গান করে দিল মাটি। কি মুস্কিল! সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত, সরকারী সব অফিসখানার কোন্ সাহেবের কদর কত৷ কেমন ক'রে চাট্‌নি বানায়, কেমন ক'রে পোলাও করে, হরেক্ রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও ক'রে৷ সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দা কেতা, পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা৷ সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়— পাগলা ষাঁড়ে কর্‌লে তাড়া কেমন ক'রে ঠেকাব তায়! কিছু চাই? কারোর কিছু চাই গো চাই ? এই যে খোকা, কি নেবে ভাই? জলছবি আর লাট্টু লাটাই কেক বিস্কুট লাল দেশলাই খেলনা বাঁশি কিংবা ঘুড়ি লেড্‌ পেনসিল রবার ছুরি? এসব আমার কিছুই নাই, কারোর কিছু চাই গো চাই?কারোর কিছু চাই গো চাই? বৌমা কি চাও শুনতে পাই? ছিটের কাপড় চিকন লেস্‌ ফ্যান্সি জিনিস ছুঁচের কেস্‌ আল্‌তা সিঁদুর কুন্তলীন কাঁচের চুড়ি বোতাম পিন্‌? আমার কাছে ওসব নাই, কারোর কিছু চাই গো চাই?কারোর কিছু চাই গো চাই? আপনি কি চান কর্তামশাই? পকেট বই কি খেলার তাস চুলের কলপ জুতোর ব্রাশ্‌ কলম কালি গঁদের তুলি নস্যি চুরুট সুর্তি গুলি? ওসব আমার কিছুই নাই, কারোর কিছু চাই গো চাই? কিম্ভূত! বিদঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভুত, সারাদিন ধ'রে তার শুনি শুধু খুঁৎ খুঁৎ। মাঠ পারে ঘাট পারে কেঁদে মরে খালি সে, ঘ্যান্ ঘ্যান আব্দারে ঘন ঘন নালিশে। এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না- কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায়না । কোকিলের মত তার কন্ঠেতে সুর চাই, গলা শুনে আপনার বলে, 'উহু, দুর ছাই!' আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই- তাই দেখে মরে কেঁদে- তার কোন ডানা নেই! হাতিটার কি বাহার দাঁতে আর শুন্ডে- ও রকম জুরে তার দিতে হবে মুন্ডে! কাঙ্গারুর লাফ দেখে ভারি তার হিংসে- ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢেঙে চিমসে! সিংহের কেশরের মত তার তেজ কৈ? পিছে খাসা গোসাপের খাজ কাটা লেজ কৈ? একলা সে সব হলে মেটে তার প্যাখনা; যারে পায় তারে বলে, 'মোর দশা দেখ্না!' কেদেঁ কেদেঁ শেষটায়- আষাঢ়ের বাইশে হল বিনা চেষ্টায় চেয়েছে যা তাই সে। ভুলে গিয়ে কাঁদাকাটি আহ্লাদে আবেশে চুপিচুপি একলাটি ব'সে ব'সে ভাবে সে- লাফ দিয়ে হুশ্ করে হাতি কভু নাচে কি? কলাগাছ খেলে পরে কাঙ্গারুটা বাঁচে কি ? ভোঁতামুখে কুহুডাক শুনে লোকে কবে কি? এই দেহে শুঁড়ো নাক খাপ ছাড়া হবে কি? 'বুড়ো হাতি ওড়ে' ব'লে কেউ যদি গালি দেয় ? কান টেনে ল্যাজ মলে 'দুয়ো' ব'লে তালি দেয়? কেউ যদি তেড়েমেরে বলে তার সামনেই- কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই? জবাব কি দেবে ছাই,আছে কিছু বলবার? কাচুঁ মাচুঁ বসে তাই ,মনে শুধু তোলপার- 'নই ঘোড়া,নই হাতি, নই সাপ বিচছু মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচছু। মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই, নই জুতা নই ছাতা,আমি তবে কেউ নই!' কুম্‌ড়োপটাশ (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ নাচে—    খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;    চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;    চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ কাঁদে— খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে; উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে; বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’!   (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ হাসে—    থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে;    ঝাপ্‌সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্‌ফাসে;    তিনটি বেলায় উপোশ করে থাকবে শুয়ে ঘাসে! (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ছোটে— সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে; হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে; ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় না কেউ মোটে!   (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ডাকে—    সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে;    ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে;    শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে!তুচ্ছ ভেবে এ‐সব কথা করছে যারা হেলা, কুম্‌ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা। দেখবে তখন কোন কথাটি কেমন করে ফলে, আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে। কেন সব কুকুরগুলো কেন সব কুকুরগুলো খামখা চ্যাঁচায় রাতে ? কেন বল দাঁতের পোকা থাকেনা ফোক্‌লা দাঁতে ? পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা, কেন সে কাদের দোষে?- এস ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে । খাই খাই খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে— খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে। যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে, জড় করে আনি সব— থাক সেই আশাতে। ডাল ভাত তরকারি ফল-মূল শস্য, আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য, রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি, ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি, আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে— খুঁজে পেতে আনি খেতে— নয় বড়ো সিধে সে! জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয়, জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিয়ো। ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা, জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা।ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ), বার্মার ‘ঙাপ্পি’তে বাপ্ রে কি গন্ধ! মান্দ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কণ্ঠ, জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘণ্ট! আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা, কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা। দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা; তা না হলে কলা খাও— চটো কেন? বসো না— সবে হল খাওয়া শুরু, শোনো শোনো আরো খায়— সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়। বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে, খাসা দেখ ‘খাপ্ খায়’ চাপ্‌কানে দাড়িতে। তেলে জলে ‘মিশ খায়’, শুনেছ তা কেও কি? যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি? ডিঙি চড়ে স্রোতে প’ড়ে পাক খায় জেলেরা, ভয় পেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা; বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়, কেউ খায় থতমত— তাও লিখি তালিকায়। ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্ নাহি পায় রে— ‘দিন আনে দিন খায়’ কত লোক হায় রে। হোঁচটের চোট্ খেয়ে খোকা ধরে কান্না মা বলেন চুমু খেয়ে, ‘সেরে গেছে, আর না।’ ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য কিলচড় লাথি ঘুঁষি হয় তার খাদ্য। জুতো খায় গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে, তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে। গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্‌সিম্, পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্‌ঝিম্।কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা, কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা। টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা, ঘাব্‌ড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা। আকাশেতে কাৎ হ’য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা, পালোয়ান খায় দেখ ডিগ্‌বাজি কুড়িটা। ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা, কাশীতে প্রসাদ খেয়ে সাধু হই পাক্কা। কথা শোনো, মাথা খাও, রোদ্দুরে যেও না— আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না। ‘ফেল্’ ক’রে মুখ খেয়ে কেঁদেছিলে সেবারে, আদা-নুন খেয়ে লাগো পাশ করো এবারে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো নাকো; যেয়ো নাকো ভড়্‌কে, খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে। এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা— খাও তবে কচুপোড়া খাও তবে ঘণ্টা। খিচুড়ি হাঁস ছিল, সজারুও, (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না ৷ বক কহে কচ্ছপে—'বাহবা কি ফুর্তি ! অতি খাসা আমাদের 'বকচ্ছপ মূর্তি' ৷' টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা— পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ? ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি, চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি ! জিরাফের সাধ নাই মাঠে–ঘাটে ঘুরিতে, ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে ৷ গরু বলে, 'আমারেও ধরিল কি ও রোগে ? মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে ?' 'হাতিমি'র দশা দেখ–তিমি ভাবে জলে যাই হাতি বলে, 'এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই ৷' সিংহের শিং নাই এই বড় কষ্ট— হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট ৷ খুচরো ছড়া শুনেছ কি ব'লে গেলোশুনেছ কি ব'লে গেলো সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ? টকটক থাকে নাকো হ'লে পরে বৃষ্টি-- তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।বল্‌ব কি ভাইবলব কি ভাই হুগলি গেলুম              বলছি তোমায় চুপি-চুপি-- দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর              মাথায় তাদের নেইকো টুপি।।কহ ভাই কহ রেকহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে,        বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে,        ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।ঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোলঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোল ভপ্‌ ভপ্‌ বাশিঁ ঝন্‌ ঝন্‌ করতাল্‌ ঠন্‌ ঠন্‌ কাসিঁ। ধুমধাম বাপ্‌ বাপ্‌ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা। আকাশের গায়েআকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে, দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে; তাই দেখে খুঁৎ ধরা বুড়ো কয় চটে, দেখছ কি, এই রং পাকা নয় মোটে।।শোন শোন গল্প শোনশোন শোন গল্প শোন,'এক যে ছিলো গুরু',       এই আমার গল্প হলো শুরু।             যদু আর বংশীধর যমযজ ভাই তারা,                    এই আমার গল্প হলো সারা।মাসি গো মাসিমাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি               নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্‌-- হাতীর মাথায় ব্যাঙের ছাতা               কাগের বাসায় বগের ডিম।।ডাক্তার ফস্টারডাক্তার ফস্টার ইস্কুল মাস্টার বেত তার চটপট ছাত্রেরা ছটফট-- ভয়ে সব পস্তায়, বাড়ি ছেড়ে রাস্তায়, গ্রাম ছেড়ে শহরে, গয়া কাশী লাহোরে। ফিরে আসে সন্ধ্যায় পড়ে শোনে মন দেয়।।বাসরে বাস! সাবাস বীরবাসরে বাস! সাবাস বীর!         ধনুকখানি ধরে, পায়রা দেখে মারলে তীর--          কাগটা গেল মরে!বলছি ওরে, ছাগল ছানাবলছি ওরে, ছাগল ছানা, উড়িস নে রে উড়িস নে। জানিস তোদের উড়তে মানা-- হাতপাগুলো ছুড়িস নে।। তিন বুড়ো পণ্ডিততিন বুড়ো পণ্ডিত টাকচুড়ো নগরে            চড়ে এক গামলায় পাড়িড় দেয় সাগরে। গামলাতে ছেদা ছিলো, আগে কেউ দেখেনি,            গানখানি তাই মোর থেমে গেল এখনি।। রঙ হলো চিড়েতনরঙ হল চিড়েতন, সব গেল গুলিয়ে, গাধা যায় মামাবাড়ি, টাকে হাত বুলিয়ে বেড়াল মরে বিষম খেয়ে চাঁদের ধরল মাথা, হঠাৎ দেখি ঘরবাড়ি সব ময়দা দিয়ে গাথা ।।নাচননাচ্ছি মোরা মনের সাধে গাচ্ছি তেড়ে গান হুলো মেনি যে যার গলায় কালোয়াতীর তান। নাচ্ছি দেখে চাঁদা মামা হাসছে ভরে গাল চোখটি ঠেরে ঠাট্টা করে, দেখনা বুড়ার চাল। খুড়োর কল কল করেছেন আজবরকম চণ্ডীদাসের খুড়ো— সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো। খুড়োর যখন অল্প বয়স— বছর খানেক হবে— উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষন অট্টরবে। আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে, খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চম্‌কে গেল লোকে। বল্‌লে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে, বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।” সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে, পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে। দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা, ঘণ্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা। বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা, ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা। সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি— মণ্ডা মিঠাই চপ্‌ কাট্‌লেট্‌ খাজা কিংবা লুচি। মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে, মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে। এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে, উত্সাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে। হেসে খেলে দু‐দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে, খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে। সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো, অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো। খোকা ঘুমায় কোন্‌খানে কোন্‌ সুদূর দেশে, কোন্‌ মায়ের বুকে, কাদের খোকা মিষ্টি এমন ঘুমায় মনের সুখে? অজানা কোন্‌ দেশে সেথা কোন্‌খানে তার ঘর? কোন্‌ সমুদ্র, কত নদী, কত দেশের পর? কেমন সুরে, কি ব'লে মা ঘুমপাড়ানি গানে খোকার চোখে নিত্যি সেথা ঘুমটি ডেকে আনে? ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী তাদেরও কি থাকে? "ঘুমটি দিয়ে যাওগো" ব'লে মা কি তাদের ডাকে? শেয়াল আসে বেগুন খেতে, বর্গি আসে দেশে? ঘুমের সাথে মিষ্টি মধুর মায়ের সুরটি মেশে? খোকা জানে মায়ের মুখটি সবার চেয়ে ভালো, সবার মিষ্টি মায়ের হাসি, মায়ের চোখের আলো। স্বপন মাঝে ছায়ার মত মায়ের মুখটি ভাসে, তাইতে খোকা ঘুমের ঘোরে আপন মনে হাসে। খোকার ভাবনা মোমের পুতুল লোমের পুতুল আগ্‌লে ধ'রে হাতে তবুও কেন হাব্‌লা ছেলের মন ওঠে না তাতে? একলা জেগে একমনেতে চুপ্‌টি ক'রে ব'সে, আন্‌মনা সে কিসের তরে আঙুলখানি চোষে? নাইকো হাসি নাইকো খেলা নাইকো মুখে কথা, আজ সকালে হাব্‌লাবাবুর মন গিয়েছে কোথা? ভাব্‌ছে বুঝি দুধের বোতল আস্‌ছে নাকো কেন? কিংবা ভাবে মায়ের কিসে হচ্ছে দেরী হেন। ভাব্‌ছে এবার দুধ খাবে না কেবল খাবে মুড়ি, দাদার সাথে কোমন বেঁধে করবে হুড়োহুড়ি, ফেল্‌বে ছুঁড়ে চামচটাকে পাশের বাড়ির চালে, না হয় তেড়ে কামড়ে দেবে দুষ্টু ছেলের গালে। কিংবা ভাবে একটা কিছু ঠুক্‌তে যদি পেতো— পুতুলটাকে করত ঠুকে এক্কেবারে থেঁতো। গন্ধ বিচার সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা, ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা। বললে রাজা, 'মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?' মন্ত্রী বলে, 'এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!' রাজা বলেন, 'মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,' বদ্যি বলে, 'আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।' রাজা হাঁকেন , 'বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।' পাত্র বলে, 'নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র- নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?' রাজা বলেন, 'কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্‌বে।' কোটাল বলে, 'পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর, গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।' রাজা বলেন, 'আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,' ভীম বলে, 'আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্ রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ'- ব'লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত। রাজার শালা চন্দ্রকেতু তারেই ধ'রে শেষটা বল্ল রাজা, 'তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।' চন্দ্র বলেন, 'মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ, গন্ধ শুকে মর্‌তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?' ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই, ভাব্‌ল মনে, 'ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-' সাহস করে বল্লে বুড়ো, 'মিথ্যে সবাই বকছিস, শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্‌শিস।' রাজা বলেন, 'হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,' তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ। জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্‌ল কত গন্ধ, রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ। রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্‌ল কাঁসর ঢক্কা, বাপ্‌রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা! গল্প বলা 'এক যে রাজা'–'থাম্ না দাদা, রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা৷' 'তার যে মাতুল'–'মাতুল কি সে?— সবাই জানে সে তার পিশে৷' 'তার ছিল এক ছাগল ছানা'— 'ছাগলের কি গজায় ডানা?' 'একদিন তার ছাতের 'পরে'— 'ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?' 'বাগানের এক উড়ে মালী'— 'মালী নয়তো! মেহের আলী৷' 'মনের সাধে গাইছে বেহাগ'— 'বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ৷''থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি'— 'আচ্ছা বল, চুপ করেছি৷' 'এমন সময় বিছনা ছেড়ে, হঠাৎ মামা আস্‌ল তেড়ে, ধর্‌ল সে তার ঝুঁটির গোড়া'— 'কোথায় ঝুঁটি? টাক যে ভরা৷' 'হোক না টেকো তোর তাতে কি? লক্ষীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি! ধর্‌ব ঠেসে টুঁটির 'পরে, পিটব তোমার মুণ্ড ধ'রে— কথার উপর কেবল কথা, এখন বাপু পালাও কোথা?' গানের গুঁতো গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা— আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা! গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ, ছুটছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্‌ভন্। মরছে কত জখম হয়ে করছে কত ছট্‌ফট্— বলছে হেঁকে “প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্‌পট্।” বাঁধন‐ছেঁড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিত্‍‌পাত; ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্‌পাত। চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়ছে বেগে মূর্ছায়, লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বলেছে রেগে “দূর ছাই!”       জলের প্রাণী অবাক মানি গভীর জলে চুপচাপ্,        গাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস পড়ছে দেদার ঝুপ্‌ঝাপ্।        শূন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী,        সবাই হাঁকে, “আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী।”        গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্‌কুল,        ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশমেজাজে দিল্ খুল্।        এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এমনি সেটা ওস্তাদ,        গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাত্‍‌।        আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা,        ‘বাপ রে’ বলে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা। গোঁফ চুরি হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত, তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্‌ত? দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে, একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হটাত্‍‌ গেলেন ক্ষেপে! আঁত্‍‌কে উঠে হাত‐পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল! হটাত্‍‌ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!” তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ‐বা হাঁকে পুলিশ, কেউ‐বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।” ব্যস্ত সবাই এদিক‐ওদিক করছে ঘোরাঘুরি— বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!” গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি? গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি। সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না, মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না। গ্রীষ্ম রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলেস্থলে। ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুট্‌ছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস, ফুলের বিতান শুক্‌নো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান। দারুণ তৃষায় ফির্‌ছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়, তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে। বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্‌ ধরার পাঁজর, দশ দিক হয় ঘোর ধূলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়, করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুঙ্কার, শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ। গ্রীষ্ম (ঐ এল বৈশাখ) ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম, খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব ! চোখে যেন দেখি তার ধুলিময় অঙ্গ, বিকট কুটিলজটে ভ্রুকুটির ভঙ্গ, রোদে রাঙা দুই আঁখি শুকায়েছে কোটরে, ক্ষুধার আগুন যেন জ্বলে তার জঠরে ! মনে হয় বুঝি তার নিঃশ্বাস মাত্রে তেড়ে আসে পালাজ্বর পৃথিবীর গাত্রে ! ভয় লাগে হয় বুঝি ত্রিভুবন ভস্ম- ওরে ভাই ভয় নাই পাকে ফল শস্য ! তপ্ত ভীষণ চুলা জ্বালি নিজ বক্ষে পৃথিবী বসেছে পাকে, চেয়ে দেখ চক্ষে,- আম পাকে, জাম পাকে, ফল পাকে কত যে, বুদ্ধি যে পাকে কত ছেলেদের মগজে ! গ্রীষ্ম (সর্বনেশে গ্রীষ্ম) সর্বনেশে গ্রীষ্ম এসে বর্ষশেষে রুদ্রবেশে আপন ঝোঁকে বিষম রোখে আগুন ফোঁকে ধরার চোখে। তাপিয়ে গগন কাঁপিয়ে ভুবন মাত্‌ল তপন নাচল পবন। রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলে স্থলে। ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুটছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস, ফুলের বিতান শুকনো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান। দারুণ তৃষায় ফিরছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়, তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে। বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্ ধরার পাঁজর, দশ দিক হয় ঘোর ধুলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়। করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুংকার, শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ। চলে হন্ হন্ চলে হন্ হন্     ছোটে পন্ পন্ ঘোরে বন্ বন্     কাজে ঠন্ ঠন্ বায়ু শন্ শন্     শীতে কন্ কন্ কাশি খন্ খন্     ফোঁড়া টন্ টন্ মাছি ভন্ ভন্     থালা ঝন্ ঝন্ চোর ধরা আরে ছি ছি! রাম রাম! ব'লো নাহে ব'লো না, চল্‌ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা! যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে, ভয়ানক ক'মে যায় খাবারের ভাগেতে! রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানিনাকো কারা সে, কালকে যা হ'য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে! পাঁচখানা কাট্‌লেট‌, লুচি তিন গণ্ডা, গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা, আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্‌নি— ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!তাই আজ ক্ষেপে গেছি—কত আর পার্‌ব? এতদিন স'য়ে স'য়ে এইবারে মার্‌ব৷ খাড়া আছি সারাদিন হুঁশিয়ার পাহারা, দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা৷ রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস্— যেই হও, এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্‌ফোঁস্৷ খাট্‌বে না জারিজুরি আঁটবে না মার্‌প্যাঁচ্ যারে পাব ঘাড়ে ধ'রে কেটে দেব ঘ্যাঁচ্‌ঘ্যাঁচ্৷ এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে, এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে৷রোজ বলি 'সাবধান!' কানে তবু যায় না? ঠেলাখানা বুঝ্‌বি তো এইবারে আয় না! ছবি ও গল্প ছবির টানে গল্প লিখি নেইক এতে ফাঁকি যেমন ধারা কথায় শুনি হুবহু তাই আঁকি ।পরীক্ষাতে গোল্লা পেয়ে হাবু ফেরেন বাড়িচক্ষু দুটি ছানাবড়া মুখখানি তার হাঁড়িরাগে আগুন হলেন বাবা সকল কথা শুনেআচ্ছা ক'রে পিটিয়ে তারে দিলেন তুলো ধুনেমারের চোটে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় ক'রে তোলেশুনে মায়ের বুক ফেটে যায় 'হায় কি হল' ব'লেপিসী ভাসেন চোখের জলে কুট্‌নো কোটা ফেলেআহ্লাদেতে পাশের বাড়ি আটখানা হয় ছেলে । ছায়াবাজী আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা— ছয়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা । ছায়া ধরার ব্যাবসা করি তাও জানোনা বুঝি ? রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি ! শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা, গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা । চিলগুলো যায় দুপুরবেলায় আকাশ পথে ঘুরে, ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে । কাগের ছায়া বগের ছায়া কত ঘেঁটে হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে। কেউ জানে না এ–সব কথা কেউ বোঝে না কিছু, কেউ ঘোরে না আমার মত ছায়ার পিছুপিছু। তোমরা ভাব গাছের ছায়া অমনি লুটায় ভূঁয়ে, অমনি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্ত মত শুয়ে; আসল ব্যাপার জানবে যদি আমার কথা শোনো, বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো। কেউ যবে তার রয়না কাছে, দেখতে নাহি পায়, গাছের ছায়া ফটফটিয়ে এদিক ওদিক চায়। সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হতে এসে ধামায় চেপে ধপাস করে ধরবে তারে ঠেসে। পাতলা ছায়া, ফোকলা ছায়া, ছায়া গভীর কালো— গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভাল।গাছ গাছালি শেকড় বাকল মিথ্যে সবাই গেলে, বাপ্‌রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে। নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক, যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক। চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো, শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো। আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়, লাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়। আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে বাঁচতে যদি চাও, তেঁতুল তলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও। মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া 'ব্লটিং' দিয়ে শুষে, ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে! পাক্কা নতুন টাট্‌কা ওষুধ এক্কেবারে দিশি— দাম করেছি সস্তা বড় চোদ্দ আনা শিশি। ছুটি (ঘুচবে জ্বালা) ঘুচবে জ্বালা পুঁথির পালা ভাবছি সারাক্ষণ- পোড়া স্কুলের পড়ার পরে আর কি বসে মন ? দশটা থেকেই নষ্ট খেলা, ঘণ্টা হতেই শুরু প্রাণটা করে 'পালাই পালাই' মনটা উড়ু উড়ু- পড়ার কথা খাতায়, পাতায়, মাথায় নাহি ঢোকে ! মন চলে না- মুখ চলে যায় আবোলতাবোল ব'কে ! কানটা ঘোরে কোন্‌ মুলুকে হুঁশ থাকে না তার, এ কান দিয়ে ঢুকলে কথা, ও কান দিয়ে পার । চোখ থাকে না আর কিছুতেই, কেবল দেখে ঘড়ি ; বোর্ডে আঁকা অঙ্ক ঠেকে আঁচড়কাটা খড়ি । কল্পনাটা স্বপ্নে চ'ড়ে ছুটছে মাঠে ঘাটে- আর কি রে মন বাঁধন মানে ? ফিরতে কি চায় পাঠে ? পড়ার চাপে ছট্‌ফটিয়ে আর কিরে দিন চলে ? ঝুপ্‌ ক'রে মন ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ ছুটির বন্যাজলে । ছুটি (ছুটি ছুটি ছুটি) ছুটি! ছুটি! ছুটি! মনের খুশি রয়না মনে হেসেই লুটোপুটি। ঘুচল এবার পড়ার তাড়া অঙ্ক কাটাকুটি দেখ্‌ব না আর পন্ডিতের ঐ রক্ত আঁখি দুটি। আর যাব না স্কুলের পানে নিত্য গুটি গুটি এখন থেকে কেবল খেলা কেবল ছুটোছুটি। পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে আয়রে সবাই জুটি গ্রীষ্মকালের দুপুর রোদে গাছের ডালে উঠি আয়রে সবাই হল্লা ক'রে হরেক মজা লুটি একদিন নয় দুই দিন নয় দুই দুই মাস ছুটি। ছোটে হনহন চলে হন্ হন্ ছোটে পন্ পন্ ঘোরে বন্ বন্ কাজে ঠন্ ঠন্ বায়ু শন্ শন্ শীতে কন্ কন্ কাশি খন্ খন্ ফোঁড়া টন্ টন্ মাছি ভন্ ভন্ থালা ঝন্ ঝন্   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) জালা-কুঁজো সংবাদ পেটমোটা জালা কয়, "হেসে আমি মরিরে কুঁজো তোর হেন গলা এতটুকু শরীরে!" কুঁজো কয়, "কথা কস্ আপনাকে না চিনে, ভুঁড়িখানা দেখে তোর কেঁদে আর বাঁচিনে।" জালা কয়, "সাগরের মাপে গড়া বপুখান, ডুবুরিরা কত তোলে তবু জল অফুরান।" কুঁজো কয়, "ভালো কথা ! তবে যদি দৈবে, ভুঁড়ি যায় ভেস্তিয়ে, জল কোথা রইবে?" "নিজ কথা ভুলে যাস?" জালা কয় গর্জে, "ঘাড়ে ধরে হেঁট ক'রে জল নেয় তোর যে।" কুঁজো কয়, "নিজ পায়ে তবু খাড়া রই তো- বিঁড়ে বিনা কুপোকাৎ, তেজ তোর ঐতো।" টিক্‌ টিক্‌ টং টিক্‌ টিক্‌ চলে ঘড়ি, টিক্‌ টিক্‌ টিক্‌, একটা ইঁদুর এল সে সময়ে ঠিক। ঘড়ি দেখে একলাফে তাহাতে চড়িল, টং করে অমনি ঘড়ি বাজিয়া উঠিল। অমনি ইঁদুরভায়া ল্যাজ গুটাইয়া, ঘড়ির উপর থেকে পড়ে লাফাইয়া। ছুটিয়া পালায়ে গেল আর না আসিল, টিক্‌ টিক্‌ টিক্‌ ঘড়ি চলিতে লাগিল।। টুকরো ছড়া তিন বুড়ো পন্ডিত টাকচুড়ো নগরে চ’ড়ে এক গামলায় পাড়ি দেয় সাগরে। গাম‌্‌লাতে ছেঁদা আগে কেউ দেখনি, গানখানি তাই মোর থেমে গেল এখনি।।ম্যাও ম্যাও হুলোদাদা, তোমার যে দেখা নাই? গেছিলাম রাজপুরী রানীমার সাথে ভাই! “তাই নাকি? বেশ বেশ, কি দেখেছ সেখানে?” দেখেছি ইদুর এক রানীমার উঠানে।।”গাধাটার বুদ্ধি দেখ!- চাঁট মেরে সে নিজের গালে, কে মেরেছে দেখবে বলে চড়তে গেছে ঘরের চালে।ছোট ছোট ছেলেগুলো কিসে হয় তৈরি, -কিসে হয় তৈরি, কাদা আর কয়লা ধুলো মাটি ময়লা, এই দিয়ে ছেলেগুলো তৈরি। ছোট ছোট মেয়ে গুলি কিসে হয় তৈরি। কিসে হয় তৈরি? ক্ষীর ননী চিনি আর ভাল যাহা দুনিয়ার মেয়েগুলি তাই দিয়ে তৈরি।।রং হল চিঁড়েতন সব গেল ঘুলিয়ে, গাধা যায় মামাবাড়ি টাকে হাত বুলিয়ে। বেড়াল মরে বিষম খেয়ে, চাঁদের ধরল মাথা হঠাৎ দেখি ঘর বাড়ি সব ময়দা দিয়ে গাঁথা।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) ট্যাঁশ গরু ট্যাঁশ্ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে; যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে। চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখান মস্ত, ফিট্‌ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত। তিন-বাঁকা শিং তার ল্যাজখানি প্যাঁচান- একটুকু ছোঁও যদি, বাপরে কি চ্যাঁচান! লট্খটে হাড়গোড় খট্‌খট্ ন'ড়ে যায়, ধম্‌কালে ল্যাগ্‌ব্যাগ চমকিয়ে প'ড়ে যায়। বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার, চেহারার কি বাহার- ঐ দেখ ছবি তার। ট্যাঁশ্ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে, মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে ; মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়, মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি; রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়েসে সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে। আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্‌খক্, সারা গায়ে ঘিন্ ঘিন্ ঠ্যাং কাঁপে ঠক্‌ঠক্। একদিন খেয়েছিল ন্যাকড়ার ফালি সে- তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে। কারো যদি শখ্ থাকে ট্যাঁশ গরু কিনতে , সস্তায় দিতে পারি,দেখ ভেবে চিন্তে। ঠিকানা আরে আরে জগমোহন- এস, এস, এস- বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যনাথের মেশো? আদ্যনাথের নাম শোননি? খগেনকে তো চেনো? শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো। শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়ীওলা- (কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা; তারই পিশের খড়তুতো ভাই আদ্যনাথের মেশো- লক্ষী দাদা, ঠিকানা তার একটু জেনে এসো। ঠিকানা চাও? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ'রে, চলবে সিধে নাক বরাবর, ডান দিকে চোখ রেখে; চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে। দেখবে সেথায় ডাইনে বায়ে পথ গিয়াছে কত, তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধাঁর মত। তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচর মেরে , ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে। তবেই আবার পড়বে এসে আমড়া তলার মোড়ে- তারপরে যাও যেথায় খুশি- জ্বালিয়ো নাকো মোরে । ডানপিটে বাপ্‌রে কি ডানপিটে ছেলে!- কোন দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে। একটা সে ভুত সেজে আঠা মেখে মুখে, ঠাঁই ঠাই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে। অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে, খাট থেকে রাগ ক'রে দুম্‌দাম্ পড়ে।বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!- শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে! একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘষে, একমনে মোমবাতি দেশলাই চোষে! আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে, কপ্ কপ্ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে!বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!- খুন হ'ত টম্ চাচা ওই রুটি খেলে! সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে, রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস্ ফোঁস্ ফোলে! নেড়াচুল খাড়া হয়ে রাঙা হয় রাগে, বাপ্ বাপ্ ব'লে চাচা লাফ দিয়ে ভাগে। ঢপ ঢপ ঢাক ঢোল ঢপ্ ঢপ্ ঢাক ঢোল ভপ্ ভপ্ বাঁশি ঝন্ ঝন্ করতাল্ ঠন্ ঠন্ কাঁসি। ধুমধাম বাপ্ বাপ্ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) তেজিয়ান চলে খচ্‌খচ্ রাগে গজ্‌গজ্ জুতো মচ্‌মচ্ তানে, ভুরু কট্‌মট্ ছড়ি ফট্‌ফট্ লাথি চট্‌পট্ হানে। দেখে বাঘ-রাগ লোকে 'ভাগ ভাগ' করে আগভাগ থেকে, বয়ে লাফ ঝাঁপ বলে 'বাপ্ বাপ্' সবে হাবভাব দেখে। লাথি চার চার খেয়ে মার্জার ছোটে যার যার ঘরে, মহা উৎপাত ক'রে হুটপাট্ চলে ফুটপাথ্ পরে। ঝাড়ু–বর্দার হারুসর্দার ফেরে ঘরদ্বার ঝেড়ে, তারি বালতিএ- দেখে ফাল্ দিয়ে আসে পালটিয়ে তেড়ে। রেগে লালমুখে হেঁকে গাল রুখে মারে তাল ঠুকে দাপে, মারে ঠন্‌ঠন্ হাড়ে টন্‌টন্ মাথা ঝন ঝন কাঁপে! পায়ে কলসিটে! কেন বাল্‌তিতে মেরে চাল দিতে গেলে? বুঝি ঠ্যাং যায় খোঁড়া ল্যাংচায় দেখে ভ্যাংচায় ছেলে। দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! ছুটছে মটর ঘটর ঘটর ছুটছে গাড়ী জুড়ি, ছুটছে লোকে নানান্ ঝোঁকে করছে হুড়োহুড়ি; ছুটছে কত ক্ষ্যাপার মতো পড়ছে কত চাপা, সাহেবমেমে থমকে থেমে বলছে 'মামা পাপা!' আমরা তবু তবলা ঠুকে গাচ্ছি কেমন তেড়ে 'দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!' বর্ষাকালে বৃষ্টিবাদল রাস্তা জুড়ে কাদা, ঠাণ্ডা রাতে সর্দিবাতে মরবি কেন দাদা? হোক্ না সকাল হোক্ না বিকাল                হোক্ না দুপুর বেলা, থাক্ না তোমার আপিস যাওয়া                থাক্ না কাজের ঠেলা— এই দেখ না চাঁদনি রাতের গান এনেছি কেড়ে, 'দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!'মুখ্যু যারা হচ্ছে সারা পড়ছে ব'সে একা, কেউবা দেখ কাঁচুর মাচুর                কেউ বা ভ্যাবাচ্যাকা৷ কেউ বা ভেবে হদ্দ হল, মুখটি যেন কালি কেউ বা ব'সে বোকার মতো মুণ্ডু নাড়ে খালি৷ তার চেয়ে ভাই, ভাবনা ভুলে গাওনা গলা ছেড়ে, 'দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!' বেজার হয়ে যে যার মতো করছ সময় নষ্ট, হাঁটছ কত খাটছ কত পাচ্ছ কত কষ্ট! আসল কথা বুঝছ না যে, করছ না যে চিন্তা, শুনছ না যে গানের মাঝে তবলা বাজে ধিন্‌তা? পাল্লা ধরে গায়ের জোরে গিটকিরি দাও ঝেড়ে, 'দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!' দাঁড়ের কবিতা চুপ কর্ শোন্ শোন্, বেয়াকুফ হোস্ নে ঠেকে গেছি বাপ্ রে কি ভয়ানক প্রশ্নে! ভেবে ভেবে লিখে লিখে বসে বসে দাঁড়েতে ঝিম্‌ঝিম্ টন্‌টন্ ব্যথা করে হাড়েতে। এক ছিল দাঁড়ি মাঝি— দাড়ি তার মস্ত, দাড়ি দিয়ে দাঁড়ি তার দাঁড়ে খালি ঘষ্‌ত। সেই দাঁড়ে একদিন দাঁড়কাক দাঁড়াল, কাঁকড়ার দাঁড়া দিয়ে দাঁড়ি তারে তাড়াল। কাক বলে রেগেমেগে, “বাড়াবাড়ি ঐতো! না দাঁড়াই দাঁড়ে তবু দাঁড়কাক হই তো? ভারি তোর দাঁড়িগিরি, শোন্ বলি তবে রে— দাঁড় বিনা তুই ব্যাটা দাঁড়ি হোস্ কবে রে? পাখা হলে ‘পাখি’ হয় ব্যাকরণ বিশেষে— কাঁকড়ার দাঁড়া আছে, দাঁড়ি নয় কিসে সে? দ্বারে বসে দারোয়ান, তারে যদি ‘দ্বারী’ কয়, দাঁড়ে-বসা যত পাখি সব তবে দাঁড়ি হয়! দূর দূর! ছাই দাঁড়ি! দাড়ি নিয়ে পাড়ি দে!” দাঁড়ি বলে, “বাস্ বাস্! ঐখেনে দাঁড়ি দে।” দাদা গো দাদা দাদা গো দাদা, সত্যি তোমার সুরগুলো খুব খেলে! এম্‌‌নি মিঠে- ঠিক যেন কেউ গুড় দিয়েছে ঢেলে! দাদা গো দাদা, এমন খাসা কণ্ঠ কোথায় পেলে?- এই খেলে যা! গান শোনাতে আমার কাছেই এলে? দাদা গো দাদা, পায়ে পড়ি তোর, ভয় পেয়ে যায় ছেলে- গাইবে যদি ঐখেনে গাও, ঐ দিকে মুখ মেলে । দিনের হিসাব ভোর না হতে পাখিরা জোটে গানের চোটে ঘুমটি ছোটে- চোখ্‌টি খোলো, গাত্র তোলো আরে মোলো সকাল হলো। হায় কি দশা পড়্‌তে বসা অঙ্ক কষা, কলম ঘষা। দশটা হলে হট্টগোলে দৌড়ে চলে বই বগলে! স্কুলের পড়া বিষম তাড়া, কানটি নাড়া বেঞ্চে দাঁড়া মরে কি বাঁচে! সমুখে পাছে বেত্র নাচে নাকের কাচে।। খেলতে যে চায় খেল্‌বে কি ছাই বৈকেলে হায় সময় কি পায়? খেলাটি ক্রমে যেম্‌নি জমে দখিনে বামে সন্ধ্যা নামে; ভাঙ্‌ল মেলা সাধের খেলা- আবার ঠেলা সন্ধ্যাবেলা- মুখ্‌টি হাঁড়ি তাড়াতাড়ি দিচ্ছে পাড়ি যে যার বাড়ি। ঘুমের ঝোঁকে ঝাপ্‌সা চোখে ক্ষীণ আলোকে অঙ্ক টোকে ; ছুটি পাবার সুযোগ আবার আয় রবিবার হপ্তা কাবার! দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায় দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায় নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায়? এম্নি দশাই তার কপালে লেখে। কথার পাকে মানুষ মেরে মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে, গড় করি তার অনেক তফাৎ থেকে।*বিখ্যাত ইংরাজি কবিতার অনুকরণে (অন্যান্য ছড়াসমূহ) নদী হে পর্বত, যত নদী করি নিরীক্ষণ তোমাতেই করে তারা জনম গ্রহণ। ছোট বড় ঢেউ সব তাদের উপরে কল্ কল্ শব্দ করি সদা ক্রীড়া করে, সেই নদী বেকে চুরে যায় দেশে দেশে, সাগরেতে পড়ে গিয়া সকলের শেষে। পথে যেতে যেতে নদী দেখে কত শোভা, কি সুন্দর সেই সব কিবা মনোলোভা। কোথাও কোকিলে দেখে বসি সাথী সনে, কি সুন্দর কুহু গান গায় নিজ মনে। কোথাও ময়ূর দেখে পাখা প্রসারিয়া বনধারে দলে দলে আছে দাড়াইয়া! নদীতীরে কত লোক শ্রান্তি নাশ করে, কত শত পক্ষী আসি তথা বিচারে। দেখিতে দেখিতে নদী মহাবেগে ধায় কভুও সে পশ্চাতেতে ফিরে নাহি চায়।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) নন্দগুপি হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি, চোরের মত নন্দগোপাল চলছে গুড়ি গুড়ি? লুকিয়ে বুঝি মুখোশখানা রাখছে চুপি চুপি? আজকে রাতে অন্ধকারে টেরটা পাবেন গুপি!         আয়না হাতে দাঁড়িয়ে গুপি হাসছে কেন খালি?         বিকট রকম পোশাক করে মাখছে মুখে কালি!         এম্মি করে লম্ফ দিয়ে ভেংচি যখন দেবে         নন্দ কেমন আঁৎকে যাবে -হাস্‌ছে সে তাই ভেবে।আঁধার রাতে পাতার ফাঁকে ভূতের মতন কে রে? ফন্দি এঁটে নন্দগোপাল মুখোশ মুখে ফেরে! কোথায় গুপি, আসুক না সে ইদিক্ পানে ঘুরে- নন্দদাদার হুঙ্কারে তার প্রাণটি যাবে উড়ে।        হেথায় কে রে মূর্তি ভীষণ মুখটি ভরা গোঁফে?         চিমটে হাতে জংলা গুপি বেড়ায় ঝাড়ে ঝোপে!         নন্দ যখন বাড়ির পথে আসবে গাছের আড়ে,         "মার্ মার্ মার কাট্‌রে"লে পড়বে তাহার ঘাড়ে।নন্দ চলেন এক পা দু পা আস্তে ধীরে গতি, টিপ্‌টিপিয়ে চলেন গুপি সাবধানেতে অতি- মোড়ের মুখে ঝোপের কাছে মার্‌তে গিয়ে উকি দুই সেয়ানে এক্কেবারে হঠাৎ মুখোমুখি!         নন্দ তখন ফন্দি ফাঁদন কোথায় গেল ভুলি         কোথায় গেল গুপির মুখে মার্ মার্ মার্ বুলি।         নন্দ পড়েন দাঁতকপাটি মুখোশ টুখোশ ছেড়ে         গুপির গায়ে জ্বরটি এল কম্প দিয়ে তেড়ে         গ্রামের লোকে দৌড়ে তখন বদ্যি আনে ডেকে,         কেউ বা নাচে কেউ বা কাঁদে রকম সকম দেখে।         নন্দগুপির মন্দ কপাল এম্‌নি হল শেষে,         দেখ্‌লে তাদের লুটোপুটি সবাই মেরে হেসে। নাচন নাচ্ছি মোরা মনের সাধে গাচ্ছি তেড়ে গান হুলো মেনী যে যার গলার কালোয়াতীর তান। নাচ্ছি দেখে চাঁদা মামা হাস্‌ছে ভরে গাল চোখটি ঠেরে ঠাট্টা করে দেখ্‌না বুড়োর চাল। নাচের বাতিক বয়স হল অষ্টআশি, চিমসে গায়ে ঠুন্‌কো হাড়, নাচছে বুড়ো উল্টোমাথায়- ভাঙলে বুঝি মুন্ডু ঘাড়! হেঁইয়ো ব'লে হাত পা ছেড়ে পড়ছে তেড়ে চিৎপটাং, উঠছে আবার ঝট্পটিয়ে এক্কেবারে পিঠ সটান্। বুঝিয়ে বলি, 'বৃদ্ধ তুমি এই বয়েসে কর্‌ছ কি? খাও না খানিক মশলা গুলে হুঁকোর জল আর হরতকী। ঠান্ডা হবে মাথায় আগুন, শান্ত হবে ছটফ্‌টি-' বৃদ্ধ বলে, 'থাম্ না বাপু সব তাতে তোর পট্‌পটি! ঢের খেয়েছি মশ্‌লা পাঁচন, ঢের মেখেছি চর্বি তেল, তুই ভেবেছিস আমায় এখন চাল্ মেরে তুই করবি ফেল?' এই না ব'লে ডাইনে বাঁয়ে লম্ফ দিয়ে হুশ ক'রে হঠাৎ খেয়ে উল্টোবাজি ফেললে আমায় 'পুশ' করে। 'নাচলে অমন উল্টো রকম, আবার বলি বুঝিয়ে তায়, রক্তগুলো হুড়হুড়িয়ে মগজ পানে উজিয়ে যায়।' বললে বুড়ো, 'কিন্তু বাবা, আসল কথা সহজ এই- ঢের দেখেছি পরখ্ করে কোথাও আমার মগজ নেই। তাইতে আমরা হয় না কিছু- মাথায় যে সব ফক্কিফাঁক- যতটা নাচি উল্টো নাচন, যতই না খাই চর্কিপাক।বলতে গেলাম 'তাও কি হয়'- অম্নি হঠাৎ ঠ্যাং নেড়ে আবার বুড়ো হুড়মুড়িয়ে ফেললে আমায় ল্যাং মেরে। ভাবছি সবে মারব ঘুঁষি এবার বুড়োর রগ্ ঘেঁষে, বললে বুড়ো 'করব কি বল্ ? করায় এ সব অভ্যেসে। ছিলাম যখন রেল-দারোগা চড়্‌তে হত ট্রেইনেতে চলতে গিয়ে ট্রেনগুলো সব পড়ত প্রায়ই ড্রেইনেতে। তুব্‌ড়ে যেত রেলের গাড়ি লাগত গুঁতো চাক্কাতে, ছিটকে যেতাম যখন তখন হঠাৎ এক এক ধাক্কাতে। নিত্যি ঘুমাই এক চোখে তাই, নড়লে গাড়ি- অম্নি 'বাপ্- এম্-নি ক'রে ডিগ্‌বাজিতে এক্কেবারে শুন্য লাফ। তাইতে হল নাচের নেশা, হঠাৎ হঠাৎ নাচন পায়, বসতে শুতে আপ্‌নি ভুলে ডিগ্‌বাজি খাই আচম‌্কায়! নাচতে গিয়ে দৈবে যদি ঠ্যাং লাগে তোর পাজরাতে, তাই বলে কি চটতে হবে? কিম্বা রাগে গজ্‌রাতে?' আমিও বলি, 'ঘাট হয়েছে তোমার খুরে দন্ডবৎ! লাফাও তুমি যেমন খুশি, আমরা দেখি অন্য পথ।' নারদ নারদ "হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলছিলি লাল? (আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে, নাক ডেকেছিস্ বিশ্রী সুরে? (আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো, শুন্‌ছি নাকি বেজায় হুলো? (আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি, কেউ নাকি রাখে না দাড়ি? ক্যান্ রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্!" "চোপরাও তুম্ স্পিকটি নট্, মার্‌ব রেগে পটাপট্- ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার কর্‌বি রোখ, কিম্বা যদি অম্‌নি ক'রে, মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস জোরে- আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস্ আমি স্যান্ডো করি?" "ফের লাফাচ্ছিস্! অল্‌রাইট, কামেন্ ফাইট ! কামেন্ ফাইট!" "ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি! আজকে যদি থাক্‌ত মামা, পিটিয়ে তোমায় করত ধামা।" "আরে! আরে! মার্‌বি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি!" "হাঁহাঁহাঁহাঁ! রাগ করো না, করতে চাও কি তাই বল না!" "হাঁ হাঁ তাতো সত্যি বটেই, আমি তো চটিনি মোটেই! মিথ্যে কেন লড়তে যাবি? ভেরি- ভেরি সরি মশলা খাবি?" "শেক্হ্যান্ড আর দাদা বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল।" "ডোন্ট পরোয়া অল্ রাইট্, হাউ ডু য়ু ডু গুড্ নাইট।" নিঃস্বার্থ গোপালটা কি হিংসুটে মা! খাবার দিলেম ভাগ করে, বল্লে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে। জ্যেঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, ‘দুই ভায়েতে খাও বলে’− দশটি ছিল, একটি তাহার চাখতে দিলেম ফাও বলে, আর যে নটি, ভাগ করে তায় তিনটে দিলেম গোপালকে− তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে। বুঝিয়ে বলি, কাঁদিস কেন? তুই যে নেহাৎ কনিষ্ঠ, বয়স বুঝে, সামলে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট। তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুণতি তাই, মোদ্দা আমার ছয়খানি হয়, তিন বছরে তিনটি পাই, তাও মানে না কেবল কাঁদে, স্বার্থপরের শয়তানি, শেষটা আমার মেঠাইগুলো খেতেই হলো সবখানি। নিরুপায় বসি বছরের পয়লা তারিখে মনের খাতায় রাখিলাম লিখে- "সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্, সেইটুকু খাব হব না পেটুক।" মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি, এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি! লিখিয়াছে, "যদি নেমন্তন্নে কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে, উচিত হবে কি কাঁদান তাহারে? কিম্বা যখন বিপুল আহারে , তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া- তখন কি করি, আমি নিরূপায়! তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়, ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!" নূতন বৎসর 'নূতন বছর ! নূতন বছর !' সবাই হাঁকে সকাল সাঁঝে আজকে আমার সূর্যি মামার মুখটি জাগে মনের মাঝে । মুস্কিলাসান করলে মামা, উস্কিয়ে তার আগুনখানি, ইস্কুলেতে লাগ্‌ল তালা, থাম্‌ল সাধের পড়ার ঘানি । এক্‌জামিনের বিষম ঠেলা চুক্‌ল রে ভাই ঘুচ্ল জ্বালা, নূতন সালের নূতন তালে হোক্‌ তবে আস 'হকির' পালা । কোন্‌খানে কোন্‌ মেজের কোণে, কলম কানে, চশমা নাকে, বিরামহারা কোন্‌ বেচারা দেখেন কাগজ, ভয় কি তাঁকে ? অঙ্কে দিবেন হকির গোলা, শঙ্কা ত নাই তাহার তরে, তঙ্কা হাজার মিলুক তাঁহার, ডঙ্কা মেরে চলুন ঘরে । দিনেক যদি জোটেন খেলায় সাঁঝের বেলায় মাঠের মাঝে, 'গোল্লা' পেয়ে ঝোল্লা ভরে আবার না হয় যাবেন কাজে ! আয় তবে আয়, নবীন বরষ ! মলয় বায়ের দোলায় দুলে, আয় সঘনে গগন বেয়ে, পাগলা ঝড়ের পালটি তুলে । আয় বাংলার বিপুল মাঠে শ্যামল ধানের ঢেউ খেলিয়ে, আয়রে সুখের ছুটির দিনে আম-কাঁটালের খবর নিয়ে ! আয় দুলিয়ে তালের পাখা, আয় বিছিয়ে শীতল ছায়া, পাখির নীড়ে চাঁদের হাটে আয় জাগিয়ে মায়ের মায়া । তাতুক না মাঠ, ফাটুক না কাঠ, ছুটুক না ঘাম নদীর মত, জয় হে তোমার, নূতন বছর ! তোমার যে গুণ, গাইব কত ? পুরান বছর মলিন মুখে যায় সকলের বালাই নিয়ে, ঘুচ্‌ল কি ভাই মনের কালি সেই বুড়োকে বিদায় দিয়ে ? নূতন সালে নূতন বলে, নূতন আশায়, নুতন সাজে, আয় দয়ালের নাম লয়ে ভাই, যাই সকলে যে যার কাজে ! নেড়া বেলতলায় যায় কবার? রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার উপরে বসল রাজা—        ঠোঙাভরা বাদামভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না৷ গায়ে আঁটা গরম জামা পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা;        রাজা বলে, 'বৃষ্টি নামা— নইলে কিচ্ছু মিলছে না৷' থাকে সারা দুপুর ধ'রে ব'সে ব'সে চুপটি ক'রে,        হাঁড়িপানা মুখটি ক'রে আঁকড়ে ধ'রে শ্লেটটুকু; ঘেমে ঘেমে উঠছে ভিজে ভ্যাবাচ্যাকা একলা নিজে,        হিজিবিজি লিখছে কি যে বুঝছে না কেউ একটুকু৷ ঝাঁ ঝাঁ রোদ আকাশ জুড়ে, মাথাটার ঝাঁঝ্‌রা ফুঁড়ে,        মগজেতে নাচছে ঘুরে রক্তগুলো ঝনর্‌ ঝন্‌; ঠাঠা–পড়া দুপুর দিনে, রাজা বলে, 'আর বাঁচিনে,        ছুটে আন্‌ বরফ কিনে ক'চ্ছে কেমন গা ছন্‌ছন্‌৷' সবে বলে, 'হায় কি হল! রাজা বুঝি ভেবেই মোলো!        ওগো রাজা মুখটি খোল–কওনা ইহার কারণ কি? রাঙামুখ পান্‌সে যেন তেলে ভাজা আম্‌সি হেন,        রাজা এত ঘামছে কেন–শুনতে মোদের বারণ কি?'রাজা বলে, 'কেইবা শোনে যে কথাটা ঘুরছে মনে,        মগজের নানান্‌ কোণে– আনছি টেনে বাইরে তায়, সে কথাটা বলছি শোন, যতই ভাব যতই গোণ,        নাহি তার জবাব কোনো কূলকিনারা নাইরে হায়! লেখা আছে পুঁথির পাতে, 'নেড়া যায় বেলতলাতে,'        নাহি কোনো সন্দ তাতে–কিন্তু প্রশ্ন 'কবার যায়?' এ কথাটা এদ্দিনেও পারোনিকো বুঝতে কেও,        লেখেনিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায়৷ লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?        ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?' এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা        ঢিপ্‌ ক'রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার৷ হেসে বলে, 'আজ্ঞে সে কি? এতে আর গোল হবে কি?        নেড়াকে তো নিত্যি দেখি আপন চোখে পরিষ্কার— আমাদেরি বেলতলা সে নেড়া সেথা খেলতে আসে        হরে দরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার৷' নোটবই এই দেখ পেনসিল্, নোটবুক এ–হাতে, এই দেখ ভরা সব কিল্‌বিল্ লেখাতে। ভালো কথা শুনি যেই চট্‌পট্ লিখি তায়— ফড়িঙের ক'টা ঠ্যাং, আরশুলা কি কি খায়; আঙুলেতে আটা দিলে কেন লাগে চট্‌চট্, কাতুকুতু দিলে গরু কেন করে ছট্‌ফট্। দেখে শিখে প'ড়ে শুনে ব'সে মাথা ঘামিয়ে নিজে নিজে আগাগোড়া লিখে গেছি আমি এ। কান করে কট্ কট্ ফোড়া করে টন্‌টন্— ওরে রামা ছুটে আয়, নিয়ে আয় লন্ঠন। কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খট্‌কা, ঝোলাগুড় কিসে দেয়? সাবান না পট্‌কা? এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে, জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে। পেট কেন কাম্‌ড়ায় বল দেখি পার কে? বল দেখি ঝাঁজ কেন জোয়ানের আরকে? তেজপাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়? নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়? কার নাম দুন্দুভি? কার নাম অরণি? বল্‌বে কি, তোমরা তো নোটবই পড়নি। পড়ার হিসাব ফিরল সবাই ইস্কুলেতে সাঙ্গ হল ছুটি— আবার চলে বই বগলে সবাই গুটি গুটি। পড়ার পরে কার কি রকম মনটি ছিল এবার, সময় এল এখন তারই হিসেবখানা দেবার। কেউ পড়েছেন পড়ার পুঁথি, কেউ পড়েছেন গল্প, কেউ পড়েছেন হদ্দমতন, কেউ পড়েছেন অল্প। কেউ-বা তেড়ে গড়গড়িয়ে মুখস্থ কয় ঝাড়া, কেউ-বা কেবল কাঁচুমাচু মোটে না দেয় সাড়া। গুরুমশাই এসেই ক্লাসে বলেন, ‘ওরে গদাই, এবার কিছু পড়লি? নাকি খেলতি কেবল সদাই?’ গদাই ভয়ে চোখ পাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে শেষে বল্লে, ‘এবার পড়ার ঠেলা বেজায় সর্বনেশে— মামার বাড়ি যেম্নি যাওয়া অম্নি গাছে চড়া, এক্কেবারে অম্নি ধপাস্— পড়ার মতো পড়া!’ পরিবেষণ ‘পরি’পূর্বক ‘বিষ’ধাতু তাহে ‘অনট্’ ব’সে তবে ঘটায় পরিবেষণ, লেখে অমরকোষে। —অর্থাৎ ভোজের ভাণ্ড হাতে লয়ে মেলা ডেলা ডেলা ভাগ করি পাতে পাতে ফেলা। এই দিকে এসো তবে লয়ে ভোজভাণ্ড সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড! কেহ কহে “দৈ আন” কেহ হাঁকে “লুচি” কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি। কোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে হাতাহাতি গুঁতাগুঁতি দ্বন্দরণে মাতে। কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা— অনাহারে কতধারে হল প্রাণ হত্যা। কোনো প্রভু হস্তিদেহ ভুঁড়িখানা ভারী উর্ধ্ব হতে থপ্ করি খাদ্য দেন্ ছাড়ি।কোনো চাচা অন্ধপ্রায় (‘মাইনাস কুড়ি’) ছড়ায় ছোলার ডাল পথঘাট জুড়ি। মাতব্বর বৃদ্ধ যায় মুদি চক্ষু দুটি, “কারো কিছু চাই” বলি তড়্ বড়্ ছুটি— সহসা ডালের পাঁকে পদার্পণ মাত্রে হুড়্ মুড়্ পড়ে কার নিরামিষ পাত্রে। বীরোচিত ধীর পদে এসো দেখি ত্রস্তে— ঐ দিকে খালি পাত, চল হাঁড়ি হস্তে।তবে দেখো, খাদ্য দিতে অতিথির থালে দৈবাৎ না ঢোকে কভু যেন নিজ গালে! ছুটো নাকো ওরকম মিছে খালি হাতে দিয়ো না মাছের মুড়া নিরামিষ পাতে। অযথা আক্রোশে কিম্বা অন্যায় আদরে ঢেলো না অম্বল কারো নূতন চাদরে। বোকাবৎ দন্তপাটি করিয়া বাহির কোরো না অকারণে কৃতিত্ব জাহির। পাকাপাকি আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে, কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে। রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে। ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে। হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে, জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে। লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে? বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে! কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টন্‌টন্- কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠন্‌ঠন্ রাঁধুনী বসিয়া পাকে পাক দেয় হাঁড়িতে, সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে। পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে। দুহাতে পাকালে গোফঁ তবু নাহি পাকে সে। পাগলা দাশু আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহাদের মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে দাশুকে চিনিয়া ফেলে। সেবার এক নতুন দারোয়ান আসিল, একেবারে আন্‌‌কোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই আন্দাজে ঠিক করিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চাল-চলনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু 'ছিট' আছে। তাহার চোখ দুটি গোল গোল, কান দুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় একবস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়— ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ডু তাহে ভারি যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারি।সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত পা ছোঁড়ার ভঙ্গী দেখিয়া হঠাৎ কেন জানি চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তাহার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত যে, আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।'দাশু' অর্থাৎ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের ইস্কুলে ভরতি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের 'ক্লাশের ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশোনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি কথার মানে জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু তাহাকে খামখা দুকথা শুনাইয়া বলিল, "আমার বুঝি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই ? আজ একে ইংরাজি বোঝাব, কাল ওর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আর একজন আসবেন আর এক ফরমাইস নিয়ে— ঐ করি আর কি !" দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, "তুমি তো ভারি ছ্যাঁচড়া ছোটলোক !" জগবন্ধু পণ্ডিত মশায়ের কাছে নালিশ করিল, "ঐ নতুন ছেলেটা আমায় গালাগালি দিচ্ছে।" পণ্ডিত মহাশয় দাশুকে এমনি ধমক দিয়া দিলেন যে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।আমাদের ইংরাজি পড়াইতেন বিষ্টুবাবু। জগবন্ধু তাঁহার প্রিয় ছাত্র। পড়াইতে পড়াইতে যখনই তাঁহার বই দরকার হয়, তিনি জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় 'গ্রামার' চাহিলেন, জগবন্ধু তাড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া 'গ্রামার' খানা বাহির করিয়া দিল। মাস্টার মহাশয় বইখানি খুলিয়াই হঠাৎ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "বইখানা কার ?" জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, "আমার"। মাস্টার মহাশয় বলিলেন, "হুঁ— নতুন সংস্করণ বুঝি ? বইকে-বই একেবারে বদলে গেছে।" এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন— 'যশোবন্ত দারোগা— লোমহর্ষক ডিটেকটিভ নাটক।' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। মাস্টার মহাশয় বিকট রকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, "এই সব জ্যাঠামি বিদ্যে শিখছ বুঝি ?" জগবন্ধু আম্‌তা আম্‌তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মাস্টার মহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, "থাক্‌ থাক্‌, আর ভালমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই— ঢের হয়েছে।" লজ্জায় অপমানে জগবান্ধুর দুই কান লাল হইয়া উঠিল— আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটিও দাশু ভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টাতামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অপ্রীতিকর সমালোচনা করিতাম। তাহাতে একদিনও তাহাকে বিরক্ত হইতে দেখি নাই। এক এক সময়ে সে নিজেই আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত। একদিন সে বলিল, "ভাই, আমাদের পাড়ায় যখন কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস ?" আমরা বলিলাম, "খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি ?" সে বলিল, "তা নয়। যখন আমতত্ত্ব শুকোতে দেয়, আমি সেইখানে ছাদের উপর বার দুয়েক চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই, ত্রিসীমানার যত কাক সব ত্রাহি ত্রাহি করে ছুটে পালায় কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।"একবার সে হঠাৎ পেন্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢল্‌ঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং তাহার কাছে ভারি একটা ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, "পেন্টেলুন পরেছিস্‌ কেন ?" দাশু এক গাল হাসিয়া বলিল, "ভালো ইংরাজি শিখব ব'লে।" আর একবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না, তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারে নাই, একথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টার সাহেব যখন ইস্কুল দেখিতে আসেন, তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য চিৎকার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমত শাস্তি পাইতাম, কিন্তু দাশু 'পাগলা' বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।একবার ছুটির পরে দাশু অদ্ভুত এক বাক্স লইয়া ক্লাসে হাজির হইল। মাস্টার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, "কি দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি আছে ?" দাশু বলিল, "আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।" জিনিসপত্রটা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটা তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, "খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।" তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতর দিয়া কি যেন দেখিল, এবং 'ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড় বিড় করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম— অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, "ওটা ওর টিফিনের বাক্স— ওর মধ্যে খাবার আছে।" কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, "ওটা বোধ হয় ওর মানি-ব্যাগ— ওর মধ্যে টাকা পয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়। আর একজন বলিল, "টাকা পয়সার জন্য অত বড় বাক্স কেন ? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি ?"একদিন টিফিনের সময় দাশু হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া, বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, "ওটা এখন তোমার কাছে রাখো, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দারোয়ানের কাছে দিও।" এই বলিয়া বাক্সটি দারোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উৎসাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন দারোয়ানটা একটু তফাৎ গেলেই হয়। খানিক বাদে দারোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া, কতকগুলি বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, দারোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র, আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তাহার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি বাক্সের মধ্যে বেশ ভারি একটা কাগজের পোঁটলা ন্যাকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখা গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স— তাহার ভিতর আর একটা ছোট পোঁটলা। সেটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার এক পিঠে লেখা, 'কাঁচকলা খাও' আর একটি পিঠে লেখা 'অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো নয়।' দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, "ছোকরা আচ্ছা যা হোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।" আর একজন বলিল, "যেমন ভাবে বাঁধা ছিল তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টেরও না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তাহলে সে নিজেই জব্দ হবে।" আমি বলিলাম, "বেশ কথা। ও আস্‌‌লে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বলো আর ওর মধ্যে কি আছে, সেটা বার বার করে জানতে চেয়ো।" তখন আমরা তাড়াতাড়ি কগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শোনা গেল— চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপরে বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপি চুপি তামাশা দেখিতেছিল। তাখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দারোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময় বাহিরে যাওয়ার ভান করা এ সমস্ত তাহার শয়তানি। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই সে মিছিমিছি এ কয়দিন ক্রমাগত একটা বাক্স বহিয়া বেড়াইতেছে।সাধে কি বলি 'পাগলা দাশু ?' পালোয়ান খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতী লোফেন যখন তখন, দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার গঠন। একদিন এক গুন্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারল বেগে- ভাঙল সে বাঁশ শোলার মত মট্ ক'রে তার কনুই লেগে। এইত সে দিন রাস্তা দিয়ে চল্‌‌‌তে গিয়ে দৈব বশে, উপর থেকে প্রকান্ড ইট পড়্ল তাহার মাথায় খ'সে। মুন্ডুতে তার যেম্‌‌নি ঠেকা অম্‌‌নি সে ইট এক নিমিষে গুঁড়িয়ে হ'ল ধুলোর মত, ষষ্ঠি চলেন মুচকি হেসে। ষষ্ঠি যখন ধমক হাঁকে কাঁপ্‌‌‌তে থাকে দালান বাড়ী, ফুঁয়ের জোরে পথের মোড়ে উল্টে পড়ে গরুর গাড়ী। ধুম্‌‌সো কাঠের তক্তা ছেঁড়ে মোচড় মেরে মুহূর্তেকে, একশো জালা জল ঢালে রোজ স্নানের সময় পুকুর থেকে। সকাল বেলার জল পানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া, সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া । দুপুর হ'লে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্‌‌চি ভ'রে, বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে। বিকাল বেলা খায়না কিছু গন্ডা দশেক মন্ডা ছাড়া, সন্ধ্যা হলে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া । রাত্রে সে তার হাত পা টেপায় দশটি চেলা মজুত থাকে, দুম্‌দুমাদুম্ সবাই মিলে মুগুর দিয়ে পেটায় তাকে। বললে বেশি ভাব্‌‌বে শেষে এসব কথা ফেনিয়ে বলা- দেখবে যদি আপন চোখে যাওনা কেন বেনিয়াটোলা। প্যাঁচা আর প্যাঁচানী প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী,       খাসা তোর চ্যাঁচানি শুনে শুনে আন্‌মন       নাচে মোর প্রাণমন! মাজা–গলা চাঁচা–সুর       আহলাদে ভরপুর! গলা–চেরা ধমকে       গাছ পালা চমকে, সুরে সুরে কত প্যাঁচ       গিট্‌কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্! যত ভয় যত দুখ       দুরু দুরু ধুক্ ধুক্, তোর গানে পেঁচি রে       সব ভুলে গেছি রে, চাঁদমুখে মিঠে গান       শুনে ঝরে দু'নয়ান৷ ফসকে গেল দেখ বাবাজি দেখবি নাকি দেখরে খেলা দেখ চালাকি, ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড়্ পড়্ পড়্ পড়বি পাখি - ধপ্! লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক করে যাই তীর ধনুকে, ছাড়ব সটান উর্ধ্বমুখে হুশ করে তোর লাগবে বুকে - খপ্! গুড়্ গুড়্ গুড়্ গুড়িয়ে হামা খাপ্ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা এইবার বাণ চিড়িয়া নামা - চট্! ঐ যা! গেল ফস্কে ফেঁসে - হেই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে? ঘ্যাচঁ করে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্‌ল কি বাণ ছটকে এসে- ফট্? বড়াই গাছের গোড়ায় গর্ত করে ব্যাং বেঁধেছেন বাসা, মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গান ধরেছেন খাসা। রাজার হাতি হাওদা -পিঠে হেলে দুলে আসে- বাপরে ব'লে ব্যাং বাবাজি গর্তে ঢোকেন ত্রাসে! রাজার হাতি মেজাজ ভারি হাজার রকম চাল ; হঠাৎ রেগে মটাং করে ভাঙল গাছের ডাল। গাছের মাথায় চড়াই পাখি অবাক হ'য়ে কয়- বাসরে বাস! হাতির গায়ে এমন জোরও হয়! মুখ বাড়িয়ে ব্যাং বলে, ভাই তাইত তোরে বলি- "আমরা, অর্থাৎ চার-পেয়েরা, এন্মি ভাবেই চলি"।। বদ্যি বুড়ো শুন্‌ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে , সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে? শুন্‌ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে ? চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে ? চলতে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভুয়েঁর পরে ঠেকে? কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে? শোয় নাকি সে মুন্ডুটাকে শিয়র পানে দিয়ে? হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল না দেখি গিয়ে! বন্দনা নমি সত্য সনাতন নিত্য ধনে, নমি ভক্তিভরে নমি কায়েমনে। নমি বিশ্বচরাচর লোকপতে নমি সর্বজনাশ্রয় সর্বগতে। নমি সৃষ্টি-বিধারণ শক্তিধরে, নমি প্রাণপ্রবাহিত জীব জড়ে। তব জ্যোতিবিভাসিত বিশ্বপটে মহাশুন্যতলে তব নাম রটে। কত সিন্ধুতরঙ্গিত ছন্দ ভরে কত স্তব্ধ হিমাচল ধ্যান করে। কত সৌরভ সঞ্চিত পুষ্পদলে কত সূর্য বিলুন্ঠিত পাদতলে। কত বন্দনঝঙ্কৃত ভক্তচিতে নমি বিশ্ব বরাভয় মৃত্যুজিতে।  (অন্যান্য ছড়াসমূহ) বর্ষ গেল বর্ষ এল বর্ষ গেল বর্ষ এল গ্রীষ্ম এলেন বাড়ি- পৃথ্বী এলেন চক্র দিয়ে এক বছরের পাড়ি । সত্যিকারের এই পৃথিবীর বয়স কেবা জানে, লক্ষ হাজার বছর ধরে চল্‌ছে একই টানে । আপন তালে আকাশ পথে আপনি চলে বেগে, গ্রীষ্মকালের তপ্তরোদে বর্ষাকালের মেঘে, শরৎকালের কান্নাহাসি হাল্কা বাদল হাওয়া, কুয়াশা-ঘেরা পর্দা ফেলে হিমের আসা যাওয়া- শীতের শেষে রিক্ত বেশে শূন্য করে ঝুলি, তার প্রতিশোধ ফুলে ফলে বসন্তে লয় তুলি । না জানি কোন নেশার ঝোঁকে যুগযুগান্ত ধরে, ছয়টি ঋতু দ্বারে দ্বারে পাগল হয়ে ঘোরে ! না জানি কোন ঘূর্ণীপাকে দিনের পর দিন, এমন ক'রে ঘোরায় তারে নিদ্রাবিরামহীন ! কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম রাখে লক্ষযুগের প্রথা, না জানি তার চাল চলনের হিসাব রাখে কোথা ! বর্ষ শেষ শুন রে আজব কথা, শুন বলি ভাইরে- বছরের আয়ু দেখ বেশিদিন নাই রে । ফেলে দিয়ে পুরাতন জীর্ণ এ খোলসে নূতন বরষ আসে, কোথা হতে বল সে ! কবে যে দিয়েছে চাবি জগতের যন্ত্রে, সেই দমে আজও চলে না জানি কি মন্ত্রে ! পাকে পাকে দিনরাত ফিরে আসে বার বার, ফিরে আসে মাস ঋতু- এ কেমন কারবার । কোথা আসে কোথা যায় নাহি কোন উদ্দেশ, হেসে খেলে ভেসে যায় কত দূর দূর দেশ । রবি যায় শশী যায় গ্রহ তারা সব যায়, বিনা কাঁটা কম্পাসে বিনা কল কব্জায় । ঘুরপাকে ঘুরে চলে, চলে কত ছন্দে, তালে তালে হেলে দুলে চলে রে আনন্দে । বর্ষার কবিতা কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য, আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য। কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে, হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে। সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে, ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখ খানা ফ্যাকাশে। বিনা কাজে ঘরে বাঁধা কেটে যায় বেলাটা, মাটি হল ছেলেদের ফুটবল খেলাটা। আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি, ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি। কোনখানে হাটু জল কোথা ঘন কর্দম - চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্‌দম। ব্যাঙেদের মহাসভা আহ্লাদে গদ্‌গদ্, গান করে সারারাত অতিশয় বদ্‌খদ্। বলব কি ভাই বল্‌ব কি ভাই হুগ্‌লি গেলুম বলছি তোমায় চুপি চুপি- দেখ্‌তে পেলাম তিনটে শুয়োর মাথায় তাদের নেইকো টুপি।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) বাবু অতি খাসা মিহি সূতি ফিনফিনে জামা ধুতি, চরণে লপেটা জুতি জরিদার । এ হাতে সোনার ঘড়ি, ও হাতে বাঁকান ছড়ি, আতরের ছড়াছড়ি চারিধার । চক্‌চকে চুল ছাঁটা তায় তোফা টেরিকাটা- সোনার চশমা আঁটা নাসিকায় । ঠোঁট দুটি এঁকে বেঁকে ধোঁয়া ছাড়ে থেকে থেকে, হালচাল দেখে দেখে হাসি পায় ।ঘোষেদের ছোট মেয়ে পিক্‌ ফেলে পান খেয়ে, নিচু পানে নাহি চায় হায়রে । সেই পিক থ্যাপ ক'রে লেগেছে চাদর ভরে দেখে বাবু কেঁদে মরে যায়রে । ওদিকে ছ্যাকরাগাড়ি ছুটে চলে তাড়াতাড়ি ছিট্‌কিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ঘোলাজল । সহসা সে জল লাগে জামার পিছন বাগে, বাবু করে মহারাগে কোলাহল ।। বাবুরাম সাপুড়ে বাবুরাম সাপুড়ে,              কোথা যাস্‌ বাপুরে? আয় বাবা দেখে যা,              দুটো সাপ রেখে যা! যে সাপের চোখ্‌ নেই,              শিং নেই নোখ্‌ নেই, ছোটে নাকি হাঁটে না,              কাউকে যে কাটে না, করে নাকো ফোঁস ফাঁস,              মারে নাকো ঢুঁশ্‌ ঢাঁশ্‌, নেই কোন উৎপাত,              খায় শুধু দুধভাত-- সেই সাপ জ্যাম্ত              গোটা দুই আনত? তেড়ে মেরে ডাণ্ডা              ক'রে দেই ঠাণ্ডা। বিচার ইঁদুর দেখে মাম্‌দো কুকুর বল্‌লে তেড়ে হেঁকে- 'বলব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে। আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা, আয় না খেলি দুইজনাতে মোকদ্দমা খেলা । তুই হবি চোর তোর নামেতে করব নালিশ রুজু'- 'জজ্ কে হবে?' বল্লে ইঁদুর ,বিষম ভয়ে জুজু, 'কোথায় উকিল প্যায়দা পুলিশ , বিচার কিসে হবে?' মাম্‌দো বলে 'তাও জানিসনে ? শোন বলে দেই তবে! আমিই হব উকিল হাকিম , আমিই হব জুরি, কান ধরে তোর বলব ব্যাটা, ফের করেছিস চুরি? সটান দেব ফাসির হুকুম অমনি একেবারে- বুঝবি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে।' বিজ্ঞান শিক্ষা আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি 'ফুটোস্কোপ' দিয়ে, দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে। কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা, কতখানি ভস্ ভস্ ঘিলু, কতখানি ঠক্‌ঠকে ফাঁপা। মন তোর কোন দেশে থাকে, কেন তুই ভুলে যাস্ কথা— আয় দেখি কোন ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তোর কোথা। টোল–খাওয়া ছাতাপড়া মাথা, ফাটা–মতো মনে হয় যেন, আয় দেখি বিশ্লেষ ক'রে–চোপ্‌রাও ভয় পাস্ কেন? কাৎ হয়ে কান ধ'রে দাঁড়া, জিভখানা উল্‌টিয়ে দেখা, ভালো ক'রে বুঝে শুনে দেখি–বিজ্ঞানে যে–রকম লেখা। মুণ্ডুতে 'ম্যাগনেট' ফেলে, বাঁশ দিয়ে 'রিফ্‌লেক্‌ট' ক'রে, ইঁট দিয়ে 'ভেলসিটি' ক'ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে। বিবিধ ১ করে তাড়াহুড়ো বিষম চোট্‌ কিনেছি হ্যাট্‌ পরেছি কোট্‌, পেয়েছি passage এসেছে boat, বেঁধেছি তল্পি তুলেছি মোট্‌, বলেছে সবাই, "তা হলে ওঠ্‌, আসান্‌ এবার বিলেতে ছোট্‌।" তাই সভা হবে, বিদায় ভোট্‌, কাঁদ কাঁদ ভাবে ফুলিয়ে ঠোট্‌ হেথায় সকলে করিবে জোট্‌ (প্রোগ্রামটুকু করিও Note)।প্রোগ্রাম- শুক্র সন্ধ্যা সঠিক সাত- আহার, আমোদ, উল্কাপাত।২ আসছে কাল, শনিবার অপরাহ্ণ সাড়ে চার, আসিয়া মোদের বাড়ি, কৃতার্থ করিলে সবে টুলুপুষু খুশি হবে।৩ (হুবহু) নকল করি     লেখাটি আমার সভায় (বাহবা) নিল    লজ্জা নাহি তার। ধনীরা (খামখা) কেন     ধন লয়ে যায়। যে ধন (বিলাবি) যেন     দুখী জনে পায়।[বন্ধনীর ভিতরের শব্দগুলি যে-দিক থেকেই পড়া যাক অপরিবর্তিত থাকে। ]৪ লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী। ...৫ আমরা দিশি পাগলার দল, দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল, (যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি (তাহোক) এতে দেশেরই মঙ্গল।৬ আজকে আমার প্রদীপখানি ম্লান হয়েছে আঁধার মাঝে আজকে আমার প্রাণের সুরে ক্ষণে ক্ষণে বেসুর বাজে আজকে আমার আশার বাণী মৌন আছে সংশয়েতে                                                 ...[অসমাপ্ত] ৭ সৃষ্টি যখন সদ্য কাঁচা, অনেকখানি ফাঁকা বিশ্বকর্মা নিলেন ছুটি একটি বছর ছাঁকা। ঘুম জমে না, পায় না ক্ষিদে, শরীর কেমন করে, ডাক্তারেরা দিলেন হুকুম বিশ্রামেরি তরে। আইন মাফিক নোটিশ নোটিশ দিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে গেলেন তিনি মর্তলোকে স্বাস্থ্য লাভের আশে।৮ বৃষ্টি বেগ ভরে রাস্তা গেল ডুবিয়ে ছাতা কাঁধে, জুতা হাতে, নোংরা ঘোলা কালো,     হাঁটু জল ঠেলি চলে যত লোকে। রাস্তাতে চলা দুষ্কর মুস্কিল বড় অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, বিচ্ছিরি রাস্তা,     ধরণী মহা-দুর্গম কর্দম-গ্রস্তা     যাওয়া দুষ্কর মুস্কিল রে ইস্কুলে, সর্দি জ্বর, বৃদ্ধি বড়, নিত্যি লোকে বদ্যি ডেকে     তিক্ত বড়ি খায়। বিষম কাণ্ড কর্তা চলেন, গিন্নী চলেন, খোকাও চলেন সাথে, তড়্‌বড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শুতে যাচ্ছেন রাতে । তেড়ে হন্‌হন্‌ চলে তিনজন যেন পল্টন চলে, সিঁড়ি উঠ্‌‌তেই, একি কাণ্ড ! এ আবার কি বলে ! ল্যাজ লম্বা, কান গোল্‌ গোল্‌, তিড়িং বিড়িং ছোটে, চোখ্‌ মিট্‌মিট্‌, কুটুস্‌ কাটুস্‌- এটি কোন্‌জন বটে ! হেই ! হুস্‌ ! হ্যাস্‌ ! ওরে বাস্‌‌রে মতলবখানা কিরে, করলে তাড়া যায় না তবু, দেখ্‌‌ছে আবার ফিরে । ভাবছে বুড়ো, করবো গুঁড়ো ছাতার বাড়ি মেরে, আবার ভাবে ফস্‌‌কে গেলে কাম্‌‌ড়ে দেবে তেড়ে । আরে বাপ্‌‌রে ! বস্‌ল দেখ দুই পায়ে ভর ক'রে, বুক দুর দুর বুড়ো ভল্লুর, মোমবাতি যায় প'ড়ে । ভীষণ ভয়ে দাঁত কপাটি তিন মহাবীর কাঁপে, গড়িয়ে নামে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে । বিষম চিন্তা মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার— সবাই বলে “মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!” অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব? বলবে সবাই, “মুখ্যু ছেলে”, বলবে আমায় “গো-গর্দভ!” কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর? বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর? গাধার কেন শিং থাকে না? হাতির কেন পালক নেই? গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই-ধেই? সোডার বোতল খুল্লে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে? কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে? ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়? মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন “পাগোল” কয়? কতই ভাবি এ-সব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই? বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই। বিষম ভোজ “অবাক কান্ড!” বল্‌লে পিসী, “এক চাঙাড়ি মেঠাই এল- এই ছিল সব খাটের তলায়, এক নিমিষে কোথায় গেল?” সত্যি বটে বললে খুড়ী, “আনলো দু’সের মিঠাই কিনে- হঠাৎ কোথায় উপসে গেল? ভেল্কিবাজি দুপুর দিনে?” “দাঁড়াও দেখি” বল্‌লে দাদা, “কর্‌ছি আমি এর কিনারা- কোথায় গেল পটলা ট্যাঁপা – পাচ্ছিনে যে তাদের সাড়া?” পর্দাঘেরা আড়াল দেওয়া বারান্দাটার ঐ কোণেতে চল্‌ছে কি সব ফিস্ ফ্সি্ ফিস্ শুনলে দাদা কানটি পেতে। পটলা ট্যাঁপা ব্যস্ত দুজন ট্প্‌টপাটপ্ মিঠাই ভোজে, হঠাৎ দেখে কার দুটো হাত এগিয়ে তাদের কানটি খোঁজে। কানের উপর প্যাঁচ্ ঘুরাতেই দু চোখ বেয়ে অশ্রু ছোটে, গিলবে কি ছাই মুখের মিঠাই ,কান বুঝি যায় টানের চোটে। পটল বাবুর হোম্‌রা গলা মিল্‌ল ট্যাঁপার চিকন সুরে জাগ্‌ল করুন রাগরাগিণী বিকট তানে আকাশ জুড়ে।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) বুঝবার ভুল এমনি পড়ায় মন বসেছে, পড়ার নেশায় টিফিন ভোলে। সাম্‌নে গিয়ে উৎসাহ দেই মিষ্টি দুটো বাক্য বলে।পড়্‌ছ বুঝি? বেশ বেশ বেশ! এক মনেতে পড়্‌লে পরে "লক্ষ্মীছেলে-- সোনার ছেলে" বলে সবাই আদর করে।এ আবার কি? চিত্র নাকি? বাঁদর পাজি লক্ষ্মীছাড়া-- আমায় নিয়ে রংতামাসা! পিটিয়ে তোমায় কর্‌ছি খাড়া। বুঝিয়ে বলা ও শ্যামাদাস! আয়তো দেখি, বোস তো দেখি এখেনে, সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখে নে৷ জ্বর হয়েছে? মিথ্যে কথা! ওসব তোদের চালাকি— এই যে বাবা চেঁচাচ্ছিলি, শুনতে পাইনি? কালা কি? মামার ব্যামো? বদ্যি ডাকবি? ডাকিস না হয় বিকেলে না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে! আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব— না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব৷ কোন্ কথাটা? তাও ভুলেছিস্? ছেড়ে দিছিস্ হাওয়াতে? কি বলছিলেম পরশু রাতে বিষ্টু বোসের দাওয়াতে? ভুলিসনি তো বেশ করেছিস্, আবার শুনলে ক্ষেতি কি? বড় যে তুই পালিয়ে বেড়াস্, মাড়াস্‌নে যে এদিক্‌ই! বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন? বোস্ তাহলে নিচুতেই— আজকালের এই ছোক্‌রাগুলোর তর্ সয়না কিছুতেই৷ আবার দেখ! বসলি কেন? বইগুলো আন্ নামিয়ে— তুই থাক্‌তে মুটের বোঝা বইতে যাব আমি এ? সাবধানে আন্, ধরছি দাঁড়া–সেই আমাকেই ঘামালি, এই খেয়ছে! কোন্ আক্কেলে শব্দকোষটা নামালি? ঢের হয়েছে! আয় দেখি তুই বোস্ তো দেখি এদিকে— ওরে গোপাল গোটাকয়েক পান দিতে বল্ খেঁদিকে৷    বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে, অর্থাৎ কিনা লাগ্‌ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে— গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক'রে, রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে৷ অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্, রোদ পড়েছে ঘাসেতে, এই মনে কর্, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে— আবার দেখ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি? আকাশপানে তাকাস্ খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি? কি বল্লি তুই? এ সব শুধু আবোল তাবোল বকুনি? বুঝতে হলে মগজ লাগে, বলেছিলাম তখুনি৷ মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে, যায় কি দেওয়া কোন কথা তার ভিতেরে ঢুকিয়ে?— ও শ্যামাদাস! উঠলি কেন? কেবল যে চাস্ পালাতে! না শুনবি তো মিথ্যে সবাই আসিস্ কেন জ্বালাতে? তত্ত্বকথা যায় না কানে যতই মরি চেঁচিয়ে— ইচ্ছে করে ডান্‌পিটেদের কান ম'লে দি পেঁচিয়ে৷ বুড়ীর বাড়ী গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি, ঝুরঝুরে প'ড়ো ঘরে থুর্‌থুরে বুড়ী৷ কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো, মিট্‌মিটে ঘোলা চোখ, পিট খানা কুলো৷ কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর—আঠা দিয়ে সেঁটে, সূতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে৷ ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে, খক্‌ খক্ কাশি দিলে ঠক্ ঠক্ নড়ে৷ ডাকে যদি ফিরিওয়ালা, হাঁকে যদি গাড়ী, খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী৷ বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত, ঝাঁট দিলে ঝরে প'ড়ে কাঠকুটো যত৷ ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্‌লায় ভিজে, একা বুড়ী কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে৷ মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি, থুর্‌থুরে বুড়ী তার ঝুর্‌ঝুরে বাড়ী৷৷ বেজায় খুশি বাহবা বাবুলাল ! গেলে যে হেসে ! বগলে কাতুকুতু কে দিল এসে ? এদিকে মিটিমিটি দেখ কি চেয়ে ? হাসি যে ফেটে পড়ে দু'গাল বেয়ে ! হাসে যে রাঙা ঠোঁট দন্ত মেলে চোখের কোণে কোণে বিজলী খেলে । হাসির রসে গ'লে ঝরে যে লালা কেন এ খি-খি-খি-খি হাসির পালা ? যে দেখে সেই হাসে হাহাহা হাহা বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা ! বেজায় রাগ ও হাড়্‌গিলে, হাড়্‌গিলে ভাই, খাপ্পা বড্ড আজ! ঝগড়া কি আর সাজে তোমার? এই কি তোমার যোগ্য কাজ? হোম্‌রা চোম্‌রা মান্য তোমরা বিদ্যেবুদ্ধি মর্যাদায় ওদের সঙ্গে তর্ক করছ- নাই কি কোন লজ্জা তায়? জান্‌ছ নাকি বলছে ওরা? 'কিচির মিচির কিচ্চিরি,' অর্থাৎ কিনা, তোমার নাকি চেহারাটা বিচ্ছিরি! বল্‌ছে আচ্ছা বলুক, তাতে ওদেরই তো মুখ ব্যথা, ঠ্যাঁটা লোকের শাস্তি যত, ওরাই শেষে ভুগবে তা। ওরা তোমায় খোঁড়া বল্‌ছে? বেয়াদব তো খুব দেখি! তোমার পায়ে বাতের কষ্ট- ওরা সেসব বুঝবে কি? তাই বলে কি নাচবে রাগে? উঠ্‌বে চটে চট্‌ ক'রে? মিথ্যে আরো ত্যাক্ত হবে ওদের সাথে টক্করে। ঐ শোন কি বলছে আবার, কচ্ছে কত বক্তৃতা- বলছে তোমার ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢালবে- সত্যি তা? চড়াই পাখির বড়াই দেখ তোমায় দিচ্ছে টিট্‌কিরি- বল্‌ছে, তোমার মিষ্টি গলায় গান ধরতে গিট্‌কিরি। বল্‌ছে, তোমার কাঁথাটাকে 'রিফুকর্ম' করবে কি? খোঁড়া ঠ্যাঙে নামবে জলে? আর কোলা ব্যাঙ করবে কি? আর চ'টো না, আর শুনো না, ঠ্যাঁটা মুখের টিপ্পনি, ওদের কথায় কান দিতে নেই, স'রে পড় এক্ষনি। বেশ বলেছ এসব কথা শুনলে তোদের লাগবে মনে ধাঁধাঁ, কেউ বা বুঝে পুরোপুরি, কেউ বা বুঝে আধা।কারে বা কই কিসের কথা, কই যে দফে দফে, গাছের 'পরে কাঁঠাল দেখে তেল মেখ না গোঁফে।একটি একটি কথায় যেন সদ্য দাগে কামান, মন বসনের ময়লা ধুতে তত্ত্বকথাই সাবান।বেশ বলেছ, ঢের বলেছ, ঐখেনে দাও দাঁড়ি, হাটের মাঝে ভাঙ্‌বে কেন বিদ্যে বোঝাই হাঁড়ি! বোম্বাগড়ের রাজা কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা- ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা? রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা? পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা? কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে? জোছ‌্না রাতে সবাই কেন আলতা মাথায় চোখে? ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে? টাকের পরে পন্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে। রাত্রে কেন ট্যাঁক্‌ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে। কেন রাজার বিছ্‌না পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে? সভায় কেন চেঁচায় রাজা "হুক্কা হুয়া" বলে? মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় বসে রাজার কোলে?সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি? কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী? রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে? এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে? ভয় পেয়োনা ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না— সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না। মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই, তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই! মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না— জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না? এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন, আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন। হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না? মুগুর আমার হাল্‌কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না। অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা? বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা! আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে— সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে। ভারি মজা এই নেয়েছ, ভাত খেয়েছ, ঘন্টাখানেক হবে- আবার কেন হঠাৎ হেন নামলে এখন টবে? একলা ঘরে ফুর্তি ভরে লুকিয়ে দুপুরবেলা, স্নানের ছলে ঠান্ডা জলে জল ছপ্‌ছপ্ খেলা। জল ছিটিয়ে, টব পিটিয়ে, ভাবছ, 'আমোদ ভারি- কেউ কাছে নাই, যা খুশি তাই করতে এখন পারি।' চুপ্ চুপ্ চুপ্- ঐ দুপ্ দুপ্! ঐ জেগেছে মাসি, আসছে ধেয়ে, শুনতে পেয়ে দুষ্ট মেয়ের হাসি। ভাল ছেলের নালিশ মাগো! প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা           গুড় মাখিয়ে আরাম ক'রে বসে - আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,           দুইখানা সেই আপনি খেল ক'ষে! তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে           কিল মেরেছি 'হ্যাংলা ছেলে' বলে- অম্‌‌নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে           গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!মাগো! এম্‌‌নিধারা শয়তানি তার, খেলতে গেলাম দুপুরে,           বল্‌ল, 'এখন খেলতে আমার মানা'- ঘন্টাখানেক পরেই দেখি দিব্যি ছাতের উপরে           ওড়াচ্ছে তার সবুজ ঘুড়ি খানা। তাইতে আমি দৌড়ে গিয়ে ঢিল মেরে আর খুঁচিয়ে           ঘুড়ির পেটে দিলাম করে ফুটো- আবার দেখ বুক ফুলিয়ে সটান মাথা উঁচিয়ে           আনছে কিনে নতুন ঘুড়ি দুটো! ভালরে ভাল দাদা গো! দেখছি ভেবে অনেক দূর এই দুনিয়ার সকল ভাল, আসল ভাল নকল ভাল, সস্তা ভাল দামীও ভাল, তুমিও ভাল আমিও ভাল, হেথায় গানের ছন্দ ভাল, হেথায় ফুলের গন্ধ ভাল, মেঘ-মাখানো আকাশ ভাল, ঢেউ- জাগানো বাতাস ভাল, গ্রীষ্ম ভাল বর্ষা ভাল, ময়লা ভাল ফরসা ভাল, পোলাও ভাল কোর্মা ভাল, মাছপটোলের দোলমা ভাল, কাঁচাও ভাল পাকাও ভাল, সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল, কাঁসিও ভাল ঢাকও ভাল, টিকিও ভাল টাক্ও ভাল, ঠেলার গাড়ী ঠেলতে ভাল, খাস্তা লুচি বেলতে ভাল, গিট্কিরি গান শুনতে ভাল, শিমুল তুলো ধুনতে ভাল, ঠান্ডা জলে নাইতে ভাল। কিন্তু সবার চাইতে ভাল- পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়। ভূতুড়ে খেলা পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে৷ কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত পা নেড়ে উল্লাসে, আহলাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে৷ শুনতে পেলাম ভূতের মায়ের মুচকি হাসি কট্‌কটে— দেখছে নেড়ে ঝুন্‌টি ধ'রে বাচ্চা কেমন চট্‌পটে৷ উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে, খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে! যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা, আদর করে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা৷ বলছে আবার, 'আয়রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে, দেখনা ফিরে প্যাখনা ধরে হুতোম–হাসি মুখ করে!ওরে আমার বাঁদর–নাচন আদর–গেলা কোঁত্‌কা রে! অন্ধবনের গন্ধ–গোকুল, ওরে আমার হোঁত্‌কা রে! ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বিষ্টি রে, ওরে আমার হামান–ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে৷ ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার, ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার৷ ওরে আমার গোবরা গণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্‌ রে, ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে—' এই না ব'লে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্‌ ক'রে, কোথায় বা কি, ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট্‌ ক'রে! মনের মতন কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি, বৃদ্ধ বছর উধাও হ'ল ভূতের মুলুক খুঁজি। নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে, বল্‌ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে? আর কি দিব?- মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ, সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান। মন্ডা ক্লাবের কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র ১ সম্পাদক বেয়াকুব কোথা যে দিয়েছে ডুব- এদিকেতে হায় হায় ক্লাবটি তো যায় যায়।তাই বলি সোমবারে মদগৃহে গড়পারে দিলে সবে পদধূলি ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।রকমারি পুঁথি কত নিজ নিজ রুচিমত আনিবেন সাথে সবে কিছু কিছু পাঠ হবেকরযোড়ে বারবার নিবেদিছে সুকুমার।২ কেউ বলেছে খাবো খাবো, কেউ বলেছে খাই সবাই মিলে গোল তুলেছে- আমি তো আর নাই।ছোটকু বলে, রইনু চুপে ক'মাস ধরে কহিল রূপে! জংলি বলে "রামছাগলের মাংস খেতে চাই।"যতই বলি "সবুর কর" - কেউ শোনে না কালা, জীবন বলে কোমর বেধে, কোথায় লুচির থালা?খোদন বলে রেগেমেগে ভীষণ রোষে বিষম লেগে- বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে হাজির যেন পাই।৩ শনিবার ১৭ ই সাড়ে পাঁচ বেলা, গড়পারে হৈ হৈ সরবতী মেলা।অতএব ঘড়ি ধরে সাবকাশ হয়ে আসিবেন দয়া করে হাসিমুখে লয়ে।সরবৎ সদালাপ সঙ্গীত - ভীতি ফাঁকি দিলে নাহি মাপ, জেনে রাখ-ইতি।৪ আমি,অর্থাৎ সেক্রেটারি, মাসতিনেক কল‌কেতা ছাড়ি যেই গিয়েছি অন্য দেশে অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া, কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া! চিন্তা নেইক গভীর বিষয় আমার প্রাণে এসব কি সয়?এখন থেকে সমঝে রাখ এ সমস্ত চলবে নাকো, আমি আবার এইছি ঘুরে তান ধরেছি সাবেক সুরে।শুনবে এস সুপ্রবন্ধ গিরিজার বিবেকানন্দ, মঙ্গলবার আমার বাসায়। (আর থেক না ভোজের আশায়) মহাভারতঃ আদিপর্ব কুরুকুলে পিতামহ ভীষ্মমহাশয় ভুবন বিজয়ী বীর, শুন পরিচয়- শান্তনু রাজার পুত্র নাম সত্যব্রত জগতে সার্থক নাম সত্যে অনুরত। স্বয়ং জননী গঙ্গা বর দিলা তাঁরে- নিজ ইচ্ছা বিনা বীর না মরে সংসারে। বুদ্বিভ্রংশ ঘটে হায় শান্তনু রাজার, বিবাহের লাগি বুড়া করে আবদার। মৎস্যরাজকন্যা আছে নামে সত্যবতী, তারে দেখি শান্তনুর লুপ্ত হল মতি। মৎস্যরাজ কহে, 'রাজা, কর অবধান, কিসের আশায় কহ করি কন্যাদান? সত্যব্রত জ্যেষ্ঠ সেই রাজ্য অধিকারী, আমার নাতিরা হবে তার আজ্ঞাচারি, রাজমাতা কভু নাহি হবে সত্যবতী, তেঁই এ বিবাহ- কথা অনুচিত অতি।' ভগ্ন মনে হস্তিনায় ফিরিল শান্তনু অনাহারে অনিদ্রয় জীর্ন তার তনু। মন্ত্রী মুখে সত্যব্রত শুনি সব কথা মৎস্যরাজপুরে গিয়া কহিল বারতা- রাজ্যে মম সাধ নাহি, করি অঙ্গীকার জন্মিলে তোমার নাতি রাজ্য হবে তার।' রাজা কহে, 'সাধুতুমি, সত্য তব বাণী, তোমার সন্তান হতে তবু ভয় মানি। কে জানে ভবিষ্যকথা, দৈবগতিধারা- প্রতিবাদী হয় যদি রাজ্যলাভে তারা?' সত্যব্রত কহে, 'শুন প্রতিজ্ঞা আমার, বংশ না রহিবে মম পৃথিবী মাঝার। সাক্ষী রহ চন্দ্র সূর্য লোকে লোকান্তরে এই জন্মে সত্যব্রত বিবাহ না করে।' শুনিয়া অদ্ভুত বাণী ধন্য কহে লোকে, স্বর্গ হতে পুষ্পধারা ঝরিল পলকে। সেই হতে সত্যব্রত খ্যাত চরাচরে ভীষণ প্রতিজ্ঞাবলে ভীষ্ম নাম ধরে। ঘুচিল সকল বাধা, আনন্দিত চিতে সত্যবতী রাণী হয় হস্তিনাপুরীতে। ক্রমে হলে বর্ষ গত শান্তনুর ঘরে জন্ম নিল নব শিশু, সবে সমাদরে। রাখিল বিচিত্রবীর্য নামটি তাহার শান্তনু মরিল তারে দিয়া রাজ্যভার। অকালে বিচিত্রবীর্য মুদিলেন আঁখি পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্র রাখি।। হস্তিরায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল। সেই কুলে জন্মি তবু দৈববশে হায় অন্ধ বলি ধৃতরাস্ট্র রাজ্য নাহি পায়। কনিষ্ঠ তাহার পাণ্ডু, রাজত্ব সে করে, পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে। জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন 'সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র' কহে সর্বজন। দ্বিতীয় সে মহাবলী ভীম নাম ধরে, পবন সমান তেজ পবনের বরে। তৃতীয় অর্জুন বীর, ইন্দ্রের কৃপায় রুপেগুণে শৌর্যেবীর্যে অতুল ধরায়। এই তিন সহোদর কুন্তীর কুমার, বিমাতা আছেন মাদ্রী দুই পুত্র তাঁর- নকুল ও সহদেব সুজন সুশীল এক সাথে পাঁচজনে বাড়ে তিল তিল। অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র তার, অভিমানী দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ সবাকার। পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই নষ্ট হয় কিসে, এই চিন্তা করে দুষ্ট জ্বলি হিংসাবিষে। হেনকালে সর্বজনে ভাসাইয়া শোকে মাদ্রীসহ পান্ডরাজা যায় পরলোকে। 'পান্ডু গেল', মনে মনে ভাবে দুর্যোধন, এই বারে যুধিষ্ঠির পাবে সিংহাসন! ইচ্ছা হয় এই দণ্ডে গিয়া তারে মারি- ভীমের ভয়েতে কিছু করিতে না পারি। আমার কৌশলে পাকে ভীম যদি মরে অনায়াসে যুধিষ্ঠিরে মারি তারপরে।' কুচক্র করিয়া তবে দুষ্ট দুর্যোধন নদীতীরে উৎসবের করে আয়োজন- একশত পাঁচ ভাই মিলি একসাথে আমোদ আহ্লাদে ভোজে মহানন্দে মাতে। হেন ফাঁকে দুর্যোধন পরম যতনে বিষের মিষ্টান্ন দেয় ভীমের বদনে। অচেতন হল ভীম বিষের নেশায়, সুযোগ বুঝিয়া দুষ্ট ধরিল তাহায়, গোপনে নদীর জলে দিল ভাসাইয়া, কেহ না জানিল কিছু উৎসবে মাতিয়া।। এদিকে নদীর জলে ডুবিয়া অতল তলে ভীমের অবশ দেহে ,কেমনে জানে না কেহ, কোথায় ঠেকিল শেষে বাসুকী নাগের দেশে। ভীমের বিশাল চাপে নাগের বসতি কাঁপে দেহ ভারে কত মরে, কত পলাইল ডরে , কত নাগ দলে বলে ভীমেরে মারিতে চলে দংশিয়া ভীমের গায় মহাবিষ ঢালে তায়। অদ্ভুত ঘটিল তাহে ভীম চক্ষু মেলি চাহে , বিষে হয় বিষক্ষয় মুহুর্তে চেতনা হয়, দেখে ভীম চারিপাশে নাগেরা ঘেরিয়া আসে দেখিয়া ভীষণ রাগে ধরি শত শত নাগে চূর্ণ করে বাহুবলে, মহাভয়ে নাগে দলে ছুটে যায় হাহাকরে বাসুকী রাজার দ্বারে। বাসুকী কহেন, 'শোন আর ভয় নাহি কোন, তুষি তারে সুবচনে আন হেথা সযতনে।' রাজার আদেশে তবে আবার ফিরিয়া সবে করে গিয়া নিবেদন বাসুকীর নিমন্ত্রণ ! শুনি ভীম কুতুহলে রাজার পুরীতে চলে , সেথায় ভরিয়া প্রাণ ,করিয়া অমৃত পান বিষের যাতনা আর কিছু না রহিল তার , মহাঘুমে ভরপুর সব ক্লান্তি হল দুর তখন বাসুকী তারে স্নেহভরে বারে বারে আশিস করিয়া তায় পাঠাইল হস্তিনায় । সেথা ভাই চারিজনে আছে শোকাকুল মনে কুন্তীর নয়নজল ঝরে সেথা অবিরল , মগন গভীর দুখে ফিরে সবে ম্লান মুখে । হেন কালে হারানিধি সহসা মিলালো বিধি বিষাদ হইল দুর জাগিল হস্তিনাপুর , উলসিত কলরবে আনন্দে মাতিল সবে।। মাসি গো মাসি মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্- হাতীর মাথায় ব্যাঙের ছাতা কাগের বাসায় বগের ডিম্ ।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) মূর্খ মাছি মাকড়সা                সান্‌-বাঁধা মোর আঙিনাতে                জাল বুনেছি কালকে রাতে,                ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা।                আয় না মাছি আমার ঘরে,                আরাম পাবি বসলে পরে,                ফরাশ পাতা দেখবি কেমন খাসা!মাছি                থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌ আর বলে না,                আন্‌কথাতে মন গলে না-                ব্যবসা তোমার সবার আছে জানা।                ঢুক্‌লে তোমার জালের ঘেরে                কেউ কোনদিন আর কি ফেরে?                বাপ্‌রে! সেথায় ঢুক্‌তে মোদের মানা।মাকড়সা                হাওয়ায় দোলে জালের দোলা                চারদিকে তার জান্‌লা খোলা                আপ্‌নি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে!                আয় না হেথা হাত পা ধুয়ে                পাখ্‌না মুড়ে থাক্‌ না শুয়ে-                ভন্‌ ভন্‌ ভন্‌ মরবি কেন উড়ে?মাছি                কাজ নেই মোর দোলায় দুলে,                কোথায় তোমার কথায় ভুলে                প্রাণটা নিয়ে টান্‌ পড়ে ভাই শেষে।                তোমার ঘরে ঘুম যদি পায়                সে ঘুম কভু ভাঙবে না হায়-                সে ঘুম নাকি এমন সর্বনেশে!মাকড়সা                মিথ্যে কেন ভাবিস্‌ মনে?                দেখ্‌না এসে ঘরের কোণে                ভাঁড়ার ভরা খাবার আছে কত!                দে-টাপাটপ ফেলবি মুখে                নাচ্‌বি গাবি থাক্‌বি সুখে                ভাবনা ভুলে বাদ্‌শা-রাজার মতো।মাছি                লোভ দেখালেই ভুলবে ভবি,                ভাবছ আমায় তেমনি লোভী!                মিথ্যে দাদা ভোলাও কেন খালি,                করব কি ছাই ভাড়ার দেখে?                প্রণাম করি আড়াল থেকে-                আজকে তোমার সেই গুড়ে ভাই বালি।মাকড়সা                নধর কালো বদন ভরে                রূপ যে কত উপচে পড়ে!                অবাক দেখি মুকুটমালা শিরে!                হাজার চোখে মানিক জ্বলে!                ইন্দ্রধনু পাখার তলে!                ছয় পা ফেলে আয় না দেখি ধীরে।মাছি                মন ফুর্‌ফুর্‌ ফুর্তি নাচে-                একটুখানি যাই না কাছে!                যাই যাই যাই- বাপ্‌রে একি বাঁধা।                ও দাদা ভাই রক্ষে কর!                ফাঁদ পাতা এ কেমন তরো।                পড়ে হাত পা হল বাঁধা।দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়                দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়                নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায়?                এমনি দশাই তার কপালে লেখা।                কথার পাকে মানুষ মেরে                মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে,                গড় করি তার অনেক তফাৎ থেকে। মেঘ সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে- আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে । মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে- ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে । সন্ধ্যা সকাল মেঘের মেলা- কুলকিনারা ছাড়ি রং বেরঙের পাল তুলে দেয় দেশবিদেশে পাড়ি । মাথায় জটা, মেঘের ঘটা আকাশ বেয়ে ওঠে, জোছনা রাতে চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে । কোন্‌ অকুলের সন্ধানেতে কোন্‌ পথে যায় ভেসে- পথহারা কোন্‌ গ্রামের পরে নাম-জানা-নেই-দেশে । ঘূর্ণীপথের ঘোরের নেশা দিক্‌বিদিকে লাগে, আগল ভাঙা পাগল হাওয়া বাদল রাতে জাগে ; ঝড়ের মুখে স্বপন ছুটে আঁধার আসে ঘিরে ! মেঘের প্রাণে চমক হানে আকাশ চিরে চিরে ! বুকের মাঝে শঙ্খ বাজে- দুন্দুভি দেয় সাড়া ! মেঘের মরণ ঘনিয়ে নামে মত্ত বাদল ধারা । মেঘের খেয়াল আকাশের ময়দানে বাতাসের ভরে, ছোট বড় সাদা কালো কত মেঘ চরে। কচি কচি থোপা থোপা মেঘেদের ছানা হেসে খেলে ভেসে যায় মেলে কচি ডানা। কোথা হতে কোথা যায় কোন্‌ তালে চলে, বাতাসের কানে কানে কত কথা বলে। বুড়ো বুড়ো ধাড়ি মেঘ ঢিপি হয়ে উঠে- শুয়ে ব'সে সভা করে সারাদিন জুটে। কি যে ভাবে চুপ্‌চাপ, কোন ধ্যানে থাকে, আকাশের গায়ে গায়ে কত ছবি আঁকে। কত আঁকে কত মোছে, কত মায়া করে, পলে পলে কত রং কত রূপ ধরে। জটাধারী বুনো মেঘ ফোঁস ফোঁস ফোলে, গুরুগুরু ডাক ছেড়ে কত ঝড় তোলে। ঝিলিকের ঝিকিমিকি চোখ করে কানা, হড়্‌ হড়্‌ কড়্‌ কড়্‌ দশদিকে হানা। ঝুল্‌ কালো চারিধার, আলো যায় ঘুচে, আকাশের যত নীল সব দেয় মুছে। রামগরুড়ের ছানা রামগরুড়ের ছানা          হাসতে তাদের মানা,            হাসির কথা শুনলে বলে,           "হাসব্ না-না, না-না"। সদাই মরে ত্রাসে-          ঐ বুঝি কেউ হাসে!            এক চোখে তাই মিট্‌মিটিয়ে            তাকায় আশে পাশে। ঘুম নাহি তার চোখে          আপনি বকে বকে            আপনারে কয়, "হাসিস্ যদি            মারব কিন্তু তোকে!" যায় না বনের কাছে,          কিম্বা গাছে গাছে,            দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে            হাসিয়ে ফেলে পাছে! সোয়াস্তি নেই মনে-          মেঘের কোণে কোণে            হাসির বাষ্প উঠ্‌ছে ফেঁপে            কান পেতে তাই শোনে। ঝোপের ধারে ধারে          রাতের অন্ধকারে            জোনাক্ জ্বলে আলোর তালে            হাসির ঠারে ঠারে । হাসতে হাসতে যারা          হচ্ছে কেবল সারা            রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা            বুঝছে না কি তারা? রামগরুড়ের বাসা          ধমক দিয়ে ঠাসা,            হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়            নিষেধ সেথায় হাসা। লক্ষ্মী হাত -পা- ভাঙ্গা নোংরা পুতুল মুখটি ধুলোয় মাখা, গাল দুটি তার খাবলা মতন চোখ দুটি তার ফাঁকা- কোথায় বা তার চুল বিনুনি, কোথায় বা তার মাথা, আধখানি তার ছিন্ন জামা,গায় দিয়েছে কাঁথা। পুতুলের মা ব্যস্ত কেবল তার সেবাতেই রত, খাওয়ান শোয়ান আদর করেন ঘুম ডেকে দেন কত। বলতে গেলাম "বিশ্রী পুতুল" অমনি বলেন রেগে - "লক্ষ্মী পুতুল জ্বর হয়েছে তাইত এখন জেগে।" দ্বিগুন জোরে চাপড়ে দিল "আয় আয় আয়" ব'লে- নোংরা পুতুল লক্ষ্মী হ'য়ে পড়ল ঘুমে ঢুলে! লড়াই-ক্ষ্যাপা ওই আমাদের পাগলা জগাই, নিত্যি হেথায় আসে; আপন মনে গুন্ গুনিয়ে মুচ্‌কি হাসি হাসে । চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধমক লেগে থামে; তড়াক্ করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে। ভীষন রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোচাঁ ; "এইয়ো" বলে ক্ষ্যাপার মতো শুন্যে মারে খোচাঁ । চেঁচিয়ে বলে ,"ফাদঁ পেতেছ ? জগাই কি তায় পড়ে? সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে।" উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে, কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে। এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস ধাপুস্ কত! চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মত। লাফের চোটে হাঁপিয়ে ওঠে গায়েতে ঘাম ঝরে, দুড়ুম ক'রে মাটির পরে লম্বা হয়ে পড়ে। হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখ্‌টি ক'রে ঘোলা, "জগাই মেলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা"! এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব, মড়ার মত শক্ত হ'য়ে এক্কেবারে চুপ ! তার পরেতে সটান্ বসে চুলকে খানিক মাথা, পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা। লিখলে তাতে- "শোনরে জগাই, ভীষন লড়াই হলো পাচ ব্যাটাকে খতম করে জগাই দাদা মোলো।" লোভী ছেলে কি ভেবে যে আপন মনে হাসি আসে ঠোঁটের কোণে,-আধ আধ ঝাপসা বুলি কোন কথা কয়না খুলি ।বসে বসে একলা নিজে লোভী ছেলে ভাবেন কি যে-শুধু শুধু চামচ চেটে মনে মনে সাধ কি মেটে ?একটুখানি মিষ্টি দিয়ে রাখ আমায় চুপ করিয়ে,নইলে পরে চেঁচিয়ে জোরে তুলব বাড়ি মাথায় ক'রে । শব্দকল্পদ্রুম ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা-- ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা! শাঁই শাঁই পন্‌ পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ-- ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ? হুড়মুড় ধুপধাপ--ওকি শুনি ভাইরে! দেখ্‌ছনা হিম পড়ে-- যেও নাকো বাইরে। চুপ চুপ ঐ শোন্‌! ঝুপ ঝাপ্‌ ঝপা-স! চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্‌ গব্‌ গবা-স! খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ , রাত কাটে ঐরে! দুড়দাড় চুরমার--ঘুম ভাঙে কই রে! ঘর্ঘর ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা! কত মন নাচ শোন্‌--ধেই ধেই ধিন্‌তা! ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে-- ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে! হৈ হৈ মার্ মার্ "বাপ্‌ বাপ্‌" চিৎকার-- মালকোঁচা মারে বুঝি? সরে পড়্ এইবার। শিশুর দেহ চশমা-আঁটা পণ্ডিতে কয় শিশুর দেহ দেখে- 'হাড়ের পরে মাংস দিয়ে, চামড়া দিয়ে ঢেকে, শিরার মাঝে রক্ত দিয়ে, ফুসফুসেতে বায়ু, বাঁধল দেহ সুঠাম করে পেশী এবং স্নায়ু।' কবি বলেন, 'শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি, উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি। হাসিতে তার চাঁদের আলো, পাখির কলকল, অশ্রুকণা ফুলের দলে শিশির ঢলঢল।' মা বলেন, 'এই দুরুদুরু মোর বুকেরই বাণী, তারি গভীর ছন্দে গড়া শিশুর দেহখানি। শিশুর প্রাণে চঞ্চলতা আমার অশ্রুহাসি, আমার মাঝে লুকিয়েছিল এই আনন্দরাশি। গোপনে কোন্‌ স্বপ্নে ছিল অজানা কোন আশা, শিশুর দেহে মূর্তি নিল আমার ভালবাসা।' শুনেছ কি বলে গেল শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ? টকটক থাকে নাকো হ'লে পরে বৃষ্টি- তখনও দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি। শোন শোন গল্প শোন শোন শোন গল্প শোন, ‘এক যে ছিল গুরু’ এই আমার গল্প হল শুরু। যদু আর বংশীধর যমজ ভাই তারা- এই আমার গল্প হল সারা।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ) শ্রাবণে জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত- অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত । আকাশের মুখ ঢাকা, ধোঁয়ামাখা চারিধার, পৃথিবীর ছাত পিটে ঝামাঝম্‌ বারিধার । স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়, নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায় । উৎসব ঘনঘোর উন্মাদ শ্রাবণের শেষ নাই শেষ নাই বরষার প্লাবনের । জলেজলে জলময় দশদিক্‌ টলমল্‌, অবিরাম একই গান, ঢালো জল ঢালো জল । ধুয়ে যায় যত তাপ জর্জর গ্রীষ্মের, ধুয়ে যায় রৌদ্রের স্মৃতিটুকু বিশ্বের । শুধু যেন বাজে কোথা নিঃঝুম ধুক্‌ধুক্‌, ধরণীর আশাভয় ধরণীর সুখদুখ । শ্রীগোবিন্দ-কথা আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ মানুষটি নই বাঁকা! যা বলি তা ভেবেই বলি, কথায় নেইক ফাঁকা। এখনকার সব সাহেবসুবো, সবাই আমায় চেনে দেখ্তে চাও ত দিতে পারি সাটিফিকেট এনে। ভাগ্য আমায় দেয়নি বটে করতে বি-এ পাশ, তাই বলে কি সময় কাটাই কেটে ঘোড়ার ঘাস? লোকে যে কয় বিদ্যে আমার 'কথামালা'ই শেষ- এর মধ্যে সত্যি কথা নেইক বিন্দুলেশ। ওদের পাড়ার লাইব্রেরিতে কেতাব আছে যত কেউ পড়েছে তন্নতন্ন করে আমায় মতো? আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ এমনি পড়ার যম পড়াশুনো নয়ক আমার কারুর চেয়ে কম। কতকটা এই দেখেশিখে কতক পড়েশুনে, কতক হয়ত স্বাভাবিকী প্রতিভারই গুণে উন্নতিটা করছি যেমন আশ্চর্য তা ভারি, নিজের মুখে সব কথা তার বলতে কি আর পারি? বলে গেছেন চন্ডীপতি কিংবা অন্য কেউ "আকাশ জুড়ে মেঘের বাসা, সাগরভরা ঢেউ, জীবনটাও তেমনি ঠাসা কেবল বিনা কাজে- যেদিক দিয়ে খরচ করি সেই খরচই বাজে!" আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ চলতে ফিরতে শুতে জীবনটাকে হাঁকাই নেকো মনের রথে জুতে।হাইড্রোজেনের দুই বাবাজি অক্সিজেনের এক নৃত্য কবেন গলাগলি কান্ডখানা দেখ্, আহাদেতে এক্‌সা হলে গলে হলেন জল এই সুযোগে সুবোধ শিশু "শ্রীগোবিন্দ" বল্। শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব পড় বিজ্ঞান হবে দিকজ্ঞান ঘুচিবে পথের ধাঁধা দেখিবে গুণিয়া এ দিন দুনিয়া নিয়ম নিগড়ে বাঁধা। কহে পন্ডিতে জড়সন্ধিতে বস্তুপিন্ড ফাঁকে অনু অবকাশে রন্ধ্রে- রন্ধ্রে আকাশ লুকায়ে থাকে। হেথা হেথা সেথা জড়ের পিন্ড আকাশ প্রলেপে ঢাকা নয়কো কেবল নিরেট গাঁথন, নয়কো কেবলি ফাঁকা। জড়ের বাঁধন বদ্ধ আকাশে, আকাশে বাঁধন জড়ে- পৃথিবী জুড়িয়া সাগর যেমন, প্রাণটি যেমন ধড়ে।; 'ইথার' পাথারে তড়িত বিকারে জড়ের জীবন দোলে, বিশ্ব - মোহের সুপ্তি ভাঙিছে সৃষ্টির কলরোলে।।শুন শুন বার্তা নুতন, কে যেন স্বপন দিলা ভাষা প্রাঙ্গণে স্বরে ব্যাঞ্জনে ছন্দ করেন লীলা । সৃষ্টি যেথায় জাগে নিরুপায় প্রলয় পয়োধি তীরে তারি আশেপাশে অন্ধ হুতাশে আকাশ কাঁদিয়া ফিরে। তাই ক্ষণে ক্ষণে জড়ো ব্যঞ্জনে স্বরের পরশ লাগে তাই বারেবার মৃদু হাহাকার কলসংগীতে জাগে স্বরব্যঞ্জন যেন দেহমনে জড়েতে চেতন বাণী একে বিনা আর থাকিতে না পারে, প্রাণ লয়ে টানাটানি। দোঁহি ছাড়ি দোঁহে, মূক রহে মোহে, ব্যঞ্জনে নাহি বুলি স্বরের নিশাসে 'আহা' 'উহু' ভাষে ভাষার বারতা ভুলি। ছিল অচেতন জগৎ যখন মগন আদিম ধুমে, অরূপ তিমির স্তব্ধ বধির স্বপ্ন মদির ঘুমে: আকুল গন্ধে আকাশ কুসুম উদাসে সকল দিশি, অন্ধ জড়ের বিজন আড়ালে কে যেন রয়েছে মিশি! স্তিমিত-স্বপ্ন স্বরের বর্ণ জড়ের বাধন ছিড়ি ফিরে দিশাহারা কোথা ধ্রুবতারা কোথা র্স্বগের সিঁড়ি! অ আ ই ঈ উ ঊ, হা হি হি হু হু হাল্কা শীতের হাওয়া অলখচরণ প্রেতের চলন, নিঃশ্বাসে আসা যাওয়া । লেখে কি না খেলে ছায়ার আঙুলে বাতাসে বাজায় বীণা আবেশ বিভোর আফিঙের ঘোর বস্তুত মন্ত্রহীনা। ভাবে কুল নাই একা আসি যাই যুগে যুগে চিরদিন, কাল হতে কালে আপনার তালে অনাহত বাধাহীন।।অকুল অতলে অন্ধ অচলে অস্ফুট অমানিশি, অরূপ আধারে আখি অগোচরে অনুতে অনুতে মিশি।আসে যায় আসে অবশ আয়াশে আবেশ আকুল প্রাণে, অতি আনমানা করে আনাগোনা অচেনা অজানা টানে, আধো আধো ভাষা আলেয়ার আসা , আপনি আপনহারা আদিম আলোতে আবছায়া পথে আকাশগঙ্গা- ধারা।ইচ্ছা বিকল ইন্দ্রিয়দল, জড়িত ইন্দ্রজালে, ঈশারা আভাসে ঈঙ্গিতে ভাষে রহ-রহ ইহকালে।উড়ে ইতিউতি উতালা আকুতি উসখুস উকিঝুঁকি উড়ে উচাটন, উড়ু উড়ু মন , উদাসে উধ্বমুখি।এমন একেলা একা একা খেলা একুলে ওকুলে ফের এপার ওপার এ যে একাকার একেরি একেলা হের। হেরে একবার সবি একাকার একেরি এলাকা মাঝে ঐ ওঠে শুনি, ওঙ্কার-ধ্বনি, একুলে ওকুলে বাজে।ওরে মিথ্যা এ আকাশ-চারণ মিথ্যা তোদের খোঁজা, স্বর্গ তোদের বস্তু সাধনে বহিতে জড়ের বোঝা। আকাশ বিহানে বস্তু অচল, চলে না জড়ের চাকা, আদুল আকাশে ফোকলা বাতাস কেবলি আওয়াজ ফাঁকা।সৃষ্টিতত্ত্ব বিচার করনি শাস্ত্র পড়নি দাদা- জড়ের পিন্ড আকাশে গুলিয়া ঠাসিবে ভাষার কাদা। শাস্ত্রবিধান কর প্রণিধান ওরে উদাসীন অন্ধ, ব্যঞ্জনস্বরে যেন হরিহরে কোথাও রবে না দ্বন্দ্ব। মরমে মরমে সরম পরশে বাতাস লাগিয়ে হাড়ে, ভাষার প্রবাহে পুলক- কম্পে জড়ের জতো ছাড়ে। (তবে)আয় নেমে আয়, জড়ের সভায় , জীবন মরণ দোলে, আয় নেমে আয়, ধরণীধুলায় কীর্তন কলরোলে। আয় নেমে আয় রূপের মায়ায় অরূপ ইন্দ্রজালে উল্কা ঝলকে থনল পুলকে আয় রে অশনিতালে। আয় নেমে আয় কণ্ঠ্য বর্ণে কাকুতি করিছে সবে আয় নেমে আয় র্ককশ ডাকে প্রভাতে কাকের রবে।নামো নামো নমঃ সৃষ্টি প্রথম কারণ জলধি জলে স্তব্দ তিমিরে প্রথম কাকলী প্রথম কৌতুহলে। আদিম তমসে প্রথম বর্ণ কনক কিরণ মালা প্রথম ক্ষুধিত বিশ্ব জঠরে প্রথম প্রশ্ন জ্বালা।অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি । কহে,কই কে গো, কোথায় কবে গো ,কেন বা কাহারে ডাকি? কহে কহ-কহ , কেন অহরহ ,কালের কবলে থাকি? কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে, কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে। কহে কটঁমট কথা কাটা কাটা -কেওকেটাঁ কহ কারে ? কাহার কদর কোকিল কণ্ঠে,কুন্দু কুসুম হারে? কবি কল্পনে কাব্যে কলায় কাহারে করিছ সেবা কুবের কতন কুঞ্জকাননে, কাঙালি কুটিরে কেবা । কায়দা কানুনে ,কার্য কারণে কীর্তিকলাপ মুলে , কেতাবে কোরানে কাগজে কলমে কাঁদায়ে কেরানীকুলে । কথা কাড়ি -কাড়ি কত কানাকড়ি কাজে কচু কাচকলা কভু কাছাকোছা কোর্তা কলার কভু কৌপীন ঝোলা । কুৎসা -কথনে কুটিলে কৃপণে কুলীন কন্যাদায়ে কর্মকান্ত কুলিম কান্ত,ক্লিষ্ট কাতর কায়ে । কলে কৌশলে ,কপট কোদলে ,কঠিনে কোমলে মিঠে কেদ কুৎসিত ,কুষ্ঠ কলুষ কিলবিল কৃমি কীটে। কহ সে কাহার কুহক পাথারু "কে আমি একেলা কবি ? কেন একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি !" 'ক'-এর কাঁদনে ,কাংস্য-ক্বণনে বর্ণ লভিল কায়া গহন শুন্যে জড়ের ধাক্কা কালের করাল ছায়া। সুপ্ত গগনেকরুণ বেদনে বস্তুচেতন জাগে অকাল ক্ষুধিত খাই খাই রবে বিশ্বে তরাস লাগে আকাশ অবধি ঠেকিল জলধি,খেয়াল জেগেছে খ্যাপা কারে খেতে চায় খুজে নাহি পায় দেখ কি বিষম হ্যাপা! (খালি)কর্তালে কভু কীর্তন খোলে? খোলে দাও চাটিপেটা ! নামাও আসরে 'ক'এর দোসরে, খেঁদেলো খেদেলো খেঁটা।" কহ মহামুনি কহ খুর শুনি 'খ'য়ের খবর খাঁটি খামারে খোয়ারে খানায় খন্দে খুজিনু খয়ের ঘাঁটি। কহেন বচন খুড়ে খন্‌খন্ পাখালি আঁখির দিঠি খালি খ্যাঁচাখ্যাঁচি খামচাখামচি খুঁৎখূঁতি খিটিমিটি । এখনো খুলেনি মুখের খোলস? এখনো খোলেনি আখি? নিক খেয়ালে পেখম ধরিয়া, কি খেলা খেলিল পাখি! এখনও রাখনা ক্ষুধার খবর এখনও শেখনি ভাষা পঞ্চকোষের মুখের খোসাতে অন্ন দেখনি ঠাসা? খোল খরতালে খোলসা খেয়ালে 'খোল খোল খোল 'বলে , শখের খাঁচার খিড়কী খুলিয়া খঞ্জ খেয়াল চলে। সে ক্ষুধায় পাখি পেখম খুলিয়া খাঁছায় খেমটা নাচে আখেরী ক্ষুধায় সখের ভিখারী খাস্তা খাবার যাচে- প্রখর-ক্ষুধিত তোখড় -খেয়াল -খেপিয়া রুখিল ত্বরা, চাখিয়া দেখিল, খাসা এ অখিল খেয়ালে-রচিত ধারা । খুঁজে সুখে দুখে খেয়ালের ভুলে খেয়ালে নিরখি সবি , খেলার খেয়ালে নিখিল -খেয়াল লিখিল খেয়াল ছবি । খেলার লীলা খদ্যোৎ-শিখা খেয়াল খধুপ -ধুপে' শিখী পাখা পরে নিখুত আখরে খচিত খেয়াল রূপে । খোদার উপরে খোদকারী করে ওরে ও ক্ষিপ্ত মতি কীলিয়ে অকালে কাঁঠাল পাকালে আখেরে কি হবে গতি ? খেয়ে খুরো চাঁটি খোল কহে খাঁটি, 'খাবি খাব ক্ষতি নাই,' খেয়ালের বাণী করে কানাকানি - 'গতি নাই, গতি নাই।' নিখিল খেয়াল খসড়া খাতায় লিখিল খেয়াল ছবি ক্ষণিকের সাথে খেয়ালের মুখে খতিয়া রাখিল সবি।গতি কিসে হবে, চিন্তিয়া তবে বচন শুনিনু খাসা, পঞ্চ কোষের প্রথম খোসাতে অন্ন রয়েছে ঠাসা! আত্মার মুখে আদিম -অন্ন তাহে ব্যঞ্জনগুলি অনুরাগে লাগি,করে ভাগাভাগি মুখে-মুখে দাও তুলি। এত বলি ঠেলি আত্মারে তুলি তত্ত্বের লগি ধরি, খেয়ালের প্রাণী রহে চুপ মানি বিস্ময়ে পেট ভারি । কবে কেবা জানে গতির গড়ানে গোপন গোমুখী হতে কোন ভগীরথে গলাল জগতে গতির গঙ্গা স্রোতে। দেখ আগাগোড়া গণিতের গড়া নিগূঢ় গুণ সবি গতির আবেগে আগুয়ান বেগে অগণিত গ্রহরবি। গগনে গগনে গোধুলি লগনে মগন গভীর গানে, করে গমগম আগম নিগম গুরু গম্ভীর ধ্যানে। গিরি গহ্বরে অসাধ সাগরে গঞ্জে নগরে-গ্রামে, গাঁজার গাজনে গোষ্ঠে গহনে গোকুলে গোলকধামে।শুনি সাবধানে কহি কানে কানে শাস্ত্রবচন ধরি কৌশলে ঋষি কহে কখগঘ কাহারে স্মরণ করে কয়ে দেখ জল খয়ে শুন্যতল গ'য়ে গতি অহরহ কভূ জলে ভাসে কভূ সে আকাশে হংস যাহারে কহ । আঘাতে যে মারে 'ঘ'কহি তারে হন ধাতু 'ড' করি তেঁই কখগঘ কৃষ্ণে জানহ হংস-অসুর -অরি। ব্যঙ্গে রঙ্গে ভ্রুকুটি -ভঙ্গে সঙ্গীত কলরবে রণহুংকারে ধনুঠংকারে শংকিত কর সবে । বিকল অঙ্গে ভগ্নজঙঘ এ কোন পঙ্গু মুনি ? কেন ভাঙ্গা ঠ্যাংঙে ডাঙায় নামিল বাঙালা মুলুকে শুনি। রাঙা আঁখি জলে চাঙ্গা হয়ে বলে ডিঙাব সাগর গিরি , কেন ঢঙ ধরি ব্যাঙাচির মতো লাঙুল জুড়িয়া ফিরি ?টলিল দুয়ার চিত্তগুহার চকিতে চিচিংফাক শুনি কলকল ছুটে কোলাহল শুনি চল চল ডাক । চলে চঁটপট চকিত চরণ ,চোঁচা চম্পট নৃত্যে চল চিত্রিত চিরচিন্তন চলে চঞ্চল চিত্তে। চলে চঞ্চলা চপল চমকে,চারু চৌচির বক্রে। চলে চন্দ্রমা চলে চরাচর চড়ি চড়কের বক্রে চলে চকমকি চোখের চাহনে চঞ্চরী চল ছন্দ , চলে চিৎকার চাবুক চালনে চপট চাপড়ে চন্ড চলে চুপি চুপি চতুর চৌর চৌদিকে চাহে ত্রস্ত চলে চুড়ামণি চর্বে চোষ্যে চটি চৈতনে চোস্ত চিকন চাদর চিকুর চাঁচর চোখা চালিয়াৎ চ্যাংড়া , চলে চ্যাংব্যাং চিতল কাতল চলে চুনোপুটি ট্যাংরা।।ছোটে ছঁটফটি ছায়ার ছমক ছমলীলার ছলে ছায়ারঙে মিশি ছোটে ছয় দিশি ছায়ার ছাঊনী তলে ছোটে ছায়াবাহু পিছে পিছে পিছে ছন্দে ছুটেছে রবি ছয় ঋতু ছোটে ছায়ার ছন্দে ছবির পিছনে ছবি ছায়াপথ - ছায়ে জ্যোছনা বিছায়ে... ষোল আনাই মিছে বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে, মাঝিরে কন, ''বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে? চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?'' বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে। বাবু বলেন, ''সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি, জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।''খানিক বাদে কহেন বাবু, ''বলতো দেখি ভেবে নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে? বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?'' মাঝি সে কয়, ''আরে মশাই অত কি আর জানি?'' বাবু বলেন, ''এই বয়সে জানিসনেও তা কি জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!''আবার ভেবে কহেন বাবু, '' বলতো ওরে বুড়ো, কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো? বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?'' বৃদ্ধ বলে, ''আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?'' বাবু বলেন, ''বলব কি আর বলব তোরে কি তা,- দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।''খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে, বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে! মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি, ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?'' মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু, মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু? বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!'' সঙ্গীহারা সবাই নাচে ফূর্তি করে সবাই করে গান, একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান ? দেখ্‌ছ নাকি আমার সাথে সবাই করে আড়ি- কে বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়, সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়। বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে, সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে। বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে, হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে। বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে, বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে। বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে, নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে। বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে, পরের যে ভাল করে, সাধু বলি তারে। বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে, নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে। কৌলীন্য মিছা কেন কুল নিয়া কর আঁটাআঁটি। এ যে কুল কুল নয় সার মাত্র আঁটি।। কুলের গৌরব কর কোন্ অভিমানে। মূলের হইলে দোষ কেবা তারে মানে।। ঘটকের মুখে সুধু কুলীনের চোপা। রস নাই যশ কিসে কুল হল টোপা।। আদর হইত তবে ভাঙ্গিলে অরুচি। পোকাধরা সোঁকা ভার দেখে যায় রুচি।। অতএব বৃথা এই কুলের আচার। ইথে নাহি রক্ষা পায় কুলের আচার।। কুলের সম্ভ্রম বল করিব কেমনে। শতেক বিধবা হয় একেক মরণে।। বগলেতে বৃষকাষ্ঠ শক্তিহীন যেই। কোলের কুমারী লয়ে বিয়ে করে সেই।। দুধে দাঁত ভাঙ্গে নাই শিশু নাম যার। পিতামহী সম নারী দারা হয় তার।। নরনারী তুল্য বিনা কিসে মন তোষে। ব্যভিচার হয় শুদ্ধ এই সব দোষে।। কুলকল্পে নয় রূপ সুলক্ষণ যাহা। অবশ্য প্রামাণ্য করি শিরোধার্য তাহা।। নচেৎ যে কুল তাহা দোষের কারণ। পাপের গৌরব কেন করিব ধারণ।। হে বিভু করুণাময় বিনয় আমার। এ দেশের কুলধর্ম করহ সংহার।। গুনের আদর মহৎ যে হয় তার, সাধু ব্যবহার, উপকার বিনা নাহি জানে অপকার। দেখ কুঠার করে, চন্দন ছেঁদন, চন্দন সুবাস তারে, করে বিতরণ। কাক কারো করে নাই, সম্পদ হরণ, কোকিল করেনি কারে, ধন বিতরণ। কাকের কঠোর রব, বিষ লাগে কানে, কোকিল অখিল প্রিয়, সুমধুর গানে। গুণময় হইলেই, মানে বাড়ে সব ঠাই, গুণহীনে সমাদর, কোন খানে নাই। শারি আর শুক পাখি , অনেকেই রাখে, যত্ন করে কে কোথায়, কাক পুষে থাকে ? অধমে রত্ন পেলে, কি হইবে ফল ? উপদেশে কখনো কি, সাধু হয় খল ? ভাল, মন্দ, দোষ, গুণ, আধারেতে ধরে, ভুজঙ্গ অমৃত খেয়ে, গরল উগরে। লবণ-জলধি-জল, করিয়া ভক্ষণ, জলধর করিতেছে, সুধা বরিষণ । সুঞ্জনে সুযশ গায়, কুযশ ঢাকিয়, কুজনে কুরব করে সুরব নাশিয়া। ====== তপসে মাছ কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়। গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥ মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে। মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥ পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা। সমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥ একবার রসনায় যে পেয়েছে তার। আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার॥ দৃশ্য মাত্র সর্বগাত্র প্রফুল্লিত হয়। সৌরভে আমোদ করে ত্রিভুবনময়॥ প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা। ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিই কাঁচা॥ অপরূপ হেরে রূপ পুত্রশোক হরে। মুখে দেওয়া দূরে থাক গন্ধে পেট ভরে॥ কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা। টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকাতেলে ভাজা॥ না করে উদর যেই তোমায় গ্রহণ। বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন॥ নগরের লোক সব এই কয় মাস। তোমার কৃপায় করে মহা সুখে বাস॥ বাক্য অপেক্ষা কার্য্য ভাল কাজে যদি করা হয় করো তবে ভাই মিছামিছি মুখে বলে কোনো ফল নাই। শরতের মিছা মেঘ  ডাকডোক সার ছিটে ফোঁটা নাহি তায় জলের সঞ্চার সেইরূপ মিছা তব মুখে আড়ম্বর ফলে যদি না হইলে কার্য্য হিতকর। তখনি করিবে তাহা যখন যা হয় বিলম্ব বিধান তায় কোনোমতে নয়। কল্পনায় কর যদি আলস্য এখন কখন হবে না আর সুফল সাধন। অতএব কর ভাই সাধ্য হয় যত কল্পনা না হয় যেন রাবনের মত।। ভারতের ভাগ্য-বিপ্লব পূর্বকার দেশাচার          কিছুমাত্র নাহি আর             অনাচারে অবিরত রত। কোথা পূর্ব রীতি নীতি,       অধর্মের প্রতি প্রীতি,            শ্রুতি হয় শ্রুতিপথহত।। দেশের দারুণ দুখ          দেখিয়া বিদরে বুক,              চিন্তায় চঞ্চল হয় মন। লিখিতে লেখনী কাঁদে       ম্লানমুখ মসীছাঁদে           শোক-অশ্রু করে বরিষণ।। কি ছিল কি হ'ল, আহা,      আর কি হইবে তাহা,             ভারতের ভবভরা যশ। ঘুচিবে সকল রিষ্টি          হবে সদা সুখ-বৃষ্টি,           সর্বাধারে সঞ্চারিবে রস।। সুরব সৌরভ হয়ে          দশদিকে যশ লয়ে,            প্রকাশিবে শুভ সমাচার। স্বাধীনতা মাতৃস্নেহে        ভারতের জরা-দেহে           করিবেন শোভার সঞ্চার।। দুর হবে সব ক্লান্তি         পলাবে প্রবলা ভ্রান্তি,            শান্তিজল হবে বরিষণ। পুণ্যভূমি পুনর্বার          পূর্বসুখ সহকার,           প্রাপ্ত হবে জীবন যৌবন।। প্রবীণা নবীনা হয়ে          সন্তানসমূহ লয়ে         কোলে করি করিবে পালন। সুধাসম স্তন্যপানে         জননীর মুখপানে           একদৃষ্টে করিবে ঈক্ষণ।। এরূপ স্বপনমত,         কত হয় মনোগত,          মনোমত ভাবের সঞ্চার। ফলে তাহা কবে হবে          প্রসূতির হাহারবে,          সূত সবে করে হাহাকার।। মাতৃভাষা মায়ের কোলেতে শুয়ে ঊরুতে মস্তক থুয়ে খল খল সহাস্য বদন। অধরে অমৃত ক্ষরে আধ আধ মৃদু স্বরে আধ আধ বচনরচন।। কহিতে অন্তরে আশা মুখে নাহি কটু ভাষা ব্যাকুল হয়েছে কত তায়। মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা আবো আবো আবা আবা সমুদয় দেববাণী প্রায়।। ক্রমেতে ফুটিল মুখ উঠিল মনের সুখ একে একে দেখিলে সকল। মেসো, পিসে, খুড়ো, বাপ জুজু, ভুত, ছুঁচো, সাপ স্থল জল আকাশ অনল।। ভাল মন্দ জানিতে না, মল মুত্র মানিতে না, উপদেশ শিক্ষা হল যত। পঞ্চমেতে হাতে খড়ি, খাইয়া গুরুর ছড়ি, পাঠশালে পড়িয়াছ কত।। যৌবনের আগমনে, জ্ঞানের প্রতিভা সনে, বস্তুবোধ হইল তোমার। পুস্তক করিয়া পাঠ, দেখিয়া ভবের নাট, হিতাহিত করিছ বিচার।। যে ভাষায় হয়ে প্রীত পরমেশ-গুণ-গীত বৃদ্ধকালে গান কর মুখে। মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা তুমি তার সেবা কর সুখে।। মানুষ কে? নিয়ত মানস ধামে একরূপ ভাব। জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ।। পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ। সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ।। নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ। রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ।। কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?নাহি চায় রাজ্যপদ নাহি চায় ধন। স্বর্গের সমান দেখে বন উপবন।। পৃথিবীর সমুদয় নিজ পরিজন। কাশীরাম দাস চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি জাহ্নবী, ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন, ঢালি সংস্কৃত-হ্রদে রাখিলা তেমতি; — তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন। কঠোরে গঙ্গায় পূজি ভগীরথ ব্রতী, (সুধন্য তাপস ভবে, নর-কুল-ধন! ) সগর-বংশের যথা সাধিলা মুকতি, পবিত্ৰিলা আনি মায়ে, এ তিন ভুবন; সেই রূপে ভাষা-পথ খননি স্ববলে, ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে। নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। হে কাশি, কবীশদলে তুমি পুণ্যবান্॥(চতুদ্দর্শপদী কবিতাবলী) পৃথিবী ১           হে বসুধে, জগৎজননি!      দয়াময়ী তুমি, সতি, বিদিত ভুবনে!            যবে দশানন অরি,      বিসৰ্জ্জিলা হুতাশনে জানকী সুন্দরী,            তুমি গো রাখিলা বরাননে। তুমি, ধনি, দ্বিধা হয়ে,       বৈদেহীরে কোলে লয়ে,     জুড়ালে তাহার জ্বালা বাসুকি-রমণি!২           হে বসুধে, রাধা বিরহিণী!     তার প্রতি আজি তুমি বাম কি কারণে? শ্যামের বিরহানলে,           সুভগে, অভাগা জ্বলে,           তারে যে কর না তুমি মনে? পুড়িছে অবলা বালা,        কে সম্বরে তার জ্বালা,     হায়, এ কি রীতি তব, হে ঋতু কামিনি!৩         শমীর হৃদয়ে অগ্নি জ্বলে---     কিন্তু সে কি বিরহ-অনল, বসুন্ধরে?          তা হলে বন-শোভিনী     জীবন যৌবন তাপে হারাত তাপিনী---           বিরহ দুরূহ দুহে হরে! পুড়ি আমি অভাগিনী,        চেয়ে দেখ না মেদিনি,    পুড়ে যথা বনস্থলী ঘোর দাবানলে!৪          আপনি তো জান গো ধরণি   তুমিও তো ভালবাস ঋতুকুলপতি!           তার শুভ আগমনে    হাসিয়া সাজহ তুমি নানা আভরণে---    কামে পেলে সাজে যথা রতি! অলকে ঝলকে কত               ফুল-রত্ন শত শত!    তাহার বিরহ দুঃখ ভেবে দেখ, ধনি!৫         লোকে বলে রাধা কলঙ্কিনী!    তুমি তারে ঘৃণা কেনে কর, সীমন্তিনি?          অনন্ত, জলধি নিধি---     এই দুই বরে তোমা দিয়াছেন বিধি,          তবু তুমি মধুবিলাসিনী! শ্যাম মম প্রাণ স্বামী---     শ্যামে হারায়েছি আমি,     আমার দুঃখে কি তুমি হও না দুঃখিনী?৬         হে মহি, এ অবোধ পরাণ     কেমনে করিব স্থির কহ গো আমারে?          বসন্তরাজ বিহনে     কেমনে বাঁচ গো তুমি---কি ভাবিয়া মনে---          শেখাও সে সব রাধিকারে! মধু কহে, হে সুন্দরি,             থাক হে ধৈরয ধরি,     কালে মধু বমুধারে করে মধুদান! (ব্রজাঙ্গনা কাব্য) অন্নপূর্ণার ঝাঁপি মোহিনী-রূপসী-বেশে ঝাঁপি কাঁখে করি পশিছেন, ভবানন্দ, দেখ তব ঘরে অন্নদা! বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী, অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে।– দেবীর প্রসাদে তোমা রাজপদে বরি, রাজাসন, রাজছত্র, দিবেন সত্বরে রাজলক্ষ্মী; ধন-স্রোতে তব ভাগ্যতরি ভাসিবে অনেক দিন, জননীর বরে। কিন্তু চিরস্থায়ী অর্থ নহে এ সংসারে; চঞ্চলা ধনদা রমা, ধনও চঞ্চল; তবু কি সংশয় তব, জিজ্ঞাসি তোমারে? তব বংশ-যশঃ-ঝাঁপি–অন্নদামঙ্গল– যতনে রাখিবে বঙ্গে মনের ভাণ্ডারে, রাখে যথা সুধামৃতে চন্দ্রের মণ্ডলে।কাব্য গ্রন্থঃ-সংকলিত (মাইকেল মধুসূদন দত্ত) অর্থ ভেবো না জনম তার এ ভবে কুক্ষণে, কমলিনী-রূপে যার ভাগ্য-সরোবরে না শোভেন মা কমলা সুবর্ণ কিরণে ;– কিন্তু যে, কম্পনা-রূপ খনির ভিতরে কুড়ায়ে রতন-ব্ৰজ, সাজায় ভূষণে স্বভাষা, অঙ্গের শোভা বাড়ায়ে আদরে! কি লাভ সঞ্চয়ি, কহ, রজত কাঞ্চনে, ধনপ্রিয় ?বাঁধা রমা চির কার ঘরে ? তার ধন-অধিকারী হেন জন নহে, যে জন নিৰ্ব্বংশ হলে বিস্মৃতি-আঁধারে ডুবে নাম, শিলা যথা তল-শূন্য দলে। তার ধন-অধিকারী নারে মরিবারে– রসনা-যন্ত্রের তার যত দিন বহে ভাবের সঙ্গীত-ধ্বনি, বাঁচে সে সংসারে।। অশ্ব ও কুরঙ্গ ১২কিছু দিনে উজ্জ্বলনয়ন, কুরঙ্গ সহসা আসি দিল দরশন। বিস্ময়ে চৌদিকে চায়,                 যা দেখে বাগানে তায়, কতক্ষণে হেরি অশ্বে কহে মনে মনে;— “হেন রাজ্যে এক প্রজা এ দুখ না সহে! তোমার প্রসাদ চাই,                 শুন হে বন-গোঁসাই, অাপদে, বিপদে দেব, পদে দিও ঠাঁই॥”৩এক পার্শ্ব করি অধিকার,              আরম্ভিল কুরঙ্গ বিহার; খাইল অনেক ঘাস,              কে গণিতে পারে গ্রাস? অাহার করণান্তরে                করিল পান নির্ঝরে; পরে মৃগ তরুতলে                নিদ্রা গেল কুতূহলে— গৃহে গৃহস্বামী যথা বলী স্বত্ববলে॥৪বাক্যহীন ক্রোধে অশ্ব, নিরখি এ লীলা, ভোজবাজি কিম্বা স্বপ্ন! নয়ন মুদিলা; উন্মীলি ক্ষণেক পরে কুরঙ্গে দেখিলা, রঙ্গে শুয়ে তরুতলে;                 দ্বিগুণ অাগুন হৃদে জ্বলে; তীক্ষ্ণ ক্ষুর আঘাতনে ধরণী ফাটিল, ভীম হ্রেষা গগনে উঠিল। প্রতিধ্বনি চৌদিকে জাগিল॥৫নিদ্রাভঙ্গে মৃগবর              কহিলা, “ওরে বর্ব্বর! কে তুই, কত বা বল? সৎ পড়সীর মত             না থাকিবি, হবি হত।'' কুরঙ্গের উজ্জ্বল নয়ন             ভাতিল সরোষে যেন দুইটি তপন।।৬হয়ের হৃদয়ে হৈল ভয়,             ভাবে এ সামান্য পশু নয়, শিরে শৃঙ্গ শাখাময়! প্রতি শৃঙ্গ শূলের আকার বুঝি বা শূলের তুল্য ধার, কে আমারে দিবে পরিচয়?৭মাঠের নিকটে এক মৃগয়ী থাকিত, অশ্ব তারে বিশেষ চিনিত। ধরিতে এ অশ্ববরে,            নানা ফাঁস নিরন্তরে। মৃগয়ী পাতিত। কিন্তু সৌভাগ্যের বলে, তুরঙ্গম মায়া-ছলে কভু না পড়িত॥৮কহিল তুরঙ্গ;—“পশু উচ্চশৃঙ্গধারী— মোর রাজ্য এবে অধিকারী; না চাহিল অনুমতি,               কর্কশভাষী সে অতি; হও হে সহায় মোর,              মারি দুই জনে চোর॥''৯মৃগয়ী করিয়া প্রতারণা,            কহিলা,“হা! এ কি বিড়ম্বনা! জানি সে পশুরে আমি,           বনে পশুকুলে স্বামী, শার্দ্দূলে, সিংহেরে নাশে,          দগ্ধে বন বিষশ্বাসে; একমাত্র কেবল উপায়;— মুখস ও মুখে পর,         পৃষ্ঠে চর্ম্মাসন ধর, আমি সে আসনে বসি,         করে ধনুর্ব্বাণ অসি, তা হলে বিজয় লভা যায়॥”১০হায়! ক্রোধে অন্ধ অশ্ব, কুছলে ভুলিল; লাফে পৃষ্ঠে দুষ্ট সাদী অমনি চড়িল। লোহার কণ্টকে গড়া অস্ত্র, বাঁধা পাদুকায়, তাহার আঘাতে প্রাণ যায়। মুখস নাশিল গতি, ভয়ে হয় ক্ষিপ্তমতি, চলে সাদী যে দিকে চালায়॥১১কোথা অরি, কোথা বন,              সে সুখের নিকেতন? দিনান্তে হইলা বন্দী আঁধার-শালায়। পরের অনিষ্ট হেতু ব্যগ্র যে দুর্ম্মতি, এই পুরস্কার তার কহেন ভারতী; ছায়া সম জয় যায় ধর্ম্মের সংহতি॥ আত্মবিলাপ আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়, তাই ভাবি মনে? জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়, ফিরাবো কেমনে? দিন-দিন আয়ুহীন হীনবল দিন-দিন ,-- তবু এ আশার নেশা ছুটিল না ? এ কি দায়!রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি? জাগিবি রে কবে? জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি কত দিন র'বে? নীরবিন্ধু, দূর্বাদলে, নিত্য কিরে ঝলঝলে? কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার? জাগে সে কাঁদিতে! ক্ষণপ্রভা প্রভা-দানে বাড়ায় মাত্র আঁধার পথিকে ধাঁদিতে! মরীচিকা মরুদেশে, নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে-- এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাধে কী ফল লভিলি? জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে উড়িয়া পড়িলি পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, ধাইলি, অবোধ, হায় না দেখলি না শুনিলি, এবে রে পরাণ কাঁদেবাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে, সে সাধ সাধিতে? ক্ষত মাত্র হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে কমল তুলিতে নারিলি হরিতে মণি, দংশিল কেবল ফণী এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন, কেমনে!যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়, কব তা কাহারে? সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়, কাটিতে তাহারে? মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ! এই কি লভিলি লাভ, অনাহারে, অনিদ্রায়?মুকুতা-ফলের লোভে, ডুবে রে অতল জলে যতনে ধীবর, শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে ফেলিস, পামর! ফিরি দিবি হারাধন, কে তোরে, অবোধ মন, হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে! আমরা আকাশ-পরশী গিরি দমি গুণ-বলে, নিৰ্ম্মিল মন্দির যারা সুন্দর ভারতে ; তাদের সন্তান কি হে আমরা সকলে ?— আমরা,—দুর্ব্বল, ক্ষীণ, কুখ্যাত জগতে, পরাধীন, হা বিধাতঃ, আবদ্ধ শৃঙ্খলে?— কি হেতু নিবিল জ্যোতিঃ মণি, মরকতে, ফুটিল ধুতুরা ফুল মানসের জলে নির্গন্ধে ? কে কবে মোরে ? জানিব কি মতে বামন দানব-কুলে, সিংহের ঔরসে শৃগাল কি পাপে মোরা কে কবে আমারে? রে কাল, পূরিবি কি রে পুনঃ নব রসে রস-শূন্য দেহ তুই ? অমৃত-আসারে চেতাইবি মৃত-কল্পে ? পুনঃ কি হরষে, শুক্লকে ভারত-শশী ভাতিবে সংসারে ? আশা বাহ্য-জ্ঞান শূন্য করি,নিদ্রা মায়াবিনী কত শত রঙ্গ করে নিশা-আগমনে!--- কিন্তু কি শকতি তোর এ মর-ভবনে লো আশা!---নিদ্রার কেলি আইলে যামিনী, ভাল মন্দ ভুলে লোক যখন শয়নে, দুখ,সুখ,সত্য,মিথ্যা!তুই কুহকিনী, তোর লীলা-খেলা দেখি দিবার মিলনে,--- জাগে যে স্বপন তারে দেখাস্,রঙ্গিণি! কাঙ্গালী যে,ধন-ভোগ তার তোর বলে; মগন যে,ভাগ্য-দোষে বিপদ-সাগরে, (ভুলি ভূত,বর্ত্তমান ভুলি তোর ছলে) কালে তীর-লাভ হবে,সেও মনে করে! ভবিষ্যৎ-অন্ধকারে তোর দীপ জ্বলে,--- এ কুহক পাইলি লো কোন্ দেব-বরে? আশ্বিন মাস সু-শ্যামাঙ্গ বঙ্গ এবে মহাব্রতে রত। এসেছেন ফিরে উমা, বৎসরের পরে, মহিষমৰ্দ্দিনীরূপে ভকতের ঘরে; বামে কমকায়া রমা, দক্ষিণে আয়ত- লোচনা বচনেশ্বরী, স্বর্ণবীণা করে; শিখীপৃষ্ঠে শিখীধ্বজ, যাঁর শরে হত তারক—অসুরশ্রেষ্ঠ; গণ-দল যত, তার পতি গণদেব, রাঙা কলেবরে করি-শিরঃ; —আদিব্রহ্ম বেদের বচনে । এক পদ্মে শতদল৷ শত রূপবতী— নক্ষত্রমণ্ডলী যেন একত্রে গগনে!— কি আনন্দ! পূৰ্ব্ব কথা কেন কয়ে, স্মৃতি, আনিছ হে বারি-ধারা আজি এ নয়নে?— ফলিবে কি মনে পুনঃ সে পূর্ব্ব ভকতি? ইতালি ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন, বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে, সঙ্গীত‐সুধার রস করি বরিষণ, বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;— সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাক্‌‍দেবীর বরে বড়ই যশস্বী সাধু, কবি‐কুল‐ধন, রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে। কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি, স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী (মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে। ভারতে ভারতী‐পদ উপযুক্ত গণি, উপহাররূপে আজি অরপি রতনে॥ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত স্রোতঃ-পথে বহি যথা ভীষণ ঘোষণে ক্ষণ কাল, অল্পায়ুঃ পয়োরাশি চলে বরিষায় জলাশয়ে ; দৈব-বিড়ম্বনে ঘটিল কি সেই দশা সুবঙ্গ-মণ্ডলে তোমার, কোবিদ বৈদ্য ? এই ভাবি মনে,— নাহি কি হে কেহ তব বান্ধবের দলে, তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে, স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে ? আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য-ব্রজধামে জীবে তুমি ; নানা খেলা খেলিলা হরষে ; যমুনা হয়েছ পার ; তেঁই গোপগ্রামে সবে কি ভুলিল তোমা ? স্মরণ-নিকষে, মন্দ-স্বর্ণ-রেখা-সম এবে তব নামে নাহি কি হে জ্যোতিঃ, ভাল স্বর্ণের পরশে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে। করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, দীন যে, দীনের বন্ধু !- উজ্জল জগতে হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে। কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে, যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে, সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে ! দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী। যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি। পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে, দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী, নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে। ঈশ্বরী পাটনী কে তোর তরিতে বসি,ঈশ্বরী পটনি? ছলিতে তোর রে যদি কামিনী কমলে,--- কোথা করী,বাম করে ধরি যারে বলে, উগরি,গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী? রূপের খনিতে আর আছে কিরে মণি? এর সম?চেয়ে দেখ,পদ-ছায়া-ছলে,--- কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে--- কোন্ দেবতারে পূজি,পেলি এ রমণী? কাঠের সেঁউতি তোর,পদ-পরশনে হইতেছে স্বর্ণময়!এ এব যুবতী--- নহে রে সামান্যা নারী,এই লাগে মনে; বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি। মেগে নিস্,পার করে,বর-রূপ ধনে দেখায়ে ভকতি শোন্,এ মোর যুকতি! উদ্যানে পুষ্করিণী বড় রম্য স্থলে বাস তোর, লো সরসি! দগধা বসুধা যবে চৌদিকে প্রখরে তপনের, পত্রময়ী শাখা ছত্র ধরে শীতলিতে দেহ তোর ; মৃদু শ্বাসে পশি, সুগন্ধ পাখার রূপে, বায়ু বায়ু করে। বাড়াতে বিরাম তোর আদরে, রূপসি, শত শত পাতা মিলি মিষ্টে মরমরে; স্বর্ণ-কান্তি ফুল ফুটি, তোর তটে বসি, যোগায় সৌরভ-ভোগ, কিঙ্করী যেমতি পাট-মহিষীর খাটে, শয়ন-সদনে। নিশায় বাসর রঙ্গ তোর, রসবতি, লয়ে চাঁদে,—কত হাসি প্রেম-আলিঙ্গনে! বৈতালিক-পদে তোর পিক-কুল-পাত; ভ্রমর গায়ক ; নাচে খঞ্জন, ললনে । উপক্রম যথাবিধি বন্দি কবি, আনন্দে আসরে, কহে, জোড় করি কর, গৌড় সুভাজনে;-- সেই আমি, ডুবি পূর্বে ভারত-সাগরে, তুলিল যে তিলোত্তমা-মুকুতা যৌবনে;-- কবি-গুরু বাল্মীকির প্রসাদে তত্žপরে, গম্ভীরে বাজায়ে বীণা, গাইল, কেমনে, নাশিলা সুমিত্রা-পুত্র, লঙ্কার সমরে, দেব-দৈত্য-নরাতঙ্ক-- রক্ষেন্দ্র-নন্দনে; কল্পনা দূতীর সাথে ভ্রমি ব্রজ-ধামে শুনিল যে গোপিনীর হাহাকার ধ্বনি, (বিরহে বিহ্বলা বালা হারা হয়ে শ্যামে;)-- বিরহ-লেখন পরে লিখিল লেখনী যার, বীর জায়া-পক্ষে বীর পতি-গ্রামে, সেই আমি, শুন, যত গৌড়-চূড়ামণি!--ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন, বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে, সঙ্গীত-সুধার রস করি বরিষণ, বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;-- সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাক্দেবীর বরে বড়ই যশস্বী সাধু, কবি-কুল-ধন, রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে। কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি, স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী (মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে। ভারতে ভারতী-পদ উপযুক্ত গণি, উপহাররূপে আজি অরপি রতনে। উপসংহার রাগিণী বসন্ত,তাল ধীমা তেতালা                 শুন হে সভাজন!                 আমি অভাজন,                 দীন ক্ষীণ জ্ঞানগুণে,                 ভয় হয় দেখে শুনে,                 পাছে কপাল বিগুণে,                 হারাই পূর্ব্ব মূলধন!                যদি অনুরাগ পাই,                 আনন্দের সীমা নাই,                 এ কাষেতে একষাই,                 দিব দরশন! উৰ্ব্বশী যথা তুষারের হিয়া, ধবল-শিখরে, কভু নাহি গলে রবি-বিভার চুম্বনে, কামানলে ; অবহেলি মন্মথের শরে রথীন্দ্র, হেরিল, জাগি, শয়ন-সদনে ( কনক-পুতলী যেন নিশার স্বপনে ) উৰ্ব্বশীরে । “কহ, দেবি, কহ এ কিঙ্করে,”— সুধিলা সম্ভাষি শূর সুমধুর স্বরে, “কি হেতু অকালে হেথা, মিনতি চরণে ?” উন্মদা মদন-মদে, কহিলা উৰ্ব্বশী ; “কামাতুরা আমি, নাথ, তোমার কিঙ্করী ; সরের সুকান্তি দেখি যথা পড়ে খসি কৌমুদিনী তার কোলে, লও কোলে ধরি দাসীরে ; অধর দিয়া অধর পরশি, যথা কৌমুদিনী কাঁপে, কাঁপি থর থরি।” ঊষা ১      কনক উদয়াচলে তুমি দেখা দিলে,                     হে সুর-সুন্দরি! কুমুদ-মুদয়ে আঁখি,           কিন্তু সুখে গায় পাখী,       গুঞ্জরি নিকুঞ্জে ভ্ৰমে ভ্রমর ভ্রমরী; বরসরোজিনী ধনী,              তুমি হে তার স্বজনী,       নিত্য তার প্রাণনাথে আন সাথে করি!2         তুমি দেখাইলে পথ যায় চক্রবাকী                     যথা প্রাণপতি! ব্ৰজাঙ্গনে দয়া করি,              লয়ে চল যথা হরি,         পথ দেখাইয়া তারে দেহ শীঘ্ৰগতি! কাঁদিয়া কাঁদিয়া আঁধা,  আজি গো শ্যামের রাধা,         ঘুচাও আঁধার তার, হৈমবতি সতি!৩         হায়, ঊষা, নিশাকালে আশার স্বপনে                   ছিলাম ভুলিয়া, ভেবেছিনু তুমি, ধনি,            নাশিবে ব্রজ রজনী,         ব্রজের সরোজরবি ব্রজে প্রকাশিয়া! ভেবেছিনু কুঞ্জবনে                    পাইব পরাণধনে         হেরিব কদম্বমূলে রাধা-বিনোদিয়া!৪           মুকুতা-কুণ্ডলে তুমি সাজাও, ললনে,                      কুসুমকামিনী; অান মন্দ সমীরণে                বিহারিতে তার সনে রাধা-বিনোদনে কেন আন না, রঙ্গিণি? রাধার ভূষণ যিনি,         কোথায় আজি গো তিনি            সাজাও আনিয়া তাঁরে রাধা বিরহিণী!৫            ভালে তব জ্বলে, দেবি, আভাময় মণি---                        বিমল কিরণ; ফণিনী নিজ কুন্তলে               পরে মণি কুতূহলে            কিন্তু মণি-কুলরাজা ব্রজের রতন! মধু কহে,ব্রজাঙ্গনে,              এই লাগে মোর মনে            ভূতলে অতুল মণি শ্রীমধুসূদন! কপোতাক্ষ নদ সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে। সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!-- বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে! আর কি হে হবে দেখা?--যত দিন যাবে, প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে বারি-রূপ কর তুমি ; এ মিনতি, গাবে বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে! কবি কে কবি-- কবে কে মোরে? ঘটকালি করি, শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন, সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন? সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন, অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ। আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে; নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে; মরুভূমে-- তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে! কবিগুরু দান্তে নিশান্তে সুবর্ণ-কান্তি নক্ষত্র যেমতি (তপনের অনুচর ) সুচারু কিরণে খেদায় তিমির-পুঞ্জে ; হে কবি, তেমতি প্রভা তব বিনাশিল মানস-ভুবনে অজ্ঞান!জনম তব পরম সুক্ষণে। নব কবি-কুল-পিতা তুমি, মহামতি, ব্রহ্মাণ্ডের এ সুখণ্ডে । তোমার সেবনে পরিহরি নিদ্রা পুনঃ জাগিলা ভারতী। দেবীর প্রসাদে তুমি পশিলা সাহসে সে বিষম দ্বার দিয়া আঁধার নরকে, যে বিষম দ্বার দিয়া, ত্যজি আশা,পশে পাপ প্রাণ, তুমি, সাধু, পশিলা পুলকে। যশের আকাশ হতে কভু কি হে খসে। এ নক্ষত্ৰ?কোন্ কীট কাটে এ কোরকে? কবিতা অন্ধ যে, কি রূপ কবে তার চক্ষে ধরে নলিনী ? রোধিলা বিধি কৰ্ণ-পথ যার, লভে কি সে সুখ কভু বীণার সুস্বরে ? কি কাক, কি পিকধ্বনি,—সম-ভাব তার ! মনের উদ্যান-মাঝে, কুসুমের সার কবিতা-কুসুম-রত্ন !—দয়া করি নরে, কবি-মুখ-ব্রহ্ম-লোকে ঊরি অবতার বাণীরূপে বীণাপাণি এ নর-নগরে।— দুৰ্ম্মতি সে জন, যার মনঃ নাহি মজে কবিতা-অমৃত-রসে ! হায়, সে দুৰ্ম্মতি, পুষ্পাঞ্জলি দিয়া সদা যে জন না ভজে ও চরণপদ্ম, পদ্মবাসিনি ভারতি ! কর পরিমলময় এ হিয়া-সরোজে— তুষি যেন বিজ্ঞে, মা গো, এ মোর মিনতি। কবি-মাতৃভাষা নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন অগণ্য ; তা সবে আমি অবহেলা করি, অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ, বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী | কাটাইনু কতকাল সুখ পরিহরি, এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন, অশন, শয়ন ত্যাজে, ইষ্টদেবে স্মরি, তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন | বঙ্গকুল-লক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে কহিলা-- 'হে বত্স, দেখি তোমার ভকতি, সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী! নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি? কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ-সদনে?' কমলে কামিনী কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে কালিদহে। বসি বামা শতদল‐দলে (নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে মনোহরা।) বাম করে সাপটি হেলনে গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে, বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে!— কার না ভোলে রে মনঃ, এহেন ছলনে! কবিতা‐পঙ্কজ‐রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ, ধন্য তুমি বঙ্গভূমে! যশঃ‐সুধাদানে অমর করিলা তোমা অমরকারিণী বাগ্‌‍দেবী! ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ, এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?— বঙ্গ‐হৃদ‐হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী॥ করুণ-রস সুন্দর নদের তীরে হেরিনু সুন্দরী বামারে মলিন-মুখী,শরদের শশী রাহুর তরাসে যেন!সে বিরলে বসি, মৃদে কাঁদে সুবদনা;ঝরঝরে ঝরি, গলে অশ্রু-বিন্দু,যেন মুক্তা-ফল খসি! সে নদের স্রোতঃ অশ্রু পরশন করি, ভাসে,ফুল্ল কমলের স্বর্ণকান্তি ধরি, মধুলোভী মধুকরে মধুরসে রসি গন্ধামোদী গন্ধবহে সুগন্ধ প্রদানী। না পারি বুঝিতে মায়া,চাহিনু চঞ্চলে চৌদিকে;বিজন দেশ;হৈল দেব-বাণী;--- ''কবিতা-রসের স্রোতঃ এ নদের ছলে; করুণা বামার নাম---রস-কুলে রাণী; সেই ধন্য,বশ সতী যার তপোবলে!'' কল্পনা লও দাসে সঙ্গে রঙ্গে, হেমাঙ্গি কল্পনে, বাগদেবীর প্রিয়সখি, এই ভিক্ষা করি ; হায়, গতিহীন আমি দৈব-বিড়ম্বনে,— নিকুঞ্জ-বিহারী পাখী পিঞ্জর-ভিতরি! চল যাই মনানন্দে গোকুল-কাননে, সরস বসন্তে যথা রাধাকান্ত হরি নাচিছেন, গোপীচয়ে নাচায়ে ; সঘনে পূরি বেণুরবে দেশ! কিম্বা, শুভঙ্করি, চল লো, আতঙ্কে যথা লঙ্কায় অকালে পূজেন উমায় রাম, রঘুরাজ-পতি, কিম্বা সে ভীষণ ক্ষেত্রে, যথা শরজালে নাশিছেন ক্ষত্ৰকুলে পার্থ মহামতি। কি স্বরগে, কি মরতে, অতল পাতালে, নাহি স্থল যথা, দেবি, নহে তব গতি । কাক ও শৃগালী একটি সন্দেশ চুরি করি, উড়িয়া বসিলা বৃক্ষোপরি,               কাক, হৃষ্ট-মনে;     সুখাদ্যের বাস পেয়ে,     আইল শৃগালী ধেয়ে, দেখি কাকে কহে দুষ্টা মধুর বচনে;—    “অপরূপ রূপ তব, মরি!     তুমি কি গো ব্রজের শ্রীহরি,— গোপিনীর মনোবাঞ্ছা?—কহ গুণমণি!     হে নব নীরদ-কান্তি,      ঘুচাও দাসীর ভ্রান্তি, যুড়াও এ কান দুটি করি বেণু-ধ্বনি!      পুণ্যবতী গোপ-বধূ অতি।      তেঁই তারে দিলা বিধি,      তব সম রূপ-নিধি,— মোহ হে মদনে তুমি; কি ছার যুবতী? গাও গীত, গাও, সখে করি এ মিনতি!     কুড়াইয়া কুসুম-রতনে,     গাঁথি মালা সুচারু গাঁথনে, কালিদাস কবিতা-নিকুঞ্জে তুমি পিককুল-পতি। কার গো না মজে মনঃ ও মধুর স্বরে? শুনিয়াছি লোক মুখে আপনি ভারতী, সৃজি মায়াবলে সরঃ বনের ভিতরে, নব নাগরীর বেশে তুষিলেন বরে তোমায়;অমৃত রসে রসনা সিকতি, আপনার স্বর্ণ বীণা অরপিলা করে!— সত্য কি হে এ কাহিনী, কহ, মহামতী? মিথ্যা বা কি বলে বলি! শৈলেন্দ্র-সদনে, লভি জন্ম মন্দাকিনী (আনন্দ জগতে!) নাশেন কলুষ যথা এ তিন ভূবনে; সঙ্গীত-তরঙ্গ তব উথলি ভারতে (পূণ্যভূমি!) হে কবীন্দ্র, সুধা বরিষ্ণে, দেশ-দেশান্তরে কর্ণ তোষে সেই মতে! কুক্কুট ও মণি খুঁটিতে খুঁটিতে ক্ষুদ কুক্কুট পাইল             একটি রতন;--- বণিকে সে ব্যগ্রে জিজ্ঞাসিল;--- “ঠোঁটের বলে না টুটে, এ বস্তু কেমন?”             বণিক্ কহিল,-“ভাই, এ হেন অমূল্য রত্ন, বুঝি, দুটি নাই।'' হাসিল কুক্কুট শুনি;---''তণ্ডুলের কণা বহুমূল্যতর ভাবি;---কি আছে তুলনা?” “নহে দোষ তোর, মূঢ়, দৈব এ ছলনা,             জ্ঞান-শূন্য করিল গোঁসাই!”             এই কয়ে বণিক ফিরিল। মূর্খ যে, বিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে? নর-কুলে পশু বলি লোকে তারে মানে;--- এই উপদেশ কবি দিলা এই ভানে। কুরুক্ষেত্রে যথা দাবানল বেড়ে অনল-প্রাচীরে সিংহ-বৎসে । সপ্ত রথী বেড়িলা তেমতি কুমারে । অনল-কণা-রূপে শর, শিরে পড়ে পুঞ্জে পুঞ্জে পুড়ি, অনিবার-গতি! সে কাল অনল-তেজে, সে বনে যেমতি রোষে, ভয়ে সিংহ-শিশু গরজে অস্থিরে, গরজিলা মহাবাহু চারি দিকে ফিরে রোষে, ভয়ে। ধরি ঘন ধূমের মূরতি, উড়িল চৌদিকে ধুলা, পদ-আস্ফালনে অশ্বের । নিশ্বাস ছাড়ি আর্জ্জুনি বিষাদে, ছাড়িলা জীবন-আশা তরুণ যৌবনে। আঁধারি চৌদিক যথা রাহু গ্রাসে চাঁদে গ্রাসিলা বীরেশে যম । অস্তের শয়নে নিদ্রা গেলা অভিমন্যু অন্যায় বিবাদে। কুসুম ১কেনে এত ফুল তুলিলি, স্বজনি—               ভরিয়া ডালা? মেঘাবৃত হলে,            পরে কি রজনী               তারার মালা? অার কি যতনে,          কুসুম রতনে               ব্রজের বালা?২আর কি পরিবে          কভু ফুলহার              ব্ৰজকামিনী? কেনে লো হরিলি        ভূষণ লতার—              বনশোভিনী? অলি বঁধু তার;           কে আছে রাধার—              হতভাগিনী?৩হায় লো দোলাবি,      সখি,কার গলে             মালা গাঁথিয়া? আর কি নাচে লো     তমালের তলে             বনমালিয়া? প্রেমের পিঞ্জর,         ভাঙি পিকবর,             গেছে উড়িয়া!৪আর কি বাজে লো    মনোহর বাঁশী             নিকুঞ্জবনে? ব্রজ সুধানিধি            শোভে কি লো হাসি,             ব্রজগগনে? ব্রজ কুমুদিনী,            এবে বিলাপিনী             ব্রজভবনে!৫হায় রে যমুনে            কেনে না ডুবিল             তোমার জলে অদয় অক্রূর,             যবে সে আইল             ব্রজমণ্ডলে? ক্রূর দূত হেন,             বধিলে না কেন             বলে কি ছলে?৬হরিল অধম               মম প্রাণ হরি            ব্রজরতন! ব্রজবনমধু                 নিল ব্রজ অরি,             দলি ব্রজবন? কবি মধু ভণে,            পাবে, ব্রজাঙ্গনে,             মধুসূদন! কুসুমের কীট কি পাপে, কহ তা মোরে, লো বন-সুন্দরি, কোমল হৃদয়ে তব পশিল,—কি পাপে— এ বিষম যমদূত ? কাঁদে মনে করি পরাণ যাতনা তব ; কত যে কি তাপে পোড়ায় দুরন্ত তোমা, বিষদন্তে হরি বিরাম দিবস নিশি ! মৃদে কি বিলাপে এ তোমার দুখ দেখি সখী মধুকরী, উড়ি পড়ি তব গলে যবে লো সে কাঁপে ? বিষাদে মলয় কি লো, কহ, সুবদনে, নিশ্বাসে তোমার ক্লেশে, যবে লো সে আসে যাচিতে তোমার কাছে পরিমল-ধনে ? কানন-চন্দ্রিমা তুমি কেন রাহু-গ্রাসে? মনস্তাপ-রূপে রিপু, হায়, পাপ-মনে, এইরূপে, রূপবতি, নিত্য সুখ নাশে ! কৃত্তিবাস জনক জননী তব দিলা শুভ ক্ষণে কৃত্তিবাস নাম তোমা!— কীর্ত্তির বসতি সতত তোমার নামে সুবঙ্গ-ভবনে, কোকিলের কণ্ঠে যথা স্বর, কবিপতি, নয়নরঞ্জন-রূপ কুসুম-যৌবনে, রশ্মি মাণিকের দেহে। আপনি ভারতী, বুঝি কয়ে দিলা নাম নিশার স্বপনে, পূর্ব্ব-জনমের তব স্মরি হে ভকতি! পবন-নন্দন হনু, লঙ্ঘি ভীমবলে সাগর, ঢালিলা যথা রাঘবের কানে সীতার বারতা-রূপ সঙ্গীত-লহরী;– তেমতি, যশস্বি, তুমি সুবঙ্গ-মণ্ডলে গাও গো রামের নাম সুমধুর তানে, কবি-পিতা বাল্মীকিকে তপে তুষ্ট করি!(চতুদ্দর্শপদী কবিতাবলী) কৃষ্ণচূড়া (১)     এই যে কুসুম শিরোপরে, পরেছি যতনে,      মম শ্যাম-চূড়া-রূপ ধরে এ ফুল রতনে! বসুধা নিজ কুন্তলে                 পরেছিল কুতূহলে                     এ উজ্জ্বল মণি, রাগে তারে গালি দিয়া,  লয়েছি আমি কাড়িয়া---      মোর কৃষ্ণ-চূড়া কেনে পরিবে ধরণী?(২)     এই যে কম মুকুতাফল, এ ফুলের দলে,—      হে সখি, এ মোর আঁখিজল, শিশিরের ছলে! লয়ে কৃষ্ণচূড়ামণি,            কাঁদিনু আমি, স্বজনি,                     বসি একাকিনী, তিতিনু নয়ন-জলে;                সেই জল এই দলে      গলে পড়ে শোভিতেছে, দেখ্ লো কামিনি!(৩)     পাইয়া এ কুসুম রতন—শোন্ লো যুবতি,      প্রাণহরি করিনু স্মরণ —স্বপনে যেমতি! দেখিনু রূপের রাশি                মধুর অধরে বাঁশী,                     কদমের তলে, পীত ধড়া স্বর্ণরেখা,         নিকষে যেন লো লেখা,      কুঞ্জশোভা বরগুঞ্জমালা দোলে গলে!(৪)     মাধবের রূপের মাধুরী, অতুল ভুবনে—      কার মনঃ নাহি করে চুরি, কহ লো ললনে? যে ধন রাধায় দিয়া,              রাধার মনঃ কিনিয়া                     লয়েছিলা হরি, সে ধন কি শ্যামরায়,          কেড়ে নিলা পুনরায়?      মধু কহে, তাও কভু হয় কি, সুন্দরি?(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) কেউটিয়া সাপ বিষাগার শিরঃ হেরি মণ্ডিত কমলে তোর, যম-দূত, জন্মে বিস্ময় এ মনে! কোথায় পাইলি তুই,—কোন্ পুণ্যবলে— সাজাতে কুচূড়া তোর, হেন সুভূষণে ? বড়ই অহিত-কারী তুই এ ভবনে। জীব-বংশ-ধ্বংস-রূপে সংসার-মণ্ডলে সৃষ্টি তোর। ছটফটি, কে না জানে, জ্বলে শরীর, বিষাগ্নি যবে জ্বালাস্ দংশনে?— কিন্তু তোর অপেক্ষা রে, দেখাইতে পারি, তীক্ষ্ণতর বিষধর অরি নর-কুলে! তোর সম বাহ-রূপে অতি মনোহারী,— তোর সম শিরঃ-শোভা রূপ-পদ্ম-ফুলে। কে সে ? কবে কবি, শোন্! সে রে সেই নারী, যৌবনের মদে যে রে ধৰ্ম্ম-পথ ভুলে! গদা ও সদা গদা সদা নামে          কোন এক গ্রামে              ছিল দুই জন। দূর দেশে যাইতে হইল;              দুজনে চলিল। ভয়ানক পথ—পাশে পশু ফণী বন, ভল্লুক শার্দ্দূল তাহে গর্জ্জে অনুক্ষণ।              কালসর্প যেমতি বিবরে,              তস্কর লুকায়ে থাকে গিরির গহ্বরে;                    পথিকের অর্থ অপহরে,                    কখন বা প্রাণনাশ করে। কহে সদা গদারে আহ্বানি কর কিরা পর্শি মোর পাণি                    ধৰ্ম্মে সাক্ষী মানি,           আজি হতে আমরা দুজন           হ’নু একপ্রাণ একমন,— সিন্ধু উপসুন্দ যথা—জান সে কাহিনী। আমার মঙ্গল যাহে, তোমার মঙ্গল তাহে, কবচে ভেদিলে বাণ, বক্ষ ক্ষত যথা, অমঙ্গলে অমঙ্গল উভয়ের তথা।         কহে গদা ধর্ম্ম সাক্ষী করি,         কিরা মোর তব কর ধরি, একাত্মা আমরা দোঁহে কি বাঁচি কি মরি। এইরূপে মৈত্র অালাপনে মনানন্দে চলিলা দুজনে। সতর্ক রক্ষকরূপে সদা গদা যেন বন পাশে একদৃষ্টে চাহে অনুক্ষণ, পাছে পশু সহসা করয়ে আক্রমণ। গদা চারি দিকে চায়, এরূপে উভয়ে যায়;        দেখে গদা সম্মুখে চাহিয়া        থল্যে এক পথেতে পড়িয়া। দৌড়ে মূঢ় থল্যে তুলি হেরে কুতূহলে খুলি       পূর্ণ থল্যে সুবর্ণমুদ্রায়,       তোলা ভার, এত ভারি তায়। কহে গদা সহাস বদনে করেছিনু যাত্রা আজি আতি শুভক্ষণে                    আমরা দুজনে। ‘দুজনে?’ কহিল সদা রাগে, ‘লোভে কি করিস্‌ তুই এ অর্থের ভাগে? মোর পূর্ব্ব পুণ্যফলে ভাগ্যদেবী এই ছলে মোরে অর্থ দিলা।                  পাপী তুই, অংশ তোরে                  কেন দিব, ক’ তা মোরে                         এ কি বাললীলা? রবির করের রাশি পরশি রতনে বরাঙ্গের অাভা তার বাড়ায় যতনে;                কিন্তু পড়ি মাটির উপরে               সে কর কি কোন ফল ধরে?               সৎ যে তাহার শোভা ধনে,               অসৎ নিতান্ত তুই, জনম কুক্ষণে। এই কয়ে সদানন্দ থল্যে তুলে লয়ে চলিতে লাগিলা সুখে অগ্রসর হয়ে। বিস্ময়ে অবাক্‌ গদা চলিল পশ্চাতে,--- বামন কি কভু পায় চারু চাঁদে হাতে?              এই ভাবি অতি ধীরে ধীরে              গেল গদা তিতি অশ্রুনীরে। দুই পাশে শৈলকুল ভীষণ-দর্শন, শৃঙ্গ যেন পরশে গগন। গিরিশিরে বরষায় প্রবলা যেমতি              ভীমা স্রোতস্বতী, পথিক দুজনে হেরি তস্করের দল নাবি নীচে করি কোলাহল             উভে আক্রমিল।             সদা অতি কাতরে কহিল,--- শুন ভাই, পঞ্চালে যেমতি,            বিষ্ণু রথিপতি, জিনি লক্ষ রাজে শূর কৃষ্ণায় লভিলা,                   মার চোরে করি রণ-লীলা।                  হিসাবে করিয়া আঁটাআঁটি,                  এই ধন নিও পরে বাঁটি                  তস্করদলের মাথা কাটি। কহে গদা, পাপী অামি, তুমি সৎজন, ধর্ম্মবলে নিজধন করহ রক্ষণ।                 তস্কর-কুল-ঈশ্বরে                 কহিল সে যোড় করে,            অধিপতি ওই জন ভাই, সঙ্গী মাত্র অামি ওর, ধর্ম্মের দোহাই। সঙ্গী মাত্র যদি তুই, যা চলি বর্ব্বর, নতুবা ফেলিব কাটি, কহিল তস্কর। ফাঁদে বাঁধা পাখী যথা পাইলে মুকতি, উড়ি যায় বায়ুপথে অতি দ্রুতগতি,                  গদা পলাইল। সদানন্দ নিরানন্দে বিপদে পড়িল। অালোক থাকিতে তুচ্ছ কর তুমি যারে, বঁধু কি তোমার কভু হয় সে আঁধারে? এই উপদেশ কবি দিলা এ প্রকারে। গদা-যুদ্ধ দুই মত্ত হস্তী যথা ঊর্দ্ধশুণ্ড করি, রকত-বরণ আঁখি,গরজে সঘনে,--- ঘুরায়ে ভীষণ গদা শূন্যে,কাল রণে, গরজিলা দুর্য্যোধন,গরজিলা অরি ভীমসেন।ধূলা-রাশি,চরণ-তাড়নে উড়িল;অধীরে ধরা থর থর থরি কাঁপিলা;---টলিল গিরি সে ঘন কম্পনে; উথলিল দ্বৈপায়নে জলের লহরী, ঝড়ে যেন!যথা মেঘ,বজ্রানলে ভরা, বজ্রানলে ভরা মেঘে আঘাতিলে বলে, উজলি চৌদিক তেজে বাহিরায় ত্বরা বিজলী;গদায় গদা লাগি রণ-স্থলে, উগরিল অগ্নি-কণা দরশন-হরা! আতঙ্কে বিহঙ্গ-দল পড়িল ভূতলে।। গোগৃহ-রণে হুহুঙ্কারি টঙ্কারিলা ধনুঃ ধনুর্দ্ধারী ধনঞ্জয়,মৃত্যুঞ্জয় প্রলয়ে যেমতি! চৌদিকে ঘেরিল বীরে রথ সারি সারি, স্থির বিজলীর তেজঃ,বিজলীর গতি!--- শর-জালে শূর-ব্রজে সহজে সংহারি শূরেন্দ্র,শোভিলা পূনঃ যথা দিনপতি প্রখর কিরণে মেঘে খ-মুখে নিবারি, শোভেন অম্লানে নভে।উত্তরের প্রতি কহিলা আনন্দে বলী;---''চালাও স্যন্দনে বিরাট-নন্দন,দ্রুতে,যথা সৈন-দলে লুকাইছে দুর্য্যোধন হেরি মোরে রণে, তেজস্বী মৈনাক যথা সাগরের জলে বজ্রাগ্নির কাল তেজে ভয় পেয়ে মনে।--- দণ্ডিব প্রচণ্ডে দুষ্টে গাণ্ডীবের বলে।'' গোধূলি (১)              কোথা রে রাখাল-চূড়ামণি? গোকুলের গাভীকুল,          দেখ,সখি,শোকাকুল,               না শুনে সে মুরলীর ধ্বনি!    ধীরে ধীরে গোষ্ঠে সবে পশিছে নীরব,—    আইল গোধূলি, কোথা রহিল মাধব! (২)              আইল লো তিমির যামিনী; তরুডালে চক্রবাকী         বসিয়া কাঁদে একাকী--               কাঁদে যথা রাধা বিরহিণী!    কিন্তু নিশা অবসানে হাসিবে সুন্দরী;    আর কি পোহাবে কভু মোর বিভাবরী?(৩)             ওই দেখ উদিছে গগনে— জগত-জন-রঞ্জন—                সুধাংশু রজনীধন,              প্রমদা কুমুদী হাসে প্রফুল্লিত মনে;    কলঙ্কী শশাঙ্ক, সখি, তোষে লো নয়ন--    ব্রজ-নিষ্কলঙ্ক-শশী চুরি করে মন।(৪)            হে শিশির, নিশার আসার! তিতিও না ফুলদলে         ব্রজে আজি তব জলে,             বৃথা ব্যয় উচিত গো হয় না তোমার;     রাধার নয়ন-বারি ঝরি অবিরল,     ভিজাইবে আজি ব্রজে—যত ফুলদল!(৫)             চন্দনে চর্চ্চিয়া কলেবর, পরি নানা ফুলসাজ,           লাজের মাথায় বাজ;             মজায় কামিনী এবে রসিক নাগর;      তুমি বিনা, এ বিরহ, বিকট মূরতি,      কারে আজি ব্রজাঙ্গনা দিবে প্রেমারতি?(৬)           হে মন্দ মলয় সমীরণ, সৌরভ ব্যাপারী তুমি,       ত্যজ আজি ব্রজভূমি--            অগ্নি যথা জ্বলে তথা কি করে চন্দন?     যাও হে, মোদিত কবলয় পরিমলে,     জুড়াও সুরতক্লান্ত সীমন্তিনী দলে!(৭)          যাও চলি, বায়ু-কুলপতি, কোকিলার পঞ্চস্বর                 বহ তুমি নিরন্তর--          ব্রজে আজি কাঁদে যত ব্রজের যুবতী!     মধু ভণে, ব্রজাঙ্গনে, করো না রোদন,     পাবে বঁধু---অঙ্গীকারে শ্রীমধুসূদন!(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) ছায়া পথ কহ মোরে, শশিপ্রিয়ে, কহ, কৃপা করি, কার হেতু নিত্য তুমি সাজাও গগনে, এ পথ,—উজ্জ্বল কোটি মণির কিরণে ? এ সুপথ দিয়া কি গো ইন্দ্রাণী সুন্দরী আনন্দে ভেটিতে যান নন্দন-সদনে মহেন্দ্রে, সঙ্গেতে শত বরাঙ্গী অপ্সরী, মলিনি ক্ষণেক কাল চারু তারা-গণে— সৌন্দর্য্যে ?—এ কথা দাসে কহ, বিভাবরি ! রাণী তুমি ; নীচ আমি ; তেঁই ভয় করে, অনুচিত বিবেচনা পার করিবারে আলাপ আমার সাথে ; পবন-কিঙ্করে,— ফুল-কুল সহ কথা কহ দিয়া যারে, দেও কয়ে ; কহিবে সে কানে, মৃদুস্বরে, যা কিছু ইচ্ছহ, দেবি, কহিতে আমারে ! জয়দেব চল যাই, জয়দেব, গোকুল-ভবনে তব সঙ্গে, যথা রঙ্গে তমালের তলে শিখীপুচ্ছ-চূড়া শিরে, পীতধড়া গলে নাচে শ্যাম, বামে রাধা— সৌদামিনী ঘনে! না পাই যাদবে যদি, তুমি কুতূহলে পূরিও নিকুঞ্জরাজী বেণুর স্বননে। ভুলিবে গোকুল-কুল এ তোমার ছলে,— নাচিবে শিখিনী সুখে, গাবে পিকগণে,— বহিবে সমীর ধীরে সুস্বর-লহরী,— মৃদুতর কলকলে কালিন্দী আপনি চলিবে। আনন্দে শুনি সে মধুর ধ্বনি, ধৈরজ ধরি কি রবে ব্রজের সুন্দরী? মাধবের রব, কবি, ও তব বদনে, কে আছে ভারতে ভক্ত নাহি ভাবে মনে?(চতুদ্দর্শপদী কবিতাবলী) জলধর ১       চেয়ে দেখ,প্রিয়সখি,কি শোভা গগনে! সুগন্ধ-বহ-বাহন,                  সৌদামিনী সহ ঘন        ভ্ৰমিতেছে মন্দগতি প্রেমানন্দ মনে! ইন্দ্র-চাপ রূপ ধরি,             মেঘরাজ ধ্বজোপরি,        শোভিতেছে কামকেতু—খচিত রতনে!২       লাজে বুঝি গ্রহরাজ মুদিছে নয়ন! মদন উৎসবে এবে,            মাতি ঘনপতি সেবে        রতিপতি সহ রতি ভুবনমোহন! চপলা চঞ্চলা হয়ে,            হাসি প্রাণনাথে লয়ে        তুষিছে তাহায় দিয়ে ঘন আলিঙ্গন!৩       নাচিছে শিখিনী সুখে কেকা রব করি, হেরি ব্রজ কুঞ্জবনে,             রাধা রাধাপ্রাণধনে,        নাচিত যেমতি যত গোকুল সুন্দরী! উড়িতেছে চাতকিনী            শূন্যপথে বিহারিণী        জয়ধ্বনি করি ধনী—জলদ-কিঙ্করী!৪      হায় রে কোথায় আজি শ্যাম জলধর। তব প্রিয় সৌদামিনী,           কাঁদে নাথ একাকিনী       রাধারে ভুলিলে কি হে রাধামনোহর? রত্নচূড়া শিরে পরি,            এস বিশ্ব আলো করি,       কনক উদয়াচলে যথা দিনকর।৫      তব অপরূপ রূপ হেরি, গুণমণি, অভিমানে ঘনেশ্বর             যাবে কাঁদি দেশান্তর,       আখণ্ডল-ধনু লাজে পালাবে অমনি; দিনমণি পুনঃ আসি          উদিবে আকাশে হাসি;       রাধিকার সুখে সুখী হইবে ধরণী;৬      নাচে গোকুল নারী, যথা কমলিনী নাচে মলয়-হিল্লোলে          সরসী-রূপসী-কোলে,      রুণু রুণু মধু বোলে বাজায়ে কিঙ্কিণী! বসাইও ফুলাসনে             এ দাসীরে তব সনে      তুমি নব জলধর এ তব অধীনী!৭     অরে আশা আর কি রে হবি ফলবতী? আর কি পাইব তারে          সদা প্রাণ চাহে যারে      পতি-হারা রতি কি লো পাবে রতি-পতি? মধু কহে হে কামিনী,         আশা মহামায়াবিনী!      মরীচিকা কার তৃষা কবে তোষে সতি? তারা নিত্য তোমা হেরি প্রাতে ওই গিরি-শিরে কি হেতু, কহ তা মোরে, সুচারু-হাসিনি ? নিত্য অবগাহি দেহ শিশিরের নীরে, দেও দেখা, হৈমবতি, থাকিতে যামিনী। বহে কলকল রবে স্বচ্ছ প্রবাহিণী গিরি-তলে ; সে দর্পণে নিরখিতে ধীরে ও মুখের আভা কি লো, আইস, কামিনি, কুসুম-শয়ন থুয়ে সুবর্ণ মন্দিরে?— কিম্বা, দেহ কারাগার তেয়াগি ভূতলে, স্নেহ-কারী জন-প্রাণ তুমি দেব-পুরে, ভাল বাসি এ দাসেরে, আইস এ ছলে হৃদয় আঁধার তার খেদাইতে দূরে ? সত্য যদি, নিত্য তবে শোভ নভস্তলে, জুড়াও এ আঁখি দুটি নিত্য নিত্য ঊরে।। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (চতুর্থ সর্গের শেষার্ধ) মহানন্দে সুন্দ উপসুন্দাসুর বলী অমরারি, তুষি যত দৈত্যকুলেশ্বরে মধুর সম্ভাষে, এবে, সিংহাসন ত্যজি, উঠিলা,--কুসুমবনে ভ্রমণ প্রয়াসে, একপ্রাণ দুই ভাই--বাগর্থ যেমতি! 'হে দানব' আরম্ভিলা নিকুম্ভ-কুমার সুন্দ,--'বীরদলশ্রেষ্ঠ, অমরমর্দ্দন, যার বাহু-পরাক্রমে লভিয়াছি আমি ত্রিদিব-বিভব ; শুন, হে সুরারি রথী- ব্যূহ, যার যাহা ইচ্ছা, সেই তাহা কর | চিরবাদী রিপু এবে জিনিয়া বিবাদে ঘোরতর পরিশ্রমে, আরাম সাধনে মন রত কর সবে |' উল্লাসে দনুজ, শুনি দনুজেন্দ্র-বাণী, অমনি নাদিল | সে ভৈরব-রবে ভীত আকাশ-সম্ভবা প্রতিধ্বনি পলাইলা রড়ে ; মূর্ছা পায়ে খেচর, ভূচর সহ, পড়িল ভূতলে | থরথরি গিরিবর বিন্ধ্য মহামতি কাঁপিলা, কাঁপিলা ভয়ে বসুধা সুন্দরী | দূর কাম্যবনে যথা বসেন বাসব, শুনি সে ঘোর ঘর্ঘর, ত্রস্ত হয়ে সবে, নীরবে এ ওঁর পানে লাগিলা চাহিতে | চারি দিকে দৈত্যদল চলিলা কৌতুকে, যথা শিলীমুখ-বৃন্দ, ছাড়ি মধুমতী- পুরী উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আনন্দে গুঞ্জরি মধুকালে, মধুতৃষা তুষিতে কুসুমে | মধুকুঞ্জে বামাব্রজরঞ্জন দুজন ভ্রমিলা, অশ্বিনী-পুত্র-যুগ সম রূপে অনুপম ; কিম্বা যথা পঞ্চবটি-বনে রাম রামানুজ, --যবে মোহিনী রাক্ষসী সূর্পনখা হেরি দোঁহে, মাতিল মদনে! ভ্রমিতে ভ্রমিতে দৈত্য আসি উতরিলা যথায় ফুলের মাঝে বসে একাকিনী তিলোত্তমা | সুন্দ পানে চাহিয়া সহসা কহে উপসুন্দাসুর,-- 'কি আশ্চর্য্য, দেখ-- দেখ, ভাই, পূর্ণ আজি অপূর্ব সৌরভে বনরাজী! বসন্ত কি আবার আইল? আইস দেখি কোন্ ফুল ফুটি আমোদিছে কানন?' উত্তরে হাসি সুন্দাসুর বলী,-- 'রাজ-সুখে সুখী প্রজা ; তুমি, আমি, রথি, সসাগরা বসুধারে দেবালয় সহ ভুজবলে জিনি, রাজা ; আমাদের সুখে কেন না সুখিনী হবে বনরাজী আজি?' এইরূপে দুইজন ভ্রমিলা কৌতুকে, না জানি কালরূপিণী ভুজঙ্গিনী রূপে ফুটিছে বনে সে ফুল, যার পরিমলে মত্ত এবে দুই ভাই, হায় রে, যেমতি বকুলের বাসে অলি মত্ত মধুলোভে! বিরাজিছে ফুলকুল-মাঝে একাকিনী দেবদূতী, ফুলকুল-ইন্দ্রাণী যেমতি নলিনী! কমল-করে আদরে রূপসী ধরে যে কুসুম, তার কমনীয় শোভা বাড়ে শতগুণ, যথা রবির কিরণে মণি-আভা! একাকিনী বসিয়া ভাবিনী, হেন কালে উতরিলা দৈত্যদ্বয় তথা | চমকিলা বিধুমুখী দেখিয়া সম্মুখে দৈত্যদ্বয়ে, যথা যবে ভোজরাজবালা কুন্তী, দুর্ব্বাসার মন্ত্র জপি সুবদনা, হেরিলা নিকটে হৈম-কিরীটী ভস্করে! বীরকুল-চূড়ামণি নিকুম্ভ-নন্দন উভে ; ইন্দ্রসম রূপ--অতুল ভূবনে | হেরি বীরদ্বয়ে ধনী বিস্ময় মানিয়া একদৃষ্টে দোঁহা পানে লাগিলা চাহিতে, চাহে যথা সূর্য্যমুখী সে সূর্য্যের পানে! 'কি আশ্চর্য্য! দেখ, ভাই,' কহিল শূরেন্দ্র সুন্দ ; 'দেখ চাহি, ওই নিকুঞ্জ-মাঝারে | উজ্জ্বল এ বন বুঝি দাবাগ্নিশিখাতে আজি ; কিম্বা ভগবতী আইলা আপনি গৌরী! চল, যাই ত্বরা, পূজি পদযুগ! দেবীর চরণ-পদ্ম-সদ্মে যে সৌরভ বিরাজে, তাহাতে পূর্ণ আজি বনরাজী |' মহাবেগে দুই ভাই ধাইলা সকাশে বিবশ | অমনি মধু, মন্মথে সম্ভাষি, মৃদুস্বরে ঋতুবর কহিলা সত্বরে ;-- 'হান তব ফুল-শর, ফুল-ধনু ধরি, ধনুর্দ্ধর, যথা বনে নিষাদ, পাইলে মৃগরাজে |' অন্তরীক্ষে থাকি রতিপতি, শরবৃষ্টি করি, দোঁহে অস্থির করিলা, মেঘের আড়ালে পশি মেঘনাদ যথা প্রহারয়ে সীতাকান্ত ঊর্ম্মিলাবল্লভে | জর জর ফুলশরে, উভয়ে ধরিলা রূপসীরে | আচ্ছন্নিল গগন সহসা জীমূত! শোণিতবিন্দু পড়িল চৌদিকে! ঘোষিল নির্ঘোষে ঘন কালমেঘ দূরে ; কাঁপিলা বসুধা ; দৈত্য-কুল-রাজলক্ষ্মী, হায় রে, পূরিলা দেশ হাহাকার রবে! কামমদে মত্ত এবে উপসুন্দাসুর বলী, সুন্দাসুর পানে চাহিয়া কহিলা রোষে ; 'কি কারণে তুমি স্পর্শ এ বামারে, ভ্রাতৃবধূ তব, বীর?' সুন্দ উত্তরিলা-- 'বরিনু কন্যায় আমি তোমার সম্মুখে এখনি! আমার ভার্য্যা গুরুজন তব ; দেবর বামার তুমি ; দেহ হাত ছাড়ি |' যথা প্রজ্বলিত অগ্নি আহুতি পাইলে আরো জ্বলে, উপসুন্দ--হায়, মন্দমতি-- মহা কোপে কহিল--'রে অধর্ম-আচারি, কুলাঙ্গার, ভ্রাতৃবধূ মাতৃসম মানি ; তার অঙ্গ পরশিস্ অনঙ্গ-পীড়নে?' 'কি কহিলি, পামর? অধর্মচারী আমি? কুলাঙ্গার? ধিক্ তোরে, ধিক্, দুষ্টমতি, পাপি! শৃগালের আশা কেশরীকামিনী সহ কেলি করিবার,--ওরে রে বর্ব্বর!' এতেক কহিয়া রোষে নিষ্কোশিলা অসি সুন্দাসুর, তা দেখিয়া বীরমদে মাতি, হুহুঙ্কারি নিজ অস্ত্র ধরিলা অমনি উপসুন্দ,--গ্রহ-দেষে বিগ্রহ-প্রয়াসী | মাতঙ্গিনী-প্রেম-লোভে কামার্ত্ত যেমতি মাতঙ্গ যুঝয়ে, হায়, গহন কাননে রোষাবেশে, ঘোর রণে কুক্ষণে রণিলা উভয়, ভুলিয়া, মরি, পূর্ব্বকথা যত! তমঃসম জ্ঞান-রবি সতত আবরে বিপত্তি! দোঁহার অস্ত্রে ক্ষত দুইজন, তিতি ক্ষিতি রক্তস্রোতে, পড়িলা ভূতলে! কতক্ষণে সুন্দাসুর চেতন পাইয়া, কাতরে কহিল চাহি উপসুন্দ পানে ; 'কি কর্ম করিনু, ভাই, পূর্ব্বকথা ভুলি? এত যে করিনু তপঃ ধাতায় তুষিতে ; এত যে যুঝিনু দোঁহে বাসবের সহ ; এই কি তাহার ফল ফলিল হে শেষে? বালিবন্ধে সৌধ, হায়, কেন নির্ম্মাইনু এত যত্নে? কাম-মদে রত যে দুর্ম্মতি, সতত এ গতি তার বিদিত জগতে | কিন্তু এই দুঃখ, ভাই, রহিল এ মনে-- রণক্ষেত্রে শত্রু জিনি, মরিনু অকালে, মরে যথা মৃগরাজ পড়ি ব্যাধ-ফাঁদে |' এতেক কহিয়া, হায়, সুন্দাসুর বলী, বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, শরীর ত্যাজিলা অমরারি, যথা, মরি, গান্ধারীনন্দন, নরশ্রেষ্ঠ, কুরুবংশ ধ্বংস গণি মনে, যবে ঘোর নিশাকালে অশ্বথামা রথী পাণ্ডব-শিশুর শির দিলা রাজহাতে! মহা শোকে শোকী তবে উপসুন্দ বলী কহিলা ; 'হে দৈত্যপতি, কিসের কারণে লুটায় শরীর তব ধরণীর তলে? উঠ, বীর, চল, পুনঃ দলিগে সমরে অমর! হে শূরমণি, কে রাখিবে আজি দানব-কুলের মান, তুমি না উঠিলে? হে অগ্রজ, ডাকে দাস চির অনুগত উপসুন্দ ; অল্প দোষে দেষী তব পদে কিঙ্কর ; ক্ষমিয়া তারে হে বাসবজয়ী, লয়ে এ বামারে, ভাই, কেলি কর উঠি!' এইরূপে বিলাপিয়া উপসুন্দ রথী, অকালে কালের হস্তে প্রাণ সমর্পিলা কর্মদোষে | শৈলাকারে রহিলা দুজনে ভূমিতলে, যতা শৈল--নীরব, অচল | সমরে পড়িল দৈত্য | কন্দর্প অমনি দর্পে শঙ্খ ধরি ধীর নাদিলা গম্ভিরে | বহি সে বিজয় নাদ আকাশ সম্ভবা প্রতিধ্বনি, রড়ে ধনী ধাইলা আশুগা মহারঙ্গে | তুঙ্গ শৃঙ্গে, পর্ব্বতকন্দরে, পশিল স্বর-তরঙ্গ | যথা কাম্যবনে দেব-দল, কতক্ষণে উতরিলা তথা নিরাকারা দূতী | 'উঠ,' কহিলা সুন্দরী, 'শীঘ্র করি উঠ, ওহে দেবকুলপতি! ভ্রাতৃভেদে ক্ষয় আজ দানব দুর্জ্জয় |' যথা অগ্নি-কণা-স্পর্শে বারুদ-কণিক- রাশি, ইরম্মদরূপে, উঠয়ে নিমিষে গরজি পবন-মার্গে, উঠিলা তোমতি দেবসৈন্য শূণ্যপথে! রতনে খচিত ধ্বজদণ্ড ধরি করে, চিত্ররথ রথী উন্মীলিলা দেবকেতু কৌতুকে আকাশে | শোভিল সে কেতু, শোভে ধূমকেতু যথা তারাশির,--তেজে ভস্ম করি সুররিপু! বাজাইল রণবাদ্য বাদ্যকর-দল নিক্কণে | চলিলা সবে জয়ধ্বনি করি | চলিলেন বায়ুপতি খগপতি যথা হেরি দূরে নাগবৃন্দ--ভয়ঙ্কর গতি ; সাপটি প্রচণ্ড দন্ড চলিলা হরষে শমন ; চলিলা ধনুঃ টঙ্কারিয়া রথী সেনানী ; চলিলা পাশি ; অলকার পতি, গদা হস্তে ; স্বর্ণরথে চলিলা বাসব, ত্বিষায় জিনিয়া ত্বিষাম্পতি দিনমণি | চলে বাসবীয় চমূ জীমূত যেমতি ঝড় সহ মহা রড়ে ; কিম্বা চলে যথা প্রমথনাথের সাথে প্রমথের কুল নাশিতে প্রলয়কালে, ববম্বম রবে-- ববম্বম রবে যবে রবে শিঙ্গাধ্বনি! ঘোর নাদে দেবসৈন্য প্রবেশিল আসি দৈত্যদেশে | যে যেখানে আছিল দানব, হতাশ তরাসে কেহ, কেহ ঘোর রণে মরিল! মুহুর্তে, আহা, যত নদ নদী প্রস্রবণ, রক্তময় হইয়া বহিল! শৈলাকার শবরাশি গগন পরশে | শকুনি গৃধিনী যত--বিকট মুরতি-- যুড়িয়া আকাশদেশ, উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাংসলোভে | বায়ুসখা সুখে বায়ু সহ শত শত দৈত্যপুরী লাগিলা দহিতে | মরিল দানব-শিশু, দানব-বনিতা | হায় রে, যে ঘোর বাত্যা দলে তরু-দলে বিপিনে, নাশে সে মূঢ় মুকুলিত লতা, কুসুম-কাঞ্চন-কান্তি! বিধির এ লীলা | বিলাপী বিলাপধ্বনি জয়নাদ সহ মিশিয়া পূরিল বিশ্ব ভৈরব আরবে! কত যে মারিলা যম কে পারে বর্ণিতে? কত যে চূর্ণিলা, ভাঙ্গি তুঙ্গ শৃঙ্গ, বলী প্রভঞ্জন ;--তীক্ষ্ণ শরে কত যে কাটিলা সেনানী ; কত যে যূতনাথ গদাঘাতে নাশিলা অলকানাথ ; কত যে প্রচেতা পাশী ; হায়, কে বর্ণিবে, কার সাধ্য এত? দানব-কুল-নিধনে, দেব-কুল-নিধি শচিকান্ত, নিতান্ত কাতর হয়ে মনে দয়াময়, ঘোর নাদে শঙ্খ নিনাদিলা রণভূমে | দেবসেনা, ক্ষান্ত দিয়া রণে অমনি, বিনতভাবে বেড়িলা বাসবে | কহিলেন সুনাসীর গম্ভীর বচনে ;-- 'সুন্দ-উপসুন্দাসুর, হে শূরেন্দ্র রথি, অরি মম, যমালয়ে গেছে দোঁহে চলি অকালে কপালদোষে | আর কারে ডরি? তবে বৃথা প্রাণিহত্যা কর কি কারণে? নীচের শরীরে বীর কভু কি প্রহারে? অস্ত্র? উচ্চ তরু--সেই ভস্ম ইরম্মদে | যাক্ চলি নিজালয়ে দিতিসুত যত | বিষহীন ফণী দেখি কে মারে তাহারে? আনহ চন্দনকাষ্ঠ কেহ, কেহ ঘৃত ; আইস সবে দানবের প্রেতকর্ম্ম করি যথা বিধি | বীর-কুলে সামান্য সে নহে, তোমা সবা যার শরে কাতর সমরে! বিশ্বনাশী বজ্রাগ্নিরে অবহেলা করি, জিনিল যে বাহুবলে দেবকুলরাজে, কেমনে তাহার দেহ দিবে সবে আজি খেচর ভূচর জীবে? বীরশ্রেষ্ঠ যারা, বীরারি পূজিতে রত সতত জগতে!' এতেক কহিলা যদি বাসব, অমনি সাজাইলা চিতা চিত্ররথ মহারথী | রাশি রাশি আনি কাষ্ঠ সুরভি, ঢালিলা ঘৃত তাহে | আসি শুচি--সর্ব্বশুচিকারী-- দহিলা দানব-দেহ | অনুমৃতা হয়ে, সুন্দ-উপসুন্দাসুর-মহিষী রূপসী গেলা ব্রহ্মলোকে,--দোঁহে পতিপরায়ণা | তবে তিলোত্তমাপানে চাহি সুরপতি জিষ্ণু, কহিলেন দেব মৃদু মন্দস্বরে ;-- 'তারিলে দেবতাকুলে অকূলপাথারে তুমি ; দলি দানবেন্দ্রে তোমার কল্যাণে, হে কল্যাণি, স্বর্গলাভ আবার করিনু | এ সুখ্যাতি তব, সতি, ঘুষিবে জগতে চিরদিন | যাও এবে (বিধির এ বিধি) সূর্য্যলোকে ; সুখে পশি আলোক-সাগরে, কর বাস, যথা দেবী কেশব-বাসনা, ইন্দুবদনা ইন্দিরা--জলধির তলে |' চলি গেলা তিলোত্তমা--তারকারা ধনী-- সূর্য্যলোকে | সুরসৈন্য সহ সুরপতি অমরাপুরীতে হর্ষে পুনঃ প্রবেশিলা | দুঃশাসন মেঘ-রূপ চাপ ছাড়ি, বজ্রাগ্নি যেমনে পড়ে পাহাড়ের শৃঙ্গে ভীষণ নির্ঘোষে ; হেরি ক্ষেত্রে ক্ষত্র-গ্লানি দুষ্ট দুঃশাসনে, রৌদ্ররূপী ভীমসেন ধাইলা সরোষে ; পদাঘাতে বসুমতী কাঁপিলা সঘনে ; বাজিল ঊরুতে অসি গুরু অসি-কোষে যথা সিংহ সিংহনাদে ধরি মৃগে বনে কামড়ে প্রগাঢ়ে ঘাড় লহু-ধারা শোষে ; বিদরি হৃদয় তার ভৈরব-আরবে, পান করি রক্ত-স্রোতঃ গৰ্জ্জিলা পাবনি । “মানাগ্নি নিবানু আমি আজি এ আহবে বর্ব্বর!–পাঞ্চালী সতী, পাণ্ডব-রমণী, তার কেশপাশ পর্শি, আকর্ষিলি যবে, কুরু-কুলে রাজলক্ষ্মী ত্যজিলা তখনি।" দে—দোল ওই যে শুনিছ ধ্বনি ও নিকুঞ্জ-বনে, ভেবো না গুঞ্জরে অলি চুম্বি ফুলাধরে ; ভেবো না গাইছে পিক কল কুহরণে, তুষিতে প্রত্যূষে আজি ঋতু-রাজেশ্বরে ! দেখ, মীলি,ভক্ত জন, ভক্তির নয়নে, অধোগামী দেব-গ্রাম উজ্জ্বল-অম্বরে,— আসিছেন সবে হেথা--এই দোলাসনে-- পূজিতে রাখালরাজ—রাধা-মনোহরে ! স্বর্গীয় বাজনা ওই ! পিককুল কবে, কবে বা মধুপ, করে হেন মধু-ধ্বনি ? কিন্নরের বীনা-তান অপ্সরার রবে ! আনন্দে কুসুম-সাজ ধরেন ধরণী,— নন্দন-কানন-জাত পরিমল ভবে বিতরেন বায়ু-ইন্দ্র পবন আপনি ! দেবদৃষ্টি শচী সহ শচীপতি স্বর্ণ-মেঘাসনে,           বাহিরিলা বিশ্ব দরশনে।           আরোহি বিচিত্র রথ,           চলে সঙ্গে চিত্ররথ, নিজদলে বিমণ্ডিত অস্ত্র আভরণে, রাজাজ্ঞায় আশুগতি বহিলা বাহনে।          হেরি নানা দেশ সুখে,          হেরি বহু দেশ দুঃখে—          ধর্ম্মের উন্নতি কোন স্থলে;          দেব অগ্রগতি বঙ্গে উতরিল। কহিলা মাহেন্দ্র সতী শচী সুলোচনা,          কোন্‌ দেশে এবে গতি,          কহ হে প্রাণের পতি, এ দেশের সহ কোন্ দেশের তুলনা?          উত্তরিলা মধুর বচনে          বাসব, লো চন্দ্রাননে, বঙ্গ এ দেশের নাম বিখ্যাত জগতে।          ভারতের প্রিয় মেয়ে          মা নাই তাহার চেয়ে নিত্য অলঙ্কৃত হীরা, মুক্ত, মরকতে।          সস্নেহে জাহ্নবী তারে          মেখলেন চারি ধারে বরুণ ধোয়েন পা দু’খানি।          নিত্য রক্ষকের বেশে          হিমাদ্রি উত্তর দেশে          পরেশনাথ আপনি          শিরে তার শিরোমণি সেই এই বঙ্গভূমি শুন লো ইন্দ্রাণি!         দেবাদেশে আশুগতি         চলিলেন মৃদুগতি         উঠিল সহসা ধ্বনি সভয়ে শচী আমনি ইন্দ্রেরে সুধিলা,—         নীচে কি হতেছে রণ         কহ সখে বিবরণ হেন দেশে হেন শব্দ কি হেতু জন্মিলা?         চিত্ররথ হাত জোড় করি,         কহে, শুন, ত্রিদিব-ঈশ্বরি! ‘বিবাহ করিয়া এক বালক যাইছে,         পত্নী আসে দেখ তার পিছে।’ সুধাংশুর অংশুরূপে নয়ন-কিরণ         নীচদেশে পড়িল তখন। দ্বেষ শত ধিক্ সে মনেরে, কাতর যে মনঃ পরের সুখেতে সদা এ ভব-ভবনে ! মোর মতে নর-কুলে কলঙ্ক সে জন পোড়ে আঁখি যার যেন বিষ-বরিষণে, বিকশে কুসুম যদি, গায় পিক-গণে বাসন্ত আমোদে পূরি ভাগ্যের কানন পরের! কি গুণ দেখে, কব তা কেমনে, প্রসাদ তোমার, রম, কর বিতরণ তুমি ? কিন্তু এ প্রসাদ, নমি যোড় করে মাগি রাঙা পায়ে, দেবি; দ্বেষের অনলে ( সে মহানরক ভবে!) সুখী দেখি পরে, দাসের পরাণ যেন কভু নাহি জ্বলে, যদিও না পাত তুমি তার ক্ষুদ্র ঘরে রত্ন-সিংহাসন, মা গো, কুভাগ্যের বলে! নদী-তীরে প্রাচীন দ্বাদশ শিব-মন্দির এ মন্দির-বৃন্দ হেথা কে নির্ম্মিল কবে? কোন্ জন?কোন্ কালে?জিজ্ঞাসিব কারে? কহ মোরে কহ তুমি কল কল রবে, ভুলে যদি,কল্লোলিনি,না থাক লো তারে। এ দেউল-বর্গ গাঁথি উৎসর্গিল যবে সে জন,ভাবিল কি সে,মাতি অহঙ্কারে, থাকিবে এ কীর্ত্তি তার চিরদিন ভবে, দীপরূপে আলো করি বিস্মৃতি-আঁধারে? বৃথা ভাব,প্রবাহিণি,দেখ ভাবি মনে। কি আছে লো চিরস্থায়ী এ ভবমণ্ডলে? গুঁড়া হয়ে উড়ি যায় কালের ফীড়নে পাথর;হুতাশে তার কি ধাতু না গলে?--- কোথা সে?কোথা বা নাম?ধন?লো ললনে? হায়,গত,যথা বিম্ব তব চল জলে! নন্দন-কানন লও দাসে, হে ভারতি, নন্দন-কাননে, যথা ফোটে পারিজাত ; যথায় উৰ্ব্বশী,--- কামের আকাশে বামা চির-পূর্ণ-শশী,— নাচে করতালি দিয়া বীণার স্বননে ; যথা রম্ভা, তিলোত্তমা, অলকা রূপসী মোহে মনঃ সুমধুর স্বর বরিষণে ,— মন্দাকিনী বাহিনীর স্বর্ণ তীরে বসি, মিশায়ে সু-কণ্ঠ-রব বীচির বচনে ! যথায় শিশিরের বিন্দু ফুল্ল ফুল-দলে সদা সদ্যঃ ; যথা অলি সতত গুঞ্জরে ; বহে যথা সমীরণ বহি পরিমলে ; বসি যথা শাখা-মুখে কোকিল কুহরে ; লও দাসে ; আঁখি দিয়া দেখি তব বলে ভাব-পটে কল্পনা যা সদা চিত্র করে। নিকুঞ্জবনে (১)          যমুনা পুলিনে আমি ভ্রমি একাকিনী,                     হে নিকুঞ্জবন, না পাইয়া ব্রজেশ্বরে,              আইনু হেথা সত্বরে,           হে সখে, দেখাও মোরে ব্রজের রঞ্জন! সুধাংশু সুধার হেতু,            বাঁধিয়ে আশার সেতু,           কুমুদীর মনঃ যতা উঠে গো গগনে, হেরিতে মুরলীধর---             রূপে যিনি শশধর---           আসিয়াছি আমি দাসী তোমার সদনে--- তুমি হে অম্বর, কুঞ্জবর, তব চাঁদ নন্দের নন্দন!(২)          তুমি জান কত ভাল বাসি শ্যামধনে                     আমি অভাগিনী; তুমি জান, সুভাজন,             হে কুঞ্জকুল রাজন,           এ দাসীরে কত ভাল বাসিতেন তিনি! তোমার কুসুমালয়ে           যবে গো অতিথি হয়ে,           বাজায়ে বাঁশরী ব্রজ মোহিত মোহন, তুমি জান কোন ধনী            শুনি সে মধুর ধ্বনি,           অমনি আসি সেবিত ও রাঙা চরণ, যথা শুনি জলদ-নিনাদ ধায় রড়ে প্রমদা শিখিনী।(৩)          সে কালে---জ্বলে রে মনঃ স্মরিলে সে কথা,                     মঞ্জু কুঞ্জবন,--- ছায়া তব সহচরী                সোহাগে বসাতো ধরি           মাধবে অধীনী সহ পাতি ফুলাসন; মুঞ্জরিত তরুবলী,                গুঞ্জরিত যত অলি,           কুসুম-কামিনী তুলি ঘোমটা অমনি, মলয়ে সৌরভধন                    বিতরিত অনুক্ষণ, দাতা যথা রাজেন্দ্রনন্দিনী---গন্ধামোদে মোদিয়া কানন!(৪)          পঞ্চস্বরে কত যে গাইত পিকবর                     মদন-কীর্ত্তন,--- হেরি মম শ্যাম-ধন                 ভাবি তারে নবঘন,           কত যে নাচিত সুখে শিখিনী, কানন,--- ভুলিতে কি পারি তাহা,     দেখেছি শুনেছি যাহা?           রয়েছে সে সব লেখা রাধিকার মনে। নলিনী ভুলিবে যবে             রবি-দেবে, রাধা তবে           ভুলিবে, হে মঞ্জু কুঞ্জ, ব্রজের রঞ্জনে। হায় রে, কে জানে যদি ভুলি যবে আসি গ্রাসিবে শমন।(৫)          কহ, সখে, জান যদি কোথা গুণমণি---                     রাধিকারমণ? কাম-বঁধু যথা মধু                 তুমি হে শ্যামের বঁধু           একাকী আজি গো তুমি কিসের কারণ,---           হে বসন্ত, কোথা আজি তোমার মদন? তব পদে বিলাপিনী          কাঁদি আমি অভাগিনী,           কোথা মম শ্যামমণি---কহ কুঞ্জবর! তোমার হৃদয় দয়া,              পদ্মে যথা পদ্মালয়া,           বধো না রাধার প্রাণ না দিয়া উত্তর! মধু কহে, শুন ব্রজাঙ্গনে, মধুপুরে শ্রীমধুসূদন!(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) নিশা বসন্তে কুসুম-কুল যথা বনস্থলে, চেয়ে দেখ, তারাচয় ফুটিছে গগনে, মৃগাক্ষি !— সুহাস-মুখে সরসীর জলে, চন্দ্রিমা করিছে কেলি প্রেমানন্দ-মনে। কত যে কি কহিতেছে মধুর স্বননে পবন— বনের কবি, ফুল্ল ফুল-দলে, বুঝিতে কি পার, প্রিয়ে ? নারিবে কেমনে, প্ৰেম-ফুলেশ্বরী তুমি প্রমদা-মণ্ডলে? এ হৃদয়, দেখ, এবে ওই সরোবরে,— চন্দ্রিমার রূপে এতে তোমার মূরতি ! কাল বলি অবহেলা, প্রেয়সি, যে করে নিশায়, আমার মতে সে বড় দুৰ্ম্মতি। হেন সুবাসিত শ্বাস, হাস স্নিগ্ধ করে যার, সে কি কভু মন্দ, ওলো রসবতি? নিশাকালে নদী-তীরে বট-বৃক্ষ-তলে শিব-মন্দির রাজসূয়-যজ্ঞে যথা রাজাদল চলে রতন-মুকুট শিরে ; আসিছে সঘনে অগন্য জোনাকীব্রজ, এই তরুতলে পূজিতে রজনী-যোগে বৃষভ-বাহনে। ধূপরূপ পরিমল অদূর কাননে পেয়ে, বহিতেছে তাহে হেথা কুতূহলে মলয় ; কৌমুদী, দেখ, রজত-চরণে বীচি-রব-রূপ পরি নূপুর, চঞ্চলে নাচিছে; আচাৰ্য্য-রূপে এই তরু-পতি উচ্চারিছে বীজমন্ত্র। নীরবে অম্বরে, তারাদলে তারানাথ করেন প্রণতি (বোধ হয়) আরাধিয়া দেবেশ শঙ্করে ! তুমিও, লো কল্লোলিনি, মহাব্ৰতে ব্ৰতী,— সাজায়েছ, দিব্য সাজে, বর-কলেবরে ! নূতন বৎসর ভূত-রূপ সিন্ধু-জলে গড়ায়ে পড়িল বৎসর, কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে। নিত্যগামী রথচক্র নীরবে ঘুরিল আবার আয়ুর পথে। হৃদয়-কাননে, কত শত আশা-লতা শুখায়ে মরিল, হায় রে, কব তা কারে, কব তা কেমনে! কি সাহসে আবার বা রোপিব যতনে । সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিফল হইল! বাড়িতে লাগিল বেলা ; ডুবিবে সত্বরে তিমিরে জীবন-রবি। আসিছে রজনী, নাহি যার মুখে কথা বায়ু-রূপ স্বরে ; নাহি যার কেশ-পাশে তারা-রূপ মণি ; চির-রুদ্ধ দ্বার যার নাহি মুক্ত করে ঊষা,—তপনের দূতী, অরুণ-রমণী! পরলোক আলোক-সাগর-রূপ রবির কিরণে, ডুবে যথা প্রভাতের তারা সুহাসিনী ;– ফুটে যথা প্রেমামোদে, আইলে যামিনী, কুসুম-কুলের কলি কুসুম-যৌবনে ;– বহি যথা সুপ্রবাহে প্রবাহ-বাহিনী, লভে নিরবাণ সুখে সিন্ধুর চরণে,--- এই রূপে ইহ লোক—শাস্ত্রে এ কাহিনী— নিরস্তর সুখরূপ পরম রতনে পায় পরে পর-লোকে, ধরমের বলে । হে ধৰ্ম্ম, কি লোভে তবে তোমারে বিস্মরি, চলে পাপ-পথে নর, ভুলি পাপ-ছলে ? সংসার-সাগর-মাঝে তব স্বর্ণতরি তেয়াগি, কি লোভে ডুবে বাতময় জলে ? দু দিন বাঁচিতে চাহে, চির দিন মরি ? পরিচয় যে দেশে উদয়ি রবি উদয়-অচলে, ধরণীর বিম্বাধর চুম্বেন আদরে প্রভাতে; যে দেশে গাই, সুমধুর কলে, ধাতার প্রশংসা-গীত, বহেন সাগরে জাহ্নবী; যে দেশে ভেদি বারিদ-মণ্ডলে (তুষারে বপিত বাস উর্দ্দ্ধ কলেবরে, রজতের উপবীত স্রোতঃ-রূপে গলে,) শোভেন শৈলেন্দ্র-রাজ, মানঃ-সরোবরে (স্বচ্ছ দরপণ!) হেরি ভীষণ মূরতি;– যে দেশে কুহরে পিক বাসন্ত কাননে;– দিনেশে যে দেশে সেবে নলিনী যুবতী;— চাঁদের আমোদ যথা কুমুদ-সদনে;– সে দেশে জনম মম; জননী ভারতী; তেঁই প্রেম-দাস আমি, ওলো বরাঙ্গনে! পরেশনাথ গিরি হেরি দূরে উর্দ্ধশিরঃ তোমার গগনে, অচল, চিত্রিত পটে জীমূত যেমতি। ব্যোমকেশ তুমি কি হে, (এই ভাবি মনে) মজি তপে, ধরেছ ও পাষাণ-মূরতি? এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে? তবে যদি নহ তুমি দেব উমাপতি, কহ, কোন্ রাজবীর তপোব্রতে ব্ৰতী— খচিত শিলার বর্ম্ম কুসুম-রতনে তোমার? যে হর-শিরে শশিকলা হাসে, সে হর কিরীটরূপে তব পুণ্য শিরে, চিরবাসী, যেন বাঁধা চিরপ্রেমপাশে! হেরিলে তোমায় মনে পড়ে ফাল্গুনিরে সেবিলা বীরেশ যবে পাশুপত আশে ইন্দ্ৰকীল নীলচূড়ে দেব ধূর্জ্জটিরে। পুরুরবা যথা ঘোর বনে ব্যাধ বধি অজাগরে, চিরি শিরঃ তার, লভে অমূল রতনে ; বিমুখি কেশীরে আজি, হে রাজা, সমরে, লভিলা ভুবন-লোভ তুমি কাম-ধনে ! হে সুভগ, যাত্রা তব বড় শুভ ক্ষণে !— ঐ যে দেখিছ এবে, গিরির উপরে, আচ্ছন্ন, হে মহীপতি, মূৰ্চ্ছা-রূপ ঘনে চাঁদেরে, কে ও, তা জান ? জিজ্ঞাস সত্বরে, পরিচয় দেবে সখী, সমুখে যে বসি । মানসে কমল, বলি, দেখেছ নয়নে ; দেখেছ পূর্ণিমা-রাত্রে শরদের শশী ; বধিয়াছ দীর্ঘ-শৃঙ্গী কুরঙ্গে কাননে;--- সে সকলে ধিক্ মান ! ওই হে উৰ্ব্বশী ! সোণার পুতলি যেন, পড়ি অচেতনে। পুরুলিয়া পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে? কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে, হে পুরুল্যে!দেখাইয়া ভকত-মণ্ডলে! শ্ৰীভ্রষ্ট সরস সম, হায়, তুমি ছিলে, অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে; অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে; এবে রাশি রাশি পদ্ম ফোটে তব জলে, পরিমল-ধনে ধনী করিয়া অনিলে! প্রভুর কি অনুগ্রহ! দেখ ভাবি মনে, (কত ভাগ্যবান্‌ তুমি কব তা কাহারে?) রাজাসন দিলা তিনি ভূপতিত জনে! উজলিলা মুখ তব বঙ্গের সংসারে; বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি, ভাসুক সত্যতা-স্রোতে নিত্য তব তরি। পৃথিবী নির্ম্মি গোলাকারে তোমা আরোপিলা যবে বিশ্ব-মাঝে স্রষ্টা ধরা! অতি হৃষ্ট মনে চারি দিকে তারা-চয় সুমধুর রবে ( বাজায়ে সুবর্ণ বীণা ) গাইল গগনে, কুল-বালা-দল যবে বিবাহ-উৎসবে হুলাহুলি দেয় মিলি বধূ-দরশনে। আইলেন আদি প্রভা হেম-ঘনাসনে, ভাসি ধীরে শূন্যরূপ সুনীল অর্ণবে, দেখিতে তোমার মুখ। বসন্ত আপনি আবরিলা শ্যাম বাসে বর কলেবরে; আঁচলে বসায়ে নব ফুলরূপ মণি, নব ফুল-রূপ মণি কবরী উপরে। দেবীর আদেশে তুমি,লো নব রমণি, কটিতে মেঘলা-রূপে পরিলা সাগরে। প্রতিধ্বনি (১)          কে তুমি, শ্যামেরে ডাক রাধা যথা ডাকে---                     হাহাকার রবে? কে তুমি, কোন্ যুবতী,       ডাক এ বিরলে, সতি,           অনাথা রাধিকা যথা ডাকে গো মাধবে?           অভয় হৃদয়ে তুমি কহ আসি মোরে—           কে না বাঁধা এ জগতে শ্যাম-প্রেম-ডোরে।(২)          কুমুদিনী কায়, মনঃ সঁপে শশধরে—                     ভুবনমোহন! চকোরি শশীর পাশে,        আসে সদা সুধা আশে,           নিশি হাসি বিহারয়ে লয়ে সে রতন;           এ সকল দেখিয়া কি কোপে কুমুদিনী?           স্বজনী উভয় তার---চকোরী, যামিনী!(৩)          বুঝিলাম এতক্ষণে কে তুমি ডাকিছ---                     আকাশ-নন্দিনি---! পৰ্ব্বত গহন বনে,                   বাস তব, বরাননে,           সদা রঙ্গরসে তুমি রত, হে রঙ্গিণি!           নিরাকারা ভারতি, কে না জানে তোমারে?           এসেছ কি কাঁদিতে গো লইয়া রাধারে?(৪)          জানি আমি, হে স্বজনি, ভাল বাস তুমি,                     মোর শ্যামধনে! শুনি মুরারির বাঁশী,          গাইতে তুমি গো আসি,           শিখিয়া শ্যামের গীত, মঞ্জু কুঞ্জবনে!           রাধা রাধা বলি যবে ডাকিতেন হরি—           রাধা রাধা বলি তুমি ডাকিতে, সুন্দরি!(৫)          যে ব্রজে শুনিতে আগে সঙ্গীতের ধ্বনি,                     আকাশসম্ভবে, ভূতলে, নন্দবন,                  আছিল যে বৃন্দাবন,           সে ব্রজ পূরিছে আজি হাহাকার রবে!           কত যে কাঁদে রাধিকা কি কব, স্বজনি,           চক্রবাকী সে---এ তার বিরহ রজনী!(৬)          এস, সখি, তুমি আমি ডাকি দুই জনে                     রাধা-বিনোদন; যদি এ দাসীর রব,                  কুরব ভেবে মাধব           না শুনেন, শুনিবেন তোমার বচন!           কত শত বিহঙ্গিনী ডাকে ঋতুবরে—           কোকিলা ডাকিলে তিনি আসেন সত্বরে!(৭)          না উত্তরি মোরে, রামা, যাহা আমি বলি,                     তাই তুমি বল? জানি পরিহাসে রত,              রঙ্গিণি, তুমি সতত,           কিন্তু আজি উচিত কি তোমার এ ছল?           মধু কহে, এই রীতি ধরে প্রতিধ্বনি,—           কাঁদ, কাঁদে ; হাস, হাসে, মাধব-রমণি!(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) প্রথম সর্গ সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি, কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে, পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে — অজেয় জগতে — ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা? বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া, বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন) যবে খরতর শরে, গহন কাননে, ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা, তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি। কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে? নরাধম আছিল যে নর নরকুলে চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে, মৃ্ত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি! হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে, সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে! হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে? কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি, মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া। — তুমিও আইস, দেবি তুমি মধুকরী কল্পনা! কবির ঢিত্ত-ফুলবন-মধু লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।কনক-আসনে বসে দশানন বলী — হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি সভাসদ, নতভাবে বসে চারি দিকে। ভূতলে অতুল সভা — স্ফটিকে গঠিত; তাহে শোভে রত্নরাজি, মানস-সরসে সরস কমলকুল বিকশিত যথা। শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, স্তম্ভ সারি সারি ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি, বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা, পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে (খচিত মুকুলে ফুল) পল্লবের মালা ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে রতনসম্ভবা বিভা — ঝলসি নয়নে! সুচারু চামর চারুলোচনা কিঙ্করী ঢুলায়; মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!— ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ মুরতি, পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধে বহি, অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি কাকলী লহরী, মরি! মনোহর, যথা বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল বিপিনে! কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?এহেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি, বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে অবিরল অশ্রুধারা — তিতিয়া বসনে, যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর জোড় করি, দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব কলেবর। বীরবাহু সহ যত যোধ শত শত ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল তরঙ্গ গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে— নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতি সম। এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন, হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে। আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া, বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, কহিলা রাবণ;—“নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা, রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে? হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি! কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে? কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি, হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে এ বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে! বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে এর শরে! তা না হলে মরিত কি কভু শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম, অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত— রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, সূর্পণখা, কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই অভাগী, কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা এ ভুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী) পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি আনিনু এ হৈম গেহে? হায় ইচ্ছা করে, ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে! কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি; নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী; তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে? কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস– কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা হস্তিনায় অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে!তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ) কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা নতভাবে; — “হে রাজন্, ভুবন বিখ্যাত, রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে! হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে এ জগতে? ভাবি, প্রভু দেখ কিন্তু মনে;— অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত। মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;— “যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত। কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম, তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয় ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে, যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”এতেক কহিয়া রাজা, দূত পানে চাহি, আদেশিলা,— “কহ, দূত, কেমনে পড়িল সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ জুড়ি, আরম্ভিলা ভগ্নদূত;— “হায়, লঙ্কাপতি, কেমনে কহিব আমি অপূর্ব কাহিনী? কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বীরতা?— মদকল করী যথা পশে নলবনে, পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে ধনুর্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে! শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে; সিংহনাদে; জলধির কল্লোলে; দেখেছি দ্রুত ইরম্মদে, দেব, ছুটিতে পবন– পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে, এহেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড-টঙ্কারে! কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহু সহ রণে, যূথনাথ সহ গজযূথ যথা। ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,— মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে শনশনে!— ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু! কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে পুত্র তব, হে রাজন্! কত ক্ষণ পরে, প্রবেশিলা, যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব। কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ, বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে খচিত,”— এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া পূর্বদুঃখ! সভাজন কাঁদিলা নীরবে।অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ, মন্দোদরীমনোহর;— “কহ, রে সন্দেশ– বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?” “কেমনে, হে মহীপতি,” পুনঃ আরম্ভিল ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি, কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি? অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্যক্ষ, সরোষে কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি বায়ু সহ নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম ধূমপুঞ্জসম চর্মাবলীর মাঝারে অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!— আর কি কহিব, দেব? পূর্বজন্মদোষে, একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ, কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে? কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি, হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহু সহ রণভূমে? কিন্তু নহি নিজ দোষে দোষী। ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি, রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।” এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে কহিলা; “সাবাসি, দূত! তোর কথা শুনি, কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে? ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী! চল, সবে,— চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ-জন, কেমনে পড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়নে।”উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে, কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন- সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী! হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে; কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা; তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন, যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি, বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে, রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে, জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর— অটল অচল যথা; তাহার উপরে, বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার (রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে, রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা, নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে। থানা দিয়া পূর্ব দ্বারে, দুর্বার সংগ্রামে, বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে অঙ্গদ, করভসম নব বলে বলী; কিংবা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক- ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে, ঊর্ধ্ব ফণা— ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে! উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে— হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে, কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্ঘে, বায়ুপুত্র হনু, মিত্রবর বিভীষণ। এত প্রসরণে, বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী, গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি, বেড়ে জালে সাবধানে কেশরিকামিনী,— নয়ন–রমণী রূপে, পরাক্রমে ভীমা ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি, কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে।কাব্য গ্রন্থঃ -মেঘনাদবধ কাব্য প্রথম সর্গ (মেঘনাদবধ কাব্য) সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি   বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে   অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,   কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,   পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি   রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা   ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে — অজেয় জগতে —   ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?   বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি   আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে   ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,   বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)   যবে খরতর শরে, গহন কাননে,   ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,   তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।   কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে?   নরাধম আছিল যে নর নরকুলে   চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,   মৃ্ত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!   হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর   কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,   সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!   হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?   কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে   মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি   সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি   বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,   মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।   — তুমিও আইস, দেবি তুমি মধুকরী   কল্পনা! কবির ঢিত্ত-ফুলবন-মধু   লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে   আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।      কনক-আসনে বসে দশানন বলী —   হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা   তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি   সভাসদ, নতভাবে বসে চারি দিকে।   ভূতলে অতুল সভা — স্ফটিকে গঠিত;   তাহে শোভে রত্নরাজি, মানস-সরসে   সরস কমলকুল বিকশিত যথা।   শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, স্তম্ভ সারি সারি   ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,   বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে   ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,   পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে   (খচিত মুকুলে ফুল) পল্লবের মালা   ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে   রতনসম্ভবা বিভা — ঝলসি নয়নে!   সুচারু চামর চারুলোচনা কিঙ্করী   ঢুলায়; মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি   চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা   হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি   দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!—   ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ মুরতি,   পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা   শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধে বহি,   অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি   কাকলী লহরী, মরি! মনোহর, যথা   বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল বিপিনে!   কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি   ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা   স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?      এহেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,   বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে   অবিরল অশ্রুধারা — তিতিয়া বসনে,   যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে   বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর জোড় করি,   দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত   ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব কলেবর।   বীরবাহু সহ যত যোধ শত শত   ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে   একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল তরঙ্গ   গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে—   নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতি সম।   এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,   হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি   নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।   আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে   দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া,   বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, কহিলা রাবণ;—      “নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,   রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে   কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী   বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া   কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?   হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!   কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?   কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,   হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে   সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে   এ বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!   বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে   একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে   নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু   তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে   নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে   এর শরে! তা না হলে মরিত কি কভু   শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,   অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত—   রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, সূর্পণখা,   কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই অভাগী,   কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা   এ ভুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)   পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি   আনিনু এ হৈম গেহে? হায় ইচ্ছা করে,   ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে   পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!   কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে   উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল   এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে   শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;   নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;   তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?   কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”      এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস–   কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা   হস্তিনায় অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে   শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে   হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে!      তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ)   কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা   নতভাবে; — “হে রাজন্, ভুবন বিখ্যাত,   রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে!   হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে   এ জগতে? ভাবি, প্রভু দেখ কিন্তু মনে;—   অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে   বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর   সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল   মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।   মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”      উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;—   “যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান   সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল   মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।   কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ   অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম,   তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়   ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে,   যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”      এতেক কহিয়া রাজা, দূত পানে চাহি,   আদেশিলা,— “কহ, দূত, কেমনে পড়িল   সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”      প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ জুড়ি,   আরম্ভিলা ভগ্নদূত;— “হায়, লঙ্কাপতি,   কেমনে কহিব আমি অপূর্ব কাহিনী?   কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বীরতা?—   মদকল করী যথা পশে নলবনে,   পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে   ধনুর্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম   থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে!   শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে;   সিংহনাদে; জলধির কল্লোলে; দেখেছি   দ্রুত ইরম্মদে, দেব, ছুটিতে পবন–   পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে,   এহেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড-টঙ্কারে!   কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—      পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহু সহ   রণে, যূথনাথ সহ গজযূথ যথা।   ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,—   মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি   গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি   উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে   শনশনে!— ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু!   কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?      এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে   পুত্র তব, হে রাজন্! কত ক্ষণ পরে,   প্রবেশিলা, যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব।   কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ,   বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে   খচিত,”— এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল   ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া   পূর্বদুঃখ! সভাজন কাঁদিলা নীরবে।      অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,   মন্দোদরীমনোহর;— “কহ, রে সন্দেশ–   বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা   দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?”   “কেমনে, হে মহীপতি,” পুনঃ আরম্ভিল   ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি,   কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি?   অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্যক্ষ, সরোষে   কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া   বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে   কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ   উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি বায়ু সহ   নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম   ধূমপুঞ্জসম চর্মাবলীর মাঝারে   অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!—   আর কি কহিব, দেব? পূর্বজন্মদোষে,   একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ,   কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে?   কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি,   হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহু সহ   রণভূমে? কিন্তু নহি নিজ দোষে দোষী।   ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি,   রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।”   এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস   মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে   কহিলা; “সাবাসি, দূত! তোর কথা শুনি,   কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে   সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী   কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে?   ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী! চল, সবে,—   চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ-জন,   কেমনে পড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি   বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়নে।”      উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,   কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন   অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-   সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী!   হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে;   কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা;   তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন,   যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ   দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,   বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন   আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,   রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,   জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।      দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর—   অটল অচল যথা; তাহার উপরে,   বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা   শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার   (রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা   জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক   অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,   রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,   নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে।   থানা দিয়া পূর্ব দ্বারে, দুর্বার সংগ্রামে,   বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে   অঙ্গদ, করভসম নব বলে বলী;   কিংবা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক-   ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে, ঊর্ধ্ব ফণা—   ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে!   উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি   বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে—   হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে,   কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন   শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্ঘে, বায়ুপুত্র হনু,   মিত্রবর বিভীষণ। এত প্রসরণে,   বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী,   গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি,   বেড়ে জালে সাবধানে কেশরিকামিনী,—   নয়ন–রমণী রূপে, পরাক্রমে ভীমা   ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি   রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি,   কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে।      ====== প্রস্তাবনা রাগিণী খাম্বাজ,তাল মধ্যমান মরি হায়,কোথা সে সুখের সময়, সে সময় দেশময় নাট্যরস সবিশেষ ছিল রসময়!                শুন গো ভারতভূতি,                কত নিদ্রা যাবে তুমি,         আর নিদ্রা উচিত না হয়।                উঠ ত্যজ ঘুম ঘোর,                হইল,হইল ভোর,         দিনকর প্রাচীতে উদয়।                               কোথায় বাল্মীকি,ব্যাস,                               কোথা তব কালিদাস,         কোথা ভবভূতি মহোদয়।                               অলীক কুনাট্য রঙ্গে,                               মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,         নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।                               সুধারস অনাদরে,                               বিষবারি পান করে,         তাহে হয় তনু মনঃ ক্ষয়।                               মধু বলে জাগ মা গো,                               বিভু স্থানে এই মাগ,         সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়।। প্রাণ কি সুরাজ্যে, প্রাণ, তব রাজ-সিংহাসন ! বাহু-রূপে দুই রথী, দুর্জয় সমরে, বিধির বিধানে পুরী তব রক্ষা করে ;— পঞ্চ অনুচর তোমা সেবে অনুক্ষণ । সুহাসে ঘ্ৰাণেরে গন্ধ দেয় ফুলবন ; যতনে শ্রবণ আনে সুমধুর স্বরে ; সুন্দর যা কিছু আছে, দেখায় দর্শন ভূতলে, সুনীল নভে, সৰ্ব্ব চরাচরে ! স্পর্শ, স্বাদ, সদা ভোগ যোগায়, সুমতি ! পদরূপে দুই বাজী তব রাজ-দ্বারে ; জ্ঞান-দেব মন্ত্রী তব—ভবে বৃহস্পতি ;— সরস্বতী অবতার রসনা সংসারে ! স্বর্ণস্রোতোরূপে লহু, অবিরল-গতি, বহি অঙ্গে, রঙ্গে ধনী করে হে তোমারে ! বংশীধ্বনি (১)কে ও বাজাইছে বাঁশী, স্বজনি, মৃদু মৃদু স্বরে নিকুঞ্জবনে? নিবার উহারে ; শুনি ও ধ্বনি দ্বিগুণ আগুন জ্বলে লো মনে?– এ আগুনে কেনে অাহুতি দান? অমনি নারে কি জ্বালাতে প্রাণ?(২)বসন্ত অন্তে কি কোকিলা গায় পল্লব—বসনা শাখা-সদনে? নীরবে নিবিড় নীড়ে সে যায়--- বাঁশীধ্বনি আজি নিকুঞ্জবনে? হায়, ও কি আর গীত গাইছে? না হেরি শ্যামে ও বাঁশী কাঁদিছে?(৩)শুনিয়াছি, সই, ইন্দ্র রুষিয়া গিরিকুল-পাখা কাটিলা যবে, সাগরে অনেক নগ পশিয়া রহিল ডুবিয়া---জলধিভবে। সে শৈল সকল শির উচ্চ করি নাশে এবে সিন্ধুগামিনী তরী।(৪)কি জানি কেমনে প্রেমসাগরে বিচ্ছেদ-পাহাড় পশিল আসি? কার প্রেমতরী নাশ না করে--- ব্যাধ যেন পাখী পাতিয়া ফাঁসি--- কার প্রেমতরী মগনে না জলে বিচ্ছেদ-পাহাড়----বলে কি ছলে!(৫)হায় লো সখি, কি হবে স্মরিলে গত সুখ? তারে পাব কি আর? বাসি ফুলে কি লো সৌরভ মিলে? ভুলিলে ভাল যা----স্মরণ তার? মধুরাজে ভেবে নিদাঘ-জ্বালা, কহে মধু, সহ, ব্রজের বালা!(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) বংশী-ধ্বনি ১নাচিছে কদম্বমূলে,          বাজায়ে মুরলী,রে,      রাধিকারমণ! চল,সখি,ত্বরা করি,             দেখিগে প্রাণের হরি,        ব্রজের রতন! চাতকী আমি স্বজনি,                শুনি জলধর-ধ্বনি কেমনে ধৈরজ ধরি থাকি লো এখন?          যাক্ মান,যাক্ কুল,                   মন-তরী পাবে কূল; চল,ভাসি প্রেমনীরে,ভেবে ও চরণ!২       মানস সরসে,সখি,                      ভাসিছে মরাল রে,               কমল কাননে!       কমলিনী কোন্ ছলে,                       থাকিবে ডুবিয়া জলে,              বঞ্চিয়া রমণে?         যে যাহারে ভাল বাসে,                          যে যাইবে তার পাশে---      মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিব কেমনে?              যদি অবহেলা করি,                        রুষিবে শম্বর-অরি;      কে সম্বরে স্মর-শরে এ তিন ভুবনে!৩ওই শুন,পুনঃ বাজে                  মজাইয়া মন,রে,             মুরারির বাঁশী! সুমন্দ মলয় আনে             ও নিনাদ মোর কাণে---        আমি শ্যাম-দাসী। জলদ গরজে যবে,                ময়ূরী নাচে সে রবে;--- আমি কেন না কাটিব শরমের ফাঁসি?          সৌদামিনী ঘন সনে,                    ভ্রমে সদানন্দ মনে;--- রাধিকা কেন ত্যজিবে রাধিকাবিলাসী।৪ফুটিছে কুসুমকুল                  মুঞ্জু কুঞ্জবনে,রে,         যথা গুণমণি! হেরি মোর শ্যামচাঁদ,                   পীরিতের ফুল ফাঁদ,              পাতে লো ধরণী!       কি লজ্জা!হা ধিক্ তারে,                    ছয় ঋতু বরে যারে, আমার প্রাণের ধন লোভে সে রমণী?           চল,সখি,শীঘ্র যাই,                     পাছে মাধবে হারাই,--- মণিহারা ফণিনী কি বাঁচে লো স্বজনি?৫সাগর উদ্দেশে নদী            ভ্রমে দেশে দেশে,রে, অবিরাম গতি--- গগনে উদিলে শশী,                     হাসি যেন পড়ে খসি,          নিশি রূপবতী;     আমার প্রেম-সাগর,                      দুয়ারে মোর নাগর, তাবে ছেড়ে রব আমি?ধিক্ এ কুমতি!          আমার সুধাংশু নিধি---                      দিয়াছে আমায় বিধি--- বিরহ আঁধারে আমি?ধিক্ এ যুকতি!৬নাচিছে কদম্বমূলে,                বাজায়ে মুরলী,রে,         রাধিকারমণ! চল,সখি,ত্বরা করি,                দেখিগে প্রাণের হরি,          গোকুল রতন!     মধু কহে ব্রজাঙ্গনে,                স্মরি ও রাঙা চরণে, যাও যথা ডাকে তোমা শ্রীমধুসূদন!       যৌবন মধুর কাল,                আশু বিনাশিবে কাল, কালে পিও প্রেমমধু করিয়া যতন।(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) ''বউ কথা কও'' কি দুখে,হে পাখি,তুমি শাখার উপরে বসি,বউ কথা কও,কও এ কাননে?---- মানিনী ভামিনী কি হে,ভামের গুমরে, পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে? তেঁই সাধ তারে তুমি মিনতি-বচনে? তেঁই হে এ কথাগুলি কহিছ কাতরে? বড়ই কৌতুক,পাখি,জনমে এ মনে--- নর-নারী-রঙ্গ কি হে বিহঙ্গিনী করে? সত্য যদি,তবে শুন,দিতেছি যুকতি; (শিখাইব শিখেছি যা ঠেকি এ কু-দায়ে) পবনের বেগে যাও যথায় যুবতী; ''ক্ষম,প্রিয়ে'' এই বলি পড় গিয়া পায়ে!--- কভু দাস,কভু প্রভু,শুন,ক্ষুণ্ণ-মতি, প্রেম-রাজ্যে রাজাসন থাকে এ উপায়ে।। বঙ্গভাষা হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;- তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি। অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ, মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;- কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন! স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে- ``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি, এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি? যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!'' পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥ বঙ্গভূমির প্রতি রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে। প্রবাসে দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে এ দেহ-আকাশ হতে, – নাহি খেদ তাহে। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে? কিন্তু যদি রাখ মনে, নাহি, মা, ডরি শমনে; মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে! সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভুলে, মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন; – কিন্তু কোন্ গুণ আছে, যাচিব যে তব কাছে, হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্মদে! তবে যদি দয়া কর, ভুল দোষ, গুণ ধর, অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে! – ফুটি যেন স্মৃতি-জলে, মানসে, মা, যথা ফলে মধুময় তামরস কি বসন্ত, কি শরদে!সংকলিত বটবৃক্ষ দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে, নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি, তরুরাজ ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে, বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি ! জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী, তোমার দুহিতা, সাধু ! যবে বসুধারে দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি, মিহির, আকুল জীব বাঁচে পূজি তাঁরে। শত-পত্রময় মঞ্চে, তোমার সদনে, খেচর—অতিথি-ব্রজ, বিরাজে সতত, পদ্মরাগ ফলপুঞ্জে ভুঞ্জি হৃষ্ট-মনে ;— মৃদু-ভাষে মিষ্টালাপ কর তুমি কত, মিষ্টালাপি, দেহ-দাহ শীতলি যতনে ! দেব নহ; কিন্তু গুণে দেবতার মত। বর্ষাকাল গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর, উথলিল নদনদী ধরণী উপর । রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে, দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে। সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব, বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব । স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়, কলহ করয়ে কোন মতে শান্ত নয়।। বসন্তে-১ (১)       ফুটিল বকুলকুল কেন লো গোকুলে আজি,                  কহ তা, স্বজনি? আইলা কি ঋতুরাজ?         ধরিলা কি ফুলসাজ,                  বিলাসে ধরণী? মুছিয়া নয়ন-জল,               চল লো সকলে চল,        শুনিব তমাল তলে বেণুর সুরব;---        আইল বসন্ত যদি, আসিবে মাধব!(২)       যে কালে ফুটে লো ফুল, কোকিল কুহরে, সই,                  কুসুমকাননে, মুঞ্জরয়ে তরুবলী,               গুঞ্জরয়ে সুখে অলি,                  প্রেমানন্দ মনে, সে কালে কি বিনোদিয়া,   প্রেমে জলাঞ্জলি দিয়া,        ভুলিতে পারেন, সখি, গোকুলভবন?        চল লো নিকুঞ্জবনে পাইব সে ধন!(৩)       স্বন, স্বন, স্বনে শুন, বহিছে পবন, সই,                  গহন কাননে, হেরি শ্যামে পাই প্ৰীত,            গাইছে মঙ্গল গীত,                  বিহঙ্গমগণে! কুবলয় পরিমল,             নহে এ ; স্বজনি, চল,—        ও সুগন্ধ দেহগন্ধ বহিছে পবন।        হায় লো, শ্যামের বপুঃ সৌরভসদন!(৪)       উচ্চ বীচি রবে, শুন, ডাকিছে যমুনা ওই                  রাধায়, স্বজনি; কল কল কল কলে,                সুতরঙ্গ দল চলে,                  যথা গুণমণি। সুধাকর-কররাশি              সম লো শ্যামের হাসি,        শোভিছে তরল জলে; চল, ত্বরা করি—        ভুলি গে বিরহ-জ্বালা হেরি প্রাণহরি!(৫)       ভ্রমর গুঞ্জরে যথা ; গায় পিকবর, সই,                  সুমধুর বোলে; মরমরে পাতাদল;                   মৃদুরবে বহে জল                  মলয় হিল্লোলে;--- কুসুম-যুবতী হাসে,          মোদি দশ দিশ বাসে,—        কি সুখ লভিব, সখি, দেখ ভাবি মনে,        পাই যদি হেন স্থলে গোকুলরতনে?(৬)       কেন এ বিলম্ব আজি, কহ ওলো সহচরি,                  করি এ মিনতি? কেন অধোমুখে কাঁদ,               আবরি বদনচাঁদ,                  কহ, রূপবতি? সদা মোর সুখে সুখী,           তুমি ওলো বিধুমুখি,        আজি লো এ রীতি তব কিসের কারণে?        কে বিলম্বে হেন কালে? চল কুঞ্জবনে!(৭)       কাঁদিব লো সহচরি, ধরি সে কমলপদ,                  চল, ত্বরা করি, দেখিব কি মিষ্ট হাসে,          শুনিব কি মিষ্ট ভাষে,                  তোষেন শ্রীহরি দুঃখিনী দাসীরে; চল,              হইমু লো হতবল,        ধীরে ধীরে ধরি মোরে, চল লো স্বজনি ;–        সুধে---মধু শূন্য কুঞ্জে কি কাজ, রমণি?(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) বসন্তে-২ (১)     সখি রে,— বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে! পিককুল কলকল,          চঞ্চল অলিদল,                     উছলে সুরবে জল,                        চল লো বনে! চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি ব্ৰজরমণে!(২)     সখি রে,— উদয় অচলে ঊষা, দেখ, আসি হাসিছে! এ বিরহ বিভাবরী           কাটানু ধৈরজ ধরি                     এবে লো রব কি করি?                        প্রাণ কাঁদিছে! চল লো নিকুঞ্জে যথা কুঞ্জমণি নাচিছে!(৩)     সখি রে,— পূজে ঋতুরাজে আজি ফুলজালে ধরণী! ধূপরূপে পরিমল,           আমোদিছে বনস্থল,                     বিহঙ্গমকুলকল,                        মঙ্গল ধ্বনি! চল লো, নিকুঞ্জ পূজি শ্যামরাজে, স্বজনি!(৪)     সখি রে,— পাদ্যরূপে অশ্রুধারা দিয়া ধোব চরণে! দুই কর কোকনদে,          পূজিব রাজীব পদে;                     শ্বাসে ধূপ, লো প্রমদে,                        ভাবিয়া মনে! কঙ্কণ কিঙ্কিণী ধ্বনি বাজিবে লো সঘনে।(৫)     সখি রে,— এ যৌবন ধন, দিব উপহার রমণে! ভালে যে সিন্দূরবিন্দু,          হইবে চন্দনবিন্দু;---                     দেখিব লো দশ ইন্দু                        সুনখগণে! চিরপ্রেম বর মাগি লব, ওলো ললনে!(৬)     সখি রে,— বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে! পিককুল কলকল,          চঞ্চল অলিদল                     উছলে সুরবে জল,                        চল লো বনে! চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি—মধুসূদনে! বসন্তের একটি পাখীর প্রতি নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে, মাধবের বাৰ্ত্তাবহ ; যার কুহরণে ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে !— তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে ! মধুময় মধুকাল সৰ্ব্বত্র জগতে ,— কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে, বসুমতী সতী যবে রত প্রেমব্রতে?— দুরন্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে নিৰ্দ্দয় ; ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি ! না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্মে কেশে, পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি !— ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনোহর বেশে সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্ৰগতি ! বাল্মীকি স্বপনে ভ্রমিনু আমি গহন কাননে একাকী ৷ দেখিনু দূরে যুব এক জন, দাঁড়ায়ে তাহার কাছে প্রাচীন ব্রাহ্মণ--- দ্রোণ যেন ভয়-শূন্য কুরুক্ষেত্র-রণে ৷ ''চাহিস্ বধিতে মোরে কিসের কারণে?'' জিজ্ঞাসিলা দ্বিজবর মধুর বচনে ৷ ''বধি তোমা হরি আমি লব তব ধন,'' উত্তরিলা যুব জন ভীম গরজনে ৷--- পরিবরতিল স্বপ্ন ৷ শুনিনু সত্বরে সুধাময় গীত-ধ্বনি,আপনি ভারতী, মোহিতে ব্রহ্মার মনঃ,স্বর্ণ বীণা করে, আরম্ভিলা গীত যেন---মনোহর অতি! সে দুরন্ত যুব জন,সে বৃদ্ধের বরে, হইল,ভারত,তব কবি-কুল-পতি! বিজয়া-দশমী ''যেয়ো না,রজনি,আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি,দয়াময়ি,এ পরাণ যাবে!--- উদিলে নির্দ্দয় রবি উদয়-অচলে, নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে! বার মাস তিতি,সত্যি,নিত্য অশ্রুজলে, পেয়েছি উমায় আমি!কি সান্ত্বনা-ভাবে--- তিনটি দিনেতে,কহ,লো তারা-কুন্তলে, এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে? তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে দূর করি অন্ধকার;শুনিতেছি বাণী--- মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে! দ্বিগুণ আঁধার ঘর হবে,আমি জানি, নিবাও এ দীপ যদি!''---কহিলা কাতরে নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী। বীর-রস ভৈরব-আকৃতি শূরে দেখিনু নয়নে গিরি-শিরে ; বায়ু-রথে, পূর্ণ ইরম্মদে, প্রলয়ের মেঘ যেন! ভীম শরাসনে ধরি বাম করে বীর, মত্ত বীর-মদে, টঙ্কারিছে মুহুর্মুহুঃ,হুঙ্কারি ভীষণে, ব্যোমকেশ-সম কায়;ধরাতল পদে, রতন-মণ্ডিত শিরঃ ঠেকিছে গগনে, বিজলী-ঝলসা-রূপে উজলি জলদে। চাঁদের পরিধি,যেন রাহুর গরাসে ঢালখান;ঊরু-দেশে অসি তীক্ষ্ণ অতি, চৌদিকে,বিবিধ অস্ত্র।সুধিনু তরাসে,--- ''কে এ মহাজন,কহ গিরি মহামতি?'' আইল শব্দ বহি স্তব্ধ আকাশে--- ''বীর-রস এ বীবেন্দ্র,রস-কুল-পতি!'' ভারত-ভূমি কে না লোভে, ফণিনীর কুন্তলে যে মণি ভূপতিত তারারূপে, নিশাকালে ঝলে ? কিন্তু কৃতান্তের দূত বিষদন্তে গণি, কে করে সাহস তারে কেড়ে নিতে বলে ? হায় লো ভারত-ভূমি! বৃথা স্বর্ণ-জলে ধুইলা বরাঙ্গ তোর, কুরঙ্গ-নয়নি, বিধাতা ? রতন সিঁথি গড়ায়ে কৌশলে, সাজাইলা পোড়া ভাল তোর লো, যতনি! নহিস্ লো বিষময়ী যেমতি সাপিনী; রক্ষিতে অক্ষম মান প্রকৃত যে পতি ; পুড়ি কামানলে, তোরে করে লো অধীনী (হা ধিক্!) যবে যে ইচ্ছে, যে কামী দুৰ্ম্মতি! কার শাপে তোর তরে, ওলো অভাগিনি, চন্দন হইল বিষ;সুধা তিত অতি ? ভাষা মূঢ় সে, পণ্ডিতগণে তাহে নাহি গণি, কহে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি ভাষা!—শত ধিক্ তারে! ভুলে সে কি করি, শকুন্তলা তুমি, তব মেনকা জননী ? রূপ-হীনা দুহিতা কি, মা যার অপ্সরী ?— বীণার রসনা-মূলে জন্মে কি কুধ্বনি ? কবে মন্দ-গন্ধ শ্বাস শ্বাসে ফুলেশ্বরী নলিনী ? সীতারে গর্ভে ধরিলা ধরণী । দেব-যোনি মা তোমার ; কাল নাহি নাশে রূপ তাঁর ; তবু কাল করে কিছু ক্ষতি । নব রস-সুধা কোথা বয়েসের হাসে ? কালে সুবর্ণের বর্ণ ম্লান, লো যুবতি! নব শশিকলা তুমি ভারত-আকাশে, নব-ফুল বাক্য-বনে, নব মধুমতী। ভূত কাল কোন্ মূল্য দিয়া পুনঃ কিনি ভূত কালে, ----কোন্ মূল্য ----এ মন্ত্রণা কারে লয়ে করি? কোন্ ধন, কোন্ মুদ্রা, কোন্ মণি-জালে এ দুর্ল্লভ দ্রব্য-লাভ ? কোন্ দেবে স্মরি, কোন্ যোগে,কোন্ তপে,কোন্ ধর্ম্ম করি? আছে কি এমন জন ব্রাহ্মণে,চণ্ডালে, এ দীক্ষা-শিক্ষার্থে যারে গুরু-পদে বরি, এ তত্ত্ব-স্বরূপ পদ্ম পাই যে মৃণালে?--- পশে যে প্রবাহ বহি অকূল সাগরে, ফিরি কি সে আসে পুনঃ পর্ব্বত-সদনে? যে বারির ধারা ধরা সতৃষ্ণায় ধরে, উঠে কি সে পুনঃ কভু বারিদাতা ঘনে?--- বর্ত্তমানে তোরে,কাল,যে জন আদরে তার তুই!গেলে তোরে পায় কোন্ জনে? মধুকর শুনি গুন গুন ধ্বনি তোর এ কাননে, মধুকর,এ পরাণ কাঁদে রে বিষাদে! ফুল-কুল-বধূ-দলে সাধিস্ যতনে অনুক্ষণ,মাগি ভিক্ষা অতি মৃদু নাদে, তুমকী বাজায়ে যথা রাজার তোরণে ভিখারী,কি হেতু তুই?ক মোরে,কি সাদে মোমের ভাণ্ডারে মধু রাখিস্ গোপনে, ইন্দ্র যথা চন্দ্রলোকে,দানব-বিবাদে সুধামৃত?এ আয়াসে কি সুফল ফলে? কৃপণের ভাগ্য তোর!কৃপণ যেমতি অনাহারে,অনিদ্রায়,সঞ্চয়ে বিকলে বৃথা অর্থ;বিধি-বশে তোর সে দুর্গতি! গৃহ-চ্যুত করি তোরে,লুটি লয় বলে পর জন পরে তোর শ্রমের সঙ্গতি! ময়ূর ও গৌরী ময়ুর কহিল কাঁদি গেীরীর চরণে,          কৈলাস-ভবনে;—         “অবধান কর দেবি,          আমি ভৃত্য নিত্য সেবি প্রিয়োত্তম সুতে তব এ পৃষ্ঠ-আসনে।          রথী যথা দ্রুত রথে,          চলেন পবন-পথে দাসের এ পিঠে চড়ি সেনানী সুমতি; তবু, মা গো, আমি দুখী অতি!         করি যদি কেকাধ্বনি,         ঘৃণায় হাসে অমনি খেচর, ভূচর জন্তু;—মরি, মা, শরমে!         ডালে মূঢ় পিক যবে         গায় গীত, তার রবে মাতিয়া জগৎ-জন বাখানে অধমে!         বিবিধ কুসুম কেশে,         সাজি মনোহর বেশে, বরেন বসুধা দেবী যবে ঋতুবরে কোকিল মঙ্গল-ধ্বনি করে। অহরহ কুহুধ্বনি বাজে বনস্থলে; নীরবে থাকি, মা, আমি; রাগে হিয়া জ্বলে!        ঘুচাও কলঙ্ক শুভঙ্করি, পুত্রের কিঙ্কর আমি এ মিনতি করি,        পা দুখানি ধরি।” উত্তর করিলা গৌরী সুমধুর স্বরে;— “পুত্রের বাহন তুমি খ্যাত চরাচরে,        এ আক্ষেপ কর কি কারণে? হে বিহঙ্গ, অঙ্গ-কান্তি ভাবি দেখ মনে!    চন্দ্রককলাপে দেখ নিজ পুচ্ছ-দেশে;    রাখাল রাজার সম চূড়াখানি কেশে!    আখণ্ডল-ধনুর বরণে মণ্ডিলা সু-পুচ্ছ ধাতা তোমার সৃজনে!       সদা জ্বলে তব গলে       স্বর্ণহার ঝল ঝলে, যাও, বাছা, নাচ গিয়া ঘনের গর্জ্জনে,       হরষে সু-পুচ্ছ খুলি       শিরে স্বর্ণ-চূড়া তুলি;       করগে কেলি ব্রজ-কুঞ্জ-বনে।       করতালি ব্রজাঙ্গনা       দেবে রঙ্গে বরাঙ্গনা— তোষ গিয়া ময়ূরীরে,প্রেম-আলিঙ্গনে!       শুন বাছা, মোর কথা শুন,       দিয়াছেন কোন কোন গুণ, দেব সনাতন প্রতি-জনে;      সু-কলে কোকিল গায়,      বাজ বজ্র-গতি ধায়, অপরূপ রূপ তব, খেদ কি কারণে?”—     নিজ অবস্থায় সদা স্থির যার মন,     তার হতে সুখীতর অন্য কোন্ জন? ময়ূরী ১             তরুশাখা উপরে, শিখিনি,        কেনে লো বসিয়া তুই বিরস বদনে? না হেরিয়া শ্যামচাঁদে,      তোরও কি পরাণ কাঁদে,             তুইও কি দুঃখিনী!       আহা!কে না ভালবাসে রাধিকারমণে?       কার না জুড়ায় আঁখি শশী, বিহঙ্গিনি?২             আয়,পাখি,আমরা দুজনে       গলা ধরাধরি করি ভাবি লো নীরবে; নবীন নীরদে প্রাণ;               তুই করেছিস্ দান---             সে কি তোর হবে?      আর কি পাইবে রাধা রাধিকারঞ্জনে?      তুই ভাব্ ঘনে ধনি,আমি শ্ৰীমাধবে!৩              কি শোভা ধরয়ে জলধর,        গভীর গরজি যবে উড়ে সে গগনে! স্বর্ণবর্ণ শক্র-ধনু—                 রতনে খচিত তনু—            চূড়া শিরোপর;       বিজলী কনক দাম পরিয়া যতনে,       মুকুলিত লতা যথা পরে তরুবর!৪            কিন্তু ভেবে দেখ্ লো কামিনি,      মম শ্যাম-রূপ অনুপম ত্রিভুবনে! হায়,ও রূপ-মাধুরী,                কার মন নাহি চুরি,            করে,রে শিখিনি!     যার অাঁখি দেখিয়াছে রাধিকামোহনে,     সেই জানে কেনে রাধা কুলকলঙ্কিনী!৫             তরুশাখা উপরে, শিখিনি,       কেনে লো বসিয়া তুই বিরসবদনে? না হেরিয়া শ্যামচাঁদে,         তোর কি পরাণ কাঁদে             তুই কি দুঃখিনী?      আহা!কে না ভালবাসে শ্রীমধুসূদনে?      মধু কহে, যা কহিলে,সত্য বিনোদিনি!(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) মলয় মারুত (১)          শুনেছি মলয় গিরি তোমার আলয়—                     মলয় পবন! বিহঙ্গিনীগণ তথা                গায়ে বিদ্যাধরী যথা,           সঙ্গীত সুধায় পূরে নন্দনকানন; কুসুমকুলকামিনী,            কোমলা কমলা জিনি,           সেবে তোমা, রতি যথা সেবেন মদন!(২)          হায়, কেনে ব্রজে আজি ভ্ৰমিছ হে তুমি—                      মন্দ সমীরণ? যাও সরসীর কোলে,          দোলাও মৃদু হিল্লোলে           সুপ্রফুল্ল নলিনীরে—প্রেমানন্দ মন! ব্ৰজ-প্রভাকর যিনি        ব্ৰজ আজি ত্যজি তিনি,           বিরাজেন অস্তাচলে—নন্দের নন্দন!(৩)          সৌরভ রতন দানে তুষিবে তোমারে                     আদরে নলিনী; তব তুল্য উপহার          কি আজি আছে রাধার?           নয়ন আসারে, দেব, ভাসে সে দুঃখিনী! যাও যথা পিকবধূ—            বরিষে সঙ্গীত-মধু,—           এ নিকুঞ্জে কাঁদে আজি রাধা বিরহিণী।(৪)          তবে যদি, সুভগ, এ অভাগীর দুঃখে                     দুঃখী তুমি মনে, যাও আশু, আশুগতি,          যথা ব্ৰজকুলপতি—           যাও যথা পাবে, দেব, ব্রজের রতনে! রাখার রোদনধ্বনি                বহ যথা শ্যামমণি—           কহ তাঁরে মরে রাধা শ্যামের বিহনে!(৫)          যাও চলি, মহাবলি, যথা বনমালী–                     রাধিকা-বাসন; তুঙ্গ শৃঙ্গ দুষ্টমতি,                রোধে যদি তব গতি,           মোর অনুরোধে তারে ভেঙো, প্রভঞ্জন! তরুরাজ যুদ্ধ আশে,        তোমারে যদি সম্ভাষে--           ব্রজাঘাতে যেও তায় করিয়া দলন!(৬)          দেখি তোমা পীরিতের ফাঁদ পাতে যদি                     নদী রূপবতী; মজো না বিভ্রমে তার,           তুমি হে দূত রাধার,           হেরো না, হেরো না দেব কুসুম যুবতী! কিনিতে তোমার মন,            দিবে সে সৌরভধন,           অবহেলি সে ছলনা, যেয়ো আশুগতি!(৭)          শিশিরের নীরে ভাবি অশ্রুবারিধারা,                     ভুলো না, পবন! কোকিলা শাখা উপরে,        ডাকে যদি পঞ্চস্বরে,           মোর কিরে---শীঘ্র করে ছেড়ো সে কানন! স্মরি রাধিকার দুঃখ,             হইও সুখে বিমুখ—           মহৎ যে পরদুঃখে দুঃখী সে সুজন!(৮)          উতরিবে যবে যথা রাধিকারমণ,                     মোর দূত হয়ে, কহিও গোকুল কাঁদে         হারাইয়া শ্যামচাঁদে---           রাধার রোদনধ্বনি দিও তাঁরে লয়ে; আর কথা আমি নারী       শরমে কহিতে নারি,---           মধু কহে, ব্রজাঙ্গনে, আমি দিব কয়ে। মহাভারত কল্পনা-বাহনে সুখে করি আরোহণ, উতরিনু, যথা বসি বদরীর তলে, করে বীণা, গাইছেন গীত কুতূহলে সত্যবতী-সুত কবি,—ঋষিকুল-ধন ! শুনিলু গম্ভীর ধ্বনি ; উম্মীলি নয়ন দেখিনু কৌরবেশ্বরে, মত্ত বাহুবলে ; দেখিনু পবন-পুত্রে, ঝড় যথা চলে হুঙ্কারে !আইলা কর্ণ—সূর্যের নন্দন— তেজস্বী। উজ্জ্বলি যথা ছোটে অনম্বরে নক্ষত্র, আইলা ক্ষেত্রে পার্থ মহামতি, আলো করি দশ দিশ, ধরি বাম করে গাণ্ডীব—প্রচণ্ড-দণ্ড-দাতা রিপু প্রতি। তরাসে আকুল হৈনু এ কাল সমরে দ্বাপরে গোগৃহ-রণে উত্তর যেমতি। মিত্রাক্ষর বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে, লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি ! কত ব্যথা লাগে পর' যবে এ নিগড় কোমল চরণে- স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে, মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে ? কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে ? নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে ! কি কাজ পবিত্রি' মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে ? কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে ? প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,- চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে ? মেঘ ও চাতক উড়িল আকাশে মেঘ গরজি ভৈরবে;—             ভানু পলাইল ত্রাসে;             তা দেখি তড়িৎ হাসে;             বহিল নিশ্বাস ঝড়ে;            ভাঙ্গে তবু মড়-মড়ে;            গিরি-শিরে চূড়া নড়ে,                       যেন ভূ-কম্পনে; অধীরা সভয়ে ধরা সাধিলা বাসবে।           আইল চাতক-দল,           মাগি কোলাহলে জল— “তৃষায় আকুল মোরা, ওহে ঘনপতি! এ জ্বালা জুড়াও, প্রভু, করি এ মিনতি।” বড় মানুষের ঘরে ব্রতে, কি পরবে, ভিখারী-মণ্ডল যথা অাসে ঘোর রবে;—          কেহ আসে, কেহ যায়;          কেহ ফিরে পুনরায়          আবার বিদায় চায়;          ত্রস্ত লোভে সবে;—          সেরূপে চাতক-দল,          উড়ি করে কোলাহল;— “তৃষায় আকুল মোরা, ওহে ঘনপতি! এ জ্বালা জুড়াও জলে, করি এ মিনতি।”          রোষে উত্তরিলা ঘনবর;— “অপরে নির্ভর যার, অতি সে পামর!          বায়ু-রূপ দ্রুত রথে চড়ি,          সাগরের নীল পায়ে পড়ি,          আনিয়াছি বারি;—          ধরার এ ধার ধারি।          এই বারি পান করি,          মেদিনী সুন্দরী          বৃক্ষ-লতা-শস্যচয়ে          স্তন-দুগ্ধ বিতরয়ে          শিশু যথা বল পায়,          সে রসে তাহারা খায়, অপরূপ রূপ-সুধা বাড়ে নিরন্তর; তাহারা বাঁচায়, দেখ, পশু-পক্ষী-নর।         নিজে তিনি হীন-গতি; জল গিয়া আনিবারে নাহিক শকতি;         তেঁই তাঁর হেতু বারি-ধারা।—         তোমরা কাহারা?         তোমাদের দিলে জল,         কভু কি ফলিবে ফল?        পাখা দিয়াছেন বিধি;        যাও, যথা জলনিধি;        যাও, যথা জলাশয়;—        নদ-নদী-তড়াগাদি, জল যথা রয়।        কি গ্রীষ্ম, কি শীত কালে,        জল যেখানে পালে, সেখানে চলিয়া যাও, দিনু এ যুকতি।”        চাতকের কোলাহল অতি।        ক্রোধে তড়িতেরে ঘন কহিলা,—       “অগ্নি-বাণে তাড়াও এ দলে।”—        তড়িৎ প্রভুর আজ্ঞা মানিলা।       পলায় চাতক, পাখা জ্বলে। যা চাহ, লভ সদা নিজ-পরিশ্রমে; এই উপদেশ কবি দিলা এই ক্রমে। মেঘদূত কামী যক্ষ দগ্ধ,মেঘ,বিরহ-দহনে, দূত-পদে বরি পূর্ব্বে,তোমায় সাধিল বহিতে বারতা তার অলকা-ভবনে, যেখানে বিরহে প্রিয়া ক্ষুণ্ণ মনে ছিল। কত যে মিনতি কথা কাতরে কহিল তব,পদতলে সে,তা পড়ে কি হে মনে? জানি আমি,তুষ্ট হয়ে তার সে সাধনে প্রদানিলা তুমি তারে যা কিছু যাচিল; তেঁই গো প্রবাসে আজি এই ভিক্ষা করি;--- দাসের বারতা লয়ে যাও শীঘ্রগতি বিরাজে,হে মেঘরাজ,যথা সে যুবতী, অধীর এ হিয়া হায়,যার রূপ স্মরি! কুসুমের কানে স্বনে মলয় যেমতি মৃদু নাদে,কয়ো তারে,এ বিরহে মরি! মেঘনাদ ও বিভীষণ 'এতক্ষণে' -অরিন্দম কহিলা বিষাদে 'জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল রক্ষঃপুরে ! হায়, তাত, উচিত কি তব একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী, সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ ? -শূলী-শম্ভূনিভ কুম্ভকর্ণ ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী ? নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে ? চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ? কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি পিতৃতুল্য | ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে, পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে, লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে |' উত্তরিলা বিভীষণ;-'বৃথা এ সাধনা, ধীমান্ ! রাঘবদাস আমি ; কি প্রকারে তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে অনুরোধ ?' উত্তরিলা কাতরে রাবণি ;- 'হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে ! রাঘবের দাস তুমি ? কেমনে ও মুখে আনিলে ও কথা, তাত, কহ তা দাসেরে ! স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে ; পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি ধুলায় ? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে কে তুমি ? জনম তব কোন্ মহাকুলে ? কেবা সে অধম রাম ? স্বচ্ছ সরোবরে করে ফেলি রাজ হংস পঙ্কজ কাননে ; যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে, শৈবালদলের ধাম ? মৃগেন্দ্র কেশরী কবে, হে বীর-কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে মিত্রভাবে ? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি, অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে | ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ ; নহিলে অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে ? কহ, মহারথি, একি মহারথিপ্রথা ? নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে এ কথা ! ছাড়হ পথ ; আসিব ফিরিয়া এখনি ! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে, বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি ! দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ, রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের ! কি দেখি ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে ? নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগল্ ভে পশিল দম্ভী ; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে | তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে বনবাসী ! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে ভ্রমে দুরাচার দৈত্য ? প্রফুল্ল কমলে কীটবাস ? কহ, তাত, সহিব কেমনে হেন অপমান আমি,-ভ্রাতৃ পুত্র তব ? তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে ?' মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী, মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে ;- 'নহি দোষী আমি, বত্স; বৃথা ভর্ত্স মোরে তুমি ! নিজ কর্ম দোষে হায় মজাইলা এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি ! বিরত সতত পাপে দেবকুল ; এবে পাপপূর্ণ লঙ্কা পুরী ; প্রলয়ে যেমতি বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে ! রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী তেঁই আমি ! পরদোষে কে চাহে মজিতে ?' রুষিলা বাসবত্রাস ! গম্ভীরে যেমতি নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, কহিলা বীরেন্দ্র বলী ;-'ধর্মপথগামী, হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে তুমি ;-কোন্ ধর্মমতে, কহ দাসে, শুনি, জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,-এ সকলে দিলা জলাঞ্জলি ? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা ! এ শিক্ষা হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে ? কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা ! হেন সহবাসে, হে পিতৃব্য, বর্বরত কেন না শিখিবে ? গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি |' মেঘনাদবথ কাব্য (৫ম সর্গ) কুসুম-শয়নে যথা সুবর্ণ-মন্দিরে বিরাজে বীরেন্দ্র বলী ইন্দ্রজিত,তথা পশিল কূজন-ধ্বনি সে সুখ-সদনে। জাগিলা বীর-কুন্জর কুন্জবন-গীতে। প্রমীলার করপদ্ম করপদ্মে ধরি রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি নলিনীর কানে অলি কহে গুন্জরিয়া প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে চুম্বি নিমীলিত আঁখি )—“ডাকিছে কূজনে, হৈমবতী ঊষা তুমি,রূপসি, তোমারে পাখী-কুল; মিল, প্রিয়ে, কমল লোচন উঠ, চিরানন্দ মোর; সূর্য্যকান্তমণি- সম এ পরাণ,কান্তে, তুমি রবিচ্ছবি;—- তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন; ভাগ্য-বৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে আমার; নয়ন-তারা; মহার্হ রতন; উঠি দেখ,শশিমুখি,কেমনে ফুটিছে, চুরি করি কান্তি তব মন্জু কুন্জবনে কুসুম ;” চমকি রামা উঠিলা সত্বরে;— গোপিনী কামিনী যথা বেনুর সুরবে; আবরিলা অবয়ব সুচারু-হাসিনী শরমে। কহিলা পুনঃ কুমার আদরে;— “পোহাইল এতক্ষনে তিমির-শর্বরী; তা না হলে ফুটিতে কি তুমি, কমলিনি, জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়? চল, প্রিয়ে, এবে বিদায় হইব নমি জননীর পদে; পরে যথাবিধি পূজি দেব বৈশ্বানরে, ভীষণ-অশনি-সম শর-বরিষণে রামের সংগ্রাম-সাধ মিটাব সংগ্রামে।” সাজিলা রাবণ-বধূ, রাবণ-নন্দন, অতুল জগতে দোঁহে; বামাকুলোত্তমা প্রমীলা, পুরুষোত্তম মেঘনাদ বলী; শয়ন-মন্দির হতে বাহিরিলা দোঁহে— প্রভাতের তারা যথা অরুনের সাথে; বাজিল রাক্ষস-বাদ্য; নমিল রক্ষক; জয় মেঘনাদ উঠিল গগনে; রতন-শিবিকাসনে বসিলা হরষে দম্পতী। বহিলা যান যানবাহ- দলে মন্দোদরী মহিষীর সুবর্ন-মন্দিরে। প্রবেশিলা অরিন্দম, ইন্দু-নিভাননা প্রমীলা সুন্দরী সহ,সে স্বর্ণ-মন্দিরে। ত্রিজটা নামে রাক্ষসী আইল ধাইয়া। কহিল বীর-কেশরী; ”শুন লো ত্রিজটে, নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি আমি আজি যুঝিব রামের সঙ্গে পিতার আদেশে, নাশিব রাক্ষস-রিপু; তেঁই ইচ্ছা করি পূজিতে জননী পদ। যাও বার্তা লয়ে; কহ,পুত্র, পুত্রবধু দাঁড়ায়ে দুয়ারে তোমার,হে লঙ্কেশ্বরী;” সাষ্টাঙ্গে প্রণমি, কহিলা শূরে ত্রিজটা, (বিকটা রাক্ষসী)— ”শিবের মন্দিরে এবে রাণী মন্দোদরী, যুবরাজ; তোমার মঙ্গল-হেতু তিনি অনিদ্রায়, অনাহারে পূজেন উমেশে; তব সম পুত্র, শূর,কার এ জগতে? কার বা এ হেন মাতা?”—এতেক কহিয়া সৌদামিনী-গতি দূতী ধাইল সত্বরে। বাহিরিলা লঙ্কেশ্বরী শিবালয় হতে প্রণমে দম্পতী পদে। হরষে দুজনে কোলে করি, শিরঃ চুম্বি, কাঁদিলা মহিষী। কহিলা বীরেন্দ্র; ”দেবি আশীষ দাসেরে। নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি যথাবিধি, পশিব সমরে আজি, নাশিব রাঘবে; শিশু ভাই বীরবাহু; বধিয়াছে তারে পামর। দেখিব মোরে নিবারে কি বলে? দেহ পদ-ধূলি, মাতঃ ;তোমার প্রসাদে নির্ব্বিঘ্ন করিব আজি তীক্ষ্ন শর-জালে লঙ্কা; বাঁধি দিব আনি তাত বিভীষণে রাজদ্রোহী; খেদাইব সুগ্রীব অঙ্গদে সাগর অতল জলে;” উত্তরিলা রাণী, মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে;— “কেমনে বিদায় তোরে করি রে বাছনি; আঁধারি হৃদয়াকাশ,তুই পূর্ণ শশী আমার। দুরন্ত রণে সীতাকান্ত বলী; দুরন্ত লক্ষণ শূর; কাল-সর্প-সম দয়া-শূন্য বিভীষণ; মত্ত লোভ-মদে, স্ববন্ধু-বান্ধবে মূঢ় নাশে অনায়াসে, ক্ষুধায় কাতর ব্যাঘ্র গ্রাসয়ে যেমতি স্বশিশু; কুক্ষনে,বাছা, নিকষা শাশুড়ী ধরেছিলা গর্ভে দুষ্টে, কহিনু রে তোরে; এ কনক-লঙ্কা মোর মজালে দুর্ম্মতি;” হাসিয়া মায়ের পদে উত্তরিলা রথী;— কেন, মা ডরাও তুমি রাঘবে লক্ষণে, রক্ষোবৈরী? দুইবার পিতার আদেশে তুমুল সংগ্রামে আমি বিমুখিনু দোঁহে অগ্নিময় শর-জালে; ও পদ-প্রসাদে চির-জয়ী দেব-দৈত্য-নরের সমরে এ দাস; জানেন তাত বিভীষণ, দেবি, তব পুত্র-পরাক্রম; দম্ভোলি-নিক্ষেপী সহস্রাক্ষ সহ যত দেব-কুল-রথী; পাতালে নাগেন্দ্র, মর্ত্তে নগেন্দ্র; কি হেতু সভয় হইলা আজি,কহ, মা, আমারে? কি ছার সে রাম, তারে ডরাও আপনি? মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে, উত্তরিলা লঙ্কেশ্বরী; ”যাইবি রে যদি;— রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে রক্ষুন এ কাল-রণে; এই ভিক্ষা করি তার পদ যুগে আমি। কি আর কহিব? নয়নের তারা হারা করি রে থুইলি আমায় এ ঘরে তুই;” কাঁদিয়া মহিষী কহিলা,চাহিয়া তবে প্রমীলার পানে;— “থাক,মা,আমার সঙ্গে তুমি; জুড়াইব, ও বিধুবদন হেরি এ পোড়া পরাণ; বহুলে তারার করে উজ্জ্বল ধরণী।” বন্দি জননীর পদ বিদায় হইলা ভীমবাহু কাঁদি রাণী, পুত্র-বধূ সহ, প্রবেশিলা পুনঃ গৃহে। শিবিকা ত্যজিয়া, পদ-ব্রজে যুবরাজ চলিলা কাননে— ধীরে ধীরে রথীবর চলিলা একাকী, কুসুম-বিব্রিত পথে যজ্ঞশালা মুখে। =========== মেঘনাদবধ কাব্য (৩য় সর্গ) প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী। অশ্রুআঁখি-বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে কভু,ব্রজ-কুঞ্জ-বনে,হায়রে, যেমনি ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী। অবচয়ি ফুল-চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে, বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি, ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে, পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে; কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি। চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।” কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর- সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে; লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ- অরি ফিরিছে চৌদিকে অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা” রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;– “কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি, বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে, কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি? দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ; রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,– আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে? পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে; দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি? যথা বায়ু-সখা সহ দাবানল গতি দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে। টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি; ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;– কিন্তু নিশা-কালে কবে ধূম-পুঞ্জ পারে আবরিতে অগ্নি-শিখা? অগ্নিশিখা-তেজে চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে। কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ, স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে; পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ; বন-হস্তী বনে ডুবিল অতল জলে জলচর যত ; শিবিরে বসেন প্রভু রঘু-চুড়ামণি করপুটে শূর-সিংহ লক্ষণ সম্মুখে, পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত, রুদ্র-কুল-সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি । সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’-ধ্বনি উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর কোলাহলে, সাগর-কল্লোল যথা; ত্রস্তে রক্ষোরথী, দাশরথি-পানে চাহি, কহিলা কেশরী,– “চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে। নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?” বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে। “ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি, “দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া; মায়াময় লঙ্কা-ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে; কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি; এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে। শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি-কালে? রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে;” হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে, (ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে;) কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে, আর যত গুরুজনে;— নৃ-মুন্ড-মালিনী নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী, বীরেন্দ্র-কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী, তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব? বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে? কহ শীঘ্র করি;” উত্তরিলা ভীমা-রূপী; “বীর-শ্রেষ্ঠ তুমি, রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে; নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে।” এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা, প্রফুল্ল কুসুম যথা (শিশির মন্ডিত) বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ-সমীরণে; উত্তরিলা রঘুপতি; ”শুন, সুকেশিনী, বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে। অরি মম রক্ষ-পতি; তোমরা সকলে কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে বৈরি-ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে? আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”। এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;– “দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে, শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা-দলে।” প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ, প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া, রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক। না জানি এ বামা-দলে কে আঁটে সমরে ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি– রক্তবীজ-কুল-অরি?” কহিলা রাঘব;– ”চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্র-বধূ।” যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে, অগ্নিময় দশ দিশ; দেখিলা সম্মুখে রাঘবেন্দ্র বিভা-রাশি নির্ধূম আকাশে, সুবর্নি বারিদপুঞ্জে; শুনিলা চমকি কোদন্ড-ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া-দড়বড়ি, হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি। সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা, ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী; উড়িছে পতাকা —রত্ন-সঙ্কলিত-আভা; মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী; বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে। গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে অটল,চলিছে মধ্যে বামা-কুল-দল; উপত্যকা-পথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ, গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি। সর্ব-অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী, কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ-দন্ড করে হৈমময়; তার পাছে চলে বাদ্যকরী, বিদ্যাধরী-দল যথা, হায় রে ভূতলে অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা- আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে; তার পাছে শূল-পাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা; চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি; আস্ফালিলা শূলে কেহ; হাসিলা কেহ বা অট্টহাসে টিটকারি; কেহ বা নাদিলা, গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী, বীর-মদে, কাম-মদে উন্মাদ ভৈরবী; লক্ষ্য করি রক্ষোবরে, কহিলা রাঘব;– ”কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি, কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে; নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?” উত্তরিলা বিভীষণ; ”নিশার স্বপন নহে এ,বৈদেহী-নাথ,কহিনু তোমারে। কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী। মহাশক্তি-সম তেজে;দম্ভোলি-নিক্ষেপী সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে, সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;” লঙ্কার কনক-দ্বারে উতরিলা সতী প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস, প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা; উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী;— ”কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে? নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ-কুল-বধূ, খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে; বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে। ========== মেঘনাদবধ কাব্য (চতুর্থ সর্গ) নমি আমি,কবি-গুরু তব পদাম্বুজে, বাল্মীকি;হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি, তব অনুগামী দাস,রাজেন্দ্র-সঙ্গমে দিন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে; তব পদ-চিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি, পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে, দমনিয়া ভব-দম দুরন্ত শমনে— অমর; শ্রীভর্ত্তৃহরি; সূরী ভবভূতি শ্রীকন্ঠ;ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি ভারতীর, কালিদাস–সুমধুর-ভাষী; মুরারী-মূরলীধ্বনি-সদৃশ মুরারি মনোহর;কীর্ত্তিবাস,কীর্ত্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলঙকার;–হে পিতঃ, কেমনে, কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি? গাঁথিব নূতন মালা ,তুলি সযতনে তব কাব্যদানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে বিবিধ ভূষনে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব (দীন আমি;) রত্নরাজী,তুমি নাহি দিলে, রত্নাকর? কৃপা,প্রভু কর আকিন্চনে। একাকিনি শোকাকুলা, অশোক-কাননে কাঁদেন রাঘব-বান্ছা আঁধার কুটিরে নীরবে;দুরন্ত চেড়ী,সতীরে ছাড়িয়া, ফেরে দূরে মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে– হীন-প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে মলিন-বদনা দেবী,হায় রে যেমতি খনির তিমির গর্ভে (না পারে পশিতে সৌর-কর-রাশি যথা) সূর্য্যকান্ত-মণি; কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি-তলে; স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া উছ্বাসে বিলাপী যথা; লড়িছে বিষাদে মর্মরিয়া পাতাকুল; বসেছে অরবে শাখে পাখী; রাশি রাশি কুসুম পড়েছে তরুমূলে; যেন তরু, তাপি মনস্তাপে, ফেলিয়াছে খুলি সাজ; দূরে প্রবাহিণী, উচ্চ বিচী-রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে, কহিতে বারীশে যেন এ দুঃখ-কাহিনী; না পশে সুধাংশু-অংশু সে ঘোর বিপিনে ফোটে কি কমল কভু সমল সলিলে? তবুও উজ্বল বন ও অপূর্ব্ব রূপে; একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী, তমোময় ধামে যেন; হেন কালে তথা সরমা সুন্দরী আসি বসিলা কাঁদিয়া সতীর চরণ-তলে,সরমা সুন্দরী– রক্ষঃকুল-রাজলক্ষী রক্ষোবধূ-বেশে; কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি সুলোচনা কহিলা মধুর স্বরে; ”দুরন্ত চেড়ীরা, তোমারে ছাড়িয়া, দেবি ফিরিছে নগরে, মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা-কালে; এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে পা-দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা,সুন্দর ললাটে দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে এ বেশ? নিষ্ঠুর,হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি; কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ? কেমনে হরিল ও বরাঙ্গ-অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি? কৌটা খুলি,রক্ষো বধূ যত্নে দিলা ফোঁটা। সীমন্তে ; সিন্দুর বিন্দু শোভিল ললাটে, গোধূলি-ললাটে, আহা; তারা-রত্ন-যথা; দিয়া ফোঁটা, পদ-ধূলি লইলা সরমা । ”ক্ষম লক্ষি, ছুইনু ও দেব-আকাঙ্খিত তনু;কিন্তু চির-দাসী দাসী ও চরণে;” এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী পদতলে;আহা মরি সুবর্ণ-দেউটি তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি দশ দিশ; মৃদু-স্বরে কহিলা মৈথিলী;— ”বৃথা গন্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখী; আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইনু দূরে আভরণ,যবে পাপী আমারে ধরিল বনাশ্রমে। ছড়াইনু পথে সে সকলে, চিহ্ন হেতু। সেই হেতু আনিয়াছে হেথা– এ কনক-লঙ্কাপুরে—-ধীর রঘুনাথে; মণি,মুক্তা, রতন, কি আছে লো জগতে, যাহে নাহি অবহেলি লভিতে সে ধনে? যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে ঝরে পূত বারি-ধারা, কহিলা জানকী, মধুর ভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি সরমারে,—“হিতৈষিণী সীতার পরমা তুমি,সখি; পূর্ব্ব-কথা শুনিবারে যদি ইচ্ছা তব,কহি আমি, শুন মনঃ দিয়া।— ছিনু মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে, কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে বাঁধি নীড়,থাকে সুখে;ছিনু ঘোর বনে, নাম পঞ্চবটী,মর্ত্ত্যে সুর-বন-সম। সদা করিতেন সেবা লক্ষণ সুমতি। দন্ডক ভান্ডার যার, ভাবি দেখ মনে, কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি নিত্য ফল-মূল বীর সৌমিত্রি; মৃগয়া করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীব নাশে সতত বিরত,সখি রাঘবেন্দ্র বলী,— দয়ার সাগর নাথ ,বিদিত জগতে; “ভুলিনু পূর্ব্বের সুখ। রাজার নন্দিনী রঘু-কুল-বধু আমি; কিন্তু এ কাননে, পাইনু, সরমা সই,পরম পিরীতি ; কুটীরের চারিদিকে কত যে ফুটিত ফুলকুল নিত্য নিত্য,কহিব কেমনে? পঞ্চবটী-বন-চর মধু নিরবধি; জাগাত প্রভাতে মোরে কহরি সুস্বরে পিকরাজ;কোন রাণী,কহ; শশিুমুখি, হেন চিত্ত-বিনোদন বৈতালিক-গীতে খোলে আঁখি? শিখী সহ । শিখীনি সুখিনী নাচিত দুয়ারে মোর; নর্ত্তক,নর্ত্তকী, এ দোঁহার সম, রামা,আছে কি জগতে? অতিথি আসিত নিত্য করভ,করভী, মৃগ- শিশু, বিহঙ্গম,স্বর্ণ-অঙ্গ কেহ, কেহ, শুভ্র,কেহ কাল,কেহ বা চিত্রিত, যথা বাসবের ধনুঃ ঘন-বন-শিরে; অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে, মহাদরে; পালিতাম পরম যতনে, মরুভূমে স্রতোস্বতী তৃষাতুরে যথা, আপনি সুজলবতী বারিদ-প্রসাদে। সরসী আরসি মোর; তুলি কুবলয়ে, (অতুল রতন-সম) পরিতাম কেশে; সাজিতাম ফুল-সাজে; হাসিতেন প্রভু, বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে; হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে? আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে দেখিবে সে পা-দুখানি—আশার সরসে রাজীব; নয়ন মণি? হে দারুণ বিধি, কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে? এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে। কাঁদিলা সরমা সতী তিতি অশ্রু-নীরে। কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি রক্ষোবধূ সরমা, কহিলা সতী সীতার চরণে;— ”স্মরিলে পূর্ব্বের কথা ব্যাথা মনে যদি পাও, দেবী, থাক তবে ; কি কাজ স্মরিয়া?— হেরি তব অশ্রু-বারি ইচ্ছি মরিবারে;” উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা ( কাদম্বা যেমতি মধু-স্বরা);–“এ অভাগী,হায়, লো সুভগে, যদি না কাঁদিবে, তবে কে আর কাঁদিবে এ জগতে? কহি, শুন পূর্ব্বের কাহিনী। বরিষার কালে,সখি,প্লাবন-পীড়নে কাতর,প্রবাহ,ঢালে,তীর অতিক্রমি, বারি-রাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ দুঃখিত,দুঃখের কথা কহে সে অপরে। তেঁই আমি কহি,তুমি শুন,লো সরমে; কে আছে সীতার আর এ অবরু-পুরে? ”পঞ্চবটী-বনে মোরা গোদাবরী-তটে ছিনু সুখে। হায়, সখি,কেমনে বর্ণিব সে কান্তার-কান্তি আমি? সতত স্বপনে শুনিতাম মন-বীণা বন-দেবী-করে; সরসীর তীরে বসি, দেখিতাম কভু সৌর-কর-রাশি-বেশে সুরবালা-কেলি পদ্মবনে; কভু সাধ্ধী ঋষিবংশ-বধূ সুহাসিনী আসিতেন দাসীর কুটীরে, সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে; অজিন (রন্জিত, আহা, কত শত রঙে;) পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরুমূলে, সখী-ভাবে সম্ভাষিয়া ছায়ায়,কভু বা কুরঙ্গিনী-সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে, গাইতাম গীত শুনি কোকিলের ধ্বনি; নব-লতিকার,সতি দিতাম বিবাহ তরু-সহ; চুম্বিতাম মন্জরিত যবে দম্পতী, মন্জরীবৃন্দে আনন্দে সম্ভাষি নাতিনী বলিয়া সবে; গুন্জরিলে অলি, নাতিনী-জামাই বলি বরিতাম তারে; কভু বা প্রভুরর সহ ভ্রমিতাম সুখে নদী-তটে; দেখিতাম তরল সলিলে নূতন গগন যেন,নব তারাবলী, নব নিশাকান্ত-কান্তি ; কভু বা উঠিয়া পর্ব্বত-উপরে ,সখি বসিতাম আমি নাথের চরণ-তলে, ব্রততী যেমতি বিশাল রসাল-মূলে; কত যে আদরে তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন- সুধা, হায়, কব কারে ? কব বা কেমনে? শুনেছি কৈলাস-পুরে কৈলাস-নিবাসী ব্যোমকেশ,স্বর্ণাসনে বসি গৌরী-সনে, আগম,পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্র-কথা পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে; শুনিতাম সেইরূপে আমিও,রূপি, নানাকথা ; এখনও, এ বিজন বনে, ভাবি আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী;— সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি, সে সঙ্গীত ?”—নীরবিলা আয়ত-লোচনা বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী;— “শুনিলে তোমার কথা, রাঘব-রমণি, ঘৃণা জন্মে রাজ-ভোগে ; ইচ্ছা করে,ত্যজি রাজ্য-সুখ, যাই চলি হেন বনবাসে; কিন্তু ভেবে দেখি যদি,ভয় হয় মনে। রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে তমোময়,নিজগুনে আলো করে বনে সে কিরণ; নিশি যবে যায় কোন দেশে, মলিন-বদন সবে তার সমাগমে; যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি, কেন না হইবে সুখী সর্ব্ব জন তথা, জগৎ-আনন্দ তুমি, ভুবন-মোহিনী; কহ, দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা-ধ্বনি দাসী, পিকবর-রব নব পল্লব-মাঝারে সরষ মধুর মাসে ; কিন্তু নাহি শুনি হেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে;” =========== মেঘনাদবধ কাব্য (তৃতীয় সর্গ) প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী। অশ্রুআঁখি-বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে কভু,ব্রজ-কুঞ্জ-বনে,হায়রে, যেমনি ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী। অবচয়ি ফুল-চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে, বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি, ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে, পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে; কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি। চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।” কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর- সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে; লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ- অরি ফিরিছে চৌদিকে অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা” রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;– “কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি, বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে, কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি? দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ; রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,– আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে? পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে; দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি? যথা বায়ু-সখা সহ দাবানল গতি দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে। টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি; ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;– কিন্তু নিশা-কালে কবে ধূম-পুঞ্জ পারে আবরিতে অগ্নি-শিখা? অগ্নিশিখা-তেজে চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে। কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ, স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে; পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ; বন-হস্তী বনে ডুবিল অতল জলে জলচর যত ; শিবিরে বসেন প্রভু রঘু-চুড়ামণি করপুটে শূর-সিংহ লক্ষণ সম্মুখে, পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত, রুদ্র-কুল-সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি । সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’-ধ্বনি উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর কোলাহলে, সাগর-কল্লোল যথা; ত্রস্তে রক্ষোরথী, দাশরথি-পানে চাহি, কহিলা কেশরী,– “চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে। নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?” বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে। “ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি, “দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া; মায়াময় লঙ্কা-ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে; কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি; এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে। শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি-কালে? রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে;” হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে, (ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে;) কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে, আর যত গুরুজনে;— নৃ-মুন্ড-মালিনী নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী, বীরেন্দ্র-কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী, তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব? বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে? কহ শীঘ্র করি;” উত্তরিলা ভীমা-রূপী; “বীর-শ্রেষ্ঠ তুমি, রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে; নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে।” এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা, প্রফুল্ল কুসুম যথা (শিশির মন্ডিত) বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ-সমীরণে; উত্তরিলা রঘুপতি; ”শুন, সুকেশিনী, বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে। অরি মম রক্ষ-পতি; তোমরা সকলে কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে বৈরি-ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে? আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”। এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;– “দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে, শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা-দলে।” প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ, প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া, রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক। না জানি এ বামা-দলে কে আঁটে সমরে ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি– রক্তবীজ-কুল-অরি?” কহিলা রাঘব;– ”চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্র-বধূ।” যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে, অগ্নিময় দশ দিশ; দেখিলা সম্মুখে রাঘবেন্দ্র বিভা-রাশি নির্ধূম আকাশে, সুবর্নি বারিদপুঞ্জে; শুনিলা চমকি কোদন্ড-ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া-দড়বড়ি, হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি। সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা, ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী; উড়িছে পতাকা —রত্ন-সঙ্কলিত-আভা; মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী; বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে। গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে অটল,চলিছে মধ্যে বামা-কুল-দল; উপত্যকা-পথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ, গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি। সর্ব-অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী, কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ-দন্ড করে হৈমময়; তার পাছে চলে বাদ্যকরী, বিদ্যাধরী-দল যথা, হায় রে ভূতলে অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা- আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে; তার পাছে শূল-পাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা; চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি; আস্ফালিলা শূলে কেহ; হাসিলা কেহ বা অট্টহাসে টিটকারি; কেহ বা নাদিলা, গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী, বীর-মদে, কাম-মদে উন্মাদ ভৈরবী; লক্ষ্য করি রক্ষোবরে, কহিলা রাঘব;– ”কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি, কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে; নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?” উত্তরিলা বিভীষণ; ”নিশার স্বপন নহে এ,বৈদেহী-নাথ,কহিনু তোমারে। কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী। মহাশক্তি-সম তেজে;দম্ভোলি-নিক্ষেপী সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে, সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;” লঙ্কার কনক-দ্বারে উতরিলা সতী প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস, প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা; উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী;— ”কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে? নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ-কুল-বধূ, খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে; বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে। ========== মেঘনাদবধ কাব্য (প্রথম সর্গ) সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি   বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে   অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,   কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,   পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি   রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা   ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে — অজেয় জগতে —   ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?   বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি   আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে   ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,   বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)   যবে খরতর শরে, গহন কাননে,   ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,   তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।   কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে?   নরাধম আছিল যে নর নরকুলে   চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,   মৃ্ত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!   হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর   কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,   সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!   হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?   কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে   মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি   সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি   বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,   মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।   — তুমিও আইস, দেবি তুমি মধুকরী   কল্পনা! কবির ঢিত্ত-ফুলবন-মধু   লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে   আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।      কনক-আসনে বসে দশানন বলী —   হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা   তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি   সভাসদ, নতভাবে বসে চারি দিকে।   ভূতলে অতুল সভা — স্ফটিকে গঠিত;   তাহে শোভে রত্নরাজি, মানস-সরসে   সরস কমলকুল বিকশিত যথা।   শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, স্তম্ভ সারি সারি   ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,   বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে   ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,   পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে   (খচিত মুকুলে ফুল) পল্লবের মালা   ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে   রতনসম্ভবা বিভা — ঝলসি নয়নে!   সুচারু চামর চারুলোচনা কিঙ্করী   ঢুলায়; মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি   চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা   হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি   দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!—   ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ মুরতি,   পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা   শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধে বহি,   অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি   কাকলী লহরী, মরি! মনোহর, যথা   বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল বিপিনে!   কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি   ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা   স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?      এহেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,   বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে   অবিরল অশ্রুধারা — তিতিয়া বসনে,   যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে   বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর জোড় করি,   দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত   ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব কলেবর।   বীরবাহু সহ যত যোধ শত শত   ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে   একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল তরঙ্গ   গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে—   নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতি সম।   এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,   হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি   নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।   আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে   দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া,   বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, কহিলা রাবণ;—      “নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,   রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে   কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী   বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া   কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?   হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!   কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?   কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,   হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে   সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে   এ বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!   বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে   একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে   নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু   তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে   নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে   এর শরে! তা না হলে মরিত কি কভু   শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,   অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত—   রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, সূর্পণখা,   কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই অভাগী,   কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা   এ ভুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)   পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি   আনিনু এ হৈম গেহে? হায় ইচ্ছা করে,   ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে   পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!   কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে   উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল   এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে   শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;   নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;   তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?   কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”      এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস–   কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা   হস্তিনায় অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে   শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে   হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে!      তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ)   কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা   নতভাবে; — “হে রাজন্, ভুবন বিখ্যাত,   রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে!   হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে   এ জগতে? ভাবি, প্রভু দেখ কিন্তু মনে;—   অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে   বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর   সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল   মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।   মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”      উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;—   “যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান   সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল   মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।   কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ   অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম,   তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়   ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে,   যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”      এতেক কহিয়া রাজা, দূত পানে চাহি,   আদেশিলা,— “কহ, দূত, কেমনে পড়িল   সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”      প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ জুড়ি,   আরম্ভিলা ভগ্নদূত;— “হায়, লঙ্কাপতি,   কেমনে কহিব আমি অপূর্ব কাহিনী?   কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বীরতা?—   মদকল করী যথা পশে নলবনে,   পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে   ধনুর্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম   থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে!   শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে;   সিংহনাদে; জলধির কল্লোলে; দেখেছি   দ্রুত ইরম্মদে, দেব, ছুটিতে পবন–   পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে,   এহেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড-টঙ্কারে!   কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—      পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহু সহ   রণে, যূথনাথ সহ গজযূথ যথা।   ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,—   মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি   গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি   উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে   শনশনে!— ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু!   কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?      এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে   পুত্র তব, হে রাজন্! কত ক্ষণ পরে,   প্রবেশিলা, যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব।   কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ,   বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে   খচিত,”— এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল   ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া   পূর্বদুঃখ! সভাজন কাঁদিলা নীরবে।      অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,   মন্দোদরীমনোহর;— “কহ, রে সন্দেশ–   বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা   দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?”   “কেমনে, হে মহীপতি,” পুনঃ আরম্ভিল   ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি,   কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি?   অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্যক্ষ, সরোষে   কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া   বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে   কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ   উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি বায়ু সহ   নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম   ধূমপুঞ্জসম চর্মাবলীর মাঝারে   অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!—   আর কি কহিব, দেব? পূর্বজন্মদোষে,   একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ,   কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে?   কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি,   হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহু সহ   রণভূমে? কিন্তু নহি নিজ দোষে দোষী।   ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি,   রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।”   এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস   মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে   কহিলা; “সাবাসি, দূত! তোর কথা শুনি,   কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে   সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী   কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে?   ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী! চল, সবে,—   চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ-জন,   কেমনে পড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি   বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়নে।”      উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,   কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন   অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-   সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী!   হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে;   কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা;   তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন,   যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ   দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,   বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন   আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,   রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,   জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।      দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর—   অটল অচল যথা; তাহার উপরে,   বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা   শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার   (রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা   জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক   অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,   রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,   নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে।   থানা দিয়া পূর্ব দ্বারে, দুর্বার সংগ্রামে,   বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে   অঙ্গদ, করভসম নব বলে বলী;   কিংবা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক-   ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে, ঊর্ধ্ব ফণা—   ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে!   উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি   বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে—   হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে,   কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন   শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্ঘে, বায়ুপুত্র হনু,   মিত্রবর বিভীষণ। এত প্রসরণে,   বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী,   গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি,   বেড়ে জালে সাবধানে কেশরিকামিনী,—   নয়ন–রমণী রূপে, পরাক্রমে ভীমা   ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি   রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি,   কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে। মেঘনাদবধ কাব্য (ষষ্ঠ সর্গ) কুশাসনে ইন্দ্রজিৎ পূজে ইষ্টদেবে নিভৃতে; কৌশিক বস্ত্র,কৌশিক উত্তরি, চন্দনের ফোঁটা ভালে, ফুলমালা গলে। পুড়ে ধূপ দানে ধূপ; জ্বলিছে চৌদিকে পুত ঘৃতরসে দীপ; পুস্প রাশি রাশি, গন্ডারের শৃঙ্গে গড়া কোষা কোষী, ভরা হে জাহ্নবি, তব জলে, কলুষনাশিনী তুমি; পাশে হেম-ঘন্টা, উপহার নানা হেমপাত্রে; রুদ্ধ দ্বার;— বসেছে একাকী যমদূত, ভীমবাহু লক্ষণ পশিলা মায়াবলে দেবালয়ে। ঝনঝনিল অসি পিধানে,ধ্বনিল বাজি তুণীর-ফলকে, কাঁপিল মন্দির ঘন বীরপদভরে। চমকি মুদিত আঁখি মিলিলা রাবণি। দেখিলা সম্মুখে বলী দেবকৃতি রথী— তেজস্বী মধ্যাহ্নে যথা দেব অংশুমালী; সাষ্টাঙ্গে প্রণমি শূর, কৃতাঞ্জলিপুটে, কহিলা “হে বিভাবসু, শুভক্ষণে আজি পূজিল তোমারে দাস, তেঁই, প্রভু, তুমি পবিত্রিলা লঙ্কাপুরী ও পদ-অর্পণে; কিন্তু কি কারণে,কহ, তেজস্বি, আইলা রক্ষঃকুলরিপু নর লক্ষণের রূপে প্রসাদিতে এ অধীনে? এ কি লীলা তব, প্রভাময়? ”পুনঃ বলী নমিলা ভূতলে। উত্তরিলা বীরদর্পে রৌদ্র দাশরথি;— ”নহি বিভাবসু আমি, দেখ নিরখিয়া, রাবণি; লক্ষণ নাম, জন্ম রঘুকুলে; সংহারিত, বীরসিংহ, তোমায় সংগ্রামে আগমন হেথা মম; দেহ রণ মোরে অবিলম্বে।” যথা পথে সহসা হেরিলে ঊর্দ্ধফণা ফণীশ্বরে, ত্রাসে হীনগতি পথিক, চাহিলা বলী লক্ষণের পানে সভয় হইল আজি ভয়শূ্ন্য হিয়া; প্রচন্ড উত্তাপে পিন্ড হায় রে গলিল; গ্রাসিল মিহিরে রাহু, সহসা আঁধারি তেজপুঞ্জ ;অম্বুনাথে নিদাঘ শুষিল; পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে; বিস্ময়ে কহিলা শূর, “সত্য যদি তুমি রামানুজ,কহ,রথি,কি ছলে পশিলা রক্ষোরাজপুরে আজি? রক্ষঃ শত শত, যক্ষপতিত্রাস বলে, ভীম-অস্ত্রপাণি, রক্ষিছে নগরদ্বার;শৃঙ্গধরসম এ পুর-প্রাচীর উচ্চ;—প্রাচীর উপরে ========== যমুনাতটে ১মৃদু কলরবে তুমি,ওহে শৈবলিনি, কি কহিছ ভাল করে কহ না আমারে। সাগর-বিরহে যদি, প্রাণ তব কাঁদে, নদি, তোমার মনের কথা কহ রাধিকারে--- তুমি কি জান না, ধনি, সেও বিরহিণী?২তপনতনয়া তুমি;তেঁই কাদম্বিনী পালে তোমা শৈলনাথ-কাঞ্চন-ভবনে; জন্ম তব রাজকুলে,(সৌরভ জনমে ফুলে) রাধিকারে লজ্জা তুমি কর কি কারণে? তুমি কি জান না সেও রাজার নন্দিনী?৩এস, সখি, তুমি আমি বসি এ বিরলে! দু'জনের মনোজ্জ্বালা জুড়াই দু'জনে; তব কূলে,কল্লোলিনি,ভ্ৰমি আমি একাকিনী, অনাথা অতিথি আমি তোমার সদনে— তিতিছে বসন মোর নয়নের জলে!৪ফেলিয়া দিয়াছি আমি যত অলঙ্কার--- রতন, মুকুতা, হীরা, সব আভরণ! ছিঁড়িয়াছি ফুল-মালা জুড়াতে মনের জ্বালা, চন্দন চর্চ্চিত দেহে ভস্মের লেপন! আর কি এ সবে সাদ আছে গো রাধার?৫তবে যে সিন্দূরবিন্দু দেখিছ ললাটে, সধবা বলিয়া আমি রেখেছি ইহারে! কিন্তু অগ্নিশিখা সম, হে সখি, সীমস্তে মম জ্বলিছে এ রেখা আজি—কহিমু তোমারে— গোপিলে এ সব কথা প্রাণ যেন ফাটে!৬বসো আসি,শশিমুখি,আমার আঁচলে, কমল আসনে যথা কমলবাসিনী! ধরিয়া তোমার গলা, কাঁদি লো আমি অবলা, ক্ষণেক ভুলি এ জ্বালা, ওহে প্রবাহিণি! এস গো বসি দুজনে এ বিজন স্থলে!৭কি আশ্চৰ্য্য!এত করে করিনু মিনতি, তবু কি আমার কথা শুনিলে না, ধনি? এ সকল দেখে শুনে, রাধার কপাল-গুণে, তুমিও কি ঘৃণিলা গো রাধায়, স্বজনি? এই কি উচিত তব, ওহে স্রোতস্বতি?৮হায় রে তোমারে কেন দোষি, ভাগ্যবতি? ভিখারিণী রাধা এবে—তুমি রাজরাণী। হরপ্রিয়া মন্দাকিনী,সুভগে,তব সঙ্গিনী, অর্পেণ সাগর-করে তিনি তব পাণি! সাগর-বাসরে তব তাঁর সহ গতি!৯মৃদু হাসি নিশি আসি দেখা দেয় যবে, মনোহর সাজে তুমি সাজ লো কামিনী। তারাময় হার পরি,শশধরে শিরে ধরি, কুসুমদাম কবরী,তুমি বিনোদিনী, দ্রুতগতি পতিপাশে যাও কলরবে ।১০হায় রে এ ব্রজে আজি কে আছে রাখার? কে জানে এ ব্ৰজজনে রাধার যাতন? দিবা অবসান হলে,রবি গেলে অস্তাচলে, যদিও ঘোর তিমিরে ডোবে ত্রিভুবন, নলিনী যেমনি জ্বলে–এত জ্বালা কার?১১উচ্চ তুমি নীচ এবে আমি হে যুবতি, কিন্তু পর-দুঃখে দুঃখী না হয় যে জন, বিফল জনম তার,অবশ্য সে দুরাচার। মধু কহে, মিছে ধনি করিছ রোদন, কাহার হৃদয়ে দয়া করেন বসতি?(ব্রজাঙ্গনা কাব্য) যশঃ লিখিনু কি নাম মোর বিফল যতনে বালিতে,রে কাল,তোর সাগরের তীরে ? ফেন-চূড় জল-রাশি আসি কি রে ফিরে, মুছিতে তুচ্ছেতে ত্বরা এ মোর লিখনে ? অথবা খোদিনু তারে যশোগিরি-শিরে, গুণ-রূপ যন্ত্রে কাটি অক্ষর সুক্ষণে নারিবে উঠাতে যাহে,ধুয়ে নিজ নীরে, বিস্মৃতি,বা মলিনিতে মলের মিলনে?--- শূন্য-জল জল-পথে জলে লোক স্মরে; দেব-শূন্য দেবালয়ে অদৃশ্যে নিবাসে দেবতা;ভস্মের রাশি ঢাকে বৈশ্বানরে। সেই রূপে,ধড় যবে পড়ে কাল-গ্রাসে, যশোরূপাশ্রমে প্রাণ মর্ত্ত্যে বাস করে;--- কুযশে নরকে যেন সুযশে---আকাশে। যশের মন্দির সুবর্ণ-দেউল আমি দেখিনু স্বপনে অতি-তুঙ্গ শৃঙ্গ শিরে! সে শৃঙ্গের তলে, বড় অপ্রশস্ত সিঁড়ি গড়া মায়া-বলে, বহুবিধ রোধে রুদ্ধ উর্দ্ধগামী জনে! তবুও উঠিতে তথা-- সে দুর্গম স্থলে-- করিছে কঠোর চেষ্টা কষ্ট সহি মনে বহু প্রাণী। বহু প্রাণী কাঁদিছে বিকেলে, না পারি লভিতে যত্নে সে রত্ন-ভবনে। ব্যথিল হৃদয় মোর দেখি তা সবারে।-- শিয়রে দাঁড়ায়ে পরে কহিলা ভারতী, মৃদু হাসি; ``ওরে বাছা, না দিলে শকতি আমি, ও দেউলে কার সাধ্য উঠিবারে? যশের মন্দির ওই; ওথা যার গতি, অশক্ত আপনি যম ছুঁইতে রে তারে!'' যশের মন্দির সূবর্ণ দেউল আমি দেখিনু স্বপনে অতি-তুঙ্গ শৃঙ্গ শিরে!সে শৃঙ্গের তলে, বড় অপ্রশস্ত সিঁড়ি গড়া মায়া-বলে, বহুবিধ রোধে রুদ্ধ ঊর্দ্ধগামী জনে! তবুও উঠিতে তথা---সে দুর্গম স্থলে--- করিছে কঠোর চেষ্টা কষ্ট সহি মনে বহু প্রাণী। বহু প্রাণী কাঁদিছে বিকলে, না পারি লভিতে যত্নে সে রত্ন-ভবনে। ব্যথিল হৃদয় মোর দেখি তা সবারে।--- শিয়রে দাঁড়ায়ে পরে কহিলা ভারতী, মৃদু হাসি;''ওরে বাছা,না দিলে শকতি আমি,ও দেউলে কার সাধ্য উঠিবারে? যশের মন্দির ওই;ওথা যার গতি, অশক্ত আপনি যম ছুঁইতে রে তারে!'' রসাল ও স্বর্ণ-লতিকা রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;--- ''শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।              নিদারুণ তিনি অতি;              নাহি দয়া তব প্রতি; তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।              মলয় বহিলে, হায়,              নতশিরা তুমি তায়, মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;              হিমাদ্রি সদৃশ আমি,              বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী, মেঘলোকে উঠে শির আকাশ ভেদিয়া!     কালাগ্নির মত তপ্ত তপন তাপন,---        আমি কি লো ডরাই কখন?              দূরে রাখি গাভী-দলে,              রাখাল আমার তলে              বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,--- শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন! আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।             কেহ অন্ন রাঁধি খায়             কেহ পড়ি নিদ্রা যায                       এ রাজ চরণে।             শীতলিয়া মোর ডরে             সদা আসি সেবা করে মোর অতিথির হেথা আপনি পবন! মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!            তুমি কি তা জান না ললনে?            দেখ মোর ডাল-রাশি,            কত পাখী বাঁধে আসি                            বাসা এ আগারে!            ধন্য মোর জনম সংসারে! কিন্তু তব দুখ দেখি নিত্য আমি দুখী; নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখি!'' যুদ্ধার্থ গম্ভীরতার বাণী তব পানে!            সুধা-আশে আসে অলি,            দিলে সুধা যায় চলি,--- কে কোথা কবে গো দুখী সখার মিলনে?''          ''ক্ষুদ্র-মতি তুমি অতি''            রাগি কহে তরুপতি, ''নাহি কিছু অভিমান?ধিক্ চন্দ্রাননে!'' নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;            আইলেন প্রভঞ্জন,            সিংহনাদ করি ঘন, যথা ভীম ভীমসেন কৌরব-সমরে। আইল খাইতে মেঘ দৈত্যকুল রড়ে;           ঐরাবত পিঠে চড়ি           রাগে দাঁত কড়মড়ি, ছাড়িলেন বজ্র ইন্দ্র কড় কড় কড়ে! ঊরু ভাঙ্গি কুরুরাজে বধিলা যেমতি।                           ভীম যোধপতি;           মহাঘাতে মড়মড়ি           রসাল ভূতলে পড়ি                          হায়, বায়ুবলে হারাইয়া আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে! ঊর্দ্ধশির যদি তুমি কুল মান ধনে; করিও না ঘৃণা তবু নীচশির জনে! এই উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে।। রামায়ণ সাধিনু নিদ্রায় বৃথা সুন্দর সিংহলে।— স্মৃতি, পিতা বাল্মীকির বৃদ্ধ-রূপ ধরি, বসিলা শিয়রে মোর ; হাতে বীণা করি, গাইলা সে মহাগীত, যাহে হিয়া জ্বলে, যাহে আজু আঁখি হতে অশ্রু-বিন্দু গলে ! কে সে মূঢ় ভূভারতে, বৈদেহি সুন্দরি, নাদি আর্দ্রে মনঃ যার তব কথা স্মরি, নিত্য-কান্তি কমলিনী তুমি ভক্তি-জলে! দিব্য চক্ষুঃ দিলা গুরু;দেখিনু সুক্ষণে শিলা জলে;কুম্ভকর্ণ পশিল সমরে, চলিল অচল যেন ভীষণ ঘোষণে, কাঁপায় ধরায় ঘন ভীম-পদ-ভরে। বিনাশিলা রামানুজ মেঘনাদে রণে; বিনাশিলা রঘুরাজ রক্ষোরাজেশ্বরে। রাশি-চক্র রাজপথে,শোভে যথা, রম্য-উপবনে, বিরাম-অ্যালয়বৃন্দ ; গড়িলা তেমতি দ্বাদশ মন্দির বিধি, বিবিধ রতনে, তব নিত্য পথে শূন্যে, রবি, দিনপতি। মাস কাল প্রতি গৃহে তোমার বসতি, গ্রহেন্দ্র ; প্রবেশ তব কখন সুক্ষণে,— কখন বা প্রতিকুল জীব-কুল প্রতি! অাসে এ বিরামালয়ে সেবিতে চরণে গ্রহব্রজ ; প্রজাব্রজ, রাজাসন-তলে পূজে রাজপদ যথা ; তুমি তেজাকর, হৈমময় তেজ-পুঞ্জ প্রসাদের ছলে, প্রদান প্রসন্ন ভাবে সবার উপর। কাহার মিলনে তুমি হাস কুতূহলে, কাহার মিলনে বাম,—শুনি পরস্পর। রৌদ্র-রস শুনিনু গম্ভীর ধ্বনি গিরির গহ্বরে, ক্ষুধাৰ্ত্ত কেশরী যেন নাদিছে ভীষণে; প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জ্জিছে গগনে ; সচূড়ে পাহাড় কাঁপে থর থর থরে, কাঁপে চারি দিকে বন যেন ভূকম্পনে ; উথলে অদূরে সিন্ধু যেন ক্রোধ-ভরে, যবে প্রভঞ্জন আসে নির্ঘোষ ঘোষণে। জিজ্ঞাসিনু ভারতীরে জ্ঞানার্থে সত্বরে! কহিলা মা;---''রৌদ্র নামে রস,রৌদ্র অতি, রাখি আমি,ওরে বাছা,বাঁধি এই স্থলে, (কৃপা করি বিধি মোরে দিলা এ শকতি) বাড়বাগ্নি মগ্ন যথা সাগরের জল। বড়ই কর্কশ-ভাষী,নিষ্ঠুর,দুর্ম্মতি, সতত বিবাদে মত্ত,পুড়ি রোষানলে।'' লক্ষ্মণের প্রতি সূর্পণখা কে তুমি,--বিজন বনে ভ্রম হে, একাকী, বিভূতি-ভূষিত অঙ্গ? কি কৌতুকে, কহ, বৈশ্বানর, লুকাইছ ভস্মের মাঝারে? মেঘের আড়ালে যেন পূর্ণশশী আজি? ফাটে বুক জটাজুট হেরি তব শিরে, মঞ্জুকেশি! স্বর্ণশয্যা ত্যজি জাগি আমি বিরাগে, যখন ভাবি, নিত্য নিশাযোগে শয়ন, বারাঙ্গ তব, হায় রে, ভূতলে! উপাদেয় রাজভোগ যোগাইলে দাসী, কাঁদি ফিরাইয়া মুখ, পড়ে যাবে মনে তোমার আহার নিত্য ফল মূল, বলি! সুবর্ণ-মন্দিরে পশি নিরানন্দ গতি, কেন না--নিবাস তব বঞ্জুল মঞ্জুলে! হে সুন্দর, শীঘ্র আসি কহ মোরে শুনি-- কোন্ দুঃখে ভব-সুখে বিমুখ হইলা এ নব যৌবনে তুমি? কোন্ অভিমানে রাজবেশ ত্যজিলা হে উদাসীর বেশে? হেমাঙ্গ মৈনাক-সম, হে তেজস্বি কহ, কার ভয়ে ভ্রম তুমি এ বন সাগরে একাকী, আবরি তেজঃ, ক্ষীণ, ক্ষুন্ন খেদে? তোমার মনের কথা কহ আসি মোরে |-- যদি পরাভূত তুমি রিপুর বিক্রমে, কহ শিঘ্র ; দিব সেনা ভব-বিজয়িনী, রথ, গজ, অশ্ব, রথী--অতুল জগতে! বৈজয়ন্ত-ধামে নিত্য শচিকান্ত বলী ত্রস্ত অস্ত্র-ভয়ে যার, হেন ভীম রথী যুঝিবে তোমার হেতু--আমি আদেশিলে! চন্দ্রলোকে, সূর্যলোকে,--যে লোকে ত্রিলোকে লুকাইবে অরি তব, বাঁধি আনি তারে দিব তব পদে, শূর! চামুণ্ডা আপনি, (ইচ্ছা যদি কর তুমি) দাসীর সাধনে, (কুলদেবী তিনি, দেব,) ভীমখণ্ডা হাতে, ধাইবেন হুহুঙ্কারে নাচিতে সংগ্রামে-- দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস!--যদি অর্থ চাহ, কহ শীঘ্র ; --অলঙ্কার ভান্ডার খুলিব তুষিতে তোমার মনঃ ; নতুবা কুহকে শুষি রত্নাকরে, লুটি দিব রত্ন-জালে! মণিযোনি খনি যত, দিব হে তোমারে! প্রেম-উদাসীন যদি তুমি, গুণমণি, কহ, কোন্ যুবতীর--(আহা, ভগ্যবতী রামাকুলে সে রমণী!)--কহ শীঘ্র করি,-- কোন্ যুবতীর নব যৌবনের মধু বাঞ্ছা তব? অনিমেষে রূপ তার ধরি, (কামরূপা আমি, নাথ,) সেবিব তোমারে! আনি পারিজাত ফুল, নিত্য সাজাইব শয্যা তব! সঙ্গে মোর সহস্র সঙ্গিনী, নৃত্য গীত রঙ্গে রত | অপ্সরা, কিন্নরী, বিদ্যাধরী,--ইন্দ্রাণীর কিঙ্করী যেমতি, তেমতি আমারে সেবে দশ শত দাসী | সুবর্ণ-নির্মিত গৃহে আমার বসতি-- মুক্তাময় মাঝ তার ; সোপান খচিত মরকতে ; স্তম্ভে হীরা ; পদ্মরাগ মণি ; গবাক্ষে দ্বিরদ-রদ, রতন কপাটে! সুকল স্বরলহরী উথলে চৌদিকে দিবানিশি ; গায় পাখী সুমধুর স্বরে ; সুমধুরতর স্বরে গায় বীণাবাণী বামাকুল! শত শত কুসুম-কাননে লুটি পরিমল, বায়ু অনুক্ষণ বহে! খেলে উত্স ; চলে জল কল কল কলে! কিন্তু বৃথা এ বর্ণনা | এস, গুণনিধি, দেখ আসি,--এ মিনতি দাসীর ও পদে! কায়, মনঃ, প্রাণ আমি সঁপিব তোমারে! ভঞ্জ আসি রাজভোগ দাসীর আলয়ে ; নহে কহ, প্রাণেশ্বর! অম্লান বদনে, এ বেশ ভূষণ ত্যজি, উদাসিনী-বেশে সাজি, পূজি, উদাসীন, পাদ-পদ্ম তব! রতন কাঁচলি খুলি, ফেলি তারে দূরে, আবরি বাকলে স্তন ; ঘুচাইয়া বেণী, মণ্ডি জটাজূটে শিরঃ ; ভুলি রত্নরাজী, বিপিন-জনিত ফুলে বাঁধি হে কবরী! মুছিয়া চন্দন, লেপি ভস্ম কলেবরে | পরি রুদ্রাক্ষের মালা, মুক্তামালা ছিঁড়ি গলদেশে! প্রেম-মন্ত্র দিও কর্ণ-মূলে ; গুরুর দক্ষিণা-রূপে প্রেম-গুরু-পদে দিব এ যৌবন-ধন প্রেম-কুতূহলে! প্রেমাধীনা নারীকুল ডরে কি হে দিতে জলাঞ্জলি, মঞ্জুকেশি, কুল, মান, ধনে প্রেম-লাভ লোভে কভু?--বিরলে লিখিয়া লেখন, রাখিনু, সখে, এই তরুতলে | নিত্য তোমা হেরি হেথা ; নিত্য ভ্রম তুমি এই স্থলে | দেখ চেয়ে ; ওই যে শোভিছে শমী,--লতাবৃতা, মরি, ঘোনটায় যেন, লজ্জাবতী!--দাঁড়াইয়া উহার আড়ালে, গতিহীনা লজ্জাভয়ে, কত যে চেয়েছি তব পানে, নরবর--হায়! সূর্যমুখী চাহে যথা স্থির-আঁখি সে সূর্যের পানে!-- কি আর কহিব তার? যত ক্ষণ তুমি থাকিতে বসিয়া, নাথ ; থাকিত দাঁড়ায়ে প্রেমের নিগড়ে বদ্ধা এ তোমার দাসী! গেলে তুমি শূণ্যাসনে বসিতাম কাঁদি! হায় রে, লইয়া ধূলা, সে স্থল হইতে যথায় রাখিতে পদ, মাখিতাম ভালে, হব্য-ভস্ম তপস্বিনী মাখে ভালে যথা! কিন্তু বৃথা কহি কথা! পড়িও নৃমণি, পড়িও এ লিপিখানি, এ মিনতি পদে! যদিও ও হৃদয়ে দয়া উদয়ে, যাইও গোদাবরী-পূর্বকূলে ; বসিব সেখানে মুদিত কুমুদীরূপে আজি সায়ংকালে ; তুষিও দাসীরে আসি শশধর-বেশে! লয়ে তরি সহচরী থাকিবেক তীরে ; সহজে পাইবে পার | নিবিড় সে পারে কানন, বিজন দেশ | এস, গুণনিধি! দেখিব প্রেমের স্বপ্ন জাগি হে দুজনে! যদি আজ্ঞা দেহ, এবে পরিচয় দিব সংক্ষেপে | বিখ্যাত, নাথ, লঙ্কা, রক্ষঃপুরী স্বর্ণময়ী, রাজা তথা রাজ-কুল-পতি রাবণ, ভগিনী তাঁর দাসী ; লোকমুখে যদি না শুনিয়া থাক, নাম সূর্পনখা | কত যে বয়স তার ; কি রূপ বিধাতা দিয়েছেন, আশু আসি দেখ, নরমণি! আইস মলয়-রূপে ; গন্ধহীন যদি এ কুসুম, ফিরে তবে যাইও তখনি! আইস ভ্রমর-রূপে ; না যোগায় যদি মধু এ যৌবন-ফুল, যাইও উড়িয়া গুঞ্জরি বিরাগ-রাগে! কি আর কহিব? মলয় ভ্রমর, দেব, আসি সাধে দোহে বৃন্তাসনে মালতীরে! এস, সখে, তুমি ;-- এই নিবেদন করে সূর্পনখা পদে | শুন নিবেদন পুনঃ | এত দূর লিখি লেখন, সখীর মুখে শুনিনু হরষে, রাজরথী দশরথ অযোধ্যাধিপতি, পুত্র তুমি, হে কন্দর্প-গর্ব্ব-খর্ব্ব-কারি, তাঁহার ; অগ্রজ সহ পশিয়াছ বনে পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু | কি আশ্চর্য্য! মরি,-- বালাই লইয়া তব, মরি, রঘুমণি, দয়ার সাগর তুমি! তা না হলে কভু রাজ্য-ভোগ ত্যজিতে কি ভাতৃ-প্রেম-বশে? দয়ার সাগর তুমি | কর দয়া মোরে, প্রেম-ভিখারিনী আমি তোমার চরণে! চল শীঘ্র যাই দোঁহে স্বর্ণ লঙ্কাধামে | সম পাত্র মানি তোমা, পরম আদরে, অর্পিবেন শুভ ক্ষণে রক্ষঃ-কুল-পতি দাসীরে কমল-পদে | কিনিয়া, নৃমণি, অযোধ্যা-সদৃশ রাজ্য শতেক যৌতুকে, হবে রাজা ; দাসী-ভাবে সেবিবে এ দাসী! এস শীঘ্র, প্রাণেশ্বর ; আর কথা যত নিবেদিব পাদ-পদ্মে বসিয়া বিরলে | ক্ষম অশ্রু-চিহ্ন পত্রে ; আনন্দে বহিছে অশ্রু-ধারা! লিখেছে কি বিধাতা এ ভালে হেন সুখ, প্রাণসখে? আসি ত্বরা করি, প্রশ্নের উত্তর, নাথ, দেহ এ দাসীরে | শকুন্তলা মেনকা অপ্সরারূপী, ব্যাসের ভারতী প্রসবি, ত্যজিলা ব্যস্তে, ভারত-কাননে, শকুন্তলা সুন্দরীরে, তুমি, মহামতি, কণ্বরূপে পেয়ে তারে পালিলা যতনে, কালিদাস ! ধন্য কবি, কবি-কুল-পতি ! তব কাব্যাশ্রমে হেরি এ নারী-রতনে কে না ভাল বাসে তারে, দুষ্মন্ত যেমতি প্রেমে অন্ধ?কে না পড়ে মদন-বন্ধনে? নন্দনের পিক-ধ্বনি সুমধুর গলে; পারিজাত-কুসুমের পরিমল শ্বাসে; মানস-কমল-রুচি বদন-কমলে; অধরে অমৃত-সুধা;সৌদামিনী হাসে; কিন্তু ও মৃগাক্ষি হতে যবে গলি,ঝলে অশ্রুধারা,ধৈর্য্য ধরে কে মর্ত্ত্যে,আকাশে? শনি কেন মন্দ গ্রহ বলি নিন্দা তোমা করে জ্যোতিষী ? গ্রহেন্দ্র তুমি,শনি মহামতি! ছয় চন্দ্র রত্নরূপে সুবর্ণ টোপরে তোমার ; সুকটিদেশে পর, গ্রহ-পতি হৈম সারসন, যেন আলোক-সাগরে ! সুনীল গগন-পথে ধীরে তব গতি। বাখানে নক্ষত্র-দল ও রাজ-মূরতি সঙ্গীতে, হেমাঙ্গ বীণা বাজায়ে অম্বরে। হে চল রশ্মির রাশি,সুধি কোন জনে,--- কোন জীব তব রাজ্যে আনন্দে নিবাসে? জন-শূন্য নহ তুমি,জানি আমি মনে, হেন রাজা প্রজা-শূন্য,---প্রত্যয়ে না আসে!--- পাপ,পাপ-জাত মৃত্যু,জীবন-কাননে, তব দেশে,কীটরূপে কুসুম কি নাশে? শিশুপাল নর-পাল-কুলে তব জনম সুক্ষণে শিশুপাল ! কহি শুন, রিপুরূপ ধরি, ওই যে গরুড়-ধ্বজে গরজেন ঘনে বীরেশ, এ ভব-দহে মুকতির তরি! টঙ্কারি কার্ম্মুক, পশ হুহুঙ্কারে রণে ; এ ছার সংসার-মায়া অম্তিমে পাসরি ; নিন্দাছলে বন্দ, ভক্ত, রাজীব-চরণে । জানি, ইষ্টদেব তব, নহেন হে অরি বাসুদেব ; জানি আমি বাগ্দেবীর বরে । লৌহদন্ত হল, শুন, বৈষ্ণব সুমতি, ছিঁড়ি ক্ষেত্রে-দেহ যথা ফলবান করে সে ক্ষেত্রে ; তোমায় ক্ষণ যাতিনি তেমতি আজি, তীক্ষ্ণ শর-জালে বধি এ সমরে, পাঠাবেন সুবৈকুণ্ঠে সে বৈকুণ্ঠ-পতি । শৃঙ্গার-রস শুনিনু নিদ্রায় আমি,নিকুঞ্জ-কাননে, মনোহর বীণা-ধ্বনি;---দেখিনু সে স্থলে রূপস পুরুষ এক কুসুম-আসনে, ফুলের ঠৌপর শিরে,ফুল-মালা গলে। হাত ধরাধরি করি নাচে কুতূহলে চৌদিকে রমণী-চয়,কামাগ্নি-নয়নে,--- উজলি কানন-রাজি বরাঙ্গ-ভূষণে, ব্রজে যথা ব্রজাঙ্গনা রাস-রঙ্গ-ছলে। সে কামাগ্নি-কণা লয়ে সে যুবক,হাসি জ্বালাইছে হিয়াবৃন্দে;ফুল-ধনুঃ ধরি হানিতেছে চারি দিকে বাণ রাশি রাশি কি দেব কি নর উভে জর জর করি! ''কামদেব অবতার রস-কুলে আসি, শৃঙ্গার রসের নাম।''জাগিনু শিহরি। শ্মশান বড় ভাল বাসি আমি ভ্রমিতে এ স্থলে,--- তত্ত্ব-ধীক্ষা-দায়ী স্থল জ্ঞানের নয়নে ৷ নীরবে আসীন হেথা দেখি ভস্মাসনে মৃত্যু---তেজোহীন আঁখি,হাড়-মালা গলে, বিকট অধরে হাসি,যেন ঠাট-ছলে! অর্থের গৌরব বৃথা হেথা---এ সদনে--- রূপের প্রফুল্ল ফুল শুষ্ক হুতাশনে, বিদ্যা,বুদ্ধি,বল,মান,বিফল সকলে। কি সুন্দর অট্টালিকা,কি কুটীর-বাসী, কি রাজা,কি প্রজা,হেথা উভয়ের গতি। জীবনের স্রোতঃ পড়ে এ সাগরে আসি। গহন কাননে বায়ু উড়ায় যেমতি পত্র-পুঞ্জে,আয়ু-কুঞ্জে,কাল,জীব-রাশি উড়ায়ে,এ নদ-পাড়ে তাড়ায় তেমতি। শ্যামা-পক্ষী আঁধার পিঞ্জরে তুই,রে কুঞ্জ-বিহারি বিহঙ্গ, কি রঙ্গে গীত গাইস্ সুস্বরে ? ক মোরে, পূর্ব্বের সুখ কেমনে বিস্মরে মনঃ তোর ? বুঝা রে, যা বুঝিতে না পারি! সঙ্গীত-তরঙ্গ-সঙ্গে মিশি কি রে ঝরে অদৃশ্যে ও কারাগারে নয়নের বারি? রোদন-নিনাদ কি রে লোকে মনে করে মধুমাখা গীত-ধ্বনি, অজ্ঞানে বিচারি? কে ভাবে, হৃদয়ে তোর কি ভাব উথলে?— কবির কুভাগ্য তোর, আমি ভাবি মনে। দুখের আঁধারে মজি গাইস্ বিরলে তুই,পাখি, মজায়ে রে মধু-বরিষণে! কে জানে যাতনা কত তোর ভব-তলে ? মোহে গন্ধে গন্ধরস সহি হুতাশনে! শ্রীপঞ্চমী নহে দিন দূরে, দেবি যবে ভূভারতে বিসর্জ্জিব ভূভারত, বিস্মৃতির জলে, ও তব ধবল মূর্ত্তি সুদল কমলে ;— কিন্তু চিরস্থায়ী পূজা তোমার জগতে ! মনোরূপ-পদ্ম যিনি রোপিলা কৌশলে এ মানব-দেহ-সরে, তাঁর ইচ্ছামতে সে কুসুমে বাস তব, যথা মরকতে কিম্বা পদ্মরাগে জ্যোতিঃ নিত্য ঝলঝলে ! কবির হৃদয়-বনে যে ফুল ফুটিবে, সে ফুল-অঞ্জলি লোক ও রাঙা চরণে পরম-ভকতি-ভাবে চিরকাল দিবে দশ দিশে, যত দিন এ মর ভবনে মনঃ-পদ্ম ফোটে, পূজা, তুমি, মা, পাইবে !— কি কাজ মাটির দেহে তবে, সনাতনে ? সংস্কৃত কাণ্ডারী-বিহীন তরি যথা সিন্ধু-জলে সহি বহু দিন ঝড়, তরঙ্গ-পীড়নে, লভে কূল কালে, মন্দ পবন-চালনে; সে সুদশা আজি তব সুভাগ্যের বলে, সংস্কৃত, দেব-ভাষা মানব-মণ্ডলে, সাগর-কল্লোল-ধ্বনি, নদের বদনে, বজ্রনাদ, কম্পবান্ বীণা-তার-গণে! রাজাশ্রম আজি তব ! উদয়-অচলে, কনক-উদয়াচলে, আবার, সুন্দরি, বিক্রম-অাদিত্যে তুমি হের লো হরষে, নব আদিত্যের রূপে ! পুৰ্ব্বে-রূপ ধরি, ফোট পুনঃ পুর্ব্বরূপে, পুনঃ পূৰ্ব্ব-রসে এত দিনে প্রভাতিল দুখ-বিভাবরী ; ফোট মনানন্দে হাসি মনের সরসে । ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি               ইলিশ মাছের ডিম|        ইলশে গুঁড়ি          ইলশে গুঁড়ি               দিনের বেলায় হিম|            কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,         পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,        মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে              আলতা-পাটি শিম্|      ইলশে গুঁড়ি          হিমের কুঁড়ি,              রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্| হালকা হাওয়ায়          মেঘের ছাওয়ায়              ইলশে গুঁড়ির নাচ, -     ইলশে গুঁড়ির          নাচন্ দেখে             নাচছে ইলিশ মাছ|      কেউ বা নাচে জলের তলায়   ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,     নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,            পুকুরে ছিপ গাছ|      উলসে ওঠে মনটা, দেখে            ইলশে গুঁড়ির নাচ|  ইলশে গুঁড়ি          পরীর ঘুড়ি            কোথায় চলেছে, ঝমরো চুলে          ইলশে গুঁড়ি            মুক্তো ফলেছে!       ধানেক বনে চিংড়িগুলো     লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;     ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,            আকাশ গলেছে, বাঁশের পাতায়          ঝিমোয় ঝিঁঝিঁ,             বাদল চলেছে| মেঘায় মেঘায়          সূর্য্যি ডোবে           জড়িয়ে মেঘের জাল, ঢাকলো মেঘের          খুঞ্চে-পোষে           তাল-পাটালীর থাল|        লিখছে যারা তালপাতাতে       খাগের কলম বাগিয়ে হাতে      তাল বড়া দাও তাদের পাতে            টাটকা ভাজা চাল; পাতার বাঁশী          তৈরী করে'           দিও তাদের কাল|  খেজু পাতায়          সবুজ টিয়ে            গড়তে পারে কে? তালের পাতার          কানাই ভেঁপু            না হয় তাদের দে|      ইলশে গুঁড়ি - জলের ফাঁকি       ঝরছে কত বলব তা কী?       ভিজতে এল বাবুই পাখী           বাইরে ঘর থেকে; - পড়তে পাখায়          লুকালো জল         ভিজলো নাকো সে|  ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!           পরীর কানের দুল,   ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!           ঝরো কদম ফুল|       ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে      ঝাড়ছে পাখা - টুনটুনিতে     নেবুফুলের          কুঞ্জটিতে          দুলছে দোদুল দুল্; ইলশে গুঁড়ি           মেঘের খেয়াল          ঘুম-বাগানের ফুল| উত্তম ও অধম কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায় কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে বিষ লেগে গেল তাই।ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা বিষম ব্যথায় জাগে, মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায় জাগে শিয়রের আগে।বাপেরে সে বলে র্ভৎসনা ছলে কপালে রাখিয়া হাত, তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে তোমার কি নাই দাতঁ?কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল “তুই রে হাসালি মোরে, দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে দংশি কেমন করে?”কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?মূল : শেখ সা’দী অনুবাদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত করবী দূর হতে আমি গোলাপেরি মত ঠিক তবু আমোদিত করিতে পারিনা দিক।।গোলাপেরি মত অতুলন মম হাসি তুব হায় অলি ফিরে যায় কাছে আসি।।পথের প্রান্তে ফুটে আছি অহরহ গোলাপের মত রচিতে পারি নে মোহ।।ভালোবাসা মোর রাখি নি কাটায় ঘিরে সুলভ প্রেমের দুর্দশা তাই কিরে।।গোলাপের মত কন্টকী নই শুধু তাই কি এ বুকে জমে না গোলাপী মধু।। কালোর আলো কালোর বিভায় পূর্ণ ভুবন, কালোরে কি করিস ঘৃণা? আকাশ-ভরা আলো বিফল কালো আঁখির আলো বিনা। কালো ফণীর মাথায় মণি, সোনার আধার আঁধার খনি, বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তে যে বাজায় বীণা, কালোর গানে পুলক আনে, অসাড় বনে বয় দখিনা! কালো মেঘের বৃষ্টিধারা তৃপ্তি সে দেয় তৃষ্ণা হরে, কোমল হীরার কমল ফোটে কালো নিশির শ্যমসায়রে! কালো অলির পরশ পেলে তবে মুকুল পাপড়ি মেলে, তবে সে ফুল হয় গো সফল রোমাঞ্চিত বৃন্ত পরে! কালো মেঘের বাহুর তটে ইন্দ্রধনু বিরাজ করে। সন্ন্যাসী শিব শ্মশানবাসী,--সংসারী সে কালোর প্রেমে, কালো মেঘের কটাক্ষেরি ভয়ে অসুর আছে থেমে। দৃপ্ত বলীর শীর্ষ পরে কালোর চরণ বিরাজ করে, পূণ্য-ধারা গঙ্গা হল- সেও তো কালো চরণ ঘেমে, দুর্বাদলশ্যামের রূপে-- রূপের বাজার গেছে নেমে। প্রেমের মধুর ঢেউ উঠেছে কালিন্দীরি কালো জলে, মোহন বাঁশীর মালিক যে জন তারেও লোকে কালোই বলে, বৃন্দাবনের সেই যে কালো-- রূপে তাহার ভুবন আলো, রাসের মধুর রসের লীলা, -তাও সে কালো তমাল তলে, নিবিড় কালো কালাপানির কালো জলেই মুক্তা ফলে। কালো ব্যাসের কৃপায় আজো বেঁচে আছে বেদের বাণী, দ্বৈপায়ন - সেই কৃষ্ণ কবি- শ্রেষ্ঠ কবি তাঁরেই মানি, কালো বামুন চাণক্যেরে আঁটবে কে কূট-নীতির ফেরে? কালো অশোক জগৎ-প্রিয়, রাজার সেরা তাঁরে জানি, হাবসী কালো লোকমানের মানে আরব আর ইরাণী। কালো জামের মতন মিঠে- কালোর দেশ এই জম্বুদ্বীপে- কালোর আলো জ্বলছে আজো, আজো প্রদীপ যায় নি নিবে, কালো চোখের গভীর দৃষ্টি কল্যানেরি করছে সৃষ্টি, বিশ্ব-ললাট দীপ-- কালো রিষ্টিনাশা হোমের টিপে, রক্ত চোখের ঠান্ডা কাজল-- তৈরী সে এই ম্লান প্রদীপে! কালোর আলোর নেই তুলনা- কালোরে কী করিস ঘৃণা! গগন-ভরা তারার মীনা বিফল- চোখের তারা বীনা, কালো মেঘে জাগায় কেকা, চাঁদের বুকেও কৃষন-লেখা, বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তের যে বাজায় বীণা, কালোর গানে জীবন আনে নিথর বনে বয় দখিনা! কোনো ধর্মধ্বজের প্রতি প্রেমের ধর্ম করছ প্রচার কে গো তুমি সবুট লাথি নিয়ে, ডায়ার-মার্কা শিষ্টাচারের লাল-পেয়ালার শেষ তলানি পিয়ে! কুষলে তো চলছে তোমার অর্ধঘন্টা ধর্মোপদেশ দেওয়া, টিফিন এবং টি-এর ফাঁকে? জমছে ভাল ঋষ্ট কথার খেয়া? মুখোস খোলা, মুখস্থ বোল বোলো না আর টিয়াপাখির মত, মোটা মাসহারার মোহে,- দোরেখা ঢং চালাবে আর কত? বয়স গত, ক্ষ্যাপার মত কামড় দিতে এলে নকল দাঁতে? বাঁধানো দাঁত উল্টে গিয়ে, আহা, শেষে লাগবে যে টাক রাতে! নিরীহ যে সত্যাগ্রহী -কি লাভ হল তারে লাথি মেরে? সে করেছে তোমায় ক্ষমা, তার চোখে আজ নাও দেখে খৃষ্টেরে। অক্রোধে ক্রোধ জিনতে হবে, -সে শিক্ষা কি রইল শিকেয় তোলা, ডিগ্রি নিয়ে ফুরিয়ে গেছে ডাগর-বুলির যা কিছু বোলাবোলা? উদর তন্ত্র উদরতা? ধর্ম কেবল কথারই কাপ্তেনী? ডঙ্কা-নাদের পিছন পিছন সত্য নিয়ে খেলছ ছেনিমেনি? চেয়ে দেখ ক্রুসের পরে ক্ষুদ্ধ কে ওই তোমার ব্যবহারে। জীবন্তবৎ পাষাণ-মুরৎ! -হেঁটমাথা তার লজ্জাতে ধিক্কারে। কুড়ি শ বতসরের ক্ষত লাল হয়ে তাঁর উঠছত্র নতুন করে। দেখছে জগৎ  -পাথর ফেটে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে শোণিত ঝরে। দাও ক্ষমা দাও, চোখ মেলে চাও,-- কি কান্ড হায় করছ গজাল ঠুকে? নিরীহদের নির্যাতনের সব ব্যথা কার বাজছে দ্যাখো বুকে! কিম্বা দ্যাখার নাই প্রয়োজন, তোমরা এখন সবাই বিজিগীষু, জিঙ্গো আসল ইষ্ট সবার, তার আবরণ-দেবতা মাত্র যীশু! ডায়ার-ডৌল জবরদস্তি, -তাতেই দেখি আজ তোমাদের রুচি। গোবর-দস্ত আইন গড়ে নিষ্ঠুরতায় নিচ্ছ করে শুচি। বীরত্বেরই বিজয়-মালা বর্বরতার দিচ্ছ গলায় তুলে। অমানুষের করছ পূজা, সেরা-মানুষ কৃষ্টদেবে ভুল। মরদ-মেয়ে ভুগছ সমান হূণ-বিজয়ের বড়াই-লালচ-রোগে, মানুষকে আর মানুষ বলেই চিনতে যেন চাইছ না, হায়, চোখে। ঢাকের পিছে ট্যামট্যামি-প্রায় টমির ধাঁচায় ট্যাঁশটোশও আজ ঘোরে। শয়তানই যে হাওয়ায় হাঁটায় শূন্যে ওঠায় সে হুঁশ গেছে সরে। নেইক খেয়াল, আত্মা বেচে জগত-জোড়া কিনছে জমিদারী। কে জানে ক'দিনের ঠিকা, ঠিকাদারের ঠ্যাকার কিন্তু ভারি! ধিঙ্গি চলে জঙ্গী চালে, কুচ, করে লাল কাগজ-ওলা চলে, নাক তুলে যায় দালাল-ফোড়ে, আজ দেখি হায় পাদরীও সেই দলে! যাও দলে যাও, ডঙ্কা বাজাও, অহঙ্কারের ছায়া ক্ষণস্থায়ী। মিছাই ব্রতের বিঘ্ন ঘটাও অহঙ্কারের হুমকি-ব্যবসায়ী! আমরা তোমার চাই না শিক্ষা, চাই না বিদ্যা, হে বিদ্যা-বিক্রয়ী! ধর্ম-কথাও পণ্য যাদের তাদের পণ্য কিনতে ব্যাগ্র নাহি। মানুষ খুঁজে ফিরছি মোরা, -মানুষ হবার রাস্তা যে বাতলাবে, তিক্ত হয়ে গেছে জীবন ঘরের পরের অমানুষের তাঁবে। ফলিয়ে দেবে মর্ত্যে যে জন বুদ্ধ-যীশুর স্বর্গ-সূচন বাণী, শহীদ-কুলের হৃদ্য-শৌর্য হৃদয়ে যার পেতেছে রাজধানী, জাতিভেদের টিটকারী যে পরকে শুধুই দেয় না নানান ছলে, জমিয়ে বুকে জিঙ্গোয়ানীর জবর জাতিভেদের হলাহলে, ষোল-আনা মানুষ হবার নিমন্ত্রণ দেবে যে সব জনে, সেই মানুষে খুঁজছি মোরা, অহনিশি খুঁজছি ব্যাকুল মনে, নিক্তি ধরে করলে তৌল ওহন সে যার ভজবে পুরাপুরি, লোভের মোহের মন্ত্রণাতে ভাবের ঘরে করবে না যে চুরি, পথ চেয়ে তার সই অনাচার দুঃখ অপার অন্তত লাঞ্চনা, বেশ জানি, আজ সয় যারা ক্লেশ তাদের তরেই স্বর্গীয় সান্তনা, নিরীহ যেই ধন্য যে সেই ধৃত-ব্রত দৈব-মাশাল-ধারী, নিঃস্ব যারা তারাই হবে বিপুল ভবে রাজ্যে-অধিকারী। কোন্ দেশে কোন্ দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল? কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই দলতে হয় রে দুর্বা কোমল? কোথায় ফলে সোনার ফসল, সোনার কমল ফোটেরে? সে আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রেকোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা ফিঙে নাচে গাছে গাছে? কোথায় জলে মরাল চলে, মরালী তার পাছে পাছে? বাবুই কোথা বাসা বোনে, চাতক বারি যাচে রে? সে আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে! খাঁটি সোনা মধুর চেয়ে আছে মধুর সে এই আমার দেশের মাটি আমার দেশের পথের ধূলা খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।চন্দনেরি গন্ধভরা, শীতল করা, ক্লান্তি-হরা যেখানে তার অঙ্গ রাখি সেখানটিতেই শীতল পাটি।শিয়রে তার সূর্য এসে সোনার কাঠি ছোঁয়ায় হেসে, নিদ-মহলে জ্যোৎস্না নিতি বুলায় পায়ে রূপার কাঠি।নাগের বাঘের পাহারাতে হচ্ছে বদল দিনে রাতে, পাহাড় তারে আড়াল করে সাগর সে তার ধোয়ায় পা'টি।নারিকেলের গোপন কোষে অন্ন-পানী’ যোগায় গো সে, কোল ভরা তার কনক ধানে আটটি শীষে বাঁধা আঁটি।মধুর চেয়ে আছে মধুর সে এই আমার দেশের মাটি। ঘুমের রানী দেখা হলো ঘুম নগরীর রাজকুমারীর সংগে সন্ধ্যা বেলায় ঝাপসা ঝোপের ধারে পরনে তার হাওয়ার কাপড় ওড়না ওড়ে অঙ্গে দেখলে সে রূপ ভুলতে কি কেউ পারে?চোখ দুটো তার ঢুলু ঢুলু মুখখানি তার পিঠে আফিম ফুলের রক্তিম হার চুলে নিশ্বাসে তার হাসনু হেনা হাস্যে মধুর ছিটে আলগোছে সে আলগা পায়েই বুল।এক যে আছে কুঞ্ঝটিকার দেয়াল ঘেরা কেল্লা মৌনমুখী সেথায় নাকি থাকে মন্ত্র পড়ে বাড়ায় কমায় জোনাক পোকার জেল্লা মন্ত্র পড়ে চাঁদকে সে রোজ ডাকে।তোঁত পোকাতে তাঁত বোনে তার জানলাতে দেয় পর্দা হুতোম প্যাঁচা প্রহন হাঁকে দ্বারে ঝর্ণাগুলি পূর্ণ চাঁদের আলোয় হয়ে জর্দা জলতরঙ্গ বাজনা শোনায় তারে।কালো কাঁচের আর্শিতে সে মুখ দেখে সুস্পষ্ট আলো দেখে কালো নদীর জলে রাজ্যেতে তার নেইকো মোটেই স্থায়ী রকম কষ্ট স্বপন সেথায় বাড়ায় দলে দলে।সন্ধ্যা বেলা অন্ধকারে হঠাৎ হলো দেখা ঘুম নগরীর রাজকুমারীর সনে মধুর হেসে সুন্দরী সে বেড়ায় একা একা মুর্ছা হেনে বেড়ায় গো নির্জনে। চম্পা আমারে ফুটিতে হ’লো বসন্তের অন্তিম নিশ্বাসে, বিষণ্ণ যখন বিশ্ব নির্মম গ্রীষ্মের পদানত; রুদ্র তপস্যার বনে আধ ত্রাসে আধেক উল্লাসে, একাকী আসিতে হ’লো — সাহসিকা অপ্সরার মতো। বনানী শোষণ-ক্লিষ্ট মর্মরি’ উঠিল এক বার, বারেক বিমর্ষ কুঞ্জে শোনা গেল ক্লান্ত কুহু স্বর; জন্ম-যবনিকা-প্রান্তে মেলি’ নব নেত্র সুকুমার দেখিলাম জলস্থল, — শুন্য, শুষ্ক, বিহ্বল, জর্জর।তবু এনু বাহিরিয়া, — বিশ্বাসের বৃন্তে বেপমান, – চম্পা আমি, — খর তাপে আমি কভু ঝরিবো না মরি, উগ্র মদ্য-সম রৌদ্র — যার তেজে বিশ্ব মুহ্যমান, – বিধাতার আশির্বাদে আমি তা সহজে পান করি।ধীরে এনু বাহিরিয়া, ঊষার আতপ্ত কর ধরি'; মূর্ছে দেহ, মোহে মন, — মুহুর্মুহু করি অনুভব! সূর্যের বিভূতি তবু লাবণ্যে দিতেছ তনু ভরি'; দিনদেবে নমস্কার! আমি চম্পা! সূর্যের সৌরভ। চরকার গান ভোমরায় গান গায় চরকায়, শোন ভাই! খেই নাও, পাঁজা দাও, আমরাও গান গাই। ঘর-বার করবার দরকার নেই আর, মন দাও চরকায় আপনার আপনার! চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘর-ঘর। ঘর-ঘর ক্ষীর-সর, -আপনায় নির্ভর! পড়শীর কন্ঠে জাগল সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া। ঝর কায় ঝুর ঝুর ফুর ফুর বইছে! চরকার বুলবুল কোন বোল কইছে? কোন ধন দরকার চরকার আজ গো? ঝিউড়ির খেই আর বউড়ির পাঁজ গো! চরকার ঘর্ঘর পল্লীর ঘর-ঘর। ঘর-ঘর ঘির দীপ, -আপনায় নির্ভর! পল্লীর উল্লাস জাগল সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! আর নয় আইটাই ঢিস-ঢিস দিন-ভর, শোন বিশকর্মার বিস্ময়-মন্তর! চরকার চর্যায় সন্তোষ মনটায়, রোজগার রোজদিন ঘন্টায় ঘন্টায়! চরকার ঘর্ঘর বস্তির ঘর-ঘর। ঘর-ঘর মঙ্গল, -আপনায় নির্ভর! বন্দর-পত্তন হঞ্জে সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চরকায় সম্পদ, চরকায় অন্ন, বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ! বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন কাঞ্চন-তৌলেই কিনতেন একদিন। চরকার ঘর্ঘর শ্রেষ্ঠীর ঘর-ঘর। ঘর-ঘর সম্পদ, -আপনায় নির্ভর! সুপ্তের রাজ্যে দৈবের সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চরকাই লজ্জার সজ্জার বস্ত্র। চরকাই দৈনের সংসার-অস্ত্র। চরকাই সন্তান চরকাই সম্মান। চরকায় দুঃখীর দুঃখের শেষ ত্রাণ। চরকার ঘর্ঘর বঙ্গের ঘর-ঘর। ঘর-ঘর সমভ্রম, -আপনায় নির্ভর! প্রত্যাশ ছাড়বার জাগল সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! ফুরসুৎ সার্থক করবার ভেলকি! উসখুস হাত! বিশকর্মার খেল কি! তন্দ্রার হুদ্দোয় একলার দোকলা! চরকাই একজাই পায়সার টোকলা। চরকার ঘর্ঘর হিন্দের ঘর-ঘর। ঘর-ঘর হিকমৎ, -আপনায় নির্ভর! লাখ লাখ চিত্তে জাগল সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! নিঃস্বের মূলধন রিক্তের সঞ্চয়, বঙ্গের স্বস্তিক চরকার গাও জয়! চরকায় দৌলত! চরকায় ইজ্জৎ! চরকায় উজ্জ্বল লক্ষীর ইজ্জৎ! চরকার ঘর্ঘর গৌড়ের ঘর-ঘর। ঘর-ঘর গৌরব, -আপনায় নির্ভর! গঙ্গায় মেঘনায় তিস্তায় সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চন্দ্রের চরকায় জ্যোৎস্নার সৃষ্টি! সূর্যের কাটনায় কাঞ্চন বৃষ্টি! ইন্দ্রের চরকায় মেঘ জল থান থান। হিন্দের চরকায় ইজ্জৎ সম্মান! চরকার দৌলত! ইজ্জৎ ঘর-ঘর। ঘর-ঘর হিম্মৎ, -আপনায় নির্ভর! গুজরাট-পাঞ্জাব-বাংলায় সাড়া, দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া ছিন্নমুকুল সবচেয়ে যে ছোটো পিঁড়িখানি সেইখানি আর কেউ রাখেনা পেতে, ছোট থালায় হয় নাকো ভাত বাড়া, জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে; বাড়ির মধ্যে সব-চেয়ে যে ছোটো খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে, সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিল, তারই খাওয়া ঘুচেছে সব-আগে ।সব-চেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি খুশি ছিল ঘেঁষাঘেঁষির ঘরে, সেই গেছে, হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে, দিয়ে গেছে, জায়গা খালি করে । ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা, ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি; ভয়-তরাসে ছিল যে সব-চেয়ে সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি ।...চ'লে গেছে একলা চুপে চুপে-- দিনের আলো গেছে আঁধার ক'রে; যাবার বেলা টের পেলো না কেহ, পারলে না কেউ রাখতে তারে ধ'রে। চলে গেলো, --পড়তে চোখের পাতা,-- বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝি ! হারিয়ে গেলো--অজানাদের ভিড়ে, হারিয়ে গেলো-পেলাম না আর খুঁজি।হারিয়ে গেছে--হারিয়ে গেছে, ওরে ! হারিয়ে গেছে বোল-বলা সেই বাঁশি হারিয়ে গেছে কচি সে মুখখানি, দুধে-ধোওয়া কচি দাঁতের হাসি। আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে ভেসে গেছে শিউলি ফুলের রাশি , ঢুকেছে হায় শশ্মানঘরের মাঝে ঘর ছেড়ে তাই হৃদয় শশ্মান-বাসী ।সবচেয়ে যে ছোটো কাপড়গুলি সেগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে, যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোটো আজকে সেটি শূন্যে পড়ে কাঁদে, সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো সে গিয়েছে সবার আগে সরে ছোট্ট যে জন ছিল রে সব চেয়ে সে দিয়েছে সকল শূন্য করে । জবা আমারে লইয়া সুখী হও তুমি ওগো দেবী শবাসনা, আর খুঁজিও না মানব-শোনিত, আর তুমি খুঁজিও না। আর মানুষের হৃত্ পিণ্ডটা নিওনা খড়গে ছিঁড়ে, হাহকার তুমি তুলো না গো আর সুখের নিভৃত নীড়ে। এই দেখ আমি উঠেছি ফুটিয়া উজলি পুষ্পসভা, ব্যথিত ধরার হৃত্ পিণ্ডটি আমি যে রক্তজবা। তোমার চরণে নিবেদিত আমি, আমি যে তোমার বলি, দৃষ্টি-ভোগের রাঙ্গা খর্পরে রক্ত কলিজা-কলি। আমারে লইয়া খুশি হও ওগো, নম দেবি নম নম, ধরার অর্ঘ্য করিয়া গ্রহণ, ধরার শিশুরে ক্ষম। ঝর্ণা ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা! তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!      অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,      গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে, তনু ভরি' যৌবন, তাপসী অপর্ণা!             ঝর্ণা! পাষাণের স্নেহধারা! তুষারের বিন্দু! ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু|      মেঘ হানে জুঁইফুলী বৃষ্টি ও-অঙ্গে,      চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে, ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা!              ঝর্ণা! এস তৃষার দেশে এস কলহাস্যে - গিরি-দরী-বিহীরিনী হরিনীর লাস্যে,      ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,      শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত; ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা;              ঝর্ণা! শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী! পাহাড়ে বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী!      পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো,      হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো, স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা!              ঝর্ণা! মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে!      মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে;      মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুত্পর্ণা              ঝর্ণা! ঝর্নার গান চপল পায় কেবল ধাই, কেবল গাই পরীর গান, পুলক মোর সকল গায়, বিভোল মোর সকল প্রাণ। শিথিল সব শিলার পর চরণ থুই দোদুল মন, দুপুর-ভোর ঝিঁঝির ডাক, ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন। বিজন দেশ, কুজন নাই নিজের পায় বাজাই তাল, একলা গাই, একলা ধাই , দিবস রাত, সাঁঝ সকাল। ঝুঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড় ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়; শঙ্কা নাই, সমান যাই, টগর-ফুল-নূপুর পায়, কোন্ গিরির হিম ললাট ঘামল মোর উদ্ভবে, কোন্ পরীর টুটুল হার কোন্ নাচের উৎসবে। খেয়াল নাই-নাই রে ভাই পাই নি তার সংবাদই, ধাই লীলায়,-খিলখিলাই বুলবুলির বোল সাধি। বন-ঝাউয়ের ঝোপগুলায় কালসারের দল চরে, শিং শিলায়-শিলার গায়, ডালচিনির রং ধরে। ঝাঁপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই, দুলিয়ে যাই অচল-ঠাঁট, নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই- টিলার গায় ডালিত-ফাট। শালিক শুক বুলায় মুখ থল-ঝাঁঝির মখ্মলে, জরির জাল আংরাখায় অঙ্গ মোর ঝলমলে। নিম্নে ধাই, শুনতে পাই ‘ফটিক জল।’হাঁকছে কে, কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার নিক না সেই পাঁক ছেঁকে। গরজ যার জল স্যাঁচার পাতকুয়ায় যাক না সেই, সুন্দরের তৃষ্ণা যার আমরা ধাই তার আশেই। তার খোঁজেই বিরাম নেই বিলাই তান-তরল শ্লোক, চকোর চায় চন্দ্রমায়, আমরা চাই মুগ্ধ-চোখ। চপল পায় কেবল ধাই উপল-ঘায় দিই ঝিলিক, দুল দোলাই মন ভোলাই, ঝিলমিলাই দিগ্মিদিক। দূরের পাল্লা ছিপখান তিন-দাঁড় - তিনজন মাল্লা চৌপর দিন-ভোর দ্যায় দূর-পাল্লা!          পাড়ময় ঝোপঝাড়          জঙ্গল-জঞ্জাল,          জলময় শৈবাল          পান্নার টাঁকশাল | কঞ্চির তীর-ঘর ঐ-চর জাগছে, বন-হাঁস ডিম তার শ্যাওলায় ঢাকছে|          চুপ চুপ - ওই ডুব          দ্যায় পান্ কৌটি          দ্যায় ডুব টুপ টুপ          ঘোমটার বৌটি! ঝকঝক কলসীর বক্ বক্ শোন্ গো ঘোমটার ফাঁক বয় মন উন্মন গো|          তিন-দাঁড় ছিপখান          মন্থর যাচ্ছে,          তিনজন মাল্লায়          কোন গান গাচ্ছে? রূপশালি ধান বুঝি এইদেশে সৃষ্টি, ধুপছায়া যার শাড়ী তার হাসি মিষ্টি|          মুখখানি মিষ্টিরে          চোখদুটি ভোমরা          ভাব-কদমের - ভরা          রূপ দেখ তোমরা ! ময়নামতীর জুটি ওর নামই টগরী, ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে জল হোলো গোখরী!          ডাক পাখী ওর লাগি'          ডাক ডেকে হদ্দ,          ওর তরে সোঁত-জলে          ফুল ফোটে পদ্ম| ওর তরে মন্থরে নদ হেথা চলছে, জলপিপি ওর মৃদু বোল বুঝি বোলছে|          দুইতীরে গ্রামগুলি          ওর জয়ই গাইছে,          গঞ্জে যে নৌকা সে          ওর মুখই চাইছে| আটকেছে যেই ডিঙা চাইছে সে পর্শ, সঙ্কটে শক্তি ও সংসারে হর্ষ|          পান বিনে ঠোঁট রাঙা          চোখ কালো ভোমরা,          রূপশালী-ধান-ভানা          রূপ দেখ তোমরা*        *        *        *    পান সুপারি! পান সুপারি! এইখানেতে শঙ্কা ভারি, পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে চলরে টেনে বৈঠা হেনে; বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে বুক দে টানো, বইটা হানো - সাত সতেরো কোপ কোপানো| হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো ডাইনী যেন ঝামর-চুলো নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে লোক দেখে কি থমকে গেল| জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে রাত্রি এল রাত্রি এল| ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে ফিরছে কারা মাছের পাছে, পীর বদরের কুদরতিতে নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে|*        *        *        *      আর জোর দেড় ক্রোশ - জোর দের ঘন্টা, টান ভাই টান সব - নেই উত্কণ্ঠা|          চাপ চাপ শ্যাওলার          দ্বীপ সব সার সার,          বৈঠৈর ঘায়ে সেই          দ্বীপ সব নড়ছে,          ভিল্ ভিলে হাঁস তায়          জল-গায় চড়ছে| ওই মেঘ জমছে, চল্ ভাই সমঝে, গান গাও দাও শিশ, বকশিশ! বকশিশ!          খুব জোর ডুব-জল          বয় স্রোত ঝিরঝির,          নেই ঢেউ কল্লোল,          নয় দুর নয় তীর| নেই নেই শঙ্কা, চল্ সব ফুর্তি, বকশিশ টঙ্কা, বকশিশ ফুর্তি|          ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,          ঝাউ-গাছ দুলছে,          ঢোল-কলমীর ফুল          তন্দ্রায় ঢুলছে| লকলক শর-বন বক তায় মগ্ন, চুপচাপ চারদিক - সন্ধ্যার লগ্ন|          চারদিক নিঃসাড়,          ঘোর-ঘোর রাত্রি,          ছিপ-খান তিন-দাঁড়,          চারজন যাত্রি|*        *        *        *    জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে - স্বপন পানে পরাণ টানে|         তারায় ভরা আকাশ ওকি         ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে         লুটিয়ে পল আচম্বিতে         কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে! *        *        *        *    কেবল তারা! কেবল তারা! শেষের শিরে মানিক পারা, হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি কেবল তারা যেথায় চাহি|         কোথায় এল নৌকাখানা         তারার ঝড়ে হই রে কাণা,         পথ ভুলে কি এই তিমিরে         নৌকা চলে আকাশ চিরে! জ্বলছে তারা! নিভছে তারা! মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়, যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায় জোনাক যেন পন্থা-হারা|         তারায় আজি ঝামর হাওয়া-         ঝামর আজি আঁধার রাতি,         অগুনতি অফুরান তারা         জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি| কালো নদীর দুই কিনারে কল্পতরু কুঞ্জ কি রে? ফুল ফুটেছে ভারে ভারে - ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে|         বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে         পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;         বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে         ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা| চোখে কেমন লগছে ধাঁধা - লাগছে যেন কেমন পারা, তারাগুলোই জোনাক হল কিম্বা জোনাক হল তারা|         নিথর জলে নিজের ছায়া         দেখছে আকাশ ভরা তারায়,         ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে         জলে জোনাক দিশে হারায়| দিশে হারায় যায় ভেসে যায় স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে? মরা গাঙ আর সুর-সরিত্ এক হয়ে যেথায় মেশে রে!         কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর         জোনাক কোথা হয় সুরু যে         নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা         চোখ যে আলা রতন উঁছে| আলেয়াগুলো দপদপিয়ে জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে', উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!         আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা         আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা         একলা ছোটে বন বাদাড়ে         ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে; সাপ মানে না, ভাঘ জানে না, ভূতগুলো তার সবাই চেনা, ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে রণরণিয়ে হনহনিয়ে|         বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,         কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,         জাগছে হাওয়া জলের ধারে,         চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে! শুকতারাটি আজ নিশীথে দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে, রাস্তা এঁকে সেই আলোতে ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে|         ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,         মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;         রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে         ধরছে কারা মাছগুলোকে! চলছে তরী চলছে তরী - আর কত পথ? আর ক'ঘড়ি? এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী, ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি -         ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্         দেখছ আলো? ঐতো কুঠি         ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই         রাতের মতন আজকে ছুটি| ঝপ ঝপ তিনখান দাঁড় জোর চলছে, তিনজন মাল্লার হাত সব জ্বলছে;         গুরগুর মেঘ সব         গায় মেঘ মল্লার,         দূর-পাল্লার শেষ         হাল্লাক্ মাল্লার! পদ্মার প্রতি হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী! হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোল তারি মত চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত| দুর্নমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন গম্ভীর; সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর |রুদ্র সমুদ্রের মত, সমুদ্রেরি মত সমুদার তোমার বদরহস্ত বিতরিছে ঐশ্বর্যসম্ভার| উর্বর করিছ মহি, বহিতেছ বাণিজ্যের তরী গ্রাসিয়া নগর গ্রাম হাসিতেছ দশদিক ভরি|অন্তহীন মূর্ছনায় আন্দোলিত আকাশ সংগীতে, - ঝঙ্কারিয়া রুদ্রবীণা, মিলাইছ ভৈরবে ললিতে প্রসন্ন কখনো তুমি, কভু তুমি একান্ত নিষ্ঠুর; দুর্বোধ, দুর্গম হায়, চিরদিন দুর্জ্ঞেয় সুদূর!শিশুকাল হতে তুমি উচ্ছৃঙ্খল, দুরন্ত দুর্বার; সগর রাজার ভস্ম করিয়ে স্পর্শ একবার! স্বর্গ হতে অবতরি ধেয়ে চলে এলে এলোকেশে, কিরাত-পুলিন্দ-পুণ্ড্র অনাচারী অন্ত্যজের দেশে!বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন মনোরথ বৃথা বাজাইল শঙ্খ, নিলে বেছে তুমি নিজ পথ; আর্যের নৈবেদ্য, বলি, তুচ্ছ করি হে বিদ্রোহী নদী! অনাহুত-অনার্যের ঘরে গিয়ে আছ সে অবধি|সেই হকে আছ তুমি সমস্যার মত লোক-মাঝে, ব্যাপৃত সহস্র ভুজ বিপর্যয় প্রলয়ের কাজে! দম্ভ যবে মূর্তি ধরি স্তম্ভ ও গম্ বুজে দিনরাত অভ্রভেদী হয়ে ওঠে, তুমি না দেখাও পক্ষপাত|তার প্রতি কোনদিন, সিন্ধুসঙ্গী, হে সাম্যবাদিনী! মূর্খে বলে কীতিনাশা, হে কোপনা কল্লোলনাদিনী! ধনী দীনে একাসনে বসায়ে রেখেছ তব তীরে, সতত সতর্ক তারা অনিশ্চিত পাতার কুটিরে;না জানে সুপ্তির স্বাদ, জড়তার বারতা না জানে, ভাঙ্গনের মুখে বসি গাহে গান প্লাবনের তানে, নাহিক বস্তুর মায়া, মরিতে প্রস্তুত চির দিনই! অয়ি স্বাতন্ত্রের ধারা! অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবনী! পাল্কীর গান পাল্কী চলে! পাল্কী চলে! গগন-তলে আগুন জ্বলে!স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা রৌদ্রে সারাময়রামুদি চক্ষু মুদি’ পাটায় ব’সে ঢুলছে ক’ষে।দুধের চাঁছি শুষছে মাছি, উড়ছে কতক ভনভনিয়ে। আসছে কা’রা হন্ হনিয়ে? হাটের শেষে রুক্ষ বেশে ঠিক দু’পুরে ধায় হাটুরে!কুকুর গুলো শুঁকছে ধূলো, ধুঁকছে কেহ ক্লান্ত দেহ।গঙ্গা ফড়িং লাফিয়ে চলে; বাঁধের দিকে সূর্য্য ঢলে।পাল্কী চলে রে, অঙ্গ টলেরে! আর দেরি কত? আর কত দূর? প্রথম গালি বয়েস- আড়াই কি দুই মনটি নির্মল জুই, হালকা যেন হাওয়া মেয়ে সে মুখ-চাওয়া মায়ের কাছে কাছে ছায়ার মত আছে জানে না মা বিনা কিছুই৷ আর সে দিদি চেনে তার দিদি সে সাথী খেলিবার, দুটিতে পিঠোপিঠি তবুও খিটিমিটি হয় না বেশী বেশী নাইক রেষারেষি ১৪০০ সাল আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি     কৌতূহলভরে--  আজি হতে শতবর্ষ পরে। আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের     লেশমাত্র ভাগ-- আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,  আজিকার কোনো রক্তরাগ অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে     তোমাদের করে  আজি হতে শতবর্ষ পরে।তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার     বসি বাতায়নে সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি     ভেবে দেখো মনে--  একদিন শতবর্ষ আগে চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি  নিখিলের মর্মে আসি লাগে-- নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন     উন্মত্ত অধীর-- উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা     দক্ষিণসমীর-- সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা     যৌবনের রাগে  তোমাদের শতবর্ষ আগে। সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,     কবি এক জাগে-- কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়     কত অনুরাগে  একদিন শতবর্ষ আগে।  আজি হতে শতবর্ষ পরে এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি     তোমাদের ঘরে? আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন  পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে। আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে  ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব     পল্লবমর্মরে  আজি হতে শতবর্ষ পরে। অকর্মার বিভ্রাট লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা, তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা? যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি। ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ'সে, দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব'সে। ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই। চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা, এরে আজ চলা করে ধরাইব আখা। হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে-- খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে। অকৃতজ্ঞ ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অক্ষমতা এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা — সলিল রয়েছে প'ড়ে, শুধু দেহ নাই। এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই - চাই। দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা! মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল — বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা! চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে, মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে। কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়! কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়! অক্ষমা যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার, দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর। জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির। অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে, হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী। সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে, পারিস নে কত বার — 'কই অন্ন কই ' কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ। জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ— যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় , সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক , সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়— তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক! অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায় চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, তখন কোন্‌ কথা জানাতে তার এত অধৈর্য। --যে কথা দেহের অতীত। খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী সে তো কেবল খাঁচারি নয়, তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর, আছে করুণ বিস্মৃতি। সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি-- এ তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।-- বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে দেশ-পারানো কোন্‌ দেশের দিকে, দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন কোন্‌ কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে। দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ, রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে। শুধু কেবল পথ চলাতেই কি এ পথের লক্ষ্য? ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান, তার সত্য মিলবে কোন্‌খানে? মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ। তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ, মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা। অন্ধকারে সে দেখছে অভাবিতের স্বপ্ন। স্বপ্নেই কি তার শেষ? উষার আলোয় তার ফুলের প্রকাশ; আজ নেই, তাই বলে কি নেই কোনোদিনই? অচল স্মৃতি আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে         জাগিয়া রয়েছে নিতি অচল ধবল শৈল-সমান         একটি অচল স্মৃতি ।         প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি         সে নীরব হিমগিরি আমার দিবস আমার রজনী         আসিছে যেতেছে ফিরি ।    যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর         মর্ম গভীরতম — উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া         সকল উচ্চে মম । মোর কল্পনা শত         রঙিন মেঘের মতো তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে ,         সোহাগে হতেছে নত ।    আমার শ্যামল তরুলতাগুলি         ফুলপল্লবভারে সরস কোমল বাহুবেষ্টনে         বাঁধিতে চাহিছে তারে । শিখর গগনলীন         দুর্গম জনহীন , বাসনাবিহগ একেলা সেথায়         ধাইছে রাত্রিদিন ।    চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া ,         কত গীত , কত কথা — মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন         নিশ্চল নীরবতা । দূরে গেলে তবু , একা         সে শিখর যায় দেখা — চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার         নিত্যনীহাররেখা । অচলা বুড়ি অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা। ফুলো ফুলো দুই চোখে তার, দুই গালে আর ঠোঁটে উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে। পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা, কপালে দুই ভুরুর মাঝে উল্‌কি-আঁকা ফোঁটা। গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে, সেবা ক'রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনোমতে। খোঁড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর; আধপাগলি ঝি ছিল এক, বাড়ি বালেশ্বর। দাদাঠাকুর বলত, 'বুড়ি, জমল কত টাকা, সঙ্গে ওটা যাবে না তো, বাক্সে রইল ঢাকা, ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না-ধার, জানোই তো এই অসময়ে টাকার কী দরকার।' বুড়ি হেসে বলে, 'ঠাকুর, দরকার তো আছেই, সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।'সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে, এককালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে। বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই-- দিন চালাবে এমনতরো উপায় কিছু নাই। শেষকালে সে ক্ষুধার দায়ে, দৈন্যদশার লাজে চলে গেল হাঁসপাতালে রোগীসেবার কাজে। এর পিছনে বুড়ি ছিল, আর ছিল লোক তার কংসারি শীল বেনের ছেলে মুকুন্দ মোক্তার। গ্রামের লোকে ছি-ছি করে, জাতে ঠেলল তাকে, একলা কেবল অচল বুড়ি আদর করে ডাকে। সে বলে, 'তুই বেশ করেছিস যা বলুক-না যেবা, ভিক্ষা মাগার চেয়ে ভালো দুঃখী দেহের সেবা।'জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধ, বেগার খাটার ডাক-- রাই ডোম্‌নির ছেলে বললে, কাজের যে নেই ফাঁক, পারবে না আজ যেতে। শুনে কোতলপুরের রাজা বললে, ওকে যে ক'রে হোক দিতেই হবে সাজা। মিশনরির স্কুলে প'ড়ে, কম্পোজিটরের কাজ শিখে সে শহরেতে আয় করেছে ঢের-- তাই হবে কি ছোটোলোকের ঘাড়-বাঁকানো চাল। সাক্ষ্য দিল হরিশ মৈত্র, দিল মাখনলাল-- ডাকলুঠের এক মোকদ্দমায় মিথ্যে জড়িয়ে ফেলে গোষ্ঠকে তো চালান দিল সাত বছরের জেলে। ছেলের নামের অপমানে আপন পাড়া ছাড়ি ডোম্‌নি গেল ভিন গাঁয়েতে পাততে নতুন বাড়ি। প্রতি মাসে অচলবুড়ি দামোদরের পারে মাসকাবারের জিনিস নিয়ে দেখে আসত তারে। যখন তাকে খোঁটা দিল গ্রামের শম্ভু পিসে 'রাই ডোম্‌নির 'পরে তোমার এত দরদ কিসে' বুড়ি বললে, 'যারা ওকে দিল দুঃখরাশি তাদের পাপের বোঝা আমি হালকা করে আসি।'পাতানো এক নাতনি বুড়ির একজ্বরি জ্বরে ভুগতেছিল স্বরূপগঞ্জে আপন শ্বশুরঘরে। মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তুলল দিন রাত্রি জেগে, ফিরে এসে আপনি পড়ল রোগের ধাক্কা লেগে। দিন ফুরলো, দেব্‌তা শেষে ডেকে নিল তাকে, এক আঘাতে মারল যেন সকল পল্লীটাকে। অবাক হল দাদাঠাকুর, অবাক স্বরূপকাকা, ডোম্‌নিকে সব দিয়ে গেছে বুড়ির জমা টাকা। জিনিসপত্র আর যা ছিল দিল পাগল ঝিকে, সঁপে দিল তারই হাতে খোঁড়া কুকুরটিকে। ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, 'অপাত্রে এই দান। পরলোকের হারালো পথ, ইহলোকের মান।' শান্তিনিকেতন, আষাঢ়, ১৩৪৪ অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে– এবার কিছু কি, কবি করেছ সঞ্চয়। ভরেছ কি কল্পনার কনক-অঞ্চলে চঞ্চলপবনক্লিষ্ট শ্যাম কিশলয়, ক্লান্ত করবীর গুচ্ছ। তপ্ত রৌদ্র হতে নিয়েছ কি গলাইয়া যৌবনের সুরা– ঢেলেছ কি উচ্ছলিত তব ছন্দঃস্রোতে, রেখেছ কি করি তারে অনন্তমধুরা। এ বসন্তে প্রিয়া তব পূর্ণিমানিশীথে নবমল্লিকার মালা জড়াইয়া কেশে তোমার আকাঙক্ষাদীপ্ত অতৃপ্ত আঁখিতে যে দৃষ্টি হানিয়াছিল একটি নিমেষে সে কি রাখ নাই গেঁথে অক্ষয় সংগীতে। সে কি গেছে পুষ্পচ্যুত সৌরভের দেশে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) অচেতন মাহাত্ম্য হে জলদ, এত জল ধরে আছ বুকে তবু লঘুবেগে ধাও বাতাসের মুখে। পোষণ করিছ শত ভীষণ বিজুলি তবু স্নিগ্ধ নীল রূপে নেত্র যায় ভুলি। এ অসাধ্য সাধিতেছ অতি অনায়াসে কী করিয়া, সে রহস্য কহি দাও দাসে। গুরুগুরু গরজনে মেঘ কহে বাণী, আশ্চর্য কী আছে ইথে আমি নাহি জানি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অচেনা তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো, লুকানো নহ, তবু লুকানো থাকো।         ছবির মতো ভাবনা পরশিয়া         একটু আছ মনেরে হরষিয়া।অনেক দিন দিয়েছ তুমি দেখা, বসেছ পাশে, তবুও আমি একা। আমার কাছে রহিলে বিদেশিনী,         লইলে শধু নয়ন মম জিনি।বেদনা কিছু আছে বা তব মনে, সে ব্যথা ঢাকে তোমারে আবরণে।         শূন্য-পানে চাহিয়া থাকো তুমি,         নিশ্বসিয়া উঠে কাননভূমি।মৌন তব কী কথা বলে বুঝি, অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি।         চলিয়া যাও তখন মনে বাজে--         চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে। অজয় নদী এককালে এই অজয়নদী ছিল যখন জেগে                    স্রোতের প্রবল বেগে             পাহাড় থেকে আনত সদাই ঢালি        আপন জোরের গর্ব ক'রে চিকন-চিকন বালি।   অচল বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে যখন ক্রমে ক্রমে               জোর গেল তার কমে, নদীর আপন আসন বালি নিল হরণ করে,      নদী গেল পিছনপানে সরে;                  অনুচরের মতো      রইল তখন আপন বালির নিত্য-অনুগত। কেবল যখন বর্ষা নামে ঘোলা জলের পাকে                  বালির প্রতাপ ঢাকে। পূর্বযুগের আক্ষেপে তার ক্ষোভের মাতন আসে, বাঁধনহারা ঈর্ষা ছোটে সবার সর্বনাশে। আকাশেতে গুরুগুরু মেঘের ওঠে ডাক, বুকের মধ্যে ঘুরে ওঠে হাজার ঘূর্ণিপাক। তারপরে আশ্বিনের দিনে শুভ্রতার উৎসবে সুর আপনার পায় না খুঁজে শুভ্র আলোর স্তবে। দূরের তীরে কাশের দোলা, শিউলি ফুটে দূরে, শুষ্ক বুকে শরৎ নামে বালিতে রোদ্‌দুরে। চাঁদের কিরণ পড়ে যেথায় একটু আছে জল যেন বন্ধ্যা কোন্‌ বিধবার লুটানো অঞ্চল। নিঃস্ব দিনের লজ্জা সদাই বহন করতে হয়, আপনাকে হায় হারিয়ে-ফেলা অকীর্তি অজয়। অজ্ঞাত বিশ্ব জন্মেছি তোমার মাঝে ক্ষণিকের তরে অসীম প্রকৃতি! সরল বিশ্বাসভরে তবু তোরে গৃহ ব’লে মাতা ব’লে মানি। আজ সন্ধ্যাবেলা তোর নখদন্ত হানি প্রচন্ড পিশাচরূপে ছুটিয়া গর্জিয়া, আপনার মাতৃবেশ শূন্যে বিসর্জিয়া কুটি কুটি ছিন্ন করি বৈশাখের ঝড়ে ধেয়ে এলি ভয়ংকরী ধূলিপক্ষ-’পরে, তৃণসম করিবারে প্রাণ উৎপাটন। সভয়ে শুধাই আজি, হে মহাভীষণ, অনন্ত আকাশপথ রুধি চারি ধারে কে তুমি সহস্রবাহু ঘিরেছ আমারে? আমার ক্ষণিক প্রাণ কে এনেছে যাচি? কোথা মোরে যেতে হবে, কেন আমি আছি?   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) অঞ্চলের বাতাস পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায় , অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায় , শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ — শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায় । অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস , অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস , সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায় , সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস । কার প্রাণখানি হতে করি হায় – হায় বাতাসে উড়িয়া এল পরশ – আভাস ! ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস , ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা ! দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস , বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) অণুকাব্য (১) স্বপ্ন আমার জোনাকি , দীপ্ত প্রাণের মণিকা , স্তব্ধ আঁধার নিশীথে উড়িছে আলোর কণিকা ॥ (২) আমার লিখন ফুটে পথধারে ক্ষণিক কালের ফুলে , চলিতে চলিতে দেখে যারা তারে চলিতে চলিতে ভুলে ॥ (৩) প্রজাপতি সেতো বরষ না গণে , নিমেষ গণিয়া বাঁচে , সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে ॥ (৪) দুঃখের আগুন কোন্ জ্যোতির্ময় পথরেখা টানে বেদনার পরপার পানে॥ (৫) দেবমন্দির-আঙিনাতলে          শিশুরা করেছে মেলা। দেবতা ভোলেন পূজারি-দলে,          দেখেন শিশুর খেলা॥ (৬) আকাশ ধরারে বাহুতে বেড়িয়া রাখে, তবুও আপনি অসীম সুদূরে থাকে॥ (৮) দূর এসেছিল কাছে– ফুরাইলে দিন, দূরে চলে গিয়ে আরো সে নিকটে আছে। (৯) দাঁড়ায়ে গিরি, শির মেঘে তুলে, দেখে না সরসীর বিনতি। অচল উদাসীর পদমূলে ব্যাকুল রূপসীর মিনতি॥ (১০) মেঘ সে বাষ্পগিরি, গিরি সে বাষ্পমেঘ, কালের স্বপ্নে যুগে যুগে ফিরি ফিরি এ কিসের ভাবাবেগ॥ (১১) দুই তীরে তার বিরহ ঘটায়ে সমুদ্র করে দান অতল প্রেমের অশ্রুজলের গান॥ (১২) পর্বতমালা আকাশের পানে চাহিয়া না কহে কথা, অগমের লাগি ওরা ধরণীর স্তম্ভিত ব্যাকুলতা॥ (১৩) একদিন ফুল দিয়েছিলে , হায় , কাঁটা বিঁধে গেছে তার । তবু , সুন্দর , হাসিয়া তোমায় করিনু নমস্কার ॥ (১৪) হে বন্ধু , জেনো মোর ভালোবাসা , কোনো দায় নাহি তার — আপনি সে পায় আপন পুরস্কার ॥ (১৫) স্বল্প সেও স্বল্প নয়, বড়োকে ফেলে ছেয়ে। দু-চারিজন অনেক বেশি বহুজনের চেয়ে॥ (১৬) মেঘের দল বিলাপ করে আঁধার হল দেখে , ভুলেছে বুঝি নিজেই তারা সূর্য দিল ঢেকে ॥ (১৭) অসীম আকাশ শূন্য প্রসারি রাখে, হোথায় পৃথিবী মনে মনে তার অমরার ছবি আঁকে॥ (১৮) আকর্ষণগুণে প্রেম এক ক’রে তোলে। শক্তি শুধু বেঁধে রাখে শিকলে শিকলে॥ (১৯) মহাতরু বহে বহু বরষের ভার। যেন সে বিরাট এক মুহূর্ত তার॥ (২০) স্তব্ধ অতল শব্দবিহীন মহাসমুদ্রতলে বিশ্ব ফেনার পুঞ্জ সদাই ভাঙিয়া জুড়িয়া চলে॥ (২১) মোর কাগজের খেলার নৌকা         ভেসে চলে যায় সোজা বহিয়া আমার অকাজ দিনের         অলস বেলার বোঝা॥ (২২) শিশির রবিরে শুধু জানে বিন্দুরূপে আপন বুকের মাঝখানে॥ (২৩) আপন অসীম নিষ্ফলতার পাকে মরু চিরদিন বন্দী হইয়া থাকে॥ (২৪) সাগরের কানে জোয়ার-বেলায় ধীরে কয় তটভূমি, “তরঙ্গ তব যা বলিতে চায় তাই লিখে দাও তুমি।’সাগর ব্যাকুল ফেন-অক্ষরে যতবার লেখে লেখা চির-চঞ্চল অতৃপ্তিভরে ততবার মোছে রেখা ॥ (২৫) স্তব্ধ হয়ে কেন্দ্র আছে, না দেখা যায় তারে চক্র যত নৃত্য করি ফিরিছে চারি ধারে ।। (২৬) জীবন-খাতার অনেক পাতাই এমনিতরো শূন্য থাকে; আপন মনের ধেয়ান দিয়ে পূর্ণ করে লও না তাকে। সেথায় তোমার গোপন কবি রচুক আপন স্বর্গছবি, পরশ করুক দৈববাণী সেথায় তোমার কল্পনাকে॥ (২৭) ভেবেছিনু গনি গনি লব সব তারা — গনিতে গনিতে রাত হয়ে যায় সারা , বাছিতে বাছিতে কিছু না পাইনু বেছে । আজ বুঝিলাম , যদি না চাহিয়া চাই তবেই তো একসাথে সব-কিছু পাই — সিন্ধুরে তাকায়ে দেখো , মরিয়ো না সেঁচে ॥ (২৮) আকাশ কভু পাতে না ফাঁদ কাড়িয়ে নিতে চাঁদে, বিনা বাঁধনে তাই তো চাঁদ, নিজেরে নিজে বাঁধে। অত চুপি চুপি কেন কথা কও অত চুপি চুপি কেন কথা কও ওগো মরণ, হে মোর মরণ। অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও, ওগো একি প্রণয়েরি ধরন। যবে সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল পড়ে ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া, যবে ফিরে আসে গোঠে গাভীদল সারা দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া, তুমি পাশে আসি বস অচপল ওগো অতি মৃদুগতি-চরণ। আমি বুঝি না যে কী যে কথা কও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।হায় এমনি করে কি, ওগো চোর, ওগো মরণ, হে মোর মরণ, চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর করি হৃদিতলে অবতরণ। তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল মোর অবশ বক্ষশোণিতে। কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল তব কিঙ্কিণি-রণরণিতে? শেষে পসারিয়া তব হিম-কোল মোরে স্বপনে করিবে হরণ? আমি বুঝি না যে কেন আস-যাও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।কহ মিলনের এ কি রীতি এই ওগো মরণ, হে মোর মরণ। তার সমারোহভার কিছু নেই– নেই কোনো মঙ্গলাচরণ? তব পিঙ্গলছবি মহাজট সে কি চূড়া করি বাঁধা হবে না। তব বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট সে কি আগে-পিছে কেহ ববে না। তব মশাল-আলোকে নদীতট আঁখি মেলিবে না রাঙাবরন? ত্রাসে কেঁপে উঠিবে না ধরাতল ওগো মরণ,হে মোর মরণ?যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন ওগো মরণ, হে মোর মরণ, তাঁর কতমতো ছিল আয়োজন, ছিল কতশত উপকরণ। তাঁর লটপট করে বাঘছাল তাঁর বৃষ রহি রহি গরজে, তাঁর বেষ্টন করি জটাজাল যত ভুজঙ্গদল তরজে। তাঁর ববম্‌ববম্‌ বাজে গাল, দোলে গলায় কপালাভরণ, তাঁর বিষাণে ফুকারি উঠে তান ওগো মরণ, হে মোর মরণ।শুনি শ্মশানবাসীর কলকল ওগো মরণ, হে মোর মরণ, সুখে গৌরীর আঁখি ছলছল, তাঁর কাঁপিছে নিচোলাবরণ। তাঁর বাম আঁখি ফুরে থরথর, তাঁর হিয়া দুরুদুরু দুলিছে, তাঁর পুলকিত তনু জরজর, তাঁর মন আপনারে ভুলিছে। তাঁর মাতা কাঁদে শিরে হানি কর খেপা বরেরে করিতে বরণ, তাঁর পিতা মনে মানে পরমাদ ওগো মরণ, হে মোর মরণ।তুমি চুরি করি কেন এস চোর ওগো মরণ, হে মোর মরণ। শুধু নীরবে কখন নিশি-ভোর, শুধু অশ্রু-নিঝর-ঝরন। তুমি উৎসব করো সারারাত তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে। মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি হাত নব রক্তবসনে সাজায়ে। তুমি কারে করিয়ো না দৃক্‌পাত, আমি নিজে লব তব শরণ যদি গৌরবে মোরে লয়ে যাও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।যদি কাজে থাকি আমি গৃহমাঝ ওগো মরণ, হে মোর মরণ, তুমি ভেঙে দিয়ো মোর সব কাজ, কোরো সব লাজ অপহরণ। যদি স্বপনে মিটায়ে সব সাধ আমি শুয়ে থাকি সুখশয়নে, যদি হৃদয়ে জড়ায়ে অবসাদ থাকি আধজাগরূক নয়নে, তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ করি প্রলয়শ্বাস ভরণ– আমি ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ, ওগো মরণ, হে মোর মরণ।আমি যাব যেথা তব তরী রয় ওগো মরণ, হে মোর মরণ, যেথা অকূল হইতে বায়ু বয় করি আঁধারের অনুসরণ। যদি দেখি ঘনঘোর মেঘোদয় দূর ঈশানের কোণে আকাশে, যদি বিদ্যুৎফণী জ্বালাময় তার উদ্যত ফণা বিকাশে, আমি ফিরিব না করি মিছা ভয়– আমি করিব নীরবে তরণ সেই মহাবরষার রাঙা জল ওগো মরণ, হে মোর মরণ।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা। অরণ্য তাহারি তলে ঊর্ধ্বে বাহু মেলি আপন শ্যামল অর্ঘ্য নিঃশব্দে করিছে নিবেদন। মাঘের তরুণ রৌদ্র ধরণীর ‘পরে বিছাইল দিকে দিকে স্বচ্ছ আলোকের উত্তরীয়। এ কথা রাখিনু লিখে উদাসীন চিত্রকর এই ছবি মুছিবার আগে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) অদৃশ্য কারণ রজনী গোপনে বনে ডালপালা ভ’রে কুঁড়িগুলি ফুটাইয়া নিজে যায় স’রে। ফুল জাগি বলে, মোরা প্রভাতের ফুল— মুখর প্রভাত বলে, নাহি তাহে ভুল।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অদৃষ্টের হাতে লেখা অদৃষ্টের হাতে লেখা সূক্ষ্ম এক রেখা, সেই পথ বয়ে সবে হয় অগ্রসর। কত শত ভাগ্যহীন ঘুরে মরে সারাদিন প্রেম পাইবার আগে মৃত্যু দেয় দেখা, এত দূরে আছে তার প্রাণের দোসর! কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নিরদয়, প্রণয়ী মিলিল যদি–অতি অসময়! “হৃদয়টি?’ “দিয়াছি তা!’ কান্দিয়া সে কহে, “হাতখানি প্রিয়তম?’ “নহে, নহে, নহে!’   Matthew Arnold    (অনুবাদ কবিতা) অধরা অধরা মাধুরী ধরা পড়িয়াছে এ মোর ছন্দবন্ধনে। বলাকাপাঁতির পিছিয়ে-পড়া ও পাখি, বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে। গত ফসলের পলাশের রাঙিমারে ধরে রাখে ওর পাখা, জরা শিরীষের পেলব আভাস ওর কাকলিতে মাখা। শুনে যাও বিদেশিনী, তোমার ভাষায় ওরে ডাকো দেখি নাম ধরে।ও জানে তোমারি দেশের আকাশ তোমারি রাতের তারা, তব যৌবন-উৎসবে ও যে গানে গানে দেয় সাড়া, ওর দুটি পাখা চঞ্চলি উঠে তব হৃৎকম্পনে। ওর বাসাখানি তব কুঞ্জের নিভৃত প্রাঙ্গনে। অধিকার অধিকার বেশি কার বনের উপর সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর। বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল, গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল। পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া, বর্ণে আমি দিগ্‌বিদিক রেখেছি কাড়িয়া। গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব, গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব। কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে, হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে। মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর, প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অনন্ত জীবন অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,       জনমেছি দু দিনের তরে-- যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে       গান গাই আনন্দের ভরে। এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান       রবে না রবে না চিরদিন-- পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,       পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,       জগতের আনন্দ যে তোরা,       জগতের বিষাদ-পাসরা। পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী       তোরা তার একেকটি ঢেউ, কখন উঠিলি আর কখন মিলালি       জানিতেও পারিল না কেউ।      নাই তোর নাই রে ভাবনা,       এ জগতে কিছুই মরে না। নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা       ভেসে আসে, সাগরে মিশায়--       জান না কোথায় তারা যায়! একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর       রচিছে বিশাল মহাদেশ,       না জানি কবে তা হবে শেষ! মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,       জান না তো কোথায় তা যায়!       আকাশের সাগরসীমায়! আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে       গীতরাজ্য হতেছে সৃজন, যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে       সেইখানে করিছে গমন।       আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ,       উঠিবে গানের মহাদেশ।      নাই তোর নাই রে ভাবনা,       এ জগতে কিছুই মরে না। কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল       দুটি ভাই গলাগলি করি দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল       দুটি সখা হাতে হাতে ধরি, দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে       ঘুমায়ে করিছে স্তনপান, ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা       স্নেহমাখা নত দু’নয়ান, দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক       বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি-- কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি       আজ আমি গিয়েছি পাসরি।       তা বলে নাহি কি তাহা মনে?       ছবিগুলি মেশেনি জীবনে? স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি       রচিতেছে জীবন আমার-- কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে       চিনিতে পারি নে তাহা আর। হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক       দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে-- তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি       সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে। হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক       আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি, সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি       প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।       সকলি মিশেছে আসি হেথা,       জীবনে কিছু না যায় ফেলা--       এই-যে যা-কিছু চেয়ে দেখি       এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে       নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি, চারি দিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম       জীবনের স্রোত মিশে আসি। সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,       কোটি কোটি তারা হতে ঝরে, জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ       ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে--       মেশে আসি সেই সিন্ধু-’পরে। পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম       সেই মহাসাগর-উদ্দেশে, আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি       অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে--       সাগরে পড়িব অবশেষে। জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে       রচিত হতেছে পলে পলে       অনন্ত-জীবন মহাদেশ,       কে জানে হবে কি তাহা শেষ!তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো,       ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি-- তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে       তুই আর তোর গানগুলি। মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে,       একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,       তুই আর তোর এই গান। অনন্ত পথে বাতায়নে বসি ওরে হেরি প্রতিদিন ছোটো মেয়ে খেলাহীন, চপলতাহীন, গম্ভীর কর্তব্যরত, তৎপরচরণে আসে যায় নিত্যকাজে; অশ্রুভরা মনে ওর মুখপানে চেয়ে হাসি স্নেহভরে। আজি আমি তরী খুলি যাব দেশান্তরে; বালিকাও যাবে কবে কর্ম-অবসানে আপন স্বদেশে; ও আমারে নাহি জানে, আমিও জানি নে ওরে—দেখিবারে চাহি কোথা ওর হবে শেষ জীবসূত্র বাহি। কোন্‌ অজানিত গ্রামে কোন্‌ দূরদেশে কার ঘরে বধূ হবে, মাতা হবে শেষে, তার পরে সব শেষ—তারো পরে, হায়, এই মেয়েটির পথ চলেছে কোথায়!   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) অনন্ত প্রেম তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার। চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার– কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা, অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা, অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে। আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে– পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে, রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে। নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি, একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি– সকল কালের সকল কবির গীতি। অনন্ত মরণ কোটি কোটি ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে         বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,         হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।         এ ধরণী মরণের পথ,         এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?          সে তো শুধু পলক, নিমেষ। অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,         না জানি কোথায় তার শেষ। যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ মরে গেছি,         মরিতেছি প্রতি পলে পলে, জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি         জানি নে মরণ কারে বলে।একমুঠা মরণেরে জীবন বলে কি তবে,         মরণের সমষ্টি কেবল? একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,        নাম নিয়ে এত কোলাহল। মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,       পলে পলে উঠিব আকাশে       নক্ষত্রের কিরণনিবাসে।মরণ বাড়িবে যত কোথায় কোথায় যাব,        বাড়িবে প্রাণের অধিকার-- বিশাল প্রাণের মাঝে কত গ্রহ কত তারা        হেথা হোথা করিবে বিহার । উঠিবে জীবন মোর কত-না আকাশ ছেয়ে,         ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী-- যুগ-যুগান্তর যাবে, নব নব রাজ্য পাবে         নব নব তারায় প্রবেশি।কবে রে আসিবে সেই দিন        উঠিব সে আকাশের পথে,        আমার মরণ-ডোর দিয়ে        বেঁধে দেব জগতে জগতে।        আমাদের মরণের জালে        জগৎ ফেলিব আবরিয়া,        এ অনন্ত আকাশসাগরে        দশ দিক রহিব ঘেরিয়া।জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক--           আমাদের অনন্ত মরণ,           মরণের হবে না মরণ। এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু            লইলাম তোমার শরণ। এসো তুমি এসো কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি,           পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,           আমাদের করো হে পালন। আনন্দে পুরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে           মরণের অনন্ত উৎসব। কার নিমন্ত্রণে মোরা মহাযজ্ঞে এসেছি রে,           উঠেছে বিপুল কলরব।যে ডাকিছে ভালোবেসে, তারে চিনিস নে শিশু?           তার কাছে কেন তোর ডর? জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,        মরণ তো নহে তোর পর।        আয়, তারে অলিঙ্গন কর্-        আয়, তার হাতখানি ধর্। অনবচ্ছিন্ন আমি আজি মগ্ন হয়েছিনু ব্রহ্মাণ্ড‐মাঝারে, যখন মেলিনু আঁখি হেরিনু আমারে। ধরণীর বস্ত্রাঞ্চল দেখিলাম তুলি, আমার নাড়ীর কম্পে কম্পমান ধূলি। অনন্ত আকাশতলে দেখিলাম নামি, আলোকদোলায় বসি দুলিতেছি আমি। আজি গিয়েছিনু চলি মৃত্যুপরপারে, সেথা বৃদ্ধ পুরাতন হেরিনু আমারে। অবিচ্ছিন্ন আপনারে নিরখি ভুবনে শিহরি উঠিনু কাঁপি আপনার মনে। জলে স্থলে শূন্যে আমি যত দূরে চাই আপনারে হারাবার নাই কোনো ঠাঁই। জলস্থল দূর করি ব্রহ্ম অন্তর্যামী, হেরিলাম তার মাঝে স্পন্দমান আমি।১৩০৬ অনাগতা এসেছিল বহু আগে যারা মোর দ্বারে,                     যারা চলে গেছে একেবারে, ফাগুন-মধ্যাহ্নবেলা শিরীষছায়ায় চুপে চুপে                     তারা ছায়ারূপে      আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্বাদলে।                 ঘন কালো দিঘিজলে      পিছনে-ফিরিয়া-চাওয়া আঁখি জ্বলো জ্বলো                     করে ছলোছলো।              মরণের অমরতালোকে ধূসর আঁচল মেলি ফিরে তারা গেরুয়া আলোকে।যে এখনো আসে নাই মোর পথে,      কখনো যে আসিবে না আমার জগতে,            তার ছবি আঁকিয়াছি মনে--               একেলা সে বাতায়নে            বিদেশিনী জন্মকাল হতে।      সে যেন শেঁউলি ভাসে ক্ষীণ মৃদু স্রোতে,                 কোথায় তাহার দেশ                     নাই সে উদ্দেশ।         চেয়ে আছে দূর-পানে      কার লাগি আপনি সে নাহি জানে।           সেই দূরে ছায়ারূপে রয়েছে সে                 বিশ্বের সকল-শেষে          যে আসিতে পারিত তবুও                     এল না কভুও।          জীবনের মরীচিকাদেশে মরুকন্যাটির আঁখি ফিরে ভেসে ভেসে। অনাবশ্যকের আবশ্যকতা কী জন্যে রয়েছ, সিন্ধু তৃণশস্যহীন— অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচো নিশিদিন। সিন্ধু কহে, অকর্মণ্য না রহিত যদি ধরণীর স্তন হতে কে টানিত নদী?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অনাবৃষ্টি প্রাণের সাধন কবে নিবেদন করেছি চরণতলে, অভিষেক তার হল না তোমার করুণ নয়নজলে। রসের বাদল নামিল না কেন তাপের দিনে। ঝরে গেল ফুল মালা পরাই নি তোমার গলে।মনে হয়েছিল, দেখেছি করুণা আঁখির পাতে- উড়ে গেল কোথা শুকনো যূথীর সাথে। যদি এ মাটিতে চলিতে চলিতে পড়িত তোমার দান এ মাটি লভিত প্রাণ, একদা গোপনে ফিরে পেতে তারে অমৃত ফলে। অনাবৃষ্টি শুনেছিনু পুরাকালে মানবীর প্রেমে দেবতারা স্বর্গ হতে আসিতেন নেমে। সেকাল গিয়েছে। আজি এই বৃষ্টিহীন শুষ্কনদী দগ্ধক্ষেত্র বৈশাখের দিন কাতরে কৃষককন্যা অনুনয়বাণী কহিতেছে বারম্বার—আয় বৃষ্টি হানি। ব্যাকুল প্রত্যাশাভরে গগনের পানে চাহিতেছে থেকে থেকে করুণ নয়ানে। তবু বৃষ্টি নাহি নামে; বাতাস বধির উড়ায়ে সকল মেঘ ছুটেছে অধীর, আকাশের সর্বরস রৌদ্ররসনায় লেহন করিল সূর্য। কলিযুগে, হায়, দেবতারা বৃদ্ধ আজি। নারীর মিনতি এখন কেবল খাটে মানবের প্রতি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) অনিত্যের যত আবর্জনা অনিত্যের যত আবর্জনা পূজার প্রাঙ্গণ হতে প্রতি ক্ষণে করিয়ো মার্জনা। অনুরাগ ও বৈরাগ্য প্রেম কহে, হে বৈরাগ্য, তব ধর্ম মিছে। প্রেম, তুমি মহামোহ—বৈরাগ্য কহিছে— আমি কহি, ছাড়্‌ স্বার্থ, মুক্তিপথ দেখ্‌। প্রেম কহে, তা হলে তো তুমি আমি এক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অনেক তিয়াষে করেছি ভ্ৰমণ অনেক তিয়াষে করেছি ভ্ৰমণ জীবন কেবলি খোঁজা। অনেক বচন করেছি রচন, জমেছে অনেক বোঝা। যা পাই নি তারি লইয়া সাধনা যাব কি সাগরপার। যা গাই নি তারি বহিয়া বেদনা ছিঁড়িবে বীণার তার?   (স্ফুলিঙ্গ) অনেক মালা গেঁথেছি মোর অনেক মালা গেঁথেছি মোর কুঞ্জতলে, সকালবেলার অতিথিরা পরল গলে। সন্ধেবেলা কে এল আজ নিয়ে ডালা। গাঁথব কি হায় ঝরা পাতায় শুকনো মালা।    (স্ফুলিঙ্গ) অনেক হাজার বছরের অনেক হাজার বছরের মরু-যবনিকার আচ্ছাদন যখন উৎক্ষিপ্ত হল, দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের বিরাট কঙ্কাল;-- ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে ছিল তার জীবনক্ষেত্র। তার মুখরিত শতাব্দী আপনার সমস্ত কবিগান বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন। আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে, যে বিপুল সম্ভাব্য সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে-- যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে তাও নিবল। যা বিকাল, আর যা বিকাল না,-- দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে একই মূল্যের ছাপ নিয়ে। কোথাও রইল না তার ক্ষত, কোথাও বাজল না তার ক্ষতি। ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের হয়েছে আবর্তন। নূতন নূতন বিশ্ব অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে আলোকে, ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে; অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ, যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ। মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি। তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে। প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য, তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে। হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা। জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম স্তিমিত নিভৃতে দাও আমাকে আশ্রয়। অনেককালের একটিমাত্র দিন অনেককালের একটিমাত্র দিন কেমন করে বাঁধা পড়েছিল একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে, কোনো ছবিতে। কালের দূত তাকে সরিয়ে রেখেছিল চলাচলের পথের বাইরে। যুগের ভাসান খেলায় অনেক কিছু চলে গেল ঘাট পেরিয়ে, সে কখন ঠেকে গিয়েছিল বাঁকের মুখে কেউ জানতে পারে নি। মাঘের বনে আমের কত বোল ধরল, কত পড়ল ঝরে; ফাল্গুনে ফুটল পলাশ, গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে; চৈত্রের রৌদ্রে আর সর্ষের খেতে কবির লড়াই লাগল যেন মাঠে আর আকাশে। আমার সেই আটকে-পড়া দিনটির গায়ে কোনো ঋতুর কোনো তুলির চিহ্ন লাগেনি। একদা ছিলেম ঐ দিনের মাঝখানেই। দিনটা ছিল গা ছড়িয়ে নানা কিছুর মধ্যে; তারা সমস্তই ঘেঁষে ছিল আশেপাশে সামনে। তাদের দেখে গেছি সবটাই কিন্তু চোখে পড়েনি সমস্তটা। ভালোবেসেছি, ভালো করে জানিনি কতখানি বেসেছি। অনেক গেছে ফেলাছড়া; আনমনার রসের পেয়ালায় বাকি ছিল কত। সেদিনের যে পরিচয় ছিল আমার মনে আজ দেখি তার চেহারা অন্য ছাঁদের। কত এলোমেলো, কত যেমন-তেমন সব গেছে মিলিয়ে। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে তাকে আজ দূরের পটে দেখছি যেন সেদিনকার সে নববধূ। তনু তার দেহলতা, ধূপছায়া রঙের আঁচলটি মাথায় উঠেছে খোঁপাটুকু ছাড়িয়ে। ঠিকমতো সময়টি পাই নি। তাকে সব কথা বলবার, অনেক কথা বলা হয়েছে যখন-তখন, সে-সব বৃথা কথা। হতে হতে বেলা গেছে চলে। আজ দেখা দিয়েছে তার মূর্তি,-- স্তব্ধ সে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া-আলোর বেড়ার মধ্যে, মনে হচ্ছে কী একটা কথা বলবে, বলা হল না,-- ইচ্ছে করছে ফিরে যাই পাশে, ফেরার পথ নেই। অন্তর মম বিকশিত করো অন্তর মম বিকশিত করো      অন্তরতর হে। নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,     সুন্দর কর হে।            জাগ্রত করো, উদ্যত করো,                 নির্ভয় করো হে।       মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।            অন্তর মম বিকশিত করো,                 অন্তরতর হে।যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,   মুক্ত করো হে বন্ধ, সঞ্চার করো সকল মর্মে   শান্ত তোমার ছন্দ।       চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,           নন্দিত করো, নন্দিত করো,               নন্দিত করো হে।           অন্তর মম বিকশিত করো                অন্তরতর হে। অন্তর্যামী এ কী কৌতুক নিত্যনূতন     ওগো কৌতুকময়ী, আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে     বলিতে দিতেছ কই। অন্তরমাঝে বসি অহরহ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ, মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ     মিশায়ে আপন সুরে। কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই, তুমি যা বলাও আমি বলি তাই, সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,     কোথা ভেসে যাই দূরে। বলিতেছিলাম বসি এক ধারে আপনার কথা আপন জনারে, শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে     ঘরের কাহিনী যত-- তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে নবীন প্রতিমা নব কৌশলে     গড়িলে মনের মতো।সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী, কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি-- আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি     রহস্যে নিমগন। এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে, এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে, এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে     অন্তরবিদারণ। নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায় ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়, নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়     নূতন রাগিণীভরে। যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা, যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা, জানি না এনেছি কাহার বারতা     কারে শুনাবার তরে। কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার, কেহ এক বলে কেহ বলে আর, আমারে শুধায় বৃথা বার বার     দেখে তুমি হাস বুঝি। কে গো তুমি, কোথা রয়েছ গোপনে,     আমি মরিতেছি খুঁজি।এ কী কৌতুক নিত্যনূতন     ওগো কৌতুকময়ী। যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে     চলিতে দিতেছ কই। গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে, চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে, গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে     শত বার যাতায়াতে, একদা প্রথম প্রভাতবেলায় সে পথে বাহির হইনু হেলায়-- মনে ছিল, দিন কাজে ও খেলায়     কাটায়ে ফিরিব রাতে। পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক, কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক, ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক     এসেছি নূতন দেশে। কখনো উদার গিরির শিখরে কভু বেদনার তমোগহ্বরে চিনি না যে পথ সে পথের 'পরে     চলেছি পাগল-বেশে। কভু বা পন্থ গহন জটিল, কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল, কভু সংকটছায়াশঙ্কিল,     বঙ্কিম দুরগম-- খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ, ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন, আশেপাশে হতে তাকায় মরণ     সহসা লাগায় ভ্রম। তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়, কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায়, তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়     চিত্ত মাতিয়া উঠে। কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ, কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ, চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ     মৃত্যুর মুখে ছুটে।খেপার মতন কেন এ জীবন, অর্থ কী তার, কোথা এ ভ্রমণ, চুপ করে থাকি শুধায় যখন--     দেখে তুমি হাস বুঝি। কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে     আমি যে তোমারে খুঁজি।রাখো কৌতুক নিত্যনূতন     ওগো কৌতুকময়ী। আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব     বলে দাও মোরে অয়ি। আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার, ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার মূর্ছনাভরে গীতঝংকার     ধ্বনিছ মর্মমাঝে? আমার মাঝারে করিছ রচনা অসীম বিরহ, অপার বাসনা, কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা     মোর বেদনায় বাজে? মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী কহিতেছ কোন্‌ অনাদি কাহিনী, কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী     জাগাও গভীর সুর। হবে যবে তব লীলা-অবসান, ছিঁড়ে যাবে তার, থেমে যাবে গান, আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ     তব রহস্যপুর? জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার করিবারে পূজা কোন্‌ দেবতাররহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার     মহামন্দিরতলে? নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান, যেন সচেতন বহ্নিসমান     নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে। অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে এই দীপখানি নিবে যাবে যবে বুঝিবে কি, কেন এসেছিনু ভবে,     কেন জ্বলিলাম প্রাণে? কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে তোমার বিজন নূতন এ পথে, কেন রাখিলে না সবার জগতে     জনতার মাঝখানে? জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল সেদিন কি হবে সহসা সফল? সেই শিখা হতে রূপ নির্মল     বাহিরি আসিবে বুঝি! সব জটিলতা হইবে সরল     তোমারে পাইব খুঁজি।ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন     ওগো কৌতুকময়ী, জীবনের শেষে কী নূতন বেশে     দেখা দিবে মোরে অয়ি! চিরদিবসের মর্মের ব্যথা, শত জনমের চিরসফলতা, আমার প্রেয়সী, আমার দেবতা,     আমার বিশ্বরূপী,মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া মধুর অধরে করুণ হাসিয়া     দাঁড়াবে কি চুপিচুপি? ললাট আমার চুম্বন করি নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি, নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি,     জানি না চিনিব কি না-- শূন্য গগন নীলনির্মল, নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল, না বহে পবন, নাই কোলাহল,     বাজিছে নীরব বীণা-- অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে, কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে     ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে। গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার, উড়িছে আকুল কুন্তলভার, নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার     পরশরসতরঙ্গে। হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি     বরষি করুণাভরে। নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ, মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ     অশ্রুবাষ্পথরে। নাহিকো অর্থ, নাহিকো তত্ত্ব, নাহিকো মিথ্যা, নাহিকো সত্য,আপনার মাঝে আপনি মত্ত--     দেখিয়া হাসিবে বুঝি। আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে,     ফিরিতে হবে না খুঁজি।যদি কৌতুক রাখ চিরদিন     ওগো কৌতুকময়ী, যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া     হবে অন্তরজয়ী, তবে তাই হোক। দেবী, অহরহ জনমে জনমে রহো তবে রহো, নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ     জীবনে জাগাও প্রিয়ে। নব নব রূপে-- ওগো রূপময়, লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয়, কাঁদাও আমারে, ওগো নির্দয়,     চঞ্চল প্রেম দিয়ে। কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে, কখনো আলোকে কখনো তিমিরে, কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে     পরশ করিয়া যাবে-- বক্ষোবীণায় বেদনার তার এইমতো পুন বাঁধিব আবার, পরশমাত্রে গীতঝংকার     উঠিবে নূতন ভাবে। এমনি টুটিয়া মর্মপাথর ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর, জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর     বহিয়া চলিবে দূরে।বরষ বরষ দিবসরজনী অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি     আমার গানের সুরে। যত শত ভুল করেছি এবার সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার-- ওগো মায়াবিনী, কত ভুলাবার     মন্ত্র তোমার আছে! আবার তোমারে ধরিবার তরে ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে, পথ হতে পথে, ঘর হতে ঘরে     দুরাশার পাছে পাছে। এবারের মতো পুরিয়া পরান তীব্র বেদনা করিয়াছি পান, সে সুরা তরল অগ্নিসমান     তুমি ঢালিতেছ বুঝি! আবার এমনি বেদনার মাঝে     তোমারে ফিরিব খুঁজি।   ভাদ্র, ১৩০১ অন্ধকারের পার হতে আনি অন্ধকারের পার হতে আনি প্রভাতসূর্য মন্দ্রিল বাণী, জাগালো বিচিত্রেরে এক আলোকের আলিঙ্গনের ঘেরে।    (স্ফুলিঙ্গ) অন্নের লাগি মাঠে অন্নের লাগি মাঠে লাঙলে মানুষ মাটিতে আঁচড় কাটে। কলমের মুখে আঁচড় কাটিয়া খাতার পাতার তলে মনের অন্ন ফলে। (স্ফুলিঙ্গ) অন্য মা আমার মা না হয়ে তুমি           আর - কারো মা হলে ভাবছ তোমায় চিনতেম না ,           যেতেম না ঐ কোলে ? মজা আরো হত ভারি , দুই জায়গায় থাকত বাড়ি , আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে ,           তুমি পারের গাঁয়ে । এইখানেতেই দিনের বেলা যা - কিছু সব হত খেলা দিন ফুরোলেই তোমার কাছে           পেরিয়ে যেতেম নায়ে । হঠাৎ এসে পিছন দিকে আমি বলতেম , ' বল্‌ দেখি কে ?' তুমি ভাবতে , চেনার মতো            চিনি নে তো তবু । তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি বলতেম গলা ধরে — ' আমায় তোমার চিনতে হবেই ,           আমি তোমার অবু !'    ঐ পারেতে যখন তুমি           আনতে যেতে জল , এই পারেতে তখন ঘাটে           বল্‌ দেখি কে বল্‌ ? কাগজ - গড়া নৌকোটিকে ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে , যদি গিয়ে পৌঁছোত সে           বুঝতে কি , সে কার ? সাঁতার আমি শিখিনি যে নইলে আমি যেতেম নিজে , আমার পারের থেকে আমি           যেতেম তোমার পার । মায়ের পারে অবুর পারে থাকত তফাত , কেউ তো কারে ধরতে গিয়ে পেত নাকো ,           রইত না একসাথে । দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে দেখা - দেখি দূরে দূরে — সন্ধেবেলায় মিলে যেত           অবুতে আর মাতে ।    কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে           যদি বিপিন মাঝি পার করতে তোমার পারে           নাই হত মা রাজি । ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে বসতে তুমি , পায়ের কাছে           বসত ক্ষান্তবুড়ি , উঠত তারা সাত ভায়েতে , ডাকত শেয়াল ধানের খেতে , উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়           কোথায় যেত উড়ি । তখন কি মা , দেরি দেখে ভয় হত না থেকে থেকে পার হয়ে মা , আসতে হতই           অবু যেথায় আছে । তখন কি আর ছাড়া পেতে ? দিতেম কি আর ফিরে যেতে ? ধরা পড়ত মায়ের ওপার           অবুর পারের কাছে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) অপমান-বর ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে। কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে। কেহ কহে 'মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো', সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ। কেহ বলে 'তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে', কেহ কয় 'ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে'।কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে, 'দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে-- ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব, সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব। একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি। বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি!'ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি-- লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি! চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা, এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা। ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে-- গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, কাঞ্চন দিল হাতে।বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে, সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে। কহিল,'রে শঠ, নিঠুর কপট, কহি নে কাহারো কাছে-- এমনি করে কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে! বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো, অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো!'কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ, 'ভণ্ডতাপস, ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ! তুমি সুখে ব'সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে, অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে!' কহিল কবীর, 'অপরাধী আমি, ঘরে এসো নারী তবে-- আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে?'দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি কবীর কহিল, 'দীনের ভবনে তোমারে পাঠাল হরি।' কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে, 'লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।' কহিল কবীর, 'ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ-- এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ।'ঘুচাইল তার মনের বিকার, করিল চেতনা দান-- সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান। রটি গেল দেশে--কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে। শুনিয়া কবীর কহে নতশির, 'আমি সকলের নীচে। যদি কূল পাই তরণী-গরব রাখিতে না চাহি কিছু-- তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব-নিচু।'রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা। দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা। কহিলেন, 'থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা-মাঝে; আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে!' দূত কহে, 'তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ, যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।'রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি-- কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী। কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি, কেহ রহে নতশিরে, রাজা ভাবে--এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে! ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী, বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গে লইয়া নারী।পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল, কৌতুকভরে হাসে-- শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে। তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে-- কহিল, 'পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে! কেন অধমেরে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান!' কহিল কবীর, 'জননী, তুমি যে আমার প্রভুর দান।'২৮ আশ্বিন, ১৩০৬ অপযশ বাছা রে, তোর চক্ষে কেন জল।      কে তোরে যে কী বলেছে         আমায় খুলে বল্‌।      লিখতে গিয়ে হাতে মুখে         মেখেছ সব কালি, নোংরা ব ' লে তাই দিয়েছে গালি?         ছি ছি, উচিত এ কি।                            পূর্ণশশী মাখে মসী—         নোংরা বলুক দেখি।    বাছা রে, তোর সবাই ধরে দোষ।     আমি দেখি সকল-তাতে         এদের অসন্তোষ।     খেলতে গিয়ে কাপড়খানা         ছিঁড়ে খুঁড়ে এলে তাই কি বলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।         ছি ছি, কেমন ধারা।    ছেঁড়া মেঘে প্রভাত হাসে,         সে কি লক্ষ্মীছাড়া।    কান দিয়ো না তোমায় কে কী বলে।    তোমার নামে অপবাদ যে         ক্রমেই বেড়ে চলে।    মিষ্টি তুমি ভালোবাস         তাই কি ঘরে পরে লোভী বলে তোমার নিন্দে করে!         ছি ছি, হবে কী।    তোমায় যারা ভালোবাসে         তারা তবে কী। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) অপরাজিতা ফুটিল অপরাজিতা ফুটিল, লতিকার গর্ব নাহি ধরে— যেন পেয়েছে লিপিকা আকাশের আপন অক্ষরে।  (স্ফুলিঙ্গ) অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে পাহাড়িয়া যত। একে একে দিল মোরে পুষ্পের মঞ্জরি নমস্কারসহ। ধরণী লভিয়াছিল কোন্‌ ক্ষণে প্রস্তর আসনে বসি বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর, এ পুষ্পের দান, মানুষের জন্মদিনে উৎসর্গ করিবে আশা করি। সেই বর, মানুষেরে সুন্দরের সেই নমস্কার আজি এল মোর হাতে আমার জন্মের এই সার্থক স্মরণ। নক্ষত্রে-খচিত মহাকাশে কোথাও কি জ্যোতিঃসম্পদের মাঝে কখনো দিয়েছে দেখা এ দুর্লভ আশ্চর্য সম্মান। অপরিবর্তনীয় এক যদি আর হয় কী ঘটিবে তবে? এখনো যা হয়ে থাকে, তখনো তা হবে। তখন সকল দুঃখ ঘোচে যদি ভাই, এখন যা সুখ আছে দুঃখ হবে তাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অপরিহরণীয় মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন। ভাগ্য কহে, সব নিব যা তোর আপন। নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার। কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অবরুদ্ধ ছিল বায়ু অবরুদ্ধ ছিল বায়ু; দৈত্য সম পুঞ্জ মেঘভার ছায়ার প্রহরীব্যূহে ঘিরে ছিল সূর্যের দুয়ার; অভিভূত আলোকের মূর্ছাতুর ম্লান অসম্মানে দিগন্ত আছিল বাষ্পাকুল। যেন চেয়ে ভূমিপানে অবসাদে-অবনত ক্ষীণশ্বাস চির প্রাচীনতা স্তব্ধ হয়ে আছে বসে দীর্ঘকাল, ভুলে গেছে কথা, ক্লান্তিভারে আঁখিপাতা বদ্ধপ্রায়।                              শূন্যে হেনকালে জয়শঙ্খ উঠিল বাজিয়া। চন্দন তিলক ভালে শরৎ উঠিল হেসে চমকিত গগন প্রাঙ্গণে; পল্লবে পল্লবে কাঁপি বনলক্ষ্মী কিঙ্কিণী কঙ্কণেবিচ্ছুরিল দিকে দিকে জ্যোতিষ্কণা। আজি হেরি চোখে কোন্‌ অনির্বচনীয় নবীনেরে তরুণ আলোকে। যেন আমি তীর্থযাত্রী অতিদূর ভাবী কাল হতে মন্ত্রবলে এসেছি ভাসিয়া। উজান স্বপ্নের স্রোতে অকস্মাৎ উত্তরিনু বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে যেন এই মুহূর্তেই। চেয়ে চেয়ে বেলা মোর কাটে। আপনারে দেখি আমি আপন বাহিরে, যেন আমি অপর যুগের কোনো অজানিত, সদ্য গেছে নামি’ সত্তা হতে প্রত্যহের আচ্ছাদন; অক্লান্ত বিস্ময় যার পানে চক্ষু মেলি তারে যেন আঁকড়িয়া রয় পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো। এই তো ছুটির কাল, সর্ব দেহ মন হতে ছিন্ন হোলো অভ্যাসের জাল, নগ্ন চিত্ত মগ্ন হোলো সমস্তের মাঝে। মনে ভাবি, পুরানোর দুর্গদ্বারে মৃত্যু যেন খুলে দিল চাবি, নূতন বাহিরি’ এল; তুচ্ছতার জীর্ণ উত্তরীয় ঘুচালো সে; অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে কী অভাবনীয় প্রকাশিত তার স্পর্শে, রজনীর মৌন সুবিপুলপ্রভাতের গানে সে মিশায়ে দিল; কালো তার চুল পশ্চিম দিগন্ত পারে নামহীন বন-নীলিমায় বিস্তারিল রহস্য নিবিড়।                           আজি মুক্তিমন্ত্র গায় আমার বক্ষের মাঝে দূরের পথিকচিত্ত মম, সংসার যাত্রার প্রান্তে সহমরণের বধূ সম।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) অবর্জিত আমি চলে গেলে ফেলে রেখে যাব পিছু চিরকাল মনে রাখিবে, এমন কিছু,           মূঢ়তা করা তা নিয়ে মিথ্যে ভেবে। ধুলোর খাজনা শোধ করে নেবে ধুলো, চুকে গিয়ে তবু বাকি রবে যতগুলো           গরজ যাদের তারাই তা খুঁজে নেবে। আমি শুধু ভাবি, নিজেরে কেমনে ক্ষমি-- পুঞ্জ পুঞ্জ বকুনি উঠেছে জমি,           কোন্‌ সৎকারে করি তার সদ্‌গতি। কবির গর্ব নেই মোর হেন নয়-- কবির লজ্জা পাশাপাশি তারি রয়,           ভারতীর আছে এই দয়া মোর প্রতি। লিখিতে লিখিতে কেবলি গিয়েছি ছেপে, সময় রাখি নি ওজন দেখিতে মেপে,           কীর্তি এবং কুকীর্তি গেছে মিশে। ছাপার কালিতে অস্থায়ী হয় স্থায়ী, এ অপরাধের জন্যে যে-জন দায়ী           তার বোঝা আজ লঘু করা যায় কিসে। বিপদ ঘটাতে শুধু নেই ছাপাখানা, বিদ্যানুরাগী বন্ধু রয়েছে নানা--           আবর্জনারে বর্জন করি যদি চারি দিক হতে গর্জন করি উঠে, "ঐতিহাসিক সূত্র দিবে কি টুটে,           যা ঘটেছে তারে রাখা চাই নিরবধি।" ইতিহাস বুড়ো, বেড়াজাল তার পাতা, সঙ্গে রয়েছে হিসাবের মোটা খাতা--           ধরা যাহা পড়ে ফর্দে সকলি আছে। হয় আর নয়, খোঁজ রাখে শুধু এই, ভালোমন্দর দরদ কিছুই নেই,           মূল্যের ভেদ তুল্য তাহার কাছে। বিধাতাপুরুষ ঐতিহাসিক হলে চেহারা লইয়া ঋতুরা পড়িত গোলে,           অঘ্রাণ তবে ফাগুন রহিত ব্যেপে। পুরানো পাতারা ঝরিতে যাইত ভুলে, কচি পাতাদের আঁকড়ি রহিত ঝুলে,           পুরাণ ধরিত কাব্যের টুঁটি চেপে। জোড়হাত করে আমি বলি, "শোনো কথা, সৃষ্টির কাজে প্রকাশেরি ব্যগ্রতা,           ইতিহাসটারে গোপন করে সে রাখে। জীবনলক্ষ্মী মেলিয়া রঙের রেখা ধরার অঙ্গে আঁকিছে পত্রলেখা,           ভূতত্ত্ব তার কঙ্কালে ঢাকা থাকে। বিশ্বকবির লেখা যত হয় ছাপা প্রুফ্‌শিটে তার দশগুণ পড়ে চাপা,           নব এডিশনে নূতন করিয়া তুলে। দাগি যাহা, যাহে বিকার, যাহাতে ক্ষতি, মমতামাত্র নাহি তো তাহার প্রতি--           বাঁধা নাহি থাকে ভুলে আর নির্ভুলে। সৃষ্টির কাজ লুপ্তির সাথে চলে, ছাপাযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের বলে           এ বিধান যদি পদে পদে পায় বাধা-- জীর্ণ ছিন্ন মলিনের সাথে গোঁজা কৃপণপাড়ার রাশীকৃত নিয়ে বোঝা           সাহিত্য হবে শুধু কি ধোপার গাধা। যাহা কিছু লেখে সেরা নাহি হয় সবি, তা নিয়ে লজ্জা না করুক কোনো কবি--           প্রকৃতির কাজে কত হয় ভুলচুক; কিন্তু, হেয় যা শ্রেয়ের কোঠায় ফেলে তারেও রক্ষা করিবার ভূতে পেলে           কালের সভায় কেমনে দেখাবে মুখ। ভাবী কালে মোর কী দান শ্রদ্ধা পাবে, খ্যাতিধারা মোর কত দূর চলে যাবে,           সে লাগি চিন্তা করার অর্থ নাহি। বর্তমানের ভরি অর্ঘ্যের ডালি অদেয় যা দিনু মাখায়ে ছাপার কালি           তাহারি লাগিয়া মার্জনা আমি চাহি। অবসান জানি দিন অবসান হবে, জানি তবু কিছু বাকি রবে। রজনীতে ঘুমহারা পাখি এক সুরে গাহিবে একাকী- যে শুনিবে, সে রহিবে জাগি সে জানিবে, তারি নীড়হারা স্বপন খুঁজিছে সেই তারা যেথা প্রাণ হয়েছে বিবাগী। কিছু পরে করে যাবে চুপ ছায়াঘন স্বপনের রূপ। ঝরে যাবে আকাশকুসুম, তখন কূজনহীন ঘুম এক হবে রাত্রির সাথে। যে-গান স্বপনে নিল বাসা তার ক্ষীণ গুঞ্জন-ভাষা শেষ হবে সব-শেষ রাতে। অবসান হল রাতি অবসান হল রাতি। নিবাইয়া ফেলো কালিমামলিন ঘরের কোণের বাতি। নিখিলের আলো পূর্ব আকাশে জ্বলিল পুণ্যদিনে; এক পথে যারা চলিবে তাহারা সকলেরে নিক্‌ চিনে।  (স্ফুলিঙ্গ) অবিচার নারীর দুখের দশা অপমানে জড়ানো এই দেখি দিকে দিকে ঘরে ঘরে ছড়ানো। জানো কি এ অন্যায় সমাজের হিসাবে নিমেষে নিমেষে কত হলাহল মিশাবে? পুরুষ জেনেছে এটা বিধিনির্দিষ্ট তাদের জীবন-ভোজে নারী উচ্ছিষ্ট। রোগ-তাপে সেবা পায়, লয় তাহা অলসে-- সুধা কেন ঢালে বিধি ছিদ্র এ কলসে! সমসম্মান হেথা নাহি মানে পুরুষে, নিজ প্রভুপদমদে তুলে রয় ভুরু সে। অর্ধেক কাপুরুষ অর্ধেক রমণী তাতেই তো নাড়ীছাড়া এ দেশের ধমণী। বুঝিতে পারে না ওরা-- এ বিধানে ক্ষতি কার। জানি না কী বিপ্লবে হবে এর প্রতিকার। একদা পুরুষ যদি পাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়ে নারীর পাশে নাহি নামে যুদ্ধে অর্ধেক-কালি-মাখা সমাজের বুকটা খাবে তবে বারে বারে শনির চাবুকটা। এত কথা বৃথা বলা--যে পেয়েছে ক্ষমতা নিঃসহায়ের প্রতি নাই তার মমতা, আপনার পৌরুষ করি দিয়া লাঞ্ছিত অবিচার করাটাই হয় তার বাঞ্ছিত। অবোধ হিয়া বুঝে না বোঝে অবোধ হিয়া বুঝে না বোঝে, করে সে একি ভুল— তারার মাঝে কাঁদিয়া খোঁজে ঝরিয়া-পড়া ফুল।   (স্ফুলিঙ্গ) অভয় আজি বর্ষশেষ-দিনে, গুরুমহাশয়, কারে দেখাইছ বসে অন্তিমের ভয়? অনন্ত আশ্বাস আজি জাগিছে আকাশে, অনন্ত জীবনধারা বহিছে বাতাসে, জগৎ উঠেছে হেসে জাগরণসুখে, ভয় শুধু লেগে আছে তব শুষ্ক মুখে। দেবতা রাক্ষস নহে মেলি মৃত্যুগ্রাস— প্রবঞ্চনা করি তুমি দেখাইছ ত্রাস। বরঞ্চ ঈশ্বরে ভুলি স্বল্প তাহে ক্ষতি— ভয়, ঘোর অবিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি। তিনি নিজে মৃত্যুকথা ভুলায়ে ভুলায়ে রেখেছেন আমাদের সংসারকুলায়ে। তুমি কে কর্কশ কণ্ঠ তুলিছ ভয়ের? আনন্দই উপাসনা আনন্দময়ের।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) অভিমান কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ! বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ। যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ, কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান। যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি, কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি। যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ তারি কাছে তারি 'পরে তোমার নালিশ! নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে, পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে-- তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্‌, সাপ্তাহিকে দিগ্‌বিদিকে বাজাস নে ঢাক। একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল, অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ২৬ চৈত্র, ১৩০২ অভিলাষ ১ জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ! তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার । অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা , তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয় ।২ তোমার বাঁশরি স্বরে বিমোহিত মন — মানবেরা , ওই স্বর লক্ষ্য করি হায় , যত অগ্রসর হয় ততই যেমন কোথায় বাজিছে তাহা বুঝিতে না পারে ।৩ চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে , পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া , তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ , মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে ।৪ হিমক্ষেত্র , জনশূন্য কানন , প্রান্তর , চলিল সকল বাধা করি অতিক্রম । কোথায় যে লক্ষ্যস্থান খুঁজিয়া না পায় , বুঝিতে না পারে কোথা বাজিছে বাঁশরি ।৫ ওই দেখো ছুটিয়াছে আর-এক দল , লোকারণ্য পথমাঝে সুখ্যাতি কিনিতে ; রণক্ষেত্রে মৃত্যুর বিকট মূর্তি মাঝে , শমনের দ্বার সম কামানের মুখে ।৬ ওই দেখো পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয় । পহুঁছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান ।৭ কোথায় তোমার অন্ত রে দুরভিলাষ ‘ স্বর্ণঅট্টালিকা মাঝে ?' তা নয় তা নয় । ‘ সুবর্ণখনির মাঝে অন্ত কি তোমার ?' তা নয় , যমের দ্বারে অন্ত আছে তব ।৮ তোমার পথের মাঝে , দুষ্ট অভিলাষ , ছুটিয়াছে মানবেরা সন্তোষ লভিতে । নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা , তোমার পথের মাঝে সন্তোষ থাকে না!৯ নাহি জানে তারা হায় নাহি জানে তারা দরিদ্র কুটির মাঝে বিরাজে সন্তোষ । নিরজন তপোবনে বিরাজে সন্তোষ । পবিত্র ধর্মের দ্বারে সন্তোষ আসন ।১০ নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা তোমার কুটিল আর বন্ধুর পথেতে সন্তোষ নাহিকো পারে পাতিতে আসন । নাহি পশে সূর্যকর আঁধার নরকে ।১১ তোমার পথেতে ধায় সুখের আশয়ে নির্বোধ মানবগণ সুখের আশয়ে ; নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা কটাক্ষও নাহি করে সুখ তোমা পানে ।১২ সন্দেহ ভাবনা চিন্তা আশঙ্কা ও পাপ এরাই তোমার পথে ছড়ানো কেবল এরা কি হইতে পারে সুখের আসন এ-সব জঞ্জালে সুখ তিষ্ঠিতে কি পারে ।১৩ নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা নির্বোধ মানবগন নাহি জানে ইহা পবিত্র ধর্মের দ্বারে চিরস্থায়ী সুখ পাতিয়াছে আপনার পবিত্র আসন ।১৪ ওই দেখো ছুটিয়াছে মানবের দল তোমার পথের মাঝে দুষ্ট অভিলাষ হত্যা অনুতাপ শোক বহিয়া মাথায় ছুটেছে তোমার পথে সন্দিগ্ধ হৃদয়ে ।১৫ প্রতারণা প্রবঞ্চনা অত্যাচারচয় পথের সম্বল করি চলে দ্রুতপদে তোমার মোহন জালে পড়িবার তরে । ব্যাধের বাঁশিতে যথা মৃগ পড়ে ফাঁদে ।১৬ দেখো দেখো বোধহীন মানবের দল তোমার ও মোহময়ী বাঁশরির স্বরে এবং তোমার সঙ্গী আশা উত্তেজনে পাপের সাগরে ডুবে মুক্তার আশয়ে ।১৭ রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ দেখিতেছে চারি ধারে আনন্দিত মনে সমস্ত বর্ষের তার শ্রমের যে ফল ।১৮ দুরাকাঙ্ক্ষা হায় তব প্রলোভনে পড়ি কর্ষিতে কর্ষিতে সেই দরিদ্র কৃষক তোমার পথের শোভা মনোময় পটে চিত্রিতে লাগিল হায় বিমুগ্ধ হৃদয়ে ।১৯ ওই দেখো আঁকিয়াছে হৃদয়ে তাহার শোভাময় মনোহর অট্টালিকারাজি হীরক মাণিক্য পূর্ণ ধনের ভাণ্ডার নানা শিল্পে পরিপূর্ণ শোভন আপণ ।২০ মনোহর কুঞ্জবন সুখের আগার শিল্প-পারিপাট্যযুক্ত প্রমোদভবন গঙ্গা সমীরণ স্নিগ্ধ পল্লীর কানন প্রজাপূর্ণ লোভনীয় বৃহৎ প্রদেশ ।২১ ভাবিল মুহূর্ত-তরে ভাবিল কৃষক সকলই এসেছে যেন তারি অধিকারে তারি ওই বাড়ি ঘর তারি ও ভাণ্ডার তারি অধিকারে ওই শোভন প্রদেশ ।২২ মুহূর্তেক পরে তার মুহূর্তেক পরে লীন হল চিত্রচয় চিত্তপট হতে ভাবিল চমকি উঠি ভাবিল তখন ‘ আছে কি এমন সুখ আমার কপালে ?'২৩ ‘ আমাদের হায় যত দুরাকাঙ্ক্ষাচয় মানসে উদয় হয় মুহূর্তের তরে কার্যে তাহা পরিণত না হতে না হতে হৃদয়ের ছবি হায় হৃদয়ে মিশায় । '২৪ ওই দেখো ছুটিয়াছে তোমার ও পথে রক্তমাখা হাতে এক মানবের দল সিংহাসন রাজদণ্ড ঐশ্বর্য মুকুট প্রভুত্ব রাজত্ব আর গৌরবের তরে ।২৫ ওই দেখো গুপ্তহত্যা করিয়া বহন চলিতেছে অঙ্গুলির ‘ পরে ভর দিয়া চুপি চুপি ধীরে ধীরে অলক্ষিত ভাবে তলবার হাতে করি চলিয়াছে দেখো ।২৬ হত্যা করিতেছে দেখো নিদ্রিত মানবে সুখের আশয়ে বৃথা সুখের আশয়ে ওই দেখো ওই দেখো রক্তমাখা হাতে ধরিয়াছে রাজদণ্ড সিংহাসনে বসি ।২৭ কিন্তু হায় সুখলেশ পাবে কি কখন ? সুখ কি তাহারে করিবেক আলিঙ্গন ? সুখ কি তাহার হৃদে পাতিবে আসন ? সুখ কভু তারে কিগো কটাক্ষ করিবে ?২৮ নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে বৃষ্টি বজ্র সহ্য করি যে সুখের তরে ছুটিয়াছে আপনার অভীষ্ট সাধনে ?২৯ কখনোই নয় তাহা কখনোই নয় পাপের কী ফল কভু সুখ হতে পারে পাপের কী শাস্তি হয় আনন্দ ও সুখ কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়৩০ প্রজ্বলিত অনুতাপ হুতাশন কাছে বিমল সুখের হায় স্নিগ্ধ সমীরণ হুতাশনসম তপ্ত হয়ে উঠে যেন তখন কি সুখ কভু ভালো লাগে আর ।৩১ নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে ছুটেছে না মানি বাধা অভীষ্ট সাধনে মনস্তাপে পরিণত হয়ে উঠে শেষে ।৩২ হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে ।৩৩ কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপে দুষ্ট অভিলাষ! চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস , কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন , কাঁদালে সীতায় হায় অশোক-কাননে ।৩৪ রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ ।৩৫ দুর্যোধন-চিত্ত হায় অধিকার করি অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে ।৩৬ নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন ।৩৭ বলি না হে অভিলাষ তোমার ও পথ পাপেতেই পরিপূর্ণ পাপেই নি র্মি ত তোমার কতকগুলি আছয়ে সোপান কেহ কেহ উপকারী কেহ অপকারী ।৩৮ উচ্চ অভিলাষ! তুমি যদি নাহি কভু বিস্তারিতে নিজ পথ পৃথিবীমণ্ডলে তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ?৩৯ সকলেই যদি নিজ নিজ অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকিত নিজ বিদ্যা বুদ্ধিতেই তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ? অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে অমন   আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে             চলবে না। এবার   হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো, কেউ    জানবে না, কেউ বলবে না।        বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,        দেশ বিদেশে কতই ঘুরি - এবার   বলো আমার মনের কোণে             দেবে ধরা, ছলবে না।        আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে             চলবে না।       জানি আমার কঠিন হৃদয়        চরণ রাখার যোগ্য সে নয় - সখা,    তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়             তবু কি প্রাণ গলবে না।       না হয় আমার নাই সাধনা,        ঝরলে তোমার কৃপার কণা তখন    নিমেষে কি ফুটবে না ফুল             চকিতে ফল ফলবে না।        আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে             চলবে না।বোলপুর, ১১ ভাদ্র ১৩১৬ কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ২৩ অমলধারা ঝরনা যেমন অমলধারা ঝরনা যেমন স্বচ্ছ তোমার প্রাণ, পথে তোমার জাগিয়ে তুলুক আনন্দময় গান। সম্মুখেতে চলবে যত পূর্ণ হবে নদীর মতো, দুই কূলেতে দেবে ভ’রে সফলতার দান।    (স্ফুলিঙ্গ) অযোগ্যের উপহাস নক্ষত্র খসিল দেখি দীপ মরে হেসে। বলে, এত ধুমধাম, এই হল শেষে! রাত্রি বলে, হেসে নাও, বলে নাও সুখে, যতক্ষণ তেলটুকু নাহি যায় চুকে।  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে, রচে শিল্প শৈবালের দলে। মর্যাদা নাইকো তার, তবু তাহে রয় জীবনের স্বল্পমূল্য কিছু পরিচয়।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) অলস সময়-ধারা বেয়ে অলস সময়-ধারা বেয়ে মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে। সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে। কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে সুদীর্ঘ অতীতে জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে। এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল, এসেছে মোগল; বিজয়রথের চাকা উড়ায়েছে ধূলিজাল,উড়িয়াছে বিজয়পতাকা। শূন্যপথে চাই, আজ তার কোনো চিহ্ন নাই। নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো। আরবার সেই শূন্যতলে আসিয়াছে দলে দলে লৌহবাঁধা পথে অনলনিশ্বাসী রথে প্রবল ইংরেজ, বিকীর্ণ করেছে তার তেজ। জানি তারো পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল, কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল; জানি তার পণ্যবাহী সেনা জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না।মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে দেখি সেথা কলকলরবে বিপুল জনতা চলে নানা পথে নানা দলে দলে যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে জীবনে মরণে। ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে। ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে। রাজছত্র ভেঙে পড়ে,রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে। গুরুগুরু গর্জন গুন্‌গুন্‌ স্বর দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর। দুঃখ সুখ দিবসরজনী মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘পরে ওরা কাজ করে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) অল্প জানা ও বেশি জানা তৃষিত গর্দভ গেল সরোবরতীরে, ‘ছিছি কালো জল!’ বলি চলি এল ফিরে। কহে জল, জল কালো জানে সব গাধা, যে জন অধিক জানে বলে জল সাদা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অল্পেতে খুশি হবে অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি। মুড়কির মোয়া চাই, চাই ভাজা ভেটকি।আনবে কট্‌কি জুতো, মট্‌কিতে ঘি এনো, জলপাইগুঁড়ি থেকে এনো কই জিয়োনো– চাঁদনিতে পাওয়া যাবে বোয়ালের পেট কি।চিনেবাজারের থেকে এনো তো করমচা, কাঁকড়ার ডিম চাই, চাই যে গরম চা, নাহয় খরচা হবে মাথা হবে হেঁট কি।মনে রেখো বড়ো মাপে করা চাই আয়োজন, কলেবর খাটো নয়– তিন মোন প্রায় ওজন। খোঁজ নিয়ো ঝড়িয়াতে জিলিপির রেট কী।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) অসময় হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে?        এখনো সময় আছে কি, সময় আছে কি? দূরে কলরব ধ্বনিছে মন্দ মন্দ রে---        ফুরালো কি পথ? এসেছি পুরীর কাছে কি? মনে হয় সেই সুদূর মধুর গন্ধ রে        রহি রহি যেন ভাসিয়া আসিছে বাতাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। ঐ কি প্রদীপ দেখা যায় পুরমন্দিরে?        ও যে দুটি তারা দূর পশ্চিমগগনে। ও কি শিঞ্জিত ধ্বনিছে কনকমঞ্জীরে?        ঝিল্লির রব বাজে বনপথে সঘনে। মরীচিকালেখা দিগন্তপথ রঞ্জি রে        সারাদিন আজি ছলনা করেছে হতাশে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। এতদিনে সেথা বনবনান্ত নন্দিয়া        নব বসন্তে এসেছে নবীন ভূপতি। তরুণ আশার সোনার প্রতিমা বন্দিয়া        নব আনন্দে ফিরিছে যুবক যুবতী। বীণার তন্ত্রী আকুল ছন্দে ক্রন্দিয়া        ডাকিছে সবারে আছে যারা দূর প্রবাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। আজিকে সবাই সাজিয়াছে ফুলচন্দনে,        মুক্ত আকাশে যাপিবে জ্যোত্‍‌স্নাযামিনী। দলে দলে চলে বাঁধাবাঁধি বাহুবন্ধনে---        ধ্বনিছে শূন্যে জয়সংগীতরাগিণী। নূতন পতাকা নূতন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে        দক্ষিণবায়ে উড়িছে বিজয়বিলাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। সারা নিশি ধরে বৃথা করিলাম মন্ত্রণা,        শরত্‍‌-প্রভাত কাটিল শূন্যে চাহিয়া। বিদায়ের কালে দিতে গেনু কারে সান্ত্বনা,        যাত্রীরা হোথা গেল খেয়াতরী বাহিয়া। আপনারে শুধু বৃথা করিলাম বঞ্চনা,        জীবন-আহুতি দিলাম কী আশা-হুতাশে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। প্রভাতে আমায় ডেকেছিল সবে ইঙ্গিতে,        বহুজনমাঝে লয়েছিল মোরে বাছিয়া--- যবে রাজপথ ধ্বনিয়া উঠিল সংগীতে        তখনো বারেক উঠেছিল প্রাণ নাচিয়া। এখন কি আর পারিব প্রাচীর লঙ্ঘিতে---        দাঁড়ায়ে বাহিরে ডাকিব কাহারে বৃথা সে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে        অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে। দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে,        শান্তিসমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে। দুয়ার-প্রান্তে দাঁড়ায়ে বাহির-প্রান্তরে        ভেরী বাজাইব মোর প্রাণপণ প্রয়াসে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---        এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিছে আকাশে। অসময় বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা। আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম। এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া, এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি— নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি। শুধু এ মর্মরহীন বনপথ-’পরি তোমারি মঞ্জীর দুটি উঠিছে গুঞ্জরি। প্রিয়তমে, এ কাননে এলে অসময়ে, কালিকার গান আজি আছে মৌন হয়ে। তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল, অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) অসম্পূর্ণ সংবাদ চকোরী ফুকারি কাঁদে, ওগো পূর্ণ চাঁদ, পণ্ডিতের কথা শুনি গনি পরমাদ! তুমি নাকি একদিন রবে না ত্রিদিবে, মহাপ্রলয়ের কালে যাবে নাকি নিবে! হায় হায় সুধাকর, হায় নিশাপতি, তা হইলে আমাদের কী হইবে গতি! চাঁদ কহে, পণ্ডিতের ঘরে যাও প্রিয়া, তোমার কতটা আয়ু এসো শুধাইয়া।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অসম্ভব পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ , যবে ভাবিনু মনে , একা একা কোথা চলিতেছিলাম নিষ্কারণে । শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে , খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে , দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । এমনি রাত্রে কতবার , মোর বাহুতে মাথা , শুনেছিল সে যে কবির ছন্দে কাজরি-গাথা । রিমিঝিমি ঘন বর্ষণে বন রোমাঞ্চিত , দেহে আর মনে এক হয়ে গেছে যে-বাঞ্ছিত এল সেই রাতি বহি শ্রাবণের সে-বৈভব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । দূরে চলে যাই নিবিড় রাতের অন্ধকারে , আকাশের সুর বাজিছে শিরায় বৃষ্টিধারে । যূথীবন হতে বাতাসেতে আসে সুধার স্বাদ , বেণীবাঁধনের মালায় পেতেম যে-সংবাদ এই তো জেগেছে নবমালতীর সে সৌরভ — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । ভাবনার ভুলে কোথা চলে যাই অন্যমনে পথসংকেত কত জানায়েছে যে-বাতায়নে । শুনিতে পেলেম সেতারে বাজিছে সুরের দান অশ্রুজলের আভাসে জড়িত আমারি গান । কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । অসম্ভব ভালো যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো, কোন্‌ স্বর্গপুরী তুমি ক’রে থাকো আলো। আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়, অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অসাধ্য চেষ্টা শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অস্তসখী রজনী একাদশী         পোহায় ধীরে ধীরে, রঙিন মেঘমালা          উষারে বাঁধে ঘিরে। আকাশে ক্ষীণ শশী         আড়ালে যেতে চায়, দাঁড়ায়ে মাঝখানে         কিনারা নাহি পায়। এ-হেন কালে যেন         মায়ের পানে মেয়ে রয়েছে শুকতারা         চাঁদের মুখে চেয়ে। কে তুমি মরি মরি         একটুখানি প্রাণ। এনেছ কী না জানি         করিতে ওরে দান।    মহিমা যত ছিল         উদয়-বেলাকার যতেক সুখসাথি         এখনি যাবে যার, পুরানো সব গেল—         নূতন তুমি একা বিদায়-কালে তারে         হাসিয়া দিলে দেখা।    ও চাঁদ যামিনীর         হাসির অবশেষ, ও শুধু অতীতের             সুখের স্মৃতিলেশ। তারারা দ্রুতপদে             কোথায় গেছে সরে— পারে নি সাথে যেতে,             পিছিয়ে আছে পড়ে।    তাদেরই পানে ও যে             নয়ন ছিল মেলি, তাদেরই পথে ও যে             চরণ ছিল ফেলি, এমন সময়ে কে             ডাকিলে পিছু-পানে একটি আলোকেরই             একটু মৃদু গানে।    গভীর রজনীর             রিক্ত ভিখারিকে ভোরের বেলাকার             কী লিপি দিলে লিখে। সোনার-আভা-মাখা             কী নব আশাখানি শিশির-জলে ধুয়ে             তাহারে দিলে আনি। অস্ত-উদয়ের             মাঝেতে তুমি এসে প্রাচীন নবীনেরে             টানিছ ভালোবেসে— বধূ ও বর-রূপে             করিলে এক-হিয়া করুণ কিরণের             গ্রন্থি বাঁধি দিয়া। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) অস্তাচলের পরপারে সন্ধ্যাসূর্যের প্রতিআমার এ গান তুমি যাও সাথে করে নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে । সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে! সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায় , প্রভাত – পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায় । গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন , ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত , তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো । সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া !  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) অস্পষ্ট আজি ফাল্গুনে দোলপূর্ণিমারাত্রি,      উপছায়া-চলা বনে বনে মন             আবছা পথের যাত্রী। ঘুম-ভাঙানিয়া জোছনা--      কোথা থেকে যেন আকাশে কে বলে,             "একটুকু কাছে বোসো না।' ফিস্‌ফিস্‌ করে পাতায় পাতায়,           উস্‌খুস্‌ করে হাওয়া। ছায়ার আড়ালে গন্ধরাজের           তন্দ্রাজড়িত চাওয়া। চন্দনিদহে থইথই জল           ঝিক্‌ঝিক্‌ করে আলোতে, জামরুলগাছে ফুলকাটা কাজে           বুনুনি সাদায় কালোতে। প্রহরে প্রহরে রাজার ফটকে           বহুদূরে বাজে ঘণ্টা। জেগে উঠে বসে ঠিকানা-হারানো           শূন্য-উধাও মনটা। বুঝিতে পারি নে কত কী শব্দ--           মনে হয় যেন ধারণা, রাতের বুকের ভিতরে কে করে           অদৃশ্য পদচারণা। গাছগুলো সব ঘুমে ডুবে আছে,           তন্দ্রা তারায় তারায়, কাছের পৃথিবী স্বপ্নপ্লাবনে           দূরের প্রান্তে হারায়। রাতের পৃথিবী ভেসে উঠিয়াছে           বিধির নিশ্চেতনায়, আভাস আপন ভাষার পরশ           খোঁজে সেই আনমনায়। রক্তের দোলে যে-সব বেদনা           স্পষ্ট বোধের বাহিরে ভাবনাপ্রবাহে বুদ্‌বুদ্‌ তারা,           স্থির পরিচয় নাহি রে। প্রভাত-আলোক আকাশে আকাশে           এ চিত্র দিবে মুছিয়া, পরিহাসে তব অবচেতনার           বঞ্চনা যাবে ঘুচিয়া। চেতনার জালে এ মহাগহনে           বস্তু যা-কিছু টিঁকিবে, সৃষ্টি তারেই স্বীকার করিয়া           স্বাক্ষর তাহে লিখিবে। তবু কিছু মোহ, কিছু কিছু ভুল           জাগ্রত সেই প্রাপণার প্রাণতন্তুতে রেখায় রেখায়           রঙ রেখে যাবে আপনার। এ জীবনে তাই রাত্রির দান           দিনের রচনা জড়ায়ে চিন্তা-কাজের ফাঁকে ফাঁকে সব           রয়েছে ছড়ায়ে ছড়ায়ে। বুদ্ধি যাহারে মিছে বলে হাসে           সে যে সত্যের মূলে আপন গোপন রসসঞ্চারে           ভরিছে ফসলে ফুলে। অর্থ পেরিয়ে নিরর্থ এসে           ফেলিছে রঙিন ছায়া-- বাস্তব যত শিকল গড়িছে,           খেলেনা গড়িছে মায়া। অস্ফুট ও পরিস্ফুট ঘটিজল বলে, ওগো মহাপারাবার, আমি স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল, তুমি অন্ধকার। ক্ষুদ্র সত্য বলে, মোর পরিষ্কার কথা, মহাসত্য তোমার মহান্‌ নীরবতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি দুখ জ্বালা সব যাই ভুলি। অধরে অধরে পরশিয়া প্রাণমন উঠে হরষিয়া। মাথা রাখি যবে ওই বুকে ডুবে যাই আমি মহা সুখে। যবে বল তুমি, “ভালবাসি’, শুনে শুধু আঁখিজলে ভাসি।Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) আইডিয়াল নিয়ে থাকে আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি। প্রাক্‌টিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি। শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো– অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা ক’রে তোলো।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আকাঙ্ক্ষা আজি       শরততপনে প্রভাতস্বপনে                    কী জানি পরান কী যে চায় !      ওই        শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে                    বিহগবিহগী কী যে গায় !      আজি       মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে ,                    রহে না আবাসে মন হায় !      কোন্     কুসুমের আশে , কোন্ ফুলবাসে                    সুনীল আকাশে মন ধায় !         আজি       কে যেন গো নাই , এ প্রভাতে তাই                    জীবন বিফল হয় গো !      তাই       চারি দিকে চায় , মন কেঁদে গায় —                     ‘ এ নহে , এ নহে , নয় গো ! '      কোন্     স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে                     কোন্ ছায়াময়ী অমরায় !      আজি       কোন্ উপবনে বিরহবেদনে                    আমারি কারণে কেঁদে যায় !         আমি       যদি গাঁথি গান অথির - পরান                    সে গান শুনাব কারে আর !      আমি       যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা                    কাহারে পরাব ফুলহার !      আমি       আমার এ প্রাণ যদি করি দান                    দিব প্রাণ তবে কার পায় !      সদা       ভয় হয় মনে পাছে অযতনে                    মনে মনে কেহ ব্যথা পায় ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) আকাঙ্ক্ষা (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আম্র, তোর কী হইতে ইচ্ছা যায় বল্‌। সে কহে, হইতে ইক্ষু সুমিষ্ট সরল।— ইক্ষু, তোর কী হইতে মনে আছে সাধ? সে কহে, হইতে আম্র সুগন্ধ সুস্বাদ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আকাশ শিশুকালের থেকে          আকাশ আমার মুখে চেয়ে একলা গেছে ডেকে।        দিন কাটত কোণের ঘরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা             কাছের দিকে সর্বদা মুখ-ফেরা;         তাই সুদূরের পিপাসাতে    অতৃপ্ত মন তপ্ত ছিল। লুকিয়ে যেতেম ছাতে,                চুরি করতেম আকাশভরা সোনার বরন ছুটি,           নীল অমৃতে ডুবিয়ে নিতেম ব্যাকুল চক্ষু দুটি। দুপুর রৌদ্রে সুদূর শূন্যে আর কোনো নেই পাখি,             কেবল একটি সঙ্গীবিহীন চিল উড়ে যায় ডাকি                         নীল অদৃশ্যপানে;             আকাশপ্রিয় পাখি ওকে আমার হৃদয় জানে। স্তব্ধ ডানা প্রখর আলোর বুকে      যেন সে কোন্‌ যোগীর ধেয়ান মুক্তি-অভিমুখে।                       তীক্ষ্ণ তীব্র সুর           সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্ম হয়ে দূরের হতে দূর                         ভেদ করে যায় চলে                বৈরাগী ঐ পাখির ভাষা মন কাঁপিয়ে তোলে।     আলোর সঙ্গে আকাশ যেথায় এক হয়ে যায় মিলে                         শুভ্রে এবং নীলে           তীর্থ আমার জেনেছি সেইখানে      অতল নীরবতার মাঝে অবগাহনস্নানে।                আবার যখন ঝঞ্ঝা, যেন প্রকাণ্ড এক চিল      এক নিমেষে ছোঁ মেরে নেয় সব আকাশের নীল,             দিকে দিকে ঝাপটে বেড়ায় স্পর্ধাবেগের ডানা,                  মানতে কোথাও চায় না কারো মানা,             বারে বারে তড়িৎশিখার চঞ্চু-আঘাত হানে      অদৃশ্য কোন্‌ পিঞ্জরটার কালো নিষেধপানে,                            আকাশে আর ঝড়ে                  আমার মনে সব-হারানো ছুটির মূর্তি গড়ে।                            তাই তো খবর পাই--                  শান্তি সেও মুক্তি, আবার অশান্তিও তাই। আকাশতলে উঠল ফুটে আকাশতলে উঠল ফুটে আলোর শতদল। পাপড়িগুলি থরে থরে ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে, ঢেকে গেলো অন্ধকারের নিবিড় কালো জল। মাঝখানেতে সোনার কোষে আনন্দে, ভাই, আছি বসে - আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে আলোর শতদল।আকাশেতে ঢেউ দিয়ে রে বাতাস বহে যায়। চার দিকে গান বেজে ওঠে, চার দিকে প্রাণ নেচে ছোটে, গগনভরা পরশখানি লাগে সকল গায়। ডুব দিয়ে এই প্রাণ-সাগরে নিতেছি প্রাণ বক্ষ ভরে, ফিরে ফিরে আমায় ঘিরে বাতাস বহে যায়।দশ দিকেতে আঁচল পেতে কোল দিয়েছে মাটি। রয়েছে জীব যে যেখানে সকলকে সে ডেকে আনে, সবার হাতে সবার পাতে অন্ন সে দেয় বাঁটি। ভরেছে মন গীত গন্ধে, বসে আছি মহানন্দে, আমায় ঘিরে আঁচল পেতে কোল দিয়েছে মাটি।আলো, তোমায় নমি, আমার মিলাক অপরাধ। ললাটেতে রাখো আমার পিতার আশীর্বাদ। বাতাস, তোমায় নমি, আমার ঘুচুক অবসাদ। সকল দেহে বুলিয়ে দাও পিতার আশীর্বাদ। মাটি, তোমায় নমি, আমার মিটুক সর্ব সাধ। গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো পিতার আশীর্বাদ।পৌষ ১৩১৬ কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ৪৮ আকাশপ্রদীপ গোধূলিতে নামল আঁধার ,                         ফুরিয়ে গেল বেলা ,           ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল                         চেনা মুখের মেলা ।           দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা                         নয়ন ছলোছলো ,           এবার তবে ঘরের প্রদীপ                         বাইরে নিয়ে চলো ।           মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা ।           পাণ্ডু-আঁধার বিদায়রাতের শেষে যে তাকাত শিশিরসজল শূন্যতা-উদ্দেশে           সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে                     অস্তলোকের প্রান্তদ্বারের কাছে । অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে —           যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে । আকাশ-সিন্ধু-মাঝে এক ঠাঁই আকাশ-সিন্ধু-মাঝে এক ঠাঁই কিসের বাতাস লেগেছে– জগৎ-ঘূর্ণি জেগেছে। ঝলকি উঠেছে রবি-শশাঙ্ক, ঝলকি ছুটেছে তারা, অযুত চক্র ঘুরিয়া উঠেছে অবিরাম মাতোয়ারা। স্থির আছে শুধু একটি বিন্দু ঘূর্ণির মাঝখানে– সেইখান হতে স্বর্ণকমল উঠেছে শূন্যপানে। সুন্দরী, ওগো সুন্দরী, শতদলদলে ভুবনলক্ষ্ণী দাঁড়ায়ে রয়েছ মরি মরি। জগতের পাকে সকলি ঘুরিছে, অচল তোমার রূপরাশি। নানা দিক হতে নানা দিন দেখি– পাই দেখিবারে ওই হাসি।জনমে মরণে আলোকে আঁধারে চলেছি হরণে পূরণে, ঘুরিয়া চলেছি ঘুরনে। কাছে যাই যার দেখিতে দেখিতে চলে যায় সেই দূরে, হাতে পাই যারে পলক ফেলিতে তারে ছুঁয়ে যাই ঘুরে। কোথাও থাকিতে না পারি ক্ষণেক, রাখিতে পারি নে কিছু– মত্ত হৃদয় ছুটে চলে যায় ফেনপুঞ্জের পিছু। হে প্রেম, হে ধ্রুবসুন্দর, স্থিরতার নীড় তুমি রচিয়াছ ঘূর্ণার পাকে খরতর। দ্বীপগুলি তব গীতমুখরিত, ঝরে নির্ঝর কলভাষে, অসীমের চির-চরম শান্তি নিমেষের মাঝে মনে আসে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আকাশে চেয়ে দেখি আকাশে চেয়ে দেখি অবকাশের অন্ত নেই কোথাও। দেশকালের সেই সুবিপুল আনুকূল্যে তারায় তারায় নিঃশব্দ আলাপ, তাদের দ্রুতবিচ্ছুরিত আলোক-সংকেতে তপস্বিনী নীরবতার ধ্যান কম্পমান। অসংখ্যের ভারে পরিকীর্ণ আমার চিত্ত; চারদিকে আশু প্রয়োজনের কাঙালের দল; অসীমের অবকাশকে খণ্ড খণ্ড করে ভিড় করেছে তারা উৎকণ্ঠ কোলাহলে। সংকীর্ণ জীবনে আমার স্বর তাই বিজড়িত, সত্য পৌঁছয় না অনুজ্জ্বল বাণীতে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত কথার মূল্য হল দীন; অর্থ গেল মুছে। আমার ভাষা যেন কুয়াশার জড়িমায় অবমানিত হেমন্তের বেলা, তার সুর পড়েছে চাপা। সুস্পষ্ট প্রভাতের মতো মন অনায়াসে মাথা তুলে বলতে পারে না-- "ভালোবাসি।" সংকোচ লাগে কণ্ঠের কৃপণতায়। তাই ওগো বনস্পতি, তোমার সম্মুখে এসে বসি সকালে বিকালে, শ্যামচ্ছায়ায় সহজ করে নিতে চাই আমার বাণী। দেখি চেয়ে, তোমার পল্লবস্তবক অনায়াসে পার হয়েছে শাখাব্যূহের জটিলতা, জয় করে নিয়েছে চারদিকে নিস্তব্ধ অবকাশ। তোমার নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস সেই উদার পথে উত্তীর্ণ হয়ে যায় সূর্যোদয়-মহিমার মাঝে। সেই পথ দিয়ে দক্ষিণ বাতাসের স্রোতে অনাদি প্রাণের মন্ত্র তোমার নবকিশলয়ের মর্মে এসে মেলে-- বিশ্বহৃদয়ের সেই আনন্দমন্ত্র-- "ভালোবাসি।" বিপুল ঔৎসুক্য আমাকে বহন করে নিয়ে যায় সুদূরে; বর্তমান মুহূর্তগুলিকে অবলুপ্ত করে কালহীনতায়। যেন কোন্‌ লোকান্তরগত চক্ষু জন্মান্তর থেকে চেয়ে থাকে অমার মুখের দিকে,-- চেতনাকে নিষ্কারণ বেদনায় সকল সীমার পরপারে দেয় পাঠিয়ে। ঊর্ধ্বলোক থেকে কানে আসে সৃষ্টির শাশ্বতবাণী-- "ভালোবাসি।" যেদিন যুগান্তের রাত্রি হল অবসান আলোকের রশ্মিদূত বিকীর্ণ করেছিল এই আদিমবাণী আকাশে আকাশে। সৃষ্টিযুগের প্রথম লগ্নে প্রাণসমুদ্রের মহাপ্লাবনে তরঙ্গে তরঙ্গে দুলেছিল এই মন্ত্র-বচন। এই বাণীই দিনে দিনে রচনা করেছে স্বর্ণচ্ছটায় মানসী প্রতিমা আমার বিরহ-গগনে অস্তসাগরের নির্জন ধূসর উপকূলে। আজ দিনান্তের অন্ধকারে এজন্মের যত ভাবনা যত বেদনা নিবিড় চেতনায় সম্মিলিত হয়ে সন্ধ্যাবেলার একলা তারার মতো জীবনের শেষবাণীতে হোক উদ্ভাসিত-- "ভালোবাসি।" আকাশে ছড়ায়ে বাণী আকাশে ছড়ায়ে বাণী অজানার বাঁশি বাজে বুঝি। শুনিতে না পায় জন্তু, মানুষ চলেছে সুর খুঁজি। আকাশে যুগল তারা আকাশে যুগল তারা চলে সাথে সাথে অনন্তের মন্দিরেতে আলোক মেলাতে।(স্ফুলিঙ্গ) আকাশে সোনার মেঘ আকাশে সোনার মেঘ কত ছবি আঁকে, আপনার নাম তবু লিখে নাহি রাখে।(স্ফুলিঙ্গ) আকাশের আলো মাটির তলায় আকাশের আলো মাটির তলায় লুকায় চুপে, ফাগুনের ডাকে বাহিরিতে চায় কুসুমরূপে।(স্ফুলিঙ্গ) আকাশের চাঁদ হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —                 এই হল তার বুলি।          দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,                 কাঁদে সে দু হাত তুলি।          হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,                 পাখিরা গাহিছে সুখে।          সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,                 বিকালে ঘরের মুখে।          বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে                 খেলিছে আঙিনা-কোণে,          কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী                 হাসিছে আপন মনে।            কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়                 চলেছে যে যার কাজে —          কত জনরব কত কলরব                 উঠিছে আকাশমাঝে।          পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,                'কে তুমি কাঁদিছ বসি । '          সে কেবল বলে নয়নের জলে,                'হাতে পাই নাই শশী।'             সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে                 অযাচিত ফুলদল,           দখিন সমীর বুলায় ললাটে                 দক্ষিণ করতল।          প্রভাতের আলো আশিস-পরশ                 করিছে তাহার দেহে,          রজনী তাহারে বুকের আঁচলে                 ঢাকিছে নীরব স্নেহে।          কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর                 কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,          পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে                 লইতে বন্ধু করি।          এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,                 কত ভালোবাসাবাসি,          সংসারসুখ কাছে কাছে তার                 কত আসে যায় ভাসি,          মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,                 কহে সে নয়নজলে,         'তোমাদের আমি চাহি না কারেও,                 শশী চাই করতলে।'             শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,                 সেও ব'সে এক ঠাঁই।          অবশেষে যবে জীবনের দিন                 আর বেশি বাকি নাই,          এমন সময়ে সহসা কী ভাবি                 চাহিল সে মুখ ফিরে          দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর                 সুনীল সিন্ধুতীরে।          সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া                 কাটিতেছে পাকা ধান,          ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,                 মাঝি বসে গায় গান।          দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,                 বধূরা চলেছে ঘাটে,          মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন                 আসিছে গ্রামের হাটে।          নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,                 কহে ম্রিয়মাণ মন,         'শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই                 আর বার এ জীবন।'             দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ                 সুন্দর লোকালয়          প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে                 চির-কল্লোলময়।          স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী                 ফিরিছে গৃহের মাঝে,          প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর                 প্রতি দিবসের কাজে।          সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে                 ঘরের ছেলের মতো,          রজনী সবারে কোলেতে লইছে                 নয়ন করিয়া নত।          ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,                 ছোটো কথা, ছোটো সুখ,          প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,                 ছোটো ছোটো হাসিমুখ          আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া                 মানবজীবন ঘিরি,          বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই                 দেখিতেছে ফিরি ফিরি।             দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম                 অতীত জীবন-রেখা,          অস্তরবির সোনার কিরণে                 নূতন বরনে লেখা।          যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া                 চাহে নি কখনো ফিরে,          নবীন আভায় দেখা দেয় তারা                 স্মৃতিসাগরের তীরে।          হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া                 পুরবীরাগিণী বাজে,          দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়                  ওই জীবনের মাঝে।          দিনের আলোক মিলায়ে আসিল                 তবু পিছে চেয়ে রহে—          যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়                 তার বেশি কিছু নহে।            সোনার জীবন রহিল পড়িয়া                 কোথা সে চলিল ভেসে।          শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি                 রবিশশীহীন দেশে। আকুল আহ্বান অভিমান ক'রে কোথায় গেলি,        আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়। দিন রাত কেঁদে কেঁদে ডাকি        আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়। সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার,        মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না। একে একে সবাই ঘরে এল,        আমায় যে মা, "মা' কেউ বলে না। সময় হল বেঁধে দেব চুল,        পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি। সাঁজের তারা সাঁজের গগনে --        কোথায় গেল, রানী আমার রানী!ও মা, রাত হল, আঁধার করে আসে,        ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়। আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু --        শূন্য শেজ শূন্যপানে চায়। কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে ভরা, সেই নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে।        শ্রান্ত দেহ ঢুলে ঢুলে পড়ে, তবু মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।আঁধার রাতে চলে গেলি তুই, আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়। কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,        তারা শুধু তারার পানে চায়। পথে কোথাও জনপ্রাণী নেই,        ঘরে ঘরে সবাই ঘুমিয়ে আছে। মা তোর শুধু একলা দ্বারে বসে,        চুপি চুপি আয় মা, মায়ের কাছে। আমি তোরে নুকিয়ে রেখে দেব,        রেখে দেব বুকের মধ্যে করে -- থাক্‌, মা, সে তার পাষাণ হৃদি নিয়ে        অনাদর যে করেছে তোরে। মলিন মুখে গেলি তাদের কাছে -- তবু তারা নিলে না মা কোলে? বড়ো বড়ো আঁখি দুখানি        রইলি তাদের মুখের পানে তুলে? এ জগৎ কঠিন -- কঠিন --        কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া। সেইখানে তুই আয় মা ফিরে আয় --        এত ডাকি দিবি নে কি সাড়া?হে ধরণী, জীবের জননী,        শুনেছি যে মা তোমায় বলে। তবে কেন তোর কোলে সবে        কেঁদে আসে কেঁদে যায় চলে। তবে কেন তোর কোলে এসে        সন্তানের মেটে না পিপাসা। কেন চায় -- কেন কাঁদে সবে,        কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা। কেন হেথা পাষাণ পরান        কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর! কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে        কেন তারে করে দেয় দূর! কেঁদে যে-জন ফিরে চলে যায়,        তার তরে কাঁদিস নে কেহ -- এই কি মা জননীর প্রাণ!        এই কি মা জননীর স্নেহ!ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,        ফুল ফোটা সে দেখে গেল না। ফুলে ফুলে ভরে গেল বন,        একটি সে তো পরতে পেল না। ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায় --        ফুল নিয়ে আর সবাই পরে। ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,        একটিও রবে না তার তরে! তার তরে মা কেবল আছে,        আছে শুধু জননীর স্নেহ, আছে শুধু মা'র অশ্রুজল --        কিছু নাই, নাই আর কেহ। খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,        হাসত যারা তারা আজও হাসে, তার তরে কেহ ব'সে নেই,        মা শুধু রয়েছে তারি আশে!হায় বিধি, এ কি ব্যর্থ হবে!        ব্যর্থ হবে মা'র ভালোবাসা! কত জনের কত আশা পুরে,        ব্যর্থ হবে মার প্রাণের আশা! আকুল আহ্বান সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার—     মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না। একে একে সবাই ঘরে এল,     আমায় যে মা, ‘মা' কেউ বলে না। সময় হল, বেঁধে দেব চুল,     পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি। সাঁঝের তারা সাঁঝের গগনে—     কোথায় গেল রানী আমার রানী।    রাত্রি হল, আঁধার করে আসে,     ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়। আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু—     শূন্য শেজ শূন্য-পানে চায়। কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে-ভরা,     নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে। শ্রান্ত দেহ ঢুলে পড়ে, তবু     মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।    আঁধার রাতে চলে গেলি তুই,     আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়। কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,     তারা শুধু তারার পানে চায়। এ জগৎ কঠিন— কঠিন—     কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া— সেইখানে তুই আয় মা, ফিরে আয়—     এত ডাকি, দিবি নে কি সাড়া।    ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,       ফুল-ফোটা সে দেখে গেল না, ফুলে ফুলে ভরে গেল বন       একটি সে তো পরতে পেল না। ফুল সে ফোটে ফুল যে ঝরে যায়—       ফুল নিয়ে যে আর-সকলে পরে, ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,       একটিও যে রইবে না তার তরে।    খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,       হাসত যারা তারা আজো হাসে, তার তরে তো কেহই বসে নেই,       মা যে কেবল রয়েছে তার আশে। হায় রে বিধি, সব কি ব্যর্থ হবে—       ব্যর্থ হবে মায়ের ভালোবাসা। কত জনের কত আশা পূরে,       ব্যর্থ হবে মার প্রাণেরই আশা। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) আগমনী সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া        ফুটিল প্রভাততারা। হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল        ঢালিয়া সুধার ধারা। মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে কমল নয়ন খুলিল হরষে, হিমালয় শিরে অমল আভায়        শোভিল ধবল তুষারজটা। খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার, ঝরিল কনককিরণধার, শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল,        রবির বিমল কিরণছটা। গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে, উঠেছে নাচিয়া হরষভরে, অচল গিরিও হয়েছে যেমন        অধীর পাগল-পারা। তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া, কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া , ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি        ঝরিছে নিঝরধারা। তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা, চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা, অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে        মাতিয়া সুখের গানে। মুখে একটিও নাহিকো বাণী শবদচকিতা মেনকারানী তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে,        চাহিয়া পথের পানে। আজ মেনকার আদরিণী উমা        আসিবে বরষ-পরে। তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি        উঠিয়াছে ঘরে ঘরে। অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়, কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়, কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে        এখনো উমা মা এলনা কেন? হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে, "কই উমা কই' বলে "উমা কই',        তিলেক বেয়াজ সহে না যেন! বরষের পরে আসিবেন উমা        রানীর নয়নতারা , ছেলেবেলাকার সহচরী যত        হরষে পাগল-পারা। ভাবিছে সকলে আজিকে উমায়        দেখিবে নয়ন ভ'রে, আজিকে আবার সাজাব তাহায়        বালিকা উমাটি ক'রে। তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে, তেমনি চিকন-চিকন বাকলে, তেমনি করিয়া পরাব গলায়        বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা। তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ, জননীর কাছে বলিব গিয়ে        "এই নে মা তোর তাপসী বালা'। লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ হেরি উথলিবে মায়ের সুখ, হরষে জননী নয়নের জলে        চুমিবে উমার সে মুখখানি। হরষে ভূধর অধীর-পারা হরষে ছুটিবে তটিনীধারা, হরষে নিঝর উঠিবে উছসি,        উঠিবে উছসি মেনকারানী। কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে বনে বনে বনে ফিরিবি বালা, তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা,        পরাবি উমার বিনোদ গলে। তারকা-খচিত গগন-মাঝে শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে তেমনি শারদা অবনী শশী        শোভিবে কেমন অবনীতলে! ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে,        দেখো চেয়ে গিরিরানী! আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ,        হাসি-হাসি মুখখানি। বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া        দাঁড়াল উমারে ঘিরি। শিথিল চিকুরে অমল মালিকা        পরাইয়া দিল ধীরি। হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই        উমার চিবুক ধ'রে, "বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে        আছিলি কেমন করে? আমরা তো সখি সারাটি বরষ        রহিয়াছি পথ চেয়ে -- কবে আসিবেক আমাদের সেই মেনকারানীর মেয়ে! এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ এই নে, মৃণাল বালা, হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে পরিলে কুসুম-মালা।' কেহ বা কহিল,"এবার স্বজনি, দিব না তোমায় ছেড়ে ভিখারি ভবের সর্বস্ব ধন আমরা লইব কেড়ে। বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা এয়েছ বরষ-পরে, কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল তিনটি দিনের তরে।' কেহ বা কহিল,"বলো দেখি,সখী, মনে পড়ে ছেলেবেলা? সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে কত-না করেছি খেলা! সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী গেলে তপোবন-মাঝে-- নয়নের জলে আমরা সকলে সাজানু তাপসী-সাজে। কোমল শরীরে বাকল পরিয়া এলায়ে নিবিড় কেশ লভিবারে পতি মনের মতন কত-না সহিলে ক্লেশ। ছেলেবেলাকার সখীদের সব এখনো তো মনে আছে, ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে ভুলিস তাদের পাছে!' কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে        চলিল আলয়-মুখে, কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে        আকুল মায়ের বুকে। হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী,        চুমিয়া উমার অধরখানি, "আয় মা জননি আয় মা কোলে,        আজ বরষের পরে। দুখিনী মাতার নয়নের জল তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্‌ তবে উমা আর ,কে আছে আমার        এ শূন্য আঁধার ঘরে? সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে        কী হবে শুনে সে ব্যথা, বল্‌ দেখি, উমা, পতির ঘরের        সকল কুশল-কথা।' এত বলি রানী হরষে আদরে        উমারে কোলেতে লয়ে, হরষের ধারা বরষি নয়নে        পশিল গিরি-আলয়ে। আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে        উঠিল হরষ-ধ্বনি, কত দিন পরে মেনকা-মহিষী        পেয়েছে নয়নমণি! আগুন জ্বলিত যবে আগুন জ্বলিত যবে আপন আলোতে সাবধান করেছিলে মোরে দূর হতে। নিবে গিয়ে ছাইচাপা আছে মৃতপ্রায়, তাহারি বিপদ হতে বাঁচাও আমায়।(স্ফুলিঙ্গ) আছি আমি বিন্দুরূপে, হে অন্তরযামী আছি আমি বিন্দুরূপে, হে অন্তরযামী আছি আমি বিশ্বকেন্দ্রস্থলে। “আছি আমি’ এ কথা স্মরিলে মনে মহান্‌ বিস্ময় আকুল করিয়া দেয়,স্তব্ধ এ হৃদয় প্রকাণ্ড রহস্যভারে। “আছি আর আছে’ অন্তহীন আদি প্রহেলিকা, কার কাছে শুধাইব অর্থ এর! তত্ত্ববিদ্‌ তাই কহিতেছে,”এ নিখিলে আর কিছু নাই, শুধু এক আছে।’ করে তারা একাকার অস্তিত্বরহস্যরাশি করি অস্বীকার। একমাত্র তুমি জান এ ভবসংসারে যে আদি গোপন তত্ত্ব, আমি কবি তারে চিরকাল সবিনয়ে স্বীকার করিয়া অপার বিস্ময়ে চিত্ত রাখিব ভরিয়া।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আছে আমার হৃদয় আছে ভরে আছে আমার হৃদয় আছে ভরে, এখন তুমি যা খুশি তাই করো। এমনি যদি বিরাজ' অন্তরে বাহির হতে সকলই মোর হরো।     সব পিপাসার যেথায় অবসান     সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,     তাহার পরে মরুপথের মাঝে     উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।এই যে খেলা খেলছ কত ছলে এই খেলা তো আমি ভালবাসি। এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে, আরেক দিকে জাগিয়ে তোল' হাসি।     যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি     গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,     কোলের থেকে যখন ফেল' দূরে     বুকের মাঝে আবার তুলে ধর'।কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি আজ গড়ি খেলাঘর আজ গড়ি খেলাঘর, কাল তারে ভুলি— ধূলিতে যে লীলা তারে মুছে দেয় ধূলি।(স্ফুলিঙ্গ) আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় আজ   ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়          লুকোচুরির খেলা।       নীল আকাশে কে ভাসালে          সাদা মেঘের ভেলা।             আজ   ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,                   উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,             আজ   কিসের তরে নদীর চরে                      চখাচখির মেলা।ওরে   যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,          যাবো না আজ ঘরে! ওরে   আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ          নেব রে লুঠ করে।             যেন    জোয়ার জলে ফেনার রাশি                   বাতাসে আজ ফুটেছে হাসি,             আজ   বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি                   কাটবে সারা বেলা। আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে; চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে। হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা, ধাইতে ধাইতে লোপ ক’রে চলে সীমা, কোন্‌ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে, বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে। বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে। জানে না কিছুই কোন্‌ মহাদ্রিতলে গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে, নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে কোন্‌ সে ভীষণ জীবন-মরণ রাজে। বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।ঈশান কোণেতে ওই যে  ঝড়ের বাণী গুরু গুরু রবে কী করিছে কানাকানি। দিগন্তরালে কোন্‌ ভবিতব্যতা স্তব্ধ তিমিরে বহে ভাষাহীন ব্যথা, কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে ঘনায়ে উঠিছে কোন্‌ আসন্ন কাজে। বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।১১ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজ বারি ঝরে ঝর ঝর আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে। আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে। শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে, জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের ‘পরে। আজ মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে।ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে ওই ঝড়ে, বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে। অন্তরে আজ কী কলরোল, দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল, হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে। আজ এমন করে কে মেতেছে বাহিরে ঘরে।১৪ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে তোমারেই ভালোবেসেছি। জনতা বাহিয়া চিরদিন ধরে শুধু তুমি আমি এসেছি। দেখি চারি দিক-পানে কী যে জেগে ওঠে প্রাণে– তোমার আমার অসীম মিলন যেন গো সকল খানে। কত যুগ এই আকাশে যাপিনু সে কথা অনেক ভুলেছি। তারায় তারায় যে আলো কাঁপিছে সে আলোকে দোঁহে দুলেছি।তৃণরোমাঞ্চ ধরণীর পানে আশ্বিনে নব আলোকে চেয়ে দেখি যবে আপনার মনে প্রাণ ভরি উঠে পুলকে। মনে হয় যেন জানি এই অকথিত বাণী, মূক মেদিনীর মর্মের মাঝে জাগিছে সে ভাবখানি। এই প্রাণে-ভরা মাটির ভিতরে কত যুগ মোরা যেপেছি, কত শরতের সোনার আলোকে কত তৃণে দোঁহে কেঁপেছি।প্রাচীন কালের পড়ি ইতিহাস সুখের দুখের কাহিনী– পরিচিতসম বেজে ওঠে সেই অতীতের যত রাগিণী। পুরাতন সেই গীতি সে যেন আমার স্মৃতি, কোন্‌ ভাণ্ডারে সঞ্চয় তার গোপনে রয়েছে নিতি। প্রাণে তাহা কত মুদিয়া রয়েছে কত বা উঠিছে মেলিয়া– পিতামহদের জীবনে আমরা দুজনে এসেছি খেলিয়া।লক্ষ বরষ আগে যে প্রভাত উঠেছিল এই ভুবনে তাহার অরুণকিরণকণিকা গাঁথ নি কি মোর জীবনে? সে প্রভাতে কোন্‌খানে জেগেছিনু কেবা জানে। কী মুরতি-মাঝে ফুটালে আমারে সেদিন লুকায়ে প্রাণে! হে চির-পুরানো,চিরকাল মোরে গড়িছ নূতন করিয়া। চিরদিন তুমি সাথে ছিলে মোর, রবে চিরদিন ধরিয়া।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা। আমি দেখলেম নবীনকে, প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ যার দর্শন হারিয়েছে। কল্পনা করছি,-- অনাগত যুগ থেকে তীর্থযাত্রী আমি ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে। উজান স্বপ্নের স্রোতে পৌঁছলেম এই মুহূর্তেই বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে। কেবলি তাকিয়ে আছি উৎসুক চোখে। আপনাকে দেখছি আপনার বাইরে,-- অন্যযুগের অজানা আমি অভ্যস্ত পরিচয়ের পরপারে। তাই তাকে নিয়ে এত গভীর কৌতূহল। যার দিকে তাকাই চক্ষু তাকে আঁকড়িয়ে থাকে পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো। আমার নগ্নচিত্ত আজ মগ্ন হয়েছে সমস্তের মাঝে। জনশ্রুতির মলিন হাতের দাগ লেগে যার রূপ হয়েছে অবলুপ্ত, যা পরেছে তুচ্ছতার মলিন চীর তার সে জীর্ণ উত্তরীয় আজ গেল খ'সে। দেখা দিল সে অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে। দেখা দিল সে অনির্বচনীয়তায়। যে বোবা আজ পর্যন্ত ভাষা পায়নি জগতের সেই অতি প্রকাণ্ড উপেক্ষিত আমার সামনে খুলেছে তার অচল মৌন, ভোর-হয়ে-ওঠা বিপুল রাত্রির প্রান্তে প্রথম চঞ্চল বাণী জাগল যেন। আমার এতকালের কাছের জগতে আমি ভ্রমণ করতে বেরিয়েছি দূরের পথিক। তার আধুনিকের ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিয়েছে চিরকালের রহস্য। সহমরণের বধূ বুঝি এমনি ক'রেই দেখতে পায় মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে নূতন চোখে চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ। আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে আজি  বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে। আজি       খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো, আজি       ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো, এই          সংগীত-মুখরিত গগনে তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো। এই          বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে দিয়ো       ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।অতি        নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে আজি       পল্লবে পল্লবে বাজে রে– দূরে         গগনে কাহার পথ চাহিয়া আজি       ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে। মোর        পরানে দখিন বায়ু লাগিছে, কারে       দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে, এই          সৌরভবিহ্বল রজনী কার         চরণে ধরণীতলে জাগিছে। ওগো        সুন্দর, বল্লভ, কান্ত, তব         গম্ভীর আহ্বান কারে।বোলপুর, ২৬ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজি গন্ধবিধুর সমীরণে আজি      গন্ধবিধুর সমীরণে কার         সন্ধানে ফিরি বনে বনে। আজি  ক্ষুব্ধ নীলাম্বর-মাঝে এ কী  চঞ্চল ক্রন্দন বাজে। সুদূর দিগন্তের সকরুণ সংগীত লাগে মোর চিন্তায় কাজে– আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে গন্ধবিধুর সমীরণে।ওগো        জানি না কী নন্দনরাগে সুখে        উৎসুক যৌবন জাগে। আজি  আম্রমুকুলসৌগন্ধ্যে, নব-     পল্লব-মর্মর ছন্দে, চন্দ্র-কিরণ-সুধা-সিঞ্চিত অম্বরে অশ্রু-সরস মহানন্দে আমি  পুলকিত কার পরশনে গন্ধবিধুর সমীরণে।বোলপুর, ফাল্গুন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ; আপন আগুনে শোক দগ্ধ করি দিল আপনারে উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে। সায়াহ্নবেলার ভালে অস্তসূর্য দেয় পরাইয়া রক্তোজ্জল মহিমার টিকা, স্বর্ণময়ী করে দেয় আসন্ন রাত্রির মুখশ্রীরে, তেমনি জ্বলন্ত শিখা মৃত্যু পরাইল মোরে জীবনের পশ্চিমসীমায়। আলোকে তাহার দেখা দিল অখন্ড জীবন, যাহে জন্মমৃত্যু এক হয়ে আছে; সে মহিমা উদ্‌বারিল যাহার উজ্জ্বল অমরতা কৃপণ ভাগ্যের দৈন্যে দিনে দিনে রেখেছিল ঢেকে। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার। আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম, দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার। পরানসখা বন্ধু হে আমার।বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই, তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই। সুদূর কোন্‌ নদীর পারে, গহন কোন্‌ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার। পরানসখা বন্ধু হে আমার।“পদ্মা’ বোট, শ্রাবণ, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে আজি   বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে।       আজি   খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,       আজি   ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,       এই    সংগীতমুখরিত গগনে       তব    গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।       এই    বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে       দিয়ো   ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।অতি   নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে আজি   পল্লবে পল্লবে বাজে রে - দূরে   গগনে কাহার পথ চাহিয়া আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।       মোর   পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,       কারে   দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,       এই    সৌরভবিহবল রজনী       কার   চরণে ধরণীতলে জাগিছে।       ওগো   সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,       তব   গম্ভীর আহবান কারে।কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ৫৫ আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে          গোপন তব চরণ ফেলে নিশার মতো নীরব ওহে         সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।              প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,              বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,              নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি         নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।কূজনহীন কাননভূমি,       দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে, একেলা কোন্‌ পথিক তুমি       পথিকহীন পথের ‘পরে।             হে একা সখা, হে প্রিয়তম,             রয়েছে খোলা এ ঘর মম,             সমুখ দিয়ে স্বপনসম        যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আজি হেরিতেছি আমি আজি হেরিতেছি আমি, হে হিমাদ্রি, গভীর নির্জনে পাঠকের মতো তুমি বসে আছ অচল আসনে, সনাতন পুঁথিখানি তুলিয়া লয়েছ অঙ্ক’পরে। পাষাণের পত্রগুলি খুলিয়া গিয়াছে থরে থরে, পড়িতেছ একমনে। ভাঙিল গড়িল কত দেশ, গেল এল কত যুগ– পড়া তব হইল না শেষ। আলোকের দৃষ্টিপথে এই-যে সহস্র খোলা পাতা ইহাতে কি লেখা আছে ভব-ভবানীর প্রেম-গাথা– নিরাসক্ত নিরাকাঙক্ষ ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বর কেমনে দিলেন ধরা সুকোমল দুর্বল সুন্দর বাহুর করুণ আকর্ষণে – কিছু নাহি চাহি যাঁর তিনি কেন চাহিলেন– ভালোবাসিলেন নির্বিকার– পরিলেন পরিণয়পাশ। এই-যে প্রেমের লীলা ইহারই কাহিনী বহে হে শৈল, তোমার যত শিলা।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো, দিক্‌-দিগন্ত ঢাকি। আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো, আমরা খাঁচার পাখি– হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর, আজি কি আসিল প্রলয়রাত্রি ঘোর। চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া। চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া? দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?– তোমাপানে চাই, কাঁদিয়া শুধাই আমরা খাঁচার পাখি।ফাল্গুন এলে সহসা দখিনপবন হতে মাঝে মাঝে রহি রহি আসিত সুবাস সুদূরকুঞ্জভবন হতে অপূর্ব আশা বহি। হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর, মাঝে মাঝে যবে রজনী হইত ভোর, কী মায়ামন্ত্রে বন্ধনদুখ নাশিয়া খাঁচার কোণেতে প্রভাত পশিত হাসিয়া ঘনমসী-আঁকা লোহার শলাকা সোনার সুধায় মাখি।– নিখিল বিশ্ব পাইতাম প্রাণে আমরা খাঁচার পাখি।আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা কিছুই না যায় দেখা– আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়া, হোথা পড়ে নি সোনার রেখা। হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর, আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর। আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে– কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে। মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন তোমারে না দেয় ব্যথা। পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন লয়ে বৃথা আকুলতা। হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর, তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর। সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া, সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া– “নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ কহো আমাদের ডাকি, মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আজু সখি মুহু মুহু আজু সখি , মুহু মুহু গাহে পিক কুহু কুহু , কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু       দোঁহার পানে চায় । যুবনমদবিলসিত পুলকে হিয়া উলসিত , অবশ তনু অলসিত       মূরছি জনু যায় । আজু মধু চাঁদনী প্রাণউনমাদনী , শিথিল সব বাঁধনী ,       শিথিল ভই লাজ । বচন মৃদু মরমর, কাঁপে রিঝ থরথর , শিহরে তনু জরজর       কুসুমবনমাঝ । মলয় মৃদু কলয়িছে , চরণ নহি চলয়িছে , বচন মুহু খলয়িছে ,       অঞ্চল লুটায় । আধফুট শতদল বায়ুভরে টলমল আঁখি জনু ঢলঢল       চাহিতে নাহি চায় । অলকে ফুল কাঁপয়ি কপোলে পড়ে ঝাঁপয়ি , মধু-অনলে তাপয়ি ,       খসয়ি পড়ু পায় । ঝরই শিরে ফুলদল , যমুনা বহে কলকল , হাসে শশি ঢলঢল —       ভানু মরি যায় । আতার বিচি আতার বিচি নিজে পুঁতে পাব তাহার ফল, দেখব ব'লে ছিল মনে বিষম কৌতূহল।        তখন আমার বয়স ছিল নয়, অবাক লাগত কিছুর থেকে কেন কিছুই হয়। দোতলাতে পড়ার ঘরের বারান্দাটা বড়ো, ধুলো বালি একটা কোণে করেছিলুম জড়ো। সেথায় বিচি পুঁতেছিলুম অনেক যত্ন করে, গাছ বুঝি আজ দেখা দেবে, ভেবেছি রোজ ভোরে। জানলাটার পূর্বধারে টেবিল ছিল পাতা, সেইখানেতে পড়া চলত; পুঁথিপত্র খাতা রোজ সকালে উঠত জমে দুর্ভাবনার মতো; পড়া দিতেন, পড়া নিতেন মাস্টার মন্মথ। পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ যেত ঐ দিকে, গোল হত সব বানানেতে, ভুল হত সব ঠিকে। অধৈর্য অসহ্য হত, খবর কে তার জানে কেন আমার যাওয়া-আসা ঐ কোণটার পানে। দু মাস গেল, মনে আছে, সেদিন শুক্রবার-- অঙ্কুরটি দেখা দিল নবীন সুকুমার। অঙ্ক-কষার বারান্দাতে চুনসুরকির কোণে অপূর্ব সে দেখা দিল, নাচ লাগালো মনে। আমি তাকে নাম দিয়েছি আতা গাছের খুকু, ক্ষণে ক্ষণে দেখতে যেতেম, বাড়ল কতটুকু। দুদিন বাদেই শুকিয়ে যেত সময় হলে তার, এ জায়গাতে স্থান নাহি ওর করত আবিষ্কার; কিন্তু যেদিন মাস্টার ওর দিলেন মৃত্যুদণ্ড, কচিকচি পাতার কুঁড়ি হল খণ্ড খণ্ড, আমার পড়ার ত্রুটির জন্যে দায়ী করলেন ওকে, বুক যেন মোর ফেটে গেল, অশ্রু ঝরল চোখে। দাদা বললেন, কী পাগলামি, শান-বাঁধানো মেঝে, হেথায় আতার বীজ লাগানো ঘোর বোকামি এ যে। আমি ভাবলুম সারা দিনটা বুকের ব্যথা নিয়ে, বড়োদের এই জোর খাটানো অন্যায় নয় কি এ। মূর্খ আমি ছেলেমানুষ, সত্য কথাই সে তো, একটু সবুর করলেই তা আপনি ধরা যেত। আত্ম-অপমান মোছো তবে অশ্রুজল , চাও হাসিমুখে বিচিত্র এ জগতের সকলের পানে । মানে আর অপমানে সুখে আর দুখে নিখিলের ডেকে লও প্রসন্ন পরানে । কেহ ভালোবাসে কেহ নাহি ভালোবাসে , কেহ দূরে যায় কেহ কাছে চলে আসে — আপনার মাঝে গৃহ পেতে চাও যদি আপনারে ভুলে তবে থাকো নিরবধি । ধনীর সন্তান আমি , নহি গো ভিখারি , হৃদয়ে লুকানো আছে প্রেমের ভাণ্ডার — আমি ইচ্ছা করি যদি বিলাইতে পারি গভীর সুখের উৎস হৃদয় আমার । দুয়ারে দুয়ারে ফিরি মাগি অন্নপান কেন আমি করি তবে আত্ম-অপমান !  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) আত্মশত্রুতা খোঁপা আর এলোচুলে বিবাদ হামাশা, পাড়ার লোকেরা জোটে দেখিতে তামাশা। খোঁপা কয় এলোচুল, কী তোমার ছিরি! এলো কয়, খোঁপা তুমি রাখো বাবুগিরি। খোঁপা কহে, টাক ধরে হই তবে খুশি। তুমি যেন কাটা পড়ো, এলো কয় রুষি। কবি মাঝে পড়ি বলে, মনে ভেবে দেখ্‌ দুজনেই এক তোরা, দুজনেই এক। খোঁপা গেলে চুল যায়, চুলে যদি টাক— খোঁপা, তবে কোথা রবে তব জয়ঢাক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আত্মাভিমান আপনি কণ্টক আমি , আপনি জর্জর । আপনার মাঝে আমি শুধু ব্যথা পাই । সকলের কাছে কেন যাচি গো নির্ভর — গৃহ নাই , গৃহ নাই , মোর গৃহ নাই ! অতি তীক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র আত্ম – অভিমান সহিতে পারে না হায় তিল অসম্মান । আগেভাগে সকলের পায়ে ফুটে যায় ক্ষুদ্র ব ‘ লে পাছে কেহ জানিতে না পায় । বরঞ্চ আঁধারে রব ধুলায় মলিন , চাহি না চাহি না এই দীন অহংকার — আপন দারিদ্র্যে আমি রহিব বিলীন , বেড়াব না চেয়ে চেয়ে প্রসাদ সবার । আপনার মাঝে যদি শান্তি পায় মন বিনীত ধুলার শয্যা সুখের শয়ন ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) আদর ক’রে মেয়ের নাম আদর ক’রে মেয়ের নাম রেখেছে ক্যালিফর্নিয়া, গরম হল বিয়ের হাট ঐ মেয়েরই দর নিয়া। মহেশদাদা খুঁজিয়া গ্রামে গ্রামে পেয়েছে ছেলে ম্যাসাচুসেট্‌স্‌ নামে, শাশুড়ি বুড়ি ভীষণ খুশি নামজাদা সে বর নিয়া– ভাটের দল চেঁচিয়ে মরে নামের গুণ বর্ণিয়া।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আদিরহস্য বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব, কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব। ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি— যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আধখানা বেল আধখানা বেল খেয়ে কানু বলে,– “কোথা গেল বেল একখানা।’ আধা গেলে শুধু আধা বাকি থাকে, যত করি আমি ব্যাখ্যানা,সে বলে, “তাহলে মহা ঠকিলাম, আমি তো দিয়েছি ষোল আনা দাম।’– হাতে হাতে সেটা করিল প্রমাণ ঝাড়া দিয়ে তার ব্যাগখানা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আধা রাতে গলা ছেড়ে আধা রাতে গলা ছেড়ে মেতেছিনু কাব্যে, ভাবিনি পাড়ার লোকে মনেতে কী ভাববে। ঠেলা দেয় জানলায়, শেষে দ্বার-ভাঙাভাঙি, ঘরে ঢুকে দলে দলে মহা চোখ-রাঙারাঙি– শ্রাব্য আমার ডোবে ওদেরই অশ্রাব্যে। আমি শুধু করেছিনু সামান্য ভনিতাই, সামলাতে পারল না অরসিক জনে তাই– কে জানিত অধৈর্য মোর পিঠে নাববে!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আনন্দেরই সাগর থেকে আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান। দাঁড় ধরে আজ বোস্‌ রে সবাই, টান রে সবাই টান্‌। বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী, ঢেউয়ের ‘পরে ধরব পাড়ি যায় যদি যাক প্রাণ । আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান।কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা, ভয়ের কথা কে বলে আজ– ভয় আছে সব জানা। কোন্‌ শাপে কোন্‌ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে; পালের রশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান। আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান।১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আপন শোভার মূল্য আপন শোভার মূল্য পুষ্প নাহি বোঝে, সহজে পেয়েছে যাহা দেয় তা সহজে।  (স্ফুলিঙ্গ) আপনার রুদ্ধদ্বার-মাঝে আপনার রুদ্ধদ্বার-মাঝে অন্ধকার নিয়ত বিরাজে। আপন-বাহিরে মেলো চোখ, সেইখানে অনন্ত আলোক।  (স্ফুলিঙ্গ) আপনারে তুমি করিবে গোপন আপনারে তুমি করিবে গোপন কী করি। হৃদয় তোমার আঁখির পাতায় থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি। আজ আসিয়াছ কৌতুকবেশে, মানিকের হার পরি এলোকেশে, নয়নের কোণে আধো হাসি হেসে এসেছ হৃদয়পুলিনে। ভুলি নে তোমার বাঁকা কটাক্ষে, ভুলি নে চতুর নিঠুর বাক্যে ভুলি নে। করপল্লবে দিলে যে আঘাত করিব কি তাহে আঁখিজলপাত। এমন অবোধ নহি গো। হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব সহি গো।আজ এই বেশে এসেছ আমায় ভুলাতে। কভু কি আস নি দীপ্ত ললাটে স্নিগ্ধ পরশ বুলাতে। দেখেছি তোমার মুখ কথাহারা– জলে-ছলছল ম্লান আঁখিতারা, দেখেছি তোমার ভয়-ভরে সারা করুণ পেলব মুরতি। দেখেছি তোমার বেদনাবিধুর পলকবিহীন নয়নে মধুর মিনতি। আজি হাসিমাখা নিপুণ শাসনে তরাস আমি যে পাব মনে মনে এমন অবোধ নহি গো হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব সহি গো।(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আপনারে নিবেদন আপনারে নিবেদন সত্য হয়ে পূর্ণ হয় যবে সুন্দর তখনি মূর্তি লভে।  (স্ফুলিঙ্গ) আপনি ফুল লুকায়ে বনছায়ে আপনি ফুল লুকায়ে বনছায়ে গন্ধ তার ঢালে দখিনবায়ে।  (স্ফুলিঙ্গ) আপিস থেকে ঘরে এসে আপিস থেকে ঘরে এসে মিলত গরম আহার্য, আজকে থেকে রইবে না আর তাহার জো। বিধবা সেই পিসি ম’রে গিয়েছে ঘর খালি করে, বদ্দি স্বয়ং করেছে তার সাহায্য।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আফ্রিকা উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে                      স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,    তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে                 রুদ্র সমুদ্রের বাহু            প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে      ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা- বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়                কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।         সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি           সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,      চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,         প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু      মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।           বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে                  বিরূপের ছদ্মবেশে,          শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়            তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।।                  হায় ছায়াবৃতা,               কালো ঘোমটার নীচে       অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ              উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।                  এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে, নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,                     এল মানুষ-ধরার দল গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।                   সভ্যের বর্বর লোভ           নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।     তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে        পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,           দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়                বীভৎস কাদার পিণ্ড চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়           মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা     সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;          শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;             কবির সংগীতে বেজে উঠছিল                  সুন্দরের আরাধনা।।                   আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে    প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,       যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-          অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,                  এসো যুগান্তরের কবি,            আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে               দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;               বলো 'ক্ষমা কর'-                   হিংস্র প্রলাপের মধ্যে                             সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।। আবার আবার কেন রে আমার আবার আবার কেন রে আমার সেই ছেলেবেলা আসে নি ফিরে, হরষে কেমন আবার তা হলে, সাঁতারিয়ে ভাসি সাগরের জলে, খেলিয়ে বেড়াই শিখরী শিরে! স্বাধীন হৃদয়ে ভালো নাহি লাগে, ঘোরঘটাময় সমাজধারা, না, না, আমি রে যাব সেই স্থানে, ভীষণ ভূধর বিরাজে যেখানে, তরঙ্গ মাতিছে পাগল পারা! অয়ি লক্ষ্মী, তুমি লহো লহো ফিরে, ধন ধান্য তুমি যাদেছ মোরে, জাঁকালো উপাধি নাহি আমি চাই, ক্রীতদাসে মম কোনো সুখ নাই, সেবকের দল যাক-না সোরে! তুলে দাও মোরে সেই শৈল-‘পরে, গরজি ওঠে যা সাগর-নাদে, অন্য সাধ নাই, এই মাত্র চাই, ভ্রমিব সেথায় স্বাধীন হৃদে! অধিক বয়স হয় নে তো মম, এখনি বুঝিতে পেরেছি হায়, এ ধরা নহে তো আমার কারণে, আর মম সুখ নাহি এ জীবনে, কবে রে এড়াব এ দেহ দায়! একদা স্বপনে হেরেছিনু আমি, সুবিমল এক সুখের স্থান, কেন রে আমার সে ঘুম ভাঙিল কেন রে আমার নয়ন মেলিল, দেখিতে নীরস এ ধরা খান! এক কালে আমি বেসেছিনু ভালো, ভালোবাসা-ধন কোথায় এবে, বাল্যসখা সব কোথায় এখন– হায় কী বিষাদে ডুবেছে এ মন, আশারও আলোক গিয়েছে নিবে! অমোদ-আসরে আমোদ-সাথীরা, মাতায় ক্ষণেক আমোদ রসে, কিন্তু এ হৃদয়, আমোদের নয়, বিরলে কাঁদি যে একেলা বসে! উঃ কী কঠোর, বিষম কঠোর, সেই সকলের আমোদ-রব, শত্রু কিম্বা সখা নহে যারা মনে, অথচ পদ বা বিভব কারণে, দাও ফিরে মোরে সেই সখাগুলি, বয়সে হৃদয়ে সমান যারা, এখনি যে আমি ত্যেজিব তা হলে, গভীর নিশীথ-আমোদীর দলে, হৃদয়ের ধার কি ধারে তারা! সর্বস্ব রতন, প্রিয়তমা ওরে, তোরেও সুধাই একটি কথা, বল দেখি কিসে আর মম সুখ, হেরিয়েও যবে তোর হাসি-মুখ, কমে না হৃদয়ে একটি ব্যথা! যাক তবে সব, দুঃখ নাহি তায়, শোকের সমাজ নাহিকো চাই, গভীর বিজনে মনের বিরাগে, স্বাধীন হৃদয়ে ভালো যাহা লাগে, সুখে উপভোগ করিব তাই! মানব-মন্ডলী ছেড়ে যাব যাব, বিরাগে কেবল, ঘৃণাতে নয়, অন্ধকারময় নিবিড় কাননে, থাকিব তবুও নিশ্চিন্ত মনে, আমারও হৃদয় আঁধারময়! কেন রে কেন রে হল না আমার, কপোতের মতো বায়ুর পাখা, তা হলে ত্যেজিয়ে মানব-সমাজ, গগনের ছাদ ভেদ করি আজ, থাকিতাম সুখে জলদে ঢাকা!George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা) আবার এরা ঘিরেছে মোর মন আবার এরা ঘিরেছে মোর মন। আবার চোখে নামে যে আবরণ। আবার এ যে নানা কথাই জমে, চিত্ত আমার নানা দিকেই ভ্রমে, দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে, আবার এ যে হারাই শ্রীচরণ।তব নীরব বাণী হৃদয়তলে ডোবে না যেন লোকের কোলাহলে। সবার মাঝে আমার সাথে থাকো, আমায় সদা তোমার মাঝে ঢাকো, নিয়ত মোর চেতনা-‘পরে রাখো আলোকে-ভরা উদার ত্রিভুবন।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে– আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে। এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ, এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান, নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে। আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।১০ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমগাছ এ তো সহজ কথা ,                           অঘ্রানে এই স্তব্ধ নীরবতা                      জড়িয়ে আছে সামনে আমার                                       আমের গাছে ;                           কিন্তু ওটাই সবার চেয়ে                                        দুর্গম মোর কাছে ।                      বিকেল বেলার রোদ্‌দুরে এই চেয়ে থাকি ,                           যে রহস্য ওই তরুটি রাখল ঢাকি                                 গুঁড়িতে তার ডালে ডালে                                       পাতায় পাতায় কাঁপনলাগা তালে                            সে কোন্‌ ভাষা আলোর সোহাগ                                           শূন্যে বেড়ায় খুঁজি ।                                 মর্ম তাহার স্পষ্ট নাহি বুঝি ,                           তবু যেন অদৃশ্য তার চঞ্চলতা                                        রক্তে জাগায় কানে-কানে কথা ,                           মনের মধ্যে বুলায় যে অঙ্গুলি                                 আভাস-ছোঁওয়া ভাষা তুলি                                       সে এনে দেয় অস্পষ্ট ইঙ্গিত                                           বাক্যের অতীত ।                              ওই যে বাকলখানি                                 রয়েছে ওর পর্দা টানি                      ওর ভিতরের আড়াল থেকে আকাশ-দূতের সাথে                                 বলা - কওয়া কী হয় দিনে রাতে ,                           পরের মনের স্বপ্নকথার সম                                 পৌঁছবে না কৌতূহলে মম ।                           দুয়ার-দেওয়া যেন বাসরঘরে                      ফুলশয্যার গোপন রাতে কানাকানি করে ,                                 অনুমানেই জানি ,                           আভাসমাত্র না পাই তাহার বাণী । ফাগুন আসে বছরশেষের পারে ,                                  দিনে-দিনেই খবর আসে দ্বারে ।                      একটা যেন চাপা হাসি কিসের ছলে                                 অবাক শ্যামলতার তলে                      শিকড় হতে শাখে শাখে                                 ব্যাপ্ত হয়ে থাকে ।                      অবশেষে খুশির দুয়ার হঠাৎ যাবে খুলে                                 মুকুলে মুকুলে । আমরা কি সত্যিই চাই শোকের অবসান শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সুহৃদ্‌বরেষুআমরা কি সত্যই চাই শোকের অবসান? আমাদের গর্ব আছে নিজের শোককে নিয়েও। আমাদের অতি তীব্র বেদনাও বহন করে না স্থায়ী সত্যকে-- সান্ত্বনা নেই এমন কথায়; এতে আঘাত লাগে আমাদের দুঃখের অহংকারে। জীবনটা আপন সকল সঞ্চয় ছড়িয়ে রাখে কালের চলাচলের পথে; তার অবিরাম-ধাবিত চাকার তলায় গুরুতর বেদনার চিহ্নও যায় জীর্ণ হয়ে, অস্পষ্ট হয়ে। আমাদের প্রিয়তমের মৃত্যু একটিমাত্র দাবি করে আমাদের কাছে সে বলে--"মনে রেখো।" কিন্তু সংখ্যা নেই প্রাণের দাবির, তার আহ্বান আসে চারিদিক থেকেই মনের কাছে; সেই উপস্থিত কালের ভিড়ের মধ্যে অতীতকালের একটিমাত্র আবেদন কখন হয় অগোচর। যদি বা তার কথাটা থাকে তার ব্যথাটা যায় চলে। তবু শোকের অভিমান জীবনকে চায় বঞ্চিত করতে। স্পর্ধা ক'রে প্রাণের দূতগুলিকে বলে-- খুলব না দ্বার। প্রাণের ফসলখেত বিচিত্র শস্যে উর্বর, অভিমানী শোক তারি মাঝখানে ঘিরে রাখতে চায় শোকের দেবত্র জমি,-- সাধের মরুভূমি বানায় সেখানটাতে, তার খাজনা দেয় না জীবনকে। মৃত্যুর সঞ্চয়গুলি নিয়ে কালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ। সেই অভিযোগে তার হার হতে থাকে দিনে দিনে। কিন্তু চায় না সে হার মানতে; মনকে সমাধি দিতে চায় তার নিজকৃত কবরে। সকল অহংকারই বন্ধন, কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার। ধন জন মান সকল আসক্তিতেই মোহ, নিবিড় মোহ আপন শোকের আসক্তিতে। আমরা চাষ করি আনন্দে আমরা   চাষ করি আনন্দে।           মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥ রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে,   বাঁশের বনে পাতা নড়ে,           বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥ সবুজ প্রাণের গানের লেখা   রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,           মাতে রে কোন্‌ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে। ধানের শিষে পুলক ছোটে-- সকল ধরা হেসে ওঠে           অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে॥(রচনাকাল: 1911) আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা। নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে, এসো নির্মল নীল পথে, এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরিপর্বতে। এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেত শতদল শীতল-শিশির-ঢালা।ঝরা মালতীর ফুলে আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে ভরা গঙ্গার কূলে ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে তোমার চরণমূলে। গুঞ্জরতান তুলিয়ো তোমার সোনার বীণার তারে মৃদু মধু ঝংকারে, হাসিঢালা সুর গলিয়া পড়িবে ক্ষণিক অশ্রুধারে। রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি ঝলকে অলককোণে, পলকের তরে সকরুণ করে বুলায়ো বুলায়ো মনে– সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা, আঁধার হইবে আলা।শান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা, দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা। কোথা হতে চৈত্রমাসে হাঁসের শ্রেণী উড়ে আসে, অঘ্রানেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা আমরা কিছুই জানি নেকো সেই সুদূরের কথা। আমরা জানি গ্রাম ক’খানি, চিনি দশটি গিরি– মা ধরণী রাখেন মোদের কোলের মধ্যে ঘিরি।সে ছিল ওই বনের ধারে ভুট্টাখেতের পাশে যেখানে ওই ছায়ার তলে জলটি ঝ’রে আসে। ঝর্না হতে আনতে বারি জুটত হোথা অনেক নারী, উঠত কত হাসির ধ্বনি তারি ঘরের দ্বারে– সকাল-সাঁঝে আনাগোনা তারি পথের ধারে। মিশত কুলুকুলুধ্বনি তারি দিনের কাজে, ওই রাগিনী পথ হারাত তারি ঘুমের মাঝে।সন্ধ্যাবেলায় সন্ন্যাসী এক, বিপুল জটা শিরে, মেঘে-ঢাকা শিখর হতে নেমে এলেন ধীরে। বিস্ময়েতে আমরা সবে শুধাই, “তুমি কে গো হবে।’ বসল যোগী নিরুত্তরে নির্ঝরিণীর কূলে নীরবে সেই ঘরের পানে স্থির নয়ন তুলে। অজানা কোন্‌ অমঙ্গলে বক্ষ কাঁপে ডরে– রাত্রি হল, ফিরে এলেম যে যার আপন ঘরে।পরদিনে প্রভাত হল দেবদারুর বনে, ঝর্নাতলায় আনতে বারি জুটল নারীগণে। দুয়ার খোলা দেখে আসি– নাই সে খুশি, নাই সে হাসি, জলশূন্য কলসখানি গড়ায় গৃহতলে, নিব-নিব প্রদীপটি সেই ঘরের কোণে জ্বলে। কোথায় সে যে চলে গেল রাত না পোহাতেই, শূন্য ঘরের দ্বারের কাছে সন্ন্যাসীও নেই।চৈত্রমাসে রৌদ্র বাড়ে, বরফ গ’লে পড়ে– ঝর্নাতলায় বসে মোরা কাঁদি তাহার তরে। আজিকে এই তৃষার দিনে কোথায় ফিরে নিঝর বিনে, শুষ্ক কলস ভরে নিতে কোথায় পাবে ধারা। কে জানে সে নিরুদ্দেশে কোথায় হল হারা। কোথাও কিছু আছে কি গো, শুধাই যারে তারে– আমাদের এই আকাশ-ঢাকা দশ পাহাড়ের পারে।গ্রীষ্মরাতে বাতায়নে বাতাস হু হু করে, বসে আছি প্রদীপ-নেবা তাহার শূন্য ঘরে। শুনি বসে দ্বারের কাছে ঝর্না যেন তারেই যাচে– বলে, “ওগো, আজকে তোমার নাই কি কোনো তৃষা। জলে তোমার নাই প্রয়োজন, এমন গ্রীষ্মনিশা?’ আমিও কেঁদে কেঁদে বলি, “হে অজ্ঞাতচারী, তৃষ্ণা যদি হারাও তবু ভুলো না এই বারি।’হেনকালে হঠাৎ যেন লাগল চোখে ধাঁধা, চারি দিকে চেয়ে দেখি নাই পাহাড়ের বাধা। ওই-যে আসে, কারে দেখি– আমাদের যে ছিল সে কি। ওগো, তুমি কেমন আছ, আছ মনের সুখে? খোলা আকাশতলে হেথা ঘর কোথা কোন্‌ মুখে? নাইকো পাহাড়, কোনোখানে ঝর্না নাহি ঝরে, তৃষ্ণা পেলে কোথায় যাবে বারিপানের তরে?সে কহিল, “যে ঝর্না বয় সেথা মোদের দ্বারে, নদী হয়ে সে’ই চলেছে হেথা উদার ধারে। সে আকাশ সেই পাহাড় ছেড়ে অসীম-পানে গেছে বেড়ে সেই ধরারেই নাইকো হেথা পাষাণ-বাঁধা বেঁধে।’ “সবই আছে, আমরা তো নেই’ কইনু তারে কেঁদে। সে কহিল করুণ হেসে, “আছ হৃদয়মূলে।’ স্বপন ভেঙে চেয়ে দেখি আছি ঝর্নাকূলে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আমাদের ছোট নদী আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক, রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।আর-পারে আমবন তালবন চলে, গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে। তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাহিবার কালে গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে আচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে। বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে, বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।। আমার এ গান ছেড়েছে তার আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার, তোমার কাছে রাখে নি আর সাজের অহংকার। অলংকার যে মাঝে পড়ে মিলনেতে আড়াল করে, তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার।তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা, মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা। জীবন লয়ে যতন করি’ যদি সকল বাঁশি গড়ি, আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার।কলিকাতা, ১ শ্রাবণ,  ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা, আমি চাহি বন্ধুজন যারা তাহাদের হাতের পরশে মর্তের অন্তিম প্রীতিরসে নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ, নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ। শূন্য ঝুলি আজিকে আমার; দিয়েছি উজাড় করি যাহা কিছু আছিল দিবার, প্রতিদানে যদি কিছু পাই— কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা— তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই পারের খেয়ায় যাব যবে ভাষাহীন শেষের উৎসবে ।  (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু, নয় তো হীনবল - শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে ফেলবে অশ্রুজল। মন্দমধুর সুখে শোভায় প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়। তোমার সাথে জাগতে সে চায় আনন্দে পাগল।নাচ' যখন ভীষণ সাজে তীব্র তালের আঘাত বাজে, পালায় ত্রাসে পালায় লাজে সন্দেহ বিহবল। সেই প্রচন্ড মনোহরে প্রেম যেন মোর বরণ করে, ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার দিক সে রসাতল।৪ আষাঢ় ১৩১৭ কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ৮৯ আমার এই ছোটো কলসিটা পেতে রাখি আমার এই ছোটো কলসিটা পেতে রাখি ঝরনাধারার নিচে। বসে থাকি কোমরে আঁচল বেঁধে, সারা সকালবেলা, শেওলা ঢাকা পিছল পাথরটাতে পা ঝুলিয়ে। এক নিমেষেই ঘট যায় ভরে তার পরে কেবলি তার কানা ছাপিয়ে ওঠে, জল পড়তে থাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বিনা কাজে বিনা ত্বরায়; ঐ যে সূর্যের আলোয় উপচে-পড়া জলের চলে ছুটির খেলা, আমার খেলা ঐ সঙ্গেই ছলকে ওঠে মনের ভিতর থেকে। সবুজ বনের মিনে-করা উপত্যকার নীল আকাশের পেয়ালা, তারি পাহাড়-ঘেরা কানা ছাপিয়ে পড়ছে ঝরঝরানির শব্দ। ভোরের ঘুমে তার ডাক শুনতে পায় গাঁয়ের মেয়েরা। জলের ধ্বনি বেগনি রঙের বনের সীমানা যায় পেরিয়ে, নেমে যায় যেখানে ঐ বুনোপাড়ার মানুষ হাট করতে আসে, তরাই গ্রামের রাস্তা ছেড়ে বাঁকে বাঁকে উঠতে থাকে চড়াই পথ বেয়ে, তার বলদের গলায় রুনুঝুনু ঘণ্টা বাজে, তার বলদের পিঠে শুকনো কাঠের আঁটি বোঝাই-করা। এমনি করে প্রথম প্রহর গেল কেটে। রাঙা ছিল সকালবেলাকার নতুন রৌদ্রের রঙ, উঠল সাদা হয়ে। বক উড়ে চলেছে পাহাড় পেরিয়ে জলার দিকে, শঙ্খচিল উড়ছে একলা ঘন নীলের মধ্যে,ঊর্ধ্বমুখ পর্বতের উধাও চিত্তে নিঃশব্দ জপমন্ত্রের মতো। বেলা হল, ডাক পড়ল ঘরে। ওরা রাগ করে বললে, "দেরি করলি কেন?" চুপ করে থাকি নিরুত্তরে। ঘট ভরতে দেরি হয় না সে তো সবাই জানে; বিনাকাজে উপচে-পড়া-সময় খোওয়ানো, তার খাপছাড়া কথা ওদের বোঝাবে কে? আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।।কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে, খুশি রই আপন মনে- বাতাস বহে সুমন্দ। সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা, শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা। ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে, ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ।।আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত। আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। রচনা: শিলাইদহ ১৭ চৈত্র ১৩১৮ গীতবিতান পূজা ৫৫৯, বিশ্বভারতী ১৩৮০ সং পৃ ২২০ থেকে সংগৃহীত।পাঠান্তর: গীতিমাল্যে (রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী ১৩৮৯ সং, খণ্ড ১১, পৃ ১৩৪) পঙ্‌ক্তি ৭ এ 'আপন-মনে' ছিল 'মনে মনে"। আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে বিশাল ভবে প্রাণের রথে বাহির হতে পারব কবে। প্রবল প্রেমে সবার মাঝে ফিরব ধেয়ে সকল কাজে, হাটের পথে তোমার সাথে মিলন হবে, প্রাণের রথে বাহির হতে পারব কবে।নিখিল আশা-আকাঙক্ষা-ময় দুঃখে সুখে, ঝাঁপ দিয়ে তার তরঙ্গপাত ধরব বুকে। মন্দভালোর আঘাতবেগে, তোমার বুকে উঠব জেগে, শুনব বাণী বিশ্বজনের কলরবে। প্রাণের রথে বাহির হতে পারব কবে।১ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমার কাছে শুনতে চেয়েছ শ্রীমান ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কল্যাণীয়েষুআমার কাছে শুনতে চেয়েছ গানের কথা; বলতে ভয় লাগে, তবু কিছু বলব। মানুষের জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছে আপন সার্থক ভাষা। মানুষের বোধ অবুঝ, সে বোবা, যেমন বোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সেই বিরাট বোবা আপনাকে প্রকাশ করে ইঙ্গিতে, ব্যাখ্যা করে না। বোবা বিশ্বের আছে ভঙ্গি, আছে ছন্দ, আছে নৃত্য আকাশে আকাশে। অণুপরমাণু অসীম দেশে কালে বানিয়েছে আপন আপন নাচের চক্র, নাচছে সেই সীমায় সীমায়; গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ। তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা, ঘাসের ফুল থেকে শুরু ক'রে আকাশের তারা পর্যন্ত। মানুষের বোধের বেগ যখন বাঁধ মানে না, বাহন করতে চায় কথাকে,-- তখন তার কথা হয়ে যায় বোবা, সেই কথাটা খোঁজে ভঙ্গি, খোঁজে ইশারা, খোঁজে নাচ, খোঁজে সুর, দেয় আপনার অর্থকে উলটিয়ে, নিয়মকে দেয় বাঁকা ক'রে। মানুষ কাব্যে রচে বোবার বাণী। মানুষের বোধ যখন বাহন করে সুরকে তখন বিদ্যুচ্চঞ্চল পরমাণুপুঞ্জের মতোই সুরসংঘকে বাঁধে সীমায়, ভঙ্গি দেয় তাকে, নাচায় তাকে বিচিত্র আবর্তনে। সেই সীমায়-বন্দী নাচন পায় গানে-গড়া রূপ। সেই বোবা রূপের দল মিলতে থাকে। সৃষ্টির অন্দরমহলে, সেখানে যত রূপের নটী আছে ছন্দ মেলায় সকলের সঙ্গে নূপুর-বাঁধা চাঞ্চল্যের দোলযাত্রায়। আমি যে জানি এ-কথা যে-মানুষ জানায় বাক্যে হোক সুরে হোক, রেখায় হোক, সে পণ্ডিত। আমি যে রস পাই, ব্যথা পাই, রূপ দেখি, এ-কথা যার প্রাণ বলে গান তারি জন্যে, শাস্ত্রে সে আনাড়ি হলেও তার নাড়িতে বাজে সুর। যদি সুযোগ পাও কথাটা নারদমুনিকে শুধিয়ো, ঝগড়া বাধাবার জন্যে নয়, তত্ত্বের পার পাবার জন্যে সংজ্ঞার অতীতে। আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে আমার     খেলা যখন ছিল তোমার সনে          তখন     কে তুমি তা কে জানত। তখন     ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,          জীবন     বহে যেত অশান্ত।          তুমি     ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত                যেন আমার আপন সখার মতো,          হেসে     তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে                সেদিন    কত-না বন-বনান্ত।ওগো,     সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান          কোনো     অর্থ তাহার কে জানত। শুধু     সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,          সদা     নাচত হৃদয় অশান্ত।          হঠাৎ     খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -                স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,          তোমার     চরণপানে নয়ন করি নত                ভুবন     দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ৬৮ আমার খোলা জানালাতে আমার খোলা জানালাতে শব্দবিহীন চরণপাতে কে এলে গো, কে গো তুমি এলে। একলা আমি বসে আছি অস্তলোকের কাছাকাছি পশ্চিমেতে দুটি নয়ন মেলে। অতিসুদূর দীর্ঘ পথে আকুল তব আঁচল হতে আঁধারতলে গন্ধরেখা রাখি জোনাক-জ্বালা বনের শেষে কখন এলে দুয়ারদেশে শিথিল কেশে ললাটখানি ঢাকি।তোমার সাথে আমার পাশে কত গ্রামের নিদ্রা আসে– পান্থবিহীন পথের বিজনতা, ধূসর আলো কত মাঠের, বধূশূন্য কত ঘাটের আঁধার কোণে জলের কলকথা। শৈলতটের পায়ের ‘পরে তরঙ্গদল ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন তারি আনলে বহন করি। কত বনের শাখে শাখে পাখির যে গান সুপ্ত থাকে এনেছ তাই মৌন নূপুর ভরি।মোর ভালে ওই কোমল হস্ত এনে দেয় গো সূর্য-অস্ত, এনে দেয় গো কাজের অবসান– সত্যমিথ্যা ভালোমন্দ সকল সমাপনের ছন্দ, সন্ধ্যানদীর নিঃশেষিত তান। আঁচল তব উড়ে এসে লাগে আমার বক্ষে কেশে, দেহ যেন মিলায় শূন্য’পরি, চক্ষু তব মৃত্যুসম স্তব্ধ আছে মুখে মম কালো আলোয় সর্বহৃদয় ভরি।যেমনি তব দখিন-পাণি তুলে নিল প্রদীপখানি, রেখে দিল আমার গৃহকোণে, গৃহ আমার এক নিমেষে ব্যাপ্ত হল তারার দেশে তিমিরতটে আলোর উপবনে। আজি আমার ঘরের পাশে গগনপারের কারা আসে অঙ্গ তাদের নীলাম্বরে ঢাকি। আজি আমার দ্বারের কাছে অনাদি রাত স্তব্ধ আছে তোমার পানে মেলি তাহার আঁখি।এই মুহূর্তে আধেক ধরা লয়ে তাহার আঁধার-ভরা কত বিরাম, কত গভীর প্রীতি, আমার বাতায়নে এসে দাঁড়ালো আজ দিনের শেষে– শোনায় তোমায় গুঞ্জরিত গীতি। চক্ষে তব পলক নাহি, ধ্রুবতারার দিকে চাহি তাকিয়ে আছ নিরুদ্দেশের পানে। নীরব দুটি চরণ ফেলে আঁধার হতে কে গো এলে আমার ঘরে আমার গীতে গানে।–কত মাঠের শূন্যপথে, কত পুরীর প্রান্ত হতে, কত সিন্ধুবালুর তীরে তীরে, কত শান্ত নদীর পারে, কত স্তব্ধ গ্রামের ধারে, কত সুপ্ত গৃহদুয়ার ফিরে, কত বনের বায়ুর ‘পরে এলো চুলের আঘাত ক’রে আসিলে আজ হঠাৎ অকারণে। বহু দেশের বহু দূরের বহু দিনের বহু সুরের আনিলে গান আমার বাতায়নে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে সত্য হবে– ওগো সত্য,আমার এমন সুদিন ঘটবে কবে। সত্য সত্য সত্য জপি, সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি, সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব নিখিল ভবে, সত্য, তোমার পূর্ণ প্রকাশ দেখব কবে।তোমায় দূরে সরিয়ে, মরি আপন অসত্যে। কী যে কাণ্ড করি গো সেই ভূতের রাজত্বে। আমার আমি ধুয়ে মুছে তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে, সত্য, তোমায় সত্য হব বাঁচব তবে, তোমার মধ্যে মরণ আমার মরবে কবে।১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭ আমার নয়ন-ভুলানো এলে আমার নয়ন-ভুলানো এলে। আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে। শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণ-রাঙা-চরণ ফেলে নয়ন-ভুলানো এলে।আলোছায়ার আঁচলখানি লুটিয়ে পড়ে বনে বনে, ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে কী কথা কয় মনে মনে। তোমায় মোরা করব বরণ, মুখের ঢাকা করো হরণ, ওই টুকু ওই মেঘাবরণ দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে। নয়ন-ভুলানো এলে।বনদেবীর দ্বারে দ্বারে শুনি গভীর শঙ্খধনি, আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী। কোথায় সোনার নূপুর বাজে, বুঝি আমার হিয়ার মাঝে, সকল ভাবে সকল কাজে পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে– নয়ন-ভুলানো এলে।শান্তিনিকেতন, ৭ ভাদ্র, ১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে                  তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে ॥          নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে          না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে, আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে--                  অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥ ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান                  তোমায় আমার গান।          পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,          জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে-- তুমি অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে          প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে ॥ আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে মরছে সে এই নামের কারাগারে। সকল ভুলে যতই দিবারাতি নামটারে ওই আকাশপানে গাঁথি, ততই আমার নামের অন্ধকারে হারাই আমার সত্য আপনারে।জড়ো করে ধূলির ‘পরে ধূলি নামটারে মোর উচ্চ করে তুলি। ছিদ্র পাছে হয় রে কোনোখানে চিত্ত মম বিরাম নাহি মানে, যতন করি যতই এ মিথ্যারে ততই আমি হারাই আপনারে।২১ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমার পাচকবর গদাধর মিশ্র আমার পাচকবর গদাধর মিশ্র, তারি ঘরে দেখি মোর কুন্তলবৃষ্য। কহিনু তাহারে ডেকে,– “এ শিশিটা এনেছে কে, শোভন করিতে চাও হেঁশেলের দৃশ্য?’সে কহিল, “বরিষার এই ঋতু; সরিষার কহে, “কাঠমুণ্ডার নেপালের গুণ্ডার এই তেলে কেটে যায় জঠরের গ্রীষ্ম। লোকমুখে শুনেছি তো, রাজা-গোলকুণ্ডার এই সাত্ত্বিক তেলে পূজার হবিষ্য। আমি আর তাঁরা সবে চরকের শিষ্য।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে বাঁধব না আজ তোড়ায়, রঙ-বেরঙের সুতোগুলো থাক্‌, থাক্‌ পড়ে ঐ জরির ঝালর। শুনে ঘরের লোকে বলে, "যদি না বাঁধ জড়িয়ে জড়িয়ে ওদের ধরব কী করে, ফুলদানিতে সাজাব কোন্‌ উপায়ে?" আমি বলি, "আজকে ওরা ছুটি-পাওয়া নটী, ওদের উচ্চহাসি অসংযত, ওদের এলোমেলো হেলাদোলা বকুলবনে অপরাহ্নে, চৈত্রমাসের পড়ন্ত রৌদ্রে। আজ দেখো ওদের যেমন-তেমন খেলা, শোনো ওদের যখন-তখন কলধ্বনি, তাই নিয়ে খুশি থাকো।" বন্ধু বললে, "এলেম তোমার ঘরে ভরা পেয়ালার তৃষ্ণা নিয়ে। তুমি খ্যাপার মতো বললে, আজকের মতো ভেঙে ফেলেছি ছন্দের সেই পুরোনো পেয়ালাখানা আতিথ্যের ত্রুটি ঘটাও কেন?" আমি বলি, "চলো না ঝরনাতলায়, ধারা সেখানে ছুটছে আপন খেয়ালে, কোথাও মোটা, কোথাও সরু। কোথাও পড়ছে শিখর থেকে শিখরে, কোথাও লুকোল গুহার মধ্যে। তার মাঝে মাঝে মোটা পাথর পথ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বর্বরের মতো, মাঝে মাঝে গাছের শিকড় কাঙালের মতো ছড়িয়েছে আঙুলগুলো, কাকে ধরতে চায় ঐ জলের ঝিকিমিকির মধ্যে?" সভার লোকে বললে, "এ যে তোমার আবাঁধা বেণীর বাণী, বন্দিনী সে গেল কোথায়?" আমি বলি, "তাকে তুমি পারবে না আজ চিনতে, তার সাতনলী হারে আজ ঝলক নেই, চমক দিচ্ছে না চুনি-বসানো কঙ্কণে।" ওরা বললে, "তবে মিছে কেন? কী পাবে ওর কাছ থেকে?" আমি বলি, "যা পাওয়া যায় গাছের ফুলে ডালে পালায় সব মিলিয়ে। পাতার ভিতর থেকে তার রঙ দেখা যায় এখানে সেখানে, গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ার ঝাপটায়। চারদিকের খোলা বাতাসে দেয় একটুখানি নেশা লাগিয়ে। মুঠোয় করে ধরবার জন্যে সে নয়, তার অসাজানো আটপহুরে পরিচয়কে অনাসক্ত হয়ে মানবার জন্যে তার আপন স্থানে।" আমার মাঝারে যে আছে কে গো সে আমার মাঝারে যে আছে কে গো সে কোন্‌ বিরহিণী নারী? আপন করিতে চাহিনু তাহারে, কিছুতেই নাহি পারি। রমণীরে কে বা জানে– মন তার কোন্‌খানে। সেবা করিলাম দিবানিশি তার, গাঁথি দিনু গলে কত ফুলহার, মনে হল সুখে প্রসন্নমুখে চাহিল সে মোর পানে। কিছু দিন যায়,একদিন হায় ফেলিল নয়নবারি– “তোমাতে আমার কোনো সুখ নাই’ কহে বিরহিণী নারী।রতনে জড়িত নূপুর তাহারে পরায়ে দিলাম পায়ে, রজনী জাগিয়া ব্যজন করিনু চন্দন-ভিজা বায়ে। রমণীরে কে বা জানে– মন তার কোন্‌খানে। কনকখচিত পালঙ্ক’পরে বসানু তাহারে বহু সমাদরে, মনে হল হেন হাসিমুখে যেন চাহিল সে মোর পানে। কিছু দিন যায়, লুটায়ে ধুলায় ফেলিল নয়নবারি– “এ-সবে আমার কোনো সুখ নাই’ কহে বিরহিণী নারী।বাহিরে আনিনু তাহারে, করিতে হৃদয়দিগ্‌বিজয়। সারথি হইয়া রথখানি তার চালানু ধরণীময়। রমণীরে কে বা জানে– মন তার কোন্‌খানে। দিকে দিকে লোক সঁপি দিল প্রাণ, দিকে দিকে তার উঠে চাটুগান, মনে হল তবে দীপ্ত গরবে চাহিল সে মোর পানে। কিছু দিন যায়,মুখ সে ফিরায়, ফেলে সে নয়নবারি– “হৃদয় কুড়ায়ে কোনো সুখ নাই’ কহে বিরহিণী নারী।আমি কহিলাম,”কারে তুমি চাও ওগো বিরহিণী নারী।’ সে কহিল,”আমি যারে চাই,তার নাম না কহিতে পারি।’ রমণীরে কে বা জানে– মন তার কোন্‌খানে। সে কহিল,”আমি যারে চাই তারে পলকে যদি গো পাই দেখিবারে, পুলকে তখনি লব তারে চিনি চাহি তার মুখপানে।’ দিন চলে যায়, সে কেবল হায় ফেলে নয়নের বারি– অজানারে কবে আপন করিব’ কহে বিরহিণী নারী।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আমার মাঝে তোমার লীলা হবে আমার মাঝে তোমার লীলা হবে, তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।      এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,      ঘুচে যাবে সকল অহংকার,      আনন্দময় তোমার এ সংসার           আমার কিছু আর বাকি না রবে।মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।      সব বাসনা যাবে আমার থেমে      মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,      দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে           তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে। আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান, আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে; তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন-মাঝে। যাচি হে তোমার চরম শান্তি, পরানে তোমার পরম কান্তি, আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।১৩১৩ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমার মিলন লাগি তুমি আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে। তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে।           কত কালের সকাল-সাঁঝে           তোমার চরণধ্বনি বাজে,           গোপনে দূত গৃহ-মাঝে                গেছে আমায় ডেকে।ওগো পথিক, আজকে আমার সকল পরাণ ব্যেপে থেকে থেকে হরষ যেন উঠছে কেঁপে কেঁপে           যেন সময় এসেছে আজ,           ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -           বাতাস আসে, হে মহারাজ,                তোমার গন্ধ মেখে। আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি আমার শেষবেলাকার ঘরখানি বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে, তার নাম দেব শ্যামলী। ও যখন পড়বে ভেঙে সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো, মাটির কোলে মিশবে মাটি; ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে; ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না মৃতদিনের প্রেতের বাসা। সেই মাটিতে গাঁথব আমার শেষ বাড়ির ভিত যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি, সব কলঙ্কের মার্জনা, যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে; যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর রক্তলোলুপ হিংস্র নির্ঘোষ গেছে নিঃশব্দ হয়ে। সেই মাটির ছাদের নিচে বসব আমি রোজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোনা এক-একমুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে। মাঘের শেষে যার আমের বোল দক্ষিণের হাওয়ায় অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ। আমি ভালোবেসেছি বাংলাদেশের মেয়েকে; যে-দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন, ওর কচি ধানের চিকন আভা। তাদের কালো চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি ঐ মাটির দিগন্তে নীল বনসীমায় গোধূলির শেষ আলোটির নিমীলনে। প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি সহজে উঠবে জেগে ভোরবেলাকার সোনার কাঠির প্রথম ছোঁওয়ায়; তার চোখ-জুড়ানো শ্যামলিমায় স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চৈত্ররাতের চাঁদের নিদ্রাহারা মিতালিতে। চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে পদ্মার ভাঙনলাগা খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে, গাঙশালিকের হাজার খোপের বাসায়; সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে, পুকুরের পাড়ির উপরে। আমার দু-চোখ ভ'রে মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়, রাঙা পথের ও পারে, যেখানে শুকনো ঘাসের হলদে মাঠে চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গোরু নিরুৎসুক আলস্যে, লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে; যেখানে সাথীবিহীন তালগাছের মাথায় সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা। আজ আমি তোমার ডাকে ধরা দিয়েছি শেষবেলায়। এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে, যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে, নবদূর্বাশ্যামলের করুণ পদস্পর্শে চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়, নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে। আমার সোনার বাংলা কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো-- কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো, মরি হায়, হায় রে-- মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥ তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে, তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি। তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে, মরি হায়, হায় রে-- তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥ ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে, সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে, তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে, মরি হায়, হায় রে-- ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে-- দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে। ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে, মরি হায়, হায় রে-- আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি ॥ আমারে যদি জাগালে আজি নাথ আমারে যদি জাগালে আজি নাথ, ফিরো না তবে ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত। নিবিড় বন-শাখার ‘পরে আষাঢ়-মেঘে বৃষ্টি ঝরে, বাদলভরা আলসভরে ঘুমায়ে আছে রাত। ফিরো না তুমি ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত।বিরামহীন বিজুলিঘাতে নিদ্রাহারা প্রাণ বরষা-জলধারার সাথে গাহিতে চাহে গান। হৃদয় মোর চোখের জলে বাহির হল তিমিরতলে, আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে বাড়ায়ে দুই হাত। ফিরো না তুমি ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত।৩ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমি এই যে সবার সামান্য পথ, পায়ে হাঁটার গলি সে পথ দিয়ে আমি চলি সুখে দুঃখে লাভে ক্ষতিতে, রাতের আঁধার দিনের জ্যোতিতে। প্রতি তুচ্ছ মুহূর্তেরই আবর্জনা করি আমি জড়ো, কারো চেয়ে নইকো অমি বড়ো। চলতে পথে কখনো বা বিঁধছে কাঁটা পায়ে, লাগছে ধুলো গায়ে; দুর্বাসনার এলোমেলো হাওয়া, তারি মধ্যে কতই চাওয়া পাওয়া, কতই বা হারানো, খেয়া ধরে ঘাটে আঘাটায় নদী-পারানো। এমনি করে দিন কেটেছে, হবে সে-দিন সারা বেয়ে সর্বসাধারণের ধারা। শুধাও যদি সবশেষে তার রইল কী ধন বাকী, স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি তা কি! জানি, এমন নাই কিছু যা পড়বে কারো চোখে, স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দুলবে বিশ্বলোকে। নয় সে মানিক, নয় সে সোনা,-- যায় না তারে যাচাই করা, যায় না তারে গোনা। এই দেখো-না শীতের রোদের দিনের স্বপ্নে বোনা সেগুন বনে সবুজ-মেশা সোনা, শজনে গাছে লাগল ফুলের রেশ, হিমঝুরির হৈমন্তী পালা হয়েছে নিঃশেষ। বেগনি ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা স্তব্ধ বটের শাখা ঘোর রহস্যে ঢাকা। ফলসা গাছের ঝরা পাতা গাছের তলা জুড়ে হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে। গোরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে উড়তি ধুলোয় দিকের আঁচল ধূসর ক'রে চলে। নীরবতার বুকের মধ্যখানে দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে। কাজভোলা এই দিন নীল আকাশে পাখির মতো নিঃসীমে হয় নীল। এরি মধ্যে আছি আমি, সব হতে এই দামি। কেননা আজ বুকের কাছে যায় না জানা, আরেকটি সেই দোসর আমি উড়িয়ে চলে বিরাট তাহার ডানা জগতে জগতে অন্তবিহীন ইতিহাসের পথে। এই যে আমার কুয়োতলার কাছে সামান্য ঐ আমের গাছে কখনো বা রৌদ্র খেলায়, কভু শ্রাবণধারা, সারা বয়ষ থাকে আপনহারা সাধারণ এই অরণ্যানীর সবুজ আবরণে, মাঘের শেষে অকারণে ক্ষণকালের গোপন মন্ত্রবলে গভীর মাটির তলে শিকরে তার শিহর লাগে, শাখায় শাখায় হঠাৎ বাণী জাগে,-- "আছি, আছি, এই যে আমি আছি।" পুষ্পোচ্ছ্বাসে ধায় সে বাণী স্বর্গলোকের কাছাকাছি দিকে দিগন্তরে। চন্দ্র সূর্য তারার আলো তারে বরণ করে। এমনি করেই মাঝে মাঝে সোনার কাঠি আনে কভু প্রিয়ার মুগ্ধ চোখে, কভু কবির গানে-- অলস মনের শিয়রেতে কে সে অন্তর্যামী; নিবিড় সত্যে জেগে ওঠে সামান্য এই আমি। যে আমিরে ধূসর ছায়ায় প্রতিদিনের ভিড়ের মধ্যে দেখা সেই আমিরে এক নিমেষের আলোয় দেখি একের মধ্যে একা। সে-সব নিমেষ রয় কি না রয় কোনোখানে, কেউ তাহাদের জানে বা না-ই জানে, তবু তারা জীবনে মোর দেয় তো আনি ক্ষণে ক্ষণে পরম বাণী অনন্তকাল যাহা বাজে বিশ্বচরাচরের মর্মমাঝে "আছি আমি আছি"-- যে বাণীতে উঠে নাচি মহাগগন-সভাঙ্গনে আলোক-অপ্সরী তারার মাল্য পরি। আমি অতি পুরাতন আমি অতি পুরাতন, এ খাতা হালের হিসাব রাখিতে চাহে নূতন কালের। তবুও ভরসা পাই— আছে কোনো গুণ, ভিতরে নবীন থাকে অমর ফাগুন। পুরাতন চাঁপাগাছে নূতনের আশা নবীন কুসুমে আনে অমৃতের ভাষা।  (স্ফুলিঙ্গ) আমি চঞ্চল হে আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি। দিন চলে যায়, আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে, ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার পরশ পাবার প্রয়াসী। আমি সুদূরের পিয়াসি। ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই, সে কথা যে যাই পাসরি।আমি উৎসুক হে, হে সুদূর, আমি প্রবাসী। তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো কী কথা আমায় শুনাও সতত। তব ভাষা শুনে তোমারে হৃদয় জেনেছে তাহার স্বভাষী। হে সুদূর,আমি প্রবাসী। ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ সে কথা যে যাই পাসরি। ‘আমি উন্মনা হে, হে সুদূর,আমি উদাসী। রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায় তরুমর্মরে, ছায়ার খেলায়, কী মুরতি তব নীলাকাশশায়ী নয়নে উঠে গো আভাসি। হে সুদূর,আমি উদাসী। ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাসরি।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আমি চেয়ে আছি আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবা-পানে। স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। নীচে সব-নীচে এ ধূলির ধরণীতে যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে, যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নাই কিছু,        যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে।        স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়, যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়। আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে, সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম        ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।        স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে। স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। নীচে সব নীচে এ ধূলির ধরণীতে যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে, যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নেই কিছু যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে, স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়, যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়। আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে, এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে, সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে। স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।১৫ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আমি বদল করেছি আমার বাসা শ্রীমতী রানী দেবী কল্যাণীয়াসু       ১ আমি বদল করেছি আমার বাসা। দুটিমাত্র ছোটো ঘর আমার আশ্রয়। ছোটো ঘরই আমার মনের মতো। তার কারণ বলি তোমাকে। বড়ো ঘর বড়োর ভান করে মাত্র, আসল বড়োকে বাইরে ঠেকিয়ে রাখে অবজ্ঞায়। আমার ছোটো ঘর বড়োর ভান করে না। অসীমের প্রতিযোগিতার স্পর্ধা তার নেই ধনী ঘরের মূঢ় ছেলের মতো। আকাশের শখ ঘরে মেটাতে চাইনে; তাকে পেতে চাই তার স্বস্থানে, পেতে চাই বাইরে পূর্ণভাবে। বেশ লাগছে। দূর আমার কাছেই এসেছে। জানলার পাশেই বসে বসে ভাবি-- দূর ব'লে যে পদার্থ সে সুন্দর। মনে ভাবি সুন্দরের মধ্যেই দূর। পরিচয়ের সীমার মধ্যে থেকেও সুন্দর যায় সব সীমাকে এড়িয়ে। প্রয়োজনের সঙ্গে লেগে থেকেও থাকে আলগা, প্রতিদিনের মাঝখানে থেকেও সে চিরদিনের। মনে পড়ে এক দিন মাঠ বেয়ে চলেছিলেম পালকিতে অপরাহ্নে; কাহার ছিল আটজন। তার মধ্যে একজনকে দেখলেম যেন কালো পাথরে কাটা দেবতার মূর্তি; আপন কর্মের অপমানকে প্রতিপদে সে চলছিল পেরিয়ে ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে পাখি যেমন যায় উড়ে। দেবতা তার সৌন্দর্যে তাকে দিয়েছেন সুদূরতার সম্মান। এই দূর আকাশ সকল মানুষেরই অন্তরতম; জানলা বন্ধ, দেখতে পাইনে। বিষয়ীর সংসার, আসক্তি তার প্রাচীর, যাকে চায় তাকে রুদ্ধ করে কাছের বন্ধনে। ভুলে যায় আসক্তি নষ্ট করে প্রেমকে, আগাছা যেমন ফসলকে মারে চেপে। আমি লিখি কবিতা, আঁকি ছবি। দূরকে নিয়ে সেই আমার খেলা; দূরকে সাজাই নানা সাজে, আকাশের কবি যেমন দিগন্তকে সাজায় সকালে সন্ধ্যায়। কিছু কাজ করি তাতে লাভ নেই, তাতে লোভ নেই, তাতে আমি নেই। যে কাজে আছে দূরের ব্যাপ্তি তাতে প্রতিমুহূর্তে আছে আমার মহাকাশ। এই সঙ্গে দেখি মৃত্যুর মধুর রূপ, স্তব্ধ নিঃশব্দ সুদূর, জীবনের চারদিকে নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্র; সকল সুন্দরের মধ্যে আছে তার আসন, তার মুক্তি।     ২ অন্য কথা পরে হবে। গোড়াতেই বলে রাখি তুমি চা পাঠিয়েছ, পেয়েছি। এতদিন খবর দিইনি সেটা আমার স্বভাবের বিশেষত্ব। যেমন আমার ছবি আঁকা, চিঠি লেখাও তেমনি। ঘটনার ডাকপিওনগিরি করে না সে। নিজেরই সংবাদ সে নিজে। জগতে রূপের আনাগোনা চলছে, সেই সঙ্গে আমার ছবিও এক-একটি রূপ, অজানা থেকে বেরিয়ে আসছে জানার দ্বারে। সে প্রতিরূপ নয়। মনের মধ্যে ভাঙাগড়া কত, কতই জোড়াতাড়া; কিছু বা তার ঘনিয়ে ওঠে ভাবে, কিছু বা তার ফুটে ওঠে চিত্রে; এতদিন এই সব আকাশবিহারীদের ধরেছি কথার ফাঁদে। মন তখন বাতাসে ছিল কান পেতে, যে ভাব ধ্বনি খোঁজে তারি খোঁজে। আজকাল আছে সে চোখ মেলে। রেখার বিশ্বে খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, দেখবে ব'লে। সে তাকায়, আর বলে, দেখলেম। সংসারটা আকারের মহাযাত্রা। কোন্‌ চির-জাগরূকের সামনে দিয়ে চলেছে, তিনিও নীরবে বলছেন, দেখলেম। আদি যুগে রঙ্গমঞ্চের সম্মুখে সংকেত এল, "খোলো আবরণ।" বাষ্পের যবনিকা গেল উঠে, রূপের নটীরা এল বাহির হয়ে; ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু, তিনি দেখলেন। তাঁর দেখা আর তাঁর সৃষ্টি একই। চিত্রকর তিনি। তাঁর দেখার মহোৎসব দেশে দেশে কালে কালে।  ৩ অসীম আকাশে কালের তরী চলেছে রেখার যাত্রী নিয়ে, অন্ধকারের ভূমিকায় তাদের কেবল আকারের নৃত্য; নির্বাক অসীমের বাণী বাক্যহীন সীমার ভাষায়, অন্তহীন ইঙ্গিতে।-- অমিতার আনন্দসম্পদ ডালিতে সাজিয়ে নিয়ে চলেছে সুমিতা, সে ভাব নয়, সে চিন্তা নয়, বাক্য নয়, শুধু রূপ, আলো দিয়ে গড়া। আজ আদিসৃষ্টির প্রথম মুহূর্তের ধ্বনি পৌঁছল আমার চিত্তে,-- যে ধ্বনি অনাদি রাত্রির যবনিকা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, "দেখো।" এতকাল নিভৃতে আপনি যা বলেছি আপনি তাই শুনেছি, সেখান থেকে এলেম আর-এক নিভৃতে, এখানে আপনি যা আঁকছি, দেখছি তাই আপনি। সমস্ত বিশ্ব জুড়ে দেবতার দেখবার আসন, আমিও বসেছি তাঁরই পাদপীঠে, রচনা করছি দেখা। আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,        বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।       এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর                  জীবন ভ'রে।     না চাহিতে মোরে যা করেছ দান       আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,      দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়       সে মহাদানেরই যোগ্য করে         অতি-ইচ্ছার সংকট হতে               বাঁচায়ে মোরে। আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি        তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-          তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে                যাও যে সরে।        এ যে তব দয়া জানি হায়,    নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,        পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন        তব মিলনেরই যোগ্য করে        আধা- ইচ্ছার সংকট হতে               বাঁচায়ে মোরে। আমি বেসেছিলেম ভালো আমি বেসেছিলেম ভালো সকল দেহে মনে এই ধরণীর ছায়া আলো আমার এ জীবনে। সেই যে আমার ভালোবাসা লয়ে আকুল অকূল আশা ছড়িয়ে দিল আপন ভাষা আকাশনীলিমাতে। রইল গভীর সুখে দুখে, রইল সে-যে কুঁড়ির বুকে ফুল-ফোটানোর মুখে মুখে ফাগুনচৈত্ররাতে। রইল তারি রাখি বাঁধা ভাবী কালের হাতে।  (স্ফুলিঙ্গ) আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে, বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। কে জানে এই গ্রাম, কে জানে এর নাম, খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে– শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে।বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে। কত আষাঢ় মাসে ভিজে মাটির বাসে বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে। সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে।এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়, এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়। এই পুকুরে তারি, সাঁতার-কাটা বারি, ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়। এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়।এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি। কুশল পুছি তারে দাঁড়াত তার দ্বারে লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি। সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি।পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে, দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে। পারের যাত্রিদলে খেয়ার ঘাটে চলে, কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আমি হেথায় থাকি আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান, দিয়ো তোমার জগৎসভায় এইটুকু মোর স্থান। আমি তোমার ভুবন-মাঝে লাগি নি নাথ, কোনো কাজে– শুধু কেবল সুরে বাজে অকাজের এই প্রাণ।নিশায় নীরব দেবালয়ে তোমার আরাধন, তখন মোরে আদেশ কোরো গাইতে হে রাজন্‌। ভোরে যখন আকাশ জুড়ে বাজবে বীণা সোনার সুরে আমি যেন না রই দূরে এই দিয়ো মোর মান।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আয় রে বসন্ত আয় রে বসন্ত, হেথা কুসুমের সুষমা জাগা রে শান্তিস্নিগ্ধ মুকুলের হৃদয়ের গোপন আগারে। ফলেরে আনিবে ডেকে সেই লিপি যাস রেখে, সুবর্ণের তুলিখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগা রে।  (স্ফুলিঙ্গ) আয়না দেখেই চমকে বলে আয়না দেখেই চমকে বলে, “মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে, বেশিদিন আর বাঁচব না তো–‘ ভাবছে বসে একা সে। ডাক্তারেরা লুটল কড়ি, খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি, অবশেষে বাঁচল না সেই বয়স যখন একাশি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) আর আমায় আমি নিজের শিরে বইব না আর আমায় আমি নিজের শিরে বইব না। আর নিজের দ্বারে কাঙাল হয়ে রইব না। এই বোঝা তোমার পায়ে ফেলে বেড়িয়ে পড়ব অবহেলে– কোনো খবর রাখব না ওর, কোনো কথাই কইব না। আমায় আমি নিজের শিরে বইব না।বাসনা মোর যারেই পরশ করে সে, আলোটি তার নিবিয়ে ফেলে নিমেষে। ওরে সেই অশুচি, দুই হাতে তার যা এনেছে চাই নে সে আর, তোমার প্রেমে বাজবে না যা সে আর আমি সইব না আমায় আমি নিজের শিরে বইব না।১৫ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আর নাই রে বেলা নামল ছায়া আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে, এখন চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে। জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে, ওরে ডাকে আমায় পথের ‘পরে সেই ধ্বনিতে। চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।এখন বিজন পথে করে না কেউ আসা-যাওয়া, ওরে প্রেম-নদীতে উঠেছে ঢেউ, উতল হাওয়া। জানি নে আর ফিরব কিনা, কার সাথে আজ হবে চিনা, ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে। চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।১৩ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন। বসন্তের অজস্র সম্মান ভরি দিল তরুশাখা কবির প্রাঙ্গণে নব জন্মদিনের ডালিতে। রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি-- এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ। মনে করি,গান গাই বসন্তবাহারে। আসন্ন বিরহস্বপ্ন ঘনাইয়া নেমে আসে মনে। জানি জন্মদিন এক অবিচিত্র দিনে ঠেকিবে এখনি, মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে। পুষ্পবীথিকার ছায়া এ বিষাদে করে না করুণ, বাজে না স্মৃতির ব্যথা অরণ্যের মর্মরে গুঞ্জনে নির্মম আনন্দ এই উৎসবের বাজাইবে বাঁশি বিচ্ছেদের বেদনারে পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া। আরম্ভ ও শেষ শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে, হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে। আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয় সেইখানে পুনরায় আরম্ভ-উদয়।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) আরশি তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে            হাসিমুখ মেজে, সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে            ফিরে দিল সে যে।                     রাখিল না কিছু আর,                     স্ফটিক সে নির্বিকার                               আকাশের মতো--                     সেথা আসে শশী রবি,                     যায় চলে, তার ছবি                               কোথা হয় গত।একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে            সমাপিলে খেলা আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে            শুক্ল সন্ধ্যাবেলা।                     সে ছায়া খেলারই ছলে                     নিয়েছিনু হিয়াতলে                               হেলাভরে হেসে,                     ভেবেছিনু চুপে চুপে                     ফিরে দিব ছায়ারূপে                               তোমারি উদ্দেশে।সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে            হল প্রাণবান। দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে            তোমার সে দান।                     যদিবা দেখিতে তারে                     পারিতে না চিনিবারে                               অয়ি এলোকেশী--                     আমার পরান পেয়ে                     সে আজি তোমারো চেয়ে                               বহুগুণে বেশি।কেমনে জানিবে তুমি তারে সুর দিয়ে            দিয়েছি মহিমা। প্রেমের অমৃতস্নানে সে যে, অয়ি প্রিয়ে,            হারায়েছে সীমা।                     তোমার খেয়াল ত্যেজে                     পূজার গৌরবে সে যে                               পেয়েছে গৌরব।                     মর্তের স্বপন ভুলে                     অমরাবতীর ফুলে                               লভিল সৌরভ।   ৯ মাঘ, ১৩৩৮ আরো আঘাত সইবে আমার আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারো, আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো। যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরমতানে, নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো।লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা, মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না। জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস, জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো।৪ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আরো একবার যদি পারি আরো একবার যদি পারি খুঁজে দেব সে আসনখানি যার কোলে রয়েছে বিছানো বিদেশের আদরের বাণী।অতীতের পালানো স্বপন আবার করিবে সেথা ভিড়, অস্ফুট গুঞ্জনস্বরে আরবার রচি দিবে নীড়।সুখস্মৃতি ডেকে ডেকে এনে জাগরণ করিবে মধুর, যে বাঁশি নীরব হয়ে গেছে ফিরায়ে আনিবে তার সুর।বাতায়নে রবে বাহু মেলি বসন্তের সৌরভের পথে, মহানিঃশব্দের পদধ্বনি শোনা যাবে নিশীথজগতে।বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে যে প্রেয়সী পেতেছে আসন চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া কানে কানে তাহারি ভাষণ।ভাষা যার জানা ছিল নাকো, আঁখি যার কয়েছিল কথা, জাগায়ে রাখিবে চিরদিন সকরুণ তাহারি বারতা।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) আরোগ্য - ১০ অলস সময়-ধারা বেয়ে মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে। সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে। কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে সুদীর্ঘ অতীতে জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে। এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল, এসেছে মোগল; বিজয়রথের চাকা উড়ায়েছে ধূলিজাল,উড়িয়াছে বিজয়পতাকা। শূন্যপথে চাই, আজ তার কোনো চিহ্ন নাই। নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো। আরবার সেই শূন্যতলে আসিয়াছে দলে দলে লৌহবাঁধা পথে অনলনিশ্বাসী রথে প্রবল ইংরেজ, বিকীর্ণ করেছে তার তেজ। জানি তারো পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল, কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল; জানি তার পণ্যবাহী সেনা জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না। মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে দেখি সেথা কলকলরবে বিপুল জনতা চলে নানা পথে নানা দলে দলে যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে জীবনে মরণে। ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে। ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে। রাজছত্র ভেঙে পড়ে,রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে। গুরুগুরু গর্জন গুন্‌গুন্‌ স্বর দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর। দুঃখ সুখ দিবসরজনী মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে ওরা কাজ করে। আরোগ্য--৯ বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে আতশবাজির খেলা আকাশে আকাশে, সূর্য তারা ল’য়ে যুগযুগান্তের পরিমাপে। অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে। প্রস্থানের অঙ্কে আজ এসেছি যেমনি দীপশিখা ম্লান হয়ে এল, ছায়াতে পড়িল ধরা এ খেলার মায়ার স্বরূপ, শ্লথ হয়ে এল ধীরে সুখ দুঃখ নাট্যসজ্জাগুলি। দেখিলাম, যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে। দেখিলাম চাহি শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।(উদয়ন, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – বিকাল) আলো আসে দিনে দিনে আলো আসে দিনে দিনে, রাত্রি নিয়ে আসে অন্ধকার। মরণসাগরে মিলে সাদা কালো গঙ্গাযমুনার।  (স্ফুলিঙ্গ) আলো তার পদচিহ্ন আলো তার পদচিহ্ন আকাশে না রাখে; চলে যেতে জানে, তাই চিরদিন থাকে।  (স্ফুলিঙ্গ) আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে পান্থ, বিদেশী পান্থ। ঘন্টা বাজিল দূরে ও পারের রাজপুরে, এখনো যে পথে চলেছিস তুই হায় রে পথশ্রান্ত পান্থ, বিদেশী পান্থ।দেখ্‌ সবে ঘরে ফিরে এল, ওরে পান্থ, বিদেশী পান্থ। পূজা সারি দেবালয়ে প্রসাদী কুসুম লয়ে, এখন ঘুমের কর্‌ আয়োজন হায় রে পথশ্রান্ত পান্থ, বিদেশী পান্থ।রজনী আঁধার হয়ে আসে, ওরে পান্থ, বিদেশী পান্থ। ওই-যে গ্রামের ‘পরে দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে– দীপহীন পথে কী করিবি একা হায় রে পথশ্রান্ত পান্থ, বিদেশী পান্থ।এত বোঝা লয়ে কোথা যাস, ওরে পান্থ, বিদেশী পান্থ। নামাবি এমন ঠাঁই পাড়ায় কোথা কি নাই। কেহ কি শয়ন রাখে নাই পাতি হায় রে পথশ্রান্ত পান্থ, বিদেশী পান্থ।পথের চিহ্ন দেখা নাহি যায় পান্থ, বিদেশী পান্থ। কোন্‌ প্রান্তরশেষে কোন্‌ বহুদূর দেশে কোথা তোর রাত হবে যে প্রভাত হায় রে পথশ্রান্ত পান্থ, বিদেশী পান্থ।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায় আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়, আঁধারেতে চলে যায় বাহিরে। ভাবে মনে, বৃথা এই আসা আর যাওয়া, অর্থ কিছুই এর নাহি রে। কেন আসি, কেন হাসি, কেন আঁখিজলে ভাসি, কার কথা বলে যাই, কার গান গাহি রে– অর্থ কিছুই তার নাহি রে।ওরে মন, আয় তুই সাজ ফেলে আয়, মিছে কী করিস নাট-বেদীতে। বুঝিতে চাহিস যদি বাহিরেতে আয়, খেলা ছেড়ে আয় খেলা দেখিতে। ওই দেখ্‌ নাটশালা পরিয়াছে দীপমালা, সকল রহস্য তুই চাস যদি ভেদিতে নিজে না ফিরিলে নাট-বেদীতে।নেমে এসে দূরে এসে দাঁড়াবি যখন– দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি, এই হাসি-রোদনের মহানাটকের অর্থ তখন কিছু বুঝিবি। একের সহিত একে মিলাইয়া নিবি দেখে, বুঝে নিবি, বিধাতার সাথে নাহি যুঝিবি– দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই, জানি আমি তার সাথে আমার আত্মার ভেদ নাই এক আদি জ্যোতি-উৎস হতে চৈতন্যের পুণ্যস্রোতে আমার হয়েছে অভিষেক, ললাটে দিয়েছে জয়লেখ, জানায়েছে অমৃতের আমি অধিকারী; পরম-আমির সাথে যুক্ত হতে পারি বিচিত্র জগতে প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) আলোয় আলোকময় করে হে আলোয় আলোকময় ক’রে হে এলে আলোর আলো। আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো। সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা, যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো।তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ। তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান। তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে, হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো।বোলপুর, ২০ অগ্রহায়ণ, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আশার আলোকে আশার আলোকে জ্বলুক প্রাণের তারা, আগামী কালের প্রদোষ-আঁধারে ফেলুক কিরণধারা।   (স্ফুলিঙ্গ) আশার সীমা সকল আকাশ ,              সকল বাতাস ,            সকল শ্যামল ধরা , সকল কান্তি ,                   সকল শান্তি             সন্ধ্যাগগন - ভরা , যত - কিছু সুখ                যত সুধামুখ ,             যত মধুমাখা হাসি , যত নব নব                 বিলাসবিভব ,              প্রমোদমদিরারাশি , সকল পৃথ্বী ,                    সকল কীর্তি ,               সকল অর্ঘ্যভার , বিশ্বমথন                    সকল যতন ,               সকল রতনহার , সব পাই যদি                 তবু নিরবধি               আরো পেতে চায় মন — যদি তারে পাই                তবে শুধু চাই                একখানি গৃহকোণ । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) আশিষ-গ্রহণ চলিয়াছি রণক্ষেত্রে সংগ্রামের পথে। সংসারবিপ্লবধ্বনি আসে দূর হতে। বিদায় নেবার আগে, পারি যতক্ষণ পরিপূর্ণ করি লই মোর প্রাণমন নিত্য-উচ্চারিত তব কলকণ্ঠস্বরে উদার মঙ্গলমন্ত্রে—হৃদয়ের ‘পরে লই তব শুভস্পর্শ, কল্যাণসঞ্চয়। এই আশীর্বাদ করো, জয়পরাজয় ধরি যেন নম্রচিত্তে করি শির নত দেবতার আশীর্বাদী কুসুমের মতো। বিশ্বস্ত স্নেহের মূর্তি দুঃস্বপ্নের প্রায় সহসা বিরূপ হয়—তবু যেন তায় আমার হৃদয়সুধা না পায় বিকার, আমি যেন আমি থাকি নিত্য আপনার।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) আশীর্বাদ পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের আশীর্ভাষণ    নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,     জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।             অঞ্জন সে কী মধুরাতে             লাগালো কে যে নয়নপাতে,     সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।    এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,     রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।             অপ্সরীর নৃত্যগুলি             তুলির মুখে এনেছ তুলি,     রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।    যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে     কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,             মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে             রঙিন উপহাসি যে হাসে     রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে।    বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,     তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।             বিধির সাথে কেমন ছলে             নীরবে তব আলাপ চলে,     সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত।    ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,     ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।             তব আঁকন-পটের 'পরে             জানি গো চিরদিনের তরে     নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়।    চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,     তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।             তোমার সেই তরুণতাকে             বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,     অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে।    তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,     নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।             ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--             মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা     দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে। আশীর্বাদ ইহাদের করো আশীর্বাদ।         ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি,              নন্দনের এনেছে সম্বাদ,              ইহাদের করো আশীর্বাদ। ছোটো ছোটো হাসিমুখ           জানে না ধরার দুখ,              হেসে আসে তোমাদের দ্বারে। নবীন নয়ন তুলিকৌতুকেতে দুলি দুলি                             চেয়ে চেয়ে দেখে চারি ধারে। সোনার রবির আলো            কত তার লাগে ভালো,              ভালো লাগে মায়ের বদন। হেথায় এসেছে ভুলি,           ধুলিরে জানে না ধূলি,              সবই তার আপনার ধন। কোলে তুলে লও এরে—     এ যেন কেঁদে না ফেরে,              হরষেতে না ঘটে বিষাদ। বুকের মাঝারে নিয়ে            পরিপূর্ণ প্রাণ দিয়ে              ইহাদের করো আশীর্বাদ। নূতন প্রবাসে এসে              সহস্র পথের দেশে              নীরবে চাহিছে চারি ভিতে। এত শত লোক আছে,          এসেছে তোমারি কাছে              সংসারের পথ শুধাইতে। যেথা তুমি লয়ে যাবে           কথাটি না কয়ে যাবে,              সাথে যাবে ছায়ার মতন, তাই বলি, দেখো দেখো,      এ বিশ্বাস রেখো রেখো,              পাথারে দিয়ো না বিসর্জন। ক্ষুদ্র এ মাথার ‘পর                রাখো গো করুণ কর,                  ইহারে কোরো না অবহেলা। এ ঘোর সংসার-মাঝে              এসেছে কঠিন কাজে,          আসে নি করিতে শুধু খেলা। দেখে মুখশতদল                 চোখে মোর আসে জল,          মনে হয় বাঁচিবে না বুঝি—    পাছে সুকুমার প্রাণ                ছিঁড়ে হয় খান্‌-খান্‌          জীবনের পারাবারে বুঝি। এই হাসিমুখগুলি                 হাসি পাছে যায় ভুলি,          পাছে ঘেরে আঁধার প্রমাদ! উহাদের কাছে ডেকে              বুকে রেখে কোলে রেখে           তোমরা করো গো আশীর্বাদ। বলো, ‘সুখে যাও চ '   লে           ভবের তরঙ্গ দ'লে,            স্বর্গ হতে আসুক বাতাস। সুখদুঃখ কোরো হেলা,          সে কেবল ঢেউ-খেলা           নাচিবে তোদের চারি পাশ। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) আষাঢ় নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।      বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,      আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে। এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।      দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি      মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি, রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে। এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে। খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।      পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,      দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ, দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে। খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।      ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,      ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল, ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।                                  - শিলাইদহ                                  ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭ আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে। একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে, সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল; সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল। আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি, কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।শিলাইদহ, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ, চিরজনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো, অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে, স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে। প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে, আমি কিছুই চাইব না তো রইব চেয়ে; সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।শান্তিনিকেতন, ১০ পৌষ, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) আসা-যাওয়ার পথ চলেছে আসা-যাওয়ার পথ চলেছে উদয় হতে অস্তাচলে, কেঁদে হেসে নানান বেশে পথিক চলে দলে দলে। নামের চিহ্ন রাখিতে চায় এই ধরণীর ধুলা জুড়ে, দিন না যেতেই রেখা তাহার ধুলার সাথে যায় যে উড়ে।   (স্ফুলিঙ্গ) আহ্বান জ্বেলে দিয়ে যাও সন্ধ্যাপ্রদীপ বিজন ঘরের কোণে। নামিল শ্রাবণ, কালো ছায়া তার ঘনাইল বনে বনে।বিস্ময় আনো ব্যগ্র হিয়ার পরশ-প্রতীক্ষায় সজল পবনে নীল বসনের চঞ্চল কিনারায়, দুয়ার-বাহির হতে আজি ক্ষণে ক্ষণে তব কবরীর কবরীমালার বারতা আসুক মনে।বাতায়ন হতে উৎসুক উই আঁখি তব মঞ্জীর-ধ্বনি পথ বেয়ে তোমারে কি যায় ডাকি।কম্পিত এই মোর বক্ষের ব্যথা অলকে তোমার আনে কি চঞ্চলতা বকুলবনের মুখরিত সমীরণে। আহ্বানগীত পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ ,     শুনিতে পেয়েছি ওই — সবাই এসেছে লইয়া নিশান ,     কই রে বাঙালি কই ! সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়     বঙ্গসাগরের তীরে , ‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘     ডাকিতেছে ফিরে ফিরে । ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো ,     পথে কেন নাই লোক , সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন —     বেঁচে আছে শুধু শোক । গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে ,     চেয়ে থাকে হিমগিরি , রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে     আসে যায় ফিরি ফিরি । কত - না সংকট , কত - না সন্তাপ     মানবশিশুর তরে , কত - না বিবাদ কত - না বিলাপ     মানবশিশুর ঘরে ! কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস ,     কেহ কারে নাহি মানে , ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস     হৃদয়ের মাঝখানে । হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা ,     সংশয় - আঁধারে যুঝে , কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা —     কে দিবে আলয় খুঁজে ! মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস ,     করিতে হইবে রণ , পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস —     শোনো শোনো সৈন্যগণ ! পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে ,     বাতাস ছুটেছে তাই — গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে      চলিয়াছে কত ভাই । বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা ,     শুনেছে কি তাহা সবে ? জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা     জালদগম্ভীর রবে ? হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ?     আঁখি খুলেছে কি কেহ ? ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ?     ছেড়েছে খেলার গেহ ? কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ?     কেন মরো ভয়ে লাজে ? খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় ,     চলো পৃথিবীর মাঝে । ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে ,     জড়িমাজড়িত তনু , আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে     ঘুমায় কীটের অণু । চারি দিকে তার আপন - উল্লাসে     জগৎ ধাইছে কাজে , চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে     স্বরগসংগীত বাজে ! চারি দিকে তার মানবমহিমা     উঠিছে গগনপানে , খুঁজিছে মানব আপনার সীমা     অসীমের মাঝখানে ! সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস ,     আপনারে জানে বড়ো — আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস ,     ধুলা করিতেছে জড়ো । সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম ,     জগতের রঙ্গভূমি — হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম ,     কেন গো ঘুমাও তুমি । ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে ,     শুনিতেছ হাহাকার — তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে ,     এ সমুদ্র করো পার । মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে ,     তুমি এসো , দাও যোগ — বাধার মতন জড়াও চরণ     এ কী রে করম - ভোগ । তা যদি না পারো সরো তবে সরো ,     ছড়ে দাও তবে স্থান , ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো —     কেন এ বিলাপগান !    ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার ,     ভেবে দেখ্ তোরা কারা , মানবের মতো ধরিয়া আকার ,     কেন রে কীটের পারা ? আছে ইতিহাস , আছে কুলমান ,     আছে মহত্ত্বের খনি — পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান     শোন্ তার প্রতিধ্বনি । খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে     গ্রহতারকার পথ , জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে     উড়াতেন মনোরথ । চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া     তৃষিত - আকুল - প্রাণে দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া     চাহিয়া বিশ্বের পানে । তবে কেন সবে বধির হেথায় ,     কেন অচেতন প্রাণ — বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায়     বিশ্বের আহ্বানগান ! মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে ,     কেন রে বুঝি নে ভাষা ? তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে     কেন রে জাগে না আশা ? উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে ,     কেন রে নাচে না প্রাণ ? নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে ,     কেন রে জাগে না গান ? কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে ,     পড়ে আছি মুখোমুখি — মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে ,     জগতের সুখে সুখী !    চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে ,     চলো জনকোলাহলে — মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে     অসীম আকাশতলে । তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের'পরে ,     নৃত্যগীত নব নব — বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে     এককণ্ঠ হয়ে কব । মানবের সুখ মানবের আশা     বাজিবে আমার প্রাণে , শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা     ফুটিবে আমার গানে । মানবের কাজে মানবের মাঝে     আমরা পাইব ঠাঁই , বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে —     শুনিতে পেয়েছি ভাই ! মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল ,     ফেলো ভিখারির চীর — পরো নব সাজ , ধরো নব বল ,     তোলো তোলো নত শির । তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে     জগতের নিমন্ত্রণ — দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে ,     দাসত্বের আভরণ । সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন ,     হাসিয়া চাহিবে ধীরে , পুরবরবির হিরণ কিরণ     পড়িবে তোমার শিরে । বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া     হৃদয়ের শতদল , জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া     প্রভাতের পরিমল । উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায়     মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ — জগতের লোক সুধার আশায়     সে ভাষা করিবে পান । চাহিবে মোদের মায়ের বদনে ,     ভাসিবে নয়নজলে — বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে     মায়ের চরণতলে । বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে     কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি , গান গেয়ে কবি জগতের তলে     স্থান কিনে দাও তুমি । এক বার কবি মায়ের ভাষায়      গাও জগতের গান — সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় ,     ঘুচে যায় অপমান । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) আহ্বানসংগীত ওরে তুই জগৎ-ফুলের কীট, জগৎ যে তোর শুকায়ে আসিল,      মাটিতে পড়িল খসে-- সারা দিন রাত গুমরি গুমরি      কেবলি আছিস বসে। মড়কের কণা,নিজ হাতে তুই      রচিলি নিজের কারা, আপনার জালে জড়ায়ে পড়িয়া       আপনি হইলি হারা। অবশেষে কারে অভিশাপ দিস       হাহুতাশ করে সারা, কোণে বসে শুধু ফেলিস নিশাস,       ঢালিস বিষের ধারা।জগৎ যে তোর মুদিয়া আসিল,        ফুটিতে নারিল আর, প্রভাত হইলে প্রাণের মাঝারে        ঝরে না শিশিরধার। ফেলিস নিশাস, মরুর বাতাস       জ্বলিস জ্বালাস কত, আপন জগতে আপনি আছিস       একটি রোগের মতো। হৃদয়ের ভার বহিতে পার না,       আছ মাথা নত করে-- ফুটিবে না ফুল, ফলিবে না ফল,       শুকায়ে পড়িবে মরে।রোদন,রোদন, কেবলি রোদন,       কেবলি বিষাদশ্বাস-- লুকায়ে, শুকায়ে, শরীর গুটায়ে       কেবলি কোটরে বাস। নাই কোনো কাজ--মাঝে মাঝে চাস       মলিন আপনা-পানে, আপনার স্নেহে কাতর বচন       কহিস আপন কানে। দিবস রজনী মরীচিকাসুরা       কেবলি করিস পান। বাড়িতেছে তৃষা, বিকারের তৃষা--       ছট্‌ফট্‌ করে প্রাণ। ‘দাও দাও’ ব’লে সকলি যে চাস,       জঠর জ্বলিছে ভুখে-- মুঠি মুঠি ধুলা তুলিয়া লইয়া       কেবলি পুরিস মুখে। নিজের নিশাসে কুয়াশা ঘনায়ে       ঢেকেছে নিজের কায়া, পথ আঁধারিয়া পড়েছে সমুখে       নিজের দেহের ছায়া। ছায়ার মাঝারে দেখিতে না পাও,       শব্দ শুনিলে ডর’-- বাহু প্রসারিয়া চলিতে চলিতে,       নিজেরে আঁকড়ি ধর’। চারি দিকে শুধু ক্ষুধা ছড়াইছে       যে দিকে পড়িছে দিঠ, বিষেতে ভরিলি জগৎ রে তুই       কীটের অধম কীট।আজিকে বারেক ভ্রমরের মতো       বাহির হইয়া আয়, এমন প্রভাতে এমন কুসুম       কেন রে শুকায়ে যায়। বাহিরে আসিয়া উপরে বসিয়া       কেবলি গাহিবি গান, তবে সে কুসুম কহিবে রে কথা,       তবে সে খুলিবে প্রাণ। আকাশে হাসিবে তরুণ তপন,       কাননে ছুটিবে বায়, চারি দিকে তোর প্রাণের লহরী       উথলি উথলি যায়। বায়ুর হিল্লোলে ধরিবে পল্লব       মরমর মৃদু তান, চারি দিক হতে কিসের উল্লাসে       পাখিতে গাহিবে গান। নদীতে উঠিবে শত শত ঢেউ,       গাবে তারা কল কল, আকাশে আকাশে উথলিবে শুধু       হরষের কোলাহল। কোথাও বা হাসি কোথাও বা খেলা       কোথাও বা সুখগান-- মাঝে বসে তুই বিভোর হইয়া,       আকুল পরানে নয়ান মুদিয়া অচেতন সুখে চেতনা হারায়ে       করিবি রে মধুপান। ভুলে যাবি ওরে আপনারে তুই       ভুলে যাবি তোর গান। মোহ ছুটিবে রে নয়নেতে তোর, যে দিকে চাহিবি হয়ে যাবে ভোর, যাহারে হেরিবি তাহারে হেরিয়া       মজিয়া রহিবে প্রাণ। ঘুমের ঘোরেতে গাহিবে পাখি       এখনো যে পাখি জাগে নি, ভোরের আকাশ ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া       উঠিবে বিভাসরাগিণী। জগৎ-অতীত আকাশ হইতে       বাজিয়া উঠিবে বাঁশি, প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া       কোথায় যাইবে ভাসি। উদাসিনী আশা গৃহ তেয়াগিয়া অসীম পথের পথিক হইয়া সুদূর হইতে সুদূরে উঠিয়া       আকুল হইয়া চায়, যেমন বিভোর চকোরের গান ভেদিয়া ভেদিয়া সুদূর বিমান চাঁদের মরণে মরিতে গিয়া       মেঘেতে হারায়ে যায়। মুদিত নয়ান, পরান বিভল, স্তব্ধ হইয়া শুনিবি কেবল, জগতেরে সদা ডুবায়ে দিতেছে       জগৎ-অতীত গান-- তাই শুনি যেন জাগিতে চাহিছে       ঘুমেতে-মগন প্রাণ। জগৎ বাহিরে যমুনাপুলিনে       কে যেন বাজায় বাঁশি, স্বপন-সমান পশিতেছে কানে       ভেদিয়া নিশীথরাশি--এ গান শুনি নি,এ আলো দেখি নি,       এ মধু করিনি পান, এমন বাতাস পরান পুরিয়া       করে নি রে সুধা দান, এমন প্রভাত-কিরণ মাঝার       কখনো করি নি স্নান, বিফলে জগতে লভিনু জনম,       বিফলে কাটিল প্রাণ। দেখ্‌ রে সবাই চলেছে বাহিরে       সবাই চলিয়া যায়, পথিকেরা সবে হাতে হাতে ধরি       শোন্‌ রে কী গান গায়। জগৎ ব্যাপিয়া শোন্‌ রে সবাই       ডাকিতেছে, আয়,আয়-- কেহ বা আগেতে কেহ বা পিছায়ে,       কেহ ডাক শুনে ধায়।অসীম আকাশে স্বাধীন পরানে       প্রাণের আবেগে ছোটে, এ শোভা দেখিলে জড়ের শরীরে       পরান নাচিয়া ওঠে। তুই শুধু ওরে ভিতরে বসিয়া       গুমরি মরিতে চাস! তুই শুধু ওরে করিস রোদন,       ফেলিস দুখের শ্বাস! ভূমিতে পড়িয়া আঁধারে বসিয়া       আপনা লইয়া রত আপনারে সদা কোলেতে তুলিয়া       সোহাগ করিস কত! আর কতদিন কাটিবে এমন,       সময় যে চলে যায়। ওই শোন্‌ ওই ডাকিছে সবাই,       বাহির হইয়া আয়! ইঁটের গাদার নিচে ইঁটের গাদার নিচে ফটকের ঘড়িটা। ভাঙা দেয়ালের গায়ে হেলে-পড়া কড়িটা। পাঁচিলটা নেই, আছে কিছু ইঁট সুরকি। নেই দই সন্দেশ, আছে খই মুড়কি। ফাটা হুঁকো আছে হাতে, গেছে গড়গড়িটা। গলায় দেবার মতো বাকি আছে দড়িটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ইচ্ছামতী যখন যেমন মনে করি           তাই হতে পাই যদি আমি তবে একখানি হই           ইচ্ছামতী নদী । রইবে আমার দখিন ধারে           সূর্য ওঠার পার , বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায়           নামবে অন্ধকার । আমি কইব মনের কথা           দুই পারেরই সাথে , আধেক কথা দিনের বেলায় ,           আধেক কথা রাতে ।       যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই           আপন গাঁয়ের ঘাটে ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই           দূরের মাঠে মাঠে । গাঁয়ের মানুষ চিনি , যারা           নাইতে আসে জলে , গোরু মহিষ নিয়ে যারা           সাঁতরে ওপার চলে । দূরের মানুষ যারা তাদের            নতুনতরো বেশ , নাম জানি নে , গ্রাম জানি নে           অদ্ভুতের একশেষ ।       জলের উপর ঝলোমলো           টুকরো আলোর রাশি । ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন ,           হাততালি আর হাসি । নিচের তলায় তলিয়ে যেথায়           গেছে ঘাটের ধাপ সেইখানেতে কারা সবাই           রয়েছে চুপচাপ । কোণে কোণে আপন মনে           করছে তারা কী কে । আমারই ভয় করবে কেমন           তাকাতে সেই দিকে ।       গাঁয়ের লোকে চিনবে আমার           কেবল একটুখানি । বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে           আমিই সে কি জানি ? একধারেতে মাঠে ঘাটে           সবুজ বরন শুধু , আর - এক ধারে বালুর চরে            রৌদ্র করে ধূ   ধূ । দিনের বেলায় যাওয়া আসা ,           রাত্তিরে থম্   থম্ ! ডাঙার পানে চেয়ে চেয়ে           করবে গা ছম্ ছম্ । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) ইছামতী নদী অয়ি তন্বী ইছামতী, তব তীরে তীরে শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে— শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র তব তটদেশে। বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দিত বেশে ঘনঘোরঘটা-সাথে বজ্রবাদ্যরবে পূর্ববায়ুকল্লোলিত তরঙ্গ-উৎসবে তুলিয়া আনন্দধ্বনি দক্ষিণে ও বামে আশ্রিত পালিত তব দুই-তট-গ্রামে সমারোহে চলে এসো শৈলগৃহ হতে সৌভাগ্যে শোভায় গর্বে উল্লসিত স্রোতে। যখন রব না আমি, রবে না এ গান, তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চরিয়া প্রাণ, তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী, বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী!   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ইতিহাসবিশারদ গণেশ ধুরন্ধর ইতিহাসবিশারদ গণেশ ধুরন্ধর ইজারা নিয়েছে একা বম্বাই বন্দর। নিয়ে সাতজন জেলে দেখে মাপকাঠি ফেলে– সাগরমথনে কোথা উঠেছিল চন্দর, কোথা ডুব দিয়ে আছে ডানাকাটা মন্দর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ইদিলপুরেতে বাস নরহরি শর্মা ইদিলপুরেতে বাস নরহরি শর্মা, হঠাৎ খেয়াল গেল যাবেই সে বর্মা। দেখবে-শুনবে কে যে তাই নিয়ে ভাবনা, রাঁধবে বাড়বে, দেবে গোরুটাকে জাবনা– সহধর্মিণী নেই, খোঁজে সহধর্মা। গেল তাই খণ্ডালা, গেল তাই অণ্ডালে, মহা রেগে গাল দেয় রেলগাড়ি-চণ্ডালে, সাথি খুঁজে সে বেচারা কী গলদ্‌ঘর্মা– বিস্তর ভেবে শেষে গেল সে কোডর্মা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ইয়ারিং ছিল তার দু কানেই ইয়ারিং ছিল তার দু কানেই। গেল যবে স্যাকরার দোকানেই মনে প’ল, গয়না তো চাওয়া যায়, আরেকটা কান কোথা পাওয়া যায়– সে কথাটা নোটবুকে টোকা নেই! মাসি বলে, “তোর মত বোকা নেই।’  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ইস্কুল-এড়ায়নে সেই ছিল বরিষ্ঠ ইস্কুল-এড়ায়নে সেই ছিল বরিষ্ঠ, ফেল-করা ছেলেদের সবচেয়ে গরিষ্ঠ। কাজ যদি জুটে যায় দুদিনে তা ছুটে যায়, চাকরির বিভাগে সে অতিশয় নড়িষ্ঠ– গলদ করিতে কাজে ভয়ানক দ্রঢ়িষ্ঠ।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ইস্টেশন সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি, চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি। ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে, ভাঁটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে কেউ-বা উজান ট্রেনে। সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে, কেউ-বা গাড়ি ফেল্‌ করে তার শেষ-মিনিটের দোষে।           দিনরাত গড়্‌গড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌,           গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।           ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে           কভু পশ্চিমে, কভু পূর্বে। চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি       মনেতে দেয় আনি নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা--       কেবল যাওয়া-আসা। মঞ্চতলে দণ্ডে পলে       ভিড় জমা হয় কত-- পতাকাটা দেয় দুলিয়ে,             কে কোথা হয় গত। এর পিছনে সুখদুঃখ-           ক্ষতিলাভের তাড়া                দেয় সবলে নাড়া।                সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে                ভোঁ ভোঁ ক'রে বাঁশি বাজে সংকেতে।                দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই               কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই। ওদের চলা ওদের পড়ে-থাকায় আর কিছু নেই, ছবির পরে           কেবল ছবি আঁকায়। খানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে           তার পরে যায় মুছে, আত্ম-অবহেলার খেলা           নিত্যই যায় ঘুচে। ছেঁড়া পটের টুকরো জমে           পথের প্রান্ত জুড়ে, তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায়           কোন্‌খানে যায় উড়ে। "গেল গেল' ব'লে যারা           ফুকরে কেঁদে ওঠে ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত           তারাই পিছে ছোটে।                    ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,                    এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।                    মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,                    নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে। চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি--      এই কথাটাইনিলেম মনে মানি। কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা-- আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়,       দেখার জিনিস এটা। কালের পরে যায় চলে কাল,       হয় না কভু হারা ছবির বাহন চলাফেরার ধারা। দুবেলা সেই এ সংসারের       চলতি ছবি দেখা, এই নিয়ে রই যাওয়া-আসাআর       ইস্টেশনে একা।                              এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,           আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।           আসে কারা এক দিক হতে ঐ,           ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ঐ। ঈর্ষার সন্দেহ লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে। দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্‌ পামর? গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ, কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ। সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে। মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু, বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ঈশ্বরের হাস্যমুখ দেখিবারে পাই ঈশ্বরের হাস্যমুখ দেখিবারে পাই যে আলোকে ভাইকে দেখিতে পায় ভাই। ঈশ্বর প্রণামে তবে হাতজোড় হয় যখন ভাইয়ের প্রেমে মিলাই হৃদয়।   (স্ফুলিঙ্গ) উচ্চের প্রয়োজন কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল, হাট ভ’রে দিই আমি কত শস্য ফল। পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ, পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ। বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু। গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) উজ্জ্বলে ভয় তার উজ্জ্বলে ভয় তার, ভয় মিট্‌মিটেতে, ঝালে তার যত ভয় তত ভয় মিঠেতে।ভয় তার পশ্চিমে, ভয় তার পূর্বে, যে দিকে তাকায় ভয় সাথে সাথে ঘুরবে। ভয় তার আপনার বাড়িটার ইঁটেতে, ভয় তার অকারণে অপরের ভিটেতে।ভয় তার বাহিরেতে, ভয় তার অন্তরে, ভয় তার ভূত-প্রেতে, ভয় তার মন্তরে। দিনের আলোতে ভয় সামনের দিঠেতে, রাতের আঁধারে ভয় আপনারি পিঠেতে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে ওই যে তিনি, ও ই যে বাহির পথে। আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি, ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি। ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে ঠাঁই করে তুই নে রে কোনোমতে।কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ, সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ। টান্‌ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া, টান্‌ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া, চল্‌ রে টেনে আলোর অন্ধকারে নগর গ্রামে অরণ্যে পর্বতে।ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি, বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি। রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ। গাইছে না মন মরণজয়ী গান? আকাঙক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো ছুটছে নাকি বিপুল ভবিষ্যতে।গোরাই, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ বিজ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু করকমলেষুবন্ধু, এ যে আমার লজ্জাবতী লতা কী পেয়েছে আকাশ হতে কী এসেছে বায়ুর স্রোতে পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে সে যে প্রাণের কথা। যত্নভরে খুঁজে খুঁজে তোমায় নিতে হবে বুঝে, ভেঙে দিতে হবে যে তার নীরব ব্যাকুলতা। আমার লজ্জাবতী লতা।বন্ধু, সন্ধ্যা এল, স্বপনভরা পবন এরে চুমে। ডালগুলি সব পাতা নিয়ে জড়িয়ে এল ঘুমে। ফুলগুলি সব নীল নয়ানে চুপিচুপি আকাশপানে তারার দিকে চেয়ে চেয়ে কোন্‌ ধেয়ানে রতা। আমার লজ্জাবতী লতা।বন্ধু, আনো তোমার তড়িৎ-পরশ, হরষ দিয়ে দাও, করুণ চক্ষু মেলে ইহার মর্মপানে চাও। সারা দিনের গন্ধগীতি সারা দিনের আলোর স্মৃতি নিয়ে এ যে হৃদয়ভারে ধরায় অবনতা– আমার লজ্জাবতী লতা।বন্ধু, তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা ক্ষুদ্র তাহা নয়, সত্য যেথা কিছু আছে বিশ্ব সেথা রয় এই-যে মুদে আছে লাজে পড়বে তুমি এরি মাঝে– জীবনমৃত্যু রৌদ্রছায়া ঝটিকার বারতা। আমার লজ্জাবতী লতা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ (আরোগ্য) কল্যাণীয় শ্রীসুরেন্দ্রনাথ করবহু লোক এসেছিল জীবনের প্রথম প্রভাতে — কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌতূহলী, কেহ কাজে সঙ্গ দিতে, কেহ দিতে বাধা। আজ যারা কাছে আছ এ নিঃস্ব প্রহরে, পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয় তোমরা আপন দীপ আনিয়াছ হাতে, খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়স্পর্শ দিতে। তোমরা পথিকবন্ধু, যেমন রাত্রির তারা অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল।   পরিপূর্ণ বেদনার ভরে   মুহূর্তেই বুঝি ফেটে পড়ে,   বসন্তের দুরন্ত বাতাসে   নুয়ে বুঝি নমিবে ভূতল—   রসভরে অসহ উচ্ছ্বাসে   থরে থরে ফলিয়াছে ফল। তুমি এসো নিকুঞ্জনিবাসে, এসো মোর সার্থকসাধন।   লুটে লও ভরিয়া অঞ্চল   জীবনের সকল সম্বল,   নীরবে নিতান্ত অবনত   বসন্তের সর্ব-সমর্পণ—   হাসি মুখে নিয়ে যাও যত   বনের বেদননিবেদন। শুক্তিরক্ত নখরে বিক্ষত ছিন্ন করি ফেলো বৃন্তগুলি।   সুখাবেশে বসি লতামূলে   সারাবেলা অলস অঙ্গুলে   বৃথা কাজে যেন অন্যমনে   খেলাচ্ছলে লহো তুলি তুলি—   তব ওষ্ঠে দশনদংশনে   টুটে যাক পূর্ণ ফলগুলি। আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে গুঞ্জরিছে ভ্রমর চঞ্চল।   সারাদিন অশান্ত বাতাস   ফেলিতেছে মর্মরনিশ্বাস,   বনের বুকের আন্দোলনে   কাঁপিতেছে পল্লব-অঞ্চল—   আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে   পুঞ্জ পুঞ্জ ধরিয়াছে ফল।    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ (সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে) শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসুসহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে। লেখার কথা মাথায় যদি জোটে তখন আমি লিখতে পারি হয়তো। কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে, যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো। যদি দেখ খোলসটা খসিয়াছে বৃদ্ধের, যদি দেখ চপলতা প্রলাপেতে সফলতা ফলেছে জীবনে সেই ছেলেমিতে-সিদ্ধের, যদি ধরা পড়ে সে যে নয় ঐকান্তিক ঘোর বৈদান্তিক, দেখ গম্ভীরতায় নয় অতলান্তিক, যদি দেখ কথা তার কোনো মানে-মোদ্দার হয়তো ধারে না ধার, মাথা উদ্‌ভ্রান্তিক, মনখানা পৌঁছয় খ্যাপামির প্রান্তিক, তবে তার শিক্ষার দাও যদি ধিক্কার– সুধাব, বিধির মুখ চারিটা কী কারণে। একটাতে দর্শন করে বাণী বর্ষণ, একটা ধ্বনিত হয় বেদ-উচ্চারণে। একটাতে কবিতা রসে হয় দ্রবিতা, কাজে লাগে মনটারে উচাটনে মারণে। নিশ্চিত জেনো তবে, একটাতে হো হো রবে পাগলামি বেড়া ভেঙে উঠে উচ্ছ্বাসিয়া। তাই তারি ধাক্কায় বাজে কথা পাক খায়, আওড় পাকাতে থাকে মগজেতে আসিয়া। চতুর্মুখের চেলা কবিটিরে বলিলে তোমরা যতই হাস, রবে সেটা দলিলে। দেখাবে সৃষ্টি নিয়ে খেলে বটে কল্পনা, অনাসৃষ্টিতে তবু ঝোঁকটাও অল্প না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরশান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩৪৩ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) উদবৃত্ত তব দক্ষিণ হাতের পরশ কর নি সমর্পন। লেকে আর মেছে তব আলো ছায়া ভাবনার প্রাঙ্গণে খনে খনে আলিপন।বৈশাখে কৃশ নদী পূর্ণ স্রোতের প্রসাদ না দিল যদি শুধু কুণ্ঠিত বিশীর্ণ ধারা তীরের প্রান্তে জাগালো পিয়াসী মন।যতটুকু পাই ভীরু বাসনার অঞ্জলিতে নাই বা উচ্ছলিল, সারা দিবসের দৈন্যের শেসে সঞ্চয় সে যে সারা জীবনের স্বপ্নের আয়োজন। উদারচরিতানাম্ প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্‌ ধিক্‌ করে তারে কাননে সবাই— সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) উদাসীন হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি ,       ছুটি নে কাহারো পিছুতে । মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই                      কিছুতে ।       নির্ভয়ে ধাই সুযোগ - কুযোগ বিছুরি ,       খেয়াল - খবর রাখি নে তো কোনো - কিছুরি—       উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধা                        সুখে পড়ে থাকি নিচুতেই , থাকি                                         নিচুতে ।                  হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি                          ছুটি নে কাহারো পিছুতে—                  মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই                                        কিছুতে । যেথা - সেথা ধাই , যাহা - তাহা পাই—         ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে । তাই ব'লে কিছু কাড়াকাড়ি ক'রে                         কাড়ি নে ।             যাহা যেতে চায় ছেড়ে দিই তারে তখুনি ,             বকি নে কারেও , শুনি নে কাহারো বকুনি—             কথা যত আছে মনের তলায় তলিয়ে                  ভুলেও কখনো সহসা তাদের                                  নাড়ি নে ।                  যেথা - সেথা ধাই , যাহা - তাহা পাই—                          ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে ।                  তাই ব'লে কিছু তাড়াতাড়ি ক'রে                                      কাড়ি নে । মন - দে'য়া - নে'য়া অনেক করেছি ,             মরেছি হাজার মরণে— নূপুরের মতো বেজেছি চরণে                         চরণে ।             আঘাত করিয়া ফিরেছি দুয়ারে দুয়ারে ,             সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে—             অশ্রু গাঁথিয়া রচিয়াছি কত মালিকা ,                        রাঙিয়াছি তাহা হৃদয় - শোণিত—                                  বরনে ।                   মন - দে'য়া - নে'য়া অনেক করেছি ,                         মরেছি হাজার মরণে                  নূপুরের মতো বেজেছি চরণে                                  চরণে । এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,             মন ফেলে তাই ছুটেছি ; তাড়াতাড়ি ক'রে খেলাঘরে এসে                         জুটেছি ।             বুকভাঙা বোঝা নেব না রে আর তুলিয়া ,             ভুলিবার যাহা একেবারে যাব ভুলিয়া— যাঁর বেড়ি তাঁরে ভাঙা বেড়িগুলি ফিরায়ে      বহুদিন পরে মাথা তুলে আজ                              উঠেছি ।      এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,             মন ফেলে তাই ছুটেছি ।      তাড়াতাড়ি ক'রে খেলাঘরে এসে                              জুটেছি । কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত             আগে পড়িত না নয়নে— তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম                   চয়নে ।          মধুকরসম ছিনু সঞ্চয়প্রয়াসী ;          কুসুমকান্তি দেখি নাই , মধু - পিয়াসী— বকুল কেবল দলিত করেছি আলসে                     ছিলাম যখন নিলীন বকুল—                                  শয়নে ।                কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত                      আগে পড়িত না নয়নে —                তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম                                  চয়নে । দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি ,             মন নাহি মোর কিছুতে ; তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি                        পিছুতে ।         সবলে কারেও ধরি নে বাসনা - মুঠিতে ,         দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে—         যখনি ছেড়েছি উচ্চে উঠার দুরাশা               হাতের নাগালে পেয়েছি সবারে                                 নিচুতে ।                দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি,                       মন নাহি মোর কিছুতে—                তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি                                  পিছুতে ।কাব্যগ্রন্থ - ক্ষণিকা উদ্বোধন প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে           প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে      প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে           শুধায়ে ফিরিল, সুর খুঁজে পাবে কবে।                এসো এসো সেই নব সৃষ্টির কবি                নবজাগরণ-যুগপ্রভাতের রবি।           গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে           তরুণী উষার শিশিরস্নানের কালে,                আলো-আঁধারের আনন্দবিপ্লবে।      সে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে      শুনাও তাহারে আগমনীসংগীতে           যে জাগায় চোখে নূতন দেখার দেখা।     যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে      বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,           বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।                অবাক আলোর লিপি যে বহিয়া আনে                নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,                নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে           বিহ্বল প্রাতে সংগীতসৌরভে,           দূর-আকাশের অরুণিম উৎসবে।           যে জাগায় জাগে পূজার শঙ্খধ্বনি,           বনের ছায়ায় লাগায় পরশমণি,                যে জাগায় মোছে ধরার মনের কালি                মুক্ত করে সে পূর্ণ মাধুরী-ডালি। জাগে সুন্দর, জাগে নির্মল, জাগে আনন্দময়ী--                    জাগে জড়ত্বজয়ী।           জাগো সকলের সাথে           আজি এ সুপ্রভাতে, বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহো আপনার স্থান--      তোমার জীবনে সার্থক হোক                    নিখিলের আহ্বান। উপকথা মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায়।       বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায় । আর্দ্র - পাখা পাখিগুলি               গীতগান গেছে ভুলি ,           নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা । বসিয়া আঁধার ঘরে                 বরষার ঝরঝরে           মনে পড়ে কত উপকথা । কভু মনে লয় হেন                   এ - সব কাহিনী যেন           সত্য ছিল নবীন জগতে । উড়ন্ত মেঘের মতো                 ঘটনা ঘটিত কত ,           সংসার উড়িত মনোরথে । রাজপুত্র অবহেলে                   কোন্ দেশে যেত চলে           কত নদী কত সিন্ধু - পার । সরোবর - ঘাট আলা,                 মণি হাতে নাগবালা           বসিয়া বাঁধিত কেশভার । সিন্ধুতীরে কত দূরে                কোন্ রাক্ষসের পুরে           ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি । হাসি তার মণিকণা                 কেহ তাহা দেখিত না ,           মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি । সাত ভাই একত্তরে                  চাঁপা হয়ে ফুটিত রে ,           এক বোন ফুটিত পারুল । সম্ভব কি অসম্ভব                   একত্রে আছিল সব —           দুটি ভাই সত্য আর ভুল । বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা,                না ছিল কঠিন বাধা ,           নাহি ছিল বিধির বিধান , হাসিকান্না লঘুকায়া                  শরতের আলোছায়া ,           কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ ! আজি ফুরায়েছে বেলা ,            জগতের ছেলেখেলা           গেছে আলো - আঁধারের দিন । আর তো নাই রে ছুটি ,            মেঘরাজ্য গেছে টুটি ,           পদে পদে নিয়ম - অধীন । মধ্যাহ্নে রবির দাপে                বাহিরে কে রবে তাপে,           আলয় গড়িতে সবে চায় । যবে হায় প্রাণপণ                   করে তাহা সমাপন           খেলারই মতন ভেঙে যায় ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) উপলক্ষ কাল বলে,আমি সৃষ্টি করি এই ভব। ঘড়ি বলে, তা হলে আমিও স্রষ্টা তব।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) উপহার স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই,            কী যে দেব তাই ভাবনা— যত দিতে সাধ করি মনে মনে            খুঁজে - পেতে সে তো পাব না। আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে            সবাই করেছে একতা, বাকি যে এখন আছে কত ধন            না তোলাই ভালো সে কথা। সোনা রুপো আর হীরে জহরত            পোঁতা ছিল সব মাটিতে, জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে            নে গেছে যে যার বাটীতে। টাকাকড়ি মেলা আছে টাকশালে,              নিতে গেলে পড়ি বিপদে।    বসনভূষণ আছে সিন্দুকে,            পাহারাও আছে ফি পদে।    এ যে সংসারে আছি মোরা সবে            এ বড়ো বিষম দেশ রে। ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চ ' লে গিয়ে            ভুলে গিয়ে সব শেষ রে। ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন            যে যাহারে পারে দেয় যে। তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়,            কত মিছে হয় ব্যয় যে। স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত,            চোখে যদি দেখা যেত রে, কতগুলো তবে জিনিস-পত্র            বল্‌ দেখি দিত কে তোরে। তাই ভাবি মনে কী ধন আমার            দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে, খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি,            বাস্‌, সব যাবে চুকিয়ে।    কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে            কিনে রেখে দেব মন তোর— এমন আমার মন্ত্রণা নেই,            জানি নে ও হেন মন্তর। নবীন জীবন, বহুদূর পথ            পড়ে আছে তোর সুমুখে; স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই            পিয়ে নিস এক চুমুকে। সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে           নব আশে নব পিয়াসে, যদি ভুলে যাস, সময় না পাস,           কী যায় তাহাতে কী আসে। মনে রাখিবার চির-অবকাশ           থাকে আমাদেরই বয়সে, বাহিরেতে যার না পাই নাগাল            অন্তরে জেগে রয় সে।    পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী            আপনার মনে সিধে সে কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে            যায় চলে দেশ-বিদেশে— যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে            এসেছে আদরে গলিয়া তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে            অজানা সাগরে চলিয়া। অচল শিখর ছোটো নদীটিরে            চিরদিন রাখে স্মরণে— যতদূর যায় স্নেহধারা তার            সাথে যায় দ্রুতচরণে। তেমনি তুমিও থাক না'ই থাক,            মনে কর মনে কর না, পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া               আমার আশিস-ঝরনা।। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ঊর্মি, তুমি চঞ্চলা ঊর্মি, তুমি চঞ্চলা নৃত্যদোলায় দাও দোলা, বাতাস আসে কী উচ্ছ্বাসে— তরণী হয় পথভোলা।   (স্ফুলিঙ্গ) ঋতুসংহার হে কবীন্দ্র কালিদাস, কল্পকুঞ্জবনে নিভৃতে বসিয়া আছ প্রেয়সীর সনে যৌবনের যৌবরাজ্যসিংহাসন-’পরে। মরকতপাদপীঠ-বহনের তরে রয়েছে সমস্ত ধরা, সমস্ত গগন স্বর্ণরাজছত্র ঊর্ধ্বে করেছে ধারণ শুধু তোমাদের-’পরে; ছয় সেবাদাসী ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি; নব নব পাত্র ভরি ঢালি দেয় তারা নব নব বর্ণময়ী মদিরার ধারা তোমাদের তৃষিত যৌবনে; ত্রিভুবন একখানি অন্তঃপুর, বাসরভবন। নাই দুঃখ, নাই দৈন্য, নাই জনপ্রাণী— তুমি শুধু আছ রাজা, আছে তব রানী।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ঋষি কবি বলেছেন পরি দ্যাবা পৃথিবী সদ্য আয়ম্‌   উপাতিষ্ঠে প্রথমজামৃতস্য।                --অথর্ববেদঋষি কবি বলেছেন-- ঘুরলেন তিনি আকাশ পৃথিবী, শেষকালে এসে দাঁড়ালেন প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে। কে এই প্রথমজাত অমৃত, কী নাম দেব তাকে? তাকেই বলি নবীন, সে নিত্যকালের। কত জরা কত মৃত্যু বারে বারে ঘিরল তাকে চারদিকে, সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে বারে বারে সে বেরিয়ে এল, প্রতিদিন ভোরবেলার আলোতে ধ্বনিত হল তার বাণী-- "এই আমি প্রথমজাত অমৃত।" দিন এগোতে থাকে, তপ্ত হয়ে ওঠে বাতাস, আকাশ আবিল হয়ে ওঠে ধুলোয়, বৃদ্ধ সংসারের কর্কশ কোলাহল আবর্তিত হতে থাকে দূর হতে দূরে। কখন দিন আসে আপন শেষপ্রান্তে, থেমে যায় তাপ, নেমে যায় ধুলো, শান্ত হয় কর্কশ কণ্ঠের পরিণামহীন বচসা, আলোর যবনিকা সরে যায় দিক্‌সীমার অন্তরালে। অন্তহীন নক্ষত্রলোকে, ম্লানিহীন অন্ধকারে জেগে ওঠে বাণী-- "এই আমি প্রথমজাত অমৃত।" শতাব্দীর পর শতাব্দী আপনাকে ঘোষণা করে মানুষের তপস্যায়; সে-তপস্যা ক্লান্ত হয়, হোমাগ্নি যায় নিবে, মন্ত্র হয় অর্থহীন, জীর্ণ সাধনার শতছিদ্র মলিন আচ্ছাদন ম্রিয়মাণ শতাব্দীকে ফেলে ঢেকে। অবশেষে কখন শেষ সূর্যাস্তের তোরণদ্বারে নিঃশব্দচরণে আসে যুগান্তের রাত্রি, অন্ধকারে জপ করে শান্তিমন্ত্র শবাসনে সাধকের মতো। বহুবর্ষব্যাপী প্রহর যায় চলে, নবযুগের প্রভাত শুভ্র শঙ্খ হাতে দাঁড়ায় উদয়াচলের স্বর্ণশিখরে, দেখা যায়, তিমিরধারায় ক্ষালন করেছে কে ধূলিশায়ী শতাব্দীর আবর্জনা; ব্যাপ্ত হয়েছে অপরিসীম ক্ষমা অন্তর্হিত অপরাধের কলঙ্কচিহ্নের 'পরে। পেতেছে শান্ত জ্যোতির আসন প্রথমজাত অমৃত। বালক ছিলেম, নবীনকে তখন দেখেছি আনন্দিত চোখে ধরণীর সবুজে, আকাশের নীলিমায়। দিন এগোল। চলল জীবনযাত্রার রথ এ-পথে ও-পথে। ক্ষুব্ধ অন্তরের তাপতপ্ত নিঃশ্বাস। শুকনো পাতা ওড়াল দিগন্তে। চাকার বেগে বাতাস ধুলায় হল নিবিড়। আকাশচর কল্পনা উড়ে গেল মেঘের পথে, ক্ষুধাতুর কামনা মহ্যাহ্নের রৌদ্রে ঘুরে বেড়াল ধরাতলে ফলের বাগানে ফসলের খেতে আহূত অনাহূত। আকাশে পৃথিবীতে এ জন্মের ভ্রমণ হল সারা পথে বিপথে। আজ এসে দাঁড়ালেম প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে। এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক; চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি ভেদ করি কুহেলিকা সত্যের অমৃত রূপ করুক প্রকাশ। সর্বমানুষের মাঝে এক চিরমানবের আনন্দকিরণ চিত্তে মোর হোক বিকীরিত। সংসারের ক্ষুব্ধতার স্তব্ধ ঊর্ধ্বলোকে নিত্যের যে শান্তিরূপ তাই যেন দেখে যেতে পারি, জীবনের জটিল যা বহু নিরর্থক, মিথ্যার বাহন যাহা সমাজের কৃত্রিম মূল্যেই, তাই নিয়ে কাঙালের অশান্ত জনতা দূরে ঠেলে দিয়ে এ জন্মের সত্য অর্থ স্পষ্ট চোখে জেনে যাই যেন সীমা তার পেরোবার আগে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) এ কথা সে কথা মনে আসে এ কথা সে কথা মনে আসে, বর্ষাশেষে শরতের মেঘ যেন ফিরিছে বাতাসে। কাজের বাঁধনহারা শূন্যে করে মিছে আনাগোনা; কখনো রুপালি আঁকে, কখনো ফুটায়ে তোলে সোনা। অদ্ভুত মূর্তি সে রচে দিগন্তের কোণে, রেখার বদল করে পুনঃ পুনঃ যেন অন্যমনে। বাষ্পের সে শিল্পকাজ যেন আনন্দের অবহেলা– কোনোখানে দায় নেই, তাই তার অর্থহীন খেলা। জাগার দায়িত্ব আছে, কাজ নিয়ে তাই ওঠাপড়া। ঘুমের তো দায় নেই, এলোমেলো স্বপ্ন তাই গড়া। মনের স্বপ্নের ধাত চাপা থাকে কাজের শাসনে, বসিতে পায় না ছুটি স্বরাজ-আসনে। যেমনি সে পায় ছাড়া খেয়ালে খেয়ালে করে ভিড়, স্বপ্ন দিয়ে রচে যেন উড়ুক্ষু পাখির কোন্‌ নীড়। আপনার মাঝে তাই পেতেছি প্রমাণ– স্বপ্নের এ পাগলামি বিশ্বের আদিম উপাদান। তাহারে দমনে রাখে, ধ্রুব করে সৃষ্টির প্রণালী কর্তৃত্ব প্রচণ্ড বলশালী। শিল্পের নৈপুণ্য এই উদ্দামেরে শৃঙ্খলিত করা, অধরাকে ধরা।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) এ কী অকৃতজ্ঞতার বৈরাগ্য প্রলাপ ক্ষণে ক্ষণে এ কী অকৃতজ্ঞতার বৈরাগ্য প্রলাপ ক্ষণে ক্ষণে বিকারের রোগীসম অকস্মাৎ ছুটে যেতে চাওয়া আপনার আবেষ্টন হতে।                              ধন্য এ জীবন মোর— এই বাণী গাব আমি, প্রভাতে প্রথম-জাগা পাখি যে সুরে ঘোষণা করে আপনাতে আনন্দ আপন। দুঃখ দেখা দিয়েছিল, খেলায়েছি দুঃখ-নাগিনীরে ব্যথার বাঁশির সুরে। নানা রন্ধ্রে প্রাণের ফোয়ারা করিয়াছি উৎসারিত অন্তরের নানা বেদনায়। এঁকেছি বুকের রক্তে মানসীর ছবি, বারবার ক্ষণিকের পটে, মুছে গেছে রাত্রির শিশির জলে,মুছে গেছে আপনার আগ্রহ স্পর্শনে,—তবু আজো আছে তারা সূক্ষ্ম রেখা স্বপনের চিত্রশালা জুড়ে, আছে তারা অতীতের শুষ্ক মাল্যগন্ধে বিজড়িত। কালের অঞ্জলি হতে ভ্রষ্ট কত অব্যক্ত মাধুরী রসে পূর্ণ করিয়াছে থরে থরে মনের বাতাস, প্রভাত আকাশ যথা চেনা অচেনার বহু সুরে কূজনে গুঞ্জনে ভরা। অনভিজ্ঞ নব কৈশোরের কম্পমান হাত হতে স্খলিত প্রথম বরমালা কণ্ঠে ওঠে নাই, তাই আজিও অক্লিষ্ট অমলিন আছে তার অস্ফুট কলিকা। সমস্ত জীবন মোর তাই দিয়ে পুষ্প-মুকুটিত। পেয়েছি যা অযাচিত প্রেমের অমৃতরস , পাইনি যা বহু সাধনায় দুই মিশেছিল মোর পীড়িত যৌবনে। কল্পনায় বাস্তবে মিশ্রিত, সত্যে ছলনায়, জয়ে পরাজয়ে বিচিত্রিত নাট্যধারা বেয়ে, আলোকিত রঙ্গমঞ্চে প্রচ্ছন্ন নেপথ্যভূমে, সুগভীর সৃষ্টিরহস্যের যে প্রকাশ পর্বে পর্বে পর্যায়ে পর্যায়ে উদ্বারিতআমার জীবন রচনায়, তাহারে বাহন করি, স্পর্শ করেছিল মোরে কতদিন জাগরণক্ষণে অপরূপ অনিবর্চনীয়। আজি বিদায়ের বেলা স্বীকার করিব তারে, সে আমার বিপুল বিস্ময়। গাব আমি, হে জীবন, অস্তিত্বের সারথী আমার , বহু রণক্ষেত্র তুমি করিয়াছ পার, আজি লয়ে যাও মৃত্যুর সংগ্রামশেষে নবতর বিজয়যাত্রায়।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) এ জন্মের সাথে লগ্ন স্বপ্নের জটিল সূত্র যবে এ জন্মের সাথে লগ্ন স্বপ্নের জটিল সূত্র যবে ছিঁড়িল অদৃশ্যঘাতে, সে মুহূর্তে দেখিনু সম্মুখে অজ্ঞাত সুদীর্ঘ পথ অতি দূর নিঃসঙ্গের দেশে নিরাসক্ত নির্মমের পানে। অকস্মাৎ মহা একা ডাক দিল একাকীরে প্রলয় তোরণ চূড়া হতে । অসংখ্য অপরিচিত জ্যোতিষ্কের নিঃশব্দতা মাঝে মেলিনু নয়ন; জানিলাম একাকীর নাই ভয়, ভয় জনতার মাঝে; একাকীর কোনো লজ্জা নাই, লজ্জা শুধু যেথা সেথা যার তার চক্ষুর ইঙ্গিতে। বিশ্বসৃষ্টিকর্তা একা, সৃষ্টিকাজে আমার আহ্বানবিরাট নেপথ্যলোকে তাঁর আসনের ছায়াতলে। পুরাতন আপনার ধ্বংসোন্মুখ মলিন জীর্ণতা ফেলিয়া পশ্চাতে, রিক্তহস্তে মোরে বিরচিতে হবে নূতন জীবনচ্ছবি শূন্য দিগন্তের ভূমিকায়।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) এ জীবনে সুন্দরের পেয়েছি মধুর আশীর্বাদ এ জীবনে সুন্দরের পেয়েছি মধুর আশীর্বাদ, মানুষের প্রীতিপাত্রে পাই তাঁরি সুধার আস্বাদ! দুঃসহ দুঃখের দিনে অক্ষত অপরাজিত আত্মারে লয়েছি আমি চিনে। আসন্ন মৃত্যুর ছায়া যেদিন করেছি অনুভব সেদিন ভয়ের হাতে হয় নি দুর্বল পরাভব। মহত্তম মানুষের স্পর্শ হতে হই নি বঞ্চিত, তাঁদের অমৃতবাণী অন্তরেতে করেছি সঞ্চিত। জীবনের বিধাতার যে দাক্ষিণ্য পেয়েছি জীবনে তাহারি স্মরণলিপি রাখিলাম সকৃতজ্ঞমনে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি– অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি এই মহামন্ত্রখানি, চরিতার্থ জীবনের বাণী। দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহার মধুরসে ক্ষয় নাই তার। তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে– সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে। শেষ স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীর ব’লে যাব তোমার ধূলির তিলক পরেছি ভালে, দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে। সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি, এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) এই করেছ ভালো এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো। আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো।যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার। অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে, বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।৪ আষাঢ়,১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ; পাশে তোমার হবে কি আজ স্থান। দেখতে পাব অপূর্ব সেই মুখ, রইবে চেয়ে হৃদয় উৎসুক, বারে বারে চরণ ঘিরে ঘিরে ফিরবে আমার অশ্রুভরা গান?সাহস করে তোমার পদমূলে আপনারে আজ ধরি নাই যে তুলে, পড়ে আছি মাটিতে মুখ রেখে, ফিরিয়ে পাছে দাও হে আমার দান। আপনি যদি আমার হাতে ধরে কাছে এসে উঠতে বল মোরে, তবে প্রাণের অসীম দরিদ্রতা এই নিমেষেই হবে অবসান।বোলপুর, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এই তো তোমার প্রেম এই তো তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ। এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন। এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ-‘পরে, এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃত ক্ষরণ। এই তো তোমার প্রেম,ওগো হৃদয়হরণ।প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে। এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে। তোমারি মুখ ওই নুয়েছে, মুখে আমার চোখ থুয়েছে, আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার– আমার এই মলিন অহংকার। দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার। আমার এই মলিন অহংকার।এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে, হল রে তাঁর আসার সময় আশা এল প্রাণে। স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে, সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার। ওরে আয় সময় নেই যে আর।১৯ আশ্বিন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে তব আনন্দ মহাসংগীতে বাজে। তোমার আকাশ, উদার আলোকধারা, দ্বার ছোটো দেখে ফেরে না যেন গো তারা, ছয় ঋতু যেন সহজ নৃত্যে আসে অন্তরে মোর নিত্য নূতন সাজে।তব আনন্দ আমার অঙ্গে মনে বাধা যেন নাহি পায় কোনো আবরণে। তব আনন্দ পরম দুঃখে মম জ্বলে উঠে যেন পুণ্য আলোকসম, তব আনন্দ দীনতা চূর্ণ করি’ ফুটে উঠে ফেটে আমার সকল কাজে।১৩ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এই যেন ভক্তের মন এই যেন ভক্তের মন বট-অশ্বত্থের বন। রচে তার সমুদার কায়াটি ধ্যানঘন গম্ভীর ছায়াটি, মর্মরে বন্দন-মন্ত্র জাগায় রে বৈরাগি কোন সমীরণ।   (স্ফুলিঙ্গ) এই সে পরম মূল্য এই সে পরম মূল্য আমার পুজার— না পূজা করিলে তবু শাস্তি নাই তার।   (স্ফুলিঙ্গ) এক গাঁয়ে আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ, তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি তাহার গানে আমার নাচে বুক। তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে, যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে-- আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি, মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক-- তাদের বনের অনেক মধুমাছি মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক। তাদের ঘাটে পূজার জবামালা ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে, তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে-- আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।আমাদের এই গ্রামের গলি-'পরে আমের বোলে ভরে আমের বন, তাদের খেতে যখন তিসি ধরে মোদের খেতে তখন ফোটে শণ। তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে। তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা, আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে-- আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।কাব্যগ্রন্থ - ক্ষণিকা এক পরিণাম শেফালি কহিল, আমি ঝরিলাম, তারা! তারা কহে, আমারো তো হল কাজ সারা— ভরিলাম রজনীর বিদায়ের ডালি আকাশের তারা আর বনের শেফালি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) একই পথ দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) একটা খোঁড়া ঘোড়ার ‘পরে একটা খোঁড়া ঘোড়ার ‘পরে চড়েছিল চাটুর্জে,পড়ে গিয়ে কী দশা তার হয়েছিল হাঁটুর যে! বলে কেঁদে, “ব্রাহ্মণেরে বইতে ঘোড়া পারল না যে সইত তাও, মরি আমি তার থেকে এই অধিক লাজে– লোকের মুখের ঠাট্টা যত বইতে হবে টাটুর যে!’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) একটি একটি করে তোমার একটি একটি করে তোমার পুরানো তার খোলো, সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো। ভেঙে গেছে দিনের মেলা, বসবে সভা সন্ধ্যাবেলা, শেষের সুর যে বাজাবে তার আসার সময় হল– সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।দুয়ার তোমার খুলে দাও গো আঁধার আকাশ-‘পরে, সপ্তলোকের নীরবতা আসুক তোমার ঘরে। এতদিন যে গেয়েছ গান আজকে তারি হোক অবসান, এ যন্ত্র যে তোমার যন্ত্র সেই কথাটাই ভোলো। সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।তিনধরিয়া, ৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) একটি নমস্কারে, প্রভু একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে।ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌ তব ভবন-দ্বারে।নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে।হংস যেমন মানসযাত্রী, তেমনি সারা দিবসরাত্রি একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে।২৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) একটি শিশির বিন্দু বহু দিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে       বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,             দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।      দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া       ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে             একটি শিশিরবিন্দু।(স্ফুলিঙ্গ হতে সংগৃহীত) এক-তরফা হিসাব সাতাশ, হলে না কেন এক-শো সাতাশ, থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস। সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা, কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায় একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায় আগন্তুক। রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ সূর্যনক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে যে আলোক আসে নামি’ ধরণীর শ্যামল ললাটে সে তোমার চক্ষু চুম্বি’ তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; দূর যুগান্তর হতে মহাকাল-যাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তেরে তব শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি’ অনন্তের পানে সেথা তুমি একা যাত্রী, অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) একদিন তুচ্ছ আলাপের ফাঁক দিয়ে একদিন তুচ্ছ আলাপের ফাঁক দিয়ে কোন্‌ অভাবনীয় স্মিতহাস্যে আমার আত্মবিহ্বল যৌবনটাকে দিলে তুমি দোলা; হঠাৎ চমক দিয়ে গেল তোমার মুখে একটি অমৃতরেখা; আর কোনোদিন তার দেখা মেলেনি। জোয়ারের তরঙ্গলীলায় গভীর থেকে উৎক্ষিপ্ত হল চিরদুর্লভের একটি রত্নকণা শতলক্ষ ঘটনার সমুদ্র-বেলায়। এমনি এক পলকে বুকে এসে লাগে অপরিচিত মুহূর্তের চকিত বেদনা প্রাণের আধখোলা জালনায় দূর বনান্ত থেকে পথ-চলতি গানে। অভূতপূর্বের অদৃশ্য অঙ্গুলি বিরহের মীড় লাগিয়ে যায় হৃদয়-তারে বৃষ্টিধারামুখর নির্জন প্রবাসে, সন্ধ্যাযূথীর করুণ স্নিগ্ধ গন্ধে, রেখে দিয়ে যায় কোন্‌ অলক্ষ্যে আকস্মিক আপন স্খলিত উত্তরীয়ের স্পর্শ। তার পরে মনে পড়ে একদিন সেই বিস্ময়-উন্মনা নিমেষটিকে অকারণে অসময়ে; মনে পড়ে শীতের মধ্যাহ্নে, যখন গোরুচরা শস্যরিক্ত মাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে বেলা যায় কেটে; মনে পড়ে, যখন সঙ্গহারা সায়াহ্নের অন্ধকারে সূর্যাস্তের ওপার থেকে বেজে ওঠে ধ্বনিহীন বীণার বেদনা। একলা আমি বাহির হলেম একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে, সাথে সাথে কে চলে মোর নীরব অন্ধকারে। ছাড়াতে চাই অনেক করে ঘুরে চলি, যাই যে সরে, মনে করি আপদ গেছে, আবার দেখি তারে।ধরণী সে কাঁপিয়ে চলে– বিষম চঞ্চলতা। সকল কথার মধ্যে সে চায় কইতে আপন কথা। সে যে আমার আমি, প্রভু, লজ্জা তাহার নাই যে কভু, তারে নিয়ে কোন্‌ লাজে বা যাব তোমার দ্বারে।১৪ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) একা আমি ফিরব না আর একা আমি ফিরব না আর এমন করে– নিজের মনে কোণে কোণে মোহের ঘোরে।তোমায় একলা বাহুর বাঁধন দিয়ে ছোটো করে ঘিরতে গিয়ে আপনাকে যে বাঁধি কেবল আপন ডোরে।যখন আমি পাব তোমায় নিখিলমাঝে সেইখনে হৃদয় পাব হৃদয়রাজে। এই   চিত্ত আমার বৃন্ত কেবল তারি ‘পরে বিশ্বকমল; তারি ‘পরে পূর্ণ প্রকাশ দেখাও মোরে।২ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) একা ব’সে সংসারের প্রান্ত-জানালায় একা ব’সে সংসারের প্রান্ত-জানালায় দিগন্তের নীলিমায় চোখে পড়ে অনন্তের ভাষা। আলো আসে ছায়ায় জড়িত শিরীষের গাছ হতে শ্যামলের স্নিগ্ধ সখ্য বহি। বাজে মনে– নহে দূর,নহে বহু দূর। পথরেখা লীন হল অস্তগিরিশিখর-আড়ালে, স্তব্ধ আমি দিনান্তের পান্থশালা-দ্বারে, দূরে দীপ্তি দেয় ক্ষণে ক্ষণে শেষতীর্থমন্দিরের চূড়া। সেথা সিংহদ্বারে বাজে দিন-অবসানের রাগিণী যার মূর্ছনায় মেশা এ জন্মের যা-কিছু সুন্দর, স্পর্শ যা করেছে প্রাণ দীর্ঘ যাত্রাপথে পূর্ণতার ইঙ্গিত জানায়ে। বাজে মনে– নহে দূর,নহে বহু দূর।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) একাকিনী একাকিনী বসে থাকে আপনারে সাজায়ে যতনে।                 বসনে ভূষণে           যৌবনেরে করে মূল্যবান।              নিজেরে করিবে দান                   যার হাতে           সে অজানা তরুণের সাথে         এই যেন দূর হতে তার কথা-বলা।                  এই প্রসাধনকলা,           নয়নের এ-কজ্জললেখা, উজ্জ্বল বসন্তীরঙা অঞ্চলের এ-বঙ্কিমরেখা           মণ্ডিত করেছে দেহ প্রিয়সম্ভাষণে।                   দক্ষিণপবনে অস্পষ্ট উত্তর আসে শিরীষের কম্পিত ছায়ায়।       এইমতো দিন যায়,              ফাগুনের গন্ধে ভরা দিন।       সায়াহ্নিক দিগন্তের সীমন্তে বিলীন             কুঙ্কুম-আভায় আনে                  উৎকণ্ঠিত প্রাণে                     তুলি' দীর্ঘশ্বাস--           অভাবিত মিলনের আরক্ত আভাস। এখনো অঙ্কুর যাহা এখনো অঙ্কুর যাহা তারি পথ-পানে প্রত্যহ প্রভাতে রবি আশীৰ্বাদ আনে।   (স্ফুলিঙ্গ) এপারে-ওপারে রাস্তার ওপারে      বাড়িগুলি ঘেঁষাঘেঁষি সারে সারে।           ওখানে সবাই আছে ক্ষীণ যত আড়ালের আড়ে-আড়ে কাছে-কাছে।               যা-খুশী প্রসঙ্গ নিয়ে                    ইনিয়ে-বিনিয়ে           নানা কণ্ঠে বকে যায় কলস্বরে।                    অকারণে হাত ধরে;                যে যাহারে চেনে       পিঠেতে চাপড় দিয়ে নিয়ে যায় টেনে                    লক্ষ্যহীন অলিতে গলিতে,           কথা-কাটাকাটি চলে গলাগলি চলিতে চলিতে। বৃথাই কুশলবার্তা জানিবার ছলে      প্রশ্ন করে বিনা কৌতূহলে।           পরস্পরে দেখা হয়,                বাঁধা ঠাট্টা করে বিনিময়।      কোথা হতে অকস্মাৎ ঘরে ঢুকে                হেসে ওঠে অহেতু কৌতুকে।       "আনন্দবাজার' হতে সংবাদ-উচ্ছিষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে           ছুটির মধ্যাহ্নবেলা বিষম বিতর্কে যায় কেটে। সিনেমা-নটীর ছবি নিয়ে দুই দলে           রূপের তুলনা-দ্বন্দ্ব চলে,    উত্তাপ প্রবল হয় শেষে           বন্ধুবিচ্ছেদের কাছে এসে।      পথপ্রান্তে দ্বারের সম্মুখে বসি ফেরিওয়ালাদের সাথে হুঁকো-হাতে দর-কষাকষি।           একই সুরে দম দিয়ে বার বার    গ্রামোফোনে চেষ্টা চলে থিয়েটরি গান শিখিবার। কোথাও কুকুরছানা ঘেউ-ঘেউ আদরের ডাকে                চমক লাগায় বাড়িটাকে।           শিশু কাঁদে মেঝে মাথা হানি,   সাথে চলে গৃহিণীর অসহিষ্ণু তীব্র ধমকানি।           তাস-পিটোনির শব্দ, নিয়ে জিত হার                থেকে থেকে বিষম চিৎকার। যেদিন ট্যাক্সিতে চ'ড়ে জামাই উদয় হয় আসি           মেয়েতে মেয়েতে হাসাহাসি,                    টেপাটেপি, কানাকানি, অঙ্গরাগে লাজুকেরে সাজিয়ে দেবার টানাটানি।           দেউরিতে ছাতে বারান্দায় নানাবিধ আনাগোনা ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলে যায়।      হেথা দ্বার বন্ধ হয় হোথা দ্বার খোলে, দড়িতে গামছা ধুতি ফর্‌ফর্‌ শব্দ করি ঝোলে।           অনির্দিষ্ট ধ্বনি চারি পাশে             দিনে রাত্রে কাজের আভাসে।      উঠোনে অনবধানে-খুলে-রাখা কলে                জল বহে যায় কলকলে;      সিঁড়িতে আসিতে যেতে           রাত্রিদিন পথ স্যাঁত্‌সেঁতে।       বেলা হলে ওঠে ঝন্‌ঝনি               বাসন-মাজার ধ্বনি।       বেড়ি হাতা খুন্তি রান্নাঘরে ঘরকরনার সুরে ঝংকার জাগায় পরস্পরে।      কড়ায় সর্ষের তেল চিড়্‌বিড়্‌ ফোটে, তারি মধ্যে কইমাছ অকস্মাৎ ছ্যাঁক্‌ করে ওঠে। বন্দেমাতরম্‌-পেড়ে শাড়ি নিয়ে তাঁতিবউ ডাকে          বউমাকে।     খেলার ট্রাইসিকেলে ছড়্‌ ছড়্‌ খড়্‌ খড়্‌ আঙিনায় ঘোরে কার ছেলে। যাদের উদয় অস্ত আপিসের দিক্‌চক্রবালে      তাদের গৃহিণীদের সকালে বিকালে দিন পরে দিন যায়      দুইবার জোয়ার-ভাঁটায়          ছুটি আর কাজে। হোথা পড়া-মুখস্থের একঘেয়ে অশ্রান্ত আওয়াজে                ধৈর্য হারাইছে পাড়া,           এগ্‌জামিনেশনে দেয় তাড়া। প্রাণের প্রবাহে ভেসে           বিবিধ ভঙ্গীতে ওরা মেশে।                চেনা ও অচেনা           লঘু আলাপের ফেনা                    আবর্তিয়া তোলে           দেখাশোনা আনাগোনা গতির হিল্লোলে। রাস্তার এপারে আমি নিঃশব্দ দুপুরে           জীবনের তথ্য যত ফেলে রেখে দূরে                জীবনের তত্ত্ব যত খুঁজি                    নিঃসঙ্গ মনের সঙ্গে যুঝি,      সারাদিন চলেছে সন্ধান           দুরূহের ব্যর্থ সমাধান।        মনের ধূসর কূলে প্রাণের জোয়ার মোরে একদিন দিয়ে গেছে তুলে।     চারি দিকে তীক্ষ্ণ আলো ঝক্‌ঝক্‌ করে           রিক্তরস উদ্দীপ্ত প্রহরে।                ভাবি এই কথা--      ওইখানে ঘনীভূত জনতার বিচিত্র তুচ্ছতা        এলোমেলো আঘাতে সংঘাতে নানা শব্দ নানা রূপ জাগিয়ে তুলিছে দিনরাতে।      কিছু তার টেঁকে নাকো দীর্ঘকাল,           মাটিগড়া মৃদঙ্গের তাল               ছন্দটারে তার           বদল করিছে বারংবার।    তারি ধাক্কা পেয়ে মন                ক্ষণে-ক্ষণ           ব্যগ্র হয়ে ওঠে জাগি      সর্বব্যাপী সামান্যের সচল স্পর্শের লাগি।               আপনার উচ্চতট হতে নামিতে পারে না সে যে সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে। এবার নীরব করে দাও এবার  নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে। তার  হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে। নিশীথরাতের নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে যে তান দিয়ে অবাক কর’ গ্রহশশীরে।যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে, গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে। বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি, একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে।৩০ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) এসে মোর কাছে "এসে মোর কাছে" শুকতারা গাহে গান। প্রদীপের শিখা নিবে চ’লে গেল, মানিল সে আহ্বান।   (স্ফুলিঙ্গ) এসেছিনু নিয়ে শুধু আশা এসেছিনু নিয়ে শুধু আশা, চলে গেনু দিয়ে ভালোবাসা।   (স্ফুলিঙ্গ) এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষনে এসো হে এসো, সজল ঘন, বাদলবরিষনে– বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে। এসো হে গিরিশিখর চুমি, ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি– গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে।ব্যথিয়ে উঠে নীপের বন পুলকভরা ফুলে। উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে। এসো হে এসো হৃদয়ভরা, এসো হে এসো পিপাসা-হরা, এসো হে আঁখি-শীতল-করা ঘনায়ে এসো মনে।১৭ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ঐশ্বর্য ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে। পূরবের নবসূর্য, নিশীথের শশী, তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি। আমার এ গান এও জগতের গানে মিশে যায় নিখিলের মর্মমাঝখানে; শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর সকলের মাঝে তার আপনার ঘর। কিন্তু, হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার ক্ষুদ্র রুদ্ধদ্বারে শুধু একাকী তোমার। নাহি পড়ে সূর্যালোক, নাহি চাহে চাঁদ, নাহি তাহে নিখিলের নিত্য আশীর্বাদ। সম্মুখে দাঁড়ালে মৃত্যু মুহূর্তেই হায় পাংশুপান্ডু শীর্ণম্লান মিথ্যা হয়ে যায়।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ওই মহামানব আসে ওই মহামানব আসে; দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে। সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক— এল মহাজন্মের লগ্ন। আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন। উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব নব জীবনের আশ্বাসে। জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়, মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) ওই যে তরী দিল খুলে ওই যে তরী দিল খুলে। তোর বোঝা কে নেবে তুলে। সামনে যখন যাবি ওরে থাক্‌ না পিছন পিছে পড়ে, পিঠে তারে বইতে গেলি, একলা পড়ে রইলি কূলে।ঘরের বোঝা টেনে টেনে। পারের ঘাটে রাখলি এনে, তাই যে তোরে বারে বারে ফিরতে হল গেলি ভুলে। ডাক রে আবার মাঝিরে ডাক, বোঝা তোমার যাক ভেসে যাক, জীবনখানি উজাড় করে সঁপে দে তার চরণমূলে।তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা, মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা। সারা জনম তোমার লাগি প্রতিদিন যে আছি জাগি, তোমার তরে বহে বেড়াই দুঃখসুখের ব্যথা। মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।যা পেয়েছি, যা হয়েছি যা-কিছু মোর আশা। না জেনে ধায় তোমার পানে সকল ভালোবাসা। মিলন হবে তোমার সাথে, একটি শুভ দৃষ্টিপাতে, জীবনবধূ হবে তোমার নিত্য অনুগতা; মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।বরণমালা গাঁথা আছে, আমার চিত্তমাঝে, কবে নীরব হাস্যমুখে আসবে বরের সাজে। সেদিন আমার রবে না ঘর, কেই-বা আপন, কেই-বা অপর, বিজন রাতে পতির সাথে মিলবে পতিব্রতা। মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।শিলাইদহ, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ওগো মৌন, না যদি কও ওগো মৌন, না যদি কও না-ই কহিলে কথা। বক্ষ ভরি বইব আমি তোমার নীরবতা। স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে, রজনী রয় যেমন করে জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা ধৈর্যে অবনতা।হবে হবে প্রভাত হবে আঁধার যাবে কেটে। তোমার বাণী সোনার ধারা পড়বে আকাশ ফেটে। তখন আমার পাখির বাসায় জাগবে কি গান তোমার ভাষায়। তোমার তানে ফোটাবে ফুল আমার বনলতা?তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ওড়ার আনন্দে পাখি ওড়ার আনন্দে পাখি শূন্যে দিকে দিকে বিনা অক্ষরের বাণী যায় লিখে লিখে। মন মোর ওড়ে যবে জাগে তার ধ্বনি, পাখার আনন্দ সেই বহিল লেখনী।   (স্ফুলিঙ্গ) ওরা এসে আমাকে বলে ওরা এসে আমাকে বলে, কবি, মৃত্যুর কথা শুনতে চাই তোমার মুখে। আমি বলি, মৃত্যু যে আমার অন্তরঙ্গ, জড়িয়ে আছে আমার দেহের সকল তন্তু। তার ছন্দ আমার হৃৎস্পন্দনে, আমার রক্তে তার আনন্দের প্রবাহ। বলছে সে,--চলো চলো, চলো বোঝা ফেলতে ফেলতে, চলো মরতে মরতে নিমেষে নিমেষে আমারি টানে, আমারি বেগে। বলছে, চুপ করে বস যদি যা-কিছু আছে সমস্তকে আঁকড়িয়ে ধরে তবে দেখবে, তোমার জগতে ফুল গেল বাসি হয়ে, পাঁক দেখা দিল শুকনো নদীতে, ম্লান হল তোমার তারার আলো। বলছে, "থেমো না, থেমো না, পিছনে ফিরে তাকিয়ো না, পেরিয়ে যাও পুরোনোকে জীর্ণকে ক্লান্তকে অচলকে। "আমি মৃত্যু-রাখাল সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি যুগ হতে যুগান্তরে নব নব চারণ-ক্ষেত্রে। "যখন বইল জীবনের ধারা আমি এসেছি তার পিছনে পিছনে, দিইনি তাকে কোনো গর্তে আটক থাকতে। তীরের বাঁধন কাটিয়ে কাটিয়ে ডাক দিয়ে নিয়ে গেছি মহাসমুদ্রে, সে সমুদ্র আমিই। "বর্তমান চায় বর্তিয়ে থাকতে। সে চাপাতে চায় তার সব বোঝা তোমার মাথায়, বর্তমান গিলে ফেলতে চায় তোমার সব-কিছু আপন জঠরে। তার পরে অবিচল থাকতে চায় আকণ্ঠপূর্ণ দানবের মতো জাগরণহীন নিদ্রায়। তাকেই বলে প্রলয়। এই অনন্ত অচঞ্চল বর্তমানের হাত থেকে আমি সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করতে এসেছি, অন্তহীন নব নব অনাগতে।" ওরা কাজ করে অলসসময়ধারা বেয়ে মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে। সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে। কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে সুদীর্ঘ অতীতে জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে। এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল, এসেছে মোগল; বিজয়রথের চাকা উড়ায়েছে ধূলিজাল, উড়িয়াছে বিজয়পতাকা। শূন্যপথে চাই, আজ তার কোনো চিহ্ন নাই। নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো। আরবার সেই শূন্যতলে আসিয়াছে দলে দলে লৌহবাঁধা পথে অনলনিশ্বাসী রথে প্রবল ইংরেজ, বিকীর্ণ করেছে তার তেজ। জানি তারও পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল, কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশ-বেড়া জাল । জানি তার পণ্যবাহী সেনা জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না। মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে দেখি সেথা কলকলরবে বিপুল জনতা চলে নানা পথে নানা দলে দলে যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে জীবনে মরণে। ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে - ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে। রাজছত্র ভেঙে পড়ে; রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে; জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে; রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে, অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে। গুরুগুরু গর্জন - গুন্‌গুন্‌ স্বর - দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর। দুঃখ সুখ দিবসরজনী মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে ওরা কাজ করে। ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া, ওরে আমার মন রে, আমার মন। জানি নে তুই কিসের লাগিকোন্‌ জগতে আছিস জাগি– কোন্‌ সেকালের বিলুপ্ত ভুবন। কোন্‌ পুরানো যুগের বাণী অর্থ যাহার নাহি জানি তোমার মুখে উঠছে আজি ফুটে। অনন্ত তোর প্রাচীন স্মৃতি কোন্‌ ভাষাতে গাঁথছে গীতি, শুনে চক্ষে অশ্রুধারা ছুটে। আজি সকল আকাশ জুড়ে যাচ্ছে তোমার পাখা উড়ে, তোমার সাথে চলতে আমি নারি। তুমি যাদের চিনি ব’লে টানছ বুকে, নিচ্ছ কোলে, আমি তাদের চিনতে নাহি পারি।আজকে নবীন চৈত্রমাসে পুরাতনের বাতাস আসে, খুলে গেছে যুগান্তরের সেতু। মিথ্যা আজি কাজের কথা, আজ জেগেছে যে-সব ব্যথা এই জীবনে নাইকো তাহার হেতু। গভীর চিত্তে গোপন শালা সেথা ঘুমায় যে রাজবালা জানি নে সে কোন্‌ জনমের পাওয়া। দেখে নিলেম ক্ষণেক তারে, যেমনি আজি মনের দ্বারে যবনিকা উড়িয়ে দিল হাওয়া। ফুলের গন্ধ চুপে চুপে আজি সোনার কাঠি-রূপে ভাঙালো তার চিরযুগের ঘুম। দেখছে লয়ে মুকুর করে আঁকা তাহার ললাট-‘পরে কোন্‌ জনমের চন্দনকুঙ্কুম।আজকে হৃদয় যাহা কহে মিথ্যা নহে, সত্য নহে, কেবল তাহা অরূপ অপরূপ। খুলে গেছে কেমন করে আজি অসম্ভবের ঘরে মর্চে-পড়া পুরানো কুলুপ। সেথায় মায়াদ্বীপের মাঝে নিমন্ত্রণের বীণা বাজে, ফেনিয়ে ওঠে নীল সাগরের ঢেউ, মর্মরিত-তমাল-ছায়ে ভিজে চিকুর শুকায় বায়ে– তাদের চেনে, চেনে না বা কেউ। শৈলতলে চরায় ধেনু, রাখালশিশু বাজায় বেণু, চূড়ায় তারা সোনার মালা পরে। সোনার তুলি দিয়ে লিখা চৈত্রমাসের মরীচিকা কাঁদায় হিয়া অপূর্বধন-তরে।গাছের পাতা যেমন কাঁপে দখিনবায়ে মধুর তাপে তেমনি মম কাঁপছে সারা প্রাণ। কাঁপছে দেহে কাঁপছে মনে হাওয়ার সাথে আলোর সনে, মর্মরিয়া উঠছে কলতান। কোন্‌ অতিথি এসেছে গো, কারেও আমি চিনি নে গো মোর দ্বারে কে করছে আনাগোনা। ছায়ায় আজি তরুর মূলে ঘাসের ‘পরে নদীর কূলে ওগো তোরা শোনা আমায় শোনা– দূর-আকাশের-ঘুম-পাড়ানি মৌমাছিদের-মন-হারানি জুঁই-ফোটানো ঘাস-দোলানো গান, জলের-গায়ে-পুলক-দেওয়া ফুলের-গন্ধ-কুড়িয়ে-নেওয়া চোখের পাতে-ঘুম-বোলানো তান।শুনাস নে গো ক্লান্ত বুকের বেদনা যত সুখের দুখের — প্রেমের কথা– আশার নিরাশার। শুনাও শুধু মৃদুমন্দ অর্থবিহীন কথার ছন্দ, শুধু সুরের আকুল ঝংকার। ধারাযন্ত্রে সিনান করি যত্নে তুমি এসো পরি চাঁপাবরন লঘু বসনখানি। ভালে আঁকো ফুলের রেখা চন্দনেরই পত্রলেখা, কোলের ‘পরে সেতার লহো টানি। দূর দিগন্তে মাঠের পারে সুনীল-ছায়া গাছের সারে নয়নদুটি মগ্ন করি চাও। ভিন্নদেশী কবির গাঁথা অজানা কোন্‌ ভাষার গাথা গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া গাও।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে কামনার আবর্জনা যত, ক্ষুধিত অহমিকার উঞ্ছবৃত্তি-সঞ্চিত জঞ্জালরাশি দগ্ধ হয়ে গিয়ে ধন্য হোক আলোকের দানে, এ মর্ত্যের প্রান্ত-পথ দীপ্ত ক’রে দিক, অবশেষে নিঃশেষে মিলিয়া যাক পূর্ব সমুদ্রের পারে অপূর্ব উদয়াচল চূড়ে অরুণ কিরণ তলে একদিন অমর্ত্য প্রভাতে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা ওরে  নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে আজকে যে যা বলে বলুক তোরে, সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা। আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়; আর তো কিছুই নড়ে না রে ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়। ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা, চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা, ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়। আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ, দেখে না যে বাণ ডেকেছে জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ। চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে, আছে অচল আসনখানা মেলে যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়, আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।তোরে হেথায় করবে সবাই মানা। হঠাৎ আলো দেখবে যখন ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা। সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়। আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী চিরকাল কি রইবে খাড়া। পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি। ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে, ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে ভুলগুলো সব আন্‌ রে বাছা-বাছা। আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।আন্‌ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে। বিবাগী কর্‌ অবাধপানে, পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে। আপদ আছে, জানি অঘাত আছে, তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে, ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে পথে চলার বিধিবিধান যাচা। আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।চিরযুবা তুই যে চিরজীবী, জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি। সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা, বসন্তেরে পরাস আকুল-করা আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা, আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা। ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী, লুব্ধ বাহু বাড়াইয়া উচ্ছ্বসি উল্লসি আমারে কি পেতে চাস চির আলিঙ্গনে। শুধু এক মুহূর্তের উন্মত্ত মিলনে তোর বক্ষোমাঝে চাস করিতে বিলয় আমার বক্ষের যত সুখ দুঃখ ভয়? আমিও তো কতদিন ভাবিয়াছি মনে বসি তোর তটোপান্তে প্রশান্ত নির্জনে, বাহিরে চঞ্চলা তুই প্রমত্তমুখরা, শানিত অসির মতো ভীষণ প্রখরা, অন্তরে নিভৃত স্নিগ্ধ শান্ত সুগম্ভীর– দীপহীন রুদ্ধদ্বার অর্ধরজনীর বাসরঘরের মতো নিষুপ্ত নির্জন– সেথা কার তরে পাতা সুচির শয়ন।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ওরে পাখি ওরে পাখি, থেকে থেকে ভুলিস কেন সুর, যাস নে কেন ডাকি— বাণীহারা প্রভাত হয় যে বৃথা জানিস নে তুই কি তা।অরুণ-আলোর প্রথম পরশ গাছে গাছে লাগে, কাঁপনে তার তোরই যে সুর পাতায় পাতায় জাগে— তুই যে ভোরের আলোর মিতা জানিস নে তুই কি তা।জাগরণের লক্ষ্মী যে ওই আমার শিয়রেতে আছে আঁচল পেতে, জানিস নে তুই কি তা। গানের দানে উহারে তুই করিস নে বঞ্চিতা!দুঃখরাতের স্বপনতলে প্রভাতী তোর কী যে বলে নবীন প্রাণের গীতা, জানিস নে তুই কি তা।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) ওরে মাঝি ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি, শুনতে কি পাস দূরের থেকে পারের বাঁশি উঠছে বাজি। তরী কি তোর দিনের শেষে ঠেকবে এবার ঘাটে এসে। সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি।যেন আমার লাগছে মনে, মন্দমধুর এই পবনে সিন্ধুপারের হাসিটি কার আঁধার বেয়ে আসছে আজি। আসার বেলায় কুসুমগুলি কিছু এনেছিলেম তুলি, যেগুলি তার নবীন আছে এইবেলা নে সাজিয়ে সাজি।১৮ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কঠিন পাথর কাটি কঠিন পাথর কাটি মূর্তিকর গড়িছে প্রতিমা। অসীমেরে রূপ দিক্‌ জীবনের বাধাময় সীমা।   (স্ফুলিঙ্গ) কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন,   ও তার   ঘুম ভাঙাইনু রে। লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন,   ওগো,   তায় জাগাইনু রে॥      পোষ মেনেছে হাতের তলে   যা বলাই সে তেমনি বলে--               দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে॥      অচল ছিল, সচল হয়ে    ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে--               নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে॥(রচনাকাল: 1911) কণিকা যথার্থ আপনকুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান, বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান। ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই, চন্দ্রসূর্যতারকারে করে 'ভাই ভাই'। নভশ্চর ব'লে তাঁর মনের বিশ্বাস, শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস। ভাবে, 'শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে; বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।' বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি--- সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।হাতে-কলমেবোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক, এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক! মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই, আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই॥গৃহভেদআম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই, আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই; মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি--- মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি॥গরজের আত্মীয়তাকহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে, আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে? থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে॥কুটুম্বিতাকেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব'লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা; কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা॥উদারচরিতানাম্প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই; সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছি ভাই?।অসম্ভব ভালোযথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো, কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো? আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায় অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়॥প্রত্যক্ষ প্রমাণবজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ আমর গর্জনে বলে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে, মাথায় পড়িলে তবে বলে--- 'বজ্র বটে!'ভক্তিভাজনরথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম--- ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি', মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'--- হাসে অন্তর্যামী॥ উপকারদম্ভশৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥সন্দেহের কারণ'কত বড়ো আমি' কহে নকল হীরাটি। তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি॥অকৃতজ্ঞধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে॥নিজের ও সাধারণেরচন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে, কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে॥মাঝারির সতর্কতাউত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে॥নতিস্বীকারতপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়, তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়, অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে॥কর্তব্যগ্রহণকে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি--- শুনিয়া জগত্‍‌ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তিরাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা॥মোহনদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে--- কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে॥ফুল ও ফলফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল, কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্! ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি--- তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি॥প্রশ্নের অতীতহে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা? সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা। কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর? হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর॥মোহের আশঙ্কাশিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা--- শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা; বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়, আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো॥চালকঅদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে? সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি, সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি॥ কত অজানারে জানাইলে তুমি কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই- দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে, নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই। দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে, চির জনমের পরিচিত ওহে, তুমিই চিনাবে সবে। তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোন মানা, নাহি কোন ডর, সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ- দেখা যেন সদা পাই। দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। কত কী যে আসে কত কী যে যায কত কী যে আসে কত কী যে যায়           বাহিয়া চেতনাবাহিনী! আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত হেথা হোথা তারি পড়ে থাকে কত--- ছিন্নসূত্র বাছি শত শত           তুমি গাঁথ বসে কাহিনী। ওগো একমনা, ওগো অগোচরা,           ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী! তব ঘরে কিছু ফেলা নাহি যায়           ওগো হৃদয়ের গেহিনী! কত সুখ দুখ আসে প্রতিদিন, কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ--- তুমি তাই লয়ে বিরামবিহীন           রচিছ জীবনকাহিনী। আঁধারে বসিয়া কী যে কর কাজ           ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী। কত যুগ ধরে এমনি গাঁথিছ           হৃদিশতদলশায়িনী! গভীর নিভৃতে মোর মাঝখানে কী যে আছে কী যে নাই কে বা জানে, কী জানি রচিলে আমার পরানে           কত-না যুগের কাহিনী--- কত জনমের কত বিস্মৃতি           ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী। কত দিবা কত বিভাবরী কত দিবা কত বিভাবরী কত নদী নদে লক্ষ স্রোতের মাঝখানে এক পথ ধরি, কত ঘাটে ঘাটে লাগায়ে, কত সারিগান জাগায়ে, কত অঘ্রানে নব নব ধানে কতবার কত বোঝা ভরি কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে কত স্বর্ণভার কোন্‌ গ্রামে আজ সাধিতে কী কাজ বাঁধিয়া ধরিলে তব তরী।হেথা বিকিকিনি কার হাটে। কেন এত ত্বরা লইয়া পসরা, ছুটে চলে এরা কোন্‌ বাটে। শুন গো থাকিয়া থাকিয়া বোঝা লয়ে যায় হাঁকিয়া, সে করুণ স্বরে মন কী যে করে– কী ভেবে আমার দিন কাটে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার– হেথা কারা রয় লহো পরিচয়, কারা আসে যায় এই ঘাটে।যেথা হতে যাই, যাই কেঁদে। এমনটি আর পাব কি আবার সরে না যে মন সেই খেদে। সে-সব কাঁদন ভুলালে, কী দোলায় প্রাণ দুলালে। হোথা যারা তীরে আনমনে ফিরে আমি তাহাদের মরি সেধে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার। এই হাটে নামি দেখে লব আমি– এক বেলা তরী রাখো বেঁধে।গান ধর তুমি কোন্‌ সুরে। মনে পড়ে যায় দূর হতে এনু, যেতে হবে পুন কোন্‌ দূরে। শুনে মনে পড়ে, দুজনে খেলেছি সজনে বিজনে, সে যে কত দেশ নাহি তার শেষ– সে যে কতকাল এনু ঘুরে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার। বাজিয়াছে শাঁখ, পড়িয়াছে ডাক সে কোন্‌ অচেনা রাজপুরে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) কথা চাই, কথা চাই, হাঁকে কথা চাই, কথা চাই, হাঁকে কথার বাজারে; কথাওয়ালা অাসে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারে হাজারে। প্রাণে তোর বাণী যদি থাকে মৌনে ঢাকিয়া রাখ্‌ তাকে মুখর এ হাটের মাঝারে।   (স্ফুলিঙ্গ) কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি যাব   অকারণে ভেসে কেবল ভেসে, ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী কোথায়     যেতেছি কোন্‌ দেশে সে কোন্‌ দেশে। কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে শোনাব গান একলা তোমার কানে, ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা আমার সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।আজো সময়  হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি। ওগো  ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে। মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি আপন      কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে। কখন তুমি আসবে ঘাটের ‘পরে বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে। অস্তরবির শেষ আলোটির মতো তরী    নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।বোলপুর, ৩০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কনে দেখা হয়ে গেছে কনে দেখা হয়ে গেছে, নাম তার চন্দনা; তোমারে মানাবে ভায়া, অতিশয় মন্দ না। লোকে বলে, খিট্‌খিটে, মেজাজটা নয় মিঠে– দেবী ভেবে নেই তারে করিলে বা বন্দনা। কুঁজো হোক, কালো হোক, কালাও না, অন্ধ না।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কনের পণের আশে কনের পণের আশে চাকরি সে ত্যেজেছে। বারবার আয়নাতে মুখখানি মেজেছে। হেনকালে বিনা কোনো কসুরে যম এসে ঘা দিয়েছে শ্বশুরে, কনেও বাঁকালো মুখ– বুকে তাই বেজেছে। বরবেশ ছেড়ে হীরু দরবেশ সেজেছে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কন্‌কনে শীত তাই কন্‌কনে শীত তাই চাই তার দস্তানা; বাজার ঘুরিয়ে দেখে, জিনিসটা সস্তা না। কম দামে কিনে মোজা বাড়ি ফিরে গেল সোজা– কিছুতে ঢোকে না হাতে, তাই শেষে পস্তানা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কন্যাবিদায় জননী, কন্যারে আজ বিদায়ের ক্ষণে আপন অতীতরূপ পড়িয়াছে মনে যখন বালিকা ছিলে।                  মাতৃক্রোড় হতে তোমারে ভাসালো ভাগ্য দূরতর স্রোতে সংসারের।          তার পর গেল কত দিন দুঃখে সুখে,          বিচ্ছেদের ক্ষত হল ক্ষীণ।এ-জন্মের আরম্ভভূমিকা-- সংকীর্ণ সে প্রথম উষার মতো-- ক্ষণিক প্রদোষে মিলাইল লয়ে তার স্বর্ণ কুহেলিকা। বাল্যে পরেছিলে শুভ্র মাঙ্গল্যের টিকা, সিন্দূররেখায় হল লীন।                     সে-রেখাটি জীবনের পূর্বভাগ দিল যেন কাটি। আজ সেই ছিন্নখণ্ড ফিরে এল শেষে তোমার কন্যার মাঝে অশ্রুর আবেশে। কবি (অনূদিত কবিতা) ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া , কভু বা অবাক , কভু ভকতি-বিহ্বল হিয়া ।            নিজের প্রাণের মাঝে            একটি যে বীণা বাজে , সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া । বনে যতগুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা , কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা ,            কারো বা সোনার মুখ ,            কেহ রাঙা টুকটুক , কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা , কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি । বলাবলি করে , আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায় , “ প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায় । ”   সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্‌ বিশাল-কায়া হেথায় জাগিছে আলো , হোথায় ঘুমায় ছায়া ।             কোথাও বা বৃদ্ধবট —              মাথায় নিবিড় জট ; ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল ;            কোথাও বা ঋষির মতো            অশথের গাছ যত দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল । মহর্ষি গুরুরে হেরি অমনি ভকতিভরে সসম্ভ্রমে শিষ্যগণ যেমন প্রণাম করে , তেমনি করিবে দেখি গাছেরা দাঁড়াল নুয়ে , লতা-শ্মশ্রুময় মাথা ঝুলিয়া পড়িল ভুঁয়ে । একদৃষ্টে চেয়ে দেখি প্রশান্ত সে মুখচ্ছবি , চুপি চুপি কহে তারা “ ওই সেই । ওই কবি । ”                                          — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা) কবি-কাহিনী (চতুর্থ সর্গ) "এ তবে স্বপন শুধু, বিম্বের মতন আবার মিলায়ে গেল নিদ্রার সমুদ্রে! সারারাত নিদ্রার করিনু আরাধনা-- যদি বা আইল নিদ্রা এ শ্রান্ত নয়নে, মরীচিকা দেখাইয়া গেল গো মিলায়ে! হা স্বপ্ন, কি শক্তি তোর, এ হেন মূরতি মুহূর্ত্তের মধ্যে তুই ভাঙ্গিলি, গড়িলি? হা নিষ্ঠুর কাল, তোর এ কিরূপ খেলা-- সত্যের মতন গড়িলি প্রতিমা, স্বপ্নের মতন তাহা ফেলিলি ভাঙ্গিয়া? কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মতন উঠিল, আবার গেল মিলায়ে তাহাতে? না না, তাহা নয় কভু, নলিনী, সে কি গো কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত! যাহার মোহিনী মূর্ত্তি হৃদয়ে হৃদয়ে শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে, যত কাল রব বেঁচে যার ভালবাসা চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়, সে বালিকা, সে নলিনী, সে স্বর্গপ্রতিমা, কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল? না না, তাহা নয় কভু, তা যেন না হয়! দেহকারাগারমুক্ত সে নলিনী এবে সুখে দুখে চিরকাল সম্পদে বিপদে আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ। চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে। দেহকারাগারমুক্ত হইলে আমিও তাহার হৃদয়সাথে মিশাব হৃদয়। নলিনী, আছ কি তুমি, আছ কি হেথায়? একবার দেখা দেও, মিটাও সন্দেহ! চিরকাল তরে তোরে ভুলিতে কি হবে? তাই বল্ নলিনী লো, বল্ একবার! চিরকাল আর তোরে পাব না দেখিতে, চিরকাল আর তোর হৃদয়ে হৃদয় পাব না কি মিশাইতে, বল্ একবার। মরিলে কি পৃথিবীর সব যায় দূরে? তুই কি আমারে ভুলে গেছিস্ নলিনি? তা হোলে নলিনি, আমি চাই না মরিতে। তোর ভালবাসা যেন চিরকাল মোর হৃদয়ে অক্ষয় হোয়ে থাকে গো মুদ্রিত-- কষ্ট পাই পাব, তবু চাই না ভুলিতে! তুমি নাহি থাক যদি তোমার স্মৃতিও থাকে যেন এ হৃদয় করিয়া উজ্জ্বল! এই ভালবাসা যাহা হৃদয়ে মরমে অবশিষ্ট রাখে নাই এক তিল স্থান, একটি পার্থিব ক্ষুদ্র নিশ্বাসের সাথে মুহূর্ত্তে না পালটিতে আঁখির পলক ক্ষণস্থায়ী কুসুমের সুরভের মত শূন্য এই বায়ুস্রোতে যাইবে মিশায়ে? হিমাদ্রির এই স্তব্ধ আঁধার গহ্বরে সময়ের পদক্ষেপ গণিতেছি বসি, ভবিষ্যৎ ক্রমে হইতেছে বর্ত্তমান, বর্ত্তমান মিশিতেছে অতীতসমুদ্রে। অস্ত যাইতেছে নিশি, আসিছে দিবস, দিবস নিশার কোলে পড়িছে ঘুমায়ে। এই সময়ের চক্র ঘুরিয়া নীরবে পৃথিবীরে মানুষেরে অলক্ষিতভাবে পরিবর্ত্তনের পথে যেতেছে লইয়া, কিন্তু মনে হয় এই হিমাদ্রীর বুকে তাহার চরণ-চিহ্ন পড়িছে না যেন। কিন্তু মনে হয় যেন আমার হৃদয়ে দুর্দ্দাম সময়স্রোত অবিরামগতি, নূতন গড়ে নি কিছু, ভাঙ্গে নি পুরাণো। বাহিরের কত কি যে ভাঙ্গিল চূরিল, বাহিরের কত কি যে হইল নূতন, কিন্তু ভিতরের দিকে চেয়ে দেখ দেখি-- আগেও আছিল যাহা এখনো তা আছে, বোধ হয় চিরকাল থাকিবে তাহাই! বরষে বরষে দেহ যেতেছে ভাঙ্গিয়া, কিন্তু মন আছে তবু তেমনি অটল। নলিনী নাইকো বটে পৃথিবীতে আর, নলিনীরে ভালবাসি তবুও তেমনি। যখন নলিনী ছিল, তখন যেমন তার হৃদয়ের মূর্ত্তি ছিল এ হৃদয়ে, এখনো তেমনি তাহা রয়েছে স্থাপিত। এমন অন্তরে তারে রেখেছি লুকায়ে, মরমের মর্ম্মস্থলে করিতেছি পূজা, সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে ভাঙ্গিবারে এ জনমে সে মোর প্রতিমা, হৃদয়ের আদরের লুকানো সে ধন! ভেবেছিনু এক বার এই-যে বিষাদ নিদারুণ তীব্র স্রোতে বহিছে হৃদয়ে এ বুঝি হৃদয় মোর ভাঙ্গিবে চূরিবে-- পারে নি ভাঙ্গিতে কিন্তু এক তিল তাহা, যেমন আছিল মন তেমনি রয়েছে! বিষাদ যুঝিয়াছিল প্রাণপণে বটে, কিন্তু এ হৃদয়ে মোর কি যে আছে বল, এ দারুণ সমরে সে হইয়াচে জয়ী। গাও গো বিহগ তব প্রমোদের গান, তেমনি হৃদয়ে তার রবে প্রতিধ্বনি! প্রকৃতি! মাতার মত সুপ্রসন্ন দৃষ্টি যেমন দেখিয়াছিনু ছেলেবেলা আমি, এখনো তেমনি যেন পেতেছি দেখিতে। যা কিছু সুন্দর, দেবি, তাহাই মঙ্গল, তোমার সুন্দর রাজ্যে হে প্রকৃতিদেবি তিল অমঙ্গল কভু পারে না ঘটিতে। অমন সুন্দর আহা নলিনীর মন, জীবন সৌন্দর্য্য, দেবি তোমার এ রাজ্যে অনন্ত কালের তরে হবে না বিলীন। যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবে তা দেবি, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। তোমার আশ্বাসবাক্যে হে প্রকৃতিদেবি, সংশয় কখনো আমি করি না স্বপনে! বাজাও রাখাল তব সরল বাঁশরী! গাও গো মনের সাধে প্রমোদের গান! পাখীরা মেলিয়া যবে গাইতেছে গীত, কানন ঘেরিয়া যবে বহিতেছে বায়ু, উপত্যকাময় যবে ফুটিয়াছে ফুল, তখন তোদের আর কিসের ভাবনা? দেখি চিরহাস্যময় প্রকৃতির মুখ, দিবানিশি হাসিবারে শিখেছিস্ তোরা! সমস্ত প্রকৃতি যবে থাকে গো হাসিতে, সমস্ত জগৎ যবে গাহে গো সঙ্গীত, তখন ত তোরা নিজ বিজন কুটীরে ক্ষুদ্রতম আপনার মনের বিষাদে সমস্ত জগৎ ভুলি কাঁদিস না বসি! জগতের, প্রকৃতির ফুল্ল মুখ হেরি আপনার ক্ষুদ্র দুঃখ রহে কি গো আর? ধীরে ধীরে দূর হোতে আসিছে কেমন বসন্তের সুরভিত বাতাসের সাথে মিশিয়া মিশিয়া এই সরল রাগিণী। একেক রাগিণী আছে করিলে শ্রবণ মনে হয় আমারি তা প্রাণের রাগিণী-- সেই রাগিণীর মত আমার এ প্রাণ, আমার প্রাণের মত যেন সে রাগিণী! কখন বা মনে হয় পুরাতন কাল এই রাগিণীর মত আছিল মধুর, এমনি স্বপনময় এমনি অস্ফুট-- পাই শুনি ধীরি ধীরি পুরাতন স্মৃতি প্রাণের ভিতরে যেন উথলিয়া উঠে!" ক্রমে কবি যৌবনের ছাড়াইয়া সীমা, গম্ভীর বার্দ্ধক্যে আসি হোলো উপনীত! সুগম্ভীর বৃদ্ধ কবি, স্কন্ধে আসি তার পড়েছে ধবল জটা অযত্নে লুটায়ে! মনে হোতো দেখিলে সে গম্ভীর মুখশ্রী হিমাদ্রি হোতেও বুঝি সমুচ্চ মহান্! নেত্র তাঁর বিকীরিত কি স্বর্গীয় জ্যোতি, যেন তাঁর নয়নের শান্ত সে কিরণ সমস্ত পৃথিবীময় শান্তি বরষিবে। বিস্তীর্ণ হইয়া গেল কবির সে দৃষ্টি, দৃষ্টির সম্মুখে তার, দিগন্তও যেন খুলিয়া দিত গো নিজ অভেদ্য দুয়ার। যেন কোন দেববালা কবিরে লইয়া অনন্ত নক্ষত্রলোকে কোরেছে স্থাপিত-- সামান্য মানুষ যেথা করিলে গমন কহিত কাতর স্বরে ঢাকিয়া নয়ন, "এ কি রে অনন্ত কাণ্ড, পারি না সহিতে!" সন্ধ্যার আঁধারে হোথা বসিয়া বসিয়া, কি গান গাইছে কবি, শুন কলপনা। কি "সুন্দর সাজিয়াছে ওগো হিমালয় তোমার বিশালতম শিখরের শিরে একটি সন্ধ্যার তারা! সুনীল গগন ভেদিয়া, তুষারশুভ্র মস্তক তোমার! সরল পাদপরাজি আঁধার করিয়া উঠেছে তাহার পরে; সে ঘোর অরণ্য ঘেরিয়া হুহুহু করি তীব্র শীতবায়ু দিবানিশি ফেলিতেছে বিষণ্ণ নিশ্বাস! শিখরে শিখরে ক্রমে নিভিয়া আসিল অস্তমান তপনের আরক্ত কিরণে প্রদীপ্ত জলদচূর্ণ। শিখরে শিখরে মলিন হইয়া এল উজ্জ্বল তুষার, শিখরে শিখরে ক্রমে নামিয়া আসিল আঁধারের যবনিকা ধীরে ধীরে ধীরে! পর্ব্বতের বনে বনে গাঢ়তর হোলো ঘুমময় অন্ধকার। গভীর নীরব! সাড়াশব্দ নাই মুখে, অতি ধীরে ধীরে অতি ভয়ে ভয়ে যেন চলেছে তটিনী সুগম্ভীর পর্ব্বতের পদতল দিয়া! কি মহান্! কি প্রশান্ত! কি গম্ভীর ভাব! ধরার সকল হোতে উপরে উঠিয়া স্বর্গের সীমায় রাখি ধবল জটায় জড়িত মস্তক তব ওগো হিমালয় নীরব ভাষায় তুমি কি যেন একটি গম্ভীর আদেশ ধীরে করিছ প্রচার! সমস্ত পৃথিবী তাই নীরব হইয়া শুনিছে অনন্যমনে সভয়ে বিস্ময়ে। আমিও একাকী হেথা রয়েছি পড়িয়া, আঁধার মহা-সমুদ্রে গিয়াছি মিশায়ে, ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র নর আমি, শৈলরাজ! অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র তৃণটির মত হারাইয়া দিগ্বিদিক্, হারাইয়া পথ, সভয়ে বিস্ময়ে, হোয়ে হতজ্ঞানপ্রায় তোমার চরণতলে রয়েছি পড়িয়া। ঊর্দ্ধ্বমুখে চেয়ে দেখি ভেদিয়া আঁধার শূন্যে শূন্যে শত শত উজ্জ্বল তারকা, অনিমিষ নেত্রগুলি মেলিয়া যেন রে আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। ওগো হিমালয়, তুমি কি গম্ভীর ভাবে দাঁড়ায়ে রয়েছ হেথা অচল অটল, দেখিছ কালের লীলা, করিছ গননা, কালচক্র কত বার আইল ফিরিয়া! সিন্ধুর বেলার বক্ষে গড়ায় যেমন অযুত তরঙ্গ, কিছু লক্ষ্য না করিয়া কত কাল আইল রে, গেল কত কাল হিমাদ্রি তোমার ওই চক্ষের উপরি। মাথার উপর দিয়া কত দিবাকর উলটি কালের পৃষ্ঠা গিয়াছে চলিয়া। গম্ভীর আঁধারে ঢাকি তোমার ও দেহ কত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে পোহায়ে। কিন্তু বল দেখি ওগো হিমালয়গিরি মানুষসৃষ্টির অতি আরম্ভ হইতে কি দেখিছ এইখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে? যা দেখিছ যা দেখেছ তাতে কি এখনো সর্ব্বাঙ্গ তোমার গিরি উঠে নি শিহরি? কি দারুণ অশান্তি এই মনুষ্যজগতে-- রক্তপাত, অত্যাচার , পাপ কোলাহল দিতেছে মানবমনে বিষ মিশাইয়া! কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে অধীনতাশৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে, অবশেষে মন এত হোয়েছে নিস্তেজ, কলঙ্কশৃঙ্খল তার অলঙ্কাররূপে আলিঙ্গন ক'রে তারে রেখেছে গলায়! দাসত্বের পদধূলি অহঙ্কার কোরে মাথায় বহন করে পরপ্রত্যাশীরা! যে পদ মাথায় করে ঘৃণার আঘাত সেই পদ ভক্তিভরে করে গো চুম্বন! যে হস্ত ভ্রাতারে তার পরায় শৃঙ্খল, সেই হস্ত পরশিলে স্বর্গ পায় করে। স্বাধীন, সে অধীনেরে দলিবার তরে, অধীন, সে স্বাধীনেরে পূজিবারে শুধু! সবল, সে দুর্ব্বলেরে পীড়িতে কেবল—দুর্ব্বল, বলের পদে আত্ম বিসর্জ্জিতে! স্বাধীনতা কারে বলে জানে সেই জন কোথায় সেই অসহায় অধীন জনের কঠিন শৃঙ্খলরাশি দিবে গো ভাঙ্গিয়া, না, তার স্বাধীন হস্ত হোয়েছে কেবল অধীনের লৌহপাশ দৃঢ় করিবারে। সবল দুর্ব্বলে কোথা সাহায্য করিবে-- দুর্ব্বলে অধিকতর করিতে দুর্ব্বল বল তার-- হিমগিরি, দেখিছ কি তাহা? সামান্য নিজের স্বার্থ করিতে সাধন কত দেশ করিতেছে শ্মশান অরণ্য, কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা রক্তময়পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া, তবুও মানুষ বলি গর্ব্ব করে তারা, তবু তারা সভ্য বলি করে অহঙ্কার! কত রক্তমাখা ছুরি হাসিছে হরষে, কত জিহ্বা হৃদয়েরে ছিঁড়িছে বিঁধিছে! বিষাদের অশ্রুপূর্ণ নয়ন হে গিরি অভিশাপ দেয় সদা পরের হরষে, উপেক্ষা ঘৃণায় মাখা কুঞ্চিত অধর পরঅশ্রুজলে ঢালে হাসিমাখা বিষ! পৃথিবী জানে না গিরি হেরিয়া পরের জ্বালা, হেরিয়া পরের মর্ম্মদুখের উচ্ছ্বাস, পরের নয়নজলে মিশাতে নয়নজল—পরের দুখের শ্বাসে মিশাতে নিশ্বাস! প্রেম? প্রেম কোথা হেথা এ অশান্তিধামে? প্রণয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া যেথায় বিচরে ইন্দ্রিয়সেবা, প্রেম সেথা আছে? প্রেমে পাপ বলে যারা, প্রেম তারা চিনে? মানুষে মানুষে যেথা আকাশ পাতাল, হৃদয়ে হৃদয়ে যেথা আত্ম-অভিমান, যে ধরায় মন দিয়া ভাল বাসে যারা উপেক্ষা বিদ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদে তারাই অধিক সহে বিষাদ যন্ত্রণা, সেথা যদি প্রেম থাকে তবে কোথা নাই-- তবে প্রেম কলুষিত নরকেও আছে! কেহ বা রতনময় কনকভবনে ঘুমায়ে রয়েছে সুখে বিলাসের কোলে, অথচ সুমুখ দিয়া দীন নিরালয় পথে পথে করিতেছে ভিক্ষান্নসন্ধান! সহস্র পীড়িতদের অভিশাপ লোয়ে সহস্রের রক্তধারে ক্ষালিত আসনে সমস্ত পৃথিবী রাজা করিছে শাসন, বাঁধিয়া গলায় সেই শাসনের রজ্জু সমস্ত পৃথিবী তাহার রহিয়াছে দাস! সহস্র পীড়ন সহি আনত মাথায় একের দাসত্বে রত অযুত মানব! ভাবিয়া দেখিলে মন উঠে গো শিহরি-- ভ্রমান্ধ দাসের জাতি সমস্ত মানুষ। এ অশান্তি কবে দেব হবে দূরীভূত! অত্যাচার-গুরুভারে হোয়ে নিপীড়িত সমস্ত পৃথিবী, দেব, করিছে ক্রন্দন! সুখ শান্তি সেথা হোতে লয়েছে বিদায়! কবে, দেব, এ রজনী হবে অবসান? স্নান করি প্রভাতের শিশিরসলিলে তরুণ রবির করে হাসিবে পৃথিবী! অযুত মানবগণ এক কণ্ঠে, দেব, এক গান গাইবেক স্বর্গ পূর্ণ করি! নাইক দরিদ্র ধনী অধিপতি প্রজা-- কেহ কারো কুটীরেতে করিলে গমন মর্য্যাদার অপমান করিবে না মনে, সকলেই সকলের করিতেছে সেবা, কেহ কারো প্রভু নয়, নহে কারো দাস! নাই ভিন্ন জাতি আর নাই ভিন্ন ভাষা নাই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন আচার ব্যাভার! সকলেই আপনার আপনার লোয়ে পরিশ্রম করিতেছে প্রফুল্ল-অন্তরে। কেহ কারো সুখে নাহি দেয় গো কণ্টক, কেহ কারো দুখে নাহি করে উপহাস! দ্বেষ নিন্দা ক্রূরতার জঘন্য আসন ধর্ম্ম-আবরণে নাহি করে গো সজ্জিত! হিমাদ্রি, মানুষসৃষ্টি-আরম্ভ হইতে অতীতের ইতিহাস পড়েছ সকলি, অতীতের দীপশিখা যদি হিমালয় ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পারে গো ভেদিতে তবে বল কবে, গিরি, হবে সেই দিন যে দিন স্বর্গই হবে পৃথ্বীর আদর্শ! সে দিন আসিবে গিরি, এখনিই যেন দূর ভবিষ্যৎ সেই পেতেছি দেখিতে যেই দিন এক প্রেমে হইয়া নিবদ্ধ মিলিবেক কোটি কোটি মানবহৃদয়। প্রকৃতির সব কার্য্য অতি ধীরে ধীরে, এক এক শতাব্দীর সোপানে সোপানে-- পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে, পৃথিবীর সে অবস্থা আসে নি এখনো কিন্তু এক দিন তাহা আসিবে নিশ্চয়। আবার বলি গো আমি হে প্রকৃতিদেবি যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবেক তাহা, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। এ যে সুখময় আশা দিয়াছ হৃদয়ে ইহার সঙ্গীত, দেবি, শুনিতে শুনিতে পারিব হরষচিতে ত্যজিতে জীবন!" সমস্ত ধরার তরে নয়নের জল বৃদ্ধ সে কবির নেত্র করিল পূর্ণিত! যথা সে হিমাদ্রি হোতে ঝরিয়া ঝরিয়া কত নদী শত দেশ করয়ে উর্ব্বরা। উচ্ছ্বসিত করি দিয়া কবির হৃদয় অসীম করুণা সিন্ধু পোড়েছে ছড়ায়ে সমস্ত পৃথিবীময়। মিলি তাঁর সাথে জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী কাঁদিলেন আর্দ্র হোয়ে পৃথিবীর দুখে, ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন! কবির প্রাচীননেত্রে পৃথিবীর শোভা এখনও কিছু মাত্র হয় নি পুরাণো? এখনো সে হিমাদ্রির শিখরে শিখরে একেলা আপন মনে করিত ভ্রমণ। বিশাল ধবল জটা, বিশাল ধবল শ্মশ্রু, নেত্রের স্বর্গীয় জ্যোতি, গম্ভীর মূরতি, প্রশস্ত ললাটদেশ, প্রশান্ত আকৃতি তার মনে হোত হিমাদ্রির অধিষ্ঠাতৃদেব! জীবনের দিন ক্রমে ফুরায় কবির! সঙ্গীত যেমন ধীরে আইসে মিলায়ে, কবিতা যেমন ধীরে আইসে ফুরায়ে, প্রভাতের শুকতারা ধীরে ধীরে যথা ক্রমশঃ মিশায়ে আসে রবির কিরণে, তেমনি ফুরায়ে এল কবির জীবন। প্রতিরাত্রে গিরিশিরে জোছনায় বসি আনন্দে গাইত কবি সুখের সঙ্গীত। দেখিতে পেয়েছে যেন স্বর্গের কিরণ, শুনিতে পেয়েছে যেন দূর স্বর্গ হোতে, নলিনীর সুমধুর আহ্বানের গান। প্রবাসী যেমন আহা দূর হোতে যদি সহসা শুনিতে পায় স্বদেশ-সঙ্গীত, ধায় হরষিত চিতে সেই দিক্ পানে, একদিন দুইদিন যেতেছে যেমন চলেছে হরষে কবি সেই দেশ হোতে স্বদেশসঙ্গীতধ্বনি পেতেছে শুনিতে। এক দিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া! হিমাদ্রি হইল তার সমাধিমন্দির, একটি মানুষ সেথা ফেলে নি নিশ্বাস! প্রত্যহ প্রভাত শুধু শিশিরাশ্রুজলে হরিত পল্লব তার করিত প্লাবিত! শুধু সে বনের মাঝে বনের বাতাস, হুহু করি মাঝে মাঝে ফেলিত নিশ্বাস! সমাধি উপরে তার তরুলতাকুল প্রতিদিন বরষিত কত শত ফুল! কাছে বসি বিহগেরা গাইত গো গান, তটিনী তাহার সাথে মিশাইত তান।       (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস) কবি-কাহিনী (তৃতীয় সর্গ) কত দেশ দেশান্তরে ভ্রমিল সে কবি! তুষারস্তম্ভিত গিরি করিল লঙ্ঘন, সুতীক্ষ্নকণ্টকময় অরণ্যের বুক মাড়াইয়া গেল চলি রক্তময় পদে। কিন্তু বিহঙ্গের গান, নির্ঝরের ধ্বনি, পারে না জুড়াতে আর কবির হৃদয়। বিহগ, নির্ঝর-ধ্বনি প্রকৃতির গীত-- মনের যে ভাগে তার প্রতিধ্বনি হয় সে মনের তন্ত্রী যেন হোয়েছে বিকল। একাকী যাহাই আগে দেখিত সে কবি তাহাই লাগিত তার কেমন সুন্দর, এখন কবির সেই একি হোলো দশা-- যে প্রকৃতি-শোভা-মাঝে নলিনী না থাকে ঠেকে তা শূন্যের মত কবির নয়নে, নাইক দেবতা যেন মন্দিরমাঝারে। বালার মুখের জ্যোতি করিত বর্দ্ধন প্রকৃতির রূপচ্ছটা দ্বিগুণ করিয়া; সে না হোলে অমবস্যানিশির মতন সমস্ত জগৎ হোত বিষণ্ণ আঁধার।               -- জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ধরা, নীরব রজনী। অরণ্যের অন্ধকারময় গাছগুলি মাথার উপরে মাখি রজত জোছনা, শাখায় শাখায় ঘন করি জড়াজড়ি, কেমন গম্ভীরভাবে রোয়েছে দাঁড়ায়ে। হেথায় ঝোপের মাঝে প্রচ্ছন্ন আঁধার, হোথায় সরসীবক্ষে প্রশান্ত জোছনা। নভপ্রতিবিম্বশোভী ঘুমন্ত সরসী চন্দ্র তারকার স্বপ্ন দেখিতেছে যেন! লীলাময় প্রবাহিণী চলেছে ছুটিয়া, লীলাভঙ্গ বুকে তার পাদপের ছায়া ভেঙ্গে চুরে কত শত ধরিছে মূরতি। গাইছে রজনী কিবা নীরব সঙ্গীত! কেমন নীরব বন নিস্তব্ধ গম্ভীর-- শুধু দূর-শৃঙ্গ হোতে ঝরিছে নির্ঝর, শুধু একপাশ দিয়া সঙ্কুচিত অতি তটিনীটি সর সর যেতেছে চলিয়া। অধীর বসন্তবায়ু মাঝে মাঝে শুধু ঝরঝরি কাঁপাইছে গাছের পল্লব। এহেন নিস্তব্ধ রাত্রে কত বার আমি গম্ভীর অরণ্যে একা কোরেছি ভ্রমণ। স্নিগ্ধ রাত্রে গাছপালা ঝিমাইছে যেন, ছায়া তার পোড়ে আছে হেথায় হোথায়। দেখিয়াছি নীরবতা যত কথা কয় প্রাণের মরম-তলে, এত কেহ নয়। দেখি যবে অতি শান্ত জোছনায় মজি নীরবে সমস্ত ধরা রয়েছে ঘুমায়ে, নীরবে পরশে দেহ বসন্তের বায়, জানি না কি এক ভাবে প্রাণের ভিতর উচ্ছ্বসিয়া উথলিয়া উঠে গো কেমন! কি যেন হারায়ে গেছে খুঁজিয়া না পাই, কি কথা ভুলিয়া যেন গিয়েছি সহসা, বলা হয় নাই যেন প্রাণের কি কথা, প্রকাশ করিতে গিয়া পাই না তা খুঁজি! কে আছে এমন যার এ হেন নিশীথে, পুরাণো সুখের স্মৃতি উঠে নি উথলি! কে আছে এমন যার জীবনের পথে এমন একটি সুখ যায় নি হারায়ে, যে হারা-সুখের তরে দিবা নিশি তার হৃদয়ের এক দিক শূন্য হোয়ে আছে। এমন নীরব-রাত্রে সে কি গো কখনো ফেলে নাই মর্ম্মভেদী একটি নিশ্বাস? কর স্থানে আজ রাত্রে নিশীথপ্রদীপে উঠিছে প্রমোদধ্বনি বিলাসীর গৃহে। মুহূর্ত্ত ভাবে নি তারা আজ নিশীথেই কত চিত্ত পুড়িতেছে প্রচ্ছন্ন অনলে। কত শত হতভাগা আজ নিশীথেই হারায়ে জন্মের মত জীবনের সুখ মর্ম্মভেদী যন্ত্রণায় হইয়া অধীর একেলাই হা হা করি বেড়ায় ভ্রমিয়া!              -- ঝোপে-ঝাপে ঢাকা ওই অরণ্যকুটীর। বিষণ্ণ নলিনীবালা শূন্য নেত্র মেলি চাঁদের মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া! জানি না কেমন কোরে বালার বুকের মাঝে সহসা কেমন ধারা লেগেছে আঘাত-- আর সে গায় না গান, বসন্ত ঋতুর অন্তে পাপিয়ার কণ্ঠ যেন হোয়েছে নীরব। আর সে লইয়া বীণা বাজায় না ধীরে ধীরে, আর সে ভ্রমে না বালা কাননে কাননে। বিজন কুটীরে শুধু মরণশয্যার 'পরে একেলা আপন মনে রয়েছে শুইয়া। যে বালা মুহূর্ত্তকাল স্থির না থাকিত কভু, শিখরে নির্ঝরে বনে করিত ভ্রমণ—কখনো তুলিত ফুল, কখনো গাঁথিত মালা, কখনো গাইত গান, বাজাইত বীণা-- সে আজ এমন শান্ত, এমন নীরব স্থির! এমন বিষণ্ণ শীর্ণ সে প্রফুল্ল মুখ! এক দিন, দুই দিন, যেতেছে কাটিয়া ক্রমে-- মরণের পদশব্দ গণিছে সে যেন! আর কোন সাধ নাই, বাসনা রয়েছে শুধু কবিরে দেখিয়া যেন হয় গো মরণ। এ দিকে পৃথিবী ভ্রমি সহিয়া ঝটিকা কত ফিরিয়া আসিছে কবি কুটীরের পানে, মধ্যাহ্নের রৌদ্রে যথা জ্বলিয়া পুড়িয়া পাখী সন্ধ্যায় কুলায়ে তার আইসে ফিরিয়া। বহুদিন পরে কবি পদার্পিল বনভূমে, বৃক্ষলতা সবি তার পরিচিত সখা! তেমনি সকলি আছে, তেমনি গাইছে পাখী, তেমনি বহিছে বায়ু ঝর ঝর করি। অধীরে চলিল কবি কুটীরের পানে-- দুয়ারের কাছে গিয়া দুয়ারে আঘাত দিয়া ডাকিল অধীর স্বরে, নলিনী! নলিনী! কিছু নাই সাড়া শব্দ, দিল না উত্তর কেহ, প্রতিধ্বনি শুধু তারে করিল বিদ্রূপ। কুটীরে কেহই নাই, শূন্য তা রয়েছে পড়ি-- বেষ্টিত বিতন্ত্রী বীণা লূতাতন্তুজালে। ভ্রমিল আকুল কবি কাননে কাননে, ডাকিয়া সমুচ্চ স্বরে, নলিনী! নলিনী! মিলিয়া কবির স্বরে বনদেবী উচ্চস্বরে ডাকিল কাতরে আহা, নলিনী! নলিনী! কেহই দিল না সাড়া, শুধু সে শব্দ শুনি সুপ্ত হরিণেরা ত্রস্ত উঠিল জাগিয়া। অবশেষে গিরিশৃঙ্গে উঠিল কাতর কবি, নলিনীর সাথে যেথা থাকিত বসিয়া। দেখিল সে গিরি-শৃঙ্গে, শীতল তুষার-'পরে, নলিনী ঘুমায়ে আছে ম্লানমুখচ্ছবি। কঠোর তুষারে তার এলায়ে পড়েছে কেশ, খসিয়া পড়েছে পাশে শিথিল আঁচল। বিশাল নয়ন তার অর্দ্ধনিমীলিত, হাত দুটি ঢাকা আছে অনাবৃত বুকে। একটি হরিণশিশু খেলা করিবার তরে কভু বা অঞ্চল ধরি টানিতেছে তার, কভু শৃঙ্গ দুটি দিয়া সুধীরে দিতেছে ঠেলি, কভু বা অবাক্ নেত্রে রহিছে চাহিয়া! তবু নলিনীর ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গিছে না, নীরবে নিস্পন্দ হোয়ে রয়েছে ভূতলে। দূর হোতে কবি তারে দেখিয়া কহিল উচ্চে, "নলিনী, এয়েছি আমি দেখ্সে বালিকা।" তবুও নলিনী বালা না দিয়া উত্তর শীতল তুষার-'পরে রহিল ঘুমায়ে। কবি সে শিখর-'পরে করি আরোহণ শীতল অধর তার করিল চুম্বন—শিহরিয়া চমকিয়া দেখিল সে কবি না নড়ে হৃদয় তার, না পড়ে নিশ্বাস। দেখিল না, ভাবিল না, কহিল না কিছু, যেমন চাহিয়া ছিল রহিল চাহিয়া। নিদারুণ কি যেন কি দেখিছে তরাসে নয়ন হইয়া গেল অচল পাষাণ। কতক্ষণে কবি তবে পাইল চেতন, দেখিল তুষারশুভ্র নলিনীর দেহ হৃদয়জীবনহীন জড় দেহ তার অনুপম সৌন্দর্য্যের কুসুম-আলয়, হৃদয়ের মরমের আদরের ধন—তৃণ কাষ্ঠ সম ভূমে যায় গড়াগড়ি! বুকে তারে তুলে লয়ে ডাকিল "নলিনী", হৃদয়ে রাখিয়া তারে পাগলের মত কবি কহিল কাতর স্বরে "নলিনী" "নলিনী"! স্পন্দহীন, রক্তহীন অধর তাহার অধীর হইয়া ঘন করিল চুম্বন।              -- তার পর দিন হোতে সে বনে কবিরে আর পেলে না দেখিতে কেহ, গেছে সে কোথায়! ঢাকিল নলিনীদেহ তুষারসমাধি-- ক্রমে সে কুটীরখানি কোথা ভেঙ্গে চুরে গেল, ক্রমে সে কানন হোলো গ্রাম লোকালয়, সে কাননে--কবির সে সাধের কাননে অতীতের পদচিহ্ন রহিল না আর।   (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস) কবি-কাহিনী (দ্বিতীয় সর্গ) "এত কাল হে প্রকৃতি        করিনু তোমার সেবা,             তবু কেন এ হৃদয় পূরিল না দেবি?   এখনো বুকের মাঝে           রয়েছে দারুণ শূন্য,             সে শূন্য কি এ জনমে পূরিবে না আর?      মনের মন্দির মাঝে           প্রতিমা নাহিক যেন,             শুধু এ আঁধার গৃহ রয়েছে পড়িয়া--      কত দিন বল দেবি           রহিবে এমন শূন্য,             তা হোলে ভাঙিয়ে যাবে এ মনোমন্দির!      কিছু দিন পরে আর          দেখিব সেখানে চেয়ে             পূর্ব্ব হৃদয়ের আছে ভগ্ন-অবশেষ,    সে ভগ্ন-অবশেষে--           সুখের সমাধি 'পরে             বসিয়া দারুণ দুখে কাঁদিতে কি হবে?      মনের অন্তর-তলে            কি যে কি করিছে হুহু,             কি যেন আপন ধন নাইকো সেখানে,   সে শূন্য পূরাবে দেবি            ঘুরিছে পৃথিবীময়             মরুভূমে তৃষাতুর মৃগের মতন।      কত মরীচিকা দেবী           করেছে ছলনা মোরে,             কত ঘুরিয়াছি তার পশ্চাতে পশ্চাতে,      অবশেষে শ্রান্ত হয়ে           তোমারে শুধাই দেবি             এ শূন্য পূরিবে না কি কিছুতে আমার?      উঠিছে তপন শশী,           অস্ত যাইতেছে পুনঃ,             বসন্ত শরত শীত চক্রে ফিরিতেছে;      প্রতি পদক্ষেপে আমি         বাল্যকাল হোতে দেবি             ক্রমে ক্রমে কত দূর যেতেছি চলিয়া--     বাল্যকাল গেছে চলে,          এসেছে যৌবন এবে, যৌবন যাইবে চলি আসিবে বার্দ্ধক্য--      তবু এ মনের শূন্য             কিছুতে কি পূরিবে না?             মন কি করিবে হুহু চিরকাল তরে?      শুনিয়াছিলাম কোন্‌            উদাসী যোগীর কাছে--             "মানুষের মন চায় মানুষেরি মন;      গম্ভীর সে নিশীথিনী,           সুন্দর সে উষাকাল,             বিষণ্ণ সে সায়াহ্নের ম্লান মুখচ্ছবি,      বিস্তৃত সে অম্বুনিধি,           সমুচ্চ সে গিরিবর, আঁধার সে পর্ব্বতের গহ্বর বিশাল,      তটিনীর কলধ্বনি,              নির্ঝরের ঝর ঝর, আরণ্য বিহঙ্গদের স্বাধীন সঙ্গীত,      পারে না পূরিতে তারা  বিশাল মনুষ্য-হৃদি-- মানুষের মন চায় মানুষেরি মন।'      শুনিয়া, প্রকৃতিদেবি,          ভ্রমিণু পৃথিবীময়; কত লোক দিয়েছিল হৃদি-উপহার--      আমার মর্ম্মের গান            যবে গাহিতাম দেবি    কত লোক কেঁদেছিল শুনিয়া সে গীত।      তেমন মনের মত              মন পেলাম না দেবি,             আমার প্রাণের কথা বুঝিল না কেহ,      তাইতে নিরাশ হোয়ে         আবার এসেছি ফিরে,             বুঝি গো এ শূন্য মন পূরিল না আর।"      এইরূপে কেঁদে কেঁদে         কাননে কাননে কবি             একাকী আপন-মনে করিত ভ্রমণ।      সে শোক-সঙ্গীত শুনি         কাঁদিত কাননবালা,             নিশীথিনী হাহা করি ফেলিত নিশ্বাস,     বনের হরিণগুলি                আকুল নয়নে আহা             কবির মুখের পানে রহিত চাহিয়া।     "হাহা দেবি একি হোলো,     কেন পূরিল না প্রাণ"             প্রতিধ্বনি হোতো তার কাননে কাননে।     শীর্ণ নির্ঝরিণী যেথা           ঝরিতেছে মৃদু মৃদু,             উঠিতেছে কুলু কুলু জলের কল্লোল,     সেখানে গাছের তলে          একাকী বিষণ্ণ কবি             নীরবে নয়ন মুদি থাকিত শুইয়া--    তৃষিত হরিণশিশু               সলিল করিয়া পান             দেখি তার মুখপানে চলিয়া যাইত।    শীতরাত্রে পর্ব্বতের            তুষারশয্যার 'পরে             বসিয়া রহিত স্তব্ধ প্রতিমার মত,    মাথার উপরে তার             পড়িত তুষারকণা,             তীব্রতম শীতবায়ু যাইত বহিয়া।    দিনে দিনে ভাবনায়             শীর্ণ হোয়ে গেল দেহ,             প্রফুল্ল হৃদয় হোলো বিষাদে মলিন,   রাক্ষসী স্বপ্নের তরে           ঘুমালেও শান্তি নাই,             পৃথিবী দেখিত কবি শ্মশানের মত   এক দিন অপরাহ্নে              বিজন পথের প্রান্তে             কবি বৃক্ষতলে এক রহিছে শুইয়া,   পথ-শ্রমে শ্রান্ত দেহ,            চিন্তায় আকুল হৃদি,             বহিতেছে বিষাদের আকুল নিশ্বাস।   হেন কালে ধীরি ধীরি           শিয়রের কাছে আসি             দাঁড়াইল এক জন বনের বালিকা,   চাহিয়া মুখের পানে             কহিল করুণ স্বরে,             "কে তুমি গো পথশ্রান্ত বিষণ্ণ পথিক?   অধরে বিষাদ যেন               পেতেছে আসন তার             নয়ন কহিছে যেন শোকের কাহিনী।   তরুণ হৃদয় কেন                অমন বিষাদময়?             কি দুখে উদাস হোয়ে করিছ ভ্রমণ?"   গভীর নিশ্বাস ফেলি             গম্ভীরে কহিল কবি,             "প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না বালা?"   একে একে কত কথা    কহিল বালিকা কাছে,             যত কথা রুদ্ধ ছিল হৃদয়ে কবির--   আগ্নেয় গিরির বুকে            জ্বলন্ত অগ্নির মত             যত কথা ছিল কবি কহিলা গম্ভীরে।   "নদ নদী গিরি গুহা              কত দেখিলাম, তবু             প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না দেবি।"   বালার কপোল বাহি              নীরবে অশ্রুর বিন্দু             স্বর্গের শিশির-সম পড়িল ঝরিয়া,   সেই এক অশ্রুবিন্দু               অমৃতধারার মত             কবির হৃদয় গিয়া প্রবেশিল যেন;   দেখি সে করুণবারি              নিরশ্রু কবির চোখে             কত দিন পরে হোল অশ্রুর উদয়।   শ্রান্ত হৃদয়ের তরে              যে আশ্রয় খুঁজে খুঁজে             পাগল ভ্রমিতেছিল হেথায় হোথায়--   আজ যেন এইটুকু               আশ্রয় পাইল হৃদি,             আজ যেন একটুকু জুড়ালো যন্ত্রণা।   যে হৃদয় নিরাশায়                মরুভূমি হোয়েছিল             সেথা হোতে হল আজ অশ্রু উৎসারিত।   শ্রান্ত সে কবির মাথা             রাখিয়া কোলের 'পরে,             সরলা মুছায়ে দিল অশ্রুবারিধারা।   কবি সে ভাবিল মনে,           তুমি কোথাকার দেবী             কি অমৃত ঢালিলে গো প্রাণের ভিতর!   ললনা তখন ধীরে               চাহিয়া কবির মুখে             কহিল মমতাময় করুণ কথায়,--   "হোথায় বিজন বনে             দেখেছ কুটীর ওই,             চল পান্থ ওইখানে যাই দুজনায়।   বন হোতে ফল মূল             আপনি তুলিয়া দিব, নির্ঝর হইতে তুলি আনিব সলিল,   যতনে পর্ণের শয্যা              দিব আমি বিছাইয়া,             সুখনিদ্রা-কোলে সেথা লভিবে বিরাম,   আমার বীণাটি লয়ে              গান শুনাইব কত,             কত কি কথায় দিন যাইবে কাটিয়া।   হরিণশাবক এক                 আছে ও গাছের তলে,             সে যে আসি কত খেলা খেলিবে পথিক।   দূরে সরসীর ধারে               আছে এক চারু কুঞ্জ, তোমারে লইয়া পান্থ দেখাব সে বন।   কত পাখী ডালে ডালে  সারাদিন গাইতেছে,             কত যে হরিণ সেথা করিতেছে খেলা।   আবার দেখাব সেই               অরণ্যের নির্ঝরিণী, আবার নদীর ধারে লয়ে যাব আমি,   পাখী এক আছে মোর        সে যে কত গায় গান--             নাম ধোরে ডাকে মোরে "নলিনী' "নলিনী'।   যা আছে আমার কিছু           সব আমি দেখাইব,             সব আমি শুনাইব যত জানি গান--   আসিবে কি পান্থ ওই           বনের কুটীরমাঝে?"             এতেক শুনিয়া কবি চলিল কুটীরে।   কি সুখে থাকিত কবি,  বিজন কুটীরে সেই             দিনগুলি কেটে যেত মুহূর্তের মত—কি শান্ত সে বনভূমি,             নাই লোক নাই জন,             শুধু সে কুটীরখানি আছে এক ধারে।   আঁধার তরুর ছায়ে--            নীরব শান্তির কোলে             দিবস যেন রে সেথা রহিত ঘুমায়ে।   পাখীর অস্ফুট গান,              নির্ঝরের ঝরঝর             স্তব্ধতারে আরো যেন দিত মিষ্ট করি।   আগে এক দিন কবি              মুগ্ধ প্রকৃতির রূপে             অরণ্যে অরণ্যে একা করিত ভ্রমণ,   এখন দুজনে মিলি                ভ্রমিয়া বেড়ায় সেথা,             দুই জন প্রকৃতির বালক বালিকা।   সুদূর কাননতলে                 কবিরে লইয়া যেত             নলিনী, সে যেন এক বনেরি দেবতা।   শ্রান্ত হোলে পথশ্রমে             ঘুমাত কবির কোলে,             খেলিত বনের বায়ু কুন্তল লইয়া,   ঘুমন্ত মুখের পানে                চাহিয়া রহিত কবি--             মুখে যেন লিখা আছে আরণ্য কবিতা।   "একি দেবি কলপনা,            এত সুখ প্রণয়ে যে             আগে তাহা জানিতাম না ত!   কি এক অমৃতধারা               ঢেলেছ প্রাণের 'পরে             হে প্রণয় কহিব কেমনে?   অন্য এক হৃদয়েরে                হৃদয় করা গো দান,             সে কি এক স্বর্গীয় আমোদ।   এক গান গায় যদি                 দুইটি হৃদয়ে মিলি,             দেখে যদি একই স্বপন,   এক চিন্তা এক আশা              এক ইচ্ছা দুজনার,             এক ভাবে দুজনে পাগল,   হৃদয়ে হৃদয়ে হয়                  সে কি গো সুখের মিল--             এ জনমে ভাঙ্গিবে না তাহা।   আমাদের দুজনের                 হৃদয়ে হৃদয়ে দেবি             তেমনি মিশিয়া যায় যদি--   এক সাথে এক স্বপ্ন              দেখি যদি দুই জনে             তা হইলে কি হয় সুন্দর!   নরকে বা স্বর্গে থাকি,            অরণ্যে বা কারাগারে             হৃদয়ে হৃদয়ে বাঁধা হোয়ে--   কিছু ভয় করি নাকো--বিহ্বল প্রণয়ঘোরে             থাকি সদা মরমে মজিয়া।   তাই হোক্‌--হোক্‌ দেবি আমাদের দুই জনে             সেই প্রেম এক কোরে দিক্‌।   মজি স্বপনের ঘোরে               হৃদয়ের খেলা খেলি             যেন যায় জীবন কাটিয়া।"   নিশীথে একেলা হোলে  এইরূপ কত গান             বিরলে গাইত কবি বসিয়া বসিয়া।   সুখ বা দুখের কথা                বুকের ভিতরে যাহা             দিন রাত্রি করিতেছে আলোড়িত-প্রায়,   প্রকাশ না হোলে তাহা,মরমের গুরুভারে             জীবন হইয়া পড়ে দারুণ ব্যথিত।   কবি তার মরমের                 প্রণয় উচ্ছ্বাস-কথা             কি করি যে প্রকাশিবে পেত না ভাবিয়া।   পৃথিবীতে হেন ভাষা             নাইক, মনের কথা             পারে যাহা পূর্ণভাবে করিতে প্রকাশ।   ভাব যত গাঢ় হয়,                প্রকাশ করিতে গিয়া             কথা তত না পায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া।   বিষাদ যতই হয়                   দারুণ অন্তরভেদী,             অশ্রুজল তত যায় শুকায়ে যেমন!   মরমের ভার-সম                  হৃদয়ের কথাগুলি             কত দিন পারে বল চাপিয়া রাখিতে?   একদিন ধীরে ধীরে               বালিকার কাছে গিয়া             অশান্ত বালক-মত কহিল কত কি!   অসংলগ্ন কথাগুলি,             মরমের ভাব আরো             গোলমাল করি দিল প্রকাশ না করি।   কেবল অশ্রুর জলে,              কেবল মুখের ভাবে             পড়িল বালিকা তার মনের কি কথা!   এই কথাগুলি যেন                পড়িল বালিকা ধীরে--             "কত ভাল বাসি বালা কহিব কেমনে!    তুমিও সদয় হোয়ে               আমার সে প্রণয়ের             প্রতিদান দিও বালা এই ভিক্ষা চাই।"   গড়ায়ে পড়িল ধীরে                বালিকার অশ্রুজল,             কবির অশ্রুর সাথে মিশিল কেমন—স্কন্ধে তার রাখি মাথা            কহিল কম্পিত স্বরে,             "আমিও তোমারে কবি বাসি না কি ভাল?"   কথা না স্ফুরিল আর, শুধু অশ্রুজলরাশি             আরক্ত কপোল তার করিল প্লাবিত।   এইরূপ মাঝে মাঝে              অশ্রুজলে অশ্রুজলে             নীরবে গাইত তারা প্রণয়ের গীত।   অরণ্যে দুজনে মিলি              আছিল এমন সুখে             জগতে তারাই যেন আছিল দুজন—যেন তারা সুকোমল              ফুলের সুরভি শুধু,             যেন তারা অপ্সরার সুখের সঙ্গীত।   আলুলিত চুলগুলি               সাজাইয়া বনফুলে             ছুটিয়া আসিত বালা কবির কাছেতে,   একথা ওকথা লয়ে                কি যে কি কহিত বালা             কবি ছাড়া আর কেহ বুঝিতে নারিত।   কভু বা মুখের পানে              সে যে কি রহিত চেয়ে,             ঘুমায়ে পড়িত যেন হৃদয় কবির।   কভু বা কি কথা লয়ে            সে যে কি হাসিত হাসি,             তেমন সরল হাসি দেখ নি কেহই।   আঁধার অমার রাত্রে               একাকী পর্ব্বতশিরে             সেও গো কবির সাথে রহিত দাঁড়ায়ে,   উনমত্ত ঝড় বৃষ্টি                   বিদ্যুৎ আশনি আর             পর্ব্বতের বুকে যবে বেড়াত মাতিয়া,   তাহারো হৃদয় যেন               নদীর তরঙ্গ-সাথ             করিত গো মাতামাতি হেরি সে বিপ্লব—করিত সে ছুটাছুটি,              কিছুতে সে ডরিত না,             এমন দুরন্ত মেয়ে দেখি নি ত আর!   কবি যা কহিত কথা              শুনিত কেমন ধীরে,             কেমন মুখের পানে রহিত চাহিয়া।   বনদেবতার মত                   এমন সে এলোথেলো,             কখনো দুরন্ত অতি ঝটিকা যেমন,   কখনো এমন শান্ত                 প্রভাতের বায়ু যথা             নীরবে শুনে গো যবে পাখীর সঙ্গীত।   কিন্তু, কলপনা, যদি              কবির হৃদয় দেখ             দেখিবে এখনো তাহা পূর্ণ হয় নাই।   এখনো কহিছে কবি,              "আরো দাও ভালবাসা,             আরো ঢালো' ভালবাসা হৃদয়ে আমার।"   প্রেমের অমৃতধারা                 এত যে করেছে পান,             তবু মিটিল না কেন প্রণয়পিপাসা?   প্রেমের জোছনাধারা               যত ছিল ঢালি বালা             কবির সমুদ্র-হৃদি পারে নি পূরিতে।   স্বাধীন বিহঙ্গ-সম,                 কবিদের তরে দেবি             পৃথিবীর কারাগার যোগ্য নহে কভু।   অমন সমুদ্র-সম                    আছে যাহাদের মন             তাহাদের তরে দেবি নহে এ পৃথিবী।   তাদের উদার মন                  আকাশে উড়িতে যায়,             পিঞ্জরে ঠেকিয়া পক্ষ নিম্নে পড়ে পুনঃ,   নিরাশায় অবশেষে                 ভেঙ্গে চুরে যায় মন,             জগৎ পূরায় তার আকুল বিলাপে।   কবির সমুদ্র-বুক                   পূরাতে পারিবে কিসে             প্রেম দিয়া ক্ষুদ্র ওই বনের বালিকা।   কাতর ক্রন্দনে আহা               আজিও কাঁদিল কবি,             "এখনও পূরিল না প্রাণের শূন্যতা।"   বালিকার কাছে গিয়া               কাতরে কহিল কবি,             "আরো দাও ভালবাসা হৃদয়ে ঢালিয়া।   আমি যত ভালবাসি                তত দাও ভালবাসা,             নহিলে গো পূরাবে না এ প্রাণের শূন্যতা।"   শুনিয়া কবির কথা                 কাতরে কহিল বালা,             "যা ছিল আমার কবি দিয়েছি সকলি--   এ হৃদয়, এ পরাণ,                সকলি তোমার কবি,             সকলি তোমার প্রেমে দেছি বিসর্জ্জন।   তোমার ইচ্ছার সাথে              ইচ্ছা মিশায়েছি মোর,             তোমার সুখের সাথে মিশায়েছি সুখ।"   সে কথা শুনিয়া কবি               কহিল কাতর স্বরে,             "প্রাণের শূন্যতা তবু ঘুচিল না কেন?   ওই হৃদয়ের সাথে                  মিশাতে চাই এ হৃদি,             দেহের আড়াল তবে রহিল গো কেন?   সারাদিন সাধ যায়                  সুধাই মনের কথা,             এত কথা তব কেন পাই না খুঁজিয়া?   সারাদিন সাধ যায়                  দেখি ও মুখের পানে,             দেখেও মিটে না কেন আঁখির পিপাসা?   সাধ যায় এ জীবন                  প্রাণ ভোরে ভাল বাসি,             বেসেও প্রাণের শূন্য ঘুচিল না কেন?   আমি যত ভালবাসি                তত দাও ভালবাসা,             নহিলে গো পূরিবে না প্রাণের শূন্যতা।   একি দেবি! একি তৃষ্ণা জ্বলিছে হৃদয়ে মোর,             ধরার অমৃত যত করিয়াছি পান,   প্রকৃতির কাছে যত               তরল স্বর্গীয় গীতি,             সকলি হৃদয়ে মোর দিয়াছি ঢালিয়া--   শুধু দেবি পৃথিবীর                হলাহল আছে যত             তাহাই করি নি পান মিটাতে পিপাসা!   শুধু দেবি ঐশ্বর্য্যের               কনকশৃঙ্খল দিয়া             বাঁধি নাই আমার এ স্বাধীন হৃদয়!   শুধু দেবি মিটাইতে               মনের বীরত্ব-গর্ব্ব             লক্ষ মানবের রক্তে ধুই নি চরণ!   শুধু দেবি এ জীবনে               নিশাচর বিলাসেরে             সুখ-স্বাস্থ্য অর্ঘ্য দিয়া করি নাই সেবা!   তবু কেন হৃদয়ের                 তৃষা মিটিল না মোর,             তবু কেন ঘুচিল না প্রাণের শূন্যতা?   শুনেছি বিলাসসুরা                 বিহ্বল করিয়া হৃদি             ডুবাইয়া রাখে সদা বিস্মৃতির ঘুমে!   কিন্তু দেবি-- কিন্তু দেবি--         এত যে পেয়েছি কষ্ট,             বিস্মৃতি চাই নে তবু বিস্মৃতি চাই নে!--   সে কি ভয়ানক দশা,              কল্পনাও শিহরে গো--             স্বর্গীয় এ হৃদয়ের জীবনে মরণ!   আমার এ মন দেবি                 হোক্‌ মরুভূমি-সম             তৃণলতা-জল-শূন্য জ্বলন্ত প্রান্তর,   তবুও তবুও আমি                 সহিব তা প্রাণপণে,             বহিব তা যত দিন রহিব বাঁচিয়া,   মিটাতে মনের তৃষা                ত্রিভুবন পর্য্যটিব,             হত্যা করিব না তবু হৃদয় আমার।   প্রেম ভক্তি স্নেহ আদি  মনের দেবতা যত             যতনে রেখেছি আমি মনের মন্দিরে,   তাঁদের করিতে পূজা              ক্ষমতা নাইকো ব'লে             বিসর্জ্জন করিবারে পারিব না আমি।   কিন্তু ওগো কলপনা                আমার মনের কথা             বুঝিতে কে পারিবেক বল দেখি দেবি?   আমার ব্যথার মর্ম্ম                কারে বুঝাইবে বল—বুঝাইতে না পারিলে বুক যায় ফেটে।   যদি কেহ বলে দেবি                "তোমার কিসে দুখ,             হৃদয়ের বিনিময়ে পেয়েছ হৃদয়,   তবে কাল্পনিক দুখে              এত কেন ম্রিয়মাণ?'             তবে কি বলিয়া আমি দিব গো উত্তর?   উপায় থাকিতে তবু               যে সহে বিষাদজ্বালা             পৃথিবী তাহারি কষ্টে হয় গো ব্যথিত--   আমার এ বিষাদের                 উপায় নাইক কিছু,             কারণ কি তাও দেবি পাই না খুঁজিয়া।   পৃথিবী আমার কষ্ট                 বুঝুক্‌ বা না বুঝুক্‌,             নলিনীরে কি বলিয়া বুঝাইব দেবি?   তাহারে সামান্য কথা              গোপন করিলে পরে             হৃদয়ে কি কষ্ট হয় হৃদয় তা জানে।   এত তারে ভালবাসি,             তবু কেন মনে হয়             ভালবাসা হইল না আশ মিটাইয়া!   আঁধার সমুদ্রতলে                  কি যেন বেড়াই খুঁজে,             কি যেন পাইতেছি না চাহিতেছি যাহা।   বুকের যেখানে তারে              রাখিতে চাই গো আমি             সেখানে পাই নে যেন রাখিতে তাহারে--   তাইতে অন্তর বুক                 এখনো পূরিতেছে না,             তাইতে এখনো শূন্য রয়েছে হৃদয়।"   কবির প্রণয়সিন্ধু                   ক্ষুদ্র বালিকার মন             রেখেছিল মগ্ন করি অগাধ সলিলে--   উপরে যে ঝড় ঝঞ্ঝা               কত কি বহিয়া যেত             নিম্নে তার কোলাহল পেত না শুনিতে,   প্রণয়ের অবিচিত্র                   নিয়তনূতন তবু             তরঙ্গের কলধ্বনি শুনিত কেবল,   সেই একতান ধ্বনি                 শুনিয়া শুনিয়া তার             হৃদয় পড়িয়াছিল ঘুমায়ে কেমন!   বনের বালিকা আহা               সে ঘুমে বিহ্বল হোয়ে             কবির হৃদয়ে রাখি অবশ মস্তক   স্বর্গের স্বপন শুধু                  দেখিত দিবস রাত,             হৃদয়ের হৃদয়ের অনন্ত মিলন।   বালিকার সে হৃদয়ে                সে প্রণয়মগ্ন হৃদে,             অবশিষ্ট আছিল না এক তিল স্থান--   আর কিছু জানিত না,   আর কিছু ভাবিত না,             শুধু সে বালিকা ভাল বাসিত কবিরে।   শুধু সে কবির গান                 কত যে লাগিত ভাল,             শুনে শুনে শুনা তার ফুরাত না আর।   শুধু সে কবির নেত্র                কি এক স্বর্গীয় জ্যোতি             বিকীরিত, তাই হেরি হইত বিহ্বল!   শুধু সে কবির কোলে    ঘুমাতে বাসিত ভাল,             কবি তার চুল লয়ে করিত কি খেলা।   শুধু সে কবিরে বালা              শুনতে বাসিত ভাল             কত কি--কত কি কথা অর্থ নাই যার,   কিন্তু সে কথায় কবি               কত যে পাইত অর্থ             গভীর সে অর্থ নাই কত কবিতার--   সেই অর্থহীন কথা,                হৃদয়ের ভাব যত             প্রকাশ করিতে পারে না এমন কিছু না।   একদিন বালিকারে                 কবি সে কহিল গিয়া--             "নলিনি! চলিনু আমি ভ্রমিতে পৃথিবী!   আর একবার বালা                 কাশ্মীরের বনে বনে             যাই গো শুনিতে আমি পাখীর কবিতা!   রুসিয়ার হিমক্ষেত্রে                আফ্রিকার মরুভূমে             আর একবার আমি করি গে ভ্রমণ!   এইখানে থাক তুমি,              ফিরিয়া আসিয়া পুনঃ             ওই মধুমুখখানি করিব চুম্বন।"   এতেক কহিয়া কবি                নীরবে চলিয়া গেল             গোপনে মুছিয়া ফেলি নয়নের জল।   বালিকা নয়ন তুলি                নীরবে রহিল চাহি,             কি দেখিছে সেই জানে অনিমিষ চখে।   সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে   তবুও রহিল চাহি,             তবুও ত পড়িল না নয়নে নিমেষ।   অনিমিষ নেত্র ক্রমে                করিয়া প্লাবিত             একবিন্দু দুইবিন্দু ঝরিল সলিল।   বাহুতে লুকায়ে মুখ               কাতর বালিকা             মর্ম্মভেদী অশ্রুজলে করিল রোদন।   হা-হা কবি কি করিলে,ফিরে দেখ, ফিরে এস,             দিও না বালার হৃদে অমন আঘাত--   নীরবে বালার আহা                কি বজ্র বেজেছে বুকে,             গিয়াছে কোমল মন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া!   হা কবি অমন কোরে               অনর্থক তার মনে             কি আঘাত করিলে যে বুঝিলে না তাহা?   এত কাল সুখস্বপ্ন                  ডুবায়ে রাখিয়া মন,             এত দিন পরে তাহা দিবে কি ভাঙ্গিয়া?   কবি ত চলিয়া যায়--    সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে,             আঁধারে কাননভূমি হইল গম্ভীর--   একটি নড়ে না পাতা,   একটু বহে না বায়ু,             স্তব্ধ বন কি যেন কি ভাবিছে নীরবে!   তখন বনান্ত হোতে                সুধীরে শুনিল কবি             উঠিছে নীরব শূন্যে বিষণ্ণ সঙ্গীত--   তাই শুনি বন যেন                 রয়েছে নীরবে অতি,             জোনাকি নয়ন শুধু মেলিছে মুদিছে।   একবার কবি শুধু                  চাহিল কুটীরপানে,             কাতরে বিদায় মাগি বনদেবী-কাছে   নয়নের জল মুছি--                যে দিকে নয়ন চলে             সে দিকে পথিক কবি যাইল চলিয়া।                        সঙ্গীত             কেন ভালবাসিলে আমায়?             কিছুই নাইক গুণ, কিছুই জানি না আমি,             কি আছে? কি দিয়ে তব তুষিব হৃদয়! যা আমার ছিল সাধ্য               সকলি করেছি আমি             কিছুই করি নি দোষ চরণে তোমার, শুধু ভাল বাসিয়াছি,               শুধু এ পরান মন             উপহার সঁপিয়াছি তোমার চরণে। তাতেও তোমার মন              তুষিতে নারিনু যদি             তবে কি করিব বল, কি আছে আমার? গেলে যদি, গেলে চলি,           যাও যেথা ভাল লাগে--             একবার মনে কোরো দীন অধীনীরে। ভ্রমিতে ধরার মাঝে                যত ভালবাসা পাবে,             তাতে যদি ভাল থাক তাই হোক্‌ তবে-- তবু একবার যদি                   মনে কর নলিনীরে             যে দুখিনী, যে তোমারে এত ভালবাসে! কি করিলে মন তব                পারিতাম জুড়াইতে             যদি জানিতাম কবি করিতাম তাহা! আমি অতি অভাগিনী              জানি না বলিয়া যেন             বিরক্ত হোয়ো না কবি এই ভিক্ষা দাও! না জানিয়া না শুনিয়া              যদি দোষ করে থাকি, ক্ষুদ্র আমি, ক্ষমা তবে করিয়ো আমারে-- তুমি ভাল থেকো কবি,ক্ষুদ্র এক কাঁটা যেন             ফুটে না তোমার পায়ে ভ্রমিতে পৃথিবী। জননি, কোথায় তুমি              রেখে গেলে দুহিতারে?             কত দিন একা একা কাটালাম হেথা, একেলা তুলিয়া ফুল              কত মালা গাঁথিতাম,             একেলা কাননময় করিতাম খেলা! তোমার বীণাটি ল'য়ে,   উঠিয়া পর্ব্বতশিরে             একেলা আপন মনে গাইতাম গান-- হরিণশিশুটি মোর                  বসিত পায়ের তলে,             পাখীটি কাঁধের 'পরে শুনিত নীরবে। এইরূপ কত দিন                   কাটালেম বনে বনে,             কত দিন পরে তবে এলে তুমি কবি! তখন তোমারে কবি               কি যে ভালবাসিলাম এত ভাল কাহারেও বাসি নাই কভু। দূর স্বরগের এক                   জ্যোতির্ম্ময় দেব-সম             কত বার মনে মনে করেছি প্রণাম। দূর থেকে আঁখি ভরি             দেখিতাম মুখখানি,             দূর থেকে শুনিতাম মধুময় গান। যে দিন আপনি আসি    কহিলে আমার কাছে             ক্ষুদ্র এই বালিকারে ভালবাস তুমি, সে দিন কি হর্ষে কবি    কি আনন্দে কি উচ্ছ্বাসে             ক্ষুদ্র এ হৃদয় মোর ফেটে গেল যেন। আমি কোথাকার কেবা! আমি ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র,             স্বর্গের দেবতা তুমি ভালবাস মোরে? এত সৌভাগ্য, কবি,     কখনো করি নি আশা--             কখনো মুহূর্ত্ত-তরে জানি নি স্বপনে। যেথায় যাও-না কবি,              যেথায় থাক-না তুমি,             আমরণ তোমারেই করিব অর্চ্চনা। মনে রাখ নাই রাখ,                তুমি যেন সুখে থাক             দেবতা! এ দুখিনীর শুন গো প্রার্থনা।   (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস) কবি-কাহিনী (প্রথম সর্গ) শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া। তোমার বীণার ধ্বনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে শুনিত, দেখিত কত সুখের স্বপন। একাকী আপন মনে সরল শিশুটি তোমারি কমল-বনে করিত গো খেলা, মনের কত কি গান গাহিত হরষে, বনের কত কি ফুলে গাঁথিত মালিকা। একাকী আপন মনে কাননে কাননে যেখানে সেখানে শিশু করিত ভ্রমণ; একাকী আপন মনে হাসিত কাঁদিত। জননীর কোল হতে পালাত ছুটিয়া, প্রকৃতির কোলে গিয়া করিত সে খেলা-- ধরিত সে প্রজাপতি, তুলিত সে ফুল, বসিত সে তরুতলে, শিশিরের ধারা ধীরে ধীরে দেহে তার পড়িত ঝরিয়া। বিজন কুলায়ে বসি গাহিত বিহঙ্গ, হেথা হোথা উঁকি মারি দেখিত বালক কোথায় গাইছে পাখী। ফুলদলগুলি, কামিনীর গাছ হোতে পড়িলে ঝরিয়া ছড়ায়ে ছড়ায়ে তাহা করিত কি খেলা! প্রফুল্ল উষার ভূষা অরুণকিরণে বিমল সরসী যবে হোত তারাময়ী, ধরিতে কিরণগুলি হইত অধীর। যখনি গো নিশীথের শিশিরাশ্রু-জলে ফেলিতেন উষাদেবী সুরভি নিশ্বাস, গাছপালা লতিকার পাতা নড়াইয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিয়া ঘুমন্ত নদীর যখনি গাহিত বায়ু বন্য-গান তার, তখনি বালক-কবি ছুটিত প্রান্তরে, দেখিত ধান্যের শিষ দুলিছে পবনে। দেখিত একাকী বসি গাছের তলায়, স্বর্ণময় জলদের সোপানে সোপানে উঠিছেন উষাদেবী হাসিয়া হাসিয়া। নিশা তারে ঝিল্লীরবে পাড়াইত ঘুম, পূর্ণিমার চাঁদ তার মুখের উপরে তরল জোছনা-ধারা দিতেন ঢালিয়া, স্নেহময়ী মাতা যথা সুপ্ত শিশুটির মুখপানে চেয়ে চেয়ে করেন চুম্বন। প্রভাতের সমীরণে, বিহঙ্গের গানে উষা তার সুখনিদ্রা দিতেন ভাঙ্গায়ে। এইরূপে কি একটি সঙ্গীতের মত, তপনের স্বর্ণময়-কিরণে প্লাবিত প্রভাতের একখানি মেঘের মতন, নন্দন বনের কোন অপ্সরা-বালার সুখময় ঘুমঘোরে স্বপনের মত কবির বালক-কাল হইল বিগত।                -- যৌবনে যখনি কবি করিল প্রবেশ, প্রকৃতির গীতধ্বনি পাইল শুনিতে, বুঝিল সে প্রকৃতির নীরব কবিতা। প্রকৃতি আছিল তার সঙ্গিনীর মত। নিজের মনের কথা যত কিছু ছিল কহিত প্রকৃতিদেবী তার কানে কানে, প্রভাতের সমীরণ যথা চুপিচুপি কহে কুসুমের কানে মরমবারতা। নদীর মনের গান বালক যেমন বুঝিত, এমন আর কেহ বুঝিত না। বিহঙ্গ তাহার কাছে গাইত যেমন, এমন কাহারো কাছে গাইত না আর। তার কাছে সমীরণ যেমন বহিত এমন কাহারো কাছে বহিত না আর। যখনি রজনীমুখ উজলিত শশী, সুপ্ত বালিকার মত যখন বসুধা সুখের স্বপন দেখি হাসিত নীরবে, বসিয়া তটিনীতীরে দেখিত সে কবি-- স্নান করি জোছনায় উপরে হাসিছে সুনীল আকাশ, হাসে নিম্নে স্রোতস্বিনী; সহসা সমীরণের পাইয়া পরশ দুয়েকটি ঢেউ কভু জাগিয়া উঠিছে। ভাবিত নদীর পানে চাহিয়া চাহিয়া, নিশাই কবিতা আর দিবাই বিজ্ঞান। দিবসের আলোকে সকলি অনাবৃত, সকলি রয়েছে খোলা চখের সমুখে-- ফুলের প্রত্যেক কাঁটা পাইবে দেখিতে। দিবালোকে চাও যদি বনভূমি-পানে, কাঁটা খোঁচা কর্দ্দমাক্ত বীভৎস জঙ্গল তোমার চখের 'পরে হবে প্রকাশিত; দিবালোকে মনে হয় সমস্ত জগৎ নিয়মের যন্ত্রচক্রে ঘুরিছে ঘর্ঘরি। কিন্তু কবি নিশাদেবী কি মোহন-মন্ত্র পড়ি দেয় সমুদয় জগতের 'পরে, সকলি দেখায় যেন স্বপ্নের মতন; ঐ স্তব্ধ নদীজলে চন্দ্রের আলোকে পিছলিয়া চলিতেছে যেমন তরণী, তেমনি সুনীল ঐ আকাশসলিলে ভাসিয়া চলেছে যেন সমস্ত জগৎ; সমস্ত ধরারে যেন দেখিয়া নিদ্রিত, একাকী গম্ভীর-কবি নিশাদেবী ধীরে তারকার ফুলমালা জড়ায়ে মাথায়, জগতের গ্রন্থ কত লিখিছে কবিতা। এইরূপে সেই কবি ভাবিত কত কি। হৃদয় হইল তার সমুদ্রের মত, সে সমুদ্রে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারকার প্রতিবিম্ব দিবানিশি পড়িত খেলিত, সে সমুদ্র প্রণয়ের জোছনা-পরশে লঙ্ঘিয়া তীরের সীমা উঠিত উথলি, সে সমুদ্র আছিল গো এমন বিস্তৃত সমস্ত পৃথিবীদেবী, পারিত বেষ্টিতে নিজ স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে। সে সিন্ধু-হৃদয়ে দুরন্ত শিশুর মত মুক্ত সমীরণ হু হু করি দিবানিশি বেড়াত খেলিয়া। নির্ঝরিণী, সিন্ধুবেলা, পর্ব্বতগহ্বর, সকলি কবির ছিল সাধের বসতি। তার প্রতি তুমি এত ছিলে অনুকূল কল্পনা! সকল ঠাঁই পাইত শুনিতে তোমার বীণার ধ্বনি, কখনো শুনিত প্রস্ফুটিত গোলাপের হৃদয়ে বসিয়া বীণা লয়ে বাজাইছ অস্ফুট কি গান। কনককিরণময় উষার জলদে একাকী পাখীর সাথে গাইতে কি গীত তাই শুনি যেন তার ভাঙ্গিত গো ঘুম! অনন্ত-তারা-খচিত নিশীথগগনে বসিয়া গাইতে তুমি কি গম্ভীর গান, তাহাই শুনিয়া যেন বিহ্বলহৃদয়ে নীরবে নিশীথে যবে একাকী রাখাল সুদূর কুটীরতলে বাজাইত বাঁশী তুমিও তাহার সাথে মিলাইতে ধ্বনি, সে ধ্বনি পশিত তার প্রাণের ভিতর। নিশার আঁধার-কোলে জগৎ যখন দিবসের পরিশ্রমে পড়িত ঘুমায়ে তখন সে কবি উঠি তুষারমন্ডিত সমুচ্চ পর্ব্বতশিরে গাইত একাকী প্রকৃতিবন্দনাগান মেঘের মাঝারে। সে গম্ভীর গান তার কেহ শুনিত না, কেবল আকাশব্যাপী স্তব্ধ তারকারা এক দৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া। কেবল, পর্ব্বতশৃঙ্গ করিয়া আঁধার, সরল পাদপরাজি নিস্তব্ধ গম্ভীর ধীরে ধীরে শুনিত গো তাহার সে গান; কেবল সুদূর বনে দিগন্তবালায় হৃদয়ে সে গান পশি প্রতিধ্বনিরূপে মৃদুতর হোয়ে পুন আসিত ফিরিয়া। কেবল সুদূর শৃঙ্গে নির্ঝরিণী বালা সে গম্ভীর গীতি-সাথে কণ্ঠ মিশাইত, নীরবে তটিনী যেত সমুখে বহিয়া, নীরবে নিশীথবায়ু কাঁপাত পল্লব। গম্ভীরে গাইত কবি--"হে মহাপ্রকৃতি, কি সুন্দর, কি মহান্‌ মুখশ্রী তোমার, শূন্য আকাশের পটে হে প্রকৃতিদেবি কি কবিতা লিখেছে যে জ্বলন্ত অক্ষরে, যত দিন রবে প্রাণ পড়িয়া পড়িয়া তবু ফুরাবে না পড়া; মিটিবে না আশ! শত শত গ্রহ তারা তোমার কটাক্ষে কাঁপি উঠে থরথরি, তোমার নিশ্বাসে ঝটিকা বহিয়া যায় বিশ্বচরাচরে। কালের মহান্‌ পক্ষ করিয়া বিস্তার, অনন্ত আকাশে থাকি হে আদি জননি, শাবকের মত এই অসংখ্য জগৎ তোমার পাখার ছায়ে করিছ পালন! সমস্ত জগৎ যবে আছিল বালক, দুরন্ত শিশুর মত অনন্ত আকাশে করিত গো ছুটাছুটি না মানি শাসন, স্তনদানে পুষ্ট করি তুমি তাহাদের অলঙ্ঘ্য সখ্যের ডোরে দিলে গো বাঁধিয়া। এ দৃঢ় বন্ধন যদি ছিঁড়ে একবার, সে কি ভয়ানক কাণ্ড বাঁধে এ জগতে, কক্ষচ্ছিন্ন কোটি কোটি সূর্য্য চন্দ্র তারা অনন্ত আকাশময় বেড়ায় মাতিয়া, মণ্ডলে মণ্ডলে ঠেকি লক্ষ সূর্য্য গ্রহ চূর্ণ চূর্ণ হোয়ে পড়ে হেথায় হোথায়; এ মহান্‌ জগতের ভগ্ন অবশেষ চূর্ণ নক্ষত্রের স্তূপ, খণ্ড খণ্ড গ্রহ বিশৃঙ্খল হোয়ে রহে অনন্ত আকাশে! অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সময়, যা ভাবিতে পৃথিবীর কীট মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধি হোয়ে পড়ে ভয়ে সঙ্কুচিত, তাহাই তোমার দেবি সাধের আবাস। তোমার মুখের পানে চাহিতে হে দেবি ক্ষুদ্র মানবের এই স্পর্ধিত জ্ঞানের দুর্ব্বল নয়ন যায় নিমীলিত হোয়ে। হে জননি আমার এ হৃদয়ের মাঝে অনন্ত-অতৃপ্তি-তৃষ্ণা জ্বলিছে সদাই, তাই দেবি পৃথিবীর পরিমিত কিছু পারে না গো জুড়াইতে হৃদয় আমার, তাই ভাবিয়াছি আমি হে মহাপ্রকৃতি, মজিয়া তোমার সাথে অনন্ত প্রণয়ে জুড়াইব হৃদয়ের অনন্ত পিপাসা! প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া, তত দূর জানিবারে জীবন আমার করেছি ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ। ভ্রমিতেছি পৃথিবীর কাননে কাননে-- বিহঙ্গও যত দূর পারে না উড়িতে সে পর্ব্বতশিখরেও গিয়াছি একাকী; দিবাও পশে নি দেবি যে গিরিগহ্বরে, সেথায় নির্ভয়ে আমি করেছি প্রবেশ। যখন ঝটিকা ঝঞ্ঝা প্রচণ্ড সংগ্রামে অটল পর্ব্বতচূড়া করেছে কম্পিত, সুগম্ভীর অম্বুনিধি উন্মাদের মত করিয়াছে ছুটাছুটি যাহার প্রতাপে, তখন একাকী আমি পর্ব্বত-শিখরে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি সে ঘোর বিপ্লব, মাথার উপর দিয়া অজস্র অশনি সুবিকট অট্টহাসে গিয়াছে ছুটিয়া, প্রকাণ্ড শিলার স্তূপ পদতল হোতে পড়িয়াছে ঘর্ঘরিয়া উপত্যকা-দেশে, তুষারসঙ্ঘাতরাশি পড়েছে খসিয়া শৃঙ্গ হোতে শৃঙ্গান্তরে উলটি পালটি। অমানিশীথের কালে নীরব প্রান্তরে বসিয়াছি, দেখিয়াছি চৌদিকে চাহিয়া, সর্ব্বব্যাপী নিশীথের অন্ধকার গর্ভে এখনো পৃথিবী যেন হতেছে সৃজিত। স্বর্গের সহস্র আঁখি পৃথিবীর 'পরে নীরবে রয়েছে চাহি পলকবিহীন, স্নেহময়ী জননীর স্নেহ-আঁখি যথা সুপ্ত বালকের পরে রহে বিকসিত। এমন নীরবে বায়ু যেতেছে বহিয়া, নীরবতা ঝাঁ ঝাঁ করি গাইছে কি গান-- মনে হয় স্তব্ধতার ঘুম পাড়াইছে। কি সুন্দর রূপ তুমি দিয়াছ উষায়, হাসি হাসি নিদ্রোত্থিতা বালিকার মত আধঘুমে মুকুলিত হাসিমাখা আঁখি! কি মন্ত্র শিখায়ে দেছ দক্ষিণ-বালারে-- যে দিকে দক্ষিণবধূ ফেলেন নিঃশ্বাস, সে দিকে ফুটিয়া উঠে কুসুম-মঞ্জরী, সে দিকে গাহিয়া উঠে বিহঙ্গের দল, সে দিকে বসন্ত-লক্ষ্মী উঠেন হাসিয়া। কি হাসি হাসিতে জানে পূর্ণিমাশর্ব্বরী-- সে হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত, সে হাসি দেখিয়া হাসে উথল জলধি, সে হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর। হে প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন কেমন বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া, করুণা, প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন—ন্যায়, ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্‌-- ক্রোধ, দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব, নিরাশা মরুর মত দারুণ বিষণ্ণ-- তেমনি আবার এই বাহির জগৎ বিচিত্র বেশভূষায় করেছ সজ্জিত। তোমার বিচিত্র কাব্য-উপবন হোতে তুলিয়া সুরভি ফুল গাঁথিয়া মালিকা, তোমারি চরণতলে দিব উপহার!" এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-গগনে প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি।   (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস) কবির অহংকার গান গাহি বলে কেন অহংকার করা ! শুধু গাহি বলে কেন কাঁদি না শরমে ! খাঁচার পাখির মতো গান গেয়ে মরা , এই কি , মা , আদি অন্ত মানবজনমে ! সুখ নাই , সুখ নাই , শুধু মর্মব্যথা — মরীচিকা – পানে শুধু মরি পিপাসায় । কে দেখালে প্রলোভন , শূন্য অমরতা — প্রাণে ম’রে গানে কি রে বেঁচে থাকা যায় ! কে আছ মলিন হেথা , কে আছ দুর্বল , মোরে তোমাদের মাঝে করো গো আহ্বান — বারেক একত্রে বসে ফেলি অশ্রুজল , দূর করি হীন গর্ব , শূন্য অভিমান তার পরে একসাথে এস কাজ করি কেবলি বিলাপগান দূরে পরিহরি ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে– সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়। ভুলে গেছি কবে থকে আসছি তোমায় চেয়ে সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়।ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়, তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে– সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়।কতই নামে ডেকেছি যে, কতই ছবি এঁকেছি যে, কোন্‌ আনন্দে চলেছি, তার ঠিকানা না পেয়ে– সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়।পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি, তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদায় আছে ছেয়ে– সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়।তিনধরিয়া, ৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কমল ফুটে অগম জলে কমল ফুটে অগম জলে, তুলিবে তারে কেবা। সবার তরে পায়ের তলে তৃণের রহে সেবা।   (স্ফুলিঙ্গ) করিয়াছি বাণীর সাধনা করিয়াছি বাণীর সাধনা দীর্ঘকাল ধরি, আজ তারে ক্ষণে ক্ষণে উপহাস পরিহাস করি। বহু ব্যবহার আর দীর্ঘ পরিচয় তেজ তার করিতেছে ক্ষয়। নিজেরে করিয়া অবহেলা নিজেরে নিয়ে সে করে খেলা। তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত বাক্যে তার বাক্যের অতীত। সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে, অকূল সিন্ধুরে নিবেদন করিতে প্রণাম, মন তাই বলিতেছে, আমি চলিলাম।সেই সিন্ধু-মাঝে সূর্য দিনযাত্রা করি দেয় সারা, সেথা হতে সন্ধ্যাতারা রাত্রিরে দেখায়ে আনে পথ যেথা তার রথ চলেছে সন্ধান করিবারে নূতন প্রভাত-আলো তমিস্রার পারে। আজ সব কথা, মনে হয়, শুধু মুখরতা। তারা এসে থামিয়াছে পুরাতন সে মন্ত্রের কাছে ধ্বনিতেছে যাহা সেই নৈঃশব্দ্যচূড়ায় সকল সংশয় তর্ক যে মৌনের গভীরে ফুরায়। লোকখ্যাতি যাহার বাতাসে ক্ষীণ হয়ে তুচ্ছ হয়ে আসে। দিনশেষে কর্মশালা ভাষা রচনার নিরুদ্ধ করিয়া দিক দ্বার। পড়ে থাক্‌ পিছে বহু আবর্জনা, বহু মিছে। বারবার মনে মনে বলিতেছি, আমি চলিলাম-- যেথা নাই নাম, যেখানে পেয়েছে লয় সকল বিশেষ পরিচয়, নাই আর আছে এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে, যেখানে অখন্ড দিন আলোহীন অন্ধকারহীন, আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসংগমে। এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে। আপন স্বাতন্ত্র৻ হতে নিঃসক্ত দেখিব তারে আমি বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী।আসন্ন বর্ষের শেষ। পুরাতন আমার আপন শ্লথবৃন্ত ফলের মতন ছিন্ন হয়ে আসিতেছে। অনুভব তারি আপনারে দিতেছে বিস্তারি আমার সকল-কিছু-মাঝে প্রচ্ছন্ন বিরাজে নিগূঢ় অন্তরে যেই একা, চেয়ে আছি পাই যদি দেখা। পশ্চাতের কবি মুছিয়া করিছে ক্ষীণ আপন হাতের আঁকা ছবি। সুদূর সম্মুখে সিন্ধু, নিঃশব্দ রজনী, তারি তীর হতে আমি আপনারি শুনি পদধ্বনি। অসীম পথের পান্থ, এবার এসেছি ধরা-মাঝে মর্তজীবনের কাজে। সে পথের 'পরে ক্ষণে ক্ষণে অগোচরে সকল পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি অমূল্য উপাদেয় এমন সম্পদ যাহা হবে মোর অক্ষয় পাথেয়। মন বলে, আমি চলিলাম, রেখে যাই আমার প্রণাম তাঁদের উদ্দেশে যাঁরা জীবনের আলো ফেলেছেন পথে যাহা বারে বারে সংশয় ঘুচালো। করুণা অপরাহ্নে ধূলিচ্ছন্ন নগরীর পথে বিষম লোকের ভিড়; কর্মশালা হতে ফিরে চলিয়াছে ঘরে পরিশ্রান্ত জন বাঁধমুক্ত তটিনীর স্রোতের মতন। ঊর্ধ্বশ্বাসে রথ-অশ্ব চলিয়াছে ধেয়ে ক্ষুধা আর সারথির কশাঘাত খেয়ে। হেনকালে দোকানির খেলামুগ্ধ ছেলে কাটা ঘুড়ি ধরিবারে চলে বাহু মেলে। অকস্মাৎ শকটের তলে গেল পড়ি, পাষাণকঠিন পথ উঠিল শিহরি। সহসা উঠিল শূন্যে বিলাপ কাহার, স্বর্গে যেন দয়াদেবী করে হাহাকার। ঊর্ধ্বপানে চেয়ে দেখি স্খলিতবসনা লুটায়ে লুটায়ে ভূমে কাঁদে বারাঙ্গনা।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) কর্ণ কুন্তি সংবাদ (কাব্যনাট্য)কর্ণ। পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার         বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার         অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত         সেই আমি-- কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!কুন্তী। বৎস, তোর জীবনের প্রথম প্রভাতে         পরিচয় করায়েছি তোরে বিশ্ব-সাথে         সেই আমি, আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব লাজ         তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ।কর্ণ। দেবী, তব নতনেত্রকিরণসম্পাতে         চিত্ত বিগলিত মোর, সূর্যকরঘাতে         শৈলতুষারের মতো। তব কণ্ঠস্বর        যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-'পর        জাগাইছে অপূর্ব বেদনা। কহো মোরে        জন্ম মোর বাঁধা আছে কী রহস্য-ডোরে        তোমা সাথে হে অপরিচিতা!কুন্তী। ধৈর্য ধর্,        ওরে বৎস, ক্ষণকাল। দেব দিবাকর        আগে যাক অস্তাচলে। সন্ধ্যার তিমির        আসুক নিবিড় হয়ে।-- কহি তোরে বীর,        কুন্তি আমি।কর্ণ। তুমি কুন্তী! অর্জুনজননী! কুন্তী। অর্জুনজননী বটে! তাই মনে গণি         দ্বেষ করিয়ো না বৎস। আজো মনে পড়ে         অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে         তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণকুমার         রঙ্গস্থলে, নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার         প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো।         যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত         তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী         অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী         জাগায়ে জর্জর বক্ষে-- কাহার নয়ন         তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্-চুম্বন।         অর্জুনজননী সে যে। যবে কৃপ আসি         তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি,         কহিলেন "রাজকুলে জন্ম নহে যার         অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার'--        আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী,        দাঁড়ায়ে রহিলে, সেই লজ্জা-আভাখানি        দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে        কে সে অভাগিনী। অর্জুনজননী সে যে।        পুত্র দুর্যোধন ধন্য, তখনি তোমারে        অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক। ধন্য তারে।        মোর দুই নেত্র হতে অশ্রুবারিরাশি        উদ্দেশে তোমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি        অভিষেক-সাথে। হেনকালে করি পথ        রঙ্গমাঝে পশিলেন সূত অধিরথ        আনন্দবিহ্বল। তখনি সে রাজসাজে       চারি দিকে কুতূহলী জনতার মাঝে       অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে       সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃসম্ভাষণে।       ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে       ধিক্কারিল; সেইক্ষণে পরম গরবে       বীর বলি যে তোমারে ওগো বীরমণি       আশিসিল, আমি সেই অর্জুনজননী।কর্ণ। প্রণমি তোমারে আর্যে। রাজমাতা তুমি,         কেন হেথা একাকিনী। এ যে রণভূমি,         আমি কুরুসেনাপতি।কুন্তী। পুত্র, ভিক্ষা আছে--         বিফল না ফিরি যেন।কর্ণ। ভিক্ষা, মোর কাছে!         আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম ছাড়া আর         যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার।কুন্তী। এসেছি তোমারে নিতে।    কর্ণ। কোথা লবে মোরে! কুন্তী। তৃষিত বক্ষের মাঝে-- লব মাতৃক্রোড়ে।    কর্ণ। পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি, তুমি ভাগ্যবতী,         আমি কুলশীলহীন ক্ষুদ্র নরপতি--         মোরে কোথা দিবে স্থান। কুন্তী। সর্ব-উচ্চভাগে         তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে         জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি। কর্ণ। কোন্ অধিকার-মদে         প্রবেশ করিব সেথা। সাম্রাজ্যসম্পদে         বঞ্চিত হয়েছে যারা মাতৃস্নেহধনে         তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে         কহো মোরে। দ্যূতপণে না হয় বিক্রয়,         বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়--         সে যে বিধাতার দান। কুন্তী। পুত্র মোর, ওরে,         বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে        এসেছিলি একদিন-- সেই অধিকারে        আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্বিচারে_        সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম        লহো আপনার স্থান।কর্ণ। শুনি স্বপ্নসম,         হে দেবী, তোমার বাণী। হেরো, অন্ধকার         ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে, লুপ্ত চারি ধার--         শব্দহীনা ভাগীরথী। গেছ মোরে লয়ে        কোন্ মায়াচ্ছন্ন লোকে, বিস্মৃত আলয়ে,        চেতনাপ্রত্যুষে। পুরাতন সত্যসম        তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম।        অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার,        যেন মোর জননীর গর্ভের আঁধার        আমারে ঘেরিছে আজি। রাজমাতঃ অয়ি,        সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী        তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে        রাখো ক্ষণকাল। শুনিয়াছি লোকমুখে        জননীর পরিত্যক্ত আমি। কতবার        হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার        এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায়,        কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায়        "জননী, গুণ্ঠন খোলো, দেখি তব মুখ'--        অমনি মিলায় মূর্তি তৃষার্ত উৎসুক        স্বপনেরে ছিন্ন করি। সেই স্বপ্ন আজি        এসেছে কি পাণ্ডবজননীরূপে সাজি        সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথীতীরে।        হেরো দেবী, পরপারে পাণ্ডবশিবিরে        জ্বলিয়াছে দীপালোক, এ পারে অদূরে        কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে        খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া। কালি প্রাতে        আরম্ভ হইবে মহারণ। আজ রাতে        অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম        আমার মাতার স্নেহস্বর। মোর নাম       তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সংগীতে       উঠিল বাজিয়া-- চিত্ত মোর আচম্বিতে       পঞ্চপাণ্ডবের পানে "ভাই' ব'লে ধায়। কুন্তী। তবে চলে আয় বৎস, তবে চলে আয়।    কর্ণ। যাব মাতঃ, চলে যাব, কিছু শুধাব না--         না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা।         দেবী, তুমি মোর মাতা! তোমার আহ্বানে         অন্তরাত্মা জাগিয়াছে-- নাহি বাজে কানে         যুদ্ধভেরী, জয়শঙ্খ-- মিথ্যা মনে হয়         রণহিংসা, বীরখ্যাতি, জয়পরাজয়।         কোথা যাব, লয়ে চলো। কুন্তী। ওই পরপারে         যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ স্কন্ধাবারে         পাণ্ডুর বালুকাতটে। কর্ণ। হোথা মাতৃহারা         মা পাইবে চিরদিন! হোথা ধ্রুবতারা         চিররাত্রি রবে জাগি সুন্দর উদার         তোমার নয়নে! দেবী, কহো আরবার         আমি পুত্র তব।কুন্তী। পুত্র মোর! কর্ণ। কেন তবে         আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে         কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন         অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে। কেন চিরদিন         ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে--         কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে।         রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে--         তাই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে         নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে         দুর্নিবার আকর্ষণে। মাতঃ, নিরুত্তর?         লজ্জা তব ভেদ করি অন্ধকার স্তর         পরশ করিছে মোরে সর্বাঙ্গে নীরবে--         মুদিয়া দিতেছে চক্ষু। থাক্, থাক্ তবে--         কহিয়ো না কেন তুমি ত্যজিলে আমারে।         বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে         মাতৃস্নেহ, কেন সেই দেবতার ধন         আপন সন্তান হতে করিলে হরণ         সে কথার দিয়ো না উত্তর। কহো মোরে         আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে। কুন্তী। হে বৎস, ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম         বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম         শত খণ্ড করি। ত্যাগ করেছিনু তোরে         সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক'রে         তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন--তবু হায়,         তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায়,         খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে। বঞ্চিত যে ছেলে         তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে         আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি         বিশ্বদেবতার। আমি আজি ভাগ্যবতী,         পেয়েছি তোমার দেখা। যবে মুখে তোর         একটি ফুটে নি বাণী তখন কঠোর         অপরাধ করিয়াছি-- বৎস, সেই মুখে         ক্ষমা কর্ কুমাতায়। সেই ক্ষমা বুকে         ভর্ৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল,         পাপ দগ্ধ ক'রে মোরে করুক নির্মল। কর্ণ। মাতঃ, দেহো পদধূলি, দেহো পদধূলি--         লহো অশ্রু মোর। কুন্তী। তোরে লব বক্ষে তুলি         সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে।         ফিরাতে এসেছি তোরে নিজ অধিকারে।         সূতপুত্র নহ তুমি, রাজার সন্তান--         দূর করি দিয়া বৎস, সর্ব অপমান         এসো চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা। কর্ণ। মাতঃ, সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা,         তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব।         পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্, কৌরব কৌরব--         ঈর্ষা নাহি করি কারে। কুন্তী। রাজ্য আপনার         বাহুবলে করি লহো, হে বৎস, উদ্ধার।         দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির,         ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর         সারথি হবেন রথে, ধৌম্য পুরোহিত         গাহিবেন বেদমন্ত্র-- তুমি শত্রুজিৎ         অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে         নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্নসিংহাসনে।    কর্ণ। সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ--         তাহারে দিতেছ, মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস।        একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত        সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।        মাতা মোর, ভ্রাতা মোর, মোর রাজকুল       এক মুহূর্তেই মাতঃ,করেছ নির্মূল       মোর জন্মক্ষণে। সূতজননীরে ছলি       আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি,       কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে       ছিন্ন ক'রে ধাই যদি রাজসিংহাসনে,       তবে ধিক্ মোরে। কুন্তী। বীর তুমি, পুত্র মোর,         ধন্য তুমি। হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর         দণ্ড তব। সেইদিন কে জানিত হায়,         ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়         সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে         ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে,         আপনার জননীর কোলের সন্তানে         আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে।         এ কী অভিশাপ! কর্ণ। মাতঃ, করিয়ো না ভয়।         কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়।         আজি এই রজনীর তিমিরফলকে         প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে         ঘোর যুদ্ধ-ফল। এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে         অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে         জয়হীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন         কর্মের উদ্যম-- হেরিতেছি শান্তিময়         শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয়         সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।         জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান--         আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।         জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে         নামহীন, গৃহহীন-- আজিও তেমনি         আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী         দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-'পরে।         শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে        জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,        বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই। কর্তব্যগ্রহণ কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি। শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কর্ম ভৃত্যের না পাই দেখা প্রাতে । দুয়ার রয়েছে খোলা ,                স্নানজল নাই তোলা ,            মূর্খাধম আসে নাই রাতে । মোর ধৌত বস্ত্রখানি              কোথা আছে নাহি জানি ,             কোথা আহারের আয়োজন ! বাজিয়া যেতেছে ঘড়ি            বসে আছি রাগ করি —              দেখা পেলে করিব শাসন । বেলা হলে অবশেষে              প্রণাম করিল এসে ,               দাঁড়াইল করি করজোড় । আমি তারে রোষভরে           কহিলাম , “ দূর হ রে ,                দেখিতে চাহি নে মুখ তোর । ” শুনিয়া মূঢ়ের মতো                ক্ষণকাল বাক্যহত                 মুখে মোর রহিল সে চেয়ে — কহিল গদ্‌গদস্বরে ,                 “ কালি রাত্রি দ্বিপ্রহরে                মারা গেছে মোর ছোটো মেয়ে । ” এত কহি ত্বরা করি                গামোছাটি কাঁধে ধরি                নিত্যকাজে গেল সে একাকী । প্রতি দিবসের মতো                ঘষা মাজা মোছা কত ,                কোনো কর্ম রহিল না বাকি ।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) কলঙ্কব্যবসায়ী ধুলা, করো কলঙ্কিত সবার শুভ্রতা সেটা কি তোমারি নয় কলঙ্কর কথা?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কলরবমুখরিত খ্যাতির প্রাঙ্গণে যে আসন কলরবমুখরিত খ্যাতির প্রাঙ্গণে যে আসন পাতা হয়েছিল কবে, সেথা হতে উঠে এসো, কবি, পূজা সাঙ্গ করি দাও চাটুলুব্ধ জনতা-দেবীরে বচনের অর্ঘ্য বিরচিয়া। দিনের সহস্র কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এল; যে প্রহরগুলি ধ্বনি-পণ্যবাহী নোঙর ফেলেছে তারা সন্ধ্যার নির্জন ঘাটে এসে। আকাশের আঙিনায় শান্ত যেথা পাখির কাকলী সুরসভা হতে সেথা নৃত্যপরা অপ্সরকন্যার বাষ্পে-বোনা চেলাঞ্চল উড়ে পড়ে, দেহ ছড়াইয়া স্বর্ণোজ্জ্বল বর্ণরশ্মিচ্ছটা। চরম ঐশ্বর্য নিয়ে অস্তলগনের, শূন্য পূর্ণ করি এল চিত্রভানু, দিল মোরে করস্পর্শ, প্রসারিল দীপ্ত শিল্পকলাঅন্তরের দেহলিতে, গভীর অদৃশ্যলোক হতে ইশারা ফুটিয়া পড়ে তুলির রেখায়। আজন্মের বিচ্ছিন্ন ভাবনা যত, স্রোতের সেঁউলি-সম যারা নিরর্থক ফিরেছিল অনিশ্চিত হাওয়ায় হাওয়ায় , রূপ নিয়ে দেখা দেবে ভাঁটার নদীর প্রান্ত তীরে অনাদৃত মঞ্জরীর অজানিত আগাছার মতো,— কেহ শুধাবে না নাম, অধিকারগর্ব নিয়ে তার ঈর্ষা রহিবে না কারো, অনামিক স্মৃতি-চিহ্ন তারা খ্যাতিশূন্য অগোচরে র’বে যেন অস্পষ্ট বিস্মৃতি।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) কল্পনামধুপ প্রতিদিন প্রাতে শুধু গুন্ গুন্ গান , লালসে অলস-পাখা অলির মতন । বিকল হৃদয় লয়ে পাগল পরান কোথায় করিতে যায় মধু অন্বেষণ । বেলা বহে যায় চলে — শ্রান্ত দিনমান , তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন , মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান , সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন । কুসুমদলের বেড়া , তারি মাঝে ছায়া , সেথা বসে করি আমি কল্পমধু পান — বিজনে সৌরভময়ী মধুময়ী মায়া , তাহারি কুহকে আমি করি আত্মদান — রেণুমাখা পাখা লয়ে ঘরে ফিরে আসি আপন সৌরভে থাকি আপনি উদাসী ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কল্পনার সাথি যখন কুসুমবনে ফির একাকিনী , ধরায় লুটায়ে পড়ে পূর্ণিমাযামিনী , দক্ষিণবাতাসে আর তটিনীর গানে শোন যবে আপনার প্রাণের কাহিনী — যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনতবয়ানে ফুলের মতন দুটি অঙ্গুলিতে ধরি মালা গাঁথ ভোরবেলা গুন্ গুন্ তানে — মধ্যাহ্নে একেলা যবে বাতয়নে ব ‘ সে নয়নে মিলাতে চায় সুদূর আকাশ , কখন আঁচলখানি প ‘ ড়ে যায় খ ‘ সে , কখন হৃদয় হতে উঠে দীর্ঘশ্বাস , কখন অশ্রুটি কাঁপে নয়নের পাতে — তখন আমি কি , সখী , থাকি তব সাথে !  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কল্লোলমুখর দিন কল্লোলমুখর দিন ধায় রাত্রি-পানে। উচ্ছল নির্ঝর চলে সিন্ধুর সন্ধানে। বসন্তে অশান্ত ফুল পেতে চায় ফল। স্তব্ধ পূর্ণতার পানে চলিছে চঞ্চল।   (স্ফুলিঙ্গ) কষ্টের জীবন (মানুষ কাঁদিয়া হাসে) মানুষ কাঁদিয়া হাসে, পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া। পাদপ শুকায়ে গেলে, তবুও সে না হয় পতিত, তরণী ভাঙিয়া গেলে তবু ধীরে যায় সে ভাসিয়া, ছাদ যদি পড়ে যায়, দাঁড়াইয়া রহে তবু ভিত। বন্দী চলে যায় বটে, তবুও তো রহে কারাগার, মেঘে ঢাকিলেও সূর্য কোনোমতে দিন অস্ত হয়, তেমনি হৃদয় যদি ভেঙেচুরে হয় চুরমার, কোনোক্রমে বেঁচে থাকে তবুও সে ভগন হৃদয়। ভগন দর্পণ যথা, ক্রমশ যতই ভগ্ন হয়, ততই সে শত শত, প্রতিবিম্ব করয়ে ধারণ, তেমনি হৃদয় হতে, কিছুই গো যাইবার নয়। হোক না শীতল স্তব্ধ, শত খন্ডে ভগ্ন চূর্ণ মন, হউক-না রক্তহীন, হীনতেজ তবুও তাহারে, বিনিদ্র জ্বলন্ত জ্বালা, ক্রমাগত করিবে দাহন, শুকায়ে শুকায়ে যাবে, অন্তর বিষম শোকভারে, অথচ বাহিরে তার, চিহ্নমাত্র না পাবে দর্শন।George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা) কহিল তারা, "জ্বালিব আলোখানি। কহিল তারা, "জ্বালিব আলোখানি। আঁধার দূর হবে না হবে, সে অামি নাহি জানি।"   (স্ফুলিঙ্গ) কাঁচড়াপাড়াতে এক ছিল রাজপুত্তুর কাঁচড়াপাড়াতে এক ছিল রাজপুত্তুর, রাজকন্যারে লিখে পায় না সে উত্তর। টিকিটের দাম দিয়ে রাজ্য বিকাবে কি এ, রেগেমেগে শেষকালে বলে ওঠে–দুত্তোর! ডাকবাবুটিকে দিল মুখে ডালকুত্তোর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কাঁচা আম তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়                        চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্‌দুরে ।                যখন-দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়                            হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে ।                    তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম ,                           বদল হয়েছে পালের হাওয়া                    পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে ।            সেদিন গেছে যেদিন দৈবে-পাওয়া দুটি-একটি কাঁচা আম                            ছিল আমার সোনার চাবি ,                        খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি ;                           আজ সে তালা নেই , চাবিও লাগে না ।                      গোড়াকার কথাটা বলি ।            আমার বয়সে এ বাড়িতে যেদিন প্রথম আসছে বউ                         পরের ঘর থেকে ,            সেদিন যে-মনটা ছিল নোঙর-ফেলা নৌকো                বান ডেকে তাকে দিলে তোলপাড় করে ।                    জীবনের বাঁধা বরাদ্দ ছাপিয়ে দিয়ে                        এল অদৃষ্টের বদান্যতা ।                পুরোনো ছেঁড়া আটপৌরে দিনরাত্রিগুলো                         খসে পড়ল সমস্ত বাড়িটা থেকে ।                কদিন তিনবেলা রোশনচৌকিতে                        চার দিকের প্রাত্যহিক ভাষা দিল বদলিয়ে ;                                 ঘরে ঘরে চলল আলোর গোলমাল                                         ঝাড়ে লণ্ঠনে ।                        অত্যন্ত পরিচিতের মাঝখানে                                 ফুটে উঠল অত্যন্ত আশ্চর্য ।                        কে এল রঙিন সাজে সজ্জায় ,                                 আলতা-পরা পায়ে পায়ে —            ইঙ্গিত করল যে , সে এই সংসারের পরিমিত দামের মানুষ নয় — সেদিন সে ছিল একলা অতুলনীয় ।                            বালকের দৃষ্টিতে এই প্রথম প্রকাশ পেল —            জগতে এমন কিছু যাকে দেখা যায় কিন্তু জানা যায় না ।                           বাঁশি থামল , বাণী থামল না —                                  আমাদের বধূ রইল                          বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা ।              তার ভাব , তার আড়ি , তার খেলাধুলো ননদের সঙ্গে ।                অনেক সংকোচে অল্প একটু কাছে যেতে চাই ,                        তার ডুরে শাড়িটি মনে ঘুরিয়ে দেয় আবর্ত ;                 কিন্তু , ভ্রূকুটিতে বুঝতে দেরি হয় না , আমি ছেলেমানুষ ,                    আমি মেয়ে নই , আমি অন্য জাতের ।                তার বয়স আমার চেয়ে দুই-এক মাসের                        বড়োই হবে বা ছোটোই হবে ।                    তা হোক , কিন্তু এ কথা মানি ,                            আমরা ভিন্ন মসলায় তৈরি ।                মন একান্তই চাইত , ওকে কিছু একটা দিয়ে                           সাঁকো বানিয়ে নিতে ।                একদিন এই হতভাগা কোথা থেকে পেল                           কতকগুলো রঙিন পুথি ;                    ভাবলে , চমক লাগিয়ে দেবে ।                           হেসে উঠল সে ; বলল ,                                 “ এগুলো নিয়ে করব কী । ”                ইতিহাসের উপেক্ষিত এই-সব ট্র্যাজেডি                        কোথাও দরদ পায় না ,                লজ্জার ভারে বালকের সমস্ত দিনরাত্রির                         দেয় মাথা হেঁট করে ।            কোন্‌ বিচারক বিচার করবে যে , মূল্য আছে                                সেই পুঁথিগুলোর ।                      তবু এরই মধ্যে দেখা গেল , শস্তা খাজনা চলে                        এমন দাবিও আছে ওই উচ্চাসনার — সেখানে ওর পিড়ে পাতা মাটির কাছে ।                           ও ভালোবাসে কাঁচা আম খেতে                        শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে ।            প্রসাদলাভের একটি ছোট্ট দরজা খোলা আছে                 আমার মতো ছেলে আর ছেলেমানুষের জন্যেও ।                           গাছে চড়তে ছিল কড়া নিষেধ ।                           হাওয়া দিলেই ছুটে যেতুম বাগানে ,                        দৈবে যদি পাওয়া যেত একটিমাত্র ফল                           একটুখানি দুর্লভতার আড়াল থেকে ,                        দেখতুম , সে কী শ্যামল , কী নিটোল , কী সুন্দর ,                           প্রকৃতির সে কী আশ্চর্য দান ।                        যে লোভী চিরে চিরে ওকে খায়                           সে দেখতে পায় নি ওর অপরূপ রূপ ।           একদিন শিলবৃষ্টির মধ্যে আম কুড়িয়ে এনেছিলুম ;                ও বলল , “ কে বলেছে তোমাকে আনতে । ”                        আমি বললুম , “ কেউ না । ”                    ঝুড়িসুদ্ধ মাটিতে ফেলে চলে গেলুম ।            আর-একদিন মৌমাছিতে আমাকে দিলে কামড়ে ;                    সে বললে , “ এমন করে ফল আনতে হবে না । ”                           চুপ করে রইলুম ।                                    বয়স বেড়ে গেল ।            একদিন সোনার আংটি পেয়েছিলুম ওর কাছ থেকে ;                তাতে স্মরণীয় কিছু লেখাও ছিল ।            স্নান করতে সেটা পড়ে গেল গঙ্গার জলে —                    খুঁজে পাই নি ।            এখনো কাঁচা আম পড়ছে খসে খসে                গাছের তলায় , বছরের পর বছর ।                    ওকে আর খুঁজে পাবার পথ নেই । কাঁধে মই বলে কই ভূঁইচাপা গাছ কাঁধে মই, বলে “কই ভূঁইচাপা গাছ’, দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ, ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা– কী খেতাব দেব তায় ঘুরে যায় মাথা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ দেহটা যেমনি ক’রে ঘোরাও যেখানে বাম হাত বামে থাকে, ডান হাত ডানে। কাগজের নৌকা ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে কাগজ-নৌকাখানি। লিখে রাখি তাতে আপনার নাম, লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে যতনে লাইন টানি। যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে আমার লিখন পড়িয়া তখন বুঝিবে সে অনুমানি কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে কাগজ-নৌকাখানি ।।আমার নৌকা সাজাই যতনে শিউলি বকুলে ভরি। বাড়ির বাগানে গাছের তলায় ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়, শিশিরের জল করে ঝলমল্‌ প্রভাতের আলো পড়ি। সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা, বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী ঠেকে কোনোখানে যেয়ে - প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল কাগজের তরী বেয়ে ।।আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে চেয়ে থাকি বসি তীরে। ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে, রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে, আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি, বায়ু বহে ধীরে ধীরে । গগনের তলে মেঘ ভাসে কত আমারি সে ছোটো নৌকার মতো - কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়, কোন দেশে গিয়ে লাগে। ঐ মেঘ আর তরণী আমার কে যাবে কাহার আগে ।।বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে নিয়ে যায় মোরে টানি আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি, যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি, কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায় আমার নৌকাখানি । কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা, কেহ তারে কভু নাহি করে মানা, ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে - ধায় নব নব দেশে। কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি মন যায় ভেসে ভেসে ।।রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়, মুখ ঢাকি দুই হাতে - চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার, কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার - তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে নৌকা চলেছে রাতে। আকাশের তারা মিটি মিটি করে, শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে, তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি তীরে তীরে ফিরে ভাসি। ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।(শিশু কাব্যগ্রন্থ) কাঙালিনী আনন্দময়ীর আগমনে ,        আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে । হেরো ওই ধনীর দুয়ারে        দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে । উৎসবের হাসি - কোলাহল        শুনিতে পেয়েছে ভোরবেলা , নিরানন্দ গৃহ তেয়াগিয়া        তাই আজ বাহির হইয়া আসিয়াছে ধনীর দুয়ারে        দেখিবারে আনন্দের খেলা । বাজিতেছে উৎসবের বাঁশি ,        কানে তাই পশিতেছে আসি , ম্লান চোখে তাই ভাসিতেছে        দুরাশার সুখের স্বপন ; চারি দিকে প্রভাতের আলো        নয়নে লেগেছে বড়ো ভালো , আকাশেতে মেঘের মাঝারে        শরতের কনক তপন । কত কে যে আসে , কত যায় ,        কেহ হাসে , কেহ গান গায় , কত বরনের বেশভূষা —        ঝলকিছে কাঞ্চন - রতন , কত পরিজন দাসদাসী ,        পুষ্প পাতা কত রাশি রাশি চোখের উপরে পড়িতেছে        মরীচিকা - ছবির মতন । হেরো তাই রহিয়াছে চেয়ে        শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে । শুনেছে সে , মা এসেছে ঘরে ,      তাই বিশ্ব আনন্দে ভেসেছে , মার মায়া পায় নি কখনো ,        মা কেমন দেখিতে এসেছে । তাই বুঝি আঁখি ছলছল ,      বাষ্পে ঢাকা নয়নের তারা ! চেয়ে যেন মার মুখ পানে বালিকা কাতর অভিমানে        বলে , ‘ মা গো এ কেমন ধারা । এত বাঁশি , এত হাসিরাশি ,        এত তোর রতন - ভূষণ , তুই যদি আমার জননী ,        মোর কেন মলিন বসন !'    ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলি ভাইবোন করি গলাগলি ,        অঙ্গনেতে নাচিতেছে ওই ; বালিকা দুয়ারে হাত দিয়ে তাদের হেরিছে দাঁড়াইয়ে , ভাবিতেছে নিশ্বাস ফেলিয়ে —        আমি তো ওদের কেহ নই । স্নেহ ক ' রে আমার জননী        পরায়ে তো দেয় নি বসন , প্রভাতে কোলেতে করে নিয়ে        মুছায়ে তো দেয় নি নয়ন । আপনার ভাই নেই বলে        ওরে কি রে ডাকিবে না কেহ ? আর কারো জননী আসিয়া        ওরে কি রে করিবে না স্নেহ ? ও কি শুধু দুয়ার ধরিয়া        উৎসবের পানে রবে চেয়ে        শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে ? ওর প্রাণ আঁধার যখন        করুণ শুনায় বড়ো বাঁশি , দুয়ারেতে সজল নয়ন ,        এ বড়ো নিষ্ঠুর হাসিরাশি । আজি এই উৎসবের দিনে        কত লোক ফেলে অশ্রুধার , গেহ নেই , স্নেহ নেই , আহা ,        সংসারেতে কেহ নেই তার । শূন্য হাতে গৃহে যায় কেহ ,        ছেলেরা ছুটিয়া আসে কাছে , কী দিবে কিছুই নেই তার ,        চোখে শুধু অশ্রুজল আছে । অনাথ ছেলেরে কোলে নিবি        জননীরা, আয় তোরা সব । মাতৃহারা মা যদি না পায়        তবে আজ কিসের উৎসব ! দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া        ম্লানমুখ বিষাদে বিরস , তবে মিছে সহকার - শাখা        তবে মিছে মঙ্গল - কলস । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কাছের রাতি দেখিতে পাই কাছের রাতি দেখিতে পাই মানা। দূরের চাঁদ চিরদিনের জানা।   (স্ফুলিঙ্গ) কাঠের সিঙ্গি ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়, সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়।           গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি, চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি। ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্‌কে দিতেম কষে,           কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে। গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে, "চুপ করো" যেই ধম্‌কানো আর চম্‌কাত সেইখনে। আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো           সম্ভাবনা ছিল না কখ্‌খোনো। মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে,           আপত্তি ও করত না তার তরে।    বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে    তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে।    ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ,    দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ।    খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।"    আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা--    যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার           দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।"    মেজ্‌দিদি আর ছোড়্‌দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে,           কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে    নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে,    কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে।    পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে,    এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে। কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা, তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা— এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা          সুরের-গন্ধ-ঢালা?।তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে, খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে, কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা! এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা          সুরের-গন্ধ-ঢালা?।রাতের বাসা হয়নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি, বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি। শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে, অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে। নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা— এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা          সুরের-গন্ধ-ঢালা?। কাব্য তবু কি ছিল না তব সুখদুঃখ যত, আশা নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব আমাদেরি মতো, হে অমর কবি! ছিল না কি অনুক্ষণ রাজসভা-ষড়্‌চক্র, আঘাত গোপন? কখনো কি সহ নাই অপমানভার, অনাদর, অবিশ্বাস, অন্যায় বিচার, অভাব কঠোর ক্রূর—নিদ্রাহীন রাতি কখনো কি কাটে নাই বক্ষে শেল গাঁথি? তবু সে সবার ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত নির্মল ফুটিয়াছে কাব্য তব সৌন্দর্যকমল আনন্দের সূর্য-পানে; তার কোনো ঠাঁই দুঃখদৈন্যদুর্দিনের কোনো চিহ্ন নাই। জীবনমন্থনবিষ নিজে করি পান অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) কাল প্রাতে মোর জন্মদিন কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে এ শৈল-আতিথ্যবাসে বুদ্ধের নেপালী ভক্ত এসেছিল মোর বার্তা শুনে। ভূতলে আসন পাতি বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র শুনাইল আমার কল্যাণে-- গ্রহণ করিনু সেই বাণী। এ ধারায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব সব মানবের জন্ম সার্থক করেছে একদিন, মানুষের জন্মক্ষণ হতে নারায়ণী এ ধরণী যাঁর আবির্ভাব লাগি অপেক্ষা করেছে বহু যুগ, যাঁহাতে প্রত্যক্ষ হল ধরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়, শুভক্ষণে পুণ্যমন্ত্রে তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে-- প্রবেশি মানবলোকে আশি বর্ষ আগে এই মহাপুরুষের পুণ্যভাগী হয়েছি আমিও। কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে গাহিতে তোমার গান কহিল সকলে সহসা রুধিয়া গেল হৃদয়ের দ্বার– যেথায় আসন তব, গোপন আগার। স্থানভেদে তব গান– মূর্তি নব নব– সখাসনে হাস্যোচ্ছ্বাস সেও গান তব, প্রিয়াসনে প্রিয়ালাপ, শিশুসনে খেলা– জগতে যেথায় যত আনন্দের মেলা সর্বত্র তোমার গান বিচিত্র গৌরবে আপনি ধ্বনিতে থাকে সরবে নীরবে। আকাশে তারকা ফুটে, ফুলবনে ফুল, খনিতে মানিক থাকে– হয় নাকো ভুল। তেমনি আপনি তুমি যেখানে যে গান রেখেছ, কবিও যেন রাখে তার মান।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) কালিদাসের প্রতি আজ তুমি কবি শুধু, নহ আর কেহ— কোথা তব রাজসভা, কোথা তব গেহ, কোথা সেই উজ্জয়িনী—কোথা গেল আজ প্রভু তব, কালিদাস, রাজ-অধিরাজ। কোনো চিহ্ন নাহি কারো। আজ মনে হয় ছিলে তুমি চিরদিন চিরানন্দময় অলকার অধিবাসী। সন্ধ্যাভ্রশিখরে ধ্যান ভাঙি উমাপতি ভূমানন্দভরে নৃত্য করিতেন যবে, জলদ সজল গর্জিত মৃদঙ্গরবে, তড়িৎ চপল ছন্দে ছন্দে দিত তাল, তুমি সেই ক্ষণে গাহিতে বন্দনাগান—গীতিসমাপনে কর্ণ হতে বর্হ খুলি স্নেহহাস্যভরে পরায়ে দিতেন গৌরী তব চূড়া-’পরে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) কালুর খাবার শখ সব চেয়ে পিষ্টকে কালুর খাবার শখ সব চেয়ে পিষ্টকে। গৃহিণী গড়েছে যেন চিনি মেখে ইষ্টকে। পুড়ে সে হয়েছে কালো, মুখে কালু বলে “ভালো’, মনে মনে খোঁটা দেয় দগ্ধ অদৃষ্টকে। কলিক্‌-ব্যথায় ডাকে ক্রুসে-বেঁধা খ্রীস্টকে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কালের প্রবল আবর্তে প্রতিহত কালের প্রবল আবর্তে প্রতিহত ফেনপুঞ্জের মতো, আলোকে আঁধারে রঞ্জিত এই মায়া, অদেহ ধরিল কায়া। সত্তা আমার,জানি না, সে কোথা হতে হল উত্থিত নিত্যধাবিত স্রোতে। সহসা অভাবনীয় অদৃশ্য এক আরম্ভ-মাঝে কেন্দ্র রচিল স্বীয়। বিশ্বসত্তা মাঝখানে দিল উঁকি, এ কৌতুকের পশ্চাতে আছে জানি না কে কৌতুকী। ক্ষণিকারে নিয়ে অসীমের এই খেলা, নববিকাশের সাথে গেঁথে দেয় শেষ-বিনাশের হেলা, আলোকে কালের মৃদঙ্গ উঠে বেজে, গোপনে ক্ষণিকা দেখা দিতে আসে মুখ-ঢাকা বধূ সেজে, গলায় পরিয়া হার বুদ্‌বুদ্‌ মণিকার। সৃষ্টির মাঝে আসন করে সে লাভ, অনন্ত তারে অন্তসীমায় জানায় অবির্ভাব। কালো অন্ধকারের তলায় কালো অন্ধকারের তলায় পাখির শেষ গান গিয়েছে ডুবে। বাতাস থমথমে, গাছের পাতা নড়ে না, স্বচ্ছরাত্রের তারাগুলি যেন নেমে আসছে পুরাতন মহানিম গাছের ঝিল্লি-ঝংকৃত স্তব্ধ রহস্যের কাছাকাছি। এমন সময়ে হঠাৎ আবেগে আমার হাত ধরলে চেপে; বললে, "তোমাকে ভুলব না কোনোদিনই।" দীপহীন বাতায়নে আমার মূর্তি ছিল অস্পষ্ট, সেই ছায়ার আবরণে তোমার অন্তরতম আবেদনের সংকোচ গিয়েছিল কেটে। সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমের অমরাবতী ব্যাপ্ত হল অনন্ত স্মৃতির ভূমিকায়। সেই মুহূর্তের আনন্দবেদনা বেজে উঠল কালের বীণায়, প্রসারিত হল আগামী জন্মজন্মান্তরে। সেই মুহূর্তে আমার আমি তোমার নিবিড় অনুভবের মধ্যে পেল নিঃসীমতা। তোমার কম্পিত কণ্ঠের বাণীটুকুতে সার্থক হয়েছে আমার প্রাণের সাধনা, সে পেয়েছে অমৃত। তোমার সংসারে অসংখ্য যা-কিছু আছে তার সবচেয়ে অত্যন্ত ক'রে আছি আমি, অত্যন্ত বেঁচে। এই নিমেষটুকুর বাইরে আর যা-কিছু সে গৌণ। এর বাইরে আছে মরণ, একদিন রূপের আলো-জ্বালা রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যাব নেপথ্যে। প্রত্যক্ষ সুখদুঃখের জগতে মূর্তিমান অসংখ্যতার কাছে আমার স্মরণচ্ছায়া মানবে পরাভব। তোমার দ্বারের কাছে আছে যে কৃষ্ণচূড়া যার তলায় দুবেলা জল দাও আপন হাতে, সেও প্রধান হয়ে উঠে' তার ডালপালার বাইরে সরিয়ে রাখবে আমাকে বিশ্বের বিরাট অগোচরে। তা হোক, এও গৌণ। কালো ঘোড়া কালো অশ্ব অন্তরে যে সারারাত্রি ফেলেছে নিশ্বাস           সে আমার অন্ধ অভিলাষ। অসাধ্যের সাধনায় ছুটে যাবে ব'লে           দুর্গমেরে দ্রুত পায়ে দ'লে                  খুরে খুরে খুঁড়েছে ধরণী,                        করেছে অধীর হ্রেষাধ্বনি।ও যেন রে যুগান্তের কালো অগ্নিশিখা,               কালো কুজ্ঝটিকা।   অকস্মাৎ নৈরাশ্য-আঘাতে         দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে               দুর্দাম এসেছে বাহিরিয়া। যারে নিয়ে এল সে-যে ব্যথায় মূর্তিত মোর প্রিয়া,         বাহিরে না স্থান পেয়ে               ধ্যানের আসন ছিল ছেয়ে।              এ-অমাবস্যায়       বল্গাহারা কালো অশ্ব ঊর্ধ্বশ্বাসে ধায়।                 কালো চিন্তা মম                  আত্মঘাতী ঝঞ্ঝাসম               বিস্মৃতির চিরবিলুপ্তিতে                    চলে ঝাঁপ দিতে                        নিরঙ্কিত পথ বেয়ে।                      যাক ধেয়ে।               সৃষ্টিহীন দৃষ্টিহীন রাত্রিপারে                     ব্যর্থ দুরাশারে                            নিয়ে যাক্‌--               অন্তিম শূন্যের মাঝে নিশ্চল নির্বাক্‌।         তার পরে বিরহের অগ্নিস্নানে শুভ্র মন               রৌদ্রস্নাত আশ্বিনের বৃষ্টিশূন্য মেঘের মতন                              উন্মুক্ত আলোকে                        দীপ্তি পাক্‌ সুনির্মল শোকে। কালো মেঘ আকাশের তারাদের ঢেকে কালো মেঘ আকাশের তারাদের ঢেকে মনে ভাবে, জিত হল তার। মেঘ কোথা মিলে যায় চিহ্ন নাহি রেখে, তারাগুলি রহে নির্বিকার।   (স্ফুলিঙ্গ) কাশী কাশীর গল্প শুনেছিলুম যোগীনদাদার কাছে,               পষ্ট মনে আছে। আমরা তখন ছিলাম না কেউ, বয়েস তাঁহার সবে               বছর-আষ্টেক হবে।               সঙ্গে ছিলেন খুড়ি, মোরব্বা বানাবার কাজে ছিল না তাঁর জুড়ি। দাদা বলেন, আমলকি বেল পেঁপে সে তো আছেই, এমন কোনো ফল ছিল না এমন কোনো গাছেই তাঁর হাতে রস জমলে লোকের গোল না ঠেকত--এটাই               ফল হবে কি মেঠাই। রসিয়ে নিয়ে চালতা যদি মুখে দিতেন গুঁজি মনে হত বড়োরকম রসগোল্লাই বুঝি। কাঁঠাল বিচিত্র মোরব্বা যা বানিয়ে দিতেন তিনি পিঠে ব'লে পৌষমাসে সবাই নিত কিনি। দাদা বলেন, "মোরব্বাটা হয়তো মিছেমিছিই, কিন্তু মুখে দিতে যদি, বলতে কাঁঠাল বিচিই।"          মোরব্বাতে ব্যাবসা গেল জ'মে          বেশ কিঞ্চিৎ টাকা জমল ক্রমে। একদিন এক চোর এসেছে তখন অনেক রাত, জানলা দিয়ে সাবধানে সে বাড়িয়ে দিল হাত। খুড়ি তখন চাটনি করতে তেল নিচ্ছেন মেপে, ধড়াস করে চোরের হাতে জানলা দিলেন চেপে। চোর বললে, "উহু উহু'; খুড়ি বললেন, "আহা, বাঁ হাত মাত্র, এইখানেতেই থেকে যাক-না তাহা।' কেঁদে-কেটে কোনোমতে চোর তো পেল খালাস; খুড়ি বললেন, "মরবি, যদি এ ব্যাবসা তোর চালাস।'দাদা বললেন, "চোর পালালো, এখন গল্প থামাই, ছ'দিন হয়নি ক্ষৌর করা, এবার গিয়ে কামাই।" আমরা টেনে বসাই; বলি, "গল্প কেন ছাড়বে।" দাদা বলেন, "রবার নাকি, টানলেই কি বাড়বে।-- কে ফেরাতে পারে তোদের আবদারের এই জোর, তার চেয়ে যে অনেক সহজ ফেরানো সেই চোর। আচ্ছা তবে শোন্‌, সে মাসে গ্রহণ লাগল চাঁদে, শহর যেন ঘিরল নিবিড় মানুষ বোনা ফাঁদে। খুড়ি গেছেন স্নান করতে বাড়ির দ্বারের পাশে, আমার তখন পূর্ণগ্রহণ ভিড়ের রাহুগ্রাসে। প্রাণটা যখন কণ্ঠাগত, মরছি যখন ডরে, গুণ্ডা এসে তুলে নিল হঠাৎ কাঁধের 'পরে। তখন মনে হল, এ তো বিষ্ণুদূতের দয়া, আর-একটু দেরি হলেই প্রাপ্ত হতেম গয়া। বিষ্ণুদূতটা ধরল যখন যমদূতের মূর্তি এক নিমেষেই একেবারেই ঘুচল আমার ফুর্তি। সাত গলি সে পেরিয়ে শেষে একটা এঁধোঘরে বসিয়ে আমায় রেখে দিল খড়ের আঁঠির 'পরে। চৌদ্দ আনা পয়সা আছে পকেট দেখি ঝেড়ে, কেঁদে কইলাম, "ও পাঁড়েজি, এই নিয়ে দাও ছেড়ে।' গুণ্ডা বলে, "ওটা নেব, ওটা ভালো দ্রব্যই, আরো নেব চারটি হাজার নয়শো নিরেনব্বই-- তার উপরে আর দু আনা, খুড়িটা তো মরবে, টাকার বোঝা বয়ে সে কি বৈতরণী তরবে। দেয় যদি তো দিক চুকিয়ে, নইলে--' পাকিয়ে চোখ যে ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিলে সেটা মারাত্মক।এমনসময়, ভাগ্যি ভালো, গুণ্ডাজির এক ভাগ্নি মূর্তিটা তার রণচণ্ডী, যেন সে রায়বাঘ্‌নি, আমার মরণদশার মধ্যে হলেন সমাগত দাবানলের ঊর্ধ্বে যেন কালো মেঘের মতো। রাত্তিরে কাল ঘরে আমার উঁকি মারল বুঝি, যেমনি দেখা অমনি আমি রইনু চক্ষু বাজি। পরের দিনে পাশের ঘরে, কী গলা তার বাপ, মামার সঙ্গে ঠাণ্ডা ভাষায় নয় সে বাক্যালাপ। বলছে, "তোমার মরণ হয় না, কাহার বাছনি ও, পাপের বোঝা বাড়িয়ো না আর, ঘরে ফেরৎ দিয়ো-- আহা, এমন সোনার টুকরো--' শুনে আগুন মামা; বিশ্রী রকম গাল দিয়ে কয়, "মিহি সুরটা থামা।' এ'কেই বলে মিহি সুর কি, আমি ভাবছি শুনে। দিন তো গেল কোনোমতে কড়ি বর্‌গা গুনে। রাত্রি হবে দুপুর, ভাগ্নি ঢুকল ঘরে ধীরে; চুপি চুপি বললে কানে, "যেতে কি চাস ফিরে।' লাফিয়ে উঠে কেঁদে বললেম, "যাব যাব যাব।' ভাগ্নি বললে, "আমার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নাবো-- কোথায় তোমার খুড়ির বাসা অগস্ত্যকুণ্ডে কি, যে ক'রে হোক আজকে রাতেই খুঁজে একবার দেখি; কালকে মামার হাতে আমার হবেই মুণ্ডপাত।'-- আমি তো, ভাই, বেঁচে গেলেম, ফুরিয়ে গেল রাত।হেসে বললেম যোগীনদাদার গম্ভীর মুখ দেখে, ঠিক এমনি গল্প বাবা শুনিয়েছে বই থেকে। দাদা বললেন, "বিধি যদি চুরি করেন নিজে পরের গল্প, জানিনে ভাই, আমি করব কী যে।' কী কথা বলিব বলে কী কথা বলিব বলে বাহিরে এলেম চলে, দাঁড়ালেম দুয়ারে তোমার– ঊর্ধ্বমুখে উচ্চরবে বলিতে গেলেম যবে কথা নাহি আর। যে কথা বলিতে চাহে প্রাণ সে শুধু হইয়া উঠে গান। নিজে না বুঝিতে পারি, তোমারে বুঝাতে নারি, চেয়ে থাকি উৎসুক-নয়ান।তবে কিছু শুধায়ো না– শুনে যাও আনমনা, যাহা বোঝ, যাহা নাই বোঝ। সন্ধ্যার আঁধার-পরে মুখে আর কণ্ঠস্বরে বাকিটুকু খোঁজো। কথায় কিছু না যায় বলা, গান সেও উন্মত্ত উতলা। তুমি যদি মোর সুরে নিজ কথা দাও পুরে গীতি মোর হবে না বিফলা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) কী পাই, কী জমা করি কী পাই, কী জমা করি, কী দেবে, কে দেবে, দিন মিছে কেটে যায় এই ভেবে ভেবে। চ'লে তো যেতেই হবে— কী যে দিয়ে যাব বিদায় নেবার অাগে এই কথা ভাবো!   (স্ফুলিঙ্গ) কী যে কোথা হেথা হোথা যায় ছড়াছড়ি কী যে কোথা হেথা হোথা যায় ছড়াছড়ি, কুড়িয়ে যতনে বাঁধি দিয়ে দড়াদড়ি। তবুও কখন শেষে বাঁধন যায় রে ফেঁসে, ধুলায় ভোলার দেশে যায় গড়াগড়ি— হায় রে, রয় না তার দাম কড়াকড়ি।   (স্ফুলিঙ্গ) কীটের বিচার মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট, কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ। পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে; বলে, ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে! তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে, হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে। কীট বলে, হয়েছে কী, কেন এত রাগ, ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ! আমি যেটা নাহি বুঝি সেটা জানি ছার, আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছারখার।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কীর্তি যত গড়ে তুলি কীর্তি যত গড়ে তুলি ধূলি তারে করে টানাটানি। গান যদি রেখে যাই তাহারে রাখেন বীণাপাণি।   (স্ফুলিঙ্গ) কুঁজো তিনকড়ি ঘোরে কুঁজো তিনকড়ি ঘোরে পাড়া চারিদিককার, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে নিয়ে ঝুলি ভিক্ষার। বলে সিধু গড়গড়ি রাগে দাঁত কড়মড়ি, “ভিখ্‌ মেগে ফের’, মনে হয় না কি ধিক্কার?’ ঝুলি নিজে কেড়ে বলে, “মাহিনা এ শিক্ষার।’  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে– কাঁদিছে আপন মনে, কুসুমের দলে বন্ধ হয়ে করুণ কাতর স্বনে। কহিছে সে,”হায় হায়, বেলা যায় বেলা যায় গো ফাগুনের বেলা যায়।’ ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, কিছু নাই তোর ভাবনা। কুসুম ফুটিবে, বাঁধন টুটিবে, পুরিবে সকল কামনা। নিঃশেষ হয়ে যাবি যবে তুই ফাগুন তখনো যাবে না।কুঁড়ির ভিতরে ফিরিছে গন্ধ কিসের আশে– ফিরিছে আপনমাঝে, বাহিরিতে চায় আকুল শ্বাসে কী জানি কিসের কাজে। কহিছে সে,”হায় হায়, কোথা আমি যাই,কারে চাই গো না জানিয়া দিন যায়।’ ভয় নাই তোর,ভয় নাই ওরে, ভয় নাই, কিছু নাই তোর ভাবনা। দখিনপবন দ্বারে দিয়া কান জেনেছে রে তোর না কামনা। আপনারে তোর না করিয়া ভোর দিন তোর চলে যাবে না।কুঁড়ির ভিতরে আকুল গন্ধ ভাবিছে বসে– ভাবিছে উদাসপারা, “জীবন আমার কাহার দোষে এমন অর্থহারা।’ কহিছে সে,”হায় হায়, কেন আমি বাঁচি,কেন আছি গো অর্থ না বুঝা যায়।’ ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে, ভয় নাই, কিছু নাই তোর ভাবনা। যে শুভ প্রভাতে সকলের সাথে মিলিবি, পুরাবি কামনা, আপন অর্থ সেদিন বুঝিবি– জনম ব্যর্থ যাবে না।      (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) কুটুম্বিতা-বিচার কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা— কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কুমার কুমার, তোমার প্রতীক্ষা করে নারী, অভিষেক-তরে এনেছে তীর্থবারি।             সাজাবে অঙ্গ উজ্জ্বল বরবেশে,             জয়মাল্য-যে পরাবে তোমার কেশে,             বরণ করিবে তোমারে সে-উদ্দেশে                          দাঁড়ায়েছে সারি সারি।দৈত্যের হাতে স্বর্গের পরাভবে বারে বারে, বীর, জাগ ভয়ার্ত ভবে।             ভাই ব'লে তাই নারী করে আহ্বান,             তোমারে রমণী পেতে চাহে সন্তান,             প্রিয় ব'লে গলে করিবে মাল্য দান                          আনন্দে গৌরবে।হেরো, জাগে সে যে রাতের প্রহর গণি, তোমার বিজয়শঙ্খ উঠুক ধ্বনি।             গর্জিত তব তর্জনধিক্কারে             লজ্জিত করো কুৎসিত ভীরুতারে,             মন্দ্রিত হোক বন্দীশালার দ্বারে                          মুক্তির জাগরণী।তুমি এসে যদি পাশে নাহি দাও স্থান, হে কিশোর, তাহে নারীর অসম্মান।             তব কল্যাণে কুঙ্কুম তার ভালে,             তব প্রাঙ্গণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে,             তব বন্দনে সাজায় পূজার থালে                              প্রাণের শ্রেষ্ঠ দান।তুমি নাই, মিছে বসন্ত আসে বনে বিরহবিকল চঞ্চল সমীরণে।             দুর্বল মোহ কোন আয়োজন করে             যেথা অরাজক হিয়া লজ্জায় মরে--             ওই ডাকে, রাজা, এসো এ শূন্য ঘরে                              হৃদয়সিংহাসনে।চেয়ে আছে নারী, প্রদীপ হয়েছে জ্বালা-- বিফল কোরো না বীরের বরণডালা।             মিলনলগ্ন বারে বারে ফিরে যায়             বরসজ্জার ব্যর্থতাবেদনায়,             মনে মনে সদা ব্যথিত কল্পনায়                              তোমারে পরায় মালা।তব রথ তারা স্বপ্নে দেখিছে জেগে, ছুটিছে অশ্ব বিদ্যুৎকশা লেগে।             ঘুরিছে চক্র বহ্নিবরন সে যে,             উঠিছে শূন্যে ঘর্ঘর তার বেজে,             প্রোজ্জ্বল চূড়া প্রভাতসূর্যতেজে,                              ধ্বজা রঞ্জিত রাঙা সন্ধ্যার মেঘে।উদ্দেশহীন দুর্গম কোন্‌খানে চল দুঃসহ দুঃসাহসের টানে।             দিল আহ্বান আলসনিদ্রা-নাশা             উদয়কূলের শৈলমূলের বাসা,             অমরালোকের নব আলোকের ভাষা                              দীপ্ত হয়েছে দৃপ্ত তোমার প্রাণে।অদূরে সুনীল সাগরে ঊর্মিরাশি উত্তালবেগে উঠিছে সমুচ্ছ্বাসি।             পথিক ঝটিকা রুদ্রের অভিসারে             উধাও ছুটিছে সীমাসমুদ্রপারে,             উল্লোল কলগর্জিত পারাবারে                              ফেনগর্গরে ধ্বনিছে অট্টহাসি।আত্মলোপের নিত্যনিবিড় কারা, তুমি উদ্দাম সেই বন্ধনহারা।             কোনো শঙ্কার কার্মূকটংকারে             পারে না তোমারে বিহ্বল করিবারে,             মৃত্যুর ছায়া ভেদিয়া তিমিরপারে                              নির্ভয়ে ধাও যেথা জ্বলে ধ্রুবতারা।চাহে নারী তব রথসঙ্গিনী হবে, তোমার ধনুর তূণ চিহ্নিয়া লবে।             অবারিত পথে আছে আগ্রহভরে             তব যাত্রায় আত্মদানের তরে,             গ্রহণ করিয়ো সম্মানে সমাদরে--                              জাগ্রত করি রাখিয়ো শঙ্খরবে। কুমারসম্ভবগান যখন শুনালে, কবি, দেবদম্পতিরে কুমারসম্ভবগান, চারি দিকে ঘিরে দাঁড়ালো প্রমথগণ—শিখরের ‘পর নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর স্থগিত-বিদ্যুৎ-লীলা, গর্জনবিরত, কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা। কভু স্মিতহাসে কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ, কভু দীর্ঘশ্বাস অলক্ষে বহিল, কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস দেখা দিল আঁখিপ্রান্তে—যবে অবশেষে ব্যাকুল শরমখানি নয়ননিমেষে নামিল নীরবে, কবি, চাহি দেবীপানে সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) কুয়াশার আক্ষেপ ‘কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে— মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!’ কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি? মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কুসুমের শোভা কুসুমের শোভা কুসুমের অবসানে মধুরস হয়ে লুকায় ফলের প্রাণে   (স্ফুলিঙ্গ) কৃতীর প্রমাদ টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কৃপণা এসেছিনু দ্বারে ঘনবর্ষণ রাতে, প্রদীপ নিবালে কেন অঞ্চলাঘাতে। কালো ছায়াখানি মনে পড়ে গেল আঁকা, বিমুখ মুখের ছবি অন্তরে ঢাকা, কলঙ্করেখা যেন চিরদিন চাঁদ বহি চলে সাথে সাথে।কেন বাধা হল দিতে মাধুরীর কণা হায় হায়, হে কৃপণ্য। তব যৌবন-মাঝে লাবণ্য বিরাজে, লিপিখানি তার নিয়ে এসে তবু কেন যে দিলে না হাতে। কৃষ্ণকলি কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,           কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে           কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ। ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,   মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।         কালো? তা সে যতই কালো হোক,           দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে           ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই, শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে           কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই। আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু   শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।         কালো? তা সে যতই কালো হোক,           দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,         ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ। আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,         মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ। আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে, আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।         কালো? তা সে যতই কালো হোক,         দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।এমনি করে কাজল কালো মেঘ           জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে। এমনি করে কালো কোমল ছায়া         আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে। এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।         কালো? তা সে যতই কালো হোক,         দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,           আর যা বলে বলুক অন্য লোক। দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে         কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ। মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।         কালো? তা সে যতই কালো হোক,         দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। কে আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো !   সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,    ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।    সে চলে গেল , বলে গেল না ,     সে কোথায় গেল ফিরে এল না ,     সে যেতে যেতে চেয়ে গেল ,                 কী যেন গেয়ে গেল--    তাই আপন মনে বসে আছি                    কুসুম-বনেতে ।        সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে ,            চঁদের আলোর দেশে গেছে ,            যেখান দিয়ে হেসে গেছে                 হাসি তার রেখে গেছে রে ।        মনে হল আঁখির কোণে              আমায় যেন ডেকে গেছে সে । আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ,               ভাবতেছি তাই একলা বসে ।    সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল                ঘুমের ঘোর । সে প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল               ফুলের ডোর । সে কুসুম-বনের উপর দিয়ে                কী কথা যে বলে গেল ,            ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে               সঙ্গে তারি চলে গেল ।            হৃদয় আমার আকুল হল ,            নয়ন আমার মুদে এল ,               কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে! কে বলে সব ফেলে যাবি কে বলে সব ফেলে যাবি মরণ হাতে ধরবে যবে। জীবনে তুই যা নিয়েছিস মরণে সব নিতে হবে। এই ভরা ভাণ্ডারে এসে শূন্য কি তুই যাবি শেষে। নেবার মতো যা আছে তোর ভালো করে নেই তুই তবে।আবর্জনার অনেক বোঝা জমিয়েছিস যে নিরবধি, বেঁচে যাবি, যাবার বেলা ক্ষয় করে সব যাস রে যদি। এসেছি এই পৃথিবীতে, হেথায় হবে সেজে নিতে, রাজার বেশে চল্‌ রে হেসে মৃত্যুপারের সে উৎসবে।শিলাইদহ, ২৫ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কেউ চেনা নয় কেউ চেনা নয় সব মানুষই অজানা। চলেছে আপনার রহস্যে আপনি একাকী। সেখানে তার দোসর নেই। সংসারের ছাপমারা কাঠামোয় মানুষের সীমা দিই বানিয়ে। সংজ্ঞার বেড়া-দেওয়া বসতির মধ্যে বাঁধা মাইনের কাজ করে সে। থাকে সাধারণের চিহ্ন নিয়ে ললাটে। এমন সময় কোথা থেকে ভালোবাসার বসন্ত-হাওয়া লাগে, সীমার আড়ালটা যায় উড়ে, বেরিয়ে পড়ে চির-অচেনা। সামনে তাকে দেখি স্বয়ংস্বতন্ত্র, অপূর্ব, অসাধারণ, তার জুড়ি কেউ নেই। তার সঙ্গে যোগ দেবার বেলায় বাঁধতে হয় গানের সেতু, ফুলের ভাষায় করি তার অভ্যর্থনা। চোখ বলে, যা দেখলুম, তুমি আছ তাকে পেরিয়ে। মন বলে চোখে-দেখা কানে-শোনার ওপারে যে রহস্য তুমি এসেছ সেই অগমের দূত,-- রাত্রি যেমন আসে পৃথিবীর সামনে নক্ষত্রলোক অবারিত ক'রে। তখন হঠাৎ দেখি আমার মধ্যেকার অচেনাকে, তখন আপন অনুভবের তল খুঁজে পাইনে, সেই অনুভব "তিলে তিলে নূতন হোয়।" কেন জ্যোতিষীরা বলে, সবিতার আত্মদান-যজ্ঞের হোমাগ্নিবেদিতলে      যে জ্যোতি উৎসর্গ হয় মহারুদ্রতপে          এ বিশ্বের মন্দিরমণ্ডপে,           অতিতুচ্ছ অংশ তার ঝরে      পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মৃৎপাত্রের 'পরে।          অবশিষ্ট অমেয় আলোকধারা                    পথহারা,               আদিম দিগন্ত হতে          অক্লান্ত চলেছে ধেয়ে নিরুদ্দেশ স্রোতে।      সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে অপার তিমির-তেপান্তরে      অসংখ্য নক্ষত্র হয়ে রশ্মিপ্লাবী নিরন্ত নির্ঝরে                    সর্বত্যাগী অপব্যয়,          আপন সৃষ্টির 'পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়।      কিংবা এ কি মহাকাল কল্পকল্পান্তের দিনে রাতে      এক হাতে দান ক'রে ফিরে ফিরে নেয় অন্য হাতে।          সঞ্চয়ে ও অপচয়ে যুগে যুগে কাড়াকাড়ি যেন--                             কিন্তু, কেন।      তার পরে চেয়ে দেখি মানুষের চৈতন্যজগতে      ভেসে চলে সুখদুঃখ কল্পনাভাবনা কত পথে।          কোথাও বা জ্ব'লে ওঠে জীবন-উৎসাহ,               কোথাও বা সভ্যতার চিতাবহ্নিদাহ          নিভে আসে নিঃস্বতার ভস্ম-অবশেষে।                    নির্ঝর ঝরিছে দেশে দেশে--      লক্ষ্যহীন প্রাণস্রোতে মৃত্যুর গহ্বরে ঢালে মহী          বাসনার বেদনার অজস্র বুদ্বুদপুঞ্জ বহি।                    কে তার হিসাব রাখে লিখি।                    নিত্য নিত্য এমনি কি               অফুরান আত্মহত্যা মানবসৃষ্টির                         নিরন্তর প্রলয়বৃষ্টির                                অশ্রান্ত প্লাবনে।                            নিরর্থক হরণে ভরণে                     মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা               মহাকাল করিতেছে দ্যূতখেলা                             বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন--                                       কিন্তু, কেন।      প্রথম বয়সে কবে ভাবনার কী আঘাত লেগে                    এ প্রশ্নই মনে উঠেছিল জেগে--               শুধায়েছি, এ বিশ্বের কোন্‌ কেন্দ্রস্থলে                         মিলিতেছে প্রতি দণ্ডে পলে                    অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের উল্লোল গর্জন,                             ঝটিকার মন্দ্রস্বন,                                         দিবসনিশার          বেদনাবীণার তারে চেতনার মিশ্রিত ঝংকার,                    পূর্ণ করি ঋতুর উৎসব               জীবনের মরণের নিত্যকলরব,                    আলোকের নিঃশব্দ চরণপাত          নিয়ত স্পন্দিত করি দ্যুলোকের অস্তহীন রাত। কল্পনায় দেখেছিনু, প্রতিধ্বনিমণ্ডল বিরাজে          ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দর-মাঝে।                      সেথা বাঁধে বাসা          চতুর্দিক হতে আসি জগতের পাখা-মেলা ভাষা। সেথা হতে পুরানো স্মৃতিরে দীর্ণ করি             সৃষ্টির আরম্ভবীজ লয় ভরি ভরি          আপনার পক্ষপুটে ফিরে-চলা যত প্রতিধ্বনি।                    অনুভব করেছি তখনি,      বহু যুগযুগান্তের কোন্‌ এক বাণীধারা                    নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি পথহারা          সংহত হয়েছে অবশেষে                    মোর মাঝে এসে।      প্রশ্ন মনে আসে আরবার,          আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার--                    রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে      চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?                    উজাড় করিয়া দিবে তার      পান্থের পাথেয়পত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার--                    ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড হেন?                             কিন্তু, কেন। কেন (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কেন গো এমন স্বরে বাজে তব বাঁশি , মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া , রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া ! কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায় , ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে , হায় যদি এত লজ্জা কথায় কথায় , হায় যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে ! কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল , কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া , আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল — এরি তরে এত তৃষ্ণা , এ কাহার মায়া ! মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা , খেলা যদি , কেন হেন মর্মভেদী খেলা !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কেন (সঞ্চয়িতা) কেন গো এমন স্বরে বাজে তার বাঁশি - মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া, রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া! কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায়, ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে - হায়, যদি এত লজ্জা কথায় কথায়, হায়, যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে! কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল, কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া! আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল - এরই তরে এত তৃষ্ণা, এ কাহার মায়া! মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা - খেলা যদি, কেন হেন মর্মভেদী খেলা! কেন মধুর রঙিন খেলেনা দিলে ও রাঙা হাতে        তখন বুঝি রে বাছা, কেন যে প্রাতে এত রঙ খেলে মেঘে           জলে রঙ ওঠে জেগে,         কেন এত রঙ লেগে ফুলের পাতে—        রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে।               গান গেয়ে তোরে আমি নাচাই যবে          আপন হৃদয়-মাঝে বুঝি রে তবে,   পাতায় পাতায় বনে       ধ্বনি এত কী কারণে,           ঢেউ বহে নিজমনে তরল রবে,           বুঝি তা তোমারে গান শুনাই যবে।           যখন নবনী দিই লোলুপ করে        হাতে মুখে মেখেচুকে বেড়াও ঘরে,   তখন বুঝিতে পারি       স্বাদু কেন নদীবারি,        ফল মধুরসে ভারী কিসের তরে,        যখন নবনী দিই লোলুপ করে।           যখন চুমিয়ে তোর বদনখানি        হাসিটি ফুটায়ে তুলি তখনি জানি   আকাশ কিসের সুখে     আলো দেয় মোর মুখে,        বায়ু দিয়ে যায় বুকে অমৃত আনি—        বুঝি তা চুমিলে তোর বদনখানি।    (শিশু কাব্যগ্রন্থ) কেন মার’ সিঁধ-কাটা ধূর্তে কেন মার’ সিঁধ-কাটা ধূর্তে। কাজ ওর দেয়ালটা খুঁড়তে। তোমার পকেটটাকে করেছ কি ডোবা হে– চিরদিন বহমান অর্থের প্রবাহে বাধা দেবে অপরের পকেটটি পূরতে? আর, যত নীতিকথা সে তো ওর চেনা না– ওর কাছে অর্থনীতিটা নয় জেনানা; বন্ধ ধনেরে তাই দেয় সদা ঘুরতে, হেথা হতে হোথা তারে চালায় মুহূর্তে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া, বাহির হনু তিমির-রাতে তরণীখানি বাহিয়া। অরুণ আজি উঠেছে– আশোক আজি ফুটেছে– না যদি উঠে,না যদি ফুটে, তবুও আমি চলিব ছুটে তোমার মুখে চাহিয়া।নয়নপাতে ডেকেছ মোরে নীরবে। হৃদয় মোর নিমেষ-মাঝে উঠেছে ভরি গরবে। শঙ্খ তব বাজিল– সোনার তরী সাজিল– না যদি বাজে, না যদি সাজে, গরব যদি টুটে গো লাজে চলিব তবু নীরবে।কথাটি আমি শুধাব নাকো তোমারে। দাঁড়াব নাকো ক্ষণেক-তরে দ্বিধার ভরে দুয়ারে। বাতাসে পাল ফুলিছে– পতাকা আজি দুলিছে– না যদি ফুলে, না যদি দুলে, তরণী যদি না লাগে কূলে শুধাব নাকো তোমারে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে চাঁদের জোছনা এই সমুদ্রবেলায়! এসো প্রিয়ে এইখানে বসি কিছুকাল; গীতস্বর মৃদু মৃদু পশুক শ্রবণে! সুকুমার নিস্তব্ধতা আর নিশীথিনী– সাজে ভালো মর্ম-ছোঁয়া সুধা-সংগীতেরে। বইস জেসিকা, দেখো, গগন-প্রাঙ্গণ জলৎ কাঞ্চন-পাতে খচিত কেমন! এমন একটি নাই তারকামণ্ডল দিব্য গীত যে না গায় প্রতি পদক্ষেপে! অমর আত্মাতে হয় এমনি সংগীত। কিন্তু ধূলিময় এই মর্ত্য-আবরণ যতদিন রাখে তারে আচ্ছন্ন করিয়া ততদিন সে সংগীত পাই না শুনিতে।William Shakespeare (অনুবাদ কবিতা) কো তুঁহু বোলবি মোয় কো তুঁহু বোলবি মোয় ! হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন , আঁখউপর তুঁহু রচলহি আসন , অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম       নিমিখ ন অন্তর হোয় ।       কো তুঁহু বোলবি মোয় !    হৃদয়কমল তব চরণে টলমল , নয়নযুগল মম উছলে ছলছল , প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল       চাহে মিলাইতে তোয় ।       কো তুঁহু বোলবি মোয় !    বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে , হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে , আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে ,       উতল প্রাণ উতরোয় ।       কো তুঁহু বোলবি মোয় !    হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল , শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল , বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল ,       চরণকমলযুগ ছোঁয় ।       কো তুহু বোলবি মোয় !    গোপবধূজন বিকশিতযৌবন , পুলকিত যমুনা , মুকুলিত উপবন , নীলনীর'পর ধীর সমীরণ ,       পলকে প্রাণমন খোয়       কো তুঁহু বোলবি মোয় ! তৃষিত আঁখি , তব মুখ'পর বিহরই , মধুর পরশ তব রাধা শিহরই , প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই       পদতলে অপনা থোয় ।       কো তুঁহু বোলবি মোয় !    কো তুঁহু কো তুঁহু সব জন পুছয়ি , অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি , যাচে ভানু , সব সংশয় ঘুচয়ি ,       জনম চরণ'পর গোয় ।       কো তুঁহু বোলবি মোয় ! কোথায় হায় কোথা যাবে ! অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি ,                পথ কোথা পাবে !               হায় , কোথা যাবে !                কঠিন বিপুল এ জগৎ ,          খুঁজে নেয় যে যাহার পথ । স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে               কার মুখে চাবে ।               হায় , কোথা যাবে !            মোরা কেহ সাথে রহিব না ,         মোরা কেহ কথা কহিব না । নিমেষ যেমনি যাবে , আমাদের ভালোবাসা              আর নাহি পাবে ।              হায় , কোথা যাবে !           মোরা বসে কাঁদিব হেথায় ,        শূন্যে চেয়ে ডাকিব তোমায় ; মহা সে বিজন মাঝে হয়তো বিলাপধ্বনি                 মাঝে মাঝে শুনিবারে পাবে ,                 হায় , কোথা যাবে !          দেখো , এই ফুটিয়াছে ফুল ,       বসন্তেরে করিছে আকুল , পুরানো সুখের স্মৃতি বাতাস আনিছে নিতি                কত স্নেহভাবে ,                হায় , কোথা যাবে !         খেলাধূলা পড়ে না কি মনে ,         কত কথা স্নেহের স্মরণে । সুখে দুখে শত ফেরে সে - কথা জড়িত যে রে ,                 সেও কি ফুরাবে !                 হায় , কোথা যাবে !            চিরদিন তরে হবে পর ,         এ - ঘর রবে না তব ঘর । যারা ওই কোলে যেত , তারাও পরের মতো ,                 বারেক ফিরেও নাহি চাবে ।                       হায় , কোথা যাবে !                হায় , কোথা যাবে ! যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও ,       এইখানে দুঃখ রেখে যাও । যে বিশ্রাম চেয়েছিলে , তাই যেন সেথা মিলে —               আরামে ঘুমাও ।               যাবে যদি , যাও । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো। বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো। রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা– ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো। বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।বেদনাদূতী গাহিছে, “ওরে প্রাণ, তোমার লাগি জাগেন ভগবান। নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে, দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান। তোমার লাগি জাগেন ভগবান।’গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি, বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি। এ ঘোর রাতে কিসের লাগি পরান মম সহসা জাগি এমন কেন করিছে মরি মরি। বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে, নিবিড়তর তিমির চোখে আনে। জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল প্রাণ গভীর সুরে, সকল গান টানিছে পথপানে। নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো। বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো। ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া, সময় গেলে হবে না যাওয়া, নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো। পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কোনো জাপানি কবিতার ইংরাজি অনুবাদ হইতে বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া, বাতাসেতে দেবদারু উঠছে শ্বসিয়া। দিবসের পরে বসি রাত্রি মুদে আঁখি, নীড়েতে বসিয়া যেন পাহাড়ের পাখি। শ্রান্ত পদে ভ্রমি আমি নগরে নগরে বিজন অরণ্য দিয়া পর্বতে সাগরে। উড়িয়া গিয়াছে সেই পাখিটি আমার, খুঁজিয়া বেড়াই তারে সকল সংসার। দিন রাত্রি চলিয়াছি, শুধু চলিয়াছি —           ভুলে যেতে ভুলিয়া গিয়াছি।আমি যত চলিতেছি রৌদ্র বৃষ্টি বায়ে হৃদয় আমার তত পড়িছে পিছায়ে। হৃদয় রে, ছাড়াছাড়ি হল তোর সাথে — এক ভাব রহিল না তোমাতে আমাতে। নীড় বেঁধেছিনু যেথা যা রে সেইখানে, একবার ডাক্ গিয়ে আকুল পরানে। কে জানে, হতেও পারে, সে নীড়ের কাছে হয়তো পাখিটি মোর লুকাইয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে বৃষ্টিজলে আমি ভ্রমিতেছি —           ভুলে যেতে ভুলিয়ে গিয়েছি।দেশের সবাই জানে কাহিনী আমার। বলে তারা, ‘এত প্রেম আছে বা কাহার!' পাখি সে পলায়ে গেছে কথাটি না ব'লে, এমন তো সব পাখি উড়ে যায় চলে। চিরদিন তারা কভু থাকে না সমান এমন তো কত শত রয়েছে প্রমাণ। ডাকে আর গায় আর উড়ে যায় পরে, এ ছাড়া বলো তো তারা আর কী বা করে? পাখি গেল যার, তার এক দুঃখ আছে —           ভুলে যেতে ভুলে সে গিয়াছে!সারা দিন দেখি আমি উড়িতেছে কাক, সারা রাত শুনি আমি পেচকের ডাক। চন্দ্র উঠে অস্ত যায় পশ্চিমসাগরে,           পূরবে তপন উঠে জলদের স্তরে। পাতা ঝরে, শুভ্র রেণু উড়ে চারি ধার — বসন্তমুকুল এ কি? অথবা তুষার? হৃদয়, বিদায় লই এবে তোর কাছে — বিলম্ব হইয়া গেল, সময় কি আছে? শান্ত হ'রে, একদিন সুখী হবি তবু — মরণ সে ভুলে যেতে ভোলে না তো কভু!  (অনূদিত কবিতা) কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস। সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস।এই   অকুল সংসারে দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে। ঘোরবিপদ-মাঝে কোন্‌ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।তুমি        কাহার সন্ধানে সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে। এমন        ব্যাকুল করে কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।তোমার     ভাবনা কিছু নাই– কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই। তুমি   মরণ ভুলে কোন্‌ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।১৭ পৌষ, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) কোন্‌ খ'সে-পড়া তারা কোন্‌ খ'সে-পড়া তারা মোর প্রাণে এসে খুলে দিল আজি সুরের অশ্রুধারা।   (স্ফুলিঙ্গ) কোপাই পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়, মনে মনে দেখি তাকে। এক পারে বালুর চর, নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত,- অন্য পারে বাঁশবন, আমবন, পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে, অনেক দিনের গুড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ- পুকুরের ধারে সর্ষেখেত, পথের ধারে বেতের জঙ্গল, দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত, তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি। ঐখানে রাজবংশীদের পাড়া, ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে, হাটের কাছে টিনের ছাদওয়ালা গঞ্জ- সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম, মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে। ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়, তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না। বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।একদিন ছিলেম ওরি চরের ঘাটে, নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে। ভোরের শুকতারাকে দেখে জেঘেছি, ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে নৌকার ছাদের উপর। আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে চলে গেছে ওর উদাসীর ধারা- পথিক যেমন চলে যায় গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।তার পরে যৌবনের শেষ এসেছি তরুবিরল এই মাঠের প্রান্তে। ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ দেখা যায় অদূরে।এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী। প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার। অনার্য তার নামখানি কত কালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর কলভাষার সঙ্গে জড়িত। গ্রামের সঙ্গে তার গলাগলি স্থলের সঙ্গে জলের নেই বিরোধ। তার এ পারের সঙ্গে ও পারের কথা চলে সহজে। শণের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে, জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা। রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে। অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে, তীরে আম জাম আমলকীল ঘেঁষাঘেঁষি।ওর ভাষা গৃহস্থপাড়ার ভাষা- তাকে সাধুভাষা বলে না। জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে, রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে। ছিপছিপে ওর দেহটি বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয় হাততাল দিয়ে সহজ নাচে। বর্ষায় ওর অঙ্গে অঙ্গে লাগে মাতলামি মহুয়া-মাতাল গাঁয়ের মেয়ের মতো- ভাঙে না, ডোবায় না, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবর্তের ঘাঘরা দুই তীরকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে উচ্চ হেসে ধেয়ে চলে।শরতের শেষে স্বচ্ছ হয়ে আসে জল, ক্ষীণ হয় তার ধারা, তলার বালি চোখো পড়ে, তখন শীর্ণ সমারোহের পাণ্ডুরতা তাকে তো লজ্জা দিতে পারে না। তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন; এ দুইয়েই তার শোভা- যেমন নটী যখন অলংকারের ঝংকার দিয়ে নাচে, আর যখন সে নীরবে বসে থাকে ক্লান্ত হয়ে, চোখের চাহনিতে আলস্য, একটুকানি হাসির আভাস ঠোঁটের কোণে। কোপাই আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি করে নিলে, সেই ছন্দের আপোস হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে., যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি। তার ভাঙা তালে হে'টে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে; পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি আঁটি আঁটি খড় বোঝাই করে; হাটে যাবে কুমোর বাঁকে করে হাঁড়ি নিয়ে; পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা; আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু ছেড়া ছাতি মাথায়। কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা “কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে! এতই যাতনা দুখিনী আমারে দিতেছ কেমন করে? গাঁথিয়া রেখেছি পরাতে মালিকা তোমার গলার-‘পরে, কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা, যেয়ো না ফেলিয়া মোরে! এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে? যে শপথ তুমি বলেছ আমারে মনে করে দেখো তবে, মনে করো সেই কুঞ্জ যেথায় কহিলে আমারি হবে। কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে, এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে?’ এত বলি এক কাঁদিছে ললনা ভাসিছে লোচন-লোরে “কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে। এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে?’William Chappel (অনুবাদ কবিতা) ক্যান্ডীয় নাচ সিংহলে সেই দেখেছিলেম ক্যান্ডিদলের নাচ; শিকড়গুলোর শিকড় ছিঁড়ে যেন শালের গাছ           পেরিয়ে এল মুক্তিমাতাল খ্যাপা,      হুংকার তার ছুটল আকাশ-ব্যাপা। ডালপালা সব দুড়্‌দাড়িয়ে ঘূর্ণি হাওয়ায় কহে--                    নহে, নহে, নহে-- নহে বাধা, নহে বাঁধন, নহে পিছন-ফেরা,           নহে আবেগ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা,      নহে মৃদু লতার দোলা, নহে পাতার কাঁপন-- আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা এ যে তপের তাপন।         ওদের ডেকে বলেছিল সমুদ্দরের ঢেউ, "আমার ছন্দ রক্তে আছে এমন আছে কেউ।'         ঝঞ্ঝা ওদের বলেছিল, "মঞ্জীর তোর আছে ঝংকারে যার লাগাবে লয় আমার প্রলয়নাচে।'         ঐ যে পাগল দেহখানা, শূন্যে ওঠে বাহু,           যেন কোথায় হাঁ করেছে রাহু--         লুব্ধ তাহার ক্ষুধার থেকে চাঁদকে করবে ত্রাণ,           পূর্ণিমাকে ফিরিয়ে দেবে প্রাণ।         মহাদেবের তপোভঙ্গে যেন বিষম বেগে                     নন্দী উঠল জেগে;           শিবের ক্রোধের সঙ্গে         উঠল জ্বলে দুর্দাম তার প্রতি অঙ্গে অঙ্গে           নাচের বহ্নিশিখা                    নিদয়া নির্ভীকা। খুঁজতে ছোটে মোহমদের বাহন কোথায় আছে      দাহন করবে এই নিদারুণ আনন্দময় নাচে। নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন,      আপন শক্তি মুক্ত ক'রে ছেঁড়েন আপন বাঁধন; দুঃখবেগে জাগিয়ে তোলেন সকল ভয়ের ভয়;           জয়ের নৃত্যে আপনাকে তাঁর জয়। ক্যামেলিয়া নাম তার কমলা, দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা। সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায় । আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে। মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়, আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে। কোলে তার ছিল বই আর খাতা। যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই -- সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না, প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে, প্রায়ই হয় দেখা। মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্‌, ও তো আমার সহযাত্রিণী। নির্মল বুদ্ধির চেহারা ঝক্‌ঝক্‌ করছে যেন। সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ। মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন, উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি -- রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত, কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা। এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে। কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা, বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে, নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে -- না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের। একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়। কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ। ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে, ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে। কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্‌পিশ্‌ করে। এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে টানতে করলে শুরু। কাছে এসে বললুম, ‘ ফেলো চুরোট। ‘ যেন পেলেই না শুনতে, ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে। মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়। হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্‌মট্‌ ক’রে -- আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল। বোধ হয় আমাকে চেনে। আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়, বেশ একটু চওড়া গোছের নাম। লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ, বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার। হাত কাঁপতে লাগল, কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে। আপিসের বাবুরা বললে, ‘বেশ করেছেন মশায়। ‘ একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়, একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।পরদিন তাকে দেখলুম না, তার পরদিনও না, তৃতীয় দিনে দেখি একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে। বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো। ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে, আমাকে কোনো দরকারই ছিল না। আবার বললুম মনে মনে, ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা -- বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো। ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে। সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার। ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া -- রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে গাছের আড়ালে, সামনে বরফের পাহাড়। শোনা গেল আসবে না এবার। ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা, মোহনলাল -- রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশম, দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়। সে বললে, ‘তনুকা আমার বোন, কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে। ‘ মেয়েটি ছায়ার মতো, দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু -- যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়। ফুটবলের সর্দারের ‘পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি -- মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া। হায় রে ভাগ্যের খেলা!যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে, ‘একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা -- একটি ফুলের গাছ। ‘ এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম। তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ, এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে। ‘ জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?’ সে বললে ‘ক্যামেলিয়া’। চমক লাগল -- আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে। হেসে বললেম, ‘ ক্যামেলিয়া, সহজে বুঝি এর মন মেলে না। ‘ তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে, খুশিও হল। চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে। দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়। একটা দো-কামরা গাড়িতে টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে। থাক্‌ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত, বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল সাঁওতাল পরগনায়। জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে -- বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না। কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র। এইখানে বাসা বেঁধেছেন শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়। সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে, অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে, পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে, মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায় -- উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে। বাসাবাড়ি কোথাও নেই, তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে। সঙ্গী ছিল না কেউ, কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া। কমলা এসেছে মাকে নিয়ে। রোদ ওঠবার আগে হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায় শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে। মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে, কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে। অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যায় ও পারে, সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে। আর আমাকে সে যে চিনেছে তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা। ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই। আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে -- পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে, আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক -- শর্ট‌্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা, কমলার পাশে পা ছড়িয়ে হাভানা চুরোট খাচ্ছে। আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে একটা শ্বেতজবার পাপড়ি, পাশে পড়ে আছে বিলিতি মাসিক পত্র।মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও। তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ। আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে, পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি। সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে, সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।সময় হয়েছে আজ। যে আনে আমার রান্নার কাঠ ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে। তার হাত দিয়ে পাঠাব শালপাতার পাত্রে। তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প। বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে। ‘ বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া সাঁওতাল মেয়ের কানে, কালো গালের উপর আলো করেছে। সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে। ‘ আমি বললেম, ‘ এইজন্যেই। ‘ তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়। ক্লান্ত মোর লেখনীর ক্লান্ত মোর লেখনীর এই শেষ আশা— নীরবের ধ্যানে তার ডুবে যাবে ভাষা।   (স্ফুলিঙ্গ) ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,           পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু॥     এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥           এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,           পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।     দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়, সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥ ক্ষণমিলন পরম আত্মীয় বলে যারে মনে মানি তারে আমি কতদিন কতটুকু জানি! অসীম কালের মাঝে তিলেক মিলনে পরশে জীবন তার আমার জীবনে। যতটুকু লেশমাত্র চিনি দুজনায়, তাহার অনন্তগুণ চিনি নাকো হায়। দুজনের এক জন এক দিন যবে বারেক ফিরাবে মুখ, এ নিখিল ভবে আর কভু ফিরিবে না মুখোমুখি পথে, কে কার পাইবে সাড়া অনন্ত জগতে! এ ক্ষণমিলনে তবে, ওগো মনোহর, তোমারে হেরিনু কেন এমন সুন্দর! মুহূর্ত-আলোক কেন, হে অন্তরতম, তোমারে চিনিনু চিরপরিচিত মম?    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ক্ষণিক ধ্বনির স্বত-উচ্ছ্বাসে ক্ষণিক ধ্বনির স্বত-উচ্ছ্বাসে সহসা নির্ঝরিণী আপনারে লয় চিনি। চকিত ভাবের ক্বচিৎ বিকাশে বিস্মিত মোর প্রাণ পায় নিজ সন্ধান।   (স্ফুলিঙ্গ) ক্ষণিক মিলন আকাশের দুই দিক হতে           দুইখানি মেঘ এল ভেসে ,                   দুইখানি দিশাহারা মেঘ —          কে জানে এসেছে কোথা হতে ! সহসা থামিল থমকিয়া              আকাশের মাঝখানে এসে। দোঁহাপানে চাহিল দুজনে         চতুর্থীর চাঁদের আলোতে । ক্ষীণালোকে বুঝি মনে পড়ে       দুই অচেনার চেনাশোনা , মনে পড়ে কোন্ ছায়া দ্বীপে ,      কোন্ কুহেলিকা - ঘের দেশে , কোন্ সন্ধ্যাসাগরের কূলে        দুজনের ছিল আনাগোনা ! মেলে দোঁহে তবুও মেলে না ,      তিলেক বিরহ রহে মাঝে — চেনা বলে মিলিবারে চায় ,         অচেনা বলিয়া মরে লাজে । মিলনের বাসনার মাঝে             আধখানি চাঁদের বিকাশ — দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুয়ি ,           মাঝে যেন শরমের হাস! দুখানি অলস আঁখিপাতা ,         মাঝে সুখস্বপন - আভাস ! দোঁহার পরশ লয়ে দোঁহে          ভেসে গেল , কহিল না কথা — বলে গেল সন্ধ্যার কাহিনী ,         লয়ে গেল উষার বারতা ।    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ক্ষণিকা খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা - খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা। কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে      লয়ে তার ভীরু দীপশিখা! দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এল ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এল, বিদায়দিনের-পরে আবরণ ফেলো অপ্রগল্‌ভ সূর্যাস্ত-আভার; সময় যাবার শান্ত হোক, স্তব্ধ হোক, স্মরণসভার সমারোহ না রচুক শোকের সম্মোহ। বনশ্রেণী প্রস্থানের দ্বারে ধরণীর শান্তিমন্ত্র দিক মৌন পল্লবসম্ভারে। নামিয়া আসুক ধীরে রাত্রির নিঃশব্দ আশীর্বাদ, সপ্তর্ষির জ্যোতির প্রসাদ।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে, তাই হেরো আজি তোমার সর্বাঙ্গ ঘেরি পুলকিছে শ্যাম শস্পরাজি প্রস্ফুটিত পুষ্পজালে; বনস্পতি শত বরষার আনন্দবর্ষণকাব্য লিখিতেছে পত্রপুঞ্জে তার বল্কলে শৈবালে জটে; সুদুর্গম তোমার শিখর নির্ভয় বিহঙ্গ যত কলোল্লাসে করিছে মুখর। আসি নরনারীদল তোমার বিপুল বক্ষপটে নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি বাঁধিয়াছে নির্ঝরিণীতটে। যেদিন উঠিয়াছিলে অগ্নিতেজে স্পর্ধিতে আকাশ, কম্পমান ভূমণ্ডলে, চন্দ্রসূর্য করিবারে গ্রাস — সেদিন হে গিরি, তব এক সঙ্গী আছিল প্রলয়; যখনি থেমেছ তুমি, বলিয়াছ “আর নয় নয়’, চারি দিক হতে এল তোমা’পরে আনন্দনিশ্বাস, তোমার সমাপ্তি ঘেরি বিস্তারিল বিশ্বের বিশ্বাস।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কাল্‌নায়, শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়, হাঁড়িগুলো রাখে আল্‌নায়। কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে, টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে ব’লে রেখে দেয় খোলা জাল্‌নায়– নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে, চুন দেয় তারা ডাল্‌নায়।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ক্ষুদ্র অনন্ত অনন্ত দিবসরাত্রি কালের উচ্ছ্বাস — তারি মাঝখানে শুধু একটি নিমেষ , একটি মধুর সন্ধ্যা , একটু বাতাস , মৃদু আলো – আঁধারের মিলন – আবেশ — তারি মাঝখানে শুধু একটুকু জুঁই একটুকু হাসিমাখা সৌরভের লেশ , একটু অধর তার ছুঁই কি না – ছুঁই , আপন আনন্দ লয়ে উঠিতেছে ফুটে আপন আনন্দ লয়ে পড়িতেছে টুটে । সমগ্র অনন্ত ওই নিমেষের মাঝে একটি বনের প্রান্তে জুঁই হয়ে উঠে । পলকের মাঝখানে অনন্ত বিরাজে । যেমনি পলক টুটে ফুল ঝরে যায় , অনন্ত আপনা – মাঝে আপনি মিলায় ।।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ক্ষুদ্র আমি বুঝেছি বুঝেছি , সখা , কেন হাহাকার , আপনার’পরে মোর কেন সদা রোষ । বুঝেছি বিফল কেন জীবন আমার — আমি আছি , তুমি নাই , তাই অসন্তোষ । সকল কাজের মাঝে আমারেই হেরি — ক্ষুদ্র আমি জেগে আছে ক্ষুধা লয়ে তার , শীর্নবাহু – আলিঙ্গনে আমারেই ঘেরি করিছে আমার হায় অস্থিচর্ম সার । কোথা নাথ , কোথা তব সুন্দর বদন — কোথায় তোমার নাথ , বিশ্ব – ঘেরা হাসি । আমারে কাড়িয়া লও , করো গো গোপন — আমারে তোমারে মাঝে করো গো উদাসী । ক্ষুদ্র আমি করিতেছে বড়ো অহংকার , ভাঙো নাথ , ভাঙো নাথ , অভিমান তার ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ক্ষুদ্রের দম্ভ শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) খড়দয়ে যেতে যদি সোজা এস খুল্‌না খড়দয়ে যেতে যদি সোজা এস খুল্‌না যত কেন রাগ কর, কে বলে তা ভুল না। মালা গাঁথা পণ ক’রে আন যদি আমড়া, রাগ করে বেত মেরে ফাটাও-না চামড়া, তবুও বলতে হবে– ও জিনিস ফুল না। বেঞ্চিতে বসে তুমি বল যদি “দোল দাও’, চটে-মটে শেষে যদি কড়া কড়া বোল দাও, পষ্ট বুঝিয়ে দেব– ওটা নয় ঝুল্‌না। যদি বা মাথার গোলে ঘরে এসে বসবার হাঁটুতে বুরুষ করো একমনে দশবার, কী করি, বলতে হবে– ওখানে তো চুল না।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) খবর পেলেম কল্য খবর পেলেম কল্য, তাঞ্জামেতে চ’ড়ে রাজা গাঞ্জামেতে চলল। সময়টা তার জলদি কাটে; পৌঁছল যেই হলদিঘাটে একটা ঘোড়া রইল বাকি, তিনটে ঘোড়া মরল। গরানহাটায় পৌঁছে সেটা মুটের ঘাড়ে চড়ল।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) খাটুলি একলা হোথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে-- আপন-ভোলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে। খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে      টানছে তামাক বসে আপন-মনে। মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী                বইছে নিরবধি।      আয়োজনের বালাই নেইকো ঘরে, আমের কাঠের নড়্‌নড়ে এক তক্তপোষের 'পরে        মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা বিধবা তার মেয়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা। নাতনি গেছে, রাখে তারি পোষা ময়নাটাকে, ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি। সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পদ পেয়ে জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে। দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তো ডুবছে দেনায়, হয়তো ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচাকেনায়।             বাইরে দারিদ্র্যের    কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের, তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি, প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী। হয়তো গোরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে, মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে, ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের-দেশে হয়তো হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে-- শুকনো করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে। বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শোকের পায় না ফাঁক, ভাবতে পারে স্পষ্ট ক'রে নেইকো এমন বাক্‌। জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে কী বলবে যে কেমন ক'রে পায় না ভেবে শেষে।খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি, ভাব্‌নাগুলো ধোঁয়ায় মেলায়, ধোঁয়ায় ওঠে ফুটি। ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলোছায়ার নাচে, নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে, চক্ষু ভোলায় খেতের ফসল রঙের হরির-লুটে-- জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন অতি সহজ ব'লেই তাহা জানে না ওর মন। খুদিরাম ক’সে টান খুদিরাম ক’সে টান দিল থেলো হুঁকোতে– গেল সারবান কিছু অন্তরে ঢুকোতে। অবশেষে হাঁড়ি শেষ করি রসগোল্লার রোদে বসে খুদুবাবু গান ধরে মোল্লার; বলে, “এতখানি রস দেহ থেকে চুকোতে হবে তাকে ধোঁয়া দিয়ে সাত দিন শুকোতে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) খুব তার বোলচাল খুব তার বোলচাল, সাজ ফিট্‌ফাট্‌, তক্‌রার হলে আর নাই মিট্‌মাট্‌। চশমায় চম্‌কায়, আড়ে চায় চোখ– কোনো ঠাঁই ঠেকে নাই কোনো বড়ো লোক।–   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) খেয়া খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে, কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে। দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা, সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা। পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব কত সর্বনাশ, নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস, রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে, সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা, উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা— শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম, দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম। এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে, কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) খেলা এই জগতের শক্ত মনিব সয় না একটু ত্রুটি, যেমন নিত্য কাজের পালা তেমনি নিত্য ছুটি। বাতাসে তার ছেলেখেলা, আকাশে তার হাসি, সাগর জুড়ে গদ্‌গদ ভাষ বুদ্‌বুদে যায় ভাসি। ঝরনা ছোটে দূরের ডাকে পাথরগুলো ঠেলে-- কাজের সঙ্গে নাচের খেয়াল কোথার থেকে পেলে। ঐ হোথা শাল, পাঁচশো বছর মজ্জাতে ওর ঢাকা-- গম্ভীরতায় অটল যেমন, চঞ্চলতায় পাকা। মজ্জাতে ওর কঠোর শক্তি, বকুনি ওর পাতায়-- ঝড়ের দিনে কী পাগলামি চাপে যে ওর মাথায়।   ফুলের দিনে গন্ধের ভোজ অবাধ সারাক্ষণ,   ডালে ডালে দখিন হাওয়ার বাঁধা নিমন্ত্রণ। খেলা তোমার কটি - তটের ধটি        কে দিল রাঙিয়া । কোমল গায়ে দিল পরায়ে       রঙিন আঙিয়া । বিহানবেলা আঙিনাতলে এসেছ তুমি কী খেলাছলে , চরণ দুটি চলিতে ছুটি         পড়িছে ভাঙিয়া । তোমার কটি - তটের ধটি        কে দিল রাঙিয়া ।    কিসের সুখে সহাস মুখে        নাচিছ বাছনি , দুয়ার - পাশে জননী হাসে           হেরিয়া নাচনি । তাথেই থেই তালির সাথে কাঁকন বাজে মায়ের হাতে , রাখাল - বেশে ধরেছ হেসে            বেণুর পাঁচনি । কিসের সুখে সহাস মুখে         নাচিছ বাছনি ।    ভিখারি ওরে , অমন   করে          শরম ভুলিয়া মাগিস কী বা মায়ের গ্রীবা          আঁকড়ি ঝুলিয়া । ওরে রে লোভী , ভুবনখানি গগন হতে উপাড়ি আনি ভরিয়া দুটি ললিত মুঠি        দিব কি তুলিয়া । কী চাস ওরে অমন করে         শরম ভুলিয়া ।    নিখিল শোনে আকুল মনে        নূপুর - বাজনা । তপন শশী হেরিছে বসি        তোমার সাজনা।       ঘুমাও যবে মায়ের বুকে আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে , জাগিলে পরে প্রভাত করে         নয়ন - মাজনা । নিখিল শোনে আকুল মনে        নূপুর - বাজনা ।    ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি        নয়ন - ঢুলানী , গায়ের ‘পরে কোমল করে         পরশ - বুলানী । মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি জগৎ - মাতা রয়েছে জাগি , ভুবন - মাঝে নিয়ত রাজে         ভুবন - ভুলানী । ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি          নয়ন - ঢুলানী । (শিশু কাব্যগ্রন্থ) খেলা (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পথের ধারে অশথতলে           মেয়েটি খেলা করে ; আপন-মনে আপনি আছে           সারাটি দিন ধরে । উপর-পানে আকাশ শুধু ,           সমুখ-পানে মাঠ , শরৎকালে রোদ পড়েছে ,           মধুর পথঘাট । দুটি-একটি পথিক চলে ,           গল্প করে , হাসে । লজ্জাবতী বধূটি গেল           ছায়াটি নিয়ে পাশে । আকাশ-ঘেরা মাঠের ধারে           বিশাল খেলাঘরে একটি মেয়ে আপন-মনে           কতই খেলা করে ।       মাথার'পরে ছায়া পড়েছে ,           রোদ পড়েছে কোলে , পায়ের কাছে একটি লতা           বাতাস পেয়ে দোলে । মাঠের থেকে বাছুর আসে ,           দেখে নূতন লোক , ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে থাকে           ড্যাবা ড্যাবা চোখ । কাঠবিড়ালি উসুখুসু           আশেপাশে ছোটে , শব্দ পেলে লেজটি তুলে           চমক খেয়ে ওঠে । মেয়েটি তাই চেয়ে দেখে           কত যে সাধ যায় — কোমল গায়ে হাত বুলায়ে           চুমো খেতে চায় !    সাধ যেতেছে কাঠবিড়ালি           তুলে নিয়ে বুকে , ভেঙে ভেঙে টুকুটুকু           খাবার দেবে মুখে । মিষ্টি নামে ডাকবে তারে           গালের কাছে রেখে , বুকের মধ্যে রেখে দেবে           আঁচল দিয়ে ঢেকে । ‘‘ আয় আয়''' ডাকে সে তাই —           করুণ স্বরে কয় , ‘‘ আমি কিছু বলব না তো           আমায় কেন ভয় ! '' মাথা তুলে চেয়ে থাকে           উঁচু ডালের পানে — কাঠবিড়ালি ছুটে পালায়           ব্যথা সে পায় প্রাণে ।       রাখাল ছেলের বাঁশি বাজে           সুদূর তরুছায় , খেলতে খেলতে মেয়েটি তাই           খেলা ভুলে যায় । তরুর মূলে মাথা রেখে           চেয়ে থাকে পথে , না জানি কোন্ পরীর দেশে           ধায় সে মনোরথে । একলা কোথায় ঘুরে বেড়ায়           মায়াদ্বীপে গিয়ে — হেনকালে চাষী আসে           দুটি গোরু নিয়ে । শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে ,           চমক ভেঙে চায় । আঁখি হতে মিলায় মায়া ,           স্বপন টুটে যায় ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) খেলা-ভোলা তুই কি ভাবিস , দিনরাত্তির           খেলতে আমার মন ? কক্‌খনো তা সত্যি না মা —           আমার কথা শোন্‌ । সেদিন ভোরে দেখি উঠে বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে , রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে           বাঁশের ডালে ডালে ; ছুটির দিনে কেমন সুরে পুজোর সানাই বাজছে দূরে , তিনটে শালিখ ঝগড়া করে           রান্নাঘরের চালে — খেলনাগুলো সামনে মেলি কী যে খেলি , কী যে খেলি , সেই কথাটাই সমস্তখন           ভাবনু আপন মনে । লাগল না ঠিক কোনো খেলাই , কেটে গেল সারাবেলাই , রেলিঙ ধরে রইনু বসে           বারান্দাটার কোণে ।       খেলা - ভোলার দিন মা , আমার           আসে মাঝে মাঝে । সেদিন আমার মনের ভিতর           কেমনতরো বাজে । শীতের বেলায় দুই পহরে দূরে কাদের ছাদের ‘পরে ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে   দেয়           বেগনি রঙের শাড়ি । চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই , তেপান্তরের পার বুঝি ঐ , মনে ভাবি ঐখানেতেই           আছে রাজার বাড়ি । থাকত যদি মেঘে - ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া তক্‌খুনি যে যেতেম তারে           লাগাম দিয়ে কষে । যেতে যেতে নদীর তীরে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে পথ শুধিয়ে নিতেম আমি           গাছের তলায় বসে ।       এক - এক দিন যে দেখেছি , তুই           বাবার চিঠি হাতে চুপ করে কী ভাবিস বসে           ঠেস দিয়ে জানলাতে মনে হয় তোর মুখে চেয়ে তুই যেন কোন্‌ দেশের মেয়ে , যেন আমার অনেক কালের           অনেক দূরের মা । কাছে গিয়ে হাতখানি ছুঁই হারিয়ে - ফেলা মা যেন তুই , মাঠ - পারে কোন্‌ বটের তলার           বাঁশির সুরের মা । খেলার কথা যায় যে ভেসে , মনে ভাবি কোন্‌ কালে সে কোন্‌ দেশে তোর বাড়ি ছিল           কোন্‌ সাগরের কূলে । ফিরে যেতে ইচ্ছে করে অজানা সেই দ্বীপের ঘরে তোমায় আমায় ভোরবেলাতে           নৌকোতে পাল তুলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) খেলেনা ভাবে শিশু, বড়ো হলে শুধু যাবে কেনা বাজার উজাড় করি সমস্ত খেলেনা। বড়ো হলে খেলা যত ঢেলা বলি মানে, দুই হাত তুলে চায় ধনজন-পানে। আরো বড়ো হবে না কি যবে অবহেলে ধরার খেলার হাট হেসে যাবে ফেলে?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) খোকা খোকার চোখে যে ঘুম আসে      সকল - তাপ - নাশা — জান কি কেউ কোথা হতে যে      করে সে যাওয়া - আসা । শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে জোনাকি - জ্বলা বনের ছায়ে দুলিছে দুটি পারুল - কুঁড়ি ,      তাহারি মাঝে বাসা — সেখান থেকে খোকার চোখে      করে সে যাওয়া - আসা ।    খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি      চমকে ঘুমঘোরে — কোন্‌ দেশে যে জনম তার      কে কবে তাহা মোরে । শুনেছি কোন্‌ শরৎ - মেঘে শিশু - শশীর কিরণ লেগে সে হাসিরুচি জনমি ছিল      শিশিরশুচি ভোরে — খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি      চমকে ঘুমঘোরে ।    খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে      যে কচি কোমলতা — জান কি সে যে এতটা কাল      লুকিয়ে ছিল কোথা । মা যবে ছিল কিশোরী মেয়ে করুণ তারি পরান ছেয়ে মাধুরীরূপে মুরছি ছিল      কহে নি কোনো কথা — খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে      যে কচি কোমলতা ।    আশিস আসি পরশ করে      খোকারে ঘিরে ঘিরে — জান কি কেহ কোথা হতে সে      বরষে তার শিরে । ফাগুনে নব মলয়শ্বাসে , শ্রাবণে নব নীপের বাসে , আশিনে নব ধান্যদলে ,      আষাড়ে নব নীরে — আশিস আসি পরশ করে      খোকারে ঘিরে ঘিরে ।    এই - যে খোকা তরুণতনু      নতুন মেলে আঁখি — ইহার ভার কে লবে আজি      তোমরা জান তা কি । হিরণময় কিরণ - ঝোলা যাঁহার এই ভুবন - দোলা তপন - শশী - তারার কোলে      দেবেন এরে রাখি — এই - যে খোকা তরুণতনু      নতুন মেলে আঁখি । (শিশু কাব্যগ্রন্থ) খোকার রাজ্য খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে আমি যদি পারি বাসা নিতে—      তবে আমি একবার      জগতের পানে তার           চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।      তার রবি শশী তারা      জানি নে কেমনধারা           সভা করে আকাশের তলে,   আমার খোকার সাথে    গোপনে দিবসে রাতে         শুনেছি তাদের কথা চলে।    শুনেছি আকাশ তারে    নামিয়া মাঠের পারে         লোভায় রঙিন ধনু হাতে,    আসি শালবন -' পরে    মেঘেরা মন্ত্রণা করে         খেলা করিবারে তার সাথে।    যারা আমাদের কাছে    নীরব গম্ভীর আছে,         আশার অতীত যারা সবে,    খোকারে তাহারা এসে    ধরা দিতে চায় হেসে         কত রঙে কত কলরবে।    খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে   সকল-উদ্দেশ-হারা    সকল-ভূগোল-ছাড়া           অপরূপ অসম্ভব দেশে—    যেথা আসে রাত্রিদিন   সর্ব-ইতিহাস-হীন           রাজার রাজত্ব হতে হাওয়া,    তারি যদি এক ধারে         পাই আমি বসিবারে           দেখি কারা করে আসা-যাওয়া।    তাহারা অদ্ভুত লোক,    নাই কারো দুঃখ শোক,           নেই তারা কোনো কর্মে কাজে,    চিন্তাহীন মৃত্যুহীন    চলিয়াছে চিরদিন           খোকাদের গল্পলোক-মাঝে।    সেথা ফুল গাছপালা    নাগকন্যা রাজবালা     যাহা খুশি তাই করে,     সত্যেরে কিছু না ডরে,           সংশয়েরে দিয়ে যায় ফাঁকি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) খ্যাতি আছে সুন্দরী বলে তার খ্যাতি আছে সুন্দরী বলে তার, ত্রুটি ঘটে নুন দিতে ঝোলে তার; চিনি কম পড়ে বটে পায়সে স্বামী তবু চোখ বুজে খায় সে– যা পায় তাহাই মুখে তোলে তার, দোষ দিতে মুখ নাহি খোলে তার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) খ্যাতি নিন্দা পার হয়ে জীবনের এসেছি প্রদোষে খ্যাতি নিন্দা পার হয়ে জীবনের এসেছি প্রদোষে, বিদায়ের ঘাটে আছি বসে। আপনার দেহটারে অসংশয়ে করেছি বিশ্বাস, জরার সুযোগ পেয়ে নিজেরে সে করে পরিহাস, সকল কাজেই দেখি কেবলি ঘটায় বিপর্যয়, আমার কর্তৃত্ব করে ক্ষয়; সেই অপমান হতে বাঁচাতে যাহারা অবিশ্রাম দিতেছে পাহারা, পাশে যারা দাঁড়ায়েছে দিনান্তের শেষ আয়োজনে, নাম না’ই বলিলাম তাহারা রহিল মনে মনে। তাহারা দিয়েছে মোরে সৌভাগ্যের শেষ পরিচয়, ভুলায়ে রাখিছে তারা দুর্বল প্রাণের পরাজয়; এ কথা স্বীকার তারা করে খ্যাতি প্রতিপত্তি যত সুযোগ্য সক্ষমদের তরে; তাহারাই করিছে প্রমাণ অক্ষমের ভাগ্যে আছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সেই দান। সমস্ত জীবন ধরে খ্যাতির খাজনা দিতে হয়, কিছু সে সহে না অপচয়; সব মূল্য ফুরাইলে যে দৈন্য প্রেমের অর্ঘ্য আনে অসীমের স্বাক্ষর সেখানে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) গণিতে রেলেটিভিটি প্রমাণের ভাবনায় গণিতে রেলেটিভিটি প্রমাণের ভাবনায় দিনরাত একা ব’সে কাটালো সে পাবনায়– নাম তার চুনিলাল, ডাক নাম ঝোড়্‌কে। ১ গুলো সবই ১ সাদা আর কালো কি, গণিতের গণনায় এ মতটা ভালো কি। অবশেষে সাম্যের সামলাবে তোড় কে।একের বহর কভু বেশি কভু কম হবে, এক রীতি হিসাবের তবুও কি সম্ভবে। ৭ যদি বাঁশ হয়, ৩ হয় খড়কে, তবু শুধু ১০ দিয়ে জুড়বে সে জোড় কে।যোগ যদি করা যায় হিড়িম্বা কুন্তীতে, সে কি ২ হতে পারে গণিতের গুন্‌তিতে। যতই না কষে নাও মোচা আর থোড়কে তার গুণফল নিয়ে আঁক যাবে ভড়কে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) গত দিবসের ব্যর্থ প্রাণের গত দিবসের ব্যর্থ প্রাণের যত ধুলা, যত কালি, প্রতি উষা দেয় নবীন আশার আলো দিয়ে প্রক্ষালি।   (স্ফুলিঙ্গ) গদ্য ও পদ্য শর কহে, আমি লঘু, গুরু তুমি গদা, তাই বুক ফুলাইয়া খাড়া আছ সদা। করো তুমি মোর কাজ, তর্ক যাক চুকে— মাথা ভাঙা ছেড়ে দিয়ে বেঁধো গিয়ে বুকে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) গব্বুরাজার পাতে ছাগলের কোর্‌মাতে গব্বুরাজার পাতে ছাগলের কোর্‌মাতে যবে দেখা গেল তেলা- পোকাটা রাজা গেল মহা চ’টে, চীৎকার করে ওঠে,– “খানসামা কোথাকার বোকাটা।’ মন্ত্রী জুড়িয়া পাণি কহে, “সবই এক প্রাণী।’ রাজার ঘুচিয়া গেল ধোঁকাটা। জীবের শিবের প্রেমে একদম গেল থেমে মেঝে তার তলোয়ার ঠোকাটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে ১ গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে, নিভৃত নিরালা ঠাঁই, লেশমাত্র আলো নাই, লুকানো এ প্রেমসাধ গোপনে নিবসে, শুদ্ধ যবে ভালোবাসা নয়নে তোমার, ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়, উচ্ছ্বসয়ে এ-হৃদয়, ভয়ে ভয়ে জড়সড় তখনি আবার। ২ শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে, জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল-তরে, কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়, নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে। ৩ যা হবার হইয়াছে– কিন্তু প্রাণনাথ! নিতান্ত হইবে যবে এ শরীরপাত, আমার সমাধি-স্থানে কোরো নাথ কোরো মনে, রয়েছে এ এক দুঃখিনী হয়ে ধরাসাৎ। ৪ যত যাতনা আছে দলুক আমায়, সহজে সহিতে নাথ সব পারা যায়, কিন্তু হে তুমি-যে মোরে, ভুলে যাবে একেবারে সে কথা করিতে মনে হৃদি ফেটে যায়। ৫ রেখো তবে এই মাত্র কথাটি আমার, এই কথা শেষ কথা, কথা নাহি আর, (এ দেহ হইলে পাত, যদি তুমি প্রাণনাথ, প্রকাশো আমার তরে তিলমাত্র শোক, ধর্মত হবে না দোষী দোষিবে না লোক– কাতরে বিনয়ে তাই, এই মাত্র ভিক্ষা চাই, কখনো চাহি নে আরো কোনো ভিক্ষা আর) যবে আমি যাব ম’রে, চির এ দুঃখিনী তরে, বিন্দুমাত্র অশ্রুজল ফেলো একবার– আজন্ম এত যে ভালোবেসেছি তোমায়, সে প্রেমের প্রতিদান একমাত্র প্রতিদান, তা বই কিছুই আর দিয়ো না আমায়।George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা) গরজের আত্মীয়তা কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে, আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে? থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) গর্ব করে নিই নে ও নাম গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী, আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে। যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে। তোমা হতে অনেক দূরে থাকি সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি, নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে মনে মনে মরি যে সেই লাজে।অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে রাখো আমায় যেথা আমার স্থান। আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে করো তোমার নত নয়ন দান। আমার পূজা দয়া পাবার তরে, মান যেন সে না পায় করো ঘরে, নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার ‘পরে বসে নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।রেলপথ। ই। বি। এস। আর, ২২ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে , বিসরি ত্রাস - লোকলাজে       সজনি , আও আও লো । অঙ্গে চারু নীল বাস , হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ , হরিণনেত্রে বিমল হাস ,       কুঞ্জবনমে আও লো । ঢালে কুসুম সুরভভার , ঢালে বিহগ সুরবসার , ঢালে ইন্দু অমৃতধার       বিমল রজত ভাতি রে । মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে , অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে , ফুটল সজনি , পুঞ্জে পুঞ্জে       বকুল যূথি জাতি রে । দেখ সজনি , শ্যামরায় নয়নে প্রেম উথল যায় , মধুর বদন অমৃতসদন       চন্দ্রমায় নিন্দিছে । আও আও সজনিবৃন্দ , হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ, শ্যামকো পদারবিন্দ       ভানুসিংহ বন্দিছে । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) গহির নীদমে গহির নীদমে বিবশ শ্যাম মম, অধরে বিকশত হাস, মধুর বদনমে মধুর ভাব অতি কিয়ে পায় পরকাশ ! চুম্বনু শত শত চন্দ্ৰ বদন রে, তবহুঁ ন পূরল আশ, অতি ধীরে ময় হৃদয়ে রাখনু নহি নহি মিটল তিয়াষ। শ্যাম, সুখে তুঁহু নীদ যাও পহু মঝু এ প্রেমময় উরসে, অনিমিখ নয়নে সারা রজনী হেরব মুখ তব হরষে।শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে হাস বিকাশত কায়, কোন্‌ স্বপন অব দেখত মাধব, কহবে কোন্‌ হমায়! এ মুখ স্বপনে মৈক কি দেখত হরষে বিকশত হাসি? শ্যাম, শ্যাম মম, কৈসে শোধব তুঁহুক প্রেমঋণ রাশি! জনম জনম মম প্রাণ পূর্ণ করি থাক হৃদয় করি আলা, তুঁহুক পাশ রহি হাসয়ি হাসয়ি সহব সকল দুখ জ্বালা। বিহঙ্গ, কাহ তু বোলন লাগলি? শ্যাম ঘুমায় হমারা, রহ রহ চন্দ্রম, ঢাল ঢাল, তব শীতল. জোছন-ধারা!তারা-মালিনী মধুরা যামিনী ন যাও ন যাও বালা, নিরদয় রবি, অব কাহ তু আওলি আনলি বিরহক জ্বালা! হমার সারা জীবন জনি ইহ রজনী রহত সমান, হেরয়ি হেরয়ি শ্যামমুখচ্ছবি প্রাণ ভইত অবসান! ভানু কহত অব “রবি অতি নিষ্ঠুর, নলিন-মিলন অভিলাষে কত শত নারীক মিলন টুটাওত, ডারত বিরহ-হুতাশে!”(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) গাছ দেয় ফল গাছ দেয় ফল ঋণ ব'লে তাহা নহে। নিজের সে দান নিজেরি জীবনে বহে। পথিক আসিয়া লয় যদি ফলভার প্রাপ্যের বেশি সে সৌভাগ্য তার।   (স্ফুলিঙ্গ) গাছগুলি মুছে-ফেলা গাছগুলি মুছে-ফেলা, গিরি ছায়া-ছায়া— মেঘে আর কুয়াশায় রচে একি মায়া। মুখঢাকা ঝরনার শুনি আকুলতা— সব যেন বিধাতার চুপিচুপি কথা।   (স্ফুলিঙ্গ) গাছের পাতায় লেখন লেখে গাছের পাতায় লেখন লেখে বসন্তে বর্ষায়— ঝ'রে পড়ে, সব কাহিনী ধুলায় মিশে যায়।   (স্ফুলিঙ্গ) গাড়িতে মদের পিপে গাড়িতে মদের পিপে ছিল তেরো-চোদ্দো, এঞ্জিনে জল দিতে দিল ভুলে মদ্য। চাকাগুলো ধেয়ে করে ধানখেত-ধ্বংসন, বাঁশি ডাকে কেঁদে কেঁদে “কোথা কানু জংশন’– ট্রেন করে মাতলামি নেহাত অবোধ্য, সাবধান করে দিতে কবি লেখে পদ্য।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) গান যে ছিল আমার স্বপনচারিণী এতদিন তারে বুঝিতে পারি নি, দিন চলে গেছে কুঁজিতে। শুভখনে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে, তোমারে পেরেছি বুঝিতে।কে মোরে ফিরাবে অনাদরে, কে মোরে ডাকিবে কাচে, কাহার প্রেমের বেদনার মাঝে আমার মূল্য আছে, এ নিরন্তর সংশয়ে আর পারি না কেবলি যুঝিতে-- তোমারেই শুধু সত্য পেরেছি বুঝিতে। গান (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ওগো       কে যায় বাঁশরি বাজায়ে !                    আমার ঘরে কেহ নাই যে !      তারে       মনে পড়ে যারে চাই যে !      তার        আকুল পরান বিরহের গান                    বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে !      আমি        আমার কথা তারে জানাব কী করে ,                      প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে !                 কুসুমের মালা গাঁথা হল না ,                     ধূলিতে পড়ে শুকায় রে !                 নিশি হয় ভোর , রজনীর চাঁদ                     মলিন মুখ লুকায় রে !                 সারা বিভাবরী কার পূজা করি                     যৌবনডালা সাজায়ে !      ওই       বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায় ,                     আমি কেন থাকি হায় রে ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) গান (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) তুমি পড়িতেছ হেসে               তরঙ্গের মতো এসে                    হৃদয়ে আমার । যৌবনসমুদ্রমাঝে                    কোন্‌ পূর্ণিমায় আজি                    এসেছে জোয়ার ! উচ্ছল পাগল নীরে                  তালে তালে ফিরে ফিরে          এ মোর নির্জন তীরে   কী খেলা তোমার ! মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে                 কত নৃত্যে কত সুরে          এসো কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার । তুমি পড়িতেছ হেসে               তরঙ্গের মতো এসে                       হৃদয়ে আমার । জাগরণসম তুমি                    আমার ললাট চুমি                        উদিছ নয়নে । সুষুপ্তির প্রান্ততীরে                 দেখা দাও ধীরে ধীরে                       নবীন কিরণে । দেখিতে দেখিতে শেষে              সকল হৃদয়ে এসে          দাঁড়াও আকুল কেশে রাতুল চরণে — সকল আকাশ টুটে                  তোমাতে ভরিয়া উঠে ,          সকল কানন ফুটে জীবনে যৌবনে । জাগরণসম তুমি                     আমার ললাট চুমি                       উদিছ নয়নে । কুসুমের মতো শ্বসি                পড়িতেছ খসি খসি                      মোর বক্ষ -' পরে । গোপন শিশিরছলে                  বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে                       প্রাণ সিক্ত করে । নিঃশব্দ সৌরভরাশি                 পরানে পশিছে আসি      সুখস্বপ্ন পরকাশি   নিভৃত অন্তরে । পরশপুলকে ভোর                  চোখে আসে ঘুমঘোর ,      তোমার চুম্বন , মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে । কুসুমের মতো শ্বসি                পড়িতেছ খসি খসি                       মোর বক্ষ -' পরে । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) গান আরম্ভ চারি দিকে খেলিতেছে মেঘ ,         বায়ু আসি করিছে চুম্বন --   সীমাহারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া            হৃদয়ে করিছে আলিঙ্গন ।            অনন্ত এ আকাশের কোলে            টলমল মেঘের মাঝার            এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর            তোর তরে কবিতা আমার !            যবে আমি আসিব হেথায়            মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায় ।            বাতাসে উড়িবে তোর বাস ,            ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ ,            ঈষৎ মেলিয়া আঁখি - পাতা             মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া --             হৃদয়ের মৃদুল কিরণ             অধরেতে পড়িবে লুটিয়া ।           এলো থেলো কেশপাশ লয়ে           বসে বসে , খেলিবি হেথায় ,           উষার অলক দুলাইয়া           সমীরণ যেমন খেলায় ।           চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব          আধোফোটা হাসির কুসুম ,          মুখ লয়ে বুকের মাঝারে          গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম ।          কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি         আসিবে মেঘের শিশুগুলি ,         ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে         অবাক হইয়া চেয়ে রবে ।           মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে           আয় লো কবিতা , মোর বামে --           চম্পক - অঙ্গুলি দুটি দিয়ে           অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে           যেমন করিয়া উষা নামে ।              বায়ু হতে আয় লো কবিতা ,           আসিয়া বসিবি মোর পাশে --           কে জানে , বনের কোথা হতে           ভেসে ভেসে সমীরণস্রোতে           সৌরভ যেমন করে আসে ।            হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে            বধূ মোর , ধীরে ধীরে আয় --           ভীরু প্রেম যেমন করিয়া           ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া ,            বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে            অমনি মুরছি পড়ে যায় ।                অথবা শিথিল কলেবরে         এসো তুমি , বোসো মোর পাশে --         মরণ যেমন করে আসে ,         শিশির যেমন করে ঝরে ,         পশ্চিমের আঁধারসাগরে         তারাটি যেমন করে যায় অতি ধীরে মৃদু হেসে সিঁদুর সীমন্তদেশে         দিবা সে যেমন করে আসে         মরিবারে স্বামীর চিতায়         পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায় । পরবাসী ক্ষীণ - আয়ু একটি মুমূর্ষু বায়ু         শেষ কথা বলিতে বলিতে         তখনি যেমন মরে যায়         তেমনি , তেমনি করে এসো --         কবিতা রে , বধূটি আমার ,         দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস ,         দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী ,         বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে         মরমে রাখিব মুখখানি । গান গাওয়ালে আমায় গান গাওয়ালে আমায় তুমি কতই ছলে যে, কত সুখের খেলায়, কত নয়নজলে হে। ধরা দিয়ে দাও না ধরা, এস কাছে, পালাও ত্বরা, পরান কর ব্যথায় ভরা পলে পলে হে। গান গাওয়ালে এমনি করে কতই ছলে যে।কত তীব্র তারে, তোমার বীণা সাজাও যে, শত ছিদ্র করে জীবন বাঁশি বাজাও হে। তব সুরের লীলাতে মোর জনম যদি হয়েছে ভোর, চুপ করিয়ে রাখো এবার চরণতলে হে, গান গাওয়ালে চিরজীবন কতই ছলে যে।রেলপথে, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) গান দিয়ে যে তোমায় গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বাহির মনে চিরদিবস মোর জীবনে। নিয়ে গেছে গান আমারে ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে, গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই এই ভুবনে।কত শেখা সেই শেখালো, কত গোপন পথ দেখালো, চিনিয়ে দিল কত তারা হৃদ্‌গগনে। বিচিত্র সুখদুখের দেশে রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল কোন্‌ ভবনে।৯ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) গানগুলি মোর বিষে ঢালা গানগুলি মোর বিষে ঢালা কী হবে আর তাহা বই? ফুটন্ত এ প্রাণের মাঝে বিষ ঢেলেছে বিষময়ী! গানগুলি মোর বিষেঢালা, কী হবে আর তাহা বই? বুকের মধ্যে সর্প আছে, তুমিও সেথা আছে অয়ি!Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) গানভঙ্গ গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা, ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি, কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষা পাখি; শানিত তরবারি গলাটি যেন নাচিয়া ফিরে দশ দিকে--- কখন কোথা যায় না পাই দিশা, বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে। আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল, আপনি কাটি দেয় তাহা; সভার লোকে শুনে অবাক মানে, সঘনে বলে `বাহা বাহা'।কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে; বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে। বালক-বেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি--- বাদল-দিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি। গেয়েছে আগমনী শরত্‍‌প্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান--- হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে দুনয়ান। যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে, গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে। ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উত্‍‌সব-রাতি--- পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি, বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ, করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন, সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে সাহানার সুর--- সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর। সে ছাড়া কারো গান শুনিলেই তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে। প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা-নাড়া--- সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া। থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ; বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত। কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ``ওস্তাদজি, গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি! এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে, শিকারী বিড়ালের খেলা। সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে, বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে। শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর, ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর। কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহত্‍‌ সভাগৃহকোণে, ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে। বসিয়া বাম পাশে প্রতাপরায়, দিতেছে শত উত্‍‌সাহ--- ``আহাহা, বাহা বাহা কহিছে কানে, ``গলা ছাড়িয়া গান গাহ। সভার লোকে সবে অন্যমনা, কেহ বা কানাকানি করে। কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চ'লে যায় ঘরে। ``ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়। সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, ``গরম আজি অতিশয়। করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ। নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ।বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী--- কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাঁপে থরথরি। হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উত্‍‌সের মুখে--- কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে, তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরজ গায় প্রাণপণে।গানের এক পদ মনের ভ্রমে হারায়ে গেল কী করিয়া, আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে--- লইতে চাহে শুধরিয়া। আবার ভুলে যায় পড়ে না মনে, শরমে মস্তক নাড়ি আবার শুরু হতে ধরিল গান--- আবার ভুলি দিল ছাড়ি। দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরুদেবে। কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে। গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরি, সহসা হাহারবে উঠিল কাঁদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি। কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি, গানের সুতা ছিঁড়ি পড়িল খসি, অশ্রু-মুকুতার রাশি। কোলের সখী তানপুরার 'পরে রাখিল লজ্জিত মাথা--- ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্রন্দনগাথা। নয়ন ছলছল, প্রতাপরায় কর বুলায় তার দেহে--- ``আইস হেথা হতে আমরা যাই কহিল সকরুণ স্নেহে। শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উত্‍‌সবঘর বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুঁহু দোঁহা-কর। বরজ করজোড়ে কহিল, ``প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ। এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ! জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি--- সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা, মিনতি তব পদে স্বামী! একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে--- গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে। তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে--- বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে। জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে--- যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে। গান-রচনা এ শুধু অলস মায়া , এ শুধু মেঘের খেলা , এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন — এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন । শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারাবেলা আপনার ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি , এও সেই ছায়া – খেলা বসন্তের সমীরণে । কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে । কারে যেন দেব ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি , সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে । এ খেলা খেলিবে হায় খেলার সাথি কে আছে ? ভুলে ভুলে গান গাই — কে শোনে , কে নাই শোনে — যদি কিছু মনে পড়ে , যদি কেহ আসে কাছে !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) গানের খেয়া যে গান আমি গাই জানি নে সে কার উদ্দেশ্যে। যবে জাগে মনে অকারণে চপল হাওয়া সুর যায় ভেসে কার উদ্দেশ্যে। ঐ মুখে চেয়ে দেখি, জানি নে তুমিই সে কি অতীত কালের মুরতি এসেছ নতুন কালের বেশে। কভূ জাগে মনে, যে আসে নি এ জীবনে ঘাট খুঁজি খুঁজি গানের খেয়া সে মাগিতেছে বুঝি আমার তীরেতে এসে। গানের জাল দেবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে আপন-মনে যাও চলে গান গেয়ে। যে আকাশের সুরের লেখা লেখ কুঝি না তা, কেবল রহি চেয়ে। হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে, প্রতিদিনের ঠিকঠিকানা ভোলে- মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন গন্ধের পথ বেয়ে।গানের টানা জালে নিমেষ-ঘেরা বাঁধন হাতে টানে অসীম কালে। মাটির আড়ালে করি ভেদন স্বর্গলোকের আনে বেদন, পরান ফেলে ছেয়ে। গানের পারে দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার     গানের ও পারে। আমার    সুরগুলি পায় চরণ, আমি     পাই নে তোমারে।         বাতাস বহে মরি মরি,     আর বেঁধে রেখো না তরী,         এসো এসো পার হয়ে মোর     হৃদয়-মাঝারে।।         তোমার সাথে গানের খেলা     দূরের খেলা যে -         বেদনাতে বাঁশি বাজায়     সকল বেলা যে।         কবে নিয়ে আমার বাঁশি     বাজাবে গো আপনি আসি         আনন্দময় নীরব রাতের     নিবিড় আঁধারে?।শান্তিনিকেতন ২৮ ফাল্গুন ১৩২০(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) গান্ধারীর আবেদন দুর্যোধন।                    প্রণমি চরণে তাত! ধৃতরাষ্ট্র।                    ওরে দুরাশয়,                               অভীষ্ট হয়েছে সিদ্ধ? দুর্যোধন।                   লভিয়াছি জয়। ধৃতরাষ্ট্র।                    এখন হয়েছ সুখী? দুর্যোধন।                   হয়েছি বিজয়ী। ধৃতরাষ্ট্র।                    অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই                               রে দুর্মতি? দুর্যোধন।                   সুখ চাহি নাই মহারাজ!                               জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।                               ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা                               কুরুপতি-- দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা                               জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,                               সদ্য করিয়াছি পান; সুখী নহি, তাত,                               অদ্য আমি জয়ী। পিতঃ, সুখে ছিনু, যবে                               একত্রে আছিনু বদ্ধ পাণ্ডবে কৌরবে,                               কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে                               কর্মহীন গর্বহীন দীপ্তিহীন সুখে।                               সুখে ছিনু, পাণ্ডবের গাণ্ডীবটঙ্কারে                               শঙ্কাকুল শত্রুদল আসিত না দ্বারে।                               সুখে ছিনু, পাণ্ডবেরা জয়দৃপ্ত করে                               ধরিত্রী দোহন করি' ভ্রাতৃপ্রীতিভরে                               দিত অংশ তার-- নিত্য নব ভোগসুখে                               আছিনু নিশ্চিন্তচিত্তে অনন্ত কৌতুকে।                               সুখে ছিনু, পাণ্ডবের জয়ধ্বনি যবে                               হানিত কৌরবকর্ণ প্রতিধ্বনিরবে।                               পাণ্ডবের যশোবিম্ব-প্রতিবিম্ব আসি                               উজ্জ্বল অঙ্গুলি দিয়া দিত পরকাশি                               মলিন কৌরবকক্ষ। সুখে ছিনু, পিতঃ,                               আপনার সর্বতেজ করি নির্বাপিত                               পাণ্ডবগৌরবতলে স্নিগ্ধশান্তরূপে,                               হেমন্তের ভেক যথা জড়ত্বের কূপে।                               আজি পাণ্ডুপুত্রগণে পরাভব বহি                               বনে যায় চলি-- আজ আমি সুখী নহি,                               আজ আমি জয়ী। ধৃতরাষ্ট্র।                    ধিক্‌ তোর ভ্রাতৃদ্রোহ।                               পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ                               সে কি ভুলে গেলি? দুর্যোধন।                   ভুলিতে পারি নে সে যে--                               এক পিতামহ, তবু ধনে মানে তেজে                               এক নহি। যদি হত দূরবর্তী পর                               নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর                               মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,                               কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব-উদয়শিখরে                               দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।                               আজ দ্বন্দ্ব ঘুচিয়াছে, আজি আমি জয়ী,                               আজি আমি একা। ধৃতরাষ্ট্র।                    ক্ষুদ্র ঈর্ষা! বিষময়ী                               ভুজঙ্গিনী! দুর্যোধন।                   ক্ষুদ্র নহে, ঈর্ষা সুমহতী।                               ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি                               মধ্যে রাখে ব্যবধান; লক্ষ লক্ষ তৃণ                               একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন;                               নক্ষত্র অসংখ্য থাকে সৌভ্রাত্রবন্ধনে--                               এক সূর্য, এক শশী। মলিন কিরণে                               দূর বন-অন্তরালে পাণ্ডুচন্দ্রলেখা                               আজি অস্ত গেল, আজি কুরুসূর্য একা--                               আজি আমি জয়ী! ধৃতরাষ্ট্র।                    আজি ধর্ম পরাজিত।দুর্যোধন।                   লোকধর্ম রাজধর্ম এক নহে পিতঃ!                               লোকসমাজের মাঝে সমকক্ষ জন                               সহায় সুহৃদ্‌-রূপে নির্ভর বন্ধন।                               কিন্তু রাজা একেশ্বর; সমকক্ষ তার                               মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,                               সম্মুখের অন্তরাল, পশ্চাতের ভয়,                               অহর্নিশি যশঃশক্তিগৌরবের ক্ষয়,                               ঐশ্বর্যের অংশ-অপহারী। ক্ষুদ্র জনে                               বলভাগ ক'রে লয়ে বান্ধবের সনে                               রহে বলী; রাজদণ্ড যত খণ্ড হয়                               তত তার দুর্বলতা, তত তার ক্ষয়।                               একা সকলের ঊর্ধ্বে মস্তক আপন                               যদি না রাখিবে রাজা, যদি বহুজন                               বহুদূর হতে তাঁর সমুদ্ধত শির                               নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির,                               তবে বহুজন--'পরে বহুদূরে তাঁর                               কেমনে শাসনদৃষ্টি রহিবে প্রচার?                               রাজধর্মে ভ্রাতৃধর্ম বন্ধুধর্ম নাই,                               শুধু জয়ধর্ম আছে, মহারাজ, তাই                               আজি আমি চরিতার্থ-- আজি জয়ী আমি--                               সম্মুখের ব্যবধান গেছে আজি নামি                               পাণ্ডবগৌরবগিরি পঞ্চচূড়াময়। ধৃতরাষ্ট্র।                    জিনিয়া কপটদ্যূতে তারে কোস জয়,                               লজ্জাহীন অহংকারী! দুর্যোধন।                   যার যাহা বল                               তাই তার অস্ত্র, পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।                               ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,                               তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ                               কোন্‌ নর লজ্জা পায়? মূঢ়ের মতন                               ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমাঝে আত্মসমর্পণ                               যুদ্ধ নহে, জয়লাভ এক লক্ষ্য তার--                               আজি আমি জয়ী পিতঃ, তাই অহংকার। ধৃতরাষ্ট্র।                    আজি তুমি জয়ী, তাই তব নিন্দাধ্বনি                               পরিপুর্ণ করিয়াছে অম্বর অবনী                               সমুচ্চ ধিক্কারে। দুর্যোধন।                   নিন্দা! আর নাহি ডরি,                               নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।                               নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী                               স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি                               মোর পাদপীঠতলে। 'দুর্যোধন পাপী'                               'দুর্যোধন ক্রূরমনা' 'দুর্যোধন হীন'                               নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন,                               রাজদণ্ড স্পর্শ করি কহি মহারাজ,                               আপামর জনে আমি কহাইব আজ--                               'দুর্যোধন রাজা, দুর্যোধন নাহি সহে                               রাজনিন্দা-আলোচনা, দুর্যোধন বহে                               নিজ হস্তে নিজ নাম।' ধৃতরাষ্ট্র।                    ওরে বৎস, শোন্‌,                               নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্বাসন                               নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে                               গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,                               নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।                               রসনায় নৃত্য করি চপল চঞ্চল                               নিন্দা শ্রান্ত হয়ে পড়ে; দিয়ো না তাহারে                               নিঃশব্দে আপন শক্তি বৃদ্ধি করিবারে                               গোপন হৃদয়দুর্গে। প্রীতিমন্ত্রবলে                               শান্ত করো, বন্দী করো নিন্দাসর্পদলে                               বংশীরবে হাস্যমুখে। দুর্যোধন।                   অব্যক্ত নিন্দায়                               কোনো ক্ষতি নাহি করে রাজমর্যাদায়;                               ভ্রূক্ষেপ না করি তাহে। প্রীতি নাহি পাই                               তাহে খেদ নাহি, কিন্তু স্পর্ধা নাহি চাই                               মহারাজ! প্রীতিদান স্বেচ্ছার অধীন,                               প্রীতিভিক্ষা দিয়ে থাকে দীনতম দীন--                               সে প্রীতি বিলাক তারা পালিত মার্জারে,                               দ্বারের কুক্কুরে, আর পাণ্ডবভ্রাতারে--                               তাহে মোর নাহি কাজ। আমি চাহি ভয়,                               সেই মোর রাজপ্রাপ্য-- আমি চাহি জয়                               দর্পিতের দর্প নাশি। শুন নিবেদন                               পিতৃদেব-- একাল তব সিংহাসন                               আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে,                               কণ্টকতরুর মতো নিষ্ঠুর প্রাচীরে                               তোমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান--                               শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্যগুণগান,                               আমাদের নিত্য নিন্দা-- এইমতে, পিতঃ,                               পিতৃস্নেহ হতে মোরা চিরনির্বাসিত।                               এইমতে, পিতঃ, মোরা শিশুকাল হতে                               হীনবল-- উৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে                               পাষাণের বাধা পড়ি মোরা পরিক্ষীণ                               শীর্ণ নদ, নষ্টপ্রাণ, গতিশক্তিহীন,                               পদে পদে প্রতিহত; পাণ্ডবেরা স্ফীত,                               অখণ্ড, অবাধগতি। অদ্য হতে পিতঃ,                               যদি সে নিন্দুকদলে নাহি কর দূর                               সিংহাসনপার্শ্ব হতে, সঞ্জয় বিদুর                               ভীষ্মপিতামহে, যদি তারা বিজ্ঞবেশে                               হিতকথা ধর্মকথা সাধু-উপদেশে                               নিন্দায় ধিক্কারে তর্কে নিমেষে নিমেষে                               ছিন্ন ছিন্ন করি দেয় রাজকর্মডোর,                               ভারাক্রান্ত করি রাখে রাজদণ্ড মোর,                               পদে পদে দ্বিধা আনে রাজশক্তি-মাঝে,                               মুকুট মলিন করে অপমানে লাজে,                               তবে ক্ষমা দাও পিতৃদেব-- নাহি কাজ                               সিংহাসনকণ্টকশয়নে-- মহারাজ,                               বিনিময় করে লই পাণ্ডবের সনে                               রাজ্য দিয়ে বনবাস, যাই নির্বাসনে। ধৃতরাষ্ট্র।                     হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মোর                                কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর                                সুহৃদের নিন্দাবাক্য, হইত কল্যাণ।                                অধর্মে দিয়েছি যোগ, হারায়েছি জ্ঞান,                                এত স্নেহ। করিতেছি সর্বনাশ তোর,                                এত স্নেহ। জ্বালাতেছি কালানল ঘোর                                পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে--                                তবু পুত্র, দোষ দিস স্নেহ নাই ব'লে?                                মণিলোভে কালসর্প করিলি কামনা,                                দিনু তোরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা                                অন্ধ আমি।-- অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে                                চিরদিন-- তোরে লয়ে প্রলয়তিমিরে                                চলিয়াছি-- বন্ধুগণ হাহাকাররবে                                করিছে নিষেধ, নিশাচর গৃধ্র-সবে                                করিতেছে অশুভ চীৎকার, পদে পদে                                সংকীর্ণ হতেছে পথ, আসন্ন বিপদে                                কণ্টকিত কলেবর, তবু দৃঢ়করে                                ভয়ংকর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তোরে                                বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে                                ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে                                উল্কার আলোকে-- শুধু তুমি আর আমি,                                আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী--                                নাই সম্মুখের দৃষ্টি, নাই নিবারণ                                পশ্চাতের, শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ                                নিদারুণ নিপাতের। সহসা একদা                                চকিতে চেতনা হবে, বিধাতার গদা                                মুহূর্তে পড়িবে শিরে, আসিবে সময়--                                ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরো না সংশয়,                                আলিঙ্গন করো না শিথিল, ততক্ষণ                                দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব স্বার্থধন--                                হও জয়ী, হও সুখী, হও তুমি রাজা                                একেশ্বর।-- ওরে, তোরা জয়বাদ্য বাজা।                                জয়ধ্বজা তোল্‌ শূন্যে। আজি জয়োৎসবে                                ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে--                                না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,                                নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা-ভয়                                কুরুবংশরাজলক্ষ্ণী নাহি রবে আর--                                শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,                                আর কালান্তক যম-- শুধু পিতৃস্নেহ                                আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ। চর।                           মহারাজ, অগ্নিহোত্র দেব-উপাসনা                                ত্যাগ করি বিপ্রগণ, ছাড়ি সন্ধ্যার্চনা,                                দাঁড়ায়েছে চতুষ্পথে পাণ্ডবের তরে                                প্রতীক্ষিয়া; পৌরগণ কেহ নাহি ঘরে,                                পাণ্যশালা রুদ্ধ সব; সন্ধ্যা হল, তবু                                ভৈরবমন্দির-মাঝে নাহি বাজে, প্রভু,                                শঙ্খঘণ্টা সন্ধ্যাভেরী, দীপ নাহি জ্বলে;                                শোকাতুর নরনারী সবে দলে দলে                                চলিয়াছে নগরের সিংহদ্বার-পানে                                দীনবেশে সজলনয়নে। দুর্যোধন।                    নাহি জানে                                জাগিয়াছে দুর্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন!                                ঘনায়ে এসেছে আজি তোদের দুর্দিন।                                রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়                                ঘনিষ্ঠ কঠিন। দেখি কতদিন রয়                                প্রজার পরম স্পর্ধা-- নির্বিষ সর্পের                                ব্যর্থ ফণা-আস্ফালন, নিরস্ত্র দর্পের                                হুহুংকার। [প্রতিহারীর প্রবেশ] প্রতিহারী।                   মহারাজ, মহিষী গান্ধারী                                দর্শনপ্রার্থিনী পদে। ধৃতরাষ্ট্র।                     রহিনু তাঁহারি                                প্রতীক্ষায়। দুর্যোধন।                    পিতঃ, আমি চলিলাম তবে। ধৃতরাষ্ট্র।                     করো পলায়ন। হায়, কেমনে বা সবে                                সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ                                ওরে পুণ্যভীত! মোরে তোর নাহি লাজ। [গান্ধারীর প্রবেশ] গান্ধারী।                     নিবেদন আছে শ্রীচরণে। অনুনয়                                রক্ষা করো নাথ! ধৃতরাষ্ট্র।                     কভু কি অপূর্ণ রয়                                প্রিয়ার প্রার্থনা? গান্ধারী।                     ত্যাগ করো এইবার-- ধৃতরাষ্ট্র।                     কারে হে মহিষী? গান্ধারী।                     পাপের সংঘর্ষে যার                                পড়িছে ভীষণ শান ধর্মের কৃপাণে,                                সেই মূঢ়ে। ধৃতরাষ্ট্র।                     কে সে জন? আছে কোন্‌খানে?                                শুধু কহো নাম তার। গান্ধারী।                     পুত্র দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্র।                     তাহারে করিব ত্যাগ! গান্ধারী।                     এই নিবেদন                                তব পদে। ধৃতরাষ্ট্র।                     দারুণ প্রার্থনা, হে গান্ধারী                                রাজমাতা! গান্ধারী।                     এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি                                হে কৌরব? কুরুকুলপিতৃপিতামহ                                স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা করে অহরহ                                নরনাথ! ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে--                                কৌরবকল্যাণলক্ষ্ণী যার অত্যাচারে                                অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ                                রাত্রিদিন। ধৃতরাষ্ট্র।                     ধর্ম তারে করিবে শাসন                                ধর্মেরে যে লঙ্ঘন করেছে-- আমি পিতা-- গান্ধারী।                     মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা                                জাগ্রহ হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?                                স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে                                উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি                                তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?                                শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি                                বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি                                দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে-- লয়ে টানি                                মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,                                প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,                                সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ। ধৃতরাষ্ট্র।                     কী রাখিব তারে ত্যাগ করি? গান্ধারী।                     ধর্ম তব। ধৃতরাষ্ট্র।                     কী দিবে তোমারে ধর্ম? গান্ধারী।                     দুঃখ নব নব।                                পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে                                জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে                                দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া? ধৃতরাষ্ট্র।                     হায় প্রিয়ে,                                ধর্মবশে একবার দিনু ফিরাইয়ে                                দ্যূতবদ্ধ পাণ্ডবের হৃত রাজ্যধন।                                পরক্ষণে পিতৃস্নেহ করিল গুঞ্জন                                শত বার কর্ণে মোর, 'কী করিলি ওরে!                                এক কালে ধর্মাধর্ম দুই তরী-'পরে                                পা দিয়ে বাঁচে না কেহ। বারেক যখন                                নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ                                তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে;                                পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।                                কী করিলি হতভাগ্য, বৃদ্ধ বুদ্ধিহত,                                দুর্বল দ্বিধায় পড়ি? অপমানক্ষত                                রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলাবে না আর                                পাণ্ডবের মনে-- শুধু নব কাষ্ঠভার                                হুতাশনে দান। অপমানিতের করে                                ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।                                সক্ষমে দিয়ো না ছাড়ি দিয়ে স্বল্প পীড়া--                                করহ দলন। কোরো না বিফল ক্রীড়া                                পাপের সহিত; যদি ডেকে আন তারে,                                বরণ করিয়া তবে লহো একেবারে।'                                এইমত পাপবুদ্ধি পিতৃস্নেহরূপে                                বিঁধিতে লাগিল মোর কর্ণে চুপে চুপে                                কত কথা তীক্ষ্ণ সূচিসম। পুনরায়                                ফিরানু পাণ্ডবগণে; দ্যূতছলনায়                                বিসর্জিনু দীর্ঘ বনবাসে। হায় ধর্ম,                                হায় রে প্রবৃত্তিবেগ! কে বুঝিবে মর্ম                                সংসারের! গান্ধারী।                     ধর্ম নহে সম্পদের হেতু,                                মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু--                                ধর্মেই ধর্মের শেষ। মূঢ়-নারী আমি,                                ধর্মকথা তোমারে কী বুঝাইব স্বামী,                                জান তো সকলই। পাণ্ডবেরা যাবে বনে,                                ফিরাইলে ফিরিবে না, বদ্ধ তারা পণে।                                এখন এ মহারাজ্য একাকী তোমার                                মহীপতি-- পুত্রে তব ত্যজ এইবার;                                নিষ্পাপেরে দুঃখ দিয়ে নিজে পুর্ণ সুখ                                লইয়ো না, ন্যায়ধর্মে কোরো না বিমুখ                                পৌরবপ্রাসাদ হতে-- দুঃখ সুদুঃসহ                                আজ হতে, ধর্মরাজ, লহো তুলি লহো,                                দেহো তুলি মোর শিরে। ধৃতরাষ্ট্র।                     হায় মহারানী,                                সত্য তব উপদেশ, তীব্র তব বাণী। গান্ধারী।                     অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি                                আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি                                সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;                                কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।                                ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে                                ফেলে রাখি সেও চলে যাক নির্বাসনে,                                বঞ্চিত পাণ্ডবদের সমদুঃখভার                                করুক বহন। ধৃতরাষ্ট্র।                     ধর্মবিধি বিধাতার--                                জাগ্রত আছেন তিনি, ধর্মদণ্ড তাঁর                                রয়েছে উদ্যত নিত্য; অয়ি মনস্বিনী,                                তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য করিবেন তিনি।                                আমি পিতা-- গান্ধারী।                     তুমি রাজা, রাজ-অধিরাজ,                                বিধাতার বাম হস্ত; ধর্মরক্ষা-কাজ                                তোমা-'পরে সমর্পিত। শুধাই তোমারে,                                যদি কোনো প্রজা তব সতী অবলারে                                পরগৃহ হতে টানি করে অপমান                                বিনা দোষে-- কী তাহার করিবে বিধান? ধৃতরাষ্ট্র।                     নির্বাসন। গান্ধারী।                     তবে আজ রাজপদতলে                                সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে                                বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্যোধন                                অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন,                                প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব                                স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ-- ভালোমন্দ                                নাহি বুঝি তার; দণ্ডনীতি, ভেদনীতি,                                কূটনীতি কত শত, পুরুষের রীতি                                পুরুষেই জানে। বলের বিরোধে বল,                                ছলের বিরোধে কত জেগে উঠে ছল,                                কৌশলে কৌশল হানে-- মোরা থাকি দূরে                                আপনার গৃহকর্মে শান্ত অন্তঃপুরে                                যে সেথা টানিয়া আনে বিদ্বেষ-অনল,                                যে সেথা সঞ্চার করে ঈর্ষার গরল                                বাহিরের দ্বন্দ্ব হতে, পুরুষেরে ছাড়ি                                অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী                                গৃহধর্মচারিণীর পুণ্যদেহ- 'পরে                                কলুষপরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে                                হস্তক্ষেপ-- পতি-সাথে বাধায়ে বিরোধ                                যে নর পত্নীরে হানি লয় তার শোধ,                                সে শুধু পাষণ্ড নহে, সে যে কাপুরুষ।                                মহারাজ, কী তার বিধান? অকলুষ                                পুরুবংশে পাপ যদি জন্মলাভ করে                                সেও সহে; কিন্তু, প্রভু, মাতৃগর্বভরে                                ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ                                জন্মিয়াছে-- হায় নাথ, সেদিন যখন                                অনাথিনী পাঞ্চালীর আর্তকণ্ঠরব                                প্রাসাদপাষাণভিত্তি করি দিল দ্রব                                লজ্জা-ঘৃণা-করুণার তাপে, ছুটি গিয়া                                হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্ত্র আকর্ষিয়া                                খল খল হাসিতেছে সভা-মাঝখানে                                গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা-- ধর্ম জানে                                সেদিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন                                জননীর শেষ গর্ব। কুরুরাজগণ,                                পৌরুষ কোথায় গেছে ছাড়িয়া ভারত!                                তোমরা, হে মহারথী, জড়মূর্তিবৎ                                বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে,                                কেহ বা হাসিলে, কেহ করিলে কৌতুকে                                কানাকানি-- কোষমাঝে নিশ্চল কৃপাণ                                বজ্রনিঃশেষিত লুপ্তবিদ্যুৎ-সমান                                নিদ্রাগত-- মহারাজ, শুন মহারাজ,                                এ মিনতি। দূর করো জননীর লাজ,                                বীরধর্ম করহ উদ্ধার, পদাহত                                সতীত্বের ঘুচাও ক্রন্দন; অবনত                                ন্যায়ধর্মে করহ সম্মান-- ত্যাগ করো                                দূর্যোধনে। ধৃতরাষ্ট্র।                     পরিতাপদহনে জর্জর                                হৃদয়ে করিছ শুধু নিষ্ফল আঘাত                                হে মহিষী! গান্ধারী।                     শতগুণ বেদনা কি, নাথ,                                লাগিছে না মোরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে                                দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে                                সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তারে প্রাণ                                কোনো ব্যথা নাহি পায় তার দণ্ডদান                                প্রবলের অত্যাচার। যে দণ্ডবেদনা                                পুত্রেরে পার না দিতে সে কারে দিয়ো না;                                যে তোমার পুত্র নহে তারো পিতা আছে,                                মহা-অপরাধী হবে তুমি তার কাছে                                বিচারক। শুনিয়াছি বিশ্ববিধাতার                                সবাই সন্তান মোরা-- পুত্রের বিচার                                নিয়ত করেন তিনি আপনার হাতে                                নারায়ণ; ব্যথা দেন, ব্যথা পান সাথে;                                নতুবা বিচারে তাঁর নাই অধিকার,                                মূঢ় নারী লভিয়াছি অন্তরে আমার                                এই শাস্ত্র। পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি                                নির্বিচারে, মহারাজ, তবে নিরবধি                                যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষীজনে,                                ধর্মাধিপ নামে, কর্তব্যের প্রবর্তনে,                                ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে--                                ন্যায়ের বিচার তব নির্মমতারূপে                                পাপ হয়ে তোমারে দাগিবে। ত্যাগ করো                                পাপী দুর্যোধনে। ধৃতরাষ্ট্র।                     প্রিয়ে, সংহর, সংহর                                তব বাণী। ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,                                ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর                                ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,                                তাই তারে ত্যজিতে না পারি-- আমি তার                                একমাত্র। উন্মত্ত-তরঙ্গ-মাঝখানে                                যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্‌ প্রাণে                                ছাড়ি যাব? উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি                                তবু তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি,                                তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি                                এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি                                অকাতরে-- অংশ লই তার দুর্গতির,                                অর্ধ ফল ভোগ করি তার দুর্মতির,                                সেই তো সান্ত্বনা মোর-- এখন তো আর                                বিচারের কাল নাই, নাই প্রতিকার,                                নাই পথ-- ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,                                ফলিবে যা ফলিবার আছে। [প্রস্থান] গান্ধারী।                     হে আমার                                অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে                                প্রতীক্ষা করিয়া থাকো বিধির বিধিরে                                ধৈর্য ধরি। যেদিন সুদীর্ঘ রাত্রি-'পরে                                সদ্য জেগে উঠে কাল সংশোধন করে                                আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।                                দুঃসহ উত্তাপে যথা স্থির গতিহীন                                ঘুমাইয়া পড়ে বায়ু-- জাগে ঝঞ্ঝাঝড়ে                                অকস্মাৎ, আপনার জড়ত্বের 'পরে                                করে আক্রমণ, অন্ধ বৃশ্চিকের মতো                                ভীমপুচ্ছে আত্মশিরে হানে অবিরত                                দীপ্ত বজ্রশূল, সেইমত কাল যবে                                জাগে, তারে সভয়ে অকাল কহে সবে।                                লুটাও লুটাও শির-- প্রণম, রমণী,                                সেই মহাকালে; তার রথচক্রধ্বনি                                দূর রুদ্রলোক হতে বজ্রঘর্ঘরিত                                ওই শুনা যায়। তোর আর্ত জর্জরিত                                হৃদয় পাতিয়া রাখ্‌ তার পথতলে।                                ছিন্ন সিক্ত হৃৎপিণ্ডের রক্তশতদলে                                অঞ্জলি রচিয়া থাক্‌ জাগিয়া নীরবে                                চাহিয়া নিমেষহীন। তার পরে যবে                                গগনে উড়িবে ধূলি, কাঁপিবে ধরণী,                                সহসা উঠিবে শূন্যে ক্রন্দনের ধ্বনি--                                হায় হায় হা রমণী, হায় রে অনাথা,                                হায় হায় বীরবধূ; হায় বীরমাতা,                                হায় হায় হাহাকার-- তখন সুধীরে                                ধুলায় পড়িস লুটি অবনতশিরে                                মুদিয়া নয়ন। তার পরে নমো নম                                সুনিশ্চিত পরিণাম, নির্বাক্‌ নির্মম                                দারুণ করুণ শান্তি! নমো নমো নম                                কল্যাণ কঠোর কান্ত, ক্ষমা স্নিগ্ধতম!                                নমো নমো বিদ্বেষের ভীষণা নির্বৃতি!                                শ্মশানে ভস্মমাখা পরমা নিষ্কৃতি! [দুর্যোধন-মহিষী ভানুমতীর প্রবেশ] ভানুমতী।                   ইন্দুমুখী, পরভৃতে, লহো তুলি শিরে                                মাল্যবস্ত্র অলংকার। গান্ধারী।                     বৎসে, ধীরে, ধীরে।                                পৌরব ভবনে কোন্‌ মহোৎসব আজি?                                কোথা যাও নব বস্ত্র-অলংকারে সাজি                                বধূ মোর? ভানুমতী।                   শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ                                সমাগত। গান্ধারী।                     শত্রু যার আত্মীয়স্বজন                                আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম শত্রু তার,                                অজেয় তাহার শত্রু। নব অলংকার                                কোথা হতে হে কল্যাণী? ভানুমতী।                   জিনি বসুমতী                                ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি                                দিয়েছিল যত রত্নমণি-অলংকার--                                যজ্ঞদিনে যাহা পরি ভাগ্য-অহংকার                                ঠিকরিত মাণিক্যের শত সূচীমুখে                                দ্রৌপদীর অঙ্গ হতে, বিদ্ধ হত বুকে                                কুরুকুলকামিনীর, সে রত্নভূষণে                                আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে। গান্ধারী।                     হা রে মূঢ়ে, শিক্ষা তবু হল না তোমার--                                সেই রত্ন নিয়ে তবু এত অহংকার!                                এ কী ভয়ংকরী কান্তি, প্রলয়ের সাজ।                                যুগান্তের উল্কাসম দহিছে না আজ                                এ মণিমঞ্জীর তোরে? রত্নললাটিকা                                এ যে তোর সৌভাগ্যের বজ্রানলশিখা।                                তোরে হেরি অঙ্গে মোর ত্রাসের স্পন্দন                                সঞ্চারিছে, চিত্তে মোর উঠিছে ক্রন্দন--                                আনিছে শঙ্কিত কর্ণে তোর অলংকার                                উন্মাদিনী শংকরীর তাণ্ডবঝংকার। ভানুমতী।                   মাতঃ, মোরা ক্ষত্রনারী, দুর্ভাগ্যের ভয়                                নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়--                                মধ্যাহ্নগগনে কভু, কভু অস্তধামে,                                ক্ষত্রিয়মহিমা-সূর্য উঠে আর নামে।                                ক্ষত্রবীরাঙ্গনা, মাতঃ, সেই কথা স্মরি                                শঙ্কার বক্ষেতে থাকি সংকটে না ডরি                                ক্ষণকাল। দুর্দিন দুর্যোগ যদি আসে,                                বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি উপহাসে                                কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবী--                                কেমনে বাঁচিতে হয় শ্রীচরণ সেবি                                সে শিক্ষাও লভিয়াছি। গান্ধারী।                     বৎসে, অমঙ্গল                                একেলা তোমার নহে। লয়ে দলবল                                সে যবে মিটায় ক্ষুধা, উঠে হাহাকার,                                কত বীররক্তস্রোতে কত বিধবার                                অশ্রুধারা পড়ে আসি-- রত্ন-অলংকার                                বধূহস্ত হতে খসি পড়ে শত শত                                চূতলতাকুঞ্জবনে মঞ্জরীর মতো                                ঝঞ্ঝাবাতে। বৎসে, ভাঙিয়ো না বদ্ধ সেতু,                                ক্রীড়াচ্ছলে তুলিয়ো না বিপ্লবের কেতু                                গৃহমাঝে-- আনন্দের দিন নহে আজি।                                স্বজনদুর্ভাগ্য লয়ে সর্ব অঙ্গে সাজি                                গর্ব করিয়ো না মাতঃ! হয়ে সুসংযত                                আজ হতে শুদ্ধচিত্তে উপবাসব্রত                                করো আচরণ-- বেণী করি উন্মোচন                                শান্ত মনে করো, বৎসে, দেবতা-অর্চন।                                এ পাপসৌভাগ্যদিনে গর্ব-অহংকারে                                প্রতিক্ষণে লজ্জা দিয়ো নাকো বিধাতারে।                                খুলে ফেলো অলংকার, নব রক্তাম্বর;                                থামাও উৎসববাদ্য, রাজ-আড়ম্বর;                                অগ্নিগৃহে যাও, পুত্রী, ডাকো পুরোহিতে--                                কালের প্রতীক্ষা করো শুদ্ধসত্ত্ব চিতে্‌। যুধিষ্ঠির।                     আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি, জননী,                                বিদায়ের কালে। গান্ধারী।                     সৌভাগ্যের দিনমণি                                দুঃখরাত্রি-অবসানে দ্বিগুণ উজ্জ্বল                                উদিবে হে বৎসগণ! বায়ু হতে বল,                                সূর্য হতে তেজ, পৃথ# হতে ধৈর্যক্ষমা                                করো লাভ দুঃখব্রত পুত্র মোর! রমা                                দৈন্য-মাঝে গুপ্ত থাকি দীন-ছদ্ম-রূপে                                    ফিরুন পশ্চাতে তব সদা চুপে চুপে,                                দুঃখ হতে তোমা-তরে করুন সঞ্চয়                                অক্ষয় সম্পদ। নিত্য হউক নির্ভয়                                নির্বাসনবাস। বিনা পাপে দুঃখভোগ                                অন্তরে জ্বলন্ত তেজ করুক সংযোগ                                  বহ্নিশিখাদগ্ধ দীপ্ত সুবর্ণের প্রায়।                                সেই মহাদুঃখ হবে মহৎ সহায়                                তোমাদের। সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী                                ধর্মরাজ বিধি, যবে শুধিবেন তিনি                                  নিজহস্তে আত্মঋণ তখন জগতে                                দেব নর কে দাঁড়াবে তোমাদের পথে!                                মোর পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ                                খণ্ডন করুক সব মোর আশীর্বাদ                                পুত্রাধিক পুত্রগণ! অন্যায় পীড়ন                                গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক মন্থন।                                (দ্রৌপদীকে আলিঙ্গনপূর্বক)                                ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,                                হে আমার রাহুগ্রস্ত শশী, একবার                                  তোলো শির, বাক্য মোর করো অবধান।                                যে তোমারে অবমানে তারি অপমান                                  জগতে রহিবে নিত্য, কলঙ্ক অক্ষয়।                                তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়                                  ভাগ করে লইয়াছে সর্ব কুলাঙ্গনা--                                কাপুরুষতার হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।                                যাও বৎসে, পতি-সাথে অমলিনমুখ                                অরণ্যেরে করো স্বর্গ, দুঃখে করো সুখ।                                বধূ মোর, সুদুঃসহ পতিদুঃখব্যথা                                বক্ষে ধরি সতীত্বের লভো সার্থকতা।                                রাজগৃহে আয়োজন দিবসযামিনী                                  সহস্র সুখের-- বনে তুমি একাকিনী                                  সর্বসুখ, সর্বসঙ্গ, সর্বৈশ্বর্যময়,                                সকল সান্ত্বনা একা, সকল আশ্রয়,                                    ক্লান্তির আরাম, শান্তি, ব্যাধির শুশ্রূষা,                                  দুর্দিনের শুভলক্ষ্ণী, তামসীর ভূষা                                    উষা মূর্তিমতী। তুমি হবে একাকিনী                                  সর্বপ্রীতি, সর্বসেবা, জননী, গেহিনী--                                  সতীত্বের শ্বেতপদ্ম সম্পূর্ণ সৌরভে                                শতদলে প্রস্ফুটিয়া জাগিবে গৌরবে। গাবার মতো হয় নি কোনো গান গাবার মতো হয় নি কোনো গান, দেবার মতো হয় নি কিছু দান। মনে যে হয় সবি রইল বাকি তোমায় শুধু দিয়ে এলেম ফাঁকি, কবে হবে জীবন পূর্ণ করে এই জীবনের পূজা অবসান।আর-সকলের সেবা করি যত প্রাণপণে দিই অর্ঘ্য ভরি ভরি। সত্য মিথ্যা সাজিয়ে দিই যে কত দীন বলিয়া পাছে ধরা পড়ি। তোমার কাছে গোপন কিছু নাই, তোমার পূজায় সাহস এত তাই, যা আছে তাই পায়ের কাছে আনি অনাবৃত দরিদ্র এই প্রাণ।৭ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) গায়ে আমার পুলক লাগে গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর, হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর। আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে কেমন করে মনোহরণ ছড়ালে মন মোর।কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে। পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে। আনন্দ আজ কিসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে, বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর।শিলাইদহ, ২৫ আশ্বিন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) গালির ভঙ্গি লাঠি গালি দেয়, ছড়ি, তুই সরু কাঠি! ছড়ি তারে গালি দেয়, তুমি মোটা লাঠি!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) গিন্নির কানে শোনা ঘটে অতি সহজেই গিন্নির কানে শোনা ঘটে অতি সহজেই “গিনি সোনা এনে দেব’ কানে কানে কহ যেই। না হলে তোমারি কানে দুর্গ্রহ টেনে আনে, অনেক কঠিন শোনা– চুপ করে রহ যেই।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয় গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয় রূপের মোহনে আছিল মাতি, প্রাণের স্বপন আছিল যখন প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি! শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার এখন ফুটিতে পারে, সুবিমলতর দিবস আমার এখন উঠিতে পারে। বালক কালের প্রেমের স্বপন– মধুর যেমন উজল যেমন তেমন কিছুই আসিবে না, তেমন কিছুই আসিবে না! সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা, স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা! সে প্রতিমা সেই পরিমল সম পলকে যা লয় পায়, প্রভাতকালের স্বপন যেমন পলকে মিশায়ে যায়। অলস প্রবাহ জীবনে আমার সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর সে কিরণ কভু ভাসিবে না, সে কিরণ কভু ভাসিবে না!Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা) গিরিবক্ষ হতে আজি গিরিবক্ষ হতে আজি ঘুচুক কুজ্ঝটি-আবরণ, নূতন প্রভাতসূর্য এনে দিক্‌ নবজাগরণ। মৌন তার ভেঙে যাক, জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্ব লোক হতে বাণীর নির্ঝরধারা প্রবাহিত হোক শতস্রোতে।    (স্ফুলিঙ্গ) গীতহীন চলে গেছে মোর বীণাপাণি             কতদিন হল সে না জানি । কী জানি কী অনাদরে              বিস্মৃত ধূলির পরে            ফেলে রেখে গেছে বীণাখানি । ফুটেছে কুসুমরাজি —               নিখিল জগতে আজি             আসিয়াছে গাহিবার দিন , মুখরিত দশ দিক ,                  অশ্রান্ত পাগল পিক ,             উচ্ছ্বসিত বসন্তবিপিন । বাজিয়া উঠেছে ব্যথা ,               প্রাণ - ভরা ব্যাকুলতা ,             মনে ভরি উঠে কত বাণী , বসে আছি সারাদিন                 গীতিহীন স্তুতিহীন —              চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।    আর সে নবীন সুরে                 বীণা উঠিবে না পুরে ,              বাজিবে না পুরানো রাগিণী ; যৌবনে যোগিনীমত ,               লয়ে নিত্য মৌনব্রত               তুই বীণা রবি উদাসিনী । কে বসিবে এ আসনে               মানসকমলবনে ,              কার কোলে দিব তোরে আনি — থাক্‌ পড়ে ওইখানে                 চাহিয়া আকাশপানে —                চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।    কখনো মনের ভুলে                যদি এরে লই তুলে              বাজে বুকে বাজাইতে বীণা ; যদিও নিখিল ধরা                   বসন্তে সংগীত ভরা ,              তবু আজি গাহিতে পারি না । কথা আজি কথাসার ,               সুর তাহে নাহি আর ,                গাঁথা ছন্দ বৃথা বলে মানি — অশ্রুজলে ভরা প্রাণ ,               নাহি তাহে কলতান —               চলে গেছে মোর বীণাপাণি । ভাবিতাম সুরে বাঁধা                এ বীণা আমারি সাধা ,                এ আমার দেবতার বর ; এ আমারি প্রাণ হতে               মন্ত্রভরা সুধাস্রোতে                পেয়েছে অক্ষয় গীতস্বর । একদিন সন্ধ্যালোকে                অশ্রুজল ভরি চোখে               বক্ষে এরে লইলাম টানি — আর না বাজিতে চায় ,              তখনি বুঝিনু হায়              চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) গীতোচ্ছ্বাস নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার । প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার বসন্তকানন-মাঝে বসন্তসমীরে । তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত । তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত । তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো । জগৎ-কমলবনে কমল-আসনা কত দিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে । সে এল না -- এল তার মধুর মিলন, বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর! দৃষ্টি তার ফিরে এল, কোথা সে নয়ন! চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর! গুণজ্ঞ আমি প্রজাপতি ফিরি রঙিন পাখায়, কবি তো আমার পানে তবু না তাকায়। বুঝিতে না পারি আমি, বলো তো ভ্রমর, কোন্‌ গুণে কাব্যে তুমি হয়েছ অমর। অলি কহে, আপনি সুন্দর তুমি বটে, সুন্দরের গুণ তব মুখে নাহি রটে। আমি ভাই মধু খেয়ে গুণ গেয়ে ঘুরি, কবি আর ফুলের হৃদয় করি চুরি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) গুপ্তিপাড়ায় জন্ম তাহার গুপ্তিপাড়ায় জন্ম তাহার; নিন্দাবাদের দংশনে অভিমানে মরতে গেল মোগলসরাই জংসনে। কাছা কোঁচা ঘুচিয়ে গুপি ধরল ইজের, পরল টুপি, দু হাত দিয়ে লেগে গেল কোফ্‌তা-কাবাব-ধ্বংসনে। গুরুপুত্র সঙ্গে ছিল– বললে তারে, “অংশ নে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) গৃহশত্রু আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে                নব অভিসারসাজে,      নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন,      না গাহে বিহগ, না চলে পবন,      মৌন সকল পৌর ভবন                সুপ্তনগরমাঝে-- শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে              বিমরি বিমরি বাজে।      অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর              পদে পদে মরি লাজে।আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া                বসি বাতায়নকাছে--      অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায়,      লহরীর লেশ নাহি যমুনায়,      জনহীন পথ আঁধারে মিশায়,                পাতাটি কাঁপে না গাছে-- শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয়                উলসি বিলসি নাচে।      উতলা পাগল করে কলরোল,                বাঁধন টুটিলে বাঁচে।আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে,                মধুর মিলনরাতি--      স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার,      নির্বাণ দীপ, রুদ্ধ দুয়ার,      শ্রাবণগগন করে হাহাকার                তিমিরশয়ন পাতি-- শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে                জ্বালায়ে রেখেছে বাতি।      কোথায় লুকাই, কেমনে নিবাই                নিলাজ ভূষণভাতি।আমি আমার গোপন মরমের কথা                রেখেছি মরমতলে।      মলয় কহিছে আপন কাহিনী,      কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী,      নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী                আপনার কলকলে-- শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি                গীতঝংকারছলে      যে কথা যখন করিব গোপন                সে কথা তখনি বলে। গোয়ালিনী হাটেতে চল পথের বাঁকে বাঁকে, হে গোয়ালিনী, শিশুরে নিয়ে কাঁখে।        হাটের সাথে ঘরের সাথে        বেঁধেছ ডোর আপন হাতে                 পরুষ কলকোলাহলের ফাঁকে।হাটের পথে জানি না কোন্‌ ভুলে কৃষ্ণকলি উঠিছে ভরি ফুলে।        কেনাবেচার বাহনগুলা        যতই কেন উড়াক ধুলা                 তোমারি মিল সে ওই তরুমূলে।শালিখপাখি আহারকণা-আশে মাঠের 'পরে চরিছে ঘাসে ঘাসে।        আকাশ হতে প্রভাতরবি        দেখিছে সেই প্রাণের ছবি,                 তোমারে আর তাহারে দেখে হাসে।মায়েতে আর শিশুতে দোঁহে মিলে ভিড়ের মাঝে চলেছ নিরিবিলে।        দুধের ভাঁড়ে মায়ের প্রাণ        মাধুরী তার করিল দান,                 লোভের ভালে স্নেহের ছোঁওয়া দিলে। গ্রহণে ও দানে কৃতাঞ্জলি কর কহে, আমার বিনয়, হে নিন্দুক, কেবল নেবার বেলা নয়। নিই যবে নিই বটে অঞ্জলি জুড়িয়া, দিই যবে সেও দিই অঞ্জলি পুরিয়া।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ঘট ভরা আমার এই ছোটো কলসখানি সারা সকাল পেতে রাখি ঝরনাধারার নিচে। বসে থাকি একটি ধারে শেওলাঢাকা পিছল কালো পাথরটাতে। ঘট ভরে যায় বারে বারে-- ফেনিয়ে ওঠে, ছাপিয়ে পড়ে কেবলি। সবুজ দিয়ে মিনে-করা শৈলশ্রেণীর নীল আকাশে ঝর্‌ঝরানির শব্দ ওঠে দিনে রাতে। ভোরের ঘুমে ডাক শোনে তার গাঁয়ের মেয়েরা। জলের শব্দ যায় পেরিয়ে বেগনি রঙের বনের সীমানা, পাহাড়তলির রাস্তা ছেড়ে যেখানে ঐ হাটের মানুষ ধীরে ধীরে উঠছে চড়াইপথে, বলদ দুটোর পিঠে বোঝাই শুকনো কাঠের আঁটি; রুনুঝুনু ঘণ্টা গলায় বাঁধা। ঝর্‌ঝরানি আকাশ ছাপিয়ে ভাবনা আমার ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় চলে পথহারানো দূর বিদেশে। রাঙা ছিল সকালবেলার প্রথম রোদের রং উঠল সাদা হয়ে। বক উড়ে যায় পাহাড় পেরিয়ে। বেলা হল ডাক পড়েছে ঘরে। ওরা আমায় রাগ ক'রে কয় "দেরি করলি কেন?" চুপ করে সব শুনি; ঘট ভরতে হয় না দেরি সবাই জানে, উপচে-পড়া জলের কথা বুঝবে না তো কেউ। ঘন কাঠিন্য রচিয়া শিলাস্তূপে ঘন কাঠিন্য রচিয়া শিলাস্তূপে দূর হতে দেখি আছে দুর্গমরূপে। বন্ধুর পথ করিনু অতিক্রম— নিকটে আসিনু, ঘুচিল মনের ভ্রম। আকাশে হেথায় উদার আমন্ত্রণ, বাতাসে হেথায় সখার আলিঙ্গন, অজানা প্রবাসে যেন চিরজানা বাণী প্রকাশ করিল আত্মীয়গৃহখানি।   (স্ফুলিঙ্গ) ঘন্টা বাজে দূরে ঘন্টা বাজে দূরে। শহরের অভ্রভেদী আত্মঘোষণার মুখরতা মন থেকে লুপ্ত হয়ে গেল, আতপ্ত মাঘের রৌদ্রে অকারণে ছবি এল চোখে জীবনযাত্রার প্রান্তে ছিল যাহা অনতিগোচর।গ্রামগুলি গেঁথে গেঁথে মেঠো পথ গেছে দূর-পানে নদীর পাড়ির ‘পর দিয়ে। প্রাচীন অশথতলা, খেয়ার আশায় লোক ব’সে পাশে রাখি হাটের পসরা। গঞ্জের টিনের চালাঘরে গুড়ের কলস সারি সারি, চেটে যায় ঘ্রাণলুব্ধ পাড়ার কুকুর, ভিড় করে মাছি। রাস্তায় উপুড়মুখো গাড়ি পাটের বোঝাই ভরা, একে একে বস্তা টেনে উচ্চস্বরে চলেছে ওজন আড়তের আঙিনায়। বাঁধা-খোলা বলদেরা রাস্তার সবুজ প্রান্তে ঘাস খেয়ে ফেরে, লেজের চামর হানে পিঠে। সর্ষে আছে স্তূপাকার গোলায় তোলার অপেক্ষায়। জেলেনৌকো এল ঘাটে, ঝুড়ি কাঁখে জুটেছে মেছুনি; মাথার উপরে ওড়ে চিল। মহাজনী নৌকোগুলো ঢালুতটে বাঁধা পাশাপাশি। মাল্লা বুনিতেছে জাল রৌদ্রে বসি চালের উপরে। আঁকড়ি মোষের গলা সাঁতারিয়া চাষী ভেসে চলে ওপারে ধানের খেতে। অদূরে বনের ঊর্ধ্বে মন্দিরের চূড়া ঝলিছে প্রভাত-রৌদ্রালোকে। মাঠের অদৃশ্য পারে চলে রেলগাড়ি ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর ধ্বনিরেখা টেনে দিয়ে বাতাসের বুকে, পশ্চাতে ধোঁয়ায় মেলি দূরত্বজয়ের দীর্ঘ বিজয়পতাকা।মনে এল, কিছুই সে নয়, সেই বহুদিন আগে, দু’পহর রাতি, নৌকা বাঁধা গঙ্গার কিনারে। জ্যোৎস্নায় চিক্কণ জল, ঘনীভূত ছায়ামূর্তি নিষ্কম্প অরণ্যতীরে-তীরে, ক্কচিৎ বনের ফাঁকে দেখা যায় প্রদীপের শিখা। সহসা উঠিনু জেগে। শব্দশূন্য নিশীথ-আকাশে উঠিছে গানের ধ্বনি তরুণ কন্ঠের, ছুটিছে ভাঁটির স্রোতে তন্বী নৌকা তরতর বেগে। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল; দুই পারে স্তব্ধ বনে জাগিয়া রহিল শিহরণ; চাঁদের-মুকুট-পরা অচঞ্চল রাত্রির প্রতিমা রহিল নির্বাক্‌ হয়ে পরাভূত ঘুমের আসনে।পশ্চিমের গঙ্গাতীর, শহরের শেষপ্রান্তে বাসা, দূর প্রসারিত চর শূন্য আকাশের নীচে শূন্যতার ভাষ্য করে যেন। হেথা হোথা চরে গোরু শস্যশেষ বাজরার খেতে; তর্‌মুজের লতা হতে ছাগল খেদায়ে রাখে কাঠি হাতে কৃষাণ-বালক। কোথাও বা একা পল্লীনারী শাকের সন্ধানে ফেরে ঝুড়ি নিয়ে কাঁখে। কভু বহু দূরে চলে নদীর রেখার পাশে পাশে নতপৃষ্ঠ ক্লিষ্টগতি গুণটানা মাল্লা একসারি। জলে স্থলে সজীবের আর চিহ্ন নাই সারাবেলা। গোলকচাঁপার গাছ অনাদৃত কাছের বাগানে; তলায়-আসন-গাঁথা বৃদ্ধ মহানিম, নিবিড় গম্ভীর তার আভিজাত্যচ্ছায়া। রাত্রে সেথা বকের আশ্রয়। ইঁদারায় টানা জল নালা বেয়ে সারাদিন কুলুকুলু চলে ভুট্টার ফসলে দিতে প্রাণ। ভজিয়া জাঁতায় ভাঙে গম পিতল-কাঁকন-পরা হাতে। মধ্যাহ্ন আবিষ্ট করে একটানা সুর।পথে-চলা এই দেখাশোনা ছিল যাহা ক্ষণচর চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশে, চিত্তে আজ তাই জেগে ওঠে; এই-সব উপেক্ষিত ছবি জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদবেদনা দূরের ঘণ্টার রবে এনে দেয় মনে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) ঘরের খেয়া সন্ধ্যা হয়ে আসে; সোনা-মিশোল ধূসর আলো ঘিরল চারিপাশে।নৌকোখানা বাঁধা আমার মধ্যিখানের গাঙে অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে। আপন গাঁয়ে কুটীর আমার দূরের পটে লেখা, ঝাপসা আভায় যাচ্ছে দেখা বেগনি রঙের রেখা।        যাব কোথায় কিনারা তার নাই, পশ্চিমেতে মেঘের গায়ে একটু আভাস পাই। হাঁসের দলে উড়ে চলে হিমালয়ের পানে, পাখা তাদের চিহ্নবিহীন পথের খবর জানে। শ্রাবণ গেল, ভাদ্র গেল, শেষ হল জল-ঢালা, আকাশতলে শুরু হল শুভ্র আলোর পালা। খেতের পরে খেত একাকার প্লাবনে রয় ডুবে, লাগল জলের দোলযাত্রা পশ্চিমে আর পুবে। আসন্ন এই আঁধার মুখে নৌকোখানি বেয়ে      যায় কারা ঐ, শুধাই, "ওগো নেয়ে,               চলেছ কোন্‌খানে।" যেতে যেতে জবাব দিল, "যাব গাঁয়ের পানে।" অচিন শূন্যে ওড়া পাখি চেনে আপন নীড়, জানে বিজনমধ্যে কোথায় আপন জনের ভিড়। অসীম আকাশ মিলেছে ওর বাসার সীমানাতে, ঐ অজানা জড়িয়ে আছে জানাশোনার সাথে| তেমনি ওরা ঘরের পথিক ঘরের দিকে চলে যেথায় ওদের তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে।    দাঁড়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায় ধীরে,             মিলায় সুদূর নীরে। সেদিন দিনের অবসানে সজল মেঘের ছায়ে আমার চলার ঠিকানা নাই, ওরা চলল গাঁয়ে। ঘাসি কামারের বাড়ি ঘাসি কামারের বাড়ি সাঁড়া, গড়েছে মন্ত্রপড়া খাঁড়া। খাপ থেকে বেরিয়ে সে উঠেছে অট্টহেসে; কামার পালায় যত বলে, “দাঁড়া দাঁড়া।’ দিনরাত দেয় তার নাড়ীটাতে নাড়া।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ঘাসে আছে ভিটামিন ঘাসে আছে ভিটামিন, গোরু ভেড়া অশ্ব ঘাস খেয়ে বেঁচে আছে, আঁখি মেলে পশ্য। অনুকূল বাবু বলে, “ঘাস খাওয়া ধরা চাই, কিছুদিন জঠরেতে অভ্যেস করা চাই– বৃথাই খরচ ক’রে চাষ করা শস্য। গৃহিণী দোহাই পাড়ে মাঠে যবে চরে সে, ঠেলা মেরে চলে যায় পায়ে যবে ধরে সে– মানবহিতের ঝোঁকে কথা শোনে কস্য; দুদিনে না যেতে যেতে মারা গেল লোকটা, বিজ্ঞানে বিঁধে আছে এই মহা শোকটা, বাঁচলে প্রমাণ-শেষ হ’ত যে অবশ্য।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ঘুমচোরা কে নিল খোকার ঘুম হরিয়া। মা তখন জল নিতে              ও পাড়ার দিঘিটিতে              গিয়াছিল ঘট কাঁখে করিয়া।— তখন রোদের বেলা               সবাই ছেড়েছে খেলা,              ও পারে নীরব চখা-চখীরা; শালিক থেমেছে ঝোপে,            শুধু পায়রার খোপে              বকাবকি করে সখা-সখীরা; তখন রাখাল ছেলে               পাঁচনি ধুলায় ফেলে              ঘুমিয়ে পড়েছে বটতলাতে; বাঁশ-বাগানের ছায়ে             এক-মনে এক পায়ে              খাড়া হয়ে আছে বক জলাতে। সেই ফাঁকে ঘুমচোর              ঘরেতে পশিয়া মোর              ঘুম নিয়ে উড়ে গেল গগনে, মা এসে অবাক রয়,            দেখে খোকা ঘর-ময়              হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে সঘনে।                 আমার খোকার ঘুম নিল কে। যেথা পাই সেই চোরে            বাঁধিয়া আনিব ধরে,              সে লোক লুকাবে কোথা ত্রিলোকে। যাব সে গুহার ছায়ে            কালো পাথরের গায়ে              কুলু কুলু বহে যেথা ঝরনা। যাব সে বকুলবনে              নিরিবিলি সে বিজনে             ঘুঘুরা করিছে ঘর-করনা। যেখানে সে-বুড়া বট            নামায়ে দিয়েছে জট,              ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে, যেখানে বনের কাছে              বনদেবতারা নাচে              চাঁদিনিতে রুনুঝুনু নূপুরে, যাব আমি ভরা সাঁঝে           সেই বেণুবন - মাঝে           আলো যেথা রোজ জ্বালে জোনাকি— শুধাব মিনতি করে,            ‘আমাদের ঘুমচোরে              তোমাদের আছে জানাশোনা কি। '                 কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে। কোনোমতে দেখা তার          পাই যদি একবার               লই তবে সাধ মোর পুরায়ে। দেখি তার বাসা খুঁজি          কোথা ঘুম করে পুঁজি,              চোরা ধন রাখে কোন্‌ আড়ালে। সব লুঠি লব তার,           ভাবিতে হবে না আর              খোকার চোখের ঘুম হারালে ডানা দুটি বেঁধে তারে       নিয়ে যাব নদীপারে              সেখানে সে বসে এক কোণেতে জলে শরকাঠি ফেলে        মিছে মাছ-ধরা খেলে              দিন কাটাইবে কাশবনেতে। যখন সাঁঝের বেলা           ভাঙিবে হাটের মেলা              ছেলেরা মায়ের কোল ভরিবে, সারা রাত টিটি-পাখি       টিটকারি দিবে ডাকি—              ‘ঘুমচোরা কার ঘুম হরিবে। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ঘুমের তত্ব জাগার থেকে ঘুমোই , আবার           ঘুমের থেকে জাগি — অনেক সময় ভাবি মনে           কেন , কিসের লাগি ? আমাকে , মা , যখন তুমি           ঘুম পাড়িয়ে রাখ তখন তুমি হারিয়ে গিয়ে           তবু হারাও নাকো । রাতে সূর্য , দিনে তারা           পাই নে , হাজার খুঁজি । তখন তা'রা ঘুমের সূর্য ,           ঘুমের তারা বুঝি ? শীতের দিনে কনকচাঁপা যায় না দেখা গাছে , ঘুমের মধ্যে নুকিয়ে থাকে           নেই তবুও আছে । রাজকন্যে থাকে , আমার           সিঁড়ির নিচের ঘরে । দাদা বলে , ' দেখিয়ে দে তো । '           বিশ্বাস না করে । কিন্তু , মা , তুই জানিস নে কি           আমার সে রাজকন্যে ঘুমের তলায় তলিয়ে থাকে ,           দেখি নে সেইজন্যে ।    নেই তবুও আছে এমন           নেই কি কত জিনিস ? আমি তাদের অনেক জানি ,           তুই কি তাদের চিনিস ? যেদিন তাদের রাত পোয়াবে            উঠবে চক্ষু মেলি সেদিন তোমার ঘরে হবে           বিষম ঠেলাঠেলি । নাপিত ভায়া , শেয়াল ভায়া ,            ব্যাঙ্গমা বেঙ্গুমী ভিড় ক'রে সব আসবে যখন           কী যে করবে তুমি ! তখন তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো           আমিই জেগে থেকে নানারকম খেলায় তাদের           দেব ভুলিয়ে রেখে । তার পরে যেই জাগবে তুমি           লাগবে তাদের ঘুম , তখন কোথাও কিচ্ছুই নেই           সমস্ত নিজ্‌ঝুম ।   (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) ঘোষালের বক্তৃতা ঘোষালের বক্তৃতা করা কর্তব্যই, বেঞ্চি চৌকি আদি আছে সব দ্রব্যই। মাতৃভূমির লাগি পাড়া ঘুরে মরেছে, একশো টিকিট বিলি নিজ হাতে করেছে। চোখ বুজে ভাবে, বুঝি এল সব সভ্যই। চোখ চেয়ে দেখে, বাকি শুধু নিরেনব্বই।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) চড়িভাতি ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে; অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক। মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক। যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে। জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল ক'রে শেষে ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে। বারে বারে ঘটি ভ'রে জল তুলে কেউ আনে, কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে। হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে, তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে। গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে।                সকল-কর্ম-ভোলা দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্‌ আঘাটায়                যথেচ্ছ ভাঁটায়। মানুষ যখন পাকা ক'রে প্রাচীর তোলে নাই মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই, সেইদিনকার আল্‌গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ মাঝে মাঝে রক্তে আজও লাগায় মন্ত্রগান। সেইদিনকার যথেচ্ছ-রস আস্বাদনের খোঁজে মিলেছিলেম অবেলাতে অনিয়মের ভোজে। কারো কোনো স্বত্বদাবীর নেই যেখানে চিহ্ন, যেখানে এই ধরাতলের সহজ দাক্ষিণ্য, হালকা সাদা মেঘের নিচে পুরানো সেই ঘাসে, একটা দিনের পরিচিত আমবাগানের পাশে, মাঠের ধারে, অনভ্যাসের সেবার কাজে খেটে কেমন ক'রে কয়টা প্রহর কোথায় গেল কেটে।           সমস্ত দিন ডাকল ঘুঘু দুটি। আশে পাশে এঁটোর লোভে কাক এল সব জুটি, গাঁয়ের থেকে কুকুর এল, লড়াই গেল বেধে-- একটা তাদের পালালো তার পরাভবের খেদে।রৌদ্র পড়ে এল ক্রমে, ছায়া পড়ল বেঁকে, ক্লান্ত গোরু গাড়ি টেনে চলেছে হাট থেকে।           আবার ধীরে ধীরে নিয়ম-বাঁধা যে-যার ঘরে চলে গেলেম ফিরে। একটা দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি, পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধার রাতি। চতুর্থ সর্গ "এ তবে স্বপন শুধু, বিম্বের মতন আবার মিলায়ে গেল নিদ্রার সমুদ্রে! সারারাত নিদ্রার করিনু আরাধনা-- যদি বা আইল নিদ্রা এ শ্রান্ত নয়নে, মরীচিকা দেখাইয়া গেল গো মিলায়ে! হা স্বপ্ন, কি শক্তি তোর, এ হেন মূরতি মুহূর্ত্তের মধ্যে তুই ভাঙ্গিলি, গড়িলি? হা নিষ্ঠুর কাল, তোর এ কিরূপ খেলা-- সত্যের মতন গড়িলি প্রতিমা, স্বপ্নের মতন তাহা ফেলিলি ভাঙ্গিয়া? কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মতন উঠিল, আবার গেল মিলায়ে তাহাতে? না না, তাহা নয় কভু, নলিনী, সে কি গো কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত! যাহার মোহিনী মূর্ত্তি হৃদয়ে হৃদয়ে শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে, যত কাল রব বেঁচে যার ভালবাসা চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়, সে বালিকা, সে নলিনী, সে স্বর্গপ্রতিমা, কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল? না না, তাহা নয় কভু, তা যেন না হয়! দেহকারাগারমুক্ত সে নলিনী এবে সুখে দুখে চিরকাল সম্পদে বিপদে আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ। চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে। দেহকারাগারমুক্ত হইলে আমিও তাহার হৃদয়সাথে মিশাব হৃদয়। নলিনী, আছ কি তুমি, আছ কি হেথায়? একবার দেখা দেও, মিটাও সন্দেহ! চিরকাল তরে তোরে ভুলিতে কি হবে? তাই বল্ নলিনী লো, বল্ একবার! চিরকাল আর তোরে পাব না দেখিতে, চিরকাল আর তোর হৃদয়ে হৃদয় পাব না কি মিশাইতে, বল্ একবার। মরিলে কি পৃথিবীর সব যায় দূরে? তুই কি আমারে ভুলে গেছিস্ নলিনি? তা হোলে নলিনি, আমি চাই না মরিতে। তোর ভালবাসা যেন চিরকাল মোর হৃদয়ে অক্ষয় হোয়ে থাকে গো মুদ্রিত-- কষ্ট পাই পাব, তবু চাই না ভুলিতে! তুমি নাহি থাক যদি তোমার স্মৃতিও থাকে যেন এ হৃদয় করিয়া উজ্জ্বল! এই ভালবাসা যাহা হৃদয়ে মরমে অবশিষ্ট রাখে নাই এক তিল স্থান, একটি পার্থিব ক্ষুদ্র নিশ্বাসের সাথে মুহূর্ত্তে না পালটিতে আঁখির পলক ক্ষণস্থায়ী কুসুমের সুরভের মত শূন্য এই বায়ুস্রোতে যাইবে মিশায়ে? হিমাদ্রির এই স্তব্ধ আঁধার গহ্বরে সময়ের পদক্ষেপ গণিতেছি বসি, ভবিষ্যৎ ক্রমে হইতেছে বর্ত্তমান, বর্ত্তমান মিশিতেছে অতীতসমুদ্রে। অস্ত যাইতেছে নিশি, আসিছে দিবস, দিবস নিশার কোলে পড়িছে ঘুমায়ে। এই সময়ের চক্র ঘুরিয়া নীরবে পৃথিবীরে মানুষেরে অলক্ষিতভাবে পরিবর্ত্তনের পথে যেতেছে লইয়া, কিন্তু মনে হয় এই হিমাদ্রীর বুকে তাহার চরণ-চিহ্ন পড়িছে না যেন। কিন্তু মনে হয় যেন আমার হৃদয়ে দুর্দ্দাম সময়স্রোত অবিরামগতি, নূতন গড়ে নি কিছু, ভাঙ্গে নি পুরাণো। বাহিরের কত কি যে ভাঙ্গিল চূরিল, বাহিরের কত কি যে হইল নূতন, কিন্তু ভিতরের দিকে চেয়ে দেখ দেখি-- আগেও আছিল যাহা এখনো তা আছে, বোধ হয় চিরকাল থাকিবে তাহাই! বরষে বরষে দেহ যেতেছে ভাঙ্গিয়া, কিন্তু মন আছে তবু তেমনি অটল। নলিনী নাইকো বটে পৃথিবীতে আর, নলিনীরে ভালবাসি তবুও তেমনি। যখন নলিনী ছিল, তখন যেমন তার হৃদয়ের মূর্ত্তি ছিল এ হৃদয়ে, এখনো তেমনি তাহা রয়েছে স্থাপিত। এমন অন্তরে তারে রেখেছি লুকায়ে, মরমের মর্ম্মস্থলে করিতেছি পূজা, সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে ভাঙ্গিবারে এ জনমে সে মোর প্রতিমা, হৃদয়ের আদরের লুকানো সে ধন! ভেবেছিনু এক বার এই-যে বিষাদ নিদারুণ তীব্র স্রোতে বহিছে হৃদয়ে এ বুঝি হৃদয় মোর ভাঙ্গিবে চূরিবে-- পারে নি ভাঙ্গিতে কিন্তু এক তিল তাহা, যেমন আছিল মন তেমনি রয়েছে! বিষাদ যুঝিয়াছিল প্রাণপণে বটে, কিন্তু এ হৃদয়ে মোর কি যে আছে বল, এ দারুণ সমরে সে হইয়াচে জয়ী। গাও গো বিহগ তব প্রমোদের গান, তেমনি হৃদয়ে তার রবে প্রতিধ্বনি! প্রকৃতি! মাতার মত সুপ্রসন্ন দৃষ্টি যেমন দেখিয়াছিনু ছেলেবেলা আমি, এখনো তেমনি যেন পেতেছি দেখিতে। যা কিছু সুন্দর, দেবি, তাহাই মঙ্গল, তোমার সুন্দর রাজ্যে হে প্রকৃতিদেবি তিল অমঙ্গল কভু পারে না ঘটিতে। অমন সুন্দর আহা নলিনীর মন, জীবন সৌন্দর্য্য, দেবি তোমার এ রাজ্যে অনন্ত কালের তরে হবে না বিলীন। যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবে তা দেবি, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। তোমার আশ্বাসবাক্যে হে প্রকৃতিদেবি, সংশয় কখনো আমি করি না স্বপনে! বাজাও রাখাল তব সরল বাঁশরী! গাও গো মনের সাধে প্রমোদের গান! পাখীরা মেলিয়া যবে গাইতেছে গীত, কানন ঘেরিয়া যবে বহিতেছে বায়ু, উপত্যকাময় যবে ফুটিয়াছে ফুল, তখন তোদের আর কিসের ভাবনা? দেখি চিরহাস্যময় প্রকৃতির মুখ, দিবানিশি হাসিবারে শিখেছিস্ তোরা! সমস্ত প্রকৃতি যবে থাকে গো হাসিতে, সমস্ত জগৎ যবে গাহে গো সঙ্গীত, তখন ত তোরা নিজ বিজন কুটীরে ক্ষুদ্রতম আপনার মনের বিষাদে সমস্ত জগৎ ভুলি কাঁদিস না বসি! জগতের, প্রকৃতির ফুল্ল মুখ হেরি আপনার ক্ষুদ্র দুঃখ রহে কি গো আর? ধীরে ধীরে দূর হোতে আসিছে কেমন বসন্তের সুরভিত বাতাসের সাথে মিশিয়া মিশিয়া এই সরল রাগিণী। একেক রাগিণী আছে করিলে শ্রবণ মনে হয় আমারি তা প্রাণের রাগিণী-- সেই রাগিণীর মত আমার এ প্রাণ, আমার প্রাণের মত যেন সে রাগিণী! কখন বা মনে হয় পুরাতন কাল এই রাগিণীর মত আছিল মধুর, এমনি স্বপনময় এমনি অস্ফুট-- পাই শুনি ধীরি ধীরি পুরাতন স্মৃতি প্রাণের ভিতরে যেন উথলিয়া উঠে!" ক্রমে কবি যৌবনের ছাড়াইয়া সীমা, গম্ভীর বার্দ্ধক্যে আসি হোলো উপনীত! সুগম্ভীর বৃদ্ধ কবি, স্কন্ধে আসি তার পড়েছে ধবল জটা অযত্নে লুটায়ে! মনে হোতো দেখিলে সে গম্ভীর মুখশ্রী হিমাদ্রি হোতেও বুঝি সমুচ্চ মহান্! নেত্র তাঁর বিকীরিত কি স্বর্গীয় জ্যোতি, যেন তাঁর নয়নের শান্ত সে কিরণ সমস্ত পৃথিবীময় শান্তি বরষিবে। বিস্তীর্ণ হইয়া গেল কবির সে দৃষ্টি, দৃষ্টির সম্মুখে তার, দিগন্তও যেন খুলিয়া দিত গো নিজ অভেদ্য দুয়ার। যেন কোন দেববালা কবিরে লইয়া অনন্ত নক্ষত্রলোকে কোরেছে স্থাপিত-- সামান্য মানুষ যেথা করিলে গমন কহিত কাতর স্বরে ঢাকিয়া নয়ন, "এ কি রে অনন্ত কাণ্ড, পারি না সহিতে!" সন্ধ্যার আঁধারে হোথা বসিয়া বসিয়া, কি গান গাইছে কবি, শুন কলপনা। কি "সুন্দর সাজিয়াছে ওগো হিমালয় তোমার বিশালতম শিখরের শিরে একটি সন্ধ্যার তারা! সুনীল গগন ভেদিয়া, তুষারশুভ্র মস্তক তোমার! সরল পাদপরাজি আঁধার করিয়া উঠেছে তাহার পরে; সে ঘোর অরণ্য ঘেরিয়া হুহুহু করি তীব্র শীতবায়ু দিবানিশি ফেলিতেছে বিষণ্ণ নিশ্বাস! শিখরে শিখরে ক্রমে নিভিয়া আসিল অস্তমান তপনের আরক্ত কিরণে প্রদীপ্ত জলদচূর্ণ। শিখরে শিখরে মলিন হইয়া এল উজ্জ্বল তুষার, শিখরে শিখরে ক্রমে নামিয়া আসিল আঁধারের যবনিকা ধীরে ধীরে ধীরে! পর্ব্বতের বনে বনে গাঢ়তর হোলো ঘুমময় অন্ধকার। গভীর নীরব! সাড়াশব্দ নাই মুখে, অতি ধীরে ধীরে অতি ভয়ে ভয়ে যেন চলেছে তটিনী সুগম্ভীর পর্ব্বতের পদতল দিয়া! কি মহান্! কি প্রশান্ত! কি গম্ভীর ভাব! ধরার সকল হোতে উপরে উঠিয়া স্বর্গের সীমায় রাখি ধবল জটায় জড়িত মস্তক তব ওগো হিমালয় নীরব ভাষায় তুমি কি যেন একটি গম্ভীর আদেশ ধীরে করিছ প্রচার! সমস্ত পৃথিবী তাই নীরব হইয়া শুনিছে অনন্যমনে সভয়ে বিস্ময়ে। আমিও একাকী হেথা রয়েছি পড়িয়া, আঁধার মহা-সমুদ্রে গিয়াছি মিশায়ে, ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র নর আমি, শৈলরাজ! অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র তৃণটির মত হারাইয়া দিগ্বিদিক্, হারাইয়া পথ, সভয়ে বিস্ময়ে, হোয়ে হতজ্ঞানপ্রায় তোমার চরণতলে রয়েছি পড়িয়া। ঊর্দ্ধ্বমুখে চেয়ে দেখি ভেদিয়া আঁধার শূন্যে শূন্যে শত শত উজ্জ্বল তারকা, অনিমিষ নেত্রগুলি মেলিয়া যেন রে আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। ওগো হিমালয়, তুমি কি গম্ভীর ভাবে দাঁড়ায়ে রয়েছ হেথা অচল অটল, দেখিছ কালের লীলা, করিছ গননা, কালচক্র কত বার আইল ফিরিয়া! সিন্ধুর বেলার বক্ষে গড়ায় যেমন অযুত তরঙ্গ, কিছু লক্ষ্য না করিয়া কত কাল আইল রে, গেল কত কাল হিমাদ্রি তোমার ওই চক্ষের উপরি। মাথার উপর দিয়া কত দিবাকর উলটি কালের পৃষ্ঠা গিয়াছে চলিয়া। গম্ভীর আঁধারে ঢাকি তোমার ও দেহ কত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে পোহায়ে। কিন্তু বল দেখি ওগো হিমালয়গিরি মানুষসৃষ্টির অতি আরম্ভ হইতে কি দেখিছ এইখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে? যা দেখিছ যা দেখেছ তাতে কি এখনো সর্ব্বাঙ্গ তোমার গিরি উঠে নি শিহরি? কি দারুণ অশান্তি এই মনুষ্যজগতে-- রক্তপাত, অত্যাচার , পাপ কোলাহল দিতেছে মানবমনে বিষ মিশাইয়া! কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে অধীনতাশৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে, অবশেষে মন এত হোয়েছে নিস্তেজ, কলঙ্কশৃঙ্খল তার অলঙ্কাররূপে আলিঙ্গন ক'রে তারে রেখেছে গলায়! দাসত্বের পদধূলি অহঙ্কার কোরে মাথায় বহন করে পরপ্রত্যাশীরা! যে পদ মাথায় করে ঘৃণার আঘাত সেই পদ ভক্তিভরে করে গো চুম্বন! যে হস্ত ভ্রাতারে তার পরায় শৃঙ্খল, সেই হস্ত পরশিলে স্বর্গ পায় করে। স্বাধীন, সে অধীনেরে দলিবার তরে, অধীন, সে স্বাধীনেরে পূজিবারে শুধু! সবল, সে দুর্ব্বলেরে পীড়িতে কেবল-- দুর্ব্বল, বলের পদে আত্ম বিসর্জ্জিতে! স্বাধীনতা কারে বলে জানে সেই জন কোথায় সেই অসহায় অধীন জনের কঠিন শৃঙ্খলরাশি দিবে গো ভাঙ্গিয়া, না, তার স্বাধীন হস্ত হোয়েছে কেবল অধীনের লৌহপাশ দৃঢ় করিবারে। সবল দুর্ব্বলে কোথা সাহায্য করিবে-- দুর্ব্বলে অধিকতর করিতে দুর্ব্বল বল তার-- হিমগিরি, দেখিছ কি তাহা? সামান্য নিজের স্বার্থ করিতে সাধন কত দেশ করিতেছে শ্মশান অরণ্য, কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা রক্তময়পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া, তবুও মানুষ বলি গর্ব্ব করে তারা, তবু তারা সভ্য বলি করে অহঙ্কার! কত রক্তমাখা ছুরি হাসিছে হরষে, কত জিহ্বা হৃদয়েরে ছিঁড়িছে বিঁধিছে! বিষাদের অশ্রুপূর্ণ নয়ন হে গিরি অভিশাপ দেয় সদা পরের হরষে, উপেক্ষা ঘৃণায় মাখা কুঞ্চিত অধর পরঅশ্রুজলে ঢালে হাসিমাখা বিষ! পৃথিবী জানে না গিরি হেরিয়া পরের জ্বালা, হেরিয়া পরের মর্ম্মদুখের উচ্ছ্বাস, পরের নয়নজলে মিশাতে নয়নজল-- পরের দুখের শ্বাসে মিশাতে নিশ্বাস! প্রেম? প্রেম কোথা হেথা এ অশান্তিধামে? প্রণয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া যেথায় বিচরে ইন্দ্রিয়সেবা, প্রেম সেথা আছে? প্রেমে পাপ বলে যারা, প্রেম তারা চিনে? মানুষে মানুষে যেথা আকাশ পাতাল, হৃদয়ে হৃদয়ে যেথা আত্ম-অভিমান, যে ধরায় মন দিয়া ভাল বাসে যারা উপেক্ষা বিদ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদে তারাই অধিক সহে বিষাদ যন্ত্রণা, সেথা যদি প্রেম থাকে তবে কোথা নাই-- তবে প্রেম কলুষিত নরকেও আছে! কেহ বা রতনময় কনকভবনে ঘুমায়ে রয়েছে সুখে বিলাসের কোলে, অথচ সুমুখ দিয়া দীন নিরালয় পথে পথে করিতেছে ভিক্ষান্নসন্ধান! সহস্র পীড়িতদের অভিশাপ লোয়ে সহস্রের রক্তধারে ক্ষালিত আসনে সমস্ত পৃথিবী রাজা করিছে শাসন, বাঁধিয়া গলায় সেই শাসনের রজ্জু সমস্ত পৃথিবী তাহার রহিয়াছে দাস! সহস্র পীড়ন সহি আনত মাথায় একের দাসত্বে রত অযুত মানব! ভাবিয়া দেখিলে মন উঠে গো শিহরি-- ভ্রমান্ধ দাসের জাতি সমস্ত মানুষ। এ অশান্তি কবে দেব হবে দূরীভূত! অত্যাচার-গুরুভারে হোয়ে নিপীড়িত সমস্ত পৃথিবী, দেব, করিছে ক্রন্দন! সুখ শান্তি সেথা হোতে লয়েছে বিদায়! কবে, দেব, এ রজনী হবে অবসান? স্নান করি প্রভাতের শিশিরসলিলে তরুণ রবির করে হাসিবে পৃথিবী! অযুত মানবগণ এক কণ্ঠে, দেব, এক গান গাইবেক স্বর্গ পূর্ণ করি! নাইক দরিদ্র ধনী অধিপতি প্রজা-- কেহ কারো কুটীরেতে করিলে গমন মর্য্যাদার অপমান করিবে না মনে, সকলেই সকলের করিতেছে সেবা, কেহ কারো প্রভু নয়, নহে কারো দাস! নাই ভিন্ন জাতি আর নাই ভিন্ন ভাষা নাই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন আচার ব্যাভার! সকলেই আপনার আপনার লোয়ে পরিশ্রম করিতেছে প্রফুল্ল-অন্তরে। কেহ কারো সুখে নাহি দেয় গো কণ্টক, কেহ কারো দুখে নাহি করে উপহাস! দ্বেষ নিন্দা ক্রূরতার জঘন্য আসন ধর্ম্ম-আবরণে নাহি করে গো সজ্জিত! হিমাদ্রি, মানুষসৃষ্টি-আরম্ভ হইতে অতীতের ইতিহাস পড়েছ সকলি, অতীতের দীপশিখা যদি হিমালয় ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পারে গো ভেদিতে তবে বল কবে, গিরি, হবে সেই দিন যে দিন স্বর্গই হবে পৃথ্বীর আদর্শ! সে দিন আসিবে গিরি, এখনিই যেন দূর ভবিষ্যৎ সেই পেতেছি দেখিতে যেই দিন এক প্রেমে হইয়া নিবদ্ধ মিলিবেক কোটি কোটি মানবহৃদয়। প্রকৃতির সব কার্য্য অতি ধীরে ধীরে, এক এক শতাব্দীর সোপানে সোপানে-- পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে, পৃথিবীর সে অবস্থা আসে নি এখনো কিন্তু এক দিন তাহা আসিবে নিশ্চয়। আবার বলি গো আমি হে প্রকৃতিদেবি যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবেক তাহা, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। এ যে সুখময় আশা দিয়াছ হৃদয়ে ইহার সঙ্গীত, দেবি, শুনিতে শুনিতে পারিব হরষচিতে ত্যজিতে জীবন!" সমস্ত ধরার তরে নয়নের জল বৃদ্ধ সে কবির নেত্র করিল পূর্ণিত! যথা সে হিমাদ্রি হোতে ঝরিয়া ঝরিয়া কত নদী শত দেশ করয়ে উর্ব্বরা। উচ্ছ্বসিত করি দিয়া কবির হৃদয় অসীম করুণা সিন্ধু পোড়েছে ছড়ায়ে সমস্ত পৃথিবীময়। মিলি তাঁর সাথে জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী কাঁদিলেন আর্দ্র হোয়ে পৃথিবীর দুখে, ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন! কবির প্রাচীননেত্রে পৃথিবীর শোভা এখনও কিছু মাত্র হয় নি পুরাণো? এখনো সে হিমাদ্রির শিখরে শিখরে একেলা আপন মনে করিত ভ্রমণ। বিশাল ধবল জটা, বিশাল ধবল শ্মশ্রু, নেত্রের স্বর্গীয় জ্যোতি, গম্ভীর মূরতি, প্রশস্ত ললাটদেশ, প্রশান্ত আকৃতি তার মনে হোত হিমাদ্রির অধিষ্ঠাতৃদেব! জীবনের দিন ক্রমে ফুরায় কবির! সঙ্গীত যেমন ধীরে আইসে মিলায়ে, কবিতা যেমন ধীরে আইসে ফুরায়ে, প্রভাতের শুকতারা ধীরে ধীরে যথা ক্রমশঃ মিশায়ে আসে রবির কিরণে, তেমনি ফুরায়ে এল কবির জীবন। প্রতিরাত্রে গিরিশিরে জোছনায় বসি আনন্দে গাইত কবি সুখের সঙ্গীত। দেখিতে পেয়েছে যেন স্বর্গের কিরণ, শুনিতে পেয়েছে যেন দূর স্বর্গ হোতে, নলিনীর সুমধুর আহ্বানের গান। প্রবাসী যেমন আহা দূর হোতে যদি সহসা শুনিতে পায় স্বদেশ-সঙ্গীত, ধায় হরষিত চিতে সেই দিক্ পানে, একদিন দুইদিন যেতেছে যেমন চলেছে হরষে কবি সেই দেশ হোতে স্বদেশসঙ্গীতধ্বনি পেতেছে শুনিতে। এক দিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া! হিমাদ্রি হইল তার সমাধিমন্দির, একটি মানুষ সেথা ফেলে নি নিশ্বাস! প্রত্যহ প্রভাত শুধু শিশিরাশ্রুজলে হরিত পল্লব তার করিত প্লাবিত! শুধু সে বনের মাঝে বনের বাতাস, হুহু করি মাঝে মাঝে ফেলিত নিশ্বাস! সমাধি উপরে তার তরুলতাকুল প্রতিদিন বরষিত কত শত ফুল! কাছে বসি বিহগেরা গাইত গো গান, তটিনী তাহার সাথে মিশাইত তান। চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া দূরেতে রাখিয়া এলেম তারে, রূপ-ফাঁদ হতে পালাইতে তার, প্রণয়ে ডুবাতে মদিরা-ধারে। এত দূরে এসে বুঝিনু এখন এখনো ঘুচে নি প্রণয়-ঘোর, মাথায় যদিও চড়েছে মদিরা প্রণয় রয়েছে হৃদয়ে মোর। যুবতীর শেষে লইনু শরণ মাগিনু সহায় তার, অনেক ভাবি সে কহিল তখন “চপলা নারীর সার।’ আমি কহিলাম “সে কথা তোমার কহিতে হবে না মোরে– দোষ যদি কিছু বলিবারে পারো শুনি প্রণিধান করে।’ যুবতী কহিল “তাও কভু হয়? যদি বলি দোষ আছে– নামের আমার কুযশ হইবে কহিনু তোমার কাছে।’ এখন তো আর নাই কোনো আশা হইয়াছি অসহায়– চপলা আমার মরমে মরমে বাণ বিঁধিতেছে, হায়! দলে মিশি তার ইন্দ্রিয় আমার বিরোধী হয়েছে মোর, যুবতী আমার–বলিছে আমারে রূপের অধীন ঘোর!Lord Cantalupe (অনুবাদ কবিতা) চরণ দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায়, দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ । শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায়, শতলক্ষ কুসুমের পরশস্বপন । শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায় । প্রভাতের প্রদোষের দুটি সূর্যলোক অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় । যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে, নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে - নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় । হোথা যে নিঠুর মাটি, শুষ্ক ধরাতল - এসো গো হৃদয়ে এসো, ঝুরিছে হেথায় লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।। চলার পথের যত বাধা চলার পথের যত বাধা পথবিপথের যত ধাঁধা পদে পদে ফিরে ফিরে মারে, পথের বীণার তারে তারে তারি টানে সুর হয় বাঁধা। রচে যদি দুঃখের ছন্দ দুঃখের-অতীত আনন্দ তবেই রাগিণী হবে সাধা।   (স্ফুলিঙ্গ) চলিতে চলিতে চরণে উছলে চলিতে চলিতে চরণে উছলে চলিবার ব্যাকুলতা— নূপুরে নূপুরে বাজে বনতলে মনের অধীর কথা।   (স্ফুলিঙ্গ) চলে যাবে সত্তারূপ চলে যাবে সত্তারূপ সৃজিত যা প্রাণেতে কায়াতে, রেখে যাবে মায়ারূপ রচিত যা আলোতে ছায়াতে।   (স্ফুলিঙ্গ) চাই গো আমি তোমারে চাই চাই গো আমি তোমারে চাই তোমায় আমি চাই– এই কথাটি সদাই মনে বলতে যেন পাই। আর যা-কিছু বাসনাতে ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো তোমায় আমি চাই।রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলোর প্রার্থনাই– তেমনি গভীর মোহের মাঝে তোমায় আমি চাই। শান্তিরে ঝড় যখন হানে শান্তি তবু চায় সে প্রাণে, তেমনি তোমায় আঘাত করি তবু তোমায় চাই।৩ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) চাও যদি সত্যরূপে চাও যদি সত্যরূপে দেখিবারে মন্দ– ভালোর আলোতে দেখো, হোয়ো নাকো অন্ধ।   (স্ফুলিঙ্গ) চাতুরী আমার খোকা করে গো যদি মনে      এখনি উড়ে পারে সে যেতে           পারিজাতের বনে ।           যায় না সে কি সাধে।      মায়ের বুকে মাথাটি থুয়ে      সে ভালোবাসে থাকিতে শুয়ে,      মায়ের মুখ না দেখে যদি           পরান তার কাঁদে।    আমার খোকা সকল কথা জানে।      কিন্তু তার এমন ভাষা,           কে বোঝে তার মানে।           মৌন থাকে সাধে ?      মায়ের মুখে মায়ের কথা      শিখিতে তার কী আকুলতা,      তাকায় তাই বোবার মতো           মায়ের মুখচাঁদে।    খোকার ছিল রতনমণি কত—      তবু সে এল কোলের ‘পরে         ভিখারীটির মতো।           এমন দশা সাধে ?      দীনের মতো করিয়া ভান      কাড়িতে চাহে মায়ের প্রাণ,      তাই সে এল বসনহীন            সন্ন্যাসীর ছাঁদে।    খোকা যে ছিল বাঁধন-বাধা-হারা—      যেখানে জাগে নূতন চাঁদ        ঘুমায় শুকতারা।        ধরা সে দিল সাধে?     অমিয়মাখা কোমল বুকে     হারাতে চাহে অসীম সুখে,     মুকতি চেয়ে বাঁধন মিঠা        মায়ের মায়া-ফাঁদে।    আমার খোকা কাঁদিতে জানিত না,      হাসির দেশে করিত শুধু           সুখের আলোচনা ।           কাঁদিতে চাহে সাধে?      মধুমুখের হাসিটি দিয়া      টানে সে বটে মায়ের হিয়া,      কান্না দিয়ে ব্যথার ফাঁসে           দ্বিগুণ বলে বাঁধে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) চালক অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে? সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) চাষের সময়ে চাষের সময়ে যদিও করি নি হেলা। ভুলিয়া ছিলাম ফসল কাটার বেলা।   (স্ফুলিঙ্গ) চাহিছ বারে বারে চাহিছ বারে বারে আপনারে ঢাকিতে— মন না মানে মানা, মেলে ডানা আঁখিতে।   (স্ফুলিঙ্গ) চিঠি শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু                                স্টীমার ‘ রাজহংস ' । গঙ্গা    চিঠি লিখব কথা ছিল ,           দেখছি সেটা ভারি শক্ত । তেমন যদি খবর থাকে           লিখতে পারি তক্ত তক্ত । খবর বয়ে বেড়ায় ঘুরে           খবরওয়ালা ঝাঁকা-মুটে । আমি বাপু ভাবের ভক্ত           বেড়াই নাকো খবর খুঁটে । এত ধুলো , এত খবর           কলকাতাটার গলিতে! নাকে চোকে খবর ঢোকে           দু-চার কদম চলিতে । এত খবর সয় না আমার           মরি আমি হাঁপোষে । ঘরে এসেই খবরগুলো           মুছে ফেলি পাপোষে । আমাকে তো জানই বাছা!            আমি একজন খেয়ালি । কথাগুলো যা বলি , তার           অধিকাংশই হেঁয়ালি । আমার যত খবর আসে           ভোরের বেলা পুব দিয়ে । পেটের কথা তুলি আমি           পেটের মধ্যে ডুব দিয়ে । আকাশ ঘিরে জাল ফেলে           তারা ধরাই ব্যাবসা । থাক্ গে তোমার পাটের হাটে           মথুর কুণ্ডু শিবু সা । কল্পতরুর তলায় থাকি           নই গো আমি খবুরে । হাঁ করিয়ে চেয়ে আছি           মেওয়া ফলে সবুরে । তবে যদি নেহাত কর           খবর নিয়ে টানাটানি । আমি বাপু একটি কেবল           দুষ্টু মেয়ের খবর জানি! দুষ্টুমি তার শোনো যদি           অবাক হবে সত্যি! এত বড়ো বড়ো কথা তার           মুখখানি একরত্তি । মনে মনে জানেন তিনি           ভারি মস্ত লোকটা । লোকের সঙ্গে না-হক কেবল           ঝগড়া করবার ঝোঁকটা । আমার সঙ্গেই যত বিবাদ           কথায় কথায় আড়ি । এর নাম কি ভদ্র ব্যাভার!           বড্ড বাড়াবাড়ি । মনে করেছি তার সঙ্গে           কথাবার্তা বন্দ করি । প্রতিজ্ঞা থাকে না পাছে           সেইটে ভারি সন্দ করি । সে না হলে সকাল বেলায়           চামেলি কি ফুটবে! সে নইলে কি সন্ধে বেলায়           সন্ধেতারা উঠবে । সে না হলে দিনটা ফাঁকি           আগাগোড়াই মস্কারা । পোড়ারমুখী জানে সেটা           তাই এত তার আস্কারা । চুড়ি-পরা হাত দুখানি           কতই জানে ফন্দি । কোনোমতে তার সাথে তাই           করে আছি সন্ধি ।    নাম যদি তার জিগেস কর           নামটি বলা হবে না । কী জানি সে শোনে যদি           প্রাণটি আমার রবে না । নামের খবর কে রাখে তার           ডাকি তারে যা খুশি । দুষ্টু বলো , দস্যি বলো ,           পোড়ারমুখী , রাক্ষুসী! বাপ মায়ে যে নাম দিয়েছে           বাপ মায়েরি থাক্ সে । ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি           তুলে রাখুন বাক্সে! এক জনেতে নাম রাখবে           অন্নপ্রাশনে । বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে            বিষম শাসন এ! নিজের মনের মত সবাই           করুক নামকরণ । বাবা ডাকুন ‘ চন্দ্রকুমার '           খুড়ো ‘ রামচরণ ' ! ধার-করা নাম নেব আমি           হবে না তো সিটি । জানই আমার সকল কাজে           Originality । ঘরের মেয়ে তার কি সাজে           সঙস্কৃত নাম । এতে কেবল বেড়ে ওঠে           অভিধানের দাম । আমি বাপু ডেকে বসি           যেটা মুখে আসে , যারে ডাকি সেই তা বোঝে           আর সকলে হাসে! দুষ্টু মেয়ের দুষ্টুমি — তায়           কোথায় দেব দাঁড়ি! অকূল পাথার দেখে শেষে           কলমের হাল ছাড়ি! শোনো বাছা , সত্যি কথা           বলি তোমার কাছে —     ত্রিজগতে তেমন মেয়ে           একটি কেবল আছে! বর্ণিমেটা কারো সঙ্গে           মিলে পাছে যায় — তুমুল ব্যাপার উঠবে বেধে           হবে বিষম দায়! হপ্তাখানেক বকাবকি           ঝগড়াঝাঁটির পালা , একটু চিঠি লিখে , শেষে           প্রাণটা ঝালাফালা । আমি বাপু ভালোমানুষ           মুখে নেইকো রা । ঘরের কোণে বসে বসে           গোঁফে দিচ্ছি তা । আমি যত গোলে পড়ি           শুনি নানান বাক্যি । খোঁড়ার পা যে খানায় পড়ে           আমিই তাহার সাক্ষী । আমি কারো নাম করি নি           তবু ভয়ে মরি । তুই পাছে নিস গায়ে পেতে           সেইটো বড়ো ডরি! কথা একটা উঠলে মনে           ভারি তোরা জ্বালাস । আমি বাপু আগে থাকতে           বলে হলুম খালাস!    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) চিত্ত আমার হারাল আজ চিত্ত আমার হারাল আজ মেঘের মাঝখানে, কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে। বিজুলি তা’র বীণার তারে আঘাত করে বারে বারে, বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে।পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে জড়াল রে অঙ্গ আমার, ছড়াল প্রাণে। পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি হল আমার সাথের সাথি, অট্টহাসে ধায় কোথা সে– বারণ না মানে।তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) চিত্ত তোমায় নিত্য হবে আমার    চিত্ত তোমায় নিত্য হবে             সত্য হবে - ওগো     সত্য, আমার এখন সুদিন।             ঘটবে কবে।         সত্য সত্য সত্য জপি,         সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,         সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব             নিখিল ভবে -         সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ             দেখব কবে।        তোমায় দূরে সরিয়ে মরি             আপন অসত্যে।         কী যে কান্ড করি গো সেই             ভূতের রাজত্বে।         আমার আমি ধুয়ে মুছে         তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,         সত্য, তোমায় সত্য হব             বাঁচব তবে -         তোমার মধ্যে মরণ আমার             মরবে কবে।১৫ শ্রাবণ ১৩১৭ কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ১৩৭ চিত্রা জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে    তুমি বিচিত্ররূপিণী। অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে, আকুল পুলকে উলসিছ ফুলকাননে, দ্যুলোকে ভূলোকে বিলসিছ চলচরণে,    তুমি চঞ্চলগামিনী। মুখর নূপুর বাজিছে সুদূর আকাশে, অলকগন্ধ উড়িছে মন্দ বাতাসে, মধুর নৃত্যে নিখিল চিত্তে বিকাশে    কত মঞ্জুল রাগিণী। কত না বর্ণে কত না স্বর্ণে গঠিত কত যে ছন্দে কত সংগীতে রটিত কত না গ্রন্থে কত না কণ্ঠে পঠিত    তব অসংখ্য কাহিনী। জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে    তুমি বিচিত্ররূপিণী।অন্তরমাঝে শুধু তুমি একা একাকী    তুমি অন্তরব্যাপিনী। একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে, একটি পদ্ম হৃদয়বৃন্তশয়নে, একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে--    চারি দিকে চিরযামিনী। অকূল শান্তি সেথায় বিপুল বিরতি, একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি, নাহি কাল দেশ, তুমি অনিমেষ মুরতি--    তুমি অচপলদামিনী। ধীর গম্ভীর গভীর মৌনমহিমা, স্বচ্ছ অতল স্নিগ্ধ নয়ননীলিমা স্থির হাসিখানি উষালোকসম অসীমা,    অয়ি প্রশান্তহাসিনী। অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী    তুমি অন্তরবাসিনী। চিন্তাহরণ দালালের বাড়ি চিন্তাহরণ দালালের বাড়ি গিয়ে একশো টাকার একখানি নোট দিয়ে তিনখানা নোট আনে সে দশ টাকার। কাগজ্‌-গন্‌তি মুনফা যতই বাড়ে টাকার গন্‌তি লক্ষ্মী ততই ছাড়ে, কিছুতে বুঝিতে পারে না দোষটা কার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) চির-আমি যখন     পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে, চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা,     মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে - আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন     জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়, কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, ফুলের বাগান ঘন ঘাসের     পরবে সজ্জা বনবাসের, শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় - আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন     এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে, কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে। ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী     এমনি সেদিন উঠবে ভরি, চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে। আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।তখন     কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি? সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি। নতুন নামে ডাকবে মোরে,     বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে, আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি। আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) চিরকাল একি লীলা গো চিরকাল একি লীলা গো– অনন্ত কলরোল। অশ্রুত কোন্‌ গানের ছন্দে অদ্ভুত এই দোল। দুলিছ গো, দোলা দিতেছ। পলকে আলোকে তুলিছ, পলকে আঁধারে টানিয়া নিতেছ। সমুখে যখন আসি তখন পুলকে হাসি, পশ্চাতে যবে ফিরে যায় দোলা ভয়ে আঁখিজলে ভাসি। সমুখে যেমন পিছেও তেমন, মিছে করি মোরা গোল। চিরকাল একই লীলা গো– অনন্ত কলরোল।ডান হাত হতে বাম হাতে লও, বাম হাত হতে ডানে। নিজধন তুমি নিজেই হরিয়া কী যে কর কে বা জানে। কোথা বসে আছ একেলা– সব রবিশশী কুড়ায়ে লইয়া তালে তালে কর এ খেলা। খুলে দাও ক্ষণতরে, ঢাকা দাও ক্ষণপরে– মোরা কেঁদে ভাবি, আমারি কী ধন কে লইল বুঝি হ’রে! দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান সে কথাটি কে বা জানে। ডান হাত হতে বাম হাতে লও, বাম হাত হতে ডানে।এইমতো চলে চির কাল গো শুধু যাওয়া, শুধু আসা। চির দিনরাত আপনার সাথ আপনি খেলিছ পাশা। আছে তো যেমন যা ছিল– হারায় নি কিছু, ফুরায় নি কিছু যে মরিল যে বা বাঁচিল। বহি সব সুখদুখ এ ভুবন হাসিমুখ, তোমারি খেলার আনন্দে তার ভরিয়া উঠেছে বুক। আছে সেই আলো, আছে সেই গান, আছে সেই ভালোবাসা। এইমতো চলে চির কাল গো শুধু যাওয়া, শুধু আসা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) চিরজনমের বেদনা চিরজনমের বেদনা, ওহে চিরজীবনের সাধনা।                     তোমার আগুন উঠুক হে জ্বলে,                     কৃপা করিয়ো না দুর্বল ব’লে,                     যত তাপ পাই সহিবারে চাই,                            পুড়ে হোক ছাই বাসনা। অমোঘ যে ডাক সেই ডাক দাও               আর দেরি কেন মিছে। যা আছে বাঁধন বক্ষ জড়ায়ে               ছিঁড়ে প’ড়ে যাক পিছে। গরজি গরজি শঙ্খ তোমার বাজিয়া বাজিয়া উঠুক এবার, গর্ব টুটিয়া নিদ্রা ছুটিয়া               জাগুক তীব্র চেতনা।  কলিকাতা, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) চিরদিন কোথা রাত্রি , কোথা দিন , কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা , কে বা আসে কে বা যায় , কোথা বসে জীবনের মেলা , কে বা হাসে কে বা গায় , কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা , কোথা পথ , কোথা গৃহ , কোথা পান্থ , কোথা পথহারা ! কোথা খ ‘ সে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে , উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা , বহে যায় কালবায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে , ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে ! এত ভাঙা এত গড়া , আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে , এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব — কোথা কে বা , কোথা সিন্ধু , কোথা ঊর্মি , কোথা তার বেলা — গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব ! জনপূর্ণ সুবিজনে , জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন আকাশমণ্ডপে শুধু বসে আছে এক ‘চিরদিন’ ।২ কী লাগিয়া বসে আছ , চাহিয়া রয়েছ কার লাগি , প্রলয়ের পরপারে নেহারিছ কার আগমন , কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ , চিরবিরহীর মতো চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি ! অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস , আকাশপ্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস , জগতের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি ! অনন্ত আঁধার – মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর , পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ , পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর । সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস , সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর — হাসি , কাঁদি , ভালোবাসি , নাই তব হাসি কান্না মায়া — আসি , থাকি , চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া !৩ তাই কি ? সকলি ছায়া ? আসে , থাকে , আর মিলে যায় ? তুমি শুধু একা আছ , আর সব আছে আর নাই ? যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে , ফুল ঝরে তাই ? প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই , সে কি শুধু মরণের পায় ? এ ফুল চাহে না কেহ ? লহে না এ পূজা – উপহার ? এ প্রাণ , প্রাণের আশা , টুটে কি অসীম শূন্যতায় । বিশ্বের উঠিছে গান , বধিরতা বহি সিংহাসনে ? বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ , শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার ? যুগযুগান্তের প্রেম কে লইবে , নাই ত্রিভুবনে ? চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে — বাঁশি শুনি চলিয়াছে , সে কি হায় বৃথা অভিসার ! বলো না সকলি স্বপ্ন , সকলি এ মায়ার ছলন — বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে , সে স্বপন কাহার স্বপন ? সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার ?৪ ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি , প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ । জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান । অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ — যত দেয় তত পায় , কিছুতে না হয় অবসান । যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন — যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ । যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন , অসীমে জগতে একি পিরিতির আদান – প্রদান ! কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন – উপহারে , নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন । প্রেমে টেনে আনে প্রেম , সে প্রেমের পাথার কোথা রে ! প্রাণ দিলে প্রাণ আসে , কোথা সেই অনন্ত জীবন ! ক্ষুদ্র আপনারে দিলে , কোথা পাই অসীম আপন — সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে !  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে; বাজে লেখা, বাজে পড়া, দিন কাটে মিথ্যা বাজে ছলে। যে গুণী কাটাতে পারে বেলা তার বিনা আবশ্যকে তারে “এসো এসো” ব’লে যত্ন ক’রে বসাই বৈঠকে। কেজো লোকদের করি ভয়, কব্‌জিতে ঘড়ি বেঁধে শক্ত করে বেঁধেছে সময়– বাজে খরচের তরে উদ্‌বৃত্ত কিছুই নেই হাতে, আমাদের মতো কুঁড়ে লজ্জা পায় তাদের সাক্ষাতে। সময় করিতে নষ্ট আমরা ওস্তাদ, কাজের করিতে ক্ষতি নানামতো পেতে রাখি ফাঁদ। আমার শরীরটা যে ব্যস্তদের তফাতে ভাগায়– আপনার শক্তি নেই, পরদেহে মাশুল লাগায়। সরোজদাদার দিকে চাই– সব তাতে রাজি দেখি, কাজকর্ম যেন কিছু নাই, সময়ের ভাণ্ডারেতে দেওয়া নেই চাবি, আমার মতন এই অক্ষমের দাবি মেটাবার আছে তার অক্ষুণ্ন উদার অবসর, দিতে পারে অকৃপণ অক্লান্ত নির্ভর। দ্বিপ্রহর রাত্রিবেলা স্তিমিত আলোকে সহসা তাহার মূর্তি পড়ে যবে চোখে মনে ভাবি, আশ্বাসের তরী বেয়ে দূত কে পাঠালে, দুর্যোগের দুঃস্বপ্ন কাটালে। দায়হীন মানুষের অভাবিত এই আবির্ভাব দয়াহীন অদৃষ্টের বন্দীশালে মহামূল্য লাভ।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) চিরনবীনতা দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়— আমি মৃত্যু তোর মাতা, নাহি মোরে ভয়। নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন আমি তোরে ক’রে দিই প্রত্যহ নবীন।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) চিরায়মানা যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।       বেণী নাহয় এলিয়ে রবে,        সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,              নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।            কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।           যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।              এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।    ভয় কোরো না - অলক্তরাগ        মোছে যদি মুছিয়া যাক,                নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।            খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।               এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।          হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।         ও পার হতে দলে দলে        বকের শ্রেণী উড়ে চলে,              থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।              ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।          হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।            প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো? কে দেখতে পায় চোখের কাছে        কাজল আছে কি না আছে,              তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।            আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।            কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।          এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।      গাঁথা যদি না হয় মালা        ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,              ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।              মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।            এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।। চুম্বন অধরের কানে যেন অধরের ভাষা, দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে- গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধরসংগমে। দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে। ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে- দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা। প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে- অধরেতে থরে থরে চুম্বনের খেলা। দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ম- মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে ! দুটি অধরের এই মধুর মিলন দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন। চুরি-নিবারণ সুয়োরাণী কহে, রাজা দুয়োরাণীটার কত মতলব আছে বুঝে ওঠা ভার। গোয়াল্‌-ঘরের কোণে দিলে ওরে বাসা, তবু দেখো অভাগীর মেটে নাই আশা। তোমারে ভুলায়ে শুধু মুখের কথায় কালো গরুটিরে তব দুয়ে নিতে চায়। রাজা বলে, ঠিক ঠিক, বিষম চাতুরী— এখন কী ক’রে ওর ঠেকাইব চুরি! সুয়ো বল, একমাত্র রয়েছে ওষুধ, গোরুটা আমারে দাও, আমি খাই দুধ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) চেয়ে থাকা মনেতে সাধ যে দিকে চাই       কেবলি চেয়ে রব। দেখিব শুধু, দেখিব শুধু,        কথাটি নাহি কব। পরানে শুধু জাগিবে প্রেম,        নয়নে লাগে ঘোর, জগতে যেন ডুবিয়া রব        হইয়া রব ভোর। তটিনী যায়, বহিয়া যায়,        কে জানে কোথা যায়; তীরেতে বসে রহিব চেয়ে,        সারাটি দিন যায়। সুদূর জলে ডুবিছে রবি        সোনার লেখা লিখি, সাঁঝের আলো জলেতে শুয়ে         করিছে ঝিকিমিকি। সুধীর স্রোতে তরণীগুলি         যেতেছে সারি সারি, বহিয়া যায়, ভাসিয়া যায়         কত-না নরনারী। না জানি তারা কোথায় থাকে        যেতেছে কোন্‌ দেশে, সুদূর তীরে কোথায় গিয়ে         থামিবে অবশেষে। কত কী আশা গড়িছে বসে         তাদের মনখানি, কত কী সুখ কত কী দুখ         কিছুই নাহি জানি।দেখিব পাখি আকাশে ওড়ে,         সুদূরে উড়ে যায়, মিশায়ে যায় কিরণমাঝে,         আঁধাররেখাপ্রায়! তাহারি সাথে সারাটি দিন         উড়িবে মোর প্রাণ, নীরবে বসে তাহারি সাথে         গাহিব তারি গান। তাহারি মতো মেঘের মাঝে         বাঁধিতে চাহি বাসা, তাহারি মতো চাঁদের কোলে         গড়িতে চাহি আশা! তাহারি মতো আকাশে উঠে,         ধরার পানে চেয়ে ধরায় যারে এসেছি ফেলে         ডাকিব গান গেয়ে। তাহারি মতো, তাহারি সাথে         উষার দ্বারে গিয়ে, ঘুমের ঘোর ভাঙায়ে দিব         উষারে জাগাইয়ে।পথের ধারে বসিয়া রব         বিজন তরুছায়, সমুখ দিয়ে পথিক যত         কত-না আসে যায় ধুলায় বসে আপন-মনে         ছেলেরা খেলা করে, মুখেতে হাসি সখারা মিলে         যেতেছে ফিরে ঘরে।পথের ধারে ঘরের দ্বারে         বালিকা এক মেয়ে, ছোটো ভায়েরে পাড়ায় ঘুম         কত কী গান গেয়ে। তাহার পানে চাহিয়া থাকি         দিবস যায় চলে, স্নেহেতে ভরা করুণ আঁখি—         হৃদয় যায় গলে। এতটুকু সে পরানটিতে         এতটা সুধারাশি । কাছেতে তাই দাঁড়ায়ে তারে         দেখিতে ভালোবাসি।কোথা বা শিশু কাঁদিছে পথে         মায়েরে ডাকি ডাকি, আকুল হয়ে পথিকমুখে         চাহিছে থাকি থাকি। কাতর স্বর শুনিতে পেয়ে         জননী ছুটে আসে, মায়ের বুক জড়ায়ে শিশু         কাঁদিতে গিয়ে হাসে। অবাক হয়ে তাহাই দেখি         নিমেষ ভুলে গিয়ে, দুইটি ফোঁটা বাহিরে জল         দুইটি আঁখি দিয়ে।যায় রে সাধ জগৎ-পানে         কেবলি চেয়ে রই অবাক হয়ে, আপনা ভুলে,         কথাটি নাহি কই। চৈত্রের সেতারে বাজে চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্তবাহার, বাতাসে বাতাসে উঠে তরঙ্গ তাহার।   (স্ফুলিঙ্গ) ছবি-আঁকিয়ে ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে,     চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে।             পথ-চলা সেই দেখাগুলো লাইন দিয়ে এঁকে                    পাঠিয়ে দিলে দেশ-বিদেশের থেকে। যাহা-তাহা যেমন-তেমন আছে কতই কী যে,     তোমার চোখে ভেদ ঘটে নাই চণ্ডালে আর দ্বিজে।               ঐ যে গরিবপাড়া,   আর কিছু নেই ঘেঁষাঘেঁষি কয়টা কুটীর ছাড়া।               তার ওপারে শুধু        চৈত্রমাসের মাঠ করছে ধু ধু।   এদের পানে চক্ষু মেলে কেউ কভু কি দাঁড়ায়,   ইচ্ছে ক'রে এ ঘরগুলোর ছায়া কি কেউ মাড়ায়।   তুমি বললে, দেখার ওরা অযোগ্য নয় মোটে;   সেই কথাটিই তুলির রেখায় তক্ষনি যায় রটে।   হঠাৎ তখন ঝেঁকে উঠে আমরা বলি, তাই তো,   দেখার মতোই জিনিস বটে, সন্দেহ তার নাই তো।    ঐযে কারা পথে চলে, কেউ করে বিশ্রাম,     নেই বললেই হয় ওরা সব, পোঁছে না কেউ নাম--     তোমার কলম বললে, ওরা খুব আছে এই জেনো;     অমনি বলি, তাই বটে তো, সবাই চেনো-চেনো।     ওরাই আছে, নেইকো কেবল বাদশা কিংবা নবাব;     এই ধরণীর মাটির কোলে থাকাই ওদের স্বভাব।     অনেক খরচ ক'রে রাজা আপন ছবি আঁকায়,     তার পানে কি রসিক লোকে কেউ কখনো তাকায়।     সে-সব ছবি সাজে-সজ্জায় বোকার লাগায় ধাধাঁ,     আর এরা সব সত্যি মানুষ সহজ রূপেই বাঁধা।    ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে,     এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে।     জন্তুটা তো পায় না খাতির হঠাৎ চোখে ঠেকলে,     সবাই ওঠে হাঁ হাঁ ক'রে সবজি-খেতে দেখলে।     আজ তুমি তার ছাগলামিটা ফোটালে যেই দেহে     এক মুহূর্তে চমক লেগে বলে উঠলেম, কে হে।     ওরে ছাগলওয়ালা, এটা তোরা ভাবিস কার--     আমি জানি, একজনের এই প্রথম আবিষ্কার। ছয় অতিথিবৎসল,        ডেকে নাও পথের পথিককে          তোমার আপন ঘরে,            দাও ওর ভয় ভাঙিয়ে।        ও থাকে প্রদোষের বস্‌তিতে,        নিজের কালো ছায়া ওর সঙ্গে চলে          কখনো সমুখে কখনো পিছনে,        তাকেই সত্য ভেবে ওর যত দুঃখ যত ভয়।        দ্বারে দাঁড়িয়ে তোমার আলো তুলে ধরো,          ছায়া যাক মিলিয়ে,              থেমে যাক ওর বুকের কাঁপন।  বছরে বছরে ও গেছে চলে         তোমার আঙিনার সামনে দিয়ে,           সাহস পায় নি ভিতরে যেতে,           ভয় হয়েছে পাছে ওর বাইরের ধন                      হারায় সেখানে।                  দেখিয়ে দাও ওর আপন বিশ্ব                      তোমার মন্দিরে,   সেখানে মুছে গেছে কাছের পরিচয়ের কালিমা,      ঘুচে গেছে নিত্যব্যবহারের জীর্ণতা,        তার চিরলাবণ্য হয়েছে পরিস্ফুট।  পান্থশালায় ছিল ওর বাসা,   বুকে আঁকড়ে ছিল তারই আসন, তারই শয্যা,   পলে পলে যার ভাড়া জুগিয়ে দিন কাটালো        কোন্‌ মুহূর্তে তাকে ছাড়বে ভয়ে        আড়াল তুলেছে উপকরণের।   একবার ঘরের অভয় স্বাদ পেতে দাও তাকে                           বেড়ার বাইরে।আপনাকে চেনার সময় পায় নি সে,      ঢাকা ছিল মোটা মাটির পর্দায়;   পর্দা খুলে দেখিয়ে দাও যে, সে আলো, সে আনন্দ,          তোমারই সঙ্গে তার রূপের মিল।      তোমার যজ্ঞের হোমাগ্নিতে          তার জীবনের সুখদুঃখ আহুতি দাও,             জ্বলে উঠুক তেজের শিখায়,             ছাই হোক যা ছাই হবার।       হে অতিথিবৎসল,             পথের মানুষকে ডেকে নাও ঘরে,             আপনি যে ছিল আপনার পর হয়ে                    সে পাক্‌ আপনাকে। শান্তিনিকেতন, ২৪ অক্টোবর ১৯৩৫ ছল তোমারে পাছে সহজে বুঝি     তাই কি এত লীলার ছল - বাহিরে যবে হাসির ছটা     ভিতরে থাকে আঁখির জল। বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা - যে কথা তুমি বলিতে চাও     সে কথা তুমি বল না।।তোমারে পাছে সহজে ধরি     কিছুরই তব কিনারা নাই - দশের দলে টানি গো পাছে     কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই। বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা - যে পথে তুমি চলিতে চাও     সে পথে তুমি চল না।।সবার চেয়ে অধিক চাহ,     তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও - হেলার ভরে খেলার মতো     ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও? বুঝেছি আমি, বুজেছি তব     ছলনা - সবার যাহে তৃপ্তি হল     তোমার তাহে হল না।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) ছলনা সংসার মোহিনী নারী কহিল সে মোরে, তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য প্রেমডোরে। যখন ফুরায়ে গেল সব লেনা দেনা, কহিল, ভেবেছ বুঝি উঠিতে হবে না!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে, ওরে  হবে তোর জয়। অন্ধকার যায় বুঝি কেটে, ওরে  আর নেই ভয়। ওই দেখ্‌ পূর্বাশার ভালে নিবিড় বনের অন্তরালে শুকতারা হয়েছে উদয়। ওরে  আর নেই ভয়।এরা যে কেবল নিশাচর– অবিশ্বাস আপনার ‘পর, নিরাশ্বাস, আলস্য সংশয়, এরা প্রভাতের নয়। ছুটে আয়, আয় রে বাহিরে, চেয়ে দেখ্‌, দেখ্‌ ঊর্ধ্বশিরে, আকাশ হতেছে জ্যোতির্ময়। ওরে  আর নেই ভয়।২১ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ছায়াছবি আমার প্রিয়ার সচল ছায়াছরি সজল নীলাকাশে। আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে, সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার ভাসে। বারিঝরা বনের গন্ধ নিয়া পরশহারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া। আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায় আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়, আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে। ছায়াসঙ্গিনী কোন্‌ ছায়াখানি সঙ্গে তব ফেরে লয়ে স্বপ্নরুদ্ধ বাণী             তুমি কি আপনি তাহা জানো।      চোখের দৃষ্টিতে তব রয়েছে বিছানো।             আপনাবিস্মৃত তারি।         স্তম্ভিত স্তিমিত অশ্রুবারি।একদিন জীবনের প্রথম ফাল্গুনী           এসেছিল, তুমি তারি পদধ্বনি শুনি                    কম্পিত কৌতুকী           যেমনি খুলিয়া দ্বার দিলে উঁকি       আম্রমঞ্জরির গন্ধে মধুপগুঞ্জনে                  হৃদয়স্পন্দনে       এক ছন্দে মিলে গেল বনের মর্মর।              অশোকের কিশলয়স্তর উৎসুক যৌবনে তব বিস্তারিল নবীন রক্তিমা।         প্রাণোচ্ছ্বাস নাহি পায় সীমা               তোমার আপনা-মাঝে,           সে-প্রাণেরই ছন্দ বাজে   দূর নীল বনান্তের বিহঙ্গসংগীতে, দিগন্তে নির্জনলীন রাখালের করুণ বংশীতে।               তব বনচ্ছায়ে আসিল অতিথি পান্থ, তৃণস্তরে দিল সে বিছায়ে       উত্তরী-অংশুকে তার সুবর্ণ পূর্ণিমা                   চম্পকবর্ণিমা।          তারি সঙ্গে মিশে    প্রভাতের মৃদু রৌদ্র দিশে দিশে             তোমার বিধুর হিয়া                   দিল উচ্ছ্বাসিয়া।তার পর সসংকোচে বদ্ধ করি দিলে তব দ্বার,       উচ্ছৃঙ্খল সমীরণে উদ্দাম কুন্তলভার                 লইলে সংযত করি-- অশান্ত তরুণ প্রেম বসন্তের পন্থ অনুসরি       স্খলিত কিংশুক-সাথে              জীর্ণ হল ধূসর ধুলাতে।      তুমি ভাবো সেই রাত্রিদিন                           চিহ্নহীন               মল্লিকাগন্ধের মতো                      নির্বিশেষে গত।   জানো না কি যে-বসন্ত সম্বরিল কায়া           তারি মৃত্যুহীন ছায়া       অহর্নিশি আছে তব সাথে সাথে                  তোমার অজ্ঞাতে। অদৃশ্য মঞ্জরি তার আপনার রেণুর রেখায়               মেশে তব সীমন্তের সিন্দূরলেখায়। সুদূর সে ফাল্গুনের স্তব্ধ সুর তোমার কণ্ঠের স্বর করি দিল উদাত্ত মধুর।         যে চাঞ্চল্য হয়ে গেছে স্থির তারি মন্ত্রে চিত্ত তব সকরুণ, শান্ত, সুগম্ভীর। ছিন্ন করে লও হে মোরে ছিন্ন করে লও হে মোরে আর বিলম্ব নয় ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি এই জাগে মোর ভয়। এ ফুল তোমার মালার মাঝে ঠাঁই পাবে কি, জানি না যে, তবু তোমার আঘাতটি তার ভাগ্যে যেন রয়। ছিন্ন করো ছিন্ন করো আর বিলম্ব নয়।কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে, আসবে আঁধার করে, কখন তোমার পূজার বেলা কাটবে অগোচরে। যেটুকু এর রঙ ধরেছে, গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে, তোমার সেবায় লও সেটুকু থাকতে সুসময়। ছিন্ন করো ছিন্ন করো আর বিলম্ব নয়।৩ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ছুটির দিনে ওই দেখো মা, আকাশ ছেয়ে           মিলিয়ে এল আলো, আজকে আমার ছুটোছুটি           লাগল না আর ভালো। ঘণ্টা বেজে গেল কখন,            অনেক হল বেলা। তোমায় মনে পড়ে গেল,           ফেলে এলেম খেলা। আজকে আমার ছুটি, আমার           শনিবারের ছুটি। কাজ যা আছে সব রেখে আয়           মা তোর পায়ে লুটি। দ্বারের কাছে এইখানে বোস,           এই হেথা চোকাঠ— বল্‌ আমারে কোথায় আছে           তেপান্তরের মাঠ।    ওই দেখো মা, বর্ষা এল           ঘনঘটায় ঘিরে, বিজুলি ধায় এঁকেবেঁকে           আকাশ চিরে চিরে। দেব্‌তা যখন ডেকে ওঠে             থর্‌থরিয়ে কেঁপে ভয় করতেই ভালোবাসি             তোমায় বুকে চেপে। ঝুপ্‌ঝুপিয়ে বৃষ্টি যখন             বাঁশের বনে পড়ে কথা শুনতে ভালোবাসি             বসে কোণের ঘরে। ওই দেখো মা, জানলা দিয়ে             আসে জলের ছাট— বল্‌ গো আমায় কোথায় আছে             তেপান্তরের মাঠ।    কোন্‌ সাগরের তীরে মা গো,             কোন্‌ পাহাড়ের পারে, কোন্‌ রাজাদের দেশে মা গো,             কোন্‌ নদীটির ধারে। কোনোখানে আল বাঁধা তার             নাই ডাইনে বাঁয়ে? পথ দিয়ে তার সন্ধেবেলায়             পৌঁছে না কেউ গাঁয়ে? সারা দিন কি ধূ ধূ করে             শুকনো ঘাসের জমি? একটি গাছে থাকে শুধু             ব্যাঙ্গমা - বেঙ্গমী? সেখান দিয়ে কাঠকুড়ুনি             যায় না নিয়ে কাঠ? বল্‌ গো আমায় কোথায় আছে             তেপান্তরের মাঠ।    এমনিতরো মেঘ করেছে           সারা আকাশ ব্যেপে, রাজপুত্তুর যাচ্ছে মাঠে           একলা ঘোড়ায় চেপে। গজমোতির মালাটি তার           বুকের ‘পরে নাচে— রাজকন্যা কোথায় আছে           খোঁজ পেলে কার কাছে। মেঘে যখন ঝিলিক মারে           আকাশের এক কোণে দুয়োরানী - মায়ের কথা           পড়ে না তার মনে? দুখিনা মা গোয়াল - ঘরে           দিচ্ছে এখন ঝাঁট, রাজপুত্তুর চলে যে কোন্‌           তেপান্তরের মাঠ।    ওই দেখো মা, গাঁয়ের পথে           লোক নেইকো মোটে, রাখাল - ছেলে সকাল করে           ফিরেছে আজ গোঠে। আজকে দেখো রাত হয়েছে           দিস না যেতে যেতে, কৃষাণেরা বসে আছে           দাওয়ায় মাদুর পেতে। আজকে আমি নুকিয়েছি মা,           পুঁথিপত্তর যত— পড়ার কথা আজ বোলো না।           যখন বাবার মতো। বড়ো হব তখন আমি              পড়ব প্রথম পাঠ—   আজ বলো মা, কোথায় আছে             তেপান্তরের মাঠ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ছোটো ফুল আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে , সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায় ! তাই যদি , তাই হোক , দুঃখ নাহি তায় — তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে । যারা থাকে অন্ধকারে , পাষাণকারায় , আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে , নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায় , নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে ! ক্ষুদ্র ফুল , আপনার সৌরভের সনে নিয়ে আসে স্বাধীনতা , গভীর আশ্বাস — মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে , মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস । ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে বৃহৎ জগৎ , আর বৃহৎ আকাশ !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ছোটোবড়ো এখনো তো বড়ো হই নি আমি,           ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে। দাদার চেয়ে অনেক মস্ত হব           বড়ো হয়ে বাবার মতো হলে। দাদা তখন পড়তে যদি না চায়, পাখির ছানা পোষে কেবল খাঁচায়, তখন তারে এমনি বকে দেব!             বলব, ‘তুমি চুপটি করে পড়ো। ' বলব, ‘তুমি ভারি দুষ্টু ছেলে'—              যখন হব বাবার মতো বড়ো।        তখন নিয়ে দাদার খাঁচাখানা        ভালো ভালো পুষব পাখির ছানা।    সাড়ে দশটা যখন যাবে বেজে             নাবার জন্যে করব না তো তাড়া। ছাতা একটা ঘাড়ে করে নিয়ে             চটি পায়ে বেড়িয়ে আসব পাড়া। গুরুমশায় দাওয়ায় এলে পরে চৌকি এনে দিতে বলব ঘরে, তিনি যদি বলেন ‘সেলেট কোথা?             দেরি হচ্ছে, বসে পড়া করো' আমি বলব, ‘খোকা তো আর নেই,             হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। '      গুরুমশায় শুনে তখন কবে,      ‘বাবুমশায়, আসি এখন তবে। '    খেলা করতে নিয়ে যেতে মাঠে             ভুলু যখন আসবে বিকেল বেলা, আমি তাকে ধমক দিয়ে কব,             ‘ কাজ করছি, গোল কোরো না মেলা। ' রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয় একলা যাব, করব না তো ভয়— মামা যদি বলেন ছুটে এসে             ‘ হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো' বলব আমি, ‘দেখছ না কি মামা,             হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। '      দেখে দেখে মামা বলবে, ‘তাই তো,      খোকা আমার সে খোকা আর নাই তো। '    আমি যেদিন প্রথম বড়ো হব             মা সেদিনে গঙ্গাস্নানের পরে আসবে যখন খিড়কি - দুয়োর দিয়ে             ভাববে ‘কেন গোল শুনি নে ঘরে। ' তখন আমি চাবি খুলতে শিখে যত ইচ্ছে টাকা দিচ্ছি ঝিকে, মা দেখে তাই বলবে তাড়াতাড়ি,             ‘ খোকা, তোমার খেলা কেমনতরো। ' আমি বলব, ‘মাইনে দিচ্ছি আমি,             হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো।      ফুরোয় যদি টাকা, ফুরোয় খাবার,      যত চাই মা, এনে দেব আবার। '    আশ্বিনেতে পুজোর ছুটি হবে,             মেলা বসবে গাজনতলার হাটে, বাবার নৌকো কত দূরের থেকে             লাগবে এসে বাবুগঞ্জের ঘাটে। বাবা মনে ভাববে সোজাসুজি, খোকা তেমনি খোকাই আছে বুঝি, ছোটো ছোটো রঙিন জামা জুতো             কিনে এনে বলবে আমায় ‘পরো'। আমি বলব, ‘দাদা পরুক এসে,             আমি এখন তোমার মতো বড়ো।      দেখছ না কি যে ছোটো মাপ জামার—      পরতে গেলে আঁট হবে যে আমার। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) জগৎ জুড়ে উদার সুরে জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে। বাতাস জল আকাশ আলো সবারে কবে বাসিব ভালো, হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে।নয়নদুটি মেলিলে কবে পরান হবে খুশি, যে পথ দিয়া চলিয়া যাব সবারে যাব তুষি। রয়েছ তুমি, এ কথা কবে জীবন-মাঝে সহজ হবে, আপনি কবে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন। নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন।তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি। গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি। এখন সময় হয়েছে কি। সভায় গিয়ে তোমায় দেখি জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন।শিলাইদহ, ৩০ আশ্বিন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জগদীশচন্দ্র শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু                                প্রিয়করকমলে বন্ধু,যেদিন ধরণী ছিল ব্যথাহীন বাণীহীন মরু, প্রাণের আনন্দ নিয়ে, শঙ্কা নিয়ে, দুঃখ নিয়ে, তরু দেখা দিল দারুণ নির্জনে। কত যুগ-যুগান্তরে কান পেতে ছিল স্তব্ধ মানুষের পদশব্দ তরে নিবিড় গহনতলে। যবে এল মানব অতিথি, দিল তারে ফুল ফল, বিস্তারিয়া দিল ছায়াবীথি। প্রাণের আদিমভাষা গূঢ় ছিল তাহার অন্তরে, সম্পূর্ণ হয় নি ব্যক্ত আন্দোলনে ইঙ্গিতে মর্মরে। তার দিনরজনীর জীবযাত্রা বিশ্বধরাতলে চলেছিল নানা পথে শব্দহীন নিত্যকোলাহলে সীমাহীন ভবিষ্যতে; আলোকের আঘাতে তনুতে প্রতিদিন উঠিয়াছে চঞ্চলিত অণুতে অণুতে স্পন্দবেগে নিঃশব্দ ঝংকারগীতি; নীরব স্তবনে সূর্যের বন্দনাগান গাহিয়াছে প্রভাতপবনে। প্রাণের প্রথমবাণী এইমতো জাগে চারিভিতে তৃণে তৃণে বনে বনে, তবু তাহা রয়েছে নিভৃতে-- কাছে থেকে শুনি নাই; হে তপস্বী, তুমি একমনা নিঃশব্দেরে বাক্য দিলে; অরণ্যের অন্তরবেদনা শুনেছ একান্তে বসি; মূক জীবনের যে ক্রন্দন ধরণীর মাতৃবক্ষে নিরন্তর জাগাল স্পন্দন অঙ্কুরে অঙ্কুরে উঠি, প্রসারিয়া শত ব্যগ্র শাখা, পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া শিকড়ে শিকড়ে আঁকাবাঁকা জন্মমরণের দ্বন্দ্বে, তাহার রহস্য তব কাছে বিচিত্র অক্ষররূপে সহসা প্রকাশ লভিয়াছে। প্রাণের আগ্রহবার্তা নির্বাকের অন্তঃপুত হতে অন্ধকার পার করি আনি দিলে দৃষ্টির আলোতে। তোমার প্রতিভাদীপ্ত চিত্তমাঝে কহে আজি কথা তরুর মর্মর সাথে মানব-মর্মের আত্মীয়তা; প্রাচীন আদিমতম সম্বন্ধের দেয় পরিচয়। হে সাধকশ্রেষ্ঠ, তব দুঃসাধ্য সাধন লভে জয়-- সতর্ক দেবতা যেথা গুপ্তবাণী রেখেছেন ঢাকি সেথা তুমি দীপ্তহস্তে অন্ধকারে পশিলে একাকী, জাগ্রত করিলে তারে। দেবতা আপন পরাভবে যেদিন প্রসন্ন হন, সেদিন উদার জয়রবে ধ্বনিত অমরাবতী আনন্দে রচিয়া দেয় বেদি বীর বিজয়ীর তরে, যশের পতাকা অভ্রভেদী মর্তের চূড়ায় উড়ে।                        মনে আছে একদা যেদিন আসন প্রচ্ছন্ন তব, অশ্রদ্ধার অন্ধকারে লীন, ঈর্ষাকণ্টকিত পথে চলেছিলে ব্যথিত চরণে, ক্ষুদ্র শত্রুতার সাথে প্রতিক্ষণে অকারণ রণে হয়েছ পীড়িত শ্রান্ত। সে দুঃখই তোমার পাথেয়, সে অগ্নি জ্বেলেছে যাত্রাদীপ, অবজ্ঞা দিয়েছে শ্রেয়, পেয়েছ সম্বল তব আপনার গভীর অন্তরে। তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে দিগন্তরে সমুদ্রের এ কূলে ও কূলে; আপন দীপ্তিতে আজি বন্ধু, তূমি দীপ্যমান; উচ্ছ্বসি উঠিছে বাজি বিপুল কীর্তির মন্ত্র তোমার আপন কর্মমাঝে। জ্যোতিষ্কসভার তলে যেথা তব আসন বিরাজে সেথায় সহস্রদীপ জ্বলে আজি দীপালি-উৎসবে! আমারো একটি দীপ তারি সাথে মিলাইনু যবে চেয়ে দেখো তার পানে, এ দীপ বন্ধুর হাতে জ্বালা; তোমার তপস্যাক্ষেত্র ছিল যবে নিভৃত নিরালা। বাধায় বেষ্টিত রুদ্ধ, সেদিন সংশয়সন্ধ্যাকালে কবি-হাতে বরমাল্য সে-বন্ধু পরায়েছিল ভালে; অপেক্ষা করে নি সে তো জনতার সমর্থন তরে, দুর্দিনে জ্বেলেছে দীপ রিক্ত তব অর্ঘ্যথালি-'পরে। আজি সহস্রের সাথে ঘোষিল সে, "ধন্য ধন্য তুমি, ধন্য তব বন্ধুজন, ধন্য তব পুণ্য জন্মভূমি।' জটিল সংসার জটিল সংসার, মোচন করিতে গ্রন্থি জড়াইয়া পড়ি বারংবার। গম্য নহে সোজা, দুর্গম পথের যাত্রা স্কন্ধে বহি দুশ্চিন্তার বোঝা। পথে পথে যথাতথা শত শত কৃত্রিম বক্রতা। অণুক্ষণ হতাশ্বাস হয়ে শেষে হার মানে মন। জীবনের ভাঙা ছন্দে ভ্রষ্ট হয় মিল, বাঁচিবার উৎসাহ ধূলিতলে লুটায়ে শিথিল। ওগো আশাহারা, শুষ্কতার 'পরে আনো নিখিলের রসবন্যাধারা। বিরাট আকাশে, বনে বনে, ধরণীর ঘাসে ঘাসে সুগভীর অবকাশ পূর্ণ হয়ে আছে গাছে গাছে, অন্তহীন শান্তি-উৎসস্রোতে। অন্তঃশীল যে রহস্য আঁধারে আলোতে তারে সদ্য করুক আহ্বান আদিম প্রাণের যজ্ঞে মর্মের সহজ সামগান। আত্মার মহিমা যাহা তুচ্ছতায় দিয়েছে জর্জরি ম্লান অবসাদে,তারে দাও দূর করি, লুপ্ত হয়ে যাক শূন্যতলে দ্যুলোকের ভূলোকের সন্মিলিত মন্ত্রণার বলে। জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই, ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে। মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই চাহিতে গেলে মরি লাজে। জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম, এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম, তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা ফেলিয়া দিতে পারি না যে।তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া মরণ আনে রাশি রাশি, আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি তবুও তাই ভালোবাসি। এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি, কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি, আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই ভয় যে আসে মনোমাঝে।২২ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে। এই বেসুরো জটিলতায় পরান আমার মরে ব্যথায়, হঠাৎ আমার গান থেমে যায় বারে বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে।এই বেদনা বইতে আমি পারি না যে, তোমার সভার পথে এসে মরি লাজে। তোমার যারা গুণী আছে বসতে নারি তাদের কাছে, দাঁড়িয়ে থাকি সবার পাছে বাহির-দ্বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে।বোলপুর, ৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে প্রেমহার হয় গাঁথা। জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী। হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি। দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে সঙ্কটদুঃখত্রাতা। জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে। দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে – গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে। তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে তব চরণে নত মাথা। জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। জননী তোমার করুণ চরণখানি জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে। জননী, তোমার মরণহরণ বাণী নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে। তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে, তোমারে নমি হে সকল জীবন-কাজে; তনু মন ধন করি নিবেদন আজি ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে। জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জন্ম ও মরণ সে তো সেদিনের কথা বাক্যহীন যবে এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে বিনা কোন পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে, একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে। আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি। এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান নিয়েছ ভুবননাথ! সমস্ত এ প্রাণ সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব দিতেছি অঞ্জলী তাও তব পূজাশেষে লবে সবে তোমা-সাথে মোরে ভালোবেসে, এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে। যে প্রবাসে রাখো সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে। নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে বাধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে বিকিশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে নব নব পুস্পদলে। প্রেম-আকর্ষণে যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে, বাহিরে আসিবে ছুটি - অন্তহীন প্রাণে নিখিল জগতে তব প্রেমের আহবানে নব নব জীবনে গন্ধ যাব রেখে, নব নব বিকাশের গন্ধ যাব এঁকে। কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে এক ধরাতল-মাঝে শুধু এক রূপে বাঁচিয়া থাকিতে! নব নব মৃত্যুপথে তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।। জন্মকথা খোকা মাকে শুধায় ডেকে —        ‘ এলেম আমি কোথা থেকে ,   কোন্‌খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে । '                     মা শুনে কয় হেসে কেঁদে                  খোকারে তার বুকে বেঁধে —   ‘ ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে ।                       ছিলি আমার পুতুল - খেলায় ,                    প্রভাতে শিবপূজার বেলায়   তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি ।                  তুই আমার ঠাকুরের সনে                    ছিলি পূজার সিংহাসনে ,           তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি ।                     আমার চিরকালের আশায় ,                  আমার সকল ভালোবাসায় ,           আমার মায়ের দিদিমায়ের পরানে —                  পুরানো এই মোদের ঘরে                  গৃহদেবীর কোলের ‘পরে                যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে ।                        যৌবনেতে যখন হিয়া                         উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া ,            তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে ,                   আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে                   জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে             তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে ।                      সব দেবতার আদরের ধন                    নিত্যকালের তুই পুরাতন ,              তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী —                      তুই জগতের স্বপ্ন হতে                     এসেছিস আনন্দ - স্রোতে                নূতন হয়ে আমার বুকে বিলসি ।                          নির্নিমেষে তোমায় হেরে                        তোর রহস্য বুঝি নে রে ,               সবার ছিলি আমার হলি কেমনে ।                         ওই দেহে এই দেহ চুমি                         মায়ের খোকা হয়ে তুমি                 মধুর হেসে দেখা দিলে ভুবনে ।                        হারাই হারাই ভয়ে গো তাই                       বুকে চেপে রাখতে যে চাই ,                   কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে ।                       জানি না কোন্‌ মায়ায় ফেঁদে                            বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে                আমার এ ক্ষীণ বাহু দুটির আড়ালে । '(শিশু কাব্যগ্রন্থ) জন্মকালেই ওর লিখে দিল কুষ্ঠি জন্মকালেই ওর লিখে দিল কুষ্ঠি, ভালো মানুষের ‘পরে চালাবে ও মুষ্টি। যতই প্রমাণ পায় বাবা বলে, “মোদ্দা, কভু জন্মেনি ঘরে এত বড়ো যোদ্ধা।’ “বেঁচে থাকলেই বাঁচি’ বলে ঘোষগুষ্টি,– এত গাল খায় তবু এত পরিপুষ্টি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জন্মতিথির উপহার একটি কাঠের বাক্স      শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু    স্নেহ-উপহার এনেছি রে দিতে           লিখেও এনেছি দু-তিন ছত্তর । দিতে কত কী যে সাধ যায় তোরে           দেবার মতো নেই জিনিস-পত্তর! টাকাকড়িগুলো ট্যাঁকশালে আছে           ব্যাঙ্কে আছে সব জমা , ট্যাঁকে আছে খালি গোটা দুত্তিন ,           এবার করো বাছ ক্ষমা! হীরে জহরাৎ যত ছিল মোর           পোঁতা ছিল সব মাটিতে , জহরী যে যেত সন্ধান পেয়ে           নে গেছে যে যার বাটীতে! দুনিয়া শহর জমিদারি মোর ,           পাঁচ ভূতে করে কাড়াকাড়ি , হাতের কাছেতে যা-কিছু পেলুম ,           নিয়ে এনু তাই তাড়াতাড়ি! স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত           চোখে যদি দেখা যেত রে , বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে           বল্ দেখি দিত কে তোরে! জিনিসটা অতি যৎসামান্য            রাখিস ঘরের কোণে , বাক্সখানি ভরে স্নেহ দিনু তোরে           এইটে থাকে যেন মনে! বড়োসড়ো হবি ফাঁকি দিয়ে যাবি ,           কোন্খেনে রবি নুকিয়ে , কাকা-ফাকা সব ধুয়ে-মুছে ফেলে           দিবি একেবারে চুকিয়ে । তখন যদি রে এই কাঠখানা           মনে একটুকু তোলে ঢেউ — একবার যদি মনে পড়ে তোর           ‘ বুজি ' বলে বুঝি ছিল কেউ! এই-যে সংসারে আছি মোরা সবে           এ বড়ো বিষম দেশটা! ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চলে যেতে           ভুলে যেতে সবার চেষ্টা! ভয়ে ভয়ে তাই সবারে সবাই           কত কী যে এনে দিচ্ছে , এটা-ওটা দিয়ে স্মরণ জাগিয়ে            বেঁধে রাখিবার ইচ্ছে! মনে রাখতে যে মেলাই কাঠ-খড় চাই ,           ভুলে যাবার ভারি সুবিধে , ভালোবাস যারে কাছে রাখ তারে           যাহা পাস তারে খুবি দে! বুঝে কাজ নেই এত শত কথা ,           ফিলজফি হোক ছাই! বেঁচে থাকো তুমি সুখে থাকো বাছা           বালাই নিয়ে মরে যাই! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) জন্মদিন তোমরা রচিলে যারে                    নানা অলংকারে                তারে তো চিনি নে আমি,                    চেনেন না মোর অন্তর্যামী তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা।          বিধাতার সৃষ্টিসীমা                    তোমাদের দৃষ্টির বাহিরে।          কালসমুদ্রের তীরে                    বিরলে রচেন মূর্তিখানি          বিচিত্রিত রহস্যের যবনিকা টানি                    রূপকার আপন নিভৃতে।                        বাহির হইতে                    মিলায়ে আলোক অন্ধকার      কেহ এক দেখে তারে, কেহ দেখে আর।          খণ্ড খণ্ড রূপ আর ছায়া,               আর কল্পনার মায়া,      আর মাঝে মাঝে শূন্য, এই নিয়ে পরিচয় গাঁথে                    অপরিচয়ের ভূমিকাতে।               সংসারখেলার কক্ষে তাঁর          যে-খেলেনা রচিলেন মূর্তিকার      মোরে লয়ে মাটিতে আলোতে,                    সাদায় কালোতে,          কে না জানে সে ক্ষণভঙ্গুর      কালের চাকার নিচে নিঃশেষে ভাঙিয়া হবে চুর।          সে বহিয়া এনেছে যে-দান      সে করে ক্ষণেকতরে অমরের ভান--          সহসা মুহূর্তে দেয় ফাঁকি,                    মুঠি-কয় ধূলি রয় বাকি, আর থাকে কালরাত্রি সব-চিহ্ন-ধুয়ে-মুছে-ফেলা।          তোমাদের জনতার খেলা               রচিল যে পুতুলিরে          সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে               এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে।          এ কথা কল্পনা কর যবে                    তখন আমার               আপন গোপন রূপকার          হাসেন কি আঁখিকোণে,                    সে কথাই ভাবি আজ মনে। জন্মদিন আসে বারে বারে জন্মদিন আসে বারে বারে মনে করাবারে— এ জীবন নিত্যই নূতন প্রতি প্রাতে আলোকিত পুলকিত দিনের মতন।   (স্ফুলিঙ্গ) জন্মবাসরের ঘটে জন্মবাসরের ঘটে নানা তীর্থে পুণ্যতীর্থবারি করিয়াছি আহরণ, এ কথা রহিল মোর মনে। একদা গিয়েছি চিন দেশে, অচেনা যাহারা ললাটে দিয়েছে চিহ্ন "তুমি আমাদের চেনা' ব'লে। খসে পড়ে গিয়েছিল কখন পরের ছদ্মবেশ; দেখা দিয়েছিল তাই অন্তরের নিত্য যে মানুষ; অভাবিত পরিচয়ে আনন্দের বাঁধ দিল খুলে। ধরিনু চিনের নাম, পরিনু চিনের বেশবাস। এ কথা বুঝিনু মনে, যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে। আনে সে প্রাণের অপূর্বতা। বিদেশী ফুলের বনে অজানা কুসুম ফুটে থাকে-- বিদেশী তাহার নাম, বিদেশে তাহার জন্মভূমি, আত্মার আনন্দক্ষেত্রে তার আত্মীয়তা অবারিত পায় অভ্যর্থনা। জবাবদিহি কবি হয়ে দোল-উৎসবে           কোন্‌ লাজে কালো সাজে আসি, এ নিয়ে রসিকা তোরা সবে           করেছিলি খুব হাসাহাসি। চৈত্রের দোল-প্রাঙ্গণে           আমার জবাবদিহি চাই এ দাবি তোদের ছিল মনে,           কাজ ফেলে আসিয়াছি তাই। দোলের দিনে, সে কী মনের ভুলে,           পরেছিলাম যখন কালো কাপড়, দখিন হাওয়া দুয়ারখানা খুলে           হঠাৎ পিঠে দিল হাসির চাপড়। সকল বেলা বেড়াই খুঁজি খুঁজি           কোথা সে মোর গেল রঙের ডালা, কালো এসে আজ লাগালো বুঝি           শেষ প্রহরে রঙহরণের পালা। ওরে কবি, ভয় কিছু নেই তোর--           কালো রঙ যে সকল রঙের চোর। জানি যে ওর বক্ষে রাখে তুলি           হারিয়ে-যাওয়া পূর্ণিমা ফাল্গুনী-- অস্তরবির রঙের কালো ঝুলি,           রসের শাস্ত্রে এই কথা কয় শুনি। অন্ধকারে অজানা-সন্ধানে           অচিন লোকে সীমাবিহীন রাতে রঙের তৃষা বহন করি প্রাণে           চলব যখন তারার ইশারাতে, হয়তো তখন শেষ-বয়সের কালো           করবে বাহির আপন গ্রন্থি খুলি যৌবনদীপ--জাগাবে তার আলো           ঘুমভাঙা সব রাঙা প্রহরগুলি। কালো তখন রঙের দীপালিতে           সুর লাগাবে বিস্মৃত সংগীতে। জমল সতেরো টাকা জমল সতেরো টাকা; সুদে টাকা খেলাবার শখ গেল, নবু তাই গেল চলি ম্যালাবার। ভাবনা বাড়ায় তার মুনফার মাত্রা, পাঁচ মেয়ে বিয়ে ক’রে বাঁচল এ যাত্রা। কাজ দিল কন্যারা ঠেলাগাড়ি ঠেলাবার, রোদ্‌দুরে ভার্যার ভিজে চুল এলাবার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জয়ধ্বনি যাবার সময় হলে জীবনের সব কথা সেরে শেষবাক্যে জয়ধ্বনি দিয়ে যাব মোর অদৃষ্টেরে।        বলে যাব, পরমক্ষণের আশীর্বাদ বারবার আনিয়াছে বিস্ময়ের অপূর্ব আস্বাদ।           যাহা রুগ্ন, যাহা ভগ্ন, যাহা মগ্ন পঙ্কস্তরতলে                    আত্মপ্রবঞ্চনাছলে                তাহারে করি না অস্বীকার।                    বলি, বারবার                  পতন হয়েছে যাত্রাপথে                         ভগ্ন মনোরথে;                              বারে বারে পাপ           ললাটে লেপিয়া গেছে কলঙ্কের ছাপ;           বারবার আত্মপরাভব কত                     দিয়ে গেছে মেরুদণ্ড করি নত;           কদর্যের আক্রমণ ফিরে ফিরে                    দিগন্ত গ্লানিতে দিল ঘিরে।      মানুষের অসম্মান দুর্বিষহ দুখে           উঠেছে পুঞ্জিত হয়ে চোখের সম্মুখে,                ছুটি নি করিতে প্রতিকার--           চিরলগ্ন আছে প্রাণে ধিক্কার তাহার। অপূর্ণ শক্তির এই বিকৃতির সহস্র লক্ষণ           দেখিয়াছি চারি দিকে সারাক্ষণ,     চিরন্তন মানবের মহিমারে তবু              উপহাস করি নাই কভু।       প্রত্যক্ষ দেখেছি যথা দৃষ্টির সম্মুখে মোর হিমাদ্রিরাজের সমগ্রতা, গুহাগহ্বরের যত ভাঙাচোরা রেখাগুলো তারে               পারে নি বিদ্রূপ করিবারে--      যত-কিছু খণ্ড নিয়ে অখণ্ডেরে দেখেছি তেমনি, জীবনের শেষবাক্যে আজি তারে দিব জয়ধ্বনি। জর্মন প্রোফেসার জর্মন প্রোফেসার দিয়েছেন গোঁফে সার কত যে! উঠেছে ঝাঁকড়া হয়ে খোঁচা-খোঁচা ছাঁটা ছাঁটা– দেখে তাঁর ছাত্রের ভয়ে গায়ে দেয় কাঁটা, মাটির পানেতে চোখ নত যে। বৈদিক ব্যাখ্যায় বাণী তাঁর মুখে এসে যে নিমেষে পা বাড়ান ওষ্ঠের দ্বারদেশে চরণকমল হয় ক্ষত যে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জল ধরাতলে                     চঞ্চলতা সব-আগে নেমেছিল জলে ।                        সবার প্রথম ধ্বনি উঠেছিল জেগে                                         তারি স্রোতোবেগে ।                                   তরঙ্গিত গতিমত্ত সেই জল                             কলোল্লোলে উদ্‌বেল উচ্ছল                        শৃঙ্খলিত ছিল স্তব্ধ পুকুরে আমার ,                  নৃত্যহীন ঔদাসীন্যে অর্থহীন শূন্যদৃষ্টি তার ।                        গান নাই , শব্দের তরণী হোথা ডোবা ,                                         প্রাণ হোথা বোবা ।                  জীবনের রঙ্গমঞ্চে ওখানে রয়েছে পর্দা টানা ,                        ওইখানে কালো বরনের মানা ।                             ঘটনার স্রোত নাহি বয় ,                                   নিস্তব্ধ সময় ।                  হোথা হতে তাই মনে দিত সাড়া                                   সময়ের বন্ধ-ছাড়া                         ইতিহাস-পলাতক কাহিনীর কত                             সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি নানামতো ।                                   উপরের তলা থেকে                                            চেয়ে দেখে                  না-দেখা গভীরে ওর মায়াপুরী এঁকেছিনু মনে ।                         নাগকন্যা মানিকদর্পণে                             সেথায় গাঁথিছে বেণী ,                        কুঞ্চিত লহরিকার শ্রেণী                             ভেসে যায় বেঁকে বেঁকে                  যখন বিকেলে হাওয়া জাগিয়া উঠিত থেকে থেকে ।                         তীরে যত গাছপালা পশুপাখি                     তারা আছে অন্যলোকে , এ শুধু একাকী ।                                         তাই সব                        যত কিছু অসম্ভব কল্পনার মিটাইত সাধ ,                  কোথাও ছিল না তার প্রতিবাদ ।                                তার পরে মনে হল একদিন ,                  সাঁতারিতে পেল যারা পৃথিবীতে তারাই স্বাধীন ,                             বন্দী তারা যারা পায় নাই ।                                   এ আঘাত প্রাণে নিয়ে চলিলাম তাই                  ভূমির নিষেধগণ্ডি হতে পার ।                        অনাত্মীয় শত্রুতার                             সংশয় কাটিল ধীরে ধীরে ,                                   জলে আর তীরে                  আমারে মাঝেতে নিয়ে হল বোঝাপড়া ।                                   আঁকড়িয়া সাঁতারের ঘড়া                        অপরিচয়ের বাধা উত্তীর্ণ হয়েছি দিনে দিনে ,                             অচেনার প্রান্তসীমা লয়েছিনু চিনে ।                                   পুলকিত সাবধানে                             নামিতাম স্নানে ,                        গোপন তরল কোন্‌ অদৃশ্যের স্পর্শ সর্ব গায়ে                                   ধরিত জড়ায়ে ।                             হর্ষ-সাথে মিলি ভয়                                   দেহময়                        রহস্য ফেলিত ব্যাপ্ত করি ।                           পূর্বতীরে বৃদ্ধ বট প্রাচীন প্রহরী                  গ্র ন্থি ল শিকড়গুলো কোথায় পাঠাত নিরালোকে                             যেন পাতালের নাগলোকে ।                        এক দিকে দূর আকাশের সাথে                                   দিনে রাতে                        চলে তার আলোকছায়ার আলাপন ,                   অন্য দিকে দূর নিঃশব্দের তলে নিমজ্জন                                   কিসের সন্ধানে                        অবিচ্ছিন্ন প্রচ্ছন্নের পানে ।    সেই পুকুরের                        ছিনু আমি দোসর দূরের                                    বাতায়নে বসি নিরালায় ,                   বন্দী মোরা উভয়েই জগতের ভিন্ন কিনারায় ;                        তার পরে দেখিলাম , এ পুকুর এও বাতায়ন —                  এক দিকে সীমা বাঁধা , অন্য দিকে মুক্ত সারাক্ষণ ।                             করিয়াছি পারাপার                                   যত শত বার                        ততই এ তটে-বাঁধা জলে                                   গভীরের বক্ষতলে                        লভিয়াছি প্রতি ক্ষণে বাধা-ঠেলা স্বাধীনের জয় ,                                   গেছে চলি ভয় । জলযাত্রা নৌকো বেঁধে কোথায় গেল, যা ভাই মাঝি ডাকতে মহেশগঞ্জে যেতে হবে শীতের বেলা থাকতে। পাশের গাঁয়ে ব্যাবসা করে ভাগ্নে আমার বলাই, তার আড়তে আসব বেচে খেতের নতুন কলাই। সেখান থেকে বাদুড়ঘাটা আন্দাজ তিনপোয়া, যদুঘোষের দোকান থেকে নেব খইয়ের মোয়া। পেরিয়ে যাব চন্দনীদ' মুন্সিপাড়া দিয়ে, মালসি যাব, পুঁটকি সেথায় থাকে মায়ে ঝিয়ে। ওদের ঘরে সেরে নেব দুপুরবেলার খাওয়া; তারপরেতে মেলে যদি পালের যোগ্য হাওয়া একপহরে চলে যাব মুখ্‌লুচরের ঘাটে, যেতে যেতে সন্ধে হবে খড়কেডাঙার হাটে। সেথায় থাকে নওয়াপাড়ায় পিসি আমার আপন, তার বাড়িতে উঠব গিয়ে, করব রাত্রিযাপন। তিন পহরে শেয়ালগুলো উঠবে যখন ডেকে ছাড়ব শয়ন ঝাউয়ের মাথায় শুকতারাটি দেখে। লাগবে আলোর পরশমণি পুব আকাশের দিকে,      একটু ক'রে আঁধার হবে ফিকে।        বাঁশের বনে একটি-দুটি কাক           দেবে প্রথম ডাক। সদর পথের ঐ পারেতে গোঁসাইবাড়ির ছাদ আড়াল করে নামিয়ে নেবে একাদশীর চাঁদ। উসুখুসু করবে হাওয়া শিরীষ গাছের পাতায়, রাঙা রঙের ছোঁয়া দেবে দেউল-চুড়োর মাথায়।     বোষ্টমি সে ঠুনুঠুনু বাজাবে মন্দিরা, সকালবেলার কাজ আছে তার নাম শুনিয়ে ফিরা।      হেলেদুলে পোষা হাঁসের দল যেতে যেতে জলের পথে করবে কোলাহল। আমারও পথ হাঁসের যে-পথ, জলের পথে যাত্রী, ভাসতে যাব ঘাটে ঘাটে ফুরোবে যেই রাত্রি। সাঁতার কাটব জোয়ার-জলে পৌঁছে উজিরপুরে, শুকিয়ে নেব ভিজে ধুতি বালিতে রোদ্‌দুরে।             গিয়ে ভজনঘাটা কিনব বেগুন পটোল মুলো, কিনব সজনেডাঁটা।             পৌঁছব আটবাঁকে, সূর্য উঠবে মাঝগগনে, মহিষ নামবে পাঁকে। কোকিল-ডাকা বকুল-তলায় রাঁধব আপন হাতে, কলার পাতায় মেখে নেব গাওয়া ঘি আর ভাতে। মাখনাগাঁয়ে পাল নামাবে, বাতাস যাবে থেমে; বনঝাউ-ঝোপ রঙিয়ে দিয়ে সূর্য পড়বে নেমে। বাঁকাদিঘির ঘাটে যাব যখন সন্ধে হবে      গোষ্ঠে-ফেরা ধেনুর হাম্বারবে। ভেঙে-পড়া ডিঙির মতো হেলে-পড়া দিন তারা-ভাসা আঁধার-তলায় কোথায় হবে লীন। জাগি রহে চাঁদ জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন সারাটি রজনী! শ্রান্ত জগত ঘুমে অচেতন সারাটি রজনী! অতি ধীরে ধীরে হৃদে কী লাগিয়া মধুময় ভাব উঠে গো জাগিয়া সারাটি রজনী! ঘুমায়ে তোমারি দেখি গো স্বপন সারাটি রজনী! জাগিয়া তোমারি দেখি গো বদন সারাটি রজনী! ত্যজিবে যখন দেহ ধূলিময় তখনি কি সখি তোমার হৃদয়, আমার ঘুমের শয়ন-‘পরে ভ্রমিয়া বেড়াবে প্রণয়-ভরে। সারাটি রজনী!(অনুবাদ কবিতা) জাগিবার চেষ্টা মা কেহ কি আছ মোর , কাছে এসো তবে , পাশে বসে স্নেহ ক’রে জাগাও আমায় । স্বপ্নের সমাধি – মাঝে বাঁচিয়া কী হবে , যুঝিতেছি জাগিবারে — আঁখি রুদ্ধ হায় , ডেকো না ডেকো না মোরে ক্ষুদ্রতার মাঝে , স্নেহময় আলস্যেতে রেখো না বাঁধিয়া , আশীর্বাদ করে মোরে পাঠাও গো কাজে — পিছনে ডেকো না আর কাতরে কাঁদিয়া । মোর বলে কাহারেও দেব না কি বল! মোর প্রাণে পাবে না কি কেহ নবপ্রাণ করুণা কি শুধু ফেলে নয়নের জল , প্রেম কি ঘরের কোণে গাহে শুধু গান! তবেই ঘুচিবে মোর জীবনের লাজ যদি মা করিতে পারি কারো কোনো কাজ ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) জাগ্রত স্বপ্ন আজ একেলা বসিয়া , আকাশে চাহিয়া ,             কী সাধ যেতেছে , মন!     বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?            কোন্‌ স্বপনেতে নিমগন ?     বসন্তবাতাসে আঁখি মুদে আসে ,           মৃদু মৃদু বহে শ্বাস ,     গায়ে এসে যেন এলায়ে পড়িছে     কুসুমের মৃদু বাস । যেন সুদূর নন্দনকাননবাসিনী     সুখঘুমঘোরে মধুরহাসিনী ,     অজানা প্রিয়ার ললিত পরশ          ভেসে ভেসে বহে যায় , অতি মৃদু মৃদু লাগে গায় ।       বিস্মরণমোহে আঁধারে আলোকে            মনে পড়ে যেন তায় ,      স্মৃতি-আশা-মাখা মৃদু সুখে দুখে          পুলকিয়া উঠে কায় ।      ভ্রমি আমি যেন সুদূর কাননে ,          সুদূর আকাশতলে ,      আনমনে যেন গাহিয়া বেড়াই          সরযূর কলকলে ।      গহন বনের কোথা হতে শুনি          বাঁশির স্বর-আভাস ,      বনের হৃদয় বাজাইছে যেন           মরমের অভিলাষ ।      বিভোর হৃদয়ে বুঝিতে পারি নে          কে গায় কিসের গান ,      অজানা ফুলের সুরভি মাখানো          স্বরসুধা করি পান ।      যেন রে কোথায় তরুর ছায়ায়          বসিয়া রূপসী বালা ,      কুসুমশয়নে আধেক মগনা      বাকলবসনে আধেক নগনা,      সুখদুখগান গা ই ছে শুইয়া          গাঁথিতে গাঁথিতে মালা ।      ছায়ায় আলোকে , নিঝরের ধারে ,      কোথা কোন্‌ গুপ্ত গুহার মাঝারে ,      যেন হেথা হোথা কে কোথায় আছে          এখনি দেখিতে পাব —      যেন রে তাদের চরণের কাছে          বীণা লয়ে গান গাব ।      শুনে শুনে তারা আনত নয়নে            হাসিবে মুচুকি হাসি ,      শরমের আভা অধরে কপোলে          বেড়াইবে ভাসি ভাসি ।      মাথায় বাঁধিয়া ফুলের মালা          বেড়াইব বনে বনে ।      উড়িতেছে কেশ , উড়িতেছে বেশ ,      উদাস পরান কোথা নিরুদ্দেশ ,      হাতে লয়ে বাঁশি মুখে লয়ে হাসি ,          ভ্রমিতেছি আনমনে ।      চারি দিকে মোর বসন্ত হসিত ,      যৌবনকুসুম প্রাণে বিকশিত ,      কুসুমের'পরে ফেলিব চরণ          যৌবনমাধুরীভরে ।      চারি দিকে মোর মাধবী মালতী          সৌরভে আকুল করে ।      কেহ কি আমারে চাহিবে না ?      কাছে এসে গান গাহিবে না ?      পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে          কবে না প্রাণের আশা ?      চাঁদের আলোতে দখিন বাতাসে      কুসুমকাননে বাঁধি বাহুপাশে      শরমে সোহাগে মৃদুমধুহাসে          জানাবে না ভালোবাসা ?      আমার যৌবনকুসুমকাননে          ললিত চরণে বেড়াবে না ?      আমার প্রাণের লতিকা-বাঁধন          চরণে তাহার জড়াবে না ?      আমার প্রাণের কুসুম গাঁথিয়া          কেহ পরিবে না গলে ?      তাই ভাবিতেছি আপনার মনে          বসিয়া তরুর তলে । জান তুমি রাত্তিরে জান তুমি, রাত্তিরে নাই মোর সাথি আর– ছোটোবউ, জেগে থেকো, হাতে রেখো হাতিয়ার। যদি করে ডাকাতি, পারিনে যে তাকাতেই, আছে এক ভাঙা বেত আছে ছেঁড়া ছাতি আর। ভাঙতে চায় না ঘুম, তা না হলে দুমাদুম্‌ লাগাতেম কিল ঘুষি চালাতেম লাথি আর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জানা-অজানা এই ঘরে আগে পাছে                বোবা কালা বস্তু যত আছে                         দলবাঁধা এখানে সেখানে ,                কিছু চোখে পড়ে , কিছু পড়ে না মনের অবধানে ।                        পিতলের ফুলদানিটাকে                বহে নিয়ে টিপাইটা এক কোণে মুখ ঢেকে থাকে ।                        ক্যাবিনেটে কী যে আছে কত ,                           না জানার ই মতো ।                পর্দায় পড়েছে ঢাকা সাসির দুখানা কাঁচ ভাঙা ;                        আজ চেয়ে অকস্মাৎ দেখা গেল পর্দাখানা রাঙা —                             চোখে পড়ে পড়েও না ;                          জাজিমেতে আঁকে আলপনা                      সাতটা বেলার আলো সকালে রোদ্‌দুরে ।                             সবুজ একটি শাড়ি ডুরে                      ঢেকে আছে ডেস্কোখানা ; কবে তারে নিয়েছিনু বেছে ,                             রঙ চোখে উঠেছিল নেচে ,                আজ যেন সে রঙের আগুনেতে পড়ে গেছে ছাই ,                       আছে তবু ষোলো-আনা নাই ।                          থাকে থাকে দেরাজের                      এলোমেলো ভরা আছে ঢের                          কাগজপত্তর নানামতো ,                      ফেলে দিতে ভুলে যাই কত ,                জানি নে কী জানি কোন্‌ আছে দরকার ।                       টেবিলে হেলানো ক্যালেণ্ডার ,                হঠাৎ ঠাহর হল আটই তারিখ । ল্যাভেণ্ডার                      শিশিভরা রোদ্‌দুরের রঙে । দিনরাত                টিক্‌টিক্‌ করে ঘড়ি , চেয়ে দেখি কখনো দৈবাৎ ।                          দেয়ালের কাছে                 আলমারিভরা বই আছে ;                          ওরা বারো-আনা পরিচয়-অপেক্ষায় রয়েছে অজানা ।                           ওই যে দেয়ালে ছবিগুলো হেথা হোথা , রেখেছিনু কোনো-এক কালে ;                আজ তারা ভুলে-যাওয়া ,                          যেন ভূতে-পাওয়া ,                      কার্পেটের ডিজাইন                স্পষ্টভাষা বলেছিল একদিন ;                             আজ অন্যরূপ ,                                   প্রায় তারা চুপ ।                      আগেকার দিন আর আজিকার দিন                পড়ে আছে হেথা হোথা একসাথে সম্বন্ধবিহীন ।                                  এইটুকু ঘর ।                কিছু বা আপন তার , অনেক কিছুই তার পর ।                                   টেবিলের ধারে তাই                      চোখ-বোজা অভ্যাসের পথ দিয়ে যাই ।                          দেখি যারা অনেকটা স্পষ্ট দেখি নাকো ।                জানা অজানার মাঝে সরু এক চৈতন্যের সাঁকো ,                             ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনা                          তারি'পরে চলে আনাগোনা ।                আয়না-ফ্রেমের তলে ছেলেবেলাকার ফোটোগ্রাফ                      কে রেখেছে , ফিকে হয়ে গেছে তার ছাপ ।                          পাশাপাশি ছায়া আর ছবি ।                             মনে ভাবি , আমি সেই রবি ,                স্পষ্ট আর অস্পষ্টের উপাদানে ঠাসা                      ঘরের মতন ; ঝাপ্‌সা পুরানো ছেঁড়া ভাষা                          আসবাবগুলো যেন আছে অন্যমনে ।                সামনে রয়েছে কিছু , কিছু লুকিয়েছে কোণে কোণে ।                                   যাহা ফেলিবার                ফেলে দিতে মনে নেই । ক্ষয় হয়ে আসে অর্থ তার                          যাহা আছে জমে ।                             ক্রমে ক্রমে অতীতের দিনগুলি                মুছে ফেলে অস্তিত্বের অধিকার । ছায়া তারা                          নূতনের মাঝে পথহারা ;                যে অক্ষরে লিপি তারা লিখিয়া পাঠায় বর্তমানে                       সে কেহ পড়িতে নাহি জানে । জানার বাঁশি হাতে নিয়ে জানার বাঁশি হাতে নিয়ে না-জানা বাজান তাঁহার নানা সুরের বাজানা।   (স্ফুলিঙ্গ) জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে, সহসা হে প্রিয়, কত গৃহে পথে রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন। কতবার তুমি মেঘের আড়ালে এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে, অরুণ-কিরণে চরণ বাড়ালে, ললাটে রাখিলে শুভ পরশন।সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে কত কালে কালে কত লোকে লোকে কত নব নব আলোকে আলোকে অরূপের কত রূপদরশন। কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে অমৃতের কত রসবরষন।বোলপুর, ১০ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জামাই মহিম এল জামাই মহিম এল, সাথে এল কিনি– হায় রে কেবলই ভুলি ষষ্ঠীর দিনই। দেহটা কাহিল বড়ো, রাঁধবার নামে, কে জানে কেন রে, বাপু, ভেসে যায় ঘামে। বিধাতা জানেন আমি বড়ো অভাগিণী। বেয়ানকে লিখে দেব, খাওয়াবেন তিনি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জিরাফের বাবা বলে জিরাফের বাবা বলে,– “খোকা তোর দেহ দেখে দেখে মনে মোর ক’মে যায় স্নেহ। সামনে বিষম উঁচু, পিছনেতে খাটো, এমন দেহটা নিয়ে কী করে যে হাঁটো।’ খোকা বলে, “আপনার পানে তুমি চেহো, মা যে কেন ভালোবাসে বোঝে না তা কেহ।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) জীবন জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা, যেমন চলার অঙ্গ পা-তোলা পা-ফেলা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) জীবন উৎসর্গ এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার, যূথভ্রষ্ট বাণবিদ্ধ হরিণী আমার, এইখানে বিরাজিছে সেই চির হাসি, আঁধারিতে পারিবে না তাহা মেঘরাশি। এই হস্ত এ হৃদয় চিরকাল মতো তোমার, তোমারি কাজে রহিবে গো রত! কিসের সে চিরস্থায়ী ভালোবাসা তবে, গৌরবে কলঙ্কে যাহা সমান না রবে? জানি না, জানিতে আমি চাহি না, চাহি না, ও হৃদয়ে এক তিল দোষ আছে কিনা, ভালোবাসি তোমারেই এই শুধু জানি, তাই হলে হল, আর কিছু নাহি মানি। দেবতা সুখের দিনে বলেছ আমায়, বিপদে দেবতা সম রক্ষিব তোমায়, অগ্নিময় পথ দিয়া যাব তব সাথে, রক্ষিব, মরিব কিংবা তোমারি পশ্চাতে।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা) জীবন পবিত্র জানি জীবন পবিত্র জানি, অভাব্য স্বরূপ তার অজ্ঞেয় রহস্য-উৎস হতে পেয়েছে প্রকাশ কোন্‌ অলক্ষিত পথ দিয়ে, সন্ধান মেলে না তার। প্রত্যহ নূতন নির্মলতা দিল তারে সূর্যোদয় লক্ষ ক্রোশ হতে স্বর্ণঘটে পূর্ণ করি আলোকের অভিষেকধারা, সে জীবন বাণী দিল দিবসরাত্রিরে, রচিল অরণ্যফুলে অদৃশ্যের পূজা-আয়োজন, আরতির দীপ দিল জ্বালি নিঃশব্দ প্রহরে। চিত্ত তারে নিবেদিল জন্মের প্রথম ভালোবাসা।প্রত্যহের সব ভালোবাসা তারি আদি সোনার কাঠিতে উঠেছে জাগিয়া, প্রিয়ারে বেসেছি ভালো বেসেছি ফুলের মঞ্জরিকে; করেছে সে অন্তরতম পরশ করেছে যারে। জন্মের প্রথম গ্রন্থে নিয়ে আসে অলিখিত পাতা, দিনে দিনে পূর্ণ হয় বাণীতে বাণীতে, আপনার পরিচয় গাঁথা হয়ে চলে, দিনশেষে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে ছবি, নিজেরে চিনিতে পারে রূপকার নিজের স্বাক্ষরে, তার পরে মুছে ফেলে বর্ণ তার রেখা তার উদাসীন চিত্রকর কালো কালি দিয়ে— কিছু বা যায় না মোছা সুবর্ণের লিপি, ধ্রুবতারকার পাশে জাগে তার জ্যোতিষ্কের লীলা ।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) জীবন মরণ ওরা যায়, এরা করে বাস; অন্ধকার উত্তর বাতাস বহিয়া কত-না হা-হুতাশ ধূলি আর মানুষের প্রাণ উড়াইয়া করিছে প্রয়াণ। আঁধারেতে রয়েছি বসিয়া; একই বায়ু যেতেছে শ্বসিয়া মানুষের মাথার উপরে, অরণ্যের পল্লবের স্তরে। যে থাকে সে গেলদের কয়, “অভাগা, কোথায় পেলি লয়। আর না শুনিবি তুই কথা, আর হেরিবি তরুলতা, চলেছিস মাটিতে মিশিতে, ঘুমাইতে আঁধার নিশীথে।’ যে যায় সে এই বলে যায়, “তোদের কিছুই নাই হায়, অশ্রুজল সাক্ষী আছে তায়। সুখ যশ হেথা কোথা আছে সত্য যা তা মৃতদেরি কাছে। জীব, তোরা ছায়া, তোরা মৃত, আমরাই জীবন্ত প্রকৃত।’Victor Hugo (অনুবাদ কবিতা) জীবন যখন শুকায়ে যায় জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার, হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ, শান্তচরণে এসো।আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন, দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ, রাজ-সমারোহে এসো।বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায় ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।২৮ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জীবনদেবতা তব জীবনদেবতা তব দেহে মনে অন্তরে বাহিরে আপন পূজার ফুল আপনি ফুটান ধীরে ধীরে মাধুর্যে সৌরভে তারি অহোরাত্র রহে যেন ভরি তোমার সংসারখানি, এই আমি আশীর্বাদ করি।   (স্ফুলিঙ্গ) জীবনবহনভাগ্য নিত্য আশীর্বাদে জীবনবহনভাগ্য নিত্য আশীর্বাদে ললাট করুক স্পর্শ অনাদি জ্যোতির দান-রূপে-- নব নব জাগরণে প্রভাতে প্রভাতে মর্ত এ আয়ুর সীমানায়। ম্লানিমার ঘন আবরণ দিনে দিনে পড়ুক খসিয়া অমর্তলোকের দ্বারে নিদ্রায় জড়িত রাত্রিসম। হে সবিতা,তোমার কল্যাণতম রূপ কারো অপাবৃত, সেই দিব্য আবির্ভাবে হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত। জীবনযাত্রার পথে জীবনযাত্রার পথে ক্লান্তি ভুলি, তরুণ পথিক, চলো নির্ভীক। আপন অন্তরে তব আপন যাত্রার দীপালোক অনির্বাণ হোক।   (স্ফুলিঙ্গ) জীবনরহস্য যায় জীবনরহস্য যায় মরণরহস্য-মাঝে নামি, মুখর দিনের আলো নীরব নক্ষত্রে যায় থামি।   (স্ফুলিঙ্গ) জীবনে তব প্রভাত এল জীবনে তব প্রভাত এল নব-অরুণকান্তি। তোমারে ঘেরি মেলিয়া থাক শিশিরে-ধোওয়া শান্তি। মাধুরী তব মধ্যদিনে শক্তিরূপ ধরি কর্মপটু কল্যাণের করুক দূর ক্লান্তি।   (স্ফুলিঙ্গ) জীবনে যত পূজা হল না সারা জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে হারালো ধারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে, জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা– জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।২৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জীবনে যা চিরদিন জীবনে যা চিরদিন রয়ে গেছে আভাসে প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে, জীবনের শেষ দানে জীবনের শেষ গানে, হে দেবতা, তাই আজি দিব তব সকাশে, প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে।কথা তারে শেষ করে পারে নাই বাঁধিতে, গান তারে সুর দিয়ে পারে নাই সাধিতে। কী নিভৃতে চুপে চুপে মোহন নবীনরূপে নিখিল নয়ন হতে ঢাকা ছিল, সখা, সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।ভ্রমেছি তাহারে লয়ে দেশে দেশে ফিরিয়া, জীবনে যা ভাঙাগড়া সবি তারে ঘিরিয়া। সব ভাবে সব কাজে আমার সবার মাঝে শয়নে স্বপনে থেকে তবু ছিল একা সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।কত দিন কত লোকে চেয়েছিল উহারে, বৃথা ফিরে গেছে তারা বাহিরের দুয়ারে আর কেহ বুঝিবে না, তোমা সাথে হবে চেনা সেই আশা লয়ে ছিল আপনারি আকাশে, প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।২৪ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে এ বিস্ময় মনে আজ জাগে-- লক্ষকোটি নক্ষত্রের অগ্নিনির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা ছুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া দিকে দিকে, তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্তলে অকস্মাৎ করেছি উত্থান অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাসে। এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি জড়ের বিরাট অঙ্কতলে উদ্‌ঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয় শাখায়িত রূপে রূপান্তরে। অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের মোহাবিষ্ট প্রদোষের ছায়া আচ্ছন্ন করিয়া ছিল পশুলোক দীর্ঘ যুগ ধরি; কাহার একাগ্র প্রতীক্ষায় অসংখ্য দিবসরাত্রি-অবসানে মন্থরগমনে এল মানুষ প্রাণের রঙ্গভূমে; নূতন নূতন দীপ একে একে উঠিতেছে জ্বলে, নূতন নূতন অর্থ লভিতেছে বাণী; অপূর্ব আলোকে মানুষ দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ, পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা-- আমি সে নাট্যের পাত্রদলে পরিয়াছি সাজ। আমারো আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে, এ আমার পরম বিস্ময়। সাবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্তনিকেতন, আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে কী গূঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্যপ্রদক্ষিণ-- সে রহস্যসূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশি বর্ষ আগে, চলে যাব কয় বর্ষ পরে। জীবনের দীপে তব জীবনের দীপে তব আলোকের আশীর্বচন আঁধারের অচৈতন্যে সঞ্চিত করুক জাগরণ।   (স্ফুলিঙ্গ) জুতা-আবিষ্কার কহিলা হবু, `শুন গো গোবুরায়,        কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র--- মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়        ধরণী-মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র! তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,        রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি। আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,        রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!             শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,             নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।' শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,        দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে। পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,        পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে। রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,        কান্নাকাটি পড়িল বাড়িমধ্যে, অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি        কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,             `যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,             পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!' শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,        কহিল শেষে, `কথাটা বটে সত্য--- কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি,        ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব। ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা        তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে, কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা        উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?             আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,             পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।' আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,      যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী      দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী। বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,      ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য। অনেক ভেবে কহিল, `গেলে মাটি      ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?'             কহিল রাজা, `তাই যদি না হবে,             পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?' সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে        কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ, ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে        ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ। ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,        ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য। ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,        ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য।             কহিল রাজা, `করিতে ধুলা দূর,             জগত্‍‌ হল ধুলায় ভরপুর!' তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক        মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি। পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,        নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি। জলের জীব মরিল জল বিনা,        ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা--- পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,        সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা।             কহিল রাজা, `এমনি সব গাধা             ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!' আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;        বসিল পুন যতেক গুণবন্ত--- ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,        ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত। কহিল, `মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,      ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।' কহিল কেহ, `রাজারে ঘরে রাখো,      কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র।             ধুলার মাঝে না যদি দেন পা             তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।' কহিল রাজা, `সে কথা বড়ো খাঁটি,        কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ, মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি        দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।' কহিল সবে, `চামারে তবে ডাকি        চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী। ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি        মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।'             কহিল সবে, `হবে সে অবহেলে,             যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।' রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,        ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম। যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,        না মিলে তত উচিত-মতো চর্ম। তখন ধীরে চামার-কুলপতি        কহিল এসে ঈষত্‍‌ হেসে বৃদ্ধ, `বলিতে পারি করিলে অনুমতি,        সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।             নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে             ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।' কহিল রাজা, `এত কি হবে সিধে,        ভাবিয়া ম'ল সকল দেশ-শুদ্ধ!' মন্ত্রী কহে, `বেটারে শূল বিঁধে        কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।' রাজার পদ চর্ম-আবরণে        ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে। মন্ত্রী কহে, `আমারো ছিল মনে        কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।'             সেদিন হতে চলিল জুতা পরা---             বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা। জ্ঞানের দৃষ্টি ও প্রেমের সম্ভোগ ‘কালো তুমি’— শুনি জাম কহে কানে কানে, যে আমারে দেখে সেই কালো বলি জানে, কিন্তু সেটুকু জেনে ফের কেন জাদু? যে আমারে খায় সেই জানে আমি স্বাদু।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ, পরাণ সঁপিবে বিধবা-বালা। জ্বলুক্‌ জ্বলুক্‌ চিতার আগুন, জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা॥ শোন্‌ রে যবন!-- শোন্‌ রে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে, সাক্ষী র'লেন দেবতা তার এর প্রতিফল ভুগিতে হবে॥ ওই যে সবাই পশিল চিতায়, একে একে একে অনলশিখায়, আমরাও আয় আছি যে কজন, পৃথিবীর কাছে বিদায় লই। সতীত্ব রাখিব করি প্রাণপণ, চিতানলে আজ সঁপিব জীবন-- ওই যবনের শোন্‌ কোলাহল, আয় লো চিতায় আয় লো সই! জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ, অনলে আহুতি দিব এ প্রাণ। জ্বলুক্‌ জ্বলুক্‌ চিতার আগুন, পশিব চিতায় রাখিতে মান। দেখ্‌ রে যবন! দেখ্‌ রে তোরা! কেমনে এড়াই কলঙ্ক-ফাঁসি; জ্বলন্ত অনলে হইব ছাই, তবু না হইব তোদের দাসী॥ আয় আয় বোন! আয় সখি আয়! জ্বলন্ত অনলে সঁপিবারে কায়, সতীত্ব লুকাতে জ্বলন্ত চিতায়, জ্বলন্ত চিতায় সঁপিতে প্রাণ! দেখ্‌ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন, দেখ্‌ রে চন্দ্রমা দেখ্‌ রে গগন! স্বর্গ হতে সব দেখ্‌ দেবগণ, জলদ-অক্ষরে রাখ্‌ গো লিখে। স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্‌ রে, সতীত্ব-রতন, করিতে রক্ষণ, রাজপুত সতী আজিকে কেমন, সঁপিছে পরান অনল-শিখে॥ জ্বালো নবজীবনেব জ্বালো নবজীবনেব নির্মল দীপিকা, মর্তের চোখে ধরো স্বর্গের লিপিকা। আঁধারগহনে রচো আলোকের বীথিকা, কলকোলাহলে আনো অমৃতের গীতিকা।  (স্ফুলিঙ্গ) জ্যোতিষ-শাস্ত্র আমি শুধু বলেছিলেম—     ‘কদম গাছের ডালে পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে     যখন সন্ধেকালে            তখন কি কেউ তারে            ধরে আনতে পারে। ' শুনে দাদা হেসে কেন           বললে আমায়, ‘ খোকা,           তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা। চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে     কেমন করে ছুঁই; আমি বলি, ‘দাদা, তুমি     জান না কিচ্ছুই। মা আমাদের হাসে যখন     ওই জানলার ফাঁকে তখন তুমি বলবে কি, মা     অনেক দূরে থাকে। '             তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,             তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। ' দাদা বলে, ‘পাবি কোথায়        অত বড়ো ফাঁদ। '   আমি বলি, ‘কেন দাদা,        ওই তো ছোটো চাঁদ,             দুটি মুঠোয় ওরে             আনতে পারি ধরে। '   শুনে দাদা হেসে কেন             বললে আমায়, ‘খোকা,             তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।   চাঁদ যদি এই কাছে আসত        দেখতে কত বড়ো। '   আমি বলি, ‘কী তুমি ছাই        ইস্কুলে যে পড়।   মা আমাদের চুমো খেতে        মাথা করে নিচু,   তখন কি আর মুখটি দেখায়        মস্ত বড়ো কিছু। '             তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,             তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ) জ্যোতিষী ওই   যে রাতের তারা             জানিস কি , মা , কারা ? সারাটিখন ঘুম না জানে চেয়ে থাকে মাটির পানে           যেন কেমনধারা! আমার যেমন নেইকো ডানা , আকাশ - পানে উড়তে মানা ,           মনটা কেমন করে , তেমনি ওদের পা নেই বলে পারে না যে আসতে চলে           এই পৃথিবীর ‘পরে ।       সকালে যে নদীর বাঁকে জল নিতে যাস কলসী কাঁখে           সজনেতলার ঘাটে , সেথায় ওদের আকাশ থেকে আপন ছায়া দেখে দেখে           সারা পহর কাটে । ভাবে ওরা চেয়ে চেয়ে ' হতেম যদি গাঁয়ের মেয়ে            তবে সকাল - সাঁজে কলসিখানি ধরে বুকে সাঁতরে নিতেম মনের সুখে           ভরা নদীর মাঝে ' ।       আর আমাদের ছাতের কোণে তাকায় , যেথা গভীর বনে           রাক্ষসদের ঘরে রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে , সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তাকে           জাগাই শয্যা‘পরে ।   ভাবে ওরা , আকাশ ফেলে হত যদি তোমার ছেলে ,           এইখানে এই ছাতে দিন কাটাত খেলায় খেলায় তার পরে সেই রাতের বেলায়           ঘুমোত তোর সাথে ।       যেদিন আমি নিষুত রাতে হঠাৎ উঠি বিছানাতে           স্বপন থেকে জেগে জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে তারাগুলি আকাশ ছেয়ে           ঝাপসা আছে মেঘে । বসে বসে ক্ষণে ক্ষণে সেদিন আমার হয় যে মনে           ওদের স্বপ্ন বলে । অন্ধকারের ঘুম লাগে যেই ওরা আসে সেই পহরেই ,           ভোরবেলা যায় চলে । আঁধার রাতি অন্ধ ও যে , দেখতে না পায় , আলো খোঁজে ,           সবই হারিয়ে ফেলে । তাই আকাশে মাদুর পেতে সমস্তখন স্বপনেতে           দেখা - দেখা খেলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) ঝড় দেখ্‌ রে চেয়ে নামল বুঝি ঝড়, ঘাটের পথে বাঁশের শাখা ঐ করে ধড়ফড়। আকাশতলে বজ্রপাণির ডঙ্কা উঠল বাজি,        শীঘ্র তরী বেয়ে চল্‌ রে মাঝি। ঢেউয়ের গায়ে ঢেউগুলো সব গড়ায় ফুলে ফুলে, পুবের চরে কাশের মাথা উঠছে দুলে দুলে। ঈশান কোণে উড়তি বালি আকাশখানা ছেয়ে        হু হু করে আসছে ছুটে ধেয়ে। কাকগুলো তার আগে আগে উড়ছে প্রাণের ডরে, হার মেনে শেষ আছাড় খেয়ে পড়ে মাটির 'পরে। হাওয়ার বিষম ধাক্কা তাদের লাগছে ক্ষণে ক্ষণে উঠছে পড়ছে, পাখার ঝাপট দিতেছে প্রাণপণে। বিজুলি ধায় দাঁত মেলে তাঁর ডাকিনীটার মতো, দিক্‌দিগন্ত চমকে ওঠে হঠাৎ মর্মাহত। ওই রে মাঝি, খেপল গাঙের জল, লগি দিয়ে ঠেকা নৌকো, চরের কোলে চল। সেই যেখানে জলের শাখা, চখাচখির বাস, হেথাহোথায় পলিমাটি দিয়েছে আশ্বাস     কাঁচা সবুজ নতুন ঘাসে ঘেরা। তলের চরে বালুতে রোদ পোহায় কচ্ছপেরা। হোথায় জলে বাঁশ টাঙিয়ে শুকোতে দেয় জাল, ডিঙির ছাতে বসে বসে সেলাই করে পাল।     রাত কাটাব ওইখানেতেই করব রাঁধাবাড়া,     এখনি আজ নেই তো যাবার তাড়া। ভোর থাকতেই কাক ডাকতেই নৌকো দেব ছাড়ি, ইঁটেখোলার মেলায় দেব সকাল সকাল পাড়ি। ঝড়ের দিনে আজি এই আকুল আশ্বিনে              মেঘে-ঢাকা দুরন্ত দুর্দিনে হেমন্ত-ধানের খেতে         বাতাস উঠেছে মেতে,              কেমনে চলিবে পথ চিনে?              আজি এই দুরন্ত দুর্দিনে!              দেখিছ না ওগো সাহসিকা,              ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা! মনে ভেবে দেখো তবে      এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে              কবরীর শেফালিমালিকা।              ভেবে দেখো ওগো সাহসিকা!              আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়              নূপুর বাঁধে কি কেহ পায়? যদি আজি বৃষ্টির জল       ধুয়ে দেয় নীলাঞ্চল              গ্রামপথে যাবে কি লজ্জায়              আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়?             হে উতলা শোনো কথা শোনো,              দুয়ার কি খোলা আছে কোনো? এ বাঁকা পথের শেষে        মাঠ যেথা মেঘে মেশে              বসে কেহ আছে কি এখনো?              এ দুর্যোগে, শোনো ওগো শোনো!              আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে              নিবে কি যাবে না বারে বারে? আজ যদি বাজে বাঁশি        গান কি যাবে না ভাসি              আশ্বিনের অসীম আঁধারে              ঝড়ের ঝাপটে বারে বারে? ঝাঁকড়াচুল ঝাঁকড়া চুলের মেয়ের কথা কাউকে বলি নি, কোন্‌ দেশে যে চলে গেছে সে-চঞ্চলিনী।           সঙ্গী ছিল কুকুর কালু,           বেশ ছিল তার আলুথালু, আপনা-'পরে অনাদরে ধুলায় মলিনী।হুটোপাটি ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিষ্কারণেই দিঘির জলে গাছের ডালে গতি ক্ষণে-ক্ষণেই।           পাগলামি তার কানায় কানায়,           খেয়াল দিয়ে খেলা বানায়, উচ্চহাসে কলভাষে কলকলিনী।দেখা হলে যখন-তখন বিনা অপরাধে মুখভঙ্গী করত আমায় অপমানের ছাঁদে।           শাসন করতে যেমন ছুটি           হঠাৎ দেখি ধুলায় লুটি' কাজল আঁখি চোখের জলে ছলছলিনী।আমার সঙ্গে পঞ্চাশবার জন্মশোধের আড়ি কথায় কথায় নিত্যকালের মতন ছাড়াছাড়ি।           ডাকলে তারে "পুঁটলি' ব'লে           সাড়া দিত মর্জি হলে, ঝগড়াদিনের নাম ছিল তার স্বর্ণনলিনী। ঝিনেদার জ্ঞাদনার ঝিনেদার জ্ঞাদনার ছেলেটার জন্যে ত্রিচিনাপল্লী গিয়ে খুঁজে পেল কন্যে।শহরেতে সব-সেরা ছিল যেই বিবেচক দেখে দেখে বললে সে,– “কিবে নাক, কিবে চোখ; চুলের ডগার খুঁত বুঝবে না অন্যে।’কন্যেকর্তা শুনে ঘটকের কানে কয়,–“ওটুকু ত্রুটির তরে করিস্‌নে কোনো ভয়; ক’খানা মেয়েকে বেছে আরো তিনজন নে, তাতেও না ভরে যদি ভরি কয় পণ নে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ঝুলন আমি   পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা              নিশীথবেলা।       সঘন বরষা, গগন আঁধার       হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার---       ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;       বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা              রাত্রিবেলা॥ওগো,   পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!              দে দোল্ দোল্।       পশ্চাত্‍‌ হতে হাহা ক'রে হাসি       মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,       যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।       আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল!              দে দোল্ দোল্।আজি   জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে              বুকের কাছে।       থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,       ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,       নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;       ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার ব্যাকুলিয়াছে              বুকের কাছে॥হায়,   এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে              শয়ন-'পরে।       ব্যথা পাছে লাগে---- দুখ পাছে জাগে       নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে       বাসরশয়ন করেছি রচন কুসুমথরে;       দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে              যতনভরে॥কত    সোহাগ করেছি চুম্বন করি নয়নপাতে              স্নেহের সাথে।       শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে       কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে,       গুঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোত্‍‌স্নারাতে;       যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে              স্নেহের সাথে॥শেষে   সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে              আবেশবশে।       পরশ করিলে জাগে না সে আর,       কুসুমের হার লাগে গুরুভার,       ঘুমে, জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে       বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে              আবেশবশে॥ঢালি   মধুরে মধুর বধূরে আমার হারাই বুঝি,              পাই নে খুঁজি।       বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,       ব্যাকুল নয়ন হেরি চারি পাশে       শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পুঁজি;       অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি              কাহারে খুঁজি॥তাই   ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা              রাত্রিবেলা       মরণদোলায় ধরি রশিগাছি       বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,       ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা;       আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা              নিশীথবেলা॥           দে দোল্ দোল্।            দে দোল্ দোল্।          এ মহাসাগরে তুফান তোল্       বধূরে আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল।       প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে প্রলয়রোল।       বক্ষশোণিতে উঠেছে আবার কী হিল্লোল!       ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার কী কল্লোল!          উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,          উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,       বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী--- মত্তরোল।              দে দোল্ দোল্।      আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর       আবরণরাশি করিয়া দে দূর,       করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-বসন খোল্।              দে দোল্ দোল্।      প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ       চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয়-লাজ,       বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে ভাবে বিভোল।              দে দোল্ দোল্।       স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটি পাগল।              দে দোল্ দোল্।রামপুর বোয়ালিয়া, ১৫ চৈত্র ১২৯৯ সূত্রঃ সোনার তরী টাকা সিকি আধুলিতে টাকা সিকি আধুলিতে ছিল তার হাত জোড়া; যে-সাহসে কিনেছিল পান্তোয়া সাত ঝোড়া। ফুঁকে দিয়ে কড়াকড়ি শেষে হেসে গড়াগড়ি; ফেলে দিতে হল সব– আলুভাতে পাত-জোড়া।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) টেরিটি বাজারে তার টেরিটি বাজারে তার সন্ধান পেনু– গোরা বোষ্টমবাবা, নাম নিল বেণু। শুদ্ধ নিয়ম-মতে মুরগিরে পালিয়া, গঙ্গাজলের যোগে রাঁধে তার কালিয়া– মুখে জল আসে তার চরে যবে ধেনু। বড়ি ক’রে কৌটায় বেচে পদরেণু।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ট্রাম্‌-কন্‌ডাক্টার ট্রাম্‌-কন্‌ডাক্টার, হুইসেলে ফুঁক দিয়ে শহরের বুক দিয়ে বারো-আনা বাকি তার মাথাটার তেলো যে, চিরুনির চালাচালি শেষ হয়ে এল যে। বিধাতার নিজ হাতে ঝাঁট-দেওয়া ফাঁকটার কিছু চুল দুপাশেতে ফুটপাত আছে পেতে, মাঝে বড়ো রাস্তাটা বুক জুড়ে টাকটার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ডাকাতের সাড়া পেয়ে ডাকাতের সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি ইজেরে চোক ঢেকে মুখ ঢেকে ঢাকা দিল নিজেরে। পেটে ছুরি লাগালো কি, প্রাণ তার ভাগালো কি, দেখতে পেল না কালু হল তার কী যে রে!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ডাকো ডাকো ডাকো আমারে ডাকো ডাকো ডাকো আমারে, তোমার স্নিগ্ধ শীতল গভীর পবিত্র আঁধারে। তুচ্ছ দিনের ক্লান্তি গ্লানি দিতেছে জীবন ধুলাতে টানি, সারাক্ষণের বাক্যমনের সহস্র বিকারে।মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে, তোমার নিবিড় নীরব উদার অনন্ত আঁধারে। নীরব রাত্রে হারাইয়া বাক্‌ বাহির আমার বাহিরে মিশাক, দেখা দিক মম অন্তরতম অখণ্ড আকারে।৭ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) ডুবারি যে সে কেবল ডুবারি যে সে কেবল ডুব দেয় তলে। যেজন পারের যাত্রী সেই ভেসে চলে।   (স্ফুলিঙ্গ) ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে পাকুড়তলির মাঠে                    বামুনমারা দিঘির ঘাটে                 আদিবিশ্ব-ঠাকুরমায়ের আস্‌মানি এক চেলা                           ঠিক দুক্ষুর বেলা                        বেগ্‌নি-সোনা দিক্‌-আঙিনার কোণে                    ব 'সে ব 'সে ভুঁইজোড়া এক চাটাই বোনে                           হলদে রঙের শুকনো ঘাসে ।                সেখান থেকে ঝাপসা স্মৃতির কানে আসে                    ঘুম-লাগা রোদ্‌দুরে                        ঝিম্‌ঝিমিনি সুরে —                    ‘ ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে ,                সুন্দরীকে বিয়ে দিলেম ডাকাতদলের মেলে । ”                       সুদূর কালের দারুণ ছড়াটিকে                স্পষ্ট করে দেখি নে আজ , ছবিটা তার ফিকে ।                    মনের মধ্যে বেঁধে না তার ছুরি ,                সময় তাহার ব্যথার মূল্য সব করেছে চুরি ।                    বিয়ের পথে ডাকাত এসে হরণ করলে মেয়ে ,                এই বারতা ধুলোয়-পড়া শুকনো পাতার চেয়ে                    উত্তাপহীন , ঝেঁটিয়ে-ফেলা আবর্জনার মতো ।                        দুঃসহ দিন দুঃখেতে বিক্ষত                    এই-কটা তার শব্দমাত্র দৈবে রইল বাকি ,                        আগুন-নেভা ছাইয়ের মতন ফাঁকি ।                           সেই মরা দিন কোন্‌ খবরের টানে                               পড়ল এসে সজীব বর্তমানে ।                তপ্ত হাওয়ার বাজপাখি আজ বারে বারে                               ছোঁ মেরে যায় ছড়াটারে ,                এলোমেলো ভাবনাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে                    টুক্‌রো করে ওড়ায় ধ্বনিটাকে ।                জাগা মনের কোন্‌ কুয়াশা স্বপ্নেতে যায় ব্যেপে , ধোঁয়াটে এক কম্বলেতে ঘুমকে ধরে চেপে ,                         রক্তে নাচে ছড়ার ছন্দে মিলে —                    ‘ ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে । '                জমিদারের বুড়ো হাতি হেলে দুলে চলেছে বাঁশতলায় ,                           ঢঙ্‌ঢঙিয়ে ঘন্টা দোলে গলায় ।               বিকেলবেলার চিকন আলোর আভাস লেগে                    ঘোলা রঙের আলস ভেঙে উঠি জেগে ।                        হঠাৎ দেখি , বুকে বাজে টন্‌টনানি                    পাঁজরগুলোর তলায় তলায় ব্যথা হানি ।                        চটকা ভাঙে যেন খোঁচা খেয়ে —                    কই আমাদের পাড়ার কালো মেয়ে —                ঝুড়ি ভ ' রে মুড়ি আনত , আনত পাকা জাম ,                           সামান্য তার দাম ,                        ঘরের গাছের আম আনত কাঁচামিঠা ,                    আনির স্থলে দিতেম তাকে চার-আনিটা ।                        ওই যে অন্ধ কলুবুড়ির কান্না শুনি —                     কদিন হল জানি নে কোন্‌ গোঁয়ার খুনি                           সমত্থ তার নাতনিটিকে                    কেড়ে নিয়ে ভেগেছে কোন্‌ দিকে ।                আজ সকালে শোনা গেল চৌকিদারের মুখে ,                    যৌবন তার দ ' লে গেছে , জীবন গেছে চুকে ।                        বুক-ফাটানো এমন খবর জড়ায়                           সেই সেকালের সামান্য এক ছড়ায় ।                    শাস্ত্রমানা আস্তিকতা ধুলোতে যায় উড়ে —                ‘ উপায় নাই রে , নাই প্রতিকার ' বাজে আকাশ জুড়ে ।                    অনেক কালের শব্দ আসে ছড়ার ছন্দে মিলে —                       ‘ ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে । '                 জমিদারের বুড়ো হাতি হেলে দুলে চলেছে বাঁশতলায় ,                            ঢঙ্‌ঢঙিয়ে ঘন্টা দোলে গলায় । তখন আমার আয়ুর তরণী শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ চৌধুরী কল্যাণীয়েষুতখন আমার আয়ুর তরণী যৌবনের ঘাট গেছে পেরিয়ে। যে-সব কাজ প্রবীণকে প্রাজ্ঞকে মানায় তাই নিয়ে পাকা করছিলেম পাকা চুলের মর্যাদা। এমন সময়ে আমাকে ডাক দিলে তোমার সবুজপত্রের আসরে। আমার প্রাণে এনে দিলে পিছুডাক, খবর দিলে নবীনের দরবারে আমার ছুটি মেলেনি। দ্বিধার মধ্যে মুখ ফিরালেম পেরিয়ে-আসা পিছনের দিকে। পর্যাপ্ত তারুণ্যের পরিপূর্ণ মূর্তি দেখা দিল আমার চোখের সম্মুখে। ভরা যৌবনের দিনেও যৌবনের সংবাদ এমন জোয়ারের বেগে এসে লাগেনি আমার লেখনীতে। আমার মন বুঝল যৌবনকে না ছাড়ালে যৌবনকে যায় না পাওয়া।; আজ এসেছি জীবনের শেষ ঘাটে। পুবের দিক থেকে হাওয়ায় আসে পিছুডাক, দাঁড়াই মুখ ফিরিয়ে। আজ সামনে দেখা দিল এ জন্মের সমস্তটা। যাকে ছেড়ে এলেম তাকেই নিচ্ছি চিনে। সরে এসে দেখছি আমার এতকালের সুখদুঃখের ঐ সংসার, আর তার সঙ্গে সংসারকে পেরিয়ে কোন্‌ নিরুদ্দিষ্ট। ঋষি-কবি প্রাণপুরুষকে বলেছেন-- "ভুবন সৃষ্টি করেছ তোমার এক অর্ধেককে দিয়ে,-- বাকি আধখানা কোথায় তা কে জানে।" সেই একটি-আধখানা আমার মধ্যে আজ ঠেকেছে আপন প্রান্তরেখায়; দুইদিকে প্রসারিত দেখি দুই বিপুল নিঃশব্দ, দুই বিরাট আধখানা,-- তারি মাঝখানে দাঁড়িয়ে শেষকথা ব'লে যাব-- দুঃখ পেয়েছি অনেক, কিন্তু ভালো লেগেছে, ভালোবেসেছি। তখন আমার বয়স ছিল সাত তখন আমার বয়স ছিল সাত। ভোরের বেলায় দেখতেম জানলা দিয়ে অন্ধকারের উপরকার ঢাকা খুলে আসছে, বেরিয়ে আসছে কোমল আলো নতুন-ফোটা কাঁটালিচাঁপার মতো। বিছানা ছেড়ে চলে যেতেম বাগানে কাক ডাকবার আগে, পাছে বঞ্চিত হই কম্পমান নারকেল শাখাগুলির মধ্যে সূর্যোদয়ের মঙ্গলাচরণে। তখন প্রতিদিনটি ছিল স্বতন্ত্র, ছিল নতুন। যে প্রভাত পূর্বদিকের সোনার ঘাট থেকে আলোতে স্নান করে আসত রক্তচন্দনের তিলক এঁকে ললাটে, সে আমার জীবনে আসত নতুন অতিথি, হাসত আমার মুখে চেয়ে।-- আগেকার দিনের কোনো চিহ্ন ছিল না তার উত্তরীয়ে। তারপরে বয়স হল কাজের দায় চাপল মাথার 'পরে। দিনের পরে দিন তখন হল ঠাসাঠাসি। তারা হারাল আপনার স্বতন্ত্র মর্যাদা। একদিনের চিন্তা আর-একদিনে হল প্রসারিত, একদিনের কাজ আর-একদিনে পাতল আসন। সেই একাকার-করা সময় বিস্তৃত হতে থাকে নতুন হতে থাকে না। একটানা বয়েস কেবলি বেড়ে ওঠে, ক্ষণে ক্ষণে শমে এসে চিরদিনের ধুয়োটির কাছে ফিরে ফিরে পায় না আপনাকে। আজ আমার প্রাচীনকে নতুন ক'রে নেবার দিন এসেছে। ওঝাকে ডেকেছি, ভূতকে দেবে নামিয়ে। গুণীর চিঠিখানির জন্যে প্রতিদিন বসব এই বাগানটিতে, তাঁর নতুন চিঠি ঘুম-ভাঙার জানালাটার কাছে। প্রভাত আসবে আমার নতুন পরিচয় নিতে, আকাশে অনিমেষ চক্ষু মেলে আমাকে শুধাবে "তুমি কে?" আজকের দিনের নাম খাটবে না কালকের দিনে। সৈন্যদলকে দেখে সেনাপতি, দেখে না সৈনিককে;-- দেখে আপন প্রয়োজন, দেখে না সত্য, দেখে না স্বতন্ত্র মানুষের বিধাতাকৃত আশ্চর্যরূপ। এতকাল তেমনি করে দেখেছি সৃষ্টিকে, বন্দীদলের মতো প্রয়োজনের এক শিকলে বাঁধা। তার সঙ্গে বাঁধা পড়েছি সেই বন্ধনে নিজে। আজ নেব মুক্তি। সামনে দেখছি সমুদ্র পেরিয়ে নতুন পার। তাকে জড়াতে যাব না এ পারের বোঝার সঙ্গে। এ নৌকোয় মাল নেব না কিছুই যাব একলা নতুন হয়ে নতুনের কাছে। তখন বয়স ছিল কাঁচা তখন বয়স ছিল কাঁচা; কতদিন মনে মনে এঁকেছি নিজের ছবি, বুনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার, জিন নেই, লাগাম নেই, ছুটেছি ডাকাত-হানা মাঠের মাঝখান দিয়ে ভরসন্ধ্যেবেলায়; ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো ধরণী যেন পিছু ডাকছে আঁচল দুলিয়ে। আকাশে সন্ধ্যার প্রথম তারা দূরে মাঠের সীমানায় দেখা যায় একটিমাত্র ব্যগ্র বিরহী আলো একটি কোন্‌ ঘরে নিদ্রাহীন প্রতীক্ষায়। যে ছিল ভাবীকালে আগে হতে মনের মধ্যে ফিরছিল তারি আবছায়া, যেমন ভাবী আলোর আভাস আসে ভোরের প্রথম কোকিল-ডাকা অন্ধকারে। তখন অনেকখানি সংসার ছিল অজানা, আধ্‌জানা। তাই অপরূপের রাঙা রঙটা মনের দিগন্ত রেখেছিলে রাঙিয়ে; আসন্ন ভালোবাসা এনেছিল অঘটন-ঘটনার স্বপ্ন। তখন ভালোবাসার যে কল্পরূপ ছিল মনে তার সঙ্গে মহাকাব্যযুগের দুঃসাহসের আনন্দ ছিল মিলিত। এখন অনেক খবর পেয়েছি জগতের, মনে ঠাওরেছি সংসারের অনেকটাই মার্কামারা খবরের মালখানা। মনের রসনা থেকে অজানার স্বাদ গেছে মরে, অনুভবে পাইনে ভালোবাসায় সম্ভবের মধ্যে নিয়তই অসম্ভব, জানার মধ্যে অজানা, কথার মধ্যে রূপকথা। ভুলেছি প্রিয়ার মধ্যে আছে সেই নারী, যে থাকে সাত সমুদ্রের পারে, সেই নারী আছে বুঝি মায়ার ঘুমে, যার জন্যে খুঁজতে হবে সোনার কাঠি। তত্ত্ব ও সৌন্দর্য শুনিয়াছি নিম্নে তব, হে বিশ্বপাথার, নাহি অন্ত মহামূল্য মণিমুকুতার। নিশিদিন দেশে দেশে পন্ডিত ডুবারি রত রহিয়াছে কত অন্বেষণে তারি। তাহে মোর নাহি লোভ মহাপারাবার! যে আলোক জ্বলিতেছে উপরে তোমার, যে রহস্য দুলিতেছে তব বক্ষতলে, যে মহিমা প্রসারিত তব নীল জলে, যে সংগীত উঠে তব নিয়ত আঘাতে, যে বিচিত্র লীলা তব মহানৃত্যে মাতে, এ জগতে কভু তার অন্ত যদি জানি, চিরদিনে কভু তাহে শ্রান্তি যদি মানি, তোমার অতলমাঝে ডুবিব তখন যেথায় রতন আছে অথবা মরণ।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) তত্ত্বজ্ঞানহীন যার খুশি রুদ্ধচক্ষে করো বসি ধ্যান, বিশ্ব সত্য কিম্বা ফাঁকি লভ সেই জ্ঞান। আমি ততক্ষণ বসি তৃপ্তিহীন চোখে বিশ্বেরে দেখিয়া লই দিনের আলোকে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) তনু ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি । এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী। শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি । চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল , সারানিশি সারাদিন ভ্রমর পিপাসী । ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল , মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি । পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস । মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয় কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস তনুঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয় । ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব বালা , পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে গন্ধ চলে যায়, হায়, বন্ধ নাহি থাকে, ফুল তারে মাথা নাড়ি ফিরে ফিরে ডাকে। বায়ু বলে, যাহা গেল সেই গন্ধ তব, যেটুকু না দিবে তারে গন্ধ নাহি কব।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) তপনের পানে চেয়ে তপনের পানে চেয়ে সাগরের ঢেউ বলে, "ওই পুতলিরে এনে দে-না কেউ।"   (স্ফুলিঙ্গ) তপোবন মনশ্চক্ষে হেরি যবে ভারত প্রাচীন পুরব পশ্চিম হতে উত্তর দক্ষিণ মহারণ্য দেখা দেয় মহাচ্ছায়া লয়ে। রাজা রাজ্য-অভিমান রাখি লোকালয়ে অশ্বরথ দূরে বাঁধি যায় নতশিরে গুরুর মন্ত্রণা লাগি— স্রোতস্বিনীতীরে মহর্ষি বসিয়া যোগাসনে, শিষ্যগণ বিরলে তরুর তলে করে অধ্যয়ন প্রশান্ত প্রভাতবায়ে, ঋষিকন্যাদলে পেলব যৌবন বাঁধি পরুষ বল্কলে আলবালে করিতেছে সলিল সেচন। প্রবেশিছে বনদ্বারে ত্যজি সিংহাসন মুকুটবিহীন রাজা পক্ককেশজালে ত্যাগের মহিমাজ্যোতি লয়ে শান্ত ভালে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) তব সিংহাসনের আসন হতে তব   সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে, মোরবিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে। একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান, তোমার কানে গেল সে সুর এলে তুমি নেমে, মোর   বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে।তোমার সভায় কত-না গান কতই আছেন গুণী; গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে। লাগল বিশ্বতানের মাঝে একটি করুণ সুর, হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে, মোর  বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে।২৭ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তব চিত্তগগনের তব চিত্তগগনের দূর দিক্‌সীমা বেদনার রাঙা মেঘে পেয়েছে মহিমা।   (স্ফুলিঙ্গ) তব জন্মদিবসের দানের উৎসবে তব জন্মদিবসের দানের উৎসবে বিচিত্র সজ্জিত আজি এই প্রভাতের উদয়-প্রাঙ্গণ। নবীনের দানসত্র কুসুমে পল্লবে অজস্র প্রচুর। প্রকৃতি পরীক্ষা করি দেখে ক্ষণে ক্ষণে আপন ভাণ্ডার, তোমারে সম্মুখে রাখি পেল সে সুযোগ। দাতা আর গ্রহীতার যে সংগম লাগি বিধাতার নিত্যই আগ্রহ আজি তা সার্থক হল, বিশ্বকবি তাহারি বিস্ময়ে তোমারে করেন আশীর্বাদ— তাঁর কবিত্বের তুমি সাক্ষীরূপে দিয়েছ দর্শন বৃষ্টিধৌত শ্রাবণের নির্মল আকাশে ।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) তবু তবু মনে রেখো, যদি দূরে যাই চলি, সেই পুরাতন প্রেম যদি এক কালে হয়ে আসে দূরস্মৃত কাহিনী কেবলি, ঢাকা পড়ে নব নব জীবনের জালে ।তবু মনে রেখো, যদি বড়ো কাছে থাকি, নূতন এ প্রেম যদি হয় পুরাতন, দেখে না দেখিতে পায় যদি শ্রান্ত আঁখি-- পিছনে পড়িয়া থাকি ছায়ার মতন ।তবু মনে রেখো, যদি তাহে মাঝে মাঝে উদাস বিষাদ-ভরে কাটে সন্ধ্যাবেলা, অথবা শারদ প্রাতে বাধা পড়ে কাজে, অথবা বসন্তরাতে থেমে যায় খেলা ।তবু মনে রেখো, যদি মনে প'ড়ে আর আঁখিপ্রান্তে দেখা নাহি দেয় অশ্রুধার ।(গ্রন্থঃ শ্রেষ্ঠ কবিতা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নির্বাচিত; প্রকাশক: মাটিগন্ধা, ২০১৮।) তম্বুরা কাঁধে নিয়ে তম্বুরা কাঁধে নিয়ে শর্মা বাণেশ্বর ভেবেছিল, তীর্থেই যাবে সে থানেশ্বর। হঠাৎ খেয়াল চাপে গাইয়ের কাজ নিতে– বরাবর গেল চলে একদম গাজনিতে, পাঠানের ভাব দেখে ভাঙিল গানের স্বর।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) তরঙ্গের বাণী সিন্ধু তরঙ্গের বাণী সিন্ধু চাহে বুঝাবারে। ফেনায়ে কেবলি লেখে, মুছে বারে বারে।   (স্ফুলিঙ্গ) তর্ক নারীকে দিবেন বিধি পুরুষের অন্তরে মিলায়ে                      সেই অভিপ্রায়ে                  রচিলেন সূক্ষ্মশিল্পকারুময়ী কায়া —              তারি সঙ্গে মিলালেন অঙ্গের অতীত কোন্‌ মায়া                          যারে নাহি যায় ধরা ,                       যাহা শুধু জাদুমন্ত্রে ভরা ,              যাহারে অন্তরতম হৃদয়ের অদৃশ্য আলোকে                  দেখা যায় ধ্যানাবিষ্ট চোখে ,                      ছন্দোজালে বাঁধে যার ছবি                  না-পাওয়া বেদনা দিয়ে কবি ।                      যার ছায়া সুরে খেলা করে                  চঞ্চল দিঘির জলে আলোর মতন থরথরে ।                      ‘ নিশ্চিত পেয়েছি ' ভেবে যারে              অবুঝ আঁকড়ি রাখে আপন ভোগের অধিকারে ,                  মাটির পাত্রটা নিয়ে বঞ্চিত সে অমৃতের স্বাদে ,                      ডুবায় সে ক্লান্তি-অবসাদে                           সোনার প্রদীপ শিখা-নেভা ।              দূর হতে অধরাকে পায় যে বা                  চরিতার্থ করে সে ' ই কাছের পাওয়ারে ,                      পূর্ণ করে তারে ।             নারীস্তব শুনালেম । ছিল মনে আশা —                  উচ্চতত্ত্বে-ভরা এই ভাষা              উৎসাহিত করে দেবে মন ললিতার ,                      পাব পুরস্কার ।                  হায় রে , দুর্গ্রহগুণে                          কাব্য শুনে                  ঝক্‌ঝকে হাসিখানি হেসে              কহিল সে , “ তোমার এ কবিত্বের শেষে                  বসিয়েছ মহোন্নত যে-কটা লাইন আগাগোড়া সত্যহীন ।                          ওরা সব-কটা                      বানানো কথার ঘটা ,              সদরেতে যত বড়ো অন্দরেতে ততখানি ফাঁকি ।                      জানি না কি —                  দূর হতে নিরামিষ সাত্ত্বিক মৃগয়া ,              নাই পুরুষের হাড়ে অমায়িক বিশুদ্ধ এ দয়া । ”                  আমি শুধালেম , “ আর , তোমাদের ?”              সে কহিল , “ আমাদের চারি দিকে শক্ত আছে ঘের                          পরশ-বাঁচানো ,                      সে তুমি নিশ্চিত জান । ”                   আমি শুধালেম , “ তার মানে ?”              সে কহিল , “ আমরা পুষি না মোহ প্রাণে ,                      কেবল বিশুদ্ধ ভালোবাসি । ”                          কহিলাম হাসি ,                  “ আমি যাহা বলেছিনু সে কথাটা সমস্ত বড়ো বটে ,              কিন্তু তবু লাগে না সে তোমার এ স্পর্ধার নিকটে ।                  মোহ কি কিছুই নেই রমণীর প্রেমে । ”                      সে কহিল একটুকু থেমে ,                  “ নেই বলিলেই হয় । এ কথা নিশ্চিত —                          জোর করে বলিবই —                  আমরা কাঙাল কভু নই । ”              আমি কহিলাম , “ ভদ্রে , তা হলে তো পুরুষের জিত । ”                          “ কেন শুনি ”                  মাথাটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলিল তরুণী ।              আমি কহিলাম , “ যদি প্রেম হয় অমৃতকলস ,                          মোহ তবে রসনার রস ।                  সে সুধার পূর্ণ স্বাদ থেকে              মোহহীন রমণীরে প্রবঞ্চিত বলো করেছে কে ।                  আনন্দিত হই দেখে তোমার লাবণ্যভরা কায়া ,              তাহার তো বারো-আনা আমারি অন্তরবাসী মায়া ।                          প্রেম আর মোহে একেবারে বিরুদ্ধ কি দোঁহে ।                           আকাশের আলো              বিপরীতে-ভাগ-করা সে কি সাদা কালো ।                  ওই আলো আপনার পূর্ণতারে চূর্ণ করে                           দিকে দিগন্তরে ,                             বর্ণে বর্ণে                      তৃণে শস্যে পুষ্পে পর্ণে ,                   পাখির পাখায় আর আকাশের নীলে ,              চোখ ভোলাবার মোহ মেলে দেয় সর্বত্র নিখিলে ।                  অভাব যেখানে এই মন-ভোলাবার                      সেইখানে সৃষ্টিকর্তা বিধাতার হার ।                          এমন লজ্জার কথা বলিতেও নাই —                   তোমরা ভোল না শুধু ভুলি আমরাই ।                          এই কথা স্পষ্ট দিনু কয়ে ,              সৃষ্টি কভু নাহি ঘটে একেবারে বিশুদ্ধেরে লয়ে ।                  পূর্ণতা আপন কেন্দ্রে স্তব্ধ হয়ে থাকে ,                      কারেও কোথাও নাহি ডাকে ।              অপূর্ণের সাথে দ্বন্দ্বে চাঞ্চল্যের শক্তি দেয় তারে ,                      রসে রূপে বিচিত্র আকারে ।                          এরে নাম দিয়ে মোহ                                       যে করে বিদ্রোহ                  এড়ায়ে নদীর টান সে চাহে নদীরে ,                           পড়ে থাকে তীরে ।                      পুরুষ সে ভাবের বিলাসী ,              মোহতরী বেয়ে তাই সুধাসাগরের প্রান্তে আসি                  আভাসে দেখিতে পায় পরপারে অরূপের মায়া                          অসীমের ছায়া ।              অমৃতের পাত্র তার ভরে ওঠে কানায় কানায়                          স্বল্প জানা ভূরি অজানায় । ”                     কোনো কথা নাহি ব ' লে              সুন্দরী ফিরায়ে মুখ দ্রুত গেল চলে । পরদিন বটের পাতায়              গুটিকত সদ্যফোটা বেলফুল রেখে গেল পায় ।                  বলে গেল , “ ক্ষমা করো , অবুঝের মতো                      মিছেমিছি বকেছিনু কত । ”                 ঢেলা আমি মেরেছিনু চৈত্রে-ফোটা কাঞ্চনের ডালে ,                  তারি প্রতিবাদে ফুল ঝরিল এ স্পর্ধিত কপালে ।                         নিয়ে এই বিবাদের দান                      এ বসন্তে চৈত্র মোর হল অবসান । তাই তোমার আনন্দ আমার পর তাই  তোমার আনন্দ আমার ‘পর তুমি  তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার     প্রেম হত যে মিছে। আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা, আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা, মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে তোমার     ইচ্ছা তরঙ্গিছে।তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে তবু         আমার হৃদয় লাগি ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে প্রভু        নিত্য আছ জাগি। তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে, তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে, মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায়       পূর্ণ প্রকাশিছে।জানিপুর। গোরাই, ২৮ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তারকার আত্মহত্যা জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধার সাগরে         ঝাঁপায়ে পড়িল এক তারা ,         একেবারে উন্মাদের পারা ।     চৌদিকে অসংখ্য তারা রহিল চাহিয়া            অবাক হইয়া --     এই - যে জ্যোতির বিন্দু আছিল তাদের মাঝে         মুহুর্তে সে গেল মিশাইয়া ।                   যে সমূদ্রতলে         মনোদুঃখে আত্মঘাতী         চির - নির্বাপিত - ভাতি         শত মৃত তারকার         মৃতদেহ রয়েছে শয়ান         সেথায় সে করেছে পয়ান ।         কেন গো , কী হয়েছিল তার ।         একরার শুধালে না কেহ --         কী লাগি সে তেয়াগিল দেহ ।                      যদি কেহ শুধাইত         আমি জানি কী যে সে কহিত ।              যতদিন বেঁচে ছিল         আমি জানি কী তারে দহিত ।          সে কেবল হাসির যন্ত্রণা ,                 আর কিছু না !     জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড ঢাকিতে আঁধার হৃদি             অনিবার হাসিতেই রহে ,              যত হাসে ততই সে দহে ।     তেমনি , তেমনি তারে হাসির অনল                    দারুণ উজ্জল --      দহিত , দহিত তারে , দহিত , কেবল ।     জ্যোতির্ময় তারাপূর্ণ বিজন তেয়াগি     তাই আজ ছুটেছে সে নিতান্ত মনের ক্লেশে     আঁধারের তারাহীন বিজনের লাগি ।             কেন গো তোমরা যত তারা     উপহাস করি তারে হাসিছ অমন ধারা ।          তোমাদের হয় নি তো ক্ষতি ,     যেমন আছিল আগে তেমনি রয়েছে জ্যোতি ।           সে কি কভু ভেবেছিল মনে -           ( এত গর্ব আছিল কি তার ) ।     আপনারে নিবাইয়া তোমাদের করিবে আঁধার ।           গেল , গেল , ডুবে গেল , তারা এক ডুবে গেল ,              আঁধারসাগরে --              গভীর নিশীথে              অতল আকাশে ।     হৃদয় , হৃদয় মোর , সাধ কি রে যায় তোর     ঘুমাইতে ওই মৃত তারাটির পাশে                 ওই আঁধারসাগরে                 এই গভীর নিশীথে                ওই অতল আকাশে । তারা ও আঁখি কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস , বহিয়া আনিতেছিল ফুলের সুবাস । রাত্রি হ ' ল , আঁধারের ঘনীভূত ছায়ে পাখিগুলি একে একে পড়িল ঘুমায়ে । প্রফুল্ল বসন্ত ছিল ঘেরি চারি ধার আছিল প্রফুল্লতর যৌবন তোমার , তারকা হাসিতেছিল আকাশের মেয়ে , ও আঁখি হাসিতেছিল তাহাদের চেয়ে । দুজনে কহিতেছিনু কথা কানে কানে , হৃদয় গাহিতেছিল মিষ্টতম তানে । রজনী দেখিনু অতি পবিত্র বিমল , ও মুখ দেখিনু অতি সুন্দর উজ্জ্বল । সোনার তারকাদের ডেকে ধীরে ধীরে , কহিনু , “ সমস্ত স্বর্গ ঢালো এর শিরে! ” বলিনু আঁখিরে তব “ ওগো আঁখি-তারা , ঢালো গো আমার ' পরে প্রণয়ের ধারা । ”                     — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা) তারা তোমার নামে বাটের মাঝে তারা    তোমার নামে বাটের মাঝে মাসুল লয় যে ধরি। দেখি শেষে ঘাটে এসে নাইকো পারের কড়ি। তারা তোমার কাজের তানে নাশ করে গো ধনে প্রাণে, সামান্য যা আছে আমার লয় তা অপহরি।আজকে আমি চিনেছি সেই ছদ্মবেশী-দলে। তারাও আমায় চিনেছে হায় শক্তিবিহীন ব’লে। গোপন মূর্তি ছেড়েছে তাই, লজ্জা শরম আর কিছু নাই, দাঁড়িয়েছে আজ মাথা তুলে পথ অবরোধ করি।বোলপুর, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তারা দিনের বেলা এসেছিল তারা দিনের বেলা এসেছিল আমার ঘরে, বলেছিল, একটি পাশে রইব প’ড়ে। বলেছিল, দেবতা সেবায় আমরা হব তোমার সহায়– যা কিছু পাই প্রসাদ লব পূজার পরে।এমনি করে দরিদ্র ক্ষীণ মলিন বেশে সংকোচেতে একটি কোণে রইল এসে। রাতে দেখি প্রবল হয়ে পশে আমার দেবালয়ে, মলিন হাতে পূজার বলি হরণ করে।বোলপুর, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তারাগুলি সারারাতি তারাগুলি সারারাতি কানে কানে কয়। সেই কথা ফুলে ফুলে ফুটে বনময়।   (স্ফুলিঙ্গ) তাল গাছ তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায় কোথা পাবে পাখা সে ।তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে গোল গোল পাতাতে ইচ্ছাটি মেলে তার মনে মনে ভাবে বুঝি ডানা এই, উড়ে যেতে মানা নেই বাসাখানি ফেলে তার । সারাদিন ঝরঝর থত্থর কাঁপে পাতা পত্তর ওড়ে যেন ভাবে ও, মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে তারাদের এড়িয়ে যেন কোথা যাবে ও।তারপরে হাওয়া যেই নেমে যায় পাতা কাঁপা থেমে যায়, ফেরে তার মনটি যেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার, ভালো লাগে আরবার পৃথিবীর কোণটি। তালগাছ তালগাছ        এক পায়ে দাঁড়িয়ে                       সব গাছ ছাড়িয়ে                             উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ,      কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়                       একেবারে উড়ে যায়;                             কোথা পাবে পাখা সে? তাই তো সে    ঠিক তার মাথাতে                       গোল গোল পাতাতে                             ইচ্ছাটি মেলে তার,-- মনে মনে       ভাবে, বুঝি ডানা এই,                       উড়ে যেতে মানা নেই                             বাসাখানি ফেলে তার। সারাদিন       ঝরঝর থত্থর                       কাঁপে পাতা-পত্তর,                             ওড়ে যেন ভাবে ও, মনে মনে       আকাশেতে বেড়িয়ে                       তারাদের এড়িয়ে                             যেন কোথা যাবে ও। তার পরে       হাওয়া যেই নেমে যায়,                       পাতা-কাঁপা থেমে যায়,                             ফেরে তার মনটি যেই ভাবে,     মা যে হয় মাটি তার                       ভালো লাগে আরবার                             পৃথিবীর কোণটি। তিনকড়ি তোল্‌পাড়িয়ে উঠল পাড়া তিনকড়ি। তোল্‌পাড়িয়ে উঠল পাড়া, তবু কর্তা দেন না সাড়া! জাগুন শিগ্‌গির জাগুন্‌। কর্তা। এলারামের ঘড়িটা যে চুপ রয়েছে, কই সে বাজে– তিনকড়ি। ঘড়ি পরে বাজবে, এখন ঘরে লাগল আগুন। কর্তা। অসময়ে জাগলে পরে ভীষণ আমার মাথা ধরে– তিনকড়ি। জানলাটা ঐ উঠল জ্বলে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ভাগুন। কর্তা। বড্ড জ্বালায় তিনকড়িটা– তিনকড়ি। জ্বলে যে ছাই হল ভিটা, ফুটপাথে ঐ বাকি ঘুমটা শেষ করতে লাগুন।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) তীর্থযাত্রী কন্‌কনে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা—    ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ,        রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,           একেবারে দুর্জয় শীত।ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো           শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।        মাঝে মাঝে মন যায় বিগড়েযখন মনে পড়ে পাহাড়তলিতে বসন্তমঞ্জিল, তার চাতাল,    আর শর্বতের পেয়ালা হাতে রেশমি সাজে যুবতীর দল।এ দিকে উটওয়ালারা গাল পাড়ে, গন্‌গন্‌ করে রাগে,        ছুটে পালায় মদ আর মেয়ের খোঁজে।    মশাল যায় নিভে, মাথা রাখবার জায়গা জোটে না।        নগরে যাই, সেখানে বৈরিতা; নগরীতে সন্দেহ।           গ্রামগুলো নোংরা, তারা চড়া দাম হাঁকে।কঠিন মুশকিল।           শেষে ঠাওরালেম চলব সারারাত,               মাঝে মাঝে নেব ঝিমিয়ে           আর কানে কানে কেউ বা গান গাবে—                   এ সমস্তই পাগলামি।                    ভোরের দিকে এলেম, যেখানে মিঠে শীত সেই পাহাড়ের খাদে;সেখানে বরফ-সীমার নীচেটা ভিজে-ভিজে, ঘন গাছ-গাছালির গন্ধ।নদী চলেছে ছুটে, জলযন্ত্রের চাকা আঁধারকে মারছে চাপড়।দিগন্তের গায়ে তিনটে গাছ দাঁড়িয়ে,বুড়ো সাদা ঘোড়াটা মাঠ বেয়ে দৌড় দিয়েছে।পৌঁছলেম শরাবখানায়, তার কপাটের মাথায় আঙুরলতা।দুজন মানুষ খোলা দরোজার কাছে পাশা খেলছে টাকার লোভে,        পা দিয়ে ঠেলছে শূন্য মদের কুপো।           কোনো খবরই মিলল না সেখানে,               চললেম আরো আগে।                   যেতে যেতে সন্ধে হল;        সময় পেরিয়ে যায় যায়, তখন খুঁজে পেলেম জায়গাটা—           বলা যেতে পারে ব্যাপারটা তৃপ্তিজনক।     মনে পড়ে এ-সব ঘটেছে অনেক কাল আগে,           আবার ঘটে যেন এই ইচ্ছে, কিন্তু লিখে রাখো—এই লিখে রাখো—এত দূরে যে আমাদের টেনে নিয়েছিল        সে কি জন্মের সন্ধানে না মৃত্যুর।           জন্ম একটা হয়েছিল বটে—               প্রমাণ পেয়েছি, সন্দেহ নেই।এর আগে তো জন্মও দেখেছি, মৃত্যুও—        মনে ভাবতেম তারা এক নয়।কিন্তু এই-যে জন্ম এ বড়ো কঠোর—দারুণ এর যাতনা, মৃত্যুর মতো, আমাদের মৃত্যুর মতোই।এলেম ফিরে আপন আপন দেশে, এই আমাদের রাজত্বগুলোয়    আর কিন্তু স্বস্তি নেই সেই পুরানো বিধিবিধানেযার মধ্যে আছে সব অনাত্মীয় আপন দেবদেবী আঁকড়ে ধ’রে।           আর-একবার মরতে পারলে আমি বাঁচি। তুমি তুমি             কোন্ কাননের ফুল ,           তুমি           কোন্ গগনের তারা !      তোমায়         কোথায় দেখেছি           যেন            কোন্ স্বপনের পারা !                     কবে তুমি গেয়েছিলে ,                     আঁখির পানে চেয়েছিলে                        ভুলে গিয়েছি ।      শুধু           মনের মধ্যে জেগে আছে ,                        ঐ নয়নের তারা ।।      তুমি             কথা কয়ো না ,           তুমি           চেয়ে চলে যাও ।      এই              চাঁদের আলোতে           তুমি        হেসে গলে যাও ।      আমি            ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে                       চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে ,      তোমার         আঁখির মতন দুটি তারা                       ঢালুক কিরণ - ধারা ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত তপস্যার মতো। স্তব্ধ ভূমানন্দ যেন রোমাঞ্চিত নিবিড় নিগূঢ়-ভাবের পথশূন্য তোমার নির্জনে, নিষ্কলঙ্ক নীহারের অভ্রভেদী আত্মবিসর্জনে। তোমার সহস্র শৃঙ্গ বাহু তুলি কহিছে নীরবে ঋষির আশ্বাসবাণী, “শুন শুন বিশ্বজন সবে, জেনেছি, জেনেছি আমি।’ যে ওঙ্কার আনন্দ-আলোতে উঠেছিল ভারতের বিরাট গভীর বক্ষ হতে আদি-অন্ত-বিহীনের অখণ্ড অমৃতলোক-পানে, সে আজি উঠিছে বাজি, গিরি, তব বিপুল পাষাণে। একদিন এ ভারতে বনে বনে হোমাগ্নি-আহুতি ভাষাহারা মহাবার্তা প্রকাশিতে করেছে আকূতি, সেই বহ্নিবাণী আজি অচল প্রস্তরশিখারূপে শৃঙ্গে শৃঙ্গে কোন্‌ মন্ত্র উচ্ছ্বাসিছে মেঘধুম্রস্তূপে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) তুমি আমার আপন তুমি আমার আপন, তুমি আছ আমার কাছে, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও। তোমার মাঝে মোর জীবনের সব আনন্দ আছে, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।আমায়             দাও সুধাময় সুর, আমার             বাণী করো সুমধুর; আমার             প্রিয়তম তুমি, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।এই          নিখিল আকাশ ধরা এই যে      তোমায় দিয়ে ভরা, আমার      হৃদয় হতে এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।দুখি      জেনেই কাছে আস, ছোটো   বলেই ভালোবাস, আমার   ছোটো মুখে এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।মাঘ, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি একটি ফুলের মতো মণি তুমি একটি ফুলের মতো মণি এম্‌নি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর! মুখের পানে তাকাই যখনি ব্যথায় কেন কাঁদায় অন্তর! শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি পড়ি এই আশীষ মন্তর, বিধি তোরে রাখুন চিরকাল এমনি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর!Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) তুমি এবার আমায় লহো তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো। এবার তুমি ফিরো না হে– হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো। যে দিন গেছে তোমা বিনা তারে আর ফিরে চাহি না, যাক সে ধুলাতে। এখন  তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন  জাগি অহরহ।কী আবেশে কিসের কথায় ফিরেছি হে যথায় তথায় পথে প্রান্তরে, এবার  বুকের কাছে ও মুখ রেখে তোমার আপন বাণী কহো।কত কলুষ কত ফাঁকি এখনো যে আছে বাকি মনের গোপনে, আমায় তার লাগি আর ফিরায়ো না, তারে আগুন দিয়ে দহো।২৮ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি। সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে, সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে, পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে, বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।মনে করি অমনি সুরে গাই, কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই। কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে; হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে; আমায় তুমি ফেলেছ কোন্‌ ফাঁদে চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!১০ ভাদ্র- রাত্রি, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি গল্প জমাতে পার শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত প্রিয়বরেষুতুমি গল্প জমাতে পার। বসো তোমার কেদারায়, ধীরে ধীরে টান দাও গুড়গুড়িতে, উছলে ওঠে আলাপ তোমার ভিতর থেকে হালকা ভাষায়, যেন নিরাসক্ত ঔৎসুক্যে, তোমার কৌতুকে-ফেনিল মনের কৌতূহলের উৎস থেকে। ঘুরেছ নানা জায়গায়, নানা কাজে, আপন দেশে, অন্য দেশে। মনটা মেলে রেখেছিলে চারদিকে, চোখটা ছিলে খুলে। মানুষের যে-পরিচয় তার আপন সহজভাবে, যেমন-তেমন অখ্যাত ব্যাপারের ধারায় দিনে দিনে যা গাঁথা হয়ে ওঠে, সামান্য হলেও যাতে আছে সত্যের ছাপ, অকিঞ্চিৎকর হলেও যার আছে বিশেষত্ব, সেটা এড়ায়নি তোমার দৃষ্টি। সেইটে দেখাই সহজ নয়, পণ্ডিতের দেখা সহজ। শুনেছি তোমার পাঠ ছিল সায়ান্সে, শুনেছি শাস্ত্রও পড়েছ সংস্কৃত ভাষায়; পার্সি জবানিও জানা আছে। গিয়েছ সমুদ্রপারে, ভারতে রাজসরকারের ইম্পীরিয়ল রথযাত্রার লম্বা দড়িতে "হেঁইয়ো' ব'লে দিতে হয়েছে টান। অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি মগজে বোঝাই হয়েছে কম নয়, পুঁথির থেকেও কিছু, মানুষের প্রাণযাত্রা থেকেও বিস্তর। তবু সব-কিছু নিয়ে তোমার যে পরিচয় মুখ্য সে তোমার আলাপ-পরিচয়ে। তুমি গল্প জমাতে পার। তাই যখন-তখন দেখি, তোমার ঘরে মানুষ লেগেই আছে, কেউ তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো কেউ বয়সে বেশি। গল্প করতে গিয়ে মাস্টারি কর না, এই তোমার বাহাদুরি। তুমি মানুষকে জান, মানুষকে জানাও, জীবলীলার মানুষকে। একে নাম দিতে পারি সাহিত্য,-- সব-কিছুর কাছে-থাকা। তুমি জমা করেছ তোমার মনে নানা লোকের সঙ্গ, সেইটে দিতে পার সবাইকে অনায়াসে,-- সেইটেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের তকমা পরিয়ে পণ্ডিত-পেয়াদা সাজাও না থমকিয়ে দিতে ভালোমানুষকে। তোমার জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারটা পূর্ণ আছে যথাস্থানেই। সেটা বৈঠকখানাকে কোণ-ঠেসা করে রাখেনি। যেখানে আসন পাত' গল্পের ভোজে সেখানে ক্ষুধিতের পাতের থেকে ঠেকিয়ে রাখ লাইব্রেরি ল্যাবরেটরিকে। একটিমাত্র কারণ,-- মানুষের 'পরে আছে তোমার দরদ,-- যে-মানুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে সুখদুঃখের দুর্গম পথে, বাঁধা পড়ে নানা বন্ধনে ইচ্ছায় অনিচ্ছায়,-- যে-মানুষ বাঁচে, যে-মানুষ মরে অদৃষ্টের গোলকধাঁদার পাকে। সে-মানুষ রাজাই হোক ভিখিরিই হোক তার কথা শুনতে মানুষের অসীম আগ্রহ। তার কথা যে-লোক পারে বলতে সহজেই সে-ই পারে, অন্যে পারে না। বিশেষ এই হাল-আমলে। আজ মানুষের জানাশোনা তার দেখাশোনাকে দিয়েছে আপাদমস্তক ঢেকে। একটু ধাক্কা পেলে তার মুখে নানা কথা অনর্গল ছিটকে পড়ে-- নানা সমস্যা, নানা তর্ক, একান্ত মানুষের আসল কথাটা যায় খাটো হয়ে। আজ বিপুল হল সমস্যা, বিচিত্র হল তর্ক, দুর্ভেদ্য হল সংশয়,-- আজকের দিনে সেইজন্যেই এত করে বন্ধুকে খুঁজি, মানুষের সহজ বন্ধুকে যে গল্প জমাতে পারে। এ দুর্দিনে মাস্টারমশায়কেও অত্যন্ত দরকার। তাঁর জন্যে ক্লাস আছে পাড়ায় পাড়ায়-- প্রায়মারি, সেকেণ্ডারি। গল্পের মজলিস জোটে দৈবাৎ। সমুদ্রের ওপারে একদিন ওরা গল্পের আসর খুলেছিল, তখন ছিল অবকাশ; ওরা ছেলেদের কাছে শুনিয়েছিল, রবিন্‌সন্‌ ক্রুসো, সকল বয়সের মানুষের কাছে ডন্‌ কুইক্‌সোট্‌। দুরূহ ভাবনার আঁধি লাগল দিকে দিকে; লেক্‌চারের বান ডেকে এল, জলে স্থলে কাদায় পাঁকে গেল ঘুলিয়ে। অগত্যা অধ্যাপকেরা জানিয়ে দিলে একেই বলে গল্প। বন্ধু, দুঃখ জানাতে এলুম তোমার বৈঠকে। আজকাল-এর ছাত্রেরা দেয় আজকাল-এর দোহাই। আজকাল-এর মুখরতায় তাদের অটুট বিশ্বাস। হায় রে আজকাল কত ডুবে গেল কালের মহাপ্লাবনে মোটাদামের মার্কা-মারা পসরা নিয়ে। যা চিরকাল-এর তা আজ যদি বা ঢাকা পড়ে কাল উঠবে জেগে। তখন মানুষ আবার বলবে খুশি হয়ে,-- গল্প বলো। তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে। এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে। এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে, এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে, এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে। তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত, এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত, এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে। এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে, এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে; এসো সকল-কর্ম-অবসানে। তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।অগ্রহায়ণ, ১৩১৪? (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি প্রভাতের শুকতারা তুমি প্রভাতের শুকতারা আপন পরিচয় পালটিয়ে দিয়ে কখনো বা তুমি দেখা দাও গোধূলির দেহলিতে, এই কথা বলে জ্যোতিষী। সূর্যাস্তবেলায় মিলনের দিগন্তে রক্ত-অবগুণ্ঠনের নিচে শুভদৃষ্টির প্রদীপ তোমার জ্বাল শাহানার সুরে। সকালবেলায় বিরহের আকাশে শূন্য বাসরঘরের খোলা দ্বারে ভৈরবীর তানে লাগাও বৈরাগ্যের মূর্ছনা। সুপ্তিসমুদ্রের এপারে ওপারে, চিরজীবন, সুখদুঃখের আলোয় অন্ধকারে মনের মধ্যে দিয়েছ আলোকবিন্দুর স্বাক্ষর। যখন নিভৃতপুলকে রোমাঞ্চ লেগেছে মনে গোপনে রেখেছ তার 'পরে সুরলোকের সম্মতি, ইন্দ্রাণীর মালার একটি পাপড়ি, তোমাকে এমনি করেই জেনেছি আমাদের সকালসন্ধ্যার সোহাগিনী। পণ্ডিত তোমাকে বলে শুক্রগ্রহ; বলে, আপন সুদীর্ঘ কক্ষে তুমি বৃহৎ, তুমি বেগবান, তুমি মহিমান্বিত; সূর্যবন্দনার প্রদক্ষিণপথে তুমি পৃথিবীর সহযাত্রী, রবিরশ্মিগ্রথিত দিনরত্নের মালা দুলছে তোমার কণ্ঠে। যে মহাযুগের বিপুল ক্ষেত্রে তোমার নিগূঢ় জগদ্ব্যাপার সেখানে তুমি স্বতন্ত্র, সেখানে সুদূর, সেখানে লক্ষকোটিবৎসর আপনার জনহীন রহস্যে তুমি অবগুণ্ঠিত। আজ আসন্ন রজনীর প্রান্তে কবিচিত্তে যখন জাগিয়ে তুলেছ নিঃশব্দ শান্তিবাণী। সেই মুহূর্তেই আমাদের অজ্ঞাত ঋতুপর্যায়ের আবর্তন তোমার জলে স্থলে বাষ্পমণ্ডলীতে রচনা করছে সৃষ্টিবৈচিত্র৻। তোমার সেই একেশ্বর যজ্ঞে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আমাদের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ। হে পণ্ডিতের গ্রহ, তুমি জ্যোতিষের সত্য সে-কথা মানবই, সে সত্যের প্রমাণ আছে গণিতে। কিন্তু এও সত্য, তার চেয়েও সত্য যেখানে তুমি আমাদেরি আপন শুকতারা, সন্ধ্যাতারা, যেখানে তুমি ছোটো, তুমি সুন্দর, যেখানে আমাদের হেমন্তের শিশিরবিন্দুর সঙ্গে তোমার তুলনা, যেখানে শরতের শিউলি ফুলের উপমা তুমি, যেখানে কালে কালে প্রভাতে মানব-পথিককে নিঃশব্দে সংকেত করেছ জীবনযাত্রার পথের মুখে, সন্ধ্যায় ফিরে ডেকেছ চরম বিশ্রামে। তুমি বসন্তের পাখি বনের ছায়ারে তুমি বসন্তের পাখি বনের ছায়ারে করো ভাষা দান। আকাশ তোমার কণ্ঠে চাহে গাহিবারে আপনারি গান। তুমি বাঁধছ নূতন বাসা তুমি বাঁধছ নূতন বাসা, আমার ভাঙছে ভিত। তুমি খুঁজছ লড়াই, আমার মিটেছে হার-জিত। তুমি বাঁধছ সেতারে তার, থামছি সমে এসে। চক্ররেখা পূর্ণ হল আরম্ভে আর শেষে।   (স্ফুলিঙ্গ) তুমি যখন গান গাহিতে বল তুমি যখন গান গাহিতে বল             গর্ব আমার ভ’রে উঠে বুকে; দুই আঁখি মোর করে ছলছল,             নিমেষহারা চেয়ে তোমার মুখে। কঠিন কটু যা আছে মোর প্রাণে গলিতে চায় অমৃতময় গানে, সব সাধনা আরাধনা মম             উড়িতে চায় পাখির মত সুখে।                        তৃপ্ত তুমি আমার গীতরাগে,                         ভালো লাগে তোমার ভালো লাগে,                         জানি আমি এই গানেরই বলে                                 বসি গিয়ে তোমারি সম্মুখে।                        মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই,                         গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই,                         সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে,                                 বন্ধু ব’লে ডাকি মোর প্রভুকে।(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি যে কাজ করছ আমায় তুমি যে কাজ করছ, আমায় সেই কাজে কি লাগাবে না। কাজের দিনে আমায় তুমি আপন হাতে জাগাবে না? ভালোমন্দ ওঠাপড়ায় বিশ্বশালার ভাঙাগড়ায় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যেন তোমার সাথে হয় গো চেনা।ভেবেছিলেম বিজন ছায়ায় নাই যেখানে আনাগোনা, সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায় সেথায় হবে জানাশোনা। অন্ধকারে একা একা সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা, ডাকো তোমার হাটের মাঝে চলছে যেথায় বেচাকেনা।৬ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তুমি যে তুমিই, ওগো তুমি যে তুমিই, ওগো সেই তব ঋণ আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধি চিরদিন। তৃতীয় সর্গ কত দেশ দেশান্তরে ভ্রমিল সে কবি! তুষারস্তম্ভিত গিরি করিল লঙ্ঘন, সুতীক্ষ্নকণ্টকময় অরণ্যের বুক মাড়াইয়া গেল চলি রক্তময় পদে। কিন্তু বিহঙ্গের গান, নির্ঝরের ধ্বনি, পারে না জুড়াতে আর কবির হৃদয়। বিহগ, নির্ঝর-ধ্বনি প্রকৃতির গীত-- মনের যে ভাগে তার প্রতিধ্বনি হয় সে মনের তন্ত্রী যেন হোয়েছে বিকল। একাকী যাহাই আগে দেখিত সে কবি তাহাই লাগিত তার কেমন সুন্দর, এখন কবির সেই একি হোলো দশা-- যে প্রকৃতি-শোভা-মাঝে নলিনী না থাকে ঠেকে তা শূন্যের মত কবির নয়নে, নাইক দেবতা যেন মন্দিরমাঝারে। বালার মুখের জ্যোতি করিত বর্দ্ধন প্রকৃতির রূপচ্ছটা দ্বিগুণ করিয়া; সে না হোলে অমবস্যানিশির মতন সমস্ত জগৎ হোত বিষণ্ণ আঁধার।                 -- জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ধরা, নীরব রজনী। অরণ্যের অন্ধকারময় গাছগুলি মাথার উপরে মাখি রজত জোছনা, শাখায় শাখায় ঘন করি জড়াজড়ি, কেমন গম্ভীরভাবে রোয়েছে দাঁড়ায়ে। হেথায় ঝোপের মাঝে প্রচ্ছন্ন আঁধার, হোথায় সরসীবক্ষে প্রশান্ত জোছনা। নভপ্রতিবিম্বশোভী ঘুমন্ত সরসী চন্দ্র তারকার স্বপ্ন দেখিতেছে যেন! লীলাময় প্রবাহিণী চলেছে ছুটিয়া, লীলাভঙ্গ বুকে তার পাদপের ছায়া ভেঙ্গে চুরে কত শত ধরিছে মূরতি। গাইছে রজনী কিবা নীরব সঙ্গীত! কেমন নীরব বন নিস্তব্ধ গম্ভীর-- শুধু দূর-শৃঙ্গ হোতে ঝরিছে নির্ঝর, শুধু একপাশ দিয়া সঙ্কুচিত অতি তটিনীটি সর সর যেতেছে চলিয়া। অধীর বসন্তবায়ু মাঝে মাঝে শুধু ঝরঝরি কাঁপাইছে গাছের পল্লব। এহেন নিস্তব্ধ রাত্রে কত বার আমি গম্ভীর অরণ্যে একা কোরেছি ভ্রমণ। স্নিগ্ধ রাত্রে গাছপালা ঝিমাইছে যেন, ছায়া তার পোড়ে আছে হেথায় হোথায়। দেখিয়াছি নীরবতা যত কথা কয় প্রাণের মরম-তলে, এত কেহ নয়। দেখি যবে অতি শান্ত জোছনায় মজি নীরবে সমস্ত ধরা রয়েছে ঘুমায়ে, নীরবে পরশে দেহ বসন্তের বায়, জানি না কি এক ভাবে প্রাণের ভিতর উচ্ছ্বসিয়া উথলিয়া উঠে গো কেমন! কি যেন হারায়ে গেছে খুঁজিয়া না পাই, কি কথা ভুলিয়া যেন গিয়েছি সহসা, বলা হয় নাই যেন প্রাণের কি কথা, প্রকাশ করিতে গিয়া পাই না তা খুঁজি! কে আছে এমন যার এ হেন নিশীথে, পুরাণো সুখের স্মৃতি উঠে নি উথলি! কে আছে এমন যার জীবনের পথে এমন একটি সুখ যায় নি হারায়ে, যে হারা-সুখের তরে দিবা নিশি তার হৃদয়ের এক দিক শূন্য হোয়ে আছে। এমন নীরব-রাত্রে সে কি গো কখনো ফেলে নাই মর্ম্মভেদী একটি নিশ্বাস? কর স্থানে আজ রাত্রে নিশীথপ্রদীপে উঠিছে প্রমোদধ্বনি বিলাসীর গৃহে। মুহূর্ত্ত ভাবে নি তারা আজ নিশীথেই কত চিত্ত পুড়িতেছে প্রচ্ছন্ন অনলে। কত শত হতভাগা আজ নিশীথেই হারায়ে জন্মের মত জীবনের সুখ মর্ম্মভেদী যন্ত্রণায় হইয়া অধীর একেলাই হা হা করি বেড়ায় ভ্রমিয়া!                -- ঝোপে-ঝাপে ঢাকা ওই অরণ্যকুটীর। বিষণ্ণ নলিনীবালা শূন্য নেত্র মেলি চাঁদের মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া! জানি না কেমন কোরে বালার বুকের মাঝে সহসা কেমন ধারা লেগেছে আঘাত-- আর সে গায় না গান, বসন্ত ঋতুর অন্তে পাপিয়ার কণ্ঠ যেন হোয়েছে নীরব। আর সে লইয়া বীণা বাজায় না ধীরে ধীরে, আর সে ভ্রমে না বালা কাননে কাননে। বিজন কুটীরে শুধু মরণশয্যার 'পরে একেলা আপন মনে রয়েছে শুইয়া। যে বালা মুহূর্ত্তকাল স্থির না থাকিত কভু, শিখরে নির্ঝরে বনে করিত ভ্রমণ-- কখনো তুলিত ফুল, কখনো গাঁথিত মালা, কখনো গাইত গান, বাজাইত বীণা-- সে আজ এমন শান্ত, এমন নীরব স্থির! এমন বিষণ্ণ শীর্ণ সে প্রফুল্ল মুখ! এক দিন, দুই দিন, যেতেছে কাটিয়া ক্রমে-- মরণের পদশব্দ গণিছে সে যেন! আর কোন সাধ নাই, বাসনা রয়েছে শুধু কবিরে দেখিয়া যেন হয় গো মরণ। এ দিকে পৃথিবী ভ্রমি সহিয়া ঝটিকা কত ফিরিয়া আসিছে কবি কুটীরের পানে, মধ্যাহ্নের রৌদ্রে যথা জ্বলিয়া পুড়িয়া পাখী সন্ধ্যায় কুলায়ে তার আইসে ফিরিয়া। বহুদিন পরে কবি পদার্পিল বনভূমে, বৃক্ষলতা সবি তার পরিচিত সখা! তেমনি সকলি আছে, তেমনি গাইছে পাখী, তেমনি বহিছে বায়ু ঝর ঝর করি। অধীরে চলিল কবি কুটীরের পানে-- দুয়ারের কাছে গিয়া দুয়ারে আঘাত দিয়া ডাকিল অধীর স্বরে, নলিনী! নলিনী! কিছু নাই সাড়া শব্দ, দিল না উত্তর কেহ, প্রতিধ্বনি শুধু তারে করিল বিদ্রূপ। কুটীরে কেহই নাই, শূন্য তা রয়েছে পড়ি-- বেষ্টিত বিতন্ত্রী বীণা লূতাতন্তুজালে। ভ্রমিল আকুল কবি কাননে কাননে, ডাকিয়া সমুচ্চ স্বরে, নলিনী! নলিনী! মিলিয়া কবির স্বরে বনদেবী উচ্চস্বরে ডাকিল কাতরে আহা, নলিনী! নলিনী! কেহই দিল না সাড়া, শুধু সে শব্দ শুনি সুপ্ত হরিণেরা ত্রস্ত উঠিল জাগিয়া। অবশেষে গিরিশৃঙ্গে উঠিল কাতর কবি, নলিনীর সাথে যেথা থাকিত বসিয়া। দেখিল সে গিরি-শৃঙ্গে, শীতল তুষার-'পরে, নলিনী ঘুমায়ে আছে ম্লানমুখচ্ছবি। কঠোর তুষারে তার এলায়ে পড়েছে কেশ, খসিয়া পড়েছে পাশে শিথিল আঁচল। বিশাল নয়ন তার অর্দ্ধনিমীলিত, হাত দুটি ঢাকা আছে অনাবৃত বুকে। একটি হরিণশিশু খেলা করিবার তরে কভু বা অঞ্চল ধরি টানিতেছে তার, কভু শৃঙ্গ দুটি দিয়া সুধীরে দিতেছে ঠেলি, কভু বা অবাক্ নেত্রে রহিছে চাহিয়া! তবু নলিনীর ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গিছে না, নীরবে নিস্পন্দ হোয়ে রয়েছে ভূতলে। দূর হোতে কবি তারে দেখিয়া কহিল উচ্চে, "নলিনী, এয়েছি আমি দেখ্সে বালিকা।" তবুও নলিনী বালা না দিয়া উত্তর শীতল তুষার-'পরে রহিল ঘুমায়ে। কবি সে শিখর-'পরে করি আরোহণ শীতল অধর তার করিল চুম্বন-- শিহরিয়া চমকিয়া দেখিল সে কবি না নড়ে হৃদয় তার, না পড়ে নিশ্বাস। দেখিল না, ভাবিল না, কহিল না কিছু, যেমন চাহিয়া ছিল রহিল চাহিয়া। নিদারুণ কি যেন কি দেখিছে তরাসে নয়ন হইয়া গেল অচল পাষাণ। কতক্ষণে কবি তবে পাইল চেতন, দেখিল তুষারশুভ্র নলিনীর দেহ হৃদয়জীবনহীন জড় দেহ তার অনুপম সৌন্দর্য্যের কুসুম-আলয়, হৃদয়ের মরমের আদরের ধন-- তৃণ কাষ্ঠ সম ভূমে যায় গড়াগড়ি! বুকে তারে তুলে লয়ে ডাকিল "নলিনী", হৃদয়ে রাখিয়া তারে পাগলের মত কবি কহিল কাতর স্বরে "নলিনী" "নলিনী"! স্পন্দহীন, রক্তহীন অধর তাহার অধীর হইয়া ঘন করিল চুম্বন।                -- তার পর দিন হোতে সে বনে কবিরে আর পেলে না দেখিতে কেহ, গেছে সে কোথায়! ঢাকিল নলিনীদেহ তুষারসমাধি-- ক্রমে সে কুটীরখানি কোথা ভেঙ্গে চুরে গেল, ক্রমে সে কানন হোলো গ্রাম লোকালয়, সে কাননে--কবির সে সাধের কাননে অতীতের পদচিহ্ন রহিল না আর। তোমাদের জানি তবু আমরা যে দূরের মানুষ তোমাদের জানি, তবু তোমরা যে দূরের মানুষ। তোমাদের আবেষ্টন, চলাফেরা, চারি দিকে ঢেউ ওঠা-পড়া, সবই চেনা জগতের তবু তার আমন্ত্রণে দ্বিধা-- সবা হতে আমি দূরে, তোমাদের নাড়ীর যে ভাষা সে আমার আপন প্রাণের, বিষণ্ন বিস্ময় লাগে যবে দেখি স্পর্শ তার সসংকোচ পরিচয় নিয়ে আনে যেন প্রবাসীর পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণ আত্মীয়তা। আমি কিছু দিতে চাই, তা না হলে জীবনে জীবনে মিল হবে কী করিয়া-- আসি না নিশ্চিত পদক্ষেপে-- ভয় হয়, রিক্ত পাত্র বুঝি, বুঝি তার রসস্বাদ হারায়েছে পূর্বপরিচয়, বুঝি আদানে-প্রদানে রবে না সম্মান। তাই আশঙ্কার এ দূরত্ব হতে এ নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা-মাঝে তোমাদের ডেকে বলি, যে জীবনলক্ষ্মী মোরে সাজায়েছে নব নব সাজে তার সাথে বিচ্ছেদের দিনে নিভায়ে উৎসবদীপ দারিদ্র৻ের লাঞ্ছনায় ঘটাবে না কভু অসম্মান, অলংকার খুলে নেবে,একে একে বর্ণসজ্জাহীন উত্তরীয়ে ঢেকে দিবে, ললাটে আঁকিবে শুভ্র তিলকের রেখা; তোমরাও যোগ দিয়ো জীবেনের পূর্ণ ঘট নিয়ে সে অন্তিম অনুষ্ঠানে, হয়তো শুনিবে দূর হতে দিগন্তের পরপারে শুভশঙ্খধ্বনি। তোমায় আমার প্রভু করে রাখি তোমায় আমার প্রভু করে রাখি আমার আমি সেইটুকু থাক্‌ বাকি। তোমায় আমি হেরি সকল দিশি, সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি, তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি, ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি– তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি কেবল আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি। তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে, রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি– তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর, যবে আমার জনম হবে ভোর। চলে যাব নবজীবন-লোকে, নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে, নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে পরব তব নবমিলন-ডোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই, বারে বারে নূতন লীলা তাই। আবার তুমি জানি নে কোন্‌ বেশে পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে, আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে, লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।১০ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব লোকের মাঝে; মোর আঁকা পটে দেখেছে তোমায় অনেকে অনেক সাজে। কত জনে এসে মোরে ডেকে কয় “কে গো সে’, শুধায় তব পরিচয়– “কে গো সে।’ তখন কী কই, নাহি আসে বাণী, আমি শুধু বলি,”কী জানি! কী জানি!’ তুমি শুনে হাস, তারা দুষে মোরে কী দোষে।তোমার অনেক কাহিনী গাহিয়াছি আমি অনেক গানে। গোপন বারতা লুকায়ে রাখিতে পারি নি আপন প্রাণে। কত জন মোরে ডাকিয়া কয়েছে, “যা গাহিছ তার অর্থ রয়েছে কিছু কি।’ তখন কী কই, নাহি আসে বাণী, আমি শুধু বলি,”অর্থ কী জানি!’ তারা হেসে যায়,তুমি হাস বসে মুচুকি।তোমায় জানি না চিনি না এ কথা বলো তো কেমনে বলি। খনে খনে তুমি উঁকি মারি চাও, খনে খনে যাও ছলি। জ্যোৎস্নানিশীথে পূর্ণ শশীতে দেখেছি তোমার ঘোমটা খসিতে, আঁখির পলকে পেয়েছি তোমায় লখিতে। বক্ষ সহসা উঠিয়াছে দুলি, অকারণে আঁখি উঠেছে আকুলি, বুঝেছি হৃদয়ে ফেলেছ চরণ চকিতে।তোমায় খনে খনে আমি বাঁধিতে চেয়েছি কথার ডোরে। চিরকাল-তরে গানের সুরেতে রাখিতে চেয়েছি ধরে। সোনার ছন্দে পাতিয়াছি ফাঁদ, বাঁশিতে ভরেছি কোমল নিখাদ, তবু সংশয় জাগে ধরা তুমি দিলে কি! কাজ নাই,তুমি যা খুশি তা করো– ধরা না’ই দাও মোর মন হরো, চিনি বা না চিনি প্রাণ উঠে যেন পুলকি।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি তবুও দয়া করে চরণে নিয়ো টানি। আমি যা গড়ে তুলে আরামে থাকি ভুলে সুখের উপাসনা করি গো ফলে ফুলে– সে ধুলা-খেলাঘরে রেখো না ঘৃণাভরে, জাগায়ো দয়া করে বহ্নি-শেল হানি।সত্য মুদে আছে দ্বিধার মাঝখানে, তাহারে তুমি ছাড়া ফুটাতে কে বা জানে। মৃত্যু ভেদ করি’ অমৃত পড়ে ঝরি’, অতল দীনতার শূন্য উঠে ভরি’ পতন-ব্যথা মাঝে চেতনা আসি বাজে, বিরোধ কোলাহলে গভীর তব বাণী।২২ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমার প্রেম যে বইতে পারি এমন সাধ্য নাই তোমার প্রেম যে বইতে পারি এমন সাধ্য নাই। এ সংসারে তোমার আমার মাঝখানেতে তাই কৃপা করে রেখেছ  নাথ অনেক ব্যবধান– দুঃখসুখের অনেক বেড়া ধনজনমান।আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে আভাসে দাও দেখা– কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রবির মৃদু রেখা। শক্তি যারে দাও বহিতে অসীম প্রেমের ভার একেবারে সকল পর্দা ঘুচায়ে দাও তার।না রাখ তার ঘরের আড়াল না রাখ তার ধন, পথে এনে নিঃশেষে তায় কর অকিঞ্চন। না থাকে তার মান অপমান, লজ্জা শরম ভয়, একলা তুমি সমস্ত তার বিশ্বভুবনময়।এমন করে মুখোমুখি সামনে তোমার থাকা, কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ পূর্ণ করে রাখা, এ দয়া যে পেয়েছে তার লোভের সীমা নাই– সকল লোভে সে সরিয়ে ফেলে তোমায় দিতে ঠাঁই।তিনধরিয়া, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমার বীণায় কত তার আছে তোমার বীণায় কত তার আছে কত-না সুরে, আমি তার সাথে আমার তারটি দিব গো জুড়ে। তার পর হতে প্রভাতে সাঁঝে তব বিচিত্র রাগিণীমাঝে আমারো হৃদয় রণিয়া রণিয়া বাজিবে তবে। তোমার সুরেতে আমার পরান জড়ায়ে রবে।তোমার তারায় মোর আশাদীপ রাখিব জ্বালি। তোমার কুসুমে আমার বাসনা দিব গো ঢালি। তার পর হতে নিশীথে প্রাতে তব বিচিত্র শোভার সাথে আমারো হৃদয় জ্বলিবে ফুটিবে, দুলিবে সুখে– মোর পরানের ছায়াটি পড়িবে তোমার মুখে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) তোমার মঙ্গলকার্য তোমার মঙ্গলকার্য তব ভূত্য-পানে অযাচিত যে প্রেমেরে ডাক দিয়ে আনে, যে অচিন্ত্য শক্তি দেয়, যে অক্লান্ত প্রাণ, সে তাহার প্রাপ্য নহে— সে তোমারি দান। তোমার সঙ্গে আমার মিলন তোমার সঙ্গে আমার মিলন বাধল কাছেই এসে। তাকিয়ে ছিলেম আসন মেলে— অনেক দূরের থেকে এলে, আঙিনাতে বাড়িয়ে চরণ ফিরলে কঠিন হেসে— তীরের হাওয়ায় তরী উধাও পারের নিরুদ্দেশে। তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না– দিনে দিনে উঠছে জমে কতই দেনা। সবাই তোমায় সভার বেশে প্রণাম করে গেল এসে, মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই মান রহে না।কী জানাব চিত্তবেদন, বোবা হয়ে গেছে যে মন, তোমার কাছে কোনো কথাই আর কহে না। ফিরায়ো না এবার তারে লও গো অপমানের পারে, করো তোমার চরণতলে চির-কেনা।বোলপুর, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমার সৃষ্টির পথ কবির শেষ রচনা ৩০শে জুলাই ১৯৪১ সকাল সাড়ে নটা...তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী ! মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে । এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বরে করেছ চিহ্নিত ; তার তরে রাখোনি গোপন রাত্রি । তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায় সে যে তার অন্তরের পথ, সে যে চির স্বচ্ছ, সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চির সমুজ্বল । বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু এই নিয়ে তাহার গৌরব । লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত । সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে । কিছুতে পারেনা তারে প্রবঞ্চিতে, শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা-জালে, হে ছলনাময়ী। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে। এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত; তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি। তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায় সে যে তার অন্তরের পথ, সে যে চিরস্বচ্ছ , সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চিরসমুজ্জল। বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু, এই নিয়ে তাহার গৌরব। লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত। সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে, শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ডারে। অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার। জননী গো, গাঁথব তোমার গলার মুক্তাহার। চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে মালা হয়ে জড়িয়ে আছে, তোমার বুকে শোভা পাবে আমার দুখের অলংকার।ধন ধান্য তোমারি ধন, দিতে চাও তো দিয়ো আমায়, নিতে চাও তো লও। দুঃখ আমার ঘরের জিনিস, খাঁটি রতন তুই তো চিনিস– তোর প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস, এ মোর অহংকার।১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) তোমারে পাছে সহজে বুঝি তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল, বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল। বুঝি গো আমি বুঝি গো তব ছলনা, যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই– দশের দলে টানি গো পাছে বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই। বুঝি গো আমি বুঝি গো তব ছলনা, যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।সবার চেয়ে অধিক চাহ তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও– হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও। বুঝেছি আমি বুঝেছি তব ছলনা, সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) তোমারে হেরিয়া চোখে তোমারে হেরিয়া চোখে, মনে পড়ে শুধু, এই মুখখানি দেখেছি স্বপ্নলোকে। তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি, ওই যে আসে, আসে, আসে। যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী সে যে আসে, আসে, আসে। গেয়েছি গান যখন যত আপন-মনে খ্যাপার মতো সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী- সে যে আসে, আসে, আসে।কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে সে যে আসে, আসে, আসে। কত শ্রাবণ অন্ধকারে মেঘের রথে সে যে আসে, আসে, আসে।দুখের পরে পরম দুখে, তারি চরণ বাজে বুকে, সুখে কখন্‌ বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি। সে যে আসে, আসে, আসে।কলিকাতা, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ থাকে সে কাহালগাঁয় থাকে সে কাহালগাঁয়; কলুটোলা আফিসে রোজ আসে দশটায় এক্কায় চাপি সে। ঠিক যেই মোড়ে এসে লাগাম গিয়েছে ফেঁসে, দেরি হয়ে গেল ব’লে ভয়ে মরে কাঁপি সে– ঘোড়াটার লেজ ধ’রে করে দাপাদাপি সে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে এসো তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে। তাই তোমার মাধুর্যসুধা ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা, জলে স্থলে দাও যে ধরা কত আকার লয়ে।বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে আপনি তুমি ছোটো হয়ে এসো হৃদয়ে। আমিও কি আপন হাতে করব ছোটো বিশ্বনাথে। জানাব আর জানব তোমায় ক্ষুদ্র পরিচয়ে?শিলাইদহ, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে– নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে। তোমায় দিতে পূজার ডালি বেড়িয়ে পড়ে সকল কালি, পরান আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে।এতদিন তো ছিল না মোর কোনো ব্যথা, সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল মলিনতা। আজ ওই শুভ্র কোলের তরে ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে দিয়ো না গো, দিয়ো না আর ধুলায় শুতে।কলিকাতা, ২৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দাঁয়েদের গিন্নিটি দাঁয়েদের গিন্নিটি কিপ্‌টে সে অতিশয়, পান থেকে চুন গেলে কিছুতে না ক্ষতি সয়। কাঁচকলা-খোষা দিয়ে পচা মহুয়ার ঘিয়ে ছেঁচকি বানিয়ে আনে– সে কেবল পতি সয়; একটু করলে “উহুঁ’ যদি এক রতি সয়!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও। আমার দিকে ও মুখ ফিরাও। পাশে থেকে চিনতে নারি, কোন্‌ দিকে যে কী নেহারি, তুমি আমার হৃদ্‌বিহারী হৃদয়পানে হাসিয়া চাও।বলো আমায় বলো কথা, গায়ে আমার পরশ করো। দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় তুমি তুলে ধরো। যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে– হাসি মিছে,কান্না মিছে, সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দাড়ীশ্বরকে মানত ক’রে দাড়ীশ্বরকে মানত ক’রে গোঁপ-গাঁ গেল হাবল– স্বপ্নে শেয়ালকাঁটা-পাখি গালে মারল খাবল।দেখতে দেখতে ছাড়ায় দাড়ি ভদ্র সীমার মাত্রা– নাপিত খুঁজতে করল হাবল রাওলপিণ্ডি যাত্রা। উর্‌দু ভাষায় হাজাম এসে বক্‌ল আবল-তাবল।তিরিশটা খুর একে একে ভাঙল যখন পটাৎ কামারটুলি থেকে নাপিত আনল তখন হঠাৎ যা হাতে পায় খাঁড়া বঁটি কোদাল করাত সাবল।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দান .         কাঁকন-জোড়া এনে দিলেম যবে,         ভেবেছিলেম, হয়তো খুশি হবে। তুলে তুমি নিলে হাতের 'পরে, ঘুরিয়ে তুমি দেখলে ক্ষণেক-তরে, পরেছিলে হয়তো গিয়ে ঘরে -         হয়তো বা তা রেখেছিলে খুলে। এলে যেদিন বিদায় নেবার রাতে কাঁকনদুটি দেখি নাই তো হাতে,                  হয়তো এলে ভুলে।।        দেয় যে জনা কী দশা পায় তাকে,         দেওয়ার কথা কেনই মনে রাখে! পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে শাখা আবার চায় কি তাহার পানে। বাতাসেতে-উড়িয়ে-দেওয়া গানে         তারে কি আর স্মরণ করে পাখি? দিতে যারা জানে এ সংসারে এমন ক'রেই তারা দিতে পারে                  কিছু না রয় বাকি।।        নিতে যারা জানে তারাই জানে,         বোঝে তারা মূল্যটি কোনখানে। তারাই জানে, বুকের রত্নহারে সেই মণিটি কজন দিতে পারে হৃদয় দিতে দেখিতে হয় যারে -         যে পায় তারে সে পায় অবহেলে। পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে সহজ ব'লেই সহজ তাহা নহে,                  দৈবে তারে মেলে।।        ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে         দেবার মতো কী আছে এই ভবে। কোন্ খনিতে কোন্ ধনভান্ডারে, সাগর-তলে কিম্বা সাগর-পারে, যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে         যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে! তাই তো বলি যা-কিছু মোর দান গ্রহণ করেই করবে মূল্যবান                  আপন হৃদয় দিয়ে।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) দান (২) ভেবেছিলাম চেয়ে নেব ,                 চাই নি সাহস করে—            সন্ধেবেলায় যে মালাটি            গলায় ছিলে পরে—     আমি        চাই নি সাহস করে ।            ভেবেছিলাম সকাল হলে            যখন পারে যাবে চলে            ছিন্ন মালা শয্যাতলে                 রইবে বুঝি পড়ে ।            তাই আমি কাঙালের মতো                 এসেছিলেম ভোরে—     তবু         চাই নি সাহস করে ।            এ তো মালা নয় গো , এ যে                 তোমার তরবারি ।            জ্বলে ওঠে আগুন যেন ,                 বজ্র - হেন ভারী—    এ যে         তোমার তরবারি ।            তরুণ আলো জানলা বেয়ে            পড়ল তোমার শয়ন ছেয়ে ,            ভোরের পাখি শুধায় গেয়ে                 ‘ কী পেলি তুই নারী ' ।            নয় এ মালা , নয় এ থালা ,                 গন্ধজলের ঝারি ,     এ যে        ভীষণ তরবারি ।            তাই তো আমি ভাবি বসে                 এ কী তোমার দান ।            কোথায় এরে লুকিয়ে রাখি                  নাই যে হেন স্থান ।     ওগো ,       এ কী তোমার দান ।  শক্তিহীনা মরি লাজে ,            এ ভূষণ কি আমায় সাজে ।            রাখতে গেলে বুকের মাঝে                 ব্যথা যে পায় প্রাণ ।            তবু আমি বইব বুকে                 এই বেদনার মান—     নিয়ে         তোমারি এই দান ।            আজকে হতে জগৎমাঝে                ছাড়ব আমি ভয় ,            আজ হতে মোর সকল কাজে                তোমার হবে জয়—     আমি       ছাড়ব সকল ভয় ।            মরণকে মোর দোসর করে            রেখে গেছ আমার ঘরে ,            আমি তারে বরণ ক'রে                   রাখব পরান - ময় ।            তোমার তরবারি আমার                 করবে বাঁধন ক্ষয় ।     আমি        ছাড়ব সকল ভয় ।           তোমার লাগি অঙ্গ ভরি                 করব না আর সাজ ।           নাই - বা তুমি ফিরে এলে                 ওগো হৃদয়রাজ ।     আমি        করব না আর সাজ ।           ধুলায় বসে তোমার তরে           কাঁদব না আর একলা ঘরে ,           তোমার লাগি ঘরে - পরে                 মানব না আর লাজ ।           তোমার তরবারি আমায়                 সাজিয়ে দিল আজ ,     আমি       করব না আর সাজ । দানরিক্ত জলহারা মেঘখানি বরষার শেষে পড়ে আছে গগনের এক কোণ ঘেঁষে। বর্ষাপূর্ণ সরোবর তারি দশা দেখে সারাদিন ঝিকিমিকি হাসে থেকে থেকে। কহে, ওটা লক্ষ্মীছাড়া, চালচুলাহীন, নিজেরে নিঃশেষ করি কোথায় বিলীন। আমি দেখো চিরকাল থাকি জলভরা, সারবান, সুগম্ভীর, নাই নড়াচড়া। মেঘ কহে, ওহে বাপু, কোরো না গরব, তোমার পূর্ণতা সে তো আমারি গৌরব।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) দামামা ওই বাজে দামামা ওই বাজে, দিন-বদলের পালা এল ঝোড়ো যুগের মাঝে। শুরু হবে নির্মম এক নূতন অধ্যায়, নইলে কেন এত অপব্যয়-- আসছে নেমে নিষ্ঠুর অন্যায়, অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরই ভূত ভবিষ্যতের দূত। কৃপণতার পাথর-ঠেলা বিষম বন্যাধারা লোপ করে দেয় নিঃস্ব মাটির নিষ্ফলা চেহারা। জমে-ওঠা মৃত বালির স্তর ভাসিয়ে নিয়ে ভর্তি করে লুপ্তির গহ্বর পলিমাটির ঘটায় অবকাশ, মরুকে সে মেরে মেরেই গজিয়ে তোলে ঘাস। দুব্‌লা খেতের পুরানো সব পুনরুক্তি যত অর্থহারা হয় সে বোবার মতো। অন্তরেতে মৃত বাইরে তবু মরে না যে অন্ন ঘরে করেছে সঞ্চিত-- ওদের ঘিরে ছুটে আসে অপব্যয়ের ঝড়, ভাঁড়ারে ঝাঁপ ভেঙে ফেলে, চালে ওড়ায় খড়। অপঘাতের ধাক্কা এসে পড়ে ওদের ঘাড়ে, জাগায় হাড়ে হাড়ে। হঠাৎ অপমৃত্যুর সংকেতে নূতন ফসল চাষের তরে আনবে নূতন খেতে। শেষ পরীক্ষা ঘটাবে-- দুর্দৈবে-- জীর্ণ যুগে সঞ্চয়েতে কী যাবে,কী রইবে। পালিশ-করা জীর্ণতাকে চিনতে হবে আজি, দামামা তাই ওই উঠেছে বাজি। দামিনীর আঁখি কিবা দামিনীর আঁখি কিবা ধরে জ্বল’ জ্বল’ বিভা কার তরে জ্বলিতেছে কেবা তাহা জানিবে? চারি দিকে খর ধার বাণ ছুটিতেছে তার কার-‘পরে লক্ষ্য তার কেবা অনুমানিবে? তার চেয়ে নলিনীর আঁখিপানে চাহিতে কত ভালো লাগে তাহা কে পারিবে কহিতে? সদা তার আঁখি দুটি নিচু পাতে আছে ফুটি, সে আঁখি দেখে নি কেহ উঁচু পানে তুলিতে! যদি বা সে ভুলে কভু চায় কারো আননে, সহসা লাগিয়া জ্যোতি সে-জন বিস্ময়ে অতি চমকিয়া উঠে যেন স্বরগের কিরণে! ও আমার নলিনী লো, লাজমাখা নলিনী, অনেকেরি আঁখি-‘পরে সৌন্দর্য বিরাজ করে, তোর আঁখি-‘পরে প্রেম নলিনী লো নলিনী! দামিনীর দেহে রয় বসন কনকময় সে বসন অপসরী সৃজিয়াছে যতনে, যে গঠন যেই স্থান প্রকৃতি করেছে দান সে-সকল ফেলিয়াছে ঢাকিয়া সে বসনে। নলিনী বসন পানে দেখ দেখি চাহিয়া তার চেয়ে কত ভালো কে পারিবে কহিয়া? শিথিল অঞ্চল তার ওই দেখো চারি ধার স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে, যেথা যে গঠন আছে পূর্ণ ভাবে বিকাশিছে যেখানে যা উঁচু নিচু প্রকৃতির বিধানে! ও আমার নলিনী লো, সুকোমলা নলিনী মধুর রূপের ভাস তাই প্রকৃতির বাস, সেই বাস তোর দেহে নলিনী লো নলিনী! দামিনীর মুখ-আগে সদা রসিকতা জাগে, চারি ধারে জ্বলিতেছে খরধার বাণ সে, কিন্তু কে বলিতে পারে শুধু সে কি ধাঁধিবারে, নহে তা কি খর ধারে বিঁধিবারি মানসে? কিন্তু নলিনীর মনে মাথা রাখি সঙ্গোপনে ঘুমায়ে রয়েছে কিবা প্রণয়ের দেবতা। সুকোমল সে শয্যার অতি যা কঠিন ধার দলিত গোলাপ তাও আর কিছু নহে তা! ও আমার নলিনী লো, বিনয়িনী নলিনী রসিকতা তীব্র অতি নাই তার এত জ্যোতি তোমার নয়নে যত নলিনী লো নলিনী।Thomas Moore (অনুবাদ কবিতা) দায়মোচন চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,      এ কথা বলিতে চাও বোলো। এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -      তার পরে যদি তুমি ভোল মনে করাব না আমি শপথ তোমার, আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার - যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,      আবার আসিতে হয় এসো। সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,      তবু ভালোবাস যদি বেসো।।বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,      পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা। অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি      যাত্রায় নাহি দিব বাধা। আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি, ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী, তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন      আমার স্মৃতির আঁখিজলে - আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন      রবে তব বিস্মৃতিতলে।।দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে      যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে, হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -      নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে। মার্জনা কর যদি পাব তবে বল, করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল - সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,      দিবে লাজ তার বেশি দিলে। দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই      দুঃখের মূল্য না মিলে।।দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার      বরমাল্যের অপমানে। যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,      চেয়ে নিতে সে কভু না জানে। প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি, সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি - যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,      যা পাই নি বড়ো সেই নয়। চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন      চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) দিক্‌বালা দূর আকাশের পথ উঠিছে জলদরথ, নিমেন চাহি দেখে কবি ধরণী নিদ্রিত। অস্ফুট চিত্রের মত নদ নদী পরবত, পৃথিবীর পটে যেন রয়েছে চিত্রিত! সমস্ত পৃথিবী ধরি একটি মুঠায় অনন্ত সুনীল সিন্ধু সুধীরে লুটায়। হাত ধরাধরি করি দিক্‌বালাগণ দাঁড়ায়ে সাগরতীরে ছবির মতন। কেহ বা জলদময় মাখায়ে জোছানা। নীল দিগন্তের কোলে পাতিছে বিছানা। মেখের শয্যায় কেহ ছড়ায়ে কুন্তল নীরবে ঘুমাইতেছে নিদ্রায় বিহ্বল। সাগরতরঙ্গ তার চরণে মিলায়, লইয়া শিথিল কেশ পবন খেলায়। কোন কোন দিক্‌বালা বসি কুতূহলে আকাশের চিত্র আঁকে সাগরের জলে। আঁকিল জলদমালা চন্দ্রগ্রহ তারা, রঞ্জিল সাগর দিয়া জোছনার ধারা। পাপিয়ার ধ্বনি শুনি কেহ হাসিমুখে প্রতিধ্বনিরমণীরে জাগায় কৌতুকে! শুকতারা প্রভাতের ললাটে ফুটিল, পূরবের দিক্‌দেবী জাগিয়া উঠিল। লোহিত কমলকরে পূরবের দ্বার খুলিয়া, সিন্দূর দিল সীমন্তে উষার। মাজি দিয়া উদয়ের কনকসোপান, তপনের সারথিরে করিল আহ্বান। সাগর-ঊর্ম্মির শিরে সোনার চরণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেচে গেল দিক্‌বালাগণ। পূরবদিগন্ত-কোলে জলদ ঙ্গছায়ে ধরণীর মুখ হ’তে আঁধার মুছায়ে, বিমল শিশিরজলে ধুইয়া চরণ, নিবিড় কুন্তলে মাখি কনককিরণ, সোনার মেঘের মত আকাশের তলে, কনককমলসম মানসের জলে ভাসিতে লাগিল যত দিক্‌-বালাগণে— উলসিত তনুখানি প্রভাতপবনে। ওই হিমগিরি-’পরে কোন দিক্‌বালা রঞ্জিছে কনককরে নীহারিকামালা! নিভৃতে সরসীজলে করিতেছে স্নান, ভাসিছে কমলবনে কমলবয়ান। তীরে উঠি মালা গাঁথি শিশিরের জলে পরিছে তুষারশুভ্র সুকুমার গলে। ওদিকে দেখেছ ওই সাহারা-প্রান্তরে, মধ্যে দিক্‌দেবী শুভ্র বালুকার ‘পরে। অঙ্গ হতে ছুটিতেছে জ্বলন্ত কিরণ, চাহিতে মুখের পানে ঝলসে নয়ন। আঁকিছে বালুকাপুঞ্জে শত শত রবি, আঁকিছে দিগন্তপটে মরীচিকা-ছবি। অন্য দিকে কাশ্মীরের উপত্যকা-তলে পরি শত বরণের ফুলমালা গলে, শত বিহঙ্গের গান শুনিতে শুনিতে, সরসীলহরীমালা গুনিতে গুনিতে, এলায়ে কোমল তনু কমলকাননে আলসে দিকের বালা মগন স্বপনে। ওই হোথা দিক্‌দেবী বসিয়া হরষে ঘুরায় ঋতুর চক্র মৃদুল পরশে। ফুরায়ে গিয়েছে এবে শীতসমীরণ, বসন্ত পৃথিবীতলে অর্পিবে চরণ। পাখীরে গাহিতে কহি অরণ্যের গান মলয়ের সমীরণে করিয়া আহ্বান বনদেবীদের কাছে কাননে কাননে কহিল ফুটাতে ফুলদিক‍্‌দেবীগণে— বহিল মলয়বায়ু কাননে ফিরিয়া, পাখীরা গাহিল গান কানন ভরিয়া। ফুলবালা-সাথে আসি বনদেবীগণ ধীরে দিক‍্‌দেবীদের বন্দিল চরণ। দিগন্তে ওই বৃষ্টিহারা দিগন্তে ওই বৃষ্টিহারা মেঘের দলে জুটি লিখে দিল—আজ ভুবনে আকাশভরা ছুটি।   (স্ফুলিঙ্গ) দিগন্তে পথিক মেঘ দিগন্তে পথিক মেঘ চলে যেতে যেতে ছায়া দিয়ে নামটুকু লেখে আকাশেতে।   (স্ফুলিঙ্গ) দিগ্‌বলয়ে দিগ্‌বলয়ে নব শশীলেখা টুকরো যেন মানিকের রেখা।   (স্ফুলিঙ্গ) দিদি নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা পশ্চিমি মজুর। তাহাদেরি ছোটো মেয়ে ঘাটে করে আনাগোনা; কত ঘষামাজা ঘটি বাটি থালা লয়ে, আসে ধেয়ে ধেয়ে দিবসে শতেক বার; পিত্তলকঙ্কণ পিতলের থালি-’পরে বাজে ঠন্‌ ঠন্‌; বড়ো ব্যস্ত সারাদিন, তারি ছোটো ভাই, নেড়ামাথা, কাদামাখা, গায়ে বস্ত্র নাই, পোষা প্রাণীটির মতো পিছে পিছে এসে বসি থাকে উচ্চ পাড়ে দিদির আদেশে স্থিরধৈর্যভরে। ভরা ঘট লয়ে মাথে, বাম কক্ষে থালি, যায় বালা ডান হাতে ধরি শিশুকর—জননীর প্রতিনিধি কর্মভারে-অবনত অতি ছোটো দিদি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) দিদিমণি– অফুরান সান্ত্বনার খনি দিদিমণি– অফুরান সান্ত্বনার খনি। কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ। কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি। এ অখণ্ড প্রসন্নতা ঘিরে তারে রয়েছে উজ্জ্বলি, রচিতেছে শান্তির মণ্ডলী; ক্ষিপ্র হস্তক্ষেপে চারি দিকে স্বস্তি দেয় ব্যেপে; আশ্বাসের বাণী সুমধুর আবসাদ করি দেয় দূর। এ স্নেহমাধুর্যধারা অক্ষম রোগীরে ঘিরে আপনার রচিছে কিনারা; অবিরাম পরশ চিন্তার বিচিত্র ফসলে যেন উর্বর করিছে দিন তার। এ মাধুর্য করিতে সার্থক এতখানি নির্বলের ছিল আবশ্যক। অবাক হইয়া তারে দেখি, রোগীর দেহের মাঝে অনন্ত শিশুরে দেখেছে কি।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) দিন চলে না যে দিন চলে না যে, নিলেমে চড়েছে খাট-টিপাই; ব্যাবসা ধরেছি গল্পেরে করা নাট্যি-fy। ক্রিটিক মহল করেছি ঠাণ্ডা, মুর্গি এবং মুর্গি-আণ্ডা খেয়ে করে শেষ, আমি হাড় দুটি- চারটি পাই– ভোজন-ওজনে লেখা ক’রে দেয় certify।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দিন পরে যায় দিন দিন পরে যায় দিন, স্তব্ধ বসে থাকি; ভাবি মনে, জীবনের দান যত কত তার বাকি চুকায়ে সঞ্চয় অপচয়। অযত্নে কী হয়ে গেছে ক্ষয়, কী পেয়েছি প্রাপ্য যাহা, কী দিয়েছি যাহা ছিল দেয়, কী রয়েছে শেষের পাথেয়। যারা কাছে এসেছিল, যারা চলে গিয়েছিল দূরে, তাদের পরশখানি রয়ে গেছে মোর কোন্‌ সুরে। অন্যমনে কারে চিনি নাই, বিদায়ের পদধ্বনি প্রাণে আজি বাজিছে বৃথাই। হয়তো হয় নি জানা ক্ষমা করে কে গিয়েছে চলে কথাটি না ব’লে। যদি ভুল করে থাকি তাহার বিচার ক্ষোভ কি রাখিবে তবু যখন রব না আমি আর। কত সূত্র ছিন্ন হল জীবনের আস্তরণময়, জোড়া লাগাবারে আর রবে না সময়। জীবনের শেষপ্রান্তে যে প্রেম রয়েছে নিরবধি মোর কোনো অসম্মান তাহে ক্ষতচিহ্ন দেয় যদি, আমার মৃত্যুর হস্ত আরোগ্য আনিয়া দিক তারে, এ কথাই ভাবি বারে বারে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) দিন রাত্রি নাহি মানি দিন রাত্রি নাহি মানি, আয় তোরা আয় রে, চির সুখ-রসে রত আমরা হেথায় রে। বসন্তে মলয় বায় একটি মিলায়ে যায়, আরেকটি আসে পুনঃ মধুময় তেমনি, প্রেমের স্বপন হায় একটি যেমনি যায় আরেকটি সুস্বপন জাগি উঠে অমনি। নন্দন কানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে! তবে তা ইহাই রে। প্রেমের নিশ্বাস হেথা ফেলিতেছি বালিকা, সুরভি নিশ্বাস যথা ফেলে ফুল-কলিকা, তাহাদের আঁখিজল এমন সে সুবিমল এমন সে সমুজল মুকুতার পারা রে, তাদের চুম্বন হাসি দিবে কত সুধারাশি যাদের মধুর এত নয়নের ধারা রে। নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে। তবে তা ইহাই রে! থাকুক ও-সব সুখ চাই না, গো চাই না, যে সুখ-ভিখারী আমি তাহা যে গো পাই না। দুই হৃদি এক ঠাঁই প্রণয়ে মিলিতে চাই সুখে দুখে যে প্রেমের নাহি হবে শেষ রে। প্রেমে উদাসীন হৃদি শত যুগে যাপে যদি, তার চেয়ে কত ভালো এ সুখ নিমেষ রে! নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে তবে তা ইহাই রে।Thomas Moore (অনুবাদ কবিতা) দিনের অালো নামে যখন দিনের অালো নামে যখন ছায়ার তাতলে আমি আসি ঘট ভরিবার ছলে একলা দিঘির জলে। তাকিয়ে থাকি, দেখি, সঙ্গীহারা একটি সন্ধ্যাতারা ফেলেছে তার ছায়াটি এই কমলসাগরে।ডোবে না সে, নেবে না সে, ঢেউ দিলে সে যায় না তবু স’রে— যেন আমার বিফল রাতের চেয়ে থাকার স্মৃতিকালের কালো পটের 'পরে রইল আঁকা নিতি। মোর জীবনের ব্যর্থ দীপের অগ্নিরেখার বাণী ঐ যে ছায়াখানি।   (স্ফুলিঙ্গ) দিনের প্রহরগুলি হয়ে গেল পার দিনের প্রহরগুলি হয়ে গেল পার বহি কর্মভার। দিনান্ত ভরিছে তরী রঙিন মায়ায় আলোয় ছায়ায়।   (স্ফুলিঙ্গ) দিনের প্রান্তে এসেছি দিনের প্রান্তে এসেছি গোধূলির ঘাটে। পথে পথে পাত্র ভরেছি অনেক কিছু দিয়ে। ভেবেছিলেম চিরপথের পাথেয় সেগুলি; দাম দিয়েছি কঠিন দুঃখে। অনেক করেছি সংগ্রহ মানুষের কথার হাটে, কিছু করেছি সঞ্চয় প্রেমের সদাব্রতে। শেষে ভুলেছি সার্থকতার কথা, অকারণে কুড়িয়ে বেড়ানোই হয়েছে অন্ধ অভ্যাসে বাঁধা; ফুটো ঝুলিটার শূন্য ভরাবার জন্যে বিশ্রাম ছিল না। আজ সামনে যখন দেখি ফুরিয়ে এল পথ, পাথেয়ের অর্থ আর রইল না কিছুই। যে প্রদীপ জ্বলেছিল মিলন-শয্যার পাশে সেই প্রদীপ এনেছিলেম হাতে ক'রে। তার শিখা নিবল আজ, সেটা ভাসিয়ে দিতে হবে স্রোতে। সামনের আকাশে জ্বলবে একলা সন্ধ্যার তারা। যে বাঁশি বাজিয়েছি ভোরের আলোয় নিশীথের অন্ধকারে, তার শেষ সুরটি বেজে থামবে রাতের শেষ প্রহরে। তার পরে? যে জীবনে আলো নিবল সুর থামল, সে যে এই আজকের সমস্ত কিছুর মতোই ভরা সত্য ছিল, সে-কথা একেবারেই ভুলবে জানি, ভোলাই ভালো। তবু তার আগে কোনো একদিনের জন্য কেউ একজন সেই শূন্যটার কাছে একটা ফুল রেখো বসন্তের যে ফুল একদিন বেসেছি ভালো আমার এতদিনকার যাওয়া-আসার পথে শুকনো পাতা ঝরেছে, সেখানে মিলেছে আলোক ছায়া, বৃষ্টিধারায় আমকাঁঠালের ডালে ডালে জেগেছে শব্দের শিহরণ, সেখানে দৈবে কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল জল-ভরা ঘট নিয়ে যে চলে গিয়েছিল চকিত পদে। এই সামান্য ছবিটুকু আর সব কিছু থেকে বেছে নিয়ে কেউ একজন আপন ধ্যানের পটে এঁকো কোনো একটি গোধূলির ধূসরমুহূর্তে। আর বেশি কিছু নয়। আমি আলোর প্রেমিক; প্রাণরঙ্গভূমিতে ছিলুম বাঁশি-বাজিয়ে। পিছনে ফেলে যাব না একটা নীরব ছায়া দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে। যে পথিক অস্তসূর্যের ম্লায়মান আলোর পথ নিয়েছে সে তো ধুলোর হাতে উজাড় করে দিলে সমস্ত আপনার দাবি; সেই ধুলোর উদাসীন বেদীটার সামনে রেখে যেয়ো না তোমার নৈবেদ্য; ফিরে নিয়ে যাও অন্নের থালি, যেখানে তাকিয়ে আছে ক্ষুধা, যেখানে অতিথি বসে আছে দ্বারে, যেখানে প্রহরে প্রহরে বাজছে ঘন্টা জীবনপ্রবাহের সঙ্গে কালপ্রবাহের মিলের মাত্রা রেখে। দিবস যদি সাঙ্গ হল না যদি গাহে পাখি দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি, ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে– এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে, যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি, ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে, ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে, বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে শকতি যার পড়িতে চায় টুটে– ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা করুণাঘন গভীর গোপনতা, ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।কলিকাতা, ২৯ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দিবসরজনী তন্দ্রাবিহীন দিবসরজনী তন্দ্রাবিহীন মহাকাল আছে জাগি— যাহা নাই কোনোখানে, যারে কেহ নাহি জানে, সে অপরিচিত কল্পনাতীত কোন আগামীর লাগি।   (স্ফুলিঙ্গ) দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয় দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়, হে প্রভু, প্রত্যহ মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়। ফিরেছি আপন-মনে আলসে লালসে বিলাসে আবেশে ভেসে প্রবৃত্তির বশে নানা পথে, নানা ব্যর্থ কাজে– তুমি তবু তখনো যে সাথে সাথে ছিলে মোর প্রভু, আজ তাহা জানি। যে অলস চিন্তা-লতা প্রচুরপল্লবাকীর্ণ ঘন জটিলতা হৃদয়ে বেষ্টিয়া ছিল, তারি শাখাজালে তোমার চিন্তার ফুল আপনি ফুটালে নিগূঢ় শিকড়ে তার বিন্দু বিন্দু সুধা গোপনে সিঞ্চন করি। দিয়ে তৃষ্ণা-ক্ষুধা, দিয়ে দণ্ড-পুরস্কার সুখ-দুঃখ-ভয় নিয়ত টানিয়া কাছে দিয়েছ প্রশ্রয়।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) দিল্লি দরবার দেখিছ না অয়ি ভারত-সাগর,অয়ি গো হিমাদ্রি দেখিছ চেয়ে, প্রলয়-কালের নিবিড় আঁধার, ভারতের ভাল ফেলেছে ছেয়ে। অনন্ত সমুদ্র তোমারই বুকে, সমুচ্চ হিমাদ্রি তোমারি সম্মুখে, নিবিড় আঁধারে, এ ঘোর দুর্দিনে, ভারত কাঁপিছে হরষ-রবে! শুনিতেছি নাকি শত কোটি দাস, মুছি অশ্রুজল, নিবারিয়া শ্বাস, সোনার শৃঙ্খল পরিতে গলায় হরষে মাতিয়া উঠেছে সবে? শুধাই তোমারে হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন? তুমি শুনিয়াছ হে গিরি-অমর, অর্জুনের ঘোর কোদণ্ডের স্বর, তুমি দেখিয়াছ সুবর্ণ আসনে, যুধিষ্ঠির-রাজা ভারত শাসনে, তুমি শুনিয়াছ সরস্বতী-কূলে, আর্য-কবি গায় মন প্রাণ খুলে, তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন? তুমি শুনিতেছ ওগো হিমালয়, ভারত গাইছে ব্রিটিশের জয়, বিষণ্ণ নয়নে দেখিতেছ তুমি - কোথাকার এক শূন্যে মরুভূমি - সেথা হতে আসি ভারত-আসন লয়েছে কাড়িয়া, করিছে শাসন, তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি,ভারতে আজি কি সুখের দিন? তবে এই-সব দাসের দাসেরা, কিসের হরষে গাইছে গান? পৃথিবী কাঁপায়ে অযুত উচ্ছ্বাসে কিসের তরে গো উঠায় তান? কিসের তরে গো ভারতের আজি, সহস্র হৃদয় উঠেছে বাজি? যত দিন বিষ করিয়াছে পান,কিছুতে জাগে নি এ মহাশ্মশান,           বন্ধন শৃঙ্খলে করিতে সম্মান           ভারত জাগিয়া উঠেছে আজি?           কুমারিকা হতে হিমালয়-গিরি           এক তারে কভু ছিল না গাঁথা, আজিকে একটি চরণ-আঘাতে, সমস্ত ভারত তুলেছে মাথা! এসেছিল যবে মহম্মদ ঘোরি, স্বর্গ রসাতল জয়নাদে ভরি           রোপিতে ভারতে বিজয়ধ্বজা, তখনো একত্রে ভারত জাগে নি, তখনো একত্রে ভারত মেলে নি,           আজ জাগিয়াছে, আজ মিলিয়াছে--           বন্ধনশৃঙ্খলে করিতে পূজা!           ব্রিটিশ-রাজের মহিমা গাহিয়া           ভূপগণ ওই আসিছে ধাইয়া রতনে রতনে মুকুট ছাইয়া ব্রিটিশ-চরণে লোটাতে শির-- ওই আসিতেছে জয়পুররাজ, ওই যোধপুর আসিতেছে আজ ছাড়ি অভিমান তেয়াগিয়া লাজ, আসিছে ছুটিয়া অযুত বীর!           হা রে হতভাগ্য ভারতভূমি,           কন্ঠে এই ঘোর কলঙ্কের হার           পরিবারে আজি করি অলংকার           গৌরবে মাতিয়া উঠেছে সবে?           তাই কাঁপিতেছে তোর বক্ষ আজি           ব্রিটিশ-রাজের বিজয়রবে? ব্রিটিশ-বিজয় করিয়া ঘোষণা, যে গায় গাক্‌ আমরা গাব না           আমরা গাব না হরষ গান, এসো গো আমরা যে ক'জন আছি, আমরা ধরিব আরেক তান। দীন দান নিবেদিল রাজভৃত্য, "মহারাজ, বহু অনুনয়ে সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম তোমার সোনার দেবালয়ে না লয়ে আশ্রয় আজি পথপ্রান্তে তরুচ্ছায়াতলে করিছেন নামসংকীর্তন। ভক্তবৃন্দ দলে দলে ঘেরি তাঁরে দরদর-উদ্‌বেলিত আনন্দধারায় ধৌত ধন্য করিছেন ধরণীর ধূলি। শূন্যপ্রায় দেবাঙ্গন; ভৃঙ্গ যথা স্বর্ণময় মধুভান্ড ফেলি সহসা কমলগন্ধে মত্ত হয়ে দ্রুত পক্ষ মেলি ছুটে যায় গুঞ্জরিয়া উন্মীলিত পদ্ম-উপবনে উন্মুখ পিপাসাভরে, সেইমতো নরনারীগণে সোনার দেউল-পানে না তাকায়ে চলিয়াছে ছুটি যেথায় পথের প্রান্তে ভক্তের হৃদয়পদ্ম ফুটি বিতরিছে স্বর্গের সৌরভ। রত্নবেদিকার 'পরে একা দেব রিক্ত দেবালয়ে।'                             শুনি রাজা ক্ষোভভরে সিংহাসন হতে নামি গেলা চলি যেথা তরুচ্ছায়ে সাধু বসি তৃণাসনে; কহিলেন নমি তাঁর পায়ে, "হেরো প্রভু, স্বর্ণশীর্ষ নৃপতিনির্মিত নিকেতন অভ্রভেদী দেবালয়, তারে কেন করিয়া বর্জন দেবতার স্তবগান গাহিতেছ পথপ্রান্তে বসে?'"সে মন্দিরে দেব নাই' কহে সাধু।                             রাজা কহে রোষে, "দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ। রত্নসিংহাসন-'পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ-- শূন্য তাহা?'          "শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ' সাধু কহে, "আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।'ভ্রূ কুঞ্চিয়া কহে রাজা, "বিংশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া রচিয়াছি অনিন্দিত যে মন্দির অম্বর ভেদিয়া, পূজামন্ত্রে নিবেদিয়া দেবতারে করিয়াছি দান, তুমি কহ সে মন্দিরে দেবতার নাহি কোনো স্থান!'শান্ত মুখে কহে সাধু, "যে বৎসর বহ্নিদাহে দীন বিংশতি সহস্র প্রজা গৃহহীন অন্নবস্ত্রহীন দাঁড়াইল দ্বারে তব, কেঁদে গেল ব্যর্থ প্রার্থনায় অরণ্যে, গুহার গর্ভে, পথপ্রান্তে তরুর ছায়ায়, অশ্বত্থবিদীর্ণ জীর্ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণে, সে বৎসর বিংশ লক্ষ মুদ্রা দিয়া রচি তব স্বর্ণদীপ্ত ঘর দেবতারে সমর্পিলে। সে দিন কহিলা ভগবান-- "আমার অনাদি ঘরে অগণ্য আলোক দীপ্যমান অনন্তনীলিমা-মাঝে; মোর ঘরে ভিত্তি চিরন্তন সত্য, শান্তি, দয়া, প্রেম। দীনশক্তি যে ক্ষুদ্র কৃপণ নাহি পারে গৃহ দিতে গৃহহীন নিজ প্রজাগণে সে আমারে গৃহ করে দান!' চলি গেলা সেই ক্ষণে পথপ্রান্তে তরুতলে দীন-সাথে দীনের আশ্রয়। অগাধ সমুদ্র-মাঝে স্ফীত ফেন যথা শূন্যময় তেমনি পরম শূন্য তোমার মন্দির বিশ্বতলে, স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্‌বুদ্‌!'                   রাজা জ্বলি রোষানলে, কহিলেন, "রে ভন্ড পামর, মোর রাজ্য ত্যাগ করে এ মুহূর্তে চলি যাও।'                   সন্ন্যাসী কহিলা শান্ত স্বরে, "ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত কর ভক্তজনে।' দীনের দান মরু কহে, অধমেরে এত দাও জল, ফিরে কিছু দিব হেন কী আছে সম্বল? মেঘ কহে, কিছু নাহি চাই, মরুভূমি, আমারে দানের সুখ দান করো তুমি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) দুঃখ এড়াবার আশা দুঃখ এড়াবার আশা নাই এ জীবনে। দুঃখ সহিবার শক্তি যেন পাই মনে।   (স্ফুলিঙ্গ) দুঃখ যেন জাল পেতেছে দুঃখ যেন জাল পেতেছে চারদিকে; চেয়ে দেখি যার দিকে সবাই যেন দুর্‌গ্রহদের মন্ত্রণায় গুমরে কাঁদে যন্ত্রণায়। লাগছে মনে এই জীবনের মূল্য নেই, আজকে দিনের চিত্তদাহের তুল্য নেই। যেন এ দুখ অন্তহীন, ঘরছাড়া মন ঘুরবে কেবল পন্থহীন। এমন সময় অকস্মাৎ মনের মধ্যে হানল চমক তড়িদ্‌ঘাত, এক নিমেষেই ভাঙল আমার বন্ধ দ্বার, ঘুচল হঠাৎ অন্ধকার। সুদূর কালের দিগন্তলীন বাগবাদিনীর পেলেম সাড়া শিরায় শিরায় লাগল নাড়া। যুগান্তরের ভগ্নশেষে ভিত্তিছায়ায় ছায়ামূর্তি মুক্তকেশে বাজায় বীণা; পূর্বকালের কী আখ্যানে উদার সুরের তানের তন্তু গাঁথছে গানে; দুঃসহ কোন্‌ দারুণ দুখে স্মরণ-গাঁথা করুণ গাথা; দুর্দাম কোন্‌ সর্বনাশের ঝঞ্ঝাঘাতের মৃত্যুমাতাল বজ্রপাতের গর্জরবে রক্তরঙিন যে-উৎসবে রুদ্রদেবের ঘূর্ণিনৃত্যে উঠল মাতি প্রলয়রাতি, তাহারি ঘোর শঙ্কাকাঁপন বারে বারে ঝংকারিয়া কাঁপছে বীণার তারে তারে। জানিয়ে দিলে আমায়, অয়ি অতীতকালের হৃদয়পদ্মে নিত্য-আসীন ছায়াময়ী, আজকে দিনের সকল লজ্জা সকল গ্লানি পাবে যখন তোমার বাণী, বর্ষশতের ভাসান-খেলার নৌকা যবে অদৃশ্যেতে মগ্ন হবে, মর্মদহন দুঃখশিখা হবে তখন জ্বলনবিহীন আখ্যায়িকা, বাজবে তারা অসীম কালের নীরব গীতেশান্ত গভীর মাধুরীতে; ব্যথার ক্ষত মিলিয়ে যাবে নবীন ঘাসে, মিলিয়ে যাবে সুদূর যুগের শিশুর উচ্চহাসে। দুঃখশিখার প্রদীপ জ্বেলে দুঃখশিখার প্রদীপ জ্বেলে খোঁজো আপন মন, হয়তো সেথা হঠাৎ পাবে চিরকালের ধন।   (স্ফুলিঙ্গ) দুঃখহারী মনে করো, তুমি থাকবে ঘরে,         আমি যেন যাব দেশান্তরে। ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী, জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি—         ভালো করে দেখ্‌ তো মনে করি         কী এনে মা, দেব তোমার তরে।             চাস কি মা, তুই এত এত সোনা—         সোনার দেশে করব আনাগোনা। সোনামতী নদীতীরের কাছে সোনার ফসল মাঠে ফ'লে আছে, সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে—         না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না।            পরতে কি চাস মুক্তো গেঁথে হারে —         জাহাজ বেয়ে যাব সাগর-পারে। সেখানে মা, সকালবেলা হলে ফুলের ‘পরে মুক্তোগুলি দোলে, টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাসের কোলে—           যত পারি আনব ভারে ভারে।             দাদার জন্যে আনব মেঘে - ওড়া          পক্ষিরাজের বাচ্ছা দুটি ঘোড়া। বাবার জন্যে আনব আমি তুলি কনক-লতার চারা অনেকগুলি— তোর তরে মা, দেব কৌটা খুলি           সাত-রাজার - ধন মানিক একটি জোড়া। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে এসেছে আমার দ্বারে; একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত— অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়। এই হার-জিত-খেলা—জীবনের মিথ্যা এ কুহক— শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা— দুঃখের পরিহাসে ভরা। ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি— মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) দুঃসময় যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,       সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,       যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,       দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা— তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,       এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত,       এ যে অজাগর-গরজে সাগর ফুলিছে; এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত,       ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে। কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,       কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা— তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,       এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,       ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে; বিশ্বজগৎ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি       স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে; সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি       দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা— ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,       এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি       ইঙ্গিত করি তোমা-পানে আছে চাহিয়া; নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি       শত তরঙ্গে তোমা-পানে উঠে ধাইয়া; বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি       ‘এসো এসো’ সুরে করুণ-মিনতি-মাখা— ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,       এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন;       ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা। ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা ব’সে ক্রন্দন;      ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ-রচনা। আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন      উষা-দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা— ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,      এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। দুঃস্বপন কোথা হতে এসে দুঃস্বপন কোথা হতে এসে জীবনে বাধায় গণ্ডগোল। কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে কিছু নাই আছে মার কোল। ভেবেছিনু আর-কেহ বুঝি, ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি, তব হাসি দেখে আজ বুঝি তুমিই দিয়েছ মোরে দোল।এ জীবন সদা দেয় নাড়া লয়ে তার সুখ দুখ ভয়; কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া, সেই যেন মোর সমুদয়। এ ঘোর কাটিয়া যাবে চোখে নিমেষেই প্রভাত-আলোকে, পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে থেমে যাবে সকল কল্লোল।৮ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দুই আমি বৃষ্টি কোথায় নুকিয়ে বেড়ায়           উড়ো মেঘের দল হয়ে , সেই দেখা দেয় আর - এক ধারায়           শ্রাবণ - ধারার জল হয়ে । আমি ভাবি চুপটি করে           মোর দশা হয় ওই যদি ! কেই বা জানে আমি আবার           আর - একজনও হই যদি ! একজনারেই তোমরা চেন           আর - এক আমি কারোই না । কেমনতরো ভাবখানা তার           মনে আনতে পারোই না । হয়তো বা ওই মেঘের মতোই           নতুন নতুন রূপ ধরে কখন সে যে   ডাক দিয়ে যায় ,           কখন থাকে চুপ করে । কখন বা সে পুবের কোণে           আলো - নদীর বাঁধ বাঁধে , কখন বা সে আধেক রাতে           চাঁদকে ধরার ফাঁদ ফাঁদে । শেষে তোমার ঘরের কথা           মনেতে তার যেই আসে , আমার মতন হয়ে আবার           তোমার কাছে সেই আসে । আমার ভিতর লুকিয়ে আছে           দুই রকমের দুই খেলা , একটা সে ওই আকাশ - ওড়া ,           আরেকটা এই ভুঁই - খেলা । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) দুই উপমা যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে; যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার। সর্বজন সর্বক্ষণ চলে যেই পথে তৃণগুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোনোমতে; যে জাতি চলে না কভু তারি পথ-’পরে তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) দুই পাখি খাঁচার পাখি ছিল     সোনার খাঁচাটিতে                বনের পাখি ছিল বনে। একদা কী করিয়া     মিলন হল দোঁহে,         কী ছিল বিধাতার মনে। বনের পাখি বলে,  খাঁচার পাখি ভাই,        বনেতে যাই দোঁহে মিলে। খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয়         খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।'                  বনের পাখি বলে-- "না, আমি     শিকলে ধরা নাহি দিব।'         খাঁচার পাখি বলে-- "হায়, আমি     কেমনে বনে বাহিরিব!' বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি                  বনের গান ছিল যত, খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--                  দোঁহার ভাষা দুইমতো। বনের  পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,         বনের গান গাও দিখি। খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।           বনের পাখি বলে-- না, আমি     শিখানো গান নাহি চাই।'         খাঁচার পাখি বলে-- "হায়, আমি     কেমনে বন-গান গাই।'          বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,         কোথাও বাধা নাহি তার।' খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি         কেমন ঢাকা চারি ধার।' বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও         মেঘের মাঝে একেবারে।' খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে         বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'         বনের পাখি বলে-- "না, সেথা     কোথায় উড়িবারে পাই!'         খাঁচার পাখি বলে-- "হায়, মেঘে     কোথায় বসিবার ঠাঁই!' এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে         তবুও কাছে নাহি পায়। খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,         নীরবে চোখে চোখে চায়। দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,         বুঝাতে নারে আপনায়। দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,         কাতরে কহে, "কাছে আয়!'         বনের পাখি বলে--না, কবে     খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।         খাঁচার পাখি বলে--হায়, মোর     শকতি নাহি উড়িবার।   শাহাজাদপুর  ১৯ আষাঢ়  ১২৯৯   কাব্যগ্রন্থ - সোনার তরী দুই পারে দুই কূলের আকুল প্রাণ দুই পারে দুই কূলের আকুল প্রাণ, মাঝে সমুদ্র অতল বেদনাগান।   (স্ফুলিঙ্গ) দুই বন্ধু মূঢ় পশু ভাষাহীন নির্বাক্‌হৃদয়, তার সাথে মানবের কোথা পরিচয়! কোন্‌ আদি স্বর্গলোকে সৃষ্টির প্রভাতে হৃদয়ে হৃদয়ে যেন নিত্য যাতায়াতে পথচিহ্ন পড়ে গেছে, আজো চিরদিনে লুপ্ত হয় নাই তাহা, তাই দোঁহে চিনে। সেদিনের আত্মীয়তা গেছে বহুদূরে; তবুও সহসা কোন্‌ কথাহীন সুরে পরানে জাগিয়া উঠে ক্ষীণ পূর্বস্মৃতি, অন্তরে উচ্ছলি উঠে সুধাময়ী প্রীতি, মুগ্ধ মূঢ় স্নিগ্ধ চোখে পশু চাহে মুখে— মানুষ তাহারে হেরে স্নেহের কৌতুকে। যেন দুই ছদ্মবেশে দু বন্ধুর মেলা— তার পরে দুই জীবে অপরূপ খেলা।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) দুই বিঘা জমি শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।' কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই - চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই। শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা, পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা - ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি। সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া, দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!' আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে, কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে - করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে। সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য - কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য। ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি। হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো, একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি! গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি - ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি। পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ - স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ। বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে। দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে - কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে, রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি, যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি! সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা! আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ - পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ! আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন, তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন! ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন - কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন! কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি। যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি - প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি! বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা, একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা। সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম, অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম। সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন - ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন। সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে, দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে। ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা। স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী। ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি। কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব - দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।' চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ; বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ - শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।' বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!' বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!' আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে - তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।। দু-কানে ফুটিয়ে দিয়ে দু-কানে ফুটিয়ে দিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়া বর বলে, “কান দুটো ধীরে ধীরে নাড়া।’ বউ দেখে আয়নায়, জাপানে কি চায়নায় হাজার হাজার আছে মেছনীর পাড়া– কোথাও ঘটেনি কানে এত বড়ো ফাঁড়া।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দুখের দশা শ্রাবণরাতি দুখের দশা শ্রাবণরাতি— বাদল না পায় মানা, চলেছে একটানা। সুখের দশা যেন সে বিদ্যুৎ ক্ষণহাসির দূত।   (স্ফুলিঙ্গ) দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে, ভিক্ষা তাদের চুকাইয়া দাও আগে। মোর নিবেদন নিভৃতে তোমার কাছে– সেবক তোমার অধিক কিছু না মাগে। ভাঙিয়া এসেছি ভিক্ষাপাত্র, শুধু বীণাখানি রেখেছি মাত্র, বসি এক ধারে পথের কিনারে বাজাই সে বীণা দিবসরাত্র।দেখো কতজন মাগিছে রতনধূলি, কেহ আসিয়াছে যাচিতে নামের ঘটা– ভরি নিতে চাহে কেহ বিদ্যার ঝুলি, কেহ ফিরে যাবে লয়ে বাক্যের ছটা। আমি আনিয়াছি এ বীণাযন্ত্র, তব কাছে লব গানের মন্ত্র, তুমি নিজ-হাতে বাঁধো এ বীণায় তোমার একটি স্বর্ণতন্ত্র।নগরের হাটে করিব না বেচাকেনা, লোকালয়ে আমি লাগিব না কোনো কাজে। পাব না কিছুই,রাখিব না কারো দেনা, অলস জীবন যাপিব গ্রামের মাঝে। তরুতলে বসি মন্দ-মন্দ ঝংকার দিব কত কী ছন্দ, যত গান গাব তব বাঁধা তারে বাজিবে তোমার উদার মন্দ্র।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) দুয়োরানী ইচ্ছে করে , মা , যদি তুই           হতিস দুয়োরানী ! ছেড়ে দিতে এমনি কি ভয়           তোমার এ ঘরখানি । ওইখানে ওই পুকুরপারে জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে ও যেন ঘোর বনের মধ্যে           কেউ কোত্থাও নেই । ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে , শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে           থাকব দুজনেই । বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে , আসবে না কেউ তোমার কাছে , দিনরাত্তির কোমর বেঁধে           থাকব পাহারাতে । রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে মারবে উঁকি আড়ে আড়ে , দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি           ধনুক নিয়ে হাতে ।       আঁচলেতে খই নিয়ে তুই           যেই দাঁড়াবি দ্বারে অমনি যত বনের হরিণ           আসবে সারে সারে । শিঙগুলি সব আঁকাবাঁকা , গায়েতে দাগ চাকা চাকা , লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে           পায়ের কাছে এসে । ওরা সবাই আমায় বোঝে , করবে না ভয় একটুও যে , হাত বুলিয়ে দেব গায়ে ,           বসবে কাছে ঘেঁষে । ফলসা - বনে গাছে গাছে ফল ধরে মেঘ করে আছে , ওইখানেতে ময়ূর এসে           নাচ দেখিয়ে যাবে । শালিখরা সব মিছিমিছি লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি , কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে           হাত থেকে ধান খাবে ।       দিন ফুরোবে , সাঁঝের আঁধার           নামবে তালের গাছে । তখন এসে ঘরের কোণে           বসব কোলের কাছে । থাকবে না তোর কাজ কিছু তো , রইবে না তোর কোনো ছুতো , রূপকথা তোর বলতে হবে           রোজই নতুন করে । সীতার বনবাসের ছড়া সবগুলি তোর আছে পড়া ; সুর করে তাই আগাগোড়া           গাইতে হবে তোরে । তার পরে যেই অশথবনে ডাকবে পেঁচা , আমার মনে একটুখানি ভয় করবে           রাত্রি নিষুত হলে । তোমার বুকে মুখটি গুঁজে ঘুমেতে চোখ আসবে বুজে — তখন আবার বাবার কাছে           যাস নে যেন চলে ! (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) দুর্বোধ তুমি মোরে পার না বুঝিতে? প্রশান্তবিষাদভরে                  দুটি আঁখি প্রশ্ন করে                অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে,                চন্দ্রমা যেমন-ভাবে স্থিরনতমুখে                 চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে।।               কিছু আমি করি নি গোপন। যাহা আছে সব আছে               তোমার আঁখির কাছে                প্রসারিত অবারিত মন।               দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা,                তাই মোরে বুঝিতে পার না?               এ যদি হইত শুধু মণি, শত খন্ড করি তারে            সযত্নে বিবিধাকারে                একটি একটি করি গণি               একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার                পরাতেম গলায় তোমার।।              এ যদি হইত শুধু ফুল, সুগোল সুন্র ছোট,           উষালোকে ফোটো-ফোটো,              বসন্তের পবনে দোদুল-              বৃন্দ হতে সযত্নে আনিতাম তুলে,              পরায়ে দিতাম কালো চুলে।।             এ যে সখী ,সমস্ত হৃদয়। কোথা জল কোথা কূল,        দিক হয়ে যায় ভুল,                   অন্তহীন রহস্যনিলয়।                  এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী,                  এ তবু তোমার রাজধানী।।                কী তোমারে চাহি বুঝাইতে? গভীর হৃদয়-মাঝে             নাহি জানি কী যে বাজে                  নিশিদিন নীরব সংগীতে,                  শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন                  রজনীর ধ্বনির মতন।।                  এ যে সুখ হইত শুধু সুখ, কেবল একটি হাসি               অধরের প্রান্তে আসি                 আনন্দ করিত জাগরূক।                 মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা,                  বলিতে হতো না কোনো কথা।।                এ যদি হইত শুধু দুখ দুটি বিন্দু অশ্রুজল           দুই চক্ষে ছলছল,                বিষন্ন অধর , স্নায়ুমুখ- প্রত্যেক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা,                নীরবে প্রকাশ হত কথা।।                    এ যে সখী,হৃদয়ের প্রেম- সুখদুখবেদনার          আদি অন্ত নাহি যার,               চিরদৈন্য,চিরপূর্ণ হেম। নব নব ব্যাকুলতা জাগে   নূতন - নূতনালোকে              পাঠ করো রাত্রিদিন ধরে।              বুঝা যায় আধো প্রেম,আধখানা মন-              সমস্ত কে বুঝেছে কখন।। দুর্ভাগা দেশ হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।               মানুষের অধিকারে               বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।               বিধাতার রুদ্ররোষে               দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।               চরণে দলিত হয়ে               ধূলায় সে যায় বয়ে - সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।               অজ্ঞানের অন্ধকারে               আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না  নমস্কার।               তবু নত করি আঁখি               দেখিবার পাও না কি নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান। অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে - অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।               সবারে না যদি ডাকো,               এখনো সরিয়া থাকো, আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান - মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান। দুর্লভ জন্ম একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ, পড়িবে নয়ন-’পরে অন্তিম নিমেষ। পরদিনে এইমত পোহাইবে রাত, জাগ্রত জগৎ-’পরে জাগিবে প্রভাত। কলরবে চলিবেক সংসারের খেলা, সুখে দু:খে ঘরে ঘরে বহি যাবে বেলা। সে কথা স্মরণ করি নিখিলের পানে আমি আজি চেয়ে আছি উৎসুক নয়ানে। যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়, সকলই দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয়। দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান, দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ। যা পাই নি তাও থাক্‌, যা পেয়েছি তাও, তুচ্ছ ব’লে যা চাই নি তাই মোরে দাও।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) দুষ্টু তোমার কাছে আমিই দুষ্টু           ভালো যে আর সবাই । মিত্তিরদের কালু নিলু           ভারি ঠাণ্ডা ক - ভাই ! যতীশ ভালো , সতীশ ভালো ,           ন্যাড়া নবীন ভালো , তুমি বল ওরাই কেমন           ঘর করে রয় আলো । মাখন বাবুর দুটি ছেলে           দুষ্টু তো নয় কেউ — গেটে তাদের কুকুর বাঁধা            করতেছে ঘেউ ঘেউ । পাঁচকড়ি ঘোষ লক্ষ্মী ছেলে ,           দত্তপাড়ার গবাই , তোমার কাছে আমিই দুষ্টু           ভালো যে আর সবাই । তোমার কথা আমি যেন           শুনি নে কক্‌খনোই , জামাকাপড় যেন আমার           সাফ থাকে না কোনোই ! খেলা করতে বেলা করি ,           বৃষ্টিতে যাই ভিজে , দুষ্টুপনা আরো আছে            অমনি কত কী যে ! বাবা আমার চেয়ে ভালো ?           সত্যি বলো তুমি , তোমার কাছে করেন নি কি           একটুও দুষ্টুমি ? যা বল সব শোনেন তিনি ,           কিচ্ছু ভোলেন নাকো ? খেলা ছেড়ে আসেন চলে           যেমনি তুমি ডাকো ? (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) দূর পুজোর ছুটি আসে যখন           বকসারেতে যাবার পথে — দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে           ঘুম হয় না কোনোমতে । সেখানে যেই নতুন বাসায়           হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে দূর কি আবার পালিয়ে আসে           আমাদেরই বাড়ির ঘাটে ! দূরের সঙ্গে কাছের কেবল           কেনই যে এই লুকোচুরি , দূর কেন যে করে এমন           দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি । আমরা যেমন ছুটি হলে           ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই           বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে , তেমনিতরো সকালবেলা           ছুটিয়ে আলো আকাশেতে রাতের থেকে দিন যে বেরোয়           দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে ? সে - ও তো যায় পশ্চিমেতেই ,           ঘুরে ঘুরে সন্ধে হলে , তখন দেখে রাতের মাঝেই           দূর সে আবার গেছে চলে । সবাই যেন পলাতকা           মন টেকে না কাছের বাসায় । দলে দলে পলে পলে           কেবল চলে দূরের আশায় । পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি ,            ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি , হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি           কেবল বাজে থাকি থাকি । আমায় এরা যেতে বলে ,           যদি বা যাই , জানি তবে দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে           মায়ের কাছেই ফিরতে হবে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) দূর সাগরের পারের পবন দূর সাগরের পারের পবন আসবে যখন কাছের কূলে রঙিন আগুন জ্বালবে ফাগুন, মাতবে অশোক সোনার ফুলে।   (স্ফুলিঙ্গ) দৃষ্টি বুঝি গো সন্ধার কাছে     শিখেছে সন্ধার মায়া                  ওই আঁখিদুটি, চাহিলে হৃদয়-পানে     মরমেতে পড়ে ছায়া,                  তারা উঠে ফুটি। আগে কে জানিত বল     কত কি লুকানো ছিল                  হৃদয়নিভৃতে-- তোমার নয়ন দিয়া     আমার নিজের হিয়া                  পাইনু দেখিতে। কখনো গাও নি তুমি,     কেবল নীরবে রহি                  শিখায়েছ গান-- স্বপ্নময় শান্তিময়     পূরবী রাগিণীতানে                  বাঁধিয়াছ প্রাণ। আকাশের পানে চাই     সেই সুরে গান গাই                  একেলা বসিয়া। একে একে সুরগুলি     অনন্তে হারায়ে যায়                  আধারে পশিয়া।। দেওয়া নেওয়া বাদল দিনের প্রথম কদমফুল আমায় করেছ দান, আমি তো দিয়েছি ভরা শ্রাবণের মেঘমল্লার গান। সজল ছায়ার অন্ধকারে ঢাকিয়া তারে এনেছি সুরে শ্যামল খেতের প্রথম সোনার ধান।আজ এনে দিলে যাহা হয়তো দিবে না কাল, রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল। স্মৃতিবন্যার উছল প্লাবনে আমার এ গান শ্রাবণে শ্রাবণে ফিরিয়া ফিরিয়া বাহিবে তরণী ভরি তব সম্মান। দেখলো সজনী চাঁদনি রজনী দেখলো সজনী চাঁদনি রজনী, সমুজল যমুনা গাওত গান, কানন কানন করত সমীরণ কুসুমে কুসুমে চুম্বন দান। কাহ লো যমুনা জোছন-ঢল ঢল সুহাস সুনীল বারি? আজু তোঁহারই উজল সলিল পর নয়ন সলিল দিব ডারি। কাহ সমীরণ লুটই কুসুম-বন অলসি পড়সি যমুনায়?' তোঁহার চম্পক-বাসিত লহরে মিশাব নিশাস-বায়।জনম গোঁয়ায়নু রোয়ত রোয়ত হম তর কোই ত কাঁদল না! জনম গোঁয়ায়নু সাধত সাধত হমকো কোইত সাধল না! সকল তয়াগনু যো ধন আশে সো বি তয়াগল মোয় অপন ছোড়ি সব, অপন করনু যোয় সো বি সজনি পর হোয়! যমুনে হাস হাস লো হরখে হম তর রোয়বে কে? তোঁহারি সুহসিত নীল সলিল পরি রাধা সঁপবে দে! এক দিবস যব মাধ হমারা আসবে কিনার তোর,— যব সো পেখবে তোঁহার সলিলে ভাসত তনুয়া মোর—তব্‌ কি শ্যাম সো মানস পাশে তিল দুখ পাওবে না? শ্যামক নয়নে বিন্দু নয়ন জল তবহুঁ কি আওবে না? রয়নে কুঞ্জে আসবে যব সখি শ্যাম হমারই আশে, ফুকারবে যব্‌ রাধা রাধা মুরলি ঊরধ-শ্বাসে, যব সব গোপিনী আসবে ছূটই যব হম আসব না; যব সব গোপিনী জাগবে চমকই যব হম জগব না, তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে হেরবে আকুল শ্যাম? বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে রাধা রাধা নাম?না যমুনা, সো এক শ্যাম মম শ্যামক শত শত নারী; হম যব যাওব শত শত রাধা চরণে রহবে তারি! তব সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে, কাহ তয়াগব দে? অভাগীর তর বৃন্দাবনমে কহ সখি, রোয়ব কে! ভানু কহে চুপি ‘মান ভরে রহ আও বনে ব্রজ-নারী, মিলবে শ্যামক শত শত অাদর শত শত লোচন বারি।     (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায় দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায় দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, নিয়ে তার বিচিত্রবেদনা, চিত্রকরা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়, নিয়ে তার বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে ম্লান হয়ে আসে তার রূপ, পরিচিত তীরে তীরে তরুচ্ছায়া-আলিঙ্গিত লোকালয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে সন্ধ্যা-আরতির ধ্বনি, ঘরে ঘরে রুদ্ধ হয় দ্বার, ঢাকা পড়ে দীপশিখা, নৌকা বাঁধা পড়ে ঘাটে। দুই তটে ক্ষান্ত হোলো পারাপার, ঘনাল রজনী, বিহঙ্গের মৌনগান অরণ্যের শাখায় শাখায় মহানিঃশব্দের পায়ে রচি দিল আত্মবলি তার।এক কৃষ্ণ অরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্র্যের পরে স্থলে জলে। ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড় হাতে— হে পূষন, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল, এবার প্রকাশ করো তোমার কল্যাণতমরূপ, দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) দেখো চেয়ে গিরির শিরে দেখো চেয়ে গিরির শিরে মেঘ করেছে গগন ঘিরে, আর কোরো না দেরি। ওগো আমার মনোহরণ, ওগো স্নিগ্ধ ঘনবরন, দাঁড়াও, তোমায় হেরি। দাঁড়াও গো ওই আকাশ-কোলে, দাঁড়াও আমার হৃদয়-দোলে, দাঁড়াও গো ওই শ্যামল-তৃণ-‘পরে, আকুল চোখের বারি বেয়ে দাঁড়াও আমার নয়ন ছেয়ে, জন্মে জন্মে যুগে যুগান্তরে। অমনি করে ঘনিয়ে তুমি এসো, অমনি করে তড়িৎ-হাসি হেসো, অমনি করে উড়িয়ে দিয়ো কেশ। অমনি করে নিবিড় ধারা-জলে অমনি করে ঘন তিমির-তলে আমায় তুমি করো নিরুদ্দেশ।ওগো তোমার দরশ লাগি ওগো তোমার পরশ মাগি গুমরে মোর হিয়া। রহি রহি পরান ব্যেপে আগুন-রেখা কেঁপে কেঁপে যায় যে ঝলকিয়া। আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে বলাকা-দল যাচ্ছে উড়ে জানি নে কোন্‌ দূর-সমুদ্র-পারে। সজল বায়ু উদাস ছুটে, কোথায় গিয়ে কেঁদে উঠে পথবিহীন গহন অন্ধকারে। ওগো তোমার আনো খেয়ার তরী, তোমার সাথে যাব অকূল-‘পরি, যাব সকল বাঁধন-বাধা-খোলা। ঝড়ের বেলা তোমার স্মিতহাসি লাগবে আমার সর্বদেহে আসি, তরাস-সাথে হরষ দিবে দোলা।ওই যেখানে ঈশান কোণে তড়িৎ হানে ক্ষণে ক্ষণে বিজন উপকূলে– তটের পায়ে মাথা কুটে তরঙ্গদল ফেনিয়ে উঠে গিরির পদমূলে, ওই যেখানে মেঘের বেণী জড়িয়ে আছে বনের শ্রেণী– মর্মরিছে নারিকেলের শাখা, গরুড়সম ওই যেখানে ঊর্ধ্বশিরে গগন-পানে শৈলমালা তুলেছে নীল পাখা, কেন আজি আনে আমার মনে ওইখানেতে মিলে তোমার সনে বেঁধেছিলেম বহুকালের ঘর– হোথায় ঝড়ের নৃত্য-মাঝে ঢেউয়ের সুরে আজো বাজে যুগান্তরের মিলনগীতিস্বর।কে গো চিরজনম ভ’রে নিয়েছ মোর হৃদয় হ’রে উঠছে মনে জেগে। নিত্যকালের চেনাশোনা করছে আজি আনাগোনা নবীন-ঘন মেঘে। কত প্রিয়মুখের ছায়া কোন্‌ দেহে আজ নিল কায়া, ছড়িয়ে দিল সুখদুখের রাশি– আজকে যেন দিশে দিশে ঝড়ের সাথে যাচ্ছে মিশে কত জন্মের ভালোবাসাবাসি। তোমায় আমায় যত দিনের মেলা লোক-লোকান্তে যত কালের খেলা এক মুহূর্তে আজ করো সার্থক। এই নিমেষে কেবল তুমি একা জগৎ জুড়ে দাও আমারে দেখা, জীবন জুড়ে মিলন আজি হোক।পাগল হয়ে বাতাস এল, ছিন্ন মেঘে এলোমেলো হচ্ছে বরিষন, জানি না দিগ্‌দিগন্তরে আকাশ ছেয়ে কিসের তরে চলছে আয়োজন। পথিক গেছে ঘরে ফিরে, পাখিরা সব গেছে নীড়ে, তরণী সব বাঁধা ঘাটের কোলে। আজি পথের দুই কিনারে জাগিছে গ্রাম রুদ্ধ দ্বারে, দিবস আজি নয়ন নাহি খোলে। শান্ত হ রে, শান্ত হ রে প্রাণ– ক্ষান্ত করিস প্রগল্‌ভ এই গান, ক্ষান্ত করিস বুকের দোলাদুলি। হঠাৎ যদি দুয়ার খুলে যায়, হঠাৎ যদি হরষ লাগে গায় যায়, তখন চেয়ে দেখিস আঁখি তুলি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে, আপন জেনে আদর করি নে। পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে, বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে। আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে আমার হয়ে এলে যেথায় নেমে সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধরে সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।ভাই তুমি যে ভায়ের মাঝে প্রভু, তাদের পানে তাকাই না যে তবু, ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন তোমার মুঠা কেন ভরি নে। ছুটে এসে সবার সুখে দুখে দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে, সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।৫ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ) দেবতার গ্রাস গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসংগমে তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি প্রস্তুত হইল ঘাটে।                        পুণ্য লোভাতুর মোক্ষদা কহিল আসি, "হে দাদাঠাকুর, আমি তব হব সাথি।' বিধবা যুবতী, দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি, কেবল মিনতি করে--অনুরোধ তার এড়ানো কঠিন বড়ো--"স্থান কোথা আর' মৈত্র কহিলেন তারে। "পায়ে ধরি তব' বিধবা কহিল কাঁদি, "স্থান করি লব কোনোমতে এক ধারে।' ভিজে গেল মন, তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ, "নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?' উত্তর করিল নারী, "রাখাল? সে রবে আপন মাসির কাছে। তার জন্মপরে বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে, বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন মানুষ করেছে যত্নে--সেই হতে ছেলে মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে। দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে মার চেয়ে আপনার মাসির বুকে।'সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর, প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে। ঘাটে আসি দেখে--সেথা আগেভাগে ছুটি রাখাল বসিয়া আছে তরী-'পরে উঠি নিশ্চিন্ত নীরবে। "তুই হেথা কেন ওরে' মা শুধালো; সে কহিল, "যাইব সাগরে।' "যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে, নেমে আয়।' পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে সে কহিল দুটি কথা, "যাইব সাগরে।' যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে, "থাক্‌ থাক্‌ সঙ্গে যাক্‌।' মা রাগিয়া বলে "চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!' যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন "নারায়ণ নারায়ণ' করিল স্মরণ। পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে। মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়, "ছি ছি ছি এমন কথা বলিবার নয়।'রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা-- অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা ছুটে আসি বলে, "বাছা, কোথা যাবি ওরে!' রাখাল কহিল হাসি, "চলিনু সাগরে, আবার ফিরিব মাসি!' পাগলের প্রায় অন্নদা কহিল ডাকি, "ঠাকুরমশায়, বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার, কে তাহারে সামালিবে? জন্ম হতে তার মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও-- কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।' রাখাল কহিল, "মাসি, যাইব সাগরে, আবার ফিরিব আমি।' বিপ্র স্নেহভরে কহিলেন, "যতক্ষণ আমি আছি ভাই, তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই। এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ, অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ কিছু নাই; যাতায়াত মাস দুই কাল, তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।'শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি, দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা। তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্নবেলা জোয়ারের আশে। কৌতূহল অবসান, কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল। মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর, লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ। হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক, অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন, সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে, "ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার? সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে। ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দ গীতে সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে-- আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী। রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে, "দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?'সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে। রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরমীরে উত্তাল উদ্দাম। "তরণী ভিড়াও তীরে' উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল। কোথা তীর? চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা, অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি উদ্ধতবিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল, ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্‌, কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে। তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে, "বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ-- যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ, অসময়ে এ তুফান! শুন এই বেলা, করহ মানত রক্ষা; করিয়ো না খেলা ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।' যার যত ছিল অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল না করি বিচার। তবু তখনি পলকে তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে। মাঝি কহে পুনর্বার, "দেবতার ধন কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্‌।' ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, "এই সে রমণী দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে চুরি করে নিয়ে যায়।' "দাও তারে ফেলে' এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর যাত্রী সবে। কহে নারী, "হে দাদাঠাকুর, রক্ষা করো, রক্ষা করো!' দুই দৃঢ় করে রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে। র্ভৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ, "আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে, শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে! শোধ্‌ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ করে এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!'মোক্ষদা কহিল, "অতি মূর্খ নারী আমি, কী বলেছি রোষবশে--ওগো অন্তর্যামী, সেই সত্য হল? সে যে মিথ্যা কতদূর তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর? শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা? শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?' বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তারে সহসা মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা, দংশিল বৃশ্চিকদংশ। "মাসি! মাসি! মাসি!' বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক। চীৎকারি উঠিল বিপ্র, "রাখ্‌ রাখ্‌ রাখ্‌!' চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে প'ড়ে মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে ফুটন্ত তরঙ্গমাঝে মেলি আর্ত চোখ "মাসি' বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে। "ফিরায়ে আনিব তোরে' কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে-- আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে। দেবতার বিদায় দেবতামন্দিরমাঝে ভকত প্রবীণ জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন। হেনকালে সন্ধ্যাবেলা ধুলিমাখা দেহে বস্ত্রহীন জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে। কহিল কাতরকণ্ঠে “গৃহ মোর নাই এক পাশে দয়া করে দেহো মোরে ঠাঁই।” সসংকোচে ভক্তবর কহিলেন তারে, “আরে আরে অপবিত্র, দূর হয়ে যারে।” সে কহিল, “চলিলাম”—চক্ষের নিমেষে ভিখারি ধরিল মূর্তি দেবতার বেশে। ভক্ত কহে, “প্রভু, মোরে কী ছল ছলিলে!” দেবতা কহিল, “মোরে দূর করি দিলে। জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়াতরে, গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।”   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) দেশান্তরী প্রাণ-ধারণের বোঝাখানা বাঁধা পিঠের 'পরে, আকাল পড়ল, দিন চলে না, চলল দেশান্তরে। দূর শহরে একটা কিছু যাবেই যাবে জুটে, এই আশাতেই লগ্ন দেখে ভোরবেলাতে উঠে দুর্গা ব'লে বুক বেঁধে সে চলল ভাগ্যজয়ে, মা ডাকে না পিছুর ডাকে অমঙ্গলের ভয়ে। স্ত্রী দাঁড়িয়ে দুয়ার ধরে দুচোখ শুধু মোছে, আজ সকালে জীবনটা তার কিছুতেই না রোচে। ছেলে গেছে জাম কুড়োতে দিঘির পাড়ে উঠি, মা তারে আজ ভুলে আছে তাই পেয়েছে ছুটি। স্ত্রী বলেছে বারে বারে, যে ক'রে হোক খেটে সংসারটা চালাবে সে, দিন যাবে তার কেটে। ঘর ছাইতে খড়ের আঁঠির জোগান দেবে সে যে, গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেবে দেয়াল পাঁচিল মেঝে। মাঠের থেকে খড়কে কাঠি আনবে বেছে বেছে, ঝাঁটা বেঁধে কুমোরটুলির হাটে আসবে বেচে। ঢেঁকিতে ধান ভেনে দেবে বামুনদিদির ঘরে, খুদকুঁড়ো যা জুটবে তাতেই চলবে দুর্বছরে। দূর দেশেতে বসে বসে মিথ্যা অকারণে কোনোমতেই ভাব্‌না যেন না রয় স্বামীর মনে। সময় হল, ঐ তো এল খেয়াঘাটের মাঝি, দিন না যেতে রহিমগঞ্জে যেতেই হবে আজি। সেইখানেতে চৌকিদারি করে ওদের জ্ঞাতি, মহেশখুড়োর মেঝো জামাই, নিতাই দাসের নাতি। নতুন নতুন গাঁ পেরিয়ে অজানা এই পথে পৌঁছবে পাঁচদিনের পরে শহর কোনোমতে। সেইখানে কোন্‌ হালসিবাগান, ওদের গ্রামের কালো, শর্ষেতেলের দোকান সেথায় চালাচ্ছে খুব ভালো। গেলে সেথায় কালুর খবর সবাই বলে দেবে-- তারপরে সব সহজ হবে, কী হবে আর ভেবে। স্ত্রী বললে, "কালুদাকে খবরটা এই দিয়ো, ওদের গাঁয়ের বাদল পালের জাঠতুত ভাই প্রিয় বিয়ে করতে আসবে আমার ভাইঝি মল্লিকাকে উনত্রিশে বৈশাখে।" দেহের মিলন প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ – তরে । প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন । হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -‘ পরে । তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন , অধর মরিতে চায় তোমার অধরে । তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন । হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে , চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন । সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে দেহের রহস্য – মাঝে হইব মগন । আমার এ দেহমন চির রাত্রিদিন তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) দোতলায় ধুপ্‌ধাপ্‌ দোতলায় ধুপ্‌ধাপ্‌ হেমবাবু দেয় লাফ, মা বলেন, একি খেলা ভূতের নাচন নেচে? নাকি সুরে বেলা হেমা, “চলতে যে পারিনে, মা, সকালে সর্দি লেগে যেমনি উঠেছি হেঁচে অমনি যে খচ্‌ করে পা আমার মচ্‌কেছে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) দ্বার খোলা ছিল মনে দ্বার খোলা ছিল মনে, অসর্তকে সেথা অকস্মাৎ লেগেছিল কী লাগিয়া কোথা হতে দুঃখের আঘাত; সে লজ্জায় খুলে গেল মর্মতলে প্রচ্ছন্ন যে বল জীবনের নিহিত সম্বল। ঊর্ধ্ব হতে জয়ধ্বনি অন্তরে দিগন্তপথে নামিল তখনি, আনন্দের বিচ্ছুরিত আলো মুহূর্তে আঁধার-মেঘ দীর্ণ করি হৃদয়ে ছড়ালো। ক্ষুদ্র কোটরের অসম্মান লুপ্ত হল, নিখিলের আসনে দেখিনু নিজ স্থান, আনন্দে আনন্দময় চিত্ত মোর করি নিল জয়, উৎসবের পথ চিনে নিল মুক্তিক্ষেত্রে সগৌরবে আপন জগৎ। দুঃখ-হানা গ্লানি যত আছে, ছায়া সে, মিলালো তার কাছে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) দ্বারে একা তুমি নিঃসঙ্গ প্রভাতে, অতীতের দ্বার রুদ্ধ তোমার পশ্চাতে।         সেথা হল অবসান         বসন্তের সব দান, উৎসবের সব বাতি নিবে গেল রাতে।    সেতারের তার হল চুপ, শুষ্কমালা, ভষ্মশেষ দগ্ধ গন্ধধূপ।         কবরীর ফুলগুলি         ধূলিতে হইল ধূলি, লজ্জিত সকল সজ্জা বিরস বিরূপ।    সম্মুখে উদাস বর্ণহীন ক্ষীণছন্দ মন্দগতি তব রাত্রিদিন।         সম্মুখে আকাশ খোলা,         নিস্তব্ধ, সকল-ভোলা-- মত্ততার কলরব শান্তিতে বিলীন।    আভরণহারা তব বেশ, কজ্জলবিহীন আঁখি, রুক্ষ তব কেশ।         শরতের শেষ মেঘে         দীপ্তি জ্বলে রৌদ্র লেগে, সেইমতো শোকশুভ্র স্মৃতি-অবশেষ।    তবু কেন হয় যেন বোধ অদৃষ্ট পশ্চাৎ হতে করে পথরোধ।         ছুটি হল যার কাছে         কিছু তার প্রাপ্য আছে, নিঃশেষে কি হয় নাই সব পরিশোধ।    সূক্ষ্মতম সেই আচ্ছাদন, ভাষাহারা অশ্রুহারা অজ্ঞাত কাঁদন।         দুর্লঙ্ঘ্য-যে সেই মানা         স্পষ্ট যারে নেই জানা, সবচেয়ে সুকঠিন অবন্ধ বাঁধন।    যদি বা ঘুচিল ঘুমঘোর, অসাড় পাখায় তবু লাগে নাই জোর।         যদি বা দূরের ডাকে         মন সাড়া দিতে থাকে, তবুও বারণে বাঁধে নিকটের ডোর।    মুক্তিবন্ধনের সীমানায় এমনি সংশয়ে তব দিন চলে যায়।         পিছে রুদ্ধ হল দ্বার,         মায়া রচে ছায়া তার, কবে সে মিলাবে আছ সেই প্রতীক্ষায়। দ্বিতীয় সর্গ "এত কাল হে প্রকৃতি করিনু তোমার সেবা,              তবু কেন এ হৃদয় পূরিল না দেবি?    এখনো বুকের মাঝে রয়েছে দারুণ শূন্য,              সে শূন্য কি এ জনমে পূরিবে না আর?       মনের মন্দির মাঝে প্রতিমা নাহিক যেন,              শুধু এ আঁধার গৃহ রয়েছে পড়িয়া--       কত দিন বল দেবি রহিবে এমন শূন্য,              তা হোলে ভাঙিয়ে যাবে এ মনোমন্দির!       কিছু দিন পরে আর দেখিব সেখানে চেয়ে              পূর্ব্ব হৃদয়ের আছে ভগ্ন-অবশেষ,     সে ভগ্ন-অবশেষে-- সুখের সমাধি 'পরে              বসিয়া দারুণ দুখে কাঁদিতে কি হবে?       মনের অন্তর-তলে কি যে কি করিছে হুহু,              কি যেন আপন ধন নাইকো সেখানে,    সে শূন্য পূরাবে দেবি ঘুরিছে পৃথিবীময়              মরুভূমে তৃষাতুর মৃগের মতন।       কত মরীচিকা দেবী করেছে ছলনা মোরে,              কত ঘুরিয়াছি তার পশ্চাতে পশ্চাতে,       অবশেষে শ্রান্ত হয়ে তোমারে শুধাই দেবি              এ শূন্য পূরিবে না কি কিছুতে আমার?       উঠিছে তপন শশী, অস্ত যাইতেছে পুনঃ,              বসন্ত শরত শীত চক্রে ফিরিতেছে;       প্রতি পদক্ষেপে আমি বাল্যকাল হোতে দেবি              ক্রমে ক্রমে কত দূর যেতেছি চলিয়া--      বাল্যকাল গেছে চলে, এসেছে যৌবন এবে,   যৌবন যাইবে চলি আসিবে বার্দ্ধক্য--       তবু এ মনের শূন্য কিছুতে কি পূরিবে না?              মন কি করিবে হুহু চিরকাল তরে?       শুনিয়াছিলাম কোন্‌ উদাসী যোগীর কাছে--              "মানুষের মন চায় মানুষেরি মন;       গম্ভীর সে নিশীথিনী, সুন্দর সে উষাকাল,              বিষণ্ণ সে সায়াহ্নের ম্লান মুখচ্ছবি,       বিস্তৃত সে অম্বুনিধি, সমুচ্চ সে গিরিবর,   আঁধার সে পর্ব্বতের গহ্বর বিশাল,       তটিনীর কলধ্বনি, নির্ঝরের ঝর ঝর,   আরণ্য বিহঙ্গদের স্বাধীন সঙ্গীত,       পারে না পূরিতে তারা বিশাল মনুষ্য-হৃদি--   মানুষের মন চায় মানুষেরি মন।'       শুনিয়া, প্রকৃতিদেবি, ভ্রমিণু পৃথিবীময়;   কত লোক দিয়েছিল হৃদি-উপহার--       আমার মর্ম্মের গান যবে গাহিতাম দেবি     কত লোক কেঁদেছিল শুনিয়া সে গীত।       তেমন মনের মত মন পেলাম না দেবি,              আমার প্রাণের কথা বুঝিল না কেহ,       তাইতে নিরাশ হোয়ে আবার এসেছি ফিরে,              বুঝি গো এ শূন্য মন পূরিল না আর।"       এইরূপে কেঁদে কেঁদে কাননে কাননে কবি              একাকী আপন-মনে করিত ভ্রমণ।       সে শোক-সঙ্গীত শুনি কাঁদিত কাননবালা,              নিশীথিনী হাহা করি ফেলিত নিশ্বাস,      বনের হরিণগুলি আকুল নয়নে আহা              কবির মুখের পানে রহিত চাহিয়া।      "হাহা দেবি একি হোলো, কেন পূরিল না প্রাণ"              প্রতিধ্বনি হোতো তার কাননে কাননে।      শীর্ণ নির্ঝরিণী যেথা ঝরিতেছে মৃদু মৃদু,              উঠিতেছে কুলু কুলু জলের কল্লোল,      সেখানে গাছের তলে একাকী বিষণ্ণ কবি              নীরবে নয়ন মুদি থাকিত শুইয়া--     তৃষিত হরিণশিশু সলিল করিয়া পান              দেখি তার মুখপানে চলিয়া যাইত।     শীতরাত্রে পর্ব্বতের তুষারশয্যার 'পরে              বসিয়া রহিত স্তব্ধ প্রতিমার মত,     মাথার উপরে তার পড়িত তুষারকণা,              তীব্রতম শীতবায়ু যাইত বহিয়া।     দিনে দিনে ভাবনায় শীর্ণ হোয়ে গেল দেহ,              প্রফুল্ল হৃদয় হোলো বিষাদে মলিন,    রাক্ষসী স্বপ্নের তরে ঘুমালেও শান্তি নাই,              পৃথিবী দেখিত কবি শ্মশানের মত    এক দিন অপরাহ্নে বিজন পথের প্রান্তে              কবি বৃক্ষতলে এক রহিছে শুইয়া,    পথ-শ্রমে শ্রান্ত দেহ, চিন্তায় আকুল হৃদি,              বহিতেছে বিষাদের আকুল নিশ্বাস।    হেন কালে ধীরি ধীরি শিয়রের কাছে আসি              দাঁড়াইল এক জন বনের বালিকা,    চাহিয়া মুখের পানে কহিল করুণ স্বরে,              "কে তুমি গো পথশ্রান্ত বিষণ্ণ পথিক?    অধরে বিষাদ যেন পেতেছে আসন তার              নয়ন কহিছে যেন শোকের কাহিনী।    তরুণ হৃদয় কেন অমন বিষাদময়?              কি দুখে উদাস হোয়ে করিছ ভ্রমণ?"    গভীর নিশ্বাস ফেলি গম্ভীরে কহিল কবি,              "প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না বালা?"    একে একে কত কথা কহিল বালিকা কাছে,              যত কথা রুদ্ধ ছিল হৃদয়ে কবির--    আগ্নেয় গিরির বুকে জ্বলন্ত অগ্নির মত              যত কথা ছিল কবি কহিলা গম্ভীরে।    "নদ নদী গিরি গুহা কত দেখিলাম, তবু              প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না দেবি।"    বালার কপোল বাহি নীরবে অশ্রুর বিন্দু              স্বর্গের শিশির-সম পড়িল ঝরিয়া,    সেই এক অশ্রুবিন্দু অমৃতধারার মত              কবির হৃদয় গিয়া প্রবেশিল যেন;    দেখি সে করুণবারি নিরশ্রু কবির চোখে              কত দিন পরে হোল অশ্রুর উদয়।    শ্রান্ত হৃদয়ের তরে যে আশ্রয় খুঁজে খুঁজে              পাগল ভ্রমিতেছিল হেথায় হোথায়--    আজ যেন এইটুকু আশ্রয় পাইল হৃদি,              আজ যেন একটুকু জুড়ালো যন্ত্রণা।    যে হৃদয় নিরাশায় মরুভূমি হোয়েছিল              সেথা হোতে হল আজ অশ্রু উৎসারিত।    শ্রান্ত সে কবির মাথা রাখিয়া কোলের 'পরে,              সরলা মুছায়ে দিল অশ্রুবারিধারা।    কবি সে ভাবিল মনে, তুমি কোথাকার দেবী              কি অমৃত ঢালিলে গো প্রাণের ভিতর!    ললনা তখন ধীরে চাহিয়া কবির মুখে              কহিল মমতাময় করুণ কথায়,--    "হোথায় বিজন বনে দেখেছ কুটীর ওই,              চল পান্থ ওইখানে যাই দুজনায়।    বন হোতে ফল মূল আপনি তুলিয়া দিব,   নির্ঝর হইতে তুলি আনিব সলিল,    যতনে পর্ণের শয্যা দিব আমি বিছাইয়া,              সুখনিদ্রা-কোলে সেথা লভিবে বিরাম,    আমার বীণাটি লয়ে গান শুনাইব কত,              কত কি কথায় দিন যাইবে কাটিয়া।    হরিণশাবক এক আছে ও গাছের তলে,              সে যে আসি কত খেলা খেলিবে পথিক।    দূরে সরসীর ধারে আছে এক চারু কুঞ্জ,   তোমারে লইয়া পান্থ দেখাব সে বন।    কত পাখী ডালে ডালে সারাদিন গাইতেছে,              কত যে হরিণ সেথা করিতেছে খেলা।    আবার দেখাব সেই অরণ্যের নির্ঝরিণী,   আবার নদীর ধারে লয়ে যাব আমি,    পাখী এক আছে মোর সে যে কত গায় গান--              নাম ধোরে ডাকে মোরে "নলিনী' "নলিনী'।    যা আছে আমার কিছু সব আমি দেখাইব,              সব আমি শুনাইব যত জানি গান--    আসিবে কি পান্থ ওই বনের কুটীরমাঝে?"              এতেক শুনিয়া কবি চলিল কুটীরে।    কি সুখে থাকিত কবি, বিজন কুটীরে সেই              দিনগুলি কেটে যেত মুহূর্তের মত--    কি শান্ত সে বনভূমি, নাই লোক নাই জন,              শুধু সে কুটীরখানি আছে এক ধারে।    আঁধার তরুর ছায়ে-- নীরব শান্তির কোলে              দিবস যেন রে সেথা রহিত ঘুমায়ে।    পাখীর অস্ফুট গান, নির্ঝরের ঝরঝর              স্তব্ধতারে আরো যেন দিত মিষ্ট করি।    আগে এক দিন কবি মুগ্ধ প্রকৃতির রূপে              অরণ্যে অরণ্যে একা করিত ভ্রমণ,    এখন দুজনে মিলি ভ্রমিয়া বেড়ায় সেথা,              দুই জন প্রকৃতির বালক বালিকা।    সুদূর কাননতলে কবিরে লইয়া যেত              নলিনী, সে যেন এক বনেরি দেবতা।    শ্রান্ত হোলে পথশ্রমে ঘুমাত কবির কোলে,              খেলিত বনের বায়ু কুন্তল লইয়া,    ঘুমন্ত মুখের পানে চাহিয়া রহিত কবি--              মুখে যেন লিখা আছে আরণ্য কবিতা।    "একি দেবি কলপনা, এত সুখ প্রণয়ে যে              আগে তাহা জানিতাম না ত!    কি এক অমৃতধারা ঢেলেছ প্রাণের 'পরে              হে প্রণয় কহিব কেমনে?    অন্য এক হৃদয়েরে হৃদয় করা গো দান,              সে কি এক স্বর্গীয় আমোদ।    এক গান গায় যদি দুইটি হৃদয়ে মিলি,              দেখে যদি একই স্বপন,    এক চিন্তা এক আশা এক ইচ্ছা দুজনার,              এক ভাবে দুজনে পাগল,    হৃদয়ে হৃদয়ে হয় সে কি গো সুখের মিল--              এ জনমে ভাঙ্গিবে না তাহা।    আমাদের দুজনের হৃদয়ে হৃদয়ে দেবি              তেমনি মিশিয়া যায় যদি--    এক সাথে এক স্বপ্ন দেখি যদি দুই জনে              তা হইলে কি হয় সুন্দর!    নরকে বা স্বর্গে থাকি, অরণ্যে বা কারাগারে              হৃদয়ে হৃদয়ে বাঁধা হোয়ে--    কিছু ভয় করি নাকো--বিহ্বল প্রণয়ঘোরে              থাকি সদা মরমে মজিয়া।    তাই হোক্‌--হোক্‌ দেবি আমাদের দুই জনে              সেই প্রেম এক কোরে দিক্‌।    মজি স্বপনের ঘোরে হৃদয়ের খেলা খেলি              যেন যায় জীবন কাটিয়া।"    নিশীথে একেলা হোলে এইরূপ কত গান              বিরলে গাইত কবি বসিয়া বসিয়া।    সুখ বা দুখের কথা বুকের ভিতরে যাহা              দিন রাত্রি করিতেছে আলোড়িত-প্রায়,    প্রকাশ না হোলে তাহা,মরমের গুরুভারে              জীবন হইয়া পড়ে দারুণ ব্যথিত।    কবি তার মরমের প্রণয় উচ্ছ্বাস-কথা              কি করি যে প্রকাশিবে পেত না ভাবিয়া।    পৃথিবীতে হেন ভাষা নাইক, মনের কথা              পারে যাহা পূর্ণভাবে করিতে প্রকাশ।    ভাব যত গাঢ় হয়, প্রকাশ করিতে গিয়া              কথা তত না পায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া।    বিষাদ যতই হয় দারুণ অন্তরভেদী,              অশ্রুজল তত যায় শুকায়ে যেমন!    মরমের ভার-সম হৃদয়ের কথাগুলি              কত দিন পারে বল চাপিয়া রাখিতে?    একদিন ধীরে ধীরে বালিকার কাছে গিয়া              অশান্ত বালক-মত কহিল কত কি!    অসংলগ্ন কথাগুলি, মরমের ভাব আরো              গোলমাল করি দিল প্রকাশ না করি।    কেবল অশ্রুর জলে, কেবল মুখের ভাবে              পড়িল বালিকা তার মনের কি কথা!    এই কথাগুলি যেন পড়িল বালিকা ধীরে--              "কত ভাল বাসি বালা কহিব কেমনে!     তুমিও সদয় হোয়ে আমার সে প্রণয়ের              প্রতিদান দিও বালা এই ভিক্ষা চাই।"    গড়ায়ে পড়িল ধীরে বালিকার অশ্রুজল,              কবির অশ্রুর সাথে মিশিল কেমন--    স্কন্ধে তার রাখি মাথা কহিল কম্পিত স্বরে,              "আমিও তোমারে কবি বাসি না কি ভাল?"    কথা না স্ফুরিল আর, শুধু অশ্রুজলরাশি              আরক্ত কপোল তার করিল প্লাবিত।    এইরূপ মাঝে মাঝে অশ্রুজলে অশ্রুজলে              নীরবে গাইত তারা প্রণয়ের গীত।    অরণ্যে দুজনে মিলি আছিল এমন সুখে              জগতে তারাই যেন আছিল দুজন--    যেন তারা সুকোমল ফুলের সুরভি শুধু,              যেন তারা অপ্সরার সুখের সঙ্গীত।    আলুলিত চুলগুলি সাজাইয়া বনফুলে              ছুটিয়া আসিত বালা কবির কাছেতে,    একথা ওকথা লয়ে কি যে কি কহিত বালা              কবি ছাড়া আর কেহ বুঝিতে নারিত।    কভু বা মুখের পানে সে যে কি রহিত চেয়ে,              ঘুমায়ে পড়িত যেন হৃদয় কবির।    কভু বা কি কথা লয়ে সে যে কি হাসিত হাসি,              তেমন সরল হাসি দেখ নি কেহই।    আঁধার অমার রাত্রে একাকী পর্ব্বতশিরে              সেও গো কবির সাথে রহিত দাঁড়ায়ে,    উনমত্ত ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎ আশনি আর              পর্ব্বতের বুকে যবে বেড়াত মাতিয়া,    তাহারো হৃদয় যেন নদীর তরঙ্গ-সাথ              করিত গো মাতামাতি হেরি সে বিপ্লব--    করিত সে ছুটাছুটি, কিছুতে সে ডরিত না,              এমন দুরন্ত মেয়ে দেখি নি ত আর!    কবি যা কহিত কথা শুনিত কেমন ধীরে,              কেমন মুখের পানে রহিত চাহিয়া।    বনদেবতার মত এমন সে এলোথেলো,              কখনো দুরন্ত অতি ঝটিকা যেমন,    কখনো এমন শান্ত প্রভাতের বায়ু যথা              নীরবে শুনে গো যবে পাখীর সঙ্গীত।    কিন্তু, কলপনা, যদি কবির হৃদয় দেখ              দেখিবে এখনো তাহা পূর্ণ হয় নাই।    এখনো কহিছে কবি, "আরো দাও ভালবাসা,              আরো ঢালো' ভালবাসা হৃদয়ে আমার।"    প্রেমের অমৃতধারা এত যে করেছে পান,              তবু মিটিল না কেন প্রণয়পিপাসা?    প্রেমের জোছনাধারা যত ছিল ঢালি বালা              কবির সমুদ্র-হৃদি পারে নি পূরিতে।    স্বাধীন বিহঙ্গ-সম, কবিদের তরে দেবি              পৃথিবীর কারাগার যোগ্য নহে কভু।    অমন সমুদ্র-সম আছে যাহাদের মন              তাহাদের তরে দেবি নহে এ পৃথিবী।    তাদের উদার মন আকাশে উড়িতে যায়,              পিঞ্জরে ঠেকিয়া পক্ষ নিম্নে পড়ে পুনঃ,    নিরাশায় অবশেষে ভেঙ্গে চুরে যায় মন,              জগৎ পূরায় তার আকুল বিলাপে।    কবির সমুদ্র-বুক পূরাতে পারিবে কিসে              প্রেম দিয়া ক্ষুদ্র ওই বনের বালিকা।    কাতর ক্রন্দনে আহা আজিও কাঁদিল কবি,              "এখনও পূরিল না প্রাণের শূন্যতা।"    বালিকার কাছে গিয়া কাতরে কহিল কবি,              "আরো দাও ভালবাসা হৃদয়ে ঢালিয়া।    আমি যত ভালবাসি তত দাও ভালবাসা,              নহিলে গো পূরাবে না এ প্রাণের শূন্যতা।"    শুনিয়া কবির কথা কাতরে কহিল বালা,              "যা ছিল আমার কবি দিয়েছি সকলি--    এ হৃদয়, এ পরাণ, সকলি তোমার কবি,              সকলি তোমার প্রেমে দেছি বিসর্জ্জন।    তোমার ইচ্ছার সাথে ইচ্ছা মিশায়েছি মোর,              তোমার সুখের সাথে মিশায়েছি সুখ।"    সে কথা শুনিয়া কবি কহিল কাতর স্বরে,              "প্রাণের শূন্যতা তবু ঘুচিল না কেন?    ওই হৃদয়ের সাথে মিশাতে চাই এ হৃদি,              দেহের আড়াল তবে রহিল গো কেন?    সারাদিন সাধ যায় সুধাই মনের কথা,              এত কথা তব কেন পাই না খুঁজিয়া?    সারাদিন সাধ যায় দেখি ও মুখের পানে,              দেখেও মিটে না কেন আঁখির পিপাসা?    সাধ যায় এ জীবন প্রাণ ভোরে ভাল বাসি,              বেসেও প্রাণের শূন্য ঘুচিল না কেন?    আমি যত ভালবাসি তত দাও ভালবাসা,              নহিলে গো পূরিবে না প্রাণের শূন্যতা।    একি দেবি! একি তৃষ্ণা জ্বলিছে হৃদয়ে মোর,              ধরার অমৃত যত করিয়াছি পান,    প্রকৃতির কাছে যত তরল স্বর্গীয় গীতি,              সকলি হৃদয়ে মোর দিয়াছি ঢালিয়া--    শুধু দেবি পৃথিবীর হলাহল আছে যত              তাহাই করি নি পান মিটাতে পিপাসা!    শুধু দেবি ঐশ্বর্য্যের কনকশৃঙ্খল দিয়া              বাঁধি নাই আমার এ স্বাধীন হৃদয়!    শুধু দেবি মিটাইতে মনের বীরত্ব-গর্ব্ব              লক্ষ মানবের রক্তে ধুই নি চরণ!    শুধু দেবি এ জীবনে নিশাচর বিলাসেরে              সুখ-স্বাস্থ্য অর্ঘ্য দিয়া করি নাই সেবা!    তবু কেন হৃদয়ের তৃষা মিটিল না মোর,              তবু কেন ঘুচিল না প্রাণের শূন্যতা?    শুনেছি বিলাসসুরা বিহ্বল করিয়া হৃদি              ডুবাইয়া রাখে সদা বিস্মৃতির ঘুমে!    কিন্তু দেবি-- কিন্তু দেবি-- এত যে পেয়েছি কষ্ট,              বিস্মৃতি চাই নে তবু বিস্মৃতি চাই নে!--    সে কি ভয়ানক দশা, কল্পনাও শিহরে গো--              স্বর্গীয় এ হৃদয়ের জীবনে মরণ!    আমার এ মন দেবি হোক্‌ মরুভূমি-সম              তৃণলতা-জল-শূন্য জ্বলন্ত প্রান্তর,    তবুও তবুও আমি সহিব তা প্রাণপণে,              বহিব তা যত দিন রহিব বাঁচিয়া,    মিটাতে মনের তৃষা ত্রিভুবন পর্য্যটিব,              হত্যা করিব না তবু হৃদয় আমার।    প্রেম ভক্তি স্নেহ আদি মনের দেবতা যত              যতনে রেখেছি আমি মনের মন্দিরে,    তাঁদের করিতে পূজা ক্ষমতা নাইকো ব'লে              বিসর্জ্জন করিবারে পারিব না আমি।    কিন্তু ওগো কলপনা আমার মনের কথা              বুঝিতে কে পারিবেক বল দেখি দেবি?    আমার ব্যথার মর্ম্ম কারে বুঝাইবে বল--              বুঝাইতে না পারিলে বুক যায় ফেটে।    যদি কেহ বলে দেবি "তোমার কিসে দুখ,              হৃদয়ের বিনিময়ে পেয়েছ হৃদয়,    তবে কাল্পনিক দুখে এত কেন ম্রিয়মাণ?'              তবে কি বলিয়া আমি দিব গো উত্তর?    উপায় থাকিতে তবু যে সহে বিষাদজ্বালা              পৃথিবী তাহারি কষ্টে হয় গো ব্যথিত--    আমার এ বিষাদের উপায় নাইক কিছু,              কারণ কি তাও দেবি পাই না খুঁজিয়া।    পৃথিবী আমার কষ্ট বুঝুক্‌ বা না বুঝুক্‌,              নলিনীরে কি বলিয়া বুঝাইব দেবি?    তাহারে সামান্য কথা গোপন করিলে পরে              হৃদয়ে কি কষ্ট হয় হৃদয় তা জানে।    এত তারে ভালবাসি, তবু কেন মনে হয়              ভালবাসা হইল না আশ মিটাইয়া!    আঁধার সমুদ্রতলে কি যেন বেড়াই খুঁজে,              কি যেন পাইতেছি না চাহিতেছি যাহা।    বুকের যেখানে তারে রাখিতে চাই গো আমি              সেখানে পাই নে যেন রাখিতে তাহারে--    তাইতে অন্তর বুক এখনো পূরিতেছে না,              তাইতে এখনো শূন্য রয়েছে হৃদয়।"    কবির প্রণয়সিন্ধু ক্ষুদ্র বালিকার মন              রেখেছিল মগ্ন করি অগাধ সলিলে--    উপরে যে ঝড় ঝঞ্ঝা কত কি বহিয়া যেত              নিম্নে তার কোলাহল পেত না শুনিতে,    প্রণয়ের অবিচিত্র নিয়তনূতন তবু              তরঙ্গের কলধ্বনি শুনিত কেবল,    সেই একতান ধ্বনি শুনিয়া শুনিয়া তার              হৃদয় পড়িয়াছিল ঘুমায়ে কেমন!    বনের বালিকা আহা সে ঘুমে বিহ্বল হোয়ে              কবির হৃদয়ে রাখি অবশ মস্তক    স্বর্গের স্বপন শুধু দেখিত দিবস রাত,              হৃদয়ের হৃদয়ের অনন্ত মিলন।    বালিকার সে হৃদয়ে সে প্রণয়মগ্ন হৃদে,              অবশিষ্ট আছিল না এক তিল স্থান--    আর কিছু জানিত না, আর কিছু ভাবিত না,              শুধু সে বালিকা ভাল বাসিত কবিরে।    শুধু সে কবির গান কত যে লাগিত ভাল,              শুনে শুনে শুনা তার ফুরাত না আর।    শুধু সে কবির নেত্র কি এক স্বর্গীয় জ্যোতি              বিকীরিত, তাই হেরি হইত বিহ্বল!    শুধু সে কবির কোলে ঘুমাতে বাসিত ভাল,              কবি তার চুল লয়ে করিত কি খেলা।    শুধু সে কবিরে বালা শুনতে বাসিত ভাল              কত কি--কত কি কথা অর্থ নাই যার,    কিন্তু সে কথায় কবি কত যে পাইত অর্থ              গভীর সে অর্থ নাই কত কবিতার--    সেই অর্থহীন কথা, হৃদয়ের ভাব যত              প্রকাশ করিতে পারে না এমন কিছু না।    একদিন বালিকারে কবি সে কহিল গিয়া--              "নলিনি! চলিনু আমি ভ্রমিতে পৃথিবী!    আর একবার বালা কাশ্মীরের বনে বনে              যাই গো শুনিতে আমি পাখীর কবিতা!    রুসিয়ার হিমক্ষেত্রে আফ্রিকার মরুভূমে              আর একবার আমি করি গে ভ্রমণ!    এইখানে থাক তুমি, ফিরিয়া আসিয়া পুনঃ              ওই মধুমুখখানি করিব চুম্বন।"    এতেক কহিয়া কবি নীরবে চলিয়া গেল              গোপনে মুছিয়া ফেলি নয়নের জল।    বালিকা নয়ন তুলি নীরবে রহিল চাহি,              কি দেখিছে সেই জানে অনিমিষ চখে।    সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে তবুও রহিল চাহি,              তবুও ত পড়িল না নয়নে নিমেষ।    অনিমিষ নেত্র ক্রমে করিয়া প্লাবিত              একবিন্দু দুইবিন্দু ঝরিল সলিল।    বাহুতে লুকায়ে মুখ কাতর বালিকা              মর্ম্মভেদী অশ্রুজলে করিল রোদন।    হা-হা কবি কি করিলে,ফিরে দেখ, ফিরে এস,              দিও না বালার হৃদে অমন আঘাত--    নীরবে বালার আহা কি বজ্র বেজেছে বুকে,              গিয়াছে কোমল মন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া!    হা কবি অমন কোরে অনর্থক তার মনে              কি আঘাত করিলে যে বুঝিলে না তাহা?    এত কাল সুখস্বপ্ন ডুবায়ে রাখিয়া মন,              এত দিন পরে তাহা দিবে কি ভাঙ্গিয়া?    কবি ত চলিয়া যায়-- সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে,              আঁধারে কাননভূমি হইল গম্ভীর--    একটি নড়ে না পাতা, একটু বহে না বায়ু,              স্তব্ধ বন কি যেন কি ভাবিছে নীরবে!    তখন বনান্ত হোতে সুধীরে শুনিল কবি              উঠিছে নীরব শূন্যে বিষণ্ণ সঙ্গীত--    তাই শুনি বন যেন রয়েছে নীরবে অতি,              জোনাকি নয়ন শুধু মেলিছে মুদিছে।    একবার কবি শুধু চাহিল কুটীরপানে,              কাতরে বিদায় মাগি বনদেবী-কাছে    নয়নের জল মুছি-- যে দিকে নয়ন চলে              সে দিকে পথিক কবি যাইল চলিয়া।                        সঙ্গীত             কেন ভালবাসিলে আমায়?              কিছুই নাইক গুণ, কিছুই জানি না আমি,              কি আছে? কি দিয়ে তব তুষিব হৃদয়!   যা আমার ছিল সাধ্য সকলি করেছি আমি              কিছুই করি নি দোষ চরণে তোমার,   শুধু ভাল বাসিয়াছি, শুধু এ পরান মন              উপহার সঁপিয়াছি তোমার চরণে।   তাতেও তোমার মন তুষিতে নারিনু যদি              তবে কি করিব বল, কি আছে আমার?   গেলে যদি, গেলে চলি, যাও যেথা ভাল লাগে--              একবার মনে কোরো দীন অধীনীরে।   ভ্রমিতে ধরার মাঝে যত ভালবাসা পাবে,              তাতে যদি ভাল থাক তাই হোক্‌ তবে--   তবু একবার যদি মনে কর নলিনীরে              যে দুখিনী, যে তোমারে এত ভালবাসে!   কি করিলে মন তব পারিতাম জুড়াইতে              যদি জানিতাম কবি করিতাম তাহা!   আমি অতি অভাগিনী জানি না বলিয়া যেন              বিরক্ত হোয়ো না কবি এই ভিক্ষা দাও!   না জানিয়া না শুনিয়া যদি দোষ করে থাকি,   ক্ষুদ্র আমি, ক্ষমা তবে করিয়ো আমারে--   তুমি ভাল থেকো কবি,ক্ষুদ্র এক কাঁটা যেন              ফুটে না তোমার পায়ে ভ্রমিতে পৃথিবী।   জননি, কোথায় তুমি রেখে গেলে দুহিতারে?              কত দিন একা একা কাটালাম হেথা,   একেলা তুলিয়া ফুল কত মালা গাঁথিতাম,              একেলা কাননময় করিতাম খেলা!   তোমার বীণাটি ল'য়ে, উঠিয়া পর্ব্বতশিরে              একেলা আপন মনে গাইতাম গান--   হরিণশিশুটি মোর বসিত পায়ের তলে,              পাখীটি কাঁধের 'পরে শুনিত নীরবে।   এইরূপ কত দিন কাটালেম বনে বনে,              কত দিন পরে তবে এলে তুমি কবি!   তখন তোমারে কবি কি যে ভালবাসিলাম   এত ভাল কাহারেও বাসি নাই কভু।   দূর স্বরগের এক জ্যোতির্ম্ময় দেব-সম              কত বার মনে মনে করেছি প্রণাম।   দূর থেকে আঁখি ভরি দেখিতাম মুখখানি,              দূর থেকে শুনিতাম মধুময় গান।   যে দিন আপনি আসি কহিলে আমার কাছে              ক্ষুদ্র এই বালিকারে ভালবাস তুমি,   সে দিন কি হর্ষে কবি কি আনন্দে কি উচ্ছ্বাসে              ক্ষুদ্র এ হৃদয় মোর ফেটে গেল যেন।   আমি কোথাকার কেবা! আমি ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র,              স্বর্গের দেবতা তুমি ভালবাস মোরে?   এত সৌভাগ্য, কবি, কখনো করি নি আশা--              কখনো মুহূর্ত্ত-তরে জানি নি স্বপনে।   যেথায় যাও-না কবি, যেথায় থাক-না তুমি,              আমরণ তোমারেই করিব অর্চ্চনা।   মনে রাখ নাই রাখ, তুমি যেন সুখে থাক              দেবতা! এ দুখিনীর শুন গো প্রার্থনা। দ্বিধা এসেছিলু তবু আস নাই, তাই জানায়ে গেলে সমুখের পথে পলাতকা পদ-পতন ফেলে। তোমার সে উদাসীনতা উপহাসভরে জানালো কি মোর দীনতা। সে কি চল-করা অবহেলা, জানি না সে- চপল চরণ সত্য কি ঘাসে ঘাসে গেল উপেক্ষা মেলে। পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা ঝরে জল, ছলছল করে শ্যাম বনাস্ততল।তুমি কোথা দুরে কুঞ্জছায়াতে মিলে গেলে কলমুখর মায়াতে, পিছে পিছে তব ছায়ারৌদ্রের খেলা গেলে তুমি খেলে। বাহিরেতে ধরণীর খেলা খুঁজে ধরণীর খেলা খুঁজে শিশু শুকতারা তিমিররজনীতীরে এল পথহারা। উষা তারে ডাক দিয়ে ফিরে নিয়ে যায়, আলোকের ধন বুঝি আলোকে মিলায়।   (স্ফুলিঙ্গ) ধরাতল ছোটো কথা, ছোটো গীত, আজি মনে আসে। চোখে পড়ে যাহা-কিছু হেরি চারি পাশে। আমি যেন চলিয়াছি বাহিয়া তরণী, কূলে কূলে দেখা যায় শ্যামল ধরণী। সবই বলে, “যাই যাই” নিমেষে নিমেষে, ক্ষণকাল দেখি ব’লে দেখি ভালোবেসে। তীর হতে দুঃখ সুখ দুই ভাইবোনে মোর মুখপানে চায় করুণ নয়নে। ছায়াময় গ্রামগুলি দেখা যায় তীরে, মনে ভাবি কত প্রেম আছে তারে ঘিরে। যবে চেয়ে চেয়ে দেখি উৎসুক নয়ানে আমার পরান হতে ধরার পরানে— ভালোমন্দ দুঃখসুখ অন্ধকার-আলো, মনে হয়, সব নিয়ে এ ধরণী ভালো।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ধীরু কহে শূন্যেতে মজো রে ধীরু কহে শূন্যেতে মজো রে, নিরাধার সত্যেরে ভজো রে। এত বলি যত চায় শূন্যেতে ওড়াটা কিছুতে কিছু-না-পানে পৌঁছে না ঘোড়াটা, চাবুক লাগায় তারে সজোরে। ছুটে মরে সারারাত, ছুটে মরে সারাদিন– হয়রান হয়ে তবু আমিহীন ঘোড়াহীন আপনারে নাহি পড়ে নজরে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ধীরে সন্ধ্যা আসে ধীরে সন্ধ্যা আসে, একে একে গ্রন্থি যত যায় স্খলি প্রহরের কর্মজাল হতে। দিন দিল জলাঞ্জলি খুলি পশ্চিমের সিংহদ্বার সোনার ঐশ্বর্য তার অন্ধকার আলোকের সাগরসংগমে। দূর প্রভাতের পানে নত হয়ে নিঃশব্দে প্রণমে। চক্ষু তার মুদে আসে,এসেছে সময় গভীর ধানের তলে আপনার বাহ্য পরিচয় করিতে মগন। নক্ষত্রের শান্তিক্ষেত্র অসীম গগন যেথা ঢেকে রেখে দেয় দিনশ্রীর অরূপ সত্তারে, সেথায় করিতে লাভ সত্য আপনারে খেয়া দেয় রাত্রি পারাবারে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে, গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে। সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে, ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে। ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ, রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া। অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা। প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি, ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা, বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি, মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ধ্বনি জন্মেছিনু সূক্ষ্ম তারে বাঁধা মন নিয়া ,                      চারি দিক হতে শব্দ উঠিত ধ্বনিয়া                                     নানা কম্পে নানা সুরে                             নাড়ীর জটিল জালে ঘুরে ঘুরে ।                      বালকের মনের অতলে দিত আনি                             পাণ্ডুনীল আকাশের বাণী                                     চিলের সুতীক্ষ্ণ সুরে                                           নির্জন দুপুরে ,                      রৌদ্রের প্লাবনে যবে চারি ধার                             সময়েরে করে দিত একাকার                                     নিষ্কর্ম তন্দ্রার তলে ।                      ওপাড়ার কুকুরের সুদূর কলকোলাহলে            মনেরে জাগাত মোর অনির্দিষ্ট ভাবনার পারে                                     অস্পষ্ট সংসারে ।                      ফেরিওলাদের ডাক সূক্ষ্ম হয়ে কোথা যেত চলি ,                                     যে-সকল অলিগলি                                                 জানি নি কখনো                                           তারা যেন কোনো                                       বোগদাদের বসোরার                                            পরদেশী পসরার                             স্বপ্ন এনে দিত বহি ।                                     রহি রহি                     রাস্তা হতে শোনা যেত সহিসের ডাক ঊর্ধ্বস্বরে ,                                     অন্তরে অন্তরে                              দিত সে ঘোষণা কোন্‌ অস্পষ্ট বার্তার ,                                     অসম্পন্ন উধাও যাত্রার ।                             একঝাঁক পাতিহাঁস                                     টলোমলো গতি নিয়ে উচ্চকলভাষ                                            পুকুরে পড়িত ভেসে ।                      বটগাছ হতে বাঁকা রৌদ্ররশ্মি এসে তাদের সাঁতার-কাটা জলে                                      সবুজ ছায়ার তলে                      চিকন সাপের মতো পাশে পাশে মিলি খেলাত আলোর কিলিবিলি ।                                     বেলা হলে            হলদে গামছা কাঁধে হাত দোলাইয়া যেত চলে                             কোন্‌খানে কে যে ।                      ইস্কুলে উঠিত ঘণ্টা বেজে ।                             সে ঘণ্টার ধ্বনি            নিরর্থ আহ্বানঘাতে কাঁপাইত আমার ধমনী ।                      রৌদ্রক্লান্ত ছুটির প্রহরে                  আলস্যে-শিথিল শান্তি ঘরে ঘরে ;                             দক্ষিণে গঙ্গার ঘাট থেকে                                     গম্ভীরমন্দ্রিত হাঁক হেঁকে                             বাষ্পশ্বাসী সমুদ্র-খেয়ার ডিঙা                                     বাজাইত শিঙা ,                             রৌদ্রের প্রান্তর বহি                      ছুটে যেত দিগন্তে শব্দের অশ্বারোহী ।                             বাতায়নকোণে                                      নির্বাসনে                      যবে দিন যেত বয়ে            না-চেনা ভুবন হতে ভাষাহীন নানা ধ্বনি লয়ে                   প্রহরে প্রহরে দূত ফিরে ফিরে                      আমারে ফেলিত ঘিরে ।            জনপূর্ণ জীবনের যে আবেগ পৃথ্বীনাট্যশালে                                      তালে ও বেতালে                                           করিত চরণপাত ,                                                 কভু অকস্মাৎ                                     কভু মৃদুবেগে ধীরে                             ধ্বনিরূপে মোর শিরে            স্পর্শ দিয়ে চেতনারে জাগাইত ধোঁয়ালি চিন্তায় ,                      নিয়ে যেত সৃষ্টির আদিম ভূমিকায় । চোখে দেখা এ বিশ্বের গভীর সুদূরে                                     রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে                      ছন্দের মন্দিরে বসি রেখা-জাদুকর কাল             আকাশে আকাশে নিত্য প্রসারে বস্তুর ইন্দ্রজাল ।                              যুক্তি নয় , বুদ্ধি নয় ,                      শুধু যেথা কত কী যে হয় —            কেন হয় কিসে হয় সে প্রশ্নের কোনো                          নাহি মেলে উত্তর কখনো ।            যেথা আদিপিতামহী পড়ে বিশ্ব-পাঁচালির ছড়া                        ইঙ্গিতের অনুপ্রাসে গড়া —            কেবল ধ্বনির ঘাতে বক্ষস্পন্দে দোলন দুলায়ে                             মনেরে ভুলায়ে                      নিয়ে যায় অস্তিত্বের ইন্দ্রজাল যেই কেন্দ্রস্থলে ,                বোধের প্রত্যুষে যেথা বুদ্ধির প্রদীপ নাহি জ্বলে । ধ্যান যত ভালোবাসি, যত হেরি বড়ো ক’রে তত, প্রিয়তমে, আমি সত্য হেরি তোরে। যত অল্প করি তোরে, তত অল্প জানি— কখনো হারায়ে ফেলি, কভু মনে আনি। আজি এ বসন্তদিনে বিকশিতমন হেরিতেছি আমি এক অপূর্ব স্বপন— যেন এ জগৎ নাহি, কিছু নাহি আর, যেন শুধু আছে এক মহাপারাবার, নাহি দিন নাহি রাত্রি নাহি দন্ড পল, প্রলয়ের জলরাশি স্তব্ধ অচঞ্চল; যেন তারি মাঝখানে পূর্ণ বিকাশিয়া একমাত্র পদ্ম তুমি রয়েছ ভাসিয়া; নিত্যকাল মহাপ্রেমে বসি বিশ্বভূপ তোমামাঝে হেরিছেন আত্মপ্রতিরূপ।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ধ্রুবসত্য আমি বিন্দুমাত্র আলো, মনে হয় তবু আমি শুধু আছি আর কিছু নাই কভু। পলক পড়িল দেখি আড়ালে আমার তুমি আছ হে অনাদি আদি অন্ধকার!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের রসপাত্রগুলি আনিল এ শয্যাতলে জনহীন প্রভাতের রবির মিত্রতা, অজানা নির্ঝরিণীর বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটার হিরন্ময় লিপি, সুনিবিড় অরণ্যবীথির নিঃশব্দ মর্মরে বিজড়িত স্নিগ্ধ হৃদয়ের দৌত্যখানি। রোগপঙ্গু লেখনীর বিরল ভাষার ইঙ্গিতে পাঠায় কবি আর্শীবাদ তার।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) নতিস্বীকার তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয় তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়, অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নতুন রঙ এ ধূসর জীবনের গোধূলী, ক্ষীণ তার উদাসীন স্মৃতি, মুছে-আসা সেই ম্লান ছবিতে রঙ দেয় গুঞ্জনগীতি।ফাগুনের চম্পকপরাগে সেই রঙ জাগে, ঘুমভাঙা কোকিলের কূজনে সেই রঙ লাগে, সেই রঙ পিয়ালের ছায়াতে ঢেলে দেয় পুর্ণিমাতিথি।এই ছবি ভেরবী-আলাপে দোলে মোর কম্পিত বক্ষে, সেই ছবি সেতারের প্রলাপে মরীচিকা এনে দেয় চক্ষে, বুকের লালিম-রঙে রাঙানো সেই ছবি স্বপ্নের অতিথি। নদী ওরে তোরা কি জানিস কেউ জলে কেন ওঠে এত ঢেউ । ওরা দিবস - রজনী নাচে , তাহা শিখেছে কাহার কাছে । শোন্‌ চলচল্‌ ছলছল্‌ সদাই গাহিয়া চলেছে জল । ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে , ওরা কার কোলে ব'সে দুলে । সদা হেসে করে লুটোপুটি , চলে কোন্‌খানে ছুটোছুটি । ওরা সকলের মন তুষি আছে আপনার মনে খুশি ।    আমি বসে বসে তাই ভাবি , নদী কোথা হতে এল নাবি । কোথায় পাহাড় সে কোন্‌খানে , তাহার নাম কি কেহই জানে । কেহ যেতে পারে তার কাছে , সেথায় মানুষ কি কেউ আছে । সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস , নাহি পশুপাখিদের বাস , সেথা শবদ কিছু না শুনি , পাহাড় বসে আছে মহামুনি ।    তাহার মাথার উপরে শুধু সাদা বরফ করিছে ধু ধু । সেথা রাশি রাশি মেঘ যত থাকে ঘরের ছেলের মতো । শুধু হিমের মতন হাওয়া সেথায় করে সদা আসা - যাওয়া , শুধু সারা রাত তারাগুলি তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি । শুধু ভোরের কিরণ এসে তারে মুকুট পরায় হেসে । সেই নীল আকাশের পায়ে সেথা কোমল মেঘের গায়ে সেথা সাদা বরফের বুকে নদী ঘুমায় স্বপনসুখে । কবে মুখে তার রোদ লেগে নদী আপনি উঠিল জেগে , কবে একদা রোদের বেলা তাহার মনে পড়ে গেল খেলা । সেখায় একা ছিল দিনরাতি , কেহই ছিল না খেলার সাথি । সেথায় কথা নাহি কারো ঘরে , সেথায় গান কেহ নাহি করে । তাই ঝুরু ঝুরু ঝিরি ঝিরি । নদী বাহিরিল ধীরি ধীরি । মনে ভাবিল , যা আছে ভবে সবই দেখিয়া লইতে হবে ।    নীচে পাহাড়ের বুক জুড়ে গাছ উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে । তারা বুড়ো বুড়ো তরু যত তাদের বয়স কে জানে কত । তাদের খোপে খোপে গাঁঠে গাঁঠে পাখি বাসা বাঁধে কুটো - কাঠে । তারা ডাল তুলে কালো কালো আড়াল করেছে রবির আলো । তাদের শাখায় জটার মতো ঝুলে পড়েছে শেওলা যত । তারা মিলায়ে মিলায়ে কাঁধ যেন পেতেছে আঁধার - ফাঁদ । তাদের তলে তলে নিরিবিলি নদী হেসে চলে খিলিখিলি । তারে কে পারে রাখিতে ধরে , সে যে ছুটোছুটি যায় সরে । সে যে সদা খেলে লুকোচুরি , তাহার পায়ে পায়ে বাজে নুড়ি । পথে শিলা আছে রাশি রাশি , তাহা ঠেলে চলে হাসি হাসি । পাহাড় যদি থাকে পথ জুড়ে নদী হেসে যায় বেঁকেচুরে । সেথায় বাস করে শিং - তোলা যত বুনো ছাগ দাড়ি - ঝোলা । সেথায় হরিণ রোঁয়ায় ভরা তারা কারেও দেয় না ধরা । সেথায় মানুষ নূতনতর , তাদের শরীর কঠিন বড়ো । তাদের চোখ দুটো নয় সোজা , তাদের কথা নাহি যায় বোঝা । তারা পাহাড়ের ছেলেমেয়ে সদাই কাজ করে গান গেয়ে । তারা সারা দিনমান খেটে আনে বোঝাভরা কাঠ কেটে । তারা চড়িয়া শিখর -' পরে বনের হরিণ শিকার করে ।    নদী যত আগে আগে চলে ততই সাথি জোটে দলে দলে । তারা তারি মতো , ঘর হতে সবাই বাহির হয়েছে পথে । পায়ে ঠুনু ঠুনু বাজে নুড়ি , যেন বাজিতেছে মল চুড়ি । গায়ে আলো করে ঝিকিঝিক , যেন পরেছে হীরার চিক । মুখে কলকল কত ভাষে এত কথা কোথা হতে আসে । শেষে সখীতে সখীতে মেলি হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি । শেষে কোলাকুলি কলরবে তারা এক হয়ে যায় সবে । তখন কলকল ছুটে জল — কাঁপে টলমল ধরাতল , কোথাও নীচে পড়ে ঝরঝর — পাথর কেঁপে ওঠে থরথর , শিলা খান্‌ খান্‌ যায় টুটে — নদী চলে পথ কেটে কুটে । ধারে গাছগুলো বড়ো বড়ো তারা হয়ে পড়ে পড়ো - পড়ো । কত বড়ো পাথরের চাপ জলে খসে পড়ে ঝুপঝাপ । তখন মাটি - গোলা ঘোলা জলে ফেনা ভেসে যায় দলে দলে । জলে পাক ঘুরে ঘুরে ওঠে , যেন পাগলের মতো ছোটে ।    শেষে পাহাড় ছাড়িয়ে এসে নদী পড়ে বাহিরের দেশে । হেথা যেখানে চাহিয়া দেখে চোখে সকলি নূতন ঠেকে । হেথা চারি দিকে খোলা মাঠ , হেথা সমতল পথঘাট । কোথাও চাষিরা করিছে চাষ , কোথাও গোরুতে খেতেছে ঘাস । কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে । কোথাও রাখাল ছেলের দলে খেলা করিছে গাছের তলে । কোথাও নিকটে গ্রামের মাঝে লোকে ফিরিছে নানান কাজে । কোথাও বাধা কিছু নাহি পথে , নদী চলেছে আপন মতে । পথে বরষার জলধারা আসে চারি দিক হতে তারা , নদী দেখিতে দেখিতে বাড়ে , এখন কে রাখে ধরিয়া তারে ।    তাহার দুই কূলে উঠে ঘাস , সেথায় যতেক বকের বাস । সেথা মহিষের দল থাকে , তারা লুটায় নদীর পাঁকে । যত বুনো বরা সেথা ফেরে তারা দাঁত দিয়ে মাটি চেরে । সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে , রাতে হুয়া হুয়া করে ডাকে ।    দেখে এইমতো কত দেশ , কে বা গনিয়া করিবে শেষ । কোথাও কেবল বালির ডাঙা , কোথাও মাটিগুলো রাঙা রাঙা , কোথাও ধারে ধারে উঠে বেত , কোথাও দুধারে গমের খেত । কোথাও ছোটোখাটো গ্রামখানি , কোথাও মাথা তোলে রাজধানী — সেথায় নবাবের বড়ো কোঠা , তারি পাথরের থাম মোটা । তারি ঘাটের সোপান যত , জলে নামিয়াছে শত শত । কোথাও সাদা পাথরের পুলে নদী বাঁধিয়াছে দুই কূলে । কোথাও লোহার সাঁকোয় গাড়ি চলে ধকো ধকো ডাক ছাড়ি ।    নদী এইমতো অবশেষে এল নরম মাটির দেশে । হেথা যেথায় মোদের বাড়ি নদী আসিল দুয়ারে তারি । হেথায় নদী নালা বিল খালে দেশ ঘিরেছে জলের জালে । কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে , কত ছেলেরা সাঁতার কাটে ; কত জেলেরা ফেলিছে জাল , কত মাঝিরা ধরেছে হাল , সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি , কত খেয়া - তরী দেয় পাড়ি ।    কোথাও পুরাতন শিবালয় তীরে সারি সারি জেগে রয় । সেথায় দু - বেলা সকালে সাঁঝে পূজার কাঁসর - ঘণ্টা বাজে । কত জটাধারী ছাইমাখা ঘাটে বসে আছে যেন আঁকা । তীরে কোথাও বসেছে হাট , নৌকা ভরিয়া রয়েছে ঘাট । মাঠে কলাই সরিষা ধান , তাহার কে করিবে পরিমাণ । কোথাও নিবিড় আখের বনে শালিক চরিছে আপন মনে । কোথাও ধু ধু করে বালুচর সেথায় গাঙশালিকের ঘর । সেথায় কাছিম বালির তলে আপন ডিম পেড়ে আসে চলে । সেথায় শীতকালে বুনো হাঁস কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস । সেথায় দলে দলে চখাচখী করে সারাদিন বকাবকি । সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে । কোথাও ধানের খেতের ধারে ঘন কলাবন বাঁশঝাঁড়ে ঘন আম - কাঁঠালের বনে গ্রাম দেখা যায় এক কোণে । সেথা আছে ধান গোলাভরা , সেথা খড়গুলা রাশ - করা । সেথা গোয়ালেতে গোরু বাঁধা কত কালো পাটকিলে সাদা । কোথাও কলুদের কুঁড়েখানি , সেথায় ক্যাঁ কোঁ ক'রে ঘোরে ঘানি । কোথাও কুমারের ঘরে চাক , দেয় সারাদিন ধরে পাক । মুদি দোকানেতে সারাখন বসে পড়িতেছে রামায়ণ । কোথাও বসি পাঠশালা - ঘরে যত ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ে , বড়ো বেতখানি লয়ে কোলে ঘুমে গুরুমহাশয় ঢোলে । হেথায় এঁকে বেঁকে ভেঙে চুরে গ্রামের পথ গেছে বহু দূরে । সেথায় বোঝাই গোরুর গাড়ি ধীরে চলিয়াছে ডাক ছাড়ি । রোগা গ্রামের কুকুরগুলো ক্ষুধায় শুঁকিয়া বেড়ায় ধুলো । যেদিন পুরনিমা রাতি আসে চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে । বনে ও পারে আঁধার কালো , জলে ঝিকিমিকি করে আলো । বালি চিকিচিকি করে চরে , ছায়া ঝোপে বসি থাকে ডরে । সবাই ঘুমায় কুটিরতলে , তরী একটিও নাহি চলে । গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে , জলে ঢেউ নাহি ওঠে পড়ে । কভু ঘুম যদি যায় ছুটে কোকিল কুহু কুহু গেয়ে উঠে , কভু ও পারে চরের পাখি রাতে স্বপনে উঠিছে ডাকি ।    নদী চলেছে ডাহিনে বামে , কভু কোথাও সে নাহি থামে । সেথায় গহন গভীর বন , তীরে নাহি লোক নাহি জন । শুধু কুমির নদীর ধারে সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে । বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে , ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে । কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ , তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ । রাতে চুপিচুপি আসে ঘাটে , জল চকো চকো করি চাটে ।    হেথায় যখন জোয়ার ছোটে , নদী ফুলিয়ে ঘুলিয়ে ওঠে । তখন কানায় কানায় জল , কত ভেসে আসে ফুল ফল । ঢেউ হেসে ওঠে খলখল , তরী করি ওঠে টলমল । নদী অজগরসম ফুলে গিলে খেতে চায় দুই কূলে । আবার ক্রমে আসে ভাঁটা পড়ে , তখন জল যায় সরে সরে । তখন নদী রোগা হয়ে আসে , কাদা দেখা দেয় দুই পাশে । বেরোয় ঘাটের সোপান যত যেন বুকের হাড়ের মতো ।    নদী চলে যায় যত দূরে ততই জল ওঠে পুরে পুরে । শেষে দেখা নাহি যায় কূল , চোখে দিক হয়ে যায় ভুল । নীল হয়ে আসে জলধারা , মুখে লাগে যেন নুন - পারা । ক্রমে নীচে নাহি পাই তল , ক্রমে আকাশে মিশায় জল , ডাঙা কোন্‌খানে পড়ে রয় — শুধু জলে জলে জলময় । ওরে একি শুনি কোলাহল , হেরি একি ঘন নীল জল । ওই বুঝি রে সাগর হোথা , উহার কিনারা কে জানে কোথা । ওই লাখো লাখো ঢেউ উঠে সদাই মরিতেছে মাথা কুটে । ওঠে সাদা সাদা ফেনা যত যেন বিষম রাগের মতো । জল গরজি গরজি ধায় , যেন আকাশ কাড়িতে চায় । বায়ু কোথা হতে আসে ছুটে , ঢেউয়ে হাহা করে পড়ে লুটে । যেন পাঠশালা - ছাড়া ছেলে ছুটে লাফায়ে বেড়ায় খেলে । হেথা যতদূর পানে চাই কোথাও কিছু নাই , কিছু নাই । শুধু আকাশ বাতাস জল , শুধুই কলকল কোলাহল , শুধু ফেনা আর শুধু ঢেউ — আর নাহি কিছু নাহি কেউ ।    হেথায় ফুরাইল সব দেশ , নদীর ভ্রমণ হইল শেষ । হেথা সারাদিন সারাবেলা তাহার ফুরাবে না আর খেলা । তাহার সারাদিন নাচ গান কভু হবে নাকো অবসান । এখন কোথাও হবে না যেতে , সাগর নিল তারে বুক পেতে । তারে নীল বিছানায় থুয়ে তাহার কাদামাটি দিবে ধুয়ে । তারে ফেনার কাপড়ে ঢেকে , তারে ঢেউয়ের দোলায় রেখে , তার কানে কানে গেয়ে সুর তার শ্রম করি দিবে দূর । নদী চিরদিন চিরনিশি রবে অতল আদরে মিশি । নদীযাত্রা চলেছে তরণী মোর শান্ত বায়ুভরে। প্রভাতের শুভ্র মেঘ দিগন্তশিয়রে। বরষার ভরা নদী তৃপ্ত শিশুপ্রায় নিস্তরঙ্গ পুষ্ট-অঙ্গ নিঃশব্দে ঘুমায়। দুই কূলে স্তব্ধ ক্ষেত্র শ্যামশস্যে ভরা, আলস্যমন্থর যেন পূর্ণগর্ভা ধরা। আজি সর্ব জলস্থল কেন এত স্থির? নদীতে না হেরি তরী, জনশূন্য তীর। পরিপূর্ণ ধরা-মাঝে বসিয়া একাকী চিরপুরাতন মৃত্যু আজি ম্লান-আঁখি সেজেছে সুন্দরবেশে, কেশে মেঘভার, পড়েছে মলিন আলো ললাটে তাহার। গুঞ্জরিয়া গাহিতেছে সকরুণ তানে, ভুলায়ে নিতেছে মোর উতলা পরানে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) নদীর পালিত এই জীবন আমার নদীর পালিত এই জীবন আমার। নানা গিরিশিখরের দান নাড়ীতে নাড়ীতে তার বহে, নানা পলিমাটি দিয়ে ক্ষেত্র তার হয়েছে রচিত, প্রাণের রহস্যরস নানা দিক হতে শস্যে শস্যে লভিল সঞ্চার। পূর্বপশ্চিমের নানা গীতস্রোতজালে ঘেরা তার স্বপ্ন জাগরণ। যে নদী বিশ্বের দূতী দূরকে নিকটে আনে, অজানার অভ্যর্থনা নিয়ে আসে ঘরের দুয়ারে। সে আমার রচেছিল জন্মদিন-- চিরদিন তার স্রোতে বাঁধন-বাহিরে মোর চলমান বাসা ভেসে চলে তীর হতে তীরে। আমি ব্রাত্য, আমি পথচারী, অবারিত আতিথ্যের অন্নে পূর্ণ হয়ে ওঠে বারে বারে নির্বিচারে মোর জন্মদিবসের থালি। নদীর প্রতি খাল খাল বলে, মোর লাগি মাথা-কোটাকুটি, নদীগুলা আপনি গড়ায়ে আসে ছুটি। তুমি খাল মহারাজ, কহে পারিষদ, তোমারে জোগাতে জল আছে নদীনদ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা; শ্যালা শুনে এল, তার ডাক-নাম টঙ্কা।বলে, “হেন উপদেশ তোমারে দিয়েছে সে কে, আজও আছে রাক্ষস, হঠাৎ চেহারা দেখে রামের সেবক ব’লে করে যদি শঙ্কা।আকৃতি প্রকৃতি তব হতে পারে জম্‌কালো, দিদি যা বলুন, মুখ নয় কভু কম কালো — খামকা তাদের ভয় লাগিবে আচমকা। হয়তো বাজাবে রণডঙ্কা।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নব বৎসরে করিলাম পণ নব বৎসরে করিলাম পণ– লব স্বদেশের দীক্ষা, তব আশ্রমে তোমার চরণে হে ভারত, লব শিক্ষা। পরের ভূষণ পরের বসন তেয়াগিব আজ পরের অশন; যদি হই দীন, না হইব হীন, ছাড়িব পরের ভিক্ষা। নব বৎসরে করিলাম পণ– লব স্বদেশের দীক্ষা।না থাকে প্রাসাদ, আছে তো কুটির কল্যাণে সুপবিত্র। না থাকে নগর, আছে তব বন ফলে ফুলে সুবিচিত্র। তোমা হতে যত দূরে গেছি সরে তোমারে দেখেছি তত ছোটো করে; কাছে দেখি আজ হে হৃদয়রাজ, তুমি পুরাতন মিত্র। হে তাপস, তব পর্ণকুটির কল্যাণে সুপবিত্র।পরের বাক্যে তব পর হয়ে দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা। তোমারে ভুলিতে ফিরায়েছি মুখ, পরেছি পরের সজ্জা। কিছু নাহি গণি কিছু নাহি কহি জপিছ মন্ত্র অন্তরে রহি– তব সনাতন ধ্যানের আসন মোদের অস্থিমজ্জা। পরের বুলিতে তোমারে ভুলিতে দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।সে-সকল লাজ তেয়াগিব আজ, লইব তোমার দীক্ষা। তব পদতলে বসিয়া বিরলে শিখিব তোমার শিক্ষা। তোমার ধর্ম, তোমার কর্ম, তব মন্ত্রের গভীর মর্ম লইব তুলিয়া সকল ভুলিয়া ছাড়িয়া পরের ভিক্ষা। তব গৌরবে গরব মানিব, লইব তোমার দীক্ষা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) নবজাতক নবীন আগন্তুক,      নব যুগ তব যাত্রার পথে                    চেয়ে আছে উৎসুক।      কী বার্তা নিয়ে মর্তে এসেছ তুমি;               জীবনরঙ্গভূমি      তোমার লাগিয়া পাতিয়াছে কী আসন।          নরদেবতার পূজায় এনেছ               কী নব সম্ভাষণ।       অমরলোকের কী গান এসেছ শুনে।               তরুণ বীরের তূণে      কোন্‌ মহাস্ত্র বেঁধেছ কটির 'পরে         অমঙ্গলের সাথে সংগ্রাম-তরে।          রক্তপ্লাবনে পঙ্কিল পথে               বিদ্বেষে বিচ্ছেদে         হয়তো রচিবে মিলনতীর্থ               শান্তির বাঁধ বেঁধে। কে বলিতে পারে তোমার ললাটে লিখা      কোন্‌ সাধনার অদৃশ্য জয়টিকা।    আজিকে তোমার অলিখিত নাম                    আমরা বেড়াই খুঁজি--          আগামী প্রাতের শুকতারা-সম                    নেপথ্যে আছে বুঝি।          মানবের শিশু বারে বারে আনে                    চির আশ্বাসবাণী--               নূতন প্রভাতে মুক্তির আলো                    বুঝি-বা দিতেছে আনি। নববর্ষ এল আজি নববর্ষ এল আজি দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে; আনে নি আশার বাণী, দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়; প্রতিকূল ভাগ্য আসে হিংস্র বিভীষিকার আকারে— তখনি সে অকল্যাণ যখনি তাহারে করি ভয়। যে জীবন বহিয়াছি পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা; দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে শোধ করি তার শেষ দেনা।   (স্ফুলিঙ্গ) নবীন অতিথি ওহে     নবীন অতিথি,           তুমি   নূতন কি তুমি চিরন্তন। যুগে যুগে কোথা তুমি ছিলে সংগোপন। যতনে কত কী আনি    বেঁধেছিনু গৃহখানি, হেথা কে তোমারে বলো করেছিল নিমন্ত্রণ। কত আশা ভালোবাসা গভীর হৃদয়তলে ঢেকে রেখেছিনু বুকে, কত হাসি অশ্রুজলে! একটি না কহি বাণী      তুমি এলে মহারানী, কেমনে গোপনে মনে করিলে হে পদার্পণ।    (শিশু কাব্যগ্রন্থ) নম্রতা কহিল কঞ্চির বেড়া, ওগো পিতামহ বাঁশবন, নুয়ে কেন পড় অহরহ? আমরা তোমারি বংশে ছোটো ছোটো ডাল, তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল। বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে, নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।      হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে ॥ বাসনার বশে মন অবিরত         ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,      স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে ॥ সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ,  তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ--      নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে। তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর,সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার--      কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে ॥ জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি,    তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,      যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে। জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর      লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর--      তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে ॥(রচনাকাল: 1887) নলিনী লীলাময়ী নলিনী, চপলিনী নলিনী, শুধালে আদর করে ভালো সে কি বাসে মোরে, কচি দুটি হাত দিয়ে ধরে গলা জড়াইয়ে, হেসে হেসে একেবারে ঢলে পড়ে পাগলিনী! ভালো বাসে কি না, তবু বলিতে চাহে না কভু নিরদয়া নলিনী! যবে হৃদি তার কাছে, প্রেমের নিশ্বাস যাচে চায় সে এমন করে বিপাকে ফেলিতে মোরে, হাসে কত, কথা তবু কয় না! এমন নির্দোষ ধূর্ত চতুর সরল, ঘোমটা তুলিয়া চায় চাহনি চপল উজল অসিত-তারা-নয়না! অমনি চকিত এক হাসির ছটায় ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়, তখনি পলায় আর রয় না!Alfred Tennyson (অনুবাদ কবিতা) না চেয়ে যা পেলে তার যত দায় না চেয়ে যা পেলে তার যত দায় পুরাতে পার না তাও, কেমনে বহিবে চাও যত কিছু সব যদি তার পাও!   (স্ফুলিঙ্গ) না জানি কারে দেখিয়াছি না জানি কারে দেখিয়াছি, দেখেছি কার মুখ। প্রভাতে আজ পেয়েছি তার চিঠি। পেয়েছি তাই সুখে আছি, পেয়েছি এই সুখ– কারেও আমি দেখাব নাকো সেটি। লিখন আমি নাহিকো জানি– বুঝি না কী যে রয়েছে বাণী– যা আছে থাক্‌ আমার থাক্‌ তাহা। পেয়েছি এই সুখে আজি পবনে উঠে বাঁশরি বাজি, পেয়েছি সুখে পরান গাহে “আহা’।পণ্ডিত সে কোথা আছে, শুনেছি নাকি তিনি পড়িয়া দেন লিখন নানামতো। যাব না আমি তাঁর কাছে, তাঁহারে নাহি চিনি, থাকুন লয়ে পুরানো পুঁথি যত। শুনিয়া কথা পাব না দিশে, বুঝেন কিনা বুঝিব কিসে, ধন্দ লয়ে পড়িব মহা গোলে। তাহার চেয়ে এ লিপিখানি মাথায় কভু রাখিব আনি যতনে কভু তুলিব ধরি কোলে।রজনী যবে আঁধারিয়া আসিবে চারি ধারে, গগনে যবে উঠিবে গ্রহতারা; ধরিব লিপি প্রসারিয়া বসিয়া গৃহদ্বারে– পুলকে রব হয়ে পলকহারা তখন নদী চলিবে বাহি যা আছে লেখা তাহাই গাহি, লিপির গান গাবে বনের পাতা– আকাশ হতে সপ্তঋষি গাহিবে ভেদি গহন নিশি গভীর তানে গোপন এই গাথা।বুঝি না-বুঝি ক্ষতি কিবা, রব অবোধসম। পেয়েছি যাহা কে লবে তাহা কাড়ি। রয়েছে যাহা নিশিদিবা রহিবে তাহা মম, বুকের ধন যাবে না বুক ছাড়ি। খুঁজিতে গিয়া বৃথাই খুঁজি, বুঝিতে গিয়া ভুল যে বুঝি, ঘুরিতে গিয়া কাছেরে করি দূর। না-বোঝা মোর লিখনখানি প্রাণের বোঝা ফেলিল টানি, সকল গানে লাগায়ে দিল সুর।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) নাগকুমারী আমি যখন ছোটো ছিলুম, ছিলুম তখন ছোটো; আমার ছুটির সঙ্গী ছিল ছবি আঁকার পোটো। বাড়িটা তার ছিল বুঝি শঙ্খী নদীর মোড়ে, নাগকন্যা আসত ঘাটে শাঁখের নৌকো চ'ড়ে। চাঁপার মতো আঙুল দিয়ে বেণীর বাঁধন খুলে ঘন কালো চুলের গুচ্ছে কী ঢেউ দিত তুলে। রৌদ্র-আলোয় ঝলক দিয়ে বিন্দুবারির মতো মাটির 'পরে পড়ত ঝরে মুক্তা মানিক কত। নাককেশরের তলায় ব'সে পদ্মফুলের কুঁড়ি দূরের থেকে কে দিত তার পায়ের তলায় ছুঁড়ি। একদিন সেই নাগকুমারী ব'লে উঠল, কে ও। জবাব পেলে, দয়া ক'রে আমার বাড়ি যেয়ো। রাজপ্রাসাদের দেউড়ি সেথায় শ্বেত পাথরে গাঁথা, মণ্ডপে তার মুক্তাঝালর দোলায় রাজার ছাতা। ঘোড়সওয়ারি সৈন্য সেথায় চলে পথে পথে, রক্তবরন ধ্বজা ওড়ে তিরিশঘোড়ার রথে। আমি থাকি মালঞ্চেতে রাজবাগানের মালী, সেইখানেতে যূথীর বনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালি। রাজকুমারীর তরে সাজাই কনকচাঁপার ডালা, বেণীর বাঁধন-তরে গাঁথি শ্বেতকরবীর মালা। মাধবীতে ধরল কুঁড়ি, আর হবে না দেরি-- তুমি যদি এস তবে ফুটবে তোমায় ঘেরি। উঠবে জেগে রঙনগুচ্ছ পায়ের আসনটিতে, সামনে তোমার করবে নৃত্য ময়ূর-ময়ূরীতে। বনের পথে সারি সারি রজনীগন্ধায় বাতাস দেবে আকুল ক'রে ফাগুনি সন্ধ্যায়। বলতে বলতে মাথার উপর উড়ল হাঁসের দল, নাগকুমারী মুখের 'পরে টানল নীলাঞ্চল। ধীরে ধীরে নদীর 'পরে নামল নীরব পায়ে। ছায়া হয়ে গেল কখন চাঁপাগাছের ছায়ে। সন্ধ্যামেঘের সোনার আভা মিলিয়ে গেল জলে। পাতল রাতি তারা-গাঁথা আসন শূন্যতলে। নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস— বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) নাটক নাটক লিখেছি একটি। বিষয়টা কী বলি। অর্জুন গিয়েছেন স্বর্গে,         ইন্দ্রের অতিথি তিনি নন্দনবনে। উর্বশী গেলেন মন্দারের মালা হাতে         তাঁকে বরণ করবেন ব'লে। অর্জুন বললেন, ``দেবী, তুমি দেবলোকবাসিনী,       অতিসম্পূর্ণ তোমার মহিমা,           অনিন্দিত তোমার মাধুরী,               প্রণতি করি তোমাকে।           তোমার মালা দেবতার সেবার জন্যে।উর্বশী বললেন, ``কোনো অভাব নেই দেবলোকের,            নেই তার পিপাসা।         সে জানেই না চাইতে,     তবে কেন আমি হলেম সুন্দর!            তার মধ্যে মন্দ নেই,         তবে ভালো হওয়া কার জন্যে! আমার মালার মূল্য নেই তার গলায়।     মর্তকে প্রয়োজন আমার,         আমাকে প্রয়োজন মর্তের।            তাই এসেছি তোমার কাছে,       তোমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে করো আমাকে বরণ,            দেবলোকের দুর্লভ সেই আকাঙ্ক্ষা       মর্তের সেই অমৃত-অশ্রুর ধারা।         ভালো হয়েছে আমার লেখা। `ভালো হয়েছে' কথাটা কেটে দেব কি চিঠি থেকে?         কেন, দোষ হয়েছে কী?     সত্য কথাই বেরিয়েছে কলমের মুখে।         আশ্চর্য হয়েছ আমার অবিনয়ে,       বলছ, ``ভালো যে হয়েইছে জানলে কী ক'রে?    আমার উত্তর এই, নিশ্চিত নাই বা জানলেম। এক কালের ভালোটা       হয়তো হবে না অন্য কালের ভালো।    তাই তো এক নিশ্বাসে বলতে পারি              `ভালো হয়েছে'।    চিরকালের সত্য নিয়ে কথা হত যদি              চুপ করে থাকতেম ভয়ে।       কত লিখেছি কতদিন,              মনে মনে বলেছি `খুব ভালো'।     আজ পরম শত্রুর নামে          পারতেম যদি সেগুলো চালাতে               খুশি হতেম তবে।          এ লেখারও একদিন হয়তো হবে সেই দশা---              সেইজন্যেই, দোহাই তোমার,     অসংকোচে বলতে দাও আজকের মতো---               এ লেখা হয়েছে ভালো।        এইখানটায় একটুখানি তন্দ্রা এল। হঠাত্‍‌-বর্ষণে চারি দিক থেকে ঘোলা জলের ধারা       যেমন নেমে আসে, সেইরকমটা। তবু ঝেঁকে ঝেঁকে উঠে টলমল ক'রে কলম চলছে,      যেমনটা হয় মদ খেয়ে নাচতে গেলে।            তবু শেষ করব এ চিঠি,      কুয়াশার ভিতর দিয়েও জাহাজ যেমন চলে,                 কল বন্ধ করে না। বিষয়টা হচ্ছে আমার নাটক।       বন্ধুদের ফর্মাশ, ভাষা হওয়া চাই অমিত্রাক্ষর।              আমি লিখেছি গদ্যে।       পদ্য হল সমুদ্র,            সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি।                 তার বৈচিত্র্য ছন্দতরঙ্গে,                      কলকল্লোলে! গদ্য এল অনেক পরে।      বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর।           সুশ্রী-কুশ্রী ভালো-মন্দ তার আঙিনায় এল                          ঠেলাঠেলি করে।           ছেঁড়া কাঁথা আর শাল-দোশালা                  এল জড়িয়ে মিশিয়ে।       সুরে বেসুরে ঝনাঝন্ ঝংকার লাগিয়ে দিল। গর্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে       আকাশে উঠে পড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ।                 কখনো ছাড়লে অগ্নিনিশ্বাস,             কখনো ঝরালে জলপ্রপাত। কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল;       কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও মরুভূমি। একে অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ;       পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে             এর নানারকম গতি অবগতি। বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে,         অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ            গুরু লঘু নানা ভঙ্গিতে। সেই গদ্যে লিখেছি আমার নাটক,         এতে চিরকালের স্তব্ধতা আছে                আর চলতি কালের চাঞ্চল্য। নানা গান গেয়ে ফিরি নানা লোকালয় নানা গান গেয়ে ফিরি নানা লোকালয়; হেরি সে মত্ততা মোর বৃদ্ধ আসি কয়, “তাঁর ভৃত্য হয়ে তোর এ কী চপলতা। কেন হাস্য-পরিহাস, প্রণয়ের কথা, কেন ঘরে ঘরে ফিরি তুচ্ছ গীতরসে ভুলাস এ সংসারের সহস্র অলসে।’ দিয়েছি উত্তর তাঁরে, “ওগো পক্ককেশ, আমার বীণায় বাজে তাঁহারি আদেশ। যে আনন্দে যে অনন্ত চিত্তবেদনায় ধ্বনিত মানবপ্রাণ, আমার বীণায় দিয়েছেন তারি সুর– সে তাঁহারি দান। সাধ্য নাই নষ্ট করি সে বিচিত্র গান। তব আজ্ঞা রক্ষা করি নাই সে ক্ষমতা, সাধ্য নাই তাঁর আজ্ঞা করিতে অন্যথা।’  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে, যারা অন্যমনা,তারা শোনো আপনারে ভুলো না কখনো। মৃত্যুঞ্জয় যাহাদের প্রাণ, সব তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দীপ যারা জ্বালে অনির্বাণ, তাহাদের মাঝে যেন হয় তোমাদেরি নিত্য পরিচয়। তাহাদের খর্ব কর যদি খর্বতার অপমানে বন্দী হয়ে রবে নিরবধি। তাদের সন্মানে মান নিয়ো বিশ্বে যারা চিরস্মরণীয়। নাম তার চিনুলাল নাম তার চিনুলাল হরিরাম মোতিভয়, কিছুতে ঠকায় কেউ এই তার অতি ভয়। সাতানব্বই থেকে তেরোদিন ব’কে ব’কে বারোতে নামিয়ে এনে তবু ভাবে, গেল ঠকে। মনে মনে আঁক কষে, পদে পদে ক্ষতি-ভয়। কষ্টে কেরানি তার টিঁকে আছে কতিপয়।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নাম তার ডাক্তার ময়জন নাম তার ডাক্তার ময়জন। বাতাসে মেশায় কড়া পয়জন। গণিয়া দেখিল, বড়ো বহরের একখানা রীতিমতো শহরের টিঁকে আছে নাবালক নয়জন। খুশি হয়ে ভাবে, এই গবেষণা না জানি সবার কবে হবে শোনা, শুনিতে বা বাকি রবে কয়জন।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নাম তার ভেলুরাম ধুনিচাঁদ শিরত্থ নাম তার ভেলুরাম ধুনিচাঁদ শিরত্থ, ফাটা এক তম্বুরা কিনেছে সে নিরর্থ। সুরবোধ-সাধনায় ধুরপদে বাধা নাই, পাড়ার লোকেরা তাই হারিয়েছে ধীরত্ব– অতি-ভালোমানুষেরও বুকে জাগে বীরত্ব॥   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নাম তার সন্তোষ নাম তার সন্তোষ, জঠরে অগ্নিদোষ, হাওয়া খেতে গেল সে পচম্বা। নাকছাবি দিয়ে নাকে বাঘনাপাড়ায় থাকে বউ তার বেঁটে জগদম্বা। ডাক্তার গ্রেগ্‌সন দিল ইনজেক্‌শন– দেহ হল সাত ফুট লম্বা। এত বাড়াবাড়ি দেখে সন্তোষ কহে হেঁকে, “অপমান সহিব কথম্‌ বা। শুন ডাক্তার ভায়া, উঁচু করো মোর পায়া, স্ত্রীর কাছে কেন রব কম বা। খড়ম জোড়ায় ঘষে ওষুধ লাগাও কষে– শুনে ডাক্তার হতভম্বা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নামকরণ একদিন মুখে এল নূতন এ নাম —            চৈতালিপূর্ণিমা ব ' লে কেন যে তোমারে ডাকিলাম                        সে কথা শুধাও যবে মোরে                                   স্পষ্ট ক ' রে                             তোমারে বুঝাই                         হেন সাধ্য নাই ।            রসনায় রসিয়েছে , আর কোনো মানে                        কী আছে কে জানে ।                  জীবনের যে সীমায়                        এসেছ গম্ভীর মহিমায়                             সেথা অপ্রমত্ত তুমি ,                  পেরিয়েছ ফাল্গুনের ভাঙাভাণ্ড উচ্ছিষ্টের ভুমি ,            পৌঁছিয়াছ তপঃশুচি নিরাসক্ত বৈশাখের পাশে ,                        এ কথাই বুঝি মনে আসে                             না ভাবিয়া আগুপিছু ।            কিংবা এ ধ্বনির মাঝে অজ্ঞাত কুহক আছে কিছু ।                        হয়তো মুকুল-ঝরা মাসে            পরিণতফলনম্র অপ্রগল্‌ভ যে মর্যাদা আসে                             আম্রডালে ,                        দেখেছি তোমার ভালে                  সে পূর্ণতা স্তব্ধতামন্থর —            তার মৌন-মাঝে বাজে অরণ্যের চরম মর্মর ।            অবসন্ন বসন্তের অবশিষ্ট অন্তিম চাঁপায়                        মৌমাছির ডানারে কাঁপায়                             নিকুঞ্জের ম্লান মৃদু ঘ্রাণে ,            সেই ঘ্রাণ একদিন পাঠায়েছ প্রাণে ,                  তাই মোর উৎকণ্ঠিত বাণী                        জাগায়ে দিয়েছে নামখানি ।                   সেই নাম থেকে থেকে ফিরে ফিরে                        তোমারে গুঞ্জন করি ঘিরে      চারি দিকে ,             ধ্বনিলিপি দিয়ে তার বিদায়স্বাক্ষর দেয় লিখে ।                  তুমি যেন রজনীর জ্যোতিষ্কের শেষ পরিচয়                        শুকতারা , তোমার উদয়                             অস্তের খেয়ায় চ ' ড়ে আসা ,                        মিলনের সাথে বহি বিদায়ের ভাষা ।                                   তাই বসে একা                        প্রথম দেখার ছন্দে ভরি লই সব-শেষ দেখা ।                                    সেই দেখা মম                                         পরিস্ফুটতম ।                  বসন্তের শেষমাসে শেষ শুক্লতিথি                             তুমি এলে তাহার অতিথি ,                  উজাড় করিয়া শেষ দানে            ভাবের দাক্ষিণ্য মোর অন্ত নাহি জানে ।                   ফাল্গুনের অতিতৃপ্তি ক্লান্ত হয়ে যায় ,                        চৈত্রে সে বিরলরসে নিবিড়তা পায় ,                  চৈত্রের সে ঘন দিন তোমার লাবণ্যে মূর্তি ধরে ;            মিলে যায় সারঙের বৈরাগ্যরাগের শান্তস্বরে ,                  প্রৌঢ় যৌবনের পূর্ণ পর্যাপ্ত মহিমা                        লাভ করে গৌরবের সীমা ।           হয়তো এ-সব ব্যাখ্যা স্বপ্ন-অন্তে চিন্তা ক'রে বলা ,                  দাম্ভিক বুদ্ধিরে শুধু ছলা —                        বুঝি এর কোনো অর্থ নাইকো কিছুই ।            জ্যৈষ্ঠ-অবসানদিনে আকস্মিক জুঁই                         যেমন চমকি জেগে উঠে                  সেইমতো অকারণে উঠেছিল ফুটে ,                        সেই চিত্রে পড়েছিল তার লেখা            বাক্যের তুলিকা যেথা স্পর্শ করে অব্যক্তের রেখা ।                        পুরুষ যে রূপকার ,            আপনার সৃষ্টি দিয়ে নিজেরে উদ্‌ভ্রান্ত করিবার                             অপূর্ব উপকরণ বিশ্বের রহস্যলোকে করে অন্বেষণ ।                        সেই রহস্যই নারী —            নাম দিয়ে ভাব দিয়ে মনগড়া মূর্তি রচে তারি ;                  যাহা পায় তার সাথে যাহা নাহি পায়                              তাহারে মিলায় ।                  উপমা তুলনা যত ভিড় করে আসে                             ছন্দের কেন্দ্রের চারি পাশে ,                  কুমোরের ঘুরখাওয়া চাকার সংবেগে            যেমন বিচিত্র রূপ উঠে জেগে জেগে ।                  বসন্তে নাগকেশরের সুগন্ধে মাতাল            বিশ্বের জাদুর মঞ্চে রচে সে আপন ইন্দ্রজাল ।                  বনতলে মর্মরিয়া কাঁপে সোনাঝুরি ;            চাঁদের আলোর পথে খেলা করে ছায়ার চাতুরী ;                        গভীর চৈতন্যলোকে            রাঙা নিমন্ত্রণলিপি দেয় লিখি কিংশুকে অশোকে ;                  হাওয়ায় বুলায় দেহে অনামীর অদৃশ্য উত্তরী ,                       শিরায় সেতার উঠে গুঞ্জরি গুঞ্জরি ।             এই যারে মায়ারথে পুরুষের চিত্ত ডেকে আনে                  সে কি নিজে সত্য করে জানে                             সত্য মিথ্যা আপনার ,            কোথা হতে আসে মন্ত্র এই সাধনার ।                        রক্তস্রোত-আন্দোলনে জেগে                  ধ্বনি উচ্ছ্বসিয়া উঠে অর্থহীন বেগে ;            প্রচ্ছন্ন নিকুঞ্জ হতে অকস্মাৎ ঝঞ্ঝায় আহত                        ছিন্ন মঞ্জরীর মতো                   নাম এল ঘূর্ণিবায়ে ঘুরি ঘুরি ,            চাঁপার গন্ধের সাথে অন্তরেতে ছড়াল মাধুরী । নামজাদা দানুবাবু রীতিমতো খর্‌চে নামজাদা দানুবাবু রীতিমতো খর্‌চে, অথচ ভিটেয় তার ঘুঘু সদা চরছে। দানধর্মের ‘পরে মন তার নিবিষ্ট, রোজগার করিবার বেলা জপে “শ্রীবিষ্ণু’, চাঁদার খাতাটা তাই দ্বারে দ্বারে ধরছে। এই ভাবে পুণ্যের খাতা তার ভরছে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ,              বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে- আপনগড়া স্বপন হতে               তোমার মধ্যে জনম লয়ে।                     ঢেকে তোমার হাতের লেখা                     কাটি নিজের নামের রেখা,                     কতদিন আর কাটবে জীবন                                   এমন ভীষণ আপদ বয়ে।  সবার সজ্জা হরণ করে                   আপনাকে সে সাজাতে চায়। সকল সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে                     আপনাকে সে বাজাতে চায়।                           আমার এ নাম যাক না চুকে,                            তোমারি নাম নেব মুখে,                            সবার সঙ্গে মিলব সেদিন                                       বিনা-নামের পরিচয়ে। ( ২১ শ্রাবণ, ১৩১৭) নারী তুমি এ মনের সৃষ্টি, তাই মনোমাঝে এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে। যখন তোমারে হেরি জগতের তীরে মনে হয় মন হতে এসেছ বাহিরে। যখন তোমারে দেখি মনোমাঝখানে মনে হয় জন্ম-জন্ম আছ এ পরানে। মানসীরূপিণী তুমি, তাই দিশে দিশে সকল সৌন্দর্যসাথে যাও মিলে মিশে। চন্দ্রে তব মুখশোভা, মুখে চন্দ্রোদয়, নিখিলের সাথে তব নিত্য বিনিময়। মনের অনন্ত তৃষ্ণা মরে বিশ্ব ঘুরি, মিশায় তোমার সাথে নিখিল মাধুরী। তার পরে মনগড়া দেবতারে মন ইহকাল পরকাল করে সমর্পণ।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) নারী তুমি ধন্যা নারী তুমি ধন্যা– আছে ঘর, আছে ঘরকন্না। তারি মধ্যে রেখেছ একটুখানি ফাঁক। সেথা হতে পশে কানে বাহিরের দুর্বলের ডাক। নিয়ে এসো শুশ্রূষার ডালি, স্নেহ দাও ঢালি। যে জীবলক্ষ্মীর মনে পালনের শক্তি বহমান, নারী তুমি নিত্য শোন তাহারি আহ্বান। সৃষ্টিবিধাতার নিয়েছ কর্মের ভার, তুমি নারী তাঁহারি আপন সহকারী। উন্মুক্ত করিতে থাকো আরোগ্যের পথ, নবীন করিতে থাকো জীর্ণ যে-জগৎ, শ্রীহারা যে তার ‘পরে তোমার ধৈর্যের সীমা নাই, আপন অসাধ্য দিয়ে দয়া তব টানিছে তারাই। বুদ্ধিভ্রষ্ট অসহিষ্ঞু অপমান করে বারে বারে, চক্ষু মুছে ক্ষমা কর তারে। অকৃতজ্ঞতার দ্বারে আঘাত সহিছ দিনরাতি, লও শির পাতি। যে অভাগ্য নাহি লাগে কাজে, প্রাণলক্ষ্মী ফেলে যারে আবর্জনা-মাঝে, তুমি তারে আনিছ কুড়ায়ে, তার লাঞ্ছনার তাপ স্নিগ্ধ হস্তে দিতেছ জুড়ায়ে। দেবতারে যে পূজা দেবার দুর্ভাগারে কর দান সেই মূল্য তোমার সেবার। বিশ্বের পালনী শক্তি নিজ বীর্যে বহ চুপে চুপে মাধুরীর রূপে। ভ্রষ্ট যেই, ভগ্ন যেই, বিরূপ বিকৃত, তারি লাগি সুন্দরের হাতের অমৃত।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) নাসিক হইতে খুড়ার পত্র কলকত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা, সুরেনবাবু, আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা। খুড়া সাবকো কায়কো নহি পতিয়া ভেজো বাচ্ছা-- মহিনা-ভর্‌ কুছ খবর মিলে না ইয়ে তো নহি আচ্ছা! টপাল্‌, টপাল্‌, কঁহা টপাল্‌রে, কপাল হমারা মন্দ, সকাল বেলাতে নাহি মিলতা টপাল্‌কো নাম গন্ধ! ঘরকো যাকে কায়কো বাবা, তুম্‌সে হম্‌সে ফর্‌খৎ। দো-চার কলম লীখ্‌ দেওঙ্গে ইস্‌মে ক্যা হয় হর্‌কৎ! প্রবাসকো এক সীমা পর হম্‌ বৈঠ্‌কে আছি একলা-- সুরিবাবাকো বাস্তে আঁখ্‌সে বহুৎ পানি নেক্‌লা। সর্বদা মন কেমন কর্‌তা, কেঁদে উঠ্‌তা হির্দয়-- ভাত খাতা, ইস্কুল যাতা, সুরেনবাবু নির্দয়! মন্‌কা দুঃখে হূহু কর্‌কে নিক্‌লে হিন্দুস্থানী-- অসম্পূর্ণ ঠেক্‌তা কানে বাঙ্গলাকো জবানী। মেরা উপর জুলুম কর্‌তা তেরি বহিন বাই, কী করেঙ্গা কোথায় যাঙ্গা ভেবে নাহি পাই! বহুৎ জোরসে গাল টিপ্‌তা দোনো আঙ্গ্‌লি দেকে, বিলাতী এক পৈনি বাজ্‌না বাজাতা থেকে থেকে, কভী কভী নিকট আকে ঠোঁটমে চিম্‌টি কাটতা, কাঁচিলে কর কোঁক্‌ড়া কোঁক্‌ড়া চুলগুলো সব ছাঁটতা, জজসাহেব কুছ বোল্‌তা নহি রক্ষা করবে কেটা, কঁহা গয়োরে কঁহা গয়োরে জজসাহেবকি বেটা! গাড়ি চড়্‌কে লাঠিন পড়কে তুম্‌ তো যাতা ইস্কিল্‌ ঠোঁটে নাকে চিম্‌টি খাকে হমারা বহুৎ মুস্কিল! এদিকে আবার party হোতা খেল্‌নেকোবি যাতা, জিম্‌খানামে হিম্‌ঝিম্‌ এবং থোড়া বিস্কুট খাতা। তুম ছাড়া কোই সম্‌জে না তো হম্‌রা দুরাবস্থা, বহির তেরি বহুৎ merry খিল্‌খিল্‌ কর্কে হাস্তা! চিঠি লিখিও মাকে দিও বহুৎ বহুৎ সেলাম, আজকের মতো তবে বাবা বিদায় হোকে গেলাম।সুরেনবাবু = সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর । টপাল্ = চিঠির ডাক । বহিন বাই = ইন্দিরা দেবী । জজসাহেব = অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর , সুরেন্দ্রনাথের পিতা । নিজের ও সাধারণের চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে, কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নিজের হাতে উপার্জনে নিজের হাতে উপার্জনে সাধনা নেই সহিষ্ণুতার। পরের কাছে হাত পেতে খাই, বাহাদুরি তারি গুঁতার। কৃপণ দাতার অন্নপাকে ডাল যদি বা কমতি থাকে গাল-মিশানো গিলি তো ভাত– নাহয় তাতে নেইকো সুতার। নিজের জুতার পাত্তা না পাই, স্বাদ পাওয়া যায় পরের জুতার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নিদ্রা-ব্যাপার কেন নিদ্রা-ব্যাপার কেন হবেই অবাধ্য, চোখ-চাওয়া ঘুম হোক মানুষের সাধ্য– এম.এস্‌সি বিভাগের ব্রিলিয়ান্‌ট্‌ ছাত্র এই নিয়ে সন্ধান করে দিনরাত্র, বাজায় পাড়ার কানে নানাবিধ বাদ্য, চোখ-চাওয়া ঘটে তাহে, নিদ্রার শ্রাদ্ধ।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নিদ্রিতা একদা রাতে নবীন যৌবনে                স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া, বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার---                ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া । শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,                পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর । আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ,                ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর । সমুখে প'ড়ে দীর্ঘ রাজপথ,                দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার, নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে                আপন-মনে ভাবিনু একবার--- অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে                ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা                স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা ।।অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,                কত যে দেশ বিদেশ হনু পার ! একদা এক ধূসরসন্ধ্যায়                ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার । সবাই সেথা অচল অচেতন,                কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী, নদীর তীরে জলের কলতানে                ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি । ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,                নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে । প্রাসাদ মাঝে পশিনু সাবধানে,                শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে । ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,                কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা । একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,                ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা ।। কমলফুল বিমল শেজখানি,                নিলীন তাহে কোমল তনুলতা । মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,                বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা । মেঘের মত গুচ্ছ কেশরাশি                শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে । একটি বাহু বক্ষ-'পরে পড়ি,                একটি বাহু লুটায় এক ধারে । আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,                কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি--- পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা                অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি । দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি---                ঘুমের দেশে স্বপন একখানি, পালঙ্কেতে মগন রাজবালা                আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা ।।ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,                না মানে বাধা হৃদয়কম্পন । ভূতলে বসি আনত করি শির                মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন । পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,                তাহারি পানে চাহিনু একমনে--- দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন                কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে । ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়ে                লিখিয়া দিনু আপন নামধাম । লিখিনু, 'অয়ি নিদ্রানিমগনা,                আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম ।' যতন করে কনক-সুতে গাঁথি                রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি--- ঘুমের দেশে ঘুমায়ে রাজবালা,                তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা ।। নিদ্রিতার চিত্র মায়ায় রয়েছে বাঁধা প্রদোষ – আঁধার ; চিত্রপটে সন্ধ্যাতারা অস্ত নাহি যায় । এলাইয়া ছড়াইয়া গুচ্ছ কেশভার বাহুতে মাথাটি রেখে রমণী ঘুমায় । চারি দিকে পৃথিবীতে চিরজাগরণ , কে ওরে পাড়ালে ঘুম তারি মাঝখানে ! কোথা হতে আহরিয়া নীরব গুঞ্জন চিরদিন রেখে গেছে ওরই কানে কানে ! ছবির আড়ালে কোথা অনন্ত নির্ঝর নীরব ঝর্ঝর – গানে পড়িছে ঝরিয়া । চিরদিন কাননের নীরব মর্মর , লজ্জা চিরদিন আছে দাঁড়ায়ে সমুখে — যেমনি ভাঙিবে ঘুম , মরমে মরিয়া বুকের বসনখানি তুলে দিবে বুকে ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) নিধু বলে আড়চোখে কুছ নেই পরোয়া নিধু বলে আড়চোখে, “কুছ নেই পরোয়া।’– স্ত্রী দিলে গলায় দড়ি বলে, “এটা ঘরোয়া।’ দারোগাকে হেসে কয়, “খবরটা দিতে হয়’– পুলিস যখন করে ঘরে এসে চড়োয়া। বলে, “চরণের রেণু নাহি চাহিতেই পেনু।’– এই ব’লে নিধিরাম করে পায়ে-ধরোয়া।নিধু বাঁকা ক’রে ঘাড় ওড়নাটা উড়িয়ে বলে, “মোর পাকা হাড়, যাব নাকো বুড়িয়ে। যে যা খুশি করুক-না, মারুক-না, ধরুক-না, তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস দেব সব তুড়িয়ে।’ গালি তারে দিল লোকে হাসে নিধু আড়চোখে; বলে, “দাদা, আরো বলো, কান গেল জুড়িয়ে।’পিসে হয় কুলদার, ভুলুদার কাকা সে– আড়চোখে হাসে আর করে ঘাড় বাঁকা সে। যবে গিয়ে শালিখায় সাহেবের গালি খায়, “কেয়ার করিনে’ ব’লে তুড়ি মারে আকাশে। যেদিন ফয়জাবাদে পত্নী ফুঁপিয়ে কাঁদে, “তবে আসি’ ব’লে হাসি চলে যায় ঢাকা সে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নিন্দুকের দুরাশা মালা গাঁথিবার কালে ফুলের বোঁটায় ছুঁচ নিয়ে মালাকর দুবেলা ফোটায়। ছুঁচ বলে মনদুঃখে, ওরে জুঁই দিদি, হাজার হাজার ফুল প্রতিদিন বিঁধি, কত গন্ধ কোমলতা যাই ফুঁড়ে ফুঁড়ে কিছু তার নাহি পাই এত মাথা খুঁড়ে। বিধি-পায়ে মাগি বর জুড়ি কর দুটি ছুঁচ হয়ে না ফোটাই, ফুল হয়ে ফুটি। জুঁই কহে নিশ্বসিয়া, আহা হোক তাই, তোমারো পুরুক বাঞ্ছা আমি রক্ষা পাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নিরাপদ নীচতা তুমি নীচে পাঁকে পড়ি ছড়াইছ পাঁক, যে জন উপরে আছে তারি তো বিপাক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নিরুদ্দেশ যাত্রা আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে            হে সুন্দরী?   বলো, কোন পার ভিড়িবে তোমার           সোনার তরী    যখনই শুধাই, ওগো বিদেশিনী,     তুমি হাস শুধু, মধুরহাসিনী- বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে           তোমার মনে।     নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি     অকুল সে উঠিছে আকুলি,     দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন           গগনকোণে।   কী আছে হোথায়-চলেছি কিসের            অন্বেষণে? বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়          অপরিচিতা-   ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কুলে         দিনের চিতা,   ঝরিতেছে জল তরল অনল,    গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,   দিকবধূ যেন ছলছল-আঁখি          অশ্রুজলে, হোথায় কি আছে আলয় তোমার    উর্মিমুখর সাগরের পার     মেঘচুম্বিত অস্তগিরির         চরণতলে? তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে       কথা না ব'লে। নিরুদ্যম অবকাশ শূন্য শুধু নিরুদ্যম অবকাশ শূন্য শুধু, শান্তি তাহা নয়— যে কর্মে রয়েছে সত্য তাহাতে শান্তির পরিচয়।   (স্ফুলিঙ্গ) নির্জন রোগীর ঘর নির্জন রোগীর ঘর। খোলা দ্বার দিয়ে বাঁকা ছায়া পড়েছে শয্যায়। শীতের মধ্যাহ্নতাপে তন্দ্রাতুর বেলা চলেছে মন্থরগতি শৈবালে দুর্বলস্রোত নদীর মতন। মাঝে মাঝে জাগে যেন দূর অতীতের দীর্ঘশ্বাস শস্যহীন মাঠে।মনে পড়ে কতদিন ভাঙা পাড়িতলে পদ্মা কর্মহীন প্রৌঢ় প্রভাতের ছায়াতে আলোতে আমার উদাস চিন্তা দেয় ভাসাইয়া ফেনায় ফেনায়। স্পর্শ করি শূন্যের কিনারা জেলেডিঙি চলে পাল তুলে, যূথভ্রষ্ট শুভ্র মেঘ পড়ে থাকে আকাশের কোণে। আলোতে ঝিকিয়া-ওঠা ঘট কাঁখে পল্লীমেয়েদের ঘোমটায় গুন্ঠিত আলাপে গুঞ্জরিত বাঁকা পথে আম্রবনচ্ছায়ে কোকিল কোথায় ডাকে ক্ষণে ক্ষণে নিভৃত শাখায়, ছায়ায় কুন্ঠিত পল্লীজীবনযাত্রার রহস্যের আবরণ কাঁপাইয়া তোলে মোর মনে। পুকুরের ধারে ধারে সর্ষেখেতে পূর্ণ হয়ে যায় ধরণীর প্রতিদান রৌদ্রের দানের, সূর্যের মন্দিরতলে পুষ্পের নৈবেদ্য থাকে পাতা।আমি শান্ত দৃষ্টি মেলি নিভৃত প্রহরে পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা, সেই সবিতারে যাঁর জ্যোতীরূপে প্রথম মানুষ মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছে স্বরূপ। মনে মনে ভাবিয়াছি, প্রাচীন যুগের বৈদিক মন্ত্রের বাণী কন্ঠে যদি থাকিত আমার মিলিত আমার স্তব স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে; ভাষা নাই, ভাষা নাই; চেয়ে দূর দিগন্তের পানে মৌন মোর মেলিয়াছি পাণ্ডুনীল মধ্যাহ্ন-আকাশে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ আজি এ প্রভাতে রবির কর                 কেমনে পশিল প্রাণের পর,       কেমনে  পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান! না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।                 জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,       ওরে     উথলি উঠেছে বারি, ওরে  প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।                 থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,                 শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,                 ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল                 গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।                 হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়                 ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় - বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।                 কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,                 চারি দিকে তার বাঁধন কেন!                 ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন,                 সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,                 লহরীর পরে লহরী তুলিয়া                 আঘাতের পরে আঘাত কর্।                 মাতিয়া যখন উঠেছে পরান                 কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!                 উথলি যখন উঠেছে বাসনা                 জগতে তখন কিসের ডর!                আমি    ঢালিব করুণাধারা,                 আমি    ভাঙিব পাষাণকারা,                 আমি    জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া                             আকুল পাগল-পারা।                 কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,                 রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।                 শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,                 ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব, হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে, এত সাধ আছে - প্রাণ হয়ে আছে ভোর।।কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ - দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।                 ওরে, চারি দিকে মোর                 এ কী কারাগার ঘোর - ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্। ওরে আজ     কী গান গেয়েছে পাখি,                 এসেছে রবির কর। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ - প্রাথমিক রচনা আজি এ প্রভাতে প্রভাতবিহগ         কী গান গাইল রে! অতিদূর দূর আকাশ হইতে        ভাসিয়া আইল রে! না জানি কেমনে পশিল হেথায়        পথহারা তার একটি তান,     আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া     গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া     আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া        ছুঁয়েছে আমার প্রাণ। আজি এ প্রভাতে সহসা কেন রে        পথহারা রবিকর আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে        আমার প্রাণের ‘পর! বহুদিন পরে একটি কিরণ        গুহায় দিয়েছে দেখা, পড়েছে আমার আঁধার সলিলে        একটি কনকরেখা।     প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি     থর থর করি কাঁপিছে বারি,     টলমল জল করে থল থল,     কল কল করি ধরেছে তান। আজি এ প্রভাতে কী জানি কেন রে        জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।     জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর     পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর, বুকের উপরে আঁধার বসিয়া        করিছে নিজের ধ্যান। না জানি কেন রে এতদিন পরে        জাগিয়া উঠেছে প্রাণ। জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা, আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা। রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে, ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-’পরে। দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা। তারি মুখ দেখে দেখে আঁধার হাসিতে শেখে, তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান। শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ, প্রাণের মাঝারে ভাসি দোলে রে দোলে রে হাসি, দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম, দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম।মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো, পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো। আঁধার সলিল- ‘পরে ঝর ঝর বারি ঝরে ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল-- বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল। শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি, তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই-- ঝর ঝর কল কল--দিন নাই, রাত নাই। এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে, আঁধার সলিল -‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে। এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ, এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।       আজি এ প্রভাতে রবির কর        কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে        প্রভাত-পাখির গান। না জানি কেন রে এতদিন পরে        জাগিয়া উঠিল প্রাণ।        জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ        রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে। হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়, বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়           কোথায় কারার দ্বার। প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া উঠে শূন্যপানে---পড়ে আছাড়িয়া করে শেষে হাহাকার। প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায় ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়, আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি আকাশের পানে উঠিতে চায়।প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারি দিকে তার বাঁধন কেন? ভাঙ্‌ রে হৃদয় ভাঙ্‌ রে বাঁধন, সাধ্‌ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পর আঘাত কর। মাতিয়া যখন উঠিছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ !উথলি যখন উঠিছে বাসনা, জগতে তখন কিসের ডর!সহসা আজি এ জগতের মুখ        নূতন করিয়া দেখিনু কেন? একটি পাখির আধখানি তান        জগতের গান গাহিল যেন! জগৎ দেখিতে হইব বাহির        আজিকে করেছি মনে, দেখিব না আর নিজেরি স্বপন        বসিয়া গুহার কোণে। আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া        আকুল পাগল-পারা; কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,        দিব রে পরান ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব হেসে খলখল গেয়ে কলকল        তালে তালে দিব তালি। তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া-- যাইব বহিয়া--যাইব বহিয়া-- হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া        গাহিয়া গাহিয়া গান, যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ        ফুরাবে না আর প্রাণ। এত কথা আছে এত গান আছে        এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে এত সাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর।এত সুখ কোথা এত রূপ কোথা        এত খেলা কোথা আছে! যৌবনের বেগে বহিয়া যাইব        কে জানে কাহার কাছে! অগাধ বাসনা অসীম আশা        জগৎ দেখিতে চাই! জাগিয়াছে সাধ চরাচরময়        প্লাবিয়া বহিয়া যাই।        যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,        যত কাল আছে বহিতে পারি,        যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,           তবে আর কিবা চাই!           পরানের সাধ তাই।কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ, দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান-- ‘পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা, বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,        সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,        জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া-- আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্‌ দেশ--        জগতে ঢালিব প্রাণ,        গাহিব করুণাগান,        উদ্‌বেগ-অধীর হিয়া        সুদূর সমুদ্রে গিয়া সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ।       ওরে, চারি দিকে মোর        এ কী কারাগার ঘোর ! ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্ !        ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,           এয়েছে রবির কর ! নির্লিপ্ত বাছা রে মোর বাছা, ধূলির ‘পরে হরষভরে      লইয়া তৃণগাছা আপন মনে খেলিছ কোণে,      কাটিছে সারা বেলা। হাসি গো দেখে এ ধূলি মেখে      এ তৃণ লয়ে খেলা।         আমি যে কাজে রত, লইয়া খাতা ঘুরাই মাথা      হিসাব কষি কত, আঁকের সারি হতেছে ভারী      কাটিয়া যায় বেলা— ভাবিছ দেখি মিথ্যা একি      সময় নিয়ে খেলা।         বাছা রে মোর বাছা, খেলিতে ধূলি গিয়েছি ভুলি      লইয়ে তৃণগাছা। কোথায় গেলে খেলেনা মেলে      ভাবিয়া কাটে বেলা, বেড়াই খুঁজি করিতে পুঁজি      সোনারূপার ঢেলা।         যা পাও চারি দিকে তাহাই ধরি তুলিছ গড়ি      মনের সুখটিকে। না পাই যারে চাহিয়া তারে      আমার কাটে বেলা, আশাতীতেরই আশায় ফিরি      ভাসাই মোর ভেলা। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) নিষ্কাম পরহিতে কে ইহারে সামলায় নিষ্কাম পরহিতে কে ইহারে সামলায়– স্বার্থেরে নিঃশেষে-মুছে-ফেলা মামলায়। চলেছে উদারভাবে সম্বল-খোয়ানি– গিনি যায়, টাকা যায়, সিকি যায় দোয়ানি, হল সারা বাঁটোয়ারা উকিলে ও আমলায়। গিয়েছে পরের লাগি অন্নের শেষ গুঁড়ো– কিছু খুঁটে পাওয়া যায় ভূষি তুঁষ খুদকুঁড়ো গোরুহীন গোয়ালের তলাহীন গামলায়।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নিষ্ফল উপহার নিম্নে আবর্তিয়া ছুটে যমুনার জল-- দুই তীরে গিরিতট, উচ্চ শিলাতল। সংকীর্ণ গুহার পথে মূর্ছি জলধার উন্মত্ত প্রলাপে ওঠে গর্জি অনিবার।এলায়ে জটিল বক্র নির্ঝরের বেণী নীলাভ দিগন্তে ধায় নীল গিরিশ্রেণী। স্থির তাহা, নিশিদিন তবু যেন চলে-- চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে।মাঝে মাঝে শাল তাল রয়েছে দাঁড়ায়ে, মেঘেরে ডাকিছে গিরি ইঙ্গিত বাড়ায়ে। তৃণহীন সুকঠিন শতদীর্ণ ধরা, রৌদ্রবন বনফুলে কাঁটাগাছ ভরা।দিবসের তাপ ভূমি দিতেছে ফিরায়ে-- দাঁড়ায়ে রয়েছে গিরি আপনার ছায়ে পথশূন্য, জনশূন্য, সাড়া-শব্দ-হীন। ডুবে রবি, যেমন সে ডুবে প্রতিদিন।রঘুনাথ হেথা আসি যবে উত্তরিলা শিখগুরু পড়িছেন ভগবৎ লীলা। রঘু কহিলেন নমি চরণে তাঁহার, "দীন আনিয়াছে, প্রভু, হীন উপহার।'বাহু বাড়াইয়া গুরু শুধায়ে কুশল আশিসিলা মাথায় পরশি করতল। কনকে মাণিক্যে গাঁথা বলয়-দুখানি গুরুপদে দিলা রঘু জুড়ি দুই পাণি।ভূমিতল হইতে বালা লইলেন তুলে, দেখিতে লাগিলা প্রভু ঘুরায়ে অঙ্গুলে। হীরকের সূচীমুখ শতবার ঘুরি হানিতে লাগিল শত আলোকের ছুরি।ঈষৎ হাসিয়া গুরু পাশে দিলা রাখি, আবার সে পুঁথি-'পরে নিবেশিলা আঁখি। সহসা একটি বালা শিলাতল হতে গড়ায়ে পড়িয়া গেল যমুনার স্রোতে।"আহা আহা" চীৎকার করি রঘুনাথ ঝাঁপায়ে পড়িল জলে বাড়ায়ে দু হাত। আগ্রহে সমস্ত তার প্রাণমনকায় একখানি বাহু হয়ে ধরিবারে যায়।বারেকের তরে গুরু না তুলিলা মুখ, নিভৃত অন্তরে তাঁর জাগে পাঠসুখ। কালো জল কটাক্ষিয়া চলে ঘুরি ঘুরি, যেন সে ছলনাভরা সুগভীর চুরি।দিবালোক চলে গেল দিবসের পিছু যমুনা উতলা করি না মিলিল কিছু। সিক্তবস্ত্রে রিক্তহাতে শ্রান্তনতশিরে রঘুনাথ গুরু-কাছে আসিলেন ফিরে।"এখনো উঠাতে পারি' করজোড়ে যাচে, "যদি দেখাইয়া দাও কোন্‌খানে আছে।' দ্বিতীয় কঙ্কণখানি ছুঁড়ি দিয়া জলে গুরু কহিলেন, "আছে ওই নদীতলে।' নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল রাঙা গোলাপ গাল দুখানি, সুধায় মাখা সুকোমল। শুভ্র বিমল করকমল ফুটে আছে চিরদিন! হৃদয়টুকু শুষ্ক শুধু পাষাণসম সুকঠিন!Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) নীলুবাবু বলে শোনো নেয়ামৎ দর্জি নীলুবাবু বলে, “শোনো নেয়ামৎ দর্জি, পুরোনো ফ্যাশানটাতে নয় মোর মর্জি।’ শুনে নিয়ামৎ মিঞা যতনে পঁচিশটে সম্মুখে ছিদ্র, বোতাম দিল পৃষ্ঠে। লাফ দিয়ে বলে নীলু, “এ কী আশ্চর্যি!’ ঘরের গৃহিণী কয়, “রয় না তো ধর্যি।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) নীহারিকা বাদল-শেষের আবেশ আছে ছুঁয়ে                    তমালছায়াতলে, সজনে গাছের ডাল পড়েছে নুয়ে                    দিঘির প্রান্তজলে।         অস্তরবির-পথ-তাকানো মেঘে         কালোর বুকে আলোর বেদন লেগে--                    কেন এমন খনে         কে যেন সে উঠল হঠাৎ জেগে                    আমার শূন্য মনে।"কে গো তুমি, ওগো ছায়ায় লীন"                    প্রশ্ন পুছিলাম। সে কহিল, "ছিল এমন দিন                    জেনেছ মোর নাম।         নীরব রাতে নিসুত দ্বিপ্রহরে         প্রদীপ তোমার জ্বেলে দিলেম ঘরে,                    চোখে দিলেম চুমো;         সেদিন আমায় দেখলে আলস-ভরে                    আধ-জাগা আধ-ঘুমো।আমি তোমার খেয়ালস্রোতে তরী,                    প্রথম-দেওয়া খেয়া-- মাতিয়েছিলেম শ্রাবণশর্বরী                    লুকিয়ে-ফোটা কেয়া।         সেদিন তুমি নাও নি আমায় বুঝে,         জেগে উঠে পাও নি ভাষা খুঁজে,                    দাও নি আসন পাতি-- সংশয়িত স্বপন-সাথে যুঝে                    কাটল তোমার রাতি।তার পরে কোন্‌ সব-ভুলিবার দিনে                    নাম হল মোর হারা! আমি যেন অকালে আশ্বিনে                    এক-পসলার ধারা।         তার পরে তো হল আমার জয়--         সেই প্রদোষের ঝাপসা পরিচয়                    ভরল তোমার ভাষা,         তার পরে তো তোমার ছন্দোময়                    বেঁধেছি মোর বাসা।চেনো কিম্বা নাই বা আমায় চেনো                    তবু তোমার আমি। সেই সেদিনের পায়ের ধ্বনি জেনো                    আর যাবে না থামি।         যে-আমারে হারালে সেই কবে         তারই সাধন করে গানের রবে                    তোমার বীণাখানি।         তোমার বনে প্রোল্লোল পল্লবে                    তাহার কানাকানি।সেদিন আমি এসেছিলেম একা                    তোমার আঙিনাতে। দুয়ার ছিল পাথর দিয়ে ঠেকা                    নিদ্রাঘেরা রাতে।         যাবার বেলা সে-দ্বার গেছি খুলে         গন্ধ-বিভোল পবন-বিলোল ফুলে,                         রঙ-ছড়ানো বনে--         চঞ্চলিত কত শিথিল চুলে,                         কত চোখের কোণে।রইল তোমার সকল গানের সাথে                    ভোলা নামের ধুয়া। রেখে গেলেম সকল প্রিয়হাতে                    এক নিমেষের ছুঁয়া।         মোর বিরহ সব মিলনের তলে         রইল গোপন স্বপন-অশ্রুজলে--                    মোর আঁচলের হাওয়া         আজ রাতে ওই কাহার নীলাঞ্চলে                    উদাস হয়ে ধাওয়া।" নূতন নূতন ও সনাতন রাজা ভাবে, নব নব আইনের ছলে ন্যায় সৃষ্টি করি আমি। ন্যায়ধর্ম বলে, আমি পুরাতন, মোরে জন্ম কেবা দেয়— যা তব নূতন সৃষ্টি সে শুধু অন্যায়।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নূতন কল্পে নূতন কল্পে সৃষ্টির আরম্ভে আঁকা হল অসীম আকাশে কালের সীমানা আলোর বেড়া দিয়ে। সব চেয়ে বড়ো ক্ষেত্রটি অযুত নিযুত কোটি কোটি বৎসরের মাপে। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্যোতিষ্কপতঙ্গ দিয়েছে দেখা, গণনায় শেষ করা যায় না। তারা কোন্‌ প্রথম প্রত্যুষের আলোকে কোন্‌ গুহা থেকে উড়ে বেরোল অসংখ্য, পাখা মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল চক্রপথে আকাশ থেকে আকাশে। অব্যক্তে তারা ছিল প্রচ্ছন্ন, ব্যক্তের মধ্যে ধেয়ে এল মরণের ওড়া উড়তে;-- তারা জানে না কিসের জন্যে এই মৃত্যুর দুর্দান্ত আবেগ। কোন্‌ কেন্দ্রে জ্বলছে সেই মহা আলোক যার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়বার জন্যে হয়েছে উন্মত্তের মতো উৎসুক। আয়ুর অবসান খুঁজছে আয়ুহীনের অচিন্ত্য রহস্যে। একদিন আসবে কল্পসন্ধ্যা, আলো আসবে ম্লান হয়ে, ওড়ার বেগ হবে ক্লান্ত পাখা যাবে খসে, লুপ্ত হবে ওরা চিরদিনের অদৃশ্য আলোকে। ধরার ভূমিকায় মানব-যুগের সীমা আঁকা হয়েছে ছোটো মাপে আলোক-আঁধারের পর্যায়ে নক্ষত্রলোকের বিরাট দৃষ্টির অগোচরে। সেখানকার নিমেষের পরিমাণে এখানকার সৃষ্টি ও প্রলয়। বড়ো সীমানার মধ্যে মধ্যে ছোটো ছোটো কালের পরিমণ্ডল আঁকা হচ্ছে মোছা হচ্ছে। বুদ্বুদের মতো উঠল মহেন্দজারো, মরুবালুর সমুদ্রে, নিঃশব্দে গেল মিলিয়ে। সুমেরিয়া, আসীরিয়া, ব্যাবিলন, মিসর, দেখা দিল বিপুল বলে কালের ছোটো-বেড়া-দেওয়া ইতিহাসের রঙ্গস্থলীতে, কাঁচা কালির লিখনের মতো লুপ্ত হয়ে গেল অস্পষ্ট কিছু চিহ্ন রেখে। তাদের আকাঙক্ষাগুলো ছুটেছিল পতঙ্গের মতো অসীম দুর্লক্ষ্যের দিকে। বীরেরা বলেছিল অমর করবে সেই আকাঙক্ষার কীর্তিপ্রতিমা; তুলেছিল জয়স্তম্ভ। কবিরা বলেছিল, অমর করবে সেই আকাঙক্ষার বেদনাকে, রচেছিল মহাকবিতা। সেই মুহূর্তে মহাকাশের অগণ্য-যোজন পত্রপটে লেখা হচ্ছিল ধাবমান আলোকের জ্বলদক্ষরে সুদূর নক্ষত্রের হোমহুতাগ্নির মন্ত্রবাণী। সেই বাণীর একটি একটি ধ্বনির উচ্চারণ কালের মধ্যে ভেঙে পড়েছে যুগের জয়স্তম্ভ, নীরব হয়েছে কবির মহাকাব্য, বিলীন হয়েছে আত্মগৌরবে স্পর্ধিত জাতির ইতিহাস। আজ রাত্রে আমি সেই নক্ষত্রলোকের নিমেষহীন আলোর নিচে আমার লতাবিতানে বসে নমস্কার করি মহাকালকে। অমরতার আয়োজন শিশুর শিথিল মুষ্টিগত খেলার সামগ্রীর মতো ধুলায় প'ড়ে বাতাসে যাক উড়ে। আমি পেয়েছি ক্ষণে ক্ষণে অমৃতভরা মুহূর্তগুলিকে, তার সীমা কে বিচার করবে? তার অপরিমেয় সত্য অযুত নিযুত বৎসরের নক্ষত্রের পরিধির মধ্যে ধরে না; কল্পান্ত যখন তার সকল প্রদীপ নিবিয়ে সৃষ্টির রঙ্গমঞ্চ দেবে অন্ধকার করে তখনো সে থাকবে প্রলয়ের নেপথ্যে কল্পান্তরের প্রতীক্ষায়। নূতন চাল এক দিন গরজিয়া কহিল মহিষ, ঘোড়ার মতন মোর থাকিবে সহিস। একেবারে ছাড়িয়াছি মহিষি-চলন, দুই বেলা চাই মোর দলন-মলন। এই ভাবে প্রতিদিন, রজনী পোহালে, বিপরীত দাপাদাপি করে সে গোহালে। প্রভু কহে,চাই বটে! ভালো, তাই হোক! পশ্চাতে রাখিল তার দশ জন লোক। দুটো দিন না যাইতে কেঁদে কয় মোষ, আর কাজ নেই প্রভু, হয়েছে সন্তোষ। সহিসের হাত হতে দাও অব্যাহতি, দলন-মলনটার বাড়াবাড়ি অতি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নূতন জন্মদিনে নূতন জন্মদিনে পুরাতনের অন্তরেতে নূতনে লও চিনে।   (স্ফুলিঙ্গ) নূতন যুগের প্রত্যুষে কোন্‌ নূতন যুগের প্রত্যুষে কোন্‌ প্রবীণ বুদ্ধিমান নিত্যই শুধু সূক্ষ্ম বিচার করে— যাবার লগ্ন, চলার চিন্তা নিঃশেষে করে দান সংশয়ময় তলহীন গহ্বরে। নির্ঝর যথা সংগ্রামে নামে দুর্গম পর্বতে, অচেনার মাঝে ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ দুঃসাহসের পথে, বিঘ্নই তোর স্পর্ধিত প্রাণ জাগায়ে তুলিবে যে রে— জয় করি তবে জানিয়া লইবি অজানা অদৃষ্টেরে।   (স্ফুলিঙ্গ) নূতন সে পলে পলে নূতন সে পলে পলে অতীতে বিলীন, যুগে যুগে বর্তমান সেই তো নবীন। তৃষ্ণা বাড়াইয়া তোলে নূতনের সুরা, নবীনের চিরসুধা তৃপ্তি করে পুরা।   (স্ফুলিঙ্গ) নৈবেদ্য তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখিরজনীর শুভ্র অবসানে ; কিছু আর নাহি বাকি,নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহূর্তের দৈন্যরাশি,নাই অভিমান, নাই দীনকান্না, নাই গর্বহাসি,নাই পিছে ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালিখানিভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি। নৌকাযাত্রা মধু মাঝির ওই যে নৌকোখানা   বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে , কারো কোনো কাজে লাগছে না তো ,   বোঝাই করা আছে কেবল পাটে । আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি , পাল তুলে দিই চারটে পাঁচটা ছটা —   মিথ্যে ঘুরে বেড়াই নাকো হাটে ।        আমি কেবল যাই একটিবার        সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।           তখন তুমি কেঁদো না মা , যেন   বসে বসে একলা ঘরের কোণে —        আমি তো মা , যাচ্ছি নেকো চলে   রামের মতো চোদ্দ বছর বনে । আমি যাব রাজপুত্রু হয়ে নৌকো - ভরা সোনামানিক বয়ে , আশুকে আর শ্যামকে নেব সাথে ,   আমরা শুধু যাব মা তিন জনে ।       আমি কেবল যাব একটিবার       সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।        ভোরের বেলা দেব নৌকো ছেড়ে ,     দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে ।     দুপুরবেলা তুমি পুকুর - ঘাটে ,      আমরা তখন নতুন রাজার দেশে । পেরিয়ে যাব তির্‌পুর্নির ঘাট , পেরিয়ে যাব তেপান্তরের মাঠ , ফিরে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে ,           গল্প বলব তোমার কোলে এসে ।      আমি কেবল যাব একটিবার      সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার । (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ন্যায়দণ্ড তোমার ন্যায়ের দণ্ড প্রত্যেকের করে অর্পণ করেছ নিজে। প্রত্যেকের ’পরে দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ। সে গুরু সম্মান তব সে দুরূহ কাজ নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি সবিনয়ে। তব কার্যে যেন নাহি ডরি কভু কারে।           ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়্গসম তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্হান।অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। সঞ্চয়িতা (১৪০০ সং.) পৃ. ৪৪১ নৈবেদ্য গ্রন্থে [রবীন্দ্র রচনাবলী (পশ্চিমবঙ্গ সরকার শতবার্ষিকী সং) খণ্ড ২, পৃ ৮৯৩] কবিতার কোনো নাম নেই। পঁচিশে বৈশাখ চলেছে শ্রীমান অমিয়চন্দ্র চক্রবতী কল্যাণীয়েষুপঁচিশে বৈশাখ চলেছে জন্মদিনের ধারাকে বহন করে মৃত্যুদিনের দিকে। সেই চলতি আসনের উপর বসে কোন্‌ কারিগর গাঁথছে ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায় নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা। রথে চড়ে চলেছে কাল; পদাতিক পথিক চলতে চলতে পাত্র তুলে ধরে, পায় কিছু পানীয়;-- পান সারা হলে পিছিয়ে পড়ে অন্ধকারে; চাকার তলায় ভাঙা পাত্র ধুলায় যায় গুঁড়িয়ে। তার পিছনে পিছনে নতুন পাত্র নিয়ে যে আসে ছুটে, পায় নতুন রস, একই তার নাম, কিন্তু সে বুঝি আর-একজন। একদিন ছিলেম বালক। কয়েকটি জন্মদিনের ছাঁদের মধ্যে সেই যে-লোকটার মূর্তি হয়েছিল গড়া তোমরা তাকে কেউ জান না। সে সত্য ছিল যাদের জানার মধ্যে কেউ নেই তারা। সেই বালক না আছে আপন স্বরূপে না আছে কারো স্মৃতিতে। সে গেছে চলে তার ছোটো সংসারটাকে নিয়ে; তার সেদিনকার কান্না-হাসির প্রতিধ্বনি আসে না কোনো হাওয়ায়। তার ভাঙা খেলনার টুকরোগুলোও দেখিনে ধুলোর 'পরে। সেদিন জীবনের ছোটো গবাক্ষের কাছে সে বসে থাকত বাইরের দিকে চেয়ে। তার বিশ্ব ছিল সেইটুকু ফাঁকের বেষ্টনীর মধ্যে। তার অবোধ চোখ-মেলে চাওয়া ঠেকে যেত বাগানের পাঁচিলটাতে সারি সারি নারকেল গাছে। সন্ধ্যেবেলাটা রূপকথার রসে নিবিড়; বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে বেড়া ছিল না উঁচু, মনটা এদিক থেকে ওদিকে ডিঙিয়ে যেত অনায়াসেই। প্রদোষের আলো-আঁধারে বস্তুর সঙ্গে ছায়াগুলো ছিল জড়িয়ে, দুইই ছিল একগোত্রের। সে-কয়দিনের জন্মদিন একটা দ্বীপ, কিছুকাল ছিল আলোতে, কাল-সমুদ্রের তলায় গেছে ডুবে। ভাঁটার সময় কখনো কখনো দেখা যায় তার পাহাড়ের চূড়া, দেখা যায় প্রবালের রক্তিম তটরেখা। পঁচিশে বৈশাখ তার পরে দেখা দিল আর-এক কালান্তরে, ফাল্গুনের প্রত্যুষে রঙিন আভার অস্পষ্টতায়। তরুণ যৌবনের বাউল সুর বেঁধে নিল আপন একতারাতে, ডেকে বেড়াল নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে অনির্দেশ্য বেদনার খ্যাপা সুরে। সেই শুনে কোনো-কোনোদিন বা বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর আসন টলেছিল, তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর কোনো কোনো দূতীকে পলাশবনের রঙমাতাল ছায়াপথে কাজ-ভোলানো সকাল-বিকালে। তখন কানে কানে মৃদু গলায় তাদের কথা শুনেছি, কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি। দেখেছি কালো চোখের পক্ষ্ণরেখায় জলের আভাস; দেখেছি কম্পিত অধরে নিমীলিত বাণীর বেদনা; শুনেছি ক্বণিত কঙ্কণে চঞ্চল আগ্রহের চকিত ঝংকার। তারা রেখে গেছে আমার অজানিতে পঁচিশে বৈশাখের প্রথম ঘুমভাঙা প্রভাতে নতুন ফোটা বেলফুলের মালা; ভোরের স্বপ্ন তারি গন্ধে ছিল বিহ্বল। সেদিনকার জন্মদিনের কিশোর জগৎ ছিল রূপকথার পাড়ার গায়ে-গায়েই, জানা না-জানার সংশয়ে। সেখানে রাজকন্যা আপন এলোচুলের আবরণে কখনো বা ছিল ঘুমিয়ে, কখনো বা জেগেছিল চমকে উঠে' সোনার কাঠির পরশ লেগে। দিন গেল। সেই বসন্তীরঙের পঁচিশে বৈশাখের রঙ-করা প্রাচীরগুলো পড়ল ভেঙে। যে পথে বকুলবনের পাতার দোলনে ছায়ায় লাগত কাঁপন, হাওয়ায় জাগত মর্মর, বিরহী কোকিলের কুহুরবের মিনতিতে আতুর হত মধ্যাহ্ন, মৌমাছির ডানায় লাগত গুঞ্জন ফুলগন্ধের অদৃশ্য ইশারা বেয়ে, সেই তৃণ-বিছানো বীথিকা পৌঁছল এসে পাথরে-বাঁধানো রাজপথে। সেদিনকার কিশোরক সুর সেধেছিল যে-একতারায় একে একে তাতে চড়িয়ে দিল তারের পর নতুন তার। সেদিন পঁচিশে বৈশাখ আমাকে আনল ডেকে বন্ধুর পথ দিয়ে তরঙ্গমন্দ্রিত জনসমুদ্রতীরে। বেলা-অবেলায় ধ্বনিতে ধ্বনিতে গেঁথে জাল ফেলেছি মাঝদরিয়ায়; কোনো মন দিয়েছে ধরা, ছিন্ন জালের ভিতর থেকে কেউ বা গেছে পালিয়ে। কখনো দিন এসেছে ম্লান হয়ে, সাধনায় এসেছে নৈরাশ্য, গ্লানিভারে নত হয়েছে মন। এমন সময়ে অবসাদের অপরাহ্নে অপ্রত্যাশিত পথে এসেছে অমরাবতীর মর্ত্যপ্রতিমা; সেবাকে তারা সুন্দর করে, তপঃক্লান্তের জন্যে তারা আনে সুধার পাত্র; ভয়কে তারা অপমানিত করে উল্লোল হাস্যের কলোচ্ছ্বাসে; তারা জাগিয়ে তোলে দুঃসাহসের শিখা ভস্মে-ঢাকা অঙ্গারের থেকে; তারা আকাশবাণীকে ডেকে আনে প্রকাশের তপস্যায়। তারা আমার নিবে-আসা দীপে জ্বালিয়ে গেছে শিখা, শিথিল-হওয়া তারে বেঁধে দিয়েছে সুর, পঁচিশে বৈশাখকে বরণমাল্য পরিয়েছে আপন হাতে গেঁথে। তাদের পরশমণির ছোঁওয়া আজো আছে আমার গানে আমার বাণীতে। সেদিন জীবনের রণক্ষেত্রে দিকে দিকে জেগে উঠল সংগ্রামের সংঘাত গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে। একতারা ফেলে দিয়ে কখনো বা নিতে হল ভেরী। খর মধ্যাহ্নের তাপে ছুটতে হল জয়পরাজয়ের আবর্তনের মধ্যে। পায়ে বিঁধেছে কাঁটা, ক্ষত বক্ষে পড়েছে রক্তধারা। নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে, জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে। বিদ্বেষে অনুরাগে ঈর্ষায় মৈত্রীতে, সংগীতে পরুষ কোলাহলে আলোড়িত তপ্ত বাষ্পনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে আমার জগৎ গিয়েছে তার কক্ষপথে। এই দুর্গমে, এই বিরোধ-সংক্ষোভের মধ্যে পঁচিশে বৈশাখের প্রৌঢ় প্রহরে তোমরা এসেছ আমার কাছে। জেনেছ কি, আমার প্রকাশে অনেক আছে অসমাপ্ত অনেক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অনেক উপেক্ষিত? অন্তরে বাহিরে সেই ভালো মন্দ, স্পষ্ট অস্পষ্ট, খ্যাত অখ্যাত, ব্যর্থ চরিতার্থের জটিল সম্মিশ্রণের মধ্য থেকে যে আমার মূর্তি তোমাদের শ্রদ্ধায়, তোমাদের ভালোবাসায়, তোমাদের ক্ষমায় আজ প্রতিফলিত, আজ যার সামনে এনেছ তোমাদের মালা, তাকেই আমার পঁচিশে বৈশাখের শেষবেলাকার পরিচয় বলে নিলেম স্বীকার করে, আর রেখে গেলেম তোমাদের জন্যে আমার আশীর্বাদ। যাবার সময় এই মানসী মূর্তি রইল তোমাদের চিত্তে, কালের হাতে রইল বলে করব না অহংকার। তার পরে দাও আমাকে ছুটি জীবনের কালো-সাদা সূত্রে গাঁথা সকল পরিচয়ের অন্তরালে; নির্জন নামহীন নিভৃতে; নানা সুরের নানা তারের যন্ত্রে সুর মিলিয়ে নিতে দাও এক চরম সংগীতের গভীরতায়। পক্ষীমানব যন্ত্রদানব, মানবে করিলে পাখি।      স্থল জল যত তার পদানত           আকাশ আছিল বাকি। বিধাতার দান পাখিদের ডানাদুটি।      রঙের রেখায় চিত্রলেখায়           আনন্দ উঠে ফুটি; তারা যে রঙিন পান্থ মেঘের সাথি।      নীল গগনের মহাপবনের           যেন তারা একজাতি। তাহাদের লীলা বায়ুর ছন্দে বাঁধা;      তাহাদের প্রাণ, তাহাদের গান           আকাশের সুরে সাধা; তাই প্রতিদিন ধরণীর বনে বনে      আলোক জাগিলে একতানে মিলে           তাহাদের জাগরণে। মহাকাশতলে যে মহাশান্তি আছে      তাহাতে লহরী কাঁপে থরথরি           তাদের পাখার নাচে। যুগে যুগে তারা গগনের পথে পথে      জীবনের বাণী দিয়েছিল আনি           অরণ্যে পর্বতে; আজি একি হল, অর্থ কে তার জানে।      স্পর্ধা পতাকা মেলিয়াছে পাখা           শক্তির অভিমানে। তারে প্রাণদেব করে নি আশীর্বাদ।      তাহারে আপন করে নি তপন,           মানে নি তাহারে চাঁদ। আকাশের সাথে অমিল প্রচার করি      কর্কশস্বরে গর্জন করে           বাতাসেরে জর্জরি। আজি মানুষের কলুষিত ইতিহাসে      উঠি মেঘলোকে স্বর্গ-আলোকে           হানিছে অট্টহাসে। যুগান্ত এল বুঝিলাম অনুমানে--                         অশান্তি আজ উদ্যত বাজ                              কোথাও না বাধা মানে; ঈর্ষা হিংসা জ্বালি মৃত্যুর শিখা      আকাশে আকাশে বিরাট বিনাশে           জাগাইল বিভীষিকা। দেবতা যেথায় পাতিবে আসনখানি      যদি তার ঠাঁই কোনোখানে নাই           তবে, হে বজ্রপাণি, এ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়তলে      রুদ্রের বাণী দিক দাঁড়ি টানি           প্রলয়ের রোষানলে। আর্ত ধরার এই প্রার্থনা শুন--      শ্যামবনবীথি পাখিদের গীতি           সার্থক হোক পুন। পঞ্চমী ভাবি বসে বসে                                      গত জীবনের কথা ,                               কাঁচা মনে ছিল                                     কী বিষম মূঢ়তা ।                               শেষে ধিক্‌কারে বলি হাত নেড়ে ,                                     যাক গে সে কথা যাক গে ।            তরুণ বেলাতে যে খেলা খেলাতে                  ভয় ছিল হারবার ,            তারি লাগি , প্রিয়ে , সংশয়ে মোরে                  ফিরিয়েছ বার বার ।            কৃপণ কৃপার ভাঙা কণা একটুক                   মনে দেয় নাই সুখ ।            সে যুগের শেষে আজ বলি হেসে ,                  কম কি সে কৌতুক                      যতটুকু ছিল ভাগ্যে ,                          দুঃখের কথা থাক্‌ গে ।                                  পঞ্চমী তিথি                                      বনের আড়াল থেকে                               দেখা দিয়েছিল                                     ছায়া দিয়ে মুখ ঢেকে ।                               মহা আক্ষেপে বলেছি সেদিন ,                                     এ ছল কিসের জন্য ।            পরিতাপে জ্বলি আজ আমি বলি ,                  সিকি চাঁদিনীর আলো            দেউলে নিশার অমাবস্যার                  চেয়ে যে অনেক ভালো ।            বলি আরবার , এসো পঞ্চমী , এসো ,                  চাপা হাসিটুকু হেসো ,            আধখানি বেঁকে ছলনায় ঢেকে   না জানিয়ে ভালোবেসো ।                      দয়া , ফাঁকি নামে গণ্য ,                          আমারে করুক ধন্য ।                               আজ খুলিয়াছি                                     পুরানো স্মৃতির ঝুলি ,                               দেখি নেড়েচেড়ে                                      ভুলের দুঃখগুলি ।                               হায় হায় এ কী , যাহা কিছু দেখি                                     সকলি যে পরিহাস্য ।            ভাগ্যের হাসি কৌতুক করি                  সেদিন সে কোন্‌ ছলে            আপনার ছবি দেখিতে চাহিল                   আমার অশ্রুজলে ।            এসো ফিরে এসো সেই ঢাকা বাঁকা হাসি ,                  পালা শেষ করো আসি ।            মূঢ় বলিয়া করতালি দিয়া                  যাও মোরে সম্ভাষি ।                      আজ করো তারি ভাষ্য                          যা ছিল অবিশ্বাস্য ।                                বয়স গিয়েছে ,                                     হাসিবার ক্ষমতাটি                               বিধাতা দিয়েছে ,                                     কুয়াশা গিয়েছে কাটি ।                               দুখদুর্দিন কালো বরনের                                      মুখোশ করেছে ছিন্ন ।            দীর্ঘ পথের শেষ গিরিশিরে                  উঠে গেছে আজ কবি ।            সেথা হতে তার ভূতভবিষ্য                  সব দেখে যেন ছবি ।            ভয়ের মূর্তি যেন যাত্রার সঙ্‌ ,                  মেখেছে কুশ্রী রঙ ।             দিনগুলি যেন পশুদলে চলে , ঘণ্টা বাজায়ে গলে ।                       কেবল ভিন্ন ভিন্ন                          সাদা কালো যত চিহ্ন । পড়েছি আজ রেখার মায়ায় শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কল্যাণীয়েষু      ১ পড়েছি আজ রেখার মায়ায়। কথা ধনীঘরের মেয়ে, অর্থ আনে সঙ্গে করে, মুখরার মন রাখতে চিন্তা করতে হয় বিস্তর। রেখা অপ্রগল্‌ভা, অর্থহীনা, তার সঙ্গে আমার যে ব্যবহার সবই নিরর্থক। গাছের শাখায় ফুল ফোটানো ফল ধরানো, সে কাজে আছে দায়িত্ব; গাছের তলায় আলোছায়ার নাট-বসানো সে আর-এক কাণ্ড। সেইখানেই শুকনো পাতা ছড়িয়ে পড়ে, প্রজাপতি উড়তে থাকে, জোনাকি ঝিকমিক করে রাতের বেলা। বনের আসরে এরা সব রেখা-বাহন হাল্কা চালের দল, কারো কাছে জবাবদিহি নেই। কথা আমাকে প্রশ্রয় দেয় না, তার কঠিন শাসন; রেখা আমার যথেচ্ছাচারে হাসে, তর্জনী তোলে না। কাজকর্ম পড়ে থাকে, চিঠিপত্র হারিয়ে ফেলি, ফাঁক পেলেই ছুটে যাই রূপ-ফলানোর অন্দরমহলে। এমনি করে, মনের মধ্যে অনেকদিনের যে-লক্ষ্মীছাড়া লুকিয়ে আছে তার সাহস গেছে বেড়ে। সে আঁকছে, ভাবছে না সংসারের ভালোমন্দ, গ্রাহ্য করে না লোকমুখের নিন্দাপ্রশংসা।২ মনটা আছে আরামে। আমার ছবি-আঁকা কলমের মুখে খ্যাতির লাগাম পড়েনি। নামটা আমার খুশির উপরে সর্দারি করতে আসেনি এখনো, ছবি-আঁকার বুক জুড়ে আগেভাগে নিজের আসনটা বিছিয়ে বসেনি; ঠেলা দিয়ে দিয়ে বলছে না "নাম রক্ষা ক'রো।" অথচ ঐ নামটা নিজের মোটা শরীর নিয়ে স্বয়ং কোনো কাজই করে না। সব কীর্তির মুখ্য ভাগটা আদায় করবার জন্যে দেউড়িতে বসিয়ে রাখে পেয়াদা; হাজার মনিবের পিণ্ড-পাকানো ফরমাশটাকে বেদী বানিয়ে স্তূপাকার ক'রে রাখে কাজের ঠিক সামনে। এখনো সেই নামটা অবজ্ঞা করেই রয়েছে অনুপস্থিত;-- আমার তুলি আছে মুক্ত যেমন মুক্ত আজ ঋতুরাজের লেখনী। পণ্ডিত কুমিরকে ডেকে বলে পণ্ডিত কুমিরকে ডেকে বলে, “নক্র, প্রখর তোমার দাঁত, মেজাজটা বক্র। আমি বলি নখ তব করো তুমি কর্তন, হিংস্র স্বভাব তবে হবে পরিবর্তন আমিষ ছাড়িয়া যদি শুধু খাও তক্র।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পত্র নৌকাযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিতসুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন স্থলচরবরেষুজলে বাসা বেঁধেছিলেম , ডাঙায় বড়ো কিচিমিচি । সবাই গলা জাহির করে , চেঁচায় কেবল মিছিমিছি । সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে , ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয় , ভদ্রলোকের গায়ে পড়ে কলম নেড়ে কালি ছিটোয় । এখানে যে বাস করা দায় ভনভনানির বাজারে , প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে হট্টগোলের মাঝারে । কানে যখন তালা ধরে , উঠি যখন হাঁপিয়ে কোথায় পালাই , কোথায় পালাই — জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে গঙ্গাপ্রাপ্তির আশা করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেম । তোমাদের না বলে কয়ে আস্তে আস্তে সরেছিলেম ।দুনিয়ার এ মজলিসেতে এসেছিলেম গান শুনতে , আপন মনে গুনগুনিয়ে রাগ – রাগিণীর জাল বুনতে । গান শোনে সে কাহার সাধ্যি , ছোঁড়াগুলো বাজায় বাদ্যি , বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে থাকে তারা তুলো ধুনতে । ডেকে বলে , হেঁকে বলে , ভঙ্গি করে বেঁকে বলে — ‘‘ আমার কথা শোনো সবাই , গান শোনো আর নাই শোনো। গান যে কাকে বলে সেইটে বুঝিয়ে দেব , তাই শোনে । ”টীকে করেন ব্যখ্যা করেন , জেঁকে ওঠে বক্তিমে — কে দেখে তার হাত – পা নাড়া , চক্ষু দুটোর রক্তিমে ! চন্দ্রসূর্য জ্বলছে মিছে আকাশখানার চালাতে — তিনি বলেন , ‘‘ আমিই আছি জ্বলতে এবং জ্বালাতে । ”’ কুঞ্জবনের তানপুরোতে সুর বেঁধেছে বসন্ত , সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ , হয় নাকো তাঁর পছন্দ । তাঁরি সুরে গাক – না সবাই টপ্পা খেয়াল ধুরবোধ — গায় না যে কেউ , আসল কথা নাইকো কারো সুর – বোধ ! কাগজওয়ালা সারি সারি নাড়ছে কাগজ হাতে নিয়ে — বাঙলা থেকে শান্তি বিদায় তিনশো কুলোর বাতাস দিয়ে । কাগজ দিয়ে নৌকা বানায় বেকার যত ছেলেপিলে , কর্ণ ধরে পার করবেন দু – এক পয়সা খেয়া দিলে । সস্তা শুনে ছুটে আসে যত দীর্ঘকর্ণগুলো — বঙ্গদেশের চতুর্দিকে তাই উড়ছে এত ধুলো । খুদে খুদে ‘আর্য’ গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে , ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে । তাঁরা বলেন , ‘‘ আমিই কল্কি” — গাঁজার কল্কি হবে বুঝি ! অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি ।পাড়ার এমন কত আছে কত কব তার ! বঙ্গদেশে মেলাই এল বরা ‘- অবতার । দাঁতের জোরে হিন্দুশাস্ত্র তুলবে তারা পাঁকের থেকে , দাঁতকপাটি লাগে তাদের দাঁত – খিঁচুনির ভঙ্গি দেখে । আগাগোড়াই মিথ্যে কথা , মিথ্যেবাদীর কোলাহল , জিব নাচিয়ে বেড়ায় যত জিহ্বাওয়ালা সঙের দল । বাক্যবন্যা ফেনিয়ে আসে , ভাসিয়ে নে যায় তোড়ে — কোনোক্রমে রক্ষে পেলাম মা – গঙ্গারই ক্রোড়ে ।হেথায় কিবা শান্তি – ঢালা কুলুকুলু তান ! সাগর – পানে বহন করে গিরিরাজের গান । ধীরি ধীরি বাতাসটি দেয় জলের গায়ে কাঁটা । আকাশেতে আলো – আঁধার খেলে জোয়ারভাঁটা । তীরে তীরে গাছের সারি পল্লবেরই ঢেউ । সারা দিবস হেলে দোলে , দেখে না তো কেউ । পূর্বতীরে তরুশিরে অরুণ হেসে চায় — পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে সন্ধ্যা নেমে যায় । তীরে ওঠে শঙ্খধ্বনি , ধীরে আসে কানে , সন্ধ্যাতারা চেয়ে থাকে ধরণীর পানে । ঝাউবনের আড়ালেতে চাঁদ ওঠে ধীরে , ফোটে সন্ধ্যাদীপগুলি অন্ধকার তীরে । এই শান্তি – সলিলেতে দিয়েছিলেম ডুব , হট্টগোলটা ভুলেছিলেম , সুখে ছিলেম খুব ।জান তো ভাই আমি হচ্ছি জলচরের জাত , আপন মনে সাঁতরে বেড়াই — ভাসি যে দিনরাত । রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠি , হাওয়াটি খাই চোখ বুজে , ভয়ে ভয়ে কাছে এগোই তেমন তেমন লোক বুঝে । গতিক মন্দ দেখলে আবার ডুবি অগাধ জলে , এমনি করেই দিনটা কাটাই লুকোচুরির ছলে । তুমি কেন ছিপ ফেলেছ শুকনো ডাঙায় বসে ? বুকের কাছে বিদ্ধ করে টান মেরেছ কষে । আমি তোমায় জলে টানি , তুমি ডাঙায় টানো — অটল হয়ে বসে আছ , হার তো নাহি মানো । আমারি নয় হার হয়েছে , তোমারি নয় জিত — খাবি খাচ্ছি ডাঙায় পড়ে হয়ে পড়ে চিত । আর কেন ভাই , ঘরে চলো ছিপ গুটিয়ে নাও , রবীন্দ্রনাথ পড়ল ধরা ঢাক পিটিয়ে দাও ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পত্র শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্টীমার । খুলনা মাগো আমার লক্ষ্মী , মনিষ্যি না পক্ষী! এই ছিলেম তরীতে , কোথায় এনু ত্বরিতে! কাল ছিলেম খুলনায় , তাতে তো আর ভুল নাই , কলকাতায় এসেছি সদ্য , বসে বসে লিখছি পদ্য ।তোদের ফেলে সারাটা দিন আছি অমনি এক রকম , খোপে বসে পায়রা যেন করছি কেবল বক্বকম! বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর মেঘ করেছে আকাশে , উষার রাঙা মুখখানি গো কেমন যেন ফ্যাকাশে! বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই দুয়োরগুলো ভেজানো , ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই ঘরে আছে কে যেন! পক্ষীটি সেই ঝুপসি হয়ে ঝিমচ্ছে রে খাঁচাতে , ভুলে গেছে নেচে নেচে পুচ্ছটি তার নাচাতে । ঘরের কোণে আপন মনে শূন্য পড়ে বিছেনা , কাহার তরে কেঁদে মরে সে কথাটা মিছে না! বইগুলো সব ছড়িয়ে প ' ড়ে নাম লেখা তায় কার গো! এমনি তারা রবে কি রে খুলবে না কেউ আর গো! এটা আছে সেটা আছে অভাব কিছু নেই তো , স্মরণ করে দেয় রে যারে থাকে নাকো সেই তো! বাগানে ওই দুটো গাছে ফুল ফুটেছে রাশি রাশি , ফুলের গন্ধে মনে পড়ে ফুল কে আমায় দিত মেলা , বিছেনায় কার মুখটি দেখে সকাল হত সকালবেলা! জল থেকে তুই আসবি কবে মাটির লক্ষ্মী মাটিতে ঠাকুরবাবুর ছয় নম্বর জোড়াসাঁকোর বাটীতে!ইস্টিম ওই রে ফুরিয়ে এল নোঙর তবে ফেলি অদ্য । অবিদিত নেই তো তোমার রবিকাকা কুঁড়ের হদ্দ! আজকে নাকি মেঘ করেছে ঠেকছে কেমন ফাঁকা-ফাঁকা , তাই খানিকটা ফোঁসফোঁসিয়ে বিদায় হল — রবিকাকা ।পত্র শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্টীমার । খুলনা বসে বসে লিখলেম চিঠি পুরিয়ে দিলাম চারটি পিঠই , পেলেম না তার জবাবই এমনি তোমার নবাবী!দুটো ছত্র লিখবি পত্র একলা তোমার ‘ রব্-কা ' যে! পোড়ারমুখী তাও হবে না আলিস্যি তোর সব কাজে! ঝগড়াটে নয় স্বভাব আমার নইলে দেখতে কারখানা , গলার চোটে আকাশ ফেটে হয়ে যেত চারখানা , বাছা আমার দেখতে পেতে এই কলমের ধারখানা!তোমার মতো এমনি মা তো দেখি নি এ বঙ্গে গো , মায়া দয়া যা-কিছু সে যদিন থাকে সঙ্গে গো! চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল কেমনতরো ঢঙ এ গো! তোমার প্রাণ যে পাষাণ-সম জানি সেটা Long ago!সংসারে যে সবি মায়া সেটা নেহাত গল্প না! বাইরেতে এক ভিতরে এক এ যেন কার খল-পনা! সত্যি বলে যেটা দেখি সেটা আমার কল্পনা! ভেবে একবার দেখো বাছা ফিলজফি অল্প না!মস্ত একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কে রেখেছে সাজিয়ে যা করি তা কেবল ‘ থোড়া জমির বাস্তে কাজিয়ে! ' বৃষ্টি পড়ে চিঠি না পাই , মনটা নিয়ে ততই হাঁপাই , শূন্যে চেয়ে ততই ভাবি সকলি ভোজ-বাজি এ! ফিলজফি মনের মধ্যে ততই ওঠে গাঁজিয়ে!দূর হোক গে , এত কথা কেনই বলি তোমাকে! ভরা নায়ে পা দিয়েছ , আছ তুমি দেমাকে! ---তোমার সঙ্গে আর কথা না , তুমি এখন লোকটা মস্ত , কাজ কি বাপু , এইখেনেতেই রবীন্দ্রনাথ হলেন অস্ত ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পত্র (সম্পাদক সমীপেষু) শ্রীমান্ দামু বসু এবং চামু বসু                    সম্পাদক সমীপেষু । দামু বোস আর চামু বোসে           কাগজ বেনিয়েছে বিদ্যেখানা বড্ড ফেনিয়েছে!                    (আমার দামু আমার চামু!)    কোথায় গেল বাবা তোমার           মা জননী কই! সাত-রাজার-ধন মানিক ছেলের           মুখে ফুটছে খই!                    (আমার দামু আমার চামু!) দামু ছিল একরত্তি           চামু তথৈবচ , কোথা থেকে এল শিখে           এতই খচমচ!                    (আমার দামু আমার চামু!)    দামু বলেন ‘ দাদা আমার '           চামু বলেন ‘ ভাই ', আমাদের দোঁহাকার মতো           ত্রিভুবনে নাই!                    (আমার দামু আমার চামু!)    গায়ে পড়ে গাল পাড়ছে           বাজার সরগরম , মেছুনি-সংহিতায় ব্যাখ্যা           হিঁদুর ধরম!                    (দামু আমার চামু!)    দামুচন্দ্র অতি হিঁদু           আরো হিঁদু চামু সঙ্গে সঙ্গে গজায় হিঁদু           রামু বামু শামু                    (দামু আমার চামু!)    রব উঠেছে ভারতভূমে           হিঁদু মেলা ভার , দামু চামু দেখা দিয়েছেন           ভয় নেইকো আর ।                    (ওরে দামু , ওরে চামু!)    নাই বটে গোতম অত্রি           যে যার গেছে সরে , হিঁদু দামু চামু এলেন           কাগজ হাতে করে ।                    (আহা দামু আহা চামু!)    লিখছে দোঁহে হিঁদুশাস্ত্র           এডিটোরিয়াল , দামু বলছে মিথ্যে কথা           চামু দিচ্ছে গাল ।                    (হায় দামু হায় চামু!)    এমন হিঁদু মিলবে না রে            সকল হিঁদুর সেরা , বোস বংশ আর্যবংশ           সেই বংশের এঁরা!                    (বোস দামু বোস চামু!)    কলির শেষে প্রজাপতি           তুলেছিলেন হাই , সুড়সুড়িয়ে বেড়িয়ে এলেন           আর্য দুটি ভাই ;                    (আর্য দামু চামু!)    দন্ত দিয়ে খুঁড়ে তুলছে           হিঁদু শাস্ত্রের মূল , মেলাই কচুর আমদানিতে           বাজার হুলুস্থুল ।                    (দামু চামু অবতার!)    মনু বলেন ‘ মনু আমি '           বেদের হল ভেদ , দামু চামু শাস্ত্র ছাড়ে ,           রইল মনে খেদ!                    (ওরে দামু ওরে চামু!)    মেড়ার মত লড়াই করে           লেজের দিকটা মোটা , দাপে কাঁপে থরথর           হিঁদুয়ানির খোঁটা!                    (আমার হিঁদু দামু চামু!)    দামু চামু কেঁদে আকুল           কোথায় হিঁদুয়ানি! ট্যাকে আছে গোঁজ ' যেথায়           সিকি দুয়ানি ।                    (থলের মধ্যে হিঁদুয়ানি!)    দামু চামু ফুলে উঠল           হিঁদুয়ানি বেচে , হামাগুড়ি ছেড়ে এখন           বেড়ায় নেচে নেচে!                    (ষেটের বাছা দামু চামু!)    আদর পেয়ে নাদুস নুদুস           আহার করছে কসে , তরিবৎটা শিখলে নাকো           বাপের শিক্ষাদোষে!                    (ওরে দামু চামু!)    এসো বাপু কানটি নিয়ে ,           শিখবে সদাচার , কানের যদি অভাব থাকে           তবেই নাচার!                    (হায় দামু হায় চামু!) পড়াশুনো করো , ছাড়ো           শাস্ত্র আষাঢ়ে , মেজে ঘষে তোল্ রে বাপু           স্বভাব চাষাড়ে ।                    (ও দামু ও চামু!)    ভদ্রলোকের মান রেখে চল্           ভদ্র বলবে তোকে , মুখ ছুটোলে কুলশীলটা           জেনে ফেলবে লোকে!                    (হায় দামু হায় চামু!)    পয়সা চাও তো পয়সা দেব           থাকো সাধুপথে , তাবচ্চ শোভতে কেউ কেউ           যাবৎ ন ভাষতে!                     (হে দামু হে চামু!) (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পথহারা আজকে আমি কতদূর যে              গিয়েছিলেম চলে ! যত তুমি ভাবতে পারো তার চেয়ে সে অনেক আরো , শেষ করতে পারব না তা           তোমায় ব'লে ব'লে ।    অনেক দূর সে , আরো দূর সে ,           আরো অনেক দূর । মাঝখানেতে কত যে বেত , কত যে বাঁশ , কত যে খেত , ছাড়িয়ে ওদের ঠাকুরবাড়ি           ছাড়িয়ে তালিমপুর ।    পেরিয়ে গেলেম যেতে যেতে           সাত - কুশি সব গ্রাম , ধানের গোলা গুনব কত জোদ্দারদের গোলার মতো , সেখানে যে মোড়ল কারা           জানি নে তার নাম ।    একে একে মাঠ পেরোলুম           কত মাঠের পরে । তার পরে , উঃ , বলি মা শোন্‌ , সামনে এল প্রকাণ্ড বন , ভিতরে তার ঢুকতে গেলে           গা ছ্ম্ছ্ম্ করে ।    জামতলাতে বুড়ি   ছিল ,           বললে ' খবরদার '! আমি বললেম বারণ শুনে ' ছ - পণ কড়ি এই নে গুনে ', যতক্ষণ সে গুনতে থাকে           হয়ে গেলাম পার ।    কিছুরই শেষ নেই কোত্থাও           আকাশ পাতাল জুড়ি । যতই চলি যতই চলি বেড়েই চলে বনের গলি , কালো মুখোশপরা আঁধার           সাজল জুজুবুড়ি ।    খেজুরগাছের মাথায় বসে           দেখছে কারা ঝুঁকি । কারা যে সব ঝোপের পাশে একটুখানি মুচকে হাসে , বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো           কেবল মারে উঁকি ।    আমায় যেন চোখ টিপছে           বুড়ো গাছের গুঁড়ি । লম্বা লম্বা কাদের পা যে ঝুলছে ডালের মাঝে মাঝে , মনে হচ্ছে পিঠে আমার           কে দিল সুড়সুড়ি ।    ফিসফিসিয়ে কইছে কথা           দেখতে না পাই কে সে । অন্ধকারে দুদ্দাড়িয়ে কে যে কারে যায় তাড়িয়ে , কী জানি কী গা চেটে যায়           হঠাৎ কাছ এসে । ফুরোয় না পথ ভাবছি আমি           ফিরব কেমন করে । সামনে দেখি কিসের ছায়া , ডেকে বলি , ' শেয়াল ভায়া , মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ           দেখিয়ে দে - না মোরে । '    কয় না কিছুই , চুপটি করে           কেবল মাথা নাড়ে । সিঙ্গিমামা কোথা থেকে হঠাৎ কখন এসে ডেকে কে জানে মা , হালুম ক'রে            পড়ল যে কার ঘাড়ে ।    বল্‌ দেখি তুই , কেমন করে           ফিরে পেলেম মাকে ? কেউ জানে না কেমন করে ; কানে কানে বলব তোরে ? যেমনি স্বপন ভেঙে গেল           সিঙ্গিমামার ডাকে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) পথিক আমি পথিক আমি। পথ চলতে চলতে দেখেছি পুরাণে কীর্তিত কত দেশ আজ কীর্তি-নিঃস্ব। দেখেছি দর্পোদ্ধত প্রতাপের অবমানিত ভগ্নশেষ, তার বিজয় নিশান বজ্রাঘাতে হঠাৎ স্তব্ধ অট্টহাসির মতো গেছে উড়ে; বিরাট অহংকার হয়েছে সাষ্টাঙ্গে ধুলায় প্রণত, সেই ধুলার 'পরে সন্ধ্যাবেলায় ভিক্ষুক তার জীর্ণ কাঁথা মেলে বসে, পথিকের শ্রান্ত পদ সেই ধুলায় ফেলে চিহ্ন,-- অসংখ্যের নিত্য পদপাতে সে চিহ্ন যায় লুপ্ত হয়ে। দেখেছি সুদূর যুগান্তর বালুর স্তরে প্রচ্ছন্ন, যেন হঠাৎ ঝঞ্ঝার ঝাপটা লেগে কোন্‌ মহাতরী হঠাৎ ডুবল ধূসর সমুদ্রতলে, সকল আশা নিয়ে, গান নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে। এই অনিত্যের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে অনুভব করি আমার হৃৎস্পন্দনে অসীমের স্তব্ধতা। পথিক দেখেছি আমি পুরাণে কীর্তিত কত দেশ পথিক দেখেছি আমি পুরাণে কীর্তিত কত দেশ কীর্তি-নিঃস্ব আজি; দেখেছি অবমানিত ভগ্নশেষ দর্পোদ্ধত প্রতাপের; অন্তর্হিত বিজয়-নিশান বজ্রাঘাতে স্তব্ধ যেন অট্টহাসি; বিরাট সম্মান সাষ্টাঙ্গে সে ধুলায় প্রণত, যে ধুলার পরে মেলে সন্ধ্যাবেলা ভিক্ষু জীর্ণ কাঁথা, যে ধুলায় চিহ্ন ফেলে শ্রান্ত পদ পথিকের, পুনঃ সেই চিহ্ন লোপ করে অসংখ্যের নিত্য পদপাতে। দেখিলাম বালুস্তরে প্রচ্ছন্ন সুদূর যুগান্তর, ধূসর সমুদ্রতলে যেন মগ্ন মহাতরী অকস্মাৎ ঝঞ্ঝাবর্ত বলে লয়ে তার সব ভাষা, সর্ব দিন রজনীর আশা, মুখরিত ক্ষুধাতৃষ্ণা, বাসনা-প্রদীপ্ত ভালবাসা। তবু করি অনুভব বসি’ এই অনিত্যের বুকে , অসীমের হৃৎস্পন্দন তরঙ্গিছে মোর দুঃখে সুখে ।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) পথের পথিক করেছ আমায় পথের পথিক করেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। আলেয়া জ্বালালে প্রান্তরভালে সেই আলো মোর সেই আলো। ঘাটে বাঁধা ছিল খেয়াতরী, তাও কি ডুবালে ছল করি। সাঁতারিয়া পার হব বহি ভার সেই ভালো মোর সেই ভালো।ঝড়ের মুখে যে ফেলেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। সব সুখজালে বজ্র জ্বালালে সেই আলো মোর সেই আলো। সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি– কী ভয় লাগালে, গেল ছাড়ি– একাকীর পথে চলিব জগতে সেই ভালো মোর সেই ভালো।কোনো মান তুমি রাখ নি আমার সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। হৃদয়ের তলে যে আগুন জ্বলে সেই আলো মোর সেই আলো। পাথেয় যে ক’টি ছিল কড়ি পথে খসি কবে গেছে পড়ি, শুধু নিজবল আছে সম্বল সেই ভালো মোর সেই ভালো।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) পথের বাঁধন পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।        রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল        পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,             ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে                  দিগঙ্গনার নৃত্য,             হঠাৎ-আলোর ঝল্‌কানি লেগে                  ঝলমল করে চিত্ত।নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ, বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।        হঠাৎ কখন্‌ সন্ধ্যাবেলায়        নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,             প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে                  অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ             উদ্ধত যত শাখার শিখরে                  রডোডেন্‌ড্রন্‌ গুচ্ছ।নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন, নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন।        পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,        বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,             ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের                  কূজনে দুজনে তৃপ্ত।             আমরা চকিত অভাবনীয়ের                  ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।   বাঙ্গালোর, আষাঢ়, ১৩৩৫ পদ্মা হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিনে, গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন, নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন, নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে। যখন মুখর তব চক্রবাকদল সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল, যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে, তুমি কোন্‌ গান কর আমি কোন্‌ গান দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান। নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায় শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়। কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে, যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে— কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড় কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড় পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন? জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে, আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায় হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়?   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পদ্মায় আমার নৌকো বাঁধা ছিল পদ্মানদীর পারে, হাঁসের পাঁতি উড়ে যেত মেঘের ধারে ধারে-- জানিনে মন-কেমন-করা লাগত কী সুর হাওয়ার আকাশ বেয়ে দূর দেশেতে উদাস হয়ে যাওয়ার। কী জানি সেই দিনগুলি সব কোন্‌ আঁকিয়ের লেখা, ঝিকিমিকি সোনার রঙে হালকা তুলির রেখা। বালির 'পরে বয়ে যেত স্বচ্ছ নদীর জল, তেমনি বইত তীরে তীরে গাঁয়ের কোলাহল-- ঘাটের কাছে, মাঠের ধারে, আলো-ছায়ার স্রোতে; অলস দিনের উড়্‌নিখানার পরশ আকাশ হতে বুলিয়ে যেত মায়ার মন্ত্র আমার দেহে-মনে।        তারই মধ্যে আসত ক্ষণে ক্ষণে             দূর কোকিলের সুর,          মধুর হত আশ্বিনে রোদ্‌দুর।     পাশ দিয়ে সব নৌকো বড়ো বড়ো পরদেশিয়া নানা খেতের ফসল ক'রে জড়ো পশ্চিমে হাট বাজার হতে, জানিনে তার নাম, পেরিয়ে আসত ধীর গমনে গ্রামের পরে গ্রাম               ঝপ্‌ঝপিয়ে দাঁড়ে। খোরাক কিনতে নামত দাঁড়ি ছায়ানিবিড় পাড়ে।             যখন হত দিনের অবসান গ্রামের ঘাটে বাজিয়ে মাদল গাইত হোলির গান। ক্রমে রাত্রি নিবিড় হয়ে নৌকো ফেলত ঢেকে, একটি কেবল দীপের আলো জ্বলত ভিতর থেকে। শিকলে আর স্রোতে মিলে চলত টানের শব্দ;        স্বপ্নে যেন ব'কে উঠত রজনী নিস্তব্ধ। পুবে হাওয়ায় এল ঋতু, আকাশ-জোড়া মেঘ; ঘরমুখো ওই নৌকোগুলোয় লাগল অধীর বেগ।   ইলিশমাছ আর পাকা কাঁঠাল জমল পারের হাটে,   কেনাবেচার ভিড় লাগল নৌকো-বাঁধা ঘাটে।   ডিঙি বেয়ে পাটের আঁঠি আনছে ভারে ভারে,   মহাজনের দাঁড়িপাল্লা উঠল নদীর ধারে।   হাতে পয়সা এল, চাষি ভাব্‌না নাহি মানে,   কিনে নতুন ছাতা জুতো চলেছে ঘর-পানে।   পরদেশিয়া নৌকোগুলোর এল ফেরার দিন,   নিল ভরে খালি-করা কেরোসিনের টিন;   একটা পালের 'পরে ছোটো আরেকটা পাল তুলে   চলার বিপুল গর্বে তরীর বুক উঠেছে ফুলে।   মেঘ ডাকছে গুরু গুরু, থেমেছে দাঁড় বাওয়া,   ছুটছে ঘোলা জলের ধারা, বইছে বাদল হাওয়া। পদ্মের পাতা পেতে অাছে অঞ্জলি পদ্মের পাতা পেতে অাছে অঞ্জলি রবির করের লিখন ধরিবে বলি। সায়াহে রবি অস্তে নামিবে যবে সে ক্ষণলিখন তখন কোথায় রবে।   (স্ফুলিঙ্গ) পবিত্র জীবন মিছে হাসি , মিছে বাঁশি , মিছে এ যৌবন , মিছে এই দরশের পরশের খেলা । চেয়ে দেখো , পবিত্র এ মানবজীবন , কে ইহারে অকাতরে করে অবহেলা ! ভেসে ভেসে এই মহা চরাচরস্রোতে কে জানে গো আসিয়াছে কোন্খান হতে , কোথা হতে নিয়ে এল প্রেমের আভাস , কোন্ অন্ধকার ভেদি উঠিল আলোতে ! এ নহে খেলার ধন , যৌবনের আশ — বোলো না ইহার কানে আবেশের বাণী ! নহে নহে এ তোমার বাসনার দাস , তোমার ক্ষুধার মাঝে আনিয়ো না টানি ! এ তোমার ঈশ্বরের মঙ্গল – আশ্বাস , স্বর্গের আলোক তব এই মুখখানি ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পর ও আত্মীয় ছাই বলে, শিখা মোর ভাই আপনার, ধোঁওয়া বলে, আমি তো যমজ ভাই তার। জোনাকি কহিল, মোর কুটুম্বিতা নাই, তোমাদের চেয়ে আমি বেশি তার ভাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) পর-বিচারে গৃহভেদ আম্র কহে, এক দিন, হে মাকাল ভাই, আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই— মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি, মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) পরবেশ কে তুমি ফিরিছ পরি প্রভুদের সাজ। ছদ্মবেশে বাড়ে না কি চতুর্গুণ লাজ! পরবস্ত্র অঙ্গে তব হয়ে অধিষ্ঠান তোমারেই করিছে না নিত্য অপমান? বলিছে না, “ওরে দীন, যত্নে মোরে ধরো, তোমার চর্মের চেয়ে আমি শ্রেষ্ঠতর?” চিত্তে যদি নাহি থাকে আপন সম্মান, পৃষ্ঠে তবে কালো বস্ত্র কলঙ্কনিশান। ওই তুচ্ছ টুপিখানা চড়ি তব শিরে ধিক্কার দিতেছে না কি তব স্বজাতিরে। বলিতেছে, “যে মস্তক আছে মোর পায় হীনতা ঘুচেছে তার আমারি কৃপায়।” সর্বাঙ্গে লাঞ্ছনা বহি এ কী অহংকার! ওর কাছে জীর্ণ চীর জেনো অলংকার।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পরম সুন্দর আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে পরম সুন্দর আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে। অসীম অরূপ রূপে রূপে স্পর্শমণি রসমূর্তি করিছে রচনা, প্রতিদিন চিরনূতনের অভিষেক চিরপুরাতন বেদীতলে। মিলিয়া শ্যামলে নীলিমায় ধরণীর উত্তরীয় বুনে চলে ছায়াতে আলোতে। আকাশের হৃৎস্পন্দন পল্লবে পল্লবে দেয় দোলা। প্রভাতের কন্ঠ হতে মণিহার করে ঝিলিমিলি বন হতে বনে। পাখিদের অকারণ গান সাধুবাদ দিতে থাকে জীবনলক্ষ্মীরে। সবকিছু সাথে মিশে মানুষের প্রীতির পরশ অমৃতের অর্থ দেয় তারে, মধুময় করে দেয় ধরণীর ধূলি, সর্বত্র বিছায়ে দেয় চিরমানবের সিংহাসন।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) পরস্পর বাণী কহে, তোমারে যখন দেখি, কাজ, আপনার শূণ্যতায় বড়ো পাই লাজ। কাজ শুনি কহে, অয়ি পরিপূর্ণা বাণী, নিজেরে তোমার কাছে দীন ব’লে জানি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) পরিচয় একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে       বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে । তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি , " পরিচয় কোনো আছে নাকি,         যাবে কোনখানে ? " আমি শুধু বলেছি, " কে জানে !"নদীতে লাগিল দোলা ,বাঁধনে পড়িল টান----     একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।         সেই গান শুনি কুসুমিত তরুতলে তরূন তরূণী   তুলিল অশোক---    মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল ," এ আমাদেরই লোক "।   আর কিছু নয়, সে মোর প্রথম পরিচয় ।।তার পরে জোয়ারের বেলা সাঙ্গ হল. সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা ; কোকিলের ক্লান্ত গানে বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে ; কনকচাঁপার দল পড়ে ঝুরে; ভেসে যায় দূরে, ফাল্গুনের উৎসবরাতির নিমন্ত্রণলিখনপাঁতির ছিন্ন অংশ তারা অর্থহারা ।ভাঁটার গভীর টানে তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে । নুতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে শুধাইছে দূর হতে চেয়ে, ' সন্ধ্যার তারার দিকে    বহিয়া  চলেছে তরণী কে ?"       সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার,        ' মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,          আমি তোমাদেরই লোক,          আর কিছু নয়----- এই হোক শেষ পরিচয় ।। পরিচয় একটি মেয়ে আছে জানি,            পল্লীটি তার দখলে, সবাই তারি পুজো জোগায়            লক্ষ্মী বলে সকলে। আমি কিন্তু বলি তোমায়            কথায় যদি মন দেহ— খুব যে উনি লক্ষ্মী মেয়ে            আছে আমার সন্দেহ। ভোরের বেলা আঁধার থাকে,            ঘুম যে কোথা ছোটে ওর— বিছানাতে হুলুস্থুলু            কলরবের চোটে ওর। খিল্‌খিলিয়ে হাসে শুধু            পাড়াসুদ্ধ জাগিয়ে, আড়ি করে পালাতে যায়            মায়ের কোলে না গিয়ে। হাত বাড়িয়ে মুখে সে চায়,            আমি তখন নাচারই, কাঁধের ‘পরে তুলে তারে            করে বেড়াই পাচারি। মনের মতো বাহন পেয়ে            ভারি মনের খুশিতে মারে আমায় মোটা মোটা            নরম নরম ঘুষিতে। আমি ব্যস্ত হয়ে বলি—            ‘একটু রোসো রোসো মা। ' মুঠো করে ধরতে আসে            আমার চোখের চশমা। আমার সঙ্গে কলভাষায়            করে কতই কলহ। তুমুল কাণ্ড! তোমরা তারে            শিষ্ট আচার বলহ? তবু তো তার সঙ্গে আমার            বিবাদ করা সাজে না। সে নইলে যে তেমন করে             ঘরের বাঁশি বাজে না। সে না হলে সকালবেলায়            এত কুসুম ফুটবে কি। সে না হলে সন্ধেবেলায়            সন্ধেতারা উঠবে কি। একটি দণ্ড ঘরে আমার            না যদি রয় দুরন্ত কোনোমতে হয় না তবে            বুকের শূন্য পূরণ তো। দুষ্টুমি তার দখিন-হাওয়া             সুখের তুফান-জাগানে দোলা দিয়ে যায় গো আমার            হৃদয়ের ফুল-বাগানে।    নাম যদি তার জিজ্ঞেস কর            সেই আছে এক ভাবনা, কোন্‌ নামে যে দিই পরিচয়            সে তো ভেবেই পাব না। নামের খবর কে রাখে ওর,            ডাকি ওরে যা-খুশি— দুষ্টু বল, দস্যি বল,                             পোড়ারমুখী, রাক্ষুসি। বাপ-মায়ে যে নাম দিয়েছে             বাপ-মায়েরই থাক্‌ সে নয়। ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি             তুলে রাখুন বাক্সে নয়। একজনেতে নাম রাখবে             কখন অন্নপ্রাশনে, বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে—             ভারি বিষম শাসন এ।    নিজের মনের মতো সবাই             করুন কেন নামকরণ— বাবা ডাকুন চন্দ্রকুমার,             খুড়ো ডাকুন রামচরণ। ঘরের মেয়ে তার কি সাজে             সঙস্কৃত নামটা ওই। এতে কারো দাম বাড়ে না             অভিধানের দামটা বৈ। আমি বাপু, ডেকেই বসি              যেটাই মুখে আসুক-না— যারে ডাকি সেই তা বোঝে,             আর সকলে হাসুক-না— একটি ছোটো মানুষ তাহার             একশো রকম রঙ্গ তো। এমন লোককে একটি নামেই             ডাকা কি হয় সংগত। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) পরিচয় (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) দয়া বলে, কে গো তুমি মুখে নাই কথা? অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) পরিচয় (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) একদিন দেখিলাম উলঙ্গ সে ছেলে ধুলি-’পরে বসে আছে পা-দুখানি মেলে। ঘাটে বসি মাটি ঢেলা লইয়া কুড়ায়ে দিদি মাজিতেছে ঘটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে। অদূরে কোমললোম ছাগবৎস ধীরে চরিয়া ফিরিতেছিল নদী-তীরে-তীরে। সহসা সে কাছে আসি থাকিয়া থাকিয়া বালকের মুখ চেয়ে উঠিল ডাকিয়া। বালক চমকি কাঁপি কেঁদে ওঠে ত্রাসে, দিদি ঘাটে ঘটি ফেলে ছুটে চলে আসে। এক কক্ষে ভাই লয়ে অন্য কক্ষে ছাগ দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ! পশুশিশু, নরশিশু—দিদি মাঝে প’ড়ে দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয়ডোরে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পরিচিত সীমানার পরিচিত সীমানার বেড়াঘেরা থাকি ছোটো বিশ্বে; বিপুল অপরিচিত নিকটেই রয়েছে অদৃশ্যে। সেথাকার বাঁশিরবে অনামা ফুলের মৃতুগন্ধে জানা না-জানার মাঝে বাণী ফিরে ছায়াময় ছন্দে।   (স্ফুলিঙ্গ) পরিত্যক্ত চলে গেল , আর কিছু নাই কহিবার ।     চলে গেল , আর কিছু নাই গাহিবার ।     শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে          দীনহীন হৃদয় আমার , শুধু বলিতেছে ,     “ চলে গেল সকলেই চলে গেল গো ,      বুক শুধু ভেঙে গেল দলে গেল গো । ”         বসন্ত চলিয়া গেলে বর্ষা কেঁদে কেঁদে বলে ,             “ ফুল গেল , পাখি গেল --     আমি শুধু রহিলাম , সবই গেল গো । ”     দিবস ফুরালে রাতি স্তব্ধ হয়ে রহে ,               শুধু কেঁদে কহে ,     “ দিন গেল , আলো গেল , রবি গেল গো --      কেবল একেলা আমি , সবই গেল গো । ”      উত্তরবায়ুর সম প্রাণের বিজনে মম                    কে যেন কাঁদিছে শুধু                   “ চলে গেল , চলে গেল ,                    সকলেই চলে গেল গো । ”           উৎসব ফুরায়ে গেলে ছিন্ন শুষ্ক মালা                    পড়ে থাকে হেথায় হোথায় --     তৈলহীন শিখাহীন ভগ্ন দীপগুলি                                    ধুলায় লুটায় --     একবার ফিরে কেহ দেখে নাকো ভুলি ,                  সবে চলে যায় ।               পুরানো মলিন ছিন্ন বসনের মতো                  মোরে ফেলে গেল ,         কাতর নয়নে চেয়ে রহিলাম কত --                 সাথে না লইল ।              তাই প্রাণ গাহে শুধু , কাঁদে শুধু , কহে শুধু ,               “ মোরে ফেলে গেল ,          সকলেই মোরে ফেলে গেল ,                 সকলেই চলে গেল গো । ”                একবার ফিরে তারা চেয়েছিল কি ?                   বুঝি চেয়েছিল ।           একবার ভুলে তারা কেঁদেছিল কি ?                   বুঝি কেঁদেছিল ।                   বুঝি ভেবেছিল --          লয়ে যাই -- নিতান্ত কি একেলা কাঁদিবে ?                  তাই বুঝি ভেবেছিল ।                  তাই চেয়েছিল ।                  তার পরে ? তার পরে !                  তার পরে বুঝি হেসেছিল ।          একফোঁটা অশ্রুবারি মুহূর্তেই শুকাইল ।                তার পরে ? তার পরে !                          চলে গেল ।                তার পরে ? তার পরে ! ফুল গেল , পাখি গেল , আলো গেল , রবি গেল ,               সবই গেল , সবই গেল গো --                  হৃদয় নিশ্বাস ছাড়ি কাঁদিয়া কহিল ,              “ সকলেই চলে গেল গো ,               আমারেই ফেলে গেল গো । ” পরের কর্ম-বিচার নাক বলে, কান কভু ঘ্রাণ নাহি করে, রয়েছে কুণ্ডল দুটো পরিবার তরে। কান বলে, কারো কথা নাহি শুনে নাক, ঘুমোবার বেলা শুধু ছাড়ে হাঁকডাক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের, আজ এই সম্মানহীনের দরিদ্র বেলায় দিলে দেখা যেথা আমি সাথিহীন একা উৎসবের প্রাঙ্গণ-বাহিরে শস্যহীন মরুময় তীরে। যেখানে এ ধরণীর প্রফুল্ল প্রাণের কুঞ্জ হতে অনাদৃত দিন মোর নিরুদ্দেশ স্রোতে ছিন্নবৃন্ত চলিয়াছে ভেসে বসন্তের শেষে। তবুও তো কৃপণতা নাই তব দানে, যৌবনের পূর্ণ মূল্য দিলে মোর দীপ্তিহীন প্রাণে, অদৃষ্টের অবজ্ঞারে কর নি স্বীকার — ঘুচাইলে অবসাদ তার; জানাইলে চিত্তে মোর লভি অনুক্ষণ সুন্দরের অভ্যর্থনা, নবীনের আসে নিমন্ত্রণ।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) পল্লীগ্রামে হেথায় তাহারে পাই কাছে — যত কাছে ধরাতল ,                যত কাছে ফুলফল —              যত কাছে বায়ু জল আছে । যেমন পাখির গান ,                 যেমন জলের তান ,              যেমনি এ প্রভাতের আলো , যেমনি এ কোমলতা ,               অরণ্যের শ্যামলতা ,              তেমনি তাহারে বাসি ভালো । যেমন সুন্দর সন্ধ্যা ,                  যেমন রজনীগন্ধা ,              শুকতারা আকাশের ধারে , যেমন সে অকলুষা                  শিশিরনির্মলা উষা ,               তেমনি সুন্দর হেরি তারে । যেমন বৃষ্টির জল ,                   যেমন আকাশতল ,               সুখসুপ্তি যেমন নিশার , যেমন তটিনীনীর ,                  বটচ্ছায়া অটবীর ,               তেমনি সে মোর আপনার । যেমন নয়ন ভরি                    অশ্রুজল পড়ে ঝরি               তেমনি সহজ মোর গীতি — যেমন রয়েছে প্রাণ                  ব্যাপ্ত করি মর্মস্থান                তেমনি রয়েছে তার প্রীতি ।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পশ্চাতের নিত্যসহচর, অকৃতার্থ হে অতীত পশ্চাতের নিত্যসহচর, অকৃতার্থ হে অতীত, অতৃপ্ত তৃষ্ণার যত ছায়ামূর্তি প্রেতভূমি হতে নিয়েছ আমার সঙ্গ, পিছু-ডাকা অক্লান্ত আগ্রহে আবেশ-আবিল সুরে বাজাইছ অস্ফুট সেতার, বাসাছাড়া মৌমাছির গুন গুন গুঞ্জরণ যেন পুষ্পরিক্ত মৌনী বনে। পিছু হতে সম্মুখের পথে দিতেছ বিস্তীর্ণ করি’ অস্ত শিখরের দীর্ঘ ছায়া নিরন্ত ধূসর পাণ্ডু বিদায়ের গোধূলি রচিয়া। পশ্চাতের সহচর, ছিন্ন করো স্বপ্নের বন্ধন; রেখেছ হরণ করি’ মরণের অধিকার হতেবেদনার ধন যত, কামনার রঙিন ব্যর্থতা, মৃত্যুরে ফিরায়ে দাও। আজি মেঘমুক্ত শরতের দূরে-চাওয়া আকাশেতে ভারমুক্ত চির পথিকের বাঁশিতে বেজেছে ধ্বনি, আমি তারি হব অনুগামী।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) পশ্চিমে রবির দিন পশ্চিমে রবির দিন হলে অবসান তখনো বাজুক কানে পুরবীর গান।   (স্ফুলিঙ্গ) পসারিনী পসারিনী, ওগো পসারিনী, কেটেছে সকালবেলা হাটে হাটে লয়ে বিকিকিনি।         ঘরে ফিরিবার খনে         কী জানি কী হল মনে,                 বসিলি গাছের ছায়াতলে--         লাভের জমানো কড়ি         ডালায় রহিল পড়ি,                 ভাবনা কোথায় ধেয়ে চলে।      এই মাঠ, এই রাঙা ধূলি, অঘ্রানের-রৌদ্র-লাগা চিক্কণ কাঁঠালপাতাগুলি         শীতবাতাসের শ্বাসে         এই শিহরন ঘাসে--                 কী কথা কহিল তোর কানে। বহুদূর নদীজলে            আলোকের রেখা ঝলে,                    ধ্যানে তোর কোন্‌ মন্ত্র আনে।      সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হতে সহসা আদিম স্পন্দ সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে।            তাই এ তরুতে তৃণে            প্রাণ আপনারে চিনে                    হেমন্তের মধ্যাহ্নের বেলা--            মৃত্তিকার খেলাঘরে            কত যুগযুগান্তরে                    হিরণে হরিতে তোর খেলা।      নিরালা মাঠের মাঝে বসি সাম্প্রতের আবরণ মন হতে গেল দ্রুত খসি।            আলোকে আকাশে মিলে            যে-নটন এ নিখিলে                    দেখ তাই আঁখির সম্মুখে,            বিরাট কালের মাঝে            যে ওঙ্কারধ্বনি বাজে                    গুঞ্জরি উঠিল তোর বুকে।      যত ছিল ত্বরিত আহ্বান পরিচিত সংসারের দিগন্তে হয়েছে অবসান।            বেলা কত হল, তার            বার্তা নাহি চারিধার,                    না কোথাও কর্মের আভাস।            শব্দহীনতার স্বরে            খররৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করে,                    শূন্যতার উঠে দীর্ঘশ্বাস।      পসারিনী, ওগো পসারিনী, ক্ষণকাল-তরে আজি ভুলে গেলি যত বিকিকিনি।            কোথা হাট, কোথা ঘাট,            কোথা ঘর, কোথা বাট,                    মুখর দিনের কলকথা--            অনন্তের বাণী আনে            সর্বাঙ্গে সকল প্রাণে                    বৈরাগ্যের স্তব্ধ ব্যাকুলতা। পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি– জ্বর গেল, যায় না যে তবু তার পথ্যি। সেই চলে জলসাবু, সেই ডাক্তারবাবু, কাঁচা কুলে আমড়ায় তেমনি আপত্তি।ইস্কুলে যাওয়া নেই সেইটে যা মঙ্গল– পথ খুঁজে ঘুরিনেকো গণিতের জঙ্গল। কিন্তু যে বুক ফাটে দূর থেকে দেখি মাঠে ফুটবল-ম্যাচে জমে ছেলেদের দঙ্গল।কিনুরাম পণ্ডিত, মনে পড়ে, টাক তার– সমান ভীষণ জানি চুনিলাল ডাক্তার। খুলে ওষুধের ছিপি হেসে আসে টিপিটিপি– দাঁতের পাটিতে দেখি, দুটো দাঁত ফাঁক তার।জ্বরে বাঁধে ডাক্তারে, পালাবার পথ নেই; প্রাণ করে হাঁসফাঁস যত থাকি যত্নেই। জ্বর গেলে মাস্টারে গিঁঠ দেয় ফাঁসটারে– আমারে ফেলেছে সেরে এই দুটি রত্নেই।উদয়ন, শান্তিনিকেতন, ১৫। ৯। ৩৮ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাঁচিলের এধারে পাঁচিলের এধারে ফুলকাটা চিনের টবে সাজানো গাছ সুসংযত। ফুলের কেয়ারিতে কাঁচিছাঁটা বেগনি গাছের পাড়। পাঁচিলের গায়ে গায়ে বন্দী-করা লতা। এরা সব হাসে মধুর করে, উচ্চহাস্য নেই এখানে; হাওয়ায় করে দোলাদুলি কিন্তু জায়গা নেই দুরন্ত নাচের, এরা আভিজাত্যের সুশাসনে বাঁধা। বাগানটাকে দেখে মনে হয় মোগল বাদশার জেনেনা, রাজ-আদরে অলংকৃত, কিন্তু পাহারা চারদিকে, চরের দৃষ্টি আছে ব্যবহারের প্রতি। পাঁচিলের ওপারে দেখা যায় একটি সুদীর্ঘ য়ুকলিপটাস খাড়া উঠেছে ঊর্ধ্বে। পাশেই দুটি তিনটি সোনাঝুরি প্রচুর পল্লবে প্রগল্‌ভ। নীল আকাশ অবারিত বিস্তীর্ণ ওদের মাথার উপরে। অনেকদিন দেখেছি অন্যমনে, আজ হঠাৎ চোখে পড়ল ওদের সমুন্নত স্বাধীনতা, দেখলেম, সৌন্দর্যের মর্যাদা আপন মুক্তিতে। ওরা ব্রাত্য, আচারমুক্ত, ওরা সহজ; সংযম আছে ওদের মজ্জার মধ্যে বাইরে নেই শৃঙ্খলার বাঁধাবাঁধি। ওদের আছে শাখার দোলন দীর্ঘ লয়ে; পল্লবগুচ্ছ নানা খেয়ালের; মর্মরধ্বনি হাওয়ায় ছড়ানো। আমার মনে লাগল ওদের ইঙ্গিত; বললেম, "টবের কবিতাকে রোপণ করব মাটিতে, ওদের ডালপালা যথেচ্ছ ছড়াতে দেব বেড়াভাঙা ছন্দের অরণ্যে।" পাখি যবে গাহে গান পাখি যবে গাহে গান, জানে না, প্রভাতরবিরে সে তার প্রাণের অর্ঘ্যদান। ফুল ফুটে বন-মাঝে— সেই তো তাহার পূজানিবেদন, আপনি সে জানে না যে।   (স্ফুলিঙ্গ) পাখিওয়ালা বলে এটা কালোরঙ চন্দনা পাখিওয়ালা বলে, “এটা কালোরঙ চন্দনা।’ পানুলাল হালদার বলে, “আমি অন্ধ না– কাক ওটা নিশ্চিত, হরিনাম ঠোঁটে নাই।’ পাখিওয়ালা বলে, “বুলি ভালো করে ফোটে নাই– পারে না বলিতে বাবা, কাকা নামে বন্দনা।’  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাখির পালক খেলাধুলো সব রহিল পড়িয়া,             ছুটে চ ' লে আসে মেয়ে— বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্‌ দেখ্‌,             কী এনেছি দেখ্‌ চেয়ে। ' আঁখির পাতায় হাসি চমকায়,             ঠোঁটে নেচে ওঠে হাসি— হয়ে যায় ভুল, বাঁধে নাকো চুল,             খুলে পড়ে কেশরাশি। দুটি হাত তার ঘিরিয়া ঘিরিয়া             রাঙা চুড়ি কয়গাছি, করতালি পেয়ে বেজে ওঠে তারা;             কেঁপে ওঠে তারা নাচি। মায়ের গলায় বাহু দুটি বেঁধে             কোলে এসে বসে মেয়ে। বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্‌ দেখ্‌,              কী এনেছি দেখ্‌ চেয়ে। '    সোনালি রঙের পাখির পালক             ধোওয়া সে সোনার স্রোতে— খসে এল যেন তরুণ আলোক             অরুণের পাখা হতে। নয়ন-ঢুলানো কোমল পরশ             ঘুমের পরশ যথা— মাখা যেন তায় মেঘের কাহিনী,             নীল আকাশের কথা। ছোটোখাটো নীড়, শাবকের ভিড়,             কতমত কলরব, প্রভাতের সুখ, উড়িবার আশা—            মনে পড়ে যেন সব। লয়ে সে পালক কপোলে বুলায়,            আঁখিতে বুলায় মেয়ে, বলে হেসে হেসে, ‘ওমা, দেখ্‌ দেখ্‌,            কী এনেছি দেখ্‌ চেয়ে। '    মা দেখিল চেয়ে, কহিল হাসিয়ে,            ‘কিবা জিনিসের ছিরি!' ভূমিতে ফেলিয়া গেল সে চলিয়া,            আর না চাহিল ফিরি। মেয়েটির মুখে কথা না ফুটিল,            মাটিতে রহিল বসি। শূন্য হতে যেন পাখির পালক            ভূতলে পড়িল খসি। খেলাধুলো তার হল নাকো আর,            হাসি মিলাইল মুখে, ধীরে ধীরে শেষে দুটি ফোঁটা জল            দেখা দিল দুটি চোখে। পালকটি লয়ে রাখিল লুকায়ে            গোপনের ধন তার— আপনি খেলিত, আপনি তুলিত,            দেখাত না কারে আর। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) পাখির ভোজ ভোরে উঠেই পড়ে মনে ,                              মুড়ি খাবার নিমন্ত্রণে                                   আসবে শালিখ পাখি ।                        চাতালকোণে বসে থাকি ,                                   ওদের খুশি দেখতে লাগে ভালো ।                             স্নিগ্ধ আলো                        এ অঘ্রানের শিশির-ছোঁওয়া প্রাতে ,                  সরল লোভে চপল পাখির চটুল নৃত্য-সাথে                             শিশুদিনের প্রথম হাসি মধুর হয়ে মেলে —                                   চেয়ে দেখি সকল কর্ম ফেলে ।                     জাড়ের হাওয়ায় ফুলিয়ে ডানা                                    একটুকু মুখ ঢেকে                             অতিথিরা থেকে থেকে                  লাল্‌চে-কালো সাদা রঙের পরিচ্ছন্ন বেশে                                         দেখা দিচ্ছে এসে ।                           খানিক পরেই একে একে জোটে পায়রাগুলো ,                              বুক ফুলিয়ে হেলে-দুলে খুঁটে খুঁটে ধুলো                                                 খায় ছড়ানো ধান ।                        ওদের সঙ্গে শালিখদলের পঙ্‌ক্তি-ব্যবধান                                                 একটুমাত্র নেই ।                                          পরস্পরে একসমানেই                        ব্যস্ত পায়ে বেড়ায় প্রাতরাশে ।                  মাঝে মাঝে কী অকারণ ত্রাসে                                   ত্রস্ত পাখা মেলে                  এক মুহূর্তে যায় উড়ে ধান ফেলে ।                         আবার ফিরে আসে                             অহেতু আশ্বাসে । এমন সময় আসে কাকের দল ,                         খাদ্যকণায় ঠোকর মেরে দেখে কী হয় ফল ।                             একটুখানি যাচ্ছে সরে আসছে আবার কাছে ,                                    উড়ে গিয়ে বসছে তেঁতুলগাছে ।                        বাঁকিয়ে গ্রীবা ভাবছে বারংবার ,                  নিরাপদের সীমা কোথায় তার ।                        এবার মনে হয় ,                  এতক্ষণে পরস্পরের ভাঙল সমন্বয় ।                  কাকের দলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিৎ মন                        সন্দেহ আর সতর্কতায় দুলছে সারাক্ষণ ।                             প্রথম হল মনে ,                        তাড়িয়ে দেব ; লজ্জা হল তারি পরক্ষণে —                  পড়ল মনে , প্রাণের যজ্ঞে ওদের সবাকার                             আমার মতোই সমান অধিকার ।                        তখন দেখি , লাগছে না আর মন্দ                  সকালবেলার ভোজের সভায়                                   কাকের নাচের ছন্দ ।              এই যে বহায় ওরা                        প্রাণস্রোতের পাগ্‌লাঝোরা ,                              কোথা হতে অহরহ আসছে নাবি                                         সেই কথাটাই ভাবি ।                        এই খুশিটার স্বরূপ কী যে , তারি                                         রহস্যটা বুঝতে নাহি পারি ।                        চটুলদেহ দলে দলে                   দুলিয়ে তোলে যে আনন্দ খাদ্যভোগের ছলে ,                        এ তো নহে এই নিমেষের সদ্য চঞ্চলতা ,                             অগণ্য এ কত যুগের অতি প্রাচীন কথা ।                  রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাওয়া যেমন সুরে বাজায় বাঁশি ,                        কালের বাঁশির মৃত্যুরন্ধ্রে সেই মতো উচ্ছ্বাসি                             উৎসারিছে প্রাণের ধারা ।                  সেই প্রাণেরে বাহন করি আনন্দের এই তত্ত্ব অন্তহারা দিকে দিকে পাচ্ছে পরকাশ ।                  পদে পদে ছেদ আছে তার , নাই তবু তার নাশ ।                  আলোক যেমন অলক্ষ্য কোন্‌ সুদূর কেন্দ্র হতে                                   অবিশ্রান্ত স্রোতে                              নানা রূপের বিচিত্র সীমায়                  ব্যক্ত হতে থাকে নিত্য নানা ভঙ্গে নানা রঙ্গিমায়                        তেমনি যে এই সত্তার উচ্ছ্বাস                             চতুর্দিকে ছড়িয়ে ফেলে নিবিড় উল্লাস —                  যুগের পরে যুগে তবু হয় না গতিহারা ,                        হয় না ক্লান্ত অনাদি সেই ধারা ।                             সেই পুরাতন অনির্বচনীয়                   সকালবেলায় রোজ দেখা দেয় কি ও                                   আমার চোখের কাছে                        ভিড়-করা ওই শালিখগুলির নাচে ।                    আদিমকালের সেই আনন্দ ওদের নৃত্যবেগে                             রূপ ধ ' রে মোর রক্তে ওঠে জেগে ।                         তবুও দেখি কখন কদাচিৎ                                         বিরূপ বিপরীত —                             প্রাণের সহজ সুষমা যায় ঘুচি ,                                         চঞ্চুতে চঞ্চুতে খোঁচাখুচি ;                        পরাভূত হতভাগ্য মোর দুয়ারের কাছে                             ক্ষত-অঙ্গে শরণ মাগিয়াছে ।                        দেখেছি সেই জীবন-বিরুদ্ধতা ,                             হিংসার ক্রুদ্ধতা —                        যেমন দেখি কুহেলিকার কুশ্রী অপরাধ ,                  শীতের প্রাতে আলোর প্রতি কালোর অপবাদ —                        অহংকৃত ক্ষণিকতার অলীক পরিচয় ,                             অসীমতার মিথ্যা পরাজয় ।                        তাহার পরে আবার করে ছিন্নেরে গ্রন ্ থন                                   সহজ চিরন্তন ।                        প্রাণোৎসবে অতিথিরা আবার পাশাপাশি                             মহাকালের প্রাঙ্গণেতে নৃত্য করে আসি । পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম কস্তুরীমৃগসম। ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে কোথা দিশা খুঁজে পাই না। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।বক্ষ হইতে বাহির হইয়া আপন বাসনা মম ফিরে মরীচিকাসম। বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে বক্ষে ফিরিয়া পাই না। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে চাহে যেন বাঁশি মম উতলা পাগলসম। যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর রাগিণী খুঁজিয়া পাই না। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) পাঠশালে হাই তোলে পাঠশালে হাই তোলে মতিলাল নন্দী; বলে, “পাঠ এগোয় না যত কেন মন দি।’ শেষকালে একদিন গেল চড়ি টঙ্গায়, পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসালো মা-গঙ্গায়, সমাস এগিয়ে গেল, ভেসে গেল সন্ধি– পাঠ এগোবার তরে এই তার ফন্দি।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাড়াতে এসেছে এক পাড়াতে এসেছে এক নাড়িটেপা ডাক্তার, দূর থেকে দেখা যায় অতি উঁচু নাক তার। নাম লেখে ওষুধের, এ দেশের পশুদের সাধ্য কী পড়ে তাহা এই বড়ো জাঁক তার। যেথা যায় বাড়ি বাড়ি দেখে যে ছেড়েছে নাড়ী, পাওনাটা আদায়ের মেলে না যে ফাঁক তার। গেছে নির্বাকপুরে ভক্তের ঝাঁক তার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাড়ায় আছে ক্লাব পাড়ায় আছে ক্লাব, আমার একতলার ঘরখানা দিয়েছি ওদের ছেড়ে। কাগজে পেয়েছি প্রশংসাবাদ, ওরা মীটিং করে আমাকে পরিয়েছে মালা। আজ আট বছর থেকে শূন্য আমার ঘর। আপিস থেকে ফিরে এসে দেখি সে ঘরের একটা ভাগে টেবিলে পা তুলে কেউ পড়ছে খবরের কাগজ, কেউ খেলছে তাস, কেউ করছে তুমুল তর্ক। তামাকের ধোঁয়ায় ঘনিয়ে ওঠে বদ্ধ হাওয়া, ছাইদানিতে জমতে থাকে, ছাই, দেশলাইকাঠি, পোড়া সিগারেটের টুকরো। এই প্রচুর পরিমাণ ঘোলা আলাপের গোলামাল দিয়ে দিনের পর দিন আমার সন্ধ্যার শূন্যতা দিই ভরে। আবার রাত্তির দশটার পরে খালি হয়ে যায় উপুড়-করা একটা উচ্ছিষ্ট অবকাশ। বাইরে থেকে আসে ট্র৻ামের শব্দ, কোনোদিন আপন মনে শুনি গ্রামোফোনের গান, যে কয়টা রেকর্ড আছে ঘুরে ফিরে তারি আবৃত্তি। আজ ওরা কেউ আসে নি; গেছে হাবড়া স্টেশনে অভ্যর্থনায়; কে সদ্য এনেছে সমুদ্রপারের হাততালি আপন নামটার সঙ্গে বেঁধে। নিবিয়ে দিয়েছি বাতি। যাকে বলে "আজকাল' অনেকদিন পরে সেই আজকালটা, সেই প্রতিদিনের নকীব আজ নেই সন্ধ্যায় আমার ঘরে। আটবছর আগে এখানে ছিল হাওয়ায়-ছড়ানো যে স্পর্শ, চুলের যে অস্পষ্ট গন্ধ, তারি একটা বেদনা লাগল ঘরের সব কিছুতেই। যেন কী শুনব বলে রইল কান পাতা; সেই ফুলকাটা ঢাকাওয়ালা পুরোনো খালি চৌকিটা যেন পেয়েছে কার খবর। পিতামহের আমলের পুরোনো মুচকুন্দ গাছ দাঁড়িয়ে আছে জানলার সামনে কৃষ্ণ রাতের অন্ধকারে। রাস্তার ওপারের বাড়ি আর এই গাছের মধ্যে যেটুকু আকাশ আছে সেখানে দেখা যায় জ্বলজ্বল করছে একটি তারা। তাকিয়ে রইলেম তার দিকে চেয়ে, টনটন করে বুকের ভিতরটা। যুগল জীবনের জোয়ার জলে কত সন্ধ্যায় দুলেছে ঐ তারার ছায়া। অনেক কথার মধ্যে মনে পড়ছে ছোট্ট একটি কথা। সেদিন সকালে কাগজ পড়া হয়নি কাজের ভিড়ে; সন্ধ্যেবেলায় সেটা নিয়ে বসেছি এই ঘরেতেই, এই জানলার পাশে এই কেদারায়। চুপি চুপি সে এল পিছনে কাগজখানা দ্রুত কেড়ে নিল হাত থেকে। চলল কাড়াকাড়ি উচ্চ হাসির কলরোলে। উদ্ধার করলুম লুঠের জিনিস, স্পর্ধা করে আবার বসলুম পড়তে। হঠাৎ সে নিবিয়ে দিল আলো। আমার সেদিনকার সেই হার-মানা অন্ধকার আজ আমাকে সর্বাঙ্গে ধরেছে ঘিরে, যেমন করে সে আমাকে ঘিরেছিল দুয়ো-দেওয়া নীরব হাসিতে ভরা বিজয়ী তার দুই বাহু দিয়ে, সেদিনকার সেই আলো-নেবা নির্জনে। হঠাৎ ঝরঝরিয়ে উঠল হাওয়া গাছের ডালে ডালে, জানলাটা উঠল শব্দ করে, দরজার কাছের পর্দাটা উড়ে বেড়াতে লাগল অস্থির হয়ে। আমি বলে উঠলেম, "ওগো, আজ তোমার ঘরে তুমি এসেছ কি মরণলোক থেকে তোমার বাদামি রঙের শাড়িখানি পরে?" একটা নিঃশ্বাস লাগল আমার গায়ে, শুনলেম অশ্রুতবাণী, "কার কাছে আসব?" আমি বললেম, "দেখতে কি পেলে না আমাকে?" শুনলেম, "পৃথিবীতে এসে যাকে জেনেছিলেম একান্তই, সেই আমার চিরকিশোর বঁধু তাকে তো আর পাইনে দেখতে এই ঘরে।" শুধালেম, "সে কি নেই কোথাও?" মৃদু শান্তসুরে বললে, "সে আছে সেইখানেই যেখানে আছি আমি। আর কোথাও না।" দরজার কাছে শুনলেম উত্তেজিত কলরব, হাবড়া স্টেশন থেকে ওরা ফিরেছে। পাতায় পাতায় দুলিছে শিশির পূরবীপাতায় পাতায় দুলিছে শিশির গাহিছে বিহগগণ, ফুলবন হতে সুরভি হরিয়া বহিতেছে সমীরণ সাঁঝের আকাশ মাঝারে এখনো মৃদুল কিরণ জ্বলে। নলিনীর সাথে বসিয়া তখন কত-না হরষে কাটাইনু ক্ষণ, কে জানিত তবে বালিকা নিদয় রেখেছিল ঢাকি কপট-হৃদয় সরল হাসির তলে! এই তো সেথায় ভ্রমি, গো, যেথায় থাকিত সে মোর কাছে, প্রকৃতি জানে না পরিবরতন সকলি তেমনি আছে! তেমনি গোলাপ রূপ-হাসি-ময় জ্বলিছে শিশির-ভরে, যে হাসি-কিরণে আছিল প্রকৃতি দ্বিগুণ দ্বিগুণ মধুর আকৃতি, সে হাসি নাইকো আর!Irish Song (অনুবাদ কবিতা) পাতালে বলিরাজার যত বলীরামরা পাতালে বলিরাজার যত বলীরামরা, ভূতলেতে ঘাসিরাম আর ঘনশ্যামরা, লড়াই লাগালো বেগে; ভূমিকম্পন লেগে চারিদিকে হাহাকার করে ওঠে গ্রামরা। মানুষ কহিল, “ক্রমে খবর উঠছে জমে, সেটা খুব মজা, তবু মরি কেন আমরা।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাথরপিণ্ড সাগরতীরে পাথরপিণ্ড ঢুঁ মারতে চায় কাকে,                বুঝি আকাশটাকে।         শান্ত আকাশ দেয় না কোনো জবাব,    পাথরটা রয় উঁচিয়ে মাথা, এমনি সে তার স্বভাব।           হাতের কাছেই আছে সমুদ্রটা,    অহংকারে তারই সঙ্গে লাগত যদি ওটা,           এমনি চাপড় খেত, তাহার ফলে    হুড়্‌মুড়িয়ে ভেঙেচুরে পড়ত অগাধ জলে। ঢুঁ-মারা এই ভঙ্গীখানা কোটি বছর থেকে      ব্যঙ্গ ক'রে কপালে তার কে দিল ঐ এঁকে। পণ্ডিতেরা তার ইতিহাস বের করেছেন খুঁজি;      শুনি তাহা, কতক বুঝি, নাইবা কতক বুঝি।         অনেক যুগের আগে একটা সে কোন্‌ পাগলা বাষ্প আগুন-ভরা রাগে      মা ধরণীর বক্ষ হতে ছিনিয়ে বাঁধন-পাশ          জ্যোতিষ্কদের ঊর্ধ্বপাড়ায় করতে গেল বাস।      বিদ্রোহী সেই দুরাশা তার প্রবল শাসন-টানে                  আছাড় খেয়ে পড়ল ধরার পানে।             লাগল কাহার শাপ,        হারালো তার ছুটোছুটি, হারালো তার তাপ।               দিনে দিনে কঠিন হয়ে ক্রমে             আড়ষ্ট এক পাথর হয়ে কখন গেল জমে।   আজকে যে ওর অন্ধ নয়ন, কাতর হয়ে চায়               সম্মুখে কোন্‌ নিঠুর শূন্যতায়।   স্তম্ভিত চীৎকার সে যেন, যন্ত্রণা নির্বাক,        যে যুগ গেছে তার উদ্দেশে কণ্ঠহারার ডাক।      আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে        কান পেতে সে আছে ঢেউয়ের তরল কলস্বরে;             শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা                  হেরে-যাওয়া সে-যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা। পাবনায় বাড়ি হবে পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইঁট কিনি, রাঁধুনিমহল-তরে করোগেট-শীট্‌ কিনি। ধার ক’রে মিস্ত্রির সিকি বিল চুকিয়েছি, পাওনাদারের ভয়ে দিনরাত লুকিয়েছি, শেষে দেখি জানলায় লাগে নাকো ছিট্‌কিনি। দিনরাত দুড়্‌দাড়্‌ কী বিষম শব্দ যে, তিনটে পাড়ার লোক হয়ে গেল জব্দ যে, ঘরের মানুষ করে খিট্‌ খিট্‌ খিট্‌কিনি।কী করি না ভেবে পেয়ে মথুরায় দিনু পাড়ি, বাজে খরচের ভয়ে আরেকটা পাকাবাড়ি বানাবার মতলবে পোড়ো এক ভিট কিনি। তিনতলা ইমারত শোভা পায় নবাবেরই, সিঁড়িটা রইল বাকি চিহ্ন সে অভাবেরই, তাই নিয়ে গৃহিণীর কী যে নাক-সিট্‌কিনি।শান্তিনিকেতন, ৫ বৈশাখ, ১৩৪৪ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পাষাণী মা হে ধরণী , জীবের জননী ,        শুনেছি যে মা তোমায় বলে , তবে কেন তোর কোলে সবে        কেঁদে আসে , কেঁদে যায় চলে । তবে কেন তোর কোলে এসে        সন্তানের মেটে না পিয়াসা । কেন চায় , কেন কাঁদে সবে ,        কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা । কেন হেথা পাষাণ - পরান ,        কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর , কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে        কেন তারে করে দেয় দূর । কাঁদিয়া যে ফিরে চলে যায়        তার তরে কাঁদিস নে কেহ , এই কি মা , জননীর প্রাণ ,        এই কি মা , জননীর স্নেহ !    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পাষাণে পাষাণে তব পাষাণে পাষাণে তব শিখরে শিখরে লিখেছ, হে গিরিরাজ, অজানা অক্ষরে কত যুগযুগাস্তের প্রভাতে সন্ধ্যায় ধরিত্রীর ইতিবৃত্ত অনন্ত-অধ্যায়। মহান সে গ্রন্থপত্র, তারি এক দিকে কেবল একটি ছত্রে রাখিবে কি লিখে—তব শৃঙ্গশিলাতলে দুদিনের খেলা, অামাদের কজনের আনন্দের মেলা।   (স্ফুলিঙ্গ) পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে। বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি। হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি। মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই দিতেছে নিঃশব্দ করতালি। আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, জানে তা কি এ কালিম্পঙ। ভান্ডারে সঞ্চিত করে পর্বতশিখর অন্তহীন যুগ-যুগান্তর। আমার একটি দিন বরমাল্য পরাইল তারে, এ শুভ সংবাদ জানাবারে অন্তরীক্ষে দুর হতে দুরে অনাহত সুরে প্রভাতে সোনার ঘণ্টা বাজে ঢঙ ঢঙ, শুনিছে কি এ কালিম্পঙ। পিছু-ডাকা যখন দিনের শেষে            চেয়ে দেখি সমুখপানে সূর্য ডোবার দেশে                      মনের মধ্যে ভাবি                 অস্তসাগর-তলায় গেছে নাবি            অনেক সূর্য-ডোবার সঙ্গে অনেক আনাগোনা,                      অনেক দেখাশোনা,            অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়,                 শক্তিমানের অনেক পরিচয়।     তাদের হারিয়ে-যাওয়ার ব্যাথায় টান লাগে না মনে,              কিন্তু যখন চেয়ে দেখি সামনে সবুজ বনে                             ছায়ায় চরছে গোরু,              মাঝ দিয়ে তার পথ গিয়েছে সরু,                     ছেয়ে আছে শুক্‌নো বাঁশের পাতায়,            হাট করতে চলে মেয়ে ঘাসের আঁঠি মাথায়,                 তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই বাজে--            ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ঐ যা-কিছুর মাঝে।     ঐ যা-কিছুর ছবির ছায়া দুলেছে কোন্‌কালে            শিশুর-চিত্ত-নাচিয়ে-তোলা ছড়াগুলির তালে--                                                তিরপূর্নির চরে                                                         বালি ঝুর্‌ঝুর্‌ করে,                             কোন্‌ মেয়ে সে চিকন-চিকন চুল দিচ্ছে ঝাড়ি,                     পরনে তার ঘুরে-পড়া ডুরে একটি শাড়ি।            ঐ যা-কিছু ছবির আভাস দেখি সাঁঝের মুখে     মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে। পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ, খড়কে দিয়ে উসকে দিচ্ছে থেকে থেকে। হাতির দাঁতের মতো কোমল সাদা পঙ্খের কাজ-করা মেজে; তার উপরে খান-দুয়েক মাদুর পাতা। ছোটো ছেলেরা জড়ো হয়েছি ঘরের কোণে মিটমিটে আলোয়। বুড়ো মোহন সর্দার কলপ-লাগানো চুল বাবরি-করা, মিশকালো রঙ চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসছে, শিথিল হয়েছে মাংস, হাতের পায়ের হাড়গুলো দীর্ঘ, কণ্ঠস্বর সরু-মোটায় ভাঙা। রোমাঞ্চ লাগবার মতো তার পূর্ব-ইতিহাস। বসেছে আমাদের মাঝখানে, বলছে রোঘো ডাকাতের কথা। আমরা সবাই গল্প আঁকড়ে বসে আছি। দক্ষিণের হাওয়া-লাগা ঝাউডালের মতো দুলছে মনের ভিতরটা। খোলা জানলার সামনে দেখা যায় গলি, একটা হলদে গ্যাসের আলোর খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে একচোখো ভূতের মতো। পথের বাঁ ধারটাতে জমেছে ছায়া। গলির মোড়ে সদর রাস্তায় বেলফুলের মালা হেঁকে গেল মালী। পাশের বাড়ি থেকে কুকুর ডেকে উঠল অকারণে। নটার ঘণ্টা বাজল দেউড়িতে। অবাক হয়ে শুনছি রোঘোর চরিতকথা। তত্ত্বরত্নের ছেলের পৈতে, রোঘো বলে পাঠাল চরের মুখে, "নমো নমো করে সারলে চলবে না ঠাকুর, ভেবো না খরচের কথা।" মোড়লের কাছে পত্র দেয় পাঁচ হাজার টাকা দাবি ক'রে ব্রাহ্মণের জন্যে। রাজার খাজনা-বাকির দায়ে বিধবার বাড়ি যায় বিকিয়ে, হঠাৎ দেওয়ানজির ঘরে হানা দিয়ে দেনা শোধ ক'রে দেয় রঘু। বলে--"অনেক গরিবকে দিয়েছ ফাঁকি, কিছু হালকা হোক তার বোঝা।" একদিন তখন মাঝরাত্তির, ফিরছে রোঘো লুঠের মাল নিয়ে, নদীতে তার ছিপের নৌকো অন্ধকারে বটের ছায়ায়। পথের মধ্যে শোনে-- পাড়ায় বিয়েবাড়িতে কান্নার ধ্বনি, বর ফিরে চলেছে বচসা করে; কনের বাপ পা আঁকড়ে ধরেছে বরকর্তার। এমন সময় পথের ধারে ঘন বাঁশ বনের ভিতর থেকে হাঁক উঠল, রে রে রে রে রে রে। আকাশের তারাগুলো যেন উঠল থরথরিয়ে। সবাই জানে রোঘো ডাকাতের পাঁজর-ফাটানো ডাক। বরসুদ্ধ পালকি পড়ল পথের মধ্যে; বেহারা পালাবে কোথায় পায় না ভেবে। ছুটে বেরিয়ে এল মেয়ের মা অন্ধকারের মধ্যে উঠল তার কান্না-- "দোহাই বাবা, আমার মেয়ের জাত বাঁচাও।" রোঘো দাঁড়াল যমদূতের মতো-- পালকি থেকে টেনে বের করলে বরকে, বরকর্তার গালে মারল একটা প্রচণ্ড চড়, পড়ল সে মাথা ঘুরে। ঘরের প্রাঙ্গণে আবার শাঁখ উঠল বেজে, জাগল হুলুধ্বনি; দলবল নিয়ে রোঘো দাঁড়াল সভায়, শিবের বিয়ের রাতে ভূতপ্রেতের দল যেন। উলঙ্গপ্রায় দেহ সবার, তেলমাখা সর্বাঙ্গে, মুখে ভুসোর কালি। বিয়ে হল সারা। তিন প্রহর রাতে যাবার সময় কনেকে বললে ডাকাত "তুমি আমার মা, দুঃখ যদি পাও কখনো স্মরণ ক'রো রঘুকে।" তারপরে এসেছে যুগান্তর। বিদ্যুতের প্রখর আলোতে ছেলেরা আজ খবরের কাগজে পড়ে ডাকাতির খবর। রূপকথা-শোনা নিভৃত সন্ধ্যেবেলাগুলো সংসার থেকে গেল চলে, আমাদের স্মৃতি আর নিবে-যাওয়া তেলের প্রদীপের সঙ্গে সঙ্গে। পিস্‌নি কিশোরগাঁয়ের পুবের পাড়ায় বাড়ি পিস্‌নি বুড়ি চলেছে গ্রাম ছাড়ি। একদিন তার আদর ছিল, বয়স ছিল ষোলো, স্বামী মরতেই বাড়িতে বাস অসহ্য তার হল। আর-কোনো ঠাঁই হয়তো পাবে আর-কোনো এক বাসা, মনের মধ্যে আঁকড়ে থাকে অসম্ভবের আশা। অনেক গেছে ক্ষয় হয়ে তার, সবাই দিল ফাঁকি,        অল্প কিছু রয়েছে তার বাকি। তাই দিয়ে সে তুলল বেঁধে ছোট্ট বোঝাটাকে,        জড়িয়ে কাঁথা আঁকড়ে নিল কাঁখে। বাঁ হাতে এক ঝুলি আছে, ঝুলিয়ে নিয়ে চলে, মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে বসে ধূলির তলে।        শুধাই যবে, কোন্‌ দেশেতে যাবে,        মুখে ক্ষণেক চায় সকরুণ ভাবে; কয় সে দ্বিধায়, "কী জানি ভাই, হয়তো আলম্‌ডাঙা,             হয়তো সান্‌কিভাঙা,        কিংবা যাব পাটনা হয়ে কাশী।" গ্রাম-সুবাদে কোন্‌কালে সে ছিল যে কার মাসি, মণিলালের হয় দিদিমা, চুনিলালের মামি--        বলতে বলতে হঠাৎ যে যায় থামি,             স্মরণে কার নাম যে নাহি মেলে।        গভীর নিশাস ফেলে           চুপটি ক'রে ভাবে,      এমন করে আর কতদিন যাবে। দূরদেশে তার আপন জনা, নিজেরই ঝঞ্ঝাটে           তাদের বেলা কাটে।   তারা এখন আর কি মনে রাখে        এতবড়ো অদরকারি তাকে। চোখে এখন কম দেখে সে, ঝাপসা যে তার মন, ভগ্নশেষের সংসারে তার শুকনো ফুলের বন। স্টেশন-মুখে গেল চলে পিছনে গ্রাম ফেলে, রাত থাকতে, পাছে দেখে পাড়ায় মেয়ে ছেলে। দূরে গিয়ে, বাঁশবাগানের বিজন গলি বেয়ে পথের ধারে বসে পড়ে, শূন্যে থাকে চেয়ে। পুঁটু চৈত্রের মধ্যাহ্নবেলা কাটিতে না চাহে। তৃষাতুরা বসুন্ধরা দিবসের দাহে। হেনকালে শুনিলাম বাহিরে কোথায় কে ডাকিল দূর হতে, “পুঁটুরানী, আয়।” জনশূন্য নদীতটে তপ্ত দ্বিপ্রহরে কৌতুহল জাগি উঠে স্নেহকণ্ঠস্বরে। গ্রন্থখানি বন্ধ করি উঠিলাম ধীরে, দুয়ার করিয়া ফাঁক দেখিনু বাহিরে। মহিষ বৃহৎকায় কাদামাখা গায়ে স্নিগ্ধনেত্রে নদীতীরে রয়েছে দাঁড়ায়ে। যুবক নামিয়া জলে ডাকিছে তাহায় স্নান করাবার তরে, “পুঁটুরানী, আয়!” হেরি সে যুবারে—হেরি পুঁটুরানী তারি মিশিল কৌতুকে মোর স্নিগ্ধ সুধাবারি।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পুণ্যের হিসাব সাধু যবে স্বর্গে গেল, চিত্রগুপ্তে ডাকি কহিলেন, “আনো মোর পুণ্যের হিসাব।” চিত্রগুপ্ত খাতাখানি সম্মুখেতে রাখি দেখিতে লাগিল তার মুখের কী ভাব। সাধু কহে চমকিয়া, “মহা ভুল এ কী! প্রথমের পাতাগুলো ভরিয়াছ আঁকে, শেষের পাতায় এ যে সব শূন্য দেখি— যতদিন ডুবে ছিনু সংসারের পাঁকে ততদিন এত পুণ্য কোথা হতে আসে!” শুনি কথা চিত্রগুপ্ত মনে মনে হাসে। সাধু মহা রেগে বলে, “যৌবনের পাতে এত পুণ্য কেন লেখ দেবপূজা-খাতে।” চিত্রগুপ্ত হেসে বলে, “বড়ো শক্ত বুঝা। যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।”  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) পুতুল ভাঙা ' সাত - আটটে সাতাশ ', আমি           বলেছিলাম বলে গুরুমশায় আমার ‘পরে           উঠল রাগে জ্বলে । মা গো , তুমি পাঁচ পয়সায়           এবার রথের দিনে সেই যে রঙিন পুতুলখানি           আপনি দিলে কিনে খাতার নিচে ছিল ঢাকা ;           দেখালে এক ছেলে , গুরুমশায় রেগেমেগে           ভেঙে দিলেন ফেলে । বললেন , ' তোর দিনরাত্তির           কেবল যত খেলা । একটুও তোর মন বসে না           পড়াশুনার বেলা! '    মা গো , আমি জানাই কাকে ?           ওঁর কি গুরু আছে ? আমি যদি নালিশ করি           এক্‌খনি তাঁর কাছে ? কোনোরকম খেলার পুতুল           নেই কি , মা , ওঁর ঘরে সত্যি কি ওঁর একটুও মন           নেই পুতুলের ‘পরে ? সকাল - সাঁজে তাদের নিয়ে           করতে গিয়ে খেলা কোনো পড়ায় করেন নি কি           কোনোরকম হেলা ? ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে           ভাঙেন কেহ রাগে , বল দেখি মা , ওঁর মনে তা           কেমনতরো লাগে ? (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) পুনর্মিলন কিসের হরষ কোলাহল        শুধাই তোদের, তোরা বল্‌। আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে         আনন্দে হতেছে কভু লীন-- চাহিয়া ধরণী-পানে নব আনন্দের গানে         মনে পড়ে আর-এক দিন। সে তখন ছেলেবেলা--রজনী প্রভাত হলে, তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়ি ছুটিয়া যেতেম চলে; সারি সারি নারিকেল বাগানের এক পাশে, বাতাস আকুল করে আম্রমুকুলের বাসে।           পথপাশে দুই ধারে           বেলফুল ভারে ভারে ফুটে আছে, শিশুমুখে প্রথম হাসির প্রায়--           বাগানে পা দিতে দিতে           গন্ধ আসে আচম্বিতে, নর‌্‌গেস্ কোথা ফুটে খুঁজে তারে পাওয়া দায়। মাঝেতে বাঁধানো বেদী, জুঁইগাছ চারি ধারে-- সূর্যোদয় দেখা দিত প্রাচীরের পরপারে।           নবীন রবির আলো          সে যে কী লাগিত ভালো, সর্বাঙ্গে সুবর্ণসুধা অজস্র পড়িত ঝরে-- প্রভাত ফুলের মতো ফুটায়ে তুলিত মোরে।      এখনো সে মনে আছে            সেই জানালার কাছে বসে থাকিতাম একা জনহীন দ্বিপ্রহরে।            অনন্ত আকাশ নীল,            ডেকে চলে যেত চিল জানায়ে সুতীব্র তৃষা সুতীক্ষ্ণ করুণ স্বরে।            পুকুর গলির ধারে,           বাঁধা ঘাট এক পারে-- কত লোক যায় আসে, স্নান করে, তোলে জল--           রাজহাঁস তীরে তীরে           সারাদিন ভেসে ফিরে, ডানা দুটি ধুয়ে ধুয়ে করিতেছে নিরমল।           পূর্ব ধারে বৃদ্ধ বট           মাথায় নিবিড় জট, ফেলিয়া প্রকাণ্ড ছায়া দাঁড়ায়ে রহস্যময়।           আঁকড়ি শিকড়-মুঠে           প্রাচীর ফেলেছে টুটে, খোপেখাপে ঝোপেঝাপে কত-না বিস্ময় ভয়। বসি শাখে পাখি ডাকে সারাদিন একতান- চারি দিক স্তব্ধ হেরি কী যেন করিত প্রাণ। মৃদু তপ্ত সমীরণ গায়ে লাগিত এসে, সেই সমীরণস্রোতে কত কি আসিত ভেসে           কোন্‌ সমুদ্রের কাছে           মায়াময় রাজ্য আছে, সেথা হতে উড়ে আসে পাখির ঝাঁকের মতো কত মায়া, কত পরী, রূপকথা কত শত।আরেকটি ছোটো ঘর মনে পড়ে নদীকূলে, সম্মুখে পেয়ারাগাছ ভরে আছে ফলে ফুলে। বসিয়া ছায়াতে তারি ভুলিয়া শৈশবখেলা, জাহ্নবীপ্রবাহ-পানে চেয়ে আছি সারাবেলা। ছায়া কাঁপে, আলো কাঁপে, ঝুরু ঝুরু বহে বায়-- ঝর ঝর মর মর পাতা ঝরে পড়ে যায়।           সাধ যেত যাই ভেসে           কত রাজ্যে কত দেশে, দুলায়ে দুলায়ে ঢেউ নিয়ে যাবে কত দূর--           কত ছোটো ছোটো গ্রাম           নূতন নূতন নাম, অভ্রভেদী শুভ্র সৌধ, কত নব রাজপুর। কত গাছ, কত ছায়া জটিল বটের মূল--           তীরে বালুকার ‘পরে,           ছেলেমেয়ে খেলা করে, সন্ধ্যায় ভাসায় দীপ, প্রভাতে ভাসায় ফুল। ভাসিতে ভাসিতে শুধু দেখিতে দেখিতে যাব কত দেশ, কত মুখ, কত-কী দেখিতে পাব।           কোথা বালকের হাসি,           কোথা রাখালের বাঁশি, সহসা সুদূর হতে অচেনা পাখির গান।          কোথাও বা দাঁড় বেয়ে          মাঝি গেল গান গেয়ে, কোথাও বা তীরে বসে পথিক ধরিল তান। শুনিতে শুনিতে যাই আকাশেতে তুলে আঁখি-- আকাশেতে ভাসে মেঘ, আকাশেতে ওড়ে পাখি। হয়তো বরষা কাল-- ঝর ঝর বারি ঝরে, পুলকরোমাঞ্চ ফুটে জাহ্নবীর কলেবরে--           থেকে থেকে ঝন্‌ ঝন্‌           ঘন বাজ-বরিষন, থেকে থেকে বিজলীর চমকিত চকমকি।            বহিছে পুরব বায়,            শীতে শিহরিছে কায়, গহন জলদে দিবা হয়েছে আঁধারমুখী।           সেই সেই ছেলেবেলা            আনন্দে করেছি খেলা প্রকৃতি গো, জননী গো, কেবলি তোমারি কোলে। তার পরে কী যে হল-- কোথা যে গেলেম চলে। হৃদয় নামেতে এক বিশাল অরণ্য আছে,           দিশে দিশে নাহিকো কিনারা,           তারি মাঝে হ’নু, পথহারা।           সে বন আঁধারে ঢাকা           গাছের জটিল শাখা           সহস্র স্নেহের বাহু দিয়ে           আঁধার পালিছে বুকে নিয়ে। নাহি রবি, নাহি শশী, নাহি গ্রহ, নাহি তারা,           কে জানে কোথায় দিগ‍্‌বিদিক।           আমি শুধু একেলা পথিক।           তোমারে গেলেম ফেলে,           অরণ্যে গেলেম চলে,           কাটালেম কত শত দিন           ম্রিয়মাণ সুখশান্তিহীন।আজিকে একটি পাখি পথ দেখাইয়া মোরে          আনিল এ অরণ্য-বাহিরে          আনন্দের সমুদ্রের তীরে।          সহসা দেখিনু রবিকর,          সহসা শুনিনু কত গান।          সহসা পাইনু পরিমল,          সহসা খুলিয়া গেল প্রাণ। দেখিনু ফুটিছে ফুল, দেখিনু উড়িছে পাখি,          আকাশ পুরেছে কলস্বরে।জীবনের ঢেউগুলি ওঠে পড়ে চারিদিকে,          রবিকর নাচে তার ‘পরে। চারি দিকে বহে বায়ু, চারিদিকে ফুটে আলো,          চারিদিকে অনন্ত আকাশ, চারি দিক-পানে চাই--চারিদিকে প্রাণ ধায়,         জগতের অসীম বিকাশ। কেহ এসে বসে কোলে, কেহ ডাকে সখা ব’লে,        কাছে এসে কেহ করে খেলা। কেহ হাসে, কেহ গায়, কেহ আসে, কেহ যায়--        এ কী হেরি আনন্দের মেলা! যুবক যুবতি হাসে, বালক বালিকা নাচে        দেখে যে রে জুড়ায় নয়ন। ও কে হোথা গান গায়, প্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়,         ও কী শুনি অমিয়-বচন।        তাই আজি শুধাই তোমারে,        কেন এ আনন্দ চারিধারে! বুঝেছি গো বুঝেছি গো, এতদিন পরে বুঝি        ফিরে পেলে হারানো সন্তান। তাই বুঝি দুই হাতে জড়ায়ে লয়েছ বুকে,         তাই বুঝি গাহিতেছ গান। ভালোবাসা খুঁজিবারে গেছিনু অরণ্যমাঝে,         হৃদয়ে হইনু পথহারা,         বরষিনু অশ্রুবারিধারা। ভ্রমিলাম দূরে দূরে--কে জানিত বল্‌ দেখি         হেথা এত ভালোবাসা আছে। যেদিকেই চেয়ে দেখি সেইদিকে ভালোবাসা           ভাসিতেছে নয়নের কাছে। মা আমার, আজ আমি কত শত দিন পরে           যখনি রে দাঁড়ানু সম্মুখে, অমনি চুমিলি মুখ, কিছু নাই অভিমান,          অমনি লইলি তুলে বুকে। ছাড়িব না তোর কোল, রব হেথা অবিরাম,         তোর কাছে শিখিব রে স্নেহ, সবারে বাসিব ভালো--কেহ না নিরাশ হবে          মোরে ভালো বাসিবে যে কেহ। পুরস্কার সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে    কহিল কবির স্ত্রী 'রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো, রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো, মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,    তার খোঁজ রাখ কি! গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব--- মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম, মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,    না মিলে শস্যকণা। অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা, নিশিদিন ধ'রে এ কি ছেলেখেলা! ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা    লক্ষ্মীর উপাসনা। ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী, যা করিতে হয় করহ এখনি। এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি    কিসে কড়ি আসে দুটো!' দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া, পরিহাসছলে ঈষত্‍‌ হাসিয়া    কহে জুড়ি করপুট, 'ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে, লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে, ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে    এ কথা শুনিবে কেবা! আমার কপালে বিপরীত ফল--- চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল, ভারতী না থাকে থির এক পল    এতো করি তাঁর সেবা। তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল, আনমনা যদি হই এক-তিল    অমনি সর্বনাশ!' মনে মনে হাসি মুখ করি ভার কহে কবিজায়া, 'পারি নেকো আর, ঘরসংসার গেল ছারেখার,    সব তাতে পরিহাস!' এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি চঞ্চল করে অঞ্চল টানি    রোষছলে যায় চলি। হেরি সে ভুবন-গরব-দমন অভিমানবেগে অধীর গমন উচাটন কবি কহিল, 'অমন    যেয়ো না হৃদয় দলি। ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়, কী করিতে হবে বলো সে উপায়, ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়---    বুদ্ধি জোগাও তুমি। একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই তোমার মুরতি সেখানে চাপাই, বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই---    সমস্ত মরুভূমি।' 'হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়' হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়, 'যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়    আমার কপালগুণে। কথার কখনো ঘটে নি অভাব, যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব, একবার ওগো বাক্য-নবাব    চলো দেখি কথা শুনে। শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি, সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি, ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি    চলো রাজসভা-মাঝে। আমাদের রাজা গুণীর পালক, মানুষ হইয়া গেল কত লোক, ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক    লাগিবে কিসের কাজে!' কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ, ভাবিল--- বিপদ দেখিতেছি আজ, কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,    কপালে কী জানি আছে! মুখে হেসে বলে, 'এই বৈ নয়! আমি বলি, আরো কী করিতে হয়! প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়    বিধবা হইবে পাছে। যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ, ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ--- হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,    কেয়ূর, কনকহার। বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে, কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে    আয়োজন করো তার।' ব্রাহ্মণী কহে, 'মুখাগ্রে যার বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার    না দেখি আবশ্যক। নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা এনেছি পাড়ার করি উপাসনা, সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,    রসনা ক্ষান্ত হোক।' এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ আনে বেশবাস নানান-ধরন, কবি ভাবে মুখ করি বিবরন---    আজিকে গতিক মন্দ। গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া, আপনার হাতে যতনে কষিয়া    পরাইল কটিবন্ধ। উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়, কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়, অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,    কুণ্ডল দেয় কানে। অঙ্গে যতই চাপায় রতন কবি বসি থাকে ছবির মতন, প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন    সেও আজি হার মানে। এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া বেশভূষা সব সমাধা করিয়া গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া    বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা। হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক; হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক,    'আ মরি, সেজেছ কিবা!' ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া; কহিল বচন অমিয় ছানিয়া, 'পুরনারীদের পরান হানিয়া    ফিরিয়া আসিবে আজি। তখন দাসীরে ভুলো না গরবে, এই উপকার মনে রেখো তবে, মোরেও এমন পরাইতে হবে    রতনভূষণরাজি।' কোলের উপরে বসি বাহুপাশে বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে    কানে কানে কথা কয়। দেখিতে দেখিতে কবির অধরে হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে, মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে    ফাটিয়া বাহির হয়। কহে উচ্ছ্বসি, 'কিছু না মানিব, এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব    ও রাঙা চরণতলে!' বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি, উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি,    দ্রুত রাজগৃহে চলে। কবির রমণী কুতুহলে ভাসে, তাড়তাড়ি উঠি বাতায়নপাশে উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে---    কালো চোখে আলো নাচে। কহে মনে মনে বিপুলপুলকে--- রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে, এমনটি আর পড়িল না চোখে    আমার যেমন আছে॥ এ দিকে কবির উত্‍‌সাহ ক্রমে নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে, যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে    মরিতে পাইলে বাঁচে। রাজসভাসদ্ সৈন্য পাহারা গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা, সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা---    হেথা কী আসিতে আছে! হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয় রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়, মন্ত্রী হইতে দ্বারীমহাশয়    সবে গম্ভীরমুখ। মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি ধরি আছে হেন যমের মুরতি তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি---    দমি যায় তার বুক। বসি মহারাজ মহেন্দ্ররায় মহোচ্চ গিরিশিখরের প্রায়, জন-অরণ্য হেরিছে হেলায়    অচল-অটল ছবি। কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া শত শত দেশ সরস করিয়া, সে মহামহিমা নয়ন ভরিয়া    চাহিয়া দেখিল কবি। বিচার সমাধা হল যবে, শেষে ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে    দেশের প্রধান চর। অতি সাধুমত আকার প্রকার, এক-তিল নাহি মুখের বিকার, ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার    নাহি জানে কোনো নর। ব্রত নানামত সতত পালয়ে, এক কানাকড়ি মুল্য না লয়ে ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে    বিতরিছে যাকে তাকে। চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে--- কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে    সন্ধান তার রাখে। নামাবলি গায়ে বৈষ্ণবরূপে যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে, মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে    কী করিল নিবেদন। অমনি আদেশ হইল রাজার, 'দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হজার।' 'সাধু সাধু' কহে সভার মাঝার    যত সভাসদ্‌জন। পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে--- 'এ যে দান ইহা যোগ্যপাত্রে, দেশের আবাল-বনিতা-মাত্রে    ইথে না মানিবে দ্বেষ।' সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে, দেখি সভাজন 'আহা আহা' করে, মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে    ঈষত্‍‌ হাস্যলেশ। আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ ধুলিভরা দুটি লইয়া চরণ চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ    পবিত্র পদপঙ্কে। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম, বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম, প্রখরমুর্তি অগ্নিশর্ম---    ছাত্র মরে আতঙ্কে। কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক'রে পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক'রে, মটর কড়াই মিশায়ে কাঁকরে    চিবাইল যেন দাঁতে। কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু, সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু; রাজা বলে, 'এঁরে দক্ষিণা কিছু    দাও দক্ষিণ হাতে।' তার পরে এল গনত্‍‌কার, গণনায় রাজা চমত্‍‌কার, টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনত্‍‌কার    বাজায়ে সে গেল চলি। আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য, রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য    ভরিয়া দিলেন থলি। আসে নট ভাট রাজপুরোহিত--- কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত, কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত    কারো বা হরিত্‍‌বর্ণ। আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য--- কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ--- যার যথামত পায় বরাদ্দ;    রাজা আজি দাতাকর্ণ। যে যাহার সবে যায় স্বভবনে, কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে, রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে    বিপন্নমুখছবি। কহে ভূপ, 'হোথা বসিয়া কে ওই, এস তো, মন্ত্রী, সন্ধান লই।' কবি কহি উঠে, 'আমি কেহ নই,    আমি শুধু এক কবি।' রাজা কহে, 'বটে! এসো এসো তবে, আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।' বসাইলা কাছে মহাগৌরবে    ধরি তার কর দুটি। মন্ত্রী ভাবিল, যাই এই বেলা, এখন তো শুরু  হবে ছেলেখেলা--- কহে, 'মহারাজ, কাজ আছে মেলা,    আদেশ পাইলে উঠি।' রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত, নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ বাহির হইয়া গেল সমস্ত    সভাস্থ দলবল--- পাত্র মিত্র অমাত্য আদি, অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী, উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ-উপাধি    বন্যার যেন জল॥ চলি গেল যবে সভ্যসুজন মুখোমুখি করি বসিলা দুজন; রাজা বলে, 'এবে কাব্যকূজন    আরম্ভ করো কবি।' কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে বাণীবন্দনা করে নত মুখে, 'প্রকাশো জননী নয়নসমুখে    প্রসন্ন মুখছবি। বিমল মানসসরস-বাসিনী শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী    কমলকুঞ্জাসনা, তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন খ্যাপার মতন আছি চিরদিন    উদাসীন আনমনা। চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া, আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া    পেয়েছি স্বরগসুধা। সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি, তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী--- সুরের খাদ্যে জানো তো মা, বাণী,    নরের মিটে না ক্ষুধা। যা হবার হবে সে কথা ভাবি না, মা গো, একবার ঝংকারো বীণা, ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী    অমৃত-উত্‍‌স-ধারা। যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান মলিনমর্ত-মাঝে বহমান    নিয়ত আত্মহারা। যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া, অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া    বিশ্বতন্ত্রী হতে। যে রাগিণী চিরজন্ম ধরিয়া চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া--- অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া    ছুটে সহস্র স্রোতে। কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়, নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়--- বালুকার'পরে কালের বেলায়    ছায়া-আলোকের খেলা। জগতের যত রাজা মহারাজ কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ, সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ---    টুটিছে সন্ধ্যাবেলা। শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর বিপুল বৃহত্‍‌ গভীর মধুর, চিরদিন তাহে আছে ভরপুর    মগন গগনতল। যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী--- জানে না আপনা, জানে না ধরণী,    সংসারকোলাহল। সে জন পাগল, পরান বিকল--- ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল,    ঠেকেছে চরণে তব। তোমার অমল কমলগন্ধ হৃদয়ে ঢালিছে মহা-আনন্দ--- অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ    শুনিছ নিত্য নব। বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী--- বারেকের তরে ভুলাও, জননী, কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী,    কেবা আগে কেবা পিছে--- কার জয় হল কার পরাজয়, কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়, কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,    কে উপরে কেবা নীচে। গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে ছোটো জগতের ছোটোবড়ো সবে, সুখে প'ড়ে রবে পদপল্লবে    যেন মালা একখানি। তুমি মানসের মাঝখানে আসি দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি, কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি    বীণা হাতে বীণাপাণি। ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা সারি সারি যত মানবের ধারা অনাদিকালের পান্থ যাহারা    তব সংগীতস্রোতে। দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল, দশ দিক্‌বধূ খুলি কেশজাল    নাচে দশ দিক হতে।' এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি পূণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি    রাঘবের ইতিহাস। অসহ দুঃখ সহি নিরবধি কেমনে জনম গিয়েছে দগধি, জীবনের শেষ দিবস অবধি    অসীম নিরাশ্বাস। কহিল, 'বারেক ভাবি দেখো মনে সেই একদিন কেটেছে কেমনে যেদিন মলিন বাকলবসনে    চলিলা বনের পথে--- ভাই লক্ষ্মণ বয়স নবীন, ম্লানছায়াসম বিষাদবিলীন নববধূ সীতা আভরণহীন    উঠিলা বিদায়রথে। রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার, প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে-সার, এমন বজ্র কখনো কি আর    পড়েছে এমন ঘরে! অভিষেক হবে, উত্‍‌সবে তার আনন্দময় ছিল চারি ধার--- মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার    শুধু নিমেষের ঝড়ে। আর-একদিন, ভেবে দেখো মনে, যেদিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্মণে ফিরিয়া নিভৃত কুটিরভবনে    দেখিলা জানকী নাহি--- 'জানকী' 'জানকী' আর্ত রোদনে ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে, মহা-অরণ্য আঁধার-আননে    রহিল নীরবে চাহি। তার পরে দেখো শেষ কোথা এর, ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের--- এত বিষাদের এত বিরহের    এত সাধনার ধন, সেই সীতাদেবী রাজসভা-মাঝে বিদায়বিনয়ে নমি রঘুরাজে দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে    হইলা অদর্শন। সে-সকল দিন সেও চলে যায়, সে অসহ শোক--- চিহ্ন কোথায়--- যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায়    অসীম দগ্ধরেখা। দ্বিধা ধরাভুমি জুড়েছে আবার, দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার, সরযূর কূলে দুলে তৃণসার    প্রফুল্লশ্যামলেখা। শুধু সে দিনের একখানি সুর চিরদিন ধ'রে বহু বহু দূর কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর    মধুর করুণ তানে। সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে আজিও সে গীত মহাসংগীতে    বাজে মানবের কানে।' তার পরে কবি কহিল সে কথা, কুরুপাণ্ডবসমরবারতা--- গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা    ব্যাপিল সর্ব দেশ; দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি, ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি, মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি    অরণ্যপরিবেশ। এক গিরি হতে দুই-স্রোত-পারা দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা    নিষ্ঠুর অভিমানে, দেখিতে দেখিতে হল উপনীত ভারতের যত ক্ষত্রশোণিত--- ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত    প্রলয়বন্যাগানে। দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল, আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল, গৃহবন্ধন করি নির্মূল    ছুটিল রক্তধারা--- ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি, বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি    নিবায়ে সূর্যতারা। সমরবন্যা যবে অবসান সোনার ভারত বিপুল শ্মশান, রাজগৃহ যত ভূতলশয়ান    পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই। ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে বসিয়া শোণিতপঙ্কশয়নে, চাহি ধরা-পানে আনতবয়নে    মুখেতে বচন নাই। বহু দিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ, মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ, সমাধা যজ্ঞ মহা-নরমেধ    বিদ্বেষহুতাশনে। সকল কামনা করিয়া পূর্ণ সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য    স্বর্ণসিংহাসনে। স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার, শ্মশান হইতে আসে হাহাকার রাজপুরবধূ যত অনাথার    মর্মবিদার রব। 'জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়' সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়--- পরিহাস বলে আজ মনে হয়,    মিছে মনে হয় সব। কালি যে ভারত সারা দিন ধরি অট্ট গরজে অম্বর ভরি রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি    ছাড়ি কুলভয়লাজে, পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া বসি একাকিনী শোকার্তহিয়া    শূন্যশ্মশানমাঝে। কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব, সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব, সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব    ভস্মও নাহি তার। যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি সে আজি কাহার তাহাও না জানি, কোথা ছিল রাজা কোথা রাজধানী    চিহ্ন নাহিকো আর। তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর--- যেন সে অমর সমরসাগর গ্রহণ করেছে নব কলেবর    একটি বিরাট গানে। বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ, সফল আশার বিষাদ মহান্, উদাস শান্তি করিতেছে দান    চিরমানবের প্রাণে। হায়, এ ধরায় কত অনন্ত বরষে বরষে শীত বসন্ত সুখে দুখে ভরি দিক্-দিগন্ত    হাসিয়া গিয়াছে ভাসি। এমনি বরষা আজিকার মতো কতদিন কত হয়ে গেছে গত, নবমেঘভারে গগন আনত    ফেলেছে অশ্রুরাশি। যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে, দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে, প্রেমিক যেজন ভালো সে বেসেছে    আজি আমাদেরই মতো; তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান--- দেশে দেশে তার নাহি পরিমাণ,    ভেসে ভেসে যায় কত। শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে, সমস্ত প্রাণে কেন-যে কে জানে    ভরে আসে আঁখিজল--- বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা, বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা, লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা    সুন্দর ধরাতল! এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ, যে ক' দিন আছি মানসের সাধ    মিটাব আপন-মনে--- যার যাহা আছে তার থাক্ তাই, কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই    একটি নিভৃত কোণে। শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি, বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি, পুষ্পের মত সংগীতগুলি    ফুটাই আকাশভালে। অন্তর হতে আহরি বচন আনন্দলোক করি বিরচন, গীতরসধারা করি সিঞ্চন    সংসারধুলিজালে। অতিদুর্গম সৃষ্টিশিখরে অসীম কালের মহাকন্দরে সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে    ঝর্ঝরসংগীতে, স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা--- সেথা হতে টানি লব গীতধারা    ছোটো এই বাঁশরিতে। ধরণীর শ্যাম করপুটখানি ভরি দিব আমি সেই গীত আনি, বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী    মধুর-অর্থ-ভরা। নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া, করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া    বাসন্তীবাস-পরা। ধরণীর তলে গগনের গায় সাগরের জলে অরণ্যছায় আরেকটুখানি নবীন আভায়    রঙিন করিয়া দিব। সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর, দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর---    তার পরে ছুটি নিব। সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল, সুন্দর হবে নয়নের জল, স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল    আরো আপনার হবে। প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে, আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-'পরে    শিশিরের মত রবে। না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে--- কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে    মাগিছে তেমনি সুর। কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা, কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা, বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা    রেখে যাব সুমধুর। থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী--- তোমারি চরণে প্রাণের আরতি, চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি,    রাখি না কাহারো আশা। কত সুখ ছিল হয়ে গেছে দুখ, কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ, ম্লান হয়ে গেছে কত উত্‍‌সুক    উন্মুখ ভালোবাসা। শুধু ও চরণ হৃদয়ে বিরাজে, শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে, স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে---    আয় রে বত্‍‌স, আয়, ফেলে রেখে আয় হাসি ক্রন্দন, ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন, হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন    চিরবসন্ত-বায়। সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়, জন্মের মত বরিনু তোমায়--- কমলগন্ধ কোমল দু পায়    বার বার নমোনম।' এত বলি কবি থামাইল গান, বসিয়া রহিল মুগ্ধনয়ান, বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান    বীণাঝংকার-সম। পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল্, আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল--- দু বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল,    কবিরে লইলা বুকে। কহিলা 'ধন্য, কবি গো, ধন্য, আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন, তোমারে কী আমি কহিব অন্য---    চিরদিন থাকো সুখে। ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে, করি পরিতোষ কোন্ উপহারে, যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে    সব দিতে পারি আনি।' প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দজলে ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে, 'কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে    ওই ফুলমালাখানি।' মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে, কেহ শিবিকায় কেহ ধায় রথে, নানা দিকে লোক যায় নানামতে    কাজের অন্বেষণে। কবি নিজমনে ফিরিছে লুব্ধ, যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ কল্পধেনুর অমৃতদুগ্ধ    দোহন করিছে মনে। কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ---    সুখহাস মুখে ফুটে। কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে--- যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে    দিতেছে চঞ্চুপুটে। অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন কত কী-যে কথা ভাবিতেছে মন, হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন    সহসা কবিরে হেরি বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনিঝিনি বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী, হাসিজালখানি অতুলহাসিনী    ফেলিলা কবিরে ঘেরি। কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি; অতি সত্বর সম্মুখে আসি কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি,    'দেখো কী এনেছি বালা! নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন, আমি আনিয়াছি করিয়া যতন তোমার কণ্ঠে দেবার মতন    রাজকণ্ঠের মালা।' এত বলি মালা শির হতে খুলি প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি, কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি    ফিরায়ে রহিল মুখ। মিছে ছল করি মুখে করে রাগ, মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ, গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ,    হৃদয়ে উথলে সুখ। কবি ভাবে বিধি অপ্রসন্ন, বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ    শূন্যে নয়ন মেলি। কবির ললনা আধখানি বেঁকে চোরা কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে, পতির মুখের ভাবখানা দেখে    মুখের বসন ফেলি উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া, তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া, চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া    পড়িল তাহার বুকে। সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া শতবার করি আপনি সাধিয়া    চুম্বিল তার মুখে। বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায় আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়, মালাখানি লয়ে আপন গলায়    আদরে পরিলা সতী। ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে--- বাঁধা প'ল এক মাল্যবাঁধনে    লক্ষ্মীসরস্বতী॥শাহাজাদপুর, ১৩ শ্রাবণ ১৩০০ সূত্রঃ সোনার তরী পুরাতন পুরাতন ভৃত্য ভূতের মতন চেহারা যেমন,   নির্বোধ অতি ঘোর— যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন,   “কেষ্টা বেটাই চোর।” উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত,   শুনেও শোনে না কানে। যত পায় বেত না পায় বেতন,   তবু না চেতন মানে। বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ   চীৎকার করি “কেষ্টা”— যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া,   খুঁজে ফিরি সারা দেশটা। তিনখানা দিলে একখানা রাখে,   বাকি কোথা নাহি জানে; একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে   তিনখানা করে আনে। যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে   নিদ্রাটি আছে সাধা; মহাকলরবে গালি দেই যবে   “পাজি হতভাগা গাধা”— দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে,   দেখে জ্বলে যায় পিত্ত। তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য। ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি   বলে, “আর পারি নাকো, রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার,   কেষ্টারে লয়ে থাকো। না মানে শাসন   বসন বাসন   অশন আসন যত কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো   যেতেছে জলের মতো। গেলে সে বাজার সারা দিনে আর   দেখা পাওয়া তার ভার— করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি   ভৃত্য মেলে না আর!” শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে,   আনি তার টিকি ধরে; বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই,   দূর করে দিনু তোরে।” ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়;   পরদিনে উঠে দেখি, হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে   বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি— প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ,   অতি অকাতর চিত্ত! ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে—  মোর পুরাতন ভৃত্য! সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা   করিয়া দালালগিরি। করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন   বারেক আসিব ফিরি। পরিবার তায় সাথে যেতে চায়,   বুঝায়ে বলিনু তারে— পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য,   নহিলে খরচ বাড়ে। লয়ে রশারশি করি কষাকষি   পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে   গৃহিণী কহিল কাঁদি, “পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে   কষ্ট অনেক পাবে।” আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম!   নিবারণ সাথে যাবে।” রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায়   নামিয়া বর্ধমানে— কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত,   তামাক সাজিয়া আনে! স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর    কত বা সহিব নিত্য! যত তারে দুষি তবু হনু খুশি   হেরি পুরাতন ভৃত্য!নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে   পিছনে সমুখে যত লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা   করিল কণ্ঠাগত। জন‐ছয়‐সাতে  মিলি এক‐সাথে   পরমবন্ধুভাবে করিলাম বাসা; মনে হল আশা,   আরামে দিবস যাবে। কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা,   কোথা বনমালী হরি! কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত!   আমি বসন্তে মরি। বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো   বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ; আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে   ভরিল সকল অঙ্গ। ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ,   “কেষ্ট আয় রে কাছে। এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে   প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।” হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক,    সে যেন পরম বিত্ত— নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে   মোর পুরতন ভৃত্য। মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল,   শিরে দেয় মোর হাত; দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম,   মুখে নাই তার ভাত। বলে বার বার, “কর্তা, তোমার   কোনো ভয় নাই, শুন— যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে   দেখিতে পাইবে পুন।” লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম;   তাহারে ধরিল জ্বরে; নিল সে আমার কালব্যাধিভার   আপনার দেহ‐’পরে। হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন,   বন্ধ হইল নাড়ী; এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে,  এতদিনে গেল ছাড়ি। বহুদিন পরে আপনার ঘরে   ফিরিনু সারিয়া তীর্থ; আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই   মোর পুরাতন ভৃত্য। পুরানো সেই দিনের কথা পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়। ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়। আয়    আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়। মোরা   সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়। মোরা   ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--         বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়। হায়     মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়-- আবার  দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥(রচনাকাল: 1885) পুরোনো বট লুটিয়ে পড়ে জটিল জটা, ঘন পাতার গহন ঘটা, হেথা হোথায় রবির ছটা,      পুকুর-ধারে বট। দশ দিকেতে ছড়িয়ে শাখা কঠিন বাহু আঁকাবাঁকা স্তব্ধ যেন আছে আঁকা,      শিরে আকাশ-পট। নেবে নেবে গেছে জলে শিকড়গুলো দলে দলে, সাপের মতো রসাতলে      আলয় খুঁজে মরে। শতেক শাখা-বাহু তুলি বায়ুর সাথে কোলাকুলি, আনন্দেতে দোলাদুলি      গভীর প্রেমভরে। ঝড়ের তালে নড়ে মাথা, কাঁপে লক্ষকোটি পাতা, আপন-মনে গায় সে গাথা,      দুলায় মহাকায়া। তড়িৎ পাশে উঠে হেসে, ঝড়ের মেঘ ঝটিৎ এসে দাঁড়িয়ে থাকে এলোকেশে,      তলে গভীর ছায়া।    নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ      মাথার লয়ে জট, ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে      ওগো প্রাচীন বট! কতই পাখি তোমার শাখে      বসে যে চলে গেছে, ছোটো ছেলেরে তাদেরই মতো      ভুলে কি যেতে আছে? তোমার মাঝে হৃদয় তারি      বেঁধেছিল যে নীড়। ডালেপালায় সাধগুলি তার      কত করেছে ভিড়। মনে কি নেই সারাটা দিন      বসিয়ে বাতায়নে, তোমার পানে রইত চেয়ে      অবাক দুনয়নে? ভাঙা ঘাটে নাইত কারা,      তুলত কারা জল, পুকুরেতে ছায়া তোমার      করত টলমল। জলের উপর রোদ পড়েছে      সোনা-মাখা মায়া, ভেসে বেড়ায় দুটি হাঁস      দুটি হাঁসের ছায়া। ছোটো ছেলে রইত চেয়ে,      বাসনা অগাধ— মনের মধ্যে খেলাত তার      কত খেলার সাধ। বায়ুর মতো খেলত যদি      তোমার চারি ভিতে, ছায়ার মতো শুত যদি       তোমার ছায়াটিতে, পাখির মতো উড়ে যেত      উড়ে আসত ফিরে, হাঁসের মতো ভেসে যেত তোমার তীরে তীরে। মনে হত, তোমার ছায়ে        কতই যে কী আছে,   কাদের যেন ঘুম পাড়াতে        ঘুঘু ডাকত গাছে।   মনে হত, তোমার মাঝে        কাদের যেন ঘর।   আমি যদি তাদের হতেম!        কেন হলেম পর।   ছায়ার মতো ছায়ায় তারা        থাকে পাতার ‘পরে,   গুন্‌গুনিয়ে সবাই মিলে        কতই যে গান করে।   দূর লাগে মূলতানে তান,        পড়ে আসে বেলা,   ঘাটে বসে দেখে জলে                  আলোছায়ার খেলা।   সন্ধে হলে খোঁপা বাঁধে        তাদের মেয়েগুলি, ছেলেরা সব দোলায় বসে        খেলায় দুলি দুলি। তোমার পানে রইত চেয়ে       অবাক দুনয়নে?       তোমার তলে মধুর ছায়া        তোমার তলে ছুটি, তোমার তলে নাচত বসে         শালিখ পাখি দুটি।   গহিন রাতে দখিন বাতে        নিঝুম চারি ভিত,   চাঁদের আলোয় শুভ্র তনু,        ঝিমি ঝিমি গীত।   ওখানেতে পাঠশালা নেই,        পণ্ডিতমশাই—   বেত হাতে নাইকো বসে        মাধব গোসাঁই।   সারাটা দিন ছুটি কেবল,        সারাটা দিন খেলা—    পুকুর-ধারে আঁধার-করা           বটগাছের তলা।      আজকে কেন নাইকো তারা।           আছে আর-সকলে,   তারা তাদের বাসা ভেঙে           কোথায় গেছে চলে।   ছায়ার মধ্যে মায়া ছিল           ভেঙে দিল কে।   ছায়া কেবল রইল প'ড়ে,           কোথায় গেল সে।   ডালে বসে পাখিরা আজ           কোন্‌ প্রাণেতে ডাকে।   রবির আলো কাদের খোঁজে           পাতার ফাঁকে ফাঁকে।   গল্প কত ছিল যেন          তোমার খোপে-খাপে,   পাখির সঙ্গে মিলে-মিশে           ছিল চুপে-চাপে,   দুপুর বেলা নূপুর তাদের           বাজত অনুক্ষণ,   ছোটো দুটি ভাই-ভগিনীর           আকুল হত মন।   ছেলেবেলায় ছিল তারা,           কোথায় গেল শেষে।   গেছে বুঝি ঘুম-পাড়ানি           মাসিপিসির দেশে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) পুষ্প পুষ্প ছিল বৃক্ষশাখে, হে নারী, তোমার অপেক্ষায়                     পল্লবচ্ছায়ায়।           তোমার নিশ্বাস তারে লেগে           অন্তরে সে উঠিয়াছে জেগে,                     মুখে তব কী দেখিতে পায়।সে কহিছে-- "বহু পূর্বে তুমি আমি কবে একসাথে                     আদিম প্রভাতে           প্রথম আলোকে জেগে উঠি           এক ছন্দে বাঁধা রাখী দুটি                     দুজনে পরিনু হাতে হাতে।"আধো আলো-অন্ধকারে উড়ে এনু মোরা পাশে পাশে                     প্রাণের বাতাসে।           একদিন কবে কোন্‌ মোহে           দুই পথে চলে গেনু দোঁহে                     আমাদের মাটির আবাসে।"বারে বারে বনে বনে জন্ম লই নব নব বেশে                     নব নব দেশে।           যুগে যুগে রূপে রূপান্তরে           ফিরিনু সে কী সন্ধান-তরে                     সৃজনের নিগূঢ় উদ্দেশে।"অবশেষে দেখিলাম কত জন্ম-পরে নাহি জানি                        ওই মুখখানি।             বুঝিলাম আমি আজও আছি             প্রথমের সেই কাছাকাছি,                        তুমি পেলে চরমের বাণী।"তোমার আমার দেহে আদিছন্দ আছে অনাবিল                        আমাদের মিল।             তোমার আমার মর্মতলে             একটি সে মূল সুর চলে,                        প্রবাহ তাহার অন্তঃশীল।"কী যে বলে সেই সুর, কোন্‌ দিকে তাহার প্রত্যাশা,                        জানি নাই ভাষা।             আজ, সখী, বুঝিলাম আমি             সুন্দর আমাতে আছে থামি--                        তোমাতে সে হল ভালোবাসা।' পুষ্পচয়িনী হে পুষ্পচয়িনী, ছেড়ে আসিয়াছ তুমি কবে উজ্জয়িনী                    মালিনীছন্দের বন্ধ টুটে।     বকুল উৎফুল্ল হয়ে উঠে         আজো বুঝি তব মুখমদে।                নূপুররণিত পদে। আজো বুঝি অশোকের ভাঙাইবে ঘুম।                কী সেই কুসুম যা দিয়ে অতীত জন্মে গণেছিলে বিরহের দিন।        বুঝি সে-ফুলের নাম বিস্মৃতিবিলীন     ভর্তৃপ্রসাদন ব্রতে যা দিয়ে গাঁথিতে মালা                  সাজাইতে বরণের ডালা। মনে হয় যেন তুমি ভুলে-যাওয়া তুমি--                  মর্ত্যভূমি     তোমারে যা ব'লে জানে সেই পরিচয়            সম্পূর্ণ তো নয়। তুমি আজ          করেছ যে-অঙ্গসাজ                নহে সদ্য আজিকার।        কালোয় রাঙায় তার            যে ভঙ্গীটি পেয়েছে প্রকাশ               দেয় বহুদূরের আভাস।        মনে হয় যেন অজানিতে                        রয়েছ অতীতে।    মনে হয় যে-প্রিয়ের লাগি         অবন্তীনগরসৌধে ছিলে জাগি,                তাহারি উদ্দেশে     না জেনে সেজেছ বুঝি সে-যুগের বেশে।            মালতীশাখার 'পরে        এই-যে তুলেছ হাত ভঙ্গীভরে            নহে ফুল তুলিবার প্রয়োজনে,                      বুঝি আছে মনে                যুগ-অন্তরাল হতে বিস্মৃত বল্লভ            লুকায়ে দেখিছে তব সুকোমল ও-করপল্লব।        অশরীরী মুগ্ধনেত্র যেন গগনে সে                    হেরে অনিমেষে        দেহভঙ্গিমার মিল লতিকার সাথে                আজি মাঘীপূর্ণিমার রাতে।     বাতাসেতে অলক্ষিতে যেন কার ব্যাপ্ত ভালোবাসা               তোমার যৌবনে দিল নৃত্যময়ী ভাষা। পূজার সাজ আশ্বিনের মাঝামাঝি          উঠিল বাজনা বাজি,                   পূজার সময় এল কাছে।       মধু বিধু দুই ভাই             ছুটাছুটি করে তাই,                   আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।         পিতা বসি ছিল দ্বারে,         দুজনে শুধালো তারে,                  ‘কী পোশাক আনিয়াছ কিনে। '      পিতা কহে, ‘আছে আছে     তোদের মায়ের কাছে,                  দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে। '         সবুর সহে না আর—          জননীরে বার বার                   কহে, ‘মা গো, ধরি তোর পায়ে,      বাবা আমাদের তরে            কী কিনে এনেছে ঘরে                   একবার দে না মা, দেখায়ে। '         ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা            দুখানি ছিটের জামা                    দেখাইল করিয়া আদর।      মধু কহে, ‘আর নেই?'       মা কহিল, ‘আছে এই                   একজোড়া ধুতি ও চাদর। '         রাগিয়া আগুন ছেলে,         কাপড় ধুলায় ফেলে                   কাঁদিয়া কহিল, ‘চাহি না মা,      রায়বাবুদের গুপি             পেয়েছে জরির টুপি,                   ফুলকাটা সাটিনের জামা। '         মা কহিল, ‘মধু, ছি ছি,     কেন কাঁদ মিছামিছি,                   গরিব যে তোমাদের বাপ।      এবার হয় নি ধান,            কত গেছে লোকসান,                   পেয়েছেন কত দুঃখতাপ।      তবু দেখো বহু ক্লেশে         তোমাদের ভালোবেসে                   সাধ্যমত এনেছেন কিনে।      সে জিনিস অনাদরে            ফেলিলি ধূলির ‘পরে—                   এই শিক্ষা হল এতদিনে। '        বিধু বলে, ‘এ কাপড়          পছন্দ হয়েছে মোর,                   এই জামা পরাস আমারে। '      মধু শুনে আরো রেগে          ঘর ছেড়ে দ্রুতবেগে                   গেল রায়বাবুদের দ্বারে।         সেথা মেলা লোক জড়ো,        রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো;                   দালান সাজাতে গেছে রাত।      মধু যবে এক কোণে            দাঁড়াইল ম্লান মনে                   চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ।         কাছে ডাকি স্নেহভরে         কহেন করুণ স্বরে                   তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,      ‘কী রে মধু, হয়েছে কী।       তোরে যে শুক্‌নো দেখি। '                  শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া,         কহিল, ‘আমার তরে           বাবা আনিয়াছে ঘরে                   শুধু এক ছিটের কাপড়। '      শুনি রায়মহাশয়                 হাসিয়া মধুরে কয়,                   ‘সেজন্য ভাবনা কিবা তোর। '         ছেলেরে ডাকিয়া চুপি           কহিলেন, ‘ওরে গুপি,                   তোর জামা দে তুই মধুকে। '      গুপির সে জামা পেয়ে           মধু ঘরে যায় ধেয়ে                    হাসি আর নাহি ধরে মুখে।         বুক ফুলাইয়া চলে—          সবারে ডাকিয়া বলে,                   ‘দেখো কাকা! দেখো চেয়ে মামা!      ওই আমাদের বিধু              ছিট পরিয়াছে শুধু,                   মোর গায়ে সাটিনের জামা। '        মা শুনি কহেন আসি            লাজে অশ্রুজলে ভাসি                   কপালে করিয়া করাঘাত,      ‘হই দুঃখী হই দীন              কাহারো রাখি না ঋণ,                   কারো কাছে পাতি নাই হাত।         তুমি আমাদেরই ছেলে          ভিক্ষা লয়ে অবহেলে                   অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে!      ছেঁড়া ধুতি আপনার              ঢের বেশি দাম তার                   ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে।         আয় বিধু, আয় বুকে,          চুমো খাই চাঁদমুখে,                   তোর সাজ সব চেয়ে ভালো।      দরিদ্র ছেলের দেহে              দরিদ্র বাপের স্নেহে                   ছিটের জামাটি করে আলো। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) পূর্ণ মিলন নিশিদিন কাঁদি , সখী , মিলনের তরে যে মিলন ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মতন । লও লও বেঁধে লও কেড়ে লও মোরে — লও লজ্জা , লও বস্ত্র , লও আবরণ । এ তরুণ তনুখানি লহ চুরি করে — আঁখি হতে লও ঘুম , ঘুমের স্বপন । জাগ্রত বিপুল বিশ্ব লও তুমি হরে অনন্তকালের মোর জীবন – মরণ । বিজন বিশ্বের মাঝে মিলনশ্মশানে নির্বাপিতসূর্যালোক লুপ্ত চরাচর , লাজমুক্ত বাসমুক্ত দুটি নগ্ন প্রাণে তোমাতে আমাতে হই অসীম সুন্দর । এ কী দুরাশার স্বপ্ন হায় গো ঈশ্বর , তোমা ছাড়া এ মিলন আছে কোন্খানে ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) পূর্ণা তুমি গো পঞ্চদশী শুক্লা নিশার অভিসারপথে চরম তিথির শশী। স্মিত স্বপ্নের আভাস লেগেছে বিহ্বল তব রাতে। ক্বচিৎ চকিত বিহগকাকলি তব যৌবনে উঠিছে আকুলি নব আষাঢ়ের কেতকীগন্ধ- শিথিলিত নিদ্রাতে।যেন অশ্রুত বনমর্মর তোমার বক্ষে কাঁপে থরথর। অগোচর চেতনার অকারণ বেদনার ছায়া এসে পড়ে মনের দিগন্তে, গোপন অশান্তি উছলিয়া তুলে ছলছল জল কষ্জল-আঁখিপাতে। পৃথিবী আজ আমার প্রণতি গ্রহন করো, পৃথিবী, শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।। মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা, বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে, মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে, মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দু:সহ দ্বন্দ্বে। ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা, বাম হাতে চুর্ণ কর পাত্র, তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে; দু:সাধ্য কর বীরের জীবনকে মহত্ জীবনে যার অধিকার। শ্রেয়কে কর দুরমূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে। তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম, ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক। জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি- সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা। তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে।। তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের ছিল দুর্জয়- সে পুরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়। তার অঙ্গুলি ছিল স্থুল, কলাকৌশলবর্জিত; গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত; অগ্নিতে বাষ্পেতে দু:স্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে। জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি, প্রাণের ‘পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।। দেবতা এলেন পরযুগে, মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের- জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত; জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে। উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়, পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট।। নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব, তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস। ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা- তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে! তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি। দেবতার মন্ত্র উঠেছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে। তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব ক্ষণে ক্ষণে উঠেছে ফণা তুলে- তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করেছ আঘাত, ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে।। শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্জিত জীবনের প্রণতি। বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্তসঞ্চার তোমার যে মাটির তলায় তাকে আজ স্পর্শ করি- উপলব্ধি করি সর্বদেহে মনে। অগণিত যুগযুগান্তের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়। আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদু:খের শেষ পরিণাম- রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল-পরিচয়-গ্রাসী নি:শব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।। অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী, গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী, নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবী, অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তাতুমি ভীষণা। একদিকে আপক্বধান্যভারনম্র তোমার শস্যত্রে- সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে; অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী ”আমি আনন্দিত”। অন্যদিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্র পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য। বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুত্চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়- সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ; তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে; হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো। আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে; চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা; বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে।। স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা, অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে; তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছে শত শত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ; বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছে তোমার বর্জিত সৃষ্টি অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে।। জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ তোমার খন্ডকালের ছোট ছোট পিঞ্জরে, তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান।। আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসি নি তোমার সম্মুখে; এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে তার জন্য অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে। তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে যে বিপুল নিমেষগুলি উম্মীলিত নিমীলিতহতে থাকে তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোন-একটি আসনের সত্যমুল্য যদি দিয়ে থাকি, জীবনের কোন-একটি ফলবান্ খন্ডকে যদি জয় করে থাকি পরম দু:খে তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে; সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।। হে উদাসীন পৃথিবী, আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে তোমার নির্মম পদপ্রান্তে আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।। পেঁচোটাকে মাসি তার পেঁচোটাকে মাসি তার যত দেয় আস্করা, মুশকিল ঘটে তত এক সাথে বাস করা। হঠাৎ চিমটি কাটে কপালের চামড়ায়– বলে সে, “এমনি ক’রে ভিমরুল কামড়ায়।’ আমার বিছানা নিয়ে খেলা ওর চাষ-করা– মাথার বালিশ থেকে তুলোগুলো হ্রাস-করা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পেন্‌সিল টেনেছিনু হপ্তায় সাতদিন পেন্‌সিল টেনেছিনু হপ্তায় সাতদিন, রবার ঘষেছি তাহে তিনমাস রাতদিন। কাগজ হয়েছে সাদা; সংশোধনের বাধা ঘুচে গেছে, এইবার শিক্ষক হাত দিন কিন্তু ছবির কোণে স্বাক্ষর বাদ দিন।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) পোড়ো বাড়ি শূন্য দালান পোড়ো বাড়ি শূন্য দালান-- বোবা স্মৃতির চাপা কাঁদন হুহু করে, মরা-দিনের-কবর-দেওয়া ভিতের অন্ধকার গুমরে ওঠে প্রেতের কন্ঠে সারা দুপুরবেলা। মাঠে মাঠে শুকনো পাতার ঘূর্ণিপাকে হাওয়ার হাঁপানি। হঠাৎ হানে বৈশাখী তার বর্বরতা ফাগুনদিনের যাবার পথে।সৃষ্টিপীড়া ধাক্কা লাগায় শিল্পকারের তুলির পিছনে। রেখায় রেখায় ফুটে ওঠে রূপের বেদনা সাথিহারার তপ্ত রাঙা রঙে। কখনো বা ঢিল লেগে যায় তুলির টানে; পাশের গলির চিক-ঢাকা ওই ঝাপসা আকাশতলে হঠাৎ যখন রণিয়ে ওঠে সংকেতঝংকার, আঙুলের ডগার 'পরে নাচিয়ে তোলে মাতালটাকে। গোধূলির সিঁদুর ছায়ায় ঝ'রে পড়ে পাগল আবেগের হাউই-ফাটা আগুনঝুরি।বাধা পায়, বাধা কাটায় চিত্রকরের তুলি। সেই বাধা তার কখনো বা হিংস্র অশ্লীলতায়, কখনো বা মন্দির অসংযমে। মনের মধ্যে ঘোলা স্রোতের জোয়ার ফুলে ওঠে, ভেসে চলে ফেনিয়ে-ওঠা অসংলগ্নতা। রূপের বোঝাই ডিঙি নিয়ে চলল রূপকার রাতের উজান স্রোত পেরিয়ে হঠাৎ-মেলা ঘাটে। ডাইনে বাঁয়ে সুর-বেসুরের দাঁড়ের ঝাপট চলে, তাল দিয়ে যায় ভাসান-খেলা শিল্পসাধনার। প্রকারভেদ বাবলাশাখারে বলে আম্রশাখা, ভাই, উনানে পুড়িয়া তুমি কেন হও ছাই? হায় হায়, সখী, তব ভাগ্য কী কঠোর! বাবলার শাখা বলে, দুঃখ নাহি মোর। বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চূতলতা, নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রকাশিতা আজ তুমি ছোটো বটে, যার সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধা                         যেন তার আধা।                   অধিকারগর্বভরে             সে তোমারে নিয়ে চলে নিজঘরে।          মনে জানে তুমি তার ছায়েবানুগতা-- তমাল সে, তার শাখালগ্ন তুমি মাধবীর লতা।             আজ তুমি রাঙাচেলি দিয়ে মোড়া                                 আগাগোড়া,                 জড়োসড়ো ঘোমটায়-ঢাকা                         ছবি যেন পটে আঁকা।     আসিবে-যে আর-একদিন, নারীর মহিমা নিয়ে হবে তুমি অন্তরে স্বাধীন                  বাহিরে যেমনি থাক্‌।              আজিকে এই-যে বাজে শাঁখ            এরি মধ্যে আছে গূঢ় তব জয়ধ্বনি।      জিনি লবে তোমার সংসার, হে রমণী,                     সেবার গৌরবে।      যে-জন আশ্রয় তব তোমারি আশ্রয় সেই লবে। সংকোচের এই আবরণ দূর ক'রে                 সেদিন কহিবে-- দেখো মোরে!              সে দেখিবে ঊর্ধ্বে মুখ তুলি সৃপ্ত হয়ে পড়ে গেছে ধূসর সে কুণ্ঠিত গোধূলি--                  দিগন্তের 'পরে স্মিতহাসে পূর্ণচন্দ্র একা জাগে বসন্তের বিস্মিত আকাশে।               বুঝিবে সে দেহে মনে। প্রচ্ছন্ন হয়েছে তরু পুষ্পিত লতার আলিঙ্গনে প্রকৃতির খেদ (দ্বিতীয় পাঠ) বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা, সুকুমারী শৈলবালা         অমল সলিলা গঙ্গা অই বহি যায় রে। প্রদীপ্ত তুষাররাশি, শুভ্র বিভা পরকাশি         ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে গোমুখীর শিখরে। ফুটিয়াছে কমলিনী অরুণের কিরণে। নির্ঝরের এক ধারে, দুলিছে তরঙ্গ-ভরে         ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে। হেলিয়া নলিনী-দলে প্রকৃতি কৌতুকে দোলে         গঙ্গার প্রবাহ ধায় ধুইয়া চরণ। ধীরে ধীরে বায়ু আসি দুলায়ে অলকরাশি         কবরী কুসুমগন্ধ করিছে হরণ।বিজনে খুলিয়া প্রাণ, সপ্তমে চড়ায়ে তান,         শোভনা প্রকৃতিদেবী গা'ন ধীরে ধীরে। নলিনী-নয়নদ্বয়, প্রশান্ত বিষাদময়         মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে।-- "অভাগী ভারত হায় জানিতাম যদি -- বিধবা হইবি শেষে, তা হলে কি এত ক্লেশে তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ। তা হলে কি হিমালয়, গর্বে-ভরা হিমালয়, দাঁড়াইয়া তোর পাশে, পৃথিবীরে উপহাসে, তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান। তা হলে কি শতদলে তোর সরোবরজলে হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ, কাননে কুসুমরাশি, বিকাশি মধুর হাসি, প্রদান করিত কি লো অমন সুবাস। তা হলে ভারত তোরে, সৃজিতাম মরু করে         তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ। প্রজ্বলন্ত দিবাকর বর্ষিত জ্বলন্ত কর         মরীচিকা পান্থগণে করিত ছলনা।' থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন গলিল তুষারমালা, তরুণী সরসী-বালা         ফেলিল নীহারবিন্দু নির্ঝরিণীজলে। কাঁপিল পাদপদল,উথলে গঙ্গার জল         তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটায় ভূতলে। ঈষৎ আঁধাররাশি, গোমুখী শিখর গ্রাসি         আটক করিল নব অরুণের কর। মেঘরাশি উপজিয়া, আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া,         ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর। আবার গাইল ধীরে প্রকৃতিসুন্দরী।--         "কাঁদ্‌ কাঁদ্‌ আরো কাঁদ্‌ অভাগী ভারত। হায় দুখনিশা তোর, হল না হল না ভোর,         হাসিবার দিন তোর হল না আগত। লজ্জাহীনা! কেন আর! ফেলে দে-না অলংকার         প্রশান্ত গভীর অই সাগরের তলে। পূতধারা মন্দাকিনী ছাড়িয়া মরতভূমি         আবদ্ধ হউক পুন ব্রহ্ম-কমণ্ডলে। উচ্চশির হিমালয়, প্রলয়ে পাউক লয়,         চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি। কাঁদ্‌ তুই তার পরে, অসহ্য বিষাদভরে         অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি। দেখ্‌ আর্য-সিংহাসনে, স্বাধীন নৃপতিগণে         স্মৃতির আলেখ্যপটে রয়েছে চিত্রিত। দেখ্‌ দেখি তপোবনে, ঋষিরা স্বাধীন মনে,           কেমন ঈশ্বর ধ্যানে রয়েছে ব্যাপৃত। কেমন স্বাধীন মনে, গাইছে বিহঙ্গগণে,         স্বাধীন শোভায় শোভে কুসুম নিকর। সূর্য উঠি প্রাতঃকালে, তাড়ায় আঁধারজালে         কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর। তখন কি মনে পড়ে,ভারতী মানস-সরে         কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত। শুনিয়া ভারত পাখি, গাইত শাখায় থাকি,         আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত। সে-সব স্মরণ করে কাঁদ্‌ লো আবার! আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর্‌,         ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার।         প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ।         ভারত-সাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি, মরুভূমি হয়ে থাক্‌ সমস্ত প্রদেশ।'         বলিতে নারিল আর প্রকৃতিসুন্দরী, ধ্বনিয়া আকাশ ভূমি, গরজিল প্রতিধ্বনি, কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুদ্ধ হিমগিরি। জাহ্নবী উন্মত্তপারা, নির্ঝর চঞ্চল ধারা,         বহিল প্রচণ্ড বেগে ভেদিয়া প্রস্তর। প্রবল তরঙ্গভরে, পদ্ম কাঁপে থরে থরে,         টলিল প্রকৃতি-সতী আসন-উপর। সুচঞ্চল সমীরণে, উড়াইল মেঘগণে,         সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত। আবার প্রকৃতি-সতী আরম্ভিল গীত।--         "দেখিয়াছি তোর আমি সেই বেশ। অজ্ঞাত আছিলি যবে মানব নয়নে।         নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ। বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে।      কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে?         সম্পদ বিপদ সুখ, হরষ বিষাদ দুখ      কিছুই না জানিতিস সে কি পড়ে মনে?      সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ -       যখন মানবগণ, করে নাই নিরীক্ষণ,      তোর সেই সুদুর্গম অরণ্য প্রদেশ।      না বিতরি গন্ধ হায়, মানবের নাসিকায়         বিজনে অরণ্যফুল যাইত শুকায়ে -         তপনকিরণ-তপ্ত, মধ্যাহ্নের বায়ে। সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ।         সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল। না দেখি মনুষ্যমুখ, না জানিয়া দুঃখ সুখ,         না করিয়া অনুভব মান অপমান। অজ্ঞান শিশুর মতো, আনন্দে দিবস যেত, সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান। তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল। সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল। সৌভাগ্যে হানিয়া বাজ, তা হলে তো তোরে আজ অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না। পদাঘাতে উপহাসে, তা হলে তো কারাবাসে         সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা। অরণ্যেতে নিরিবিলি, সে যে তুই ভালো ছিলি,         কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা। দেখি মরীচিকা হায় আনন্দে বিহ্বলপ্রায়         না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না। আর্যরা আইল শেষে, তোর এ বিজন দেশে,         নগরেতে পরিণত হল তোর বন। হরষে প্রফুল্ল মুখে হাসিলি সরলা সুখে,         আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন। ঋষিগণ সমস্বরে অই সামগান করে         চমকি উঠিছে আহা হিমালয় গিরি। ওদিকে ধনুর ধ্বনি, কাঁপায় অরণ্যভূমি         নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি। সরস্বতী নদীকূলে, কবিরা হৃদয় খুলে         গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত। বীণাপাণি কুতূহলে, মানসের শতদলে,         গাহেন সরসী-বারি করি উথলিত। সেই-এক অভিনব, মধুর সৌন্দর্য তব,         আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে। আঁধার সাগরতলে একটি রতন জ্বলে         একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে। সুবিস্তৃত অন্ধকূপে, একটি প্রদীপ-রূপে         জ্বলিতিস তুই আহা, নাহি পড়ে মনে? কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি         হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে? এই অমানিশা তোর, আর কি হবে না ভোর         কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে। অনন্তকালের মতো, সুখসূর্য অস্তগত         ভাগ্য কি অনন্তকাল রবে এই রূপে। তোর ভাগ্যচক্র শেষে থামিল কি হেতা এসে,         বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার। আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর,         ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার। প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল,         ছিন্নভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ। ভারতসাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি         মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।' প্রকৃতির খেদ (প্রথম পাঠ) ১        বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা ,        বিধির মানস-বালা ,   মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে ।        প্রদীপ্ত তুষাররাশি ,        শুভ্র বিভা পরকাশি ,   ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে ।১১ আবার ধরিয়া ধীরে সুমধুর তান । প্রকৃতি বিষাদে দুঃখে আরম্ভিল গান । ‘ কাঁদ্‌! কাঁদ্‌! আরো কাঁদ্‌ অভাগী ভারত        হায়! দুঃখ-নিশা তোর ,        হল না হল না ভোর , হাসিবার দিন তোর হল না আগত ?২৪        অরণ্যেতে নিরিবিলি ,        সে যে তুই ভালো ছিলি , কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা ।        দেখি মরীচিকা হায়!        আনন্দে বিহ্বলপ্রায়!   না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না ।২৭        সেই এক অভিনব        মধুর সৌন্দর্য তব , আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে । আঁধার সাগরতলে        একটি রতন জ্বলে একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে ।        সুবিস্তৃত অন্ধকূপে ,        একটি প্রদীপ-রূপে        জ্বলিতিস তুই আহা ,        নাহি পড়ে মনে ?    কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে ।        সেই অমানিশা তোর ,        আর কি হবে না ভোর কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে ।        অনন্ত কালের মতো ,        সুখসূর্য অস্তগত , ভাগ্য কি অনন্ত কাল রবে এই রূপে ।        তোর ভাগ্যচক্র শেষে ,        থামিল কি হেথা এসে , বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার        আয় রে প্রলয় ঝড় ,        গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার ।        প্রভঞ্জন ভীমবল ,        খুলে দেও বায়ুদল , ছিন্ন ভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ ।        ভারতসাগর রুষি ,        উগরো বালুকারাশি মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ । প্রচ্ছন্ন পশু সংগ্রামমদিরাপানে আপনা-বিস্মৃত দিকে দিকে হত্যা যারা প্রসারিত করে মরণলোকের তারা যন্ত্রমাত্র শুধু, তারা তো দয়ার পাত্র মনুষ্যত্বহারা! সজ্ঞানে নিষ্ঠুর যারা উন্মত্ত হিংসায় মানবের মর্মতন্তু ছিন্ন ছিন্ন করে তারাও মানুষ বলে গণ্য হয়ে আছে! কোনো নাম নাহি জানি বহন যা করে ঘৃণা ও আতঙ্কে মেশা প্রবল ধিক্কার-- হায় রে নির্লজ্জ ভাষা! হায় রে মানুষ! ইতিহাসবিধাতারে ডেকে ডেকে বলি-- প্রচ্ছন্ন পশুর শান্তি আর কত দূরে নির্বাপিত চিতাগ্নিতে স্তব্ধ ভগ্নস্তূপে! প্রজাপতি সকালে উঠেই দেখি         প্রজাপতি একি    আমার লেখার ঘরে,                  শেলফের 'পরে         মেলেছে নিস্পন্দ দুটি ডানা--    রেশমি সবুজ রঙ, তার 'পরে সাদা রেখা টানা।    সন্ধ্যাবেলা বাতির আলোয় অকস্মাৎ                  ঘরে ঢুকে সারারাত         কী ভেবেছে কে জানে তা--                  কোনোখানে হেথা         অরণ্যের বর্ণ গন্ধ নাই,                   গৃহসজ্জা ওর কাছে সমস্ত বৃথাই।         বিচিত্র বোধের এ ভুবন,                  লক্ষকোটি মন    একই বিশ্ব লক্ষকোটি ক'রে জানে              রূপে রসে নানা অনুমানে।       লক্ষকোটি কেন্দ্র তারা জগতের,         সংখ্যাহীন স্বতন্ত্র পথের              জীবনযাত্রার যাত্রী,                  দিনরাত্রি         নিজের স্বাতন্ত্র৻রক্ষা-কাজে              একান্ত রয়েছে বিশ্ব-মাঝে।    প্রজাপতি বসে আছে যে কাব্যপুঁথির 'পরে                  স্পর্শ তারে করে,                       চক্ষে দেখে তারে,         তার বেশি সত্য যাহা তাহা একেবারে                  তার কাছে সত্য নয়--                       অন্ধকারময়।         ও জানে কাহারে বলে মধু, তবু    মধুর কী সে-রহস্য জানে না ও কভু।         পুষ্পপাত্রে নিয়মিত আছে ওর ভোজ--                  প্রতিদিন করে তার খোঁজ                       কেবল লোভের টানে,                            কিন্তু নাহি জানে       লোভের অতীত যাহা। সুন্দর যা, অনির্বচনীয়,                  যাহা প্রিয়,         সেই বোধ সীমাহীন দূরে আছে                  তার কাছে।         আমি যেথা আছি     মন যে আপন টানে তাহা হতে সত্য লয় বাছি।                  যাহা নিতে নাহি পারে      তাই শূন্যময় হয়ে নিত্য ব্যাপ্ত তার চারি ধারে।                  কী আছে বা নাই কী এ,           সে শুধু তাহার জানা নিয়ে। জানে না যা, যার কাছে স্পষ্ট তাহা, হয়তো-বা কাছে         এখনি সে এখানেই আছে    আমার চৈতন্যসীমা অতিক্রম করি' বহুদূরে         রূপের অন্তরদেশে অপরূপপুরে।                  সে আলোকে তার ঘর         যে আলো আমার অগোচর। প্রতাপের তাপ ভিজা কাঠ অশ্রুজলে ভাবে রাত্রিদিবা, জ্বলন্ত কাঠের আহা দীপ্তি তেজ কিবা। অন্ধকার কোণে পড়ে মরে ঈর্ষারোগে— বলে, আমি হেন জ্যোতি পাব কী সুযোগে। জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, কাঁচা কাঠ ওগো, চেষ্টাহীন বাসনায় বৃথা তুমি ভোগো। আমরা পেয়েছি যাহা মরিয়া পুড়িয়া, তোমারি হাতে কি তাহা আসিবে উড়িয়া? ভিজা কাঠ বলে, বাবা, কে মরে আগুনে! জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, তবে খাক ঘুণে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রতিধ্বনি অয়ি প্রতিধ্বনি,      বুঝি আমি তোরে ভালোবাসি,      বুঝি আর কারেও বাসি না। আমারে করিলি তুই আকুল ব্যাকুল,      তোর লাগি কাঁদে মোর বীণা। তোর মুখে পাখিদের শুনিয়া সংগীত,      নির্ঝরের শুনিয়া ঝর্ঝর, গভীর রহস্যময় অরণ্যের গান,      বালকের মধুমাখা স্বর, তোর মুখে জগতের সংগীত শুনিয়া,      তোরে আমি ভালোবাসিয়াছি; তবু কেন তোরে আমি দেখিতে না পাই,      বিশ্বময় তোরে খুঁজিয়াছি। চিরকাল---চিরকাল----       তুই কি রে চিরকাল           সেই দূরে রবি, আধো সুরে গাবি শুধু গীতের আভাস,           তুই চিরকবি। দেখা তুই দিবি না কি? নাহয় না দিলি      একটি কি পুরাবি না আশ? কাছে হতে একবার শুনিবারে চাই      তোর গীতোচ্ছ্বাস। অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের গান,      ঝটিকার বজ্রগীতস্বর, দিবসের প্রদোষের রজনীর গীত,     চেতনার নিদ্রার মর্মর, বসন্তের বরষার শরতের গান,     জীবনের মরণের স্বর, আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে     ব্যাপ্ত করি বিশ্বচরাচর, পৃথিবীর চন্দ্রমার গ্রহ-তপনের,    কোটি কোটি তারার সংগীত, তোর কাছে জগতের কোন্‌ মাঝখানে     না জানি রে হতেছে মিলিত। সেইখানে একবার বসাইবি মোরে      সেই মহা-আঁধার নিশায়, শুনিব রে আঁখি মুদি বিশ্বের সংগীত      তোর মুখে কেমন শুনায়।জোছনায় ফুলবনে একাকী বসিয়া থাকি,       আঁখি দিয়া অশ্রুবারি ঝরে-- বল্‌ মোরে বল্‌ অয়ি মোহিনী ছলনা,       সে কি তোরি তরে? বিরামের গান গেয়ে সায়াহ্নের বায়        কোথা বহে যায়-- তারি সাথে কেন মোর প্রাণ হু হু করে,        সে কি তোরি তরে? বাতাসে সৌরভ ভাসে, আঁধারে কত-না তারা,        আকাশে অসীম নীরবতা-- তখন প্রাণের মাঝে কত কথা ভেসে যায়,       সে কি তোরি কথা? ফুলের সৌরভগুলি আকাশে খেলাতে এসে       বাতাসেতে হয় পথহারা,       চারিদিকে ঘুরে হয় সারা,       মার কোলে ফিরে যেতে চায়,       ফুলে ফুলে খুঁজিয়া বেড়ায়, তেমনি প্রাণের মাঝে অশরীরী আশাগুলি       ভ্রমে কেন হেথায় হোথায়--       সেকি কি তোরে চায়? আঁখি যেন কার তরে পথ-পানে চেয়ে আছে         দিন গনি গনি, মাঝে মাঝে কারো মুখে সহসা দেখে সে যেন        অতুল রূপের প্রতিধ্বনি,         কাছে গেলে মিলাইয়া যায়         নিরাশের হাসিটির প্রায়-- সৌন্দর্যে মরীচিকা এ কাহার মায়া,        এ কি তোরি ছায়া!জগতের গানগুলি দূর-দূরান্তর হতে       দলে দলে তোর কাছে যায়, যেন তারা বহ্নি হেরি পতঙ্গের মতো       পদতলে মরিবারে চায়! জগতের মৃত গানগুলি       তোর কাছে পেয়ে নব প্রাণ, সংগীতের পরলোক হতে       গান যেন দেহমুক্ত গান। তাই তার নব কণ্ঠধ্বনি       প্রভাতের স্বপনের প্রায়, কুসুমের সৌরভের সাথে       এমন সহজে মিশে যায়।আমি ভাবিতেছি বসে গানগুলি তোরে       না জানি কেমনে খুঁজে পায়--       না জানি কোথায় খুঁজে পায়।       না জানি কী গুহার মাঝারে       অস্ফুট মেঘের উপবনে,       স্মৃতি ও আশায় বিজড়িত       আলোক-ছায়ার সিংহাসনে, ছায়াময়ী মূর্তিখানি আপনে আপনি মিশি       আপনি বিস্মিত আপনায়,       কার পানে শূন্যপানে চায়! সায়াহ্নে প্রশান্ত রবি স্বর্ণময় মেঘমাঝে          পশ্চিমের সমুদ্রসীমায় প্রভাতের জন্মভূমি শৈশব পুরব-পানে          যেমন আকুল নেত্রে চায়, পুরবের শূন্যপটে প্রভাতের স্মৃতিগুলি          এখনো দেখিতে যেন পায়, তেমনি সে ছায়াময়ী কোথা যেন চেয়ে আছে         কোথা হতে আসিতেছে গান-- এলানো কুন্তলজালে সন্ধ্যার তারকাগুলি   গান শুনে মুদিছে নয়ান।          বিচিত্র সৌন্দর্য জগতের          হেথা আসি হইতেছে লয়। সংগীত, সৌরভ, শোভা জগতে যা-কিছু আছে          সবি হেথা প্রতিধ্বনিময় ।          প্রতিধ্বনি, তব নিকেতন,         তোমার সে সৌন্দর্য অতুল,          প্রাণে জাগে ছায়ার মতন--          ভাষা হয় আকুল ব্যাকুল। আমরণ চিরদিন কেবলি খুঁজিব তোরে          কখনো কি পাব না সন্ধান? কেবলি কি রবি দূরে, অতি দূর হতে         শুনিব রে ওই আধো গান? এই বিশ্বজগতের মাঝখানে দাঁড়াইয়া          বাজাইবি সৌন্দর্যের বাঁশি, অনন্ত জীবনপথে খুঁজিয়া চলিব তোরে,          প্রাণমন হইবে উদাসী। তপনেরে ঘিরি ঘিরি যেমন ঘুরিছে ধরা,          ঘুরিব কি তোর চারি দিকে? অনন্ত প্রাণের পথে বরষিবি গীতধারা,          চেয়ে আমি রব অনিমিখে। তোরি মোহময় গান শুনিতেছি অবিরত,          তোরি রূপ কল্পনায় লিখা-- করিস নে প্রবঞ্চনা সত্য করে বল্‌ দেখি          তুই তো নহিস মরীচিকা? কত বার আর্ত স্বরে শুধায়েছি প্রাণপণে,         অয়ি তুমি কোথায়--কোথায়-- অমনি সুদূর হতে কেন তুমি বলিয়াছ         ‘কে জানে কোথায়’? আশাময়ী, ও কী কথা তুমি কি আপনহারা--          আপনি জান না আপনায়? প্রতিনিধি অ্যাক্‌ওয়ার্থ্‌ সাহেব কয়েকটি মারাঠি গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা "ভগোয়া ঝেণ্ডা' নামে খ্যাত।বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে           শিবাজি হেরিলা এক দিন-- রামদাস গুরু তাঁর ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার           ফিরিছেন যেন অন্নহীন। ভাবিলা, এ কী এ কাণ্ড! গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড--           ঘরে যাঁর নাই দৈন্যলেশ! সব যাঁর হস্তগত, রাজ্যেশ্বর পদানত,           তাঁরো নাই বাসনার শেষ! এ কেবল দিনে রাত্রে জল ঢেলে ফুটা পাত্রে           বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে। কহিলা, "দেখিতে হবে কতখানি দিলে তবে           ভিক্ষাঝুলি ভরে একেবারে।' তখনি লেখনী আনি কী লিখি দিলা কী জানি,           বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে, "গুরু যবে ভিক্ষা-আশে আসিবেন দুর্গ-পাশে           এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে।'গুরু চলেছেন গেয়ে, সম্মুখে চলেছে ধেয়ে           কত পান্থ কত অশ্বরথ!-- "হে ভবেশ, হে শংকর, সবারে দিয়েছ ঘর,           আমারে দিয়েছ শুধু পথ। অন্নপূর্ণা মা আমার লয়েছে বিশ্বের ভার,           সুখে আছে সর্ব চরাচর-- মোরে তুমি, হে ভিখারি, মার কাছ হতে কাড়ি           করেছ আপন অনুচর।'সমাপন করি গান সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান           দুর্গদ্বারে আসিয়া যখন-- বালাজি নমিয়া তাঁরে দাঁড়াইল এক ধারে           পদমূলে রাখিয়া লিখন। গুরু কৌতূহলভরে তুলিয়া লইলা করে,           পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি-- বন্দি তাঁর পাদপদ্ম শিবাজি সঁপিছে অদ্য           তাঁরে নিজরাজ্য-রাজধানী।পরদিনে রামদাস গেলেন রাজার পাশ,           কহিলেন, "পুত্র, কহো শুনি, রাজ্য যদি মোরে দেবে কী কাজে লাগিবে এবে--           কোন্‌ গুণ আছে তব গুণী?' "তোমারি দাসত্বে প্রাণ আনন্দে করিব দান'           শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে। গুরু কহে, "এই ঝুলি লহ তবে স্কন্ধে তুলি,           চলো আজি ভিক্ষা করিবারে।'শিবাজি গুরুর সাথে ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে           ফিরিলে পুরদ্বারে-দ্বারে। নৃপে হেরি ছেলেমেয়ে ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে,           ডেকে আনে পিতারে মাতারে। অতুল ঐশ্বর্যে রত, তাঁর ভিখারির ব্রত!           এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা! ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে, হস্ত কাঁপে থরেথরে,           ভাবে ইহা মহতের লীলা। দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে, ক্ষান্ত দিয়া কর্মকাজে           বিশ্রাম করিছে পুরবাসী। একতারে দিয়ে তান রামদাস গাহে গান           আনন্দে নয়নজলে ভাসি, "ওহে ত্রিভুবনপতি, বুঝি না তোমার মতি,           কিছুই অভাব তব নাহি-- হৃদয়ে হৃদয়ে তবু ভিক্ষা মাগি ফির, প্রভু,           সবার সর্বস্বধন চাহি।'অবশেষে দিবসান্তে নগরের এক প্রান্তে           নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি-- ভিক্ষা-অন্ন রাঁধি সুখে গুরু কিছু দিলা মুখে,           প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি। রাজা তবে কহে হাসি, "নৃপতির গর্ব নাশি           করিয়াছ পথের ভিক্ষুক-- প্রস্তুত রয়েছে দাস, আরো কিবা অভিলাষ--           গুরু-কাছে লব গুরু দুখ।'গুরু কহে, "তবে শোন্‌,করিলি কঠিন পণ,           অনুরূপ নিতে হবে ভার-- এই আমি দিনু কয়ে মোর নামে মোর হয়ে           রাজ্য তুমি লহ পুনর্বার। তোমারে করিল বিধি ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,           রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন। পালিবে যে রাজধর্ম জেনো তাহা মোর কর্ম,           রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন।'"বৎস, তবে এই লহো মোর আশীর্বাদসহ           আমার গেরুয়া গাত্রবাস-- বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া নিয়ো'           কহিলেন গুরু রামদাস। নৃপশিষ্য নতশিরে বসি রহে নদীতীরে,           চিন্তারাশি ঘনায়ে ললাটে। থামিল রাখালবেণু, গোঠে ফিরে গেল ধেনু,           পরপারে সূর্য গেল পাটে।পূরবীতে ধরি তান একমনে রচি গান           গাহিতে লাগিলা রামদাস, "আমারে রাজার সাজে বসায়ে সংসারমাঝে           কে তুমি আড়ালে কর বাস! হে রাজা, রেখেছি আনি তোমারি পাদুকাখানি,           আমি থাকি পাদপীঠতলে-- সন্ধ্যা হয়ে এল ওই, আর কত বসে রই!           তব রাজ্যে তুমি এসো চলে।' প্রত্যক্ষ প্রমাণ বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে, মাথায় পড়িলে তবে বলে—বজ্র বটে!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার করস্পর্শ দিয়ে। এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ। বাক্যহীন প্রাণীলোক-মাঝে এই জীব শুধু ভালো মন্দ সব ভেদ করি দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে; দেখেছে আনন্দে যারে প্রাণ দেওয়া যায় যারে ঢেলে দেওয়া যায় অহেতুক প্রেম, অসীম চৈতন্যলোকে পথ দেখাইয়া দেয় যাহার চেতনা। দেখি যবে মূক হৃদয়ের প্রাণপণ আত্মনিবেদন আপনার দীনতা জানায়ে, ভাবিয়া না পাই ও যে কী মূল্য করেছে আবিষ্কার আপন সহজ বোধে মানবস্বরূপে; ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না, আমারে বুঝায়ে দেয়– সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) প্রত্যাশা সকলে আমার কাছে যত কিছু চায় সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে ! আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায় , রেখেছি কত – না ঋণ এই পৃথিবীতে । আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ , সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে ! এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ , অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে ! হা ঈশ্বর , আমি কিছু চাহি নাকো আর , ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা । মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার ‘ পাইনি’ ‘পাইনি’ বলে আর কাঁদিব না । তোমারেও মাগিব না , অলস কাঁদনি — আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) প্রথম আলোর আভাস লাগিল গগনে প্রথম আলোর আভাস লাগিল গগনে; তৃণে তৃণে উষা সাজালো শিশিরকণা৷ যারে নিবেদিল তাহারি পিপাসি কিরণে নিঃশেষ হল রবি-অভ্যর্থনা।   (স্ফুলিঙ্গ) প্রথম চুম্বন স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি— বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি। শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে। নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায় নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়। সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন। দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি, আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি। প্রথম দিনের সূর্য প্রথম দিনের সূর্য   প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে_   কে তুমি?        মেলে নি উত্তর।বৎসর বৎসর চলে গেল।    দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল    পশ্চিমসাগরতীরে        নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়_           কে তুমি?               পেল না উত্তর।।  (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) প্রথম পূজা ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির। লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বকর্মা তার ভিত-পত্তন করেছিলেন                      কোন্ মান্ধাতার আমলে,     স্বয়ং হনুমান এনেছিলেন তার পাথর বহন করে। ইতিহাসের পণ্ডিত বলেন, এ মন্দির কিরাত জাতের গড়া,                     এ দেবতা কিরাতের।            একদা যখন ক্ষত্রিয় রাজা জয় করলেন দেশ দেউলের আঙিনা পূজারিদের রক্তে গেল ভেসে,     দেবতা রক্ষা পেলেন নতুন নামে নতুন পূজাবিধির আড়ালে— হাজার বৎসরের প্রাচীন ভক্তিধারার স্রোত গেল ফিরে।     কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তার প্রবেশপথ লুপ্ত।   কিরাত থাকে সমাজের বাইরে,            নদীর পূর্বপারে তার পাড়া।         সে ভক্ত, আজ তার মন্দির নেই, তার গান আছে।                নিপুণ তার হাত, অভ্রান্ত তার দৃষ্টি।            সে জানে কী করে পাথরের উপর পাথর বাঁধে,         কী করে পিতলের উপর রুপোর ফুল তোলা যায় —     কৃষ্ণশিলায় মূর্তি গড়বার ছন্দটা কী। রাজশাসন তার নয়, অস্ত্র তার নিয়েছে কেড়ে ,         বেশে বাসে ব্যবহারে সম্মানের চিহ্ন হতে সে বর্জিত,                বঞ্চিত সে পুঁথির বিদ্যায়।         ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের স্বর্ণচূড়া পশ্চিম দিগন্তে যায় দেখা,                চিনতে পারে নিজেদেরই মনের আকল্প,                        বহু দূরের থেকে প্রণাম করে।   কার্তিক পূর্ণিমা, পূজার উৎসব।     মঞ্চের উপরে বাজছে বাঁশি মৃদঙ্গ করতাল,            মাঠ জুড়ে কানাতের পর কানাত,                        মাঝে মাঝে উঠেছে ধ্বজা।     পথের দুই ধারে ব্যাপারীদের পসরা —তামার পাত্র, রুপোর অলংকার, দেবমূর্তির পট, রেশমের কাপড়; ছেলেদের খেলার জন্যে কাঠের ডমরু, মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি; অর্ঘ্যের উপকরণ, ফল মালা ধূপ বাতি, ঘড়া ঘড়া তীর্থবারি।     বাজিকর তারস্বরে প্রলাপবাক্যে দেখাচ্ছে বাজি,                        কথক পড়ছে রামায়ণকথা।     উজ্জ্বলবেশে সশস্ত্র প্রহরী ঘুরে বেড়ায় ঘোড়ায় চড়ে;         রাজ-অমাত্য হাতির উপর হাওদায়,                        সম্মুখে বেজে চলেছে শিঙা।     কিংখাবে ঢাকা পাল্কিতে ধনীঘরের গৃহিণী,                    আগে পিছে কিংকরের দল।            সন্ন্যাসীর ভিড় পঞ্চবটের তলায় —                        নগ্ন, জটাধারী, ছাইমাখা;                মেয়েরা পায়ের কাছে ভোগ রেখে যায় —                        ফল, দুধ, মিষ্টান্ন, ঘি, আতপতণ্ডুল।   থেকে থেকে আকাশে উঠছে চীৎকারধ্বনি                         ‘জয় ত্রিলোকেশ্বরের জয়'।         কাল আসবে শুভলগ্নে রাজার প্রথম পূজা, স্বয়ং আসবেন মহারাজা রাজহস্তীতে চড়ে।                    তাঁর আগমন-পথের দুই ধারে            সারি সারি কলার গাছে ফুলের মালা,                    মঙ্গলঘটে আম্রপল্লব।         আর ক্ষণে ক্ষণে পথের ধুলায় সেচন করছে গন্ধবারি।                শুক্লত্রয়োদশীর রাত।         মন্দিরে প্রথম প্রহরের শঙ্খ ঘণ্টা ভেরী পটহ থেমেছে।     আজ চাঁদের উপরে একটা ঘোলা আবরণ,                জ্যোৎস্না আজ ঝাপসা —                    যেন মূর্ছার ঘোর লাগল।          বাতাস রুদ্ধ —                ধোঁয়া জমে আছে আকাশে,            গাছপালাগুলো যেন শঙ্কায় আড়ষ্ট। কুকুর অকারণে আর্তনাদ করছে, ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে উঠছে ডেকে                    কোন্ অলক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে।         হঠাৎ গম্ভীর ভীষণ শব্দ শোনা গেল মাটির নীচে —            পাতালে দানবেরা যেন রণদামামা বাজিয়ে দিলে —                    গুরু-গুরু গুরু-গুরু।            মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টা বাজতে লাগল প্রবল শব্দে।                    হাতি বাঁধা ছিল,              তারা বন্ধন ছিঁড়ে গর্জন করতে করতে                         ছুটল চার দিকে                            যেন ঘূর্ণি-ঝড়ের মেঘ।                        তুফান উঠল মাটিতে —            ছুটল উট মহিষ গোরু ছাগল ভেড়া         ঊর্ধ্বশ্বাসে পালে পালে। হাজার হাজার দিশাহারা লোক         আর্তস্বরে ছুটে বেড়ায় —                 চোখে তাদের ধাঁধা লাগে, আত্মপরের ভেদ হারিয়ে কে কাকে দেয় দ'লে।         মাটি ফেটে ফেটে ওঠে ধোঁয়া, ওঠে গরম জল — ভীম-সরোবরের দিঘি বালির নীচে গেল শুষে।            মন্দিরের চূড়ায় বাঁধা বড়ো ঘণ্টা দুলতে দুলতে                    বাজতে লাগল ঢং ঢং।                আচম্কা ধ্বনি থামল একটা ভেঙে-পড়ার শব্দে। পৃথিবী যখন স্তব্ধ হল         পূর্ণপ্রায় চাঁদ তখন হেলেছে পশ্চিমের দিকে। আকাশে উঠছে জ্বলে-ওঠা কানাতগুলোর ধোঁয়ার কুণ্ডলী,         জ্যোৎস্নাকে যেন অজগর সাপে জড়িয়েছে।     পরদিন আত্মীয়দের বিলাপে দিগ্বিদিক যখন শোকার্ত তখন রাজসৈনিকদল মন্দির ঘিরে দাঁড়ালো,                    পাছে অশুচিতার কারণ ঘটে।     রাজমন্ত্রী এল, দৈবজ্ঞ এল, স্মার্ত পণ্ডিত এল।দেখলে বাহিরের প্রাচীর ধূলিসাৎ।         দেবতার বেদীর উপরের ছাদ পড়েছে ভেঙে। পণ্ডিত বললে, সংস্কার করা চাই আগামী পূর্ণিমার পূর্বেই,                নইলে দেবতা পরিহার করবেন তাঁর মূর্তিকে। রাজা বললেন, ‘সংস্কার করো। '         মন্ত্রী বললেন, ‘ওই কিরাতরা ছাড়া কে করবে পাথরের কাজ। ওদের দৃষ্টিকলুষ থেকে দেবতাকে রক্ষা করব কী উপায়ে,         কী হবে মন্দিরসংস্কারে যদি মলিন হয় দেবতার অঙ্গমহিমা। '            কিরাতদলপতি মাধবকে রাজা আনলেন ডেকে।         বৃদ্ধ মাধব, শুক্লকেশের উপর নির্মল সাদা চাদর জড়ানো — পরিধানে পীতধড়া, তাম্রবর্ণ দেহ কটি পর্যন্ত অনাবৃত,                    দুই চক্ষু সকরুণ নম্রতায় পূর্ণ।         সাবধানে রাজার পায়ের কাছে রাখলে একমুঠো কুন্দফুল,                    প্রণাম করলে স্পর্শ বাঁচিয়ে। রাজা বললেন, ‘তোমরা না হলে দেবালয়-সংস্কার হয় না। '            ‘ আমাদের ‘পরে দেবতার ওই কৃপা'     এই ব'লে দেবতার উদ্দেশে মাধব প্রণাম জানালে।            নৃপতি নৃসিংহরায় বললেন, ‘চোখ বেঁধে কাজ করা চাই,     দেবমূর্তির উপর দৃষ্টি না পড়ে। পারবে?' মাধব বললে, ‘অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন অন্তর্যামী।         যতক্ষণ কাজ চলবে, চোখ খুলব না। '     বাহিরে কাজ করে কিরাতের দল,         মন্দিরের ভিতরে কাজ করে মাধব,            তার দুই চক্ষু পাকে পাকে কালো কাপড়ে বাঁধা। দিনরাত সে মন্দিরের বাহিরে যায় না —         ধ্যান করে, গান গায়, আর তার আঙুল চলতে থাকে। মন্ত্রী এসে বলে, ‘ত্বরা করো, ত্বরা করো —          তিথির পরে তিথি যায়, কবে লগ্ন হবে উত্তীর্ণ।’ মাধব জোড়হাতে বলে, যাঁর কাজ তাঁরই নিজের আছে ত্বরা,               আমি তো উপলক্ষ।’ অমাবস্যা পার হয়ে শুক্লপক্ষ এল আবার। অন্ধমাধব আঙুলের স্পর্শ দিয়ে পাথরের সঙ্গে কথা কয়,            পাথর তার সাড়া দিতে থাকে।         কাছে দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরী।            পাছে মাধব চোখের বাঁধন খোলে। পণ্ডিত এসে বললে, ‘একাদশীর রাত্রে প্রথম পূজার শুভক্ষণ।         কাজ কি শেষ হবে তার পূর্বে। ' মাধব প্রণাম করে বললে, ‘আমি কে যে উত্তর দেব।     কৃপা যখন হবে সংবাদ পাঠাব যথাসময়ে,         তার আগে এলে ব্যাঘাত হবে, বিলম্ব ঘটবে। ' ষষ্ঠী গেল, সপ্তমী পেরোল —         মন্দিরের দ্বার দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে                     মাধবের শুক্লকেশে।     সূর্য অস্ত গেল। পাণ্ডুর আকাশে একাদশীর চাঁদ। মাধব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে,            ‘যাও প্রহরী, সংবাদ দিয়ে এসো গে                মাধবের কাজ শেষ হল আজ।                    লগ্ন যেন বয়ে না যায়। '         প্রহরী গেল। মাধব খুলে ফেললে চোখের বন্ধন।         মুক্ত দ্বার দিয়ে পড়েছে একাদশী-চাঁদের পূর্ণ আলো                    দেবমূর্তির উপরে।         মাধব হাঁটু গেড়ে বসল দুই হাত জোড় করে,                একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে,                        দুই চোখে বইল জলের ধারা। আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা দেবতার সঙ্গে ভক্তের।   রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে।     তখন মাধবের মাথা নত বেদীমূলে।         রাজার তলোয়ারে মুহূর্তে ছিন্ন হল সেই মাথা।            দেবতার পায়ে এই প্রথম পূজা, এই শেষ প্রণাম।কাব্যগ্রন্থ - পুনশ্চ প্রথম সর্গ শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া। তোমার বীণার ধ্বনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে শুনিত, দেখিত কত সুখের স্বপন। একাকী আপন মনে সরল শিশুটি তোমারি কমল-বনে করিত গো খেলা, মনের কত কি গান গাহিত হরষে, বনের কত কি ফুলে গাঁথিত মালিকা। একাকী আপন মনে কাননে কাননে যেখানে সেখানে শিশু করিত ভ্রমণ; একাকী আপন মনে হাসিত কাঁদিত। জননীর কোল হতে পালাত ছুটিয়া, প্রকৃতির কোলে গিয়া করিত সে খেলা-- ধরিত সে প্রজাপতি, তুলিত সে ফুল, বসিত সে তরুতলে, শিশিরের ধারা ধীরে ধীরে দেহে তার পড়িত ঝরিয়া। বিজন কুলায়ে বসি গাহিত বিহঙ্গ, হেথা হোথা উঁকি মারি দেখিত বালক কোথায় গাইছে পাখী। ফুলদলগুলি, কামিনীর গাছ হোতে পড়িলে ঝরিয়া ছড়ায়ে ছড়ায়ে তাহা করিত কি খেলা! প্রফুল্ল উষার ভূষা অরুণকিরণে বিমল সরসী যবে হোত তারাময়ী, ধরিতে কিরণগুলি হইত অধীর। যখনি গো নিশীথের শিশিরাশ্রু-জলে ফেলিতেন উষাদেবী সুরভি নিশ্বাস, গাছপালা লতিকার পাতা নড়াইয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিয়া ঘুমন্ত নদীর যখনি গাহিত বায়ু বন্য-গান তার, তখনি বালক-কবি ছুটিত প্রান্তরে, দেখিত ধান্যের শিষ দুলিছে পবনে। দেখিত একাকী বসি গাছের তলায়, স্বর্ণময় জলদের সোপানে সোপানে উঠিছেন উষাদেবী হাসিয়া হাসিয়া। নিশা তারে ঝিল্লীরবে পাড়াইত ঘুম, পূর্ণিমার চাঁদ তার মুখের উপরে তরল জোছনা-ধারা দিতেন ঢালিয়া, স্নেহময়ী মাতা যথা সুপ্ত শিশুটির মুখপানে চেয়ে চেয়ে করেন চুম্বন। প্রভাতের সমীরণে, বিহঙ্গের গানে উষা তার সুখনিদ্রা দিতেন ভাঙ্গায়ে। এইরূপে কি একটি সঙ্গীতের মত, তপনের স্বর্ণময়-কিরণে প্লাবিত প্রভাতের একখানি মেঘের মতন, নন্দন বনের কোন অপ্সরা-বালার সুখময় ঘুমঘোরে স্বপনের মত কবির বালক-কাল হইল বিগত।                  -- যৌবনে যখনি কবি করিল প্রবেশ, প্রকৃতির গীতধ্বনি পাইল শুনিতে, বুঝিল সে প্রকৃতির নীরব কবিতা। প্রকৃতি আছিল তার সঙ্গিনীর মত। নিজের মনের কথা যত কিছু ছিল কহিত প্রকৃতিদেবী তার কানে কানে, প্রভাতের সমীরণ যথা চুপিচুপি কহে কুসুমের কানে মরমবারতা। নদীর মনের গান বালক যেমন বুঝিত, এমন আর কেহ বুঝিত না। বিহঙ্গ তাহার কাছে গাইত যেমন, এমন কাহারো কাছে গাইত না আর। তার কাছে সমীরণ যেমন বহিত এমন কাহারো কাছে বহিত না আর। যখনি রজনীমুখ উজলিত শশী, সুপ্ত বালিকার মত যখন বসুধা সুখের স্বপন দেখি হাসিত নীরবে, বসিয়া তটিনীতীরে দেখিত সে কবি-- স্নান করি জোছনায় উপরে হাসিছে সুনীল আকাশ, হাসে নিম্নে স্রোতস্বিনী; সহসা সমীরণের পাইয়া পরশ দুয়েকটি ঢেউ কভু জাগিয়া উঠিছে। ভাবিত নদীর পানে চাহিয়া চাহিয়া, নিশাই কবিতা আর দিবাই বিজ্ঞান। দিবসের আলোকে সকলি অনাবৃত, সকলি রয়েছে খোলা চখের সমুখে-- ফুলের প্রত্যেক কাঁটা পাইবে দেখিতে। দিবালোকে চাও যদি বনভূমি-পানে, কাঁটা খোঁচা কর্দ্দমাক্ত বীভৎস জঙ্গল তোমার চখের 'পরে হবে প্রকাশিত; দিবালোকে মনে হয় সমস্ত জগৎ নিয়মের যন্ত্রচক্রে ঘুরিছে ঘর্ঘরি। কিন্তু কবি নিশাদেবী কি মোহন-মন্ত্র পড়ি দেয় সমুদয় জগতের 'পরে, সকলি দেখায় যেন স্বপ্নের মতন; ঐ স্তব্ধ নদীজলে চন্দ্রের আলোকে পিছলিয়া চলিতেছে যেমন তরণী, তেমনি সুনীল ঐ আকাশসলিলে ভাসিয়া চলেছে যেন সমস্ত জগৎ; সমস্ত ধরারে যেন দেখিয়া নিদ্রিত, একাকী গম্ভীর-কবি নিশাদেবী ধীরে তারকার ফুলমালা জড়ায়ে মাথায়, জগতের গ্রন্থ কত লিখিছে কবিতা। এইরূপে সেই কবি ভাবিত কত কি। হৃদয় হইল তার সমুদ্রের মত, সে সমুদ্রে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারকার প্রতিবিম্ব দিবানিশি পড়িত খেলিত, সে সমুদ্র প্রণয়ের জোছনা-পরশে লঙ্ঘিয়া তীরের সীমা উঠিত উথলি, সে সমুদ্র আছিল গো এমন বিস্তৃত সমস্ত পৃথিবীদেবী, পারিত বেষ্টিতে নিজ স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে। সে সিন্ধু-হৃদয়ে দুরন্ত শিশুর মত মুক্ত সমীরণ হু হু করি দিবানিশি বেড়াত খেলিয়া। নির্ঝরিণী, সিন্ধুবেলা, পর্ব্বতগহ্বর, সকলি কবির ছিল সাধের বসতি। তার প্রতি তুমি এত ছিলে অনুকূল কল্পনা! সকল ঠাঁই পাইত শুনিতে তোমার বীণার ধ্বনি, কখনো শুনিত প্রস্ফুটিত গোলাপের হৃদয়ে বসিয়া বীণা লয়ে বাজাইছ অস্ফুট কি গান। কনককিরণময় উষার জলদে একাকী পাখীর সাথে গাইতে কি গীত তাই শুনি যেন তার ভাঙ্গিত গো ঘুম! অনন্ত-তারা-খচিত নিশীথগগনে বসিয়া গাইতে তুমি কি গম্ভীর গান, তাহাই শুনিয়া যেন বিহ্বলহৃদয়ে নীরবে নিশীথে যবে একাকী রাখাল সুদূর কুটীরতলে বাজাইত বাঁশী তুমিও তাহার সাথে মিলাইতে ধ্বনি, সে ধ্বনি পশিত তার প্রাণের ভিতর। নিশার আঁধার-কোলে জগৎ যখন দিবসের পরিশ্রমে পড়িত ঘুমায়ে তখন সে কবি উঠি তুষারমন্ডিত সমুচ্চ পর্ব্বতশিরে গাইত একাকী প্রকৃতিবন্দনাগান মেঘের মাঝারে। সে গম্ভীর গান তার কেহ শুনিত না, কেবল আকাশব্যাপী স্তব্ধ তারকারা এক দৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া। কেবল, পর্ব্বতশৃঙ্গ করিয়া আঁধার, সরল পাদপরাজি নিস্তব্ধ গম্ভীর ধীরে ধীরে শুনিত গো তাহার সে গান; কেবল সুদূর বনে দিগন্তবালায় হৃদয়ে সে গান পশি প্রতিধ্বনিরূপে মৃদুতর হোয়ে পুন আসিত ফিরিয়া। কেবল সুদূর শৃঙ্গে নির্ঝরিণী বালা সে গম্ভীর গীতি-সাথে কণ্ঠ মিশাইত, নীরবে তটিনী যেত সমুখে বহিয়া, নীরবে নিশীথবায়ু কাঁপাত পল্লব। গম্ভীরে গাইত কবি--"হে মহাপ্রকৃতি, কি সুন্দর, কি মহান্‌ মুখশ্রী তোমার, শূন্য আকাশের পটে হে প্রকৃতিদেবি কি কবিতা লিখেছে যে জ্বলন্ত অক্ষরে, যত দিন রবে প্রাণ পড়িয়া পড়িয়া তবু ফুরাবে না পড়া; মিটিবে না আশ! শত শত গ্রহ তারা তোমার কটাক্ষে কাঁপি উঠে থরথরি, তোমার নিশ্বাসে ঝটিকা বহিয়া যায় বিশ্বচরাচরে। কালের মহান্‌ পক্ষ করিয়া বিস্তার, অনন্ত আকাশে থাকি হে আদি জননি, শাবকের মত এই অসংখ্য জগৎ তোমার পাখার ছায়ে করিছ পালন! সমস্ত জগৎ যবে আছিল বালক, দুরন্ত শিশুর মত অনন্ত আকাশে করিত গো ছুটাছুটি না মানি শাসন, স্তনদানে পুষ্ট করি তুমি তাহাদের অলঙ্ঘ্য সখ্যের ডোরে দিলে গো বাঁধিয়া। এ দৃঢ় বন্ধন যদি ছিঁড়ে একবার, সে কি ভয়ানক কাণ্ড বাঁধে এ জগতে, কক্ষচ্ছিন্ন কোটি কোটি সূর্য্য চন্দ্র তারা অনন্ত আকাশময় বেড়ায় মাতিয়া, মণ্ডলে মণ্ডলে ঠেকি লক্ষ সূর্য্য গ্রহ চূর্ণ চূর্ণ হোয়ে পড়ে হেথায় হোথায়; এ মহান্‌ জগতের ভগ্ন অবশেষ চূর্ণ নক্ষত্রের স্তূপ, খণ্ড খণ্ড গ্রহ বিশৃঙ্খল হোয়ে রহে অনন্ত আকাশে! অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সময়, যা ভাবিতে পৃথিবীর কীট মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধি হোয়ে পড়ে ভয়ে সঙ্কুচিত, তাহাই তোমার দেবি সাধের আবাস। তোমার মুখের পানে চাহিতে হে দেবি ক্ষুদ্র মানবের এই স্পর্ধিত জ্ঞানের দুর্ব্বল নয়ন যায় নিমীলিত হোয়ে। হে জননি আমার এ হৃদয়ের মাঝে অনন্ত-অতৃপ্তি-তৃষ্ণা জ্বলিছে সদাই, তাই দেবি পৃথিবীর পরিমিত কিছু পারে না গো জুড়াইতে হৃদয় আমার, তাই ভাবিয়াছি আমি হে মহাপ্রকৃতি, মজিয়া তোমার সাথে অনন্ত প্রণয়ে জুড়াইব হৃদয়ের অনন্ত পিপাসা! প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া, তত দূর জানিবারে জীবন আমার করেছি ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ। ভ্রমিতেছি পৃথিবীর কাননে কাননে-- বিহঙ্গও যত দূর পারে না উড়িতে সে পর্ব্বতশিখরেও গিয়াছি একাকী; দিবাও পশে নি দেবি যে গিরিগহ্বরে, সেথায় নির্ভয়ে আমি করেছি প্রবেশ। যখন ঝটিকা ঝঞ্ঝা প্রচণ্ড সংগ্রামে অটল পর্ব্বতচূড়া করেছে কম্পিত, সুগম্ভীর অম্বুনিধি উন্মাদের মত করিয়াছে ছুটাছুটি যাহার প্রতাপে, তখন একাকী আমি পর্ব্বত-শিখরে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি সে ঘোর বিপ্লব, মাথার উপর দিয়া অজস্র অশনি সুবিকট অট্টহাসে গিয়াছে ছুটিয়া, প্রকাণ্ড শিলার স্তূপ পদতল হোতে পড়িয়াছে ঘর্ঘরিয়া উপত্যকা-দেশে, তুষারসঙ্ঘাতরাশি পড়েছে খসিয়া শৃঙ্গ হোতে শৃঙ্গান্তরে উলটি পালটি। অমানিশীথের কালে নীরব প্রান্তরে বসিয়াছি, দেখিয়াছি চৌদিকে চাহিয়া, সর্ব্বব্যাপী নিশীথের অন্ধকার গর্ভে এখনো পৃথিবী যেন হতেছে সৃজিত। স্বর্গের সহস্র আঁখি পৃথিবীর 'পরে নীরবে রয়েছে চাহি পলকবিহীন, স্নেহময়ী জননীর স্নেহ-আঁখি যথা সুপ্ত বালকের পরে রহে বিকসিত। এমন নীরবে বায়ু যেতেছে বহিয়া, নীরবতা ঝাঁ ঝাঁ করি গাইছে কি গান-- মনে হয় স্তব্ধতার ঘুম পাড়াইছে। কি সুন্দর রূপ তুমি দিয়াছ উষায়, হাসি হাসি নিদ্রোত্থিতা বালিকার মত আধঘুমে মুকুলিত হাসিমাখা আঁখি! কি মন্ত্র শিখায়ে দেছ দক্ষিণ-বালারে-- যে দিকে দক্ষিণবধূ ফেলেন নিঃশ্বাস, সে দিকে ফুটিয়া উঠে কুসুম-মঞ্জরী, সে দিকে গাহিয়া উঠে বিহঙ্গের দল, সে দিকে বসন্ত-লক্ষ্মী উঠেন হাসিয়া। কি হাসি হাসিতে জানে পূর্ণিমাশর্ব্বরী-- সে হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত, সে হাসি দেখিয়া হাসে উথল জলধি, সে হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর। হে প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন কেমন বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া, করুণা, প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন-- ন্যায়, ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্‌-- ক্রোধ, দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব, নিরাশা মরুর মত দারুণ বিষণ্ণ-- তেমনি আবার এই বাহির জগৎ বিচিত্র বেশভূষায় করেছ সজ্জিত। তোমার বিচিত্র কাব্য-উপবন হোতে তুলিয়া সুরভি ফুল গাঁথিয়া মালিকা, তোমারি চরণতলে দিব উপহার!" এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-গগনে প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি। প্রথমে আশাহত হয়েছিনু প্রথমে আশাহত হয়েছিনু ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা; তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু, কী করে যে সে কথা শুধায়ো না।Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) প্রবাসী হে প্রবাসী,          আমি কবি যে বাণীর প্রসাদ-প্রত্যাশী                    অন্তরতমের ভাষা               সে করে বহন। ভালোবাসা          তারি পক্ষে ভর করি নাহি জানে দূর।                    রক্তের নিঃশব্দ সুর               সদা চলে নাড়ীতন্তু বেয়ে,            সেই সুর যে ভাষার শব্দে আছে ছেয়ে          বাণীর অতীতগামী তাহারি বাণীতে           ভালোবাসা আপনার গূঢ় রূপ পারে যে জানিতে।      হে বিষয়ী, হে সংসারী, তোমরা যাহারা                    আত্মহারা,          যারা ভালোবাসিবার বিশ্বপথ     হারায়েছ, হারায়েছ আপন জগৎ,          রয়েছে আত্মবিরহী গৃহকোণে,               বিরহের ব্যথা নেই মনে।      আমি কবি পাঠালেম তোমাদের উদ্ভ্রান্ত পরানে সে ভাষার দৌত্য যাহা হারানো নিজেরে কাছে আনে,          ভেদ করি মরুকারা   শুষ্ক চিত্তে নিয়ে আসে বেদনার ধারা।               বিস্মৃতি দিয়েছে তাহে ঘের   আজন্মকালের যাহা নিত্যদান চিরসুন্দরের--          তারে আজ লও ফিরে।               লক্ষ্মীর মন্দিরে         আমি আনিয়াছি নিমন্ত্রণ; জানায়েছি, সেথাকার তোমার আসন               অন্যমনে তুমি আছ ভুলি।          জড় অভ্যাসের ধূলি               আজি নববর্ষে পুণ্যক্ষণে          যাক উড়ে তোমার নয়নে দেখা দিক্‌--এ ভুবনে সর্বত্রই কাছে আসিবার          তোমার আপন অধিকার।               সুদূরের মিতা,      মোর কাছে চেয়েছিলে নূতন কবিতা।               এই লও বুঝে,      নূতনের স্পর্শমন্ত্র এর ছন্দে পাও যদি খুঁজে। প্রবাসে বিদেশমুখো মন যে আমার কোন্‌ বাউলের চেলা, গ্রাম-ছাড়ানো পথের বাতাস সর্বদা দেয় ঠেলা। তাই তো সেদিন ছুটির দিনে টাইমটেবিল প'ড়ে             প্রাণটা উঠল নড়ে। বাক্সো নিলেম ভর্তি করে, নিলেম ঝুলি থলে, বাংলাদেশের বাইরে গেলেম গঙ্গাপারে চ'লে। লোকের মুখে গল্প শুনে গোলাপ-খেতের টানে মনটা গেল এক দৌড়ে গাজিপুরের পানে। সামনে চেয়ে চেয়ে দেখি, গম-জোয়ারির খেতে             নবীন অঙ্কুরেতে বাতাস কখন হঠাৎ এসে সোহাগ করে যায় হাত বুলিয়ে কাঁচা শ্যামল কোমল কচি গায়। আটচালা ঘর, ডাহিন দিকে সবজি-বাগানখানা শুশ্রূষা পায় সারা দুপুর, জোড়া-বলদটানা আঁকাবাঁকা কল্‌কলানি করুণ জলের ধারায়-- চাকার শব্দে অলস প্রহর ঘুমের ভারে ভারায়।             ইঁদারাটার কাছে বেগনি ফলে তুঁতের শাখা রঙিন হয়ে আছে। অনেক দূরে জলের রেখা চরের কূলে কূলে, ছবির মতো নৌকো চলে পাল-তোলা মাস্তুলে। সাদা ধুলো হাওয়ায় ওড়ে, পথের কিনারায়             গ্রামটি দেখা যায়। খোলার চালের কুটীরগুলি লাগাও গায়ে গায়ে মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আমকাঁঠালের ছায়ে। গোরুর গাড়ি পড়ে আছে মহানিমের তলে, ডোবার মধ্যে পাতা-পচা পাঁক-জমানো জলে   গম্ভীর ঔদাস্যে অলস আছে মহিষগুলি      এ ওর পিঠে আরামে ঘাড় তুলি। বিকেল-বেলায় একটুখানি কাজের অবকাশে             খোলা দ্বারের পাশে      দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার তরুণ মেয়ে আপন-মনে অকারণে বাহির-পানে চেয়ে অশথতলায় বসে তাকাই ধেনুচারণ মাঠে, আকাশে মন পেতে দিয়ে সমস্ত দিন কাটে। মনে হ'ত, চতুর্দিকে হিন্দি ভাষায় গাঁথা একটা যেন সজীব পুঁথি, উলটিয়ে যাই পাতা-- কিছু বা তার ছবি-আঁকা কিছু বা তার লেখা, কিছু বা তার আগেই যেন ছিল কখন্‌ শেখা। ছন্দে তাহার রস পেয়েছি, আউড়িয়ে যায় মন। সকল কথার অর্থ বোঝার নাইকো প্রয়োজন। প্রবীণ বিশ্বজগৎ যখন করে কাজ স্পর্ধা ক'রে পরে ছুটির সাজ। আকাশে তার আলোর ঘোড়া চলে, কৃতিত্বেরে লুকিয়ে রাখে পরিহাসের ছলে। বনের তলে গাছে গাছে শ্যামল রূপের মেলা, ফুলে ফলে নানান্‌ রঙে নিত্য নতুন খেলা। বাহির হতে কে জানতে পায়, শান্ত আকাশতলে প্রাণ বাঁচাবার কঠিন কর্মে নিত্য লড়াই চলে। চেষ্টা যখন নগ্ন হয়ে শাখায় পড়ে ধরা, তখন খেলার রূপ চলে যায়, তখন আসে জরা। বিলাসী নয় মেঘগুলো তো জলের ভারে ভরা, চেহারা তার বিলাসিতার রঙের ভূষণ পরা। বাইরে ওরা বুড়োমিকে দেয় না তো প্রশ্রয়-- অন্তরে তাই চিরন্তনের বজ্রমন্দ্র রয়। জল-ঝরানো ছেলেখেলা যেমনি বন্ধ করে ফ্যাকাশে হয় চেহারা তার, বয়স তাকে ধরে। দেহের মাঝে হাজার কাজে বহে প্রাণের বায়ু-- পালের তরীর মতন যেন ছুটিয়ে চলে আয়ু, বুকের মধ্যে জাগায় নাচন, কণ্ঠে লাগায় সুর, সকল অঙ্গ অকারণে উৎসাহে ভরপুর। রক্তে যখন ফুরোবে ওর খেলার নেশা খোঁজা তখনি কাজ অচল হবে, বয়স হবে বোঝা। ওগো তুমি কী করছ, ভাই, স্তব্ধ সারাক্ষণ-- বুদ্ধি তোমার আড়ষ্ট যে, ঝিমিয়ে-পড়া মন। নবীন বয়স যেই পেরোল খেলাঘরের দ্বারে মরচে-পড়া লাগল তালা, বন্ধ একেবারে। ভালোমন্দ বিচারগুলো খোঁটায় যেন পোঁতা। আপন মনের তলায় তুমি তলিয়ে গেলে কোথা। চলার পথে আগল দিয়ে বসে আছ স্থির-- বাইরে এসো, বাইরে এসো, পরমগম্ভীর। কেবলই কি প্রবীণ তুমি, নবীন নও কি তাও। দিনে দিনে ছি ছি কেবল বুড়ো হয়েই যাও। আশি বছর বয়স হবে ওই যে পিপুলগাছ, এ আশ্বিনের রোদ্‌দুরে ওর দেখলে বিপুল নাচ? পাতায় পাতায় আবোল-তাবোল, শাখায় দোলাদুলি, পান্থ হাওয়ার সঙ্গে ও চায় করতে কোলাকুলি। ওগো প্রবীণ, চলো এবার সকল কাজের শেষে নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার বেশে। প্রবীণ ও নবীন পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়, কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায়-হায়। পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা, আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রভাত নির্মল তরুণ উষা, শীতল সমীর,       শিহরি শিহরি উঠে শান্ত নদীনীর।       এখনো নামে নি জলে রাজহাঁসগুলি,       এখনো ছাড়ে নি নৌকা সাদা পাল তুলি।       এখনো গ্রামের বধূ আসে নাই ঘাটে,       চাষি নাহি চলে পথে, গোরু নাই মাঠে।       আমি শুধু একা বসি মুক্ত বাতায়নে       তপ্ত ভাল পাতিয়াছি উদার গগনে।       বাতাস সোহাগস্পর্শ বুলাইছে কেশে,       প্রসন্ন কিরণখানি মুখে পড়ে এসে।       পাখির আনন্দগান দশ দিক হতে       দুলাইছে নীলাকাশ অমৃতের স্রোতে।       ধন্য আমি হেরিতেছি আকাশের আলো,       ধন্য আমি জগতেরে বাসিয়াছি ভালো।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) প্রভাত উৎসব হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি, জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি। প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি, আকাশ-পানে চাই কী জানি কারে দেখি।।পুরবমেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা, অরুণরথচূড়া আধেক যায় দেখা। তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব, মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব।।আকাশ,‘এসো এসো 'ডাকিছ বুঝি ভাই- গেছি তো তোরি বুকে ,আমি তো হেথা নাই। প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর, আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর।।ওঠো হে ওঠো রবি ,আমারে তুলে লও, অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও। আকাশপারাবার বুঝি হে পার হবে- আমারে লও তবে আমারে লও তবে।। প্রভাত-উৎসব হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি! জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি! ধরায় আছে যত মানুষ শত শত আসিছে প্রাণে মোর,হাসিছে গলাগলি। এসেছে সখা সখী বসিয়া চোখাচোখি, দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি। এসেছে ভাই বোন পুলকে ভরা মন, ডাকিছে, ‘ভাই ভাই’ আঁখিতে আঁখি তুলি। সখারা এল ছুটে, নয়নে তারা ফুটে, পরানে কথা উঠে-- বচন গেল ভুলি। সখীরা হাতে হাতে ভ্রমিছে সাথে সাথে, দোলায় চড়ি তারা করিছে দোলাদুলি। শিশুরে লয়ে কোলে জননী এল চলে, বুকেতে চেপে ধরে বলিছে ‘ঘুমো ঘুমো’। আনত দু’নয়ানে চাহিয়া মুখপানে বাছার চাঁদমুখে খেতেছে শত চুমো। পুলকে পুরে প্রাণ, শিহরে কলেবর, প্রেমের ডাক শুনি এসেছে চরাচর-- এসেছে রবি শশী,এসেছে কোটি তারা, ঘুমের শিয়রেতে জাগিয়া থাকে যারা। পরান পুরে গেল হরষে হল ভোর জগতে যারা আছে সবাই প্রাণে মোর।প্রভাত হল যেই কী জানি হল এ কী! আকাশপানে চাই কী জানি কারে দেখি! প্রভাতবায়ু বহে কী জানি কী যে কহে, মরমমাঝে মোর কী জানি কী যে হয়! এসো হে এসো কাছে সখা হে এসো কাছে-- এসো হে ভাই এসো,বোসো হে প্রাণময়। পুরব-মেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা, অরুণরথচূড়া আধেক যায় দেখা। তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব-- মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব! মধুর মধু আলো, মধুর মধু বায়, মধুর মধু গানে তটিনী বয়ে যায়! যে দিকে আঁখি চায় সে দিকে চেয়ে থাকে, যাহারি দেখা পায় তারেই কাছে ডাকে, নয়ন ডুবে যায় শিশির-আঁখি-ধারে, হৃদয় ডুবে যায় হরষ-পারাবারে। আয় রে আয় বায়ু, যা রে যা প্রাণ নিয়ে, জগত-মাঝারেতে দে রে তা প্রসারিয়ে। ভ্রমিবি বনে বনে, যাইবি দিশে দিশে, সাগরপারে গিয়ে পুরবে যাবি মিশে। লইবি পথ হতে পাখির কলতান, যূথীর মৃদুশ্বাস, মালতীমৃদুবাস-- অমনি তারি সাথে যা রে যা নিয়ে প্রাণ। পাখির গীতধার ফুলের বাসভার ছড়াবি পথে পথে হরষে হয়ে ভোর, অমনি তারি সাথে ছড়াবি প্রাণ মোর। ধরারে ঘিরি ঘিরি কেবলি যাবি বয়ে ধরার চারি দিকে প্রাণেরে ছড়াইয়ে।পেয়েছি এত প্রাণ যতই করি দান কিছুতে যেন আর ফুরাতে নারি তারে। আয় রে মেঘ, আয় বারেক নেমে আয়, কোমল কোলে তুলে আমারে নিয়ে যা রে! কনক-পাল তুলে বাতাসে দুলে দুলে ভাসিতে গেছে সাধ আকাশ-পারাবারে।আকাশ, এসো এসো, ডাকিছ বুঝি ভাই-- গেছি তো তোরি বুকে, আমি তো হেথা নাই। প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর, আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর।ওঠো হে ওঠো রবি,আমারে তুলে লও, অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও, আকাশ-পারাবার বুঝি হে পার হবে-- আমারে লও তবে, আমারে লও তবে।জগৎ আসে প্রাণে, জগতে যায় প্রাণ জগতে প্রাণে মিলি গাহিছে একি গান! কে তুমি মহাজ্ঞানী, কে তুমি মহারাজ, গরবে হেলা করি হেসো না তুমি আজ। বারেক চেয়ে দেখো আমার মুখপানে-- উঠেছে মাথা মোর মেঘের মাঝখানে, আপনি আসি উষা শিয়রে বসি ধীরে অরুণকর দিয়ে মুকুট দেন শিরে, নিজের গলা হতে কিরণমালা খুলি দিতেছে রবি-দেব আমার গলে তুলি! ধূলির ধূলি আমি রয়েছি ধূলি-’পরে, জেনেছি ভাই বলে জগৎ চরাচরে। প্রভাত-উৎসব (সঞ্চয়িতা) হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি, জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি । প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি, আকাশ-পানে চাই কী জানি কারে দেখি ।।পুরবমেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা, অরূণরথচূড়া আধেক যায় দেখা । তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব, মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব ।।আকাশ, 'এসো এসো' ডাকিছ বুঝি ভাই-- গেছি তো তোরি বুকে, আমি তো হেথা নাই । প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর, আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর ।।ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও, অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও । আকাশপারাবার বুঝি হে পার হবে-- আমারে লও তবে, আমারে লও তবে ।। প্রভাতরবির ছবি আঁকে ধরা প্রভাতরবির ছবি আঁকে ধরা সূর্যমুখীর ফুলে। তৃপ্তি না পায়, মুছে ফেলে তায়, আবার ফুটায়ে তুলে।   (স্ফুলিঙ্গ) প্রভাতের ফুল ফুটিয়া উঠক প্রভাতের ফুল ফুটিয়া উঠক সুন্দর পরিমলে। সন্ধ্যাবেলায় হোক সে ধন্য মধুরসে-ভরা ফলে।   (স্ফুলিঙ্গ) প্রভেদ তোমাতে আমাতে আছে তো প্রভেদ            জানি তা বন্ধু, জানি,      বিচ্ছেদ তবু অন্তরে নাহি মানি।            এক জ্যোৎস্নায় জেগেছি দুজনে            সারারাত-জাগা পাখির কূজনে,            একই বসন্তে দোঁহাকার মনে                  দিয়েছে আপন বাণী।তুমি চেয়ে আছ আলোকের পানে,                  পশ্চাতে মোর মুখ--      অন্তরে তবু গোপন মিলনসুখ।            প্রবল প্রবাহে যৌবনবান            ভাসায়েছে দুটি দোলায়িত প্রাণ,            নিমেষে দোঁহারে করেছে সমান                     একই আবর্তে টানি।সোনার বর্ণ মহিমা তোমার            বিশ্বের মনোহর,      আমি অবনত পাণ্ডুর কলেবর।            উদাস বাতাসে পরান কাঁপায়ে            অগৌরবের শরম ছাপায়ে            আমারে তোমার বসাইল বাঁয়ে,                     একাসনে দিল আনি।            নবারুণরাগে রাঙা হয়ে গেল                    কালো ভেদরেখাখানি। প্রভেদ (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) অনুগ্রহ দুঃখ করে, দিই, নাহি পাই। করুণা কহেন, আমি দিই, নাহি চাই।  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রলাপ ১ ১ গিরির উরসে নবীন নিঝর, ছুটে ছুটে অই হতেছে সারা। তলে তলে তলে নেচে নেচে চলে, পাগল তটিনী পাগলপারা।  ২ হৃদি প্রাণ খুলে ফুলে ফুলে ফুলে, মলয় কত কী করিছে গান। হেতা হোতা ছুটি ফুল-বাস লুটি, হেসে হেসে হেসে আকুল প্রাণ।৩ কামিনী পাপড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি, উড়িয়ে উড়িয়ে ছিঁড়িয়ে ফেলে। চুপি চুপি গিয়ে ঠেলে ঠেলে দিয়ে, জাগায়ে তুলিছে তটিনীজলে।৪ ফিরে ফিরে ফিরে ধীরে ধীরে ধীরে, হরষে মাতিয়া, খুলিয়া বুক। নলিনীর কোলে পড়ে ঢ'লে ঢ'লে, নলিনী সলিলে লুকায় মুখ।৫ হাসিয়া হাসিয়া কুসুমে আসিয়া, ঠেলিয়া উড়ায় মধুপ দলে। গুন্‌ গুন্‌ গুন্‌ রাগিয়া আগুন, অভিশাপ দিয়া কত কী বলে।৬ তপন কিরণ -- সোনার ছটায়, লুটায় খেলায় নদীর কোলে। ভাসি ভাসি ভাসি স্বর্ণ ফুলরাশি হাসি হাসি হাসি সলিলে দোলে।৭ প্রজাপতিগুলি পাখা দুটি তুলি উড়িয়া উড়িয়া বেড়ায় দলে। প্রসারিয়া ডানা করিতেছে মানা কিরণে পশিতে কুসুমদলে।৮ মাতিয়াছে গানে সুললিত তানে পাপিয়া ছড়ায় সুধার ধার। দিকে দিকে ছুটে বন জাগি উঠে কোকিল উতর দিতেছে তার।৯ তুই কে লো বালা! বন করি আলা, পাপিয়ার সাথে মিশায়ে তান! হৃদয়ে হৃদয়ে লহরী তুলিয়া, অমৃত ললিত করিস্‌ গান।১০ স্বর্গ ছায় গানে বিমানে বিমানে ছুটিয়া বেড়ায় মধুর তান। মধুর নিশায় ছাইয়া পরান, হৃদয় ছাপিয়া উঠেছে গান।১১ নীরব প্রকৃতি নীরব ধরা। নীরবে তটিনী বহিয়া যায়। তরুণী ছড়ায় অমৃতধারা, ভূধর, কানন, জগত ছায়।    ১২ মাতাল করিয়া হৃদয় প্রাণ, মাতাল করিয়া পাতাল ধরা। হৃদয়ের তল অমৃতে ডুবায়ে, ছড়ায় তরুণী অমৃতধারা।    ১৩ কে লো তুই বালা! বন করি আলা, ঘুমাইছে বীণা কোলের 'পরে। জ্যোতির্ম্ময়ী ছায়া স্বরগীয় মায়া, ঢল ঢল ঢল প্রমোদ-ভরে।১৪ বিভোর নয়নে বিভোর পরানে -- চারি দিক্‌ পানে চাহিস্‌ হেসে! হাসি উঠে দিক্‌! ডাকি উঠে পিক্‌! নদী ঢলে পড়ে পুলিন দেশে!!১৫ চারি দিক্‌ চেয়ে কে লো তুই মেয়ে, হাসি রাশি রাশি ছড়িয়ে দিস্‌? আঁধার ছুটিয়া জোছনা ফুটিয়া কিরণে উজলি উঠিছে দিশ্‌!১৬ কমলে কমলে এ ফুলে ও ফুলে, ছুটিয়া খেলিয়া বেড়াস্‌ বালা! ছুটে ছুটে ছুটে খেলায় যেমন মেঘে মেঘে মেঘে দামিনী-মালা।১৭ নয়নে করুণা অধরে হাসি, উছলি উছলি পড়িছে ছাপি। মাথায় গলায় কুসুমরাশি বাম করতলে কপোল চাপি।১৮ এতকাল তোরে দেখিনু সেবিনু -- হৃদয়-আসনে দেবতা বলি। নয়নে নয়নে, পরানে পরানে, হৃদয়ে হৃদয়ে রাখিনু তুলি।১৯ তবুও তবুও পূরিল না আশ, তবুও হৃদয় রহেছে খালি। তোরে প্রাণ মন করিয়া অর্পণ ভিখারি হইয়া যাইব চলি।২০ আয় কল্পনা মিলিয়া দুজনা, ভূধরে কাননে বেড়াব ছুটি। সরসী হইতে তুলিয়া কমল লতিকা হইতে কুসুম লুটি।২১ দেখিব ঊষার পূরব গগনে, মেঘের কোলেতে সোনার ছটা। তুষার-দর্পণে দেখিছে আনন সাঁজের লোহিত জলদ-ঘটা।২২ কনক-সোপানে উঠিছে তপন ধীরে ধীরে ধীরে উদয়াচলে। ছড়িয়ে ছড়িয়ে সোনার বরন, তুষারে শিশিরে নদীর জলে।২৩ শিলার আসনে দেখিব বসিয়ে, প্রদোষে যখন দেবের বালা পাহাড়ে লুকায়ে সোনার গোলা আঁখি মেলি মেলি করিবে খেলা।২৪ ঝর ঝর ঝর নদী যায় চলে, ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিছে বায়। চপল নিঝর ঠেলিয়া পাথর ছুটিয়া -- নাচিয়া -- বহিয়া যায়।২৫ বসিব দুজনে -- গাইব দুজনে, হৃদয় খুলিয়া, হৃদয়ব্যথা; তটিনী শুনিবে, ভূধর শুনিবে জগত শুনিবে সে-সব কথা।২৬ যেথায় যাইবি তুই কলপনা, আমিও সেথায় যাইব চলি। শ্মশানে, শ্মশানে -- মরু বালুকায়, মরীচিকা যথা বেড়ায় ছলি।২৭ আয় কলপনা আয় লো দুজনা, আকাশে আকাশে বেড়াই ছুটি। বাতাসে বাতাসে আকাশে আকাশে নবীন সুনীল নীরদে উঠি।২৮ বাজাইব বীণা আকাশ ভরিয়া, প্রমোদের গান হরষে গাহি, যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া, অবাক জগত রহিবে চাহি!২৯ জলধররাশি উঠিবে কাঁপিয়া, নব নীলিমায় আকাশ ছেয়ে। যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া, দেবতারা সব রহিবে চেয়ে।৩০ সুর-সুরধুনী আলোকময়ী, উজলি কনক বালুকারাশি। আলোকে আলোকে লহরী তুলিয়া, বহিয়া বহিয়া যাইছে হাসি।৩১ প্রদোষ তারায় বসিয়া বসিয়া, দেখিব তাহার লহরীলীলা। সোনার বালুকা করি রাশ রাশ, সুর-বালিকারা করিবে খেলা।৩২ আকাশ হইতে দেখিব পৃথিবী! অসীম গগনে কোথায় পড়ে। কোথায় একটি বালুকার রেণু বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।৩৩ কোথায় ভূধর কোথায় শিখর অসীম সাগর কোথায় পড়ে। কোথায় একটি বালুকার রেণু, বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।৩৪ আয় কল্পনা আয় লো দুজনা, এক সাথে সাথে বেড়াব মাতি। পৃথিবী ফিরিয়া জগত ফিরিয়া, হরষে পুলকে দিবস রাতি। প্রলাপ ২ ঢাল্‌! ঢাল্‌ চাঁদ! আরো আরো ঢাল্!           সুনীল আকাশে রজতধারা! হৃদয় আজিকে উঠেছে মাতিয়া           পরাণ হয়েছে পাগলপারা! গাইব রে আজ হৃদয় খুলিয়া           জাগিয়া উঠিবে নীরব রাতি! দেখাব জগতে হৃদয় খুলিয়া           পরাণ আজিকে উঠেছে মাতি! হাসুক পৃথিবী, হাসুক জগৎ,           হাসুক হাসুক চাঁদিমা তারা! হৃদয় খুলিয়া করিব রে গান           হৃদয় হয়েছে পাগলপারা! আধ ফুটো-ফুটো গোলাপ-কলিকা           ঘাড়খানি আহা করিয়া হেঁট মলয় পবনে লাজুক বালিকা           সউরভ রাশি দিতেছে ভেট! আয় লো প্রমদা! আয় লো হেথায়           মানস আকাশে চাcর ধারা! গোলাপ তুলিয়া পর্‌ লো মাথায়           সাঁঝের গগনে ফুটিবে তারা । হেসে ঢল্‌ ঢল্‌ পূর্ণ শতদল           ছড়িয়ে ছড়িয়ে সুরভিরাশি নয়নে নয়নে, অধরে অধরে           জ্যোছনা উছলি পড়িছে হাসি! চুল হতে ফুল খুলিয়ে খুলিয়ে           ঝরিয়ে ঝরিয়ে পড়িছে ভূমে! খসিয়া খসিয়া পড়িছে আঁচল           কোলের উপর কমল থুয়ে! আয় লো তরুণী! আয় লো হেথায়!           সেতার ওই যে লুটায় ভূমে বাজা লো ললনে! বাজা একবার           হৃদয় ভরিয়ে মধুর ঘুমে! নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে আঙুল!           নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে তান! অবাক্‌ হইয়া মুখপানে তোর           চাহিয়া রহিব বিভল প্রাণ! গলার উপরে সঁপি হাতখানি           বুকের উপরে রাখিয়া মুখ আদরে অস্ফুটে কত কি যে কথা           কহিবি পরানে ঢালিয়া সুখ! ওই রে আমার সুকুমার ফুল           বাতাসে বাতাসে পড়িছে দুলে হৃদয়েতে তোরে রাখিব লুকায়ে           নয়নে নয়নে রাখিব তুলে। আকাশ হইতে খুঁজিবে তপন           তারকা খুঁজিবে আকাশ ছেয়ে! খুঁজিয়া বেড়াবে দিকবধূগণ           কোথায় লুকাল মোহিনী মেয়ে? আয় লো ললনে ! আয় লো আবার           সেতারে জাগায়ে দে-না লো বালা! দুলায়ে দুলায়ে ঘাড়টি নামায়ে           কপোলেতে চুল করিবে খেলা! কী-যে মূরতি শিশুর মতন!           আধ ফুটো-ফুটো ফুলের কলি! নীরব নয়নে কী-যে কথা কয়           এ জনমে আর যাব না ভুলি! কী-যে ঘুমঘোরে ছায় প্রাণমন           লাজে ভরা ওই মধুর হাসি! পাগলিনী বালা গলাটি কেমন           ধরিস্‌ জড়িয়ে ছুটিয়ে আসি! ভুলেছি পৃথিবী ভুলেছি জগৎ           ভুলেছি, সকল বিষয় মানে! হেসেছে পৃথিবী-- হেসেছে জগৎ           কটাক্ষ করিলি কাহারো পানে! আয়! আয় বালা! তোরে সাথে লয়ে           পৃথিবী ছাড়িয়া যাই লো চলে! চাঁদের কিরণে আকাশে আকাশে           খেলায়ে বেড়াব মেঘের কোলে! চল্‌ যাই মোরা আরেক জগতে           দুজনে কেবল বেড়াব মাতি কাননে কাননে, খেলাব দুজনে           বনদেবীকোলে যাপিব রাতি! যেখানে কাননে শুকায় না ফুল!           সুরভি-পূরিত কুসুমকলি! মধুর প্রেমেরে দোষে না যেথায়           সেথায় দুজনে যাইব চলি! প্রলাপ ৩ আয় লো প্রমদা! নিঠুর ললনে           বার বার বল্‌ কী আর বলি! মরমের তলে লেগেছে আঘাত           হৃদয় পরাণ উঠেছে জ্বলি! আর বলিব না এই শেষবার           এই শেষবার বলিয়া লই মরমের তলে জ্বলেছে আগুন           হৃদয় ভাঙিয়া গিয়াছে সই! পাষাণে গঠিত সুকুমার ফুল!           হুতাশনময়ী দামিনী বালা! অবারিত করি মরমের তল           কহিব তোরে লো মরম জ্বালা! কতবার তোরে কহেছি ললনে!           দেখায়েছি খুলে হৃদয় প্রাণ! মরমের ব্যথা,হৃদয়ের কথা,           সে-সব কথায় দিস্‌ নি কান। কতবার সখি বিজনে বিজনে           শুনায়েছি তোরে প্রেমের গান, প্রেমের আলাপক প্রেমের প্রলাপ           সে-সব প্রলাপে দিস্‌ নি কান! কতবার সখি! নয়নের জল           করেছি বর্ষণ চরণতলে! প্রতিশোধ তুই দিস্‌ নিকো তার           শুধু এক ফোঁটা নয়নজলে! শুধা ওলো বালা! নিশার আঁধারে           শুধা ওলো সখি! আমার রেতে আঁখিজল কত করেছে গোপন           মর্ত্য পৃথিবীর নয়ন হতে! শুধা ওলো বালা নিশার বাতাসে           লুটিতে আসিয়া ফুলের বাস হৃদয়ে বহন করেছে কিনা সে--           নিরাশ প্রেমীর মরম শ্বাস! সাক্ষী আছ ওগো তারকা চন্দ্রমা!           কেঁদেছি যখন মরম শোকে-- হেসেছে পৃথিবী, হেসেছে জগৎ           কটাক্ষ করিয়া হেসেছে লোকে! সহেছি সে-সব তোর তরে সখি!           মরমে মরমে জ্বলন্ত জ্বালা ! তুচ্ছ করিবারে পৃথিবী জগতে           তোমারি তরে লো শিখেছি বালা! মানুষের হাসি তীব্র বিষমাখা           হৃদয় শোণিত করেছে ক্ষয়! তোমারি তরে লো সহেছি সে-সব           ঘৃণা উপহাস করেছি জয়! কিনিতে হৃদয় দিয়েছি হৃদয়           নিরাশ হইয়া এসেছি ফিরে; অশ্রু মাগিবারে দিয়া অশ্রুজল           উপেক্ষিত হয়ে এয়েছি ফিরে। কিছুই চাহি নি পৃথিবীর কাছে-           প্রেম চেয়েছিনু ব্যাকুল মনে। সে বাসনা যবে হল না পূরণ           চলিয়া যাইব বিজন বনে! তোর কাছে বালা এই শেষবার           ফেলিল সলিল ব্যাকুল হিয়া ভিখারি হইয়া যাইব লো চলে           প্রেমের আশায় বিদায় দিয়া ! সেদিন যখন ধন, যশ, মান,           অরির চরণে দিলাম ঢালিসেইদিন আমি ভেবেছিনু মনে           উদাস হইয়া যাইব চলি। তখনো হায় রে একটি বাঁধনে           আবদ্ধ আছিল পরাণ দেহ। সে দৃঢ় বাঁধন ভেবেছিনু মনে           পারিবে না আহা ছিঁড়িতে কেহ! আজ ছিঁড়িয়াছে, আজ ভাঙিয়াছে,           আজ সে স্বপন গিয়াছে চলি। প্রেম ব্রত আজ করি উদ্‌যাপন           ভিখারি হইয়া যাইব চলি! পাষাণের পটে ও মূরতিখানি           আঁকিয়া হৃদয়ে রেখেছি তুলি গরবিনি! তোর ওই মুখখানি           এ জনমে আর যাব না ভুলি! মুছিতে নারিব এ জনমে আর           নয়ন হইতে নয়নবারি যতকাল ওই ছবিখানি তোর           হৃদয়ে রহিবে হৃদয় ভরি। কী করিব বালা মরণের জলে           ওই ছবিখানি মুছিতে হবে! পৃথিবীর লীলা ফুরাইবে আজ,           আজিকে ছাড়িয়া যাইব ভবে! এ ভাঙা হৃদয় কত সবে আর!           জীর্ণ প্রাণ কত সহিবে জ্বালা! মরণের জল ঢালিয়া অনলে           হৃদয় পরাণ জুড়াল বালা! তোরে সখি এত বাসিতাম ভালো           খুলিয়া দেছিনু হৃদয়তল সে-সব ভাবিয়া ফেলিবি না বালা           শুধু এক ফোঁটা নয়ন জল? আকাশ হইতে দেখি যদি বালা           নিঠুর ললনে! আমার তরে এক ফোঁটা আহা নয়নের জল           ফেলিস্‌ কখনো বিষাদভরে! সেই নেত্রজলে-- এক বিন্দু জলে           নিভায়ে ফেলিব হৃদয় জ্বালা! প্রদোষে বসিয়া প্রদোষ তারায়           প্রেম গান সুখে করিব বালা! প্রশ্ন চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে,      কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল-চক্ররথে ঘুরে।           কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন,                    সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন           পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে                         দুর্লক্ষ্য আলোতে।                আপনার পানে চাই,           লেশমাত্র পরিচয় নাই।      এ কি কোনো দৃশ্যাতীত জ্যোতি। কোন্‌ অজানারে ঘিরি এই অজানার নিত্য গতি।      বহুযুগে বহুদূরে স্মৃতি আর বিস্মৃতি-বিস্তার,                যেন বাষ্পপরিবেশ তার      ইতিহাসে পিণ্ড বাঁধে রূপে রূপান্তরে। "আমি' উঠে ঘনাইয়া কেন্দ্র-মাঝে অসংখ্য বৎসরে। সুখদুঃখ ভালোমন্দ রাগদ্বেষ ভক্তি সখ্য স্নেহ           এই নিয়ে গড়া তার সত্তাদেহ;      এরা সব উপাদান ধাক্কা পায়, হয় আবর্তিত,                    পুঞ্জিত, নর্তিত।           এরা সত্য কী যে                বুঝি নাই নিজে।           বলি তারে মায়া-- যাই বলি শব্দ সেটা, অব্যক্ত অর্থের উপচ্ছায়া।                তার পরে ভাবি, এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি "আমি' অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি।      অসীম রহস্য নিয়ে মুহূর্তের নিরর্থকতায়           লুপ্ত হবে নানারঙা জলবিম্বপ্রায়,      অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা                    আত্মার বারতা।      তখনো সুদূরে ঐ নক্ষত্রের দূত ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ                    অপার আকাশ-মাঝে,                         কিছুই জানি না কোন্‌ কাজে। বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর,                    ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর। প্রশ্ন - শিশু কাব্যগ্রন্থ মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্‌,         সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা। এখন আমি তোমার ঘরে বসে         করব শুধু পড়া-পড়া খেলা। তুমি বলছ দুপুর এখন সবে,         নাহয় যেন সত্যি হল তাই, একদিনও কি দুপুরবেলা হলে         বিকেল হল মনে করতে নাই? আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে         সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে, বাগ্‌দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে         শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে। আঁধার হল মাদার-গাছের তলা,         কালি হয়ে এল দিঘির জল, হাটের থেকে সবাই এল ফিরে,         মাঠের থেকে এল চাষির দল। মনে কর্‌-না উঠল সাঁঝের তারা,         মনে কর্‌-না সন্ধে হল যেন। রাতের বেলা দুপুর যদি হয়         দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।(শিশু কাব্যগ্রন্থ) প্রশ্ন - সঞ্চয়িতা কো তুঁহুঁ বোলবি মোয় । হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন, আঁখউপর তুঁহুঁ রচলহি আসন।। অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম     নিমিখ ন অন্তর হোয়।।হৃদয়কমল তব চরণে টলমল, নয়নযুগল মম উছলে ছলছল-- প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল     চাহে মিলাইতে তোয়।।বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয়গরল রে, হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে, আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে--     উতল প্রাণ উতরোয়।।হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল, শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল, বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল--     চরণকমলযুগ ছোঁয়।।গোপবধূজন বিকশিতযৌবন, পুলকিত যমুনা, মুকুলিত উপবন-- নীলনীর'পরে ধীর সমীরণ     পলকে প্রাণমন খোয়।।তৃষিত আঁখি তব মুখ'পর বিহরই, মধুর পরশ তব রাধা শিহরই-- প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই     পদতলে আপনা থোয়।।কো তুঁহুঁ কো তুঁহুঁ সব জন পুছয়ি অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি-- যাচে ভানু, সব সংশয় ঘুচয়ি     জনম চরণ'পর গোয়।। প্রশ্ন-রবীন্দ্রনাথ ভগবান , তুমি যুগে যুগে দূত , পাঠায়েছ বারে বারে                     দয়াহীন সংসারে , তারা বলে গেল  ‘ক্ষমা করো সবে ‘, বলে গেল  ‘ভালোবাসো —                     অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো ‘ । বরণীয় তারা , স্মরণীয় তারা , তবুও বাহির-দ্বারে আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে ।আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে                হেনেছে নিঃসহায়ে , আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে                বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে । আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে । কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে , বাঁশি সংগীতহারা ,                  অমাবস্যার কারা লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে ,                  তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে — যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু , নিভাইছে তব আলো , তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ , তুমি কি বেসেছ ভালো । প্রশ্নের অতীত হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা। কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর? হিমাদ্রি কহিল, মোর চির-নিরুত্তর।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) প্রাইমারি ইস্কুলে প্রাইমারি ইস্কুলে প্রায়-মারা পণ্ডিত সব কাজ ফেলে রেখে ছেলে করে দণ্ডিত। নাকে খত দিয়ে দিয়ে ক্ষয়ে গেল যত নাক, কথা-শোনবার পথ টেনে টেনে করে ফাঁক; ক্লাসে যত কান ছিল সব হল খণ্ডিত, বেঞ্চিটেঞ্চিগুলো লণ্ডিত ভণ্ডিত।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) প্রাচীন ভারত দিকে দিকে দেখা যায় বিদর্ভ, বিরাট, অযোধ্যা, পাঞ্চাল, কাঞ্চী উদ্ধতললাট স্পর্ধিছে অম্বরতল অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে, অশ্বের হ্রেষায় আর হস্তীর বৃংহিতে, অসির ঝঞ্ঝনা আর ধনুর টংকারে, বীণার সংগীত আর নূপুরঝংকারে, বন্দীর বন্দনারবে, উৎসব-উচ্ছ্বাসে, উন্নাদ শঙ্খের গর্জে, বিজয়-উল্লাসে, রথের ঘর্ঘরমন্দ্রে, পথের কল্লোলে নিয়ত ধ্বনিত ধ্মাত কর্মকলরোলে। ব্রাহ্মণের তপোবন অদূরে তাহার, নির্বাক্‌ গম্ভীর শান্ত সংযত উদার। হেথা মত্ত স্ফীতস্ফূর্ত ক্ষত্রিয়গরিমা, হোথা স্তব্ধ মহামৌন ব্রাহ্মণমহিমা।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) প্রাণ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই! ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত, বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রু-ময় - মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়! তা যদি না পারি, তবে বাঁচি যত কাল তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই, তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই। হাসিমুখে নিয়া ফুল, তার পরে হায় ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।। প্রায়শ্চিত্ত উপর আকাশে সাজানো তড়িৎ-আলো--      নিম্নে নিবিড় অতিবর্বর কালো ভূমিগর্ভের রাতে--       ক্ষুধাতুর আর ভূরিভোজীদের                     নিদারুণ সংঘাতে      ব্যাপ্ত হয়েছে পাপের দুর্দহন,      সভ্যনামিক পাতালে যেথায়                    জমেছে লুটের ধন।      দুঃসহ তাপে গর্জি উঠিল                    ভূমিকম্পের রোল,      জয়তোরণের ভিত্তিভূমিতে                    লাগিল ভীষণ দোল।      বিদীর্ণ হল ধনভাণ্ডারতল,      জাগিয়া উঠিছে গুপ্ত গুহার                    কালীনাগিনীর দল।           দুলিছে বিকট ফণা,      বিষনিশ্বাসে ফুঁসিছে অগ্নিকণা।              নিরর্থ হাহাকারে      দিয়ো না দিয়ো না অভিশাপ বিধাতারে।                পাপের এ সঞ্চয়          সর্বনাশের পাগলের হাতে                    আগে হয়ে যাক ক্ষয়।        বিষম দুঃখে ব্রণের পিণ্ড                বিদীর্ণ হয়ে, তার           কলুষপুঞ্জ ক'রে দিক উদগার।      ধরার বক্ষ চিরিয়া চলুক                বিজ্ঞানী হাড়গিলা,           রক্তসিক্ত লুব্ধ নখর                একদিন হবে ঢিলা। প্রতাপের ভোজে আপনারে যারা বলি করেছিল দান           সে-দুর্বলের দলিত পিষ্ট প্রাণ                নরমাংসাশী করিতেছে কাড়াকাড়ি,                    ছিন্ন করিছে নাড়ী। তীক্ষ্ণ দশনে টানাছেঁড়া তারি দিকে দিকে যায় ব্যেপে                         রক্তপঙ্কে ধরার অঙ্ক লেপে।                সেই বিনাশের প্রচণ্ড মহাবেগে      একদিন শেষে বিপুলবীর্য শান্তি উঠিবে জেগে।                  মিছে করিব না ভয়,            ক্ষোভ জেগেছিল তাহারে করিব জয়।               জমা হয়েছিল আরামের লোভে                              দুর্লভতার রাশি,               লাগুক তাহাতে লাগুক আগুন--                    ভস্মে ফেলুক গ্রাসি।           ঐ দলে দলে ধার্মিক ভীরু                         কারা চলে গির্জায়                    চাটুবাণী দিয়ে ভুলাইতে দেবতায়।           দীনাত্মাদের বিশ্বাস, ওরা                      ভীত প্রার্থনারবে                       শান্তি আনিবে ভবে।           কৃপণ পূজায় দিবে নাকো কড়িকড়া।                    থলিতে ঝুলিতে কষিয়া আঁটিবে                                শত শত দড়িদড়া।                    শুধু বাণীকৌশলে                               জিনিবে ধরণীতলে।                    স্তূপাকার লোভ                              বক্ষে রাখিয়া জমা                    কেবল শাস্ত্রমন্ত্র পড়িয়া                              লবে বিধাতার ক্ষমা।           সবে না দেবতা হেন অপমান                     এই ফাঁকি ভক্তির।           যদি এ ভুবনে থাকে আজো তেজ                           কল্যাণশক্তির           ভীষণ যজ্ঞে প্রায়শ্চিত্ত                     পূর্ণ করিয়া শেষে           নূতন জীবন নূতন আলোকে                     জাগিবে নূতন দেশে। প্রার্থনা চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বাসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়, যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি- পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা, নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।। প্রার্থনা (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো , সখা , তাই ‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ করিছে সবাই । সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সমুখে বলিতেছে , ‘ এ জগতে আর কিছু নাই । ‘ নাথ , তুমি একবার এসো হাসিমুখে এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায় — সুখদুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে , যাক আলো-অন্ধকার তোমার প্রভায় । নহিলে ডুবেছি আমি , মরেছি হেথায় , নহিলে ঘুচে না আর মর্মের ক্রন্দন — শুষ্ক ধূলি তুলি শুধু সুধাপিপাসায় , প্রেম ব’লে পরিয়াছি মরণবন্ধন । কভু পড়ি কভু উঠি , হাসি আর কাঁদি — খেলাঘর ভেঙে প’ড়ে রচিবে সমাধি ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) প্রার্থনা (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) আজি    কোন্‌ ধন হতে বিশ্ব আমারে                কোন্‌ জনে করে বঞ্চিত তব      চরণকমলরতনরেণুকা                অন্তরে আছে সঞ্চিত । কত      নিঠুর কঠোর দরশে ঘরষে                মর্মমাঝারে শল্য বরষে               তবু প্রাণমন পীযূষপরশে                    পলে পলে পুলকাঞ্চিত ! আজি    কিসের পিপাসা মিটিল না , ওগো                 পরম - পরান - বল্লভ । চিতে    চিরসুধা করে সঞ্চার , তব                সকরুণ করপল্লব । হেথা     কত দিনে রাতে অপমানঘাতে                আছি নতশির গঞ্জিত , তবু      চিত্তললাট তোমারি স্বকরে                রয়েছে তিলকরঞ্জিত । হেথা     কে আমার কানে কঠিন বচনে                বাজায় বিরোধঝঞ্ঝনা ! প্রাণে    দিবসরজনী উঠিতেছে ধ্বনি                তোমারি বীণার গুঞ্জনা । নাথ ,     যার যাহা আছে তার তাই থাক্‌ ,                আমি থাকি চিরলাঞ্ছিত । শুধু      তুমি এ জীবনে নয়নে নয়নে                থাকো থাকো চিরবাঞ্ছিত । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) প্রিয়া শত বার ধিক্‌ আজি আমারে, সুন্দরী, তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি। তোমার মহিমাজ্যোতি তব মূর্তি হতে আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে। যখন তোমার ‘পরে পড়ে নি নয়ন জগৎ-লক্ষ্মীর দেখা পাই নি তখন। স্বর্গের অঞ্জন তুমি মাখাইলে চোখে, তুমি মোরে রেখে গেছ অনন্ত এ লোকে। এ নীল আকাশ এত লাগিত কি ভালো, যদি না পড়িত মনে তব মুখ-আলো। অপরূপ মায়াবলে তব হাসি-গান বিশ্বমাঝে লভিয়াছে শত শত প্রাণ। তুমি এলে আগে-আগে দীপ লয়ে করে, তব পাছে পাছে বিশ্ব পশিল অন্তরে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) প্রেম নিবিড়তিমির নিশা, অসীম কান্তার, লক্ষ দিকে লক্ষ জন হইতেছে পার। অন্ধকারে অভিসার, কোন্‌ পথপানে কার তরে, পান্থ তাহা আপনি না জানে। শুধু মনে হয় চিরজীবনের সুখ এখনি দিবেক দেখা লয়ে হাসিমুখ। কত স্পর্শ কত গন্ধ কত শব্দ গান কাছ দিয়ে চলে যায় শিহরিয়া প্রাণ। দৈবযোগে ঝলি উঠে বিদ্যুতের আলো, যারেই দেখিতে পাই তারে বাসি ভালো— তাহারে ডাকিয়া বলি—ধন্য এ জীবন, তোমারি লাগিয়া মোর এতেক ভ্রমণ। অন্ধকারে আর সবে আসে যায় কাছে, জানিতে পারি নে তারা আছে কি না আছে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) প্রেমতত্ত্ব নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে তটিনী মিশেছে সাগর-‘পরে, পবনের সাথে মিশিছে পবন চির-সুমধুর প্রণয়-ভরে! জগতে কেহই নাইকো একেলা, সকলি বিধির নিয়ম-গুণে, একের সহিত মিশিছে অপরে আমি বা কেন না তোমার সনে? দেখো, গিরি ওই চুমিছে আকাশে, ঢেউ-‘পরে ঢেউ পড়িছে ঢলি, সে কুলবালারে কে বা না দোষিবে, ভাইটিরে যদি যায় সে ভুলি! রবি-কর দেখো চুমিছে ধরণী, শশি-কর চুমে সাগর জল, তুমি যদি মোরে না চুম’, ললনা, এ-সব চুম্বনে কী তবে ফল?P. B. Shelley (অনুবাদ কবিতা) প্রেমের আদিম জ্যোতি আকাশে সঞ্চরে প্রেমের আদিম জ্যোতি আকাশে সঞ্চরে শুভ্রতম তেজে, পৃথিবীতে নামে সেই নানা রূপে রূপে নানা বর্ণে সেজে।       (স্ফুলিঙ্গ) প্রেমের আনন্দ থাকে প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ। প্রেমের বেদন থাকে সমস্ত জীবন।   (স্ফুলিঙ্গ) প্রেয়সী হে প্রেয়সী, হে শ্রেয়সী, হে বীণাবাদিনী, আজি মোর চিত্তপদ্মে বসি একাকিনী ঢালিতেছ স্বর্গসুধা; মাথার উপর সদ্যস্নাত বরষার স্বচ্ছ নীলাম্বর রাখিয়াছে স্নিগ্ধহস্ত আশীর্বাদে ভরা; সম্মুখেতে শস্যপূর্ণ হিল্লোলিত ধরা বুলায় নয়নে মোর অমৃতচুম্বন; উতলা বাতাস আসি করে আলিঙ্গন; অন্তরে সঞ্চার করি আনন্দের বেগ বহে যায় ভরা নদী; মধ্যাহ্নের মেঘ স্বপ্নমালা গাঁথি দেয় দিগন্তের ভালে। তুমি আজি মুগ্ধমুখী আমারে ভুলালে, ভুলাইলে সংসারের শতলক্ষ কথা— বীণাস্বরে রচি দিলে মহা নীরবতা।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক; অনাদরের শস্য গজায়, তুচ্ছ দামের শাক। আঁচল ভরে তুলতে আসে গরিব-ঘরের মেয়ে, খুশি হয়ে বাড়িতে যায়, যা জোটে তাই পেয়ে। আজকে আমার চাষ চলে না, নাই লাঙলের বালাই; পোড়ো মাঠের কুঁড়েমিতে মন্থর দিন চালাই। জমিতে রস কিছু আছে, শক্ত যায় নি আঁটি; ফলায় না সে ফল তবুও সবুজ রাখে মাটি। শ্রাবণ আমার গেছে চলে, নাই বাদলের ধারা; অঘ্রান সে সোনার ধানের দিন করেছে সারা। চৈত্র আমার রোদে পোড়া, শুকনো যখন নদী, বুনো ফলের ঝোপের তলায় ছায়া বিছায় যদি, জানব আমার শেষের মাসে ভাগ্য দেয় নি ফাঁকি, শ্যামল ধরার সঙ্গে আমার বাঁধন রইল বাকি।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) ফসল গিয়েছে পেকে ফসল গিয়েছে পেকে, দিনান্ত আপন চিহ্ন দিল তারে পাণ্ডূর আভায়।          আলোকের ঊর্ধ্বসভা হতে     আসন পড়িছে নুয়ে ভূতলের পানে।          যে মাটির উদ্‌বোধন বাণী               জাগায়েছে তারে একদিন,          শোনো আজি তাহারই আহ্বান                 আসন্ন রাত্রির অন্ধকারে।   সে মাটির কোল হতে যে দান নিয়েছে এতকাল       তার চেয়ে বেশি প্রাণ কোথাও কি হবে ফিরে দেওয়া          কোনো নব জন্মদিনে নব সূর্যোদয়ে! ফাগুন এল দ্বারে ফাগুন এল দ্বারে, কেহ যে ঘরে নাই— পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।   (স্ফুলিঙ্গ) ফুরিয়ে গেল পৌষের দিন ফুরিয়ে গেল পৌষের দিন; কৌতূহলী ভোরের আলো কুয়াশার আবরণ দিলে সরিয়ে। হঠাৎ দেখি শিশিরে-ভেজা বাতাবি গাছে ধরেছে কচি পাতা; সে যেন আপনি বিস্মিত। একদিন তমসার কূলে বাল্মীকি আপনার প্রথম নিশ্বসিত ছন্দে চকিত হয়েছিলেন নিজে,-- তেমনি দেখলেম ওকে। অনেকদিনকার নিঃশব্দ অবহেলা থেকে অরুণ-আলোতে অকুণ্ঠিত বাণী এনেছে এই কয়টি কিশলয়; সে যেন সেই একটুখানি কথা তুমিই বলতে পারতে, কিন্তু না ব'লে গিয়েছ চলে। সেদিন বসন্ত ছিল অনতিদূরে; তোমার আমার মাঝখানে ছিল আধ-চেনার যবনিকা কেঁপে উঠল সেটা মাঝে মাঝে; মাঝে মাঝে তার একটা কোণ গেল উড়ে; দুরন্ত হয়ে উঠল দক্ষিণ বাতাস, তবু সরাতে পারেনি অন্তরাল। উচ্ছৃঙ্খল অবকাশ ঘটল না; ঘণ্টা গেল বেজে, সায়াহ্নে তুমি চলে গেলে অব্যক্তের অনালোকে। ফুল ও ফল ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল, কত দূরে রয়েছিস বল্‌ মোরে বল্‌। ফল কহে, মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি, তোমারি অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ফুল কোথা থাকে গোপনে ফুল কোথা থাকে গোপনে, গন্ধ তাহারে প্রকাশে। প্রাণ ঢাকা থাকে স্বপনে, গান যে তাহারে প্রকাশে।   (স্ফুলিঙ্গ) ফুল ছিঁড়ে লয় ফুল ছিঁড়ে লয় হাওয়া, সে পাওয়া মিথ্যে পাওয়া– আনমনে তার পুষ্পের ভার ধুলায় ছড়িয়ে যাওয়া।যে সেই ধুলার ফুলে হার গেঁথে লয় তুলেহেলার সে ধন হয় যে ভূষণ তাহারি মাথার চুলে।শুধায়ো না মোর গান কারে করেছিনু দান– পথধুলা-'পরে আছে তারি তরে যার কাছে পাবে মনি।   (স্ফুলিঙ্গ) ফুলদানি হতে একে একে ফুলদানি হতে একে একে আয়ুক্ষীণ গোলাপের পাপড়ি পড়িল ঝরে ঝরে। ফুলের জগতে মৃত্যুর বিকৃতি নাহি দেখি। শেষ ব্যঙ্গ নাহি হানে জীবনের পানে অসুন্দর। যে মাটির কাছে ঋণী আপনার ঘৃণা দিয়ে অশুচি করে না তারে ফুল, রূপে গন্ধে ফিরে দেয় ম্লান অবশেষ। বিদায়ের সকরুণ স্পর্শ আছে তাহে; নাইকো ভর্ৎসনা। জন্মদিনে মৃত্যুদিনে দোঁহে যবে করে মুখোমুখি দেখি যেন সে মিলনে পূর্বাচলে অস্তাচলে অবসন্ন দিবসের দৃষ্টিবিনিময়-- সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান। ফুলবালা গাথাতরল জলদে বিমল চাঁদিমা    সুধার ঝরণা দিতেছে ঢালি। মলয় ঢলিয়া কুসুমের কোলে    নীরবে লইছে সুরভিডালি। যমুনা বহিছে নাচিয়া নাচিয়া    গাহিয়া গাহিয়া অফুট গান— থাকিয়া থাকিয়া বিজনে পাপিয়া    কানন ছাপিয়া তুলিছে তান। পাতায় পাতায় লুকায়ে কুসুম,    কুসুমে কুসুমে শিশির দুলে— শিশিরে শিশিরে জোছনা পড়েছে    মুকুতা-গুলিন সাজায়ে ফুলে। তটের চরণে তটিনী ছুটিছে,    ভ্রমর লুটিছে ফুলের বাস— সেঁউতি ফুটিছে, বকুল ফুটিছে    ছড়ায়ে ছড়ায়ে সুরভিশ্বাস। কুহরি উঠিছে কাননে কোকিল,    শিহরি উঠিছে দিকের বালা— তরল লহরী গাঁথিছে আঁচলে    ভাঙা ভাঙা যত চাঁদের মালা। ঝোপে ঝোপে ঝোপে লুকায়ে আঁধার,    হেথা হোথা চাঁদ মারিছে উঁকি— সুধীরে আঁধার-ঘোমটা হইতে    কুসুমের থোলো হাসে মুচুকি। এস কল্‌পনে! এ মধুর রেতে    দুজনে বীণায় পূরিব তান। সকল ভুলিয়া হৃদয় খুলিয়া    আকাশে তুলিয়া করিব গান। হাসি কহে বালা, “ফুলের জগতে    যাইবে আজিকে কবি? দেখিবে কত কি অভূত ঘটনা,    কত কি অভূত ছবি! চারি দিকে যেথা ফুলে ফুলে আলা    উড়িছে মধুপকুল। ফুলদলে-দলে ভ্রমি ফুলবালা    ফুঁ দিয়া ফুটায় ফুল। দেখিবে কেমনে শিশিরসলিলে    মুখ মাজি ফুলবালা কুসুমরেণুর সিঁদুর পরিয়া    ফুলে ফুলে করে খেলা। দেহখানি ঢাকি ফুলের বসনে    প্রজাপতি-’পরে চড়ি কমলকাননে কুসুমকামিনী    ধীরে ধীরে যায় উড়ি। কমলে বসিয়া মুচুকি হাসিয়া    দুলিছে লহরীভরে, হাসিমুখখানি দেখিছে নীরবে    সরসী-আরসি-’পরে। ফুলকোল হ’তে পাপড়ি খসায়ে    সলিলে ভাসায়ে দিয়া চড়ি সে পাতায় ভেসে ভেসে যায়    মিরে ডাকিয়া নিয়া। কোলে ক’রে লয়ে মিরে তখন    গাহিবারে কহে গান। গান গাওয়া হলে হরষে মোহিনী    ফুলমধু করে দান। দুই চারি বালা হাত ধরি ধরি    কামিনী-পাতায় বসি চুপি চুপি চুপি ফুলে দেয় দোল,    পাপড়ি পড়য়ে খসি। দুই ফুলবালা মিলি বা কোথায়    গলা-ধরাধরি করি ঘাসে ঘাসে ঘাসে ছুটিয়া বেড়ায়    প্রজাপতি ধরি ধরি কুসুমের ‘পরে দেখিয়া মিরে    আবরি পাতার দ্বার ফুলফাঁদে ফেলি পাখায় মাখায়    কুসুমরেণুর ভার। ফাঁফরে পড়িয়া মির উড়িয়া    বাহির হইতে চায়, কুসমরমণী হাসিয়া অমনি    ছুটিয়ে পালিয়ে যায়। ডাকিয়া আনিয়া সবারে তখনি    প্রমোদে হইয়া ভোর কহে হাসি হাসি করতালি দিয়া    ‘কেমন পরাগচোর!” এত বলি ধীরে কলপনা-রাণী    বীণায় আভানি তান বাজাইল বীণা আকাশ ভরিয়া    অবশ করিয়া প্রাণ! গভীর নিশীথে সুদূর আকাশে    মিশিল বীণার রব, ঘুমঘোরে আঁখি মুদিয়া রহিল    দিকের বালিকা সব। ঘুমায়ে পড়িল আকাশ পাতাল,    ঘুমায়ে পড়িল স্বরগবালা, দিগন্তের কোলে ঘুমায়ে পড়িল    জোছনা-মাখানো জলদমালা। একি একি ওগো কলপনা সখি!    কোথায় আনিলে মোরে! ফুলের পৃথিবী— ফুলের জগৎ—    স্বপন কি ঘুমঘোরে? হাসি কলপনা কহিল শোভনা,    “মোর সাথে এস কবি! দেখিবে কত কি অভূত ঘটনা    কত কি অভূত ছবি! ওই দেখ ওই ফুলবালাগুলি    ফুলের সুরভি মাখিয়া গায় শাদা শাদা ছোট পাখাগুলি তুলি    এ ফুলে ও ফুলে উড়িয়া যায়! এ ফুলে লুকায়, ও ফুলে লুকায়—    এ ফুলে ও ফুলে মারিছে উঁকি, গোলাপের কোলে উঠিয়া দাঁড়ায়—    ফুল টলমল পড়িছে ঝুঁকি। ওই হোথা ওই ফুলশিশু-সাথে    বসি ফুলবালা অশোক ফুলে দুজনে বিজনে প্রেমের আলাপ    কহে চুপিচুপি হৃদয় খুলে।” কহিল হাসিয়া কলপনাবালা    দেখায়ে কত কি ছবি, “ফুলবালাদের প্রেমের কাহিনী    শুনিবে এখন কবি?” এতেক শুনিয়া আমরা দুজনে    বসিনু চাঁপার তলে, সুমুখে মোদের কমলকানন    নাচে সরসীর জলে। এ কি কলপনা, এ কি লো তরুণী,    দুরন্ত কুসুমশিশু ফুলের মাঝারে লুকায়ে লুকায়ে    হানিছে ফুলের ইষু। চারি দিক হতে ছুটিয়া আসিয়া শৈশবসঙ্গীত    হেরিয়া নূতন প্রাণী চারি ধার ঘিরি রহিল দাঁড়ায়ে    যতেক কুসুমরাণী! গোলাপ মালতী, শিউলি সেঁউতি,    পারিজাত নরগেশ, সব ফুলবাস মিলি এক ঠাঁই    ভরিল কাননদেশ। চুপি চুপি আসি কোন ফুলশিশু    ঘা মারে বীণার ‘পরে, ঝন্‌ করি যেই বাজি উঠে তার    চমকি পলায় ডরে। অমনি হাসিয়া কলপনাসখী    বীণাটি লইয়া করে, ধীরি ধীরি ধীরি মৃদুল মৃদুল    বাজায় মধুর স্বরে অবাক্‌ হইয়া ফুলবালাগণ    মোহিত হইয়া তানে নীরব হইয়া চাহিয়া রহিল    শোভনার মুখপানে। ধীরি ধীরি সবে বসিয়া পড়িল    হাতখানি দিয়া গালে, ফুলে বসি বসি ফুলশিশুগণ     দুলিতেছে তালে তালে। হেন কালে এক আসিয়া মির    কহিল তাদের কানে, “এখনো রয়েছে বাকী কত কাজ,    ব’সে আছ এইখানে? রঙ দিতে হবে কুসুমের দলে,    ফুটাতে হইবে কুঁড়ি— মধুহীন কত গোলাপকলিকা    রয়েছে কানন জুড়ি!” অমনি যেন রে চেতন পাইয়া    যতেক কুসুমবালা, পাখাটি নাড়িয়া উড়িয়া উড়িয়া    পশিল কুসুমশালা। মুখ ভারী করি ফুলশিশুদল    তুলিকা লইয়া হাতে মাখাইয়া দিল কত কি বরণ    কুসুমের পাতে পাতে। চারি দিকে দিকে ফুলশিশুদল    ফুলের বালিকা কত নীরব হইয়া রয়েছে বসিয়া,    সবাই কাজেতে রত। চারি দিক এবে হইল বিজন,    কানন নীরব ছবি— ফুলবালাদের প্রেমের কাহিনী    কহে কলপনাদেবী।            —    আজি পূরণিমা নিশি,    তারকাকাননে বসি অলসনয়নে শশী    মৃদুহাসি হাসিছে। পাগল পরাণে ওর লেগেছে ভাবের ঘোর, যামিনীর পানে চেয়ে    কি যেন কি ভাষিছে! কাননে নিঝর ঝরে মৃদু কলকল স্বরে, অলি ছুটাছুটি করে    গুন্‌ গুন্‌ গাহিয়া! সমীর অধীরপ্রাণ গাহিয়া উঠিছে গান, তটিনী ধরেছে তান,    ডাকি উঠে পাপিয়া। সুখের স্বপন-মত পশিছে সে গান যত ঘুমঘোরে জ্ঞানহত    দিক্‌বধূ-শ্রবণে— সমীর সভয়হিয়া মৃদু মৃদু পা টিপিয়া উঁকি মারি দেখে গিয়া    লতাবধূ-ভবনে! কুসুম-উৎসবে আজি ফুলবালা ফুলে সাজি, কত না মধুপরাজি    এক ঠাঁই কাননে! ফুলের বিছানা পাতি হরষে প্রমোদে মাতি কাটাইছে সুখরাতি    নৃত্যগীতবাদনে!    ফুলবাস পরিয়া    হাতে হাতে ধরিয়া নাচি নাচি ঘুরি আসে কুসুমের রমণী।    চুলগুলি এলিয়ে    উড়িতেছে খেলিয়ে, ফুলরেণু ঝরি ঝরি পড়িতেছে ধরণী।    ফুলবাঁশী ধরিয়ে    মৃদু তান ভরিয়ে বাজাইছে ফুলশিশু বসি ফুল-আসনে।    ধীরে ধীরে হাসিয়া    নাচি নাচি আসিয়া তালে তালে করতালি দেয় কেহ সঘনে।    কোনো ফুলরমণী    চুপি চুপি অমনি ফুলবালকের কানে কথা যায় বলিয়ে।    কোথাও বা বিজনে    বসি আছে দুজনে, পৃথিবীর আর সব গেছে যেন ভুলিয়ে!    কোনো ফুলবালিকা    গাঁথি ফুলমালিকা ফুলবালকের কথা একমনে শুনিছে,    বিব্রত শরমে    হরষিত-মরমে আনত আননে বালা ফুলদল গুণিছে!দেখেছ হোথায় অশোকবালক    মালতীর পাশে গিয়া কহিছে কত কি মরমকাহিনী,    খুলিয়া দিয়াছে হিয়া। ভ্রূকুটি করিয়া নিদয়া মালতী    যেতেছে সুদূরে চলি, মৃদু-উপহাসে সরল প্রেমের    কোমলহৃদয় দলি। অধীর অশোক যদি বা কখনো    মালতীর কাছে আসে, ছুটিয়া অমনি পলায় মালতী    বসে বকুলের পাশে। থাকিয়া থাকিয়া সরোষ ভ্রূকুটি    অশোকের পানে হানে— ভ্রূকুটি সেগুলি বাণের মতন    বিঁধিল অশোকপ্রাণে। হাসিতে হাসিতে কহিল মালতী    বকুলের সাথে কথা, মলিন অশোক রহিল বসিয়া    হৃদয়ে বহিয়া ব্যথা। দেখ দেখি চেয়ে মালতীহৃদয়ে    কাহারে সে ভালবাসে! বল দেখি মোরে হৃদয় তাহার    রয়েছে কাহার পাশে? ওই দেখ তার হৃদয়ের পটে    অশোকেরই নাম লিখা! অশোকেরি তরে জ্বলিছে তাহার    প্রণয়-অনলশিখা! এই যে নিদয় চাতুরী সতত    দলিছে অশোকপ্রাণ— অশোকের চেয়ে মালতীহৃদয়ে    বিঁধিছে তাহার বাণ। মনে মনে করে কত বার বালা,    অশোকের কাছে গিয়া, কহিবে তাহারে মরমকাহিনী    হৃদয় খুলিয়া দিয়া। ক্ষমা চাবে গিয়া পায়ে ধরে তার,    খাইয়া লাজের মাথা পরাণ ভরিয়া লইবে কাঁদিয়া,    কহিবে মনের ব্যথা। তবুও কি যেন আটকে চরণ,    সরমে সরে না বাণী, বলি বলি করি বলিতে পারে না    মনোকথা ফুলরাণী। মন চাহে এক ভিতরে ভিতরে,    প্রকাশ পায় যে আর— সামালিতে গিয়া নারে সামালিতে    এমন জ্বালা সে তার! মলিন অশোক ম্রিয়মাণ মুখে    একেলা রহিল সেথা, নয়নের বারি নয়নে নিবারি    হৃদয়ে হৃদয়ব্যথা। দেখে নি কিছুই, শোনে নি কিছুই    কে গায় কিসের গান, রহিয়াছে বসি বহি আপনার    হৃদয়ে-বিঁধানো বাণ। কিছুই নাহি রে পৃথিবীতে যেন,    সব সে গিয়েছে ভুলি, নাহি রে আপনি— নাহি রে হৃদয়—    রয়েছে ভাবনাগুলি। ফুলবালা এক, দেখিয়া অশোকে    আদরে কহিল তারে, “কেন গো অশোক, মলিন হইয়া    ভাবিছ বসিয়া কারে?” এত বলি তার ধরি হাতখানি    আনিল সভার ‘পরে— “গাও না অশোক— গাও” বলি তারে    কত সাধাসাধি করে। নাচিতে লাগিল ফুলবালা-দল—    মির ধরি তান— মৃদু মৃদু মৃদু বিষাদের স্বরে    অশোক গাহিল গান।গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে,    মধুপ হোথা যাস্‌ নে— ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে    কাঁটার ঘা খাস্‌ নে! হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা,    শেফালী হোথা ফুটিয়ে— ওদের কাছে মনের ব্যথা    বল্‌ রে মুখ ফুটিয়ে! মির কহে, “হোথায় বেলা,    হোথায় আছে নলিনী— ওদের কাছে বলিব নাকো    আজিও যাহা বলি নি! মরমে যাহা গোপন আছে    গোলাপে তাহা বলিব, বলিতে যদি জ্বলিতে হয়    কাঁটারি ঘায়ে জ্বলিব!” বিষাদের গান কেন গো আজিকে?    আজিকে প্রমোদরাতি! হরষের গান গাও গো অশোক    হরষে প্রমোদে মাতি! সবাই কহিল, “গাও গো অশোক,    গাও গো প্রমোদগান, নাচিয়া উঠুক কুসুমকানন    নাচিয়া উঠুক প্রাণ!” কহিল অশোক, “হরষের গান    গাহিতে বোলো না আর— কেমনে গাহিব? হৃদয়বীণায়    বাজিছে বিষাদ-তার।” এতেক বলিয়া অশোক বালক    বসিল ভূমির ‘পরে— কে কোথায় সব গেল সে ভুলিয়া    আপন ভাবনা-ভরে! কিছু দিন আগে কি ছিল অশোক!    তখন আরেক ধারা, নাচিয়া ছুটিয়া এখানে সেখানে    বেড়াত অধীর-পারা! নবীন যুবক, শোহনগঠন,    সবাই বাসিত ভালো— যেখান যাইত অশোক যুবক    সেখান করিত আলো! কিছু দিন হতে এ কেমন ভাব—    কোথাও না যায় আর। একলাটি থাকে বিরলে বসিয়া    হৃদয়ে পাষাণভার! অরুণকিরণ হইতে এখন    বরণ বাহির করি রাঙায় না আর ললিত বসন    মোহিনী তুলিটি ধরি। পূরণিমা-রেতে জোছনা হইতে    অমিয় করিয়া চুরি মধু নিরমিয়া নাহি রাখে আর    কুসুমপাতায় পূরি!ক্রমশ নিভিল চাঁদের জোছনা,    নিভিল জোনাক-পাঁতি— পূরবের দ্বারে উষা উঁকি মারে,    আলোকে মিশাল রাতি! প্রভাত-পাখীরা উঠিল গাহিয়া,    ফুটিল প্রভাতকুসুমকলি— প্রভাতশিশিরে নাহিবে বলিয়া    চলে ফুলবালা পথ উজলি। তার পরদিন রটিল প্রবাদ    অশোক নাইক ঘরে! কোথায় অবোধ কুসুমবালক    গিয়েছে বিষাদভরে! কুসুমে কুসুমে পাতায় পাতায়    খুঁজিয়া বেড়ায় সকলে মিলি— কি হবে— কোথাও নাহিক অশোক!    কোথায় বালক গেল রে চলি!কহে কলপনা, “খুঁজি চল গিয়া    অশোক গিয়াছে কোথা— সুমুখে শোভিছে কুসুমকানন    দেখ দেখি, কবি, হোথা! ঘার উঁচু করি হোথা গরবিনী    ফুটেছে ম্যাগ্‌নোলিয়া— কাননের যেন চোখের সামনে    রূপরাশি খুলি দিয়া! সাধাসাধি করে কত শত ফুল    চারি দিকে হেথা হোথা— মুচকিয়া হাসে গরবের হাসি    ফিরিয়া না কয় কথা! হ্যাদে দেখ, কবি, সরসীভিতরে    কমল কেমন ফুটেছে! এ পাশে ও পাশে পড়িছে হেলিয়া—    প্রভাতসমীর উঠেছে! ঘোমটা-ভিতরে লোহিত অধরে    বিমল কোমল হাসি সরসী-আলয় মধুর করেছে    সৌরভ রাশি রাশি! নিরমল জলে নিরমল রূপে    পৃথিবী করিছে আলো— পৃথিবীর প্রেমে তবু নাহি মন,    রবিরেই বাসে ভালো! কাননবিপিনে কত ফুল ফুটে    কিছুই বালা না জানে, হৃদয়ের কথা কহে সুবদনী,    সখীদের কানে কানে। হোথায় দেখেছ লজ্জাবতী লতা    লুটায়ে ধরণী-’পরে, ঘার হেঁট করি কেমন রয়েছে    মরমসরম-ভরে। দূর হতে তার দেখিয়া আকার    মির যদিবা আসে সরমে সভয়ে মলিন হইয়া    স’রে যায় এক পাশে! গুন গুন করি যদিবা মির    শুধায় প্রেমের কথা— কাঁপে থর থর, না দেয় উতর,    হেঁট করি থাকে মাথা! ওই দেখ হোথা রজনীগন্ধা    বিকাশে বিশদ বিভা, মধুপে ডাকিয়া দিতেছে হাঁকিয়া    ঘাড় নাড়ি নাড়ি কিবা!”চমকিয়া কহে কল্পনাবালা,—    “দেখিয়া কাননছবি ভুলিয়ে গেলাম যে কাজে আমরা    এসেছি এখানে কবি! ওই যে মালতী বিরলে বসিয়া    সুবাস দিয়াছে এলি, মাথার উপরে আটকে তপন    প্রজাপতি পাখা মেলি। এস দেখি, কবি, ওইখানটিতে    দাঁড়াই গাছের তলে, শুনি চুপি চুপি মালতীবালারে    মির কি কথা বলে।” কহিছে মির, “কুসুমকুমারি—    বকুল পাঠালে মোরে, তাই ত্বরা ক’রে এসেছি হেথায়    বারতা শুনাতে তোরে! অশোকবালক কি যে হয়ে গেছে    সে কথা বলিব কারে। তোর মত হেন মোহিনীবালারে    ভুলিতে কি কভু পারে? তবু তারে আহা উপেখিয়া তুই    র’বি কি হেথায় বোন? পরাণ সঁপিয়া অশোক তবু কি    পাবে নাকো তোর মন? মনের হুতাশে আশারে পুড়ায়ে    উদাস হইয়া গেছে, কাননে কাননে খুঁজিয়া বেড়াই    কে জানে কোথায় আছে।” চমকি উঠিল মালতীবালিকা    ঘুম হ’তে যেন জাগি, অবাক্‌ হইয়া রহিল বসিয়া    কি জানি কিসের লাগি! “চলিয়া গিয়াছে অশোককুমার?”    কহিল ক্ষণেক-পর, “চলিয়া গিয়াছে অশোক আমার    ছাড়িয়া আপন ঘর? তবে আর আমি বিষাদকাননে    থাকিব কিসের আশে? যাইব অশোক গিয়েছে যেখানে,    যাইব তাহার পাশে! বনে বনে ফিরি বেড়াব খুঁজিয়া    শুধাব লতার কাছে, খুঁজিব কুসুমে খুঁজিব পাতায়    অশোক কোথায় আছে! খুঁজিয়া খুঁজিয়া অশোকে আমার    যায় যদি যাবে প্রাণ— আমা হ’তে তবু হবে না কখনো    প্রণয়ের অপমান!”ছাড়ি নিজবন চলিল মালতী    চলিল আপন মনে, অশোকবালকে খুঁজিবার তরে    ফিরে কত বনে বনে। “অশোক” “অশোক” ডাকিয়া ডাকিয়া    লতায় পাতায় ফিরে, মিরে শুধায়, ফুলেরে শুধায়,—    “অশোক এখানে কি রে?” হোথায় নাচিছে অমল সরসী    চল দেখি হোথা কবি— নিরমল জলে নাচিছে কমল    মুখ দেখিতেছে রবি! রাজহাঁস দেখ সাঁতারিছে জলে    শাদা শাদা পাখা তুলি, পিঠের উপরে পাখার উপরে    বসি ফুলবালাগুলি! এখানেও নাই, চল যাই তবে—    ওই নিঝরের ধারে মাধবী ফুটেছে, শুধাই উহারে    বলিতে যদি সে পারে। বেগে উথলিয়া পড়িছে নিঝর—    ফেনগুলি ধরি ধরি ফুলশিশুগণ করিতেছে খেলা    রাশ রাশ করি করি! আপনার ছায়া ধরিবারে গিয়া    না পেয়ে হাসিয়া উঠে— হাসিয়া হাসিয়া হেথায় হোথায়    নাচিয়া খেলিয়া ছুটে! ওগো ফুলশিশু! খেলিছ হোথায়    শুধাই তোমার কাছে, অশোকবালকে দেখেছ কোথাও,    অশোক হেথা কি আছে? এখানেও নাই, এস তবে, কবি,    কুসুমে খুঁজিয়া দেখি— ওই যে ওখানে গোলাপ ফুটিয়া    হোথায় রয়েছে— এ কি? এ কি গো ঘুমায়— হেথায়— হেথায়—    মুদিয়া দুইটি আঁখি, গোলাপের কোলে মাথাটি সঁপিয়া    পাতায় দেহটি রাখি! এই আমাদের অশোকবালক    ঘুমায়ে রয়েছে হেথা! দুখিনী ব্যাকুলা মালতীবালিকা    খুঁজিয়া বেড়ায় কোথা? চল চল, কবি, চল দুই জনে    মালতীরে ডেকে আনি, হরষে এখনি উঠিবে নাচিয়া    কাতরা কুসুমরাণী!            ...কোথাও তাহারে পেনু না খুঁজিয়া    এখন কি করি তবে! অশোকবালক না যায় কোথাও,    বুঝায়ে রাখিতে হবে! গোলাপশয়নে ঘুমায় অশোক    দুখতাপ সব ভুলি, চল দেখি সেথা কহিব আমরা    সব কথা তারে খুলি! দেখ দেখ, কবি, অশোকশিয়রে    ওই না মালতী হোথা? গোলাপ হইতে লয়েছে তুলিয়া    কোলে অশোকের মাথা। কত যে বেড়ানু খুঁজিয়া খুঁজিয়া    কাননে কাননে পশি! কখন্‌ হেথায় এসেছে বালিকা?    রয়েছে হোথায় বসি! ঘুমায়ে রয়েছে অশোকবালক    শ্রমেতে কাতর হয়ে, মুখের পানেতে চাহিয়া মালতী    কোলেতে মাথাটি লয়ে! ঘুমায়ে ঘুমায়ে অশোকবালক    সুখের স্বপন হেরে, গাছের পাতাটি লইয়া মালতী    বীজন করিছে তারে। নত করি মুখ দেখিছে বালিকা    দুখানি নয়ন ভরি, নয়ন হইতে শিশিরের মত    সলিল পড়িছে ঝরি! ঘুমায়ে ঘুমায়ে অশোকের যেন    অধর উঠিল কাঁপি! “মালতী” “মালতী” বলিয়া বালার    হাতটি ধরিল চাপি! হরষে ভাসিয়া কহিল মালতী    হেঁট করি আহা মাথা, “অশোক— অশোক— মালতী তোমার    এই যে রয়েছে হেথা!” ঘুমের ঘোরেতে পশিল শ্রবণে    “এই-যে, রয়েছে হেথা!” নয়নের জলে ভিজায়ে পলক    অশোক তুলিল মাথা! একি রে স্বপন? এখনো একি রে    স্বপন দেখিছে নাকি? আবার চাহিল অশোকবালক,    আবার মাজিল আঁখি! অবাক্‌ হইয়া রহিল বসিয়া,    বচন নাহিক সরে— থাকিয়া থাকিয়া পাগলের মত    কহিল অধীর স্বরে, “মালতী— মালতী— আমার মালতী!”    মালতী কহিল কাঁদি “তোমারি মালতী! তোমারি মালতী!”    অশোকের হৃদয়ে বাঁধি!— “ক্ষমা কর মোরে অশোক আমার,    কত না দিয়েছি জ্বালা! ভালবাসি ব’লে ক্ষমা কর মোরে    আমি যে অবোধ বালা! তোমার হৃদয় ছাড়িয়া কখন    আর না যাইব চলি, দিবস রজনী রহিব হেথায়    বিষাদ ভাবনা ভুলি! ও হৃদয় ছাড়ি মালতীর আর    কোথায় আরাম আছে? তোমারে ছাড়িয়া দুখিনী মালতী    যাবে আর কার কাছে?” অশোকের হাতে দিয়া দুটি হাত    কত যে কাঁদিল বালা! কাঁদিছে দুজনে বসিয়া বিজনে    ভুলিয়া সকল জ্বালা! উড়িল দুজনে পাশাপাশি হয়ে    হাত ধরাধরি করি— সাজিল তখন পৃথিবী জগৎ    হাসিতে আনন ভরি! গাহিয়া উঠিল হরষে মির,    নিঝর বহিল হাসি— দুলিয়া দুলিয়া নাচিল কুসুম    ঢালিয়া সুরভিরাশি! ফিরিল আবার অশোকের ভাব    প্রমোদে পূরিল প্রাণ— এখানে সেখানে বেড়ায় খেলিয়া    হরষে গাহিয়া গান। অশোক মালতী মিলিয়া দুজনে    জোনাকের আলো জ্বালি একই কুসুমে মাখায় বরণ,    মধু দেয় ঢালি ঢালি!বরষের পরে এল হরষের যামিনী আবার মিলিল যত কুসুমের কামিনী! জোছনা পড়িছে ঝরি সুমুখের সরসে—    টলমল ফুলদলে,    ধরি ধরি গলে দলে,    নাচে ফুলবালা-দলে,        মালা দুলে উরসে— তখন সুখের তানে মরমের হরষে অশোক মনের সাধে গীতধারা বরষে।দেখে যা— দেখে যা— দেখে যা লো তোরা        সাধের কাননে মোর আমার সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া, মলয় বহিছে সুরভি লুটিয়া রে— হেথা জ্যোছনা ফুটে তটিনী ছুটে        প্রমোদে কানন ভোর। আয় আয় সখি, আয় লো, হেথা দুজনে কহিব মনের কথা, তুলিব কুসুম দুজনে মিলি রে— সুখে গাঁথিব মালা, গণিব তারা,        করিব রজনী ভোর! এ কাননে বসি গাহিব গান, সুখের স্বপনে কাটাব প্রাণ, খেলিব দুজনে মনেরি খেলা রে— প্রাণে রহিবে মিশি দিবস নিশি        আধো আধো ঘুমঘোর! ফুলের অক্ষরে প্রেম ফুলের অক্ষরে প্রেম লিখে রাখে নাম আপনার— ঝ’রে যায়, ফেরে সে আবার। পাথরে পাথরে লেখা কঠিন স্বাক্ষর দুরাশার ভেঙে যায়, নাহি ফেরে আর।    (স্ফুলিঙ্গ) ফুলের ইতিহাস বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল        প্রথম মেলিল আঁখি তার,        প্রথম হেরিল চারি ধার।           মধুকর গান গেয়ে বলে,        ‘মধু কই, মধু দাও দাও। '         হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে        ফুল বলে, ‘এই লও লও। '        বায়ু আসি কহে কানে কানে,        ‘ফুলবালা, পরিমল দাও। '        আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল,        ‘যাহা আছে সব লয়ে যাও। '        তরুতলে চ্যুতবৃন্ত মালতীর ফুল        মুদিয়া আসিছে আঁখি তার,        চাহিয়া দেখিল চারি ধার।        মধুকর কাছে এসে বলে,        ‘মধু কই, মধু চাই চাই। '        ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া        ফুল বলে, ‘কিছু নাই নাই। '        ‘ফুলবালা, পরিমল দাও'        বায়ু আসি কহিতেছে কাছে।        মলিন বদন ফিরাইয়া        ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ) ফুলের কলিকা প্রভাতরবির ফুলের কলিকা প্রভাতরবির প্রসাদ করিছে লাভ, কবে হবে তার হৃদয় ভরিয়া ফলের আবির্ভাব।    (স্ফুলিঙ্গ) বঁধুয়া, হিয়াপর আওরে বঁধুয়া, হিয়া পর আওরে, মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মধু ভাষয়ি, হমার মুখ পর চাওরে! যুগ যুগ সম কত দিবস বহয়ি গল, শ্যাম তু আওলি না, চন্দ-উজর মধু-মধুর কুঞ্জপর মুরলি বজাওলি না! লয়ি গলি সাথ বয়ানক হাসরে, লয়ি গলি নয়ন-আনন্দ! শূন্য বৃন্দাবন, শূন্য হৃদয় মন, কঁহি ছিল ও মুখ চন্দ? ইথি ছিল আকুল গোপ নয়ন জল, কথি ছিল ও তব হাসি?ইথি ছিল নীরব বংশীবটতট, কথি ছিল ও তব বাঁশি! আওলি যদিরে ঠারলি কাহে, সরমে মলিন বয়ান! আপন দুখ কথা কছু নহি বোলব, নিয়ড় আও তুঁহু কান! তুঝ মুখ চাহয়ি শত-যুগ-ভর দুখ নিমিখে ভেল অবসান। এক হাসি তুঝ দূর করল রে সকল মান অভিমান! ধন্য ধন্য রে ভানু গাহিছে প্রেমক নাহিক ওর। হরখে পুলকিত জগত চরাচর দুহুঁক প্রেমরস ভোর।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) বউ কথা কও 'বউ কথা কও' 'বউ কথা কও' যতই গায় সে পাখি নিজের কথাই কুঞ্জবনের সব কথা দেয় ঢাকি।   (স্ফুলিঙ্গ) বউ নিয়ে লেগে গেল বউ নিয়ে লেগে গেল বকাবকি রোগা ফণী আর মোটা পঞ্চিতে, মণিকর্ণিকা-ঘাটে ঠকাঠকি যেন বাঁশে আর সরু কঞ্চিতে। দুজনে না জানে এই বউ কার, মিছেমিছি ভাড়া বাড়ে নৌকার, পঞ্চি চেঁচায় শুধু হাউহাউ,– “পারবিনে তুই মোরে বঞ্চিতে।’ বউ বলে, “বুঝে নিই দাউদাউ মোর তরে জ্বলে ঐ কোন্‌ চিতে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বঙ্গবাসীর প্রতি আমায়       বোলো না গাহিতে বোলো না । এ কি        শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা                    শুধু মিছে কথা ছলনা ! আমায়       বোলো না গাহিতে বোলো না । এ যে         নয়নের জল , হতাশের শ্বাস ,             কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ , এ যে         বুক - ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে                    গভীর মরমবেদনা । এ কি         শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,                    শুধু মিছে কথা ছলনা !             এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি               কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি ,             মিছে কথা কয়ে মিছে যশ লয়ে                    মিছে কাজে নিশিযাপনা !             কে জাগিবে আজ , কে করিবে কাজ ,             কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ —             কাতরে কাঁদিবে , মা ' র পায়ে দিবে                    সকল প্রাণের কামনা । এ কি         শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,           শুধু মিছে কথা ছলনা !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বঙ্গভূমির প্রতি কেন     চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে ! এরা     চাহে না তোমারে চাহে না যে , আপন মায়েরে নাহি জানে ! এরা     তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না — মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে ! তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি — স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি , জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী । এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না — মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে ! মনের বেদনা রাখো , মা , মনে , নয়নবারি নিবারো নয়নে , মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে — ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে । শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী দুঃখ জানায়ে কী হবে ,   জননী , নির্মম চেতনহীন পাষাণে !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বঙ্গমাতা পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে। দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান। পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে। প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে। শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে। সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।কাব্যগ্রন্থঃ চৈতালি বজাও রে মোহন বাঁশি বজাও রে মোহন বাঁশি । সারা দিবসক বিরহদহনদুখ ,             মরমক তিয়াষ নাশি । রিঝমনভেদন বাঁশরিবাদন             কঁহা শিখলি রে কান ? হানে থিরথির মরমঅবশকর             লহু লহু মধুময় বাণ । ধসধস করতহ উরহ বিয়াকুলু ,             ঢুলু ঢুলু অবশনয়ান ; কত কত বরষক বাত সোঁয়ারয় ,             অধীর করয় পরান । কত শত আশা পূরল না বঁধু ,             কত সুখ করল পয়ান । পহু গো কত শত পীরিতযাতন             হিয়ে বিঁধাওল বাণ । হৃদয় উদাসয় , নয়ন উছাসয়              দারুণ মধুময় গান । সাধ যায় বঁধূ , যমুনাবারিম              ডারিব দগধপরান । সাধ যায় পহু , রাখি চরণ তব              হৃদয়মাঝ হৃদয়েশ , হৃদয়জুড়াওন বদনচন্দ্র তব              হেরব জীবনশেষ । সাধ যায়, ইহ চন্দ্রমকিরণে              কুসুমিত কুঞ্জবিতানে বসন্তবায়ে প্রাণ মিশায়ব             বাঁশিক সুমধুর গানে । প্রাণ ভৈবে মঝু বেণুগীতময় ,              রাধাময় তব বেণু । জয় জয় মাধব , জয় জয় রাধা ,              চরণে প্রণমে ভানু । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি,               সে কি সহজ গান।        সেই সুরেতে জাগব আমি               দাও মোরে সেই কান।                                   ভুলব না আর সহজেতে,                                   সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে                                   মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে                                          যে অন্তহীন প্রাণ।        সে ঝড় যেন সই আনন্দে               চিত্তবীণার তারে        সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত               নাচাও যে ঝংকারে।                                   আরাম হতে ছিন্ন ক'রে                                   সেই গভীরে লও গো মোরে                                   অশান্তির অন্তরে যেথায়                                          শান্তি সুমহান। ( তিনধরিয়া, ২১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭) বঞ্চিত রাজসভাতে ছিল জ্ঞানী ,                                        ছিল অনেক গুণী ।                                   কবির মুখে কাব্যকথা শুনি                                       ভাঙল দ্বিধার বাঁধ ,                                   সমস্বরে জাগল সাধুবাদ ।                           উষ্ণীষেতে জড়িয়ে দিল                                মণিমালার মান ,                                   স্বয়ং রাজার দান ।                           রাজধানীময় যশের বন্যাবেগে                               নাম উঠল জেগে ।                              দিন ফুরাল । খ্যাতিক্লান্ত মনে                        যেতে যেতে পথের ধারে                                   দেখল বাতায়নে ,                           তরুণী সে , ললাটে তার                                   কুঙ্কুমেরি ফোঁটা ,                           অলকেতে সদ্য অশোক ফোটা ।                                   সামনে পদ্মপাতা ,                           মাঝখানে তার চাঁপার মালা গাঁথা ,                               সন্ধেবেলার বাতাস গন্ধে ভরে ।                        নিশ্বাসিয়া বললে কবি ,                           এই মালাটি নয় তো আমার তরে । বটে আমি উদ্ধত বটে আমি উদ্ধত, নই তবু ক্রুদ্ধ তো, শুধু ঘরে মেয়েদের সাথে মোর যুদ্ধ তো। যেই দেখি গুণ্ডায় ক্ষমি হেঁটমুণ্ডায়, দুর্জন মানুষেরে ক্ষমেছেন বুদ্ধ তো। পাড়ায় দারোগা এলে দ্বার করি রুদ্ধ তো– সাত্ত্বিক সাধকের এ আচার শুদ্ধ তো।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বড়ো কাজ নিজে বহে বড়ো কাজ নিজে বহে আপনার ভার। বড়ো দুঃখ নিয়ে আসে সান্তনা তাহার। ছোটো কাজ, ছোটো ক্ষতি, ছোটো দুঃখ যত— বোঝা হয়ে চাপে, প্রাণ করে কণ্ঠাগত।    (স্ফুলিঙ্গ) বড়োই সহজ বড়োই সহজ রবিরে ব্যঙ্গ করা, অাপন আলোকে আপনি দিয়েছে ধরা।   (স্ফুলিঙ্গ) বধূ ঠাকুরমা দ্রুততালে ছড়া যেত প ' ড়ে — ভাবখানা মনে আছে — “ বউ আসে চতুর্দোলা চ ' ড়ে                           আম কাঁঠালের ছায়ে ,          গলায় মোতির মালা , সোনার চরণচক্র পায়ে । ”                              বালকের প্রাণে           প্রথম সে নারীমন্ত্র আগমনীগানে ছন্দের লাগাল দোল আধোজাগা কল্পনার শিহরদোলায় ,           আঁধার-আলোর দ্বন্দ্বে যে প্রদোষে মনেরে ভোলায় ,                  সত্য-অসত্যের মাঝে লোপ করি সীমা                            দেখা দেয় ছায়ার প্রতিমা ।           ছড়া-বাঁধা চতুর্দোলা চলেছিল যে-গলি বাহিয়া                            চিহ্নিত করেছে মোর হিয়া            গভীর নাড়ীর পথে অদৃশ্য রেখায় এঁকেবেঁকে ।                            তারি প্রান্ত থেকে অশ্রুত সানাই বাজে অনিশ্চিত প্রত্যাশার সুরে                            দুর্গম চিন্তার দূরে দূরে ।            সেদিন সে কল্পলোকে বেহারাগুলোর পদক্ষেপে                            বক্ষ উঠেছিল কেঁপে কেঁপে ,            পলে পলে ছন্দে ছন্দে আসে তারা আসে না তবুও ,                            পথ শেষ হবে না কভুও ।    সেকাল মিলাল । তার পরে , বধূ-আগমনগাথা            গেয়েছে মর্মরচ্ছন্দে অশোকের কচি রাঙা পাতা ;      বেজেছে বর্ষণঘন শ্রাবণের বিনিদ্র নিশীথে ;                      মধ্যাহ্নে করুণ রাগিণীতে                                  বিদেশী পান্থের শ্রান্ত সুরে ।                      অতিদূর মায়াময়ী বধূর নূপুরে             তন্দ্রার প্রত্যন্তদেশে জাগায়েছে ধ্বনি                                       মৃদু রণরণি । ঘুম ভেঙে উঠেছিনু জেগে ,                                   পূর্বাকাশে রক্ত মেঘে                                       দিয়েছিল দেখা              অনাগত চরণের অলক্তের রেখা ।                       কানে কানে ডেকেছিল মোরে              অপরিচিতার কণ্ঠ স্নিগ্ধ নাম ধ ' রে —                                সচকিতে                       দেখে তবু পাই নি দেখিতে ।                       অকস্মাৎ একদিন কাহার পরশ           রহস্যের তীব্রতায় দেহে মনে জাগাল হরষ ;                       তাহারে শুধায়েছিনু অভিভূত মুহূর্তেই ,                                “ তুমিই কি সেই ,                      আঁধারের কোন্‌ ঘাট হতে                                   এসেছ আলোতে! ”             উত্তরে সে হেনেছিল চকিত বিদ্যুৎ ; ইঙ্গিতে জানায়েছিল , “ আমি তারি দূত ,             সে রয়েছে সব প্রত্যক্ষের পিছে ,                      নিত্যকাল সে শুধু আসিছে ।      নক্ষত্রলিপির পত্রে তোমার নামের কাছে                      যার নাম লেখা রহিয়াছে      অনাদি অজ্ঞাত যুগে সে চড়েছে তার চতুর্দোলা ,                       ফিরিছে সে চির-পথভোলা                              জ্যোতিষ্কের আলোছায়ে ,      গলায় মোতির মালা , সোনার চরণচক্র পায়ে । ” বন শ্যামল সুন্দর সৌম্য, হে অরণ্যভূমি, মানবের পুরাতন বাসগৃহ তুমি। নিশ্চল নির্জীব নহ সৌধের মতন— তোমার মুখশ্রীখানি নিত্যই নূতন প্রাণে প্রেমে ভাবে অর্থে সজীব সচল। তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল, দাও বস্ত্র, দাও শয্যা, দাও স্বাধীনতা; নিশিদিন মর্মরিয়া কহ কত কথা অজানা ভাষার মন্ত্র; বিচিত্র সংগীতে গাও জাগরণগাথা; গভীর নিশীথে পাতি দাও নিস্তব্ধতা অঞ্চলের মতো জননীবক্ষের; বিচিত্র হিল্লোলে কত খেলা কর শিশুসনে; বৃদ্ধের সহিত কহ সনাতন বাণী বচন-অতীত।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বন-ফুল (অষ্টম সর্গ) বিসর্জনআজিও পড়িছে ওই সেই সে নির্ঝর! হিমাদ্রির বুকে বুকে শৃঙ্গে শৃঙ্গে ছুটে সুখে, সরসীর বুকে পড়ে ঝর ঝর ঝর।আজিও সে শৈলবালা বিস্তারিয়া ঊর্ম্মিমালা, চলিছে কত কি কহি আপনার মনে! তুষারশীতল বায় পুষ্প চুমি চুমি যায়, খেলা করে মনোসুখে তটিনীর সনে।কুটীর তটিনীতীরে লতারে ধরিয়া শিরে মুখছায়া দেখিতেছে সলিলদর্পণে! হরিণেরা তরুছায়ে খেলিতেছে গায়ে গায়ে, চমকি হেরিছে দিক পাদপকম্পনে।বনের পাদপপত্র আজিও মানবনেত্র হিংসার অনলময় করে নি লোকন! কুসুম লইয়া লতা প্রণত করিয়া মাথা মানবেরে উপহার দেয় নি কখন!বনের হরিণগণে মানবের শরাসনে ছুটে ছুটে ভ্রমে নাই তরাসে তরাসে! কানন ঘুমায় সুখে নীরব শান্তির বুকে, কলঙ্কিত নাহি হোয়ে মানবনিশ্বাসে।কমলা বসিয়া আছে উদাসিনী বেশে      শৈলতটিনীর তীরে এলোথেলো কেশে অধরে সঁপিয়া কর, অশ্রু বিন্দু ঝর ঝর ঝরিছে কপোলদেশে— মুছিছে আঁচলে। সম্বোধিয়া তটিনীরে ধীরে ধীরে বলে, ‘তটিনী বহিয়া যাও আপনার মনে! কিন্তু সেই ছেলেবেলা যেমন করিতে খেলা তেমনি করিয়ে খেলো নির্ঝরের সনে!তখন যেমন স্বরে কল কল গান করে মৃদু বেগে তীরে আসি পড়িতে লো ঝাঁপি বালিকা ক্রীড়ার ছলে পাথর ফেলিয়া জলে মারিতাম— জলরাশি উঠিত লো কাঁপিতেমনি খেলিয়ে চল্‌ তুই লো তটিনীজল! তেমনি বিতরি সুখ নয়নে আমার। নির্ঝর তেমনি কোরে ঝাঁপিয়া সরসী-পরে পড়্‌ লো উগরি শুভ্র ফেনরাশিভার!মুছিতে লো অশ্রুবারি এয়েছি হেথায়। তাই বলি পাপিয়ারে! গান কর্ সুধাধারে নিবাইয়া হৃদয়ের অনলশিখায়!ছেলেবেলাকার মত বায়ু তুই অবিরত লতার কুসুমরাশি কর্ লো কম্পিত! নদী চল্‌ দুলে দুলে! পুষ্প দে হৃদয় খুলে! নির্ঝর সরসীবক্ষ কর্ বিচলিত!সেদিন আসিবে আর হৃদিমাঝে যাতনার রেখা নাই, প্রমোদেই পূরিত অন্তর! ছুটাছুটি করি বনে বেড়াইব ফুল্লমনে, প্রভাতে অরুণোদয়ে উঠিব শিখর!মালা গাঁথি ফুলে ফুলে জড়াইব এলোচুলে, জড়ায়ে ধরিব গিয়ে হরিণের গল! বড় বড় দুটি আঁখি মোর মুখপানে রাখি এক দৃষ্টে চেয়ে রবে হরিণ বিহ্বল!সেদিন গিয়েছে হা রে— বেড়াই নদীর ধারে ছায়াকুঞ্জে শুনি গিয়ে শুকদের গান! না থাক্‌, হেথায় বসি, কি হবে কাননে পশি— শুক আর গাবে নাকো খুলিয়ে পরাণ! সেও যে গো ধরিয়াছে বিষাদের তান!জুড়ায়ে হৃদয়ব্যথা দুলিবে না পুষ্পলতা, তেমন জীবন্ত ভাবে বহিবে না বায়! প্রাণহীন যেন সবি— যেন রে নীরব ছবি— প্রাণ হারাইয়া যেন নদী বহে যায়!তবুও যাহাতে হোক্‌ নিবাতে হইবে শোক, তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল! তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে! তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!যাই তবে বনে বনে ভ্রমিগে আপনমনে, যাই তবে গাছে গাছে ঢালি দিই জল! শুকপাখীদের গান শুনিয়া জুড়াই প্রাণ, সরসী হইতে তবে তুলিগে কমল!হৃদয় নাচে না ত গো তেমন উল্লাসে! ভ্রমিত ভ্রমিই বনে ম্রিয়মাণ শূন্যমনে, দেখি ত দেখিই বোসে সলিল-উচ্ছ্বাসে! তেমন জীবন্ত ভাব নাই ত অন্তরে— দেখিয়া লতার কোলে ফুটন্ত কুসুম দোলে, কুঁড়ি লুকাইয়া আছে পাতার ভিতবে—নির্ঝরের ঝরঝরে হৃদয়ে তেমন কোরে উল্লাসে শোণিতরাশি উঠে না নাচিয়া! কি জানি কি করিতেছি, কি জানি কি ভাবিতেছি, কি জানি কেমনধারা শূন্যপ্রায় হিয়া!তবুও যাহাতে হোক্‌ নিবাতে হইবে শোক, তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল। তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে, তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!কাননে পশিগে তবে শুক যেথা সুধারবে গান করে জাগাইয়া নীরব কানন। উঁচু করি করি মাথা হরিণেরা বৃক্ষপাতা সুধীরে নিঃশঙ্কমনে করিছে চর্ব্বণ!’সুন্দরী এতেক বলি পশিল কাননস্থলী, পাদপ রৌদ্রের তাপ করিছে বারণ। বৃক্ষছায়ে তলে তলে ধীরে ধীরে নদী চলে সলিলে বৃক্ষের মূল করি প্রক্ষালন।হরিণ নিঃশঙ্কমনে শুয়ে ছিল ছায়াবনে, পদশব্দ পেয়ে তারা চমকিয়া উঠে। বিস্তারি নয়নদ্বয় মুখপানে চাহি রয়, সহসা সভয় প্রাণে বনান্তরে ছুটে।ছুটিছে হরিণচয়, কমলা অবাক্‌ রয়— নেত্র হতে ধীরে ধীরে ঝরে অশ্রুজল। ওই যায়— ওই যায় হরিণ হরিণী হায়— যায় যায় ছুটে ছুটে মিলি দলে দল।কমলা বিষাদভরে কহিল সমুচ্চস্বরে— প্রতিধ্বনি বন হোতে ছুটে বনান্তরে— ‘যাস্‌ নে— যাস্‌ নে তোরা, আয় ফিরে আয়! কমলা— কমলা সেই ডাকিতেছে তোরে!সেই যে কমলা সেই থাকিত কুটীরে, সেই যে কমলা সেই বেড়াইত বনে! সেই যে কমলা পাতা ছিঁড়ি ধীরে ধীরে হরষে তুলিয়া দিত তোদের আননে!কোথা যাস্‌— কোথা যাস্‌— আয় ফিরে আয়! ডাকিছে তোদের আজি সেই সে কমলা! কারে ভয় করি তোরা যাস্‌ রে কোথায়? আয় হেথা দীর্ঘশৃঙ্গ! আয় লো চপলা!এলি নে— এলি নে তোরা এখনো এলি নে— কমলা ডাকিছে যে রে,তবুও এলি নে! ভুলিয়া গেছিস্‌ তোরা আজি কমলারে? ভুলিয়া গেছিস্‌ তোরা আজি বালিকারে?খুলিয়া ফেলিনু এই কবরীবন্ধন, এখনও ফিরিবি না হরিণের দল? এই দেখ্‌— এই দেখ্‌ ফেলিয়া বসন পরিনু সে পুরাতন গাছের বাকল! যাক্‌ তবে, যাক্‌ চলে— যে যায় যেখানে— শুক পাখী উড়ে যাক্‌ সুদূর বিমানে! আয়— আয়— আয় তুই আয় রে মরণ!বিনাশশক্তিতে তোর নিভা এ যন্ত্রণা! পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন! বহিতে অনল হৃদে আর ত পারি না! নীরদ স্বরগে আছে, আছেন জনক স্নেহময়ী মাতা মোর কোল রাখি পাতি— সেথায় মিলিব গিয়া, সেথায় যাইব— ভোর করি জীবনের বিষাদের রাতি! নীরদে আমাতে চড়ি প্রদোষতারায় অস্তগামী তপনেরে করিব বীক্ষণ, মন্দাকিনী তীরে বসি দেখিব ধরায় এত কাল যার কোলে কাটিল জীবন। শুকতারা প্রকাশিবে উষার কপোলে তখন রাখিয়া মাথা নীরদের কোলে— অশ্রুজলসিক্ত হয়ে কব সেই কথা পৃথিবী ছাড়িয়া এনু পেয়ে কোন্‌ ব্যথা!নীরদের আঁখি হোতে ববে অশ্রুজল! মুছিব হরষে আমি তুলিয়া আঁচল! আয়— আয়— আয় তুই, আয় রে মরণ! পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!’এত বলি ধীরে ধীরে উঠিল শিখর! দেখে বালা নেত্র তুলে— চারি দিক গেছে খুলে উপত্যকা, বনভূমি, বিপিন, ভূধর!তটিনীর শুভ্র রেখা— নেত্রপথে দিল দেখা— বৃক্ষছায়া দুলাইয়া বহে বহে যায়!ছোট ছোট গাছপালা— সঙ্কীর্ণ নির্ঝরমালা— সবি যেন দেখা যায় রেখা-রেখা-প্রায়।গেছে খুলে দিগ্বিদিক— নাহি পাওয়া যায় ঠিক কোথা কুঞ্জ— কোথা বন— কোথায় কুটীর! শ্যামল মেঘের মত— হেথা হোথা কত শত দেখায় ঝোপের প্রায় কানন গভীর!তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী! মাথায় জলদ ঠেকে, চরণে চাহিয়া দেখে গাছপালা ঝোপে-ঝাপে ভূধর আবরি!ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা-রেখা হেথা হোথা যায় দেখাকে কোথা পড়িয়া আছে কে দেখে কোথায়! বন, গিরি, লতা, পাতা আঁধারে মিশায়!অসংখ্য শিখরমালা ব্যাপি চারি ধার— মধ্যের শিখর-পরে (মাথায় আকাশ ধরে) কমলা দাঁড়ায়ে আছে, চৌদিকে তুষার!চৌদিকে শিখরমালা— মাঝেতে কমলা বালা একেলা দাঁড়ায়ে মেলি নয়নযুগল! এলোথেলো কেশপাশ, এলোথেলো বেশবাস, তুষারে লুটায়ে পড়ে বসন-আঁচল!যেন কোন্‌ সুরবালা দেখিতে মর্ত্ত্যের লীলা স্বর্গ হোতে নামি আসি হিমাদ্রিশিখরেচড়িয়া নীরদ-রথে— সমুচ্চ শিখর হোতে দেখিলেন পৃথ্বীতল বিস্মিত অন্তরে!তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী! হিমময় বায়ু ছুটে, অন্তরে অন্তরে ফুটে হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধপ্রায় করি! শীতল তুষারদল কোমল চরণতল দিয়াছে অসাড় করে পাষাণের মত! কমলা দাঁড়ায়ে আছে যেন জ্ঞানহত! কোথা স্বর্গ— কোথা মর্ত্ত্য— আকাশ পাতাল! কমলা কি দেখিতেছে! কমলা কি ভাবিতেছে! কমলার হৃদয়েতে ঘোর গোলমাল!চন্দ্র সূর্য্য নাই কিছু— শূন্যময় আগু পিছু! নাই রে কিছুই যেন ভূধর কানন! নাইক শরীর দেহ, জগতে নাইক কেহ— একেলা রয়েছে যেন কমলার মন! কে আছে— কে আছে— আজি কর গো বারণ!বালিকা ত্যজিতে প্রাণ করেছে মনন! বারণ কর গো তুমি গিরি হিমালয়! শুনেছ কি বনদেবী— করুণা-আলয়— বালিকা তোমার কোলে করিত ক্রন্দন, সে নাকি মরিতে আজ করেছে মনন?বনের কুসুমকলি তপনতাপনে জ্বলি শুকায়ে মরিবে নাকি করেছে মনন! শীতল শিশিরধারে জীয়াও জীয়াও তারে বিশুষ্ক হৃদয়মাঝে বিতরি জীবন!উদিল প্রদোষতারা সাঁঝের আঁচলে— এখনি মুদিবে আঁখি? বারণ করিবে না কি? এখনি নীরদকোলে মিশাবে কি বোলে?অনন্ত তুষারমাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী! মোহস্বপ্ন গেছে ছুটে— হেরিল চমকি উঠে চৌদিকে তুষাররাশি শিখর আবরি!উচ্চ হোতে উচ্চ গিরি জলদে মস্তক ঘিরি দেবতার সিংহাসন করিছে লোকন! বনবালা থাকি থাকি সহসা মুদিল আঁখি কাঁপিয়া উঠিল দেহ! কাঁপি উঠে মন!অনন্ত আকাশমাঝে একেলা কমলা! অনন্ত তুষারমাঝে একেলা কমলা! সমুচ্চ শিখর-পরে একেলা কমলা! আকাশে শিখর উঠে চরণে পৃথিবী লুটে— একেলা শিখর-পরে বালিকা কমলা! ওই— ওই— ধর্‌— ধর্‌— পড়িল বালিকা! ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!— খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা! খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া! ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়! উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া! কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়! কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস! কমলার জীবনের হোলো অবসান! ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস, জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ! কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান! কমলার জীবনের হোলো অবসান! দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন! কমলার— প্রতিমার হল বিসর্জ্জন! আকাশে শিখর উঠে চরণে পৃথিবী লুটে— একেলা শিখর-পরে বালিকা কমলা! ওই— ওই— ধর্ ‌— ধর্ ‌— পড়িল বালিকা! ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!— খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা! খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া! ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়! উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া! কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়! কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস! কমলার জীবনের হোলো অবসান! ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস, জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ! কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান! কমলার জীবনের হোলো অবসান! দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন! কমলার— প্রতিমার হল বিসর্জ্জন!   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (চতুর্থ সর্গ) নিভৃত যমুনাতীরে বসিয়া রয়েছে কি রে      কমলা নীরদ দুই জনে? যেন দোঁহে জ্ঞানহত— নীরব চিত্রের মতো      দোঁহে দোঁহা হেরে একমনে।দেখিতে দেখিতে কেন অবশ পাষাণ হেন,      চখের পলক নাহি পড়ে। শোণিত না চলে বুকে, কথাটি না ফুটে মুখে,      চুলটিও না নড়ে না চড়ে!মুখ ফিরাইল বালা, দেখিল জোছনামালা      খসিয়া পড়িছে নীল যমুনার নীরে— অস্ফুট কল্লোলস্বর উঠিছে আকাশ-'পর      অর্পিয়া গভীর ভাব রজনী-গভীরে!দেখিছে লুটায় ঢেউ আবার লুটায়,      দিগন্তে খেলায়ে পুন দিগন্তে মিলায়! দেখে শূন্য নেত্র তুলি— খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি      জোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়।     একখণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি মলিন করিয়া রাতি      মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে।     পাখী এক গেল উড়ে নীল নভোতলে,      ফেনখণ্ড গেল ভেসে নীল নদীজলে, দিবা ভাবি অতিদূরে আকাশ সুধায় পূরে      ডাকিয়া উঠিল এক প্রমুগ্ধ পাপিয়া। পিউ, পিউ, শূন্যে ছুটে উচ্চ হতে উচ্চে উঠে—      আকাশ সে সূক্ষ্ম স্বরে উঠিল কাঁপিয়া।বসিয়া গণিল বালা কত ঢেউ করে খেলা,      কত ঢেউ দিগন্তের আকাশে মিলায়, কত ফেন করি খেলা লুটায়ে চুম্বিছে বেলা,      আবার তরঙ্গে চড়ি সুদূরে পলায়।দেখি দেখি থাকি থাকি আবার ফিরায়ে আঁখি      নীরদের মুখপানে চাহিল সহসা— আধেক মুদিত নেত্র অবশ পলকপত্র—      অপূর্ব মধুর ভাবে বালিকা বিবশা!নীরদ ক্ষণেক পরে উঠে চমকিয়া,      অপূর্ব স্বপন হতে জাগিল যেন রে। দূরেতে সরিয়া গিয়া থাকিয়া থাকিয়া      বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে— ‘সে কী কথা শুধাইছ বিপিনরমণী!      ভালবাসি কিনা আমি তোমারে কমলে? পৃথিবী হাসিয়া যে লো উঠিবে এখনি!      কলঙ্ক রমণী নামে রটিবে তা হলে?ও কথা শুধাতে আছে? ও কথা ভাবিতে আছে!      ও-সব কি স্থান দিতে আছে মনে মনে? বিজয় তোমার স্বামী বিজয়ের পত্মী তুমি      সরলে! ও কথা তবে শুধাও কেমনে?     তবুও শুধাও যদি দিব না উত্তর!— হৃদয়ে যা লিখা আছে দেখাবো না কারো কাছে,      হৃদয়ে লুকান রবে আমরণ কাল! রুদ্ধ অগ্নিরাশিসম দহিবে হৃদয় মম      ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া যাবে হৃদিগ্রন্থিজাল।যদি ইচ্ছা হয় তবে লীলা সমাপিয়া ভবে      শোণিতধারায় তাহা করিব নির্বাণ। নহে অগ্নিশৈলসম জ্বলিবে হৃদয় মম      যত দিন দেহমাঝে রহিবেক প্রাণ!যে তোমারে বন হতে এনেছে উদ্ধারি      যাহারে করেছ তুমি পাণি সমর্পণ প্রণয় প্রার্থনা তুমি করিও তাহারি—      তারে দিয়ো যাহা তুমি বলিবে আপন!চাই না বাসিতে ভালো, ভালবাসিব না।      দেবতার কাছে এই করিব প্রার্থনা— বিবাহ করেছ যারে সুখে থাক লয়ে তারে      বিধাতা মিটান তব সুখের কামনা!’‘বিবাহ কাহারে বলে জানি না তা আমি’      কহিল কমলা তবে বিপিনকামিনী, “কারে বলে পত্মী আর কারে বলে স্বামী,      কারে বলে ভালবাসা আজিও শিখি নি।এইটুকু জানি শুধু এইটুকু জানি,      দেখিবারে আঁখি মোর ভালবাসে যারে শুনিতে বাসি গো ভাল যার সুধাবাণী—      শুনিব তাহার কথা দেখিব তাহারে!ইহাতে পৃথিবী যদি কলঙ্ক রটায়      ইহাতে হাসিয়া যদি উঠে সব ধরা বল গো নীরদ আমি কি করিব তার?      রটায়ে কলঙ্ক তবে হাসুক না তারা।বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না—      তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে! তাহারই ভালবাসা করিব কামনা      যে মোরে বাসে না ভাল, ভালবাসি যারে”।নীরদ অবাক রহি কিছুক্ষণ পরে বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে, “সে কী কথা বল বালা, যে জন তোমারে      বিজন কানন হতে করিয়া উদ্ধার আনিল, রাখিল যত্নে সুখের আগারে—      সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?হৃদয় সঁপেছে যে লো তোমারে নবীনা      সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?” কমলা কহিল ধীরে, “আমি তা জানি না”।      নীরদ সমুচ্চ স্বরে কহিল আবার—‘ তবে যা লো দুশ্চারিণী! যেথা ইচ্ছা তোর      কর্ তাই যাহা তোর কহিবে হৃদয়— কিন্তু যত দিন দেহে প্রাণ রবে মোর—      তোর এ প্রণয়ে আমি দিব না প্রশ্রয়!আর তুই পাইবি না দেখিতে আমারে      জ্বলিব যদিন আমি জীবন-অনলে— স্বরগে বাসিব ভাল যা খুসী যাহারে      প্রণয়ে সেথায় যদি পাপ নাহি বলে!কেন বল্‌ পাগলিনী! ভালবাসি মোরে অনলে জ্বালিতে চাস্‌ এ জীবন ভোরে! বিধাতা যে কি আমার লিখেছে কপালে! যে গাছে রোপিতে যাই শুকায় সমূলে।'ভর্ৎসনা করিবে ছিল নীরদের মনে—      আদরেতে স্বর কিন্তু হয়ে এল নত! কমলা নয়নজল ভরিয়া নয়নে      মুখপানে চাহি রয় পাগলের মতো!নীরদ উদ্‌গামী অশ্রু করি নিবারিত      সবেগে সেখান হতে করিল প্রয়াণ। উচ্ছ্বাসে কমলা বালা উন্‌মত্ত চিত      অঞ্চল করিয়া সিক্ত মুছিল নয়ান।   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (তৃতীয় সর্গ) ‘যমুনার জল করে থল্‌ থল্‌      কলকলে গাহি প্রেমের গান। নিশার আঁচোলে পড়ে ঢোলে ঢোলে      সুধাকর খুলি হৃদয় প্রাণ! বহিছে মলয় ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে,      নুয়ে নুয়ে পড়ে কুসুমরাশি! ধীরি ধীরি ধীরি ফুলে ফুলে ফিরি      মধুকরী প্রেম আলাপে আসি! আয় আয় সখি! আয় দুজনায়      ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা। ফুলে ফুলে আলা বকুলের তলা,      হেথায় আয় লো বিপিনবালা। নতুন ফুটেছে মালতীর কলি,      ঢলি ঢলি পড়ে এ ওর পানে! মধুবাসে ভুলি প্রেমালাপ তুলি      অলি কত কি-যে কহিছে কানে! আয় বলি তোরে, আঁচলটি ভোরে      কুড়া-না হোথায় বকুলগুলি! মাধবীর ভরে লতা নুয়ে পড়ে,      আমি ধীরি ধীরি আনি লো তুলি। গোলাপ কত যে ফুটেছে কমলা,      দেখে যা দেখে যা বনের মেয়ে! দেখ‍্‌সে হেথায় কামিনী পাতায়      গাছের তলাটি পড়েছে ছেয়ে। আয় আয় হেথা, ওই দেখ্‌ ভাই,      ভ্রমরা একটি ফুলের কোলে— কমলা, ফুঁ দিয়ে দে-না লো উড়িয়ে,      ফুলটা আমি লো নেব যে তুলে। পারি না লো আর, আয় হেথা বসি      ফুলগুলি নিয়ে দুজনে গাঁথি! হেথায় পবন খেলিছে কেমন      তটিনীর সাথে আমোদে মাতি! আয় ভাই হেথা, কোলে রাখি মাথা      শুই একটুকু ঘাসের 'পরে— বাতাস মধুর বহে ঝুরু ঝুর,      আঁখি মুদে আসে ঘুমের তরে! বল্‌ বনবালা এত কি লো জ্বালা!      রাত দিন তুই কাঁদিবি বসে! আজো ঘুমঘোর ভাঙ্গিল না তোর,      আজো মজিলি না সুখের রসে! তবে যা লো ভাই! আমি একেলাই      রাশ্‌ রাশ্‌ করি গাঁথিয়া মালা। তুই নদীতীরে কাঁদ‍্‌গে লো ধীরে      যমুনারে কহি মরমজ্বালা! আজো তুই বোন! ভুলিবি নে বন?      পরণকুটীর যাবি নে ভুলে? তোর ভাই মন কে জানে কেমন।      আজো বলিলি নে সকল খুলে?’ ‘কি বলিব বোন! তবে সব শোন্‌!’      কহিল কমলা মধুর স্বরে, ‘লভেছি জনম করিতে রোদন      রোদন করিব জীবন ভোরে! ভুলিব সে বন?— ভুলিব সে গিরি?      সুখের আলয় পাতার কুঁড়ে? মৃগে যাব ভুলে— কোলে লয়ে তুলে      কচি কচি পাতা দিতাম ছিঁড়ে। হরিণের ছানা একত্রে দুজনা      খেলিয়ে খেলিয়ে বেড়াত সুখে! শিঙ ধরি ধরি খেলা করি করি      আঁচল জড়িয়ে দিতাম মুখে! ভুলিব তাদের থাকিতে পরাণ?      হৃদয়ে সে সব থাকিতে লেখা? পারিব ভুলিতে যত দিন চিতে      ভাবনার আহা থাকিবে রেখা? আজ কত বড় হয়েছে তাহারা,      হয়ত আমার না দেখা পেয়ে কুটীরের মাঝে খুঁজে খুঁজে খুঁজে      বেড়াতেছে আহা ব্যাকুল হয়ে! শুয়ে থাকিতাম দুপরবেলায়      তাহাদের কোলে রাখিয়ে মাথা, কাছে বসি নিজে গলপ কত যে      করিতেন আহা তখন মাতা! গিরিশিরে উঠি করি ছুটাছুটি      হরিণের ছানাগুলির সাথে তটিনীর পাশে দেখিতাম বসে      মুখছায়া যবে পড়িত তাতে! সরসীভিতরে ফুটিলে কমল      তীরে বসি ঢেউ দিতাম জলে, দেখি মুখ তুলে— কমলিনী দুলে      এপাশে ওপাশে পড়িতে ঢলে! গাছের উপরে ধীরে ধীরে ধীরে      জড়িয়ে জড়িয়ে দিতেম লতা, বসি একাকিনী আপনা-আপনি      কহিতাম ধীরে কত কি কথা! ফুটিলে গো ফুল হরষে আকুল      হতেম, পিতারে কতেম গিয়ে! ধরি হাতখানি আনিতাম টানি,      দেখাতেম তাঁরে ফুলটি নিয়ে! তুষার কুড়িয়ে আঁচল ভরিয়ে      ফেলিতাম ঢালি গাছের তলে— পড়িলে কিরণ, কত যে বরণ      ধরিত, আমোদে যেতাম গলে! দেখিতাম রবি বিকালে যখন      শিখরের শিরে পড়িত ঢলে করি ছুটাছুটি শিখরেতে উঠি      দেখিতাম দূরে গিয়াছে চোলে! আবার ছুটিয়ে যেতাম সেখানে      দেখিতাম আরও গিয়াছে সোরে! শ্রান্ত হয়ে শেষে কুটীরেতে এসে      বসিতাম মুখ মলিন করে! শশধরছায়া পড়িলে সলিলে      ফেলিতাম জলে পাথরকুচি— সরসীর জল উঠিত উথুলে,      শশধরছায়া উঠিত নাচি। ছিল সরসীতে এক-হাঁটু জল,      ছুটিয়া ছুটিয়া যেতেম মাঝে, চাঁদের ছায়ারে গিয়া ধরিবারে      আসিতাম পুন ফিরিয়া লাজে। তটদেশে পুন ফিরি আসি পর      অভিমানভরে ঈষৎ রাগি চাঁদের ছায়ায় ছুঁড়িয়া পাথর      মারিতাম— জল উঠিত জাগি। যবে জলধর শিখরের ‘পর      উড়িয়া উড়িয়া বেড়াত দলে, শিখরেতে উঠি বেড়াতাম ছুটি—      কাপড়-চোপড় ভিজিত জলে! কিছুই— কিছুই— জানিতাম না রে,      কিছুই হায় রে বুঝিতাম না। জানিতাম হা রে জগৎমাঝারে      আমরাই বুঝি আছি কজনা! পিতার পৃথিবী পিতার সংসার      একটি কুটীর পৃথিবীতলে জানি না কিছুই ইহা ছাড়া আর—      পিতার নিয়মে পৃথিবী চলে! আমাদেরি তরে উঠে রে তপন,      আমাদেরি তরে চাঁদিমা উঠে, আমাদেরি তরে বহে গো পবন,      আমাদেরি তরে কুসুম ফুটে! চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে      সংসার, মানুষ কাহারে বলে। বনের কুসুম ফুটিতাম বনে,      শুকায়ে যেতেম বনের কোলে। জানিব আমারি পৃথিবী ধরা,      খেলিব হরিণশাবক-সনে— পুলকে হরষে হৃদয় ভরা,      বিষাদভাবনা নাহিক মনে। তটিনী হইতে তুলিব জল,      ঢালি ঢালি দিব গাছের তলে। পাখিরে বলিব ‘কমলা বল্‌’,      শরীরের ছায়া দেখিব জলে! জেনেছি মানুষ কাহারে বলে।      জেনেছি হৃদয় কাহারে বলে! জেনেছি রে হায় ভালবাসিলে      কেমন আগুনে হৃদয় জ্বলে! এখন আবার বেঁধেছি চুলে,      বাহুতে পরেছি সোনার বালা। উরসেতে হার দিয়েছি তুলে,      কবরীর মাঝে মণির মালা! বাকলের বাস ফেলিয়াছি দূরে—      শত শ্বাস ফেলি তাহার তরে, মুছেছি কুসুম রেণুর সিঁদুরে      আজো কাঁদে হৃদি বিষাদভরে! ফুলের বলয় নাইক হাতে,      কুসুমের হার ফুলের সিঁথি— কুসুমের মালা জড়ায়ে মাথে      স্মরণে কেবল রাখিনু গাঁথি! এলো এলো চুলে ফিরিব বনে      রুখো রুখো চুল উড়িবে বায়ে। ফুল তুলি তুলি গহনে বনে      মালা গাঁথি গাঁথি পরিব গায়ে! হায় রে সে দিন ভুলাই ভালো!      সাধের স্বপন ভাঙিয়া গেছে! এখন মানুষে বেসেছি ভালো,      হৃদয় খুলিব মানুষ-কাছে! হাসিব কাঁদিব মানুষের তরে,      মানুষের তরে বাঁধিব চুলে— মাখিব কাজল আঁখিপাত ভরে,      কবরীতে মণি দিব রে তুলে। মুছিনু নীরজা! নয়নের ধার,      নিভালাম সখি হৃদয়জ্বালা! তবে সখি আয় আয় দুজনায়      ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা! এই যে মালতী তুলিয়াছ সতি!      এই যে বকুল ফুলের রাশি; জুঁই আর বেলে ভরেছ আঁচলে,      মধুপ ঝাঁকিয়া পড়িছে আসি! এই হল মালা, আর না লো বালা—      শুই লো নীরজা! ঘাসের 'পরে। শুন‍্‌ছিস বোন! শোন্‌ শোন্‌ শোন্‌!      কে গায় কোথায় সুধার স্বরে! জাগিয়া উঠিল হৃদয় প্রাণ!      স্মরণের জ্যোতি উঠিল জ্বলে! ঘা দিয়েছে আহা মধুর গান      হৃদয়ের অতি গভীর তলে! সেই-যে কানন পড়িতেছে মনে      সেই-যে কুটীর নদীর ধারে! থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌ হৃদয়বেদন      নিভাইয়া ফেলি নয়নধারে! সাগরের মাঝে তরণী হতে      দূর হতে যথা নাবিক যত— পায় দেখিবারে সাগরের ধারে      মেঘ্‌লা মেঘ্‌লা ছায়ার মত! তেমনি তেমনি উঠিয়াছে জাগি—      অফুট অফুট হৃদয়-'পরে কী দেশ কী জানি, কুটীর দুখানি,      মাঠের মাঝেতে মহিষ চরে! বুঝি সে আমার জনমভূমি      সেখান হইতে গেছিনু চলে! আজিকে তা মনে জাগিল কেমনে      এত দিন সব ছিলুম ভুলে। হেথায় নীরজা, গাছের আড়ালে      লুকিয়ে লুকিয়ে শুনিব গান, যমুনাতীরেতে জ্যোছনার রেতে      গাইছে যুবক খুলিয়া প্রাণ! কেও কেও ভাই? নীরদ বুঝি?      বিজয়ের[১] আহা প্রাণের সখা! গাইছে আপন ভাবেতে মজি      যমুনা পুলিনে বসিয়ে একা! যেমন দেখিতে গুণও তেমন,      দেখিতে শুনিতে সকলি ভালো— রূপে গুণে মাখা দেখি নি এমন,      নদীর ধারটি করেছে আলো! আপনার ভাবে আপনি কবি      রাত দিন আহা রয়েছে ভোর! সরল প্রকৃতি মোহনছবি      অবারিত সদা মনের দোর মাথার উপরে জড়ান মালা—      নদীর উপরে রাখিয়া আঁখি জাগিয়া উঠেছে নিশীথবালা      জাগিয়া উঠেছে পাপিয়া পাখি! আয় না লো ভাই গাছের আড়ালে      আয় আর একটু কাছেতে সরে এই খানে আয় শুনি দুজনায়      কি গায় নীরদ সুধার স্বরে!’শ্রবণ জীবন হৃদয় ভরি      বাজাও সে বীণা বাজাও বালা! নয়নে রাখিব নয়নবারি      মরমে নিবারি মরমজ্বালা! অবোধ হৃদয় মানিবে শাসন শোকবারিধারা মানিবে বারণ, কী যে ও বীণার মধুর মোহন      হৃদয় পরাণ সবাই জানে— যখনি শুনি ও বীণার স্বরে মধুর সুধায় হৃদয় ভরে, কী জানি কিসের ঘুমের ঘোরে      আকুল করে যে ব্যাকুল প্রাণে! কী জানি লো বালা! কিসের তরে      হৃদয় আজিকে কাঁদিয়া উঠে। কী জানি কী ভাব ভিতরে ভিতরে      জাগিয়া উঠেছে হৃদয় পুটে! অফুট মধুর স্বপনে যেমন জাগি উঠে হৃদে কী জানি কেমন      কী ভাব কে জানে কিসের লাগি! বাঁশরীর ধ্বনি নিশীথে যেমন সুধীর গভীরে মোহিয়া শ্রবণ জাগায় হৃদয়ে কী জানি কেমন      কী ভাব কে জানে কিসের লাগি। দিয়াছে জাগায়ে ঘুমন্ত এ মনে, দিয়াছে জাগায়ে ঘুমন্ত স্মরণে,      ঘুমন্ত পরাণ উঠেছে জাগি!ভেবেছিনু হায় ভুলিব সকল সুখ দুখ শোক হাসি অশ্রুজল আশা প্রেম যত ভুলিব— ভুলিব—      আপনা ভুলিয়া রহিব সুখে! ভেবেছিনু হায় কল্পনাকুমারী বীণাস্বরসুধা পিইয়া তোমারি হৃদয়ের ক্ষুধা রাখিব নিবারি      পাশরি সকল বিষাদ দুখে! প্রকৃতিশোভায় ভরিব নয়নে, নদীকলস্বরে ভরিব শ্রবণে      বীণার সুধায় হৃদয় ভরি! ভুলিব প্রেম যে আছে এ ধরায়, ভুলিব পরের বিষাদ ব্যথায়      ফেলে কি না ধরা নয়নবারি! কই তা পারিনু শোভনা কল্পনে! বিস্মৃতির জলে ডুবাইতে মনে! আঁকা যে মূরতি হৃদয়ের তলে      মুছিতে লো তাহা যতন করি! দেখ লো এখন অবারি হৃদয় মরম-আধার হুতাশনময়, শিরায় শিরায় বহিছে অনল      জ্বলন্ত জ্বালায় হৃদয় ভরি!প্রেমের মূরতি হৃদয়গুহায় এখনো স্থাপিত রয়েছে রে হায়!      বিষাদ-অনলে আহুতি দিয়া বলো তুমি তবে বলো কলপনে যে মূরতি আঁকা হৃদয়ের সনে      কেমনে ভুলিব থাকিতে হিয়া। কেমনে ভুলিব থাকিতে পরাণ কেমনে ভুলিব থাকিতে জ্ঞেয়ান      পাষাণ না হলে হৃদয় দেহ! তাই বলি বালা! আবার— আবার স্বর্গ হতে আনি অমৃতের ধার—      ঢাল গো হৃদয়ে সুধার স্নেহ।শুকায়ে যাউক সজল নয়ান,      হৃদয়ের জ্বালা নিবুক হৃদে, রেখো না হৃদয়ে একটুকু খান      বিষাদ বেদনা যেখানে বিঁধে। কেন লো— কেন লো— ভুলিব কেন লো— এত দিন যারে বেসেছিনু ভাল      হৃদয় পরাণ দেছিনু যারে— স্থাপিয়া যাহারে হৃদয়াসনে পূজা করেছিনু দেবতা-সনে      কোন্‌ প্রাণে আজি ভুলিব তারে!—দ্বিগুণ জ্বলুক হৃদয়-আগুন।      দ্বিগুণ বহুক বিষাদধারা। স্মরণের আভা ফুটুক দ্বিগুণ।      হোক হৃদিপ্রাণ পাগল পারা।প্রেমের প্রতিমা আছে যা হৃদয়ে      মরমশোণিতে আছে যা গাঁথা— শত শত শত অশ্রু বারিচয়ে      দিব উপহার দিব রে তথা।এত দিন যার তরে অবিরল      কেঁদেছিনু হায় বিষাদভরে, আজিও— আজিও— নয়নের জল      বরষিবে আঁখি তাহারি তরে।এত দিন ভাল বেসেছিনু যারে      হৃদয় পরাণ দেছিনু খুলে— আজিও রে ভালবাসিব তাহারে,      পরাণ থাকিতে যাব না ভুলে।হৃদয়ের এই ভগনকুটীরে      প্রেমের প্রদীপ করেছে আলা— যেন রে নিবিয়া না যায় কখনো      সহস্র কেন রে পাই-না জ্বালা।কেবল দেখিব সেই মুখখানি,      দেখিব সেই সে গরব হাসি। উপেক্ষার সেই কটাক্ষ দেখিব,      অধরের কোণে ঘৃণার রাশি।তবু কল্পনা কিছু ভুলিব না!      সকলি হৃদয়ে থাকুক গাঁথা— হৃদয়ে, মরমে, বিষাদবেদনা      যত পারে তারে দিক না ব্যথা।ভুলিব না আমি সেই সন্ধ্যাবায়, ভুলিব না ধীরে নদী ব'হে যায়,      ভুলিব না হায় সে মুখশশী। হব না— হব না— হব না বিস্মৃত, যত দিন দেহে রহিবে শোণিত,      জীবন তারকা না যাবে খসি। প্রেমগান কর তুমি কল্পনা! প্রেমগীতে মাতি বাজুক বীণা!      শুনিব, কাঁদিব হৃদয় ঢালি! নিরাশ প্রণয়ী কাঁদিবে নীরবে।— বাজাও বাজাও বীণাসুধারবে      নব অনুরাগ হৃদয়ে জ্বালি!প্রকৃতিশোভায় ভরিব নয়নে, নদীকলস্বরে ভরিব শ্রবণে,      প্রেমের প্রতিমা হৃদয়ে রাখি। গাও গো তটিনী প্রেমের গান, ধরিয়া অফুট মধুর তান      প্রেমগান কর বনের পাখি।‘কহিল কমলা ‘শুনেছিস্‌ ভাই      বিষাদে দুঃখে যে ফাটিছে প্রাণ! কিসের লাগিয়া, মরমে মরিয়া      করিছে অমন খেদের গান? কারে ভালবাসে? কাঁদে কার তরে?      কার তরে গায় খেদের গান? কার ভালবাসা পায় নাই ফিরে      সঁপিয়া তাহারে হৃদয় প্রাণ? ভালবাসা আহা পায় নাই ফিরে!      অমন দেখিতে অমন আহা! নবীন যুবক ভালবাসে কি রে?      কারে ভালবাসে জানিস্‌ তাহা?বসেছিনু কাল ওই গাছতলে      কাঁদিতে ছিলেম কত কি ভাবি— যুবক তখনি সুধীরে আপনি      প্রাসাদ হইতে আইল নাবি।কহিল ‘শোভনে! ডাকিছে বিজয়,      আমার সহিত আইস তথা’। কেমন আলাপ! কেমন বিনয়!      কেমন সুধীর মধুর কথা!চাইতে নারিনু মুখপানে তাঁর,      মাটির পানেতে রাখিয়ে মাথা শরমে পাশরি বলি বলি করি      তবুও বাহির হল না কথা!কাল হতে ভাই! ভাবিতেছি তাই      হৃদয় হয়েছে কেমন ধারা! থাকি থাকি থাকি উঠি লো চমকি,      মনে হয় কার পাইনু সাড়া!কাল হতে তাই মনের মতন বাঁধিয়াছি চুল করিয়া যতন, কবরীতে তুলে দিয়াছি রতন,      চুলে সঁপিয়াছি ফুলের মালা, কাজল মেখেছি নয়নের পাতে, সোনার বলয় পরিয়াছি হাতে, রজতকুসুম সঁপিয়াছি মাথে,      কি কহিব সখি! এমন জ্বালা!’পাদটীকা ঝাঁপ দাও ↑ কমলাকে যিনি সংসারে আনেন।   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (দ্বিতীয় সর্গ) যেও না! যেও না! দুয়ারে আঘাত করে কে ও পান্থবর? ‘কে ওগো কুটীরবাসি ! দ্বার খুলে দাও আসি! ’ তবুও কেন রে কেউ দেয় না উত্তর? আবার পথিকবর আঘাতিল ধীরে! “বিপন্ন পথিক আমি, কে আছে কুটিরে?” তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাঁই— তটিনী বহিয়া যায় আপনার মনে! পাদপ আপন মনে প্রভাতের সমীরণে দুলিছে, গাইছে গান সরসর স্বনে! সমীরে কুটীরশিরে লতা দুলে ধীরে ধীরে বিতরিয়া চারি দিকে পুষ্পপরিমল! আবার পথিকবর আঘাতে দুয়ার-‘পর— ধীরে ধীরে খুলে গেল শিথিল অর্গল। বিস্ফারিয়া নেত্রদ্বয় পথিক অবাক্‌ রয়, বিস্ময়ে দাঁড়ায়ে আছে ছবির মতন। কেন পান্থ, কেন পান্থ, মৃগ যেন দিক্‌ভ্রান্ত অথবা দরিদ্র যেন হেরিয়া রতন! কেন গো কাহার পানে দেখিছ বিস্মিত প্রাণে— অতিশয় ধীরে ধীরে পড়িছে নিশ্বাস? দারুণ শীতের কালে ঘর্মবিন্দু ঝরে ভালে, তুষারে করিয়া দৃঢ় বহিছে বাতাস! ক্রমে ক্রমে হয়ে শান্ত সুধীরে এগোয় পান্থ, থর থর করি কাঁপে যুগল চরণ— ধীরে ধীরে তার পরে সভয়ে সংকোচভরে পথিক অনুচ্চ স্বরে করে সম্বোধন— ‘সুন্দরি! সুন্দরি!’ হায়। উত্তর নাহিক পায়! আবার ডাকিল ধীরে “সুন্দরি! সুন্দরি!” শব্দ চারি দিকে ছুটে, প্রতিধ্বনি জাগি উঠে, কুটীর গম্ভীরে কহে ‘সুন্দরি! সুন্দরি! ’ তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাঁই, এখনো পৃথিবী ধরা নীরবে ঘুমায়! নীরব পরণশালা, নীরব ষোড়শী বালা, নীরবে সুধীর বায়ু লতারে দুলায়! পথিক চমকি প্রাণে দেখিল চৌদিক-পানে— কুটীরে ডাকিছে কেও “কমলা! কমলা!’ অবাক্‌ হইয়া রহে, অস্ফুটে কে ওগো কহে? সুমধুর স্বরে যেন বালকের গলা! পথিক পাইয়া ভয়, চমকি দাঁড়ায়ে রয়, কুটীরের চারি ভাগে নাই কোনজন! এখনো অস্ফুটস্বরে ‘কমলা! কমলা!’ ক'রে কুটীর আপনি যেন করে সম্ভাষণ! কে জানে কাহাকে ডাকে, কে জানে কেন বা ডাকে, কেমনে বলিব কেবা ডাকিছে কোথায়? সহসা পথিকবর দেখে দণ্ডে করি ভর ‘কমলা! কমলা!’ বলি শুক গান গায়! আবার পথিকবর হন ধীরে অগ্রসর, ‘সুন্দরি! সুন্দরি!’ বলি ডাকিয়া আবার! আবার পথিক হায় উত্তর নাহিক পায়, বসিল ঊরুর ‘পরে সঁপি দেহভার! সঙ্কোচ করিয়া কিছু পান্থবর আগুপিছু একটু একটু করে হন অগ্রসর! আনমিত করি শিরে পথিকটি ধীরে ধীরে বালার নাসার কাছে সঁপিলেন কর! হস্ত কাঁপে থরথরে, বুক ধুক্‌ ধুক্‌ করে, পড়িল অবশ বাহু কপোলের ‘পর— লোমাঞ্চিত কলেবরে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম ঝরে, কে জানে পথিক কেন টানি লয় কর! আবার কেন কি জানি বালিকার হস্তখানি লইলেন আপনার করতল-'পরি— তবুও বালিকা হায় চেতনা নাহিক পায়— অচেতনে শোক জ্বালা রয়েছে পাশরি! রুক্ষ রুক্ষ কেশরাশি বুকের উপরে আসি থেকে থেকে কাঁপি উঠে নিশ্বাসের ভরে! বাঁহাত আঁচল-'পরে অবশ রয়েছে পড়ে এলো কেশরাশি মাঝে সঁপি ডান করে। ছাড়ি বালিকার কর ত্রস্ত উঠে পান্থবর দ্রুতগতি চলিলেন তটিনীর ধারে, নদীর শীতল নীরে ভিজায়ে বসন ধীরে ফিরি আইলেন পুন কুটীরের দ্বারে। বালিকার মুখে চোখে শীতল সলিল-সেকে সুধীরে বালিকা পুন মেলিল নয়ন। মুদিতা নলিনীকলি মরমহুতাশে জ্বলি মুরছি সলিলকোলে পড়িল যেমন— সদয়া নিশির মন হিম সেঁচি সারাক্ষণ প্রভাতে ফিরায়ে তারে দেয় গো চেতন। মেলিয়া নয়নপুটে বালিকা চমকি উঠে একদৃষ্টে পথিকেরে করে নিরীক্ষণ। পিতা মাতা ছাড়া কারে মানুষে দেখে নি হা রে, বিস্ময়ে পথিকে তাই করিছে লোকন! আঁচল গিয়াছে খ'সে, অবাক্‌ রয়েছে ব'সে বিস্ফারি পথিক-পানে যুগল নয়ন! দেখেছে কভু কেহ কি এহেন মধুর আঁখি? স্বর্গের কোমল জ্যোতি খেলিছে নয়নে— মধুর-স্বপনে-মাখা সারল্য-প্রতিমা-আঁকা ‘কে তুমি গো?’ জিজ্ঞাসিছে যেন প্রতিক্ষণে। পৃথিবী-ছাড়া এ আঁখি স্বর্গের আড়ালে থাকি পৃথ্বীরে জিজ্ঞাসে ‘কে তুমি?কে তুমি?' মধুর মোহের ভুল, এ মুখের নাই তুল— স্বর্গের বাতাস বহে এ মুখটি চুমি! পথিকের হৃদে আসি নাচিছে শোণিত রাশি, অবাক্‌ হইয়া বসি রয়েছে সেথায়! চমকি ক্ষণেক-পরে কহিল সুধীর স্বরে বিমোহিত পান্থবর কমলাবালায়, ‘সুন্দরি, আমি গো পান্থ দিক্‌ভ্রান্ত পথশ্রান্ত উপস্থিত হইয়াছি বিজন কাননে! কাল হতে ঘুরি ঘুরি শেষে এ কুটীরপুরী আজিকার নিশিশেষে পড়িল নয়নে! বালিকা! কি কব আর, আশ্রয় তোমার দ্বার পান্থ পথহারা আমি করি গো প্রার্থনা। জিজ্ঞাসা করি গো শেষে মৃতে লয়ে ক্রোড়দেশে কে তুমি কুটীরমাঝে বসি সুধাননা?’ পাগলিনীপ্রায় বালা হৃদয়ে পাইয়া জ্বালা চমকিয়া বসে যেন জাগিয়া স্বপনে। পিতার বদন-‘পরে নয়ন নিবিষ্ট ক'রে স্থির হ'য়ে বসি রয় ব্যাকুলিত মনে। নয়নে সলিল ঝরে, বালিকা সমুচ্চ স্বরে বিষাদে ব্যাকুলহৃদে কহে ‘পিতা— পিতা’ । কে দিবে উত্তর তোর, প্রতিধ্বনি শোকে ভোর রোদন করিছে সেও বিষাদে তাপিতা। ধরিয়া পিতার গলে আবার বালিকা বলে উচ্চৈস্বরে “পিতা— পিতা” , উত্তর না পায়! তরুণী পিতার বুকে বাহুতে ঢাকিয়া মুখে, অবিরল নেত্রজলে বক্ষ ভাসি যায়। শোকানলে জল ঢালা সাঙ্গ হ'লে উঠে বালা, শূন্য মনে উঠি বসে আঁখি অশ্রুময়! বসিয়া বালিকা পরে নিরখি পথিকবরে সজল নয়ন মুছি ধীরে ধীরে কয়, ‘কে তুমি জিজ্ঞাসা করি, কুটীরে এলে কি করি— আমি যে পিতারে ছাড়া জানি না কাহারে! পিতার পৃথিবী এই, কোনদিন কাহাকেই দেখি নি তো এখানে এ কুটীরের দ্বারে! কোথা হতে তুমি আজ আইলে পৃথিবীমাঝ? কি ব'লে তোমারে আমি করি সম্বোধন? তুমি কি তাহাই হবে পিতা যাহাদের সবে ‘মানুষ’ বলিয়া আহা করিত রোদন? কিংবা জাগি প্রাতঃকালে যাদের দেবতা ব'লে নমস্কার করিতেন জনক আমার? বলিতেন যার দেশে মরণ হইলে শেষে যেতে হয়, সেথাই কি নিবাস তোমার?— নাম তার স্বর্গভূমি, আমারে সেথায় তুমি ল'য়ে চল, দেখি গিয়া পিতায় মাতায়! ল'য়ে চল দেব তুমি আমারে সেথায়। যাইব মায়ের কোলে, জননীরে মাতা ব'লে আবার সেখানে গিয়া ডাকিব তাঁহারে। দাঁড়ায়ে পিতার কাছে জল দিব গাছে গাছে, সঁপিব তাঁহার হাতে গাঁথি ফুলহারে! হাতে ল'য়ে শুকপাখি বাবা মোর নাম ডাকি ‘কমলা’ বলিতে আহা শিখাবেন তারে! লয়ে চল, দেব, তুমি সেথায় আমারে! জননীর মৃত্যু হ'লে, ওই হোথা গাছতলে রাখিয়াছিলেন তাঁরে জনক তখন! ধবলতুষার ভার ঢাকিয়াছে দেহ তাঁর, স্বরগের কুটীরেতে আছেন এখন! আমিও তাঁহার কাছে করিব গমন!’ বালিকা থামিল সিক্ত হয়ে আঁখিজলে পথিকেরও আঁখিদ্বয় হ'ল আহা অশ্রুময়, মুছিয়া পথিক তবে ধীরে ধীরে বলে, ‘আইস আমার সাথে, স্বর্গরাজ্য পাবে হাতে, দেখিতে পাইবে তথা পিতায় মাতায়। নিশা হল অবসান, পাখীরা করিছে গান, ধীরে ধীরে বহিতেছে প্রভাতের বায়! আঁধার ঘোমটা তুলি প্রকৃতি নয়ন খুলি চারি দিক ধীরে যেন করিছে বীক্ষণ— আলোকে মিশিল তারা, শিশিরের মুক্তাধারা গাছ পালা পুষ্প লতা করিছে বর্ষণ! হোথা বরফের রাশি, মৃত দেহ রেখে আসি হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করায়ে শয়ান, এই লয়ে যাই চ'লে, মুছে ফেল অশ্রুজলে— অশ্রুবারিধারে আহা পূরেছে নয়ান!’ পথিক এতেক কয়ে মৃত দেহ তুলে লয়ে হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করিল প্রোথিত। কুটীরেতে ধীরি ধীরি আবার আইল ফিরি, কত ভাবে পথিকের চিত্ত আলোড়িত। ভবিষ্যৎ-কলপনে কত কি আপন মনে দেখিছে, হৃদয়পটে আঁকিতেছে কত— দেখে পূর্ণচন্দ্র হাসে নিশিরে রজতবাসে ঢাকিয়া, হৃদয় প্রাণ করি অবারিত— জাহ্নবী বহিছে ধীরে, বিমল শীতল নীরে মাখিয়া রজতরশ্মি গাহি কলকলে— হরষে কম্পিত কায়, মলয় বহিয়া যায় কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কুসুমের দলে— ঘাসের শয্যার 'পরে ঈষৎ হেলিয়া পড়ে শীতল করিছে প্রাণ শীত সমীরণ— কবরীতে পুষ্পভার কে ও বাম পাশে তার, বিধাতা এমন দিন হবে কি কখন? অদৃষ্টে কি আছে আহা! বিধাতাই জানে তাহা যুবক আবার ধীরে কহিল বালায়, ‘কিসের বিলম্ব আর? ত্যজিয়া কুটীরদ্বার আইস আমার সাথে, কাল বহে যায়!’ তুলিয়া নয়নদ্বয় বালিকা সুধীরে কয়, বিষাদে ব্যাকুল আহা কোমল হৃদয়— ‘কুটীর! তোদের সবে ছাড়িয়া যাইতে হবে, পিতার মাতার কোলে লইব আশ্রয়। হরিণ! সকালে উঠি কাছেতে আসিত ছুটি, দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে আঁচল চিবায়— ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি মুখেতে দিতাম তুলি তাকায়ে রহিত মোর মুখপানে হায়! তাদের করিয়া ত্যাগ যাইব কোথায়? যাইব স্বরগভূমে, আহা হা! ত্যজিয়া ঘুমে এতক্ষণে উঠেছেন জননী আমার— এতক্ষণে ফুল তুলি গাঁথিছেন মালাগুলি, শিশিরে ভিজিয়া গেছে আঁচল তাঁহার— সেথাও হরিণ আছে, ফুল ফুটে গাছে গাছে, সেখানেও শুক পাখি ডাকে ধীরে ধীরে! সেথাও কুটীর আছে, নদী বহে কাছে কাছে, পূর্ণ হয় সরোবর নির্ঝরের নীরে। আইস! আইস দেব! যাই ধীরে ধীরে! আয় পাখি! আয় আয়! কার তরে রবি হায়, উড়ে যা উড়ে যা পাখি! তরুর শাখায়! প্রভাতে কাহারে পাখি! জাগাবি রে ডাকি ডাকি ‘কমলা!’ ‘কমলা!’ বলি মধুর ভাষায়? ভুলে যা কমলা নামে, চলে যা সুখের ধামে, ‘কমলা!’ ‘কমলা!’ ব'লে ডাকিস নে আর। চলিনু তোদের ছেড়ে, যা শুক শাখায় উড়ে— চলিনু ছাড়িয়া এই কুটীরের দ্বার। তবু উড়ে যাবি নে রে, বসিবি হাতের ‘পরে? আয় তবে, আয় পাখি, সাথে সাথে আয়, পিতার হাতের ‘পরে আমার নামটি ধ'রে— আবার আবার তুই ডাকিস সেথায়। আইস পথিক তবে কাল বহে যায়”। সমীরণ ধীরে ধীরে চুম্বিয়া তটিনীনীরে দুলাইতে ছিল আহা লতায় পাতায়— সহসা থামিল কেন প্রভাতের বায়? সহসা রে জলধর নব অরুণের কর কেন রে ঢাকিল শৈল অন্ধকার করে? পাপিয়া শাখার ‘পরে ললিত সুধীর স্বরে তেমনি কর-না গান, থামিলি কেন রে? ভুলিয়া শোকের জ্বালা ওই রে চলিছে বালা। কুটীর ডাকিছে যেন ‘যেয়ো না— যেয়ো না!’ তটিনীতরঙ্গকুল ভিজায়ে গাছের মূল ধীরে ধীরে বলে যেন ‘যেয়ো না! যেয়ো না’ — বনদেবী নেত্র খুলি পাতার আঙ্গুল তুলি যেন বলিছেন আহা ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’ — নেত্র তুলি স্বর্গ-পানে দেখে পিতা মেঘযানে হাত নাড়ি বলিছেন ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’ — বালিকা পাইয়া ভয় মুদিল নয়নদ্বয়, এক পা এগোতে আর হয় না বাসনা— আবার আবার শুন কানের কাছেতে পুন কে কহে অস্ফুট স্বরে ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (পঞ্চম সর্গ) বিজয় নিভৃতে কী কহে নিশীথে? কি কথা শুধায় নীরজা বালায়—      দেখেছ, দেখেছ হোথা? ফুলপাত্র হতে ফুল তুলি হাতে নীরজা শুনিছে, কুসুম গুণিছে,      মুখে নাই কিছু কথা। বিজয় শুধায়— কমলা তাহারে গোপনে, গোপনে ভালবাসে কি রে? তার কথা কিছু বলে কি সখীরে?      যতন করে কি তাহার তরে। আবার কহিল, “বলো কমলায় বিজন কানন হইতে যে তায় করিয়া উদ্ধার সুখের ছায়ায়      আনিল, হেলা কি করিবে তারে? যদি সে ভাল না বাসে আমায় আমি কিন্তু ভালবাসিব তাহায়      যত দিন দেহে শোণিত চলে”। বিজয় যাইল আবাস ভবনে নিদ্রায় সাধিতে কুসুমশয়নে।      বালিকা পড়িল ভূমির তলে। বিবর্ণ হইল কপোল বালার, অবশ হইয়ে এল দেহভার—      শোণিতের গতি থামিল যেন! ও কথা শুনিয়া নীরজা সহসা কেন ভূমিতলে পড়িল বিবশা?      দেহ থর থর কাঁপিছে কেন? ক্ষণেকের পরে লভিয়া চেতন, বিজয়-প্রাসাদে করিল গমন, দ্বারে ভর দিয়া চিন্তায় মগন      দাঁড়ায়ে রহিল কেন কে জানে? বিজয় নীরবে ঘুমায় শয্যায়, ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিতেছে বায়, নক্ষত্রনিচয় খোলা জানালায়      উঁকি মারিতেছে মুখের পানে! খুলিয়া মেলিয়া অসংখ্য নয়ন উঁকি মারিতেছে যেন রে গগন, জাগিয়া ভাবিয়া দেখিলে তখন      অবশ্য বিজয় উঠিত কাঁপি! ভয়ে, ভয়ে ধীরে মুদিত নয়ন পৃথিবীর শিশু ক্ষুদ্র-প্রাণমন— অনিমেষ আঁখি এড়াতে তখন      অবশ্য দুয়ার ধরিত চাপি! ধীরে, ধীরে, ধীরে খুলিল দুয়ার, পদাঙ্গুলি ‘পরে সঁপি দেহভার কেও বামা ডরে প্রবেশিছে ঘরে      ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলিয়া ভয়ে! একদৃষ্টে চাহি বিজয়ের মুখে রহিল দাঁড়ায়ে শয্যার সমুখে, নেত্রে বহে ধারা মরমের দুখে,      ছবিটির মত অবাক্‌ হয়ে! ভিন্ন ওষ্ঠ হতে বহিছে নিশ্বাস— দেখিছে নীরজা, ফেলিতেছে শ্বাস, সুখের স্বপন দেখিয়ে তখন      ঘুমায় যুবক প্রফুল্লমুখে! ‘ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও গভীরে— দেখো না দুখিনী নয়নের নীরে করিছে রোদন তোমারি কারণ—      ঘুমাও বিজয় ঘুমাও সুখে! দেখো না তোমারি তরে একজন সারা নিশি দুখে করি জাগরণ বিছানার পাশে করিছে রোদন—      তুমি ঘুমাইছ ঘুমাও ধীরে! দেখো না বিজয়! জাগি সারা নিশি প্রাতে অন্ধকার যাইলে গো মিশি আবাসেতে ধীরে যাইব গো ফিরে—      তিতিয়া বিষাদে নয়ননীরে      ঘুমাও বিজয়। ঘুমাও ধীরে!’   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (প্রথম সর্গ) চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে     সংসার, মানুষ কাহারে বলে। বনের কুসুম ফুটিতাম বনে     শুকায়ে যেতাম বনের কোলে!—দীপনির্বাণনিশার আঁধার রাশি করিয়া নিরাস রজতসুষমাময়, প্রদীপ্ত তুষারচয় হিমাদ্রি-শিখর-দেশে পাইছে প্রকাশ অসংখ্য শিখরমালা বিশাল মহান্‌; ঝর্ঝরে নির্ঝর ছুটে, শৃঙ্গ হ'তে শৃঙ্গ উঠে দিগন্তসীমায় গিয়া যেন অবসান! শিরোপরি চন্দ্র সূর্য , পদে লুটে পৃথ্বীরাজ্য মস্তকে স্বর্গের ভার করিছে বহন; তুষারে আবরি শির ছেলেখেলা পৃথিবীর ভুরুক্ষেপে যেন সব করিছে লোকন। কত নদী কত নদ কত নির্ঝরিণী হ্রদ পদতলে পড়ি তার করে আস্ফালন! মানুষ বিস্ময়ে ভয়ে দেখে রয় স্তব্ধ হয়ে, অবাক্‌ হইয়া যায় সীমাবদ্ধ মন!চৌদিকে পৃথিবী ধরা নিদ্রায় মগন, তীব্র শীতসমীরণে দুলায়ে পাদপগণে বহিছে নির্ঝরবারি করিয়া চুম্বন, হিমাদ্রিশিখরশৈল করি আবরিত গভীর জলদরাশি তুষার বিভায় নাশিস্থির ভাবে হেথা সেথা রহেছে নিদ্রিত। পর্বতের পদতলে ধীরে ধীরে নদী চলে উপলরাশির বাধা করি অপগত, নদীর তরঙ্গকুল সিক্ত করি বৃক্ষমূল নাচিছে পাষাণতট করিয়া প্রহত! চারি দিকে কত শত কলকলে অবিরত পড়ে উপত্যকা-মাঝে নির্ঝরের ধারা। আজি নিশীথিনী কাঁদে আঁধারে হারায়ে চাঁদে মেঘ-ঘোমটায় ঢাকি কবরীর তারা।                          কল্পনে! কুটীর কার তটিনীর তীরে তরুপত্র-ছায়ে-ছায়ে পাদপের গায়ে- গায়ে ডুবায়ে চরণদেশ স্রোতস্বিনীনীরে? চৌদিকে মানববাস নাহিক কোথায়, নাহি জনকোলাহল গভীর বিজনস্থল শান্তির ছায়ায় যেন নীরবে ঘুমায়! কুসুমভূষিত বেশে কুটীরের শিরোদেশে শোভিছে লতিকামালা প্রসারিয়া কর, কুসুমস্তবকরাশি দুয়ার-উপরে আসি উঁকি মারিতেছে যেন কুটীরভিতর! কুটীরের এক পাশে শাখাদীপ[১] ধূমশ্বাসে স্তিমিত আলোকশিখা করিছে বিস্তার। অস্পষ্ট আলোক, তায় আঁধার মিশিয়া যায়— ম্লান ভাব ধরিয়াছে গৃহ-ঘর-দ্বার! গভীর নীরব ঘর, শিহরে যে কলেবর! হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে বয়— বিষাদের অন্ধকারে গভীর শোকের ভারে গভীর নীরব গৃহ অন্ধকারময়! কে ওগো নবীনা বালা উজলি পরণশালা বসিয়া মলিনভাবে তৃণের আসনে? কোলে তার সঁপি শির কে শুয়ে হইয়া স্থিরথেক্যে থেক্যে দীর্ঘশ্বাস টানিয়া সঘনে— সুদীর্ঘ ধবল কেশ ব্যাপিয়া কপোলদেশ, শ্বেতশ্মশ্রু ঢাকিয়াছে বক্ষের বসন— অবশ জ্ঞেয়ানহারা, স্তিমিত লোচনতারা, পলক নাহিক পড়ে নিস্পন্দ নয়ন! বালিকা মলিনমুখে বিশীর্ণা বিষাদদুখে, শোকে ভয়ে অবশ সে সুকোমল-হিয়া। আনত করিয়া শির বালিকা হইয়া স্থির পিতার-বদন-পানে রয়েছে চাহিয়া। এলোথেলো বেশবাস, এলোথেলো কেশপাশ অবিচল আঁখিপার্শ্ব করেছে আবৃত! নয়নপলক স্থির, হৃদয় পরাণ ধীর, শিরায় শিরায় রহে স্তব্ধ শোণিত। হৃদয়ে নাহিক জ্ঞান, পরাণে নাহিক প্রাণ, চিন্তার নাহিক রেখা হৃদয়ের পটে! নয়নে কিছু না দেখে, শ্রবণে স্বর না ঠেকে, শোকের উচ্ছ্বাস নাহি লাগে চিত্ততটে! সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলি, সুধীরে নয়ন মেলি ক্রমে ক্রমে পিতা তাঁর পাইলেন জ্ঞান! সহসা সভয়প্রাণে দেখি চারিদিক পানে আবার ফেলিল শ্বাস ব্যাকুলপরান — কি যেন হারায়ে গেছে, কি যেন আছে না আছে, শোকে ভয়ে ধীরে ধীরে মুদিল নয়ন— সভয়ে অস্ফুট স্বরে সরিল বচন, "কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!" চমকি উঠিল যেন নীরব রজনী! চমকি উঠিল যেন নীরব অবনী! ঊর্মিহীন নদী যথা ঘুমায় নীরবে— সহসা করণক্ষেপে সহসা উঠে রে কেঁপে, সহসা জাগিয়া উঠে চলঊর্মি সবে! কমলার চিত্তবাপী সহসা উঠিল কাঁপি পরানে পরান এলো হৃদয়ে হৃদয়! স্তব্ধ শোণিতরাশি আস্ফালিল হৃদে আসি, আবার হইল চিন্তা হৃদয়ে উদয়! শোকের আঘাত লাগি পরাণ উঠিল জাগি, আবার সকল কথা হইল স্মরণ! বিষাদে ব্যাকুল হৃদে নয়নযুগল মুদে আছেন জনক তাঁর, হেরিল নয়ন। স্থির নয়নের পাতে পড়িল পলক, শুনিল কাতর স্বরে ডাকিছে জনক, "কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!" বিষাদে ষোড়শী বালা চমকি অমনি (নেত্রে অশ্রুধারা ঝরে) কহিল কাতর স্বরে পিতার নয়ন-‘পরে রাখিয়া নয়ন, "কেন পিতা! কেন পিতা! এই-যে রয়েছি হেতা" — বিষাদে নাহিক আর সরিল বচন! বিষাদে মেলিয়া আঁখি বালার বদনে রাখি এক দৃষ্টে স্থিরনেত্রে রহিল চাহিয়া! নেত্রপ্রান্তে দরদরে, শোক-অশ্রুবারি ঝরে, বিষাদে সন্তাপে শোকে আলোড়িত হিয়া! গভীরনিশ্বাসক্ষেপে হৃদয় উঠিল কেঁপে, ফাটিয়া বা যায় যেন শোণিত-আধার! ওষ্ঠপ্রান্ত থরথরে কাঁপিছে বিষাদভরে নয়নপলক-পত্র কাঁপে বার বার— শোকের স্নেহের অশ্রু করিয়া মোচন কমলার পানে চাহি কহিল তখন, ‘আজি রজনীতে মা গো! পৃথিবীর কাছে বিদায় মাগিতে হবে, এই শেষ দেখা ভবে! জানি না তোমার শেষে অদৃষ্টে কি আছে— পৃথিবীর ভালবাসা পৃথিবীর সুখ আশা, পৃথিবীর স্নেহ প্রেম ভক্তি সমুদায়, দিনকর নিশাকর গ্রহ তারা চরাচর, সকলের কাছে আজি লইব বিদায়! গিরিরাজ হিমালয়! ধবল তুষারচয়! অয়ি গো কাঞ্চনশৃঙ্গ মেঘ-আবরণ! অয়ি নির্ঝরিণীমালা! স্রোতস্বিনী শৈলবালা! অয়ি উপত্যকে! অয়ি হিমশৈলবন! আজি তোমাদের কাছে মুমূর্ষু বিদায় যাচে, আজি তোমাদের কাছে অন্তিম বিদায়। কুটীর পরণশালা সহিয়া বিষাদজ্বালা আশ্রয় লইয়াছিনু যাহার ছায়ায়— স্তিমিত দীপের প্রায় এত দিন যেথা হায় অন্তিমজীবনরশ্মি করেছি ক্ষেপণ, আজিকে তোমার কাছে মুমূর্ষু বিদায় যাচে, তোমারি কোলের পরে সঁপিব জীবন! নেত্রে অশ্রুবারি ঝরে, নহে তোমাদের তরে, তোমাদের তরে চিত্ত ফেলিছে না শ্বাস— আজি জীবনের ব্রত উদ্‌যাপন করিব তো, বাতাসে মিশাবে আজি অন্তিম নিশ্বাস! কাঁদি না তাহার তরে, হৃদয় শোকের ভরে হতেছে না উৎপীড়িত তাহারো কারণ। আহা হা! দুখিনী বালা সহিবে বিষাদজ্বালা আজিকার নিশিভোর হইবে যখন? কালি প্রাতে একাকিনী অসহায়া অনাথিনী সংসারসমুদ্র-মাঝে ঝাঁপ দিতে হবে! সংসারযাতনাজ্বালা কিছু না জানিস্‌, বালা, আজিও!— আজিও তুই চিনিস নে ভবে! ভাবিতে হৃদয় জ্বলে,— মানুষ কারে যে বলে জানিস্‌ নে কারে বলে মানুষের মন। কার দ্বারে কাল প্রাতে দাঁড়াইবি শূন্যহাতে, কালিকে কাহার দ্বারে করিবি রোদন! অভাগা পিতার তোর জীবনের নিশা ভোর— বিষাদ নিশার শেষে উঠিবেক রবি আজ রাত্রি ভোর হলে! কারে আর পিতা বলে ডাকিবি, কাহার কোলে হাসিবি খেলিবি? জীবধাত্রী বসুন্ধরে! তোমার কোলের ‘পরে অনাথা বালিকা মোর করিনু অর্পণ! দিনকর! নিশাকর! আহা এ বালার ‘পর তোমাদের স্নেহদৃষ্টি করিও বর্ষণ! শুন সব দিক্‌বালা! বালিকা না পায় জ্বালা তোমরা জননীস্নেহে করিও পালন! শৈলবালা! বিশ্বমাতা! জগতের স্রষ্টা পাতা! শত শত নেত্রবারি সঁপি পদতলে— বালিকা অনাথা বোলে স্থান দিও তব কোলে, আবৃত করিও এরে স্নেহের আঁচলে! মুছ মা গো অশ্রুজল! আর কি কহিব বলো! অভাগা পিতারে ভোলো জন্মের মতন! আটকি আসিছে স্বর!— অবসন্ন কলেবর। ক্রমশ মুদিয়া, মা গো, আসিছে নয়ন! মুষ্টিবদ্ধ করতল, শোণিত হইছে জল, শরীর হইয়া আসে শীতল পাষাণ! এই— এই শেষবার— কুটিরের চারি ধার দেখে লই! দেখে লই মেলিয়া নয়ান! শেষবার নেত্র ভোরে এই দেখে লই তোরে চিরকাল তরে আঁখি হইবে মুদ্রিত! সুখে থেকো চিরকাল!— সুখে থেকো চিরকাল! শান্তির কোলেতে বালা থাকিও নিদ্রিত!’ স্তবধ হৃদয়োচ্ছ্বাস! স্তবধ হইল শ্বাস! স্তবধ লোচনতারা! স্তবধ শরীর! বিষম শোকের জ্বালা— মুর্চ্ছিয়া পড়িল বালা, কোলের উপরে আছে জনকের শির! গাইল নির্ঝরবারি বিষাদের গান, শাখার প্রদীপ ধীরে হইল নির্বাণ!পাদটীকা ঝাঁপ দাও ↑ হিমালয়ে এক প্রকার বৃক্ষ আছে, তাহার শাখা অগ্নিসংযুক্ত হইলে দীপের ন্যায় জ্বলে, তথাকার লোকেরা উহা প্রদীপের পরিবর্তে ব্যবহার করে।     (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (ষষ্ঠ সর্গ) ‘কমলা ভুলিবে সেই শিখর কানন,      কমলা ভুলিবে সেই বিজন কুটীর— আজ হতে নেত্র! বারি কোরো না বর্ষণ,      আজ হতে মন প্রাণ হও গো সুস্থির।অতীত ও ভবিষ্যত হইব বিসমৃত।      জুড়িয়াছে কমলার ভগন হৃদয়! সুখের তরঙ্গ হৃদে হয়েছে উত্থিত,      সংসার আজিকে হোতে দেখি সুখময়।বিজয়েরে আর করিব না তিরস্কার      সংসারকাননে মোরে আনিয়াছে বলি। খুলিয়া দিয়াছে সে যে হৃদয়ের দ্বার,      ফুটায়েছে হৃদয়ের অস্ফুটিত কলি!জমি জমি জলরাশি পর্ব্বতগুহায়      একদিন উথলিয়া উঠে রে উচ্ছ্বাসে, একদিন পূর্ণ বেগে প্রবাহিয়া যায়,      গাহিয়া সুখের গান যায় সিন্ধুপাশে।—আজি হতে কমলার নূতন উচ্ছ্বাস,      বহিতেছে কমলার নূতন জীবন। কমলা ফেলিবে আহা নূতন নিশ্বাস,      কমলা নূতন বায়ু করিবে সেবন।কাঁদিতে ছিলাম কাল বকুলতলায়,      নিশার আঁধারে অশ্রু করিয়া গোপন! ভাবিতে ছিলাম বসি পিতায় মাতায়—      জানি না নীরদ আহা এয়েছে কখন।সেও কি কাঁদিতে ছিল পিছনে আমার?      সেও কি কাঁদিতে ছিল আমারি কারণ? পিছনে ফিরিয়া দেখি মুখপানে তার,      মন যে কেমন হল জানে তাহা মন।নীরদ কহিল হৃদি ভরিয়া সুধায়—      ‘শোভনে! কিসের তরে করিছ রোদন?’ আহা হা! নীরদ যদি আবার শুধায়,      ‘কমলে! কিসের তরে করিছ রোদন?’বিজয়েরে বলিয়াছি প্রাতঃকালে কাল—      একটি হৃদয়ে নাই দুজনের স্থান! নীরদেই ভালবাসা দিব চিরকাল,      প্রণয়ের করিব না কভু অপমান।ওই যে নীরজা আসে পরাণ-সজনী,      একমাত্র বন্ধু মোর পৃথিবীমাঝার! হেন বন্ধু আছে কি রে নির্দ্দয় ধরণী!      হেন বন্ধু কমলা কি পাইবেক আর?ওকি সখি কোথা যাও? তুলিবে না ফুল?      নীরজা, আজিকে সই গাঁথিবে না মালা? ওকি সখি আজ কেন বাঁধ নাই চুল?      শুকনো শুকনো মুখ কেন আজি বালা?মুখ ফিরাইয়া কেন মুছ আঁখিজল?      কোথা যাও, কোথা সই, যেও না, যেও না! কি হয়েছে? বল্‌বি নে— বল্‌ সখি বল্‌!      কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা?’‘কি হয়েছে, কে দিয়েছে, বলি গো সকল।      কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা— ফেলিব যে চিরকাল নয়নের জল      নিভায়ে ফেলিতে বালা মরমবেদনা!কে দিয়েছে মনমাঝে জ্বালায়ে অনল?      বলি তবে তুই সখি তুই! আর নয়— কে আমার হৃদয়েতে ঢেলেছে গরল?      কমলারে ভালবাসে আমার বিজয়!কেন হলুম না বালা আমি তোর মত,      বন হতে আসিতাম বিজয়ের সাথে— তোর মত কমলা লো মুখ আঁখি যত      তা হলে বিজয়-মন পাইতাম হাতে!পরাণ হইতে অগ্নি নিভিবে না আর      বনে ছিলি বনবালা সে ত বেশ ছিলি— জ্বালালি!— জ্বলিলি বোন! খুলি মর্ম্মদ্বার—      কাঁদিতে করিগে যত্ন যেথা নিরিবিলি’।কমলা চাহিয়া রয়, নাহি বহে শ্বাস।      হৃদয়ের গূঢ় দেশে অশ্রুরাশি মিলি ফাটিয়া বাহির হতে করিল প্রয়াস—      কমলা কহিল ধীরে “জ্বালালি জ্বলিলি!”আবার কহিল ধীরে, আবার হেরিল নীরে      যমুনাতরঙ্গে খেলে পূর্ণ শশধর— তরঙ্গের ধারে ধারে রঞ্জিয়া রজতধারে      সুনীল সলিলে ভাসে রজন্ময় কর!হেরিল আকাশ-পানে সুনীল জলদযানে      ঘুমায়ে চন্দ্রিমা ঢালে হাসি এ নিশীথে। কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে পাগল বনের মেয়ে      আকুল কত কি মনে লাগিত ভাবিতে!‘ওই খানে আছে পিতা, ওই খানে আছে মাতা,      ওই জ্যোৎসনাময় চাঁদে করি বিচরণ দেখিছেন হোথা হোতে দাঁড়ায়ে সংসারপথে      কমলা নয়নবারি করিছে মোচন।একি রে পাপের অশ্রু? নীরদ আমার—      নীরদ আমার যথা আছে লুক্কায়িত, সেই খান হোতে এই অশ্রুবারিধার      পূর্ণ উৎস-সম আজ হল উৎসারিত।এ ত পাপ নয় বিধি! পাপ কেন হবে?      বিবাহ করেছি বলে নীরদে আমার ভাল বাসিব না? হায় এ হৃদয় তবে      বজ্র দিয়া দিক বিধি করে চুরমার!এ বক্ষে হৃদয় নাই, নাইক পরাণ,      একখানি প্রতিমূর্ত্তি রেখেছি শরীরে— রহিবে, যদিন প্রাণ হবে বহমান      রহিবে, যদিন রক্ত রবে শীরে শীরে!সেই মূর্ত্তি নীরদের! সে মূর্ত্তি মোহন      রাখিলে বুকের মধ্যে পাপ কেন হবে? তবুও সে পাপ— আহা নীরদ যখন      বলেছে, নিশ্চয় তারে পাপ বলি তবে!তবু মুছিব না অশ্রু এ নয়ান হোতে,      কেন বা জানিতে চাব পাপ কারে বলি? দেখুক জনক মোর ওই চন্দ্র হোতে      দেখুন জননী মোর আঁখি দুই মেলি!     নীরজা গাইত ‘চল্‌ চন্দ্রলোকে রবি। সুধাময় চন্দ্রলোক, নাই সেথা দুখ শোক,      সকলি সেথায় নব ছবি!ফুলবক্ষে কীট নাই, বিদ্যুতে অশনি নাই,      কাঁটা নাই গোলাপের পাশে! হাসিতে উপেক্ষা নাই, অশ্রুতে বিষাদ নাই,      নিরাশার বিষ নাই শ্বাসে।নিশীথে আঁধার নাই, আলোকে তীব্রতা নাই,      কোলাহল নাইক দিবায়! আশায় নাইক অন্ত, নূতনত্বে নাই অন্ত,      তৃপ্তি নাই মাধুর্য্যশোভায়।লতিকা কুসুমময়, কুসুম সুরভিময়,      সুরভি মৃদুতাময় যেথা! জীবন স্বপনময়, স্বপন প্রমোদময়,      প্রমোদ নূতনময় সেথা!সঙ্গীত উচ্ছ্বাসময়, উচ্ছ্বাস মাধুর্য্যময়,      মাধুর্য্য মত্ততাময় অতি। প্রেম অস্ফুটতামাখা, অস্ফুটতা স্বপ্নমাখা,      স্বপ্নে-মাখা অস্ফুটিত জ্যোতি!গভীর নিশীথে যেন, দূর হোতে স্বপ্ন-হেন      অস্ফুট বাঁশীর মৃদু রব— সুধীরে পশিয়া কানে শ্রবণ হৃদয় প্রাণে      আকুল করিয়া দেয় সব।এখানে সকলি যেন অস্ফুট মধুর-হেন,      উষার সুবর্ণ জ্যোতি-প্রায়। আলোকে আঁধার মিশে মধু জ্যোছনায় দিশে      রাখিয়াছে ভরিয়া সুধায়!দূর হোতে অপ্সরার মধুর গানের ধার,      নির্ঝরের ঝর ঝর ধ্বনি। নদীর অস্ফুট তান মলয়ের মৃদুগান      একত্তরে মিশেছে এমনি!সকলি অস্ফুট হেথা মধুর স্বপনে-গাঁথা      চেতনা মিশান’ যেন ঘুমে। অশ্রু শোক দুঃখ ব্যথা কিছুই নাহিক হেথা      জ্যোতির্ম্ময় নন্দনের ভূমে!’আমি যাব সেই খানে পুলকপ্রমত্ত প্রাণে      সেই দিনকার মত বেড়াব খেলিয়া— বেড়াব তটিনীতীরে, খেলাব তটিনীনীরে,      বেড়াইব জ্যোছনায় কুসুম তুলিয়া!শুনিছি মৃত্যুর পিছু পৃথিবীর সব-কিছু      ভুলিতে হয় নাকি গো যা আছে এখানে! ওমা! সে কি করে হবে? মরিতে চাই না তবে      নীরদে ভুলিতে আমি চাব কোন্‌ প্রাণে?’কমলা এতেক পরে হেরিল সহসা      নীরদ কাননপথে যাইছে চলিয়া— মুখপানে চাহি রয় বালিকা বিবশা,      হৃদয়ে শোণিতরাশি উঠে উথলিয়া।নীরদের স্কন্ধে খেলে নিবিড় কুন্তল,      দেহ আবরিয়া রহে গৈরিক বসন, গভীর ঔদাস্যে যেন পূর্ণ হৃদিতল—      চলিছে যে দিকে যেন চলিছে চরণ।যুবা কমলারে দেখি ফিরাইয়া লয় আঁখি,      চলিল ফিরায়ে মুখ দীর্ঘশ্বাস ফেলি। যুবক চলিয়া যায় বালিকা তবুও হায়!      চাহি রয় একদৃষ্টে আঁখিদ্বয় মেলি।ঘুম হতে যেন জাগি সহসা কিসের লাগি      ছুটিয়া পড়িল গিয়া নীরদের পায়। যুবক চমকি প্রাণে হেরি চারি দিক-পানে      পুনঃ না করিয়া দৃষ্টি ধীরে চলি যায়।‘কোথা যাও— কোথা যাও— নীরদ! যেও না!      একটি কহিব কথা শুন একবার! মুহূর্ত্ত— মুহূর্ত্ত রও— পুরাও কামনা!      কাতরে দুখিনী আজি কহে বার বার!জিজ্ঞাসা করিবে নাকি আজি যুবাবর      ‘কমলা কিসের তরে করিছ রোদন?’ তা হলে কমলা আজি দিবেক উত্তর,      কমলা খুলিবে আজি হৃদয়বেদন।দাঁড়াও— দাঁড়াও যুবা! দেখি একবার,      যেথা ইচ্ছা হয় তুমি যেও তার পর! কেন গো রোদন করি শুধাও আবার,      কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর!কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর,      কমলা হৃদয় খুলি দেখাবে তোমায়— সেথায় রয়েছে লেখা দেখো তার পর      কমলা রোদন করে কিসের জ্বালায়!’‘কি কব কমলা আর কি কব তোমায়,      জনমের মত আজ লইব বিদায়! ভেঙ্গেছে পাষাণ প্রাণ, ভেঙ্গেছে সুখের গান—      এ জন্মে সুখের আশা রাখি নাক আর!এ জন্মে মুছিব নাক নয়নের ধার! কত দিন ভেবেছিনু যোগীবেশ ধরে      ভ্রমিব যেথায় ইচ্ছা কানন-প্রান্তরে।তবু বিজয়ের তরে এত দিন ছিনু ঘরে      হৃদয়ের জ্বালা সব করিয়া গোপন— হাসি টানি আনি মুখে এত দিন দুখে দুখে      ছিলাম, হৃদয় করি অনলে অর্পণ!কি আর কহিব তোরে— কালিকে বিজয় মোরে      কহিল জন্মের মত ছাড়িতে আলয়! জানেন জগৎস্বামী— বিজয়ের তরে আমি      প্রেম বিসর্জ্জিয়াছিনু তুষিতে প্রণয়।’এত বলি নীরবিল ক্ষুব্ধ যুবাবর!      কাঁপিতে লাগিল কমলার কলেবর, নিবিড় কুন্তল যেন উঠিল ফুলিয়া—      যুবারে সম্ভাষে বালা, এতেক বলিয়া—‘কমলা তোমারে আহা ভালবাসে বোলে      তোমারে করেছে দূর নিষ্ঠুর বিজয়! প্রেমেরে ডুবাব আজি বিসমৃতির জলে,      বিসমৃতির জলে আজি ডুবাব হৃদয়!তবুও বিজয় তুই পাবি কি এ মন? নিষ্ঠুর! আমারে আর পাবি কি কখন? পদতলে পড়ি মোর দেহ কর ক্ষয়— তবু কি পারিবি চিত্ত করিবারে জয়? তুমিও চলিলে যদি হইয়া উদাস—কেন গো বহিব তবে এ হৃদি হতাশ? আমিও গো আভরণ ভূষণ ফেলিয়া যোগিনী তোমার সাথে যাইব চলিয়া।যোগিনী হইয়া আমি জন্মেছি যখন যোগিনী হইয়া প্রাণ করিব বহন। কাজ কি এ মণি মুক্তা রজত কাঞ্চন— পরিব বাকলবাস ফুলের ভূষণ।নীরদ! তোমার পদে লইনু শরণ— লয়ে যাও যেথা তুমি করিবে গমন! নতুবা যমুনাজলে এখনই অবহেলে ত্যজিব বিষাদদগ্ধ নারীর জীবন!’পড়িল ভূতলে কেন নীরদ সহসা?      শোণিতে মৃত্তিকাতল হইল রঞ্জিত! কমলা চমকি দেখে সভয়ে বিবশা      দারুণ ছুরিকা পৃষ্ঠে হয়েছে নিহিত!কমলা সভয়ে শোকে করিল চিৎকার।      রক্তমাখা হাতে ওই চলিছে বিজয়! নয়নে আঁচল চাপি কমলা আবার —      সভয়ে মুদিয়া আঁখি স্থির হয়ে রয়।আবার মেলিয়া আঁখি মুদিল নয়নে,      ছুটিয়া চলিল বালা যমুনার জলে— আবার আইল ফিরি যুবার সদনে,      যুমনা-শীতল জলে ভিজায়ে আঁচলে।যুবকের ক্ষত স্থানে বাঁধিয়া আঁচল      কমলা একেলা বসি রহিল তথায়— এক বিন্দু পড়িল না নয়নের জল,      এক বারো বহিল না দীর্ঘশ্বাস-বায়।তুলি নিল যুবকের মাথা কোল-পরে—      একদৃষ্টে মুখপানে রহিল চাহিয়া। নির্জ্জীব প্রতিমা-প্রায় না নড়ে না চড়ে,      কেবল নিশ্বাস মাত্র যেতেছে বহিয়া।চেতন পাইয়া যুবা কহে কমলায়,      ‘যে ছুরীতে ছিঁড়িয়াছে জীবনবন্ধন অধিক সুতীক্ষ্ম ছুরী তাহা অপেক্ষায়      আগে হোতে প্রেমরজ্জু করেছে ছেদন।বন্ধুর ছুরিকা-মাখা দ্বেষহলাহলে      করেছে হৃদয়ে দেহে আঘাত ভীষণ, নিবেছে দেহের জ্বালা হৃদয়-অনলে—      ইহার অধিক আর নাইক মরণ!বকুলের তলা হোক্‌ রক্তে রক্তময়!      মৃত্তিকা রঞ্জিত হোক্‌ লোহিত বরণে! বসিবে যখন কাল হেথায় বিজয়      আচ্ছন্ন বন্ধুতা পুনঃ উদিবে না মনে?মৃত্তিকার রক্তরাগ হোয়ে যাবে ক্ষয়—      বিজয়ের হৃদয়ের শোণিতের দাগ আর কি কখনো তার হবে অপচয়?      অনুতাপ-অশ্রুজলে মুছিবে সে রাগ?বন্ধুতার ক্ষীণ জ্যোতি প্রেমের কিরণে      (রবিকরে হীনভাতি নক্ষত্র যেমন) বিলুপ্ত হয়েছে কি রে বিজয়ের মনে?      উদিত হইবে না কি আবার কখন?একদিন অশ্রুজল ফেলিবে বিজয়!      একদিন অভিশাপ দিবে ছুরিকারে! একদিন মুছিবারে হইতে হৃদয়      চাহিবে সে রক্তধারা অশ্রুবারিধারে!কমলে! খুলিয়া ফেল আঁচল তোমার!      রক্তধারা যেথা ইচ্ছা হোক প্রবাহিত! বিজয় শুধেছে আজি বন্ধুতার ধার      প্রেমেরে করায়ে পান বন্ধুর শোণিত!চলিনু কমলা আজ ছাড়িয়া ধরায়—      পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িয়া বন্ধন, জলাঞ্জলি দিয়া পৃথিবীর মিত্রতায়,      প্রেমের দাসত্ব রজ্জু করিয়া ছেদন!”অবসন্ন হোয়ে পঞ্চল যুবক তখনি,      কমলার কোল হোতে পড়িল ধরায়! উঠিয়া বিপিনবালা সবেগে অমনি      ঊর্দ্ধহস্তে কহে উচ্চ সুদৃঢ় ভাষায়—‘জলন্ত জগৎ! ওগো চন্দ্র সূর্য্য তারা!      দেখিতেছ চিরকাল পৃথিবীর নরে! পৃথিবীর পাপ পুণ্য, হিংসা, রক্তধারা      তোমরাই লিখে রাখ জ্বলদ্‌ অক্ষরে!সাক্ষী হও তোমরা গো করিও বিচার!—      তোমরা হও গো সাক্ষী পৃথ্বী চরাচর! বহে যাও!— বহে যাও যমুনার ধার,      নিষ্ঠুর কাহিনী কহি সবার গোচর!এখনই অস্তাচলে যেও না তপন!      ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি দিনকর! এই, এই রক্তধারা করিয়া শোষণ      লয়ে যাও, লয়ে যাও স্বর্গের গোচর!ধুস্‌ নে যমুনাজল! শোণিতের ধারে!      বকুল তোমার ছায়া লও গো সরিয়ে! গোপন করো না উহা নিশীথ! আঁধারে!      জগৎ! দেখিয়া লও নয়ন ভরিয়ে!অবাক হউক্‌ পৃথ্বী সভয়ে, বিস্ময়ে!      অবাক হইয়া যাক্‌ আঁধার নরক! পিশাচেরা লোমাঞ্চিত হউক সভয়ে!      প্রকৃতি মুদুক ভয়ে নয়নপলক!রক্তে লিপ্ত হয়ে যাক্‌ বিজয়ের মন!      বিসমৃতি! তোমার ছায়ে রেখো না বিজয়ে; শুকালেও হৃদিরক্ত এ রক্ত যেমন      চিরকাল লিপ্ত থাকে পাষাণ হৃদয়ে!বিষাদ! বিলাসে তার মাখি হলাহল      ধরিও সমুখে তার নরকের বিষ! শান্তির কুটীরে তার জ্বালায়ো অনল!      বিষবৃক্ষবীজ তার হৃদয়ে রোপিস্‌!দূর হ— দূর হ তোরা ভূষণ রতন!      আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা! আবার কবরি! তোরে করিনু মোচন!      আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!কি বলিস্‌ যমুনা লো! কমলা বিধবা!      জাহ্নবীরে বল্‌ গিয়ে ‘কমলা বিধবা’! পাখী! কি করিস্‌ গান ‘কমলা বিধবা!      দেশে দেশে বল্‌ গিয়ে ‘কমলা বিধবা!আয়! শুক ফিরে যা লো বিজন শিখরে,      মৃগদের বল্‌ গিয়া উঁচু করি গলা— কুটীরকে বল্‌ গিয়ে, তটিনী,নির্ঝরে—      ‘বিধবা হয়েছে সেই বালিকা কমলা!’উহুহু! উহুহু— আর সহিব কেমনে?      হৃদয়ে জ্বলিছে কত অগ্নিরাশি মিলি। বেশ ছিনু বনবালা, বেশ ছিনু বনে!—      নীরজা বলিয়া গেছে ‘জ্বালালি! জ্বলিলি!’ (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বন-ফুল (সপ্তম সর্গ) শ্মশানগভীর আঁধার রাত্রি শ্মশান ভীষণ! ভয় যেন পাতিয়াছে আপনার আঁধার আসন! সর সর মরমরে সুধীরে তটিনী বহে যায়। প্রাণ আকুলিয়া বহে ধূমময় শ্মশানের বায়!গাছপালা নাই কোথা প্রান্তর গম্ভীর! শাখাপত্রহীন বৃক্ষ, শুষ্ক, দগ্ধ, উঁচু করি শির দাঁড়াইয়া দূরে— দূরে নিরখিয়া চারি দিক-পান পৃথিবীর ধ্বংসরাশি, রহিয়াছে হোয়ে ম্রিয়মাণ?শ্মশানের নাই প্রাণ যেন আপনার, শুষ্ক তৃণরাজি তার ঢাকিয়াছে বিশাল বিস্তার! তৃণের শিশির চুমি বহে নাকো প্রভাতের বায় কুসুমের পরিমল ছড়াইয়া হেথায় হোথায়।শ্মশানে আঁধার ঘোর ঢালিয়াছে বুক! হেথা হোথা অস্থিরাশি ভস্মমাঝে লুকাইয়া মুখ! পরশিয়া অস্থিমালা তটিনী আবার সরি যায় ভস্মরাশি ধুয়ে ধুয়ে, নিভাইয়া অঙ্গারশিখায়!বিকট দশন মেলি মানবকপাল— ধ্বংসের স্মরণস্তূপ, ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল! গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস, মেলিয়া দশনপাঁতি পৃথিবীরে করে উপহাস!মানবকঙ্কাল শুয়ে ভসেমর শয্যায়— কাণের কাছেতে গিয়া বায়ু কত কথা ফুসলায়! তটিনী কহিছে কাণে ‘উঠ! উঠ! উঠ নিদ্রা হোতে’ ঠেলিয়া শরীর তার ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে!উঠ গো কঙ্কাল! কত ঘুমাইবে আর! পৃথিবীর বায়ু এই বহিতেছে উঠ আরবার! উঠ গো কঙ্কাল! দেখ স্রোতস্বিনী ডাকিছে তোমায় ঘুমাইবে কত আর বিসর্জ্জন দিয়া চেতনায়!বল না, বল না তুমি ঘুমাও কি বোলে? কাল যে প্রেমের মালা পরাইয়াছিল এই গলে তরুণী ষোড়শী বালা! আজ তুমি ঘুমাও কি বলে! অনাথারে একাকিনী সঁপিয়া এ পৃথিবীর কোলে!উঠ গো— উঠ গো— পুনঃ করিনু আহ্বান! শুন, রজনীর কাণে ওই সে করিছে খেদ গান! সময় তোমার আজো ঘুমাবার হয় নাই ত রে! কোল বাড়াইয়া আছে পৃথিবীর সুখ তোমা-তরে!তুমি গো ঘুমাও, আমি বলি না তোমারে! জীবনের রাত্রি তব ফুরায়েছে নেত্রধারে-ধারে! এক বিন্দু অশ্রুজল বরষিতে কেহ নাই তোর, জীবনের নিশা আহা এত দিনে হইয়াছে ভোর!ভয় দেখাইয়া আহা নিশার তামসে— একটি জ্বলিছে চিতা, গাঢ় ঘোর ধূমরাশি শ্বসে! একটি অনলশিখা জ্বলিতেছে বিশাল প্রান্তরে, অসংখ্য স্ফুলিঙ্গকণা নিক্ষেপিয়া আকাশের পরে।কার চিতা জ্বলিতেছে কাহার কে জানে? কমলা! কেন গো তুমি তাকাইয়া চিতাগ্নির পানে? একাকিনী অন্ধকারে ভীষণ এ শ্মশানপ্রদেশে ভূষণবিহীনদেহে, শুষ্কমুখে, এলোথেলো কেশে?কার চিতা জান কি গো কমলে জিজ্ঞাসি! দেখিতেছ কার চিতা শ্মশানেতে একাকিনী আসি? নীরদের চিতা? নীরদের দেহ অগ্নিমাঝে জ্বলে? নিবায়ে ফেলিবে অগ্নি, কমলে, কি নয়নের জলে?নীরব নিস্তব্ধ ভাবে কমলা দাঁড়ায়ে!      গভীর নিশ্বাসবায়ু উচ্ছ্বাসিয়া উঠে! ধূমময় নিশীথের শ্মশানের বায়ে      এলোথেলো কেশরাশি চারি দিকে ছুটে!ভেদি অমা নিশীথের গাঢ় অন্ধকার      চিতার অনলোত্থিত অস্ফুট আলোক পড়িয়াছে ঘোর মলান মুখে কমলার,      পরিস্ফুট করিতেছে সুগভীর শোক!নিশীথে শ্মশানে আর নাই জন প্রাণী,      মেঘান্ধ অমান্ধকারে মগ্ন চরাচর! বিশাল শ্মশানক্ষেত্রে শুধু একাকিনী      বিষাদপ্রতিমা বামা বিলীন-অন্তর!তটিনী চলিয়া যায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া!      নিশীথশ্মশানবায়ু স্বনিছে উচ্ছ্বাসে! আলেয়া ছুটিছে হোথা আঁধার ভেদিয়া!      অস্থির বিকট শব্দ নিশার নিশ্বাসে!শৃগাল চলিয়া গেল সমুচ্চে কাঁদিয়া      নীরব শ্মশানময় তুলি প্রতিধ্বনি! মাথার উপর দিয়া পাখা ঝাপটিয়া      বাদুড় চলিয়া গেল করি ঘোরধ্বনি!এ-হেন ভীষণ স্থানে দাঁড়ায়ে কমলা!      কাঁপে নাই কমলার একটিও কেশ! শূন্যনেত্রে শূন্যহৃদে চাহি আছে বালা      চিতার অনলে করি নয়ননিবেশ!কমলা চিতায় নাকি করিবে প্রবেশ?      বালিকা কমলা নাকি পশিবে চিতায়? অনলে সংসারলীলা করিবি কি শেষ?      অনলে পুড়াবি নাকি সুকুমার কায়?সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম হায়—      ছুটিতিস্‌ ফুল তুলে কাননে কাননে ফুলে ফুল সাজাইয়া ফুলসম কায়—      দেখাতিস্‌ সাজসজ্জা পিতার সদনে!দিতিস হরিণশৃঙ্গে মালা জড়াইয়া!      হরিণশিশুরে আহা বুকে লয়ে তুলি সুদূর কাননভাগে যেতিস্‌ ছুটিয়া,      ভ্রমিতিস্‌ হেথা হোথা পথ গিয়া ভুলি!সুধাময়ী বীণাখানি লোয়ে কোল-পরে      সমুচ্চ হিমাদ্রিশিরে বসি শিলাসনে বীণার ঝঙ্কার দিয়া মধুময় স্বরে      গাহিতিস্‌ কত গান আপনার মনে!হরিণেরা বন হোতে শুনিয়া সে স্বর      শিখরে আসিত ছুটি তৃণাহার ভুলি! শুনিত,ঘিরিয়া বসি ঘাসের উপর      বড় বড় আঁখিদুটি মুখ-পানে তুলি!সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম বনে      চিতার অনলে আজ হবে তোর শেষ? সুখের যৌবন হায় পোড়াবি আগুনে?      সুকুমার দেহ হবে ভস্ম-অবশেষ!না, না, না, সরলা বালা, ফিরে যাই চল্‌      এসেছিলি যেথা হোতে সেই সে কুটীরে! আবার ফুলের গাছে ঢালিবি লো জল!      আবার ছুটিবি গিয়ে পর্ব্বতের শিরে!পৃথিবীর যাহা কিছু ভুলে যা লো সব,      নিরাশযন্ত্রণাময় পৃথ্বীর প্রণয়! নিদারুণ সংসারে ঘোর কলরব,      নিদারুণ সংসারের জ্বালা বিষ্ময়।তুই স্বরগের পাখী পৃথিবীতে কেন!      সংসারকণ্টকবনে পারিজাত ফুল! নন্দনের বনে গিয়া গাইবি খুলিয়া হিয়া,      নন্দনমলয়বায়ু করিবি আকুল।আয় তবে ফিরে যাই বিজন শিখরে—      নির্ঝর ঢালিছে যেথা স্ফটিকের জল, তটিনী বহিছে যথা কলকলস্বরে,      সুবাস নিশ্বাস ফেলে বনফুলদল!বন-ফুল ফুটেছিলি ছায়াময় বনে,      শুকাইলি মানবের নিশ্বাসের বায়ে! দয়াবয়ী বনদেবী শিশিরসেচনে      আবার জীবন তোরে দিবেন ফিরায়ে।এখনো কমলা ওই রয়েছে দাঁড়িয়ে      জ্বলন্ত চিতার পরে মেলিয়ে নয়ন! ওই রে সহসা ওই মূর্চ্ছিয়ে পড়িয়ে      ভসেমর শয্যার পরে করিল শয়ন!এলায়ে পড়িল ভসেম সুনিবিড় কেশ!      অঞ্চলবসন ভসেম পড়িল এলায়ে! উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আলুথালু বেশ      কমলার বক্ষ হোতে, শ্মশানের বায়ে!নিবে গেল ধীরে ধীরে চিতার অনল!      এখনো কমলা বালা মূর্চ্ছায় মগন! শুকতারা উজলিল গগনের তল,      এখনো কমলা বালা স্তব্ধ অচেতন!ওই রে কুমারী উষা বিলোল চরণে উঁকি মারি পূর্ব্বাশার সুবর্ণ তোরণে রক্তিম অধরখানি হাসিতে ছাইয়া সিঁদুর প্রকৃতিভালে দিল পরাইয়া।এখনো কমলা বালা ঘোর অচেতন, কমলা-কপোল চুমে অরুণকিরণ! গণিছে কুন্তলগুলি প্রভাতের বায়, চরণে তটিনী বালা তরঙ্গ দুলায়!কপোলে, আঁখির পাতে পড়েছে শিশির! নিস্তেজ সুবর্ণকরে পিতেছে মিহির! শিথিল অঞ্চলখানি লোয়ে ঊর্ম্মিমালা কত কি— কত কি কোরে করিতেছে খেলা!ক্রমশঃ বালিকা ওই পাইছে চেতন! ক্রমশঃ বালিকা ওই মেলিছে নয়ন! বক্ষোদেশ আবরিয়া অঞ্চলবসনে নেহারিল চারি দিক বিস্মিত নয়নে।ভস্মরাশিসমাকুল শ্মশানপ্রদেশ!      মলিনা কমলা ছাড়া যেদিকে নেহারি বিশাল শ্মশানে নাই সৌন্দর্য্যের লেশ,      জন প্রাণী নাই আর কমলারে ছাড়ি!সূর্য্যকর পড়িয়াছে শুষ্কমলানপ্রায়, ভস্মমাখা ছুটিতেছে প্রভাতের বায়! কোথাও নাই রে যেন আঁখির বিশ্রাম, তটিনী ঢালিছে কাণে বিষাদের গান!বালিকা কমলা ক্রমে করিল উত্থান ফিরাইল চারি দিকে নিস্তেজ নয়ান। শ্মশানের-ভস্ম-মাখা অঞ্চল তুলিয়া যেদিকে চরণ চলে যাইল চলিয়া!   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস) বনবাস বাবা যদি রামের মতো      পাঠায় আমায় বনে যেতে আমি পারি নে কি      তুমি ভাবছ মনে? চোদ্দ বছর ক' দিনে হয়      জানি নে মা ঠিক, দণ্ডক বন আছে কোথায়      ওই মাঠে কোন্‌ দিক। কিন্তু আমি পারি যেতে,      ভয় করি নে তাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    বনের মধ্যে গাছের ছায়ায়      বেঁধে নিতেম ঘর— সামনে দিয়ে বইত নদী,      পড়ত বালির চর। ছোটো একটি থাকত ডিঙি      পারে যেতেম বেয়ে— হরিণ চ'রে বেড়ায় সেথা,      কাছে আসত ধেয়ে। গাছের পাতা খাইয়ে দিতেম      আমি নিজের হাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    কত যে গাছ ছেয়ে থাকত      কত রকম ফুলে, মালা গেঁথে পরে নিতেম      জড়িয়ে মাথার চুলে। নানা রঙের ফলগুলি সব      ভুঁয়ে পড়ত পেকে, ঝুড়ি ভরে ভরে এনে      ঘরে দিতেম রেখে; খিদে পেলে দুই ভায়েতে      খেতেম পদ্মপাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    রোদের বেলায় অশথ - তলায়      ঘাসের ‘পরে আসি রাখাল - ছেলের মতো কেবল      বাজাই বসে বাঁশি। ডালের ‘পরে ময়ূর থাকে,      পেখম পড়ে ঝুলে— কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায়      ন্যাজটি পিঠে তুলে। কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম      দুপুরবেলার তাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি      শুকোনো ডালপালা, বনের ধারে বসে থাকি      আগুন হলে জ্বালা। পাখিরা সব বাসায় ফেরে,      দূরে শেয়াল ডাকে, সন্ধেতারা দেখা যে যায়      ডালের ফাঁকে ফাঁকে। মায়ের কথা মনে করি      বসে আঁধার রাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    ঠাকুরদাদার মতো বনে      আছেন ঋষি মুনি, তাঁদের পায়ে প্রণাম করে      গল্প অনেক শুনি। রাক্ষসেরে ভয় করি নে,      আছে গুহক মিতা— রাবণ আমার কী করবে মা,      নেই তো আমার সীতা। হনুমানকে যত্ন করে      খাওয়াই দুধে - ভাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার      থাকত সাথে সাথে।    মা গো, আমায় দে - না কেন      একটি ছোটো ভাই— দুইজনেতে মিলে আমরা      বনে চলে যাই।    আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি      রাম - যাত্রার গান, মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো,      হাতে ধনুক - বাণ। চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই      এম্‌নি বরষাতে— লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বনে ও রাজ্যে সারাদিন কাটাইয়া সিংহাসন পরে      সন্ধ্যায় পশিল রাম শয়নের ঘরে।      শয্যার আধেক অংশ শূন্য বহুকাল,      তারি পরে রাখিলেন পরিশ্রান্ত ভাল।      দেবশূন্য দেবালয়ে ভক্তের মতন      বসিলেন ভূমি-পরে সজলনয়ন,      কহিলেন নতজানু কাতর নিশ্বাসে—      “যতদিন দীনহীন ছিনু বনবাসে      নাহি ছিল স্বর্ণমণি মাণিক্যমুকতা,      তুমি সদা ছিলে লক্ষ্মী প্রত্যক্ষ দেবতা।      আজি আমি রাজ্যেশ্বর, তুমি নাই আর,      আছে স্বর্ণমাণিক্যের প্রতিমা তোমার।”      নিত্যসুখ দীনবেশে বনে গেল ফিরে,      স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বনের ছায়া কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ । তট-তরু কোলে কোলে           সারাদিন কলরোলে            স্রোতস্বিনী যায় চলে সুদূরে সাধের গেহ ;            কোথা রে তরুর ছায়া ,   বনের শ্যামল স্নেহ ; কোথা রে সুনীল দিশে               বনান্ত রয়েছে মিশে            অনন্তের অনিমিষে নয়ন নিমেষ-হারা । দূর হতে বায়ু এসে                 চলে যায় দূর-দেশে            গীত - গান যায় ভেসে , কোন্ দেশে যায় তারা । হাসি , বাঁশি , পরিহাস ,             বিমল সুখের শ্বাস ,            মেলামেশা বারো মাস নদীর শ্যামল তীরে ; কেহ খেলে , কেহ দোলে ,          ঘুমায় ছায়ার কোলে ,            বেলা শুধু যায় চলে কুলুকুলু নদীনীরে ।            বকুল কুড়োয় কেহ , কেহ গাঁথে মালাখানি ; ছায়াতে ছায়ার প্রায়                বসে বসে গান গায় ,             করিতেছে কে কোথায় চুপিচুপি কানাকানি । খুলে গেছে চুলগুলি ,                বাঁধিতে গিয়েছে ভুলি ,            আঙুলে ধরেছে তুলি আঁখি পাছে ঢেকে যায় ,            কাঁকন খসিয়া গেছে , খুঁজিছে গাছের ছায় । বনের মর্মের মাঝে                 বিজনে বাঁশরি বাজে ,            তারি সুরে মাঝে মাঝে ঘুঘু দুটি গান গায় । ঝুরু ঝুরু কত পাতা                গাহিছে বনের গাথা ,           কত-না মনের কথা তারি সাথে মিশে যায় । লতাপাতা কত শত                খেলে কাঁপে কত মতো            ছোটো ছোটো আলোছায়া ঝিকিমিকি বন ছেয়ে ,            তারি সাথে তারি মতো খেলে কত ছেলেমেয়ে ।                 কোথায় সে গুন গুন ঝরঝর মরমর ,            কোথা সে মাথার'পরে লতাপাতা থরথর ।            কোথায় সে ছায়া আলো , ছেলেমেয়ে খেলাধূলি ,            কোথা সে ফুলের মাঝে এলোচুলে হাসিগুলি । কোথা রে সরল প্রাণ ,              গভীর আনন্দ - গান ,           অসীম শান্তির মাঝে প্রাণের সাধের গেহ ,           তরুর শীতল ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বন্দী দাও খুলে দাও, সখী, ওই বাহুপাশ — চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান । কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস — ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান । কোথায় উষার আলো, কোথায় আকাশ — এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান! আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ, তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ । আকুল অঙ্গুলিগুলি করি কোলাকুলি গাঁথিছে সর্বাঙ্গে মোর পরশের ফাঁদ । ঘুমঘোরে শূন্যপানে দেখি মুখ তুলি শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ । স্বাধীন করিয়া দাও, বেঁধো না আমায় — স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তার পায় ।। বয়স আমার বুঝি হয়ত তখন হবে বারো বয়স আমার বুঝি হয়তো তখন হবে বারো, অথবা কী জানি হবে দুয়েক বছর বেশি আরো। পুরাতন নীলকুঠি-দোতলার 'পর ছিল মোর ঘর। সামনে উধাও ছাত-- দিন আর রাত আলো আর অন্ধকারে সাথিহীন বালকের ভাবনারে এলোমেলো জাগাইয়া যেত, অর্থশূন্য প্রাণ তারা পেত, যেমন সমুখে নীচে আলো পেয়ে বাড়িয়া উঠিছে বেতগাছ ঝোপঝাড়ে পুকুরের পাড়ে সবুজের আলপনায় রঙ দিয়ে লেপে। সারি সারি ঝাউগাছ ঝরঝর কেঁপে নীলচাষ-আমলের প্রাচীন মর্মর তখনো চলিছে বহি বৎসর বৎসর। বৃদ্ধ সে গাছের মতো তেমনি আদিম পুরাতন বয়স-অতীত সেই বালকের মন নিখিল প্রাণের পেত নাড়া, আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া, তাকায়ে রহিত দূরে। রাখালের বাঁশির করুণ সুরে অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, নাড়ীতে উঠিত নেচে। জাগ্রত ছিল না বুদ্ধি, বুদ্ধির বাহিরের যাহা তাই মনের দেউড়ি-পারে দ্বারী-কাছে বাধা পায় নাই। স্বপ্নজনতার বিশ্বে ছিল দ্রষ্টা কিংবা স্রষ্টা রূপে, পণ্যহীন দিনগুলি ভাসাইয়া দিত চুপে চুপে পাতার ভেলায়। নিরর্থ খেলায়। টাট্টু ঘোড়া চড়ি রথতলা মাঠে গিয়ে দুর্দাম ছুটাত তড়বড়ি, রক্তে তার মাতিয়ে তুলিতে গতি, নিজেরে ভাবিত সেনাপতি পড়ার কেতাবে যারে দেখে ছবি মনে নিয়েছিল এঁকে। যুদ্ধহীন রণক্ষেত্রে ইতিহাসহীন সেই মাঠে এমনি সকাল তার কাটে। জবা নিয়ে গাঁদা নিয়ে নিঙাড়িয়া রস মিশ্রিত ফুলের রঙে কী লিখিত, সে লেখার যশ আপন মর্মের মাঝে হয়েছে রঙিন-- বাহিরের করতালিহীন। সন্ধ্যাবেলা বিশ্বনাথ শিকারীকে ডেকে তার কাছ থেকে বাঘশিকারের গল্প নিস্তদ্ধ সে ছাতের উপর, মনে হ'ত, সংসারের সব চেয়ে আশ্চর্য খবর। দম্‌ ক'রে মনে মনে ছুটিত বন্দুক, কাঁপিয়া উঠিত বুক। চারি দিকে শাখায়িত সুনিবিড় প্রায়োজন যত তারি মাঝে এ বালক অর্‌কিড-তরুকার মতো ডোরাকাটা খেয়ালের অদ্ভুত বিকাশে দোলে শুধু খেলার বাতাসে। যেন সে রচয়িতার হাতে পুঁথির প্রথম শূন্য পাতে অলংকরণ আঁকা,মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কী লেখা, বাকি সব আঁকাবাঁকা রেখা। আজ যবে চলিতেছে সাংঘাতিক হিসাবনিকাশ, দিগ্‌দিগন্তে ক্ষমাহীন অদৃষ্টের দশনবিকাশ, বিধাতার ছেলেমানুষির খেলাঘর যত ছিল ভেঙে সব হল চৌচির। আজ মনে পড়ে সেই দিন আর রাত, প্রশস্ত সে ছাত, সেই আলো সেই অন্ধকারে কর্মসমুদ্রের মাঝে নৈষ্কর্ম্যদ্বীপের পারে বালকের মনখানা মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক যেন। এ সংসারে কী হতেছে কেন ভাগ্যের চক্রান্তে কোথা কী যে, প্রশ্নহীন বিশ্বে তার জিজ্ঞাসা করে নি কভু নিজে। এ নিখিলে যে জগৎ ছেলেমানুষির বয়স্কের দৃষ্টিকোণে সেটা ছিল কৌতুকহাসির, বালকের জানা ছিল না তা। সেইখানে অবাধ আসন তার পাতা। সেথা তার দেবলোক,স্বকল্পিত স্বর্গের কিনারা, বুদ্ধির ভর্ৎসনা নাই,নাই সেথা প্রশ্নের পাহারা, যুক্তির সংকেত নাই পথে, ইচ্ছা সঞ্চরণ করে বল্গামুক্ত রথে। বর এসেছে বীরের ছাঁদে বর এসেছে বীরের ছাঁদে, বিয়ের লগ্ন আটটা। পিতল-আঁটা লাঠি কাঁধে, গালেতে গালপাট্টা। শ্যালীর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে আলাপ যখন উঠল জমে, রায়বেঁশে নাচ নাচের ঝোঁকে মাথায় মারলে গাঁট্টা। শ্বশুর কাঁদে মেয়ের শোকে, বর হেসে কয়– “ঠাট্টা’!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বরবধূ এ-পারে চলে বর, বধূ সে পরপারে,              সেতুটি বাঁধা তার মাঝে। তাহারি 'পরে দান আসিছে ভারে ভারে,          তাহারি 'পরে বাঁশি বাজে।                যাত্রা দুজনার                লক্ষ্য একই তার,                     তবুও যত কাছে আসে                সতত যেন থাকে                বিরহ ফাঁকে ফাঁকে                     তৃপ্তিহারা অবকাশে।সে-ফাঁক গেলে ঘুচে থেমে যে যাবে গান,          দৃষ্টি হবে বাধাময়, যেথায় দূর নাহি সেথায় যত দান          কাছেতে ছোটো হয়ে রয়।                বিরহনদীজলে                খেয়ার তরী চলে,                     বায় সে মিলনেরই ঘাটে।                হৃদয় বারবার                করিবে পারাপার                     মিলিতে উৎসবনাটে।বেলা যে পড়ে এল, সূর্য নামে ধীরে,          আলোক ম্লান হয়ে আসে। ভাঙিয়া গেছে হাট, জনতাহীন তীরে          নৌকা বাঁধা পাশে পাশে।                এ-পারে বর চলে                পুরানো বটতলে,                    নদীটি বহি চলে মাঝে,                বধূরে দেখা যায়                মাঠের কিনারায়,                   সেতুর 'পরে বাঁশি বাজে। বরষার রাতে জলের আঘাতে বরষার রাতে জলের আঘাতে পড়িতেছে যুর্থী ঝরিয়া। পরিমলে তারি সজল পবন করুণায় উঠে ভরিয়া।   (স্ফুলিঙ্গ) বরষে বরষে শিউলিতলায় বরষে বরষে শিউলিতলায় ব’স অঞ্জলি পাতি, ঝরা ফুল দিয়ে মালাখানি লহ গাঁথি এ কথাটি মনে জান’— দিনে দিনে তার ফুলগুলি হবে মান, মালার রূপটি বুঝি মনের মধ্যে রবে কোনোখানে যদি দেখ তারে খুঁজি।সিন্দুকে রহে বন্ধ, হঠাৎ খুলিলে আভাসেতে পাও পুরানো কালের গন্ধ।   (স্ফুলিঙ্গ) বরের বাপের বাড়ি বরের বাপের বাড়ি যেতেছে বৈবাহিক, সাথে সাথে ভাঁড় হাতে চলেছে দই-বাহিক। পণ দেবে কত টাকা লেখাপড়া হবে পাকা, দলিলের খাতা নিয়ে এসেছে সই-বাহিক।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বর্ষণগৌরব তার বর্ষণগৌরব তার গিয়েছে চুকি, রিক্তমেঘ দিকপ্রান্তে ভয়ে দেয় উঁকি।     (স্ফুলিঙ্গ) বর্ষশেষ নির্মল প্রত্যুষে আজি যত ছিল পাখি বনে বনে শাখে শাখে উঠিয়াছে ডাকি। দোয়েল শ্যামার কণ্ঠে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, গেয়ে গেয়ে পাপিয়ার নাহি মিটে আশ। করুণ মিনতিস্বরে অশ্রান্ত কোকিল অন্তরের আবেদনে ভরিছে নিখিল। কেহ নাচে, কেহ গায়, উড়ে মত্তবৎ, ফিরিয়া পেয়েছে যেন হারানো জগৎ। পাখিরা জানে না কেহ আজি বর্ষশেষ, বকবৃদ্ধ-কাছে নাহি শুনে উপদেশ। যতদিন এ আকাশে এ জীবন আছে, বরষের শেষ নাহি তাহাদের কাছে। মানুষ আনন্দহীন নিশিদিন ধরি আপনারে ভাগ করে শতখানা করি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বর্ষা নেমেছে প্রান্তরে অনিমন্ত্রণে বর্ষা নেমেছে প্রান্তরে অনিমন্ত্রণে; ঘনিয়েছে সার-বাঁধা তালের চূড়ায়, রোমাঞ্চ দিয়েছে বাঁধের কালো জলে। বর্ষা নামে হৃদয়ের দিগন্তে যখন পারি তাকে আহ্বান করতে। কিছুকাল ছিলেম বিদেশে। সেখানকার শ্রাবণের ভাষা আমার প্রাণের ভাষার সঙ্গে মেলেনি। তার অভিষেক হল না আমার অন্তরপ্রাঙ্গণে। সজল মেঘ-শ্যামলের সঞ্চরণ থেকে বঞ্চিত জীবনে কিছু শীর্ণতা রয়ে গেল বনস্পতির অঙ্গের আয়তি ঐ তো দেয় বাড়িয়ে বছরে বছরে; তার কাষ্ঠফলকে চক্রচিহ্নে স্বাক্ষর যায় রেখে। তেমনি ক'রে প্রতি বছরে বর্ষার আনন্দ আমার মজ্জার মধ্যে রসসম্পদ কিছু যোগ করে। প্রতিবার রঙের প্রলেপ লাগে জীবনের পটভূমিকায় নিবিড়তর ক'রে; বছরে বছরে শিল্পকারের অঙ্গুরি-মুদ্রার গুপ্ত সংকেত অঙ্কিত হয় অন্তর-ফলকে। নিরালায় জানলার কাছে বসেছি যখন নিষ্কর্মা প্রহরগুলো নিঃশব্দ চরণে কিছু দান রেখে গেছে আমার দেহলিতে; জীবনের গুপ্ত ধনের ভাণ্ডারে পুঞ্জিত হয়েছে বিস্মৃত মুহূর্তের সঞ্চয়। বহু বিচিত্রের কারুকলায় চিত্রিত এই আমার সমগ্র সত্তা তার সমস্ত সঞ্চয় সমস্ত পরিচয় নিয়ে কোনো যুগে কি কোনো দিব্যদৃষ্টির সম্মুখে পরিপূর্ণ অবারিত হবে? তার সকল তপস্যায় সে চেয়েছে গোচরতাকে; বলেছে, যেমন বলে গোধূলির অস্ফুট তারা, বলেছে, যেমন বলে নিশান্তের অরুণ আভাস,-- "এস প্রকাশ, এস।" কবে প্রকাশ হবে পূর্ণ, আপনি প্রত্যক্ষ হব আপনার আলোতে বধূ যেমন সত্য ক'রে জানে আপনাকে, সত্য ক'রে জানায়, যখন প্রাণে জাগে তার প্রেম, যখন দুঃখকে পারে সে গলার হার করতে, যখন দৈন্যকে দেয় সে মহিমা, যখন মৃত্যুতে ঘটে না তার অসমাপ্তি। বর্ষাযাপন রাজধানী কলিকাতা; তেতালার ছাতে        কাঠের কুঠরি এক ধারে; আলো আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে,        বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।মেঝেতে বিছানা পাতা,      দুয়ারে রাখিয়া মাথা            বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি, সৌধ-ছাদ শত শত          ঢাকিয়া রহস্য কত            আকাশেরে করিছে ভ্রূকুটি। নিকটে জানালা-গায়        এক কোণে আলিসায়            একটুকু সবুজের খেলা, শিশু অশথের গাছ           আপন ছায়ার নাচ            সারা দিন দেখিছে একেলা। দিগন্তের চারি পাশে        আষাঢ় নামিয়া আসে,            বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো, সমস্ত আকাশজোড়া        গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া            চিকমিকে বিদ্যুতের আলো। চারি দিকে অবিরল         ঝরঝর বৃষ্টিজল           এই ছোটো প্রান্ত-ঘরটিরে দেয় নির্বাসিত করি         দশ দিক অপহরি           সমুদয় বিশ্বের বাহিরে। বসে বসে সঙ্গীহীন         ভালো লাগে কিছুদিন           পড়িবারে মেঘদূতকথা— বাহিরে দিবস রাতি        বায়ু করে মাতামাতি           বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা; বহুপূর্ব আষাঢ়ের           মেঘাচ্ছন্ন ভারতের           নগ-নদী-নগরী বাহিয়া কত শ্রুতিমধু নাম         কত দেশ কত গ্রাম           দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া। ভালো করে দোঁহে চিনি,  বিরহী ও বিরহিণী           জগতের দু পারে দুজন— প্রাণে প্রাণে পড়ে টান,    মাঝে মহা ব্যবধান,           মনে মনে কল্পনা সৃজন। যক্ষবধূ গৃহকোণে         ফুল নিয়ে দিন গণে           দেখে শুনে ফিরে আসি চলি। বর্ষা আসে ঘন রোলে,   যত্নে টেনে লই কোলে           গোবিন্দদাসের পদাবলী। সুর করে বার বার       পড়ি বর্ষা-অভিসার—           অন্ধকার যমুনার তীর, নিশীথে নবীনা রাধা     নাহি মানে কোনো বাধা,           খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটির। অনুক্ষণ দর দর         বারি ঝরে ঝর ঝর,           তাহে অতি দূরতর বন; ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার,    সঙ্গে কেহ নাহি আর           শুধু এক কিশোর মদন।আষাঢ় হতেছে শেষ,   মিশায়ে মল্লার দেশ          রচি 'ভরা বাদরের' সুর। খুলিয়া প্রথম পাতা,    গীতগোবিন্দের গাথা          গাহি 'মেঘে অম্বর মেদুর'। স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে     ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ বৃষ্টি পড়ে—          শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায় ‘রজনী শাঙন ঘন ঘন  দেয়া গরজন’          সেই গান মনে পড়ে যায়। ‘পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে   বিগলিত চীর অঙ্গে’          মনসুখে নিদ্রায় মগন— সেই ছবি জাগে মনে  পুরাতন বৃন্দাবনে          রাধিকার নির্জন স্বপন। মৃদু মৃদু বহে শ্বাস,    অধরে লাগিছে হাস,          কেঁপে উঠে মুদিত পলক; বাহুতে মাথাটি থুয়ে  একাকিনী আছে শুয়ে,          গৃহকোণে ম্লান দীপালোক। গিরিশিরে মেঘ ডাকে,   বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে          দাদুরী ডাকিছে সারারাতি— হেনকালে কী না ঘটে,   এ সময়ে আসে বটে          একা ঘরে স্বপনের সাথি। মরি মরি স্বপ্নশেষে     পুলকিত রসাবেশে          যখন সে জাগিল একাকী, দেখিল বিজন ঘরে      দীপ নিবু নিবু করে          প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি। বাড়িছে বৃষ্টির বেগ,     থেকে থেকে ডাকে মেঘ,          ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া, সেই ঘনঘোরা নিশি     স্বপ্নে জাগরণে মিশি          না জানি কেমন করে হিয়া।লয়ে পুঁথি দু-চারিটি     নেড়ে চেড়ে ইটি সিটি          এইমতো কাটে দিনরাত। তার পরে টানি লই      বিদেশী কাব্যের বই,          উলটি পালটি দেখি পাত— কোথা রে বর্ষার ছায়া    অন্ধকার মেঘমায়া          ঝরঝর ধ্বনি অহরহ, কোথায় সে কর্মহীন      একান্তে আপনে-লীন          জীবনের নিগূঢ় বিরহ! বর্ষার সমান সুরে         অন্তর বাহির পুরে          সংগীতের মুষলধারায়, পরানের বহুদূর           কূলে কূলে ভরপুর,          বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়! তখন সে পুঁথি ফেলি,    দুয়ারে আসন মেলি          বসি গিয়ে আপনার মনে, কিছু করিবার নাই        চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই          দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে। মাথাটি করিয়া নিচু       বসে বসে রচি কিছু          বহু যত্নে সারাদিন ধরে— ইচ্ছা করে অবিরত        আপনার মনোমত          গল্প লিখি একেকটি করে। ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা          নিতান্তই সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি         প্রত্যহ যেতেছে ভাসি          তারি দু-চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা          ঘটনার ঘনঘটা,          নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে       সাঙ্গ করি’ মনে হবে          শেষ হয়ে হইল না শেষ। জগতের শত শত         অসমাপ্ত কথা যত,          অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল, অজ্ঞাত জীবনগুলা,       অখ্যাত কীর্তির ধুলা,          কত ভাব, কত ভয় ভুল— সংসারের দশদিশি        ঝরিতেছে অহর্নিশি          ঝরঝর বরষার মতো— ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি      পড়িতেছে রাশি রাশি          শব্দ তার শুনি অবিরত। সেই-সব হেলাফেলা,     নিমেষের লীলাখেলা          চারি দিকে করি স্তূপাকার, তাই দিয়ে করি সৃষ্টি      একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি          জীবনের শ্রাবণনিশার। বর্ষার দিনে এমন দিনে তারে বলা যায়           এমন ঘনঘোর বরিষায় - এমন মেঘস্বরে          বাদল-ঝরঝরে           তপনহীন ঘন তমসায়।।          সে কথা শুনিবে না কেহ আর,           নিভৃত নির্জন চারি ধার। দুজনে মুখোমুখি          গভীর দুখে দুখি,           আকাশে জল ঝরে অনিবার -           জগতে কেহ যেন নাহি আর।।          সমাজ সংসার মিছে সব,           মিছে এ জীবনের কলরব। কেবল আঁখি দিয়ে          আঁখির সুধা পিয়ে           হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব -           আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।          বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,           চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ। সে কথা আঁখিনীরে          মিশিয়া যাবে ধীরে,           বাদলবায়ে তার অবসান -           সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ।।          তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার           নামাতে পারি যদি মনোভার! শ্রাবণবরিষনে          একদা গৃহকোণে           দু কথা বলি যদি কাছে তার           তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।          আছে তো তার পরে বারো মাস -           উঠিবে কত কথা, কত হাস। আসিবে কত লোক,          কত-না দুখশোক,           সে কথা কোনখানে পাবে নাশ -           জগৎ চলে যাবে বারো মাস।।          ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,           বিজুলি থেকে থেকে চমকায়। যে কথা এ জীবনে          রহিয়া গেল মনে           সে কথা আজি যেন বলা যায়           এমন ঘনঘোর বরিষায়।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) বলিয়াছিনু মামারে বলিয়াছিনু মামারে– তোমারি ঐ চেহারাখানি কেন গো দিলে আমারে। তখনো আমি জন্মিনি তো, নেহাত ছিনু অপরিচিত, আগেভাগেই শাস্তি এমন, এ কথা মনে ঘা মারে। হাড় ক’খানা চামড়া দিয়ে ঢেকেছে যেন চামারে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বলের অপেক্ষা বলী ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ— কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) বলো গো বালা, আমারি তুমি পিলুবলো গো বালা, আমারি তুমি হইবে চিরকাল! অনিয়া দিব চরণতলে যা-কিছু আছে সাগরজলে পৃথিবী-‘পরে আকাশতলে অমূল মণি জাল! শুনি আশার মোহন-রব যা-কিছু ভালো লাগিবে তব আনিয়া দিব, হও গো, যদি আমারি চিরকাল! যেথায় মোরা বেড়াব দুটি, কুসুমগুলি উঠিবে ফুটি, নদীর জলে শুনিতে পাব দেবতাদের বাণী। তারকাগুলি দেখাবে যেন প্রেমিকদেরি জগতহেন, মধুর এক স্বপন সম দেখাবে ধরাখানি! আকাশ-ভেদী শিখর হতে পতনশীল নিঝর-স্রোতে নাহিয়া যথা কানন-ভূমি হরিত-বাসে সাজে, চির-প্রবাহী সুখের ধারে দোঁহার হৃদি হাসিবে হারে– যেই সুখের মূল লুকানো কলপনার মাঝে! প্রেম দেবের কুহক জালে হৃদয়ে যার অমৃত ঢালে, সেই সে জনে করেন প্রেম কত না সুখ-দান। ভবন তাঁর স্বরগ-‘পরে, যেথায় তাঁর চরণ পড়ে ধরার মাঝে স্বরগ শোভা ধরে, গো, সেইখান!Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা) বশীরহাটেতে বাড়ি বশীরহাটেতে বাড়ি বশ-মানা ধাত তার, ছেলে বুড়ো যে যা বলে কথা শোনে যার-তার। দিনরাত সর্বথা সাধে নিজ খর্বতা, মাথা আছে হেঁট-করা, সদা জোড়-হাত তার, সেই ফাঁকে কুকুরটা চেটে যায় পাত তার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বসন্ত আওল রে বসন্ত আওল রে !  মধুকর গুন গুন , অমুয়ামঞ্জরী       কানন ছাওল রে ।   শুন শুন সজনী হৃদয় প্রাণ মম       হরখে আকুল ভেল ,   জর জর রিঝসে দুখ জ্বালা সব       দূর দূর চলি গেল । মরমে বহই বসন্তসমীরণ ,       মরমে ফুটই ফুল ,    মরমকুঞ্জ'পর বোলই কুহু কুহু       অহরহ কোকিলকুল ।   সখি রে উছসত প্রেমভরে অব       ঢলঢল বিহ্বল প্রাণ , নিখিল জগত জনু হরখ - ভোর ভই       গায় রভসরসগান । বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন       কহিছে দুখিনী রাধা , কঁহি রে সো প্রিয় , কঁহি সো প্রিয়তম ,      হৃদিবসন্ত সো মাধা ? ভানু কহত অতি গহন রয়ন অব ,       বসন্তসমীর শ্বাসে মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল       ফুল্ল বাসনা - বাসে । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) বসন্ত পাঠায় দূত বসন্ত পাঠায় দূত রহিয়া রহিয়া যে কাল গিয়েছে তার নিশ্বাস বহিয়া।   (স্ফুলিঙ্গ) বসন্ত যে লেখা লেখে বসন্ত যে লেখা লেখে বনে বনান্তরে নামুক তাহারি মন্ত্র লেখনীর 'পরে।   (স্ফুলিঙ্গ) বসন্ত-অবসান কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান! কখন বকুল-মূল              ছেয়েছিল ঝরা ফুল , কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান ! কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !       এবার বসন্তে কি রে                যুথীগুলি জাগে নি রে ! অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান ! এবার কি সমীরণ                   জাগয় নি ফুলবন , সাড়া দিয়ে গেল না তো , চলে গেল ম্রিয়মাণ ! কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!       যতগুলি পাখি ছিল            গেয়ে বুঝি চলে গেল , সমীরণে মিলে গেল বনের বিলাপতান । ভেঙেছে ফুলের মেলা ,   চলে গেছে হাসি - খেলা , এতক্ষণে সন্ধ্যাবেলা জাগিয়া চাহিল প্রাণ । কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান !       বসন্তের শেষ রাতে            এসেছি রে শূন্য হাতে , এবার গাঁথি নি মালা , কী তোমারে করি দান ! কাঁদিছে নীরব বাঁশি ,                         অধরে মিলায় হাসি , তোমার নয়নে ভাসে ছলছল অভিমান । এবার বসন্ত গেল , হল না , হল না গান !    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বসন্তের আসরে ঝড় বসন্তের আসরে ঝড় যখন ছুটে আসে মুকুলগুলি না পায় ডর, কচি পাতারা হাসে। কেবল জানে জীর্ণ পাতা ঝড়ের পরিচয়— ঝড় তো তারি মুক্তিদাতা, তারি বা কিসে ভয়।   (স্ফুলিঙ্গ) বসন্তের হাওয়া যবে অরণ্য মাতায় বসন্তের হাওয়া যবে অরণ্য মাতায় নৃত্য উঠে পাতায় পাতায়। এই নৃত্যে সুন্দরকে অৰ্ঘ্য দেয় তার, "ধন্য তুমি" বলে বার বার।   (স্ফুলিঙ্গ) বস্তুতে রয় রূপের বাঁধন বস্তুতে রয় রূপের বাঁধন, ছন্দ সে রয় শক্তিতে, অর্থ সে রয় ব্যক্তিতে   (স্ফুলিঙ্গ) বস্ত্রহরণ ‘সংসারে জিনেছি’ ব’লে দুরন্ত মরণ জীবন বসন তার করিছে হরণ। যত বস্ত্রে টান দেয়, বিধাতার বরে। বস্ত্র বাড়ি চলে তত নিত্যকাল ধ’রে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) বহু কোটি যুগ পরে বহু কোটি যুগ পরে সহসা বাণীর বরে জলচর প্রাণীদের কণ্ঠটা পাওয়া যেই সাগর জাগর হল কতমতো আওয়াজেই। তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে; চিঁ চিঁ করে চিংড়ি; ইলিস বেহাগ ভাঁজে যেন মধু নিংড়ি; শাঁখগুলো বাজে, বহে দক্ষিণে হাওয়া যেই; গান গেয়ে শুশুকেরা লাগে কুচ-কাওয়াজেই।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশে। একদা নূতন বর্ষ অতলান্ত সমুদ্রের বুকে মোরে এনেছিল বহি তরঙ্গের বিপুল প্রলাপে দিক হতে যেথা দিগন্তরে শূন্য নীলিমার 'পরে শূন্য নীলিমায় তটকে করিছে অস্বীকার। সেদিন দেখিনু ছবি অবিচিত্র ধরণীর-- সৃষ্টির প্রথম রেখাপাতে জলমগ্ন ভবিষ্যৎ যবে প্রতিদিন সূর্যোদয়-পানে আপনার খুঁজিছে সন্ধান। প্রাণের রহস্য-ঢাকা তরঙ্গের যবনিকা-'পরে চেয়ে চেয়ে ভাবিলাম, এখনো হয় নি খোলা আমার জীবন-আবরণ-- সম্পূর্ণ যে আমি রয়েছে গোপনে অগোচর। নব নব জন্মদিনে যে রেখা পড়িছে আঁকা শিল্পীর তুলির টানে টানে ফোটে নি তাহার মাঝে ছবির চরম পরিচয়। শুধু করি অনুভব, চারি দিকে অব্যক্তের বিরাট প্লাবন বেষ্টন করিয়া আছে দিবসরাত্রিরে। বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।   (স্ফুলিঙ্গ) বাঁশি কিনু গোয়ালার গলি।                 দোতলা বাড়ির        লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর                   পথের ধারেই।      লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,            মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।      মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি                সিদ্ধিদাতা গণেশের                          দরজার 'পরে আঁটা।            আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব                       এক ভাড়াতেই,                              সেটা টিকটিকি।                      তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,                           নেই তার অন্নের অভাব॥         বেতন পঁচিশ টাকা,                সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি। খেতে পাই দত্তদের বাড়ি         ছেলেকে পড়িয়ে। শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,     সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,        আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।            এঞ্জিনের ধস্ ধস্,                বাঁশির আওয়াজ,                    যাত্রীর ব্যস্ততা,                       কুলি-হাঁকাহাঁকি।                          সাড়ে-দশ বেজে যায়,          তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥  ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---                তাঁর দেওরের মেয়ে,   অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।          লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---               সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।                     মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,                           আমি তথৈবচ।   ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---             পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥                          বর্ষা ঘনঘোর।                     ট্রামের খরচা বাড়ে,               মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।                     গলিটার কোণে কোণে               জমে ওঠে, পচে ওঠে           আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,                  মাছের কান্‌কা,                         মরা বেড়ালের ছানা---                ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।             ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া                    মাইনের মতো,                            বহু ছিদ্র তার।                         আপিসের সাজ                গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,                     সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।                         বাদলের কালো ছায়া                     স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে                         কলে পড়া জন্তুর মতন                              মূর্ছায় অসাড়!                     দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা                জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।               গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---                     যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,                          বড়ো বড়ো চোখ,                                শৌখিন মেজাজ।                          কর্নেট বাজানো তার শখ।                 মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে                             এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে---                 কখনো গভীর রাতে,                          ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,                 কখনো বৈকালে                          ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।                                হঠাত্‍‌ সন্ধ্যায়         সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,            সমস্ত আকাশে বাজে                অনাদি কালের বিরহবেদনা।            তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে                এ গলিটা ঘোর মিছে         দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।            হঠাত্‍‌ খবর পাই মনে,     আকবর বাদশার সঙ্গে            হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।                 বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে                      ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে                           এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥         এ গান যেখানে সত্য               অনন্ত গোধুলিলগ্নে                     সেইখানে                         বহি চলে ধলেশ্বরী,               তীরে তমালের ঘন ছায়া---                     আঙিনাতে               যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার        পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥২৫ আষাঢ় ১৩৩৯ সূত্রঃ পরিশেষ বাঁশি (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ওগো , শোনো কে বাজায় ! বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়। অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি         চুরি করে হাসিখানি , বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায় ।            ওগো শোনো কে বাজায় !    কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে , বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে । যমুনারই কলতান          কানে আসে , কাঁদে প্রাণ , আকাশে ঐ মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায় !            ওগো শোনো কে বাজায় !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বাঁশিওয়ালা ‘ওগো বাঁশিওয়ালা,     বাজাও তোমার বাঁশি,         শুনি আমার নূতন নাম’- এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,         মনে আছে তো? আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।     সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেন নি         আমাকে মানুষ ক‘রে গড়তে,         রেখেছেন আধাআধি করে। অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি-     সেকালে আর আজকের কালে,           মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,         মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়। আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকোয়-     চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন,         কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায়।            সেখান থেকে দেখি         প্রখর আলোয় ঝাপসা দূরের জগৎ; বিনা কারণে কাঙাল মন অধীর হয়ে ওঠে;     দুই হাত বাড়িয়ে দিই নাগাল পাই নে কিছুই কোন দিকে।।        বেলাতো কাটে না, বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে- ভেসে যায় মুক্তিপারের খেয়া,     ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা,            ভেসে যায় চলতি বেলার আলোছায়া।            এমন-সময় বাজে তোমার বাঁশি             ভরা জীবনের সুরে,             মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে     দব্দবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ।।কী বাজাও তুমি, জানি নে সে সুর জাগায় কার মনে কী ব্যথা।     বুঝি বাজাও পঞ্চম রাগে দক্ষিণ হাওয়ার নবযৌবনের ভাটিয়ারি। শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়- যে ছিল পাহাড়তলীর ঝিরঝিরে নদী তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে শ্রাবণের বাদলরাত্রি। সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে, একগুঁয়ে পাথরগুলোকে ঠেলা দিচ্ছে অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণিমাতন।।আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক, আগুনের ডাক, পাঁজরের-উপরে-আছাড়-খাওয়া মরণসাগরের ডাক, ঘরের-শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক। যেন হাঁক দিয়ে আসে অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি- ছিনিয়ে নেবে, ভাসিয়ে দেবে বুঝি। অঙ্গে অঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে কালবৈশাখীর-ঘূর্ণি-মার-খাওয়া অরণ্যের বকুনি।।ডানা দেয় নি বিধাতা- তোমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে ঝোড়ো আকাশে উড়ো প্রাণের পাগলামি।।ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে; সবাই বলে ‘ভালো’। তারা দেখে আমার ইচ্ছার নেই জোর, সাড়া নেই লোভের, ঝাপট লাগে মাথার উপর- ধূলোয় লুটোই মাথা। দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত ক’রে ফেলি নেই এমন বুকের পাটা; কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে, কাঁদতে শুধু জানি, জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।।বাঁশিওয়ালা, বেজে ওঠে তোমার বাঁশি, ডাক পড়ে অমর্তলোকে; সেখানে আপন গরিমায় উপরে উঠেছে আমার মাথা। সেখানে কুয়াশার পর্দা-ছেঁড়া তরুণ সূর্য আমার জীবন। সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয় আমার বারণ-না-মানা আগ্রহ, উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে প্রথম-ক্ষুধায়-অস্থির-গরুড়ের মতো। জেগে ওঠে বিদ্রোহিনী, তীক্ষè চোখের আড়ে জানায় ঘৃণা চারদিকে ভীরুর ভিড়কে- কৃশ কুটিলের কাপুরুষতাকে।।বাঁশিওয়ালা, হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি। জানি নে, ঠিক জায়গাটি কোথায়, ঠিক সময় কখন, চিনবে কেমন ক’রে। দোসরহারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝণক রাত্রে সেই নারীতো ছায়ারূপে গেছে তোমার অভিসারে চোখ-এড়ানো পথে। সেই অজানাকে কত বসন্তে পরিয়েছ ছন্দের মালা- শুকোবে না তার ফুল।।তোমার ডাক শুনে একদিন ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল ঘোমটা খসা নারী। যেন সে হঠাৎ-গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির, চমক লাগালো তোমাকেই। সে নামবে না গানের আসন থেকে; সে লিখবে তোমাকে চিঠি রাগিনীর আবছায়ায় বসে- তুমি জানবে না তার ঠিকানা। ওগো বাঁশিওয়ালা, সে থাক তোমার বাঁশির সুরের দূরত্বে। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাংলাদেশের মানুষ হয়ে ছুটিতে ধাও চিতোরে, কাঁচড়াপাড়ার জলহাওয়াটা লাগল এতই তিতো রে? মরিস ভয়ে ঘরের প্রিয়ার, পালাস ভয়ে ম্যালেরিয়ার, হায় রে ভীরু, রাজপুতানার ভূত পেয়েছে কী তোরে। লড়াই ভালোবাসিস, সে তো আছেই ঘরের ভিতরে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বাউল দূরে অশথতলায় পুঁতির            কণ্ঠিখানি গলায়           বাউল             দাঁড়িয়ে কেন আছ ?                    সামনে আঙিনাতে তোমার           একতারাটি হাতে           তুমি               সুর লাগিয়ে নাচো !                    পথে করতে খেলা আমার            কখন হল বেলা           আমায়            শাস্তি দিল তাই ।                     ইচ্ছে হোথায় নাবি কিন্তু               ঘরে বন্ধ চাবি           আমার            বেরোতে পথ নাই ।                          বাড়ি ফেরার তরে তোমায়           কেউ না তাড়া করে           তোমার           নাই কোনো পাঠশালা ।                    সমস্ত দিন কাটে তোমার           পথে ঘাটে মাঠে           তোমার           ঘরেতে নেই তালা ।                    তাই তো তোমার নাচে আমার            প্রাণ যেন ভাই বাঁচে —           আমার            মন যেন পায় ছুটি ।                    ওগো তোমার নাচে যেন               ঢেউয়ের দোলা আছে ,            ঝড়ে               গাছের লুটোপুটি ।                    অনেক দূরের দেশ আমার            চোখে লাগায় রেশ ,           যখন               তোমায় দেখি পথে ।                    দেখতে পায় যে মন যেন               নাম - না - জানা বন           কোন্‌              পথহারা পর্বতে ।                    হঠাৎ মনে লাগে , যেন               অনেক দিনের আগে ,           আমি              অমনি ছিলেম ছাড়া ।                       সেদিন গেল ছেড়ে , আমার                      পথ নিল কে কেড়ে ,           আমার             হারাল একতারা ।                    কে নিল গো টেনে , আমায়            পাঠশালাতে এনে ,           আমার            এল গুরুমশায় ।                    মন সদা যার চলে যত                ঘরছাড়াদের দলে           তারে         ঘরে কেন বসায় ?                    কও তো আমায় ভাই , তোমার           গুরুমশায় নাই ?            আমি              যখন দেখি ভেবে                    বুঝতে পারি খাঁটি , তোমার           বুকের একতারাটি ,           তোমায়           ঐ তো পড়া দেবে ।                    তোমার কানে কানে ওরই               গুনগুনানি গানে           তোমায়           কোন্‌ কথা যে কয় !                     সব কি তুমি বোঝ ? তারই              মানে যেন খোঁজ           কেবল             ফিরে ভুবনময় ।                    ওরই কাছে বুঝি আছে              তোমার নাচের পুঁজি ,           তোমার           খেপা পায়ের ছুটি ?                    ওরই সুরের বোলে তোমার            গলার মালা দোলে           তোমার           দোলে মাথার ঝুঁটি ।                    মন যে আমার পালায় তোমার           একতারা - পাঠশালায় ,           আমায়            ভুলিয়ে দিতে পার ?                    নেবে আমায় সাথে ? এ - সব             পণ্ডিতেরই হাতে           আমায়             কেন সবাই মার ?                    ভুলিয়ে দিয়ে পড়া আমায়            শেখাও সুরে - গড়া           তোমার           তালা - ভাঙার পাঠ ।                    আর কিছু না চাই , যেন               আকাশখানা পাই ,           আর               পালিয়ে যাবার মাঠ ।                    দূরে কেন আছ ? দ্বারের             আগল ধরে নাচো ,           বাউল             আমারই এইখানে ।                    সমস্ত দিন ধ ' রে যেন               মাতন ওঠে ভ ' রে           তোমার           ভাঙন - লাগা গানে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) বাকি কুসুমের গিয়েছে সৌরভ, জীবনের গিয়েছে গৌরব। এখন যা-কিছু সব ফাঁকি, ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে সেই জালে ধরা পড়ে অধরা যা চেতনার সতর্কতা ছিল এড়াইয়া আগোচরে মনের গহনে। নামে বাঁধিবারে চাই, না মানে নামের পরিচয়। মূল্য তার থাকে যদি দিনে দিনে হয় তাহা জানা হাতে হাতে ফিরে। অকস্মাৎ পরিচয়ে বিস্ময় তাহার ভুলায় যদি বা, লোকালয়ে নাহি পায় স্থান, মনের সৈকততটে বিকীর্ণ সে রহে কিছুকাল, লালিত যা গোপনের প্রকাশ্যের অপমানে দিনে দিনে মিশায় বালুতে। পণ্যহাটে অচিহ্নিত পরিত্যক্ত রিক্ত এ জীর্ণতা যুগে যুগে কিছু কিছু দিয়ে গেছে অখ্যাতের দান সাহিত্যের ভাষা-মহাদ্বীপে প্রাণহীন প্রবালের মতো।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) বাণী-বিনিময় মা , যদি তুই আকাশ হতিস ,            আমি চাঁপার গাছ , তোর সাথে মোর বিনি - কথায়           হত কথার নাচ । তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে           কেবল থেকে থেকে কত রকম নাচন দিয়ে           আমায় যেত ডেকে । মা ব'লে তার সাড়া দেব           কথা কোথায় পাই , পাতায় পাতায় সাড়া আমার           নেচে উঠত তাই । তোর আলো মোর শিশির - ফোঁটায়           আমার কানে কানে টলমলিয়ে কী বলত যে           ঝলমলানির গানে । আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম           আমার যত কুঁড়ি , কথা কইতে গিয়ে তারা           নাচন দিত জুড়ি । উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর           কোথায় থেকে এসে আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে           কোথায় যেত ভেসে । সেই হত তোর বাদল - বেলার           রূপকথাটির মতো ; রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায়           পেরিয়ে রাজ্য কত ; সেই আমারে বলে যেত           কোথায় আলেখ - লতা , সাগরপারের দৈত্যপুরের           রাজকন্যার কথা ; দেখতে পেতেম দুয়োরানীর            চক্ষু ভর - ভর , শিউরে উঠে পাতা আমার           কাঁপত থরোথরো । হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার           হাওয়ার পাছে পাছে নামত আমার পাতায় পাতায়           টাপুর - টুপুর নাচে ; সেই হত তোর কাঁদন - সুরে           রামায়ণের পড়া , সেই হত তোর গুনগুনিয়ে           শ্রাবণ - দিনের ছড়া । মা , তুই হতিস নীলবরনী ,            আমি সবুজ কাঁচা ; তোর হত , মা , আলোর হাসি ,           আমার পাতার নাচা । তোর হত , মা , উপর থেকে           নয়ন মেলে চাওয়া , আমার হত আঁকুবাঁকু           হাত তুলে গান গাওয়া । তোর হত , মা চিরকালের           তারার মণিমালা , আমার হত দিনে দিনে           ফুল - ফোটাবার পালা । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) বাণীর মুরতি গড়ি বাণীর মুরতি গড়ি একমনে নির্জন প্রাঙ্গণে পিণ্ড পিণ্ড মাটি তার যায় ছড়াছড়ি, অসমাপ্ত মূক শূন্যে চেয়ে থাকে নিরুৎসুক। গর্বিত মূর্তির পদানত মাথা করে থাকে নিচু, কেন আছে উত্তর না দিতে পারে কিছু বহুগুণে শোচনীয় হায় তার চেয়ে এক কালে যাহা রূপ পেয়ে কালে কালে অর্থহীনতায় ক্রমশ মিলায়। নিমন্ত্রণ ছিল কোথা শুধাইলে তারে উত্তর কিছু না দিতে পারে—কোন্‌ স্বপ্ন বাঁধিবারে বহিয়া ধূলির ঋণ দেখা দিল মানবের দ্বারে। বিস্মৃত স্বর্গের কোন্‌ উর্বশীর ছবি ধরণীর চিত্তপটে বাঁধিতে চাহিয়াছিল কবি, তোমারে বাহনরূপে ডেকেছিল, চিত্রশালে যত্নে রেখেছিল, কখন সে অন্যমনে গেছে ভুলি আদিম আত্মীয় তব ধূলি, অসীম বৈরাগ্যে তার দিক্‌বিহীন পথে তুলি নিল বাণীহীন রথে। এই ভালো, বিশ্বব্যাপী ধূসর সম্মানে আজ পঙ্গু আবর্জনা নিয়ত গঞ্জনাকালের চরণক্ষেপে পদে পদে বাধা দিতে জানে, পদাঘাতে পদাঘাতে জীর্ণ অপমানে শান্তি পায় শেষে আবার ধূলিতে যবে মেশে।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) বাণীহারা ওগো মোর নাহি যে বাণী আকাশে হৃদয় শুধু বিছাতে জানি। আমি অমাবিভাবরী আলোকহারা মেলিয়া তারা চাহি নিঃশেষ পথপানে নিষ্ফল আশা নিয়ে প্রাণে। বহুদূরে বাজে তব বাঁশি, সকরুণ সুর আসে ভাসি বিহ্বল বায়ে নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে। তোমারি সুরের প্রতিধ্বনি দিই যে ফিরায়ে- সে কি তব স্বপ্নের তীরে ভাঁটার স্রোতের মতো লাগে ধীরে, অতি ধীরে থীরে। বাতাবির চারা একদিন শান্ত হলে আষাঢ়ের ধারা বাতাবির চারা আসন্ন-বর্ষণ কোন্‌ শ্রাবণ প্রভাতে রোপন করিলে নিজহাতে আমার বাগানে। বহুকাল গেল চলি; প্রখর পৌষের অবসানে কুহেলি ঘুচাল যবে কৌতূহলী ভোরের আলোকে, সহসা পড়িল চোখ,-- হেরিনু শিশিরে ভেজা সেই গাছে কচিপাতা ধরিয়াছে, যেন কী আগ্রহে কথা কহে, যে-কথা আপনি শুনে পুলকেতে দুলে; যেমন একদা কবে তমসার কূলে সহসা বাল্মীকি মুনি আপনার কণ্ঠ হতে আপন প্রথম ছন্দ শুনি' আনন্দ সঘন গভীর বিস্ময়ে নিমগন। কোথায় আছ না-জানি এ সকালে কী নিষ্ঠুর অন্তরালে, -- সেথা হতে কোনো সম্ভাষণ পরশে না এ প্রান্তের নিভৃত আসন। হেনকালে অকস্মাৎ নিঃশব্দের অবহেলা হতে প্রকাশিল অরুণ আলোতে এ কয়টি কিশলয়। এরা যেন সেই কথা কয় বলিতে পারিতে যাহা তবু না বলিয়া চলে গেছে প্রিয়া। সেদিন বসন্ত ছিল দূরে আকাশ জাগেনি সুরে, অচেনার যবনিকা কেঁপেছিল ক্ষণে ক্ষণে তখনো যায়নি সরে দুরন্ত দক্ষিণ সমীরণে। প্রকাশের উচ্ছৃঙ্খল অবকাশ না ঘটিতে পরিচয় না রটিতে, ঘণ্টা গেল বেজে অব্যক্তের অনালোকে সায়াহ্নে গিয়েছ সভা ত্যেজে। বাতাস শুধায়, "বলে তো, কমল, বাতাস শুধায়, "বলে তো, কমল, তব রহস্য কী যে।" কমল কহিল, "আমার মাঝারে অামি রহস্য নিজে।"   (স্ফুলিঙ্গ) বাতাসে তাহার প্রথম পাপড়ি বাতাসে তাহার প্রথম পাপড়ি খসায়ে ফেলিল যেই, অমনি জানিয়ো, শাখায় গোলাপ থেকেও আর সে নেই।   (স্ফুলিঙ্গ) বাতাসে নিবিলে দীপ বাতাসে নিবিলে দীপ দেখা যায় তারা, আঁধারেও পাই তবে পথের কিনারা। সুখ-অবসানে আসে সম্ভোগের সীমা, দুঃখ তবে এনে দেয় শান্তির মহিমা।   (স্ফুলিঙ্গ) বাদরবরখন নীরদগরজন বাদরবরখন নীরদগরজন       বিজুলী চমকন ঘোর , উপেখই কৈছে আও তু কুঞ্জে       নিতি নিতি , মাধব মোর । ঘন ঘন চপলা চমকয় যব পহু ,       বজরপাত যব হোয় , তুঁহুক বাত তব সমরয়ি প্রিয়তম ,       ডর অতি লাগত মোয় । অঙ্গবসন তব ভীঁখত মাধব ,       ঘন ঘন বরখত মেহ — ক্ষুদ্র বালি হম , হমকো লাগয়       কাহ উপেখবি দেহ ? বইস বইস পহু , কুসুমশয়ন'পর       পদযুগ দেহ পসারি — সিক্ত চরণ তব মোছব যতনে —       কুন্তলভার উঘারি । শ্রান্ত অঙ্গ তব হে ব্রজসুন্দর ,       রাখ বক্ষ -' পর মোর , তনু তব ঘেরব পুলকিত পরশে       বাহুমৃণালক ডোর । ভানু কহে বৃকভানুনন্দিনী ,       প্রেমসিন্ধু মম কালা , তোঁহার লাগয় , প্রেমক লাগয়       সব কছু সহবে জ্বালা । বাদশার মুখখানা গুরুতর গম্ভীর বাদশার মুখখানা গুরুতর গম্ভীর, মহিষীর হাসি নাহি ঘুচে; কহিলা বাদশা-বীর,– “যতগুলো দম্ভীর দম্ভ মুছিব চেঁচে-পুঁছে।’উঁচু মাথা হল হেঁট, খালি হল ভরা পেট, শপাশপ্‌ পিঠে পড়ে বেত। কভু ফাঁসি কভু জেল, কভু শূল কভু শেল, কভু ক্রোক দেয় ভরা খেত।মহিষী বলেন তবে,– “দম্ভ যদি না র’বে কী দেখে হাসিব তবে, প্রভু।’ বাদশা শুনিয়া কহে,– “কিছুই যদি না রহে হসনীয় আমি র’ব তবু।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বাদশাহের হুকুম বাদশাহের হুকুম,-- সৈন্যদল নিয়ে এল আফ্রাসায়েব খাঁ, মুজফ্‌ফর খাঁ, মহম্মদ আমিন খাঁ, সঙ্গে এল রাজা গোপাল সিং ভদৌরিয়া, উদইৎ সিং বুন্দেলা। গুরুদাসপুর ঘেরাই করল মোগল সেনা। শিখদল আছে কেল্লার মধ্যে, বন্দা সিং তাদের সর্দার। ভিতরে আসে না রসদ, বাইরে যাবার পথ সব বন্ধ। থেকে থেকে কামানের গোলা পড়ছে প্রাকার ডিঙিয়ে-- চারদিকের দিক্‌সীমা পর্যন্ত রাত্রির আকাশ মশালের আলোয় রক্তবর্ণ। ভাণ্ডারে না রইল গম, না রইল যব, না রইল জোয়ারি;-- জ্বালানি কাঠ গেছে ফুরিয়ে। কাঁচা মাংস খায় ওরা অসহ্য ক্ষুধায়, কেউ বা খায় নিজের জঙ্ঘা থেকে মাংস কেটে। গাছের ছাল, গাছের ডাল গুঁড়ো ক'রে তাই দিয়ে বানায় রুটি। নরক-যন্ত্রণায় কাটল আট মাস, মোগলের হাতে পড়ল গুরদাসপুর গড়। মৃত্যুর আসর রক্তে হল আকণ্ঠ পঙ্কিল, বন্দীরা চীৎকার করে "ওয়াহি গুরু, ওয়াহি গুরু," আর শিখের মাথা স্খলিত হয়ে পড়ে দিনের পর দিন। নেহাল সিং বালক; স্বচ্ছ তরুণ সৌম্যমুখে অন্তরের দীপ্তি পড়েছে ফুটে। চোখে যেন স্তব্ধ আছে সকালবেলার তীর্থযাত্রীর গান। সুকুমার উজ্জ্বল দেহ, দেবশিল্পী কুঁদে বের করেছে বিদ্যুতের বাটালি দিয়ে। বয়স তার আঠারো কি উনিশ হবে, শালগাছের চারা, উঠেছে ঋজু হয়ে, তবু এখনো হেলতে পারে দক্ষিণের হাওয়ায়। প্রাণের অজস্রতা দেহে মনে রয়েছে কানায় কানায় ভরা। বেঁধে আনলে তাকে। সভার সমস্ত চোখ ওর মুখে তাকাল বিস্ময়ে করুণায়। ক্ষণেকের জন্যে ঘাতকের খড়্‌গ যেন চায় বিমুখ হতে এমন সময় রাজধানী থেকে এল দূত, হাতে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁয়ের স্বাক্ষর-করা মুক্তিপত্র। যখন খুলে দিলে তার হাতের বন্ধন, বালক শুধাল, আমার প্রতি কেন এই বিচার? শুনল, বিধবা মা জানিয়েছে শিখধর্ম নয় তার ছেলের, বলেছে, শিখেরা তাকে জোর করে রেখেছিল বন্দী ক'রে। ক্ষোভে লজ্জায় রক্তবর্ণ হল বালকের মুখ। বলে উঠল, "চাইনে প্রাণ মিথ্যার কৃপায়, সত্যে আমার শেষ মুক্তি, আমি শিখ।" বার বার সখি বারণ করনু বার বার, সখি, বারণ করনু       ন যাও মথুরাধাম বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি        করত হমারই শ্যাম। ধিক্ তুঁহু দাম্ভিক, ধিক্ রসনা ধিক্,       লইলি কাহারই নাম। বোল ত সজনি, মথুরা‐অধিপতি        সো কি হমারই শ্যাম। ধনকো শ্যাম সো, মথুরাপুরকো,        রাজ্যমানকো হোয়। নহ পীরিতিকো, ব্রজকামিনীকো,        নিচয় কহনু ময় তোয়। যব তুঁহু ঠারবি সো নব নরপতি        জনি রে করে অবমান— ছিন্নকুসুমসম ঝরব ধরা‐’পর,        পলকে খোয়ব প্রাণ। বিসরল বিসরল সো সব বিসরল        বৃন্দাবনসুখসঙ্গ— নব নগরে, সখি, নবীন নাগর—        উপজল নব নব রঙ্গ। ভানু কহত, অয়ি বিরহকাতরা,        মনমে বাঁধহ থেহ— মুগুধা বালা, বুঝই বুঝলি না        হমার শ্যামক লেহ॥ বারেক ভালোবেসে যে জন মজে বারেক ভালোবেসে যে জন মজে দেবতাসম সেই ধন্য, দ্বিতীয়বার পুন প্রেমে যে পড়ে মূর্খের অগ্রগণ্য। আমিও সে দলের মূর্খরাজ দুবার প্রেমপাশে পড়ি; তপন শশী তারা হাসিয়া মরে, আমিও হাসি– আর মরি।Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) বালক বয়স তখন ছিল কাঁচা; হালকা দেহখানা ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা। উড়ত পাশের ছাদের থেকে পায়রাগুলোর ঝাঁক, বারান্দাটার রেলিং-'পরে ডাকত এসে কাক। ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ওপার থেকে, তপসিমাছের ঝুড়ি নিত গামছা দিয়ে ঢেকে। বেহালাটা হেলিয়ে কাঁধে ছাদের 'পরে দাদা, সন্ধ্যাতারার সুরে যেন সুর হত তাঁর সাধা। জুটেছি বৌদিদির কাছে ইংরেজি পাঠ ছেড়ে, মুখখানিতে-ঘের-দেওয়া তাঁর শাড়িটি লালপেড়ে। চুরি ক'রে চাবির গোছা লুকিয়ে ফুলের টবে স্নেহের রাগে রাগিয়ে দিতেম নানান উপদ্রবে। কঙ্কালী চাটুজ্জে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে; বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে। দ্রুত লয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া; থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া-- মনে মনে ইচ্ছে হত, যদিই কোনো ছলে ভর্তি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে ভাব্‌না মাথায় চাপত নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে, গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে। স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ির কাছে এসে হঠাৎ দেখি, মেঘ নেমেছে ছাদের কাছে ঘেঁষে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, রাস্তা ভাসে জলে, ঐরাবতের শুঁড় দেখা দেয় জল-ঢালা সব নলে। অন্ধকারে শোনা যেত রিম্‌ঝিমিনি ধারা, রাজপুত্র তেপান্তরে কোথা সে পথহারা। ম্যাপে যে-সব পাহাড় জানি, জানি যে-সব গাঙ কুয়েন্‌লুন আর মিসিসিপি ইয়াংসিকিয়াং, জানার সঙ্গে আধেক-জানা, দূরের থেকে শোনা, নানা রঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল-বোনা, নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা, ভাব্‌নাগুলো তারই মধ্যে ফিরত থাকি থাকি, বানের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি। বালিশ নেই, সে ঘুমোতে যায় মাথার নিচে ইঁট দিয়ে বালিশ নেই, সে ঘুমোতে যায় মাথার নিচে ইঁট দিয়ে। কাঁথা নেই; সে প’ড়ে থাকে রোদের দিকে পিঠ দিয়ে। শ্বশুর বাড়ি নেমন্তন্ন, তাড়াতাড়ি তারই জন্য ছেঁড়া গামছা পরেছে সে তিনটে-চারটে গিঁঠ দিয়ে। ভাঙা ছাতার বাঁটখানাতে ছড়ি ক’রে চায় বানাতে, রোদে মাথা সুস্থ করে ঠাণ্ডা জলের ছিট দিয়ে। হাসির কথা নয় এ মোটে, খেঁকশেয়ালিই হেসে ওঠে যখন রাতে পথ করে সে হতভাগার ভিট দিয়ে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বাসনার ফাঁদ যারে চাই তার কাছে আমি দিই ধরা , সে আমার না হইতে আমি হই তার । পেয়েছি বলিয়ে মিছে অভিমান করা , অন্যেরে বাঁধিতে গিয়ে বন্ধন আমার । নিরখিয়া দ্বারমুক্ত সাধের ভাণ্ডার দুই হাতে লুটে নিই রত্ন ভূরি ভূরি — নিয়ে যাব মনে করি , ভারে চলা ভার , চোরা দ্রব্য বোঝা হয়ে চোরে করে চুরি । চিরদিন ধরণীর কাছে ঋণ চাই , পথের সম্বল ব ‘ লে জমাইয়া রাখি , আপনারে বাঁধা রাখি সেটা ভুলে যাই — পাথেয় লইয়া শেষে কারাগারে থাকি । বাসনার বোঝা নিয়ে ডোবে – ডোবে তরী — ফেলিতে সরে না মন , উপায় কী করি!  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বাসাবাড়ি এই শহরে এই তো প্রথম আসা। আড়াইটা রাত, খুঁজে বেড়াই কোন্‌ ঠিকানায় বাসা। লণ্ঠনটা ঝুলিয়ে হাতে আন্দাজে যাই চলি, অজগরের ভূতের মতন গলির পরে গলি। ধাঁধাঁ ক্রমেই বেড়ে ওঠে, এক জায়গায় থেমে দেখি পথে বাঁদিক থেকে ঘাট গিয়েছে নেমে। আঁধার মুখোষ-পরা বাড়ি সামনে আছে খাড়া; হাঁ-করা-মুখ দুয়ারগুলো, নাইকো শব্দসাড়া। চৌতলাতে একটা ধারে জানলাখানার ফাঁকে প্রদীপশিখা ছুঁচের মতো বিঁধছে আঁধারটাকে।             বাকি মহল যত কালো মোটা ঘোমটা-দেওয়া দৈত্যনারীর মতো। বিদেশীর এই বাসাবাড়ি কেউবা কয়েক মাস এইখানে সংসার পেতেছে, করছে বসবাস; কাজকর্ম সাঙ্গ করি কেউবা কয়েকদিনে চুকিয়ে ভাড়া কোন্‌খানে যায়, কেই বা তাদের চিনে। শুধাই আমি, "আছ কি কেউ, জায়গা কোথায় পাই।" মনে হল জবাব এল, "আমরা নাই নাই।" সকল দুয়োর জানলা হতে, যেন আকাশ জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রাতের পাখি শূন্যে চলল উড়ে। একসঙ্গে চলার বেগে হাজার পাখা তাই অন্ধকারে জাগায় ধ্বনি, "আমরা নাই নাই।" আমি সুধাই, "কিসের কাজে এসেছ এইখানে।" জবাব এল, "সেই কথাটা কেহই নাহি জানে। যুগে যুগে বাড়িয়ে চলি নেই-হওয়াদের দল, বিপুল হয়ে ওঠে যখন দিনের কোলাহল সকল কথার উপরেতে চাপা দিয়ে যাই--               নাই, নাই, নাই।" পরের দিনে সেই বাড়িতে গেলাম সকালবেলা-- ছেলেরা সব পথে করছে লড়াই-লড়াই খেলা, কাঠি হাতে দুই পক্ষের চলছে ঠকাঠকি। কোণের ঘরে দুই বুড়োতে বিষম বকাবকি-- বাজিখেলায় দিনে দিনে কেবল জেতা হারা, দেনা-পাওনা জমতে থাকে, হিসাব হয় না সারা। গন্ধ আসছে রান্নাঘরের, শব্দ বাসন-মাজার; শূন্য ঝুড়ি দুলিয়ে হাতে ঝি চলেছে বাজার। একে একে এদের সবার মুখের দিকে চাই, কানে আসে রাত্রিবেলার "আমরা নাই নাই"। বাহির হইতে দেখো না এমন করে বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখো না বাহিরে। আমায় পাবে না আমার দুখে ও সুখে, আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে, আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহি রে।সাগরে সাগরে কলরবে যাহা বাজে, মেঘগর্জনে ছুটে ঝঞ্ঝার মাঝে, নীরব মন্দ্রে নিশীথ-আকাশে রাজে আঁধার হইতে আঁধারে আসন পাতিয়া– আমি সেই এই মানবের লোকালয়ে বাজিয়া উঠেছি সুখে দুখে লাজে ভয়ে, গরজি ছুটিয়া ধাই জয়ে পরাজয়ে বিপুল ছন্দে উদার মন্দ্রে মাতিয়া।যে গন্ধ কাঁপে ফুলের বুকের কাছে, ভোরের আলোকে যে গান ঘুমায়ে আছে, শারদ-ধান্যে যে আভা আভাসে নাচে কিরণে কিরণে হসিত হিরণে হরিতে, সেই গন্ধই গড়েছে আমার কায়া, সে গান আমাতে রচিছে নূতন মায়া, সে আভা আমার নয়নে ফেলেছে ছায়া– আমার মাঝারে আমারে কে পারে ধরিতে।নর-অরণ্যে মর্মতান তুলি, যৌবনবনে উড়াই কুসুমধূলি, চিত্তগুহায় সুপ্ত রাগিণীগুলি, শিহরিয়া উঠে আমার পরশে জাগিয়া। নবীন উষার তরুণ অরুণে থাকি গগনের কোণে মেলি পুলকিত আঁখি, নীরব প্রদোষে করুণ কিরণে ঢাকি থাকি মানবের হৃদয়চূড়ায় লাগিয়া।তোমাদের চোখে অঁখিজল ঝরে যবে আমি তাহাদের গেঁথে দিই গীতরবে, লাজুক হৃদয় যে কথাটি নাহি কবে সুরের ভিতরে লুকাইয়া কহি তাহারে। নাহি জানি আমি কী পাখা লইয়া উড়ি, খেলাই ভুলাই দুলাই ফুটাই কুঁড়ি, কোথা হতে কোন্‌ গন্ধ যে করি চুরি সন্ধান তার বলিতে পারি না কাহারে।যে আমি স্বপন-মুরতি গোপনচারী, যে আমি আমারে বুঝিতে বুঝাতে নারি, আপন গানের কাছেতে আপনি হারি, সেই আমি কবি। কে পারে আমারে ধরিতে। মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে, ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে, যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে, কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) বাহির হতে বহিয়া আনি বাহির হতে বহিয়া আনি সুখের উপাদান। আপনা-মাঝে আনন্দের আপনি সমাধান।    (স্ফুলিঙ্গ) বাহিরে বস্তুর বোঝা বাহিরে বস্তুর বোঝা, ধন বলে তায়। কল্যাণ সে অন্তরের পরিপূর্ণতায়।    (স্ফুলিঙ্গ) বাহিরে যাহারে খুঁজেছিনু দ্বারে দ্বারে বাহিরে যাহারে খুঁজেছিনু দ্বারে দ্বারে পেয়েছি ভাবিয়া হারায়েছি বারে বারে— কত রূপে রূপে কত-না অলংকারে অন্তরে তারে জীবনে লইব মিলায়ে, বাহিরে তখন দিব তার সুধা বিলায়ে।   (স্ফুলিঙ্গ) বাহু কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা-- কাহারে কাঁদিয়া বলে, 'যেয়ো না, যেয়ো না!' কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা, কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা! কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা, গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক-অক্ষরে । পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা, মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে । কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে । দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডালা, রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে । লতায়ে থাকুক বুকে চির-আলিঙ্গন, ছিঁড়ো না, ছিঁড় না দুটি বাহুর বন্ধন ।। বিকেলবেলার দিনান্তে মোর বিকেলবেলার দিনান্তে মোর পড়ন্ত এই রোদ পুবগগনের দিগন্তে কি জাগায় কোনো বোধ। লক্ষকোটি আলোবছর-পারে সৃষ্টি করার যে বেদনা মাতায় বিধাতারে হয়তো তারি কেন্দ্র-মাঝে যাত্রা অামার হবে— অস্তবেলার আলোতে কি আভাস কিছু রবে।   (স্ফুলিঙ্গ) বিচলিত কেন মাধবীশাখা বিচলিত কেন মাধবীশাখা, মঞ্জরী কাঁপে থরথর। কোন্‌ কথা তার পাতায় ঢাকা চুপিচুপি করে মরমর।   (স্ফুলিঙ্গ) বিচার আমার খোকার কত যে দোষ      সে-সব আমি জানি, লোকের কাছে মানি বা নাই মানি।      দুষ্টামি তার পারি কিম্বা             নারি থামাতে,      ভালোমন্দ বোঝাপড়া             তাতে আমাতে।      বাহির হতে তুমি তারে             যেমনি কর দুষী                 যত তোমার খুশি,      সে বিচারে আমার কী বা হয়।             খোকা বলেই ভালোবাসি,               ভালো বলেই নয়।    খোকা আমার কতখানি      সে কি তোমরা বোঝ। তোমরা শুধু দোষ গুণ তার খোঁজ।      আমি তারে শাসন করি           বুকেতে বেঁধে ,      আমি তারে কাঁদাই যে গো           আপনি কেঁদে।      বিচার করি, শাসন করি,           করি তারে দুষী             আমার যাহা খুশি।      তোমার শাসন আমরা মানি নে গো।           শাসন করা তারেই সাজে             সোহাগ করে যে গো। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বিচিত্র সাধ আমি যখন পাঠশালাতে যাই      আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে, দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই      ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে। ‘চুড়ি চা— ই, চুড়ি চাই' সে হাঁকে, চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে, যায় সে চলে যে পথে তার খুশি,      যখন খুশি খায় সে বাড়ি গিয়ে। দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে,       নাইকো তাড়া হয় বা পাছে দেরি। ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে       অম্‌নি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি।    আমি যখন হাতে মেখে কালি       ঘরে ফিরি, সাড়ে চারটে বাজে, কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালী       বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মাঝে। কেউ তো তারে মানা নাহি করে কোদাল পাছে পড়ে পায়ের ‘পরে। গায়ে মাথায় লাগছে কত ধুলো,       কেউ তো এসে বকে না তার কাজে। মা তারে তো পরায় না সাফ জামা,       ধুয়ে দিতে চায় না ধুলোবালি। ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি       বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী।    একটু বেশি রাত না হতে হতে        মা আমারে ঘুম পাড়াতে চায়। জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে পথে        পাগড়ি পরে পাহারওলা যায়। আঁধার গলি, লোক বেশি না চলে, গ্যাসের আলো মিট্‌মিটিয়ে জ্বলে, লণ্ঠনটি ঝুলিয়ে নিয়ে হাতে        দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির দরজায়। রাত হয়ে যায় দশটা এগারোটা        কেউ তো কিছু বলে না তার লাগি। ইচ্ছে করে পাহারওলা হয়ে        গলির ধারে আপন মনে জাগি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বিচ্ছেদ বাগানে ওই দুটো গাছে           ফুল ফুটেছে কত যে, ফুলের গন্ধে মনে পড়ে           ছিল ফুলের মতো যে। ফুল যে দিত ফুলের সঙ্গে           আপন সুধা মাখায়ে, সকাল হত সকাল বেলায়           যাহার পানে তাকায়ে, সেই আমাদের ঘরের মেয়ে           সে গেছে আজ প্রবাসে, নিয়ে গেছে এখান থেকে          সকাল বেলার শোভা সে। একটুখানি মেয়ে আমার            কত যুগের পুণ্য যে, একটুখানি সরে গেছে           কতখানিই শূন্য যে।    বিষ্টি পড়ে টুপুর টুপুর,          মেঘ করেছে আকাশে, উষার রাঙা মুখখানি আজ          কেমন যেন ফ্যাকাশে। বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই,          দুয়োরগুলো ভেজানো, ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই          ঘরে আছে কে যেন। ময়নাটি ওই চুপটি করে          ঝিমোচ্ছে সেই খাঁচাতে, ভুলে গেছে নেচে নেচে           পুচ্ছটি তার নাচাতে। ঘরের-কোণে আপন-মনে           শূন্য প'ড়ে বিছানা, কার তরে সে কেঁদে মরে—              সে কল্পনা মিছা না। বইগুলো সব ছড়িয়ে আছে,           নাম লেখা তায় কার গো। এম্‌নি তারা রবে কি হায়,           খুলবে না কেউ আর গো। এটা আছে সেটা আছে           অভাব কিছু নেই তো— স্মরণ করে দেয় রে যারে           থাকে নাকো সেই তো। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বিচ্ছেদ (অনুবাদ কবিতা) প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে তরীখানি যেতেছিল ধীরি, কম্পমান কেতু তার, চেয়েছিল কতবার সে দ্বীপের পানে ফিরি ফিরি। যারে আহা ভালোবাসি, তারে যবে ছেড়ে আসি যত যাই দূর দেশে চলি, সেইদিক পানে হায়, হৃদয় ফিরিয়া চায় যেখানে এসেছি তারে ফেলি। বিদেশেতে দেখি যদি, উপত্যকা, দ্বীপ, নদী, অতিশয় মনোহর ঠাঁই, সুরভি কুসুমে যার, শোভিত সকল ধার শুধু হৃদয়ের ধন নাই, বড়ো সাধ হয় প্রাণে, থাকিতাম এইখানে, হেথা যদি কাটিত জীবন, রয়েছে যে দূরবাসে, সে যদি থাকিত পাশে কী যে সুখ হইত তখন। পূর্বদিক সন্ধ্যাকালে, গ্রাসে অন্ধকার জালে ভীত পান্থ চায় ফিরে ফিরে, দেখিতে সে শেষজ্যোতি, সুষ্ঠুতর হয়ে অতি এখনো যা জ্বলিতেছে ধীরে, তেমনি সুখের কাল, গ্রাসে গো আঁধার-জাল অদৃষ্টের সায়াহ্নে যখন, ফিরে চাই বারে বারে, শেষবার দেখিবারে সুখের সে মুমূর্ষু কিরণ।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা) বিজনে আমারে ডেকো না আজি , এ নহে সময় — একাকী রয়েছি হেথা গভীর বিজন , রুধিয়া রেখেছি আমি অশান্ত হৃদয় , দুরন্ত হৃদয় মোর করিব শাসন । মানবের মাঝে গেলে এ যে ছাড়া পায় , সহস্রের কোলাহলে হয় পথহারা , লুব্ধ মুষ্টি যাহা পায় আঁকড়িতে চায় , চিরদিন চিররাত্রি কেঁদে কেঁদে সারা । ভর্ৎসনা করিব তারে বিজনে বিরলে , একটুকু ঘুমাক সে কাঁদিয়া কাঁদিয়া , শ্যামল বিপুল কোলে আকাশ – অঞ্চলে প্রকৃতি জননী তারে রাখুন বাঁধিয়া । শান্ত স্নেহকোলে বসে শিখুক সে স্নেহ , আমারে আজিকে তোরা ডাকিস নে কেহ ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বিজ্ঞ খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা,             খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ। ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি             আমরা যখন উড়েয়েছিলেম ফানুস। আমি যখন খাওয়া - খাওয়া খেলি             খেলার থালে সাজিয়ে নিয়ে নুড়ি, ও ভাবে বা সত্যি খেতে হবে             মুঠো করে মুখে দেয় মা, পুরি। সামনেতে ওর শিশুশিক্ষা খুলে             যদি বলি, ‘খুকি, পড়া করো' দু হাত দিয়ে পাতা ছিঁড়তে বসে—             তোমার খুকির পড়া কেমনতরো। আমি যদি মুখে কাপড় দিয়ে             আস্তে আস্তে আসি গুড়িগুড়ি তোমার খুকি অম্‌নি কেঁদে ওঠে,              ও ভাবে বা এল জুজুবুড়ি। আমি যদি রাগ করে কখনো             মাথা নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বকি— তোমার খুকি খিল্‌খিলিয়ে হাসে।             খেলা করছি মনে করে ও কি। সবাই জানে বাবা বিদেশ গেছে             তবু যদি বলি ‘আসছে বাবা' তাড়াতাড়ি চার দিকেতে চায়—             তোমার খুকি এম্‌নি বোকা হাবা। ধোবা এলে পড়াই যখন আমি             টেনে নিয়ে তাদের বাচ্ছা গাধা, আমি বলি ‘আমি গুরুমশাই',             ও আমাকে চেঁচিয়ে ডাকে ‘দাদা'। তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়,             গণেশকে ও বলে যে মা গানুশ। তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা,            তোমার খুকি ভারি ছেলেমানুষ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বিড়ালে মাছেতে হল সখ্য বিড়ালে মাছেতে হল সখ্য। বিড়াল কহিল, “ভাই ভক্ষ্য, বিধাতা স্বয়ং জেনো সর্বদা কন তোরে– ঢোকো গিয়ে বন্ধুর রসময় অন্তরে, সেখানে নিজেরে তুমি সযতনে রক্ষ। ঐ দেখো পুকুরের ধারে আছে ঢালু ডাঙা, ঐখানে সয়তান বসে থাকে মাছরাঙা, কেন মিছে হবে ওর চঞ্চুর লক্ষ্য!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বিদায় বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে শেস কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে। তেমনি তুমি যাবে জানি, ঝলক দেবে হাসিখানি, অলক হতে কসবে অশোক নাচের তালে। ভাসান-খেলার তরীখানি চলবে বেয়ে, একলা ঘাটে রইব চেয়ে। অস্তরবি তোমার পালে রঙিন রশ্মি যখন ঢালে কালিমা রয় আমার রাতের অন্তরালে। বিদায়রথের ধ্বনি বিদায়রথের ধ্বনি দূর হতে ওই আসে কানে। ছিন্নবন্ধনের শুধু কোনো শব্দ নাই কোনোখানে।   (স্ফুলিঙ্গ) বিদায় তবে আমি যাই গো তবে যাই      ভোরের বেলা শূন্য কোলে      ডাকবি যখন খোকা বলে, বলব আমি, ‘নাই সে খোকা নাই। '           মা গো, যাই।         হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে      যাব মা, তোর বুকে বয়ে, ধরতে আমায় পারবি নে তো হাতে। জলের মধ্যে হব মা, ঢেউ, জানতে আমায় পারবে না কেউ— স্নানের বেলা খেলব তোমার সাথে।         বাদলা যখন পড়বে ঝরে      রাতে শুয়ে ভাববি মোরে, ঝর্‌ঝরানি গান গাব ওই বনে।      জানলা দিয়ে মেঘের থেকে      চমক মেরে যাব দেখে, অমার হাসি পড়বে কি তোর মনে।        খোকার লাগি তুমি মা গো,      অনেক রাতে যদি জাগ তারা হয়ে বলব তোমায়, ‘ঘুমো!'       তুই ঘুমিয়ে পড়লে পরে        জ্যোৎস্না হয়ে ঢুকব ঘরে, চোখে তোমার খেয়ে যাব চুমো।           স্বপন হয়ে আঁখির ফাঁকে       দেখতে আমি আসব মাকে, যাব তোমার ঘুমের মধ্যিখানে।       জেগে তুমি মিথ্যে আশে       হাত বুলিয়ে দেখবে পাশে— মিলিয়ে যাব কোথায় কে তা জানে।           পুজোর সময় যত ছেলে        আঙিনায় বেড়াবে খেলে, বলবে ‘খোকা নেই রে ঘরের মাঝে'।        আমি তখন বাঁশির সুরে        আকাশ বেয়ে ঘুরে ঘুরে তোমার সাথে ফিরব সকল কাজে।           পুজোর কাপড় হাতে করে        মাসি যদি শুধায় তোরে, ‘খোকা তোমার কোথায় গেল চলে। '        বলিস ‘খোকা সে কি হারায়,        আছে আমার চোখের তারায়, মিলিয়ে আছে আমার বুকে কোলে। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বিদায় (অনুবাদ কবিতা) যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে নব বন্ধু নব হর্ষ নব সুখ আশে। সুন্দরী রমণী কত, দেখিবে গো শত শত ফেলে গেলে যারে তারে পড়িবে কি মনে? তব প্রেম প্রিয়তম, অদৃষ্টে নাইকো মম সে-সব দুরাশা সখা করি না স্বপনে কাতর হৃদয় শুধু এই ভিক্ষা চায় ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়। স্মরিলে এ অভাগীর যাতনার কথা, যদিও হৃদয়ে লাগে তিলমাত্র ব্যথা, মরমের আশা এই, থাক্‌ রুদ্ধ মরমেই কাজ নাই দুখিনীরে মনে করে আর। কিন্তু দুঃখ যদি সখা, কখনো গো দেয় দেখা মরমে জনমে যদি যাতনার ভার, ও হৃদয় সান্ত্বনার বন্ধু যদি চায় ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।Mrs. Amelia Opie (অনুবাদ কবিতা) বিদায় (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) হে তটিনী, সে নগরে নাই কলস্বন তোমার কণ্ঠের মতো; উদার গগন, অলিখিত মহাশাস্ত্র, নীল পত্রগুলি দিক হতে দিগন্তরে নাহি রাখে খুলি; শান্ত স্নিগ্ধ বসুন্ধরা শ্যামল অঞ্জনে সত্যের স্বরূপখানি নির্মল নয়নে রাখে না নবীন করি— সেথায় কেবল একমাত্র আপনার অন্তর সম্বল অকূলের মাঝে। তাই ভীতশিশুপ্রায় হৃদয় চাহে না আজি লইতে বিদায় তোমা-সবাকার কাছে। তাই প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিতেছে আর্ত আলিঙ্গনে নির্জনলক্ষ্মীরে। শুভশান্তিপত্র তব অন্তরে বাঁধিয়া দাও, কণ্ঠে পরি লব।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বিদায় শেষের কবিতা থেকে কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও। তারি রথ নিত্যই উধাও জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।                  ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেরি তার জাল তুলে নিল দ্রুতরথে       দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে          তোমা হতে বহু দূরে। মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়-- রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়              আমার পুরানো নাম। ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি পারিবে না চিনিতে আমায়।                          হে বন্ধু, বিদায়।কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্তবাতাসে অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস, ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ, সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো--কিছু মোর পিছে রহিল সে তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতিপ্রদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি, হয়তো ধরিবে কভু নাম-হারা স্বপ্নের মুরতি। তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,                  সে আমার প্রেম।তারে আমি রাখিয়া এলেম অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে। পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে কালের যাত্রায়।  হে বন্ধু, বিদায়। তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি              হোক তব সন্ধ্যাবেলা,                  পূজার সে খেলা ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;              তৃষার্ত আবেগ-বেগে ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।              তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে       যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,              তার সাথে দিব না মিশায়ে যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।আজো তুমি নিজে হয়তো-বা করিবে রচন মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন। ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।                          হে বন্ধু, বিদায়। মোর লাগি করিয়ো না শোক, আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।              মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই-- শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই। উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে              সেই ধন্য করিবে আমাকে। শুক্লপক্ষ হতে আনি রজনীগন্ধার বৃন্তখানি    যে পারে সাজাতে অর্ঘ্যথালা  কৃষ্ণপক্ষ রাতে, যে আমারে দেখিবারে পায়                  অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি, এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।তোমারে যা দিয়েছিনু তার পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার। হেথা মোর তিলে তিলে দান, করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।                  ওগো তুমি নিরুপম,                        হে ঐশ্বর্যবান, তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান-- গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।                        হে বন্ধু, বিদায়। বিদায়-চুম্বন একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার জনমের মতো দেখা হবে না কো আর। মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার। সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার। কিন্তু মোর আশা নাই, যে দিকে ফিরিয়া চাই সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার! ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার? উপায় কী আছে বলো উপায় কী তার? দেখামাত্র সেই জনে, ভালোবাসা আসে মনে ভালো বাসিলেই ভুলা নাহি যায় আর! নাহি বাসিতাম যদি এত ভালো তারে অন্ধ হয়ে প্রেমে তার মজিতাম না রে যদি নাহি দেখিতাম, বিচ্ছেদ না জানিতাম তা হলে হৃদয় ভেঙে যেত না আমার! আমারে বিদায় দাও যাই গো সুন্দরী, যাই তবে হৃদয়ের প্রিয় অধীশ্বরী, থাকো তুমি থাকো সুখে, বিমল শান্তির বুকে সুখ, প্রেম, যশ, আশা থাকুক তোমার একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার।Robert Burns (অনুবাদ কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১ মধুর সূর্যের আলো , আকাশ বিমল , সঘনে উঠিছে নাচি তরঙ্গ উজ্জ্বল ।          মধ্যাহ্নের স্বচ্ছ করে          সাজিয়াছে থরে থরে ক্ষুদ্র নীল দ্বীপগুলি , শুভ্র শৈলশির ।          কাননে কুঁড়িরে ঘিরি          পড়িতেছে ধীরি ধীরি পৃথিবীর অতি মৃদু নিশ্বাসসমীর । একই আনন্দে যেন গায় শত প্রাণ — বাতাসের গান আর পাখিদের গান ।          সাগরের জলরব          পাখিদের কলরব এসেছে কোমল হয়ে স্তব্ধতার সংগীত-সমান ।কিন্তু নিরাশাও শান্ত হয়েছে এমন যেমন বাতাস এই , সলিল যেমন          মনে হয় মাথা থুয়ে          এইখানে থাকি শুয়ে অতিশয় শ্রান্তকায় শিশুটির মতো ।          কাঁদিয়া দুঃখের প্রাণ          করে দিই অবসান — যে দুঃখ বহিতে হবে , বহিয়াছি কত । আসিবে ঘুমের মতো মরণের কোল , ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসিবে কপোল ।          মুমূর্ষু শ্রবণতলে          মিশাইবে পলে পলে সাগরের অবিরাম একতান অন্তিম কল্লোল ।   Shelley   (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১০ কেমনে কী হল পারি নে বলিতে, এইটুকু শুধু জানি– নবীন কিরণে ভাসিছে সে দিন প্রভাতের তনুখানি। বসন্ত তখনো কিশোর কুমার, কুঁড়ি উঠে নাই ফুটি, শাখায় শাখায় বিহগ বিহগী বসে আছে দুটি দুটি। কী যে হয়ে গেল পারি নে বলিতে, এইটুকু শুধু জানি– বসন্তও গেল, তাও চলে গেল একটি না কয়ে বাণী। যা-কিছু মধুর সব ফুরাইল, সেও হল অবসান– আমারেই শুধু ফেলে রেখে গেল সুখহীন ম্রিয়মাণ।Christina Rossetti (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১১ রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে মনটি আমার আমি গোলাপে রাখিনু ঢেকে — সে বিছানা সুকোমল , বিমল নীহার চেয়ে , তারি মাঝে মনখানি রাখিলাম লুকাইয়ে । একটি ফুল না নড়ে , একটি পাতা না পড়ে — তবু কেন ঘুমায় না , চমকি চমকি চায় — ঘুম কেন পাখা নেড়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায় ? আর কিছু নয় , শুধু গোপনে একটি পাখি কোথা হতে মাঝে মাঝে উঠিতেছে ডাকি ডাকি । ঘুমা তুই , ওই দেখ বাতাস মুদেছে পাখা , রবির কিরণ হতে পাতায় আছিস ঢাকা — ঘুমা তুই , ওই দেখ তো চেয়ে দুরন্ত বায় ঘুমেতে সাগর- ' পরে ঢুলে পড়ে পায় পায় । দুখের কাঁটায় কি রে বিঁধিতেছে কলেবর ? বিষাদের বিষদাঁতে করিছে কি জরজর ? কেন তবে ঘুম তোর ছাড়িয়া গিয়াছে আঁখি ? কে জানে , গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি ।শ্যামল কানন এই মোহমন্ত্রজালে ঢাকা , অমৃতমধুর ফল ভরিয়ে রয়েছে শাখা , স্বপনের পাখিগুলি চঞ্চল ডানাটি তুলি উড়িয়া চলিয়া যায় আঁধার প্রান্তর- ' পরে — গাছের শিখর হতে ঘুমের সংগীত ঝরে । নিভৃত কানন- ' পর শুনি না ব্যাধের স্বর , তবে কেন এ হরিণী চমকায় থাকি থাকি । কে জানে , গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি ।Swinburne (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১২ দেখিনু যে এক আশার স্বপন শুধু তা স্বপন, স্বপনময়– স্বপন বই সে কিছুই নয়। অবশ হৃদয় অবসাদময় হারাইয়া সুখ শ্রান্ত অতিশয়– আজিকে উঠিনু জাগি কেবল একটি স্বপন লাগি! বীণাটি আমার নীরব হইয়া গেছে গীতগান ভুলি, ছিঁড়িয়া টুটিয়া ফেলেছি তাহার একে একে তারগুলি। নীরব হইয়া রয়েছে পড়িয়া সুদূর শ্মশান-‘পরে, কেবল একটি স্বপন-তরে! থাম্‌ থাম্‌ ওরে হৃদয় আমার, থাম্‌ থাম্‌ একেবারে, নিতান্তই যদি টুটিয়া পড়িবি একেবারে ভেঙে যা রে– এই তোর কাছে মাগি। আমার জগৎ, আমার হৃদয়– আগে যাহা ছিল এখন তা নয় কেবল একটি স্বপন লাগি।Christina Rossetti (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১৩ নহে নহে এ মনে মরণ। সহসা এ প্রাণপূর্ণ নিশ্বাসবাতাস নীরবে করে যে পলায়ন, আলোতে ফুটায় আলো এই আঁখিতারা নিবে যায় একদা নিশীথে, বহে না রুধিরনদী, সুকোমল তনু ধূলায় মিলায় ধরণীতে, ভাবনা মিলায় শূন্যে, মৃত্তিকার তলে রুদ্ধ হয় অময় হৃদয়– এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়। কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন পিরিতির স্মিরিতিমন্দিরে, উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে, মরণ-অতীত চির-নূতন পরান স্মরণে করে না বিচরণ– সেই বটে সেই তো মরণ!Hood (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ২ সারাদিন গিয়েছিনু বনে ফুলগুলি তুলেছি যতনে ।     প্রাতে মধুপানে রত     মুগ্ধ মধুপের মতো গান গাহিয়াছি আনমনে ।   এখন চাহিয়া দেখি , হায় , ফুলগুলি শুকায় শুকায় ।    যত চাপিলাম মুঠি    পাপড়িগুলি গেল টুটি — কান্না ওঠে , গান থেমে যায় ।   কী বলিছ সখা হে আমার — ফুল নিতে যাব কি আবার ।     থাক্‌ বঁধু , থাক্‌ থাক্‌ ,      আর কেহ যায় যাক , আমি তো যাব না কভু আর ।   শ্রান্ত এ হৃদয় অতি দীন , পরান হয়েছে বলহীন ।    ফুলগুলি মুঠা ভরি     মুঠায় রহিবে মরি , আমি না মরিব যত দিন ।Mrs. Browning (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৩ আমায় রেখো না ধরে আর, আর হেথা ফুল নাহি ফুটে। হেমন্তের পড়িছে নীহার, আমায় রেখো না ধরে আর। যাই হেথা হতে যাই উঠে, আমার স্বপন গেছে টুটে। কঠিন পাষাণপথে যেতে হবে কোনোমতে পা দিয়েছি যবে। একটি বসন্তরাতে ছিলে তুমি মোর সাথে– পোহালো তো, চলে যাও তবে।Ernest Myers (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৪ প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস একটি বিরল অশ্রুবারি ধীরে ওঠে, ধীরে ঝরে যায়, শুনিলে তোমার নাম আজ। কেবল একটুখানি লাজ– এই শুধু বাকি আছে হায়। আর সব পেয়েছে বিনাশ। এক কালে ছিল যে আমারি গেছে আজ করি পরিহাস।Aubre De Vere (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৫ ১ গোলাপ হাসিয়া বলে, “আগে বৃষ্টি যাক চলে, দিক দেখা তরুণ তপন– তখন ফুটাব এ যৌবন।’ গেল মেঘ, এল উষা, আকাশের আঁখি হতে মুছে দিল বৃষ্টিবারিকণা– সে তো রহিল না। কোকিল ভাবিছে মনে, “শীত যাবে কত ক্ষণে, গাছপালা ছাইবে মুকুলে– তখন গাহিব মন খুলে।’ কুয়াশা কাটিয়া যায়, বসন্ত হাসিয়া চায়, কানন কুসুমে ভরে গেল– সে যে মরে গেল!২ এত শীঘ্র ফুটিলি কেন রে! ফুটিলে পড়িতে হয় ঝরে– মুকুলের দিন আছে তবু, ফোটা ফুল ফোটে না তো আর। বড়ো শীঘ্র গেলি মধুমাস, দু দিনেই ফুরালো নিশ্বাস। বসন্ত আবার আসে বটে, গেল যে সে ফেরে না আবার।Augusta Webster (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৬ হাসির সময় বড়ো নেই, দু দণ্ডের তরে গান গাওয়া। নিমেষের মাঝে চুমো খেয়ে মুহূর্তে ফুরাবে চুমো খাওয়া। বেলা নাই শেষ করিবারে অসম্পূর্ণ প্রেমের মন্ত্রণা– সুখস্বপ্ন পলকে ফুরায়, তার পরে জাগ্রত যন্ত্রণা। কিছু ক্ষণ কথা কয়ে লও, তাড়াতাড়ি দেখে লও মুখ, দু দণ্ডের খোঁজ দেখাশুনা– ফুরাইবে খুঁজিবার সুখ। বেলা নাই কথা কহিবারে যে কথা কহিতে ফাটে প্রাণ। দেবতারে দুটো কথা ব’লে পূজার সময় অবসান। কাঁদিতে রয়েছে দীর্ঘ দিন– জীবন করিতে মরুময়, ভাবিতে রয়েছে চিরকাল– ঘুমাইতে অনন্ত সময়।P. B. Marston (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৭ বেঁচেছিল, হেসে হেসে খেলা করে বেড়াত সে– হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হল তোমার! শত রঙ-করা পাখি, তোর কাছে ছিল না কি– কত তারা, বন, সিন্ধু, আকাশ অপার! জননীর কোল হতে কেন তবে কেড়ে নিলি! লুকায়ে ধরার কোলে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলি! শত-তারা-পুষ্প-ময়ী মহতী প্রকৃতি অয়ি, নাহয় একটি শিশু নিলি চুরি ক’রে– অসীম ঐশ্বর্য তব তাহে কি বাড়িল নব? নূতন আনন্দকণা মিলিল কি ওরে? অথচ তোমারি মতো বিশাল মায়ের হিয়া সব শূন্য হয়ে গেল একটি সে শিশু গিয়া।Victor Hugo (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৮ নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম একা বন আলো করিয়া, রূপসী তাহার সহচরীগণ শুকায়ে পড়েছে ঝরিয়া। একাকিনী আহা, চারি দিকে তার কোনো ফুল নাহি বিকাশে, হাসিতে তাহার মিশাইতে হাসি নিশাস তাহার নিশাসে। বোঁটার উপরে শুকাইতে তোরে রাখিব না একা ফেলিয়া– সবাই ঘুমায়, তুইও ঘুমাগে তাহাদের সাথে মিলিয়া। ছড়ায়ে দিলাম দলগুলি তোর কুসুমসমাধিশয়নে যেথা তোর বনসখীরা সবাই ঘুমায় মুদিত নয়নে। তেমনি আমার সখারা যখন যেতেছেন মোরে ফেলিয়া প্রেমহার হতে একটি একটি রতন পড়িছে খুলিয়া, প্রণয়ীহৃদয় গেল গো শুকায়ে প্রিয়জন গেল চলিয়া– তবে এ আঁধার আঁধার জগতে রহিব বলো কী বলিয়া।Moore (অনূদিত কবিতা) বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৯ ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে! ছেলেবেলা ওই নামে আমায় ডাকিত– তাড়াতাড়ি খেলাধুলা সব ত্যাগ করে অমনি যেতেম ছুটে, কোলে পড়িতাম লুটে। রাশি-করা ফুলগুলি পড়িয়া থাকিত। নীরব হইয়া গেছে যে স্নেহের স্বর– কেবল স্তব্ধতা বাজে আজি এ শ্মশান-মাঝে কেবল ডাকি গো আমি “ঈশ্বর ঈশ্বর’! মৃত কণ্ঠে আর যাহা শুনিতে না পাই সে নাম তোমারি মুখে শুনিবারে চাই। হাঁ সখা, ডাকিয়ো তুমি সেই নাম ধরে– ডাকিলেই সাড়া পাবে, কিছু না বিলম্ব হবে, তখনি কাছেতে যাব সব ত্যাগ করে।Mrs. Browning (অনূদিত কবিতা) বিধাতা দিলেন মান বিধাতা দিলেন মান বিদ্রোহের বেলা। অন্ধ ভক্তি দিনু যবে করিলেন হেলা।   (স্ফুলিঙ্গ) বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-- মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন; মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ। সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে-- যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী কুড়াইয়া আনি। জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে। বিফল নিন্দা ‘তোরে সবে নিন্দা করে গুণহীন ফুল’ শুনিয়া নীরবে হাসি কহিল শিমূল, যতক্ষণ নিন্দা করে, আমি চুপে চুপে ফুটে উঠি আপনার পরিপূর্ণ রূপে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) বিবসনা ফেলো গো বসন ফেলো — ঘুচাও অঞ্চল । পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ সুরবালিকার বেশ কিরণবসন । পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল , জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা । বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাঁড়াও একেলা । সর্বাঙ্গে পড়ুক তব চাঁদের কিরণ , সর্বাঙ্গে মলয় – বায়ু করুক সে খেলা । অসীম নীলিমা – মাঝে হও নিমগন তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মতো । অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত । আসুক বিমল উষা মানবভবনে , লাজহীনা পবিত্রতা — শুভ্র বিবসনে ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বিবাহের পঞ্চম বরষে বিবাহের পঞ্চম বরষে যৌবনের নিবিড় পরশে গোপন রহস্যভরে পরিণত রসপুঞ্জ অন্তরে অন্তরে পুষ্পের মঞ্জরি হতে ফলের স্তবকে বৃন্ত হতে ত্বকে সুবর্ণবিভায় ব্যাপ্ত করে। সংবৃত সুমন্দ গন্ধ অতিথিরে ডেকে আনে ঘরে সংযত শোভায় পথিকের নয়ন লোভায়। পাঁচ বৎসরের ফুল্ল বসন্তের মাধবীমঞ্জরি মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিল ভরি; মধু সঞ্চয়ের পর মধুপেরে করিল মুখর। শান্ত আনন্দের আমন্ত্রণে আসন পাতিয়া দিল রবাহূত অনাহূত জনে।বিবাহের প্রথম বৎসরে দিকে দিগন্তরে শাহানায় বেজেছিল বাঁশি, উঠেছিল কল্লোলিত হাসি, আজ স্মিতহাস্য ফুটে প্রভাতের মুখে নিঃশব্দ কৌতুকে। বাঁশি বাজে কানাড়ায় সুগম্ভীর তানে সপ্তর্ষির ধ্যানের আহ্বানে! পাঁচ বৎসরের ফুল্ল বিকশিত সুখস্বপ্নখানি সংসারের মাঝখানে পূর্ণতার স্বর্গ দিল আনি। বসন্তপঞ্চম রাগ আরম্ভেতে উঠেছিল বাজি, সুরে সুরে তালে তালে পূর্ণ হয়ে উঠিয়াছে আজি, পুষ্পিত অরণ্যতলে প্রতি পদক্ষেপে মঞ্জীরে বসন্তরাগ উঠিতেছে কেঁপে।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) বিমল আলোকে আকাশ সাজিবে বিমল আলোকে আকাশ সাজিবে, শিশিরে ঝলিবে ক্ষিতি, হে শেফালি, তব বীণায় বাজিবে শুভ্রপ্রাণের গীতি।   (স্ফুলিঙ্গ) বিরহ আমি      নিশি - নিশি কত রচিব শয়ন                    আকুলনয়ন রে !      কত       নিতি - নিতি বনে করিব যতনে                    কুসুমচয়ন রে !      কত       শারদ যামিনী হইবে বিফল ,                    বসন্ত যাবে চলিয়া !      কত       উদিবে তপন আশার স্বপন ,                     প্রভাতে যাইবে ছলিয়া !      এই       যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া ,                    মরিব কাঁদিয়া রে !      সেই      চরণ পাইলে মরণ মাগিব                    সাধিয়া সাধিয়া রে ।      আমি      কার পথ চাহি এ জনম বাহি ,                    কার দরশন যাচি রে !      যেন      আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া ,                    তাই আমি বসে আছি রে ।      তাই      মালাটি   গাঁথিয়া পরেছি মাথায়                    নীলবাসে তনু ঢাকিয়া ,      তাই      বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে                    একেলা রয়েছি জাগিয়া ।      ওগো     তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি ,                    তাই কেঁদে যায় প্রভাতে ।      ওগো     তাই ফুলবনে মধুসমীরণে                    ফুটে ফুল কত শোভাতে !            ওই       বাঁশিস্বর তার আসে বার বার ,                    সেই   শুধু কেন আসে না !      এই       হৃদয় - আসন শূন্য যে থাকে ,                    কেঁদে মরে শুধু বাসনা ।      মিছে     পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় ,                    বহে যমুনার লহরী ,      কেন      কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —                     যামিনী যে ওঠে শিহরি ।      ওগো     যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে ,                     মোর হাসি আর রবে কি !      এই       জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন                    আমারে হেরিয়া কবে কী !      আমি      সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা                    প্রভাতে চরণে ঝরিব ,      ওগো     আছে সুশীতল যমুনার জল —                    দেখে তারে আমি মরিব । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বিরহবৎসর-পরে মিলনের বীণা বিরহবৎসর-পরে মিলনের বীণা তেমন উন্মাদ-মন্দ্রে কেন বাজিলি না। কেন তোর সপ্তস্বর সপ্তস্বর্গপানে ছুটিয়া গেল না ঊর্ধ্বে উদ্দাম-পরানে বসন্তে-মানস-যাত্রী বলাকার মতো। কেন তোর সর্ব তন্ত্র সবলে প্রহত মিলিত ঝংকার-ভরে কাঁপিয়া কাঁদিয়া আনন্দের আর্তরবে চিত্ত উন্মাদিয়া উঠিল না বাজি। হতাশ্বাস মৃদুস্বরে গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া লাজে শঙ্কাভরে কেন মৌন হল। তবে কি আমারি প্রিয়া সে পরশ-নিপুণতা গিয়াছে ভুলিয়া। তবে কি আমারি বীণা ধূলিচ্ছন্ন-তার সেদিনের মতো ক’রে বাজে নাকো আর।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) বিরহীর পত্র হয় কি না হয় দেখা , ফিরি কি না ফিরি ,           দূরে গেলে এই মনে হয় ;      দুজনার মাঝখানে অন্ধকারে ঘিরি           জেগে থাকে সতত সংশয় ।      এত লোক , এত জন , এত পথ গলি ,           এমন বিপুল এ সংসার —      ভয়ে ভয়ে হাতে হাতে বেঁধে বেঁধে চল , ি            ছাড়া পেলে কে আর কাহার ।            তারায় তারায় সদা থাকে চোখে চোখে           অন্ধকারে অসীম গগনে ।      ভয়ে ভয়ে অনিমেষে কম্পিত আলোকে           বাঁধা থাকে নয়নে নয়নে ।     চৌদিকে অটল স্তব্ধ সুগভীর রাত্রি ,            তরুহীন মরুময় ব্যোম —      মুখে মুখে চেয়ে তাই চলে যত যাত্রী           চলে গ্রহ রবি তারা সোম ।            নিমেষের অন্তরালে কী আছে কে জানে ,           নিমেষে অসীম পড়ে ঢাকা —      অন্ধ কালতুরঙ্গম রাশ নাহি মানে ,           বেগে ধায় অদৃষ্টের চাকা ।      কাছে কাছে পাছে পাছে চলিবারে চাই ,           জেগে জেগে দিতেছি পাহারা ,      একটু এসেছে ঘুম — চমকি তাকাই           গেছে চলে কোথায় কাহারা !      ছাড়িয়ে চলিয়া গেলে কাঁদি তাই একা           বিরহের সমুদ্রের তীরে ।      অনন্তের মাঝখানে দু - দন্ডের দেখা           তাও কেন রাহু এসে ঘিরে !      মৃত্যু যেন মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় ,           পাঠায় সে বিরহের চর ।      সকলেই চলে যাবে , পড়ে রবে হায়           ধরণীর শূন্য খেলাঘর ।         গ্রহ তারা ধূমকেতু কত রবি শশী           শূন্য ঘেরি জগতের ভিড় ,      তারি মাঝে যদি ভাঙে , যদি যায় খসি           আমাদের দু - দন্ডের নীড় —      কোথায় কে হারাইব! কোন্ রাত্রিবেলা           কে কোথায় হইব অতিথি !      তখন কি মনে রবে দু - দিনের খেলা ,           দরশের পরশের স্মৃতি !         তাই মনে করে কি রে চোখে জল আসে           একটুকু চোখের আড়ালে !      প্রাণ যারে প্রাণের অধিক ভালোবাসে           সেও কি রবে না এক কালে !      আশা নিয়ে এ কি শুধু খেলাই কেবল —            সুখ দুঃখ মনের বিকার !      ভালোবাসা কাঁদে , হাসে , মোছে অশ্রুজল ,           চায় , পায় , হারায় আবার ।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বিরাট মানবচিত্তে বিরাট মানবচিত্তে অকথিত বাণীপুঞ্জ অব্যক্ত আবেগে ফিরে কাল হতে কালে মহাশূন্যে নীহারিকাসম। সে আমার মনঃসীমানার সহসা আঘাতে ছিন্ন হয়ে আকারে হয়েছে ঘনীভূত, আবর্তন করিতেছে আমার রচনাকক্ষপথে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে আতশবাজির খেলা আকাশে আকাশে, সূর্য তারা ল’য়ে যুগযুগান্তের পরিমাপে। অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে। প্রস্থানের অঙ্কে আজ এসেছি যেমনি দীপশিখা ম্লান হয়ে এল, ছায়াতে পড়িল ধরা এ খেলার মায়ার স্বরূপ, শ্লথ হয়ে এল ধীরে সুখ দুঃখ নাট্যসজ্জাগুলি। দেখিলাম, যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে। দেখিলাম চাহি শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) বিরাম বিরাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) বিলয় যেন তার আঁখি দুটি নবনীল ভাসে ফুটিয়া উঠিছে আজি অসীম আকাশে। বৃষ্টিধৌত প্রভাতের আলোকহিল্লোলে অশ্রুমাখা হাসি তার বিকাশিয়া তোলে। তার সেই স্নেহলীলা সহস্র আকারে সমস্ত জগৎ হতে ঘিরিছে আমারে। বরষার নদী-’পরে ছলছল আলো, দূরতীরে কাননের ছায়া কালো কালো, দিগন্তের শ্যামপ্রান্তে শান্ত মেঘরাজি— তারি মুখখানি যেন শতরূপ সাজি। আঁখি তার কহে যেন মোর মুখে চাহি— “আজ প্রাতে সব পাখি উঠিয়াছে গাহি, শুধু মোর কণ্ঠস্বর এ প্রভাতবায়ে অনন্ত জগৎমাঝে গিয়েছে হারায়ে।”   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বিলাপ ওগো      এত প্রেম - আশা প্রাণের তিয়াষা                    কেমনে আছে সে পাসরি !      তবে       সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী ,                    সেথা কি বাজে না বাঁশরি !      সখী ,       হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,                    সেথা কি পবন বহে না !       সে যে     তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ                    মোর কথা তারে কহে না !      যদি       আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী                    আমারে ভুলাল কেন সে !     ওগো       এ চির জীবন করিব রোদন                    এই ছিল তার মানসে !      যবে       কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে                    কেটেছিল সুখরাতি রে ,      তবে       কে জানিত তার বিরহ আমার                    হবে জীবনের সাথী রে !      যদি       মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে ,                    তোরা একবার দেখে আয় —      এই        নয়নের তৃষা পরানের আশা                    চরণের তলে রেখে আয় ।      আর        নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার ,                    কত আর ঢেকে রাখি বল্ ।      আর        পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে                    এক - ফোঁটা তার আঁখিজল ।      না না ,    এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে                    তারে আর কেহ সেধো না ।      আমি       কথা নাহি কব , দুখ লয়ে রব ,                    মনে মনে স ' ব বেদনা ।      ওগো      মিছে , মিছে সখী , মিছে এই প্রেম ,                    মিছে পরানের বাসনা ।      ওগো      সুখদিন হায় যবে চলে যায়                    আর ফিরে আর আসে না ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বিশুদাদা– দীর্ঘবপু, দৃঢ়বাহু, দুঃসহ কর্তব্যে নাহি বাধা বিশুদাদা– দীর্ঘবপু, দৃঢ়বাহু, দুঃসহ কর্তব্যে নাহি বাধা, বুদ্ধিতে উজ্জ্বল চিত্ত তার সর্বদেহে তৎপরতা করিছে বিস্তার। তন্দ্রার আড়ালে রোগক্লিষ্ট ক্লান্ত রাত্রিকালে মূর্তিমান শক্তির জাগ্রত রূপ প্রাণে বলিষ্ঠ আশ্বাস বহি আনে, নির্নিমেষ নক্ষত্রের মাঝে যেমন জাগ্রত শক্তি নিঃশব্দ বিরাজে অমোঘ আশ্বাসে সুপ্ত রাত্রে বিশ্বের আকাশে। যখন শুধায় মোরে, দুঃখ কি রয়েছে কোনোখানে মনে হয়, নাই তার মানে– দুঃখ মিছে ভ্রম, আপন পৌরুষে তারে আপনি করিব অতিক্রম। সেবার ভিতরে শক্তি দুর্বলের দেহে করে দান বলের সম্মান।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) বিশ্বধরণীর বিপুল কুলায় বিশ্বধরণীর এই বিপুল কুলায় সন্ধ্যা-- তারি নীরব নির্দেশে নিখিল গতির বেগ ধায় তারি পানে। চৌদিকে ধূসরবর্ণ আবরণ নামে। মন বলে, ঘরে যাব-- কোথা ঘর নাহি জানে। দ্বার খোলে সন্ধ্যা নিঃসঙ্গিনী, সম্মুখে নীরন্ধ্র অন্ধকার। সকল আলোর অন্তরালে বিস্মৃতির দূতী খুলে নেয় এ মর্তের ঋণ-করা সাজসজ্জা যত-- প্রক্ষিপ্ত যা-কিছু তার নিত্যতার মাঝে ছিন্ন জীর্ণ মলিন অভ্যাস। আঁধারে অবগাহন-স্নানে নির্মল করিয়া দেয় নবজন্ম নগ্ন ভূমিকারে। জীবনের প্রান্তভাগে অন্তিম রহস্যপথে দেয় মুক্ত করি সৃষ্টির নূতন রহস্যেরে। নব জন্মদিন তারে বলি আঁধারের মন্ত্র পড়ি সন্ধ্যা যারে জাগায় আলোকে। বিশ্বলক্ষ্মী বিশ্বলক্ষ্মী, তুমি একদিন বৈশাখে বসেছিলে দারুণ তপস্যায় রুদ্রের চরণতলে। তোমার তনু হল উপবাসে শীর্ণ, পিঙ্গল তোমার কেশপাশ। দিনে দিনে দুঃখকে তুমি দগ্ধ করলে দুঃখেরি দহনে, শুষ্ককে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলে পূজার পুণ্যধূপে। কালোকে আলো করলে, তেজ দিলে নিস্তেজকে, ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল ত্যাগের হোমাগ্নিতে। দিগন্তে রুদ্রের প্রসন্নতা ঘোষণা করলে মেঘগর্জনে, অবনত হল দাক্ষিণ্যের মেঘপুঞ্জ উৎকণ্ঠিতা ধরণীর দিকে। মরুবক্ষে তৃণরাজি শ্যাম আস্তরণ দিল পেতে, সুন্দরের করুণ চরণ নেমে এল তার 'পরে। বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা! দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে, তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে। বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে! নইলে একটি গাভী পাবার তরে এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল মৃত্যুদূত চুপে চুপে, জীবনের দিগন্ত আকাশে যত ছিল সূক্ষ্ম ধূলি স্তরে স্তরে দিল ধৌত করি ব্যথার দ্রাবক রসে দারুণ স্বপ্নের তলে তলে চলেছিল পলে পলে দৃঢ়হস্তে নিঃশব্দে মার্জনা । কোন্‌ক্ষণে নটলীলা-বিধাতার নব নাট্যভূমে উঠে গেল যবনিকা। শূন্য হতে জ্যোতির তর্জনী স্পর্শ দিল একপ্রান্তে স্তম্ভিত বিপুল অন্ধকারে, আলোকের থরহর শিহরণ চমকি চমকি ছুটিল বিদ্যুৎবেগে অসীম তন্দ্রার স্তূপে স্তূপে, দীর্ণ দীর্ণ করি’ দিল তারে। গ্রীষ্মরিক্ত অবলুপ্ত নদীপথে অকস্মাৎ প্লাবনের দুরন্ত ধারায় বন্যার প্রথম নৃত্য শুষ্কতার বক্ষে বিসর্পিয়া ধায় যথা শাখায় শাখায়;—সেইমতো জাগরণশূন্য আঁধারের গূঢ় নাড়ীতে নাড়ীতে, অন্তঃশীলা জ্যোতির্ধারা দিল প্রবাহিয়া। আলোকে আঁধারে মিলি চিত্তাকাশে অর্ধস্ফুট অস্পষ্টের রচিল বিভ্রম। অবশেষে দ্বন্দ্ব গেল ঘুচি’। পুরাতন সম্মোহের স্থূল কারা-প্রাচীর বেষ্টন, মুহূর্তেই মিলাইল কুহেলিকা। নূতন প্রাণের সৃষ্টি হোলো অবারিত স্বচ্ছ শুভ্র চৈতন্যের প্রথম প্রত্যূষ অভ্যুদয়ে। অতীতের সঞ্চয়-পুঞ্জিত দেহখানা, ছিল যাহা আসন্নের বক্ষ হতে ভবিষ্যের দিকে মাথা তুলি’ বিন্ধ্যগিরি ব্যবধান সম, আজ দেখিলাম প্রভাতের অবসন্ন মেঘ তাহা, স্রস্ত হয়ে পড়ে দিগন্ত বিচ্যুত। বন্ধমুক্ত আপনারে লভিলাম সুদূর অন্তরাকাশে ছায়াপথ পার হয়ে গিয়ে অলোক আলোকতীর্থে সূক্ষ্মতম বিলয়ের তটে।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) বিশ্বের হৃদয়-মাঝে বিশ্বের হৃদয়-মাঝে কবি আছে সে কে। কুসুমের লেখা তার বারবার লেখে— অতৃপ্ত হৃদয়ে তাহা বারবার মোছে, অশান্ত প্রকাশব্যথা কিছুতে না ঘোচে।   (স্ফুলিঙ্গ) বিসর্জন দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর। এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন বুঝাইল--- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ, এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ। শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে। ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে, পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি; শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে। বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি--- কোনোমতে কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে, পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর--- যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে। কাঁদিয়া শুধালো নারী, ``ব্রাহ্মণঠাকুর, এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর! দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই, দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই! তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে! এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা, সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!' ব্রাহ্মণ কহিল, 'বাছা, এ যে ঘোর কলি। অনেক করেছ বটে তবু এও বলি--- আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো? সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো? দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে, নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে। শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে--- পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে। তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে? মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি মার কাছে--- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে, অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে, কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে, 'মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে--- এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই, এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।' যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে মার কোলে সমর্পিল।--- নিষ্ঠা এরে বলে।'মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক'রে, আপনারে ধিক্কারিল--- 'এত দিন ধরে বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা--- নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।' ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন। ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার পড়ে যায়--- কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর। দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি। সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে, একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর--- 'ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর, এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।' বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি; সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী, দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি; কহিল, 'মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়--- ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়--- তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল আছে ওরে বাছা।'                    জাগিয়াছে কলরোল অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে। কহিল, 'মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে। একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে একমনে।' এত বলি সমর্পিল জলে অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না। ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর। কহে দেবী, 'রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্, তোর ধন তোরে দিনু।' রোমাঞ্চিতকায় নয়ন মেলিয়া কহে, 'কই মা... কোথায়!' পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী; গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি। চীত্‍‌কারি উঠিল নারী, 'দিবি নে ফিরায়ে!' মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে। বিসর্জন (অনূদিত কবিতা) যে তোরে বাসেরে ভালো , তারে ভালোবেসে বাছা ,          চিরকাল সুখে তুই রোস্‌ । বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই ,           এখন তাহারি তুই হোস্‌ । আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে । সুখ শান্তি নিয়ে যাস্‌ তোর পাছে পাছে , দুঃখ জ্বালা রেখে যাস্‌ আমাদের কাছে ।   হেথা রাখিতেছি ধরে , সেথা চাহিতেছে তোরে ,          দেরী হ ' ল , যা ' তাদের কাছে । প্রাণের বাছাটি মোর , লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই ,           দুইটি কর্তব্য তোর আছে । একটু বিলাপ যাস আমাদের দিয়ে , তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে ; এক বিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে , হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে ।                    — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা) বীরপুরুষ মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে      মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে । তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে, আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে      টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে । রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে      রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে      এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে । ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই কোনোখানে জনমানব নাই, তুমি যেন আপনমনে তাই      ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা? আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,      ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,     মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে । গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে, সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,      অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো । তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,       ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে’      ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে । তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে, বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে      পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো। আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,      ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’ হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল      কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল । আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার! এক পা আগে আসিস যদি আর - এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,      টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।’ শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে      চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’      আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’ ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে, ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,      শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা। কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,      কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে      ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে। আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’, তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে      চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে - বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!      কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -      এমন কেন সত্যি হয় না আহা। ঠিক যেন এক গল্প হত তবে, শুনত যারা অবাক হত সবে, দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,      খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’ পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে,       ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’(শিশু কাব্যগ্রন্থ) বুড়ি এক যে ছিল চাঁদের কোণায়           চরকা - কাটা বুড়ি   পুরাণে তার বয়স লেখে           সাতশো হাজার কুড়ি । সাদা সুতোয় জাল বোনে সে           হয় না বুনন সারা পণ ছিল তার ধরবে জালে           লক্ষ কোটি তারা ।    হেনকালে কখন আঁখি           পড়ল ঘুমে ঢুলে , স্বপনে তার বয়সখানা           বেবাক গেল ভুলে । ঘুমের পথে পথ হারিয়ে ,           মায়ের কোলে এসে পূর্ণ চাঁদের হাসিখানি           ছড়িয়ে দিল হেসে ।    সন্ধেবেলায় আকাশ চেয়ে           কী পড়ে তার মনে । চাঁদকে করে ডাকাডাকি ,           চাঁদ হাসে আর শোনে । যে - পথ দিয়ে এসেছিল           স্বপন - সাগর - তীরে দু - হাত তুলে সে - পথ দিয়ে           চায় সে যেতে ফিরে ।    হেনকালে মায়ের মুখে            যেমনি আঁখি তোলে চাঁদে ফেরার পথখানি যে           তক্‌খনি সে ভোলে । কেউ জানে না কোথায় বাসা ,           এল কী পথ বেয়ে , কেউ জানে না , এই মেয়ে সেই           আদ্যিকালের মেয়ে ।    বয়সখানার খ্যাতি তবু           রইল জগৎ জুড়ি — পাড়ার লোকে যে দেখে সেই           ডাকে , ' বুড়ি বুড়ি ' । সব - চেয়ে যে পুরানো সে ,           কোন্‌ মন্ত্রের বলে সব - চেয়ে আজ নতুন হয়ে           নামল ধরাতলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) বুদ্ধভক্তি জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে, ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।      হুংকৃত যুদ্ধের বাদ্য সংগ্রহ করিবারে শমনের খাদ্য। সাজিয়াছে ওরা সবে উৎকটদর্শন, দন্তে দন্তে ওরা করিতেছে ঘর্ষণ, হিংসার উষ্মায় দারুণ অধীর সিদ্ধির বর চায় করুণানিধির--      ওরা তাই স্পর্ধায় চলে      বুদ্ধের মন্দিরতলে। তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো, ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।      গর্জিয়া প্রার্থনা করে-- আর্তরোদন যেন জাগে ঘরে ঘরে। আত্মীয়বন্ধন করি দিবে ছিন্ন, গ্রামপল্লীর রবে ভস্মের চিহ্ন, হানিবে শূন্য হতে বহ্নি-আঘাত, বিদ্যার নিকেতন হবে ধূলিসাৎ--      বক্ষ ফুলায়ে বর যাচে      দয়াময় বুদ্ধের কাছে। তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো, ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।      হত-আহতের গনি সংখ্যা তালে তালে মন্দ্রিত হবে জয়ডঙ্কা। নারীর শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ, মিথ্যায় কলুষিবে জনতার বিশ্বাস, বিষবাষ্পের বাণে রোধি দিবে নিশ্বাস--      মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে      বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে। তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো, ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো। বুদ্ধির আকাশ যবে সত্যে সমুজ্জ্বল বুদ্ধির আকাশ যবে সত্যে সমুজ্জ্বল, প্রেমরসে অভিষিক্ত হৃদয়ের ভূমি— জীবনতরুতে ফলে কল্যাণের ফল, মাধুরীর পুষ্পগুচ্ছে উঠে সে কুসুমি।   (স্ফুলিঙ্গ) বুধু মাঠের শেষে গ্রাম,                 সাতপুরিয়া নাম।      চাষের তেমন সুবিধা নেই কৃপণ মাটির গুণে,      পঁয়ত্রিশ ঘর তাঁতির বসত, ব্যাবসা জাজিম বুনে।      নদীর ধারে খুঁড়ে খুঁড়ে পলির মাটি খুঁজে      গৃহস্থেরা ফসল করে কাঁকুড়ে তরমুজে ঐখানেতে বালির ডাঙা, মাঠ করছে ধু ধু, ঢিবির 'পরে বসে আছে গাঁয়ের মোড়াল বুধু।      সামনে মাঠে ছাগল চরছে ক'টা--      শুকনো জমি, নেইকো ঘাসের ঘটা। কী যে ওরা পাচ্ছে খেতে ওরাই সেটা জানে,      ছাগল ব'লেই বেঁচে আছে প্রাণে। আকাশে আজ হিমের আভাস, ফ্যাকাশে তার নীল,      অনেক দূরে যাচ্ছে উড়ে চিল। হেমন্তের এই রোদ্‌দুরটা লাগছে অতি মিঠে, ছোটো নাতি মোগ্‌লুটা তার জড়িয়ে আছে পিঠে। স্পর্শপুলক লাগছে দেহে, মনে লাগছে ভয়--               বেঁচে থাকলে হয়। গুটি তিনটি মরে শেষে ঐটি সাধের নাতি,               রাত্রিদিনের সাথি! গোরুর গাড়ির ব্যাবসা বুধুর চলছে হেসে-খেলেই, নাড়ি ছেঁড়ে এক পয়সা খরচ করতে গেলেই। কৃপণ ব'লে গ্রামে গ্রামে বুধুর নিন্দে রটে, সকালে কেউ নাম করে না উপোস পাছে ঘটে। ওর যে কৃপণতা সে তো ঢেলে দেবার তরে, যত কিছু জমাচ্ছে সব মোগ্‌লু নাতির 'পরে। পয়সাটা তার বুকের রক্ত, কারণটা তার ঐ-- এক পয়সা আর কারো নয় ঐ ছেলেটার বই। না খেয়ে, না প'রে, নিজের শোষণ ক'রে প্রাণ যেটুকু রয় সেইটুকু ওর প্রতি দিনের দান। দেব্‌তা পাছে ঈর্ষাভরে নেয় কেড়ে মোগ্‌লুকে,               আঁকড়ে রাখে বুকে। এখনো তাই নাম দেয়নি, ডাক নামেতেই ডাকে, নাম ভাঁড়িয়ে ফাঁকি দেবে নিষ্ঠুর দেব্‌তাকে। বৃক্ষবন্দনা অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ, ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-'পরে; আনিলে বেদনা নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।                             সেদিন অম্বর-মাঝে শ্যামে নীলে মিশ্রমন্ত্রে স্বর্গলোকে জ্যোতিষ্কসমাজে মর্তের মাহাত্ম্যগান করিলে ঘোষণা। যে জীবন মরণতোরণদ্বার বারম্বার করি উত্তরণ যাত্রা করে যুগে যুগে অনন্তকালের তীর্থপথে নব নব পান্থশালে বিচিত্র নূতন দেহরথে, তাহারি বিজয়ধ্বজা উড়াইলে নিঃশঙ্ক গৌরবে অজ্ঞাতের সম্মুখে দাঁড়ায়ে। তোমার নিঃশব্দ রবে প্রথম ভেঙেছে স্বপ্ন ধরিত্রীর, চমকি উল্লসি নিজেরে পড়েছে তার মনে-- দেবকন্যা দুঃসাহসী কবে যাত্রা করেছিল জ্যোতিঃস্বর্গ ছাড়ি দীনবেশে পাংশুম্লান গৈরিকবসন-পরা,খণ্ড কালে দেশে অমরার আনন্দেরে খণ্ড খণ্ড ভোগ করিবারে, দুঃখের সংঘাতে তারে বিদীর্ণ করিয়া বারে বারে নিবিড় করিয়া পেতে।                          মৃত্তিকার হে বীর সন্তান, সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান মরুর দারুণ দুর্গ হতে;যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে; সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়, দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে ধূলিরে করিয়া মু্‌গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে ব্যাপিলে আপন পন্থা।                              বাণীশূন্য ছিল একদিন জলস্থল শূন্যতল, ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন-- শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয়, যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয়, সুরের বিচিত্র বর্ণে আপনার দৃশ্যহীন তনু রঞ্জিত করিয়া নিল, অঙ্কিল গানের ইন্দ্রধনু উত্তরীর প্রান্তে প্রান্তে । সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যলোক হতে, আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে। ইন্দ্রের অপ্সরী আসি মেঘে হানিয়া কঙ্কণ বাষ্পপাত্র চূর্ণ করি লীলানৃত্যে করেছে বর্ষণ যৌবন অমৃতরস, তুমি তাই নিলে ভরি ভরি আপনার পুত্রপুষ্পপুটে, অনন্তযৌবনা করি সাজাইলে বসুন্ধরা।                    হে নিস্তব্ধ, হে মহাগম্ভীর, বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ দেখালে শক্তির; তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে শুনিতে মৌনের মহাবানী; দুশ্চিন্তার গুরুভারে নতশীর্ষ বিলুণ্ঠিতে শ্যামসৌম্যচ্ছায়াতলে তব-- প্রাণের উদার রূপ,রসরূপ নিত্য নব নব, বিশ্বজয়ী বীররূপ ধরণীর, বাণীরূপ তার লভিতে আপন প্রাণে। ধ্যানবলে তোমার মাঝার গেছি আমি, জেনেছি, সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে সৃষ্টিযজ্ঞে যেই হোম, তোমার সত্তায় চুপে চুপে ধরে তাই শ্যামস্নিগ্ধরূপ; ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী, শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই যে তেজে ভরিলে মজ্জা, মানবেরে তাই করি দান করেছ জগৎজয়ী; দিলে তারে পরম সম্মান; হয়েছে সে দেবতার প্রতিস্পর্ধী-- সে অগ্নিচ্ছটায় প্রদীপ্ত তাহার শক্তি বিশ্বতলে বিস্ময় ঘটায় ভেদিয়া দুঃসাধ্য বিঘ্নবাধা। তব প্রাণে প্রাণবান, তব স্নেহচ্ছায়ায় শীতল, তব তেজে তেজীয়মান, সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব, তারি দূত হয়ে ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য ল'য়ে শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি                         অর্পিলাম তোমায় প্রণামী। বৃক্ষরোপণ উৎসব গান১মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে,           হে প্রবল প্রাণ। ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে,           হে কোমল প্রাণ। মৌনী মাটির মর্মের গান কবে উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মর তব রবে, মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে,           হে মোহন প্রাণ।পথিকবন্ধু, ছায়ার আসন পাতি           এসো শ্যাম সুন্দর, এসো বাতাসের অধীর খেলার সাথী,           মাতাও নীলাম্বর। উষায় জাগাও শাখায় গানের আশা, সন্ধ্যায় আনো বিরামগভীর ভাষা, রচি দাও রাতে সুপ্তগীতের বাসা,           হে উদার প্রাণ।২আয় আমাদের অঙ্গনে,           অতিথি বালক তরুদল, মানবের স্নেহসঙ্গ নে,           চল্‌, আমাদের ঘরে চল্‌। শ্যামবঙ্কিম ভঙ্গিতে চঞ্চল কলসংগীতে দ্বারে নিয়ে আয় শাখায় শাখায়           প্রাণ-আনন্দ-কোলাহল।           তোদের নবীন পল্লবে           নাচুক আলোক সবিতার, দে পবনে বনবল্লভে           মর্মর গীত উপহার। আজি শ্রাবণের বর্ষণে আশীর্বাদের স্পর্শ নে, পড়ুক মাথায় পাতায় পাতায়           অমরাবতীর ধারাজল।ক্ষিতিবক্ষের ধন হে ধরণী,ধরো           ফিরে নিয়ে তব বক্ষে। শুভদিনে এরে দীক্ষিত করো           আমাদের চিরসখ্যে। অন্তরে পাক কঠিন শক্তি,           কোমলতা ফুলে পত্রে, পক্ষিসমাজে পাঠাক পত্রী           তোমার অন্নসত্রে।অপহে মেঘ, ইন্দ্রের ভেরি বাজাও গম্ভীর মন্দ্রস্বনে মেদুর অম্বরতলে। আনন্দিত প্রাণের স্পন্দনে জাগুক এ শিশুবৃক্ষ। মহোৎসবে লহো এরে ডেকে। বনের সৌভাগ্যদিনে ধরণীর বর্ষা অভিষেকে।তেজসৃষ্টির প্রথম বাণী তুমি, হে আলোক; এ নব তরুতে তব শুভদৃষ্টি হোক। একদা প্রচুর পুষ্পে হবে সার্থকতা উহার প্রচ্ছন্ন প্রাণে রাখো সেই কথা। স্নিগ্ধ পল্লবের তলে তব তেজ ভরি হোক তব জয়ধ্বনি শতবর্ষ ধরি।মরুৎহে পবন কর নাই গৌণ,        আষাঢ়ে বেজেছে তব বংশী। তাপিত নিকুঞ্জের মৌন        নিশ্বাসে দিলে তুমি ধ্বংসি। এ তরু খেলিবে তব সঙ্গে,        সংগীত দিয়ো এরে ভিক্ষা। দিয়ো তব ছন্দের রঙ্গে        পল্লবহিল্লোল শিক্ষা।ব্যোমআকাশ, তোমার সহাস উদার দৃষ্টি মাটির গভীরে জাগায় রূপের সৃষ্টি। তব আহ্বানে এই তো শ্যামলমূর্তি আলোক-অমৃতে খুঁজিছে প্রাণের পূর্তি। দিয়েছ সাহস, তাই তব নীলবর্ণে বর্ণ মিলায় আপন হরিৎপর্ণে। তরুতরুণেরে করুণায় করো ধন্য, দেবতার স্নেহ পায় যেন এই বন্য।মাঙ্গলিকপ্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হোক হে শিশু চিরায়ু, বিশ্বের প্রসাদস্পর্শে শক্তি দিক সুধাসিক্ত বায়ু। হে বালকবৃক্ষ, তব উজ্জ্বল কোমল কিশলয় আলোক করিয়া পান ভান্ডারেতে করুক সঞ্চয় প্রচ্ছন্ন প্রশান্ত তেজ। লয়ে তব কল্যাণকামনা শ্রাবণবর্ষণযজ্ঞে তোমারে করিনু অভ্যর্থনা।-- থাকো প্রতিবেশী হয়ে, আমাদের বন্ধু হয়ে থাকো। মোদের প্রাঙ্গণে ফেলো ছায়া, পথের কঙ্কর ঢাকো কুসুমবর্ষণে; আমাদের বৈতালিক বিহঙ্গমে শাখায় আশ্রয় দিয়ো; বর্ষে বর্ষে পুষ্পিত উদ্যমে অভিনন্দনের গন্ধ মিলাইয়ো বর্ষাগীতিকায় সন্ধ্যাবন্দনার গানে। মোদের নিকুঞ্জবীথিকায় মঞ্জুল মর্মরে তব ধরিত্রীর অন্তঃপুর হতে প্রাণমাতৃকায় মন্ত্র উচ্ছ্বসিবে সূর্যের আলোতে। শত বর্ষ হবে গত, রেখে যাব আমাদের প্রীতি শ্যামল লাবণ্যে তব। সে যুগের নূতন অতিথি বসিবে তোমার ছায়ে। সেদিন বর্ষণমহোৎসবে আমাদের নিমন্ত্রণ পাঠাইয়ো তোমার সৌরভে দিকে দিকে বিশ্বজনে। আজি এই আনন্দের দিন তোমার পল্লবপুঞ্জে পুষ্পে তব হোক মৃত্যুহীন। রবীন্দ্রের কন্ঠ হতে এ সংগীত তোমার মঙ্গলে মিলিল মেঘের মন্দ্রে, মিলিল কদম্বপরিমলে। বৃদ্ধ কবি মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে জীবন হতেছে শেষ, শিথিল কপোল মলিন নয়ন তুষার-ধবল কেশ! পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া অযতনে বীণাখানি, বাজাবার বল নাইকো এ হাতে জড়িমা জড়িত বাণী! গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা! হইল বিদায় নিতে; আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই অমৃত আমার চিতে? তবু একবার আর-একবার ত্যজিবার আগে প্রাণ, মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব সাধের সে-সব গান! দুলিবে আমার সমাধি-উপরে তরুগণ শাখা তুলি, বনদেবতারা গাইবে তখন মরণের গানগুলি!  (অনুবাদ কবিতা) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর দিনের আলো নিবে এল,              সুয্যি ডোবে - ডোবে। আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে               চাঁদের লোভে লোভে। মেঘের উপর মেঘ করেছে—               রঙের উপর রঙ, মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।               বাজল ঠঙ ঠঙ। ও পারেতে বিষ্টি এল,               ঝাপসা গাছপালা। এ পারেতে মেঘের মাথায়              একশো মানিক জ্বালা। বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে              ছেলেবেলার গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,             নদেয় এল বান। ' আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা,             কোথায় বা সীমানা! দেশে দেশে খেলে বেড়ায়,             কেউ করে না মানা। কত নতুন ফুলের বনে             বিষ্টি দিয়ে যায়, পলে পলে নতুন খেলা             কোথায় ভেবে পায়। মেঘের খেলা দেখে কত             খেলা পড়ে মনে, কত দিনের নুকোচুরি            কত ঘরের কোণে। তারি সঙ্গে মনে পড়ে            ছেলেবেলার গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,            নদেয় এল বান। '    মনে পড়ে ঘরটি আলো            মায়ের হাসিমুখ, মনে পড়ে মেঘের ডাকে            গুরুগুরু বুক। বিছানাটির একটি পাশে            ঘুমিয়ে আছে খোকা, মায়ের ‘পরে দৌরাত্মি সে            না যায় লেখাজোখা। ঘরেতে দুরন্ত ছেলে            করে দাপাদাপি, বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে—            সৃষ্টি ওঠে কাঁপি। মনে পড়ে মায়ের মুখে            শুনেছিলেম গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,             নদেয় এল বান। মনে পড়ে সুয়োরানী            দুয়োরানীর কথা, মনে পড়ে অভিমানী            কঙ্কাবতীর ব্যথা। মনে পড়ে ঘরের কোণে             মিটিমিটি আলো, একটা দিকের দেয়ালেতে             ছায়া কালো কালো। বাইরে কেবল জলের শব্দ             ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ ঝুপ্‌— দস্যি ছেলে গল্প শোনে             একেবারে চুপ। তারি সঙ্গে মনে পড়ে             মেঘলা দিনের গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,             নদেয় এল বান। '    কবে বিষ্টি পড়েছিল,             বান এল সে কোথা। শিবঠাকুরের বিয়ে হল,             কবেকার সে কথা। সেদিনও কি এম্‌নিতরো              মেঘের ঘটাখানা। থেকে থেকে বাজ বিজুলি             দিচ্ছিল কি হানা। তিন কন্যে বিয়ে করে             কী হল তার শেষে। না জানি কোন্‌ নদীর ধারে,             না জানি কোন্‌ দেশে, কোন্‌ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে             কে গাহিল গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,              নদেয় এল বান। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর দিনের আলো নিবে এল সুয্যি ডোবে ডোবে । আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে । মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ । মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজল ঠং ঠং । ও পারেতে বৃষ্টি এল, ঝাপসা গাছপালা । এ পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা । বাদলা হাওয়ায় মনে পরে ছেলেবেলার গান-- বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান ।।আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা, কোথায় বা সীমানা-- দেশে দেশে খেলে বেড়ায়, কেউ করে না মানা । কত  নতুন ফুলের বনে বৃষ্টি দিয়ে যায়, পলে পলে নতুন কেহ্লা কোথায় ভেবে পায়! মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পড়ে মনে, কত দিনের লুকোচুরি কত ঘরের কোণে! তারি সঙ্গে মনে পরে ছেলেবেলার গান-- বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান ।।মনে পরে ঘরটি আলো, মায়ের হাসিমুখ-- মনে পরে মেঘের ডাকে গুরুগুরু বুক । বিছানাটির একটি পাশে ঘুমিয়ে আছে খোকা, মায়ের 'পরে দৌরাত্মি সে না যায় লেখাজোকা । ঘরেতে দুরন্ত ছেলে করে দাপাদাপি-- বাইরেতে মেঘ ডেকে উঠে, সৃষ্টি উঠে কাঁপি । মনে পরে মায়ের মুখে শুনেছিলেম গান- বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান ।মনে পরে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর কথা, মনে পরে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা । মনে পরে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো, চারি দিকের দেয়াল জুড়ে ছায়া কালো কালো । বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু--প্ ঝু--প্ ঝু প দস্যি ছেলে গল্প শোনে, একেবারে চুপ । তারি সঙ্গে মনে পরে মেঘলা দিনের গান-- বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান ।।কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা-- শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা! সেদিনও কি এমনি তরো মেঘের ঘটাখানা! থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা! তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে! না জানি কোন্ নদীর ধারে, না জানি কোন্ দেশে, কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান-- বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান ।। বৃষ্টি রৌদ্র ঝুঁটি - বাঁধা ডাকাত সেজে দল বেঁধে মেঘ চলেছে যে           আজকে সারাবেলা । কালো ঝাঁপির মধ্যে ভরে সুর্যিকে নেয় চুরি করে ,           ভয় - দেখাবার খেলা । বাতাস তাদের ধরতে মিছে হাঁপিয়ে ছোটে পিছে পিছে ,           যায় না তাদের ধরা । আজ যেন ওই জড়োসড়ো আকাশ জুড়ে মস্ত বড়ো           মন - কেমন - করা । বটের ডালে ডানা - ভিজে কাক বসে ওই ভাবছে কী যে ,           চড়ুইগুলো চুপ । বৃষ্টি হয়ে গেছে ভোরে শজনেপাতায় ঝরে ঝরে           জল পড়ে টুপটুপ । লেজের মধ্যে মাথা থুয়ে খাঁদন কুকুর আছে শুয়ে           কেমন একরকম । দালানটাতে ঘুরে ঘুরে পায়রাগুলো কাঁদন - সুরে           ডাকছে বকবকম । কার্তিকে ওই ধানের খেতে ভিজে হাওয়া উঠল মেতে           সবুজ ঢেউয়ের ‘পরে । পরশ লেগে দিশে দিশে হিহি করে ধানের শিষে           শীতের কাঁপন ধরে । ঘোষাল - পাড়ার লক্ষ্মী বুড়ি ছেঁড়া কাঁথায় মুড়িসুড়ি           গেছে পুকুরপাড়ে ,   দেখতে ভালো পায় না চোখে বিড়বিড়িয়ে বকে বকে           শাক তোলে , ঘাড় নাড়ে । ঐ ঝমাঝম বৃষ্টি নামে মাঠের পারে দূরের গ্রামে           ঝাপসা বাঁশের বন । গোরুটা কার থেকে থেকে খোঁটায় - বাঁধা উঠছে ডেকে           ভিজছে সারাক্ষণ । গদাই কুমোর অনেক ভোরে সাজিয়ে নিয়ে উঁচু ক'রে            হাঁড়ির উপর হাঁড়ি চলছে রবিবারের হাটে , গামছা মাথায় জলের ছাঁটে           হাঁকিয়ে গোরুর গাড়ি । বন্ধ আমার রইল খেলা , ছুটির দিনে সারাবেলা           কাটবে কেমন করে ? মনে হচ্ছে এমনিতরো ঝরবে বৃষ্টি ঝরোঝরো           দিনরাত্তির ধরে ! এমন সময় পুবের কোণে কখন যেন অন্যমনে           ফাঁক ধরে ওই মেঘে , মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে হঠাৎ চোখের পাতা মেলে           আকাশ ওঠে জেগে । ছিঁড়ে - যাওয়া মেঘের থেকে পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে ,           লাগায় ঝিলিমিলি । বাঁশবাগানের মাথায় মাথায় তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায়           হাসায় খিলিখিলি । হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে ভুলিয়ে দিলে একনিমেষে            বাদলবেলার কথা । হারিয়ে - পাওয়া আলোটিরে নাচায় ডালে ফিরে ফিরে           বেড়ার ঝুমকোলতা । উপর নিচে আকাশ ভরে এমন বদল কেমন করে           হয় , সে - কথাই ভাবি । উলটপালট খেলাটি এই , সাজের তো তার সীমানা নেই ,           কার কাছে তার চাবি ? এমন যে ঘোর মন - খারাপি বুকের মধ্যে ছিল চাপি           সমস্ত খন আজি — হঠাৎ দেখি সবই মিছে নাই কিছু তার আগে পিছে           এ যেন কার বাজি । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) বেছে লব সব-সেরা বেছে লব সব-সেরা, ফাঁদ পেতে থাকি— সব-সেরা কোথা হতে দিয়ে যায় ফাঁকি। আপনারে করি দান, থাকি করজোড়ে— সব-সেরা আপনিই বেছে লয় মোরে।   (স্ফুলিঙ্গ) বেজি অনেকদিনের এই ডেস্কো —         আনমনা কলমের কালিপড়া ফ্রেস্কো                    দিয়েছে বিস্তর দাগ ভুতূড়ে রেখার ।                          যমজ সোদর ওরা যে সব লেখার —                             ছাপার লাইনে পেল ভদ্রবেশে ঠাঁই ,                                    তাদের স্মরণে এরা নাই ।                          অক্সফোর্ড ডিক্সনারি , পদকল্পতরু ,                             ইংরেজ মেয়ের লেখা ‘ সাহারার মরু '                                   ভ্রমণের বই , ছবি আঁকা ,                             এগুলোর একপাশে চা রয়েছে ঢাকা                          পেয়ালায় মডার্‌ন্‌ রিভিয়ুতে চাপা ।                                   পড়ে আছে সদ্যছাপা                             প্রুফগুলো কুঁড়েমির উপেক্ষায় ।                                       বেলা যায় ,                             ঘড়িতে বেজেছে সাড়ে পাঁচ ,                                   বৈকালী ছায়ার নাচ         মেঝেতে হয়েছে শুরু , বাতাসে পর্দায় লেগে দোলা ।              খাতাখানি আছে খোলা । —                    আধঘণ্টা ভেবে মরি ,              প্যান্থীজ্‌ম্‌ শব্দটাকে বাংলায় কী করি ।           পোষা বেজি হেনকালে দ্রুতগতি এখানে সেখানে              টেবিল চৌকির নীচে ঘুরে গেল কিসের সন্ধানে —                    দুই চক্ষু ঔৎসুক্যের দীপ্তিজ ্ব লা ,              তাড়াতাড়ি দেখে গেল আলমারির তলা                          দামি দ্রব্য যদি কিছু থাকে ;                     ঘ্রাণ কিছু মিলিল না তীক্ষ্ণ নাকে              ঈপ্সিত বস্তুর । ঘুরে ফিরে অবজ্ঞায় গেল চলে ,         এ ঘরে সকলি ব্যর্থ আরসুলার খোঁজ নেই ব ' লে ।                            আমার কঠিন চিন্তা এই ,                          প্যান্থীজ্‌ম্‌ শব্দটার বাংলা বুঝি নেই । বেণীর মোটরখানা বেণীর মোটরখানা চালায় মুখুর্জে। বেণী ঝেঁকে উঠে বলে, “মরল কুকুর যে!’ অকারণে সেরে দিলে দফা ল্যাম্‌-পোস্‌টার, নিমেষেই পরলোকে গতি হল মোষটার। যেদিকে ছুটেছে সোজা ওদিকে পুকুর যে– আরে চাপা পড়ল কে? জামাই খুকুর যে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বেদনা দিবে যত বেদনা দিবে যত অবিরত দিয়ো গো। তবু এ ম্লান হিয়া কুড়াইয়া নিয়ো গো। যে ফুল আনমনে উপবনে তুলিলে কেন গো হেলাভরে ধুলা-'পরে ভুলিলে।বিঁধিয়া তব হারে গেঁথো তারে প্রিয় গো।   (স্ফুলিঙ্গ) বেদনায় সারা মন বেদনায় সারা মন করতেছে টনটন্‌ শ্যালী কথা বলল না সেই বৈরাগ্যে। মরে গেলে ট্রাস্‌টিরা করে দিক বণ্টন বিষয়-আশয় যত– সবকিছু যাক গে। উমেদারি-পথে আহা ছিল যাহা সঙ্গী– কোথা সে শ্যামবাজার কোথা চৌরঙ্গি– সেই ছেঁড়া ছাতা চোরে নেয় নাই ভাগ্যে– আর আছে ভাঙা ঐ হ্যারিকেন লণ্ঠন, বিশ্বের কাজে তারা লাগে যদি লাগ্‌ গে।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বেলা আটটার কমে বেলা আটটার কমে খোলে না তো চোখ সে। সামলাতে পারে না যে নিদ্রার ঝোঁক সে। জরিমানা হলে বলে,– “এসেছি যে মা ফেলে, আমার চলে না দিন মাইনেটা না পেলে। তোমার চলবে কাজ যে ক’রেই হোক সে, আমারে অচল করে মাইনের শোক সে।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) বেসুর ভাগ্য তাহার ভুল করেছে-- প্রাণের তানপুরার গানের সাথে মিল হল না, বেসুরো ঝংকার।            এমন ত্রুটি ঘটল কিসে            আপনিও তা বোঝে নি সে, অভাব কোথাও নেই-যে কিছুই এই কি অভাব তার।ঘরটাকে তার ছাড়িয়ে গেল ঘরেরই আসবাবে। মনটাকে তার ঠাঁই দিল না ধনের প্রাদুর্ভাবে।            যা চাই তারো অনেক বেশি            ভিড় করে রয় ঘেঁষাষেঁষি, সেই ব্যাঘাতের বিরুদ্ধে তাই বিদ্রোহ তার নাবে।সব চেয়ে যা সহজ সেটাই দুর্লভ তার কাছে। সেই সহজের মূর্তি যে তার বুকের মধ্যে আছে।            সেই সহজের খেলাঘরে            ওই যারা সব মেলা করে দূর হতে ওর বদ্ধ জীবন সঙ্গ তাদের যাচে।প্রাণের নিঝর স্বভাব-ধারায় বয় সকলের পানে, সেটাই কি কেউ ফিরিয়ে দিল উলটো দিকের টানে।            আত্মদানের রুদ্ধ বাণী            বক্ষকপাট বেড়ায় হানি, সঞ্চিত তার সুধা কি তাই ব্যথা জাগায় প্রাণে।আপনি যেন আর কেহ সে এই লাগে তার মনে, চেনা ঘরের অচল ভিতে কাটায় নির্বাসনে।            বসন ভূষণ অঙ্গরাগে            ছদ্মবেশের মতন লাগে, তার আপনার ভাষা যে হায় কয় না আপন জনে।আজকে তারে নিজের কাছে পর করেছে কা'রা, আপন-মাঝে বিদেশে বাস হায় এ কেমনধারা।            পরের খুশি দিয়ে সে যে            তৈরি হল ঘ'ষে মেজে, আপনাকে তাই খুঁজে বেড়ায় নিত্য আপন-হারা। বৈজ্ঞানিক যেম্‌নি মা গো গুরু গুরু              মেঘের পেলে সাড়া     যেম্‌নি এল আষাঢ় মাসে               বৃষ্টিজলের ধারা,     পুবে হাওয়া মাঠ পেরিয়ে               যেম্‌নি পড়ল আসি     বাঁশ-বাগানে সোঁ সোঁ করে                   বাজিয়ে দিয়ে বাঁশি—           অম্‌নি দেখ্‌ মা, চেয়ে—           সকল মাটি ছেয়ে      কোথা থেকে উঠল যে ফুল                এত রাশি রাশি।         তুই যে ভাবিস ওরা কেবল                অম্‌নি যেন ফুল,      আমার মনে হয় মা, তোদের                সেটা ভারি ভুল।      ওরা সব ইস্‌কুলের ছেলে,                পুঁথি-পত্র কাঁখে      মাটির নীচে ওরা ওদের                 পাঠশালাতে থাকে।           ওরা পড়া করে           দুয়োর-বন্ধ ঘরে,      খেলতে চাইলে গুরুমশায়                 দাঁড় করিয়ে রাখে।         বোশেখ-জষ্টি মাসকে ওরা                  দুপুর বেলা কয়,      আষাঢ় হলে আঁধার করে                  বিকেল ওদের হয়।      ডালপালারা শব্দ করে                  ঘনবনের মাঝে,      মেঘের ডাকে তখন ওদের                  সাড়ে চারটে বাজে।           অমনি ছুটি পেয়ে           আসে সবাই ধেয়ে,      হলদে রাঙা সবুজ সাদা                 কত রকম সাজে।         জানিস মা গো, ওদের যেন                  আকাশেতেই বাড়ি,      রাত্রে যেথায় তারাগুলি                 দাঁড়ায় সারি সারি।      দেখিস নে মা, বাগান ছেয়ে                 ব্যস্ত ওরা কত!      বুঝতে পারিস কেন ওদের                 তাড়াতাড়ি অত?             জানিস কি কার কাছে             হাত বাড়িয়ে আছে।      মা কি ওদের নেইকো ভাবিস                 আমার মায়ের মতো? (শিশু কাব্যগ্রন্থ) বৈতরণী অশ্রুস্রোতে স্ফীত হয়ে বহে বৈতরণী , চৌদিকে চাপিয়া আছে আঁধার রজনী । পূর্ব তীর হতে হু হু আসিছে নিশ্বাস , যাত্রী লয়ে পশ্চিমেতে চলেছে তরণী । মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিদ্যুৎ – বিকাশ , কেহ কারে নাহি চেনে ব’সে নতশিরে । গলে ছিল বিদায়ের অশ্রুকণা – হার , ছিন্ন হয়ে একে একে ঝ’রে পড়ে নীরে । ওই বুঝি দেখা যায় ছায়া – পরপার , অন্ধকারে মিটিমিটি তারা – দীপ জ্বলে । হোথায় কি বিস্মরণ , নিঃস্বপ্ন নিদ্রার শয়ন রচিয়া দিবে ঝরা ফুলদলে ! অথবা অকূলে শুধু অনন্ত রজনী ভেসে চলে কর্ণধারবিহীন তরণী !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) বৈরাগ্য কহিল গভীর রাত্রে সংসারে বিরাগী— “গৃহ তেয়াগিব আজি ইষ্টদেব লাগি। কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে?” দেবতা কহিলা, “আমি।”—শুনিল না কানে। সুপ্তিমগ্ন শিশুটিরে আঁকড়িয়া বুকে প্রেয়সী শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে। কহিল, “কে তোরা ওরে মায়ার ছলনা?” দেবতা কহিলা, “আমি।”—কেহ শুনিল না। ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু?” দেবতা কহিলা, “হেথা।”—শুনিল না তবু। স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি— দেবতা কহিলা, “ফির।”—শুনিল না বাণী। দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়, আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?” (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয় ।অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ । এই বসুধার মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত নানাবর্ণগন্ধময় । প্রদীপের মতো সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায় জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায় তোমার মন্দির-মাঝে ।                     ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার । যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে ।মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া, প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া । বোঝাপড়া মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে। কেউ বা তোমায় ভালোবাসে কেউ বা বাসতে পারে না যে, কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে, কতকটা যে স্বভাব তাদের কতকটা বা তোমারো ভাই, কতকটা এ ভবের গতিক— সবার তরে নহে সবাই। তোমায় কতক ফাঁকি দেবে তুমিও কতক দেবে ফাঁকি, তোমার ভোগে কতক পড়বে পরের ভোগে থাকবে বাকি, মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম— তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম! মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি এলে সুখের বন্দরেতে, জলের তলে পাহাড় ছিল লাগল বুকের অন্দরেতে, মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো উঠল কেঁপে আর্তরবে— তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ ঝগড়া করে মরতে হবে? ভেসে থাকতে পার যদি সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়, না পার তো বিনা বাক্যে টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো। এটা কিছু অপূর্ব নয়, ঘটনা সামান্য খুবই— শঙ্কা যেথায় করে না কেউ সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি। মনেরে তাই কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।তোমার মাপে হয় নি সবাই তুমিও হও নি সবার মাপে, তুমি মর কারো ঠেলায় কেউ বা মরে তোমার চাপে— তবু ভেবে দেখতে গেলে এমনি কিসের টানাটানি? তেমন করে হাত বাড়ালে সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি। আকাশ তবু সুনীল থাকে, মধুর ঠেকে ভোরের আলো, মরণ এলে হঠাৎ দেখি মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো। যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর। মনেরে তাই কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।নিজের ছায়া মস্ত করে অস্তাচলে বসে বসে আঁধার করে তোল যদি জীবনখানা নিজের দোষে, বিধির সঙ্গ বিবাদ করে নিজের পায়েই কুড়ুল মার, দোহাই তবে এ কার্যটা যত শীঘ্র পার সারো। খুব খানিকটে কেঁদে কেটে অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া মনের সঙ্গ এক রকমে করে নে ভাই, বোঝাপড়া। তাহার পরে আঁধার ঘরে প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো— ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে কতটুকুন তফাত হল। মনেরে তাই কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে। ব্যর্থ যদি     প্রেম দিল না প্রাণে কেন     ভোরের আকাশ ভরে দিলে     এমন গানে গানে?                         কেন     তারার মালা গাঁথা,                         কেন     ফুলের শয়ন পাতা, কেন     দখিন হাওয়া গোপন কথা     জানায় কানে কানে?।                        যদি     প্রেম দিলে না প্রাণে কেন     আকাশ তবে এমন চাওয়া     চায় এ মুখের পানে?                         তবে     ক্ষণে ক্ষণে কেন                         আমার     হৃদয় পাগল হেন, তরী     সেই সাগরে ভাসায় যাহার     কূল সে নাহি জানে?।শান্তিনিকেতন ২৮ আশ্বিন ১৩২০(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) ব্যাকুল অমন করে আছিস কেন মা গো,             খোকারে তোর কোলে নিবি না গো? পা ছড়িয়ে ঘরের কোণে কী যে ভাবিস আপন মনে,             এখনো তোর হয় নি তো চুল বাঁধা। বৃষ্টিতে যায় মাথা ভিজে, জানলা খুলে দেখিস কী যে—             কাপড়ে যে লাগবে ধুলোকাদা। ওই তো গেল চারটে বেজে, ছুটি হল ইস্কুলে যে—             দাদা আসবে মনে নেইকো সিটি। বেলা অম্‌নি গেল বয়ে, কেন আছিস অমন হয়ে—             আজকে বুঝি পাস নি বাবার চিঠি। পেয়াদাটা ঝুলির থেকে সবার চিঠি গেল রেখে—              বাবার চিঠি রোজ কেন সে দেয় না? পড়বে বলে আপনি রাখে, যায় সে চলে ঝুলি - কাঁখে,              পেয়াদাটা ভারি দুষ্টু স্যায়না।                  মা গো মা, তুই আমার কথা শোন্‌,               ভাবিস নে মা, অমন সারা ক্ষণ। কালকে যখন হাটের বারে বাজার করতে যাবে পারে                কাগজ কলম আনতে বলিস ঝিকে। দেখো ভুল করব না কোনো— ক খ থেকে মূর্ধন্য ণ                বাবার চিঠি আমিই দেব লিখে। কেন মা, তুই হাসিস কেন। বাবার মতো আমি যেন                অমন ভালো লিখতে পারি নেকো, লাইন কেটে মোটা মোটা বড়ো বড়ো গোটা গোটা                 লিখব যখন তখন তুমি দেখো। চিঠি লেখা হলে পরে বাবার মতো বুদ্ধি করে                ভাবছ দেব ঝুলির মধ্যে ফেলে? কক্‌খনো না, আপনি নিয়ে যাব তোমায় পড়িয়ে দিয়ে,               ভালো চিঠি দেয় না ওরা পেলে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ব্রিজটার প্ল্যান দিল ব্রিজটার প্ল্যান দিল বড়ো এন্‌জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্‌ট্‌ বোর্ডের সবচেয়ে সীনিয়ার। নতুন রকম প্ল্যান দেখে সবে অজ্ঞান, বলে, “এই চাই, এটা চিনি নাই-চিনি আর।’ব্রিজখানা গেল শেষে কোন্‌ অঘটন দেশে, তার সাথে গেছে ভেসে ন হাজার গিনি আর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভক্তি ও অতিভক্তি ভক্তি আসে রিক্তহস্ত প্রসন্নবদন— অতিভক্তি বলে, দেখি কী পাইলে ধন। ভক্তি কয়, মনে পাই, না পারি দেখাতে।— অতিভক্তি কয়, আমি পাই হাতে হাতে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ভক্তিভাজন রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ভক্তের প্রতি সরল সরস স্নিগ্ধ তরুণ হৃদয়, কী গুণে তোমারে আমি করিয়াছি জয় তাই ভাবি মনে। উৎফুল্ল উত্তান চোখে চেয়ে আছ মুখপানে প্রীতির আলোকে আমারে উজ্জ্বল করি। তারুণ্য তোমার আপন লাবণ্যখানি লয়ে উপহার পরায় আমার কণ্ঠে, সাজায় আমারে আপন মনের মতো দেবতা-আকারে ভক্তির উন্নত লোকে প্রতিষ্ঠিত করি। সেথায় একাকী আমি সসংকোচে মরি। সেথা নিত্য ধূপে দীপে পূজা-উপচারে অচল আসন-’পরে কে রাখে আমারে? গেয়ে গেয়ে ফিরি পথে আমি শুধু কবি— নহি আমি ধ্রুবতারা, নহি আমি রবি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ভগ্ন মন্দির ভাঙা দেউলের দেবতা, তব বন্দনা রচিতে ছিন্ন বীণার তন্ত্রী বিরতা - সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ তোমার আরতিবারতা তব মন্দির স্থিরগম্ভীর ভাঙা দেউলের দেবতা।         তব জনহীন ভবনে থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ নববসন্তপবনে যে ফুল রচে নি পূজার অর্ঘ, রাখে নি ও রাঙা চরনে সে ফুল ফোটার আসে সমাচার জনহীন ভাঙা ভবনে।        পূজাহীন তব পূজারী কোথা সারাদিন ফিরে উদাসীন কার প্রসাদের ভিখারি গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায় চির-উপবাস-ভূখারি! ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে পূজাহীন তব পূজারি।        ভাঙা দেউলের দেবতা, কত উৎসব হইল নীরব, কত পূজানিশা বিগতা কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা কত যায় কত কব তা, শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন ভাঙা দেউলের দেবতা। ভজন পূজন সাধন আরাধনা ভজন পূজন সাধন আরাধনা           সমস্ত থাক্‌ পড়ে। রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে          কেন আছিস ওরে। অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে, নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে---          দেবতা নাই ঘরে।তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে           করছে চাষা চাষ--- পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,          খাটছে বারো মাস। রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে, ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে; তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি         আয় রে ধুলার 'পরে।মুক্তি?   ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,             মুক্তি কোথায় আছে। আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন প'রে             বাঁধা সবার কাছে। রাখো রে ধ্যান, থাক্‌ রে ফুলের ডালি, ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি, কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে              ঘর্ম পড়ুক ঝরে।কয়া।গোরাই ২৭ আষাঢ় ১৩১৭ ভজনমন্দিরে তব ভজনমন্দিরে তব পূজা যেন নাহি রয় থেমে, মানুষে কোরো না অপমান। যে-ঈশ্বরে ভক্তি কর, হে সাধক, মানুষের প্রেমে তাঁরি প্রেম করো সপ্রমাণ।   (স্ফুলিঙ্গ) ভজহরি হংকঙেতে সারাবছর আপিস করেন মামা , সেখান থেকে এনেছিলেন চীনের দেশের শ্যামা , দিয়েছিলেন মাকে, ঢাকার নীচে যখন-তখন শিস দিয়ে সে ডাকে। নিচিনপুরের বনের থেকে ঝুলির মধ্যে ক'রে ভজহরি আনত ফড়িঙ ধরে । পাড়ায় পাড়ায় যত পাখি খাঁচায় খাঁচায় ঢাকা আওয়াজ শুনেই উঠত নেচে , ঝাপট দিত পাখা । কাউকে ছাতু , কাউকে পোকা , কাউকে দিত ধান , অসুখ করলে হলুদজলে করিয়ে দিত স্নান । ভজু বলত , “ পোকার দেশে আমিই হচ্ছি দত্যি , আমার ভয়ে গঙ্গাফড়িঙ ঘুমোয় না একরত্তি । ঝোপে ঝোপে শাসন আমার কেবলই ধরপাকড় , পাতায় পাতায় লুকিয়ে বেড়ায় যত পোকামাকড় । ”একদিন সে ফাগুন মাসে মাকে এসে বলল , “ গোধূলিতে মেয়ের আমার বিয়ে হবে কল্য । ” শুনে আমার লাগল ভারি মজা , এই আমাদের ভজা , এরও আবার মেয়ে আছে , তারও হবে বিয়ে , রঙিন চেলির ঘোমটা মাথায় দিয়ে । শুধাই তাকে , “ বিয়ের দিনে খুব বুঝি ধুম হবে ?” ভজু বললে , “ খাঁচার রাজ্যে নইলে কি মান রবে । কেউবা ওরা দাঁড়ের পাখি , পিঁজরেতে কেউ থাকে , নেমন্তন্ন চিঠিগুলো পাঠিবে দেব ডাকে । মোটা মোটা ফড়িঙ দেব , ছাতুর সঙ্গে দই , ছোলা আনব ভিজিয়ে জলে , ছড়িয়ে দেব খই । এমনি হবে ধুম, সাত পাড়াতে চক্ষে কারও রইবে না আর ঘুম। ময়নাগুলোর খুলবে গলা, খাইয়ে দেব লঙ্কা; কাকাতুয়া চীৎকারে তার বাজিয়ে দেবে ডঙ্কা । পায়রা যত ফুলিয়ে গলা লাগাবে বক্‌বকম , শালিকগুলোর চড়া মেজাজ , আওয়াজ নানারকম । আসবে কোকিল , চন্দনাদের শুভাগমন হবে , মন্ত্র শুনতে পাবে না কেউ পাখির কলরবে । ডাকবে যখন টিয়ে বরকর্তা রবেন বসে কানে আঙুল দিয়ে । ” ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ - যুগান্তর । অসীম নীলিমে লুটে                ধরণী ধাইবে ছুটে ,           প্রতিদিন আসিবে , যাইবে রবিকর ।           প্রতিদিন প্রভাতে জাগিবে নরনারী , প্রতিসন্ধ্যা শ্রান্তদেহে                ফিরিয়া আসিবে গেহে ,            প্রতিরাত্রে তারকা ফুটিবে সারি সারি ।           কত আনন্দের ছবি , কত সুখ আশা আসিবে যাইবে হায় ,               সুখ - স্বপনের প্রায়           কত প্রাণে জাগিবে , মিলাবে ভালোবাসা ।           তখনো ফুটিবে হেসে কুসুম - কানন , তখনো রে কত লোকে             কত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে           আঁকিবে আকাশ - পটে   সুখের স্বপন ।           নিবিলে দিনের আলো , সন্ধ্যা হলে , নিতি বিরহী নদীর ধারে                  না জানি ভাবিবে কারে ,           না - জানি সে কী কাহিনী , কী সুখ , কী স্মৃতি ।                     দূর হতে আসিতেছে , শুন কান পেতে —           কত গান , সেই মহা - রঙ্গভূমি হতে কত যৌবনের হাসি ,               কত উৎসবের বাঁশি ,           তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের স্রোতে ।           কত মিলনের গীত , বিরহের শ্বাস ,           তুলেছে মর্মর তান বসন্ত - বাতাস , সংসারের কোলাহল                ভেদ করি অবিরল           লক্ষ নব কবি ঢালে প্রাণের উচ্ছ্বাস ।              ওই দূর খেলাঘরে খেলাইছ কারা !           উঠেছে মাথার'পরে আমাদেরি তারা । আমাদেরি ফুলগুলি                 সেথাও নাচিছে দুলি ,           আমাদেরি পাখিগুলি গেয়ে হল সারা ।           ওই দূর খেলাঘরে করে আনাগোনা           হাসে কাঁদে কত কে যে নাহি যায় গণা । আমাদের পানে হায়               ভুলেও তো নাহি চায় ,           মোদের ওরা তো কেউ ভাই বলিবে না           ওই - সব মধুমুখ অমৃত - সদন ,           না জানি রে আর কারা করিবে চুম্বন । শরমময়ীর পাশে                    বিজড়িত আধ - ভাষে           আমরা তো শুনাব না প্রাণের বেদন ।           আমাদের খেলাঘরে কারা খেলাইছ ! সাঙ্গ না হইতে খেলা               চলে এনু সন্ধেবেলা ,           ধূলির সে ঘর ভেঙে কোথা ফেলাইছ ।           হোথা , যেথা বসিতাম মোরা দুই জন ,           হাসিয়া কাঁদিয়া হত মধুর মিলন , মাটিতে কাটিয়া রেখা              কত লিখিতাম লেখা ,           কে তোরা মুছিলি সেই সাধের লিখন ।           সুধাময়ী মেয়েটি সে হোথায় লুটিত ,           চুমো খেলে হাসিটুকু ফুটিয়া উঠিত । তাই রে মাধবীলতা                 মাথা তুলেছিল হোথা ,           ভেবেছিনু চিরদিন রবে মুকুলিত ।           কোথায় রে , কে তাহারে করিলি দলিত ।                      ওই যে শুকানো ফুল ছুঁড়ে ফেলে দিলে           উহার মরম - কথা বুঝিতে নারিলে । ও যেদিন ফুটেছিল                নব রবি উঠেছিল ,           কানন মাতিয়াছিল বসন্ত - অনিলে ।           ওই যে শুকায় চাঁপা পড়ে একাকিনী ,            তোমরা তো জানিবে না উহার কাহিনী । কবে কোন্ সন্ধেবেলা    ওরে তুলেছিল বালা           ওরি মাঝে বাজে কোন্ পূরবীরাগিণী ।           যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার           কোথায় সে গেছে চলে , সে তো নেই আর । একটু কুসুমকণা                    তাও নিতে পারিল না ,            ফেলে রেখে যেতে হল মরণের পার ; কত সুখ , কত ব্যথা ,               সুখের দুখের কথা           মিশিছে ধূলির সাথে ফুলের মাঝার ।                     মিছে শোক , মিছে এই বিলাপ কাতর ,           সম্মুখে রয়েছে পড়ে যুগ - যুগান্তর । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) ভয় নেই আমি আজ রান্নাটা দেখছি ভয় নেই, আমি আজ রান্নাটা দেখছি। চালে জলে মেপে, নিধু, চড়িয়ে দে ডেকচি। আমি গণি কলাপাতা, তুমি এসো নিয়ে হাতা, যদি দেখ, মেজবউ, কোনোখানে ঠেকছি। রুটি মেখে বেলে দিয়ো, উনুনটা জ্বেলে দিয়ো, মহেশকে সাথে নিয়ে আমি নয় সেঁকছি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভয়ের দুরাশা জননী জননী ব’লে ডাকি তোরে ত্রাসে, যদি জননীর স্নেহ মনে তোর আসে শুনি আর্তস্বর। যদি ব্যাঘ্রিনীর মতো অকস্মাৎ ভুলে গিয়ে হিংসা লোভ যত মানবপুত্রেরে কর স্নেহের লেহন। নখর লুকায়ে ফেলি পরিপূর্ণ স্তন যদি দাও মুখে তুলি, চিত্রাঙ্কিত বুকে যদি ঘুমাইতে দাও মাথা রাখি সুখে। এমনি দুরাশা! আছ তুমি লক্ষ কোটি গ্রহতারা চন্দ্রসূর্য গগনে প্রকটি হে মহামহিম! তুলি তব বজ্রমুঠি তুমি যদি ধর আজি বিকট ভ্রূকুটি, আমি ক্ষীণ ক্ষুদ্রপ্রাণ কোথা পড়ে আছি, মা বলিয়া ভুলাইব তোমারে পিশাচী!    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) ভাগ্যরাজ্য আমার এ ভাগ্যরাজ্যে পুরানো কালের যে প্রদেশ,           আয়ুহারাদের ভগ্নশেষ                সেথা পড়ে আছে                    পূর্বদিগন্তের কাছে। নিঃশেষ করেছে মূল্য সংসারের হাটে,           অনাবশ্যকের ভাঙা ঘাটে                জীর্ণ দিন কাটাইছে তারা                    অর্থহারা। ভগ্ন গৃহে লগ্ন ঐ অর্ধেক প্রাচীর;           আশাহীন পূর্ব আসক্তির                    কাঙাল শিকড়জাল বৃথা আঁকড়িয়া ধরে প্রাণপণে বর্তমান কাল।           আকাশে তাকায় শিলালেখ,                     তাহার প্রত্যেক           অস্পষ্ট অক্ষর আজ পাশের অক্ষরে                     ক্লান্ত সুরে প্রশ্ন করে,           "আরো কি রয়েছে বাকি কোনো কথা,           শেষ হয়ে যায় নি বারতা।" এ আমার ভাগ্যরাজ্যে অন্যত্র হোথায় দিগন্তরে           অসংলগ্ন ভিত্তি-'পরে                    করে আছে চুপ      অসমাপ্ত আকাঙক্ষার অসম্পূর্ণ রূপ।           অকথিত বাণীর ইঙ্গিতে                    চারিভিতে           নীরবতা-উৎকণ্ঠিত মুখ                    রয়েছে উৎসুক। একদা যে যাত্রীদের সংকল্পে ঘটেছে অপঘাত,           অন্য পথে গেছে অকস্মাৎ,                    তাদের চকিত আশা,           স্থকিত চলার স্তব্ধ ভাষা                     জানায়, হয় নি চলা সারা-- দুরাশার দূরতীর্থ আজো নিত্য করিছে ইশারা।           আজিও কালের সভা-মাঝে                    তাদের প্রথম সাজে              পড়ে নাই জীর্ণতার দাগ, লক্ষ্যচ্যুত কামনায় রয়েছে আদিম রক্তরাগ।           কিছু শেষ করা হয় নাই,                    হেরো, তাই           সময় যে পেল না নবীন                    কোনোদিন                পুরাতন হতে-- শৈবালে ঢাকে নি তারে বাঁধা-পড়া ঘাটে-লাগা স্রোতে;           স্মৃতির বেদনা কিছু, কিছু পরিতাপ,                    কিছু অপ্রাপ্তির অভিশাপ                তারে নিত্য রেখেছে উজ্জ্বল; না দেয় নীরস হতে মজ্জাগত গুপ্ত অশ্রুজল।                    যাত্রাপথ-পাশে           আছ তুমি আধো-ঢাকা ঘাসে-- পাথরে খুদিতেছিনু, হে মূর্তি, তোমারে কোন্‌ ক্ষণে                    কিসের কল্পনে।       অপূর্ণ তোমার কাছে পা না উত্তর।           মনে যে কী ছিল মোর যেদিন ফুটিত তাহা শিল্পের সম্পূর্ণ সাধনাতে                    শেষ-রেখাপাতে,           সেদিন তা জানিতাম আমি;                তার আগে চেষ্টা গেছে থামি।                    সেই শেষ না-জানার           নিত্য নিরুত্তরখানি মর্ম-মাঝে রয়েছে আমার;                    স্বপ্নে তার প্রতিবিম্ব ফেলি সচকিত আলোকের কটাক্ষে সে করিতেছে কেলি। ভার টুনটুনি কহিলেন, রে ময়ূর, তোকে দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে। ময়ূর কহিল, বটে! কেন, কহ শুনি, ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি টুনটুনি কহে, এ যে দেখিতে বেআড়া, দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারে বাড়া। আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত, তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত। ময়ূর কহিল, শোক করিয়ো না মিছে, জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ভারতসমুদ্র তার বাষ্পোচ্ছ্বাস নিশ্বসে গগনে ভারতসমুদ্র তার বাষ্পোচ্ছ্বাস নিশ্বসে গগনে আলোক করিয়া পান, উদাস দক্ষিণসমীরণে অনির্বচনীয় যেন আনন্দের অব্যক্ত আবেগ। উর্ধ্ববাহু হিমাচল, তুমি সেই উদ্বাহিত মেঘ শিখরে শিখরে তব ছায়াচ্ছন্ন গুহায় গুহায় রাখিছ নিরুদ্ধ করি– পুনর্বার উন্মুক্ত ধারায় নূতন আনন্দস্রোতে নব প্রাণে ফিরাইয়া দিতে অসীমজিজ্ঞাসারত সেই মহাসমুদ্রের চিতে। সেইমতো ভারতের হৃদয়সমুদ্র এতকাল করিয়াছে উচ্চারণ ঊর্ধ্ব-পানে যে বাণী বিশাল, অনন্তের জ্যোতিস্পর্শে অনন্তেরে যা দিয়েছে ফিরে, রেখেছ সঞ্চয় করি হে হিমাদ্রি, তুমি স্তব্ধশিরে। তব মৌন শৃঙ্গ-মাঝে তাই আমি ফিরি অন্বেষণে ভারতের পরিচয় শান্ত-শিব-অদ্বৈতের সনে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ভারতী শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়           তোমার ও বীণা নীরব কেন? কবির বিজন মরমে লুকায়ে           নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন? অযতনে, আহা, সাধের বীণাটি           ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে, অযতনে, আহা, এলোথেলো চুল           এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে। কেন গো আজিকে এ-ভাব তোমার           কমলবাসিনী ভারতী রানী-- মলিন মলিন বসন ভূষণ           মলিন বদনে নাহিকো বাণী। তবে কি জননি অমৃতভাষিণি           তোমার ও বীণা নীরব হবে? ভারতের এই গগন ভরিয়া           ও বীণা আর না বাজিবে তবে? দেখো তবে মাতা দেখো গো চাহিয়া           তোমার ভারত শ্মশান-পারা, ঘুমায়ে দেখিছে সুখের স্বপন           নরনারী সব চেতনহারা। যাহা-কিছু ছিল সকলি গিয়াছে,           সে-দিনের আর কিছুই নাই, বিশাল ভারত গভীর নীরব,           গভীর আঁধার যে-দিকে চাই। তোমারো কি বীণা ভারতি জননী,           তোমারো কি বীণা নীরব হবে? ভারতের এই গগন ভরিয়া           ও-বীণা আর না বাজিবে তবে? না না গো, ভারতী, নিবেদি চরণে           কোলে তুলে লও মোহিনী বীণা। বিলাপের ধ্বনি উঠাও জননি,           দেখিব ভারত জাগিবে কি না। অযুত অযুত ভারতনিবাসী           কাঁদিয়া উঠিবে দারুণ শোকে, সে রোদনধ্বনি পৃথিবী ভরিয়া           উঠিবে, জননি, দেবতালোকে। তা যদি না হয় তা হলে, ভারতি,           তুলিয়া লও বিজয়ভেরী, বাজাও জলদগভীর গরজে           অসীম আকাশ ধ্বনিত করি। গাও গো হুতাশ-পূরিত গান,           জ্বলিয়া উঠুক অযুত প্রাণ, উথলি উঠুক ভারত-জলধি--           কাঁপিয়া উঠুক অচলা ধরা। দেখিব তখন প্রতিভাহীনা           এ ভারতভূমি জাগিবে কি না, ঢাকিয়া বয়ান আছে যে শয়ান           শরমে হইয়া মরমে-মরা! এই ভারতের আসনে বসিয়া           তুমিই ভারতী গেয়েছ গান, ছেয়েছে ধরার আঁধার গগন           তোমারি বীণার মোহন তান। আজও তুমি, মাতা, বীণাটি লইয়া           মরম বিঁধিয়া গাও গো গান-- হীনবল সেও হইবে সবল,           মৃতদেহ সেও পাইবে প্রাণ। ভারতের কোন্‌ বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি ভারতের কোন্‌ বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আচার্য জগদীশ। কী অদৃশ্য তপোভূমি বিরচিলে এ পাষাণনগরীর শুষ্ক ধূলিতলে। কোথা পেলে সেই শান্তি এ উন্মত্ত জনকোলাহলে যার তলে মগ্ন হয়ে মুহূর্তে বিশ্বের কেন্দ্র-মাঝে দাঁড়াইলে একা তুমি– এক যেথা একাকী বিরাজে সূর্যচন্দ্র পুষ্পপত্র-পশুপক্ষী-ধুলায়-প্রস্তরে– এক তন্দ্রাহীন প্রাণ নিত্য যেথা নিজ অঙ্ক-‘পরে দুলাইছে চরাচর নিঃশব্দ সংগীতে। মোরা যবে মত্ত ছিনু অতীতের অতিদূর নিষ্ফল গৌরবে– পরবস্ত্রে, পরবাক্যে, পরভঙ্গিমার ব্যঙ্গরূপে কল্লোল করিতেছিনু স্ফীতকন্ঠে ক্ষুদ্র অন্ধকূপে– তুমি ছিলে কোন্‌ দূরে। আপনার স্তব্ধ ধ্যানাসন কোথায় পাতিয়াছিলে। সংযত গম্ভীর করি মন ছিলে রত তপস্যায় অরূপরশ্মির অন্বেষণে লোকলোকান্তের অন্তরালে — যেথা পূর্ব ঋষিগণে বহুত্বের সিংহদ্বার উদ্‌ঘাটিয়া একের সাক্ষাতে দাঁড়াতেন বাক্যহীন স্তম্ভিত বিস্মিত জোড়হাতে। হে তপস্বী, ডাকো তুমি সামমন্ত্রে জলদগর্জনে, “উত্তিষ্ঠত নিবোধত!’ ডাকো শাস্ত্র-অভিমানী জনে পাণ্ডিত্যের পণ্ডতর্ক হতে। সুবৃহৎ বিশ্বতলে ডাকো মূঢ় দাম্ভিকেরে। ডাক দাও তব শিষ্যদলে, একত্রে দাঁড়াক তারা তব হোমহুতাগ্নি ঘিরিয়া। আরবার এ ভারত আপনাতে আসুক ফিরিয়া নিষ্ঠায়, শ্রদ্ধায়, ধ্যানে– বসুক সে অপ্রমত্তচিতে লোভহীন দ্বন্দ্বহীন শুদ্ধ শান্ত গুরুর বেদীতে  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ভালো মন্দ জাল কহে, পঙ্ক আমি উঠাব না আর। জেলে কহে, মাছ তবে পাওয়া হবে ভার।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ভালোবাসা এসেছিল একদিন তরুণ বয়সে ভালোবাসা এসেছিল একদিন তরুণ বয়সে নির্ঝরের প্রলাপকল্লোলে, অজানা শিখর হতে সহসা বিস্ময় বহি আনি ভ্রূভঙ্গিত পাষাণের নিশ্চল নির্দেশ লঙ্ঘিয়া উচ্ছল পরিহাসে, বাতাসেরে করি ধৈর্যহারা, পরিচয়ধারা-মাঝে তরঙ্গিয়া অপরিচয়ের অভাবিত রহস্যের ভাষা, চারি দিকে স্থির যাহা পরিমিত নিত্য প্রত্যাশিত তারি মধ্যে মুক্ত করি ধাবমান বিদ্রোহের ধারা।আজ সেই ভালোবাসা স্নিগ্ধ সান্ত্বনার স্তব্ধতায় রয়েছে নিঃশব্দ হয়ে প্রচ্ছন্ন গভীরে। চারি দিকে নিখিলের বৃহৎ শান্তিতে মিলেছে সে সহজ মিলনে, তপস্বিনী রজনীর তারার আলোয় তার আলো, পূজারত অরণ্যের পুষ্প অর্ঘ্যে তাহার মাধুরী।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে তেমনি যে তোমা-পানে নাহি চায় গ্রীস্‌ তাহার হৃদয় মন পাষাণ কুলিশ ইংরাজেরা ভাঙিয়াছে প্রাচীর তোমার দেবতাপ্রতিমা লয়ে গেছে [সিন্ধুপার] এ দেখে কার না হবে হবে ॥। ধূমকেতু সম তারা কী কুক্ষণে হায় ছাড়িয়া সে ক্ষুদ্র দ্বীপ আইল হেথায় অসহায় বক্ষ তব রক্তময় করি দেবতা প্রতিমাগুলি লয়ে গেল হরি।George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা) ভাষা ও ছন্দ যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়, মহানদ ব্রহ্মপুত্র অকস্মাৎ দুর্দাম দুর্বার দুঃসহ অন্তরবেগে তীরতরু করিয়া উন্মূল মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল তট-অরণ্যের তলে তরঙ্গের ডম্বরু বাজায়ে ক্ষিপ্ত ধূর্জটির প্রায়; সেইমত বনানীর ছায়ে স্বচ্ছ শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে অপূর্ব উদ্‌বেগভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে মহর্ষি বাল্মীকি কবি, রক্তবেগতরঙ্গিত বুকে গম্ভীর জলদমন্দ্রে বারম্বার আবর্তিয়া মুখে নব ছন্দ; বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত মুহূর্তে নিল যে জন্ম পরিপূর্ণ বাণীর সংগীত, তারে লয়ে কী করিবে, ভাবে মুনি কী তার উদ্দেশ --- তরুণগরুড়সম কী মহৎক্ষুধার আবেশ পীড়ন করিছে তারে, কী তাহার দুরন্ত প্রার্থনা, অমর বিহঙ্গশিশু কোন্‌ বিশ্বে করিবে রচনা আপন বিরাট নীড় --- অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার, তার নিত্য জাগরণ ; অগ্নিসম দেবতার দান ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে আহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ। অস্তে গেল দিনমণি। দেবর্ষি নারদ সন্ধ্যাকালে শাখাসুপ্ত পাখিদের সচকিয়া জটারশ্মিজালে, স্বর্গের নন্দনগন্ধে অসময়ে শ্রান্ত মধুকরে বিস্মিত ব্যাকুল করি, উত্তরিলা তপোভূমি-'পরে। নমস্কার করি কবি শুধাইলা সঁপিয়া আসন --- "কী মহৎ দৈবকার্যে, দেব, তব মর্ত্যে আগমন ?" নারদ কহিলা হাসি, "করুণার উৎসমূুখে, মুনি, যে ছন্দ উঠিল ঊর্ধ্বে, ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মা তাহা শুনি আমারে কহিলা ডাকি, 'যাও তুমি তমসার তীরে, বাণীর-বিদ্যুৎ-দীপ্ত ছন্দোবাণ-বিদ্ধ বাল্মীকিরে বারেক শুধায়ে এসো --- বোলো তারে, ওগো ভাগ্যবান্‌, এ মহা সংগীতধন কাহারে করিবে তুমি দান। এই ছন্দে গাঁথি লয়ে কোন্‌ দেবতার যশঃকথা স্বর্গের অমরে কবি মর্ত্যলোকে দিবে অমরতা ?" কহিলেন শির নাড়ি ভাবোন্মত্ত মহামুনিবর, "দেবতার সামগীতি গাহিতেছে বিশ্বচরাচর, ভাষাশূন্য, অর্থহারা। বহ্নি ঊর্ধ্বে মেলিয়া অঙ্গুলি ইঙ্গিতে করিছে স্তব ; সমুদ্র তরঙ্গবাহু তুলি কী কহিছে স্বর্গ জানে ; অরণ্য উঠায়ে লক্ষ শাখা মর্মরিছে মহামন্ত্র ; ঝটিকা উড়ায়ে রুদ্র পাখা গাহিছে গর্জনগান ; নক্ষত্রের অক্ষৌহিণী হতে অরণ্যের পতঙ্গ অবধি, মিলাইছে এক স্রোতে সংগীতের তরঙ্গিণী বৈকুণ্ঠের শান্তিসিন্ধুপারে। মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে, ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে। অবিরত রাত্রিদিন মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ। পরিস্ফুট তত্ত্ব তার সীমা দেয় ভাবের চরণে ; ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্ধ্বমুখে অনন্ত গগনে উড়িতে সে নাহি পারে সংগীতের মতন স্বাধীন মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন। প্রভাতের শুভ্র ভাষা বাক্যহীন প্রত্যক্ষ কিরণ জগতের মর্মদ্বার মুহূর্তেকে করি উদ্‌ঘাটন। নির্বারিত করি দেয় ত্রিলোকের গীতের ভাণ্ডার ; যামিনীর শান্তিবাণী ক্ষণমাত্রে অনন্ত সংসার আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, বাক্যহীন পরম নিষেধ বিশ্বকর্মা-কোলাহল মন্ত্রবলে করি দিয়া ভেদ নিমেষে নিবায়ে দেয় সর্ব খেদ সকল প্রয়াস, জীবলোক-মাঝে আনে মরণের বিপুল আভাস ; নক্ষত্রের ধ্রুব ভাষা অনির্বাণ অনলের কণা জ্যোতিষ্কের সূচীপত্রে আপনার করিছে সূচনা নিত্যকাল মহাকাশে ; দক্ষিণের সমীরের ভাষা কেবল নিশ্বাসমাত্রে নিকুঞ্জে জাগায় নব আশা, দুর্গম পল্লবদুর্গে অরণ্যের ঘন অন্তঃপুরে নিমেষে প্রবেশ করে, নিয়ে যায় দূর হতে দূরে যৌবনের জয়গান-- সেইমত প্রত্যক্ষ প্রকাশ কোথা মানবের বাক্যে, কোথা সেই অনন্ত আভাস, কোথা সেই অর্থভেদী অভ্রভেদী সংগীত-উচ্ছ্বাস, আত্মবিদারণকারী মর্মান্তিক মহান নিঃশ্বাস ? মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর, অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর ভাবের স্বাধীন লোকে, পক্ষবান্‌ অশ্বরাজ-সম উদ্দাম-সুন্দর-গতি --- সে আশ্বাসে ভাসে চিত্ত মম। সূর্যেরে বহিয়া যথা ধায় বেগে দিব্য অগ্নিতরী মহাব্যোমনীলসিন্ধু প্রতিদিন পারাপার করি, ছন্দ সেই অগ্নিসম বাক্যেরে করিব সমর্পণ --- যাবে চলি মর্ত্যসীমা অবাধে করিয়া সন্তরণ, গুরুভার পৃথিবীরে টানিয়া লইবে ঊর্ধ্বপানে, কথারে ভাবের স্বর্গে, মানবেরে দেবপীঠস্থানে। মহাম্বুধি যেইমত ধ্বনিহীন স্তব্ধ ধরণীরে বাঁধিয়াছে চতুর্দিকে অন্তহীন নৃত্যগীতে ঘিরে তেমনি আমার ছন্দ ভাষারে ঘেরিয়া আলিঙ্গনে গাবে যুগে যুগান্তরে সরল গম্ভীর কলস্বনে দিক হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান, ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্যাদা করি দান। হে দেবর্ষি, দেবদূত, নিবেদিয়ো পিতামহ-পায়ে স্বর্গ হতে যাহা এল স্বর্গে তাহা নিয়ো না ফিরায়ে। দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে, তুলিব দেবতা করি মানুষেরে মোর ছন্দে গানে। ভগবন্‌, ত্রিভুবন তোমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজে --- কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে। কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম, কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো, মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয় নি নত, সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক, কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক, কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম-- কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।" নারদ কহিলা ধীরে, "অযোধ্যায় রঘুপতি রাম।" "জানি আমি জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা" --- কহিলা বাল্মীকি, "তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা, সকল ঘটনা তাঁর-- ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে। পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।" নারদ কহিলা হাসি, "সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।" এত বলি দেবদূত মিলাইল দিব্য স্বপ্ন হেন সুদূর সপ্তর্ষিলোকে। বাল্মীকি বসিলা ধ্যানাসনে, তমসা রহিল মৌন, স্তব্ধতা জাগিল তপোবনে।===== ০০০০০ =====রচনাকাল : ৯ কার্তিক, ১৩০৪ ( ৩৬ বছর বয়েসে ) । কাব্যগ্রন্থ : 'কথা ও কাহিনী' ( 'কাহিনী' অংশে ) । ভিক্ষা ও উপার্জন বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা, কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা। দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস— কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস। বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি? শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী, আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে, তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) ভিতরে ও বাহিরে খোকা থাকে জগৎ-মায়ের      অন্তঃপুরে— তাই সে শোনে কত যে গান      কতই সুরে। নানান রঙে রাঙিয়ে দিয়ে      আকাশ পাতাল মা রচেছেন খোকার খেলা-      ঘরের চাতাল। তিনি হাসেন, যখন তরু-      লতার দলে খোকার কাছে পাতা নেড়ে      প্রলাপ বলে। সকল নিয়ম উড়িয়ে দিয়ে      সূর্য শশী খোকার সাথে হাসে, যেন      এক-বয়সী। সত্যবুড়ো নানা রঙের      মুখোশ পরে শিশুর সনে শিশুর মতো      গল্প করে। চরাচরের সকল কর্ম      করে হেলা মা যে আসেন খোকার সঙ্গে      করতে খেলা। খোকার জন্যে করেন সৃষ্টি      যা ইচ্ছে তাই— কোনো নিয়ম কোনো বাধা-      বিপত্তি নাই। বোবাদেরও কথা বলান      খোকার কানে, অসাড়কেও জাগিয়ে তোলেন      চেতন প্রাণে। খোকার তরে গল্প রচে      বর্ষা শরৎ, খেলার গৃহ হয়ে ওঠে      বিশ্বজগৎ। খোকা তারি মাঝখানেতে      বেড়ায় ঘুরে, খোকা থাকে জগৎ-মায়ের      অন্তঃপুরে।    আমরা থাকি জগৎ-পিতার      বিদ্যালয়ে— উঠেছে ঘর পাথর-গাঁথা      দেয়াল লয়ে।   জ্যোতিষশাস্ত্র-মতে চলে      সূর্য শশী, নিয়ম থাকে বাগিয়ে ল'য়ে     রশারশি। এম্‌নি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে      বৃক্ষ লতা, যেন তারা বোঝেই নাকো      কোনোই কথা। চাঁপার ডালে চাঁপা ফোটে      এম্‌নি ভানে যেন তারা সাত ভায়েরে      কেউ না জানে। মেঘেরা চায় এম্‌নিতরো      অবোধ ভাবে, যেন তারা জানেই নাকো      কোথায় যাবে। ভাঙা পুতুল গড়ায় ভুঁয়ে      সকল বেলা, যেন তারা কেবল শুধু      মাটির ঢেলা। দিঘি থাকে নীরব হয়ে      দিবারাত্র, নাগকন্যের কথা যেন      গল্পমাত্র। সুখদুঃখ এম্‌নি বুকে      চেপে রহে, যেন তারা কিছুমাত্র      গল্প নহে। যেমন আছে তেম্‌নি থাকে      যে যাহা তাই— আর যে কিছু হবে এমন      ক্ষমতা নাই। বিশ্বগুরু-মশায় থাকেন      কঠিন হয়ে, আমরা থাকি জগৎ-পিতার      বিদ্যালয়ে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ভীরু কেন এ কম্পিত প্রেম, অয়ি ভীরু, এনেছ সংসারে--                    ব্যর্থ করি রাখিবে কি তারে।             আলোকশঙ্কিত তব হিয়া             প্রচ্ছন্ন নিভৃত পথ দিয়া                    থেমে যায় প্রাঙ্গণের দ্বারে।হায়, সে যে পায় নাই আপন নিশ্চিত পরিচয়,                    বন্দী তারে রেখেছে সংশয়।             বাহিরে সামান্য বাধা সেও             সে-প্রেমেরে কেন করে হেয়,                       অন্তরেও তার পরাজয়।ওই শোনো কেঁপে ওঠে নিশীথরাত্রির অন্ধকার,                       আহ্বান আসিছে বারম্বার।             থেকো না ভয়ের অন্ধ ঘেরে,             অবজ্ঞা করিয়ো দুর্গমেরে,                    জিনি লহো সত্যেরে তোমার।নিষ্ঠুরকে মেনে লহো সুদুঃসহ দুঃখের উৎসাহে,                    প্রেমের গৌরব জেনো তাহে।             দীপ্তি দেয় রুদ্ধ অশ্রুজল,             নষ্ট আশা হয় না নিষ্ফল,                       সমুজ্জল করে চিত্তদাহে।শীর্ণ ফুল রৌদ্রে পুড়ে কালো হয়, হোক-না সে কালো--                       দীন দীপে নিবুক-না আলো।             দুর্বল যে মিথ্যার খাঁচায়             নিত্যকাল কে তারে বাঁচায়,                   মরে যাহা মরা তার ভালো।আঘাত বাঁচাতে গিয়ে বঞ্চিত হবে কি এ-জীবন,                   শুধিবে না দুর্মূল্যের পণ।             প্রেম সে কি কৃপণতা জানে,             আত্মরক্ষা করে আত্মদানে--                   ত্যাগবীর্যে লভে মুক্তিধন। ভীরুতা গভীর সুরে গভীর কথা     শুনিয়ে দিতে তোরে            সাহস নাহি পাই।মনে মনে হাসবি কিনা     বুঝব কেমন করে?            আপনি হেসে তাই            শুনিয়ে দিয়ে যাই--ঠাট্টা করে ওড়াই সখী,            নিজের কথাটাই।হাল্কা তুমি কর পাছে            হাল্কা করি ভাই,            আপন ব্যথাটাই। সত্য কথা সরলভাবে     শুনিয়ে দিতে তোরে            সাহস নাহি পাই।অবিশ্বাসে হাসবি কিনা     বুঝব কেমন করে?            মিথ্যা ছলে তাই            শুনিয়ে দিয়ে যাই,উল্টা করে বলি আমি            সহজ কথাটাই।ব্যর্থ তুমি কর পাছে            ব্যর্থ করি ভাই,            আপন ব্যথাটাই। সোহাগ-ভরা প্রাণের কথা     শুনিয়ে দিতে তোরে            সাহস নাহি পাই।সোহাগ ফিরে পাব কিনা     বুঝব কেমন করে?            কঠিন কথা তাই            শুনিয়ে দিয়ে যাই,গর্বছলে দীর্ঘ করি            নিজের কথাটাই।ব্যথা পাছে না পাও তুমি            লুকিয়ে রাখি তাই            নিজের ব্যথাটাই। ইচ্ছা করে নীরব হয়ে     রহিব তোর কাছে,            সাহস নাহি পাই।মুখের 'পরে বুকের কথা     উথ্‌লে ওঠে পাছে            অনেক কথা তাই            শুনিয়ে দিয়ে যাই,কথার আড়ে আড়াল থাকে           মনের কথাটাই।তোমায় ব্যথা লাগিয়ে শুধু            জাগিয়ে তুলি ভাই            আপন ব্যথাটাই। ইচ্ছা করি সুদূরে যাই,     না আসি তোর কাছে।            সাহস নাহি পাই।তোমার কাছে ভীরুতা মোর     প্রকাশ হয় রে পাছে            কেবল এসে তাই            দেখা দিয়েই যাই,স্পর্ধাতলে গোপন করি            মনের কথাটাই।নিত্য তব নেত্রপাতে            জ্বালিয়ে রাখি ভাই,            আপন ব্যথাটাই। ভুজ-পাশ-বদ্ধ অ্যান্টনি এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে! একটি ভুজঙ্গ-ভুজে আমারে জড়ায়ে আছে; আরেকটি শ্যাম-বাহু, শতেক মুকুতা ঝুলে, সোনার মদিরা পাত্র আকাশে রয়েছে তুলে। অলকের মেঘ মাঝে জ্বলিতেছে মুখখানি, রূপের মদিরা পিয়া আবেশে অবশ হিয়া, পড়েছে মাতাল হয়ে, কখন্‌ কিছু না জানি! রাখিয়া বক্ষের পরে অবশ চিবুক মোর, হাসিতেছি তার পানে, হৃদয়ে আঁধার ঘোর! বাতায়ন-যবনিকা, বাতাস, সরায়ে ধীরে বীজন করিছে আসি এ মোর তাপিত শিরে। সম্মুখেতে দেখা যায় পীতবর্ণ বালুকায় অস্তগামী রবিকর আদূর “নীলের’ তীরে। চেয়ে আছি, দেখিতেছি, নদীর সুদূর পারে, (কী জানি কিসের দুখ!) পশ্চিম দিকের মুখ বিষণ্ণ হইয়া আসে সন্ধ্যার আঁধার ভারে। প্রদোষ তারার মুখে হাসি আসি উঁকি মারে! রোমীয় স্বপন এক জাগিছে সম্মুখে মোর, ঘুরিছে মাথার মাঝে, মাথায় লেগেছে ঘোর। রোমীয় সমর-অস্ত্র ঝঞ্ঝনিয়া উঠে বাজি, বিস্ফারিত নাসা চাহে রণ-ধূম পিতে আজি। কিন্তু হায়! অমনি সে মুখ্‌ পানে হেসে চায়, কী জানি কী হয় মতি, হীন প্রমোদের প্রতি। বীরের ভ্রূকুটিগুলি তখনি মিলায়ে যায়! গরবিত, শূন্য হিয়া, জর্জর আবেশ-বাণে, যে প্রমোদ ঘৃণা করি হেসে চাই তারি পানে। অনাহূত হর্ষ এক জাগ্রতে স্বপনে আসি, শৌর্যের সমাধি-পরে ঢালে রবি-কর রাশি! কতবার ঘৃণি তারে! রমণী সে অবহেলে পৌরুষ নিতেছে কাড়ি বিলাসের জালে ফেলে! কিন্তু সে অধর হতে অমনি অজস্র স্রোতে ঝরে পড়ে মৃদু হাসি, চুম্বন অমৃত-মাখা আমারে করিয়া তুলে, ভাঙাঘর ফুলে ঢাকা। বীরত্বের মুখ খানি একবার মনে আনি, তার পরে ওই মুখে ফিরাই নয়ন মম, ওই মুখ! একখানি উজ্জ্বল কলঙ্ক সম! ওই তার শ্যাম বাহু আমারে ধরেছে হায়! অঙ্গুলির মৃদু স্পর্শে বল মোর চলে যায়! মুখ ফিরাইয়া লই– রমণী যেমনি ধীরি মৃদু কণ্ঠে মৃদু কহে, অমনি আবার ফিরি। রোমের আঁধার মেঘ দেখে যেই মুখ-‘পরে, অমনি দু বাহু দিয়ে কণ্ঠ জড়াইয়া ধরে, বরষে নয়নবারি আমার বুকের মাঝ, চুমিয়া সে অশ্রুবারি শুকানো বীরের কাজ। তার পরে ত্যজি মোরে চরণ পড়িছে টলে, থর থর কেঁপে বলে–“যাও, যাও, যাও চলে!’ ঢুলু ঢুলু আঁখিপাতা পুরে অশ্রু-মুকুতায়, শ্যামল সৌন্দর্য তার হিম-শ্বেত হয়ে যায়! জীবনের লক্ষ্য, আশা, ইচ্ছা, হারাইয়া ফেলি, চেয়ে দেখি তার পানে কাতর নয়ন মেলি। আবার ফিরাই মুখ, কটাক্ষেতে চেয়ে রই, কল&ড়বঁ;ঙ্ক প্রমোদে মাতি তাহারে টানিয়া লই! আরেকটি বার রোম, হইব সন্তান তোর একটি বাসনা এই বন্দী এ হৃদয়ে মোর। গৌরবে সম্মানে মরি এই এক আছে আশ, চাহি না করিতে ব্যয় চুম্বনে অন্তিম শ্বাস! বুঝি হায় সে আশাও পুরিবে না কোনো কালে রোমীয় মৃত্যুও বুঝি ঘটিবে না এ কপালে! রোমীয় সমাধি চাই তাও বুঝি ভাগ্যে নাই, ওই বুকে মরে যাব, বুঝি মরণের কালে!Robert Buchanan (অনুবাদ কবিতা) ভুত হয়ে দেখা দিল ভুত হয়ে দেখা দিল বড়ো কোলাব্যাঙ, এক পা টেবিলে রাখে, কাঁধে এক ঠ্যাঙ। বনমালী খুড়ো বলে, — “করো মোরে রক্ষে, শীতল দেহটি তব বুলিয়ো না বক্ষে।’ উত্তর দেয় না সে, দেয় শুধু “ক্যাঙ’।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভূমিকম্প হায় ধরিত্রী, তোমার আঁধার পাতালদেশে অন্ধ রিপু লুকিয়েছিল ছদ্মবেশে--           সোনার পুঞ্জ যেথায় রাখ,           আঁচলতলে যেথায় ঢাক      কঠিন লৌহ, মৃত্যুদূতের চরণধূলির                    পিণ্ড তারা, খেলা জোগায়                              যমালয়ের ডাণ্ডাগুলির। উপর তলায় হাওয়ার দোলায় নবীন ধানে ধানশ্রীসুর মূর্ছনা দেয় সবুজ গানে।           দুঃখে সুখে স্নেহে প্রেমে           স্বর্গ আসে মর্তে নেমে, ঋতুর ডালি ফুল-ফসলের অর্ঘ্য বিলায়,                    ওড়না রাঙে ধূপছায়াতে                              প্রাণনটিনীর নৃত্যলীলায়। অন্তরে তোর গুপ্ত যে পাপ রাখলি চেপে তার ঢাকা আজ স্তরে স্তরে উঠল কেঁপে।           যে বিশ্বাসের আবাসখানি           ধ্রুব ব'লেই সবাই জানি      এক নিমেষে মিশিয়ে দিলি ধূলির সাথে,                    প্রাণের দারুণ অবমানন                              ঘটিয়ে দিলি জড়ের হাতে। বিপুল প্রতাপ থাক্‌-না যতই বাহির দিকে কেবল সেটা স্পর্ধাবলে রয় না টিঁকে।           দুর্বলতা কুটিল হেসে           ফাটল ধরায় তলায় এসে--       হঠাৎ কখন দিগ্‌ব্যাপিনী কীর্তি যত                    দর্পহারীর অট্টহাস্যে                              যায় মিলিয়ে স্বপ্নমতো। হে ধরণী, এই ইতিহাস সহস্রবার যুগে যুগে উদঘাটিলে সামনে সবার।           জাগল দম্ভ বিরাট রূপে,           মজ্জায় তার চুপে চুপে      লাগল রিপুর অলক্ষ্য বিষ সর্বনাশা--                     রূপক নাট্যে ব্যাখ্যা তারি                              দিয়েছ আজ ভীষণ ভাষায়। যে যথার্থ শক্তি সে তো শান্তিময়ী, সৌম্য তাহার কল্যাণরূপ বিশ্বজয়ী।           অশক্তি তার আসন পেতে           ছিল তোমার অন্তরেতে--      সেই তো ভীষণ, নিষ্ঠুর তার বীভৎসতা,                    নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠাহীন                              তাই সে এমন হিংসারতা। ভূমিকা স্মৃতিরে আকার দিয়ে আঁকা , বোধে যার চিহ্ন পড়ে ভাষায় কুড়ায়ে তারে রাখা ,                     কী অর্থ ইহার মনে ভাবি ।                                   এই দাবি                        জীবনের এ ছেলেমানুষি ,       মরণেরে বঞ্চিবার ভান ক ' রে খুশি ,                  বাঁচা-মরা খেলাটাতে জিতিবার শখ ,        তাই মন্ত্র প ' ড়ে আনে কল্পনার বিচিত্র কুহক ।                  কালস্রোতে বস্তুমূর্তি ভেঙে ভেঙে পড়ে , আপন দ্বিতীয় রূপ প্রাণ তাই ছায়া দিয়ে গড়ে ।                  “ রহিল ” বলিয়া যায় অদৃশ্যের পানে ; মৃত্যু যদি করে তার প্রতিবাদ , নাহি আসে কানে ।                  আমি বদ্ধ ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের জালে , আমার আপন-রচা কল্পরূপ ব্যাপ্ত দেশে কালে ,                   এ কথা বিলয়দিনে নিজে নাই জানি আর কেহ যদি জানে তাহারেই বাঁচা ব'লে মানি । ভূমিকা (খাপছাড়া) ডুগডুগিটা বাজিয়ে দিয়ে ধুলোয় আসর সাজিয়ে দিয়ে পথের ধারে বসল জাদুকর। এল উপেন, এল রূপেন, দেখতে এল নৃপেন, ভূপেন, গোঁদলপাড়ার এল মাধু কর। দাড়িওয়ালা বুড়ো লোকটা, কিসের-নেশায়-পাওয়া চোখটা, চারদিকে তার জুটল অনেক ছেলে। যা-তা মন্ত্র আউড়ে, শেষে একটুখানি মুচকে হেসে ঘাসের ‘পরে চাদর দিল মেলে। উঠিয়ে নিল কাপড়টা যেই দেখা দিল ধুলোর মাঝেই দুটো বেগুন, একটা চড়ুইছানা, জামের আঁঠি, ছেঁড়া ঘুড়ি, একটিমাত্র গালার চুড়ি, ধুঁইয়ে-ওঠা ধুনুচি একখানা, টুকরো বাসন চিনেমাটির, মুড়ো ঝাঁটা খড়কেকাঠির, নলছে-ভাঙা হুঁকো, পোড়া কাঠটা– ঠিকানা নেই আগুপিছুর, কিছুর সঙ্গে যোগ না কিছুর, ক্ষণকালের ভোজবাজির এই ঠাট্টা।শান্তিনিকেতন, ১৬ পৌষ, ১৩৪৩ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভূমিকা (শিশু) জগৎ - পারাবারের তীরে                 ছেলেরা করে মেলা ।            অন্তহীন গগনতল            মাথার ‘পরে অচঞ্চল ,            ফেনিল ওই সুনীল জল                  নাচিছে সারা বেলা ।           উঠিছে তটে কী কোলাহল —                  ছেলেরা করে মেলা ।               বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর ,                   ঝিনুক নিয়ে খেলা ।            বিপুল নীল সলিল -' পরি            ভাসায় তারা খেলার তরী            আপন হাতে হেলায় গড়ি                   পাতায় - গাঁথা ভেলা ।             জগৎ - পারাবারের তীরে                    ছেলেরা করে খেলা ।               জানে না তারা সাঁতার দেওয়া ,                    জানে না জাল ফেলা ।               ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে ,                বণিক ধায় তরণী বেয়ে ,             ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে                       সাজায় বসি ঢেলা ।                রতন ধন খোঁজে না তারা ,                    জানে না জাল ফেলা ।                 ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে ,                      হাসে সাগর - বেলা ।                 ভীষণ ঢেউ শিশুর কানে                 রচিছে গাথা তরল তানে ,                 দোলনা ধরি যেমন গানে                           জননী দেয় ঠেলা ।               সাগর খেলে শিশুর সাথে ,                      হাসে সাগর - বেলা ।                     জগৎ - পারাবারের তীরে                      ছেলেরা করে মেলা ।                    ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে ,                   তরণী ডুবে সুদূর জলে ,                   মরণ - দূত উড়িয়া চলে ,                        ছেলেরা করে খেলা ।                   জগৎ - পারাবারের তীরে                            শিশুর মহামেলা । (শিশু কাব্যগ্রন্থ) ভেসে-যাওয়া ফুল ভেসে-যাওয়া ফুল ধরিতে নারে, ধরিবারই ঢেউ ছুটায় তারে।    (স্ফুলিঙ্গ) ভোতনমোহন স্বপ্ন দেখেন ভোতনমোহন স্বপ্ন দেখেন, চড়েছেন চৌঘুড়ি। মোচার খোলার গাড়িতে তাঁর ব্যাঙ দিয়েছেন জুড়ি। পথ দেখালো মাছরাঙাটায়, দেখল এসে চিংড়িঘাটায়– ঝুম্‌কো ফুলের বোঝাই নিয়ে মোচার খোলা ভাসে। খোকনবাবু বিষম খুশি খিল্‌খিলিয়ে হাসে।উত্তরায়ণ, ৫। ৯। ৩৮ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভোরের আলো-আঁধারে ভোরের আলো-আঁধারে থেকে থেকে উঠছে কোকিলের ডাক যেন ক্ষণে ক্ষণে শব্দের আতশবাজি। ছেঁড়া মেঘ ছড়িয়েছে আকাশে একটু একটু সোনার লিখন নিয়ে। হাটের দিন, মাঠের মাঝখানকার পথে চলেছে গোরুর গাড়ি। কলসীতে নতুন আখের গুড়, চালের বস্তা, গ্রামের মেয়ে কাঁখের ঝুড়িতে নিয়েছে কচুশাক, কাঁচা আম, শজনের ডাঁটা। ছটা বাজল ইস্কুলের ঘড়িতে। ঐ ঘণ্টার শব্দ আর সকাল বেলাকার কাঁচা রোদ্দুরের রঙ মিলে গেছে আমার মনে। আমার ছোটো বাগানের পাঁচিলের গায়ে বসেছি চৌকি টেনে করবীগাছের তলায়। পুবদিক থেকে রোদ্দুরের ছটা বাঁকা ছায়া হানছে ঘাসের 'পরে। বাতাসে অস্থির দোলা লেগেছে পাশাপাশি দুটি নারকেলের শাখায়। মনে হচ্ছে যমজ শিশুর কলরবের মতো। কচি দাড়িম ধরেছে গাছে চিকন সবুজের আড়ালে। চৈত্রমাস ঠেকল এসে শেষ হপ্তায়। আকাশে ভাসা বসন্তের নৌকোয় পাল পড়েছে ঢিলে হয়ে। দূর্বাঘাস উপবাসে শীর্ণ; কাঁকর-ঢালা পথের ধারে বিলিতি মৌসুমি চারায় ফুলগুলি রঙ হারিয়ে সংকুচিত। হাওয়া দিয়েছে পশ্চিম দিক থেকে,-- বিদেশী হাওয়া চৈত্রমাসের আঙিনাতে। গায়ে দিতে হল আবরণ অনিচ্ছায়। বাঁধানো জলকুণ্ডে জল উঠছে শিরশিরিয়ে, টলমল করছে নালগাছের পাতা, লাল মাছ কটা চঞ্চল হয়ে উঠল। নেবুঘাস ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে খেলা-পাহাড়ের গায়ে। তার মধ্যে থেকে দেখা যায় গেরুয়া পাথরের চতুর্মুখ মূর্তি। সে আছে প্রবহমান কালের দূর তীরে উদাসীন; ঋতুর স্পর্শ লাগে না তার গায়ে। শিল্পের ভাষা তার, গাছপালার বাণীর সঙ্গে কোনো মিল নেই। ধরণীর অন্তঃপুর থেকে যে শুশ্রূষা দিনে রাতে সঞ্চারিত হচ্ছে সমস্ত গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায়, ঐ মূর্তি সেই বৃহৎ আত্মীয়তার বাইরে। মানুষ আপন গূঢ় বাক্য অনেক কাল আগে যক্ষের মৃত ধনের মতো ওর মধ্যে রেখেছে নিরুদ্ধ ক'রে, প্রকৃতির বাণীর সঙ্গে তার ব্যবহার বন্ধ। সাতটা বাজল ঘড়িতে। ছড়িয়ে-পড়া মেঘগুলি গেছে মিলিয়ে। সূর্য উঠল প্রাচীরের উপরে, ছোটো হয়ে গেল গাছের যত ছায়া। খিড়কির দরজা দিয়ে মেয়েটি ঢুকল বাগানে। পিঠে দুলছে ঝালরওআলা বেণী, হাতে কঞ্চির ছড়ি; চরাতে এনেছে একজোড়া রাজহাঁস, আর তার ছোটো ছোটো ছানাগুলিকে। হাঁস দুটো দাম্পত্য দায়িত্বের মর্যাদায় গম্ভীর, সকলের চেয়ে গুরুতর ঐ মেয়েটির দায়িত্ব জীবপ্রাণের দাবি স্পন্দমান ছোট ঐ মাতৃমনের স্নেহরসে। আজকের এই সকালটুকুকে ইচ্ছে করেছি রেখে দিতে। ও এসেছে অনায়াসে, অনায়াসেই যাবে চলে। যিনি দিলেন পাঠিয়ে তিনি আগেই এর মূল্য দিয়েছেন শোধ ক'রে আপন আনন্দ-ভাণ্ডার থেকে। ভোরের পাখি ডাকে কোথায় ভোরের পাখি ডাকে কোথায় ভোরের পাখি ডাকে। ভোর না হতে ভোরের খবর কেমন করে রাখে। এখনো যে আঁধার নিশি জড়িয়ে আছে সকল দিশি কালীবরন পুচ্ছ ডোরের হাজার লক্ষ পাকে। ঘুমিয়ে-পড়া বনের কোণে পাখি কোথায় ডাকে।ওগো তুমি ভোরের পাখি, ভোরের ছোটো পাখি, কোন্‌ অরুণের আভাস পেয়ে মেল’ তোমার আঁখি। কোমল তোমার পাখার ‘পরে সোনার রেখা স্তরে স্তরে, বাঁধা আছে ডানায় তোমার উষার রাঙা রাখি। ওগো তুমি ভোরের পাখি, ভোরের ছোটো পাখি।রয়েছে বট, শতেক জটা ঝুলছে মাটি ব্যেপে, পাতার উপর পাতার ঘটা উঠছে ফুলে ফেঁপে। তাহারি কোন্‌ কোণের শাখে নিদ্রাহারা ঝিঁঝির ডাকে বাঁকিয়ে গ্রীবা ঘুমিয়েছিলে পাখাতে মুখ ঝেঁপে, যেখানে বট দাঁড়িয়ে একা জটায় মাটি ব্যেপে।ওগো ভোরের সরল পাখি, কহো আমায় কহো– ছায়ায় ঢাকা দ্বিগুণ রাতে ঘুমিয়ে যখন রহ, হঠাৎ তোমার কুলায়-‘পরে কেমন ক’রে প্রবেশ করে আকাশ হতে আঁধার-পথে আলোর বার্তাবহ। ওগো ভোরের সরল পাখি কহো আমায় কহো!কোমল তোমার বুকের তলে রক্ত নেচে উঠে, উড়বে ব’লে পুলক জাগে তোমার পক্ষপুটে। চক্ষু মেলি পুবের পানে নিদ্রা-ভাঙা নবীন গানে অকুণ্ঠিত কণ্ঠ তোমার উৎস-সমান ছুটে। কোমল তোমার বুকের তলে রক্ত নেচে উঠে।এত আঁধার-মাঝে তোমার এতই অসংশয়! বিশ্বজনে কেহই তোরে করে না প্রত্যয়। তুমি ডাক,”দাঁড়াও পথে, সূর্য আসেন স্বর্ণরথে– রাত্রি নয়, রাত্রি নয়, রাত্রি নয় নয়।’ এত আঁধার-মাঝে তোমার এতই অসংশয়!আনন্দেতে জাগো আজি আনন্দেতে জাগো। ভোরের পাখি ডাকে যে ওই তন্দ্রা এখন না গো। প্রথম আলো পড়ুক মাথায়, নিদ্রা-ভাঙা আঁখির পাতায়, জ্যোতির্ময়ী উদয়-দেবীর আশীর্বচন মাগো। ভোরের পাখি গাহিছে ওই, আনন্দেতে জাগো।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ভোলানাথ লিখেছিল ভোলানাথ লিখেছিল, তিন-চারে নব্বই– গণিতের মার্কায় কাটা গেল সর্বই। তিন চারে বারো হয়, মাস্টার তারে কয়; “লিখেছিনু ঢের বেশি” এই তার গর্বই।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) ভোলানাথের খেলার তরে ভোলানাথের খেলার তরে খেলনা বানাই অামি। এই বেলাকার খেলাটি তার ওই বেলা যায় থামি।   (স্ফুলিঙ্গ) ভ্রমণী মাটির ছেলে হয়ে জন্ম, শহর নিল মোরে                পোষ্যপুত্র ক'রে। ইঁটপাথরের আলিঙ্গনের রাখল আড়ালটিকে                আমার চতুর্দিকে। বই প'ড়ে তাই পেতে হত ভ্রমণকারীর দেখা                ছাদের উপর একা। কষ্ট তাদের, বিপদ তাদের, তাদের শঙ্কা যত                লাগত নেশার মত। পথিক যে জন পথে পথেই পায় সে পৃথিবীকে,           মুক্ত সে চৌদিকে। চলার ক্ষুধায় চলতে সে চায় দিনের পরে দিনে           অচেনাকেই চিনে। লড়াই ক'রে দেশ করে জয়, বহায় রক্তধারা,           ভূপতি নয় তারা। পলে পলে পার যারা হয় মাটির পরে মাটি           প্রত্যেক পদ হাঁটি-- নাইকো সেপাই, নাইকো কামান, জয়পতাকা নাহি--           আপন বোঝা বাহি অপথেও পথ পেয়েছে, অজানাতে জানা,           মানে নাইকো মানা-- মরু তাদের, মেরু তাদের, গিরি অভ্রভেদী           তাদের বিজয়বেদী। সবার চেয়ে মানুষ ভীষণ; সেই মানুষের ভয়           ব্যাঘাত তাদের নয়। তারাই ভূমির বরপুত্র, তাদের ডেকে কই,           তোমরা পৃথ্বীজয়ী। মংপু পাহাড়ে কুজ্‌ঝটিজাল যেই          সরে গেল মংপু-র          নীল শৈলের গায়ে          দেখা দিল রঙপুর। বহুকেলে জাদুকর, খেলা বহুদিন তার, আর কোনো দায় নেই, লেশ নেই চিন্তার। দূর বৎসর-পানে ধ্যানে চাই যদ্‌দূর দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্‌দুর। কত রাজা এল গেল, ম'ল এরই মধ্যে, লড়েছিল বীর, কবি লিখেছিল পদ্যে। কত মাথা-কাটাকাটি সভ্যে অসভ্যে, কত মাথা-ফাটাফাটি সনাতনে নব্যে। ঐ গাছ চিরদিন যেন শিশু মস্ত, সূর্য-উদয় দেখে, দেখে তার অস্ত। ঐ ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা, দিন গেলে ওরই 'পরে জপ করে সন্ধ্যা। নিচে রেখা দেখা যায় ঐ নদী তিস্তার, কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার। হেনকালে একদিন বৈশাখী গ্রীষ্মে টানাপাখা-চলা সেই সেকালের বিশ্বে রবিঠাকুরের দেখা সেইদিন মাত্তর, আজি তো বয়স তার কেবল আটাত্তর-- সাতের পিঠের কাছে একফোঁটা শূন্য-- শত শত বরষের ওদের তারুণ্য। ছোটো আয়ু মানুষের, তবু একি কাণ্ড, এটুকু সীমায় গড়া মনোব্রহ্মাণ্ড-- কত সুখে দুখে গাঁথা, ইষ্টে অনিষ্টে, সুন্দর কুৎসিতে, তিক্তে ও মিষ্টে, কত গৃহ-উৎসবে, কত সভাসজ্জায়, কত রসে মজ্জিত অস্থি ও মজ্জায়, ভাষার-নাগাল-ছাড়া কত উপলব্ধি, ধেয়ানের মন্দিরে আছে তার স্তব্ধি। অবশেষে একদিন বন্ধন খণ্ডি অজানা অদৃষ্টের অদৃশ্য গণ্ডি অন্তিম নিমেষেই হবে উত্তীর্ণ। তখনি অকস্মাৎ হবে কি বিদীর্ণ এত রেখা এত রঙে গড়া এই সৃষ্টি, এত মধু-অঞ্জনে রঞ্জিত দৃষ্টি। বিধাতা আপন ক্ষতি করে যদি ধার্য নিজেরই তবিল-ভাঙা হয় তার কার্য, নিমেষেই নিঃশেষ করি ভরা পাত্র বেদনা না যদি তার লাগে কিছুমাত্র, আমারই কী লোকসান যদি হই শূন্য-- শেষক্ষয় হলে কারে কে করিবে ক্ষুণ্ন। এ জীবনে পাওয়াটারই সীমাহীন মূল্য, মরণে হারানোটা তো নহে তার তুল্য। রবিঠাকুরের পালা শেষ হবে সদ্য, তখনো তো হেথা এক অখণ্ড অদ্য জাগ্রত রবে চির-দিবসের জন্যে এই গিরিতটে, এই নীলিম অরণ্যে। তখনো চলিবে খেলা নাই যার যুক্তি-- বার বার ঢাকা দেওয়া, বার বার মুক্তি। তখনো এ বিধাতার সুন্দর ভ্রান্তি-- উদাসীন এ আকাশে এ মোহন কান্তি। মঙ্গলগীত শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক এতবড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা         দুলিতেছে আকাশসাগরে — দিন - দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা         শুধু কি, মা, যাব খেলা করে । তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি ,         অরণ্য বহিছে ফুল-ফল — শত কোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি         গণিতেছে প্রতি দণ্ড পল !       শুধু কি , মা , হাসিখেলা প্রতি দিন রাত         দিবসের প্রত্যেক প্রহর ! প্রভাতের পরে আসি নূতন প্রভাত         লিখিছে কি একই অক্ষর ! কানাকানি হাসাহাসি কোণেতে গুটায়ে ,         অলস নয়ননিমীলন , দণ্ড - দুই ধরণীর ধূলিতে লুটায়ে          ধূলি হয়ে ধূলিতে শয়ন !       নাই কি , মা , মানবের গভীর ভাবনা ,         হৃদয়ের সীমাহীন আশা ! জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা ,         জীবনের অনন্ত পিপাসা ! হৃদয়েতে শুষ্ক কি , মা , উৎস করুণার ,         শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন ! জগৎ শুধু কি , মা গো , তোমার আমার         ঘুমাবার কুসুম - আসন ! শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি         অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা । পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি ,         শকুনির মতো নির্মমতা। শুনো না করিছে কারা কথা - কাটাকাটি         মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে , রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি ,         আপনার বুদ্ধিরে বাখানে ।       তুমি এস দূরে এস , পবিত্র নিভৃতে ,         ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি । সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে         প্রতি নিমেষের যত ধূলি ! নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল         আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে , উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল         তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে ।       আছে মা , তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ ,         হৃদয়েতে উষার আভাস , খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল নয়ন —         চারি দিকে মর্ত্যের প্রবাস । আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে         পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি — ক্ষুদ্র কথা , ক্ষুদ্র কাজে , ক্ষুদ্র শত ছলে ,         কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি ।       কেন , মা , তোমারে কেহ চাহে না জানাতে         মানবের উচ্চ কুলশীল — অনন্তজগৎ - ব্যাপী ঈশ্বরের সাথে         তোমার যে সুগভীর মিল । কেন কেহ দেখায় না — চারি দিকে তব         ঈশ্বরের বাহুর বিস্তার ! ঘেরি তোরে , ভোগসুখ ঢালি নব নব         গৃহ বলি রচে কারাগার ।       অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও , মা আসি ,         চেয়ে দেখো আকাশের পানে — পড়ুক বিমলবিভা পূর্ণ রূপরাশি         স্বর্গমুখী কমলনয়ানে । আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে         প্রভাতের কুসুমের মতো , দাঁড়াও সায়াহ্নমাঝে পবিত্র হৃদয়ে         মাথাখানি করিয়া আনত ।       শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী ,         ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল ! বিশ্ব - চরাচর গাহে কাহারে বাখানি         আদিহীন অন্তহীন কাল ! যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া ,         উঠেছে সংগীতকোলাহল , ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া         মা , আমরা যাত্রা করি চল্ ।       যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে ,          যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ , যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে ,         শিরে ধরি সত্যের আদেশ । যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে         প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক , আয় , মা গো , যাত্রা করি জগতের কাজে         তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক ।       জেনো , মা , এ সুখে - দুঃখে - আকুল সংসারে         মেটে না সকল তুচ্ছ আশ — তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে         কোরো না , কোরো না অবিশ্বাস । সুখ ব ' লে যাহা চাই সুখ তাহা নয় ,         কী যে চাই জানি না আপনি — আঁধারে জ্বলিছে ওই ওরে কোরো ভয় ,         ভুজঙ্গের মাথার ও মণি ।       ক্ষুদ্র সুখ ভেঙে যায় না সহে নিশ্বাস ,         ভাঙে বালুকার খেলাঘর — ভেঙে গিয়ে বলে দেয় এ নহে আবাস ,         জীবনের এ নহে নির্ভর । সকলে শিশুর মতো কত আবদার         আনিছে তাঁহার সন্নিধান — পূর্ণ যদি নাহি হল , অমনি তাহার         ঈশ্বরে করিছে অপমান !       কিছুই চাব না , মা গো , আপনার তরে ,         পেয়েছে যা শুধিব সে ঋণ — পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয় - ভিতরে ,         ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন । সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে ,         প্রেম দিলে প্রেমে পুরে প্রাণ , নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে         ক্রন্দনের নাহি অবসান ।       মধুপাত্রে হতপ্রাণ পিপীলির মতো         ভোগসুখে জীর্ণ হয়ে থাকা , ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো শির নত         আঁকড়িয়া সংসারের শাখা , জগতের হিসাবেতে শূন্য হয়ে হায়         আপনারে আপনি ভক্ষণ , ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া জলবিম্ব প্রায় —         এই কি রে সুখের লক্ষণ ।       এই অহিফেনসুখ কে চায় ইহাকে !         মানবত্ব এ নয় এ নয় । রাহুর মতন সুখ গ্রাস করে রাখে         মানবের মানবহৃদয় । মানবেরে বল দেয় সহস্র বিপদ ,         প্রাণ দেয় সহস্র ভাবনা , দারিদ্র্যে খুঁজিয়া পাই মনের সম্পদ ,         শোকে পাই অনন্ত সান্ত্বনা ।       চিরদিবসের সুখ রয়েছে গোপন         আপনার আত্মার মাঝার । চারি দিকে সুখ খুঁজে শ্রান্ত প্রাণমন —         হেথা আছে , কোথা নেই আর । বাহিরের সুখ সে , সুখের মরীচিকা —         বাহিরেতে নিয়ে যায় ছ ' লে , যখন মিলায়ে যায় মায়াকুহেলিকা         কেন কাঁদি সুখ নেই ব ' লে । দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে         চিরজ্যোতি চিরছায়াময় — ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে         জীবনের অনন্ত আলয় । পুণ্যজ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি ,         অন্নপূর্ণা জননী - সমান , মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি         কর সবে সুখশান্তি দান ।       মা , আমার এই জেনো হৃদয়ের সাধ         তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা — মানবেরে জ্যোতি দাও , করো আশীর্বাদ ,          অকলঙ্ক মূর্তি মধুরিমা । কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয় ,         হেসে খেলে দিন যায় কেটে , দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময় ,         বলিবার সাধ নাহি মেটে ।       কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে,         কিছুতে, মা, বলিতে না পারি — স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে ,         নয়নে উথলে অশ্রুবারি । সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে         একখানি পবিত্র জীবন; ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে         আশীর্বাদ করো , মা , গ্রহণ । ২ শ্রীমতী ইন্দিরা।   প্রাণাধিকাসু । নাসিক চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয় ,         কথায় কথায় বাড়ে কথা । সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয় ,         কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা । ফেনার উপরে ফেনা , ঢেউ -' পরে ঢেউ ,         গরজনে বধির শ্রবণ — তীর কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ ,         হা হা করে আকুল পবন ।       এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এস কেহ         পরিপূর্ণ একটি জীবন , নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ ,         থেমে যাবে সহস্র বচন । তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ         লক্ষ্যহারা শত শত মত , যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন         সে দিকে হেরিবে সবে পথ ।       অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে ,         মানে না বাহুর আক্রমণ । একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে         নীরবে করে সে পলায়ন । এস মা , উষার আলো , অকলঙ্ক প্রাণ ,         দাঁড়াও এ সংসার - আঁধারে । জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান ,         কূল দাও নিদ্রার পাথারে । চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি ,         মানবের পাষাণ পরান । শাণিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী ,         হৃদয়ের রক্ত করে পান । তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল ,         উল্কাধারা করিছে বর্ষণ — শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া বিফল         স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ ।       শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে         মেলি দুটি সকরুণ চোখ , পড়ুক দু - ফোঁটা অশ্রু জগতের'পরে         যেন দুটি বাল্মীকীর শ্লোক । ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে ,         করুণার অমৃতনির্ঝরে , তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে         দয়া হবে মানবের'পরে ।       সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া          হও তুমি অক্ষয় সুন্দর । ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া         দুই - চারি পলকের পর । তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর ;         প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো । তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ - অন্তর         মানুষে মানুষ বাসে ভালো । ৩ শ্রীমতী ইন্দিরা ।   প্রাণাধিকাসু । নাসিক । আমার এ গান , মা গো , শুধু কি নিমেষে মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে ?           আমার প্রাণের কথা           নিদ্রাহীন আকুলতা   শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি , মা , ভেসে !       এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে , সত্যের পথের'পরে নাম ধরে ডাকে ।           সংসারের সুখে দুখে           চেয়ে থাকে তোর মুখে , চির - আশীর্বাদ - সম কাছে কাছে থাকে ।       বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস , অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ ।           পড়িয়া সংসারঘোরে           কাঁদিয়া হেরিলে তোরে ভাগ করে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস ।       সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে ,           এ গান আপন সুরে           মন তোর রাখে পুরে , ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে । আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন তোমার বসন হয় , তোমার ভূষণ ।           পৃথিবীর ধূলিজাল           করে দেয় অন্তরাল , তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন ।       আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা , উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা           সৌরভের মতো তোরে           নিয়ে যায় চুরি করে — খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা ।       এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা , অন্ধকারে অনিমিষে নিশি করে সারা ।           তোমার মুখের'পরে           জেগে থাকে স্নেহভরে অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনারা ।       আমার এ গান যেন পশি তোর কানে মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে ।           তপ্ত শোণিতের মতো           বহে শিরে অবিরত , আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে ।       এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে , আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে ।           এ যেন রে করে দান           সতত নূতন প্রাণ , এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে ।       যদি যাই , মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি , এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ - আঁখি ।           যবে হায় সব গান           হয়ে যাবে অবসান এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) মথুরায় বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ? বিহরিছে সমীরণ , কুহরিছে পিকগণ , মথুরায় উপবন কুসুমে সাজিল ওই । বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?বিকচ বকুল ফুল দেখে যে হতেছে ভুল , কোথাকার অলিকুল গুঞ্জরে কোথায় ! এ নহে কি বৃন্দাবন ? কোথা সেই চন্দ্রানন ? ওই কি নূপুরধ্বনি বনপথে শুনা যায় ? একা আছি বনে বসি , পীত ধড়া পড়ে খসি , সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই । বাঁশরি বাজাতে চাহি , বাঁশরি বাজিল কই ?এক বার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি , মনোসাধে , আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায় । কোথা সে বিধুরা বালা , মলিন মালতীমালা , হৃদয়ে বিরহ – জ্বালা , এ নিশি পোহায় , হায় । কবি যে হল আকুল , এ কি রে বিধির ভুল , মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই ? বাঁশরি বাজাতে গিয়ে বাঁশরি বাজিল কই ?   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) মধ্যাহ্ন বেলা দ্বিপ্রহর। ক্ষুদ্র শীর্ণ নদীখানি শৈবালে জর্জর স্থির স্রোতোহীন। অর্ধমগ্ন তরী-পরে মাছরাঙা বসি, তীরে দুটি গোরু চরে শস্যহীন মাঠে। শান্তনেত্রে মুখ তুলে মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকূলে জনহীন নৌকা বাঁধা। শূন্য ঘাটতলে রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক স্নান করে জলে পাখা ঝটপটি। শ্যামশষ্পতটে তীরে খঞ্জন দুলায়ে পুচ্ছ নৃত্য করি ফিরে। চিত্রবর্ণ পতঙ্গম স্বচ্ছ পক্ষভরে আকাশে ভাসিয়া উড়ে, শৈবালের পরে ক্ষণে ক্ষণে লভিয়া বিশ্রাম। রাজহাঁস অদূরে গ্রামের ঘাটে তুলি কলভাষ শুভ্র পক্ষ ধৌত করে সিক্ত চঞ্চুপুটে। শুষ্কতৃণগন্ধ বহি ধেয়ে আসে ছুটে তপ্ত সমীরণ—চলে যায় বহু দূর। থেকে থেকে ডেকে ওঠে গ্রামের কুকুর কলহে মাতিয়া। কভু শান্ত হাম্বাস্বর, কভু শালিকের ডাক, কখনো মর্মর জীর্ণ অশথের, কভু দূর শূন্য-পরে চিলের সুতীব্র ধ্বনি, কভু বায়ুভরে আর্ত শব্দ বাঁধা তরণীর—মধ্যাহ্নের অব্যক্ত করুণ একতান, অরণ্যের স্নিগ্ধচ্ছায়া, গ্রামের সুষুপ্ত শান্তিরাশি, মাঝখানে বসে আছি আমি পরবাসী। প্রবাসবিরহদুঃখ মনে নাহি বাজে; আমি মিলে গেছি যেন সকলের মাঝে; ফিরিয়া এসেছি যেন আদি জন্মস্থলে বহুকাল পরে—ধরণীর বক্ষতলে পশু পাখি পতঙ্গম সকলের সাথে ফিরে গেছি যেন কোন্‌ নবীন প্রভাতে পূর্বজন্মে, জীবনের প্রথম উল্লাসে আঁকড়িয়া ছিনু যবে আকাশে বাতাসে জলে স্থলে, মাতৃস্তনে শিশুর মতন— আদিম আনন্দরস করিয়া শোষণ।    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মন উড়ুউড়ু চোখ ঢুলুঢুলু মন উড়ুউড়ু, চোখ ঢুলুঢুলু, ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক– আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো, ছন্দটা নির্‌বাঁধুনিক। পাঠকেরা বলে, “এ তো নয় সোজা, বুঝি কি বুঝিনে যায় না সে বোঝা।’ কবি বলে, “তার কারণ, আমার কবিতার ছাঁদ আধুনিক।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মনে পড়া মাকে আমার পড়ে না মনে ।           শুধু কখন খেলতে গিয়ে                    হঠাৎ অকারণে একটা কী সুর গুনগুনিয়ে           কানে আমার বাজে , মায়ের কথা মিলায় যেন           আমার খেলার মাঝে । মা বুঝি গান গাইত , আমার           দোলনা ঠেলে ঠেলে ; মা গিয়েছে , যেতে যেতে           গানটি গেছে ফেলে ।    মাকে আমার পড়ে না মনে ।           শুধু যখন আশ্বিনেতে                    ভোরে শিউলিবনে শিশির - ভেজা হাওয়া বেয়ে           ফুলের গন্ধ আসে , তখন কেন মায়ের কথা           আমার মনে ভাসে ? কবে বুঝি আনত মা সেই           ফুলের সাজি বয়ে , পুজোর গন্ধ আসে যে তাই           মায়ের গন্ধ হয়ে ।    মাকে আমার পড়ে না মনে ।           শুধু যখন বসি গিয়ে                    শোবার ঘরের কোণে ; জানলা থেকে তাকাই দূরে            নীল আকাশের দিকে , মনে হয় মা আমার পানে           চাইছে অনিমিখে । কোলের ‘পরে ধরে কবে           দেখত আমায় চেয়ে , সেই চাউনি রেখে গেছে           সারা আকাশ ছেয়ে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) মনে পড়ে শৈলতটে তোমাদের নিভৃত কুটির মনে পড়ে, শৈলতটে তোমাদের নিভৃত কুটির; হিমাদ্রি যেথায় তার সমুচ্চ শান্তির আসনে নিস্তব্ধ নিত্য, তুঙ্গ তার শিখরের সীমা লঙ্ঘন করিতে চায় দূরতম শূন্যের মহিমা। অরণ্য যেতেছে নেমে উপত্যকা বেয়ে; নিশ্চল সবুজবন্যা, নিবিড় নৈ:শব্দ্যে রাখে ছেয়ে ছায়াপুঞ্জ তার। শৈলশৃঙ্গ-অন্তরালে প্রথম অরুণোদয়-ঘোষণার কালে অন্তরে আনিতে স্পন্দ বিশ্বজীবনের সদ্যস্ফূর্ত চঞ্চলতা। নির্জন বনের গূঢ় আনন্দের যত ভাষাহীন বিচিত্র সংকেতে লভিতাম হৃদয়েতে যে বিস্ময় ধরণীর প্রাণের আদিম সূচনায়। সহসা নাম-না-জানা পাখিদের চকিত পাখায় চিন্তা মোর যেত ভেসে শুভ্রহিমরেখাঙ্কিত মহানিরুদ্দেশে। বেলা যেত,লোকালয় তুলিত ত্বরিত করি সুপ্তোত্থিত শিথিল সময়। গিরিগাত্রে পথ গেছে বেঁকে, বোঝা বহি চলে লোক,গাড়ি ছুটে চলে থেকে থেকে। পার্বতী জনতা বিদেশী প্রাণযাত্রার খন্ড খন্ড কথা মনে যায় রেখে, রেখা-রেখা অসংলগ্ন ছবি যায় এঁকে। শুনি মাঝে মাঝে অদূরে ঘণ্টার ধ্বনি বাজে, কর্মের দৌত্য সে করে প্রহরে প্রহরে। প্রথম আলোর স্পর্শ লাগে, আতিথ্যের সখ্য জাগে ঘরে ঘরে। স্তরে স্তরে দ্বারের সোপানে নানারঙা ফুলগুলি অতিথির প্রাণে। গৃহিণীর যত্ন বহি প্রকৃতির লিপি নিয়ে আসে আকাশে বাতাসে। কলহাস্যে মানুষের স্নেহের বারতা যুগযুগান্তের মৌনে হিমাদ্রির আনে সার্থকতা। মনে ভাবিতেছি যেন অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি মনে ভাবিতেছি, যেন অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি ছাড়া পেল আজি, দীর্ঘকাল ব্যাকরণদুর্গে বন্দী রহি অকস্মাৎ সারি সারি কুচকাওয়াজের পদক্ষেপে উঠেছে অধীর হয়ে খেপে। লঙ্ঘিয়াছে বাক্যের শাসন, নিয়েছে অবুদ্ধিলোকে অবদ্ধ ভাষণ, ছিন্ন করি অর্থের শৃঙ্খলপাশ সাধুসাহিত্যের প্রতি ব্যঙ্গহাস্যে হানে পরিহাসল সব ছেড়ে অধিকার করে শুধু শ্রুতি — বিচিত্র তাদের ভঙ্গি, বিচিত্র আকূতি। বলে তারা, আমরা যে এই ধরণীর নিশ্বসিত পবনের আদিম ধ্বনির জন্মেছি সন্তান, যখনি মানবকন্ঠে মনোহীন প্রাণ নাড়ীর দোলায় সদ্য জেগেছে নাচিয়া উঠেছি বাঁচিয়া। শিশুকন্ঠে আদিকাব্যে এনেছি উচ্ছলি অস্তিত্বের প্রথম কাকলি। গিরিশিরে যে পাগল-ঝোরা শ্রাবণের দূত, তারি আত্মীয় আমরা আসিয়াছি লোকালয়ে সৃষ্টির ধ্বনির মন্ত্র লয়ে। মর্মরমুখর বেগে যে ধ্বনির কলোৎসব অরণ্যের পল্লবে পল্লবে, যে ধ্বনি দিগন্তে করে ঝড়ের ছন্দের পরিমাপ, নিশান্তের জাগায় যাহা প্রভাতের প্রকান্ড প্রলাপ, সে ধ্বনির ক্ষেত্র হতে হরিয়া করেছে পদানত বন্য ঘোটকের মতো মানুষ শব্দেরে তার জটিল নিয়মসূত্রজালে বার্তাবহনের লাগি অনাগত দূর দেশে কালে। বল্গাবদ্ধ-শব্দ-অশ্বে চড়ি মানুষ করেছে দ্রুত কালের মন্থর যত ঘড়ি। জড়ের অচল বাধা তর্কবেগে করিয়া হরণ অদৃশ্য রহস্যলোকে গহনে করেছে সঞ্চরণ, ব্যূহে বঁধি শব্দ-অক্ষৌহিণী প্রতি ক্ষণে মূঢ়তার আক্রমণ লইতেছি জিনি। কখনো চোরের মতো পশে ওরা স্বপ্নরাজ্যতলে, ঘুমের ভাটার জলে নাহি পায় বাধা — যাহা-তাহা নিয়ে আসে, ছন্দের বাঁধনে পড়ে বাঁধা, তাই দিয়ে বুদ্ধি অন্যমনা করে সেই শিল্পের রচনা সূত্র যার অসংলগ্ন স্খলিত শিথিল, বিধির সৃষ্টির সাথে নারাখে একান্ত তার মিল; যেমন মাতিয়া উঠে দশ-বিশ কুকুরের ছানা — এ ওর ঘাড়েতে চড়ে, কোনো উদ্দ্যেশ্যের নাই মানা, কে কাহারে লাগায় কামড়, জাগায় ভীষণ শব্দে গর্জনের ঝড়, সে কামড়ে সে গর্জনে কোনো অর্থ নাই হিংস্রতার, উদ্দাম হইয়া উঠে শুধু ধ্নি শুধু ভঙ্গি তার। মনে মনে দেখিতেছি, সারা বেলা ধরি দলে দলে শব্দ ছোটে অর্থ ছিন্ন করি — আকাশে আকাশে যেন বাজে, আগ‌্ডুম বাগ‌্ডুম ঘোড়াডুম সাজে। মনে মনে দেখলুম মনে মনে দেখলুম সেই দূর অতীত যুগের নিঃশব্দ সাধনা যা মুখর ইতিহাসকে নিষিদ্ধ রেখেছে আপন তপস্যার আসন থেকে। দেখলেম দুর্গম গিরিব্রজে কোলাহলী কৌতূহলী দৃষ্টির অন্তরালে অসূর্যম্পশ্য নিভৃতে ছবি আঁকছে গুণী গুহাভিত্তির 'পরে, যেমন অন্ধকার পটে সৃষ্টিকার আঁকছেন বিশ্বছবি। সেই ছবিতে ওরা আপন আনন্দকেই করেছে সত্য, আপন পরিচয়কে করেছে উপেক্ষা, দাম চায়নি বাইরের দিকে হাত পেতে, নামকে দিয়েছে মুছে। হে অনামা, হে রূপের তাপস, প্রণাম করি তোমাদের। নামের মায়াবন্ধন থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছি তোমাদের এই যুগান্তরের কীর্তিতে। নাম-ক্ষালন যে পবিত্র অন্ধকারে ডুব দিয়ে তোমাদের সাধনাকে করেছিলে নির্মল, সেই অন্ধকারের মহিমাকে আমি আজ বন্দনা করি। তোমাদের নিঃশব্দ বাণী রয়েছে এই গুহায়, বলছে--নামের পূজার অর্ঘ্য, ভাবীকালের খ্যাতি, সে তো প্রেতের অন্ন; ভোগশক্তিহীন নিরর্থকের কাছে উৎসর্গ-করা। তার পিছনে ছুটে সদ্য বর্তমানের অন্নপূর্ণার পরিবেষণ এড়িয়ে যেয়ো না, মোহান্ধ। আজ আমার দ্বারের কাছে শজনে গাছের পাতা গেল ঝ'রে, ডালে ডালে দেখা দিয়েছে কচি পাতার রোমাঞ্চ; এখন প্রৌঢ় বসন্তের পারের খেয়া চৈত্রমাসের মধ্যস্রোতে; মধ্যাহ্নের তপ্ত হাওয়ায় গাছে গাছে দোলাদুলি; উড়তি ধুলোয় আকাশের নীলিমাতে ধূসরের আভাস, নানা পাখির কলকাকলিতে বাতাসে আঁকছে শব্দের অস্ফুট আলপনা। এই নিত্য-বহমান অনিত্যের স্রোতে আত্মবিস্মৃত চলতি প্রাণের হিল্লোল; তার কাঁপনে আমার মন ঝলমল করছে কৃষ্ণচূড়ার পাতার মতো। অঞ্জলি ভরে এই তো পাচ্ছি সদ্য মুহূর্তের দান, এর সত্যে নেই কোনো সংশয়, কোনো বিরোধ। যখন কোনোদিন গান করেছি রচনা, সেও তো আপন অন্তরে এইরকম পাতার হিল্লোল, হাওয়ার চাঞ্চল্য, রৌদ্রের ঝলক, প্রকাশের হর্ষবেদনা। সেও তো এসেছে বিনা নামের অতিথি, গর-ঠিকানার পথিক। তার যেটুকু সত্য তা সেই মুহূর্তেই পূর্ণ হয়েছে, তার বেশি আর বাড়বে না একটুও, নামের পিঠে চড়ে। বর্তমানের দিগন্তপারে যে-কাল আমার লক্ষ্যের অতীত সেখানে অজানা অনাত্মীয় অসংখ্যের মাঝখানে যখন ঠেলাঠেলি চলবে লক্ষ লক্ষ নামে নামে, তখন তারি সঙ্গে দৈবক্রমে চলতে থাকবে বেদনাহীন চেতনাহীন ছায়ামাত্রসার আমারো নামটা, ধিক থাক্‌ সেই কাঙাল কল্পনার মরীচিকায়। জীবনের অল্প কয়দিনে বিশ্বব্যাপী নামহীন আনন্দ দিক আমাকে নিরহংকার মুক্তি। সেই অন্ধকারকে সাধনা করি যার মধ্যে স্তব্ধ বসে আছেন বিশ্বচিত্রের রূপকার, যিনি নামের অতীত, প্রকাশিত যিনি আনন্দে। মনে হয়েছিল আজ সব-কটা দুর্গ্রহ মনে হয়েছিল আজ সব-কটা দুর্গ্রহ চক্র ক'রে বসেছে দুর্মন্ত্রণায়। অদৃষ্ট জাল ফেলে অন্তরের শেষ তলা থেকে টেনে টেনে তুলছে নাড়ি-ছেঁড়া যন্ত্রণাকে। মনে হয়েছিল, অন্তহীন এই দুঃখ; মনে হয়েছিল, পন্থহীন নৈরাশ্যের বাধায় শেষ পর্যন্ত এমনি ক'রে অন্ধকার হাতড়িয়ে বেড়ানো। ভিতসুদ্ধ বাসা গেছে ডুবে, ভাগ্যের ভাঙনের অপঘাতে। এমন সময়ে সদ্যবর্তমানের প্রাকার ডিঙিয়ে দৃষ্টি গেল দূর অতীতের দিগন্তলীন বাগ্‌বাদিনীর বাণীসভায় যুগান্তরের ভগ্নশেষের ভিত্তিচ্ছায়ায় ছায়ামূর্তি বাজিয়ে তুলেছে রুদ্রবীণায় পুরাণখ্যাত কালের কোন্‌ নিষ্ঠুর আখ্যায়িকা। দুঃসহ দুঃখের স্মরণতন্তু দিয়ে গাঁথা সেই দারুণ কাহিনী। কোন্‌ দুর্দাম সর্বনাশের বজ্রঝঞ্ঝনিত মৃত্যুমাতাল দিনের হুহুংকার, যার আতঙ্কের কম্পনে ঝংকৃত করছে বীণাপাণি আপন বীণার তীব্রতম তার। দেখতে পেলেম কতকালের দুঃখ লজ্জা গ্লানি, কত যুগের জলৎধারা মর্মনিঃস্রাব সংহত হয়েছে, ধরেছে দহনহীন বাণীমূর্তি অতীতের সৃষ্টিশালায়। আর তার বাইরে পড়ে আছে নির্বাপিত বেদনার পর্বতপ্রমাণ ভস্মরাশি, জ্যোতির্হীন বাক্যহীন অর্থশূন্য। মনের আকাশে তার মনের আকাশে তার দিক্‌সীমানা বেয়ে বিবাগি স্বপনপাখি চলিয়াছে ধেয়ে।   (স্ফুলিঙ্গ) মন্ত্রেসে যে পূত রাখীররাঙা সুতো মন্ত্রেসে যে পূত রাখীররাঙা সুতো বাঁধন দিয়েছিনু হাতে, আজ কিআছে সেটি সাথে। বিদায়বেলা এল মেঘের মতো ব্যেপে, গ্রন্থি বেঁধে দিতে দু হাত গেল কেঁপে, সেদিন থেকে থেকে চক্ষুদুটি ছেপে ভরে যে এল জলধারা। আজকে বসে আছি পথের এক পাশে, আমের ঘন বোলে বিভোল মধুমাসে তুচ্ছ কথাটুকু কেবল মনে আসে ভ্রমর যেন পথহারা– সেই-যে বাম হাতে একটি সরু রাখী– আধেক রাঙা, সোনা আধা, আজো কি আছে সেটি বাঁধা।পথ যে কতখানি কিছুই নাহি জানি, মাঠের গেছে কোন্‌ শেষে চৈত্র-ফসলের দেশে। যখন গেলে চলে তোমার গ্রীবামূলে দীর্ঘ বেণী তব এলিয়ে ছিল খুলে, মাল্যখানি গাঁথা সাঁজের কোন্‌ ফুলে লুটিয়ে পড়েছিল পায়ে। একটুখানি তুমি দাঁড়িয়ে যদি যেতে! নতুন ফুলে দেখো কানন ওঠে মেতে, দিতেম ত্বরা করে নবীন মালা গেঁথে কনকচাঁপা-বনছায়ে। মাঠের পথে যেতে তোমার মালাখানি প’ল কি বেণী হতে খসে আজকে ভাবি তাই বসে।নূপুর ছিল ঘরে গিয়েছ পায়ে প’রে– নিয়েছ হেথা হতে তাই, অঙ্গে আর কিছু নাই। আকুল কলতানে শতেক রসনায় চরণ ঘেরি তব কাঁদিছে করুণায়, তাহারা হেথাকার বিরহবেদনায় মুখর করে তব পথ। জানি না কী এত যে তোমার ছিল ত্বরা, কিছুতে হল না যে মাথার ভূষা পরা, দিতেম খুঁজে এনে সিঁথিটি মনোহরা– রহিল মনে মনোরথ। হেলায়-বাঁধা সেই নূপুর-দুটি পায়ে আছে কি পথে গেছে খুলে সে কথা ভাবি তরুমূলে।অনেক গীতগান করেছি অবসান অনেক সকালে ও সাঁজে অনেক অবসরে কাজে। তাহারি শেষ গান আধেক লয়ে কানে দীর্ঘ পথ দিয়ে গেছ সুদূর-পানে, আধেক-জানা সুরে আধেক-ভোলা তানে গেয়েছ গুন্‌ গুন্‌ স্বরে। কেন না গেলে শুনি একটি গান আরো– সে গান শুধু তব, সে নহে আর কারো– তুমিও গেলে চলে সময় হল তারো, ফুটল তব পূজাতরে। মাঠের কোন্‌খানে হারালো শেষ সুর যে গান নিয়ে গেল শেষে, ভাবি যে তাই অনিমেষে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) ময়ূরের দৃষ্টি দক্ষিণায়নের সূর্যোদয় আড়াল ক'রে                                   সকালে বসি চাতালে ।                           অনুকূল অবকাশ ;                তখনো নিরেট হয়ে ওঠে নি কাজের দাবি,                           ঝুঁকে পড়ে নি লোকের ভিড়                                    পায়ে পায়ে সময় দলিত করে দিয়ে ।                                         লিখতে বসি ,                                   কাটা খেজুরের গুঁড়ির মতো               ছুটির সকাল কলমের ডগায় চুঁইয়ে দেয় কিছু রস ।                        আমাদের ময়ূর এসে পুচ্ছ নামিয়ে বসে                                   পাশের রেলিংটির উপর ।                      আমার এই আশ্রয় তার কাছে নিরাপদ ,          এখানে আসে না তার বেদরদী শাসনকর্তা বাঁধন হাতে ।                বাইরে ডালে ডালে কাঁচা আম পড়েছে ঝুলে ,                      নেবু ধরেছে নেবুর গাছে ,                           একটা একলা কুড়চিগাছ                আপনি আশ্চর্য আপন ফুলের বাড়াবাড়িতে ।                                   প্রাণের নিরর্থক চাঞ্চল্যে                           ময়ূরটি ঘাড় বাঁকায় এদিকে ওদিকে ।                                    তার উদাসীন দৃষ্টি                কিছুমাত্র খেয়াল করে না আমার খাতা-লেখায় ;          করত , যদি অক্ষরগুলো হত পোকা ;                তা হলে নগণ্য মনে করত না কবিকে ।          হাসি পেল ওর ওই গম্ভীর উপেক্ষায় ,                ওরই দৃষ্টি দিয়ে দেখলুম আমার এই রচনা ।                      দেখলুম , ময়ূরের চোখের ঔদাসীন্য                                   সমস্ত নীল আকাশে ,                কাঁচা-আম-ঝোলা গাছের পাতায় পাতায় ,                          তেঁতুলগাছের গুঞ্জনমুখর মৌচাকে । ভাবলুম , মাহেন্দজারোতে                       এইরকম চৈত্রশেষের অকেজো সকালে                           কবি লিখেছিল কবিতা ,                      বিশ্বপ্রকৃতি তার কোনোই হিসাব রাখে নি ।                কিন্তু , ময়ূর আজও আছে প্রাণের দেনাপাওনায় ,                      কাঁচা আম ঝুলে পড়েছে ডালে ।                 নীল আকাশ থেকে শুরু করে সবুজ পৃথিবী পর্যন্ত                      কোথাও ওদের দাম যাবে না কমে ।                আর , মাহেন্দজারোর কবিকে গ্রাহ্যই করলে না ।                     পথের ধারের তৃণ , আঁধার রাত্রের জোনাকি ।                        নিরবধি কাল আর বিপুলা পৃথিবীতে                           মেলে দিলাম চেতনাকে ,                টেনে নিলেম প্রকৃতির ধ্যান থেকে বৃহৎ বৈরাগ্য                                   আপন মনে ;                      খাতার অক্ষরগুলোকে দেখলুম                                         মহাকালের দেয়ালিতে                           পোকার ঝাঁকের মতো ।                      ভাবলুম , আজ যদি ছিঁড়ে ফেলি পাতাগুলো                তা হলে পর্শুদিনের অ ন্ত্য সৎকার এগিয়ে রাখব মাত্র ।            এমন সময় আওয়াজ এল কানে ,                “ দাদামশায় , কিছু লিখেছ না কি । '                       ওই এসেছে — ময়ূর না ,                           ঘরে যার নাম সুনয়নী ,                      আমি যাকে ডাকি শুনায়নী ব ' লে ।                ওকে আমার কবিতা শোনাবার দাবি সকলের আগে ।                আমি বললেম , “ সুরসিকে , খুশি হবে না ,                           এ গদ্যকাব্য । ”                কপালে ভ্রূকুঞ্চনের ঢেউ খেলিয়ে                           বললে , “ আচ্ছা , তাই সই । ”                      সঙ্গে একটু স্তুতিবাক্য দিলে মিলিয়ে ; বললে , “ তোমার কণ্ঠস্বরে ,                                   গদ্যে রঙ ধরে পদ্যের । ”                      ব ' লে গলা ধরলে জড়িয়ে ।          আমি বললেম , “ কবিত্বের রঙ লাগিয়ে নিচ্ছ                      কবিকণ্ঠ থেকে তোমার বাহুতে ?”          সে বললে , “ অকবির মতো হল তোমার কথাটা ;                কবিত্বের স্পর্শ লাগিয়ে দিলেম তোমারই কণ্ঠে ,                       হয়তো জাগিয়ে দিলেম গান । ”                  শুনলুম নীরবে , খুশি হলুম নিরুত্তরে ।          মনে-মনে বললুম , প্রকৃতির ঔদাসীন্য অচল রয়েছে                অসংখ্য বর্ষকালের চূড়ায় ,          তারই উপরে একবারমাত্র পা ফেলে চলে যাবে                            আমার শুনায়নী ,                      ভোরবেলার শুকতারা ।          সেই ক্ষণিকের কাছে হার মানবে বিরাটকালের বৈরাগ্য ।                   মাহেন্দজারোর কবি , তোমার সন্ধ্যাতারা                           অস্তাচল পেরিয়ে                      আজ উঠেছে আমার জীবনের                            উদয়াচলশিখরে । মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান মরণ রে ,       তুঁহু মম শ্যামসমান । মেঘবরণ তুঝ , মেঘজটাজুট , রক্ত কমল কর , রক্ত অধর - পুট , তাপ - বিমোচন করুণ কোর তব       মৃত্যু - অমৃত করে দান ।       তুঁহু মম শ্যামসমান ।    মরণ রে ,       শ্যাম তোঁহারই নাম ! চির বিসরল যব নিরদয় মাধব       তুঁহু ন ভইবি মোয় বাম , আকুল রাধা - রিঝ অতি জরজর , ঝরই নয়ন দউ অনুখন ঝরঝর । তুঁহু মম মাধব , তুঁহু মম দোসর ,       তুঁহু মম তাপ ঘুচাও ,       মরণ , তু আও রে আও । ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি , আঁখিপাত মঝু আসব মোদয়ি , কোরউপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি ,       নীদ ভরব সব দেহ । তুঁহু নহি বিসরবি , তুঁহু নহি ছোড়বি , রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি , হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন ,       অতুলন তোঁহার লেহ । দূর সঙে তুঁহু বাঁশি বজাওসি , অনুখন ডাকসি , অনুখন ডাকসি       রাধা রাধা রাধা । দিবস ফুরাওল , অবহুঁ ম যাওব , বিরহতাপ তব অবহুঁ ঘুচাওব , কুঞ্জবাট'পর অবহুঁ ম ধাওব ,       সব কছু টুটইব বাধা । গগন সঘন অব , তিমিরমগন ভব , তড়িত চকিত অতি , ঘোর মেঘরব , শালতালতরু সভয় তবধ সব ,       পন্থ বিজন অতি ঘোর — একলি যাওব তুঝ অভিসারে , যাক পিয়া তুঁহু কি ভয় তাহারে , ভয় বাধা সব অভয় মুরতি ধরি ,       পন্থ দেখাওব মোর । ভানুসিংহ কহে — ছিয়ে ছিয়ে রাধা ,       চঞ্চল হৃদয় তোহারি , মাধব পহু মম , পিয় স মরণসে       অব তুঁহু দেখ বিচারি । মরীচিকা ওই-যে তোমার মানস-প্রজাপতি ঘরছাড়া সব ভাবনা যত, অলস দিনে কোথা ওদের গতি।              দখিন হাওয়ার সাড়া পেয়ে চঞ্চলতার পতঙ্গদল ভিতর থেকে বাইরে আসে ধেয়ে।                    চেলাঞ্চলে উতল হল তারা,           চক্ষে মেলে চপল পাখা আকাশে পথহারা।              বকুলশাখায় পাখির হঠাৎ ডাকে চমকে-যাওয়া চরণ ঘিরে ঘুরে বেড়ায় শাড়ির ঘূর্ণিপাকে।                    কাটায় ব্যর্থ বেলা           অঙ্গে অঙ্গে অস্থিরতার চকিত এই খেলা।       মনে তোমার ফুল-ফোটানো মায়া    অস্ফুট কোন্‌ পূর্বরাগের রক্তরঙিন ছায়া।              ঘিরল তারা তোমায় চারি পাশে                      ইঙ্গিতে আভাসে                ক্ষণে ক্ষণে চমকে ঝলকে।                      তোমার অলকে দোলা দিয়ে বিনা ভাষায় আলাপ করে কানে কানে,                নাই কোনো যার মানে।            মরীচিকার ফুলের সাথে মরীচিকার প্রজাপতির মিলন ঘটে ফাল্গুনপ্রভাতে।            আজি তোমার যৌবনেরে ঘেরি    যুগলছায়ার স্বপনখেলা তোমার মধ্যে হেরি। মরীচিকা (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) এসো , ছেড়ে এসো , সখী , কুসুমশয়ন । বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে । কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন । দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা , স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে । দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে । চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে , সুখদুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয় — হাসি – কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয় । সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান , মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) মর্তবাসী কাকা বলেন , সময় হলে           সবাই চ ' লে           যায় কোথা সেই স্বর্গ - পারে । বল্‌ তো কাকী           সত্যি তা কি                    একেবারে ? তিনি বলেন , যাবার আগে                    তন্দ্রা লাগে           ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি , দ্বারের পাশে            তখন আসে                    ঘাটের মাঝি । বাবা গেছেন এমনি করে                    কখন ভোরে           তখন আমি বিছানাতে । তেমনি মাখন           গেল কখন                    অনেক রাতে । কিন্তু আমি বলছি তোমায়                     সকল সময়           তোমার কাছেই করব খেলা , রইব জোরে           গলা ধরে                    রাতের বেলা । সময় হলে মানব না তো ,                    জানব না তো ,           ঘণ্টা মাঝির বাজল কবে ।   তাই কি রাজা           দেবেন সাজা                    আমায় তবে ? তোমরা বল , স্বর্গ ভালো                    সেথায় আলো           রঙে রঙে আকাশ রাঙায় , সারা বেলা           ফুলের খেলা                    পারুলডাঙায় ! হোক - না ভালো যত ইচ্ছে —                     কেড়ে নিচ্ছে           কেই বা তাকে বলো , কাকী ? যেমন আছি           তোমার কাছেই                    তেমনি থাকি ! ওই আমাদের গোলাবাড়ি ,                    গোরুর গাড়ি           পড়ে আছে চাকা - ভাঙা , গাবের ডালে           পাতার লালে                    আকাশ রাঙা । সেথা বেড়ায় যক্ষীবুড়ি                    গুড়িগুড়ি           আসশেওড়ার ঝোপে ঝাপে ফুলের গাছে           দোয়েল নাচে                     ছায়া কাঁপে । নুকিয়ে আমি সেথা পলাই ,                    কানাই বলাই           দু - ভাই আসে পাড়ার থেকে ।   ভাঙা গাড়ি           দোলাই নাড়ি                    ঝেঁকে ঝেঁকে । সন্ধেবেলায় গল্প বলে                    রাখ কোলে ,           মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি । চালতা - শাখে           পেঁচা ডাকে ,                    বাড়ে রাতি । স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি                    বলছি , কাকী ,           দেখব আমায় কে কী করে । চিরকালই           রইব খালি                    তোমার ঘরে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) মর্মবাণী শিল্পীর ছবিতে যাহা মূর্তিমতী, গানে যাহা ঝরে ঝরনায়, সে বাণী হারায় কেন জ্যোতি, কেন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়মুখের কথায় সংসারের মাঝে নিরন্তর প্রয়োজনে জনতার কাজে? কেন আজ পরিপূর্ণ ভাষা দিয়ে পৃথিবীর কানে কানে বলিতে পারিনে "প্রিয়ে ভালোবাসি"? কেন আজ সুরহারা হাসি যেন সে কুয়াশা মেলা হেমন্তের বেলা? অনন্ত অম্বর অপ্রয়োজনের সেথা অখণ্ড প্রকাণ্ড অবসর, তারি মাঝে কে তারা অন্য তারকারে জানাইতে পারে আপনার কানে কানে কথা। তপস্বিনী নীরবতা আসন বিস্তীর্ণ যার অসংখ্য যোজন দূর ব্যেপে অন্তরে অন্তরে উঠে কেঁপে আলোকের নিগূঢ় সংগীতে। খণ্ড খণ্ড দণ্ডে পলে ভারাকীর্ণ চিতে নাই সেই অসীমের অবসর; তাই অবরুদ্ধ তার স্বর, ক্ষীণসত্য ভাষা তার। প্রত্যহের অভ্যস্ত কথার মূল্য যার ঘুচে, অর্থ যায় মুছে। তাই কানে কানে বলিতে সে নাহি জানে সহজে প্রকাশি' "ভালোবাসি"। আপন হারানো বাণী, খুঁজিবারে, বনস্পতি, আসি তব দ্বারে। তোমার পল্লবপুঞ্জ শাখাব্যূহভার অনায়াসে হয়ে পার আপনার চতুর্দিকে মেলেছে নিস্তব্ধ অবকাশ। সেথা তব নিঃশব্ধ উচ্ছ্বাস সূর্যোদয় মহিমার পানে আপনারে মিলাইতে জানে। অজানা সাগর পার হতে দক্ষিণের বায়ুস্রোতে অনাদি প্রাণের যে বারতা তব নব কিশলয়ে রেখে যায় কানে কানে কথা,-- তোমার অন্তরতম-- সে কথা জাগুক প্রাণে মম;-- আমার ভাবনা ভরি উঠুক বিকাশি "ভালোবাসি"। তোমার ছায়ায় বসে বিপুল বিরহ মোরে ঘেরে; বর্তমান মূহূর্তেরে অবলুপ্ত করি দেয় কালহীনতায়। জন্মান্তর হতে যেন লোকান্তরগত আঁখি চায় মোর মুখে। নিষ্কারণ দুখে পাঠাইয়া দেয় মোর চেতনারে সকল সীমার পারে। দীর্ঘ অভিসারপথে সংগীতের সুর তাহারে বহিয়া চলে দূর হতে দূর। কোথায় পাথেয় পাবে তার ক্ষুধা পিপাসার, এ সত্য বাণীর তরে তাই সে উদাসী "ভালোবাসি"। ভোর হয়েছিল যবে যুগান্তের রাতি আলোকের রশ্মিগুলি খুঁজি সাথি এ আদিম বাণী করেছিল কানাকানি গগনে গগনে। নব সৃষ্টি যুগের লগনে মহাপ্রাণ-সমুদ্রের কূল হতে কূলে তরঙ্গ দিয়েছে তুলে এ মন্ত্রবচন। এই বাণী করেছে রচন সুবর্ণকিরণ বর্ণে স্বপন-প্রতিমা আমার বিরহাকাশে যেথা অস্তশিখরের সীমা। অবসাদ-গোধূলির ধূলিজাল তারে ঢাকিতে কি পারে? নিবিড় সংহত করি এ-জন্মের সকল ভাবনা সকল বেদনা দিনান্তের অন্ধকারে মম সন্ধ্যাতারা সম শেষবাণী উঠুক উদ্ভাসি-- "ভালোবাসি"। মহতের দুঃখ সূর্য দুঃখ করি বলে নিন্দা শুনি স্বীয়, কী করিলে হব আমি সকলের প্রিয়। বিধি কহে, ছাড়ো তবে এ সৌর সমাজ, দু-চারি জনেরে লয়ে করো ক্ষুদ্র কাজ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মহারাজা ভয়ে থাকে মহারাজা ভয়ে থাকে পুলিশের থানাতে, আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে। চর ফিরে তাকে তাকে– সাধু যদি ছাড়া থাকে খোঁজ পেলে নৃপতিরে হয় তাহা জানাতে, রক্ষা করিতে তারে রাখে জেলখানাতে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মহাস্বপ্ন পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন, নিদ্রামগ্ন মহাদেব দেখিছেন মহান্‌ স্বপন্‌। বিশাল জগৎ এই প্রকাণ্ড স্বপন সেই, হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিম্বের মতন। উঠিতেছে চন্দ্র সূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার, উঠিতেছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার। উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে, উঠিতেছে ডুবিতেছে রাত্রি দিন, আকাশের তলে । একা বসি মহাসিন্ধু চিরদিন গাইতেছে গান, ছুটিয়া সহস্র নদী পদতলে মিলাইছে প্রাণ। তটিনীর কলরব, লক্ষ নির্ঝরের ঝর ঝর, সিন্ধুর গম্ভীর গীত, মেঘের গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ঝটিকা করিছে হা হা আশ্রয়-আলয় তার ছাড়ি বাজায়ে অরণ্যবীণা ভীমবল শত বাহু নাড়ি, রুদ্র রাগ আলাপিয়া গড়ায়ে পড়িছে হিমরাশ পর্বতদৈত্যের যেন ঘনীভূত ঘোর অট্টহাস, ধীরে ধীরে মহারণ্য নাড়িতেছে জটাময় মাথা-- ঝর ঝর মর মর উঠিতেছে সুগম্ভীর গাথা। চেতনার কোলাহলে দিবস পুরিছে দশ দিশি, ঝিল্লিরবে একমন্ত্র জপিতেছে তাপসিনী নিশি, সমস্ত একত্রে মিলি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া চারি ভিত উঠাইছে মহা-হৃদে মহা এক স্বপনসংগীত। স্বপনের রাজ্য এই স্বপন-রাজ্যের জীবগণ দেহ ধরিতেছে কত মুহুর্মুহু নূতন নূতন। ফুল হয়ে যায় ফল, ফুল ফল বীজ হয় শেষে, নব নব বৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকে কানন-প্রদেশে। বাষ্প হয়, মেঘ হয়, বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিবারিধারা নির্ঝর তটিনী হয়, ভাঙি ফেলে শিলাময় কারা। নিদাঘ মরিয়া যায়, বরষা শ্মশানে আসি তার নিবায় জলন্ত চিতা বরষিয়া অশ্রুবারিধার। বরষা হইয়া বৃদ্ধ শ্বেতকেশ শীত হয়ে যায়, যযাতির মতো পুন বসন্তযৌবন ফিরে পায়। এক শুধু পুরাতন, আর সব নূতন নূতন এক পুরাতন হৃদে উঠিতেছে নূতন স্বপন। অপূর্ণ স্বপন-সৃষ্ট মানুষেরা অভাবের দাস, জাগ্রত পূর্ণতা-তরে পাইতেছে কত না প্রয়াস। চেতনা ছিঁড়িতে চাহে আধো-অচেতন আবরণ-- দিনরাত্রি এই আশা, এই তার একমাত্র পণ। পূর্ণ আত্মা জাগিবেন, কভু কি আসিবে হেন দিন? অপূর্ণ জগৎ-স্বপ্ন ধীরে ধীরে হইবে বিলীন? চন্দ্র-সূর্য-তারকার অন্ধকার স্বপ্নময়ী ছায়া জ্যোতির্ময় সে হৃদয়ে ধীরে ধীরে মিলাইবে কায়া। পৃথিবী ভাঙিয়া যাবে, একে একে গ্রহতারাগণ ভেঙে ভেঙে মিলে যাবে একেকটি বিম্বের মতন। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ চেয়ে জ্যোতির্ময় মহান্‌ বৃহৎ জীব-আত্মা মিলাইবে একেকটি জলবিম্ববৎ। কভু কি আসিবে, দেব, সেই মহাস্বপ্ন-ভাঙা দিন সত্যের সমুদ্র-মাঝে আধো সত্য হয়ে যাবে লীন? আধেক প্রলয়জলে ডুবে আছে তোমার হৃদয়-- বলো, দেব, কবে হেন প্রলয়ের হইবে প্রলয়। মাকাল গৌরবর্ণ নধর দেহ, নাম শ্রীযুক্ত রাখাল, জন্ম তাহার হয়েছিল, সেই যে-বছর আকাল।        গুরুমশায় বলেন তারে,        "বুদ্ধি যে নেই একেবারে;   দ্বিতীয়ভাগ করতে সারা ছ'মাস ধরে নাকাল।"   রেগেমেগে বলেন, "বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল।"  নামটা শুনে ভাবলে প্রথম বাঁকিয়ে যুগল ভুরু;   তারপর সে বাড়ি এসে নৃত্য করলে শুরু।          হঠাৎ ছেলের মাতন দেখি          সবাই তাকে শুধায়, এ কী!   সকলকে সে জানিয়ে দিল, নাম দিয়েছেন গুরু--   নতুন নামের উৎসাহে তার বক্ষ দুরুদুরু।  কোলের 'পরে বসিয়ে দাদা বললে কানে-কানে,   "গুরুমশায় গাল দিয়েছেন, বুঝিসনে তার মানে!"          রাখাল বলে, "কখ্‌খোনো না,          মা যে আমায় বলেন সোনা,   সেটা তো গাল নয় সে কথা পাড়ার সবাই জানে।   আচ্ছা, তোমায় দেখিয়ে দেব, চলো তো ঐখানে।"  টেনে নিয়ে গেল তাকে পুকুরপাড়ের কাছে,   বেড়ার 'পরে লতায় যেথা মাকাল ফ'লে আছে।          বললে, "দাদা সত্যি বোলো,          সোনার চেয়ে মন্দ হল?   তুমি শেষে বলতে কি চাও, গাল ফলেছে গাছে।"   "মাকাল আমি" ব'লে রাখাল দু হাত তুলে নাচে।  দোয়াত কলম নিয়ে ছোটে, খেলতে নাহি চায়,   লেখাপড়ায় মন দেখে মা অবাক হয়ে যায়।          খাবার বেলায় অবশেষে          দেখে ছেলের কাণ্ড এসে--   মেঝের 'পরে ঝুঁকে প'ড়ে খাতার পাতাটায়   লাইন টেনে লিখছে শুধু-- মাকালচন্দ্র রায়। মাকে আমার পড়ে না মনে মাকে আমার পড়ে না মনে।          শুধু কখন খেলতে গিয়ে                   হঠাৎ অকারণেএকটা কী সুর গুনগুনিয়ে          কানে আমার বাজে,মায়ের কথা মিলায় যেন          আমার খেলার মাঝে।মা বুঝি গান গাইত, আমার          দোলনা ঠেলে ঠেলে;মা গিয়েছে, যেতে যেতে          গানটি গেছে ফেলে।মাকে আমার পড়ে না মনে।          শুধু যখন আশ্বিনেতে                   ভোরে শিউলিবনেশিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে          ফুলের গন্ধ আসে,তখন কেন মায়ের কথা          আমার মনে ভাসে?কবে বুঝি আনত মা সেই          ফুলের সাজি বয়ে,পুজোর গন্ধ আসে যে তাই          মায়ের গন্ধ হয়ে।মাকে আমার পড়ে না মনে।          শুধু যখন বসি গিয়ে                   শোবার ঘরের কোণে;জানলা থেকে তাকাই দূরে          নীল আকাশের দিকেমনে হয়, মা আমার পানে          চাইছে অনিমিখে।কোলের 'পরে ধরে কবে          দেখত আমায় চেয়ে,সেই চাউনি রেখে গেছে          সারা আকাশ ছেয়ে।   ৯ আশ্বিন, ১৩২৮ মাঝারির সতর্কতা উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মাঝি আমার যেতে ইচ্ছে করে      নদীটির ওই পারে—      যেথায় ধারে ধারে বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো      বাঁধা সারে সারে। কৃষাণেরা পার হয়ে যায়      লাঙল কাঁধে ফেলে;      জাল টেনে নেয় জেলে, গোরু মহিষ সাঁৎরে নিয়ে      যায় রাখালের ছেলে। সন্ধে হলে যেখান থেকে      সবাই ফেরে ঘরে      শুধু রাতদুপরে শেয়ালগুলো ডেকে ওঠে      ঝাউডাঙাটার ‘পরে।      মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব      খেয়াঘাটের মাঝি।    শুনেছি ওর ভিতর দিকে      আছে জলার মতো।      বর্ষা হলে গত ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সেথায়      চখাচখী যত। তারি ধারে ঘন হয়ে      জন্মেছে সব শর;      মানিক - জোড়ের ঘর, কাদাখোঁচা পায়ের চিহ্ন      আঁকে পাঁকের ‘পর। সন্ধ্যা হলে কত দিন মা,      দাঁড়িয়ে ছাদের কোণে      দেখেছি একমনে— চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে      সাদা কাশের বনে।      মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব      খেয়াঘাটের মাঝি।    এ - পার ও - পার দুই পারেতেই      যাব নৌকো বেয়ে।      যত ছেলেমেয়ে স্নানের ঘাটে থেকে আমায়      দেখবে চেয়ে চেয়ে। সূর্য যখন উঠবে মাথায়      অনেক বেলা হলে—      আসব তখন চলে ‘বড়ো খিদে পেয়েছে গো—      খেতে দাও মা' বলে। আবার আমি আসব ফিরে      আঁধার হলে সাঁঝে      তোমার ঘরের মাঝে। বাবার মতো যাব না মা,      বিদেশে কোন্‌ কাজে।      মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব      খেয়াঘাটের মাঝি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) মাঝে মাঝে বিধাতার ঘটে একি ভুল মাঝে মাঝে বিধাতার ঘটে একি ভুল– ধান পাকাবার মাসে ফোটে বেলফুল। হঠাৎ আনাড়ি কবি তুলি হাতে আঁকে ছবি, অকারণে কাঁচা কাজে পেকে যায় চুল।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মাটিতে মিশিল মাটি মাটিতে মিশিল মাটি, যাহা চিরন্তন রহিল প্রেমের স্বর্গে অন্তরের ধন।   (স্ফুলিঙ্গ) মাতৃবৎসল মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে। বলে, ‘আমরা কেবল করি খেলা, সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা। সোনার খেলা খেলি আমরা ভোরে, রুপোর খেলা খেলি চাঁদকে-ধরে। ' আমি বলি, ‘যাব কেমন করে। '        তারা বলে, ‘এসো মাঠের শেষে। সেইখানেতে দাঁড়াবে হাত তুলে,          আমরা তোমায় নেব মেঘের দেশে। ' আমি বলি, ‘মা যে আমার ঘরে বসে আছে চেয়ে আমার তরে, তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে। '          শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে।     তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ;          তুমি যেন হবে আমার চাঁদ—     দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে,          আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।        ঢেউয়ের মধ্যে মা গো যারা থাকে,     তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।     বলে, ‘আমরা কেবল করি গান     সকাল থেকে সকল দিনমান। ' তারা বলে, ‘কোন্‌ দেশে যে ভাই, আমরা চলি ঠিকানা তার নাই। ' আমি বলি, ‘কেমন করে যাই। '          তারা বলে, ‘এসো ঘাটের শেষে। সেইখানেতে দাঁড়াবে চোখ বুজে,          আমরা তোমায় নেব ঢেউয়ের দেশে। ' আমি বলি, ‘মা যে চেয়ে থাকে, সন্ধে হলে নাম ধরে মোর ডাকে, কেমন করে ছেড়ে থাকব তাকে। '           শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে।     তার চেয়ে মা, আমি হব ঢেউ,          তুমি হবে অনেক দূরের দেশ।     লুটিয়ে আমি পড়ব তোমার কোলে,          কেউ আমাদের পাবে না উদ্দেশ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) মাধব না কহ আদরবাণী মাধব , না কহ আদরবাণী ,       না কর প্রেমক নাম । জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা       ছলনা না কর শ্যাম । কপট , কাহ তুঁহু ঝূট বোলসি ,       পীরিত করসি তু মোয় ? ভালে ভালে হম অলপে চিহ্ননু ,       না পতিয়াব রে তোয় । ছিদল তরীসম কপট প্রেম'পর       ডারনু যব মনপ্রাণ , ডুবনু ডুবনু রে ঘোর সায়রে       অব কুত নাহিক ত্রাণ । মাধব , কঠোর বাত হমারা       মনে লাগল কি তোর ? মাধব , কাহ তু মলিন করলি মুখ ,       ক্ষমহ গো কুবচন মোর ! নিদয় বাত অব কবহুঁ ন বোলব ,       তুঁহু মম প্রাণক প্রাণ । অতিশয় নির্মম ব্যথিনু হিয়া তব       ছোড়য়ি কুবচনবাণ মিটল মান অব — ভানু হাসতহি       হেরই পীরিতলীলা । কভু অভিমানিনী , আদরিণী কভু       পীরিতিসাগর বালা । মাধো রায়বাহাদুর কিষনলালের স্যাকরা জগন্নাথ, সোনারুপোর সকল কাজে নিপুণ তাহার হাত। আপন বিদ্যা শিখিয়ে মানুষ করবে ছেলেটাকে এই আশাতে সময় পেলেই ধরে আনত তাকে; বসিয়ে রাখত চোখের সামনে, জোগান দেবার কাজে লাগিয়ে দিত যখন তখন; আবার মাঝে মাঝে ছোটো মেয়ের পুতুল-খেলার গয়না গড়াবার ফরমাশেতে খাটিয়ে নিত; আগুন ধরাবার সোনা গলাবার কর্মে একটুখানি ভুলে চড়চাপড়টা পড়ত পিঠে, টান লাগাত চুলে। সুযোগ পেলেই পালিয়ে বেড়ায় মাধো যে কোন্‌খানে ঘরের লোকে খুঁজে ফেরে বৃথাই সন্ধানে। শহরতলির বাইরে আছে দিঘি সাবেককেলে সেইখানে সে জোটায় যত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে। গুলিডাণ্ডা খেলা ছিল, দোলনা ছিল গাছে, জানা ছিল যেথায় যত ফলের বাগান আছে। মাছ ধরবার ছিপ বানাত, সিসুডালের ছড়ি; টাট্টুঘোড়ার পিঠে চড়ে ছোটাত দড়্‌বড়ি। কুকুরটা তার সঙ্গে থাকত, নাম ছিল তার বটু-- গিরগিটি আর কাঠবেড়ালি তাড়িয়ে ফেরায় পটু। শালিখপাখির মহলেতে মাধোর ছিল যশ, ছাতুর গুলি ছড়িয়ে দিয়ে করত তাদের বশ। বেগার দেওয়ার কাজে পাড়ায় ছিল না তার মতো, বাপের শিক্ষানবিশিতেই কুঁড়েমি তার যত। বড়োলোকের ছেলে ব'লে গুমর ছিল মনে, অত্যাচারে তারই প্রমাণ দিত সকলখনে। বটুর হবে সাঁতারখেলা, বটু চলছে ঘাটে, এসেছে যেই দুলালচাঁদের গোলা খেলার মাঠে অকারণে চাবুক নিয়ে দুলাল এল তেড়ে; মাধো বললে, "মারলে কুকুর ফেলব তোমায় পেড়ে।" উঁচিয়ে চাবুক দুলাল এল, মানল নাকো মানা, চাবুক কেড়ে নিয়ে মাধো করলে দুতিনখানা। দাঁড়িয়ে রইল মাধো, রাগে কাঁপছে থরোথরো, বললে, "দেখব সাধ্য তোমার, কী করবে তা করো।" দুলাল ছিল বিষম ভীতু, বেগ শুধু তার পায়ে; নামের জোরেই জোর ছিল তার, জোর ছিল না গায়ে।দশবিশজন লোক লাগিয়ে বাপ আনলে ধরে, মাধোকে এক খাটের খুরোয় বাঁধল কষে জোরে। বললে, "জানিসনেকো বেটা, কাহার অন্ন ধারিস, এত বড়ো বুকের পাটা, মনিবকে তুই মারিস। আজ বিকালে হাটের মধ্যে হিঁচড়ে নিয়ে তোকে, দুলাল স্বয়ং মারবে চাবুক, দেখবে সকল লোকে।" মনিববাড়ির পেয়াদা এল দিন হল যেই শেষ। দেখলে দড়ি আছে পড়ি, মাধো নিরুদ্দেশ। মাকে শুধায়, "এ কী কাণ্ড।" মা শুনে কয়, "নিজে আপন হাতে বাঁধন তাহার আমিই খুলেছি যে। মাধো চাইল চলে যেতে; আমি বললেম, যেয়ো, এমন অপমানের চেয়ে মরণ ভালো সেও।" স্বামীর 'পরে হানল দৃষ্টি দারুণ অবজ্ঞার; বললে, "তোমার গোলামিতে ধিক্‌ সহস্রবার।" ছেলে মেয়ে চলল বেড়ে, হল সে সংসারী; কোন্‌খানে এক পাটকলে সে করতেছে সর্দারি। এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক; বললে, "মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক্‌। দলের সঙ্গে যোগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।" মাধো বললে, "মরাই ভালো এ বেইমানির চেয়ে।" শেষপালাতে পুলিশ নামল, চলল গুঁতোগাঁতা; কারো পড়ল হাতে বেড়ি, কারো ভাঙল মাথা। মাধো বললে, "সাহেব, আমি বিদায় নিলেম কাজে, অপমানের অন্ন আমার সহ্য হবে না যে।" চলল সেথায় যে-দেশ থেকে দেশ গেছে তার মুছে, মা মরেছে, বাপ মরেছে, বাঁধন গেছে ঘুচে। পথে বাহির হল ওরা ভরসা বুকে আঁটি, ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর পুরোনো তার মাটি। মান অপমান উপেক্ষা করি দাঁড়াও মান অপমান উপেক্ষা করি দাঁড়াও, কণ্টকপথ অকুণ্ঠপদে মাড়াও, ছিন্ন পতাকা ধূলি হতে লও তুলি। রুদ্রের হাতে লাভ করো শেষ বর, আনন্দ হোক দুঃখের সহচর, নিঃশেষ ত্যাগে আপনারে যাও ভুলি।   (স্ফুলিঙ্গ) মানবহৃদয়ের বাসনা নিশীথে রয়েছি জেগে ; দেখি অনিমেখে , লক্ষ হৃদয়ে সাধ শূন্যে উড়ে যায় । কত দিক হতে তারা ধায় কত দিকে ! কত – না অদৃশ্যকায়া ছায়া – আলিঙ্গন বিশ্বময় কারে চাহে , করে হায় – হায় । কত স্মৃতি খুঁজিতেছে শ্মশানশয়ন — অন্ধকারে হেরো শত তৃষিত নয়ন ছায়াময় পাখি হয়ে কার পানে ধায় । ক্ষীণশ্বাস – মুমূর্ষুর অতৃপ্ত বাসনা ধরণীর কূলে কূলে ঘুরিয়া বেড়ায় । উদ্দেশে ঝরিছে কত অশ্রুবারিকণা , চরণ খুঁজিয়া তারা মরিবারে চায় । কে শুনিছে শত কোটি হৃদয়ের ডাক ! নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) মানসলোক মানসকৈলাসশৃঙ্গে নির্জন ভুবনে ছিলে তুমি মহেশের মন্দিরপ্রাঙ্গণে তাঁহার আপন কবি, কবি কালিদাস। নীলকণ্ঠদ্যুতিসম স্নিগ্ধনীলভাস চিরস্থির আষাঢ়ের ঘনমেঘদলে, জ্যোতির্ময় সপ্তর্ষির তপোলোকতলে। আজিও মানসধামে করিছ বসতি; চিরদিন রবে সেথা, ওহে কবিপতি, শংকরচরিত গানে ভরিয়া ভুবন।— মাঝে হতে উজ্জয়িনী-রাজনিকেতন, নৃপতি বিক্রমাদিত্য, নবরত্নসভা, কোথা হতে দেখা দিল স্বপ্ন ক্ষণপ্রভা। সে স্বপ্ন মিলায়ে গেল, সে বিপুলচ্ছবি, রহিলে মানসলোকে তুমি চিরকবি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মানসী শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী-- পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন। সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা। কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না, সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা, বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার, চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার। লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ, তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন। পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা-- অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা। ২৮ চৈত্র, ১৩০২ (চৈতালি) মানিক কহিল পিঠ পেতে দিই দাঁড়াও মানিক কহিল, “পিঠ পেতে দিই দাঁড়াও। আম দুটো ঝোলে, ওর দিকে হাত বাড়াও। উপরের ডালে সবুজে ও লালে ভরে আছে, কষে নাড়াও। নিচে নেমে এসে ছুরি দিয়ে শেষে ব’সে ব’সে খোসা ছাড়াও। যদি আসে মালি চোখে দিয়ে বালি পারো যদি তারে তাড়াও। বাকি কাজটার মোর ‘পরে ভার, পাবে না শাঁসের সাড়াও। আঁঠি যদি থাকে দিয়ো মালিটাকে, মাড়াব না তার পাড়াও। পিসিমা রাগিলে তাঁর চড়ে কিলে বাঁদরামি-ভূত তাড়াও।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মায়াবাদ হা রে নিরানন্দ দেশ, পরি জীর্ণ জরা, বহি বিজ্ঞতার বোঝা, ভাবিতেছ মনে ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে! লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে মিথ্যা ব'লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে। যুগযুগান্তর ধ'রে পশু পক্ষী প্রাণী অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি; তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস! লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা তুমি জানিতেছ মনে, সব ছেলেখেলা। মা-লক্ষ্মী কার পানে মা, চেয়ে আছ       মেলি দুটি করুণ আঁখি। কে ছিঁড়েছে ফুলের পাতা,       কে ধরেছে বনের পাখি। কে কারে কী বলেছে গো,       কার প্রাণে বেজেছে ব্যথা— করুণায় যে ভরে এল       দুখানি তোর আঁখির পাতা। খেলতে খেলতে মায়ের আমার       আর বুঝি হল না খেলা। ফুলের গুচ্ছ কোলে প'ড়ে—       কেন মা এ হেলাফেলা।    অনেক দুঃখ আছে হেথায়,       এ জগৎ যে দুঃখে ভরা— তোমার দুটি আঁখির সুধায়       জুড়িয়ে গেল নিখিল ধরা। লক্ষ্মী আমায় বল্‌ দেখি মা,       লুকিয়ে ছিলি কোন্‌ সাগরে। সহসা আজ কাহার পুণ্যে        উদয় হলি মোদের ঘরে। সঙ্গে করে নিয়ে এলি       হৃদয়-ভরা স্নেহের সুধা, হৃদয় ঢেলে মিটিয়ে যাবি       এ জগতের প্রেমের ক্ষুধা।    থামো, থামো, ওর কাছেতে       কোয়ো না কেউ কঠোর কথা, করুণ আঁখির বালাই নিয়ে       কেউ কারে দিয়ো না ব্যথা। সইতে যদি না পারে ও,       কেঁদে যদি চলে যায়— এ-ধরণীর পাষাণ-প্রাণে       ফুলের মতো ঝরে যায়। ও যে আমার শিশিরকণা,       ও যে আমার সাঁঝের তারা— কবে এল কবে যাবে       এই ভয়তে হই রে সারা। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) মাস্টার বলে মাস্টার বলে, “তুমি দেবে ম্যাট্রিক, এক লাফে দিতে চাও হবে না সে ঠিক। ঘরে দাদামশায়ের দেখো example, সত্তর বৎসরও হয়নিকো ample। একদা পরীক্ষায় হবে উত্তীর্ণ যখন পাকবে চুল, হাড় হবে জীর্ণ।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মাস্টারবাবু আমি আজ কানাই মাস্টার,      পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি। আমি ওকে মারি নে মা, বেত,      মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি। রোজ রোজ দেরি করে আসে,      পড়াতে দেয় না ও তো মন, ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই      যত আমি বলি ‘শোন্‌ শোন্‌'। দিনরাত খেলা খেলা খেলা,      লেখায় পড়ায় ভারি হেলা। আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ',      ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ'।    প্রথম   ভাগের পাতা খুলে        আমি ওরে বোঝাই মা, কত— চুরি করে খাস নে কখনো,        ভালো হোস গোপালের মতো। যত বলি সব হয় মিছে,        কথা যদি একটিও শোনে— মাছ যদি দেখেছে কোথাও        কিছুই থাকে না আর মনে। চড়াই পাখির দেখা পেলে        ছুটে যায় সব পড়া ফেলে। যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ',        দুষ্টুমি করে বলে ‘মিয়োঁ'।    আমি ওরে বলি বার বার,        ‘পড়ার সময় তুমি পোড়ো— তার পরে ছুটি হয়ে গেলে        খেলার সময় খেলা কোরো। ' ভালোমানুষের মতো থাকে,        আড়ে আড়ে চায় মুখপানে, এম্‌নি সে ভান করে যেন        যা বলি বুঝেছে তার মানে। একটু সুযোগ বোঝে যেই        কোথা যায় আর দেখা নেই। আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ',        ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ'। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) মিছে ডাক'–মন বলে, আজ না মিছে ডাক'–মন বলে, আজ না— গেল উৎসবরাতি, ম্লান হয়ে এল বাতি, বাজিল বিসর্জন-বাজনা। সংসারে যা দেবার মিটিয়ে দিমু এবার, চুকিয়ে দিয়েছি তার খাজনা। শেষ আলো, শেষ গান, জগতের শেষ দান নিয়ে যাব—আজ কোনো কাজ না। বাজিল বিসর্জন-বাজনা।   (স্ফুলিঙ্গ) মিলনদৃশ্য হেসো না, হেসো না তুমি বুদ্ধি-অভিমানী! একবার মনে আনো ওগো ভেদজ্ঞানী, সে মহাদিনের কথা, যবে শকুন্তলা বিদায় লইতেছিল স্বজনবৎসলা জন্মতপোবন হতে—সখা সহকার, লতাভগ্নী মাধবিকা, পশুপরিবার, মাতৃহারা মৃগশিশু, মৃগী গর্ভবতী, দাঁড়াইল চারি দিকে; স্নেহের মিনতি গুঞ্জরি উঠিল কাঁদি পল্লবমর্মরে, ছলছল মালিনীর জলকলস্বরে; ধ্বনিল তাহারি মাঝে বৃদ্ধ তপস্বীর মঙ্গলবিদায়মন্ত্র গদ্‌গদগম্ভীর। তরুলতা পশুপক্ষীনদনদীবন নরনারী সবে মিলি করুণ মিলন।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মিলন-সুলগনে মিলন-সুলগনে, কেন বল্‌, নয়ন করে তোর ছল্‌ছল্‌। বিদায়দিনে যবে ফাটে বুক সেদিনও দেখেছি তো হাসিমুখ।   (স্ফুলিঙ্গ) মিলের চুমকি গাঁথি ছন্দের পাড়ের মাঝে মাঝে মিলের চুমকি গাঁথি ছন্দের পাড়ের মাঝে মাঝে অকেজো অলস বেলা ভরে ওঠে শেলাইয়ের কাজে। অর্থভরা কিছুই-না চোখে ক’রে ওঠে ঝিল্‌মিল্‌ ছড়াটার ফাঁকে ফাঁকে মিল। গাছে গাছে জোনাকির দল করে ঝলমল; সে নহে দীপের শিখা, রাত্রি খেলা করে আঁধারেতে টুকরো আলোক গেঁথে গেঁথে। মেঠো গাছে ছোটো ছোটো ফুলগুলি জাগে; বাগান হয় না তাহে, রঙের ফুটকি ঘাসে লাগে। মনে থাকে, কাজে লাগে, সৃষ্টিতে সে আছে শত শত; মনে থাকবার নয়, সেও ছড়াছড়ি যায় কত। ঝরনায় জল ঝ’রে উর্বরা করিতে চলে মাটি; ফেনাগুলো ফুটে ওঠে, পরক্ষণে যায় ফাটি ফাটি। কাজের সঙ্গেই খেলা গাঁথা– ভার তাহে লঘু রয়, খুশি হন সৃষ্টির বিধাতা।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) মুকুলের বক্ষোমাঝে মুকুলের বক্ষোমাঝে কুসুম আঁধারে আছে বাঁধা, সুন্দর হাসিয়া বহে প্রকাশের সুন্দর এ বাধা।   (স্ফুলিঙ্গ) মুক্ত যে ভাবনা মোর মুক্ত যে ভাবনা মোর ওড়ে ঊর্ধ্ব-পানে সেই এসে বসে মোর গানে।   (স্ফুলিঙ্গ) মুক্তপথে বাঁকাও ভুরু দ্বারে আগল দিয়া, চক্ষু করো রাঙা, ঐ আসে মোর জাত-খোয়ানো প্রিয়া ভদ্র-নিয়ম-ভাঙা। আসন পাবার কাঙাল ও নয় তো আচার-মানা ঘরে- আমি ওকে বসাব হয়তো ময়লা কাঁথার 'পরে। সাবধানে রয় বাজার-দরের খোঁজে সাধু গাঁয়ের লোক. ধুলার বরন ধূসর বেশে ও যে এড়ায় তাদের চোখ। বেশের আদর করতে গিয়ে ওরা রূপের আদর ভোলে- আমার পাশে ও মোর মনোচোরা, একলা এসো চলে। হঠাৎ কখন এসেছ ঘর ফেলে তুমি পথিক বধূ, মাটির ভাঁড়ে কোথায় থেকে পেলে পদ্মাবনের মধু। ভালোবাসি ভাবের সহজ খেলা এসছ তাই শুনে- মাটির পাত্রে নাইকো আমার হেলা হাতের পরশগুণে। পায়ে নূপুর নাই রহিল বাঁধা, নাচেতে কাজ নাই, যে-চলনটি রক্তে তোমার সাধা মন ভোলাবে তাই। লজ্জা পেতে লাগে তোমার লাজ ভূষণ নেইকো বলে, নষ্ট হবে নেই তো এমন সাজ ধুলোর 'পরে চলে। গাঁয়ের কুকুর ফেরে তোমার পাশে, রাখালরা হয় জড়ো, বেদের মেয়ের মতন অনায়াসে টাট্টু ঘোড়ায় চড়ো। ভিজে শাড়ি হাঁটুর 'পরে তুলে পার হয়ে যাও নদী, বামুনপাড়ার রাস্তা যে যাই ভুলে তোমায় দেখি যদি। হাটের দিনে শাক তুলে নাও ক্ষেতে চুপড়ি নিয়ে কাঁধে, মটর কলাই খাওয়াও আঁচল পেতে পথের গাধাটাকে। মান নাকো বাদল দিনের মানা, কাদায়-মাখা পায়ে মাথায় তুলে কচুর পাতাখানা যাও চলে দূর গাঁয়ে। পাই তোমারে যেমন খুশি তাই যেতায় খুশি সেথা। আয়োজনের বালাই কিছু নাই জানবে বলো কে তা। সতর্কতার দায় গুচায়ে দিয়ে পাড়ার অনাদরে এসো ও মোর জাত খোয়ানো প্রিয়ে, মু্ক্ত পথের 'পরে। মুক্তবাতায়নপ্রান্তে জনশূন্য ঘরে মুক্তবাতায়নপ্রান্তে জনশূন্য ঘরে বসে থাকি নিস্তব্ধ প্রহরে, বাহিরে শ্যামল ছন্দে উঠে গান ধরণীর প্রাণের আহ্বান; অমৃতের উৎসস্রোতে চিত্ত ভেসে চলে যায় দিগন্তের নীলিম আলোতে। কার পানে পাঠাইবে স্তুতি ব্যগ্র এই মনের আকূতি, অমূল্যেরে মূল্য দিতে ফিরে সে খুঁজিয়া বাণীরূপ, করে থাকে চুপ, বলে,আমি আনন্দিত– ছন্দ যায় থামি– বলে, ধন্য আমি।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) মুক্তি এই—সহজে ফিরিয়া আসা সহজের মাঝে মুক্তি এই—সহজে ফিরিয়া আসা সহজের মাঝে, নহে কৃচ্ছ্রসাধনায় ক্লিষ্ট কৃশ বঞ্চিত প্রাণের আত্ম অস্বীকারে। রিক্ততায় নিঃস্বতায়, পূর্ণতার প্রেতচ্ছবি ধ্যান করা অসম্মান জগৎলক্ষ্মীর। আজ আমি দেখিতেছি, সম্মুখে মুক্তির পূর্ণরূপ ওই বনস্পতি মাঝে, ঊর্ধ্বে তুলি’ ব্যগ্র শাখা তার শরৎ প্রভাতে আজি স্পর্শিছে সে মহা অলক্ষ্যেরে কম্পমান পল্লবে পল্লবে; লভিল মজ্জার মাঝে সে মহা আনন্দ যাহা পরিব্যাপ্ত লোকে লোকান্তরে, বিচ্ছুরিত সমীরিত আকাশে আকাশে, স্ফুটোন্মুখ পুষ্পে পুষ্পে, পাখিদের কণ্ঠে কণ্ঠে স্বত উৎসারিত।সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন লুকায়েছে তৃণতলে সর্ব আবর্জনাগ্রাসী বিরাট ধুলায়, জপমন্ত্র মিলে গেছে পতঙ্গ-গুঞ্জনে। অনিঃশেষ যে-তপস্যা প্রাণরসে উচ্ছ্বসিত, সব দিতে সব নিতে যে বাড়াল কমণ্ডলু দ্যুলোকে ভূলোকে, তারি বর পেয়েছি অন্তরে মোর, তাই সর্ব দেহমন প্রাণ সূক্ষ্ম হয়ে প্রসারিল আজি ওই নিঃশব্দ প্রান্তরে ছায়ারৌদ্রে হেথাহোথা যেথায় রোমন্থরত ধেনু আলস্যে শিথিল অঙ্গ, তৃপ্তিরস-সম্ভোগ তাদের সঞ্চারিছে ধীরে মোর পুলকিত সত্তার গভীরে। দলে দলে প্রজাপতি রৌদ্র হতে নিতেছে কাঁপায়ে নীরব আকাশবাণী শেফালীর কানে কানে বলা, তাহারি বীজন আজি শিরায় শিরায় রক্তে মোর মৃদু স্পর্শে শিহরিত তুলিছে হিল্লোল।                                          হে সংসার আমাকে বারেক ফিরে চাও; পশ্চিমে যাবার মুখে বর্জন কোরো না মোরে উপেক্ষিত ভিক্ষুকের মতো।জীবনের শেষপাত্র উচ্ছলিয়া দাও পূর্ণ করি’, দিনান্তের সর্বদানযজ্ঞে যথা মেঘের অঞ্জলি পূর্ণ করি দেয় সন্ধ্যা, দান করি’ চরম আলোর অজস্র ঐশ্বর্যরাশি সমুজ্জ্বল সহস্র রশ্মির,— সর্বহর আঁধারের দস্যুবৃত্তি ঘোষণার আগে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) মুচকে হাসে অতুল খুড়ো মুচকে হাসে অতুল খুড়ো, কানে কলম গোঁজা। চোখ টিপে সে বললে হঠাৎ, “পরতে হবে মোজা।’ হাসল ভজা, হাসল নবাই– “ভারি মজা’ ভাবল সবাই– ঘরসুদ্ধ উঠল হেসে, কারণ যায় না বোঝা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মুরগি পাখির ‘পরে মুরগি পাখির ‘পরে অন্তরে টান তার, জীবে তার দয়া আছে এই তো প্রমাণ তার। বিড়াল চাতুরী ক’রে পাছে পাখি নেয় ধরে এই ভয়ে সেই দিকে সদা আছে কান তার– শেয়ালের খলতায় ব্যথা পায় প্রাণ তার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মুর্খু নেই বা হলেম যেমন তোমার           অম্বিকে গোঁসাই । আমি তো , মা , চাই নে হতে           পণ্ডিতমশাই । নাই যদি হই ভালো ছেলে , কেবল যদি বেড়াই খেলে তুঁতের ডালে খুঁজে বেড়াই           গুটিপোকার গুটি , মুর্খু হয়ে রইব তবে ? আমার তাতে কীই বা হবে , মুর্খু যারা তাদেরই তো           সমস্তখন ছুটি ।    তারাই তো সব রাখাল ছেলে           গোরু চরায় মাঠে । নদীর ধারে বনে বনে           তাদের বেলা কাটে । ডিঙির ' পরে পাল তুলে দেয় , ঢেউয়ের মুখে নাও খুলে দেয় , ঝাউ কাটতে যায় চলে সব           নদীপারের চরে । তারাই মাঠে মাচা পেতে পাখি তাড়ায় ফসল - খেতে , বাঁকে করে দই নিয়ে যায়           পাড়ার ঘরে ঘরে ।    কাস্তে হাতে চুবড়ি মাথায় ,           সন্ধে হলে পরে ফেরে গাঁয়ে কৃষাণ ছেলে ,           মন যে কেমন করে । যখন গিয়ে পাঠশালাতে দাগা বুলোই খাতার পাতে , গুরুমশাই দুপুরবেলায়           বসে বসে ঢোলে , হাঁকিয়ে গাড়ি কোন্ গাড়োয়ান মাঠের পথে যায় গেয়ে গান , শুনে আমি পণ করি যে           মুর্খু হব বলে ।    দুপুরবেলায় চিল ডেকে যায় ;           হঠাৎ হাওয়া আসি বাঁশ - বাগানে বাজায় যেন           সাপ - খেলাবার বাঁশি । পুবের দিকে বনের কোলে বাদল - বেলার আঁচল দোলে , ডালে ডালে উছলে ওঠে           শিরীষফুলের ঢেউ । এরা যে পাঠ - ভোলার দলে পাঠশালা সব ছাড়তে বলে , আমি জানি এরা তো , মা ,           পণ্ডিত নয় কেউ ।    যাঁরা অনেক পুঁথি পড়েন           তাঁদের অনেক মান । ঘরে ঘরে সবার কাছে           তাঁরা আদর পান । সঙ্গে তাঁদের ফেরে চেলা , ধুমধামে যায় সারা বেলা , আমি তো , মা , চাই নে আদর           তোমার আদর ছাড়া । তুমি যদি মুর্খু বলে আমাকে মা না নাও কোলে তবে আমি পালিয়ে যাব           বাদলা মেঘের পাড়া ।    সেখান থেকে বৃষ্টি হয়ে           ভিজিয়ে দেব চুল । ঘাটে যখন যাবে , আমি           করব হুলুস্থূল । রাত থাকতে অনেক ভোরে আসব নেমে আঁধার করে , ঝড়ের হাওয়ায় ঢুকব ঘরে           দুয়ার ঠেলে ফেলে , তুমি বলবে মেলে আঁখি , ' দুষ্টু দেয়া খেপল না কি ?' আমি বলব , ' খেপেছে আজ           তোমার মুর্খু ছেলে । ' (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) মুহুর্ত মিলায়ে যায় মুহুর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে— আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে।   (স্ফুলিঙ্গ) মূল আগা বলে, আমি বড়ো, তুমি ছোটো লোক। গোড়া হেসে বলে, ভাই, ভালো তাই হোক। তুমি উচ্চে আছ ব’লে গর্বে আছ ভোর, তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মৃত্তিকা খোরাকি দিয়ে মৃত্তিকা খোরাকি দিয়ে বাঁধে বৃক্ষটারে, আকাশ আলোক দিয়ে মুক্ত রাখে তারে।   (স্ফুলিঙ্গ) মৃত্যু ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময় মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়। তুমি পরিপূর্ণ রূপ, তব বক্ষে কোলে জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের মূল্য দিতে হয় সে প্রাণ অমৃতলোকে মৃত্যু করে জয়।   (স্ফুলিঙ্গ) মৃত্যুদূত এসেছিল হে প্রলয়ংকর, অকস্মাৎ মৃত্যুদূত এসেছিল হে প্রলয়ংকর, অকস্মাৎ তব সভা হতে। নিয়ে গেল বিরাট প্রাঙ্গণে তব; চক্ষে দেখিলাম অন্ধকার; দেখিনি অদৃশ্য আলো আঁধারের স্তরে স্তরে অন্তরে অন্তরে, যে আলোক নিখিল জ্যোতির জ্যোতি; দৃষ্টি মোর ছিল আচ্ছাদিয়া আমার আপন ছায়া। সেই আলোকের সামগান মন্দ্রিয়া উঠিবে মোর সত্তার গভীর গুহা হতে সৃষ্টির সীমান্ত জ্যোতির্লোকে, তারি লাগি ছিল মোর আমন্ত্রণ। লব আমি চরমের কবিত্বমর্যাদা জীবনের রঙ্গভূমে, এরি লাগি সেধেছিনু তান।বাজিল না রুদ্রবীণা নিঃশব্দ ভৈরব নবরাগে, জাগিল না মর্মতলে ভীষণের প্রসন্ন মুরতি তাই ফিরাইয়া দিলে। আসিবে আরেক দিন যবে তখন কবির বাণী পরিপক্ব ফলের মতন নিঃশব্দে পড়িবে খসি’ আনন্দের পূর্ণতার ভারে অনন্তের অর্ঘ্যডালি পরে। চরিতার্থ হবে শেষে জীবনের শেষমূল্য, শেষযাত্রা, শেষনিমন্ত্রণ।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যুমাধুরী পরান কহিছে ধীরে—হে মৃত্যু মধুর, এই নীলাম্বর, এ কি তব অন্তঃপুর! আজি মোর মনে হয়, এ শ্যামলা ভূমি বিস্তীর্ণ কোমল শয্যা পাতিয়াছ তুমি। জলে স্থলে লীলা আজি এই বরষার, এই শান্তি, এ লাবণ্য, সকলই তোমার। মনে হয়, যেন তব মিলন-বিহনে অতিশয় ক্ষুদ্র আমি এ বিশ্বভুবনে। প্রশান্ত করুণচক্ষে, প্রসন্ন অধরে, তুমি মোরে ডাকিতেছ সর্ব চরাচরে। প্রথমমিলনভীতি ভেঙেছে বধূর তোমার বিরাট মূর্তি নিরখি মধুর। সর্বত্র বিবাহবাঁশি উঠিতেছে বাজি, সর্বত্র তোমার ক্রোড় হেরিতেছি আজি।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যুর পরে আজিকে হয়েছে শান্তি , জীবনের ভুলভ্রান্তি সব গেছে চুকে । রাত্রিদিন ধুক্‌ধুক্‌ তরঙ্গিত দুঃখসুখ থামিয়াছে বুকে । যত কিছু ভালোমন্দ যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছু আর নাই । বলো শান্তি , বলো শান্তি , দেহ-সাথে সব ক্লান্তি হয়ে যাক ছাই ।গুঞ্জরি করুক তান ধীরে ধীরে করো গান বসিয়া শিয়রে । যদি কোথা থাকে লেশ জীবনস্বপ্নের শেষ তাও যাক মরে । তুলিয়া অঞ্চলখানি মুখ- ' পরে দাও টানি , ঢেকে দাও দেহ । করুণ মরণ যথা ঢাকিয়াছে সব ব্যথা সকল সন্দেহ ।বিশ্বের আলোক যত দিগ্‌বিদিকে অবিরত যাইতেছে বয়ে , শুধু ওই আঁখি- ' পরে নামে তাহা স্নেহভরে অন্ধকার হয়ে । জগতের তন্ত্রীরাজি দিনে উচ্চে উঠে বাজি , রাত্রে চুপে চুপে সে শব্দ তাহার ‘ পরে চুম্বনের মতো পড়ে নীরবতারূপে ।মিছে আনিয়াছ আজি বসন্তকুসুমরাজি দিতে উপহার । নীরবে আকুল চোখে ফেলিতেছ বৃথা শোকে নয়নাশ্রুধার । ছিলে যারা রোষভরে বৃথা এতদিন পরে করিছ মার্জনা । অসীম নিস্তব্ধ দেশে চিররাত্রি পেয়েছে সে অনন্ত সান্ত্বনা ।গিয়েছে কি আছে বসে জাগিল কি ঘুমাল সে কে দিবে উত্তর । পৃথিবীর শ্রান্তি তারে ত্যজিল কি একেবারে জীবনের জ্বর! এখনি কি দুঃখসুখে কর্মপথ-অভিমুখে চলেছে আবার । অস্তিত্বের চক্রতলে একবার বাঁধা প ' লে পায় কি নিস্তার ।বসিয়া আপন দ্বারে ভালোমন্দ বলো তারে যাহা ইচ্ছা তাই । অনন্ত জনমমাঝে গেছে সে অনন্ত কাজে , সে আর সে নাই । আর পরিচিত মুখে তোমাদের দুখে সুখে আসিবে না ফিরে । তবে তার কথা থাক্‌ , যে গেছে সে চলে যাক বিস্মৃতির তীরে ।জানি না কিসের তরে যে যাহার কাজ করে সংসারে আসিয়া , ভালোমন্দ শেষ করি যায় জীর্ণ জন্মতরী কোথায় ভাসিয়া । দিয়ে যায় যত যাহা রাখো তাহা ফেলো তাহা যা ইচ্ছা তোমার । সে তো নহে বেচাকেনা — ফিরিবে না , ফেরাবে না জন্ম-উপহার ।কেন এই আনাগোনা , কেন মিছে দেখাশোনা দু-দিনের তরে , কেন বুকভরা আশা , কেন এত ভালোবাসা অন্তরে অন্তরে , আয়ু যার এতটুক , এত দুঃখ এত সুখ কেন তার মাঝে , অকস্মাৎ এ সংসারে কে বাঁধিয়া দিল তারে শত লক্ষ কাজে —হেথায় যে অসম্পূর্ণ , সহস্র আঘাতে চূর্ণ বিদীর্ণ বিকৃত , কোথাও কি একবার সম্পূর্ণতা আছে তার জীবিত কি মৃত , জীবনে যা প্রতিদিন ছিল মিথ্যা অর্থহীন ছিন্ন ছড়াছড়ি মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি তারে গাঁথিয়াছে আজি অর্থপূর্ণ করি —হেথা যারে মনে হয় শুধু বিফলতাময় অনিত্য চঞ্চল সেথায় কি চুপে চুপে অপূর্ব নূতন রূপে হয় সে সফল — চিরকাল এই-সব রহস্য আছে নীরব রুদ্ধ-ওষ্ঠাধর । জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে পেয়েছে উত্তর ।সে হয়তো দেখিয়াছে পড়ে যাহা ছিল পাছে আজি তাহা আগে , ছোটো যাহা চিরদিন ছিল অন্ধকারে লীন বড়ো হয়ে জাগে । যেথায় ঘৃণার সাথে মানুষ আপন হাতে লেপিয়াছে কালি নূতন নিয়মে সেথা জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা কে দিয়াছে জ্বালি ।কত শিক্ষা পৃথিবীর খসে পড়ে জীর্ণচীর জীবনের সনে , সংসারের লজ্জাভয় নিমেষেতে দগ্ধ হয় চিতাহুতাশনে । সকল অভ্যাস-ছাড়া সর্ব-আবরণ-হারা সদ্যশিশুসম নগ্নমূর্তি মরণের নিষ্কলঙ্ক চরণের সম্মুখে প্রণমো ।আপন মনের মতো সংকীর্ণ বিচার যত রেখে দাও আজ । ভুলে যাও কিছুক্ষণ প্রত্যহের আয়োজন , সংসারের কাজ । আজি ক্ষণেকের তরে বসি বাতায়ন- ' পরে বাহিরেতে চাহো । অসীম আকাশ হতে বহিয়া আসুক স্রোতে বৃহৎ প্রবাহ ।উঠিছে ঝিল্লির গান , তরুর মর্মরতান , নদীকলস্বর — প্রহরের আনাগোনা যেন রাত্রে যায় শোনা আকাশের'পর । উঠিতেছে চরাচরে অনাদি অনন্ত স্বরে সংগীত উদার — সে নিত্য-গানের সনে মিশাইয়া লহো মনে জীবন তাহার ।ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে দেখো তারে সর্বদৃশ্যে বৃহৎ করিয়া । জীবনের ধূলি ধুয়ে দেখো তারে দূরে থুয়ে সম্মুখে ধরিয়া । পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে মাপিয়ো না তারে । থাক্‌ তব ক্ষুদ্র মাপ ক্ষুদ্র পুণ্য ক্ষুদ্র পাপ সংসারের পারে ।আজ বাদে কাল যারে ভুলে যাবে একেবারে পরের মতন তারে লয়ে আজি কেন বিচার-বিরোধ হেন , এত আলাপন । যে বিশ্ব কোলের'পরে চিরদিবসের তরে তুলে নিল তারে তার মুখে শব্দ নাহি , প্রশান্ত সে আছে চাহি ঢাকি আপনারে ।বৃথা তারে প্রশ্ন করি , বৃথা তার পায়ে ধরি , বৃথা মরি কেঁদে , খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে — কোন্‌ অঞ্চলের তলে নিয়েছে সে বেঁধে । ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে , ফিরে নিতে চাহি মিছে , সে কি আমাদের ? পলেক বিচ্ছেদে হায় তখনি তো বুঝা যায় সে যে অনন্তের ।চক্ষের আড়ালে তাই কত ভয় সংখ্যা নাই , সহস্র ভাবনা । মুহূর্ত মিলন হলে টেনে নিই বুকে কোলে , অতৃপ্ত কামনা । পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি , শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি , চাহি চারিভিতে , অনন্তের ধনটিরে আপনার বুক চিরে চাহি লুকাইতে ।হায় রে নির্বোধ নর , কোথা তোর আছে ঘর , কোথা তোর স্থান । শুধু তোর ওইটুকু অতিশয় ক্ষুদ্র বুক ভয়ে কম্পমান । ঊর্ধ্বে ওই দেখ্‌ চেয়ে সমস্ত আকাশ ছেয়ে অনন্তের দেশ — সে যখন এক ধারে লুকায়ে রাখিবে তারে পাবি কি উদ্দেশ ?ওই হেরো সীমাহারা গগনেতে গ্রহতারা অসংখ্য জগৎ , ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত হয়তো সে একা পান্থ খুঁজিতেছে পথ । ওই দূর-দূরান্তরে অজ্ঞাত ভুবন- ' পরে কভু কোনোখানে আর কি গো দেখা হবে , আর কি সে কথা কবে , কেহ নাহি জানে ।যা হবার তাই হোক , ঘুচে যাক সর্ব শোক , সর্ব মরীচিকা । নিবে যাক চিরদিন পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ মর্তজন্মশিখা । সব তর্ক হোক শেষ , সব রাগ সব দ্বেষ , সকল বালাই । বলো শান্তি , বলো শান্তি , দেহ-সাথে সব ক্লান্তি পুড়ে হোক ছাই । মেঘদূত নিমেষে টুটিয়া গেল সে মহাপ্রতাপ। ঊর্ধ্ব হতে একদিন দেবতার শাপ পশিল সে সুখরাজ্যে, বিচ্ছেদের শিখা করিয়া বহন; মিলনের মরীচিকা, যৌবনের বিশ্বগ্রাসী মত্ত অহমিকা মুহূর্তে মিলায়ে গেল মায়াকুহেলিকা খররৌদ্রকরে। ছয় ঋতু সহচরী ফেলিয়া চামরছত্র, সভাভঙ্গ করি সহসা তুলিয়া দিল রঙ্গযবনিকা— সহসা খুলিয়া গেল, যেন চিত্রে লিখা, আষাঢ়ের অশ্রুপ্লুত সুন্দর ভুবন। দেখা দিল চারি দিকে পর্বত কানন নগর নগরী গ্রাম—বিশ্বসভামাঝে তোমার বিরহবীণা সকরুণ বাজে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মেঘের কোলে রোদ হেসেছে মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা।।কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্‌ বনে যাই, কোন্‌ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা।।কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে– তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে। রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু, মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা।। মেঘের পরে মেঘ জমেছে মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে- আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে। কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে, আজ আমি যে বসে আছি তোমারই আশ্বাসে। আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।তুমি যদি না দেখা দাও কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা। দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি, পরাণ আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে। আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে। মেছুয়াবাজার থেকে পালোয়ান চারজন মেছুয়াবাজার থেকে পালোয়ান চারজন পরের ঘরেতে করে জঞ্জাল-মার্জন। ডালায় লাগিয়ে চাপ বাক্সো করেছে সাফ, হঠাৎ লাগালো গুঁতো পুলিসের সার্জন। কেঁদে বলে, “আমাদের নেই কোনো গার্জন, ভেবেছিনু হেথা হয় নৈশবিদ্যালয়– নিখর্‌চা জীবিকার বিদ্যা-উপার্জন।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) মোর কিছু ধন আছে সংসারে মোর কিছু ধন আছে সংসারে, বাকি সব ধন স্বপনে নিভৃতস্বপনে। ওগো কোথা মোর আশার অতীত, ওগো কোথা তুমি পরশচকিত, কোথা গো স্বপনবিহারী। তুমি এসো এসো গভীর গোপনে, এসো গো নিবিড় নীরব চরণে বসনে প্রদীপ নিবারি, এসো গো গোপনে। মোর কিছু ধন আছে সংসারে বাকি সব আছে স্বপনে নিভৃত স্বপনে।রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি, পথ ভরিয়াছে আলোকে প্রখর আলোকে। সবার অজানা, হে মোর বিদেশী, তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী, হে মোর স্বপনবিহারী। তোমারে চিনিব প্রাণের পুলকে, চিনিব সজল আঁখির পলকে, চিনিব বিরলে নেহারি পরমপুলকে। এসো প্রদোষের ছায়াতল দিয়ে, এসো না পথের আলোকে প্রখরআলোকে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) মোর চেতনায় মোর চেতনায় আদিসমুদ্রের ভাষা ওঙ্কারিয়া যায়; অর্থ তার নাহি জানি, আমি সেই বাণী। শুধু ছলছল কলকল; শুধু সুর, শুধু নৃত্য, বেদনার কলকোলাহল; শুধু এ সাঁতার-- কখনো এ পারে চলা, কখনো ও পার, কখনো বা অদৃশ্য গভীরে, কভু বিচিত্রের তীরে তীরে। ছন্দের তরঙ্গদোলে কত যে ইঙ্গিত ভঙ্গি জেগে ওঠে, ভেসে যায় চলে। স্তব্ধ মৌনী অচলের বহিয়া ইশারা নিরন্তর স্রোতোধারা অজানা সম্মুখে ধায়, কোথা তার শেষ কে জানে উদ্দেশ। আলোছায়া ক্ষণে ক্ষণে দিয়ে যায় ফিরে ফিরে স্পর্শের পর্যায়। কভু দূরে কখনো নিকটে প্রবাহের পটে মহাকাল দুই রূপ ধরে পরে পরে কালো আর সাদা। কেবলি দক্ষিণে বামে প্রকাশ ও প্রকাশের বাধা অধরার প্রতিবিম্ব গতিভঙ্গে যায় এঁকে এঁকে, গতিভঙ্গে যায় ঢেকে ঢেকে। মোহ এ মোহ ক'দিন থাকে, এ মায়া  মিলায়, কিছুতে পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে - কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায়, মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে । কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায় । ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে । কোথা সেই হাসিপ্রাপ্ত চুম্বনতৃষিত রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর! কোথা কুসুমিত তনু পূর্ণবিকশিত - কম্পিত পুলকভরে, যৌবনকাতর! তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা, সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা, সেই প্রাণোপরিপূর্ণ মরণ-অনল - মনে প'ড়ে হাসি আসে? চোখে আসে জল? মোহ (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মোহের আশঙ্কা শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধভরা— বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়, আমি যত কাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) মৌন যাহা-কিছু বলি আজি সব বৃথা হয়, মন বলে মাথা নাড়ি—এ নয়, এ নয়। যে কথায় প্রাণ মোর পরিপূর্ণতম সে কথা বাজে না কেন এ বীণায় মম। সে শুধু ভরিয়া উঠি অশ্রুর আবেগে হৃদয়আকাশ ঘিরে ঘনঘোর মেঘে; মাঝে মাঝে বিদ্যুতের বিদীর্ণ রেখায় অন্তর করিয়া ছিন্ন কী দেখাতে চায়? মৌন মূক মূঢ়-সম ঘনায়ে আঁধারে সহসা নিশীথরাত্রে কাঁদে শত ধারে। বাক্যভারে রুদ্ধকণ্ঠ, রে স্তম্ভিত প্রাণ, কোথায় হারায়ে এলি তোর যত গান। বাঁশি যেন নাই, বৃথা নিশ্বাস কেবল— রাগিনীর পরিবর্তে শুধু অশ্রুজল।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মৌলানা জিয়াউদ্দিন কখনো কখনো কোনো অবসরে           নিকটে দাঁড়াতে এসে; "এই যে' বলেই তাকাতেম মুখে,           "বোসো' বলিতাম হেসে। দু-চারটে হত সামান্য কথা,           ঘরের প্রশ্ন কিছু, গভীর হৃদয় নীরবে রহিত           হাসিতামাশার পিছু। কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়,           অকথিত কত বাণী, চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন           আজিকে সে কথা জানি। প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে           সামান্য যাওয়া-আসা, সেটুকু হারালে কতখানি যায়           খুঁজে নাহি পাই ভাষা। তব জীবনের বহু সাধনার           যে পণ্যভারে ভরি মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে           তোমার নবীন তরী, যেমনি তা হোক মনে জানি তার           এতটা মূল্য নাই যার বিনিময়ে পাবে তব স্মৃতি           আপন নিত্য ঠাঁই-- সেই কথা স্মরি বার বার আজ           লাগে ধিক্‌কার প্রাণে-- অজানা জনের পরম মূল্য           নাই কি গো কোনোখানে। এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে           কোথা হতে খুঁজে আনি ছুরির আঘাত যেমন সহজ           তেমন সহজ বাণী। কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব,           কারো অর্থের খ্যাতি-- কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্‌ সহায়,           কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি-- তুমি আপনার বন্ধুজনেরে           মাধুর্যে দিতে সাড়া, ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা           সকল খ্যাতির বাড়া। ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি           আনন্দমহিমায় আপনার দান নিঃশেষ করি           ধুলায় মিলায়ে যায়-- আকাশে আকাশে বাতাসে তাহারা           আমাদের চারি পাশে তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে           সৌরভনিশ্বাসে। ম্যাক্‌বেথ্‌ (ডাকিনী । ম্যাক্‌বেথ্‌) দৃশ্য : বিজন প্রান্তর । বজ্র বিদ্যুৎ । তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — ঝড় বাদলে আবার কখন মিল্‌ব মোরা তিনটি জনে। ২য় ডা — ঝগড়া ঝাঁটি থামবে যখন, হার জিত সব মিট্‌বে রণে। ৩য় ডা — সাঁঝের আগেই হবে সে ত; ১ম ডা — মিল্‌ব কোথায় বোলে দে ত। ২য় ডা — কাঁটা খোঁচা মাঠের মাঝ। ৩য় ডা — ম্যাক্কেথ সেথা আস্‌চে আজ। ১ম ডা — কটা বেড়াল! যাচ্ছি ওরে! ২য় ডা — ঐ বুঝি ব্যাং ডাক্‌চে মোরে! ৩য় ডা — চল্‌ তবে চল্‌ ত্বরা কোরে! সকলে — মোদের কাছে ভালই মন্দ, মন্দ যাহা ভাল যে তাই, অন্ধকারে কোয়াশাতে ঘুরে ঘুরে ঘুরে বেড়াই!প্রস্থান। দৃশ্য : এক প্রান্তর। বজ্র। তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — এতক্ষণ বোন কোথায় ছিলি? ২য় ডা — মারতে ছিলুম শুয়োরগুলি। ৩য় ডা — তুই ছিলি বোন, কোথায় গিয়ে? ১ম ডা — দেখ্‌, একটা মাঝির মেয়ে গোটাকতক বাদাম নিয়ে খাচ্ছিল সে কচ্‌মচিয়ে কচ্‌মচিয়ে কচ্‌মচিয়ে– চাইলুম তার কাছে গিয়ে, পোড়ারমুখী বোল্লে রেগে “ডাইনি মাগী যা তুই ভেগে।’ আলাপোয় তার স্বামী গেছে, আমি যাব পাছে পাছে। বেঁড়ে একটা ইঁদুর হোয়ে চালুনীতে যাব বোয়ে– যা বোলেছি কোর্‌ব আমি কোর্‌ব আমি– নইক আমি এমন মেয়ে! ২য় ডা — আমি দেব বাতাস একটি। ১ম ডা — তুমি ভাই বেশ লোকটি! ৩য় ডা — একটি পাবি আমার কাছে। ১ম ডা — বাকি সব আমারি আছে। * * * খড়ের মত একেবারে শুকিয়ে আমি ফেল্‌ব তারে। কিবা দিনে কিবা রাতে ঘুম রবে না চোকের পাতে। মিশ্‌বে না কেউ তাহার সাথে। একাশি বার সাত দিন শুকিয়ে শুকিয়ে হবে ক্ষীণ। জাহাজ যদি না যায় মারা ঝড়ের মুখে সবে সারা। বল্‌ দেখি বোন্‌, এইটে কি! ২য় ডা — কই, কই, কই, দেখি, দেখি। ১ম ডা — একটা মাঝির বুড় আঙুল রোয়েচে লো বোন, আমার কাছে, বাড়িমুখো জাহাজ তাহার পথের মধ্যে মারা গেছে। ৩য় ডা — ঐ শোন্‌ শোন্‌ বাজ্‌ল ভেরী আসে ম্যাক্কেথ, নাইক দেরী! দৃশ্য : গুহা। মধ্যে ফুটন্ত কটাহ। বজ্র। তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — কালো বেড়াল তিনবার করেছিল চীৎকার। ২য় ডা — তিনবার আর একবার সজারুটা ডেকেছিল। ৩য় ডা — হার্পি বলে আকাশ তলে “সময় হোল’ “সময় হোল!’ ১ম ডা — আয় রে কড়া ঘিরে ঘিরে বেড়াই মোরা ফিরে ফিরে বিষমাখা ওই নাড়ি ভুঁড়ি কড়ার মধ্যে ফেল্‌ রে ছুঁড়ি। ব্যাং একটা ঠান্ডা ভুঁয়ে একত্রিশ দিন ছিল শুয়ে, কড়ার মধ্যে ফেল্‌ব মোরা। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ২য় ডা — জলার সাপের মাংস নিয়ে সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে। গির্গিটি-চোক ব্যাঙ্গের পা, টিকটিকি-ঠ্যাং পেঁচার ছা। কুত্তোর জিব, বাদুড় রোঁয়া, সাপের জিব আর শুওর শোঁয়া। শক্ত ওষুধ কোরতে হবে টগ্‌বগিয়ে ফোটাই তবে। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বলরে আগুন ওঠ্‌রে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ৩য় ডা — মকরের আঁশ, বাঘের দাঁত, ডাইনি-মড়া, হাঙ্গর ব্যাঁৎ, ইষের শিকড় তুলেছি রাতে, নেড়ের পিলে মেশাই তাতে, পাঁঠার পিত্তি, শেওড়া ডাল গেরণ-কালে কেটেছি কাল, তাতারের ঠোঁট, তুর্কি নাক, তাহার সাথে মিশিয়ে রাখ। আন্‌গে রে সেই ভ্রূণ-মরা, খানায় ফেলে খুন-করা, তারি একটি আঙুল নিয়ে সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে। বাঘের নাড়ি ফেলে তাতে ঘন কর আগুন-তাতে। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ২য় ডা — বাঁদর ছানার রক্তে তবে ওষুধ ঠান্ডা কোরতে হবে– তবেই ওষুধ শক্ত হবে।  (অনুবাদ কবিতা) যক্ষ হে যক্ষ তোমার প্রেম ছিল বদ্ধ কোরকের মতো, একান্তে প্রেয়সী তব সঙ্গে যবে ছিল অনিয়ত সংকীর্ণ ঘরের কোণে, আপন বেষ্টনে তুমি যবে রুদ্ধ রেখেছিলে তারে দু-জনের নির্জন উৎসবে সংসারের নিভৃত সীমায়, শ্রাবণের মেঘজাল কৃপণের মতো যথা শশাঙ্কের রচে অন্তরাল আপনার আলিঙ্গনে আপনি হারায়ে ফেলে তারে, সম্পূর্ণ মহিমা তার দেখিতে পায় না একেবারে অন্ধ মোহাবেশে। বর তুমি পেলে যবে প্রভুশাপে, সামীপ্যের বন্ধন ছিন্ন হ'ল, বিরহের দুঃখতাপে প্রেম হ'ল পূর্ণ বিকশিত; জানিল সে আপনারে বিশ্বধরিত্রীর মাঝে। নির্বাধে তাহার চারিধারে সন্ধ্যা অর্ঘ্য করে দান বৃষ্টিজলে সিক্ত বনযূথী গন্ধের অঞ্জলি; নীপনিকুঞ্জের জানাল আকুতি রেণুভারে মন্থর পবন। উঠে গেল যবনিকা আত্মবিস্মৃতির, দেখা দিল দিকে দিগন্তরে লিখা উদার বর্ষার বাণী, যাত্রামন্ত্র বিশ্বপথিকের মেঘধ্বজে আঁকা, দিগ্বধূ-প্রাঙ্গণ হতে নির্ভীকের শূন্যপথে অভিসার। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে দীক্ষা পেলে অশ্রুধৌত সৌম্য বিষাদের; নিত্যরসে আপনি করিলে সৃষ্টি রূপসীর অপূর্ব মুরতি অন্তহীন গরিমায় কান্তিময়ী। এক দিন ছিল সেই সতী গৃহের সঙ্গিনী, তারে বসাইলে ছন্দশঙ্খ রবে আলোক-আলোকদীপ্ত অলকার অমর গৌরবে অনন্তের আনন্দ-মন্দিরে। প্রেম তব ছিল বাক্যহীন, আজ সে পেয়েছে তার ভাষা, আজ তার রাত্রিদিন সংগীত তরঙ্গে আন্দোলিত। তুমি আজ হলে কবি মুক্ত তব দৃষ্টিপথে উদ্বারিত নিখিলের ছবি শ্যামমেঘে স্নিগ্ধচ্ছায়া। বক্ষ ছাড়ি মর্মে অধ্যাসীনা প্রিয়া তব ধ্যানোদ্ভবা লয়ে তার বিরহের বীণা। অপরূপ রূপে রচি বিচ্ছেদের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তোমার প্রেমের সৃষ্টি উৎসর্গ করিলে বিশ্বজনে। যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে,               মনে করি আর পাব না ছাড়া।        যখন আমায় ফেল তুমি নীচে,               মনে করি আর হব না খাড়া।                   আবার তুমি দাও যে বাঁধন খুলে,                   আবার তুমি নাও আমারে তুলে,                   চিরজীবন বাহু-দোলায় তব                     এমনি করে কেবলি দাও নাড়া।       ভয় লাগায়ে তন্দ্রা কর ক্ষয়,       ঘুম ভাঙায়ে তখন ভাঙ ভয়।                     দেখা দিয়ে ডাক দিয়ে যাও প্রাণে,                     তাহার পরে লুকাও যে কোন্‌খানে,                     মনে করি এই হারালেম বুঝি,                           কোথা হতে আবার যে দাও সাড়া। ১১ শ্রাবণ, ১৩১৭ যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায় যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায় দিনে দিনে সামর্থ্য ঝরায়, যৌবন এ জীর্ণ নীড় পিছে ফেলে দিয়ে যায় ফাঁকি, কেবল শৈশব থাকে বাকি। বদ্ধ ঘরে কর্মক্ষুব্ধ সংসার–বাহিরে অশক্ত সে শিশুচিত্ত মা খুঁজিয়া ফিরে। বিত্তহারা প্রাণ লুব্ধ হয় বিনা মূল্যে স্নেহের প্রশ্রয় কারো কাছে করিবারে লাভ, যার আবির্ভাব ক্ষীণজীবিতেরে করে দান জীবনের প্রথম সম্মান। “থাকো তুমি’ মনে নিয়ে এইটুকু চাওয়া কে তারে জানাতে পারে তার প্রতি নিখিলের দাওয়া শুধু বেঁচে থাকিবার। এ বিস্ময় বারবার আজি আসে প্রাণে প্রাণলক্ষ্মী ধরিত্রীর গভীর আহ্বানে মা দাঁড়ায় এসে যে মা চিরপুরাতন নূতনের বেশে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) যখন গগনতলে যখন গগনতলে অাঁধারের দ্বার গেল খুলি সোনার সংগীতে উষা চয়ন করিল তারাগুলি।   (স্ফুলিঙ্গ) যখন ছিলেম পথেরই মাঝখানে যখন ছিলেম পথেরই মাঝখানে মনটা ছিল কেবল চলার পানে বোধ হত তাই, কিছুই তো নাই কাছে— পাবার জিনিস সামনে দূরে আছে। লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছব এই ঝোঁকে সমস্ত দিন চলেছি একরোখে। দিনের শেষে পথের অবসানে মুখ ফিরে আজ তাকাই পিছু-পানে। এখন দেখি পথের ধারে ধারে পাবার জিনিস ছিল সারে সারে। সামনে ছিল যে দূর সুমধুর পিছনে আজ নেহারি সেই দূর।   (স্ফুলিঙ্গ) যখন জলের কল যখন জলের কল হয়েছিল পলতায় সাহেবে জানালো খুদু, ভরে দেবে জল তায়। ঘড়াগুলো পেত যদি শহরে বহাত নদী, পারেনি যে সে কেবল কুমোরের খলতায়।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) যখন দেখা হল যখন দেখা হল তার সঙ্গে চোখে চোখে তখন আমার প্রথম বয়েস; সে আমাকে শুধাল, "তুমি খুঁজে বেড়াও কাকে?" আমি বললেম, "বিশ্বকবি তাঁর অসীম ছড়াটা থেকে একটা পদ ছিঁড়ে নিলেন কোন্‌ কৌতুকে, ভাসিয়ে দিলেন পৃথিবীর হাওয়ার স্রোতে, যেখানে ভেসে বেড়ায় ফুলের থেকে গন্ধ, বাঁশির থেকে ধ্বনি। ফিরছে সে মিলের পদটি পাবে ব'লে; তার মৌমাছির পাখায় বাজে খুঁজে বেড়াবার নীরব গুঞ্জরণ।" শুনে সে রইল চুপ করে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। আমার মনে লাগল ব্যথা, বললেম, "কী ভাবছ তুমি?" ফুলের পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বললে,-- "কেমন করে জানবে তাকে পেলে কিনা, তোমার সেই অসংখ্যের মধ্যে একটিমাত্রকে।" আমি বললেম, "আমি যে খুঁজে বেড়াই সে তো আমার ছিন্ন জীবনের সবচেয়ে গোপন কথা; ও-কথা হঠাৎ আপনি ধরা পড়ে যার আপন বেদনায়, আমি জানি আমার গোপন মিল আছে তারি ভিতর।" কোনো কথা সে বলল না। কচি শ্যামল তার রঙটি; গলায় সরু সোনার হারগাছি, শরতের মেঘে লেগেছে ক্ষীণ রোদের রেখা। চোখে ছিল একটা দিশাহারা ভয়ের চমক পাছে কেউ পালায় তাকে না ব'লে। তার দুটি পায়ে ছিল দ্বিধা, ঠাহর পায়নি কোন্‌খানে সীমা তার আঙিনাতে। দেখা হল। সংসারে আনাগোনার পথের পাশে আমার প্রতীক্ষা ঐটুকু নিয়ে। তার পরে সে চলে গেছে। যখনি যেমনি হোক জিতেনের মর্‌জি যখনি যেমনি হোক জিতেনের মর্‌জি কথায় কথায় তার লাগে আশ্চর্যি।অডিটর ছিল জিতু হিসাবেতে টঙ্ক, আপিসে মেলাতেছিল বজেটের অঙ্ক; শুনলে সে, গেছে দেশে রামদীন দর্‌জি, শুনতে না-শুনতেই বলে “আশ্চর্যি’।যে দোকানি গাড়ি তাকে করেছিল বিক্রি কিছুতে দাম না পেয়ে করেছে সে ডিক্রি, বিস্তর ভেবে জিতু উঠল সে গর্জি– “ভারি আশ্চর্যি।শুনলে, জামাইবাড়ি ছিল বুড়ি ঝিনাদায়, ছ বছর মেলেরিয়া ভুগে ভুগে চিনা দায়, সেদিন মরেছে শেষে পুরোনো সে ওর ঝি, জিতেন চশমা খুলে বলে “আশ্চর্যি’।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) যত বড়ো হোক ইন্দ্ৰধনু সে যত বড়ো হোক ইন্দ্ৰধনু সে সুদূর-আকাশে-আঁকা, অামি ভালোবাসি, মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।   (স্ফুলিঙ্গ) যতকাল তুই শিশুর মতো যতকাল তুই শিশুর মতো              রইবি বলহীন, অন্তরেরি অন্তঃপুরে              থাক্‌ রে ততদিন।                            অল্প ঘায়ে পড়বি ঘুরে,                            অল্প দাহে মরবি পুড়ে,                            অল্প গায়ে লাগলে ধুলা                                   করবে যে মলিন--                            অন্তরেরি অন্তঃপুরে                                   থাক্‌ রে ততদিন। যখন তোমার শক্তি হবে        উঠবে ভরে প্রাণ আগুন-ভরা সুধা তাঁহার        করবি যখন পান--              বাইরে তখন যাস রে ছুটে,              থাকবি শুচি ধুলায় লুটে,              সকল বাঁধন অঙ্গে নিয়ে                     বেড়াবি স্বাধীন--              অন্তরেরি অন্তঃপুরে                     থাক্‌ রে ততদিন। ১৪ শ্রাবণ, ১৩১৭ যথাকর্তব্য ছাতা বলে, ধিক্‌ ধিক্‌ মাথা মহাশয়, এ অন্যায় অবিচার আমারে না সয়। তুমি যাবে হাটে বাটে দিব্য অকাতরে, রৌদ্র বৃষ্টি যতকিছু সব আমা-’পরে। তুমি যদি ছাতা হতে কী করিতে দাদা? মাথা কয়, বুঝিতাম মাথার মর্যাদা, বুঝিতাম তার গুণে পরিপূর্ণ ধরা, মোর একমাত্র গুণ তারে রক্ষা করা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) যথার্থ আপন কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান। ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই, চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই। নভশ্চর ব’লে তার মনের বিশ্বাস, শূণ্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস। ভাবে শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতা-ডোরে। বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে। বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি, সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী, কবির বিচিত্র গান নিতে পার কাড়ি আপন চরণপ্রান্তে; তুমি মুগ্ধচিতে মগ্ন আছ আপনার গৃহের সংগীতে। স্তবে তব নাহি কান, তাই স্তব করি, তাই আমি ভক্ত তব, অনিন্দ্যসুন্দরী। ভুবন তোমারে পূজে, জেনেও জান না; ভক্তদাসীসম তুমি কর আরাধনা খ্যাতিহীন প্রিয়জনে। রাজমহিমারে যে করপরশে তব পার’ করিবারে দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে ধূলি ঝাঁট দাও তুমি আপনার ঘরে। সেই তো মহিমা তব, সেই তো গরিমা– সকল মাধুর্য চেয়ে তারি মধুরিমা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) যা পায় সকলই জমা করে যা পায় সকলই জমা করে, প্রাণের এ লীলা রাত্রিদিন। কালের তাণ্ডবলীলাভরে সকলই শূন্যেতে হয় লীন।   (স্ফুলিঙ্গ) যা রাখি আমার তরে যা রাখি আমার তরে মিছে তারে রাখি, আমিও রব না যবে সেও হবে ফাঁকি। যা রাখি সবার তরে সেই শুধু রবে— মোর সাথে ডোবে না সে, রাখে তারে সবে।   (স্ফুলিঙ্গ) যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায় ১ যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়, লভিবে সুযশ কীর্তি গৌরব যেথায়, কিন্তু গো একটি কথা, কহিতেও লাগে ব্যথা, উঠিবে যশের যবে সমুচ্চ সীমায়, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়– সুখ্যাতি অমৃত রবে, উৎফুল্ল হইবে যবে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়। ২ কত যে মমতা-মাখা, আলিঙ্গন পাবে সখা, পাবে প্রিয় বান্ধবের প্রণয় যতন, এ হতে গভীরতর, কতই উল্লাসকর, কতই আমোদে দিন করিবে যাপন, কিন্তু গো অভাগী আজি এই ভিক্ষা চায়, যখন বান্ধব-সাথ, আমোদে মাতিবে নাথ, তখন অভাগী বলে স্মরিয়ো আমায়। ৩ সুচারু সায়াহ্নে যবে ভ্রমিতে ভ্রমিতে, তোমার সে মনোহরা, সুদীপ্ত সাঁজের তারা, সেখানে সখা গো তুমি পাইবে দেখিতে– মনে কি পড়িবে নাথ, এক দিন আমা সাথ, বনভ্রমি ফিরে যবে আসিতে ভবনে– ওই সেই সন্ধ্যাতারা, দুজনে দেখেছি মোরা, আরো যেন জ্বল জ্বল জ্বলিত গগনে। ৪ নিদাঘের শেষাশেষি, মলিনা গোলাপরাশি, নিরখি বা কত সুখী হইতে অন্তরে, দেখি কি স্মরিবে তায়, সেই অভাগিনী হায় গাঁথিত যতনে তার মালা তোমা তরে! যে-হস্ত গ্রথিত বলে তোমার নয়নে হত তা সৌন্দর্য-মাখা, ক্রমেতে শিখিলে সখা গোলাপে বাসিত ভালো যাহারি কারণে– তখন সে দুঃখিনীকে কোরো নাথ মনে। ৫ বিষণ্ণ হেমন্তে যবে, বৃক্ষের পল্লব সবে শুকায়ে পড়িবে খসে খসে চারি ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। নিদারুণ শীত কালে, সুখদ আগুন জ্বেলে, নিশীথে বসিবে যবে অনলের ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। সেই সে কল্পনাময়ী সুখের নিশায়, বিমল সংগীত তান, তোমার হৃদয় প্রাণ। নীরবে সুধীরে ধীরে যদি গো জাগায়– আলোড়ি হৃদয়-তল, এক বিন্দু অশ্রুজল, যদি আঁখি হতে পড়ে সে তান শুনিলে, তখন করিয়ো মনে, এক দিন তোমা সনে, যে যে গান গাহিয়াছি হৃদি প্রাণ খুলে, তখন স্মরিয়ো হায় অভাগিনী বলে।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা) যাওয়া-আসার একই যে পথ যাওয়া-আসার একই যে পথ জান না তা কি অন্ধ। যাবার পথ রোধিতে গেলে আসার পথ বন্ধ ।   (স্ফুলিঙ্গ) যাত্রা ইস্‌টিমারের ক্যাবিনটাতে কবে নিলেম ঠাঁই ,                                   স্পষ্ট মনে নাই ।                             উপরতলার সারে                        কামরা আমার একটা ধারে ।                                    পাশাপাশি তারি                                         আরো ক্যাবিন সারি সারি                                              নম্বরে চিহ্নিত ,                  একই রকম খোপ সেগুলোর দেয়ালে ভিন্নিত ।            সরকারী যা আইনকানুন তাহার যাথাযথ্য                  অটুট , তবু যাত্রীজনের পৃথক বিশেষত্ব                        রুদ্ধদুয়ার ক্যাবিনগুলোয় ঢাকা ;                  এক চলনের মধ্যে চালায় ভিন্ন ভিন্ন চাকা ,                                         ভিন্ন ভিন্ন চাল ।                                   অদৃশ্য তার হাল ,                        অজানা তার লক্ষ্য হাজার পথেই ,                  সেথায় কারো আসনে ভাগ হয় না কোনোমতেই ।            প্রত্যেকেরই রিজার্ভ করা কোটর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ;                  দরজাটা খোলা হলেই সম্মুখে সমুদ্র                        মুক্ত চোখের'পরে                                   সমান সবার তরে ,                             তবুও সে একান্ত অজানা ,                        তরঙ্গতর্জনী-তোলা অলঙ্ঘ্য তার মানা ।                     মাঝে মাঝে ঘণ্টা পড়ে । ডিনার-টেবিলে            খাবার গন্ধ , মদের গন্ধ , অঙ্গরাগের সুগন্ধ যায় মিলে —                        তারি সঙ্গে নানা রঙের সাজে                  ইলেক্‌ট্রিকের আলো-জ্বালা কক্ষমাঝে                        একটু জানা অনেকখানি না-জানাতেই মেশা                             চক্ষু-কানের স্বাদের ঘ্রাণের সম্মিলিত নেশা                                          কিছুক্ষণের তরে মোহাবেশে ঘনিয়ে সবায় ধরে ।                         চেনাশোনা হাসি-আলাপ মদের ফেনার মতো                             বুদ্‌বুদিয়া ওঠে আবার গভীরে হয় গত ।                                    বাইরে রাত্রি তারায় তারাময় ,                             ফেনিল সুনীল তেপান্তরে মরণ-ঘেরা ভয় ।                           হঠাৎ কেন খেয়াল গেল মিছে ,                  জাহাজখানা ঘুরে আসি উপর থেকে নীচে ।            খানিক যেতেই পথ হারালুম , গলির আঁকেবাঁকে                              কোথায় ওরা কোন্‌ অফিসার থাকে ।                        কোথাও দেখি সেলুন-ঘরে ঢুকে ,            ক্ষুর বোলাচ্ছে নাপিত সে কার ফেনায়-মগ্ন মুখে ।                             হোথায় রান্নাঘর ;                        রাঁধুনেরা সার বেঁধেছে পৃথুল-কলেবর ।             গা ঘেঁষে কে গেল চলে ড্রেসিং-গাউন-পরা ,                        স্নানের ঘরে জায়গা পাবার ত্বরা ।                  নীচের তলার ডেকের ‘ পরে কেউ বা করে খেলা ,                        ডেক-চেয়ারে কারো শরীর মেলা ,                    বুকের উপর বইটা রেখে কেউ বা নিদ্রা যায় ,                        পায়চারি কেউ করে ত্বরিত পায় ।            স্টুয়ার্ড্‌ হোথায় জুগিয়ে বেড়ায় বরফী শর্বৎ ।                  আমি তাকে শুধাই আমার ক্যাবিন-ঘরের পথ                                   নেহাত থতোমতো ।                  সে শুধাল , নম্বর তার কত ।                              আমি বললেম যেই ,                         নম্বরটা মনে আমার নেই —                  একটু হেসে নিরুত্তরে গেল আপন কাজে ,                        ঘেমে উঠি উদ্‌বেগে আর লাজে ।                  আবার ঘুরে বেড়াই আগে পাছে ,            চেয়ে দেখি কোন্‌ ক্যাবিনের নম্বর কী আছে ।                  যেটাই দেখি মনেতে হয় , এইটে হতে পারে ;                        সাহস হয় না ধাক্কা দিতে দ্বারে । ভাবছি কেবল , কী যে করি , হল আমার এ কী —                        এমন সময় হঠাৎ চমকে দেখি ,                              নিছক স্বপ্ন এ যে ,                        এক যাত্রার যাত্রী যারা কোথায় গেল কে যে ।                   গভীর রাত্রি ; বাতাস লেগে কাঁপে ঘরের সাসি ,                       রেলে গাড়ি অনেক দূরে বাজিয়ে গেল বাঁশি । যাত্রাপথ মনে পড়ে , ছেলেবেলায় যে বই পেতুম হাতে ঝুঁকে পড়ে যেতুম পড়ে তাহার পাতে পাতে । কিছু বুঝি , নাই বা কিছু বুঝি , কিছু না হোক পুঁজি , হিসাব কিছু না থাক্‌ নিয়ে লাভ অথবা ক্ষতি , অল্প তাহার অর্থ ছিল , বাকি তাহার গতি । মনের উপর ঝরনা যেন চলেছে পথ খুঁড়ি , কতক জলের ধারা আবার কতক পাথর নুড়ি । সব জড়িয়ে ক্রমে ক্রমে আপন চলার বেগে পূর্ণ হয়ে নদী ওঠে জেগে । শক্ত সহজ এ সংসারটা যাহার লেখা বই হালকা ক ' রে বুঝিয়ে সে দেয় কই । বুঝছি যত খুজছি তত , বুঝছি নে আর ততই — কিছু বা হাঁ , কিছু বা না , চলছে জীবন স্বতই ।কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা , দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা । আলগা মলিন পাতাগুলি , দাগি তাহার মলাট দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট । মায়ের ঘরের চৌকাঠেতে বারান্দার এক কোণে দিন-ফুরানো ক্ষীণ আলোতে পড়েছি একমনে । অনেক কথা হয় নি তখন বোঝা , যেটুকু তার বুঝেছিলাম মোট কথাটা সোজা — ভালোমন্দে লড়াই অনিঃশেষ , প্রকাণ্ড তার ভালোবাসা , প্রচণ্ড তার দ্বেষ । বিপরীতের মল্লযুদ্ধ ইতিহাসের রূপ সামনে এল , রইনু বসে চুপ ।শুরু হতে এইটে গেল বোঝা , হয়তো বা এক বাঁধা রাস্তা কোথাও আছে সোজা , যখন-তখন হঠাৎ সে যায় ঠেকে , আন্দাজে যায় ঠিকানাটা বিষম এঁকেবেঁকে । সব-জানা দেশ এ নয় কভু , তাই তো তেপান্তরে রাজপুত্তুর ছোটায় ঘোড়া না-জানা কার তরে । সদাগরের পুত্র সেও যায় অজানার পার খোঁজ নিতে কোন্‌ সাত-রাজা-ধন গোপন মানিকটার । কোটালপুত্র খোঁজে এমন গুহায়-থাকা চোর যাকে ধরলে সকল চুরির কাটবে বাঁধন-ডোর । যাত্রী ওরে যাত্রী, যেতে হবে বহুদূরদেশে। কিসের করিস চিন্তা বসি পথশেষে? কোন্‌ দুঃখে কাঁদে প্রাণ? কার পানে চাহি বসে বসে দিন কাটে শুধু গান গাহি শুধু মুগ্ধনেত্র মেলি? কার কথা শুনে মরিস জ্বলিয়া মিছে মনের আগুনে? কোথায় রহিবে পড়ি এ তোর সংসার! কোথায় পশিবে সেথা কলরব তার! মিলাইবে যুগ যুগ স্বপনের মতো, কোথা রবে আজিকার কুশাঙ্কুরক্ষত! নীরবে জ্বলিবে তব পথের দু ধারে গ্রহতারকার দীপ কাতারে কাতারে। তখনো চলেছ একা অনন্ত ভুবনে— কোথা হতে কোথা গেছ না রহিবে মনে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) যাত্রী আমি ওরে যাত্রী আমি ওরে। পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে।               দুঃখসুখের বাঁধন সবই মিছে,               বাঁধা এ-ঘর রইবে কোথায় পিছে, বিষয়বোঝা টানে আমায় নীচে,                     ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যাবে পড়ে।                     যাত্রী আমি ওরে। চলতে পথে গান গাহি প্রাণ ভরে।               দেহ-দুর্গে খুলবে সকল দ্বার,               ছিন্ন হবে শিকল বাসনার,               ভালোমন্দ কাটিয়ে হব পার                      চলতে রব লোকে লোকান্তরে।                                    যাত্রী আমি ওরে। যা-কিছু ভার যাবে সকাল সরে।               আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে               ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,               সকাল-সাঁঝে পরান মম টানে                     কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে।                     যাত্রী আমি ওরে--               বাহির হলেম না জানি কোন্‌ ভোরে।                     তখন কোথাও গায় নি কোনো পাখি,                                কী জানি রাত কতই ছিল বাকি              নিমেষহারা শুধুই একটি আঁখি                            জেগেছিল অন্ধকারের 'পরে।               যাত্রী আমি ওরে।        কোন্‌ দিনান্তে পৌঁছব কোন্‌ ঘরে।               কোন্‌ তারকা দীপ জ্বালে সেইখানে,               বাতাস কাঁদে কোন্‌ কুসুমের ঘ্রাণে,               কে গো সেথায় স্নিগ্ধ দু-নয়ানে                     অনাদিকাল চাহে আমার তরে। (গোরাই নদী, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭) যাবার দিন যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই - যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই। এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে     যে শতদল পদ্ম রাজে তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই। যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে, অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে। পরশ যাঁরে যায় না করা     সকল দেহে দিলেন ধরা, এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই - যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।২০ শ্রাবণ ১৩১৭ (কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা) যাবার দিনে এই কথাটি যাবার দিনে এই কথাটি               বলে যেন যাই--- যা দেখেছি যা পেয়েছি               তুলনা তার নাই।                   এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে                   যে শতদল পদ্ম রাজে               তারই মধু পান করেছি                          ধন্য আমি তাই---               যাবার দিনে এই কথাটি                         জানিয়ে যেন যাই।বিশ্বরূপের খেলাঘরে             কতই গেলেম খেলে, অপরূপকে দেখে গেলেম            দুটি নয়ন মেলে।                 পরশ যাঁরে যায় না করা                 সকল দেহে দিলেন ধরা।                 এইখানে শেষ করেন যদি                                শেষ করে দিন তাই---                 যাবার বেলা এই কথাটি                                জানিয়ে যেন যাই।   ২০ শ্রাবণ, ১৩১৭ যাবার সময় হোলো বিহঙ্গের। এখনি কুলায় যাবার সময় হোলো বিহঙ্গের। এখনি কুলায় রিক্ত হবে। স্তব্ধ গীতি ভ্রষ্ট নীড় পড়িবে ধুলায় অরণ্যের আন্দোলনে। শুষ্ক পত্র জীর্ণ পুষ্প সাথে পথচিহ্নহীন শূন্যে যাবে উড়ে রজনী প্রভাতে অস্তসিন্ধু পরপারে। কতকাল এই বসুন্ধরা আতিথ্য দিয়েছে; কভু আম্রমুকুলের গন্ধে ভরা পেয়েছি আহ্বানবাণী ফাল্গুনের দাক্ষিণ্যে মধুর, অশোকের মঞ্জরী সে ইঙ্গিতে চেয়েছে মোর সুর, দিয়েছি তা প্রীতিরসে ভরি’; কখনো বা ঝঞ্ঝাঘাতে বৈশাখের, কণ্ঠ মোর রুধিয়াছে উত্তপ্ত ধুলাতে, পক্ষ মোর করেছে অক্ষম; সব নিয়ে ধন্য আমি প্রাণের সম্মানে। এ পারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি ক্ষণ তরে পশ্চাতে ফিরিয়া মোর নম্র নমস্কারে বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) যুগল আমি থাকি একা, এই বাতায়নে বসে এক বৃন্তে যুগলকে দেখা--                 সেই মোর সার্থকতা।              বুঝিতে পারি সে কথা          লোকে লোকে কী আগ্রহ অহরহ                 করিছে সন্ধান আপনার বাহিরেতে কোথা হবে আপনার দান। তা নিয়ে বিপুল দুঃখে বিশ্বচিত্ত জেগে উঠে,              তারি সুখে পূর্ণ হয়ে ফুটে                    যা-কিছু মধুর।                 যত বাণী, যত সুর,          যত রূপ, তপস্যার যত বহ্নিলিখা,                         সৃষ্টিচিত্তশিখা,                  আকাশে আকাশে লিখে                       দিকে দিকে অণুপরমাণুদের মিলনের ছবি।                  গ্রহ তারা রবি যে-আগুন জ্বেলেছে তা বাসনারই দাহ,         সেই তাপে জগৎপ্রবাহ চঞ্চলিয়া চলিয়াছে বিরহমিলনদ্বন্দ্বঘাতে।                 দিনরাতে         কালের অতীত পার হতে, অনাদি আহ্বানধ্বনি ফিরিতেছে ছায়াতে আলোতে।                  সেই ডাক শুনে      কত সাজে সাজিয়েছে আজি এ-ফাল্গুনে             বনে বনে অভিসারিকার দল,                পত্রে পুষ্পে হয়েছে চঞ্চল-- সমস্ত বিশ্বের মর্মে যে-চাঞ্চল্য তারায় তারায়               তরঙ্গিছে প্রকাশধারায়,      নিখিল ভুবনে নিত্য যে-সংগীত বাজে              মূর্তি নিল বনচ্ছায়ে যুগলের সাজে। যুগে যুগে জলে রৌদ্রে বায়ুতে যুগে যুগে জলে রৌদ্রে বায়ুতে গিরি হয়ে যায় ঢিবি। মরণে মরণে নুতন আয়ুতে তৃণ রহে চিরজীবী।   (স্ফুলিঙ্গ) যে আঁধারে ভাইকে দেখিতে নাহি পায় যে আঁধারে ভাইকে দেখিতে নাহি পায় সে আঁধারে অন্ধ নাহি দেখে আপনায়।   (স্ফুলিঙ্গ) যে করে ধর্মের নামে যে করে ধর্মের নামে বিদ্বেষ সঞ্চিত ঈশ্বরকে অর্ঘ্য হতে সে করে বঞ্চিত।    (স্ফুলিঙ্গ) যে ফুল এখনো কুঁড়ি যে ফুল এখনো কুঁড়ি তারি জন্মশাখে রবি নিজ আশীর্বাদ প্রতিদিন রাখে।   (স্ফুলিঙ্গ) যে যায় তাহারে অার যে যায় তাহারে অার ফিরে ডাকা বৃথা। অশ্রুজলে স্মৃতি তার হোক পল্লবিতা।   (স্ফুলিঙ্গ) যে রত্ন সবার সেরা যে রত্ন সবার সেরা তাহারে খুঁজিয়া ফেরা ব্যর্থ অন্বেষণ। কেহ নাহি জানে, কিসে ধরা দেয় আপনি সে এলে শুভক্ষণ।   (স্ফুলিঙ্গ) যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে, ইংলণ্ডে দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি রেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে, ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির-উজ্জ্বল পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে। দ্বীপের নিকুঞ্জতল তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে। তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে উঠিয়াছ দীপ্তজ্যোতি মাধ্যাহ্নের গগনের 'পরে; নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি।   শিলাইদহ, ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩২২ যেদিন চৈতন্য মোর মুক্তি পেল লুপ্তিগুহা হতে যেদিন চৈতন্য মোর মুক্তি পেল লুপ্তিগুহা হতে নিয়ে এল দুঃসহ বিস্ময়ঝড়ে দারুণ দুর্যোগে কোন্‌ নরকাগ্নিগিরিগহ্বরের তটে; তপ্তধূমে গর্জি উঠি ফুঁসিছে সে মানুষের তীব্র অপমান, অমঙ্গলধ্বনি তার কম্পান্বিত করে ধরাতল, কালিমা মাখায় বায়ুস্তরে। দেখিলাম একালের আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা, দেখিনু সর্বাঙ্গে তার বিকৃতির কদর্য বিদ্রূপ। একদিকে স্পর্ধিত ক্রূরতা, মত্ততার নির্লজ্জ হুংকার, অন্যদিকে ভীরুতার দ্বিধাগ্রস্ত চরণ-বিক্ষেপ, বক্ষে আলিঙ্গিয়া ধরি কৃপণের সতর্ক সম্বল; সন্ত্রস্ত প্রাণীর মতো ক্ষণিক গর্জন অন্তে ক্ষীণস্বরে তখনি জানায় নিরাপদ নীরব নম্রতা। রাষ্ট্রপতি যত আছেপ্রৌঢ় প্রতাপের, মন্ত্রসভাতলে আদেশ নির্দেশ রেখেছে নিষ্পিষ্ট করি রুদ্ধ ওষ্ঠ অধরের চাপে সংশয়ে সংকোচে। এদিকে দানব-পক্ষী ক্ষুব্ধশূন্যে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বৈতরণী নদী পার হতে যন্ত্রপক্ষ হুংকারিয়া নরমাংসক্ষুধিত শকুনি, আকাশেরে করিল অশুচি। মহাকাল-সিংহাসনে সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে, কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বিভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন নিত্যকাল র’বে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকণ্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই   আমি ছিলেম অন্যমনে | আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই   সে যে রইল সঙ্গোপনে |          মাঝে মাঝে হিয়া আকুলপ্রায়          স্বপন দেখে চম্ কে উঠে চায়,          মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়   কোথায় দখিন সমীরণে |ওগো সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া              আমায় দেশে দেশান্তে | যেন সন্ধানে তার উঠে নিঃশ্বাসিয়া              ভুবন নবীন বসন্তে |         কে জানিত দূরে ত নেই সে         আমারি গো আমারি সেই যে,         এ মাধুরী ফুটেছে হায়রে আমার হৃদয় উপবনে |শিলাইদহ ২৬ চৈত্র ১৩১৮ গীতিমাল্য - ১৭, গীতাঞ্জলি যে-মাসেতে আপিসেতে যে-মাসেতে আপিসেতে হল তার নাম ছাঁটা স্ত্রীর শাড়ি নিজে পরে, স্ত্রী পরিল গামছাটা। বলে, “আমি বৈরাগী, ছেড়ে দেব শিগ্‌গির, ঘরে মোর যত আছে বিলাস-সামিগ্‌গির।’ ছিল তার টিনে-গড়া চা-খাওয়ার চাম্‌চাটা, কেউ তা কেনে না সেটা যত করে দাম-ছাঁটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) যোগিয়া বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে ,      রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে । স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে               আলোক ঝলকি উঠে           পুলক নাচিছে গাছে গাছে । নবীন যৌবন যেন                   প্রেমের মিলনে কাঁপে ,           আনন্দ বিদ্যুৎ - আলো নাচে । জুঁই সরোবরতীরে                  নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে           ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে , অতি মৃদু হাসি তার ,               বরষার বৃষ্টিধার           গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে । আজিকে আপন প্রাণে              না জানি বা কোন্খানে           যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে । ধীরে ধীরে সুর তার                মিলাইছে চারি ধার ,           আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে । গাছপালা চারি ভিতে                সংগীতের মাধুরীতে           মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি । এ প্রভাত মনে হয়                  আরেক প্রভাতময় ,           রবি যেন আর কোনো রবি । ভাবিতেছি মনে মনে                 কোথা কোন্ উপবনে           কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি , চোখে তার অশ্রুরেখা    একটু দেছে কি দেখা ,           ছড়ায়েছে চরণ দুখানি । তার কি পায়ের কাছে     বাঁশিটি পড়িয়া আছে —           আলোছায়া পড়েছে কপোলে । মলিন মালাটি তুলি                 ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি            ভাসাইছে সরসীর জলে । বিষাদ - কাহিনী তার                সাধ যায় শুনিবার           কোন্খানে তাহার ভবন । তাহার আঁখির কাছে                যার মুখ জেগে আছে           তাহারে বা দেখিতে কেমন । এ কী রে আকুল ভাষা !           প্রাণের নিরাশ আশা           পল্লবের মর্মরে মিশালো । না জানি কাহারে চায়     তার দেখা নাহি পায়           ম্লান তাই প্রভাতের আলো । এমন কত - না প্রাতে                চাহিয়া আকাশপাতে           কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস , সে - সব প্রভাত গেছে ,               তারা তার সাথে গেছে           লয়ে গেছে হৃদয় - হুতাশ ! এমন কত না আশা                 কত ম্লান ভালোবাসা           প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া , তাদের হৃদয় - ব্যথা                 তাদের মরণ - গাথা           কে গাইছে একত্র করিয়া , পরস্পর পরস্পরে                  ডাকিতেছে নাম ধরে ,           কেহ তাহা শুনিতে না পায় । কাছে আসে , বসে পাশে ,              তবুও কথা না ভাষে ,           অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায় । চায় তবু নাহি পায় ,                  অবশেষে নাহি চায় ,           অবশেষে নাহি গায় গান , ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া               বনের ছায়ায় গিয়া           মুছে আসে সজল নয়ান । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) যোগীনদা যোগীনদাদার জন্ম ছিল ডেরাস্মাইলখাঁয়ে। পশ্চিমেতে অনেক শহর অনেক গাঁয়ে গাঁয়ে বেড়িয়েছিলেন মিলিটারি জরিপ করার কাজে, শেষ বয়সে স্থিতি হল শিশুদলের মাঝে। "জুলুম তোদের সইব না আর" হাঁক চালাতেন রোজই, পরের দিনেই আবার চলতে ঐ ছেলেদের খোঁজই। দরবারে তাঁর কোনো ছেলের ফাঁক পড়বার জো কী-- ডেকে বলতেন, "কোথায় টুনু, কোথায় গেল খোঁকি।" "ওরে ভজু, ওরে বাঁদর, ওরে লক্ষ্মীছাড়া" হাঁক দিয়ে তাঁর ভারি গলায় মাতিয়ে দিতেন পাড়া। চারদিকে তাঁর ছোটো বড়ো জুটত যত লোভী কেউ বা পেত মার্বেল, কেউ গণেশমার্কা ছবি।               কেউ বা লজঞ্জুস, সেটা ছিল মজলিসে তাঁর হাজরি দেবার ঘুষ। কাজলি যদি অকারণে করত অভিমান হেসে বলতেন "হাঁ করো তো", দিতেন ছাঁচি পান। আপনসৃষ্ট নাতনিও তাঁর ছিল অনেকগুলি, পাগলি ছিল, পটলি ছিল, আর ছিল জঙ্গুলি। কেয়া-খয়ের এনে দিত, দিত কাসুন্দিও, মায়ের হাতের জারকলেবু যোগীনদাদার প্রিয়।তখনো তাঁর শক্ত ছিল মুগুর-ভাঁজা দেহ, বয়স যে ষাট পেরিয়ে গেছে বুঝত না তা কেহ। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, চোখদুটি জ্বল্‌জ্বলে, মুখ যেন তাঁর পাকা আমটি, হয়নি সে থল্‌থলে। চওড়া কপাল, সামনে মাথায় বিরল চুলের টাক, গোঁফ জোড়াটার খ্যাতি ছিল, তাই নিয়ে তাঁর জাঁক।দিন ফুরোত, কুলুঙ্গিতে প্রদীপ দিত জ্বালি। বেলের মালা হেঁকে যেত মোড়ের মাথায় মালী। চেয়ে রইতেম মুখের দিকে শান্তশিষ্ট হয়ে, কাঁসর-ঘণ্টা উঠত বেজে গলির শিবালয়ে। সেই সেকালের সন্ধ্যা মোদের সন্ধ্যা ছিল সত্যি, দিন-ভ্যাঙানো ইলেকট্রিকের হয়নিকো উৎপত্তি। ঘরের কোণে কোণে ছায়া, আঁধার বাড়ত ক্রমে, মিট্‌মিটে এক তেলের আলোয় গল্প উঠত জমে। শুরু হলে থামতে তাঁরে দিতেম না তো ক্ষণেক, সতি মিথ্যে যা-খুশি তাই বানিয়ে যেতেন অনেক। ভূগোল হত উলটো-পালটা, কাহিনী আজগুবি,               মজা লাগত খুবই। গল্পটুকু দিচ্ছি, কিন্তু দেবার শক্তি নাই তো বলার ভাবে যে রঙটুকু মন আমাদের ছাইত।হুশিয়ারপুর পেরিয়ে গেল ছন্দৌসির গাড়ি, দেড়টা রাতে সর্‌হরোয়ায় দিল স্টেশন ছাড়ি।      ভোর থাকতেই হয়ে গেল পার বুলন্দশর আম্লোরিসর্সার।      পেরিয়ে যখন ফিরোজাবাদ এল          যোগীনদাদার বিষম খিদে পেল। ঠোঙায়-ভরা পকৌড়ি আর চলছে মটরভাজা এমন সময় হাজির এসে জৌনপুরের রাজা। পাঁচশো-সাতশো লোকলস্কর, বিশপঁচিশটা হাতি মাথার উপর ঝালর-দেওয়া প্রকাণ্ড এক হাতি।   মন্ত্রী এসেই দাদার মাথায় চড়িয়ে দিল তাজ,                বললে, "যুবরাজ,   আর কতদিন রইবে প্রভু, মোতিমহল ত্যেজে।'   বলতে বলতে রামশিঙা আর ঝাঁঝর উঠল বেজে।              ব্যাপারখানা এই--   রাজপুত্র তেরো বছর রাজভবনে নেই।                  সদ্য ক'রে বিয়ে,   নাথদোয়ারার সেগুনবনে শিকার করতে গিয়ে   তার পরে যে কোথায় গেল, খুঁজে না পায় লোক।   কেঁদে কেঁদে অন্ধ হল রানীমায়ের চোখ|   খোঁজ পড়ে যায় যেমনি কিছু শোনে কানাঘুষায়,   খোঁজে পিণ্ডিদাদনখাঁয়ে, খোঁজে লালামুসায়।   খুঁজে খুঁজে লুধিয়ানায় ঘুরেছে পঞ্জাবে,   গুলজারপুর হয়নি দেখা, শুনছি পরে যাবে।   চঙ্গামঙ্গা দেখে এল সবাই আলমগিরে,   রাওলপিণ্ডি থেকে এল হতাশ হয়ে ফিরে।   ইতিমধ্যে যোগীনদাদা হাৎরাশ জংশনে   গেছেন লেগে চায়ের সঙ্গে পাঁউরুটি-দংশনে।             দিব্যি চলছে খাওয়া,   তারি সঙ্গে খোলা গায়ে লাগছে মিঠে হাওয়া--   এমন সময় সেলাম করলে জৌনপুরের চর;   জোড় হাতে কয়, "রাজাসাহেব, কঁহা আপ্‌ কা ঘর।'   দাদা ভাবলেন, সম্মানটা নিতান্ত জম্‌কালো,   আসল পরিচয়টা তবে না দেওয়াই তো ভালো।   ভাবখানা তাঁর দেখে চরের ঘনালো সন্দেহ,   এ মানুষটি রাজপুত্রই, নয় কভু আর-কেহ।   রাজলক্ষণ এতগুলো একখানা এই গায়   ওরে বাস রে, দেখেনি সে আর কোনো জায়গায়।      তার পরে মাস পাঁচেক গেছে দুঃখে সুখে কেটে,      হারাধনের খবর গেল জৌনপুরের স্টেটে।      ইস্টেশনে নির্ভাবনায় বসে আছেন দাদা,      কেমন করে কী যে হল লাগল বিষম ধাঁধা।      গুর্খা ফৌজ সেলাম করে দাঁড়ালো চারদিকে,      ইস্টেশনটা ভরে গেল আফগানে আর শিখে।      ঘিরে তাঁকে নিয়ে গেল কোথায় ইটার্সিতে,      দেয় কারা সব জয়ধ্বনি উর্‌দুতে ফার্সিতে।      সেখান থেকে মৈনপুরী, শেষে লছ্‌মন্‌-ঝোলায়      বাজিয়ে সানাই চড়িয়ে দিল ময়ূরপংখি দোলায়।      দশটা কাহার কাঁধে নিল, আর পঁচিশটা কাহার                  সঙ্গে চলল তাঁহার।      ভাটিণ্ডাতে দাঁড় করিয়ে জোরালো দূরবীনে      দখিনমুখে ভালো করে দেখে নিলেন চিনে                  বিন্ধ্যাচলের পর্বত।      সেইখানেতে খাইয়ে দিল কাঁচা আমের শর্বৎ।      সেখান থেকে এক পহরে গেলেন জৌনপুরে                     পড়ন্ত রোদ্‌দুরে।                    এইখানেতেই শেষে      যোগীনদাদা থেমে গেলেন যৌবরাজ্যে এসে।             হেসে বললেন, "কী আর বলব দাদা,      মাঝের থেকে মটর-ভাজা খাওয়ায় পড়ল বাধা।"             "ও হবে না, ও হবে না" বিষম কলরবে      ছেলেরা সব চেঁচিয়ে উঠ্‌ল, "শেষ করতেই হবে।"                  যোগীনদা কয়, "যাক গে,             বেঁচে আছি শেষ হয়নি ভাগ্যে।      তিনটে দিন না যেতে যেতেই হলেম গলদ্‌ঘর্ম।      রাজপুত্র হওয়া কি, ভাই, যে-সে লোকের কর্ম।      মোটা মোটা পরোটা আর তিন পোয়াটাক ঘি      বাংলাদেশের-হাওয়ায়-মানুষ সইতে পারে কি।      নাগরা জুতায় পা ছিঁড়ে যায়, পাগড়ি মুটের বোঝা,                  এগুলি কি সহ্য করা সোজা।      তা ছাড়া এই রাজপুত্রের হিন্দি শুনে কেহ                  হিন্দি বলেই করলে না সন্দেহ।        যেদিন দূরে শহরেতে চলছিল রামলীলা               পাহারাটা ছিল সেদিন ঢিলা।        সেই সুযোগে গৌড়বাসী তখনি এক দৌড়ে                  ফিরে এল গৌড়ে।               চলে গেল সেই রাত্রেই ঢাকা--        মাঝের থেকে চর পেয়ে যায় দশটি হাজার টাকা।               কিন্তু, গুজব শুনতে পেলেম শেষে,        কানে মোচড় খেয়ে টাকা ফেরত দিয়েছে সে।"     "কেন তুমি ফিরে এলে" চেঁচাই চারিপাশে,             যোগীনদাদা একটু কেবল হাসে।      তার পরে তো শুতে গেলেম, আধেক রাত্রি ধ'রে      শহরগুলোর নাম যত সব মাথার মধ্যে ঘোরে।             ভারতভূমির সব ঠিকানাই ভুলি যদি দৈবে,             যোগীনদাদার ভূগোল-গোলা গল্প মনে রইবে। যৌবন – স্বপ্ন আমার যৌবনস্বপ্নে যেন           ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ । ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে          রূপসীর পরশের মতো । পরানে পুলক বিকাশিয়া           বহে কেন দক্ষিণা বাতাস যেথা ছিল যত বিরহিণী            সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস ! বসন্তের কুসুমকাননে               গোলাপের আঁখি কেন নত ? জগতের যত লাজময়ী              যেন মোর আঁখির সকাশ ? কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে ,       মরমের শরমে বিব্রত ! প্রতি নিশি ঘুমাই যখন             পাশে এসে বসে যেন কেহ , সচকিত স্বপনের মতো            জাগরণে পলায় সলাজে । যেন কার আঁচলের বায়            উষার পরশি যায় দেহ , শত নূপুরের রুনুঝুনু             বনে যেন গুঞ্জরিয়া বাজে । মদির প্রাণের ব্যাকুলতা            ফুটে ফুটে বকুলমুকুলে ; কে আমারে করেছে পাগল —      শূন্যে কেন চাই আঁখি তুলে ! যেন কোন্ উর্বশীর আঁখি          চেয়ে আছে আকাশের মাঝে !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) যৌবনের প্রান্তসীমায় যৌবনের প্রান্তসীমায় জড়িত হয়ে আছে অরুণিমার ম্লান অবশেষ;-- যাক কেটে এর আবেশটুকু; সুস্পষ্টের মধ্যে জেগে উঠুক আমার ঘোর-ভাঙা চোখ স্মৃতিবিস্মৃতির নানা বর্ণে রঞ্জিত দুঃখসুখের বাষ্পঘনিমা স'রে যাক সন্ধ্যামেঘের মতো আপনাকে উপেক্ষা ক'রে। ঝরে-পড়া ফুলের ঘনগন্ধে আবিষ্ট আমার প্রাণ, চারদিকে তার স্বপ্ন মৌমাছি গুন গুন করে বেড়ায়, কোন্‌ অলক্ষ্যের সৌরভে। এই ছায়ার বেড়ায় বদ্ধ দিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসুক মন শুভ্র আলোকের প্রাঞ্জলতায়। অনিমেষ দৃষ্টি ভেসে যাক কথাহীন ব্যথাহীন চিন্তাহীন সৃষ্টির মহাসাগরে। যাব লক্ষ্যহীন পথে, সহজে দেখব সব দেখা, শুনব সব সুর, চলন্ত দিনরাত্রির কলরোলের মাঝখান দিয়ে। আপনাকে মিলিয়ে নেব শস্যশেষ প্রান্তরের সুদূরবিস্তীর্ণ বৈরাগ্যে। ধ্যানকে নিবিষ্ট করব ঐ নিস্তব্ধ শালগাছের মধ্যে যেখানে নিমেষের অন্তরালে সহস্রবৎসরের প্রাণ নীরবে রয়েছে সমাহিত। কাক ডাকছে তেঁতুলের ডালে, চিল মিলিয়ে গেল রৌদ্রপাণ্ডুর সুদূর নীলিমায়। বিলের জলে বাঁধ বেঁধে ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে জেলে। বিলের পরপারে পুরাতন গ্রামের আভাস, ফিকে রঙের নীলাম্বরের প্রান্তে বেগনি রঙের আঁচলা। গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে মাছধরা জালের উপরকার আকাশে। মাছরাঙা স্তব্ধ বসে আছে বাঁশের খোঁটায়, তার স্থির ছায়া নিস্তরঙ্গ জলে। ভিজে বাতাসে শ্যাওলার ঘন স্নিগ্ধগন্ধ। চারদিক থেকে অস্তিত্বের এই ধারা নানা শাখায় বইছে দিনেরাত্রে। অতি পুরাতন প্রাণের বহুদিনের নানা পণ্য নিয়ে এই সহজ প্রবাহ,-- মানব-ইতিহাসের নূতন নূতন ভাঙনগড়নের উপর দিয়ে এর নিত্য যাওয়া আসা। চঞ্চল বসন্তের অবসানে আজ আমি অলস মনে আকণ্ঠ ডুব দেব এই ধারার গভীরে; এর কলধ্বনি বাজবে আমার বুকের কাছে আমার রক্তের মৃদুতালের ছন্দে। এর আলো ছায়ার উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাক আমার চেতনা চিন্তাহীন তর্কহীন শাস্ত্রহীন মৃত্যু-মহাসাগরসংগমে। রক্তমাখা দন্তপংক্তি হিংস্র সংগ্রামের রক্তমাখা দন্তপংক্তি হিংস্র সংগ্রামের শত শত নগরগ্রামের অন্ত্র আজ ছিন্ন ছিন্ন করে; ছুটে চলে বিভীষিকা মূর্ছাতুর দিকে দিগন্তরে। বন্যা নামে যমলোক হতে, রাজ্যসাম্রাজ্যের বাঁধ লুপ্ত করে সর্বনাশা স্রোতে। যে লোভ-রিপুরে লয়ে গেছে যুগে যুগে দূরে দূরে সভ্য শিকারীর দল পোষমানা শ্বাপদের মতো, দেশবিদেশের মাংস করেছে বিক্ষত, লোলজিহ্বা সেই কুকুরের দল অন্ধ হয়ে ছিঁড়িল শৃঙ্খল, ভুলে গেল আত্মপর; আদিম বন্যতা তার উদ্‌বারিয়া উদ্দাম নখর পুরাতন ঐতিহ্যের পাতাগুলা ছিন্ন করে, ফেলে তার অক্ষরে অক্ষরে পঙ্কলিপ্ত চিহ্নের বিকার। অসন্তুষ্ট বিধাতার ওরা দূত বুঝি, শত শত বর্ষের পাপের পুঁজি ছড়াছড়ি করে দেয় এক সীমা হতে সীমান্তরে, রাষ্ট্রমদমত্তদের মদ্যভান্ড চূর্ণ করে আবর্জনাকুণ্ডতলে। মানব আপন সত্তা ব্যর্থ করিয়াছে দলে দলে, বিধাতার সংকল্পের নিত্যই করেছে বিপর্যয় ইতিহাসময়। সেই পাপে আত্মহত্যা-অভিশাপে আপনার সাধিছে বিলয়। হয়েছে নির্দয় আপন ভীষণ শত্রু আপনার 'পরে, ধূলিসাৎ করে ভুরিভোজী বিলাসীর ভাণ্ডারপ্রাচীর। শ্মশানবিহারবিলাসিনী ছিন্নমস্তা,মুহূর্তেই মানুষের সুখস্বপ্ন জিনি বক্ষ ভেদি দেখা দিল আত্মহারা, শতস্রোতে নিজ রক্তধারা নিজে করি পান। এ কুৎসিত লীলা যবে হবে অবসান, বীভৎস তান্ডবে এ পাপযুগের অন্ত হবে, মানব তপস্বীবেশে চিতাভস্মশয্যাতলে এসে নবসৃষ্টি-ধ্যানের আসনে স্থান লবে নিরাসক্তমনে-- আজি সেই সৃষ্টির আহ্বান ঘোষিছে কামান। রঙ্গমঞ্চে একে একে নিবে গেল যবে দীপশিখা রঙ্গমঞ্চে একে একে নিবে গেল যবে দীপশিখা রিক্ত হোলো সভাতল, আঁধারের মসী-অবলেপে স্বপ্নচ্ছবি-মুছেযাওয়া সুষুপ্তির মতো শান্ত হোলো চিত্ত মোর নিঃশব্দের তর্জনী সংকেতে। এতকাল যে সাজে রচিয়াছিনু আপনার নাট্য পরিচয় প্রথম উঠিতে যবনিকা, সেই সাজ মুহূর্তেই হোলো নিরর্থক। চিহ্নিত করিয়াছিনু আপনারে নানা চিহ্নে, নানা বর্ণ প্রসাধনে সহস্রের কাছে, মুছিল তা, আপনাতে আপনার নিগূঢ় পূর্ণতা আমারে করিল স্তব্ধ, সূর্যাস্তের অন্তিম সৎকারে দিনান্তের শূন্যতায় ধরার বিচিত্র চিত্রলেখা যখন প্রচ্ছন্ন হয়, বাধামুক্ত আকাশ যেমন নির্বাক বিস্ময়ে স্তব্ধ তারাদীপ্ত আত্মপরিচয়ে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) রজনী প্রভাত হল রজনী প্রভাত হল— পাখি, ওঠো জাগি, আলোকের পথে চলো অমৃতের লাগি।   (স্ফুলিঙ্গ) রবিবার সোম মঙ্গল বুধ এরা সব           আসে তাড়াতাড়ি , এদের ঘরে আছে বুঝি           মস্ত হাওয়া - গাড়ি ? রবিবার সে কেন , মা গো ,            এমন দেরি করে ? ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে           সকল বারের পরে । আকাশ - পারে তার বাড়িটি           দূর কি সবার চেয়ে ? সে বুঝি মা তোমার মতো           গরিব - ঘরের মেয়ে ?    সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল           থাকবারই জন্যেই , বাড়ি - ফেরার দিকে ওদের           একটুও মন নেই । রবিবারকে কে যে এমন           বিষম তাড়া করে , ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন           আধ ঘণ্টার পরে । আকাশ - পারে বাড়িতে তার           কাজ আছে সব - চেয়ে ? সে বুঝি , মা , তোমার মতো           গরিব - ঘরের মেয়ে ।    সোম মঙ্গল বুধের যেন           মুখগুলো সব হাঁড়ি ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের           বিষম আড়াআড়ি । কিন্তু শনির রাতের শেষে            যেমনি উঠি জেগে , রবিবারের মুখে দেখি           হাসিই আছে লেগে । যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে           মোদের মুখে চেয়ে । সে বুঝি , মা , তোমার মতো           গরিব ঘরের মেয়ে ? (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) রসগোল্লার লোভে রসগোল্লার লোভে পাঁচকড়ি মিত্তির দিল ঠোঙা শেষ করে বড়ো ভাই পৃথ্বির। সইল না কিছুতেই যকৃতের নিচুতেই যন্ত্র বিগড়ে গিয়ে ব্যামো হল পিত্তির। ঠোঙাটাকে বলে, “পাজি ময়রার কারসাজি।’ দাদার উপরে রাগে– দাদা বলে, “চিত্তির! পেটে যে স্মরণসভা আপনারি কীর্তির।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) রাজপুতানা এই ছবি রাজপুতানার;   এ দেখি মৃত্যুর পৃষ্ঠে বেঁচে থাকিবার             দুর্বিষহ বোঝা।   হতবুদ্ধি অতীতের এই যেন খোঁজা             পথভ্রষ্ট বর্তমানে অর্থ আপনার,                      শূন্যেতে হারানো অধিকার।   ঐ তার গিরিদুর্গে অবরুদ্ধ নিরর্থ ভ্রূকুটি             ঐ তার জয়স্তম্ভ তোলে ক্রুদ্ধ মুঠি                      বিরুদ্ধ ভাগ্যের পানে। মৃত্যুতে করেছে গ্রাস তবুও যে মরিতে না জানে,    ভোগ করে অসম্মান অকালের হাতে                      দিনে রাতে,                  অসাড় অন্তরে             গ্লানি অনুভব নাহি করে, আপনারি চাটুবাক্যে আপনারে ভুলায় আশ্বাসে--                       জানে না সে,          পরিপূর্ণ কত শতাব্দীর পণ্যরথ               উত্তীর্ণ না হতে পথ          ভগ্নচক্র পড়ে আছে মরুর প্রান্তরে, ম্রিয়মাণ আলোকের প্রহরে প্রহরে               বেড়িয়াছে অন্ধ বিভাবরী     নাগপাশে; ভাষাভোলা ধূলির করুণা লাভ করি               একমাত্র শান্তি তাহাদের।     লঙ্ঘন যে করে নাই ভোলামনে কালের বাঁধের                    অন্তিম নিষেধসীমা--     ভগ্নস্তূপে থাকে তার নামহীন প্রচ্ছন্ন মহিমা;                    জেগে থাকে কল্পনার ভিতে     ইতিবৃত্তহারা তার ইতিহাস উদার ইঙ্গিতে। কিন্তু এ নির্লজ্জ কারা! কালের উপেক্ষাদৃষ্টি-কাছে               না থেকেও তবু আছে।                    একি আত্মবিস্মরণমোহ,     বীর্যহীন ভিত্তি-'পরে কেন রচে শূন্য সমারোহ।          রাজ্যহীন সিংহাসনে অত্যুক্তির রাজা,                        বিধাতার সাজা।                              হোথা যারা মাটি করে চাষ          রৌদ্রবৃষ্টি শিরে ধরি বারো মাস,               ওরা কভু আধামিথ্যা রূপে            সত্যেরে তো হানে না বিদ্রূপে।               ওরা আছে নিজ স্থান পেয়ে;     দারিদ্র৻ের মূল্য বেশি লুপ্তমূল্য ঐশ্বর্যের চেয়ে। এদিকে চাহিয়া দেখো টিটাগড়।     লোষ্ট্রে লৌহে বন্দী হেথা কালবৈশাখীর পণ্যঝড়।               বণিকের দম্ভে নাই বাধা,     আসমুদ্র পৃথ্বীতলে দৃপ্ত তার অক্ষুণ্ন মর্যাদা।          প্রয়োজন নাহি জানে ওরা               ভূষণে সাজায়ে হাতিঘোড়া     সম্মানের ভান করিবার,       ভুলাইতে ছদ্মবেশী সমুচ্চ তুচ্ছতা আপনার।     শেষের পংক্তিতে যবে থামিবে ওদের ভাগ্যলিখা,               নামিবে অন্তিম যবনিকা,        উত্তাল রজতপিণ্ড-উদ্ধারের শেষ হবে পালা,             যন্ত্রের কিঙ্করগুলো নিয়ে ভস্মডালা                    লুপ্ত হবে নেপথ্যে যখন,   পশ্চাতে যাবে না রেখে প্রেতের প্রগল্‌ভ প্রহসন।     উদাত্ত যুগের রথে বল্গাধরা সে রাজপুতানা               মরুপ্রস্তরের স্তরে একদিন দিল মুষ্টি হানা;         তুলিল উদ্ভেদ করি কলোল্লোলে মহা-ইতিহাস প্রাণে উচ্ছ্বসিত, মৃত্যুতে ফেনিল; তারি তপ্তশ্বাস          স্পর্শ দেয় মনে, রক্ত উঠে আবর্তিয়া বুকে--                        সে যুগের সুদূর সম্মুখে          স্তব্ধ হয়ে ভুলি এই কৃপণ কালের দৈন্যপাশে-               জর্জরিত, নতশির অদৃষ্টের অট্টহাসে,               গলবদ্ধ পশুশ্রেণীসম চলে দিন পরে দিন                                লজ্জাহীন।                        জীবনমৃত্যুর দ্বন্দ্ব-মাঝে     সেদিন যে দুন্দুভি মন্দ্রিয়াছিল তার প্রতিধ্বনি বাজে          প্রাণের কুহরে গুমরিয়া। নির্ভয় দুর্দান্ত খেলা,     মনে হয়, সেই তো সহজ, দূরে নিক্ষেপিয়া ফেলা আপনারে নিঃসংশয় নিষ্ঠুর সংকটে। তুচ্ছ প্রাণ     নহে তো সহজ; মৃত্যুর বেদিতে যার কোনো দান নাই কোনো কালে সেই তো দুর্ভর অতি,     আপনার সঙ্গে নিত্য বাল্যপনা দুঃসহ দুর্গতি। প্রচণ্ড সত্যেরে ভেঙে গল্পে রচে অলস কল্পনা               নিষ্কর্মার স্বাদু উত্তেজনা,     নাট্যমঞ্চে ব্যঙ্গ করি বীরসাজে তারস্বর আস্ফালনে উন্মত্ততা করে কোন্‌ লাজে।         তাই ভাবি হে রাজপুতানা,      কেন তুমি মানিলে না যথাকালে প্রলয়ের মানা,           লভিলে না বিনষ্টির শেষ স্বর্গলোক;                    জনতার চোখ                        দীপ্তিহীন         কৌতুকের দৃষ্টিপাতে পলে পলে করে যে মলিন।               শঙ্করের তৃতীয় নয়ন হতে         সম্মান নিলে না কেন যুগান্তের বহ্নির আলোতে। রাজবিচার বিপ্র কহে, রমণী মোর আছিল যেই ঘরে নিশীথে সেথা পশিল চোর ধর্মনাশ-তরে। বেঁধেছি তারে, এখন কহো চোরে কী দেব সাজা।' 'মৃত্যু' শুধু কহিলা তারে রতনরাও রাজা। ছুটিয়া আসি কহিল দূত, 'চোর সে যুবরাজ-- বিপ্র তাঁরে ধরেছে রাতে, কাটিল প্রাতে আজ। ব্রাহ্মণেরে এনেছি ধরে, কী তারে দিব সাজা?' 'মুক্তি দাও' কহিলা শুধু রতনরাও রাজা।৪ কার্তিক, ১৩০৬ রাজমিস্ত্রী বয়স আমার হবে তিরিশ ,           দেখতে আমায় ছোটো , আমি নই মা , তোমার শিরিশ ,           আমি হচ্ছি নোটো । আমি যে রোজ সকাল হলে যাই শহরের দিকে চলে           তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চড়ে । সকাল থেকে সারা দুপর ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর           খেয়ালমতো দেয়াল তুলি গড়ে । ভাবছ তুমি নিয়ে ঢেলা ঘর - গড়া সে আমার খেলা ,           কক্‌খনো না সত্যিকার সে কোঠা । ছোটো বাড়ি নয় তো মোটে , তিনতলা পর্যন্ত ওঠে ,           থামগুলো তার এমনি মোটা মোটা । কিন্তু যদি শুধাও আমায় ওইখানেতেই কেন থামায় ?           দোষ কী ছিল ষাট - সত্তর তলা ? ইঁট সুরকি জুড়ে জুড়ে একেবারে আকাশ ফুঁড়ে           হয় না কেন কেবল গেঁথে চলা ? গাঁথতে গাঁথতে কোথায় শেষে ছাত কেন না তারায় মেশে ?           আমিও তাই ভাবি নিজে নিজে । কোথাও গিয়ে কেন থামি যখন শুধাও , তখন আমি           জানি নে তো তার উত্তর কী যে । যখন খুশি ছাতের মাথায়            উঠছি ভারা বেয়ে । সত্যি কথা বলি , তাতে           মজা খেলার চেয়ে । সমস্ত দিন ছাত - পিটুনি গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি ,           অনেক নিচে চলছে গাড়িঘোড়া । বাসনওআলা থালা বাজায় ; সুর করে ওই হাঁক দিয়ে যায়           আতাওআলা নিয়ে ফলের ঝোড়া । সাড়ে চারটে বেজে ওঠে , ছেলেরা সব বাসায় ছোটে           হো হো করে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো । রোদ্ দুর    যেই আসে পড়ে পুবের মুখে কোথায় ওড়ে           দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো । আমি তখন দিনের শেষে ভারার থেকে নেমে এসে           আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে । জান তো , মা , আমার পাড়া যেখানে ওই খুঁটি গাড়া            পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে । তোরা যদি শুধাস মোরে খড়ের চালায় রই কী করে ?           কোঠা যখন গড়তে পারি নিজে ; আমার ঘর যে কেন তবে সব - চেয়ে না বড়ো হবে ?           জানি নে তো তার উত্তর কী যে ! (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) রাজা ও রানী এক যে ছিল রাজা সেদিন   আমায় দিল সাজা ।           ভোরের রাতে উঠে আমি     গিয়েছিলুম ছুটে ,           দেখতে ডালিম গাছে বনের    পিরভু কেমন নাচে ।           ডালে ছিলেম চড়ে , সেটা     ভেঙেই গেল পড়ে ।           সেদিন হল মানা আমার   পেয়ারা পেড়ে আনা ,           রথ দেখতে যাওয়া , আমার   চিঁড়ের পুলি খাওয়া ।           কে দিল সেই সাজা , জান      কে ছিল সেই রাজা ?              এক যে ছিল রানী আমি     তার কথা সব মানি ।           সাজার খবর পেয়ে আমায়   দেখল কেবল চেয়ে ।           বললে না তো কিছু , কেবল   মুখটি করে নিচু           আপন ঘরে গিয়ে সেদিন   রইল আগল দিয়ে ।           হল না তার খাওয়া , কিংবা    রথ দেখতে যাওয়া ।           নিল আমায় কোলে সাজার   সময় সারা হলে ।            গলা ভাঙা - ভাঙা তার     চোখ - দুখানি রাঙা ।           কে ছিল সেই রানী আমি     জানি জানি জানি ।   (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) রাজা বসেছেন ধ্যানে রাজা বসেছেন ধ্যানে, বিশজন সর্দার চীৎকাররবে তারা হাঁকিছে– “খবরদার’।সেনাপতি ডাক ছাড়ে, মন্ত্রী সে দাড়ি নাড়ে, যোগ দিল তার সাথে ঢাকঢোল-বর্দার।ধরাতল কম্পিত, পশুপ্রাণী লম্ফিত, রানীরা মূর্ছা যায় আড়ালেতে পর্দার।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) রাজার বাড়ি আমার রাজার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না সে তো; সে বাড়ি কি থাকত যদি লোকে জানতে পেত। রুপো দিয়ে দেয়াল গাঁথা, সোনা দিয়ে ছাত, থাকে থাকে সিঁড়ি ওঠে সাদা হাতির দাঁত। সাত মহলা কোঠায় সেথা থাকেন সুয়োরানী, সাত রাজার ধন মানিক – গাঁথা গলার মালাখানি। আমার রাজার বাড়ি কোথায় শোন্‌ মা, কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে সেইখানে।রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা সাত সাগরের পারে, আমি ছাড়া আর কেহ তো পায় না খুঁজে তারে। দু হাতে তার কাঁকন দুটি, দুই কানে দুই দুল, খাটের থেকে মাটির ‘পরে লুটিয়ে পড়ে চুল। ঘুম ভেঙে তার যাবে যখন সোনার কাঠি ছুঁয়ে হাসিতে তার মানিকগুলি পড়বে ঝ’রে ভুঁয়ে। রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা শোন্‌ মা, কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।তোমরা যখন ঘাটে চল স্নানের বেলা হলে আমি তখন চুপি চুপি যাই সে ছাদে চলে। পাঁচিল বেয়ে ছায়াখানি পড়ে মা, যেই কোণে সেইখানেতে পা ছড়িয়ে বসি আপন মনে। সঙ্গে শুধু নিয়ে আসি মিনি বেড়ালটাকে, সেও জানে নাপিত ভায়া কোন্‌খানেতে থাকে। জানিস নাপিতপাড়া কোথায়? শোন্‌ মা কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।   (শিশু কাব্যগ্রন্থ) রাজার মতো বেশে তুমি রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে              পরাও যারে মণিরতন-হার-- খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে,              বসন-ভুষণ হয় যে বিষম ভার।                    ছেঁড়ে পাছে আঘাত লাগি,                    পাছে ধুলায় হয় সে দাগি, আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে,              চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার-- রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,              পরাও যারে মণিরতন-হার।কী হবে মা অমনতরো রাজার মতো সাজে,             কী হবে ওই মণিরতন-হারে। দুয়ার খুলে দাও যদি তো ছুটি পথের মাঝে            রৌদ্রবায়ু-ধুলাকাদার পাড়ে।                   যেথায় বিশ্বজনের মেলা                   সমস্ত দিন নানান খেলা, চারি দিকে বিরাট গাথা বাজে হাজার সুরে,           সেথায় সে যে পায় না অধিকার, রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,           পরাও যারে মণিরতন-হার। ( বোলপুর, ২ শ্রাবণ, ১৩১৭) রাতের গাড়ি এ প্রাণ, রাতের রেলগাড়ি,               দিল পাড়ি--          কামরায় গাড়িভরা ঘুম,               রজনী নিঝুম।               অসীম আঁধারে     কালি-লেপা কিছুনয় মনে হয় যারে          নিদ্রার পারে রয়েছে সে               পরিচয়হারা দেশে।     ক্ষণ-আলো ইঙ্গিতে উঠে ঝলি,          পার হয়ে যায় চলি      অজানার পরে অজানায়,          অদৃশ্য ঠিকানায়।     অতিদূর-তীর্থের যাত্রী,          ভাষাহীন রাত্রি,     দূরের কোথা যে শেষ          ভাবিয়া না পাই উদ্দেশ।     চালায় যে নাম নাহি কয়;          কেউ বলে, যন্ত্র সে, আর কিছু নয়। মনোহীন বলে তারে, তবু অন্ধের হাতে     প্রাণমন সঁপি দিয়া বিছানা সে পাতে। বলে, সে অনিশ্চিত, তবু জানে অতি            নিশ্চিত তার গতি। নামহীন যে অচেনা বার বার পার হয়ে যায়     অগোচরে যারা সবে রয়েছে সেথায়,        তারি যেন বহে নিশ্বাস, সন্দেহ-আড়ালেতে মুখ-ঢাকা জাগে বিশ্বাস।          গাড়ি চলে, নিমেষ বিরাম নাই আকাশের তলে।      ঘুমের ভিতরে থাকে অচেতনে          কোন্‌ দূর প্রভাতের প্রত্যাশা নিদ্রিত মনে। রাতের বাদল মাতে রাতের বাদল মাতে তমালের শাখে; পাখির বাসায় এসে "জাগো জাগো" ডাকে।    (স্ফুলিঙ্গ) রাত্রি অভিভূত ধরণীর দীপ-নেভা তোরণদুয়ারে                আসে রাত্রি,           আধা অন্ধ, আধা বোবা,                বিরাট অস্পষ্ট মূর্তি, যুগারম্ভসৃষ্টিশালে অসমাপ্তি পুঞ্জীভূত যেন                নিদ্রার মায়ায়। হয় নি নিশ্চিত ভাগ সত্যের মিথ্যার,           ভালোমন্দ-যাচাইয়ের তুলাদণ্ডে                    বাটখারা ভুলের ওজনে। কামনার যে পাত্রটি দিনে ছিল আলোয় লুকানো           আঁধার তাহারে টেনে আনে--      ভরে দেয় সুরা দিয়ে           রজনীগন্ধার গন্ধে,                ঝিমিঝিমি ঝিল্লির ঝননে,           আধ-দেখা কটাক্ষে ইঙ্গিতে। ছায়া করে আনাগোনা সংশয়ের মুখোশ-পরানো,      মোহ আসে কালো মূর্তি লালরঙে এঁকে,                তপস্বীরে করে সে বিদ্রূপ। বেড়াজাল হাতে নিয়ে সঞ্চরে আদিম মায়াবিনী      যবে গুপ্ত গুহা হতে গোধূলির ধূসর প্রান্তরে           দস্যু এসে দিবসের রাজদণ্ড কেড়ে নিয়ে যায়। বিশ্বনাট্যে প্রথম অঙ্কের      অনিশ্চিত প্রকাশের যবনিকা           ছিন্ন করে এসেছিল দিন,      নির্বারিত করেছিল বিশ্বের চেতনা           আপনার নিঃসংশয় পরিচয়।      আবার সে আচ্ছাদন মাঝে-মাঝে নেমে আসে স্বপ্নের সংকেতে।      আবিল বুদ্ধির স্রোতে ক্ষণিকের মতো           মেতে ওঠে ফেনার নর্তন।      প্রবৃত্তির হালে ব'সে কর্ণধার করে           উদ্‌ভ্রান্ত চালনা তন্দ্রাবিষ্ট চোখে। নিজেরে ধিক্কার দিয়ে মন ব'লে ওঠে,      "নহি নহি আমি নহি অপূর্ণ সৃষ্টির           সমুদ্রের পঙ্কলোকে অন্ধ তলচর অর্ধস্ফুট শক্তি যার বিহ্বলতা-বিলাসী মাতাল           তরলে নিমগ্ন অনুক্ষণ। আমি কর্তা, আমি মুক্ত, দিবসের আলোকে দীক্ষিত,      কঠিন মাটির 'পরে           প্রতি পদক্ষেপ যার                আপনারে জয় করে চলা।" রাত্রি (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনীনাগিনী আকাশ – পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা , আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী । মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা । উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিত রাগিণী । রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি — একে একে খুলে পাক , আঁকিবাঁকি কোথা যায় ভাগি । পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর , সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা । শিয়রেতে সারা দিন জেগে রবে বিপুল সাগর — নিভৃতে স্তিমিত দীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি রানী, তোর মধুখানা দিঠি রানী, তুই মণি তুই ধন, তোর কথা ভাবি সারাক্ষণ। দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটে কী করিয়া? সাধ যায় তোর কাছে গিয়া চুপিচাপি বসি এক ভিতে ছোটোছোটো সেই ঘরটিতে। ছোটো হাতখানি হাতে করে অধরেতে রেখে দিই ধরে। ভিজাই ফেলিয়া আঁখিজল ছোট সে কোমল করতল।Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা) রান্নার সব ঠিক রান্নার সব ঠিক, পেয়েছি তো নুনটা– অল্প অভাব আছে, পাইনি বেগুনটা। পরিবেষণের তরে আছি মোরা সব ভাই, যাদের আসার কথা অনাগত সব্বাই। পান পেলে পুরো হয়, জুটিয়েছি চুনটা– একটু-আধটু বাকি, নাই তাহে কুণ্ঠা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) রায়ঠাকুরানী অম্বিকা রায়ঠাকুরানী অম্বিকা। দিনে দিনে তাঁর বাড়ে বাণীটার লম্বিকা। অবকাশ নেই তবুও তো কোনো গতিকে নিজে ব’কে যান, কহিতে না দেন পতিকে। নারীসমাজের তিনি তোরণের স্তম্ভিকা। সয় নাকো তাঁর দ্বিতীয় কাহারো দম্ভিকা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) রাষ্ট্রনীতি কুড়াল কহিল, ভিক্ষা মাগি ওগো শাল, হাতল নাহিকো, দাও একখানি ডাল। ডাল নিয়ে হাতল প্রস্তুত হল যেই, তার পরে ভিক্ষুকের চাওয়া-চিন্তা নেই— একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ, শাল বেচারার হল আদি অন্ত লোপ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) রাস্তায় চলতে চলতে রাস্তায় চলতে চলতে বাউল এসে থামল তোমার সদর দরজায়। গাইল, "অচিন পাখি উড়ে আসে খাঁচায়;" দেখে অবুঝ মন বলে-- অধরাকে ধরেছি। তুমি তখন স্নানের পরে এলোচুলে দাঁড়িয়েছিলে জানলায়। অধরা ছিল তোমার দূরে-চাওয়া চোখের পল্লবে, অধরা ছিল তোমার কাঁকন-পরা নিটোল হাতের মধুরিমায়। ওকে ভিক্ষে দিলে পাঠিয়ে, ও গেল চলে; জানলে না এইগানে তোমারই কথা। তুমি রাগিণীর মতো আস যাও একতারার তারে তারে। সেই যন্ত্র তোমার রূপের খাঁচা, দোলে বসন্তের বাতাসে। তাকে বেড়াই বুকে ক'রে; ওতে রঙ লাগাই, ফুল কাটি আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে। যখন বেজে ওঠে, ওর রূপ যাই ভুলে, কাঁপতে কাঁপতে ওর তার হয় অদৃশ্য। অচিন তখন বেরিয়ে আসে বিশ্বভুবনে, খেলিয়ে যায় বনের সবুজে মিলিয়ে যায় দোলনচাঁপার গন্ধে। অচিন পাখি তুমি, মিলনের খাঁচায় থাক, নানা সাজের খাঁচা। সেখানে বিরহ নিত্য থাকে পাখির পাখায়, স্থকিত ওড়ার মধ্যে। তার ঠিকানা নেই, তার অভিসার দিগন্তের পারে সকল দৃশ্যের বিলীনতায়। রাহুর প্রেম শুনেছি আমারে ভালোই লাগে না, নাই বা লাগিল তোর ।           কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া           চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া                লোহার শিকল-ডোর । তুই তো আমার বন্দী অভাগী, বাঁধিয়াছি কারাগারে, প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে ।           জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি,           যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,           বসন্তে শীতে দিবসে নিশীথে           সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে এ পাষাণপ্রাণ চিরশৃঙ্খল চরণ জড়ায়ে ধ'রে-- একবার তোরে দেখেছি যখন কেমনে এড়াবি মোরে?           চাও নাহি চাও, ডাকো নাই ডাকো,           কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো, যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি-- এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ, এ অশ্রুজল, এই ভাঙা বুক, ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি।।নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া--           কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে           দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া । গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে           চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে           আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে                চেয়ে তোর মুখপানে ।           যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান           সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান, যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার আঁধার মুরতি আঁকা-- সকলি পড়িবে আমার আড়ালে, জগৎ পড়িবে ঢাকা । দুঃস্বপনের মতো চিরকাল তোমারে রহিব ঘিরে, দিবসরজনী এ মুখ দেখিব তোমার নয়ননীরে চিরভিক্ষার মতন দাঁড়ায়ে রব সম্মুখে তোর । 'দাও দাও' বলে কেবলি ডাকিব, ফেলিব নয়নলোর । কেবলি সাধিব, কেবলি কাঁদিব, কেবলি ফেলিব শ্বাস, কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে করিব রে হাহুতাশ । মোর এক নাম কেবলি বসিয়া জপিব কানেতে তব, কাঁটার মতন দিবসরজনী পায়েতে বিঁধিয়ে রব । গত জনমের অভিশাপ-সম রব আমি কাছে কাছে, ভাবী জনমের অদৃষ্ট-হেন বেড়াইব পাছে পাছে।।যেন রে অকূল সাগর মাঝারে ডুবেছে জগৎ-তরী,           তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী--           রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি, যুঝিস ছাড়াতে, ছাড়িব না তবু মহাসমুদ্র-'পরি ।           পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ,           পলে পলে তোর বাহু বলহীন-- দোহে অনন্তে ডুবি নিশিদিন, তবু আছি তোরে ধরি।।রোগের মতন বাঁধিব তোমারে দারুণ আলিঙ্গনে--           মোর যাতনায় হইবি অধীর,           আমারি অনলে দহিবে শরীর, অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর কিছু রহিবে না মনে।।ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি, কেবল দেখিবি মোরে-- এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছে তোরে । নিশীতে বসিয়া থেকে থেকে তুই শুনিবি আঁধারঘোরে কোথা হতে এক ঘোর উন্মাদ ডাকে তোর নাম ধ'রে । নিরজন পথে চলিতে চলিতে সহসা সভয় গণি সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি আমার হাসির ধ্বনি।।          হেরো অমোঘন মরুময়ী নিশা--           আমার পরান হারায়েছে দিশা, অনন্ত ক্ষুদা অনন্ত তৃষা করিতেছে হাহাকার ।           আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে           এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে, এ ঘোর পিপাসা যুগযুগান্তে মিটিবে কি কভু আর!           বুকের ভিতরে ছুরির মতন,           মনের মাঝারে বিষের মতন, রোগের মতন, শোকের মতন রব আমি অনিবার।।জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে, আশার পিছনে ভয়--           ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে           চিরদিন ধরে দিবসের পিছে                সমস্ত ধরাময় । যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া এই তো নিয়ম ভবে-- ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুদা জাগিয়া রবে।। রাহুর মতন মৃত্যু রাহুর মতন মৃত্যু শুধু ফেলে ছায়া, পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত জড়ের কবলে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। প্রেমের অসীম মূল্য সম্পূর্ণ বঞ্চনা করি লবে হেন দস্যু নাই গুপ্ত নিখিলের গুহা-গহ্বরেতে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। সব-চেয়ে সত্য ক’রে পেয়েছিনু যারে সব-চেয়ে মিথ্যা ছিল তারি মাঝে ছদ্মবেশ ধরি, অস্তিত্বের এ কলঙ্ক কভু সহিত না বিশ্বের বিধান এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। সব-কিছু চলিয়াছে নিরন্তর পরিবর্তবেগে, সেই তো কালের ধর্ম।মৃত্যু দেখা দেয় এসে একান্তই অপরিবর্তনে, এ বিশ্বে তাই সে সত্য নহে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। বিশ্বেরে যে জেনেছিল আছে ব’লে সেই তার আমি অস্তিত্বের সাক্ষী সেই, পরম আমির সত্যে সত্য তার এ কথা নিশ্চিত মনে জানি ।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) রিক্ত বইছে নদী বালির মধ্যে, শূন্য বিজন মাঠ,           নাই কোনো ঠাঁই ঘাট। অল্প জলের ধারাটি বয়, ছায়া দেয় না গাছে,           গ্রাম নেইকো কাছে। রুক্ষ হাওয়ায় ধরার বুকে সূক্ষ্ম কাঁপন কাঁপে           চোখ-ধাঁধানো তাপে। কোথাও কোনো শব্দ-যে নেই তারই শব্দ বাজে ঝাঁ-ঝাঁ ক'রে সারাদুপুর দিনের বক্ষোমাঝে। আকাশ যাহার একলা অতিথ শুষ্ক বালুর স্তূপে দিগ্‌বধূ রয় অবাক হয়ে বৈরাগিণীর রূপে। দূরে দূরে কাশের ঝোপে শরতে ফুল ফোটে,             বৈশাখে ঝড় ওঠে। আকাশ ব্যেপে ভূতের মাতন বালুর ঘূর্ণি ঘোরে; নৌকো ছুটে আসে না তো সামাল সামাল ক'রে। বর্ষা হলে বন্যা নামে দূরের পাহাড় হতে,             কূল-হারানো স্রোতে জলে স্থলে হয় একাকার; দমকা হাওয়ার বেগে সওয়ার যেন চাবুক লাগায় দৌড়-দেওয়া মেঘে। সারা বেলাই বৃষ্টিধারা ঝাপট লাগায় যবে মেঘের ডাকে সুর মেশে না ধেনুর হাম্বারবে। খেতের মধ্যে কল্‌কলিয়ে ঘোলা স্রোতের জল ভাসিয়ে নিয়ে আসে না তো শ্যাওলা-পানার দল। রাত্রি যখন ধ্যানে বসে তারাগুলির মাঝে      তীরে তীরে প্রদীপ জ্বলে না যে--                       সমস্ত নিঃঝুম জাগাও নেই কোনোখানে, কোথাও নেই ঘুম। রূপ-নারানের কূলে রূপ-নারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়। রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ, চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়; সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে।    (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) রূপ-বিরূপ এই মোর জীবনের মহাদেশে      কত প্রান্তরের শেষে,           কত প্লাবনের স্রোতে                এলেম ভ্রমণ করি শিশুকাল হতে--      কোথাও রহস্যঘন অরণ্যের ছায়াময় ভাষা,           কোথাও পাণ্ডুর শুষ্ক মরুর নৈরাশা,      কোথাও-বা যৌবনের কুসুমপ্রগল্‌ভ বনপথ,           কোথাও-বা ধ্যানমগ্ন প্রাচীন পর্বত      মেঘপুঞ্জে স্তব্ধ যার দুর্বোধ কী বাণী,                কাব্যের ভাণ্ডারে আনি           স্মৃতিলেখা ছন্দে রাখিয়াছি ঢাকি,                আজ দেখি, অনেক রয়েছে বাকি।      সুকুমারী লেখনীর লজ্জা ভয় যা পুরুষ, যা নিষ্ঠুর, উৎকট যা, করে নি সঞ্চয়                    আপনার চিত্রশালে;           তার সংগীতের তালে                    ছন্দোভঙ্গ হল তাই,                সংকোচে সে কেন বোঝে নাই।           সৃষ্টিরঙ্গভূমিতলে রূপ-বিরূপের নৃত্য একসঙ্গে নিত্যকাল চলে,      সে দ্বন্দ্বের করতালঘাতে           উদ্দাম চরণপাতে সুন্দরের ভঙ্গী যত অকুণ্ঠিত শক্তিরূপ ধরে,      বাণীর সম্মোহবন্ধ ছিন্ন করে অবজ্ঞার ভরে। তাই আজ বেদমন্ত্রে হে বজ্রী, তোমার করি স্তব--                তব মন্ত্ররব             করুক ঐশ্বর্যদান, রৌদ্রী রাগিণীর দীক্ষা নিয়ে যাক মোর শেষগান,           আকাশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে      রূঢ় পৌরুষের ছন্দে           জাগুক হুংকার, বাণীবিলাসীর কানে ব্যপ্ত হোক ভর্ৎসনা তোমার। রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার যাইবি কি তুই, ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? পাদপের ছায়া মাথার ‘পরে, পাখিরা গাইছে মধুর স্বরে অথবা উড়িছে পাখা বিছায়ে হরষে সে গিরি-কাননে! রূপসী আমার প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? শিখর উঠেছে আকাশ-‘পরি, ফেনময় স্রোত পড়িছে মরি, সুরভি-কুঞ্জ ছায়া বিছায়ে শোভিছে সে গিরি-কাননে! রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? ধবল শিখর কুসুমে ভরা সরসে ঝরিছে নিঝর-ধারা উছসে উঠিয়া সলিল-কণা শীতলিছে গিরি-কাননে! রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? সুখ দুখ যাহা দিলেন, বিধি, কিছুই মানিতে চায় না হৃদি, তোমারে ও প্রেমে লইয়া পাশে ভ্রমি যদি গিরি-কাননে!Robert Burns (অনুবাদ কবিতা) রূপে ও অরূপে গাঁথা রূপে ও অরূপে গাঁথা এ ভুবনখানি— ভাব তারে সুর দেয়, সত্য দেয় বাণী। এসো মাঝখানে তার, অানো ধ্যান আপনার ছবিতে গানেতে যেথা নিত্য কানাকানি।   (স্ফুলিঙ্গ) রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি বাহিরে দাঁড়ানু এসে ক্ষণেকের লাগি। শান্ত মৌন নগরীর সুপ্ত হর্ম্য-শিরে হেরিনু জ্বলিছে তারা নিস্তব্ধ তিমিরে। ভূত ভাবী বর্তমান একটি পলকে মিলিল বিষাদস্নিগ্ধ আনন্দপুলকে আমার অন্তরতলে; অনির্বচনীয় সে মুহূর্তে জীবনের যত-কিছু প্রিয়, দুর্লভ বেদনা যত, যত গত সুখ, অনুদ্‌গত অশ্রুবাষ্প, গীত মৌনমূক আমার হৃদয়পাত্রে হয়ে রাশি রাশি কী অনলে উজ্জ্বলিল। সৌরভে নিশ্বাসি অপরূপ ধূপধূম উঠিল সুধীরে তোমার নক্ষত্রদীপ্ত নিঃশব্দ মন্দিরে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) রোম্যাণ্টিক আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক।               সে কথা মানিয়া লই                    রসতীর্থ-পথের পথিক।                 মোর উত্তরীয়ে           দুয়ার-বাহিরে তব আসি যবে                    সুর করে ডাকি আমি ভোরের ভৈরবে।          বসন্তবনের গন্ধ আনি তুলে                    রজনীগন্ধার ফুলে                নিভৃত হাওয়ায় তব ঘরে।          কবিতা শুনাই মৃদুস্বরে,                    ছন্দ তাহে থাকে,                         তার ফাঁকে ফাঁকে          শিল্প রচে বাক্যের গাঁথুনি--                         তাই শুনি                    নেশা লাগে তোমার হাসিতে।                         আমার বাঁশিতে                    যখন আলাপ করি মুলতান          মনের রহস্য নিজ রাগিণীর পায় না সন্ধান।             যে-কল্পলোকের কেন্দ্রে তোমারে বসাই                    ধূলি-আবরণ তার সযত্নে খসাই--          আমি নিজে সৃষ্টি করি তারে।             ফাঁকি দিয়ে বিধাতারে কারুশালা হতে তাঁর চুরি করে আনি রঙ-রস,          আনি তাঁরি জাদুর পরশ।      জানি, তার অনেকটা মায়া,                         অনেকটা ছায়া। আমারে শুধাও যবে "এরে কভু বলে বাস্তবিক?'      আমি বলি, "কখনো না, আমি রোম্যাণ্টিক।'                যেথা ঐ বাস্তব জগৎ           সেখানে আনাগোনার পথ               আছে মোর চেনা।                  সেথাকার দেনা               শোধ করি--সে নহে কথায় তাহা জানি--                    তাহার আহ্বান আমি মানি। দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,               সেথায় রমণী দস্যুভীতা--      সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম;                    সেথায় নির্মম কর্ম; সেথা ত্যাগ, সেথা দুঃখ, সেথা ভেরি বাজুক "মাভৈঃ';           শৌখিন বাস্তব যেন সেথা নাহি হই।                 সেথায় সুন্দর যেন ভৈরবের সাথে                    চলে হাতে-হাতে। রৌদ্রতাপ ঝাঁঝাঁ করে রৌদ্রতাপ ঝাঁঝাঁ করে জনহীন বেলা দুপহরে। শূন্য চৌকির পানে চাহি, সেথায় সান্ত্বনালেশ নাহি। বুক ভরা তার হতাশের ভাষা যেন করে হাহাকার। শূন্যতার বাণী ওঠে করুণায় ভরা, মর্ম তার নাহি যায় ধরা। কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়— অবুঝ মনের ব্যথা করে হায়-হায়— কী হল যে, কেন হল কিছু নাহি বোঝে, দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে। চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর, শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) লটারিতে পেল পীতু লটারিতে পেল পীতু হাজার পঁচাত্তর, জীবনী লেখার লোক জুটিল সে-মাত্তর। যখনি পড়িল চোখে চেহারাটা চেক্‌টার “আমি পিসে’ কহে এসে ড্রেন্‌ইন্‌স্‌পেক্‌টার। গুরু-ট্রেনিঙের এক পিলেওয়ালা ছাত্তর অযাচিত এল তার কন্যার পাত্তর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) লাজময়ী কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি             তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে, ফুটে না। কখন বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে             সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না। অভিমানে যাই দূরে, কথা তার নাহি ফুরে,             চরণ বারণ-তরে উঠে উঠে, উঠে না। কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি             চেয়ে থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না। যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি             চাহি দেখে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না। সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি             মরমেতে ম'রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না! লাজময়ি তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে             প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু ছুটে না! লুকায়ে আছেন যিনি লুকায়ে আছেন যিনি জগতের মাঝে আমি তাঁরে প্রকাশিব সংসারের কাজে।   (স্ফুলিঙ্গ) লুকোচুরি আমি যদি দুষ্টুমি করে        চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি, ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে        কচি পাতায় করি লুটোপুটি, তবে তুমি আমার কাছে হারো, তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।      তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। '        আমি শুধু হাসি চুপটি করে।    যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে        সবই আমি দেখব নয়ন মেলে। স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে        আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে; এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে, দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—      তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে        তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।    দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে        বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে, গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে        পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে, আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—      তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে        তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।    সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে        যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে তখন আমি ফুলের খেলা খেলে           টুপ্‌ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে। আবার আমি তোমার খোকা হব, ‘গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।        তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। '           আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ) শক্তির শক্তি দিবসে চক্ষুর দম্ভ দৃষ্টিশক্তি লয়ে, রাত্রি যেই হল সেই অশ্রু যায় বয়ে! আলোরে কহিল—আজ বুঝিয়াছি ঠেকি তোমারি প্রসাদবলে তোমারেই দেখি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) শক্তির সীমা কহিল কাঁসার ঘটি খন্‌ খন্‌ স্বর— কূপ,তুমি কেন খুড়া হলে না সাগর? তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব, জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব। কূপ কহে,সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ, সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ। কিন্তু বাপু, তার লাগি তুমি কেন ভাব! যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নাবো— তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) শক্তের ক্ষমা নারদ কহিল আসি, হে ধরণী দেবী, তব নিন্দা করে নর তব অন্ন সেবি। বলে মাটি, বলে ধূলি, বলে জড় স্থুল, তোমারে মলিন বলে অকৃতজ্ঞকুল। বন্ধ করো অন্নজল, মুখ হোক চুন, ধুলামাটি কী জিনিস বাছারা বুঝুন। ধরণী কহিলা হাসি, বালাই, বালাই! ওরা কি আমার তুল্য, শোধ লব তাই? ওদের নিন্দায় মোর লাগিবে না দাগ, ওরা যে মরিবে যদি আমি করি রাগ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) শত্রুতাগৌরব পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা, জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) শনির দশা আধবুড়ো ঐ মানুষটি মোর নয় চেনা--        একলা বসে ভাবছে কিংবা ভাবছে না,               মুখ দেখে ওর সেই কথাটাই ভাবছি,               মনে মনে আমি যে ওর মনের মধ্যে নাবছি।       বুঝিবা ওর মেঝোমেয়ে পাতা ছয়েক ব'কে        মাথার দিব্যি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ওকে।               উমারানীর বিষম স্নেহের শাসন,          জানিয়েছিল, চতুর্থীতে খোকার অন্নপ্রাসন--               জিদ ধরেছে, হোক-না যেমন ক'রেই          আসতে হবে শুক্রবার কি শনিবারের ভোরেই।                    আবেদনের পত্র একটি লিখে               পাঠিয়েছিল বুড়ো তাদের কর্তাবাবুটিকে।                    বাবু বললে, "হয় কখনো তা কি,          মাসকাবারের ঝুড়িঝুড়ি হিসাব লেখা বাকি,               সাহেব শুনলে আগুন হবে চটে,                    ছুটি নেবার সময় এ নয় মোটে।'                 মেয়ের দুঃখ ভেবে          বুড়ো বারেক ভেবেছিল কাজে জবাব দেবে।          সুবুদ্ধি তার কইল কানে রাগ গেল যেই থামি,          আসন্ন পেন্‌সনের আশা ছাড়াটা পাগলামি।          নিজেকে সে বললে, "ওরে, এবার না হয় কিনিস          ছোটোছেলের মনের মতো একটা-কোনো জিনিস।'          যেটার কথাই ভেবে দেখে দামের কথায় শেষে                      বাধায় ঠেকে এসে।        কেইবা জানবে দামটা যে তার কত,     বাইরে থেকে ঠিক দেখাবে খাঁটি রুপোর মতো।     এমনি করে সংশয়ে তার কেবলই মন ঠেলে,     হাঁ-না নিয়ে ভাব্‌নাস্রোতে জোয়ার-ভাঁটা খেলে।        রোজ সে দেখে টাইম্‌টেবিলখানা,     ক'দিন থেকে ইস্‌টিশনে প্রত্যহ দেয় হানা।        সামনে দিয়ে যায় আসে রোজ মেল,             গাড়িটা তার প্রত্যহ হয় ফেল।          চিন্তিত ওর মুখের ভাবটা দেখে     এমনি একটা ছবি মনে নিয়েছিলেম এঁকে।                   কৌতূহলে শেষে     একটুখানি উসখুসিয়ে একটুখানি কেশে,             শুধাই তারে ব'সে তাহার কাছে, "কী ভাবতেছেন, বাড়িতে কি মন্দ খবর আছে।"        বললে বুড়ে, "কিচ্ছুই নয়, মশায়,             আসল কথা, আছি শনির দশায়।     তাই ভাবছি কী করা যায় এবার ঘৌড়দৌড়ে দশটি টাকা বাজি ফেলে দেবার।     আপনি বলুন, কিনব টিকিট আজ কি।"          আমি বললেম, "কাজ কী।"        রাগে বুড়োর গরম হল মাথা;     বললে, "থামো, ঢের দেখেছি পরামর্শদাতা! কেনার সময় রইবে না আর আজিকার এই দিন বই! কিনব আমি, কিনব আমি, যে ক'রে হোক কিনবই।" শরতে আজ কোন্‌ অতিথি শরতে আজ কোন্‌ অতিথি        এল প্রাণের দ্বারে। আনন্দগান গা রে হৃদয়,        আনন্দগান গা রে।              নীল আকাশের নীরব কথা              শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা              বেজে উঠুক আজি তোমার                            বীণার তারে তারে।শস্যখেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে, ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর        অমল জলধারে।               যে এসেছে তাহার মুখে               দেখ্‌ রে চেয়ে গভীর সুখে,               দুয়ার খুলে তাহার সাথে                            বাহির হয়ে যা রে। (শান্তিনিকেতন, ১৮ ভাদ্র, ১৩১৬) শরতে শিশিরবাতাস লেগে শরতে শিশিরবাতাস লেগে জল ভ'রে আসে উদাসি মেঘে। বরষন তবু হয় না কেন, ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন।   (স্ফুলিঙ্গ) শরতের শুকতারা একাদশী রজনী                    পোহায় ধীরে ধীরে — রাঙা মেঘ দাঁড়ায়                    উষারে ঘিরে ঘিরে । ক্ষীণ চাঁদ নভের                    আড়ালে যেতে চায় , মাঝখানে দাঁড়ায়ে                    কিনারা নাহি পায় । বড়ো ম্লান হয়েছে                    চাঁদের মুখখানি , আপনাতে আপনি                    মিশাবে অনুমানি । হেরো দেখো কে ওই                    এসেছে তার কাছে , শুকতারা চাঁদের                    মুখেতে চেয়ে আছে । মরি মরি কে তুমি                    একটুখানি প্রাণ , কী না জানি এনেছ                    করিতে ওরে দান । চেয়ে দেখো আকাশে                    আর তো কেহ নাই , তারা যত গিয়েছে                    যে যার নিজ ঠাঁই । সাথীহারা চন্দ্রমা                    হেরিছে চারি ধার , শূন্য আহা নিশির                    বাসর-ঘর তার! শরতের প্রভাতে                    বিমল মুখ নিয়ে তুমি শুধু রয়েছে                       শিয়রে দাঁড়াইয়ে । ও হয়তো দেখিতে                    পেলে না মুখ তোর! ও হয়তো তারার                    খেলার গান গায় , ও হয়তো বিরাগে                    উদাসী হতে চায়! ও কেবল নিশির                    হাসির অবশেষ! ও কেবল অতীত                    সুখের স্মৃতিলেশ! দ্রুতপদে তাহারা                    কোথায় চলে গেছে — সাথে যেতে পারে নি                    পিছনে পড় আছে! কত দিন উঠেছ                    নিশির শেষাশেষি , দেখিয়াছ চাঁদেতে                    তারাতে মেশামেশি! দুই দণ্ড চাহিয়া                     আবার চলে যেতে , মুখখানি লুকাতে                    উষার আঁচলেতে । পুরবের একান্তে                    একটু দিয়ে দেখা , কী ভাবিয়া তখনি                    ফিরিতে একা একা । আজ তুমি দেখেছ                    চাঁদের কেহ নাই , স্নেহময়ি , আপনি                     এসেছ তুমি তাই! দেহখানি মিলায়                    মিলায় বুঝি তার! হাসিটুকু রহে না                    রহে না বুঝি আর!    দুই দণ্ড পরে তো                    রবে না কিছু হায়! কোথা তুমি , কোথায়                    চাঁদের ক্ষীণকায়! কোলাহল তুলিয়া                     গরবে আসে দিন , দুটি ছোটো প্রাণের                    লিখন হবে লীন । সুখশ্রমে মলিন                    চাঁদের একসনে নবপ্রেম মিলাবে                    কাহার রবে মনে!    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) শা-জাহান এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান, কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান।       শুধু তব অন্তরবেদনা চিরন্তন হয়ে থাক্, সম্রাটের ছিল এ সাধনা       রাজশক্তি বজ্রসুকঠিন সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন       কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ,       এই তব মনে ছিল আশ।     হীরামুক্তামানিক্যের ঘটা যেন শুন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা     যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,              শুধু থাক্     একবিন্দু নয়নের জল কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল     এ তাজমহল॥           হায় ওরে মানবহৃদয়,             বার বার     কারো পানে ফিরে চাহিবার          নাই যে সময়,           নাই নাই।     জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই        ভুবনের ঘাটে ঘাটে---     এক হাতে লও বোঝা, শুন্য করে দাও অন্য হাটে।         দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে             তব কুঞ্জবনে     বসন্তের মাধবীমঞ্জরি         যেই ক্ষণে দেয় ভরি             মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল---     বিদায়গোধুলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্ন দল।              সময় যে নাই,         আবার শিশিররাত্রে তাই     নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি।          হায় রে হৃদয়,      তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।      নাই নাই, নাই যে সময়॥        হে সম্রাট্, তাই তব শঙ্কিত হৃদয়           চেয়েছিল করিবারে সময়ের হৃদয়হরণ                সৌন্দর্যে ভুলায়ে।            কণ্ঠে তার কী মালা দুলায়ে                করিলে বরণ           রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে!                      রহে না যে                    বিলাপের অবকাশ                      বারো মাস,                   তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে         চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে।               জ্যোত্‍‌স্নারাতে নিভৃত মন্দিরে                    প্রেয়সীরে             যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে         সেই কানে-কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে                 অনন্তের কানে।              প্রেমের করুণ কোমলতা,                    ফুটিল তা         সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥                হে সম্রাট্ কবি,              এই তব হৃদয়ের ছবি,                 এই তব নব মেঘদূত,                     অপূর্ব অদ্ভুত                 ছন্দে গানে              উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে---                  যেথা তব বিরহিণী প্রিয়া                     রয়েছে মিশিয়া                  প্রভাতের অরুণ-আভাসে,              ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে,          পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্যবিলাসে,                    ভাষার অতীত তীরে          কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে।                   তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি                         এড়াইয়া কালের প্রহরী                চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া---                   `ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!'               চলে গেছ তুমি আজ,                     মহারাজ---           রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে,                সিংহাসন গেছে টুটে,                     তব সৈন্যদল        যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল             তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে           উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-'পরে।                 বন্দীরা গাহে না গান,           যমুনাকল্লোল-সাথে নহবত মিলায় না তান।               তব পুরসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ                   ভগ্ন প্রাসাদের কোণে                 ম'রে গিয়ে ঝিল্লিস্বনে                   কাঁদায় রে নিশার গগন।               তবুও তোমার দূত অমলিন,                   শ্রান্তিক্লান্তিহীন,           তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া,        তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া,               যুগে যুগান্তরে             কহিতেছে একস্বরে           চিরবিরহীর বাণী নিয়া---       `ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!'            মিথ্যা কথা! কে বলে যে ভোল নাই?               কে বলে রে খোল নাই                    স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার?                  অতীতের চির-অস্ত-অন্ধকার             আজিও হৃদয় তব রেখেছে বাঁধিয়া?                  বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়া                      আজিও সে হয়নি বাহির?             সমাধিমন্দির এক ঠাঁই রহে চিরস্থির,                      ধরার ধূলায় থাকি        স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি।              জীবনেরে কে রাখিতে পারে!        আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।              তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে        নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।              স্মরণের গ্রন্থি টুটে            সে যে যায় ছুটে                বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।        মহারাজ, কোনো মহারাজ্য কোনোদিন                পারে নাই তোমারে ধরিতে।        সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে                      নাহি পারে---                   তাই এ ধরারে             জীবন-উত্‍‌সব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে                 মৃত্‍‌পাত্রের মত যাও ফেলে।                     তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহত্‍‌,                         তাই তব জীবনের রথ                     পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার                                বারম্বার।                                  তাই              চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই।                      যে প্রেম সম্মুখপানে                চলিতে চালাতে নাহি জানে,           যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজসিংহাসন,                 তার বিলাসের সম্ভাষণ           পথের ধূলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে---                 দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে।                      সেই তব পশ্চাতের পদধূলি-'পরে         তব চিত্ত হতে বায়ুভরে              কখন সহসা       উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা।               তুমি চলে গেছ দূরে,           সেই বীজ অমর অঙ্কুরে             উঠেছে অম্বর-পানে,                কহিছে গম্ভীর গানে---                   `যত দূর চাই           নাই নাই সে পথিক নাই।     প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছাড়ি দিল পথ,           রুধিল না সমুদ্র পর্বত।               আজি তার রথ           চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে             নক্ষত্রের গানে           প্রভাতের সিংহদ্বার-পানে।                 তাই           স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি,                ভারমুক্ত সে এখানে নাই।' শান্তি থাক্ থাক্ চুপ কর্ তোরা , ও আমার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে । আবার যদি জেগে ওঠে বাছা কান্না দেখে কান্না পাবে যে । কত হাসি হেসে গেছে ও , মুছে গেছে কত অশ্রুধার , হেসে কেঁদে আজ ঘুমাল , ওরে তোরা কাঁদাস নে আর ।কত রাত গিয়েছিল হায় , বসেছিল বসন্তের বায় , পুবের জানালাখানি দিয়ে চন্দ্রালোক পড়েছিল গায় ; কত রাত গিয়েছিল হায় , দূর হতে বেজেছিল বাঁশি , সুরগুলি কেঁদে ফিরেছিল বিছানার কাছে কাছে আসি । কত রাত গিয়েছিল হায় , কোলেতে শুকানো ফুলমালা নত মুখে উলটি পালটি চেয়ে চেয়ে কেঁদেছিল বালা । কত দিন ভোরে শুকতারা উঠেছিল ওর আঁখি -‘ পরে , সমুখের কুসুম – কাননে ফুল ফুটেছিল থরে থরে । একটি ছেলেরে কোলে নিয়ে বলেছিল সোহাগের ভাষা , কারেও বা ভালোবেসেছিল , পেয়েছিল কারো ভালোবাসা ! হেসে হেসে গলাগলি করে খেলেছিল যাহাদের নিয়ে আজো তারা ওই খেলা করে , ওর খেলা গিয়েছে ফুরিয়ে । সেই রবি উঠেছে সকালে ফুটেছে সুমুখে সেই ফুল , ও কখন খেলাতে খেলাতে মাঝখানে ঘুমিয়ে আকুল । শ্রান্ত দেহ , নিস্পন্দ নয়ন , ভুলে গেছে হৃদয় – বেদনা । চুপ করে চেয়ে দেখো ওরে , থামো থামো , হেসো না কেঁদো না ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) শান্তিমন্ত্র কাল আমি তরী খুলি লোকালয়মাঝে আবার ফিরিয়া যাব আপনার কাজে— হে অন্তর্যামিনী দেবী, ছেড়ো না আমারে, যেয়ো না একেলা ফেলি জনতাপাথারে কর্মকোলাহলে। সেথা সর্ব ঝঞ্ঝনায় নিত্য যেন বাজে চিত্তে তোমার বীণায় এমনি মঙ্গলধ্বনি। বিদ্বেষের বাণে বক্ষ বিদ্ধ করি যবে রক্ত টেনে আনে, তোমার সান্ত্বনাসুধা অশ্রুবারিসম পড়ে যেন বিন্দু বিন্দু ক্ষতপ্রাণে মম। বিরোধ উঠিবে গর্জি শতফণা ফণী, তুমি মৃদুস্বরে দিয়ো শান্তিমন্ত্রধ্বনি— স্বার্থ মিথ্যা, সব মিথ্যা—বোলো কানে কানে— আমি শুধু নিত্য সত্য তোর মাঝখানে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) শিকড় ভাবে, "সেয়ানা আমি শিকড় ভাবে, "সেয়ানা আমি, অবোধ যত শাখা। ধূলি ও মাটি সেই তো খাঁটি, আলোকলোক ফাঁকা।"   (স্ফুলিঙ্গ) শিমূল রাঙা রঙে শিমূল রাঙা রঙে চোখেরে দিল ভ’রে। নাকটা হেসে বলে, “হায় রে যাই ম’রে।’ নাকের মতে, গুণ কেবলি আছে ঘ্রাণে, রূপ যে রঙ খোঁজে নাকটা তা কি জানে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) শিশু ভোলানাথ ওরে মোর শিশু ভোলানাথ ,        তুলি দুই হাত যেখানে করিস পদপাত বিষম তাণ্ডবে তোর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব ;           আপন বিভব আপনি করিস নষ্ট হেলাভরে ;           প্রলয়ের ঘূর্ণচক্র -' পরে চূর্ণ খেলেনার ধূলি উড়ে দিকে দিকে ;           আপন সৃষ্টিকে ধ্বংস হতে ধ্বংসমাঝে মুক্তি দিস অনর্গল , খেলারে করিস রক্ষা ছিন্ন করি খেলেনা - শৃঙ্খল ।    অকিঞ্চন , তোর কাছে কিছুরই তো কোনো মূল্য নাই ,           রচিস যা তোর ইচ্ছা তাই           যাহা খুশি তাই দিয়ে , তার পর ভুলে যাস যাহা ইচ্ছা তাই নিয়ে । আবরণ তোরে নাহি পারে সম্বরিতে দিগম্বর ,            স্রস্ত ছিন্ন পড়ে ধূলি -' পর । লজ্জাহীন সজ্জাহীন বিত্তহীন আপনা - বিস্মৃত ,           অন্তরে ঐশ্বর্য তোর , অন্তরে অমৃত । দারিদ্র্য করে না দীন , ধূলি তোরে করে না অশুচি , নৃত্যের বিক্ষোভে তোর সব গ্লানি নিত্য যায় ঘুচি ।    ওরে শিশু ভোলানাথ , মোরে ভক্ত ব'লে            নে রে তোর তাণ্ডবের দলে ;           দে রে চিত্তে মোর           সকল - ভোলার ওই ঘোর , খেলেনা - ভাঙার খেলা দে আমারে বলি । আপন সৃষ্টির বন্ধ আপনি ছিঁড়িয়া যদি চলি           তবে তোর মত্ত নর্তনের চালে আমার সকল গান ছন্দে ছন্দে মিলে যাবে তালে ।    (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) শিশুর জীবন ছোটো ছেলে হওয়ার সাহস           আছে কি এক ফোঁটা,                    তাই তো এমন বুড়ো হয়েই মরি। তিলে তিলে জমাই কেবল           জমাই এটা ওটা,                    পলে পলে বাক্স বোঝাই করি। কালকে-দিনের ভাবনা এসে আজ-দিনেরে মারলে ঠেসে                    কাল তুলি ফের পরদিনের বোঝা। সাধের জিনিস ঘরে এনেই দেখি, এনে ফল কিছু নেই           খোঁজের পরে আবার চলে খোঁজা। ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত দেখতে না পাই পথ,           তাকিয়ে থাকি পরশু দিনের পানে, ভবিষ্যৎ তো চিরকালই           থাকবে ভবিষ্যৎ ,                    ছুটি তবে মিলবে বা কোন্‌খানে? বুদ্ধি-দীপের আলো জ্বালি হাওয়ায় শিখা কাঁপছে খালি,                    হিসেব করে পা টিপে পথ হাঁটি। মন্ত্রণা দেয় কতজনা, সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা,                    পদে-পদে হাজার খুঁটিনাটি। শিশু হবার ভরসা আবার           জাগুক আমার প্রাণে,                    লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে, ভবিষ্যতের মুখোশখানা           খসাব একটানে,                    দেখব তারেই বর্তমানের কালে। ছাদের কোণে পুকুরপারে জানব নিত্য-অজানারে                    মিশিয়ে রবে অচেনা আর চেনা; জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা তৈরি হবে আমার খেলা,                    সুখ রবে মোর বিনামূল্যেই কেনা। বড়ো হবার দায় নিয়ে, এই           বড়োর হাটে এসে                    নিত্য চলে ঠেলাঠেলির পালা। যাবার বেলায় বিশ্ব আমার           বিকিয়ে দিয়ে শেষে                    শুধুই নেব ফাঁকা কথার ডালা! কোন্‌টা সস্তা, কোন্‌টা দামি ওজন করতে গিয়ে আমি                    বেলা আমার বইয়ে দেব দ্রুত, সন্ধ্যা যখন আঁধার হবে হঠাৎ মনে লাগবে তবে                    কোনোটাই না হল মনঃপুত। বাল্য দিয়ে যে-জীবনের           আরম্ভ হয় দিন                    বাল্যে আবার হোক-না তাহা সারা। জলে স্থলে সঙ্গ আবার           পাক-না বাঁধন-হীন,                    ধুলায় ফিরে আসুক-না পথহারা। সম্ভাবনার ডাঙা হতে অসম্ভবের উতল স্রোতে                    দিই-না পাড়ি স্বপন-তরী নিয়ে। আবার মনে বুঝি না এই, বস্তু বলে কিছুই তো নেই                    বিশ্ব গড়া যা খুশি তাই দিয়ে। প্রথম যেদিন এসেছিলেম           নবীন পৃথ্বীতলে                    রবির আলোয় জীবন মেলে দিয়ে, সে যেন কোন্‌ জগৎ-জোড়া           ছেলেখেলার ছলে,                    কোথাত্থেকে কেই বা জানে কী এ! শিশির যেমন রাতে রাতে, কে যে তারে লুকিয়ে গাঁথে,                    ঝিল্লি বাজায় গোপন ঝিনিঝিনি। ভোরবেলা যেই চেয়ে দেখি, আলোর সঙ্গে আলোর এ কী                    ইশারাতে চলছে চেনাচিনি। সেদিন মনে জেনেছিলেম           নীল আকাশের পথে                    ছুটির হাওয়ায় ঘুর লাগাল বুঝি! যা-কিছু সব চলেছে ওই           ছেলেখেলার রথে                    যে-যার আপন দোসর খুঁজি খুঁজি। গাছে খেলা ফুল-ভরানো ফুলে খেলা ফল-ধরানো,                    ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে। স্থলের খেলা জলের কোলে, জলের খেলা হাওয়ার দোলে,                    হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে। ছেলের সঙ্গে আছ তুমি           নিত্য ছেলেমানুষ,                     নিয়ে তোমার মালমসলার ঝুলি। আকাশেতে ওড়াও তোমার           কতরকম ফানুস                    মেঘে বোলাও রঙ-বেরঙের তুলি। সেদিন আমি আপন মনে ফিরেছিলেম তোমার সনে,                    খেলেছিলেম হাত মিলিয়ে হাতে। ভাসিয়েছিলেম রাশি রাশি কথায় গাঁথা কান্নাহাসি                    তোমারই সব ভাসান-খেলার সাথে। ঋতুর তরী বোঝাই কর           রঙিন ফুলে ফুলে,                    কালের স্রোতে যায় তারা সব ভেসে। আবার তারা ঘাটে লাগে           হাওয়ায় দুলে দুলে                    এই ধরণীর কূলে কূলে এসে। মিলিয়েছিলেম বিশ্ব-ডালায় তোমার ফুলে আমার মালায়                    সাজিয়েছিলেম ঋতুর তরণীতে, আশা আমার আছে মনে বকুল কেয়া শিউলি -সনে                    ফিরে ফিরে আসবে ধরণীতে। সেদিন যখন গান গেয়েছি           আপন মনে নিজে,                    বিনা কাজে দিন গিয়েছে চলে, তখন আমি চোখে তোমার           হাসি দেখেছি যে,                    চিনেছিলে আমায় সাথি বলে। তোমার ধুলো তোমার আলো আমার মনে লাগত ভালো,                    শুনেছিলেম উদাস-করা বাঁশি। বুঝেছিলে সে-ফাল্গুনে আমার সে-গান শুনে শুনে                    তোমারও গান আমি ভালোবাসি। দিন গেল ঐ মাঠে বাটে,           আঁধার নেমে প’ল;                    এপার থেকে বিদায় মেলে যদি তবে তোমার সন্ধেবেলার             খেয়াতে পাল তোলো,                    পার হব এই হাটের ঘাটের নদী। আবার ওগো শিশুর সাথি, শিশুর ভুবন দাও তো পাতি,                    করব খেলা তোমায় আমায় একা। চেয়ে তোমার মুখের দিকে তোমায়, তোমার জগৎটিকে                    সহজ চোখে দেখব সহজ দেখা। (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) শীত পাখি বলে ‘আমি চলিলাম',           ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না', মলয় কহিয়া গেল শুধু           ‘বনে বনে আমি ছুটিব না'। কিশলয় মাথাটি না তুলে           মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি, সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস           টানি দিল মুখের উপরি। পাখি কেন গেল গো চলিয়া,           কেন ফুল কেন সে ফুটে না। চপল মলয় সমীরণ           বনে বনে কেন সে ছুটে না। শীতের হৃদয় গেছে চলে,           অসাড় হয়েছে তার মন, ত্রিবলিবলিত তার ভাল           কঠোর জ্ঞানের নিকেতন। জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,           ফুলের যৌবন পরিমল, মলয়ের বাল্যখেলা যত,           পল্লবের বাল্য - কোলাহল— সকলি সে মনে করে পাপ,          মনে করে প্রকৃতির ভ্রম, ছবির মতন বসে থাকা          সেই জানে জ্ঞানীর ধরম। তাই পাখি বলে ‘চলিলাম',          ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না'। মলয় কহিয়া গেল শুধু          ‘বনে বনে আমি ছুটিব না'। আশা বলে ‘বসন্ত আসিবে',          ফুল বলে ‘আমিও আসিব', পাখি বলে ‘আমিও গাহিব',          চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব'।    বসন্তের নবীন হৃদয়          নূতন উঠেছে আঁখি মেলে— যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,          যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে। মনে তার শত আশা জাগে,          কী যে চায় আপনি না বুঝে— প্রাণ তার দশ দিকে ধায়          প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে। ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে—          পাখি গায়, সেও গান গায়— বাতাস বুকের কাছে এলে          গলা ধ'রে দুজনে খেলায়। তাই শুনি ‘বসন্ত আসিবে'          ফুল বলে ‘আমিও আসিব' , পাখি বলে ‘আমিও গাহিব',          চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব'। শীত, তুমি হেথা কেন এলে।             উত্তরে তোমার দেশ আছে— পাখি সেথা নাহি গাহে গান,             ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে। সকলি তুষারমরুময়,             সকলিআঁধার জনহীন— সেথায় একেলা বসি বসি             জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।(শিশু কাব্যগ্রন্থ) শীতের বিদায় বসন্ত বালক মুখ-ভরা হাসিটি,     বাতাস ব'য়ে ওড়ে চুল— শীত চলে যায়, মারে তার গায়     মোটা মোটা গোটা ফুল। আঁচল ভরে গেছে শত ফুলের মেলা, গোলাপ ছুঁড়ে মারে টগর চাঁপা বেলা— শীত বলে, ‘ভাই, এ কেমন খেলা,     যাবার বেলা হল, আসি। ' বসন্ত হাসিয়ে বসন ধ'রে টানে, পাগল করে দেয় কুহু কুহু গানে, ফুলের গন্ধ নিয়ে প্রাণের ‘পরে হানে—     হাসির ‘পরে হানে হাসি। ওড়ে ফুলের রেণু, ফুলের পরিমল, ফুলের পাপড়ি উড়ে করে যে বিকল— কুসুমিত শাখা, বনপথ ঢাকা,     ফুলের ‘পরে পড়ে ফুল। দক্ষিনে বাতাসে ওড়ে শীতের বেশ, উড়ে উড়ে পড়ে শীতের শুভ্র কেশ; কোন্‌ পথে যাবে না পায় উদ্দেশ,         হয়ে যায় দিক ভুল।   বসন্ত বালক হেসেই কুটিকুটি,   টলমল করে রাঙা চরণ দুটি,   গান গেয়ে পিছে ধায় ছুটিছুটি—         বনে লুটোপুটি যায়।   নদী তালি দেয় শত হাত তুলি,   বলাবলি করে ডালপালাগুলি,   লতায় লতায় হেসে কোলাকুলি—         অঙ্গুলি তুলি চায়।   রঙ্গ দেখে হাসে মল্লিকা মালতী,   আশেপাশে হাসে কতই জাতী যূথী,   মুখে বসন দিয়ে হাসে লজ্জাবতী—         বনফুলবধূগুলি।   কত পাখি ডাকে কত পাখি গায়,   কিচিমিচিকিচি কত উড়ে যায়,   এ পাশে ও পাশে মাথাটি হেলায়—         নাচে পুচ্ছখানি তুলি।   শীত চলে যায়, ফিরে ফিরে চায়,   মনে মনে ভাবে ‘এ কেমন বিদায়'—   হাসির জ্বালায় কাঁদিয়ে পালায়,         ফুলঘায় হার মানে।   শুকনো পাতা তার সঙ্গে উড়ে যায়,   উত্তরে বাতাস করে হায়-হায়—   আপাদমস্তক ঢেকে কুয়াশায়         শীত গেল কোন্‌খানে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) শীতের রোদ্দুর শীতের রোদ্দুর। সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে। বেগনি-ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা ঝুরি-নামা বৃদ্ধ বট ডাল মেলেছে রাস্তার ওপার পর্যন্ত। ফলসাগাছের ঝরা পাতা হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে ধুলোর সাঙাত হয়ে। কাজ-ভোলা এই দিন উধাও বলাকার মতো লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম নীলিমায়। ঝাউগাছের মর্মরধ্বনিতে মিশে মনের মধ্যে এই কথাটি উঠছে বেজে, "আমি আছি।" কুয়োতলার কাছে সামান্য ঐ আমের গাছ; সারা বছর ও থাকে আত্মবিস্মৃত, বনের সাধারণ সবুজের আবরণে ও থাকে ঢাকা। এমন সময় মাঘের শেষে হঠাৎ মাটির নিচে শিকড়ে শিকড়ে তার শিহর লাগে, শাখায় শাখায় মুকুলিত হয়ে ওঠে বাণী-- "আমি আছি," চন্দ্রসূর্যের আলো আপন ভাষায় স্বীকার করে তার সেই ভাষা। অলস মনের শিয়রে দাঁড়িয়ে হাসেন অন্তর্যামী, হঠাৎ দেন ঠেকিয়ে সোনার কাঠি প্রিয়ার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি দিয়ে, কবির গানের সুর দিয়ে, তখন যে-আমি ধূলিধূসর সামান্য দিনগুলির মধ্যে মিলিয়ে ছিল, সে দেখা দেয় এক নিমেষের অসমান্য আলোকে। সে-সব দুর্মূল্য নিমেষ কোনো রত্নভাণ্ডারে থেকে যায় কি না জানিনে; এইটুকু জানি-- তারা এসেছে আমার আত্মবিস্মৃতির মধ্যে, জাগিয়েছে আমার মর্মে বিশ্বমর্মের নিত্যকালের সেই বাণী "আমি আছি।" শুচি রামানন্দ পেলেন গুরুর পদ–     সারাদিন তার কাটে জপে তপে,         সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরকে ভোজ্য করেন নিবেদন,            তার পরে ভাঙে তাঁর উপবাস                যখন অন্তরে পান ঠাকুরের প্রসাদ। সেদিন মন্দিরে উৎসব–     রাজা এলেন, রানী এলেন,         এলেন পণ্ডিতেরা দূর দূর থেকে, এলেন নানাচিহ্নধারী নানা সম্প্রদায়ের ভক্তদল।     সন্ধ্যাবেলায় স্নান শেষ করে।         রামানন্দ নৈবেদ্য দিলেন ঠাকুরের পায়ে–            প্রসাদ নামল না তাঁর অন্তরে,                আহার হল না সেদিন। এমনি যখন দুই সন্ধ্যা গেল কেটে,         হৃদয় রইল শুষ্ক হয়ে, গুরু বললেন মাটিতে ঠেকিয়ে মাথা,         "ঠাকুর, কী অপরাধ করেছি।’ ঠাকুর বললেন, "আমার বাস কি কেবল বৈকুণ্ঠে।     সেদিন আমার মন্দিরে যারা প্রবেশ পায় নি         আমার স্পর্শ যে তাদের সর্বাঙ্গে,            আমারই পাদোদক নিয়ে প্রাণপ্রবাহিণী বইছে তাদের শিরায়।     তাদের অপমান আমাকে বেজেছে;            আজ তোমার হাতের নৈবেদ্য অশুচি।’ "লোকস্থিতি রক্ষা করতে হবে যে প্রভু’            ব’লে গুরু চেয়ে রইলেন ঠাকুরের মুখের দিকে। ঠাকুরের চক্ষু দীপ্ত হয়ে উঠল; বললেন,            "যে লোকসৃষ্টি স্বয়ং আমার,     যার প্রাঙ্গণে সকল মানুষের নিমন্ত্রণ, তার মধ্যে তোমার লোকস্থিতির বেড়া তুলে     আমার অধিকারে সীমা দিতে চাও                    এতবড়ো স্পর্ধা!’ রামানন্দ বললেন, "প্রভাতেই যাব এই সীমা ছেড়ে,         দেব আমার অহংকার দূর করে তোমার বিশ্বলোকে।’         তখন রাত্রি তিন-প্রহর,     আকাশের তারাগুলি যেন ধ্যানমগ্ন।         গুরুর নিদ্রা গেল ভেঙে; শুনতে পেলেন,            "সময় হয়েছে, ওঠো, প্রতিজ্ঞা পালন করো।’ রামানন্দ হাতজোড় করে বললেন, "এখনো রাত্রি গভীর,     পথ অন্ধকার, পাখিরা নীরব।         প্রভাতের অপেক্ষায় আছি।’ ঠাকুর বললেন, "প্রভাত কি রাত্রির অবসানে।     যখনি চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী,         তখনি এসেছে প্রভাত।            যাও তোমার ব্রতপালনে।’ রামানন্দ বাহির হলেন পথে একাকী,     মাথার উপরে জাগে ধ্রুবতারা। পার হয়ে গেলেন নগর, পার হয়ে গেলেন গ্রাম।     নদীতীরে শ্মশান, চণ্ডাল শবদাহে ব্যাপৃত।         রামানন্দ দুই হাত বাড়িয়ে তাকে নিলেন বক্ষে। সে ভীত হয়ে বললে, "প্রভু, আমি চণ্ডাল, নাভা আমার নাম,                হেয় আমার বৃত্তি,         অপরাধী করবেন না আমাকে।’ গুরু বললেন, "অন্তরে আমি মৃত, অচেতন আমি,     তাই তোমাকে দেখতে পাই নি এতকাল,         তাই তোমাকেই আমার প্রয়োজন–            নইলে হবে না মৃতের সৎকার।’ চললেন গুরু আগিয়ে।         ভোরের পাখি উঠল ডেকে,     অরুণ-আলোয় শুকতারা গেল মিলিয়ে।            কবীর বসেছেন তাঁর প্রাঙ্গণে,         কাপড় বুনছেন আর গান গাইছেন গুন্‌ গুন্‌ স্বরে। রামানন্দ বসলেন পাশে,         কণ্ঠ তাঁর ধরলেন জড়িয়ে। কবীর ব্যস্ত হয়ে বললেন,     "প্রভু, জাতিতে আমি মুসলমান,         আমি জোলা, নীচ আমার বৃত্তি।’ রামানন্দ বললেন, "এতদিন তোমার সঙ্গ পাই নি বন্ধু,     তাই অন্তরে আমি নগ্ন,         চিত্ত আমার ধুলায় মলিন, আজ আমি পরব শুচিবস্ত্র তোমার হাতে–         আমার লজ্জা যাবে দূর হয়ে।’         শিষ্যেরা খুঁজতে খুঁজতে এল সেখানে,     ধিক্‌কার দিয়ে বললে, "এ কী করলেন প্রভু!’ রামানন্দ বললেন, "আমার ঠাকুরকে এতদিন যেখানে হারিয়েছিলুম     আজ তাঁকে সেখানে পেয়েছি খুঁজে।’            সূর্য উঠল আকাশে                আলো এসে পড়ল গুরুর আনন্দিত মুখে।     কাব্যগ্রন্থ -  পুনশ্চ শুন সখি বাজত বাঁশি শুন সখি , বাজত বাঁশি গভীর রজনী , উজল কুঞ্জপথ ,       চন্দ্রম ডারত হাসি । দক্ষিণপবনে কম্পিত তরুগণ ,       তম্ভিত যমুনাবারি , কুসুমসুবাস উদাস ভইল , সখি ,       উদাস হৃদয় হমারি । বিগলিত মরম , চরণ খলিতগতি ,       শরম ভরম গয়ি দূর , নয়ন বারিভর , গরগর অন্তর ,       হৃদয় পুলকপরিপূর । কহ সখি , কহ সখি , মিনতি রাখ সখি ,       সো কি হমারই শ্যাম ? মধুর কাননে মধুর বাঁশরি       বজায় হমারি নাম ? কত কত যুগ সখি , পুণ্য করনু হম ,       দেবত করনু ধেয়ান , তব ত মিলল সখি , শ্যামরতন মম ,       শ্যাম পরানক প্রাণ ।            শ্যাম রে , শুনত শুনত তব মোহন বাঁশি ,       জপত জপত তব নামে , সাধ ভইল ময় দেহ ডুবায়ব       চাঁদউজল যমুনামে ! ‘ চলহ তুরিত গতি শ্যাম চকিত অতি ,       ধরহ সখীজন হাত , নীদমগন মহী , ভয় ডর কছু নহি ,       ভানু চলে তব সাথ । ' শুনব হাতির হাঁচি “শুনব হাতির হাঁচি’ এই ব’লে কেষ্টা নেপালের বনে বনে ফেরে সারা দেশটা। শুঁড়ে সুড়্‌সুড়ি দিতে নিয়ে গেল কঞ্চি, সাত জালা নস্যি ও রেখেছিল সঞ্চি, জল কাদা ভেঙে ভেঙে করেছিল চেষ্টা– হেঁচে দু-হাজার হাঁচি মরে গেল শেষটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) শুনলো শুনলো বালিকা শুনলো শুনলো বালিকা, রাখ কুসুমমালিকা, কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহিরে। দুলই কুসুম মুঞ্জরী, ভমর ফিরই গুঞ্জরি, অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহিরে। শশি-সনাথ যামিনী, বিরহ-বিধুর কামিনী, কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে। অধর উঠই কাঁপিয়া, সখি-করে কর আপিয়া, কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে। মৃদু সমীর সঞ্চলে হরয়ি শিথিল অঞ্চলে, বালি হৃদয় চঞ্চলে কানন-পথ চাহিরে; কুঞ্জপানে হেরিয়া, অশ্রুবারি ডারিয়া ভানু গায় শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহিরে!   (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) শুভক্ষণ ওগো মা,            রাজার দুলাল যাবে আজি মোর                      ঘরের সমুখপথে,            আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে                   রহিব বলো কী মতে।            বলে দে আমায় কী করিব সাজ,            কী ছাঁদে কবরী বেঁধে লব আজ,            পরিব অঙ্গে কেমন ভঙ্গে                   কোন্‌ বরনের বাস।         মা গো,      কী হল তোমার, অবাক নয়নে                          মুখপানে কেন চাস।         আমি     দাঁড়াব যেথায় বাতায়নকোণে                    সে চাবে না সেথা জানি তাহা মনে--                    ফেলিতে নিমেষ দেখা হবে শেষ,                          যাবে সে সুদূর পুরে,         শুধু           সঙ্গের বাঁশি কোন্‌ মাঠ হতে                          বাজিবে ব্যাকুল সুরে।         তবু           রাজার দুলাল যাবে আজি মোর                          ঘরের সমুখপথে,         শুধু           সে নিমেষ লাগি না করিয়া বেশ                          রহিব বলো কী মতে।ওগো মা,            রাজার দুলাল গেল চলি মোর                    ঘরের সমুখপথে,            প্রভাতের আলো ঝলিল তাহার                    স্বর্ণশিখর রথে।            ঘোমটা খসায়ে বাতায়নে থেকে            নিমেষের লাগি নিয়েছি মা দেখে,            ছিঁড়ি মণিহার ফেলেছি তাহার                   পথের ধুলার 'পরে।         মা গো,      কী হল তোমার, অবাক নয়নে                          চাহিস কিসের তরে!         মোর      হার-ছেঁড়া মণি নেয় নি কুড়ায়ে,                    রথের চাকায় গেছে সে গুঁড়ায়ে                    চাকার চিহ্ন ঘরের সমুখে                    পড়ে আছে শুধু আঁকা।         আমি     কী দিলেম কারে জানে না সে কেউ--                          ধুলায় রহিল ঢাকা।         তবু           রাজার দুলাল গেল চলি মোর                          ঘরের সমুখপথে--         মোর      বক্ষের মণি না ফেলিয়া দিয়া                          রহিব বলো কী মতে। শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে, ঐ একটা অনেক কালের বুড়ো, আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে। আজ আমি ওকে জানাচ্ছি-- পৃথক হব আমরা। ও এসেছে কতলক্ষ পূর্বপুরুষের রক্তের প্রবাহ বেয়ে; কত যুগের ক্ষুধা ওর, কত তৃষ্ণা; সে সব বেদনা বহু দিনরাত্রিকে মথিত করেছে সুদীর্ঘ ধারাবাহী অতীতকালে; তাই নিয়ে ও অধিকার ক'রে বসল নবজাত প্রাণের এই বাহনকে, ঐ প্রাচীন, ঐ কাঙাল। আকাশবাণী আসে ঊর্ধ্বলোক হতে, ওর কোলাহলে সে যায় আবিল হয়ে। নৈবেদ্য সাজাই পূজার থালায়, ও হাত বাড়িয়ে নেয় নিজে। জীর্ণ করে ওকে দিনে দিনে পলে পলে, বাসনার দহনে, ওর জরা দিয়ে আচ্ছন্ন করে আমাকে যে-আমি জরাহীন। মুহূর্তে মুহূর্তে ও জিতে নিয়েছে আমার মমতা, তাই ওকে যখন মরণে ধরে ভয় লাগে আমার যে-আমি মৃত্যুহীন। আমি আজ পৃথক হব। ও থাক্‌ ঐ খানে দ্বারের বাহিরে, ঐ বৃদ্ধ, ঐ বুভুক্ষু। ও ভিক্ষা করুক, ভোগ করুক, তালি দিক্‌ বসে বসে ওর ছেঁড়া চাদরখানাতে; জন্মমরণের মাঝখানটাতে যে আল-বাঁধা খেতটুকু আছে সেইখানে করুক উঞ্ছবৃত্তি। আমি দেখব ওকে জানলায় ব'সে, ঐ দূরপথের পথিককে, দীর্ঘকাল ধরে যে এসেছে বহু দেহমনের নানা পথের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর নানা খেয়া পার হয়ে। উপরের তলায় বসে দেখব ওকে ওর নানা খেয়ালের আবেশে, আশা-নৈরাশ্যের ওঠা-পড়ায় সুখদুঃখের আলো-আঁধারে। দেখব যেমন করে পুতুলনাচ দেখে; হাসব মনে মনে। মুক্ত আমি, স্বচ্ছ আমি, স্বতন্ত্র আমি, নিত্যকালের আলো আমি, সৃষ্টি-উৎসের আনন্দধারা আমি, অকিঞ্চন আমি, আমার কোনো কিছুই নেই অহংকারের প্রাচীরে ঘেরা। শুশ্রূষা ব্যথাক্ষত মোর প্রাণ লয়ে তব ঘরে অতিথিবৎসলা নদী কত স্নেহভরে শুশ্রূষা করিলে আজি— স্নিগ্ধ হস্তখানি দগ্ধ হৃদয়ের মাঝে সুধা দিল আনি। সায়াহ্ন আসিল নামি, পশ্চিমের তীরে ধান্যক্ষেত্রে রক্তরবি অস্ত গেল ধীরে। পূর্বতীরে গ্রাম বন নাহি যায় দেখা, জ্বলন্ত দিগন্তে শুধু মসীপুঞ্জরেখা; সেথা অন্ধকার হতে আনিছে সমীর কর্ম-অবসান-ধ্বনি অজ্ঞাত পল্লীর। দুই তীর হতে তুলি দুই শান্তিপাখা আমারে বুকের মাঝে দিলে তুমি ঢাকা। চুপি চুপি বলি দিলে, “বৎস, জেনো সার, সুখ দুঃখ বাহিরের, শান্তি সে আত্মার।”   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) শূন্য ছিল মন না-কোলাহলে-ঢাকা নানা-আনাগোনা-আঁকা দিনের মতন। নানা-জনতায়-ফাঁকা কর্মে-অচেতন শূন্য ছিল মন।জানি না কখন এল নূপুরবিহীন নিঃশব্দ গোধূলি। দেখি নাই স্বর্ণরেখা কী লিখিল শেষ লেখা দিনান্তের তুলি। আমি যে ছিলাম একা তাও ছিনু ভুলি। আইল গোধূলি।হেনকালে আকাশের বিস্ময়ের মতো কোন্‌ স্বর্গ হতে চাঁদখানি লয়ে হেসে শুক্লসন্ধ্যা এল ভেসে আঁধারের স্রোতে। বুঝি সে আপনি মেশে আপন আলোতে এল কোথা হতে।অকস্মাৎ বিকশিত পুষ্পের পুলকে তুলিলাম আঁখি। আর কেহ কোথা নাই, সে শুধু আমারি ঠাঁই এসেছে একাকী। সম্মুখে দাঁড়ালো তাই মোর মুখে রাখি অনিমেষ আঁখি।রাজহংস এসেছিল কোন্‌ যুগান্তরে শুনেছি পুরাণে। দময়ন্তী আলবালে স্বর্ণঘটে জল ঢালে নিকুঞ্জবিতানে, কার কথা হেনকালে কহি গেল কানে– শুনেছি পুরাণে।জ্যোৎস্নাসন্ধ্যা তারি মতো আকাশ বাহিয়া এল মোর বুকে। কোন্‌ দূর প্রবাসের লিপিখানি আছে এর ভাষাহীন মুখে। সে যে কোন্‌ উৎসুকের মিলনকৌতুকে এল মোর বুকে।দুইখানি শুভ্র ডানা ঘেরিল আমারে সর্বাঙ্গে হৃদয়ে। স্কন্ধে মোর রাখি শির নিস্পন্দ রহিল স্থির কথাটি না কয়ে। কোন্‌ পদ্মবনানীর কোমলতা লয়ে পশিল হৃদয়ে?আর কিছু বুঝি নাই,শুধু বুঝিলাম আছি আমি একা। এই শুধু জানিলাম জানি নাই তার নাম লিপি যার লেখা। এই শুধু বুঝিলাম না পাইলে দেখা রব আমি একা।ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় এ দিনরজনী, এ মোর জীবন! হায় হায়, চিরদিন হয়ে আছে অর্থহীন এ বিশ্বভুবন। অনন্ত প্রেমের ঋণ করিছে বহন ব্যর্থ এ জীবন।ওগো দূত দূরবাসী, ওগো বাক্যহীন, হে সৌম্য-সুন্দর, চাহি তব মুখপানে ভাবিতেছি মুগ্ধপ্রাণে কী দিব উত্তর। অশ্রু আসে দু নয়ানে, নির্বাক্‌ অন্তর, হে সৌম্য-সুন্দর।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) শূন্য ঝুলি নিয়ে হায় শূন্য ঝুলি নিয়ে হায় ভিক্ষু মিছে ফেরে, আপনারে দেয় যদি পায় সকলেরে।    (স্ফুলিঙ্গ) শূন্য পাতার অন্তরালে শূন্য পাতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে বাণী, কেমন করে আমি তারে বাইরে ডেকে আনি। যখন থাকি অন্যমনে দেখি তারে হৃদয়কোণে, যখন ডাকি দেয় সে ফাঁকি— পালায় ঘোমটা টানি।   (স্ফুলিঙ্গ) শেষ কথা রাগ কর নাই কর, শেষ কথা এসেছি বলিতে তোমার প্রদীপ আছে, নাইকো সলিতে। শিল্প তার মূল্যবান, দেয় না সে আলো, চোখেতে জড়ায় লোভ, মনেতে ঘনায় ছায়া কালো অবসাদে। তবু তারে প্রাণপণে রাখি যতনেই, ছেড়ে যাব তার পথ নেই। অন্দকারে অন্ধদৃষ্টি নানাবিধ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরে আচ্ছন্ন করিয়া বাস্তবেরে। অস্পষ্ট তোমারে যবে ব্যগ্রকণ্ঠ ডাক দিই অত্যুক্তির স্তবে তোমারে লঙ্ঘন করি সে-ডাক বাজিতে থাকে সুরে তারি উদ্দেশে আজো যে রয়েছে দূরে। হয়তো সে আসিবে না কভূ, তিমিরে আচ্ছন্ন তুমি তারেই নির্দেশ কর তবু। তোমার এ দূত অন্ধকার গোপনে আমার ইচ্ছারে করিয়া পঙ্গু গতি তার করেছে হরণ, জীবনের উৎসজলে মিশায়েছ মাদক মরণ। রক্তে মোর যে-দূর্বল আছে শঙ্কিত বক্ষের কাজে তারেই সে করেছে সহায়, পশুবাহনের মতো মোহভার তাহারে বহায়। সে যে একান্তই দীন, মূল্যহীন, নিগড়ে বাঁধিয়া তারে আপনারে বিড়ম্বিত করিতেছ পূর্ণ দান হতে, এ প্রমাদ কখনো কি দেখিবে আলোতে। প্রেম নাহি দিয়ে যারে টানিয়াছ উচ্ছিষ্টের লোভে সে-দীন কি পার্শ্বে তব শোভে। কভু কি জানিতে পাবে অসম্মানে নত এই প্রাণ বহন করিছে নিত্য তোমারি আপন অসম্মান। আমারে যা-পারিলে না দিতে সে-কার্পণ্য তোমারেই চিরদিন রহিল বঞ্চিতে। শেষ কথা (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে , সে কথা হইলে বলা সব বলা হয় । কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে , তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয় । শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে , পাখির মতন ধায় চরাচরময় । শত গান ম'রে গিয়ে , নূতন জীবনে একটি কথায় চাহে হইতে বিলয় । সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি , আর বাজাব না বীণা চিরদিন - তরে । সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি , মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে । সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে , আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) শেষ কথা (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) মাঝে মাঝে মনে হয়, শত কথা-ভারে হৃদয় পড়েছে যেন নুয়ে একেবারে। যেন কোন্‌ ভাবযজ্ঞ বহু আয়োজনে চলিতেছে অন্তরের সুদূর সদনে। অধীর সিন্ধুর মতো কলধ্বনি তার অতি দূর হতে কানে আসে বারম্বার। মনে হয় কত ছন্দ, কত-না রাগিণী, কত-না আশ্চর্য গাথা, অপূর্ব কাহিনী, যতকিছু রচিয়াছে যত কবিগণে সব মিলিতেছে আসি অপূর্ব মিলনে— এখনি বেদনাভরে ফাটি গিয়া প্রাণ উচ্ছ্বসি উঠিবে যেন সেই মহাগান। অবশেষে বুক ফেটে শুধু বলি আসি— হে চিরসুন্দর, আমি তোরে ভালবাসি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) শেষ খেয়া দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া      ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ। ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া      গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান। নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা      ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়, তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া---      সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়।           ওরে আয়      আমায় নিয়ে যাবি কে রে           দিনশেষের শেষ খেয়ায়।সাঁজের বেলা ভাঁটার স্রোতে ও পার হতে একটানা      একটি-দুটি যায় যে তরী ভেসে। কেমন করে চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্‌খানা      আমার ঘাটে ছিল আমার দেশে। অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে      ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়, ডাকলে আমি ক্ষণেক থামি হেথায় পাড়ি ধরবে সে      এমন নেয়ে আছে রে কোন্ নায়।           ওরে আয়      আমায় নিয়ে যাবি কে রে           দিনশেষের শেষ খেয়ায়।ঘরেই যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘরপানে,      পারে যারা যাবার গেছে পারে; ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে      সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে। ফুলের বার নাইকো আর,      ফসল যার ফলল না--- চোখের জল ফেলতে হাসি পায়---      দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না, সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়।           ওরে আয়      আমায় নিয়ে যাবি কে রে           বেলাশেষের শেষ খেয়ায়। শেষ চিঠি মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন,       অপরাধ হয়েছে আমার          তাই আছে মুখ ফিরিয়ে।   ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে,          আমার জায়গা নেই--              হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি। এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে।   অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন       মোচড় যেন দিত বুকে। ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক'রে,       তাই খুললেম ঘরের তালা। একজোড়া আগ্রার জুতো,       চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি          শেলফে তার পড়বার বই,                  ছোটো হার্মোনিয়ম।       একটা অ্যালবাম, ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়।          আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি।   ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল,              শিশি, খালি পাউডারের কৌটো। চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে।          টেবিলের সামনে। লাল চামড়ার বাক্স,       ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে। তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে,       আঁক কষবার খাতা। ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি,       আমারি ঠিকানা লেখা অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে।   শুনেছি ডুবে মরবার সময়       অতীত কালের সব ছবি          এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে-- চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে       অনেক কথা এক নিমেষে। অমলার মা যখন গেলেন মারা   তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।       কেমন একটা ভয় লাগল মনে,              ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন।       কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ,              যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া       ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল              ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে।       সাহস হ'ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি।              কাজ করছি আপিসে বসে,                  হঠাৎ হ'ত মনে              যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে। বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে--      বললে, "মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি।          মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে              আজকালকার দিনে।'       লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার,          বললেম "কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে'। ইস্কুলে তো গেল,       কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে। কতদিন স্কুলের বাস্‌ অমনি যেত ফিরে।          সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ। ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে;   বললে, "এমন করে চলবে না।       নিজে ওকে যাব নিয়ে,   বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে,       ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।' মাসির সঙ্গে গেল চলে।       অশ্রুহীন অভিমান          নিয়ে গেল বুক ভরে              যেতে দিলেম বলে। বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায়       নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে।   চার মাস খবর নেই। মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা          গুরুর কৃপায়।   মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে,       বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা। চার মাস পরে এলেম ফিরে।   ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে--       পথের মধ্যে পেলেম চিঠি--          কী আর বলব,              দেবতাই তাকে নিয়েছে। যাক সে-সব কথা।   অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,          তাতে লেখা--   "তোমাকে দেখতে বড্‌ডো ইচ্ছে করছে'।              আর কিছুই নেই।                       ----------------------------- ৩১ শ্রাবণ, ১৩৩৯ শেষ চুম্বন দূর স্বর্গে বাজে যেন নীরব ভৈরবী। ঊষার করুণ চাঁদ শীর্ণমুখচ্ছবি। ম্লান হয়ে এল তারা; পূর্বদিগ্‌বধূর কপোল শিশিরসিক্ত, পান্ডুর, বিধুর। ধীরে ধীরে নিবে গেল শেষ দীপশিখা, খসে গেল যামিনীর স্বপ্নযবনিকা। প্রবেশিল বাতায়নে পরিতাপসম রক্তরশ্মি প্রভাতের আঘাত নির্মম। সেইক্ষণে গৃহদ্বারে সত্বর সঘন আমাদের সর্বশেষ বিদায়-চুম্বন। মুহূর্তে উঠিল বাজি চারি দিক হতে কর্মের ঘর্ঘরমন্দ্র সংসারের পথে। মহারবে সিংহদ্বার খুলে বিশ্বপুরে— অশ্রুজল মুছে ফেলি চলি গেনু দূরে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) শেষ বসন্তরাত্রে শেষ বসন্তরাত্রে যৌবনরস রিক্ত করিনু বিরহবেদনপাত্রে।   (স্ফুলিঙ্গ) শেষ বেলা এল বেলা পাতা ঝরাবারে; শীর্ণ বলিত কায়া, আজ শুধু ভাঙা ছায়া           মেলে দিতে পারে।     একদিন ডাল ছিল ফুলে ফুলে ভরা               নানা-রঙ-করা।           কুঁড়ি ধরা ফলে      কার যেন কী কৌতূহলে           উঁকি মেরে আসা      খুঁজে নিতে আপনার বাসা।           ঋতুতে ঋতুতে       আকাশের উৎসবদূতে      এনে দিত পল্লবপল্লীতে তার কখনো পা টিপে চলা হালকা হাওয়ার,      কখনো-বা ফাল্গুনের অস্থির এলোমেলো চাল      জোগাইত নাচনের তাল।                    জীবনের রস আজ মজ্জায় বহে,                     বাহিরে প্রকাশ তার নহে।              অন্তরবিধাতার সৃষ্টিনির্দেশে           যে অতীত পরিচিত সে নূতন বেশে                সাজবদলের কাজে ভিতরে লুকালো--      বাহিরে নিবিল দীপ, অন্তরে দেখা যায় আলো।           গোধূলির ধূসরতা ক্রমে সন্ধ্যার                    প্রাঙ্গণে ঘনায় আঁধার।                মাঝে-মাঝে জেগে ওঠে তারা,           আজ চিনে নিতে হবে তাদের ইশারা।        সমুখে অজানা পথ ইঙ্গিত মেলে দেয় দূরে,           সেথা যাত্রার কালে যাত্রীর পাত্রটি পুরে      সদয় অতীত কিছু সঞ্চয় দান করে তারে           পিপাসার গ্লানি মিটাবারে।                    যত বেড়ে ওঠে রাতি।      সত্য যা সেদিনের উজ্জ্বল হয় তার ভাতি।                    এই কথা ধ্রুব জেনে, নিভৃতে লুকায়ে      সারা জীবনের ঋণ একে একে দিতেছি চুকায়ে। শেষ লেখা তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে , হে ছলনাময়ী । মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে । এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ; তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি । তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে-পথ দেখায় সে যে তার অন্তরের পথ , সে যে চিরস্বচ্ছ , সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চিরসমুজ্জল । বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু , এই নিয়ে তাহার গৌরব । লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত । সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে । কিছুতে পারে না তা ' রে প্রবঞ্চিতে , শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভান্ডারে । অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার । শেষ সঞ্চয় দিনান্তবেলায় শেষের ফসল দিলেম তরী 'পরে, এ-পারে কৃষি হল সারা, যাব ও-পারের ঘাটে। হংসবলাকা উড়ে যায় দূরের তীরে, তারার আলোয়, তারি ডানার ধ্বনি বাজে মোর অন্তরে। ভাঁটার নদী ধায় সাগরপানে কলতানে, ভাবনা মোর ভেসে যায় তারি টানে। যা-কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয় সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা, শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে। শেষ হিসাব চেনাশোনার সাঁঝবেলাতে           শুনতে আমি চাই-- পথে পথে চলার পালা           লাগল কেমন, ভাই। দুর্গম পথ ছিল ঘরেই,           বাইরে বিরাট পথ-- তেপান্তরের মাঠ কোথা-বা,           কোথা-বা পর্বত। কোথা-বা সে চড়াই উঁচু,           কোথা-বা উতরাই,                    কোথা-বা পথ নাই। মাঝে-মাঝে জুটল অনেক ভালো--           অনেক ছিল বিকট মন্দ,                    অনেক কুশ্রী কালো। ফিরেছিলে আপন মনের           গোপন অলিগলি, পরের মনের বাহির-দ্বারে           পেতেছে অঞ্জলি। আশাপথের রেখা বেয়ে           কতই এলে গেলে, পাওনা ব'লে যা পেয়েছ           অর্থ কি তার পেলে।                    অনেক কেঁদে-কেটে ভিক্ষার ধন জুটিয়েছিলে           অনেক রাস্তা হেঁটে। পথের মধ্যে লুঠেল দস্যু           দিয়েছিল হানা, উজাড় করে নিয়েছিল           ছিন্ন ঝুলিখানা। অতি কঠিন আঘাত তারা           লাগিয়েছিল বুকে-- ভেবেছিলুম, চিহ্ন নিয়ে           সে সব গেছে চুকে। হাটে-বাটে মধুর যাহা           পেয়েছিলুম খুঁজি, মনে ছিল, যত্নের ধন           তাই রয়েছে পুঁজি। হায় রে ভাগ্য, খোলো তোমার ঝুলি।           তাকিয়ে দেখো, জমিয়েছিলে ধূলি। নিষ্ঠুর যে ব্যর্থকে সে           করে যে বর্জিত, দৃঢ় কঠোর মুষ্টিতলে           রাখে সে অর্জিত নিত্যকালের রতন-কণ্ঠহার;           চিরমূল্য দেয় সে তারে                    দারুণ বেদনার। আর যা-কিছু জুটেছিল           না চাহিতেই পাওয়া-- আজকে তারা ঝুলিতে নেই,           রাত্রিদিনের হাওয়া ভরল তারাই, দিল তারা           পথে চলার মানে, রইল তারাই একতারাতে           তোমার গানে গানে। শেষদৃষ্টি আজি এ আঁখির শেষদৃষ্টির দিনে ফাগুনবেলার ফুলের খেলার                দানগুলি লব চিনে। দেখা দিয়েছিল মুখর প্রহরে                দিনের দুয়ার খুলি, তাদের আভায় আজি মিলে যায় রাঙা গোধূলির শেষতুলিকায় ক্ষণিকের রূপ-রচনলীলায়                সন্ধ্যার রঙগুলি। যে অতিথিদেহে ভোরবেলাকার                রূপ নিল ভৈরবী, অস্তরবির দেহলিদুয়ারে বাঁশিতে আজিকে আঁকিল উহারে মুলতানরাগে সুরের প্রতিমা                গেরুয়া রঙের ছবি। খনে খনে যত মর্মভেদিনী                বেদনা পেয়েছে মন নিয়ে সে দুঃখ ধীর আনন্দে বিষাদকরুণ শিল্পছন্দে অগোচর কবি করেছে রচনা                মাধুরী চিরন্তন। একদা জীবনে সুখের শিহর                নিখিল করেছে প্রিয়। মরণপরশে আজি কুণ্ঠিত অন্তরালে সে অবগুণ্ঠিত, অদেখা আলোকে তাকে দেখা যায়                কী অনির্বচনীয়। যা গিয়েছে তার অধরারূপের                অলখ পরশখানি যা রয়েছে তারি তারে বাঁধে সুর, দিক্‌সীমানার পারের সুদূর কালের অতীত ভাষার অতীত                শুনায় দৈববাণী। শেষপর্ব যেথা দূর যৌবনের প্রান্তসীমা সেথা হতে শেষ অরুণিমা শীর্ণপ্রায় আজি দেখা যায়। সেথা হতে ভেসে আসে চৈত্রদিবসে দীর্ঘশ্বাসে অস্ফুট মর্মর কোকিলের ক্লান্ত স্বর, ক্ষীণস্রোত তটিনীর অলস কল্লোল,-- রক্তে লাগে মৃদুমন্দ দোল। এ আবেশ মুক্ত হ'ক; ঘোরভাঙা চোখ শুভ্র সুস্পষ্টের মাঝে জাগিয়া উঠুক রঙকরা দুঃখ সুখ সন্ধ্যার মেঘের মতো যাক সরে আপনারে পরিহাস করে। মুছে যাক সেই ছবি-- চেয়ে থাকা পথপানে, কথা কানে কানে, মৌনমুখে হাতে হাত ধরা, রজনীগন্ধায় সাজি ভরা, চোখে চোখে চাওয়া দুরু দুরু বক্ষ নিয়ে আসা আর যাওয়া। যে-খেলা আপনা সাথে সকালে বিকালে ছায়া-অন্তরালে, সে খেলার ঘর হতে হল আসিবার বেলা বাহির-আলোতে। ভাঙিব মনের বেড়া কুসুমিত কাঁটালতা ঘেরা যেথা স্বপনেরা মধুগন্ধে মরে ঘুরে ঘুরে গুণ গুণ সুরে। নেব আমি বিপুল বৃহৎ আদিম প্রাণের দেশ-- তেপান্তর মাঠের সে-পথ সাত সমুদ্রের তটে তটে যেখানে ঘটনা ঘটে, নাই তার দায়, যেতে যেতে দেখা যায়, শোনা যায়, দিনরাত্রি যায় চলে নানা ছন্দে নানা কলরোলে। থাক্‌ মোর তরে আপক্ক ধানের খেত অঘ্রানের দীপ্ত দ্বিপ্রহরে; সোনার তরঙ্গদোলে মুগ্ধ দৃষ্টি যার 'পরে ভেসে যায় চলে কথাহীন ব্যথাহীন চিন্তাহীন সৃষ্টির সাগরে যেথায় অদৃশ্য সাথি লীলাবরে সারাদিন ভাষায় প্রহর যত খেলার নৌকার মতো। দূরে চেয়ে রব আমি স্থির ধরণীর বিস্তীর্ণ বক্ষের কাছে যেথা শাল গাছে সহস্র বর্ষের প্রাণ সমাহিত রয়েছে নীরবে নিস্তব্ধ গৌরবে। কেটে যাক আপনা-ভোলানো মোহ, কেটে যাক আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রতি বৎসরের আয়ুকর্তব্যের আবর্জনাভার না করুক স্তূপাকার,-- নির্ভাবনা তর্কহীন শাস্ত্রহীন পথ বেয়ে বেয়ে যাই চলে অর্থহীন গান গেয়ে। প্রাণে আর চেতনায় এক হয়ে ক্রমে অনায়াসে মিলে যাব মৃত্যুমহাসাগর-সংগমে, আলো-অঁধধারের দ্বন্দ্ব হয়ে ক্ষীণ গোধূলি নিঃশব্দ রাত্রে যেমন অতলে হয় লীন। শেষের অবগাহন সাঙ্গ করো, কবি, প্রদোষের শেষের অবগাহন সাঙ্গ করো, কবি, প্রদোষের নির্মল তিমির তলে। ভৃতি তব সেবার শ্রমের সংসার যা দিয়েছিল আঁকড়িয়া রাখিয়ো না বুকে; এক প্রহরের মূল্য আরেক প্রহরে ফিরে নিতে কুণ্ঠা কভু নাহি তার; বাহির দ্বারের যে দক্ষিণা অন্তরে নিয়ো না টেনে এ মুদ্রার স্বর্ণলেপটুকু দিনে দিনে হাতে হাতে ক্ষয় হয়ে লুপ্ত হয়ে যাবে, উঠিবে কলঙ্কলেখা ফুটি। ফল যদি ফলায়েছ বনে মাটিতে ফেলিয়া তার হোক অবসান। সাঙ্গ হোলো ফুল ফোটাবার ঋতু, সেই সঙ্গে সাঙ্গ হয়ে যাক লোকমুখবচনের নিশ্বাসপবনে দোল খাওয়া। পুরস্কার প্রত্যাশায় পিছু ফিরে বাড়ায়ো না হাতযেতে যেতে; জীবনে যা-কিছু তব সত্য ছিল দান মূল্য চেয়ে অপমান করিয়ো না তারে; এ জনমে শেষ ত্যাগ হোক তব ভিক্ষাঝুলি, নব বসন্তের আগমনে অরণ্যের শেষ শুষ্ক পত্রগুচ্ছ যথা। যার লাগি আশাপথ চেয়ে আছ সে নহে সম্মান, সে যে নব জীবনের অরুণের আহ্বান-ইঙ্গিত, নব জাগ্রতের ভালে প্রভাতের জ্যোতির তিলক।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) শেষের কবিতা কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও? তারি রথ নিত্য উধাও। জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয় স্পন্দন চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন। ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল তুলে নিল দ্রুত রথে দু’সাহসী ভ্রমণের পথে তোমা হতে বহু দূরে। মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম। আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়; রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায় আমার পুরানো নাম। ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু বিদায়।কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্ত বাতাসে অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস, ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ, সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে তোমার প্রাণের প্রাণে, বিস্মৃতি প্রাদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি, হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি। তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় – সে আমার প্রেম। তারে আমি রাখিয়া এলাম অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে। পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে কালের যাত্রায়। হে বন্ধু বিদায়।তোমায় হয়নি কোন ক্ষতি। মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত মুরতি   যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি হোক তবে সন্ধ্যা বেলা- পূজার সে খেলা ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে; তৃষার্ত আবেগ বেগে ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে। তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায় তার সাথে দিব না মিশায়ে যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে। আজও তুমি নিজে হয়তো বা করিবে বচন মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়। হে বন্ধু বিদায়।মোর লাগি করিয়ো না শোক- আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক। মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই, শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই। উৎকণ্ঠা আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে সে ধন্য করিবে আমাকে। শুক্লপক্ষ হতে আনি রজনীগন্ধার বৃন্তখানি যে পারে সাজাতে অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে সে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালমন্দ মিলায়ে সকলি, এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি। তোমারে যা দিয়েছিনু তার পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার। হেথা মোর তিলে তিলে দান, করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম, ওগো নিরূপম, হে ঐশ্বর্যবান তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু বিদায়। শেষের মধ্যে অশেষ আছে শেষের মধ্যে অশেষ আছে                  এই কথাটি  মনে, আজকে আমার গানের শেষে               জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।                           সুর গিয়েছে থেমে তবু                            থামতে যেন চায় না কভু,                            নীরবতায় বাজছে বীণা                                   বিনা প্রয়োজনে।তারে যখন আঘাত লাগে,              বাজে যখন সুরে-- সবার চেয়ে বড়ো যে গান              সে রয় বহুদূরে।                            সকল আলাপ গেলে থেমে                            শান্ত বীণায় আসে নেমে,                            সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে                                   বাজে গভীর স্বনে। কলিকাতা, ২৬ শ্রাবণ, ১৩১৭ শ্বশুরবাড়ির গ্রাম শ্বশুরবাড়ির গ্রাম, নাম তার কুলকাঁটা, যেতে হবে উপেনের– চাই তাই চুল-ছাঁটা। নাপিত বললে, “কাঁচি খুঁজে যদি পাই বাঁচি– ক্ষুর আছে, একেবারে করে দেব মূল-ছাঁটা। জেনো বাবু, তাহলেই বেঁচে যায় ভুল-ছাঁটা।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) শ্যাম মুখে তব মধুর অধরমে শ্যাম , মুখে তব মধুর অধরমে       হাস বিকশিত কায় ? কোন স্বপন অব দেখত মাধব ,       কহবে কোন হমায় ! নীদমেঘ'পর স্বপনবিজলিসম       রাধা বিলসত হাসি । শ্যাম , শ্যাম মম , কৈসে শোধব       তুঁহুক প্রেমঋণরাশি । বিহঙ্গ , কাহ তু বোলন লাগলি ?       শ্যাম ঘুমায় হমারা ! রহ রহ চন্দ্রম , ঢাল ঢাল তব       শীতল জোছনধারা । তারকমালিনী সুন্দর যামিনী       অবহুঁ ন যাও রে ভাগি , নিরদয় রবি , অব কাহ তু আওলি,       জ্বাললি বিরহক আগি । ভানু কহত—অব রবি অতি নিষ্ঠুর       নলিনমিলনঅভিলাষে কত নরনারীক মিলন টুটাওত,       ডারত বিরহহুতাশে । শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর শ্যামরে, নিপট কঠিন মন তোর। রোয়ত রোয়ত সজনী রাধা রজনী করত স ভোর। একলি বিরল কুটীরে বৈঠত চাহত যমুনা পানে,— ছল ছল নয়ন, বচন নহি নিকসত, পরাণ থেহ ন মানে । ঘোর গহন নিশি একলি রাধা যায় কদম তৰুমূলে, ভূমি শয়ন পর আকুল কুন্তল, কাঁদই আপন ভূলে। সহসা চমকয়ি চায় সখী কভু মগন যখন গৃহ কাজে—ছূটি আসয়ি বোলে “শুনলো, , শ্যামক বাঁশরি বাজে।” আনমনে সো অবলা বালা বৈসয়ি গুৰুজন মাঝে, তুয়া নাম বঁধু লিখত ভূমি পর, চমকি মুছই পুন লাজে। নিঠুর শ্যামরে, কৈসে অব তুঁহুঁ রহত দূর মথুরায়— ঘোর রজনী কৈস গোঁয়ায়সি কৈস দিবস তব যায় ! কৈস মিটাওসি প্রেম পিপাসা কঁহা বজাওসি বাঁশি? পীতবাস তুঁহু কথিরে ছোড়লি, কথি সো বঙ্কিম হাসি? কনক হার অব পহিরলি কণ্ঠে, কথি ফেকলি বন মালা?গোপী হৃদয় অঁধার করলিরে, সিংহাসন কর অালা; এ দুখ চিরদিন রহি গল মনমে, ভানু কহে, ছি ছি কালা! ঝটিতি আও তুহুঁ হমারি সাথে, বিরহ ব্যাকুলা বালা ।    (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) শ্যামল ঘন বকুলবন শ্যামল ঘন বকুলবন- ছায়ে ছায়ে যেন কী সুর বাজে মধুর পায়ে পায়ে।   (স্ফুলিঙ্গ) শ্যামলা যে-ধরণী ভালোবাসিয়াছি তোমারে দেখিয়া ভাবি তুমি তারি আছ কাছাকাছি।            হৃদয়ের বিস্তীর্ণ আকাশে                  উন্মুক্ত বাতাসে                        চিত্ত তব স্নিগ্ধ সুগভীর।                      হে শ্যামলা, তুমি ধীর,                   সেবা তব সহজ সুন্দর,            কর্মেরে বেষ্টিয়া তব আত্মসমাহিত অবসর।                মাটির অন্তরে                       স্তরে স্তরে                    রবিরশ্মি নামে পথ করি,                তারি পরিচয় ফুটে দিবসশর্বরী                    তরুলতিকায় ঘাসে,                        জীবনের বিচিত্র বিকাশে।            তেমনি প্রচ্ছন্ন তেজ চিত্ততলে তব                  তোমার বিচিত্র চেষ্টা করে নব নব                               প্রাণমূর্তিময়,                        দেয় তারে যৌবন অক্ষয়।    প্রতিদিবসের সব কাজে সৃষ্টির প্রতিভা তব অক্লান্ত বিরাজে।                তাই দেখি তোমার সংসার          চিত্তের সজীব স্পর্শে সর্বত্র তোমার আপনার।           আষাঢ়ের প্রথম বর্ষণে     মাটির যে-গন্ধ উঠে সিক্ত সমীরণে,                ভাদ্রে যে-নদীটি ভরা কূলে কূলে,                মাঘের শেষে যে-শাখা গন্ধঘন আমের মুকুলে,                    ধানের হিল্লোলে ভরা নবীন যে-খেত,                        অশ্বত্থের কম্পিত সংকেত,                আশ্বিনে শিউলিতলে পূজাগন্ধ যে স্নিগ্ধ ছায়ার,                    জানি না এদের সাথে কী মিল তোমার।               দেখি ব'সে জানালার ধারে--                               প্রান্তরের পারে                        নীলাভ নিবিড় বনে                               শীতসমীরণে                        চঞ্চল পল্লবঘন সবুজের 'পরে                               ঝিলিমিলি করে                        জনহীন মধ্যাহ্নের সূর্যের কিরণ,                             তন্দ্রাবিষ্ট আকাশের স্বপ্নের মতন।          দিগন্তে মন্থর মেঘ, শঙ্খচিল উড়ে যায় চলি                   ঊর্ধ্বশূন্যে, কতমতো পাখির কাকলি,                               পীতবর্ণ ঘাস            শুষ্ক মাঠে, ধরণীর বনগন্ধি আতপ্ত নিঃশ্বাস                  মৃদুমন্দ লাগে গায়ে, তখন সে-ক্ষণে            অস্তিত্বের যে ঘনিষ্ঠ অনুভূতি ভরি উঠে মনে, প্রাণের যে প্রশান্ত পূর্ণতা, লভি তাই                    যখন তোমার কাছে যাই--          যখন তোমারে হেরি                রহিয়াছ আপনারে ঘেরি                   গম্ভীর শান্তিতে,                        স্নিগ্ধ সুনিস্তব্ধ চিতে,          চক্ষে তব অন্তর্যামী দেবতার উদার প্রসাদ                           সৌম্য আশীর্বাদ। শ্যামা উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ , গলায় পলার হারখানি ।                          চেয়েছি অবাক মানি                               তার পানে ।                  বড়ো বড়ো কাজল নয়ানে              অসংকোচে ছিল চেয়ে                          নবকৈশোরের মেয়ে ,               ছিল তারি কাছাকাছি বয়স আমার ।         স্পষ্ট মনে পড়ে ছবি । ঘরের দক্ষিণে খোলা দ্বার ,              সকালবেলার রোদে বাদামগাছের মাথা         ফিকে আকাশের নীলে মেলেছে চিকন ঘন পাতা ।              একখানি সাদা শাড়ি কাঁচা কচি গায়ে ,         কালো পাড় দেহ ঘিরে ঘুরিয়া পড়েছে তার পায়ে ।              দুখানি সোনার চুড়ি নিটোল দু হাতে ,                    ছুটির মধ্যাহ্নে পড়া কাহিনীর পাতে         ওই মূর্তিখানি ছিল । ডেকেছে সে মোরে মাঝে মাঝে              বিধির খেয়াল যেথা নানাবিধ সাজে         রচে মরীচিকালোক নাগালের পারে               বালকের স্বপ্নের কিনারে ।                    দেহ ধরি মায়া         আমার শরীরে মনে ফেলিল অদৃশ্য ছায়া                    সূক্ষ্ম স্পর্শময়ী ।              সাহস হল না কথা কই ।         হৃদয় ব্যথিল মোর অতিমৃদু গুঞ্জরিত সুরে —              ও যে দূরে , ও যে বহুদূরে ,         যত দূরে শিরীষের ঊর্ধ্বশাখা যেথা হতে ধীরে              ক্ষীণ গন্ধ নেমে আসে প্রাণের গভীরে ।                         একদিন পুতুলের বিয়ে ,                               পত্র গেল দিয়ে ।                    কলরব করেছিল হেসে খেলে                 নিমন্ত্রিত দল । আমি মুখচোরা ছেলে              একপাশে সংকোচে পীড়িত । সন্ধ্যা গেল বৃথা ,         পরিবেশনের ভাগে পেয়েছিনু মনে নেই কী তা ।              দেখেছিনু , দ্রুতগতি দুখানি পা আসে যায় ফিরে ,                    কালো পাড় নাচে তারে ঘিরে ।                কটাক্ষে দেখেছি , তার কাঁকনে নিরেট রোদ         দু হাতে পড়েছে যেন বাঁধা । অনুরোধ উপরোধ                    শুনেছিনু তার স্নিগ্ধ স্বরে ।              ফিরে এসে ঘরে                    মনে বেজেছিল তারি প্রতিধ্বনি                          অর্ধেক রজনী ।                       তার পরে একদিন              জানাশোনা হল বাধাহীন ।         একদিন নিয়ে তার ডাকনাম                                তারে ডাকিলাম ।                    একদিন ঘুচে গেল ভয় ,         পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে কথা-বিনিময় ।              কখনো বা গড়ে-তোলা দোষ                    ঘটায়েছে ছল-করা রোষ ।         কখনো বা শ্লেষবাক্যে নিষ্ঠুর কৌতুক                    হেনেছিল দুখ ।              কখনো বা দিয়েছিল অপবাদ                    অনবধানের অপরাধ ।         কখনো দেখেছি তার অযত্নের সাজ —              রন্ধনে ছিল সে ব্যস্ত , পায় নাই লাজ ।                     পুরুষসুলভ মোর কত মূঢ়তারে         ধিক্‌কার দিয়েছে নিজ স্ত্রীবুদ্ধির তীব্র অহংকারে ।              একদিন বলেছিল , “ জানি হাত দেখা । ”         হাতে তুলে নিয়ে হাত নতশিরে গ নে ছিল রেখা —              বলেছিল , “ তোমার স্বভাব         প্রেমের লক্ষণে দীন । ” দিই নাই কোনোই জবাব । পরশের সত্য পুরস্কার         খণ্ডিয়া দিয়েছে দোষ মিথ্যা সে নিন্দার ।                          তবু ঘুচিল না                    অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা ।              সুন্দরের দূরত্বের কখনো হয় না ক্ষয় ,         কাছে পেয়ে না পাওয়ার দেয় অফুরন্ত পরিচয় ।        পুলকে বিষাদে মেশা দিন পরে দিন              পশ্চিমে দিগন্তে হয় লীন ।         চৈত্রের আকাশতলে নীলিমার লাবণ্য ঘনাল ,                          আশ্বিনের আলো                    বাজাল সোনার ধানে ছুটির সানাই ।         চলেছে মন্থর তরী নিরুদ্দেশে স্বপ্নেতে বোঝাই । শ্রান্তি সুখশ্রমে আমি , সখী , শ্রান্ত অতিশয় ; পড়েছে শিথিল হয়ে শিরার বন্ধন । অসহ্য কোমল ঠেকে কুসুমশয়ন , কুসুমরেণুর সাথে হয়ে যাই লয় । স্বপনের জালে যেন পড়েছি জড়ায়ে । যেন কোন্ অস্তাচলে সন্ধ্যাস্বপ্নময় রবির ছবির মতো যেতেছি গড়ায়ে , সুদূরে মিলিয়া যায় নিখিলনিলয় । ডুবিতে ডুবিতে যেন সুখের সাগরে কোথাও না পাই ঠাঁই , শ্বাস রুদ্ধ হয় — পরান কাঁদিতে থাকে মৃত্তিকার তরে । এ যে সৌরভের বেড়া , পাষাণের নয় — কেমনে ভাঙিতে হবে ভাবিয়া না পাই , অসীম নিদ্রার ভারে পড়ে আছি তাই ।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) শ্রাবণের কালো ছায়া শ্রাবণের কালো ছায়া নেমে আসে তমালের বনে যেন দিক্ললনার গলিত-কাজল-বরিষনে।   (স্ফুলিঙ্গ) শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা অবদানশতকঅনাথপিণ্ডদ বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন"প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি, ওগো পুরবাসী, কে রয়েছে জাগি, অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ-                    নিনাদে। সদ্য মেলিতেছে তরুণ তপন আলস্যে অরুণ সহাস্য লোচন শ্রাবস্তীপুরীর গগনলগন                    প্রাসাদে। বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান এখনো ধরে নি মাঙ্গলিক গান, দ্বিধাভরে পিক মৃদু কুহুতান                    কুহরে। ভিক্ষু কহে ডাকি, "হে নিদ্রিত পুর, দেহো ভিক্ষা মোরে, করো নিদ্রা দূর'-- সুপ্ত পৌরজন শুনি সেই সুর                    শিহরে। সাধু কহে, "শুন, মেঘ বরিষার নিজেরে নাশিয়া দেয় বৃষ্টিধার, সর্ব ধর্মমাঝে ত্যাগধর্ম সার                    ভুবনে।' কৈলাসশিখর হতে দূরাগত ভৈরবের মহাসংগীতের মতো সে বাণী মন্দ্রিল সুখতন্দ্রারত                    ভবনে। রাজা জাগি ভাবে বৃথা রাজ্য ধন, গৃহী ভাবে মিছা তুচ্ছ আয়োজন, অশ্রু অকারণে করে বিসর্জন                    বালিকা। যে ললিত সুখে হৃদয় অধীর মনে হল তাহা গত যামিনীর স্খলিত দলিত শুষ্ক কামিনীর                    মালিকা। বাতায়ন খুলে যায় ঘরে ঘরে, ঘুমভাঙা আঁখি ফুটে থরে থরে অন্ধকার পথ কৌতূহলভরে                    নেহারি। "জাগো, ভিক্ষা দাও' সবে ডাকি ডাকি সুপ্ত সৌধে তুলি নিদ্রাহীন আঁখি শূন্য রাজবাটে চলেছে একাকী                    ভিখারি। ফেলি দিল পথে বণিকধনিকা মুঠি মুঠি তুলি রতনকণিকা-- কেহ কণ্ঠহার, মাথার মণিকা                    কেহ গো। ধনী স্বর্ণ আনে থালি পূরে পূরে, সাধু নাহি চাহে, পড়ে থাকে দূরে-- ভিক্ষু কহে, "ভিক্ষা আমার প্রভুরে                    দেহো গো।' বসনে ভূষণে ঢাকি গেল ধূলি, কনকে রতনে খেলিল বিজুলি, সন্ন্যাসী ফুকারে লয়ে শূন্য ঝুলি                    সঘনে-- "ওগো পৌরজন, করো অবধান, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ তিনি বুদ্ধ ভগবান, দেহো তারে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান                    যতনে।' ফিরে যায় রাজা, ফিরে যায় শেঠ, মিলে না প্রভুর যোগ্য কোনো ভেট, বিশাল নগরী লাজে রহে হেঁট-                    আননে। রৌদ্র উঠে ফুটে, জেগে উঠে দেশ, মহানগরীর পথ হল শেষ, পুরপ্রান্তে সাধু করিলা প্রবেশ                    কাননে। দীন নারী এক ভূতলশয়ন না ছিল তাহার অশন ভূষণ, সে আসি নমিল সাধুর চরণ-                    কমলে। অরণ্য-আড়ালে রহি কোনোমতে একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে, বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে                    ভূতলে। ভিক্ষু ঊর্ধ্বভুজে করে জয়নাদ-- কহে, "ধন্য মাতঃ, করি আশীর্বাদ, মহাভিক্ষুকের পুরাইলে সাধ                    পলকে।' চলিলা সন্ন্যাসী ত্যজিয়া নগর ছিন্ন চীরখানি লয়ে শিরোপর সঁপিতে বুদ্ধের চরণনখর-                     আলোকে। সংশয়ী কোথায় যেতে ইচ্ছে করে           শুধাস কি মা , তাই ? যেখান থেকে এসেছিলেম           সেথায় যেতে চাই । কিন্তু সে যে কোন্‌ জায়গা           ভাবি অনেকবার । মনে আমার পড়ে না তো          একটুখানি তার । ভাবনা আমার দেখে বাবা           বললে সেদিন হেসে , ' সে - জায়গাটি মেঘের পারে           সন্ধ্যাতারার দেশে । ' তুমি বল , ' সে - দেশখানি           মাটির নিচে আছে , যেখান থেকে ছাড়া পেয়ে           ফুল ফোটে সব গাছে । ' মাসি বলে , ' সে - দেশ আমার           আছে সাগরতলে , যেখানেতে আঁধার ঘরে           লুকিয়ে মানিক জ্বলে । ' দাদা আমার চুল টেনে দেয় ,           বলে , ' বোকা ওরে , হাওয়ায় সে - দেশ মিলিয়ে আছে            দেখবি কেমন করে ?' আমি শুনে ভাবি , আছে           সকল জায়গাতেই । সিধু মাস্টার বলে শুধু           ' কোনোখানেই নেই । '   (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) সংসারেতে দারুণ ব্যথা সংসারেতে দারুণ ব্যথা লাগায় যখন প্রাণে "আমি যে নাই" এই কথাটাই মনটা যেন জানে। যে আছে সে সকল কালের, এ কাল হতে ভিন্ন— তাহার গায়ে লাগে না তো কোনো ক্ষতের চিহ্ন।   (স্ফুলিঙ্গ) সখি লো সখি লো নিকরুণ মাধব সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায় করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা,      কঠিন‐হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়। মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা,        বয়ন‐পান তছু চাহল রাধা, চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল— দণ্ড দণ্ড, সখি, চাহয়ি রহল—      মন্দ মন্দ, সখি— নয়নে বহল বিন্দু বিন্দু জলধার। মৃদু মৃদু হাসে বৈঠল পাশে,       কহল শ্যাম কত মৃদু মধু ভাষে। টুটয়ি গইল পণ, টুটইল মান,       গদগদ আকুল ব্যাকুল প্রাণ, ফুকরয়ি উছসয়ি কাঁদিল রাধা— গদগদ ভাষ নিকাশল আধা— শ্যামক চরণে বাহু পসারি কহল, শ্যাম রে, শ্যাম হমারি, রহ তুঁহু, রহ তুঁহু, বঁধু গো রহ তুঁহু,       অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু— তুঁহু বিনে মাধব, বল্লভ, বান্ধব,        আছয় কোন হমার! পড়ল ভূমি‐’পর শ্যামচরণ ধরি,        রাখল মুখ তছু শ্যামচরণ‐’পরি, উছসি উছসি কত কাঁদয়ি কাঁদয়ি        রজনি করল প্রভাত।            মাধব বৈসল, মৃদু মধু হাসল কত অশোয়াস‐বচন মিঠ ভাষল,       ধরইল বালিক হাত। সখি লো, সখি লো, বোল ত সখি লো,       যত দুখ পাওল রাধা, নিঠুর শ্যাম কিয়ে আপন মনমে        পাওল তছু কছু আধা। হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি        বহুত স প্রবোধ দেল, হাসয়ি হাসয়ি পলটয়ি চাহয়ি        দূর দূর চলি গেল। অব সো মথুরাপুরক পন্থমে        ইঁহ যব রোয়ত রাধা। মরমে কি লাগল তিলভর বেদন,       চরণে কি তিলভর বাধা। বরখি আঁখিজল ভানু কহে,       অতি       দুখের জীবন ভাই। হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু        কাঁদিবার কো নাই।। সখিরে—পিরীত বুঝবে কে সখিরে— পিরী ত বুঝবে কে ? অঁধার হৃদয়ক দুঃখ কাহিনী           বোলব , শুনবে কে ? রাধিকার অতি অন্তর বেদন           কে বুঝবে অয়ি সজনী কে বুঝবে সখি রোয়ত রাধা           কোন দুখে দিন রজনী ? কলঙ্ক রটায়ব জনি সখি রটাও          কলঙ্ক নাহিক মানি , সকল তয়াগব লভিতে শ্যামক            একঠো আদর বাণী । মিনতি করিলো সখি শত শত বার , তু           শ্যামক না দিহ গারি , শীল মান কুল , অপনি সজনি হম           চরণে দেয়নু ডারি । সখিলো— বৃন্দাবনকো দুরুজন মানুখ           পিরীত নাহিক জানে , বৃথাই নিন্দা কাহ রটায়ত           হমার শ্যামক নামে ? কলঙ্কিনী হম রাধা , সখিলো           ঘৃণা করহ জনি মনমে ন আসিও তব্‌ কবহুঁ সজনিলো           হমার অঁধা ভবনমে । কহে ভানু অব— বুঝবে না সখি           কোহি মরমকো বাত , বিরলে শ্যামক কহিও বেদন           বৃক্ষে রাখয়ি মাথ । সখী,ভাবনা কাহারে বলে সখী,    ভাবনা কাহারে বলে। সখী,    যাতনা কাহারে বলে ।        তোমরা যে বলো দিবস-রজনী    ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—         সখী,    ভালোবাসা কারে কয়!  সে কি   কেবলই যাতনাময় ।         সে কি   কেবলই চোখের জল?   সে কি   কেবলই দুখের শ্বাস ?         লোকে তবে করে   কী সুখেরই তরে   এমন দুখের আশ ।        আমার চোখে তো সকলই শোভন,         সকলই নবীন, সকলই বিমল,    সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,        বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।         তারা  কেবলই হাসে, কেবলই গায়,   হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—         না জানে বেদন, না জানে রোদন,   না জানে সাধের যাতনা যত ।         ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,   জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,         হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে   আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।         আমার মতন সুখী কে আছে।   আয় সখী, আয় আমার কাছে—         সুখী হৃদয়ের সুখের গান   শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।         প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল    একদিন নয় হাসিবি তোরা—         একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া    সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।।("ভগ্নহৃদয়" গ্রন্থ থেকে) সঙ্গী আরেক দিনের কথা পড়ি গেল মনে। একদা মাঠের ধারে শ্যাম তৃণাসনে একটি বেদের মেয়ে অপরাহ্নবেলা কবরী বাঁধিতেছিল বসিয়া একেলা। পালিত কুকুরশিশু আসিয়া পিছনে কেশের চাঞ্চল্য হেরি খেলা ভাবি মনে লাফায়ে লাফায়ে উচ্চে করিয়া চিৎকার দংশিতে লাগিল তার বেণী বারম্বার। বালিকা ভর্ৎসিল তারে গ্রীবাটি নাড়িয়া, খেলার উৎসাহ তাহে উঠিল বাড়িয়া। বালিকা মারিল তারে তুলিয়া তর্জনী, দ্বিগুণ উঠিল মেতে খেলা মনে গণি। তখন হাসিয়া উঠি লয়ে বক্ষ-’পরে বালিকা ব্যথিল তারে আদরে আদরে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) সজনি গো শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা সজনি গো , শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা      নিশীথযামিনী রে । কুঞ্জপথে সখি , কৈসে যাওব      অবলা কামিনী রে । উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত ,       ঘন ঘন গর্জিত মেহ । দমকত বিদ্যুত , পথতরু লুন্ঠত ,       থরহর কম্পত দেহ । ঘন ঘন রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌       বরখত নীরদপুঞ্জ । ঘোর গহন ঘন তালতমালে       নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ । বোল ত সজনী , এ দুরুযোগে       কুঞ্জে নিরদয় কান দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত       সকরুণ রাধা নাম ।    সজনি , মোতিম হারে বেশ বনা দে ,      সীঁথি লগা দে ভালে । উরহি বিলোলিত শিথিল চিকুর মম       বাঁধহ মালত মালে খোল দুয়ার ত্বরা করি সখি রে ,       ছোড় সকল ভয়লাজে — হৃদয় বিহগসম ঝটপট করত হি       পঞ্জরপিঞ্জরমাঝে । গহন রয়নমে ন যাও বালা       নওলকিশোরক পাশ — গরজে ঘন ঘন , বহু ডর পাওব ,       কহে ভানু তব দাস । সজনি সজনি রাধিকালো সজনি সজনি রাধিকালো দেখ অবহুঁ চাহিয়া, মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া। পিনহ ঝটিত কুমুম হার, পিনহ নীল আঙিয়া। সুন্দরি সিন্দূর দেকে সীঁথি করছ রাঙিয়া। সহচরি সব নাচ নাচ মধুর গীত গাওরে, চঞ্চল মঞ্জীর রাব কুঞ্জ গগন ছাওরে।সজনি অব উজার মঁদির কনক দীপ জ্বালিয়া, সুরভি করছ কুঞ্জ ভবন গন্ধ সলিল ঢালিয়া । মল্লিকা চমেলি বেলি কুসুম তুলহ বালিকা, গাঁথ যূঁথি, গাঁথ জাতি, গাঁথ বকুল মালিকা । তৃষিত-নয়ন ভানুসিংহ কুঞ্জ-পথম চাছিয়া মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে, মৃদুল গান গাহিয়া।    (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) সজ্ঞান আত্মবিসর্জন বীর কহে, হে সংসার, হায় রে পৃথিবী, ভাবিস নে মোরে কিছু ভুলাইয়া নিবি— আমি যাহা দিই তাহা দিই জেনে-শুনে ফাঁকি দিয়ে যা পেতিস তার শতগুণে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সতিমির রজনি, সচকিত সজনী সতিমির রজনী , সচকিত সজনী,      শূন্য নিকুঞ্জঅরণ্য । কলয়িত মলয়ে , সুবিজন নিলয়ে      বালা বিরহবিষণ্ন ! নীল আকাশে তারক ভাসে ,       যমুনা গাওত গান , পাদপ মরমর , নির্ঝর ঝরঝর,       কুসুমিত বল্লিবিতান । তৃষিত নয়ানে বনপথপানে       নিরখে ব্যাকুল বালা , দেখ না পাওয়ে , আঁখ ফিরাওয়ে,       গাঁথে বনফুলমালা । সহসা রাধা চাহল সচকিত,       দূরে খেপল মালা , কহল - সজনি শুন , বাঁশরি বাজে,       কুঞ্জে আওল কালা । চকিত গহন নিশি , দূর দূর দিশি       বাজত বাঁশি সুতানে । কন্ঠ মিলাওল ঢলঢল যমুনা       কল কল কল্লোলগানে । ভণে ভানু , অব শুন গো কানু       পিয়াসিত গোপিনী প্রাণ । তোঁহার পীরিত বিমল অমৃতরস       হরষে করবে পান ।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) সতী সতীলোকে বসি আছে কত পতিব্রতা, পুরাণে উজ্জ্বল আছে যাঁহাদের কথা। আরো আছে শত লক্ষ অজ্ঞাতনামিনী খ্যাতিহীনা কীর্তিহীনা কত-না কামিনী— কেহ ছিল রাজসৌধে কেহ পর্ণঘরে, কেহ ছিল সোহাগিনী কেহ অনাদরে; শুধু প্রীতি ঢালি দিয়া মুছি লয়ে নাম চলিয়া এসেছে তারা ছাড়ি মর্তধাম। তারি মাঝে বসি আছে পতিতা রমণী মর্তে কলঙ্কিনী, স্বর্গে সতীশিরোমণি। হেরি তারে সতীগর্বে গরবিনী যত সাধ্বীগণ লাজে শির করে অবনত। তুমি কী জানিবে বার্তা, অন্তর্যামী যিনি তিনিই জানেন তার সতীত্বকাহিনী।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) সত্য ১ ভয়ে ভয়ে ভ্রমিতেছি মানবের মাঝে হৃদয়ের আলোটুকু নিবে গেছে ব’লে ! কে কী বলে তাই শুনে মরিতেছি লাজে , কী হয় কী হয় ভেবে ভয়ে প্রাণ দোলে ! ‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে মরি পরের নয়নে , ‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে খুঁজে কাঁদি পথে পথে , অবশেষে শুয়ে পড়ি ধূলির শয়নে — ভয় হয় এক পদ অগ্রসর হতে ! বজ্রের আলোক দিয়ে ভাঙো অন্ধকার , হৃদি যদি ভেঙে যায় সেও তবু ভালো । যে গৃহে জানালা নাই সে তো কারাগার — ভেঙে ফেলো , আসিবেক স্বরগের আলো । হায় হায় কোথা সেই অখিলের জ্যোতি ! চলিব সরল পথে অশঙ্কিতগতি !২ জ্বালায়ে আঁধার শূন্যে কোটি রবিশশী দাঁড়ায়ে রয়েছ একা অসীমসুন্দর । সুগভীর শান্ত নেত্র রয়েছে বিকশি , চিরস্থির শুভ্র হাসি , প্রসন্ন অধর । আনন্দে আঁধার মরে চরণ পরশি , লাজ ভয় লাজে ভয়ে মিলাইয়া যায় — আপন মহিমা হেরি আপনি হরষি চরাচর শির তুলি তোমাপানে চায় । আমার হৃদয়দীপ আঁধার হেথায় , ধূলি হতে তুলি এরে দাও জ্বালাইয়া — ওই ধ্রুবতারাখানি রেখেছ যেথায় সেই গগনের প্রান্তে রাখো ঝুলাইয়া । চিরদিন জেগে রবে নিবিবে না আর , চিরদিন দেখাইবে আঁধারের পার ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) সত্য মোর অবলিপ্ত সংসারের বিচিত্র প্রলেপে সত্য মোর অবলিপ্ত সংসারের বিচিত্র প্রলেপে, বিবিধের বহু হস্তক্ষেপে, অযত্নে অনবধানে হারালো প্রথম রূপ, দেবতার আপন স্বাক্ষর লুপ্ত প্রায়; ক্ষয়-ক্ষীণ জ্যোতির্ময় আদি মূল্য তার। চতুষ্পথে দাঁড়াল সে ললাটে পণ্যের ছাপ নিয়ে আপনারে বিকাইতে, অঙ্কিত হতেছে তার স্থান পথে-চলা সহস্রের পরীক্ষা-চিহ্নিত তালিকায়। হেনকালে একদিন আলো-আঁধারের সন্ধি-স্থলে আরতি শঙ্খের ধ্বনি যে-লগ্নে বাজিল সিন্ধুপারে, মনে হোলো, মুহূর্তেই থেমে গেল সব বেচাকেনা, শান্ত হল আশা-প্রত্যাশার কোলাহল। মনে হোলো, পরের মুখের মূল্য হতে মুক্ত, সব চিহ্ন-মোছাঅসজ্জিত আদি-কৌলীন্যের শান্ত পরিচয় বহি যেতে হবে নীরবের ভাষাহীন সংগীত-মন্দিরে একাকীর একতারা হাতে। আদিম সৃষ্টির যুগে প্রকাশের যে আনন্দ রূপ নিল আমার সত্তায় আজ ধূলিমগ্ন তাহা, নিদ্রাহারা রুগ্ন বুভুক্ষার দীপধূমে কলঙ্কিত। তারে ফিরে নিয়ে চলিয়াছি মৃত্যুস্নানতীর্থতটে সেই আদি নির্ঝরতলায় । বুঝি এই যাত্রা মোর স্বপ্নের অরণ্যবীথিপারে পূর্ব ইতিহাসধৌত অকলঙ্ক প্রথমের পানে। যে প্রথম বারে বারে ফিরে আসে বিশ্বের সৃষ্টিতে কখনো বা অগ্নিবর্ষী প্রচণ্ডের প্রলয় হুংকারে, কখনো বা অকস্মাৎ স্বপ্নভাঙা পরম বিস্ময়ে শুকতারানিমন্ত্রিত আলোকের উৎসব প্রাঙ্গণে।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ) সত্যের আবিষ্কার কহিলেন বসুন্ধরা, দিনের আলোকে আমি ছাড়া আর কিছু পড়িত না চোখে, রাত্রে আমি লুপ্ত যবে শূন্যে দিল দেখা অনন্ত এ জগতের জ্যোতির্ময়ী লেখা।।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সত্যের সংযম স্বপ্ন কহে, আমি মুক্ত, নিয়মের পিছে নাহি চলি। সত্য কহে, তাই তুমি মিছে। স্বপ্ন কয়, তুমি বদ্ধ অনন্ত শৃঙ্খলে। সত্য কয়, তাই মোরে সত্য সবে বলে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সন্দেহের কারণ কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি।— তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সন্ধেবেলায় বন্ধুঘরে সন্ধেবেলায় বন্ধুঘরে জুটল চুপিচুপি গোপেন্দ্র মুস্তুফি। রাত্রে যখন ফিরল ঘরে সবাই দেখে তারিফ করে– পাগড়িতে তার জুতোজোড়া, পায়ে রঙিন টুপি। এই উপদেশ দিতে এল– সব করা চাই এলোমেলো, “মাথায় পায়ে রাখব না ভেদ’ চেঁচিয়ে বলে গুপি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) সন্ধ্যা ক্ষান্ত হও, ধীরে কও কথা। ওরে মন, নত করো শির। দিবা হল সমাপন, সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী। তিমিরের তীরে অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে এল আরতির বেলা। ওই শুন বাজে নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। ধীরে নামাইয়া আনো বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পূরবীর ম্লান- মন্দ স্বরে। রাখো রাখো অভিযোগ তব, মৌন করো বাসনার নিত্য নব নব নিষ্ফল বিলাপ। হেরো মৌন নভস্তল, ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন, মৌন জলস্থল স্তম্ভিত বিষাদে নম্র। নির্বাক্‌ নীরব দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী-- নয়নপল্লব নত হয়ে ঢাকে তার নয়নযুগল, অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু-ছলছল করিয়া গোপন। বিষাদের মহাশান্তি ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তেসান্ত্বনা-পরশ। আজি এই শুভক্ষণে, শান্ত মনে, সন্ধি করো অনন্তের সনে সন্ধ্যার আলোকে। বিন্দু দুই অশ্রুজলে দাও উপহার-- অসীমের পদতলে জীবনের স্মৃতি। অন্তরের যত কথা শান্ত হয়ে গিয়ে, মর্মান্তিক নীরবতা করুক বিস্তার।        হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে সুপ্তপ্রায় গ্রাম। পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে, শিশুরা খেলে না; শূন্য মাঠ জনহীন; ঘরে-ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন কুটির-অঙ্গনে বাঁধা, ছবির মতন স্তব্ধপ্রায়। গৃহকার্য হল সমাপন-- কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি সম্মুখে দেখিছে চাহি, ভাবিছে কী জানি ধূসর সন্ধ্যায়।           অমনি নিস্তব্ধপ্রাণে বসুন্ধরা, দিবসের কর্ম-অবসানে, দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি দিগন্তের পানে। ধীরে যেতেছে প্রবাহি সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত অম্বরে নিঃশব্দ চরণে; আকাশের দূরান্তরে একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির একেকটি দীপ্ত তারা, সুদূর পল্লীর প্রদীপের মতো। ধীরে যেন উঠে ভেসে ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ননিমেষে কত যুগ-যুগান্তের অতীত আভাস, কত জীবজীবনের জীর্ণ ইতিহাস।যেন মনে পড়ে সেই বাল্যনীহারিকা; তার পরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা; তার পরে স্নিগ্ধশ্যাম অন্নপূর্ণালয়ে জীবধাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে লক্ষ কোটি জীব-- কত দুঃখ, কত ক্লেশ, কত যুদ্ধ, কত মৃত্যু, নাহি তার শেষ।ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার, গাঢ়তর নীরবতা-- বিশ্বপরিবার সুপ্ত নিশ্চেতন। নিঃসঙ্গিনী ধরণীর বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর একটি ব্যথিত প্রশ্ন, ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর, শূন্যপানে-- "আরো কোথা? আরো কত দূর?" সন্ধ্যারবি মেঘে দেয় সন্ধ্যারবি মেঘে দেয় নাম সই করে। লেখা তার মুছে যায়, মেঘ যায় সরে।   (স্ফুলিঙ্গ) সফলতা লভি যবে সফলতা লভি যবে মাথা করি নত, জাগে মনে আপনার অক্ষমতা যত।   (স্ফুলিঙ্গ) সব চেয়ে ভক্তি যার সব চেয়ে ভক্তি যার অস্ত্রদেবতারে অস্ত্র যত জয়ী হয় আপনি সে হারে।   (স্ফুলিঙ্গ) সব ঠাঁই মোর ঘর আছে সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া। পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই– তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই, কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই সন্ধান লব বুঝিয়া। ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়, তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।রহিয়া রহিয়া নব বসন্তে ফুলসুগন্ধ গগনে কেঁদে ফেরে হিয়া মিলনবিহীন মিলনের শুভ লগনে। আপনার যারা আছে চারি ভিতে পারি নি তাদের আপন করিতে, তারা নিশিদিশি জাগাইছে চিতে বিরহবেদনা সঘনে। পাশে আছে যারা তাদেরই হারায়ে ফিরে প্রাণ সারা গগনে।তৃণে পুলকিত যে মাটির ধরা লুটায় আমার সামনে– সে আমায় ডাকে এমন করিয়া কেন যে,কব তা কেমনে। মনে হয় যেন সে ধূলির তলে যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে, সে দুয়ার খুলি কবে কোন্‌ ছলে বাহির হয়েছি ভ্রমণে। সেই মূক মাটি মোর মুখ চেয়ে লুটায় আমার সামনে।নিশার আকাশ কেমন করিয়া তাকায় আমার পানে সে। লক্ষযোজন দূরের তারকা মোর নাম যেন জানে সে। যে ভাষায় তারা করে কানাকানি সাধ্য কী আর মনে তাহা আনি; চিরদিবসের ভুলে-যাওয়া বাণী কোন্‌ কথা মনে আনে সে। অনাদি উষায় বন্ধু আমার তাকায় আমার পানে সে।এ সাত-মহলা ভবনে আমার চির-জনমের ভিটাতে স্থলে জলে আমি হাজার বাঁধনে বাঁধা যে গিঁঠাতে গিঁঠাতে। তবু হায় ভুলে যাই বারে বারে, দূরে এসে ঘর চাই বাঁধিবারে, আপনার বাঁধা ঘরেতে কি পারে ঘরের বাসনা মিটাতে। প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায় চির-জনমের ভিটাতে।যদি চিনি,যদি জানিবারে পাই, ধুলারেও মানি আপনা। ছেটো বড়ো হীন সবার মাঝারে করি চিত্তের স্থাপনা। হই যদি মাটি,হই যদি জল, হই যদি তৃণ,হই ফুলফল, জীব-সাথে যদি ফিরি ধরাতল কিছুতেই নাই ভাবনা। যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে অন্তবিহীন আপনা।বিশাল বিশ্বে চারি দিক হতে প্রতি কণা মোরে টানিছে। আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ শত কোটি কর হানিছে। ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস। মোর তরে জল দু হাত বাড়াস? নিশ্বাসে বুকে পশিয়া বাতাস চির-আহ্বান আনিছে। পর ভাবি যারে তারা বারে বারে সবাই আমারে টানিছে।আছে আছে প্রেম ধুলায় ধুলায়, আনন্দ আছে নিখিলে। মিথ্যায় ঘেরে,ছোটো কণাটিরে তুচ্ছ করিয়া দেখিলে। জগতের যত অণু রেণু সব আপনার মাঝে অচল নীরব বহিছে একটি চিরগৌরব– এ কথা না যদি শিখিলে জীবনে মরণে ভয়ে ভয়ে তবে প্রবাসী ফিরিবে নিখিলে।ধুলা-সাথে আমি ধুলা হয়ে রব সে গৌরবের চরণে। ফুলমাঝে আমি হব ফুলদল তাঁর পূজারতি-বরণে। যেথা যাই আর যেথায় চাহি রে তিল ঠাঁই নাই তাঁহার বাহিরে, প্রবাস কোথাও নাহি রে নাহি রে জনমে জনমে মরণে। যাহা হই আমি তাই হয়ে রব সে গৌরবের চরণে।ধন্য রে আমি অনন্ত কাল, ধন্য আমার ধরণী। ধন্য এ মাটি,ধন্য সুদূর তারকা হিরণ-বরনী। যেথা আছি আমি আছি তাঁরি দ্বারে, নাহি জানি ত্রাণ কেন বল কারে। আছে তাঁরি পারে তাঁরি পারাবারে বিপুল ভুবনতরণী। যা হয়েছি আমি ধন্য হয়েছি, ধন্য এ মোর ধরণী।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) সবুজের অভিযান ওরে নবীন , ওরে আমার কাঁচা,     ওরে সবুজ ওরে অবুঝ ,           আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা । রক্ত আলোয় মদে মাতাল ভোরে আজকে যে যা বলে বলুক তোরে, সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক'রে       পুচ্ছটি তোর উর্দ্ধে তুলে নাচা ।             আয় দুরন্ত ,আয় রে আমার কাঁচা ।খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়      আর তো কিছুই নড়ে না রে          ওদের ঘরে , ওদের ঘরের দাওয়ায় ।ওই যে প্রবীণ,  ওই যে পরম পাকা-- চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা , ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা      অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায় ।      আয় জীবন্ত আয় রে আমার কাঁচা ।বাহির পানে তাকায় না যে কেউ দেখে না যে বান ডেকেছে--    জোয়ার জলে উঠছে প্রবল ঢেউ । চলতে ওরা চায়না মাটির ছেলে মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে , আছে অচল আসনখানা মেলে       যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায় ।           আয় অশান্ত ,আয় রে আমার কাঁচা ।তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।     হঠাৎ আলো দেখবে যখন          ভাববে একি বিষম কান্ডখানা । সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে    লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায় ।        আয় প্রচন্ড, আয় রে আমার কাঁচা ।শিকল দেবীর ঐ যে পূজাবেদি    চিরকাল কি রইবে খাড়া ?       পাগলামি তুই, আয় রে দুয়ার ভেদি। ঝড়ের মাতন বিজয় কেতন নেড়ে ১৩৩৩ তোমার শরীর — তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড় রাত্রি আর দিন তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড় রাত্রি আর দিন তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে! কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নক্ষত্রের তলে বসে আছি — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া! তোমার শরীর — তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড় রাত্রি আর দিন তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে — ফলে গেছে কতবার, ঝরে গেছে তৃণ!* আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি; তোমার শরীর ছানি মিটায় পিপাসা কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা দিয়েছ কাহারে! কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ! উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন কেটে যায়! উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!* জানি আমি — আমি যাব চলে তোমার অনেক আগে; তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন — আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে নক্ষত্র অনেক রাত আরো, নক্ষত্র অনেক রাত আরো, (যদিও তোমারও রাত্রি আর দিন শেষ হবে একদিন কবে!) আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর, আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।* আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন — কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন করেছিলে তুমি! — জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি আকাশের তারার মতন ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন তার আগে! এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে মুছে যায় পৃথিবীর পর, একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর! আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি — জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি আকাশের তারার মতন ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!* আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ — তার আগে এই রাত্রি — দিন পড়িতেছে ঝরে! এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি! কখন গিয়েছে তবু থামি সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে! আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ — তবু সেই রাত্রি আর দিন পড়ে গেল ঝ’রে। সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!* জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে তুমি আর; নক্ষত্রের পারে যদি আমি চলে যাই, পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই যদি আমি — আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ; তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি আমার এ নক্ষত্রের তলে! — জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে — তোমার শরীর আজ ঝরে রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে! যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে — জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!* তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে! নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! — একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা। আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! — কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি রয়েছি দাঁড়ায়ে! নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা! একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!* চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন। জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই। তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই আমার এখানে তুমি আর! একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন; আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই; তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!* তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে। আলো অন্ধকারে তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি! নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন — আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি এই দূর সমুদ্রের জলে! যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে! সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে সমুদ্রের জলে, নক্ষত্রের তলে! রাত্রে, অন্ধকারে! তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি, আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!* তোমার শরীর — তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড় রাত্রি আর দিন। তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নক্ষত্রের তলে বসে আছি — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া! ১৯৪৬-৪৭ দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা: পথে ঘাটে ট্রাক ট্রাম লাইনে ফুটপাতে; কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে-মনে হয়, জলের মতন দামে। সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে র্পৌছুবে সকলের আগে সকলেই তাই। অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়,তবু নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব-অথবা যা নিলেমের নয় সে-সব জিনিস বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে। পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়। অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে। পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে সবই নেয়,নারীকেও নিয়ে যায়। বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন কোথাও নদীর পান উড়ে যেতে চায়, অথবা মাটির দিকে- পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে মিশে গিয়ে পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে,তবু আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে পরিচিত জল,আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার-ক’রে নিতে হবে: ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হয়ে যায়লীন হ’য়ে গেলে তারা তখন তো-মৃত। মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো, মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি শান্ত মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই ব’লে মনে হয়; তাহ’লে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হ’তো।বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল। সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার খোঁপা বেঁধে নিতে আসে- কিন্তু কার হাতে? আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে- কিন্তু কার তরে? হাত নেই- কোথাও মানুষ নেই-, বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব।এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে; নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক এ-পাড়ার বড়ো মেজো ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত; এখন টু শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও; মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়; সময়ের হাতে অন্তহীন।ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির ঈশ্বরী মেয়ের সাথে বিবাহের কিছু আগে- বিবাহের কিছু পরে- সন্তানের জন্মাবার আগে সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ় ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে মৃতপ্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে- অন্ধকারে জমিদারদের চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে। ওরা খুব বেশি ভালো ছিলো না; তবুও আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরহ্মরতায় অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো ক’রে কথা ভাবা এখন কঠিন; অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার নিয়ম এখন আছে, তারপর একা অন্ধকারে বাকি সত্য আঁচ ক’রে নেওয়ার রেওয়াজ রয়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়- দ্বেষ। সৃষ্টির মনের কথা : আমাদেরি আন্তরিকতাতে আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল ঝর্নার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়; মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর ভ’রে গেছে, পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে বধ ক’রে ঘুমাতেছি- তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে। ঘুমাতেছে। যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে ব’লে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি, হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ- আর তুমি?' আমার বুকের 'পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে চোখ তুলে শুধাবে সে- রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে বলে যাবে, 'গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার; মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির-‘ কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে; সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে এই সব প্রাণকণা জেগেছিলো- বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের মনীষী লোকের কাছে এই সব অণুর মতন উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে। সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেনুর শরীরে রেনুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী সহসা নিকটে এসে কোনো-কিছু বলবার আগে আধ-খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের কথা ব’লে গিয়েছিলা; তবু- অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা অখণ্ড অনন্তে অন্তর্হিত হ’য়ে গেছে, কেউ নেই কিছু নেই- সূর্য নিভে গেছে ।এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে। আমরা এ-পৃথিবীর বহুদিনকার কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি। মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে। অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু আমাদের এই শতকের বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু- বেড়ে যায় শুধু; তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময় জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।এ-যুগে কোথাও কোনো আলো- কোনো কান্তিময় আলো চোখের সুমূখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার রাত্রির মায়ের মতো : মানুষের বিহ্বল দেহের সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়- মানুষের বিহ্বল আত্মাকে লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে তাকে আর শুধায় না- অতীতের শুধানো প্রশ্নের, উত্তর চায় না আর- শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ বীতকাম হয় যাতে- এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়, স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে- মানুষের রক্তাক্ত আত্মায় সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের- মানুষের জীবন নির্মল। আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই? তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে যে অনবনমনে চলেছে আজো- তার হৃদয়ের ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়। অইখানে সারা দিন ঐখানে সারা দিন উঁচু ঝাউবন খেলা করে হলদে সবুজ নীল রঙ্গ তার বুকে; পাখি মেঘ রৌদ্রের; তবু আজও হদয়ের গভীর অসুখে মানবেরা পড়ে আছে কেন।আজ অন্ধ শতাব্দীর শতচ্ছিদ্রতার ভিতর আলোর খোঁজে যদি চলে যায় তবুও শাশ্বত হয়ে থাকে অন্ধকার।নতুন যুগের জন্য তবুও প্রয়ান করা ভালো। চিতল হরিণ ঐ শিঙ তুলে ফিকে জোছনায় হরিণী কে খোঁজে তবু পাবে না কখনও; ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায়। অঘ্রাণ আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি- বিকেলের এই রঙ- রঙের শূন্যতা রোদের নরম রোম- ঢালু মাঠ- বিবর্ণ বাদামি পাখি- হলুদ বিচালি পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে-ঘাসে- কুড়ুনির মুখে তাই নাই কোনো কথা,ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে- জীবনেরে জেনেছে সে- কুয়াশায় খালি তাই তার ঘুম পায়- খেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে- খেতের ভিতর এখনি সে নেই যেন- ঝ'রে পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ণ সোনালিতুলিটুকু;- মুছে যায়;- কেউ ছবি আঁকিবে না মাঠে-মাঠে যেন তারপর, আঁকিতে চায় না কেউ,- এখন অঘ্রাণ এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়; একদিন নীল ডিম দেখিনি কি?- দুটো পাখি তাদের নীড়ের মৃদু খড়সেইখানে চুপে চুপে বিছায়েছে;- তবু নীড়- তবু ডিম,- ভালোবাসা সাধ শেষ হয় তারপর কেউ তাহা চায় নাকো- জীবনের অনেক দেয়- তবুও জীবন আমাদের ছুটি দেয় তারপর- একখানা আধখানা লুকানো বিস্ময়অথবা বিস্ময় নয়- শুধু শান্তি- শুধু হিম কোথায় যে রয়েছে গোপন অঘ্রাণ খুলেছে তারে- আমার মনের থেকে কুড়ায়ে করেছে আহরণ। অঘ্রাণ প্রান্তরে ‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে- বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে; সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে; আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায় ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়; নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ …… হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে, সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে; পতঙ্গ পালক্‌ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ; আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব। অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব। অদ্ভুত আঁধার এক অদ্ভুত আঁধার এক আসিয়াছে পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি, এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয় মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। অনন্ত জীবন যদি পাই আমি অনন্ত জীবন যদি পাই আমি তাহ’লে অনন্তকাল একা পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিবো সবুজ ঘাস ফুটে উঠে দেখিবো হলুদ ঘাস ঝরে যায় দেখিবো আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে- ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা লেগে থাকে বুকে তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা পাবো আমি; দেখিবো অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস খুলে ফেলে চলে যায় মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো দেখিবো অনেক আমি— দেখিবো অনেকগুলো বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা অনন্দা এই পৃথিবীর এ এক শতচ্ছিদ্র নগরী। দিন ফুরুলে তারার আলো খানিক নেমে আসে। গ্যাসের বাতি দাঁড়িয়ে থাকে রাতের বাতাসে। দ্রুতগতি নরনারীর ক্ষণিক শরীর থেকে উৎসারিত ছায়ার কালো ভারে আঁধার আলোয় মনে হ’তে পারে এ-সব দেয়াল যে-কোনো নগরীর; সন্দেহ ভয় অপ্রেম দ্বেষ অবক্ষয়ের ভিড় সূর্য তারার আলোয় অঢেল রক্ত হ’তে পারে যে-কোনোদিন; সে কতবার আঁধার বেশি শানিত হয়েছে; বাহক নেই- দুরন্ত কাল নিজেই বয়েছে নিজেরি শব নিজে মানুষ, মানবপ্রাণের রহস্যময় গভীর গুহার থেকে সিংহ শকুন শেয়াল নেউল সর্পদন্ত ডেকে।হৃদয় আছে ব’লেই মানুষ, দেখ, কেমন বিচলিত হ’য়ে বোনভায়েকে খুন ক’রে সেই রক্ত দেখে আঁশটে হৃদয়ে জেগে উঠে ইতিহাসের অধম স্থূলতাকে ঘুচিয়ে দিতে জ্ঞানপ্রতিভা আকাশ প্রেম নক্ষত্রকে ডাকে।এই নগরী যে-কোনো দেশ; যে-কোনো পরিচয়ে আজ পৃথিবীর মানবজাতির ক্ষয়ের বলয়ে অন্তবিহীন ফ্যাক্টরি ক্রেন ট্রাকের শব্দে ট্র্যাফিক কোলাহলে হৃদয়ে যা হারিয়ে গেছে মেশিনকণ্ঠে তাকে শূণ্য অবলেহন থেকে ডাকে। তুমি কি গ্রীস পোল্যাণ্ড চেক প্যারিস মিউনিক টোকিও রোম ন্যুইয়র্ক ক্রেমলিন আটলাণ্টিক লণ্ডন চীন দিল্লী মিশর করাচী প্যালেস্টাইন? একটি মৃত্যু, এক ভূমিকা,একটি শুধু আইন।' বলছে মেশিন। মেশিনপ্রতিম অধিনায়ক বলে : সকল ভূগোল নিতে হবে নতুন ক’রে গড়ে আমরা হাতে গড়া ইতিহাসের ভেতরে, নতুন সময় সীমাবলয় সবই তো আজ আমি; ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমার স্বত্বাধিকারকামী; আমি সংঘ জাতি রীতি রক্ত হলুদ নীল; সবুজ শাদা মেরুন অশ্লীল নিয়মগুলো বাতিল করি; কালো কোর্তা দিয়ে ওদের ধূসর পাটকিলে বফ্ কোর্তা তাড়িয়ে আমার অনুচরের বৃন্দ অন্ধকারের বার আলোক ক’রে কী অবিনাশ দ্বৈপ-পরিবার।,এই দ্বীপই দেশ, এ-দ্বীপ নিখিল তবে। অন্য সকল দ্বীপের হ’তে হবে আমার মতো- আমার অনুচরের মতো ধ্রুব হে রক্তবীজ, তুমি হবে আমার আঘাত পেয়ে অনবতুল আমির মতো শুভ।'সবাই তো আজ যে যার অন্তরঙ্গ জিনিস খুঁজে মানবভ্রাতাবোনকে বুকে টেনে নেবার ছলে তাদের নিকেশ ক’রে অনির্বচন রক্তে এই পৃথিবীর জলে নানারকম নতুন নামের বৃহৎ ভীষণ নদী হ’য়ে গেল; এই পৃথিবীর সব নগরী পরিক্রমা ক’রে নতুন অভিধানের শব্দে ছন্দে জেগে সুপরিসর ভোরে এ-সব নদী গভীরতর মানে পেতে চায়- দিকসময়ের আতল রক্ত ক্ষালন ক’রে অননুতপ্ততায়; বাস্তবিকই জল কি জলের নিকটতম মানে? অথবা কি মানবরক্ত বহন করি নির্মম অজ্ঞানে? কি আন্তরিক অর্থ কোথায় আছে? এই পৃথিবীর গোষ্ঠীরা কি পরস্পরের কাছে ভাইয়ের মতো : সৎ প্রকৃতির স্পষ্ট উৎস থেকে মানবসভ্যতার এই মলিন ব্যতিক্রমে জেগে ওঠে? যে যার দেহ আত্মা ভালোবেসে অমল জলকণার মতন সমুদ্রকে এক মুঠে ধ’রে আছে? ভালো ক’রে বেঁচে থাকার বিশদ নির্দেশে সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাতে এসে হিংসা গ্লানি মৃত্যুকে শেষ ক’রে জেগে আছে?জেগে উঠে সময়সাগরতীরে সূর্যস্রোতে তবুও ক্লান্ত পতিত মলিন হ’তে কী আবেদন আসছে মানুষ প্রতিদিনই- কোথার থেকে শকুনক্রান্তি বলে : 'জলের নদী? জেগে উঠুক আপামরের রক্ত কোলাহলে!'এ-সুর শুরু হয়েছিলো কুরুবর্ষে- বেবিলনে ট্রয়ে; মানুষ মানী জ্ঞানী প্রধান হ’য়ে গেছে; তবুও হৃদয়ে ভালোবাসার যৌনকুয়াশা কেটে যে-প্রেম আসে সেটা কি তাক নিজের ছায়ার প্রতি? জলের কলরোলের পাশে এই নগরীর অন্ধকারে আজ আঁধার আরো গভীরতর ক’রে ফেলে সভ্যতার এই অপার আত্মরতি; চারিদিকে নীল নরকে প্রবেশ করার চাবি অসীম স্বর্গ খুলে দিয়ে লক্ষ কোটি নরককীটের দাবি জাগিয়ে তবু সে- কীট ধ্বংস করার মতো হ’য়ে ইতিহাসের গভীরতর শক্তি ও প্রেম রেখেছে কিছু হয়তো হৃদয়ে। অনিবার যেখানে রয়েছে আলো পাহাড় জলের সমবায়- তবুও সেখানে যদি আবিষ্কার করি প্যারাফিন অনেক মাটির নীচে,- অথবা সেখানে যদি সংগ্রাম-বিলীন অজস্র অস্পষ্ট মুণ্ড অনুকম্পা হৃদয়ে জাগায়, তাহ'লে প্রভাত এলে মনিয়া পাখিরা পিছে কি করে' বালক ভেসে যাবে উজ্জ্বল জলবিম্বের মত হেসে? কি ক'রে বা নাগরিক নিজের নারীকে ভালোবেসে জেনে নেবে হেমন্তের সন্ধ্যার আলোকে গ্যাস আর নক্ষত্রের লিপ্সা থেকে জেগে যারা চায় তাহাদের কাছে তবু স্মিত সমন্বয়? মৃথেদ উপেক্ষিত পীত দেহ- বলো,- ক্ষমাময়। বৃত্তের মতন- এসো,- ঘুরি মোরা বঙ্কিম আবেগে। অনির্বাণ সর্বদাই এরকম নয়, তবু মাঝে মাঝে মনে হয় কোন দূর উত্তরসাগরে কোনো ঢেউ নেই; তুমি আর আমি ছাড়া কেউ সেখানে ঢোকার পথ হারিয়ে ফেলেছেনেই নীলকণ্ঠ পাখিদের ডানা গুঞ্জরণ ভালোবেসে আমাদের পৃথিবীর এই রৌদ্র; কলকাতার আকাশে চৈত্রের ভোরে যেই নীলিমা হঠাৎ এসে দেখা দেয় মিলাবার আগে এইখানে সে আকাশ নেই; রাতে নক্ষত্রেরা সে রকম আলোর গুঁড়ির মতো অন্ধকার অন্তহীন নয়।তবুও আকাশ আছেঃ অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে নক্ষত্র দু’-একজন চেয়ে থাকে চেয়ে থাকে আমাদের দিকে- যেন টের পায়পৃথিবীর কাছে আমাদের সব কথা -সব কথা বলা ডাভেন্ট্রিডোমেই টাসে স্টেফানিতে যুদ্ধ শান্তি বিরতি নিয়তির ফাঁদে চিরদিন বেধে গিয়ে ব্যহত রণনে শব্দের অপরিমেয় অচল বালির মরুভূমি সৃষ্টি করে গেছে; -কোনো কথা কোনো গানকাউকেই বলে নাই; কোন গান পাখিরাও গায় নাই।তাই এই পাখিহীন নীলিমাবিহীন শাদা স্তব্ধতার দেশে তুমি আর আমি দুই বিভিন্ন রাত্রির দিক থেকে যাত্রা করে উত্তরের সাগরের দীপ্তির ভিতরে এখন মিশেছিএখন বাতাসে শব্দ নেই-তবু শুধু বাতাসের শব্দ হয় বাতাসের মত সময়ের কোনো রৌদ্র নেই, তবু আছে কোনো পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারাদিন হংসের আলোর কণ্ঠ র’য়ে গেছে; কোন রাণী নেই-তবু হংসীর আশার কণ্ঠ এইখানে সাগরের রৌদ্রে সারা দিন। অনুপম ত্রিবেদী এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে। যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয় যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ নিজ চিন্তার বিষয় পরিশেষ করে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে এখন ঘুমায়ে আছে—তাহাদের ঘুম ভেঙে দিতে নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে—ওই পারে মৃত্যুর তালা ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা ঈশার শবোত্থান—বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে হেগেল ও মার্কস : তার ডান আর বাম কান ধ’রে দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিল; এমন সময় দু পকেটে হাত রেখে ভ্রুকুটির চোখে নিরাময় জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম; প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হল একটি টোটেম : উটের ছবির মতো—একজন নারীর হৃদয়ে; মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি; ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী দিব্য মহিলা এক; কোথায় সে আঁচলের খুঁট; কেবলই উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে, ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে? তা হলে তা প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান। জড় ও অজড় ডায়ালেক্‌টিক্‌ মিলে আমাদের দু দিকের কান টানে ব’লে বেঁচে থাকি—ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিল টান।    (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ) অনুসূর্যের গান কোনো এক বিপদের গভীর বিস্ময় আমাদের ডাকে। পিছে-পিছে ঢের লোক আসে। আমরা সবের সাথে ভিড়ে চাপা প’ড়ে- তবু- বেঁচে নিতে গিয়ে জেনে বা না-জেনে ঢের জনতাকে পিষে- ভিড় ক’রে, করুণার ছোট বড় উপকন্ঠে- সাহসিক নগরে বন্দরে সর্বদাই কোনো এক সমুদ্রের দিকে সাগরের প্রয়াণে চলেছি। সে-সমুদ্র- জীবন বা মরণের; হয়তো না আশার দহনে উদ্বেল। যারা বড়ো, মহীয়ান- কোনো এক উৎকন্ঠার পথে তবু স্থির হ’য়ে চ’লে গেছে; একদিন নচিকেতা ব’লে মনে হ’তো তাহাদের; একদিন আত্তিলার মতো তবু; আজ তারা জনতার মতো। জীবনের অবিরাম বিশৃঙ্খলা স্থির ক’রে দিতে গিয়ে তবু সময়ের অনিবার উদ্ভাবনা এসে যে-সব শিশুকে যুবা- প্রবীণ করেছে তারপর তাদের চোখের আলো অনাদির উত্তরাধিকার থেকে, নিরবচ্ছিন্ন কাজ ক’রে তাদের প্রায়ান্ধ চোখে আজ রাত লেন্‌স, চেয়ে দেখে চারিদিকে অগণন মৃতদের চোক্ষের ফস্‌ফোরেসেন্‌স্‌। তাদের সম্মুখে আলো     দীনাত্মা তারার     জ্যোৎস্নার মতন। জীবনের শুভ অর্থ ভালো ক'রে জীবনধারণ অনুভব ক'রে তবু তাহাদের কেউ-কেউ আজ রাতে যদি অই জীবনের সব নিঃশেষ সীমা সমুজ্জ্বল, স্বাভাবিক হ'য়ে যাবে মনে ভেবে- স্মরণীয় অঙ্কে কথা বলে, তাহ'লে সে কবিতা কালিমা মনে হবে আজ? আজকে সমাজ সকলের কাছ থেকে চেয়েছে কি নিরন্তর তিমিরবিদারী অনুসূর্যের কাজ। অনেক আকাশ গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে কারে ভালোবাসে! — পাখির মতন কেঁপে — ডানা মেলে — হিম চোখ বুজে অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে — নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে ঘুমাতে চেয়েছে, তবু — ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসেঁ — তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর কমে যায়; তাই নীল আকাশের স্বাদ–সচ্ছলতা– পূর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর; মানুষের অন্তরের অবসাদ — মৃত্যুর জড়তা সমুদ্র ভাঙিয়া যায় — নক্ষত্রের সাথে কয় কথা যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে — তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে — এক অধীরতা, তাই লয়ে সেই উষ্ণ আকাশের চাই যে জড়াতে গোধূলির মেঘে মেঘে, নক্ষত্রের মতো রব নক্ষত্রের সাথে!আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে — এক ক্ষমতা ওগো শক্তি, তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার বাধা পায়, জেনে লয় লক্ষত্রের মতন স্বচ্ছতা! আমারে করেছ তুমি অসহিষ্ণু — ব্যর্থ — চমৎকার! জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার, কবর খুলেছে মুখ বার বার যার ইশারায়, বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙক্ষার তার তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিড়ে শুধু যায়! একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে — বৈকালের আলোয় — সন্ধ্যায়!সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড় — তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর — অস্থিরতা! অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির — অধীর! তাহারই হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা! একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা তাহারে করেছে মুগ্ধ — অন্ধকার নক্ষত্র আবার তাহারে নিয়েছে ডেকে — জেনেছে সে এই চঞ্চলতা জীবনের; উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার এই উদ্বেলতা লয়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা, স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে ঢাকি; আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা সবাই এসেছে পথে, আসে নাই তবু সেই পাখি! — নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী, ছায়ার উপরে তার নিজের পাখায় ছায়া ফেলে সাজায়েছে স্বপ্নের পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি! সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে!কেউ তারে দেখে নাই; মানুষের পথ ছেড়ে দূরে হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা লয়ে যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষব্ধ হয়ে কথা কয়, আকাঙক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে হেমন্তের নদী, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে; দূরে প’ড়ে পৃথিবীর ধূলা — মাটি — নদী — মাঠ — ঘাস — পৃথিবীর সিন্ধু দূরে — আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ!এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা, সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ, সুন্দর! ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, আরো ভীষণতা আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের পর তুমি এসে বসিয়াছ — এই খানে অশান্ত সাগর তোমারে এনেছি ডেকে — হে ক্ষমতা, তোমার বেদনা পাহাড়ের বনে-বনে তুলিতেছে উত্তরের ঝড় আকাশের চোখে-মুখে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি — উল্লাসের মতন যন্ত্রণা!আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে তোমার প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন! সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে, আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে, সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে সব আকাঙক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে! বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে! নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে!যে মুহূর্ত চলে গেছে — জীবনের যেই দিনগুলি ফুরায়ে গিয়েছে সব, একবার আসে তারা ফিরে; তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছ তুমি ধূলি! তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে! হে ক্ষমতা, মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে! তারা সব ছলে গেছে — ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে উত্তর — হাওয়ার মতো তুমি আজও রহিয়াছ লেগে! যে সময় চলে গেছে তাও কাপে ক্ষমতার বিষ্ময়ে — আবেগে!তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন! আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে; বেদনা — উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন! — তাই কৌতুহল — তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে, জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে দেখিতে চেয়েছি আমি, নিরাশার কোলে বসে একা চেয়েছি আশারে আমি, বাঁধনের হাতে হেরে হেরে চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা! — ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!আমিপ্রণয়িনী, তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী! আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে! — প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি কেঁপে উঠে — হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে! সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে! তবুও হারায়ে গেছ, হঠাৎ কখন কাছে এসে প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ, আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে!কেন তুমি আস যাও? — হে অস্থির, হবে নাকি ধীর! কোনোদিন? — রৌদ্রের মতন তুমি সাগরের পরে একবার — দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির! — তারপর, চলে যাও কোন দূরে পশ্চিমে — উত্তরে — ইন্দ্রধনুকের মতো তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্বলে, চাঁদের আলোর মতো একবার রাত্রির সাগরে খেলা কর — জোছনা চলে যায়, তবু তুমি যাও চলে তার আগে; যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা বলে!যা পেয়েছি একবার, পাব নাকি আবার তা খুঁজে! যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে, ক্ষীণ হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা! ব্যথার বুকের’ পরে আর এক ব্যথা — বিহ্বলতা নেমে এল উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে; আলো অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছে শুধু এই ব্যথা, দুলিতেছি এই ব্যথা — উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে! সব শেষ হবে — তবু আলোড়ন, তা কি শেষ হবে!সকল যেতেছে চলে — সব যায় নিভে — মুছে — ভেসে — যে সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু বুকে জেগে রয়! যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে — রাতে — নিরুদ্দেশে, তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়! যে মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয় গোপনে চোখের’ পরে — ব্যথিতের স্বপ্নের মতন! ঘুমন্তের এই অশ্রু — কোন্‌ পীড়া — সে কোন্‌ বিস্ময় জানায়ে দিতেছে এসে! — রাত্রি — দিন আমাদের মন বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা একা ফিরিছে এমন!আমরা মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে অনেক গভীর রাতে — একবার পৃথিবীর পানে চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মতো চুপে চুপে ভেসে চলে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে কোন্‌ দিকে পথ বেয়ে! — আমাদের কেউ কি তা জানে। ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে চলে যাই; কোন্‌ — এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে? পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে আরো আকাশের দিকে — অন্ধকারে, অন্য কারো আকাশের থেকে!একদিন বুজিবে কি চারি দিকে রাত্রির গহ্বর! নিবন্ত বাতির বুকে চুপে চুপে যেমন আঁধার চলে আসে, ভালোবেসে — নুয়ে তার চোখের উপর চুমো খায়, তারপর তারে কোলে টেনে লয় তার — মাথার সকল স্বপ্ন, হৃদয়ের সকল সঞ্চার একদিন সেই শূন্য সেই শীত — নদীর উপরে ফুরাবে কি? দুলে দুলে অন্ধকারে তবুও আবার আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মতো স্বরে গান গাবে, আকাশ উঠিবে কেঁপে আবার সে সংগীতের ঝড়ে!পৃথিবীর — আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন, জেগে আছি; বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে, পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন, সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে চলিতেছে; কোন্‌ — এক দূর দেশ — কোন্‌ নিরুদ্দেশে জন্ম তার হয়েছিল — সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে; দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে কোন্‌ স্বপ্ন? — এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন্‌ আকাশেরে খুঁজে ফিরি! — গুহার হাওয়ার মতো বন্দি হয়ে মন তব ফেরে!গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মতো হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে ভেসে — সে যে কারে চায়! হিমেল হাওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত, সেও কি শাখার মতো — পাতার মতন ঝরে যায়! বনের বুকের গান তার মতো শব্দ করে গায়! হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে! অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে — স্বপনেরে বিদায় জানায় জীবন মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে; ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে — ঢেউয়ের গায়ে!হয়তো সে মিশে গেছে — তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ! কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে! শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ শুনেছে সে উষ্ণ গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে! বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে, যে ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে যে প্রেম হয়েছে ক্ষুব্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে মিলায়েছে গান তার, তারপর চলে গেছে রয়ে। সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে!তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে, সে যে তারে ডাকে! পৃথিবী চায় নি যারে, মানুষ করেছে যারে ভয় অনেক গভীর রাতে তারায় তারায় মুখ ঢাকে তবুও সে! কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময় তাহার মানুষ চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয়! মানুষীর মতো? কিংবা আকাশের তারাটির মতো — সেই দূর — প্রণয়িনী আমাদের পৃথিবীর নয়! তার দৃষ্টি — তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত — ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত!আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা — বিহ্বলতা লেগে, তাহার বুকের রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল! — মেঘের চিলের মতো — দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যাই — পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল — সকাল পৃথিবীর — যেন কোন্‌ মায়াবীর নষ্ট ইন্দ্রজাল কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে! কেঁপে কেঁপে পড়িতেছে ঝরে! আরো কাছে আসিয়াছি তবু আজ — আরো কাছে কাল আসিব তবুও আমি — দিন রাত্রি রয় পিছে পড়ে — তারপর একদিন কুয়াশার মতো সব বাধা যাবে সরে!সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বারবার! কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা, বুঝেছে তা মন — চারি দিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার! একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার বাঁধন খুলিয়া দেবে! অধীর ঢেউয়ের মতো ছুটে সেদিন সে খুঁজে লবে অই দুরে নক্ষত্রের পার! সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে! অনেক নদীর জল অনেক নদীর জল উবে গেছে — ঘরবাড়ি সাকো ভেঙে গেল; সে সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ কারা তবু কাছে চলে এল যে সুর্য অয়নে নেই কোনো দিন, — মনে তাকে দেকা যেত যদি — যে নারী দেখে নি কেউ — ছ-সাতটি তারার তিমিরে হৃদয়ে এসেছে সেই নদী। তুমি কথা বল — আমি জীবন-মৃত্যুর শব্দ শুনি: সকালে শিশির কণা যে-রকম ঘাসে অচিরে মরণশীল হয়ে তবু সূর্যে আবার মৃত্যু মুখে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে। জন্মতারকার ডাকে বার বার পৃথিবীতে ফিরে এসে আমি দেখেছি তোমার চোখে একই ছায়া পড়ে: সে কি প্রেম? অন্ধকার? — ঘাস ঘুম মৃত্যু প্রকৃতির অন্ধ চলাচলের ভিতরে। স্থির হয়ে আছে মন; মনে হয় তবু সে ধ্রুব গতির বেগে চলে, মহা-মহা রজনীর ব্রহ্মান্ডকে ধরে; সৃষ্টির গভীর গভীর হংসী প্রেম নেমেছে — এসেছে আজ রক্তের ভিতরে।‘এখানে পৃথিবী আর নেই–‘ ব’লে তারা পৃথিবরি জনকল্যাণেই বিদায় নিয়েছে হিংসা ক্লান্তির পানে; কল্যাণ, কল্যাণ; এই রাত্রির গবীরতর মানে। শান্তি এই আজ; এইখানে স্মৃতি; এখানে বিস্মৃতি তবু; প্রেম ক্রমায়াত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি। অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয় করে অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয় করে ফেলে বুঝছি সময় যদিও অনন্ত, তবু প্রেম যেন অনন্ত নিয়ে নয়।তবু তোমাকে ভালোবেসে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে বুঝেছি অকূলে জেগে রয় ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় । অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে তারা সব মৃত । ইতিহাসে তবুও তাদের কেবলি বাঁচার প্রয়োজন ব’লে তাদের উত্তর অধিকার কোনো কোনো মানবের হাতে আসে। তারা ম’রে গেছে। সবারই জীবনে আলো প্রয়োজন জেনে সকলের জন্যে স্পষ্ট পরিমিত সূর্য পেতে গিয়ে তবুও বিলোল অন্ধকারে- তারা আজ পৃথিবীর নিয়মে নীরব। এই অই বাক্তির জীবনে সুসময় শুভ অর্থ পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন র’য়ে গেছে জেনে নিয়ে তারা, তবুও, ব্যক্তির চেয়ে ঢের বেশি গহন স্বভাবে উৎসারিত জীবন-বিসারী ক্ষুব্ধ জনতাসমুদ্র দেখেছিল। সেইখানে এক দিন মানুষের কাহিনী জন্মেছে; বেড়ে গেছে; কাহিনীর মৃত্যু হয় নাই; কাহিনী ক্রমেই ইতিহাস। জীবনধারণে- জানি- তবু- জীবনকে, ভালো ক’রে অর্থময় ক’রে নিতে গিয়ে ইতিহাস কেবলি আয়ত হয়ে আলো পেতে চায়। নিজেদের আব্‌ছা ব্যক্তির মত মনে ক’রে তারা, ইতিহাস স্পষ্ট ক’রে দিতে গিয়ে তবু আজ এই শতকের শূণ্য হাতে শূন্যতার চেয়ে বেশি দান দিয়েছিল হয়ত বা। দেয় নি কি? আজ এই হেমন্তের অন্ধকার রাতে আমরা বিহ্বল ব্যক্তি,- তুমি- আমি- আরো ঢের লোক; মানুষ-সমুদ্রে ঠেকে অন্ধকার বিম্বের মতন তবুও সবার আগে নিজের আকাশ নিজের সাহস স্বপ্ন মকরকেতন আপনার মননশীলতা গণনার প্রিয় জিনিসের মত মনে ভেবে নিয়ে অন্য সকলের কথা ভুলে যাই।সকলের জীবনের শুভ উদযাপনের চেষ্টায় সূর্যের সুনাম আরো বড় ক’রে দিতে গিয়ে তারা নিজেদের বিষণ্ণ সূর্যের কথা ভুলে গিয়েছিল। মানবের কথা বিরচিত হয়ে চলে- সেই সব দূর আতুর ভঙ্গুর সুমেরীয় দিন থেকে আজ জেনিভায়,- মস্কৌ-ইংলান্ড্- আত্‌লান্তিক চার্টারে, ইউ-এন্-ওয়ের ক্লান্ত প্রৌঢ়তায়- সতর্কতায়, চীন- ভারতের- সব শীত পৃথিবীর নিরাশ্রয় মানবের আত্মার ধিক্কারে- অন্তর্দানে। হেমন্তের রাত আজ ক্ষুব্ধতায়- জনতায়- নর্দমায়-ক্লেদে লোভাতুর ক্রূর রাষ্ট্রসমাজের রতির নৈরাজ্যে অসম্ভব অন্ধ মৃত্যুতে ফুরোনো ধানের ক্ষেতে তবু মৃত পঙ্গপালদের ভিড়ে নরকের নিরাশার প্রয়োজন র’য়ে গেছে জেনে, তবু বলে : 'গভীর- গভীরতর তবুও জীবন- নিজেদের দীনাত্মা ব্যক্তির মত মনে ক’রে ওরা সকলের জন্যে সময়ের সুন্দর, সীমিত আলো সঞ্চারিত ক’রে দিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল । জীবনধারণে, তবু জীবনের আরো বর্ণনীয় ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে আরো সুস্থ- আরো প্রিয়তর ধারণায় ইতিহাস:- ইঙ্গিতের আরো স্পষ্টতায়; তবে তা' উজ্জ্বল হ’লে জীবন তবুও নিরালোক হয়ে রবে কত দিন? কত দিন হতে পারে!' অনেক রাত্রিদিন অনেক রাত্রিদিন ক্ষয় ক'রে ফেলে এখন এসেছি এক উৎসের ভিতরে; মাঠের উপরে ক্রমে ছায়া নেমে আসে, দু-চারটে উঁচু গাছ রোদে খেলা করে। পৃথিবী রক্তপাত অশান্তি এখন; অর্থময়তা তবু পেতে পারে মন।কেউ নেই - শুধু এই মননের সহায়তা আছে; যা-কিছু বুঝেছি অনেক দিন সে-সবের নীতি দু-চারটে বই ঠাণ্ডা সলতের আলো নক্ষত্র ও সূর্যে আধো উজ্জ্বল প্রকৃতি আছে তবে, পৃথিবীতে হৃদয় যা চেয়েছিলো তার শূন্যতাকে স্নিগ্ধ ক'রে রয়েছে যুক্তির অন্তঃসার।শরীর নির্বল হ'য়ে যেতেছে কেবলি; ক্রমে আরো ক্ষমাহীন কঠিন সময় মনকে নিস্তার দিলে দিতে পেরে তবু শরীরকে ক'রে যাবে ক্ষয়; ক্ষয়িত এ-শরীরের সঙ্গে মিলন ভুলে মন হতে চায় সনাতন মন। অন্ধকার গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে ।ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে- কোনদিন আর জাগবো না জেনে কোনদিন জাগবো না আমি- কোনোদিন জাগবো না আর- হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, তুমি দিনের আলো নও, উদম্য নও, স্বপ্ন নও, হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে, রয়েছে যে অগাধ ঘুম, সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই, তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও–জানো না কি চাঁদ, নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, জানো না কি নিশীথ, আমি অনেক দিন– অনেক অনেক দিন অন্ধকারের সারাতসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাত ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে বুঝতে পেরেছি আবার, ভয় পেয়েছি, পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা; দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে ; সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে। হায়, উৎসব!হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী , তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন ; আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই।যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গীত, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ, সেখানেই সূর্য , পৃথিবী, বৃহস্প্রতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি, শত শত শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর ; এইসব ভয়াবহ আরতী!গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে জাগাতে চাও কেন? অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ; তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে ।ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো- ধীরে- পউষের রাতে কোনোদিন জাগব না জেনে- কোনদিন জাগব না আমি- কোনদিন আর। অন্ধকার থেকে গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি। বীজের ভেতর থেকে কী ক’রে অরণ্য জন্ম নেয়,- জলের কণার থেকে জেগে ওঠে নভোনীল মহান সাগর, কী ক’রে এ-প্রকৃতিতে—পৃথিবীতে, আহা, ছায়াচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে মানব প্রথম এসেছিল, আমরা জেনেছি সব,—অনুভব করেছি সকলই। সূর্য জেলে,—কল্লোল সাগর জল কোথাও দিগন্তে আছে, তাই শুভ্র অপলক সব শঙ্খের মতন আমাদের শরীরের সিন্ধু-তীর।এই সব ব্যাপ্ত অনুভব থেকে মানুষের স্মরণীয় মন জেগে ব্যথা বাধা ভয় রক্তফেনশীর্ষ ঘিরে প্রাণে সঞ্চারিত ক’রে গেছে আশা আর আশা; সকল অজ্ঞান কবে জ্ঞান আলো হবে, সকল লোভের চেয়ে সৎ হবে না কি সব মানুষের তরে সব মানুষের ভালোবাসা।আমরা অনেক যুগ ইতিহাসে সচকিত চোখ মেলে থেকে দেখেছি আসন্ন সূর্য আপনাকে বলয়িত ক’রে নিতে জানে নব নব মৃত সূর্যে শীতে; দেখেছি নির্ঝর নদী বালিয়াড়ি মরুর উঠানে মরণের-ই নামরূপ অবিরল কী যে।তবু শ্মশান থেকে দেখেছি চকিত রৌদ্রে কেমন জেগেছে শালিধান; ইতিহাস-ধূলো-বিষ উৎসারিত ক’রে নব নবতর মানুষের প্রাণ প্রতিটি মৃত্যুর স্তর ভেদ ক’রে এক তিল বেশি চেতনার আভা নিয়ে তবু খাঁচার পাখির কাছে কী নীলাভ আকাশ-নির্দেশী! হয়তো এখনো তাই;—তবু রাত্রি শেষ হলে রোজ পতঙ্গ-পালক-পাতা শিশির-নিঃসৃত শুভ্র ভোরে আমরা এসেছি আজ অনেক হিংসার খেলা অবসান ক’রে; অনেক দ্বেসের ক্লান্তি মৃত্যু দেখে গেছি। আজো তবু আজো ঢের গ্লানি-কলঙ্কিত হয়ে ভাবিঃ রক্তনদীদের পারে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির শোকাবহ অঙ্ক কঙ্কালে কি মাছি তোমাদের মৌমাছির নীড় অল্পায়ু সোনালি রৌদ্রে; প্রেমের প্রেরণা নেই—শুধু নির্ঝ্রিত শ্বাস পণ্যজাত শরীরের মৃত্যু-ম্লান পণ্য ভালোবেসে; তবুও হয়তো আজ তোমার উড্ডীন নব সূর্যের উদ্দেশ্য।ইতিহাসে-সঞ্চারিত হে বিভিন্ন জাতি, মন, মানব-জীবন, এই পৃথিবীর মুখ যত বেশি চেনা যায়—চলা যায় সময়ের পথে, তত বেশি উওরণ সত্য নয়;—জানি; তবু জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলো অধিক নির্মল হলে নটীর প্রেমের চেয়ে ভালো সফল মানব প্রেমে উৎসারিত হয় যদি, তবে নব নদী নব নীড় নগরী নীলিমা সৃষ্টি হবে। আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে। অন্ধকারে জলের কোলাহল বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড় কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলা রঙের আলোয় জ্বলে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে। যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে- মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে কোথায় আছে জানি না তোঃ কোথায় সমাজ, অর্থনীতি?- স্বর্গগামী সিঁড়ি ভেঙ্গে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী হয়ে কি আজ চারি দিকে গণনাহীন ধূসর দেয়ালে ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল করে’? পুরাণপুরুষ, গনমানুষ, নারীপুরুষ,্মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব অর্থবিহীন হয়ে গেলে-তবুও আরেক নবীনতর ভোরে সার্থকতা পাওয়া যাবে, ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার অবক্ষয়ের জলে। প্রাচীন কথা নতুন করে’ এই পৃথিবীর বোন-ভায়ে ভাবছে একাএকা বসে’ যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ আমাদের এই আকাশ সাগর আধাঁর আলোয় আজ যে দৌড় কঠিন; নেই মনে হয়- সে দ্বার খুলে দিয়ে যেতে হবে আবার আলোয়, অসাড় আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে। অন্য এক প্রেমিককে মাথার উপর দিয়ে কার্তিকের মেঘ ভেসে যায়; দুই পা স্নিগ্ধ করে প্রান্তরের ঘাস; উঁচু-উঁচু গাছের অস্পষ্ট কথা কী যেন অন্তিম সূত্র নিয়ে, বাকিটুকু অবিরল গাছের বাতাস।চিলের ডানার থেকে ঠিকরিয়ে রোদ চুমোর মতন চুপে মানুষের চোখে এসে পড়ে; শত টুকরোর মতো ভেঙে সূর্য ক্রমে আরও স্থির- স্থিরতর হতে চায় নদীর ভিতরে।লাল নীল হলদে শাদা কমলা পালকের মাছরাঙা চিহ্ন হয়ে চুপে উড়ে এসে দুই অন্ধ সমুদ্রের মাঝখানে কতটুকু রৌদ্রবিন্দু আছে দেখাতে চেয়েছে ভালোবেসে।সমস্ত সন্দেহ থেকে হৃদয়কে সরিয়ে এবার শান্ত স্থির পরিষ্কার করে চেয়ে দেখি মাছরাঙা সূর্য নিভে গেছে; অন্য প্রেমিককে পাবে অন্য এক ভোরে।দেশ, ৯ পৌষ ১৩৬১ অন্য প্রেমিককে মাছরাঙা চ’লে গেছে — আজ নয় কবেকার কথা; তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল। দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ’য়ে গেছে ক্ষয়; বেদনা পেয়েছে তবু মানুষের নিজেরও হৃদয় প্রকৃতির অনির্বচনীয় সব চিহ্ন থেকে দু’ চোখ ফিরিয়ে; বুদ্ধি আর লালসার সাধনাকে সব চেয়ে বড় ভেবে নিয়ে।মাছরাঙা চ’লে গেছে — আজ নয় কবেকার কথা; তারপর বারবার ফিরে এসে ডানাপালকের উজ্জলতা ক্ষয় ক’রে তারপর হয়ে গেছে ক্ষয়। মাছরাঙা মানুষের মতো সূর্য নয়? কাজ করে কথা ব’লে চিন্তা করে চলেছে মানব; যদিও সে শ্রেষ্ঠ চিন্তা সারাদিন চিন্তানাশা সাগরের জলে ডুবে গিয়ে নিঃশব্দতা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে? অবরোধ বহুদিন আমার এ-হৃদয়কে অবরোধ ক’রে র’য়ে গেছে; হেমন্তের স্তব্ধতায় পুনরায় ক’রে অধিকার। কোথায় বিদেশে যেন এক তিল অধিক প্রবীণ এক নীলিমায় পারে তাহাকে দেখিনি আমি ভালো ক’রে,- তবু মহিলার মনন-নিবিড় প্রাণ কখন আমার চোখঠারে চোখ রেখে ব’লে গিয়েছিলোঃ ‘সময়ের গ্রন্থি সনাতন, তবু সময়ও তা বে’ধে দিতে পারে?’ বিবর্ণ জড়িত এক ঘর; কি ক’রে প্রাসাদ তাকে বলি আমি? অনেক ফাটল নোনা আরসোলা কৃকলাস দেয়ালের ‘পর ফ্রেমের ভিতরে ছবি খেয়ে ফেলে অনুরাধাপুর- ইলোরার; মাতিসের- সেজানের- পিকাসোর, অথবা কিসের ছবি? কিসের ছবির হাড়গোড়? কেবল আধেক ছায়া- ছায়ায় আশ্চর্য সব বৃত্তের পরিধির র’য়ে গেছে। কেউ দেখে- কেউ তাহা দেখে নাকো- আমি দেখি নাই। তবু তার অবলঙ কালো টেবিলের পাশে আধাআধি চাঁদনীর রাতে           মনে পড়ে আমিও বসেছি একদিন। কোথাকার মহিলা সে? কবেকার?- ভারতী নর্ডিক গ্রীক মুশ্লিন মার্কিন?           অথবা সময় তাকে সনাক্ত করে না আর;           সর্বদাই তাকে ঘিরে আধো অন্ধকার; চেয়ে থাকি,- তবুও সে পৃথিবীর ভাষা ছেড়ে পরিভাষাহীন।           মনে পড়ে সেখানে উঠোনে এক দেবদারু গাছ ছিলো। তারপর সূর্যালোকে ফিরে এসে মনে হয় এইসব দেবদারু নয়।           সেইখানে তম্বুরার শব্দ ছিলো। পৃথিবীতে দুন্দুভি বেজে ওঠে- বেজে ওঠে; সুর তান লয়           গান আছে পৃথিবীতে জানি, তবু গানের হৃদয় নেই। একদিন রাত্রি এসে সকলের ঘুমের ভিতরে আমাকে একাকী জেনে ডেকে নিলো- অন্য-এক ব্যবহারে                                       মাইলটাক দূরে পুরোপুরি। সবই আছে- খুব কাছে; গোলকধাঁধার পথে ঘুরি তবুও অনন্ত মাইল তারপর- কোথাও কিছুই নেই ব’লে। অনেক আগের কথা এই সব- এই সময় বৃত্তের মতো গোল ভেবে চুরুটের আস্ফোট জানুহীন, মলিন সমাজ সেই দিকে অগ্রসর হয় রোজ- একদিন সেই দেশ পাবে। সেই নারী নেই আর ভুলে তারা শতাব্দীর অন্ধকার ব্যসনে ফুরাবে। অবশেষে এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ। সবুজ পাতার ‘পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকালবেলাকে। আবার বিকলে হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে এই সব গাছগুলো, -যেন কোনো দূর থেকে অস্পষ্ট বাাতস বাঘের ঘ্রাণের মোত হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস; চেয়ে দেখ- ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস নড়ে উঠে ত্রস্ততায়, – আধো নীল আকাশের বুকে হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে; একজোট হেয় কাজ করে মানুষেরা যে- রকম ভোটের ব্যালটে : তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে - সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে। অবসরের গান শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয় – বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়! চারি দিকে এখন সকাল – রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল! মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ – পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল! প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর, চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়: চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ! আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার – শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস!মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়।গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা; ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব – মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে – শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয় দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ – আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত।তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে; তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার পর; মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর! তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল, চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল!০২. পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের পরে সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা; শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা!ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন! ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে – পৃথিবীর সব সিংহাসন – আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় – যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায় নি তাদের সময়; পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়! প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে! চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে কাটায় নি — কাটায় কি কাল। অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে! যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে – পাশাপাশি – জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি!অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড় আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে। মাটির নিচের থেকে তারা মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা!আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে – আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে। সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে; শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে।শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন!– জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফলে – দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে – এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে!০৩. ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে মাঠে গিয়ে আর! রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় – জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়! আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ!এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়! সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন – জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে।এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়! এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে! এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর – রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর; ভালোবাসা আসিবে না – জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর!অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে! অভিভাবিকা তবুও যখন মৃত্যু হবে উপস্থিত আর-একটি প্রভাতের হয়তো বা অন্যতর বিস্তীর্ণতায়,- মনে হবে অনেক প্রতীক্ষা মোরা ক'রে গেছি পৃথিবীতে চোয়ালের মাংস ক্রমে ক্ষীণ ক'রে কোনো এক বিশীর্ণ কাকের অক্ষি-গোলকের সাথে আঁখি-তারকার সব সমাহার এক দেখে; তবু লঘু হাস্যে- সন্তানের জন্ম দিয়ে- তারা আমাদের মতো হবে- সেই কথা জেনে- ভুলে গিয়ে- লোল হাস্যে জলের তরঙ্গ মোরা শুনে গেছি আমাদের প্রাণের ভিতর, নব শিকড়ের স্বাদ অনুভব ক'রে গেছি- ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে। অনেক গন্ধর্ব, নাগ, কুকুর, কিন্নর, পঙ্গপাল বহুবিধ জন্তুর কপাল। উন্মোচিত হ'য়ে বিরুদ্ধে দাঁড়ায়ে থাকে পথ- পথান্তরে, তবু ওই নীলিমাকে প্রিয় অভিভাবিকার মতো মনে হয়, হাতে তার তুলাদণ্ড; শান্ত- স্থির; মুখের প্রতিজ্ঞাপাশে নির্জন, নীলাভ বৃত্তি ছাড়া কিছু নেই। যেন তার কাছে জীবনের অভ্যুদয় মধ্য সমুদ্রের 'পরে অনুকূল বাতাসের প্ররোচনাময় কোনো এক ক্রীড়া- ক্রীড়া;- বেরিলমণির মতো তরঙ্গের উজ্জ্বল আঘাতে মৃত্যু। স্থির- শুভ্র- নৈসর্গিক কথা বলিবার অবসর। অশ্বত্থ বটের পথে অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী; ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে; সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে গিয়েছি অনেক দিন দেখিয়াছি ধূপ জ্বালো, ধরো সন্ধ্যাবাতি থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাতে,- এখুনি আসিবে কিনা রাতি বিনুনি বেঁধেছ তাই-কাঁচাপোকাটিপ তুমি কপালের 'পরে পড়িয়াছ-তারপর ঘুমায়েছঃ কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে পানের বাটার 'পরে; নোনার মতো নম্র শরীরটি পাতিনির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,- বউকথাকওটির ছানা নীল জামরুল নীড়ে- জ্যোৎস্নায়- ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়, আর রাত্রি মাতা-পাখাটির মতো ছড়ায়ে রয়েছে তার ডানা। আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধূলোয় কাঁটায় চ'লে গেছি বহুদূরে;-দ্যাখোনিকো, বোঝোনিকো করনিকো মানা; রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন- পানের বাটায়। অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট শেষ হয়ে গেছে আজ; — চেয়ে দেখ কতো শত শতাব্দীর বট হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে আকাঙ্খার গান গায় — অশ্বত্থেরও কি যেন কামনা জাগে মনে : সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে, চন্দ্রশেখরের মতো তার জট উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদের আজ পুনরাগমনে;মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি — রায়গুণাকর আসিবে না — দেশবন্ধু আসিয়াছে ক্ষুরধার পদ্মায় এবার, কালীগহে ক্লান্ত গাঙশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়, আসিয়াছে চন্ডীদাস — রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার; শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা : মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর। অস্তচাঁদে ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী! -অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী, নিঝ্ঝুম বিছানার পরে মেঘবৌ'র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,- চেয়ে থাকি চোখ তুলে'-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া মেঘের ঘোমটা তুলে' প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া! সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে' ফিরে' ফিরে' মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে! দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে, দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে, কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে, কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে, কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে! আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে- হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি! ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক'রেছি মোরা চুপে চুপে পান, চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান! পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা, নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা! নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ- চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু! সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!আমি ছিনু 'ক্রবেদুর' কোন্ দূর 'প্রভেন্স্'-প্রান্তরে! -দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি! আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা; মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা! -'অলিভ' পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ, মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!স্পেইনের 'সিয়েরা'য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী- নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী! কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন! অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন! তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি, নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি। চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে! ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা! -কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা, গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা! 'ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে' এমনই রূপালি রাতে কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে! অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!- মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি! তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া, তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা! তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু, জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু! মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী, বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি! আকাশলীনা সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে; ফিরে এসো সুরঞ্জনা : নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার; দূর থেকে দূরে - আরও দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।কী কথা তাহার সাথে? - তার সাথে! আকাশের আড়ালে আকাশে মৃত্তিকার মতো তুমি আজ ; তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস : বাতাসের ওপারে বাতাস - আকাশের ওপারে আকাশ। আকাশে চাঁদের আলো ১ আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ বাতাসে ঘুঘুর ডাক—অশত্থে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—নরম ঘুঘুর ডাক আজ তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ২ কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ৩ আর তো ক্লান্তি নাই—নাইকো চেষতা আজ—নাইকো রক্ত ব্যথা—বিমূঢ় ভিড়ের থেকে নিয়েছি জীবন ভরে ছুটি হেঁটেছি অনেক পথ—আমার ফুরালো পথ—এখানে সকল পথ তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজকাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে; আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে; পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসেপৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান, কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ; আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের। আছে এখন চৈত্রের দিন নিভে আসে- আরো নিভে আসে; এখানে মাঠের 'পরে শুয়ে আছি ঘাসে; এসে শেষ হ’য়ে যায় মানুষের ইচ্ছা কাজ পৃথিবীর পথে, দু-চারটে- বড়ো জোর একশো শরতে;উর ময় চীন ভারতের গল্প বহিঃপৃথিবীর শর্তে হ’য়ে গেছে শেষ; জীবনের রূপ আর রক্তের নির্দেশ পৃথিবীর কাম আর বিচ্ছেদের ভূমা- মনে হয়- এক তিলের সমান; কিন্তু এই চেয়ে থাকা, স্থিতি, রাত্রি, শান্তি- অফুরান।চারিদিকে বড়ো-বড়ো আকাশ ও গাছের শরীরে সময় এসেছে তার নীড়ে। ভালো লাগে পৃথিবীর রূঢ় নষ্ট সত্যতার দিনের ব্যত্যয়; অন্ধকার সনাতনে মিশে যাওয়া- কিন্তু মরণের ঘুম নয়;জেগে থাকা : নক্ষত্রের বাগীশ্বরী দ্যোতনার থেকে কিছু দূরে ; পৃথিবীর অবলুপ্ত জ্ঞানী বন্ধুরে এই স্তব্ধ মাটিতেই মিশে যেতে হ’লো জেনে তবু চোখ রেখে নীলাকাশে শুয়ে থাকা পৃথিবীর মাধুরীর অন্ধকার ঘাসে। আজ অন্ধ সাগরের বেগে উৎসারিত রাত্রির মতন আলোড়ন মানুষের প্রিয়তর দিক নির্ণয়ের পথ আজ প্রতিহত; তবুও কোথাও নির্মল সন্ততি দেশ সময়ের নব নব তীর-           পেতে পায়ে হয়তো বা মানব হৃদয়;মহাপতনের দিনে আজ অবহিত হয়ে নিতে হয়। যদিও অধীর লক্ষ্যে অন্ধকারে মানুষ চলেছে ধ্বংস আশা বেদনায়বন্য মরালের মত চেতনায় নীল কুয়াশায়,- কুহেলি সরিয়ে তবু মানুষের কাহিনীর পথে ভাস্বরতা এসে পড়ে মাঝে মাঝে-           স্বচ্ছ ক্রান্তিবলয়ের মতন জগতে।মনে হয় মহানিশীথের স্তন্যপায়ী মানুষ তবুও শিশুসূর্যের সন্তান, স্থিরতর বিষয়ী সে,-           যদিও হৃদয়ে রক্তে আজো ভুল অকূলের গান। আজ তারা কই সব আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক — পুকুরের জলে বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, — চলে গেল কবে যে নীরবে, তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে তারে আর দেখি নাকো — কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে, জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে খেলা করে গেছে তারা কত দিন — ফড়িঙ কীটের দিন যত দিন চলেতাহারা নিকটে ছিলো — রোদের আনন্দে মেতে — অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে বহুদিন কাছে ছিলো; — অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ — মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে; কোথায় গিয়েছে তারা? ওই দূর আকাশেল নীল লাল তারার ভিতরে অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু — ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে? শুধালাম — উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে। আজকে রাতে আজকে রাতে তোমায় কাছে আমার কাছে পেলে কথা বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর। কিন্তু যেই নীট নিয়মে ভাবনা আবেগ ভাব বিশুদ্ধ হয় বিষয় ও তার যুক্তির ভিতর; আমিও সেই ফলাফলের ভিতরে থেকে গিয়ে দেখেছি ভারত লন্ডন রোম নিউইয়র্ক চীন আজকে রাতের ইতিহাস ও মৃত ম্যামথ সব নিবিড় নিয়মাধীন। কোথায় তুমি রয়েছ কোন পাশার দান হাতে; কী কাজ খুঁজে; সকল অনুশীলন ভালো নয়; গভীরভাবে জেনেছি যে-সব সকাল বিকাল নদী নক্ষত্রকে তারই ভিতর প্রবীণ গল্প নিহিত হয়ে রয়। আজকের এক মুহূর্ত হে মৃত্যু, তুমি আমাকে ছেড়ে চলেছো ব’লে আমি খুব গভীর খুশি?                              কিন্তু আরো-খানিকটা চেয়েছিলাম; চারিদিকে তুমি হাড়ের পাহাড় বানিয়ে রেখেছো;- যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমি অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবো এইখানে মৃতবৎসা, মাতাল, ভিখারি ও কুকুরদের ভিড়ে কোথায় তাকে রেখে দিলে তুমি? এতদিন ব’সে পুরোনো বীজগণিতের শেষ পাতা শেষ করতে-না-করতেই সমস্ত মিথ্যা প্রমাণিত হ’য়ে গেলো; কোন-এক গভীর নতুন বীজগণিত যেন পরিহাসের চোখ নিয়ে অপেক্ষা করছে;- আবার মিথ্যা প্রমাণিত হবে ব’লে? সে-ই শেষ সত্য ব’লে? জীবনঃ ভারতের, চীনের, আফ্রিকার নদীপাহাড়ে বিচরণের                                                           মূঢ় আনন্দ নয় আর বরং নির্ভীক বীরদের রচিত পৃথিবীর ছিদ্রে-ছিদ্রে ইস্ক্রপের মতো আটকে থাকবার শৌর্য ও আমোদঃ তারপর চুম্বক পাহাড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হবার মতো আস্বাদ? জীবনঃ নির্ভীক নাদীদের সৌন্দর্যের আঘাতে নিগ্রো সঙ্গীতের বেদনার ধূলোরাশি? কিন্তু এ-বেদনা আত্মিক, তার ঝাপ্সা;- একাকীঃ তাই কিছু নয়ঃ- কিন্তু তিলে-তিলে আঁটকে থাকবার বেদনাঃ পৃথিবীর সমস্ত কুকুর ফুটপাতে বোধ করছে আজ। যেন এত দিনের বীজগণিত কিছু নয়, যেন নতুন বীজগণিত নিয়ে এসেছে আকাশ! বাংলার পাড়াগাঁয়ে শীতের জ্যোৎস্না আমি কত বার দেখলাম কত বালিকাকে নিয়ে গেলো বাঘ- জঙ্গলের অন্ধকারে; কতবার হটেনটট-জুলু দম্পতির প্রেমের কথাবার্তার ভিতর আফ্রিকার সিংহকে লাফিয়ে পড়তে দেখলাম; কিন্তু সেই সব মূঢ়তার দিন নেই আর সিংহদের; নীলিমার থেকে সমুদ্রের থেকে উঠে এসে পরিস্ফুট রোদের ভিতর উজ্জ্বল দেহ অদৃশ্য রাখে তারা; শাদা, হলদে, লাল কালো মানুষদের আর-কোনো শেষ বক্তব্য আছে কি না জিজ্ঞাসা করে। যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমরা অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবে সেই সব শাদা-শাদা ঘোড়ার ভিড় যেন কোন জ্যোৎস্নার নদীতে ঘিরে নিস্তব্ধ হ’য়ে অপেক্ষা করছে কোথাও; আমার হৃদয়ের ভিতর সেই সুপক্ক রাত্রির গন্ধ পাই আমি।কাব্যগ্রন্থ - মহাপৃথিবী আট বছর আগের এক দিন শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে; কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আধাঁরেযখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-তবে সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার; কোনোদিন জাগিবেনা আর।কোনোদিন জাগিবেনা আর। জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম - অবিরাম ভার সহিবেনা আর - এই কথা বলেছিলো তারে চাঁদডুবে চ’লে গেলে - অদ্ভুদ আঁধারে যেন তার জানালার ধারে উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।তবুও তো পেঁচা জাগে; গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা মশা তার অন্ধকার সংগ্রামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসেরক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি; সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি। ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বির্কীন জীবন অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন; চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা, যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা এই জেনে।অশ্বথের শাখা করেনি কি প্রতিবাদ ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে করেনি কি মাখামাখি? থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে বলেনি কি; ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে চমৎকার ! ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’ জানায়নি পেঁচা এসে এ-তুমুল গাড় সমাচার ?জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের- তোমার অসহ্য বোধ হ’লো; মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো মর্গে - গুমোটে- থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে। শোনো তবু এ মৃতের গল্প; কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই; বিবাহিত জীবনের সাধ কোথাও রাখেনি কোন খাদ, সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু মধু-আর মননের মধু দিয়েছে জানিতে; হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই; তাই লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।জানি - তবু জানি নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি; অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় - আর এক বিপন্ন বিষ্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত - ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই; তাই লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা, থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে, চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’ চমৎকার ! ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-হে প্রগাঢ় পিতামহী,আজো চমৎকার ? আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দিবো কালীদহে বেনোজলে পার; আমরা দুজনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার। আদিম প্রথম মানুষ কবে এসেছিল এই সবুজ মাঠের ফসলের উৎসবে! দেহ তাহাদের এই শস্যের মতো উঠেছিল। ফলে, এই পৃথিবীর ক্ষেতের কিনারে, সবজির কোলে কোলে এসেছিল তারা ভোরের বেলায় রৌদ্র পোহাবে ব’লে— এসেছিল তারা পথ ধরে এই জলের গানের রবে! এই পৃথিবীর ভাষা ভালোবেসেছিল, ভালো লেগেছিল এ মাটির ভালোবাসা! ভালো লেগেছিল এ বুকের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ! এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ ভালো লেগেছিল—বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ! প্রথম মানুষ—চোখে তাহাদের প্রথম ভোরের আশা! এসেছিল সন্তান— দেহে তাঁহাদের নীল সাগরের ঢেউয়ের ফেনার ঘ্রাণ! শঙ্খের মতো কানে তাহাদের সিন্ধু উঠিত গেয়ে। শস্যের মতো তারা ওই নীল আকাশের পানে চেয়ে গেয়ে গেছে গান! ধানের গন্ধে পৃথিবীর ক্ষেত ছেয়ে আলোয় ছায়ায় ফসলের মতো করিয়া গিয়াছে স্নান! সে কোন প্রথম ভোরে প্রথম মানুষ আসিল প্রথম মানুষীর হাত ধরে! ভালো লেগেছিল এ দেহের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ! এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ ভালো লেগেছিল–বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ! নীল আকাশের প্রথম রৌদ্র ক্ষেতে পড়েছিল ঝরে! আদিম দেবতারা আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে তোমাকে দিলো রূপ- কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিলো তারা; তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিলো মাছির মতো কামনা৷আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে আমাকে দিলো লিপি রচনা করবার আবেগঃ যেন আমিও আগুন বাতাস জল যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়, নিশীথ-দেবদারু-দ্বীপ; কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপস্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে তবু তুমি মাটির পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছো; আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়ার ভিতর।আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ। অবাক হয়ে ভাবি আজ রাতে কোথায় তুমি? রূপ কেন নির্জন দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না- পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ? স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে- ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –হয়ে ব্যবহৃত –ব্যবহৃত – আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো_ হো ক’রে হেসে উঠলোঃ ‘ব্যবহৃত – ব্যবহৃত হ’য়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়?’হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!- চারিদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হ’য়ে উঠলো যেন; পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতহেদের দূর্গন্ধের মতো, যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় – উল্কায় কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক! আবহমান পৃথিবী এখন এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম। সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে; যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে; যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় ক্ষেতের গোধূম চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুমগাঢ় করে দিয়ে যায়।-এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের। সমূদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ নদীর তরঙ্গে – ক্রমে তুষারের স্তুপে তার ঢেউ একবার টের পাবে, দ্বিতীয়বারের সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে ঢের।এইখানে সময়কে যতদুর দেখা যায় চোখে নির্জন ক্ষেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভুত চাষা; এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে; অঘ্রানের বিকেলের কমলা আলোকে নিড়োনো ক্ষেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে; একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে। পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে নষ্ট হয়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে; সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হয়ে আসে। মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হল মানুষের বৃত্তি আদায়। যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায় আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন। অভিভূত হয়ে আছে — চেয়ে দ্যাখো — বেদনার নিজের নিয়ম। নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়; জলপাই অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা; ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়; প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়। পৃথিবীর রাজপথে-রক্তপথে-অন্ধকার অববাহিকায় এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়। তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মুক অপেক্ষায়; তাহার মাথার ‘পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়; এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হয়ে থেকে ক্রমে একদিন কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?চেয়েছে মাটির দিকে — ভুগর্ভে তেলের দিকে সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা, মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার; দুরবীণে কিমাকার সিংহের সাড়া পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে। বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তারা। যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে, মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে; চিরদিন এইসব হ্নদয় ও রুধিরের ধারা। মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে; অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।মোমের আলোয় আজ গ্রস্থের কাছে ব’সে – অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে আমরা যতটা দূর চ’লে যাই -চেয়ে দেখি আরো কিছু আছে তারপরে। অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে ছায়া ফ্যালে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে, কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে, অথবা যে সব থাম সমীচীন মিস্তিরির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে, তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ। হয়তো অনেক এগিয়ে তারা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোলতার নেই অবলেশ।তাই তারা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরও জীবনের লিপ্ত অভিধানে বর্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে। সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয় — এই জ্ঞানে লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে নিজের বীজের তরে জোর করে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে। অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।একটি আলোক নিয়ে বসে থাকা চিরদিন; নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে; সে সবের দিন শেষ হয়ে গেছে এখন সৃষ্টির মনে — অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে। সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে। একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে — বালুচরে, সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে। আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি — বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে। যদি কেউ বলে এসে : ‘এই সেই নারী, একে তুমি চেয়েছিলে এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ– তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কব্ে‌ ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর, যদিও অনেক মৃত্যুপরস্পরা ছিলো ইতিহাসে; বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অবলঙ ছবি; নানারুপ ক্ষতি ক্ষয় নানা দিকে মরে গেছি — মনে পড়ে বটে এইসব ছবি দেখি; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থাণু। এক দরজায় ঢুকে বহিস্কৃত হয়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে অমেয় আলোয় হেঁটে তারা সব। (আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্‌ বাতাসের শব্দ শুনেছিল; তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?) আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি কাচের গেলাসে জলে উজ্জুল শফরী; সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো; তারপর অন্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে। সৃষ্টির নাড়ীর ‘পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায় অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ; তবু তারা করে নাকো পরস্পরের ঋণশোধ। আবার আসিব ফিরে আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়;হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে; রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়; - রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে - আমাকে একটি কথা দাও আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো সহজ মহৎ বিশাল, গভীর; – সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন, আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর। সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো: সেই দিনের – আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন সেই উজ্জ্বল পাখিনীর – পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন। আমাকে তুমি আমাকে তুমি দেখিয়েছিলে একদিন; মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল; দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়; জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে: পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়। তারপর দূরে অনেক দূরে খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান গায় — গান গায় এই দুপুরের বাতাস।এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপুর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন। বিকেলে নরম মুহুর্ত; নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা যাওয়া; একটা ধবর চিতল-হরিণীর ছায়া আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মুর্তির মতো নদীর জলে সমস্ত বিকেলবেলা ধরে স্থির!মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ আগুণের — ঘিয়ের ঘ্রাণ; বিকেলে অসম্ভব বিষন্নতা। ঝাউ হরিতকী শাল, নিভস্ত সূর্যে পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু– বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জোছনায়–ছায়ায়, রাত্রি; নক্ষত্র ও নক্ষত্রের অতীত নিস্তব্ধতা!মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো। আমাদের রূঢ় কথা শুনে আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ; তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে ডুবে যাবে? কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না সরে পিরামিড্‌ বেবিলন শেষ হল — ঝরে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস; তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা কোনোদিন হল না প্রকাশ: যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে, কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে নতুন স্পন্দন পায় নতুন আগ্রহে গন্ধে ভরে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস;তখন আমরা ওই নক্ষত্রের দিকে চাই — মনে হয় সব অস্পষ্টতা ধীরে ধীরে ঝরিতেছে, — যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে, যেই শানি — মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে — কয় নাকো কথা, যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে, আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ — অন্ধ মৃত হিম, একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম। আমার এ ছোটো মেয়ে আমার এ ছোটো মেয়ে — সব শেষ মেয়ে এই শুয়ে আছে বিছানার পাশে – শুয়ে থাকে —উঠে বসে —পাখির মতন কথা কয় হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে মাঠে মাঠে আকাশে আকাশেভুলে যাই ওর কথা — আমার প্রথম মেয়ে সেই মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন বলে এসে: ‘বাবা, তুমি ভালো আছ? ভালো আছ? — ভালোবাসো? হাতখানা ধরি তার:ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি — আজও মনে কর?’ দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই আমার চোখের ’পরে, আমার মুখের ’পরে মৃত মেয়ে; আমিও তাহার মুখে দু’হাত বুলাই; তবু তার মুখ নাই — চোখ চুল নাই।তবু তারে চাই আমি — তারে শুধু — পৃথিবীতে আর কিছু নয় রক্ত মাংস চোখ চুল — আমার সে মেয়ে আমার প্রথম মেয়ে — সেই পাখি — শাদা পাখি — তারে আমি চাই; সে যেন বুঝিল সব — নতুন জীবন তাই পেয়ে হঠাৎ দাঁড়াল কাছে সেই মৃত মেয়ে।বলিল সে: ‘আমারে চেয়েছ, তাই ছোটো বোনটিরে – তোমার সে ছোটো-ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নিচে রেখে সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এত দিন ঘুমাতেছিলাম আমি’ — ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে, বলিলাম: ‘আবার ঘুমাও গিয়ে — ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।’ব্যথা পেল সেই প্রাণ — খানিক দাঁড়াল চুপে — তারপর ধোঁয়া সব তার ধোঁয়া হয়ে খসে গেল ধীরে ধীরে তাই, শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক — চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে — আর কেউ নাই। আমি কবি-সেই কবি আমি কবি-সেই কবি- আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি! আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে! মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে! বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে! দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!স্বপন-সুরার ঘোরে আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক'রে! জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা- পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা! -নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ'রে!ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি! ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে! -ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,- বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!বিজন তারার সাঁঝে আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে! প'ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়! হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়! কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে! আমি যদি হতাম আমি যদি হতাম বনহংস; বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভিতর এক নিরালা নীড়ে;তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম- তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন- নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা, শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ। হয়তো গুলির শব্দঃ আমাদের তির্যক গতিস্রোত, আমাদের পাখায় পিস্‌টনের উল্লাস, আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ আমাদের স্তব্ধতা, আমাদের শান্তি। আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না: থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার; আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে। আমি হাত প্রসারিত করে দেই আমি হাত প্রসারিত ক'রে দেই বায়ুর ভিতরে, অনেক জীবাণূ এসে রোমকূপে জমে- এই এক আলোড়ন রয়ে গেছে পৃথিবীতে। মানুষের অন্তরেও এ- রকম; কোনো এক রমনীকে দেখে প্রীতি, কোনো জননায়কের অবয়ব দেখে বিস্ময়, কোনো বিষয়ীর জানুর উপরে হাত রেখে দিয়ে আশা।এইসব অনুভব তবু আজ কীলক লিপির পরে ভোরের আলোয়       অতীত রাত্রির পরিভাষা। কেন না মানুষ- বায়ু, রোমকূপ, জীবাণুর মতো নয়!        ইহাদের সরলতা শিশুর মতন        মানুষ অনেকদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকে             ক্রমশই হ'য়ে যায় বিশদ অতল;এইসব ইতিহাস পরম্পরা বুঝে আমার হৃদয় থেকে বিচুর্ণ কাচের খণ্ড খুঁজে বুঝে গেঝি মরণ কি। অথবা জীবন কেন অধিক বিশদ নিয়ন্ত্রণ।সকল রঙের শিখা একসাথে মিলে গিয়ে হ'য়ে যায় শাদা। একটি জমাট ঢিলে বহুতর বিরোধের বাধা অনেক আবহ তার বুকের ভিতরে ধ'রে রেখে         মানুষ ও বহ্মাণ্ডের পরমায়ু নিম্রীল বাতাসে লাঙ্গুল ঘুরায়ে অগ্নির অক্ষরে ফেলে এঁকে।#অগ্রন্থিত কাব্যসমগ্র আলেয়া প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া! -হেথা, গৃহবাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা, ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি! আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার সাগরে! ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের পরে নিশি নেমে আসে গাঢ়-স্বপনঙ্কুল! শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল বনমালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে! বেণুবনশাখে কোন্‌ পেচকের রবে চমকিছে নিরালা যামিনী! পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগকামিনী আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়! শ্মশানশয্যায় নেভ-নেভ কোন্‌ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে! নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে স্বপ্নের বুদ্‌বুদে বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল- হে অনল-উন্মুখ, চঞ্চল উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি সন্তরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি কোন্‌ দূর কামনার পানে! ঝলমল দিবা অবসান বধির আঁধারে কান্তারের দ্বারে একি তব মৌন নিবেদন! -দিগভ্রান্ত-দরদী-উন্মন! পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠে নি তো জ্বলে আকাঙ্কার উলঙ্গ উল্লাসে! জনতায়-নগরীর তোরণের পাশে, অন্তঃপুরিকার বুকে, মণিসৌধসোপানের তীরে, মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়স্কান- খনির তিমিরে যাও নি তো কভু তুমি পাথেয় সন্ধানে! ভাঙা হাটে-ভিজা মাঠে-মরণের পানে শীত প্রেতপুরে একা একা মরিতেছ ঘুরে না জানি কী পিপাসার ক্ষোভে! আমাদের ব্যর্থতায়, আমাদের সকাতর কামনায় লোভে মাগিতে আস নি তুমি নিমেষের ঠাঁই! -অন্ধকার জলাভুমি কঙ্কালের ছাই, পল্লীকান্তারের ছায়া-তেপান্তর পথের বিস্ময় নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময় করিয়াছে বিমনা তোমারে! রাত্রি-পারাবারে ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি! হেমন্তের হিম পথ ধরি, পউষ, আকাশতলে দহি দহি দহি ছুটিতেছ বিহ্বল বিরহী কত শত যুগজন্ম বহি! কারে কবে বেসেছিলে ভালো হে ফকির, আলেয়ার আলো! কোন্‌ দূরে অস-মিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া! সে কোন্‌ রাত্রির হিমে হয়ে গেছে হারা! নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু, আঁধার সাহারা! আজও তব লোহিত কপোলে চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতেছে জ্ব’লে অনল-ব্যথায়! চ’লে যায়-মিলনের লগ্ন চ’লে যায়! দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি! ছলাময় আকাশের নিচে লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার অগ্নি অভিসার! বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি, অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি, উষার বাতাস ভুলি, পলাতকা রাত্রির পিছনে যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে। আলোক পত্র হে নদী আকাশ মেঘ পাহাড় বনানী, সৃজনের অন্ধকার অনির্দেশ উৎসের মতন আজ এই পৃথিবীতে মানুষের মন মনে হয়; অধঃপতিত এক প্রাণী। প্রেম তার সব চেয়ে ছায়া, নিরাধার নিঃস্বতায়- অকৃত্রিম আগুনের মত নিজেকে না চিনে আজ রক্তে পরিণত হে আগুন, কবে পাব জ্যোতিঃদীপাধার। মানুষের জ্ঞানালোক সীমাহীন শক্তি পরিধির ভিতরে নিঃসীম; ক্ষমতার লালসায় অহেতুক বস্তুপুঞ্জে হুম; সূর্য নয়- তারা নয়- ধোঁইয়ার শরীর।এ অঙ্গার অগ্নি হোক, এই অগ্নি ধ্যানালোক হোক; জ্ঞান হোক প্রেম,- প্রেম শোকাবহ জ্ঞান হৃদয়ে ধারণ ক’রে সমাজের প্রাণ অধিক উজ্জ্বল অর্থে করে নিক অশোক আলোক।কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী আলোপৃথিবী ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছি পৃথিবীভরা আলো তবুও গভীর গ্লানি ছিল কুরুবর্ষে রোমে ট্রয়ে; উত্তরাধিকার ইতিহাসের হৃদয়ে বেশি পাপ ক্রমেই ঘনালো।সে গরল মানুষ ও মনীষীরা এসে হয়তো বা একদিন ক’রে দেবে ক্ষয়; আজ তবু কন্ঠে বিষ রেখে মানবতার হৃদয় স্পষ্ট হতে পারে পরস্পরকে ভালবেসে।কোথাও রয়েছে যেন অবিনশ্বর আলোড়নঃ কোনো এক অন্য পথে- কোন্‌ পথে নেই পরিচয়; এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়; সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।আমাদের পৃথিবীর বনঝিরি জলঝিরি নদী হিজল বাতাবী নিম বাবলার সেখানেও খেলা করেছে সমস্ত দিন; হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা ফেনিল বুদ্ধির দৌড়;- আজকের মানবের নিঃসঙ্গতা যদিসেসব শ্যামল নীল বিস্তারিত পথে হ’তে চায় অন্য কোনো আলো কোনো মর্মের সন্ধানী, মানুষের মন থেকে কাটবে না তা হ’লে যদিও সব গ্লানি তবু আলো ঝল্কাবে অন্য এক সূর্যের শপথে।আমাদের পৃথিবীর পাখালী ও নীলডানা নদী আমলকী জামরুল বাঁশ ঝাউয়ে সেখানেও খেলা করেছে সমস্ত দিন;- হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি;- শতকের ম্লান চিহ্ন ছেড়ে দিয়ে যদিনরনারী নেমে পড়ে প্রকৃত ও হৃদয়ের মর্মরিত হরিতের পথে- অশ্রু রক্ত নিস্ফলতা মরণের খণ্ড খণ্ড গ্লানি তাহ’লে রবে;- তবু আদি ব্যথা হবে কল্যাণী জীবনের নব নব জলধারা- উজ্জ্বল জগতে। আশা অনুমিতি সূর্যের আকাশের মত মানুষেরা অনুভাবনায় স্থির এক আশ্বাস রয়ে গেছে পৃথিবীতে, রয়ে গেছে আমাদের হৃদয়ে যে এই ইতিহাস পৃথিবীর রক্তাক্ত নদীর কেবলি আয়ত উৎসারণ অন্ধকারে নিজেরে প্রচুর ক’রে তবু স্তিমিত হয়ে পড়ে; মতুন নির্মল জলকণিকারা আসে নক্ষত্রের সূর্যের নীলিমার মানব হৃদয়ের আশ্চর্য রেবার হিল্লীলের মত। সময় যা আচ্ছন্ন করেছিল তাকে সময় সংক্রান্তির পারে মৃত্যু বা নিশ্চিহ্ন করেছিল তাকে উজ্জ্বল বস্তুপুঞ্জে জাগিয়ে তুল্বার জন্যে দেখ সচেতন হয়ে জেগে উঠে মানবঃ চারিদিকে উন্মুক্ত সূর্যের অন্তরালে সূর্যের আলোর নক্ষত্রেরা রাত্রির নগরীর জ্ঞানের অন্তহীন পরিচ্ছন্ন পবিত্রের ভিতর। আশা ভরসা ইতিহাসপথ বেয়ে অবশেষে এই শতাব্দীতে মানুষের কাজ আশায় আলোয় শুরু হয়েছিল বুঝি- শুভ্র কথা বলা হতেছিল;- রৌদ্রে জলে ভালোলেগেছিল শরীরকে- জীবনকে।কিন্তু তবু সবি প্রিয় মানুষের হাতে অপ্রিয় প্রহার হয়ে মূল্যহীন মানুষের গায়ে আশ্চর্য মৃত্যুর মত মূল্য হয়- হিম হয়।মানুষের সভ্যতার বয়ঃসন্ধি দোষ হয়তো কাটেনি আজো, তাই এরকমই হতে হবে আরো রাত্রি দিন;- নক্ষত্র সূর্যের সাথে সঞ্চালিত হয়ে তবু আলোকের পথে মৃত ম্যামথের কাছে কুহেলিত ঋণ শেষ ক'রে মানুষ সফল হতে পারে উৎসাহ সংকল্প প্রেমে মূল্যের অক্ষুন্ন সংস্কারে; আশা করা যাক।সুধীরাও সেই কথা ভাবে, আপ্রাণ নির্দেশ দান করে। ইতিহাসে ঘুরপথ ভুল পথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয় আরো ঢের আছে, তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়। ইতিবৃত্ত একদিন কোন এক আঞ্জির গাছের ডালে সকালের রোদের ভিতর সোনালি সবুজ এক ডোরাকাটা রাক্ষুসে মাকড়কে আমি একটি মিহিনসুতো নিয়ে দুলে নির্জন বাতাসে দেখেছি স্বর্গের থেকে পৃথিবীর দিকে এল নেমে, পৃথিবীর থেকে ক্রমে চলে গেল নরকের পানে; হয়তো সে ঊর্ণনাভ নয়। অগস্ত্যের মতো নানা আয়ুর সন্ধানে চোখে তার লেগে ছিল ব্রহ্মার বিস্ময়।ঢের আগেকার কথা এই সব- তখন বালক আমি পৃথিবীর কোণে। অশ্বত্থের ত্রিকোণ পাতায় যেন মনে হত বালিকার মুখ মিষ্টি হয়ে নেমে আসে হৃদয়ের দিকে, নদীর ভিতরে জলে যেন তার করুণ চিবুক স্থিরতর কথা ভাবে- সমস্ত নদীর ঘ্রাণ আরো অধিক উদ্ভিদ মাটি মাংস- ধূসর হয়ে থাকে; যেন আমি জলের শিকড় ছিঁড়ে একদিন হয়েছি মানুষ, কাতর আমোদ সব ফিরে চায় আবার আমাকে।পৃথিবীর ঘরে তবু ফিরে গিয়ে- অভিভাবনায় সেগুন কাঠের শক্ত টেবিলের ‘পরে নীরবে জ্বেলেছি আলো ছিপছিপে ধূর্ত মোমের তবুও যখন চোখ নেমে এল বইয়ের ভিতরেএক- আধ- দুই ইঞ্চি ঘুমের ভিতরে ডুবে গেল, কঠিন দানব এক দাঁড়াল মুখের কাছে এসে- যেন আমি অপরাধে বিবর্ণ বালক উলঙ্গ পরীর চুল-কিংবা তার ঘোটকীর লেজ ভালোবেসে। তবুও আকাশ থেকে পুনরায়- ধীরে জলপাই ধূম্র এক ভোরবেলা উদ্গীরিত হলে সকলের আগে ক্ষুদ্র জাগরূক বর্তুল দোয়েল তখনো বাতাস পেয়ে জাগে নাই ব’লে নদীর কিনার দিয়ে শঙ্খচূড় সাপের মতন আমার এ শরীরের ছায়াকে বাঁকিয়ে নিতে গিয়ে সহসা দেখেছি তুমি কর্কচের মতন আলোকে শ্বেতকায়া সাপিনীর মতন দাঁড়িয়ে। ইতিহাসযান সেই শৈশবের থেকে এ-সব আকাশ মাঠ রৌদ্র দেখেছি; এই সব নক্ষত্র দেখেছি। বিস্ময়র চোখে চেয়ে কতবার দেখা গেছে মানুষের বাড়ি রোদের ভিতরে যেন সমুদ্রের পারে পাখিদের বিষণ্ণ শক্তির মতো আয়োজনে নির্মিত হতেছে; কোলাহলে-কেমন নিশীথ উৎসবে গ’ড়ে ওঠে। একদিন শূন্যতায় স্তব্ধতায় ফিরে দেখি তারা কেউ আর নেই। পিতৃপুরুষেরা সব নিজ স্বার্থ ছেড়ে দিয়ে অতীতের দিকে স’রে যায়- পুরানো গাছের সাথে সহমর্মী জিনিসের মতো হেমন্তের রৌদ্রে-দিনে-অন্ধকারে শেষবার দাঁড়ায়ে তবুও কখনো শীতের রাতে যখন বেড়েছে খুব শীত দেখেছি পিপুল গাছ আর পিতাদের ঢেউ আর সব জিনিষ : অতীত।তারপর ঢের দিন চ’লে গেলে আবার জীবনোৎসব যৌনমত্তার চেয়ে ঢের মহীয়ান, অনেক করুণ। তবুও আবার মৃত্যু।-তারপর একদিন মউমাছিদের অনুরণনের বলে রৌদ্র বিচ্ছুরিত হ’ইয়ে গেলে নীল আকাশ নিজের কন্ঠে কেমন নিঃসৃত হয়ে ওঠে;- হেমন্তের অপরাহ্নে পৃথিবী মাঠের দিকে সহসা তাকালে কোথাও শনের বনে- হলুদ রঙের খড়ে- চাষার আঙুলে গালে-কেমন নিমীল সনা পশ্চিমের অদৃশ্য সূর্যের থেকে চুপে নামে আসে; প্রকৃতি ও পাখির শরীর ছুঁয়ে মৃতোপম মানুষের হাড়ে কি যেন কিসের সৌরব্যবহারে এসে লেগে থাকে। অথবা কখনো সূর্য- মনে পড়ে- অবহিত হয়ে নীলিমার মাঝপথে এসে থেমে র’য়ে গেছে- বড়ো গোল-রাহুর আভাস বেই-এমনই পবিত্র নিরুদ্বেল। এই সব বিকেলের হেমন্তের সূর্যছবি- তবু দেখাবার মতো আজ কোনো দিকে কেউ নেই আর, অনেকেই মাটির শয়ানে ফুরাতেছে। মানুষেরা এই সব পথে এসে চ’লে গেছে,- ফিরে ফিরে আসে;- তাদের পায়ের রেখায় পথ কাটে কারা, হাল ধরে, বীজ বোনে, ধান সমুজ্বল কী অভিনিবেশে সোনা হয়ে ওঠে- দেখে; সমস্ত দিনের আঁচ শেষ হলে সমস্ত রাতের অগণন নক্ষত্রেও ঘুমাবার জুড়োবার মতো কিছু নেই;- হাতুড়ি করাত দাঁত নেহাই তুর্‌পুন্ পিতাদের হাত থেকে ফিরেফির্‌তির মতো অন্তহীন সন্ততির সন্ততির হাতে কাজ ক’রে চ’লে গেছে কতো দিন। অথবা এদের চেয়ে আরেক রকম ছিলো কেউ-কেউ; ছোটা বা মাঝারি মধ্যবিত্তদের ভিড়;- সেইখানে বই পড়া হত কিছু- লেখা হত; ভয়াবহ অন্ধকারে সরুসলতের রেড়ীর আলোয় মতো কী যেন কেমন এক আশাবাদ ছিল তাহাদের চোখে মুখে মনের নিবেশে বিমনস্কতায়; সাংসারে সমাজে দেশে প্রত্যন্তও পরাজিত হলে ইহাদের মনে হত দীনতা জয়ের চেয়ে বড়; অথবা বিজয় পরাজয় সব কোনো- এক পলিত চাঁদের এ-পিঠ ও-পিঠ শুধু;- সাধনা মৃত্যুর পরে লোকসফলতা দিয়ে দেবে; পৃথিবীতে হেরে গেলে কোনো ক্ষোভ নেই।* * *মাঝে-মাঝে প্রান্ত্রের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত- কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাঁকালে কেমন নিবিড়ভাবে হয়ে ওঠে, আহা। সেখানে স্থবির যুবা কোনো- এক তন্বী তরুণীর নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙ্গা চাঁদে অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারেঃ অনেক তরুণী যুবা- যৌবরাজ্যে যাহাদের শেষ হয়ে গেছে- তারাও সেখানে অগণন চৈত্রের কিরণে কিংবা হেমন্তের আরো। অনবলুন্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে চাঁদকে নিখিল ক’রে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড় ক’রে দিতে চেয়েছিল,- মনে মনে- মুখে নয়- দেহে নয়; বাংলার মানসসাধনশীত শরীরের চেয়ে আরো বেশি জয়ী হয়ে শুক্ল রাতে গ্রামীণ উৎসব শেষ ক’রে দিতে গিয়ে শরীরের কবলে তো তবুও ডুবেছে বার-বার অপরাধী ভীরুদের মতো প্রাণে। তারা সব মৃত আজ। তাহাদের সন্ততির সন্ততিরা অপরাধী ভীরুদের মতন জীবিত। ‘ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিন কেটে গেল- ঢের অভিজ্ঞতা জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, হাতে খননের অস্ত্র নেই- মনে হয়- চারিদিকে ঢিবি দেয়ালের নিরেট নিঃসঙ্গ অন্ধকার’- ব’লে যেন কেউ যেন কথা বলে। হয়তো সে বাংলার জাতীয় জীবন। সত্যের নিজের রূপ তবুও সবের চেয়ে নিকট জিনিস সকলের; অধিগত হলে প্রাণ জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের মতন অনিমেষ হয়ে থাকে নক্ষত্রের আকাশে তাকালে। আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে? আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য ব’লে গেছে অর্ধমিথ্যার? জীবন তবুও অবিস্মরণীয় সততাকে চায়; তবু ভয়- হয়তো বা চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নেই। ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিনে কেটে গেল-ঢের অভিজ্ঞতা জীবলে জড়িত হয়ে গেল, তবু, নক্ষত্রের রাতের মতন সফলতা মানুষের দূরবীনে র’য়ে গেছে,- জ্যোতির্গ্রন্থে; জীবনের জন্যে আজো নেই। অনেক মানুষী খেলা দেখা হলো, বই পড়া সাঙ্গ হলো-ত বু কে বা কাকে জ্ঞান দেবে- জ্ঞান বড় দূর- দূরতর আজ। সময়ের ব্যাপ্তি যেই জ্ঞান আনে আমাদের প্রাণে তা তো নেই; স্থবিরতা আছে- জরা আছে। চারিদিক থেকে ঘিরে কেবলি বিচিত্র ভয় ক্লান্তি অবসাদ র’য়ে গেছে। নিজেকে কেবলি আত্মকীড় করি; নীড় গড়ি। নীড় ভেঙে অন্ধকারে এই যৌথ মন্ত্রণার মাল্যিন এড়ায়ে উৎক্রান্ত হতে ভয় পাই। সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যশব্দ এসে ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে- ভয় পাই- গুহার লুকাই; লীন হতে চাই- লীন- ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে চাই। আমাদের দু’হাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম। নচিকেতা ধর্মধনে উপবাসী হয়ে গেলে যম প্রীত হয়। তবুও ব্রহ্মে লীন হওয়াও কঠিন। আমারা এখনও লুপ্ত হই নি তো। এখনও পৃথিবী সূর্যে হয়ে রৌদ্রে অন্ধকারে ঘুরে যায়। থামালেই ভালো হত- হয়তো বা; তবুও সকলই উৎস গতি যদি,- রৌদ্রশুভ্র সিন্ধুর উৎসবে পাখির প্রমাথা দীপ্তি সাগরের সূর্যের স্পর্শে মানুষের হৃদয়ে প্রতীক ব’লে ধরা দেয় জ্যাতির পথের থেকে যদি, তাহলে যে আলো অর্ঘ্য ইতিহাসে আছে, তবু উৎসাহ নিবেশ যেই জনমানসের অনির্বচনীয় নিঃসঙ্কোচ এখনও আসে নি তাকে বর্তমান অতীতের দিকচক্রবালে বার-বার নেভাতে জ্বালাতে গিয়ে মনে হয় আজকের চেয়ে আরো দূর অনাগত উত্তরণলোক ছাড়া মানুষের তরে সেই প্রীতি, স্বর্গ নেই, গতি আছে;- তবু গতির ব্যসন থেকে প্রগতি অনেক স্থিরতর; সে অনেক প্রতারণাপ্রতিভার সেতুলোক পার হল ব’লে স্থির;-হতে হবে ব’লে দীন, প্রমাণ কঠিন; তবুও প্রেমিক- তাকে হতে হবে; সময় কোথাও পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন জেনে বিরচিত নয়; তবু সে তার বহিমুর্খ চেতনার দান সব দিয়ে গেছে ব’লে মনে হয়; এর পর আমাদের অন্তর্দীপ্ত হবার সময়।কাব্যগ্রন্থ - বেলা অবেলা কালবেলা ইহাদেরি কানে একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল; পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে শুনিল আধেক কথা – এই সব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল: একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে। উত্তরপ্রবেশ পুরনো সময় সুর ঢের কেটে গেল। যদি বলা যেত: সমুদ্রের পারে কেটে গেছে সোনার বলের মতো সুর্য ছিল পুবের আকাশে– সেই পটভূমিকায় ঢের ফেনশীর্ষ ঢেউ, উড়ন্ত ফেনার মতো অগণন পাখি। পুরনো বছর দেশ ঢের কেটে গেল রোদের ভিতরে ঘাসে শুয়ে; পুকুরের জল থেকে কিশোরের মতো তৃপ্ত হাতে ঠান্ডা পানিফল, জল ছিড়ে নিতে গিয়ে; চোখের পলকে তবু যুবকের মতো মৃগনাভিঘন বড় নগরে পথে কোনো এক সুর্যের জগতে চোখের নিমেষ পড়েছিল। সেইখানে সুর্য তুব অস্ত যায়। পুনরুদয়ের ভোরে আসে মানুষের হৃদয়ের অগোচর গম্বুজের উপরে আকাশে। এ ছাড়া দিনের কোনো সুর নেই; বসন্তের অন্য সাড়া নেই। প্লেন আছে; অগণন প্লেন অগণ্য এয়োরোড্রাম রয়ে গেছে চারি দিকে উঁচুনিচু অন্তহীন নীড়– হলেও বা হয়ে যেত পাখির মতন কাকলি আনন্দে মুখর;সেইখানে ক্লান্তি তবু– ক্লান্তি–ক্লান্তি; কেন ক্লান্তি তা ভেবে বিস্ময়; সেইখানে মৃত্যু তবু; এই শুধু– এই; চাঁদ আসে একলাটি; নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে; দিগন্তের সমুদ্রের থেকে হাওয়া প্রথম আবেগে এসে তবু অস্ত যায়; উদয়ের ভোরে ফিলে আসে আপামর মানুষের হৃদয়ের অগোচর রক্ত হেডলাইনের–রক্তের উপরে আকাশে। এ ছাড়া পাখির কোনো সুর– বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই। নিখিল ও নীড় জনমানবের সমস্ত নিয়মে সজন নির্জন হয়ে থাকে ভয় প্রেম জ্ঞান ভুল আমাদের মানবতা রোল উত্তরপ্রবেশ করে আরো বড় চেতনার লোকে; অনন্ত সূর্যের অস্ত শেষ করে দিয়ে বীতশোক হে অশোক সঙ্গী ইতিহাস, এ ভোর নবীন বলে মেনে নিতে হয়; এখন তৃতীয় অঙ্ক অতএব; আগুনে আলোয় জ্যোতির্ময়। উত্তরসাময়িকী আকাশের থেকে আলো নিভে যায় ব’লে মনে হয়। আবার একটি দিন আমাদের মৃগতৃষ্ণার মতো পৃথিবীতে শেষ হয়ে গেল তবে;— শহরের ট্রাম উত্তেজিত হয়ে উঠে সহজেই ভবিতব্যতার যাত্রীদের বুকে নিয়ে কোন্‌ এক নিরুদ্দেশ কুড়োতে চলেছে। এই দিকে পায়দলদের ভিড়—অই দিকে টর্চের মশালে বার—বার যে যার নিজের নামে সকলের চেরে আগে নিজের নিকটে পরিচিত;— ব্যক্তির মতন নিঃসহায়; জনতাকে অবিকল অমঙ্গল সমুদ্রের মতো মনে ক’রে যে যার নিজের কাছে নিবারিত দ্বীপের মতন হয়ে পড়ে অভিমানে—ক্ষমাহীন কঠিন আবেগে।সে মুহূর্ত কেটে যায়; ভালোবাসা চায় না কি মানুষ নিজের পৃথিবীর মানুষের? শহরে রাত্রির পথে হেঁটে যেতে যেতে কোথাও ট্রাফিক থেকে উৎসারিত অবিরল ফাঁস নাগপাশ খুলে ফেলে কিছুক্ষণ থেমে থেমে এ রকম কথা মনে হয় অনেকেরই;— আত্মসমাহিতিকূট ঘুমায়ে গিয়েছে হৃদয়ের! তবু কোনো পথ নেই এখনো অনেক দিন, নেই। একটি বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে নিভে গেছে প্রায়। আমাদের আধো-চেনা কোনো-এক পুরোনো পৃথিবী নেই আর। আমাদের মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবী আসে নি তো। এই দুই দিগন্তের থেকে সময়ের তাড়া খেয়ে পলাতক অনেক পুরুষ—নারী পথে ফুটপাতে মাঠে জীপে ব্যারাকে হোটেলে অলিগলির উত্তেজে কমিটি-মিটিঙে ক্লাবে অন্ধকারে অনর্গল ইচ্ছার ঔরসে সঞ্চারিত উৎসবের খোঁজে আজো সূর্যের বদলে দ্বিতীয় সূর্যকে বুঝি শুধু অন্ন, শক্তি, অর্থ, শুধু মানবীর মাংসের নিকটে এসে ভিক্ষা করে। সারাদিন— অনেক গভীর রাতের নক্ষত্র ক্লান্ত হয়ে থাকে তাদের বিলোল কাকলীতে। সকল নেশন আজ এই এক বিলোড়িত মহা-নেশনের কুয়াশায় মুখ ঢেকে যে যার দ্বীপের কাছে তবু সত্য থেকে— শতাব্দীর রাক্ষসী বেলায় দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার এক-একটি বিমুখ নেশন।শীত আর বীতশোক পৃথিবীর মাঝখানে আজ দাঁড়ায়ে এ জীবনের কতগুলো পরিচিত সত্ত্বশূন্য কথা— যেমন নারীর প্রেম, নদীর জলের বীথি, সারসের আশ্চর্য ক্রেঙ্কার নীলিমায়, দীনতায় যেই জ্ঞান, জ্ঞানের ভিতর থেকে যেই ভালোবাসা; মানুষের কাছে মানুষের স্বাভাবিক দাবীর আশ্চর্য বিশুদ্ধতা; যুগের নিকটে ঋণ, মনবিনিময়, এবং নতুন জননীতিকের কথা— আরো স্মরণীয় কাজ সকলের সুস্থতার— হৃদয়ের কিরিণের দাবী করে; আর অদূরের বিজ্ঞানের আলাদা সজীব গভীরতা; তেমন বিজ্ঞান যাহা নিজের প্রতিভা দিয়ে জেনে সেবকের হাত দিব্য আলোকিত ক’রে দেয়— সকল সাধের কারণ-কর্দম-ফেণা প্রিয়তর অভিষেকে স্নিগ্ধ ক’রে দিতে;— এই সব অনুভব ক’রে নিয়ে সপ্রতিভ হতে হবে না কি। রাত্রির চলার পথে এক তিল অধিক নবীন সম্মুখীন— অবহিত আলোকবর্ষের নক্ষত্রেরা জেগে আছে। কথা ভেবে আমাদের বহিরাশ্রয়িতা মানবস্বভাবস্পর্শে আরো ঋত— অন্তর্দীপ্ত হয়।কাব্যগ্রন্থ - বেলা অবেলা কালবেলা উদয়াস্ত পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়- আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়? যদিও চোখের ঘুম ভুলে গিয়ে মননের অহঙ্কারে চর্বি জ্বালায়অপ্রেমিক, কোনো কিছু শেষ সত্য জেনে নেবে বিষয়ের থেকে। তবু কোনো জাদুকর পুরানো স্ফটিক তার যায় নাই রেখে। সময় কাটাতে হয় ব্যবহৃত হস্তাক্ষরে চীবরের ছায়াপাত দেখে। অথবা উদ্রিক্ত যারা হয় নাক'- চিরকাল থাকে সমীচীন,- তাহাদের মুণ্ড যেন কালো হাঁড়ি- মাচার উপরে সমাসীন; মৃত্যু নাই তাহাদের;- জানে সব দেবী, পরী, জিন। আর যারা বহুদিন পৃথিবীতে মেধে- মনে- ছিল কর্মক্ষম, তারপর বুড়ো হয়ে স্মরণ করিতে চায় অবলুপ্ত মলয়াচলমঃ তাদের হৃদয়ে ঢের মেষ আছে নাই কোনো শুভ্রঘ্রাণ গম। পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়- আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়? কন্যা তুলা কর্কটের বৃশ্চিকের আবার ঘটুক সমবায়। উদয়াস্ত (অগ্রন্থিত) সূর্যের উদয় সহসা সমস্ত নদী চমকিত ক'রে ফেলে- অকস্মাৎ দ্যাখা দিয়ে- চ'লে যায়; হাড়ের ভিতরে মেঘেদের অন্ধকার; স্তম্ভিত বন্ধুর মতো ভোর এইখানে সাধু রাত্রির হাত ধ'রে তাকে শ্রেয়তর চালানির মূল জেনে নিখিলের- মৃত মাংসের স্তুপ চারিদিকে; তার মাঝে ধন্বন্তরি, কালনেমি কিছু চায়; দুস্তর চাদর গায়ে অন্ধ বাতাসের। সূর্য তবু- সূর্য যেন জ্যোতি প্রতিবিম্ব রেখে গেছে তরবারে- ভাঁড়ের হৃদয়ে, ধর্মোশোকের মনে।করজোড়ে ভাবে তারা; ঝলিছে সারস শব ঢের বৈতরনী তরঙ্গের দিকে ভেসে যেতে- যেতে লোকোত্তর সূর্যের আমোদে। উন্মেষ কোথাও নদীর পারে সময়ের বুকে- দাঁড়ায়ে রয়েছে আজো সাবেককালের এক স্তিমিত প্রাসাদ; দেয়ালে একটি ছবিঃ বিচারসাপেক্ষ ভাবে নৃসিংহ উঠেছে; কোথাও মঙ্গল সংঘটন হ’য়ে যাবে অচিরাৎ।নিবিড় রমণী তার জ্ঞানময় প্রেমিকের খোঁজে অনেক মলিন যুগ- অনেক রক্তাক্ত যুগ সমুত্তীর্ণ ক’রে আজ এই সময়ের পারে এসে পুনরায় দেখে আবহ্মানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চ’ড়ে। উপলব্ধি যা পেয়েছি সে সবের চেয়ে আরো স্থির দিন পৃথিবীতে আসে; আসে না কি? চারিদিকে হিংসা দ্বেষ কলহ রয়েছে; সময়ের হাত এসে সে সবের অমিলন, মলিন প্রেরণা তবুও তো মুছে দিয়ে যেতে পারে,- ভাবি। সেই আদিকাল থেকে আজকের মুহুর্ত অবধি মানুষের কাহিনীর যতদূর অগ্রসর হয়ে গেছে তাতে প্রান্তে ঠেকে দেখছি কেবলি : মলিন বালির দান নিয়ে তার মরুভূমি সূর্যের কিরণে দাঁড়াতে শিখেছে অনেক দিন; তবুও তো মানুষের কাছে মানুষের দাবি র’য়ে গেছে মনে ভেবে হৃদয়ে কুয়াশা করুণ প্রশ্নের মত খেলা ক’রে গেছে ঢের দিন। আমাদের পায়ে চলার পথ ঘিরে অব্যক্ত ব্যথার কবেকার নচিকেতা- আজকের মানুষের হাড় প্রাণের সমুদ্রে সুরে ফেনশীর্ষ ঢেউয়ের উপরে সূর্যের দিগন্তে দেশে আমাদের তুলে নিতে চায়; নিঃসহায় ডুবুরির মতো ডুবে মরে; সমুদ্রপাখির শাদা, বিরহীর মতন ডানায় সেই শূণ্য অন্ধকার দিকের ভিতরে আমাদের ইতিহাস পিরামিড ভেঙে ফেলে;- লণ্ডন- ক্রেমলিন গড়ে। কেবলি আশঙ্কা, ব্যথা, নিরাশার সম্মুখীন হয়ে মানুষের মরণের সমুদ্রের ঢেউ রূপান্তরিত করে নিতে চেয়ে মানুষের জীবনের সুর জেনেছে কোথাও ভয় নেই- নেই- নেই। তবুও কোথাও ধর্মমন্দিরের অভয়পাণির সফলতা আবার ভোরের সূর্যে সুমুখে রবে না কোনো দিন। কবের প্রথম অবপ্রাণনায় জেগে শাদা পাতা খুলেছিল যারা, গল্প লিখে গিয়েছিল ঢের, আদি রৌদ্র দেখেছিল, সিন্ধুর কল্লোল শুনে গিয়েছিল ঢের, দিয়ে গিয়েছিল, আকাশের মুখোমুখি অন্য এক আকাশের মত যারা নীল হয়ে রাত্রি হয়ে নক্ষত্রের মত হয়ে মিশে গিয়েছিল : তারা আর তাদের মরণ আজ আমাদের পাশের পথের নিচে যতদূর ভুল তাহাদের অস্তসূর্য ততদূর আমাদের উদয়ের মতন অরুণ; শ্বেতাশ্বতর থেকে দীপঙ্কর অবধি সবই শাদা স্বাভাবিক মনে হয় ব’লে মৃত স্বভাবের মতন করুণ । বিকেলের ক্ষয়ের ভিতরে এসে আজ তবে আমাদের দিন অনিবার ইতিহাস অঙ্গারের প্রতিভাকে সঞ্চয়ের মত মনে ভেবে মরণকে যা দেবার- জীবনকে যা দেবার সব কঠিন উৎসবে-দীন অন্তঃকরণে দিয়ে দেবে। ঊনিশশো চৌত্রিশের একটা মোটরকার খটকা নিয়ে আসে।মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস, যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর আলোর সন্তানদের মধ্যে তার নাম সবচেয়ে প্রথম।একটা অন্ধকার জিনিস : পরিষ্কার ভোরের বেলা দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে উনিশশো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে; পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে, ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বধূর মতো সহসা অগোচর মাঠ নদী যেন নিশ্চেষ্ট, সহসা যেন প্রতীজ্ঞা হারিয়ে ফেলে, এই মোটর অগ্রদূত, সে ছুটে চলেছে যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত; একটা মোটরকারের পথ সব সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে, অন্ধকারের মতো। স্ট্যান্ডে শহরের বিরাট ময়দানের পুবে পশ্চিমে-ফুটপাথের পাশে মোটারকার; নিঃশব্দ। মাথায় হুড ভিতরের বুরুশ-করা গভীর গদিগুলো পালিশ স্টিয়ারিং-হুইল হেডলাইট; কী নিয়ে স্থির? কলকাতার ময়দানের একটা গাছ অন্য কিছু নিয়ে স্থির, আমি অন্যকিছু নিয়ে স্থির; মোটরের স্থিরতা একটা অন্ধকার জিনিসএকটা অন্ধকার জিনিস : রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায় সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে অসংখ্য তারের মতো, রাতের উল্কার মতো, মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো তারাও চলেছে; কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে, অন্ধকারের মতো।আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না; আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে, পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে। জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না : আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে নক্ষত্রের নিচে। এই কি সিন্ধুর হাওয়া এই কি সিন্ধুর হাওয়া? রোদ আলো বনানীর বুকের বাতাস     কোথায় গভীর থেকে আসে! অগণন পাখী উড়ে চ'লে গেলে তবু নীলাকাশ     কথা বলে নিজের বাতাসে।রাঙা মেঘ- আদি সূর্য- স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহার সব     ফুরিয়ে গিয়েছে কত দূরে। সে অনেক মানবীয় কাল ভেঙে এখন বিপ্লব     নতুন মানব-উৎস কোথাও রয়েছে এই সুরে।যাযাবর ইতিহাসসহ পথ চিনে নিতে চায়।     অনেক ফ্যাক্টরি ফোর্ট ব্যাঙ্কারেরো আত্নস্থ মনের অমার ভিতরে অমা রজনীর ভূকম্পনে কথা বলে যায়ঃ     আলো নেই, তবু তার অভিগমনের। এই জল ভালো লাগে এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে তার শান — স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, — আবেগের ভরে ঠোঁটে এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে; এই জল ভালো লাগে; — নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে — বনের ভিতর বার বার উড়ে যায়, — তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশেঝরে পড়ে; — যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ, যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়, বনের কিনা েঝরে যেই ধান বুকে করে শান — শালিখুদ, তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের পরে চোখের পাতায় – আমার চুলের পরে, — অপরাহ্নে রাঙা রোদে সবুজ আতায় রেখেছে নরম হাত যেন তার — ঢালিছে বুকের থেকে দুধ। এই ডাঙা ছেড়ে হায় এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে। বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে: ছড়ায়ে রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;- তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বলো- আমি কোনো-মতে বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে- উটির পর্বতে যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে কোন দেশে,- কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে বিনুনী খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;- পৃথিবীর পথেযাব নাকো : অশ্বত্থের ঝরাপাতা স্লান শাদা ধুলোর ভিতর, যখন এ- দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে- পাখিটিও নাই, অবিরল ঘাস শুধু ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর, খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দু’একটা বিষণ্ণ চড়াই, অশ্বত্থের পাতাগুলো প’ড়ে আছে স্লান শাদা ধুলোর ভিতর; এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই। এই নিদ্রা আমার জীবনে কোনো ঘুম নাই মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি এই নিদ্রা?গায় তার ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ- অবসাদ সুখ চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন-বিমুখ প্রাণ তারএই দিন এই রাত্রি আসে যায়- বুঝিতে দেয় না তারে; কোনো ধ্বনি ঘ্রাণ কোনো ক্ষুধা- কোনো ইচ্ছা- পরীরো সোনার চুল হয় যাতে ম্লানঃ আমাদের পৃথিবীর পরীদের;- জানেনা সে; শোনেনা সে জীবনের লক্ষ্য মৃত নিঃশ্বাসের স্বর; তাহলে ঘুমাত কবে; সে শুধু সুন্দর, প্রশ্নহীন অভিজ্ঞতাহীন দূর নক্ষত্রের মতো সুন্দর অমর শুধু; দেবতারা করেনি বিক্ষত ইহাদের।এদের অপার রূপ শান্তি সচ্ছলতা তবুও জানিত যদি আমার এ-জীবনের মুহূর্তের কথা মানুষের জীবনের মুহূর্তের কথা।দেবতারা করেনি বিক্ষত ইহাদেরঃ (দেবতারা করেনি বিক্ষত নিজেদের কোনো অভিজ্ঞতা নাই দেবতার) ঘুঘুদের শাদা ডানা- নীল রাত্রি- কমলরঙের মেঘ- সমুদ্রের ফেনা রোদ- হরিণের বুকে বেদনার নীরব আঘাত; এরা প্রশ্ন করেনাকোঃ ইহারা সুন্দর শান্ত- জীবনের উদ্‌যাপনে সন্দেহের হাত ইহারা তোলে না কেউ আঁধারে আকাশে ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে। শুনেছে কে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা? সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যথা আনে- মানুষের জীবনের এই বীভৎসা ইহাদের ছোঁয় নাকো;- ব্যুবনিক প্লেগের মতন সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধতারে নষ্ট ক'রে ফেলিতেছে মানুষের মন!গোলাপী ধূসর মেঘে পশ্চিমের বিয়োগ সে দ্যাখে না কি? প্রজাপতি পাখি-মেয়ে করেনা কি মানুষের জীবনের ব্যথা আহরণ? তবু এরা ব্যথা নয়ঃ ইহারা আবৃত সব- বিচিত্র- নীরব অবিরল জাদুঘর এরা এক;- এরা রূপ ঘুম শান্তি স্থির এই মৃত পাখি কীট- প্রজাপতি রাঙা মেঘ- সাপের আঁধার মুখে ফরিঙের জোনাকির নীড় এইসব। আমি জানি, একদিন আমিও এমন পতঙ্গের হৃদয়ের ব্যথা হব- সমুদ্রের ফেনা শাদা ফেনায় যেমন ভেঙে পড়ে- ব্যথা পায়। মানুষের মন তবুও রক্তাক্ত হয় কেন এক অন্য বেদনায় কীট যাহা জানে নাকো- জানে নাকো নদী ফেনা ঘাসরোদ- শিশির কুয়াশা জ্যোৎস্নাঃ আম্লান হেলিওট্রোপ হায়! এ-সৃষ্টির জাদুঘরে রূপ তারা- শান্তি- ছবি- তাহারা ঘুমায় সৃষ্টি তাই চায়।ভুলে যাব যেই সাধ- যে-সাহস এনেছিলো মানুষ কেবল যাহা শুধু গ্লানি হলো- কৃপা হলো- নক্ষত্রের ঘৃণা হলো- অন্য কোনো স্থল পেল নাকো। এই পথ দিয়ে এই পথ দিয়ে কেউ চ'লে যেতো জানি এই ঘাস নীলাকাশ_ এ সব শালিখ সোনালি ধান নরনারীদের ছায়া-কাটাকুটি কালো রোদে সে তার নিজের ছায়া ফেলে উবে যেতো; আসন্ন রাত্রির দিকে সহসা দিনের আলো নষ্ট হ'য়ে গেলে কোথাও নতুন ভোর র'য়ে গেছে জেনে সে তার নিজের সাধ রৌদ্র স্বর্ণ সৃষ্টি করেছিলো।তবু্ও রাত্রির দিকে চোখ তার পড়েছিলো ব'লে হে আকাশ, হে সময়, তোমার আলোকবর্ষব্যাপ্তি শেষ হ'লে যখন আমার মৃত্যু হবে সময়ের বঞ্চনায় বিরচিত সে -এক নারীর অবলা নারীর মতো চোখ মনে রবে।#জীবনান্দদাশের অগ্রন্থিত কবিতা এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি — আমি হৃষ্ট কবি আমি এক; — ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে; ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ, ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে — ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি — দেখেছি কিশোরী এস হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয় — বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন শঙ্খের মতো ছবি ফুটাতেছে — ভোরের আকাশখানা রাজহাস ভরে গেছে নব কোলাহলে নব নব সূচনার: নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে — তবু কথা বলে, তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না — কেউ যেন শুনিতেছে সবিকোন্‌ রাঙা শাটিনের মেঘে বসে — অথবা শোনে না কেউ, শূণ্য কুয়াশায় মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাবো আমিও এমন; তবু আজ সবুজ ঘাসের পরে বসে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায় পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ কারে যেন এই গুলো দেবো আমি; মৃদু ঘাসে একা — একা বসে থাকা যায় এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন। এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ : সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল; সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল, সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর; সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে; সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর – শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর, তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর। এই পৃথিবীর এই পৃথিবীর বুকের ভিতরে কোথাও শান্তি আছে; অঘ্রাণ মাস রাত্রি হ’লে অনেক বিষয়াবিষের সমাধান মাঠে জলে পাখির নীড়ে নক্ষত্রেতে থাকে; অমেয় গোলকধাঁধাঁয় ঘুরে প্রাণ চেষ্টা করে সমাজ জাতি সময় সৃষ্টি সঠিক বুঝে নিতে। সকল প্রয়াণ সফল হবে গ্লাশিয়ারের দীপ্তি আসার আগে; এখন রৌদ্রে আজন্মকাল অনুষ্ঠানের দিন; সফল হতে ইতিহাসের অনেক দিন লাগে। সে সফলতা এই পৃথিবী- হয়তো সৃশঠি চূর্ণ হ’লে হবে; আমি অনেক দূরের থেকে তাহার কারণধ্বনি নদীর জলে সমস্ত দিন ক্রন্দসী উজ্জ্বল; তোমায় আমি ভালোবাসি- এই সত্য স্বভাবপৃথিবীর দানের মতন নিজেরই ফলাফল। এই শতাব্দী-সন্ধীতে মৃত্যু (অগণন সাধারণের)সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিলো         ততোধিক অসুস্থ সময়ে         আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়। দূরে কাছ শাদা উঁচু দেয়ালের ছায়া দেখে ভয়ে মনে করে গেছি তাকে- ভালোভাবে মনে ক'রে নিলে-         এইখানে জ্ঞান হতে বেদনার সুরু- অথবা জ্ঞানের থেকে ছুটি নিয়ে সান্ত্বনার হিম হ্রদে একাকী লুকালে নির্জন স্ফটিকস্তম্ভ খুলে ফেলে মানুষের অভিভূত ঊরু         ভেঙে যাবে কোনো এক রম্য যোদ্ধা এসে। নরকেও মৃত্যু নেই- প্রীতি নেই স্বর্গের ভিতরে; মর্ত্যে সেই স্বর্গ নরকের প্রতি সৎ অবিশ্বাস নিস্তেজ প্রতীতি নিয়ে মনীষীরা প্রচারিত করে। এই সব বারবার সেই সব কোলাহল সমারোহ রীতি রক্ত,- ক্লান্তি লাগে যেন; তাহারা অনেক জানে- এই দূর মাঠে আমি খুঁজি নাকো জীবনের মানে শুধু এই মাঠ- রাত- আমারে ডেকেছে, আহা, বলেছি- 'যাবোনা আর'- কেনকেন যাবো? এই ধুলো গাভী হাঁস জ্যোৎস্না ছেড়ে আমি যাবো কোনখানে সেখানে চিন্তার ব্যথা- ব্যথা না কি? আজ রাতে শুধু আমি শান্তির আকাশ চেয়েছি যে- সেই ভালো- কথা কাজ প্রশ্ন শুধু ভুল করে- ব্যথা বহে আনে,শান্তি ভালো;- বাদামি পাতার ঘ্রাণ ভালো না কি? পাখির সোনালি চোখ- ঘাস কোথায় বিবরে তার মাছরাঙা- তার রঙ তার নীড়- হৃদয়ের সাধ এই নিয়ে কথা ভাবা এইখানে- ছবি আঁকা- মৃদু ছবি- নরম উচ্ছ্বাস;ইঁদুর ধানের শিষ বেয়ে ওঠেঃ এই ছড়া এই সোনা আকাশের চাঁদ এরা যেন নীড় তার- আমারো হৃদয় আজ চুপ হ'য়ে শুধু রঙ ঘ্রাণ শুধু শান্তি- নিঃশব্দতা- আবিষ্কার;- এই সব এই সব সঞ্চয়ের স্বাধজীবনেরে এই ব'লে জানিতেছে- জ্যোৎস্না আরো শান্ত হ'য়ে ভরেছে উঠান রাত্রি আরো ছবি হ'য়ে রূপ হ'য়ে ঘাসের কীটের মুখে শুনিতেছে গান। এই সব দিনরাত্রি মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো । এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার-দেশে এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে তাদের সম্রাট নেই,সেনাপতি নেই; - তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই; শরীর বিবশ হ’লে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের কংগ্রেসের মতো কোনো আশা হতাশার কোলাহল নেই ।অনেক শ্রমিক আছে এইখানে । আরো ঢের লোক আছে সঠিক শ্রমিক নয় তারা : - স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিধি থেকে ঝ’রে এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরো। নামগুলো কুশ্রী নয়,পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এই সব । আমরা অনেক দিন এ-সব নামের সাথে পরিচিত; তবু, গৃহ নীড় নির্দেশ সকলি হারায়ে ফেলে ওরা জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের মতন নিদিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে; জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে; অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছো । মেডিকেল ক্যাম্বেলের বেলগাছিয়ার যাদবপুরের বেড কাঁচড়া পাড়ার বেড সব মিলে কতগুলো সব? ওরা নয়-সহসা ওদের হ’য়ে আমি কাউকে শুধায়ে কোনো ঠিক মতো জবাব পাইনি । বেড আছে, বেশি নেই-সকলের প্রয়োজনে নেই। যাদের আস্তানা ঘর তল্পিতল্পা নেই হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয় । বটতলা মুচিপাড়া তালতলা জোড়াসাঁকো- আরো ঢের-ব্যর্থ-অন্ধকারে যারা ফুটপাত ধ’রে অথবা ট্রামের লাইন মাড়িয়ে চলছে তাদের আকাশ কোন দিকে? জানু ভেঙে প’ড়ে গেলে হাত কিছুক্ষণ আশাশীল হ’য়ে কিছু চায়- কিছু খোঁজে; এ ছাড়া আকাশ আর নেই ।তাদের আকাশ সর্বদাই ফুটপাতে; মাঝে-মাঝে এম্বুলেনস্‌ গাড়ির ভিতরে রণক্লান্ত নাবিকেরা ঘরে ফিরে আসে যেন এক অসীম আকাশে। এ-রকম ভাবে চ’লে দিন যদি রাত হয়, রাত যদি হ’য়ে যায় দিন, - পদাচিহ্নময় পথ হয় যদি দিকচিহ্নহীন, কেবলই পাথুরেঘাটা নিমতলা চিৎপুর- খালের এপার- ওপার রাজাবাজারের অস্পষ্ট নির্দেশে হাঘরে হাভাতেদের তরে অনেক বেডের প্রয়োজন; বিশ্রামের প্রয়োজন আছে; বিচিত্র মৃত্যুর আগে শান্তির কিছুটা প্রয়োজন। হাসপাতালের জন্যে যাহাদের অমূল্য দাদন, কিংবা যারা মরনের আগে মৃতদের জাতিধর্ম নির্বিচারে সকলকে-সব তুচ্ছতম আতর্কেও শরীরের সান্ত্বনা এনে দিতে চায়, কিংবা যারা এই সব মৃত্যু রোধ ক’রে এক সাহসী পৃথিরী সুবাতাস সমুজ্জ্বল সমাজ চেয়েছে- তাদের ও তাদের প্রতিভা প্রেম সংকল্পকে ধন্যবাদ দিয়ে মানুষকে ধন্যবাদ দিয়ে যেতে হয় । মানুষের অনিঃশেষ কাজ চিন্তা কথা রক্তের নদীর মতো ভেসে গেলে,তারপর,তবু, এক অমূল্য মুগ্ধতা অধিকার ক’রে নিয়ে ক্রমেই নির্মল হ’তে পারে। ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়; তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে; মানুষের মন জানে জীবনের মানে : সকলের ভালো করে জীবনযাপন। কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ। চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়- অলীক প্রয়াণ। মন্বন্তর শেষ হ’লে পুনরায় নব মন্বন্তর; যুদ্ধ শেয হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল; মানুযের লালসার শেষ নেই; উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই। কেবলি আসন থেকে বড়ো, নবতর সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো। মানুষের দুঃখ কষ্ট মিথ্যা নিষ্ফলতা বেড়ে যায়। মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী কেমন আশ্চর্য গান গায়; বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়; গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে রাত্রির বর্ণের মতো কালো-কালো শিকারী বেড়াল প্রেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে, ঝর্‌ ঝর্‌ ঝর্‌ সারারাত শ্রাবণের নির্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর এ-পৃথিবী ঘুম স্বপ্ন রুদ্ধশ্বাস শঠতা রিরংসা মৃত্যু নিয়ে কেমন প্রমত্ত কালো গণিকার উল্লোল সংগীতে মুখের ব্যাদান সাধ দুর্দান্ত গণিকালয়- নরক, শ্মশান হ’লো সব। জেগে উঠে আমাদের আজকের পৃথিবীকে, এ-রকম ভাবে অনুভব আমিও করেছি রোজ সকালের আলোর ভিতরে বিকেলে- রাত্রির পথে হেঁটে; দেখেছি রজনীগন্ধা নারীর শরীর অন্ন মুখে দিতে গিয়ে আমরা অঙ্গার রক্ত : শতাব্দীর অন্তহীন আগুনের ভিতরে দাঁড়িয়ে। এ-আগুন এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো? তবুও সকল কাল শতাব্দীকে হিসেব নিকেশ ক’রে আজ শুভ কাজ সূচনার আগে এই পৃথিবীর মানবহৃদয় স্নিগ্ধ হয়- বীতশোক হয়? মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো? দীনতা : অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো। এইখানে সূর্যের এইখানে সূর্যের ততদূর উজ্জ্বলতা নেই। মানুষ অনেক দিন পৃথিবীতে আছে। 'মানুষের প্রয়াণের পথে অন্ধকার ক্রমেই আলোর মতো হ’তে চায়;'- ওরা বলে, ওরা আজো এই কথা ভাবে। একদিন সৃষ্টির পরিধি ঘিরে কেমন আশ্চর্য এক আভা দেখা গিয়েছিলো; মাদালীন দেখেছিলো- আরো কেউ-কেউ; অম্বাপালী সুজাতা ও সংঘমিত্রা পৃথিবীর লৌকিক সূর্যের আড়ালে আর-এক আলো দেখেছিলো; হয়তো তা লুপ্ত এক বড়ো পৃথিবীর আলোকের নিজ গুণ, অথবা তখনকার মানুষের চোখের ও হৃদয়ের দোষ। এই বিশ শতকে এখন মানুষের কাছে আলো আঁধারের আর রকম মানে : যেখানে সূর্যের আলো নক্ষত্র বা প্রদীপের ব্যবহার নেই সেইখানে অন্ধকার; যেখানে চিন্তার ধারা রীতিহীন- শব্দের প্রয়োগ অসংগত- প্রাণের আবেগ ঢের শতকের আপ্রাণ চেষ্টায় যেখানে সহিষ্ণু স্থির মানুষের সাধনার ফলে বিপ্লবিনী নদীর বাঁধের মতো হ’য়ে- তবু কোনো একদিন কেন যেন জলের গর্জনে আলুলায়িত হয়েছে সেখানে (ওদের মতে) আলো নেই; অথবা নিজেকে নিজে প্রতিহত ক’রে ফেলে আলো সেইখানে অন্ধকার।মনীষীরা এ-রকম ভাবে আজ শুদ্ধ চিন্তা করে, সমাজের কল্যাণ চায়, দিক নির্ণয় করে। অটুট বাঁধের মতো মনে হয় জ্ঞানীদের মন যেন- টেনিসির দামোদর অথবা কোশীর। তবুও আগুন জল বাতাসের প্লাবনের মানে সেতু ভেঙে নব সেতু প্রণয়ন; আজ তা ,আত্মস্থ সেতু জানে? মাঝে-মাঝে বাসুকির লিপ্ত মাথা টলে, ক্লান্ত হ’য়ে শান্তি পায় অপরূপ প্রলয়-কম্পনে; পৃথিবীর বন্দিনীরা হেসে ওঠে । রেলের লাইনের মতো পাতা জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্তহীন কার্যকারিতায় - সুখ আছে, সৃষ্টি নেই। অনেক প্রসাদ আছে,প্রেম নেই। অনেক কল্যানশীল নগর জাগছে; সেইখানে দিনে সূর্য নিজে, নিয়ন টিউব গ্যাস রাত্রির; উন্মুক্ত বন্দর সব নীল সমুদ্রের পারে-পারে মানুষ ও মেশিনের যৌথ শক্তিবলে নীলিমাকে আটকেছে ইঁদুরের কলে । সূর্য ভারত চীন মিশরের-ক্যালডিয়ার আদিম ভোরের প্রাথমিক উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে ? দিন প্রায় শেষ হ’য়ে এলে শাদা ডানার ঝিলিকে আলো ঠিকরিয়ে গেলে বুঝেছি সংবাদবাহী আশ্চর্য পায়রা উড়ে যায় সূর্যকে টুকরো ক’রে ফেলে; খণ্ড আলোর মতো সঞ্চারিত করেছে আবেগে প্রকৃতিতে; কোনো-কোনো মানুষের বুকে; তারপর মানুষের সাধারণ ভাবনার বজেট ইনকম-ট্যাকস প্রভৃতি বিষয়ে ঠেকে নিভে গেছে।উৎসব হৃদয় মনে কাজ ক’রে গেছে একদিন সমুদ্রের নীল পথে মহেন্দ্র চলেছে-, সমস্ত ভারত শিলালিপির উদ্যমে আনন্দে ভ’রে গেছে; এরকম উৎসাহের দিন আজ তবু তো নেই আর? আমাদের কাজ আজ ছক ছলা,কিছু দূর চিন্তার সাধুতা ততদূর শব্দযোজনার সতর্ক সংগতি নিয়ে; মাঝে-মাঝে হৃদয়েরও খুচরো টুকরো ব্যবহার; (শাদা কালো রং এসে বার-বার- কেবলি মিশছে অন্ধকারে) সে-হৃদয় মানুষের আধুনিক সভ্যতার পটভূমিকায় শচীর মতন এসে দাঁড়াচ্ছে; অথবা সে ইন্দ্রাণীকে ভেদ ক’রে অহল্যার মতো; সহস্র চোখ না যোনি একদিন পরে আজ কলকাতায় ইন্দ্রের শরীরে? ইন্দ্র আজ এরা- ওরা; ইন্দ্রের আসনে আজ বেটপ্‌কা অন্তত বসা যায় শুল্ক আয়কর সুদ- বেশি খুদ-অল্পকে অস্পষ্টভাবে দিলে।          *                 *                  *                              আজো তবু অবিরাম প্রয়াণ চলেছে মানুষের : শব্দের অঙ্গার থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো ভাষা জ্ঞান জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন শববাহনের শক্তি খুঁজে তবু প্রেম পাওয়া যায় কিনা তার অক্লান্ত সন্ধানে ? মহাযুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে আবার যুদ্ধের ছায়া; পটভূমি দ্রুত স’রে গেলে রূঢ় দেয়ালের মুখোমুখি এসে আমরা সূর্যের যেই প্রাণ উজ্জ্বলতা চীনে কুরুবর্ষে গ্রীসে বেথলেহমে হারিয়ে ফেলেছি- তাকে শিশুসরলতা মূর্খের আরাধ্যে স্বর্গ ভেবে সূর্যের মধ্যন্দিন বড়ো ভাস্বরতা এখনও পাইনি খুঁজে । এখানে দিনের- জীবনের স্পষ্ট বড়ো আলো নেই; ধ্যানের সনির্বন্ধ অন্ধকার এখনো আসেনি । চারিদিকে ভোরের কি বিকেলের কাকজ্যোৎস্না ছায়ার ভিতরে আহত নগরীগুলো কোনো এক মৃত পৃথিবীর ভেতরের চিহ্ন ব’লে মনে হয়; তবু মৃত্যু এক শেষ শান্ত পবিত্রতা; আমাদের আজকের পৃথিবীর মানুষ নগরগুলো সে-রকম আন্তরিকভাবে মৃত নয়।বাজারদরের চেয়ে বেশি কালো টাকা-ঘুষ দিয়ে জীবনকে পাওয়া যাবে ভেবে যেন কোনো জীবনের উৎস-অন্বেষণে তারা সকলে চলেছে; পরস্পরের থেকে দূরে থেকে; ছিন্ন হ’য়ে; বিরোধিতা করেছে সকলের আগে নিজে- অথবা নিজের দেশ- নিজের নেশন সবের উপর সত্য মনে ক’রে,- জ্ঞানপাপে, অস্পষ্ট আবেগে ।মানুষের সকল ঘটনা গল্প নিস্ফলতা সফলতা যদি হাইড্রোজেনে পুড়ে ছাই হ’য়ে যায় তবে হ’য়ে যাক এ-রকম অপূর্ব অপ্রীতি চারাদিকে আমাদের রক্তের ভেতরে অনুরণিত হচ্ছেকোথাও সার্থককাম কেউ নয়; আমাদের শতাব্দীর মানুষের ছোটো বড়ো সফলতা সব মুষ্টিমেয় মানুষের যার-যার নিজের জিনিস, কোটি মানুষের মাঝে সমীচীন সমতায় বিতরিত হবার তা নয়। এইখানে মর্মে কীট র’য়ে গেছে মানুষের রীতির ভিতরে রীতির বিধানদাতা মানুষের শোকাবহ দোষে। প্রকৃতি আবিল কিছু, তবু মানুষের প্রয়োজন-মতো তাতে নির্মলতা আছে আরো কিছু আছে তাতে; যেন মানুষের সব-রকম প্রার্থনা মিটিয়ে বা না-মিটিয়ে প্রকৃতি ঘাসের শীর্ষে একফোঁটা নিঃশব্দ শিশিরে নিঃশব্দ শিশিরকণা- সব মূল্য বিনাশের তীরে।পাখিদের ডানা-পালকের থেকে বিকেলের আলো নিভে গেলে রাত্রির নক্ষত্রেরা হৃদয়ের আচ্ছন্নতা নেড়ে বাতাসের মুক্ত প্রবাহের মতো; যেন কোনো ঘুমন্তের মনে কথা কাজ চিন্তা স্বপ্ন অকুতোভয়তা নিজের স্বদেশে এলো।চারিদিকে অবিরল নিমিত্তের ভাগীর মতন এই সব আকাশ নক্ষত্র নীড় জল; মানুষের দিনরাত্রি প্রণয়নে অহেতুক নির্দেশের মতো র’য়ে গেছে শতাব্দীর আঁধারে আলোয়। কেউ তাকে না বলতে এ-পৃথিবী সকালের গভীর আলোয় দেখা দেয়; কেউ তাকে না চাইতে তবু ইতিহাসে দুপরের ঢেউ তার কেমন কর্কশ ক্রন্দনে কেঁপে ওঠে; নিসর্গের কাছ থেকে স্বচ্ছ জল পেয়ে তবু নদী মানুষের মূঢ় রক্তে ভ’রে যায়; সময় সন্দিগ্ধ হ’য়ে প্রশ্ন করে, ‘নদী, নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছো কি? মানুষের হৃদয়ের থেকে?' এইসব ভাল লাগে (এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল – এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে, পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল, নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; – পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসেকবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর; তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়; তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়; পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে; কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার। নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’ একটি কবিতা আমার আকাশ কালো হ'তে চায় সময়ের মির্মম আঘাতে জানি, তবু ভোরে রাত্রে, এই মহাসময়ের কাছে নদী খেত বনানীর ঝাউয়ের ঝরা সোনার মতন সূর্য তারাবীথির সমস্ত অগ্নির শক্তি আছে। হে সুবর্ণ, হে গভীর গতির প্রবাহ, আমি মন সচেতন;- আমার শরীর ভেঙ্গে ফেলে নতুন শরীর করো -নারীকে যে উজ্জ্বল প্রাণনে ভালোবেসে আভা আলো শিশিরের উৎসের মতন সজ্জন স্বর্ণের মতো শিল্পীর হাতের থাকে নেমে হে আকাশ, হে সময়গ্রন্থি সনাতন, আমি জ্ঞান আলো গান মহিলাকে ভালোবেসে আজ; সকলের নীলকন্ঠ পাখি জল সূর্যের মতন।    #বেলা অবেলা কালবেলা একটি নক্ষত্র আসে একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে সে আসবে মনে হয়; – আমার দুয়ার অন্ধকারে কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে! হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে সে এসে এগিয়ে দেয়; শিয়রে আকাশ দূর দিকে উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে অঘ্রানের রাত্রি হয়; এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ; চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়; সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে। একটি পুরোনো কবিতা আমরা মৃত্যুর দিকে জেগে উঠে দেখি চারিদিকে ছায়া ভরা ভিড় কুলোর বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন পেয়ে যায়- পেয়ে যায়- অণুপরমাণুর শরীরএকটি কি দু’টি মুখ- তাদের ভিতরে যদিও আমি দেখিনি কোনোদিন- তবুও বাতাসে প্রথম গার্গীর মতো- জানকীর মতো হয়ে ক্রমে অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে। একদিন এই দেহ ঘাস একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায় জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন; বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাঙচিল শালিখের মতন স্বাধীন; বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার; একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে —নীল ধোঁয়া নরম মলিন বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ; ফেনসা ভাতের গন্ধে আম —মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার —বার;এই সব দেখেছিল রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে, শিখেছিল, সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে; তারপর বেত বনে,জোনাকি ঝিঝির পথে হিজল আমের অন্ধকারে ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে করে,রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে – ঘুমন্ত — কন্যারে সেই —জাগাতে যায়নি আর — হয়তো সে কন্যার হৃদয় শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো — ঘুম তবু ভাঙিবার নয়। একদিন কুয়াশার এই মাঠে একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি; হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে, অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে, আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়? সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে, মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে – কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে – একদিন খুঁজেছিনু যারে- একদিন খুঁজেছিনু যারে বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে, মালতীলতার বনে, কদমের তলে, নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে! -যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুজিয়াছিনু ঝরঝর কামিনীর ব্যথার শিয়রে যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে, আর্ত কোলাহলে তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়- আজ মনে হয় পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা@ -শুধু শেষ নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া! মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর শোনে নাই কেউ গাগরীর কোলে তার উত্থলিয়া ওঠে নাই আমাদের গাঙিনীর ঢেউ! নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথের চুপে চুপে ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি! মনে হয় শুধু আমি, আর শুধু তুমি আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে কানে কত কাল কহিয়াছি আধো আধো কথা! আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া! পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি! এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ! মাহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি! মসজেদ-সরাই-শরাব ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলেজার তাপ! দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ-আলেয়ার শিখা! পদে পদে নাচে ফণা, পথে পথে কালো যবণিকা! কাতর ক্রন্দন,- কামনার কবর-বন্ধন! কাফনের অভিযান, অঙ্গার সমাধি! মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি! মর্‌মর্‌ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন- আধো আঁধারের দেশে বারবার আসে ভেসে কার সুর!- কোন্‌ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর কেঁদে মরে মন! একদিন জলসিড়ি নদীর ধারে একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ন বটের নীচে শুয়ে রব- পশমের মত লাল ফল ঝরিবে বিজন ঘাসে-বাঁকা চাঁদ জেগে রবে- নদীটির জল বাঙ্গালি মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে-তারপর যেই ভাঙ্গা ঘাটে রূপসীরা আজ আর আসে নাকো,পাট শুধু পচে অবিরল, সেইখানে কলমির দামে বেধে প্রেতনীর মত কেবল কাঁদিবে সে সারা রাত-দেখিব কখন কারা এসে আমকাঠেসাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবনের বিস্মিত আকাশ চেয়ে রবে; ভিজে পেচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে; চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-শাদা শাখা-বাংলার ঘাস আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে ভাঙ্গিতেছে ধীরে ধীরে-চারিদিকে জীবনের এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস- একদিন পৃথিবীর পথে একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফেলিয়াছি, আমার শরীর নরম ঘাসের পথে হাঁটিয়াছে; বসিয়াছে ঘাসে দেখিয়াছে নক্ষত্রের জোনাকিপোকার মতো কৌতুকের অমেয় আকাশে খেলা করে; নদীর জলের গন্ধে ভরে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর অন্ধকারে; পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির, স্লান চুল দেখা যায়; সান্ত্বনার কথা নিয়ে কারা আসে – ধূসর কড়ির মতো হাতগুলো — নগ্ন হাত সন্ধ্যার বাতাসে দেখা যায়: হলুদ ঘাসের কাছে মরা হিম প্রজাপতিটিরসুন্দর করুণ পাখা পড়ে আছে — দেখি আমি; — চুপে থেমে থাকি; আকাশে কমলা রঙ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায় — কাকগুলো নীল মনে হয়; অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই — কথা কই — হাতে হাত রাখি; করুণ বিষন্ন চুলে কার যেন কোথাকার গভীর বিষ্ময় লুকায়ে রয়েছে বুঝি… নক্ষত্রের নিচে আমি ঘুমাই একাকী; পেঁচার ধূসর ডানা সারারাত জোনাকির সাথে কথা কয়। একদিন যদি আমি একদিন যদি আমি কোনো দূর বিদেশের সমুদ্রের জলে ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে — আসি নাকো তোমাদের মাঝে ফিরে আর — লিচুর পাতার ‘পরে বহুদিন সাঁঝে যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি, — একদিন নক্ষত্রের তলে কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আনারসী শাড়ির আচঁলে ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চলে যাও জীবনের কাজে, এই শুধু… বেজির পায়ের শব্দ পাতার উপড়ে যদি বাজে সারারাত… ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলেযদি সে পাতার ‘পরে, — শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ — ধূসর চিবুক, বাম হাত চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে, তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে — সে হার ফিরাযে দিয়ে দিতে যখন কে এক ছায়া এসেছিল… দরজায় করেনি আঘাত।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা এখন ওরা এখন ওরা ভোরের বেলা সবুজ ঘাসের মাঠে হো-হো ক’রে হাসে- হো-হো হি-হি ক’রে, অসংখ্য কাল ভোর এসেছে- আজকে তবু ভোরে সময় যেন ঘোড়ার মত নিজের খুরের নাল হারিয়ে ফেলে চমকে গিয়ে অনন্ত সকাল হয়ে এখন বিভোর হয়ে আছে; মাঠের শেষে ঐ ছেলেটি রোদে শুয়ে আছে ঐ মেয়েটির কাছে।অনেক রাজার শাসন ভেঙে গেছে; অনেক নদীর বদলে গেছে গতি; আবহমান কালের থেকে পুরুষ-এয়োতি এই পৃথিবীর তুলোর দণ্ডে সোনা সবার চেয়ে দামী ভেবে সুখের সাধনা নষ্ট ক’রে গিয়েছে তবু লোভে; ওরা দু’জন ভালোবাসে অনন্ত ভোর ভ’রে এ ছাড়া 'আজ সকল সূর্য ডোবে। এখানে আকাশ নীল এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন; আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন, ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ; মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল,কবেকার কোকিলের জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু’পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল, কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়- থেমে থেমে যায়;- অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায় কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল। এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে; এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে; জামের আড়ালে সেই বউকথাকওটিরে যদি ফেল দেখে একবার — একবার দু’পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে ধরা দাও — তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে; মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে রব আমি চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে;উঠানে কে রূপবতী খেলা করে — ছাড়ায়ে দিতেছে বুঝি ধান শালিখের; ঘাস থেকে ঘাসে ঘাসে খুঁটে খুঁটে খেতেছে সে তাই; হলুদ নরম পায়ে খয়েরি শালিখগুলো ডরিছে উঠান; চেয়ে দ্যাখো সুন্দরীরে : গোরোচনা রূপ নিয়ে এসেছে কি রাই! নীলনদে — গাঢ় রৌদ্রে — কবে আমি দেখিয়াছি — করেছিল স্নান এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় — সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে মাটির ভিটের ‘পরে — লেগে থাকে অন্ধকারে ধুলোর আঘ্রাণ তাহাদের চোখে — মুখে; — কদমের ডালে পেঁচা কথা কবে — কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান সাপমাসী পোকাটিরে… সেই দিন আঁধারে উঠিবে নড়ে ধান ইঁদুরের ঠোঁটে — চোখে; বাদুড়ের কালো ডানা করমচা পল্লবেকুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়, কেউ তাহা দেখিবে না; — সেদিন এ পাড়াগাঁর পথের বিষ্ময় দেখিতে পাবো না আর — ঘুমায়ে রহিবে সব; যেমন ঘুমায় আজ রাতে মৃত যারা; যেমন হতেছে ঘুমে ক্ষয় অশ্বত্থ ঝাউয়ের পাতা চুপে — চুপে আজ রাতে, হায়; যেমন ঘুমায় মৃতা, — তাহার বুকের শাড়ি যেমন ঘুমায়। এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা; চালতার পাতা থেকে টুপ — টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির; কুয়াশায় সি’র হয়ে ছিল স্নান ধানসিড়ি নদীটির তীরে; বাদুড় আধাঁর ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা আকাঙ্খার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির…. কিশোরীর ভিড় আমের বউল দিল শীতরাতে; — আনিল আতার হিম ক্ষীর; মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম, — এ কবিতা লেখাতাহাদের ম্লান মনে কবে, তাহাদের কড়ির মতন ধূসর হাতের রূপ মনে করে; তাহাদের হৃদয়ের তরে। সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে : আমার বিষন্ন স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে। ওগো দরদিয়া -ওগো দরদিয়া তোমারে ভুলিবে সবে, যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া; ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে কে জানে রহিবে কোথা নিশিভারে নেশাখোর আঁখি তব বুজে! -হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে! চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে, গীতিহারা প্রাণ তবে হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে! হয়তো বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে শিশিরের দলে; হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি রবে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা- তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ-নীহারিকা-তারা, তোমারে চিনিবে শুধু প্রেম জোছনা-বধির জোনাকি! তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন-আলোহারা, তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা! কিংবা কেহ চিনিবে না, হয়তো বা জানিবে না কেহ কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ! -হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান’শালে যাহাদের সনে, তোমার বিষাদ-হর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে, যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি তোমারে ভুলিবে তারা- ভুলে যাবে সব কথা, সবটুকু স্মৃতি! নাম তব মুছে যাবে মুসাফের-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি নোনা ধরা দেয়ালের বুক থেকে খসে যাবে কখন না জানি! তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি, দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি! তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে! পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন, কোথা গেছে ইয়োসোফ্‌ জানে না সে, জানে না সে গিয়েছে কখন। জানে না যে, অজানা সে, আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে- জানে না রে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে! জানিতে চাহে না কিছু-ঘাড় নিচু করে কে বা রাখে আঁখি বুজে অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে! যৌবনের কোন্‌ এক নিশীথে সে কবে তুমি যে আসিয়াছিলে বনরানি। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি তুমি যে ভরিয়াছিলে-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ, গেছে ফুরায়ে তলানি। তবু তুমি আসিলে না, বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়! চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়- তুমি তাহা জানিলে না-চলে গেছে মুসাফের কবে ফের দেখা হবে আহা কে বা জানে! কবরের পরে তার পাতা ঝরে, হাওয়া কাঁদে হা হা! কখন সোনার রোদ নিভে গেছে কখন সোনার রোদ নিভে গেছে — অবিরল শুপুরির সারি আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস; কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি : ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ, কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?এই মাঠে — এই ঘাসে ফল্‌সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে আজও তার যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক — দুপুরের রোদে সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি — অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে তাহার দু-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে পৃথিবীর রাঙা রোদে চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে — জানি সে আমার কাছে আছে আজো — আজো সে আমার কাছে কাছে। কত দিন ঘাসে আর মাঠে কত দিন ঘাসে আর মাঠে আমার উৎসাহে প্রাণ কাটে খড় খুঁটি—অশ্বথ্থের শুকনো পাতা চুপে উল্টাই দু’একটা পোকা যদি পাই আমারে চেনো না নাকি: আমি যে চড়াই। কতদিন তোমাদের ভোরের উঠানে দু’-একটা খই আর মুড়কির ঘ্রাণে উড়ে আসি চুপে দেখি কোনো রূপে চাল ডাল ছোলা ক্ষুদ খুঁজে পাই কিনা ঝুরঝুর ক’রে ফুল ফুরায় সজিনা থুপ্‌ থুপ্‌ থুপ্‌ থুপ্‌—একাকী লাফাই ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই - থুপ্ থুপ্ থুপীর মতন দেখিনি কি করি আহরণ চিনি মিঠাইয়ের গুঁড়ি—মিশ্রির কণা ছাতু আটা…কলসীর পাশে বুঝি নাচিছে খঞ্জনা! আকাশে কতটা রোদ তোমাদের এত কি আমোদ। ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েদের দল উঠানে কিসের এত ভিড় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে—তোমাদের নরম শরীর হাতে তবু পাটকেল—ঢিল ? আমারে তাড়াও কেন? আমি বুঝি দাঁড়কাক চিল! চীনেবাদামের খোসা শূন্য ঠোঙা এই শুধু চাই আমি যে চড়াই। যাই উড়ে যাই জানালার পাশে বোলতার চাক খুব বড়ো হয়ে আসে হলদে বোলতা পাখি, ভাই এসেছি চড়াই এনেছি একটা কুটো আর এক খড় এই নিয়ে ঘরের ভিতর আমিও বানাবো এক ঘর কি বলো তোমরা ভাটের বনের থেকে এলে কি ভোমরা মধু পেলে খুঁজে সারাদিন একটুও ঘুমাইনি,—চোখ আসে বুজে মাকড়শা, অন্ধকারে আছো তুমি মিশে এখানে কার্ণিশে আমারে ঘুমাতে দেবে ভাই আমি যে চড়াই— থাক ঘুম—যাই উড়ে যাই আমি যে চড়াই। ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই কাঠমল্লিকায় কাঁঠালী শাখায় করবীর বনে হিজলের সনে বেগুনের ভিড়ে ঘাসের শরীরে যাই—যাই—যাই চাই—চাই—চাই গাই—গাই—গাই ঘুম নাই—নাই আমি যে চড়াই। তবু একদিন যখন হলুদ তৃণ ভ’রে আছে মাঠে পাতায় শুকনো ডাঁটে ভাসিছে কুয়াশা দেখিলাম খানিকটা রোম মাঠের কিনারে ঘাসে—নির্জন নরম শিশিরে রয়েছে ডুবে—চোখ বুজে আছে কেমন সহিষ্ণু ছায়া মুখের উপরে পড়িয়াছে বহুক্ষণ আমারে থাকিতে বলে এইখানে এই স্থির নীরবতা, এই করুণতা মৃত্যুরে নিঃশেষ ক’রে দেয় নাকি: নক্ষত্রের সাথে কয় নাকি কথা ? এর চেয়ে বেশি রূপ, বেশি রেখা, বেশি করুণতা আর কে দেখাতে পারে আকাশের নীল বুকে—অথবা এ ধুলোর আঁধারে।। কত ভোরে- দু’-পহরে কত ভোরে- দু’-পহরে – সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;- খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান কোন এক রাজকন্যা- পরনে ঘাসের শাড়ি- কালো চুলে ধান বাংলার শালিধান- আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ, হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার- ঘুম নাই, নাইকো মরণ তার আর কোনোদিন- পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো স্লান, লক্ষ্ণীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ- সারাদিন- সারারাত বুকে ক’রে আছে তারে শুপুরির বন;সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির- শ্রীমন্তও দেখেছে এমন : যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক, সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন দেখিয়াছে- অকস্মাৎ গাঢ় নীল : করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক শুনিয়াছে- সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন। কতদিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি কতদিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে; — সন্ধ্যার ধূসর সজল মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে — বাদুড় কেবল করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে — ছিন্ন ভিজে খড় বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন পড়ে আছে নরম প্রান্তর; বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে — কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল নিঃশব্দ গুবরে পোকা — সাপমাসী — ধানী শ্যামাপোকাদের দল; দিকে দিকে চালধোয়া গন্ধ মৃদু — ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বরশোনা যায় — মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব বেদনার গন্ধ ভাসে — খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি বুঝেছি এই সব; সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি এইসব। কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দুজনে; আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস সাজায়েছে, — মাঠ থেকে গাজন গানের স্নান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস ভেসে আসে; ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে আকন্দ বনের দিকে; একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ দু’মুহূর্ত ভরে রাখে — তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস পড়ে থাক: লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে বনেআধো ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কতদিন তুমি হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো বসেছ আমার কাছে এইখানে — আসিয়াছে শটিবন চুমি গভীর আঁধার আরো — দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত আসা — যাওয়া আমরা দুজনে বসে বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত মাঠ ও চাঁদের কথা: ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো। কবি ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপনে! নিরালায় সুর সাথি, বাঁধি মোর মানসীর বেণী, মানুষ দেখে নি মোরে কোনোদিন, আমারে চেনে নি! কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায় নি মোর চারি পাশে- শুধায় নি কেহ কভু-আসে কি রে,- সে কি আসে-আসে। আসে নি সে ভরাহাটে-খয়াঘাটে-পৃথিবীর পসরায় মাঝে পাটনী দেখে নি তারে কোনোদিন-মাঝি তারে ডাকে নিকো সাঁঝে। পরাপার করে নি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,- চেনা-চেনা মুখ সবই-সে যে সুদুর-অজানা!করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে, রূপসাগরের মাঝে কোন্‌ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে! সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে; খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে, বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা, ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে বকবধুটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে! হয়তো শুনেছ তারে-তার সুর, দুপুর আকাশে ঝরাপাতাভরা মরা দরিয়ার পাশে বেজেছে ঘুঘুর মুখে, জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায় হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পুবালি হাওয়ায়!হয়তো দেখেছ তারে ভুতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের পরে নিভে যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে! শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় সেই জোছনা ভাসে তারই বুকে চুপে চুপে কবি আসে সুর তার আসে। উস্‌খুস্‌ এলো চুলে ভরে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,- তারই পাশে সুর ভাসে অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!বালুঘড়িটির বুকে ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি গান যবে বাজে রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে, অকাজে! ঘুমকুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি, মধুমাছি,ঘাস হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী সাড়ে, বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে, তেঁতুলের শাখে শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে, মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে- আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে- জ্বলে ওঠে আলোয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি। আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্‌ পাষাণী!জানে না তো কী যে চায়- কবে হায় কী গেছে হারায়ে। চোখ বুজে খোঁজে একা-হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে কারে আহা।-কাঁদে হা হা পুরের বাতাস, শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস! তারই লাগি মুখ তোলে কোন মৃতা-হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা, তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়াপুত্তলিকা! কবিতা আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছে ভেসে; তা না হ'লে সকলি হারায়ে যেতো ক্ষমাহীন রক্তের- নিরুদ্দেশে। হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর; তারপর হ'য়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের। ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই, নেই কোনো নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে। বানরী ছাগল নিয়ে যে- ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে- আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-                                         খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে। চামচিকা যার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ুসন্তরণে; প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে; জীর্ণতম সমাধির ভাঙ্গা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝিঁ-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিষ্কার একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জ্যোৎস্নার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায় যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার। হে আকাশ, হে আকাশ, একদিন ছিলে তুনি মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের মতো; তারপর হ'য়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার! কমলালেবু একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোমো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে। কয়েকটি লাইন কেউ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী – আমি বহে আনি; একদিন শুনেছ যে সুর – ফুরায়েছে পুরনো তা — কোনো এক নতুন কিছুর আছে প্রয়োজন, তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন আর নাই কেউ! সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ আজিকার: শেষ মুহুর্তের আমি এক — সকলের পায়ের শব্দের সুর গেছে অন্ধকারে থেমে; তারপর আসিয়াছি নেমে আমি; আমার পায়ের শব্দ শোনো – নতুন এ, আর সব হারানো — পুরনো। উৎসবের কথা আমি কহি নাকো, পড়ি নাকো দুর্দশার গান, কে কবির প্রাণ উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে – সেই কবি — সেও যাবে সরে; যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ শুধু জেনেছে বিষাদ, মাটির আর রক্তের কর্কশ স্বাদ, যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে যে বকেছে — সেও যাবে সরে; একে একে সবই ডুবে যাবে — উৎসবের কবি, তবু বলিতে কি পারো যাতনা পাবে না কেউ আরো? যেইদিন তুমি যাবে চ’লে পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে? কিংবা যদি গায় — পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার? আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার সেদিনের পুরানো আঘাত ভুলিবে সে? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি — দিন তাহাদের আর্ত ডান হাত ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ; সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ ভুল মনে হবে; সৃষ্টির বুকের পরে ব্যথা লেগে রবে, শয়তানের সুন্দর কপালে পাপের ছাপের মতো সেইদিনও! – মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে, রোগা পায়ে করে পায়চারি, দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি সৃষ্টির দেয়ালে – আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে? যেই উড়ো উৎসাহের উৎসবের রব ভেসে আসে — তাই শুনে জাগে নি উৎসব? তবে কেন বিহ্বলের গান গায় তারা! — বলে কেন, আমাদের প্রাণ পথের আহত মাছিদের মতো!উৎসবের কথা আমি কহি নাকো, পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান; শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান – তাই আসি, নানা কাজ তার আমরা মিটায়ে যাই – জাগিবার কাল আছে — দরকার আছে ঘুমাবার; এই সচ্ছলতা আমাদের;আকাশ কহিছে কোন্‌ কথা নক্ষত্রের কানে? আনন্দের? দুর্দশার? পড়ি নাকো। সৃষ্টির আহ্বানে আসিয়াছি। সময়সিন্ধুর মতো: তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে, জানি, রয়েছ তাকায়ে, ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে ঘুম ভেঙে যায় বার বার তোমার — আমার! জানি না তো কোন্‌ কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে, ওপারের থেকে; সমুদ্রের কানে কোন্‌ কথা কই আমি এই পারে — সে কি কিছু জানে? আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে, ঢেউয়ের হোঁচট লাগে গায়ে ঘুম ভেঙে যায় বার বার তোমার আমার!কোথাও রয়েছ, জানি, তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে; পথ চলি — ঢেউ ভেজে পায়ে; রাতের বাতাস ভেসে আসে, আকাশে আকাশে নক্ষত্রের পরে এই হাওয়া যেন হা হা করে! হু হু করে ওঠে অন্ধকার! কোন্‌ রাত্রি — আঁধারের পার আজ সে খুঁজিছে! কত রাত ঝরে গেছে — নিচে — তারও নিচে কোন্‌ রাত — কোন্‌ অন্ধকার একবার এসেছিল — আসিবে না আর। তুমি এই রাতের বাতাস, বাতাসের সিন্ধু — ঢেউ, তোমার মতন কেউ নাই আর! অন্ধকার — নিঃসাড়তার মাঝখানে তুমি আনো প্রাণে সমুদ্রের ভাষা রুধিবে পিপাসা যেতেছে জাগায়ে ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে ঝরিতেছ জলের মতন – রাতের বাতাস তুমি — বাতাসে সিন্ধু — ঢেউ, তোমার মতন কেউ নাই আর!গান গায়, যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে, সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে, যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে, নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে যেই খানে, পৃথিবীর কানে শস্য গায় গান, সোনার মতন ধান ফ’লে ওঠে যেইখানে – একদিন — হয়তো — কে জানে তুমি আর আমি ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি সেইখানে বর পড়ে! যেখানে সমস্ত রাত্রি রক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে, সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে, গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে।ঘুমাতে চাও কি তুমি? অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই? – ঢেউয়ের গানের শব্দ সেখানে ফেনার গন্ধ নাই? কেহ নাই — আঙুলের হাতের পরশ সেইখানে নাই আর – রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস সেইখানে নাই তাহা কিছু; ঢেউয়ের গানের শব্দ যেখানে ফেনার গন্ধ নাই – ঘুমাতে চাও কি তুমি? সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই! তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন? — নক্ষত্রের তলে অনেক চলার পথ — সমুদ্রের জলে গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর — বাজে – ফুরাবে এ — সব, তবু…. তুমি যেই কাজে ব্যস্ত আজ — ফুরাবে না জানি; একদিন তবু তুমি তোমার আঁচলকানি টেনে লবে; যেটুকু করার ছিল সেইদিন হয়ে গেছে শেষ, আমার এ সমুদ্রের দেশ হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেইদিন, — আমার এ নক্ষেত্রের রাত হয়তো সরিয়া গেছে — তবু তুমি আসিবে হঠাৎ গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে, অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময়! চাঁদ জেগে রয় তারা ভরা আকাশের তলে, জীবন সবুজ হয়ে ফলে, শিশিরের শব্দে গান গায় অন্ধকার, আবেগ জানায় রাতের বাতাস! মাটি ধুলো কাজ করে — মাঠে মাঠে ঘাস নিবিড় — গভীর হয়ে ফলে! তারা ভরা আকাশের তলে চাঁদ তার আকাঙ্খার স্থল খুঁজে লয় – আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়। একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা, ভুলে গেছ আজ তার ভাষা! জানি আমি, তাই আমিও ভুলিয়া যেতে চাই একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা তার স্মৃতি আর তার ভাষা; পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে, একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে যে — মুহুর্তে; একবার হয়ে গেছে, তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে একবার হেঁটেছে যে, তাই যার পায়ে চলিবার শক্তি আর নাই; সব চেয়ে শীত, তৃপ্ত তাই। কেন আমি গান গাই? কেন এই ভাষা বলি আমি! এমন পিপাসা বার বার কেন জাগে! পড়ে আছে যতটা সময় এমনি তো হয়। কাউকে ভালোবেসেছিলাম কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি তবুও ভালোবাসা, দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির নেমে আসা, ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই যাই চলে যাই- নীল সকালে যাই চলে যাই- একটি নদী একটি অরূণ শিউলি শিশির পাখি- 'আমরা মায়ার মনের জিনিস মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি' বলছে সে কোন্‌ ত্রিকোণ থেকে ছায়ার পরিভাষা। কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি, তবুও ভালোবাসা। সে কোন্‌ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ হায়, যাযাবর তুমি, সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা। কার্তিক ভোরে : ১৩৪০ কার্তিকের ভোরবেলা কবে চোখে মুখে চুলের উপরে যে- শিশির ঝরলো তা শালিখ ঝরালো ব'লে ঝরেআমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিখ কার্তিকের রোদে আর জলে আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলেপা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর থেকে উড়ে যায় এ জীবনে ঢের শালিখ দেখেছি তবু সেই তিনজন শালিখ কোথায়। কার্তিক মাঠের চাঁদ জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ — পাহাড়ের মতো অই মেঘ সঙ্গে লয়ে আসে মাঝরাতে কিংবা শেষরাতে আকাশে যখন তোমারে! — মৃত কে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে! ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চলে তরাসে ছেলের মতো– আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক সময়– তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে– চাঁদ– পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়, একদিন হয়েছে যা– তারপর হাতছাড়া হয়ে হারায়ে ফুরায়ে গেছে– আজও তুমি তার স্বাদ লয়ে আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছ এসে! নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে, শস্যের ক্ষেত চেষে চেষে গেছে চাষা চ’লে; তাদের মাটির গল্প– তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে অনেক তবুও থাকে বাকি– তুমি জানো– এ পৃথিবীর আজ জানে তা কি! কার্তিক-অঘ্রাণ ১৯৪৬ পাহাড়, আকাশ, জল অনন্ত প্রান্তরঃ সৃজনের কী ভীষণ উৎস থেকে জেগে কেমন নীরব হয়ে রয়েছে আবেগ; যেন বজ্রবাতাসের ঝড় ছবির ভিতরে স্থির- ছবির ভিতরে আরো স্থির।কোথাও উজ্জ্বল সূর্য আসে; জ্যোতিষ্কেরা জ্ব'লে ওঠে সপ্রতিভ রাতে আদি ধাতু অনাদির ধাতুর আঘাতে নারীশিক্ষা হত যদি পুরুষের পাশেঃ আকাশ প্রান্তর নীল পাহাড়ের মত নক্ষত্র সূর্যের মত বিশ্ব-অন্তর্লীন উজ্জ্বল শান্তির মত আমাদের রাত্রি আর দিন হবে নাকি ব্রহ্মান্ডের লীন কারুকার্যে পরিণত। কার্ত্তিকের ভোর- ১৩৫০ চারিদিকে ভাঙনের বড় শব্দ,           পৃথিবী ভাঙার কোলাহল; তবুও তাকালে সূর্য পশ্চিমের দিকে           অস্ত গেলে,... চাঁদের ফসল                    পূবের আকাশে হৃদয় বিহীনভাবে আন্তরিকতা ভালবাসে। তেরোশো পঞ্চাশ সালে কার্ত্তিকের ভোর;           সূর্যালোকিত সব স্থান যদিও লঙ্গরখানা,           যদিও শ্মশান, তবুও কল্কির ঘোড়া সরায়ে মেয়েটি তার যুবকের কাছে           সূর্যালোকিত হয়ে আছে। কিশোরের প্রতি যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির ঢালো নি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর উর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী আসে নি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু বিষবহ্নি ঢালে নিকো বাসনার বধূ অন্তরের পানপাত্রে তব; অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব, অশ্রুহীন হাসি, কামনার পিছে ঘুরে সাজো নি উদাসী। ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে! নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান। অপরূপ রূপ-পরীস্থান দিগন্তের আগে। তোমার নির্মেষ চক্ষে কভু নাহি জাগে! আকাশকুসুবীথি দিয়া মাল্য তুমি আনো না রচিয়া ছলাময় গগনের নিচে! -রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে করো নিকো করাঘাত তুমি সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি সাজো নিকো নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল! অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল, রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজও রানী, রুধির নিঙাড়ি তব আজও দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন! কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন, দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহরীর লও নি তুলিয়া, -সুকুমার কিশোরের হিয়া! -জীবনসৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী, বক্ষে তব নাচে নিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি; শূল-তোলা শম্ভূর মতন আস্ফালিয়া উঠে নাই মন মিথ্যা বাধাবিধানের ধ্বংসের উল্লাসে! তোমার আকাশে দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠে নিকো জ্বলি কক্ষচ্যুত, উল্কাসম পড়ে নিকো স্খলি, কুজ্ঝটিকা আবর্তের মাঝে অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে! সব বিঘ্ন সকল আগল ভাঙিয়া জাগো নি তুমি স্পন্দন-পাগল অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাও নি প্রাণে! নিঃস্ব দুটি অঞ্চলির আকিঞ্চন মাগি সাজো নিকো দিকভোলা দিওয়ানা বৈরাগী! পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু বাজাও নি শ্মশান-ডমরু! জোছনাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর চক্ষে তব জাগে নি কিশোর! আঁধারের নির্বিকল্প রূপ, স্পন্দহীন বেদনার কূপ রুদ্ধ তব বুকে; তোমার সম্মূখে ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল সুন্দরীর বেশে, নিত্য বেলাশেষে যেই পুষ্প ঝরে, যে বিরহ জাগে চরাচরে, গোধূলির অবসানে শ্লোকম্লান সাঁঝে, তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে, আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা, ব্যথার সংহিতা গাহ নাই তুমি! দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি জ্বলন্ত নিষ্ঠুর! নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর, ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি! সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী মলিন করে নি তব মানসের ছবি, ফেনিল করে নি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো, এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো! কুড়ি বছর পরে আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয় আবার বছর কুড়ি পরে- হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে- তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর, ব্যস্ততা নাই আর, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড় থেকে খড় ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল ! জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,- তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার ! হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার, শিরীষের অথবা জামের ঝাউয়ের-আমেরঃ কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার- তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার ! তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে- বাবলার গলির অন্ধকারে অশথের জানালার ফাকে কোথায় লুকায় আপনাকে ! চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে ! কেন মিছে নক্ষত্রেরা কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ? কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে? কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে                                     ফুটে ওঠে কাশ? খঞ্জনারা কেন নাচে? বুলবুলি দুর্গাটুনটুনি কেন ওড়াওড়ি করে                                             বনে বনে? আমরা যে কমিশন নিয়ে ব্যস্ত- ঘাটি বাঁধি- ভালিবাসি নগর ও                                         বন্দরের শ্বাস ঘাস যে বুতের নীচে ঘাস শুধু- আর কিছু নয় আহা- মোটের যে                                 সবচেয়ে বড় এই মানব্জীবনে খঞ্জনারা নাচে কেন তবে আর- ফিঙা বুলবুলি কেন উড়াউড়ি করে                                                 বনে বনে? কেমন বৃষ্টি ঝরে কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ কেমন সবুজ পাতা—জামীর সবুজ আরও—ঘাস যে হাসির মতো—রোদ যে সোনার মতো ঘাসে সোনার রেখার মতো—সোনার রিঙের মতো—রোদ যে মেঘের কোলে—তোমার গালের টোলে রোদ তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ আকাশে সোনালি চিল পাখনা ছড়ায়ে কাঁদে—(এমন সোনালি চিল)—সোনালি রেণুর মতো ঝরিছে কান্না আহা, মিশরে শুনেছি যেন কবে আকাশে এমন ছেঁড়া ময়লা মেঘের রাশ—পড়েছে তাদের ছায়া নীলের ঘোলা জলে নিঝুম পিরামিডে এমনই সোনালি রোদ—সোনার থামের মতো—ঘিয়ের শিখার মতো রয়েছে আকাশ ছিঁড়ে তবু কেঁদেছে সোনালি চিল এমনই আকাশ ঘুরে—শুনেছি মিশরে আমি হাজার হাজার যুগ আগে তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ কোথাও চলিয়া যাবো একদিন কোথাও চলিয়া যাব একদিন;-তারপর রাত্রির আকাশ অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি; জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস বুকে নিয়ে তাহাদের;-জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে- কাঁঠাল শাখার থেকে নামি পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী ধানী শাল পশমিনা বুকে তার -শরতের রোদের বিলাস কতো কাল নিঙড়াবে;-আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু; আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু মুখে গুজে পড়ে রবে-আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি; মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু- কোথাও দেখি নি কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস — প্রান্তরের পারে নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে– নীল বুকে আছে তাহাদের গঙ্গাফরিঙের নীড়,কাঁচপোকা, প্রজাপতি শ্যামাপোকা ঢের, হিজলের ক্লান্ত পাতা– বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে তাহাদের শ্যাম বুকে–পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে বেতের নরম ফল, নাটা ফক খেতে আসে,ধুন্দুল বীজের খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে– বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের শালিখ, খন্জনা তাহা– লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু-ধারেনরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শুয়ে সে কোন দিনের কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায় নি, মজে নি আকাশ, বল্লাল সেনের ঘোড়া– ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের শব্দ হত এই পথে–আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ টেনে টেনে এই পথে– কি যেন খুঁজেছে আহা, হয়েছে উদাস; আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু–নাটা ফলে মিটিতেছে আশ- কোথাও দেখিনি আহা এমন বিজন ঘাস কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস – প্রান্তরের পারে নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে-নীল বুকে আছে তাহাদের গঙ্গাফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের, হিজলের ক্লান- পাতা,- বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে তাহাদের শ্যাম বুকে,-পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে বেতের নরম ফল, নাটা ফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে-বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের শালিখ খঞ্জনা তাহা; লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারেনরম কান্তারে এই পাড়াগার বুকে শুয়ে সে কোন্‌ দিনের কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায়নি, মজেনি আকাশ, বল্লাল সেনের ঘোড়া-ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের শব্দ হত এই পথে আরো আগে রাজপুত্র কতো দিন রাশ টেনে টেনে এই পথে কি যেন খুঁজেছে, আহা হয়েছে উদাস, আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু- নাটাফলে মিটিতেছে আশ- কোথাও মঠের কাছে কোথাও মঠের কাছে — যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে শ্যাওলায় — অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর, পাশে দীঘি মজে আছে — রূপালী মাছের কন্ঠে কামনার স্বর যেইখানে পটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে বহু বহু দিন আগে — যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা — ঝিলমিল — কড়ি খেলা ঘর; কোন্‌ যেন কুহকীর ঝাঁড়ফুঁকে ডুবে গেছে সব তারপর একদিন আমি যাব দু-প্রহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে,সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকে — দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা বেতের বনের ফাঁকে — জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায় রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়, — শাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া আলোকতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফু বাসকের গায়; তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাবো একদিন পাটকিলে ঘোড়া যার রূপ জন্মে — জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়। কোথায় গিয়েছে কোথায় গিয়েছে আজ সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া- সেই শাদা দালানের নারী? বাবলা ফুলের গন্ধে-সোনালি রোদের রঙ্গে ওড়া সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া চলে গেছে আমাদের এ পৃথিবী ছেড়ে; হৃদয় কোথায় বলো-কোথায় গিয়েছে আজ সব অন্ধকার; মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব। কোনো এক ব্যথিতাকে এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ। নরম আঁধার ঘর শান্তি নিস্তব্ধতা; এখন ভেবো না কোনো কথা এখন শোনো না কোনো স্বর রক্তাক্ত হৃদয় মুছে ঘুমের ভিতর রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো। কোনোদিন দেখিব না তারে আমি কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে, সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে, যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান, যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান, ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে; প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে। কোহিনূর তোমারে ঘেরিয়া জাগে কত স্বপ্ন–স্মৃতির শ্মশান, ভুলুণ্ঠিত লুব্ধ অভিযান; সাম্রাজ্যের অশ্রু, রক্ত, সমাধি, পতন হে হীরক, একে একে করেছ চুম্বন! স্পর্শে তব অনাদি অতীত যেন নিরন্তর মর্মে ওঠে ধ্বনি! মাধবের বক্ষে তুমি ছিলে কি গো স্যমন্তক মণি! শ্ৰীহরির বনমালা চুমি দিব্য গন্ধে অকলঙ্ক অঙ্ক তব ভরেছিলে তুমি ওগো কোহিনূর। হৃদে তব আজও বুঝি গাঁথা আছে গোপনীয় বাঁশরির সুর, যুগান্তের গাঢ় নীল পুলিনের ভাষা, বাসনা পিপাসা! অরুণ ময়ুখ স্পর্শে নিশান্তের স্বপ্ন যাও ভুলি! নব নবীনের লাগি যুগে যুগে উঠিছ মুকুলি অভিনব রূপে! নির্মম কালের অগ্নি-অঙ্গারের স্তুপে দেহ তব যায় না দহিয়া হে অটুট বজ্ৰমণি, কোটি কোটি প্রেমিকের বরণীয়া প্রিয়া। গিয়েছিলে কবে তুমি পাঠানের অন্তঃপুরে পশি সুলতান-প্ৰেয়সী! হারেমের অন্ধকারে লক্ষ বাদী বেগমের মাঝে স্থিরপ্ৰভা দামিনীর সাজে! মৌন শিখা স্পর্শে তব করেছিলে ইন্দুনিভা কত শত রূপসীর বদন পাণ্ডুর ওগো কোহিনূর। ম্লান করি দিলে কত আননের সুশ্ৰী শশীলেখা, বিচ্ছুরিলে জ্যোতিঃপাত মদগৰ্ব মোগলের প্রমোদসভাতে; বিভ্রমের লীলাকক্ষে–বিলাসের খুশরোজ রাতে শাহী বেগমের আঁখি হয়েছিল অশ্রু ছলছল তোমার সম্পদস্বপ্নে—অলখিতে ছায়াচ্ছন্ন হয়েছিল উল্লাসের সে মোতিমহল। নিশীথলাঞ্ছন বিভা জ্বলিয়া উঠিল কবে কাম্য মণি-ময়ূরের চোখে— কত দীর্ঘ শতাব্দীর অশ্রু দৈন্য শোকে করে গেল জয়শ্ৰীসম্পাত উদয়-অরুণসম, তারপর কবে অকস্মাৎ অস্তগত সাম্রাজ্যের কবর ভাঙিয়া অভিসারে চলে গেল, প্ৰিয়া-উদাসিয়া দূর সিন্ধুপারে ঐশ্বৰ্য-তোরণ-তটে তুঙ্গ সিংহদ্বারে! নব অভিনন্দনের উন্মেষের দেশে, আমাদের সৌভাগ্যের শোক রক্ত স্তব্ধ বেলাশেষে!বাসে না সে অশ্রুহিম কুহেলিরে ভালো মৃত্যুর পিঙ্গল ছায়া প্রেতপুর কালো আলেয়ার আলো করে নাকো বিমুগ্ধ তাহারে! পিরামিডসম সুপ্ত সমাধির দ্বারে দাঁড়ায় না নিস্পলক প্রহরীর বেশে! –চেয়ে থাকে, কবে কোন প্ৰেমাস্পদ এসে অঙ্কে তার এঁকে দেয় যৌবনের অরুণ-চুম্বন নিমেষের আঁখিপাতে কেড়ে লয় মন।(অগ্রন্থিত কবিতা) ক্যাম্পে এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি; সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি – কাহারে সে ডাকে!কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার; বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে, আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন, এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম আর আসে নাকো বসন্তের রাতে।চারি পাশে বনের বিস্ময়, চৈত্রের বাতাস, জোছনার শরীরের স্বাদ যেন্‌! ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; কোথাও অনেক বনে — যেইখানে জোছনা আর নাই পুরুষহিরণ সব শুনিতেছে শব্দ তার; তাহারা পেতেছে টের আসিতেছে তার দিকে। আজ এই বিস্ময়ের রাতে তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে; তাহাদের হৃদয়ের বোন বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জোছনায় – পিপাসার সন্ত্বনায় — অঘ্রাণে — আস্বাদে! কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন! মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই, সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু; কেবন পিপাসা আছে, রোমহর্ষ আছে।মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়! লালসা — আকাঙক্ষা — সাধ — প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে আজ এই বসন্তের রাতে; এই খানে আমার নক্‌টার্ন –|একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে, সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে দাঁতের — নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই সুন্দরী গাছের নীচে — জোছনায়! মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে হরিণেরা আসিতেছে।– তাদের পেতেছি আমি টের অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়, ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়। ঘুমাতে পারি না আর; শুয়ে শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি; চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণি আবার ডাকে; এইখানে পড়ে থেকে একা একা আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে হরিণীর ডাক শুনে শুনে।কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া; সকালে — আলোয় তারে দেখা যাবে – পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে। মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এই সব।আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব, মাংস খাওয়া হল তবু শেষ? কেন শেষ হবে? কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে তাদের মতন নই আমিও কি? কোনো এক বসন্তের রাতে জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে আমারেও ডাকে নি কি কেউ এসে জোছনায় — দখিনা বাতাসে অই ঘাইহরিণীর মতো?আমার হৃদয় — এক পুরুষহরিণ – পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে চিতার চোখের ভয় — চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে? আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিল নাকি জীবনের বিস্ময়ের রাতে কোনো এক বসন্তের রাতে?তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে! মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমারও পড়ে থাকি; বিয়োগের — বিয়োগের — মরণের মুখে এসে পড়ে সব ঐ মৃত মৃগদের মতো – প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই; পাই না কি? দোনলার শব্দ শুনি। ঘাইমৃগী ডেকে যায়, আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো একা একা শুয়ে থেকে; বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়। ক্যম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে; যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায় হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন – ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয় কথা ভেবে — কথা ভেবে — ভেবে।এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে – কোথাও ফড়িঙে — কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে, আমাদের সবের জীবনে। বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই। ক্ষেতে প্রান্তরে ঢের সম্রাটের রাজ্যে বাস ক'রে জীব অবশেষে একদিন দেখেছে দু-তিন ধনু দূরে কোথাও সম্রাট নেই, তবুও বিপ্লবী নেই, চাষা বলদের নিঃশব্দতা ক্ষেতের দুপুরে। বাংলার প্রান্তরের অপরাহ্ন এসে নদীর খাড়িতে মিশে ধীরে বেবিলন লণ্ডনের জন্ম, মৃত্যু হ'লে- তবুও রয়েছে পিছু ফিরে। বিকেল এমন ব'লে একটি কামিন এইখানে দেখা দিতে এলো তার কামিনীর কাছে; মানবের মরণের পরে তার মমির গহ্বর এক মাইল রৌদ্রে প'ড়ে আছে।২ আবার বিকেলবেলা নিভে যায় নদীর খাড়িতে; একটি কৃষক শুধু ক্ষেতের ভিতরে তার বলদের সাথে সারাদিন কাজ ক'রে গেছে; শতাব্দী তীক্ষ্ম হ'য়ে পড়ে। সমস্ত গাছের দীর্ঘ ছায়া বাংলার প্রান্তরে পড়েছে; এ-দিকের দিনমান- এ যুগের মতো শেষ হ'য়ে গেছে, না জেনে কৃষক চোত-বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে প'ড়ে চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল; ঊনিশশো বেয়াল্লিশ ব'লে মনে হয় তবুও কি ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সাল।৩ কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই একদিন মৃত্যু হবে, জন্ম হয়েছে; সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিলো ক্ষেতে; সূর্যাস্তের সাথে চ'লে গেছে। সূর্য উঠবে জেনে স্থির হ'য়ে ঘুমায়ে রয়েছে।             আজ রাতে শিশিরের জল প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতি নিয়ে খেলা করে;             কৃষাণের বিবর্ণ লাঙ্গল, ফালে ওপড়ানো সব অন্ধকার ঢিবি, পোয়াটাক মাইলের মতন জগৎ সারাদিন অন্তহীন কাজ ক'রে নিরুৎকীর্ণ মাঠে প'ড়ে আছে সৎ কি অসৎ।৪ অনেক রক্তের ধ্বকে অন্ধ হ'য়ে তারপর জীব এইখানে তবুও পায়নি কোনো ত্রাণ;             বৈশাখের মাঠের ফাটলে                 এখানে পৃথিবী অসমান।             আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। কেবল খড়ের স্তুপ প'ড়ে আছে দুই- তিন মাইল,             তবু তা সোনার মতো নয়, কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে             করুণ নিরীহ, নিরাশ্রয়।                 আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। জলপিপি চ'লে গেলে বিকেলের নদী কান পেতে             নিজের জলের সুর শোনে;             জীবাণুর থেকে আজ কৃষক, মানুষ                 জেগেছে কি হেতুহীন সম্প্রসারণে-             ভ্রান্তিবিলাসে নীল আচ্ছন্ন সাগরে? চৈত্য, ক্রুশ, নাইন্টিথ্রি ও সোবিয়েট শ্রুতি প্রতিশ্রুতি যুগান্তের ইতিহাস অর্থ দিয়ে কূলহীন সেই মহাসাগরে প্রাণ চিনে-চিনে হয়তো বা নচিকেতা প্রচেতার চেয়ে অনিমেষে            প্রথম ও অন্তিম মানুষের প্রিয় প্রতিমান             হ'য়ে যায় স্বাভাবিক জনমানবের সূর্যালোকে। খুঁজে তারে মরো মিছে খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর; রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক দাঁড়কাক দেখা যেত দিন-রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার: রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, — এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত, কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত! গতিবিধি সর্বদাই প্রবেশের পথ র'য়ে গেছে; এবং প্রবেশ ক'রে পুনরায় বাহির হবার;- অরণ্যের অন্ধকার থেকে এক প্রান্তরের আলোকের পথে; প্রান্তরের আলো থেকে পুনরায় রাত্রির আঁধারে; অথবা গৃহের তৃপ্তি ছেড়ে দিয়ে নারী, ভাঁড়, মক্ষিকার বারে।এই সব শরীরের বিচরণ। ঘুমায়ে সে যেতে পারে। (সচেতন যাত্রার পথ তবু আরো প্রসারিত। আলো অন্ধকার তার কাছে কিছু নয়।) উট পাখি সারাদিন দিবারৌদ্রে ফিরে বালির ভিতরে মাথা রেখে দিয়ে আপনার অন্ধ পরিচয় হয়তো ভা নিয়ে যায়,- তা' পাখির বিনয়। কোনো এক রমণীকে ভালোবেসে, কোনো এক মরকের দেশে গিয়ে জোর পেয়ে, কোন এক গ্রন্থ প'ড়ে প্রিয় সত্য পেয়ে গেছি ভেবে, অথবা আরেক সত্য সকলকে দিতে গিয়ে অভিভূত হয়ে, শরতের পরিষ্কার রাত পেয়ে সব চেয়ে পোষাকী, উজ্জ্বল- চিন্তা তবু বর্ষারাতে দ্বার থেকে দ্বারে ভিজে কুকুরের মত গাত্রদাহ ঝাড়ে। সমাধির ঢের নিচে- নদীর নিকটে সব উঁচু উঁচু গাছের শিকড়                                         গিয়ে নড়ে।সেইখানে দার্শনিকের দাঁত ক্কাথ পান করে পরিত্যাক্ত মিঠে আলিউ, মরামাস, ইঁদুরের শবের ভিতরে;- জেনে নিয়ে আমরা প্রস্তুত ক'রে নিই নিজেদের; কেননা ভূমিকা ঢের র'য়ে গেছে- বোঝা যাবে (কিছুটা বিনয় যদি থেকে থাকে চোখে)- সূশ্রী ময়ূরও কেন উটপাখি সৃষ্টি ক'রেছিল টানাপোড়েনের সুরে- সূর্যের সপ্তকে। গভীর এরিয়েলে ডুবলো সূর্য; অন্ধকারের অন্তরালে হারিয়ে গেছে দেশ। এমনতর আঁধার ভালো আজকে কঠিন রুক্ষ শতাব্দীতে। রক্ত-ব্যথা ধনিকতার উষ্ণতা এই নীরব স্নীগ্ধ অন্ধকারের শীতে নক্ষত্রদের স্থির সমাসীন পরিষদের থেকে উপদেশ পায় না নব; তবুও উত্তেজনাও যেন পায় না এখন আর; চারদিকেতে সার্থবাহের ফ্যাক্টার ব্যঙ্ক মিনার জাহাজ—সব, ইন্দ্রলোকের অপ্সরীদের ঘাটা, গ্লাসিয়ারের যুগের মতন আঁধারে নীরব।অন্ধকারের এ-হাত আমি ভালোবাসি; চেনা নারীর মতো অনেক দিনের অদর্শনার পরে আবার হাতের কাছে এসে জ্ঞানের আলো দিনকে দিয়ে কি অভিনিবেশে প্রেমের আলো প্রেমকে দিতে এসেছে সময় মতো; হাত দু’খানা ক্ষমাসফল; গণনাহীন ব্যক্তিগত গ্লানি ইতিহাসের গোলকধাঁধায় বন্দী মরুভূমি- সবের প্রে মৃত্যুতে নয়—নীরবতায় আত্মবিচারের আঘাত দেবার ছলে কি রাত এমন স্নিগ্ধ তুমি।আজকে এখন আধাঁরে অনেক মৃত ঘুমিয়ে আছে। অনেক জীবিতেরা কঠিন সাঁকো বেয়ে মৃত্যুনদীর দিকে জলের ভিতর নামছে—ব্যবহৃত পৃথিবীটিকে সন্ততিদের চেয়েও বেশি দৈব আধাঁর আকাশবাণীর কাছে ছেড়ে দিয়ে—স্থির ক’রে যায় ইতিহাসের গতি। যারা গেছে যাচ্ছে—রাতে যাবো সকলি তবে। আজকে এ-রাত তোমার থেকে আমায় দূরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তবুও তোমার চোখে আত্মা আত্মীয় এক রাত্রি হয়ে রবে।তোমায় ভালোবেসে আমি পৃথিবীতে আজকে প্রেমিক, ভাবি। তুমি তোমার নিজের জীবন ভালোবাস; কথা এইখানেতেই ফুরিয়ে গেছে; শুনেছি তোমার আত্মলোলুপতা প্রেমের চেয়ে প্রাণের বৃহৎ কাহিনীদের কাছে গিয়ে দাবি জানিয়ে নিদয় খৎ দেখিয়ে আদায় ক’রে নেয় ব্যাপক জীবন শোষণ ক’রে যে-সব নতুন সচল স্বর্গ মেলে; যদিও আজ রাষ্ট সমাজ অতীত অনাগতের কাছে তমসুকে বাধাঁ, প্রাণাকাশে বচনাতীত রাত্রি আসে তবুও তোমার গভীর এরিয়েলে। গল্পে আমি পড়িয়াছি কাঞ্চী কাশী বিদিশার কথা গল্পে আমি পড়িয়াছি কাঞ্চী কাশী বিদিশার কথা কোনদিন চোখে দেখি নাই একদিন ভাবিলাম মাঠে মাঠে কুয়াশায় যদি আমি কোনোদিন বিদিশায় যাই—মাঠে মাঠে কুয়াশায় ভাবিলাম এই কথা বহু দিন বহু বহু রাত ধ’রে আমি যদি আমি—কোনোদিন যদি আমি অবন্তীর পথে গিয়ে নামি—পউষের কুয়াশায় সাপের খোলস, পাতা, ডিম প’ড়ে আছে ঘাসে, কেন যে করুণ চোখ পথ ভুলে ভেসে গেল ময়জানি নদীটির পাশে—এসেছে এ কার বজরা ? চারিদিকে শীত নদী : যেন মরুভূমি বজরার জানালায় কার মুখ এই পথে এত দিন পরে কেন তুমি ?কবেকার মাঠ—পথ—মন্দির কুয়াশার ফাঁকে দিল দেখা হৃদয়ে তাতাল বালির মতো তৃষা নদীর আঁধার জলে ভ’রে গেল আমি যে গো দেখেছি বিদিশা।সব কথা মনে পড়ে জলসিড়ি নদী আর জানে না সে কথা নীলাভ ঘাসের পথে জ্যোৎস্নায়। গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতাসে, খড়কুটা ঝড়ে শুধু শাইকের মুখ থেকে চুপে। আবার শালিখা, সেই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে। সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে ঘুঘুর নরম ডাকে—নীরব আকাশে নক্ষত্রেরা শান্তি পায়—পউষের কুয়াশায় ধূপে পুঁয়ের সবুজ রাঙা লতা আছে ডুবে। এ কোমল স্নিগ্ধ হিম সান্ত্বনার মাসে চোখে তার শান্তি শুধু—লাল লাল ফলে বুক আছে দেখ ভ’রে। গুবরে ফড়িং কই উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতসে, খড়কুটা ঝরে শুধু শালিখের মুখ থেকে চুপে আবার শালিখ অই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে। সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে তবুও তোমারে আমি কোনোদিন পাব নাকো অসীম আকাশে। গোধূলি সন্ধির নৃত্য দরদালানের ভিড়- পৃথিবীর শেষে যেইখানে প'ড়ে আছে- শব্দহীন- ভাঙ্গা- সেইখানে উঁচু-উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল- রাঙা-চুপে-চুপে ডুবে যায়- জ্যোৎস্নায়। পিপুলের গাছে ব'সে পেঁচা শুধু একা চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।হরীতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাসঃ নৃমুণ্ডের আবছায়া- নিস্তব্ধতা- বাদামী পাতার ঘ্রাণ- মধুকুপী ঘাস।কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতোঃ পুরুষ তাদেরঃ কৃতকর্ম নবীন; খোঁপার ভিতরে চুলেঃ নরকের নবজাত মেঘ, পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।সেখানে গোপন জল ম্লান হ'য়ে হীরে হয় ফের, পাতাদের উৎসরণে কোন শব্দ নাই; তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে- বরুণে ক্রুর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে- জ্যোৎস্নায়। যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন শেষ হ'য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বাচন মেঘ, পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক কর্কট- তুলা- মীন। গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায় উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার-বার চায় সে জড়াতে করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়; এক-একটি ইট ধ্বসে-ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায় ভাঙা ঘাটলায় এই-আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে বিনুনি খসায় নাকো-শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে; কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়;ডাইনীর মতো হাত তুলে-তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো, -বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নই আমি, হায়, এমন বিজন শাদা পথ-সোঁদা পথ-বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে চলে গেছে শ্মশানের পারে বুঝি;-সন্ধ্যা সহসা কখন; সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে। ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায় ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয় ভিজে চালে ডুমুরের পাতা ঝরে—শালিখ বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময় জানালার কাছে এসে, ভিজে জানালার কাছে মৌমাছি বহুক্ষণ মৃদু গুমরায় এইসব ভালো লাগে : এইসব ম্লান গন্ধ মৃদু স্বাদ চায় পৃথিবীর পথে ঘুরে আমার হৃদয় ডুমুরের পাতা ঝরে ভিজে চালে—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয় মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়।এইসব ভালোবাসি—জীবনের পথে ঘুরে এইসব ভালোবাসে আমার হৃদয় ঘরে আলো, বৃষ্টি ক্ষান্ত হ’ল সন্ধ্যায় ঘরের দীপ জ্বলে ওঠে, ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয় ভিজে চালে কদমের পাতা ঝরে—শালিক বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময় মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায় মৃদু আরো মৃদু হয়ে অবিরল বাতাসে হারায়।।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা ঘাটশিলা—ঘটশিলা— ঘাটশিলা—ঘটশিলা— কলকাতা ছেড়ে বল ঘাটশিলা কে যায় মিছাই চিরদিন কলতাকা থাকি আমি, ঘাটশিলা ছাই।চিঠির উপরে তবু চিঠি কয়েকটা দিন এইখানে এসে তুমি থেকে যাও চিঠিগুনো হয়ে গেল পুরোনো মলিনতবু আমি গেলাম না যদিও দেখেছি আমি কলকাতা থেকে কত দিন কত রাত ঘাটশিলা গিয়েছে অনেকেএকদিন তারপর—বহুদিন পরে অনেক অসাধ অনিচ্ছায় ঘাটশিলা চলিলাম ঘাটশিলা দেখিলাম হায়আবার এসেছি ফিরে—ধোঁয়ায় ধুলায় ভিড়ে ফুটপাথে—ট্রামের জগতে পথ থেকে পথে ফিরি পথ থেকে ক্লান্ত পথে পথে।কী হল তোমার, আহা, আমার হৃদয় তোমারে যে গোধূলির তেপান্তরে মায়াবীর মতো মনে হয়,যেই এই পৃথিবীর বেলা শেষ হয়ে গেছে ম্না ঘোড়া নিয়ে একা তুমি কড়ির পাহাড় খুঁজে ঘুরিতেছ ঘুরিছ হাড়ের মরুভূমি।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা ঘাস কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পুথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস-তেমনি সুঘ্রাণ- হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিড়ে নিচ্ছে। আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে – গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে চোখে ঘষি, ঘাষের পাখনায় আমার পালক, ঘাষের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোন এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে। ঘাসের বুকের থেকে ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর – সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে — তাই নীলাকাশ মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়; — পথে পথে তাই এই ঘাস জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়, — কউমাছিদের যেন নীড় এই ঘাস; — যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস কথা কয় — তাহাদের শান — হাত খেলা করে — তাদের খোঁপায় এলো ফাঁস খুলে যায় — ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা — অনেক নিবিড়পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায় — হৃদয়ের বেদনার কথা – সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা — মাঠের চাঁদের গল্প করে – আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়; — শিশিরের শীত সরলতা তাহাদের ভালো লাগে, — কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে; গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে — পেঁচার নম্রতা; ভালো লাগে এই যে অশ্বথ পাতা আমপাতা সারারাত ঝরে। ঘাসের ভিতরে সেই চড়ায়ের শাদা ডিম ঘাসের ভিতরে সেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে — আমি ভালোবাসি নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই — কবে যেন ভেঙেছিল — ঢের ধুলো খড় লেগে আছে বুকে তার — বহুক্ষণ চেয়ে থাকি; — তারপর ঘাসের ভিতর শাদা শাদা ধুলোগুলো পড়ে আছে, দেখা যায় খইধান দেখি একরাশি ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষন্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি; কান পেতে থাকি যদি, শোনা যায়, সরপুটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর মীনকন্যাদের মতো, সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর দেখা যায় — রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ — রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসীচলে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল ছেলের মতো রাজার ছেলের মতো মিলে কোন এক আকাঙ্খার উদঘাটনে কত দূরে; বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা অপরাহ্ন এল বুঝি? — রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায় — ডানা ঝিলমিলে; এক্ষুনি আসিবে সন্ধ্যা, — পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে নদীর নরম মুখ দেখা যাবে — মুখে তার দেহে তার কতো মৃদু রেখা তোমারি মুখের মতো: তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা। ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে; তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা — আমার তরুণ দিন তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো — ঘুম আসে-বাংলার তৃণ আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে কাঁচপোকা ঘুমায়েছে — আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে, ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে — এই ঘাসে — কথাভাষাহীন আমার প্রাণের গল্প ধীরে-ধীরে যাবে-অনেক নবীন নতুন উৎসব রবে উজানের-জীবনের মধুর আঘাতেতোমাদের ব্যস্ত মনে; — তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে — যখন মানিকমালা ভোরে লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে– যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে ঝরিয়ে ঘাসের পরে, — শালিখ খঞ্জনা আজ কতো দূরে ওড়ে– কতোখানি রোদ-মেঘ — টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে। ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি-কবে যেন রাখিয়াছে হাতে তার হাতে- কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড় ঝরে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন-এই পাড়াগাঁর পথে তবু তিন শো বছর আগে হয়তো বা- আমি তার সাথেকাটায়েছি; পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা — সাতশো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে; ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে-মাঠে কতোবার কুড়ালাম খড়; বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে, ভাসানের গান গুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খর আর ঘর। ঘোড়া আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়: মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে; প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে।আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়; বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে; চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে-ঘেয়ো                        কুকুরের অস্পষ্ট কবলেহিম হয়ে নড়ে গেল ও - পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে, প্যারাফিন-লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।                        সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে; এইসব নিওলিথ - স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে। ঘোড়া আমরা যাইনি ম’রে আজো- তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় : মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জোৎস্নার প্রান্তরে; প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন- এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে। আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়; বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে; চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো- ঘুমে- ঘেয়ো কুকুরের অস্পষ্ট কবলে হিম হ’য়ে ন’ড়ে গেল ও-পাশের পাইস রেস্তরাঁতে; প্যারাফিন-লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে। সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে; এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে। চক্ষুস্থির ক্লান্ত জনসাধারণ আমি আজ,- চিরকাল;- আমার হৃদয়ে পৃথিবীর দণ্ডীদের মত পরিমিত ভাষা নেই। রাত্রিবেলা বহুক্ষণ মোমের আলোর দিকে চেয়ে, তারপর ভোরবেলা যদি আমি হাত পেতে দিই সূর্যের আলো দিকে,- তবুও আমার সেই একটি ভাবনা অতীব সহজ ভাষা খুঁজে নিতে গিয়ে হৃদয়ঙ্গম করে সব আড়ষ্ট, কঠিন দেবতারা অপরূপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস; উত্তেজিত না-হ'য়েই অনায়াসে ব'লে যায় তারাঃ হেমন্তের ক্ষেতে কবে হলুদ ফসল ফলেছিলো, অথবা কোথায় কালো হ্রদ ঘিরে ফুটে আছে সবুজ সিঙাড়া। রক্তাতিপাতের দেশে ব'সেও তাদের সেই প্রাঞ্জলতায় দেখে যাই সেই সোনালি ফসল হ্রদ, সিঙাড়ার ছবি; আমার প্রেমিক সেই জলের কিনারে ঘাসে- দক্ষ প্রজাপতি; মানুষ-ও-ছাগমুণ্ড কেটে তাকে শুদ্ধ ক'রে দিয়ে যাবে অনাগত সবি, একদিন হয়তো বা;- আজ সব উত্তমর্ণ দেবতাকে আমার হৃদয় যে-সব পবিত্র মদ দিয়েছিলো- যে সব মদির আলোর রঙের মতো ম্লান মদ দিয়ে গিয়েছিলো,- যখনি চুমুক দিই হ'য়ে থাকি চর্মচক্ষুস্থির!কাব্যগ্রন্থ - সাতটি তারার তিমির চলছি উধাও চলছি উধাও, বল্গাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটে শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে! কোন্‌ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি! -আঁধার আলোর সাগরশেষে প্রেতের মতো আসছে ভেসে! আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে, যেদিন আমি জেগেছিলাম, সেও জেগেছে আমার মনে! আমার মনের অন্ধকারে ত্রিশূলমূলে, দেউলদ্বারে কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ পূজার পুষ্প ঢেলে! স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, আমায় পেলে! রাত্রিদিবার জোয়ার স্রোতে নোঙরছেঁড়া হৃদয় হ’তে জেগেছে সে হালের নাবিক চোখের ধাধায় ঝড়ের ঝাঁঝে মনের মাঝে মানের মাঝে আমার চুমোর অন্বেষণে প্রিয়ার মতো আমার মনে অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে, চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রুপাথার-কূলে! ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে হাতটি রেখে হাতে! দেখিনি তার মুখখানি তো, পাইনি তারে টের, জানি নি হায় আমার বুকে আশেক-অসীমের জেগে আছে জনমভোরের সূতিকাগার থেকে! কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে! সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি! জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি গুঞ্জরিয়া এল-গেল কত গানের রানি, নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি! -ফুলের ফাগে বেহুঁশ হোলি নাকি! হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে! -জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে ঘায়েল হয়ে ফিরল আমার বুকের কেরাভেন- আকাশ-চরা শ্যেন! মরুঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি ইবলিশেরই সঙ্গে তাহার লড়াই-হল শুরু! দরাজ বুকে দিল্‌ যে উড়–উড়-! ধূসর ধু ধু দিগন্তরে হারিয়ে যাওয়া নার্গিসেই শোভা থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা! অলীক আশার, দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি, ঝড়ের ঝুঁটির পরে! পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটকে কারাগারে ভেঙে শিকল ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার চলল সে যে ছুটে! শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে- চুলের ঝুটি ধরল কে তার মুঠে! বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে, হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে! দুশমন কে পথের সুমুখে -কোথায় কে বা! এ কোন মায়া মোহ এমন কার! বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার! মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে- সে কোন সুদূরে তারার আলোরে থেকে মাথার পরের খা খা মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রাপথে কে রে! কী তৃষা তার! কী নিবেদন! মাগছে কিসের ভিখ্‌! উদ্যত পথিক হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে- আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়! -এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়! পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি আজকে নিল ডাকি হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে! মড়ার খুলি-পাহাড়প্রমাণ হাড়ে বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা! আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা, এক সোজা চুম্বকেরই ধ্বংসগিরির পানে, নোঙরহারা মাস্তুলেরই টানে! প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি, জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী! জানে কি সে ভোরের আকাশ, লক্ষ তারার আলো তাহার মনের দূয়ারপথেই নিরিখ হারালো! জানি নি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে কোন্‌ দিওয়ানার সারেং কাঁদে নয়নে নীর ঝরে! কপোত-ব্যথা ফাটে রে কার অপার গগন ভেদি! তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি কোন্‌ সে অসীম আসি! লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি প্রেমের খবর পুছে কবের থেকে কাঁদতে আছে- ‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’ চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে — জামরুল হিজলের বনে; তলতা বাঁশের ছিপ হাতে রবে — মাছ আমি ধরিব না কিছু; — দীঘির জলের গন্ধে রূপালি চিতল আর রূপসীর পিছু জামের গভীর পাতা — মাখা শান — নীল জলে খেলিছে গোপনে; আনারস ঝোপে ওই মাছরাঙা তার মাছরাঙাটির মনে অস্পষ্ট আলোয় যেন মুছে যায় — সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু ঝড়ে পড়ে পাতা ঘাসে, — চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু — এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে —চলে যায়; নীলাম্বরী সরে যায় কোকিলের পাখনার মতো ক্ষীরুয়ের শাখা ছুঁয়ে চালতার ডাল ছেড়ে বাঁশের পিছনে কোনো দূর আকাঙ্খার ক্ষেতে মাঠে চলে যায় যেন অব্যহত, যদি তার পিছে যাও দেখিবে সে আকন্দের করবীর বনে ভোমরার ভয়ে ভীরু — বহু ক্ষণ পায়চারি করে আনমনে তারপর চলে গেল : উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে। চাঁদিনীতে বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো; চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো! সে যে জানে কত পাথারের কথা, কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি! কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জোছনা, শুক্লা তিথি! হয়তো সেদিনও আমাদেরই মতো পিলুবারোয়ার বাঁশিটি নিয়া ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া! হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়, সবজি ক্ষেত! হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে এমনি কোন এক চাঁদের আলোয়-মরু ওয়েসিসে তরুর মূলে! বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে এমনি কোন-এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে! কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া! তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড়- পাতা উঠিত বাজি, তাদের শিয়রে দুলিত জোছনা, চাঁচর-চিকন পত্ররাজি! দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনাণীর লতা-পল্লব ঘিরে চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া-এল-বল্লভ-এল রে ফিরে!’ তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি, নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি-চাঁদিনী-শরাব, সুরার শিশি! সেদিনও এমনি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি, হয়তো সেদিনও ফুটেছে মোতিয়া-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাতি! হয়তো সেদিনও নেখাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে, হয়তো সেদিনও আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে! হয়তো সেদিনও এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে হয়তো সেদিনও ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া সরোর শাখে, হয়তো সেদিনও পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে! হয়তো সেদিনও পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে, হয়তো সেদিন মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে! হয়তো সেদিনও মাণিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্‌ফট্‌ দুটি পাখার বেগে! হয়তো সেদিনও খুর খুর করে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে ঘন মেহগিনি টার্পিন তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁেড়! হয়তো সেদিনও জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী! শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহর্ম্যের তোরণে গিয়া পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো! অলিভকুঞ্জে হা হা করে হাওয়া কেঁেদছে কাতর যামিনী ভরি! ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে মার্টিল পাতা পড়েছে ঝরি’! উইলোর বন উঠেছে ফুঁপায়ে-ইউ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে, তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে! কোন্‌ গ্রীস কোন্‌ কার্থেজ, রোম ক্রবেদুর যুগ কোন,- চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর শফরে বেড়ায় মন! জানি না তো কিছু-মনে হয় শুধু এমনি তুহিন চাঁদের নিচে কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হয়ে গেছে কত কী যে! কত যে শ্মশান-মশান কত যে-কত যে কামনা পিপাস-আশা অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা! চারিদিকে প্রকৃতির চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে। সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী মনে হয় ইহাদের প্রেম মনে ক’রে নিতে গেলে, চুপে তিমিরবিদারী রীতি হয়ে এরা আসে আজ নয়,- কোনো এক আগামী আকাশে। অন্নের ঋণ,বিমলিন স্মৃতি সব বন্দ্র বস্তির পথে কোনো এক দিন নিমেষের রহস্যের মতো ভুলে গিয়ে নদীর নারীর কথা-আরো প্রদীপ্তির কথা সব সহসা চকিত হয়ে ভেবে নিতে গেলে বুঝি কেউ হৃদয়কে ঘিরে রাখে দিতে চায় একা আকাশের আশেপাশে অহেতুক ভাঙা শাদা মেঘের মতন। তবুও নারীর নাম ঢের দূরে আজ, ঢের দূরে মেঘ; সারাদিন নিলেমেয় কালিমার খারিজের কাজে মিশে থেকে ছুটি নিতে ভালোবেসে ফেলে যদি মন ছুটি দিতে চায় না বিবেক। মাঝে-মাঝে বাহিরের অন্তহীন প্রসারের থেকে মানুষের চোখে-পড়া-না-পড়া সে কোন স্বভাবের সুর এসে মানবের প্রাণে কোন এক মানে পেতে চায়ঃ যে-পৃথিবী শুভ হতে গিয়ে হেরে গেছে সেই ব্যর্থতার মানে। চারিদিকে কলকাতা টোকিও দিল্লী মস্কো আতলান্তিকের কলরব, সরবরাহের ভোর, অনুপম ভোরাইয়ের গান; অগণন মানুষের সময় ও রক্তের জোগান ভাঙে গড়ে ঘর বাড়ি মরুভূমি চাঁদ রক্ত হাড় বসার বন্দর জেটি ডক; প্রীতি নেই, পেতে গেলে হৃদয়ের শান্তি স্বর্গের প্রথম দুয়ারে এসে মুখরিত ক’রে তোলে মোহিনী নরক। আমাদের এ-পৃথিবীর যতদুর উন্নত হয়েছে ততদূর মানুষের বিবেক সফল। সে-চেতনা পিরামিডে পেপিরাসে প্রিন্টিং-প্রেসে ব্যাপ্ত হয়ে তবুও অধিক আধুনিকতর চরিত্রের বল। শাদাশাদে মনে হয় সে-সব ফসলঃ পায়ের চলার পথে দিন আর রাত্রির মতন;- তবুও এদের গতি স্নিগ্ধ নিয়ন্ত্রিত ক’রে বার বার উত্তর সমাজ ঈষৎ অনন্যসাধারণ। চারিদিকে শান্ত বাতি চারিদিকে শান্ত বাতি — ভিজে গন্ধ — মৃদু কলরব; খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;- এশিরিয়া ধুলো আজ — বেবিলন ছাই হয়ে আছে। চিরদিন শহরেই থাকি চিরদিন শহরেই থাকি পড়ে থাকি পাটের আড়তে করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে দিন যায় চ’লে আকাশের তলে নক্ষত্রেরা কয় কোন্‌ কথা জোৎস্নায় প্রাণের জড়তা ব্যথা কেন পায় সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়বিয়ে হয়েছিল কবে—মরে গেছে বউ যদিও মহুয়া গাছে ফুটে ওঠে মৌ একবার ঝরে গেলে তবু তারপর মহুয়া মহুয়া তবু : কেরানির ঘর কেরানির ঘর শুধু হায় জীবনের গল্প শুধু একবার আসে—শুধু একবার নীল কুয়াশায় নিঃশেষে ফুরায়।দেবতা ভজি না আমি তীর্থ করি নাকো তোমরা ঠাকুর নিয়ে থাকো। তবু আমি একবার ছুটি পেয়ে বেড়াবার তরে গেলাম খানিকটা দূর—তারকেশ্বরে গভীর অসাধ নিয়ে—গাঢ় অনিচ্ছায় ট্রেনে আমি চড়িলাম হায় কলরবে ধোঁয়ার ধূলায় সাধ ক’রে কে বা মিছে যায়জানি না ঈশ্বর কে বা—জানি শুধু ভুখা ভগবান দিনগত পাপক্ষয় ক’রে পাব ত্রাণ তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে কিংবা কাশি মিত্রের তল্লাটে পড়ে রব তবুও যখন আমি ঢের রাতে ফিরিলাম ঘর বুকে জাগে সেই দেশ : তারকেশ্বর দেবতারে কে খুঁজেছে—সারাদিন ঘুরিয়াছি পথে অবসন্ন ধুলোর জগতে অসংখ্য ভিড়ের মাঝে আমি একখানা মুখ দেখে গিয়েছি যে থামি সিংহের মূর্তির কাছে তাহারে ফেলেছি দেখে দেখিয়াছি কবে যেন দেবতার পায়ে তা’রে এশিরিয়া ব্যাবিলনে আমি দেখেছি মিশরে ঈসিসের ঘরে সারাদিন—দিনমান আজ এই তারকেশ্বরে আবার তাহার মুখ দেখিলাম, (আহা,) ধানসিড়ি নদীটির বিকেল বেলার মৌন জলে বেতের ফলের মতো যেই চোখ, যেই রূপ ধরা দেয় পৃথিবীর নীরব আঁচলে দেখিলাম তাহা আবার তাহার মুখ দেখিলাম, আহা। চেতনা-লিখন শতাব্দীর এই ধূসর পথে এরা ওরা যে যার প্রতিহারী। আলো অন্ধকারের ক্ষণে যে যার মনে সময়সাগরের ক্লান্তিবিহীন শব্দ শোনে; অথবা তা নাড়ীর রক্তস্রোতের মতন ধ্বনি না শুনে শোনা যায়।সময় গতির শব্দময়তাকে তবু ধীরে ধীরে যথাস্থানে রেখে ট্রামের রোলে আরেক ভোরের সাড়া পেয়ে কেউ বা এখন শিশু, কেউ বা যুবা, নটী, নাগর, দক্ষ-কন্যা, অজের মুণ্ড, অখল                                         পোলিটিশ্যান্‌ এদের হাতেই দিনের আলো নিজের সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়।চারিদিকেতে শিশুরা সব অন্ধ এঁদো গলির অপার পরলোকে আজ জগৎ-শিশুর প্রাণের আকাশ ভেবে জানে না কবে নীলিমাকে হারিয়ে ফেলেছে। শিশু-অমঙ্গলের সকল জনিতারা এই পৃথিবীর সকল নগরীর আবছায়াতে ক্লান্ত-কলকাকলীর প্রেতের পরিভাষা ছড়িয়ে কবে ফুরিয়ে আবার সহজ মানব-কণ্ঠে কথা ক'বে? আকাশমর্ত্যে মহাজাতক সূর্য-গ্রহণ ছাড়া কোথাও কোনো তিলেক বেশি আলো রয়েছে জানে না কি? তবুও সবাই তারা অন্ধকারের ভিতর থেকে ক্রমে ক্রমে যার হয়ে কি আসছে আরো বিশাল আলোতে?কোথায় ট্রাম উধাও হয়ে চ'লেছে আলোকে। কয়লা গ্যাসের নিরেস ঘ্রাণ ছড়িয়ে আলোকে কোথায় এত বিমূঢ় প্রাণজন্তু নিয়ে অনন্ত বাস্‌, কার্‌, এমন দ্রুত আবেগে চলেছে! কোথাও দূরে দেবাত্মা পাহাড় রয়েছে কি? ইতিহাসের ধারণাতীত সাগর নীলিমা? চেনা জানা নকল আলোর আকাশ ছেড়ে সহজ সূর্য আছে। নব নবীন নগর মেশিন প্রাণের বন্দর- জলের বীথি আকাশী নীল রৌদ্রকণ্ঠী পাখি? সেখানে প্রেমের বিচারসহ চোখের আলোয় গোলকধাঁধার থেকে মুখ মানুষ নতুন সূর্য তারার পথের জ্যোতিধূর্লি-ধূসর হাসি দেখে কি দীন, সহৃদয়? জ্ঞান সেখানে অফুরন্ত প্যারাগ্রাফে ক্লান্তিহীন শব্দ যোজনায় কিছুই নেই প্রমাণ করে শূন্যতাকে কুড়ায় নাক' তবে?পরস্পরের দাবির কাছে অন্তরঙ্গ আত্মনিবেদনে নবীন 'রে পরিচিত হওয়ার পরে নতুন পৃথিবী রয়েছে জেনে আজকে ওরা চলার পথে ইতিহাসের চরম চেতনা;- মানব নামের কঠিন হিসাব হয়তো মেলাতেছে কী এক নতুন জ্যোতির্দেশী সমাজ সময় শান্তি গড়ার নীল সাগরের তীরে।চোখে যাদের চলতে দেখি তারা অনেক দেরী করে অনাথ মরু সাগর ঘুরে চলে; মনের প্রয়াণ মোড় ঘুরে কি দেখেছে সরণি- সাহস আলো প্রাণ যেখানে সবার তরে শুভ- এই পৃথিবী ঘরণী। ছায়া-প্রিয়া দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ গান কে গাহে, গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না! সার্সি ঘরের উঠছে বেজে উঠছে কেঁপে পর্দা! বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে জল-ডাহুরের বুকের কাছে; এ কোন্‌ বাঁশি সার্সি বাজায় এ কোন হাওয়া ফর্দা দেয় কাঁপিয়ে পর্দা! নূপুর কাহার বাজল রে ঐ! কাঁকন কাহার কাঁদল পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া মায়ার মিলন ফাঁদল কাঁকন যে তার কাঁদল! খসখসাল শাড়ি কাহার! উস্‌খুসাল চুল গো! পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে: জুল্‌পি কাহার উঠল দুলে! দুলল কাহার দুল গো! উস্‌খুসাল চুল গো! কাঁদছে পাখি পউষনিশির তেপান্তরের বক্ষে! ওর বিধবা বুকের মাঝে যে গো কার কাঁদন বাজে! ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে, নিদ্‌ নাহি মোর চক্ষে! তেপান্তরের বক্ষে! এল আমার ছায়া-প্রিয়া, কিশোরবেলার সই গো! পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; মনের মধূ-মনোরমা- কই গো সে মোর কই গো! কিশোরবেলার সই গো! ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে! গান কে গাহে, গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে বনের ছায়ায়-মাঠের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না! জনান্তিকে তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই- তবু, গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছি। কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ; বহুদিন থেকে শান্তি নেই। নীড় নেই পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তর। পাখি নেই। মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব’লেআজ তার মানবকে কী ক’রে চানাতে পারে কেউ। চারিদিকে অগণন মেশিন ও মেশিনের দেবতার কাছে নিজেকে স্বাধীন ব’লে মনে ক’রে নিতে গিয়ে তবু মানুষ এখনও বিশৃঙ্খল। দিনের আলোর দিকে তাকালেয় দেখা যায় লোক কেবলি আহত হ’য়ে মৃত হ’য়ে স্তব্ধ হয়; এ ছাড়া নির্মল কোনো জননীতি নেই। যে-মানুষ- যেই দেশে টিঁকে থাকে সে-ই ব্যক্তি হয়- রাজ্য গড়ে- সাম্রাজ্যের মতো কোনো ভূমি চায়। ব্যক্তির দাবিতে তাই সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে তারই পিপাসায় গ’ড়ে ওঠে। এ ছাড়া অমল কোনো রাজনীতি পেতে হ’লে তবে উজ্জ্বল সময়স্রোতে চ’লে যেতে হয়। সেই স্রোত আজো এই শতাব্দীর তরে নয়। সকলের তরে নয়। পঙ্গপালের মতো মানুষেরা চরে; ঝ’রে পড়ে। এই সব দিনমান মৃত্যু আশা আলো গুনে নিতে ব্যাপ্ত হ’তে হয়। নবপ্রস্থানের দিকে হৃদয় চলেছে। চোখ না এড়ায়ে তবু অকস্মাৎ কখনো ভোরের জনান্তিকে চোখে থেকে যায় আরো-এক আভাঃ আমাদের এই পৃথিবীর এই ধৃষ্ট শতাব্দীর হৃদয়ের নয়- তবু হৃদয়ের নিজের জিনিস হ’য়ে তুমি র’য়ে গেছ।তোমার মাথাত চুলে কেবলই রাত্রের মতো চুল তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে ধ’রে আছে। তোমার হৃদয়ে গায়ে আমাদের জনমানবিক রাত্রি নেই। আমাদের প্রাণে এক তিল বেশি রাত্রির মতো আমাদের মানব্জীবন প্রাচারিত হ’য়ে গেছে ব’লে- নারি, সেই এক তিল কম। আর্ত রাত্রি তুমি। শুধু অন্তহীন ঢল, মানব-খচিত সাঁকো, শুধু অমানব নদীদের অপর নারীর কন্ঠ তোমার নারীর দেহ ঘিরে; অতএব তার সেই সপ্রতিভ অমেয় শরীরে আমাদের আজকের পরিভাষা ছাড়া আরো নারী আছে। আমাদের যুগের অতীত এক কাল র’য়ে গেছে। নিজের নুড়ির ’পরে সারাদিন নদী সূর্যের- সুরের বীথি, তবু নিমেষে উপল নেই- জলও কোন্‌ অতীতে মরেছে; তবু নবীন নুড়ি- নতুন উজ্জ্বল জল নিয়ে আসে নদী; জানি আমি জানি আদি নারী শরীরিণীকে স্মৃতির (আজকে হেমন্ত ভোরে) সে কবের আঁধার অবধি; সৃষ্টির ভীষণ অমা ক্ষমাহীনতায় মানবের হৃদয়ের ভাঙা নীলিমায় বকুলের বনে মনে অপার রক্তের ঢলে গ্লেশিয়ারে জলে অসতী না হয় তবু স্মরণীয় অনন্ত উপলে প্রিয়াকে পীড়ন ক’রে কোথায় নভের দিকে চলে। জয়জয়ন্তী সূর্য কোনো দিন নগরীর শীতের প্রথম কুয়াশায় কোনো দিন হেমন্তের শালিখের রঙে ম্লান মাঠের বিকেলে হয়তো বা চৈত্রের বাতাসে চিন্তার সংবেগ এসে মানুষের প্রাণে হাত রাখেঃ তাহাকে থামায়ে রাখে। সে-চিন্তার প্রাণ সাম্রাজ্যের উত্থানের পতনের বিবর্ণ সন্তান হয়েও যা কিছু শুভ্র র’য়ে গেছে আজ- সেই সোম-সুপর্ণের থেকে এই সূর্যের আকাশে- সে-রকম জীবনের উত্তরাধিকার নিয়ে আসে। কোথাও রৌদ্রের নাম- অন্নের নারীর নাম ভালো ক’রে বুঝে নিতে গেলে নিয়মের নিগড়ের হাত এসে ফেঁদে মানুষকে যে-আবেগে যত দিন বেঁধে রেখে দেয়, যত দিন আকাশকে জীবনের নীল মরুভূমি মনে হয়, যত দিন শূন্যতার ষোলো কলা পূর্ণ হয়ে- তবে বন্দরে সৌধের ঊর্ধ্বে চাঁদের পরিধি মনে হবে,- তত দিন পৃথিবীর কবি আমি- অকবির অবলেশ আমি ভয় পেয়ে দেখি- সূর্য ওঠে; ভয় পেয়ে দেখি- অস্তগামী। যে-সমাজ নেই তবু র’য়ে গেছে, সেখানে কায়েমী মরুকে নদীর মতো মনে ভেবে অনুপম সাঁকো আজীবন গ’ড়ে তবু আমাদের প্রাণে প্রীতি নেই- প্রেম আসে নাকো’। কোথাও নিয়তিহীন নিত্য নরনারীদের খুঁজে ইতিহাস হয়তো ক্রান্তির শব্দ শোনে, পিছে টানে; অনন্ত গণনাকাল সৃষ্টি ক’রে চলে; কেবলই ব্যক্তির মৃত্যু গণনাবিহীন হয়ে প’ড়ে থাকে জেনে নিয়ে- তবে তাহাদের দলে ভিড়ে কিছু নেই- তবু সেই মহাবাহিনীর মতো হতে হবে?সংকল্পের সকল সময় শূন্য মনে হয় তবুও তো ভোর আসে- হঠাৎ উৎসের মতো, আন্তরিকভাবে; জীবনধারণ ছেপে নয়,- তবু জীবনের মতন প্রভাবে; মরুর বালির চেয়ে মিল মনে হয় বালিছুট সূর্যের বিস্ময়। মহীয়ান কিছু এই শতাব্দীতে আছে,- আরো এসে যেতে পারেঃ মহান সাগর গ্রাম নগর নিরুপম নদী;- যদিও কাহারো প্রাণে আজ এই মরণের কালিমাকে ক্ষমা করা যাবে; অনুভব করা যাবে স্মরণের পথ ধ’রে চ’লেঃ কাজ ক’রে ভুল হলে, রক্ত হলে, মানুষের অপরাধ ম্যামথের ময় কত শত রূপান্তর ভেঙে জয়জয়ন্তীর সূর্য পেতে হলে। জয়জয়ন্তীর সূর্য কোনো দিন নগরীর শীতের প্রথম কুয়াশায় কোনো দিন হেমন্তের শালিখের রঙে ম্লান মাঠের বিকেলে হয়তো বা চৈত্রের বাতাসে চিন্তার সংবেগ এসে মানুষের প্রাণে হাত রাখে; তাহাকে থামায়ে রাখে। সে চিন্তার প্রাণ সাম্রাজ্যের উত্থানের পতনের বিবর্ণ সন্তান হ'য়েও যা কিছু শুভ্র র'য়ে গেছে আজ, সেই সোম-সুপর্ণের থেকে এই সূর্যের আকাশে- সে-রকম জীবনের উত্তরাধিকার নিয়ে আসে। কোথাও রৌদ্রের নাম- অন্নের নারীর নাম ভালো ক'রে বুঝে নিতে গেলে নিয়মের নিগড়ের হাত এসে ফেঁদে মানুষকে যে আবেগে যতোদিন বেঁধে রেখে দেয়, যতোদিন আকাশকে জীবনের নীল মরুভূমি মনে হয় যতোদিন শূন্যতার ষোলকলা পূর্ণ হ'য়ে- তবে বন্দরে সৌধের উর্দ্ধে চাঁদের পরিধি মনে হবে;- ততোদিন পৃথিবীর কবি আমি- অকবির অবলেশ আমি ভয় পেয়ে দেখি- সূর্য উঠে; ভয় পেয়ে দেখি- অস্তগামী। যে-সমাজ নেই তবু র'য়ে গেছে, সেখানে কায়েমী মরুকে নদীর মতো মনে ভেবে অনুপম সাঁকো আজীবন গ'ড়ে তবু আমাদের প্রাণে প্রীতি নেই- প্রেম আসে নাকো। কোথাও নিয়তিহীন নিত্য নরনারীদের খুঁজে ইতিহাস হয়তো ক্রান্তির শব্দ শোনে, পিছে টানে অনন্ত গণনাকাল সৃষ্টি ক'রে চলে; কেবলি ব্যক্তির মৃত্যু-গণনাবিহীন হ'য়ে প'ড়ে থাকে জেনে নিয়ে -তবে তাহাদের দলে ভিড়ে কিছু নেই- তবু সেই মহাবাহিনির মতো হ'তে হবে?সংকল্পের সকল সময় শূন্য মনে হয়। তবুও তো ভোর আসে- হঠাৎ উৎসের মতো; আন্তরিকভাবে; জীবনধারণ ছেপে নয়- তবু জীবনের মতন প্রভাবে; মরুর বালির চেয়ে মিল মনে হয় বালিছুট সূর্যের বিস্ময়। মহিয়ান কিছু এই শতাব্দীতে আছে, -আরো এসে যেতে পারে; মহান সাগর গ্রাম নগর নিরুপম নদী- যদিও কাহারো প্রাণে আজ রাত স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘুম নেই, তবু এই দ্বীপ, দেশ, ভয়, অভিসন্ধানের অন্ধকারে ঘুরে সসাগরা পৃথিবীর আজ এই মরণের কালিমাকে ক্ষমা করা যাবে; অনুভব করা যাবে স্মরণের পথ ধ'রে চলে; কাজ ক'রে ভুল হ'লে, রক্ত হ'লে মানুষের অপরাধ ম্যামথের নয়   কতো শত রূপান্তর ভেঙে জয়জয়ন্তীর সূর্য পেতে হলে। ---------------------------------------------------- গ্রন্থ: বেলা অবেলা কালবেলা জার্মানীর রাত্রিপথেঃ ১৯৪৫ সে এক দেশ অনেক আগের শিশুলোকের থেকে সাগরগামী নদীর মত স্বরে আমার মনের ঘুঘুমরালহংসী ঝাউয়ের বনে আধো আলোছায়াচ্ছন্ন ভাবে মনে পড়ে টিউটনের গল্পে ছড়ায় সাগরে সূর্যালোকে গ্রিমের থেকে...... শিলাত সানুজ দানবীয় গ্যেটের সে দেশ সূর্য অনিকেত? মাঝে মাঝে আমার দেশের শিপ্রা, পদ্মা, রেবা, ঝিলম, জলশ্রীকে আমি সর্পীযোনের মতন কোথাও পাহাড় অবধি অথবা নীল ভূকল্লোলে সাগর সুভাষিতকরতে গিয়ে শুনেছিলাম রাইনের মত নদী কি এক গভীর হ্বাইমারী মেঘ সূর্য বাতাস নিয়ে নর-নারী নগর গ্রামীণতায় ব্যস্ত রীতি লক্ষ্য ক'রেই সবিতাসাধ জানিয়েছিল;- তিন দশকের পর এ-সব স্বপ্নমিশেল কি এক শূন্য অনুমিতি।যদিও আমি আজো বেশি সূর্য ভালোবাসি তবুও যারা মনের নীহারিকার পথে ঠাণ্ডা অমল দিন জাগিয়ে সূর্যপ্রতিম আকাশ সমাজ নিয়ে যাত্রা ক'রেছিল সে সব হৃদয়গ্রাহী টেলর রিলকে হ্যোল্ডার্‌লিন্‌ সবংশে কি হারিয়ে গেছে রাইখ্‌শরিরের থেকে?- ব্যক্তি স্বাধীনতায় ঘুরে অনাথ মানবতার লেন্‌দেন শুধতে ভুলে গিয়ে কি ভয় রক্ত গ্লানি রিরাংসা ফুঁপিয়ে রেখে গেছে অমোঘ বর্বরতার বেল্‌জেন্‌?     বর্বরতা কোথায় তবুও নেই?- তবু এই প্রশ্ন-আতুর মনে গভীরতার হৃদয়ব্যাধির ঈষৎ সমাধান আজকে ভীষণ নিরুদ্দেশের অন্ধকারে রয়েছে টিউটন? রোন্‌কে চিনি,- ইউরোপের হৃদয়ে রাইন্‌যান্‌ সহোদরার মতন রৌদ্র আকশ মাটি যব গোধূমের পাশে যুগে যুগে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রবেশ ক'রে এনেছিল কান্ট কাথিড্রাল দেবতাদের     ঊষাপ্রদোষ অখল ভাগনেরের অভিনিবেশ-বলয়িত গ্যেটের সূর্যকরে।যদিও তা ব্যক্তিকতার মায়ার মৃগতৃষ্ণাতীত,-তবু চমৎকৃত হয়েছিল ইউরোপের ভাবনাধূসর মন; সৌরকরভ্রমে ঊনবিংশ শতকীরা হয়তো তাকে ঘরের বহিরাশ্রয়িত দিব্য বাতায়ন- বাতায়নের বাইরে মেঘের সূর্য ভেবেছিল; আমরা আজো অনেক জেনে এর বেশি কি ভাবি? ইতিহাসের ভূমায় সীমাস্বল্পতাকে যাচাই করার রীতি গ্যেটের ছিল;- তবুও সীমার কী ভয়ঙ্কর বৈনাশিকী দাবি! সেই তো পায়ের নিচে রাখে পরমপ্রসাদগভীর তনিমাকে সময়পুরুষ বলেঃ 'তুমি নিজের কালের ভার ব'য়েছিলে লীলায়িত সৌরতেজে;- এ যুগ তবু অন্য সকলের; আরেক রকম ব্যতিক্রমের,- হে কবি, হ্বাইমার।' সময় এখন জ্যোতির্ময়ী অমেয়তার প্রবাস থেকে ফিরে নিরিখ পেয়ে গেছে নিজের নিঃশ্রেয়সের পথে; সেইখানে কাল লোকাতিত হতে গিয়ে     কোথাও থেমে গিয়ে- ক্রান্তি-আলোর বয়স বেড়ে গেলে কঠিন রীতির জগতে নবজাতক অর্থনীতি সমাজনীতি কলের     কণ্ঠে কি প্রাণকাকলী? এই পৃথিবীর আদিগন্ত ব্যক্তিশবের শেষে দেখা দেবে হয়তো নতুন সুপরিসর, নাগর সভ্যতায় মানবতার নামে নবীন ব্যক্তিহীনতাকে ভালোবেসে; হয়তো নগর রাষ্ট্র সফল হয়ে গেলে নাগরিকের মন হৃদয়প্রেমিক হয়ে যাবে সবার তরে- উচিত অনুপাতে, জড়-রীতির- অর্থনীতির সনির্বচন     মেশিন ভেনে এসব যদি হয় তা হ'লে তা অমিয় হোক্‌ আন্তরিকতাতে। জীবন চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর- নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান! ফসল উঠিছে ফলে-রসে রসে ভরিছে শিকড়; লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ। সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে! আমার দেহের গন্ধ পাই তার শরীরের ঘ্রাণ- সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে! পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে-তার সাথে সে ও আছে জেগে!২ নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের ’পর কখন এসেছে রাত্রি! – পশ্চিমের সাগরের জলে তার শব্দ;- উত্তর সমুদ্র তার, – দক্ষিন সাগর তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে ভ’রে ওঠে; – এসেছে রাত্রি! – এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে প্রথম যে এসেছিল, তারই মতো; – তাহার মতন চোখ তার, – তাহার মতন চুল, – বুকের আঁচলে প্রথম মেয়ের মতো;- পৃথিবীর নদী মঠ বন আবার পেয়েছে তারে, – সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে এখন!৩ সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে! – রক্তে রক্তে লাল হয়ে গেছে বুক তার, – আহত চিতার মতো বেগে পালায়ে গিয়েছে রোদ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল! চলে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক, – আর এক ‘কাল; আসিত না যদি আর আলো লয়ে- রৌদ্র সঙ্গে লয়ে!- এই রাত্রি- নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষ’য়ে রয়ে যেত,- যে গান শুনি নি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে!৪ যে পাতা সবুজ ছিল,- তবুও হলুদ হতে হয়,- শীতের হাড়ের হাত আজও তারে যায় নাই ছুঁয়ে- যে মুখ যুবার ছিল, তবু যার হয়ে যায় ক্ষয়, হেমন্ত রাতের আগে ঝ’রে যায়,- প’ড়ে যায় নুয়ে;- পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে,- জলে জলে, পশ্চিম সাগরে তোমার বিনুনি খুলে,- হেঁট হয়ে, – পা তোমার থুয়ে,- তোমার নক্ষত্র জ্বেলে- তোমার জলের স্বরে স্বরে রয়ে যেতে যদি আকাশের নিচে-নীল পৃথিবীর ’পরে!৫ ভোরের সূয়ের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন মেঘের মতন চুল- অন্ধকার চোখের আস্বাদ একবার পেতে চায়;- যে জন রয় না- যেই জন চলে যায়, তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ- যে ভালোবেসেছে শুধু, হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ বাতাসের মতো যার,- তাহার বুকের গান শুনে মনে যেই ইচ্ছা জাগে;- কোন দিন দেখে নাই চাঁদ যেই রাত্রি,- নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে শুনে যেই রাত্রি, আমি তার চোখে চোখ, চুলে তার চুল নেব বুনে!৬ তুমি রয়ে যাবে,- তবু,- অপেক্ষায় রয় না সময় কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে! সকলেই পথ চলে,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয়;- তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে! তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে করে! মুখে রক্ত ওঠে- তবু কমে কই বুকের সাহাস! যেতে হবে,- কে এসে চুলে ঝুঁটি টেনে লয় জোরে! শরীরের আগে কবে ঝরে যায় হৃদয়ের রস!- তবু,-চলে,-মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয় নি অবশ!৭ হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি!- কবরের থেকে শুধু আকাঙ্খার ভূত লয়ে খেলা!- আমরাও ছায় হয়ে ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি! -মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা সন্ধ্যার অনেক আগে! – দুপুরেই হয়েছি একেলা! আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন! বিকাল বেলার আগে ভেঙ্গে গেছে বিকালের মেলা- শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন! হেমন্ত আসে নি মাঠে,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!৮ শীত রাত ঢের দূরে,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে! শাদা হাতদুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে পারি এই দিনগুলো!- আমাদের রক্তের ভিতর বরফের মতো শীত, আগুনের মতো তবু জ্বর! যেই গতি,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে;- সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর,- তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে! শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে!৯ যতদিন রয়ে যাই এই শক্তি রয়ে যায় সাথে- বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন! যে ফসল নষ্ট হবে তারই ক্ষেত উড়াতে ফুরাতে আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন! নতুন বীজের গন্ধে ভ’রে দেয় আমাদের মন এই শক্তি,- একদিন হয়েতো বা ফলিবে ফসল!- এরই জোরে একদিন হয়তো বা ফলিবে ফসল!- এরই জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন আহ্লাদে ফেলিবে ভ’রে অলক্ষিত আকাশের তল! দুরন্ত চিতার মতো গতি তার, – বিদ্যুতের মতো সে চঞ্চল!১০ অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে,- যখন আকাঙ্খা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে, এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে! ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে! জীবন ধোঁয়ার মতো,- জীবন ছায়র মতো ভাসে; যে অঙ্গার জ্ব’লে জ্বলে নিভে যাবে,- হয়ে যাবে ছাই,- সাপের মত বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে জীবন পুড়িয়া যায়;- আমরাও ঝরে পুড়ে যাই! আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি-তবু শক্তি চাই!১১ জানো তুমি?- শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা?- হে ক্ষমতা, বুকে তুমি কাজ কর তোমার মতনং- তুমি আছ,- রবে তুমি,- এর বেশী কোনো নিশ্চয়তা তুমি এসে দিয়েছ কি?- ওগো মন, মানুষের মন- হে ক্ষমতা,- বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর-ভীষণ! মেঘের ঘোড়ার ’পরে আকাশের শিকারীর মতো;- সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোল আলোড়ন! চমৎকৃত কর,- শরীরেরে তুমি করেছ আহত!- যতই জেগেছ,- দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত!১২ তবু তুমি শীত রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে হৃদয়ের অন্ধকারে পড়ে থাক,- কুন্ডলী পাকায়ে!- অপেক্ষায় ব’সে থাকি,-স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে কে তোমারে!- ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে কে তোমার!- কোন অশ্র“, কোন পীড়া হতাশার ঘায়ে কখন জাগিয়া ওঠো- স্থির হয়ে বসে আছি তাই। শীত-রাত বাড়ে আরো,- নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে,- ছাইয়ে যে আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই! তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই।১৩ অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন জীবনেরে ছেড়ে দিছি!- পাতা আর পল্লবের মতো জীবন উঠেছে বেজে শব্দে-স্বরে; যতবার মন ছিঁড়ে গেছে,-হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত যতবার;- উড়ে গেছে শাখা, পাতা পড়ে গেছে যত;- পৃথিবীর বন হয়ে-ঝড়ের গতির মতো হয়ে, বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত; একবার মৃত্যু লয়ে- একবার জীবনেরে লয়ে ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে,- তার মতো গেছি বয়ে!১৪ কোথায় রয়েছে আলো আধারের বীণার আস্বাদ! ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে জীবন দিয়েছে দেখা;-আকাশের মতন অবাধ পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে, সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে জীবন দিয়েছে দেখা;- জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে মেঘে! ঘুমায়ে যা দেখি নাই, জেগে উঠে তার ব্যথা সয়ে নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে! যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে।১৫ নক্ষত্র জেনেছে কবে অই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা! বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে তাদের গতির ছন্দ,- অবিরত শক্তির পিপাসা তাহাদের,- তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে! আমাদের কাল চলে ইশারায়,- আভাসে-আভাসে! আরম্ভ হয় না কিছু-সমস্তের তবু শেষ হয়,- কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়! যা হয়েছে শেষ হয়,- শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!-১৬ সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস দোলা দিয়ে গেল কবে!- বাসি পাতা ভূতের মতন উড়ে আসে!-কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস,- যক্ষার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন!- জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ! মরণ,- সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে! বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায়- করে প্রাণপণ,- এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে,- রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে!-১৭ মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো! সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা! সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো যে পেয়েছে,- সকল মানুষ আর দেবতার কথা যে জেনেছে,- আর এক ক্ষুধা তবু-এক বিহ্বলতা তাহারও জানিতে হয়! এইমতো অন্ধকারে এসে!- জেগে জেগে যা জেনেছ,- জেনেছ তা-জেগে জেনেছ তা,- নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে! সব ভালোবাসা যার বোঝা হল,-দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!১৮ কিংবা এই জীবনেরে একবার ভালোবেসে দেখি!- পৃথিবীর পথে নয়,- এইখানে-এইখানে ব’সে- মানুষ চেয়েছে কিবা? পেয়েছে কি?-কিছু পেয়েছে কি! হয়তো পায় নি কিছু-যা পেয়েছে, তাও গেছে খ’সে অবহেলা ক’রে ক’রে কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে;- ধ্যানের সময় আসে তারপর,-স্বপ্নের সময়! শরীর ছিঁড়িয়া গেছে,-হৃদয় পড়িয়া গেছে ধসে!- অন্ধকার কথা কয়,- আকাশের তারা কথা কয় তারপর,-সব গতি থেমে যায়,- মুছে যায় শক্তির বিস্ময়!১৯ কেউ আর ডাকিবে না,- এইখানে এই নিশ্চয়তা!- তোমার দু-চোখ কেউ দেখে থাকে যদি এই পৃথিবীতে, কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কী কয়েছ কথা, তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে,- সেই পৃথিবীর শীতে,- আসিবে কি তোমারে চিনিতে এইখানে সে আবার!- উঠানে পাতার ভিড়ে ব’সে, কিংবা ঘরে- হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে দিতে,- যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে,- অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে প’ড়ে যাব খসে!২০ কিংবা কেউ কোনোদিন দেখে নাই,- চেনে নি আমারে! সকাল বেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন,- চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন আরম্ভ সে করেছিল!-কোনোদিন কোনো লোকজন তার কাছে আসে নাই;- আকাঙ্খার কবরের ’পরে পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন!- বীজ বুনে গেছে চাষা,- সে বাতাস বীজ নষ্ট করে! ঘুমের চোখের ’পরে নেমে আসে অশ্র“ আর অনিদ্রার স্বরে!২১ যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ এসে আবার আকাশ ঢাকে,- মাঠে মাঠে অধীর বাতাস ফোঁপায় শিশুর মতো,- একবার চাঁদ ওঠে ভেসে,- দূরে-কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান ক্ষেত ঘাস, আবার সন্ধ্যার রঙে ভরে ওঠে সকল আকাশ,- মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে!- যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস সকল আকাশ আর পৃথিবীর থেকে পড়ে ঝ’রে!- জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবী আকাশের পথ ধ’রে ধ’রে!২২ রাত্রির ফুলের মতো-ঘুমন্তে হৃদয়ের মতো অন্তর ঘুমিয়ে গেছে,-ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন!- সারাদিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত,- তারপর,- অন্ধকার গুহা এই-ছায়াভরা বন পেয়েছে যে!- অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন বুজে গেছে-রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে!- মুত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন,- জীবনেরে এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে! শুনে দেখি,- কোন কথা কয় রাত্রি, কোন কথা নক্ষত্র বলে সে!২৩ পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভরে- শস্য ফলে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা; নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,- মুত্যুর মত তার জীবনের বেদনার ভাষা,- আবার জানায়ে যায়!-কবরের ভূতের মতন পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা,- বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন! মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!২৪ হলুদ পাতার মতো,- আলোয়ার বাষ্পের মতন, ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে, আলোর মাছির মতো-রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে,- ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায়, -মরে যায়,- কে ফেরাতে পারে! মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে জীবন ডাকিতে আসে;-হয় নাই-গিয়েছে যা হয়ে, মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই ব্যথা-আকাঙ্খার অস্থিরতা লয়ে!২৫ মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো,- প্রিয়ার মতনং চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ; রোগীর জরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন; অসুস্থ চোখের ’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ; তাই আমি প্রিয়তম;-প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক,- ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া!- যে-ধুপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক,- যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া ঘুমানো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিয়ো, প্রিয়া!২৬ মৃত্যুকে ডেকেঠি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে। যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয়, পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে!- নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয়! পায়ের তলের পাতা-পাপড়ির মতো মনে হয় জীবনেরে,- খ’সে ক্ষয়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন জীবন পড়িয়া থাকে- তার বিছানায় খেদ,-ক্ষয়- পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অন্বেষণ।২৭ জীবন,- আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার,- একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা-ঝরা গাছে;- একটি বোঁটার মতো যে ফুল ঝরিয়া গেছে তার;- একাকী তারার মতো, সব তারা আকাশের কাছে যখন মুছিয়া গেছে,-পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে;- যে ভালোবেসেছে, তার হৃদয়ের ব্যথার মতন;- কাল যাহা থাকিবে না,- আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে;- দিন-রাত্রি-আমাদের পৃথিবীর জীবন তেমন! সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহুর্তের রঙ লয়ে মুহূর্তে নূতন!২৮ আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে! বীণার তারের মতো কেঁপে কেঁপে ছিয়ে যায় প্রাণ! অসংখ্যা পাতার মতো লুটে তারা পথে পথে ছোটে,- অধীর ঢেউয়ের মতো-অশান্ত হাওয়ার মতো গান কোনদিকে ভেসে যায়-উড়ে যায়,-কয় কোন কথা!- ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ, রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ-কোনো নিশ্চয়তা! পান্ডুর পাতার রঙ গালে,-তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা!২৯ যেখানে আসে নি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে, জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে, নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষে! তোমার চোখের ’পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে এখানে এসেছি আমি,- আর একবার কেঁপে উঠে অনেক ইচ্ছার বেগে,- শান্তির মতন অবশেষে সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে, ঘুমাব বালির ’পরে;- জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে!৩০ নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে,- পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড় রব আমি;- অনেক গতির পর-আকাঙ্খার পরে যেমন থামিতে হয়, বুজে যেতে হয় একবার পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয়- তেমন আস্বাদ এক কিংবা সেই স্বাদহীনতার সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয়! শীতের নদীর বুকের মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয়!৩১ আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে,- অথবা গ্রহের ’পরে-ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে ভাসে!- যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জোছনা ধোঁয়াটে, ফ্যাকাশে পাতার ’পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে;- যেমন হঠাৎ দুটো কালো পাখা চাঁদের আকাশে অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয়; কার পাখা?- কোন পাখি? পাখি সে কি! অথচ সে আসে!- তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা কয়!- ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার সে জাগিয়া রয়!৩২ বনের পাতার মতো,- আলেয়ার বাষ্পের মতন, ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া মেঘে আকাশের ধারে, আলোর মাছির মতো-রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে,- ঢেউ ভেঙে ঝরে যায়-মরে যায়,- কে ফেরাতে পারে! তবুও ইশারা ক’রে ফাল্গুনরাতের গন্ধে বয়ে মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আাঁধারে জীবন ডাকিতে আসে;- হয় নাই,- গিয়েছে যা হয়ে,- মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই স্মৃতি-আকাঙ্খার অস্থিরতা লয়ে!৩৪ পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভরে- শস্য ফলে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা; নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,- মুত্যুর মত তার জীবনের বেদনার ভাষা,- আবার জানায়ে যায়!-কবরের ভূতের মতন পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা,- বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন! মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন! জীবন অথবা মৃত্যু চোখে রবে জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে – আর এই বাংলার ঘাস র’বে বুকে; এই ঘাস:সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়- ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়- এই ঘাস:এরি নিচে কস্কাবতী শঙ্খশালা করিতেছে বাস: তাদের দেহের গন্ধ,চাঁপা ফুল-মাখা স্নান চুলের বিন্যাস ঘাস আজো ঢেকে আছে : যখন হেমন- আসে গৌড় বাংলায় কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস,আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি – শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে- কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে – শাদা দুধ ঝরে করবীর : কোন্‌ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল, তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে – ঘাসে : নরম ব্যাকুল। জীবন ভালোবেসে দেখা হল অনেক রক্ত রৌদ্র কোলাহল; চারিদিকে অধোমুখে মানুষেরা শব বহন করে; আজকে শতাব্দীতে মৃত্যু প্রথম কথা। তবু এ সব মৃত অবশেষে ঘুমের ভিতরে জুড়োয় গিয়ে দূর পৃথিবীর ঘাস পৃথিবী জলে এরা নদী সূর্য প্রেমের দিন ফুরিয়ে ফেলে মাটি, তোমার নিজের মনের কথা হয়ে ধীরে তোমার কাছে ঘুরছে কেমন অজ্ঞান শরীরেএখন খড়ে ভরে আছে দু-চার মাইল কামিনী ধানের ক্ষেত ঘুঘুর ডাকে আদিম শান্তি আরো অনেকক্ষণ মিছরিগুড়ির মতন বৃষ্টি রোদ্দুরে উজ্জ্বল আকাছে চাতক; ওর একরাশি আত্মীয়জন এ সব সাড়া ঐ মৃতদের ফুরিয়ে গেছে সবই সময়ের এই কার্যকলাপ গভীর মনে হয় জীবন ভালবেসে হৃদয় বুঝেছে অনুপম মূল্য দিয়ে আসছে চুপে মৃত্যুর সময় জীবন সঙ্গীত স্ট্রেচারের পরে শুয়ে কুয়াসা ফিরিছে বুঝি তোমার দুচোখেঃ ভয় নেই, মৃত্যু নয় কোনো এক অপদার্থ অন্যায় আলোক; তা’হ্লে কি এত লোক ম’রে যেত মশালের লালসায়- মাছির মতন? অমৃতের সিড়ি ব’লে মানুষেরা গড়িত কি এত শাদা শ্লোক। আজ মৃত্যু; এর আগে ম্যাটেডরদের মৃত্যু ছিল স্পেনে? লড়েছে বীরের মত রাঙা রৌদ্রে আপনারে সব চেয়ে হাম্বড়া জেনে খেয়েছে আঁধার রাত্রি অকস্মাৎ। তবু এক হরিয়ালঃ বাংলার পাখি শিকারীর-গুলি-সার-নীলাকাশ ভেবে ময় মরণকে মেনে। তবু মোরা দিবালোক উত্থাপন করি রোজ শৌণ্ডিকের মত; গেলাস ভরিয়া দেই;- মনে হয় কম্পাশ, সিন্ধু, রৌদ্র,- জীবন ফলত ধোমান মৃত্যুর চেয়ে। মরে গেছে ভূস্তরের অন্ধকার চূর্ণ পারা। কিন্তু আমাদের আয়ু মানস্পট গিলে ফেলে সূর্যের মতন ব্যক্তিগত। জীবন-মরণ দুয়ারে আমার সরাইখানার গোলমাল আসে কানে, ঘরের সার্সি বাজে তাহাদের গানে, পর্দা যে উড়ে যায় তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়! -মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে! আজও মন ওঠে রেঙে দিলদারদের দরাজ গলায় রবে, সরায়ের উৎসবে! কোন্‌ কিশোরীর চুড়ির মতন হায় পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায় বেহুঁশ হাওয়ার বুকে! সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে! পান্ডুর দুটি ঠোঁটে ডালিম ফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে! মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসি ভরা লাল গাল, ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল! আখেরের ভয় ভুলে দিলওয়ার প্রাণ খুলে জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি! অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি- নিভিছে দিনের আলো জীবন মরণ দুয়ারে আমার করে যে বাসিব ভালো একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন! পূর্ণ হয় নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন, নি একটি দল,- যৌবন শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল! উৎসব-লোভী অলি আসে নি হেথায় কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি! সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্‌ যায় দুলে আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে, সুদূর মরুদ্যানের পানেতে চেয়ে! সুখদুঃখের দোদুল ঢেউঢের তালে নেচেছে তাহারা- মায়াবীর জাদুজালে মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি, মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি! মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি! মস্তানা সেজে ভেঙে গেছ ঘরদোর, লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর! কারার ধুলায় লুন্ঠিত হ’য়ে বান্দার মতো হায় কেঁদেছে বুকের বেদুঈন মোর দুরাশার পিপাসায়! জীবনপথের তাতার দুস্যুগুলি হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি মোর গবাক্ষে কবে! কন্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে! আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে, সারাটি নিশীথ খুন রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে একাকী রয়েছি বসি, নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী পাই নি যে তাহা টের! -দূর দিগনে- চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের! কোন্‌ সুদুরের তুরাণী-প্রিয়ার তরে, বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে! দীর্ঘ দিবস ব’য়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের “রোজা” আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয় নি হায় দেখা, পরানে কখনও জাগে নি রোজা’র ঠেকা! কী যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা! এই যে নিষেধ, এই যে বিধান-আইনকানুন, এই যে শাসন মানা, ঘরদোর ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি যুবানবীনের নটনর্তন তালে, ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে, এই যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল সফেন সুরার ঝাঝের মতন ক’রে দেয় মজ্‌গুল দিওয়ানা প্রাণের নেশা! ভগবান, ভগবান, তুমি যুগ যুগ থেকে ধ’রেছ শুড়ির পেশা! -লাখো জীবনের শূণ্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার- মাতালের চিৎকার অনাদি কালের থেকে; মরণশিয়ারে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে! হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায় জীবনের নদী কলরোলে ব’য়ে যায়! কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভ নিতেছে তাহারে শুষে, ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে! মরণ-সাহারা আসি নিতে চায় তারে গ্রাসি!- তবু সে হয় না হারা ব্যথার রুধিরধারা জীবনমদের পাত্র জুড়িয়া তার যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশালাদার! জীবনে অনেক দূর জীবনে অনেক দূর সময় কাটিয়ে দিয়ে- তারপর তবু চলার কিছুটা আরো পথ আছে টের পাই;- সুমুখে বিস্ময়;- দেখেছি সূর্যের আলো মাঝে মাঝে জলের কম্পন; আশ্বিনের ঘন নীল আশ্চর্য আকাশে দেখেছি আরোহী হাঁস বাষ্পের ভিতর থেকে আসে হংসীর অনিমেষ দেহ লক্ষ্য ক’রে, মিশে যায় খুব স্বচ্ছ আলোর ভিতরে। কোথায় ফুরিয়ে যায় তারা সব- থেকে সফল। অগ্নির উৎসের মতো সৃষ্টি নির্ঝর থেকে জেগে আমারও শরীর মন মিশে যেতে চেয়েছে আবেগে। জুহু সান্টাক্রুজ থেকে নেমে অপরাহ্নে জহুর সমুদ্রপারে গিয়ে কিছুটা স্তব্ধতা ভিক্ষা করেছিলো সূর্যের নিকটে থেমে সোমেন পালিত; বাংলার থেকে এত দূরে এসে- সমাজ, দর্শন, তত্ত্ব, বিজ্ঞান হারিয়ে, প্রেমকেও যৌবনের কামাখ্যার দিকে ফেলে পশ্চিমের সমুদ্রের তীরে ভেবেছিলো বালির উপর দিয়ে সাগরের লঘুচোখ কাঁকড়ার মতন শরীরে ধবল বাতাস খাবে সারাদিন; যেইখানে দিন গিয়ে বৎসরে গড়ায়- বছর আয়ুর দিকে- নিকেল-ঘড়ির থেকে সূর্যের ঘড়ির কিনারায় মিশে যায়- সেখানে শরীর তার নকটার্ন-রক্তিম রৌদ্রের আড়ালে অরেঞ্জস্কোয়াস খাবে হয়তো বা, বোম্বায়ের ‘টাইমস্‌’টাকে                    বাতাসের বেলুনে উড়িয়ে, বর্তুল মাথায় সূর্য বালি ফেনা অবসর অরুণিমা ঢেলে, হাতির হাওয়ায় লুপ্ত কুয়েতের মতো দেবে নিমেষে ফুরিয়ে চিন্তার বুদ্‌বুদদের। পিঠের ওপার থেকে তবু এক আশ্চর্য সংগত দেখা দিলো; ঢেউ নয়, বালি নয়, ঊনপঞ্চাশ নায়ু, সূর্য নয় কিছু- সেই রলরোলে তিন চার ধনু দূরে-দূরে এয়ারোড্রামের কলরব লক্ষ্য পেলো অচিরেই- কৌতুহলে হৃষ্ট সব সুর দাঁড়ালো তাহাকে ঘিরে বৃষ মেষ বৃশ্চিকের মতন প্রচুর; সকলেরই ঝিঁক চোখে- কাঁধের উপরে মাথা-পিছু কোথাও দ্বিরুক্তি নেই মাথাত ব্যথার কথা ভেবে। নিজের মনের ভুলে কখন সে কলমকে খড়গের চেয়ে ব্যাপ্ত মনে ক’রে নিয়ে লিখেছে ভূমিকা, বই সকলকে সম্বোধন ক’রে! কখন সে বাজেট-মিটিং, নারী, পার্টি- পলিটিক্স, মাংস, মার্মালেড ছেড়ে অবতার বরাহকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলো; টোমাটোর মতো লাল গাল নিয়ে শিশুদের ভিড় কুকুরের উৎসাহ, ঘোড়ার সওয়ার, পার্শী, মেম, খোজা, বেদুইন সমুদ্রের তীর, জুহু, সূর্য, ফেনা, বালি- সান্টাক্রুজে সবচেয়ে পররতিময় আত্মক্রীড়া সে ছাড়া তবে কে আর? যেন তার দুই গালে নিরুপম দাড়ির ভিতরে দু’টো বৈবাহিক পেঁচা ত্রিভুবন আবিষ্কার ক’রে তুব ঘরে ব’সে আছে; মুন্সী, সাভাকর, নরীম্যান তিন দৃষ্টিকোণ থেকে নেমে এসে দেখে গেল, মহিলারা মর্মরের মতো স্বচ্ছ কৌতুহলভরে, অব্যয় শিল্পীরা সবঃ মেঘ না চাইতে এই জল ভালোবাসে। ঝরা ফসলের গান আঁধারে শিশির ঝরে ঘুমোনো মাঠের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ দুটো ঘুমে ভরে আজিকে বাতাসে ভাসিয়া আসিছে হলুদ পাতার ঘ্রাণ কাশের গুচ্ছ ঝ’রে পড়ে হায় খ’সে প’ড়ে যায় ধান বিদায় জানাই-গেয়ে যাই আমি ঝরা ফসলের গান,- নিভায়ে ফেলিও দেয়ালি আমার খেয়ালের খেলাঘরে!ওগো পাখি, ওগো নদী, এতোকাল ধরে দেখেছ আমারে- মোরে চিনে থাকো যদি, আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,- যেন আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই! পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই গেয়ে যাই আমি,- মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।।ঝরা ফসলের ভাষা কে শুনিবে হায়!- হিমের হাওয়ায় বিজন গাঁয়ের চাষা হয়তো তাহার সুরটুকু বুকে গেঁথে ফিরে যায় ঘরে হয়তো সাঁঝের সোনার বরণ গোপন মেঘের তরে সুরটুকু তার রেখে যায় সব,-বুকখানা তবু ভরে ঘুমের নেশায়,-চোখে চুমো খায় স্বপনের ভালোবাসা!ওগো নদী, ওগো পাখি, আমি চলে গেলে আমারে আবার ফিরিয়া ডাকিবে নাকি! আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,- জেনো আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই; পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই, গেয়ে যাই আমি, – গাহিতে গাহিতে ঘুমে বুজে আসে আঁখি ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,- ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা, আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন, আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন! মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে- তখন শুকনবধু যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে! মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি সে কোন্‌ বালিকা ‌একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী! পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার পরে দাঁড়াল সে- বাসররাত্রির বধু-মোর তরে, যেন মোর তরে! তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ-চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,- ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে-ঝরিতেছে ফুলঝুরি, স্বপনের কুঁড়ি! অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে থেকে ফুঁপায় উদাসী! কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী! কিঙ্খারে -গালিচা খাটে রাজবধু-ঝিয়ারীর বেশে কভু সে দেয় নি দেখা- মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে! দাঁড়াল সে হেঁটমুখে চোখ তার ভরে গেছে নীল অশ্রুজলে! মীনকুমারীর মতো কোন দূর সিন্ধুর অতলে ঘুরেছে সে মোর লাগি!-উড়েছে সে অসীমের সীমা! অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গলা, নরম লালিমা জ্ব’লে গেছে-নগ্ন হাত, নাই শাখা, হারায়েছে রুলি, এলোমেলো কালো চুলে খ’সে গেছে খোঁপা তার, বেণী গেছে খুলি! সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ, ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,হিম স্তন হিম রোমকূপ! আমি দেখিয়াছি তারে ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি তারই পেয়ালায় হায়! পৃথিবীর উষা ছেড়ে আসিয়াছি নামি কান্তারে- ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর, আমি দেখিয়াছি ছায়া, শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর! বুকে মোর, কোলে মোর- কঙ্কালের কাঁকালের চুমা! গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,- ঘুমা, ঘুমা! ডাকিয়া কহিল মোর রাজার দুলাল- ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন; আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন! ডাহুকী মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী,- নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী বিজন- তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে বনচ্ছায়া- অন্তরালে তরল তিমিরে! -আকাশে মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর! -নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে! সে কোন পিপাসা কোন ব্যথা তার মনে! হারায়েছে প্রিয়ারে কি?- অসীম আকাশে ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে? বাঞ্ছিত দেয়নি দেখা নিমেষের তরে!- কবে কোন রুক্ষ কাল- বৈশাখীর ঝড়ে ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি! -নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী গেয়ে যায়; সুপ্ত পল্লী-তটিনীর তীরে ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে! -পল্লবে নিস্তব্ধ পিক,- নীরব পাপিয়া, গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিণী হিয়া! আকাশে গোধূলি এল,- দিক্ হ’ল ম্লান, ফুরায় না তবু হায় হুতাশীর গান! -স্তিমিত পল্লীর তটে কাঁদে বারবার, কোন্ যেন সুনিভৃত রহস্যের দ্বার উন্মূক্ত হল না আর কোন্ সে গোপান নিল না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন! তবু সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার বছরে বয়সী আমি; বুদ্ধকে স্বচক্ষে মহানির্বাণের আশ্চর্য শান্তিতে চ’লে যেতে দেখে— তবু—অবিরল অশান্তির দীপ্তি ভিক্ষা ক’রে এখানে তোমার কাছে দাঁড়ায়ে রয়েছি; আজ ভোরে বাংলার তেরোশো চুয়ান্ন সাল এই কোথাও নদীর জলে নিজেকে গণনা ক’রে নিতে ভুলে গিয়ে আগামী লোকের দিকে অগ্রসর হ’য়ে যায়; আমি তবুও নিজেকে রোধ ক’রে আজ থেমে যেতে চাই তোমার জ্যোতির কাছে; আড়াই হাজার বছর তা হ’লে আজ এইখানে শেষ হ’য়ে গেছে।নদীর জলের পথে মাছরাঙা ডান বাড়াতেই আলো ঠিকরায়ে গেছে— যারা পথে চ’লে যায় তাদের হৃদয়ে; সৃষ্টির প্রথম আলোর কাছে; আহা, অন্তিম আভার কাছে; জীবনের যতিহীন প্রগতিশীলতা নিখিলের স্মরণীয় সত্য ব’লে প্রমাণিত হ’য়ে গেছে; দ্যাখো পাখি চলে, তারা চলে, সূর্য মেঘে জ্ব’লে যায়, আমি তবুও মধ্যম পথে দাঁড়ায়ে রয়েছি— তুমি দাঁড়াতে বলোনি। আমাকে দ্যাখোনি তুমি; দেখাবার মতো অপব্যয়ী কল্পনার ইন্দ্রত্বের আসনে আমাকে বসালে চকিত হ’য়ে দেখে যেতে যদি— তবু, সে-আসনে আমি যুগে-যুগে সাময়িক শত্রুদের বসিয়েছি, নারি, ভালোবেসে ধ্বংস হ’য়ে গেছে তা’রা সব। এ-রকম অন্তহীন পটভূমিকায়— প্রেমে— নতুন ঈশ্বরদের বার-বার লুপ্ত হ’তে দেখে আমারো হৃদয় থেকে তরুণতা হারায়ে গিয়েছে; অথচ নবীন তুমি।নারি, তুমি সকালের জল উজ্জ্বলতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো নদীকেই বিকেলে অপর ঢেউয়ে খরশান হ’তে দিতে ভুলে গিয়েছিলে; রাতের প্রখর জলে নিয়তির দিকে ব’হে যেতে দিতে মনে ছিলো কি তোমার? এখনও কি মনে নেই?আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি সেই শিথিলতা নও, জানি, তবু ইতিহাসরীতিপ্রতিভার মুখোমুখি আবছায়া দেয়ালের মতো নীল আকাশের দিকে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চেয়ে তুমি আমাদের দেশে কোনো বিশ্বাসের দীর্ঘ তরু নও।তবু কী যে উদয়ের সাগরের প্রতিবিম্ব জ্ব’লে ওঠে রোদে! উদয় সমাপ্ত হ’য়ে গেছে নাকি সে অনেক আগে? কোথাও বাতাস নেই, তবু মৰ্মরিত হ’য়ে ওঠে উদয়ের সমুদ্রের পারে। কোনো পাখি কালের ফোকরে আজ নেই, তবু, নব সৃষ্টিমরালের মতো কলস্বরে কেন কথা বলি; কোনো নারী নেই, তবু আকাশহংসীর কণ্ঠে ভোরের সাগর উতরোল।    (সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থ) তবু তাহা ভুল জানি তবু তাহা ভুল জানি — রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা: তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ় — আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জল আরো; তোমারো পৃথিবী পথ; নক্ষত্রের সাথে তুমি খেলিতেছ পাশা: শঙ্খমালা নয় শুধু: অনুরাধা রোহিনীর ও চাও ভালোবাসা, না জানি সে কতো আশা — কতো ভালোবাসা তুমি বাসিতে যে পার! এখানে নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো ঝরিছে আবারো; প্রান্তরের কুয়াশায় এখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা —এসেছে সন্ধ্যার কাক ঘরে ফিরে, — দাঁড়ায়ে রয়েছে জীর্ণ মঠ, মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে — লালপেড়ে পুরানো শাড়ির ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে — কে এসেছে আমার নিকট? কার শিশু? বলো তুমি: শুধালাম, উত্তর দিলো না কিছু বটে; কেউ নাই কোনোদিকে — মাঠে পথে কুয়াশার ভিড়; তোমারে শুধাই কবি: তুমিও কি জানো কিছু এই শিশুটির। তবুও পায়ের চিহ্ন ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত ধীরে আমাদের দু’জনকে নিতে চায় সেই শব্দহীন মাটি ঘাসে সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনোদিন সেদিকে যাবে না তবুও পায়ের চিহ্ন সেদিকেই চলে যায় কি গভীর সহজ অভ্যাসে। তার স্থির প্রেমিকের নিকট বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই,- -আমি বলিনাতো। কারো লাভ আছে;– সকলেরই;– হয়তো বা ঢের। ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে পেয়েছি ধবল শব্দ– বাতাসতাড়িত পাখিদের।মোমের প্রদীপ বড়ো ধীরে জ্ব’লে– ধীরে জ্বলে আমার টেবিলে; মনীষার বইগুলো আরো স্থির,– শান্ত,– আরাধনাশীল; তবু তুমি রাস্তার বার হ’লে,- ঘরেরও কিনারে ব’সে টের পাবে নাকি দিকে-দিকে নাচিতেছে কী ভীষণ উন্মত্ত সলিল।তারি পাশে তোমারে রুধির কোনো বই- কোনো প্রদীপের মতো আর নয়, হয়তো শঙ্খের মতো সমুদ্রের পিতা হ’য়ে সৈকতের পরে সেও সুর আপনার প্রতিভায়- নিসর্গের মতোঃ রূপ–প্রিয়– প্রিয়তম চেতনার মতো তারপরে তাই আমি ভীষণ ভিড়ের ক্ষোভে বিস্তীর্ণ হাওয়ার স্বাদ পাই; না হলে মনের বনে হরিণীকে জড়ায় ময়ালঃ দণ্ডী সত্যাগ্রহে আমি সে-রকম জীবনের করুণ আভাস অনুভব করি; কোনো গ্লাসিয়ার- হিম স্তব্ধ কর্মোরেন্ট পাল– বুঝিবে আমার কথা; জীবনের বিদ্যুৎ-কম্পাস অবসানে তুষার-ধূসর ঘুম খাবে তারা মেরুসমুদ্রের মতো অনন্ত ব্যাদানে। তিমির হননের গান কোনো হ্রদে কোথাও নদীর ঢেউয়ে কোনো এক সমুদ্রের জলে পরস্পরের সাথে দু'-দণ্ড জলের মতো মিশে সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে আমাদের জীবনের আলোড়ন- হয়তো বা জোবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো। অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে আমরা হেসেছি, আমরা খেলেছি; স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে একদিন ভালোবেসে গেছি। সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক। হেমন্তের প্রান্তরে তারার আলোক। সেই জের টেনে আজো খেলি। সূর্যালোক নেই- তবু- সূর্যালোক মনোরম মনে হ'লে হাসি। স্বতই বিমর্ষ হ'য়ে ভদ্র সাধারণ চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে আরো বেশি কালো-কালো ছায়া লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজের উঠে নর্দমায় নেমে- ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম'রে যাতে জানে। এরা সব এই পথে; ওরা সব ওই পথে- তবু মধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন- অন্তহীন বেদনার পথে। কিছু নেই- তবু এই জের টেনে খেলি; সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ'লে হাসি; জীবিত বা মৃত রমণীওর মতো ভেবে- অন্ধকারে- মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি। তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ'য়ে আমরা কি তিমিরবিলাসো? আমরা তো তিমিরবিনাশী হ'তে চাই। আমরা তো তিমিরবিনাশী। তুমি নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারি দিকে উজ্জ্বল আকাশ; বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস; কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে — গঙ্গাফড়িং সেও ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।‘মাটির অনেক নীচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে তুমি আজ? কোন্‌ কথা ভাবছ আধারে? ওই যে ওকানে পায়রা একা ডাকে জমিরের বনে; মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি-তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনেআমার এমন কাছে — আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –’ বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে — প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে। তুমি আলো তুমি আলো হতে আরো আলোকের পথে চলেছ কোথায়! তোমার চলার পথে কি গো তপতীর, ছায়ার মতন থাকা যায়! হয়তো আলোর ছায়া নেই; আলো তুমি তবুও তো- আলো তুমি ছায়ারও মনেই; বাহিরে বিশাল ঐ পৃথিবীর জাতীয়তা অ-জাতীয়তায় তুমি আলো।তুমি আলো যেইখানে সাগর-নীলিমা আজ মানুষের সন্দেহে কালো, ভাইরা ব্যথিত হ’লে ভাইদের ভালো, মানুষের মরুভূমি একখানা নীল মেঘ চায়। তুমি কেন বহু দূরে তুমি কেন বহু দূরে — ঢের দূর — আরো দূরে — নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ তুমি কেন কোনদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বলো নাকো একটিও কথা; আমরা মিনার গড়ি — ভেঙে পড়ে দুদিনেই — স্বপনের ডানা ছিড়ে ব্যথা রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে — ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয় — নীল নাভিশ্বাস; ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড যুগ থেকে আজো বারোমাস; আমাদের সত্য, আহা রক্ত হযে ঝরে শুধু; — আমাদের প্রাণের মমতা ফড়িঙের ডানা নিয়ে ওড়ে, আহা: চেয়ে দেখে অন্ধকার কঠিন ক্ষমতা ক্ষমাহীন — বার বার পথ আটকায়ে ফেলে বার বার করে তারে গ্রাস;তারপর চোখ তুলে দেখি ঐ কোন দূর নক্ষত্রের ক্লান্ত আয়োজন ক্লানি — র ভুলিতে বলে — ঘিয়ের সোনার দীপে লাল নীল শিখা জ্বলিতেছে যেন দূর রহস্যের কুয়াশায়, — আবার স্বপ্নের গন্ধে মন কেঁদে ওঠে — তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু ক্লানি — রক্তের কণিকা ঝরে শুধু — স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ — নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা? স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরিয়া, উজ্জায়িনী, গৌড় বাংলা, দিল্লী, বেবিলন? তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে; দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্‌ কাহিনীর দেশে – ‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে, কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে – নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে। তোমরা স্বপ্নের হাতে ধরা দাও তোমরা স্বপ্নের হাতে ধরা দাও—আকাশের রৌদ্র ধুলো ধোঁয়া থেকে স’রে এইখানে চ’লে এসো; পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন তোমাদের কথা শুনিয়াছি—তোমাদের ম্লান-মুখ দেখিয়াছি—তোমাদের ক্লান্ত রক্তাক্ততা দেখিয়াছি কত দিন—ব্যথিত ধানের মতো বুক থেকে পড়িতেছে ঝ’রে তোমাদের আশা শান্তি, ম্লান মেঘে সোনালি চিলের মতো কলরব ক’রে মিছে কেন ফেরো আহা—পৃথিবীর পথ থেকে হে বিষণ্ন, হে ক্লান্ত জনতা তোমরা স্বপ্নের ঘরে চ’লে এসো—এখানে মুছিয়া যাবে হৃদয়ের ব্যথা সন্ধ্যার বকের মতো চ’লে এসো ধূসর স্তনের মতো শান্ত পথ ধরে।চারিদিকে রাত্রিদিন কলরব ক’রে যায় দাঁড়কাক বাদুরের মতো পৃথিবীর পথে ওই—সেখানে কি ক’রে তবে শান্তি পা’বে মানুষ বলো তো ? এখানে গোধূলি নষ্ট হয় নাকো কোনোদিন;—কয়লার মতো রং—ম্লান পশ্চিমের মেঘে ওই লেগে আছে চিরদিন; কড়ির মতন শাদা করুণ উঠান প’ড়ে আছে চিরকাল; গোধূলি নদীর জলে রূপসীর মতো মুখখানা দেখে ধীরে—ধীরে—আরো ধীরে শান্তি ঝরে, স্বপ্ন ঝরে আকাশের থেকে।। তোমাকে মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্রে অই; কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি? কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত ক’রে। রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে- নারীর,-তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির। আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হ’লে বলেঃ ‘আমি রোদ কি ধূলো পাখি না সেই নারী?’ পাতা পাথর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি; নদী শিশির পাখি বাতাস কথা ব;লে ফুরিয়ে গেলে পরে শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে সফল হ’তে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো। যদিও পথ আছে-তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে; প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো- কী বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে। তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসেঃ মানবপ্রতিভার রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে। মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।    তোমাকে (অপ্রকাশিত) একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি। সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা– অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়– চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে। আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে তোমার মুখের মতন অবিকল।নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে; স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়; অপরাহ্ণে আকাশের রং ফিকে হলে।তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল; তোমার বুকের ‘পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস; তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর রাত; নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস। তোমাকে ভালোবেসে আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল এই জীবনের পদ্মপাতার জল; তবুও এ-জল কোথা থেকে এক নিমিষে এসে কোথায় চ'লে যায়; বুঝেছি আমি তোমাকে ভালোবেসে রাত ফুরোলে পদ্মের পাতায়।আমার মনে অনেক জন্ম ধ'রে ছিলো ব্যথা বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছো পদ্মপাতা; হয়েছো তুমি রাতের শিশির- শিশির ঝরার স্বর সারাটি রাত পদ্মপাতার পর; তবুও পদ্মপত্রে এ-জল আটকে রাখা দায়।নিত্য প্রেমের ইচ্ছা নিয়ে তবুও চঞ্চল পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল, তোমার আলোয় আলো হলাম তোমার গুণে গুণ; অনন্তকাল স্থায়ী প্রেমের আশ্বাসে করুণ জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে; পদ্মপত্র জল নিয়ে তার- জল নিয়ে তার নড়ে; পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়। তোমায় আমি তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে তুমি আমার পদ্মপাতা হলে; শিশিরকণার মতন শূণ্যে ঘুরে শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে, খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।নদী সাগর কোথায় চলে বয়ে পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হয়ে জানি না কিছু -দেখি না কিছু আর এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।তোমায় ভালবেসেছি আমি, তাই শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই, তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে শরীর যেমন মনের সঙ্গে মিশে।জানি আমি তুমি রবে- আমার হবে ক্ষয় পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়। এই আছে, নেই; এই আছে, নেই- জীবন চঞ্চল; তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল বুঝেছি আমি তোমায় ভালবেসে। তোমায় আমি দেখেছিলাম তোমায় আমি দেখেছিলাম ঢের শাদা কালো রঙ্গের সাগরের কিনারে এক দেশে রাতের শেষে–দিনের বেলার শেষে।এখন তোমায় দেখি না তবু আর সাতটি সাগর তেরো নদীর পার যেখানে আছে পাঁচটি মরুভূমি তার ওপারে গেছ কি চ’লে তুমি ঘাসের শান্তি শিশির ভালোবেসে!বটের পাতায় সে কার নাম লিখে (গভীরভাবে) ভালোবেসেছিল সে নামটিকে হরির নাম নয় সে আমি জানি, জল ভাসে আর সময় ভাসে–বটের পাতাখানি আর সে নারী কোথায় গেছে ভেসে তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে, আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান, আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে – হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ -কখন মরণ আসে কে বা জানে – কালীদহে কখন যে ঝড় কমলের নাম ভাঙে – ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর, কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখে মুখে – রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর। দক্ষিণা প্রিয়ার গালেতে চুমো খেয়ে যায় চকিতে পিয়াল রেণু!- এল দক্ষিণা-কাননের বীণা, বনানীপথের বেণু! তাই মৃগী আজ মৃগের চোখেতে বুলায়ে নিতেছে আখিঁ, বনের কিনারে কপোত আজিকে নেয় কপোতীরে ডাকি! ঘুঘুর পাখায় ঘুঙুর বাজায় আজিকে আকাশখানা,- আজ দখিনার ফর্দা হাওয়ায় পর্দা মানে না মানা! শিশিরশীর্ণা বালার কপোলে কুহেলির কালো জাল উষ্ণ চুমোর আঘাতে হয়েছে ডালিমের মতো লাল! দাড়িমের বীজ ফাটিয়া পড়িছে অধরের চারি পাশে আজ মাধবীর প্রথম উষার, দখিনা হাওয়ার শ্বাসে! মদের পেয়ালা শুকায়ে গেছিল, উড়ে গিয়েছিল মাছি, দখিনা পরশে ভরা পেয়ালার বুদবুদ্‌ ওঠে নাচি! বেয়ালার সুরে বাজিয়া উঠিছে শিরা-উপশিরাগুলি! শ্মাশানের পথে করোটি হাসিছে-হেসে খুন হল খুলি! এস্রাজ বাজে আজ মলয়ের চিতার রৌদ্রতপ সুরের সুঠোমে নিভে যায় যেন, হেসে ওঠে যেন শব! নিভে যায় রাঙা অঙ্কারমালা বৈতরনীর জলে, সুর-জাহ্নরী ফুটে ওঠে আজ মলয়ের কোলাহলে! আকাশ শিথানে মধু পরিণয়-মিলন বাসর পাতি হিমানীশীর্ণ বিধবা তারারা জ্বলে ওঠে রাতারাতি! ফাগুয়ার রাগে-চাঁদের কপোল চকিতে হয়েছে রাঙা! হিমের ঘোমটা চিরে দেয় কে গো মরমস্নায়ুতে দাঙা! লালসে কাহার আজ নীলিমার আনন রুধির লাল- নিখিলের গালে গাল পাতে কার কুঙ্কুম ভাঙা গাল! নারাঙ্গি ফাটা অধর কাহার আকাশ বাতাসে ঝরে! কাহার বাঁশিটি খুন উথলায়- পরান উদাস করে! কাহার পানেতে ছুটিছে উধাও শিশু পিয়ালের শাখা! ঠোঁটে ঠোঁট ডলে- পরাগ চোঁয়ায় অশোক ফুলের ঝাঁকা! কাহার পরশে পলাশবধুর আঁখির কেশরগুলি মুদে মুদে আসে-আর বার করে কুঁদে কুঁদে কোলাকুলি! পাতার বাজারে বাজে হুল্লোড়-পায়েলার রুণ-রুণ, কিশলয়দের ডাশা পেষে কে গো-চোখ করে ঘুমঘুম! এসেছে দখিনা-ক্ষীরের মাঝারে লুকায়ে কোন্‌-এক হীরের ছুরি!- তার লাগি তবু ক্ষ্যপা শাল নিম, তমাল বকুলে হুড়াহুড়ি! আমের কুঁড়িতে বাউল বোলতা খুনসুড়ি দিয়ে খসে যায়, অঘ্রাণে যার ঘ্রাণ পেয়েছিল, পেয়েছিল যারে পোষলায়, সাতাশে মাঘের বাতাসে তাহার দর বেড়ে গেছে দশগুণ- নিছক হাওয়ায় ঝরিয়া পড়িছে আজ মউলের কষগুণ! ঠেলে ফেলে দিয়ে ণীলমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড় দখিনার মুখে রসের বাগান বিকায়ে দিতেছে ক্ষীর! এসেছে নাগর- যামিনীর আজ জাগর রঙিন আঁখি,- কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি- আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া, মদঘূর্ণনে হায়! নিশীথের স্বেদসীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়! রূপসী ধরনী বাসকসজ্জা, রূপালি চাঁদের তলে বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে! রোল উতরোল শোণিতে শিরায়- হোরীর হা রা রা চিৎকার মুখে মুখে মধু- সুধাসীধু শুধু তিত্‌ কোথা আজ- তিত্‌ কার! শীতের বাস্তুতিতে ভেঙে আজ এল দক্ষিণা মিষ্টি মধু মদনের হুলে ঢুলে ঢুলে ঢুলে হুশহারা হল সৃষ্টি বধূ! দাও-দাও সূর্যকে জাগিয়ে দাও দাও-দাও সূর্যকে জাগিয়ে দাও হে দিন, জ্বালাও তুমি আলো। যখন নির্বাণ ছিলো- কোনো দিকে জ্যোতিষ্ক ছিলো না, যখন শূন্যের সাথে শূন্যের চুম্বনে গাঢ় নীল নীহারিকা শিখা, সাধ জেগে উঠেছিলো যখন উদ্দেশ্যহীন আর্ত অন্ধ রোদসীকে চোখে রেখে তবু অগ্নির বর্ণের মতো আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম হলো,- সে আবেগ সেইদিন সে - আলোকে জেগে কি যেন অনবতুল আভা চেয়েছিলো, বহে চলা- সূর্যে কন্ঠে কথা বলা- প্রাণ জন্ম দেয়া চেয়েছিলোআজ এক কোটি শতাব্দীর পরে অনন্তের কারুকার্যে লীন মানুষের সংকল্পের সংঘর্ষে সুন্দর রাত্রি হ'য়ে যাক সূর্য, মৈত্রী হোক সফল নির্মল নক্ষত্র মৃত্তিকা হোক; প্রেমের প্রতিভা হোক উজ্জ্বল বিনত- বহ্মাণ্ড রচনা হ'লে তার ঘাসে এক ফোঁটা শিশিরের মতো। দিনরাত্রি সমস্ত দিন সমস্ত পৃথিবীই যেন আকাশ। চারদিকে রৌদ্রের ভিতর রয়ে গেছে নির্মল জলের অনুভূতি; জল আকাশ ও আগুনের থেকে এই সব রাত্রির জন্ম হয়; অন্তহীন শুভ্রবিবেকী নক্ষত্রের; এই সব স্থায়ী জিনিস চল-বিশ্বলোকের; মানব্জীবনের; এদের অনবচ্ছিন্ন উজ্জ্বল প্রবাহে ধৌত হয়ে সমস্ত গৃহযুদ্ধের গৃহবলিভুকদের রক্তের শেষ বিন্দুও খুঁজে পাবে না কোথাও। কোথাও থাকবে না আন্তর্জাতিক অন্যায়ের ছায়া আর। দেখা যাবে দিন সূর্যশরীরীঃ যাযাবর হাঁসকে নিয়ে চলেছে মেঘের ফেনাওড়ানো দূরতর নীলিমায়; জেগে উঠবে বিকেলের শিয়রে সাগরের বাতাস যেন- দূর ময়দানের; অন্তহীন নক্ষত্রের চলা ফেরার দেশে পাওয়া যায় তাকে; ঐ ঝাউ গাছের আঁধারের ভিতরেও; বন্ধরে নগরে মানুষের হিংস্র বেড়ালের গর্জনকে বিনমিত ক'রে করুণার রাত্রিঋতুর মত পাওয়া যায় তাকে- পাওয়া যায় তাকে।আজকের মলিনতা রক্ত কোথায় লীন হয়ে যাচ্ছে সময়ের মনে- নিরবচ্ছিন্ন বিস্মরণে- দিন ও রাত্রির অন্তহীন জলঝর্ণার শুশ্রুষার শব্দের ভিতর। দীপ্তি তোমার নিকট থেকে যত দূর দেশে আমি চলে যাই তত ভালো। সময় কেবলই নিজ নিয়মের মতো- তবু কেউ সময়স্রোতের ‘পরে সাঁকো বেঁধে দিতে চায়; ভেঙ্গে যায়; যত ভাঙ্গে তত ভালো। যত স্রোত বয়ে যায় সময়ের সময়ের মতন নদীর জলসিঁড়ি, নীপার, ওডার, রাইন, রেবা, কাবেরীর তুমি তত বহে যাও, আমি তত বহে চলি, তবুও কেহই কারু নয়। আমরা জীবন তবু। তোমার জীবন নিয়ে তুমি সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চলে রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙ্গে খরতর নদী হয়ে গেলে হয়ে যেতে। তবু মানুষী হয়ে পুরুষের সন্ধান পেয়েছ; পুরুষের চেয়ে বড় জীবনের হয়তো বা।আমিও জীবন তবু- ক্বচিৎ তোমার কথা ভেবে তোমার সে শরীরের থেকে ঢের দূরে চলে গিয়ে কোথাও বিকেলবেলা নগরীর উৎসারণে উচল সিঁড়ির উপরে রৌদ্রের রঙ জ্বলে ওঠে- দেখে বুদ্ধের চেয়েও আরো দীন সুষমার সুজাতার মৃত বৎসরে বাঁচায়েছে কেউ যেন; মনে হয়, দেখা যায়।কেউ নেই-স্তব্ধতায়; তবুও হৃদয়ে দীপ্তি আছেদিন শেষ হয় নি এখনও। জীবনের দিন- কাজ শেষ হতে আজও ঢের দেরি। অন্ন নেই। হ্রৃদয়বিহীনভাবে আজ মৈত্রেয়ী ভূমার চেয়ে অন্নলোভাতুর। রক্তের সমুদ্র চারি দিকে; কলকাতা থেকে দূর গ্রিসের অলিভ বন অন্ধকার। অগণন লোক মরে যায়; এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু নয়- সেই মৃত্যু ব্যসনের মতো মনে হয়। এ ছাড়া কোথাও কোনো পাখি বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে। দুজন আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে; আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে প্রাণ তার ভরে গেছে। দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে আবার প্রথম এল- মনে হয়-যেন কিছু চেয়ে -কিছু একান্ত বিশ্বাসে। লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বথের শাখার ভিতরে অন্ধকারে নড়ে-চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে; তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল। যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে, হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে-ক্রমে যেখানে মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছেঃ সেই ব্যপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরী; ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে-শালিকের নেই আর দেরি, হলুদ কঠিন ঠ্যাং উচুঁ করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে; ঝরিছে মরিছে সব এইখানে-বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে। নারী তার সঙ্গীকেঃ’পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, জানি আমি;-তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয় কী নিয়ে থাকিবে বল;-একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা, তারপর ঝ’রে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না। হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের-প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা ফুরোত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে-‘এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর। হলুদ রঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রাণের খড় চারি দিকে শূণ্য হতে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর; চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;- প্রেমিকের মনে হলঃ’এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা, কুয়াশা রবে না আর-জনিত বাসনা নিজে-বাসনার মতো ভালোবাসা খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’ দুটি তুরঙ্গম আকাশে সমস্ত দিন আলো; পাতায় পালকে রোদ ঝিকমিক করে; জলগুলো চ'লে গেছে চেনা পথ ধ'রে অবিরল আরো দূর জলের ভিতরে।যদিও গভীরভাবে সময়ের সাগর উজ্জ্বল- কি এক নিঃশব্দ নিবিড় আবেগে তাকে কালো দু'টি তুরঙ্গম যেন অনন্তের দিকে টেনে নেয়; নিরন্তর এ রকম অগ্রসর হ'য়ে যাওয়া ভালো।সারাদিন এঁকেবেঁকে নদীটির ঢেউ মিশে যায় শাদা কালো রঙের সাগরে; সারাদিন মেঘ পাখি উঁচু উঁচু গাছ যেন প্রায় সূর্য স্পর্শ করে।মৌমাছি রৌদ্র নারী শরীর ও মন মুহূর্ত ও মহাকাল দু'জনের কাছে বারবার ব্রহ্মাণ্ডের অপরূপ অগ্নি পরিধির ভিতরে নিবিড় অগ্নিশিল্প হয়ে আছে।সব শেষ হয়ে গেলে তারপর থাকে একদিন যা জেনেছি তার চেয়ে ভালো সমস্ত দিনের সূর্য- আর সেই সূর্যের বিদায়, আঁধারের রঙে মাখা নক্ষত্রের আলো।নগর বন্দর দিক জনতার পথে ক্ষতি রক্ত ভালোবাসা ব্যথা জ্ঞান-লাভ ভালো,- তবু- সেই সব স্থিরতর ক'রে নিতে হয়; প্রকৃতি মানুষ আর সময়ের নিজের স্বভাবজেনে নিতে হয় নদী প্রান্তরের ঘাসে; এ ছাড়া আর কি সত্য ইতিহাস জানে? কিছু গ্রন্থ রীতি চিন্তা- দু'একটী নক্ষত্র নারীর দিকে চেয়ে বোঝা যায় জীবন ও মৃত্যুর মানে। দু-দিকে দু-দিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ মাঝখানে আজ এই সময়ের ক্ষণিকের আলো যে নারীর মতো এই পৃথিবীতে কোনোদিন কেউ নেই আর- সে এসে মনকে নীল- রৌদ্রনীল শ্যামলে ছড়ালো কবে যেন- আজকে হারিয়ে গেছে সব; ভুলে গেছি পটভূমি- ভুলে গেছি কে যে সেই নারী চারিদিকে গুঞ্জরিত হয়েছিলো কী সব গভীর পল্লব; যখনই আমার আত্মা বৃক্ষ আর আগুনের মতো নভোচারী হ’য়ে ওঠে- মনে হয় যেন কোনো হরিতের- নব হরিতের সংগীতে নিশ্চিহ্ন হ’য়ে মানুষের ভাষা এ-জন্মের- আরো দূর জন্ম-জন্মান্তের মুখোমুখি ফিরে এসে অনাদি আলোর ভালোবাসা সামাজিক অন্তহীন আকাশের নিচে জ্বালিয়ে শ্যামলনীল ব্যথা হ’তে চায়। আমি সেই মহাতরু- লাবন্যসাগর থেকে নিজে উঠে তুমি জাগয়েছো অনাদির সূর্য নীলিমায়- পৃথিবীর ভয়াবহ কোলাহল ভেদ ক’রে অবিনাশ স্তর আনন্দের আলোকের অন্ধকার বিহ্বলতার অন্তহীন হরিতের মর্মরিত লাবণ্যসাগর। দূর পৃথিবীর গন্ধে ভরে ওঠে দূর পৃথিবীর গন্ধে ভরে ওঠে আমার এ বাঙালির মন আজ রাতে; একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে তবুও সে ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন মউরীর মৃদু গন্ধে ভরে রবে, — কিশোরীর স্তন প্রথম জননী হয়ে যেমন নরম দুধে গলে পৃথিবীর সব দেশে–সব চেয়ে ঢের দূর নক্ষত্রের তলে সব পথে এই সব শানি — আছে: ঘাস — চোখ — শাদা হাত — স্তন —কোথাও আসিবে মৃত্যু — কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস আমারে রাখিবে ঢেকে — ভোরে, রাতে, দু’পহরে পাখির হৃদয় ঘাসের মতন সাধে ছেয়ে রবে রাতের আকাশ নক্ষত্রের নীল ফুলে ফুটে রবে — বাংলার নক্ষত্র কি নয়? জানি নাকো; তবুও তাদের বুকে স্থির শান্তি– শান্তি লেগে যায়; আকাশের বুকে তারা যেন চোখ — শাদা হাত যেন স্তন — ঘাস — | দেশ কাল সন্ততি কোথাও পাবে না শান্তি—যাবে তুমি এক দেশ থেকে দূরদেশে? এ-মাঠ পুরানো লাগে—দেয়ালে নোনার গন্ধ—পায়রা শালিখ সব চেনা? এক ছাঁদ ছেড়ে দিয়ে অন্য সূর্যে যায় তারা-লক্ষ্যের উদ্দেশে তবুও অশোকস্তম্ভ কোনো দিকে সান্তনা দেবে না।কেন লোভে উদ্‌যাপনা? মুখ ম্লান—চোখে তবু উত্তেজনা সাধ? জীবনের ধার্য বেদনার থেকে এ-নিয়মে নির্মুক্তি কোথায়। ফড়িং অনেক দূরে উড়ে যায় রোদে ঘাসে—তবু তার কামনা অবাধ অসীম ফড়িংটিকে খুঁজে পাবে প্রকৃতির গোলকধাঁধাঁয়ছেলেটির হাতে বন্দী প্রজাপতি শিশুসূর্যের মতো হাসে; তবু তার দিন শেষ হয়ে গেল; একদিন হতই-তো, যেন এই সব বিদ্যুতের মতো মৃদুক্ষুদ্র প্রাণ জানে তার; যতো বার হৃদয়ের গভীর প্রয়াসে বাঁধা ছিঁড়ে যেতে চায়—পরিচিত নিরাশায় তত বার হয় সে নীরব।অলঙ্ঘ্য অন্তঃশীল অন্ধকার ঘিরে আছে সব; জানে তাহা কীটেরাও পতঙ্গেরা শান্ত শিব পাখির ছানাও। বনহংসীশিশু শূন্যে চোখ মেলে দিয়ে অবাস্তব স্বস্তি চায়;—হে সৃষ্টির বনহংসী, কী অমৃত চাও? দেশবন্ধু বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা অশান্ত সন্তান ওগো, বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদীমাতা। কাল বৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব উত্তাল ঊর্মির তালে-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি, ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী। স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি, এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ–ক্লৈব্যের সংহারী। ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর, ভেঙেছিলে ধূলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর, ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভান্ড তীব্র দর্পে, বৈরাগের রাগে, দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে-পৃথী-পুরোভাগে। নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাবগঙ্গোত্তরী আর্ত অর্স্পশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি; বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী। এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ, শানি-প্রিয় মুমূর্ষৃর শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ গান্ডীবের টঙ্কারেতে মুহুর্মুহু বলেছিলে, আশি আমি আছি! কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী। ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভেলির সম, অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম। ছিলে তুমি রূদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে, অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে- অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে। ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি। ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে উন্মত্ত ঝটিকাসম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে; শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশল্যকরণী। ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে শবসাধকের বেশে-সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে। রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী; কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি। বিবিবশে দূরগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক, অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোকে। মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল, গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন-উচ্ছ্বাসউচ্ছল। যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে, তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে। অর্চনার হোমকুন্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি, বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি। গৌরকানি- শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা চুপে চুপে রেখে এল পূঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা। ধান কাটা হয়ে গেছে ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন – ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড় পাতা কুটো ভাঙা ডিম – সাপের খোলস নীড় শীত। এই সব উৎরায়ে ঐখানে মাঠের ভিতর ঘুমাইতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ – কেমন নিবিড়। ঐখানে একজন শুয়ে আছে- দিনরাত দেখা হত কত কত দিন, হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ; শান্তি তবু : গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ। নগ্ন নির্জন হাত আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে : আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার। যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে। মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে। ভারতসমুদ্রের তীরে কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে আজ নেই, কোন এক নগরী ছিল একদিন, কোন এক প্রাসাদ ছিল; মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ; পারস্য গালিচা, কাশ্মিরি শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা; আর তুমি নারী - এই সব ছিল সেই জগতে একদিন। অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল; অনেক কমলা রঙের রোদ; আর তুমি ছিলে; তোমার মুখের্ রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না। ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী, অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা, লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ, অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পান্ডুলিপি, রামধনু রঙের কাচের জানালা, ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায় কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের ক্ষণিক আভাস - আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়। পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! তোমার নগ্ন নির্জন হাত; তোমার নগ্ন নির্জন হাত। নদী বঁইচির ঝোপ শুধু — শাঁইবাবলার ঝাড়–আর জাম হিজলের বন– কোথাও অর্জুন গাছ–তাহার সমস্ত ছায়া এদের নিকটে টেনে নিয়ে কোন কথা সারাদিন কহিতেছে অই নদী?–এ নদী কে?–ইহার জীবনহৃদয়ে চমক আনে;যেখানে মানুষ নাই–নদী শুধু–সেইখানে গিয়ে শব্দ শুনি তাই আমি– আমি শুনি– দুপুরের জলপিপি শুনেছে এমন এই শব্দ কতদিন;আমিও শুনেছি ঢের বটের পাতার পথ দিয়েহেঁটে যেতে–ব্যাথা পেয়ে;দুপুরে জলের গন্ধে একবার স্তব্ধ হয় মন; মনে হয় কোন শিশু মরে গেছে, আমার হৃদয় যেন ছিল শিশু সেই; আলো আর আকাশের থেকে নদী যতখানি আশা করে–আমিও তেমনএকদিন করি নি কি? শুধু একদিন তবু? কারা এসে বলে গেল, ‘ নেই– গাছ নেই– রোদ নেই,মেঘ নেই– তারা নেই–আকাশ তোমার তরে নয়! ‘– হাজার বছর ধরে নদী তবু পায় কেন এই সব? শিশুর প্রাণেই নদী কেন বেঁচে থাকে?–একদিন এই নদী শব্দ ক’রে হদয়ে বিস্ময় আনিতে পারে না আর; মানুষের মন থে নদী হারায়– শেষ হয় । নব নবীনের লাগি -নব নবীনের লাগি প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমার রয়েছি জাগি! ব্যর্থ পঙ্গু খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙে, নব আকাঙক্ষা আশার স্বপনে হৃদয় মোদের রেঙে, দেবতার দ্বারে নবীন বিধান-নতুন ভিক্ষা মেগে দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অনুরাগী!ঝড়ের বাতাস চাই। চারি দিক ঘিরে শীতের কুহেলি, শ্মশানপথের ছাই, ছড়ায়ে রয়েছে পাহাড় প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি, কে সাজাবে ঘর-দেউলের পর কঙ্কাল তুলি তুলি? সূর্যচন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি! মরার ধরায় জ্যান্ত কখনও মাগিতে যাবে কি ঠাঁই!ঘুমায়ে কে আছে ঘরে! মৃতুশিশু-বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে! কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা? দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা, বাজে বাদলের রঙ্গমল্লী. ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা! ফিরিছে বালক-ঘর পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে!আমরা অশ্বরোহী!- যাযাবর যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি, মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি , মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি, চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি, সুবাস ছড়াই উশীরের মতো, ধূপের মতন দহি!গাহি মানবের জয়! কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়! সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে, কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে-কোটি কোটি শিখা জাগে, প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে, আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়! -জয় মানবের জয়! নবপ্রস্থান শীতের কুয়াশা মাঠে; অন্ধকারে এইখানে আমি। আগত ও অনাগত দিন যেন নক্ষত্রবিশাল শূন্যতার এই দিক- অথবা অপর দিক; দুয়েরি প্রাণের বিচিত্র বিষয়জ্ঞানে মিলে গেছে- তবুও প্রেমের অমর সম্মতিক্রমে। পৃথিবীর যে কোনো মানব দেশ কাল যে কোনো অপর দেশ সময় ও মানুষের তরে সেবা জ্ঞান শৃঙ্খলা অবতার হয়ে সব বাধ্যব্যথাহারা নবীন ভূগোললোকে মিশে গেছে;- দিকভ্রান্তিহীন সারসের মত,- নীল আকাশকে ঈষৎ ক্রেংকারে খুলে ফেলে। যা হয়েছে যা হয়নি সবই নক্ষত্রবীথির একজন অথবা অপর জন;- নিজেদের হৃদয়যন্ত্রের নিকটে সত্যের মত প্রতিভাত হয়ে উঠে তারা অনন্ত অমার পটভূমির ভিতরে অনিমেষ সময়ের মত জ্বলে;- মনে হয় আশা অথবা নিরাশা যদি শতান্দীর জীবনকে খেয়ে শেষ করে পবিত্রতায় তবু দিক ও সম্য মিলে একজন অমলিন তারা অমিলের ঊর্ণা ধোঁয়া ছায়া কেটে মিলনের পথে জ্ব'লে যায়; যায় না কি?- নিভু নিভু হয়ে শীতকালের দেয়ালে ফুটে ওঠে; কথায় কারণে কামে অগণন ক্লেদে কনফারেন্‌সে বাতির অভাব হ'লে পৃথিবীর মানচিত্রে অন্ধকারে পথ দেখবার মত কোনো কাউকে না পেলে ঐ তারাবলী তারা প্রাণের ভিতর জড় মূল্যের অধিক ব্যাপ্তি;- চারিদিকে এই অবিচ্ছিন্ন পাতা ছায়া শিশিরের নগরের হৃদয়কম্পনে ব'সে আমি তোমাকে জাগায়ে দিয়ে, প্রিয়, সব কালীন জননী মানুষের এক জাতি এক দেশ এক মৃত্যু একটি জীবন এক গহন আলোকে দেখি না কি? প্রেতের রোলের ভিতরে বাঙালীর ঘর ভেঙে ঝ'রে গেলে জেনিভার অমেয় প্রাসাদ ম'রে যায়;- ফ্ল্যান্ডাস, ভাডুন, ভিমি রিজ, উক্রেইন হোংয়াহো নীপার রাইন চিনদুইনের পরে সব শব কলকাতা হাওড়া মেদিনীপুর ডায়মনহারবারে বাংলায়, অগণন মানবের মৃতদেহ প্রমাণিত হয়ে কিরকম শুভ্র সৌভ্রাত্রের মত, চেয়ে দেখ, ছড়ায়ে র'য়েছে। নতুন মৃত্যুর বীজ নয়- ওরা নতুন নেশন- বীজ নতুন বঞ্চনা-ধ্বংস-মৃগতৃষ্ণাবীজ নয়; নব নব প্রাণনের সংযমে পৃথিবী গ'ড়ে সফলতা পাবে মনে হয়- মানুষের ইতিহাসভনিতার দিন শেষ ক'রে তার স্থির প্রকৃতিস্থ আত্মার আলোর বাতায়নে।আমার ব্যাহত ঘরে এ ছাড়া অপর কোনো বাতি নেই আর, আমার হৃদয়ে নেই, এইখানে মৃত পোল্যান্ডের সীমানা রাইনের রোলে মিশে গিয়ে মরণকর্কশ জামের্নির হৃদয়ের পরে হিমধূমোজ্জ্বল অলিভ-বনের আন্দোলনে এম্পিডোক্লেসের স্মৃতি বরাবর জয় ক'রে নিয়ে নবীন লক্ষ্যের গ্রীস্‌, নতুন প্রাণের চীন আফ্রিক্‌ ভারত প্যালেস্টাইন। পৃথিবীর ভয়াবহ রাষ্ট্রকূট অন্ধকারে অন্তহীন বিদ্যুৎ-বৃষ্টির জ্যোর্তিময় ব্রেজিল পাথরে আমি নবীন ভূগোল এরকম মানবীয় হয়ে যেতে দেখি;- ইতিহাস মানবিক হয়ে ওঠে;- যাযাবর শ্রীজ্ঞানের মত এখন অকুতোভয় উদাত্ত আবেগে সঞ্চারিত হয়ে যাওয়া অর্বাচীন জেনে নিয়ে তবু নতুন প্রাণের নব উদ্দেশের অভিসারী হতে চায় নাকি- চায় না কি জনসাধারণ পৃথিবীর? দেয়ালে ট্রামের পথে নর্দমায় ট্রাকের বিঘোর হনিতের অস্ফুট সিংহের শব্দে সবিস্ময় উত্তরচরিত্রে ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে যেতে পারে বাংলার লোকশ্রুত বিবর্ণ চরিত। আমার চোখের পথে আবর্তিত পৃথিবীর আঁকাবাঁকা রেখে যতদূর চ'লে গেছেঃ কলকাতা নতুন দিল্লী ইয়াঙ্কী আফ্রিক্‌ দান্তের ইটালী শেক্‌স্‌পীরিয় ইংল্যান্ড মেঘ-পাতাল মর্ত্যের গল্পের বিভিন্ন পর্বের থেকে উঠে এসে রবীন্দ্র লেনিন মার্কস ফ্রয়েড রোলাঁর আলোকিত হ'য়ে ওঠে; মুমুক্ষার অবতার বুদ্ধের চেয়েও সমুৎসুক চোখ মেলে আপামর মানবীয় ঋণ-রিরাংসা-অন্যায়-মৃত্যু-আঁধারে উজ্জ্বল পথিকৃত সাঁকোর মতন সব শতকের ভগ্নাংশকে শেষ ক’রে দিয়ে পবিত্র সময়পথে মিশে গেছে;- সব অতীতের মথিত বিষের মত শুদ্ধ হয়ে সহজ কঠিন দক্ষিণ-ভবিষ্যতে মিলে গিয়ে মানবের হৃদয়ের গভীর অশোক ধ্বনিময়তার মত তুমি হে জোবন, আজ রাতে অন্ধকারে আনন্দসূর্যের আলোড়নে আলোকিত ব’লেই তো মানব চ’লেছে।। নাবিক কবে তব হৃদয়ের নদী বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি! সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন! পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন! কারাগার-মর্মরের তলে নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে ভ'রে যায় বসুধার আহত আকাশ! অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস! -সহস্রের অঙুলিতর্জন নিত্য সহিতেছি মোরা-বারিধির বিপ্লব-গর্জন বরিয়া লয়েছ তুমি, তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো; তোমার পক্ষরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!- তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার, অবগুণ্ঠিতার হিমকৃষ্ণ অঙুলির কঙ্কাল-পরশ পরিহরি গেলে তুমি-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা চকিতে চূর্ণিয়া গেলে-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট, তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি! নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি! প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি! ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,- অগাধের সাধ তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ! মণিময় তোরণের তীরে মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে হে দুরন্ত দুর্নিবার-প্রাণ তব কাঁদে! ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন, সমুদ্রের যৌবন-গর্জন তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের! টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের হে জলধি পাখি! পে তব নাচিতেছে ল্যহারা দামিনী-বৈশাখী! ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রতœচূড় ময়ূখের টিপ, কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে! বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে! কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে- স্তম্ভিত নয়নে নীল বাতায়নে তাকায়েছ তুমি! অতি দূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী! সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া হে জল-বেদিয়া! অল্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন সিন্ধু বেদুঈন! নাহি গৃহ, নাহি পান্থশালা- লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্যপাতালে- বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে! প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর! সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছুডাকা স্বর ভুলেছ নোঙর! কোন্ দূর কুহকের কূল লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল কে বা তাহা জানে! অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে! নাবিকী হেমন্ত ফু্রায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে ; এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে সময়ের কুয়াশায় ; মাঠের ফসলগুলো বার বার ঘরে তোলা হ’তে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে পরিচ্ছন্নভাবে চলে গেছে। মৃত্তিকার ওই দিক আকাশের মুখোমুখি যেমন সাদা মেঘের প্রতিভা ; এই দিকে ঋণ, রক্ত, লোকসান, ইতর, খাতক ; কিছু নেই তবু – তবুও অপেক্ষাতুর ; হৃদয়স্পন্দন আছে – তাই অহরহ বিপদের দিকে অগ্রসর ; পাতালের মত দেশ পিছে ফেলে রেখে নরকের মত শহরে কিছু চায় ; কী যে চায়। যেন কেঊ দেখেছিল খণ্ডাকাশ যতবার পরিপূর্ণ নীলিমা হয়েছে, যতবার রাত্রির আকাশ ঘিরে স্মরনীয় নক্ষত্র এসেছে, আর তাহাদের মতো নরনারী যতবার তেমন জীবন চেয়েছিলো, যত নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেছে রৌদ্রের আকাশে, নদীর ও নগরীর মানুষের প্রতিশ্রুতির পথে যত নিরুপম সূর্যলোক জ্ব’লে গেছে – তার ঋণ শোধ ক’রে দিতে গিয়ে এই অনন্ত রৌদ্রের অন্ধকার। মানবের অভিজ্ঞতা এ-রকম। অভিজ্ঞতা বেশি ভাল হ’লে তবু ভয় পেতে হ’তো ? মৃত্যু তবে ব্যসনের মতো মনে হ’তো ? এখন ব্যসন কিছু নেই। সকলেই আজ এই বিকেলের পরে এক তিমির রাত্রির সমুদ্রের যাত্রীর মতন ভালো-ভালো নাবিক ও জাহাজের দিগন্তর খুঁজে পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন নেশনের নিঃসহায় প্রতিভূর মতো পরস্পরকে বলে, ‘হে নাবিক, হে নাবিক তুমি - সমুদ্র এমন সাধু, নীল হ’য়ে – তবুও মহান মরুভূমি ; আমরাও কেউ নেই -‘ তাহাদের শ্রেণী যোনি ঋণ রক্ত রিরংসা ও ফাঁকি উঁচু – নিচু নর নারী নিক্তিনিরপেক্ষ হ’য়ে আজ মানবের সমাজের মতন একাকী নিবিড় নাবিক হ’লে ভাল হয় ; হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি! নারীসবিতা আমরা যদি রাতের কপাট খুলে ফেলে এই পৃথিবীর নীল সাগরের বারে প্রেমের শরীর চিনে নিতাম চারিদিকের রোদের হাহাকারে,– হাওয়ায় তুমি ভেসে যেতে দখিণ দিকে– যেই খানেতে যমের দুয়ার আছে; অভিচারী বাতাসে বুক লবণ– বিলুন্ঠিত হলে আবার মার কাছে উৎরে এসে জানিয়ে দিতে পাখিদেরও স্খলন আছে। আমরা যদি রাতের কপাট খুলে দিতাম নীল সাগরের দিকে, বিষণ্নতার মুখর কারুকার্যে বেলা হারিয়ে যেত জ্যোতির মোজেয়িকে।দিনের উজান রোদের ঢলে যতটা দূরে আকাশ দেখা যায় তোমার পালক শাদা হয়ে অমেয় নীলিমায় ঐ পৃথিবীর সাটিনপরা দীর্ঘ গড়ন নারীর মতো– তবুও তো এক পাখি; সকল অলাত এইতিহাসের হৃদয় ভেঙ্গে বৃহৎ সবিতা কি! যা হয়েছে যা হতাছে সকল পরখ এইবারেতে নীল সাগরের নীড়ে গুঁড়িয়ে সূর্যনারী হলো, অকূল পাথার পাখির শরীরে। গভীর রৌদ্রে সীমান্তের এই ঢেউ– অতিবেল সাগর, নারি, শাদা হতে–হতে নীলাভ হয়;– প্রেমের বিসার, মহিয়সী, ঠিক এ–রকম আধা নীলের মতো, জ্যোতির মতো। মানব ইতিহাসের আধেক নিয়ন্ত্রিত পথে আমরা বিজোড়; তাই তো দুধের–বরণ–শাদা পাখির জগতে অন্ধকারের কপাট খুলে শুকতারাকে চোখে দেখার চেয়ে উড়ে গেছি সৌরকরের সিঁড়ির বহিরাশ্রয়িতা পেয়ে।অনেক নিমেষ অই পৃথিবীর কাঁটা গোলাপ শিশিরকণা মৃতের কথা ভেবে তবু আরো অনন্তকাল ব’সে থাকা যেত; তবু সময় কি তা দেবে। সময় শুধু বালির ঘড়ি সচল ক’রে বেবিলনের দুপুরবেলার পরে হৃদয় নিয়ে শিপ্রা নদীর বিকেলবেলা হিরণ সূর্যকরে খেলা ক’রে না ফুরোতেই কলকাতা রোম বৃহৎ নতুন নামের বিনিপাতে উড়ে যেতে বলে আমার তোমার প্রাণের নীল সাগরের সাথে।না হলে এই পৃথিবীতে আলোর মুখে অপেক্ষাতুর ব’সে থাকা যেত পাতা ঝরার দিকে চেয়ে অগণ্য দিন,–কীটে মৃণালকাঁটায় অনিকেত শাদা রঙের সরোজিনীর মুখের দিকে চেয়ে, কী এক গভির ব’সে থাকায় বিষণ্ণতার কিরণে ক্ষয় পেয়ে, নারি, তোমার ভাবা যেত।– বেবিলনে নিভে নতুন কলকাতাতে কবে ক্রান্তি, সাগর, সূর্য জ্বলে অনাথ ইতিহাসের কলরবে। নিঃসরণ দুর্গের গৌরবে ব'সে প্রাংশু আত্মা ভাবিতেছে টের পূর্বপুরুষের কথাঃ যারা তারে জঙ্ঘা দিল,- তবু আজ তরবার পরিত্যাগ করার ক্ষমতা যারা দিল;- প্রাচীন পাথর তারা এনেছিল পর্বতের থেকে স্থির কিছু গড়িবার প্রয়োজনে; তারপর ধূসর কাপড়ে মুখ ঢেকে চ'লে গেছে;- পিছন পেঁচা যা ওড়ে জ্যোৎস্নায়- সেইখানে তাদের মমতাঘুরিতেছে- ঘুরিতেছে- শত্রু মঙ্গলের মত;- আমার এ শাদা শাটিনের শেমিজও পেতেছে সেই মনস্বিনী শৃঙ্খলাকে টের। এই দুর্গ আজো তাই- ক্রিয়াবান সপ্তমীর চাঁদের শিঙের নিচে হিম লোল- বক্র- নিরুত্তর;- আজই রাতে আমার মৃত্যুর পর নতুন রক্তিম সূর্য এসে প্রয়োজন মেগে নেবে এইখানে লোকশ্রুত ভূমিকম্পের।পূর্যসূরীদের ইচ্ছা অনুশাসনের মত করিতেছে কাজ। প্রাচীন লেখের থেকে অন্ধকারে বিক্ষুব্ধ সমাজ করতালি দিয়ে হাসে; দূরবীনে দেখা যায় যাই সব জ্যোতির্ময় কণা অনন্ত মোমের তেজ নিয়ে নাচে,- সেই সব উচ্চতর রসিক দ্যোতনা মৃত্যুকে বামনের করতলে হরিতকী অন্তত ক'রে দিক আজ। নিখিল আমার ভাই নিখিল আমার ভাই, -কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে আমি সে বেদনা পাই; যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি, কোন্‌ ফণী যেন আকাশে বাতাসে তোলে বিষ গরজনি! কী যেন যাতনা মাটির বুকেতে আনিবার ওঠে রণি, আমার শস্য-স্বর্ণসরা নিমেষে হযে যে ছাই! সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।আকাশ হতেছে কালো কাহাদের যেন ছায়াপাতে হায়, নিভে যায় রাঙা আলো! বাতায়নে মোর ভেসে আসে যেন কাদের তপ্ত শ্বাস, অন্তরে মোর জড়ায়ে কাদের বেদনার নাগপাশ, বক্ষে আমার জাগিছে কাদের নিরাশা গ্লানিমা ত্রাস, মনে মনে আমি কাহাদের হায় বেসেছিনু এত ভালো। তাদের ব্যথার কুহেলি- পাথারে আকাশ হতেছে কালো।লভিয়াছে বুঝি ঠাঁই আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে নিখিলের বোন-ভাই! আমার গানেতে জাগিছে তাদের বেদনা-পীড়ার দান, আমার প্রাণেতে জাগিছে তাদের নিপীড়িত ভগবান, আমার হৃদয়যূপেতে তাহারা করিছে রক্তস্নান, আমার মনের চিতানলে জ্বলে লুটায়ে যেতেছে ছাই! আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে লভিয়াছে তারা ঠাঁই। নিজেকে নিয়মে ক্ষয় নিজেকে নিয়মে ক্ষয় ক’রে ফেলে রোজই চ’লেছে সময়; তবুও স্থিরতা এক র’য়ে গেছে, সময় ক্ষয়ের মতো নয়। অঘ্রাণের সকালের আব্‌ছা আভার মতন অসংখ্য কুয়াশায়, আশ্বিনে আকাশ রোদ মাঠের ভিতরে, নদীর বিস্তীর্ণ জলে, অথবা ঝড়ের বড় ভোরে, শীতকালে সুস্থির বিকেলে, মনে হয় আজ পৃথিবী অনেক মূল্য, সত্য ভুলে গেছে; সত্যে স্থির হয়ে আছে টের পাই তবুঃ তোমার আমার নীড় প্রকৃতির পর্দার থেকে ভেসে চোখে একটি অমেয় মূল্যে যতদিন আলো ক্ষয় হতেছে আলোকে।কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী নিরঙ্কুশ মালয় সমুদ্র পারে সে এক বন্দর আছে শ্বেতাঙ্গিনীদের। যদিও সমুদ্র আমি পৃথিবীতে দেখে গেছি ঢেরঃ নীলাভ জলের রোদে কুয়ালালুম্পুর, জাভা, সুমাত্রা ও ইন্দোচীন, বালি অনেক ঘুরেছি আমি- তারপর এখানে বাদামী মলয়ালী সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।শাদা-শাদা ছোটো ঘর নারকেল ক্ষেতের ভিতরে দিনের বেলায় আরো গাঢ় শাদা জোনাকির মতো ঝরঝরে। শ্বেতাঙ্গদম্পতি সব সেইখানে সামুদ্রিক কাঁকড়ার মতো সময় পোহায়ে যায়, মলয়ালী ভয় পায় ভ্রান্তিবশত, সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।বাণিজ্যবায়ুর গল্পে একদিন শতাব্দীর শেষে অভ্যুত্থান শুরু হ'লো এইখানে নীলসমুদ্রের কটিদেশে; বাণিজ্যবায়ুর হর্ষে কোনো একদিন, চারিদিকে পামগাছ- খোলা মদ- বেশ্যালয়- সেঁকো- কেরোসিন সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।সারাদিন দূর থেকে ধপঁইয়া রৌদ্রে রিরাংসায় সে ঊনপঞ্চাশ বাতাস তবুও বয়- উদীচির বিকীর্ণ বাতাস; নারকেল কুঞ্জবনে শাদা-শাদা ঘরগুলী ঠাণ্ডা ক'রে রাখে; লাল কাঁকরের পথ- রক্তিম গির্জার মুণ্ড দেখা যায় সবুজের ফাঁকেঃ সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন। নিরালোক একবার নক্ষত্রের দিকে চাই — একবার প্রান্তরের দিকে আমি অনিমিখে। ধানের ক্ষেতের গন্ধ মুছে গেছে কবে জীবনের থেকে যেন; প্রান্তরের মতন নীরবে বিচ্ছিন্ন খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার; নক্ষত্রেরা বাতি জ্বেলে জ্বেলে — জ্বেলে — ‘নিভে গেলে — নিভে গেলে?’ বলে তারে জাগায় আবার;জাগায় আবার। বিক্ষত খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে — বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার, ঘুম পায় তার।অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে এই সন্ধ্যার আকাশ — এই রাতের আকাশ; এইখানে ফাল্গুনের ছায়া-মাখা ঘাসে শুয়ে আছি; এখন মরণ ভালো — শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস; অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।কে যেন উঠিল হেঁচে–হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি! সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের — ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে খেয়ে যায় ঘাস; যেন কোনো ব্যথা নাই? পৃথিবীতে — আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি? ‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’ চাপা ঠোঁটে বলে দূর কৌতুকী আকাশ।ঝাউফুলে ঘাস ভরে — এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে; কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে। সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাব! কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই — চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শান্তি আমি পাব? রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাব?‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’ — বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে– ‘অথবা ঘাসের ’পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালোবেসে; অথবা তাকায়ে দ্যাখো গরুর গাড়িটি ধীরে চ’লে যায় অন্ধকারে সোনালি খড়ের বোঝা বুকে; পিছে তার সাপের খোলস, নালা খলখল অন্ধকার — শান্তি তার রয়েছে সমুখে; চলে যায় চুপে চুপে সোনালি খড়ের বোঝা বুকে– যদিও মরেছে ঢের গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, –তবু তার মৃত্যু নাই মুখে।’ নির্জন সাক্ষর তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে; যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’— পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার! তোমার এ জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই; শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে; আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে, —আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে— আকাশ ছডায়ে অাছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে; জীবনের রং তবু ফলানো কি হয় এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময় পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল, চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল; রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে কোনো এক মানুষের তরে যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরেনক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা; যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে। নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়— পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে ব’লে; আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে কোনো এক মানুষীর তরে যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে। আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত। যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে আমার শরীরে— যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে তুমি আছো জেগে— যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে আছো; জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়। হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়; কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত— তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার। যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি; তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু— বাহিরের আকাশের শীতেনক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝ’রে— ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে। জানোনাকো তুমি তার স্বাদ— তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ, জীবন অগাধ।হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার। তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে। আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে; আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে। নির্জন স্বাক্ষর তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে- আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে! যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে, পথের পাতার মতন তুমিও তখন আমার বুকের প’রে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার! তোমার এ জীবনের ধার ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে! আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর ‘পরে আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!রয়েছি সবুজ মাঠে-ঘাসে- আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে। জীবনের রঙ তবু ফলানো কি হয় এই সব ছুঁয়ে ছেনে!- সে এক বিস্ময় পৃথিবীতে নাই তাহা- আকাশেও নাই তার স্থল চেনে নাই তারে অই সমুদ্রের জল! রাতে রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে কোনো এক মানুষের তরে যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহবরে! নক্ষত্রের চেয়ে আরো এক নিঃশব্দ আসনে কোনো এক মানুষের তরে কোনো এক মানুষের মনে!একবার কথা কয়ে দেশ আর দিকের দেবতা বোবা হয়ে পড়ে থাকে -ভুলে যায় কথা যে আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্বলে নিভে যায়-ডুবে যায়- তারা যায় স্খলে! নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে,চলে আসে নতুন সময়- পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়, নতুনেরা আসিতেছে বলে১ আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে কোন এক মানুষীর তরে যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে!আমি সেই পুরোহিত-সেই পুরোহিত যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে- আমার শরীরে- যেই তারা জেগে আছে,তার দিকে ফিরে তুমি আছ জেগে- যে আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে আছ- জানিয়াছ তুমি এক নিশ্চয়তা-হয়েছ নিশ্চয়। হয়ে যায় আকাশের তলে কত আলো-আগুনের ক্ষয়; কতবার বর্তমান হয়ে গেছে ব্যাথিত অতীত- তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত যে নক্ষত্র ঝরে যায় তার! যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ- তবুও মৃত্যুর ব্যাথা দিতে পার তুমি; তোমার আকাশ তুমি উষ্ণ হয়ে আছ, তবু- বাহিরের আকাশের শীতে নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝ’রে- ক্লান্ত হয়ে- শিশিরের মতো শব্দ করে জানো নাকো তুমি তার স্বাদ, তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ, জীবন অগাধ!হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন, পথের পাতার মতন তুমিও তখন আমার বুকের প’রে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার! তোমার আকাশ- আলো -জীবনের ধার ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে! আমি চলে যাব, তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর ‘পরে আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে! নির্দেশ জীর্ণ শীর্ণ মাকু নিয়ে এখন বাতাসে তামাসা চালাতে আছে পুনরায় সময় একাকী। তবুও সে ভোরবেলা হরিয়াল পাখি ধূসর চিতল মাছে- নির্ঝরের ফাঁসে খেলা ক'রে কাকে দিয়েছিল তবে ফাঁকি? বসন্তবউরী দুটো এই ব'লে হা-হা ক'রে হাসে।সেই হাসি জ্ব'লে ওঠে নির্ঝরের পরে; গড়ায়ে গড়ায়ে গোল নুড়ি উজ্জ্বল মাছের সাথে ভোরের নির্ঝরে সময়ের মাকুটাকে করে দিল উড়্‌খুড়্‌ খুড়ি। বিরক্ত সময় তাই খুঁজে নিতে গেল কোন বিষয়ান্তরে নিজের নিয়মাধীন হৃদয়ের জুড়ি।আলো যদি নিভে যায় সময়ের ফুঁয়ে তা'হ্লে কাহার ক্ষতি- তাহলে কাহার ক্ষতি হবে। এই কথা ভেবে যায় কালো পাথরের পরে নুয়ে মৈত্রেয়ী- নাগার্জুন- কৌটিল্য নীরবে। তিন হয়, চার হয়, পাঁচ হয় তবুও তো দুয়ে আর দুয়ে। হেঁয়ালী ও নিরসন নির্ঝরের নিক্কণের মত বেঁচে রবে। নীলিমা রৌদ্র ঝিল্‌মিল, উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে! -উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী, উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি, আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা, মরীচিকা-ঢাকা! অগণন যাত্রিকের প্রাণ খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান; চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল- হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী। জনতার কোলাহলে একা ব'সে ভাবি কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী! স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা! চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা! বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত, ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ, লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে, -শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে; ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক, তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক! পঁচিশ বছর পরে (মাঠের গল্প) শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে বলিলাম: ‘একদিন এমন সময় আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!– পঁচিশ বছর পরে!’ এই বলে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে; তারপর কতবার চাঁদ আর তারা, মাঠে মাঠে মরে গেল, ইদুর — পেচাঁরা জোছনায় ধানক্ষেতে খুঁজে এল-গেল। –চোখ বুজে কতবার ডানে আর বায়ে পড়িল ঘুমায়ে কত-কেউ! — রহিলাম জেগে আমি একা — নক্ষত্র যে বেগে ছুটিছে আকাশে তার চেয়ে আগে চলে আসে যদিও সময়– পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!–তারপর — একদিন আবার হলদে তৃণ ভরে আছে মাঠে- – পাতায় শুকনো ডাঁটে ভাসিছে কুয়াশা দিকে দিকে, চুড়ায়ের ভাঙা বাসা শিশিরে গিয়েছে ভিজে — পথের উপর পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়! শসাফুল — দু-একটা নষ্ট শাদা শসা মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা লতায় — পাতায়; ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়; দেখা যায় কয়েকটা তারা হিম আকাশের গায় — ইদুর পেঁচারা ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে, পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে! পটভূমি আকাশ ভ'রে যেন নিখিল বৃক্ষ ছেয়ে তারা জেগে আছে কূলের থেকে কূলে; মানব্জাতির দু-মুহূর্তের সময়-পরিসর অধীর অবুঝ শিশুর শব্দ তুলে চেয়ে দেখে পারাপারের ব্যাপ্ত নক্ষত্রেরা আগুন নিয়ে বিষম, তবু অক্ষত স্থির জীবনে আলোকিত। ওদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন হ'য়ে তবু মানুষ যেদিন প্রথম এই পৃথিবী পেয়েছিল সেই সকালের সাগর সূর্য অনমনীয়তা আমাদের আজ এনেছে যেই বিষম ইতিহাসে- যেখানে গ্লানি হিংসা উত্তরাধিকারের ব্যথা মানুষ ও তার পটভূমির হিসেবে গরমিল রয়েছে ব'লে কখনো পরিবর্তনীয় নয়? মানুষ তবু সময় চায় সিদ্ধকাম হ'তেঃ অনেক দীর্ঘ অসময়- অনেক দুঃসময়। চারিদিকে সৈন্য বণিক কর্মী সুধী নটীর মিছিল ঘোরে মুখ ফেরাবার আগে- তাদের সবের সহগামীর মতো ইতিহাসের প্রথম উৎস থেকে দেখেছি মানুষ কেবলি ব্যাহত হয়েও তবু ভবিষ্যতের চক্রবালের দিকে কোথাও সত্য আছে ভেবে চলেছে আপ্রাণঃ পটভূমির থেকে নদীর রক্ত মুছে মুছে বিলীন হয় যেমন সেসব পটভূমির স্থান। পটভূমি বিসার কবের সে বেবিলন থেকে আজ শতান্দীর পরমায়ু শেষ কি এক নিমেষ শুধু মানুষের অন্তহীন সহিষ্ণুতায়?- নক্ষত্রের এক রাত্রি- একটি ধানের গুচ্ছ- এক বেলা সূর্যের মত? কেবলি মুষলপর্ব শেষ ক'রে নব শান্তিবাচনের পথে মানবের অভিজ্ঞতা বেড়ে মানুষেরি দোষে হতাহতকলঙ্কিনী সংখ্যা গড়ে। অতীতের স্মরণীয় ইতিহাস থেকে যা কিছু জানার আছে না জানার আছে যতো শ্লোক সবাইকে দেখতে গিয়ে বার বার অন্ধকার বেশি ক'রে দেখে। তবু এই স্বভাবের প্রতিশোধে আগামীর সমাজ অশোক হয়তো বা হতে পারে। হে তুমি গভীর ইতিহাস, আমরা মধ্যম পথে; তোমাকে সফল ক'রে দিতে ব্যক্তি বিসর্জন দিয়ে মানবের প্রাণনের সাগরে চলেছি;- মহানির্বাণের দিকে কিশাগোতমীর অজানিতে আমরা চলেছি নাকি? তা' নয়তো। আজকের চেয়ে বেশি ভালো প্রাণসূর্য উদয় হয়েছে কবে? এ রকম অশোক গভীর শিশিরে উজ্জ্বল দেখে ভুল ব'লে প্রকৃতিকে আজো মনে হ'লে মনের বিজ্ঞানে তবে শুভ্র হোক মানবীয় নিখিল ও নীড়। কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী পটভূমির পটভূমির ভিতরে গিয়ে কবে তোমার দেখেছিলাম আমি দশ-পনেরো বছর আগে;—সময় তখন তোমার চুলে কালো মেঘের ভিতর লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালালো তোমার নিশিত নারীমুখের;—জানো তো অন্তর্যামী। তোমার মুখঃ চারিদিকে অন্ধকারে জলের কোলহল, কোথাও কোনো বেলাভূমির নিয়ন্তা নেই,—গভীর বাতাসে তবুও সব রণক্লান্ত অবসন্ন নাবিক ফিরে আসে;তারা যুবা, তারা মৃত; মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল। সময় কোথাও নিবারিত হয় না, তবু, তোমার মুখের পথে আজো তাকে থামিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছ, নারি,- হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম, তারি নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে। চারিদিকে অলীক সাগর—জ্যাসন ওডিসিয়ুস ফিনিশিয় সার্থবাহের অধীর আলো,—ধর্মাশোকের নিজের তো নয়, আপতিতকাল আমরা আজো বহন ক’রে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল মুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎর্সনা…প্রেম নিভিয়ে দিলাম, প্রিয়। পতিতা আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়! সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে – সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়; প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার! সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর, কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের পর! চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস, সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস! ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা, আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা! সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী- মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় – সে যে নারী, সে যে নারী! পথহাঁটা কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে; তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:সারারাত গ্যাস লাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে। কেউ ভুল করে নাকো-ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাঁদ সব চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব; তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভবআর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা? চোখ নিচে নেমে যায়-চূরুট নীরবে জ্বলে-বাতাসে অনেক ধূলো খড়; চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতাউড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর। পরবাসী যাহাদের পায়ে পায়ে চলে চলে জাগিয়াছে আঁকাবাঁকা চেনা পথগুলি দিকে দিকে পড়ে আছে যাহাদের দেহমাটি—করোটির ধূলি, যাহারা ভেনেছে ধান গান গেয়ে—খুঁটেছে পাখির মতো মিঠে খুদকুঁড়া, যাহাদের কামনায় ইশারায় মাটি হল পানপাত্র, শষ্প হল সুরা! ছুঁয়ে ছেনে বারবার এ ভাঁড়ার করে গেছে স্যাঁতসেঁতে ম্লান, আনাচে-কানাচে আজও দুলিতেছে যাহাদের উড়ানি-পিরান, যাদের দেহের ছায়া পাঁচিলের গায় গায় মেখে গেছে মায়া, দেয়ালের শেওলায় নীল হয়ে জেগে আছে যাহাদের কায়া, যারা গেছে বীজ বুনে মাঠে মাঠে,—চষে গেছে মাটি, কেটেছে ফসল, শালি বেঁধে-বেঁধে নেছে আঁটি আঁটি, তুলিয়াছে গোলাবাড়ি—যত তিষি, ধান খড় ভরা, পেঁচা-ইঁদুরের সনে আন্‌মনে জাগিয়াছে যাদের প্রহরা, পনির ননীর গন্ধে ভরিয়াছে যাহাদের তুষ্ট গৃহস্থালি, ধুনুচিতে ধূপ ঢেলে—উঠানে প্ৰদীপ জ্বালি জ্বালি চরকায় সুতো কেটে তুলিয়াছে তন্ময় গুঞ্জন, কহিয়াছে আধো আধো কত কথা—নিভায়েছে–জুলায়েছে আলো, দেয়ালে তাদের ছায়া জাগিয়াছে এলোমেলো—কালো— না জানি কোথায় তারা, কত দূরে—জানি না তো কিছু! রাতভোর ঘোর ঘোর চোখ মোর, ঘাড়খানা নিচু তাদের সন্ধানে যেন–যাহাদের রেণুঝরা হিম মরা প্রজাপতি ডানা দিকে দিকে পড়ে আছে—মনে হয়। কত চেনা–কত তারা জানা! তাহাদেরই পরীপাখা ওড়ে যেন পাউষের নদীটির বুকে! শিশিরনিবিড় মাঠ-পাথরের মুখে তারা যেন কথা কয়!—শাঁইঝাড়ে—শালুকের দলে জোনাকির পাখনার তলে যেন তাঁহাদের দীপ আজও জ্বলে! সঙ্গোপনে বনে বনে ফেরে তারা—জ্যোৎস্নারাতে পিয়ালের মৌ আজও তারা পান করে, আজও তারা গান করে—বাসরের বর আর বউ! শিশিরের জলে জলে স্নান করে–ভিজে ভিজে বালুচর দিয়া বুনো হাঁস-হাঁসীদের সনে ফেরে পরবাসী প্রিয় আর প্রিয়া! কোরা-ডাহুকের বুকে কান পেতে শুনে যায় গান— তাদের আঙুল ছুঁয়ে চুলবুল করে ওঠে হেমন্তের মাঠভরা ধান! তাদের দেখেছি আমি গেঁয়ো পথে–দেখেছে রে ধাঙড়ের বধূ, মৌচুষ্‌কির সনে তারা বনে লুটে খায় কমলার মধু! নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর! নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর! বেদের মতন তারা আসে যায়–অবেলায় ভেঙে ফেলে ভিড়! তাদের দেখেছি আমি শাদা ভোরে—ঘুঘু ডাকা উদাস দুপুরে! —সাঁঝের নদীর বাটে—ভাঙা হাট–ভিজা মোঠ জুড়ে; পাড়াগাঁর পথে পথে নিঝ্‌ঝুম চাঁদিনীর রাতে ফিরেছে রে, ভিড়েছে রে কত বার তারা মোর সাথে! পরস্পর মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার, কহিলাম, শোনো তবে — শুনিতে লাগিল সবে, শুনিল কুমার; কহিলাম, দেখেছি সে চোখ বুজে আছে, ঘুমানো সে এক মেয়ে — নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে: সেইখানে আর নাই কেহ — এক ঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ পড়ে আছে — পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুঁজে খুঁজে তারপর — তারে আমি দেখেছি গো — সেও চোখ বুজে পড়ে ছিল — মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি! আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু — পায়ে, পাথরের মতো শাদা গায়ে এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় — কিংবা ছিল — আমার জন্য তা নয়! আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে, পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে; তবুও, হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার! ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার। তারপর, কহিল কুমার, আমিও দেখেছি তারে — বসন্তসেনার মতো সেইজন নয়, কিংবা হবে তাই — ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে — (পদ্ম — ভাগীরথী — মেঘনা — কোন্‌ নদী যে সে – সে সব জানি কি আমি! — হয়তো বা তোমাদের দেশ সেই নদী আজ আর নাই, আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!) সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায় পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায় কান দিয়ে তার শব্দ শুনে, দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে। দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়, আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় — বসন্তের দেশে জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে! জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে নদীর কিনারে! হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্‌ধবে স্তন রেখেছে সে ঢেকে! বাকিটুকু — থাক্‌ — আহা, একজনে দেখে শুধু — দেখে না অনেকে এই ছবি! দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! — আজও তবু খুঁজি কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি! কুমারের শেষ হলে পরে — আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন, কহিল সে উত্তর — সাগরে আর নাই কেউ! — জোছনা আর সাগরের ঢেউ উচুনিচু পাথরের পরে হাতে হাত ধরে সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন! ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা আর তারা ঢেউয়ের মতন জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে! ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে। সেই জলমেয়েদের স্তন ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন! তাহাদের মুখ চোখ ভিজে, ফেনার শেমিজে তাহাদের শরীর পিছল! কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল চাঁদের বুকের থেকে ঝরে উত্তর সাগরে! পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে — কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে! রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্‌মিক্‌ করে উত্তর সাগরে বরফের কুঁচির মতন সেই জলমেয়েদের স্তন মুখ বুক ভিজে ফেনার শেমিজে শরীর পিছল! কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল চাদের বুকের থেকে ঝরে উত্তর সাগরে! উত্তর সাগরে!সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে কল্পনার গল্প সব বলে; তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন আবার তো এসে যাবে; এক কবি — তন্ময়, শৌখিন, আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে! আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে হীরের ছুরির মতো গায়ে আরো ধার লবে সে শানায়ে! সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ — মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ এমনি পড়িয়া রবে পাল্‌ঙ্েকর পর — ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর। চার পাশে তার রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড় গড়েছে পাহাড়! এ রূপকার এই রূপসীর ছবি তুমি দেখিবে এসে, তুমিও দেখিবে এসে কবি! পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত — শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত! হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা ছিল কই! — তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা তোমার রক্তের তাপ পেয়ে? — আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে! কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা — তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা! হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা; কিন্তু, শোনো — স্বপ্ন নয় — আমাদেরই দেশে কবে, আহা! — যেখানে মায়াবী নাই — জাদু নাই কোনো — এ দেশের — গাল নয়, গল্প নয়, দু — একটা শাদা কথা শোনো! সেও এক রোদে লাল দিন, রোদে লাল — সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন একদিন, সেই একদিন! ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে, ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে! মায়াবীর ঘরে ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে এ ঘুমোনো মেয়ে পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন; রূপ ঝরে যায় — তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন — যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়, যারা ভয় পায় আয়নায় তার ছবি দেখে! — শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে, দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে! — দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ, চোখে ঠোঁটে অসুবিধা — ভিতরে অসুখ! কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে! — এ ঘুমোনো মেয়ে পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!.. সবাই উঠিল বলে — ঠিক — ঠিক — ঠিক! আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক, আমায় বলেছে সে কী শোনো — আর একজন এই — পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও; বলেছে সে, কাল সাঁঝরাতে আবার তোমার সাথে দেখা হবে? — আসিবে তো? — তুমি আসিবে তো! দেখা যদি পেত! নিকটে বসায়ে কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে — কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে ফিক্‌ করে হেসে! তবু আরো কথা বলিতে আসিতে — তবু, সব প্রগল্‌ভতা থেকে যেত! খোঁপা বেঁধে, ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে — সরে যেত, দেয়ালের গায়ে রহিত দাঁড়ায়ে! রাত ঢের — বাড়িবে আরো কি এই রাত! — বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি হয় নাই দেখা আমাদের দুজনার! দুইজন, একা! — বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে! কেন বা এমন করে বলে, কাল সাঁঝরাতে আমার তোমার সাথে দেখা হবে? — আসিবে তো? তুমি আসিবে তো! — আমি না কাঁদিতে কাঁদে.. দেখা যদি পেত!.. দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি? — বলিল সে তোমার বকুল, মনে আছে? — এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’, — ভালোবাসো?’ — হাসি পেল — হাসি! ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’ আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে চলে এল কাছে — জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে — আজও এত চুল! চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল একবার চুপে তুলে ধরি; চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি! থুত্‌নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি — সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি! পরিচায়ক মাঝে-মাঝে মনে হয় এ-জীবন হংসীর মতন- হয়তো-বা কোনো-এক কৃপণের ঘরে; প্রভাতে সোনার ডিম রেখে যায় খড়ের ভিতরে; পরিচিত বিস্ময়ের অনুভবে ক্রমে-ক্রমে দৃঢ় হয় গৃহস্থের মন। তাই সে হংসীরে আর চায় নাকো দুপুরে নদীর ঢালু জ’লে নিজেকে বিম্বিত ক’রে;- ক্রমে দূরে-দূরে হয়তো-বা মিশে যাবে অশিষ্ট মুকুরেঃ ছবির বইয়ের দেশে চিরকাল- ক্রুর মায়াবীর জাদুবলে। তবুও হংসীই আভা;- হয়তো-বা পতঞ্জলি জানে। সোনায়-নিটোল-করা ডিম তার বিমর্ষ প্রসব। দুপুরে সূর্যের পানে বজ্রের মতন কলরব কন্ঠে তুলে ভেসে যায় অমেয় জলের অভিযানে। কেয়াফুলস্নিগ্ধ হাওয়া স্থির তুলা দণ্ড প্রদক্ষিণ ক’রে যায়;- লোকসমাগমহীন, হিম কান্তারের পার ক’রে নাকো ভীতি আর মরণের অর্থ প্রত্যাহারঃ তবুও হংসীর পাখা তুষারের কোলাহলে আঁধারে উড্ডীন। তবুও হংসীর প্রিয় আলোকসামান্য সুর, শূন্যতার থেকে আমি ফেঁশে এইখানে প্রান্তরের অন্ধকারে দাঁড়ায়েছি এসে; মধ্য নিশীথের এই আসন্ন তারকাদের সঙ্গ ভালোবেসে। মরঁখুটে ঘোড়া ওই ঘাস খায়,– ঘাড়ে তার ঘায়ের উপরে বিনবিনে ডাঁশগুলো শিশিরের মতো শব্দ করে। এই স্থান, হ্রদ আর, বরফের মতো শাদা ঘোড়াদের তরে ছিলো তবু একদিন? র’বে তবু একদিন? হে কালপুরুষ,                                                 ধ্রুব, স্বাতী, শতভিষা, উচ্ছৃঙ্খল প্রবাহের মতো যারা তাহাদের দিশা স্থির করে কর্ণধার?- ভূতকে নিরস্ত করে প্রশান্ত সরিষা। ভূপৃষ্ঠের অই দিকে- জানি আমি- আমার নতুন ব্যাবিলন উঠেছে অনেক দূর;- শোনা যায় কর্নিশে সিঙ্ঘের গর্জন। হয়তো-বা ধূলোসাৎ হ’ইয়ে গেছে এত রাতে ময়ূরবাহন। এই দিকে বিকলাঙ্গ নদীটির থেকে পাঁচ-সাত ধনু দূরে মানুষ এখনও নীল , আদিম সাপুড়েঃ রক্ত আর মৃত্যু ছাড়া কিছু পার নাকো তারা খনিজ, অমূল্য মাটি খুঁড়ে। এই সব শেষ হ’ইয়ে যাবে তবু একদিন;- হয়তো-বা ক্রান্ত ইতিহাস শানিত সাপের মতো অন্ধকারে নিজেকে করেছে প্রায় গ্রাস। ক্রমে এক নিস্তব্ধতাঃ নীলাভ ঘাসের ফুলে সৃষ্টির বিন্যাস আমাদের হৃদয়কে ক্রমেই নীরব হ’তে বলে। যে-টেবিল শেষ্রাতে দোভাষীর- মাঝ্রাতে রাষ্ট্রভাষাভাষীর দখলে সেই সব বহু ভাষা শিখে তবু তারকার সন্তপ্ত অনলে হাতের আয়ুর রেখা আমাদের জ্বলে আজো ভৌতিক মুখের মতন; মাথার সকল চুল হ’য়ে যায় ধূসর- ধূসরতম শণ; লোষ্ট্র, আমি, জীব আর নক্ষত্র অনাদি বিবর্ণ বিবরণ বিদূষ্ক বামনের মতো হেসে একবার চায় শুধু হৃদয় জুড়াতে। ফুরফুরে আগুনের থান তবু কাঁচিছাঁটা জামার মতন মুক্ত হাতে তাহার নগ্নতা ঘিরে জ্ব’লে যায়- সে কোথাও পারে না দাঁড়াতে। নীলিমাকে যতদূর শান্ত নির্মল মনে হয় হয়তো-বা সে-রকম নেই তার মহানুভবতা। মানুষ বিশেষ-কিছু চায় এই পৃথিবীতে এসে অতীব গরিমাভরে ব’লে যায় কথা; যেন কোমো ইন্দ্রধনু পেয়ে গেলে খুশি হ’তো মন। পৃথিবীর ছোট-বড়ো দিনের ভিতর দিয়ে অবিরাম চ’লে অনেক মুহূর্ত আমি এ-রকম মনোভাব করেছি পোষণ। দেখেছি সে-সব দিনে নরকের আগুনের মতো অহরহ রক্তপাত; সে-আগুন নিভে গেলে সে-রকম মহৎ আঁধার, সে-আঁধারে দুহিতারা গেয়ে যায় নীলিমার গান; উঠে আসে প্রভাতের গোধূলির রক্তচ্ছটা-রঞ্জিত ভাঁড়। সে-আলোকে অরণ্যের সিংহকে ফিকে মরুভূমি মনে হয়; মধ্য সমুদ্রের রোল-মনে হয়—দয়াপরবশ; এরাও মহৎ- তবু মানুষের মহাপ্রতিভার মতো নয়। আজ এই শতাব্দীর পুনরায় সেই সব ভাস্বর আগুন কাজ ক’রে যায় যদি মানুষ ও মনীষী ও বৈহাসিক নিয়ে- সময়ের ইশারায় অগণন ছায়া-সৈনিকেরা আগুনের দেয়ালকে প্রতিষ্ঠিত করে যদি উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে, দেওয়ালের ’পরে যদি বানর, শেয়াল, শনি, শকুনের ছায়ার জীবন জীবঙ্কে টিটকারি দিয়ে যায় আগুনের রঙ আরো বিভাসিত হ’লে- গর্ভাঙ্কে ও অঙ্কে কান কেটে-কেটে নাটকের হয় তবু শ্রুতিবিশোধন।কাব্যগ্রন্থ - মহাপৃথিবী পলাতকা পাড়ার মাঝারে সব চেয়ে সেই কুদুঁলি মেয়েটি কই! কতদিন পরে পল্লীর পথে ফিরিয়া এসেছি ফের সারাদিনমান মুখখানি জুড়ে ফুটিত যাহার খই কই কই বালা আজিকে তোমার পাই না কেন গো টের!তোমার নখের আঁচড় আজিও লুকায়ে যায় নি বুকে, কাঁকন-কাঁদানো কণ্ঠ তোমার আজিও বাজিছে কানে! যেই গান তুমি শিখায়ে দিছিলে মনের সারিকা শুকে তাহারই ললিত লহরী আজিও বহিয়া যেতেছে প্রাণে!কই বালা কই!-প্রণাম দিলে না!- মাথায় নিলে না ধূলি -বহুদিন পরে এসেছি আবার বনতুলসীর দেশে! কুটিরের পথে ফুটিয়া রয়েছে রাঙ্গা রাঙ্গা জবাগুলি- উজান নদীতে কোথায় আমার জবাটি গিয়েছে ভেসে! পাখি ঘুমায়ে রয়েছ তুমি ক্লান্ত হ'য়ে, তাই আজ এই জ্যোৎস্নায় কাহারে জানাই আমার এ-বিস্ময়- বিস্ময়ের ঠাঁই, নক্ষত্রের থেকে এলো;- তুমি জেগে নাই,আমার বুকের 'পরে এই এক পাখি; পাখি? না ফড়িং কীট? পাখি না জোনাকি? বাদামি সোনালী নীল রোম তার রোমে-রোমে রেখেছে সে ঢাকি, এমন শীতের রাতে এসেছে একাকীনিস্তব্ধ ঘাসের থেকে কোন্‌ ধানের ছড়ার থেকে কোথায় কখন, রেশমের ডিম থেকে এই শিহরণ! পেয়েছে সে এই শিহরণ!জ্যোৎস্নায়- শীতে কাহারে সে চাহিয়াছে? কতোদূরে চেয়েছে উড়িতে? মাঠের নির্জন খড় তারে ব্যথা দিতে এসেছিলো? কোথায় বেদনা নাই এই পৃথিবীতে।না- না- তার মুখে স্বপ্ন সাহসের ভর ব্যথা সে তো জানে নাই- বিচিত্র এ-জীবনের 'পর করেছে নির্ভর; রোম- ঠোঁট- পালকের এই মুগ্ধ আড়ম্বর।জ্যোৎস্নায়- শীতে আমার কঠিন হাতে তবু তারে হলো যে আসিতে, যেই মৃত্যু দিকে-দিকে অবিরল- তোমারে তা দিতে কেন দ্বিধা? অদৃশ্য কঠিন হাতে আমিও বসেছি পাখি, আমারেও মুষড়ে ফেলিতে দ্বিধা কেহ করিবে না; জানি আমি, ভুল ক'রে দেবে নাকো ছেড়েঃ তবু আহা, তারের শিশিরে ভেজা এ রঙিন তূলোর বলেরে কোমল আঙুল দিয়ে দেখি আমি চুপে নেড়ে-চেড়ে, সোনালি উজ্জ্বল চোখে কোন্‌ এক ভয় যেন ঘেরেতবু তার; এই পাখি- এতটুকু- তবু সব শিখেছে সে- এ এক বিস্ময় সৃষ্টির কীটেরও বুকে এই ব্যথা ভয়; আশা নয়- সাধ নয়- প্রেম স্বপ্ন নয় চারিদিকে বিচ্ছেদের ঘ্রাণ লেগে রয়পৃথিবীতে; এই ক্লেশ ইহাদেরো বুকের ভিতর; ইহাদেরো; অজস্র গভীর রঙ পালকের 'পর তবে কেন? কেন এ সোনালি চোখ খুঁজেছিলো জ্যোৎস্নার সাগর? আবার খুঁজিতে গেল কেন দূর সৃষ্টি চরাচর। পাখিরা ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে — বসন্তের রাতে বিছানায় শুয়ে আছি; — এখন সে কত রাত!অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে? তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে।শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে, চোখ আর চায় না ঘুমাতে; জানালার থেকে অই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে, সাগরের জলের বাতাসে আমার হৃদয় সুস্থ হয়; সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে — সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়? সাগরের অই পারে — আরো দূর পারে কোনো এক মেরুর পাহাড়ে এই সব পাখি ছিল; ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে দলে দলে সমুদ্রের পর নেমেছিল তারা তারপর — মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে!বাদামি — সোনালি — শাদা — ফুটফুটে ডানার ভিতরে রবারের বলের মতন ছোট বুকে তাদের জীবন ছিল — যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ লক্ষ মাইল ধরে সমুদ্রের মুখে তেমন অতল সত্য হয়ে!কোথাও জীবন আছে — জীবনের স্বাদ রহিয়াছে, কোথাও নদীর জল রয়ে গেছে — সাগরের তিতা ফেনা নয়, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় এই জানিয়াছে — কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে তারা আসিয়াছে।তারপর চলে যায় কোন্‌ এক ক্ষেতে তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে যেতে সে কি কথা কয়? তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময়! অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ মাটির ঘ্রাণ, ভালোবাসা আর ভালোবাসা সন্তান, আর সেই নীড়, এই স্বাদ — গভীর — গভীর।আজ এই বসন্তের রাতে ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে; অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর। পাড়াগাঁর দু পহর ভালোবাসি পাড়াগাঁর দু’পহর ভালোবাসি — রৌদ্র যেন গন্ধ লেগে আছে স্বপনের; — কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো — কেবল প্রান্তর জানে তাহা, আর ওই প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে যেন এ-জনমে নয় — যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে এ — হৃদয় — স্বপ্নে যে বেদনা আছে : শুষ্ক পাতা — শালিখের স্বর, ভাঙা মঠ — নক্‌শাপেড়ে শাড়িখানা মেযেটির রৌদ্রের ভিতর হলুদ পাতার মতো স’রে যায়, জলসিড়িটির পাশে ঘাসে শাখাগুলো নুয়ে আছে বহু দিন ছন্দহীন বুনো চালতার: জলে তার মুখখানা দেখা যায় — ডিঙিও ভাসিছে কার জলে, মালিক কোথাও নাই, কোনোদিন এই দিকে আসিবেনা আর, ঝাঁঝরা ফোঁপরা, আহা ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে; পাড়াগাঁর দু — পহর ভালোবাসি — রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার গন্ধ লেগে আছে, আহা, কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে। পিপাসার গান কোনো এক অন্ধকারে আমি যখন যাইব চলে — আরবার আসিব কি নামি অনেক পিপাসা লয়ে এ মাটির তীরে তোমাদের ভিড়ে! কে আমারে ব্যথা দেছে — কে বা ভালোবাসে — সব ভুলে, শুধু মোর দেহের তালাসে শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে এ মাটির পরে আসিব কি নেমে! পথে পথে — থেমে — থেমে — থেমে খুঁজিব কি তারে — এখানের আলোয় আঁধারে যেইজন বেঁধেছিল বাসা! মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা আর যেই ব্যথা ছিল — যেই ঠোট চুল যেই চোখ, যেই হাত, আর যে আঙুল রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা যেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা পেয়েছিল — আর তার ধানী সুরা করেছিল পান, একদিন শুনেছে যে জল আর ফসলের গান, দেখেছে যে ঐ নীল আকাশের ছবি মানুষ — নারীর মুখ — পুরুষ — স্ত্রীর দেহ সবই যার হাত ছুয়ে আজও উষ্ণ হয়ে আছে — ফিরিয়া আসিবে সে কি তাহাদের কাছে! প্রণয়ীর মতো ভালোবেসে খুঁজিবে কি এসে একখানা দেহ শুধু! হারায়ে গিয়েছে কবে কঙ্কালে কাঁকরে এ মাটির পরে!অন্ধাকারে সাগরের জল ছেনেছে আমার দেহ, হয়েছে শীতল চোখ — ঠোট — নাসিকা আঙুল তাহার ছোয়াচে; ভিজে গেছে চুল শাদা শাদা ফেনাফুলে; কত বার দূর উপকূলে তারাভরা আকাশের তলে বালকের মতো এক — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া জেনেছি দেহের স্বাদ — গেছে বুক — মুখ পরশিয়া রাঙা রোদ — নারীর মতন এ দেহ পেয়েছে যেন তাহার চুম্বন ফসলের ক্ষেতে! প্রথম প্রণয়ী সে যে, কার্তিকের ভোরবেলা দূরে যেতে যেতে থেমে গেছে সে আমার তরে! চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে যেন তার চুমো খেয়ে! এ দেহ — অলস মেয়ে পুরুষের সোহাগে অবশ! চুমে লয় রৌদ্রের রস হেমন্ত বৈকালে উড়ো পাখাপাখালির পালে উঠানের; পেতে থাকে কান — শোনো ঝরা শিশিরের গান অঘ্রানের মাঝরাতে; হিম হাওয়া যেন শাদা কঙ্কালের হাতে এ দেহেরে এসে ধরে — ব্যথা দেয়! নারীর অধরে — চুলে — চোখে — জুঁয়ের নিশ্বাসে ঝুমকো লতার মতো তার দেহ — ফাঁসে ভরা ফসলের মতো পড়ে ছিঁড়ে এই দেহ — ব্যথা পায় ফিরে!…. তবু এই শস্যক্ষেতে পিপাসার ভাষা ফুরাবে না কে বা সেই চাষা — কাস্তে হাতে — কঠিন, কামুক — আমাদের সবটুকু ব্যথাভরা সুখ উচ্ছেদ করিবে এসে একা! কে বা সেই! জানি না তো হয় নাই দেখা আজও তার সনে; আজ শুধু দেহ — আর দেহের পীড়নে সাধ মোর চোখে ঠোঁটে চুলে শুধু পীড়া, শুধু পীড়া! — মুকুলে মুকুলে শুধু কীট, আঘাত, দংশন — চায় আজ মন!নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে পথ ভুলে বারবার পৃথিবীর ক্ষেতে জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল! অন্ধকারে শিশিরের জল কানে কানে গাহিয়াছে গান — ঢালিয়াছে শীতল অঘ্রাণ; মোর দেহ ছেনে গেছে অলস — আঢুল কুমারী আঙুল কুয়াশার; ঘ্রাণ আর পরশের সাধ জাগায়েছে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ ঢালিয়াছে আলো — প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো চুম্বনের মতো! রেখে গেছে ক্ষত সব্‌জির সবুজ রুধিরে! শস্যের মতো মোর এ শরীর ছিঁড়ে বারবার হয়েছে আহত আগুনের মতো দুপুরের রাঙা রোদ! আমি তবু ব্যথা দেই — ব্যথা পাই ফিরে! — তবু চাই সবুজ শরীরে এ ব্যথার সুখ! লাল আলো — রৌদ্রের চুমুক, অন্ধকার — কুয়াশার ছুরি মোরে যেন কেটে লয়, যেন গুড়ি গুড়ি ধুলো মোরে ধীরে লয় শুষে! মাঠে মাঠে — আড়ষ্ট পউষে ফসলের গন্ধ বুকে করে বারবার পড়ি যেন ঝ’রে!আবার পাব আমি ফিরে এই দেহ! –এ মাটির নিঃসাড় শিশিরে রক্তের তাপ ঢেলে আমি আসিব কি নামি! হেমন্তের রৌদ্রের মতন ফসলের স্তন আঙুলে নিঙাড়ি এক ক্ষেত ছাড়ি অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে এ সবুজ দেশে আর এক বার! শুনিব কি গান ঢেউদের! –জলের আঘ্রাণ লব বুকে তুলে আমি পথ ভুলে আসিব কি এ পথে আবার! ধুলো — বিছানার কীটদের মতো হব কি আহত ঘাসের আঘাতে! বেদনার সাথে সুখ পাব! লতার মতন মোর চুল, আমার আঙুল পাপড়ির মতো — হবে কি বিক্ষত তোমার আঙুলে — চুলে! লাগিবে কি ফুলে ফুলের আঘাত আরবার আমার এ পিপাসার ধার তোমাদের জাগাবে পিপাসা! ক্ষুধিতের ভাষা বুকে করে করে ফলিব কি! — পড়িব কি ঝরে পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে আর একবার আমি — নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে। পিরামিড বেলা বয়ে যায় গোধূলির মেঘ-সীমানায় ধূম্র মৌন সাঁঝে নিত্য নব দিবসের মৃতু্যঘন্টা বাজে! শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে! পান্থ ম্লান চিতার কবলে একে একে ডুবে যায় দেশ, জাতি,--সংসার, সমাজ, কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন চকিতে মিলায়ে গেছে-পাও নাই টের! কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের দেউটি নিভায়ে গেছে,---চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া, চলে গেছে প্রিয়তম,---চলে গেছে প্রিয়া! যুগান্ত্মের মণিময় গেহবাস ছাড়ি চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী, কবে কোন্ বেলাশেষে হায় দূর অস্ত্মশেখরের গায়! তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া; সাঁজের নীহারনীল সমুদ্য মথিয়া মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী! তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ-সন্ধানী অশ্রু-ছলছল চোখে,---পাণ|ডুর বদনে! ---কুষ্ঞ যবনিকা করেব ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে জানো নাই তুমি! জানে না তো মিশরেরর মূক মরুভূমি তাদের সন্ধান! হে নির্বাক পিরামিড,---অতীতের স্ত্মব্ধ প্রেত-প্রাণ অবিচল স্মৃতির মন্দির! আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির! নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে! জ্বলিয়া যেতেছে নত্যি নিশি-অবসানে নূতন ভাস্কার! বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর নিবেদিন অরুণের সনে কোন্ আশা-দূরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে! --পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দুদণ্ডের রুধির-ফোয়ারা কি এক প্রগল্ভ উষ্ঞ উল্লাসের সাড়া! থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন! শতাব্দীর বিরহীর মন নিটল নিথর সন্ত্মরি ফিরিয়া মনে গগনের রক্ত-পীত সাগরের পরে! বালুকার স্ফীত পারাবারে লোল মৃগতৃষ্ঞিকার দ্বারে মিশরের অপহৃত অন্ত্মরের লাগি মৌন ভিক্ষা মাগি!--- --খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার! মুখরিত প্রাণের সঞ্চার ধ্বনিত হইবে করেব কলহীন নীলার বেলায়!--- --বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে পিরামিড হায়! -- কত আগন্তুক-কাল,---অতিথি--সভ্যতা তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্বৃত অন্ত্মরের কথা! তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল! --তুমি রহ নিরুত্তর,---নির্বেদী,---নিশ্চল! মৌন, অন্যমনা! ---প্রিয়ার বক্ষের পরের বসি একা নীরবে করিছ তুমি শবের সাধনা হে প্রেমিক---স্বতন্হত্র স্বরাট! ---কবে সুপ্ত উত্‌সবের স্ত্মব্ধ ভাঙা হাট উঠিবে জাগিয়া! সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ-কৃষ্ঞ, পাণ|ডু, চূর্ণ, ব্যথিত কপোলে! মিশর-অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে! বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই! ---ওলটিপালটি যুগ-যুগন্ত্মের শ্মশানের ছাই জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি,--,প্রেমের প্রহরা! ---মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা-ঝরা হেমন্ত্মের বিদায়-কুহেলি, অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান দুদিনের তরে শুধু,---নবোত্‌ফুল্লা মাধবীর গান মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে নিমেষে চকিতে! ---অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে!    (ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থ) পৃথিবী আজ প্রকৃতি থেকে ফসল নীলকন্ঠ এলো; সময়পাপচক্র থেকে বাহির হলো ব্যথিত নিঃসহায়। সবের পথে শতাব্দীর এই রাত্রি ব্যাপকতা প্রশান্তি নয়- ক্রমেই বেশি স্পষ্টতা জাগায়।সময় এখন চারদিকেতে ঘনান্ধকার দেখে বলছে: নগর নরক ব্যধি সন্ধি ফলাফল জীবনের এই ত্যক্ত সন্ততিদের প্রলাপ আলাপে পরিণত হ'লো কি প্রায়? -নক্ষত্র নির্মল?হয়তো হলো:- অন্তত আজ রাত্রি একা অল্প সময়ের ভিতরে শুভ অনুধ্যায়ী সময়দেীর মতো প্রাণের প্রয়াস দ্যাখাতে গিয়ে চলতে ছেদে ব্যর্থতার হয়নি নিহত?নদী পাখি প্রহরী জ্ঞান-বিজ্ঞানীরা সব প্রেমিক? তবু সারাটা রাত অ্যাম্বুলেন্সের  গাড়ি শব কুড়িয়ে ফিরছে অন্ধকারে, চন্দ্রে সূর্যে রক্ত তরবারী?মানব কেমন স্বভাবত এই কথা কি ঠিক দেশ সময়ের মানুষমনের সহজ প্রকাশে করুণা স্বাভাবিক?আমার চোখে ভেসে ওঠে করুণা এক নারী: হাত দুটো তার ঠান্ডা শাদা-তবুও উষ্ণতা প্রিয়ের মতন, কাম তবু আজ প্রিয়তর নিরিখ পৃথিবীর: স্থুল প্রগলভ বিষয় ব্যবহার ও কথাসবের চেয়ে সুখের বিষয় ভেবে রন্ধ্রে ঋণে উন্মাদনায় পুরুষার্থ লভি; জীবনে আরেক গভীরতরভাবে ঢুকেও তো আজ তা অ-প্রেমই স্বভাব।পিরামিড ও অ্যাটম আগুন অধির প্রাণনার উৎসারিত রাষ্ট্র সমাজ শক্তি রচনায় প্ল্যান কমিশন কনফারেন্সের বৃহৎ প্রাসাদে হঠাৎ মহাসরীসৃপকে দ্যাখা যায়। পৃথিবী ও সময় সময়ের উপকণ্ঠে রাত্রি প্রায় হয়ে এল আজ সূর্যকে পশ্চিমে দেখি সারা শতাব্দীর অক্লান্ত রক্তের বোঝা গুছায়ে একাকী তবুও আশার মত মেঘে মেঘে বলয়িত হয়ে শেষ আলো ঢেলে যায়;- জ্যোতিঃপ্রাণধর্মী সূর্য অই; একদিন অ্যামিবার উৎসরণ এনেছিল; জীবনের ফেনশীর্ষ সিন্ধুর কল্লোল এক দিন মানুষকে পেয়ে;- না-মর্মী মানুষ সেই দিন ভয় পেত, গুহায় লুকাত,- তবু সূর্যকরোজ্জ্বল সোনালী মানবী তাকে 'হাঁ' বলাল;- নীল আকাশ নগরীরেখা দেখা দিল;- শঙ্খ আমলকী সাগর অলিভবন চেনা গেল রোদ্রের ভিতরে; শ্বেতাশ্বতর-প্লেটো-আলোকিত পৃথিবীর রূপ অনাদির দায়ভাগে উৎসারিত রক্তের নদীর শিয়রে আশার মত জেগে উৎসাহিত সূর্যকরে সহসা নতুন হিংসা রক্ত গ্লানিমার কাছে প্রতিহত হয়ে ধীরে ধীরে নিঃশেষে ফুরায়ে গেল তবু।ভাই-বোন-স্মৃতি-শান্তি হননের ঘোরে উদ্বেলিত বহতা নদীর মত আজো এই পৃথিবী চলেছে। তবুও তো সেই উদ্‌ঘাতিনী নদীরমণীর শব্দ কানে নিয়ে,- প্রাণে আকাশে জ্যোতিষ্ক জ্বলে হস্তা অভিজিৎ, অনুরাধা শতভিষা লুব্ধক স্বাতী; পৃথিবীতে- হৃদয়েরো গতিপথে বর্ণালির আভা সম্পূর্ণ দীপ্তির মত আলোকিত- ক্রমে আলোকিত হতে চায়।লণ্ডন রুশিয়া গ্রীস দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা চীন অগণন কন্‌ফারেন্‌সে বিকীর্ণ য়ুরোপা, আমেরিকা,- যেন বীতবর্ষণের কৃষ্ণমেঘ নক্ষত্রের পথে; ক্ষণিক উজ্জ্বল হয়ে ক্লান্তি ক্লেদ ভয় অন্ধকার হতে চায় এখুনি আবার তবু। প্রকৃতিতে সূর্য আসে, অস্তের আকাশে চ'লে যায়;- অস্তগতিহীন শুভ্র জনহৃদয়ের সূর্যনগরীর দিকে যেতে হবে চেতনায় মানুষের সময় চলেছে। পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোন্‌খানে সফলতা শক্তির ভিতর, কোন্‌খানে আকাশের গায়ে রূঢ় মনুমেন্ট উঠিতেছে জেগে, কোথায় মাস’ল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে, জানি নাকো, আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাধিঁয়াছি ঘর: সন্ধ্যায় যে দাঁড়কাক উড়ে যায় তালবনে- মুখে দুটো খড় নিয়ে যায়-সকালে যে নিমপাখি উড়ে আসে কাতর আবেগে নীল তেঁতুলের বনে- তেমনি করুণা এক বুকে আছে লেগে; বইচির মনে আমি জোনাকির রূপ দেখে হয়েছি কাতর;কদমের ডালে আমি শুনেছি যে লক্ষ্মীপেঁচা গেয়ে গেছে গান নিশুতি জ্যোৎস্না রাতে, -টুপ টুপ টুপ টুপ্‌ সারারাত ঝরে শুনেছি শিশিরগুলো –ম্লান মুখে গড় এসে করেছে আহ্বান ভাঙা সোঁদা ইটগুলো,– তারি বুকে নদী এসে কি কথা মর্মরে; কেউ নাই কোনোদিকে- তবু যদি জ্যোৎস্নায় পেতে থাক কান শুনিবে বাতাসে শব্দ : ‘ঘোড়া চড়ে কই যাও হে রায়রায়ন –’ পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে গেলে দিন আলোকিত হয়ে ওঠে—রাত্রি অন্ধকার হয়ে আসে; সর্বদাই, পৃথিবীর আহ্নিক গতির একান্ত নিয়ম, এই সব; কোথাও লঙ্ঘন নেই তিলের মতন আজো; অথবা তা হতে হলে আমাদের জ্ঞাতকুলশীল মানবীয় সময়কে রূপান্তরিত হয়ে যেতে হয় কোনো দ্বিতীয় সময়ে; সে-সময় আমাদের জন্যে নয় আজ। রাতের পর দিন—দিনের পরের রাত নিয়ে সুশৃঙ্খল পৃথিবীকে বলয়িত মরুভূমি ব’লে মনে হতে পারে তবু; শহরে নদীতে মেঘে মানুষের মনে মানবের ইতিহাসে সে অনেক সে অনেক কাল শেষ ক’রে অনুভব করা যেতে পারে কোনো কাল শেষ হয় নি কো তবু;—শিশুরা অনপনেয় ভাবে কেবলি যুবক হলো,—যুবকেরা স্থবির হয়েছে, সকলেরি মৃত্যু হবে,—মরণ হতেছে।অগণন অংকে মানুষের নাম ভোরের বাতাসে উচ্চারিত হয়েছিল শুনে নিয়ে সন্ধ্যার নদীর জলের মুহূর্তে সেই সকল মানুষ লুপ্ত হয়ে গেছে জেনে নিতে হয়; কলের নিয়মে কাজ সাঙ্গ হয়ে যায়; কঠিন নিয়মে নিরঙ্কুশভাবে ভিড়ে মানবের কাজ অসমাপ্ত হয়ে থাকে—কোথাও হৃদয় নেই তবু। কোথাও হৃদয় নেই মনে হয়, হৃদয়যন্ত্রের ভয়াবহভাবে সুস্থ সুন্দরের চেয়ে এক তিল অবান্তর আনন্দের অশোভনতায়। ইতিহাসে মাঝে-মাঝে এ-রকম শীত অসারতা নেমে আসে;—চারিদিকে জীবনের শুভ্র অর্থ র’য়ে গেছে তবু, রৌদ্রের ফলনে সোনা নারী শস্য মানুষের হৃদয়ের কাছে, বন্ধ্যা ব’লে প্রমাণিত হয়ে তার লোকোত্তর মাথার নিকটে স্বর্গের সিঁড়ির মতো;—হুন্ডি হাতে অগ্রসর হয়ে যেতে হয়। আমাদের এ-শতাব্দী আজ পৃথিবীর সাথে নক্ষত্রলোকের এই অবিরল সিঁড়ির পসরা খুলে আত্মক্রীড় হলো;—মাঘসংক্রান্তির রাত্রি আজ এমন নিষ্প্রভ হয়ে সময়ের বুনোনিতে অন্ধকার কাঁটার মতন কাকে বোনে? কেন বোনে? কোন হিকে কোথায় চলেছে? এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে,—ঝাউ শিশু জারুলে হাওয়ার শব্দ থেমে আরো থেমে-থেমে গেলে—আমাদের পৃথিবীর আহ্নিক গতির অন্ধ কন্ঠ শোনা যায়;—শোনো, এক নারীর মতন, জীবন ঘুমায় গেছে; তবু তার আঁকাবাকা অস্পষ্ট শরীর নিশির ডাকের শব্দ শুনে বেবিলনে পথে নেমে উজ্জয়িনী গ্রীসে রেনেসাঁসে রুশে আধো জেগে, তবু, হৃদয়ে বিকিয়ে গিয়ে ঘুমায়েছে আর একবার নির্জন হ্রদের পারে জেনিভার পপলারের ভিড়ে অন্ধ সুবাতাস পেয়ে;—গভীর গভীরতর রাত্রির বাতাসে লোকার্নো হ্বের্সাই মিউনিখ অতলন্তের চার্টারে ইউ-এন-ওয়ের ভিড়ে আশা দীপ্তি ক্লান্তি বাধা ব্যাসকূট বিষ- আরো ঘুম—র’য়ে গেছে হৃদয়ের—জীবনের;—নারী, শরীরের জন্যে আরো আশ্চর্য বেদনা বিমূঢ়তা লাঞ্ছনার অবতার র’য়ে গেছে; রাত এখনো রাতের স্রোতে মিশে থেকে সময়ের হাতে দীর্ঘতম রাত্রির মতন কেঁপে মাঝে-মাঝে বুদ্ধ সোক্রাতেস্‌ কনফুচ লেনিন গ্যেটে হ্যোল্ডেরলিন রবীন্দ্রের রোলে আলোকিত হতে চায়;—বেলজেনের সব-চেয়ে বেশি অন্ধকার নিচে আরো নিচে টেনে নিয়ে যেতে চায় তাকে; পৃথিবীর সমুদ্রের নীলিমায় দীপ্ত হয়ে ওঠে তবু ফেনের ঝর্ণা,—রৌদ্রে প্রদীপ্ত হয়,—মানুষের মন সহসা আকাশে বনহংসী-পাখি বর্ণালি কি রকম সাহসিকয়া চেয়ে দেখে,-সূর্যের কিরণে নিমেষেই বিকীরিত হয়ে ওঠে;—অমর ব্যথায় অসীম নিরুৎসাহে অন্তহীন অবক্ষয়ে সংগ্রামে আশায় মানবের ইতিহাস-পটভূমি অনিকেত না কি? তবু, অগণন অর্ধসত্যের উপরে সত্যের মতো প্রতিভাব হয়ে নব নবীন ব্যাপ্তির সর্গে সঞ্চারিত হয়ে মানুষ সবার জন্যে শুভ্রতার দিকে অগ্রসর হয়ে চায়—অগ্রসর হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে শস্যের ভিতরে রৌদ্রে পৃথিবীর সকালবেলায় কোনো এক কবি ব’সে আছে; অথবা সে কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে; তবুও সে প্রীত অবহিত হ’য়ে আছে।এই পৃথিবীর রোদে-এখানে রাত্রির গন্ধে-নক্ষত্রের তরে। তাই সে এখানকার ক্লান্ত মানবীয় পরিবেশ সুস্থ ক’রে নিতে চায় পরিচ্ছন্ন মানুষের মতো, সব ভবিতব্যতার অন্ধকারে দেশমিশে গেল;জীবনকে সকলের তরে ভালো ক’রে পেতে হ’লে এই অবসন্ন স্নান পৃথিবীর মতো অম্লান ,অক্লান্ত হ’য়ে বেঁচে থাকা চাই। একদিন স্বর্গে যেতে হ’তো। পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস করে পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস করে হৃদয়ের নরম কাতর অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন কাটায়েছি; বনে বনে ডালপালা উড়িতেছে — যেন পরী জিন্‌ কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের পর খইয়ের ধানের মতো দেখিয়াছি ঝরে ঝর্‌ ঝর দু-ফোটা মেঘের বৃষ্টি, — শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন, ম্লান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে… গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর:এই সব দেখিয়াছি; — দেখিয়াছি নদীটিরে — মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে; সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অম্বনে’র নীড়ের ভিতর পাখনার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে কে যেন দাঁড়ায়ে আছে: আরো দূরে দু একটা স — ব্দ খোড়ো ঘর পড়ে আছে; — খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন — থামিতে কি পারে; ‘তুমি কেন এইখানে’, ‘তুমি কেন এইখানে’ — শরের বনের থেকে দেয় সে উত্তর। (আবার পাখনা নাড়ে — কাকের তরুন ডিম পিছলায়ে পড়ে যায় শ্যাওয়ার ঝাড়ে) পৃথিবীর রৌদ্রে কেমন আশার মতো মনে হয় রোদের পৃথিবী, যতদূর মানুষের ছায়া গিয়ে পড়ে মৃত্যু আর নিরুৎসাহের থেকে ভয় আর নেই এ-রকম ভোরের ভিতরে।যতদূর মানুষের চোখ চ’লে যায় ঊর ময় হরপ্পা আথেন্‌স্‌ রোম কলকাতা রোদের সাগরে অগণন মানুষের শরীরের ভিতরে বন্দিনী মানবিকতার মতোঃ তবুও তো উৎসাহিত করে?সে অনেক লোক লক্ষ্য অসম্ভব ভাবে ম’রে গেছে ঢের আলোড়িত লোক বেঁচে আছে তবু। আরো স্মরণীয় উপলদ্ধি জন্মাতেছে। যা হবে তা আজকের নরনারীদের নিয়ে হবে। যা হল তা কালকের মৃতদের নিয়ে হয়ে গেছে।*কঠিন অমেয় দিন রাত এই সব। চারিদিকে থেকে-থেকে মানব ও অমানবিকতা সময় সীমার ঢেউয়ে অধোমুখ হয়ে চেয়ে দেখে শুধু-মরণের কেমন অপরিমেয় ছটা। তবু এই পৃথিবীর জীবনই গভীর। এক- দুই- শত বছরের পাথর নুড়ির পথে স্রোতের মতন কোথায় যে চ’লে গেছে কোন্‌ সব মানুষের দেহ, মানুষের মন। আজ ভোরে সূর্যালোকিত জল তবু ভাবনালোকিত সব মানুষের ক্রম,- তোমারা শতকী নও; তোমারা তো ঊনিশ শো অনন্তের মতন সুগম। আলো নেই? নরনারী কলরোল আলোর আবহ প্রকৃতির? মানুষেরও; অনাদির ইতিহাসসহ। পৃথিবীলোক দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে গ্রাম পতনের শব্দ হয়; মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে, দেয়ালে তাদের ছায়া তবু ক্ষতি,মৃত্যু,ভয় বিহবলতা ব’লে মনে হয়।এসব শূণ্যতা ছাড়া কোনোদিকে আজ কিছু নেই সময়ের তীরে। তবু ব্যর্থ মানুষের গ্লানি ভুল চিন্তা সংকল্পের অবিরল মরুভূমি ঘিরে বিচিত্র বৃক্ষের শব্দে স্নিগ্ধ এক দেশ এ পৃথিবী, এই প্রেম, জ্ঞান আর হৃদয়ের এই নির্দেশ। পেঁচা প্রথম ফসল গেছে ঘরে, হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল; অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে হিম হয়ে আসে বাঁশাপাতা– মরা ঘাস — আকাশের তারা! বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা! ধানক্ষেতে– মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা! ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ পৃথিবী – তবু টের পাই কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের কোনো সাধ! হলুদ পাতার ভীড়ে ব’সে, শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে, পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জাগে একা অঘ্রানের রাতে সেই পাখি– আজ মনে পড়ে সেদিনও এমনি গেছে ঘরে প্রথম ফসল; মাঠে মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর– কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!– হলুদ পাতার ভীড়ে ব’সে, শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে, পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জাগে একা অঘ্রানের রাতে এই পাখি! নদীটির শ্বাসে সে রাতেও হিম হয়ে আসে বাঁশাপাতা– মরা ঘাস — আকাশের তারা! বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা! ধানক্ষেতে– মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা! ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ পৃথিবী – তবু আমি পেয়েছি যে টের কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের কোনো সাধ! প্যারাডিম সময়ের সুতো নিয়ে কেটে গেছে ঢের দিন এক আধবার শুধু নিশিত ক্ষমতা এনেছিল,- তারপরে নিভে- মিশে গেছে; হৃদয় কাটাল কান। বালুঘড়ি ব'লে গেলঃ সময় রয়েছে ঢের সেই সুর দূর এক আশ্চর্য কক্ষের চোখের ভিতরে গিয়ে স্বর্ণ দীনারের অমোঘ বৃত্তের মত রূপ নিয়ে নড়ে। বালুঘড়ি ব'লে গেলঃ সময় রয়েছে ঢের সময় রয়েছে ঢের ইহাদের- উহাদের; সমুদ্রের বালি আর আকাশের তারার ভিতরে চ'লেছে গাধার পিঠ- সিংহ, মেষ, বিদূষ্ক, মূর্খ আর রূপসীর বিবাহ ঘটক, ক্রীতদাস কাফরী তেল ব'য়ে আনে। সময় রয়েছে ঢের- সময় রয়েছে ঢের সরবপ্রাহের সব অগণন গণিকারা জানে।চারিদিকে মৃগয়ার কলরব- সময়ের বীজ। অনেক শিকারী আজ নেমেছে আলোকে। আমিও সূর্যের তেজ দেখে গেছি বহুক্ষণ ভারুই পাখির মত চোখে; ঘুরুনো আলোয় ঘুরে সংস্করে;- উড়িবার হেতু যদিও নেইক' কিছু ক্ষিতিজ রেখার পথে আর। বহু আগে রণ ক'রে গিয়েছিল বুদ্ধ আর মার; অগ্নির অক্ষরে তবু গঠিত হয়েছে আজো সেতু। ব্রহ্মার ডিমের সাথে একসাথে জন্মেছিল যারা ভালোবেসে সেই স্বর্গ নরককে আবার ক্ষালন ক'রে- প্রমাণিত দেশে তারাই তো রেখে দেবে,- মাঝখানে যদিও র'য়েছে আজ রক্তিম সাগর, বিশ্বাসীরা চোখ বুজে ব'য়ে নেয় মুণ্ড আর কংকালের কেতু। সম্রাটের সৈনিকেরা পথে পথে চ'রে খুঁজে ফেরে কোন এক শুভলাঞ্ছন; সফেন কাজের ঢেউয়ে মৃত্যু আছে- জানে; তার আগে র'য়ে গেছে জীবন-মৃত্যুর অমিলন; যেনো কোনো নরকের কর্নিশের থেকে ধীরে উঠে কোনো এক নিম্নতর আঁধারের বিজৃম্ভিম কাক আবার সাজাতে পারে দু'মুহূর্ত ময়ূরের মতন পোষাক, সৈকতে বালির কণা নক্ষত্রের রোলে যদি এক সাথে জুটে আবছায়া, অগ্নিভয়, অন্ধকার- সময়ের হাত ঠেলে ফেলে অনাবিল অন্ত"সার নিতে দেয় খুঁটে।সৈনিকের সম্রাটেরা স্থিরতর- তবু; চারিদিকে মাতালের সাবলীল কাজ শেষ হ'লে প্রতিধ্বনিত আর থাকে নাক' যখন আকাশে জলের উপরে হেঁটে মায়বীর মত যায় চ'লে। (গভীর সৌকর্য দেখে মানবীয় আত্মা জাগে জন্তুদের ভিড়ে;) অবিস্মরণীয় সব ইতিহাস পর্যায়ের দিকে চেয়ে দেখে সর্বদাই পৃথিবীর প্রবীণ জ্ঞানীকে ডেকে আনে তারা নিত্য নতুন তিমিরে; নিপুণ ছেলের হাতে লাটিমের মত ঘোরে' দ্বৈপায়ন বলে ঘুরায়ে নিবিড় সেই প্যারাডিমটিরে।'যখন চিনির দাম বেড়ে গেছে ভয়ঙ্কর রাতা খায় সেচ্ছায় নুনের পরিজ। সমস্ত ভণ্ডুল হয়ে গেল পৃথিবীর, মসৃন টেবিলে ব'সে খেলে যায় ব্রিজ। জীবঙ্কে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের মত মেনে নিয়ে মঞ্চে বক্তৃতা দেয় কর গুণে- কুকুর ক্ষেপিরে'। ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে; যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে।'সমস্ত সভার মাঝে তারপর দম আর থাকে নাক' কোনো কুকুরের; একটি মাছিও আর বসে নাক' বক্তার নাকে একটি মশাও তাকে পায় নাক' টের; এবং পায়ের নিচে পৃথিবীরো মাটি আর নেই তবু সবি পাওয়া যাবে চালানির মাল ছাড়ালেই।' ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে; যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে।'আমরা সকলে জানি বানরাজা নক্ষত্রের থেকে সে জাহাজ এসে গেছে মুগশিরা তারকার দিকে; হয়তো শরমা তাকে তুলে ধ'রে সারমেয়দের নিকটে পাঠায়ে দেবে নির্জন তারিখে। সম্প্রতি রুটিন তবে শেষ ক'রে- ঘুমাবার পরে আবার সে দেখা দেবে আমাদের স্বাভাবিক সুবিধার তরে।' ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে; যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে। প্রতীতি বাতাবীলেবুর পাতা উড়ে যায় হাওয়ায়- প্রান্তরে,- সার্সিতে ধীরে-ধীরে জলতরঙ্গের শব্দ বাজে; একমুঠো উড়ন্ত ধূলোয় আজ সময়ের আস্ফোট রয়েছে; না হ'লে কিছুই নেই লবেজান লড়ায়ে জাহাজে। বাইরে রৌদ্রের ঋতু বছরের মতো আজ ফুরায়ে গিয়েছে; হোক-না তা; প্রকৃতি নিজের মনোভাব নিয়ে অতীব প্রবীণ; হিসেব বিষণ্ণ সত্য র'য়ে গেছে তার; এবং নির্মল ভিটামিন। সময় উচ্ছিন্ন হ'য়ে কেটে গেলে আমাদের পুরোনো প্রহের জীবনস্পন্দন তার রূপ নিতে দেরি ক'রে ফেলে,- জেনে নিয়ে যে যাহার স্বজনের কাজ করে না কি- পরার্থের কথা ভেবে ভালো লেগে গেলে। মানুষেরি ভয়াবহ স্বাভাবিকতার সুর পৃথিবী ঘুরায়; মাটির তরঙ্গ তার দু-পায়ের নিচে আধোমুখে ধ্বসে যায়;- চারিদিকে কামাতুর ব্যাক্তিরা বলেঃ এ-রকম রিপু চরিতার্থ ক'রে বেঁচে থাকা মিছে। কোথাও নবীন আশা র'য়ে গেছে ভেবে নীলিমার অনুকল্পে আজ যারা সয়েছে বিমান,- কোনো এক তনুবাত শিখরের প্রশান্তির পথে মানুষের ভবিষ্যৎ নেই- এই জ্ঞান পেয়ে গেছে; চারিদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন নেশন প'ড়ে আছে; সময় কাটায়ে গেছে মোহ ঘোচাবার আশা নিয়ে মঞ্জুভাষা, দোরিয়ান গ্রীস, চীনের দেয়াল, পীঠ, পেপিরাস, কারারা-পেপার। তাহারা মরেনি তবু;- ফেনশীর্ষ সাগরের ডুবুরির মতো চোখ বুজে অন্ধকার থেকে কথা-কাহিনীর দেশে উঠে আসে; যত যুগ কেটে যায় চেয়ে দেখে সাগরের নীল মুরুভূমি মিশে আছে নীলিমার সীমাহীন ভ্রান্তিবিলাসে। ক্ষতবিক্ষত জীব মর্মস্পর্শে এলে গেলে- তবুও হেঁয়ালি; অবশেষে মানবের স্বাভাবিক সূর্যালোকে গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ভেবে- ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সাল। 'তেতাল্লিশ' পঞ্চাশের দিগন্তরে পড়েছে বিছিয়ে। মাটির নিঃশেষ সত্য দিয়ে গড়া হয়েছিলো মানুষের শরীরের ধুলোঃ তবুও হৃদয় তার অধিক গভীরভাবে হ'তে চায় সৎ; ভাষা তার জ্ঞান চায়, জ্ঞান তার প্রেম,- ঢের সমুদ্রের বালি পাতালের কালি ঝেড়ে হ'য়ে পড়ে বিষণ্ণ, মহৎ। প্রয়াণপটভূমি বিকেলবেলার আলো ক্রমে নিভেছে আকাশ থেকে। মেঘের শরীর বিভেদ ক’রে বর্শাফলার মতো সূর্যকিরণ উঠে গেছে নেমে গেছে দিকে-দিগন্তরে; সকলি ছুপ কী এক নিবিদ প্রণয়বশত। কমলা হলুদ রঙের আলো- আকাশ নদী নগরী পৃথিবীকে সূর্য থেকে লুপ্ত হয়ে অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে ধীরে-ধীরে ডুবিয়ে দেয়;- মানবহৃদয়,দিন কি শুধু গেল? শতাব্ধী কি চ’লে গেল!- হেমন্তের এই আঁধারের হিম লাগে; চেনা জানা প্রেম প্রতীতি প্রতিভা সাধ নৈরাজ্য ভয় ভুল সব-কিছুকেই ঢেকে ফেলে অধিকতর প্রয়োজনের দেশে মানবকে সে নিয়ে গিয়ে শান্ত-আরো শান্ত হতে যদি অনুজ্ঞা দেয় জনমানবসভ্যতার এই ভীষণ নিরুদ্দেশে,- আজকে যখন সান্ত্বনা কম, নিরাশা ঢের, চেতনা কালজয়ী হতে গিয়ে প্রতি পলেই আঘাত পেয়ে অমেয় কথা ভাবে,- আজকে যদি দীন প্রকৃতি দাঁড়ায় যতি যবনিকার মতো শান্তি দিতে মৃত্যু দিতে;-জানি তবু মানবতা নিজের স্বভাবে কালকে ভোরের রক্ত প্রয়াস সূর্যসমাজ রাষ্ট্রে উঠে গেছে; ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু, নর-নারীর ভিড় নব নবীন প্রাক্‌সাধনার;-নিজের মনের সচল পৃথিবীকে ক্রেম্‌লিনে লন্ডনে দেখে তবুও তারা আরো নতুন অমল পৃথিবীর।  প্রার্থনা আমাদের প্রভু বীক্ষণ দাওঃ মরি নাকি মোরা মহাপৃথিবীর তরে? পিরামিড যারা গড়েছিলো একদিন- আর যারা ভাঙে- গড়ে;- মশাল যাহারা জ্বালায় যেমন জেঙ্গিস যদি হালে দাঁড়ায় মদির ছায়ার মতন- যত অগণন মগজের কাঁচা মালে; যে-সব ভ্রমণ শুরু হ’লো শুধু মার্কোপোলোর কালে, আকাশের দিকে তাকায়ে মোরাও বুঝেছি যে-সব জ্যোতি দেশলাইকাঠি নয় শুধু আর- কালপুরুষের গতি; ডিনামাইট দিয়ে পর্বত কাটা না-হ’লে কী করে চলে,- আমাদের প্রভু বিরতি দিয়ো না; লাখো-লাখো যুগ রতিবিহারের ঘরে মনোবীজ দাওঃ পিরামিড গড়ে- পিরামিড ভাঙে গড়ে। প্রিয়দের প্রাণে অনেক পুরোনো দিন থেকে উঠে নতুন শহরে           আমি আজ দাঁড়ালাম এসে। চোখের পলকে তবউ বোঝা গেল জনতাগভীর তিথি আজ;           কোনো ব্যতিক্রম নেই মানুষবিশেষে। এখানে রয়েছে ভোর,- নদীর সমস্ত প্রীত জল;-           কবের মনের ব্যবহারে তবু হাত বাড়াতেই দেখা গেল স্বাভাবিক ধারণার মতন সকাল-           অথবা তোমার মতন নারী আর নেই। তবুও র‌য়েছে সব নিজেদের আবিস্ট নিয়মে সময়ের কাছে সত্য হ’য়ে, কেউ যেন নিকটেই র’য়ে গেছে ব’লে;-           এই বোধ ভোর থেকে জেগেছে হৃদয়ে। আগাগোড়া নগরীর দিকে চেয়ে থাকি;           অতীব জটিল ব’লে মনে হ’লো প্রথম আঘাতে; সে-রীতির মতো এই স্থান যেন নয়ঃ           সেই দেশ বহুদিন সয়েছিলো ধাতে জ্ঞান মানমন্দিরের পথে ঘুরে বই হাতে নিয়ে;           তারপর আজকের লোক সাধারণ রাতদিন চর্চা ক’রে, মনে হয় নগরীর শিয়রের অনিরুদ্ধ ঊষা সূর্য চাঁদ           কালের চাকায় সব আর্ষপ্রায়োগের মতো ঘোরে। কেমন উচ্চিন্ন শব্দ বেজে ওঠে আকাশের থেকে;           মনে বুঝে নিতে গিয়ে তবুও ব্যাহত হয় মন;           একদিন হবে তবু এরোপ্লেনের-             আমাদেরো শ্রুতিবিশোধন। দূর থেকে প্রপেলার সময়ের দৈনিক স্পন্দনে           নিজের গুরুত্ব বুঝে হ’তে চায় আরো সাময়িক; রৌদ্রের ভিতরে ওই বিচ্ছুরিত এলুমিনিয়ম           আকাশ মাটির মধ্যবর্তিনীর মতো যেন ঠিক। ক্রমে শীত, স্বাভাবিক ধারণার মতো এই নিচের নগরী           আরো কাছে প্রতিভাত হয়ে আসে চোখে; সকল দুরুহ বস্তু সময়ের অধীনতা মেনে মানুষ ও মানুষের মৃত্যু হয়ে সহজ আলোকে দেখা দেয় ;- সর্বদাই মরণের অতীব প্রসার,-           জেনে কেউ অভ্যাসবশত তবু দু’চারটে জীবনের কথা ব্যবহার ক’রে নিতে গিয়ে দেখে অলক্লিয়ারেরও চেয়ে বেশি প্রত্যাশায় ব্যপ্তকাল ভোলেনি প্রাণের একাগ্রতা। আশা-নিরাশার থেকে মানুষের সংগ্রামের জন্মজন্মান্তর- প্রিয়দের প্রাণে তবু অবিনাশ, তমোনাশ আভা নিয়ে এসে স্বাভাবিক মনে হয়ঃ উর ময় লন্ডনের আলো ক্রেমলিনে না থেমে অভিজ্ঞভাবে চ’লে যায় প্রিয়তর দেশে। প্রেম আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো — পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত — একা — হরিণের মতো আমাদের হৃদয় যখন! জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন পান্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত আমরা ঘুমায়ে থাকি! — ছুটি লয়ে চলে যায় মন! — পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা পড়ে আছে কত — তাদের চোখের ঘুম ভেঙে যাবে আবার কখন! — জীবনের জ্বর ছেড়ে শান্ত হয়ে রয়েছে হৃদয় — অনেক জাগার পর এইমতো ঘুমাইতে হয়।অনেক জেনেছে বলে আর কিছু হয় না জানিতে; অনেক মেনেছে বরে আর কিছু হয় না মানিতে; দিন — রাত্রি — গ্রহ — তারা পৃথিবীর আকাশ ধরে ধরে অনেক উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো করে — পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে পুরুষ পাখির মতো — প্রবল হাওয়ার মতো জোরে মৃত্যুও উড়িয়া যায়! — অসাড় হতেছে পাতা শীতে, হৃদয়ে কুয়াশা আসে — জীবন যেতেছে তাই ঝরে! — পাখির মতন উড়ে পায় নি যা পৃথিবীর কোলে — মৃত্যুর চোখের পরে চুমো দেয় তাই পাবে বলে!কারণ, সাম্রাজ্য — রাজ্য — সিংহাসন — জয় — মৃত্যুর মতন নয় — মৃত্যুর শান্তির মতো নয়! কারণ, অনেক অশ্রু — রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে আমরা রাখিতে আছি জীবনের এই আলো জ্বেলে! তবুও নক্ষত্র নিজে নক্ষত্রের মতো জেগে রয়! তাহার মতন আলো হৃদয়ের অন্ধকারে পেলে মানুষের মতো নয় — নক্ষত্রের মতো হতে হয়! মানুষের মতো হয়ে মানুষের মতো চোখ মেলে মানুষের মতো পায়ে চলিতেছি যতদিন — তাই, ক্লান্তির পরে ঘুম, মৃত্যুর মতন শান্তি চাই!কারণ, যোদ্ধার মতো — আর সেনাপতির মতন জীবন যদিও চলে — কোলাহল করে চলে মন যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে, সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে যদিও বীণার মতো বেজে উঠে হৃদয়ের বন একবার — দুইবার — জীবনের অধীর আঘাতে — তবু, প্রেম, — তবু তারে ছিড়ে ফেঁড়ে গিয়েছে কখন! তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু! — অঘ্রাণের রাতে হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চলে গেছে ছিঁড়ে! পাতার মতন করে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে!তবু পাতা — তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে, বনের শাখার মতো — শাখার পাখির মতো হয়ে হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে বিদীর্ণ শাখার শব্দে — অসুস্থ ডানার কোলাহলে, ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে, আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে, আমাদের এ জীবন! — জীবনের বিহ্বলতা সয়ে আমাদের দিন চলে — আমাদের রাত্রি তবু চলে; তার ছিঁড়ে গেছে — তবু তাহারে বীণার মতো করে বাজাই, যে প্রেম চলিয়া গেছে তারই হাত ধরে! কারণ, সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি; তাই রাখিয়াছে ঢেকে পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুক! সুস্থ করে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের আসুখ!পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ — ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে! প্রেম কি আসে নি তবু? — তবে তার ইশারা আসুক! প্রেমকি চলিয়া যায় প্রাণেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে! ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে!যত দিন বেঁচে আছি আলেয়ার মতো আলো নিয়ে — তুমি চলে আস প্রেম — তুমি চলে আস কাছে প্রিয়ে! নক্ষত্রের বেশি তুমি — নক্ষত্রের আকাশের মতো! আমরা ফুরায়ে যাই — প্রেম, তুমি হও না আহত! বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে চলে আসি — চলে যাই — আকাশের পারে ইতস্তত! ভেঙে যাই — নিভে যাই — আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে! আকাশের মতো তুমি — আকাশে নক্ষত্র আছে যত — তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে!জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনও রবে জেগে জানি! জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি — ঘুমন্ত ফুলের মতো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় — তুমি তারে জ্বেলে চোখের তারার পরে তুলে লবে সেই আলোখানি। সময় ভাসিয়া যাবে দেবতা মরিবে অবহেলে তবুও দিনের মেঘ আঁধার রাত্রির মেঘ ছানি চুমো খায়! মানুষের সব ক্ষুধা আর শক্তি লয়ে পূর্বের সমুদ্র অই পশ্চিম সাগরে যাবে বয়ে!সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন! সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি, তোমার আসন সকল স্থলের’ পরে, সকল জলের’ পরে আছে! যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে হে প্রেম, তোমার! — যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন তুলিয়াছ! — অঙ্কুরের মতো তুমি — যাহা ঝরিয়াছে আবার ফুটাও তারে! তুমি ঢেউ — হাওয়ার মতন! আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে! আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি আমার বুকের পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি!জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন তুমি আছ বলে প্রেম, গানের ছন্দের মতো মন আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ বলে! হৃদয় গন্ধের মতো — হৃদয় ধুপের মতো জ্ব’লে ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন। ওগো প্রেম, বাতাসের মতো যেইদিকে যাও চলে আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন! আমি শেষ হব শুধু, ওগো প্রেম, তুমি শেষ হলে! তুমি যদি বেঁচে থাক, — জেগে রব আমি এই পৃথিবীর পর — যদিও বুকের পরে রবে মৃত্যু — মৃত্যুর কবর!তবুও সিন্ধুর জল — সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে তুমি চলে যাও প্রেম — একবার বর্তমান হয়ে — তারপর, আমাদের ফেলে দাও পিছনে — অতীতে — স্মৃতির হাড়ের মাঠে — কার্তিকের শীতে! অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে — আজও যারে দেখ নাই তাহারে তোমার চুমো দিতে চলে যাও! — দেহের ছায়ার মতো তুমি যাও রয়ে — আমরা ধরেছি ছায়া — প্রেমের তো পারি নি ধরিতে! ধ্বনি চলে গেছে দূরে — প্রতিধ্বনি পিছে পড়ে আছে — আমরা এসেছি সব — আমরা এসেছি তার কাছে!একদিন — একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা! এক রাত — এক দিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা এক দিন — এক রাত তারপর প্রেম গেছে চলে — সবাই চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে তাহারও ফুরাল রাত! তাড়াতাড়ি পড়ে গেল বেলা প্রেমেরর ও যে! — এক রাত আর এক দিন সাঙ্গ হলে পশ্চিমের মেঘে আলো এক দিন হয়েছে সোনেলা! আকাশে পুবের মেঘে রামধনু গিয়েছিল জ্বলে এক দিন রয় না কিছুই তবু — সব শেষ হয় — সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময়;এক দিন এক রাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে! আকাশ চলেছে তার — আগে আগে প্রেম চলিয়াছে! সকলের ঘুম আছে — ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে সকলের, নক্ষত্রও ঝরে যায় মনের অসুখে প্রেমের পায়ের শব্দ তবুও আকাশে বেঁচে আছে! সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে — চুকে হে প্রেম তোমারে! — মৃতেরা আবার জাগিয়াছে! যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে আরো ব্যথা — বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে — ওগো প্রেম, সেই সব ভুলে গিয়ে কে ঘুমাতে পারে! প্রেম অপ্রেমের কবিতা নিরাশার খাতে ততোধিক লোক উৎসাহ বাঁচায়ে রেখেছে; অগ্নিপরীক্ষার মতো কেবলি সময় এসে দ’হে ফেলে দিতেছে সে-সব। তোমার মৃত্যুর পরে আগুনের একতিল বেশি অধিকার সিংহ মেষ কন্যা মীন করেছে প্রত্যক্ষ অনুভব। পৃথিবী ক্রমশ তার আগেকার ছবি বদলায়ে ফেলে দিয়ে তবুও পৃথিবী হ’য়ে আছে; অপরিচিতের মতো সমাজ সংসার শত্রু  সবই পরিচিত বুনোনির মতো তবু হৃদয়ের কাছে ক্রমশই মনে হয় নিজ সজীবতা নিয়ে চমৎকার; আবর্তিত হ’য়ে যায় দানবের মায়াবলে তবুও সে-সব। তোমার মৃত্যুর পরে মনিবের একতিল বেশি অধিকার দীর্ঘ কালকেতু তুলে বাধা দিতে চেয়েছে রাসভ। তোমার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলে তুমি চ’লে গেলে কবে। সেই থেকে অন্য প্রকৃতির অনুভবে মাঝে-মাঝে উৎকন্ঠিত হ’য়ে জেগে উঠেছে হৃদয়। না-হ’লে নিরুৎসাহিত হ’তে হয়। জীবনের, মরণের, হেমন্তের এ-রকম আশ্চর্য নিয়ম; ছায়া হ’য়ে গেছো ব’লে তোমাকে এমন অসম্ভ্রম। শত্রুর অভাব নেই, বন্ধুও বিরল নয়- যদি কেঊ চায়; সেই নারী ঢের দিন আগে এই জীবনের থেকে চ’লে গেছে। ঢের দিন প্রকৃতি ও বইয়ের নিকট থেকে সদুত্তর চেয়ে                    হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করছে। তারপর অনুভব ক’রে গেছে রমণীর ছায়া বা শরীর অথবা হৃদয়,- বেড়ালের বিকশিত হাসির মতন রাঙা গোধূলির মেঘে; প্রকৃতির প্রমাণের, জীবনের দ্বারস্থ দুঃখীর মতো নয়। তোমার সংকল্প থেকে খ’সে গিয়ে ঢের দূরে চ’লে গেলে তুমি; হ’লেও-বা হ’য়ে যেতো এ জীবনঃ দিনরাত্রির মতো মরুভুমি;- তবুও হেমন্তকাল এসে পড়ে পৃথিবীতে, এমন স্তব্ধতা; জীবনেও নেই কো অন্যথা হেমন্তের সহোদর র’য়ে গেছে, সব উত্তেজের প্রতি উদাসীন; সকলের কাছ থেকে সুস্থির মনের ভাবে নিয়ে আসে ঋণ, কাউকে দেয় না কিছু, এমনই কঠিন; সরল সে নয়, তবু ভয়াবহভাবে শাদা, সাধারণ কথা জনমানুষীর কাছে ব’লে যায়- এমনই নিয়ত সফলতা। ফিরে এসো ফিরে এসো সমুদ্রের ধারে ফিরে এসো প্রান্তরের পথে; যেইখানে ট্রেন এসে থামে আম নিম ঝাউয়ের জগতে ফিরে এসো; একদিন নীল ডিম করেছ বুনন আজও তারা শিশিরে নীরব; পাখির ঝর্ণা হয়ে কবে আমারে করিবে অনুভব! ফুটপাথে অনেক রাত হয়েছে- অনেক গভীর রাত হয়েছে; কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে- ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে- কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো                                       এই-যে ট্র্যামের লাইন ছড়িয়ে আছে পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ                                                 অনুভব ক’রে হাঁটছি আমি। গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস; কোন দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার,- তারা কোথায়? তারা কি হারিয়ে গেছে? পায়ের তলে লিকলিকে ট্র্যামের লাইন,- মাথার ওপরে                                                 অসংখ্য জটিল তারের জাল শাসন করছে আমাকে। এই ঠাণ্ডা বাতাসের মুখে এই কলকাতা শহরে এই গভীর রাতে           কোনো নীল শিরার বাসাকে কাঁপতে দেখবে না তুমি; জলপাইয়ের পল্লবে ঘুম ভেঙে গেলো ব’লে কোনো ঘুঘু তার           কোমল নীলাভ ভাঙা ঘুমের আস্বাদ তোমাকে জানাতে আসবে না। হলুদ পেঁপের পাতাকে একটা আচমকা পাখি ব’লে ভুল হবে না তোমার, সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ নিবিড় হ’য়ে                                                 উঠবে না তোমার! প্যাঁচা তার ধূসর পাখা আমলকীর ডালে ঘষবে না এখানে, আমলকীর শাখা থেকে নীল শিশির ঝ’রে পড়বে না, তার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না এখানে, রাত্রিকে নীলাভতম ক’রে তুলবে না! সবুজ ঘাসের ভিতর অসংখ্য দেয়ালি পোকা ম’রে রয়েছে                                       দেখতে পাবে না তুমি এখানে পৃথিবীকে মৃত সবুজ সুন্দর কোমল একটি দেয়ালি পোকার মতো                                                 মনে হবে না তোমার, জীবনকে মৃত সবুজ সুন্দর শীতল একটি দেয়ালি পোকার মতো                                                           মনে হবে না; প্যাঁচার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না এখানে, শিশিরের সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না, সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ নিবিড় হ’য়ে উঠবে না তোমার। বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। বনের চাতক-মনের চাতক বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়- মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়! ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে- সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে! কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে! বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে, ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!ওরে চাতক, বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে, 'দে জল!' ব'লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্‌ছল্ ! মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে! মনের চাতক, হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি? ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে, আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে! আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।বনের চাতক, মনের চাতক আসে না আর ফিরে, কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে! সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে! চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে! বর্ষ-আবাহন ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে প্রভাত রবি উঠলো জেগে দিব্য পরশ পেয়ে, নাই গগণে মেঘের ছায়া যেন স্বচ্ছ স্বর্গকায়া ভুবন ভরা মুক্ত মায়া মুগ্ধ-হৃদয় চেয়ে।অতীত নিশি গেছে চ'লে চিরবিদায় বার্তা ব'লে কোন আঁধারের গভীর তলে রেখে স্মৃতিলেখা, এসো-এসো ওগো নবীন চ'লে গেছে জীর্ণ মলিন- আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন মুক্ত সীমারেখা।#অগ্রন্থিত কবিতা বলিল অশ্বত্থ সেই বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো- তোমরা কোথায় যেতে চাও? এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে: ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে; এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের! বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও; আবার কোথায় যেতে চাও? ‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয় -আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!- এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাক্সক্ষার বেদনার শুধেছিল ঋণ; দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন! ‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে? সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ? আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ? তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাক্সক্ষার ঘর!.. যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর; এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাক্সক্ষার ঘর!’ -বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর। বাংলার মুখ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতো ব্ড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দয়েলপাখি - চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ; ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে; মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপদেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে - কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় - সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়, শ্যামার নরম গান শুনেছিল - একদিন অমরায় গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায় বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়। বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি বেহারি উৎকলি-আর সব সাগরপারের দেশের মানুষ এই কলকাতায় আমরা লক্ষ লক্ষ লোক, কোটি কোটি প্রাণ-রোজ ভোরে জাগি, অন্ধকারে ঘুমাই এই কি শুধু? এর প্রচণ্ড রহস্যের কথা তোমাদের মনে জাগে না? এক মুহুর্তের জন্যও কি মনে হয় না যেন সেই অতীতের এশিরিয়া মিশর আবার তাদের গল্প বলে যাচ্ছেএই কলকাতায় মনুমেন্টের দিকে তাকিয়ে বেবিলনের সেই বিরাট স্তম্ভের কথা মনে হয় না কি যার উপরে সিংহের মূর্তি ছিল? এই শহরটাকে বেবিলন মনে হয় না? মিশর বলে?আমার কাছে এই শহরের ধুলো হাজার হাজার বছরের পুরনো বলে মনে হয় জানালায় এই নারী, দিঘির জলে এর মাছ, আলিসায় এর পাখি, দেয়ালে এর কীট এক-এক সময় হেঁয়ালির মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।বনলতা সেন তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু-ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে- আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই; তুমি আর আমি।কখনো বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে কখনো বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায় কাঁখে তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসি নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ মাথার উপর সকালের জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল, বেগুনফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ। বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে; সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন; ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে, নির্জন আমের ডালে দুলে যায় — দুলে যায় — বাতাসের সাথে বহুক্ষণ, শুধু কথা, গান নয় — নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন বুঝিয়াছি; শুপুরীর সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে নড়ে,দিনরাত কথা নয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী মরে গেছে — দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে তবু ওই পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসে আম নিম জামরুলে; প্রসন্ন প্রাণের স্রোত — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই কিছু, ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু, চেয়ে দেখি ঘুম নাই — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ মাখা ঘাসে। বাতাসের শব্দ এসে বাতাসের শব্দ এসে কিছুক্ষণ হরিতকী গাছের শাখায় মিথিরিত হয়ে থেমে যায়, তার মৃত্যু হলো বলে। এক পা দুই পা করে দুই-চার মাইল প্রান্তরের সাথে আরো পরিচিত হলে এমনি প্রান্তর থাকে রৌদ্রময়, শব্দবিহীন, যতক্ষণ অপরাহ্ন বুকের উপরে পড়ে থাকে তার; শালিখ পাখিকে আমি নাম ধরে ডাকি; ছায়া বা অনলোজ্জ্বল পাখিনীকে ডাকে তবুও সে; মানুষের অন্তঃসার অবহেলা করে বিহঙ্গের নিয়মে নির্জন। উনিশশো বেয়াল্লিশ খৃষ্টাব্দের অপরাহ্নে নেই। উনিশশো অনন্তের ভূখণ্ডে, আকাশ মাঝে মাঝে অনুভব করে নিতে চাই; শান্তি নেই; নীললোহিতের প্রতি শেষ অবিশ্বাস আছে কি না আছে ভেবে চেয়ে দেখি: পাখি,রৌদ্র, ঘাস। বিকেলের আলোয় রাতের কিনারে বসে নয় বিকেলের আলোয় স্বপ্ন দেখলামঃ কোন্‌ এক সুদূর মরুভূমিতে চলে গেছি সেখানে গভীর জোছনারাতে বালির গায়ে বালুকণার শব্দ (পৃথিবীর পাতা ঝরার মতো) স্ফটিকের নির্জন আলোর মতো বাতাস কুমারীর নির্মল মসৃণ দেহের মতো। কয়েকটি প্রেত উড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে মানুষের শব্দে চমকে হাওয়ার ভিতর হারিয়ে গিয়ে। মরণের কতশত শতাব্দীর পর সেই ধূসর পরিধি খুঁজে পাব আমিঃ তার সেই হাত আমার জিভকে আচ্ছন্ন করবে স্ফটিক আলোর মতো বাতাসের অনন্ত নিস্তব্ধতার ভিতর? বিড়াল সারাদিন একটি বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলি আমার দ্যাখা হয়; গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে কোথায় কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হ'য়ে আছে দেখি; কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচুড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে, সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়। হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তারে তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতো লুফিয়ে আনলো সে, সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল। বিপাশা অনেক বছর হ’ল সে কোথায় পৃথিবীর মনে মিশে আছে। জেগে থেকে কথা ব’লে অন্য নারীমুখ দেখে কেউ কোনোমতে কেবলি কঠিন ঋণ দীর্ঘকাল আপামর পৃথিবীর কাছে চেয়ে নিয়ে তার পর পাশ কেটে, মেয়েটির ঘুমের জগতে দেনা শোধ ক’রে দিতে ভালোভাসে, আহা। আকাশে রৌদ্রের রোল, নদী, মাঠ, পথে বাতাস সেই স্বার্থ বুকে নিয়ে নিরুপম উজ্জ্বলতা হ’ল; শূন্যের সংঘর্ষ থেকে অনুপম হ’ল নীলাকাশ; তবু স্বাতির আলো- শিশিরের মত তার অপরীপ চোখ নিজের শরীর মন প্রাণশিল্পী আর না জাগায়ে প্রেমিকের ঋতু পরিবর্তনের মত; নারী আজ সময়ের নিজের আধার। বিবেকানন্দ জয়, তরুণের জয়! জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক, জয় জয় চিন্ময়! স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল, উষা উঠেছিল জেগে পূর্ব তোরণে, বাংলা আকাশে , অরুণ-রঙিন মেঘে; আলোকে তোমার ভারত, ইশয়া-জগৎ গেছিল রেঙে।হে যুবক মুসাফের, স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শ্‌ঙ্খ জাগরণপর্বের! জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি, সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী, রক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়দমন বাঁশি!আসিলে সবসাচী, কোদন্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিল প্রাচী! টঙ্কারে তব দিকে দিকে শুধু রণিয়া উঠিল জয়, ডঙ্কা তোমার উঠিল বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়; শঙ্কাহরণ ওহে সৈনিক, নাহিক তোমার ক্ষয়!তৃতীয় নয়ন তব ম্লান বাসনার মনসিজ নাশি জ্বালাইত উৎসব! কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিত রুখে, হানিতে আঘাত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে, অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!কৃষ্ণচক্র সম ক্লৈব্যের হৃদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুষোত্তম, এসেছিলে তুমি ভিখারির দেশে ভিখারির ধর মাগি নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে, হে তরুণ বৈরাগী! মর্মে তোমার বাজিত বেদনা আর্ত জীবের লাগি।হে প্রেমিক মহাজন, তোমার পানেতে তাকাইল কোটি দরিদ্রনারায়ণ; অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে বারবার যবে কেঁদে কেঁদে গেল কাতর আঁখির জলে, অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে।কোথা পাপী? তাপী কোথা? ওগো ধ্যানী. তুমি পতিত পাবন যজ্ঞে সাজিলে হোতা! শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু করে দিলে হোম, কোটি পঞ্চমা আতুরের তরে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম, মন্ত্রে তোমার বাজিল বিপুল শানি- স্বসি- ওঁ!সোনার মুকুট ভেঙে ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে! স্বার্থ লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি, যঞ্জের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি, বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিল অংশুমালী!দরিয়ার দেশে নদী! বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল বোধি! হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে, আসিলে করুণাপ্রদীপ হসে- হিংসার অমারাতে, ব্যাধি মন্বন্তরে এলে তুমি সুধাজলধরি সংঘাতে!মহামারী ক্রন্দন ঘুটাইলে তুমি শীতল পরশে, ওগো সুকোমল চন্দন! বজ্রকঠোর, কুসুমদুল, আসিলে লোকোত্তর; হানিলে কুলিশ কখন ও ঢালিলে নির্মল নির্ঝর, নাশিলে পাতক, পাতকীর তুমি অর্পিলে নির্ভর।চক্রগদার সাথে এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম, হে ঋষি, তোমার হাতে; এনেছিলে তুমি ঝড় বিদ্যুৎ পেয়েছিলে তুমি সাম, এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব-শানি- কুসুমদাম; মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নরনারায়ণ-নাম!জয়, তরুণের জয়! আত্মহুতির রক্ত কখনও আঁধারে হয় না লয়! তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে উঠে বারবার! নাহি রে মরণে বিনাশ, শ্মশানে নাহি তার সংহার, দেশে দেশে তার বীণা বাজে-বাজে কালে কালে ঝঙ্কার! বিভিন্ন কোরাস পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থাকে আমাদের আয়ু এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান। হৃদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান; এ রকম একদিন মনে হয়েছিলো; অনেক নিকটে তবু সেই ঘোর ঘনায়েছে আজ; আমাদের উঁচু-নিচু দেয়ালের ভিতরে খোড়লে ততোধিক গুনাগার আপনার কাজ ক'রে যায়;- ঘরের ভিতর থেকে খ'সে গিয়ে সন্তুতির মন বিভীষণ, নৃসিংহের আবেদন পরিপাক ক'রে ভোরের ভিতর থেকে বিকেলের দিকে চ'লে যায়, রাতকে উপেক্ষা ক'রে পুনরায় ভোরে ভিরে আসে;- তবুও তাদের কোনো বাসস্থান নেই, যদিও বিশ্বাসে চোখ বুজে ঘর করেছি নির্মাণ ঢের আগে একদিন;- গ্রাসাচ্ছাদন নেই তবুও তাদের, যদিও মাটির দিকে মুখ রেখে পৃথিবীর ধান রুয়ে গেছি একদিন;- অন্যসব জিনিস হারায়ে, সমস্ত চিন্তার দেশ ঘুরে তবু তাহাদের মন আলোকসামন্য ভাবে সুচিন্তাকে অধিকার ক'রে কোথাও সম্মুখে পথ, পশ্চাদ্‌গমন হারায়েছে- উতরোল নিরবতা আমাদের ঘরে। আমরা তো বহুদিন লক্ষ্য চেয়ে নগরীর পথে হেঁটে গেছি;- কাজ ক'রে চ'লে গেছি অর্থভোগ করে; ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে। গ্রন্থকে বিশ্বাস ক'রে প'ড়ে গেছি; সহধর্মীদের সাথে জীবনের আখড়াই, সাক্ষরের অক্ষরের কথা মনে ক'রে নিয়ে ঢের পাপ ক'রে, পাপকথা উচ্চারণ ক'রে, তবুও বিশ্বাসভ্রষ্ট হ'য়ে গয়ে জীবনের যৌন একাগ্রতা হারাইনি; তবুও কোথাও কোনো প্রীতি নেই এতদিন পরে। নগরীর রাজপথে মোড়ে-মোড়ে চিহ্ন প'ড়ে আছে; একটি মৃতের দেহ অপরের শবকে জড়ায়ে তবুও আতঙ্কে হিম- হয়তো দ্বিতীয় কোনো মরণের কাছে। আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নারী, হেমন্তের হলুদ ফসল ইতস্তত চ'লে যায় যে যাহার স্বর্গের সন্ধানে; কারু মুখে তবুও দ্বিরুক্তি নেই- পথ নেই ব'লে, যথাস্থান থেকে খ'সে তবুও সকলি যথাস্থানে র'য়ে যায়;- শতাব্দীর শেষ হ'লে এ-রকম আবিষ্ট নিয়ম নেমে আসে;- বিকেলের বারান্দার থেকে সব জীর্ণ নরনারী চেয়ে আছে পড়ন্ত রোদের পারে সূর্যের দিকেঃ খণ্ডহীন মণ্ডলের মতো বেলোয়ারি।২নিকটে মরুর মতো মহাদেশ ছড়ায়ে রয়েছেঃ যতদূর চোখ যায়- অনুভব করি; তবু তাকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে ক'রে নিয়ে আমাদের জানালায় অনেক মানুষ, চেয়ে আছে দিনমান হেঁয়ালির দিকে। তাদের মুখের পানে চেয়ে মনে হয় হয়তো বা সমুদ্রের সুর শোনে তারা, ভীত মুখশ্রীর সাথে এ-রকম অনন্য বিস্ময় মিশে আছে;- তাহারা অনেক কাল আমাদের দেশে ঘুরে-ফিরে বেড়িয়েছে শারীরিক জিনিসের মতো; পুরুষের পরাজয় দেখে গেছে বাস্তব দৈবের সাথে রণে; হয়তো বস্তুর বল জিতে গেছে প্রজ্ঞাবশত; হয়তো বা দৈবের অজেয় ক্ষমতা- নিজের ক্ষমতা তার এত বেশি ব'লে শুনে গেছে ঢের দিন আমাদের মুখের ভণিতা; তবুও বক্তৃতা শেষ হ'য়ে যায় বেশি করতালি শুরু হ'লে। এরা তাহা জানে সব। আমাদের অন্ধকারে পরিত্যক্ত ক্ষেতের ফসল ঝাড়ে-গোছে অপরূপ হ'য়ে ওঠে তবু বিচিত্র ছবির মায়াবল। ঢের দূরে নগরীর নাভির ভিতরে আজ ভোরে যাহারা কিছুই সৃষ্টি করে নাই তাহাদের অবিকার মন শৃঙ্খলায় জেগে উঠে কাজ করে,- রাত্রে ঘুমায় পরিচিত স্মৃতির মতন। সেই থেকে কলরব, কাড়াকাড়ি, অপমৃত্যু, ভ্রাতৃবিরোধ, অন্ধকার সংসার, ব্যাজস্তুতি, ভয়, নিরাশার জন্ম হয়। সমুদ্রের পরপার থেকে তাই স্মিতচক্ষু নাবিকেরা আসে; ঈশ্বরের চেয়ে স্পর্শময় আক্ষেপে প্রস্তুত হ'য়ে অর্ধনারীশ্বর তরাইয়ের থেকে লুব্ধ বঙ্গোপসাগরে সুকুমার ছায়া ফেলে সূর্যিমামার নাবিকের লিবিডোকে উদ্বোধিত করে।৩ঘাসের উপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস। অথবা সবুজ বুঝি ঘাস। অথবা নদীর নাম মনে ল'রে নিতে গেলে চারদিকে প্রতিভাত হ'য়ে উঠে নদী দেখা দেয় বিকেল অবধি; অসংখ্য সূর্যের চোখে তরঙ্গের আনন্দে গড়ায়ে ডাইনে আর বাঁয়ে চেয়ে দ্যাখে মানুষের দুঃখ, ক্লান্তি, দীপ্তি, অধঃপতনের সীমা; ঊনিশশো বেয়াল্লিশ সালে ঠেকে পুনরায় নতুন গরিমা পেতে চায় ধোঁইয়া, রক্ত, অন্ধ আঁধারের খাত বেয়ে; ঘাসের চেয়েও বেশী মেয়ে; নদীর চেয়েও বেশি ঊনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ উৎক্রান্ত পুরুষের হাল; কামানের ঊর্ধ্বে রৌদ্রে নীলাকাশে অমল মরাল ভারতসাগর ছেড়ে উড়ে যায় অন্য এক সমুদ্রের পানে- মেঘের ফোঁটার মতো স্বচ্ছ, গড়ানে; সুবাতাস কেটে রাতা পালকের পাখি তবু; ওরা এলে সহসা রোদের পথে অনন্ত পারুলে ইস্পাতের সূচীমুখ ফুটে ওঠে ওদের কাঁধের 'পরে, নীলিমার তলে; অবশেষে জাগরূক জনসাধারণ আজ চলে? রিরাংসা, অন্যায়, রক্ত, উৎকোচ, কানাঘুষো, ভয় চেয়েছে ভাবের ঘরে চুরি বিনে জ্ঞান ও প্রণয়? মহাসাগরের জল কখমো কি সৎবিজ্ঞতার মতো হয়েছিলো স্থির- নিজের জলের ফেনশির নীড়কে কি চিনেছিলো তনুবাত নীলিমার নীচে? না হ'লে উচ্ছল সিন্ধু মিছে? তবুও মিথ্যা নয়ঃ সাগরের বালি পাতালের কালি ঠেলে সময়সুখ্যাত গুণে অন্ধ হ'য়ে, পরে আলোকিত হ'য়ে গেলে। বিস্ময় কখনো বা মৃত জনমানবের দেশে দেখা যাবে বসেছে কৃষাণঃ মৃত্তিকা-ধূসর মাথা আপ্ত বিশ্বাসে চক্ষুষ্মান।কখনো ফুরুনো ক্ষেতে দাঁড়ায়েছে সজারুর গর্তের কাছে; সেও যেন বাবলার কান্ড এক অঘ্রাণের পৃথিবীর কাছে।সহসা দেখেছি তারে দিনশেষেঃ মুখে তার সব প্রশ্ন সম্পূর্ণ নিহত; চাঁদের ও-পিঠ থেকে নেমেছে এ পৃথিবীর অন্ধকার ন্যুব্জতার মতো।সে যেন প্রস্তরখন্ড…স্থির- নড়িতেছে পৃথিবীর আহ্নিক আবর্তের সাথে; পুরাতন ছাতকুড়ো ঘ্রাণ দিয়ে নবীন মাটির ঢেউ মাড়াতে-মাড়াতে।তুমি কি প্রভাতে জাগ? সন্ধ্যায় ফিরে যাও ঘরে? আস্তীর্ণ শতাব্দী ব’হে যায়নি কি তোমার মৃত্তিকাঘন মাথার উপরে?কী তারা গিয়েছে দিয়ে- নষ্ট ধান? উজ্জীবিত ধান? সুষুম্না নাড়ীর গতি-অজ্ঞাত; তবু আমি আরো অজ্ঞান যখন দেখেছি চেয়ে কৃষাণকে বিশীর্ণ পাগড়ী বেঁধে অস্তাক্ত আলোকে গঙ্গাফড়িঙের মতো উদ্বাহু মুকুর উঠেছে জেগে চোখে;-যেন এই মৃত্তিকার গর্ভ থেকে অবিরাম চিন্তারাশি- নব-নব নগরীর আবাসের থাম জেগে অঠে একবার; আর একবার ঐ হৃদয়ের হিম প্রাণায়াম।সময়ঘড়ির কাছে রয়েছে অক্লান্তি শুধুঃ অবিরল গ্যাসে আলো, জোনাকীতে আলো; কর্কট, মিথুন, মীন, কন্যা, তুলা ঘুরিতেছে;- আমাদের অমায়িক ক্ষুধা তবে কোথায় দাঁড়ালো বুনো হাঁস পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে- জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার; এক-দুই-তিন চার-অজস্র-অপার-রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।তারপর পড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ, হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ; উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুককল্পনার হাঁস সব—পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভিতর। বেড়াল সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলই আমার দেখা হয় : গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতর, বাদামি পাতার ভিড়ে; কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর সাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি; কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে, সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলেছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়। হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রং -এর সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে; তারপর অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে সমস্ত পৃথিবীর রভিতর ছড়িয়ে দিল। বেদিয়া চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি! পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি? উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে, গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে; নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী, ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি! কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে, ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে! যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে, কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু! দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্‌দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি! বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস! ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে! তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে, তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে। ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে। তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা, তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা! চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে! যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল, চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল, -তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি, তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি, তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা, তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা! কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে! মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে, মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে! বোধ আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে! স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়! আমি তারে পারি না এড়াতে সে আমার হাত রাখে হাতে;সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়, সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়! সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে! কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার! সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙক্ষায় থেকে, শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, শরীরে জলের গন্ধ মেখে, উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে চাষার মতণ প্রাণ পেয়ে কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে? স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে! পথে চলে পারে — পারাপারে উপেক্ষা করিতে চাই তারে: মড়ার খুলির মতো ধ’রে আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে তবু সে মাথার চারি পাশে! তবু সে চোখের চারি পাশে! তবু সে বুকের চারি পাশে! আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!আমি থামি — সেও থেমে যায়;সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা? জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মতো হয়ে — সন্তানের জন্ম দিতে দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময় কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে; তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন আমার মনের মতো না কি? –তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী!হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল? বালটিকে টানি নি কি জল? কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে? মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে ঘুরিয়াছি; পুকুরের পানা শ্যালা — আঁষটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে গিয়েছে জড়ায়ে; –এই সব স্বাদ –এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ বয়েছে জীবন, নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন একদিন; এই সব সাধ জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ; চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে — ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে, অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে, ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে; আমার সে ভালোবাসিয়াছে, আসিয়াছে কাছে, উপেক্ষা সে করেছে আমারে, ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন ডেকেছি বারেবারে ভালোবেসে তারে; তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা; আমি তার উপেক্ষার ভাষা আমি তার ঘৃণার আক্রোশ অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের দোষে আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা আমি তা ভুলিয়া গেছি; তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা — ।মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ করে। আমি সব দেবতার ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়? অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়? কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন! মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন! শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!এই বোধ — শুধু এই স্বাদ পায় সে কি অগাধ — অগাধ! পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ চায় না সে? করেছে শপথ দেখিবে সে মানুষের মুখ? দেখিবে সে মানুষীর মুখ? দেখিবে সে শিশুদের মুখ? চোখে কালোশিরার অসুখ, কানে যেই বধিরতা আছে, যেই কুঁজ — গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে নষ্ট শসা — পচা চালকুমড়ার ছাঁচে, যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে — সেই সব। ভাষিত আমার এ-জীবনের ভোরবেলা থেকে- সে-সব ভূখণ্ড ছিলো চিরদিন কন্ঠস্থ আমার; একদিন অবশেষে টের পাওয়া গেল আমাদের স’জনার মতো দাঁড়াবারএ-রকম কেন হ’য়ে গেল তবে সব বুদ্ধের মৃত্যুর পরে কল্কি এসে দাঁড়াবার আগে। একবার নির্দেশের ভুল হ’য়ে গেলে আবার বিশুদ্ধ হ’তে কতোদিন লাগে?তাকাতেই উঁচুনিচু দেয়ালের অন্তরঙ্গ দেশ দেখা গেল; কারু তরে সর্বদাই ভীত হ’য়ে আছে এক তিল;- এ-রকম মনে হ’লো বিদ্যুতের মতন সহসা; সাগর- সাগর সে কি- অথবা কপিল? ভিখিরী একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুরবাগানে,         একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো---         তবে আমি হেঁটে চ ’লে যাবো মানে মানে ।         ---ব’ লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত ।আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত; তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত ।একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে, একটি পয়সা পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,         একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো---         তাহ ’লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা ।         ব ’লে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ । ভিড়ের ভিতরে তবু--- হ্যারিসন রোডে আরো গভীর অসুখ, এক পৃথিবীর ভুল;ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক । ভিখিরী একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো– তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে মানে। –ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত। আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত; তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত। একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা। বলে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ। ভিড়ের ভিতরে তবু — হ্যারিসন রোডে —আরো গভীর অসুখ, এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক। ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ দুপুর ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর — চিল একা নদীটির পাশে জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে; পায়রা গিয়েছে উড়ে তবু চরে, খোপে তার; — শসাতাটিকে, ছেড়ে গেছে মৌমাছি; — কালো মঘে জমিয়াছে মাঘের আকাশে, মরা প্রজাতিটির পাখার নরম রেণু ফেলে দিয়ে ঘাসে পিঁপড়েরা চলে যায়; — দুই দন্ড আম গাছে শালিখে — শালিখে ঝুটোপুটি, কোলাহল — বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে ডাকে নাকো-হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালে পলাশেহারায়েছে; বউ উঠানে নাই — প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি; ধান কে কুটবে বলো-কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান, রোদেও শুকাতে সে যে আসে নাকো চুল তার — করে নাকে স্নান এ-পুকুরে — ভাঁড়ারে ধানের বীজ কলায়ে গিয়েছে তার দেখি, তবুও সে আসে নাকে; আজ এ দুপুরে এসে খই ভাজিবে কি? হে চিল, সোনালি চিল, রাঙা রাজকন্যা আর পাবে না কি প্রাণ? ভেবে ভেবে ব্যথা পাব ভেবে ভেবে ব্যথা পাব: মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি – এমনি লাজুক পাখি, — ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে; যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি?শিউলির বাবলার আঁধার গলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো করে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোটো — ছোঁটো ছেলেমেয়ে বউদের প্রাণ ভুলে যায়; অন্ধকার খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারালো মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার জানে না সন্ধ্যান।আর সেই সোনালি চিলের ডানা — ডানা তার আজো কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে; — সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজও চ’লে যায় সন্ধ্যা সোনার মত হলে? ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়? আশ্চর্য বিষ্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধাকার বিছানার কোলে। ভোর ও ছয়টি বমারঃ ১৯৪২ কোথাও বাইরে গিয়ে চেয়ে দেখি দু'চারটে পাখি। ঘাসের উপরে রোদে শিশিরে শুকায় নিজেদের ক্ষেতে ধান- চার পাঁচজন লোক             মানবের মতন একাকী। মাটিরও তরঙ্গ স্বর্গীয় জ্যামিতির প্রত্যাশায় মিশে গেছে অতীত ও আজকের সমস্ত আকাশে।দিগন্তে কি ধর্মঘট?- চিম্‌নি... পাখির মতন অনায়াসে নীলিমায় ছড়ায়েছে। এখানে নদীর স্থির কাকচক্ষু জলে ঘুরুনো সিঁড়ির মত আকাশ পর্যন্ত মেঘ সব উঠে গেছে।- অনুভব করে প্রকৃতির সাথে মিলিত হতেই, অমিলনের সূর্যরোল জ্যোতির্ময় এলুমিনিয়ম অনুভব ক'রে আমি দুই তিন চার পাঁচ ছয়টি এরোপ্লেন গুনে নীলিমা দেখার ছিলে শতাব্দীর প্রেতাত্মাকে দেখছি অরুণে। ভোর হয় ভোর হয়, কি যেন আমাকে দিতে চায় শেষরাত— কোন আভা, পূর্বাভাস? হয়তোবা শেষরাত আমাকে দিতে চায় তার ভোর হয়ে ওঠা। নিদ্রা থেকে জেগে ওঠা পাখি, দু’ একবার ডাক দিয়ে, চুপ ক’রে থেকে নিজ অনুক্রমিক ডাকের মধ্যকার নীরবতা মন দিয়ে শোনে; তারপর পুনরায় ডাকে। তুমি দেখো শব্দ অনুক্রমিক, অস্থায়ী, কিন্তু দু’টি শব্দের মধ্যকার নীরবতা স্থায়ী, স্থায়ী। শেষরাতে কোনো ধ্বনি একটানা নয় সব ধ্বনি প্রতিধ্বনিহীন— থেমে-থেমে ডাকে ডাকের মাঝখানের কসমিক স্থির নীরবতা সব ধ্বনি থেমে-থেমে, কান পেতে, শোনে। গাছে গাছে পল্লবের মধ্যখানে শূন্য...শূন্যস্থান, রাত্রিভর জেগে থাকা মানুষের চোখ ভেদ ক’রে, গভীর আত্মার মধ্যে, বেদনার মধ্যে, ঢুকে যায়। কোনও বাস্তবতা থেকে ছিটকে এসে জল স্বপ্ন-মধ্যে ঢোকে শেষরাতে। সকাল নদীতে আগে হয়। গড়িয়ে গড়িয়ে নদী থেকে উঠে আসা কুয়াশার ভেপু— দশদিকে শোনা গেলে, মাটিতে, ভূমিতে, ভোর হয়... এ শহর কসমিক শেষরাত পার হয়ে কসমপলিটন হয়ে ওঠে। তখন তোমাকে ভোর, অন্ধকার কেটে যাওয়া গভীর সুস্থতা, মানুষের জ্ঞানের চেয়ে ভিন্ন জ্ঞান, আলো, অন্য এক সুস্থিরতা, পরম আনন্দ দিতে চায়। তোমার ভিতরে শূন্যস্থান— আরো বহু ভিতরের শূন্যস্থান থেকে এসে শেষরাতে— ভোরবেলা, যেন, পূর্ণ হয়… যেন, সত্যি পূর্ণ হয়।— (অগ্রন্থিত কবিতা) মকরসংক্রান্তি প্রাণে তুমি আমার মনে এলে। বালুঘড়ি বিকল রাতের বেলা। থেকে থেকে পড়ছে মনে সে কোন ধূসর বেবিলনে কবের গ্রীসের অলিভবনে তোমার সাথে সূর্যতীরে হয়েছিলো খেলা।জানি সবই ফুরিয়ে গেলে অতল সনাতনে থেকে থেকে তাঁবা নদীর অতল উৎসারণে জলদেবীর মতন জেগে জানিয়ে গেছ তুমি চম্পা কনকবতী এখন সুধার মরুভূমি মরুভূমি-মরীচিকা-মায়ামৃগের খেলা।তবুও আবার সূর্য নিয়ে এলো রজনী আমার-তোমার-আধুনিকের শতঘ্নী আঘাত জননটের মতন নেচে-কবে কী হারাল-সে কার মনে রবে তোমার-আমার- সে কার অবহেলা। মকরসংক্রান্তির রাতে (আবহমান ইতিহাসচেতনা একটি পাখির মতো যেন)কে পাখি সূর্যের থেকে সূর্যের ভিতরে নক্ষত্রের থেকে আরো নক্ষত্রের রাতে আজকের পৃথিবীর আলোড়ন হৃদয়ে জাগিয়ে আরো বড়ো বিষয়ের হাতে সে সময় মুছে ফেলে দিয়ে কি এক গভীর সুসময়! মকরক্রান্তির রাত অন্তহীন তারায় নবীন: –তবুও তা পৃথিবীর নয়; এখন গভীর রাত, হে কালপুরুষ, তবু পৃথিবীর মনে হয়।শতাব্দীর যে-কোনো নটীর ঘরে নীলিমার থেকে কিছু নীচে বিশুদ্ধ মুহূর্ত তার মানুষীর ঘুমের মতন; ঘুম ভালো–মানুষ সে নিজে ঘুমাবার মতন হৃদয় হারিয়ে ফেলেছে তবু। অবরুদ্ধ নগরী কি? বিচূর্ণ কি? বিজয়ী কি? এখন সময় অনেক বিচিত্র রাত মানুষের ইতিহাস শেষ ক’রে তবু রাতের স্বাদের মতো সপ্রতিভ বলে মনে হয়। মানুষের মৃত্যু, ক্ষয়, প্রেম বিপ্লবের ঢের নদীর নগরে এই পাখি আর এই নক্ষত্রেরা ছিলো মনে পড়ে।মকরক্রান্তির রাতে গভীর বাতাস। আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র নিজ মুখ চেনাবার মতন একান্ত ব্যাপ্ত আকাশকে পেয়ে গেছে আজ। তেমনি জীবনপথে চলে যেতে হ’লে তবে আর দ্বিধা নেই–পৃথিবী ভঙ্গুর হ’য়ে নিচে রক্তে নিভে যেতে চায়; পৃথিবী প্রতিভা হ’য়ে আকাশের মতো এক শুভ্রতায় নেমে নিজেকে মেলাতে গিয়ে বেবিলন লণ্ডন দিল্লি কলকাতার নক্টার্নে অভিভূত হয়ে গেলে মানুষের উত্তরণ মাঝপথে থেমে মহান তৃতীয় অঙ্কেঃ গর্ভাঙ্কে তবুও লপ্ত হ’য়ে যাবে না কি!– সূর্যে আরো নব সূর্যে দীপ্ত হ’য়ে প্রাণ দাও–প্রাণ দাও পাখি। মনমর্মর আমার মনের ভিতরে ছায়া আলো এসে পড়ে; যেইসব অনুভূতি ঝরে গেছে তাদের কঙ্কাল নদীকে দিয়েছি আমি-বিকেলকে-নক্ষত্রের দাহনে বিশাল আকাশকে; ফিরে আসে নবদিকচিহ্ন নিয়ে মর্মের ভিতরে।সময়ের ঢের উৎস গ্রন্থ ছবি মননের পদ্ধতি সব নিয়ে যায় হৃদয়কে যেন কোন্‌ শেষ অনুশীলনের পানে; অন্তহীন অন্ধকার রয়ে গেছে হয়তো সেখানে: অসীম আলোর মতো তবুও করেছি অনুভব। মনে হয় একদিন আকাশের মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর; দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন, শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ; সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তারজানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না… আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না- মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ? মনোকণিকা ও. কে.একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো; একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে; একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো; তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে।বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব।অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে অপরের নিয়মে নীরব।মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়; সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়; সব দিক ও. কে.।সাবলীলআকাশে সূৰ্যের আলো থাকুক না— তবু— দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে। আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই। মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।মাঝে-মাঝে পুরুষাৰ্থ উত্তেজিত হ’লে— (এ রকম উত্তেজিত হয়;) উপস্থাপয়িতার মতন অামাদের চায়ের সময়এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে। সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম; এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম।এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল: প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়— অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল।মানুষ সর্বদা যদিমানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো— (স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে), অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো, পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে, সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি যেমন সে প্রায়শই করে, পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা, অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে।চার্বাক প্রভৃতি—‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়, মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়। তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল, চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর; অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা— অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।সমুদ্রতীরেপৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের অালোর পথে এসে জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে। এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে; তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।   (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ) মনোবীজ জামিরের ঘন বন অইখানে রচেছিলো কারা? এইখানে লাগে নাই মানুষের হাত। দিনের বেলায় যেই সমারূঢ় চিন্তার আঘাত ইস্পাতের আশা গড়ে- সেই সব সমুজ্জ্বল বিবরণ ছাড়াযেন আর নেই কিছু পৃথিবীতেঃ এই কথা ভেবে যাহারা রয়েছে ঘুমে তুলীর বালিশে মাথা গুঁজে; তাহারা মৃত্যুর পর জামিরের বনে জ্যোৎস্না পাবে নাকো খুঁজে; বধির-ইস্পাত খড়্গ তাহাদের কোলে তুলে নেবে। সেই মুখ এখনও দিনের আলো কোলে নিয়ে করিতেছে খেলাঃ যেন কোনো অসংগতি নেই- সব হালভাঙা জাহাজের মতো সমন্বয় সাগরে অনেক রৌদ্র আছে ব’লে;- পরিব্যস্ত বন্দরের মতো মনে হয় যেন এই পৃথিবীকে;- যেখানে অঙ্কুশ নেই তাকে অবহেলা করিবে সে আজো জানি;- দিনশেষে বাদুড়ের-মতন-সঞ্চারে তারে আমি পাবো নাকো;- এই রাতে পেয়ারার ছায়ার ভিতরে তারে নয়- স্নিগ্ধ সব ধানগন্ধী প্যাঁচাদের প্রেম মনে পড়ে। মৃত্যু এক শান্ত ক্ষেত- সেইখানে পাবো নাকো তারে।পৃথিবীর অলিগলি বেয়ে আমি কত দিন চলিলাম। ঘুমালাম অন্ধকারে যখন বালিশেঃ নোনা ধরে নাকো সেই দেওয়ালের ধূসর পালিশে চন্দ্রমল্লিকার বন দেখিলাম রহিয়াছে জ্যোৎস্নায় মিশে। যেই সব বালিহাঁস ম’রে গেছে পৃথিবীতে শিকারির গুলির আঘাতেঃ বিবর্ণ গম্বুজে এসে জড়ো হয় আকাশের চেয়ে বড়ো রাতে; প্রেমের খাবার নিয়ে ডাকিলাম তারে আমি তবুও সে নামিল না হাতে।পৃথিবীর বেদনার মতো ম্লান দাঁড়ালামঃ হাতে মৃত সূর্যের শিখা; প্রেমের খাবার হাতে ডাকিলাম; অঘ্রাণের মাঠের মৃত্তিকা হ’য়ে গেলো; নাই জ্যোৎস্না- নাই কো মল্লিকা।সেই সব পাখি আর ফুলঃ পৃথিবীর সেই সব মধ্যস্থতা আমার ও সৌন্দর্যের শরীরের সাথে ম্যমির মতনও আজ কোনোদিকে নেই আর; সেই সব শীর্ণ দীর্ঘ মোমবাতি ফুরায়েছে আছে শুধু চিন্তার আভার ব্যবহার। সন্ধ্যা না-আসিতে তাই হৃদয় প্রবেশ করে প্যাগোডার ছায়ার ভিতরে                              অনেক ধূসর বই নিয়ে।চেয়ে দেখি কোনো-এক আননের গভীর উদয়ঃ সে-আনন পৃথিবীর নয়। দু-চোখ নিমীল তার কিসের সন্ধানে? ‘সোনা- নারী- তিশি- আর ধানে’- বলিল সেঃ ‘কেবল মাটির জন্ম হয়।’ বলিলামঃ ‘তুমিও তো পৃথিবীর নারী, কেমন কুৎসিত যেন,- প্যাগোডার অন্ধকার ছাড়ি শাদা মেঘ-খরশান বাহিরে নদীর পারে দাঁড়াবে কি?’‘শানিত নির্জন নদী’- বলিল সে- ‘তোমারি হৃদয়, যদিও তা পৃথিবীর নাদী- ন্দী নয়ঃ তোমারি চোখের স্বাদে ফুল আর পাতা জাগে না কি? তোমারি পায়ের নিচে মাথা রাখে না কি? বিশুস্ক- ধূসর- ক্রমে-ক্রমে মৃত্তিকার কৃমিদের স্তর যেন তারা; -অপ্সরা –উর্বশী তোমার উৎকৃষ্ট মেঘে ছিলো না কি বসি? ডাইনির মাংসের মতন আজ তার জঙ্ঘা আর স্তন; বাদুড়ের খাদ্যের মতন একদিন হ’য়ে যাবে; যে-সব মাছিরা কালো মাংস খায়- তারে ছিঁড়ে খাবে।’ কান্তারের পথে যেন সৌন্দর্যের ভূতের মতন তাহারে চকিত আমি করিলাম;- রোমাঞ্চিত হ’য়ে তার মন ব’লে গেলোঃ ‘তক্ষিত সৌন্দর্য সব পৃথিবীর উপনীত জাহাজের মাস্তুলের সুদীর্ঘ শরীর নিয়ে আসে একদিন, হে হৃদয়,- একদিন দার্শনিকও হিম হয়- প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীরা হবে না মলিন?’ কল্পনার অবিনাশ মহনীয় উদ্‌গিরণ থেকে আসিল সে হৃদয়ের। হাতে হাত রেখে বলিল সে। মনে হ’লো পাণ্ডুলিপি মোমের পিছনে রয়েছে সে। একদিন সমুদ্রের কালো আলোড়নে উপনিষদের শাদা পাতাগুলো ক্রমে ডুবে যাবে; ল্যাম্পের আলো হাতে সেদিন দাঁড়াবে অনেক মেধাবী মুখ স্বপ্নের বন্দরের তীরে, যদিও পৃথিবী আজ সৌন্দর্যেরে ফেলিতেছে ছিঁড়ে। মনোসরণি মনে হয় সমাবৃত হয়ে আছি কোন্‌ এক অন্ধকার ঘরে– দেয়ালের কর্নিশে মক্ষিকারা স্থিরভাবে জানে : এইসব মানুষেরা নিশ্চয়তা হারায়েছে নক্ষত্রের দোষে; পাঁচফুট জমিনের শিষ্টতায় মাথা পেতে রেখেছে আপোষে।হয়তো চেঙ্গিস আজও বাহিরে ঘুরিতে আছে করুণ রক্তের অভিযানে। বহু উপদেশ দিয়ে চলে গেলে কনফুশিয়াস– লবেজান হাওয়া এসে গাঁথুনির ইঁট সব ক’রে ফেলে ফাঁস।বাতাসে ধর্মের কল ন’ড়ে ওঠে–ন’ড়ে চলে ধীরে। সূর্যসাগরতীরে মানুষের তীক্ষ্ন ইতিহাসে কত কৃষ্ণ জননীর মৃত্যু হ’ল রক্তে–উপেক্ষায়; বুকের সন্তান তবু নবীন সংকল্পে আজো আসে। সূর্যের সোনালি রশ্মি, বোলতার স্ফটিক পাখনা, মরুভূর দেশে যেই তৃণগুচ্ছ বালির ভিতরে আমাদের তামাশার প্রগল্‌ভতা হেঁট শিরে মেনে নিয়ে চুপে তবু দুই দন্ড এই মৃত্তিকার আড়ম্বর অনুভব করে, যে সারস-দম্পতির চোখে তীক্ষ্ন ইস্পাতের মতো নদী এসে ক্ষণস্থায়ী প্রতিবিম্বে–হয়তো বা ফেলেছিলো সৃষ্টির আগাগোড়া শপথ হারিয়ে, যে বাতাস সারাদিন খেলা করে অরণ্যের রঙে, যে বনানী সুর পায়–আর যারা মানবিক ভিত্তি–গ’ড়ে–ভেঙ্গে গেলো বারবার– হয়তো বা প্রতিভার প্রকম্পনে–ভুল ক’রে–বধ ক’রে–প্রেমে– সূর্যের স্ফটিক আলো স্তিমিত হ’বার আগে সৃষ্টির পারে সেইসব বীজ আলো জন্ম পায় মৃত্তিকা অঙ্গারে। পৃথিবীকে ধাত্রীবিদ্যা শিখায়েছে যারা বহুদিন সেই সব আদি অ্যামিবারা আজ পরিহাসে হয়েছে বিলীন। সূর্যসাগরতীরে তবুও জননী ব’লে সন্ততিরা চিনে নেবে কারে।। মরীচিকার পিছে- ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে ছুটে যায় দুটি আঁখি! -কত দূর হায় বাকি! উধাও অশ্ব বগ্লাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে পথে পথে তার বাধা জমে যায়-তবু সে আসে না ফিরে!দূরে-দূরে আরো দূরে-আরো দূরে, অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ সীমানা জুড়ে ভাসিয়াছে মরুতৃষা! -হিয়া হারায়েছে দিশা! কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে কোন্‌ দিগন্তে নির্জন কোন্‌ মৌন মায়াবী-পুরে!কোন্‌-এক সুনীল দরিয়া সেথায় উত্থলিছে অনিবার! -কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার, ছোটে অঞ্জলি পেতে, তৃষার নেশায় মেতে, উষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার! খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি! যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি, নিমেষে গিয়েছে ভেঙে স্বপন-আবেশে রেঙে আঁখিদুটি তার জৌলস্‌ রাঙা হ’য়ে গেছে রাতারাতি! কোন্‌ যেন এক জিন্‌-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।কোন্‌ যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে! পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে! গেঁথে গোলাপের মালা তাকায়ে রয়েছে বালা, বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস্‌ কালো পশমিনা চুলে! বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে।ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত জর্জর, চারি দিকে তার বালুর পাথার-মরুর হাওয়ার ঝড়; নাহি শ্রান্তির লেশ, সুদুর নিরুদ্দেশ- অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের পর! পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়! চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়! ঝড়ের বাতাস মিছে ছুটছে তাহার পিছে! মরুভূর প্রেত চকমিয়া তার চক্ষের পানে চায়- সুরার তালাসে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়! মরুতৃণোজ্জ্বলা হেঁয়ালি রেখো না কিছু মনে; হৃদয় রয়েছে ব’লে চাতকের মতন আবেগ হৃদয়ের সত্য উজ্জ্বল কথা নয়,- যদিও জেগেছে তাতে জলভারানত কোনো মেঘ; হে প্রেমিক, আত্মরতিমদির কি তুমি? মেঘ;মেঘ, হৃদয়ঃ হৃদয়, আর মরুভূমি শুধু মরুভূমিএই বিশ্বের এই শুধু আর্য সমাধান; বাকি সব অনিয়ম, শূন্য, অন্ধকার; নিখিলের পাশাপাশি দ্বিতীয় আধার অন্য এক নিখিলের- অন্য এক নিখিলের তুমি; মেঘঃ মেঘ,হৃদয়ঃ হৃদয়, আর মরুতৃণোজ্জ্বল মরুভূমি মরুবালু হাড়ের মালা গলায় গেঁথে – অট্টহাসি হেসে উল্লাসেতে টলছে তারা,—জ্বলছে তারা খালি ! ঘুরছে তারা লাল মশানে কপাল—কবর ঘেঁসে , বুকের বোমাবারুদ দিয়ে আকাশটারে জ্বালি পাঁয়জোরে কাল মহাকালের পাঁজর ফেড়ে ফেড়ে মড়ার বুকে চাবুক মেরে ফিরছে মরুর বালি ! সর্বনাশের সঙ্গে তোরা দম্ভে খেলিস পাশা হেথায় কোন এক সৃষ্টিপাতের সূত্রপাতের ভূমি , —শিশু মানব গড়েছিল ঐ সাহারায় বাসা ; —সে সব গেছে কবে ঘুমের চুমার ধোঁয়ায় ধূমি ! অটল আকাশ যাচ্ছে জরির ফিতার মতো ফেড়ে , জবান তোদের জ্বলছে যমের চিতার গেলাস চুমি ! তোদের সনে ‘ডাইনোসুরে’র লড়াই হলো কত,- আলুথালু লুটিয়ে বালুর ডাইনী ছায়ার তলে আজকে তারা ঘুমিয়া আছে ,—চুল্লি শত শত উঠলো জ্বলে তাদের হাড়ে ,—তাদের নাড়ের বলে ; কাঁদছে খাঁ খাঁ কাফন-ঢাকা বালুর চাকার নিচে , মুণ্ড তাদের ,—মড়ার কপাল ভৈরবেরি গলে! তোদের বুকে জাগছে মৃগতৃষ্ণা ,—জাগে ঝর! নিস উড়িয়ে শিকার—সোয়ার ধোঁয়ার পিছে পিছে ,- মেঘে মেঘে চড়াও ,—বাজের বুক চিরে চক্কর ! নাচতে আছিস আকাশখানার গোখরাফণার নিচে, আরব মিশর চীন ভারতের হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ! সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হাপর খিঁচে খিঁচে ! তোদের ভাষা আস্ফালিছে শেখ সেনানীর বুকে! -লাল সাহারার শেরের সোয়ার ,—বালুর ঘায়ে ঘেয়ো , ধমক মেরে আঁধির বুকে ছুটছে রুখে রুখে! -তোদের মতো নেইকো তাদের সোদর—সাথী কেহ , নেইকো তাদের মোদের মতন পিছুডাকের মায়া, নেইকো তাদের মোদের মতন আর্ত মোহ-স্নেহ ! দানোয়-পাওয়া আগুনদানা ,—দারুণ পথের মুখে ! ঘায়েল করি মেঘের বুরুজ বল্লমেরি ঘর, উড়িয়া হাজার ‘ক্যারাভেন’ ও তাম্বুশিবির বুকে , উজিয়ে মরীচিকার শিখা – কালফণা জর্জর , —টলতে আছিস ,—দলতে আছিস ,—জ্বলতে আছিস ধূ ধূ ! সঙ্গে স্যাঙাত-মসুদ ডাকাত ,—তাতার যাযাবর ! গাড়তে যাবো যারা তোদের বুকের মাঝে বাসা হাড্ডি তাদের ফোফরা হ’য়ে ঝুরবে বালুর মাঝে , এইখানেতে নেইকো দরদ,-নেইকো ভালোবাসা , বর্শা লাফায় ,—উটের গলায় ঘণ্টি শুধু বাজে ! ফুরিয়ে গেছে আশা যাদের,—জুড়িয়ে গেছে জ্বালা , আয় রে বালুর ‘কারবালা’তে, অন্ধকারের ঝাঁঝে ! মহাগোধূলি সোনালী খড়ের ভারে অলস গোরুর গাড়ি—বিকেলের রোদ প’ড়ে আসে কালো নীল হলদে পাখিরা ডানা ঝাপটায় ক্ষেতের ভাঁড়ারে, শাদা পথ ধুলো মাছি—ঘুম হয়ে মিশিছে আকাশে, অস্ত-সূর্য গা এলিয়ে অড়র ক্ষেতের পারে-পারেশুয়ে থাকে; রক্তে তার এসেছে ঘুমের স্বাদ এখন নির্জনে; আসন্ন এ-ক্ষেতটিকে ভালো লাগে—চোখে অগ্নি তার নিভে-নিভে জেগে ওঠে;—স্নিগ্ধ কালো অঙ্গারের গন্ধ এসে মনে একদিন আগুনকে দেবে নিস্তার।কোথায় চার্টার প্যাক্ট কমিশন প্ল্যান ক্ষয় হয়; কেন হিংসা ঈর্ষা গ্লানি ক্লান্তি ভয় রক্ত কলরবঃ বুদ্ধের মৃত্যুর পরে যেই তন্বী ভিক্ষুণীকে এই প্রশ্ন আমার হৃদয় ক’রে চুপ হয়েছিল—আজও সময়ের কাছে তেমনই নীরব। মহাগ্রহণ অনেক সংকল্প আশা নিভে মুছে গেল; হয়তো এমনই শুরু হবে। আজকের অবস্থান ফুরিয়ে যাবে কি নতুন ব্যাপ্তির অনুভবে। মানুষ এ পৃথিবীতে ঢের দিন আছে; সময়ের পথে ছায়া লীন হয়নি এখনও তার, তবুও সে মরুর ভিতরে একটি বৃক্ষের মত যেন যুক্তিহীন; সফলতা অন্বেষণ ক’রে হারিয়ে ফেলেছে প্রাণ, নিকেতন, জল; প্রেম নেই, শূন্যলোকে সত্য-লাভ তার অর্ধসত্য অসত্যের মতন নিস্ফল। ভুলের ভিতর থেকে ভুলে গ্লানির ভিতর থেকে গ্লানির ভিতরে মানুষ যে গ্রহণের সূর্যে চলেছে তা; তবে শাশ্বত গ্রহণ সৃষ্টি করে!কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী মহাত্মা গান্ধী অনেক রাত্রির শেষে তারপর এই পৃথিবীকে ভালো ব’লে মনে হয়;—সময়ের অমেয় আঁধারে জ্যোতির তারণকণা আসে, গভীর নারীর চেয়ে অধিক গভীরতর ভাবে পৃথিবীর পতিতকে ভালোবাসে, তাই সকলেরই হৃদয়ের ’পরে এসে নগ্ন হাত রাখে; আমরাও আলো পাই—প্রশান্ত অমল অন্ধকার মনে হয় আমাদের সময়ের রাত্রিকেও।একদিন আমাদের মর্মরিত এই পৃথিবীর নক্ষত্র শিশির রোদ ধূলিকণা মানুষের মন অধিক সহজ ছিল—শ্বেতাশ্বতর যম নচিকেতা বুদ্ধদেবের। কেমন সফল এক পর্বতের সানুদেশ থেকে ঈশা এসে কথা ব’লে চ’লে গেল—মনে হল প্রভাতের জল কমনীয় শুশ্রূষার মতো বেগে এসেছে এ পৃথিবীতে মানুষের প্রাণ আশা ক’রে আছে ব’লে—চায় ব’লে,- নিরাময় হ’তে চায় ব’লে।পৃথিবীর সেই সব সত্য অনুসন্ধানের দিনে বিশ্বের কারণশিল্পের অপরূপ আভার মতন আমাদের পৃথিবীর হে আদিম ঊষাপুরুষেরা, তোমারা দাঁড়িয়েছিলে, মনে আছে, মহাত্মার ঢের দিন আগে; কোথাও বিজ্ঞান নেই, বেশি নেই, জ্ঞান আছে তবু; কোথাও দর্শন নেই, বেশি নেই; তবুও নিবিড় অন্তভের্দী দৃষ্টিশক্তি র’য়ে গেছেঃ মানুষকে মানুষের কাছে ভালো স্নিগ্ধ আন্তরিক হিত মানুষের মতো এনে দাঁড় করাবার; তোমাদের সে-রকম প্রেম ছিল,বহ্নি ছিল, সফলতা ছিল। তোমাদের চারপাশে সাম্রাজ্য রাজ্যের কোটি দীন সাধারণ পীড়িত এবং রক্তাক্ত হয়ে টের পেত কোথাও হৃদয়বত্তা নিজে নক্ষত্রের অনুপম পরিসরে হেমন্তের রাত্রির আকাশ ভ’রে ফেলে তারপর আত্মঘাতী মানুষের নিকটে নিজের দয়ার দানের মতো একজন মানবীয় মহানুভবকে পাঠাতেছে,—প্রেম শান্তি আলো এনে দিতে,—মানুষের ভয়াবহ লৌকিক পৃথিবী ভেদ ক’রে অন্তঃশীলা করুণার প্রসারিত হাতের মতন।তারপর ঢের দিন কেটে গেছে;- আজকের পৃথিবীর অবদান আরেক রকম হয়ে গেছে; যেই সব বড়-বড় মানবেরা আগেকার পৃথিবীতে ছিল তাদের অন্তর্দান সবিশেষ সমুজ্জ্বল ছিল, তবু আজ আমাদের পৃথিবী এখন ঢের বহিরাশ্রয়ী। যে সব বৃহৎ আত্মিক কাজ অতীতে হয়েছে- সহিষ্ণুতায় ভেবে সে-সবের যা দাম তা সিয়ে তবু আজ মহাত্মা গান্ধীর মতো আলোকিত মন মুমুক্ষার মাধুরীর চেয়ে এই আশ্রিত আহত পৃথিবীর কল্যাণের ভাবনায় বেশি রত; কেমন কঠিন ব্যাপক কাজের দিনে নিজেকে নিয়োগ ক’রে রাখে আলো অন্ধকারে রক্তে—কেমন শান্ত দৃঢ়তায়।এই অন্ধ বাত্যাহত পৃথিবীকে কোনো দূর স্নিগ্ধ অলৌকিক তনুবাত শিখরের অপরূপ ঈশ্বরের কাছে টেনে নিয়ে নয়—ইহলোক মিথ্যা প্রমাণিত ক’রে পরকাল দীনত্মা বিশ্বাসীদের নিধান স্বর্গের দেশ ব’লে সম্ভাষণ ক’রে নয়- কিন্তু তার শেষ বিদায়ের আগে নিজেকে মহাত্মা জীবনের ঢের পরিসর ভ’রে ক্লান্তিহীন নিয়োজনে চালায়ে নিয়েছে পৃথিবীরই সুধা সূর্য নীড় জল স্বাধীনতা সমবেদনাকে সকলকে—সকলের নিচে যারা সকলকে সকলকে দিতে।আজ এই শতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধীর সচ্ছলতা এ-রকম প্রিয় এক প্রতিভাদীপন এনে সকলের প্রাণ শতকের আঁধারের মাঝখানে কোনো স্থিরতর নির্দেশের দিকে রেখে গেছে; রেখে চ’লে গেছে-ব’লে গেছেঃ শান্তি এই, সত্য এই।হয়তো-বা অন্ধকারই সৃষ্টির অন্তিমতম কথা; হয়তো-বা রক্তেরই পিপাসা ঠিক, স্বাভাবিক- মানুষও রক্তাক্ত হতে চায়;- হয়তো-বা বিপ্লবের মানে শুধু পরিচিত অন্ধ সমাজের নিজেকে নবীন ব’লে—অগ্রগামী(অন্ধ) উত্তেজের ব্যাপ্তি ব’লে প্রচারিত করার ভিতর; হয়তো-বা শুভ পৃথিবীর কয়েকটি ভালো ভাবে লালিত জাতির কয়েকটি মানুষের ভালো থাকা—সুখে থাকা—রিরংসারক্তিম হয়ে থাকা; হয়তো-বা বিজ্ঞানের, অগ্রসর, অগ্রস্মৃতির মানে এই শুধু, এই!চারিদিকে অন্ধকার বেড়ে গেছে—মানুষের হৃদয় কঠিনতর হয়ে গেছে; বিজ্ঞান নিজেকে এসে শোকাবহ প্রতারণা ক’রেই ক্ষমতাশালী দেখ; কবেকার সরলতা আজ এই বেশি শীত পৃথিবীতে—শীত; বিশ্বাসের পরম সাগররোল ঢের দূরে স’রে চ’লে গেছে; প্রীতি প্রেম মনের আবহমান বহতার পথে যেই সব অভিজ্ঞতা বস্তুত শান্তির কল্যাণের সত্যিই আনন্দসৃষ্টির সে-সব গভীর জ্ঞান উপেক্ষিত মৃত আজ, মৃত, জ্ঞানপাপ এখন গভীরতর ব’লে; আমরা অজ্ঞান নই—প্রতিদিনই শিখি, জানি, নিঃশেষে প্রচার করি, তবু কেমন দুরপনেয় স্খলনের রক্তাক্তের বিয়োগের পৃথিবী পেয়েছি।তবু এই বিলম্বিত শতাব্দীর মুখে যখন জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানের প্রশ্রয় ঢের বেড়ে গিয়েছিল, যখন পৃথিবী পেয়ে মানুষ তবুও তার পৃথিবীকে হারিয়ে ফেলেছে, আকাশে নক্ষত্র সূর্য নীলিমার সফলতা আছে,- আছে, তবু মানুষের প্রাণে কোনো উজ্জ্বলতা নেই, শক্তি আছে, শান্তি নেই, প্রতিভা রয়েছে, তার ব্যবহার নেই।প্রেম নেই, রক্তাক্ততা অবিরল, তখন তো পৃথিবীতে আবার ঈশার পুনরুদয়ের দিন প্রার্থনা করার মতো বিশ্বাসের গভীরতা কোনো দিকে নেই; তবুও উদয় হয়—ঈশা নয়—ঈশার মতন নয়—আজ এই নতুন দিনের আর-এক জনের মতো; মানুষের প্রাণ থেকে পৃথিবীর মানুষের প্রতি যেই আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ফিরে আসে, মহাত্মা গান্ধীকে আস্থা করা যায় ব’লে; হয়তো-বা মানবের সমাজের শেষ পরিণতি গ্লানি নয়; হয়তো-বা মৃত্যু নেই, প্রেম আছে, শান্তি আছে—মানুষের অগ্রসর আছে; একজন স্থবির মানুষ দেখ অগ্রসর হয়ে যায় পথ থেকে পথান্তরে—সময়ের কিনারার থেকে সময়ের দূরতর অন্তঃস্থলে;—সত্য আছে, আলো আছে; তবুও সত্যের                                 আবিষ্কারে। আমরা আজকে এই বড় শতকের মানুষেরা সে-আলোর পরিধির ভিতরে পড়েছি। আমাদের মৃত্যু হয়ে গেলে এই অনিমেষ আলোর বলয় মানবীয় সময়কে হৃদয়ে সফলকাম সত্য হতে ব’লে জেগে র’বে; জয়, আলো সহিষ্ণুতা স্থিরতার জয়। মহিলা এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো; এইখানে এসে প’ড়ে- থেমে গেলে- একটি নারীকে কোথাও দেখেছি ব’লে স্বভববশত মনে হয়;- কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে; এইখানে সে-দিন সে হেঁটেছিলো,- আজো ঘুরে যায়; এর চেয়ে বেশি ব্যাখ্যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিতে পারে, অনিত্য নারীর রূপ বর্ণনায় যদিও সে কুটিল কলম নিয়োজিত হয় নাই কোনোদিন- তবুও মহিলা মা ম’রে অমর যারা তাহাদের স্বর্গীয় কাপড় কোচকায়ে পৃথিবীর মসৃণ গিলা অন্তরঙ্গ ক’রে নিয়ে বানায়েছে নিজের শরীর। চুলের ভিতরে উঁচু পাহাড়ের কুসুম বাতাস। দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন ধারণ করেছে তার শরীরের ফাঁস। চিতাবাঘ জন্মাবার আগে এই পাহাড়ে সে ছিলো; অজগর সাপিনীর মরণের পরে। সহসা পাহাড় ব’লে মেঘ-খন্ডকে                    শূন্যের ভিতরে ভুল হলে- প্রকৃতিস্থ হয়ে যেতে হয়; (চোখ চেয়ে ভালো ক’রে তাকালেই হতো;) কেননা কেবলি যুক্তি ভালোবেসে আমি                    প্রমাণের অভাববশত তাহাকে দেখিনি তবু আজো; এক আচ্ছান্নতা খুলে শতাব্দী নিজের মুখের নিস্ফলতা দেখাবার আগে নেমে ডুবে যায় দ্বিতীয় ব্যথায়; আদার ব্যাপারী হ’য়ে এই সব জাহাজের কথা না ভেবে মানুষ কাজ ক’রে যায় শুধু                    ভয়াবহভাবে অনায়াসে। কখনো সম্রাট শনি শেয়াল অ ভাঁড় সে-নারীর রাং দেখে হো হো ক’রে হাসে। দুইমহিলা তবুও নেমে আসে মনে হয়ঃ (বমারের কাজ সাঙ্গ হ’লে নিজের এয়োরোড্রোমে-প্রশান্তির মতো?) আছেও জেনেও জনতার কোলাহলেতাহার মনের ভাব ঠিক কী রকম- আপনারা স্থির ক’রে নিন; মনে পড়ে, সেন রায় নওয়াজ কাপূর আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন-এমনই পদবী ছিলো মেয়েটির কোনো একদিন; আজ তবু উশিন তো বিয়াল্লিশ সাল; সম্বর মৃগের বেড় জড়ায়েছে যখন পাহাড়ে কখনও বিকেলবেলা বিরাট ময়াল,অথবা যখন চিল শরতের ভোরে নীলিমার আধপথে তুলে নিয়ে গেছে রসুঁয়েকে ঠোনা দিয়ে অপরূপ চিতলের পেটি,- সহসা তাকায়ে তারা ইউৎসারিত নারীকে দেখেছে;এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হ’য়ে গেলে অন্য-এক পৃথিবীর নাম অনুভব ক’রে নিতে গিয়ে মহিলার ক্রমেই জাগছে মনস্কাম;ধূমাবতী মাতঙ্গী কমলা দশ-মহাবিদ্যা নিজেদের মুখ দেখায়ে সমাপ্ত হ’লে সে তার নিজের ক্লান্ত পায়ের সঙ্কেতে পৃথিবীকে জীবনের মতো পরিসর দিতে গিয়ে যাদের প্রেমের তরে ছিলো আড়ি পেতেতাহারা বিশেষ কেউ কিছু নয়;- এখনও প্রাণের হিতাহিত না জেনে এগিয়ে যেতে তবু পিছু হটে গিয়ে হেসে ওঠে গৌড়জনোচিতগরম জলের কাপে ভবেনের চায়ের দোকানে; উত্তেজিত হ’য়ে মনে করেছিলো (কবিদের হাড় যতদূর উদ্বোধিত হ’য়ে যেতে পারে- যদিও অনেক কবি প্রেমিকের হাতে স্ফীত হ’য়ে গেছে রাঁঢ়):‘উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশশো পঁচিশের জীব- সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরিংসার মতন কঠিন; সে না হলে মহাকাল আমাদের রক্ত ছেঁকে নিয়ে বা’র ক’রে নিতো না কি জনসাধারণ ভাবে স্যাকারিন।আমাদের প্রাণে যেই অসন্তোষ জেগে ওঠে সেই স্থির ক’রে; পুনরায় বেদনার আমাদের সব মুখ স্থুল হয়ে গেলে গাধার সুদীর্ঘ কান সন্দেহের চোখে দেখে তবু শকুনের শেয়ালের চেকনাই কান কেটে ফেলে। মাঘসংক্রান্তির রাতে হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে। অমাময়ী নিশি যদি সুজনের শেষ কথা হয়, আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়, তবুও আমার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে জ্ব’লে ওঠে সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে; বুঝিছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়, আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্ক শিখায়; মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে, মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো দেহ হবে মন হবে-তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি! মাঝে মাঝে মাঝে মাঝে অন্য সব সত্য থেকে ছুটি নিয়ে সব জল হয়ে মিশে যেতে চায়; পৃথিবীর চলমান স্পন্দনের বিহবলতায় রণ আছে, রক্ত আছে, রুজি আর রুটি আছে-খাঁটি ভালোবাসা দিতে গিয়ে ত্রুটি হয়ে যায়;অন্ধকারে হৃদয়ের দায় বিমুক্ত করার মতো কাকে আর পায় জল ছাড়া? চারি দিকে কেবলই ভ্রুকুটিছড়িয়ে এ পৃথিবীতে রক্তছাইরেখা এঁকে মুছে ফেলে দিতে গিয়ে ইতিহাস নদীর নিবিড় জলে কেবল জলের শব্দ খোঁজে; যেন কাছে- কোথাও গভীরভাবে রয়েছে সহজে পৃথিবীর স্নিগ্ধ অন্ধকার জল একাঃ কবের বিলীন হংসী আর তার হাঁস। মানুষ যা চেয়েছিল গোধূলির রঙ লেগে অশ্বত্থ বটের পাতা হতেছে নরম; খয়েরী শালিখগুলো খেলছে বাতাবীগাছে—তাদের পেটের শাদা রোম সবুজ পাতার নীচে ঢাকা প’ড়ে একবার পলকেই বার হয়ে আসে, হলুদ পাতার কোলে কেঁপে-কেঁপে মুছে যায় সন্ধ্যার বাতাসে। ও কার গোরুড় গাড়ি র’য়ে গেছে ঘাসে ঐ পাখা মেলে ফরিঙের মতো।হরিণী রয়েছে ব’সে নিজের শিশুর পাশে বড়ো চোখ মেলে; আঁকা-বাঁকা শিং তাদের মেরুর গোধূলির মেঘগুলো লেগে আছে; সবুজ ঘাসের ’পরে ছবির মতন যেন স্থির; দিঘির জলের মতো ঠান্ডা কালো নিশ্চিত চোখ; সৃষ্টির বঞ্চনা ক্ষমা করবার মতন অশোক অনুভূতি জেগে ওঠে মনে।… আঁধার নেপথ্যে সব চারিদিকে—কূল থেকে অকূলের দিকে নিরুপণে শক্তি নেই আজ আর পৃথিবীর—তবু এই স্নিগ্ধ রাত্রি নক্ষত্রে ঘাসে; কোথাও প্রান্তরে ঘরে অথবা বন্দরে নীলাকাশে; মানুষ যা চেয়েছিল সেই মহাজিজ্ঞাসার শান্তি দিতে আসে। মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে — হাসির আস্বাদ পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে কড়ির মতন শাদা মেঘের পাহাড়ে সূর্যের রাঙা ঘোড়া; পক্ষিরাজের মতো কমলা রঙের পাখা ঝাড়ে রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ উঠেছে আনন্দে জেগে — নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ চলে গেছে কলরবে; — দেখেছি সবুজ ঘাস — যত দূর চোখ যেতে পারে; ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল, — পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে ঢেকে আছে; — দেখিয়াছি বাসমতী, কাশবন আকাঙ্খার রক্ত, অপরাধমুছায়ে দিতেছে যেন বার বার কোন এক রহস্যের কুয়াশার থেকে যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু — আমাদের বিস্মিত নীরব রেখে দেয় — পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আচঁড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব। মিতাভাষণ তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন। মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো আমাদের নিয়ে যায় ডেকে শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে, তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে, দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি: যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে।মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা; ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা। তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো; এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো। মিতাভাষণ তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন। মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো আমাদের নিয়ে যায় ডেকে শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে, তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে। অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে, দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি: যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে। মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা; ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা। তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল,সূর্য মানে আলো; এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো। মিতাভাষন তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন। মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো আমাদের নিয়ে যায় ডেকে শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে; তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে। অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি: যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে তার স্নিগ্ধ মালতী-সৌরভে।মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা; ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প স্বপ্নের উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা। তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো : এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।কাব্যগ্রন্থ : বনলতা সেন মিশর ‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন- ‘স্ফীঙ্ক্‌স-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ! ঝাঁ ঝাঁ মরুর ‘লু’য়ের ফুঁয়ে হচ্চে বিলীন-ক্ষীণ মিশর দেশের কাফন্‌ পাহাড়-পিরামিতের স্তুপ!নিভে গেছে ঈশিশের রই বেদীর থেকে ধূমা, জুড়িয়ে গেছে লক্‌লকে সেই রক্তজিভার চুমা! এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমিরপূজার ঘটা, দুলছে মরুমশান শিরে মহাকালের জটা! ঘুমন্তদের কানে কানে কয় সে-ঘুমা ঘুমা!ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও, ফ্যারাওছেলে- তাদের বুকে যাচ্চে আকাশ বর্শা ঠেলে ঠেলে! হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে মেম্ননেরই বুক, ডুবে গেছে মিশররবি-বিরাট বেলের ভুখ জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমার জ্বেলে!পিরাপিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে! সোনার কাঠি নেই কি তাহার? জাগবে না কি আর! মৃত্যু সে কি শেষের কথা? শেষ কি শবাধার? সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে!নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ। কুমিরগুলোর খুলির খিলান, করাত দাঁতের খাপ উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়; ঘুমপাড়ানির ঘুম হানছে আঘাত-আকাশ বাতাস হচ্ছে যেন গুম্‌! ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ!নীলা নীলা- ধুক্‌ধুকিয়ে মিশরকবর পারে রইলে জেগে বোবা বুকের বিকল হাহাকারে লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় রামেসেসের দেশ! অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে!কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ঐ নারী ঐ পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি সারি ইয়াঙ্কী ঐ ঐ য়ুরোপী-চীনে-তাতার মুর তোমার বুকের পাঁজর দ’লে টলতেছে হুড়মুড়্‌- ফেনিয়ে তুলে খুন্‌খারাবি, খেলাপ, খবরদারি!দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল-আকাশে ঐ চাঁদ! চপল হাওয়ায় কাঁকন নীলনদেরই বাঁধ! মিশর ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুড়িখানার সুরে বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে- খেজুরবনে দূরে! আফ্রিকা এই, এই যে মিশর-জাদুর এ যে ফাঁদ!ওয়েসিসের ঠান্ডা ছায়ায় চৈতি চাঁদের তলে মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে! চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট- এই যে মিশর-আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট! কী এক মোহ এই হাওয়াতে- এই দরিয়ার জলে!শীতল পিরামিডের মাথা-গীজের মুরতি অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে! মেম্নেনের ঐ কন্ঠ ভরে চারণ-বীনার গানে! আবার জাগে ঝান্ডাঝালর- জ্যান্ত আলোর জ্যোতি! মুহূর্ত আকাশে জ্যোৎস্না- বনের পথে চিতা বাঘের গায়ের ঘ্রাণ; হৃদয় আমার হরিণ যেনঃ রাত্রি এই নীরবতার ভিতর কোন্‌ দিকে চলেছি! রূপালি পাতার ছায়া আমার শরীরে, কোথাও কোনো হরিণ নেই আর; যত দূর যাই কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ শেষ সোনালি হরিণ-শস্য কেটে নিয়েছে যেন; তারপর ধীরে-ধীরে ডুবে যাচ্ছে শত-শত মৃগীদের চোখের ঘুমের অন্ধকারের ভিতর। মৃত মাংস ডানা ভেঙে ঘুরে-ঘুরে প’ড়ে গেলো ঘাসের উপর; কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে ;- আকাশের ঘরে কোনোদিন-কোনোদিন আর তার হবে না প্রবেশ ? জানে না সে; কোনো-এক অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ ঘনায়ে এসেছে তার ? জানে না সে, আহা, সে যে আর পাখি নয়- রঙ নয়- তাহা জানে না সে; ঈর্ষা নয়- হিংসা নয়- বেদনা নিয়েছে তারে কেড়ে! সাধ নয়- স্বপ্ন নয়- একবার দুই ডানা ঝেড়ে বেদনারে মুছে ফেলে দিতে চায় ; - রুপালি বৃষ্টির গান, রৌদ্রের অাস্বাদ মুছে যায় শুধু তার,- মুছে যায় বেদনারে মুছিবার সাধ। মৃত্যু সূর্য সংকল্প সর্বদাই অন্ধকারে মৃত্যু এক চিন্তার মতন; আমাদের এই শতাব্দীর সাধ, স্বপ্ন, কাজ, প্রাণ আচ্ছাদন ক'রে দিতে আসে। ভোরের নিশ্চিন্ত মন কেমন সাহসে অনায়াসে আলো হয়- সূর্য হয়- দেখ; নদী- মেঘ- দিগন্তের পাহাড়ের নীল বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠে কেমন নিঃশব্দ অনাবিল। আমরা প্রেমের কথা- জ্ঞান মুক্তি প্রগতির দিন ঢের আগে শুরু ক'রে এখনো ব্রহ্মাণ্ড-অন্তর্লীন সুরের ভিতরে সুর-অগ্নি হতে গিয়ে বার বার অঙ্গারের অন্ধকারে সমাজ নিভিয়ে মানুষের ইতিহাস-ঊর্ণা হয়ে আছি।হে আকাশ, হে প্রতিভা, হে বিচিত্র উচ্ছ্রিত সূর্যের উজ্জ্বলন, আমাদের রোগ, পাপ, বয়সের রূঢ় মরুভূমি শেষ ক'রে মৃজনের অনাদির দীপ্তিকে আদিম চুম্বনে বিজ্ঞান, প্রেম, প্রেমাগ্নি উড্ডীন কর তুমি। মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প আঁধারে হিমের আকাশের তলে এখন জ্যোতিষ্কে কেউ নেই। সে কারা কাদের এসে বলেঃ এখন গভীর পবিত্র অন্ধকার; হে আকাশ, হে কালশিল্পী, তুমি আর সূর্য জাগিয়ো না; মহাবিশ্বকারুকার্য, শক্তি, উৎস, সাধঃ মহনীয় আগুনের কি উচ্ছিত সোনা? তবুও পৃথিবী থেকে- আমরা সৃষ্টির থেকে নিভে যাই আজঃ আমরা সূর্যের আলো পেয়ে তরঙ্গ কম্পনে কালো নদী আলো নদী হয়ে যেতে চেয়ে তবুও নগরে যুদ্ধে বাজারে বন্দরে জেনে গেছি কারা ধন্য, কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে।তাহাদের ইতিহাস-ধারা ঢের আগে শুরু হয়েছিলো; এখনি সমাপ্ত হতে পারে, তবুও আলেয়াশিখা আজো জ্বালাতেছে পুরাতন আলোর আঁধারে।আমাদের জানা ছিলো কিছু; কিছু ধ্যান ছিলো; আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো হয়তো-বা এসে পড়েছিলো; আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো;- নক্ষত্রপথের অন্তঃশূন্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিরে তবুও তো ব্রহ্মান্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে; আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে পৃথিবীতে; আমরা জেগেছি-তবু জাগাতে পারি নি; আলো ছিলো- প্রদীপের বেষ্টনী নেই; কাজ ছিল- শুরু হলো না তো; হাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের? নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ! সচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক’রে ভালোবাসে; তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে; দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়; তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো? প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়! মারা মানুষ ঢের ক্ররতর অন্ধকূপ থেকে অধিক আয়ত চোখে তবু ঐ অমৃতের বিশ্বকে দেখেছি; শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে উদ্বেলিত হয়ে অনুভব ক’রে গেছি প্রশান্তিই প্রাণরণনের সত্য শেষ কথা, তাই চোখ বুজে নীরবে থেমেছি। ফ্যাক্টরীর সিটি এসে ডাকে যদি, ব্রেন কামানের শব্দ হয়, লরিতে বোঝাই করা হিংস্র মানবিকী অথবা অহিংস নিত্য মৃতদের ভিড় উদ্দাম বৈভবে যদি রাজপথ ভেঙে চ’লে যায়, ওরা যদি কালোবাজারের মোহে মাতে, নারীমূল্যে অন্ন বিক্রি ক’রে, মানুষের দাম যদি জল হয়, আহা, বহমান ইতিহাস মরুকণিকার পিপাসা মেটাতে ওরা যদি আমাদের ডাক দিয়ে যায়- ডাক দেবে, তবু তার আগে আমরা ওদের হাতে রক্ত ভুল মৃত্যু হয়ে হারায়ে গিয়েছি?জানি ঢের কথা কাজ স্পর্শ ছিলো, তবু নগরীর ঘন্টা-রোল যদি কেঁদে ওঠে, বন্দরে কুয়াশা বাঁশি বাজে, আমরা মৃত্যুর হিম ঘুম থেকে তবে কী ক’রে আবার প্রাণকম্পনলোকের নীড়ে নভে জ্বলন্ত তিমিরগুলো আমাদের রেণুসূর্যশিখা বুখে নিয়ে হে উড্ডীন ভয়াবহ বিশ্বশিল্পলোক, মরণে ঘুমোতে বাধা পাব?- নবীন নবীন জঞ্জাতকের কল্লোলের ফেনশীর্ষে ভেসে আর একবার এসে এখানে দাঁড়াব। যা হয়েছে- যা হতেছে- এখন যা শুভ্র সূর্য হবে সে বিরাট অগ্নিশিল্প কবে এসে আমাদের ক্রোড়ে ক’রে লবে। মৃত্যুর আগে আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীতরাত্রিটিরে ভালো, খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার; পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ — অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো! বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ — মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক; আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;আমরা দেখেছি যারা বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্‌্র নীল জোছনার ভিতরে, আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে; শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে — ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ, চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু — বেলা নির্জন মাছের চোখে — পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ — মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে, বেতের লতার নিচে চড়য়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে, নমর জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে, খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জোছনার উঠানে পড়িয়াছে; বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ — বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে; নীলাভ নোনার বুকে ঘর রস গাঢ় আকাঙক্ষায় নেমে আসে;আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল; পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর পরে আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ, প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা কয়ে গেছে আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর আরো এক আলো আছে: দেহে তার বিকাল বেলার ধুসরতা: চোখের — দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির; পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ — একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল — সোনা ছিল যাহা নিরুত্তর শান্তি পায় — যেন কোন্‌ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে। কী বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখিপাখলির ডাক শুনি নি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক। মেঠো চাঁদ মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি- খড়- নাড়া- মাঠের ফাটল, শিশিরের জল। মেঠো চাঁদ- কাস্তের মত বাঁকা, চোখা- চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত- নাই লেখা-জোখা। মেঠো চাঁদ বলেঃ ‘আকাশের তলে খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার মুছে গেছে- ফসল- কাটার সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে নড়-নাড়া- পোড়া জমি- মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’…… আমি তারে বলিঃ ‘ফসল গিয়াছে ঢের ফলি, শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো- বড়ো হ’য়ে গেছো তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো! খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার মুছে গেছে কতোবার- কতোবার ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি- খড়-নাড়া-মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’ যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে – দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে – তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার- তাহাদের ছায়া যে পড়িছে আমার বুকের পরে — আমার মুখের পরে নীরবে ঝরিছে খয়েরী অশথপাতাত — বইচি, শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে, নিবিড় হয়েছে তাই আমার চিতার ছাইয়ে — বাংলার ঘাসে গভীর ঘাসের গুচ্ছে রয়েছি ঘুমায়ে আমি, — নক্ষত্র নড়িছেআকাশের থেকে দূর-আরো দূর-আরো দূর-নির্জন আকাশে বাংলার-তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে। আবার যখন জাগি, আমা শ্মশানচিতা বাংলার ঘাসে ভরে আছে, চেয়ে দেখি,-বাসকের গন্ধ পাই-আনারস ফুলে ভোমরা উড়িছে,শুনি-গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে রোদের দুপুর ভরে-শুনি আমি; ইহারা আমার ভালোবাসে- যতদিন পৃথিবীতে যতদিন পৃথিবীতে জীবন রয়েছে দুই চোখ মেলে রেখে স্থির মৃত্যু আর বঞ্চনার কুয়াশার পারে সত্য সেবা শান্তি যুক্তির নির্দেশের পথ ধ’রে চ’লে হয়তো-বা ক্রমে আরো আলো পাওয়া যাবে বাহিরে—হৃদয়ে; মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির ব্যক্তির ক্ষয়ে।ইতিহাস ঢের দিন প্রমাণ করেছে মানুষের নিরন্তর প্রয়াণের মানে হয়তো-বা অন্ধকার সময়ের থেকে বিশৃঙ্খল সমাজের পানে চ’লে যাওয়া;—গোলকধাঁধাঁর ভুলের ভিতর থেকে আরো বেশি ভুলে; জীবনের কালোরঙা মানে কি ফুরুবে। শুধু এই সময়ের সাগর ফুরুলে।জেগে ওঠে তবু মানুষ রাত্রিদিনের উদয়ে; চারিদিকে কলরোল করে পরিভাষা দেশের জাতির ব্যর্থ পৃথিবীর তীরে; ফেনিল অস্ত্র পাবে আশা? যেতেছে নিঃশেষ হয়ে সব? কী তবে থাকবে? আঁধার ও মননের আজকের এ নিষ্ফল রীতি মুছে ফেলে আবার সচেষ্ট হয়ে উঠবে প্রকৃতি?ব্যর্থ উওরাধিকারে মাঝে-মাঝে তবু কোথাকার স্পষ্ট সুর্য-বিন্দু এসে পড়ে; কিছু নেই উত্তেজিত হলে; কিছু নেই স্বার্থের ভিতরে; ধনের অদেয় কিছু নেই, সেই সবই জানে এ খন্ডিত রক্ত বণিক পৃথিবী; অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালোঃ যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো। যতদিন বেঁচে আছি যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে অপরাজিতার মতো নীল হয়ে-আরো নীল-আরো নীল হয়ে আমি যে দেখিতে চাই;- সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে, আমি যে দেখিতে চাই;- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে, পৃথিবীর পথ ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে, যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনো এক সুন্দরীর শব চন্দন চিতায় চড়ে-আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা; যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ-সবচেয়ে ঘাঢ় বিষন্নতা; যেখানে শুকায় পদ্মা-বহুদিন বিশালক্ষ্মী যেখানে নীরব; যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর! যতিহীন বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড় কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলারঙের আলোয় জ্ব’লে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে। যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে,- মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথেকোথায় আছে জানি না তো; কোথায় সমাজ, অর্থনীতি? স্বর্গগামী সিঁড়ি ভেঙে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো- মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী হয়ে কি আজ চারিদিকে গণনাহীন ধূসর দেয়াল ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল ক’রে! পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব অর্থবিহীন হয়ে গেলে,-তবু আরেক নবীনতর ভোরে সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হ’য়ে পথে-পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে। প্রাচীন কথা নতুন ক’রে এই পৃথিবীর অনন্ত বোনভায়ে ভাবছে একা-একা ব’সে যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ আমাদের এই আকাশ সাগর আঁধার আলোয় আজ যে-দোর কঠিন; নেই মনে হয়; সে-দ্বার খুলে দিয়ে যেতে হবে আবার আলোয় অসার আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে।কাব্যগ্রন্থ : বেলা অবেলা কালবেলা যতোদিন পৃথিবীতে যতোদিন পৃথিবীতে জীবন রয়েছে দুই চোখ মেলে রেখে স্থির মৃত্যু আর বঞ্চনার কুয়াশার পায়ে সত্য সেবা শান্তি যুক্তিরনির্দেশের পথ ধ'রে চ'লে হয়তো-বা ক্রমে আরো আলো পাওয়া যাবে বাহিরে- হৃদয়ে; মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির ব্যক্তির ক্ষয়ে।ইতিহাস ঢের প্রমাণ করেছে মানুষের নিরন্তর প্রয়াণের মানে হয়তো-বা অন্ধকার সময়ের থেকে বিশৃঙ্খল সমাজের পানে চ'লে যাওয়া; -গোলকধাঁধার ভুলের ভিতর থেকে আরো বেশি ভুলে; জীবনের কালোরঙা মানে কি ফুরুবে শুধু এই সময়ের সাগর ফুরুলে।জেগে ওঠে তবুও মানুষ রাত্রিদিনের উদয়ে; চারিদিকে কলরোল করে পরিভাষা দেশের জাতির দ্ব্যর্থ পৃথিবীর তীরে; ফেণিল অস্ত্র পাবে আশা? যেতেছে নিঃশেষ হ'য়ে সব? কি তবে থাকবে? আধার ও মননের আজকের এই নিস্ফল রীতি মুছে ফেলে আবার সচেষ্ট হ'য়ে উঠবে প্রকৃতি?ব্যর্থ উত্তরাধিকারে মাঝে- মাঝে তবু কোথাকার স্পষ্ট সূর্য-বিন্দু এসে পড়ে কিছু নেই উত্তেজিত হ'লে; কিছু নেই স্বার্থের ভিতরে; ধনের অদেয় কিছু নেই, সেই সবি জানে এ খন্ডিত রক্ত বণিক পৃথিবী; অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো যে- প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো। যদি আমি ঝরে যাই একদিন যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়; যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে, যখন চড়াই পাখি কাঁঠালিচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে, যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়, যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়, শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে- তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে, ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান- যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড় একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর, যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;- কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান- রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান– যদিও দিন যদিও দিন কেবলি নতুন গল্পবিশ্রুতির তারপরে রাত অন্ধকারে থেমে থাকাঃ—লুপ্তপ্রায় নীড় সঠিক ক’রে নেয়ার মতো শান্ত কথা ভাবা; যদিও গভীর রাতের তারা (মনে হয়) ঐশী শক্তির;তবুও কোথাও এখন আর প্রতিভা আভা নেই; অন্ধকারে কেবলি সময় হৃদয় দেশ ক্ষ’য়ে যেতেছে দেখে নীলিমাকে অসীম ক’রে তুমি বলতে যদি মেঘনা নদীর মতন অকূল হয়ে;‘আমি তোমার মনের নারী শরীরিণী—জানি; কেন তুমি স্তব্ধ হয়ে থাকো। তুমি আছ ব’লে আমি কেবলই দূরে চলতে ভালোবাসি, চিনি না কোনো সাঁকো।যতটা দূর যেতেছি আমি সূর্যকরোজ্জ্বলতাময় প্রাণে ততই তোমার সত্ত্বাধিকার ক্ষয় পাচ্ছে ব’লে মনে কর? তুমি আমার প্রাণের মাঝে দ্বীপ, কিন্তু সে-দ্বীপ মেঘনা নদী নয়।’-এ-কথা যদি জলের মতো উৎসারণে তুমি আমাকে—তাকে—যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে ব’লে যেতে;—শুনে নিতাম, মহাপ্রাণের বৃক্ষ থেকে পাখি শোনে যেমন আকাশ বাতাস রাতের তারকাকে। যাত্রী মানুষের জীবনের ঢের গল্প শেষ হ’য়ে গেলে র’য়ে যায় চারি দিক ঘিরে এই দেশ; নদী মাঠ পাখিদের ওড়াওড়ি গাছের শিয়রে কমলা রঙের ঢেউয়ে এসে কিছুক্ষণ খেলা করে। মনে হয় কোথাও চিহ্নিত এই রৌদ্র ছিল কবে; মানুষ সার্থক ময়- তবু সার্থকতর হবে; মনে হত কাজ ক’রে কথা ব’লে গ্রন্থ মিলিয়ে, মননের তীর থেকে আরো দূরে তীরতটে গিয়ে। সময় নিজেই তবু সব চেয়ে গভীর বিপ্লবী; ফুরিয়ে ফেলেছে সেই দিন রাত্রি সেরা সত্য-উদ্ঘাটন সবি; সেদিনের হৃদয়ের উষ্ণ উত্তেজিত স্থির ক’রে ফেলে অন্য নব কলেবরে গড়েছে শরীর। বাহিরে ভিতরে লীন হয়ে থাকে মন, শান্ত- আরো শান্ত হয় অন্তঃকরণ; পুরোনো দিনের স্তম্ভ দু-চারটে পশ্চিমের আঁধারের কাছে; নব সূর্যে সম্মেলনে- যাত্রা যাত্রা যাত্রা যাত্রা আছে। যে কামনা নিয়ে যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা! খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি, রঙের মাঝারে হেরি রঙডুবি! পরাগের ঠোঁটে পরিমলগুঁড়ি- হারায়ে ফেলি গো দিশা! আমি প্রজাপতি-মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে; বোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর, বাঁধি নাকো বাসা-কাঁপি থরথর অতসী ছুঁড়ির ঠোটের উপর শুঁড়ির গেলাসে মেতে! আমি দক্ষিণা-দুলালীর বীণা,পউষপরশহারা! ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা পিয়ালার মধু তুলি রাতজাগা হোরীর হারারা সাড়া! আমি গো লালিমা-গোধূলির সীমা, বাতাসের লাল, ফুল। দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি নীল আকাশের গোলাপী দেয়ালী! আমি খুশরোজী, আমি গো খেয়ালী, চঞ্চল, চুলবুল। বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি-মধুপরিণয়রাতি! তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন মনের মাঝারে মদনমোহন মিলননদীর নিধুর কানন রেখেছে রে মোর পাতি! যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায় যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়-সে তো আর ফিরে নাহি আসে: কাঞ্চনমালা যে কবে ঝরে গেছে;-বনে আজো কলমীর ফুল ফুটে যায়-সে তবু ফেরে না, হায়;-বিশালাক্ষ্মী: সেও তো রাতুল চরণ মুছিয়া নিয়া চলে গেছে;-মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে-শ্মশানের পাশে আর তারা আসে নাকো; সুন্দরীর বনে বাঘ ভিজে জুল-জুল চোখ তুলে চেয়ে থাকে-কতো পাটরানীদের গাঢ় এলোচুল এই গৌড় বাংলায়-পড়ে আছে তাহার পায়ের তলে ঘাসেজানে সে কি! দেখে নাকি তারাবনে পড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল, বিশুষ্ক পদ্মের দীঘি-ফোঁপড়া মহলা ঘাট, হাজার মহাল মৃত সব রূপসীরা; বুকে আজ ভেরেন্ডার ফুলে ভীমরুল গান গায়-পাশ দিয়ে খল্‌ খল্‌ খল্‌ খল্‌ বয়ে যায় খাল, তবু ঘুম ভাঙে নাকো-একবার ঘুমালে কে উঠে আসে আর যদিও ডুকারি যায় শঙ্খচিল-মর্মরিয়া মরে গো মাদার। যেই সব শেয়ালেরা যেই সব শেয়ালেরা জন্ম- জন্ম শিকারের তরে, দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে নীরবে প্রবেশ করে,- বার হয়- চেয়ে দেখে বরফের রাশি জ্যোৎস্নায় প’ড়ে আছে;- উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি সেই সব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায়ঃ তা’হলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময় জন্ম নিতো;- সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে আমারও নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে। যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে – দূর কুয়াশায় চ’লে যাবো, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;- সেদিন দু’দও এই বাংলার তীর — এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;- সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে –এই সোঁদা ঘাসের ধুলায় জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায় – চারিদিকে বাঙালীর ভিড় বহুদিন কীর্তন ভাসান গান রুপকথা যাত্রা পাঁচালীর নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবণের জীবন গোঙায়,আমারে দিয়াছে তৃপ্তি; কোনো দিন রুপহীন প্রবাসের পথে বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন কাটাইনি দিন মাস,বেহুলার লহনার মধুর জগতে তাদের পায়ের ধুলো – মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন বাঙালি নারীর কাছে – চাল- ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান – মাখা চুল, হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়; – ডাঁশা আম কামরাঙা কুল। রজনীগন্ধা এখন রজনীগন্ধা-প্রথম-নতুন- একটি নক্ষত্র শুধু বিকেলের সমস্ত আকাশে; অন্ধকার ভালো বলে শান্ত পৃথিবীর আলো নিভে আসে।অনেক কাজের পরে এইখানে থেমে থাকা ভালো; রজনীগন্ধার ফুলে মৌমাছির কাছে কেউ নেই, কিছু নেই, তবু মুখোমুখি এক আশাতীত ফুল আছে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোন এক বলয়িত পথে     মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা     বিচ্ছুরিত ক'রে দেয় সঙ্গীতের মত কণ্ঠস্বরে!     হৃদয়ে নিমীল হয়ে অনুধ্যান করে ময়দানবের দ্বীপ ভেঙে ফেলে স্বভাবসূর্যের গরিমাকে।     চিন্তার তরঙ্গ তুলে যখন তাহাকে     ডেকে যায় আমাদের রাত্রির উপরে- পঙ্কিল ইঙ্গিত এক ভেসে ওঠে নেপথ্যের অন্ধকারেঃ আরো ভূত                                             আধেক মানব     আধেক শরীর- তবু অধিক গভীরতর ভাবে এক শব।নিজের কেন্দ্রিক গুণে সঞ্চারিত হয়ে ওঠে আপনার নিরালোকে ঘোরে আচ্ছন্ন কুহক, ছায়া কুবাতাস;- আধো চিনে আপনার যাদু চিনে নিতে ফুরাতেছে- দাঁড়াতেছে- তুমি তাকে স্থির প্রেমিকের মত অবয়ব দিতে সেই ক্লীববিভূতিকে ডেকে গেলে নিরাময় অদিতির ক্রোড়ে।     অনন্ত আকাশবোধে ভরে গেলে কালের দু'ফুট মরুভূমি। অবহিত আগুনের থেকে উঠে যখন দেখেছ সিংহ, মেষ, কন্যা, মীন ববিনে জড়ানো মমি- মমি দিয়ে জড়ানো ববিন,- প্রকৃতির পরিবেদনার চেয়ে বেশি প্রামাণিক তুমি     সামান্য পাখি ও পাতা ফুল মর্মরিত ক'রে তোলে ভয়াবহভাবে সৎ অর্থসঙ্কুল। যে সব বিস্রস্ত অগ্নি লেলিহান হয়ে ওঠে উনুনের অতলের থেকে         নরকের আগুনের দেয়ালকে গড়ে,     তারাও মহৎ হয়ে অবশেষে শতাব্দীর মনে ভেতরে দেয়ালে অঙ্গার, রক্ত, এক্যুয়ামেরিন আলো এঁকে নিজেদের সংগঠিত প্রাচীরকে ধূলিসাৎ ক'রে     আধেক শবের মত স্থির;     তবুও শবের মত বিশেষ অধীরঃ     প্রসারিত হতে চায় ব্রহ্মান্ডের ভোরে; সেইসব মোটা আশা, ফিকে রং, ইতর মানুষ, ক্লীবকৈবল্যের দিকে যুগে যুগে যাদের পাঠাল দরায়ুস।সে সবের বুক থেকে নিরুত্তেজ শব্দ নেমে গিয়ে প্রশ্ন করে যেতেছিল সে সময়ে নাবিকের কাছেঃ সিন্ধু ভেঙে কত দূর নরকের সিঁড়ি নেমে আছে?- ততদূর সোপানের মত তুমি পাতালের প্রতিভা সেঁধিয়ে অবারিতভাবে সাদা পাখির মতন সেই ঘুরুনো আধারে নিজে প্রমাণিত হয়ে অনুভব করেছিলে শোচনার সীমা     মানুষের আমিষের ভীষণ ম্লানিমা, বৃহস্পতি ব্যাসে শুক্র হোমরের হায়রাণ হাড়ে বিমুক্ত হয় না তবু- কি ক'রে বিমুক্ত তবু হয়ঃ ভেবে তারা শুক্ল অস্থি হ'ল অফুরন্ত সূর্যময়।অতএব আমি আর হৃদয়ের জনপরিজন সবে মিলে শোকাবহ জাহাজের কানকাটা টিকিটের প্রেমে রক্তাভ সমুদ্র পারি দিয়ে এই অভিজ্ঞের দেশে প্রবেশ ক'রেছি তার ভূখণ্ডের তিসি ধানে তিলে। এখানে উজ্জ্বল মাছে ভ'রে আছে নদী ও সাগরঃ নীরক্ত মানুষের উদ্বোধিত করে সব অপরূপ পাখি; কেউ কাকে দূরে ফেলে রয় না একাকী। যে সব কৌটিল্য, কুট, নাগার্জুন কোথাও পায়নি সদুত্তর- এইখানে সেই সব কৃতদার, ম্লান দার্শনিক ব্রহ্মাণ্ডের গোল কারুকার্য আজ রূপালি, সোনালি মোজায়িক। একবার মানুষের শরীরের ফাঁস থেকে বা'র হয়ে তুমিঃ (যে শরীর ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম গরীয়ান) যে কোনো বস্তুর থেকে পেতেছে সস্মিত সম্মান; যে কোনো সোনার বর্ণ সিংহদম্পতির মরুভূমি, অথবা ভারতী শিল্পী একদিন যেই নিরাময় গরুড় পাখির মূর্তি গড়েছিল হাতীর ধূসরতর দাঁতে, অথবা যে মহীয়সী মহিলারা তাকাতে তাকাতে নীলিমার গরিমার থেকে এক গুরুতর ভয় ভেঙে ফেলে দীর্ঘছন্দে ছায়া ফেলে পৃথিবীর পরে,- কবিতার গাঢ় এনামেল আজ সেই সব জ্যোতির ভিতরে।। রাত্রি হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কূষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল; অথবা সে-হাইড্র্যান্ট হয়তো না গিয়েছিলো ফেঁসে। এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে। একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশেঅস্থির পেট্রল ঝেঁড়ে; সতত সতর্ক থেকে তবু কেউ যেন ভয়াবহভাবে প'ড়ে গেছে জলে। তিনটি রিক্‌শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে মায়াবীর মতো জাদুবলে।আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে- হঠকারিতায় মাইল-মাইল পথ হেঁটে- দেয়ালের পাশে দাঁড়ালাম বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে- টেরিটি বাজারে; চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে।মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে। কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে ধনুকের ছিলা রাখে টান।টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে। টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা। শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে; রাজ্য জয় ক'রে গেছে অমর আত্তিলা।নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী; পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান- আর কাকে, সোনা, তেল, কাগজের খনি।ফিরিঙ্গি যুবক ক'টি চ'লে যায় ছিমছাম। থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে; হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার ক'রে বূড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো। তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক, বস্তুর কাপড় পরে লজ্জাবশত। রাত্রি (আলোপৃথিবী) অইখানে কিছু আগে- বিরাট প্রাসাদে- এক কোণে জ্ব'লে যেতেছিল ধীরে এক্‌সটেন্‌শন্‌ লেকচারের আলো। এখন দেয়ালে রাত- তেমন ততটা কিছু নয়; পথে পথে গ্যাসলাইট র'য়েছে ঝাঁঝালো এখনো সূর্যের তেজ উপসংহারের মত জেগে। এখনো টঙ্গে চ'ড়ে উপরের শেলফের থেকে বই কি বিবর্ণ কীট- ধুলো- মাকড়সা বার হবে দোকানের সেলস্‌ম্যান চুপে ভেবে দেখে। এখনো নামেনি সেই নির্জন রিকশগুলো- নিয়ন্তার মত, সমূহ ভীড়ের চাপে র'য়েছে হারায়ে। অজস্র গলির পথে একটি মানুষ যুগপৎ র'য়েছে দাঁড়ায়ে; পৃথিবীর সকলের হৃদয়ের প্রতীকের মত; এই রাত থেকে আরো অধিক গভীরতর রাতে কলুটোলা- পাথুরিয়াঘাটা- মির্জাপুরে এসপ্লানেডের ফুটপাতে মালাঙ্গা লেনের পথে- ক্রিক রো'তে ককবার্ন লেনের ভিতরে এক জোড়া শিঙ যদি দেখা দেয় লোকটার টাকে- পরচুলা চুরি ক'রে নিয়ে গেছে তবে যাদুকর। এখানে রাত্রির পারে তোমার নিকট থেকে আমি চ'লে গেলে চ'লে যাব;- পৃথিবীর কাছ থেকে নয়; রাত্রি এই সারারাত জীবনের সকল বিষয় হয়ে আছে। তিত্তিরাজ গাছ থেকে শিশির নীরবে ঝরে যায়; ডানার আঘাতে যায় কাকদম্পতীর; হলুদ খড়ের পরে ঝ'রে পড়ে আবার শিশির হাওয়ার গুঁড়ির মত। কোথায় হারায়ে তুমি গিয়েছ কখন। মাথার উপরে সব নক্ষত্রেরা ছুরির মত বিচক্ষণ সময়ের সূতো কেটে- অবিরাম সময়ের সূতো কেটে ফেলে আমার চোখের পরে রাত্রির প্রাঞ্জলতা ঢেলে; কোথাও বাতাবী উষ্ণ হয়ে ওঠে- ঘুরে যায় মাকরসাপোকার লাটিম, ভাঁড় হাসে,- সম্রাজ্ঞীর অবয়ব হয়ে থাকে হিম; নদীরা শিশুর মত- শিশুরা নদীর মত দূর; স্বর্গের কিনারে গিয়ে ভিড় আর ভিখিরির নীল আলো করে টিমটিম। শিশুর কপাল থেকে বেজে ওঠে নরকের বিচিত্র ডিন্ডিম। রাত্রি ও ভোর শীতের রাতের এই সীমাহীন নিষ্পন্দন গহ্বরে জীবন কি বেঁচে আছে তবে? ডানা-ভাঙ্গা নক্ষত্রের মতন উৎসবে আঁধারের ভিতরে কি করেকেবলি স্ফুলিঙ্গ অন্ধ সংক্রান্তির মতো? বহুদিন ক্ষমাহীন সময়ের ভিতরে সে অনেক জ্বলেছে আছে, তবু তুমি নেই, তাই তো দাহন ভেঙ্গে গেছে মৃত নক্ষত্রের গন্ধ ক্রমেই হতেছে পরিণতঅন্ধকার সনাতনে_ সৃষ্টির প্রথম উৎসারিত পটভূমি তারি অন্তিমের কথা? অন্তহীন মোজেইকে আলোকের গোলকধাঁধায় কেউ প্রিয়া_ কেউ তার অনিবার্ণ হতে চায়; ঝ'রে যায়_ দূর মৃগতৃষ্ণিকার মতো দীপ্ত তুমি।এখন ভোরের বেলা মনে হয় তুমি শাদা যূথিকার মতো তেমনি পবিত্র স্বাদ তোমার শরীর শিখা ঘিরে কোথাও বিষয় খুঁজে তোমাকে দেখেছি রৌদ্রে লুকানো শিশিরে সৃষ্টির প্রথম ভোর থেকে অবশেষে আজ এই পরিণতশেষ ভোর, শোষ রোদ, শেষ ফুল, অন্তিম শিশির মীনকেতনের দিন জন্মান্তরে কেটে গেছে, -আজ প্রতিসারী আরেক প্রয়াণে উৎস; -একটি মেঘের মতো চ'লে এসে ভারি নীলিমায় ভেসে যেতে-যেতে_ থেমে_ শুনেছি, বলেছো তুমি, স্থিরমেঘশান্তি প্রকৃতির- মানুষ তা হারিয়ে ফেলেছে চারিদিকে সময়ের সকল বিশাল মরুভূমি বলয়িত নগরীর সমাজের সভ্যতার কলঙ্কসুন্দর মৃগতৃষ্ণায় লয় পেয়ে গেলে স্থির তুমি_ স্থিরতর তুমি#জীবনান্দদাশের অগ্রন্থিত কবিতাসমগ্র রাত্রি দিন একদিন এ-পৃথিবী জ্ঞানে আকাঙ্ক্ষায় বুঝি স্পষ্ট ছিলো, আহা; কোনো এক উন্মুখ পাহাড়ে মেঘ আর রৌদ্রের ধারে ছিলাম গাছের মতো ডানা মেলে- পাশে তুমি রয়েছিলে ছায়া।একদিন এ-জীবন সত্য ছিলো শিশিরের মতো স্বচ্ছতায়; কোনো নীল নতুন সাগরে ছিলাম- তুমিও ছিলে ঝিনুকের ঘরে সেই জোড়া মুক্তো মিথ্যে বন্দরে বিকিয়ে গেল হায়।অনেক মুহুর্ত আমি ক্ষয় করে ফেলে বুঝেছি সময় যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নিয়ে নয়।তবুও তোমাকে ভালোবেসে মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে বুঝেছি অকুলে জেগে রয় : ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ-হৃদয়। রাত্রি, মন, মানবপৃথিবী এ অন্ধকার জলের মতো; এই পৃথিবীর সকল কিণার ঘিরে নরক নগর তাপী পাপীর শান্ত শুশ্রুষায় কোথার থেকে এসে কোথায় লক্ষ্যে চ'লে যায়; সকল উত্তেজনায় আসে স্নিগ্ধ শরীরেকে ব্যাহত পাখির মতো প্রাণাকাশে ওড়ার পথে সময়শায়কে কারা কোথায় আলোককণার মতন, সূর্য হতে জন্ম পেয়েই হারিয়ে গেছে অন্ধ রক্ত স্রোতে; বু্দ্ধিজীবী নষ্ট হলো কোথায় মনের গোলকধাঁধার ছকে-সবের কাছে নিরাভিমান রাত্রি এসে নমিত হ'লে বলে; কথা ভাবায়; কথা ভাবার সর্বনাশে শান্তি কোথায় আছে? তবুও এসে অনেক কাজের পরে অন্তরাশ্রয়িতার কাছে; মৃত্যু ঘুমের অতীত ব্যথা ক্ষয় পাবে কি সহজ সরলে?এখানে কোনো আকাশসারী ইন্দ্রজাল নেই; এখানে কালের সিঁড়ির পরে মধ্যপথে অগম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বিষয় ভেবে নিতে হয়েছে নতুন যানের প্রতীকে; মৃত্যু নেই, মায়া নেই, ইতিহাস অমোঘ তবু ঠিক এ-কারণেইক্লান্তি  নেই; মনেনদীর দু-পার ঘিরে ছাউনি পড়েছে এপারে এরা জীবনপ্রেমিক: ঘোষণা ক'রে বলে; ওপারে এরা এই পৃথিবীর নিষ্পেষিত নরনারীর দলে, সিদ্ধি চায়: গণনাহীন মৃত্যুসেনা হাজির করেছেঅনেক বিনাশ সাঙ্গ হ'লে অন্ধকারের নতুন জাতক, ঢল তবুও অনেক প্রাণের প্রয়াস ঝরনা প্রেম সহিষ্ণুতা আলো দেখেছে আবার নবনবীন নৈরাশ্যে হারালো: নাবিক ক্লান্ত : নদী কি নিষ্ফল?অন্ধকারের হৃদয় এখন নিজের কাছে থেমে আশা আলো হারিয়ে যতোই শ্লেষ পরিহাস শক্তিতে কঠিন হ'য়ে সন্ততিদের কাছে পিতৃলোকের ঋণ আঁধার জলাঞ্জলি ভাবে- ততোই জনমানব প্রেমেনিহিত হ'য়ে নতুন জলকণিকারাশি বানিয়ে নিতে চায়। আবার কি তা রক্তকণা হ'য়ে গেলো? স্ফালন ক'রে অন্ধকারে জ্ঞানী হ'য়ে সে দেখছে ইতিহাসের বিরাট হয়রানি নবীন বীজের মতন আজো মানবতার বিবর্ণ আত্মায়। রাত্রির কোরাস এখন সে কতো রাত; এখন অনেক লোক দেশ-মহাদেশের সব নগরীর গুঞ্জরণ হ'তে ঘুমের ভিতরে গিয়ে ছুটি চায়। পরস্পরের পাশে নগরীর ঘ্রাণের মতন নগরী ছড়ায়ে আছে। কোনো ঘুম নিঃসাড় মৃত্যুর নামান্তর। অনেকেরই ঘুম জেগে থাকা। নগরীর রাত্রি কোনো হৃদয়ের প্রেয়সীর মতো হ'তে গিয়ে নটীরও মতন তবু নয়;- প্রেম নেই- প্রেমব্যসনেরও দিন শেষ হ'য়ে গেছে; একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের আকাশে উঠেছে; উঠে ভেঙে গেছে। কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণের প্রয়াস র'য়ে গেছে; তুচ্ছ নদী-সমুদ্রের চোরাগলি ঘিরে র'য়ে গেছে মাইন, ম্যাগ্নেটিক মাইন, অনন্ত কনভয়,- মানবিকদের ক্লান্ত সাঁকো এর চেয়ে মহীয়ান আজ কিছু নেই জেনে নিয়ে আমাদের প্রাণের উত্তরণ আসেনাকো। সূর্য অনেক দিন জ্বলে গেছে মিশরের মতো নীলিমায়। নক্ষত্র অনেক দিন জেগে আছে চীন, কুরুবর্ষের আকাশে। তারপর ঢের যুগ কেটে গেলে পর পরস্পরের কাছে মানুষ সফল হ'তে গিয়ে এক অস্পষ্ট রাত্রির অন্তর্যামী যাত্রীদের মতো জীবনের মানে বা'র ক'রে তবু জীবনের নিকট ব্যাহত হ'য়ে আরো চেতনার ব্যথায় চলেছে। মাঝে-মাঝে থেমে চেয়ে দেখে মাটির উপর থেকে মানুষের আকাশে প্রয়াণ হ'লো তাই মানুষের ইতিহাসবিবর্ণ হৃদয় নগরে-নগরে গ্রামে নিষ্প্রদীপ হয়। হেমন্তের রাতের আকাশে আজ কোনো তারা নেই। নগরীর- পৃথিবীর মানুষের চোখ থেকে ঘুম তবুও কেবলি ভেঙে যায় স্‌প্লিন্টারের অনন্ত নক্ষত্রে। পশ্চিমে প্রেতের মতন ইউরোপ; পূব দিকে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা; আফ্রিকার দেবতাত্মা জন্তুর মতন ঘনঘটাচ্ছন্নতা; ইয়াঙ্কির লেন-দেন ডলারে প্রত্যয়;- এই সব মৃত হাত তবে নব-নব ইতিহার- উন্মেষের না কি?- ভেবে কারু রক্তে স্থির প্রীতি নেই- নেই;- অগণন তাপী সাধারণ প্রাচী অবাচীর উদীচীর মতন একাকী আজ নেই- কোথাও দিৎসা নেই- জেনে তবু রাত্রিকরোজ্জ্বল সমুদ্রের পাখি। রিস্টওয়াচ কামানের ক্ষোভে চূর্ণ হ’য়ে আজ রাতে ঢের মেঘ হিম হ’য়ে আছে দিকে-দিকে! পাহাড়ের নিচে- তাহাদের কারু- কারু মণিবন্ধে ঘড়ি সময়ের কাঁটা হয়তো বা ধীরে-ধীরে ঘুরাতেছে; চাঁদের আলোর নিচে এই সব অদ্ভুত প্রহরী কিছুক্ষণ কথা কবে;- হৃদয়যন্ত্রের যেন প্রীত আকাঙ্ক্ষার মতো ন’ড়ে, সমুজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো গিলে। জলপাই পল্লবের তলে ঝরা বিন্দু-বিন্দু শিশিরের রাশি দূর সমুদ্রের শব্দ শাদা চাদরের মতো- জনহীন- বাতাসের ধ্বনি দু;-এক মুহূর্ত আরো ইহাদের গড়িবে জীবনী। স্তিমিত- স্তিমিত আরো ক’রে দিয়ে ধীরে ইহারা উঠিবে জেগে অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে। রেনকোট কাঁধে রেখে রেনকোট কাঁধে রেখে শহরের রাস্তায় কত বার নেমেছি যে রাতে কত যে গভীর রাত হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে কেবল গিয়েছি চলে পিছল পথের থেকে আরো দূর অন্ধকার পথে গলির ঘুঁজির ফাঁকে- ডাস্টবিন ইঁদুরের বিড়ালের আড়ষ্ট জগতে কত যে গভীর রাতে রাতে হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু গ্যাসপোস্টদের সাথে-হাইড্রেন্ট খুলে গিয়ে কুষ্ঠরোগী ধুয়েছে নীরবে ক্লেদ শরীরে তাহার গ্যাসের আলোর দিকে চেয়ে আছে ঘোলা চোখ হিম কাঠ মৃতবৎসার নেড়িকুকুরের ক্ষুধা পথ থেকে পথে মিটে যায় ট্যাক্সির নিচে চেয়ে দেখি চূর্ণ তার দাঁত মুখ নিঃসহায় নক্ষত্রের দিকে আছে খিঁচে হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-অবসন্ন ট্রাম বাস্‌ কলের পৃথিবী সব তখন গিয়েছে চলে ঘরে তবুও মানুষ- সে যে কল নয়- পথ থেকে আরো দূর পথের ভিতরে একা একা চলে যায়- যতদূর স্তব্ধ এই শহরের গ্যাসপোস্ট জ্বলে কী যেন কিসের তরে হাঁটিয়াছি- হেঁটে হেঁটে একদিন ক্লান্ত হবো বলে কত যে গভীর রাতে রাতে হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-তবুও কোনো ক্লান্তি নাই- কী যে চাই গাঢরাতে মিনোটায় মিনারের পাশে একেলা দাঁড়াই গিয়ে- নক্ষত্রেরা মুখোমুখি দাঁড়ায়েছে কঠিন আকাশে বাতাসে ভাসিয়া আসে ধুলো খড় হিম হাওয়া একফোঁটা – আধফোঁটা জল আমারে কে ডাকে যেন- কেউ নাই; হাওয়া শুধু কথা কয় কেমন বিহবল- হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-চুরুট জ্বালাই চুপে; এখন কত যে রাত- আকাশ ভরেছে ছেঁড়া মেঘে সারা রাত জলে জলে ভিজে ফিরি…… প্রণয়িনী ডাহুকীর মতন আবেগে কার সাথে প্রেম তবু? কে বা সেই? কারে আমি ভালোবাসি নক্ষত্রের তলে! বেবিলনে তারে আমি দেখিয়াছি- আজো আর লাগি আমি ভিজি জলে জলে- কত যে গভীর রাতে রাতে হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে- লঘু মুহূর্ত এখন দিনের শেষে তিনজন আধো আইবুড়ো ভিখিরীর অত্যন্ত প্রশান্ত হ'লো মন; ধূসর বাতাস খেয়ে এক গাল- রাস্তার পাশে ধূসর বাতাস দিয়ে ক'রে নিলো মুখ আচমন। কেননা এখন তারা যেই দেশে যাবে তাকে রাঙা নদী বলে; সেইখানে ধোপা আর গাধা এসে জলে মুখ দেখে পরস্পরের পিঠে চড়ে যাদুবলে।তবুও যাবার আগে তিনটি ভিখিরী মিলে গিয়ে গোল হ'য়ে বসে গেল তিন মগ চায়ে; একটি উওজির, রাজা, বাকিটা কোটাল, পরস্পরকে তারা নিলো বাৎলায়ে। তবুও এক ভিখিরিনী তিনজন খোঁড়া, খুড়ো, বেয়াইয়ের টানে- অথবা চায়ের মগে কুটুম হয়েছে এই জ্ঞানে মিলে-মিশে গেল রাতা চার জোড়া কানে।কাব্যগ্রন্থ - সাতটি তারার তিমির লোকসামান্য অন্ধভাবে আলোকিত হয়েছিলো তারা জীবনের সাগরে-সাগরেঃ বঙ্গোপসাগরে, চীনের সমুদ্রে- দ্বীপপুঞ্জের সাগরে। নিজের মৎসর নিয়ে নিশানের 'পরে সূর্য এঁকে চোখ মেরেছিলো তারা নীলিমার সূর্যের দিকে। তারা সব আজ রাতে বিলোড়িত জাহাজের খোল সাগরকীটের মৃত শরীরের আলেয়ার মতো সময়ের দোলা খেয়ে নড়ে; 'এশিয়া কি এশিয়াবাসীর কোপ্রস্‌পেরেটির সূর্যদেবীর নিজ প্রতীতির তরে?' ব'লে সে পুরোনো যুগ শেষ হ'য়ে যায়। কোথাও নতুন দিন আসে; কে জানে সেখানে সৎ নবীনতা র'য়ে গেছে কিনা; সূর্যের চেয়েও বেশি বালির উত্তাপে বহুকাল কেটে গেছে বহুতর শ্লোগানের পাপে। এ-রকম ইতিহাস উৎস রক্ত হ'য়ে এই নব উত্তরাধিকারে স্বর্গতি না হোক- তবু মানুষের চরিত্র সংহত হয় না কি? ভাবনা ব্যাহত হ'য়ে বেড়ে যায়- স্থির হয় না কি? হে সাগর সময়ের, হে মানুষ,- সময়ের সাগরের নিরঞ্জন-ফাঁকি চিনে নিয়ে বিমলিন নাবিকের মতন একাকী হ'লেও সে হ'তো, তবু পৃথিবী বড়ো রৌদ্রে-                                         আরো প্রিয়তর জনতায় 'নেই' এই অনুভব জয় ক'রে আনন্দে ছড়ায়ে যেতে চায়। লোকেন বোসের জর্নাল সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি — এখনো কি ভালোবাসি? সেটা অবসরে ভাববার কথা, অবসর তবু নেই; তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে এখন শেলফে চার্বাক, ফ্রয়েড, প্লেটো, পাভলভ ভাবে সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না!পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে: সুজাতা লিখেছে আমার কাছে, বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা; ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ; নাড়বো না আমি নেড়ে কার কি লাভ; মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব, সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে মানে এই — অমিতা বলছি যাকে — কিন্তু কথাটা থাক; কিন্তু তবুও — আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর, নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে এখন কি করে মন কারাভান হবে।প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি, হৃদয়, হৃদয় তুমি! তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু। অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে? অমিতা নিজে কি তাকে? অবসর মতো কথা ভাবা যাবে, ঢের অবসর চাই; দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু, ফিরে এসে রাতে ক্লাবে; কখন সময় হবে।হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে — হৃদয় কেন যে কাঁপে, ‘ভালোবাসতাম’ — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান। সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো? আজো ভালোবাসে নাকি? ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে; কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে?সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে; অমিতা কি মিহিজামে? বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই। ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে; সময়ের এই স্থির এক দিক, তবু স্থিরতর নয়; প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়। শকুন মাঠ থেকে মাঠে মাঠে — সমস্ত দুপুর ভরে এশিয়ার আকাশে আকাশে শকুনেরা চড়িতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি — নিস্তব্ধ প্রান্তর শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশেআরেক আকাশ যেন — সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর কঠিন মেঘের থেকে — যেন দূর আলো ছেড়ে ধুম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ পড়ে গেছে — পড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের ‘পরএই সব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহুর্তে শুধু — আবার করিছে আরোহণ আঁধার বিশাল ডানা পাম্‌ গাছে — পাহাড়র শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে; একবার পৃথিবীর শোভা দেখে — বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখনবন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই — একবার স্নিগ্ধ মালাবারে উড়ে যায় — কোন্‌ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চলে যায় যেন কোন্‌ মৃত্যুর ওপারে;যেন কোন্‌ বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষন্ন লেগুন কেঁদে ওঠে… চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেই সব হূন। শঙ্খমালা কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল , তোমারে চাই : বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি – কুয়াশার পাখনায় - সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক জোনাকির দেহ হতে – খুঁজেছি তোমারে সেইখানে - ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে ধানসিঁড়ি বেয়ে – বেয়ে সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে। দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা; সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে সেই পাখি দেয় ধরা - বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর, শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর। কড়ির মতন শাদা মুখ তার; দুইথানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে : দক্ষিণের শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে আগুনে হায়। চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার! স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো- দুধে আর্দ্র – কবেকার শঙ্খিনীমালার! এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর। শতাব্দী চারিদিকে নীল সাগর ডাকে অন্ধকারে, শুনি; ঐখানেতে আলোকস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ঢের একটি-দুটি তারার সাথে;- তারপরেতে অনেকগুলো তারা; অন্নে ক্ষুধা মিটে গেলেও মনের ভিতরের ব্যথার কোনো মীমাংসা নেই জানিয়ে দিয়ে আকাশ ভ’রে জ্বলে; হেমন্ত রাত ক্রমেই আরো অবোধ ক্লান্ত অধোগামী হ’য়ে চলবে কি-না ভাবতে আছে;- ঋতুর কামচক্রে সে তো চলে; কিন্তু আরো আশা আলো চলার আকাশ রয়েছে কি মানব হৃদয়ে। অথবা এ মানব প্রাণের অনুতর্ক; হেমন্ত খুব স্থির সপ্রতিভ ব্যাপ্ত হিরণ গভীর সময় ব’লে ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে উন্নতি প্রেম কাম্য মনে হলে হৃদয়কে ঠিক শীত সাহসিক হেমন্তলোক ভাবি; চারিদিকে রক্তে রৌদ্রে অনেক বিনিময়ে ব্যবহারে কিছুই তবু ফল হলো নাঃ এসো মানুষ আবার দেখা যাক সময় দেশ ও সন্ততিদের কী লাভ হ’তে পারে। ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে; কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙে, ক্রমেই বীতশোক ক’রে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে; অন্ধ অভিভূতের মতো যদিও আজ লোক চলছে, তবু মানুষকে সে চিনে নিতে বলেঃ কোথায় মধু-কোথায় কালের মক্ষিকারা-কোথায় আহ্বান নীড় গঠনের সমবায়ের শান্তি-সহিষ্ণুতার;- মানুষও জ্ঞানী; তবুও ধন্য মক্ষিকাদের জ্ঞান। কাছে-দূরে এই শতাব্দীর প্রাণ নদীরা রোল স্তব্ধ ক’রে রাখে গিয়ে যে-ভূগোলের অসারতার পরে সেখানে নীলকন্ঠ পাখি ফসল সূর্য নেই, ধুসর আকাশ,- একটি শুধু মেরুন রঙের গাছের মর্মরে আজ পৃথিবীর শূন্যপথ ও জীবনবেদের নিরাশা তাপ ভয় জেগে ওঠে;- এ-সুর ক্রমে নরম- ক্রমে হয়তো আরো কঠিন হ’তে পারে? সোফোক্লেস ও মহাভারত মানব জাতির এ ব্যর্থতা জেনেছিলো; জানি; আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধকারে। শতাব্দী শেষ সূর্যগরিমার নিচে মানুষের উচ্ছ্রিত জীবন           শুরু হ’ল- যখন সে শিশুর মতন; নদীর জলের মত আশা দিয়ে উচ্চারিত হয়ে           তবুও সে মানুষের মন। রঙীন খেলনা, ঘোড়া, জাপানী লাটিম,           আরব্যোপন্যাসের সেই পরী জিন উড্ডীন বক                    নিয়ে খেলে বিবেচনা ক’রে হয়ে যায়                              ক্রমেই নিঃস্বার্থ বিবেচক। অপরা বিদ্যার দিন ছাত্রের,           কলেজিয়ানের পুরস্কার,           অধ্যায়নবিলাসীর                    দু চারটে পেপারকাটার প’ড়ে থেকে তার পর মলিন টেবিল;           বাজেটের কমিটি মিটিঙে;- ভুলের ভিতর থেকে ভুলে- গরিমার থেকে আরো গরিমার পানে,- যেখানে আসন্ন কাল চিরকাল আগামীপ্রসবাঃ আজো যা হয়নি সেই চরিত্রের পানে। শব যেখানে রূপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর, যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর; যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায় সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়? নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ; কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল বিকালের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী রাঙা মেঘ- হ্লুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি; অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো; লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপালি নীরব। শহর হৃদয়, অনেক বড়ো-বড়ো শহর দেখেছো তুমি; সেই সব শহরের ইটপাথর, কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি; বন্দরের ওপারে সূর্যকে দেখেছি মেঘের কমলারঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মতো বোঝা রয়েছে তার; শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু-উঁচু মিনারের ওপরেও দেখেছি- নক্ষত্রেরা- অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে। শান্তি জীবন কি নীরক্ত সম্রাট এক সুধাখোর: কুট ব্যবসায়ী নীল পাশ্বচরগুলো তার মৃত্যুর উৎসব? মানুষের তরে তবে কোন পথ: কোন অন্তরীক্ষে তারে নিয়ে যাবে আসন্ন সময়? সেইখানে বালুঘড়ি, বলো, তবে স্তব্ধতার মতো: একদিন বাতাসের সাথে ঢের ধ্বনিবিনিময় করেছিলো;- তারপর হ'য়ে গেছে আঁখিহীন চুুপ। প্রান্তরের শুষ্ক ঘাসে যে সবুজ বাতাসের আশা একদিন বলেছিলো আবার করিবো আমি অমৃত সঞ্চয়- শত-শত মেঘশাবকের আঁখিতারকাও পেলো যেন ভয় শান্তি, শান্তি- উত্তেজিত শপথের উৎসারণ প্লীহা ঘিরে থাকে না সতত, বালুঘড়ি. হ'য়ে থাকে চিরদিন স্তব্ধতার মতো। শিকার ভোর; আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল : চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে : পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলী – মদির মেয়েটির মতো; কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে – মুক্তা আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি = তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো। হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালিরা সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে - মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; শুকনো অশ্বত্থ পাতা দুমুড়ে এখনো জ্বলছে তাদের; সূর্যের আলোয় তার রঙ কুসুমের মতো নেই আর; হয়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো। সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।ভোর; সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে – বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল। এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধী ঘাস ছিঁড়ে – ছিঁড়ে খাচ্ছে; নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল - ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য, এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য একটা অদ্ভুত শব্দ। নদীর জল মচকাফুলের মতো লাল। আগুন জ্বলল আবার- উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল। নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনো শিশিরভেজা গল্প; সিগারেটের ধোঁয়া; টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা; এলোমেলো কয়েকটা বন্ধুক- হিম- নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম। শিরীষের ডালপালা শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে, পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন; বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে করুণ হয়েছে ঝাউবন।নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলরবে ভেসে নারকেলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রূণ; বিকেল বলেছে এই নদীটিকে : ‘শান্ত হতে হবে -‘ অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে। তার মুখ মনে পড়ে এ- রকম স্নিগ্ধ পৃথিবীর পাতাপতঙ্গের কাছে চলে এলে; চারি দিকে রাত্রি নক্ষত্রের আলোড়ন এখন দয়ার মতো; তবুও দয়ার মানে মৃত্যুতে স্থির হয়ে থাকে ভুলে যাওয়া মানুষের সনাতন মন। হাজার বছর শুধু খেলা করে হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকতারে জোনাকির মতো; চারি দিকে চিরদিন রাত্রির নিধান; বালির উপরে জোছনা – দেবদারু ছায়া ইতস্তত বিচূর্ণ থামের মতো : দ্বারকার; – দাঁড়ায়ে রয়েছে নৃত, ম্লান। শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের – ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন; ‘মনে আছে?’ শুধালো সে – শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন?’ শীত রাত এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে - সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে; কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে? কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার? তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি, তারা কিশোর নয়, কিশোরী নয় আর; কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে: সার্কাসের ব্যথিত সিংহ, স্থবির সিংহ এক – আফিমের সিংহ – অন্ধ – অন্ধকার। চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।সিংহ অরন্যকে পাবে না আর পাবে না আর পাবে না আর কোকিলের গান বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ। হে পৃথিবী, হে বিপাশামদির নাগপাশ, – তুমি পাশ ফিরে শোও, কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর। শীত শেষ আজ রাতে শেষ হ'য়ে গেল শীত- তারপর কে যে এলো মাঠে-মাঠে খড়ে হাঁস গাভী শাদা-প্লেট আকাশের নীল পথে যেন মৃদু মেঘের মতন, ধানের সোনার ছড়া নাই মাঠে- ইঁদুর তবুও আর যাবে নাকো ঘরেতাহার রূপালি রোম একবার জ্যোৎস্নায় সচকিত ক'রে যায় মন, হৃদয়ে আস্বাদ এলো ফড়িঙের- কীটেরও যে- ঘাস থেকে ঘাসে-ঘাসে তাই নির্জন ব্যাঙের মুখে মাকড়ের জালে তারা বরং এ অধীর জীবনছেড়ে দেবে- তবু আজ জ্যোৎস্নায় সুখ ছাড়া সাধ ছাড়া আর কিছু নাই; আছে নাকি আর কিছু? পাতা খড়কুটো দিয়ে যে-আগুন জ্বেলেছে হৃদয় গভীর শীতের রাতে- ব্যথা কম পাবে ব'লে- সেই সমারোহ আর চাই?জীবন একাকী আজো- ব্যথা আজো- এখন করি না তবু বিয়োগের ভয় এখন এসেছে প্রেম;- কার সাথে? কোন্‌ খানে? জানি নাকো;- তবু সে আমারে মাঠে-মাঠে নিয়ে যায়- তারপর পৃথিবীর ঘাস পাতা ডিম নীড়ঃ সে এক বিস্ময়এ-শরীর রোগ নখ মুখ চুল- এ-জীবন ইহা যাহা ইহা যাহা নয়; রঙিন কীটের মতো নিজের প্রাণের সাধে একরাত মাঠে জেগে রয় শীতের রাতের কবিতা গভীর শীতের রাত এই সব,- তবু চারিদিকে যুবাদের হৃদয়ের জীবনের কথা মৃত্যুর উপর দিয়ে সাঁকোর মতন চেয়ে দেখে মরণের অপ্রমেয়তা সেতুর ছবির মত মিলে গিয়ে জলের ভিতরে জীবনের জয়- আর মরণের স্তব্ধতাকে অনুভব করে। অনুভব করে এই জীবনই মহৎ, মরণের চেয়ে বড় জীবনের  সুর; যদিও অন্ন আজ ভূমি নয়- তবুও মৈত্রেয়ী অন্নলোভাতুর; হৃদয়বিহীনভাবে- দশ বিশ শত কোটি টন চলে আজ পঙ্গপাল,- নিজেকে উজাড় করে;- জেনে জীবন হতাশ নয় ব’লেই জীবন। শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন, বনলতা সেন। কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন, তুমি নাই বনলতা সেন।তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও? কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও। কেন যে সবের আগে তুমি পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি (কেন যে সবের আগে তুমি) ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন, কবেকার বনলতা সেন। কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে, কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে, কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন, নিশুথির বনলতা সেন। শেষ হল জীবনের সব লেনদেন শেষ হল জীবনের সব লেনদেন বনলতা সেন কোথায় গিয়াছ তুমি এই বেলা মাছরাঙ্গা ভোলে নি তো দুপুরের খেলা শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন। তুমি নেই বনলতা সেনতোমার মত কেউ কি ছিল কোথাও কেন যে তুমি সবার আগে চলে যাও কেন যে সবের আগে তুমি পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি (কেন যে সবের আগে তুমি) ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন কবেকার বনলতা সেনকত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে কত যে ঘুমিয়ে রব বস্তির পাশে কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন নিশুথির বনলতা সেন শ্মশান কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে রূপময়ী তন্বী মাধবীরে ধরণী বরিয়া লয় বারে-বারে-বারে! -আমাদের অশ্রুর পাথারে ফুটে ওঠে সচকিতে উৎসবের হাসি,- অপরূপ বিলাসের বাঁশি! ভগ্ন প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি, ফেনাময় সুরাপাত্র ধরি ভুলে যাই বিষের অস্বাদ! মোহময় যৌবনের সাধ আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন অধর! চিরমৃত্যুচর হে মৌন শ্মশান ধূম-অবগুন্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান হেরিতেছ কিসের স্বপন! ক্ষণে ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নির্বাপন স্তব্ধ করি রাখিতেছ বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি! তবু মুখপানে চেয়ে কবে বৈতরণী হ’য়ে গেছে কলহীন! বক্ষে তব হিম হ’য়ে আছ কত উগ্রশিখা চিতা হে অনাদি পিতা! ভস্মগর্ভে, মরণের অকূল শিয়রে জন্মযুগ দিতেছ প্রহরা- কবে বসুন্ধরা মৃত্যুগাঢ় মদিবার শেষ পাত্রখানি তুলে দেবে হসে- তব, কবে লবে টানি কাঙ্কাল আঙুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে শ্মশান-তিমিরে, লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার বিবসনা শোভা দিব্য মনোলোভা! কোটি কোটি চিতা-ফণা দিয়া রূপসীর অঙ্গ-আলিঙ্গিয়া শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু! এ বসুধা-বধূ আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার! ধ্বক্‌-ধ্বক্‌-দারুণ তৃষ্ণার রসনা মেলিয়া অপেক্ষায় জেগে আছে শ্মশানের হিয়া! আলোকে আঁধারে অগণন চিতার দুয়ারে যেতেছে সে ছুটে, তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে আনিতেছে নব মৃত্যু পথিকের ডাকি, তুলিতেছে রক্ত-ধুম্র আঁখি! -নিরাশার দীর্ঘশ্বাস শুধু বৈতরণীমরু ঘেরি জ্বলে যায় ধু ধু আসে না প্রেয়সী! নিদ্রাহীন শশী, আকাশের অনাদি তারকা রহিয়াছে জেগে তার সনে; শ্মশানের হিম বাতায়নে শত শত প্রেতবধূ দিয়া যায় দেখা,- তবু সে যে প’ড়ে আছে একা, বিমনা-বিরহী! বক্ষে তার কত লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি, কত শৌর্য-সাম্রাজ্যের সীমা প্রেম-পুণ্য-পূজার গরিমা অকলঙ্ক সৌন্দর্যের বিভা গৌরবের দিবা! তবু তার মেটে নাই তৃষা; বিচ্ছেদের নিশা আজও তার হয় নাই শেষ! আশ্রান্ত অঙুলি সে যে করিছে নির্দেশ অবনীর পক্কবিম্ব অধরের পর! পাতাঝরা হেমন্তের স্বর, ক’রে দেয় সচকিত তারে, হিমানী-পাথারে কুয়াশাপুরীর মৌন জানায়ন তুলে চেয়ে থাকে আঁধারে অকূলে সুদূরের পানে! বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ-সন্ধানে এল কি রে জাহ্নবীর শেষ উর্মিধারা! অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি-কামনা-সাহারা! শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ — বহুকাল গেয়ে গেছ গান সোনালি চিলের মতো উড়ে উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে, — লক্ষ্মীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জ্যোৎস্নার আবেগে গান গায় — গুনিয়াছি রাখিপূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান তার মতো; আম চাঁপা কদমের গাছ থেকে গাহে অফুরান যেন স্নিগ্ধ ধান ঝরে.. অনন — সবুজ শালি আছে যেন লেগে বুকে তব; বল্লালের বাংলায় কবে যে উঠলে তুমি জেগে; পদ্মা, মেঘনা, ইছামতী নয় শুধু — তুমি কবি করিয়াছ স্নানসাত সমুদ্রের জলে, — ঘোড়া নিয়ে গেছ তুমি ধূম নারীবেশে অর্জুনের মতো, আহা, — আরো দূর স্মান নীল রূপের কুয়াশা ফুঁড়েছ সুপর্ন তুমি — দূর রং আরো দূর রেখা ভালোবেসে; আমাদের কালীদাহ — গাঙুড় — গাঙের চিল তবু ভালোবাসা চায় যে তোমার কাছে — চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে এই দহে — এই চুর্ণ মঠে — মঠে — এই জীর্ণ বটে বাঁধো বাসা। শ্যামলী শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন: যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল সুদূরে নতুন দেশে সোনা আছে ব’লে মহিলারই প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ুরশয্যার কথা ভুলে সকালের রূঢ় রৌদ্র ডুবে যেত কোথায় অকূলে।তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল, দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল, নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব– শ্যামলী, করেছি অনুভব।অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল; মানুষকে স্থির স্থিরতর হতে দেবে না সময়; সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্ত নদী। অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয় দূর সাগরের শব্দ — শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে কাল কিছু হয়েছিল — হবে কি শাশ্বতকাল পরে। শ্রবণরাত শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায় কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?বর্ষণ অনেকক্ষণ হয় থেমে গেছে, যত দূর চোখ যায় কালো আকাশ মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে করে চুপ করে রয়েছে যেন; নিস্তব্ধ হয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।মনে হয় কারা যেন বড় বড় কপাট খুলছে, বন্ধ করে ফেলেছে আবার; কোন্ দূর-নীরব-আকাশরেখার সীমানায়।বালিশে মাথা রেখে যারা ঘুমিয়ে আছে তারা ঘুমিয়ে থাকে; কাল ভোরে জাগবার জন্য। যে সব ধূসর হাসি, গল্প, প্রেম, মুখরেখা পৃথিবীর পাথরে কঙ্কালে অন্ধকারে মিশেছিল ধীরে ধীরে জেগে ওঠে তারা; পৃথিবীর অবিচলিত পঞ্জর থেকে খসিয়ে আমাকে খুঁজে বার করে। সমস্ত বঙ্গোপসাগরের উচ্ছাস থেকে যায় যেন; মাইলের পর মাইল মৃত্তিকা নীরব হয়ে থাকে।কে যেন বলে: আমি যদি সেই সব কপাট স্পর্শ করতে পারতাম তা হলে এইরকম গভীর নিস্তব্ধ রাতে স্পর্শ করতাম গিয়ে।- আমার কাঁধের উপর ঝাপসা হাত রেখে ধীরে ধীরে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে।চোখ তুলে আমি দুই স্তর অন্ধকারের ভিতর ধূসর মেঘের মতো প্রবেশ করলাম; সেই মুখের ভিতর প্রবেশ করলাম।কাব্যগ্রন্থ : মহাপৃথিবী শ্রাবণরাত শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায় কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?বর্ষণ অনেকক্ষণ হয় থেমে গেছে, যত দূর চোখ যায় কালো আকাশ মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে করে চুপ করে রয়েছে যেন; নিস্তব্ধ হয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।মনে হয় কারা যেন বড় বড় কপাট খুলছে, বন্ধ করে ফেলেছে আবার; কোন্ দূর-নীরব-আকাশরেখার সীমানায়।বালিশে মাথা রেখে যারা ঘুমিয়ে আছে তারা ঘুমিয়ে থাকে; কাল ভোরে জাগবার জন্য। যে সব ধূসর হাসি, গল্প, প্রেম, মুখরেখা পৃথিবীর পাথরে কঙ্কালে অন্ধকারে মিশেছিল ধীরে ধীরে জেগে ওঠে তারা; পৃথিবীর অবিচলিত পঞ্জর থেকে খসিয়ে আমাকে খুঁজে বার করে। সমস্ত বঙ্গোপসাগরের উচ্ছাস থেকে যায় যেন; মাইলের পর মাইল মৃত্তিকা নীরব হয়ে থাকে।কে যেন বলে: আমি যদি সেই সব কপাট স্পর্শ করতে পারতাম তা হলে এইরকম গভীর নিস্তব্ধ রাতে স্পর্শ করতাম গিয়ে।- আমার কাঁধের উপর ঝাপসা হাত রেখে ধীরে ধীরে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে।চোখ তুলে আমি দুই স্তর অন্ধকারের ভিতর ধূসর মেঘের মতো প্রবেশ করলাম; সেই মুখের ভিতর প্রবেশ করলাম।কাব্যগ্রন্থ : মহাপৃথিবী সন্ধ্যা হয় সন্ধ্যা হয় — চারিদিকে মৃদু নীরবতা কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে; গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেড়ে ধীরে ধীরে; আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে; পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে; পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু;জনার মনে; আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে। সন্ধ্যা হয়ে আসে সন্ধ্যা হয়ে আসে- সন্ধ্যা হয়ে আসে একা একা মাঠের বাতাসে ঘুরি আমি- বসি আমি ঘাসেওই দূরে দেখা যায় কার লাল পাড় প্রসাদের বউ বুঝি-পাশে বুঝি তার প্রসাদ রয়েছে বসে-বাড়িতেছে সন্ধ্যার আঁধারবছর আরেক হ’ল হয়েছিলো দু’জনের বিয়ে মনে পড়ে; তারপর কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আজো তারা যায় নি হারিয়েরোজই তারা সন্ধ্যা হলে আসে এই মাঠে-বসে থাকে ঘাসে লক্ষ লক্ষ তারার আকাশে বসে থাকে-মনে হয় মাঠের চাঁদের কথা কয় দুজনার প্রাণে ঢের শান্তি ও বিস্ময়আছে আমি জানি এরা দুটি পৃথিবীর আঁচলের প্রাণী মনে কোনো প্রশ্ন নাই-দ্বিধা নাই জানিপ্রাণের আশ্চর্য টান আছে চিরদিন থাকে কাছে কাছে বিচ্ছেদে বিনষ্ট হয় পাছেজীবনের শান্ত গল্প- প্রসাদ কখনো তাই বড় বেশি তীর্থে যায় নাই যদি তারে এ কথা শুধাইমৃত্যুরেও দেবে নাকি ফাঁকি? কিন্তু থাক চেয়ে দেখ যেন দুটি পাখি বসে আছে-পাখনায় শান্ত পাখা ঢাকিনক্ষত্রও চেয়ে দেখে সব এমন নিবিড় স্নিগ্ধ-এমন নীরব ভালোবাসাঃ মাটিতেও নয় অসম্ভব?এই তারা বলে নীল লাল আলো নিয়ে জ্বলে চেয়ে দেখে আকাশের তলেরক্তে রক্তে ভ’রে আছে মানুষের মন রোম নষ্ট হয়ে গেছে…গেছে বেবিলন পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতনএকদিন ভেঙে যাবে: হয়ে যাবে ধুলো আর ছাই রোম নাই আজ আর- বেবিলন নাই আজো তবু হৃদয়ের হৃদয়কে চাই। সপ্তক এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে;- জানি না সে এইখানে                                                           শুয়ে আছে কিনা। অনেক হয়েছে শোয়া;- তারপর একদিন চ’লে গেছে                                                           কোন দূর মেঘে। অন্ধকার শেষ হ’লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগেঃ সরোজিনী চ’লে গেল অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া- পাখিদের                                                           মতো পাখা বিনা? হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির                                            ভূত বলেঃ আমি তো জানি না। জাফরান- আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগেঃ লুপ্ত বেড়ালের মতো; শূন্য চাতুরির মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।কাব্যগ্রন্থ - সাতটি তারার তিমির সবিতা সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে: ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি, তাহাদের সাথে সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন; মনেপড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী, রেশম, মদের সার্থবাহ, দুধের মতন শাদা নারী।অন্তত রৌদ্রের থেকে তারা শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে সহসা বিকেলবেলা শেষ হয়ে গেলে চলে যেত কেমন নীরবে। চারি দিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র; মধ্যযুগের অবসান স্থির করে দিতে গিয়ে ইউরোপ গ্রীস হতেছে উজ্জ্বল খৃষ্টান।তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা– সিন্ধুর রাত্রির জল জানে– আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে; কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে আমরা অকূল হয়ে উঠে মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায় যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে; কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন! তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে কবেকার সমুদ্রের নুন; তোমার মুখের রেখা আজো মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন: কত আছে — তবু কত দূরে। সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে, সময়ের হাত সৌন্দর্যেরে করে না আঘাত মানুষের মনে যে সৌন্দর্য জন্ম লয়- শুকনো পাতার শুকনো পাতার মতো ঝরে নাকো বনে ঝরে নাকো বনে। নক্ষত্রও মুছে যায়- মুছে যায়- পৃথিবীর পুরাতন পথ শেষ হয়-কমলা ফুল, বন বনের পর্বত; মানুষের মনে যে সৌন্দর্য জন্ম লয়- শুকনো পাতার মতো ঝরে নাকো বনে, ঝরে নাকো বনে। সময়সেতুপথে ভোরের বেলায় মাঠ প্রান্তর নীলকন্ঠ পাখি, দুপুরবেলার আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা, সারাটি দিন মীনরৌদ্রমুখর জলের স্বর– অনবসিত বাহির ঘরের ঘরণীর এই সীমা।তবুও রৌদ্র সাগরে নিভে গেল; বলে গেল : ‘অনেক মানুষ মরে গেছে'; অনেক নারীরা কি তাদের সাথে হারিয়ে গেছে?–বলতে গেলাম আমি; উঁচু গাছের ধূসর হাড়ে চাঁদ না কি সে পাখি বাতাস আকাশ নক্ষত্র নীড় খুঁজে বসে আছে এই প্রকৃতির পলকে নিবড়ি হয়ে; পুরুষনারী হারিয়ে গেছে শষ্প নদীর অমনোনিবেশে, অমেয় সুসময়ের মতো রয়েছে হৃদয়ে। সময়ের কাছে সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয় কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি। সেই সব একদিন হয়তো বা কোনো এক সমুদ্রের পারে আজকের পরিচিত কোনো নীল আভার পাহাড়ে অন্ধকারে হাড়কঙ্করের মতো শুয়ে নিজের আয়ুর দিন তবুও গণনা ক'রে যায় চিরদিন; নীলিমার কাছ থেকে ঢের দূরে স'রে গিয়ে, সূর্যের আলোর থেকে অন্তর্হিত হ'য়েঃ পেপিরাসে- সেদিন প্রিন্টিং প্রেসে কিছু নেই আর; প্রাচীন চীনের শেষে নবতম শতাব্দীর চীন সেদিন হারিয়ে গেছে।আজকে মানুষ আমি তবুও তো- সৃষ্টির হৃদয়ে হৈমন্তিক স্পন্দনের পথে ফসল; আর এই মানবের আগামী কঙ্কাল; আর নব- নব-নব মানবের তরে কেবলি অপেক্ষাতুর হ'য়ে পথ চিনে নেওয়া- চিনে নিতে চাওয়া; আর সে-চলার পথে বাধা দিয়ে অন্নের সমাপ্তিহীন ক্ষুধা; (কেন এই ক্ষুধা- কেনই বা সমাপ্তিহীন!) যারা সব পেয়ে গেছে তাদের উচ্ছিষ্ট, যারা কিছু পায় নাই তাদের জঞ্জাল; আমি এই সব। সময়ের সমুদ্রের পারে কালকের ভোরে আর আজকের অন্ধকারে সাগরের বড়ো শাদা পাখির মতন দুইটি ছড়ানো ডানা বুকে নিয়ে কেউ কোথাও উচ্ছল প্রাণশিখা জ্বালায়ে সাহস সাধ স্বপ আছে- ভাবে। ভেবে নিক- যৌবনের জোবন্ত প্রতীকঃ তার জয়! প্রৌঢ়তার দিকে তবু পৃথিবীর জ্ঞানের বয়স অগ্রসর হ'য়ে কোন্‌ আলোকের পাখিকে দেখেছে? জয়, তার জয়, যুগে-যুগে তার জয়! ডোডো পাখি নয়;মানুষেরা বার-বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে; নব নব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে; তবুও কোথাও সেই অনির্বচনীয় স্বপনের সফলতা- নবীনতা- শুভ্র মানবিকতার ভোর? নচিকেতা জরাথ্রুস্ট্র লাওৎ-সে এঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছে? অন্ধকারে ইতিহাসপুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মতো মনে হয় যতই শান্তিতে স্থির হ'য়ে যেতে চাই; কোথাও আঘাত ছাড়া- তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই। হে কালপুরুষ তারা, অনন্ত দ্বন্দের কোলে উঠে যেতে হবে কেবলি গতির গুণগান গেয়ে- সৈকত ছেড়েছি এই স্বচ্ছন্দ উৎসবে; নতুন তরঙ্গে রৌদ্রে বিপ্লবে মিলনসূর্যে মানবিক রণ ক্রমেই নিস্তেজ হয় ক্রমেই গভীর হয় মানবিক জাতীয় মিলন? নব-নব মৃত্যুশব্দ রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় ক'রে মানুষের চেতনার দিন অমেয় চিন্তায় খ্যাত হ'য়ে তবু ইতিহাসভুবনে নবীন হবে না কি মানবকে চিনে- তবু প্রতিটি ব্যক্তির ষাট বসন্তের তরে! সেই সুনিবিড় উদ্বোধনে- 'আছে আছে আছে, এই বোধির ভিতরে চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষয় হৃদয়; জয় অস্তসূর্য, জয়, অলখ অরুণোদয়, জয়।'কাব্যগ্রন্থ - সাতটি তারার তিমির সময়ের তীরে নিচে হতাহত সৈন্যদের ভিড় পেরিয়ে, মাথার ওপর অগণন নক্ষত্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে, কোনো দূর সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শ মুখে রেখে, আমার শরীরের ভিতর অনাদি সৃষ্টির রক্তের গুঞ্জরণ শুনে, কোথায় শিবিরে গিয়ে পৌঁছলাম আমি। সেখানে মাতাল সেনানায়কেরা মদকে নারীর মতো ব্যবহার করছে, নারীকে জলের মতো; তাদের হৃদয়ের থেকে উত্থিত সৃষ্টিবিসারী গানে নতুন সমুদ্রের পারে নক্ষত্রের নগ্নলোক সৃষ্টি হচ্ছে যেন; কোথাও কোনো মানবিক নগর বন্দর মিনার খিলান নেই আর; এক দিকে বালিপ্রলেপী মরুভূমি হু-হু করছে; আর এক দিকে ঘাসের প্রান্তর ছড়িয়ে আছে- আন্তঃনাক্ষত্রিক শূন্যের মতো অপার অন্ধকারে মাইলের পর মাইল।শুধু বাতাস উড়ে আসছেঃ স্থলিত নিহত মনুষ্যত্বের শেষ সীমানাকে সময়সেতুগুলোকে বিলীন ক’রে দেবার জন্যে, উচ্ছ্রিত শববাহকের মূর্তিতে। শুধু বাতাসের প্রেতচারণ অমৃতলোকের অপস্রিয়মান নক্ষত্রযান-আলোর সন্ধানে। পাখি নেই,—সেই পাখির কঙ্কালের গুঞ্জরণ; কোনো গাছ নেই,—সেই তুঁতের পল্লবের ভিতর থেকে অন্ধ অন্ধকার তুষারপিচ্ছিল এক শোণ নদীর নির্দেশে।সেখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো, নারি, অবাক হলাম না। হতবাক হবার কী আছে? তুমি যে মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে জেগে উঠেছ নীল স্বর্গীয় শিখার মতো; সকল সময় স্থান অনুভবলোক অধিকার ক’রে সে তো থাকবে এইখানেই, আজ আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে।কোথাও মিনারে তুমি নেই আজ আর জানালার সোনালি নীল কমলা সবুজ কাচের দিগন্তে; কোথাও বনচ্ছবির ভিতরে নেই; শাদা সাধারণ নিঃসঙ্কোচ রৌদ্রের ভিতরে তুমি নেই আজ। অথবা ঝর্ণার জলে মিশরী শঙ্খরেখাসর্পিল সাগরীয় সমুৎসুকতায় তুমি আজ সূর্যজলস্ফুলিঙ্গের আত্মা-মুখরিত নও আর। তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম, কিংবা ভারতের; অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতম্বী সূর্যশিখার কোনো স্থানে আছে যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি শুভ্রতা—সকলের জন্যে! নিঃসীম শুন্যে শুন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ আর কোনো নগরী নেই সৃষ্টির মরালীকে যা বহন ক’রে চলেছে মধু বাতাসে নক্ষত্রে—লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!ডানে বাঁয়ে ওপরে নিচে সময়ের জ্বলন্ত তিমিরের ভিতর তোমাকে পেয়েছি। শুনেছি বিরাট শ্বেতপক্ষিসূর্যের ডানার উড্ডীন কলরোল; আগুনের মহান পরিধি গান ক’রে উঠছে। সমারূঢ় ‘বরং নিজেই তুমি লিখোনাকো একটি কবিতা-‘ বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর; বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর ব’সে আছে সিংহাসনে-কবি নয়- অজর অক্ষর অধ্যাপক, দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি; বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক চেয়েছিলো-হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি সমুদ্রচিল সমুদ্রচিলের সাথে আজ এই রৌদ্রের প্রভাতে     কথা ব’লে দেখিয়াছি আমি;     একবার পাহাড়ের কাছে আসে,     চকিতে সিন্ধুর দিকে যেতেছে সে নামি;     হামাগুড়ি দিয়ে ভাসে ফেনার উপরে,     মুছে যায় তরঙ্গের ঝড়ে।     দাঁড়ায়েছি শতাব্দীর ধুলো কাঁচ হাতে।।তরঙ্গের তারা খেয়ে চ'লে যায় আরো দূর তরঙ্গের পানে-     ফেনার কান্তারে     বৃষ্টির প্রথম রোদ যেইখানে     তাহার সোনালি ডানা ঝাড়ে;     যেখানে আকাশ নীল কোলাহলময়,     সমুদ্রের করিছে দূর সমুদ্র সঞ্চয়,     দিগন্ত হারায়ে যায় দিগন্তের প্রাণে।।চঞ্চল ধবল বুকে নাচিতেছে ফেনার আঙুল;     ধানের শিষের মত দু'পায়ের শিরা     নাচিছে স্পানিশ টাঙ্গো নীল ঢেউয়ে;     হৃদয় করিছে পাম মালাবার হাওয়ার মদিরা;     ট্রম্‌ ট্রম্‌- ট্রাম্‌ ট্রাম্‌- ড্রামের মতন     শৈলে শৈলে সমুদ্রের রুক্ষ আন্দোলন;     রৌদ্রে রৌদ্রে ঝলসায় ঝিনুকের  ফুল।।বিজ্ঞান কি মস্তিষ্কের বাক্সের মতন একাকী?     তোমার শরীরে জল- দ্রাক্ষার আঘ্রাণ;     তোমার হৃদয়ে পেকে ঝরিতেছে রৌদ্রের ক্ষেত     জাগিতেছে নব নব শস্যের সন্তান;     আমরা বন্দরে ফিরি- জনতায়- ঘূর্ণিস্রোতে কুকুরের মুণ্ডে                                         লোল আঁখি     পাবে নাকি লেজ তার? হো-হো- পাবে নাকি!     পাবে নাকি লেজ খুঁজে কুকুরের মত লোল আঁখি।।    ছেড়ে দিয়ে উত্তরের বাতাসের প্রাণে     জন্মেছে তোমার্ডানা- জেগেছে হৃদয়; সহস্র শতাব্দী গিঁট কাটায়েছি পথ আর ঘরের আঘ্রাণে-     আনন্দের পাইনিক' তবু পরিচয়;     জন্মেনি ধবল ডানা বিজ্ঞানের অগ্রসর চিরি     ভেঙ্গে গেছে আকাশের- নক্ষত্রের সিঁড়ি,     উৎসব খুঁজেছি রাতবিরেতের গানে।। পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়ায়েছি মনোবীজ, আহা,     আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্গ সন্তান; আথবা ঘাসের দেহে শুয়ে শুয়ে কুয়াশায়     শুনেছি ঝরিতে আছে ধান;     অথবা সন্ধ্যার নীল জনালায়     অদৃশ্য কোকিল এসে গায় এইসব বেদনার কর্কশ-রেডিয়ামে সারেনাক' তাহা।।মাঝে মাঝে একবার ধরা দেই নক্ষত্রের হাতে     চ'লে আসি সমুদ্রের পাশে; যে ক্ষেত ফুরাতে আছে- ফুরাইয়ে গেছে     তার তৃষ্ণা মিটিছে আকাশে; চেয়ে দেখি সেই নীল আকাশের ছবি; সমুদ্রের অজান্তব জানালার গল্পের সুরভি; রৌদ্রের ডানার ভেসে সেইখানে পৃথিবী হারাতে চাই আমি; সমুদ্রচিলের খেলা তুলে নিয়ে হাতে।।                    ।।২।। রঙিন বিস্তৃত রৌদ্রে প্রাণ তার করিছে বিলাস; কোনদিন ধানক্ষেতে পৃথিবীর কৃষকের প্রাণ এই রৌদ্র পায় নাই,- জলপাই পল্লবের ফল, জ্যৈষ্ঠের দুপুরে মাছি যে উল্লাসে গেয়ে গেছে গান, কুমারী কোমল ঘাড় নুয়ে চুপে যেই পক্ক রৌদ্রে বেণী করিছে বিন্যাস, নীল হয়ে বিছায়েছে পৃথিবীর মধুকূপী ঘাস, তরমুজ ক্ষেতে শুয়ে স্বপন দেখেছে চৈত্রমাস, তার চেয়ে আরো দামী গাঢ় মদে প্রাণ তার করিছে বিলাস।। পৃথিবীতে যেই রূপ কোনদিন দেখে নাই কেউঃ সিংহলের হীরা রত্ন নারী লুটে নাবিকের দল     ভারত সমুদ্রে নেমে নক্ষত্রের রজনীতে তারপর ভোরবেলা দেখেছিল স্ফটিকের মত যেই জল;     তরঙ্গের পর ঘন তরঙ্গের মধু আর দুধ,     মেঘের গোলাপী মুখ- রৌদ্রের বুদ্বুদ; তবু তারা দেখে নাই পুরুভুজ-বিছানায় নূপুর বাজায়ে নীচে ঢেউ বারুণির জানালায়ঃ সিন্ধুচিল- মক্ষিকারা ছাড়া তাহা কেউ জানে নাক কেউ।। ধ্বনিত ঢেউয়ের অগ্নি বয়ঃসন্ধি-দিবসের স্তন হয়ে রক্তে নেমে আসে!     তরঙ্গের উষ্ণ নীল তরমুজ ক্ষেতে     আমারে খুঁজিয়া পায় মৃত্যু যেনঃ         বিস্তৃতির পথে যেতে-যেতে     সমস্ত পৃথিবী যেন মিশে যায় রৌদ্রের সাগরে;     সিন্ধুচিল আর তার বনিতা যেখানে খেলা করেঃ মরণ আমারে যেন পায় সেই দারুচিনি হাওয়ার আশ্বাসে।। সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে, চেয়ে থাকি নক্ষত্রের আকাশের পানে চারিদিকে অন্ধকার: নারীর মতন হাত, কালো চোখ, ম্লান চুল ঝরে যতদূর চোখ যায় নীলজল হৃষ্ট মরালের মতো কলরব করে রাত্রিরে ডাকিতে চায় বুকে তার, প্রেম-মূঢ় পুরুষের মতন আহ্বানে পৃথিবীর কত প্রেম শেষ হ’লো – তবু এই সমুদ্রের আকাঙ্খার গানে বাধা নাই, ভয় নাই, ক্লান্তি নাই, অশ্রু নাই – মালাবার ঢেউয়ের ভিতরে চারিদিকে নীল নারিকেল বন সোনালি ফুলের গন্ধে, বিস্ময়ের ভরে জানে তাহা – কত দিন থেকে ওই মলয়ালী আর তা’র শিশু তাহা জানেজানি না মাদ্রাজ নাকি এই দেশ? জানি না মালয় নাকি? কিংবা মালাবার ? জানি না এ পৃথিবীর কোন্ পথ – কোন্ ভাষা কোন্ মুখে এখানে বাতাসে জানি না যৌবন কবে শেষ হয়ে গেছে কোন্ পৃথিবীর ধুলোতে আমার তবুও আমার প্রাণ তামিলের কিশোরের মতো ওই কিশোরীর পাশে আবার নতুন জন্ম পায় আজ; কেউ নাই অন্ধকারে কবেকার ঘাসে কত যে মৌরী খই ঝ’রে গেছে – চারিদিকে ফুটে সব উঠিছে আবার।।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা সহজ আমার এ গান কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে– আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে– তবুও হৃদয়ে গান আসে! ডাকিবার ভাষা তবুও ভুলি না আমি– তবু ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে! পৃথিবীর কানে নক্ষত্রের কানে তবু গাই গান! কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি– আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে– তবুও হৃদয়ে গান আসে!তুমি জল, তুমি ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ– তোমার সহজ মন ভেসে যায় সাগরের জলে আবেগে! কোন্‌ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিল লেগে কোন্‌ অন্ধকারে জানে না সে!– কোন ঢেউ তারে অন্ধকারে খুজিছে কেবল জানে না সে! রাত্রির সিন্ধুর জল, রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ তুমি একা! তোমারে কে ভালোবাসে! — তোমারে কি কেউ বুকে করে রাখে! জলের আবেগে তুমি চলে যাও — জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধু ধু জল তোমারে যে ডাকে!তুমি শুধু এক দিন — এক রজনীর!– মানুষের মানুষীর ভিড় তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে — কত দূরে! কোন্‌ সমুদ্রের পারে — বনে — মাঠে — কিংবা যে আকাশ জুড়ে উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে! — কিংবা যে আকাশে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ জেগে ওঠে, ডুবে যায় — তোমার প্রাণের সাধ তাহাদের তরে! যেখানে গাছের শাখা নড়ে শীত রাতে — মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন! — যেইখানে বন আদিম রাত্রির ঘ্রাণ বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান!– তুমি সেইখানে! নিঃসঙ্গ বুকের গানে নিশীথের বাতাসের মতো একদিন এসেছিলে — দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত! সাগর বলাকা ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দুরাশায় মেলে! ফেনার বৌয়ের নোন্‌তা মৌয়ের মদের গেলাস লুটে, ভোর-সাগরের শরাবখানায়–মুসল্লাতে জুটে হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে ছুটছ তুমি চ্ছল চ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই! উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্‌তো ফেনা-সই ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!রে মুসাফের, পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা সাগরজলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা! তাই কি গেলে ভেঙে হেথায় বালিয়াড়ির বাড়ি! দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু-পাড়ি- ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া, পিছের আকাশ ফিকা!বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে! ফুটছে ভাষা কেউটে ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে! প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে বরুণরানি ফিরছে যেথা, মুক্তপ্রদীপ জ্বলে যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠে ফুঁকে।যেই খানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে সাঁজ সকালে, ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে! যায় না জাহাজ যেথায়- নাবিক, পায় না নাগাল যার, লুঘ উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার ঘুরছে অবুজ সে কোন সবুজ স্বপন-খোজার কাজে!ওরে কিশোর, দূর-সোহাগী ঘর- বিরাগী সুখ! টুকটুকে কোন্‌ মেঘের পারে ফুটেফুটে কার মুখ ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার! -শাদা শকুনপাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন-ফাঁপর ফাটা বুক! সামান্য মানুষ একজন সামান্য মানুষকে দেখা যেতো রোজ ছিপ হাতে চেয়ে আছে; ভোরের পুকুরে চাপেলী পায়রাচাঁদা মৌরলা আছে; উজ্জ্বল মাছের চেয়ে খানিকটা দূরেআমার হৃদয় থেকে সেই মানুষের ব্যবধান; মনে হয়েছিলো এক হেমন্তের সকালবেলায়; এমন হেমন্তের ঢের আমাদের গোল পৃথিবীতে কেটে গেছে; তবুও আবার কেটে যায়।আমার বয়স আজ চল্লিশ বছর; সে আজ নেই এ-পৃথিবীতে; অথবা কুয়াশা ফেঁসে-ওপারে তাকালে এ-রকম অঘ্রাণের শীতেসে-সব রূপোলি মাছ জ্ব’লে ওঠে রোদে, ঘাসের ঘ্রাণের মতো স্নিগ্ধ সব জল; অনেক বছর ধ’রে মাছের ভিতরে হেসে খেলে তবু সে তাদের চেয়ে এক তিল অধিক সরল;এক বীট অধিক প্রবীণ ছিল আমাদের থেকে; ওইখানে পায়চারি করে তার ভূত- নদীর ভিতরে জলে তলতা বাশেঁর প্রতিবিম্বের মতন নিখুঁতপ্রতিটি মাছের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে-সব। আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পোলিটিক্স জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ। কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে– সে আর সপ্তমী তিথি চাঁদ। সারা দিন ট্রাম-বাস সারাদিন ট্রাম-বাস-ফেরিওলাদের ডাক- কুষ্ঠরোগী পথের উপর- হাড়ভাঙা মহিষের গাড়িগুলো-বাজারের রুক্ষ শব্দ-বস্তির চিৎকার। আমার হৃদয়ে যেই শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিল ঘর তাহারে ফিরায়ে দেয় শহরের পথ থেকে পাড়াগাঁর কান্তারের পার-কবে যে কান্তার ছেড়ে আসিয়াছি নির্বাসিত আমি রাজপুত্রের মতন, কোথায় শিমের গন্ধ? শ্যামা পাখি? কিশোর গেল কি মরে বুকের ভেতর? দুপুর ঘনায়ে ওঠে ভিজা মেঘে- চিল কাঁদে-কই বলো? কই হীরামন?- আমার হৃদয়ে যে গো শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিলো ঘর।২আমি যে সংসারে মন দিতে চাই, আমি যে বাঁধিতে চাই পৃথিবীর মানুষের মতো বাসা এক; আমি যে বন্দরে যাই, অন্নের উপায় করি-স্বামী হই পিতা হই আমি; আমি যে ভিড়ের গন্ধ গায়ে মাখি দিনরাত; আঁধারে ঘুমাই, দিনে রৌদ্রে ইতস্তত ঘুরে ফিরি; সংসারের কাজ কথা হাটের ভিতরে আমি অলক্ষ্যে যে পড়িতেছি নামি- এইসব ছেড়ে দিয়ে, হে হৃদয়, চলে যাও অঘ্রাণের পাড়াগাঁর ম্লান তেপান্তরে, সেখানে বটের বুকে দাঁড়কাক বাঁধে বাসা-রাঙা পশমের মতো ফলগুলো ঝরে শুকনো পাতার 'পরে; সেখানে সন্ধ্যার বক শঙ্খের মতন শাদা পাখনা ভাসায় কামরাঙা-রক্তমেঘে-তিনশো বছর ধরে কোন্‌ অভিমানী মঠ দেখা যায়- খড়কুটা মুখে নিয়ে শালিখ উড়িয়া যায় কান্তারের ঘাস থেকে প্রান্তরের ঘাসে, এক তারা ফুটিতেই রূপসী প্রেতিনী সেই শঙ্খমালা দেখা দেয় মাঠের বাতাসে। ...৩ যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব- হে শঙ্খমালা- অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে, আকাশের অন্ধকার সমতলতা ঘিরে যুগান্তের লুপ্ত মানবীদের মতো কয়েকটি নির্জন নক্ষত্র- এর চেয়ে গভীর জিনিস কী আর থাকতে পারে কী আর থাকতে পারে শঙ্খমালা-আর আমার বিছানা করে দিয়ো সমতল দেশের শিয়রে সবুজ ঘাসের ছবির ভিতর ধানসিড়ি নদীর জলের গন্ধের কাছে এই বাংলায়। সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয় চোখদুটো ঘুমে ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন- স্বপন কদিন রয়! এসেছে গোধূলি গোলাপীবরণ-এ তবু গোধূলি নয়! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়, আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের পরে!চোখদুটো যে নিশি ঢের- এত দিন তবু অন্ধকারের পাই নি তো কোনো টের! দিনের বেলায় যাদের দেখি নি-এসেছে তাহারা সাঁঝে; যাদের পাই নি ধুলায় পথের-ধোঁয়ায়-ভিড়ের মাঝে- শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে, কাঁকন বাজে! আকাশের নীচে- তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের!চোখদুটো ছিল জেগে কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্‌কান রাঙা মেঘে! কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে! ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে কত দিন হায়! কবে- অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে ঘোর ভেঙে গেল, খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙেদুটো চোখ ঘুম ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন-স্বপন কদিন রয় এসেছে গোধূলি গোলাপীবরণ-এ তবু গোধুলি নয়! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়- আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের পরে। সারাৎসার এখন কিছুই নেই—এখনে কিছুই নেই আর, অমল ভোরের বেলা র’ইয়ে গেছে শুধু; আশ্বিনের নীলাকাশ স্পষ্ট ক’রে দিয়ে সূর্য আসে; অনেক আবছা জল জেগে উঠে নিজ প্রয়োজনে নদী হয়ে সমস্ত রৌদ্রের কাছে জানাতেছে দাবি;নক্ষত্রেরা মানুষের আগে এসে কথা কয় ভাবি; পল অনুপল দিয়ে অন্তহীন নিপলের চকমকি ঠুকে ঐ সব তারার পরিভাষার উজ্জ্বলতা; আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের সাধারণ হৃদয়ের কথা সহজ সঙ্গের মতো জেগে নক্ষত্রকে কী ক’’রে মানুষও মানুষীর মতো ক’’রে রাখে।তবু তার উপচার নিয়ে সেই নারী কোথায় গিয়েছে আজ চ’লে; এই তো এখানে ছিল সে অনেক দিন; আকাশের সব নক্ষত্রের মৃত্যু হলে তারপর একটি নারীর মৃত্যু হয়ঃ অনুভব ক’’রে আমি অনুভব করেছি সময়। সিন্ধু বুকে তব সুরপরী বিরহবিধুর গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর! কোন্‌ দূর আকাশের ময়ুর-নীলিমা তোমারে উতলা করে! বালুচরসীমা উলঙ্ঘি তুলিছ তাই শিরোপা তোমার,- উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি-তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার! গলে মৃগতৃষ্ণাবিষ, মারীর আগল তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল! উদ্যত উর্মির বুকে অরূপের ছবি নিত্যকাল বহিছ হে মরমিয়া কবি হে দুন্দুভি দুর্জয়ের, দুরন্ত, আগধ। পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি, বিজয়ের স্বাদ তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে! কালে কালে দেশে দেশে মানুষসন্তানে তুমি শিখায়েছ বন্দু দুর্মদ-দুরাশা! আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা দুশ্চর তটের লাগি-সুদূরের তরে। রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে ধরেছ দুস্তরকাল; তুচ্ছ অভিলাষ, দুদিনের আশা, শানি-, আকাঙক্ষা, উল্লাস পলকের দৈন্য-জ্বালা-জয়-পরাজয়, ত্রাস্তব্যথা-হাসি-অশ্রু-তপস্যা সঞ্চয়- পিনাক শিখায় তব হল ছারখার ইচ্ছার বাড়বকুন্ডে, উগ্র পিপাসার ধু ধু ধু ধু বেদীতটে আপনারে দিতেছ আহুতি। মোর ক্ষুধা-দেবতারে তুমি কর স্তুতি! নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি ‘পারীয়া’র প্রাণ লয়ে আছি মোরা জাগি বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে! নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে বীভৎস খঞ্জের মতো করি মাতামাতি! চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি! ক্ষুরধার আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া চিতা গড়ি তবু বারবার-বারবার ধুতুরার তিতা নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া। মোর বক্ষকপোতের কপোতিনী প্রিয়া কোথা কবে উড়ে গেছে-পড়ে আছে আহা নষ্ট নীড়, ঝরা পাতা, পুবালিকা হা হা! কাঁদে বুকে মরা নদী, শীতের কুয়াশা! ওহে সিন্ধু,্‌ আসিয়াছি আমি সর্বনাশা ভুখারি ভিখারি একা, আসন্ন-বিকাশ! -চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস, মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর চাহি না নিতল নীড় বারুণীরানির। মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার! একদিন কুকুরের মতো হাহাকার তুলেছিনু ফোঁটা ফোঁটা রুধিরের লাগি! একদিন মুখখানা উঠেছিল রাঙি ক্লেদবসাপিন্ড চুমি সিক্ত বাসনার! মোরে ঘিরে কেঁদেছিল কুহেলি আঁধার,- শ্মশানফেরুর পাল, শিশিরর নিশা, আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা! আমার হৃদয়পীঠে মোর ভগবান বেদনার পিরামিড পাহারপ্রমাণ গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া; রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব-স্বপনে, হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে! পূজাথালা হাতে ল’য়ে আসিয়াছে কত পান’; কত পথবালা সহর্ষে সমুদ্রতীরে; বুকে যার বিষমাখা শায়কের জ্বালা সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে চুপে একা অন্ধকারে একবার দুজনার দেখা! বৈশাখের বেলাতটে সমুদ্রের স্বর- অনন্ত, অভঙ্গ, উষ্ণ, আনন্দসুন্দর! তারপর, দূর পথে অভিযান বাহি চলে যাব জীবনের জয়গান গাহি। সিন্ধুসারস দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি হে সিন্ধুসারস, মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি নাচিতেছে টারান্‌টেলা- রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দু’টি আকাশের গায় ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়। মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান, আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান। জানো লি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি? অনেক সোনার ধার ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে- হারায়েছি আনন্দের গতি; ইচ্ছা, ছিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান- এই বর্তমান হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের- বেদনার আমার সন্তান? জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেলার সন্তান, তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর। যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পণার নিঃসঙ্গ প্রভাত নেই তব; নেই নিম্নভূমি- নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত। স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো- পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা প্রাণে তার- ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো; একবার স্বপনে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো নিভে গেছে যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, ক’রে না বুনন মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে শালিকের মন, মেঘের দুপুর ভাসে- সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন মেঘের দুপুরে, তাহা, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে; সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে। তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো; অথাবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে; সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে; গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের- ইন্দ্রধনূ ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন। এইসব জানো নাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডাজান উল্লাসে; রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডানা শাদা ফেনা- শিশুদের পাশে হেলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশ! ঝিকমিক করে রৌদ্রের বরফের মতো শাদা ডানা, যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন ছিন্তা সব তার অচেনা অজানা। চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি- জম্ন তুমি নিয়েছিলে কবে, বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে স’বে আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে- দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে। শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে। ধানের রসের গল্প পৃথিবীর- পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই- আর তার প্রেমিকের ম্লান নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায় শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়। সুচেতনা সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে; সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে। এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়। কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে; তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু, দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে; পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়; সেই শস্য অগণণ মানুষের শব; শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ: এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;– প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি, না এলেই ভালো হত অনুভব করে; এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে; দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়– শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়। সুদর্শনা একদিন ম্লান হেসে আমি তোমার মতন এক মহিলার কাছে যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দঁড়িয়ে শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে, দেখেছি অমৃতসুর্য আছে। সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো, তবুও সময় স্থির নয়, আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে দেখেছে সে তোমার বলয়। এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন তোমার শরীর; তুমি দান করো নি তো; সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার ব’লে সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত। সুদর্শনা (অপ্রকাশিত) সুদর্শনা মিশে যায় অন্ধকার রাতে নদীর এ পারে বসে একদিনও দেখে নি ওপার প্রকৃতি চায় নি সেই মেয়েটি এ আলো আর রাত্রির আঘাতে পৃথিবীকে কূট চোখে দেখে নেবে- বুঝে নেবে জীবনের গ্লানি অন্ধকারচায় নি সে কলমীর ফুলভরা রক্তাক্ত প্রান্তরে অথবা চিন্তায় রূঢ় ক্ষম সৎ পাণ্ডূলিপি যা খণ্ডন করে মৃত্যুকে দেবার আগে এইসব একবার তুলে নেবে হাতেপ্রথম ঢেউয়ের থেকে দূর সুচনার মতো নদীর ভিতরে অরবে সে চলে যায়-এক খণ্ড রাত্রি মনে হয় পৃথিবীর রাত্রিকে যেন তার অনন্তের কাছে সব হাঁস ঘুমালেও নক্ষত্রালোকিত হংসী আছে সমুদ্রের পারে এসে বড়ো চাঁদ- এর চেয়ে নির্জন বিস্ময় দেখেনিকো কোনোদিন; অনেক পবনে মৌমাছিদের ভিড় যদিও খেয়েছে ঢের আকাশের বাতাসের মতন শরীর তবু সে শরীর নয়- মাংসের চোখে দেখা নক্ষত্রেরা নয় তার তরে।। সুবিনয় মুস্তফী সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে। একসাথে বিড়াল ও বিড়ালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার। ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বিড়ালের ব্যবহার, অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর, বৈকুন্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর ভুলে গিয়ে আধো আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেতো – মাটির দরের মতো রেটে; তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেতো ব’লে বিড়ালের পেটে ইঁদুর ‘হুর্‌রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে। সুরঞ্জনা সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো; পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন; কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছ; গ্রিক হিন্দু ফিনিশীয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা – নগরীর গায়ে ১৪০০ সাল [কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আজি হতে শতবর্ষ পরে” পড়িয়া]                  আজি হ’তে শত বর্ষ আগে! কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,                                     আজি হ’তে শত বর্ষ আগে।                  ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল! উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে                                     কবে এল সুদূর আড়াল?আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারী বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,                                     এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে, শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি রাতে। নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে, আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়                                     উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে।                  আজি মোরা শত বর্ষ পরে যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি                                     পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।।                   জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত গান সজল নয়নে।                                                      আজো হায়                                     বারে বারে খুলে যায়                                                       দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন, গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন                                     মনে মনে বনে বনে পল্লব মর্মরে, কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!                  ঝিরি ঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব, মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ আসব! কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।                   রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া                   সমীর উচ্ছ্বাস্ব যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!  তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে--   তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি,                                     হে কবীন্দ্র, অনুরাগ ভরে! আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে! চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী।                                     করি' চুরিআসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে, কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে। আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান যত রক্ত-রাগ তব অনুরাগ হ’তে হে চির-কিশোর কবি,                                     আনিয়াছে ভাগ !                   আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায় গান হ’য়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।আনন্দ দুলাল ওগো হে চির অমর। তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব মাধবী বাসর। যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে--                       সবগুলি তার                       একবার--তা’ পর আবার প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।                   গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী--”                                     স্বপ্ন যায় থামি', দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে অশ্রু হ’য়ে নামি'।                   মনে লাগে, শত বর্ষ আগে    তুমি জাগো--তব সাথে আরো কেহ জাগে                                     দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে                                                       লুলিত-অঞ্চলে। তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায় উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়, ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,                                         নুয়ে যায় অলক-কুসুম, তারপর যায় হারাইয়া,--তুমি একা বসিয়া নিঝ্‌ঝুম।                   সে কাহার আঁখিনীর- শিশির লাগিয়া, মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,                   কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে                                     গোপনে স্বপনে।                  সহসা খুলিয়া গেল দ্বার, আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার। শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি                   আজি তব নবীনের জানায় আকুতি!... হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,                                     সৃজিয়াছ যে তাজমহল- শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল--                   বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,   যৌবনেরে অভিশাপি-- “কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”                                     হায়, মোরা আজ মোম্‌তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!           শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট! এসেছে নূতন কবি--করিতেছে তব নান্দীপাঠ!                   উদয়াস্ত জুড়ি' আজো তব কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।                          তোমারি সে হারা-সুরখানি নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।                                                      আজি তব বরে                   শতবেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।                                তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক' প্রাণ, শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।                                        মনে হয়, কবি , আজো আছ অস্তপাট আলো করি' আমাদেরি রবি!                        আজি হ’তে শত বর্ষ আগে যে অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে রাঙা অনুরাগে,                   সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে                   প্রণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে!মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে                   ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে। আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে--                                     তোমা হ’তে শতবর্ষ পরে! অকরুণ পিয়া আমার   পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার ওই বাজে গো বিদায়বাঁশি,        পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার হাসে নিদয় হাসি।               পথিক বলে পথের গেহ               বিলিয়েছিল একটু স্নেহ,        তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে চোখ গেল ভাসি।           তখন মোদের কিশোর বয়স যেদিন হঠাৎ টুটল বাঁধন,        সেই হতে কার বিদায়-বেণুর জগৎ জুড়ে শুনছি কাঁদন।                সেই কিশোরীর হারা মায়া                ভুবন ভরে নিল কায়া,          দুলে আজও তারই ছায়া আমার সকল পথে আসি।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) অকাল-সন্ধ্যা অকাল-সন্ধ্যা [জয়জয়ন্তী কীর্তন]খোলো মা                দুয়ার খোলো প্রভাতেই                 সন্ধ্যা হল দুপুরেই                  ডুবল দিবাকর গো। সমরে                   শয়ান ওই সুত তোর                বিশ্বজয়ী কাঁদনের                  উঠছে তুফান ঝড় গো॥ সবারে                   বিলিয়ে সুধা, সে নিল                  মৃত্যু-ক্ষুধা, কুসুম ফেলে               নিল খঞ্জর গো। তাহারই                  অস্থি চিরে দেবতা                   বজ্র গড়ে নাশে ওই                 অসুর অসুন্দর গো। ওই মা                   যায় সে হেসে। দেবতার                  উপরে সে, ধরা নয়,                স্বর্গ তাহার ঘর গো॥ যাও বীর                 যাও গো চলে চরণে                    মরণ দলে করুক প্রণাম               বিশ্ব-চরাচর গো। তোমার ওই                চিত্ত জ্বেলে ভাঙ্গালে                   ঘুম ভাঙ্গালে নিজে হায়                 নিবলে চিতার পর গো। বেদনার                  শ্মশান-দহে পুড়ালে                   আপন দেহে, হেথা কি                  নাচবে না শংকর গো॥আরিয়াদহ ৬ আষাঢ়, ১৩৩২ (চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ) অকূল তুফানে নাইয়া কর পার অকূল তুফানে নাইয়া কর পার পাপ দরিয়াতে ডুবে মরি কান্ডারি নাই কড়ি নাই তরী প্রভু পারে তরিবার।। থির নহে চিত পাপ-ভীত সদা টলমল পুণ্যহীন শূন্য মরু সম হৃদি-তল নাহি ফুল নাহি ফল পার কর হে পার কর ডাকি কাঁদি অবিরল নাহি সঙ্গী নাহি বন্ধু নাহি পথেরি সম্বল। সাহারায় নাহি জল শাওন বরিষা সম তব করুণার ধারা ঝরিয়া পড়ুক পরানে আমার।। অ-কেজোর গান ঐ ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে আজ মেতে।।এই রোদ-সোহাগী পউষ-প্রাতে অথির প্রজাপতির সাথে বেড়াই কুঁড়ির পাতে পাতে     পুষ্পল মৌ খেতে। আমি আমন ধানের বিদায়-কাঁদন শুনি মাঠে রেতে।।আজ কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে, ও তার হলদে আঁচল চ’লতে জড়ায় অড়হরের ফুলে! ঐ বাবলা ফুলের নাকছবি তার, গা’য় শাড়ি নীল অপরাজিতার, চ’লেছি সেই অজানিতার     উদাস পরশ পেতে।।আমায় ডেকেছে সে চোখ-ইশারায় পথে যেতে যেতে।। ঐ ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে   আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে তাই মেতে।। অগ্র-পথিক অগ্র-পথিক হে সেনাদল,     জোর   কদম   চল রে চল।    রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর, বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর! রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান, হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!     কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?     অগ্র-পথিক রে সেনাদল,     জোর কদম     চল রে চল॥কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ! আর বিলম্ব সাজে না, চালাও কুচকাওয়াজ! আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!     আমরা ফলাব ফুল-ফসল।     অগ্র-পথিক রে যুবাদল,     জোর কদম     চল রে চল॥    প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর, হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির! দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,     মরু-সঞ্চর গতি-চপল।     অগ্র-পথিক রে পাঁওদল,     জোর কদম     চল রে চল॥স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব হারায়েছে আজ দীক্ষাদানের সে-গৌরব। অবনত-শির গতিহীন তারা। মোরা তরুণ বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ     শিখাব নতুন মন্ত্রবল।     রে নব পথিক যাত্রীদল,     জোর কদম    চল রে চল॥    আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত, গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত। সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান, তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান,     চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।     রে নবযুগের স্রষ্টাদল,     জোর কদম    চল রে চল॥    অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে। লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমিষে, জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে,     অসীম সাহসে ভাঙি আগল!     না জানা পথের নকিব-দল,     জোর কদম    চল রে চল॥পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে। রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন, কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,     পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!     অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,     জোর কদম      চল রে চল॥    আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির১ চূড়া হাতে, উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া বার; আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার ;     পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ-পাগল।     অগ্রবাহিনী পথিক-দল,     জোর কদম      চল রে চল॥    আয়র্ল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন, নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া, – সবার ধারি গো ঋণ! সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই, এক বেদনার ‘কমরেড’ভাই মোরা সবাই।     সকল দেশের মোরা সকল ।     রে চির-যাত্রী পথিক-দল,     জোর কদম      চল রে চল॥বলগা্-বিহীন শৃঙ্খল-ছেঁড়া প্রিয় তরুণ! তোদের দেখিয়া টগবগ করে বক্ষে খুন। কাঁদি বেদনায়, তবু রে তোদের ভালোবাসায় উল্লাসে নাচি আপনা-বিভোল,নব আশায়।     ভাগ্য-দেবীর লীলা-কমল,     অগ্রপথিক রে সেনাদল!     জোর কদম      চল রে চল॥    তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল। করুণার নয়–ভয়ংকরীর দুয়ার খোল। নাগিনি-দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর তোর দেশ-মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।     রক্ত-পিয়াসি অচঞ্চল     নির্মম-ব্রত রে সেনাদল!     জোর কদম      চল রে চল॥    অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা, শুন! মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন। ভ্রুকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিতে শব, রক্ষণশীল বুড়োরা করছি তারই স্তব     শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!     নির্ভীক বীর পথিক-দল,     জোর কদম      চল রে চল॥আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ, পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন, আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান! যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝ চলো জোয়ান!     জ্বাল রে মশাল জ্বাল অনল!     অগ্রযাত্রী রে সেনাদল,     জোর কদম      চল রে চল॥    নতুন করিয়া ক্লান্ত ধরার মৃত শিরায় স্পন্দন জাগে আমাদের তরে, নব আশায়। আমাদেরই তারা – চলিছে যাহারা দৃঢ় চরণ সম্মুখ পানে, একাকী অথবা শতেক জন।     মোরা সহস্র-বাহু-সবল।     রে চির-রাতের সন্ত্রিদল,     জোর কদম      চল রে চল॥    জগতের এই বিচিত্রতম মিছিলে ভাই কত রূপ কত দৃশ্যের লীলা চলে সদাই!– শ্রমরত ওই কালি-মাখা কুলি, নৌ-সারং, বলদের মাঝে হলধর চাষা দুখের সং,     প্রভু স-ভৃত্য পেষণ-কল, –     অগ্র-পথিক উদাসী-দল,     জোর কদম      চল রে চল॥নিখিল গোপন ব্যর্থ-প্রেমিক আর্ত-প্রাণ সকল কারার সকল বন্দী আহত-মান, ধরার সকল সুখী ও দুঃখী, সৎ, অসৎ, মৃত, জীবন্ত, পথ-হারা, যারা ভোলেনি পথ, –     আমাদের সাথি এরা সকল।     অগ্র-পথিক রে সেনাদল,     জোরকদম      চল রে চল॥    ছুঁড়িতেছে ভাঁটা জ্যোতির্চক্র ঘূর্ণমান হেরো পুঞ্জিত গ্রহ-রবি-তারা দীপ্তপ্রাণ; আলো-ঝলমল দিবস, নিশীথ স্বপ্নাতুর, – বন্ধুর মতো চেয়ে আছে সবে নিকট-দূর।     এক ধ্রুব সবে পথ-উতল।     নব যাত্রিক পথিক দল,     জোর কদম      চল রে চল॥    আমাদের এরা, আছে এরা সবে মোদের সাথ, এরা সখা – সহযাত্রী মোদের দিবস-রাত। ভ্রূণ-পথে আসে মোদের পথের ভাবী পথিক, এ মিছিলে মোরা অগ্র-যাত্রী সুনির্ভিক।     সুগম করিয়া পথ পিছল     অগ্র-পথিক রে সেনাদল,     জোর কদম      চল রে চল॥ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা, ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা। ডাকে সঙ্গীরা। উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি     আমাদের পথে চল-চপল।     অগ্র-পথিক তরুণ-দল     জোর কদম      চল রে চল॥    ওগো অনাগত মরু-প্রান্তর বৈতালিক! শুনিতেছি তব আগমনি-গীতি দিগ‍্‍বিদিক। আমাদেরই মাঝে আসিতেছ তুমি দ্রুত পায়ে। – ভিন-দেশী কবি! থামাও বাঁশরি বট-ছায়ে,     তোমার সাধনা আজি সফল।     অগ্র-পথিক চারণ-দল     জোর কদম      চল রে চল॥    আমরা চাহি না তরল স্বপন, হালকা সুখ, আরাম-কুশন, মখমল-চটি, পানসে থুক শান্তির বাণী, জ্ঞান-বানিয়ার বই-গুদাম, ছেঁদো ছন্দের পলকা, উর্ণা, সস্তা নাম,     পচা দৌলত; – দুপায়ে দল!     কঠোর দুখের তাপসদল,     জোর কদম      চল রে চল॥পান-আহার ভোজে মত্ত কি যত ঔদরিক? দুয়ার জানালা বন্ধ করিয়া ফেলিয়া চিক আরাম করিয়া ভুঁড়োরা ঘুমায়?–বন্ধু, শোন, মোটা ডালরুটি, ছেঁড়া কম্বল,ভূমি-শয়ন,     আছে তো মোদের পাথেয়-বল!     ওরে বেদনার পূজারি দল,     মোছ রে অশ্রু,      চল রে চল॥    নেমেছে কি রাতি? ফুরায় না পথ সুদুর্গম? কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম? বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই, থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!     মোদের লক্ষ্য চির-অটল!     অগ্র-পথিক ব্রতীর দল,     বাঁদরে বুক,      চল রে চল॥    শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ! ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে! গান গেয়ে চলে অগ্র-বাহিনী, ছুটে চল তারও পুরোভাগে!     তোর অধিকার কর দখল!     অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল!     জোর কদম      চল রে চল॥(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) অঘ্রানের সওগাত ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত? নবীন ধানের আঘ্রানে আজি অঘ্রান হ'ল মাৎ। 'গিন্নি-পাগল' চা'লের ফিরনী তশতরী ভ'রে নবীনা গিন্নী হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশীতে কাঁপিছে হাত। শিরনী রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ী গন্ধে তেলেসমাত!মিঞা ও বিবিতে বড় ভাব আজি খামারে ধরে না ধান। বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান! 'শাশবিবি' কন, 'আহা, আসে নাই কতদিন হ'ল মেজলা জামাই।' ছোট মেয়ে কয়, 'আম্মা গো, রোজ কাঁদে মেজো বুবুজান!' দলিজের পান সাজিয়া সাজিয়া সেজো-বিবি লবেজান!হল্লা করিয়া ফিরিছে পারার দস্যি ছেলের দল! ময়নামতীর শাড়ী-পরা মেয়ে গয়নাতে ঝলমল! নতুন পৈঁচি বাজুবন্দ প'রে চাষা-বৌ কথা কয় না গুমোরে, জারী গান আর গাজীর গানেতে সারা গ্রাম চঞ্চল! বৌ করে পিঠা 'পুর'-দেওয়া মিঠা, দেখে জিভে সরে জল!মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান। রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশীতে ঝুরিছে আমন ধান! কৃষক-কন্ঠে ভাটিয়ালী সুর রোয়ে রোয়ে মরে বিদায়-বিধুর! ধান ভানে বৌ, দুলে দুলে ওঠে রূপ-তরঙ্গে বান! বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রান!হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত! কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে সূর্য - আলো-সরিৎ! দিগন্তে যেন তুর্কী-কুমারী কুয়াশা-নেকাব রেখেছে উতারি'! চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ, নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হ'ল হরিৎ পাতারা পীত!নবীনের লাল ঝান্ডা উড়ায়ে আসিতেছে কিশলয়, রক্ত নিশান নহে যে রে ওরা রিক্ত শাখার জয়! 'মুজদা' এনেছে অগ্রহায়ণ- আসে নৌরোজ খোল গো তোরণ, গোলা ভ'র রাখ সারা বছরের হাসি-ভরা সঞ্চয়। বাসি বিছানায় জাগিতেছে শিশু সুন্দর নির্ভয়! অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক গাহে তোমারই জয়। আকাশ-বাতাস রবি-গ্রহ তারা চাঁদ, হে প্রেমময়।। সমুদ্র-কল্লোল নির্ঝর-কলতান- হে বিরাট, তোমারই উদার জয়গান; ধ্যান গম্ভীর কত শত হিমালয় গাহে তোমারই জয়।। তব নামের বাজায় বীণা বনের পল্লব জনহীন প্রান্তর স্তব করে, নীরব। সকল জাতির কোটি উপাসনালয় গাহে তোমারই জয়।। আলোকের উল্লাসে, আঁধারের তন্দ্রায় তব জয়গান বাজে অপরূপ মহিমায়, কোটি যুগ-যুগান্ত সৃষ্টি প্রলয় গাহে তোমারই জয়।। অনাদৃতা ওরে  অভিমানিনী!               এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।       পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু-দিন এসেছিলি,         সকল সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি।             হেলায় বিদায় দিনু যারে               ভেবেছিনু ভুলব তারে হায়!                     ভোলা কি তা যায়? ওরে   হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী।      অভাগি রে! হাসতে এসে কাঁদিয়ে গেলি,               নিজেও শেষে বিদায় নিলি কেঁদে,         ব্যথা দেওয়ার ছলে নিজেই সইলি ব্যথা রে, বুকে        সেই কথাটাই কাঁটার মতন বেঁধে!      যাবার দিনে গোপন ব্যথা বিদায়-বাঁশির সুরে         কইতে গিয়ে উঠল দু-চোখ নয়নজলে পুরে!               না কওয়া তোর সেই সে বাণী,               সেই হাসিগান সেই মু-খানি, হায়! আজও       খুঁজি সকল ঠাঁই। তোরে       যাবার দিনে কেঁদে কেন ফিরিয়ে আনিনি?                     ওরে    অভিমানিনী। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) অ-নামিকা তোমারে বন্দনা করি স্বপ্ন-সহচরী লো আমার অনাগত প্রিয়া, আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া! তোমারে বন্দনা করি…. হে আমার মানস-রঙ্গিণী, অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী! তোমারে বন্দনা করি…. নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা! আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা…. গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী! সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’- ধরা নাহি দিলে দেহে। তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে। অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে! স্বপনে পাইয়া তোমা’ স্বপনে হারাই বারে বারে অরুপা লো! রহি হ’য়ে এলে মনে, সতী হ’য়ে এলে না ক’ ঘরে। প্রিয় হ’য়ে এলে প্রেমে, বধূ হয়ে এলে না অধরে! দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্‌ শরাব, পেয়ালায় নাহি এলে!- ‘উতারো নেকার’- হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা! সুদুরিকা! দূরে থাক’-ভালোবাসা-নিকটে এসো না।তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা। তুমি মরীচিকা, তুমি জ্যোতি।- জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি, বারে বারে একই জন্মে শতবার করি! যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’। রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়, পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়! বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’ বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা, হাওয়া-পরী প্রিয় মনোরমা! ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক’ কথা কওয়া হ’য়ে।চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা! তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে! বাসনার বিপুল আগ্রহে- জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে! উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা উদগ্র কামনা, জন্ম তাই লভি বারে বারে, না-পাওয়ার করি আরাধনা!…. যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন, যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর- সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর তিলোত্তমা, তিলে তিলে! তোমারে যে করেছি চুম্বন প্রতি তরুণীর ঠোঁটে প্রকাশ গোপন।যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে, রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে, সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’ সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা! তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে! বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি- সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি! যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম, সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম। আমি কাম, তুমি হ’লে রতি, তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি! কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই! নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই? বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে? তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে। কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে- যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ বাসিছে গোপনে।সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু! আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হ’য়ে নববধূ। বুকে যারে পাই, হায়, তারি বুকে তাহারি শয্যায় নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী, ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী।…. বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে- নহে, এ সে নহে! কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে? জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে? কথা কও, কও কথা প্রিয়া, হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়, প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়। জন্ম যার কামনার বীজে কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে। দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান, ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ। আকাশ ঢেকেছে তার পাখা কামনার সবুজ বলাকা!প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন, তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন। মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়! যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়! চির-সহচরী! এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি! আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন, বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন। প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি, চিনেছি তোমায়, যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি, ধরা দেবে তায়! প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু, বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম- সে শরাব লোহু। তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়, ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়! অনুরোধ পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া। যাও রে বইয়া এই গরীবের সালামখানি লইয়া।।কাবার জিয়ারতের আমার নাই সম্বল ভাই, সারা জনম সাধ ছিল যে, মদিনাতে যাই ( রে ভাই)। মিটল না সাধ, দিন গেল মোর দুনিয়ার বোঝা বইয়া।।তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি, লইয়া যাওরে এই নিরাশের দীর্ঘ নিশ্বাসখানি। নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।মা ফাতেমা হযরত আলীর মাজার যেথায় আছে, আমার সালাম দিয়া আইস তাঁদের পায়ের কাছে। কাবায় মোজানাজাত করিও আমার কথা কইয়া।। অনেক ছিল বলার অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে পথ ছিল গো চলার, যদি দুদিন আগে আসতে আজকে মহাসাগর স্রোতে চলেছি দূর পারের পথে ঝরা পাতা হারায় যথা, সেই আঁধারে ভাসতে যাই সেই আঁধারে ভাসতে।গহন রাতি ডাকে আমায়, এসে তুমি আজকে কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে আসতে যদি হে অতিথি, ছিল যখন শুক্লা তিথি ফুটতো চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।। অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত জাগো– জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত       জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!    যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি’    হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,    নব জনম লভি’ অভিনব ধরণী     ওরে ওই আগত।।   আদি শৃঙ্খলা সনাতন শাস্ত্র-আচার    মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার!     ভেদি’ দৈত্য-কারা!     আয় সর্বহারা!    কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত।।   কোরাস্‌ :      নব ভিত্তি ’পরে    নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে!    শোন্‌  অত্যাচারী! শোন্‌ রে সঞ্চয়ী!     ছিনু সর্বহারা, হব’ সর্বজয়ী।।    ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ,    নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ!    এই  ‘অন্তর-ন্যাশনাল-সংহতি’ রে    হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত।। অপরাধ শুধু মনে থাক মোর অপরাধ শুধু মনে থাক!      আমি হাসি, তার আগুনে আমারই           অন্তর হোক পুড়ে খাক!           অপরাধ শুধু মনে থাক!নিশীথের মোর অশ্রুর রেখা প্রভাতে কপোলে যদি যায় দেখা, তুমি পড়িয়ো না সে গোপন লেখা           গোপনে সে লেখা মুছে যাক           অপরাধ শুধু মনে থাক!এ উপগ্রহ কলঙ্ক-ভরা তবু ঘুরে ঘিরি তোমারই এ ধরা, লইয়া আপন দুখের পসরা           আপনি সে খাক ঘুরপাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক!জ্যোৎস্না তাহার তোমার ধরায় যদি গো এতই বেদনা জাগায়, তোমার বনের লতায় পাতায়           কালো মেঘে তার আলো ছাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক!তোমার পাখির ভুলাইতে গান আমি তো আসিনি, হানিনি তো বাণ, আমি তো চাহিনি কোনো প্রতিদান,           এসে চলে গেছি নির্বাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক।কত তারা কাঁদে কত গ্রহে চেয়ে ছুটে দিশাহারা ব্যোমপথ বেয়ে, তেমনই একাকী চলি গান গেয়ে           তোমারে দিইনি পিছু-ডাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক!কত ঝরে ফুল, কত খসে তারা, কত সে পাষাণে শুকায় ফোয়ারা, কত নদী হয় আধ-পথে হারা,           তেমনই এ স্মৃতি লোপ পাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক!আঙিনায় তুমি ফুটেছিলে ফুল এ দূর পবন করেছিল ভুল, শ্বাস ফেলে চলে যাবে সে আকুল –           তব শাখে পাখি গান গাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক!প্রিয় মোর প্রিয়, মোরই অপরাধ, কেন জেগেছিল এত আশা সাধ! যত ভালোবাসা, তত পরমাদ,           কেন ছুঁইলাম ফুল-শাখ।           অপরাধ শুধু মনে থাক!আলোয়ার মতো নিভি,পুনঃ জ্বলি, তুমি এসেছিলে শুধু কুতূহলী, আলেয়াও কাঁদে কারও পিছে চলি –           এ কাহিনি নব মুছে যাক।           অপরাধ শুধু মনে থাক! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) অপরূপ সে দুরন্ত ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,      বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত! সে   ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।            চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,        গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে, সে   ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।      তার    চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,             ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।                     অপরূপ সে দুরন্ত,                   মন সদা তার উড়ন্ত।সে   প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–      হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।      ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে, সে   শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।            সে    ঝড়ের সাথে হাসে            সে    সাগর-স্রোতে ভাসে, সে   উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে               অপরূপ সে দুরন্ত,               মন সদা তার উড়ন্ত!সে   বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,        অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।        দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে, সে   পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।        ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,      ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।             অপরূপ সে দুরন্ত,             মন সদা তার উড়ন্ত!সে   রঙিন প্রজাপতি কভু  ফুলের দিকে মতি           কভু   ভুলের দিকে গতি তার   রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো      দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।      রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,      রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।            অপরূপ সে দুরন্ত,              মন সদা তার উড়ন্ত।         মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–      ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়। তার  তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,      মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।      চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,        হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।            তার   পথের পথিক সাথি,            তার   বন্ধু নীরব রাতি,        খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে, সে   কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।              অপরূপ সে দুরন্ত,              মন সদা তার উড়ন্ত!    তারে   জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,       তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।         সে    রয় না আন্দোলনে, যেথা   আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে। সে    চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,       আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল। সে   চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,              সে     চায় না তাহার নাম,        দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়                চায় না তাহার দাম।            অপরূপ সে দুরন্ত,            মন সদা তার উড়ন্ত!      কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,        বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’      ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,        যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে। তার   মন্দ শোনার নাইকো সময়,         রসের সাথে নিত্য প্রলয়, তারে   নিন্দা দিলে চন্দন দেয়         সে    নন্দন-জাদুকর,         সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর। তারে   লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,                    আপনাকে যে দিতে চায়–              প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।              পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,              মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!(ঝড় কাব্যগ্রন্থ) অবসর লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার, অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার। দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি, বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি                        বসে   ঢুলত আঁখি দুটি! আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া                        লাগল চোখে তোমার চাওয়া তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।    তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা, কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা! এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর                       অভি-মানিনীরে মোর!    যখন     তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি           মলিন মুখে ফুটবে হাসি,         হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি                       অরুণ ছবি তার।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) অ-বেলায় বৃথাই ওগো কেঁদে আমার কাটল যামিনী।        অবেলাতেই পড়ল ঝরে কোলের কামিনী –                   ও  সে শিথিল কামিনী।                খেলার জীবন কাটিয়ে হেলায়               দিন না যেতেই সন্ধেবেলায়               মলিন হেসে চড়ল ভেলায়                         মরণ-গামিনী। আহা   একটু আগে তোমার দ্বারে কেন নামিনি।                     আমার  অভিমানিনী।       ঝরার আগে যে কুসুমে দেখেও দেখি নাই ও যে   বৃথাই হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল, ছোট্ট বুকের একটু সুরভি        আজ তারই সেই শুকনো কাঁটা বিঁধচে বুকে ভাই – আহা   সেই সুরভি আকাশ কাঁদায় ব্যথায় যেন সাঁঝের পুরবি               জানলে না সে ব্যথাহতা               পাষাণ-হিয়ার গোপন কথা,               বাজের বুকেও কত ব্যথা                         কত  দামিনী!    আমার   বুকের তলায় রইল জমা গো –         না-কওয়া সে অনেক দিনের অনেক কাহিনি। আহা    ডাক দিলি তুই যখন, তখন কেন থামিনি!                     আমার অভিমানিনী।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) অবেলার ডাক অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে,       আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।।       আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে,      চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে।                   ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই!                    কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই।       আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে।      অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।      তরুণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ    হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ?                      এই চরণ সে বক্ষে চেপে                     চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে        জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে,      এম্‌নি দারুণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।।    দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা,       দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা।                     ভেবেছিলাম আমার কাছে                     তার দরদের শানি- আছে,    আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে।        ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।।    পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী,     মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি?                   তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা                     নিইনি, নিইনি মণির মালা,    দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে।      পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।। আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি?        ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী।                      ওরে আমার ভালোবাসা!                       কোথায় বেঁধেছিলি বাসা        যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে?    নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’      সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?        দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া।                      মাঠের পারে বনের মাঝে                      চপল তাহার নূপুর বাজে,    ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে,     ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে?    মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার?     তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার।                    তাই মা আমার বুকের কবাট                    খুলতে নারল তার করাঘাত,     এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে,       আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।।      সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে,      হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে।                     রাজ ভিখারীর আঁখির কালো,                     দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো,    আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে।   ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।।    আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা    চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা,                    আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে                     এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে   গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে! যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে?    আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম   চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম।                   হে বসনে-র রাজা আমার!                নাও এসে মোর হার-মানা-হারা!    আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে, দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে!     তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে,      দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে।                     জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার,                     ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার     মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে।     বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্‌ছ কারে?      স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে,   এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে।                    ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে                  ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে,      আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে,     কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে।   আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে,     বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে।                   ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল,                   সজল চোখের চোখ-ভরা জল-     ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে,     আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে।     দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী,    মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’                     ব’ল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে                   লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে,   বুক হ’তে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে, দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্‌তে পারে!     এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে     তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে।                    চোখের জলের ঋণী ক’রে,                    সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে?      সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে?   ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে?     তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর,   চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর।                  চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে                   ধরার সাগর অশ্রু ছেপে,      উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে,   ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে।   ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে? তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে!                 শুনতে শুনতে তোমার কোলে                  ঘুমিয়ে পড়ি। - ও কে খোলে    দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে? ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে!    সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে,   যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে!                     তবু কেন থাকি’ থাকি’,                     ইচ্ছা করে তারেই ডাকি!    যে কথা মোর রইল বাকী হায় সে কথা শুনাই কারে?   মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে!    যাই তবে মা! দেখা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে-    রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে?                    মাগো আমি জানি জানি,                    আসবে আবার অভিমানী   খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে,     ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে! অভয়-মন্ত্র বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়!           বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়! কোরাস :   বল,      হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়।           বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ পুরুষোত্তম জয়।           তুই       নির্ভর কর আপনার পর,                    আপন পতাকা কাঁধে তুলে ধর! ওরে  যে যায় যাক সে, তুই শুধু বল, ‘আমার হয়নি লয়’!      বল,      ‘আমি আছি’, আমি পুরুষোত্তম, আমি চির-দুর্জয়।      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         তুই      চেয়ে দেখ ভাই আপনার মাঝে,               সেথা জাগ্রত ভগবান রাজে, নিজ  বিধাতারে মান, আকাশ গলিয়া ক্ষরিবে রে বরাভয়! তোর  বিধাতার ধাতা বিধাতা, বিধাতা কারারুদ্ধ কি হয়?      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         আজ      বক্ষের তোর ক্ষীরোদ-সাগরে               অচেতন নারায়ণ ঘুম-ঘোরে শুধু   লক্ষ্মীর ভোগ লক্ষ্য তাঁহার, নয় কিছুতেই নয়! তোর  অচেতন চিতে জাগারে চেতনা নারায়ণ চিন্ময়।      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         ওই      নির্যাতকের বন্দি-কারায়               সত্য কি কভু শক্তি হারায়? ক্ষীণ  দুর্বল বলে খণ্ড ‘আমি’র হয় যদি পরাজয়, ওরে  অখণ্ড আমি চির-মুক্ত সে, অবিনাশী অক্ষয়!      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         ওরে      সত্য যে চির-স্বয়ম্ প্রকাশ,               রোধিবে কি তারে কারাগার-ফাঁস? ওই   অত্যাচারীর সত্য পীড়ন? আছে তার আছে ক্ষয়! সেই  সত্য মোদের ভাগ্য-বিধাতা, যাঁর হাতে শুধু রয়।      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...      যে      গেল সে নিজেরে নিঃশেষ করি               তাদের পাত্র দিয়া গেল ভরি! ওই   বন্ধু মৃত্যু পারেনিকো তাঁরে পারেনি করিতে লয়! তাই   আমাদের মাঝে নিজেরে বিলায়ে সে আজ শান্তিময়!       বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         ওরে      রুদ্র তখনই ক্ষুদ্রেরে গ্রাসে               আগেই যবে সে মরে থাকে ত্রাসে, ওরে  আপনার মাঝে বিধাতা জাগিলে বিশ্বে সে নির্ভয়! ওই   শূদ্র-কারায় কভু কি ভয়াল ভৈরব বাঁধা রয়?      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         ওই      টুটে-ফেটে-পড়া লোহার শিকল,               ভগবানে বেঁধে করিবে বিকল? ওই   কারা ওই বেড়ি কভু কি বিপুল বিধাতার ভার সয়? ওরে  যে হয় বন্দি হতে দে, শক্তি আত্মার আছে জয়।      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...         ওরে      আত্ম-অবিশ্বাসী, ভয়-ভীত!               কেন হেন ঘন অবসাদচিত? বল   পর-বিশ্বাসে পর-মুখপানে চেয়ে কি স্বাধীন হয়? তুই   আত্মাকে চিন, বল ‘আমি আছি’, ‘সত্য আমার জয়’!      বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়,      বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়।      বল,      হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়! (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) অভিযান নতুন পথের যাত্রা-পথিক চালাও অভিযান ! উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ “মানুষ মহীয়ান !”চারদিকে আজ ভীরুর মেলা , খেলবি কে আর নতুন খেলা ? জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা বাইবি কি উজান ? পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল স্বর্গে দিবি টান্ ।।সরল সাজের নাইরে সময় বেরিয়ে তোরা আয় , আজ বিপদের পরশ নেব নাঙ্গা আদুল গায় ।আসবে রণ-সজ্জা ক'বে , সেই আশায়ই রইলি সবে ! রাত পোহাবে প্রভাত হবে গাইবে পাখি গান । আয় বেরিয়ে, সেই প্রভাতে ধরবি যারা তান ।।আঁধার ঘোরে আত্নঘাতী যাত্রা-পথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত করছে কলরব ! অভিযানে বীর সেনাদল ! জ্বালাও মশাল, চল্ আগে চল্ । কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল , গাও প্রভাতের গান !ঊষার দ্বারে পৌছে গাবি ‘জয় নব উত্থান !’কাব্যগ্রন্থ: সিন্ধু-হিন্দোল 'অভিশাপ' যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-                       বুঝবে সেইদিন বুঝবে!                   ছবি আমার বুকে বেঁধে                   পাগল হ’লে কেঁদে-কেঁদে                   ফিরবে মরু কানন গিরি,                   সাগর আকাশ বাতাস চিরি’                   যেদিন আমায় খুঁজবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে!স্বপন ভেঙে নিশুত্‌ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে, কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,-                       জাগবে হঠাৎ চমকে!                   ভাববে বুঝি আমিই এসে                   ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,                   ধরতে গিয়ে দেখবে যখন                   শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!                   বেদ্‌নাতে চোখ বুঁজবে-                       বুঝবে সেদিন বুজবে।গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে আস্‌বে যখন কান্না, ব’লবে সবাই-“সেই য পথিক তার শেখানো গান না?’’                       আস্‌বে ভেঙে কান্না!                   প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,                   কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!                   প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি                   অশ্র”-হারা কঠিন আঁখি                   ঘন-ঘন মুছবে-                       বুঝ্‌বে সেদিন বুঝবে!আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন, তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ-                       কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!                   শিউলি ঢাকা মোর সমাধি                   প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!                   বুকের মালা ক’রবে জ্বালা                   চোখের জলে সেদিন বালা                   মুখের হাসি ঘুচবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে!আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি, থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী!                       আসবে শিশির-রাত্রি!                   থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,                   থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,                   বঁধুর বুকের পরশনে                   আমার পরশ আনবে মনে-                   বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে!আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না ক আ সে- তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,                       আসবে না ক’ আর সে!                   প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে                   মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,                   মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!                   সেই স্মৃতি নিতো ঐ বিছানায়                   কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে!আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে, সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে-                       দুলবে তরী রঙ্গে,                   প’ড়বে মনে সে কোন্‌ রাতে                   এক তরীতে ছিলে সাথে,                   এমনি গাঙ ছিল জোয়ার,                   নদীর দু’ধার এমনি আঁধার                   তেম্‌নি তরী ছুটবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে!তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ, আমার মতন কেঁদে-কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ-                       সখার কারা-বন্ধ!                   বন্ধু তোমার হান্‌বে হেলা                   ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;                   দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,                   বইতে প্রাণের শান্ত- এ ভার                   মরণ-সনে যুঝ্‌বে-                       বুঝবে সেদিন বুঝ্‌বে!ফুট্‌বে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী, আকাশ-ছাওয়া তারায়-তারায় বাজবে আমার কাঁদ্‌নী-                       চৈতী-রাতের চাঁদ্‌নী।                   ঋতুর পরে ফির্‌বে ঋতু,                   সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!                   চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,                   আমার মতন চোখ ভ’রে চায়                   যে-তারা তা’য় খুঁজবে-                       বুঝ্‌বে সেদিন বুঝ্‌বে!আস্‌বে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন, কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-                       টুটবে যবে বন্ধন!                   পড়বে মনে, নেই সে সাথে                   বাঁধতে বুকে দুঃখ-রাতে-                   আপনি গালে যাচবে চুমা,                   চাইবে আদর, মাগ্‌বে ছোঁওয়া,                   আপনি যেচে চুমবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে।আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হান্‌ত, সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান্ত–                       আসবো তখন পান্ত’।                   হয়ত তখন আমার কোলে                   সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,                   আপনি সেদিন সেধে কেঁদে                   চাপ্‌বে বুকে বাহু বেঁধে,                   চরণ চুমে পূজবে-                       বুঝবে সেদিন বুঝবে! অভিশাপ আমি   বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান! মম   চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।            আদি ও অন্তহীন        আজ   মনে পড়ে সেই দিন –        প্রথম যেদিন আপনার মাঝে আপনি জাগিনু আমি, আর   চিৎকার করি কাঁদিয়া উঠিল তোদের জগৎ-স্বামী। ভয়ে   কালো হয়ে গেল আলো-মুখ তার।        ফরিয়াদ করি গুমরি উঠিল মহা-হাহাকার –        ছিন্ন-কণ্ঠে আর্ত কণ্ঠে তোমাদের ওই ভীরু বিধাতার –               আর্তনাদের মহা-হাহাকার –   যে,  ‘বাঁচাও আমারে বাঁচাও হে মোর মহান, বিপুল আমি!               হে মোর সৃষ্টি! অভিশাপ মোর!        আজি হতে প্রভু তুমি হও মম স্বামী!’ – শুনি   খলখলখল অট্ট হাসিনু, আজিও সে হাসি বাজে   ওই   অগ্ন্যুদ্‌গার-উল্লাসে আর নিদাঘ-দগ্ধ               বিনা-মেঘের ওই শুষ্ক বজ্র-মাঝে!        স্রষ্টার বুকে আমি সেই দিন প্রথম জাগানু ভীতি, –        সেই দিন হতে বাজিছে নিখিলে ব্যথা-ক্রন্দন গীতি!        জাপটি ধরিয়া বিধাতারে আজও পিষে মারি পলে পলে,   এই   কালসাপ আমি, লোকে ভুল করে মোরে অভিশাপ বলে।           (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) অমর-কানন অমর কানন        মোদের অমর-কানন! বন কে বলে রে ভাই, আমাদের তপোবন,               আমাদের তপোবন।  এর   দক্ষিণে ‘শালী’ নদী কুলুকুলু বয়,   তার   কূলে কূলে শালবীথি ফুলে ফুলময়,   হেথা   ভেসে আসে জলে-ভেজা দখিনা মলয়,   হেথা          মহুয়ার মউ খেয়ে মন উচাটন।দূর প্রান্তর-ঘেরা আমাদের বাস, দুধহাসি হাসে হেথা কচি দুব-ঘাস,         উপরে মায়ের মতো চাহিয়া আকাশ,                বেণু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ  মোরা  নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,    সদা  খুশিভরা বুক হেথা হাসিভরা গাল,   মোরা  বাতাস করি গো ভেঙে হরিতকি-ডাল,    হেথা  শাখায় শাখায় শাখী, গানের মাতন।         প্রহরী মোদের ভাই ‘পুরবি’ পাহাড়,         ‘শুশুনিয়া’ আগুলিয়া পশ্চিমি দ্বার,    ওড়ে  উত্তরে উত্তরি কাননবিথার,    দূরে   ক্ষণে ক্ষণে হাতছানি দেয় তালী-বন।   হেথা  খেত-ভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রান,    হেথা  প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফুলে ফোটে প্রাণ,   ও রে  রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান,    মোরা         নারায়ণ-সাথে খেলা খেলি অনুখন।   মোরা  বটের ছায়ায় বসি করি গীতাপাঠ,          আমাদের পাঠশালা চাষি-ভরা মাঠ,          গাঁয়ে গাঁয়ে আমাদের মায়েদের হাট,          ঘরে ঘরে ভাইবোন বন্ধুস্বজন।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) অমৃতের সন্তান নীহারিকালোকে অনিমিখে চেয়ে আছেন বৈজ্ঞানিক, কত শত নব সূর্য জনমি রাঙায় অজানা দিক! আমি চেয়ে আছি তোদের পানে যে, ওরে ও শিশুর দল, নূতন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল! দিব্য জ্যোতির্দীপ্ত কত সে রবি শশী গ্রহ তারা তোদের মাঝারে লভিয়া জনম ঘুরিতেছে পথহারা, আত্মা আমার জেগে আছে যেন মেলি অনন্ত আঁখি, মাহেন্দ্রক্ষণ উদয় উষার – আরও কতদিন বাকি? জাগো অমৃতের সন্তান, জাগো বেদ-ভাষিণীর দল! বিশ্বে ভোগের মন্থনে আজ উঠিয়াছে হলাহল। অসুর-শক্তি শ্রান্ত হইয়া আজিকে আপন বিষে ঊর্ধ্বে চাহিছে দেবতার পানে, জ্বালা জুড়াইবে কীসে। আমি দেখিয়াছি, তোমাদের শুচি ক্ষুদ্র তনুর মাঝে সেই ঊর্ধ্বের দিব্য শক্তি শান্তি অমৃত রাজে। খোলো গুন্ঠন, ভোলো বন্ধন, ভাঙো ভবনের কারা, বাহির ভুবনে আসিয়া দাঁড়াও, বাধাহীন ভয়হারা। শোনো অমৃতের পুত্র! দুয়ারে দাঁড়ায়ে তোমার কাছে জরাগ্রস্ত ভিখারি যযাতি নবযৌবন যাচে! কুমারী উমার রূপে কতকাল অচল পিতার গেহে হে মহাশক্তিরূপিণী শিবানী, বদ্ধ রহিবে স্নেহে? হে মহাশক্তি, তোমারে হারায়ে পুরুষোত্তম শিব পথের ভিখারি, মৃতের শ্মশানে হয়েছে ঘৃণ্য জীব! কে বলে তোমরা বালক বালিকা? তোমরা ঊর্ধ্ব হতে নামিয়া এসেছ শুদ্ধ শক্তি দিব্য জ্যোতিস্রোতে। হৃদয়-কমণ্ডলু হতে তব অমৃতধারা ছিটাও, ঈর্ষাক্লান্ত জর্জরিত এ বিশ্বে শান্তি দাও। বাঁচাতে এসেছ, বাঁচিতে আসনি হেথা শুধু পশু সম, তপস্যা ত্যাগে পুরুষ হেথায় হয় পুরুষোত্তম; সংসারী হয়ে নারী এই দেশে হয় ঋষি বেদবতী, আনো সেই আশা, শক্তি, ধরায় স্বর্গের সেই জ্যোতি। দূর করো এই ভেদজ্ঞান, এই হানাহানি, মলিনতা, আনো ধূর্জটি-জটা হতে তব জাহ্নবীর পবিত্রতা।… প্রণাম-পুষ্পাঞ্জলি লয়ে আছি পূজারি বসিয়া একা, তোমাদের সেই দিব্য স্বরূপে কবে পাব হায় দেখা!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) অর্ঘ্য হায় চির-ভোলা! হিমালয় হতে             অমৃত আনিতে গিয়া ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের             মৃত্যু-গরল পিয়া! কেন এত ভালো বেসেছিলে তুমি             এই ধরণির ধূলি? দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে             স্বর্গে লইল তুলি! হুগলি ৩রা আষাঢ়, ১৩৩২ (চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ) অশ্বিনীকুমার আজ যবে প্রভাতের নব যাত্রীদল ডেকে গেল রাত্রিশেষে, ‘চল আগে চল’, – ‘চল আগে চল’ গাহে ঘুম-জাগা পাখি, কুয়াশা-মশারি ঠেলে জাগে রক্ত-আঁখি নবারুণ নব আশা। আজি এই সাথে, এই নব জাগরণ-আনা নব প্রাতে তোমারে স্মরিনু বীর প্রাতঃস্মরণীয় ! স্বর্গ হতে এ স্মরণ-প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ো ! নিয়ো নিয়ো সপ্তকোটি বাঙালির তব অশ্রু-জলে স্মৃতি-পূজা অর্ঘ‌্য অভিনব!আজও তারা ক্রীতদাস, আজও বদ্ধ-কর শৃঙ্খল-বন্ধনে দেব ! আজও পরস্পর করে তারা হানাহানি, ঈর্ষা-অস্ত্রে যুঝি ছিটায় মনের কালি-নিরস্ত্রের পুঁজি! মন্দভাষ গাঢ় মসি দিব্য অস্ত্র তার! ‘দুই-সপ্ত কোটি ধৃত খর তরবার’ সে শুধু কেতাবি কথা, আজও সে স্বপন! সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন উদ‍্‍গারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি! বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহো তুমি! কে করিবে নমস্কার! হায় যুক্তকর মুক্ত নাহি হল আজও! বন্ধন-জর্জর এ কর পারে না দেব ছুঁইতে ললাট! কে করিবে নমস্কার? কে করিবে পাঠ তোমার বন্দনা-গান? রসনা অসাড়! কথা আছে বাণী নাই ছন্দে নাচে হাড়!ভাষা আছে আশা নাই, নাই তাহে প্রাণ, কে করিবে এই জাতিরে নবমন্ত্র দান! অমৃতের পুত্র কবি অন্নের কাঙাল, কবি আর ঋষি নয়, প্রাণের অকাল করিয়াছে হেয় তারে! লেখনী ও কালি যত না সৃজিছে কাব্য ততোধিক গালি! কণ্ঠে যার ভাষা আছে অন্তরে সাহস, সিংহের বিবরে আজ পড়ে সে অবশ! গর্দান করিয়া উঁচু যে পারে গাহিতে নব জীবনের গান, বন্ধন-রশিতে চেপে আছে টুঁটি তার! জুলুম-জিঞ্জির মাংস কেটে বসে আছে, হাড়ে খায় চিড় আর্ত প্রতিধ্বনি তার! কোথা প্রতিকার! যারা আছে—তারা কিছু না করে নাচার!নেহারিব তোমারে যে শির উঁচু করি, তাও নাহি পারি, দেব! আইনের ছড়ি মারে এসে গুপ্ত চেড়ী। যাইবে কোথায়! আমার চরণ নহে মম বশে, হায়। এক ঘর ছাড়ি আর ঘরে যেতে নারি, মর্দজাতি হয়ে আছে পর্দা-ঘেরা নারী! এ লাঞ্ছনা, এ পীড়ন, এ আত্মকলহ, আত্মসুখপরায়ণ পরাবৃত্তি মোহ– তব বরে দূর হোক! এ জাতির পরে হে যোগী, তোমার যেন আশীর্বাদ ঝরে ! যে-আত্মচেতনা-বলে যে আত্মবিশ্বাসে যে-আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মরা জাতি বাঁচে, যোগী, তব কাছে জাতি সেই শক্তি যাচে!স্বর্গে নহে, আমাদের অতি কাছাকাছি আছ তুমি হে তাপস, তাই মোরা যাচি তব বর, শক্তি তব! জেনেছিলে তুমি স্বর্গাদপি গরীয়সী এই বঙ্গভূমি! দিলে ধর্ম, দিলে কর্ম, দিলে ধ্যান জ্ঞান, তবু সাধ মিটিল না, দিলে বলিদান আত্মারে জননি-পদে, হাঁকিলে, “মাভৈঃ! ভয় নাই, নব দিনমণি ওঠে ওই! ওরে জড়, ওঠ তোরা!” জাগিল না কেউ, তোমারে লইয়া গেল পারাপারী ঢেউ।অগ্রে তুমি জেগেছিলে অগ্রজ শহিদ, তুমি ঋষি, শুভ প্রাতে টুটেছিল নিদ, তব পথে যাত্রী যারা রাত্রি-দিবা ধরি ঘুমাল গভীর ঘুম, আজ তারা মরি বেলাশেষে জাগিয়াছে! সম্মুখে সবার অনন্ত তমিস্রাঘোর দুর্গম কান্তার! পশ্চাতে ‘অতীত’ টানে জড় হিমালয়, সংশয়ের ‘বর্তমান’ অগ্রে নাহি হয়, তোমা-হারা দেখে তারা অন্ধ ‘ভবিষ্যৎ’, যাত্রী ভীরু, রাত্রি গুরু, কে দেখাবে পথ!হে প্রেমিক, তব প্রেম বরিষায় দেশে এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে। সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষায় যাচিছে ঊষর বঙ্গ তব কাছে হায়! পীড়িত এ বঙ্গ তব কাছে হায়! পীড়িত এ বঙ্গ পথ চাহিছে তোমার, অসুর নিধনে কবে আসিবে আবার!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) আঁধারে অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে; স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে! ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ! মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা? গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু– আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) আগমনী একি     রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন– ঝন      রনরন রন ঝনঝন! সেকি    দমকি দমকি                 ধমকি ধমকি            দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি                ওঠে চোটে চোটে,           ছোটে লোটে ফোটে           বহ্নি-ফিনিকি     চমকি   চমকি                     ঢাল-তলোয়ারে খনখন!           একি    রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন                     রণ    ঝনঝন ঝন রণরণ!হৈ       হৈ রব ঐ       ভৈরব হাঁকে,   লাখে লাখে ঝাঁকে   ঝাঁকে ঝাঁকে লাল     গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে ওই      পালে পালে,               ধরা কাঁপে দাপে।           জাঁকে    মহাকাল কাঁপে থরথর!           রণে     কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত, শির    পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘররর! 'গুরু   গরগর' বোলে ভেরী তূরী, 'হর    হর হর' করি   চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন! ওঠে   ঝন্‌ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি              হু-হু-হু-হু-হু-হু-শনশন! ছোটে  সুরাসুর-সেনা হনহন!তাতা   থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল খল খল নাচে   রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,          ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল বুকে   মুখে চোখে রোষ-হুতাশন!         রোস্ কোথা শোন্!ঐ     ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,        ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,        মম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে        ধ্বংসে মাতিয়া     তাথিয়া তাথিয়া                     নাচিয়া রঙ্গে! চরণ-ভঙ্গে                     সৃষ্টি সে টলে টলমল!ওকি   বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!             ওঠে    কোলাহল,             কূট      হলাহল             ছোটে   মন্থনে পুন রক্ত-উদধি,                       ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল! টলে   নির্বিকার সে বিধাত্রীরো গো                সিংহ-আসন টলমল! কার   আকাশ-জোড়া ও আনত-নয়ানে               করুণা-অশ্রু ছলছল!বাজে   মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁজর ঝম্‌ঝম, নাচে   ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম্ বম্‌বম্! লাল    লালে-লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের, ওঠে   ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার, নাদে   ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ বিষাণ রুদ্রের!          ছোটে   রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে!          কোটি   বীর-প্রাণ          ক্ষণে    নির্বাণ তবু    শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ               গমকে শিরায় গম্‌গম্! ভয়ে   রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও               শিরদাঁড়া করে চন্‌চন্! যত    ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,               নিশীথিনী ভয়ে থম্‌থম্! বাজে  মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্‌ঝম্!ঐ     অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত হত    আহত করে রে দেবতা সত্য!         স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত-সুরায়;                  ত্রস্ত বিধাতা, মস্ত পাগল পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়!                               ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায়!              চিতার উপরে চিতা সারি সারি,                       চারিপাশে তারি               ডাকে কুক্কুর গৃহিনী শৃগাল!               প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!               প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!! আজ   রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,          দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!                     পদতলে লুটে মহিষাসুর,          মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–          শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!                           ‌‌'নাই দানব                            নাই অসুর,–                            চাইনে সুর,                            চাই মানব!'–                বরাভয়-বাণী ঐ রে কার                শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!                              ওঠ্ রে ওঠ্,                               ছোট্ রে ছোট্!                               শান্ত মন,                               ক্ষান্ত রণ!–                             খোল্ তোরণ,                              চল্ বরণ                              করব্ মা'য়;                              ডর্‌ব কায়?             ধরব পা'য় কার্ সে আর,             বিশ্ব-মা'ই পার্শ্বে যার? আজ   আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া, ঐ     শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?         কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!         এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,                 সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা       এল            বীণা-পাণি অমলা ঐ!                    এসেছে গনেশ,                     এসেছে মহেশ,                     বাস্‌রে বাস্!                     জোর উছাস্!!       এল সুন্দর সুর-সেনাপতি,       সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!       বাস্ রে বাস্‌   জোর উছাস্!!      হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি,                   তব সীমা লয় হোক।       ভুলে যাও শোক– চোখে জল ব'ক       শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!             ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!             মা'র আবাহন-গীত্ চলুক!                 দীপ জ্বলুক!                 গীত চলুক!! আজ   কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্!                     স্বা-গতম্!                     স্বা-গতম্!!                     মা-তরম্!                     মা-তরম্!!       ঐ   ঐ  ঐ  বিশ্ব কণ্ঠে       বন্দনা- বাণী লুণ্ঠে-'বন্দে মাতরম্!!! আগা মুরগি লে কে ভাগা [সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]একদা     তুমি আগা      দৌড়ে কে ভাগা      মুরগি লেকে। তোমারে   ফেলনু চিনে     ওই আননে    জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥ কালো জাম    খাচ্ছিলে যে    সেইদিন সেই    গাছে চড়ে কালো জাম    মনে করে     ফেললে খেয়ে    ভোমরা ধরে। ‘চুঁ করো      আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই, সব কুছ       কালা কালা    খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥ ভুলো আর     টেমি জিমি    চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে, তোমারে       দেখলে পরে   তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।    ও-পাড়ার      হীরু তোমায়      দেখেই পালায়    পগার-পারে, ‘রুপিয়া        লে আও,’ বলে   ধরলে তাহার     ছাগলটারে। দেখিয়াই       মটরু মিয়াঁর       মুরগি লুকায়     ঝোপের আড়ে, তাই কি        ছেলেমেয়ে       মুরগি-চোরা      বলে ডাকে॥  (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন ঘুমাইয়া ছিল আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন, বহু বৎসর মুখ চেপে ছিল পাষাণের আবরণ। তার এ ঘুমের অবসরে যত ধনলোভী রাক্ষস প্রলোভন দিয়ে করেছিল যত বুদ্ধিজীবীরে বশ। অর্থের জাব খাওয়ায়ে তাদের বলদ করিয়ে শেষে লুঠতরাজের হাট ও বাজার বসাইল সারা দেশে। সেই জাব খেয়ে বুদ্ধিওয়ালার হইল সর্বনাশ, ‘শুদ্ধি স্বামী’ ও ‘বুদ্ধু মিয়াঁ-র হইল তাহারা দাস! বুঝিল না, এই শুদ্ধি স্বামী ও বুদ্ধু মিয়াঁরা কারা খাওয়ায় কাগুজে পুরিয়ায় পুরে এরাই আফিম, পারা! সাত কোটি বাঙালির সাত জনে শুধু টাকা দিয়ে দাস করে, এরা হল কোটিপতি বাঙালি রক্ত পিয়ে। কাগুজে মগুজে ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিবলে, ছুরি আর লাঠি ধরাইয়া দিল বাঙালির করতলে। জানে এরা ভায়ে ভায়ে হেথা যদি নাহি করে লাঠালাঠি, কেমন করিয়া শাঁস শুষে খাবে, ইহাদের দিয়া আঁটি? আঁটি খেয়ে যবে ভরে নাকো পেট, শূন্য বাটি ও থালা, বাঙালি দেখিল এত পাট, ধান, মেটে না ক্ষুধার জ্বালা! তখন বিরাট আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবনে নাড়া দিয়া যেন জাগাইয়া দিল ঝঞ্জা প্রভঞ্জনে! জেগে উঠে দেখে রক্তনয়নে আগ্নেয়গিরি একী! ওরই ধান ওরই বুকে কুটিতেছে বিদেশি কল ও ঢেঁকি! উহারই বিরাট অঙ্গে উঠেছে মিলের চিমনিরাশি, উহারই ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে হয়েছে আঁখির দৃষ্টি, হাসি। এ কোন যন্ত্রদৈত্য আসিয়া যন্ত্রণা দেয় দেহে? দাসদাসী হয়ে আছে নরনারী স্বীয় পৈতৃক গেহে। একী কুৎসিত মূর্তিরা ফেরে আগুনের পর্বতে, ক্যাঙালির মতো, বাঙালি কি ওরা – লেজ ধরে চলে পথে? ভুঁড়ি-দাস আর নুড়ি-দাস যত মুড়ি খায় আর চলে, যে-কথা উহারা বলাইতে চায়, চিৎকার করে বলে! বিদারিত হল বহ্নিগিরির মুখের পাষাণভার, কাঁপিয়া উঠিল লোভীর প্রাসাদ ভীম কম্পনে তার! ক্রোধ হুংকার ওঠে ঘন ঘন প্রাণ-গহ্বর হতে, ‘লাভা’ ও অগ্নিশিখা উঠে ছুটে উর্ধ্ব আকাশপথে।কই রে কই রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার? দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিকো প্রবলের মার! দেখেছ বাঙালি দাস, দেখনিকো বাঙালির যৌবন, অগ্নিগিরির বক্ষে বেঁধেছ যক্ষ তব ভবন! হেরো, হেরো, কুণ্ডলী-পাক খুলি আগ্নেয় অজগর বিশাল জিহ্বা মেলিয়া নামিছে ক্রোধ-নেত্র প্রখর। ঘুমাইয়া ছিল পাথর হইয়া তার বুকে যত প্রাণ, অগ্নিগোলক হইয়া ছুটিছে তিরবেগে সে পাষাণ! নিঃশেষ করে দেবে আপনারে আগ্নেয়গিরি আজি, ফুলঝুরি-সম ঝরিবে এবার প্রাণের আতসবাজি! ঊর্ধ্বে উঠেছে ক্রুদ্ধ হইয়া অদেখা আকাশ ঘেরি ; তোমাদের শিরে পড়িবে আগুন, নাই বেশি আর দেরি! তোমাদের যন্ত্রের এই যত যন্ত্রণা-কারাগার এই যৌবনবহ্নি করিবে পুড়াইয়া ছারখার। সুতি ধুতিপরা দেখেছ বিনয়- নম্র বাঙালি ছেলে, ঢল ঢল চোখ জলে ছলছল একটু আদর পেলে! দুধ পায় নাই, মানুষ হয়েছে শুধু শাকভাত খেয়ে, তবুও কান্তি মাধুরী ঝরিছে কোমল অঙ্গ বেয়ে। তোমাদের মতো পলোয়ান নয়, নয় মাংসল ভারী, ওরা কৃশ, তবু ঝকমক করে সুতীক্ষ্ণ তরবারি! বঙ্গভূমির তারুণ্যের এ রঙ্গনাটের খেলা বুঝেও বোঝেনি যক্ষ রক্ষ, বুঝিবে সে শেষ বেলা!শাড়ি-মোড়া যেন আনন্দ-শ্রী দেখো বাংলার নারী, দেখনি এখনও, ওঁরাই হবেন অসি-লতা তরবারি! ওরা বিদ্যুল্লতা-সম, তবু ওরাই বজ্র হানে, ওরা কোথা থাকে, তোমরা জান না, সাগর ও মেঘ জানে। যুগান্তরের সূর্য যখন উদয়-গগনে ওঠে, সূর্যের টানে ছুটে আসে মেঘ ; তাহারই আড়ালে ছোটে ওরা যেন ভীরু পর্দানশীন! ওরাই সময় হলে ঘন ঘন ছোঁড়ে অশনি অত্যাচারীর বক্ষতলে! শ্যামবঙ্গের লীলা সে ভীষণ সুন্দর, রেখো জেনে, বাঘের মতন নাগের মতন দেখি, যে বাঙালি চেনে! তাদেরই জড়তা-পাষাণ টুটিয়া ঝরিছে অগ্নিশিখা, কে জানে কাহার তকদীরে ভাই কী শাস্তি আছে লিখা! ধোঁয়া দেখে যদি না নোয়াও মাথা, বছর খানিক বেঁচো! দেখিবে হয়েছি ফেরেশতা মোরা, তোমরা হয়েছ কেঁচো!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে - বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে। আসল হাসি, আসল কাঁদন মুক্তি এলো, আসল বাঁধন, মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে। ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস, গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে! ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন, মদন মারে খুন-মাখা তূণ পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে গো দিগ বালিকার পীতবাসে;আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! আজ কপট কোপের তূণ ধরি, ঐ আসল যত সুন্দরী, কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন, কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে! তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের আমার চোখে জল আসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর, আসল নিকট, আসল সুদূর আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে! ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল হাসল শিশির দুবঘাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আজ জাগল সাগর, হাসল মরু কাঁপল ভূধর, কানন তরু বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান ভৈরবীদের গান ভাসে, মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!! আজি মনে মনে লাগে হোরী আজি মনে মনে লাগে হোরী আজি বনে বনে জাগে হোরী।। ঝাঁঝর করতাল খরতালে বাজে বাজে কংকন চুড়ি মৃদুল আওয়াজে লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে প্রেম-উল্লাসে শ্যামল গৌরী।। আজি কদম্ব তমাল রঙ্গে লালে লাল হলো কৃষ্ণ ভ্রমর ভ্রমরী রঙ্গের উজান চলে কালো যমুনার জলে আবীর রাঙ্গা হলো ময়ূর-ময়ূরী।। মোর হৃদি বৃন্দাবন যেন রাঙে রাধা শ্যাম যুগল চরণ রাগে ও চরণ ধূলি যেন ফাগ হ’য়ে মেশে রে অন্তরে পড়ে মোর ঝরি’।। আড়াল আমি কি আড়াল করিয়া রেখেছি তব বন্ধুর মুখ? না জানিয়া আমি না জানি কতই দিয়াছি তোমায় দুখ।     তোমার কাননে দখিনা পবন     এনেছিল ফুল পূজা-আয়োজন, আমি এনু ঝড় বিধাতার ভুল – ভণ্ডুল করি সব, আমার অশ্রু-মেঘে ভেসে গেল তব ফুল-উৎসব।    মম উৎপাতে ছিঁড়েছে কি প্রিয়, বক্ষের মণিহার? আমি কি এসেছি তব মন্দিরে দস্যু ভাঙিয়া দ্বার?     আমি কি তোমার দেবতা-পূজার     ছড়ায়ে ফেলেছি ফুল-সম্ভার? আমি কি তোমার স্বর্গে এসেছি মর্ত্যের অভিশাপ আমি কি তোমার চন্দ্রের বুকে কালো কলঙ্ক-ছাপ?    ভুল করে যদি এসে থাকি ঝড়, ছিঁড়িয়া থাকি মুকুল, আমার বরষা ফুটায়েছে অনেক অধিক ফুল!     পরায়ে কাজল ঘন বেদনার     ডাগর করেছি নয়ন তোমার, কূলের আশায়, ভাঙিয়া করেছি সাত সাগরের রানি, সে দিয়াছে মালা, আমি সাজায়েছি নিখিল সুষমা-ছানি।দস্যুর মতো হয়তো খুলেছি লাজ-অবগুণ্ঠন, তব তরে আমি দস্যু, করেছি ত্রিভুবন লুণ্ঠন!     তুমি তো জান না, নিখিল বিশ্ব     কার প্রিয়া লাগি আজিকে নিঃস্ব? কার বনে ফুল ফোটাবার লাগি ঢালিয়াছি এত নীর, কার রাঙা পায়ে সাগর বাঁধিয়া করিয়াছি মঞ্জীর।    তুমি না চাহিতে আসিয়াছি আমি – সত্য কি এইটুক? ফুল ফোটা-শেষে ঝরিবার লাগি ছিলে না কি উৎসুক?     নির্মম-প্রিয়-নিষ্ঠুর হাতে     মরিতে চাহনি আঘাতে আঘাতে? মরিতে চাহনি আঘাতে আঘাতে? তুমি কি চাহনি কেহ এসে তব ছিঁড়ে দেয় গাঁথা-মালা?    পাষাণের মতো চাপিয়া থাকিনি তোমার উৎস-মুখে, আমি শুধু এসে মুক্তি দিয়াছি আঘাত হানিয়া বুকে!     তোমার স্রোতেরে মুক্তি দানিয়া     স্রোতমুখে আমি গেলাম ভাসিয়া। রহিবার যে – সে রয়ে গেল কূলে, সে রচুক সেথা নীড়! মম অপরাধে তব স্রোত হল পুণ্য তীর্থ-নীর!    রূপের দেশের স্বপন-কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু, বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙাইনু।     দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙিয়াই,     ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই, যে আসিল তব জাগরণ-শেষে মালা দাও তারই গলে, সে থাকুক তব বক্ষে – রহিব আমি অন্তর-তলে।    সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালায়ে যখন দাঁড়াবে আঙিনা-মাঝে, শুনিয়ো কোথায় কোন তারা-লোকে কার ক্রন্দন বাজে!     আমার তারার মলিন আলোকে     ম্লান হয়ে যাবে দীপশিখা চোখে, হয়তো অদূর গাহিবে পথিক আমারই রচিত গীত – যে গান গাইয়া অভিমান তব ভাঙাতাম সাঁঝে নিতি।    গোধূলি-বেলায় ফুটিবে উঠানে সন্ধ্যামণির ফুল, তুলসী-তলায় করিতে প্রণাম খুলে যাবে বাঁধা চুল।     কুন্তল-মেঘ-ফাঁকে অবিরল     অকারণে চোখে ঝরিবে গো জল, সারা শর্বরী বাতায়নে বসি নয়ন-প্রদীপ জ্বালি খুঁজিবে আকাশে কোন তারা কাঁপে তোমারে চাহিয়া খালি।    নিষ্ঠুর আমি – আমি অভিশাপ, ভুলিতে দিব না, তাই নিশ্বাস মম তোমারে ঘিরিয়া শ্বসিবে সর্বদাই।     তোমারে চাহিয়া রচিনু যে গান     কণ্ঠে কণ্ঠে লভিবে তা প্রাণ, আমার কণ্ঠে হইবে নীরব, নিখিল-কণ্ঠ-মাঝে শুনিবে আমারই সেই ক্রন্দন সে গান প্রভাতে সাঁঝে!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) আত্মগত আর জিজ্ঞাসা করিব না কোনো কথা আপনার মনে কয়ে যাব আমি আপন মনের ব্যথা। ভোরের প্রথম-ফোটা ফুলগুলি গোপনে তুলিয়া আনি অঞ্জলি দিতে তোমার দুয়ারে দাঁড়াই যুক্তপাণি। আমার চেয়েও সকরুণ চোখে ফুলগুলি চেয়ে থাকে, মোর সাথে ওরা তব পায়ে চাহে অর্পিতে আপনাকে, – তব তনু হেরি ফুলগুলি যেন অধিক ফুল্ল হয়, মনে ভাবে, ওই অঙ্গের সাথে কবে হবে পরিচয়! তুমি দ্বিধাভরে যেন ভয়ে ভয়ে আস উহাদের কাছে! ভাব বুঝি ওই ফুলের ঝাঁপিতে লোভের সাপিনি আছে! মুখ ফুটে তাই বলিতে পার না, ‘ওই ফুলগুলি দাও।’ আমার গানের ফুলগুলি বোঝে, উহাদের ভয় পাও। চেয়ে দেখি, হায়, বেদনায় মোর ফুল্ল ফুলের গুছি সূর্যের নামে শপথ করিয়া কাঁদে – ‘শুচি মোরা শুচি।’ ছড়াইয়া দিই পথের ধুলাতে প্রেম-ফুল-অঞ্জলি, ‘দেখ সাপ নাই, নাই কাঁটা’ – আমি ফিরে যেতে যেতে বলি। অবুঝ ভিখারি-মন যেতে যেতে পিছু ফিরে ফিরে চায় – ছড়ানো একটি ফুল তুলে সে কি লুকাল এলো-খোঁপায়? দূর হতে দেখে পাষাণ-মুরতি তেমনি দাঁড়ায়ে আছে, ফুল এড়াইয়া চলে গেলে তুমি কলঙ্ক লাগে পাছে! তোমার চলার পথে পড়ে যত এই পৃথিবীর ধূলি তারও চেয়ে কি গো মলিনতা-মাখা আমার কুসুমগুলি? ধুলায় তোমায় ভুলায় না পথ, পথ ভোলাবে কি ফুল? ভয় পাও কি গো যদি শোনো পথে গাহে বন-বুলবুল? তুমি শুনিলে না, তবু মোর কথা থামিতে চাহে না কেন? তোমার ফুলের ফাল্গুন মাসে ঝোড়ো মেঘ আমি যেন! তব ফুল-ভরা উৎসবে কেন জল ছিটিয়ে সে যায় তব সাথে তার কোন সে জীবনে কোন যোগ ছিল, হায়! ভয় করিয়ো না, মেঘ আসে – মেঘ শেষ হয়ে যায় গলে, আমার না-বলা কথা বলা হলে আমিও যাইব চলে। আমি জানি, এই ফাগুন ফুরাবে, খর-বৈশাখ এসে কী যেন দারুণ আগুন জ্বালাবে তোমাদের এই দেশে। ভালো লাগিবে না কিছু সেই দিন উৎসব হাসি গান, ফাগুনে যে মেঘ এসেছিল, তার তরে কাঁদিবে গো প্রাণ।            ডাকিবে, ‘এসো হে ঘনশ্যাম বারিবাহ,            জ্বলে গেল বুক, জুড়াও জুড়াও দাহ।’অভিমানী মেঘ সেদিন যদি গো নাহি আসে আর ফিরে, যে সাগর থেকে মেঘ এসেছিল – যেয়ো সে সাগর তীরে। তোমারে হেরিলে হয়তো আমার অভিমান যাব ভুলে, তব কুন্তল-সুরভিতে সাড়া পড়িবে সাগরকূলে। আমি উত্তাল তরঙ্গ হয়ে আছাড়ি পড়িব পায়ে, জলকণা হয়ে ছিটায়ে পড়িব তব অঞ্চলে, গায়ে। এই ভিখারির কথা শুনি আজ হাসিবে হয়তো প্রিয়া, তবু বলি, তুমি কাঁদিয়া উঠিবে সাগর দেখিতে গিয়া। মনে পড়ে যাবে, তোমার আকাশে মেঘ হয়ে কোনোদিন কেঁদেছিল এই সাগর তোমারে ঘিরিয়া বিরামহীন। তোমারে না পেয়ে শত পথ ঘুরে কেঁদে শত নদীনীরে           সাগরের জল সাগরে এসেছে ফিরে। তোমারে সিনান করায়েছিল সে অমৃতধারার কূলে ছেয়ে দিয়েছিল তোমার ভুবন বিহ্বল ফুলে ফুলে! তব ফুলময় তনু লয়ে ওঠে বৃন্দাবনে যে গীতি, তোমারে যে আজ নিবেদন করে ত্রিলোক শ্রদ্ধা প্রীতি। মেঘ-ঘনশ্যাম কোনো বিরহীর স্মৃতি আছে তার সাথে, মেঘ হয়ে কেঁদে এসেছিল, গেছে আঁধারে মিশায়ে রাতে। ‍সাগরে যেদিন ঝাঁপায়ে পড়িবে! তোমার পরশ পেয়ে প্রলয়-সলিলে রূপ ধরে আমি উঠিব গোপনে গেয়ে! আমার হৃদয় ছোঁয় যদি প্রিয়া তোমার তনুর মায়া, পরম শূন্যে ভাসিয়া উঠিবে আবার আমার কায়া। আজ চলে যাই – এই পৃথিবীরে আর লাগে নাকো ভালো। হেথা মানুষের নিশ্বাসে নিভে যায় যে প্রেমের আলো!           সেদিন যেন গো দ্বিধা নাহি আসে           কোনো লোক যেন নাহি থাকে পাশে, যে নামে আমারে ডাকিলে না আজ সেদিন ডেকো সে নামে কী বলে ডাকিলে বেঁচে উঠি আমি শুধাইয়ো রাধা শ্যামে।         যে নিরাধার শ্যাম শ্রীরাধার প্রেমে      রূপ ধরে আসে পৃথিবীর বুকে নেমে, যদি কোনো দিন দেখা পাও তার – মোর স্মৃতি থাকে মনে, রোদনের বান আনে যদি তব প্রেমের বৃন্দাবনে, ‘কোথায় হারিয়ে গেছি আমি’ শুধায়ো নিরালা ডাকি, খুঁজিয়া আনিবে হয়তো আমারে তাঁহার পরম আঁখি॥   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) আত্মশক্তি এসো বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি বুদ্ধ বীর! আনো উলঙ্গ সত্যকৃপাণ, বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির।তূরীয়ানন্দে ঘোষো সে আজ ‘আমি আছি’– বাণী বিশ্ব-মাঝ, পুরুষ-রাজ! সেই স্বরাজ!জাগ্রত করো নারায়ণ-নর নিদ্রিত বুকে মর-বাসীর; আত্ম-ভীতু এ অচেতন-চিতে জাগো ‘আমি-স্বামী নাঙ্গা-শির’…এসো প্রবুদ্ধ, এসো মহান শিশু-ভগবান জ্যোতিষ্মান। আত্মজ্ঞান- দৃপ্ত-প্রাণ!জানাও জানাও, ক্ষুদ্রেরও মাঝে রাজিছে রুদ্র তেজ রবির !! উদয়-তোরণে উড়ুক আত্ম-চেতন-কেতন ‘আমি-আছি’-রকরহ শক্তি-সুপ্ত-মন রুদ্র বেদনে উদ্‌বোধন, হীন রোদন – খিন্ন-জনদেখুক আত্মা-সবিতার তেজ বক্ষে বিপুলা ক্রন্দসীর! বলো, নাস্তিক হউক আপন মহিমা নেহারি শুদ্ধ ধীর!কে করে কাহারে নির্যাতন আত্ম-চেতন স্থির যখন? ঈর্ষা-রণ ভীম-মাতন পদাঘাত হানে পঞ্জরে শুধু আত্ম-বল-অবিশ্বাসীর, মহাপাপী সেই, সত্য যাহার পর-পদানত আনত শির।জাগাও আদিম স্বাধীন প্রাণ, আত্মা জাগিলে বিধাতা চান। কে ভগবান? – আত্ম-জ্ঞান!গাহে উদ্‌গাতা ঋত্বিক গান অগ্নি-মন্ত্র শক্তি-শ্রীর। না জাগিলে প্রাণে সত্য চেতনা, মানি না আদেশ কারও বাণীর !এসো বিদ্রোহী তরুণ তাপস আত্মশক্তিবুদ্ধ বীর, আনো উলঙ্গ সত্য-কৃপাণ বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) আনন্দময়ীর আগমনে আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি! আনোয়ার [চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্‌খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।   সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।   আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার ‘মা’-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, ‘হায় মাতৃহারা!’   স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।   এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘আনোয়ার!’–]                আনোয়ার!      আনোয়ার! দিলাওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো, আর নেস্ত-ও-নাবুদ করো, মারো যত জানোয়ার!              আনোয়ার! আফসোস্!              বখতেরই সাফ্ দোষ, রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ, ভেঙে গেছে শম্‌শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!             আনোয়ার! আফসোস্!          আনোয়ার! আনোয়ার! সব যদি সুম্‌সাম, তুমি কেন কাঁদো আর? দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!             আনোয়ার! আর না!–             দিল্ কাঁপে কার না? তল্‌ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা, ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?             আনোয়ার! আর না!           আনোয়ার! আনোয়ার! বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!            আলোয়ার! জিঞ্জির–           পরা মোরা খিঞ্জির! শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,– নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্‌কির!           গর্দানে জিঞ্জির!         আনোয়ার! আনোয়ার! দুর্বল্ এ গিদ্‌ধড়ে কেন তড়্‌পানো আর? জোরওয়ার শের কই? জের্‌বার জানোয়ার!          আনোয়ার! মুশ্‌কিল          জাগা কঞ্জুশ্-দিল, ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল! ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!         আনোয়ার! মুশ্‌কিল!     আনোয়ার! আনোয়ার! বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর। কোথা খোঁজো মুস্‌লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!        আনোয়ার! সব শেষ!–        দেহে খুন অবশেষ!– ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ ! আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ ! !       আনোয়ার ! সব শেষ !      আনোয়ার ! আনোয়ার ! জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর ! আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার !      আনোয়ার ! –কেউ নাই !      হাথিয়ার? –সেও নাই ! দরিয়াও থম্‌থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই ! জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে'ও ভাই !      আনোয়ার ! কেউ নাই !     আনোয়ার ! আনোয়ার ! যে বলে সে মুস্‌লিম– জিভ্ ধরে টানো তার ! বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !      আনোয়ার ! ধিক্কার !      কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার– তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার! যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্‌দার!     আনোয়ার! ধিক্কার!    আনোয়ার ! আনোয়ার! দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মনো আর রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!     আনোয়ার ! পঞ্জায়     বৃথা লোকে সম্‌ঝায়, ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্‌ নাচে ঝন্‌ঝায়, খুন-খেগো তল্‌ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,   আনোয়ার ! পঞ্জায়!   আনোয়ার ! আনোয়ার! পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার, ঘরে যত দুশ্‌মন, পরে কেন হানো মার?–   আনোয়ার ! এসো ভাই!   আজ সব শেষও যাই!– ইস্‌লামও ডুবে গেল, মুক্ত স্বদেশও নাই!- তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!      আনোয়ার ! এসো ভাই!![সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]                          ও কে? ও কে ছল আর?                   না-মা, মরা জানকে এ মিছে তর্‌সানো আর!                          আনোয়ার ! আনোয়ার!![কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-'আঃ-আঃ-আঃ!'     আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায় 'তারার পানে চেয়ে চেয়ে' ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, 'আসিবে সেদিন আসিবে!'] আন্‌মনে জল নিতে আন্‌মনে জল নিতে ভাসিল গাগরী সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি।জানি না বলিব কি, শুধাবে যবে ননদী কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি গাগরী না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি- কি বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরীএকেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে ডাকিল বৌ-কথা-কও কেন হলুদ চাঁপার শাখে বিদেশে শ্যাম আমার, পড়ল মনে সেই ডাকে ঠাঁই দে যমুনে বুকে, আমিও ডুবিয়া মরি।। আপন - পিয়াসী। আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়, আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি আমারি তিয়াসী বাসনায়।।আমারই মনের তৃষিত আকাশে কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে, কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম, অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।আমারই রচিত কাননে বসিয়া পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া, সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া, আপনারি গলে দোলে হায়।। আপন-পিয়াসী আমার    আপনার চেয়ে আপন যে জন       খুঁজি তারে আমি আপনার,     আমি    শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি       আমারি তিয়াসী বাসনায়।।    আমারই মনের তৃষিত আকাশে কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে, কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম, অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।     আমারই রচিত কাননে বসিয়া     পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,     সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,      আপনারি গলে দোলে হায়।। আমরা সেই সে জাতি ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি। সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি। আমরা সেই সে জাতি।।পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা, উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি। আমরা সেই সে জাতি।।কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম। আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী আমরা সেই সে জাতি।।নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার, আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি। আমরা সেই সে জাতি।। আমাদের নারী গুনে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়। রূপে লাবন্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী পরী লাজ পায়।। নর নহে, নারী ইসলাম পরে প্রথম আনে ঈমান, আম্মা খাদিজা জগতে সর্ব-প্রথম মুসলমান, পুরুষের সব গৌরবস্নান এক এই  মহিমায়।। নবী নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী, যাঁর ত্যাগ সেবা স্নেহ ছিল মরূভুমে কওসর পানি, যাঁর গুণ-গাথা ঘরে ঘরে প্রতি  নর-নারী আজো গায়।। রহিমার মত মহিমা কাহার, তাঁর সম সতী কেবা, নারী নয় যেন মূর্তি ধরিয়া এসেছিল পতি সেবা মোদের খাওয়ালা জগতের আলা বীরত্বে গরিমায়।। রাজ্য শাসনের রিজিয়ার নাম ইতিহাসে অক্ষয়, শৌর্যে সাহসে চাঁদ সুলতানা বিশ্বের বিস্ময়। জেবুন্নেসার তুলনায় কোথায় জ্ঞানের তাপস্যার।। বারো বছরের বালিকা লায়লা ওহাবীব দলপতি মোদের সাকিনা জাহানারা যেন ধৈর্য মূর্তিমতী, সে গৌরবের গোর হয়ে গেছে আঁধারের বোরকায়।। আঁধার হেরেমে বন্দিনী হলো সহসা আলোর মেয়ে, সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে লক্ষ খালিদা আসিবে, যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।। আমার কালো মেয়ে আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে কে দিয়েছে গালি তারে কে দিয়েছে গালি রাগ করে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি।যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে আরো মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে কে কালো দেউল করে আলো অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি।পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ তারি কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই জবা ফুলের ডালি।। আমার কৈফিয়ৎ বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি! কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’ দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে! বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা। কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা। কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে! কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা! প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’ আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’ অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি। সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’ যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে! ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও, যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে! হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী। ‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি! ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে, ‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’ গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি! স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী! ‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’ ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’- যুগের না হই, হজুগের কবি বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী, দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু! বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম, রাজ-সরকার রেখেছেন মান! যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে, হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে! যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল, মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল, তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে। হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে! প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে ‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়! বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায় গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে, গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে! রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী, স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে। মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস! কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ। মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস! হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে। রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা, বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে! অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে। প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ! আমার কোন কুলে আজ আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়? আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়?দুখেরে কান্ডারী করি আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী নয়ন ইশারায় গো?নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি কে এলে মোর সুরের সাথি গানের কিনারায়?সোনার দেশের সোনার মেয়ে ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে রাঙা অলকায়।। আমার সকল ক্ষুদ্রতা হতে আমার সকল ক্ষুদ্রতা হতে বাঁচাও প্রভূ উদার হে প্রভু, শেখাও- নীচতার চেয়ে নীচ পাপ নাহি আর। যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী, যুগ- যুগান্ত নরকেও ঝাঁপি, জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা- ক্ষমা নাই নীচত...ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমা হৃদয়ের পরিসর হৃদয়ে আমার সম ঠাঁই পায় শত্রু-মিত্র পর।নিন্দা না করি ঈর্ষা করো অন্যের সুখে সুখ পাই আরো, কাঁদি তারি তরে অশেষ দুখি ক্ষুদ্র আত্মা যার। আমার হাতে কালি মুখে কালি আমার হাতে কালি মুখে কালি আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।মোর লেখাপড়া হল না মা আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা। আমি ক লিখিতেই কালী বলে (মা) নাচি দিয়ে করতালি।কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের ধারা নামে আঁখিপাতে। আমার বর্ণপরিচয় হল না মা তোর বর্ণ বিনা কালী।যা লিখিস মা বনের পাতায় সাগর জলে আকাশ খাতায় আমি সে লেখা তোর পড়তে পারি (লোকে) মূর্খ বলে দিক না গালি।। আমি গাই তারি গান আমি গাই তারি গান- দৃপ্ত-দম্ভে যে যৌবন আজ ধরি' অসি খরশান হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে। লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা। যাহাদের নিঃশ্বাসে জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে। যারা ভেঙে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা, বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়িখানা। যাহাদের প্রান স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল, সন্সকারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল। মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকূতোভয়ে এল নির্মম-মোহ-মুগদর ভাঙনের গদা ল'য়ে বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে দু'-হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল। গরস্থানেরে চ'ষে ছুঁড়ে ফেলে যত শব কঙ্কাল বসালো ফুলের মেলা, যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালি-বেলা। -গাহি তাহাদেরি গান বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান।-সেদিন নিশীথ-বেলা দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা, প্রভাতে সে আর ফিরিল না কূলে। সেই দুরন্ত লাগি' আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি'। আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে। ফিরিল না প্রাতে যে জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে নব জগতের শরসন্ধানী অসীমের পথ-চারী, যার ভরে জাগে সদা সতর্ক মৃত্যু দুয়ারে দ্বারী!সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্তে জু'ড়ে জীবনোদ্বেগে তাড়া ক'রে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে, মানিক আহরি' আনে যারা খুঁড়ি' পাতাল যক্ষপুরী; নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হ'তে মণি চুরি। হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি' যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিঙ্করী। পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী,- এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি। গুঞ্জরি' ফেরে ক্রন্দন মোর তাদের নিখিল ব্যেপে- ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে! যাহাদের কারাবাসে অতীত রাতের বন্দিনী ঊষা ঘুম টুটি' ঐ হাসে! আমি যদি আরব হতাম আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে সেই চিহ্ন বুকে পুরে পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারতমা ফাতেমা খেলত এসে আমার ধূলি লয়ে আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে হাসান হোসেন হেসে হেসে নাচত আমার বক্ষে এসে চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহাব যত রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত কুল মুসলিম আসত কাবায় চলতে পায়ে দলত আমায় আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ত জিন্নত।। আমি যার নূপুরের ছন্দ আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর কে সেই সুন্দর, কে? আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর কে সেই সুন্দর, কে?যাহার গলে আমি বনমালা আমি যার কথার কুসুমডালা না দেখা সুদূর কে সেই সুন্দর, কে?যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে গোপনে মোরে কবিতা লেখায় সে রহে কোথায় হায়?আমি যার বরষার আনন্দ কেকা নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর কে সেই সুন্দর, কে? আমি হব সকাল বেলার পাখি "আমি হব সকাল বেলার পাখি সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।"সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, 'হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন', মা বলবেন রেগে।বলব আমি- 'আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক, হয়নি সকাল, তাই বলে কি সকাল হবে নাক'?আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে ? তোমার ছেলে উঠবে মা গো রাত পোহাবে তবে। আয় বেহেশত কে যাবি আয় আয় বেহেশতে কে যাবি আয় প্রানের বুলন্দ দরওয়াজায়, 'তাজা-ব-তাজা'র গাহিয়া গান চির-তরুণের চির-মেলায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।যুবা-যুবতীর সে-দেশে ভিড়, সেথা যেতে নারে বুঢঢা পীর, শাস্ত্র-শকুন জ্ঞান-মজুর যেতে নারে সেই হুরী-পরীর শরাব সাকীর গুলিস্তাঁয়। আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়।।সেথা হর্দম খুশীর মৌজ, তীর হানে কালো-আঁখির ফৌজ, পায়ে পায়ে সেখা আরজি পেশ, দিল চাহে সদা দিল-আফরোজ, পিরানে পরান বা৬ধা সেথায়, আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।করিল না যারা জীবনে ভুল দলিল না কাঁটা, ছেঁড়েনি ফুল, দারোয়ান হয়ে সারা জীবন আগুলিল বেড়া, ছুঁল না গুল,- যেতে নারে তারা এ-জলসায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।বুড়ো নীতিবিদ-নুড়ির প্রায় পেল না ক' এক বিন্দু রস চিরকাল জলে রহিয়া হায়!- কাঁটা বিঁধে যার ক্ষত আঙুল দোলে ফুলমালা তারি গলায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।তিলে তিলে এক্যারা পীষে মারে অপরের সাথে আপনারে, ধরণীর ঈদ-উৎসবে রোজা রেখে প'ড়ে থাকে দ্বারে, কাফের তাহারা এ ইদগায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।বুলবুল গেয়ে ফেরে বলি' যাহারা শাসায়ে ফুলবনে ফুটিতে দিল না ফুলকলি; ফুটিলে কুসুম পায়ে দলি' মারিয়াছে, পাছে বাস বিলায়! হারাম তা'রা এ -মুশায়েরায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।হেথা কোলে নিলে দিলরুবা শারাবী গজল গাহে যুবা, প্রিয়ার বে-দাগ কপোলে গো এঁকে দেয় তিল মনোলোভা, প্রেমের পাপীর এ-মোজরায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।আসিতে পারে না হেথা বে-দীন মৃত প্রান-হীন জরা-মলিন। নৌ-জোয়ানীর এ-মহফিল খুন ও শরাব হেথা অ-ভিন হেথা ধনু বাঁধা ফুলমালায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।পেয়ালায় হেথা শহীদি খুন তলোয়ার-চোঁয়া তাজা তরুণ আঙ্গুর-হৃদি চূয়ানো গো গেলাসে শরাব রাঙা অরুণ। শহীদে প্রেমিকে ভিড় হেথায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।প্রিয়া-মুখে হেথা দেখি গো চাঁদ, চাঁদে হেরি প্রিয়-মুখের ছাঁদ। সাধ ক'রে হেথা করি গো পাপ, সাধ করে বাঁধি বালির বাঁধ, এ রস-সাগরে বালু-বেলায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।। আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ! আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ! গাইবি আবার কণ্ঠছেঁড়া বিষ-অভিশাপ-সিক্ত গান।                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    আয় রে আমার বাঁধন-ভাঙার তীব্র সুখ জড়িয়ে হাতে কালকেউটে গোখরো নাগের                          পীত চাবুক! হাতের সুখে জ্বালিয়ে দে তোর সুখের বাসা ফুল-বাগান!                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    বুঝিসনি কি কাঁদায় তোরে তোরই প্রাণের সন্ন্যাসী! তোর অভিমান হল শেষে তোরই গলার নীল ফাঁসি! (তোর) হাসির বাঁশি আনলে বুকে যক্ষ্মা-রুগির রক্ত-বান,                          আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    ফানুস-ফাঁপা মানুষ দেখে, হায় অবোধ ছুটে এলি ছায়ার আশায়,                মাথায় তেমনি জ্বলছে রোদ। ফাঁকির ফানুস ছাই হল তোর,                খুঁজিস এখন রোদ-শ্মশান!                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    তুই যে আগুন, জল-ধারা চাস কার কাছে? বাষ্প হয়ে যায় উড়ে জল সাগর-শোষা তোর আঁচে। ফুলের মালার হুলের জ্বালায় জ্বলবি কত অগ্নি-ম্লান!                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    অগ্নি-ফণী! বিষ-রসানো জিহ্বা দিয়ে দিস চুমা, পাহাড়-ভাঙা জাপটানি তোর – ভাবিস সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া! মৃত্যুও যে সইতে নারে তোর সোহাগের মৃত্যু টান!                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!সুখের লালস শেষ করে দে, স্বার্থপর! কাল-শ্মশানের প্রেত-আলেয়া! তুই কোথা বল                          বাঁধবি ঘর? ঘর-পোড়ানো ত্রাস-হানা তুই সর্বনাশের লাল-নিশান!                আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    তোর তরে নয় শীতল ছায়া,                পান্থ-তরুর প্রেম-আসার, তুই যে ঘরের শান্তি-শত্রু,                রুদ্র শিবের চণ্ড মার। প্রেম-স্নেহ তোর হারাম যে রে                কসাই-কঠিন তুই পাষাণ!                          আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    সাপ ধরে তুই চাপবি বুকে                সইবে না তোর ফুলের ঘা, মারতে তোকে বাজ পাবে লাজ                চুমুর সোহাগ সইবে না! ডাক-নামে ডাক তোর তরে নয়,                আহ্বান তোর ভীম কামান।                          আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!    ফণীমনসার কাঁটার পুরে                আয় ফিরে তুই কালফণী, বিষের বাঁশি বাজিয়ে ডাকে নাগমাতা –                          ‘আয় নীলমণি!’ ক্ষুদ্র প্রেমের শূদ্রামি ছাড়,                ধর খ্যাপা তোর অগ্নি-বাণ!                আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) আর কত দিন? প্রভু, আর কত দিন তোমার প্রথম বেহেশ্‌ত পৃথিবী রহিবে গ্লানি-মলিন? ধরার অঙ্ক পাপ-কলঙ্ক-পঙ্ক-লিপ্ত করি, বরাহ মহিষ অসুর দানব ফিরিতেছে সঞ্চরি? অত্যাচারীর মার খেয়ে মরে তব দুর্বল জীব, যত খুন খায় তত বেড়ে যায় লোভী ও ভোগীর জিভ! তোমার সত্য-পথভ্রষ্ট হয়েছে মানুষ ভয়ে, আত্মা আত্মহত্যা করেছে অপমানে পরাজয়ে! মনুষ্যত্ব মুমূর্ষ আজ, ক্লৈব্য কাপুরুষতা পঙ্গু পাষাণ করেছে জীবন! – মালিন্য, দৈন্যতা, হীন প্রবৃত্তি, চামচিকা-সম জীবনের পোড়া ঘরে বাঁধিয়াছে বাসা! আশার আলোক জ্বলে নাকো অন্তরে। প্রভু, আলো দাও, আলো! ঘুচুক ভয়ের ভ্রান্তি, জড়তা, ঘন নিরাশার কালো।প্রভু আর কত দিন ধূর্তের কাছে বিশ্বাস সরলতা রবে দীন হীন? স্বার্থান্বেষী চতুরের কাছে ‘সবর’ ধৈর্য আর, ওগো কাঙালের পরম বন্ধু, কত দিন খাবে মার? যত মার খায় তত তারা জপে নিত্য তোমার নাম, আশ্রয় শুধু যাচে প্রভু তব! চায় না জপের দাস। আশ্রয় দাও পূর্ণ পরম আশ্রয়দাতা স্বামী, আশ্রয়হীনে রক্ষিতে তব শক্তি আসুক নামি। শুনিয়াছি, তুমি নহ জালিমের, উৎপীড়কের নহ, নির্যাতিত ও অসহায় যথা, তার দ্বারে জাগি রহ; ডাকিনি বলিয়া অভিমানে বুঝি লও নাই প্রতিশোধ, আপনার হাতে করেছি আপন ঘরের দুয়ার রোধ।আর ভয় নাই, প্রভু, দ্বার খুলিয়াছি, আঁধারে মরেছি তিলে তিলে, যদি আঁধারে আসিয়া বাঁচি। তুমি কৃপা করো, ক্ষমা-সুন্দর, অপরাধ ক্ষমা করো, আশ্রয় দাও দুর্বলে, উৎপীড়কেরে সংহারো।অন্ধ বধির পথভ্রান্তে দেখাও তোমার পথ, আমাদের ঘিরে থাকুক নিত্য তোমার অভয়-রথ! পশ্চিমে তব শাস্তি নেমেছে, পূর্বে নামিল কই? হে চির-অভেদ! আমরা কি তবে তোমার সৃষ্ট নই? যে শাস্তি দাও পশ্চিমে, পুবে সে ভয় দাওনি প্রভু; বিশ্বাস আর তব নাম লয়ে বেঁচে আছি মোরা তবু। সব কেড়ে নিক অত্যাচারীরা, প্রভু গো দাও অভয়, বিশ্বাস আর ধৈর্য ও তব নাম – যেন সাথি রয়। এই বিশ্বাসে, তোমার নামের মহিমায় – ফিরে পাব শান্তি, সাম্য। তব দাস মোর তব কাছে ফিরে যাব। প্রেম, আনন্দ, মাধুরী ও রস পাব এই দুনিয়াতে, তোমার বিরহে কাঁদিব আমরা জাগিয়া নিশীথ রাতে। বলো প্রেমময়, বলো হে পরম সুন্দর, বলো প্রভু, অন্ধ জীবের এই প্রার্থনা মিথ্যা হবে না কভু! তুমি বল দাও, তুমি আশা দাও, পরম শক্তিমান! বহু সুখ সহিয়াছি, এইবারে দাও চিরকল্যাণ। সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মিটাও মিটাও সাধ, তোমারই এ বাণী – দেখিব তোমার কৃপার পূর্ণ চাঁদ। প্রসন্ন হও, প্রসন্ন হও নিত্য মোদের পর, পূর্ণ হউক তোমার প্রসাদে আমাদের কুঁড়েঘর। আমরা কাঙাল, আমরা গরিব, ভিক্ষুক, মিসকিন ভোগীদের দিন অস্ত হউক, আসুক মোদের দিন। তুমিই শক্তি, ভক্তি ও প্রেম, জ্ঞান আনন্দ দাও, কবুল করো এ প্রার্থনা, প্রভু, কৃপা করো, ফিরে চাও! এক সে তোমারই ধ্যান তপস্যা আরাধনা হোক স্বামী, নিরভাব হোক মানুষ, গাহুক তব নাম দিবাযামী। ঊর্ধ্ব হইতে কে বলে ‘আমেন’, ‘তথাস্তু’ বলো, বলো, চোখের পানিতে বুকে ভেসে যায়, দেহ কাঁপে টলমল! সত্য হউক সত্য হউক ঊর্ধ্বের এই বাণী, দরিদ্রে দান করিতে করুণা, আসিছেন মহাদানী!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) আরতি শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল      শান্ত অচঞ্চল ধ্রুব-জ্যোতি। অশান্ত এ চিত করো হে সমাহিত      সদা আনন্দিত রাখো মতি॥      দুঃখ শোক সহি অসীম সাহসে      অটল রহি যেন সম্মানে যশে      তোমার ধ্যানের আনন্দ-রসে           নিমগ্ন রহি হে বিশ্বপতি॥    মন যেন না টলে কল কোলাহলে, হে রাজ-রাজ,      অন্তরে তুমি নাথ সতত বিরাজ।           বহে তব ত্রিলোক ব্যাপিয়া, হে গুণী           ওংকার-সংগীত সুর-সুরধুনী,           হে মহামৌনী, যেন সদা শুনি           সে সুরে তোমার নীরব আরতি॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) আলতা-স্মৃতি ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে, সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে?জানি, তোমার নারীর মনে নিত্য-নূতন পাওয়ার পিয়াস হঠাৎ কেন জাগল সেদিন, কণ্ঠ ফেটে কাঁদল তিয়াস! মোর আসনে সেদিন রানি নূতন রাজায় বরলে আনি, আমার রক্তে চরণ রেখে তাহার বুকে মরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।মর্মমূলে হানলে আমার অবিশ্বাসের তীক্ষ্ম ছুরি, সে-খুন সখায় অর্ঘ্য দিলে যুগল চরণ-পদ্মে পুরি। আমার প্রাণের রক্তকমল নিঙড়ে হল লাল পদতল, সেই শতদল দিয়ে তোমার নতুন রাজায় বরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।আমায় হেলায় হত্যা করে দাঁড়িয়ে আমার রক্ত-বুকে অধর-আঙুর নিঙড়েছিলে সখার তৃষা-শুষ্ক মুখে। আলতা সে নয়, সে যে খালি আমার যত চুমোর লালি! খেলতে হোরি তাইতে, গোরি, চরণতরি ভরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।জানি রানি, এমনি করে আমার বুকের রক্তধারায় আমারই প্রেম জন্মে জন্মে তোমার পায়ে আলতা পরায়! এবারও সেই আলতা-চরণ দেখতে প্রথম পায়নি নয়ন! মরণ-শোষা রক্ত আমার চরণ-ধারে ধরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।কাহার পুলক-অলক্তকের রক্তধারায় ডুবিয়ে চরণ উদাসিনী! যেচেছিলে মনের মনে আমার মরণ? আমার সকল দাবি দলে লিখলে ‘বিদায়’ চরণতলে! আমার মরণ দিয়ে তোমার সখার হৃদয় হরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) আল্লার রাহে ভিক্ষা দাও (‘ফি সবিলিল্লাহ্’)মোর  পরম-ভিক্ষু আল্লার নামে চাই   ভিক্ষা দাও গো মাতা পিতা বোন ভাই,      দাও ভিখারিরে ভিক্ষা দাও।    মোর   পরম-ডাকাত ঘরের দুয়ার খুলি     হরিয়া আমার সর্বস্ব সে               দিয়াছে ভিক্ষাঝুলি,     তাঁর মহাদান সেই ঝুলি কাঁধে তুলি        এসেছি ভিখারি, হে ধনী, ফিরিয়া চাও।           আল্লার নামে ভিক্ষা দাও।      হে ধনিক, তাঁর পাইয়াছ বহু দান,   রত্ন মানিক ভোগ যশ সম্মান,   তব প্রাসাদের চারিদিকে ভিখারিরা প্রসাদ মেগেছে ক্ষুধার অন্ন,               চায়নি তোমার হিরা।   বলো, বলো, সেই নিরন্নদের মুখে   অন্ন দিয়াছ? কেঁদেছ তাদের দুখে? লজ্জা ঢাকিয়া নগ্ন দেহের তার মুক্তি, পেয়েছে তোমার মুক্তি-হার?    তব আত্মার আত্মীয় যারা,                 তারা ক্ষুধা তৃষ্ণায়   কাঙালের বেশে কাঁদে তব দরজায় –   তাড়ায় তাদেরে গাল দিয়ে দরওয়ান,   তুমিও মানুষ, কাঁদে না তোমার প্রাণ? হিরা মানিকের পাষাণ পরিয়া                 তুমি কি পাষাণ হলে? তোমার আত্মা কাঁদে না তোমার দুয়ারে               মানুষ মলে? পাওনি শান্তি, আনন্দ প্রেম –   জানি আমি তাহা জানি, তোমার অর্থ ঢাকিয়া রেখেছে   তোমার চোখের পানি! কাঙালিনি মা-র বুকে ক্ষুধাতুর শিশু তোমার দুয়ারে কাঁদে শোনো, ওই শোনো। ভিক্ষা দাও না, রাশি রাশি হিরা মণি   তুলে রাখো আর গোনো। এ টাকা তোমার রবে না, বন্ধু জানি, এ লোভ তোমারে নরকে লইবে টানি। ‘আর্শ’ আসন টলিয়াছে আল্লার, শুনি ক্ষুধিতের কাঙালের হাহাকার। তাই সে পরম-ভিক্ষু ভিক্ষা চায় ভিখারির মারফতে তব দরজায়। ক্ষমা পাবে তুমি, আজিও সময় আছে, ভিক্ষা না দিলে পুড়িবে অগ্নি-আঁচে। মৃত্যুর আর দেরি নাই তব –   ফিরে চাও ফিরে চাও, পরম-ভিক্ষু মোর আল্লার নামে –   দরিদ্র উপবাসীরে ভিক্ষা দাও।    ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি, তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী রবি। তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে। তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা করে নাকো কেন কাঙালের ঘর আলা? এত জ্ঞান এত শক্তি, বিলাস সে কি? আলো তার দূর কুটিরে যায় না   কোন সে শিলায় ঠেকি?যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক    হবে না তাহারা কভু, তারা কল্যাণ আনেনি কখনও    তারা বুদ্ধির প্রভু। তাহাদের রস দেবার তরে কি    লেখনী করিছ ক্ষয়? শতকরা নিরানব্বই জন    তারা তব কেহ নয়? এই দরিদ্র ভিখারিরা আজ    অসহায় গৃহহারা ‘আলো দাও’ বলে কাঁদিছে দুয়ারে –    ভিক্ষা পাবে না তারা? অজ্ঞান-তিমিরান্ধকারের    ইহারা বদ্ধ জীব, উৎপীড়কের পীড়নে পীড়িত    দলিত বদ্‌-নসিব। তোমাদের আছে বিপুল শক্তি,    কৃপণ হইয়া তবে কেন সহ মানুষের অপমান,    মানুষ কি দাস রবে? আমার পিছনে পীড়িত আত্মা    অগণন জনগণ অসহ জুলুম যন্ত্রণা পেয়ে    করিতেছে ক্রন্দন। পরম-ভিক্ষু আদেশ দিলেন,    ভিক্ষা চাহিতে, তাই এই অগণন জনগণ তরে    আসিয়াছি দ্বারে, ভাই! ভোলো ভয়, দূর করো কৃপণতা,    পাষাণে প্রাণ জাগাও, ভিখারির ঝুলি পূর্ণ হইবে,    তোমরা ভিক্ষা দাও।    তোমরা কি দলপতি,    তোমরা কি নেতা? শুনেছি, তোমরা কল্যাণকামী    মহান উদারচেতা। তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিব    চরম আত্মদান, চাহিব তোমার অভিনন্দন-মালা,    যশ,খ্যাতি, প্রাণ।চাহিব তোমার গোপন ইচ্ছা    আত্ম-প্রতিষ্ঠার, চাহিব ভিক্ষা তোমার সর্ব    লোভ ও অহংকার। পরম ভিক্ষু পাঠায়েছে মোরে,    দাও সে ভিক্ষা দাও। আপনার সব লোভ ও তৃষ্ণা    তাঁহারে বিলায়ে দাও! তিনি নিরভাব, পূর্ণ। ভিক্ষা    চাহেন, এ তাঁর সাধ, শালুক ফুটায়ে যেমন তাহারই    প্রেম-প্রীতি চায় চাঁদ। যশ খ্যাতি আর অহংকারের    লোভ তাঁরে দিলে ভিখ, ফিরে পাবে তাঁর মহাদান,    হবে মহানেতা নির্ভীক! নিজেরা আত্মা ত্যাগ করে মহা    ত্যাগের পথ দেখাও! ভিক্ষা চাহে এ ভিখারি, ভিক্ষা    দাও গো ভিক্ষা দাও!    তুমি কে? তুমি মদোন্মত্ত    মানবের যৌবন, তুমি বারিদের ধারাজল, মহা    গিরির প্রস্রবণ। তুমি প্রেম, তুমি আনন্দ, তুমি    ছন্দ মূর্তিমান, তুমিই পূর্ণ প্রাণের প্রকাশ,    রুদ্রের অভিযান! যুগে যুগে তুমিই অকল্যাণেরে    করিয়াছ সংহার, তুমিই বৈরাগী, বক্ষের প্রিয়া    ত্যজি ধরো তলোয়ার! জরাজীর্ণের যুক্তি শোন না,    গতি শুধু সম্মুখে, মৃত্যুরে প্রিয় বন্ধুর সম    জড়াইয়া ধরো বুকে। তোমরাই বীর সন্তান, যুগে    যুগে এই পৃথিবীর, হাসিয়া তোমরা ফুলের মতন    লুটায়েছ নিজ শির।দেহেরে ভেবেছ ঢেলার মতন,    প্রাণ নিয়ে কর খেলা, তোমারই রক্তে যুগে যুগে আসে    অরুণ-উদয়-বেলা। তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিতে    আঁখি ভরে উঠে জলে, তোমরা যে পথে চল, কেঁদে আমি    লুটাই সে পথতলে। তোমাদেরই প্রাণ ভিক্ষা চাহিতে    এসেছি ভিখারি আমি, ভিক্ষা চাহিতে পাঠাল সর্ব–    জাতির পরম স্বামী। তোমরা শহিদ, তোমরা অমর,    নিতি আনন্দধামে তোমরা খেলিবে, তোমাদের তরে    তাঁর কৃপা নিতি নামে। তোমরাই আশা-ভরসা জাতির    স্বদেশের সেনাদল, তোমরা চলিলে, আনন্দে ধরা    কেঁপে ওঠে টলমল। তোমরা প্রবাহ, তোমরা শক্তি,    তোমরা জীবনধারা, তোমাদেরই স্রোত যুগে যুগে ভাঙে    সব বন্ধন-কারা। তুষার হইয়া কেন আছ আজও,    আগুন উঠেছে জ্বলে, দিগ্‌দিগন্ত কাঁপাইয়া, ছুটে    এসো সবে দলে দলে। তোমরা জাগিলে ঘুচে যাবে সব    ক্লৈব্য ও অবসাদ, পরম-ভিক্ষু এক আল্লার    পুরিবে সেদিন সাধ। আর কেহ ভিখ দিক বা না দিক    তোমরা ভিক্ষা দাও, সাম্য শান্তি আসিবে না যদি    তোমরা ফিরে না চাও। নহি নেতা, রাজনৈতিক, প্রেম-    ভিক্ষা আমার নীতি। পৃথিবী স্বর্গ, পৃথিবীতে ফের    জাগুক স্বর্গ-প্রীতি। অসম্ভবেরে সম্ভব করা    জাগো নবযৌবন। ভিক্ষা দাও গো, এ ধরা হউক    আল্লার গুলশন। (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) আল্লাহ আমার প্রভু আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়। আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।।আমার কিসের শঙ্কা, কোরান আমার ডঙ্কা ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।।কালেমা আমার তাবিজ, তৌহিদ আমার মুর্শিদ, ঈমান আমার ধর্ম, হেলাল আমার খুর্শিদ। 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি আমার জেহাদ- বাণী? আখের মোকাম ফেরদৌস খোদার আরশ যেথায় রয়।।আরব মেসের চীন হিন্দ মুসলিম- জাহান মোর ভাই, কেহ নয় উচ্চ কেহ নীচ, এখানে সমান সবাই। এক দেহ এক দিল এক প্রান, আমীর ফকির এক সমান, এক তকবীরে উঠি জেগে, আমার হবেই হবে জয়।। আশা হয়ত তোমার পাব’ দেখা, যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।।    ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে,     আ’লের পথে বিজন ঘাটে;     হয়ত এসে মুচকি হেসে      ধ’রবে আমার হাতটি একা।।ঐ নীলের ঐ গহন-পারে ঘোম্‌টা-হারা তোমার চাওয়া, আনলে খবর গোপন দূতী দিক্‌পারের ঐ দখিনা হাওয়া।।     বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি     আসে- যাবে নয়্‌না চুমি’     সেই সে কথা লিখছে হেতা      দিগ্বলয়ের অরুণ-লেখা। আশা (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) মহান তুমি প্রিয় এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো। অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –                                 হে চির-সুন্দর! পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,                  হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা! সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়, বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’           হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে           চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?           জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –           অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে! বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে, কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে                                 কুটিল হাসি হেসে?           ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে! তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি? তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –           হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী! পথের আজও অনেক বাকি,           তাই যদি হয় প্রিয় – পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) আশীর্বাদ আপনার ঘরে আছে যে শত্রু তারে আগে করো জয়, ভাঙো সে দেয়াল, প্রদীপের আলো যাহা আগুলিয়া রয়। অনাত্বীয়রে আত্বীয় করো, তোমার বিরাট প্রাণ করে না কো যেন কোনোদিন কোনো মানুষে অসম্মান। সংসারের মিথ্যা বাঁধন ছিন্ন হোক আগে, কবে সে তোমার সকল দেউল রাঙিবে আলোর রাগে। আশীর্বাদ কল্যাণীয়া শামসুন নাহার খাতুন জয়যুক্তাসুশত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ তারই বুকে নারী বসে আছে জ্বালি বিপদ-বাতির সিন্ধু-দীপ। শাশ্বত সেই দীপান্বিতার দীপ হতে আঁখি-দীপ ভরি আসিয়াছ তুমি অরুণিমা-আলো প্রভাতি তারার টিপ পরি। আপনার তুমি জান পরিচয় – তুমি কল্যাণী তুমি নারী – আনিয়াছ তাই ভরি হেম-ঝারি মরু-বুকে জমজম-বারি। অন্তরিকার আঁধার চিরিয়া প্রকাশিলে তব সত্য-রূপ – তুমি আছ, আছে তোমারও দেবার, তব গেহ নহে অন্ধ-কূপ। তুমি আলোকের – তুমি সত্যের – ধরার ধুলায় তাজমহল, – রৌদ্র-তপ্ত আকাশের চোখে পরালে স্নিগ্ধ নীল কাজল! আপনারে তুমি চিনিয়াছ যবে, শুধিয়াছ ঋণ, টুটেছে ঘুম, অন্ধকারের কুঁড়িতে ফুটেছ আলোকের শতদল-কুসুম। বদ্ধ কারার প্রকারে তুলেছ বন্দিনীদের জয়-নিশান – অবরোধ রোধ করিয়াছে দেহ, পারেনি রুধিতে কণ্ঠে গান। লহো স্নেহাশিস – তোমার ‘পুণ্যময়ী’র ‘শাম‍্‌স’ পুণ্যালোক শাশ্বত হোক! সুন্দর হোক! প্রতি ঘরে চির-দীপ্ত রোক।   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) আশু-প্রয়াণ গীতি কোরাস্:       বাংলার 'শের', বাংলার শির,                  বাংলার বাণী, বাংলার বীর                           সহসা ও-পারে অস্তমান।       এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥       বাংলার ঋষি বাংলার জ্ঞান বঙ্গবাণীর শ্বেতকমল,       শ্যাম বাংলার বিদ্যা-গঙ্গা অবিদ্যা-নাশী তীর্থ-জল!       মহামহিমার বিরাট পুরুষ শক্তি-ইন্দ্র তেজ-তপন—       রক্ত-উদয় হেরিতে সহসা হেরিনু সে-রবি মেঘ-মগন।কোরাস্:       বাংলার 'শের', বাংলার শির,                  বাংলার বাণী, বাংলার বীর                            সহসা ও-পারে অস্তমান।      এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥     মদ-গর্বীর গর্ব-খর্ব বল-দর্পীর দর্প-নাশ      শ্বেত-ভিতুদের শ্যাম বরাভয় রক্তাসুরের কৃষ্ণ ত্রাস।      নব ভারতের নব আশা-রবি প্রাচী'র উদার অভ্যুদয়      হেরিতে হেরিতে হেরিনু সহসা বিদায়-গোধূলি গগনময়।কোরাস্:       বাংলার 'শের', বাংলার শির,                  বাংলার বাণী, বাংলার বীর                            সহসা ও-পারে অস্তমান।      এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥     পড়িল ধসিয়া গৌরীশঙ্কর হিমালয়-শির স্বর্গচূড়,      গিরি কাঞ্চন-জঙ্ঘা গিরিল—বাংলার যবে দিন-দুপুর।      শিশুক-হাঙর শোষিছে রক্ত, মৃত্যু শোষিছে সাগর-প্রাণ—      পরাধীনা মা'র স্বাধীন সুতের মেদ-ধূমে কালো দেশ-শ্মশান। কোরাস্:       বাংলার 'শের', বাংলার শির,                  বাংলার বাণী, বাংলার বীর                            সহসা ও-পারে অস্তমান।      এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥     অরাজক মারি মড়া-কান্নায় দেশ-জননীর বদ্ধ শ্বাস,      হে দেব-আত্মা! স্বর্গ হইতে দাও কল্যাণ, দাও আভাস,      কেমন করিয়া মৃত্যু মথিয়া মৃত্যুঞ্জয় হয় মানব;      শব হয়ে গেছ, শিব হয়ে এস দেবকী-কারার নীল কেশব।কোরাস্:     বাংলার 'শের', বাংলার শির,                বাংলার বাণী, বাংলার বীর                           সহসা ও-পারে অস্তমান। এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥ আসিবে তুমি জানি প্রিয় আসিবে তুমি জানি প্রিয় আনন্দে বনে বসন্ত এলো ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।বনানতে পবন অশান্ত হল তাই কোকিল কুহরে, ঝরে গিরি নির্ঝরিণী ঝর ঝর।ফুল্ল যামিনী আজি ফুল সুবাসে চন্দ্র অতন্দ্র সুনীল আকাশে আনন্দিত দীপান্নিত অম্বর।অধীর সমীরে দিগঞ্চল দোলে মালতী বিতানে পাখি পিউ পিউ বোলে অঙ্গে অপরূপ ছন্দ আনন্দ-লহর তোলে দিকে দিকে শুনি আজ আসিবে রাজাধিরাজ প্রিয়তম সুন্দর।। ইন্দু-প্রয়াণ (কবি শরদিন্দু রায়ের অকালমৃত্যু উপলক্ষ্যে)বাঁশির দেবতা! লভিয়াছ তুমি হাসির অমর-লোক, হেথা মর-লোকে দুঃখী মানব করিতেছি মোরা শোক! অমৃত-পাথারে ডুব দিলে তুমি ক্ষীরোদ-শয়ন লভি, অনৃতের শিশু মোরা কেঁদে বলি, মরিয়াছ তুমি কবি! হাসির ঝঞ্ঝা লুটায়ে পড়েছে নিদাঘের হাহাকারে, মোরা কেঁদে বলি, কবি খোয়া গেছে অস্ত-খেয়ার পারে!আগুন-শিখায় মিশেছে তোমার ফাগুন-জাগানো হাসি, চিতার আগুনে পুড়ে গেছ ভেবে মোরা আঁখি-জলে ভাসি। অনৃত তোমার যাহা কিছু কবি তাই হয়ে গেছে ছাই, অমৃত তোমার অবিনাশী যাহা আগুনে তা পুড়ে নাই। চির-অতৃপ্ত তবু কাঁদি মোরা, ভরে না তাহাতে বুক, আজ তব বাণী আন্-মুখে শুনি, তুমি নাই, তুমি মূক।অতি-লোভী মোরা পাই না তৃপ্তি সুরভিতে শুধু ভাই, সুরভির সাথে রূপ-ক্ষুধাতুর ফুলেরও পরশ চাই। আমরা অনৃত তাই তো অমৃতে ভরে ওঠে নাকো প্রাণ, চোখে জল আসে দেখিয়া ত্যাগীর আপনা-বিলানো দান। তরুণের বুকে হে চির-অরুণ ছড়ায়েছ যত লালি, সেই লালি আজ লালে লাল হয়ে কাঁদে, খালি সব খালি!কাঁদায়ে গিয়াছ, নবরূপ ধরে হয়তো আসিবে ফিরে, আসিয়া আবার আধ-গাওয়া গান গাবে গঙ্গারই তীরে, হয়তো তোমায় চিনিব না, কবি, চিনিব তোমার বাঁশি, চিনিব তোমার ওই সুর আর চল-চঞ্চল হাসি। প্রাণের আলাপ আধ-চেনাচেনি দূরে থেকে শুধু সুরে, এবার হে কবি, করিব পূর্ণ ওই চির-কবি-পুরে।…ভালোই করেছ ডিঙিয়া গিয়াছ নিত্য এ কারাগার, সত্য যেখানে যায় নাকো বলা, গৃহ নয় সে তোমার। গিয়াছ যেখানে শাসনে সেখানে নহে নিরুদ্ধ বাণী, ভক্তের তরে রাখিয়ো সেখানে আধেক আসনখানি। বন্দী যেখানে শুনিবে তোমার মুক্তবদ্ধ সুর, – গঙ্গার কূলে চাই আর ভাবি কোথা সেই থসুর-পুর!গণ্ডির বেড়ি কাটিয়া নিয়াছ অনন্তরূপ টানি, কারও বুকে আছ মূর্তি ধরিয়া, কারও বুকে আছ বাণী। সে কি মরিবার? ভাঙি অনিত্যে নিত্য নিয়াছ বরি, ক্ষমা করো কবি, তবু লোভী মোরা শোক করি, কেঁদে মরি। না-দেখা ভেলায় চড়িয়া হয়তো আজিও সন্ধ্যাবেলা গঙ্গার কুলে আসিয়া হাসিছ দেখে আমাদের খেলা!হউক মিথ্যা মায়ার খেলা এ তবুও করিব শোক, ‘শান্তি হউক’ বলি যুগে যুগে ব্যথায় মুছিব চোখ! আসিবে আবারও নিদাঘ-শেষের বিদায়ের হাহাকার, শাঙনের ধারা আনিবে স্মরণে ব্যাথা-অভিষেক তার। হাসি নিষ্ঠুর যুগে যুগে মোরা স্নিগ্ধ অশ্রু দিয়া, হাসির কবিরে ডাকিব গভীরে শোক-ক্রন্দন নিয়া।  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) ইন্দ্র-পতন তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরু-গুরু-গুরু! আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী? শুনি, অন্দুব-কম্বু- নিনাদে ঘন বৃঙ্ঘিত- ধ্বনি। বাজে চিক্কুর- হ্রেষা- হর্ষণ মেঘ- মন্দুরা- মাঝে, সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ংকর সাজে।ঘনায় অশ্রু-বাষ্প- কুহেলি ঈশান- দিগঙ্গনে, স্তব্ধ- বেদনা দিগ-বালিকারা কী যে কাঁদুনী শোনে! কাঁদিছে ধরার তরু-লতা-পাতা, কাঁদিছে পশু-পাখী, ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি'। বাজে আনন্দ- মৃদং গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে, মর্ত্য- ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ- ইন্দ্র কাছে। সপ্ত- আকাশ- সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি, কাঁদিছে ধরায় তাহারি প্রতিধ্বনি-খালি, সব খালি!হায় অসহায় সর্বংসহা মৌনা ধরণী মাতা, শুধু দেব- পূজা তরে কি মা তর পুষ্প হরিৎমাতা? তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা? তোমার মাটির পাত্রে কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা? জীবন- সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে খাঁটি তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন, যারে ভালোবাসে মাটি।কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত- শতদিল শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল, সম্ভ্রম-নত পূজারী মৃত্যু ছিঁড়িল সে শতদলে- শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য অর্পিবে বলি' নারায়ণ-পদতলে! জানি জানি মোরা, শংখ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে- পায়ের পদন হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া র'বে। কত শান্ত্বনা- আশা-মরিচিকা কত বিশ্বাস-দিশা শোক- সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটে না প্রানের তৃষা!দুলিছে বাসুকি মণীহারা ফণী, দুলে সাথে বসুমতী, তাহার ফনার দিন-মণি আজ কোন গ্রহে দেবে জ্যোতি! জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত, শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দীপাঠ! হে মহাপুরুষ, মহাবিদ্রোহী, হে ঋষি, সোহম-স্বামী! তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি', থমকি গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র- সূর্য- তারা, নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া!যখনি স্রষ্ঠা করিয়াছে ভুল, ক'রেছ সংস্কার, তোমারি অগ্রে স্রষ্টা তোমারে ক'রেছে নমস্কার! ভৃগুর মতন যখনি দেখেছ অচেতন নারায়ণ, পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, জেগেছে জগজ্জন! ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন ধরি' হাঁকিছেন, 'আমি এমন করিয়া সত্য স্বীকার করি! জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার, তাহার চেতন- সত্যে আমার নিযুত নমস্কার!'আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি- কাহিনী মনে, তুমি দেখা দিলে অমিয়-কন্ঠ বাণীর কমল-বনে! কখন তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদন-দলে, হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে! লক্ষী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী, শিব মাখালেন ত্যাগের বুভূতি কন্ঠে গরল দানি', বিষ্ণু দিলেন ভাঙ্গনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশি, দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি।চির গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি', প্রতাপ শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি'। বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভান্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি, দেবতারা দিলেন মন্দার-মালা, মানব মাখালো ধূলি। নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন তুমি উদিলে নিখিল ছানি'- মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী! হিমালয় হ'তে বিপুল বিরাট উদার আকাশ হ'তে, বাধা-কুঞ্জর তৃণ-সম ভেসে গেল তব প্রান-স্রোতে!ছন্দ গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই বন্দিতে তোমা',আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই! বিভূতি-তিলক! কৈলাস হ'তে ফিরেছ গরল পি'ইয়া, এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভস্ম বিভূতি নিয়া! নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি সারা জীবনের না-কওয়া কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি'! এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি, দাওনি ক' অবসর তোমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর! আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা যতটুক, ভাবিয়া ভাবিয়া স্বান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক~ আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন,বিশ্বের দুর্দিন, পাষান বাংলা প'ড়ে এককোনে স্তব্ধ অশ্রুহীন! তারি মাঝি হিয়া থাকিয়া গুমরি' গুমরি' ওঠে, বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে! দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব-বন্ধু তুমি, চেয়ে দেখ আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি'। গগনে তেমনি ঘনায়েছে মেঘ, তেমনি ঝরিছে বারি, বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হ'ইয়ে আসে ঘন ভারি।পয়গম্বর ও অবতার- যুগে জন্মিনি মোরা কেহ, দেখিনি ক' মোরা তাঁদের, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ, কিন্তু যখনি বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভ'রেছে জলে! সারা প্রান যেন অঞ্জলি হ'য়ে ও-পায়ে প'ড়েছে লুটি', সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি'! বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনি ক' চোখে তাহে, নাহি আফসোস, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে; নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনি ক' তারে ভেট, দেখিয়াছি মোরা 'রাজা-সন্ন্যাসী', প্রেমের জগৎ- শেঠ!শুনি, পরার্থে প্রান দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি; হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে ব'সে দিবানিশি! হে নবযুগের হরিশ্চন্দ্র! সাড়া দাও, সাড়া দাও! কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও! রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বসর্জিয়া চন্ডাল-বেশে ভারত-শ্মশান ছিলে একা আগুলিয়া, এস সন্ন্যাসী, এস সম্রাট, আজি সে শ্মশান-মাঝে, ঐ শোনো তব পুন্য জীবন- শিশুর কাঁদন বাজে!দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারে বারে অবহেলে। ইবরাহিমের মত বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া কোরবানী দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া। ফেরেশতা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা, ভগবান-বুক মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন, তাঁরও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন, তব ভান্ডার- লক্ষীরে রাজা নিজ হাতে দিলে তুলি' ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজে দিলে পথ-ধূলি, হেম-লক্ষীর তোমারও জীবন-যাগে ছিল প্রয়োজন, পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলে না ক' দিলে যা বিসর্জন! তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম, সারা বিশ্বের ব্রাম্মন তাই বন্দিছে নমো নমো!হে যুগ- ভীষ্ম! নিন্দার শরশয্যায় তুমি শুয়ে বিশ্বের তরে অমৃত-মন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে! তোমার জীবনে বলে গেলে- ওগো কল্কি আসার আগে অকল্যানের কুরুক্ষেত্রে আজো মাঝে মাঝে জাগে চির-সত্যের পাঞ্চজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা, যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা! তুমি নব ব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত চরি' তুমিই দেখালে-ইন্দ্রেরই তরে পারিজাত-মালা শচী! আসিলে সহসা- অত্যাচারীর প্রাসাদ-স্তম্ভ টুটি' নব-নৃসিংহ-অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি' আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল মুক্তি-প্রেমে! তুমি এসেছিলে জীবন গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে! দেবতারা তাই স্তম্ভিত হের' দাঁড়ায়ে গগন তলে নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে!তোমারে দেখিয়া কাহারো হৃদয়ে জাগেনি ক' সন্দেহ হিন্দু কিম্বা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ। তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি, সবারে যেমন আল দেয় রবি, ফুল দেয় সবে ভূমি! হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি মুসলিমের আরংজিব, যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব! নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু হিন্দু- মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে-সেতু! জানিনা আজি কে অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান, ঈর্ষা-পঙ্কে পঙ্কজ হ'য়ে ফুটুক এদের প্রান! হে অরিন্দম, মৃত্যুর তীরে ক'রেছ শত্রু জয়, প্রেমিক! তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময়! তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিল কন্টক-হুল, আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল! কি যে ছিলে তুমি জানি না ক' কেহ, দেবতা কি আওলিয়া, শুধু এই জানি, হেরি আর কারে ভরেনি এমন হিয়া।আজি দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা, তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণী-মনসার বেড়া! তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হ'তে তুলে বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দরে আবার শ্রীকরে থুলে! তুমি দেখিছিলে ফাঁসির গোপীতে বাঁশির গোপীমোহন, রক্ত-যমুনা-কূলে রচে' গেলে প্রেমের বৃন্দাবন! তোমার ভগ্ন চাকায় জরায়ে চালায়েছে এরা রথ, আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ, আজ পথহারা আশ্রয়হীন সাপুড়ে মারণ- মন্ত্র সুরে!যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস, কোন শাপে ধরা স্বরাজ-রথের চক্র করিল গ্রাস? যধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী, ঐ হের' দূরে কৌরব-সেনা উল্লাসে ওঠে নাচি'। হিমালয় চিরে আগ্নেয়-বাণ চীৎকার করি' ছুটে, শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে! স্তব্ধ- বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায় কায়- নিখিল অশ্রু সাগর বুঝি বা তাহারে ডুবাতে চায়! টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির, ছাপি' হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর! ধূর্জটি-জটা-বাহিনী গঙ্গা কা৬দিয়া কাঁদিয়া চলে, তারি নিচে চিতা- যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে!মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি' তোমার প্রান, কালো মুখ তার হ'ল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান। অগুরু- পুষ্প-চন্দন পুড়ে হল সুগন্ধতর, হ'ল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হ'ল সুন্দর! ধন্য হইল ভাগীরথী-ধারা তব চিতা-ছাই মাখি', সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি'! অসুর নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে আঁখি উপাড়িতে গেছিলেম রাম, আজিকে পড়িছে মনে; রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি, দনুজ- দলনী জাগে কিনা-আছে চাহিয়া ভারত-ভূমি! ঈদ মোবারক শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো, কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো, বরষের পরে আসিলে ঈদ! ভুখারীর দ্বারে সওগাত ব'ইয়ে রিজওয়ানের, কন্টক-বনে আশ্বাস এনে গুল- বাগের, সাকীরে "জা'মের দিলে তাগিদ!খুশীর পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক বধূ জাগে আজ নিশীথ-বাসরে নির্নিমিখ! কোথা ফুলদানী, কাঁদিছে ফুল, সুদূর প্রবাসে ঘুম নাহি আসে কার সখার, মনে পড়ে শুধু সোঁদা-সোঁদা বাস এলো খোঁপার, আকুল কবরী উলঝলুল!ওগো কাল সাঁঝে দ্বিতীয়া চাঁদের ইশারা কোন মুজদা এনেছে, সুখে ডগমগ মুকুলী মন! আশাবরী- সুরে ঝুরে সানাই। আতর-সুবাসে কাতর হ'ল গো পাথর-দিল, দিলে দিলে আজ বন্ধকী দেনা-নাই দলিল, কবুলিয়তের নাই বালাই।।আজিকে এজিদে হাসেনে হোসেনে গলাগলি, দোযখে বেহেশতে সুল ও আগুনে ঢলাঢলি, শিরী ফরহাদে জড়াহড়ি! সাপিনীর মত বেঁধেছে লায়লী কায়েসে গো, বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বঁধু আয়েসে গো, গালে গালে চুমু গরাগড়ি।।দাউ- দাউ জ্বলে আজি স্ফূর্তির জাহান্নাম, শয়তান আজ বেহেশতে বিলায় শরাব-জাম, দুশম্ন দস্ত এক-জামাত! আজি আরফাত-ময়দান পাতা গাঁয়ে- গাঁয়ে, কোলাকুলি করে বাদশা ফকীরে ভায়ে-ভায়ে, কা'বা ধ'রে নাচে 'লাত-মানাত'।।আজি ইসলামী ডঙ্কা গরজে ভরি' জাহান, নাই বড় ছোট-সকল মানুষ এক সমান, রাজা প্রজা নয় কারো কেহ। কে আমীর তুমি নওয়াব বাদশা বালাখানায়? সকল কালের কলঙ্ক তুমি; জাগালে হায় ইসলামে তুমি সন্দেহ।।ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই, নাই অধিকার সঞ্চয়ের! কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ? দু'জনার হবে বুলন্দ-নসীব, লাখে লাঝে হবে বদ-নসীব? এ নহে বিধান ইসলামের।।ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান, ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান, ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার! ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে, তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে, দিয়া ভোগ কর, বীর দেদার।।বুক খালি ক'রে আপনারে আজ দাও জাকাত, করো না হিসাবী, আজি হিসাবের অঙ্কপাত! একদিন করো ভুল হিসাব। দিলে দিলে আজ খুন্সুড়ি করে দিললগী, আজিকে ছায়েলা-লায়েলা-চুমায় লাল যোগী! জামশেদ বেঁচে চায় শরাব।।পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু, ঈদ মোবারক! আসসালাম! ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম! বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ! আমার দানের অনুরাগে-রাঙা 'ঈদগা'রে! সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে- দেহ নয়, দিল হবে শহীদ।। ঈশ্বর কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’ কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?        হায় ঋষি দরবেশ,   বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ।   সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,   স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!   ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,   দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।   শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদের ক’রো না ক’ বীর, ভয়- তাহারা খোদার খোদ্‌ ‘প্রাইভেট সেক্রেটারী’ ত নয়! সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি! আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি! রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কুলে- রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’।    উহারা রত্ন-বেনে, রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে! ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে, শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে। উঠিয়াছে ঝড় উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার, ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার! কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই, ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই। তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়, হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ; কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ; বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়, উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়! যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান, ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান। আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই, আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি! গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন, মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ! নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ, তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ, ‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ? ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল, মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল! অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি, ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান? শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান? এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, – জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে! চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে, মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে। নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ, বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ। অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার? মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার। রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি, রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি। তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান, অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক, বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ। যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর, তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর, খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর! রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন, ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন!   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ বাংলার অগ্নি-নাগিনি মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা মিসেস এম. রহমান সাহেবার পবিত্র চরণারবিন্দে –এমনই প্লাবন-দুন্দুভি-বাজা ব্যাকুল শ্রাবণ মাস – সর্বনাশের ঝান্ডা দুলায়ে বিদ্রোহ-রাঙা-বাস ছুটিতে আছিনু মাভৈঃ-মন্ত্র ঘোষি অভয়কর, রণ-বিপ্লব-রক্ত-অশ্ব কশাঘাত-জর্জর! সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে, ওগো নাগমাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে! কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে, নির্জিত তব ফণা-নিঙড়ানো গরলের ধারা গলে; পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন-চূর আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর! আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল সে তব ফণা-ছায়া-দোল হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল। ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল, নোয়াইল শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল! ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী উল্লাসে ‘জয় জয় নাগমাতা’ হাঁকিল জয়-ধ্বনি! বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল! দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি পতাকা জ্বালা-উজল! তারপর মা গো কোথা গেলে তুমি, আমি কোথা হনু হারা, জাগিয়া দেখিনু, আমারে গ্রাসিয়া রাহু রাক্ষস-কারা! শৃঙ্খলিতা সে জননীর ব্যথা বাজিয়া এ ক্ষীণ বুকে অগ্নি হয়ে মা জ্বলেছিল খুন, বিষ উঠেছিল মুখে, শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখি সম পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম, – সে আক্রমণ ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ, বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ। হাতে পায়ে কটি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল, অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ, তৃষায় মেলে না জল, কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনিকো আলো বায়ু, তারই মাঝে আসি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে স্নায়ু – এত যন্ত্রণা তবু সব যেন বুকে ক্ষীর হয়ে ওঠে, শত্রুর হানা কণ্টক-ক্ষত প্রাণে ফুল হয়ে ফোটে!– এরই মাঝে তুমি এলে নাগমাতা পাতাল-বন্ধ টুটি অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি! তোমার মমতা-মানিক-আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা, তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী! তোমার আঁচল পাতা নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে ফণা তব মা গো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে ! – আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে, সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে, নহে তার তরে, – সব সন্তানে তুমি যে বেসেছ ভালো, তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো, শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি, – সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) উৎসর্গ (অগ্নিবীণা) ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে। তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে॥ দহন-বনের গহন-চারী– হায় ঋষি– কোন্ বংশীধারী নিঙ্‌ড়ে আগুন আন্‌লে বারি অগ্নি-মরুর মাঝে। সর্বনাশা কোন্ বাঁশি সে বুঝ্‌তে পারি না যে॥ দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হান্‌ছিলে বৈশাখে, হঠাৎ সে কার শুন্‌লে বেণু কদম্বের ঐ শাখে। বজ্রে তোমার বাজ্‌ল বাঁশি, বহ্নি হলো কান্না হাসি. সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী– মন সরে না কাজে। তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্ত-শিখা বাজে॥কাব্যগ্রন্থঃ-অগ্নিবীণা উদ্‌বোধন বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও ভীম বজ্র-বিষাণে দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!অগ্নি-তূর্য কাঁপাক সূর্য বাজুক রুদ্রতালে ভৈরব – দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!নট-মল্লার দীপক-রাগে জ্বলুক তাড়িত-বহ্নি আগে ভেরির রন্ধ্রে মেঘমন্দ্রে জাগাও বাণী জাগ্রত নব। দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!দাসত্বের এ ঘৃণ্য তৃপ্তি ভিক্ষুকের এ লজ্জা-বৃত্তি, বিনাশো জাতির দারুণ এ লাজ, দাও তেজ দাও মুক্তি-গরব। দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!খুন দাও নিশ্চল এ হস্তে শক্তি-বজ্র দাও নিরস্ত্রে; শীর্ষ তুলিয়া বিশ্বে মোদেরও দাঁড়াবার পুন দাও গৌরব – দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!ঘুচাতে ভীরুর নীচতা দৈন্য প্রেরো হে তোমার ন্যায়ের সৈন্য শৃঙ্খলিতের টুটাতে বাঁধন আনো আঘাত প্রচণ্ড আহব। দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!নির্বীর্য এ তেজঃ-সূর্যে দীপ্ত করো হে বহ্নি-বীর্যে, শৌর্য ধৈর্য মহাপ্রাণ দাও, দাও স্বাধীনতা সত্য বিভব! দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) উপেক্ষিত কান্না-হাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা, কখন তুমি ডাক দেবে মা, কখন আমি ভাঙব খেলা? অজানাকে আনতে জিনে জগৎটাকে ফেলুন চিনে, চাই যারে মা তায় দেখিনে ফিরে এনু তাই একেলা পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে বক্ষে বিঁধে অবহেলা।।আজকে বড় শ্রান্ত আমি আশায় আশায় মিথ্যা ঘুরে, ও মা এখন বুকে ধরো, মরণ আসে ঐ অদূরে! সৃষ্টিটাকে পায়ের তলে এসেছি মা হেলায় দলে, হৃদয় শুধু জিনতে বলে খেয়ে এনু পায়ের ঠেলা আর সহে না মাগো এখন আমায় নিয়ে হেলাফেলা।।বিশ্বজয়ের গর্ব আমার জয় করেছে ঐ পরাজয়, ছিন্ন-আশা নেতিয়ে পড়ে, ও মা এসে দাও বরাভয়! চারিদিকে মা প্রবঞ্চনা ভালোবাসার গিল্টিসোনা, আজ মণি কাল ধূলি কণা, জুয়ার হাট এই প্রেমের মেলা! খুইয়েছি সব সাধের খেলায়, বুক ভেঙেছে হেলার ঢেলা! এখন তুমি নাও মা কোলে, নয় অকূলে ভাসাই ভেলা।। উমর ফারুক তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে। প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!                     আমির-উল-মুমেনিন, তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন। তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি, বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী? ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান? মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?                     আবার লুটায়ে পড়ি। 'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি। উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু! আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু! ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন! সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ। শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি? পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি। আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর- 'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।' *  *  *  *  *  *  *  *  *  * অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে, ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে। শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ। সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে, বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।                     হেরি পশ্চাতে চাহি- তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি। দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে- উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে! হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি। প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি! মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে, সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে। কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে, তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'                     ...ভৃত্য দস্ত চুমি কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি? উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'                     খলিফা হাসিয়া বলে, 'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে। রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।' কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই। আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই। আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা। ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি, মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী। জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা, কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা। জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব- অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।' *  *  *  *  *  *  *  *  *  * তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়, সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়। মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান, তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান, সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা, বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না। *  *  *  *  *  *  *  *  *  * মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি, মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরেকাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়, উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়। শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে, বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে, আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'। কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা, বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা! রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার? মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!                     এত যে কোমল প্রাণ, করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান! মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে! ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি- 'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'                     আবু শাহমার গোরে কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে, 'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে, একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে, রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে। হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট! অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ, মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।(সংক্ষেপিত) উম্মত আমি গুনাহগার উম্মত আমি গুনাহগার (সুন্ধু ভৈরবী- কার্ফা)উম্মত আমি গুনাহগার তবু ভয় নাহি রে আমার আহমদ আমার নবী যিনি খোদ হাবিব খোদার।।যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবী, তাহারি দামন ধরি' পুলসিরাত হব পার।।কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে যবে নাফসি ইয়া নাফসি রবে, ইয়া উম্মতী বলে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার।।কাঁদিবেন সাথে মা ফাতিমা ধরিয়া আরশ আল্লার হোসায়েনের খুনের বদলায় মাফী চাই পাপী সবাকার।।দোযখ হয়েছে হারাম যে দিন পড়েছি কালেমা, যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান- বর্দার।। এ কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে এই তো নদীর খেলা (রে ভাই) এই তো বিধির খেলা। সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকীর সন্ধ্যাবেলা।সেই নদীর ধারে কোন ভরসায় (ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায় যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই পারে যাবার ভেলা।এই দেহ ভেঙ্গে হয় রে মাটি মাটিতে হয় দেহ যে কুমোর গড়ে সেই দেহ তার খোঁজ নিল না কেহ।রাতে রাজা সাজে নট-মহলে দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে সবই মাটির ঢেলা এই তো বিধির খেলা রে ভাই ভব-নদীর খেলা।। এ মোর অহংকার নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার, তোমায় আমি ক'রব সৃজন- এ মোর অহংকার! এমনি চোখের দৃষ্টি দিয়া তোমায় যারা দেখলো প্রিয়া, তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে তুমি নিখিল-রূপের রাণী- মানস-আসনে!সবাই যখন তোমায় ঘিরে ক'রবে কলরব, আমি দূরে ধেয়ান-লোকে র'চব তোমার স্তব। র'চব সুরধুনী-তীরে আমার সুরের উর্বশীরে, নিখিল কন্ঠে দুলবে তুমি গানের কন্ঠ-হার- কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার!যেদিন আমি থাকবনা ক' থাকবে আমার গান, ব'লবে সবাই, 'কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?' আকাশ ভরা হাজার তারা রইবে চেয়ে তন্দ্রাহারা, সখার সাথে জাগবে রাতে, চাইবে আকাশে আমার গানে প'ড়বে মনে আমায় আভাসে!বুকের তলা ক'রবে ব্যথা, ব'লবে কাঁদিয়া, 'বন্ধু! সে কে তোমার গানের মানসী প্রিয়া?' হাসবে সবাই, গাইবে গীতি, তুমি নয়ন-জলে তিতি' নতুন ক'রে আমার গানে আমার কবিতায় গহীন নিরালাতে ব'সে খুঁজবে আপনায়! রাখতে যেদিন নারবে ধরা তোমায় ধরিয়া ওরা সবাই ভুলবে তোমায় দু'দিন স্মরিয়া, আমার গানের অশ্রুজলে, আমার বাণীর পদ্মদলে দুলবে তুমি চিরন্তনী চির-নবীনা! রইবে শুধু বাণী, সে-দিন রইবে না বীণা!নাই বা পেলাম কন্ঠে আমার তোমার কন্ঠহার, তোমায় আমি ক'রব সৃজন এ মোর অহংকার! এইত আমার চোখের জলে, আমার গানের সুরের ছলে, কাব্যে আমার, আমার ভাষায়, আমার বেদনায়, নিত্যকালের প্রিয় আমায় ডাকছ ইশারায়!চাই না তোমায় স্বর্গে নিতে, চাই এ ধুলাতে তোমার পায়ে স্বর্গ এনে ভুবন ভুলাতে! ঊর্ধ্বে তোমার- তুমি দেবী, চাই না দেবীর দয়া, যাচি প্রিয়ার আঁখিজল, একটু দুখে অভিমানে নয়ন টলমল!যেমন ক'রে খেলতে তুমি কিশোর বয়শে- মাটির মেয়ের দিতে বিয়ে মনের হরষে। বালু দিয়ে গড়তে গেহ জাগত বুকে মাটির স্নেহ, ছিল না তো স্বর্গ তখন সূর্য তারা চাঁদ, তেমনি ক'রে খেলবে আবার পাতবে মায়া-ফাঁদ!মাটির প্রদীপ জ্বালবে তুমি মাটির কুটীরে, খুশীর রঙে ক'রবে সোনা ধূলি-মুঠিরে। আধখানে চাঁদ আকাশ 'পরে উঠবে যবে গরব-ভরে তুমি বাকী-আধখানা চাঁদ হাসবে ধরাতে, তড়িৎ প'ড়বে তোমার খোঁপায় জড়াতে!তুমি আমার বকুল যূথী- মাটির তারা-ফুল, ঈদের প্রথম চাঁদ গো তোমার কানের পার্সি-দুল। কুসুমী রাঙা শাড়িখানি চৈতী-সাঁঝে প'রবে রাণী, আকাশ-গাঙে জাগবে জোয়ার রঙের রাঙা বান, তোরণ-দ্বারে নাজবে করুণ বারোয়াঁ মূলতান।আমার রচা গানে তোমায় সেই বেলা-শেষে এমনি সুরে চাইবে কেহ পরদেশী এসে! রঙীন সাঁঝে ঐ আঙিনায় চাইবে যারা, তাদের চাওয়ায় আমার চাওয়া রইবে গোপন!- এ মোর অভিমান, যাচবে যারা তোমায়-রচি তাদের তরে গান!নাই বা দিলে ধরা আমার ধরার আঙিনায়, তোমায় জিনে গেলাম সুরের স্বয়ম্বর-সভায়! তোমার রূপে আমার বুবন আলোয় আলোয় হ'ল মগন! কাজ কি জেনে-কাহার আশায় গাঁথছ ফুল-হার, আমি তোমার গাঁথছি মালা এ মোর অহংকার! এক আল্লাহ জিন্দাবাদ উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ; আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ, আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই; নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই! ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে, দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে, ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে। মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী, উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী, অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী। ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি। মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার, ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার! আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়, কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়। বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি; তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে, নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে। সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়, আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়। যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই, উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই। ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই, দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই। মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের, শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের! আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ, নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ। পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো, এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো। সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে, তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে। দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল। ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়, ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা, এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা। ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ, পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে, হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে। আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন, তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান! ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ, মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - 'এক আল্লাহ জিন্দাবাদ'।    (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) একি আল্লার কৃপা নয়? একি আল্লার কৃপা নয়?     একি তাঁর সাহায্য নয়?     যেথা ছিল শুধু পরাজয় ভয়,     সেখানে পাইলে জয়! রক্তের স্রোত বহাতে যাহারা এসেছিল এই দেশে, ধরেছে তাদের টুঁটি টিপে আজ তাঁর অভিশাপ এসে! আল্লার আশ্রয় চেয়ে, আল্লার শক্তিতে আজ তোমরা পেয়েছ আশ্রয় আর তারা পাইতেছে লাজ। লোভ আর ভোগ চাহে যারা, নাই তাদের ধর্ম জাতি, তাদের শুধু এক নাম আছে, রাক্ষস বলে খ্যাতি! হউক হিন্দু, হউক ক্রিশ্চান, হোক সে মুসলমান, ক্ষমা নাই তার, যে আনে তাঁহার দুনিয়ায় অকল্যাণ! জুলুম যে করে শক্তি পাইয়া, দানব সে, সে অসুর, আল্লার মার পড়ে তারে করে দুনিয়া হইতে দূর। তাহাদেরই তরে দোজখে নরকে ভীষণ অগ্নি জ্বলে, দলিছে যাহারা তাঁহার সৃষ্টি মানুষেরে পদতলে! সকল জাতির সব মানুষের এক আল্লাহ্‌ সেই, তাঁর সৃষ্টির বিচার করার কারও অধিকার নেই! আমরা নিত্য চেষ্টা করিব চলিতে তাঁহারই পথে, করিব না ভয়, আসুক আঘাত শত শত দিক হতে!    নির্যাতিতের আল্লাহ্‌ তিনি, কোনো জাতি নাই তাঁর, যুগে যুগে মারে উৎপীড়কেরে তাঁহার প্রবল মার। তাঁর সৃষ্টিরে ভালোবাসে যারা, তারাই মুসলমান, মুসলিম সেই, যে মানে এক সে আল্লার ফরমান।     দূর করো লোভ, ক্ষুদ্র অহংকার, ফেলিয়া দিয়ো না, পাইয়াছ হাতে আল্লার তলোয়ার! দূর করে দাও সন্দেহ, দুর্বলের অবিশ্বাস, সমুখে জাগুক পরম সত্য আল্লার উল্লাস! খানিক পেয়েছ, খানিক পাওনি, দেরি নাই , তাও পাবে, তাঁর জ্যোতি চির-অভয়ের পথে নিত্য লইয়া যাবে! চারিদিক হতে ঘিরিয়া আসিছে হেরো অগ্নির ঢেউ, যারা তাঁর পথে রহিবে, তাঁদের মারিবে না কভু কেউ! শুধু তাহারাই রক্ষা পাইবে! সাবধান! সাবধান! মহাযুদ্ধের রূপে আসিয়াছে তাঁর শেষ ফরমান! তাঁর শক্তিতে জয়ী হবে, লয়ে আল্লার নাম, জাগো! ঘুমায়ো না আর, যতটুকু পার শুধু তাঁর কাজে লাগো! অন্তরে তব উঠুক ঝলসি আল্লার তলোয়ার, ভিতরের ভয় ঘুচিলে আসিবে এই হাতে আরবার! কোনো ব্যক্তির করিয়ো না পূজা, এক তাঁর পূজা করো, রাজনীতি নয় মুক্তির পথ, এক তাঁর পথ ধরো! মানুষের লোভ বাড়ায়ে দিয়ো না, তার জয়ধ্বনি করে, মানুষেরে ত্রাতা ভাবিলে অমনি আল্লাহ্‌ যান সরে! তিনিই সর্বকল্যাণদাতা, সর্ববিপদত্রাতা, তিনি দিশা দেন সহজ পথের, তিনিই সর্বজ্ঞতা!        তাঁর দেওয়া কৃপা-শক্তির চেয়ে, ভাই, মানবের জ্ঞানে দানব মারার কোনো সে শক্তি নাই। চুক্তিতে আর যুক্তিতে কভু মানুষ বদ্ধ হয়? তিনি প্রেম দিলে ত্রিভুবন হয় সাম্য শান্তিময়! আমি বুঝি নাকো কোনো সে ‘ইজম’ কোনোরূপ রাজনীতি, আমি শুধু জানি, আমি শুধু মানি, এক আল্লার প্রীতি! ভেদ-বিভেদের কথা বলে যারা, তারা শয়তানি চেলা, আর বেশি দিন নাই, শেষ হয়ে এসেছে তাদের খেলা! থাকি কি না থাকি এই দুনিয়ায়, তোমরা থাকিয়া দেখো, সেদিন সিজদা করো আল্লারে, কাঁদিয়া তাঁহারে ডেকো! সেদিন সত্য হয় যদি তাঁর এই বান্দার কথা, ঘুচে যাবে মোর চিরজনমের সকল দুঃখ-ব্যথা। মানুষ আবার তাঁর প্রেমে নেয়ে চিরপবিত্র হোক! জিনের দুনিয়া লভুক আবার জান্নাতের আলোক!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) এল শোকের মোহররম এল শোকের সেই মোহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে। আজি বে-তাব বিশ্বমুসলিম সেই শোকে রোয়ে রোয়ে।।মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুশের বাচ্চায় পানি চাহিয়া পেল শাহাদাত হোসেনের বক্ষে রয়ে।।এক হাতে বিবাহের কাঙ্গন এক হাতে কাসেমের লাশ, বেহুঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা সয়ে।।ঝরিছে আঁখিতে খুন হায় জয়নাল বেহুঁশ কেঁদে মানুষ ব'লে সহে এত পাথরও যেত ক্ষয়ে।।শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হযরত হোসেন শহীদ, আসমানে শোকের বারেষ, মরে আজি খুন হয়ে।। এস হে সজল এস হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া বেণুকুঞ্জ ছায়ায় এস তাল তমাল বনে এস শ্যামল ফুটাইয়া যূঁথী-কুন্দ-নীপ-কেয়া।বারিধারে এস চারিধার ভাসায়ে বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দশ দিক হাসায়ে বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।শ্রাবণ বরিষণ হরষণ ঘনায়ে এস নব ঘনশ্যাম নূপুর শোনায়ে হিজল তমাল ডালে ঝুলন ঝুলায়ে তাপিতা ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।। এসো প্রিয় আরো কাছে এস প্রিয় আরো কাছে পাইতে হূদয়ে যে বিরহী মন যাচে।দেখাও প্রিয়-ঘন স্বরূপ মোহন যে রূপে প্রেমাবেশে পরাণ নাচে।। ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদআজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে, তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের, তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।তোরে মারল' ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ। ওই ঘর ভুলানো সুরে ওই ঘর ভুলানো সুরে কে গান গেয়ে যায় দূরে তার সুরের সাথে সাথে মোর মন যেতে চায় উড়ে।তার সহজ গলার তানে সে ফুল ফোটাতে জানে তার সুরে ভাটির টানে নব জোয়ার আসে ঘুরে।তার সুরের অনুরাগে বুকে প্রণয়-বেদন জাগে বনে ফুলের আগুন লাগে ফুল সুধায় ওঠে পুরে।বুঝি সুর সোহাগে ওরই পায় যৌবন কিশোরী হিয়া বুঁদ হয়ে গো নেশায় তার পায়ে পায়ে ঘুরে।। ওগো প্রিয় তব গান ওগো প্রিয় তব গান আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বাহিয়া যায়। মোর কথাগুলি কাঁদিছে বুকের মাঝারে, পথ খুঁজে নাহি পায়।ওগো দখিনা বাতাস, ফুলের সুরভি বহ ওরি সাথে মোর না বলা বাণী লহ। ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ বন্দিনী গিরি-ঝরণা পাষাণতলে যে কথা কহিতে চায়।ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি তোদের ভাটির স্রোতে নিয়ে যা আমার না বলা কথাগুলি ধুয়ে মোর বুক হতে।ওরে ‘চোখ গেল’ ‘বৌ কথা কও’ পাখি তোদের কণ্ঠে মোর সুর যাই রাখি। ওরে মাঠের মুরলি কহিও তাহারে ডাকি আমার এ কলি, না-ফোটা বুলি, ঝরে গেল নিরাশায়।। কচুরিপানা [গান]ধ্বংস করো এই কচুরিপানা! (এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা॥             (ধুয়া)       ইহাদের সবংশে করো করো নাশ,       এদের দগ্ধ করে করো ছাই পাঁশ, (এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস, (এরা) দৈত্যের দাঁত, রাক্ষসের ডানা।–          ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥        (ধুয়া) (এরা) ম্যালেরিয়া আনে, আনে অভাব নরক, (এরা) অমঙ্গলের দূত, ভীষণ মড়ক! (এরা) একে একে গ্রাস করে নদী ও নালা। (যত) বিল ঝিল মাঠ ঘাট ডোবা ও খানা।          ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥         (ধুয়া) (এরা) বাংলার অভিশাপ, বিষ, এরা পাপ, (এসো) সমূলে কচুরিপানা করে ফেলি সাফ! (এরা) শ্যামল বাংলা দেশ করিল শ্মশান, (এরা) শয়তানি দূত দুর্ভিক্ষ-আনা।          ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥        (ধুয়া) (কাল) সাপের ফণা এর পাতায় পাতায়, (এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়, (ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই (এরে) নির্মূল করে ফেলো, শুনো না মানা।          ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥        (ধুয়া)  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) কবির মুক্তি মিলের খিল খুলে গেছে! কিলবিল করছিল, কাঁচুমাচু হয়েছিল –     কেঁচোর মতন – পেটের পাঁকে কথার কাতুকুতু! কথা কি ‘কথক’ নাচ নাচবে     চৌতালে ধামারে? তালতলা দিয়ে যেতে হলে কথাকে যেতে হয় কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে   তালের বাধাকে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে!   এই যাঃ! মিল হয়ে গেল!   ও তাল-তলার কেরদানি – দুত্তোর! মুরগিছানার চিলের মতন টেকো মাথায় ঢিলের মতন   পড়বে এইবার কথার বাণ্ডিল। ছন্দ এবার কন্ধকাটা পাঁঠার মতন ছটফটাবে। লটপটাবে লুচির লেচির আটার মতন! অক্ষর আর যক্ষর টাকা গোনার মতো   গুনতে হবে না –    অঙ্কলক্ষ্মীর ভয়ে কাব্যলক্ষ্মী থাকতেন    কুঁকড়োর মতন কুঁকড়ে! ভাবতেন, মিলের চিল কখন দেবে ঠুকরে!    আবার মিল!–   গঙ্গার দু-ধারে অনেক মিল, কটন মিল, জুট মিল, পেপার মিল –   মিলের অভাব কী? কাব্যলোকে মিল থাকবে কেন? ওকে ধুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দাও!   ওখানেও যে মিল আছে! ধুলো যদি কুলোয় যায় চুলোয় যায়, হুলো ভুলোয় যদি ল্যাজে মাখে!   ল্যাজ কেটে বেঁড়ে করে দেব!   এঁড়ে দামড়া আছে যে! আমার মিল আসছে! – মুশকিল আসান।অঙ্কলক্ষ্মীকে মানা করেছিলাম,     মিলের শাড়ি কিনতে। অঙ্কলক্ষ্মীর জ্বালায় পঙ্কলক্ষ্মী পদ্ম     আর ফোটে না!   তা বলতে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। এ কবিতা যদি পড়ে   গায়ে ধানি লংকা ঘষে দেবে! – আজ যে বিনা প্রয়াসেই অনুপ্রাসের     পাল পেয়েছি দেখছি! মিল আসছে – যেন মিলানের মেলায়     মেমের ভিড়!   নাঃ! – কবিতা লিখি। তাকে দেখেছিলাম – আমার মানসীকে   ভেটকি মাছের মতো চেহারা! আমাকে উড়ে বেহারা মনে করেছিল!     শাড়ির সঙ্গে যেন তার আড়ি।     কাঁখে হাঁড়ি – মাথায় ধামা।     জামা ব্লাউজ শেমিজ পরে না। দরকার বা কি?     তরকারি বেচে!   সরকারি ষাঁড়ের মতন নাদুস-নুদুস!     চিচিঙ্গের মতন বেণি দুলছিল।সে যে-দেশের, সে-দেশে আঁচলের চল নাই!     চলেন গজ-গমনে।   পায়ে আলতা নাই, চালতার রং।     নাম বললে – ‘আজুলি’   আমি বললাম – ‘ধ্যেৎ, তুমি কাজুলি।’ হাতে চুড়ি নাই,   তুড়ি দেয় আর মুড়ি খায়।   গলায় হার নাই, ব্যাগ আছে। পায়ে গোদ,   আমি বলি, ‘প্যাগোডা’ সুন্দরী!   গান গাই, ‘ওগো মরমিয়া!’ ও ভুল শোনে! ও গায় –     ‘ওগো বড়ো মিয়াঁ!’   থাকত হাতে ‘এয়ার গান!’ ও গায় গেঁয়ো সুরে, চাঁপা ফুল কেয়ার গান। – দাঁতে মিশি, মাঝে মাঝে পিসি বলতে ইচ্ছা করে। ডাগর মেয়েরা আমাকে যে হাঙর ভাবে।     হৃদয়ে বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ!   ভিক্ষা চাই না, শিক্ষা দিয়ে দেবে।   তাই ধরেছি রক্ষাকালীর চেড়িকে। নেংটির আবার বকেয়া সেলাই!   কবিতে লেখার মশলা পেলেই হল   তা না-ই হল গরম মশলা। – নাঃ, ঘুম আসছে,   রান্নাঘরের ধূম আসছে। বউ বলে, নাক ডাকছে,   না শাঁখ ডাকছে। আবার মিল আসছে –   ঘুম আসছে – দুম্বা ভেড়ার দুম আসছে! -----------------------শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ কবি-রাণী তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি। আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।। আপন জেনে হাত বাড়ালো- আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো, বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা পুবের অরুণ রবি,- তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়, তুমিই আমার মাঝে আসি’ অসিতে মোর বাজাও বাঁশি, আমার পূজার যা আয়োজন তোমার প্রাণের হবি। আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি। আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।। কমল-কাঁটা আজকে দেখি হিংসা-মদের মত্ত-বারণ-রণে জাগ্‌ছে শুধু মৃণাল-কাঁটা আমার কমল-বনে।     উঠল কখন ভীম কোলাহল,     আমার বুকের রক্ত-কমল     কে ছিঁড়িল-বাঁধ-ভরা জল                শুধায় ক্ষণে ক্ষণে। ঢেউ-এর দোলায় মরাল-তরী নাচ্‌বে না আন্‌মনে।।কাঁটাও আমার যায় না কেন, কমল গেল যদি! সিনান-বধূর শাপ শুধু আজ কুড়াই নিরবধি!     আস্‌বে কি আর পথিক-বালা?     প’রবে আমার মৃণাল-মালা?     আমার জলজ-কাঁটার জ্বালা                   জ্ব’লবে মোরই মনে? ফুল না পেয়েও কমল-কাঁটা বাঁধবে কে কঙ্কণে? কর্ণফুলী ওগো ও কর্ণফুলী, উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি। যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা, আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা! তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন। যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে! কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে! তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল, দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল? – বুঝি প্রিয় সব বুঝি, তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!* * *তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী – তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী? দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়, স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়? ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল, এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল? বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়, ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর, সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান? এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ, নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ। পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে, সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে! নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল! আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে, গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে? ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে? পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? – দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ? মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? – তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? – যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?* * *– ওগো চির উদাসিনী! তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি। তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি, চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি। জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে! বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়! যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়। বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে! যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!* * *–ওগো ও কর্ণফুলী! তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি? তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে, ‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে? আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি, সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী? তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী? তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি? ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ, আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ, তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!‌ আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে, তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে! অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়! ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!* * *সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ, এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ! ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি। হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে, মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে! – সে কবে বাঁচিতে চায়, জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন, সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন! আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়, যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়! হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা; তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা! ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা, তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা! আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে, ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে। হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী, বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি! শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল, তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি – দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) কর্থ্যভাষা কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন। নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥ গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী। বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥ চাষায় আমি চশ্‌শ বলি, আশায় বলি অশ্ব। কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥ শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম। পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥ পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু। বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥ চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল। শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥ শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু। বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥ আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু। ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লিখা একটি চিঠি (ফজিলাতুন্নেসা কে না পাওয়ার ব্যথায় বেদনা ভেজা বহিঃপ্রকাশ)১৫, জুলিয়াটোলা স্ট্রীট কলিকাতা ০৮-০৩-২৮ সন্ধ্যাপ্রিয় মতিহারপরশু বিকালে এসেছি কলকাতা। ওপরের ঠিকানায় আছি। আরো আগেই আসবার কথা ছিল, অসুখ বেড়ে উঠায় আসতে পারিনি। ২/৪ দিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনদিন এক জায়গায় চলে যাবো, অবশ্য দু-দশ দিনের জন্য। যেখানেই যাই, আর কেউ না পাক, তুমি খবর পাবে।বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্ততঃ তোমার বুক বেঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে , যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মত জড়িয়ে শুয়েছিল, অন্ততঃ এইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে যেতে পারবো, এই কি কম সৌভাগ্য আমার!!!কেন এই কথা বলছি শুনবে? বন্ধু আমি পেয়েছি যার সাক্ষাৎ আমি নিজেই করতে পারবো না । এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে উঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির লেখা তোমার কাছে লিখে গেলাম। আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দীপ্তি চোখের জলকণার মত ঝিলমিল করবে, মনে কর, সেই তারাটি আমি । আমার নামেই তার নামকরণ কর, কেমন ?মৃত্যু এত করে মনে করছি কেন ? জানো, ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে ! মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরলে সে আমায় বরণ করে নিবে। সমস্ত বুকটা ব্যথায় দিন রাত টন টন করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত বুকটা যেন ঐখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যেন মুক্তি হয়, বেঁচে যাবো। কিন্তু কী হবে কে জানে!! তোমার চিঠি পেয়ে অবধি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। কত কথা, কত কী!!! তার কি কূল কিনারা আছে!!! ভাবছি আমার ব্যথার রক্তকে রঙীন খেলা বলে উপহাস যিনি করেন, তিনি হয়তো দেবতা, আমার ব্যথার অশ্রুর বহু উর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাবো না। ফুল ধূলায় ঝরে পড়ে, পায়ে পিষ্ট হয়, তাই বলে কি ফুল এত অনাদরের? ভুল করে সে ফুল যদি কারোর কবরীতে ঝরেই পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রব বলে মনে করেন, তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত হচ্ছে এক্ষুণি কারো পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা। ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে, অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই ই দাও, কুকুর লেলিয়ে দিও না। আঘাত করার একটা সীমা আছে, সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে আর তক্ষুণি তার নাম হয় অবমাননা। ছেলেবেলা থেকেই পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে, যে প্রেমে বুক ভরে উঠে কানায় কানায়, তা কখনো কোথাও পাইনি।এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেল। না জানি কত উদ্বিগ্ন হয়েছ!!! কি করি বন্ধু, শরীরটা এত বেশি বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। ওষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয় না।আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকেই চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছেমত। সেই কত রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম , শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোন দিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর সলিটারি সেলে যখন বন্দি ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হত না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয় অস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্ত পাড়ের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া, দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু, ক'ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়, তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই - সেই সব জিজ্ঞাসা।যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু'ফোঁটা অশ্রুর দর্পন দেয়, শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশীতে উল্কা ফুল হয়ে তাঁর নোটন খোঁপায় ঝরে পড়বো। তাঁকে বলো বন্ধু, তাঁর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাঁকে পেয়েছি। আমার বুকের রক্তে, চোখের জলে আমি তাঁর উদ্দেশ্যে আমার শান্ত , স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ণ চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমষ্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমারে সর্বান্তকরণে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছিনে ভাই। চোখের জল, কলমের কালি দুইই শুকিয়ে গেল। তোমরা কেমন আছো, জানিয়ো। তাঁর কিছু খবর দাও না কেন? না কী সে এটুকুও মানা করেছে? ঠিক সময় মতো সে ওষুধ খায়তো ?কেবলি কীটস্ কে স্বপ্নে দেখছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানিব্রাউন পাথরের মত।ভালোবাসা নাওইতি তোমার নজরুল। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মারগিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার! কাবেরী-তীরে কর্ণাটের গঙ্গা-পূত কাবেরীর নীরে প্রভাতে সিনানে আসে শ্যামা বেণিবর্ণা কর্ণাটকুমারী এক, নাম মেঘমালা। সিনানের আগে নিতি কাহার উদ্দেশে চামেলি চম্পক ফুল তরঙ্গে ভাসায়।    ভিনদেশি বুঝি এক বণিক কুমার হেরিয়া সে এণাক্ষীরে তরণি ভিড়ায়ে রহে সেই ঘাটে বসি,যেতে নাহি চায়। স্নান-স্নিগ্ধা শ্যামলীর স্নিগ্ধতর রূপে ডুবে যায় আঁখি তার, কন্ঠে ফোটে গান –    (কর্ণাটি সামন্ত – তেতালা)    কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা। আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা॥ প্রভাত সিনানে আসি আলসে কঙ্কণ তাল হানো কলসে, খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥ দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে তব জল ঢলঢল করুণা মাগে। ঝিলম রেবা নদীতীরে মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥    দ্বিধাহীনা মেঘমালা জানিত না লাজ কুন্ঠাহীন মুখে তার ছিল না গুন্ঠন! গান শুনি কুমারের কাছে আসি কহে – কারে খোঁজে মেঘদূত? হে বিদেশি কহো! কহিতে কহিতে চাহি কুমারের চোখে কী যেন হেরিয়া মুখে বেধে যায় কথা। সেদিন প্রথম যেন আপনারে হেরি, আপনি সে উঠিল চমকি! দেহে তার লজ্জা আসি টেনে দিল অরুণ আঙিয়া! ভরা ঘট লয়ে ঘরে ফিরে! নিশি রাতে সুরের সুতায় গাঁথে কথার মুকুল।–(নাগ স্বরাবলী – তেতালা)    এসো চিরজনমের সাথি। তোমারে খুঁজেছি দূর আকাশে জ্বালায়ে চাঁদের বাতি॥ খুঁজেছি প্রভাতে, গোধূলি-লগনে, মেঘ হয়ে আমি খুঁজেছি গগনে, ঢেকেছে ধরণি আমার কাঁদনে অসীম তিমির রাতি॥ ফুল হয়ে আছে লতায় জড়ায়ে মোর অশ্রুর স্মৃতি বেণুবনে বাজে বাদল নিশীথে আমারই করুণগীতি! শত জনমের মুকুল ঝরায়ে ধরা দিতে এলে আজি মধুবায়ে বসে আছি আশা-বকুলের ছায়ে বরণের মালা গাঁথি॥    গান গাহি চমকিয়া ওঠে মেঘমালা।    আপনারে ধিক্কারে সে মরিয়া মরমে –    যদি কেহ শুনে থাকে তাহার এ গান,    কী ভাবিবে যদি শোনে বিদেশি বণিক!    সেদিন কাবেরীতীরে এল মেঘমালা    বেলা করি। গাঁয়ের বধূরা একে একে    সিনান সারিয়া ফিরে গেছে গৃহকাজে।    বণিককুমার খোঁজে কী যেন মানিক!    নীল শাড়ি পরি তন্বী মেঘমালা আসে    শ্লথগতি মদালসা, বিলম্বিতা বেণি।    বণিককুমার চাহি ওপারের পানে,    গাহে গান, – না দেখার ভান করি যেন। –    (নীলাম্বরী – তেতালা) নীলাম্বরী শাড়ি পরি, নীল যমুনায় কে যায়, কে যায়, কে যায়। যেন জলে চলে থল-কমলিনী, ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥ কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে চমকায় উন্মন চম্পাবনকে, দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥ অঙ্গের ছন্দে পলাশ, মাধবী, অশোক ফোটে, নূপুর শুনি বনতুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে! মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি। তাহারই অঙ্গ-তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥    মেঘমালা কুমারের আঁখি ফিরাইতে    কত রূপে শব্দ করে কলসে কঙ্কণে।    সাঁতারিয়া কাবেরীর শান্ত বক্ষ মাঝে    অশান্ত তরঙ্গ তোলে! বণিক কুমার    হাসি তীরে আসি কহে, ‘অঞ্চলের ফুল    অকারণে নদীজলে ভাসাও বালিকা।    ও ফুল আমারে দাও! দেবতা তোমার    প্রসন্ন হবেন, পাবে মনোমতো বর।’    মেঘমালা আঁচলের ফুলগুলি লয়ে    নদীজলে ভাসাইয়া – ঘটে জল ভরি    চলে এল ঘরপানে, চাহিল না ফিরে –    দেখিল না কার দুটি আঁখি আঁখিনীরে    ভরে গেছে কূলে কূলে। ঘরে ফিরে আসি    মেঘমালা আপনার মনে মনে কাঁদে –(নারায়ণী–আদ্ধা-কাওয়ালি) রহি রহি কেন সেই মুখ পড়ে মনে। ফিরায়ে দিয়াছি যারে অনাদরে অকারণে॥ উদাস চৈতালি দুপুরে মন উড়ে যেতে চায় সুদূরে যে বনপথে সে ভিখারি-বেশে করুণা জাগায়েছিল সকরুণ নয়নে॥ তার বুকে ছিল তৃষ্ণা, মোর ঘটে ছিল বারি। পিয়াসি ফটিকজল জল পাইল না গো ঢলিয়া পড়িল হায় জলদ নেহারি॥ তার অঞ্জলির ফুল পথধূলিতে ছড়ায়েছি সেই ব্যথা নারি ভুলিতে। অন্তরালে যারে রাখিনু চিরদিন অন্তর জুড়িয়া কেন কাঁদে সে গোপনে॥      জলে আর যায় নাকো কর্ণাট কুমারী      চলে গেল তরি বাহি বিদেশি কুমার      তরণি ভরিয়া তার নয়নের নীরে!      সেদিন নিশীথে ঝড় বাদলের খেলা,      মেঘমালা চেয়ে আছে বাতায়ন খুলি      কাবেরী নদীর পানে! ঘন অন্ধকারে      বিজলি-প্রদীপ জ্বালি কোন বিরহিণী      খুঁজে যেন তারই মতো দয়িতে তাহার।      কাঁদিয়া কাঁদিয়া কবে পড়ে যে ঘুমায়ে,      ঘুমায়ে স্বপন দেখে গাহিছে বিদেশি –    (মিশ্র নারায়ণী – তেতালা) নিশি রাতে রিম-ঝিম-ঝিম বাদল নূপুর বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর। দেয়া গরজে বিজলি চমকে জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে আধ ঘুম-ঘোরে চিনিতে নারি ওরে কে এল, কে এল বলে ডাকিছে ময়ূর। দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে আছে চেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে। কারে দেখি আমি কারে দেখি, মেঘলা আকাশ, না ওই মেঘলা মেয়ে। ধায় নদীজল মহাসাগর পানে বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে নিশিথ আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥      মেঘমালা চমকিয়া জাগি ছুটে যায়      পাগলিনিপ্রায় নদীতীরে। ডাকি ফেরে      ঝড় বাদলের সাথে কন্ঠ মিশাইয়া –      ‘কুমার! কুমার! কোথা প্রিয়তম মোর!      লয়ে যাও মোরে তব সোনার তরিতে!’      হারাইয়া গেল তার ক্ষীণ কন্ঠস্বর      অনন্ত যুগের বিরহিণীর কাঁদন      যে পথে হারায়ে যায়। আজও মোরা শুনি      কাবেরীর জল-ছলছল অশ্রু-মাখা      কর্ণাটিকা রাগিণীতে তাহারই বেদনা॥(মনোরঞ্জনী – তেতালা-ঢিমা) ওগো বৈশাখী ঝড়! লয়ে যাও অবেলায়                ঝরা এ মুকুল। লয়ে যাও আমার জীবন,– এই পায়ে দলা ফুল॥ ওগো নদীজল! লহো আমারে বিরহের সেই মহা পাথারে চাঁদের পানে চাহি যে পারাবার,          অনন্তকাল কাঁদে বেদনা-ব্যাকুল॥ ওরে মেঘ! মোরে সেই দেশে রেখে আয় যে দেশে যায় না শ্যাম মথুরায়, ভরে না বিষাদ-বিষে এ-জীবন          যে দেশের ক্ষণিকের ভুল॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) কামাল পাশা [তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আস্‌মানের আঙিনা তখন কার্‌বালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে গ্রীক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইহা গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ সৈন্যই রণস্থলে হত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাকি সব প্রাণপণে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতেছে। তুরস্কের জাতীয় সৈন্যদলের কাণ্ডারী বিশ্বত্রাস মহাবাহু কামাল-পাশা মহাহর্ষে রণস্থল হইতে তাম্বুতে ফিরিতেছেন। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদল মহাকল্লোলে অম্বর-ধরণী কাঁপাইয়া তুলিতেছে। তাহাদের প্রত্যেকের বুকে পিঠে দুই জন করিয়া নিহত বা আহত সৈন্য বাঁধা। যাহারা ফিরিতেছে তাহাদেরও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোলাগুলির আঘাতে, বেয়নটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত, পোষাক-পরিচ্ছদ ছিন্নভিন্ন, পা হইতে মাথা পর্যন্ত রক্তরঞ্জিত। তাহাদের কিন্তু সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। উদ্দাম বিজয়োন্মাদনার নেশায় মৃত্যু-কাতর রণক্লান্তি ভুলিয়া গিয়া তাহারা যেন খেপিয়া উঠিয়াছে। ভাঙা সঙ্গীনের আগায় রক্ত-ফেজ উড়াইয়া ভাঙা-খাটিয়া-আদি-দ্বারা-নির্মিত এক অভিনব চৌদলে কামালকে বসাইয়া বিষম হল্লা করিতে করিতে তাহারা মার্চ করিতেছে। ভূমিকম্পের সময় সাগর কল্লোলের মতো তাহাদের বিপুল বিজয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে যেন কেমন একটা ভীতি-কম্পনের সৃজন করিতেছে। বহু দূর হইতে সে রণ-তাণ্ডব নৃত্যের ও প্রবল ভেরী-তূরীর ঘন রোল শোনা যাইতেছে। অত্যধিক আনন্দে অনেকেরই ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইতেছিল। অনেকেরই চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছিল।]      [সৈন্য-বাহিনী দাঁড়াইয়া। হাবিলদার-মেজর তাহাদের মার্চ করাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যগণ গাইতেছিল,–]    ঐ খেপেছে পাগ্‌লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই।             কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো   কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই![হাবিলদার-মাজর মার্চের হুকুম করিল,-কুইক্ মার্চ!]      লেফ্‌ট! রাইট! লেফ্‌ট!!       লেফ্‌ট! রাইট! লেফ্‌ট!![সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ করিতে লাগিল]     ঐ খেপেছে পাগ্‌লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,      অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই!              কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো    কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই![হাবিলদার-মেজর;- লেফ্‌ট্! রাইট!]সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শম্‌শেরে। পাঠিয়ে দিলি দুশ্‌মনে সব যম-ঘর একদম্‌-সে রে!       বল্‌ দেখি ভাই বল্ হাঁ রে, দুনিয়ার কে ডর্ করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে?      [লেফট্! রাইট! লেফ্‌ট্!]     খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া! বুজ্‌দিল্ ঐ দুশ্‌মন্ সব বিল্‌কুল্ সাফ হো গিয়া!       খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!            হুর্‌রো হো!            হুর্‌রো হো! দস্যুগুলোয় সাম্‌লাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই!            কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই![হাবিলদার-মেজর;- সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্! রাইট্! লেফ্‌ট!]শির হতে এই পাঁও-তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে       রণ-ভিতুদের শান্তি-বাণী শুন্‌বে কে?            পিণ্ডারিদের খুন-রঙিন            নোখ-ভাঙা এই নীল সঙিন তৈয়ার হেয়্ হর্দম ভাই ফাড়্‌তে যিগর্ শত্রুদের! হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ্ তাদের!            সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্! ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্–       এম্‌নি করে রে–       এমনি জোরে রে– ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!– ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আসমানে আজ রক্ত-রবির আভাস!–       সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্!!       [লেফট্! রাইট! লেফ্‌ট্]হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের, তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের !       পরের মুলুক লুট করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত ! তাই   তাদের তারে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত !             কি বলো ভাই শ্যাঙাত?                      হুর্‌রো হো !                      হুর্‌রো হো ! !       দনুজ দলে দল্‌তে দাদা এম্‌নি দামাল কামাল চাই !                কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই![হাবিলদার মেজর: রাইট্ হুইল্! লেফ‌্ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্!       সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল।]আজাদ মানুষ বন্দী করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ, কুল্ মুলুকের কুষ্টি করে জোর দেখালে ক'দিন বেশ, মোদের হাতে তুর্কি-নাচন নাচ্‌লে তাধিন্ তাধিন্ শেষ!                    হুর্‌রো হো!                    হুর্‌রো হো! বদ্‌-নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই কর্‌লে কি না আল্লায়, পিশাচগুলো পড়্‌ল এসে পেল্লায় এই পাগলাদেরই পাল্লায়!            এই    পাগলাদেরই পাল্লায়!!                     হুর্‌রো হো!                     হুর্‌রো– ওদের     কল্লা দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু হল্লা,          ওদের    হল্লা শুধু হল্লা, এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধর্‌তে আসেন তুর্কি-তাজি                 মর্দ গাজি মোল্লা!                 হাঃ! হাঃ! হাঃ!       হেসে   নাড়িই ছেড়ে বা!       হা হা   হাঃ! হাঃ! হাঃ![হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্!                                 সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই! অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই!       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই![হাবিলদার-মেজর;- লেফ্‌ট্ হুইল্! য়্যাজ্‌ য়ু ওয়্যার্!- রাইট হুইল!–             লেফ্‌ট্! রাইট! লেফট্‌!] [সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।]দেখ্‌চ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ! সত্যি তো ভাই!– সন্ধেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ!       শহীদ সেনার টুক্‌টুকে বৌ লাল-পিরাহান-পরা,       স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগডগে আন্‌কোরা!– না না না,–কল্‌জে যেন টুকরো-করে-কাটা হাজার তরুণ শহীদ বীরের,–শিউরে উঠে গা'টা! আস্‌মানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই! দেখতে পেলে এক্ষুনি গে এই ছোরাটা কল্‌জেতে তার বসাই!                     মুণ্ডুটা তার খসাই! গোস্বাতে আর পাইনে ভেবে কি যে করি দশাই![হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্! রাইট্! লেফ্‌ট্!] [ঢালু পার্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া সন্তর্পণে নামিল।]                  আহা কচি ভাইরা আমার রে!       এমন কাঁচা জানগুলো খান্‌ খান্‌ করেছে কোন্‌ সে চামার রে?                     আহা কচি ভাইরা আমার রে! ![সাম্‌নে উপত্যকা। হাবিলদার মেজর :– লেফ্‌ট্ ফর্ম! সৈন্য- বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার মেজর :-ফর্‌ওয়ার্ড ! লেফ্‌ট্ ! রাইট্ ! লেফ্‌ট্ !]                     আস্‌মানের ঐ আঙরাখা                      খুন-খারাবির রঙ মাখা                      কি খুবসুরৎ বাঃ রে বা !                      জোর বাজা ভাই কাহারবা!                হোক্ না ভাই এ কারবালা ময়দান–                আমরা যে গাই সাচ্চারই জয়-গান !                          হোক্ না এ তোর কার্‌বালা ময়দান ! !                                       হুর্‌রো হো !                                       হুর্‌রো–[সাম্‌নে উপত্যকা– হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে। হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিতে লাগিল। হুকুম দিয়া গেল– 'মার্ক্ টাইম্।' সৈন্যরা এক স্থানেই দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল–]                  দ্রাম্‌! দ্রাম্‍! দ্রাম!                   লেফ্‌ট্! রাইট! লেফ্‌ট!                   দ্রাম্‌! দ্রাম্! দ্রাম্! আস্‌মানে ঐ ভাস্‌মান যে মস্ত দুটো রঙের তাল, একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,–            বুঝ্‌লে ভাই! ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের!           দেখ্‌তে নারে কারুর ভালো, তাইতে কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের।                  হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!            গৃধ্নু ওরা, লুব্ধ ওদের লক্ষ্য অসুর বল–                  হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!                  জালিম ওরা অত্যাচারী!            সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই!                  জালিম ওরা অত্যাচারী!                  সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই–                  জোর অপমান করলে ওরাই,            তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল!–                      ওরা    হিংস্র পশুর দল!                      ওরা    হিংস্র পশুর দল!![হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল-ফর্‌ওয়ার্ড! লেফ্‌ট্ হুইল্–            সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল-লেফ্‌ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্!]      সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হলো মরে।       তোদের মতন পিঠ ফেরেনি প্রাণটা হাতে করে,–               ওরা     শহীদ হলো মরে!               পিট্‌নি খেয়ে পিঠ যে তোদের ঢিট হয়েছে! কেমন!               পৃষ্ঠে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন!                     মুর্দারা সব যুদ্ধে আসিস্‌! যা যা! খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টক্‌টকে লাল কেমন গরম তাজা!                                   মুর্দারা সব যা যা!![বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল]                ত্রঁরাই বলেন হবেন রাজা!                 আরে যা যা! উচিত সাজা       তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই!              [হাবিলদার মেজর;- সাবাস সিপাই!]                 এই তো চাই! এই তো চাই! থাক্‌লে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই!                                     এই তো চাই!![কতকগুলি লোক অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল।          তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল।]                     মার্ দিয়া ভাই মার্ দিয়া!                      দুশ্‌মন্ সব হার্ গিয়া!                                কিল্লা ফতে হো দিয়া।       পর্‌ওয়া নেহি, যা নে দো ভাই যো গিয়া!                     কিল্লা ফতে হো গিয়া!                                 হুর্‌রো হো!                                 হুর্‌রো হো![হাবিলদার-মেজর;-সাবাস জোয়ান! লেফ্‌ট্! রাইট্!]      জোর্‌সে চলো পা মিলিয়ে,                       গা হিলিয়ে,              এম্‌নি করে হাত দুলিয়ে!       দাদ্‌রা তালে 'এক দুই তিন' পা মিলিয়ে                 ঢেউএর মত যাই! আজ   স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্‌তও না চাই!       আর          বেহেশ্‌তও না চাই!![হাবিলদার-মেজর:- সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]      ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,       অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল তাই!                      কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !         হো হো    কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই ! ![সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূর মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল।]      ঐ শুনেছিস্‌? ঝর্‌কাতে সব বল্‌ছে ডেকে বৌ-দলে,          'কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?' চিনিস্‌নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!– কামাল এ যে কামাল!          পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!          তা না হলে কার হবে আর রৌশন্ এমন জামাল?                             কামাল এ যে কামাল!! উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ি সব সামাল!                            ঘর-বাড়ি সব সামাল!!                আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ টুটেছে,                      ডগ্‌মগিয়ে জোশ উঠেছে!                             সাম্‌নে থেকে পালাও! শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্‌ ঘরে দীপ জ্বালাও!                            সাম্‌নে থেকে পালাও!                            যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!![হাবিলদার-মেজর:- লেফ্‌ট্ ফর্ম্! লেফ্‌ট্! রাইট! লেফ্‌ট্!-ফরওয়ার্ড্!][বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া চলিতেছে।]    ইস্! দেখেছিস! ঐ কারা ভাই সাম্‌লে চলেন পা, ফস্‌কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!                    ও তাই শিউরে ওঠে গা!                                  হাঃ হাঃ হাঃ!              মরল যে সে মরেই গেছে,                     বাঁচ্‌ল যারা রইল বেঁচে!       এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি তার আঁ?       মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ!                   হাঃ হাঃ হাঃ![সম্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু। হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল-'ফর্ম্ ইন্‌টু সিঙ্গল্‌ লাইন'। এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে 'স্লো মার্চ' করিয়া পার হইতে লাগিল।]                                সত্যি কিন্তু ভাই!       যখন মোদের বক্ষে-বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই–       কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!       কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কল্‌জেখানা পেষে! নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে তখন ডুক্‌রে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!               কে যেন ভাই কল্‌জেখানা পেষে!!       ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!       বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,                     যতই বলি বাহা!            লক্ষ্মীমণি ভাইটি আমার, আহা!!            ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পরের ভাইটি আমার, আহা!! অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা!       ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা!                  মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!       আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!                                হতভাগা রে!       মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে                 না জানি কোন্ ফুট্‌তে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়! তরুণ জীবন এম্‌নি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!       অরুণ খুনের তরুণ শহীদ! হতভাগ্য রে!       মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে! তাই যত আজ লিখ্‌নে-ওয়ালা তোদের মরণ ফুর্তি-সে জোর লেখে!       এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে‍!       মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!                                  খবর বেরোয় দৈনিকে, আর   একটি কথায় দুঃখ জানান, 'জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে!'              আঁখির পাতা ভিজল কি না কোনো কালো চোখের,       জান্‌ল না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!       পচে মরিস পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে 'বাহা'! সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!–       আয় ভাই তোর বৌ এল ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত-চেলি পরে, আঁধার-শাড়ি পরবে এখন পশ্‌বে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!–       ভাবতে নারি, গোরের মাটি করবে মাটি এ মুখ কেমন করে–               সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!       বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো! অনাদরের ভাইটি আমার! মাটির মায়ের কোলে এবার ঘুমো!! [নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।]                         ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি!       চোস্ত কথা! আয় দেখি–তোর হস্ত চুমি!       মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের? আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কল্‌সি বিষের!       কে মরেছে? কান্না কিসের?          বেশ করেছে! দেশ বাঁচাতে আপ্‌নারি জান শেষ করেছে!      বেশ করেছে!!      শহীদ ওরাই শহীদ! বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত!      শহীদ ওরাই শহীদ!![এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল। মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্যসামন্ত ও সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে আত্মহারা হইয়া 'ডবল মার্চ' করিতে লাগিল]             হুর্‌রো হো!                  হু‌র্‌রো হো!! ভাই-বেরাদর পালাও এখন! দূর্ রহো! দূর্ রহো!!            হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো![কামাল পাশাকে কোলে করিয়া নাচিতে লাগিল]    হৌ হৌ হৌ! কামাল জিতা রও!             কামাল জিতা রও!     ও কে আসে? আনোয়ার ভাই?–     আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ!!     জোর নাচো ভাই! হর্দম্ দাও লাফ!             আজ জানোয়ার সব সাফ!     হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো!! সব-কুছ আব্ দূর্ রহো! – হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো!! রণ জিতে জোর মন মেতেছে!-সালাম সবায় সালাম!–                               নাচ্‌না থামা রে! জখ্‌মি ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে!                নাচ্‌না থামা রে!–            [আহতদেরে নামাইতে নামাইতে]     কে ভাই? হাঁ হাঁ, সালাম! –ঐ শোন্‌ শোন্‌ সিপাহ্‌-সালার কামাল ভাই-এর কামাল।              [সেনাপতির অর্ডার আসিল]  'সাবাস! থামো! হো! হো!    সাবাস! হল্ট্! এক! দো!'[এক নিমিষে সমস্ত কল-রোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখনো কি তারায় তারায় যেন ঐ বিজয় গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণ হইয়া মিলিয়া গেল–]    ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই!     অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!               কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই।     হো হো,     কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!! কার বাঁশি বাজিল? কার বাঁশি বাজিল      নদীপারে আজি লো? নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল –                কার বাঁশি বাজিল?      বনে বনে দূরে দূরে      ছল করে সুরে সুরে      এত করে ঝুরে ঝুরে                কে আমায় যাচিল? পুলকে এ-তনুমন ঘন ঘন নাচিল। ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?    কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো! না-কওয়া কী কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!      মম নারী-হিয়া মাঝে      কেন এত ব্যথা বাজে?      কেন ফিরে এনু লাজে                নাহি দিয়ে যা ছিল? যাচা-প্রাণ নিয়ে আমি কেমনে সে বাঁচি লো? কেঁদে কেঁদে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) কারার ঐ লৌহকপাট কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী। ওরে ও তরুণ ঈশান, বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।গাজনের বাজনা বাজা, কে মালিক, কে সে রাজা, কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে? হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি, সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!ওরে ও পাগলা ভোলা, দে রে দে প্রলয় দোলা, গারদগুলা জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে মার হাঁক হায়দারী হাঁক, কাধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।নাচে ওই কালবোশাখী, কাটাবী কাল বসে কি দেরে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি লাথি মার ভাঙ্গরে তালা, যত সব বন্দী শালায়-আগুন-জ্বালা, আগুন-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।। কুলি মজুর দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!           চোখ ফেটে এল জল, এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে। বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌? রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে, রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে, বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা। তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!          আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ! হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়, তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান, তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান! তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে, অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে! সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে! তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’, সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি! আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন, লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ! আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও, রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও! আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল, মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল! সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই  ঘরে, মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে। সকল কালের  সকল দেশের সকল মানুষ আসি’ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।           একজনে দিলে ব্যথা- সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।           একের  অসম্মান নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান! মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান, উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান! কুহেলিকা তোমরা আমায় দেখ্‌তে কি পাও আমার গানের নদী-পারে? নিত্য কথায় কুহেলিকায় আড়াল করি আপনারে। সবাই যখন মত্ত হেথায় পান ক’রে মোর সুরের সুরা সব-চেয়ে মোর আপন যে জন স-ই কাঁদে গো তৃষ্ণাতুরা। আমার বাদল-মেঘের জলে ভর্‌ল নদী সপ্ত পাথার, ফটিক-জলের কণ্ঠে কাঁদে তৃপ্তি-হারা সেই হাহাকার! হায় রে, চাঁদের জ্যোৎস্না-ধারায় তন্দ্রাহারা বিশ্ব-নিখিল, কলঙ্ক তার নেয় না গো কেউ, রইল জু’ড়ে চাঁদেরি দিল! কৃষকের ঈদ বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে, লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গরস্থানে। হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত- কংকাল কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল? রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু- সলিলে হায়, বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়। থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে, তীর খাওয়া বুক, ঋণে- বাঁধা- শির, লুটাতে খোদার রাহে।জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু- পাঁজরের হাড়? আসমান- জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে। এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর পুটে। কৃষকের ঈদ!ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার, যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার। মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু- বন্যা আসে এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা- মসজিদে আশেপাশে।কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে? চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা, এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা? নিঙ্গাড়ি’ কোরান হাদিস ও ফেকাহ, এই মৃতদের মুখে অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে। নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি, হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি? ফল বহিয়াছ, পাওনিক রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি, লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।আল্লা- তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান? শক্তি পেলো না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান। ঈমান! ঈমান! বল রাতদিন, ঈমান কি এত সোজা? ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পুর্ণ যার ঈমান, শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আসমান। আল্লাহর নাম লইয়াছ শুধু, বোঝনিক আল্লারে। নিজে যে অন্ধ সে কি অন্যরে আলোকে লইতে পারে? নিজে যে স্বাধীন হইলনা সে স্বাধীনতা দেবে কাকে? মধু দেবে সে কি মানুষে, যাহার মধু নাই মৌচাকে?কোথা সে শক্তি- সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার আবে- জমজম শক্তি- উৎস বাহিরায় অনিবার? আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তি-হীন হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন। দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ? ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি, ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি। সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে? রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে। কেন আপনারে হানি হেলা? বন্ধুরা কহে, ‘হায় কবি, খেল এ কী নিষ্ঠুর খেলা, কোন অকারণ অভিমানে আপনারে হান অবহেলা?’ হাসিয়া কহিনু – ‘হয়েছে কী?’ বন্ধুরা কহে – ‘চুলোর ছাই! আপন সৃষ্টি করিছ নাশ, সেদিকে তোমার দৃষ্টি নাই?’ আমি কহিলাম – ‘জানি না তো সৃষ্টি করেছি কিছু আমি, আমি শুধু জানি, নদীর প্রায় ছুটিয়া চলেছি দিবাযামী! সাগরের তৃষা লয়ে নদী কেবল সুমুখে ছুটিয়া যায়, পথে পথে যেতে ঢেউ তাহার কত কথা বলে, কত কী গায়!’অকারণ কথাগুলিরে তার যদি কেহ বলে, ‘চমৎকার মধুচ্ছন্দা কাব্যশ্লোক, বাজে তরঙ্গে সুরবাহার!’ কেউ বলে, ‘পাগলের প্রলাপ, কোনো মানে নাই ওর কথার, এ নয় গোলাপ, লিশি-কলাপ, এ শুধু প্রকাশ মূর্খতার!’ শোনে না স্তুতি, নিন্দাবাদ-উন্মাদ বেগে প্রবল ঢেউ আগে ছুটে চলে, কী গান গায় কী কথা কয় সে, বোঝে না কেউ। জন্ম-শিখর হইতে মোর কোন সে অসীম মহাসাগর টানিয়া আনিল, দিল সে ডাক, তারই পানে ছুটি ছাড়িয়া ঘর!বন্ধু গো, সুর-স্রষ্টা নই, কবি নই, আমি সাগরজল, কভু মেঘ হয়ে ঝরে পড়ি, কভু নদী হয়ে বহি কেবল। মৌন উদার হিমালয়ে কভু জমে হই হিম-তুষার, সহসা সে ধ্যান ভাঙে আমার গাঢ় চুম্বনে রাঙা উষার! কেন সারা রাত জেগে কাঁদি, দিনে কাজ করি, হেসে বেড়াই, আমিই জানি না! জানি না কী লিখেছি ; কী সুরে কী গান গাই! পাগলের মতো বকি প্রলাপ, কেন যে ভিক্ষা চাই আমি, হয়তো জানে পরমোন্মাদ পরম-ভিক্ষু মোর স্বামী। কেউ বলে, আমি নদীর ঢেউ দু-কূলে ফুটাই ফুল-ফসল, কেউ বলে, আমি কূল ভাঙি ধ্বংস-বিলাসী বন্যা-জল।যার যাহা সাধ যায়, আমি মোর পথে তেমনই ধাই, ওরা কূলে বসে আমারে কয়, ‘কার সাথে কহ কী কথা ছাই?’ বুঝিতে পারি না, কেন আসি, তোমারে কেন যে ভালোবাসি, মনে হয়, বিনা প্রয়োজনের তব এ কান্না, তব হাসি। আমি কহি, ‘প্রিয় সাথিরা মোর, ছিনু রংবেজ আশমানে, যে তুলি আঁকিত রামধনু, বাশিঁ বাজিতে যে-গুলিস্তানে, সে বাঁশি সে তুলি কোন সে চোর লয়ে গেছে চুরি করিয়া, হায়! আমার মনের ছন্দিতা আর সে নূপুর পরে না পায়।’রস-প্রমত্ত অশান্ত চলিতেছিলাম রাজপথে, সম্মুখে এল ভিখারিনি মৃত ছেলে-কোলে কোথা হতে। কহিল, ‘বিলাসী! পুত্র মোর, দুধ পায় নাই এক ঝিনুক, শুকায়ে গিয়াছে অন্নহীন দেখো দেখো এই মায়ের বুক! মাতৃস্তন্য পায়নি সে, দিয়াছে মৃত্যুস্তন্য তায়, কাফন কেনার পয়সা নাই, কী পরায়ে গোরে দিব বাছায়?’ সাত আশমান যেন হঠাৎ দুলিতে লাগিল ঘোর বেগে, ঝরিতে লাগিল গ্রহ-তারা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে! কহিলাম – ‘মা গো, আমি কবি, দেশে ফিরি নাকি রস ঢেলে, সে রসের কিছু পাওনি কি তুমি আর তব মৃত ছেলে?’কহে ভিখারিনি আঁখিজলে, ‘রস পান? সে তো বিলাসীদের! তেল মাখ তুমি তেলা মাথায়, হায়, কেহ নাই ভিক্ষুকের!’ মরা খোকা নিয়ে ভিখারিনি চলে গেল কোন পথে সুদূর, জ্ঞান হলে আমি চেয়ে দেখি,- বুকে জাগে গোর মরা শিশুর! – ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বিলাসের বেণু, রাঙা গেলাস, পাঁশের স্তূপের পাশে পড়ে আতরদানি ও গোলাবপাশ! যেতে যেতে দেখি, মোটরকার ধাক্কা মারিয়া অন্ধে হায় ছুটে চলে গেল চার চাকায়, চার-পায়া চড়ে অন্ধ যায়!বন্ধু, বিলাস-সৃষ্টি এই আমার কবিতা, আমার গান অন্ধেরে আলো দিত যদি, অপঘাতে তার যেত না প্রাণ! যেতে যেতে হেরি বস্তিতে শুয়ে আছে কারা ভাঙা কাচে? গুদাম ঘরের বস্তা, এই বস্তির চেয়ে সুখে আছে! রূপ দেখিয়াছি কল্পনায় এঁকেছি স্বপ্ন-গুলবাহার, দেখিনি শ্রীহীন এই মানুষ জীর্ণ হাড্ডি-চামড়া সার! নগ্ন ক্ষুধিত ছেলেমেয়ে কাঁদায় কাঁদিয়া মায়ের প্রাণ, শুনিলাম আমি এই প্রথম শিশুর কাঁদনে আল-কোরান!মোর বাণী ছিল রসলোকের আল্লার বাণী শুনিনু এই, বিলাশের নেশা গেল টুটে, জেগে দেখি আর সে আমি নেই! গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরে দেখিয়াছি পায়ে-দলা কাদামাখা কুসুম, বক্ষে লইয়া কাঁদিছে মা, চক্ষে পিতার নাহিকো ঘুম! শিয়রের দীপে তৈল নাই, পীড়িত বালক কাঁদিয়া কয়, ‘দেখিতে পাই না মা তোর মুখ, বাবা কোথা, বড়ো লাগিছে ভয়!’ মাঠের ফসল, কাজলা মেঘ স্বপ্নে দেখিছে ঘুমায়ে বাপ, মরো মরো পুত্রেরে বাঁচায় মা-র মমতার উষ্ণ তাপ! জমিদার-মহাজনপাড়ায় মেয়ের বিয়ের বাজে সানাই, ইহাদের ঘরে বার্লি নাই, ওদের গোয়ালে দুধাল গাই।আগুন লাগুক রসলোকে, কত দূরে সেথা কারা থাকে? অভিশাপ দিনু – নামিবে সব এই দুখে শোকে, এই পাঁকে! প্রায়শ্চিত্ত করি আমি–বন্ধু, আমারে কোরো ক্ষমা! বহু ভোগ বহু বিলাস পাপ, প্রভুজি জানেন, আছে জমা! এই ক্ষুধিত ও ভিক্ষুকের আজীবন পদসেবা করি প্রায়শ্চিত্ত মোর ভোগের পূর্ণ করিয়া যেন মরি! ওরা যদি আত্মীয় নহে কেন এ আত্মা কাঁদে আমার? উহাদের তরে কেন এমন বুকে ওঠে রোদনের জোয়ার? মুক্তি চাহি না, চাহি না যশ, ভিক্ষার ঝুলি চাহি আমি, এদেরই লাগিয়া মাগিব ভিখ দ্বারে দ্বারে কেঁদে দিবাযামী!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া।এ ভরা ভাদরে আমারি মরা নদী উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি আমার এ ভাঙ্গা ঘাটে আমার এ হূদি তটে চাপিতে গেলে ওঠে দুকুল ছাপিয়া।নিষেধ নাহি মানে আমার এ পোড়া আঁখি জল লুকাব কত কাজল মাখি মাখি ছলনা করে হাসি অমনি জলে ভাসি ছলিতে গিয়া আসি ভয়েতে কাঁপিয়া।। কোথা সে পূর্ণযোগী কোথা সে পূর্ণ সিদ্ধ ও যোগী, দেখেছ কি কেউ তাঁরে, দনুজ-দলনী শক্তিরে পুন ভারতে জাগাতে পারে? কোথা সে শ্রীরাম, বশিষ্ঠ, কোথা তাপস কাত্যায়ন, যাঁর সাধনায় হইবে কাত্যায়নীর অবতরণ! ভারত জুড়িয়া শুধু সন্ন্যাসী সাধু ও গুরুর ভিড়, তবু এ ভারত হইয়াছে কেন ক্লীব মানুষের নীড়? ‘প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী, নাহি বিশ্বম্‌’ বলি কেউ আবার আনিতে পারে কি ভারতে মহাশক্তির ঢেউ? পাতাল ফুঁড়িয়া দানব দৈত্য উঠিয়াছে পৃথিবীতে, এল না তো কেউ শক্তি-সিদ্ধ তাদের সংহারিতে! কোথা সেই মহাতান্ত্রিক, কোথা চিন্ময়ী মহাকালী? মন্দিরে মন্দিরে মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা খালি! শক্তিরে খুঁজি পটুয়ার পটে, মাটির মুরতি মাঝে চিন্ময়ী শ্রীচণ্ডিকা তাই প্রকাশ হল না লাজে। কোন দুর্গারে পূজিয়া শ্রীরাম হরিলেন দুর্গতি? সেই শ্রীদুর্গা কোথা আজ, কেউ দেখেছ তাঁহার জ্যোতি? শুম্ভ নিশুম্ভেরে যে মারিল, সে চণ্ডী কি গেছে মরে? কুম্ভমেলায় শুধায়েছ কেউ সাধুদের জটা ধরে? জটা তাহাদের কটা হয়ে গেল, কটাহ হইল চোখ, আনিতে পারিল তবু কি তাহারা একটি ফোঁটা আলোক? পরিশ্রমের ভয়ে আশ্রমে আশ্রমে ছেলেমেয়ে আশ্রয় লয়ে বাঁচিয়াছে! মেদ বাড়িতেছে খেয়ে দেয়ে! মহাপ্রভুর নাম রাখিয়াছে ভিক্ষুক নেড়া নেড়ি, এরা কি ভাঙিবে অসুরের কারা, পায়ের শিকল বেড়ি? ধর্মের নামে এই অধর্ম, তাই তো ধর্মরাজ অভিশাপ দেন দারিদ্র্যব্যাধি দুর্গতিরূপে আজ। গঙ্গায় নেয়ে তীর্থে গিয়ে কে শক্তি লভিয়া আসে? মাংসের স্তূপ বেড়ে বেড়ে শুধু যায় মৃত্যুর গ্রাসে। কে ঘুচাবে এই লজ্জা ও ঘৃণা, কোথা সে যুগাবতার? জগন্নাথের রথ দেখিব না, পথ চেয়ে আছি তাঁর।  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) কোরবানী ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্-বোধন!   দুর্ব্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খাম্ খা ক্ষুব্ধ মন!                 ধ্বনি ওঠে রণি’ দূর বাণীর,--                 আজিকার এ খুন কোর্ বানীর!                 দুম্বা-শির           রুম্-বাসীর    শহীদের শির-সেরা আজি!--  রহ্ মান কি রুদ্র নন?                 ব্যস্!   চুপ খামোশ রোদন! আজ  শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে, শির দে বত্স”  শোন্! ওরে  হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির  উদ্ধোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ধোধন!                 খঞ্জরে মারো গর্দ্দানেই,                 পঞ্জরে আজি দরদ্ নেই,                 মর্দ্দানীই             পর্দ্দা নেই,         ডরতা নেই আজ খুন-খারাবীতে রক্ত-লুব্ধ মন!                 খুনে          খেল্ বো খুন-মাতন! দুনো        উনমাদনাতে সত্য মুক্তি আন্ তে যুঝবো রণ! ওরে        হত্যা নয়  আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!ওরে         হত্যা  নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!                 চ’ড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার                 মুস্ লিমে সারা দুনিয়াটার!                 ‘জুল্ ফেকার’     খুল্ বে তার         দু’ধারী ধার শেরে-খোদার,  রক্তে-পূত-বদন!                 খুনে        আজকে রুধ্ বো মন! ওরে        শক্তি-হস্তে    মুক্তি , শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্! ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!                 আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,                 ‘আজাদী’ মেলে না পস্তানো’য়!                 দস্তা নয়                সে সস্তা নয়!          হত্যা নয় কি মৃত্যুও ?          তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্                 কাঁদে--     শক্তি-দুস্ত শোন্-- “এয়্        ইবরাহীম আজ  কোরবানী  কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন!” ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ভোধন!                 এ তো নহে লোহু তরবারের                 ঘাতক জালিম জোর্ বারের!                 কোরবানের  জোর-জানের         খুন এ যে, এতে গোর্দ্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!                 এতে মা রাখে পুত্র পণ! তাই        জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন! ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!                 এই দিন-ই ‘মীনা’- ময়দানে’                 পুত্র-স্নেহের গর্দ্দানে                 ছুরি হেনে’ খুন ক্ষরিয়ে নে’         রেখেছে আব্বা ইব্ রাহীম্ সে আপনা রুদ্র পণ!                 ছি ছি!  কেঁপো না  ক্ষুদ্র মন আজ        জল্লাদ নয়,  প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন ! ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন! দ্যাখ        কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্ মানে!                 মন-খুনী কি  রে রাশ মানে?                 ত্রাসে-প্রাণে -- তবে রাস্তা নে! প্রলয়-বিষাণ ‘কিয়ামতে’  তবে বাজাবে কোন্ বোধন?                 সে কি                    সৃষ্টি-সংশোধন? ওরে         তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!-- ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!                 মুসলিম-রণ-ডঙ্কা সে,                 খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?                 টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে, ওরে        হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম-কারা, ল’ড়বো রণ-মরণ!                 ঢালে বাজ্ বে ঝন্-ঝনন্! ওরে        সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন! ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’   শক্তির উদ্বোধন!                 জোর চাই, আর যাচ্ না নয়,                 কোরবানী-দিন আজ না ওই?                 বাজ্ না কই ?   সাজ্ না কই?         কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?                 বল্-- “যুঝ্ বো জান্ ভি পণ!” ঐ          খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ, আজ       আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন! ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!উৎস: অগ্নিবীণা খাঁদু- দাদু ও মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং? খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা- নাক ড্যাঙ্গা-ড্যাং- ড্যাং!ওঁর নাকতাকে কে করল খ্যাঁদ্যা রাঁদা বুলিয়ে? চামচিকে- ছা ব'সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে। বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং। অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।ওঁর খ্যাঁদা নাকের ছ্যাঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় 'টু'! ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এ রাম! ওয়াক! থুঃ! কাছিম যেন উপুড় হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং! অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দাদু বুঝি চিনাম্যান মা, নাম বুঝি চাং চু, তাই বুঝি ওঁর মুখটা অমন চ্যাপটা সুধাংশু। জাপান দেশের নোটীশ উনি নাকে এঁটেছেন! অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়- নাক ঘুম দিলে ঐ চ্যাপটা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ। দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন! অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।লম্ফানন্দে লাফ দিয়ে মা চলতে বেঁজির ছা দাড়ির জালে প'ড়ে দাদুর আটকে গেছে গা, বিল্লি- বাচ্চা দিল্লি যেতে নাসিক এসেছেন! অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দিদিমা কি দাদুর নাকে টাঙাতে 'আলমানাক' গজাল ঠুঁকে দেছেন ভেঙ্গে বাঁকা নাকের কাঁখ? মুচি এসে দাদুর আমার নাক করেছেন 'ট্যান'! অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।বাঁশির মতন নাসিকা মা মেলে নাসিকে, সেথায় নিয়ে চল দাদু দেখন -হাসিকে! সেথায় গিয়ে করুন দাদু গরুড় দেবের ধ্যান, খাঁদু দাদু নাকু হবেন, নাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং। খালেদ খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি? কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি। মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি! বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’, তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু! খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা, তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা। ‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে, দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে। ‘খালেদ! খালেদ!’পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে, “বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!” ‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে, ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে। ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে, তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে। খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!* * *বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি, দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী! খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম? মাজার ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!– শহিদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত! খালেদের জান কব‍্‍জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত? বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত, জালিম৯ পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত‍্‍ল-গাহেতে তারই! উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা, কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি? কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব‍্‍জ করেনি জান? মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!– মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব, শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল, – এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার, খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার! কব‍্‍জা তাহার সব‍্‍জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে, দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দ‍জ‍্‍লা ফোরাত পড়িছে গলে! বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ, আলবোরজের‍ চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ। নেজার৪ ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে, তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে। দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে, ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে! ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে! রোম-সম্রাট শারাবের জাম -হাতে থরথর কাঁপে, ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে! মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা, খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।” আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে, ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে! মালেকুল-মৌত করিবে কব‍্‍জ রু্হ্ সেই খালেদের?– হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম, ওই শোনো শোনো –”আস‍্‍সালাতু খায়র মিনান্নৌম!” যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী! আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি! আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে, সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে! খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহরকাটানু কেঁদে, আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ‍্‍রিমা বেঁধে! এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে, মগ‍্‍রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে! খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু, সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু! তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা, মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা! হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে, মগ‍্‍রেব-বাদে এশার১ নামাজ পাব কিনা কে সে জানে! খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে, হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ‍্‍রিমা বেঁধে এসে!ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজি মহাবীর, দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির! চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের, আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের! খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে – আমরা জানি, – তোমার হাতের বে-দেরেগ৩ তেগ অবহেলে দিত আনি!উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, – “সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান, আমার আদেশ – খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না, সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!” ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ, দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ! খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি সিপাহ-সালারের সকল জেওরখুলিয়া ফেলিলে তুমি। শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি! বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ, সত্যের তরে হইব শহিদ, এই জীবনের সাধ! উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?” মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে, কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে! সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, – “খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!” মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে, এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে! “খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায় বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়! তখ‍্‍তের পর তখ‍্‍ত যখন তোমার তেগের আগে ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, – ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী! পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের, আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু, তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু। পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ, আমামা অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ! দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি, নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি! খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি, ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি! রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!* * *খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি, হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি! সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই, –না, না, বসে বসে শুধু মুনাজাত৬করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু! দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি, সিজদা করিতে ‘বাবা গো’বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি! পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই, আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।” টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা, খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা! বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে! হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর৯ তখনও মেটেনি গোল, এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মতো! খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে? হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে? দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে! খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে। এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে! জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে! তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন! খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা! সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়, উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ‍্‍-ভয়! পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে পেরেশান৪ ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে! তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি। টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি। এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো, শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো! দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে, চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে। মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি, অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ অবিশ্বাসের ঠুলি! শামবাসী৭ ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ, তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ! খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম, জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম! খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার? তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার! জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে, হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে! খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু, জুলফিকার৩ সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু। তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব? হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব! খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা৪ বুড়ি, কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো, শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত! আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে, শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে! ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে, শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে! খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি! মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম? খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের, চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।কৃষ্ণনগর, ২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) খুকী ও কাঠবিড়ালি কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ? বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক, খাও একা পাও যেথায় যেটুক! বাতাবি-নেবু সকল্গুলো একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো! তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও? ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল? দেখনি তবে? রাঙাদা'কে ডাকবো? দেবে ঢিল! পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা! তাইতো তার নাকটি বোঁচা! হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস! একলাই খাও হাপুস হুপুস! পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে! হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!ইস। খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও! আমিও খবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও! কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি' হবে? বৌদি হবে? হুঁ, রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঁঃ!এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো? ফ্রকটা নেবে? জামা দু'টো? আর খেয়ো না পেয়ারা তবে, বাতাবি নেবুও ছাড়ুতে হবে! দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ-মা দেখে যাও!- কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও! খেয়া পারের তরণী খেয়া পার, বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার? প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে! ঝন্‌ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে! নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ! মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ! নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে, ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে।     মসাবৃতা ঘোরা ‘কিয়ামত’ রাত্রি, খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী! দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী, শিঙ্গার হুঙ্কারে থরথর যামিনী!    লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে– অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন!    পুণ্য-পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ, ধর্মেরি বর্মে সু-রক্ষিত দিল্ সাফ! নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও কাণ্ডারী আহ্‌মদ তরী ভরা পাথেয়।    আবুবকর উস্‌মান উমর আলি হায়দর দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর! কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা, দাঁড়ি-মুখে সারি-গান –লা-শরিক আল্লাহ!    শাফায়ত’-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল, ‘জান্নাত্’ হতে ফেলে হুরি রাশ্ রাশ্ ফুল। শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল দাত্রী, গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী। বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার, ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার।-------------------------------------     আহমদ– মোহাম্মদ (সা)। লা-শরিক আল্লাহ– ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কেহ উপাস্য নাই। শাফায়ত– পরিত্রাণ জান্নাত– স্বর্গ খোকার খুশি কী যে ছাই ধানাই-পানাই – সারাদিন বাজছে সানাই, এদিকে কারুর গা নাই              আজই না মামার বিয়ে! বিবাহ! বাস, কী মজা! সারাদিন মণ্ডা গজা গপাগপ খাও না সোজা              দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। তবু বর হচ্ছিনে ভাই, বরের কী মুশকিলটাই – সারাদিন উপোস মশাই              শুধু খাও হরিমটর! শোনো ভাই, মোদের যবে বিবাহ করতে হবে – ‘বিয়ে দাও’ বলব, ‘তবে              কিছুতেই হচ্ছিনে বর!’ সত্যি, কও না মামা, আমাদের অমনি জামা অমনি মাথায় ধামা              দেবে না বিয়ে দিয়ে? মামিমা আসলে এ ঘর মোদেরও করবে আদর? বাস, কী মজার খবর!              আমি রোজ করব বিয়ে॥(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) খোকার গপ্‌প বলা মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্‌প তুমি জানো?     কও তো দেখি বাপ!’ কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’ বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল – ‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’     মা সে হেসে তখন বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্‌প বলো খোকন!’ ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি,     হাঁ মা আমি জানি,     মায়ে পোয়ে থাকত তারা, ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা!     একদিন না রাজা – ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা!     রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক     বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!     রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে।     এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ! রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ! দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়!     বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়?     টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো,     পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে?     খিদের জ্বালায় ভোগো! ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা, নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা। এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে! দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –”     ‘হাঁরে পুঁটে!’ বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্। বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে। গপ্‌প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে?     দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে? কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়, যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’     চড় চাপড় আর কিলে, ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে! সেদিনকারের গপ্‌প বলার হয়ে গেল রফা, খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা!   (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) খোকার বুদ্ধি চুন করে মুখ প্রাচীর পরে বসে শ্রীযুত খোকা, কেননা তার মা বলেছেন সে এক নিরেট বোকা। ডানপিটে সে খোকা এখন মস্ত একটা বীর, হুংকারে তাঁর হাঁস মুরগির ছানার চক্ষুস্থির! সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনই পালোয়ান! দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ান! ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা, তাঁরে কিনা বোকা বলা? কী এর উচিত সাজা? ভাবতে ভাবতে খোকার হঠাৎ চিন্তা গেল থেমে, দে দৌড় চোঁ-চাঁ আঁধমহলে পাঁচিল হতে নেমে! বুকের ভেতর ছপাই নপাই ধুকপুকুনির চোটে, বাইরে কিন্তু চতুর খোকা ঘাবড়ালেন না মোটে। হাঁপিয়ে এসে মায়ের কাছে বললে, “ওগো মা! আমি নাকি বোক-চন্দর? বুদ্ধি দেখে যা! ওই না একটা মটকু বানর দিব্যি মাচায় বসে লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই তো সে। দিদিদেরও চোখ ছিল তো, কেউ কি দেখেছেন? তবে আমায় বোকা কও যে! এ্যাঁ-এ্যাঁ, হাস ক্যান্? কী কও? ‘একী বুদ্ধি হল?’ দেখবে তবে? হাঁ, বুদ্ধি আমার … ভোলা! তু-উ-উ! লৌ-হা হা-হা-হা!”  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) খোকার সাধ আমি হবো সকালবেলার পাখি সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি। সূয্যিমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে, ‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে। বলবো আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো, হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে নাকো? আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’ ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠবো পাহাড়চূড়ে, দেখবো নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে, ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়, বলবো আমি ‘ভোর হলো যে, সাগর ছুটে আয়! ঝরনা মাসি বলবে হাসি’, ‘খোকন এলি নাকি?’ বলবো আমি নইকো খোকন, ঘুমজাগানো পাখি!’ ফুলের বনে ফুল ফোটাবো, অন্ধকারে আলো, সূয্যিমামা বলবে উঠে, ‘খোকন, ছিলে ভালো?’ বলবো ‘মামা, কথা কওয়ার নাইকো সময় আর, তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙো ঘুমের দ্বার।’ রবির আগে চলবো আমি ঘুমভাঙা গান গেয়ে, জাগবে সাগর- পাহাড়-নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে! খোশ আমদেদ আসিলে    কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।    ও চরণ    ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥    দখিনের    হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি   শবে-রাত    আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥   তালিবান    ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।     উলসি    উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥ প্রাচীন ওই    বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু। ভাঙা ওই    দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥   এল কি    অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।   এল কি    আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥   সানাইয়াঁ    ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।   কারুণের    রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।   খুশির এ‍    বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।    লাল এ    লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥ বাসি ফুল    কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!    নবীনের    আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥পদ্মা ২৭.২.২৭ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায় ভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায় কে যেন আমারে ডাকে সে কি তুমি? সে কি তুমি? সে কি তুমি?কার স্মৃতি বুকে পাষানের মত ভার হয়ে যে থাকে সে কি তুমি, সে কি তুমি? কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন হায় ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায় কার সকরুন আঁখি দুটি যেন রাতের মত মুখপানে চেয়ে থাকে সে কি তুমি? সে কি তুমি?নিশির বাতাশ কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর ওগো দুরন্ত মম সে কি তুমি, সে কি তুমিমহাসাগরের ঢেউ এর মতন বুকে এসে বাজে কাহার রোদন পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি আমার চম্পা- শাঁখে সে কি তুমি? সে কি তুমি? গভীর রাতে জাগি গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে।জেগে যবে দেখি বঁধু তুমি নাই কাছে আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে বাণ-বেঁধা পাখী সম আহত এ প্রাণ মম লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে।মৌনা নিঝুম ধরা ঘুমায়েছে সবে এসো প্রিয় এই বেলা বক্ষে নীরবে।কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে কত আভিমান কত জ্বালা এই হূদে দেখে যাও এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল কত আশা মরে গেল হাহাকারে।। গান আমার বিফল পূজাঞ্জলি     অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে। তোমার আরাধিকার পূজা     হে বিরহী, লও হে এসে। খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন, পূজে তোমায় বিশ্বভুবন, আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন     মিটবে কি সাধ ভালোবেসে॥ না-দেখা মোর বন্ধু ওগো,     কোথায় বাঁশি বাজাও একা, প্রাণ বোঝে তা অনুভবে     নয়ন কেন পায় না দেখা!    সিন্ধু যেমন বিপুল টানে তটিনীরে টেনে আনে, তেমনি করে তোমার পানে     আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) গানের আড়াল তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান -- এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ? অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়, গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ? হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা, গানের বানী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা ? হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি' -- উপকূলে ব'সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে ? বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দু'ল হয়ে শুধু কানে ?                                        হায় ভেবে নাহি পাই -- যে - চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই । সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাদা কূলে কূলে নিশিদিন ? সুরেরে আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ ? আমার গানের মালার সুবাস ছুঁল না হৃদয়ে আসি' ? আমার বুকের বাণী হল শুধু তব কন্ঠের ফাঁসি?                                      বন্ধু গো যেয়ো ভুলে -- প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধায় রেখো না সে ফুল তুলে ! উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ -- প্রভাতেই তুমি জাগি' জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি' । যে কাঁটা লতায় ফুটেছে সে-ফুল রক্তে ফাটিয়া পড়ি' সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে শাখা ভরি' দেখ নাই তারে ! -- মিলন মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি, তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি !ভোল মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ে কেহ নয় ! জানায়ো আমারে যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-- কন্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি ! গুঞ্জ-মালা গলে গুঞ্জা-মালা গলে কুঞ্জে এস হে কালা বনমালী এস দুলাইয়া বনমালা।তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে দলিয়া যাবে চলি অরুণ-রাঙা পায়ে রচেছি আসন তরুর তমাল ছায়ে পলাশে শিমুলে রাঙা প্রদীপ জ্বালা।ময়ুরে নাচাও এসে তোমার নূপুর তালে বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল্‌ কদম ডালে তোমা বিনে বনমালী বিফল এ ফুল-দোল বাঁশী বাজিবে কবে উতলা ব্রজবালা।। গোঁড়ামি ধর্ম নয় শুধুগুণ্ডামি, ভণ্ডামি আর গোঁড়ামি ধর্ম নয়, এই গোঁড়াদের সর্বশাস্ত্রে শয়তানি চেলা কয়। এক সে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু, একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু। তবু অজ্ঞানে যদি শয়তানে শরিকি স্বত্ব আনে, তার বিচারক এক সে আল্লা –লিখিত আল-কোরানে। মানুষ তাহার বিচার করিতে পারে না, নরকে তারে অথবা স্বর্গে কোন মানুষের শক্তি পাঠাতে পারে? ‘উপদেশ শুধু দিবে অজ্ঞানে’ – আল্লার সে হুকুম, নিষেধ কোরানে – বিধর্মীপরে করিতে কোনো জুলুম। কেন পাপ করে, ভুল পথে যায় মানবজন্ম লয়ে, কেন আসে এই ধরাতে জন্ম-অন্ধ পঙ্গু হয়ে, কেন কেহ হয় চিরদরিদ্র, কেহ চিরধনী হয়, কেন কেউ অভিশপ্ত, কাহারও জীবন শান্তিময়? কোন শাস্ত্রী বা মৌলানা বলো, জেনেছে তাহার ভেদ? গাধার মতন বয়েছে ইহারা শাস্ত্র কোরান বেদ!জীবনে যে তাঁরে ডাকেনিকো, প্রভু ক্ষুধার অন্ন তার কখনো বন্ধ করেননি কেন, কে করে তার বিচার? তাঁর সৃষ্টির উদার আকাশ সকলেরে থাকে ঘিরে, তাঁর বায়ু মসজিদে মন্দিরে সকলের ঘরে ফিরে। তাঁহার চন্দ্র সূর্যের আলো করে না ধর্ম ভেদ, সর্বজাতির ঘরে আসে, কই আনে না তো বিচ্ছেদ! তাঁর মেঘবারি সব ধর্মীর মাঠে ঘাটে ঘরে ঝরে, তাঁহার অগ্নি জ্বলে, বায়ু বহে সকলেরে সেবা করে। তাঁর মৃত্তিকা ফল ফুল দেয় সর্বজাতির মাঠে, কে করে প্রচার বিদ্বেষ তবু তাঁর এ প্রেমের হাটে? কোনো ‘ওলি’ কোনো দরবেশ যোগী কোনো পয়গম্বর, অন্য ধর্মে, দেয়নিকো গালি, – কে রাখে তার খবর? যাহারা গুণ্ডা, ভণ্ড, তারাই ধর্মের আবরণে স্বার্থের লোভে খ্যাপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে। জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এরা আনি আপনার পেট ভরায়, তখ্‌ত চায় এরা শয়তানি। ধর্ম-আন্দোলনের ছদ্মবেশে এরা কুৎসিত, বলে এরা, হয়ে মন্ত্রী, করিবে স্বধর্মীদের হিত। এরা জমিদার মহাজন ধনী নওয়াবি খেতাব পায়, কারও কল্যাণ চাহে না ইহারা, নিজ কল্যাণ চায়। ধনসম্পদ এত ইহাদের, করেছে কি কভু দান? আশ্রয় দেয় গরিবে কি কভু এদের ঘর দালান? ধর্ম জাতির নাম লয়ে এরা বিষাক্ত করে দেশ, এরা বিষাক্ত সাপ, ইহাদেরে মেরে করো সব শেষ। নাই পরমত-সহিষ্ণুতা সে কভু নহে ধার্মিক, এরা রাক্ষস-গোষ্ঠী ভীষণ অসুর-দৈত্যাধিক। উৎপীড়ন যে করে, নাই তার কোনো ধর্ম ও জাতি, জ্যোতির্ময়েরে আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথি! মানবে মানবে আনে বিদ্বেষ, কলহ ও হানাহানি, ইহারা দানব, কেড়ে খায় সব মানবের দানাপানি। এই আক্ষেপ জেনো তাহাদের মৃত্যুর যন্ত্রণা, মরণের আগে হতেছে তাদের দুর্গতি লাঞ্ছনা। এক সে পরম বিচারক, তাঁর শরিক কেহই নাই, কাহারে শাস্তি দেন তিনি, দেখো দুদিন পরে তা ভাই! মোরা দরিদ্র কাঙাল নির্যাতিত ও সর্বহারা, মোদের ভ্রান্ত দ্বন্দ্বের পথে নিতে চায় আজ যারা আনে অশান্তি উৎপাত আর খোঁজে স্বার্থের দাঁও, কোরানে আল্লা এদেরই কন – ‘শাখা-মৃগ হয়ে যাও।’  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) গোকুল নাগ না ফুরাতে শরতের বিদায়-শেফালি,    না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,    তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান    ফুলে ফুলে হেমনে-র বিদায়-আহবান!    অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম    ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম    রাত্রিময়ী রহস্যের; ছিন্ন শতদল    হ’ল তব পথ-সাথী; হিমানী-সজল    ছায়াপথ-বিথী দিয়া শেফালি দলিয়া    এল তব মায়া বধূ ব্যথা-জাগানিয়া!    এল অশ্রু হেমনে-র,এল ফুল-খসা    শিশির-তিমির-রাত্রি; শ্রান- দীর্ঘশ্বাসা    ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু ছায়া-কুহেলির    অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি, বিরহ-অথির    বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন!    যে-কান্না এল না চোখে, মর্মে হ’ল লীন,    বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’ল রক্তে রাঙা    আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!    বন্ধু,  তব জীবনের কুমারী আশ্বিন    পরিল বিধবা বেশ করে কোন্‌ দিন,    কোন্‌ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার    ঝ’রে গেল বৃন-গুলি রাঙা কামনার-    জানি নাই; জানি নাই, তোমার জীবনে    হাসিছে বি”েছদ-রাত্রি, অজানা গহনে    এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী!    কোন্‌ বনান-র হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী    ডাক দিল, তুমি জান। মোরা শুধু জানি    তব পায়ে কেঁদেছিল সারা পথখানি!    সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া    তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি।      রহিয়া রহিয়া    কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,    মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই    এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,    এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা।       জানি না ক’ আজ তুমি কোন্‌ লোকে রহি’    শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী!    কোথা কোন্‌ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,    প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সুর্য, তারা,    পারায়ে চলেছ একা অসীম বিরহে?    তব পথ-সাথী যারা-পিছু ডাকি’ কহে,    ‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়!    তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও    আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি!’    শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারে ও-পারে?    এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে?    কতদূরে আছ তুমি কোথা কোন্‌ বেশে?    লোকান-রে, না সে এই হৃদয়েরি দেশে    পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা?    হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা?    হারায়নি এত সূর্য এত চন্দ্র তারা,    যেথা হোক আছ বন্ধু, হওনি ক’ হারা!       সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,    সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি    নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,    আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-    আদি নাই, অন- নাই, ক্লানি- তৃপ্তি নাই-    যত পাই তত চাই-আরো আরো চাই,-    সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান    সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-    সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,    সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!    আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে    শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!….    হে নবীন, অফুরন- তব প্রাণ-ধারা।    হয়ত এ মরু-পথে হয়নি ক’ হারা,    হয়ত আবার তুমি নব পরিচয়ে    দেবে ধরা; হবে ধন্য তব দান ল’য়ে    কথা-সরস্বতী! তাহা ল’য়ে ব্যথা নয়,    কত বাণী এল, গেল, কত হ’ল লয়,    আবার আসিবে কত। শুধু মনে হয়    তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময়!    আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী    আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি    পাতি’ কর লবে তাহা, তবু যেন হায়,    হৃদয়ের কোথা কোন্‌ ব্যথা থেকে যায়!    কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্দন    গুমরি’ গুমরি’ ফেরে, হু-হু করে মন!     বাণী তব- তব দান- সে তা সকলের,      ব্যথা সেথা নয় বন্ধু! যে ক্ষতি একের      সেথায় সান-্বনা কোথা? সেথা শানি- নাই,      মোরা হারায়েছি,- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই।…      কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ-শোক,      সে-লোকে বিরহে যারা তারা সুখী হোক!      তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,      তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা!   ‘ পথিকে’ দেখেছে তা’রা, দেখেনি ‘গোকুলে’,    ডুবেনি ক’-সুখী তা রা-আজো তা’রা কূলে!    আজো মোরা প্রাণা”ছন্ন, আমরা জানি না    গোকুল সে শিল্পী গল্পী কবি ছিল কি-না!    আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে    গোকুলে পড়েছে মনে-তাই অশ্রু ঝরে!     না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,      না ফুরাতে ধরণীর মৃৎ-পাত্র-সুধা,      না পূরিতে জীবনের সকল আস্বাদ-      মধ্যাহ্নে আসিল দূত! যত তৃষ্ণা সাধ      কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায়!      ছেড়ে যেতে যেন সব স্নায়ু ছিঁড়ে যায়!      ধরার নাড়ীতে পড়ে টান! তরুলতা      জল বায়ু মাটি সব কয় যেন কথা!      যেয়ো না ক’  যেয়ো না ক’ যেন সব বলে-      তাই এত আকর্ষণ এই জলে স’লে      অনুভব করেছিলে প্রকৃতি-দুলাল!      ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল বক্ষ, লালে লাল      হ’ল ছিন্ন প্রাণ! বন্ধু, সেই রক্ত ব্যথা      র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে হেথা!   হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,    মধ্যাহ্ন আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর    কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,    পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়    হয়ত মিটেছে তৃষ্ণা, হয়ত আবার    ক্ষুধাতুর!-স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার    অথবা হয়ত আজ হে ব্যথা-সাধক,    অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক!     হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয় আমার,      যেখানে যে লোকে থাক/ করিও স্বীকার      অশ্রু-রেবা-কূলে মোর স্মৃতি-তর্পণ,     তোমারে অঞ্জলি করি’ করিনু অর্পণ!  সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা   দারিদ্র্যে দর্প তেজ নিয়া এল যারা,   যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,   যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,   সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন   এ-সহজ আয়োজন এ-স্মরণ-দিন   স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার   ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার!    নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,     এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে,     ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,     নাই বড় আয়োজন,নাই কোলাহল;     আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,     তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!     গড়ে যারা, যারা করে  প্রাসাদ নির্মাণ     শিরোপা তাদের তরে, তাদের সম্মান।  দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়   কিন’ স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়   সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে মানুষ   অচেনা রহিল তা’রা। কথার ফানুস   ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,   তারা তত পাবে মালা যমের কস’রী!   ‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?   ইতিহাস আছে, আছে অবিষ্যৎ, যাহা   অনন- কালের তরে রচে সিংহাসন,   সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।   আজ তারা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-   পূজা নয়-আজ শুধু করিনু স্মরণ। গোপন প্রিয়া পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি, মধ্যে সাগরে, এ-পারে ও-পার করছি কানাকানি! আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্ছানি, আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁয়া খানি।নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয় ! আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয় ! এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে, আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়, কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয় !চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর । গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর । গান ফুরালো যাব যবে গানের কথাই মনে রবে, পাখী তখন থাকবে না ক’-থাকবে পাখীর ঘর, উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর !তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ, অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ। উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে একটি পালক প’ড়লে পথে, ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও ! ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও !বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী ? মনের মনে নিশীথ-রাতে চুমু দেবে কি কল্পনাতে ? স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি ! মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী !দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল ! কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল ! তোমায় পেলে থামত বাঁশী, আসত মরণ সর্বনাশী । পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছ আমার বুকের কোল। বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠছে বাঁশীর বোল ।বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও, দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও । থাকবে তুমি ছায়ার সাথে মায়ার মত চাঁদনী রাতে ! যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও ! শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও !ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর ! তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর । কোথায় আছ কেমনে রাণি কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি! ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর ! চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর !রাত্রে যখন একলা শোব-চাইবে তোমার বুক, নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ । দুখের সুরায় মস্ত্ হ’য়ে থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে, কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ ! ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ ।গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান। থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান ! শিল্পী আমি, আমি কবি, তুমি আমার আঁকা ছবি, আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান । চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান ।তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর, কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির । গোপন তুমি আসলে নেমে কাব্যে আমার, আমার প্রেমে, এই-সে সুখে থাকব বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর ? দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড় !বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান, মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান ! যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে, ভোলার মাঝে উঠবে বেজে, সেই তো আমার প্রাণ ! নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান ! ঘোষণা হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে                   নাই থাক হাতিয়ার! জমায়েত হও, আপনি আসিবে                   শক্তি জুলফিকার॥আনো   আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,        ওমরের মতো কর্মানুরাগ,        খালেদের মতো সব অসাম্য                ভেঙে করো একাকার॥    ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর            আশরাফ আতরাফ; এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে            করো মিসমার সাফ!       চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে        ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;        মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,        কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,        এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –               সহিবে না আজও আর॥(ঝড় কাব্যগ্রন্থ) চক্রবাক এপার ওপার জুড়িয়া অন্ধকার মধ্যে অকূল রহস্য-পারাবার, তারই এই কূলে নিশি নিশি কাঁদে জাগি চক্রবাক সে চক্রবাকীর লাগি। ভুলে যাওয়া কোন জন্মান্তর পারে কোন সুখ-দিনে এই সে নদীর ধারে পেয়েছিল তারে সারা দিবসের সাথি, তারপর এল বিরহের চির-রাতি, – আজিও তাহার বুকের ব্যথার কাছে, সেই সে স্মৃতি পালক পড়িয়া আছে!কেটে গেল দিন, রাত্রি কাটে না আর, দেখা নাহি যায় অতি দূর ওই পার। এপারে ওপারে জনম জনম বাধা, অকূলে চাহিয়া কাঁদিছে কূলের রাধা। এই বিরহের বিপুল শূন্য ভরি কাঁদিছে বাঁশরি সুরের ছলনা করি! আমরা শুনাই সেই বাঁশরির সুর, কাঁদি – সাথে কাঁদে নিখিল ব্যথা-বিধুর।কত তেরো নদী সাত সমুদ্র পার কোন লোকে কোন দেশে গ্রহ-তারকার সৃজন-দিনের প্রিয়া কাঁদে বন্দিনী, দশদিশি ঘিরি নিষেধের নিশীথিনী। এ পারে বৃথাই বিস্মরণের কূলে খোঁজে সাথি তার, কেবলই সে পথ ভুলে। কত পায় বুকে কত সে হারায় তবু – পায়নি যাহারে ভোলেনি তাহারে কভু।তাহারই লাগিয়া শত সুরে শত গানে কাব্যে, কথায়, চিত্রে, জড় পাষাণে, লিখিছে তাহার অমর অশ্রু-লেখা। নীরন্ধ্র মেঘ বাদলে ডাকিছে কেকা ! আমাদের পটে তাহারই প্রতিচ্ছবি, সে গান শুনাই – আমরা শিল্পী কবি। এই বেদনার নিশীথ-তমসা-তীরে বিরহী চক্রবাক খুঁজে খুঁজে ফিরে কোথা প্রভাতের সূর্যোদয়ের সাথে ডাকে সাথি তার মিলনের মোহানাতে। আমরা শিশির, আমাদের আঁখি-জলে সেই সে আশার রাঙা রামধনু ঝলে।   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) চমকে চমকে ধীর ভীরু পায় চম্‌কে চম্‌কে ধীর ভীরু পায় পল্লী-বালিকা বন-পথে যায় একেলা বন-পথে যায়।সাড়ি তার কাঁটা-লতায় জড়িয়ে জড়িয়ে যায় পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে যেন তার তনুর পরশ চায়। একেলা বনপথে যায়।শিরীষের পাতায় নূপুর বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর কুসুম ঝরিয়া মরিতে চাহে তার কবরীতে, পাখী গায় পাতার ঝরোকায়। একেলা বনপথে যায়।চাহি তার নীল নয়নে হরিণী লুকায় বনে, হাতে তার কাঁকন হতে মাধবী লতা কাঁদে ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়। একেলা বনপথে যায়।। চরকার গান ঘোর –       ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর ওই  স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর॥    ১         তোর  ঘোরার শব্দে ভাই           সদাই   শুনতে যেন পাই ওই   খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই। ঘুরে   আসল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর॥    ২        ঘর ঘর তুই ঘোর রে জোরে           ঘর্ঘরঘর ঘূর্ণিতে তোর                 ঘুচুক ঘুমের ঘোর           তুই    ঘোর ঘোর ঘোর। তোর  ঘুর-চাকাতে বল-দর্পীর তোপ কামানের টুটুক জোর॥    ৩           তুই   ভারত-বিধির দান,         এই  কাঙাল দেশের প্রাণ, আবার  ঘরের লক্ষ্মী আসবে ঘরে শুনে তোর ওই গান। আর  লুটতে নারবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি ক্রোড়॥   ৪         হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর,           তাদের মিলন-সূত্র-ডোর রে               রচলি চক্রে তোর,          তুই  ঘোর ঘোর ঘোর। আবার  তোর মহিমায় বুঝল দু-ভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়॥    ৫         ভারত  বস্ত্রহীন যখন           কেঁদে  ডাকল – নারায়ণ! তুমি  লজ্জা-হারী করলে এসে লজ্জা নিবারণ, তাই  দেশ-দ্রৌপদীর বস্ত্র হরতে পারল না দুঃশাসন-চোর॥    ৬        এই  সুদর্শন-চক্রে তোর     অত্যাচারীর টুটল জোর রে ছুটল সব গুমোর           তুই  ঘোর ঘোর ঘোর। তুই  জোর জুলুমের দশম গ্রহ, বিষ্ণু-চক্র ভীম কঠোর॥    ৭         হয়ে  অন্নবস্ত্রহীন           আর  ধর্মে কর্মে ক্ষীণ দেশ  ডুবছিল ঘোর পাপের ভারে যখন দিনকে দিন, তখন  আনলে অন্ন পুণ্য-সুধা, খুললে স্বর্গ মুক্তি-দোর॥    ৮         শাসতে জুলুম নাশতে জোর           খদ্দর-বাস বর্ম তোর রে অস্ত্র সত্যডোর,           তুই  ঘোর ঘোর ঘোর। মোরা    ঘুমিয়ে ছিলাম, জেগে দেখি চলছে চরকা, রাত্রি ভোর॥    ৯         তুই  সাত রাজারই ধন,           দেশ-  মা-র পরশ-রতন, তোর  স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম মোক্ষ ধন। তুই   মায়ের আশিস, মাথার মানিক, চোখ ছেপে বয় অশ্রু-লোর॥     (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) চল্ চল্ চল্ চল্ চল্ চল্ ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী-তল অরুণ প্রাতের তরুণ দল চল্ রে চল্ রে চল্ চল্ চল্ চল্।। ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত আমরা টুটিব তিমির রাত বাঁধার বিন্ধ্যা চল।। নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশশ্মান আমরা দানিব নতুন প্রাণ বাহুতে নবীন বল।। চলরে নওজোয়ান শোনরে পাতিয়া কান- মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে-দুয়ারে জীবনের আহ্বান ভাঙ্গরে ভাঙ্গ আগল চল্ রে চল্ রে চল্ চল্ চল্ চল্।। চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে ছোটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।হেরিছে রজনী রজনী জাগিয়া চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া কুমুদীরে কাঁদাইতে।না জানি সজনী কত সে রজনী কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া হেরেছে শশীরে সরসী মুকুরে ভীরু ছায়া তরু কাঁপিয়া।কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী চিরবিরহিণী রোহিণী ভরণী অবশ আকাশ বিবশা ধরণী কাঁদানীয়া চাঁদিনীতে।। চাঁদনী-রাতে কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে, হাবুডুবু খায় তারা-বুদবুদ, জোছনা সোনায় রাঙে! তৃতীয়া চাঁদের "সাম্পানে" চড়ি চলিছে আকাশ প্রিয়া, আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া। তৃতীয়া চাঁদের বাকি "তের কলা" আবছা কালোতে আঁকা নীলিম-প্রিয়ার নীলা "গুল রুখ" অব-গুণ্ঠনে ঢাকা। সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী, সেহেলি "লায়লী" দিয়ে গেছে চুপে কূহেলী-মশারী টানি! দিক-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি, নীহার-নেটের কুয়াশা মশারি –ওকি বর্ডার তারি? সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে! উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরী, লুকিয়ে দেখে তা "চোখ গেল" বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি! "মঙ্গল" তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্রহর জাগে, ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে- বুঝি বধূর নিশাস লাগে! উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী ‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি!সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে, হেথা হোথা ছোটে-পিকের কণ্ঠে ফিক ফিক ক’রে হাসে! আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি শিশিরের রূপে ঘর্ম-বিন্দু ঝ’রে ঝরে পড়ে সখি, নবমী চাঁদের ‘সসারে’ ও কে গো চাঁদিনী-শিরাজি ঢালি’ বধূর অধর ধরিয়া কহিছে- ‘তহুরা পিও লো আলি’! কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকী চাঁদের ‘সসারে’ কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি। ফরহাদ-শিরী-লায়লী-মজনু মগজে ক’রেছে চিড়, মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালার মীড়! আনমনা সাকী! অমনি আমারো হৃদয় পেয়ালা-কোণে কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখি লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে ।কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল চাঁদমুকুর চাঁদ হেরিতেছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে। ছুটে তরঙ্গ বাসনাভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে। হেরিছে রজনি রজনি জাগিয়া চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া, কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া কুমুদীরে কাঁদাইতে।না জানি সজনি কত সে রজনি কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া, হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়াতরু কাঁপিয়া। কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরনি চির-বিরহিণী রোহিণী ভরণী, অবশ আকাশ বিবশা ধরণি কাঁদানিয়া চাঁদনীতে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) চিঠি [ছন্দ :- “এই পথটা কা-টবো পাথর ফেলে মা-রবো”]ছোট্ট বোনটি লক্ষ্মী ভো ‘জটায়ু পক্ষী’! য়্যাব্বড়ো তিন ছত্র পেয়েছি তোর পত্র। দিইনি চিঠি আগে, তাইতে কি বোন রাগে? হচ্ছে যে তোর কষ্ট বুঝতেছি খুব পষ্ট। তাইতে সদ্য সদ্য লিখতেছি এই পদ্য। দেখলি কী তোর ভাগ্যি! থামবে এবার রাগ কি? এবার হতে দিব্যি এমনি করে লিখবি! বুঝলি কী রে দুষ্টু কী যে হলুম তুষ্টু পেয়ে তোর ওই পত্র – যদিও তিন ছত্র! যদিও তোর অক্ষর হাত পা যেন যক্ষর, পেটটা কারুর চিপসে, পিঠটে কারুর ঢিপসে, ঠ্যাংটা কারুর লম্বা, কেউ বা দেখতে রম্ভা! কেউ যেন ঠিক থাম্বা, কেউ বা ডাকেন হাম্বা! থুতনো কারুর উচ্চে, কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে! এক একটা যা বানান হাঁ করে কী জানান! কারুর গা ঠিক উচ্ছের, লিখলি এমনি গুচ্ছের! না বোন, লক্ষ্মী, বুঝছ? করব না আর কুচ্ছো! নইলে দিয়ে লম্ফ আনবি ভূমিকম্প! কে বলে যে তুচ্ছ! ওই যে আঙুর গুচ্ছ! শিখিয়ে দিল কোন্ ঝি নামটি যে তোর জন্টি? লিখবে এবার লক্ষ্মী নাম ‘জটায়ু পক্ষী!’ শিগগির আমি যাচ্চি, তুই বুলি আর আচ্ছি রাখবি শিখে সব গান নয় ঠেঙিয়ে – অজ্ঞান! এখনও কি আচ্ছু খাচ্ছে জ্বরে খাপচু? ভাঙেনি বউদির ঠ্যাংটা। রাখালু কি ন্যাংটা? বলিস তাকে, রাখালী! সুখে রাখুন মা কালী! বৌদিরে কোস দোত্তি ধরবে এবার সত্যি। গপাস করে গিলবে য়্যাব্বড়ো দাঁত হিলবে! মা মাসিমায় পেন্নাম এখান হতেই করলাম! স্নেহাশিস এক বস্তা, পাঠাই, তোরা লস তা! সাঙ্গ পদ্য সবিটা? ইতি। তোদের কবি-দা।   (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) চির-চেনা নামহারা ওই গাঙের পারে বনের কিনারে বেতস-বেণুর বনে কে ওই বাজায় বীণা রে। লতায়-পাতায় সুনীল রাগে সে-সুর সোহাগ-পুলক লাগে, সে সুর ঘুমায় দিগঙ্গনার শয়নলীনা রে। আমি কাঁদি, এ সুর আমার চিরচেনা রে।ফাগুন-মাঠে শিস দিয়ে যায় উদাসী তার সুর, শিউরে ওঠে আমের মুকুল ব্যথায় ভারাতুর। সে সুর কাঁপে উতল হাওয়ায়, কিশলয়ের কচি চাওয়ায়, সে      চায় ইশারায় অস্তাচলের প্রাসাদ-মিনারে। আমি কাঁদি, এই তো আমার চিরচেনা রে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) চিরঞ্জীব জগলুল প্রাচীর দুয়ারে শুনি কলরোল সহসা তিমির-রাতে, মিসরের শের, শির শমশের-সব গেল এক সাথে! সিন্ধুর গলা জড়ায়ে কাঁদিতে দু'তীরে ললাট হানি' ছুটিয়া চ'লেছে মরু-বকৌলি 'নীল' দরিয়ার পানি! আঁচলের তার ঝিনুক মানিক কাদায় ছিটায়ে পড়ে, সোঁতের শ্যাওলা আলো কুন্তল লুটাইছে বালুচরে...... মরু-'সাইমুম'-তাঞ্জামে চড়ি' কোন পরীবানু আসে? 'লু'-হাওয়া ধরেছে ধ'রেছে বালুর পর্দা সম্ভ্রমে দুই পাশে! সূর্য নিজেরে লুকায় টানিয়া বালুর আস্তরণ, ব্যজনী দুলায় ছিন্ন পাইন-শাখায় প্রভঞ্জন। ঘূর্ণি-বাঁদীরা নীল দরিয়ায় আ৬চল ভিজায়ে আনি' ছিটাইছে বারি, মেঘ হ'তে মাগি' আনিছে বরফ-পানি। ও বুঝি মিসর- বিজয়লক্ষো মূরছিতা তাঞ্চামে, ওঠে হাহাকার ভগ্ন মিনার আঁধার দীওয়ান-ই-আমে! কৃষানের গরু মাঠে মাঠে ফেরে, ধরেনি ক' আজ হাল, গম-ক্ষেত ভেঙ্গে পানি ব'য়ে যায় তবু নাহি বাঁধে আ'ল, মনের বাঁধেরে ভেঙ্গেছে যাহার চোখের সাঁতার পানি মাঠের পানি ও আ'লেরে কেমনে বা৬ধিবে সে, নাহি জানি। হৃদয়ে যখন ঘনায় শাঙন, চোখে নামে বরষাত, তখন সহসা হয় গো মাথায় এমনি বজ্রপাত! মাটিরে উজায়ে উপুড় হইয়া কাঁদিছে শ্রমিক কুলি, বলে-"মা গো তোর উদিরে মাটির মানুষই হ'য়েছে ধূলি, রতন মানিক হয় না তো মাটি, হীরা সে হীরাই থাকে, মোদের মাথায় কোহিনূর মণি- কি করিব বল তাকে? দুর্দিনে মা গো যদি ও-মাটির দুয়ার খুলিয়া খুঁজি, চুরি করিবি না তুই এ মানিক? ফিরে পাব হারা পুঁজি? লৌ পরশি' করিনু শপথ, ফিরে নাহি পাই যদি নতুন করিয়া তর বুকে মোরা বহাব রক্ত-নদী!"আভীর-বালারা দুধাল গাধীরে দোহায় না, কাঁদে শুয়ে, দুম্বা শিশুরা দূরে চেয়ে আছে দুধ ঘাস নাহি ছুঁইয়ে। মিষ্টি ধারাল মিছরির ছুরি মিসরী মেয়ের হাসি, হাঁসা পাথরের কুঁচি-সম দাঁত,- সব যেন আজ বাসি! আঙুর লতার অলকগুচ্ছ- ডাঁশা আঙুরের থোপা, যেন তরুণীর আঙুলের ডগা- হুরী বালিকার খোঁপা, ঝুরে ঝুরে পড়ে হতাদরে আজ অশ্রুর বুঁদ-সম! কাঁদিতেছে পরী, চারিদিকে অরি, কোথায় অরিন্দম! মরু- নটী তার সোনার ঘুঙুর ছুঁড়িয়া ফেলেছে কাঁদি' হলিদ খেঁজুর-কাঁধিতে বুঝি বা রয়েছে তাহারা বা৬ধি' নতুন করিয়া মরিল গো বুঝি আজি মিসরের মমি, শ্রদ্ধায় আজি পিরামিড যায় মাটির কবরে নমি'! মিসরে খেদিব ছিল বা ছিল না, ভুলেছিল সব লোক, জগলুলে পেয়ে ভুলেছিল ওরা সুদান-হারার শোক। জানি না কখন ঘনাবে ধরার ললাটে মহাপ্রলয়, মিসরের তরে 'রোজ-কিয়ামৎ'ইহার অধিক নয়! রহিল মিস, 'চ'লে গেল তার দুর্মদ যৌবন, রুস্তম গেল, নিষ্প্রভ কায়খসরু-সিংহাসন। কি শাপে মিসর লভিল অকালে জরা যযাতির প্রায়, জানি না তাহার কোন সুত দেবে যৌবন ফিরে তায়; মিসরের চোখে বহিল নতুন সুয়েজ খালের বান, সুদান গিয়াছে- গেল আজ তার বিধাতার মহাদান! 'ফেরাউন' ডুবে না মরিতে হায় বিদায় লইল মুসা, প্রাচী'র রাত্রি কাটিবে না কি গো, উদিবে না রাঙা ঊষা?***********************শুনিয়াছি, ছিল মমির মিসরে সম্রাট ফেরাউন, জননীর কোলে সদ্য প্রসূত বাচ্চার নিত খুন! শুনেছিল বাণী, তাহারী রাজ্যে তাহার রাজপথ দিয়া অনাগত শিশু আসিছে তাহার মৃত্যু-বারতা নিয়া। জীবন ভরিয়া করিল যে শিশু-জীবনের অপমান, পরের মৃত্যু-আড়ালে দাঁড়ায়েসে-ই ভাবে, পেল প্রাণ! জনমিল মুসা, রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে, ভাসিয়া ভাসিয়া সোনার শিশু গো রাজারই ঘাটেতে চলে। ভেসে এল শিশু রানীরই কোলে গ, বাড়ে শিশু দিনে দিনে শত্রু তাহারি বুকে চ'ড়ে নাচে, ফেরাউন নাহি চিনে। এল অনাগত তারি প্রাসাদের সদর দরজা দিয়া, এখনো প্রহরী জাগে বিনিদ্র দশ দিক আগুলিয়া! -রসিক খোদার খেলা, তারি বেদনায় প্রকাশে রুদ্র যারে করে অবহেলা!মুসারে আমরা দেখিনি, তোমায় দেখেছি মিসর-মুনি, ফেরাউন মোরা দেখিনি, দেখেছি নিপীড়ন ফেরাউনী। ছোটে অনন্ত সেনা-সামন্ত অনাগত কার ভয়ে, দিকে দিকে খাড়া কারা-শৃঙ্খল, জল্লাদ ফাঁসি ল'য়ে। আইন-খাতার পাতায় পাতায় মৃত্যুদন্ড লেখা, নিজের মৃত্যু এড়াতে কেবলি নিজেরে করিছে একা! সদ্যপ্রসুত প্রতি শিশুটিরে পিয়ায় অহর্নিশ শিক্ষা দিক্ষা সভ্যতা ব'লি তিলে তিলে-মারা বিষ। ইহারা কলির নব ফেরাঊন ভেল্কি খেলায় হাড়ে, মানুষে ইহারা না মেরে প্রথমে মনুষ্যত্ব মারে! মনুষ্যত্বহীন এই সব মানুষেরই মাঝে কবে হে অতি-মানুষ, তুমি এসেছিলে জীবনের উৎসবে। চারিদিকে জাগে মৃত্যুদন্ড রাহকারা প্রতিহারী, এরই মাঝে এলে দিলেন আলোক নির্ভীক পথচারী। রাজার প্রাচীর ছিল দাঁড়াইয়া তোমারে আড়াল করি' আপনি আসিয়া দাঁড়াইলে তার সকল শূন্যে ভরি'! পয়গম্বর মুসার তবু তো ছিল 'আষা' অদ্ভুত, খোদ সে খোদার প্রেরিত- ডাকিলে আসিত স্বররগ-দূত! প্যগম্বর ছিলে না ক'তুমি- পাওনি ঐশী বাণী, স্বর্গের দূত ছিল না দসর, ছিলে না শস্ত্র-পাণি আদেশে তোমার নীল দরিয়ার বক্ষে জাগেনি পথ, তোমারে দেখিয়া করেনি সালাম কোনো গিরিপর্বত! তবুও এশিয়া আফ্রিকা গাহে তোমার মহিমা গান, মনুষত্ব্য থাকিলে মানুষ সর্বশক্তিমান!দেখাইলে তুমি, পরাধীন জাতি হয় যদি ভয়হারা, হোক নিরস্ত্র, অস্ত্রের রণে বিজয়ী হইবে তারা। অসি দিয়া নয়, নির্ভীক করে মন দিয়া রণ জয়, অস্ত্রে যুদ্ধে জয় করা সাজে- দেশ জয় নাহি হয়। ভয়ের সাগর পাড়ি দিল যেই শির করিল না নীচু, পশুর নখর দন্ত দেখিয়া হটিল না কভু পিছু, মিথ্যাচারীর ভ্রুকুটি-শাসন নিষেধ রক্ত-আঁখি না মানি- জাতির দক্ষিণ করে বা৬ধিল অভয় রাখী, বন্ধন যারে বলিন্দ হ'য়ে নন্দন-ফুলহার, না-ই হ'ল সে গো পয়গম্বর নবী দেব অবতার, সর্বকালের সবদেশের সকল নর ও নারী করে প্রতীক্ষা, গাহে বন্দনা, মাগিছে আশিস তারি!*************************'এই ভারতের মহামানবের সাগর-তীরে' হে ঋষি, তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি! গোষ্ঠে গোষ্ঠে আত্নকলহ অজাযুদ্ধের মেলা, এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত-সাগর-বেলা। পশুরাজ যবে ঘাড় ভেঙে খায় একটারে ধরে আসি' আরটা তখনো দিব্যি মোটায়ে হ'তেছে খোদার কাসি! শুনে হাসি পায় ইহাদেরও নাকি আছে গো ধর্ম জাতি, রাম-ছাগল আর ব্রহ্ম-ছাগল আরেক ছাগল পাতি! মৃত্যু যখন ঘনায় এদের কশা'য়ের কল্যাণে, তখনো ইহারা লাঙল উঁচায়ে এ উহারে গালি হানে। ইহাদের শিশু শৃগালে মারিলে এরা সভা ক'রে কাঁদে, অমৃতের বাণি শুনাতে এদের লজ্জায় নাহি বাধে! নিজেদের নাই মনুষত্ব্য, জানি না কেমনে তারা নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব, হায় রে শরম-হারা! কবে আমাদের কোন সে পুরুষে ঘৃত খেয়েছিল কেহ আমাদের হাতে তারি বাস পাই, আজো করি অবলেহ! আশা ছিল, তবু তোমাদেরি মত অতি-মানুষেরে দেখি', আমরা ভুলিব মোদের এ গ্লানি খাঁটি হবে যত মেকী! তাই মিসরের নহে এ শোক এই দুর্দিন আজি, এশিয়া আফ্রিকা দুই মহাভূমে বেদনা উঠেছে বাজি'! অধীন ভারত তোমারে স্মরণ করিয়াছে শতবার, তব হাতে ছিল জলদস্যুর ভারত-প্রবেশ-দ্বার। হে 'বনি ইসরাইলের' দেশের অগ্রনায়ক বীর, অঞ্জলি দিনু 'নীলের' সলিলে অশ্রু ভাগিরথীর! সালাম করারও স্বাধীনতা নাই সোজা দুই হাত তুলি' তব 'ফাতেহা'ইয় কি দিবে এ জাতি বিনা দু'টো বা৬ধা বুলি! মলয়-শীতলা সুজলা এ দেশে-আশিস করিও খালি- উড়ে আসে যেন তোমার দেশের মরুর দু'মুঠো বালি।তোমার বিদায়ে দূর অতীতের কথা সেই মনে পড়ে, মিসর হইতে বিদায় লইল মুসা যবে চিরতরে, সম্ব্রমে স'রে পথ ক'রে দিল নীল দরিয়ার বারি, পিছু পিছু চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া মিসরের নর-নারী। সৈন্য-সম ছোটে ফেরাউন-সেনা ঝাঁপ দিয়া পড়ে স্রোতে, মুসা হ'ল পার, ফেরাউন ফিরিল না নীল নদী হ'তে! তোমার বিদায়ে করিব না শোক, হয়ত দেখিব কাল তোমার পিছনে মরিছে ডুবিয়া ফেরাউন দজ্জাল! চিরন্তনী প্রিয়া এসো এসো এসো আমার চির-পুরানো!             বুক জুড়ে আজ বসবে এসো হৃদয়-জুড়ানো!             আমার চির-পুরানো!    পথ বিপথে কতই আমার নিত্য নূতন বাঁধন এসে যাচে,     কাছে এসেই অমনি তারা পুড়ে মরে আমার আগুন আঁচে।           তারা  এসে ভালোবাসার আশায়                 একটুকুতেই কেঁদে ভাসায়,                 ভীরু তাদের ভালোবাসা কেঁদেই ফুরানো।                 বিজয়িনী চিরন্তনী মোর!     একা  তুমিই হাস বিজয়-হাসি দীপ দেখিয়ে পথে ঘুরানো।    তুমি যেদিন মুক্তি দিলে হেসে বাঁধন কাটলে আপন হাতে,                 প্রেম-গরবি আপন প্রেমের জোরে,     জানতে আমায় সইবে না কেউ বইবে না ভার           হার মেনে সে আসতে হবে আবার তোমার দোরে।    গরবিনি! গর্ব করে এই কপালে লিখলে জয়ের টিকা     ‘চঞ্চল এই বাঁধন-হারায় বাঁধতে পারে এক এ সাহসিকা!’             প্রিয়! তাই কি আমার ভালোবাসা                     সবাই বলে সর্বনাশা,     এই    ধূমকেতু মোর আগুন-ছোঁয়া বিশ্ব-পোড়ানো?                 সর্বনাশী চপল প্রিয়া মোর!     তবে    অভিশাপের বুকে তুমিই হাসবে এসো                        নয়ন ঝুরানো॥  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) চির-বিদ্রোহী হার মেনেছ বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না! তোমার সর্বশক্তি আমায়, বাঁধতে গিয়ে হার মেনে যায়! হায়! হাসি পায়, হেরেও তুমি হারবে না? হেরে গেলে! বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না।অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া? তোমার সর্বমায়ার কাঁদন, মা-র মমতা প্রেমের বাঁধন স্পর্শ করে বিদগ্ধ হয়, রুদ্রস্বরূপ মোর কায়া। অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া?ধরতে আমায় জাল পেতেছে জটিল তোমার সাত আকাশ! সে জাল ছিঁড়ে এ ধূমকেতু বিনাশ করে বাঁধার সেতু, সপ্ত স্বর্গ পাতাল ঘিরে ভস্ম করে সকল বিঘ্ন সর্বনাশ। এই ধূমকেতু ছিঁড়ে সে জাল এই মহাকাল! রুদ্র দামাল শূন্যে নাচে প্রলয়-নাচন সংহারিয়া সর্বনাশ।শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও, দুর্গে এনে দুরন্তকে – অশ্রু চাহ রুক্ষ চোখে! আমার আগুন নিভবে নাকো যতই গলায় মালা দাও! শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও!সংহার মোর ধর্ম, আমি বিপ্লব ও ঝঞ্ঝা ঝড়, স্বধর্মে নিধন ভালো – কেন আন প্রেমের আলো? সতী-দেহত্যাগের পর শংকর কি বাঁধে ঘর?আনন্দ আর অমৃত রস কার আগুনে যায় জ্বলে? শান্তি সমাহিতের মাঝে কেন রুদ্র বিষাণ বাজে? কোন যাতনায় শিশু কাঁদে, শান্তি পায় না মা-র কোলে?লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে? লোভী ভোগীলক্ষ্মী লয়ে রাক্ষস আর দৈত্য হয়ে কী নির্যাতন করছে তোমার সৃষ্টিতে। লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে?করব আমি ধ্বংস সর্ব বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বকে। মিথ্যা হল কোরান ও বেদ এই অসাম্য অশান্তি ভেদ প্রলয় কি বাঁধতে পারে বলয়-পরা নর্তকী! এখানে সিংহ থাকে! অসিংহ সব মহাত্মাকে দাও গিয়ে ওই হরিনামের হরতকি! রুদ্রকে কে শূদ্র করে ক্ষুদ্র ধরায় রাখবে ধরে। অহম শিকল কে পরাবে সোহম স্বয়ম্ভূকে!হে মৌনী, উত্তর দাও সামনে এসে রূপ ধরে, পূজা করে ক্ষমা করে তোমায় মানুষ জনম ভরে, কী দিয়েছ তাদের বলো, থেকো নাকো চুপ করে!কেন দুর্বলেরে করে প্রবল নির্যাতন? এই সুন্দর বসুন্ধরা রাক্ষস আর দৈত্যভরা কেমন করে করব তোমায় অভেদ বলে সম্ভাষণ।লজ্জা তোমার হয় না যখন তোমায় বলে কৃপাময়! পুত্র মরে, মা তবু হায়! প্রেমভরে ডাকে তোমায়; ওগো কৃপণ! বিশ্বে তোমার দাতা বলে পরিচয়!কেন পাপ ও অপরাধের কথা তোমার শাস্ত্র কয়! কে দিল মানবজন্ম, কে দিল ধর্মাধর্ম, মুক্ত তুমি, মানুষ কেন এ বন্ধন-জ্বালা সয়?তুমি বল, ‘আমার একা তোমার উপর অধিকার।’ সেই অধিকার তোমার পরে বলো কেন দাও না মোরে? তোমার মতো পূর্ণ হব, এই ছিল মোর অহংকার!মনের জ্বালা স্নিগ্ধ নাহি করে তোমার চন্দ্রালোক! এত কুসুম এত বাতাস কেন তবু এ হাহুতাশ, কোন শোকে অশান্তিতে দেবতা হয় চণ্ডাশোক !কেন সৃষ্টি করলে নরক, জন্মায়নি যখন মানব কেন তাদের ভয় দেখাও? ভয় দেখিয়ে ভক্তি চাও? তোমার পরম ভক্তেরা তাই হয় শয়তান, হয় দানব!বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান। তোমার ধরার দুঃখ কেন আমায় নিত্য কাঁদায় হেন? বিশৃঙ্খল সৃষ্টি তোমার, তাই তো কাঁদে আমার প্রাণ!বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান! আমার কাছে শান্তি চায় লুটিয়ে পড়ে আমার গায় – শান্ত হব, আগে তারা সর্বদুঃখ-মুক্ত হোক!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) চিরশিশু নাম-হারা তুই পথিক-শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে। কোন্‌ নামের আজ প’রলি কাঁকনম বাঁধনহারায় কোন্‌ কারা এ।।      আবার মনের মতন ক’রে      কোন্‌ নামে বল ডাক্‌ব তোরে!      পথ-ভোলা তুই এই সে ঘরে           ছিলি ওরে এলি ওরে           বারে বারে নাম হারায়ে।।ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতণ-মাণি! ক্ষুধিত ঘর ভ’রলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।     আজ যে শুধু নিবিড় সুখে     কান্না-সায়র উথলে বুকে,     নতুন নামে ডাকতে তোকে          ওরে ও কে কন্ঠ র”খে’          উঠছে কেন মন ভারায়ে! অস্ত হ’তে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে।। চুড়ির তালে নুড়ির মালা চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি কালো ছোঁড়ার কাঁকাল ধরে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি।মহুয়া মদের নেশা পিয়ে, বুঁদ হয়েছে বৌয়ে-ঝিয়ে চাঁদ ছুটছে মনকে নিয়ে যেন ডুরি ছেঁড়া ঘুড়ি লো।বাজে নুপূর পাঁইজোড়, সারা গায়ে নাচের ঘোর ওলো লেগেছে মন হল নেশায় বিভোর ওই আকাশে চাঁদ হের মেঘের সাথে যেন করে খুন্‌সুড়ি লো।। চোর-ডাকাত কে তোমায় বলে ডাকাত বন্ধু, কে তোমায় চোর বলে? চারিদিকে বাজে ডাকাতি ডঙ্কা, চোরেরি রাজ্য চলে! চোর-ডাকাতের করিছে বিচার কোন্ সে ধর্মরাজ? জিজ্ঞাসা কর, বিশ্ব জুড়িয়া কে নহে দস‌্যু আজ?                      বিচারক! তব ধর্মদন্ড ধর, ছোটদের সব চুরি ক'রে আজ বড়রা হয়েছে বড়! যারা যত বড় ডাকাত-দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ তারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতি-সঙ্ঘেতে আজ। রাজার প্রাসাদ উঠিছে প্রজার জমাট রক্ত-ইঁটে, ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে। দিব্যি পেতেছো খল কলও'লা মানুষ-পেষানো কল, আখ-পেষা হয়ে বাহির হতেছে ভুখারী মানব-দল! কােটি মানুষের মনুষ্যত্ব নিঙাড়িয়া কলওয়ালা ভরিছে তাহার মদিরা-পাত্র, পুরিছে স্বর্ণ-জালা! বিপন্নদের অন্ন ঠাসিয়া ফোলে মহাজন-ভুঁড়ি নিরন্নদের ভিটে নাশ ক'রে জমিদার চড়ে জুড়ি! পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়, নিচে সেথা পাপ-শয়তান-সাকি, গাহে যক্ষের জয়! অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু, দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু।                                 পালাবার পথ নাই, দিকে দিকে আজ অর্থ-পিশাচ খুঁড়িয়াছে গড়খাই। জগৎ হয়েছে জিন্দানখানা, প্রহরী যত ডাকাত__ চোরে-চোরে এরা মাস্তুত ভাই, ঠগে ও ঠগে স্যাঙাৎ। কে বলে তোমায় ডাকাত, বন্ধু, কে বলে করিছ চুরি! চুরি করিয়াছ টাকা ঘটি বাটি, হৃদয়ে হাননি ছুরি! ইহাদের মত অমানুষ নহ, হ'তে পার তস্কর, মানুষ দেখিলে বাল্মীকি হও তোমরা রত্নাকর!(কাব্যগ্রন্থঃ সাম্যবাদী) চৈতী হাওয়া হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!     আজ্‌কে তোমার জন্মদিন-     স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?     আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,     নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল?অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ     ঘাটে আমি রই ব’সে     আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই। হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অবাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?বউল ঝ’রে  ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।। ছন্দিতা ১। ‘স্বাগতা’ – ১৬ মাত্রা (তা – না তা – নাবাবা –               তা – নানা – তা – তা -)   স্বাগতা কনক-চম্পক-বর্ণা       ছন্দিতা চপল নৃত্যের ঝরনা।   মঞ্জুলা বিধুর যৌবন-কুঞ্জে       যেন ও চরণ-নূপুর গুঞ্জে,   মন্দিরা মুরলি-শোভিত হাতে     এসো গো বিরহ-নীরস-রাতে            হে প্রিয়া কবির প্রাণ অপর্ণা॥    ২। ‘প্রিয়া’ – ৭ মাত্রা (নাবা তা – না তা -)   ‘মহুয়া’-বনে বন-পাপিয়া       এখনও ঝুরে নিশি জাগিয়া।   ফিরিয়া কবে প্রিয় আসিবে       ধরিয়া বুকে কহিবে প্রিয়া॥ শুনি, নীরবে গগনে বসি         কহ যে-কথা বিরহী শশী,   তব রোদনে বঁধু এ মনে         যমুনা বহে কূল-প্লাবিয়া॥    ৩। ‘মধুমতী’ - ৮ মাত্রা (নাবাবাবা নানা তা – দু-বার) বনকুসুম-তনু তুমি কি মধুমতী।   ঢলঢল নয়নে রস-ঘন মিনতি।   রুমুঝুমু ঘুমুরে ঘুমুঘুমু বিবশা, নিথর বসুমতী, নিশিমদ-অলসা, মুরছিত চরণে শত মদন রতি॥ রস-ছলছল গো তব মধু-কলসে   ঝরঝর ঝরনা অনুখন বরষে, – অরুণিত-নয়না মধুর রসবতী॥    ৪। ‘মত্তময়ূর’ – ২২ মাত্রা   মত্তময়ুরছন্দে নাচে কৃষ্ণ প্রেমানন্দে।   রুম ঝুম ঝুম মঞ্জীর বাজে কঙ্কণ মণিবন্ধে॥   রিমঝিম রিমঝিম ঝিম কেকা-বর্ণ ঘন বরষে,   তৃষ্ণা-তৃপ্ত আত্মা নাচে নন্দনলোকে হরষে,   ঝঞ্ঝার ঝাঁঝরতাল বাজে শূন্যে মেঘ-মন্দ্রে॥   পল্লব-ঘন-চক্ষে ঝরে অশ্রু-রসধারা   পুব-হাওয়াতে বংশী ডাকে আয় রে পথহারা। বন্দে দামিনী-বর্ণা রাধা বৃন্দাবন-চন্দে॥৫। ‘রুচিরা’ – ১৮ মাত্রা   ভ্রমর নূপুর-পরিহিতা          কৃষ্ণ-কুন্তলা।   বলয়-কাঁকন-ঝনকিতা         ছন্দ-চঞ্চলা॥   মলয়-সমীর ঝিরিঝিরি         অঙ্গে গুঞ্জরে।   কদম কেশর ঝুরুঝুরু          চম্পা মুঞ্জরে।   চটুলনয়ন চমকিতা           জ্যোৎস্না-অঞ্চলা॥ বিধুর কোকিল-কুহরিত        আম্রকুঞ্জে গো,   রূপের পরাগ ঝরে তব        পুঞ্জে পুঞ্জে গো।   নিখিল-ভুবন তব রাস         নৃত্য হিন্দোলা॥    ৬। ‘দীপক-মালা’ – ১৬ মাত্রা (তা – নানা – তা – তা,                   তা না তা নাতা)   দীপক-মালা গাঁথো গাঁথো গাঁথো সই।   আনত আঁখি তোলো তোলো গো! বেদন-জ্বালা ভোলো ভোলো গো!   মান-ভুলানো এল রাত সই॥   কাজল আঁকো নীল আঁখিতে,   চেয়ো না লাজে আঁখি ঢাকিতে,   আসন প্রাণে পাতো পাতো সই॥    ৭। ‘মন্দাকিনী’ – ১৬ মাত্রা (নানা নানা নানা                 তা না তা তা নাতা)   জল-ছলছল এসো মন্দাকিনী।   রস-ঢলঢল বারি-সঞ্চারিণী॥   হৃদয়-গগন আজি তৃষ্ণাভরে   উতল হইল প্রেম-গঙ্গা তরে, মুদিত নয়ন খোলো বৈরাগিনী॥ বিরস ভুবন রাখো সঞ্জীবিতা,   সজল সলিল আনো হিল্লোলিতা,   ঝর ঝর স্রোত-উন্মাদিনী॥৮। ‘মঞ্জুভাষিণী’ – ১৮ মাত্রা (নানা তা – নাতা নানানা                       তানা তানাতা)   আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে,   কহে কোন কথা নিশীথ স্বপনে আনমনে॥         মৃদুমর্মরে পথের পল্লবের সাথে         গাহের কোন গীতি নিশীথে পানসে জ্যোৎস্নাতে,         খোঁজে কার স্মৃতি নীরস শুভ্র চন্দনে॥   গ্রহচন্দ্রে কয় – সে কি গো মৃত্যু-দ্বার খুলে   হয়ে সৃষ্টিপার গিয়াছে অমৃতের কূলে,   কাঁদে কোন শোকে পরম সুন্দরের সনে॥  ৯। ‘মণিমালা’ – ২০ মাত্রা মঞ্জু মধু-ছন্দা             নিত্যা, তব সঙ্গী   সিন্ধুর তরঙ্গ             নৃত্যের কুরঙ্গী॥   গুঞ্জা বেলা পদ্ম            পুঞ্জীভূত বক্ষে,   অশ্রু-লাজ কুন্ঠা            শঙ্কা-ঘন চক্ষে,   অঙ্গে শ্যামকান্তা           মন্দাকিনী-ভঙ্গি॥   অঙ্গুলিতে বন্দী            অঙ্কুরিত ছন্দ,   কণ্ঠে সুর-লক্ষ্মী            বৃন্দাবনানন্দ,   গঙ্গা এলে বক্ষে           সন্ধ্যারাগে রঙ্গি॥    ১০। ‘ছন্দবৃষ্টিপ্রপাত’ – ৪৮ মাত্রা   তারকা-নূপুরে নীল নভে ছন্দ শোন ছন্দিতার   সৃষ্টিময় বৃষ্টি হয় নৃত্য সেই নন্দিতা   সাগরে নদীতে ঢেউ তোলে সেই দেবীর মুক্তকেশ,   সংগীতের হিন্দোলে তাঁর আঁখির প্রেম আবেশ,   পবনে পবনে হিল্লোলে নীল আঁচল চঞ্চলার   ছন্দোময় আনন্দময় চরণশ্রী বন্দি তাঁর॥   ১১। সৌরাষ্ট্র ভৈরব – তেতালা (বাদী মধ্যম)   মদালস ময়ুর-বীণা কার বাজে   অরুণ-বিভাসিত অম্বর-মাঝে॥   কোন মহা-মৌনীর ধ্যান হল ভঙ্গ?   নেচে ফেরে অশান্ত মায়া-কুরঙ্গ   তপোবনে রঙ্গে অনঙ্গ বিরাজে॥   নিদ্রিত রুদ্রের ললাট-বহ্নি   পাশে তার হেসে ফেরে বনবালা-তন্বী।   বিজড়িত জটাজুটে খেলে শিশু শশী দেয় মালা চন্দন ভীরু উর্বশী শংকর সাজিল রে নটরাজ সাজে॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) ছলকুমারী কত    ছল করে সে বারে বারে দেখতে আসে আমায়। কত    বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি                      আমার দোরেই থামায়।              জানলা-আড়ে চিকের পাশে               দাঁড়ায় এসে কীসের আশে,               আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে        অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল গাল দুটিকে ঘামায়।       সবাই যখন ঘুমে মগন দুরুদুরু বুকে তখন                      আমায় চুপে চুপে        দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়,                      রং খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে!               দোর দিয়ে মোর জলকে চলে               কাঁকন হানে কলস-গলে!               অমনি চোখাচোখি হলে        চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।       সইরা হাসে দেখে তাহার দোর দিয়ে মোর                      নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা,        করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার দোরেই                      শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!              একে ওকে ডাকার ভানে               আনমনা মোর মনটি টানে,               কী যে কথা সেই তা জানে        ছল-কুমারী নানান ছলে আমারে সে জানায়।       পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে                      উদাস নয়ান যখন এলোকেশে,        জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই ভাবতেছে সে,                      মরেছে সে আমায় ভালোবেসে!              বই-হাতে সে ঘরের কোণে               জানি আমার বাঁশিই শোনে,               ডাকলে রোষে আমার পানে,        নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) ছাত্রদলের গান আমরা শক্তি আমরা বল                         আমরা ছাত্রদল। মোদের         পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান                         ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।                                 আমরা ছাত্রদল।।মোদের         আঁধার রাতে বাধার পথে                         যাত্রা নাঙ্গা পায়, আমরা                শক্ত মাটী রক্তে রাঙাই                         বিষম চলার ঘাস।                 যুগে যুগে রক্তে মোদের                         সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল।                                  আমরা ছাত্রদল।।মোদের         কক্ষচ্যুত-ধূমকেতু-- প্রায়                          লক্ষ্যহারা প্রাণ আমরা                ভাগ্যদেবীর  যজ্ঞবেদীর                         নিত্য বলিদান। যখন                লক্ষ্মীদেবী  স্বর্গে উঠেন                         আমরা পশি নীল অতল!                                    আমরা ছাত্রদল।।আমরা                 ধরি মৃত্যু রাজার                         যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ, মোদের         মৃত্যু লেখে মোদের                         জীবন--ইতিহাস!             হাসির দেশে আমরা আনি                         সর্বনাশী চোখের জল                                আমরা ছাত্রদল।।                সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়                         আমরা করি ভুল!                 সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,                         আমরা ভাঙি কূল।                 দারুণ-রাতে আমরা তরুণ                         রক্তে করি পথ পিছল!                                    আমরা ছাত্রদল।।        মোদের                চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,                         বক্ষে ভরা বাক্,                 কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন                         নিত্য কালের ডাক। আমরা                তাজা খুনে লাল ক’রেছি                         সরস্বতীর শ্বেত কমল।                                     আমরা ছাত্রদল।।        ঐ                দারুণ উপপ্লবের দিনে                         আমরা দানি শির,                 মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে                         বিংশ শতাব্দীর! মোরা                গৌরবেরি কান্না দিয়ে                         ভ’রেছি মা’র শ্যাম-আঁচল।                                 আমরা ছাত্রদল।                আমরা রচি ভালোবাসার                         আশার ভবিষ্যৎ, মোদের                স্বর্গ-পথের অভাস দেখায়                         আকাশ-ছায়াপথ!                 মোদের চোখে বিশ্ববাসীর                         স্বপ্ন দেখা হোক সফল।                                 আমরা ছাত্রদল।। জনম জনম গেলো জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি, মরু মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি। বরষও পরে বরষ, আসে যায় ফিরে, পিপাসা মিটায়ে চলি, নয়নেরও তীরে, জ্বালিয়া আলেয়া শিখা, নিরাশার মরিচীকা, ডাকে মরু প্রাণনিকা, শত গীত গাহি। জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি। এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি স্বপনে হেরি গো তারে আজো মরুচারী সেই সে সাগর তলে যে তরী ডুবিল জলে সে তরী-সাথীরে খুঁজি মরুপথ বাহি জাগরণী জাগো রে তরুণ জাগো রে ছাত্রদল স্বতঃ উৎসারিত ঝর্ণাধারায় প্রায় জাগো প্রাণ-চঞ্চল ভেদ-বিভেদের গ্লানির কারা-প্রাচীর ধুলিসাৎ করি জাগো উন্নত শির জবাকুসুম-সঙ্কাশ জাগে বীর, বিধি নিষেধের ভাঙ্গো ভাঙ্গো অর্গল। ধর্ম বর্ণ জাতির ঊর্ধ্বে জাগো রে নবীন প্রাণ তোমার অভ্যুদয়ে হোক সব বিরোধের অবসান সঙ্কীর্ণতা ক্ষুদ্রতা ভোলো ভোলো সকল মানুষে ঊর্ধ্বে ধরিয়া তোলো তোমাদের চাহে আজ নিখিল জনসমাজ আনো জ্ঞানদীপ এই তিমিরের মাঝ, বিধাতার সম জাগো প্রেম প্রোজ্জ্বল। জাগরণী - ভাঙার গান কোরাস্:—         ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!                     ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,                     সন্তান দ্বারে উপবাসী, দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! জাগো গো,                জাগো গো,           তন্দ্রা-অলস জাগো গো, জাগো রে!                জাগো রে!             ১ মুক্ত করিতে বন্দিনী মা'য় কোটি বীরসুত ঐ হেরো ধায় মৃত্যু-তোরণ-দ্বার-পানে—                  কার টানে? দ্বার খোলো দ্বার খোলো! একবার ভুলে ফিরিয়া চাও।কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...          ২ জননী আমার ফিরিয়া চাও! ভাইরা আমার ফিরিয়া চাও!          চাই মানবতা, তাই দ্বারে          কর হানি মা গো বারেবারে—          দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! পুরুষ-সিংহ জাগো রে! সত্যমানব জাগো রে। বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও          সত্য-মুক্তি-মন্ত্র গাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...               ৩ লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার, নর-নারায়ণে হানে পদাঘাত                  জেনেছে সত্য-হত্যা সার।           অত্যাচার! অত্যাচার!! ত্রিশ কোটি নর-আত্মার যারা অপমান হেলা                                   করেছে রে           শৃঙ্খল গলে দিয়েছে মা'র—          সেই আজ ভগবান তোমার!       অত্যাচার! অত্যাচার!! ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-নাই কি লাজ— নাই কি আত্মসম্মান ওরে নাই জাগ্রত                      ভগবান কি রে            আমাদেরো এই বক্ষোমাঝ?            অপমান বড় অপমান ভাই                   মিথ্যার যদি মহিমা গাও! কোরাস্:—  ভিক্ষা দাও...                ৪       আল্লায় ওরে হকতা'লায়       পায়ে ঠেলে যারা অবহেলায়, আজাদ-মুক্ত আত্মারে যারা শিখায়ে ভীরুতা                               করেছে দাস—       সেই আজ ভগবান তোমার!       সেই আজ ভগবান তোমার!                             সর্বনাশ! সর্বনাশ! ছি-ছি নির্জীব পুরবাসী আর খুলো না দ্বার!                            জননী গো! জননী গো! কার তরে জ্বালো উৎসব-দীপ?                           দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!!                           মঙ্গল-ঘট ভেঙে ফেলো,                           সব গেল মা গো সব গেল!                                     অন্ধকার! অন্ধকার!                                     ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার!                                     দীপ নেবাও! দীপ নেবাও। কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...                    ৫               ছি ছি ছি ছি               এ কি দেখি গাহিস তাদেরি বন্দনা-গান, দাস সম নিস হাত পেতে দান!              ছি-ছি-ছি ছি-ছি-ছি              ওরে তরুণ ওরে অরুণ! নরসুত তুমি দাসত্বের এ ঘৃণ্য চিহ্ন                     মুছিয়া দাও!                     ভাঙিয়া দাও, এ-কারা এ-বেড়ি ভাঙিয়া দাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...                ৬ পরাধীন বলে নাই তোমাদের             সত্য-তেজের নিষ্ঠা কি! অপমান সয়ে মুখ পেতে নেবে বিষ্ঠা ছি?              মরি লাজে, লাজে মরি! এক হাতে তোরে 'পয়জার' মারে              আর হাতে ক্ষীর সর ধরি!              অপমান সে যে অপমান!              জাগো জাগো ওরে হতমান! কেটে ফেলো লোভী লুব্ধ রসনা,             আঁধারে এ হীন মুখ লুকাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...                 ৭        ঘরের বাহির হয়ো না আর,       ঝেড়ে ফেলো হীন বোঝার ভার, কাপুরুষ হীন মানবের মুখ                 ঢাকুক লজ্জা অন্ধকার।       পরিহাস ভাই পরিহাস সে যে, পরাজিতে দিতে মনোব্যথা—যদি       জয়ী আসে রাজ-রাজ সেজে। পরিহাস এ যে নির্দয় পরিহাস!               ওরে কোথা যাস বল কোথা যাস ছি ছি               পরিয়া ভীরুর দীন বাস? অপমান এত সহিবার আগে               হে ক্লীব, হে জড়, মরিয়া যাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...              ৮         পুরুষসিংহ জাগো রে!         নির্ভীক বীর জাগো রে! দীপ জ্বালি কেন আপনারি হীন কালো অন্তর         কালামুখ হেন হেসে দেখাও!         নির্লজ্জ রে ফিরিয়া চাও!         আপনার পানে ফিরিয়া চাও! অন্ধকার! অন্ধকার! নিশ্বাস আজি বন্ধ মা'র অপমানে নির্মম লাজে, তাই দিকে দিকে ক্রন্দন বাজে—        দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!       আপনার পানে ফিরিয়া চাও!কোরাস্‌:— ভিক্ষা দাও... জাগরণী-২ প্রভাতে জাগিল সকল যাত্রী তোরা ঘুমাস্ নে আর রাত্রি ভাবি, দেখাবে বিশ্ব-পথিকের সাথে তোদের সে-পথে চলার থাবি। অতীতের মোহ হউক ছিন্ন বর্তমানের কুঠারাঘাতে; ঘুমায়েছে যারা জাগুক তাহারা তোদের রুদ্র অশনি-পাতে।।'সংবাদ' ২৭ শে আশ্বিন ১৩৭০ জাগর-তূর্য ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী! অলিখিত যত গল্প-কাহিনি তোরা যে নায়ক তারই॥        শক্তিময়ী সে এক জননির     স্নেহ-সুত সব তোরা যে রে বীর, পরস্পরের আশা যে রে তোরা, মার সন্তাপ-হারী॥        নিদ্রোত্থিত কেশরীর মতো     ওঠ ঘুম ছাড়ি নব জাগ্রত! আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী॥        ঘুমঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল     দেহ মন বেঁধে করেছে বিকল, ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির বারি। উহারা কজন? তোরা অগণন সকল শক্তি-ধারী॥   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) জাগৃহি ‘হর   হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ – একী   ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম! হানে   ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক, ঘন   প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক ধু ধু   দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ, হানে   কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ! আজ  ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল, ওই   ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল! বোলে  অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ, নাচে   থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান! দোলে  হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার, বুকে   বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার! ঘোর   মার’ দৈত্য, অসুর, প্রেত,  রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর। করে   ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ – ত্রাহি   ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ! সুত   মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি হাসে   চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী। কাল-  বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি – রণ-   উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি! উর-   হার দোলে নরমুণ্ড-মালা, করে   খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা! নিয়া   রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা নাচে   ছিন্ন সে মস্তা মা, নাইকো দিশা! ‘দে রে   রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন, বুঝি   থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন! জ্বলে   বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা, আজ   বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা! শুধু   অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা, শোভে   করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা! রণ-   শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা, শুধু   রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা! একী   বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা, কিছু   নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা। আজ   ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান – হোক   রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান! আজি   বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস, বিষে   বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস! দেহো   ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ, খোলো   রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ! এ তো  নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা! আজ   জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা। তব   চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর, হল   ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর। তবে   সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন– হোক   সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন! এসো   শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে আজ   প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে! জাগো   জাগো মানব-মাতা দেবী নারী! আনো   হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি! এসো   কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে, নীল   উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে। এসো   কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,– বাজো   শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে! আজ   মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে, ওই   শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে। ওড়ে   এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়, হানে   চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়! ঘোষে   হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, – এল   হৈমবতী, এল গৌরী রানি। বাজো   মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি, এল   লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী। এল   সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক, এল   সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক! ভরা   ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল, আজ   চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল! নিয়া   মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ এল   শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ! ভাঁজো   মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর, বড়ো   কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর। ওঠে   কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম – বন্-   দে মাতরম্। বন্‌দে মাতরম্!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) জাগো মুসাফির ভোর হল, ওঠ জাগো মুসাফির, আল্লা - রাসুল বোল গাফলিয়াতি ভোল রে অলস, আয়েশ আরাম ভোল।।এই দুনিয়ার সরাইখানায় (তোর) জনম গেল ঘুমিয়ে হায়! ওঠ রে সুখশয্যা ছেড়ে, মায়ার বাঁধন খোল।।দিন ফুরিয়ে এল যে রে দিনে দিনে তর দিনের কাজে অবহেলা করলি জীবনভোর।।যে দিন আজো আছে বাকী খোদারে তুই দিসনে ফাঁকি আখেরে পার হবি যদি পুলসিরাতের পোল।। জাগো সৈনিক-আত্মা জাগো সৈনিক-আত্মা! জাগো রে দুর্দম যৌবন! আকাশ পৃথিবী আলোড়ি আসিছে ভয়াল প্রভঞ্জন। রক্ত রসনা বিস্ফারি আসে করাল ভয়ংকর! অগ্নি উগারি ওড়ে আগ্নেয়ী জুড়িয়া নীলাম্বর। এখনও তন্দ্রা নিদ্রা জড়তা ক্লৈব্য গেল না তোর? ব্রজ দমকে দামিনী চমকে, এল ঘনঘটা ঘোর! এখনও ঘুমাবে হে অমর মানবাত্মা অন্ধকারে পরি দৈন্যের শৃঙ্খল হায় পাতালের কারাগারে! গরজে কামান, তোপ, গোলাগুলি ছুটিছে দিগ্‌বিদিকে, জড়াইয়া ধরে প্রিয়া-সম সৈনিক সেই বহ্নিকে। গুলি ও গোলারে প্রিয়ার বুকের মালার ফুলের মতো লইতেছে তুলি আজ জগতের বীর সৈনিক যত। জাগো জাগো এদেশের দুর্বার দুরন্ত যৌবন! আগুনের ফুল-সুরভি এনেছে চৈতালি সমীরণ। সেই সুরভির নেশায় জেগেছে অঙ্গে অঙ্গে তেজ, রক্তের রঙে রাঙায় ভুবন ভৈরব রংরেজ! জাগো অনিদ্র অভয় মুক্ত মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ, তোমাদের পদধ্বনি শুনি হোক অভিনব উত্থান পরাধীন শৃঙ্খল-কবলিত পতিত এ ভারতের! এসো যৌবন রণ-রস-ঘন হাতে লয়ে শমশের! মৃত্যুর নয় – অমৃতের উৎসবের আমন্ত্রণ আসিতেছে ওই রক্ত-রঙিন লিপি লয়ে যে মরণ– বরণ করিয়া চলো সেই উৎসব-অভিযান-পথে, মহাশক্তির তুষার গলিয়া ছুটুক প্রবল স্রোতে! দঙ্গল বাঁধি এসো ময়দানে করিয়া কুচকাওয়াজ, গর্জি উঠুক বক্ষে রণোন্মত্ত গোলন্দাজ! রক্তে রক্তে এ কোন রুদ্র নটরাজ নাচে নাচে রে! মৃত্যুরে খুঁজি মধুমাছি, মৃত্যুর মধু কোথা আছে রে! সাইক্লোন নাচে শিরায় শিরায় মন সেথা চলে ছুটে কোথায় বোমার ধূপদানি হতে বারুদের ধোঁয়া উঠে? চলো জাগ্রত মানবাত্মা সামরিক সেনাদল, যথা প্রাণ ঝরে-ঝরে পড়ে যেন বাদলের ফুলদল! মাদল বাজিছে কামানের ওই শোনো মহা-আহ্বান! জীবনের পথে চলো আর চলো – ‘অভিযান, অভিযান’!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) জাতের বজ্জাতি জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া         ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥         হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,         তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশো-খান!                 এখন দেখিস ভারত-জোড়া                 পচে আছিস বাসি মড়া,         মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥         জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল,         তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।                 যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,                 আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,         যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥         দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে         কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে।         (তোরা)  জাতের চাপে মারলি জাতি,                 সূর্য ত্যজি নিলি বাতি, তোদের   জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো-ধোয়া॥         মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির,         বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির।                 ওরে মূর্খ ওরে জড়,                 শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো, (তোরা)   চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥         সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এই বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর,         মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম-পর।         (তোরা)  সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে                 স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে         ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভি দোওয়া॥         বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত?         কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?                 নারায়ণের জাত যদি নাই,                 তোদের কেন জাতের বালাই? (তোরা)  ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥         ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাতবিচার, (তোর)   পইতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।                 জাত সে শিকেয় তোলা রবে,                 কর্ম নিয়ে বিচার হবে, (তা-পর)   বামুন চাঁড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোয়া॥    (এই)   আচার-বিচার বড়ো করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা,   (বাবা)   এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গি-মামার খাচ্ছ থাবা।                 তাই নাইকো অন্ন নাইকো বস্ত্র,                         নাইকো সম্মান, নাইকো অস্ত্র, (এই)   জাত-জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরও অশেষ দুঃখ-সওয়া॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) জীবন জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে, এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে? তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়, জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়? মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি, শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি; সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি, বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি!   (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) জীবন-বন্দনা গাহি তাহাদের গান- ধরণীর হাতে দিল যারা আনি' ফসলের ফরমান। শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভ'রে ফুলে-ফলে! বন্য শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা যাদের শাসলে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা। যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে বনের ব্যাঘ্র ময়ূর সিংহ বিবরের ফণী ল'য়ে। এল দুর্জয় গতি-বেগ-সম যারা যাযাবর-শিশু -তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু- যাহাদের চলা লেগে উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে!খেয়াল-খুশীতে কাটি' অরণ্য রচিয়া অমরাবতী যাহারা করিল ধ্বংস সাধপ্ন পুনঃ চঞ্চলমতি, জীবন-আবেগে রুধিতে না পারি' যারা উদ্ধত-শির লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর। নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু অভিযানে, পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে! তবুও থামে না যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে চ'লেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে। যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রান বাজি রেখে হারে। আমি-মরু-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান, যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান। জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুন উগ্রসুখে সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে! আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোনো বাধা মানিল না, বর্বর বলি' যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা, কূপ-মন্ডুক 'অসংযমী'র আখ্যা দিয়াছে যারে, তারি তরে ভাই গান রচে' যাই, বন্দনা করি তারে। জোর জমিয়াছে খেলা জোর জমিয়াছে খেলা! ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকালবেলা। এই জনগণ-অরণ্যে যেন বহিত না প্রাণবায়ু, শিথিল হইয়া ছিল যেন সব স্নায়ু! সহসা মৌন-অরণ্যে আজ উঠেছে প্রবল ঝড়, ভিড় করে পাখি নীড় ছেড়ে করে কোলাহল-মর্মর। জমাট হইয়া ছিল সাগরের জল, সহসা গলিয়া ছুটিল স্রোতের ঢল। ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড়ো ছোটো মাঝারির, স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারির! এই দিকে ‘রাজি’, ওদিকে ‘নারাজি’ দল, সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’-ফুটবল! ‘রাজি’ জয়ী হবে বলে বাজি রাখে মজুর ও বিড়িওয়ালা, কেল্লার ধারে জমায়েত হয়ে বাঁধা রেখে ঘটি থালা। কাহার কেল্লা ফতে হবে সবে কয়, ‘রাজি’রা খেলিতে জানে, উহারাই জয়ী হবে নিশ্চয়। ‘গ্যালারি’ ভরতি মধ্যবিত্ত আধা-বড়োলোক যত, ছাতা উঁচাইয়া ‘রাজি’দের জয়ধ্বনি করে অবিরত। ‘নারাজি’ দলের ‘সাপোর্টার’ যত কোট প্যান্ট চাপকান, সংখ্যায় সাত কুড়ি, তবু তিন হাত তুড়িলাফ খান! এরা খায় বিড়ি, ওরা খায় সিগারেট, এরা খায় চানাচুর ও বাদাম, ওরা চপ কাটলেট!                জোর জমিয়াছে খেলা, বুট-পরা পায়ে ফুটবলে লাথি মারে, হুল্লোড় মেলা! খাইয়া ‘ফাউল-কারি’ ‘নারাজি’রা কেবল ফাউল করে, রেফারিকে দেয় কাফেরি ফতোয়া যদি সে ফাউল ধরে! ‘শেম’ ‘শেম’ বলে জনগণ, হ্যাটুয়ারা দেয় হ্যাটে তালি, খেলতে পারে না, ফেলিতে পারে না ঠেলা দিয়ে, দেয় গালি। কোন দল জেতে কোন দল হারে, উঠিয়াছে কোন্দল, ‘নারাজি’র দিকে বুড়োরা, ‘রাজি’র জোয়ান নতুন দল।               উঠেছে হট্টগোল                ওই দিল – গোল, গোল! মটরুর নানা দেড় চোখ কানা, ঝুড়ি তুলে মারে কিক, লুঙ্গি ধরে চলে ‘রাজি’রা এবার গোল দিল দেখো ঠিক! ‘নারাজি’রা হল যেন আলু-ভাজি, করে শুধু হ্যান্ডবল, যত গোল খায় তত গোলমাল করে তারা অবিরল! কবুতর ওড়ে, মোগলি লম্ফ মারে বগলের ছাতা, ‘জয় রাজি’ বলে ওড়ায় রঙিন কুচি কাগজের পাতা।                   খেলা জমিয়াছে জোর, ‘নারাজি’রা রাগে, ‘রাজি’রা ততই হাসিয়া করে স্কোর! ‘নারাজি’র দলে বিদেশি খেলুড়ি, ‘রাজি’র দেশের ছেলে, ‘রাজি’রা পায়ের জোরে খেলে ‘নারাজি’রা গা-র জোরে ঠেলে। আজও খেলা শেষ হয় নাই ময়দানে, ‘হাফটাইমের’ আগেই কে গোল খেয়েছে সবাই জানে।    এরই মাঝে আসিয়াছে ঘনঘটা রুক্ষ আকাশ ঘিরে, কারা যেন ক্রোধে নীল আশমান বিজলি-নখরে চিরে! বাজে বাদলের মাদল ঝাঁজর মৃদঙ্গ গুরুগুরু, মাথার উপরে ছাতার তাম্বু, বৃষ্টি হয়েছে শুরু! দর্শক দ্যাখে, এঁকেবেঁকে পড়ে মাঠে কারা পিছলায়ে, ‘রাজি’ দল ছোটে তিরের মতন চাকা বাঁধা যেন পায়ে!                   খেলা জোর জমিয়াছে, দর্শক সব এবার এগিয়ে এসেছে দড়ির কাছে। বৃষ্টি নেমেছে, এবার দৃষ্টি প্রখর করো রে দাদা, কার দিকে কত হয় সে ফাউল, কে ছিটায় কত কাদা।                   খেলা দ্যাখো, দ্যাখো খেলা, ‘রাজি’ কি ‘নারাজি’ জয়ী হল, বলো তোমরাই সাঁঝ-বেলা! কবুতরগুলি ফেরে নাই ঘরে, ঘুরিছে মাথার পর, কাহারা জিতিল, দেশে দেশে গিয়া শুনাবে খোশখবর!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) ঝড় ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় – শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় – কাঁদে মোর আগমনি আকাশ বাতাস বনানীতে। জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি-শিরে,     যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে     প্রাচী-র অলক্ষ্য পথ-পানে     মায়াবী দৈত্যশিশু আমি     ছুটে চলি অনির্দেশ অনর্থ-সন্ধানে! জন্মিয়াই হেরিনু, মোরে ঘিরি ক্ষতির অক্ষৌহিণী সেনা প্রণমি বন্দিল – ‘প্রভু! তব সাথে আমাদের যুগে যুগে চেনা,     মোরা তব আজ্ঞাবহ দাস – প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারি সর্বনাশ!’        বাজিল আকাশ-ঘণ্টা, বসুধা-কাঁসর; মার্তণ্ডের ধূপদানি – মেঘ-বাষ্প-ধূমে-ধূমে ভরাল অম্বর! উল্কার হাউই ছোটে, গ্রহ উপগ্রহ হতে ঘোষিল মঙ্গল;         মহাসিন্ধু-শঙ্খে বাজে অভিশাপ-আগমনি কলকল কল কলকল কল কলকল কল!     ‘জয় হে ভয়ংকর, জয় প্রলংকর’ নির্ঘোষি ভয়াল     বন্দিল ত্রিকাল-ঋষি।     ধ্যান-ভগ্ন রক্ত-আঁখি আশিস দানিল মহাকাল। উল্লম্ফিয়া উঠিলাম আকাশের পানে তুলি বাহু, আমি নব রাহু! হেরিলাম সেবারতা মহীয়সী মহালক্ষ্মী প্রকৃতির রূপ, সহসা সে ভুলিয়াছে সেবা, আগমন-ভয়ে মোর প্রস্তর-শিখার সম নিশ্চল নিশ্চুপ! অনুমানি যেন কোনো সর্বনাশা অমঙ্গল ভয় জাগি আছে শিশুর শিয়র-পাশে ধ্যানমগ্না মাতা, শ্বাস নাহি বয়। মনে হল ওই বুঝি হারা-মাতা মোর! মৌনা ওই জননীর           শুভ্র শান্ত কোলে – প্রহ্লাদকুলের আমি কাল-দৈত্য-শিশু – ঝাঁপাইয়া পড়িলাম ‘মা আমার’ বলে। নাহি জানি কোন্ ফণিমনসার হলাহল-লোকে – কোন্ বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে – নাগমাতা কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্রফণা নাগ ভীষণ তক্ষকশিশু! কোথা হয় নাগনাশী জন্মেজয়-যাগ – উচ্চারিছে আকর্ষণ-মন্ত্র কোন্ গুণী – জন্মান্তর-পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি! মন্ত্র-তেজে পাংশু হয়ে ওঠে মোর হিংসা-বিষ-ক্রোধ-কৃষ্ণ প্রাণ, আমার তুরীয় গতি – সে যে ওই অনাদি উদয় হতে হিংসাসর্প-যজ্ঞমন্ত্র-টান! ছুটে চলি অনন্ত তক্ষক ঝড় – শন – শন – শনশন শন সহসা কে তুমি এলে হে মর্ত্য-ইন্দ্রাণী মাতা, তব ওই ধূলি-আস্তরণ     বিছায়ে আমার তরে জাতকের জন্মান্তর হতে? লুকানু ও-অঞ্চল-আড়ালে, দাঁড়ালে আড়াল হয়ে মোর মৃত্যু-পথে!     ব্যর্থ হল অঞ্চল-আড়াল; বহ্নি-আকর্ষণ মন্ত্র-তেজে ব্যাকুল ভীষণ     রক্তে রক্তে বাজে মোর – শনশন শন – শন – শন – ওই শুন দূর – দূরান্তর হতে মাগো, ডাকে মোরে অগ্নি-ঋষি বিষহরি সুর!        জননী গো চলিলাম অনন্ত চঞ্চল, বিষে তব নীল হল দেহ, বৃথা মা গো দাব-দাহে পুড়ালে অঞ্চল! ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী,           মমতা-জননী দাহে মোর পড়িল মুরছি; আমি চলি প্রলয়-পথিক – দিকে দিকে মারী-মরু রচি।    ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় – শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় – কোলাহল-কল্লোলের হিল্লোল-হিন্দোল – দুরন্ত দোলায় চড়ি – ‘দে দোল দে দোল’ উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে উন্মদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে! ছুটে চলি ঝড় – গৃহ-হারা শান্তি-হারা বন্ধ-হারা ঝড় – স্বেচ্ছাচার-ছন্দে নাচি !       ক্কড়ক্কড় ক্কড়     কণ্ঠে মোর লুণ্ঠে ঘোর বজ্র-গিটকিরি, মেঘ-বৃন্দাবনে মুহু      ছুটে মোর বিজুরির জ্বালা-পিচকিরি! উড়ে সুখ-নীড়, পড়ে ছায়া-তরু,       নড়ে ভিত্তি রাজ-প্রাসাদের, তুফান-তুরগ মোর উরগেন্দ্র-বেগে ধায়। আমি ছুটি অশান্ত-লোকের প্রশান্ত-সাগর-শোষা উষ্ণশ্বাস টানি। লোকে লোকে পড়ে যায় প্রলয়ের ত্রস্ত কানাকানি!    ঝড় – ঝড় – উড়ে চলি ঝড় মহাবায়-পঙ্খিরাজে চড়ি, পড়-পড় আকাশের ঝোলা শামিয়ানা মম ধূলিধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি! প্রমত্ত সাগর-বারি – অশ্ব মম তুফানির খর ক্ষুর-বেগে আন্দোলি আন্দোলি ওঠে। ফেনা ওঠে জেগে     ঝটিকার কশা খেয়ে অনন্ত তরঙ্গ-মুখে তার ! আমি যেন সাপুড়িয়া          মারি মন্ত্র-মার– ঢেউ-এর মোচড়ে তাই        মহাসিন্ধু-মুখে জল-নাগ-নাগিনিরা আছাড়ি পিছাড়ি মরে ধুঁকে! প্রিয়া মোর ঘূর্ণিবায়ু     বেদুইন-বালা     চূর্ণি চলে ঝঞ্ঝা-চুর মম আগে আগে। ঝরনা-ঝোরা তটিনীর নটিনি-নাচন-সুখ লাগে শুষ্ক খড়কুটো ধূলি শীত-শীর্ণ বিদায়-পাতায় ফাল্গুনী-পরশে তার। – আমার ধমকে নুয়ে যায় বনস্পতির মহা মহিরুহ, শাল্মলি, পুন্নাগ, দেওদার,         ধরি যবে তার জাপটি পল্লব-ঝুঁটি, শাখা-শির ধরে দিই নাড়া; গুমরি কাঁদিয়া ওঠে প্রণতা বনানী,     চচ্চড় করে ওঠে পাহাড়ের খাড়া শির-দাঁড়া!    প্রিয়া মোর এলোমেলো গেয়ে গান আগে আগে চলে; পাগলিনি কেশে ধূলি চোখে তার মায়া-মণি ঝলে। ঘাগরির ঘূর্ণা তার ঘূর্ণি-ধাঁধা লাগায় নয়নালোকে মোর। ঘূর্ণিবালা হাসির হররা হানি বলে – ‘মনোচোর।   ধরো তো আমারে দেখি’ – ত্রস্ত-বাস হাওয়া-পরি, বেণি তার দুলে ওঠে সুকঠিন মম ভালে ঠেকি।     পাগলিনি মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পথধূলি, হানে গায় ঝরনা-কুলুকুচু, পদ্ম-বনে আলুথালু খোঁপা পড়ে খুলি!     আমি ধাই পিছে তার দুরন্ত উল্লাসে; লুকায় আলোর বিশ্ব চন্দ্র সূর্য তারা পদভর-ত্রাসে!     দীর্ঘ রাজপথ-অজগর সংকুচিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, ধরণি-কূর্মপৃষ্ঠ দীর্ণ জীর্ণ হয়ে ওঠে মত্ত মোর প্রমত্ত ঘর্ষণে।     পশ্চাতে ছুটিয়া আসে মেঘ ঐরাবত-সেনাদল গজগতি-দোলা-ছন্দে; স্বরগে বাজে বাদল-মাদল!     সপ্ত সাগর শোষি শুণ্ডে শুণ্ডে তারা– উপুড় ধরণি-পৃষ্ঠে উগারে নিযুত লক্ষ বারি-তীর-ধারা।     বয়ে যায় ধরা-ক্ষত-রসে   সহস্র পঙ্কিল স্রোত-ধার।     চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত-ধারা-ফুলে   বরষার বুকে ঝলে জল-মালা-হার। আমি ঝড়, হুল্লোড়ের সেনাপতি; খেলি মৃত্যু-খেলা ঘূর্ণনীয়া প্রিয়া-সাথে। দুর্যোগের হুলাহুলি মেলা   ধায় মম অশ্রান্ত পশ্চাতে! মম প্রাণরঙ্গে মাতি নিখিলের শিখী-প্রাণ মুহু-মুহু মাতে! শ্যাম স্বর্ণ পত্রে পুষ্পে কাঁপে তার অনন্ত কলাপ। – দারুণ দাপটে মম জেগে ওঠে অগ্নিস্রাব-জ্বলন্ত-প্রলাপ     ভূমিকম্প-জরজর থরথর ধরিত্রীর মুখে! বাসুকি-মন্দার সম মন্থনে মম সিন্ধুতট ভরে ফেনা-থুকে। জেগে ওঠে মম সেই সৃষ্টি-সিন্ধু-মন্থন-ব্যথায় রবি শশী তারকার অনন্ত বুদবুদ! – উঠে ভেঙে যায়     কত সৃষ্টি কত বিশ্ব আমার আনন্দ-গতিপথে। শিবের সুন্দর ধ্রুব-আঁখি যমের আরক্ত ঘোর মশাল-নয়ন-দীপ মম রথে। জয়ধ্বনি বাজে মোর স্বর্গদূত ‘মিকাইলের’ আতশি-পাখায়। অনন্ত-বন্ধন-নাগ-শিরস্ত্রাণ শোভে শিরে! শিখী-চূড়ায় তায়     শনির অশনি ওই ধূমকেতু-শিখা, পশ্চাতে দুলিছে মোর অনন্ত আঁধার চিররাত্রি-যবনিকা! জটা মোর নীহারিকাপুঞ্জ-ধূম পাটল পিঙ্গাস, বহে তাহে রক্ত-গঙ্গা নিপীড়িত নিখিলের লোহিত নিষ্কাশ।    ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –     ক্কড়ক্কড় ক্কড় – বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে! ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবিরশ্মি-পথ রোধে।     ঝঞ্ঝনা-ঝাপটে মম     ভীত কূর্ম সম     সহসা সৃষ্টির খোলে নিয়তি লুকায়। আমি ঝড়, জুলুমের জিঞ্জির-মঞ্জীর বাজে ত্রস্ত মম পায়! ধাক্কার ধমকে মম খান খান নিষিদ্ধের নিরুদ্ধ দুয়ার, সাগরে বাড়ব লাগে,         মড়ক দুয়ার্কি ধরে আমার ধুয়ার! কৈলাসে উল্লাস ঘোষে ডম্বরু ডিণ্ডিম     দ্রিম দ্রিম দ্রিম!     অম্বর-ডঙ্কার ডামাডোল সৃজনের বুকে আনে অশ্রু-বন্যা ব্যথা-উতরোল। ভাণ্ডারে সঞ্চিত মম দুর্বাসার হিংসা ক্রোধ শাপ। ভীমা উগ্রচণ্ডা ফেলে উল্কারূপী অগ্নি-অশ্রু, সহিতে না পারি মম তাপ! আমি ঝড়, পদতলে ‘আতঙ্ক’-কুঞ্জর, হস্তে মোর ‘মাভৈঃ’-অঙ্কুশ। আমি বলি, ছুটে চলো প্রলয়ের লাল ঝাণ্ডা হাতে, –     হে নবীন পরুষ পুরুষ! স্কন্ধে তোলো উদ্ধত বিদ্রোহ-ধ্বজা; কণ্টক-অশঙ্ক রে নির্ভীক! পুরুষ ক্রন্দন-জয়ী, – দুঃখ দেখে দুঃখ পায় – ধিক তারে ধিক আমি বলি, বিশ্ব-গোলা নিয়ে খেলো লুফোলুফি খেলা! বীর নিক বিপ্লবের লাল-ঘোড়া,     ভীরু নিক পারে-ধাওয়া পলায়ন-ভেলা! আমি বলি, প্রাণানন্দে পিয়ে নে রে বীর, জীবন-রসনা দিয়া প্রাণ ভরে মৃত্যু-ঘন ক্ষীর! আমি বলি, নরকের ‘নার’ মেখে নেয়ে আয় জ্বালা-কুণ্ড সূর্যের হাম্মামে। রৌদ্রের-চন্দন-শুচি, উঠে বসো গগনের বিপুল তাঞ্জামে!     আমি ঝড় মহাশত্রু স্বস্তি-শান্তি-শ্রীর, আমি বলি, শ্মশান-সুষুপ্তি শান্তি –      জয়নাদ আমি অশান্তির।         পশ্চিম হইতে পূর্বে ঝঞ্ঝনা-ঝাঁঝর      ঝঞ্ঝা-জগঝম্প ঘোর – বাজায়ে চলেছি ঝড় –      ঝনাৎ ঝনাৎ ঝন ঝমরঝমরঝন ঝননঝননশন   শনশনশন   হুহু হুহু হুহু – সহসা কম্পিত-কণ্ঠ-ক্রন্দন শুনি কার – ‘উহু! উহু উহু উহু!’ সজল কাজল-পক্ষ্ম কে সিক্তবসনা একা ভিজে – বিরহিণী কপোতিনী, এলোকেশ কালোমেঘে পিঁজে। নয়ন-গগনে তার নেমেছে বাদল, ভিজিয়াছে চোখের কাজল, মলিন করেছে তার কালো আঁখি-তারা     বায়ে-ওড়া কেতকীর পীত পরিমল! এ কোন্ শ্যামলী পরি পুবের পরিস্থানে কেঁদে কেঁদে যায় –     নবোদ্ভিন্ন কুঁড়ি-কদম্বের ঘন যৌবন-ব্যথায়!     জেগেছে বালার বুকে এক বুক ব্যথা আর কথা, কথা শুধু প্রাণে কাঁদে, ব্যথা শুধু বুকে বেঁধে, মুখে ফোটে শুধু আকুলতা! কদম্ব তমাল তাল পিয়াল-তলায় দূর্বাদল-মখমলে শ্যামলী-আলতা তার মুছে মুছে যায়!   বাঁধে বেণি কেয়া-কাঁটা বনে। বিদেশিনি দেয়াশিনি একমনে দেয়া-ডাক শোনে!   দাদুরির আদুরি কাজরি শোনে আর আঁখি-মেঘ-কাজল গড়ায়ে   দুখ-বারি পড়ে ঝরঝরি। ঝিমঝিম রিমঝিম – রিমিরিমি রিম ঝিম   বাজে পাঁইজোর – কে তুমি পুরবি বালা? আর যেন নাহি পাই জোর    চলা-পায়ে মোর, ও-বাজা আমারও বুকে বাজে। ঝিল্লির ঝিমানি-ঝিনিঝিনি   শুনি যেন মোর প্রতি রক্ত-বিন্দু-মাঝে!    আমি ঝড়? ঝড় আমি? – না, না, আমি বাদলের বায়!   বন্ধু! ঝড় নাই কোথায়?   ঝড় কোথা? কই? – বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই –   ওই শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিক্কুর,         ওই তার ক্ষুর-হানা মেঘে! – না, না, আজ যাই আমি, আবার আসিব ফিরে,   হে বিদ্রোহী বন্ধু মোর! তুমি থেকো জেগে!   তুমি রক্ষী এ রক্ত-অশ্বের, হে বিদ্রোহী অন্তর্দেবতা! – শুনো শুনো মায়াবিনী ওই ডাকে ফের –     পুবের হাওয়ায় – যায় – যায় – সব ভেসে যায়   পুবের হাওয়ায় –         হায়! –  (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) ঝিঙে ফুল ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল! সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল- ঝিঙে ফুল।গুল্মে পর্ণ লতিকার কর্ণে ঢল ঢল স্বর্ণে ঝলমল দোলে দুল- ঝিঙে ফুল।পাতার দেশের পাখী বাঁধা হিয়া বোঁটাতে, গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে। পউষের বেলা শেষ পরি' জাফরানি বেশ মরা মাচানের দেশ ক'রে তোল মশগুল- ঝিঙে ফুল।শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকু রে আলুথালু ঘুমু যাও রোদে-গলা দুকুরে।প্রজাপতি ডেকে যায়- 'বোঁটা ছিঁড়ে চ'লে আয়।' আসমানের তারা চায়- 'চ'লে আয় এ অকূল!' ঝিঙে ফুল।।তুমি বল-'আমি হায় ভালোবাসি মাটি-মায়, চাই না ও অলকায়- ভালো এই পথ-ভুল।' ঝিঙে ফুল।। ঝুমকোলতায় জোনাকি ঝুমকোলতায় জোনাকি- মাঝে মাঝে বিষ্টি গো আবোল তাবোল বকে কে তারও চেয়ে মিষ্টি গো মিষ্টি, মিষ্টি। আকাশে সব ফ্যাকাশে ডালিম-দানা পাকেনি, চাঁদ ওঠেনি কোলে তার মা বলে সে ডাকেনি রাগ করেছে বাঘিনী বারো বছর হাসে না, স্বপ্ন তাহার ভেঙে যায় খোকা কেন আসে না। পাথর হয়ে আছে-ঝিনুক দুধের বাটি দোলে না মাকে বলে-'খোকা কই কিছুই খেলা হলো না! কিছুই ভালো লাগে না!' কেঁদে বলে ঘরের জিনিস-'যেমন ছিলাম তেমনি আছি- খোকা কেন ভাঙে না, কিছুই ভালো লাগে না।' ঝোড়ো গান [কীর্তন](আমি)     চাইনে হতে ভ্যাবাগঙ্গারাম                       ও দাদা শ্যাম! তাই        গান গাই আর যাই নেচে যাই                        ঝম্‌ঝমা্‌ঝম্ অবিশ্রাম ॥         আমি          সাইক্লোন আর তুফান          আমি          দামোদরের বান          খোশখেয়ালে উড়াই ঢাকা, ডুবাই বর্ধমান। আর   শিবঠাকুরকে কাঠি করে বাজাই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ড্রাম॥ টাকাওয়ালা জলের সাগরে আসিনু বাহিতে তরি, ‘জল দাও’ বলে কাঁদে সর্বহারার দল – চারিদিকে জল, জলের তৃষায় মরি! টাকা নাই নাকি শুনি টাঁকশালে এসে, টাকার সঙ্গে মাখামাখি, বলে – ‘টাকা থাকে কোন দেশে?’ লক্ষ্মী-বাহন প্যাঁচারা আসিয়া সারা দেশ ভরিয়াছে, বিধাতার দেওয়া ঐশ্বর্যরে রক্ষিতা করিয়াছে! টাকার সাকার আকার এসেই হয়ে যায় যেন পাখি, এত টাকা আসে, উড়ে যায় সব, পাখা গজাইল নাকি? কোথা বাসা বাঁধে এই সে টাকার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি? কোথা ডিম পাড়ে, ছানা হয় তার কোন সে ব্যাংকে জমি? মহাকাল-ব্যাধ দেখিতে পেয়েছে তাদের টাকার বাসা, মৃত্যু-শায়ক লইয়া এসেছে– যত টাকা ট্যাঁকে ঠাসা! এই চাকতির খাঁকতি ছিল না এ জীবনে কোনোদিন, টাকার মহিমা বুঝিনু, যেদিন আকন্ঠ হল ঋণ। যত শোধ করি, তত সুদ বাড়ে! ঋণ, না কচুরিপানা? শিলমোহরের ভয়ে চাইনিকো মোহরের মিহি-দানা! ধন্না দিইনি টাকাওয়ালাদের পাকা ইমারতে কভু, আল্লাহ্ ছাড়া কারেও কখনও বলিনি হুজুর, প্রভু! টাকাওয়ালাদের দেখে এই জ্ঞান হইয়াছে সঞ্চয়, টাকাওয়ালাদের চেয়ে ঝাঁকাওয়ালা অনেক মহৎ হয়!সোনা যারা পায়, তাহারাই হয় সোনার পাথর-বাটি, আশরফি পেয়ে আশরাফ হয় চালায়ে মদের ভাঁটি! মানুষের রূপে এরা রাক্ষস রাবণ-বংশধর, পৃথিবীতে আজ বড়ো হইয়াছে যত ভোগী বর্বর! এদের ব্যাংক ‘রিভার-ব্যাংক’ হইবে দুদিন পরে, বোঝে না লোভীরা, ভীষণ মৃত্যু আসিছে এদেরই তরে! জমানো অর্থ যত অনর্থ আনিয়াছে পৃথিবীতে, পরমার্থের প্রভু আসিয়াছে তাহার হিসাব নিতে! রবে না এ টাকা, বংশেও বাতি দিতে রহিবে না কেউ, তবু কমিল না নিত্য লোভীর ভুঁড়ির ঢেকুর-ঢেউ! ইহাদের লোভ নিরন্ন দেশবাসী করিবে না ক্ষমা, বহু আক্রোশ বহু ক্রোধ বহু প্রহরণ আছে জমা। রুটি কাগজের হয়ে যায়, তবু কাগজের টাকা লয়ে, পাতালের জীব পৃথিবীতে আজও বেড়ায় মাতাল হয়ে। কোন অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করিতে আসিনু কোথা? অক্টোপাসের মতো কেন মোরে জড়াল স্বর্ণলতা? ভিখারি হওয়ার ভিক্ষা চাহিয়াছিনু আল্লার কাছে, আজ দেখি মোর চারপাশে যত ভূত প্রেত যেন নাচে! আল্লাহ্! মোরে এ শাস্তি হতে ফিরাইয়া লয়ে যাও! টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে ফাঁকা আকাশের তলে নাও!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) ঠ্যাং-ফুলি হো-হো-হো উররো হো-হো! হো-হো-হো উররো হো-হো     উররো হো-হো     বাস কী মজা! কে শুয়ে চুপ সে ভুঁয়ে, নারছে হাতে পাশ কী সোজা!    হো-বাবা! ঠ্যাং ফুলো যে! হাসে জোর ব্যাংগুলো সে     ড্যাং তুলো তার     ঠ্যাংটি দেখে! ন্যাং ন্যাং য়্যাগগোদা ঠ্যাং আঁতকে ওঠায় ডানপিটেকে! এক ঠ্যাং তালপাতা তার যেন বাঁট হালকা ছাতার!     আর পাটা তার     ভিটরে ডাগর! যেন বাপ! গোবদা গো-সাপ পেট-ফুলো হুস এক অজাগর!    মোদোটার পিসশাশুড়ি গোদ-ঠ্যাং চিপসে বুড়ি     বিশ্ব জুড়ি     খিসসা যাহার! ঠে-ঠে ঠ্যাং নাক ডেঙা ডেং এই মেয়ে কি শিষ্যা তাহার? হাদে দেখ আসছে তেড়ে গোদা-ঠ্যাং ছাঁতসে নেড়ে,     হাসছে বেড়ে     বউদি দেখে! অ ফুলি! তুই যে শুলি দ্যাখ না গিয়ে চৌদিকে কে! বটু তুই জোর দে ভোঁ দৌড়, রাখালে! ভাঙবে গোঁ তোর     নাদনা গুঁতোর     ভিটিম ভাটিম! ধুমাধুম তাল ধুমাধুম পৃষ্ঠে, - মাথায় চাটিম চাটিম!    ‘ইতু’ মুখ ভ্যাংচে বলে – গোদা ঠ্যাং ন্যাংচে চলে     ব্যাং ছা যেন     ইড়িং বিড়িং! রাগে ওর ঠ্যাং নড়ে জোর য়্যাদ্দেখেছিস – তিড়িং তিড়িং!    মলিনা! অ খুকুনি! মা গো! কী ধুকপুকুনি     হাড়-শুগুনি     ভয়-তরাসে! দেখে ইস ভয়েই মরিস ন্যাংনুলোটার পাঁইতারাকে।গোদা-ঠ্যাং পুঁচকে মেয়ে আসে জোর উঁচকে ধেয়ে     কুঁচকে কপাল,     ইস কী রগড়! লেলিয়ে দে ঢেলিয়ে! ফোঁস করে ফের! বিষ কী জবর! ইন্দু! দৌড়ে যা না! হাসি, তুই বগ দেখা না!     দগ্‌ধে না!     তোল তাতিয়ে! রেণু! বাস, রেগেই ঠ্যাঙাস, বউদি আসুন বোলতা নিয়ে!    আর না খাপচি খেলো! ওলো এ আচ্ছি যে লো,     নাচছি তো খুব     ঠ্যাং নিয়ে ওর! ব্যাচারির হ্যাঁস-ফ্যাসানির শেষ নেই, মুখ ভ্যাংচিয়ে জোর!    ধ্যাত! পা পিছলে যে সে পড়ে তার বিষ লেগেছে     ইস! পেকেছে     বিষ-ফোঁড়া এক! সে ব্যথায় ঠ্যাং ফুলে তাই ঢাক হল পা-র পিঠ জোড়া দেখ!    আচ্ছু! সত্যি সে শোন কারুর এক রত্তি সে বোন,     দোষ নেই এতে     দোষ নিয়ো না! আগে তোর ঠ্যাং ফুলে জোর, তারপরে না দস্যিপনা!    আয় ভাই আর না আড়ি, ভাব কর কান্না ছাড়ি,     ঘাড় না নাড়ি,     কসনে ‘উহুঁ’! লক্ষ্মী! ধ্যাত, শোক কী? ছিঁচ-কাঁদুনে হসনে হুঁ হুঁ! উষাদের ঘর যাবিনে? লাগে তোর লজ্জা দিনে?     বজ্জাতি নে     রাখ তুলে লো! কেন? ঠ্যাং তেড়েং বেড়েং? হাসবে লোকে? বয়েই গেল!  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) ডুবিবে না আশাতরি তুমি ভাসাইলে আশাতরি, প্রভু, দুর্দিন ঘন ঝড়ে, ততবার ঝড় থেমে যায়, তরি যতবার টলে পড়ে। তুমি যে-তরির কাণ্ডারি তার ডুবিবার ভয় নাই, তোমার আদেশে সে তরির দাঁড় বাহি, গুন টেনে যাই। আসে বিরুদ্ধশক্তি ভীষণ প্রলয়-তুফান লয়ে কাঁপে তরণির যাত্রীরা কেহ নিরাশায় কেহ ভয়ে। নদীজল কাঁপে টলমল যেন আহত ফণীর ফণা, দমকে অশনি চমকে দামিনী – ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা। অন্ধ যামিনী, দেখিতে পাই না কাণ্ডারি তুমি কোথা? তোমার জ্যোতিতে অগ্রপথের দূর করো অন্ধতা! তোমার আলোরে আবৃত করে ভয়াল তিমির রাতি, দূর করো ভয়, হে চির-অভয়, জ্বালায়ে আশার বাতি! হে নবযুগের নব অভিযান-সেনাদল, শোনো সবে, তোমরা টলিলে তুফানে তরণি আরও চঞ্চল হবে। এ তরির কাণ্ডারি আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান, বিশ্বাস রাখো তাঁর শক্তিতে, এ তাঁহার অভিযান। ভয় যার মনে যুদ্ধ না করে তার পরাজয় হয়, ভয় যার নাই মরিয়াও সেই শহিদের হয় জয়। অগ্রপথের সেনারা করে না পৃষ্ঠপ্রদর্শন, জয়ী হয় তারা জীবনে, অথবা মৃত্যু করে বরণ! জীবন মৃত্যু সমান তাদের, ঘুম জাগরণ সম, এক আল্লাহ্‌ ইহাদের প্রভু, বন্ধু ও প্রিয়তম। আল্লার নামে অভিযান করি, আমাদের ভয় কোথা, দুবার মরে না মানুষ, তবুও কেন এ দুর্বলতা। ডুবে যদি তরি, বাঁচি কীবা মরি, আল্লা মোদের সাথি, যেখানেই উঠি তাঁর আশ্রয় পাব মোরা দিবারাতি। মোদের ভরসা একমাত্র সে নিত্য পরম প্রভু, দুলুক তরণি, আমাদের মন নাহি দোলে যেন কভু। পাব কূল মোরা পাব আশ্রয় – রাখো বিশ্বাস রাখো, তাঁর কাছে করো শক্তি ভিক্ষা, তাঁরে প্রাণ দিয়া ডাকো। পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করিয়া থির করো প্রাণমন, দূর হবে সব বাধা ও বিঘ্ন,আসিবে প্রভঞ্জন। হয়তো প্রভুর পরীক্ষা ইহা, ভয় দেখাইয়া তিনি ভয় করিবেন দূর আমাদের, জ্ঞাতা একক যিনি! পার হইতেছি মোরা নিরাশা ও অবিশ্বাসের নদী, ডুবিবে তরণি, যদি ভয় পাই অধৈর্য আসে যদি! হে নবযুগের নৌসেনা, রণতরির নওজোয়ান! আল্লারে নিবেদন করে দাও আল্লার দেওয়া প্রাণ। পলাইয়া কেহ বাঁচিতে পারে না মৃত্যুর হাত হতে, মরিতে হয় তো মরিব আমরা এক-আল্লার পথে। পৃথিবীর চেয়ে সুন্দরতর কত যে জগৎ আছে, সে জগৎ দেখে যাব আনন্দধামে আল্লার কাছে। – আমাদের কীবা ভয় – আমাদের চির চাওয়া-পাওয়া এক আল্লাহ্‌ প্রেমময়! তাঁর প্রেমে মোরা উন্মাদ, তাঁর তেজ হাতে তলোয়ার, মোদের লক্ষ্য চির-পূর্ণতা নিত্য সঙ্গ তাঁর। দুলুক মোদের রণতরি, যেন মনতরি নাহি দোলে, যেখানেই যাই মোরা জানি ঠাঁই পাব, পাব তাঁর কোলে। থেমে যাবে এই দুর্যোগ-ঘন প্রলয় তুফান ঝড়, ‘কওসর-অমৃত’ পাব, করো আল্লাতে নির্ভর! মোদের অপূর্ণতা ও অভাব পূরণ করিবে সে, অসম্ভবের অভিযান-পথে সৈন্য করেছে যে! তাঁরই নাম লয়ে বলি, বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো, তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাব থাকে না কোনো। তাঁহারই কৃপায় তাঁরে ভালোবেসে, বলে আমি চলে যাই, তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই। আর বলিব না। তাঁরে ভালোবেসে ফিরে এসে মোরে বলো, কী হারাইয়া কী পাইয়াছ তুমি, কী দশা তোমার হল!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) তরুণ প্রেমিক তরুণ প্রেমিক, প্রণয় বেদন জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায় ওগো বিজয়ী, নিখিল হূদয় কর কর জয় মোহন মায়ায়।নহে ও এক হিয়ার সমান হাজার কাবা হাজার মস্‌জিদ কি হবে তোর কাবার খোঁজে আশয় খোঁজ তোর হূদয় ছায়ায়।প্রেমের আলোয় যে দিল্‌ রোশন যেথায় থাকুক সমান তাহার খুদার মস্‌জিদ মুরত মন্দির ইশাই দেউল ইহুদখানায়।অমর তার নাম প্রেমের খাতায় জ্যোতির লেখায় রবে লেখা দোজখের ভয় করে না সে থাকে না সে বেহেস্তের আশায়।। তিলক দিলে কি শ্যাম তিলক দিলে কি শ্যাম ত্রিলোক ভুলাতে? কে দিল বনমালী বনমালা গলাতে?আঁখি যেন ঢলঢল আধফোটা শতদল কে শিখাল ও চাহনি গোপিনী ছলিতে? তুমি আমার সকালবেলার সুর তুমি আমার সকালবেলার সুর বিদায় আলোয় উদাস করা অশ্রুভারাতুর।ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায় ভালোবাসা চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায় রাত্রিশেষের চাঁদ তুমি গো, বিদায়বিধুর।তুমি আমার ভোরের ঝরা ফুল শিশির নাওয়া শুভ্রশুচি পূজারিণীতুল।অরুণ তুমি তরুণ তুমি করুণ তারও চেয়ে হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে তুমি ইন্দ্রসভার মৌনবীণা নীরবনিঠুর।। তুমি মোরে ভুলিয়াছ তুমি মোরে ভুলিয়াছ তাই সত্য হোক! – সেদিন যে জ্বলেছিল দীপালি-আলোক তোমার দেউল জুড়ি – ভুল তাহা ভুল! সেদিন ফুটিয়াছিল ভুল করে ফুল তোমার অঙ্গনে প্রিয়! সেদিন সন্ধ্যায় ভুলে পেরেছিলে ফুল নোটন-খোঁপায়!ভুল করে তুলি ফুল গাঁথি বর-মালা বেলাশেষে বারে বারে হয়েছ উতলা হয়তো বা আর কারও লাগি!…আমি ভুলে নিরুদ্দেশ তরি মোর তব উপকূলে না চাহিতে বেঁধেছিনু, গেয়েছিনু গান, নীলাভ তোমার আঁখি হয়েছিল ম্লান হয়তো বা অকারণে! গোধূলি বেলায় তোমার ও-আঁখিতলে! হয়তো তোমার পড়ে মনে, কবে যেন কোন লোকে কার বধূ ছিলে ; তারই কথা শুধু মনে পড়ে! –ফিরে যাও অতীতের লোক-লোকান্তরে এমনই সন্ধ্যায় বসি একাকিনী গেহে! দুখানি আঁখির দীপ সুগভীর স্নেহে জ্বালাইয়া থাক জাগি তারই পথ চাহি! সে যেন আসিছে দূর তারা-লোক বাহি পারাইয়া অসীমের অনন্ত জিজ্ঞাসা, সে দেখেছে তব দীপ, ধরণির বাসা!শাশ্বত প্রতীক্ষমানা অনন্ত সুন্দরী! হায়, সেথা আমি কেন বাঁধিলাম তরি, কেন গাহিলাম গান আপনা পাসারি? হয়তো সে গান মম তোমার ব্যথায় বেজেছিল। হয় তো বা লেগেছিল তার পায় আমার তরির ঢেউ। দিয়াছিল ধুয়ে চরণ-অলক্ত তব। হয়তো বা ছুঁয়ে গিয়েছিল কপোলের আকুল কুন্তল আমার বুকের শ্বাস। ও-মুখ-কমল উঠেছিল রাঙা হয়ে। পদ্মের কেশর ছুঁইলে দখিনা বায়, কাঁপে থরথর যেমন কমল-দল ভঙ্গুর মৃণালে সলাজ সংকোচে সুখে পল্লব-আড়ালে, তেমনই ছোঁয়ায় মোর শিহরি শিহরি উঠেছিল বারে বারে সারা দেহ ভরি!চেয়েছিলে আঁখি তুলি, ডেকেছিল যেন প্রিয় নাম ধরে মোর – তুমি জান, কেন! তরি মম ভেসেছিল যে নয়ন-জলে কূল ছাড়ি নেমে এলে সেই সে অতলে। বলিলে,– “অজানা বন্ধু, তুমি কী গো সেই, জ্বালি দীপ গাঁথি মালা যার আশাতেই কূলে বসে একাকিনী যুগ যুগ ধরি নেমে এসো বন্ধু মোর ঘাটে বাঁধ তরি!”বিস্ময়ে রহিনু চাহি ও-মুখের পানে কী যেন রহস্য তুমি – কী যেন কে জানে – কিছুই বুঝিতে নারি! আহ্বানে তোমার কেন জাগে অভিমান, জোয়ার দুর্বার আমার আঁখির এই গঙ্গা যমুনায়!– নিরুদ্দেশ যাত্রী, হায়, আসিলি কোথায়? একি তোর ধেয়ানের সেই জাদুলোক, কল্পনার ইন্দ্রপুরী? একি সেই চোখ ধ্রুবতারাসম যাহা জ্বলে নিরন্তর ঊর্ধ্বে তোর? সপ্তর্ষির অনন্ত বাসর? কাব্যের অমরাবতী? একি সে ইন্দিরা,তোরই সে কবিতা-লক্ষ্মী? –বিরহ-অধীরা একি সেই মহাশ্বেতা, চন্দ্রপীড়-প্রিয়া? উন্মাদ ফরহাদ যারে পাহাড় কাটিয়া সৃজিতে চাহিয়াছিল – একি সেই শিঁরী? লায়লি এই কি সেই, আসিয়াছে ফিরি কায়েসের খোঁজে পুনঃ? কিছু নাহি জানি! অসীম জিজ্ঞাসা শুধু করে কানাকানি এপারে ওপারে, হায়!…তুমি তুলি আঁখি কেবলই চাহিতেছিলে! দিনান্তের পাখি বনান্তে কাঁদিতেছিল – ‘কথা কও বউ!’ ফাগুন ঝুরিতেছিল ফেলি ফুল-মউ!কাহারে খুঁজিতেছিলে আমার এ চোখে অবসান-গোধূলির মলিন আলোকে? জিজ্ঞাসার, সন্দেহের শত আলো-ছায়া ও-মুখে সৃজিতেছিল কী যেন কি মায়া! কেবলই রহস্য হায়, রহস্য কেবল, পার নাই সীমা নাই অগাধ অতল! এ যেন স্বপনে-দেখা কবেকার মুখ, এ যেন কেবলই সুখ কেবলই এ দুখ! ইহারই স্ফুলিঙ্গ যেন হেরি রূপে রূপে, এ যেন মন্দার-পুষ্প দেব-অলকায়! যখন সবারে ভুলি। ধরার বন্ধন যখন ছিঁড়িতে চাহি, স্বর্গের স্বপন কেবলই ভুলাতে চায়, এই সে আসিয়া রূপে রসে গন্ধে গানে কাঁদিয়া হাসিয়া আঁকড়ি ধরিতে চাহে,–মাটির মমতা! পরান-পোড়েনি শুধু, জানে নাকো কথা ! বুকে এর ভাষা নেই, চোখে নাই জল, নির্বাক ইঙ্গিত শুদু শান্ত অচপল! এ বুঝি গো ভাস্করের পাষাণ-মানসী সুন্দর, কঠিন, শুভ্র। ভোরের ঊষসী, দিনের আলোর তাপ সহিতে না জানে। মাঠের উদাসী সুরে বাঁশরির তানে, বাণী নাই, শুধু সুর, শুধু আকুলতা! ভাষাহীন আবেদন দেহ-ভরা কথা। এ যেন চেনার সাথে অচেনার মিশা, – যত দেখি তত হায় বাড়ে শুধু তৃষা।আসিয়া বসিলে কাছে দৃপ্ত মুক্তানন, মনে হল – আমি দিঘি, তুমি পদ্মবন! পূর্ণ হইলাম আজি, হয় হোক ভুল, যত কাঁটা তত ফুল, কোথা এর তুল? তোমারে ঘিরিয়া রব আমি কালো জল, তরঙ্গের ঊর্ধ্বে রবে তুমি শতদল, পুজারির পুষ্পাঞ্জলিসম। নিশিদিন কাঁদিব ললাট হানি তীরে তৃপ্তিহীন! তোমার মৃণাল-কাঁটা আমার পরানে লুকায়ে রাখিব, যেন কেহ নাহি জানে। …কত কী যে কহিলাম অর্থহীন কথা, শত যুগ-যুগান্তের অন্তহীন ব্যথা।শুনিলে সেসব জাগি বসিয়া শিয়রে, বলিলে, “বন্ধু গো হের দীপ পুড়ে মরে তিলে তিলে আমাদের সাথে! আর নিশি নাই বুঝি, দিবা এলে দূরে যাব মিশি! আমি শুধু নিশীথের।” যখন ধরণি নীলিমা-মঞ্জুষা খুলি হেরে মুক্তামণি বিচিত্র নক্ষত্রমালা – চন্দ্র-দীপ জ্বালি, একাকী পাপিয়া কাঁদে ‘চোখ গেল’খালি, আমি সেই নিশিথের। – আমি কই কথা, যবে শুধু ফোটে ফুল, বিশ্ব তন্দ্রাহতা। হয়তো দিবসে এলে নারিব চিনিতে, তোমারে করিব হেলা, তব ব্যথা-গীতে কেবলই পাইবে হাসি সবার সুমুখে, কাঁদিলে হাসিব আমি সরল কৌতুকে, মুছাব না আঁখি-জল। বলিব সবায়, “তুমি শাঙনের মেঘ –যথায় তথায় কেবলই কাঁদিয়া ফের, কাঁদাই স্বভাব! আমি তো কেতকী নহি, আমার কি লাভ ওই শাঙনের জলে? কদম্ব যূথীর সখারে চাহি না আমি। শ্বেত-করবীর সখী আমি। হেমন্তের সান্ধ্য-কুহেলিতে দাঁড়াই দিগন্তে আসি, নিরশ্রু-সংগীতে ভরে ওঠে দশ দিক! আমি উদাসিনী। মুসাফির! তোমারে তো আমি নাহি চিনি!”ডাকিয়া উঠিল পিক দূরে আম্রবনে মুহুমুহু কুহুকুহু আকুল নিঃস্বনে। কাঁদিয়া কহিনু আমি, “শুন, সখী শুন, কাতরে ডাকিছে পাখি কেন পুনঃ পুনঃ! চলে যাব কোন দূরে, স্বরগের পাখি তাই বুঝি কেঁদে ওঠে হেন থাকি থাকি। তোমারই কাজল আঁখি বেড়ায় উড়িয়া, পাখি নয় – তব আঁখি ওই কোয়েলিয়া!”হাসিয়া আমার বুকে পড়িলে লুটায়ে, বলিলে, –“পোড়ারমুখি আম্রবনচ্ছায়ে দিবানিশি ডাকে, শুনে কান ঝালাপালা! জানি না তো কুহু-স্বরে বুকে ধরে জ্বালা! উহার স্বভাব এই, তোমারই মতন অকারণে গাহে গান, করে জ্বালাতন!নিশি না পোহাতে বসি বাতায়ন-পাশে হলুদ-চাঁপার ডালে, কেবলই বাতাসে উহু উহু উহু করি বেদনা জানায়! বুঝিতে নারিনু আমি পাখি ও তোমায়!”নয়নের জল মোর গেল তলাইয়া বুকের পাষাণ-তলে। উৎসারিত হিয়া সহসা হারাল ধারা তপ্ত মরু-মাঝে। আপনারে অভিশাপি ক্ষমাহীন লাজে! কহিনু, “কে তুমি নারী, এ কি তব খেলা? অকারণে কেন মোর ডুবাইলে ভেলা, এ অশ্রু-পাথারে একা দিলে ভাসাইয়া? দুহাতে আন্দোলি জল কূলে দাঁড়াইয়া, অকরুণা, হাস আর দাও করতালি!অদূরে নৌবতে বাজে ইমন-ভূপালি তোমার তোরণ-দ্বারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া, – তোমার বিবাহ বুঝি? ওই বাঁশুরিয়া ডাকিছে বন্ধুরে তব?” যুঝি ঢেউ সনে শুধানু পরান-পণে।…তুমি আনমনে বারেক পশ্চাতে চাহি পড়িলে লুটায়ে স্রোতজলে, সাঁতরিয়া আসি মম পাশে ‘আমিও ডুবিব সাথে’বলিয়া তরাসে জড়ায়ে ধরিলে মোরে বাহুর বন্ধনে!… হইলাম অচেতন!… কিছু নাই মনে কেমনে উঠিনু কূলে!… কবে সে কখন জড়াইয়া ধরেছিলে মালার মতন নিশীথে পাথার-জলে, – শুধু এইটুকু সুখ-স্মৃতি ব্যথা সম চির-জাগরূক রহিল বুকের তলে!… আর কিছু নাই!… তোমারে খুঁজিয়া ফিরি এ কূলে বৃথাই, হে চীর রহস্যময়ী!ও কূলে দাঁড়ায়ে তেমনই হাসিছ তুমি সান্ধ্য-বনচ্ছায়ে চাহিয়া আমার মুখে! তোমার নয়ন বলিছে সদাই যেন, ‘ডুবিয়া মরণ এবার হল না, সখা! আজও যায় সাধ বাঁচিতে ধরার পরে। স্বপনের চাঁদ হয়তো বা দিবে ধরা জাগ্রত এলোকে, হয়তো নামিবে তুমি অশ্রু হয়ে চোখে, আসিবে পথিক-বন্ধু হয়ে প্রিয়তম বুকের ব্যাথায় মোর – পুষ্পে গন্ধ সম! অঞ্জলি হইতে নামি তোমার পূজার জড়াইয়া রব বক্ষে হয়ে কণ্ঠহার!’নিশীথের বুক-চেরা তব সেই স্বর, সেই মুখ সেই চোখ করুণা-কাতর পদ্মা-তীরে-তীরে রাতে আজও খুঁজে ফিরি! কত নামে ডাকি তোমা, – “মহাশ্বেতা, শিঁরী, লায়লি, বকৌলি, তাজ, দেবী, নারী, প্রিয়া!” – সাড়া নাহি মিলে কারও! ফুলিয়া ফুলিয়া বয়ে যায় মেঘনার তরঙ্গ বিপুল, কখনও এ-কূল ভাঙে কখনও ও-কূল!পার হতে নারি এই তরঙ্গের বাধা, ও যেন ‘এসো না’ বলে পায়ে ধরে-কাঁদা তোমার নয়ন-স্রোত! ও যেন নিষেধ, বিধাতার অভিশাপ, অনন্ত বিচ্ছেদ, স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে যেন যবনিকা!… আমাদের ভাগ্যে বুঝি চিররাত্রি লিখা! নিশীথের চখাচখি, দুইপারে থাকি দুইজনে দুইজন ফিরি সদা ডাকি! কোথা তুমি? তুমি কোথা? যেন মনে লাগে, কত যুগ দেখি নাই! কত জন্ম আগে তোমারে দেখেছি কোন নদীকূলে গেহে, জ্বালো দীপ বিষাদিনী ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে! বারে বারে কাঁপে, আকাশ-দীপিকা কাঁপে তারারাজি – যেন আঁখি-পাতা তব,– এইটুকু পড়ে মনে! কবে অভিনব উঠিলে বিকশি তুমি আমার মাঝে, দেখি নাই! দেখিব না – কত বিনা কাজে নিজেরে আড়াল করি রাখিছ সতত অপ্রকাশ সুগোপন বেদনার মতো। আমি হেথা কূলে কূলে ফিরি আর কাঁদি, কুড়ায়ে পাব না কিছু? বুকে যাহা বাঁধি তোমার পরশ পাব – একটু সান্ত্বনা! চরণ-অলক্ত-রাঙা দুটি বালুকণা, একটি নূপুর, ম্লান বেণি-খসা ফুল, করবীর সোঁদা-ঘষা পরিমল-ধুল, আধখানি ভাঙা চুড়ি রেশমি কাচের, দলিত বিশুষ্ক মালা নিশি-প্রভাতের, তব হাতে লেখা মম প্রিয় ডাক-নাম লিখিয়া ছিঁড়িয়া-ফেলা আধখানি খাম, অঙ্গের সুরভি-মাখা ত্যক্ত তপ্ত বাস, মহুয়ার মদ সম মদির নিশ্বাস পুরবের পরিস্থান হতে ভেসে-আসা, – কিছুই পাব না খুঁজি? কেবলই দুরাশা। কাঁদিবে পরান ঘিরি? নিরুদ্দেশ পানে কেবলই ভাসিয়া যাব শ্রান্ত ভাটি-টানে? তুমি বসি রবে ঊর্ধ্বে মহিম-শিখরে নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে নামিবে না প্রিয়া-রূপে ধরার ধুলায়? লো কৌতুকময়ী! শুধু কৌতুক-লীলায় খেলিবে আমারে লয়ে? –আর সবই ভুল? ভুল করে ফুটেছিল আঙিনায় ফুল? ভুল করে বলেছিলে সুন্দর? অমনি – ঢেকেছ দুহাতে মুখ ত্বরিতে তখনই! বুঝি কেহ শুনিয়াছে, দেখিয়াছে কেহ ভাবিয়া আঁধার কোণে লীলায়িত দেহ লুকাওনি সুখে লাজে? কোন শাড়িখানি পরেছিলে বাছি বাছি সে সন্ধ্যায় রানি?হয়তো ভুলেছ তুমি, আমি ভুলি নাই! যত ভাবি ভুল তাহা – তত সে জড়াই সে ভুলে সাপিনিসম বুকে ও গলায়! বাসি লাগে ফুলমেলা। – ভুলের খেলায় এবার খোয়াব সব, করিয়াছি পণ। হোক ভুল, হোক মিথ্যা, হোক এ স্বপন, –এইবার আপনারে শূন্য রিক্ত করি দিয়া যাব মরণের আগে! পাত্র ভরি করে যাব সুন্দরের করে বিষপান! তোমারে অমর করি করিব প্রয়াণ মরণের তীর্থযাত্রী! ওগো, বন্ধু প্রিয়, এমনই করিয়া ভুল দিয়া ভুলাইয়ো বারে বারে জন্মে জন্মে গ্রহে গ্রহান্তরে! ও-আঁখি-আলোক যেন ভুল করে পড়ে আমার আঁখির পরে। গোধূলি-লগনে ভুল করে হই বর, তুমি হও কনে ক্ষণিকের লীলা লাগি! ক্ষণিকের চমকি অশ্রুর শ্রাবণ-মেঘে হারাইয়া সখী!…তুমি মোরে ভুলিয়াছ, তাই সত্য হোক! নিশি-শেষে নিভে গেছে দীপালি-আলোক! সুন্দর কঠিন তুমি পরশ-পাথর তোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর – – তুমি তাহা জানিলে না! …সত্য হোক প্রিয়া দীপালি জ্বলিয়াছিল – গিয়াছে নিভিয়া!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) তূর্য-নিনাদ (আজ) ভারত-ভাগ্য-বিধাতার বুকে গুরু-লাঞ্ছনা-পাষাণ-ভার,              আর্ত-নিনাদে হাঁকিছে নকিব, – কে করে মুশকিল আসান তার?                  মন্দির আজি বন্দির ঘানি,              নির্জিত ভীত সত্য, বদ্ধ রুদ্ধ স্বাধীন আত্মার বাণী,            সন্ধি-মহলে ফন্দির ফাঁদ, গভীর আন্ধি-অন্ধকার!              হাঁকিছে নকিব – হে মহারুদ্র চূর্ণ করো এ ভণ্ডাগার॥                    রক্তে-মদের বিষ পান করি              আর্ত মানব; স্রষ্টা কাতর সৃষ্টির তাঁর নির্বাণ স্মরি!              ক্রন্দন-ঘন বিশ্বে স্বনিছে প্রলয়-ঘটার হুহুংকার, –              হাঁকিছে নকিব – অভয়-দেবতা, এ মহাপাথার করহ পার॥                    কোলাহল-ঘাঁটা হলাহল-রাশি              কে নীলকণ্ঠ গ্রাসিবে রে আজ দেবতার মাঝে দেবতা সে আসি?              উরিবে কখন ইন্দিরা, ক্রোড়ে শান্তির ঝারি সুধার ভাঁড়?              হাঁকিছে নকিব – আনো ব্যথা-ক্লেশ-মন্থন-ধন অমৃত-ধার॥                    কণ্ঠ ক্লিষ্ট ক্রন্দন-ঘাতে,              অমৃত-অধিপ নর-নারায়ণ দারুময় ঘন মনোবেদনাতে।              দশভুজে গলে শৃঙ্খল-ভার দশপ্রহরণধারিণী মার –              হাঁকিছে নকিব – ‘আবিরাবির্ম এধি’ হে নব যুগাবতার!                    মৃত্যু-আহত মৃত্যুঞ্জয়,              কে শোনাবে তাঁরে চেতন-মন্ত্র? কে গাহিবে জয় জীবনের জয়?              নয়নের নীরে কে ডুবাবে বলো বলদর্পীর অহংকার? –              হাঁকিছে নকিব – সে দিন বিশ্বে খুলিবে আরেক তোরণ-দ্বার॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) তোমায় যেমন করে ডেকেছিল তোমায় যেমন করে ডেকেছিল আরব মরুভূমি; ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী, তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী ডেকেছিল নিরবধি, হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী, তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড় জেগেছিল আশায় তোমার হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম, তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।মজলুমেরা কাবা ঘরে কেঁদেছিল যেমন করে, হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা, তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।। তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত। ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার  দেখানো পথ ॥ ক্ষমা কর হজরত।বিলাস-বিভব দলিয়াছ পায় ধূলি সম তুমি, প্রভু, তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা-নবাব কভু। এই ধরণীর ধন-সম্ভার - সকলের তাহে সম অধিকার; তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্র-বৎ ॥ ক্ষমা কর হজরত।তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি ক’রে আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে। ভিন্ ধর্মীর পূজা-মন্দির, ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর, আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনাকো পর-মত ॥ ক্ষমা কর হজরত।তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি, তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী। মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা সার করিয়াছি ধর্মন্ধতা, বেহেশ্ত্ হ’তে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত ॥ তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত। ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ ॥ ক্ষমা কর হজরত। তোমারি আঁখির মত তোমারি আঁখির মত আকাশের দুটি তারা চেয়ে থাকে মোর পানে নিশীথে তন্দ্রাহারা। সে কি তুমি? সে কি তুমি?ক্ষীণ আঁখিদীপ জ্বালি বাতায়নে জাগি একা অসীম অন্ধকারে খুঁজি তব পথরেখা সহসা দখিনবায়ে চাঁপাবনে জাগে সাড়া। সে কি তুমি? সে কি তুমি?তব স্মৃতি যদি ভুলি ক্ষণতরে আনকাজে কে যেন কাঁদিয়া ওঠে আমার বুকের মাঝে।বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে ঝড় চলে যায় কেঁদে, ঢালিয়া শ্রাবণধারা। সে কি তুমি? সে কি তুমি? তোমারে পড়িছে মনে তোমারে পড়িছে মনে       আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,       যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে       কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে-                   তোমারে পড়িছে মনে। হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে                   ঝিলিমিলি-তলে ম্লান   লুলিত অঞ্ছলে          চাহিয়া বসিয়া আছ একা, বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা। বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি, তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।                           সিক্ত-পক্ষ পাখী তোমার চাঁপার ডালে বসিয়া একাকী হয়ত তেমনি করি, ডাকিছ সাথীরে, তুমি চাহি' আছ শুধু দূর শৈল-শিরে ।।        তোমার আঁখির ঘন নীলাঞ্জন ছায়া        গগনে গগনে আজ ধরিয়াছে কায়া । ...আজি হেথা রচি' নব নীপ-মালা-- স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা              অকারণে !-জানি আমি জানি তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু। বহে আজি দিশাহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন, তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন,            খুঁজে যায় মোর গীত-সুর কোথা কোন্‌ বাতায়নে বসি' তুমি বিরহ-বিধুর। তোমার গগনে নেভে বারে বারে বিজলীর দীপ, আমার অঙ্গনে হেথা বিকশিয়া ঝরে যায় নীপ।            তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল, আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।আমার বেদনা আজি রূপ ধরি' শত গীত-সুরে নিখিল বিরহী-কন্ঠে--বিরহিণী--তব তরে ঝুরে!             এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!             তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফুল! তোমারে ভিক্ষা দাও বলো হে পরম প্রিয়-ঘন মোর স্বামী! আমাতে কাহারও অধিকার নাই, এক সে তোমার আমি। ভালো ও মন্দে মধুর দ্বন্দ্বে কী খেলা আমারে লয়ে খেলিতেছ তুমি, কেহ জানিবে না, থাকুক গোপন হয়ে! আমারেও তাহা জানিতে দিয়ো না শুধু এই জানাইয়ো, আমার পূর্ণ পরম মধুর, মধুর তুমি হে প্রিয়! আমার জানা ও না-জানা সর্ব অস্তিত্বের প্রভু একা তুমি হও! সেথা কারও ছায়া পড়ে নাকো যেন কভু! তোমার আমার পরমানন্দ ফোটে ছন্দ ও গানে, তুমি শুনো তাহা, তুমি লঘু ; গুরুজন হাত দিক কানে! লতার প্রলাপ গোলাপের মতো কথা মোর কেন ফোটে! তুমি জান, কেন উষা আসে ভোরে, কেন শুকতারা ওঠে। ঘুমে জাগরণে শয়নে স্বপনে সর্বকর্মে মম তব স্মৃতি তব নাম যেন হয় সাথি মোর, প্রিয়তম! নিবিড় বেদনা হইয়া আমার বক্ষে নিত্য থেকো, ভুলিতে দিয়ো না, আমি যদি ভুলি অমনি আমারে ডেকো! তুমি যারে ভোলো, ভাগ্যহীন সে তোমারে ভুলিয়া যায়, তুমি কৃপা করে চাহ যার পানে, সেই তব প্রেম পায়। তুমি যারে ডাক, পাগল হইয়া সেই ধায় তব পথে, বাঁশি না শুনিলে বন-হরিণী কি ছুটে আসে বন হতে? চাঁদ ওঠে আগে, দেখে অনুরাগে চকোরী ব্যাকুলা হয়, এত পাখি আছে, চাতকীরই কেন মেঘের সাথে প্রণয়? কে দিলে তাহারে মেঘের তৃষ্ণা, হে রস-মধুর, বলো! তুমি রস দিলে আঁখির আকাশ হয় জল-ছলছল। চাঁদ যবে ওঠে, চকোর তাহার চকোরীরে ভুলে যায়, চকোরীও ভোলে চকোরে, যখন চাঁদের সে দেখা পায়। চাঁদের স্বপন ভুলিয়া দুজন নীড়ে কেন ফিরে আসে? তব লীলা ধরা পড়ে যায়, দেখে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে। তুমি নির্গুণ নাকি? আমি দেখি গুণের অন্ত নাই, ভিক্ষা যাচ্ঞা করিতে আসিয়া শুধু তব গুণ গাই! ভুলে যাই আমি কী ভিক্ষা চাই, পরান কাহারে যাচে, খুঁজিয়া পাই না ভিক্ষার ঝুলি, চোরে চুরি করিয়াছে! মন হাসে, প্রাণ কাঁদে! বলে, জানি চুরি করে কোন চোরে। তোমারে যে চায় ভিক্ষা, তাহার ঝুলিটিও নাও হরে! যে হাতে ভিক্ষা চায়, ভিখারির সে হাত কাড়িয়া লও, হে মহামৌনী! কাঁদ কেন এত? কথা কও কথা কও! কত যুগ গেল, কত সে জনম শুনিনি তোমার কথা, এত অনুরাগ দিয়ে, বৈরাগী, কেন দিলে বধিরতা? তোমারে দেখার দৃষ্টি দিলে না, দিলে শুধু আঁখিজল, অশ্রু তোমার কৃপা ; তবু আঁখি হল নাকি নির্মল? দৃষ্টিরে কেন ফিরাইয়া দাও – তব সৃষ্টির পানে? বলো, বলো, কোথা লুকাইয়া আছ সৃষ্টির কোনখানে! ঊর্ধ্বে যাব না, লহো হাত ধরে তব সৃষ্টির কাছে, কোথা তুমি, সেথা লয়ে যাও, এই অন্ধ ভিখারি যাচে! কী ভিক্ষা চায় ভিখারি তোমার, আগে থেকে রাখো জেনে, চাহিব যখন, হে চোর, তখন পলায়ো না হার মেনে। আর কিছু নয়, চির প্রেমময়, তোমারে ভিক্ষা চাই, এক তুমি ছাড়া এই ভিখারির কিছুই চাওয়ার নাই! তব দেওয়া এই তনুমনপ্রাণ মোর যাহা কিছু আছে, তুমি জান, কেন নিবেদন করে দিয়াছি তোমার কাছে। যা-কিছু পেয়েছি, পাইতেছি যাহা, পাইব যা কিছু পরে, সে যে তব দান, তাই নিবেদিত থাক উহা তব তরে। তোমার দানের সম্মান, প্রভু, আমি কি রাখিতে পারি? তব দান দাও সকলে বিলায়ে, আমারে করো ভিখারি! তব দান মোর কামনা ও লোভ সঞ্চিত করে রাখে, বঞ্চিত করে তোমার মিলনে, ওই সবই ঘিরে থাকে! দান দিয়ে মোরে দিয়ো না ফিরায়ে, হে দানী, তোমারে দাও, তব দান নিয়ে তব ভিখারিরে চিরতরে চিনে নাও! তোমারেই চাই জেনে করিয়াছ চুরি ভিক্ষার ঝুলি, ধরা পড়িয়াছ মনোচোর, দাও চোখের বাঁধন খুলি। সব ভুলে যাই, কিছু মনে নাই, খেলাতেছিলে কী খেলা, আমারই মতন ঘুমাইতে কারে দাওনি? তব নাম লয়ে সুদূর মিনারে কে ডাকিছে ভোরবেলা?   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) তোরা সব জয়ধ্বনি কর তোরা সব জয়ধ্বনি কর ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি করআসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশায় নৃত্য পাগল সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক ভেনে ভাঙলো আগল মৃত্যুগহন অন্ধকুপে মহাকালের চন্ডরূপে ধূম্রধূপে বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর তোরা সব জয়ধ্বনি করদ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায় দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায় বিন্দু তাহার নয়নজলে সপ্তমহাসিন্ধু দোলে কপোলতলে বিশ্বমায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর পর হাঁকে ঐ জয় প্রলয়ংকর তোরা সব জয়ধ্বনি করমাভৈঃ মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে এবার মহানিশার শেষে আসবে ঊষা অরুণ হেসে তরুণ বেশে দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশুচাঁদের কর আলো তার ভরবে এবার ঘর তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায় ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়। আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্‌বি যদি আয়।। ধূলির ধরা বেহেশ্‌তে আজ, জয় করিল দিল রে লাজ। আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।। দেখ্‌ আমিনা মায়ের কোলে, দোলে শিশু ইসলাম দোলে। কচি মুখে শাহাদাতের বাণী সে শোনায়।। আজকে যত পাপী ও তাপী, সব গুনাহের পেল মাফী। দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী জুলুম নিল বিদায়।। নিখিল দরুদ পড়ে লয়ে নাম, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। জীন পরী ফেরেশ্‌তা সালাম জানায় নবীর পায়।। দহনমালা হায় অভাগি! আমায় দেবে তোমার মোহন মালা? বদল দিয়ে মালা, নেবে আমার দহন-জ্বালা?             কোন ঘরে আজ প্রদীপ জ্বেলে             ঘরছাড়াকে সাধতে এলে             গগনঘন শান্তি মেলে, হায়! দু-হাত পুরে আনলে ও কি সোহাগ-ক্ষীরের থালা             আহা দুখের বরণ ডালা?             পথহারা এই লক্ষ্মীছাড়ার পথের ব্যথা পারবে নিতে? করবে বহন, বালা?    লক্ষ্মীমণি! তোমার দিকে চাইতে আমি নারি,             দু-চোখ আমার নয়ন জলে পুরে, বুক ফেটে যায় তবু এ-হার ছিঁড়তে নাহি পারি, ব্যথাও দিতে নারি, – নারী! তাই যেতে চাই দূরে।                ডাকতে তোমায় প্রিয়তমা             দু-হাত জুড়ে চাইছি ক্ষমা,             চাইছি ক্ষমা চাইছি ক্ষমা গো! নয়ন-বাঁশির চাওয়ার সুরে             বনের হরিণ বাঁধবে বৃথা লক্ষ্মী গহনবালা। কল্যাণী! হায় কেমনে তোমায় দেব             যে-বিষ পান করেছি নীলের নয়ন-গালা।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) দারিদ্র্য হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার, বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার! দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস, অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস, অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ! শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম, দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম! আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজলটলটল ধরণীর মত করুণায়! তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায় করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’ সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল? জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,- রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে, তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে। কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা, দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!…. গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা, দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন, হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌, ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো, অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো, আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার, তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি, কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি! চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু, কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু, দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ, আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান, প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,- তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ, তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ। সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু, উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু। মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে! নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে! লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’ ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’ সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী? যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি! প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’! বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌ মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই ‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই। ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’ বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’! নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায় দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায় চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ! আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে! পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার। ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!- সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর, কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার, দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি? কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি? কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!…. আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই, ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই! দিদির বে-তে খোকা ‘সাত ভাই চম্পা জাগো’ – পারুলদি ডাকল, না গো? একী ভাই, কাঁদচ? – মা গো কী যে কয় – আরে দুত্তুর!পারায়ে সপ্ত-সাগর এসেছে সেই চেনা-বর? কাহিনির দেশেতে ঘর তোর সেই রাজপুত্তুর?মনে হয়, মণ্ডা মেঠাই খেয়ে জোর আয়েশ মিটাই! – ভালো ছাই লগাছে না ভাই, যাবি তুই একেলাটি!দিদি, তুই সেথায় গিয়ে যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে, জাগাব পরশ দিয়ে রেখে যাস সোনার কাঠি।   (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) দিল-দরদি (কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘খাঁচার পাখি’ শীর্ষক করুণ কবিতাটি পড়িয়া)কে ভাই তুমি সজল গলায়        গাইলে গজল আপশোশের? ফাগুন-বনের নিবল আগুন,        লাগল সেথা ছাপ পোষের।দরদ-ভেজা কান্না-কাতর        ছিন্ন তোমার স্বর শুনে ইরান মুলুক বিরান হল        এমন বাহার-মরশুমে।সিস্তানের ওই গুল-বাগিচা        গুলিস্তান আর বোস্তানে সোস্ত হয়ে দখিন হাওয়া        কাঁদল সে আপশোশ-তানে।এ কোন যিগর -পস্তানি সুর?        মস্তানি সব ফুল-বালা ঝুরল, তাদের নাজুক বুকে        বাজল ব্যথার শূল-জ্বালা।আবছা মনে পড়ছে, যে দিন        শিরাজ -বাগের গুল ভুলি শ্যামল মেয়ের সোহাগ-শ্যামার        শ্যাম হলে ভাই বুলবুলি, –কালো মেয়ের কাজল চোখের        পাগল চাওয়ার ইঙ্গিতে মস্ত্ হয়ে কাঁকন চুড়ির        কিঙ্কিণি রিন ঝিন গীতে।নাচলে দেদার দাদরা তালে,        কারফাতে, সরফর্দাতে, – হাঠাৎ তোমার কাঁপল গলা        ‘খাঁচার পাখি’ ‘গর্বাতে’।চৈতালিতে বৈকালি সুর        গাইলে, “নিজের নই মালিক, আফ্‌সে মরি আপশোশে আহ্,        আপ-সে বন্দী বৈতালিক।কাঁদায় সদাই ঘেরা-টোপের        আঁধার ধাঁধায়, তায় একা, ব্যথার ডালি একলা সাজাই,        সাথির আমার নাই দেখা।অসাড় জীবন, ঝাপসা দুচোখ        খাঁচার জীবন একটানা।” অশ্রু আসে, আর কেন ভাই,        ব্যথার ঘায়ে ঘা হানা?খুব জানি ভাই, ব্যর্থ জীবন        ডুবায় যারা সংগীতেই, মরম-ব্যথা বুঝতে তাদের        দিল-দরদি সঙ্গী নেই।জানতে কে চায় গানের পাখি        বিপুল ব্যথার বুক ভরাট, সবার যখন নওরাতি, হায়,        মোদের তখন দুঃখ-রাত!ওদের সাথি, মোদের রাতি        শয়ন আনে নয়ন-জল; গান গেয়ে ভাই ঘামলে কপাল        মুছতে সে ঘাম নাই অঞ্চল।তাই ভাবি আজ কোন দরদে        পিষছে তোমার কলজে-তল? কার অভাব আজ বাজছে বুকে,        কলজে চুঁয়ে গলছে জল!কাতর হয়ে পাথর-বুকে        বয় যবে ক্ষীর-সুরধুনী, হোক তা সুধা, খুব জানি ভাই,        সে সুধা ভরপুর-খুনই।আজ যে তোমার আঁকা-আঁশু        কণ্ঠ ছিঁড়ে উছলে যায় – কতই ব্যথায়, ভাবতে যে তা        জান ওঠে ভাই কচলে হায়!বসন্ত তো কতই এল,        গেল খাঁচার পাশ দিয়ে, এল অনেক আশ নিয়ে, শেষ        গেল দীঘল-শ্বাস নিয়ে।অনেক শারাব খারাব হল,        অনেক সাকির ভাঙল বুক! আজ এল কোন দীপান্বিতা?        কার শরমে রাঙল মুখ?কোন দরদি ফিরল? পেলে        কোন হারা-বুক আলিঙ্গন? আজ যে তোমার হিয়ার রঙে        উঠল রেঙে ডালিম-বন!যিগর-ছেঁড়া দিগর তোমার        আজ কি এল ঘর ফিরে? তাই কি এমন কাশ ফুটেছে        তোমার ব্যথার চর ফিরে?নীড়ের পাখি ম্লান চোখে চায়,        শুনছে তোমার ছিন্ন সুর; বেলা-শেষের তান ধরেছে        যখন তোমার দিন দুপুর!মুক্ত আমি পথিক-পাখি        আনন্দ-গান গাই পথের, কান্না-হাসির বহ্নি-ঘাতের        বক্ষে আমার চিহ্ন ঢের ;বীণ ছাড়া মোর একলা পথের        প্রাণের দোসর অধিক নাই, কান্না শুনে হাসি আমি,        আঘাত আমার পথিক-ভাই।বেদনা-ব্যথা নিত্য সাথি, –        তবু ভাই ওই সিক্ত সুর, দুচোখ পুরে অশ্রু আনে        উদাস করে চিত্ত-পুর!ঝাপসা তোমার দুচোখ শুনে        সুরাখ হল কলজেতে, নীল পাথারের সাঁতার পানি        লাখ চোখে ভাই গলছে যে!বাদশা-কবি! সালাম জানায়        ভক্ত তোমার অ-কবি, কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর        কথা ডুবে যায় সবই!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) দুঃশাসনের রক্ত-পান বল রে বন্য হিংস্র বীর, দুঃশাসনের চাই রুধির। চাই রুধির রক্ত চাই, ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই দুঃশাসনের রক্ত চাই! দুঃশাসনের রক্ত চাই!!অত্যাচারী সে দুঃশাসন চাই খুন তার চাই শাসন, হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি। আয় ভীম আয় হিংস্র বীর, কর অ-কণ্ঠ পান রুধির। ওরে এ যে সেই দুঃশাসন দিল শত বীরে নির্বাসন, কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত করেছে রে এই ক্রূর স্যাঙাত। মা-বোনেদের হরেছে লাজ দিনের আলোকে এই পিশাচ। বুক ফেটে চোখে জল আসে, তারে ক্ষমা করা? ভীরুতা সে! হিংসাশী মোরা মাংসাশী, ভণ্ডামি ভালবাসাবাসি! শত্রুরে পেলে নিকটে ভাই কাঁচা কলিজাটা চিবিয়ে খাই! মারি লাথি তার মড়া মুখে, তাতা-থৈ নাচি ভীম সুখে।নহি মোরা ভীরু সংসারী, বাঁধি না আমরা ঘরবাড়ি। দিয়াছি তোদের ঘরের সুখ, আঘাতের তরে মোদের বুক। যাহাদের তরে মোরা চাঁড়াল তাহারাই আজি পাড়িছে গা’ল! তাহাদের তরে সন্ধ্যা-দীপ. আমাদের আন্দামান-দ্বীপ! তাহাদের তরে প্রিয়ার বুক আমাদের তরে ভীম চাবুক। তাহাদের ভালবাসাবাসি, আমাদের তরে নীল ফাঁসি। বরিছে তাদের বাজিয়া শাঁখ, মোদের মরণে নিনাদে ঢাক।জীবনের ভোগ শুধু ওদের, তরুণ বয়সে মরা মোদের। কার তরে ওরে কার তরে সৈনিক মোরা পচি মরে? কার তরে পশু সেজেছি আজ, অকাতরে বুক পেতে নি বাজ। ধর্মাধর্ম কেন যে নাই আমাদের, তাহা কে বোঝে ভাই? কেন বিদ্রোহী সব-কিছুর? সব মায়া কেন করেছি দূর? কারে ক’স মন সে-ব্যথা তোর? যার তরে চুরি বলে চোর। যার তরে মাখি গায়ে কাদা, সেই হয় এসে পথে বাধা।ভয় নাই গৃহী! কোরো না ভয়, সুখ আমাদের লক্ষ্য নয়। বিরূপাক্ষ যে মোরা ধাতার, আমাদের তরে ক্লেশ-পাথার। কাড়ি না তোদের অন্ন-গ্রাস, তোমাদের ঘরে হানি না ত্রাস; জালিমের মোরা ফেলাই লাশ, রাজ-রাজড়ার সর্বনাশ! ধর্ম-চিন্তা মোদের নয়, আমাদের নাই মৃত্যু-ভয়! মৃত্যুকে ভয় করে যারা, ধর্মধ্বজ হোক তারা। শুধু মানবের শুভ লাগি সৈনিক যত দুখভাগী। ধার্মিক! দোষ নিয়ো না তার, কোরবানির১ সে, নয় রোজার২ ! তোমাদের তরে মুক্ত দেশ, মোদের প্রাপ্য তোদের শ্লেষ।জানি জানি ঐ রণাঙ্গন হবে যবে মোর মৃৎ-কাফন৩ ফেলিবে কি ছোট একটি শ্বাস? তিক্ত হবে কি মুখের গ্রাস? কিছুকাল পরে হাড্‌ডি মোর পিষে যাবি ভাই জুতিতে তোর! এই যারা আজ ধর্মহীন চিনে শুধু খুন আর সঙিন; তাহাদের মনে পড়িবে কার ঘরে পড়ে যারা খেয়েছে মার? ঘরে বসে নিস স্বর্গ-লোক, মেরে মরে তারে দিস দোজখ৪! ভয়ে-ভীরু ওরে ধর্মবীর! আমরা হিংস্র চাই রুধির! শহতান মোরা? আচ্ছা, তাই। আমাদের পথে এসো না ভাই।মোদের রক্ত-রুধির-রথ, মোদের জাহান্নামের পথ, ছেড়ে দেও ভাই জ্ঞান-প্রবীণ, আমরা কাফের ধর্মহীন! এর চেয়ে বেশি কি দেবে গা’ল? আমরা পিশাচ খুন-মাতাল। চালাও তোমার ধর্ম-রথ, মোদের কাঁটার রক্ত-পথ। আমরা বলিব সর্বদাই দুঃশাসনের রক্ত চাই!!চাই না ধর্ম, চাই না কাম, চাই না মোক্ষ, সব হারাম আমাদের কাছে: শুধু হালাল৫ দুশমন-খুন লাল-সে-লাল॥——————————- ১ কোরবানি– বলি। ২. রোজা– উপবাস ৩. মৃৎ-কাফন –লাশ যেখানে থাকে। ৪. দোজখ –নরক ৫. হালাল –পবিত্র দুপুর-অভিসার যাস   কোথা সই একলা ও তুই অলস বৈশাখে? জল   নিতে যে যাবি ওলো কলস কই কাঁখে?     সাঁঝ ভেবে তুই ভর-দুপুরেই দু-কূল নাচায়ে      পুকুরপানে ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজায়ে           যাসনে একা হাবা ছুঁড়ি,           অফুট জবা চাঁপা-কুঁড়ি তুই!      দ্যাখ্ রং দেখে তোর লাল গালে যায়           দিগ্‌বধূ ফাগ থাবা থাবা ছুঁড়ি,           পিক-বধূ সব টিটকিরি দেয় বুলবুলি চুমকুড়ি – ওলো  বউল-ব্যাকুল রসাল তরুর সরস ওই শাখে॥      দুপুর বেলায় পুকুর গিয়ে একূল ওকূল গেল দুকূল তোর,      ওই চেয়ে দ্যাখ পিয়াল-বনের দিয়াল ডিঙে এল মুকুল-চোর।           সারং রাগে বাজায় বাঁশি নাম ধরে তোর ওই,           রোদের বুকে লাগল কাঁপন সুর শুনে ওর সই।                     পলাশ অশোক শিমূল-ডালে                     বুলাস কি লো হিঙুল গালে তোর? আ –  আ মলো যা! তাইতে হা দ্যাখ,      শ্যাম চুমু খায় সব সে কুসুম লালে      পাগলি মেয়ে! রাগলি নাকি? ছি ছি দুপুর-কালে বল   কেমনে দিবি সরস অধর-পরশ সই তাকে?   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) দূরের বন্ধু বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন্‌ সুদূরের বিজন পুরে        ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে? আমার অনেক দুখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে,        ঘর-ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে।।      তোমার বাঁশীর উদাস কাঁদন        শিথিল করে সকল বাঁধন      কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন,        খুঁজে ফেরা পথ-বঁধরে,        ঘুরে’ ঘুরে’ দূরে দূরে।।হে মোর প্রিয়! তোমার বুকে একটুকুতেই হিংসা জাগে, তাই তো পথে হয় না থামা-তোমার ব্যথা বক্ষে লাগে!    বাঁধতে বাসা পথের পাশে     তোমার চোখে কান্না আসে     উত্তরী বায় ভেজা ঘাসে      শ্বাস ওঠে আর নয়ন বুঝে,      বন্ধু, তোমার সুরে সুরে।। দ্বীপান্তরের বন্দিনী আসে নাই ফিরে ভারত-ভারতী      মা’র কতদিন দ্বীপান্তর?    পুণ্য বেদীর শূন্যে ধ্বনিল      ক্রন্দন-‘দেড় শত বছর।’….    সপ্ত সিন্ধু তের নদী পার        দ্বীপান্তরের আন্দামান,    রূপের কমল রূপার কাঠির      কঠিন স্পর্শে যেখানে ম্লান,    শতদল যেথা শতধা ভিন্ন      শস্ত্র-পাণির অস্ত্র-ঘাস,    যস্ত্রী যেখানে সাস্ত্রী বসায়ে      বীনার তন্ত্রী কাটিছে হায়,    সেখানে হ’তে কি বেতার-সেতার      এসেছে মুক্ত-বন্ধ সুরা?    মুক্ত কি আজ বন্দিনী বাণী?      ধ্বংস হ’ল কি বক্ষ-পুর?    যক্ষপুরীর রৌপ্য-পঙ্কে      ফুটিল কি তবে রূপ-কমল?    কামান গোলার সীসা-স্তুপে কি      উঠেছে বাণীর শিশ-মহল?    শান্তি-শুচিতে শুভ্র হ’ল কি      রক্ত সোঁদাল খুন-খারাব?    তবে এ কিসের আর্ত আরতি,      কিসের তরে এ শঙ্কারাব?…   সাত সমুদ্র তের নদী পার      দ্বীপান্তরের আন্দামান,    বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন,      বন্দী সত্য ভানিছে ধান,    জীবন চুয়ানো সেই ঘানি হ’তে      আরতির তেল এনেছ কি?    হোমানল হ’তে বাণীর রক্ষী      বীর ছেলেদের চর্বি ঘি?    হায় শৌখিন পূজারী, বৃথাই      দেবীর শঙ্খে দিতেছ ফুঁ,    পুণ্য বেদীর শূন্য ভেদিয়া      ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু!    পূজারী, কাহারে দাও অঞ্জলি?      মুক্ত ভারতী ভারতে কই?    আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক,      সত্য বলিলে বন্দী হই,    অত্যাচারিত হইয়া যেখানে      বলিতে পারি না অত্যাচার,    যথা বন্দিনী সীতা সম বাণী      সহিছে বিচার-চেড়ীর মার    বাণীর মুক্ত শতদল যথা      আখ্যা লভিল বিদ্রোহী,    পূজারী, সেখানে এসেছ কি তুমি      বাণী পূজা-উপচার বহি?    সিংহেরে ভয়ে রাখে পিঞ্জরে,       ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নি-শেল,    কে জানিত কালে বীণা খাবে গুলি,      বাণীর কমল খাটিবে জেল!    তবে কি বিধির বেতার-মন্ত্র      বেজেছে বাণীর সেতারে আজ,    পদ্মে রেখেছে চরণ-পদ্ম      যুগান্তরের ধর্মরাজ?    তবে তাই হোক। ঢাক অঞ্জলি,      বাজাও পাঞ্চজন্য শাঁখ!    দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে      যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক!(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) ধূমকেতু আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু            এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! সাত      সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে, মম       ধূম-কুণ্ডুলি করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘর ঘোলাটে! আমি     অশিব তিক্ত অভিশাপ, আমি     স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার–            আর    মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,            আমি   অশিব তিক্ত অভিশাপ!আমি     সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে, আমি     বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।            শোঁও    শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,            ঘুর্       পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই            মম       পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;            করি      উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,– আমি   একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি। আমি   অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!আমি   আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া জোর   বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া! শুনি    মম বিষাক্ত 'রিরিরিরি'-নাদ          শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!          ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে          দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই– আমি   অগ্নি-কেতন উড়াই!– আমি   যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই    স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!ঐ     বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত মম    অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ! আমি   জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী, তাই   বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি। আমি   জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও! তাই   বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও! তোর   নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি! আর   যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি। মম    তূরীয় লোকের তির্যক্ গতি তূর্য গাজন বাজায় মম    বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!কচি   শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল আর   বন্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্‌ছাল, আর   কাঁচা কলিজায় পচা ঘা'র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি                       আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই! পেলে   বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!আমি   যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু– এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! আমি   শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি, আমি   ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি! তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু'পাক নি!          কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!         পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর–                   শোন্ রে মর, শোন্ অমর!–                   সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!         এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা?         কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা! হো হো  ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা! ছোট   শন শন শন ঘর ঘর সাঁই সাঁই! ছোট         পাঁই পাঁই! তুই    অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই! ওরে   ভয় নাই তোর মার নাই!! তুই    প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু, তুই    উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন'স্ অমরার ঘুম-সেতু                     তুই     ভৈরব ভয় ধূমকেতু! আমি    যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই      স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু !ঐ       ঈশ্বর-শির উল্লজ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি, আমি   বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি ! খ্যাপা  মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি লোকে  বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি ! এই    শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি ওরে   ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি ! মহা    সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি, তার    ললাট তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি ! তাই   টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,আমি   বাজাই আকাশে তালি দিয়া 'তাতা-উর্-তাক্' আর   সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক! মম    নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুৎকার আর   পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার!কাল            বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার                  তখনি রক্ত শোষে না রে তার,           দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে           পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!                  তেমনি করিয়া ভগবানে আমি                  দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী ঘিরিয়া  ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি          এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!আজ   রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে– মম    পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,          রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে! ভগবান? সে তো হাতের শিকার!– মুখে ফেনা উঠে মরে! ভয়ে   কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের 'পরে!         অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়াঅজগর কাল-কেউটে সে কোন ফিরিয়া ফিরিয়া চায়, আর ঘোরে শন্‌ শন্ শন্, ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন–       তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে,       আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে, স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে! নওরোজ রূপের সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়, নওরোজের এই মেলায়! ডামাডোল আজি চাঁদের হাট, লিট হ'ল রূপ হ'ল লোপাট! খুলে ফেলে লাজ শরম-ঠাট! রূপসীরা সব রূপ বিলায় বিনি কিম্মতে হাসি-ইঙ্গিতে হেলাফেলায়! নওরোজের এই মেলায়!শা'জাদা উজির নওয়াব-জাদারা-রূপ-কুমার এই মেলায় খরিদ-দার! নও-জোয়ানীর জহুরী ঢের খুঁজিছে বিপণি জহরতের, জহরত নিতে-টেড়া আঁখের জহর কিনিছে নির্বিকার! বাহানা করিয়া ছোঁয় গো পিরান জাহানারার নওরোজের রূপ-কুমার!ফিরি ক'রে ফেরে শা'জাদী বিবি ও বেগম সা'ব চাঁদ মুখের নাই নেকাব? শূন্য দোকানে পসারিণী কে জানে কে করে বিকি-কিনি! চুড়ি-কঙ্কনে রিণিঠিনি কাঁদিছে কোমল কড়ি রেখাব! অধরে অধরে দর কষাকষি-নাই হিসাবহেম-কপোল লাল গোলাব।হেরেম-বাঁদীরা দেরেম ফেলিয়া মাগিছে দিল, নওরোজের নও-ম'ফিল! সাহেব, গোলাম, খুনী আশেক, বিবি বাঁদী,-সব আজিকে এক! চোখে চোখে পেশ দাখিলা চেক দিলে দিলে মিল এক সামিল! বে-পরওয়া আজ বিলায় বাগিচা ফুল-ত'বিল! নওরোনের নও-ম'ফিল।ঠোঁটে ঠোঁটে আজ মিঠি শরবৎ ঢাল উপুড়, রণ-ঝনায় পা'য় নূপুর। কিস্মিস-ছেঁচা আজ অধর, আজিকে আলাপ 'মোখতসর'! কার পায়ে পড়ে কার চাদর, কাহারে জড়ায় কার কেয়ূর, প্রলাপ বকে গো কলাপ মেলিয়া মন-ময়ূর, আজি দিলের নাই সবুর।আঁখির নিক্তি করিছে ওজন প্রেম দেদার তার কাহার অশ্রু-হার চোখে চোখে আজ চেনাচেনি! বিনি মূলে আজ কেনাকেনি, নিকাশ করিয়া লেনাদেনি 'ফাজিল' কিছুতে কমে না আর! পানের বদলে মুন্না মাগিছে পান্না-হার! দিল সবার 'বে-কারার'!সাধ ক'রে আজ বরবাদ করে দিল সবাই নিমখুন কেউ কেউ জবাই! নিকপিক করে ক্ষীণ কাঁকাল, পেশোয়াজ কাঁপে টালমাটাল, গুরু ঊরু-ভারে তনু নাকাল, টলমল আঁখি জল-বোঝাই! হাফিজ উমর শিরাজ পলায়ে লেখে 'রুবাই'! নিমখুন কেউ কেউ জবাই!শিরী লাইলীরে খোঁজে ফরহাদ খোঁজে কায়েস নওরোজের এই সে দেশ! ঢুঁড়ে ফেরে হেথা যুবা সেলিম নূরজাহানের দূর সাকিম, আরংজিব আজ হইয়া ঝিম হিয়ায় হিয়ায় চাহে আয়েস! তখত-তাউস কোহিনূর কারো নাই খায়েশ, নওরোজের এই সে দেশ!গুলে-বকৌলি ঊর্বশীর এ চাঁদনী-চক, চাও হেথায় রূপ নিছক। শারাব সাকী ও রঙে রূপে আতর লোবান ধূনা ধূপে সয়লাব সব যাক ডুবে, আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক। চাঁদ মুখে আঁক কালো কলঙ্ক তিল-তিলক চাও হেথায় রূপ নিছক।হাসির নেশায় ঝিম মেরে আছে আজ সকল, লাল পানির রঙমহল! চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের দোকান ব'সেছে মমতাজের, সওদা করিতে এসেছে ফের শা'জাহান হেথা রূপ-পাগল। হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি ভবিষ্যতের তাজমহল- নওরোজের স্বপ্ন-ফল!গুলে-বকৌলি- পরীদের রাণী, দেরেম- রৌপ্যমুদ্রা, ত'বিল-তহবিল, ম'ফিল-সভা আশেক-প্রেম, মোখতাসর- সংক্ষেপ, মুন্না- সাধারণত বা৬দীর নাম, ফাজিল-অতিরিক্ত বে-কারার- ধৈর্যহারা নতুন পথিক নতুন দিনের মানুষ তোরা আয় শিশুরা আয়! নতুন চোখে নতুন লোকের নতুন ভরসায়। নতুন তারার বেভুল পথিক আসলি ধরাতে ধরার পারে আনন্দ-লোক দেখা ইশারায়। খেলার সুখে মাখলি তোরা মাটির করুণা, এই মাটিতে স্বর্গ রচিস, তোদের মহিমায়। নদীপারের মেয়ে নদীপারের মেয়ে! ভাসাই আমার গানের কমল তোমার পানে চেয়ে। আলতা-রাঙা পা দুখানি ছুপিয়ে নদী-জলে ঘাটে বসে চেয়ে আছ আঁধার অস্তাচলে। নিরুদ্দেশে ভাসিয়ে-দেওয়া আমার কমলখানি ছোঁয় কি গিয়ে নিত্য সাঁঝে তোমার চরণ, রানি?                           নদীপারের মেয়ে! গানের গাঙে খুঁজি তোমায় সুরের তরি বেয়ে। খোঁপায় গুঁজে কনক-চাঁপা, গলায় টগর-মালা, হেনার গুছি হাতে বেড়াও নদীকূলে বালা। শুনতে কি পাও আমার তরির তোমায়-চাওয়া গীতি? ম্লান হয়ে কি যায় ও-চোখে চতুর্দশীর তিথি?                           নদীপারের মেয়ে! আমার ব্যথার মালঞ্চে ফুল ফোটে তোমায়-চেয়ে। শীতল নীরে নেয়ে ভোরে ফুলের সাজি হাতে, রাঙা উষার রাঙা সতিন দাঁড়ায় আঙিনাতে। তোমার মদির শ্বাসে কি মোর গুলের সুবাস মেশে? আমার বনের কুসুম তুলি পর কি আর কেশে?                           নদীপারের মেয়ে! আমার কমল অভিমানের কাঁটায় আছে ছেয়ে! তোমার সখায় পূজ কি মোর গানের কমল তুলি? তুলতে সে-ফুল মৃণাল-কাঁটায় বেঁধে কি অঙ্গুলি? ফুলের বুকে দোলে কাঁটার অভিমানের মালা, আমার কাঁটার ঘায়ে বোঝ আমার বুকের জ্বালা?   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) নব ভারতের হলদিঘাট বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –          নব-ভারতের হলদিঘাট, উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে          উঠেছিল যথা অস্তপাট।    আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া          কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল, অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে          মধ্য গগনে কোন পাগল! আপন বুকের রক্তঝলকে          পাংশু রবিরে করে লোহিত, বিমানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,          থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত। দেবকী মাতার বুকের পাথর          নড়িল কারায় অকস্মাৎ বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর          প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত। নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ          জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, - বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –          নব ভারতের হলদিঘাট।অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?          যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়, আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার          সৈনিকে চারি তরুণ হটায়। ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা          নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন, ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –          শনির সহিত অশনি-রণ। দুই বাহু আর পশ্চাতে তার          রুষিছে তিনটি বালক শের, ‘চিত্তপ্রিয়, ‘মনোরঞ্জন,          ‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের! বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা          রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ! বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –          নব-ভারতের হলদিঘাট।    চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে          বধিতে হয় রে চার হাজার, মহাকাল করে কেমনে নাকাল          নিতাই গোরার লালবাজার! অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,          দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ; প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী          করে সহস্র প্রাণ হরণ!হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি          আয় অহিংস-বুদ্ধগণ হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ          দিতে পারে তারা হেসে কেমন! অধীন ভারত করিল প্রথম          স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ, বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –          নব-ভারতের হলদিঘাট।    সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে          অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার, ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন          দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়! গগনচুম্বী গিরিশের হতে          ইঙ্গিত দিল বীরের দল, ‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –          তোরা যাবি যদি, এ পথে চল! স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন          মোদের বুকের রক্ত-ছাপ, ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি          মোছ রে পরাধীনতার পাপ! তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,          খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’ বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –          নব-ভারতের হলদিঘাট। *********************কাব্যগ্রন্থ - প্রলয়শিখা নবযুগ -বিশ বৎসর আগে তোমার স্বপ্ন অনাগত ‘নবযুগ’-এর রক্তরাগে রেঙে উঠেছিল। স্বপ্ন সেদিন অকালে ভাঙিয়া গেল, দৈবের দোষে সাধের স্বপ্ন পূর্ণতা নাহি পেল! যে দেখায়েছিল সে মহৎ স্বপ্ন, তাঁরই ইঙ্গিতে বুঝি পথ হতে হাত ধরে এনেছিলে এই সৈনিকে খুঁজি? কোথা হতে এল লেখার জোয়ার তরবারি-ধরা হাতে কারার দুয়ার ভাঙিতে চাহিনু নিদারুণ সংঘাতে।– হাতের লেখনী, কাগজের পাতা নহে ঢাল তলোয়ার, তবুও প্রবল কেড়ে নিল দুর্বলের সে অধিকার! মোর লেখনীর বহ্নিস্রোত বাধা পেয়ে পথে তার প্রলয়ংকর ধূমকেতু হয়ে ফিরিয়া এল আবার! ধূমকেতু-সম্মার্জনী মোর করে নাই মার্জনা কারও অপরাধ ; অসুরে নিত্য হানিয়াছে লাঞ্ছনা!- হারাইয়া গেনু ধুমকেতু আমি দু-দিনের বিস্ময়, মরা তারাসম ঘুরিয়া ফিরিনু শূন্য আকাশময়।সে যুগের ওগো জগলুল! আমি ভুলিনি তোমার স্নেহ, স্মরণে আসিত তোমার বিরাট হৃদয়, বিশাল দেহ। কত সে ভুলের কাঁটা দলি, কত ফুল ছড়াইয়া তুমি, ঘুরিয়া ফিরেছ আকুল তৃষায় জীবনের মরুভূমি। আমি দেখিতাম, আমার নিরালা নীল আশমান থেকে চাঁদের মতন উঠিতেছ, কভু যাইতেছ মেঘ ঢেকে। সুদূরে থাকিয়া হেরিতাম তব ভুলের ফুলের খেলা, কে যেন বলিত, এ চাঁদ একদা হইবে পারের ভেলা।সহসা দেখিনু, এই ভেলা যাহাদের পার করে দিল, যে ভেলার দৌলত ও সওদা দশ হাতে লুটে নিল, বিশ্বাসঘাতকতা ও আঘাত-জীর্ণ সেই ভেলায় উপহাস করে তাহারাই আজ কঠোর অবহেলায়! মানুষের এই অকৃতজ্ঞতা দেখি উঠি শিহরিয়া, দানীরে কি ঋণী স্বীকার করিল এই সম্মান দিয়া? যত ভুল তুমি করিয়াছ, তার অনেক অধিক ফুল দিয়াছ রিক্ত দেশের ডালায়, দেখিল না বুলবুল! যে সূর্য আলো দেয়, যদি তার আঁচ একটুকু লাগে, তাহারই আলোকে দাঁড়ায়ে অমনি গাল দেবে তারে রাগে? নিত্য চন্দ্র সূর্য; তারাও গ্রহণে মলিন হয়; তাই বলে তার নিন্দা করা কি বুদ্ধির পরিচয়? এই কী বিচার লোভী মানুষের? বক্ষে বেদনা বাজে, অর্থের তরে অপমান করে আপনার শির-তাজে! দুঃখ কোরো না, ক্ষমা করো, ওগো প্রবীণ বনস্পতি! যার ছায়া পায় তারই ডাল কাটে অভাগা মন্দমতি।আমি দেখিয়াছি দুঃখীর তরে তোমার চোখের পানি, এক আল্লাহ্ জানেন তোমারে, দিয়াছ কী কোরবানি! এরা অজ্ঞান, এরা লোভী, তবু ইহাদেরে করো ক্ষমা, আবার এদেরে ডেকে আল্লার ঈদ্গাহে করো জমা। শপথ করিয়া কহে এ বান্দা তার আল্লার নামে, কোনো লোভ কোনো স্বার্থ লইয়া দাঁড়াইনি আমি বামে। যে আল্লা মোরে রেখেছেন দূরে সব চাওয়া পাওয়া হতে, চলিতে দেননি যিনি বিদ্বেষ-গ্লানিময় রাজপথে, যে পরম প্রভু মোর হাতে দিয়া তাঁহার নামের ঝুলি, মসনদ হতে নামায়ে, দিলেন আমারে পথের ধূলি, সেই আল্লার ইচ্ছায় তুমি ডেকেছ আমারে পাশে!– অগ্নিগিরির আগুন আবার প্রলয়ের উল্লাসে জাগিয়ে উঠেছে, তাই অনন্ত লেলিহান শিখা মেলি, আসিতে চাহিছে কে যেন বিরাট পাতাল-দুয়ার ঠেলি, অনাগত ভূমিকম্পের ভয়ে দুনিয়ায় দোলা লাগে, দ্যাখো দ্যাখো শহিদান ছুটে আসে মৃত্যুর গুলবাগে! কে যেন কহিছে, ‘বান্দা আর এক বান্দার হাত ধরো, মোর ইচ্ছায় ওর ইচ্ছারে তুমি সাহায্য করো,’ তাই নবযুগ আসিল আবার। রুদ্ধ প্রাণের ধারা নাচিছে মুক্ত গগনের তলে দুর্দম মাতোয়ারা। এই নবযুগ ভুলাইবে ভেদ, ভায়ে ভায়ে হানাহানি, এই নবযুগ ফেলিবে ক্লৈব্য ভীরুতারে দূরে টানি। এই নবযুগ আনিবে জরার বুকে নবযৌবন, প্রাণের প্রবাহ ছুটিবে, টুটিবে জড়তার বন্ধন। এই নবযুগ সকলের, ইহা শুধু আমাদের নহে, সাথে এসো নওজোয়ান! ভুলিয়া থেকো না মিথ্যা মোহে। ইহা নহে কারও ব্যাবসার, স্বদেশের স্বজাতির এ যে, শোনো আশমানে এক আল্লার ডঙ্কা উঠিছে বেজে।মোরা জনগণ, শতকরা মোরা নিরানব্বই জন, মোরাই বৃহৎ, সেই বৃহতের আজ নবজাগরণ। ক্ষুদ্রের দলে কে যাবে তোমরা ভোগবিলাসের লোভে? আর দেরি নাই, ওদের কুঞ্জ ধূলিলুন্ঠিত হবে! আছে হাদের বৃহতের তৃষা, নির্ভয় যার প্রাণ, সেই বীরসেনা লয়ে জয়ী হবে নবযুগ-অভিযান। আল্লার রাহে ভিক্ষা চাহিতে নবযুগ আসিয়াছে, মহাভিক্ষুরে ফিরায়ো না, দাও যার যাহা কিছু আছে। জাগিছে বিরাট দেহ লয়ে পুন সুপ্ত অগ্নিগিরি, তারই ধোঁয়া আজ ধোঁয়ায়ে উঠেছে আকাশভুবন ঘিরি। একী এ নিবিড় বেদনা একী এ বিরাট চেতনা জাগে পাষাণের শিরায় শিরায়, সাথে জনগণ জাগে, হুংকারে আজ বিরাট, ‘বক্ষে কার পা-র ছোঁয়া লাগে, কোন মায়াঘুমে ঘুমায়ে ছিলাম, বুঝি সেই অবসরে ক্ষুদ্রের দল বৃহতের বুকে বসে উৎপাত করে! মোর অণুপরমাণু জনগণ জাগো, ভাঙো ভাঙো দ্বার, রুদ্র এসেছে বিনাশিতে আজ ক্ষুদ্র অহংকার।’  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) নবাগত উৎপাত মনে পড়ে আজ পলাশির প্রান্তর – আসুরিক লোভে কামানের গোলা বারুদ লইয়া যথা আগুন জ্বালিল স্বাধীন এ বাংলায়। সেই আগুনের লেলিহান শিখা শ্মশানের চিতা সম আজও জ্বলিতেছে ভারতের বুকে নিষ্ঠুর আক্রোশে। দুই শতাব্দী নিপীড়িত এই দেশের নর ও নারী আঁখিজল ঢালি নিভাতে নারিল সেই আগুনের শিখা। এ কোন করালী রাক্ষুসি তার রক্তরসনা মেলি মজ্জা অস্থি রক্ত শুষিয়া শক্তি হরিয়া যেন চল্লিশ কোটি শবের উপরে নাচিছে তাথই থই! অক্ষমা অভিশপ্তা শকতি তামসী ভয়ংকরী। চল্লিশ কোটি নরকঙ্কাল লয়ে এই অকরুণা জাদুকরি নিশিদিন খেলিতেছে জাদু ও ভেলকি, হায়! যত যন্ত্রণা পাইয়াছি তত তার ভূত-প্রেত সেনা হাসিয়া অট্টহাসি বিদ্রুপ করেছে শক্তিহীনে!এ কাহার অভিশাপ সর্পিণী হয়ে জড়াইয়া আছে, সারা দেহ মন প্রাণ জরজর করি কালকূট বিষে লয়ে যায় যমলোকে! – হায়, যথা গঙ্গা যমুনা বহে – যথায় অমৃত-মধুরসধারা বর্ষণ হত নিতি, যে ভারতে ছিল নিত্য শান্তি সাম্য প্রেম ও প্রীতি, যে ভারতের এই আকাশ হইতে ঝরিত স্নিগ্ধ জ্যোতি সে আকাশ আজ মলিন হয়েছে বোমা বারুদের ধূমে। যে দেশে জ্বলিত হোমাগ্নি, সেথা বোমার আগুন এল, ক্ষুধিত দৈত্য-শক্তি শকুনি হয়ে আজ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়িয়া বেড়ায় আমাদের পচা গলা মাংসের লোভে।হে পরম পুরুষোত্তম! বলো, বলো, আর কতদিন উদাসীন হয়ে রহিবে? – তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নর নিদারুণ যাতনায় নিশিদিন করিছে আর্তনাদ! নিরস্ত্র দেশে লয়ে তব জ্যোতি সুন্দর তরবারি দুর্বল নিপীড়িতের বন্ধু হইয়া প্রকাশ হও! বন্দি আত্মা কাঁদে কারাগারে, ‘দ্বার খোলো, খোলো দ্বার! পরাধীনতার এই শৃঙ্খল খুলে দাও, খুলে দাও! নিপীড়িত যেন নতুন পীড়ার যন্ত্রণা নাহি পায়, প্রভু হয়ে নয়, বন্ধু হইয়া এসো বন্দির দেশে।’   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) নাকিব নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।          জাগাও জড়! জাগাও জীব!          জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,          জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,          জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন                   জাগে মজলুম বদ-নসিব!          মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –          ‘আজ জীবনের নব উত্থান!’          শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান                   জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,          নব জীবনের নব উত্থান –                   আজান ফুকারি এসো নকিব! হুগলি, ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) নারী সাম্যের গান গাই - আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান। অথবা পাপ যে - শয়তান যে - নর নহে নারী নহে, ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে। এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল। তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ? অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান। জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী, সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’। পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ। দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু, পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু। শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল, নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল। নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’ ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।                                     স্বর্ণ-রৌপ্যভার নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার। নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ, যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান। নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’ জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে। জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে। কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী। রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী, রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।                                     পুরুষ হৃদয়হীন, মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ। ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব, বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব। খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা। লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা। নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া, দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া। অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ, বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।                                     তিনি নর-অবতার - পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার। পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর - নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।                                     সে যুগ হয়েছে বাসি, যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী। বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’। নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!                                     যুগের ধর্ম এই- পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।                                     শোনো মর্ত্যের জীব! অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব! স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী? আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা, আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা! চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল, মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল! যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ, দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!                                     ধরার দুলালী মেয়ে, ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে। কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে, ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে! সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’ মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী। ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি! আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি! পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে! এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে, যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।                                     সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়! নারী হায় ফিরদৌসের ফুল! ফুটিতে আসিলে ধূলির ধরায় কেন?           সে কি মায়া? সে কি ভুল?              কোন আনন্দধামে জড়াইয়া ছিলে কোন একাকীর বামে? তাঁহারই জ্যোতির্মণিকা-কণিকা এসেছে প্রকৃতি হয়ে সপ্ত আকাশ রসে ডুবাইয়া প্রেম ও মাধুরী লয়ে। পরম জ্যোতির্দীপ্তিরে নাহি ডরিলে পরম রুদ্রে প্রেম-চন্দন মাখায়ে স্নিগ্ধ করিলে! শুভ্র জ্যোতির্পুঞ্জ-ঘন অরূপে গলাইলে তুমি ময়ূরকন্ঠী নবীন নীরদ রূপে! নীল মেঘে হলে শক্তি বিজলি-লেখা শূন্যবিহারী একাকী পুরুষে রহিতে দিলে না একা।    স্রষ্টা হইল প্রিয়-সুন্দর সৃষ্টিরে প্রিয়া বলি কল্পতরুতে ফুটিল প্রথম নারী আনন্দকলি! নিজ ফুলশরে যেদিন পুরুষ বিঁধিল আপন হিয়া, ফুটিল সেদিন শূন্য আকাশে আদিবাণী – ‘প্রিয়া, প্রিয়া!’ আকাশ ছাইল অনন্তদল শতদলে আর প্রেমে, শান্ত মৌনী এল যৌবন-চঞ্চল হয়ে নেমে।    কে দেখিত সেই পরম শূন্য, অসীম পাষাণ-শিলা, সীমায় যদি না বাঁধিতে তাহারে না দেখাতে রূপ-লীলা! কোন সে গোপন পরমাশ্রী প্রকৃতি লুকায়ে ছিলে? ভুবনে ভুবনে ভবন রচিয়া রস-দীপ জ্বালাইলে! অনন্তশ্রী ঝরে পড়ে নিতি অনন্ত দিকে তব, তুমি এলে, তাই সম্ভাবনায় আসিল অসম্ভব! হে পবিত্রা চির-কল্যাণী, কে বলে তোমায় মায়া ?           এই সুন্দর রবি শশী তারা           গিরি প্রান্তর নদীজলধারা অসীম আকাশ সাগর ধরিতে পারে না তোমার কায়া, তব রূপে দেখি না-দেখা পরম সুন্দরের যে ছায়া, –           কে বলে তোমায় মায়া?    তুমি তাঁর তেজ, তব তেজে জ্বলে আমার এই জীবন, সূর্যের মতো চাঁদসম আকাশের কোলে অনুখন। মাতা হয়ে তুমি দিয়াছ এ মুখে প্রথম-স্তন্যরস, স্নেহ-অঞ্চলে বাঁধিয়া এ ঘর ছাড়ায়ে করেছ বশ। যখনই পালাতে চাহিয়াছি বনে, কে তুমি অশ্রুমতী, কাঁদিয়াছ মোর হৃদয়ে বসিয়া, রোধ করিয়াছ গতি? সুন্দর প্রকৃতিরে হেরি মোর তৃষ্ণা জাগিল প্রাণে, এত সুন্দর সৃষ্টি করে যে, সে থাকে সে-কোনখানে। আমার পূর্ণ সুন্দরের যে পথের দিশারি তুমি, তুমি ছায়া হয়ে সাথে চল যবে পার হই মরুভূমি? যতবার নিভে যায় আশা-দীপ, ততবার তুমি জ্বাল, শূন্য আঁধারে সম্মুখে জ্বলে তোমার আঁধারি-আলো!    অনন্তধারা প্রেমের ঝরনা কোথা লুকাইয়া ছিলে? উদাসীন গিরি-পাষাণের হিয়া রসে ভাসাইয়া দিলে! পাথরের বিগ্রহ হয়েছিল নিস্তেজ আদি-নর, তেজোময়ী আদি-নারী সে পাষাণে কাঁপাইলে থরথর। নিষ্কাম ঘন অরণ্যে সেই প্রথম কামনা-জুঁই আঁখি মেলি যেন দেখিল সৃষ্টি, হেসে এক হল দুই! এই দুই হয়ে দ্বন্দ্ব আসিল, ছন্দ জাগিল পায়, সোনাতে কাঁকরে দুজনে মিলিয়া নূপুর বাজায়ে যায়! সালাম লহো গো প্রণাম লহো গো প্রকৃতি পুণ্যবতী, তব প্রেম দেখায়েছে গো চির আনন্দধামের জ্যোতি! প্রেমের প্রবাহ লইয়া যখন আস হয়ে উপনদী – মরুতে মরে না নরের তৃষ্ণানদী –           সাগরের পানে ছুটে চলে নিরবধি! পুরুষের জ্ঞান রসায়িত হয় প্রকৃতির প্রেমরসে, তরবারি ধরে উদাসীন নর রণক্ষেত্রে পশে! যে দেশে নারীরা বন্দিনী, আদরের নন্দিনী নয়, সে দেশে পুরুষ ভীরু কাপুরুষ জড় অচেতন রয়! অভিশপ্ত সে দেশ পরাধীন, শৌর্য-শক্তিহীন, শোধ করেনি যে দেশ কল্যাণী সেবিকা নারীর ঋণ! নারী অমৃতময়ী, নারী কৃপা – করুণাময়ের দান, কল্যাণ কৃপা পায় না, যে করে নারীর অসম্মান! বেহেশ্‌ত’ স্বর্গ শুকাইয়া যায় প্রকৃতি না থাকে যদি, জ্বলে না আগুন, আসে না ফাগুন, বহে না বায়ু ও নদী! আজও রবি শশী ওঠে ফুল ফোটে নারীদের কল্যাণে, নামে সখ্য ও সাম্য শান্তি নারীর প্রেমের টানে।           নারী আজও পথে চলে তাই ধূলিপথ হয় বিধৌত শুদ্ধ মেঘের জলে! নারীর পুণ্য প্রেম আনন্দ রূপ রস সৌরভ আজও সুন্দর করিয়া রেখেছে বিধাতার গৌরব!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) নার্গিসকে লেখা কবি নজরুলের প্রথম ও শেষ পত্র কল্যাণীয়াসু,তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনই এক আষাঢ়ে এমনই এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা।তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি —তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।তুমি ভুলে যেও না আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কী জান বা শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।তোমার আজিকার রূপ কী জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভরে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়তো সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব,-তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।দেখা? না-ই হলো এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ , হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস, আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? তারই মায়াস্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে একঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাকো জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্বদুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা-সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রী বিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারল না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারাদিন-রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ত।ইতিনিত্য শুভার্থী-নজরুল ইসলাম নিকটে বাদলা-কালো স্নিগ্ধা আমার কান্ত এল রিমঝিমিয়ে, বৃষ্টিতে তার বাজল নুপূর পায়জোরেরই শিঞ্জিনী যে। ফুটল উষার মুখটি অরুণ, ছাইল বাদল তাম্বু ধরায়; জমল আসর বর্ষা-বাসর, লাও সাকি লাও ভর-পিয়ালায়। ভিজল কুঁড়ির বক্ষ-পরাগ হিম-শিশিরের আমেজ পেয়ে হমদম! হরদম দাও মদ, মস্ত্ করো গজল গেয়ে! ফেরদৌসের ঝরকা বেয়ে গুল-বাগিচায় চলচে হাওয়া, এই তো রে ভাই ওক্ত খুশির, দ্রাক্ষারসে দিলকে নাওয়া। কুঞ্জে জরীন ফারসি ফরাস বিছিয়েচে আজ ফুলবালারা, আজ চাই-ই চাই লাল-শিরাজি স্বচ্ছ-সরস খোর্মা-পারা! মুক্তকেশী ঘোর-নয়না আজ হবে গো কান্তা সাকি, চুম্বন এবং মিষ্টি হাতের মদ পেতে তাই ভরসা রাখি! কান্তা সাথে বাঁচতে জনম চাও যদি কওসর-অমিয়, সুর বেঁধে বীণ সারেঙ্গিতে খুবসে শিরীন শরাব পিয়ো! খুঁজবে যেদিন সিকান্দারের বাঞ্ছিত আব্-হায়াত কুঁয়ায়, সন্ধান তার মিলবে আশেক দিল-পিয়ারার ওষ্ঠ চুমায়! খামখা তুমি মরছ কাজী শুষ্ক তোমার শাস্ত্র ঘেঁটে, মুক্তি পাবে মদখোরের এই আল-কিমিয়ার পাত্র চেটে!   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) নিত্য প্রবল হও অন্তরে আর বাহিরে সমান নিত্য প্রবল হও! যত দুর্দিন ঘিরে আসে, তত অটল হইয়া রও! যত পরাজয়-ভয় আসে, তত দুর্জয় হয়ে ওঠো। মৃত্যুর ভয়ে শিথিল যেন হয় তলোয়ার-মুঠো। সত্যের তরে দৈত্যের সাথে করে যাও সংগ্রাম, রণক্ষেত্রে মরিলে অমর হইয়া রহিবে নাম। এই আল্লার হুকুম – ধরায় নিত্য প্রবল রবে, প্রবলেই যুগে যুগে সম্ভব করেছে অসম্ভবে। ভালোবাসেন না আল্লা, অবিশ্বাসী ও দুর্বলেরে, ‘শেরে-খোদা’ সেই হয়, যে পেয়েছে অটল বিশ্বাসেরে! ধৈর্য ও বিশ্বাস হারায়, সে মুসলিম নয় কভু, বিশ্বে কারেও করে নাকো ভয় আল্লাহ্‌ যার প্রভু! নিন্দাবাদের মাঝে ‘আল্লাহ্ জিন্দাবাদ’-এর ধ্বনি বীর শুধু শোনে, কোনো নিন্দায় কোনো ভয় নাহি গণি। আল্লা পরম সত্য, ভয় সে ভ্রান্তির কারসাজি, প্রচণ্ড হয় তত পৌরুষ, যত দেখে দাগাবাজি! ভুলে কি গিয়াছ অসম সাহস নির্ভীক আরবির? পারস্য আর রোমক সম্রাটের কাটিয়াছে শির! কতজন ছিল সেনা তাহাদের? অস্ত্র্র কী ছিল হাতে? তাদের পরম নির্ভর ছিল শুধু এক আল্লাতে। জয় পরাজয় সমান গণিয়া করেছিল শুধু রণ, তাদের দাপটে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাঙ্গণ! তারা দুনিয়ার বাদশাহি করেছিল ভিক্ষুক হয়ে, তারা পরাজিত হয়নি কখনও ক্ষণিকের পরাজয়ে। হাসিয়া মরেছে করেনি কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন, ইসলাম মানে বুঝেছিল তারা অসত্য সাথে রণ। তারা জেনেছিল, দুনিয়ায় তারা আল্লার সৈনিক, অর্জন করেছিল স্বাধীনতা নেয়নি মাগিয়া ভিখ! জয়ী হতে হলে মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ হইতে হয়, শত্রু-সৈন্য দেখে কাঁপে ভয়ে, সে তো সেনাপতি নয়! শত্রু-সৈন্য যত দেখে তত রণ-তৃষ্ণা তার বাড়ে, দাবানল সম তেজ জ্বলে ওঠে শিরায় শিরায় হাড়ে! তলোয়ার তার তত তেজ ফোটে যত সে আঘাত খায়, তত বধ করে শত্রুর সেনা, রসদ যত ফুরায়। নিরাশ হোয়ো না! নিরাশা ও অদৃষ্টবাদীরা যত যুদ্ধ না করে হয়ে আছে কেউ আহত ও কেউ হত!যে মাথা নোয়ায়ে সিজদা করেছ এক প্রভু আল্লারে, নত করিয়ো না সে মাথা কখনও কোনো ভয়ে কোনো মারে! আল্লার নামে নিবেদিত শির নোয়ায় সাধ্য কার। আল্লা সে শির বুকে তুলে নেন, কাটে যদি তলোয়ার! ভীরু মানবেরে প্রবল করিতে চাহেন যে দুনিয়াতে তাঁরেই ইমাম নেতা বলি আমি, প্রেম মোর তারই সাথে। আড়ষ্ট নরে বলিষ্ঠ করে যাঁর কথা যাঁর কাজ, তাঁরই তরে সেনা সংগ্রহ করি, গড়ি তাঁরই শির-তাজ! গরিবের ঈদ আসিবে বলিয়া যে আত্মা রোজা রাখে, পরমাত্মার পরমাত্মীয় বলে আমি মানি তাঁকে। অকল্যাণের দূত যারা, যারা মানুষের দুশমন, তাদের সঙ্গে যে দুরন্তেরা করিবে ভীষণ রণ – মোর আল্লার আদেশে তাদেরে ডাক দিই জমায়েতে, অচেতন ছিল যারা, তারা আসিতেছে সে তীর্থপথে। আমি তকবীর-ধ্বনি করি শুধু কর্ম-বধির কানে, সত্যের যারা সৈনিক তারা জমা হবে ময়দানে! অনাগত ‘নবযুগ’-সূর্যের তুর্য বাজায়ে যাই, মৃত্যু বা কারাগারের কোনো ভয় দ্বিধা নাই। একা ‘নবযুগ’-মিনারে দাঁড়ায়ে কাঁদিয়া সকলে ডাকি, দরমার হাঁস না আসে, আসিবে মুক্তপক্ষ পাখি। এ পথে ভীষণ বাজপাখি আর নিঠুর ব্যাধের ভীতি, আলোক-পিয়াসি পাখিরা তবুও আসিছে গাহিয়া গীতি।মৃত্যু-ভয়াক্রান্ত আজিকে বাংলার নরনারী, তাদের অভয় দিতেই আমরা ধরিয়াছি তরবারি। আমরা শুনেছি ভীত আত্মার সকরুণ ফরয়্যাদ, আমরা তাদেরে রক্ষা করিব, এ যে আল্লার সাধ! আমরা হুকুম-বর্দার তাঁর পাইয়াছি ফরমান, ভীত নর-নারী তরে অকাতরে দানিব মোদের প্রাণ! বাজাই বিষাণ উড়াই নিশান ঈশান-কোণের মেঘে, প্রেম-বৃষ্টি ও বজ্র-প্রহারে আত্মা উঠিবে জেগে! রাজনীতি করে তৈরি মোদের কুচকাওয়াজের পথ, এই পথ দিয়ে আসিবে দেখিয়ো আবার বিজয়-রথ। প্রবল হওয়ার সাধ ও সাধনা যাহাদের প্রাণে আছে, তাদেরই দুয়ারে হানা দিই আমি, আসি তাহাদেরই কাছে। সঙ্ঘবদ্ধ হতেছে তাহারা বঙ্গভূমির কোলে, আমি দেখিয়াছি পূর্ণচন্দ্র তাদেরই ঊর্ধ্বে দোলে!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) নিরুদ্দেশের যাত্রী নিরুদ্দেশের পথে যেদিন প্রথম আমার যাত্রা হল শুরু। নিবিড় সে-কোন্ বেদনাতে ভয়-আতুর এ বুক কাঁপল দুরু-দুরু। মিটল না ভাই চেনার দেনা, অমনি মু্হুর্মুহু ঘরছাড়া ডাক করলে শুরু অথির বিদায়-কুহু                     উহু উহু উহু!      হাতছানি দেয় রাতের শাঙন,      অমনি বাঁধে ধরল ভাঙন –      ফেলিয়ে বিয়ের হাতের কাঙন – খুঁজে বেড়াই কোন আঙনে কাঁকন বাজে গো!      বেরিয়ে দেখি ছুটছে কেঁদে বাদলি হাওয়া হু হু! মাথার ওপর দৌড়ে টাঙন, ঝড়ের মাতন, দেয়ার গুরু গুরু।পথ হারিয়ে কেঁদে ফিরি, ‘আর বাঁচিনে! কোথায় প্রিয়,                     কোথায় নিরুদ্দেশ?’ কেউ আসে না, মুখে শুধু ঝাপটা মারে নিশীথ-মেঘের                     আকুল চাঁচর কেশ।     ‘তাল-বনা’তে ঝঞ্ঝা তাথই হাততালি দেয় বজ্রে বাজে তূরী,      মেখলা ছিঁড়ি পাগলি মেয়ে বিজলি-বালা নাচায় হিরের চুড়ি                     ঘুরি ঘুরি ঘুরি                ও সে সকল আকাশ জুড়ি!     থামল বাদল রাতের কাঁদা,      হাসল, আমার টুটল ধাঁধা,      হঠাৎ ও কার নূপুর শুনি গো?      থামল নূপুর, ভোরের তারা বিদায় নিল ঝুরি। আমি  এখন চলি সাঁঝের বধূ সন্ধ্যাতারার চলার পথে গো! আজ   অস্তপারের শীতের বায়ু কানের কাছে বইছে ঝুরু-ঝুরু।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) নিশীথ-প্রীতম হে মোর প্রিয়, হে মোর   নিশীথ-রাতের গোপন সাথি! মোদের   দুইজনারেই জনম ভরে কাঁদতে হবে গো –    শুধু   এমনি করে সুদূর থেকে, একলা জেগে রাতি।   যখন   ভুবন-ছাওয়া আঁচল পেতে নিশীথ যাবে ঘুম,         আকাশ বাতাস থমথমাবে সব হবে নিঝঝুম,   তখন   দেব দুঁহু দোঁহার চিঠির নাম-সহিতে চুম!    আর   কাঁপবে শুধু গো, মোদের   তরুণ বুকের করুণ কথা আর শিয়রে বাতি।      মোরা   কে যে কত ভালোবাসি কোনোদিনই হবে না তা বলা,    কভু   সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকব না সে কথা;    শুধু   কইতে-নারার প্রাণপোড়ানি রইবে দোঁহার ভরে বুকের তলা।             শুধু    চোখে চোখে চেয়ে থাকার –                    বুকের তলায় জড়িয়ে রাখার          ব্যাকুল কাঁপন নীরব কেঁদে কইবে কি তার ব্যথা!    কভু   কী কথা সে কইতে গিয়ে হঠাৎ যাব থেমে,           অভিমানে চারটি চোখেই আসবে বাদল নেমে।     কত   চুমুর তৃষায় কাঁপবে অধর, উঠবে কপোল ঘেমে।     হেথা   পুরবে নাকো ভালোবাসার আশা অভাগিনি,     তাই   দলবে বলে কলজেখানা রইনু পথে পাতি।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) নীল পরি ওই    সর্ষে ফুলে লুটাল কার             হলুদ-রাঙা উত্তরি।             উত্তরি-বায়    গো – ওই    আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায়             নীল সে পরির দূর তরি॥    তার    অবুঝ বীণার সবুজ সুরে             মাঠের নাটে পুলক পুরে, ওই    গহন বনের পথটি ঘুরে       আসছে দূরে কচিপাতা দূত ওরই॥       মাঠঘাট তার উদাস চাওয়ায়             হুতাশ কাঁদে গগন মগন       বেণুর বনে কাঁপচে গো তার               দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন। তার    বেতস-লতায় লুটায় তনু,          দিগ্‌বলয়ে ভুরুর ধনু, সে     পাকা ধানের হীরক-রেণু        নীল নলিনীর নীলিম-অণু             মেখেছে মুখ বুক ভরি॥(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) পউষ পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে ঐ যে এলো গো- কুজঝটিকার ঘোম্‌টা-পরা দিগন্ত-রে দাঁড়ায়ে।। সে এলো আর পাতায় পাতায় হায় বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়, অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায় পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।।পউষ এলো গো- এক বছরের শ্রানি-পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়, পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়। পউষ এলো গো! পউষ এলো- শুক্‌নো নিশাস্‌, কাঁদন-ভারাতুর বিদায়-ক্ষণের (আ-হা) ভাঙা গলার সুর- ‘ওঠে পথিক! যাবে অনেক দূর কালো চোখের করুণ চাওয়া ছাড়ায়ে।।’ পথচারী কে জানে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারি, দু'ধারে দু'কুল দুঃখ-সুখের--মাঝে আমি স্রোত-বারি! আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ'তে বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ'তে আন পথে! নিজ বাস হ'ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষন পরে বাহিরিনি পথে গিরি-পর্বতে--ফিরি নাই আর ঘরে। পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে, বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ'লে।জননীরে ভুলি' সে পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশী শুনি', যে পথে পলায় শশকেরা শুনি' ঝরনার ঝুনঝুনি, পাখী উড়ে যায় ফেলিয়া কুলায় সীমাহীন নভোপানে, সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ-যানে,-- সেই পথ ধরি' পলাইনু আমি! সেই হ'তে ছুটে চলি গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সজা বাঁকা শত গলি।                                       --কোন গ্রহ হ'তে ছিঁড়ি' উল্কার মত ছুতেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি! আমি ছুটে যাই জানিনা কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তীরে এসেছি পাহাড় চিরে। উহাদের বদূ কলস ভরিয়া নিয়ে যায় মোর বারি, আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী! ঊহারা দেখিল কেবলি আমার সলিলের শিতলতা, দেখে নাই-জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা!                                       --হায়, কত হতভাগী-- আমিই কি জানি-- মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি'। বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে-ঘটে কিঙ্কিণী, জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর মধুর রিনিকি-ঝিনি। বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি'। আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী। জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু'তীরে বিছায়ে স্নেহ, দীঘি হ'তে ডাকে পদ্মমুখীরা 'থির হও বাঁধি' গেহ!'আমি ব'য়ে যাই- ব'য়ে যাই আমি কুলুকুলু কুলুকুলু শুনি না-- কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু! সদাগর-জাদী মণি-মাণিক্যে বোঝাই করিয়া তরী ভাসে মর জলে,-- "ছল ছল" ব'লে আমি দূরে যাই সরি'। আঁকড়িয়া ধরে' দু'তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্তুলতা; ওরা দেখে নাই আবর্ত মোর, মোর অন্তর-ব্যথা!লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী, আমি বলি 'চল ছল ছল ছল ওরে বধূ তোরে চিনি! কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি!' মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে ফিরে তোরে ঘর-ছাড়া বাঁশী।                                       সে পড়ে ঝাঁপায়-জলে, আমি পথে ধাই--সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে!জানি না ক' হায় চলেছি কোথায় অজানা আকর্ষণে, চ'লেছি যতই তত সে অথই বাজে জল খনে খনে। সন্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর, ছুঁইতে হারাই--এই আছে নাই-- এই ঘর এই পর! ওরে চল চল ছল ছল কি হবে ফিরায়ে আঁখি? তরি তীরে ডাকে চক্রবাকেরে তরি সে চক্রবাকী!ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কুলায়-বাসী, আঁচল ভরিয়া কুড়ায় আমার কাদায়-ছিটানো হাসি। ওরা চ'লে এক্যায়, আমি জাগি হায় ল'ইয়ে চিতাগ্নি শব, ব্যথা-আবর্ত মচড় খাইয়া বুকে করে কলরব! ওরে বেনোজল, ছল ছল ছল ছুটে চল ছুটে চল! হেথা কাদাজল পঙ্কিল তোরে করিতেছে অবিরল। কোথা পাবি হেথা লোনা আঁখিজল, চল চল পথচারী! করে প্রতীক্ষা তোর তরে লোনা সাত-সমুদ্র-বারি! পথহারা বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে, সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে - উদাস পথিক ভাবে।‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে, ‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে; পথের পথিক পথেই বসে থাকে, জানে না সে কে তাহারে চাবে। উদাস পথিক ভাবে।বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে, ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে শৈলমূলে শৈলবালা নাবে - উদাস পথিক ভাবে।বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি, বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি, বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি, একলা থাকার গানখানি সে গাবে - উদাস পথিক ভাবে।হঠাত্‍ তাহার পথের রেখা হারায় গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়, পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায় আর কি পূবের পথের দেখা পাবে উদাস পথিক ভাবে। পথহারা পাখি পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখাবাহিরে অন্তরে ঝড় উঠিয়াছে আশ্রয় যাচি হায় কাহার কাছে!বুঝি দুখ নিশি মোর হবে না হবে না ভোর ফুটিবে না আশার আলোক রেখা।। পথিক বঁধু আজ   নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো!       পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায়-চাওয়া ছলছল?                               বলো সখী বলো বলো!!      মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,       ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি চেনা-পথিক গেছে চলে                   ফিরে আবার আসব বলে গো?                   স্বর শুনে কার চমকে ওঠ (আহা),       ওগো ওযে বিহগ-বেহাগ, নির্ঝরিণীর কলকল।                   ও নয় গো তার পায়ের ভাষা (আহা)       শীতের শেষের শুকনো পাতার ঝরে পড়ার বিদায়-ধ্বনি ও;                   কোন্ কালোরে কোন্ ভালোরে                               বাসলে ভালো (আহা)       পরদেশি কোন্ শ্যামল বঁধুর শুনচ বাঁশি সারাক্ষণই গো?       চুমচো কারে? ও নয় তোমার পথিক-বধুঁর চপল হাসি হা-হা,         তরুণ ঝাউয়ের কচি পাতায় করুণ অরুণ কিরণ ও যে (আ-হা)!                   দূরের পথিক ফিরে নাকো আর (আহা আ-হা)                   ও সে সবুজ দেশের অবুঝ পাখি         কখন এসে যাচবে বাঁধন, চলো সখী ঘরকে চলো!       ও কী? চোখে নামল কেন মেঘের ছায়া ঢল ঢল॥(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) পথিক শিশু নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে। কোন নামের আজ পরলি কাঁকন? বাঁধনহারার কোন্ কারা এ? আবার মনের মতন করে কোন নামে বল ডাকব তোরে? পথভোলা তুই এই সে ঘরে ছিলি ওরে, এলি ওরে বারে বারে নাম হারায়ে। ওরে জাদু, ওরে মানিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি! ক্ষুধিত ঘর ভরলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী। আজ কেন রে নিবিড় মুখে কান্না-সায়র উথলে বুকে? নতুন নামে ডাকতে তোকে ওরে কে কণ্ঠ রুখে? পাঁচ-ফাগুনের জুঁই-চারা এ! আজ মন-পাখি ধায় মধুরতম নাম আশিসের শেষ ছাড়ায়ে।       (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) পথের দিশা চারিদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েসির আখ্‌ড়া দিয়ে রে অগ্রদূত, চ’লতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে? পারবি যেতে ভেদ ক’রে এই বক্র-পথের চক্রব্যুহ? উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ? আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি, এর মাঝে তুই আলোকে-শিশু কোন্‌ অভিযান ক’রবি, শুনি? ছুঁড়ছে পাথর, ছিটায় কাদা, কদর্যের এই হোরি-খেলায় শুভ্র মুখে মাখিয়ে কালি ভোজপুরীদের হট্ট-মেলায় বাঙলা দেশও মাত্‌ল কি রে? তপস্যা তার ভুললো অরুণ? তাড়িখানার চীৎকারে কি নাম্‌ল ধুলায় ইন্দ্র বরুণ? ব্যগ্র-পরান অগ্রপথিক,কোন্‌ বাণী তোর শুনাতে সাধ? মন্ত্র কি তোর শুন্‌তে দেবে নিন্দাবাদীর ঢক্কা-নিনাদ?নর-নারী আজ কন্ঠ ছেড়ে কুৎসা-গানের কোরাস্‌ ধ’রে ভাবছে তা’রা সুন্দরেরই জয়ধ্বনি ক’রছে জোরে? এর মাঝে কি খবর পেলি নব-বিপ্লব-ঘোড়সাওয়ারী আসছে কেহ? টুট্‌ল তিমির, খুল্‌ল দুয়ার পুব-দয়ারী? ভগবান আজ ভূত হ’ল যে প’ড়ে দশ-চক্র ফেরে, যবন এবং কাফের মিলে হায় বেচারায় ফিরছে তেড়ে! বাঁচাতে তায় আসছে কি রে নতুন যুগের মানুষ কেহ? ধুলায় মলিন, রিক্তাভরণ, সিক্ত আঁখি, রক্ত দেহ? মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানদের মন্ত্রণাগার, রে অগ্রদূত, ভাঙতে এবার আসছে কি জাঠ কালাপাহাড়? জানিস যদি, খবর শোনা বন্ধ খাঁচার ঘেরাটোপে, উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির গিঁঠে দাড়ির ঝোপে!নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান, থাকতে নারি দেখে শুনে সুন্দরের এই হীন অপমান। ক্রুদ্ধ রোষে রুদ্ধ ব্যথায় ফোঁপায় প্রাণে ক্ষুদ্ধ বাণী, মাতালদের ঐ ভাঁটিশালায় নটিনী আজ বীণাপাণি! জাতির পারণ-সিন্ধু মথি’ স্বার্থ-লোভী পিশাচ যারা সুধার পাত্র লক্ষ্মীলাভের ক’রতেছে ভাগ-বাঁটোয়ারা, বিষ যখন আজ উঠল শেষে তখন কারুর পাইনে দিশা, বিষের জ্বালায় বিশ্ব পুড়ে, স্বর্গে তাঁরা মেটান তৃষা! শ্মাশন-শবের ছাইয়ের গাদায় আজকে রে তাই বেড়াই খুঁজে, ভাঙন-দেব আজ ভাঙের নেশায় কোথায় আছে চক্ষু বুঁজে! রে অগ্রদূত, তরুণ মনের গহন বনের রে সন্ধানী, আনিস্‌ খবর, কোথায় আমার যুগান্তরের খড়্‌পপাণি!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) পরশ পূজা আমি     এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম, আর     কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,    তখন     মুকুর পাশে একলা গেহে               আমারই এই সকল দেহে          চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো, আহা     পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম।         তখন তুমি নাইবা প্রিয় নাই বা রলে কাছে।          জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো তোমার    বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার কাঁপন লেগে আছে। তখন    নাই বা আমার রইল মনে          কোনখানে মোর দেহের বনে          জড়িয়ে ছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো,   আমি    চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম,          এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) পলাতকা কোন্‌ সুদূরের চেনা বাঁশীর ডাক শুনেছিস্‌ ওরে চখা?      ওরে আমার পলাতকা!   তোর  প’ড়লো মনে কোন্‌ হারা-ঘর,      স্বপন-পারের কোন্‌ অলকা?      ওরে আমার পলাতকা!    তোর জল ভ’রেছে চপল চোখে,    বল্‌  কোন্‌ হারা-মা ডাকলো তোকে রে?    ঐ গগন-সীমায় সাঁঝের ছায়ায়     হাতছানি দেয় নিবিড় মায়ায়-    উতল পাগল! চিনিস্‌ কি তুই চিনিস্‌ ওকে রে?   যেন বুক-ভরা ও গভীর স্নেহে ডাক দিয়ে যায়, “আয়,       ওরে আয় আয় আয়,    কেবল   আয় যে আমার দুষ্টু খোকা!        ওরে আমার পলাতকা!’’     দখিন্‌ হাওয়ায় বনের কাঁপনে-    দুলাল আমার! হাত-ইশারায় মা কি রে তোর        ডাক দিয়েছে আজ?     এতকদিনে চিন্‌লি কি রে পর ও আপনে!    নিশিভোরেই তাই কি আমার নামলো ঘরে সাঁঝ!     ধানের শীষে, শ্যামার শিসে-     যাদুমণি! বল্‌ সে কিসে রে,    তুই শিউরে চেয়ে ছিঁড়লি বাঁধন!     চোখ-ভরা তোর উছলে কাঁদন রে!    তোরে কে পিয়ালো সবুজ স্নেহের  কাঁচা বিষে রে!    যেন আচম্‌কা কোন্‌ শশক-শিশু চ’ম্‌কে ডাকে হায়,     “ওরে আয় আয় আয়     আয় রে খোকন আয়,    বনে আয় ফিরে আয় বনের চখা!        ওরে চপল পলাতকা’’।। পাগল পথিক এ কোন্‌    পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা-র আঙিনায়।             ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায়॥                     অধীন দেশের বাঁধন-বেদন                     কে এল রে করতে ছেদন?           শিকল-দেবীর বেদির বুকে মুক্তি-শঙ্খ কে বাজায়॥             মরা মায়ের লাশ কাঁধে ওই অভিমানী ভায়ে ভায়ে             বুক-ভরা আজ কাঁদন কেঁদে আনল মরণ-পারের মায়ে।                     পণ করেছে এবার সবাই,                     পর-দ্বারে আর যাব না ভাই!           মুক্তি সে তো নিজের প্রাণে, নাই ভিখারির প্রার্থনায়॥           শাশ্বত যে সত্য তারই ভুবন ভরে বাজল ভেরি,             অসত্য আজ নিজের বিষেই মরল ও তার নাইকো দেরি।                     হিংসুকে নয়, মানুষ হয়ে                     আয় রে, সময় যায় যে বয়ে!           মরার মতন মরতে, ওরে মরণভীতু! ক-জন পায়!             ইসরাফিলের শিঙা বাজে আজকে ঈশান-বিষাণ সাথে,             প্রলয়-রাগে নয় রে এবার ভৈরবীতে দেশ জাগাতে।                     পথের বাধা স্নেহের মায়ায়                     পায় দলে আয় পায় দলে আয়!                     রোদন কীসের ? – আজ যে বোধন!                     বাজিয়ে বিষাণ উড়িয়ে নিশান আয় রে আয়॥  (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) পাপ .                                       সাম্যের গান গাই! - যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই। এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি ক' কে আছে পুরুষ-নারী? আমরা ত ছার; - পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী! তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল, দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল! আদম হইতে শুরু ক'রে এই নজরুল তক্ সবে কম-বেশী ক'রে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ্!                                        বিশ্ব পাপস্থান অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান্!                                        ধর্মান্ধরা শোনো, অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো! পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেতা পাপ! সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ। এদের এড়াতে না পারিয়া যত অবতার আদি কেহ পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।                                        বন্ধু, কহিনি মিছে, ব্রক্ষ্মা বিষ্ণু শিব হ'তে ধ'রে ক্রমে নেমে এস নীচে- মানুষের কথা ছেড়ে দাও, যত ধ্যানী মুনী ঋষি যোগী আত্মা তাঁদের ত্যাগী তপস্বী, দেহ তাঁহাদের ভোগী!                                        এ-দুনিয়া পাপশালা, ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা!                                        হেথা সবে সম পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি! জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও, টুপি প'রে টিকি রেখে সদা বল যেন তুমি পাপী নও। পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং, ট্রেডমার্কার ধুম? পুলিশী পোশাক পরিয়া হ'য়েছ পাপের আসামী গুম্!                                       বন্ধু, একটা মজার গল্প শোনো, একদা অপাপ ফেরেশতা সব স্বর্গ-সভায় কোনো এই আলোচনা করিতে আছিল বিধির নিয়মে দুষি- দিন রাত নাই এত পূজা করি, এত ক'রে তাঁরে তুষি, তবু তিনি যেন খুশি নন্ - তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ জাতির 'পরে! শুনিলেন সব অন্তর্যামী, হাসিয়া সবারে ক'ন, - মলিন ধুলার সন্তান ওরা বড় দুর্বল মন, ফুলে ফুলে সেথা ভুলের বেদনা - নয়নে, অধরে শাপ, চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাঁদে চুম্বন-তাপ! সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রোণীতে চন্দ্রহার, চরণে লাক্ষা, ঠোঁটে তাম্বুল, দেখে ম'রে আছে মার! প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান, বুকে বুকে সেথা বাঁকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ। দেবদূত সব বলে, 'প্রভু, মোরা দেখিব কেমন ধরা, কেমনে সেখানে ফুল ফোটে যার শিয়রে মৃত্যু-জরা!' কহিলেন বিভু - 'তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ যে দুইজন যাক্ পৃথিবীতে, দেখুক কি ঘোর ধরণীর প্রলোভন!' 'হারুত' 'মারুত' ফেরেশতাদের গৌরব রবি-শশী ধরার ধুলার অংশী হইল মানবের গৃহে পশি'। - কায়ায় কায়ায় মায়া বুলে হেথা ছায়ায় ছায়ায় ফাঁদ, কমল-দীঘিতে সাতশ' হয়েছে এই আকাশের চাঁদ! শব্দ গন্ধ বর্ণ হেথায় পেতেছে অরূপ-ফাঁসী, ঘাটে ঘাটে হেথা ঘট-ভরা হাসি, মাঠে মাঠে কাঁদে বাঁশী! দুদিনে আতশী ফেরেশতা-প্রাণ ভিজিল মাটির রসে, শফরী-চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে। ঘাগরী ঝলকি' গাগরী ছলকি' নাগরী 'জোহরা' যায় - স্বর্গের দূত মজিল সে-রূপে, বিকাইল রাঙা পা'য়! অধর-আনার-রসে ডুবে গেল দোজখের নার-ভীতি, মাটির সোরাহী মাস্তানা হ'ল আঙ্গুরী খুনে তিতি'! কোথা ভেসে গেল সংযম-বাঁধ, বারণের বেড়া টুটে, প্রাণ ভ'রে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ-পুষ্প-পুটে। বেহেশতে সব ফেরেশতাদের বিধাতা কহেন হাসি' - 'হারুত মারুতে কি ক'রেছে দেখ ধরণী সর্বনাশী!' নয়না এখানে যাদু জানে সখা এক আঁখি-ইশারায় লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়।                                        সুন্দরী বসুমতী চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয় - কাম রতি!(সঞ্চিতা) পাপড়ি-খোলা রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনীতে রিমঝিমিয়ে মরমকথা পথের মাঝে চমকে কে গো থমকে যায় ওই শরম-নতা।          কাঁখচুমা তার কলসি-ঠোঁটে       উল্লাসে জল উলসি ওঠে,       অঙ্গে নিলাজ পুলক ছোটে                   বায় যেন হায় নরম লতা। অ-চকিতে পথের মাঝে পথ-ভুলানো পরদেশী কে হানলে দিঠি পিয়াস-জাগা পথবালা এই উর্বশীকে!          শূন্য তাহার কন্যা-হিয়া       ভরল বধূর বেদন নিয়া,             জাগিয়ে গেল পরদেশিয়া                   বিধুর বধূর মধুর ব্যথা।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) পার্থসারথি হে পার্থসারথি             বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য-শঙ্খ। চিত্তের অবসাদ দূর করো, করো দূর             ভয়-ভীত জনে করো হে নিঃশঙ্ক॥ জড়তা ও দৈন্য হানো হানো গীতার মন্ত্রে জীবন দানো             ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতঙ্ক॥    মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে, শোনাও শোনাও, অনন্তকাল ধরি             অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে॥ দুরন্ত দুর্মদ যৌবন-চঞ্চল ছাড়িয়া আসুক মা-র স্নেহ-অঞ্চল             বীর সন্তান দল             করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক॥(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) পাষাণের ভাঙালে ঘুম পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায় গলিয়া সুরের তুষার গীতিনির্ঝর বয়ে যায়।উদাসী বিবাগী মন যাচে আজ বাহুর বাঁধন কত জনমের কাঁদন ও পায়ে লুটাতে চায়।ওগো তোমার চরণ ছন্দে মোর মুঞ্জরিল গানের মুকুল তোমার বেণীর বন্ধে গো মরিতে চায় সুরের বকুল। চমকে ওঠে মোর গগণ ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়। পাহাড়ি গান মোরা     ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা     ঝরনার মতো চঞ্চল। মোরা     বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা     প্রকৃতির মতো সচ্ছল। মোরা     আকাশের মতো বাধাহীন, মোরা     মরু-সঞ্চর বেদুইন, মোরা     জানি নাকো রাজা রাজ-আইন, মোরা     পরি না শাসন-উদুখল! মোরা     বন্ধনহীন জন্মস্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল। মোরা     সিন্ধু-জোয়ার কলকলমোরাপাগল-ঝোরার ঝরা-জল কল-কলকল ছল-ছলছল কল-কলকল ছল-ছলছল। মোরা     দিল-খোলা খোলা প্রান্তর, মোরা     শক্তি-অটল মহীধর, মোরা     মুক্ত-পক্ষ নভ-চর, মোরা     হাসি-গানসম উচ্ছল। মোরা     বৃষ্টির জল বনফল খাই, শয্যা শ্যামল বন-তল, মোরা     প্রাণ দরিয়ার কল-কল, মোরা     মুক্ত-ধারার ঝরা-জল চল-চঞ্চল কল-কলকল ছল-ছলছল ছল-ছলছল।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) পিছু-ডাক সখি!         নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে?                সেথা তোমার নতুন পূজা নতুন আয়োজনে!                          প্রথম দেখা তোমায় আমায়                          যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,                          যেথায় প্রতি ধূলিকণায়,                                              লতাপাতার সনে                নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,                শূন্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদছে নিরজনে।।সেথা         তুমি যখন ভুল্‌তে আমায়, আস্‌ত অনেক কেহ, তখন         আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদত যে ঐ গেহ।                          যেদিক পানে চাইতে সেথা                          বাজ্‌তে আমার স্মৃতির ব্যথা,                          সে গ্লানি আজ ভুলবে হেথা                                              নতুন আলাপনে।                আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।আমার       এত দিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দুর, ওগো         আমার সুদুর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর।                          এখন তোমার নতুন বাঁধন                          নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,                          নতুন সাধন, গানের মাতন                                              নতুন আবাহনে।                আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদুর পুরাতন।।সখি!         আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর, আজ          মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর-ঘর!                          শূণ্য ভ’রে শুনতে পেনু                          ধেনু-চরা বনের বেণু-                          হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু                                              অন–দিগঙ্গনে।                বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!                এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।। পিলে-পটকা উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম, পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম! চুলগুলো সব বাবুই দড়ি – ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি! তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা, ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা! নিটপিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা! গাইতি-দেঁতো, উঁচকে কপাল আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল! নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি! আর হাসি? দাঁত খামচি সেটি! পাঁচের মতন থুতনো ব্যাঁকা! রগঢিলে, হুঁ ভূতনো ন্যাকা! কান দুটো টান – ঠিক সে কুলো! তোবড়ানো গাল, টিকটা ছুলো! বগলা প্রমাণ ঘাড়টি সরু, চেঁচান যেন ষাঁড় কী গোরু! চলেন গিজাং উরর কোলা ব্যাং, তালপাতা তাঁর ক্ষুর-ওলা ঠ্যাং! বদরাগি তায় এক-খেয়ালি বাস রে! খেঁকি খ্যাঁক-শেয়ালি! ফ্যাঁচকা-মাতু, ছিঁচকাঁদুনে, কয় লোকে তাই মিচকা টুনে! জগন্নাথী ঠুঁটো নুলো, লোম গায়ে ঠিক খুঁটোগুলো! ল্যাবেন্ডিসি নড়বড়ে চাল, তুবড়ি মুখে চড়বড়ে গাল! গুজুর-ঘুণে, দেড়-পাঁজুরে, ল্যাডাগ্যাপচার, ন্যাড়-নেজুড়ে! বসেন সে হাড়-ভাঙা ‘দ’, চেহারা দেখেই সব মামা ‘থ’! গিরগিটে তার ক্যাঁকলেসে ঢং দেখলে কবে, ‘ধেত, এ যে সং!’ খ্যাঙরা-কাটি আঙলাগুলো, কুঁদিলে শ্রীমুখ বাংলা চুলো! পেটফুলো ইয়া মস্ত পিলে, দৈবাতে তায় হস্ত দিলে জোর চটিতং, বিটকেলে চাঁই! ইঁট খাবে নাকো সিঁটকেলে ভাই! নাক বেয়ে তার ঝরচে সিয়ান, ময়রা যেমন করছে ভিয়ান! স্বপন দেখেন হালকা নিঁদে – কুইনাইন আর কালকাসিঁদে! বদন সদাই তোলো হাঁড়ি, গুড়ামুড়ি খান ষোলো আড়ি! ঠোকরে সবাই ন্যাড়া মাথায় – শিলাবিষ্টি ছেঁড়া ছাতায়! রাক্ষুসে ভাত গিলতে পারে বাপ রে, বিড়াল ডিঙতে নারে! হন না ভুলেও ঘরের বাহির, কাঁথার ভিতর জ্বরের জাহির! পড়বে কি আর, দূর ভূত ছাই, ওষুধ খেতেই ফুরসত নাই! বুঝলে? যত মোটকা মিলে বাগাও দেখি পটকা পিলে! বাজবে পেটে তাল ভটাভট নাক ধিনাধিন গাল ফটাফট! ঢাকডুবাডুব ইড়িং-বিড়িং নাচবে ফড়িং তিড়িং তিড়িং! চুপসো গালে গাব গুবাগুব গুপি-যন্তর বাজবে বাঃ খুব! দিব্যি বসে মারবে মাছি, কাশবে এবং হাঁচবে হাঁচি! কিলবিলিয়ে দুটো ঠ্যাং নড়বে যেমন ঠুঁটো ব্যাং!!  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) পুবের হাওয়া আমি ঝড় পশ্চিমের প্রলয়-পথিক – অসহ যৌবন-দাহে লেলিহান-শিখ দারুণ দাবাগ্নি-সম নৃত্য-ছায়ানটে মাতিয়া ছুটিতেছিনু, চলার দাপটে ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডুল করি। অগ্রে সহচরী ঘূর্ণা-হাতছানি দিয়া চলে ঘূর্ণি-পরি গ্রীষ্মের গজল গেয়ে পিলু-বারোয়াঁয় উশীরের তার-বাঁধা প্রান্তর-বীণায়। করতালি-ঠেকা দেয় মত্ত তালিবন কাহারবা-দ্রুততালে। – আমি উচাটন মন্মথ-উম্মদ আঁখি রাগরক্ত ঘোর ঘূর্ণিয়া পশ্চাতে ছুটি, প্রমত্ত চকোর প্রথম-কামনা-ভিতু চকোরিণী পানে ধায় যেন দুরন্ত বাসনা-বেগ-টানে। সহসা শুনিনু কার বিদায়-মন্থর শ্রান্ত শ্লথ গতি-ব্যথা, পাতা-থরথর পথিক-পদাঙ্ক-আঁকা পুব-পথশেষে। দিগন্তের পর্দা ঠেলি হিমমরুদেশে মাগিছে বিদায় মোর প্রিয়া ঘূর্ণি-পরি, দিগন্ত ঝাপসা তার অশ্রুহিমে ভরি। গোলে-বকৌলির দেশে মেরু-পরিস্থানে মিশে গেল হাওয়া-পরি।       অযথা সন্ধানে দিকচক্ররেখা ধরি কেঁদে কেঁদে চলি শ্রান্ত অশ্বশ্বসা-গতি। চম্পা-একাবলী ছিন্ন ম্লান ছেয়ে আছে দিগন্ত ব্যাপিয়া, - সেই চম্পা চোখে চাপি ডাকি, ‘পিয়া পিয়া’! বিদায়-দিগন্ত ছানি নীল হলাহল আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল – সাগরে ডুবিল মোর আলোক-কমলা, আঁখি মোর ঢুলে আসে – শেষ হল চলা! জাগিলাম জন্মান্তর-জাগরণ-পারে যেন কোন্ দাহ-অন্ত ছায়া-পারাবারে বিচ্ছেদ-বিশীর্ণ তনু, শীতল-শিহর! প্রতি রোমকূপে মোর কাঁপে থরথর।    কাজল-সুস্নিগ্ধ কার অঙ্গুলি-পরশ বুলায় নয়ন মোর, দুলায়ে অবশ ভার-শ্লথ তনু মোর ডাকে – ‘জাগো পিয়া। জাগো রে সুন্দর মোরি রাজা শাঁবলিয়া।’জল-নীলা ইন্দ্রনীলকান্তমণি-শ্যামা এ কোন মোহিনী তন্বী জাদুকরী বামা জাগাল উদয়-দেশে নব মন্ত্র দিয়া ভয়াল-আমারে ডাকি – ‘হে সুন্দর পিয়া!’ – আমি ঝড় বিশ্ব-ত্রাস মহামৃত্যুক্ষুধা, ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা – ওগো এত সুধা, কোথা ছিল অগ্নিকুণ্ড মোর দাবদাহে? এত প্রেমতৃষা সাধ গরল প্রবাহে? –    আবার ডাকিল শ্যামা, ‘জাগো মোরি পিয়া!’ এতক্ষণ আপনার পানে নিরখিয়া হেরিলাম আমি ঝড় অনন্ত সুন্দর পুরুষ-কেশরী বীর! প্রলয়কেশর স্কন্ধে মোর পৌরুষের প্রকাশে মহিমা! চোখে মোর ভাস্বরের দীপ্তি-অরুণিমা ঠিকরে প্রদীপ্ত তেজে! মুক্ত ঝোড়ো কেশে বিশ্বলক্ষ্মী মালা তার বেঁধে দেন হেসে!    এ কথা হয়নি মনে আগে, – আমি বীর পরুষ পুরুষ-সিংহ, জয়লক্ষ্মী-শ্রীর স্নেহের দুলাল আমি; আমারেও নারী ভালোবাসে, ভালোবাসে রক্ত-তরবারি ফুল-মালা চেয়ে! চাহে তারা নর অটল-পৌরুষ বীর্যবন্ত শক্তিধর! জানিনু যেদিন আমি এ সত্য মহান – হাসিল সেদিন মোর মুখে ভগবান মদনমোহন-রূপে! সেই সে প্রথম হেরিনু, সুন্দর আমি সৃষ্টি-অনুপম!    যাহা কিছু ছিল মোর মাঝে অসুন্দর অশিব ভয়াল মিথ্যা অকল্যাণকর আত্ম-অভিমান হিংসা দ্বেষ-তিক্ত ক্ষোভ – নিমেষে লুকাল কোথা, স্নিগ্ধশ্যাম ছোপ সুন্দরের নয়নের মণি লাগি মোর প্রাণে! পুবের পরিরে নিয়া অস্তদেশ পানে এইবার দিনু পাড়ি। নটনটী-রূপে গ্রীষ্মদগ্ধ তাপশুষ্ক মারী-ধ্বংস-স্তূপে নেচে নেচে গাই নবমন্ত্র সামগান শ্যামল জীবনগাথা জাগরণতান!    এইবার গাহি নেচে নেচে, রে জীবন-হারা, ওঠ বেঁচে! রুদ্র কালের বহ্নি-রোষ নিদাঘের দাহ গ্রীষ্ম-শোষ নিবাতে এনেছি শান্তি-সোম, ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!    জেগে ওঠ ওরে মূর্ছাতুর! হোক অশিব মৃত্যু দূর! গাহে উদ্‌গাতা সজল ব্যোম, ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম! ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম! ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম॥এসো মোর   শ্যাম-সরসা ঘনিমার      হিঙুল-শোষা বরষা        প্রেম-হরষা   প্রিয়া মোর   নিকষ-নীলা শ্রাবণের      কাজল গুলি ওলো আয়    রাঙিয়ে তুলি সবুজের       জীবন-তুলি,   মৃতে কর   প্রাণ-রঙিলা॥ আমি ভাই     পুবের হাওয়া বাঁচনের       নাচন-পাওয়া, কারফায়      কাজরি গাওয়া,   নটিনীর   পা-ঝিনঝিন! নাচি আর     নাচনা শেখাই পুরবের       বাইজিকে ভাই, ঘুমুরের       তাল দিয়ে যাই –   এক দুই     এক দুই তিন॥    বিল ঝিল     তড়াগ পুকুর পিয়ে নীর     নীল কম্বুর থইথই        টইটম্বুর! ধরা আজ     পুষ্পবতী! শুশুনির       নিদ্রা শুষি রূপসি       ঘুম-উপোসি! কদমের      উদমো খুশি দেখায় আজ   শ্যাম যুবতি॥ হুরিরা       দূর আকাশে বরুণের      গোলাব-পাশে ধারা-জল     ছিটিয়ে হাসে   বিজুলির     ঝিলিমিলিতে! অরুণ আর     বরুণ রণে মাতিল        ঘোর স্বননে আলো-ছায়     গগন-বনে   ‘শার্দূল বিক্রীড়িতে।’(শার্দূল-বিক্রীড়িত ছন্দে)    উত্রাস ভীম     মেঘে কুচকাওয়াজ       চলিছে আজ, সোন্মাদ সাগর     খায় রে দোল! ইন্দ্রের রথ     বজ্রের কামান     টানে উজান     মেঘ-ঐরাবত     মদ-বিভোল।    যুদ্ধের রোল      বরুণের জাঁতায়     নিনাদে ঘোর,      বারীশ আর বাসব             বন্ধু আজ।    সূর্যের তেজ     দহে মেঘ-গরুড়       ধূম্র-চূড়,     রশ্মির ফলক       বিঁধিছে বাজ।    বিশ্রাম-হীন     যুঝে তেজ-তপন       দিক-বারণ     শির-মদ-ধারায়       ধরা মগন!    অম্বর-মাঝ     চলে আলো-ছায়ায়       নীরব রণ     শার্দূল শিকার     খেলে যেমন।    রৌদ্রের শর     খরতর প্রখর        ক্লান্ত শেষ,     দিবা দ্বিপ্রহর        নিশি-কাজল! সোল্লাস ঘোর     ঘোষে বিজয়-বাজ        গরজি আজ     দোলে সিং-বি-        ক্রীড়ে দোল।(সিংহ-বিক্রীড় ছন্দে)    নাচায় প্রাণ     রণোন্মাদ-     বিজয়-গান,     গগনময়     মহোৎসব। রবির পথ      অরুণ-যান     কিরণ-পথ      ডুবায় মেঘ-  মহার্ণব।    মেঘের ছায়    শীতল কায়     ঘুমায় থির       দিঘির জল   অথই থই। তৃষায় ক্ষীণ    ‘ফটিক জল’   ‘ফটিক জল’    কাঁদায় দিল   চাতক ওই।    মাঠের পর     সোহাগ-ঢল     জলদ-দ্রব       ছলাৎছল    ছলাৎছল পাহাড়-গায়     ঘুমায় ঘোর     অসিত মেঘ-     শিশুর দল   অচঞ্চল।    বিলোল-চোখ   হরিণ চায়       মেঘের গায়,     চমক খায়   গগন-কোল, নদীর-পার    চখির ডাক       ‘কোয়াককো’     বনের বায়   খাওয়ায় টোল।    স্বয়ম্ভূর       সতীর শোক-      ধ্যানোম্মাদ-      নিদাঘ-দাব   তপের কাল নিশেষ আজ!  মহেশ্বর          উমার গাল       চুমার ঘায়    রাঙায় লাল।(অনঙ্গশেখর ছন্দে)    এবার আমার     বিলাস শুরু     অনঙ্গশেখরে। পরশ-সুখে       শ্যামার বুকে     কদম্ব শিহরে। কুসুমেষুর        পরশ-কাতর     নিতম্ব-মন্থরা সিনান-শুচি      স-যৌবনা       রোমাঞ্চিত ধরা। ঘন শ্রোণির,     গুরু ঊরুর,      দাড়িম-ফাটার ক্ষুধা যাচে গো আজ   পরুষ-পীড়ন      পুরুষ-পরশ-সুধা। শিথিল-নীবি      বিধুর বালা      শয়ন-ঘরে কাঁপে, মদন-শেখর      কুসুম-স্তবক      উপাধানে চাপে।    আমার বুকের     কামনা আজ     কাঁদে নিখিল জুড়ি, বনের হিয়ায়      তিয়াস জিয়ায়    প্রথম কদম-কুঁড়ি। শাখীরা আজ     শাখায় শাখা      পাখায় পাখায় বাঁধা, কুলায় রচে,      মনে শোনে       শাবক শিশুর কাঁদা।    তাপস-কঠিন      উমার গালে      চুমার পিয়াস জাগে, বধূর বুকে        মধুর আশা      কোলে কুমার মাগে! তরুণ চাহে       করুণ চোখে      উদাসী তার আঁখি, শোনে, কোথায়   কাঁদে ডাহুক      ডাহুকের ডাকি!    এবার আমার     পথের শুরু       তেপান্তরের পথে, দেখি হঠাৎ       চরণ রাঙা       মৃণাল-কাঁটার ক্ষতে। ওগো আমার      এখনও যে      সকল পথই বাকি, মৃণাল হেরি       মনে পড়ে        কাহার কমল-আঁখি!    (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) পুরববঙ্গ পদ্ম-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা-বিধৌত পূর্ব-দিগন্তে তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী-অন্তে। ব্রাহ্ম মুহুর্তের সেই পুরবাণী জাগায় সুপ্ত প্রাণ জাগায় – নব চেতনা দানি সেই সঞ্জীবনী বাণী শক্তি তার ছড়ায়             পশ্চিমে সুদূর অনন্তে॥ ঊর্মিছন্দা শত-নদীস্রোত-ধারায় নিত্য পবিত্র –             সিনান-শুদ্ধ-পুরববঙ্গ ঘন-বন-কুন্তলা প্রকৃতির বক্ষে সরল সৌম্য             শক্তি-প্রবুদ্ধ পুরববঙ্গ আজি শুভলগ্নে তারই বাণীর বলাকা         অলখ ব্যোমে মেলিল পাখা ঝংকার হানি যায় তারই পুরবাণী         জীবন্ত হউক হিম-জর্জর ভারত              নবীন বসন্তে॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) পূজারিণী এত দিনে অবেলায়- প্রিয়তম! ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম দিবাযামী যবে আমি নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়- এ দিনে অ-বেলায় জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি। পূজারিণী! ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী, ঐ আখি, ঐ মুখ, ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক, ঐ তব অপরূপ রূপ, ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’- চিনি সব চিনি।তাই আমি এতদিনে জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে ডাকি শুকু ডাকি তোমা’ প্রিয়তমা! ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে! তারি সাথে কাঁদি আমি- ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি, বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী, তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী! যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো, আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো, বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী। চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি! চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়, তারপর চেনা-শেষে তুমি-হারা পরদেশে ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’ আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি- মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি, যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি। তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম, উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর, জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর, বাধা বন্ধ-হারা অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী। সাথে তারি এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি। এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর- ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে, মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,- হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’ চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর- বিরহের কান্না-ভারাতুর বনানী-দুলানো, দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন! তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে, বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে- শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া লেগেছিল মম আঁখি-পাতে। আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,- কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।তারপর-গান গাওয়া শেষে নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে। অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে (কেন কে সে জানে) দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী, ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর প’ড়েছিল ঝরি’! একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল, কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী বল্‌ মোরে বল্‌ । এই ভাঙা বুকে ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে বল্‌ মোরে বল্‌- মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান? মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল? অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ? মোর পানে চেয়ে সবে হাসে, বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে; মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে, মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে দংশে তার বুকে, অমনি সে দলে পদতলে! বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা, ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা? তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্‌ অধিকারে নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে? কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর? জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর! নহে তা’ও নহে- বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্‌ রিক্ত অভিমানী কহে- ‘নহে তা’ও নহে।’ দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে, কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে, তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা? সে রহস্য রাণী! কেহ নাহি জানে- তুমি নাহি জান- আমি নাহি জানি। চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ- কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা! চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা! কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা! নীরবে স’য়েছ সবি- সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি। তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর; সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’ মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে, মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা, অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা বন-মাঝে একাকিনী দময়ন-ী ঘুরে ঘুরে ঝুরে, ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে। কানে- প’ড়ে মনে বনলতা সনে বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে। হেম-গিরি-শিরে হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়, কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!- চিনিলাম বুঝিলাম সবি- যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্‌ পল্লী-পথে দূরে!– দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে- আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে। কেঁদে ওঠে লতা-পাতা, ফুল পাখি নদীজল মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল, কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা! পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই, চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই, কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই? হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস, মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ! চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে- কার বক্ষ টুটে মম প্রাণ-পুটে কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে? মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে! কস’রী হরিণ-সম আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম! আপনারই ভালোবাসা আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা! অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর! ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার! কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু অনাদি পাথার! মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার! কোথা গেলে তারে পাই, যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই! ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি, পথে কত পথ-বালা যায়, তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায় ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন, পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে। প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে, গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে! প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম! পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে, লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে। কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে; ‘অনাথপিন্ডদ’-সম মহাভিক্ষু প্রাণ মম প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে, “ভিক্ষা দাও, পুরবাসি! বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’ কত এল কত গেল ফিরে,- কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে! ভাঙা-বুকে কেহ, কেহ অশ্র”-নীরে- কত এল কত গেল ফিরে! আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ, বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ। তারা আসে হেসে; শেষে হাসি-শেষে কেঁদে তারা ফিরে যায় আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে। বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্‌ ধন মাগে? সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে? কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ, কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন, কেহ রূপ দেহ। গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।…. সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান- “কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই? যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি ওগো মোর স্বামি! রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!” মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা, হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা- তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা। দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন- ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে- ‘আমি নাথ তব ভিখারিনী, আমি তোমা’ চিনি, তুমি মোরে চেন।’ বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে, এ যে মিথ্যা মায়া, জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা! ‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে, কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী, ঘরে ডেকে মারে। এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ, এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ। হ’ল না সে জয়ী, আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী। কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে, জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায় তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে। তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত, তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত। মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ- ‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে কহ মোরে কহ! নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী, তাই তব চির-মৌন ভাষা শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে কাঁদে কত ভালোবাসা আশা! এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার সে ঝড়ের রাতে, কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে। কোথা গেল পথ- কোথা গেল রথ- ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা, জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা! গত কথা গত জন্ম হেন হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন। গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে। শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া, ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া। আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ- বুঝি কোন্‌ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ। ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,- ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী মাগে কোন্‌ পূজা, ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,- নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ। যেন কোন্‌ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি, সুরভিতে মেতে উঠে বুক, উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ। বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।…. …. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী- জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা, অপমানে দাবানল-সম তেজে র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা। হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’ বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী, ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে। …. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে! সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে। সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’ ভুলিলাম অতীতের জ্বালা, বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে, অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’, একা তুমি বনবালা মোর তরে গাঁথিতেছ মালা আপনার মনে লাজে সঙ্গোপনে। জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী। অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি। বেঁচে ওঠ্‌ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই- যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’ তারি মাঝে কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে? কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়- ‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়! শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা, প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা! ছুটে এনু তব পাশে উর্ধ্বশ্বাসে, মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে, তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা; আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা। যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা অশ্র”-ভাঙা ভাষা। ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ- সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান! সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’ আজ শুধু হেসে হেসে মরি! তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’, প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া! ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে, বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন অবহেলে শুধু ভালোবাসে। ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে। ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে! কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ? কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান? এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ; আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী, তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী! কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,- দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি? মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান, তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে, তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ! লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া, আজ তারে ভুলাইতে চাহ, যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া। তাই আজি ভাবি, কার দোষে- অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে? তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী? যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি! ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক। জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক। আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা সব মিথ্যা হোক; জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক। তব মুখপানে চেয়ে আজ বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ; তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’ তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি। মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও! ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও! তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’, কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি- মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী, কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী? এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা, এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ! পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি- অপমানে ফেটে যায় বুক! প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়! রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়! এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি! ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ, পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি। নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো, এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো! ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।.. যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে, যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে। বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি, রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই, কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি? জ্বলে’ ওঠ্‌ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্‌-ধ্বক্‌, হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক। আন্‌ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী! হান্‌ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্‌ এই মিথ্যাপুরী। রক্ত-সুধা-বিষ আন্‌ মরণের ধর টিপে টুটি! এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্‌ কুটি-কুটি! কন্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা, তবু, বালা, থেকে থেকে মনে পড়ে- যতদিন বাসিনি তোমারে ভালো, যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো, তুমি ততদিনই যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিনী। ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে তব চোখে উছলাতো জল, ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে; একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি’ কত নিশি-দিন তুমি মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি’, আমি চেয়ে দেখি নাই; তারই প্রতিশোধ নিলে বুঝি এতদিনে! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ! আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি- অকর”ণা! প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকর”ণ খেলা! এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা কেমনে হানিতে পার, নারী! এ আঘাত পুর”ষের, হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম মোরা শুধু পুর”ষেরা পারি। ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান, একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া মন-প্রাণ লভে অবসান। ভুল, তাহা ভুল বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হ’রে নেয় ফুল! বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া! অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া! পথিক-দখিনা-বায়ু আমি চলিলাম বসনে-র শেষে মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে! বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্র” ভরি’ কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’! আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো, কুমারী-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে-মুখে- ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে! সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি স্মরি’ মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল- আমি আজ তৃপ্ত হ’য়ে মরি! না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-শুধু তুমি, সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি’। মোরে মনে প’ড়ে- একদা নিশীথে যদি প্রিয় ঘুশায়ে কাহারও বুকে অকারণে বুক ব্যথা করে, মনে ক’রো, মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ! আর কভু আসিবে না উগ্র সুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ! মরিয়াছে-অশান- অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী,- অমর হইয়া আছে-র’বে চিরদিন তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি! পূর্ণ-অভিনন্দন [গান] এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ! ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ! এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম! এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! ছয়বার জয় করি কারা-ব্যুহ, রাজ-রাহু-গ্রাস-মুক্ত চাঁদ! আসিলে চরণে দুলায়ে সাগর নয়-বছরের মুক্ত-বাঁধ! নবগ্রহ ছিঁড়ি ফণি-মনসার মুকুটে তোমার গাঁথিলে হার, উদিলে দশম মহাজ্যোতিষ্ক ভেদিয়া গভীর অন্ধকার! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! স্বাগত শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নব মহাবলী! দনুজ-দমন দধীচি-অস্থি, বহ্নিগর্ভ দম্ভোলি! স্বাগত সিংহ-বাহিনী-কুমার! স্বাগত হে দেব-সেনাপতি! অনাগত রণ-কুরুক্ষেত্রে সারথি-পার্থ-মহারথী! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! নৃশংস রাজ-কংস-বংশে হানিতে তোমরা ধ্বংস-মার এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র, ভাঙিয়া পাষাণ-দৈত্যাগার! এস অশান্তি-অগ্নিকাণ্ডে শান্তিসেনার কাণ্ডারি! নারায়ণী-সেনা-সেনাধিপ, এস প্রতাপের হারা- তরবারি! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর! ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ! না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ। জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ! জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! স্বর্গ হইতে জননী তোমার পেতেছেন নামি মাটিতে কোল, শ্যামল শস্যে হরিৎ ধান্যে বিছানো তাঁহারই শ্যাম আঁচল। তাঁহারি স্নেহের করুণ গন্ধ নবান্নে ভরি উঠিছে ঐ, নদীস্রোত-স্বরে কাঁদিছেন মাতা, 'কই রে আমার দুলাল কই?' স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! মোছো আঁখি-জল, এস বীর! আজ খুঁজে নিতে হবে আপন মায়, হারানো মায়ের স্মৃতি-ছাই আছে এই মাটিতেই মিশিয়া,হায়! তেত্রিশ কোটি ছেলের রক্তে মিশেছে মায়ের ভস্ম-শেষ, ইহাদেরি মাঝে কাঁদিছেন মাতা, তাই আমাদের মা স্বদেশ। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর! এস বীর! এস যুগ-সেনাপতি! সেনাদল তব চায় হুকুম, হাঁকিছে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্‌গারে গিরি অগ্নি-ধূম। পরাধীন এই তেত্রিশ কোটি বন্দির আঁখি-জলে হে বীর, বন্দিনী মাতা যাচিছে শক্তি তোমার অভয় তরবারির। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!   গল-শৃঙ্খল টুটেনি আজিও, করিতে পারি না প্রণাম পা'য়, রুদ্ধ কণ্ঠে ফরিয়াদ শুধু গুমরিয়া মরে গুরু ব্যথায়। জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম, শত্রু-খড়্‌গ-ছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর, বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! প্রণয় নিবেদন লো কিশোরী কুমারী!          পিয়াসি মন তোমার ঠোঁটের একটি গোপন চুমারই॥                            অফুট তোমার অধর ফুলে                            কাঁপন যখন নাচন তুলে                   একটু চাওয়ায় একটু ছুঁলে গো! তখন      এ-মন যেমন কেমন-কেমন কোন্ তিয়াসে কোঙারি? –   ওই     শরম-নরম গরম ঠোঁটের অধীর মদির ছোঁয়ারই।             বুকের আঁচল মুখের আঁচল বসন-শাসন টুটে ওই       শঙ্কা-আকুল কী কী আশা ভালোবাসা ফুটে সই?                            নয়ন-পাতার শয়ন-ঘেঁসা                            ফুটচে যে ওই রঙিন নেশা                            ভাসা-ভাসা বেদনমেশা গো!   ওই     বেদন-বুকে যে সুখ চোঁয়ায় ভাগ দিয়ো তার কোঙারই! আমার     কুমার হিয়া মুক্তি মাগে অধর ছোঁয়ায় তোমারই॥       (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) প্রণয়-ছল কত      ছল করে সে বারেবারে দেখতে আসে আমায়। কত      বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি আমার দোরেই থামায়॥                   জানলা আড়ে চিকের পাশে                   দাঁড়ায় এসে কিসের আশে,                   আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে,                            গাল দুটিকে ঘামায়।          অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল                            দুরু দুরু বুকে          সবাই যখন ঘুমে মগন তখন আমায় চুপে চুপে            দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়                            রঙ খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে।                   দোর দিয়ে মোর জলকে চলে                   কাঁকন মারে কলস-গলে                   অমনি চোখোচোখি হলে          চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।            সইরা হাসে দেখে ছুঁড়ির দোর দিয়ে মোর                            নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা।          করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার পথেই                            শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!          একে ওকে ডাকার ভানে          আনমনা মোর মনটি টানে,          চলতে চাদর পরশ হানে                   আমারও কী নিতুই পথে তারই বুকের জামায়॥            পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে                            উদাসনয়ান যখন এলোকেশে,          জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই                 ভাবতেছে সে, মরেছে সে আমায় ভালোবেসে।                   বই হাতে সে ঘরের কোণে                   জানি আমার বাঁশিই শোনে,                   ডাকলে রোষে আমার পানে          নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়॥ (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) প্রতিবেশিনী আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলত নিতুই সকাল-সাঁঝে। আর এ পথে চলবে না সে সেই ব্যথা হায় বক্ষে বাজে।আমার দ্বারের কাছটিতে তার ফুটত লালী গালের টোলে, টলত চরণ, চাউনি বিবশ কাঁপত নয়ন-পাতার কোলে –                   কুঁড়ি যেমন প্রথম খোলো গো!       কেউ কখনও কইনি কথা,       কেবল নিবিড় নীরবতা       সুর বাজাত অনাহতা                   গোপন মরম-বীণার মাঝে। মূক পথের আজ বুক ফেটে যায় স্মরি তারই পায়ের পরশ                   বুক-খসা তার আঁচর-চুমু, রঙিন ধুলো পাংশু হল, ঘাস শুকাল যেচে বাচাল                   জোড়-পায়েলার রুমঝুমু!আজও আমার কাটবে গো দিন রোজই যেমন কাটত বেলা, একলা বসে শূন্য ঘরে – তেমনি ঘাটে ভাসবে ভেলা –                   অবহেলা হেলাফেলায় গো!       শুধু সে আর তেমন কর       মন রবে না নেশায় ভরে       আসার আশায় সে কার তরে                   সজাগ হয়ে সকল কাজে।ডুকরে কাঁদে মন-কপোতী –       ‘কোথায় সাথির কূজন বাজে?             সে পা-র ভাষা কোথায় রাজে?’(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় যায় মহাকাল মূর্ছা যায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় যায় অতীত কৃষ্ণ-কায় যায় অতীত রক্ত-পায়— যায় মহাকাল মূর্ছা যায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়! প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!    যায় প্রবীণ      চৈতি-বায় আয় নবীন-      শক্তি আয়! যায় অতীত যায় পতিত, ‘আয় অতিথ,      আয় রে আয় –’ বৈশাখী-ঝড় সুর হাঁকায় – প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!    ওই রে দিক্-      চক্রে কার বক্রপথ      ঘুর-চাকার! ছুটছে রথ,      চক্র-ঘায় দিগ্‌বিদিক      মূর্ছা যায়!কোটি রবি শশী ঘুর-পাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়! ঘোরে গ্রহ তারা পথ-বিভোল, – ‘কাল’-কোলে ‘আজ’খায় রে দোল!    আজ প্রভাত      আনছে কায়, দূর পাহাড়-      চূড় তাকায়। জয়-কেতন      উড়ছে কার কিংশুকের      ফুল-শাখায়। ঘুরছে রথ,      রথ-চাকায় রক্ত-লাল      পথ আঁকায়। জয়-তোরণ      রচছে কার ওই উষার      লাল আভায়, প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়।গর্জে ঘোর      ঝড় তুফান আয় কঠোর      বর্তমান। আয় তরুণ আয় অরুণ আয় দারুণ, দৈন্যতায়!      দৈন্যতায়! ওই মা অভয়-হাত দেখায় রামধনুর      লাল শাঁখায়! প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়! বর্ষ-সতী-স্কন্ধে ওই নাচছে কাল      থই তা থই    কই সে কই      চক্রধর, ওই মায়ায়      খণ্ড কর। শব-মায়ায়      শিব যে যায় ছিন্ন কর      ওই মায়ায় — প্রবর্তকের ঘুর-চাকায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) প্রভাতী ভোর হোলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে! ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুল-খুকী ছোট রে! খুকুমণি ওঠ রে! রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ, দারোয়ান গায় গান শোনো ঐ, 'রামা হৈ'। ত্যাজি' নীড় ক'রে ভিড় ওড়ে পাখী আকাশে, এন্তার গান তার ভাসে ভোর বাতাসে! চুলবুল বুলবুল খুকুমনি উঠবে! খুলি'হাল তুলি' পাল ঐ তরী চ'ললো, এইবার এইবার খুকু চোখ খুললো! আলসে নয় সে ওঠে রোজ সকালে, রোজ তাই চাঁদা ভাই টিপ দেয় কপালে। উঠল ছুটল ঐ খোকাখুকী সব, 'উঠেছে আহে কে' ঐ শোনো কলরব। নাই রাত মুখ হাত ধোও, খুকু জাগো রে! জয়গানে ভগবানে তুষি'বর মাগো রে! প্রলয়োল্লাস তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!আস্‌ছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল, সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্‌ল আগল।       মৃত্যু-গহন অন্ধ-কূপে       মহাকালের চণ্ড-রূপে–                 ধূম্র-ধূপে বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আস্‌ছে ভয়ঙ্কর–       ওরে ঐ হাস্‌ছে ভয়ঙ্কর!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!ঝামর তাহার কেশের দোলায় ঝাপ্‌টা মেরে গগন দুলায়, সর্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর ঢুলায়!       বিশ্ব পাতার বক্ষ-কোলে       রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে                 দোদুল্‌ দোলে! অট্টরোলের হট্টগোলে স্তব্ধ চরাচর–       ওরে ঐ স্তব্ধ চরাচর!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!দ্বাদশ রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়, দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়!       বিন্দু তাহার নয়ন-জলে       সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে                        কপোল-তলে! বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর 'পর–       হাঁকে ঐ 'জয় প্রলয়ঙ্কর!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!মাভৈ মাভৈ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে! জরায়-মরা মুমূর্ষদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে!       এবার মহা-নিশার শেষে       আস্‌বে ঊষা অরুণ হেসে                         করুণ বেশে! দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,       আলো তার ভর্‌বে এবার ঘর।       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!ঐ সে মহাকাল-সারথি রক্ত-তড়িত-চাবুক হানে, রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড়-তুফানে! খুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে!                     গগন-তলের নীল খিলানে।       অন্ধ করার বন্ধ কূপে       দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে                           পাষাণ স্তূপে! এই তো রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর–       শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর।       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর ? –প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন! আসছে নবীন– জীবন-হারা অ-সুন্দরে কর্‌তে ছেদন!       তাই সে এমন কেশে বেশে       প্রলয় বয়েও আস্‌ছে হেসে–                            মধুর হেসে! ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!ঐ ভাঙা-গড়ার খেলা যে তার কিসের তবে ডর?       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!–       বধূরা প্রদীপ তুলে ধর্‌! কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!–       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!       তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!! প্রশস্তি -অসহায় এই অবনীতলে বিবাদ কলহ উৎপীড়নের রাজ্য চলে। আছে নিপীড়ন জনগণ চেয়ে হতাশ প্রাণে, ফরিয়াদ ওঠে ধূমায়িত হয়ে ঊর্ধ্ব পানে। নয়া জামানার নিশান ধরিয়া ইহারি মাঝে তুমি এস নওজোয়ান অগ্রপথিক সাজে। তরুণ অরুণ রশ্মির সম তোমার বাণী আনুক জীবন তিমির-বিদায় শায়ক হানি। পীড়িতের প্রাণে নব সান্ত্বনা চেতনা লয়ে তুমি এস সরদার তাহাদের মুজদা বয়ে। প্রার্থনা আমাদের ভালো করো হে ভগবান। সকলের ভালো করো হে ভগবান।।আমাদের সব লোকে বাসিবে ভালো। আমরাও সকলেরে বাসিব ভালো। রবে না হিংসা দ্বেষ দেহ ও মনে ক্লেশ, মাটির পৃথিবী হবে স্বর্গ- সমান- হে ভগবান।।জ্ঞানের আলোক দাও হে ভগবান। বিপুল শক্তি দাও হে ভগবান।।তোমারই দেওয়া জ্ঞানে চিনিব তোমায়, তোমারই শক্তি হবে কর্মে সহায়। ধর্ম যদি সাথী হয় রবে না ক দুঃখ ভয়, বিপদে পড়িলে তুমি করো যেন ত্রান- হে ভগবান।। প্রিয়ার রূপ অধর নিসপিস নধর কিসমিস   রাতুল তুলতুল কপোল; ঝরল ফুল-কুল, করল গুল ভুল   বাতুল বুলবুল চপল।    নাসায় তিলফুল হাসায় বিলকুল,   নয়ান ছলছল উদাস, দৃষ্টি চোর-চোর মিষ্টি ঘোর-ঘোর,   বয়ান ঢলঢল হুতাশ। অলক দুলদুল পলক ঢুল ঢুল,   নোলক চুম খায় মুখেই, সিঁদুর মুখটুক হিঙুল টুকটুক,   দোলক ঘুম যায় বুকেই।    ললাট ঝলমল মলাট মলমল   টিপটি টলটল সিঁথির, ভুরুর কায় ক্ষীণ শুরুর নাই চিন,   দীপটি জ্বলজ্বল দিঠির।    চিবুক টোল খায়, কী সুখ-দোল তায়   হাসির ফাঁস দেয় – সাবাস। মুখটি গোলগাল, চুপটি বোলচাল   বাঁশির শ্বাস দেয় আভাস।    আনার লাল লাল দানার তার গাল,   তিলের দাগ তায় ভোমর; কপোল-কোল ছায় চপল টোল, তায়   নীলের রাগ ভায় চুমোর॥(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) ফরিয়াদ এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান    মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!-     আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া     বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া,    যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ!    এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্‌?        ভগবান! ভগবান!   তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা!    সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা!     নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ,    ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক!   আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান।   তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ!       ভগবান! ভগবান!        রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-   ‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।    এই ধরণীর যাহা সম্বল,-    বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,   সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,-   সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’   ভগবান! ভগবান!   শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।    আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!     তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে     জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,    সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।    সন-ান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!        ভগবান! ভগবান!       তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি,    তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি!     ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া     তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া-    সন-ান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান!    ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান!         ভগবান! ভগবান!    তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,    রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!     মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া     রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!    সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান!    ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!         ভগবান! ভগবান!   জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,    সন-ান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।     মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,     মাটির মালিক তাঁহারাই হন-    যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।    নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।         ভগবান! ভগবান!   অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি,    সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি!     তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ     বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ!    এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্‌ ।    পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান-         ভগবান! ভগবান!    ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর!    ‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’     রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ,     নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ!    শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান-    ‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান! জয় জয় ভগবান!’তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ, এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ। তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে, কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান? আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ-      এতদিনে ভগবান!যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা, সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা? উদার আকাশ বাতাস কাহারা   করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা? তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান? হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?      ভগবান! ভগবান!তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্‌ নিপীড়ন-চেড়ী? আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী? ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ, আমিও মানুষ, আমিও মহান্‌ ! আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান! মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান-      এতদিনে ভগবান! চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির। বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর। এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো- আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো, এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ। মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান-   জয় নিপীড়িত প্রাণ!   জয় নব অভিযান!   জয় নব উত্থান! ফাতেমা দুলাল কাঁদে ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে অঝোর নয়নে রে। দু'হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি পড়িল কি মনে রে।।দুধের ছাওয়াল আসগর এই পানি ছাহিয়ে রে দুষ্মনের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল খুন পিয়ে রে, শাদীর নওশা কাসেম শহীদ এই পানি বহনে রে।।এই পানিতে মুছিল রে হাতের মেহেদী সকীনার, এই পানিরই ঢেউয়ে ওঠে তারি মাতম হাহাকার, শহীদানের খুন মিশে আছে এই পানিরই সনে রে।।বীর আব্বাসের বাজু শহীদ হলো এরি তরে রে, এই পানি বিহনে জয়নাল খিমায় তৃষ্ণায় মরে রে, শোকে শহীদ হলেন হোসেন জয়ী হয়েও রণে রে।। ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্ [আবির্ভাব] ১              নাই    তা   জ              তাই    লা    জ? ওরে   মুসলিম, খর্জুর-শিষে তোরা সাজ! করে   তসলিম হর কুর্নিশে শোর আওয়াজ শোন   কোন মুজ্‌দা সে উচ্চারে হেরা আজ               ধরা-মাঝ!           উরজ-য়্যামেন নজ্‌দ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম        মেশের ওমান তিহারান স্মরি কাহার বিরাট নাম। পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।               চলে   আঞ্জাম               দোলে   তাঞ্জাম খোলে   হুর-পরি মরি ফিরদৌসের হাম্মাম ! টলে   কাঁখের কলসে কওসর ভর , হাতে আব-জমজম জাম । শোন   দামাম কামান তামাম সামান নির্ঘোষি কার নাম পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লানম।’   ২              মস্       তান !              ব্যস       থাম্! দেখ   মশ্‌গুল আজি শিস্তান-বোস্তান , তেগ   গর্দানে ধরি দারোয়ান রোস্তাম । বাজে   কাহারবা বাজা, গুলজার গুলশানগুলশান : পুষ্প-বাটিকা।            গুলফাম !          দক্ষিণে দোলে আরবি দরিয়া খুশিতে সে বাগে-বাগ ,           পশ্চিমে নীলা‘লোহিতে’র খুন-জোশিতে রে লাগে আগ, মরু   সাহারা গোবিতে সব্‌জার জাগে দাগ!            নূরে  কুর্শির              পুরে   ‘তূর’ -শির, দূরে   ঘূর্ণির তালে সুর বুনে হুরি ফুর্তির, ঝুরে   সুর্খির ঘন লালি উষ্ণীষে ইরানিদূরানি তুর্কির! আজ   বেদুইন তার ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া ছুড়ে ফেলে বল্লম পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাললাম।’   ৩            ‘সাবে   ঈন’              তাবে   ঈন হয়ে   চিল্লায় জোর ‘ওই ওই নাবে দীন ! ভয়ে   ভূমি চুমে ‘লাত্ মানাত’ -এর ওয়ারেশিন । রোয়ে   ওয্‌যা-হোবলইবলিসখারেজিন , –                 কাঁপে   জীন্ !          জেদ্দার পূবে মক্কা মদিনা চৌদিকে পর্বত,          তারই মাঝে ‘কাবা’ আল্লার ঘর দুলে আজ হর ওক্ত্ , ঘন     উথলে অদূরে ‘জম-জম’ শরবৎ!               পানি    কওসর,             মণি    জওহর আনি   ‘জিবরাইল’ আজ হরদম দানে গওহর , টানি    মালিক-উল-মৌতজিঞ্জির – বাঁধে মৃত্যুর দ্বার লৌহর। হানি   বরষা সহসা ‘মিকাইল’ করে ঊষর আরবে ভিঙা , বাজে   নব সৃষ্টির উল্লাসে ঘন ‘ইসরাফিল’ -এর শিঙা!৪            জন্   জাল              কঙ্   কাল ভেদি,  ঘন জাল মেকি গণ্ডির পঞ্জার ছেদি,  মরুভূতে একী শক্তির সঞ্চার! বেদি   পঞ্জরে রণে সত্যের ডঙ্কার                 ওংকার!          শঙ্কারে করি লঙ্কার পার কার ধনু-টংকার        হুংকারে ওরে সাচ্চা-সরোদে শাশ্বত ঝংকার? ভূমা-   নন্দে রে সব টুটেছে অহংকার!              মর-  মর্মরে              নর-  ধর্ম রে বড়ো   কর্মরে দিল ইমানের জোর বর্ম রে, ভর্   দিল্ জান্ – পেয়ে শান্তি নিখিল ফিরদৌসের হর্ম্য রে! রণে   তাই তো বিশ্ব-বয়তুল্লাতে মন্ত্র ও জয়নাদ – ‘ওয়ে  মার্‌হাবা ওয়ে মার্‌হাবা এয়্ সর্‌ওয়ারে কায়েনাত !’    ৫            শর- ওয়ান              দর্- ওয়ান আজি   বান্দা যে ফেরউন শাদ্দাদ নমরুদ মারোয়ান ; তাজি   বোর্‌রাক্ হাঁকে আশমানে পর্‌ওয়ান, – ও যে   বিশ্বের চির সাচ্‌চারই বোর্‌হান –               ‘কোর-আন’!           ‘কোন্ জাদুমণি এলি ওরে’ – বলি রোয়ে মাতা আমিনায়          খোদার হবিবে বুকে চাপি, আহা, বেঁচে আজ স্বামী নাই! দূরে    আব্‌দুল্লার রুহ্ কাঁদে, “ওরে আমিনারে গমি নাই –দেখো   সতী তব কোলে কোন্ চাঁদ, সব ভর-পুর ‘কমি’ নাই।’         ‘এয়্  ফর্ জন্দ’ –          হায়   হর্‌দম্ ধায়    দাদা মোত্‌লেব কাঁদি, – গায়ে ধুলা কর্দম! ‘ভাই।  কোথা তুই?’ বলি বাচ্চারে কোলে কাঁদিছে হাম্‌জা দুর্দম! ওই   দিক্‌হারা দিক্‌পার হতে জোর-শোর আসে, ভাসে ‘কালাম’ – ‘এয়   ‘শাম্‌সোজ্জোহা বদরোদ্দোজা কামারোজ্জমাঁ’ সালাম!’      (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্ [তিরোভাব] এ কী বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ! বে-দরদ দিল্ কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর শোক।           জান-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ,           কব্‌জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ , খাক চুমে নীলা তাজ । জিব্‌রাইলের আতশি পাখা সে ভেঙে যেন খান খান, দুনিয়ার দেনা মিটে যায় আজ তবু জান আন্-চান!                    মিকাইল অবিরল           লোনা    দরিয়ার সবই জল ঢালে    কুল মুল্লুকে , ভীম বাতে খায় অবিরল ঝাউ দোল। এ কি    দ্বাদশীর চাঁদ আজ সেই? সেই রবিয়ল আউওল ?    ২    ঈশানে কাঁপিছে কৃষ্ণ নিশান, ইস্‌রাফিলের ও প্রলয়-বিষাণ আজ           কাতরায় শুধু! গুমরিয়া কাঁদে কলিজা-পিষানো বাজ! রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান? তারও বুক বেয়ে আঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান!           জমিন্-আশমান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্‌রাক্ ,           চিখ্ মেরে কাঁদে ‘আরশে’ র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক!                   হুরপরি শোকে হায়           জল-    ছলছল চোখে চায়। আজ    জাহান্নমের বহ্নি-সিন্ধু নিবে গেছে ক্ষরি জল, যত    ফিরদৌসের নার্গিস-লালা ফেলে আঁশু-পরিমল।    ৩    মৃত্তিকা-মাতা কেঁদে মাটি হল বুকে চেপে মরা লাশ, বেটার জানাজা কাঁদে যেন – তাই বহে ঘন নাভি-শ্বাস!           পাতাল-গহ্বরে কাঁদে জিন, পুন মলো কি রে সোলেমান ?           বাচ্চারে মৃগী দুধ নাহি দেয়, বিহগীরা ভোলে গান! ফুল পাতা যত খসে পড়ে, বহে উত্তর-চিরা বায়ু, ধরণির আজ শেষ যেন আয়ু, ছিঁড়ে গেছে শিরা স্নায়ু!                   মক্কা ও মদিনায়           আজ    শোকের অবধি নাই! যেন    রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদসম ছুটে। কাঁপে    ঘন ঘন কাবা , গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে।৪    নকিবের তূরী ফুৎকারি আজ বারোয়াঁর সুরে কাঁদে, কার তরবারি খান খান করে চোট মারে দূরে চাঁদে? আবুবকরের দর দর আঁশু দরিয়ার পারা ঝরে, মাতা আয়েষার কাঁদনে মুরছে আশমানে তারা ডরে! শোকে উন্মাদ ঘুরায় উমর ঘূর্ণির বেগে ছোরা, বলে ‘আল্লার আজ ছাল তুলে নেব মেরে তেগ্ , দেগে কোঁড়া ।’                   হাঁকে ঘন ঘন বীর –           ‘হবে,   জুদা তার তন শির, আজ যে বলিবে নাই বেঁচে হজরত – যে নেবে রে তাঁরে গোরে।’ আজ দারাজ দস্তে তেজ হাতিয়ার বোঁও বোঁও করে ঘোরে!    ৫    গুম্বজে কে রে গুমরিয়া কাঁদে মসজিদে মস্‌জিদে? মুয়াজ্জিনের হোশ্ নাই, নাই জোশ চিতে, শোষ হৃদে!           বেলালেরও আজ কণ্ঠে আজান ভেঙে যায় কেঁপে কেঁপে,           নাড়ি-ছেঁড়া এ কী জানাজার ডাক হেঁকে চলে ব্যেপে ব্যেপে! উস্‌মানের আর হুঁশ নাই কেঁদে কেঁদে ফেনা উঠে মুখে, আলি হাইদর ঘায়েল আজি রে বেদনার চোটে ধুঁকে!           আজ    ভোঁতা সে দুধারি ধার           ওই    আলির জুলফিকার ! আহা    রসুল-দুলালি আদরিণী মেয়ে মা ফাতেমা ওই কাঁদে, ‘কোথা    বাবাজান।’ বলি মাথা কুটে কুটে এলোকেশ নাহি বাঁধে!    ৬    হাসান-হুসেন তড়পায় যেন জবে-করা কবুতর, ‘নানাজান কই!’ বলি খুঁজে ফেরে কভু বার কভু ঘর।           নিবে গেছে আজ দিনের দীপালি, খসেছে চন্দ্র-তারা,           আঁধিয়ারা হয়ে গেছে দশ দিশি, ঝরে মুখে খুন-ঝারা!           সাগর-সলিল ফোঁপায়ে উঠে সে আকাশ ডুবাতে চায়, শুধু       লোনা জল তার আঁশু ছাড়া কিছু রাখিবে না দুনিয়ায়।           খোদ    খোদা সে নির্বিকার,           আজ    টুটেছে আসনও তাঁর! আজ      সখা মহ্‍বুবে বুকে পেতে দুখে কেন যেন কাঁটা বেঁধে, তারে      ছিনিবে কেমনে যার তরে মরে নিখিল সৃষ্টি কেঁদে!৭    বেহেশ্‌ত     সব আরাস্তা আজ, সেথা মহা ধুম-ধাম, গাহে        হুরপরি যত, ‘সাল্লালাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’             কাতারে কাতারে করজোড়ে সবে দাঁড়ায়ে গাহিছে জয়, –             ধরিতে না পেরে ধরা-মা-র চোখে দর দর ধারা বয়।             এসেছে আমিনা আবদুল্লা কি, এসেছে খদিজা সতী? আজ        জননীর মুখে হারামণি-পাওয়া-হাসা হাসে জগপতি!                     ‘খোদা,    একী তব অবিচার!’                     বলে    কাঁদে সুত ধরা-মা-র। আজ        অমরার আলো আরও ঝলমল, সেথা ফোটে আরও হাসি, শুধু         মাটির মায়ের দীপ নিভে গেল, নেমে এল অমা-রাশি                       আজ        স্বরগের হাসি ধরার অশ্রু ছাপায়ে অবিশ্রাম ওঠে        একী ঘন রোল – ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’ ফাল্গুনী সখি পাতিসনে শিলাতলে পদ্মপাতা,    সখি দিসনে গোলাব-ছিটে খাস্‌ লো মাথা!     যার অন্তরে ক্রন্দন      করে হৃদি মন্থন      তারে হরি-চন্দন        কমলী মালা-    সখি দিসনে লো দিসনে লো, বড় সে জ্বালা!       বল কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন!    এল খুন-মাখা তৃণ নিয়ে খু’নেরা ফাগুন!     সে যেন হানে হুল্‌-খুনসুড়ি,      ফেটে পড়ে ফুলকুঁড়ি      আইবুড়ো আইবুড়ো        বুকে ধরে ঘুণ!    যত বিরহিণী নিম্‌-খুন-কাটা ঘায়ে নুন!   আজ লাল-পানি পিয়ে দেখি সব-কিছু  চুর!    সবে আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর!     হ’ল মাদার আশোক ঘা’ল,      রঙন তো নাজেহাল!      লালে লাল ডালে-ডাল        পলাশ শিমুল!    সখি তাহাদের মধু ক্ষরে-মোরে বেঁধে হুল্‌!   নব সহকার-মঞ্জরী সহ ভ্রমরী!    চুমে ভোমরা নিপট, হিয়া মরে গুমরি’।     কত ঘাটে ঘাটে সই-সই      ঘট ভরে নিতি ওই,      চোখে মুখে ফোটে খই,-       আব-রাঙা গাল,    যত আধ-ভাঙা ইঙ্গিত তত হয় লাল!   আর সইতে পারিনে সই ফুল-ঝামেলা!    প্রাতে মল্লী চাঁপা, সাঁজে বেলা চামেলা!     হের ফুটবো মাধী হুরী      ডগমগ তরুপুরী,      পথে পথে ফুলঝুরি       সজিনা ফুলে!    এত ফুল দেখে কুলবালা কূল না ভুলে!   সাজি’ বাটা-ভরা ছাঁচিপান ব্যজনী-হাতে    করে স্বজনে বীজন কত সজনী ছাতে!     সেথা চোখে চোখে সঙ্কেত      কানে কথা-যাও ধেৎ,-      ঢ’লে-পড়া অঙ্কেতে       মন্‌মথ-ঘায়!    আজ আমি ছাড়া আর সবে মন-মত পায়।   সখি মিষ্টি ও ঝাল মেশা এল এ কি বায়!    এ যে বুক যত জ্বালা করে মুখ তত চায়!     এযে শরাবের মতো নেশা        এ পোড়া মলয় মেশা,      ডাকে তাহে কুলনাশা       কালামুখো পিক।    যেন কাবাব করিতে বেঁধে কলিজাতে শিক্‌!   এল আলো-রাধা ফাগ ভরি’ চাঁদের থালায়    ঝরে জোছনা-আবীর সারা শ্যাম সুষমায়!     যত ডাল-পালা নিম্‌খুন,      ফুলে ফুলে কুঙ্কুম্‌,      চুড়ি বালা রুম্‌ঝুম,       হোরির খেলা,    শুধু নিরালায় কেঁদে মরি আমি একেলা!       আজ সঙ্কেত-শঙ্কিত বন-বীথিকায়    কত কুলবধূ ছিঁড়ে শাড়ি কুলের কাঁটায়!     সখি ভরা মোর এ দু’কুল      কাঁটাহীন শুধু ফুল!      ফুলে এত বেঁধে হুল?       ভালো ছিল হায়,    সখি ছিঁড়িত দু’কূল যদি কুলের কাঁটায়! ফুল-কুঁড়ি আর পারিনে সাধতে লো সই এক ফোঁটা এই ছুঁড়িকে। ফুটবে না যে ফোটাবে কে বলল সে ফুল-কুঁড়িকে।              ঘোমটা-চাঁপা পারুল-কলি,           বৃথাই তারে সাধল অলি পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশ বাতাস ঢলি।           আ মলো ছিঃ!         ওর হল কী? সুতোর গুঁতো শ্রান্ত-শিথিল টানতে ও মন-ঘুড়িকে।           আর শুনেছিস সই? ও লো হিমের চুমু হার মেনেছে এইটুকু আইবুড়িকে!!    সন্ধে সকাল ছুঁয়ে কপাল রবির যাওয়া-আসাই সার, ব্যর্থ হল পথিক-কবির গভীর ভালোবাসার হার।           জল ঢেলে যায় জংলা বধু,           মৌমাছি দেয় কমলা মধু, শরম-চাদর খুলবে না সে আদর শুধু শুধু।           কে জানে বোন         পথভোলা কোন্ তরুণ-চোখের করুণ-চাওয়ায় চোখ ঠেরেছে ছুঁড়িকে –                               বসে আছে লো এইলজ্জাবতীর বধির বুকের সিংহ-আসন জুড়ি কে?   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) বঁধু মিটিলনা সাধ বঁধু, মিটিলনা সাধ ভালোবাসিয়া তোমায় তাই আবার বাসিতে ভালো আসিব ধরায়।আবার বিরহে তব কাঁদিব আবার প্রণয় ডোরে বাঁধিব শুধু নিমেষেরি তরে আঁখি দুটি ভ’রে তোমারে হেরিয়া ঝ’রে যাব অবেলায়।যে গোধূলি-লগ্নে নববধূ হয় নারী সেই গোধূলি-লগ্নে বঁধু দিল আমারে গেরুয়া শাড়িবঁধু আমার বিরহ তব গানে সুর হয়ে কাঁদে প্রাণে প্রাণে আমি নিজে নাহি ধরা দিয়ে সকলের প্রেম নিয়ে দিনু তব পায়।। বকরীদ ‘শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ! অন্তরে চির-নওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ। আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান, নির্লোভ নিরহংকার যারা, যাহারা নিরভিমান, দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে, ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে, অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাশ করিতে যারা জন্ম লয়েছে চিরনির্ভীক যৌবন-মাতোয়ারা, – তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার ঈদ্গাহে ময়দানে, তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে। বিভুতি, ‘মাজেজা’, যাহা পায় সব প্রভু আল্লার রাহে কোরবানি দিয়ে নির্যাতিতেরে মুক্ত করিতে চাহে। এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্‌সার, এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার! ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি। এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা, ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা! প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়, আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়। কল্পবৃক্ষ পবিত্র ‘জৈতুন’ গাছ যথা থাকে, এরা সেই আশমান থেকে এসে, সদা তারই ধ্যান রাখে! এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি, এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি। ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে, ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে। এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি! কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি! ‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে, ‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে। ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ? আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ? আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী? সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে, ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে। অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়, চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়! লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত? কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে, আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে। ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও, নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও! নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে, চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’! বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি, আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি! পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো, কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো! উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর, শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো! কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ? এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) বড়োদিন বড়োলোকদের ‘বড়োদিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো, আমাদের রাত কাটিতে চায় না, ক্ষিদে বলে, ‘নিধে! ওঠো!’ খেটে খুটে শুতে খাটিয়া পাই না, ঘরে নাই ছেঁড়া কাঁথা, বড়োদের ঘরে কত আসবাব, বালিশ বিছানা পাতা! অর্ধনগ্ন-নৃত্য করিয়া বড়োদের রাত কাটে, মোদের রক্ত খেয়ে মশা বাড়ে, গায়ে আরশুলা হাঁটে। আঁচিলের মতো ছারপোকা লয়ে পাঁচিল ধরিয়া নাচি, মাল খেয়ে ওরা বেসামাল হয়, মোরা কাশি আর হাঁচি! নানারূপ খানা খেতেছে, ষণ্ড অণ্ড ভেড়ার টোস্ট, কুলুকুলু করে আমাদের পেট, যেন ‘হনলুলু কোস্ট’। চৌরঙ্গিতে বড়োদিন হইয়াছে কী চমৎকার, গৌরজাতির ক্ষৌরকর্ম করেছে! অমত কার? মদ খেয়ে বদহজম হইয়া বাঙালির মেয়ে ধরে, শিক্ষাও পায় শিখ-বাঙালির থাপ্পড় লাথি চড়ে! এ কি সৈনিক-ধর্ম, এরাই রক্ষী কি এদেশের? সর্বলোকের ঘৃণ্য ইহারা, কলঙ্ক ব্রিটিশের। যে সৈনিকের হাত চাহে অসহায় নারী পরশিতে,চাহে নারীর ধর্ম নিতে, বীর ব্রিটিশের কামান যে নাই সেই হাত উড়াইতে। হায় রে বাঙালি, হায় রে বাংলা, ভাত-কাঙালের দেশ, মারের বদলে মার দেয় নাকো, তারা বলদ ও মেষ! মান বাঁচাইতে প্রাণ দিতে নারে, পলাইয়া যায় ঘরে, ঊর্ধ্বের মার আগুন আসিছে সেই ভীরুদের তরে! পলাইয়া এরা বাঁচিবে না কেউ! হাড় খাবে, মাস খাবে, শেষে ইহাদের চামড়ায় দেখো ডুগডুগিও বাজাবে! পথের মাতাল মাতা-ভগ্নীর সম্মান নেয় কেড়ে, শাস্তি না দিয়ে মাতালের, এরা পলায় সে পথ ছেড়ে। কোন ফিল্মের দর্শক ওরা, ঝোপের ইঁদুর বেজি, ইহাদের চেয়ে ঘরের কুকুর, সেও কত বেশি তেজি! মানবজাতির ঘৃণ্য ভীরুরা, কাঁপে মৃত্যুর ডরে, প্রাণ লয়ে ঢুকে খোপের ভিতর, দিনে দশবার মরে! বড়োদিন দেখে ছোটো মন হায় হতে চাহে নাকো বড়ো, হ্যাট কোট দেখে পথ ছেড়ে দেয় ভয়ে হয়ে জড়সড়! পচে মরে হায় মানুষ, হায় রে পঁচিশে ডিসেম্বর! কত সম্মান দিতেছে প্রেমিক খ্রিস্টে ধরার নর! ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষশিশু? আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছ জিশু!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) বধূ- বরণ এতদিন ছিলে ভুবনের তুমি আজ ধরা দিলে ভবনে, নেমে এলে আজ ধরার ধুলাতে ছিলে এতদিন স্বপনে! শুধু শোভাময়ী ছিলে এত দিন কবির মানসে কলিকা নলিন, আজ পরশিলে চিত্ত- পুলিন বিদায় গোধূলি- লগনে। ঊষার ললাট- সিন্দুর- টিপ সিথিঁতে উড়াল পবনে।।প্রভাতে ঊষা কুমারী, সেজেছে সন্ধ্যায় বধূ ঊষসী, চন্দন- টোপা- তারা- কলঙ্কে ভ'রেছে বে-দাগ- মু'শশী। মুখর মুখ আর বাচাল নয়ন লাজ সুখে আজ যাচে গুন্ঠন, নোটন- কপোতি কন্ঠে এখন কূজন উঠিছে উছসি'। এতদিন ছিলে শুধু রূপ- কথা, আজ হলে বধূ রূপসী।।দোলা চঞ্চল ছিল এই গেহ তব লটপট বেণী ঘা'য়, তারি সঞ্চিত আনন্দে ঝলে ঐ ঊর- হার মনিকায়। এ ঘরের হাসি নিয়ে যাও চোখে, সে গৃহ- দ্বীপ জ্বেলো এ আলোকে, চোখের সলিল থাকুক এ-লোকে- আজি এ মিলন মোহানায় ও- ঘরের হাসি বাশিঁর বেহাগ কাঁদুক এ ঘরে সাহানায়।।বিবাহের রঙ্গে রাঙ্গা আজ সব, রাঙ্গা মন, রাঙ্গা আভরণ, বলো নারী- 'এই রক্ত- আলোকে আজ মম নব জাগরণ!' পাপে নয় পতি পুণ্যে সুমতি থাকে যেন, হ'ইয়ো পতির সারথি। পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী, বেঁধো না নয়নে আবরণ; অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।। বধূ-বরণ এতদিন ছিলে ভূবনের তুমি আজ ধরা দিলে ভবনে, নেমে এলে আজ ধরার ধূলাতে ছিলে এতদিন স্বপনে! শুধু শোভাময়ী ছিলে এত দিন কবির মানসে কলিকা নলিন, আজ পরশিলে চিত্ত- পুলিন বিদায় গোধূলি- লগনে। ঊষার ললাট-সিন্দুর-টিপ সিথিঁতে উড়াল পবনে।।প্রভাতে ঊষা কুমারী, সেজেছে সন্ধ্যায় বধূ ঊষসী, চন্দন- টোপা- তারা- কলঙ্কে ভ'রেছে বে-দাগ- মু'শশী। মুখর মুখ আর বাচাল নয়ন লাজ সুখে আজ যাচে গুন্ঠন, নোটন- কপোতি কন্ঠে এখন কূজন উঠিছে উছসি'। এতদিন ছিলে শুধু রূপ- কথা, আজ হ'লে বধূ রূপসী।।দোলা চঞ্চল ছিল এই গেহ তব লটপট বেণী ঘা'য়, তারি সঞ্চিত আনন্দে ঝলে ঐ ঊর- হার মনিকায়। এ ঘরের হাসি নিয়ে যাও চোখে, সে গৃহ- দ্বীপ জ্বেলো এ আলোকে, চোখের সলিল থাকুক এ-লোকে- আজি এ মিলন মোহানায় ও- ঘরের হাসি বাশিঁর বেহাগ কাঁদুক এ ঘরে সাহানায়।।বিবাহের রঙ্গে রাঙ্গা আজ সব, রাঙ্গা মন, রাঙ্গা আভরণ, বলো নারী- "এই রক্ত- আলোকে আজ মম নব জাগরণ!" পাপে নয় পতি পুণ্যে সুমতি থাকে যেন, হ'য়ো পতির সারথি। পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী, বেঁধো না নয়নে আবরণ অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।।কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল বন্দনা-গান শিকলে যাদের উঠেছে বাজিয়া বীরের মুক্তি-তরবারি,          আমরা তাদেরই ত্রিশ কোটি ভাই, গাহি বন্দনা-গীতি তারই॥             তাদেরই উষ্ণ শোণিত বহিছে আমাদেরও এই শিরা-মাঝে,          তাদেরই সত্য-জয়-ঢাক আজি মোদেরই কণ্ঠে ঘন বাজে।          সম্মান নহে তাহাদের তরে ক্রন্দন-রোল দীর্ঘশ্বাস,          তাহাদেরই পথে চলিয়া মোরাও বরিব ভাই ওই বন্দি-বাস॥          শিকলে যাদের ...             মুক্ত বিশ্বে কে কার অধীন? স্বাধীন সবাই আমরা ভাই।          ভাঙিতে নিখিল অধীনতা-পাশ মেলে যদি কারা, বরিব তাই।          জাগেন সত্য ভগবান যে রে আমাদেরই এই বক্ষ-মাঝ,          আল্লার গলে কে দেবে শিকল, দেখে নেব মোরা তাহাই আজ॥          শিকলে যাদের ...             কাঁদিব না মোরা, যাও কারা-মাঝে যাও তবে বীর-সংঘ হে,          ওই শৃঙ্খলই করিবে মোদের ত্রিশ কোটি ভ্রাতৃ-অঙ্গ হে।          মুক্তির লাগি মিলনের লাগি আহুতি যাহারা দিয়াছে প্রাণ          হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরা গাহিয়া তাদেরই বিজয়-গান          শিকলে যাদের ... (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) বন্দি-বন্দনা আজি  রক্ত-নিশি-ভোরে      একী  এ শুনি ওরে,            মুক্তি-কোলাহল বন্দি-শৃঙ্খলে,     ওই  কাহারা কারাবাসে            মুক্তি-হাসি হাসে,            টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়া-তলে॥            ললাটে লাঞ্ছনা-রক্ত-চন্দন,            বক্ষে গুরু শিলা, হস্তে বন্ধন,            নয়নে ভাস্বর সত্য-জ্যোতি-শিখা,            স্বাধীন দেশ-বাণী কণ্ঠে ঘন বোলে,            সে ধ্বনি ওঠে রণি ত্রিংশ কোটি ওই                    মানব-কল্লোলে॥     ওরা  দু-পায়ে দলে গেল মরণ-শঙ্কারে,          সবারে ডেকে গেল শিকল-ঝংকারে,          বাজিল নভ-তলে স্বাধীন ডঙ্কারে,          বিজয়-সংগীত বন্দি গেয়ে চলে,          বন্দিশালা মাঝে ঝঞ্ঝা পশেছে রে                 উতল কলরোলে॥    আজি  কারার সারা দেহে মুক্তি-ক্রন্দন,          ধ্বনিছে হাহা স্বরে ছিঁড়িতে বন্ধন,          নিখিল গেহ যথা বন্দি-কারা, সেথা          কেন রে কারা-ত্রাসে মরিবে বীর-দলে।          ‘জয় হে বন্ধন’ গাহিল তাই তারা                   মুক্ত নভ-তলে॥    আজি  ধ্বনিছে দিগ্‌বধূ শঙ্খ দিকে দিকে,    আজি  গগনে কারা যেন চাহিয়া অনিমিখে,             ধু ধু ধু হোম-শিখা জ্বলিল ভারতে রে,             ললাটে জয়টিকা, প্রসূন-হার-গলে                   চলে রে বীর চলে;               সে নহে নহে কারা, যেখানে ভৈরব-               রুদ্র-শিখা জ্বলে॥   জয় হে বন্ধন-মৃত্যু-ভয়-হর! মুক্তিকামী জয়।                  স্বাধীন-চিত জয়। জয় হে                       জয় হে! জয় হে! জয় হে!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) বন্ধন অনন্তকাল এ-অনন্তলোকে             মন-ভোলানোরে তার খুঁজে ফিরে মন। দক্ষিণা-বায় চায় ফুল-কোরকে ;              পাখি চায় শাখী, লতা-পাতা-ঘেরা বন।         বিশ্বের কামনা এ – এক হবে দুই ;         নূতনে নূতনতর দেখিবে নিতুই॥ তোমারে গাওয়াত গান যার বিরহ              এড়িয়ে চলার ছলে যাচিয়াছ যায়, এল সেই সুদূরের মদির-মোহ               এল সেই বন্ধন জড়াতে গলায়।         মালা যে পরিতে জানে, কন্ঠে তাহার         হয় না গলার ফাঁসি চারু-ফুলহার॥ জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,         কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ; বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–               সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।         দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,         সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥ বিরহের চখাচখি রচে তারা নীড়,               প্রাতে শোনে নির্মল বিমানের ডাক ; সেই ডাকে ভোলে নীড়, ভোলে নদীতীর,               সন্ধ্যায় গাহে : ‘এই বন্ধন থাক’!         আকাশের তারা থাক কল্পলোকে,         মাটির প্রদীপ থাক জাগর-চোখে॥ (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) বরষায় আদর গর-গর             বাদর দর-দর             এ-তনু ডর-ডর             কাঁপিছে থর-থর॥             নয়ন ঢল-ঢল             [সজল ছল-ছল]             কাজল-কালো-জল             ঝরে লো ঝর ঝর॥    ব্যাকুল বনরাজি            শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে সজনী! মন আজি          গুমরে মনে মনে।             বিদরে হিয়া মম             বিদেশে প্রিয়তম             এ-জনু পাখিসম             বরিষা জর-জর॥    [বিজুরি হানে ছুরি           চমকি রহি রহি বিধুরা একা ঝুরি            বেদনা কারে কহি।]             সুরভি কেয়া-ফুলে             এ হৃদি বেয়াকুলে             কাঁদিছে দুলে দুলে             বনানী মর মর॥    নদীর কলকল            ঝাউ-এর ঝলমল দামিনী জ্বল জ্বল          কামিনী টলমল।             আজি লো বনে বনে             শুধানু জনে জনে             কাঁদিল বায়ুসনে             তটিনী তরতর॥    আদুরি দাদুরি লো           কহো লো কহো দেখি এমন বাদরি লো            ডুবিয়া মরিব কি?             একাকী এলোকেশে             কাঁদিব ভালোবেসে?             মরিব লেখা-শেষে             সজনি সরো সরো।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) বর্ষা-বিদায় ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন্‌ দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী! ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজি তব? পহিল্‌ ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্‌ দেশ অভিনব?তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পান্ডুর কেয়া-রেণু, তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেণু।কুমারীর ভীরু বেদনা-বিধুর প্রণয়-অশ্রু সম ঝরিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি-ভোরে অনুপম।                                   ওগো ও কাজল-মেয়ে, উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে'। কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে'। ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হ'তে। তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে উঠিল যে বল্লরী তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তা'রা কাঁদে নিশিদিন ভরি'।                                   'বৌ-কথা-কও' পাখি উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বঊ করে ডাকাডাকি। চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসী মুধুপ এসে' কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমদী দেশে।                                   তুমি চলে যাবে দূরে, ভাদরের নদী দুকূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে!যাবে যবে দূর হিম-গিরি শিরে, ওগো বাদলের পরী, ব্যথা ক'রে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহারেও স্মরি'? সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা,-- কে জানে কি ভাল বিধুর ব্যথা -- না মধুর পবিত্রতা। সেথা মহিমার উর্ধ্ব শিখরে নাই তরলতা হাসি, সেথা রজনীর রজনীগন্ধা প্রভাতে হয় না বাসি। সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা-নূপুর খুলি', চলিতে চকিতে চমকি' উঠ না, কবরে ওঠে না দুলি'। সেথা র'বে তুমি ধেয়ান-মগ্না তাপসিনী অচপল, তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি "ফটিক জল"। বাংলার মহাত্মা আজ   না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে ওই   কংস-কারার দ্বার ঠেলে। আজ   শব-শ্মশানে শিব নাচে ওই ফুল-ফুটানো পা ফেলে॥    আজ   প্রেম-দ্বারকায় ডেকেছে বান       মরুভূমে জাগল তুফান,       দিগ্‌বিদিকে উপচে পড়ে প্রাণ রে! তুমি   জীবন-দুলাল সব লালে-লাল করলে প্রাণের রং ঢেলে॥    ওই   শ্রাবস্তি-ঢল আসল নেমে       আজ ভারতের জেরুজালেমে       মুক্তি-পাগল এই প্রেমিকের প্রেমে রে‌! ওরে   আজ নদীয়ার শ্যাম নিকুঞ্জে রক্ষ-অরি রাম খেলে॥    ওই    চরকা-চাকায় ঘর্ঘরঘর       শুনি কাহার আসার খবর,       ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে! ওই    পথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে।    আজ   জাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি,       এক হল ভাই বামুন-মুচি,       প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে! আয়   এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম বলে–             ওরে    সব মায়ায় আগুন জ্বেলে॥  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) বাগিচায় বুলবুলি তুই বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।         আজো তা’র ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি, তন্দ্রাতে বিলোল।        আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায় ঝুরছে নিশিদিন, আসেনি, যখন’ হাওয়া গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল।।        কবে সে ফুল কুমারী ঘোমটা চিরি’ আসবে বাহিরে, গিশিরের স্পর্শমুখে ভাঙ্গবে, রে ঘুম রাঙবে, রে কপোল।।        ফাগুনের মুকুল জাগা দুকুল ভাঙ্গা আসবে ফুলের বান, কুঁড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটবে হাসি, ফুটবে গালে টোল।।        কবি তুই গন্ধে ভু’লে ডুবলি জলে কূল পেলিনে আর, ফুলে তোর বুক ভরেছিল, আজকে জলে ভরবে আঁখির কোল | বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা শির উঁচু করি মুসলমান। দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।।মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার, বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার, হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর চল আগে চল বাজে বিষান। ভয় নাই তর গলায় তাবিজ বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান।।নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের, শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের, ভিখারির সাজে খলীফা যাদের শাসন করিল আধা জাহান- তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।।ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর, তখনো জাগিনি যখন যোহর, হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর মাগরিবের আজ শুনি আজান। জামাত শামিল হওরে এশাতে এখনো জমাতে আছে স্থান।।শুকনো রুটিকে সম্বল ক’রে যে ঈমান আর যে প্রানের জোরে ফিরেছে জগত মন্থন ক’রে সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন। আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান।। বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী! ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি! আজ হ'তে হ'ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি, আজ হ'তে হ'ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।...অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ কপোল রাখি’ কাঁদিতেছে চাঁদ, "মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকি।" নিশীথিনী যায় দূর বন-ছায়, তন্দ্রায় ঢুলুঢুল্, ফিরে ফিরে চায়, দু’হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল।-- চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে? কে করে বীজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে? জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি!তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে সারা রাত মোরা কয়েছি যে কথা, বন্ধু, পড়িছে মনে!-- জাগিয়া একাকী জ্বালা ক'রে আঁখি আসিত যখন জল, তোমাদের পাতা মনে হ’ত যেনো সুশীতল করতল আমার প্রিয়ার!--তোমার শাখার পল্লবমর্মর মনে হ’ত যেন তারি কন্ঠের আবেদন সকাতর। তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা, তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা। তব ঝিরঝির মিরমির যেন তারি কুন্ঠিত বাণী, তোমার শাখায় ঝুলানো তারির শাড়ির আঁচলখানি।                                     --তোমার পাখার হাওয়া তারি আঙ্গুলি-পরশের মত নিবিড় আদর-ছাওয়া!ভাবিতে ভাবিতে ঢুলিয়া পড়েছি ঘুমের শ্রান্ত কোলে, ঘুমায়ে স্বপন দেখেছি,-- তোমারি সুনীল ঝালর দোলে তেমনি আমার শিথানের পাশে। দেখেছি স্বপনে, তুমি গোপনে আসিয়া গিয়াছ আমার তপ্ত ললাট চুমি’।হয়ত স্বপনে রাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি, বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে, লইয়াছি লাজে টানি’। বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন! ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, ‘কর বিদায়ের আয়োজন’।                                    --আজি বিদায়ের আগে আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জানে! মর্মের বাণী শূনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন? জানি--মুখে মুখে হবে না মোদের কোনদিন জানাজানি, বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপাণি।হয়তো তোমারে দেখিয়াছি , তুমি যাহা নও তাই ক'রে, ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে? সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল, হারা-মোমতাজে লয়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজম'ল,                                     --বল তাহে কার ক্ষতি? তোমারে লইয়া সাজাব না ঘর, সৃজিব অমরাবরী।।..হয়ত তোমার শাখায় কখনো, বসেনি আসিয়া পাখী তোমার কুঞ্জে পত্রপুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি'। শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন জেগেছে নিশীথে জাগেনি ক' সাথে খুলি' কেহ বাতায়ন।                                     -- সব আগে আমি আসি' তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছি গো ভালোবাসি! তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা, এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক্‌ দেখা।...তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না। কোলাহল করি' সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না                                     --নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।--শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে-- ঐ পল্লব-জাফ্‌রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে দেখেছ আমারে--দেখিয়াছি যবে তামি বাতায়ন খুলি'? হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি'। তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমায়ে যবে, মূর্ছিতা হবে সুখের আবেশে,--সে আলোর উৎসবে মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর? তোমার নিশ্বাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার? চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে? খড়খড়ি খুলি' চেয়ে র'বে দূর অস্ত অলখ-লোকে?-                                     --অথবা এমনি করি' দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি'?মলিন মাটির বন্ধনে বাঁধা হয় অসহায় তরু, পদতলে ধূলি, উর্দ্ধে তোমার শূন্য গগন-মরু। দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে, কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিসে পড়িছ ঝিমে! তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু, ব্যথা না হানে, কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে!... *                            *                             * ভুল করে' কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেনো ভুলি'। যদি ভুল ক'রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি', বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায়!.......তোমার জাফ্‌রি-ফাঁকে খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে--মাটিতে পেলে না যাকে! বাদল-দিনে ১      আদর-গর-গর      বাদর দর-দর      এ-তনু ডর-ডর             কাঁপিছে থর-থর।      নয়ন ঢল-ঢল      সজল ছল-ছল,      কাজল কালো জল             ঝরে লো ঝরঝর।    ২ ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে, সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে।        বিদরে হিয়া মম        বিদেশে প্রিয়তম,        এ জনু পাখি সম              বরিষা-জরজর।    ৩ কাহার ও মেঘোপরি গমন গম-গম? সখী রে মরি মরি, ভয়ে গা ছম-ছম।   গগনে ঘন ঘন   সঘনে শোনো-শোনো   ঝনন রণরণ –    সজনি ধরো ধরো।    ৪ জলদ-দামা বাজে জলদে তালে তালে, কাজরি-নাচা নাচে ময়ূর ডালে ডালে।        শ্যামল মুখ স্মরি        সখিয়া বুক মোরি        উঠিছে ব্যথা ভরি              আঁখিয়া ভরভর।৫ বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি।        সুরভি কেয়া-ফুলে        এ হৃদি বেয়াকুলে,        কাঁদিছে দুলে দুলে              বনানী মর-মর।    ৬ নদীর কলকল, ঝাউয়ের ঝল-মল, দামিনী জ্বলজ্বল, কামিনী টল-মল।        আজি লো বনে বনে        শুধানু জনে জনে,        কাঁদিল বায়ুসনে              তটিনী তরতর।    ৭ আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি, এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি?        একাকী এলোকেশে,        কাঁদিব ভালোবেসে,        মরিব লেখা-শেষে,              সজনি সরো সরো।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) বাদল-রাতের পাখি বাদল-রাতের পাখি! কবে পোহায়েছে বাদলের রাতি, তবে কেন থাকি থাকি কাঁদিছ আজিও ‘বউ কথা কও’শেফালির বনে একা, শাওনে যাহারে পেলে না, তারে কি ভাদরে পাইবে দেখা?… তুমি কাঁদিয়াছ ‘বউ কথা কও’সে-কাঁদনে তব সাথে ভাঙিয়া পড়েছে আকাশের মেঘ গহিন শাওন-রাতে। বন্ধু, বরষা-রাতি কেঁদেছে যে সাথে সে ছিল কেবল বর্ষা-রাতেরই সাথে! আকাশের জল-ভারাতুর আঁখি আজি হাসি-উজ্জ্বল ; তেরছ-চাহনি জাদু হানে আজ, ভাবে তনু ঢল ঢল! কমল-দিঘিতে কমল-মুখীরা অধরে হিঙ্গুল মাখে, আলুথালু বেশ – ভ্রমরে সোহাগে পর্ণ-আঁচলে ঢাকে। শিউলি-তলায় কুড়াইতে ফুল আজিকে কিশোরী মেয়ে অকারণ লাজে চমকিয়া ওঠে আপনার পানে চেয়ে। শালুকের কুঁড়ি গুঁজিছে খোঁপায় আবেশে বিধুরা বধূ, মুকুলি পুষ্প কুমারীর ঠোঁটে ভরে পুষ্পল মধু। আজি আনন্দ-দিনে পাবে কি বন্ধু বধূরে তোমার, হাসি দেখে লবে চিনে? সরসীর তীরে আম্রের বনে আজও যবে ওঠ ডাকি বাতায়নে কেহ বলে কি, “কে তুমি বাদল-রাতের পাখি! আজও বিনিদ্র জাগে কি সে রাতি তার বন্ধুর লাগি? যদি সে ঘুমায় – তব গান শুনি চকিতে ওঠে কি জাগি? ভিন-দেশি পাখি! আজিও স্বপন ভাঙিল না হায় তব, তাহার আকাশে আজ মেঘ নাই – উঠিয়াছে চাঁদ নব! ভরেছে শূন্য উপবন তার আজি নব নব ফুলে, সে কি ফিরে চায় বাজিতেছে হায় বাঁশি যার নদীকূলে? বাদলা-রাতের পাখি! উড়ে চলো – যথা আজও ঝরে জল, নাহিকো ফুলের ফাঁকি! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) বারাঙ্গনা কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?    হয়ত তোমায় স-ন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।    না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি;    তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি;    আমাদেরই মতো খ্যাতি যশ মান তারাও লভিতে পারে,    তাহাদের সাধনা হানা দিতে পারে সদর স্বর্গ-দ্বারে।-    স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,    কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন.    কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দান-বীর মহারথী    স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি,    শান-নু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়-    তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যায়!    মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা-শিশু,    বিস্ময়কর জন্ম যাঁহার-মহাপ্রেমিক সে যিশু!-    কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল, কেহ সে ঘৃণ্য নহে,    ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালীয়-দহে!       শোনো মানুষের বাণী,    জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোনো গ্লানি!    পাপ করিয়াছি বলিয়া কি নাই পুণ্যেরও অধিকার?    শত পাপ করি’ হয়নি ক্ষুন্ন দেবত্ব দেবতার।    অহল্যা যদি মুক্তি লভে, মা, মেরী হ’তে পারে দেবী,    তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি’?    তব সন্তানে জারজ বলিয়া কোন্‌ গোঁড়া পাড়ে গালি,    তাহাদের আমি এই দু’টো কথা জিজ্ঞাসা করি খালি-       দেবতা গো জিজ্ঞাসি-    দেড় শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী-    কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হ’য়ে নিষ্কাম ব্রতী    পুত্রকন্যা কামনা করিল? কয়জন সৎ-সতী?    ক’জন করিল তপস্যা ভাই সন্তান-লাভ তরে?    কার পাপে কোটি দুধের বা”চা আঁতুড়ে জন্মে’ মরে?    সেরেফ্‌ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,    সেই কামানার সন্তান মোরা! তবুও গর্ব কত!        শুন ধর্মের চাঁই-    জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!    অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,    অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়! বার্ষিক সওগাত বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত – দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত। রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ, গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন। লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ, ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ! নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল, রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল। সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি, নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি। পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস, মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস। আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান, দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান। আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির, দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির। নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্‌ত, বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্‌ত! – তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি, পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।… চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ – যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্‌খোস ফেরদৌস – ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে, দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে ! বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত, আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’[কৃষ্ণনগর ২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩] (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) বিজয়-গান ওই     অভ্র-ভেদী তোমার ধ্বজা               উড়ল আকাশ-পথে।        মা গো, তোমার রথ-আনা ওই               রক্ত-সেনার রথে॥        ললাট-ভরা জয়ের টিকা,        অঙ্গে নাচে অগ্নিশিখা,        রক্তে জ্বলে বহ্নিলিখা – মা!               ওই বাজে তোর বিজয়-ভেরি,               নাই দেরি আর নাই মা দেরি,                      মুক্ত তোমার হতে॥ আনো তোমার বরণডালা, আনো তোমার শঙ্খ, নারী! ওই দ্বারে মা-র মুক্তি সেনা, বিজয়-বাজা উঠছে তারই।           ওরে ভীরু! ওরে মরা!        মরার ভয়ে যাসনি তোরা;          তোদেরও আজ ডাকছি মোরা ভাই!               ওই খোলে রে মুক্তি-তোরণ,               আজ একাকার জীবন-মরণ                      মুক্ত এ ভারতে॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) বিজয়িনী হে মোর রাণি!    তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে। আমার     বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।    আমার    সমর-জয়ী অমর তরবারী      দিনে দিনে ক্লানি- আনে, হ’য়ে ওঠে ভারী,    এখন      এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,    এই        হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।     ওগো জীবন-দেবী।      আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল, আজ         বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল! আজ         বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে, বিজয়িনী!    নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,    যত  তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,           আমি  বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।। বিদায়-বেলায় তুমি অমন ক'রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না, জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না । ঐ কাতর কণ্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না, শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না ।।হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা, আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না । ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখি আর শুধু হু-হু করে বুক । চলার তোমার বাকী পথটুক্ -- পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক -- হায়, অমন ক'রে ও অকরুণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না, ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না ।।দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি তব ব্যথা কেউ বোঝে না, তোমার ব্যাথার তুমিই দরদী একাকী, পথে ফেরে যারা পথ-হারা, কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না, বুকে ক্ষত হ'য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি? দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে? এ যে মিছে অভিমান পরাবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে! তবে জান কি তোমার বিদায়-কথায় কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায় আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায় -- পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক! কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না, ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না ।। বিদায়-স্মরণে পথের দেখা এ নহে গো বন্ধু      এ নহে পথের আলাপন।    এ নহে সহসা পথ-চলা শেষে      শুধু হাতে হাতে পরশন।।    নিমেষে নিমেষে নব পরিচয়ে    হ’লে পরিচিত মোদের হৃদয়ে,    আসনি বিজয়ী-এলে সখা হ’য়ে,      হেসে হ’রে নিলে প্রাণ-মন।।    রাজাসনে বসি’ হওনি ক’ রাজা,      রাজা হ’লে বসি, হৃদয়ে,    তাই আমাদের চেয়ে তুমি বেশী      ব্যথা পেলে তব বিদায়ে।    আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে    জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হ’য়ে,    হ’লে পরিজন চির-পরিচয়ে-      পুনঃ পাব তার দরশন,      এ নহে পথের আলাপন।।হুগলী, কার্তিক ১৩৩২কাব্যগ্রন্থঃ--সিন্ধু-হিন্দোল বিদায়-বেলায় তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,        জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।    ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,        শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।    হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,    আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।     ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ      দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।      চলার তোমার বাকী পথটুকু-      পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-    হায়,  অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,        ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।    দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি       তব ব্যথা কেউ বোঝে না,         তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,      পথে ফেরে যারা পথ-হারা,      কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,      বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?    দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?    এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!     তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়      কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়     আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-      পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!    কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো       মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,    ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।কাব্যগ্রন্থঃ- ছায়ানট বিদায়-মাভৈঃ বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়, বিশ্বাসী! বলো আসবে আবার প্রভাত-রবির জয়! খণ্ড করে দেখছে যারা অসীম জীবনটাই, দুঃখ তারাই করুক বসে, দুঃখ মোদের নাই। আমরা জানি, অস্ত-খেয়ায় আসছে রে উদয়। বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।হারাই-হারাই ভয় করেই না হারিয়ে দিলি সব! মরার দলই আগলে মড়া করছে কলরব। ঘরবাড়িটাই সত্য শুধু নয় কিছুতেই নয়। বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।দৃষ্টি-অচিন দেশের পরেও আছে চিনা দেশ, এক নিমেষের নিমেষ-শেষটা নয়কো অশেষ শেষ। ঘরের প্রদীপ নিবলে বিধির আলোক-প্রদীপ রয়। বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।জয়ধ্বনি উঠবে প্রাচীন চিনের প্রাচীরে, অস্ত-ঘাটে বসে আমি তাই তো নাচি রে। বিদায়-পাতা আনবে ডেকে নবীন কিশলয়, বিশ্বাসী! বল আসবে আবার প্রভাত-রবির জয় ।  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) বিদায়-স্মরণে পথের দেখা এ নহে গো বন্ধু      এ নহে পথের আলাপন।    এ নহে সহসা পথ-চলা শেষে      শুধু হাতে হাতে পরশন।।    নিমেষে নিমেষে নব পরিচয়ে    হ’লে পরিচিত মোদের হৃদয়ে,    আসনি বিজয়ী-এলে সখা হ’য়ে,      হেসে হ’রে নিলে প্রাণ-মন।।    রাজাসনে বসি’ হওনি ক’ রাজা,      রাজা হ’লে বসি, হৃদয়ে,    তাই আমাদের চেয়ে তুমি বেশী      ব্যথা পেলে তব বিদায়ে।    আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে    জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হ’য়ে,    হ’লে পরিজন চির-পরিচয়ে-      পুনঃ পাব তার দরশন,      এ নহে পথের আলাপন।। বিদ্রোহী বল বীর -         বল উন্নত মম শির! শির     নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!              বল বীর - বল     মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'         চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'         ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,         খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া              উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর! মম     ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!              বল বীর -         আমি চির-উন্নত শির!আমি     চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-     প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি     মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!              আমি দুর্ব্বার, আমি     ভেঙে করি সব চুরমার! আমি     অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি     দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি     মানি নাকো কোনো আইন, আমি     ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,                             ভাসমান মাইন! আমি     ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি     বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!              বল বীর -          চির উন্নত মম শির!আমি     ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি     পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী! আমি     নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি     আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি     হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি     চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'          পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'          ফিং দিয়া দিই তিন দোল্! আমি     চপলা-চপল হিন্দোল!আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি      শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,          আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।              বল বীর -         আমি     চির-উন্নত শির!        আমি     চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি     দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্                             ভরপুর মদ। আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি     যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি     সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি     অবসান, নিশাবসান। আমি     ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম     এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য। আমি     কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।              বল বীর -         চির উন্নত মম শির।আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি     যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক! আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি     আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি     ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, আমি     পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড, আমি     চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড! আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব! আমি     প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস! আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি     অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী! আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল, আমি     উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল, আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি। আমি     উন্মন মন উদাসীর, আমি     বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি     অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত                             বুকে গতি ফের! আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত-     চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর! আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন, আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্। আমি     চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর! আমি     উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি     পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া! আমি     আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি     মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! - আমি     তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ! আমি     সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে                             সব বাঁধ!আমি     উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি     বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি     ঝড়ের মতন করতালি দিয়া         স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,         তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার                             হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে! আমি     বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, আমি     পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি     তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আণি     ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!         ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', - ধরি     স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!         আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি     ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!             আমি     অর্ফিয়াসের বাঁশরী,              মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্         ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্         মম বাঁশরী তানে পাশরি'         আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি     রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে     সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি     বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!আমি     আমি শ্রাবণ প্লাবন- বন্যা, কভু     ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা - আমি     ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি     অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি     ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি! আমি     ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি     জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!আমি     মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি     অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! আমি     মানব দানব দেবতার ভয়,         বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,         জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি     তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য আমি     উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি     চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে                             সব বাঁধ!! আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার,         নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি     হল বলরাম স্কন্ধে, আমি     উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।        মহা-     বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত         আমি     সেই দিন হব শান্ত, যবে     উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,         অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -              বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত         আমি     সেই দিন হব শান্ত! আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি     স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন! আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!         আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!        আমি চির-বিদ্রোহী বীর - আমি     বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির! বিদ্রোহীর বাণী দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল্! ঢের দেখালি ঢাক ঢাক আর গুড় গুড়, ঢের মিথ্যা ছল। এবার তোরা সত্য বল॥ পেটে এক আর মুখে আর এক – এই যে তোদের ভণ্ডামি, এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি। নিজের কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁকির আপশোশে, বাইরে ফাঁকা পাঁইতারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোশে। তাই হলি সব সেরেফ আজ কাপুরুষ আর ফেরেব-বাজ, সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ! ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস সব রামছাগল! যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি, দুধকে দুধ আর জলকে জল! এবার তোরা সত্য বল॥২বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস স্বরাজ চাই, স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্চে দরাজ তাই! ‘ভারত হবে ভারতবাসীর’ – এই কথাটাও বলতে ভয়! সেই বুড়োদের বলিস নেতা – তাদের কথায় চলতে হয়!বল রে তোরা বল নবীন – চাইনে এসব জ্ঞান-প্রবীণ! স্ব-স্বরূপে দেশকে ক্লীব করছে এরা দিনকে দিন, চায় না এরা – হই স্বাধীন! কর্তা হবার শখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল কেবল! ফাঁকা প্রেমের ফুসমন্তর, মুখ সরল আর মন গরল! এবার তোরা সত্য বল॥৩মহান-চেতা নেতার দলে তোল রে তরুণ তোদের নায়, ওঁরা মোদের দেবতা, সবাই করব প্রণাম ওঁদের পায়। জানিস তো ভাই শেষ বয়সে স্বতই সবার মরতে ভয়, ঝড়-তুফানে তাঁদের দিয়ে নয় তরি পার করতে নয়।জোয়ানরা হাল ধরবে তার করবে তরি তুফান পার! জয় মা বলে মাল্লা তরুণ ওই তুফানে লাখ হাজার প্রাণ দিয়ে ত্রাণ করবে মার! সেদিন করিস এই নেতাদের ধ্বংস-শেষের সৃষ্টি কল। ভয়-ভীরুতা থাকতে দেশের প্রেম ফলাবে ঘণ্টা ফল! এবার তোরা সত্য বল॥৪ধর্ম-কথা প্রেমের বাণী জানি মহান উচ্চ খুব, কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙে মন্ত্র ঝাড়ে যে বেকুব! ‘ব্যাঘ্র সাহেব, হিংসে ছাড়ো, পড়বে এসো বেদান্ত!’ কয় যদি ছাগ, লাফ দিয়ে বাঘ অমনি হবে কৃতান্ত! থাকতে বাঘের দন্ত-নখ বিফল ভাই ওই প্রেম-সেবক! চোখের জলে ডুবলে গর্ব শার্দুলও হয় বেদ-পাঠক, প্রেম মানে না খুন-খাদক। ধর্মগুরু ধর্ম শোনান, পুরুষ ছেলে যুদ্ধে চল। সেও ভি আচ্ছা, মরব পিয়ে মৃত্যু-শোণিত-অ্যালকোহল! এবার তোরা সত্য বল॥৫প্রেমিক ঠাকুর মন্দিরে যান, গাড়ুন সেথায় আস্তানা! শবে শিবায় শিব কেশবের – তৌবা – তাঁদের রাস্তা না! মৃতের সামিল এখন ওঁরা, পূজা ওঁদের জোরসে হোক, ধর্মগুরু গোর-সমাধি পূজে যেমন নিত্য লোক!তরুণ চাহে যুদ্ধ-ভূম! মুক্তি-সেনা চায় হুকুম! চাই না ‘নেতা’, চাই ‘জেনারেল’, প্রাণ-মাতনের ছুটুক ধূম! মানব-মেধের যজ্ঞধূম। প্রাণ-আঙুরের নিঙরানো রস – সেই আমাদের শান্তি-জল। সোনা-মানিক ভাইরা আমার ! আয় যাবি কে তরতে চল। এবার তোরা সত্য বল॥৬যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ! ধামা-ধরা! জামা-ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো! আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ! এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি – মরব শেষ! নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল! ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) বিধুরা পথিকপ্রিয়া আজ   নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো।         পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায় চাওয়া ছলছল?                             বলো সখী বলো বলো            মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,         ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি দূরের পথিক গেছে চলে –                           আবার ফিরে আসবে বলে গো?       স্বর শুনে কার চমকে ওঠ? আ-হা!       ও লো ও যে বিহগ-বেহাগ নির্ঝরিণীর কল-কল।            ও নয় লো তার পায়ের ভাষা, আ-হা,       শীতের শেষের ঝরা-পাতার বিদায় ধ্বনি ও,         কোন কালোরে কোন ভালোরে বাসলে ভালো, আ-হা!         খুঁজছ মেঘে পরদেশি কোন পলাতকার নয়ন-অমিয়? চুমছ   কারে? ও নয় তোমার চির-চেনার চপল হাসির আলো-ছায়া, ও যে   গুবাক-তরুর চিকন পাতায় বাদল-চাঁদের মেঘলা মায়া।                ওঠো পথিক-পূজারিনি উদাসিনী বালা! সে যে  সবুজ-দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন,               কে জানে ভাই, ঘরকে চলো।         ও কী? চোখে নামল আবার বাদল-ছায়া ঢলঢল?                            চলো সখি ঘরকে চলো।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) বিবাগিনী করেছ পথের ভিখারিনি মোরে কে গো সুন্দর সন্ন্যাসী? কোন বিবাগির মায়া-বনমাঝে বাজে ঘরছাড়া তব বাঁশি?                   ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী। তব    প্রেমরাঙা ভাঙা জোছনা হেরো   শিশির-অশ্রু-লোচনা, ওই    চলিয়াছে কাঁদি বরষার নদী গৈরিকরাঙা-বসনা। ওগো    প্রেম-মহাযোগী, তব প্রেম লাগি নিখিল বিবাগি পরবাসী!                   ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।মম    একা ঘরে নাথ দেখেছিনু তোমা ক্ষীণ দীপালোকে হীন করি, হেরি   বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রূপ তব মরি মরি!       দিয়া   বেদনার পরে বেদনা       নাথ   একী এ বিপুল চেতনা তুমি   জাগালে আমার রোদনে, অন্ধে দেখালে বিশ্ব-দ্যোতনা। ওগো   নিষ্ঠুর মোর! অশুভ ও-রূপ তাই এত বাজে বুকে আসি।                   ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) বিরহ-বিধুরা কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না; সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না! লাল-রঙিলা করব না কর মেহেদি-হেনার ছাপ ঘষে; গুলফ চুমি কাঁদবে গো কেশ চিরুণ-চুমার আপশোশে!কপোল-শয়ান অলক-শিশুর উদাস ঘুম আর ভাঙবে না; চুমহারা ঠোঁট পানের পিকের হিঙুল রঙে রাঙবে না! কার তরে ফুলশয্যা বাসর, সজ্জা নিজেই লজ্জা পায়; পীতম আমার দূর প্রবাসে, দেখবে কে সাজ-সজ্জা হায়!চাঁচর চুলে ধূম্র ওড়ে, অঙ্গ রাঙায় আগুন-রাগ, যেমনি ফোটে মন-নিকষে পিয়ার ফাগুন-স্মৃতির দাগ। সবাই বলে, চিনির চেয়েও শিরিন জীবন, – হায় কপাল! পীতম-হারা নিম-তেতো প্রাণ কেঁদেই কাটায় সাঁঝ সকাল।যেথায় থাকো খোশহালে রও, বন্ধু আমার – শোকের বল! তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, – থাকুক আমার চোখের জল! (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) বিশ্বাস ও আশা বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে, নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে । শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে, পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা, যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না। ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুখ।‘হয়তো কী হবে’ এই ভেবে যারা ঘরে বসে কাঁপে ভয়ে, জীবনের রণে নিত্য তারাই আছে পরাজিত হয়ে। তারাই বন্দি হয়ে আছে গ্লানি-অধীনতা কারাগারে; তারাই নিত্য জ্বালায় পিত্ত অসহায় অবিচারে!এরা অকারণ ভয়ে ভীত, এরা দুর্বল নির্বোধ, ইহাদের দেখে দুঃখের চেয়ে জাগে মনে বেশি ক্রোধ। এরা নির্বোধ, না করে কিছুই জিভ মেলে পড়ে আছে গোরস্তানেও ফুল ফোটে, ফুল ফোটে না এ মরা গাছে।এদের যুক্তি অদৃষ্টবাদ, বসে বসে ভাবে একা, ‘এ মোর নিয়তি, বদলানো নাহি যায় কপালের লেখা!’ পৌরুষ এরা মানে না, নিজেরে দেয় শুধু ধিক্কার, দুর্ভাগ্যের সাথে নাহি লড়ে মেনেছে ইহারা হার।এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত, মিশো না এদের সাথে, মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াতে। এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়, চোখ বুজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে, ‘ইহা আলো নয়’।প্রবল অটল বিশ্বাস যার নিশ্বাস প্রশ্বাসে, যৌবন আর জীবনের ঢেউ কল-তরঙ্গে আসে, মরা মৃত্তিকা করে প্রাণায়িত শস্যে কুসুমে ফলে, কোনো বাধা তার রুধে নাকো পথ, কেবল সুমুখে চলে, চির-নির্ভয়; পরাজয় তার জয়ের স্বর্গ-সিঁড়ি, আশার আলোক দেখে তত, যত আসে দুর্দিন ঘিরি। সেই পাইয়াছে পরম আশার আলো, যেয়ো তারই কাছে, তাহারই নিকটে মৃত্যুঞ্জয়ী অভয়-কবচ আছে।যারা বৃহতের কল্পনা করে, মহৎ স্বপ্ন দেখে, তারাই মহৎ কল্যাণ এই ধরায় এনেছে ডেকে। অসম্ভবের অভিযান-পথ তারাই দেখায় নরে, সর্বসৃষ্টি ফেরেশ্‌তারেও তারা বশীভূত করে।আত্মা থাকিতে দেহে যারা সহে আত্ম-নির্যাতন, নির্যাতকেরে বধিতে যাহারা করে না পরান-পণ, তাহারা বদ্ধ জীব পশু সম, তাহারা মানুষ নয়, তাদেরই নিরাশা মানুষের আসা ভরসা করিছে লয়।হাত-পা পাইয়া কর্ম করে না কূর্মধর্মী হয়ে, রহে কাদা-জলে মুখ লুকাইয়া আঁধার বিবরে ভয়ে, তাহারা মানব-ধর্ম ত্যজিয়া জড়ের ধর্ম লয়, তাহারা গোরস্তান, শ্মশানের, আমাদের কেহ নয়!আমি বলি, শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো, দেখিবে তাহারই প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরথর। ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়, এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!চাওয়া যদি হয় বৃহৎ, বৃহৎ সাধনাও তার হয়, তাহারই দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়। অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর, অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে, চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ-সমুদ্রে টানে। অসম সাহস আসে বুকে তার অভয় সঙ্গ করে, নিত্য জয়ের পথে চলো সেই পথিকের হাত ধরে!পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই, তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) বেদনা-অভিমান ওরে আমার বুকের বেদনা! ঝঞ্ঝা-কাতর নিশীথ রাতের কপোত সম রে      আকুল এমন কাঁদন কেঁদো না।কখন সে কার ভুবনভরা ভালোবাসা হেলায় হারালি, তাইতো রে আজ এড়িয়ে চলে সকল স্নেহে পথে দাঁড়ালি!      ভিজে ওঠে চোখের পাতা তোর,      একটি কথায় – অভিমানী মোর! ডুকরে কাঁদিস বাঁধনহারা, ‘ওগো, আমায় বাঁধন বেঁধো না’।বাঁধন গৃহের সইল না তোর, তাই বলে কি মায়াও ঘরের ডাক দেবে না তোকে?                অভিমানী গৃহহারা রে!চললে একা মরুর পথেও সাঁঝের আকাশ মায়ের মতন ডাকবে নত চোখে,                ডাকবে বধূ সন্ধ্যাতারা যে!জানি ওরে, এড়িয়ে যারে চলিস তারেই পেতে চলিস পথে। জোর করে কেউ বাঁধে না তাই বুক ফুলিয়ে চলিস বিজয়রথে।      ওরে কঠিন! শিরীষকোমল তুই!      মর্মর তোর মর্মে ছাপা বেল কামিনী জুঁই! বুকপোরা তোর ভালবাসা, মুখে মিছে বলিস ‘সেধো না’।           আমার    বুকের বেদনা। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) বেদনা-মণি একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায়        সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।          সেই মানিকের রক্ত-আলো           ভুলাল মোর মন ভুলাল গো।      সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়। আজ   রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে ওই   বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে।           এ কালফণী অনেক খুঁজি           পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো! আমার  চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) বে-শরম আরে আরে সখী          বারবার ছি ছি           ঠারত চঞ্চল আঁখিয়া সাঁবলিয়া। দুরু দুরু গুরু গুরু          কাঁপত হিয়া উরু           হাথসে গির যায় কুঙ্কুম-থালিয়া। আর না হোরি          খেলব গোরি           আবির ফাগ দে পানি মে ডারি                     হা প্যারি –           শ্যাম কী ফাগুয়া           লাল কী লুগুয়া ছি ছি মোরি শরম ধরম সব হারি মারে ছাতিয়া মে কুঙ্কুম বে-শরম বানিয়া।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) বোধন ১দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে, দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥ কেঁদো না, দমো না, বেদনা-দীর্ণ এ প্রাণে আবার আসিবে শক্তি, দুলিবে শুষ্ক শীর্ষে তোমারও সবুজ প্রাণের অভিব্যক্তি। জীবন-ফাগুন যদি মালঞ্চ-ময়ূর তখতে আবার বিরাজে, শোভিবেই ভাই, ওই তো সেদিন, শোভিবে এ শিরও পুষ্প-তাজে॥২হোয়ো না নিরাশ, অজানা যখন ভবিষ্যতের সব রহস্য, যবনিকা-আড়ে প্রহেলিকা-মধু, – বীজেই সুপ্ত স্বর্ণ শস্য! অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমার পর্যুদস্ত, ভয় নাই ভাই! ওই যে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত! দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে, দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৩দুদিনের তরে গ্রহ-ফেরে ভাই সব আশা যদি না হয় পূর্ণ, নিকট সেদিন, রবে না এদিন, হবে জালিমের গর্ব চূর্ণ! পুণ্য-পিয়াসী যাবে যারা ভাই মক্কার পূত তীর্থ লভ্যে; কণ্টক-ভয়ে ফিরবে বা তারা বরং পথেই জীবন সঁপবে। দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে, দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৪অস্তিত্বের ভিত্তি মোদের বিনাশেও যদি ধ্বংস-বন্যা, সত্য মোদের কাণ্ডারি ভাই, তুফানে আমরা পরোয়া করি না। যদিও এ পথ ভীতি-সংকুল, লক্ষ্যস্থলও কোথায় দূরে, বুকে বাঁধো বল, ধ্রুব-অলক্ষ্য আসিবে নামিয়া অভয় তূরে। দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে, দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৫অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমরা পর্যুদস্ত, ভয় নাই ভাই! রয়েছে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত! কী ভয় বন্দি, নিঃস্ব যদিও, অমার আঁধারে পরিত্যক্ত, যদি রয় তব সত্য-সাধনা স্বাধীন জীবন হবেই ব্যক্ত! দুঃখ কী ভাই হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে, দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) বোমার ভয় বোমার ভয়ে বউ, মা, বোন, নেড়রি গেঁড়রি লয়ে দিগ্‌বিদিকে পলায় ভীরু মানুষ মৃত্যু ভয়ে! কোনখানে হায় পলায় মানুষ, মৃত্যু কোথায় নাই? পলাতকের দল! বলে যাও সে-দেশ কোথায় ভাই? মানুষ মরে একবার, সে দুবার মরে নাকো, হায় রে মানুষ! তবু কেন মৃত্যুর ভয় রাখ। আরেক দেশে পালিয়া তোমার মৃত্যুভয় কি যাবে? মৃত্যু – ভ্রান্তি দিবানিশি তোমায় ভয় দেখাবে। না মরিয়া বীরের মতো মৃত্যু আলিঙ্গিয়া, তিলে তিলে মরে ভীরু যে যন্ত্রণা নিয়া, সে যাতনার চেয়ে বোমার আগুন স্নিগ্ধ আরও! মরণ আসে বন্ধু হয়ে, মরতে যদি পার তেমন মরণ। দেখবে সেদিন সবে, পৃথ্বী হবে নতুন আবার মৃত্যু-মহোৎসবে।আল্লাহ্‌ ভগবানের আমরা যদি আশ্রয় পাই, সেই সে পরম অভয়াশ্রমে মৃত্যুর ভয় নাই! যেতে পার তাঁর কাছে ছুটে তুমি প্রবল তৃষ্ণা লয়ে? তাঁহারে ছুঁইলে ছোঁবে না তোমারে কখনও মৃত্যুভয়ে! সেখানে যাওয়ার ট্রেন কোন ইস্টিশনে সে পাওয়া যায়? সে প্ল্যাটফর্ম দেখেছ কি কভু? দেখনিকো তুমি হায়! যেখানেই তুমি পালাও, মৃত্যু সাথে সাথে দৌড়াবে! জানিয়াও কেন অকারণে মৃত্যুর ভয়ে খাবি খাবে? দেখেছি ভীষণ মানুষের স্রোত ভীষণ শাস্তি সয়ে, চলেছে অজানা অরণ্যে যেন ভীতি-উন্মাদ হয়ে! পুরুষের রূপে দেখাছি বউমা করে কোণ ঠাসাঠাসি, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া বাক্স বোঁচকা পোঁটলা রাশি। যাহারা যাইতে পারিল না, পড়ে রহিল অর্থাভাবে সঞ্চিত নাই অর্থ, কোথায় ক্ষুধার অন্ন পাবে? তাহাদের কথা ভাবিল না কেউ, ধরিল না কেহ হাতে, কেহ বলিল না, ‘মরিতে হয়তো এসো মরি এক সাথে!’ কেহ বলিল না, ‘কেন পলাইব, এসো দল বেঁধে রই, সংঘবদ্ধ হইয়া আমরা এসো সৈনিক হই।’ ক্ষুদ্র অস্ত্র লয়ে কি করিয়া যুদ্ধ করিছে চীন? অস্ত্র ধরিতে পারে না, যাহারা অন্তরে বলহীন। যাহারা নির্যাতিত মানবেরে রক্ষা করিতে চায়, আকাশ হইতে নেমে আসে, হাতে অস্ত্র তারাই পায়! বোমার ভয় এ নহে, ইহা ক্লীব ভীরুর মৃত্যুভয়, ইহারা ধরার বোঝা হয়ে আছে, ইহারা মানুষ নয়।যে দেশে তাদের জন্ম সে দেশ ছেড়ে এরা পরদেশে, কেমন করিয়া খায় দায়, মুখ দেখায়, বেড়ায় হেসে? অর্থের চাকচিক্য দেখায়, হায় রে লজ্জাহীন, ইহাদেরই শিরে বোমা যেন পড়ে, ইহারা হোক বিলীন! বোমা দেখেনিকো, শব্দ শোনেনি, শুধু তার নামে প্রেমে এদের সর্ব অঙ্গ ব্যাকুল হইয়া উঠেছে ঘেমে! জীবন আর যৌবন যার আছে, সেই সে মৃত্যুহীন, গোরস্তানের শ্মশানের ভূত যারা ভীরু যারা দীন! কেন বেঁচে আছে এরা পৃথিবীরে ভারাক্রান্ত করে? ইহাদেরই শিরে পড়ে যেন যদি বোমা কোনোদিন পড়ে!নওজোয়ানরা এসো দলে দলে বীর শহিদান সেনা; তোমরা লভিবে অমর-মৃত্যু, কোনো দিন মরিবে না! ইতিহাসে আর মানবস্মৃতিতে আছে তাহাদেরই নাম, যারা সৈনিক, দৈত্যের সাথে করেছিল সংগ্রাম! যারা ভীরু, তারা কীটের মতন কখন গিয়েছে মরে, তাদের কি কোনো স্মৃতি আছে, কেউ তাদের কি মনে করে? ক্ষুদ্র-আত্মা নিষ্প্রাণ এরা, ইহারা গেলেই ভালো, ভিড় করেছিল নিরাশা-আঁধার, এবার আসিবে আলো! দেশের জাতির সৈনিক যদি কোনো দিন জয় আনে, এই আঁধারের জীব যদি ফিরে আসে আলোকের পানে, ইহাদের কাঁধে লাঙল বাঁধিয়া জমি করাইয়ো চাষ, তবে যদি হয় চেতনা এদের, হয় যদি ভয় হ্রাস! চল্লিশ কোটি মানুষ ভারতে, এক কোটি হোক সেনা, কোনো পরদেশি আসিবে না, কোনো বিদেশিরা রহিবে না! বিরাট বিপুল দেশ আমাদের, কার এত সেনা আছে, ভারত জুড়িয়া যু্দ্ধ করিবে? পরাজয় লভিয়াছে, এই মৃত্যুর ভয় শুধু, এরা রোগে ভুগে পচে মরে, তবু লভিবে না অমৃত ইহারা মৃত্যুর হাত ধরে! সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা ভাই শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ভবে, এই অস্ত্রেই সর্ব অসুর দানব বিনাশ হবে, চল্লিশ কোটি মানুষ মারিতে কোথা পাবে গোলাগুলি, সর্বভয়ের রাক্ষস পশু পালাবে লাঙ্গুল তুলি। বোমা যদি আসে, দেখে যাব মোরা বোমা সে কেমন চিজ, তাহারই ধ্বনিতে ধ্বংস হইবে সর্ব ক্লৈব্য-বীজ! যাহারা জন্ম-সৈনিক, তারা ছুটে এসো দলে দলে, শক্তি আসিবে পৃথিবী কাঁপিবে আমাদের পদতলে। আমরা যুঝিয়া মরি যদি সব ভীরুতা হইবে লয়, পৃথিবীতে শুধু বীর-সেনাদের জয় হোক, হোক জয়।  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) ব্যথা-নিশীথ এই     নীরব নিশীথ রাতে শুধু     জল আসে আঁখিপাতে।   কেন  কি কথা স্মরণে রাজে?    বুকে কার হতাদর বাজে?    কোন্‌ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে    ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে         আর  জল ভরে আঁখি-পাতে।।   মম বর্থ জীবন-বেদনা    এই  নিশীথে লুকাতে নারি,    তাই  গোপনে একাকী শয়নে    শুধু নয়নে উথলে বারি।    ছিল সেদিনো এমনি নিশা,    বুকে জেগেছিল শত তৃষা    তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা    ওই শিথিল শেফালিকাতে    আর পূরবীতে বেদনাতে।। ভজন চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।।অবতার শ্রীরাম যে জানকীর পতি তারো হ'ল বনবাসা রাবণ-কর দুর্গতি। আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়।।স্বামী পঞ্চ পান্ডব, সখা কৃষ্ণ ভগবান, দুঃশাসন করে তবু দ্রৌপদীর অপমান। পুত্র তার হ'ল হত যদুপতি যার সহায়।।মহারাজ শ্রীহরিশ্চন্দ্র রাজ্যদান করে শেষ শ্মশান- রক্ষী হয়ে লভিল চন্ডাল বেশ। বিষ্ণু- বুকে চরণ- চিহ্ন, ললাট- লেখা কে খন্ডায়।। ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা তখ্‌তে তখ্‌তে দুনিয়ায় আজি কমবখ্‌তের মেলা, শক্তি-মাতাল দৈত্যেরা সেথা করে মাতলামি খেলা। ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা, ভাঙিয়া পোড়ো না দুখে, পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে। তখ্‌তে তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে, তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে। ঘন গৈরিকে আকাশ রাঙায়ে বৈশাখী ঝড় আসে, ভাবে লোভান্ধ মানব, তাহার গোধূলি-লগন হাসে! যে আগুন ছড়ায়েছে এ বিশ্বে, তারই দাহ ফিরে এসে ভীম দাবানল-রূপে জ্বলিতেছে তাহাদেরই দেশে দেশে।    সত্যপথের তীর্থ-পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়, শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়! অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে, অবশেষে চিরলাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে! পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা, তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছে – কেহ কভু ভাবিয়ো না! ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় ওরা বাধা, পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাকো কাদা!    জয়ে পরাজয়ে সমান শান্ত রহিব আমরা সবে, জয়ী যদি হই, এক আল্লার মহিমার জয় হবে! লাঞ্ছিত হলে বাঞ্ছিত হব পরলোকে আল্লার, রণভূমে যদি হত হই মোরা হব চির-প্রিয় তাঁর! হয়তো কখনও জয়ী হবে ওরা, হটিব না মোরা তবু, বুঝিব মোদের পরীক্ষা করে মোদের পরম প্রভু!    বিদ্বেষ লয়ে ডাকিলে কি প্রভু পথভ্রান্ত ফিরে? ভালোবাসা দিয়ে তাদেরে ডাকিতে হয় বক্ষের নীড়ে। সজ্ঞানে যারা করে নিপীড়ন, মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাহাদেরই তরে আল্লার তলোয়ার। অজ্ঞান যারা ভুল পথে চলে, মারিয়ো না তাহাদেরে, ভালোবাসা পেলে ভ্রান্ত মানুষ সত্যের পথে ফেরে। সকল জাতির সকল মানুষে এক তাঁর নামে ডাকো, বুকে রাখো তাঁর ভক্তি ও প্রেম, হাতে তলোয়ার রাখো। সর্ববিশ্ব প্রসন্ন হয় তিনি প্রসন্ন হলে, সত্যপথের সর্বশত্রু ছাই হয়ে যায় জ্বলে! আমাদেরও মাঝে যার বুকে আছে লুকাইয়া প্রলোভন, তারেও কঠিন সাজা দিতে হবে, আল্লার প্রয়োজন!    আগে চলো, আগে চলো দুর্জয় নব অভিযান-সেনা, আমাদের গতি-প্রবাহ কাহারও কোনো বাধা মানিবে না। বিশ্বাস আর ধৈর্য হউক আমাদের চির-সাথি, নিত্য জ্বলিবে আমাদের পথে সূর্য চাঁদের বাতি।    ভয় নাহি, নাহি ভয়!    মিথ্যা হইবে ক্ষয়!    সত্য লভিবে জয়! ভক্তে দেখায় রক্তচক্ষু যারা, তারা হবে লয়! বলো, এ পৃথিবী মানুষের, ইহা কাহারও তখ্‌ত্ নয়!    পুণ্য তখ্‌তে বসিয়া যে করে তখ্‌তের অসম্মান, রাজার রাজা যে, তাঁর হুকুমেই যায় তার গর্দান! ভিস্তিওয়ালার রাজত্ব, ভাই, হয়ে এল ওই শেষ, বিশ্বের যিনি সম্রাট তাঁরই হইবে সর্বদেশ! রক্তচক্ষু রক্ষ যক্ষ, সাবধান! সাবধান! ভুল বুঝাইয়া, বুঝেছ ভুলাবে আল্লার ফরমান? এক আল্লারে ভয় করি মোরা, কারেও করি না ভয়, মোদের পথের দিশারি এক সে সর্বশক্তিময়। সাক্ষী থাকিবে আকাশ, পৃথিবী, রবি শশী গ্রহ তারা, কাহারা সত্যপথের পথিক, পথভ্রষ্ট কারা!    ভয় নাহি, নাহি ভয়!    মিথ্যা হইবে ক্ষয়!    সত্য লভিবে জয়!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান আসিবে আজ বন্ধু মোর। স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায় আকাশে উধাও চিত-চকোর। আসিবে আজ বন্ধু মোর।।হিজল বিছানো বন পথ দিয়া রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া। নদীর পারে বন কিনারে ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর। আসিবে আজ বন্ধু মোর।।চন্দ্রচূড় মেঘের গায় মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়, নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায় বহিছে পবন গন্ধ চোর। আসিবে আজ বন্ধু মোর।। ভাঙার গান .             ১ করার ঐ লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট রক্ত - জমাট শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী! ওরে ও তরুণ ঈশান! বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! ধ্বংস-নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।                ২ গাজনের বাজনা বাজা! কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে? হা হা হা পায় যে হাসি ভগবান পরবে ফাঁসি? সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?              ৩ ওরে ও পাগলা ভোলা দে রে দে প্রলয় দোলা গারদগুলো জোরসে ধরে হেঁচকা টানে! মার হাঁক হায়দার হাঁক, কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!              ৪ নাচে ঐ কাল-বোশেখি, কাটাবি কাল বসে কি? দে রে দেখি ভীম করার ঐ ভিত্তি নাড়ি! লাথি মার, ভাঙরে রে তালা! যত সব বন্দি-শালায়- আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি। ভীরু আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে। গৃহকোন ছাড়ি আসিয়াছ আজ দেবতার মন্দিরে। পুতুল লইয়া কাটিয়াছে বেলা আপনারে ল'য়ে শুধু হেলা-ফেলা, জানিতে না, আছে হৃদয়ের খেলা আকুল নয়ন-নীরে, এত বড় দায় নয়নে নয়নে নিমেষের চাওয়া কি রে? আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে।।আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে। জানিতে না আঁখি আঁখিতে হারায় ডুবে যায় বাণী ধীরে! তুমি ছাড়া আর ছিল না ক' কেহ ছিল না বাহির ছিল শুধু গেহ, কাজল ছিল গো জল ছিল না ও উজল আঁখির তীরে। সে-দিনও চলিতে ছলনা বাজেনি ও চরণ-মঞ্জীরে! আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে।।আমি জানি তুমি কেন কহ না ক' কথা! সে দিনও তোমার বনপথে যেতে পায়ে জরাত না লতা! সে-দিনও বেভুল তুলিয়াছ ফুল ফুল বিঁধিতে গো বিঁধেনি আঙুল, মালার সাথে যে হৃদয়ও শুকায় জানিতে না সে বারতা, জানিতে না, কাঁদে মুখর মুখের আড়ালে নিসঙ্গতা। আমি জানি তুমি কেন কহ না ক' কথা।।আমি জানি তব কপটতা, চতুরালি! তুমি জানিতে না, ও কপোলে থাকে ডালিম-দানার লালী। জানিতে না ভীরু রমণীর মন মধুকর-ভারে লতার মতন কেঁপে মরে কথা কন্ঠ জড়ায়ে নিষেধ করে গো খালি, আঁখি যত চায় তত লজ্জায় লজ্জা পাড়ে গো গালি! আমি জানি তব কপটতা, চুরতালি!আমি জানি, ভিরু! কিসের এ বিস্ময়। জানিতে না কভু নিজেরে হেরিয়া নিজেরি করে যে ভয়! পুরুষ পুরুষ- শুনেছিলাম নাম, দেখেছ পাথর করনি প্রণাম, প্রণাম করেছ লুব্ধ দ'কর চেয়েছে চরণ-ছোঁয়া। জানিতে না, হিয়া পাথর পরশি' পরশ-পাথরও হয়! আমি জানি, ভীরু, কিসের এ বিস্ময়।।কিসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি। পরানের ক্ষুধা দেশের দ'-তীরে করিতেছে কানাকানি! বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ পাপড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ, যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি, অপাঙ্গে আজ ভিড় ক'রেছে গো লুকানো যতেক বাণী। কিসের তোমার শঙ্কা, এ আমি জানি।।আমি জানি, কেন বলিতে পার না খুলি'। গোপনে তোমায় আবেদন তার জানায়েছে বুলবুলি। যে-কথা শুনিতে মনে ছিল সাধ, কেমনে সে পেল তারি সংবাদ? সেই কথা বঁধু তেমনি করিয়া বলিল নয়ন তুলি' কে জানিত এত যাদু-মাখা তার ও কঠিন অঙুলি। আমি জানি কেন বলিতে পার না খুলি'।আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা, ব্যথার পরশে হয়েছে তোমার সকল অঙ্গ সোনা! মাটির দেবীরে পরায় ভূষণ সোনার সোনায় কিবা প্র্যোজন? দেহ-কূল ছাড়ি' নেমেছে মনের অকূল নিরঞ্জনা। বেদনা আজিকে রূপেরে তোমার করিতেছে বন্দনা। আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা।।আমি জানি, ওরা বুঝিতে পারে না তোরে। নিশীথে ঘুমালে কুমারী বালিকা, বদূ জাগিয়াছে ভোরে! ওরা সাঁতারিয়া ফিরিতেছে ফেনা শুক্তি যে ডোবে- বুঝিতে পারে না! মুক্তা ফলেছে- আঁখির ঝিনুক ডুবেছে আঁখির লোরে। বোঝা কত ভার হ'লে- হৃদয়ের ভরাডুবি হয়, ওরে, অভাগিনী নারী, বুঝাবি কেমন ক'রে।। ভুলিতে পারিনে তাই ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি ভোলো মোর সে অপরাধ, আজ যে লগ্ন গোধূলি।এমনি রঙিন বেলায় খেলেছি তোমায় আমায় খুঁজিতে এসেছি তাই সেই হারানো দিনগুলি।তুমি যে গেছ ভুলে, ছিল না আমার মনে তাই আসিয়াছি তব বেড়া দেওয়া ফুলবনে গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি আজও হেথা গাহে গান আমার পোষা বুল্‌বুলি।চাহ মোর মুখে প্রিয়, এস গো আরও কাছে হয়তো সে দিনের স্মৃতি তব নয়নে আছে হয়তো সে দিনের মতই প্রাণ উঠিবে আকুলি।। ভূত-ভাগানোর গান ১    ওই    তেত্রিশ কোটি দেবতাকে তোর তেত্রিশ কোটি ভূতে আজ    নাচ বুড্‌ঢি নাচায় বাবা উঠতে বসতে শুতে! ও ভূত         যেই দেখেছে মন্দির তোর               নাই দেবতা নাচছে ইতর,   আর    মন্ত্র শুধু দন্ত-বিকাশ, অমনি ভূতের পুতে,   তোর    ভগবানকে ভূত বানালে ঘানি-চক্রে জুতে॥২ ও ভূত          যেই জেনেছে তোদের ওঝা                আজ নকলের বইছে বোঝা,   ওরে     অমনি সোজা তোদের কাঁধে খুঁটো তাদের পুঁতে, আজ ভূত-ভাগানোর মজা দেখায় বোম-ভোলা বম্বুতে!৩ও ভূত         সর্ষে-পড়া অনেক ধুনো               দেখে শুনে হল ঝুনো,   তাই     তুলো-ধুনো করছে ততই যতই মরিস কুঁথে, ও ভূত     নাচছে রে তোর নাকের ডগায় পারিসনে তুই ছুঁতে!৪          আগে   বোঝেনিকো তোদের ওঝা           তোরা   গোঁজামিলের মন্ত্র-ভজা।                (শিখলি শুধু চক্ষু-বোঁজা)           শিখলি শুধু কানার বোঝা কুঁজোর ঘাড়ে থুতে,    তাই    আপনাকে তুই হেলা করে ডাকিস স্বর্গদূতে॥৫  ওরে        জীবন-হারা, ভূতে-খাওয়া!              ভূতের হাতে মুক্তি পাওয়া           সে কি সোজা? – ভূত কি ভাগে ফুসমন্তর ফুঁতে?   তোরা    ফাঁকির ‘কিন্তু’ এড়িয়ে – পড়বি কূলহারা ‘কিন্তু’তে!৬  ওরে           ভূত তো ভূত – ওই মারের চোটে                  ভূতের বাবাও উধাও ছোটে!            ভূতের বাপ ওই ভয়টাকে মার, ভূত যাবে তোর ছুটে।   তখন     ভূতে-পাওয়া এই দেশই ফের ভরবে দেবতা দূতে॥(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষনিকা ওগো ক্ষনিকা।।মোর গগনের ঊল্কার প্রায় চমকি ক্ষনেক চকিতে মিলায় তোমার হাসির যুঁই কনিকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা।।পুষ্পধনু তব মন রাঙ্গানো বঙ্কিম ভুরু হানো হানো তোমার উতল উত্তরীয় আমারো চোখে প্রিয় ছুঁইয়ে দিও যৌবনের দাও রাজ- টীকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা আমি হবো ওগো আমি হবো তোমার মালার মলিকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা মধুকর মঞ্জীর বাজে মধুকর মঞ্জীর বাজে বাজে গুন্‌ গুন্‌ মঞ্জুল গুঞ্জরণে মৃদুল দোদুল নৃত্যে বন শবরী মাতে কুঞ্জবনে।বাজায়ছে সমীর দখিনা পল্লবে মর্মর বীণা বনভুমি ধ্যান-আসীনা সাজিল রাঙা কিশলয় বসনে।ধূলি-ধূসর প্রান্তর পরেছিল গৈরিক সন্ন্যাসী সাজ নব দূর্বাদল শ্যাম হলো আনন্দে আজ।লতিকা বিতানে ওঠে ডাকি মুহু মুহু ঘুমহারা পাখি নব নীল অঞ্জন মাখি উদাসী আকাশ হাসে চাঁদের সনে।। মন বলে তুমি আছ ভগবান মন বলে তুমি আছ ভগবান চোখ বলে তুমি নাই মিছে শুধু তোমায় ডেকে ডেকে মরি দেখা কভু নাহি পাই।মন বলে ঐ তৃণ-লতা-গাছে তব সে অরূপ মিলাইয়া আছে চোখ বলে কেন কল্পনা দিয়ে নিজেরে নিজে ভুলাই।। মনের মানুষ ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?     মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?              অনেক তো সে ছিল বাঁশি,           অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি, কই  কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল? ওগো  এমন করে নয়ন-জলে কেউ কি ভেসেছিল?         তোমরা যখন সবাই গেলে হেলায় ঠেলে পায়ে,            আমার সকল সুধাটুকুন পিয়ে,      সেই তো এসে বুকে করে তুলল আপন নায়ে            আচমকা কোন্ না-চাওয়া পথ দিয়ে।               আমার যত কলঙ্কে সে      হেসে বরণ করলে এসে আহা  বুক-জুড়ানো এমন ভালো কেউ কি বেসেছিল? ওগো  জানত কে যে মনের মানুষ সবার শেষে ছিল।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) মরণ-বরণ এসো এসো এসো ওগো মরণ! এই   মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় করো তো হরণ॥        না বেরিয়েই পথে যারা পথের ভয়ে ঘরে        বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে,        তাতা থইথই তাতা থইথই তাদের বুকের পরে ভীম   রুদ্রতালে নাচুক তোমার ভাঙন-ভরা চরণ॥         দীপক রাগে বাজাও জীবন-বাঁশি,         মড়ার মুখেও আগুন উঠুক হাসি।        কাঁধে পিঠে কাঁদে যেথা শিকল জুতোর-ছাপ,        নাই সেখানে মানুষ সেথা বাঁচা-ও মহাপাপ। সে   দেশের বুকে শ্মশান-মশান জ্বালুক তোমার শাপ, সেথা  জাগুক নবীন সৃষ্টি আবার হোক নব নামকরণ॥        হাতের তোমার দণ্ড উঠুক কেঁপে        এবার দাসের ভুবন ভবন ব্যেপে,        মেষগুলোকে শেষ করে দেশ-চিতার বুকে নাচো!        শব করে আজ শয়ন, হে শিব জানাও তুমি আছ।        মরায়-ভরা ধরায়, মরণ! তুমিই শুধু বাঁচো – এই   শেষের মাঝেই অশেষ তুমি, করছি তোমায় বরণ॥        জ্ঞান-বুড়ো ওই বলছে জীবন মায়া,        নাশ করো ওই ভীরুর কায়া ছায়া!        মুক্তিদাতা মরণ! এসো কালবোশেখির বেশে;        মরার আগেই মরল যারা, নাও তাদেরে এসে।        জীবন তুমি সৃষ্টি তুমি জরা-মরার দেশে, তাই   শিকল-বিকল মাগছে তোমার মরণ-হরণ শরণ॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) মরমি কোন মরমির মরম ব্যথা আমার বুকে বেদনা হানে,           জানি গো, সেও জানেই জানে। আমি কাঁদি তাইতে যে তার ডাগর চোখে অশ্রু আনে,           বুঝেছি তা প্রাণের টানে।     বাইরে বাঁধি মনকে যত      ততই বাড়ে মর্ম-ক্ষত,      মোর সে ক্ষত ব্যথার মতো           বাজে গিয়ে তারও প্রাণে           কে কয়ে যায় হিয়ার কানে।উদাস বায়ু ধানের খেতে ঘনায় যখন সাঁঝের মায়া, দুই জনারই নয়ন-পাতায় অমনি নামে কাজল-ছায়া!     দুইটি হিয়াই কেমন কেমন      বদ্ধ ভ্রমর পদ্মে যেমন,      হায়, অসহায় মূকের বেদন           বাজল শুধু সাঁঝের গানে,           পুবের বায়ুর হুতাশ তানে। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে। গোর - আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।।কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত। সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।।কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে, আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে (আল্লার নাম জপতে চাই) ।। মহাত্মা মোহ্‌সিন সকল জাতির সব মানুষের বন্ধু হে মোহ্‌সিন! এ যুগে তুমিই শোধ করিয়াছ এক আল্লার ঋণ॥ ভোগ করনিকো বিপুল বিত্ত পেয়ে, ভিখারি হইলে শুধু আল্লারে চেয়ে, মহাধনী হলে আল্লার কৃপা পেয়ে, দুনিয়ায় তাই রহিলে কাঙাল দীন॥মানুষের ভালোবাসায় পাইলে আল্লার ভালোবাসা, সৃষ্টির তরে কাঁদিয়া, পুরালে তব স্রষ্টার আশা। তব দান তাই ফুরায়ে নাহি ফুরায়, বিত্ত হইল নিত্য এ দুনিয়ায়, শিখাইয়া গেলে, মুসলিম তারে কয় অর্থ যাহারে কিনিতে পারে না, যে নহে লোভ-মলিন॥   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) মা যেখানেতে দেখি যাহা মা- এর মতন আহা একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই, মায়ের মতন এত আদর সোহাগ সে তো আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!হেরিলে মায়ের মুখ দূরে যায় সব দুখ মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান, মায়ের শিতল কোলে সকল যাতনা ভোলে কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।কত করি উৎপাত আবদার দিন রাত, সব স'ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা! আমাদের মুখ চেয়ে নিজের র'ন নাহি খেয়ে শত দোষে দোষী তবু মা তো তাজে না।ছিনু খোকা এতটুকু, একটুতে ছোট বুক যখন ভাঙ্গিয়া যেতো, মা-ই সে তখন বুকে করে নিশিদিন আরাম-বিরাম-হীন দোলা দেয়া শুধাতেন, 'কি হলো খোকন?'আহা সে কতই রাতি শিয়রে জ্বালায়ে বাতি একটু অসুখ হলে জাগেন মাতা, সব-কিছু ভুলে গিয়ে কেবল আমায়ের নিয়ে কত আকুলতা যেন জগন্মাতা।যখন জন্ম নিনু কত অসহায় ছিনু কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু, ওঠা বসা দূরে থাক- মুখে নাহি ছিল নাক, চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছি পিছু।তখন সে মা আবার চুমু খেয়ে বারবার চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায় বুঝিয়া নিতেন যত আমার কি ব্যথা হোতো, বল কে এমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।।তারপর কত দুখে আমারে ধরিয়া বুকে করিয়া তুলেছে মাতা দেখ কত বড় কত না সে সুন্দর এ দেহ এ অন্তর সব মোরা ভাই বোন হেথা যত পড়।পাঠশালা হতে যবে ঘরে ফিরি যাব সবে, কত না আদরে কোলে তুলি' নেবে মাতা, খাবার ধরিয়া মুখে শুধাবেন কত সুখে কত আজ লেখা হলো, পড়া কত পাতা?পড়া লেখা ভালো হ'লে দেখেছ সে কত ছলে ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে। বলে, 'মর খোকামনি! হীরা- মানিকের খনি, এমনটি নাই কারো!' শুনে বুক ভরে।গা'টি গরম হলে মা সে চোখের জলে ভেসে বলে 'ওরে যাদু কি হয়েছে বল।' কত দেবতার 'থানে' পীরে মা মানত মানে- মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।যখন ঘুমায়ে থাকি জাগে রে কাহার আ৬খি আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম। তাই কত ছড়া গানে ঘুম-পাড়ানীরে আনে, বলে,'ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চখে চুম।'দিবানিশি ভাবনা কিসে ক্লেশ পাব না, কিসে সে মাউষ হব, বড় হব কিসে; বুক ভরে ওঠে মা'র ছেলেরি গরবে তাঁর, সব দুখ সুখ হয় মায়ের আশিসে।আয় তবে ভাই বোন, আয় সবে আয় শোন গাই গান, পদধুলি শিরে লয়ে মা'র; মা'র বড় কেহ নাই- কেউ নাই কেউ নাই! নত করি বল সবে 'মা আমার! মা আমার!' মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দে সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।    তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার,    কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির    কূলে ব’সে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর    একাকিনী! যেন কোন্‌ পথ-ভুলে-আসা    ভিন্‌-গাঁ’র ভীর” মেয়ে! কেবলি জিজ্ঞাসা    করিতেছে আপনারে, ‘ এ আমি কোথায়?’    দূর হ’তে তারাকারা ডাকে, আয় আয়!    তুমি যেন তাহাদের পলাতকা মেয়ে    ভুলিয়া এসেছ হেথা ছায়া-পথ বেয়ে!    বিধি ও অবিধি মিলে মেরেছে তোমায় মা আমার-কত যেন! চোখে-মুখে, হায় তবু যেন শুধু এক ব্যথিত জিজ্ঞাসা- ‘ কেন মানে?  এরা কা’রা! কোথা হ’তে আসে এই দুঃখ ব্যথা শোক?’ এরা তো তোমার নহে পরিচিত মাগো, কন্যা অলকার! তাই সব স’য়ে যাও নির্বাক নিশ্চুপ, ধূপেরে পোড়ায় অগ্নি-জানে না তা ধূপ!…দূর-দূরান-র হ’তে আসে ছেলে-মেয়ে, ভুলে যায় খেলা তা’রা তব মুখ চেয়ে! বলে, ‘তুমি মা হবে আমার?’ ভেবে কী যে! তুমি বুকে চেপে ধর, চক্ষু ওঠে ভিজে জননীর কর”ণায়! মনে হয় যেন সকলের চেনা তুমি, সকলেরে চেন! তোমারি দেশের যেন ওরা ঘরছাড়া বেড়াতে এসেছে এই ধরণীর পাড়া প্রবাসী শিশুর দল। যাবে ওরা চ’লে গলা ধ’রে দুটি কথা ‘মা আমার’ ব’লে!হয়ত আসিয়াছিল, যদি পড়ে মনে, অথবা সে আসে নাই-না এলে স্মরণে! যে-দুরন- গেছে চ’লে আসিবে না আর, হয়ত তোমার বুকে গোরস’ান তার জাগিতেছে আজো মৌন, অথবা সে নাই! মন ত কত পাই-কত সে হারাই..সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা! শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা। হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা- হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’! মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয় মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয় মৃণ্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা তাই দুর্গতি ঘুচিল না হায়।যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী সেই দুর্গারে দেশ চায়।আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি দে পরব্রক্ষ্মময়ী শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু হব না কি বিশ্বজয়ী?এ পূজা বিলাস সংহার কর যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়। মানস-বধূ যেমন  ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাপতির ডানার ছোঁয়ায়,       ঠোঁট দুটি তার কাঁপন-আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়।          জল-ছলছল উড়ু-উড়ু চঞ্চল তার আঁখির তারা,       কখন বুঝি দেবে ফাঁকি সুদূর পথিক-পাখির পারা,             নিবিড় নয়ন-পাতার কোলে,             গভীর ব্যথার ছায়া দোলে,         মলিন চাওয়া (ছাওয়া) যেন দূরের সে কোন্ সবুজ ধোঁয়ায়।            সিঁথির বীথির খসে-পড়া কপোল-ছাওয়া চপল অলক       পলক-হারা, সে মুখ চেয়ে নাচ ভুলেছে নাকের নোলক।               পাংশু তাহার চূর্ণ কেশে,               মুখ মুছে যায় সন্ধে এসে,         বিধুর অধর-সীধু যেন নিঙড়ে কাঁচা আঙুর চোয়ায়।            দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোড়-বাঁশিতে,       পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে।               ম্লান তার লাল গালের লালিম,               রোদ-পাকা আধ-ডাঁশা ডালিম,         গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়।          চায় যেন সে শরম-শাড়ির ঘোমটা চিরি পাতা ফুঁড়ি,         আধফোঁটা বউ মউল-বউল, বোলতা-ব্যাকুল বকুল কুঁড়ি               বোল-ভোলা তার কাঁকন চুড়ি               ক্ষীরের ভিতর হিরের ছুরি,         দু-চোখ-ভরা অশ্রু যেন পাকা পিয়াল শালের ঠোঙায়।          বুকের কাঁপন হুতাশ-ভরা, বাহুর বাঁধন কাঁদন-মাখা,         নিচোল বুকের কাঁচল আঁচল স্বপন-পারের পরির পাখা।               খেয়াপারের ভেসে-আসা               গীতির মতো পায়ের ভাষা,         চরণ-চুমায় শিউরে পুলক হিমভেজা দুধ-ঘাসের রোঁয়ায়।            সে যেন কোন্ দূরের মেয়ে আমার কবিমানস-বধূ;       বুকপোরা আর মুখভার তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।               নিশীথ-রাতের স্বপন হেন,               পেয়েও তারে পাইনে যেন,         মিলন মোদের স্বপন-কূলে কাঁদনভরা চুমায় চুমায়।         নামহারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোঁয়ায়।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) মানিনী মূক করে ওই মুখর মুখে লুকিয়ে রেখো না, ওগো কুঁড়ি, ফোটার আগেই শুকিয়ে থেকো না! নলিন নয়ান ফুলের বয়ান মলিন এদিনে রাখতে পারে কোন সে কাফের আশেক বেদীনে? রুচির চারু পারুল বনে কাঁদচ একা জুঁই, বনের মনের এ বেদনা কোথায় বলো থুই? হাসির রাশির একটি ফোঁটা অশ্রু অকরুণ, হাজার তারা মাঝে যেন একটি কেঁদে খুন! বেহেশতে কে আনলে এমন আবছা বেথার রেশ, হিমের শিশির ছুঁয়ে গেছে হুরপরিদের দেশ! বরষ পরের দরশনের কই সে হরষণ, মিলবে না কি শিথিল তোমার বাহুর পরশন? শরম টুটে ফুটুক কলি শিশির-পরশে ঘোমটা ঠেলে কুণ্ঠা ফেলে সলাজ হরষে।   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) মানুষ .                           গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান, নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।                           'পূজারী, দুয়ার খোলো, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ'ল!' স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয় দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়! জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক' সাত দিন!' সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে, তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!                           ভুখারি ফুকারি' কয়, 'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!' মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি! এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্ বলে 'বাবা, আমি ভুকা-ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!' তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা - 'ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা, ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?' ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - 'তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!                           ভুখারি ফিরিয়া চলে,                           চলিতে চলিতে বলে- 'আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা'বলে বন্ধ করনি প্রভু তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি, মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!' কোথা চেঙ্গিস্‌, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার! খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!                           হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!                           মানুষেরে ঘৃণা করি' ও' কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি' মরি' ও' মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক'রে কেড়ে, যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো। আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ, আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি ক'রে প্রতি ধমনীতে রাজে! আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ, কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ। হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম, আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম। হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা, কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা? কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবা-রাতি! অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উচ্চ নহে, আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে, তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয় ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়! হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে! যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে! ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব! ওই হ'তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব। আজ চন্ডাল, কাল হ'তে পারে মহাযোগী-সম্রাট, তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ। রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে! হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!                           চাষা ব'লে কর ঘৃণা! দে'খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না! যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল, তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র'বে চিরকাল। দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী, তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি! তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে, দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।                           সে মার রহিল জমা- কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা! বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু'চোখে স্বার্থ-ঠুলি, নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ'য়েছে কুলি। মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা, তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা? তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্‌খানে!                           তোমারি কামনা-রাণী যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি'। মিলন-গান [গান]               ভাই হয়ে ভাই চিনবি আবার গাইব কি আর এমন গান। (সেদিন)   দুয়ার ভেঙে আসবে জোয়ার মরা গাঙে ডাকবে বান॥ (তোরা)    স্বার্থ-পিশাচ যেমন কুকুর তেমনি মুগুর পাস রে মান। (তাই)      কলজে চুঁয়ে গলছে রক্ত দলছে পায়ে ডলছে কান॥ (যত)      মাদি তোরা বাঁদি-বাচ্চা দাস-মহলের খাস গোলাম। (হায়)      মাকে খুঁজিস? চাকরানি সে, জেলখানাতে ভানছে ধান॥ (মা’র)     বন্ধ ঘরে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হলো দুই নয়ান। (তোরা)    শুনতে পেয়েও শুনলিনে তা মাতৃহন্তা কুসন্তান॥ (ওরে)     তোরা করিস লাঠালাঠি (আর) সিন্ধু-ডাকাত লুঠছে ধান। (তাই)     গোবর-গাদা মাথায় তোদের কাঁঠাল ভেঙে খায় শেয়ান॥ (ছিলি)    সিংহ ব্যাঘ্র, হিংসা-যুদ্ধে আজকে এমনি ক্ষিণ্ণপ্রাণ। (তোদের) মুখের গ্রাস ঐ গিলছে শিয়াল তোমরা শুয়ে নিচ্ছ ঘ্রাণ॥(তোরা)   কলুর বলদ টানিস ঘানি গলদ কোথায় নাইকো জ্ঞান। (শুধু)     পড়ছ কেতাব, নিচ্ছ খেতাব, নিমক-হারাম বে-ঈমান॥ (তোরা)   বাঁদর ডেকে মানলি সালিশ, ভাইকে দিতে ফাটল প্রাণ। (এখন)    সালিশ নিজেই 'খা ডালা সব' বোকা তোদের এই দেখান॥ (তোরা)   পথের কুকুর দু'কান-কাটা-মান-অপমান নাইকো জ্ঞান। (তাই)     যে জুতোতে মারছে গুঁতো করছ তাতেই তৈল দান॥ (তোরা)   নাক কেটে নিজ পথের যাত্রা ভঙ্গ করিস বুদ্ধিমান। (তোদের) কে যে ভাল কে যে মন্দ সব শিয়ালই এক সমান॥ (শুনি)    আপন ভিটেয় কুকুর রাজা, তার চেয়েও হীন তোদের প্রাণ। (তাই)   তোদের দেশ এই হিন্দুস্থানে নাই তোদেরই বিন্দু স্থান॥ (তোদের)  হাড় খেয়েছে, মাস খেয়েছে, (এখন) চামড়াতে দেয় হেঁচকা টান (আজ)     বিশ্ব-ভুবন ডুকরে ওঠে দেখে তোদের অসম্মান॥(আজ)    সাধে ভারত-বিধাতা কি চোখ বেঁধে ঐ মুখ লুকান। (তোরা)   বিশ্বে যে তাঁর রাখিস নে ঠাঁই কানা গরুর ভিন্ বাথান॥ (তোরা)   করলি কেবল অহরহ নীচ কলহের গরল পান। (আজো)  বুঝলি না হায় নাড়ি-ছেঁড়া মায়ের পেটের ভায়ের টান॥ (ঐ)     বিশ্ব ছিঁড়ে আনতে পারি, পাই যদি ভাই তোদের প্রাণ। (তোরা) মেঘ-বাদলের বজ্রবিষাণ (আর) ঝড়-তুফানের লাল নিশান॥ মিলন-মোহনায় হায় হাবা মেয়ে, সব ভুলে গেলি দয়িতের কাছে এসে! এত অভিমান এত ক্রন্দন সব গেল জলে ভেসে ! কূলে কূলে এত ভুলে ফুলে কাঁদা আছড়ি পিছাড়ি তোর, সব ফুলে গেলি যেই বুকে তোরে টেনে নিল মনোচোর! সিন্ধুর বুকে লুকাইলি মুখ এমনই নিবিড় করে, এমনই করিয়া হারাইলি তুই আপনারে চিরতরে – যে দিকে তাকাই নাই তুই নাই! তোর বন্ধুর বাহু গ্রাসিয়াছে তোরে বুকের পাঁজরে – ক্ষুধাতুর কাল রাহু!বিরহের কূলে অভিমান যার এমন ফেনায়ে উঠে, মিলনের মুখে সে ফিরে এমনই পদতলে পড়ে লুটে? এমনই করিয়া ভাঙিয়া পড়ে কি বুক-ভাঙা কান্নায়, বুকে বুক রেখে নিবিড় বাঁধনে পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়? তোর বন্ধুর আঙুলের ছোঁয়া এমনই কি জাদু জানে, আবেশে গলিয়া অধর তুলিয়া ধরিলি অধর পানে! একটি চুমায় মিটে গেল তোর সব সাধ সব তৃষা, ছিন্ন লতার মতন মুরছি পড়িলি হারায়ে দিশা! – একটি চুমার লাগি এতদিন ধরে এত পথ বেয়ে এলি বেয়ে এলি কি রে হতভাগি?গাঙ-চিল আর সাগর-কপোত মাছ ধরিবার ছলে, নিলাজি লো, তোর রঙ্গ দেখিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে। দুধারের চর অবাক হইয়া চেয়ে আছে তোর মুখে, সবার সামনে লুকাইলি মুখ কেমনে বঁধুর বুকে? নীলিম আকাশে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মেঘের গুণ্ঠন ফেলে বউ-ঝির মতো উঁকি দিয়ে দেখে কুতূহলী-আঁখি মেলে।‘সাম্পান’-মাঝি খুঁজে ফেরে তোর ভাটিয়ালি গানে কাঁদি, খুঁজিয়া নাকাল দুধারের খাল – তোর হেরেমের বাঁদি! হায় ভিখারিনি মেয়ে, ভুলিলি সবারে, ভুলিলি আপনা দয়িতেরে বুকে পেয়ে! তোরই মতো নদী আমি নিরবধি কাঁদি রে প্রীতম লাগি, জন্ম-শিখর বাহিয়া চলেছি তাহারই মিলন মাগি! যার তরে কাঁদি – ধার করে তারই জোয়ারের লোনা জল তোর মতো মোর জাগে না রে কভু সাধের কাঁদন-ছল। আমার অশ্রু একাকী আমার, হয়তো গোপনে রাতে কাঁদিয়া ভাসাই, ভেসে ভেসে যাই মিলনের মোহানাতে, আসিয়া সেথায় পুনঃ ফিরে যাই। – তোর মতো সব ভুলে লুটায়ে পড়ি না – চাহে না যে মোরে তারই রাঙ্গা পদমূলে! যারে চাই তারে কেবলই এড়াই কেবলই দি তারে ফাঁকি ; সে যদি ভুলিয়া আঁখি পানে চায় ফিরাইয়া লই আঁখি! –তার তীরে যবে আসি অশ্রু-উৎসে পাষাণ চাপিয়া অকারণে শুধু হাসি! অভিমানে মোর আঁখিজল জমে করকা-বৃষ্টি সম, যারে চাই তারে আঘাত হানিয়া ফিরে যায় নির্মম! একা মোর প্রেম ছুটিবে কেবলই নিচু প্রান্তর বেয়ে, সে কভু ঊর্ধ্বে আসিবে না উঠে আমার পরশ চেয়ে – চাহি না তাহারে! বুকে চাপা থাকা আমার বুকের ব্যথা, যে বুক শূন্য নহে মোরে চাহি – হব নাকো ভার সেথা! সে যদি না ডাকে কী হবে ডুবিয়া ও-গভীর কালো নীরে, সে হউক সুখী, আমি রচে যাই স্মৃতি-তাজ তার তীরে! মোর বেদনার মুখে চাপিয়াছি নিতি যে পাষাণ-ভার! তা দিয়ে রচিব পাষাণ-দেউল সে পাষাণ-দেবতার!কত স্রোতধারা হারাইছে কূল তার জলে নিরবধি, আমি হারালাম বালুচরে তার, গোপন-ফাল্গুনদী!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) মিসেস এম রহমান মোহররমের চাঁদ ওঠার তো আজিও অনেক দেরি, কোন কারবালা-মাতম উঠিল এখনি আমায় ঘেরি'? ফোরাতের মৌজ ফোঁপাইয়া ওঠে কেন গো আমার চোখে! নিখিল-এতিম ভিড় ক'রে কাঁদে আমার মানিস-লোকে! মর্সিয়া-খান! গা'সনে অকালে মর্সিয়া-শোকগীতি, সর্বহারার অশ্রু-প্লাবনে সয়লাব হবে ক্ষিতি!......আজ যবে হায় আমি কুফার পথে গো চলিতে চলিতে কারবালা মাঝে থামি, হেরি চারিধারে ঘিরিয়াছে মোরে মৃত্যু-এজিদ-সেনা, ভায়েরা আমার দুশমন-খুনে মাখিতেছে হাতে হেনা, আমি শুধু হায় রোগ শয্যায় বাজু কামড়ায়ে মরি! দানা-পানি নাই পাতার খিমায় নির্জীব আছি পড়ি'। এমন সময় এল 'দুলদুল' পৃষ্ঠে শূন্য জিন, শূন্যে কে যেন কাঁদিয়া উঠিল- 'জয়নাল আবেদিন'! শীর্ণ-পাঞ্জা দীর্ণ-পাঁজর পর্ণকুটীর ছাড়ি' উঠিতে পড়িতে ছুটিয়া আসিনু, রুধিল দুয়ার দ্বারী! বন্দিনী মা'র ডাক শুনি শুধু জীবন-ফোরাত-পারে, 'এজিদের বেড়া পারায়ে এসেছি, যাদু তুই ফিরে যারে!' কাফেলা যখন কাঁদিয়া উঠিল তখন দুপুর নিশা!- এজিদে পাইব, কোথা পাই হায় আজরাইলের দিশা? জীবন ঘিরিয়া ধূ-ধূ করে আজ শুধু সাহারার বালি, অগ্নি-সিন্ধু করিতেছি পান দোজখ করিয়া খালি! আমি পুড়ি, সাথে বেদনাও পুড়ে, নয়নে শুকায় পানি, কলিজা চাপিড়া তড়পায় শুধু বুক-ভাঙা কাৎরানি! মাতা ফাতেমার লাশের ওপর পড়িয়া কাতর স্বরে হাসান হোসেন কেমন করিয়া কেঁদেছিল, মনে পড়ে!*******************************অশ্রু-প্লাবনে হাবুডুবু খাই বেদনার উপকূলে, নিজের ক্ষতিই বড় করি আমি সকলের ক্ষতি ভুলে! ভুলে যাই-কত বিহগ-শিশুরা এই স্নেহ-বট-ছায়ে আমারই মতন আশ্রয় লভি' ভুলেছে আপন মায়ে। কত সে ক্লান্ত বেদনা-দগ্ধ মুসাফির এরই মূলে বসিয়া পেয়েছে মা'র তসল্লি, সব গ্লানি গেছে ভুলে! আজ তারা সবে করিছে মাতম আমার বাণীর মাঝে, একের বেদনা নিখিলের হ'য়ে বুকে এত ভারী বাজে! আমাদের ঘিরিয়া জমিছে অথৈ শত নয়নের জল, মধ্যে বেদনা-শতদল আমি করিতেছি টলমল! নিখিল-দরদী ছিলেন আম্মা! নাহি মোর অধিকার সকলের মাঝে সকলে ত্যাজিয়া শুধু একা কাঁদিবার!আসিয়াছি মাগো জিয়ারত লাগি' আজি অগ্রজ হ'য়ে মা-হারা আমার ব্যথাতুর ছোট ভাইবোঙ্গুলি লয়ে। অশ্রুতে মোর অন্ধ দু'চোখ, তবু ওরা ভাবিয়াছে হয়ত তোমার পথের দিশা মা জানা আছে মোর কাছে! জীবন-প্রভাতে দেউলিয়া হ'য়ে যারা ভাষাহীন গানে ভর ক'রে মাগো চলেছিল গোরস্থানের পানে, পক্ষ মেলিয়া আবরিলে তুমি সকলে আকুল স্নেহে, যত ঘর-ছাড়া কোলাকুলি করে তব কোলে তব গেহে!'কত বড় তুমি' বলিলে, বলিতে, 'আকাশ শূনয় ব'লে এত কোটি তারা চন্দ্র সূর্য গ্রহে ধরিয়াছে কোলে। শূন্য সে বুক তবু ভরেনি রে, আজো সেথা আছে ঠাঁই, শূন্য ভরিতে শূন্যতা ছাড়া দ্বিতীয় সে কিছু নাই।'গোর-পলাতক মোরা বুঝি নাই মাগো তুমি আগে থেকে গোরস্থানে দেনা শুধিয়াচ আপনারে বাঁধা রেখে! ভুলাইয়া রাখি গৃহ-হারাদের দিয়া স্ব-গৃহের চাবি গোপনে মিটালে আমাদের ঋণ-মৃত্যুর মহা-দাবি! সকলেরে তুমি সেবা ক'রে গেলে, নিলে না কারুর সেবা, আলোক সবারে আলো দেয়, দেয় আলোকেরে আল কেবা?আমাদেরও চেয়ে গোপন গভীর কাঁদে বাণী ব্যথাতুর, থেমে গেছে তার দুলালী মেয়ের জ্বালা-ক্রন্দন সুর। কমল-কাননে থেমে গেছে ঝড়ে ঘূর্ণির দামাডোল, কারার বক্ষে বাজে না ক' আর ডাঙন-ডঙ্কা-রোল! বসিবে কবে জ্ঞানের তখতে, বাংলার মুসলিম! বারে-বারে টুটে কলম তোমার না লিখিতে শুধু 'মিম'।*********************************সে ছিল আরব-বেদুঈনদের পথ-ভুলে-আসা মেয়ে, কাঁদিয়া উঠিত হেরেমের উঁচা প্রাচীরের পানে চেয়ে! সকলের সাথে সকলের মতো চাহিত সে আলো বায়ু, বন্ধন-বাঁধ ডিঙাতে না পেরে ডিঙাইয়া গেল আয়ু!সে বলিত, "ঐ হেরেম-মহল নারীদের তরে নহে, নারী নহে যারা ভুলে বাঁদী-খানা ঐ হেরেমের মোহে! নারীদের ঐ বাঁদী ক'রে রাখা অবিশ্বাসের মাঝে লোভী পুরুষের পশু-প্রবৃতী হীন অপমান রাজে! আপন ভুলিয়া বিশ্বপালিকা নিত্য-কালের নারী করিছে পুরুষ জেল-দারোগার কামনার তাঁবেদারি! বলে না কোরান, বলে না হাদিস, ইসলামী ইতিহাস, নারী নর-দাসী, বন্দিনী র'বে হেরেমেতে বারো মাস! হাদিস কোরান ফেকাহ লয়ে যারা করিছে ব্যবসাদারি, মানে না ক' তারা কোরানের বানী-সমান নর ও নারী! শাস্ত্র ছাঁকিয়া নিজেদের যত সুবিধা বাছাই ক'রে নারীদের বেলা গুম হ'য়ে রয় গুমরাহ যত চোরে!" দিনের আলোকে ধরেছিল এই মুনাফেকদের চুরি, মসজিদে বসে স্বার্থের তরে ইসলামে হানা ছুরি! আমি জানি মাগো আলোকের লাগি' তব এই অভিযান হেরেম-রক্ষী যত গোলামের কাঁপায়ে তুলিত প্রান! গোলা-গুলি নাই, গালাগালি আছে, তাই দিয়ে তারা লড়ে, বোঝে না ক' থুথু উপরে ছুঁড়িলে আপনারি মুখে পড়ে! আমরা দেখেছি, যত গালি ওরা ছুঁড়িয়া মেরেছে গায়ে, ফুল হয়ে সব ফুটিয়া উঠিয়া ঝরিয়াছে তব পায়ে। **************************কাঁটার কিঞ্জে ছিলে নাগ্মাতা সদা উদ্যত-ফণা আঘাত করিতে আসিয়া 'আঘাত' করিয়াছে বন্দনা! তোমার বিষের নীহারিকা- লোকে নিতি নব নব গ্রহ জন্ম লভিয়া নিষেধ- জগতে জাগায়েছে বিদ্রোহ! জহরের তেজ পান ক'রে মাগো তব নাগ-শিশু যত নিয়ন্ত্রিতের শিরে গড়িয়াছে ধ্বজা বিজয়োদ্ধত! মানেনি ক' তারা শাসন- ত্রাসন বাধা-নিষেধের বেড়া,- মানুষ থাকে না খোঁইয়াড়ে বন্ধ, থাকে বটে গরু-ভেড়া।এসম-আজম তাবিজের মত আজো তব রুহু পাক, তাদের ঘেরিয়া আছে কি তেমনি বেদনায় নির্বাক? অথবা 'খাতুনে-জান্নাত'মাতা ফাতিমার গুলবাগে গোলাব-কাঁটায় রাঙা গুল হ'ইয়ে ফুটেছে রক্তরাগে?***************************তোমার বেদনা- সাগরে জোয়ার জাগিল যাদের টানে, তারা কোথা আজ? সাগর শুকালে চাঁদ মরে কোনখানে?যাহাদের তরে অকালে, আম্মা, জান দিলে কোরবান, তাদের জাগায় সার্থক হোক তোমার আত্নদান! মধ্যপথে মা তোমার প্রানের নিভিল যে দীপ-শিখা, জ্বলিক নিখিল-নারীও-সীমান্তে হ'য়ে তাই জয়টিকা! বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি, চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ওই কবরের ধূলি চুমি'! মৃত্যুর পানে চলিতে আছিলে জীবনের পথ দিয়া, জীবনের পানে চলিছ কি আজ মৃত্যুরে পারাইয়া? মুক্ত-পিঞ্জর ভেদি দৈত্য-কারা উদিলাম পুন আমি কারা-ত্রাস চির-মুক্ত বাধাবন্ধ-হারা উদ্দামের জ্যোতি-মুখরিত মহা-গগন-অঙ্গনে – হেরিনু, অনন্তলোক দাঁড়াল প্রণতি করি মুক্ত-বন্ধ আমার চরণে। থেমে গেল ক্ষণেকের তরে বিশ্ব-প্রণব-ওংকার, শুনিল কোথায় বাজে ছিন্ন শৃঙ্খলে কার আহত ঝংকার!    কালের করাতে কার ক্ষয় হল অক্ষয় শিকল, শুনি আজি তারই আর্ত জয়ধ্বনি ঘোষিল গগন পবন জল স্থল। কোথা কার আঁখি হতে সরিল পাষাণ-যবনিকা, তারই আঁখি-দীপ্তি-শিখা রক্ত-রবি-রূপে হেরি ভরিল উদয়-ললাটিকা।           পড়িল গগন-ঢাকে কাঠি, জ্যোতির্লোক হতে ঝরা করুণা-ধারায় – ডুবে গেল ধরা-মা-র স্নেহ-শুষ্ক মাটি, পাষাণ-পিঞ্জর ভেদি, ছেদি নভ-নীল –    বাহিরিল কোন্ বার্তা নিয়া পুন মুক্তপক্ষ অগ্নি-জিব্রাইল! দৈত্যাগার দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ রোষে হাঁকিল প্রহরী!        কাঁদিল পাষাণে পড়ি        সদ্য-ছিন্ন চরণ-শৃঙ্খল!    মুক্তি মার খেয়ে কাঁদে পাষাণ-প্রাসাদ-দ্বারে আহত অর্গল! শুনিলাম – মম পিছে পিছে যেন তরঙ্গিছে        নিখিল বন্দির ব্যথা-শ্বাস –        মুক্তি-মাগা ক্রন্দন-আভাস।    ছুটে এসে লুটায়ে লুটায়ে যেন পড়ে মম পায়ে; বলে – ‘ওগো ঘরে-ফেরা মুক্তি-দূত! একটুকু ঠাঁই কিগো হবে না ও ঘরে-নেওয়া নায়ে?’        নয়ন নিঙাড়ি এল জল, মুখে বলিলাম তবু – ‘বন্ধু! আর দেরি নাই, যাবে রসাতল পাষাণ-প্রাচীর-ঘেরা ওই দৈত্যাগার, আসে কাল রক্ত-অশ্বে চড়ি, হেরো দুরন্ত দুর্বার!’ – বাহিরিনু মুক্ত-পিঞ্জর বুনো পাখি ক্লান্ত কণ্ঠে জয় চির-মুক্তি ধ্বনি হাঁকি – উড়িবারে চাই যত জ্যোতির্দীপ্ত মুক্ত নভ-পানে, অবসাদ-ভগ্ন ডানা ততই আমারে যেন মাটি পানে টানে। মা আমার! মা আমার! এ কী হল হায়!কে আমারে টানে মা গো উচ্চ হতে ধরার ধূলায়? মরেছে মা বন্ধহারা বহ্নিগর্ভ তোমার চঞ্চল, চরণ-শিকল কেটে পরেছে সে নয়ন-শিকল। মা! তোমার হরিণ-শিশুরে বিষাক্ত সাপিনি কোন টানিছে নয়ন-টানে কোথা কোন্ দূরে! আজ তব নীলকণ্ঠ পাখি গীতহারা হাসি তার ব্যথা-ম্লান, গতি তার ছন্দহীন, বদ্ধ তার ঝরনাপ্রাণধারা!        বুঝি নাই রক্ষীঘেরা রাক্ষস-দেউলে        এল কবে মরু-মায়াবিনী সিংহাসন পাতিল সে কবে মোর মর্ম-হর্ম্যমূলে! চরণ-শৃঙ্খল মম যখন কাটিতেছিল কাল – কোন্ চপলার কেশ-জাল কখন জড়াতেছিল গতিমত্ত আমার চরণে, লৌহবেড়ি যত যায় খুলে, তত বাঁধা পড়ি কার কঙ্কণবন্ধনে! আজ যবে পলে পলে দিন-গণা পথ-চাওয়া পথ বলে – ‘বন্ধু, এই মোর বুক পাতা, আনো তব রক্ত-পথ-রথ –’ শুনে শুধু চোখে আসে জল, কেমনে বলিব, ‘বন্ধু! আজও মোর ছিঁড়েনি শিকল! হারায়ে এসেছি সখা শত্রুর শিবিরে        প্রাণ-স্পর্শমণি মোর, রিক্ত-কর আসিয়াছি ফিরে!’... যখন আছিনু বদ্ধ রুদ্ধ দুয়ার কারাবাসে কত না আহ্বান-বাণী শুনিতাম লতা-পুষ্প-ঘাসে! জ্যোতির্লোক মহাসভা গগন-অঙ্গন জানাত কিরণ-সুরে নিত্য নব নব নিমন্ত্রণ! নাম-নাহি-জানা কত পাখি বাহিরের আনন্দ-সভায় – সুরে সুরে যেত মোরে ডাকি। শুনি তাহা চোখ ফেটে উছলাত জল – ভাবিতাম, কবে মোর টুটিবে শৃঙ্খল, কবে আমি ওই পাখি-সনে গাব গান, শুনিব ফুলের ভাষা অলি হয়ে চাঁপা-ফুলবনে। পথে যেত অচেনা পথিক, রুদ্ধ গবাক্ষ হতে রহিতাম মেলি আমি তৃষ্ণাতুর আঁখি নির্নিমিখ!        তাহাদের ওই পথ-চলা আমার পরানে যেন ঢালিত কী অভিনব সুর-সুধাগলা! পথ-চলা পথিকের পায়ে পায়ে লুটাত এ মন, মনে হত, চিৎকারিয়া কেঁদে কই – ‘হে পথিক, মোরে দাও ওই তব বাধামুক্ত অলস চরণ! দাও তব পথচলা পা-র মুক্তি-ছোঁয়া, গলে যাক এ পাষাণ, টুটে যাক ও-পরশে এ কঠিন লোহা!’ সন্ধ্যাবেলা দূরে বাতায়নে, জ্বলিত অচেনা দীপখানি, ছায়া তার পড়িত এ বন্ধন-কাতর দু-নয়নে!    ডাকিতাম, ‘কে তুমি অচেনা বধূ কার গৃহ-আলো? কারে ডাক দীপ-ইশারায়? কার আশে নিতি নিতি এত দীপ জ্বাল? ওগো, তব ওই দীপ সনে ভেসে আসে দুটি আঁখি-দীপ কার এ রুদ্ধ প্রাঙ্গণে!’ – এমনই সে কত মধু-কথা ভরিত আমার বদ্ধ বিজন ঘরের নীরবতা।    ওগো, বাহিরিয়া আমি হায় এ কী হেরি – ভাঙা-কারা বাহু মেলি আছে মোর সারা বিশ্ব ঘেরি! পরাধীনা অনাথিনি জননী আমার – খুলিল না দ্বার তাঁর, বুকে তাঁর তেমনই পাষাণ, পথতরুছায় কেহ ‘আয় আয় জাদু’ বলি জুড়াল না প্রাণ!    ভেবেছিনু ভাঙিলাম রাক্ষস-দেউল আজ দেখি সে দেউল জুড়ে আছে সারা মর্মমূল! ওগো, আমি চির-বন্দি আজ, মুক্তি নাই, মুক্তি নাই, মম মুক্তি নতশির আজ নতলাজ! আজ আমি অশ্রুহারা পাষাণ-প্রাণের কূলে কাঁদি – কখন জাগাবে এসে সাথি মোর ঘূর্ণি-হাওয়া রক্ত-অশ্ব উচ্ছৃঙ্খল আঁধি! বন্ধু! আজ সকলের কাছে ক্ষমা চাই – শত্রুপুরীমুক্ত আমি আপন পাষাণপুরে আজি বন্দি ভাই!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) মুক্ত-বন্দি বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর,      লঙ্ঘিলে আজি ভয়দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।           বন্দি তোমায় বন্দিবীর           জয় জয়স্তু বন্দিবীর!! অগ্রে তোমার নিনাদে শঙ্খ, পশ্চাতে কাঁদে ছয়-বছর, অম্বরে শোনো ডম্বরু বাজে–‘অগ্রসর হও, অগ্রসর!’ কারাগার ভেদি নিশ্বাস ওঠে বন্দিনী কোন্ ক্রন্দসীর, ডান-আঁখে আজ ঝলকে অগ্নি, বাম-আঁখে ঝরে অশ্রু-নীর। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডি-মুক্ত বন্দি-বীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।           বন্দি তোমায় বন্দিবীর           জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!    পথতরুছায় ডাকে ‘আয় আয়’ তব জননীর আর্ত স্বর, এ আগুন-ঘরে কাঁপিল সহসা ‘সপ্তদশ সে বৈশ্বানর’। আগমনি তব রণদুন্দুভি বাজিছে বিজয়-ভৈরবীর, জয় অবিনাশী উল্কা-পথিক চিরসৈনিক উচ্চশির। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।           বন্দি তোমায় বন্দিবীর           জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!    রুদ্ধ-প্রতাপ হে যুদ্ধবীর, আজি প্রবুদ্ধ নব বলে। ভুলো না বন্ধু, দলেছ দানব যুগে যুগে তব পদতলে! এ নহে বিদায়, পুন হবে দেখা অমর-সমর-সিন্ধুতীর, এসো বীর এসো, ললাটে এঁকে দি অশ্রুতপ্ত লাল রুধির। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দি-বীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।           বন্দি তোমায় বন্দিবীর           জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) মুক্তিকাম স্বাগত বঙ্গে মুক্তিকাম! সুপ্ত বঙ্গে জাগুক আবার লুপ্ত স্বাধীন সপ্তগ্রাম! শোনাও সাগর-জাগর সিন্ধু-ভৈরবী গান ভয়-হরণ, – এ যে রে তন্দ্রা, জেগে ওঠ তোরা, জেগে ঘুম দেওয়া নয় মরণ! সপ্ত-কোটি কু-সন্তান তোরা রাখিতে নারিলি সপ্তগ্রাম? খাসনি মায়ের বুকের রুধির? হালাল খাইয়া হলি হারাম ! মৃত্যু-ভূতকে দেখিলি রে শুধু, দেখিলি না তোরা ভবিষ্যৎ, অস্ত-আঁধার পার হয়ে আসে নিত্য প্রভাতে রবির রথ! অহোরাত্রিকে দেখেছে যাহারা সন্ধ্যাকে তারা করে না ভয়, তারা সোজা জানে রাত্রির পরে আবার প্রভাত হবে উদয়। দিন-কানা তোরা আঁধারের প্যাঁচা, দেখেছিস শুধু মৃত্যু-রাত, ওরে আঁখি খোল, দেখ তোরও দ্বারে এসেছে জীবন নব-প্রভাত! মৃত্যুর ‘ভয়’ মেরেছে তোদেরে, মৃত্যু তোদেরে মারেনি, ভাই! তোরা মরে তাই হয়েছিস ভূত, আলোকের দূত হলিনে তাই! জীবন থাকিতে ‘মরে আছি’ বলে পড়িয়া আছিস মড়া-ঘাটে, সিন্ধু-শকুন নেমেছে রে তাই তোদের প্রাণের রাজ-পাটে! রক্ত মাংস খেয়েছে তোদের, কঙ্কাল শুধু আছে বাকি, ওই হাড় নিয়ে উঠে দাঁড়া তোরা ‘আজও বেঁচে আছি’ বল ডাকি! জীবনের সাড়া যেই পাবে, ভয়ে সিন্ধু-শকুন পালাবে দূর, ওই হাড়ে হবে ইন্দ্র-বজ্র, দগ্ধ হবে রে বৃত্রাসুর! এ মৃতের দেশে, অমৃত-পুত্র, আনিবে কি সেই অমৃত-ঢল – যাতে প্রাণ পেয়ে মৃত সগরের দেশ এ বঙ্গ হবে সচল? জ্যান্তে-মরা এ ভীরুর ভারতে চাই নাকো মৃত-সঞ্জীবন, ক্লীবের জীবন-সুধা আনো, করো ভূতের ভবিষ্যৎ সৃজন!    (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) মুক্তি-বার লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার।       অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।       দিনের পরে দিন গিয়েছে, হয়নি আমার ছুটি,       বুকের ভিতর মৌন-কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি।             আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া,             লাগল চোখে তোমার চাওয়া,       তাই তো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।    তোমার তরে বুকের তলায়             অনেক দিনের অনেক কথা জমা, কানের কাছে মুখটি থুয়ে             গোপন সে সব কইব প্রিয়তমা।          এবার শুধু কথায়-গানে রাত্রি হবে ভোর,       শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর।             তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি,             মলিন মুখে ফুটবে হাসি,       হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি করুণ ছবি তার।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) মুক্তি-সেবকের গান ও ভাই  মুক্তিসেবক দল! তোদের  কোন্ ভায়ের আজ বিদায়-ব্যথায় নয়ান ছল-ছল?    ওই  কারা-ঘর তো নয় হারা-ঘর,         হোথাই মেলে মা-র-দেওয়া বর রে! ওরে  হোথাই মেলে বন্দিনী মা-র বুক-জড়ানো কোল! তবে  কীসের রোদনরোল? তোরা  মোছ রে আঁখির জল। ও ভাই  মুক্তিসেবক দল!।    আজ  কারায় যারা, তাদের তরে।        গৌরবে বুক উঠুক ভরে রে! মোরা  ওদের মতোই বেদনা ব্যথা মৃত্যু আঘাত হেসে        বরণ যেন করতে পারি মাকে ভালোবেসে। ওরে   স্বাধীনকে কে বাঁধতে পারে বল? ও ভাই  মুক্তিসেবক দল!    ও ভাই  প্রাণে যদি সত্য থাকে তোর        মরবে নিজেই মিথ্যা, ভীরু চোর। মোরা  কাঁদব না আজ যতই ব্যথায় পিষুক কলজে-তল।        মুক্তকে কি রুখতে পারে অসুর পশুর দল? মোরা  কাঁদব যেদিন আসবে তারা আবার ফিরে রে,        কাঙালিনি মায়ের আমার এই আঙিনা-তল। ও ভাই  মুক্তিসেবক দল॥    (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) মুনাজাত আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে           বাঁচাও প্রভু উদার। হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে           নীচ পাপ নাহি আর।যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,      যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,      জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-                ক্ষমা নাহি নীচতার।।ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার           হৃদয়ের পরিসর, যেন সম ঠাঁই পায়           শত্রু-মিত্র-পর।নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো      অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,      কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী                ক্ষুদ্র আত্মা তার।। মোমতাজ মোমতাজ মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল (যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম, আজো করে ঝলমল।কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহ্‌জাহানে শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন মর্মর গুঞ্জরে অবিরল।কেমনে জানিল শাহ্‌জাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়! (তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়? (যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজো অভিযোগ হানে (বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায় শীর্ণা যমুনা জল।। মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল, মোরা বিধাতার মত নির্ভয় মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।। মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন, বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন চিত্তমুক্ত শতদল।। মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর। কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর, মোরা শক্তি অটল মহীধর। হাসি গান শ্যাম উচ্ছল বৃষ্টির জল বনফল খাই- শয্যা শ্যামল বনতল।। মোহররম নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,- ‘আম্মা! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’ কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে, সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে! রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে- ‘জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?’ ‘হায় হায় হোসেনা’,  ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়, তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়! উন্ মাদ ‘দুল্ দুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়, আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়! মা ফতেমা আস্ মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ, বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস! রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা, মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা! ‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা-- ‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!’ কাঁদে কে রে কোলে ক’রে কাসিমের কাটা-শির? খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর! কেঁদে গেছে থামি’ হেথা মৃত্যু ও রুদ্র, বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র! গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা, ‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’ নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার, কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার! দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস, পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’! দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা, হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’ কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর, খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর, মা’র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্ পায়! জিভ চুষে’ কচি জান থাকে কিরে ধড়্ টায়? দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর, কাঁদে বানু-- ’পানি দাও, মরে যাদু আস্ গর!’ পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন, ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্! পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে ছিঁড়ে আনে মর্ম্মের বত্রিশ বাঁধনে! তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল, ‘দাদা ! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ্ পয়মাল!’ ‘হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার। খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার, ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার! নিঃশেষ দুষমন্; ও কে রণ-শ্রান্ত ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত? কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা! ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা! অঞ্জলি হ’তে পানি প’ড়ে গেল ঝর্-ঝর্, লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর! হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে?-- আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে। ‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে, লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে! বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্-- ‘আরশের’ পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা, ‘এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের।’ কত মোহর্ রম এলো, গেল চ’লে বহু কাল-- ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল! মুস্ লিম ! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন্’, ‘ওয়া হোসেনা-- ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন! ফিরে এলো আজ সেই মোহর্ রম মাহিনা,-- ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না! উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবীর, দুনিয়াতে নত নয় মুস্ লিম কারো শির,-- তবে শোন ঐ বাজে কোথা দামামা, শম্ শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা! বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তুর্য্য, হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য্য! জাগো ওঠ মুস্ লিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক। শহীদের দিনে সব লালে-লাল হ’য়ে যাক্! নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন, ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস্ দিন! হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের, হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের; আস্ গর সম দিব বাচ্চারে কোর্ বান, জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান! সকীনার শ্বেতবাস দেবো মাতা কন্যায়, কাসিমের মত দেবো জান রুধি’ অন্যায়! মোহর্ রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’ দেখো মরু-সূর্য্যে এ খুন যেন শোষে না!উৎস: অগ্নিবীণা মোহররম ওরে বাংলার মুসলিম, তোরা কাঁদ! এনেছে এজিদি বিদ্বেষ পুন মোহররমের চাঁদ। এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে তখ্‍তের লোভে এসেছে এজিদ কমবখ্‌তের বেশে! এসেছে ‘সীমার’, এসেছে ‘কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা, ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা! মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ, কাঁদে আশমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ। একদিকে মাতা ফতেমার বীর দুলাল হোসেনি সেনা, আর দিকে যত তখ্‌ত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা। মাঝে বহিতেছে শান্তিপ্রবাহ পুণ্য ফোরাত নদী, শান্তিবারির তৃষাতুর মোরা, ওরা থাকে তাহা রোধি! একদিকে ইসলামি ইমামের সিপাহি শান্তিব্রতী, আর একদিকে স্বার্থান্বেষী হিংসুক ক্রোধমতি! এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিল তখ্‌ত সে খলিফার, ভেঙে দিয়েছিল স্বর্ণ-সিংহাসনের যে অধিকার, মদগর্বী ও ভোগী বর্বর এজিদি ধর্মী যত, যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত। এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন, ‘আলীর’ সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান! এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায় হাসান হোসেনে গালি দিতে যেত মদিনা ও মক্কায়। এরাই আত্মপ্রতিষ্ঠা-লোভে মসজিদে মসজিদে বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে। ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙে। ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে এই ভোগীদের জুলুমে! ইহারা এজিদি মুসলমান, এরা ইসলামি সাম্যবাদেরে করিয়াছে খান খান! এক বিন্দুও প্রেম-অমৃত নাই ইহাদের বুকে, শিশু আসগরে তির হেনে হাসে পিশাচের মতো সুখে! আপনার সুখ ভোগ ও বিলাস ছাড়া জানে নাকো কিছু, একজন বড়ো হতে চায়, করে লক্ষ জনেরে নিচু।আজন্ম রহি শ্বেতমর্মর-প্রাসাদে মদবিলাসী, তখ্‌ত টলিলে বলে, ‘দরিদ্রে মোরা বড়ো ভালবাসি!’ দরিদ্রেরে ভালবেসে যার ভুঁড়ি ফেঁপে হল ধামা ঝুড়ি, শীতের দিনেও চর্বি গলিয়া পড়ে চাপকান ফুঁড়ি, যাদের চরণ পরশ করেনি কখনও ধরার ধূলি, যাহারা মানুষে করেছে ভৃত্য মুটে মজুর ও কুলি, অকল্যাণের দূত তারা আজ ভূত সেজে পথে পথে মৃত্যুর ভয়ে ফিরিতেছে নেমে সোনার প্রাসাদ হতে। সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের সাম্যবাদ যুগে যুগে এই অসুর-সেনারা করিয়াছে বরবাদ। ফোরাত নদীর স্রোত [ধারা]-সম ধনসম্পদ লয়ে দেয় নাকো পিয়াসের এক ফোঁটা পানি। নির্মম হয়ে মারে কাটে এরা বে-রহম, এরা টলে নাকো কোনোদিন, এজিদি তখ্‌ত টুটেছে বলিয়া ছুটিছে শ্রান্তিহীন। আল্লা রসুল মুখে বলে, তাঁর ক্ষমা পায়নিকো এরা, দেখেছে শুষ্ক দামেস্ক শুধু, দেখেনি কাবা ও হেরা। শোনেনি ইহারা আল-আরবির সাম্য প্রেমের বাণী।আল্লা! এরাও মুসলিম, এরা রসুলের উম্মত, কেন পায়নিকো প্রেম আর ক্ষমা শান্তি ও রহমত? ভুল পথে নিতে চায় অন্যেরে, ভুল পথে চলে, তবু এরা মোর ভাই, এদেরে জ্ঞান ও প্রেম ক্ষমা দাও প্রভু! লোভ ও অহংকার ইহাদেরে করিয়াছে অজ্ঞান, সাম্য মৈত্রী মানে না, তবুও এরা যে মুসলমান। এদের ভুলের, মিথ্যা মোহের করি শুধু প্রতিবাদ, ইহাদেরই প্রেমে কাঁদি আমি, কেন এরা হল জল্লাদ? আমাদের মাঝে যত দ্বন্দ্ব ও মন্দ হউক ভালো, আল্লা! আবার জ্বালাও প্রেমে শান্ত মধুর আলো! ভালোবাসাহীন এই পৃথিবীরে আর ভালো লাগে নাকো, আমার পরম প্রেমময় প্রভু, প্রেম দিয়ে বেঁধে রাখো! খলিফা হইয়া মুসলিম দুনিয়ার বাদশাহি করে, ভৃত্যে চড়ায়ে উটের পৃষ্ঠে নিজে চলে রশি ধরে!খোদার সৃষ্ট মানুষেরা ভালোবাসিতে পারে না যারা, জানি না কেমনে জন-গণ-নেতা হতে চায় হায় তারা! ত্যাগ করে নাকো ক্ষুধিতের তরে সঞ্চিত সম্পদ, নওয়াব বাদশা জমিদার হয়ে, চায় প্রতিষ্ঠা-মদ। ভোগের নওয়াব আমির ইহারা, ত্যাগের আমির কই? মোহররমের বিষাদ-মলিন চাঁদ পানে চেয়ে রই! মা ফাতেমা! কোন জন্নতে আছ? দুনিয়ার পানে চাহো, প্রার্থনা করো, দূর হোক ভায়ে ভায়ে বিদ্বেষ দাহ! আমাদের মাঝে যার লোভ আছে, তাহা দূর হয়ে যাক, যাহারা ভ্রান্ত, আসুক তাদের সত্যপথের ডাক। ফোরাতের পানি ধরার মরুতে শান্তিধারার মতো না, না, তোমারই মাতৃস্নেহ-রূপে বহে অবিরত। সেই পবিত্র স্নেহবন্যার দুই কূলে ভায়ে ভায়ে – হানাহানি করে! তুমি কাঁদিতেছ কোন জন্নত-ছায়ে? ফোরাতের পানি রক্তিম হল ; মা গো, বিদ্বেষ-বিষে, কারা তির হানে কাবার শান্তি মিনারের কার্নিশে? তুমি দাও মাগো ফিরদৌস হতে দুটি ফোঁটা আঁখিবারি, তব স্নেহবিগলিত অশ্রু, মা, সর্বতৃষ্ণাহারী! তুমি নবিজির নন্দিনী, নন্দন-আনন্দ দাও, আল্লার কাছে ভায়ে ভায়ে পুন মিলন-ভিক্ষা চাও! ‘সীমার’ ‘এজিদ’ সকলের তরে কেয়ামতে ক্ষমা চাবে, আজ দুনিয়ায় ভায়ে ভায়ে কী মা রবে দুশমনি ভাবে? দূর হোক এই ভাবের অভাব, ভায়ে ভায়ে এই আড়ি, সকলের ঘরে যাক আরবের খেজুর রসের হাঁড়ি! অখণ্ড এক চাঁদ আজ বুঝি দু-খণ্ড হয়ে যায়, শরিকি আসিল হায় যারা মানে লা-শরিক আল্লায়। কারবালা যেন নাহি আসে আর মোহররমের চাঁদে, তাজিয়া মিছিলে একী কাজিয়ার খেলা, দেখে প্রাণ কাঁদে শান্তি, শান্তি, আল্লা শান্তি দাও। সর্বদ্বন্দ্বাতীত তুমি, নাও তব প্রেমপথে নাও।   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) মোহান্তের মোহ-অন্তের গান [গান]             জাগো আজ দণ্ড-হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী।             ডুবাল পাপ-চণ্ডাল তোদের বাংলা দেশের কাশী।                                                জাগো বঙ্গবাসী॥ তোরা     হত্যা দিতিস যাঁর থানে, আজ সেই দেবতাই কেঁদে ওরে      তোদের দ্বারেই হত্যা দিয়ে মাগেন সহায় আপনি আসি।                                               জাগো বঙ্গবাসী॥                     মোহের যার নাইকো অন্ত                     পূজারী সেই মোহান্ত,                     মা-বোনে সর্বস্বান্ত করছে বেদী-মূলে। তোদেরে   পূজার প্রসাদ বলে খাওয়ায় পাপ-পুঁজ সে গুলে। তোরা       তীর্থে গিয়ে আসিস পাপ-ব্যভিচার রাশি রাশি।                                              জাগো বঙ্গবাসী॥                   এইসব ধর্ম-ঘাগী                   দেব্‌তায় করছে দাগী,                   মুখে কয় সর্বত্যাগী ভোগ-নরকে বসে। সে যে     পাপের ঘণ্টা বাজায় পাপী দেব-দেউলে পশে। আর        ভক্ত তোরা পূজিস তারেই যোগাস খোরাক সেবা-দাসী!                                             জাগো বঙ্গবাসী॥                 দিয়ে নিজ রক্তবিন্দু                  ভরালি পাপের সিন্ধু—                  ডুবলি তায় ডুবলি হিন্দু ডুবলি দেব্‌তারে। দেখো    ভোগের বিষ্ঠা পুড়ছে তোদের বেদীর ধূপধারে। পূজারীর  কমণ্ডলুর গঙ্গা-জলে মদের ফেনা উঠছে ভাসি।                                         জাগো বঙ্গবাসী॥                দিতে যায় পূজা-আরতি                 সতীত্ব হারায় সতী,                 পুণ্য-খাতায় ক্ষতি লেখায় ভক্তি দিয়ে, তার     ভোগ-মহলের জ্বলছে প্রদীপ তোদের পুণ্য-ঘিয়ে। তোদের ফাঁকা ভক্তির ভণ্ডামিতে মহাদেব আজ ঘোড়ার ঘাসী।                                        জাগো বঙ্গবাসী॥                তোরা সব শক্তিশালী                 বুকে নয়, মুখে খালি!                 বেড়ালকে বাছতে দিলি মাছের কাঁটা যে রে। তোরা    পূজারীকে করিস পূজা পূজার ঠাকুর ছেড়ে।            মার অসুর শোধরা সে ভুল, আদেশ দেন মা সর্বানাসী।            'জয় তারকেশ্বর' বলে পরবি রে নয় গলায় ফাঁসি।                                                জাগো বঙ্গবাসী॥ যদি আর বাঁশী না বাজে ( অভিভাষণ )বন্ধুগণ,আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রান আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে- “আমি ধন্য হলুম”, “আমি ধন্য হলুম”।আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই  দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মুর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে চুরি । হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ।মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।“ জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ। মেঘের উর্ধ্বে শূণ্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্র শোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের  অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূণ্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না, আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে! দেশপ্রেমী,ত্যাগী,বীর,বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন,টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু, তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোরো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা, পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোলো - ‘বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি’।তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না, কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না। নিশ্চল, নিশ্চুপ; আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।। যা শত্রু পরে পরে রাজ্যে যাদের সূর্য অস্ত যায় না কখনও, শুনিস হায়, মেরে মেরে যারা ভাবিছে অমর, মরিবে না কভু মৃত্যু-ঘায়,                     তাদের সন্ধ্যা ওই ঘনায়!           চেয়ে দেখ ওই ধূম্র-চূড়           অসন্তোষের মেঘ-গরুড়                     সূর্য তাদের গ্রাসিল প্রায়! ডুবেছে যে পথে রোম গ্রিক প্যারি – সেই পথে যায় অস্ত যায়                     ওদের সূর্য! – দেখবি আয়!    ২ অর্ধ পৃথিবী জুড়ে হাহাকার, মড়ক, বন্যা, মৃত্যুত্রাস, বিপ্লব, পাপ, অসূয়া, হিংসা, যুদ্ধ, শোষণ-রজ্জুপাশ,                     অনিল যাদের ক্ষুধিত গ্রাস –           তাদের সে লোভ-বহ্নি-শিখ           জ্বালায়ে জগৎ, দিগ্‌বিদিক,                     ঘিরেছে তাদেরই গৃহ, সাবাস! যে আগুনে তারা জ্বালাল ধরা তা এনেছে তাদেরই সর্বনাশ!                     আপনার গলে আপন ফাঁস!    ৩ এবার মাথায় দংশেছে সাপে, তাগা আর কোথা বাঁধবে বল? আপনার পোষা নাগিনি তাহার আপনার শিরে দিল ছোবল।                     ওঝা ডেকে আর বল কী ফল?           ঘরে আজ তার লেগেছে আগুন,           ভাগাড়ে তাহার পড়েছে শকুন,                     রে ভারতবাসী, চল রে চল! এই বেলা সবে ঘর ছেয়ে নেয়, তোরাই বসে কি রবি কেবল?                     আসে ঘনঘটা ঝড়-বাদল!৪ ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন! আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!                     ধর্ম-কলহ রাখ দুদিন!           নখ ও দন্ত থাকুক বাঁচিয়া,           গণ্ডূষ ফের করিবি কাঁচিয়া,                     আসিবে না ফিরে এই সুদিন! বদনা-গাড়ুতে কেন ঠোকাঠুকি, কাছা কোঁচা টেনে শক্তি ক্ষীণ,                     সিংহ যখন পঙ্ক-লীন।    ৫ ভায়ে ভায়ে আজ হাতাহাতি করে কাঁচা হাত যদি পাকিয়েছিস শত্রু যখন যায় পরে পরে – নিজের গণ্ডা বাগিয়ে নিস!                     ভুলে যা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব-রিষ।           কলহ করার পাইবি সময়,           এ সুযোগ দাদা হারাবার নয়! হাতে হাত রাখ, ফেল হাতিয়ার, ফেলে দে বুকের হিংসা-বিষ!                     নব-ভারতের এই আশিষ!    ৬ নারদ নারদ! জুতো উলটে দে! ঝগড়েটে ফল খুঁজিয়া আন। নখে নখ বাজা! এক চোখ দেখা! দুকাটি বাজিয়ে লাগাও গান!                     শত্রুর ঘরে ঢুকেছে বান!           ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,           রথ টেনে আন আনরে তাজিয়া,                     পূজা দেরে তোরা, দেরে কোরবান! শত্রুর গোরে গলাগলি কর আবার হিন্দু-মুসলমান!           বাজাও শঙ্খ, দাও আজান!(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) যাও যাও তুমি ফিরে যাও যাও তুমি ফিরে, এই মুছিনু আঁখি কে বাঁধিবে তোমারে, হায় বনের পাখি।মোর এত প্রেম আশা, মোর এত ভালোবাসা আজ সকলি দুরাশা, আর কি দিয়ে রাখি।এই অভিমান জ্বালা, মোর একেলারি কালা প্রান মিলনেরি মালা, দাও ধুলাতে ঢাকি।তোমার বেঁধেছিল নয়ন শুধু এ রূপের জালে তাই দু দিন কাঁদিয়া হায় সে বাঁধন ছাড়ালে।মোর বাঁধিয়াছে হিয়া, তায় ছাড়াব কি দিয়া সখা হিয়া ত নয়ন নহে সে ছাড়ে না কাঁদিয়া, দু দিন কাঁদিয়া।আজ যে ফুল প্রভাতে হায় ফুটিল শাখাতে তায় দেখিল না রাতে, সে ঝরিল নাকি।হায় রে কবি প্রবাসী, নাই হেথা সুখ হাসি ফুল ঝরে হলে বাসি, রয় কাঁটার ফাঁকি।। যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি কেন মনে রাখ তারে ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে আমি গান গাহি আপনার দুখে তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে আলেয়ার মত ডাকিও না আর নিশিথ অন্ধকারে দোয়া কর, মোরে দোয়া কর আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা শত কাঁদিলেঅ ফিরিবেনা সেই শুভ লগনের বেলা আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি তব চোখে কেন সজল মিনতী আমি কি কোনদিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে যুগান্তরের গান বলো ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ নবযুগ ওই এল ওই           এল ওই রক্ত-যুগান্তর রে। বলো জয় সত্যের জয় আসে ভৈরব-বরাভয়           শোনো অভয় ওই রথ-ঘর্ঘর রে॥ রে বধির! শোন পেতে কান ওঠে ওই কোন্ মহা-গান           হাঁকছে বিষাণ ডাকছে ভগবান রে। জগতে জাগল সাড়া জেগে ওঠ উঠে দাঁড়া           ভাঙ পাহারা মায়ার কারা-ঘর রে। যা আছে যাক না চুলায় নেমে পড় পথের ধুলায়           নিশান দুলায় ওই প্রলয়ের ঝড় রে। সে ঝড়ের ঝাপটা লেগে ভীম আবেগে উঠনু জেগে           পাষাণ ভেঙে প্রাণ-ঝরা নির্ঝর রে। ভুলেছি পর ও আপন ছিঁড়েছি ঘরের বাঁধন           স্বদেশ স্বজন স্বদেশ মোদের ঘর রে। যারা ভাই বদ্ধ কুয়ায় খেয়ে মার জীবন গোঁয়ায়           তাদের শোনাই প্রাণ-জাগা মন্তর রে। ঝড়ের ঝাঁটার ঝাণ্ডার নেড়ে মাভৈঃ-বাণীর ডঙ্কা মেরে           শঙ্কা ছেড়ে হাঁক প্রলয়ংকর রে। তোদের ওই চরণ-চাপে যেন ভাই মরণ কাঁপে,           মিথ্যা পাপের কণ্ঠ চেপে ধর রে। শোনা তোর বুক-ভরা গান, জাগা ফের দেশ-জোড়া প্রাণ,           যে বলিদান প্রাণ ও আত্মপর রে॥ মোরা ভাই বাউল চারণ, মানি না শাসন বারণ           জীবন মরণ মোদের অনুচর রে। দেখে ওই ভয়ের ফাঁসি হাসি জোর জয়ের হাসি,           অ-বিনাশী নাইকো মোদের ডর রে! গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই, মরা-প্রাণ উটকে দেখাই           ছাই-চাপা ভাই অগ্নি ভয়ংকর রে॥ খুঁড়ব কবর তুড়ব শ্মশান মড়ার হাড়ে নাচাব প্রাণ           আনব বিধান নিদান কালের বর রে। শুধু এই ভরসা রাখিস মরিসনি ভিরমি গেছিস           ওই শুনেছিস ভারত-বিধির স্বর রে। ধর হাত ওঠ রে আবার দুর্যোগের রাত্রি কাবার,           ওই হাসে মা-র মূর্তি মনোহর রে॥(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) যুগের আলো নিদ্রা-দেবীর মিনার-চুড়ে মুয়াজ্জিনের শুনছি আরাব, – পান করে নে প্রাণ-পেয়ালায় যুগের আলোর রৌদ্র-শারাব! উষায় যারা চমকে গেল তরুণ রবির রক্ত-রাগে, যুগের আলো! তাদের বলো, প্রথম উদয় এমনি লাগে! সাতরঙা ওই ইন্দ্রধনুর লাল রংটাই দেখল যারা, তাদের গাঁয়ে মেঘ নামায়ে ভুল করেছে বর্ষা-ধারা। যুগের আলোর রাঙা উদয়, ফাগুন-ফুলের আগুন-শিখা, সীমন্তে লাল সিঁদুর পরে আসছে হেসে জয়ন্তিকা!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) রক্ত-পতাকার গান ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!.... দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা           ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান!           ওড়াও ওড়াও লাল নিশান॥ শীতের শ্বাসেরে বিদ্রুপ করি ফোটে কুসুম, নব-বসন্ত-সূর্য উঠিছে টুটিয়া ঘুম, অতীতের ওই দশ-সহস্র বছরের হানো মৃত্যু-বাণ                     ওড়াও ওড়াও লাল নিশান॥    চির বসন্ত যৌবন করে ধরা শাসন, নহে পুরাতন দাসত্বের ওই বদ্ধ মন,           ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!           ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান। বসন্তের এই জ্যোতির পতাকা ওড়াও ঊর্ধ্বে                     গাহোরে গান!           লাল নিশান! লাল নিশান!(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) রক্তাম্বরধারিণী মা রক্তাম্বর পর মা এবার       জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন। দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন       বাজে তরবারি ঝনন-ঝন। সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেল মা গো       জ্বাল সেথা জ্বাল কাল্-চিতা। তোমার খড়গ-রক্ত হউক       স্রষ্টার বুকে লাল ফিতা। এলোকেশে তব দুলুক ঝন্‌ঝা       কাল-বৈশাখী ভীম তুফান, চরণ-আঘাতে উদ্গারে যেন       আহত বিশ্ব রক্ত-বান। নিশ্বাসে তব পেঁজা-তুলো সম       উড়ে যাক মা গো এই ভুবন, অ-সুরে নাশিতে হউক বিষ্ণু       চক্র মা তোর হেম-কাঁকন। টুটি টপে মারো অত্যাচারে মা,       গল-হার হোক নীল ফাঁসি, নয়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা       উঠুক সরোষে উদ্ভাসি। হাসো খলখল, দাও করতালি,       বলো হর হর শঙ্কর! আজ হতে মা গো অসহায় সম       ক্ষীণ ক্রন্দন সম্বর। মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক করো মা,       সে চাবুক করো নভ-তড়িৎ, জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে       লালে-লাল হোক শ্বেত হরিৎ। নিদ্রিত শিবে লাথি মারো আজ,       ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা, পিয়াও এবার অ-শিব গরল      নীলের সঙ্গে লাল মেশা। দেখা মা আবার দনুজ-দলনী      অশিব-নাশিনী চণ্ডি রূপ; দেখাও মা ঐ কল্যাণ-করই      আনিতে পারে কি বিনাশ-স্তূপ। শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ       রক্তাম্বরধারিণী মা, ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর       সৃষ্টির নব পূর্ণিমা। রঙ্গীলা আপনি রাধা রঙ্গীলা আপনি রাধা তারে হোরীর রং দিও না ফাগুনের রাণী যে রাই তারে রঙে রাঙিয়ো না।রাঙ্গা আবির রাঙ্গা ঠোঁটে গালে ফাগের লালী ফোটে রংসায়রে নেয়ে উঠে অঙ্গে ঝরে রঙের সোনা।অনুরাগ-রাঙা মনে রঙের খেলা ক্ষণে ক্ষণে অন্তরে যার রঙের লীলা (তারে) বাহিরে রং লাগিয়ো না।। রণ-ভেরী ওরে       আয়! ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়–                  ওরে       আয়! ঐ       ইস্‌লাম ডুবে যায়!                  যত শয়তান                  সারা ময়দান জুড়ি    খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়!           আজ   শখ করে জুতি-টক্করে তোড়ে  শহীদের খুলি দুশ্‌মন পায় পায়–                  ওরে আয়! তোর    জান যায় যাক, পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়! ধরে     ঝন্‌ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুরু মুস্‌লিম-পঞ্জায়!           তোর   মান যায় প্রাণ যায়– তবে    বাজাও বিষাণ, ওড়াও নিশান! বৃথা ভীরু সম্‌ঝায়!           রণ-       দুর্মদ রণ চায়!                 ওরে   আয়! ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!                 ওরে   আয়! ঐ       ঝননননন রণ-ঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়! শুনি     এই ঝন্‌ঝনা-ব্যঞ্জনা নেবে গঞ্জনা কে রে হায়?                 ওরে   আয়!           তোর       ভাই ম্লান চোখে চায়,                 মরি    লজ্জায়,                ওরে    সব যায়, তবু      কব্‌জায় তোর শম্‌শের নাহি কাঁপে আফ্‌সোসে হায়?                 রণ-    দুন্দুভি শুনি খুন-খুবি নাহি      নাচে কি রে তোর মরদের ওরে দিলিরের গোর্দায়?                    ওরে    আয় মোরা    দিলাবার খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায়! তারা     খিঞ্জির যারা জিঞ্জির-গলে ভূমি চুমি মূরছায়!                   আরে   দূর দূর! যত কুক্কুর আসি    শের-বব্বরে লাথি মারে ছি ছি ছাতি চড়ে! হাতি                   ঘা‌'ল হবে ফেরু-ঘায়? ঐ       ঝননননন রণঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!                  ওরে    আয়! বোলে   দ্রিম্‌ দ্রিম্ তানা দ্রিম, দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়! ঐ                    শের-নর হাঁকড়ায়–                   ওরে       আয়!                   ছোড়্   মন-দুখ,                   হোক   কন্দুক ঐ       বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক, স্পন্দুক বুক ঘা'য়!           নাচ্ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ– থৈ       তা‌ণ্ডব, আজ পাণ্ডব সম খাণ্ডব-দাহ চাই!                      ওরে       আয়! কর      কোর্‌বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই। ঐ       দীন্ দীন্-রব আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায়!                 শেল–   গর্জন                 করি     তর্জন হাঁকে, বর্জন নয় অর্জন আজ, শির তোর চায় মায়!             সব   গৌরব যায় যায়; বোলে দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!                    ওরে  আয় ! ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সাজ্জায়!                   ওরে  আয়! মুখ            ঢাকিবি কি লজ্জায়?                   হুর্        হুর্‌রে।                   কত       দূর রে    সেই    পুর রে যথা খুন-খোশ্‌রোজ খেলে হর্‌রোজ দুশ্‌মন-খুনে ভাই!              সেই   বীর-দেশে চল্ বীর-বেশে,    আজ    মুক্ত দেশে রে মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায়!                 ওরে     আয়!    বল্‌        'জয় সত্যম্ পুরুযোত্তম', ভীরু যারা মার খায়! নারী  আমাদেরি শুনি রণ-ভেরী হাসে খলখল হাত-তালি দিয়ে রণে ধায়!                 মোরা     রণ চাই রণ চাই,    তবে    বাজহ দামামা, বাঁধই আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায়!    মোরা   সত্য ন্যায়ের সৈনিক, খুন-গৈরিক বাস গা'য়।               ওরে     আয়! ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সজ্জায়!           ওরে     আয়! অব–       রুদ্ধের দ্বারে যুদ্ধের হাঁক নকিব ফুকারি যায়!          তোপ্ দ্রুম্ দ্রুম্ গান গায়!                   ওরে     আয়!ঐ     ঝননরণন খঞ্জর-ঘাত পঞ্জরে মূরছায়!                  হাঁকো হাইদার,                  নাই নাই ডর, ঐ     ভাই তোর ঘুর-চর্খীর সম খুন খেয়ে ঘুর্ খায়!                 ঝুটা  দৈত্যেরে                 নাশি  সত্যেরে দিবি    জয়-টীকা তোরা, ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায়!                ওরে     আয়! মোরা    খুন্‌-জোশি বীর, কঞ্জুশি লেখা আমাদের খুনে নাই! দিয়ে    সত্য ও ন্যায়ে বাদশাহি, মোরা জালিমের খুন খাই!           মোরা     দুর্মদ, ভর্‌পুর্ মদ খাই     ইশ্‌কের, ঘাত-শম্‌শের ফের নিই বুক নাঙ্গায়!           লাল   পল্টন মোরা সাচ্চা, মোরা    সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,          মরি   জালিমের দাঙ্গায়! মোরা অসি বুকে বরি হাসি মুখে মরি জয় স্বাধীনতা গাই!           ওরে     আয়! ঐ   মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!!——————————- শম্‌শের– তরবারি। খুন-খুবি– রক্তোন্মত্ততা দিলির– সাহসী, নির্ভীক দিলবার– প্রাণবন্তা। জিঞ্জির– শিকল শের-বববরে– সিংহ শের-নর– পুরুষসিংহ হাঁকাড়ায়– গর্জন করিতেছি কোরবান– উৎসর্গ খুন-খোশ-রোজ– রক্ত-মহোৎসব। হররোজ– প্রতিদিন আমামা – শিরস্ত্রাণ নকিব– তূর্যবাদক হাইদার– মহাবীর হজরত আলীর হাঁক খুন-জোশ– রক্ত-পাগলামি কঞ্জুশি– কৃপণতা ইশকের– প্রেমের শহীদান– Martyrs রবির জন্মতিথি রবির জন্মতিথি কয়জন জানে? অঙ্ক কষিয়া পেয়েছ কি বিজ্ঞানে? ধ্যানী যোগী দেখেছে কি? জ্ঞানী দেখিয়াছে? ঠিকুজি আছে কি কোনো জ্যোতিষীর কাছে? নাই – নাই ! কত কোটি যুগ মহাব্যোমে আলো অমৃত দিয়ে ধ্রুব রবি ভ্রমে! জানে না জানে না। উদয় ও অস্ত তাঁর সে শুধু লীলাবিলাস, গোপন বিহার। রবি কি অস্ত যায়? অন্ধ মানব রবি ডুবে গেল বলে করে কলরব। রবি শাশ্বত, তাঁর নিত্য প্রকাশ রূপ ধরি পৃথিবীতে ক্ষণিক বিলাস করিয়া চলিয়া যায় জ্যোতির্লোকে, এখনও দ্রষ্টা নেহারে তাঁর চোখে। এই সুরভির ফুল রস-ভরা ফল রবির গলিত প্রেমবৃষ্টির জল কবিতা ও গান সুর-নদী হয়ে বয় রবি যদি মরে যায় পৃথিবী কি রয়! জন্ম হয়নি যাহার জ্যোতির্লোকে, তন্দ্রা টুটেনি যাহার অন্ধ চোখে, রবির জন্মতিথি দেখেনি সে-জন আজও তার কাছে রবি অপ্রয়োজন। কবি হয়ে এল রবি এই বাংলায় দেখিল বুঝিল বলো কতজন তাঁয়? রবি দেখে পেয়েছে যে আলোক প্রথম তাঁরই মাঝে লভে রবি প্রথম জনম। নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায় অক্ষরজ্ঞান যদি সকলেই পায়, অ-ক্ষর অব্যয় রবি সেই দিন সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ। সেদিন নিত্য রবির জন্মতিথি হইবে। মানুষ দিবে তাঁরে প্রেমপ্রীতি।  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) রাখীবন্ধন সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী? নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!অল্কার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত- মন মোহিয়া চঞ্চুতে রাঙ্গা কলমীর কুঁড়ি- মরতের ভেট বহিয়া।সখীর গাঁইয়ের সেঁউতি- বোঁটার ফিরোজায় রেঙ্গে পেশোয়াজ আসমানী আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ- মাঝ।আকাশ এনেছে কুয়াশা- উড়ুনী, আসমানী- নীল- সাঁচুলী, তারকার টিপ, বিজলীর হার, দ্বিতীয় - চাঁদের হাঁসুলী।ঝরা বৃষ্টির ঝরঝর আর পাপিয়া শ্যামার কূজনে বাজে নহবত আকাশ ভূবনে- সই পাতিয়েছে দু-জনে!আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা- মেঘ ফেনা ফুল, হেথা জলে থলে কুমুদে আলুথালু ধরা বেয়াকুল। আকাশ০ গাঙ্গে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা, বিজুরীর গুণ টেনে টেনে চলে মেঘ- কুমারীরা হরষা।হেথা মেঘ পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা, জল ছুড়ে মারে মেঘ-বালা দল, বলে- 'চাহে দেখ পাজীরা!'কহিছে আকাশ, 'ওলো সই, তোর চকোরে পাঠাস নিশিথে, চাঁদ ছেনে দেবো জোছনা- অমৃত তোর ছেলে যত তৃষিতে। আমারে পাঠাস সোঁদা- সোঁদা- বাস তোর ও-মাটির সুরভি, প্রভাত ফুলের পরিমল মধু, সন্ধ্যাবেলার পুরবী!'হাসিয়া উঠিল আলোকে আকাশ, নত হ'ইয়ে এল পুলকে, লতা-পাতা-ফুলে বাঁধিয়া আকাশে ধরা কয়, 'সই, ভূলোকে বাঁধা প'লে আজ', চেপে ধরে বুকে লজ্জায় ওঠে কাঁপিয়া, চুমিল আকাশ নত হ'ইয়ে মুখে ধরণীরে বুকে ঝাঁপিয়া। রাজ-ভিখারী কোন ঘর-ছাড়া বিবাগীর বাঁশি শুনে উঠেছিল জাগি' ওগো চির-বৈরাগী! দাঁড়ালে ধুলায় তব কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি'- ওগো চির বৈরাগী।ছিলে ঘুম-ঘোরে রাজার দুলাল, জানিতে না কে সে পথের কাঙ্গাল ফেরে পথে পথে ক্ষুধাতুর-সাথে ক্ষুধার অন্ন মাগি', তুমি সুধার দেবতা 'ক্ষুধা ক্ষুধা' বলে কাঁদিয়া উঠিলে জাগি'- ওগো চির-বৈরাগী!আঙ্গিয়া তোমার নিলে বেদনার গৈরিক-রঙ্গে রেঙ্গে' মোহ ঘুমপুরো উঠিল শিহরি' চমকিয়া ঘুম ভেঙ্গে! জাগিয়া প্রভাতে হেরে পুরবাসী রাজা দ্বারে দ্বারে ফেরে উপবাসী, সোনার অঙ্গ পথের ধুলায় বেদনার দাগে দাগী! কে গো নারায়ন নবরূপে এলে নিখিল-বেদনা-ভাগী- ওগো চির-বৈরাগী!'দেহি ভবিত ভিকষাম' বলি' দাঁড়ালে রাজ-ভিখারী, খুলিল না দ্বার, পেলে না ভিক্ষা, দ্বারে দ্বারে ভয় দ্বারী! বলিলে, 'দেবে না? লহ তবে দান- ভিক্ষাপূর্ণ আমার এ প্রান!'- দিল না ভিক্ষা, নিল না ক' দান, ফিরিয়া চলিলে যোগী। যে-জীবন কেহ লইল না তাহা মৃত্যু লইল মাগি'।। রুবাইয়াত- ১০ তোমার দয়ার পেয়ালা প্রভু উপচে পড়ুক আমার'পর নিত্য ক্ষুধার অন্ন পেতে না যেন হয় পাততে কর। তোমার মদে মস্ত করো আমার 'আমি'র পাই সীমা, দুঃখে যেন শির না দুখায় অতঃপ্র, হে দুঃখহর! রুবাইয়াত- ১১ দুঃখে আমি মগ্ন প্রভু, দুয়ার খোলো করুণার! আমায় করো তোমার জ্যোতি, অন্তর মোর অন্ধকার। স্বর্গ যদি অর্জিতে হয় এতই পরিশ্রম করে- সে ত আমার পারিশ্রমিক, নয় সে দয়ার দান তোমার। রুবাইয়াত- ৯ যদিও মদ নিষিদ্ধ ভাই, যত পার মদ চালাও, তিনটি কথা স্মরণ রেখে; কাহার সাথে মদ্য খাও? মদ- পানের কি যোগ্য তুমি? কি মদই বা করেছ পান?- জ্ঞান পেকে না ঝুনো হলে মদ খেয়ো না এক ফোঁটাও। রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ১ হায় রে, আমার এ বদনসিব হ'ত যদি মনের মত! কিংবা গ্রহের চক্র ঘুরে আবার আমার বন্ধু হত! পালিয়ে যেত যৌবন মোর যখন হাতের মুঠি হ'তে, রেকাব সম রাখত ধ'রে এই জরারে সমুন্নত!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ২ তোমার হাতের সকল কাজে হবে শুভ নিরবধি- প্রিয়, তোমার ভাগ্যবশে নিয়তির এই নির্দেশ যদি; দাও তাহলে পান করে নিই তোমার দেওয়া শিরীন শরাব, হ'লেও হব চির-অমর, হয়ত ও-মদ সুধা-নদী!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৩ পরান ভরে পিয়ে শরাব, জীবন যাহা চিরকালের। মৃত্যু-জরা-ভরা জগৎ ফিরে কেহ আসবেনা ফের। ফুলের বাহার, গোলাব- কপোল, গেলাস- সাথী মস্ত-ইয়ার, এক লহমার খুশির তুফান, এইতো জীবন!- ভাবনা কিসের!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৪ চন্দ্র- সূর্য রাত্রি দিবা বিচিত্র সে আবেগ ভরে ওগো প্রিয়, দেখি- তোমার ধূলির 'পরে প্রণাম করে! হৃদয় আঁখির সাধ হতে মোর করো না গো নিরাশ মোরে, রইবে ন্দূরে- বসিয়ে আমায়, প্রতীক্ষার ঐ অগ্নি পরে? রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৫ তারি আমি বান্দা গোলাম, সৌখিন যে রস- পিয়াসী। গলায় যাহার দোলায় বিধি পাগল প্রেমের শিকলি ফাঁসি! প্রেমের এবং প্রেম জানানোর স্বাদ অ-রসিক বুঝবে কিসে? পান করে এ সুরার ধারা, সুর- লোকের রুপ- বিলাসী!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৬ রবি, শশী, জ্যোতিষ্ক সব, বান্দা তোমার, জ্যোতির্মতি! যেদিন হ'তে বান্দা হ'ল পেল আঁধার -হরা জ্যোতি! রাগে- অনুরাগে মেশা তোমার রুপের রৌশনীতে চন্দ্র হ'ল স্নিগ্ধ-কিরণ, সূর্য হল দীপ্ত অতি!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৭ আমার সকল ধ্যানে জ্ঞানে, বিচিত্র সে সুরে সুরে গাহি তোমার বন্দনা গান, রাজাধিরাজ, নিখিল জুড়ে! কী বলেছে তোমার কাছে মিথ্যা ক'রে আমার নামে হিংসুকেরা,- ডাকলে না আজ, তাইতে আমায় তোমার পুরে!! রুবাইয়াত-ই- হাফিজ- ৮ তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ, সর্বহারা নাই কো, প্রিয়! আমার চেয়ে তোমার কাছে, নাই সখি, কেউ অনাত্নীয়! তোমার বেণীর শৃংখলে গো নিত্য আমি বন্দী কেন? মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল, পিয়ে তোমার প্রেম- অমিয়!! রৌদ্রদগ্ধের গান এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রদীপ জ্বালো। আনো    অগ্নিবিহীন দীপ্তিশিখার তৃপ্তি অতল কালো।                      তিমির প্রদীপ জ্বালো।              নয়ন আমার তামস-তন্দ্রালসে               ঢুলে পড়ুক ঘুমের সবুজ রসে,          রৌদ্র-কুহুর দীপক-পাখা পড়ুক টুটুক খসে, আমার   নিদাঘদাহে অমামেঘের নীল অমিয়া ঢালো।                     তিমির প্রদীপ জ্বালো।         মেঘে ডুবাও সহস্রদল রবি-কমলদীপ, ফুটাও    আঁধার-কদম-ঘুমশাখে মোর স্বপন মণিনীপ।                 নিখিলগহন-তিমির তমাল গাছে                 কালো কালার উজল নয়ন নাচে,          আলো-রাধা যে কালোতে নিত্য মরণ-যাচে –   ওগো   আনো আমার সেই যমুনার জলবিজুলির আলো।                     তিমির প্রদীপ জ্বালো।         দিনের আলো কাঁদে আমার রাতের তিমির লাগি সেথায়    আঁধার-বাসরঘরে তোমার সোহাগ আছে জাগি।                 ম্লান করে দেয় আলোর দহন-জ্বালা                 তোমার হাতের চাঁদ-প্রদীপের থালা,          শুকিয়ে ওঠে তোমার তারা-ফুলের গগন-ডালা।   ওগো    অসিত আমার নিশীথ-নিতল শীতল কালোই ভালো।                    তিমির প্রদীপ জ্বালো। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) লক্ষীছাড়া আমি   নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন। শেষে   সে-ই আমারে কাঁদায়, যারে করি আপনারই জন।           দূর হতে মোর বাঁশির সুরে            পথিক-বালার নয়ন ঝুরে তার   ব্যথায়-ভরাট ভালোবাসায় হৃদয় পুরে গো! তারে   যেমনি টানি পরান-পুটে অমনি   সে হায় বিষিয়ে উঠে! তখন   হারিয়ে তারে কেঁদে ফিরি সঙ্গীহারা পথটি আবার নিজন।       মুগ্ধা ওদের নেই কোনো দোষ, আমিও ওগো ধরা দিয়ে মরি,        প্রেম-পিয়াসি প্রণয়ভুখা শাশ্বত যে আমিই তৃপ্তিহারা,        ঘরবাসীদের প্রাণ যে কাঁদে পরবাসীদের পথের ব্যথা স্মরি        তাইতো তারা এই উপোসির ওষ্ঠে ধরে ক্ষীরের থালা,                           শান্তিবারিধারা।          ঘরকে পথের বহ্নিঘাতে           দগ্ধ করি আমার সাথে,        লক্ষ্মী ঘরের পলায় উড়ে এই সে শনির দৃষ্টিপাতে গো!           জানি আমি লক্ষ্মীছাড়া           বারণ আমার উঠান মাড়া, আমি   তবু কেন সজল চোখে ঘরের পানে চাই?        নিজেই কি তা জানি আমি ভাই? হায়   পরকে কেন আপন করে বেদন পাওয়া, পথেই যাহার                   কাটবে জীবন বিজন? আর   কেউ হবে না আপন যখন, সব হারিয়ে চলতে হবে                     পথটি আমার নিজন। আমি   নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) লিচু চোর বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাড়া।পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না হোথা না আস্তে গিয়ে য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে গাছে গো যেই চড়েছি ছোট এক ডাল ধরেছি,ও বাবা মড়াত করে পড়েছি সরাত জোরে। পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই। ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার, ধুমাধুম গোটা দুচ্চার দিলে খুব কিল ও ঘুষি একদম জোরসে ঠুসি।আমিও বাগিয়ে থাপড় দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড় লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল, দেখি এক ভিটরে শেয়াল! ও বাবা শেয়াল কোথা ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা দেখে যেই আঁতকে ওঠা কুকুরও জাড়লে ছোটা! আমি কই কম্ম কাবার কুকুরেই করবে সাবাড়!‘বাবা গো মা গো’ বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে, যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!যাব ফের? কান মলি ভাই, চুরিতে আর যদি যাই! তবে মোর নামই মিছা! কুকুরের চামড়া খিঁচা সেকি ভাই যায় রে ভুলা- মালীর ঐ পিটুনিগুলা! কি বলিস? ফের হপ্তা! তৌবা-নাক খপ্তা! ল্যাবেন্ডিশ বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত ল্যাবেন্ডিশ* বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত (*কলকাতার এক জাতীয় সিপাহী)কোরাস্:     কে বলে মোদেরে ল্যাডাগ্যাপচার? আমরা সিভিল গাড়,                অরাজক এই ভারত-মাঠে হে আমরা উদ্‌মো ষাঁড়॥                মোরা      লাঙল জোয়াল দড়াদড়ি-ছাড়া,                            বড় সুখে তাই দিই শিং-নাড়া,                            অসহ-যোগীও করিবে না তাড়া রে— ওরে        ভয় নাই, ওরা বৈষ্ণব বাঘ, খাবে না মোদের হাড়! চলো       ব্যাং-বীর, বলো ঠ্যাং নেড়ে জোর, ছেডেডে ডেডেং হার্‌র্! কোরাস্:   কে বলে ইত্যাদি—              মোরা গলদঘর্ম যদিও গলিয়া,               বড়      বেজুত করেছে লেজুড় ডলিয়া,               তবু      গলদ করো না বলদ বলিয়া হে, মোরা       বড় দরকারি সরকারি গরু, তরকারি নহি তার! তবে        গতিক দেখিয়া অধিক না গিয়া সটান পগার পার! কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি—              আজ      গোবরগণেশ গোবরমন্ত                           ল্যাজে ও গোবরে খিঁচেন দন্ত,                           তবু করুণার নাহিকো অন্ত হে, যত          মামাদের কড়ি ধামা-ধরে দিয়া আমাদেরি ভাঙে ঘাড়! আর         বাবাদেরে বেঁধে ঠ্যাঙাতে মোরাই কেটে দি বাঁশের ঝাড়। কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি—              হয়ে       ইভিলের গুরু ডেভিল পশুর—                           সিভিল-বাহিনী, কি এত কসুর                           করেছি মাইরি? বলো তো শ্বশুর হে! ঐ           রাঙামুখে বাবা অন্ন দি তুলি নিজে খাই জোলো মাড়, তবু         সেলাম ঠুকিতে মলাম বাবা গো বক্র মাজা ও ঘাড়! কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি—               বহে        কালাতে ধলাতে গঙ্গা-যমুনা,                            আমরা তাহারি দিব্যি নমুনা,                            এ-রীতি পিরীতি বুঝিবে কভু না হে, তাই        কালামুখ প্রেমে আলা করি হাঁকি— 'তাড়্‌রে নেটিভ্ তাড়্'! তবে       কোপন-স্বভাব দেখিলে অমনি গোপন খাম্বা-আড়! কোরাস্:  কে বলে ইত্যাদি—            এবে        কাঁপিবে মেদিনী শত উৎপাতে                          চিৎপটাং সে কত 'ফুট্‌পাথে'             হবে        আমাদেরি ভীম কোঁৎকাতে হে! তবে      পরোয়া কি দাদা? ক্যাঁকড়ার সম নিসপিস নাড়ো দাঁড়, যদি       নিশ্চল হাতে পিস্তল কাঁপে তবু গোঁফে দাও চাড়। কোরাস্:   কে বলে ইত্যাদি—            বাবা!       যদিও এ-দেহ ঝুনো ঠনঠন                          তবু লোকে ভাবে ঠুঁটো পল্টন।             আরে       ঘোড়া নাই? বাস্, পায়ে হন্টন হে! বাজে     করতাল—আজ হরতাল। ডাকে আত্মা যে খাঁচা ছাড়্! ওরে      'ওয়ান্ পেস্ স্টেপ্ ফরওয়ার্ড মার্চ, থুড়ি থুড়ি ব্যাক্‌ওয়ার্ড্।' শরাবন তহুরা নার্গিস-বাগমে বাহার কী আগমে ভরা দিল দাগমে –                     কাঁহা মেরি পিয়ারা, আও আও পিয়ারা। দুরু দুরু ছাতিয়া ক্যায়সে এ রাতিয়া কাটুঁ বিনু সাথিয়া                     ঘাবরায়ে জিয়ারা, তড়পত জিয়ারা।           দরদে দিল জোর, রঙিলা কওসর           শরাবন তহুরা লাও সাকি লাও ভর, পিয়ালা তু ধর দে, মস্তানা কর দে, সব দিল ভর দে                     দরদ মে ইয়ারা – সঙ্গ দিল ইয়ারা।           জিগর কা খুন নেহি, ডরো মত সাকিয়া,           আঙ্গুরী-লোহুয়ো, - ক্যাঁও ভিঙ্গা আঁখিয়া? গিয়া পিয়া আতা নেহি মত কহো সহেলি, ছোড়ো হাত – পিয়ালা য়ো ভর দে তু পহেলি! মত মাচা গওগা, বসন্তমে বাহবা ম্যায় সে ক্যা তৌবা?                     আহা গোলনিয়ারা সখি গোলনিয়ারা – শরাব কা নূর সে রৌশন কর দে দুনিয়া আঁধিয়ারা                     দুনিয়া আঁধিয়ারা দুনিয়া আঁধিয়ারা।   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) শহীদী-ঈদ ১ শহীদের ঈদ এসেছে আজ শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,          আল্লার রাহে চাহে সে ভিখ: জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে আল্লার রাহে তাহারে দে,          চাহি না ফাঁকির মণিমানিক।            ২ চাহি নাকো গাভি দুম্বা উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট।          চাই কোরবানি, চাই না দান। রাখিতে ইজ্জত ইসলামের শির চাই তোর,তোর ছেলের,          দেবে কি? কে আছ মুসলমান?           ৩ ওরে ফাঁকিবাজ, ফেরেব-বাজ, আপনারে আর দিসনে লাজ—          গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়াব? যদিই রে তুই গরুর সাথ পার হয়ে যাস পুলসেরাত,           কি দিবি মোহাম্মদে জওয়াব!           ৪ শুধাবেন যবে— ওরে কাফের, কি করেছ তুমি ইসলামের?          ইসলামে দিয়ে জাহান্নম আপনি এসেছ বেহেশত 'পর— পুণ্য-পিশাচ! স্বার্থপর!          দেখাসনে মুখ, লাগে শরম!            ৫ গরুরে করিলে সেরাত পার, সন্তানে দিলে নরক-নার!          মায়া-দোষে ছেলে গেল দোজখ। কোরবানি দিলি গরু-ছাগল, তাদেরই জীবন হলো সফল         পেয়েছে তাহারা বেহেশ্‌ত্-লোক!           ৬ শুধু আপনারে বাঁচায় যে, মুসলিম নহে, ভণ্ড সে!         ইসলাম বলে—বাঁচো সবাই! দাও কোরবানি জান্ ও মাল, বেহেশত্ তোমার করো হালাল।         স্বার্থপরের বেহেশ্‌ত্‌ নাই।            ৭ ইসলামে তুমি দিয়ে কবর মুসলিম বলে করো ফখর!          মোনাফেক তুমি সেরা বে-দীন! ইসলামে যারা করে জবেহ্, তুমি তাহাদেরি হও তাঁবে।          তুমি জুতো-বওয়া তারি অধীন।           ৮ নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং, ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং,          ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম! কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করো জড়ো ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!           তোর নামাজের কি আছে দাম?           ৯ খেয়ে খেয়ে গোশ্‌ত্ রুটি তো খুব হয়েছ খোদার খাসি বেকুব,          নিজেদের দাও কোরবানি। বেঁচে যাবে তুমি বাঁচিবে দ্বীন, দাস ইসলাম হবে স্বাধীন,          গাহিছে কামাল এই গানই!          ১০ বাঁচায়ে আপনা ছেলে-মেয়ে জান্নাত পানে আছ চেয়ে          ভাবিছ সেরাত হবেই পার। কেননা, দিয়েছ সাতজনের তরে এক গরু! আর কি, ঢের!          সাতটি টাকায় গোনাহ্ কাবার!         ১১ জানো না কি তুমি, রে বেঈমান! আল্লা সর্বশক্তিমান          দেখিছেন তোর সব কিছু? জাব্বা-জোব্বা দিয়ে ধোঁকা দিবি আল্লারে, ওরে বোকা!          কেয়ামতে হবে মাথা নিচু!          ১২ ডুবে ইসলাম, আসে আঁধার! ইব্‌রাহিমের মতো আবার          কোরবানি দাও প্রেয় বিভব! 'জবিহুল্লাহ্' ছেলেরা হোক, যাক সব কিছু—সত্য রোক!         মা হাজেরা হোক মায়েরা সব।           ১৩ খা'বে দেখেছিলেন ইবরাহিম— 'দাও কোরবানি মহামহিম!'         তোরা যে দেখিস দিবালোকে কি যে দুর্গতি ইসলামের! পরীক্ষা নেন খোদা তোদের         হবিবের সাথে বাজি রেখে!          ১৪ যত দিন তোরা নিজেরা মেষ, ভীরু দুর্বল, অধীন দেশ—         আল্লার রাহে ততটা দিন দিও নাকো পশু কোরবানি, বিফল হবে রে সবখানি!        (তুই) পশু চেয়ে যে রে অধম হীন!         ১৫ মনের পশুরে করো জবাই, পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।        কশাই-এর আবার কোরবানি!— আমাদের নয়, তাদের ঈদ, বীর-সুত যারা হলো শহীদ,        অমর যাদের বীরবাণী।        ১৬ পশু কোরবানি দিস তখন আজাদ-মুক্ত হবি যখন        জুলম-মুক্ত হবে রে দ্বীন।— কোরবানির আজ এই যে খুন শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন,        জালিমের যেন রাখে না চিন্॥        আমিন্ রাব্বিল্ আলমিন!        আমিন রাব্বিল্ আলমিন!! শাওন আসিল ফিরে শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না।ধানী রং ঘাঘরীর মেঘ রং ওড়না পরিতে আমারে মাগো অনুরোধ কোরোনা কাজরী কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া সে কি ফেরার পথ পেল না মা পেল না?আমার বিদেশীরে খুঁজিতে অনুখন বুনোহাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মনঅথৈ জলে মাগো পথঘাট থৈথৈ আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই? কদমকেশর বলে কোথা তোর কিশোর চম্পাডালে ঝুলে শূন্য ঝুলনা। শাখ-ই-নবাত [‘শাখ-ই-নবাত’ বুলবুল-ই-শিরাজ কবি হাফিজের মানসীপ্রিয়া ছিলেন।]শাখ-ই-নবাত শাখ-ই-নবাত! মিষ্টি রসাল ‘ইক্ষু-শাখা’। বুলবুলিরে গান শেখাল তোমার আঁখি সুরমা-মাখা। বুলবুল-ই-শিরাজ হল গো হাফিজ গেয়ে তোমার স্তুতি, আদর করে ‘শাখ-ই-নবাত’ নাম দিল তাই তোমার তুতি। তার আদরের নাম নিয়ে আজ তুমি নিখিল-গরবিনি, তোমার কবির চেয়ে তোমায় কবির গানে অধিক চিনি। মধুর চেয়ে মধুরতর হল তোমার বঁধুর গীতি, তোমার রস-সুধা পিয়ে, তাহার সে-গান তোমার স্মৃতি। তোমার কবির – তোমার তুতির ঠোঁট ভিজালে শহদ দিয়ে, নিখিল হিয়া সরস হল তোমার শিরিন সে রস পিয়ে। কল্পনারই রঙিন পাখায় ইরান দেশে উড়ে চলি, অনেক শত বছর পিছের আঁকাবাঁকা অনেক গলি – তোমার সাথে প্রথম দেখা কবির যেদিন গোধূলিতে, আঙুর-খেতে গান ধরেছে, কুলায়-ভোলা বুলবুলিতে। দাঁড়িয়েছিলে একাকিনী ‘রোকনাবাদের নহর’ তীরে, রঙিন ছিল আকাশ যেন কুসুম-ভরা ডালিম-শাখা তোমার চোখের কোনায় ছিল আকাশ-ছানা কাজল আঁকা। সন্ধ্যা ছিল বন্দি তোমার খোঁপায়, বেণির বন্ধনীতে ; তরুণ হিয়ার শরম ছিল জমাট বেঁধে বুকের ভিতে! সোনার কিরণ পড়েছিল তোমার দেহের দেউল চূড়ে, ডাঁসা আঙুর ভেবে এল মউ-পিয়াসি ভ্রমর উড়ে। তিল হয়ে সে রইল বসে তোমার গালের গুলদানিতে, লহর বয়ে গেল সুখে রোকনাবাদের নীল পানিতে। চাঁদ তখনও লুকিয়ে ছিল তোমার চিবুক গালের টোলে, অস্তরবির লাগল গো রং শূন্য তোমার সিঁথির কোলে। ওপারেতে একলা তুমি নহর-তীরে লহর তোলো, এপারেতে বাজল বাঁশি, ‘এসেছি গো নয়ন খোলো!’… … … তুললে নয়ন এপার পানে – মেলল কি দল নার্গিস তার? দুটি কালো কাজল আখর – আকাশ ভুবন রঙিন বিথার! কালো দুটি চোখের তারা, দুটি আখর, নয়কো বেশি ; হয়তো ‘প্রিয়া’, কিংবা ‘বঁধু’ – তারও অধিক মেশামেশি! কী জানি কী ছিল লেখা – তরুণ ইরান-কবিই জানে, সাধা বাঁশি বেসুর বোলে সেদিন প্রথম কবির কানে। কবির সুখের দিনের রবি অস্ত গেল সেদিন হতে, ঘিরল চাঁদের স্বপন-মায়া মনের বনের কুঞ্জপথে। হয়তো তুমি শোননি আর বাঁশুরিয়ার বংশীধ্বনি, স্বপন-সম বিদায় তাহার স্বপন-সম আগমনি। রোকনাবাদের নহর নীরের সকল লহর কবির বুকে, ঢেউ তোলে গো সেদিন হতে রাত্রি দিবা গভীর দুখে। সেই যে দুটি কাজল হরফ দুটি কালো আঁখির পাতে, তাই নিয়ে সে গান রচে তার ; সুরের নেশায় বিশ্ব মাতে! অরুণ আঁখি তন্বী সাকি পাত্র এবং শারাব ভুলে, চেয়ে থাকে কবির মুখে করুণ তাহার নয়ন তুলে। শারাব হাতে সাকির কোলে শিরাজ কবির রঙিন নেশা যায় গো টুটে ক্ষণে ক্ষণে – মদ মনে হয় অশ্রু মেশা।অধর-কোণে হাসির ফালি ঈদের পহিল চাঁদের মতো – উঠেই ডুবে যায় নিমেষে, সুর যেন তার হৃদয়-ক্ষত। এপার ঘুরে কবির সে গান ফুলের বাসে দখিন হাওয়ায় কেঁদে ফিরেছিল কি গো তোমার কানন-কুঞ্জ ছায়ায়? যার তরে সে গান রচিল, তারই শোনা রইল বাকি? শুনল শুধু নিমেষ-সুখের শারাব-সাথি বে-দিল্ সাকি?শাখ-ই-নবাত! শাখ-ই-নবাত! পায়নি তুতি তোমার শাখা, উধাও হল তাইতে গো তার উদাস বাণী হতাশ-মাখা। অনেক সাকির আঁখির লেখা, অনেক শারাব পাত্র-ভরা, অনেক লালা নার্গিস গুল বুলবুলিস্তান গোলাব-ঝোরা ব্যর্থ হল, মিটল না গো শিরাজ কবির বুকের তৃষা, হয়তো আখের শাখায় ছিল সুধার সাথে বিষও মিশা! নইলে এ গান গাইত কে আর, বইত না এ সুরধুনী; তোমার হয়ে আমরা নিখিল বিরহীরা সে গান শুনি। আঙুর-লতায় গোটা আঙুর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবারি, শিরাজ-কবির সাকির শারাব রঙিন হল তাই নিঙাড়ি। তোমায় আড়াল করার ছলে সাকির লাগি যে গান রচে, তাতেই তোমায় পড়ায় মনে, শুনে সাকি অশ্রু মোছে! তোমার চেয়ে মোদের অনেক নসিব ভালো, হায় ইরানি! শুনলে নাকো তোমায় নিয়ে রচা তোমার কবির বাণী। তোমার কবির রচা গানে মোদের প্রিয়ার মান ভাঙাতে তোমার কথা পড়ে মনে, অশ্রু ঘনায় নয়ন-পাতে!ঘুমায় হাফিজ ‘হাফেজিয়া’য়, ঘুমাও তুমি নহর-পারে, দিওয়ানার সে দিওয়ান-গীতি একলা জাগে কবর-ধারে। তেমনি আজও আঙুর-খেতে গেয়ে বেড়ায় বুলবুলিরা, তুতির ঠোঁটে মিষ্টি ঠেকে তেমনি আজও চিনির সিরা। তেমনি আজও জাগে সাকি পাত্র হাতে পানশালাতে – তেমনি করে সুরমা-লেখা লেখে ডাগর নয়ন-পাতে। তেমনি যখন গুলজার হয় শারাব-খানা, ‘মুশায়েরা’, মনে পড়ে রোকনাবাদের কুটির তোমার পাহাড়-ঘেরা। গোধূলি সে লগ্ন আসে, সন্ধ্যা আসে ডালিম-ফুলি, ইরান মুলুক বিরান ঠেকে, নাই সেই গান, সেই বুলবুলি। হাফেজিয়ায় কাঁদন ওঠে আজও যেন সন্ধ্যা প্রভাত – ‘কোথায় আমার গোপন প্রিয়া কোথায় কোথায় শাখ-ই-নবাত!’ দন্তে কেটে খেজুর-মেতি আপেল-শাখায় অঙ্গ রেখে হয়তো আজও দাঁড়াও এসে পেশোয়াজে নীল আকাশ মেখে, শারাব-খানায় গজল শোনো তোমার কবির বন্দনা-গান; তেমনি করে সূর্য ডোবে, নহর- নীরে বহে তুফান। অথবা তা শোন না গো, শুনিবে না কোনো কালেই; জীবনে যে এল না তা কোনো লোকের কোথাও সে নাই!অসীম যেন জিজ্ঞাসা ওই ইরান-মরুর মরীচিকা, জ্বালনি কি শিরাজ-কবির লোকে তোমার প্রদীপ-শিখা? বিদায় সেদিন নিল কবি শূন্য শারাব পাত্র করে, নিঙ্‌ড়ে অধর দাওনি সুধা তৃষিত কবির তৃষ্ণা হরে! পাঁচশো বছর খুঁজেছে গো, তেমনি আজও খুঁজে ফিরে কবির গীতি তেমনি তোমায় রোকনাবাদের নহর-তীরে!(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) শাত-ইল-আরব শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর। শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।      যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী,      য়ুনানি, মিস্‌রি, আর্‌বি, কেনানি– লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্‌ বেদুঈন্‌দের চাঙ্গা শির!                                   নাঙ্গা-শির্– শম্‌শের হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর! শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।      'কুত-আমারা'র রক্তে ভরিয়া      দজ্‌লা এনেছে লোহুর দরিয়া;      উগারি সে খুন তোমাতে দজ্‌লা নাচে ভৈরব 'মস্তানি'র।                                                          এস্তা-নীর গর্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, –'শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখির!' দজ্‌লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।        বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা      ইরাক আজমে করেছ ধন্যা;–      বীর-প্রসূ দেশ হলো বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দমির!                                                  মর্দ বীর সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির।শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!      দুশ্‌মন্-লোহু ঈর্ষায়-নীল      তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল্, বাঁকে বাঁকে রোষে মোচড় খেয়েছ পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারির!                                                 জিন্দা বীর'জুলফিকার' আর 'হায়দরি' হাঁক হেথা আজো হজরত্ আলীর- শাতিল্-আরব!-শাতিল্-আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।      ললাটে তোমার ভাস্বর টীকা      বস্‌রা-গুলের বহ্নিতে লিখা– এ যে বসোরার খুন-খারাবি গো রক্ত-গোলাব-মঞ্জরীর!                                               খঞ্জরীর খঞ্জরে ঝরে খর্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত-শির! শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব!! পূত যুগে তোমার তীর।      ইরাক-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,–      কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী তোমারও দুঃখে 'জননী আমার!' বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!                                            রক্ত-ক্ষীর– পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর। শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!—————————– শাতিল আরব– আরব দেশের একটি নদীর নাম। দিলির– অসম সাহসী য়ুয়ানি– য়ুনান দেশের অধিবাসী মিস্‌রিা– মিশরের অধিবাসী কেনানি– কেনানের অধিবাসী চাঙ্গা– টাটকা কুত-আমারা– কুতল-আমার নামক স্থান, যেখানে জেনারেল টাউনসেন্ড বন্দী হন। শায়ক-বেঁধা পাখী রে নীড়-হারা, কচি বুকে শায়ক-বেঁধা পাখী!    কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?    কোথায় রে তোর কোথায় ব্যথা বাজে?    চোখের জলে অন্ধ আঁখি কিছুই দেখি না যে?    ওরে মাণিক! এ অভিমান আমায় নাহি সাজে- তোর       জুড়াই ব্যথা আমার ভাঙা বক্ষপুটে ঢাকি’। ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী, কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি? বক্ষে বিঁধে বিষ মাখানো শর, পথ-ভোলা রে! লুটিয়ে প’লি এ কা’র বুকের’ পর! কে চিনালে পথ তোরে হায় এই দুখিনীর ঘর? তোর       ব্যথার শানি- লুকিয়ে আছে আমার ঘরে নাকি? ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী! কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি? হায়, এ কোথায় শানি- খুঁজিস্‌ তোর? ডাক্‌ছে দেয়া. হাঁকছে হাওয়া, কাঁপছে কুটীর মোর! ঝঞ্ঝাবাতে নিবেছে দীপ, ভেঙেছে সব দোর, দুলে      দুঃখ রাতের অসীম রোদন বক্ষে থাকি’ থাকি’! ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী! এমন দিনে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি? মরণ যে বাপ বরণ করে তারে, ‘মা’ ‘মা’ ডেকে যে দাঁড়ায় এই শক্তিহীনার দ্বারে! মাণিক আমি পেয়ে শুধু হারাই বারে বারে, ওরে     তাই তো ভয়ে বক্ষ কাঁপে কখন দিবি ফাঁকি! ওরে আমার হারামণি! ওরে আমার পাখী! কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?হারিয়ে পাওয়া ওরে আমার মাণিক! দেখেই তোরে চিনেছি, আয়, বক্ষে ধরি খানিক! বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,   ওরে হারার ভয়ে ফেলতে পারে চিরকালের মা কি?    ওরে         আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!    কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি।    এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,    তুই তো আমার ন’সরে অতিথ্‌ অতীত কালের কেহ,    বারে বারে নাম হারায়ে এসেছিস এই গেহ,   এই          মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী!    প্রাণের আড়াল ক’রতে পারে সৃজন দিনের মা কি?    হারিয়ে যাওয়া? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি! শিকল পরার গান এই শিকল- পরা ছল মোদের এ শিকল- পরা ছল। এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়, ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন- ভয় এই বাঁধন প'রেই বাঁধন- ভয়কে করবো মোরা জয়, এই শিকল- বাঁধা পা নয় এ শিকল- ভাঙ্গা কল।।তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস, আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছো বিধির শক্তি হ্রাস।। সেই ভয় দেখানো ভুতের মোরা করব সর্বনাশ, এবার আনবো মাভৈঃ- বিজয়- মন্ত্র বল- হীনের বল।।তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়ঃ সেই ভয়ের টুটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়। মোরা আপনি মনে মরার দেশে আনব বরাভয়, মোরা ফাঁসি প'রে আনব হাসি মৃত্যু- জয়ের কল।।ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল- ঝঞ্চনা, এ যে মুক্ত পথের অগ্রদুরী চরণ- বন্দনা! এই লাঞ্চিতেরাই অত্যাচারকে হাঞ্ছে লাঞ্চনা, মোদের অস্থি দিয়েই জ্বল্বে দেশে আবার বজ্রানল।। শিশু যাদুকর শিশু যাদুকরকাজী নজরুল ইসলাম পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর  এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!  কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,  রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই। নবনীতে সুকোমল লাবণি লয়ে  এলি কে রে অবনীতে দিগ্বিজয়ে।  কত সে তিমির-নদী পারায়ে এলি-  নির্মল নভে তুই চাঁদ পহেলি। আমরার প্রজাপতি অন্যমনে  উড়ে এলি দূর কান্তার-কাননে।  পাখা ভরা মাখা তোর ফুল-ধরা ফাঁদ,  ঠোঁটে আলো চোখে কালো-কলঙ্কী চাঁদ!  কালো দিয়ে করি তোর আলো উজ্জ্বল-  কপালেতে টিপ দিয়ে নয়নে কাজল। তারা-যুঁই এই ভুঁই আসিলি যবে,  একটি তারা কি কম পড়িল নভে?  বনে কি পড়িল কম একটি কুসুম?  ধরণীর কোলে এলি একরাশ চুম। স্বরগের সব-কিছু চুরি করে, চোর,  পলাইয়া এলি এই পৃথিবীর ক্রোড়!  তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক,  তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরুক। শীতের সিন্ধু ভুলি নাই পুনঃ তাই আসিয়াছি ফিরে ওগো বন্ধু, ওগো প্রিয়, তব সেই তীরে! কূল-হারা কূলে তব নিমেষের লাগি খেলিতে আসিয়া হায় যে কবি বিবাগি সকলই হারায়ে গেল তব বালুচরে, – ঝিনুক কুড়াতে এসে – গেল আঁখি ভরে তব লোনা জল লয়ে, –তব স্রোত-টানে ভাসিয়া যে গেল দূর নিরুদ্দেশে পানে! ফিরে সে এসেছে আজ বহু বর্ষ পরে, চিনিতে পার কি বন্ধু, মনে তারে পড়ে?বর্ষার জোয়ারে যারে তব হিন্দোলায় দোলাইয়া ফেলে দিলে দুরাশা-সীমায়, ফিরিয়া সে আসিয়াছে তব ভাটি-মুখে, টানিয়া লবে কি আজ তারে তব বুকে?খেলিতে আসিনি বন্ধু, এসেছি এবার দেখিতে তোমার রূপ বিরহ-বিথার। সেবার আসিয়াছিনু হয়ে কুতূহলী, বলিতে আসিয়া – দিনু আপনারে বলিকৃপণের সম আজ আসিয়াছি ফিরে হারায়েছি মণি যথা সেই সিন্ধু-তীরে! ফেরে না তা যা হারায় – মণি-হারা ফণী তবু ফিরে ফিরে আসে! বন্ধু গো, তেমনি হয়তো এসেছি বৃথা চোর বালুচরে!– যে চিতা জ্বলিয়া, –যায় নিভে চিরতরে, পোড়া মানুষের মন সে মহাশ্মাশানে তবু ঘুরে মরে কেন, –কেন সে কে জানে! প্রভাতে ঢাকিয়া আসি কবরের তলে তারি লাগি আধ-রাতে অভিসারে চলে অবুঝ মানুষ, হায়! – ওগো উদাসীন, সে বেদনা বুঝবে না তুমি কোনোদিন!হয়তো হারানো মণি ফিরে তারা পায়, কিন্তু হায়, যে অভাগা হৃদয় হারায় হারায়ে সে চিরতরে! এ জনমে তার দিশা নাহি মিলে, বন্ধু! – তুমি পারাবার, পারাপার নাহি তব, তোমার অতলে যা ডোবে তা চিরতরে ডোবে আঁখিজলে!‌ জানিলে সাঁতার, বন্ধু, হইলে ডুবুরি, করিতাম কবে তব বক্ষ হতে চুরি রত্নহার! কিন্তু হায় জিনে শুধু মালা কী হইবে বাড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা! বন্ধু, তব রত্নহার মোর তরে নয় – মালার সহিত যদি না মেলে হৃদয়!হে উদাসী বন্ধু মোর, চির আত্মভোলা, আজি নাই বুকে তব বর্ষার হিন্দোলা! শীতের কুহেলি-ঢাকা বিষণ্ণ বয়ানে কীসের করুণা মাখা! কূলের সিথানে এলায়ে শিথিল দেহ আছ একা শুয়ে, বিশীর্ণ কপোল বালু-উপাধানে থুয়ে! তোমার কলঙ্কী বঁধু চাঁদ ডুবে যায় তেমনই উঠিয়া দূর গগন-সীমায়, ছায়া এসে পড়ে তার তোমার মুকুরে, কায়াহীন মায়াবীর মায়া বুকে পূরে ফুলে ফুলে কূলে কূলে কাঁদ অভিমানে, আছাড়ি তরঙ্গ-বাহু ব্যর্থ শূন্য পানে! যে কলঙ্কী নিশিদিন ধায় শূন্য পথে – সে দেখে না, কোথা, কোন বাতায়ন হতে, কে তারে চাহিয়াছে নিতি! সে খুঁজে বেড়ায় বুকের প্রিয়ারে ত্যজি পথের প্রিয়ায়!ভয় নাই বন্ধু ওগো, আসিনি জানিতে অন্ত তব, পেতে ঠাঁই অন্তহীন চিতে! চাঁদ না সে চিতা জ্বলে তব উপকূলে – কে কবে ডুবিয়া হায়, পাইয়াছে তল? এক ভাগ থল সেথা, তিন ভাগ জল!এসেছি দেখিতে তারে সেদিন বর্ষায় খেলিতে দেখেছি যারে উদ্দাম লীলায় বিচিত্র তরঙ্গ-ভঙ্গে! সেদিন শ্রাবণে ছলছল জল-চুড়ি-বলয়-কঙ্কণে শুনিয়াছি যে-সঙ্গীত, যার তালে তালে নেচেছে বিজলি মেঘে, শিখী নীপ-ডালে। যার লোভে অতি দূর অস্তদেশ হতে ছুটে এসেছিনু এই উদয়ের পথে! –ওগো মোর লীলা-সাথি অতীত বর্ষার, আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার! চলে গেছে আজি সেই বরষার মেঘ, আকাশের চোখে নাই অশ্রুর উদ‍্‍বেগ, গরজে না গুর গুর গগনে সে বাজ, উড়ে গেছে দূর বনে ময়ূরীরা আজ, রোয়ে রোয়ে বহে নাকো পুবালি বাতাস, শ্বসে না ঝাউয়ের শাখে সেই দীর্ঘশ্বাস, নাই সেই চেয়ে-থাকা বাতায়ন খুলি সেই পথে – মেঘ যথা যায় পথ ভুলি। না মানিয়া কাজলের ছলনা নিষেধ চোখ ছেপে জল ঝরা, –কপোলের স্বেদ মুছিবার ছলে আঁখি-জল মোছা সেই, নেই বন্ধু, আজি তার স্মৃতিও সে নেই!থর থর কাঁপে আজ শীতের বাতাস, সেদিন আশার ছিল যে দীরঘ-শ্বাস – আজ তাহা নিরাশায় কেঁদে বলে, হায় – “ওরে মূঢ়, যে চায় সে চিরতরে যায়! যাহারে রাখিবি তুই অন্তরের তলে সে যদি হারায় কভু সাগরের জলে কে তাহারে ফিরে পায়? নাই, ওরে নাই, অকূলের কূলে তারে খুঁজিস বৃথাই! যে-ফুল ফোটেনি ওরে তোর উপবনে পুবালি হাওয়ার শ্বাসে বরষা-কাঁদনে, সে ফুল ফুটিবে না রে আজ শীত-রাতে দু ফোঁটা শিশির আর অশ্রুজল-পাতে!”আমার সান্ত্বনা নাই জানি বন্ধু জানি, শুনিতে এসেছি তবু – যদি কানাকানি হয় তব কূলে কূলে আমার সে ডাক!এ কূলে বিরহ-রাতে কাঁদে চক্রবাক, ও কূলে শোনে কি তাহা চক্রবাকী তার? এ বিরহ একি শুধু বিরহ একার?কুহেলি-গুণ্ঠন টানি শীতের নিশীথে ঘুমাও একাকী যবে, নিশব্দ সংগীতে ভরে ওঠে দশ দিক, সে নিশীথে জাগি ব্যথিয়া ওঠে না বুক কভু কাও লাগি? গুণ্ঠন খুলিয়া কভু সেই আধরাতে ফিরিয়া চাহ না তব কূলে কল্পনাতে? চাঁদ সে তো আকাশের, এই ধরা-কূলে যে চাহে তোমায় তারে চাহ না কি ভুলে?তব তীরে অগস্ত্যের সম লয়ে তৃষা বসে আছি, চলে যায় কত দিবা-নিশা! যাহারে করিতে পারি চুমুকেতে পান তার পদতলে বসি গাহি শুধু গান! জানি বন্ধু, এ ধরার মৃৎপাত্রখানি ভরিতে নারিল যাহা – তারে আমি আনি ধরিব না এ অধরে! এ মম হিয়ার বিপুল শূন্যতা তাহে নহে ভরিবার! আসিয়াছি কূলে আজ, কাল প্রাতে ঝুরে কূল ছাড়ি চলে যাব দূরে বহুদূরে।বলো বন্ধু, বলো, জয় বেদনার জয়! যে-বিরহে কূলে কূলে নাহি পরিচয়, কেবলই অনন্ত জল অনন্ত বিচ্ছেদ, হৃদয় কেবলই হানে হৃদয়ে নিষেধ ; যে-বিরহে গ্রহ-তারা শূন্যে নিশিদিন ঘুরে মরে ; গৃহবাসী হয়ে উদাসীন – উল্কা-সম ছুটে যায় অসীমের পথে, ছোটে নদী দিশাহারা গিরিচূড়া হতে ; বারে বারে ফোটে ফুল কণ্টক-শাখায়, বারে বারে ছিঁড়ে যায় তবু না ফুরায় মালা-গাঁথা যে-বিরহে, যে-বিরহে জাগে চকোরী আকাশে আর কুমুদী তড়াগে ; তব বুকে লাগে নিতি জোয়ারের টান, যে-বিষ পিইয়া কণ্ঠে ফুটে ওঠে গান – বন্ধু, তার জয় হোক! এই দুঃখ চাহি হয়তো আসিব পুনঃ তব কূল বাহি। হেরিব নতুন রূপে তোমারে আবার, গাহিব নতুন গান। নব অশ্রুহার গাঁথিব গোপনে বসি। নয়নের ঝারি বোঝাই করিয়া দিব তব তীরে ডারি। হয়তো বসন্তে পুনঃ তব তীরে তীরে ফুটিবে মঞ্জরি নব শুষ্ক তরু-শিরে। আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি, আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,যেদিন ও বুকে তব শুকাইবে জল, নিদারুণ রৌদ্র-দাহে ধুধু মরুতল পুড়িবে একাকী তুমি মরূদ্যান হয়ে আসবি সেদিন বন্ধু, মম প্রেম লয়ে! আঁখির দিগন্তে মোর কুহেলি ঘনায়, বিদায়ের বংশী বাজে, বন্ধু গো বিদায়!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয় শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়। তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়। তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ কেঁদে নদী হলো করুণ বিষাদ ডাকে আয় তীরে আয়।। আকাশে মেলিয়া শত শত কর খোঁজে তোরে তরু ওরে সুন্দর তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড় লুটায় লতা ধূলায়। তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল আবার ফুটিবে বন ফুল দল ধূসর আকাশ হইবে সুনীল তোর চোখের চাওয়ায়।। শেষ বাণী ভালো আছি ছিলাম এবং ভালোই আমি আছি; হৃদয়-পদ্মে মধু পেল মনের মৌমাছি। শেষের গান আমার   বিদায়-রথের চাকার ধ্বনি ওই গো এবার কানে আসে।        পুবের হাওয়া তাই কেঁদে যায় ঝাউয়ের বনে দিঘল শ্বাসে।              ব্যথায় বিবশ গুলঞ্চ ফুল              মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল,          মাটির মায়ের কোলের মায়া ওগো আমার প্রাণ উদাসে।       অঙ্গ আসে অলস হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে,          স্বপনপারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁয়া যায় নয়ন চুমে।            হাতছানি দেয় অনাগতা,              আকাশ-ডোবা বিদায়-ব্যথা          লুটায় আমার ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন-ত্রাসে।       মোর বেদনার কপূর্রবাস ভরপুর আজ দিগ্‌বলয়ে,          বনের আঁধার লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।              হারিয়ে পাওয়া মানসী হায়              নয়নজলে শয়ন তিতায়,          ওগো, এ কোন্ জাদুর মায়ায় দু-চোখ আমার জলে ভাসে। আজ    আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন পায়ের আসা-যাওয়ার,        তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার অনেক দাবি-দাওয়ার।              আজ কেহ নাই পথের সাথি,              সামনে শুধু নিবিড় রাতি, আমায়   দূরের বাঁশি ডাক দিয়েছে, রাখবে কে আর বাঁধন-পাশে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) শেষের ডাক মরণ-রথের চাকার ধ্বনি ওই রে আমার কানে আসে। পুবের হাওয়া তাই নেমেছে পারুল বনে দীঘল শ্বাসে।                     ব্যথার কুসুম গুলঞ্চ ফুল                     মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল, গোরস্থানের মাটির বাসে তাই আমার আজ প্রাণ উদাসে। অঙ্গ আসে অবশ হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে সাগর-পারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁওয়া যার নয়ন চুমে।                     হৃদয়-কাঁদা নিদয় কথা                     আকাশ-ভেজা বিদায়-ব্যথা           লুটায় গো মোর ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন ত্রাসে।           মোর কাফনের কর্পূর-বাস ভরপুর আজ দিগবলয়ে,           বনের শাখা লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।                     ফিরে-পাওয়া লক্ষ্মী বৃথাই                     নয়ন-জলে বক্ষ তিতায় ওগো       এ কোন্ জাদুর মায়ায় আমার দু-চোখ শুধু জলে ভাসে। আজ       আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন কাদের আসা যাওয়ার,           তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার সকল দাবি দাওয়ার।                     আজ কেহ নাই পথের সাথি,                     সামনে শুধু নিবিড় রাতি আমায় দূরের মানুষ ডাক দিয়েছে রাখবে কে আর বাঁধন পাশে।   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) শোধ করো ঋণ আগুন জ্বলে না মাসে কতদিন হায় ক্ষুধিতের ঘরে, ক্ষুধার আগুনে জ্বলে কত প্রাণ তিলে তিলে যায় মরে। বোঝে না ধনিক, হোক সে হিন্দু হোক সে মুসলমান, আল্লা যাদের নিয়ামত দেন, পাষাণ তাদের প্রাণ!কত ক্ষুধাতুর শিশুর রসনা খুদকণা নাহি পায়, মা-র বুক ছেড়ে গোরস্তানের মাটিতে গিয়া ঘুমায়। যত দৌলত হাশমতওয়ালা হেরে তাহা পাশে থেকে, আতর মাখিয়া পাথরের দল যেন ছায়াছবি দেখে!ভেবেছে এমনই নিজে খেয়ে দেয়ে হইয়া খোদার খাসি দিন কেটে যাবে! এ সুখের দিন কভু হবে নাকো বাসি। জগতের লোভী মরিতেছে আজ আল্লার অভিশাপে, তবুও লোভের কাঁথা জড়াইয়া লোভী সব নিশি যাপে!একটা খাসিরে ধরিয়া যখন জবাই করে কশাই, আর একটা খাসি তখনও দিব্যি পাতা খায়, ভয় নাই। ভেবেছ ওদেশে হতেছে শাস্তি, তোমাদের হইবে না, তাই শোধ করিলে না আজও সেই পরম দানীর দেনা।আর ক-টা দিন বেঁচে থাকো, যাঁর ঋণ করিয়াছ, তিনি তোমাদের প্রাণ দৌলত নিয়ে খেলবেন ছিনিমিনি। কী ভীষণ মার খাইবে সেদিন, বোঝ না অন্ধ জীব, তোমাদের হাড়ে ভেলকি খেলিবে সেদিন এই গরিব।বেতন চাহিলে শুনিতে পায় না, মনিবের রাগ হয়, ‘তিনদিন হাঁড়ি চড়েনিকো’ শুনে ভাবে একী কথা কয়! ঘরের পার্শ্বে লেগেছে আগুন, বোঝে না স্বার্থপর, আর দেরি নাই, পুড়িয়া যাইবে তাহারও সোনার ঘর।বঞ্চিত রেখে দরিদ্রে, যারা করিয়াছে সঞ্চয়, দেখিবে এবার, তার সঞ্চয় তার অধিকারে নয়। অর্থের ফাঁদ পেতে দস্যুরে ডাকিয়া আনিছে যারা তাহারাই আগে মরিবে, ভীষণ শাস্তি পাইবে তারা।উপবাস যার দিনের সাধনা, নিশীথে শয়নসাথি, যাহারা বাহিরে গাছতলে থাকে, ঘরে জ্বলে নাকো বাতি, তাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতা কি পাবে না পুরস্কার? তারা তিলে তিলে মরে আনিয়াছে এবার খোদার মার!তাদেরই করুণ মৃত্যু এনেছে ভয়াল মৃত্যু ডাকি, তাদের আত্মা শান্তি পাইবে ভোগীর রক্ত মাখি। মানুষের মার নয় এ রে দাদা, এ যে আল্লার মার, এর ক্ষমা নাই, এ নয় ধরার ভাঁড়ামি রাজবিচার।উৎপীড়ক আর ভোগীদের আসিয়াছে রোজ-কিয়ামত ধূলি-রেণু হয়ে উড়ে যাবে সব ইহাদের নিয়ামত। এদেরই হাতের অস্ত্র কাটিবে এদেরই স্কন্ধ, শির, ইহারা মরিলে দুনিয়া হইবে স্নিগ্ধ, শান্ত, স্থির।বাক্সের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ ফ্যাকাশে হয়েছে বুঝি! বাক্স ও চাবি নেবে না উহারা, কেড়ে নেবে শুধু পুঁজি। খাবি খায় তবু চাবি ছাড়ে নাকো! উৎকট প্রলোভন মরে না কিছুতে, আত্মঘাতী তা না হয় যতক্ষণ!আমরা গরিব, শুকায়ে হয়েছি চামড়ার আমচুর, খামচে ধরেছে মাংসওয়ালারে ক্ষুধিত বুনো কুকুর। কোন বন থেকে কে জানে এসেছে নেকড়ে বাঘের দল, আমাদের ভয় নাই, আমাদের নাইকো গোরু-ছাগল।সামলাও মাল মালওয়ালা, দেখো পয়মাল হবে সব, ঊর্ধ্বে নিত্য শুনিতেছ নাকি শকুনের কলরব? ধূমকেতু নয়, কোন মেথরানি হাতে মুড়ো ঝ্যাঁটা লয়ে এসেছে আকাশে; পৃথিবী উঠেছে ভীষণ নোংরা হয়ে!নোংরা, লোভী ও ভোগী রহিবে না শুদ্ধ এ পৃথিবীতে, এ আবর্জনা পুড়ে ছাই হবে নরকের চুল্লিতে। আসিছে ফিরিয়া এই বাংলায় কাঙালের শুভদিন, আজিও সময় আছে ধনী, শোধ করো তাহাদের ঋণ!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) সংকল্প থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,- কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে। দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে, কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে, কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে, কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বর্গ পানে। জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি, কেমন করে আনছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে, কেমন জোরে টানলে সাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে, কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালযয়ের চুড়ে। তুহিন মেরু পার হয়ে যায় সন্ধানীরা কিসের আশায়; হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর ঐ চীনের জাতি এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি। আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি! কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে- আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে। আমার সীমার বাঁধন টুটে দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।। সই ভালো করে বিনোদ-বেণী সই, ভালো করে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী-ফাঁদে।সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ-কাঁটায় রাখিব খোঁপার সাথে বিঁধিয়া লো তায় তাহে রেশমী জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে।বাঁধিতে সে বাঁধন হারা বনের হরিণ জড়ায়ে দে জরীন্‌ ফিতা মোহন ছাঁদেপ্রথম প্রণয় রাগের মত আল্‌তা রঙে রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনি ঢঙে সই পায়ে ধরে বঁধু যেন আমারে সাধে।। সকল পথের বন্ধু হে আনন্দ-প্রেম-রসঘন, মধুরম, মনোহর! একী মদিরার আবেশে নেশায় কাঁপে তনু থরথর! হৃদি-পদ্মিনী নিঙাড়িয়া বঁধু – আনিতে চাও কি অমৃতমধু, উদাসীন মনে আন একী সুরভিত বন-মর্মর! ঘন অরণ্য-আড়ালে কে হাস প্রিয় জ্যোতিসুন্দর!কৃষ্ণা তিথির আড়ালে আমার চাঁদ লুকাইয়াছিলে! আমি ভেবেছিনু, আমি কালো, তুমি তাই প্রেম নাহি দিলে। বুঝি নাই, রসময়, তব খেলা ভয় হত, যদি কর অবহেলা। বেণুকা বাজায়ে পথে এনে হায় কোথা তুমি লুকাইলে? দেখেছ কি দেহে কাদা, অন্তরে রাধারে নাহি দেখিলে?তব অভিসার-পথ রুধিয়াছে কে যেন ভয়ংকর! দিগ্‌দিগন্তে অন্ধ করেছে বাধার তুফান ঝড়। সীতার মতন কে যেন গো কেশ ধরে আঁধার পাতালে লইয়া গিয়াছে মোরে। জড়াইয়া যেন শত শত নাগ বিষাক্ত অজগর দংশেছে মোরে, বিষে জরজর! – তবু, ওগো মনোহর –ডাকিনি তোমায়, যদি এই বিষ তব শ্রীঅঙ্গে লাগে! এই পঙ্ক, এ মালিন্য যদি বাধা আনে অনুরাগে। বলেছি, ‘বন্ধু, সরে যাও, সরে যাও, আমার এ ক্লেশে আমারে কাঁদিতে দাও।’ আমার দুখ ‘লু’ হাওয়ার জ্বালা না আনে গোলাপ-বাগে! ক্ষমা কোরো মোরে, ভুল বুঝিয়ো না, যদি অভিমান জাগে!জানি তুমি মোরে জড়ায়ে ধরেছ প্রকাশ-ব্রহ্মরূপে, আমার বক্ষে চেতনানন্দ হয়ে কাঁদ চুপে চুপে! হৃদি-শতদল কাঁপে মোর টলমল, মোর চোখে ঝরে তোমার অশ্রুজল! বক্ষে জড়ায়ে আন প্রেমলোকে, নামিয়া অন্ধকূপে, অমৃত স্বরূপে হে প্রিয়তম আনন্দ-স্বরূপে!আঁধারে আলোকে যখন যে পথ টানে, তুমি থাক কাছে। অরণ্যপথে তব আনন্দ কুরঙ্গ হয়ে নাচে! আমার তীর্থ-মরুপথে ছায়া হয়ে সাথে সাথে চলো আঙুরের রস লয়ে, পথের বালুকা পাখির পালক ফুল হয়ে ফুটিয়াছে! চোখে জল, বুকে মধু বলে – ‘বঁধু, আছে আছে, সাথে আছে!’   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে বিষাণ ত্রিশূল ফেলি গভীর বিষাদে জটাজুটে গঙ্গা নিস্তরঙ্গা রাহু যেন গ্রাসিয়াছে ললাটের চাঁদে।দুই করে দেবী-দেহ ধরে বুকে বাঁধে রোদনের সুর বাজে প্রণব নিনাদে ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর সুন্দরতর হল পড়ি মায়া ফাঁদে।। সত্য-কবি অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য যে গেল চ’লে বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ’লে। যে-ভোরের তারা অরুণ-রবির উদয়-তোরণ-দোরে ঘোষিল বিজয়-কিরণ-শঙ্খ-আবার প্রথম ভোরে, রবির ললাট চুম্বিল যার প্রথম রশ্মি-টীকা, বাদলের বায়ে নিভে গেল হায় দীপ্ত তাহারি শিখা! মধ্য গগনে স্তব্ধ নিশীথ, বিশ্ব চেতন-হারা, নিবিড় তিমির, আকাশ ভাঙিয়া ঝরিছে আকুল-ধারা গ্রহ শশী তারা কেউ জেগে নাই, নিভে গেছে সব বাতি, হাঁক দিয়া ফেরে ঝড়- তুফানের উতরোল মাতামাতি!হেন দুর্দিনে বেদনা-শিখার বিজলি-প্রদীপ জ্বেলে কাহারে খুঁজিতে কে তুমি নিশীথ-গগন-আঙনে এলে? বারে বারে তব দীপ নিভে যায়, জ্বালো তুমি বারে বারে, কাঁদন তোমার সে যেন বিশ্বপিতারে চাবুক মারে! কি ধন খুঁজিছ? কে তুমি সুনীল মেঘ-অবগন্ঠিতা? তুমি কি গো সেই সবুজ শিখার কবির দীপাম্বীতা? কি নেবে গো আর? ঐ নিয়ে যাও চিতার দু-মুঠো ছাই! ডাক দিয়ো না ক’, মূর্ছিতা মাতা ধুলায় পড়িয়া আছে, ডাক দিয়ো না ক’, শূন্য এ ঘর, নাই গো সে আর নাই, গঙ্গা-সলিলে ভাসিয়া গিয়াছে তাহার চিতার ছাই! আসিলে তড়িৎ-তাঞ্জামে কে গো নভোতলে তুমি সতী? সত্য-কবির সত্য জননী ছন্দ-সরত্বতী? ঝলসিয়া গেছে দু’চোখ মা তার তোরে নিশিদিন ডাকি’, বিদায়ের দিনে কন্ঠের তার গানটি গিয়াছে রাখি’ সাত কোটি এই ভগ্ন কন্ঠে; অবশেষে অভিমানী ভর-দুপুরেই খেলা ফেলে গেল কাঁদায়ে নিখিল প্রাণী! ডাকিছ কাহারে আকাশ-পানে ও ব্যাকুল দু’হাত তুলে? কোল মিলেছে মা, শ্মশান-চিতায় ঐ ভাগীরথী-কূলে!ভোরের তারা এ ভাবিয়া পথিক শুধায় সাঁঝের তারায়, কাল যে আছিল মধ্য গগনে আজি সে কোথায় হারায়? সাঁঝের তারা সে দিগন্তের কোলে ম্লান চোখে চায়, অস্ত-তোরণ-পার সে দেখায় কিরণের ইশারায়। মেঘ-তাঞ্জাম চলে কার আর যায় কেঁদে যায় দেয়া, পরপার-পারাপারে বাঁধা কার কেতকী-পাতার খেয়া? হুতাশিয়া ফেরে পূরবীর বায়ু হরিৎ-হুরীর দেশে জর্দা-পরীর কনক-কেশর কদম্ব-বন-শেষে! প্রলাপ প্রলাপ প্রলাপ করি সে আসিবে না আর ফিরে, ক্রন্দন শুধু কাঁদিয়া ফিরিবে গঙ্গার তীরে তীরে! ‘তুলির লিখন’ লেখা যে এখনো অরুণ-রক্ত-রাগে, ফুল্ল হাসিছে ‘ফুলের ফসল’ শ্যামার সবজি-বাগে, আজিও ‘তীর্থরেণু ও সলিলে’ ‘মণি-মঞ্জুষা’ ভরা, ‘বেণু-বীণা’ আর ‘কুহু-কেকা’-রবে আজো শিহরায় ধরা, জ্বলিয়া উঠিল ‘ অভ্র-আবির’ ফাগুয়ায় ‘হোম শিখা’,- বহ্নি-বাসরে টিট্‌কারি দিয়ে হাসিল ‘হোমন্তিকা’- এত সব যার প্রাণ-উৎসব সেই আজ শুধু নাই, সত্য-প্রাণ সে রহিল অমর,মায়া যাহা হ’ল ছাই! ভুল যাহা ছিল ভেঙে গেল মহাশূন্যে মিলালো ফাঁকা, সৃজন-দিনের সত্য যে, সে-ই রয়ে গেল চির-আঁকা!উন্নতশির কালজয়ী মহাকাল হ’য়ে জোড়পাণি স্কন্ধে বিজয়-পতাকা তাহারি ফিরিবে আদেশ মানি! আপনারে সে যে ব্যাপিয়া রেখেছে আপন সৃষ্টি-মাঝে, খেয়ালী বিধির ডাক এল তাই চ’লে গেল আন্‌-কাজে। ওগো যুগে যুগে কবি, ও-মরণে মরেনি তোমার প্রাণ, কবির কন্ঠে প্রকাশ সত্য-সুন্দর ভগবান। ধরায় যে বাণী ধরা নাহি দিল, যে-গান রহিল বাকী আবার আসিবে পূর্ণ করিতে, সত্য সে নহে ফাঁকি! সব বুঝি ওগো, হারা-ভীতু মোরা তবু ভাবি শুধু ভাবি, হয়ত যা গেল চিরকাল তরে হারানু তাহার দাবি।তাই ভাবি,আজ যে শ্যামার শিস খঞ্জন-নর্তন থেমে গেল, তাহা মাতাইবে পুনৎ কোন্‌ নন্দন-বন! চোখে জল আসে, হে কবি-পাবক, হেন অসময়ে গেলে যখন এ-দেশে তোমারি মতন দরকার শত ছেলে। আষাঢ়-রবির তেজোপ্রদীপ্ত তুমি ধূমকেতু-জ্বালা, শিরে মণি-হার, কন্ঠে ত্রিশিরা ফণি-মনসার মালা, তড়িৎ-চাবুক করে ধরি’ তুমি আসিলে হে নির্ভীক, মরণ-শয়নে চমকি’ চাহিল বাঙালী নির্নিমিখ। বাঁশীতে তোমার বিষাণ-মন্দ্র রণরণি/ ওঠে জয় মানুষের জয়, বিশ্বে দেবতা দৈত্য সে বড় নয়!করোনি বরণ দাসত্ব তুমি আত্ম-অসম্মান, নোয়ায়নি মাথা, চির জাগ্রত ধ্রুব তব ভগবান, সত্য তোমার পর-পদানত হয়নি ক’ কভু, তাই বলদর্পীর দন্ড তোমায় স্পর্শিতে পারে নাই! যশ-লোভী এই অন্ধ ভন্ড সজ্ঞান ভীরু-দলে তুমিই একাকী রণ-দুন্দুভি বাজালে গভীর রোলে। মেকীর বাজারে আমরণ তুমি র’য়ে গেলে কবি খাঁটি, মাটির এ-দেহ মাটি হ’ল, তব সত্য হ’ল না মাটি। আঘাত না খেলে জাগে না যে-দেশ, ছিলে সে-দেশের চালক, বাণীর আসরে তুমি একা ছিলে তূর্য-বাদক বালক।কে দিবে আঘাত? কে জাগাবে দেশ? কই সে সত্যপ্রাণ? আপনারে হেলা করি’ করি মোরা ভগবানে অপমান। বাঁশী ও বিষান নিয়ে গেছ, আছে ছেঁড়া ঢোল ভাঙা কাঁসি, লোক-দেখানো এ আঁখির সলিলে লুকানো রয়েছে হাসি। যশের মানের ছিলে না কাঙাল, শেখোনি খাতির-দারী, উচ্চকে তুমি তুচ্ছ করোনি, হওনি রাজার দ্বারী! অত্যাচারকে বলনি ক’ দয়া, ব’লেছ অত্যাচার, গড় করোনি ক’ নিগড়ের পায়, ভয়েতে মানোনি হার। অচল অটল অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি তুমি উরিয়া ধন্য ক’রেছিলে এই ভীরুর জন্মভূমি। হে মহা-মৌনী, মরণেও তুমি মৌন মাধুরী পি’য়া নিয়েছ বিদায়, যাওনি মোদের ছল-করা গীতি নিয়া! তোমার প্রয়াণে উঠিল না কবি দেশে কল-কল্লোল, সুন্দর! শুধু জুড়িয়া বসিলে মাতা সারদার কাল। স্বর্গে বাদল মাদল বাজিল, বিজলী উঠিল মাতি’, দেব-কুমারীরা হানিল বৃষ্টি-প্রসূন সারাটি রাতি। কেহ নাহি জাগি’, অর্গল-দেওয়া সকল কুটীর-দ্বারে পুত্রহারার ক্রন্দন শুধু খুঁজিয়া ফিরিছে কারে!নিশীথ-শ্মশানে অভাগিনী এক শ্বেত-বাস পরিহিতা, ভাবিছে তাহারি সিঁদুর মুছিয়া কে জ্বালালো ঐ চিতা! ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দু’টি নারীস পানে? জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে! সত্য-মন্ত্র পুথির বিধান যাক পুড়ে তোর,       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!! (এই) খোদার উপর খোদকারি তোর       মানবে না আর সর্বলোক!       মানবে না আর সর্বলোক!!    (তোর) ঘরের প্রদীপ নিবেই যদি,       নিবুক না রে, কীসের ভয়?       আঁধারকে তোর কীসের ভয়? (ওই)  ভুবন জুড়ে জ্বলছে আলো,       ভবনটাই সে সত্য নয়।       ঘরটাই তোর সত্য নয়। (ওই)  বাইরে জ্বলছে চন্দ্র সূর্য       নিত্যকালের তাঁর আলোক।       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!      লোক-সমাজের শাসক রাজা,     (আর)      রাজার শাসক মালিক যেই,       বিরাট যাঁহার সৃষ্টি এই,   তাঁর শাসনকে অগ্রে মান       তার বড়ো আর শাস্ত্র নেই,       তার বড়ো আর সত্য নেই!   সেই খোদা খোদ সহায় তোর,       ভয় কী? নিখিল মন্দ ক’ক!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!      বিধির বিধি মানতে গিয়ে       নিষেধ যদি দেয় আগল       বিশ্ব যদি কয় পাগল,   আছেন সত্য মাথার পর, –       বেপরোয়া তুই সত্য বল।       বুক ঠুকে তুই সত্য বল!(তখন) তোর পথেরই মশাল হয়ে       জ্বলবে বিধির রুদ্র-চোখ!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!      মনুর শাস্ত্র রাজার অস্ত্র       আজ আছে কাল নাইকো আশ,       কাল তারে কাল করবে গ্রাস।   হাতের খেলা সৃষ্টি যাঁর       তাঁর শুধু ভাই নাই বিনাশ,       স্রষ্টার সেই নাই বিনাশ!   সেই বিধাতায় মাথায় করে       বিপুল গর্বে বক্ষ ঠোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!   সত্যতে নাই ধানাই পানাই       সত্য যাহা সহজ তাই,       সত্য যাহা সহজ তাই;   আপনি তাতে বিশ্বাস আসে,       আপনি তাতে শক্তি পায়       সত্যের জোর-জুলুম নাই   সেই সে মহান সত্যকে মান –       রইবে না আর দুঃখ-শোক।       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!      নানান মুনির নানান মত যে,       মানবি বল সে কার শাসন?       কয় জনার বা রাখবি মন?   এক সমাজকে মানলে করবে       আরেক সমাজ নির্বাসন,       চারিদিকে শৃঙ্খল বাঁধন!   সকল পথের লক্ষ্য যিনি       চোখ পুরে নে তাঁর আলোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!  সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর,       কর্মে যদি না রয় ছল,       ধর্ম-দুগ্ধে না রয় জল,   সত্যের জয় হবেই হবে,       আজ নয় কাল মিলবে ফল,       আজ নয় কাল মিলবে ফল। (আর)প্রাণের ভিতর পাপ যদি রয়       চুষবে রক্ত মিথ্যা-জোঁক!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!          জাতের চেয়ে মানুষ সত্য,       অধিক সত্য প্রাণের টান,       প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।   বিশ্বপিতার সিংহ-আসন       প্রাণবেদিতেই অধিষ্ঠান,       আত্মার আসন তাইতো প্রাণ।   জাত-সমাজের নাই সেথা ঠাঁই       জগন্নাথের সাম্য-লোক       জগন্নাথের তীর্থ-লোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!          চিনেছিলেন খ্রিস্ট বুদ্ধ       কৃষ্ণ মোহম্মদ ও রাম –       মানুষ কী আর কী তার দাম। (তাই) মানুষ যাদের করত ঘৃণা,       তাদের বুকে দিলেন স্থান       গান্ধি আবার গান সে গান। (তোরা) মানব-শত্রু তোদেরই হায়       ফুটল না সেই জ্ঞানের চোখ।       বিধির বিধান সত্য হোক!       বিধির বিধান সত্য হোক!!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ-গীতি চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে,   ওগো এই গঙ্গার কূলে। দিশাহারা মাতা দিশা পেয়ে তাই নিয়ে গেছে কোলে তুলে   ওগো এই গঙ্গার কূলে।।    চপল চারণ বেণু-বীণে তা’র    সুর বেঁধে শুধু দিল ঝঙ্কার,    শেষ গান গাওয়া হ’ল না ক’ আর,     উঠিল চিত্ত দুলে,    তারি ডাক-নাম ধ’রে ডাকিল কে যেন অস্ত-তোরণ-মূলে,    ওগো এই গঙ্গার কূলে।।   ওরে এ ঝোড়ো হাওয়ায় কারে ডেকে যায় এ কোন সর্বনাশী     বিষাণ কবির গুমরি’ উঠিল, বেসুরো বাজিল বাঁশী।      আঁখির সলিলে ঝলসানো আঁখি      কূলে কূলে ভ’রে ওঠে থাকি’ থাকি’,      মনে পড়ে কবে আহত এ-পাখী       মৃত্যু-আফিম-ফুলে,      কোন ঝড়-বাদলের এমনি নিশীথে প’ড়েছিল ঘুমে ঢুলে।    ওগো এই গঙ্গার কুলে।।   তার ঘরের বাঁধন সহিল না সে যে চির বন্ধন-হারা,    তাই ছন্দ-পাগলে কোলে নিয়ে দোলে জননী মুক্তধারা!    ও সে আলো দিয়ে গেল আপনারে দহি’,     অমৃত বিলালো বিষ-জ্বালা সহি’,     শেষে শান্তি মাগিল ব্যথা-বিদ্রোহী       চিতার অগ্নি-শূলে!    পুনঃ নব-বীনা-করে আসিবে বলিয়া এই শ্যাম তরুমূলে    ওগো এই গঙ্গার কূলে।।কাব্যগ্রন্থঃ-ফণি-মনসা সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ আজ        আষাঢ়-মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মু-খানি ঢাকি আহা        কে তুমি জননি কার নাম ধরে বারে বারে যাও ডাকি?                          মাগো কর হানি দ্বারে দ্বারে তুমি        কোন হারামণি খুঁজিতে আসিলে ঘুম-সাগরের পারে?            ‘কই রে সত্য, সত্যেন কই’ কাতর কান্না শুধু            গগন-মরুর প্রাঙ্গণে হানে সাহারার হাহা ধুধু!            সত্য অমর, কেঁদো না জননি, আসিবে আবার রবি,            গিয়াছে বাণীর কমল-বনে মা, কমল তুলিতে কবি!ও কে        ক্রন্দসী হায় মুরছিয়া পড়ে অশ্রু-সিন্ধুতীরে            গেল সহসা নিশীথে বাণীর হাতের বেয়ালার তার ছিঁড়ে।                          আহা, কোন ভিখারিনি এরে            কাহারে হারায়ে নিখিলের দ্বারে ফরিয়াদ করে ফেরে?            সতীর কাঁদনে চোখ খুলে চায় ঊর্ধ্বে অরুন্ধতী,            নিবিড় বেদনা ম্লান করে আনে রবির কনক-জ্যোতি।            সত্য অমর, কাঁদিয়ো না সতী, আসিবে আবার রবি,            গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি!আজ        সারথি হারায়ে বিষাদে অন্ধ ছন্দ-সরস্বতী, ওগো        পুরোহিত-হারা ভারতী-দেউলে বন্ধ পূজা-আরতি                          ওরে মৃত্যু-নিষাদ ক্রূর            বিষাদ-শায়ক বিঁধিয়া করেছে বাংলার বুক চুর!            নিভে গেল মঙ্গল-দীপশিখা, বঙ্গবাণীর আলো,            দুলে দশদিকে শুধু দিশেহারা অশ্রু অতল কালো!            ‘সত্য’ অমর! কাঁদিয়া না কবি, আসিবে আবার রবি,            গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি।শ্বেত        বৈজয়ন্তী উড়ে চলে যায় মৃত্যুরও আগে আগে, ওরে        সে চির-অমর, মৃত্যু আপনি তারই পায়ে প্রাণ মাগে।                          তাই ওই বাজে জয়-ভেরি            স্বর্গ-দুয়ারে, ওঠে জয়ধ্বনি, ‘জয় সুত অমৃতেরই!’            কাঁদিসনে মাগো, ওই তোর ছেলে মাতা সারদার কোলে            শিশু হয়ে পুনঃ দুধ-হাসি হেসে তোরে ডেকে ডেকে দোলে!            ‘সত্য’ অমর, কাঁদিয়ো না কেহ, আসিবে আবার রবি,            মা বীণাপাণির সোহাগ আনিতে স্বর্গে গিয়াছে কবি।(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ-গীতি চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে,    ওগো   এই গঙ্গার কূলে। দিশাহারা মাতা দিশা পেয়ে তাই নিয়ে গেছে কোলে তুলে    ওগো    এই গঙ্গার কূলে।।     চপল চারণ বেণু-বীণে তা’র     সুর বেঁধে শুধু দিল ঝঙ্কার,     শেষ গান গাওয়া হ’ল না ক’ আর,       উঠিল চিত্ত দুলে,    তারি ডাক-নাম ধ’রে ডাকিল কে যেন অস্ত-তোরণ-মূলে,    ওগো   এই গঙ্গার কূলে।।   ওরে এ ঝোড়ো হাওয়ায় কারে ডেকে যায় এ কোন সর্বনাশী     বিষাণ কবির গুমরি’ উঠিল, বেসুরো বাজিল বাঁশী।     আঁখির সলিলে ঝলসানো আঁখি     কূলে কূলে ভ’রে ওঠে থাকি’ থাকি’,     মনে পড়ে কবে আহত এ-পাখী       মৃত্যু-আফিম-ফুলে,    কোন ঝড়-বাদলের এমনি নিশীথে প’ড়েছিল ঘুমে ঢুলে।    ওগো   এই গঙ্গার কুলে।।   তার ঘরের বাঁধন সহিল না সে যে চির বন্ধন-হারা,    তাই ছন্দ-পাগলে কোলে নিয়ে দোলে জননী মুক্তধারা!    ও সে আলো দিয়ে গেল আপনারে দহি’,     অমৃত বিলালো বিষ-জ্বালা সহি’,    শেষে শান্তি মাগিল ব্যথা-বিদ্রোহী      চিতার অগ্নি-শূলে!    পুনঃ নব-বীনা-করে আসিবে বলিয়া এই শ্যাম তরুমূলে    ওগো  এই গঙ্গার কূলে।। সন্ধ্যাতারা ঘোম্‌টা-পরা কাদের ঘরের বৌ তুমি ভাই সন্ধ্যাতারা? তোমার চোখে দৃষ্টি জাগে হারানো কোন্‌ মুখের পারা।। সাঁঝের প্রদীপ আঁচল ঝেঁপে বঁধুর পথে চাইতে বেঁকে চাউনিটি কার উঠছে কেঁপে   রোজ সাঁঝে ভাই এমনি ধারা।।কারা হারানো বধূ তুমি অস-পথে মৌন মুখে ঘনাও সাঁঝে ঘরের মায়া গৃহহীনের শূন্য বুকে। এই যে নিতুই আসা-যাওয়া, এমন কর”ণ মলিন চাওয়া, কার তরে হায় আকাশ-বধু   তুমিও কি আজ প্রিয়-হারা।। সব্যসাচী ওরে   ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠেছে হিমালয়-চাপা প্রাচী,        গৌরশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী!               দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া               জাগে মহাযোগী নয়ন মেলিয়া, মহাভারতের মহাবীর জাগে, বলে ‘আমি আসিয়াছি।’ নব-যৌবন-জলতরঙ্গে নাচে রে প্রাচীন প্রাচী!বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে, গান্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল লক্ষ লাক্ষারাগে!               বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য,               সাথে রথাশ্ব, হাঁকিছে সৈন্য, ঝড়ের ফুঁ দিয়া নাচে অরণ্য, রসাতলে দোলা লাগে, দোলায় বসিয়া হাসিছে জীবন মৃত্যুর অনুরাগে!যুগে যুগে ম’রে বাঁচে পুনঃ পাপ দুর্মতি কুরুসেনা, দুর্যোধনের পদলেহী ওরা, দুঃশাসনের কেনা!               লঙ্কাকান্ডে কুরুক্ষেত্রে,               লোভ-দানবের ক্ষুধিত নেত্রে, ফাঁসির মঞ্চে কারার বেত্রে ইহারা যে চির-চেনা! ভাবিয়াছ, কেহ শুধিবে না এই উৎপীড়নের দেনা?কালের চক্র বক্রগতিতে ঘুরিতেছে অবিরত, আজ দেখি যারা কালের শীর্ষে, কাল তারা পদানত।               আজি সম্রাট্‌ কালি সে বন্দী,               কুটীরে রাজার প্রতিদ্বন্দী! কংস-কারায় কংস-হন্তা জন্মিছে অনাগত, তারি বুক ফেটে আসে নৃসিংহ যারে করে পদাহত!আজ যার শিরে হানিছে পাদুকা কাল তারে বলে পিতা, চির-বন্দিনী হতেছে সহসা দেশ-দেশ-নন্দিতা।               দিকে দিকে ঐ বাজিছে ডঙ্কা,               জাগে শঙ্কর বিগত-শঙ্কা! লঙ্কা সায়রে কাঁদে বন্দিনী ভারত-লক্ষ্মী সীতা, জ্বলিবে তাঁহারি আঁখির সুমুখে কাল রাবণের চিতা!যুগে যুগে সে যে নব নব রূপে আসে মহাসেনাপতি, যুগে যুগে হ’ন শ্রীভগবান্‌ যে তাঁহারই রথ-সারথি!               যুগে যুগে আসে গীতা-উদ্‌গাতা               ন্যায়-পান্ডব-সৈন্যের ত্রাতা। অশিব-দক্ষযজ্ঞে যখনই মরে স্বাধীনতা-সতী, শিবের খড়গে তখনই মুন্ড হারায়েছে প্রজাপতি!নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী, জাগো রে জোয়ান! ঘুমায়ো না ভূয়ো শান্তির বাণী শুনি-               অনেক দধীচি হাড় দিল ভাই,               দানব দৈত্য তবু মরে নাই, সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, ব’সে ব’সে কাল গুণি! জাগো রে জোয়ান! বাত ধ’রে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি!দক্ষিণ করে ছিঁড়িয়া শিকল, বাম করে বাণ হানি’ এস নিরস্ত্র বন্দীর দেশে হে যুগ-শস্ত্রপাণি!               পূজা ক’রে শুধু পেয়েছি কদলী,               এইবার তুমি এস মহাবলী। রথের সুমুখে বসায়ো চক্রী চত্রুধারীরে টানি’, আর সত্য সেবিয়া দেখিতে পারি না সত্যের প্রাণহানি।মশা মেরে ঐ গরজে কামান-‘বিপ্লব মারিয়াছি। আমাদের ডান হাতে হাতকড়া, বাম হাতে মারি মাছি!’               মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি,               টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি! বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী, যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম’রে বাঁচি! সর্বহারা ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা চোরাবালির চর, ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস সেই চরে তোর ঘর? শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা, হাট তুলে দে সর্বহারা, মেঘ-জননীর অশ্রুধারা ঝ’রছে মাথার’ পর, দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি দুলিয়ে তরু-কর।।কন্যারা তোর বন্যাধারায় কাঁদছে উতরোল, ডাক দিয়েছে তাদের আজি সাগর-মায়ের কোল। নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি! পাল তু’লে তুই দে রে আজি তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী তরঙ্গে খায় দোল। নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই? মায়ার নোঙর তোল্‌।ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর যায় রে বেলা যায়। মাঝি রে! দেখ্‌ কুরঙ্গী তোর কূলের পানে চায়। যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী ঘনায় গহন শাঙন-রাতি মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’ ঘুমুস্‌ নে আর, হায়! ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া এতই কি রে দায়?হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই, চাস্‌নি ত সাত ক্রোর, একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র- ভরা অভাব তোর, চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা, একটি প্রদীপ-আলো-করা একটু-কুটীর-দোর। আস্‌ল মৃত্যু আস্‌ল জরা, আস্‌ল সিঁদেল-চোর।মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে মাটির বুকে চল্‌! শক্তমাটির ঘায়ে হউক রক্ত পদতল। প্রলয়-পথিক চ’ল্‌বি ফিরি দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি! হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’ নাচছে সিন্ধুজল। চল্‌ রে জলের যাত্রী এবার মাটির বুকে চল্‌ ।। সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে কর'না জিজ্ঞাসা মোরে প্রিয় কর'না জিজ্ঞাসা, সুখে আমি আছি কি না আছি | ডরি আমি রসনার ভাষা ; দোঁহে যবে এত কাছাকাছি, মাঝখানে ভাষা কেন চাই ; বুঝবার আর কিছু নাই ? হাত মোর বাঁধা তব হাতে, শ্রান্ত শির তব স্কন্ধোপরি, জানিনা এ সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যাতে অশ্রু যেন ওঠে আঁখি ভরি | দুঃখ নয়, ইহা দুঃখ নয়, এইটুকু জানিও নিশ্চয় | নীলাকাশে ফুটিতেছে তারা, জাতি যুথী পল্লব হরিতে ; অতি শুভ্র, অত্যুজ্জ্বল যারা, আসে চলি আঁধার তরীতে | ভেসে আজ নয়নের জলে কি আসিছে, কে আমারে বলে ?     (২) সুখ সে কেমন যাদুকর, তাকাইলে হয় অন্তর্ধান, ডাকিলে সে দেয় না উত্তর, চাহিলে সে করে না তো দান | দুঃখ যে হইলে অতীত সুখ বলি হয়গো প্রতীত ! সুখ সাথে আছে, কি না আছে, কোন নাই প্রশ্ন মিমাংশার, চলিছে সে পার্শ্বে কিবা পাছে ; সুখ দুঃখ চেনা বড় ভার ; আমরা দুজনে দু'জনার, পিছে পাছে দৃষ্টি কেন আর ? ওগো প্রিয় মোর মনে হয়, প্রেম যদি থাকে মাঝখানে, আনন্দ সে দূরে নাহি রয় | প্রাণ যবে মিলে যায় প্রাণে, সঙ্গীতে আলোকে পায় লয়, যত ভয়, যতেক সংশয় | পাছে লোকে কিছু বলে করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,- পাছে লোকে কিছু বলে।আড়ালে আড়ালে থাকি নীরবে আপনা ঢাকি, সম্মুখে চরণ নাহি চলে পাছে লোকে কিছু বলে।হৃদয়ে বুদবুদ মত উঠে চিন্তা শুভ্র কত, মিশে যায় হৃদয়ের তলে, পাছে লোকে কিছু বলে।কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি সযতনে শুকায়ে রাখি;- নিরমল নয়নের জলে, পাছে লোকে কিছু বলে।একটি স্নেহের কথা প্রশমিতে পারে ব্যথা,- চলে যাই উপেক্ষার ছলে, পাছে লোকে কিছু বলে।মহৎ উদ্দেশ্য যবে, এক সাথে মিলে সবে, পারি না মিলিতে সেই দলে, পাছে লোকে কিছু বলে।বিধাতা দেছেন প্রাণ থাকি সদা ম্রিয়মাণ; শক্তি মরে ভীতির কবলে, পাছে লোকে কিছু বলে। এরা যদি জানে এদেরও তো গড়েছেন নিজে ভগবান্ , নবরূপে দিয়েছেন চেতনা ও প্রাণ ; সুখে দুঃখে হাঁসে কাঁদে          স্নেহে প্রেমে গৃহ বাঁধে বিধে শল্যসম হৃদে ঘৃণা অপমান, জীবন্ত মানুষ এরা মায়ের সন্তান ||এরা যদি আপনারে শেখে সম্মানিতে, এরা দেশ-ভক্ত রূপে জন্মভূমি-হিতে মরণে মানিবে ধর্ম          বাক্য নহে --- দিবে কর্ম ; আলস্য বিলাস আজো ইহাদের চিতে পারেনি বাঁধিতে বাসা, পথ ভুলাইতে ||এরা হতে পারে দ্বিজ---যদি এরা জানে, এরা কি সভয় সরি' রহে ব্যবধানে ? এরা হতে পারে ,বীর,          এরা দিতে পারে শির, জননীর, ভগিনীর, পত্নীর সম্মানে, ভবিষ্যের মঙ্গলের স্বপনে ও ধ্যানে |                  এরা যদি জানে ||উচ্চ কূলে জন্ম ব'লে কত দিন আর ভাই বিপ্র রবে তব এই অহংকার ? কৃতান্ত সে কুলীনের রাখে না তো মান, তার কাছে দ্বিজ শূদ্র পারীয়া সমান | তার স্পর্শে যেই দিন          পঞ্চভূতে দেহ লীন বাহ্মণে চণ্ডালে রহে কত ব্যবধান ? কত ভালবাসি জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,- “মা, তোমারে কত ভালোবাসি!” “কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়। “এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?” মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।” “তবু কতখানি, বল।”“যতখানি ধরে তোমার মায়ের বুকে।” “নহে তার পরে?”“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।” “আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে! কর্তব্যের অন্তরায় কে তুমি দাঁড়ায়ে কর্তব্যের পথে, সময় হরিছ মোর ; কে তুমি আমার জীবন ঘিরিয়া জড়ালে স্নেহের ডোর, চির-নিদ্রাহীন নয়নে আমার আনিছ ঘুমের ঘোর? দু’নয়ন হ’তে দূরস্থ আলোকে কেন কর অন্তরাল? কেমনে লভিব লক্ষ্য জীবনের পথে কাটাইলে কাল? আমার রয়েছে কঠোর সাধনা, ফেলনা মায়ার জাল। তোমারে দেখিলে গত অনাগত যাই একেবারে ভুলে মুগ্ধ হিয়া মম চাহে লুটাইতে তোমার চরণমূলে, ফেলে যাও তারে, দলে যাও তারে, নিওনা, নিওনা তু’লে। তোমার মমতা অকল্যাণময়ী, তোমার প্রণয় ক্রূর, যদি লয়ে যায় ভুলাইয়া পথ, লয়ে যাবে কত দূর? এই স্বপ্নাবেশ রহিবার নয়, চলে যাও হে নিষ্ঠুর। [“মাল্য ও নির্মাল্য” থেকে নেওয়া] চন্দ্রাপীড়ের জাগরণ অন্ধকার মরণের ছায় কতকাল প্রণয়ী ঘুমায়?— চন্দ্রাপীড়, জাগ এইবার। বসন্তের বেলা চলে যায়, বিহগেরা সান্ধ্যগীত গায়, প্রিয়া তবু মুছে অশ্রুধার। মাস, বর্ষ হ’ল অবসান, আশা-বাঁধা ভগ্ন পরাণ নয়নেরে করেছে শাসন, কোনদিন ফেলি অশ্রুজল, করিবে না প্রিয়-অমঙ্গল— এই তার আছিল যে পণ। আজি ফুল মলয়জ দিয়া, শুভ্র-দেহা, শুভ্রতর দিয়া, পূজিয়াছে প্রণয়ের দেবে ; নবীভূত আশারাশি তার, অশ্রুমালা শোনে নাকো আর— চন্দ্রাপীড়, মেল আঁখি এবে। দেখ চেয়ে, সিক্তোত্পল দুটি তোমা পানে রহিয়াছে ফুটি, যেন সেই নেত্র-পথ দিয়া, জীবন, তেয়াগি নিজকায়, তোমারি অন্তরে যেতে চায়— তাই হোক্, উঠ গো বাঁচিয়া। প্রণয় সে আত্মার চেতন, জীবনের জনম নূতন, মরণের মরণ সেথায়। চন্দ্রাপীড়, ঘুমা’ও না আর— কানে কানে কে কহিল কার, আঁখি মেলি চন্দ্রাপীড় চায়। মৃত্যু-মোহ অই ভেঙ্গে যায়, স্বপ্ন তার চেতনে মিশায়, চারি নেত্র শুভ দরশন একদৃষ্টে কাদম্বরী চায়, নিমেষ ফেলিতে ভয় পায়— “এতো স্বপ্ন—নহে জাগরণ।” নয়ন ফিরাতে ভয় পায়, এ স্বপন পাছে ভেঙ্গে যায়, প্রাণ যেন ওঠে উথলিয়া। আঁখি দুটি মুখ চেয়ে থাক্, জীবন স্বপন হয়ে যাক্, অতীতের বেদনা ভুলিয়া। “আধেক স্বপনে, প্রিয়ে, কাটিয়া গিয়াছে নিশি, মধুর আধেক আর জাগরণে আছে মিশি ;” “মরণে অবসানে জীবন জনম প্রায়।” “জীবন?—জীবন, প্রিয়? নহি স্বপনের মোহ? মরণের কোন্ তীরে অবতীর্ণ আজ দোঁহে?”[“আলো ও ছায়া” থেকে নেওয়া ] চাহিবে না ফিরে? পথে দেখে ঘৃণাভরে কত কেহ গেল সরে উপহাস করি’ কেহ যায় পায়ে ঠেলে ; কেহ বা নিকটে আসি, বরষি সান্ত্বনারাশি ব্যথিতেরে ব্যথা দিয়ে যায় শেষে ফেলে । পতিত মানব তরে নাহি কি গো এ সংসারে একটি ব্যথিত প্রাণ, দুটি অশ্রুধার ? পথে পড়ে, অসহায় পদতলে দলে যায় দু’খানি স্নেহের কর নাহি বাড়াবার ? সত্য, দোষে আপনার চরণ স্খলিত তার ; তাই তোমাদের পদ উঠিবে ও শিরে ? তাই তার আর্তরবে সকলে বধির হবে । যে যাহার চলে যাবে—চাহিবে না ফিরে ? বর্তিকা লইয়া হাতে চলেছিল এক সাথে পথে নিভে গেল আলো পড়িয়াছে তাই ; তোমরা কি দয়া করে তুলিবে না হাত ধরে অর্ধদণ্ড তার লাগি থামিবে না ভাই ? তোমাদের বাতি দিয়া প্রদীপ জ্বালিয়া নিয়া তোমাদের হাত ধরি হোক অগ্রসর ; পঙ্কমাঝে অন্ধকারে ফেলে যদি দাও তারে, আঁধার রজনী তার রবে নিরন্তর । ডেকে আন্ পথ ভুলে গিয়াছিল, আবার এসেছে ফিরে, দাঁড়ায়ে রয়েছে দূরে, লাজে ভয়ে নত শিরে ; সম্মুখে চলে না পদ, তুলিতে পারে না আঁখি, কছে গিয়ে, হাত ধরে, ওরে তারে আন্ ডাকি।ফিরস্ নে মুখ আজ নীরব ধিক্কার করি, আজি আন্ স্নেহ-সুধা লোচন বচন ভরি। অতীতে বরষি ঘৃণা কিবা আর হবে ফল? আঁধার ভবিষ্য ভাবি, হাত ধরে লয়ে চল্।স্নেহের অভাবে পাছে এই লজ্জানত প্রাণ সঙ্কোচ হারায়ে ফেলে—আন্ ওরে ডেকে আন্! আসিয়াছে ধরা দিতে, শত স্নেহ-বাহু-পাশে বেঁধে ফেল্ ; আজ গেলে আর যদি না-ই আসে ।দিনেকের অবহেলা, দিনেকের ঘৃণাক্রোধ, একটি জীবন তোরা হারাবি জীবন-শোধ । তোরা কি জীবন দিবি? উপেক্ষা যে বিষবাণ, দুঃখ-ভরা ক্ষমা লয়ে, আন্, ওরে ডেকে আন্।[“আলো ও ছায়া” থেকে নেওয়া ] দিন চলে যায় একে একে একে হায়!                 দিনগুলি চলে যায়, কালের প্রবাহ পরে প্রবাহ গড়ায়, সাগরে বুদ্বুদ্ মত                 উন্মত্ত বাসনা যত হৃদয়ের আশা শত হৃদয়ে মিলায়, আর দিন চলে যায় ।জীবনে আঁধার করি,                 কৃতান্ত সে লয় হরি প্রাণাধিক প্রিয়জনে, কে নিবারে তায়? শিথির হৃদয় নিয়ে,                 নর শূণ্যালয়ে গিয়ে, জীবনের বোঝা লয় তুলিয়া মাথায়, আর দিন চলে যায় ।নিশ্বাস নয়নজল                 মানবের শোকানল একটু একটু করি ক্রমশঃ নিবায়, স্মৃতি শুধু জেগে রহে,                 অতীত কাহিনী কহে, লাগে গত নিশীথের স্বপনের প্রায় ; আর দিন চলে যায়![“আলো ও ছায়া” থেকে নেওয়া ] ধরায় দেবতা চাহি ত্রিদিবে দেবতা নাও যদি থাকে ধরায় দেবতা চাহি গো চাহি, মানব সবাই নয় গো মানব, কেহ বা দৈত্য, কেহ বা দানব, উত্পীড়ন করে দুর্বল নরে, তাদের তরে যে ভরসা নাহি--- ধরায় দেবের প্রতিষ্ঠা চাহি || সেকালে দেবতা গোলক তেয়াগি, মাটির ধরায় মরের গেহে, লইত জনম নর-শিশুরূপে, বাড়িয়া উঠিত নারীর স্নেহে ; ধূলা বালু লয়ে খেলিয়া বেড়াত আর দশজন শিশুর মত ;--- আসিলে সময় দৈব বলে বলী, দানবে দলিতে যাইত সে চলি, হেলায় সংহারি দুরাচারগণে, নিরাতঙ্ক করি সাধুসজ্জনে, ফিরিয়া আসিত অপরাহত || ত্রিদিব তেয়াগি আসে কি না আসে, নরের আলয়ে নারীর কোলে, আজিও দেবতা নর-জন্ম লয়, ধরণীর গ্লানি ম্লানি করি ক্ষয়, আলোকের দিকে টানিয়া তোলে ||ঐশ্বর্য আরাম চাহে ভুলাইতে, স্নেহ প্রেম কত বাঁধিতে চায়, মাতা কাঁদে, জায়া শিশু দেয় কোলে সকল বাঁধন কাটিয়া যায় | বাহিরে বাতাসে যেই আর্তনাদ, যে রোদন ধ্বনি বহিয়া যায়, শুনিতে শুনিতে অভ্যাসবশে সকলে যাহা না শুনিতে পায়--- তাই ডেকে লয় নর-দেবতায় সংগ্রামে পশিতে দানব সাথে, দানব-সংহার মানবেরি কাজ, দধীচির হাড় ইন্দ্রের হাতে বজ্র হয়ে আছে, রবে চিরদিন, মানবেরে দিয়া দেবের জয়, ত্রিদিবে দেবতা নাও যদি থাকে ধরায় দেবতা নহিলে নয় || পুষ্প প্রভঞ্জন লঙ্ঘি কোন্ সাগর উত্তাল, এলে তুমি ভীম প্রভঞ্জন, ঘন কৃষ্ণ মেঘ-জটা-জাল আবরিছে অদৃশ্য আনন। বিদ্যুৎ হানিছে দৃষ্টি তব, অশনি কহিছে রোধ বাক্, আজ আমি নতশিরে রব, ওষ্ঠাধর আজ রুদ্ধ থাক। আছাড়ি, আস্ফালি, চূর্ণ করি, শ্রান্ত হয়ে করিবে শয়ন, নিদ্রা শেষে শান্ত রূপ ধরি সম্ভাষিবে প্রসন্ন নয়ন। চুমা দিবে আমার আঁখিতে, দুলাইবে চূর্ণালোকগুলি, হাসি আমি নারিব ঢাকিতে, আধর আপনি যাবে খুলি। আপনি আসিবে বাহিরিয়া হৃদয়ের নিভৃত সুবাস, তুমি মোরে ঘিরিয়া ঘিরিয়া ফেলিবে অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস। কাল দিব রূপ গন্ধ রস, মেঘ বৃষ্টি হইলে অতীত, অরূপের মৃদুল পরশ আমারে করিবে পুলকিত। [“মাল্য ও নির্মাল্য” থেকে নেওয়া ] প্রণয়ে ব্যথা কেন যন্ত্রণার কথা,                        কেন নিরাশা ব্যথা, জড়িত রহিল ভবে ভালবাসা সাথে? কেন এত হাহাকার,                    এত ঝরে অশ্রু ধার? কেন কণ্টকের কূপ প্রণয়ের পথে?বিস্তীর্ণ প্রান্তর মাঝে                    প্রাণ এক যবে খোঁজে আকুল ব্যাকুল হয়ে সাথী একজন, ভ্রমি বহু, অতি দূরে                     পায় যবে দেখিবারে একটি পথিক-প্রাণ মনেরি মতন ;---তখন, তখন তারে                      নিয়তি কেনরে বারে, কেন না মিশাতে দেয় দুইটি জীবন? অনুলঙ্ঘ্য বাধা রাশি                  সম্মুখে দাঁড়ায় আসি--- কেন দুই দিকে আহা যায় দুই জন?অথবা, একটি প্রাণ                    আপনারে করে দান--- আপনারে দেয় ফেলে' অপরের পায় ; সে না বারেকের তরে                  ভুলেও ভ্রুক্ষেপ করে, সবলে চরণতলে দলে' চলে' যায় |নৈরাশপূরিত ভবে                        শুভযুগ কবে হবে, এরটি প্রাণের তরে আর একটি প্রাণ কাঁদিবে না সারা পথে ;---                 প্রণয়ের মনোরথে স্বর্গমর্ত্যে কেহ নাহি দিবে বাধা দান? মাতৃপূজা যেইদিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন, হাসি অশ্রু সেইদিন করিয়াছি বিসর্জন | হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর, দুঃখিনী জনম-ভূমি,---মা আমার, মা আমার! অনল পুষিতে চাহি আপনির হিয়া মাঝে, আপনারে অপরেরে নিয়োজিতে তব কাজে ; ছোটখাটো সুখ-দুঃখ---কে হিসাব রাখে তার তুমি যবে চাহ কাজ,---মা আমার, মা আমার! অতীতের কথা কহি' বর্তমান যদি যায়, সে কথাও কহিব না, হৃদয়ে জপিব তায় ; গাহি যদি কোন গান, গাব তবে অনিবার, মরিব তোমারি তরে,---মা আমার, মা আমার! মরিব তোমারি কাজে, বাঁচিব তোমারি তরে, নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেবা ধরে? যতদিন না ঘুচিবে তোমার কলঙ্ক-ভার, থাক্ প্রাণ, যাক্ প্রাণ,---মা আমার, মা আমার! মুগ্ধ প্রণয় সে কি কথা---যারে চেয়েছিলে                 পাও নাই সন্ধান তাহার? কারে বলে' কার গলে দিলে               প্রণয়ের পারিজাত হার? মুগ্ধ নর ; আঁখি ছলে মন ;                 কল্পনা সে বাস্তবের ছায় ; চারু মূর্তি করিয়া গঠন,                 শিল্পী ভাল বেসেছিলে তায় | স্বরচিত প্রতিমার তরে                 উন্মত্ত হইল যবে প্রাণ, দেবতারে কহিল কাতরে---                 পাষাণে জীবন কর দান | প্রেমময় বিধাতার বরে                 সে বাসনা পূর্ণ হ'ল তার--- অনুভূতি কঠোর প্রস্তরে,                 প্রতিমায় জীবন সঞ্চার | পাষাণের প্রতিমাটি যবে                 প্রাণময়ী নারীরূপ ধরে, নারী তবে পাবে না কি তবে               দেবী হ'তে বিধাতার বরে? সুখ নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?—       এ ধরা কি শুধু বিষাদময়? যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে       কেবলি কি নর জনম লয়?— কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা       সৃজেন কি নরে এমন করে’? মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে       মানবজীবন অবনী ‘পরে? বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,—       না,—না,—না,—মানবের তরে আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর,       না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে। কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত পড়িয়া,       সমর-অঙ্গন সংসার এই, যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ;       যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই। পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি       এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে?       আপনার কথা ভুলিয়া যাও। পরের কারণে মরণের সুখ ;       “সুখ” “সুখ” করি কেঁদনা আর, যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,       ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার। গেছে যাক ভেঙ্গে সুখের স্বপন       স্বপন অমন ভেঙ্গেই থাকে, গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো       গৃহে এস আর ঘুর’না পাকে। যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা?       বিষাদ এতই কিসের তরে? যদিই বা থাকে, যখন তখন       কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ’রে? লুকান বিষাদ আঁধার আমায়       মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত, সারাটি রজনী নীরবে নীরবে       ঢালে সুমধুর আলোক কত! লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে       গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়, দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার,       আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়। বিষাদ—বিষাদ—বিষাদ বলিয়ে       কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে’? মানবের মন এত কি অসার?       এতই সহজে নুইয়া পড়ে? সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে       পারনা মুছিতে নয়ন-ধার? পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে       চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার? আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে       আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে, সকলের তরে সকলে আমরা,       প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।[“আলো ও ছায়া” থেকে নেওয়া ] সে কি?